গোধূলী রাঙা দিগন্ত পর্ব-০২

0
181

#গোধূলী_রাঙা_দিগন্ত
#পর্বঃ২
#লেখিকাঃফারিহা_খান_নোরা
আরিবার জীবণে কয়েক ঘন্টার ব্যাবধানে সবচেয়ে বড় অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে গেল।সেই বোধহয় প্রথম মেয়ে যে কিনা আগে থেকে কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই বিয়ে করে ফেলল।বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে সম্মান বাঁচাতে বিয়েটা করতেই হলো তাকে।প্রথমে ভেবেছিল তার বর্তমান বর কি জেনো তার নাম!ও হ্যা প্রণয় শেখ সে বুঝি, না করবে কারণ চেনা নাই জানা নাই এভাবে কোনো ছেলে না দেখেই কোনো মেয়েকে বিয়ে করবে নাকি। কিন্তু না প্রণয়ও সুরসুর করে তিন কবুল বলে দিয়েছে। সাদামাটা ভাবেই বিয়ে সম্পূর্ণ হলো। আরমান শেখ আরিবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তার ডানহাতে থাকা একটা কারুকার্য খচিত বক্স থেকে নেকলেস বের করে পড়িয়ে দিলেন।বক্সে একজোড়া ঝুমকা ও চুড় ছিলো যা পড়তে আরশি আপু তাকে সাহায্য করে। সবশেষে আরমান শেখ অত্যন্ত আদুরে গলায় বললেন,

‘মা!তুমি ভেবো না এসব অন্যের জন্য নিয়ে আসা।বরং এটা ভাবো এ সবকিছু তোমার নিয়তি’তে ছিলো। যা তুমি পেয়ে গেছো তবে অপ্রত্যাশিত ভাবে।’

আরমান শেখের এমন কথায় আরিবা কিছুই বুঝলো না।সব কথাই যেনো তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে।বাবার দিকে সন্দেহের চোখে তাকায় আরিবা।সে ভালো করেই জানে আরমান‌ শেখ তার বাবার অফিসের বস। হঠাৎ করে না বলেই এই রাত্রি বেলা ছেলা নিয়ে কোথায় থেকে উদয় হলো সে বুঝতে পারছে না তাও আবার এতো বড়লোক হয়েও মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে আরিবাকে ঘরে পুত্রবধূ করে কেনই বা তুলবেন।তবে একটা কথা বুজতে পারছে পুরো ঘটনায় অবশ্যই ঘাপলা আছে নয়তো বাবা হঠাৎ করে তাকে এভাবে বিয়ে দিতেন না।

অবশেষে আসলো বিদায়ের পালা।আরিবা সবার উপরে অভিমান করেছে।সে কিছুতেই কাঁদবে না।কেন কাঁদবে আর কাদের জন্য কাঁদবে যে মানুষ গুলো তাকে এক রাত্রির মধ্যে পর করে দিয়েছে তাদের জন্য কাঁদবে?উহু কিছুতেই না।রেবা খাতুন কাঁদছেন পাশে আরশিও।দুই বোনের মধ্যে কতো ঝগড়া খুনসুটি ছিলো তবুও আজ একজন আরেক জনকে ছেড়ে যাবে বলে কাঁদছে।আরিবা মুখ শক্ত করে প্রণয়ের পিছু পিছু গাড়িতে গিয়ে বসলেন ‌।হাসান সাহেব মেয়ের আচারণে ক’ষ্ট পেলেও অনেক ক’ষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক করে রেখেছেন কারণ সে মেয়ের মতামত না নিয়েই এতো বড় একটা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছে।আরমান শেখ হাসান ও রেবাকে আস্বস্ত করলেন,সময় দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে।যদিও মনে মনে তিনিও ভয় পান কারণ দুই প্রান্তের ভিন্ন ধর্মীর দুই মানুষকে এক সুতায় বেঁধে দিয়েছে তাদের মতের বিরুদ্ধে যেয়ে। ভবিষ্যতে এখন কি হয় দেখার বিষয়।

গাড়ির পেছনের সিটে বসে আছে প্রণয়, মাঝখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে দুরত্ব বজায় রেখে বসেছে তার’ই বিয়ে করা নতুন ব‌উ।একদম জানালার গ্লাস ঘেসে বসে আছে মাথা ঠেকিয়ে।পেছনের গাড়িতে আরমান শেখ ও তার ভাই আসছে।
________________________

তখন জেদের বসে আসলেও বাড়ির সবার জন্য আরিবার খুব খারাপ লাগছে বিশেষ করে আরশির জন্য বেশি খারাপ লাগছে।আরশি আরিবার থেকে চার বছরের বড়। ছোট থেকে একসঙে সব সুখ দুঃখ হাসি কান্না ভাগাভাগি করে বড় হয়েছে তাঁরা।অনেক সময় মনে হতো দুজন দুজনের চোখের বি’ষ আবার কখনো মনে হতো তারা একজন আরেক জনকে ছাড়া থাকতেই পারে না।এই এখন যেমন মনে হচ্ছে।আরশির কথা মনে হতেই আরেকটা ব্যাপারে মনে পড়ে ঠিক তখনি আরিবার বুকের ভিতরে ধক করে উঠলো। আরশির দেবর জারিফের সাথে আরিবার প্রণয়ের সম্পর্ক রয়েছে।তারা দুজন দুজনকে ভালোবাসে,ছয় মাস হলো তাদের সম্পর্কের এখন কি করবে সে?বাবা কেন তাকে এমন অনিশ্চিত সম্পর্কে জড়িয়ে ফেলল ? তার আর জারিফের সম্পর্ক ভাঙার পরে যদি আরশি আপুর বিয়ে না টিকে?হাজার হলেও জারিফ তারিফ ভাইয়ার ছোট ভাই যার সাথে আরিবার প্রণয়ের সম্পর্ক থাকলেও পরিণয় পর্যন্ত তার বাবা গড়াতে দিলেন না।

এ সব কিছু ভাবনার মাঝেই আরিবা জোরে একটা ঝাঁকুনি খেল।সামনে তাকিয়ে দেখতে পায় বড় একটা ডুপ্লেক্স বাড়ি সামনে ও পিছনে রঙ বেরঙের লাইটিং করা।দেখেই বুঝা যায় বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান।এখন কথা হলে প্রণয়ের পরিবার আগে থেকেই জানে বিধায় এমন সাজিয়েছে কারণ দুই ঘন্টায় কেউ এভাবে সাজাতে পারবে না।তাহলে আরিবা জানতো না কেন তার বিয়ের ব্যাপারে?

প্রণয় কোনো কিছু তোয়াক্কা না করে আগেই গাড়ি থেকে নেমে যায়।আরিবা নামলে আরমান সাহেব এসে আরিবার হাত ধরে ভিতরে নিয়ে যায়।গাড়ি থেকে নাকি বর ব‌উকে নামিয়ে বাড়ির ভিতরে নিয়ে যায় আর আরিবাকে নিয়ে যাচ্ছে তার শশুর! এই ছিলো তার কপালে হাস্যকর!
___________________________

নাসিমা শেখ ড্রয়িং রুমে বসেছিলেন।আজ তার মনের বড় ইচ্ছে পূরণ হতে চলেছে।তার বড় ছেলে প্রণয়ের সঙে একমাত্র ছোট বোনের রেখে যাওয়া স্মৃতি রূপার বিয়ে।রূপাকে এবাড়ির বড় ব‌উ হিসাবে দেখতে চাওয়া এটা তার কত বছরের লালন করা ইচ্ছা সেজন্যই তো নাসিমা শেখ খুশি মনে লাল পাড় সাদা শাড়ি, গা ভর্তি স্বর্ণের গহণা পড়ে বরণ ডালা নিয়ে অপেক্ষা করছেন।ঘড়িতে এখন রাত দশটা বেজে পনের মিনিট। এর মধেই প্রণয় হন্তদন্ত হয়ে দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে।নাসিমা শেখ কিছু বলতে যাবে তার আগেই প্রণয় সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়। কিছুক্ষণ পর আরমান শেখকে দেখা যায়,লাল জামদানি শাড়ি গায়ে জড়িয়ে হালকা সাজে মাথায় ঘোমটারত অবস্থায় বধূ বেশে অচেনা একটি মেয়েকে নিয়ে আসছেন।মেয়েটি আরমান শেখের পাশে এসে আস্তে ধীরে ভীরু পায়ে দাঁড়িয়ে পড়ে।নাসিমা শেখ ভালো করে মেয়েটিকে লক্ষ করেন।দুধে আলতা গায়ের রঙে হালকা সাজেও পরীর থেকে কোনো অংশে কম লাগছে না মেয়েটিকে।এখন প্রশ্ন হলো এই মেয়েটা এখানে কেনো? এখানে তো রূপার থাকার কথা।রূপা কোথায় আর এই মেয়েটি আরমান শেখের পাশেই বা কেন। কিছুক্ষণ আগে প্রণয়ের এমন ব্যবহারে নাসিমা বেগমের মাথায় তখন একটা কথায় আসল।যার ফলে তিনি আরমান শেখের উপর গ’র্জে উঠলেন।

আরমান শেখ কিছু বলার জন্য মুখ খুলবেন তার আগেই নাসিমা শেখ গ’র্জে ওঠে চি’ল্লি’য়ে বলেন,

‘ক‌ই কে কোথায় আছো গো?দেখে যাও বু’ড়ো বয়সে এসে আমার কপাল পু’ড়’লো।তারপর আরমান শেখের উদ্দেশ্যে ঝরঝরে কন্ঠে বললেন,

‘এই বয়সে এসে এসব করতে তোমার লজ্জা করলো না? গিয়েছিলে তো ছেলেকে বিয়ে করাতে।ছেলেকে বিয়ে না করিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজে বিয়ে করলে তাও আবার হাঁটুর বয়সী একটা মেয়েকে।তাই তো বলি ছেলে আমার কোনো কথা না বলে এভাবে উপরে গেল কেন?রূপাও তো তার সাথে নেই।সাথে থাকবেই বা কি করে?যেখানে বাপের’ই বিয়ের শখ মিটে নি সেখান ছেলের বিয়ে কি করে হবে?’

নাসিমা শেখের কথায় বাড়িতে যে সকল আত্মীয় ছিল সবাই চলে এসেছে।আরমান শেখের ছোট বোন আমেনাও পাশে আসলেন।এসব দেখে আরমান শেখের লজ্জায় মাথা কা’টা যাচ্ছে।আজকে জেনো আরমান শেখের মাথা কা’টা’র‌ই দিন।মা ছেলে মিলে সকাল থেকে যে যেমন করে পারছে তার মাথা কা’ট’ছে।আরে আগে বললেই তো হতো আমার মাথাটা যখন তোদের মা ছেলের এতোই পছন্দ আমি নিজেই কেটে তোদের হাতে ধরিয়ে দিতাম।আরমান শেখ কঠোর চোখে নাসিমা শেখের দিকে তাকালেন এতো বছরের সংসারে নাসিমা তাকে একটুও বিশ্বাস করল না।ছিঃ শেষ পর্যন্ত মেয়ে সমতুল্য পূত্রবধূকে তার সাথে জড়িয়ে সন্দেহের তালিকায় ফেললেন।

প্রণয় শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে আসে।নিচ থেকে মায়ের চিৎ’কা’রে’র আওয়াজে এক মুহূর্ত দেরি করে নি নিচে নামতে।যদিও সে জানতো এমন কিছুই হবে তবে মায়ের চিৎ’কা’র তুলনামূলক ভাবে বেশিই মনে হচ্ছে।মাকে সে ভীষণ ভালোবাসে।নিচে যেয়ে দেখে কাহিনী ভিন্নি দিকে মোর নিয়েছে।প্রণয় কিছু বলতে যাবে তার আগেই আরমান শেখ আরিবার হাতটি প্রণয়ের হাতে ধরিয়ে দিয়ে করুন কন্ঠে বললেন,

‘নে বাবা তোর ব‌উ তুই সামলা আর আমার ব‌উকে আমাকএ সামলাতে দে।এই বয়সে এসে তোর জন্য আমার ব‌উ সন্দেহ করছে।শেষ বয়সে এসে ব‌উ ছাড়া হতে পারব না আমি।যা তুই চোখের সামনে থেকে। যেদিন থেকে দুনিয়াতে এন্ট্রি নিয়েছিস আমায় জ্বালিয়েই খাচ্ছিস।’

প্রণয় কিছু না বলে আরিবার হাত ধরে উপরে উঠতে লাগল।শেষের কথা কানে আসে তার মা বলছে ,

‘এই মেয়েটা প্রণয়ের ব‌উ হলে আমার রূপা কোথায়?’

____________________

বালিসে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে কান্না করছেন নাসিমা শেখ।পাশেই নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছেন আরমান শেখ।এমনিতে সারাদিন এতো সব ধকল গেছে তার উপর সম্মান নিয়ে টানাটানি এতো টেনশনে তার বেহাল অবস্থা। কোথায় একটু স্ত্রী সেবা যত্ন করবে তা না। মধ্যরাতে ম’রা কা’ন্না জুড়ে দিয়েছে।আরমান শেখ বিরক্ত হয়ে বললে,

‘আহ কি হয়েছে এভাবে কাঁদছো কেন?’

নাসিমা শেখ চোখের পানি মুছে বললেন,

‘তুমি কখনো আমার কথা শুনেছ যে,আজ শুনবে?’

‘তোমার কোন কথা শুনি নি সেটা বলো আগে।’

নাসিমা রে’গে গিয়ে তরতরিয়ে বললেন,

‘আমার ছেলেটার কি থেকে কি হয়ে গেল?শেষে কিনা কর্মচারীর মেয়ে এই বাড়ির ব‌উ হয়ে আসল। কোথায় আমার রূপা আর কোথায় এই মেয়ে।’

এমন কথায় আরমান শেখ জেনো দ্বিগুণ রে’গে যায়।তেলে বেগুনে জ্ব’লে উঠলো।বললেন,

‘শোনো নাসিমা জন্ম মৃ’ত্যু বিয়ে আল্লাহ এর হাতে তিনি যার সঙে যাকে লিখে রেখেছেন সঠিক সময়ে তার সঙ্গেই জুড়ে দিবেন।আর হ্যা কি জেনো বলছিলে?রূপার সাথে এই মেয়ে যায় না?আমিও বলছি সত্যিই রূপার সাথে আরিবা যায় না। এখন যদি তোমার অন্যের বাচ্চা কাচ্চার মুখে ফ্রি’তে দাদি ডাক শুনতে ইচ্ছে হয় তাহলে রূপাকে নিয়ে আসতে পারো। আমার বলার কিছুই নাই।’

শেষের কথাটা ঠাট্টার ছলেই বললেন।আরমান শেখের কথায় নাসিমা চুপসে গেলেন বলার মত মুখ রাখেনি এই রূপাটা।

_____________________

ড্রয়িংরুমের এমন বি’শ্রি ঘটনায় আরিবা চোখ ছলছল করছে।শেষে কিনা এ বাড়িতে প্রথম পা রাখতেই এমন জঘন্য ঘটনার সম্মুখীন হতে হলো তাকে?বুকের ভিতরটা দুরুদুরু করে কাঁপছে।প্রণয় তাকে একটা রুমে নিয়ে আসে। কিন্তু রুমে ঢুকেই আরিবার মাথায় জেনো বা’জ পড়ল।

ভিতর থেকে একটা কথায় বেরিয়ে আসে,

এসব কি!তারপর যা শুনলো তা আরিবার ভাবনার ও বাহিরে।

।চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে