নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে পর্ব-৫২+৫৩

0
106

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৫২

আনন্দ নগরের বড়ো বটগাছের নিচে শেষ দিনের বাইজি নাচ বসেছে‌। প্রধান বাইজি ছাড়াও সেখানে রয়েছে আরও চার জন। গ্ৰামবাসীদের সাথে যোগ দিয়েছে ওরাও। আরু উদাসীন হয়ে নিভৃতে ভেবে চলেছে তুরের কথা। দুই সখীর কেউ মনোযোগী নয় এই নাচে। তুর বাধ্য হয়ে এসেছে, আরু একা ঘরে ভয় পাবে বিধায় এসেছে। শেফালী দুই সখীর মাঝে এসে বলল, “আরু মুখ ভার করে রেখেছিস কেন? তুরের সাথে ঝামেলা হয়েছে? সেও মুখ ভার করে রেখেছে। কতবার জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে? জবাব পেলাম না।”

“শেফু, আমি একটা অন্যায় করে ফেলেছি। তুর ও প্রয়াস ভাইয়ের কথা আমি ওনাকে জানিয়ে দিয়েছি। এজন্য তিনি তুরের ওপর ক্ষ্যাপে আছেন। তুরও আমার ওপর রেগে আছে। আমি ভালোর জন্য বলেছিলাম, এতে বিপরীত হয়ে যাবে বুঝতে পারিনি।”

“আমি প্রয়াস ভাইকে দেখেই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। অপূর্ব ভাইয়ের এমন ব্যবহার অস্বাভাবিক নয়। একটা পরপুরুষকে এভাবে নাটকের মতো সাজিয়ে রাখা ন্যায় নয়, অন্যায়। আবার তুরের কষ্ট আমি অনুভব করতে পারছি।”
বলতে গিয়ে শেফালীর চোখ হলো টলমল। না! আর তিয়াসের কথা সে ভাববে না। তার জন্য চারটা জীবন অনিশ্চয় হয়ে পড়তে পারে। এবার সে এক পা এগোবে কাঁলাচানের দিকে। বিনিময়ে কাঁলাচান যদি এক পা এগোয়। তবে শেফালী আবার দুই পা এগোবে। তাদের সম্পর্কটা অনিশ্চিত করবে না। আরুকে আশ্বাস দিয়ে বলল, “এইসব নিয়ে তুই প্যানিক করিস না। সম্পর্কের মাঝে একটু বাধা না আসলে ভালোবাসার গভীরতা অনুভব করা যায় না।”

অপূর্ব ভ্রু কুঁচকে তাকাল উভয়ের দিকে। সময় ক্রমাগত পেরিয়ে যাচ্ছে। শীত গ্রাস করছে রাতকে। অপূর্ব সবাইকে পেরিয়ে পেছনে যেতেই শেফালী সামনে ফিরে এলো। আরুর পাশে বসে বাকিদের উদ্দেশ্য করে বলল, “তোদের দেখা হলে বলিস। ফিরে যাব।”

কাঁধে হাত রেখে আরুকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিল। আরু কেবল ক্লান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে কাতর গলায় বলল, “ভালোবাসার সংজ্ঞা জেনেও আপনি বারবার কেন এমন করেন? কেন ওর কাছে আমাকে অপরাধী করে দিলেন? প্রথমবার প্রাণের প্রিয় বোনের গায়ে হাত তুলতে আপনার বাঁধল না? নাকি ওর ভালোবাসার মূল্য আপনার কাছে নেই?”

“তোকে এই প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না। বোনকে মাথায় তুলে নেচে বাঁদর তৈরি করার চেয়ে শাসন করে মানুষ তৈরি করা আমার ভালো। তুই ঘুমা।” অপূর্বর ত্যাড়া কথায় আরু মাথা তুলল। চোখমুখে কঠোর ভাব এনে উঠে দাঁড়াল। মির্জা বাড়ির অতিথি হওয়ার কারণে ওদের আসন সবার সম্মুখে। আরু প্রথম সারিতে গিয়ে তিস্তাকে বলল, “তোমার সাথে বসব।”

চেয়ারের কাছে রোগাপটকা দেহ তিস্তার। এক পাশে সেঁটে আরুকে বসার জায়গা করে দিয়ে মনোযোগী হলো নাচ দেখায়। আরু কেবল রাগের কারণে এখানে এসেছে, ঘুমে পল্লব ঢাকতে মিনিট তিন লাগল না। তিস্তার কাঁধে মাথা রেখে পা তুলে বসে ঘুমিয়ে গেল। নাচ সমাপ্ত হওয়ার শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত সবাই উপভোগ করল সেই নাচ। দর্শকেরা টাকা উড়িয়ে দিয়েছে বাইজিদের দেহে। অপূর্ব তা করল না। ইস্কান্দার মির্জার পুতি হওয়ার দৌলতে বাইজিদের সম্মানি দিল হাতে তুলে। রেশমী নামের মহিলা অপূর্বর দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। বয়সের কারণে তেজ কমে গেলেও সাজসজ্জার ত্রুটি নেই। কৌতূহল নিয়ে বলল, “কে তুই? আগে তো কখনো তোকে এখানে দেখিনি।”

“আমি অপূর্ব আহসান। ইস্কান্দার মির্জার একমাত্র মেয়ে চম্পাকে চেনেন? আমি তার বড়ো ছেলে মোতাহার আহসানের ছেলে অপূর্ব আহসান।”

“তুই চম্পার নাতি? চম্পা কেমন আছে? চম্পাকে বলিস, রেশমী সালাম পাঠিয়েছে। আগে আমার মা নাচ করত। মায়ের সাথে এখানে আসতাম। চম্পা আমাকে কত ভালোবাসত।” রেশমীর চোখে ফোটল অতীতের আসরের দৃশ্য। নিজেকে ধাতস্থ করে টাকাগুলো নিয়ে অপূর্বর মাথায় হাত রাখল। তখন এগিয়ে এলো আরু ছাড়া সকলে। মেতে উঠল রেশমীর সাথে। রেশমাকে ‌বিদায় দিয়ে অপূর্ব লক্ষ করল, একটি ফাঁকা চেয়ারে জড়সড়ো হয়ে শুয়ে আছে আরু। পরিচিত বলতে ইলিয়াস আলী ছাড়া কেউ নেই আশেপাশে। অভিমানী আরুকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিয়ে বাড়ির দিকে এগোল অপূর্ব। বাকিরা হাঁটছে তার পিছুপিছু।
__
মির্জা বাড়ি ঘুমে বিভোর। তবে এক নবদম্পতি শুতেই পারেনি বিছানায়। শেফালী হাঁসফাঁস করছে চাপা কথা স্ফুট করতে। কালাচাঁন তার শার্ট খুলে কেবল সেন্ডো গেঞ্জি পরে লেপের তলায় ঢুকল। নোকিয়া মোবাইলে সাপ গেমস খেলতে খেলতে আড়চোখে শেফালীর দিকে এক পলক ফেলে। যার দরুন সাপের লেজে মুখ লেগে গেমস ওভার। চার্জে লাগানোর সুবিধা নেই এখানে। কালাচাঁন ফোনটা বালিশের কিনারে রেখে বলল, “ওখানে দাঁড়িয়ে কী করছ? কাল সকাল সকাল বের হব গ্ৰামের উদ্দেশ্য।”

শেফালী চট করে বিছানায় উঠে বলল, “আপনার সাথে আমার একটা কথা আছে। জরুরি কথা। শুনবেন?”

“কেন শুনব না? সব কথার চেয়ে তোমার কথাখানা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। বলো।” কালাচাঁন আগ্রহ নিয়ে বলে। তবে শেফালী স্বাভাবিক হয়ে বলতে পারছেনা। শেফালীর কাজে বিরাগী হয়ে কালাচাঁন চোখ বন্ধ করল। ফের শেফালী বলব, “শুনবেন না, আমার কথা?”

“তুমি মুখে অনশন পালন করছ। অনশন পালন করলে খেতে পারেনা। কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তুমি কথাও বলতে পারোনা। অনশন ভাঙা অবধি আমার পক্ষে অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। অনশন ভেঙে আমাকে ডেকো।” কালাচাঁন চোখ বন্ধ রেখেই বলল। ভাবাবেগ দেখা গেল না কালাচাঁনের মাঝে। তবে কালাচাঁনের চোখ বন্ধ থাকার কারণে শেফালীর জড়তা কা/ট/তে শুরু হয়েছে। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, “আমরা কি আর পাঁচটা স্বামী-স্ত্রীর মতো বৈবাহিক সম্পর্কে জড়াতে পারিনা?”

চট করে চোখ মেলল কালাচাঁন, দৃষ্টি নামিয়ে ফেলেছে শেফালী। কানে সমস্যা হয়েছে ভেবে কনিষ্ঠা আঙুল দিয়ে পরিষ্কার করে নিল এক দফা। শেফালীর মুখ বলে দিচ্ছে সে মিথ্যা শোনে নি। চাঁদশূন্য আকাশ। ঘুটঘুটে অন্ধকার বিরাজ করছে সেই কামরাতেও। শেফালীর থুতনি তুলে চোখে চোখ রেখে কালাচাঁন বলে, “আমি কি ভুল শুনলাম? আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলবে আর একবার?”

“অতীত ভোলা যায়না, আবার অতীত আঁকড়ে বাঁচা যায়না। তবে আমি বর্তমান নিয়ে বাঁচতে চাই। আমার মনের দহনের কথা আপনি জানেন, আপনার দহন আমি অনুভব করতে পারি।” এর জবাবে কিছু বলল না কালাচাঁন। মাথাটা আলতোভাবে ঠেকাল শেফালীর ললাটে। ঘনঘন শ্বাস নিল শেফালী। পৌঁছেছে প্রেম বার্তা, বেড়ে গেল উষ্ণতা। পৌষের শীতও হার মানে তাতে। কালাচাঁন যদি গড়ে নিতে পারে, নিক-না গড়ে। সমস্যা নেই। শুধু একটু আদরে সাজিয়ে নিক।

সময় ও স্রোত কখনো কি কারো জন্য অপেক্ষা করেছে? তাঁরা তো বহমান। নিজের মতো ধাবিত হওয়াই এদের কাজ। আরুর ছোটো পেট অনেকটা প্রশস্ত। এক মাস, দুই মাস, তিন মাস… পেরিয়ে গেছে নয়টি মাস। পেট না ধরে চলাফেরা করতে পারেনা আরু। কোনো কাজ আজকাল তাকে করতে হয়না। বংশে প্রথম সন্তান আসছে বলে কথা।
আরু রোয়াকে বসে আমের আচার খাচ্ছিল। বেশ স্বাদের সেই আচার? প্রথমদিকে বমি দূর করতে খেলেও আজকাল অভ্যাসের কারণে খায়। আরুর জন্য গাছের ছাল নামক মশলা থাকে না। খেয়ে শেষ করে ফেলে। মল্লিকা কলতলা থেকে পানি এনে উঠানে রেখে বলল, “তুই এখনো বসে আছিস কেন? দুলাভাই না একটু পর তোকে নিতে আসবে? জামাকাপড় গুছিয়েছিস?

“বাবাইয়ের তো কোনো খবর নেই। কখন আসবে কে জানে। তাছাড়া আমার যা জামাকাপড় আছে, ওগুলো টাইট হয়ে গেছে অনেক। তাই নেব না। মায়ের শাড়ি পরব।” আচার খেতে খেতে বলে আরু। তখনই বাড়িতে মিষ্টি, পান, সুপারি হাতে প্রবেশ করল ইমদাদ হোসেন ও অয়ন। আরুকে দেখেই ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল। উত্তেজিত হয়ে বলল, “বুবু কেমন আছিস তুই? পুঁচকে কেমন আছে?”

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

#নীলপদ্ম_গেঁথে_রেখেছি_তোর_নামে
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ৫৩

“বুবু তুই কেমন আছিস, পুঁচকে কেমন আছে?” অয়নের কথায় এক গাল হাসে আরু। নয় মাসের পেটের কারণে আরুকে আয়ত্ব করতে পারেনি অয়ন। তাই চোখমুখ বেশ মলিন। অয়নকে সরিয়ে ইমদাদুলের হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে বলল, “বাবা, কালকে আসবে বলেও কেন এলে না?”

“রাগ করিস না মা। ট্রেন মিস করে ফেলেছিলাম। আসতে আসতে দেরি হয়ে গেছে। তাই রাত করে এলাম না। এমনিতেই আমাদের গ্ৰাম ভালো নয়।” ইমদাদুল হোসেন বাইরেই শানের ওপর বসল। ‘বাড়ির একমাত্র দুলাভাই ও বেয়াইয়ের কণ্ঠ শুনে ফিরে এলেন অনিতা। প্রসন্ন হয়ে বললেন, “এখানে বসলে কেন ইমদাদুল? ভেতরে এসো।” পরপর বিরতি দিয়ে বললেন, “তুমি সবসময় দুই হাত ভরে খাবার নিয়ে আসো। তোমাকে কতদিন বলেছি, খালি হাতে আসতে?”

“নিজের শ্বশুর বাড়ি আবার মেয়ের শ্বশুরবাড়ি। খালি হাতে আসা শোভা পায়না। আমি এমনই আসব। যদি এগুলো আনতে বারণ করো, তবে আর আসব না ভাবী।” ইমদাদুলের কথায় অনিতা কান টেনে ধরল‌। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তাদের মাঝে বিরাজমান।

“হয়েছে আর ভাষণ দিতে হবেনা। চুপ করে ভেতরে এসে বসো। সুমি, ইমদাদুল ভাই আর অয়নকে শরবত দাও।”

“আমাকে নিয়ে এত ব্যস্ত হতে হবেনা। আমি আরু আর অপু নিয়ে এখনই চলে যাব। ভেলিভারির সময় মেয়ে তার মায়ের কাছে থাকলে জোর পায়। তাই পারুল আমাকে পাঠিয়েছে। কড়া হুকুম, ওকে নিয়েই যেতে হবে।”
বলতে বলতে সবাই বৈঠকখানায় গিয়ে বসল। সুমি ততক্ষণে নাস্তা এনে টেবিল সাজিয়ে ফেলেছে। আরু আর আগের মতো কাঠের সিঁড়ি ভেঙে ওপরে ওঠেনা। এই অবস্থায় অপূর্ব তাদের মালামাল নিচে নামিয়েছে। আরু ঘর থেকে জামাকাপড়ের ব্যাগ নিয়ে বৈঠকখানায় আসতে অনিতা বলল, “বিকালে গেলে হবেনা? অপু তো এখনো এলো না। দুপুরের খাবার খেয়ে বিশ্রাম নিতে নিতে অপু চলে আসবে।”

“পারুল আরুর জন্য অপেক্ষা করছে। আমি আরুকে নিয়ে যাই, অপূর্ব বিকালে এসে চলে যাবে।” ইমদাদুলের কথায় বাধ্য হয়েই সায় দিল অনিতা। নাস্তা খেয়ে রওনা হলো বাড়ির দিকে। আসার সময় রিকশা নিয়ে এসেছিল বলে তেমন সমস্যা হলো না। অনেকদিন পর আরু এলো মৃধা বাড়িতে, সাথে এলো ময়না পাখিরা। পারুল আরুকে দেখে প্রসন্ন হয়ে জড়িয়ে ধরলেন রিকশায় থাকতেই। অতঃপর হাত ধরে ধীরে ধীরে নামালেন। জড়িয়ে ধরে অয়নকে আদেশ দিল, “তাড়াতাড়ি তোর চাচিকে ডেকে নিয়ে আয়। আরু আসলেই তাকে খবর দিতে বলেছে।”

অয়ন ছুটে গেল। চোখমুখে প্রকাশ পেয়েছে উত্তেজনা। নয়না দিঘিতে কালির পাতিল ধুচ্ছিল। অয়ন দিঘির পাড়ে দাঁড়িয়ে বলে, “চাচি বুবু এসেছে, মা আপনাকে ডাকছে।”

“তুই যা, আমি হাতের কাজ শেষ করে আসছি।” মাজতে মাজতে বলে নয়না। অয়ন শুনল না বোধ হয়, কিংবা ইচ্ছা করেই নয়নার আঁচল ধরে টানতে টানতে বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। নয়না আঁচল ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, “ছাড়, অয়ন। আঁচল ছাড়। কেউ চলে আসবে। আমার হাতের মা/র খাবি কিন্তু। অয়ন! তোর মাকে বি/চার দিব। ছাড়।”

“আপনাকে বুবুর কাছে নিয়েই তবে ছাড়ব।” বলতে বলতে উঠানে নিয়ে গেল নয়নাকে। আঁচল ছাড়তেই নয়না পারুলকে উদ্দেশ্য করে বলল, “অয়ন দিনদিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছে। আমার আঁচল ধরে টেনে নিয়ে এসেছে।”

ইমদাদুল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে অয়ন কাঁচুমাচু মুখে করে ফেলে। ভীত অয়ন ছুটে যায় সাবিতের কাছে। অতঃপর আরুকে নিয়ে পিঁড়ি পেতে বসায় রোয়াকে। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “কেমন আছিস আরু?”

“ভালো আছি চাচি। তোমরা কেমন আছো?”

“ভালো আছি। অপু আসেনি?”

“উনি রাতে আসবে। সাথী, সিঁথি ওরা কোথায়? কতদিন হয়েছে ওদের সাথে কথা হয়না। ডাক দাও, কথা বলি।” পেটে হাত দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে আরু বলে। রিকশায় ঝাঁকানিতে বেসামাল তার অবস্থা। আরুর তখনকার ছাগল ছানা মিঠু এই নিয়ে চারবার ছানা দিয়েছে। উঠানের একপাশে মিঠুকে বেঁধে রাখা হয়েছে ছানা নিয়ে। ছানা দুটো খেলা করছে। আরু দুহাত বাড়িয়ে আয় বলতেই ছানা দুটো ছুটে এলেও মিঠু এলো না। চোয়ালের নিচে হাত রাখতেই ছানা যুগল পল্লব বুজে অনুভব করতে থাকল সোহাগ। আরু কৌতূহল নিয়ে বলল, “মা, মিঠু ওভাবে বসে আছে কেন? কী হয়েছে ওর?”

“মিঠুকে বোধ হয় সাপে ছোবল দিয়েছে। সারা শরীর ঘাঁ হয়ে গেছে। কালকে পশু হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম, ডাক্তার ইনজেকশন দিয়েছে। সারা শরীরে মাখার জন্য একটা মলম দিয়েছে। বলেছে, ছানা দুটো যাতে মায়ের থেকে দূরে রাখি। দুধ ছাড়া কী খাবে ছাগল দুটো?” প্রিয় ছাগলের এমন কথা শুনে আরু উঠে এগিয়ে গেল। মাটিতে বসে কোলে তুলে আদর করতে থাকে। ছাগলের দেহের বিভিন্ন অংশ পচে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। বোধ হয় বেশিদিন বাঁচবে না। ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে দিঘিতে নজর রাখতেই মাছের বুটবুট দেখতে পেল। প্রসন্ন হয়ে বলল, “মা, মাছগুলো অনেক বড়ো হয়েছে তো। একটা মাছ ধরো না? আজ মাছ দিয়ে ভাত খাব।”

“আচ্ছা। তুই এখন ঘরে চল।” পরপর আশেপাশে তাকিয়ে মিলাতে পারল না অয়নের হদিস। অপারক হয়ে ইমদাদুল হোসেনকে বলল, “আপনি এখানে থাকুন।‌ ছানা দুটো যাতে মায়ের দুগ্ধ খেতে না পারে। আমি আরুকে ঘরে দিয়ে আসি।”

বলেই আরুকে ধরে ধরে ঘরে নিয়ে গেল। আরুর ঘরটিতে রেখে ফ্যান চালু করল। আরু মায়ের হাতটি ধরে বলল, “মা, তুমি একটু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিবে? রাত হলেই পাখি পেটের ভেতরে নড়াচড়া করে। পায়ের দাগ স্পষ্ট দেখা যায়। ব্যথায় চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। উনাকেও ঠিকমতো ঘুমাতে দেইনা, আমিও ঘুমাই না। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। আমাকে একটু ঘুম পাড়িয়ে দেবে মা?”

“তুই থাক, আমি এক মিনিটের ভেতরে আসছি।” পারুল বিছানা ঝেড়ে আরুকে রেখে দিঘির দিকে গেলেন। দখিনের জানালা খুলতেই দমকা হাওয়া আরুকে ছুঁয়ে দিল। অনুভব করল পুরনো দিনের কথা। এই ঘরে কাটাল দৃশ্য ভেসে উঠল চোখের পাতায়। পেছনে তাকিয়ে দেখল, পারুল ওজু করে এসেছে। আরুকে নিজের কোলে‌ নিয়ে মধুর কণ্ঠে দোয়া পড়তে শুরু করল, করল জিকির। আরুর ছটফটে প্রাণ সেই কণ্ঠে শীতল হয়ে এলো। ওষ্ঠদ্বয় নাড়িয়ে নিজেও ব্যক্ত করল হরফ। নেত্রপল্লব ঝিমিয়ে নেমে এলো তন্দ্রার রাজত্ব।
__
ফোনের রিংটোর এক নাগাড়ে বেজে চলেছে। সময় ৫.১৫ টা। অপূর্ব ফোন রিসিভ না করে পা থেকে মোজা টেনে খুলছে। বাড়িতে প্রবেশ করে আরুর আসার কথা শুনেই চলে এসেছে এখানে। অপূর্ব ফোন রিসিভ করে কানের কাছে নিয়ে বলে, “হ্যালো মাহাদ, আমি আজ সাড়ে চারটার বের হয়েছি। তাই তোমার সাথে দেখা হয়নি। আশেপাশে খুঁজেও তোমাকে পাইনি।”

চিরচেনা কণ্ঠ শুনে আরু তাকাল। মুচকি হেসে মাথাটা অপূর্বর কোলে রেখে জড়িয়ে ধরল কোমর। অপূর্ব ওপাশের কথা আর শুনল না, কল বিচ্ছিন্ন করে আরুর মাথায় হাত চালিয়ে বলল, “লম্বা একটা ঘুম দিলি শুনলাম। তা ঘুমানোর আগে কিছু খেয়েছিস?”

“না। তবে অনেকদিন পর নিজেকে ফ্রেশ ফ্রেশ লাগছে। এতদিন ঘুমের কারণে মাথা ঝিম দিয়ে থাকত। আজ তেমন লাগছেনা। তবে খুব ভালো লাগছে। তা আপনি কখন এসেছেন?”

“এই এলাম। ফ্রেশ হয়ে একসাথে খাব।” বলতে বলতে অপূর্ব ব্যাগ থেকে নিজের সাধারণ পোশাক বের করে দিঘির দিকে রওনা হলো, মুখ ধুতে আরুও চলল পিছুপিছু। যাওয়ার সময় নিমের ডাল ভাঙতে ভুলে না। দিঘির পাড়ে বসে দাঁত মাজছে, অন্যদিকে অপূর্ব তখন সাবান দিয়ে দেহ পরিষ্কার করছে। গাছের সাথে হেলান দিয়ে পাখিকে উদ্দেশ্য করে আরু বলে, “এই পাখি, কবে তুই আমার কোলে আসবি। কবে মা বলে ডাকবি। না! না! তুই বিদেশিদের মতো মম ও ড্যাড বলে ডাকবি, ঠিক আছে?”

চলবে.. ইন শা আল্লাহ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে