দর্পহরন পর্ব-৬০+৬১+৬২

0
124

#দর্পহরন
#পর্ব-৬০

এলাকার রাজনৈতিক ময়দান উত্তপ্ত। মেয়র নির্বাচনের হাওয়া লেগেছে। নতুন একজনকে নির্বাচনের ময়দানে দেখে সালিম সাহেব অবাক হয়ে মুচকি হাসলো। গতবার সতন্ত্র হিসেবে নির্বাচনে দাঁড়িয়েছিল সিরাজ আহমেদ। সালিম সাহেব জিতলেও ভালো টক্কর দিয়েছিল সিরাজ। হয়তো জিতেও যেত যদি না শেষ মুহূর্তের খেলাটা না খেলতো সালিম। সে কথা ভেবে মিটিমিটি হাসতে হাসতে চেয়ারে দোল খেলো কিছু সময়। গতবারের শিক্ষাটা কি ভুলে গেছে সিরাজ আহমেদ? নাকি সেই ভয়ে নিজে মাঠে না নেমে মেয়েকে এগিয়ে দিয়েছে? অবশ্য যে কান্ড হয়েছিল তাতে তার মুখ দেখানোর অবস্থা নেই। এজন্যই হয়তো মেয়েকে ঠেলে দিয়েছে। সালিম সাহেব নিশ্চিত মনে শ্বাস ফেলে।

চিন্তার বিষয় কেবল মেয়েটা। ওর ভবিষ্যত কি হবে তাই ভাবছে। রণর থেকে কোন সারা নেই। ওর মাতো বলেই দিলো শুভ্রা চায় না ওরা। তাহলে উপায় কি ডিভোর্স ছাড়া? বুকটা চিনচিন করে উঠলো। তাদের পরিবারে ডিভোর্স এর কোন ইতিহাস ছিলো না। শুভ্রার হাত ধরে বুঝি সেটারও চল হয়ে যাবে।

“চাচা, জামাই আসছে এলাকায়।”
তুহিনের কথায় নড়েচড়ে বসলেন সালিম-“কবে?”
“মেলাদিনই হয়ে গেলো।”
“ওহহহ। কিছু করে?”
“মেলা কিছুই তো করে। সুমনা আপা তো ওইখানেই থাকে সারাদিন। এলাকার যারা আপনের এন্টি পার্টি তাদের সাথে দফায় দফায় মিটিং করতেছে। নিজে প্রচরনায় না থাকলেও বুদ্ধি দিতেছে। দক্ষিণ মুড়াপাড়ায় পুরান ব্রিজের পাশে নতুন ব্রিজ বানায় দিলো। ওই দিকের যত নোংরা খাল ছিলো সব সাফ কইরা ফেলছে। আবর্জনা ফেলার মাঠটা খেলার মাঠ বানায়া দিছে। রাস্তা সংস্কারের ঘোষণাও দিছে। শুনলাম আগামী শনিবার সুমনা আপা শো ডাউন কইরা সমাবেশ করবো।”
বিরক্ত হলেন সালিম-“স্বতন্ত্ররে সমর্থন দিছে? ঢাকায় যায় না?”
“কাজ থাকলে যায় আবার চইলা আসে।”
“কি মনেহয়? সবাই কারে চায়?”
তুহিন চুপ করে রইলো। সালিম সাহেব অবশ্য জবাবের আশায় বসে নেই-“মুড়াপাড়ার ওইদিকে যে ময়লার ভাগার আছিল ওইটা কি ঠিক করছে?”
তুহিন অবাক হলো-“নাহ। খুব দূর্গন্ধ হয়। লোকজনের যাওয়া আসার সমস্যা করে।”
“ওইটা পরিস্কারের ব্যবস্থা কর। আর ওইখানে খালের উপর একটা ব্রিজ বানানের কাজও কইরা ফেল। আর কালকে আমি গার্মেন্টস মালিকদের সাথে মিটিং করবো। ব্যবস্থা করিস।”
তুহিন মাথা দুলায়। উসখুস করে। সালিম সাহেব জানতে চাইলো-“কিছু কবি?”
“ফাহিম।”
সালিম সাহেব হাত দেখালেন-“বাদ দে। জোর করার দরকার নাই।”
“না, জোর করমু কেন? সে থাকতে চায় আপনের সাথে।”
“সত্যি কইতাছোস!”
“হুমমম। তাইলে কি কালকে ডাকুম ওরে?”
কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে মাথা দুলিয়ে সম্মতি দিলেন।

রাতে খাওয়ার টেবিলে সবাই যখন উপস্থিত তখনই কথা তুললো সালিম-“ভাইজান, এইবার সবাই একটু নির্বাচনে মন দেই। বাড়ির মেয়েরা যারা আছো সবাই সকাল থিকা প্রচারনায় যাইয়েন।”
মোর্শেদ বললো-“সবাই তো শুনতেছি সতন্ত্ররে সাপোর্ট করতেছে।”
“করুক। আমরা এইবার চেষ্টা করবো মন থিকা, কোন অবহেলা করা যাইব না। আমার জিততেই হইবো নাইলে টিকতে পারুম না। হাত থিকা কাজ সব চইলা যাইতেছে একে একে। ওইদিন মোহন কইলো, চান্দা দিতে চায় না কেউ। এইদিকে ট্যাবলেটের বিক্রি কম। পুলিশের ব্যাপক ধরপাকর চলতাছে। সরকারি একটা কাজও পাই নাই গত একবছরে। কেমনে চলুন বুঝতাছেন?”
শরীফ চুপচাপ খাচ্ছিলো। সালিম সাহেব ওকে ধরলো-“তুই আর তন্ময় আমার সাথে থাকবি শরীফ। ভাইজানতো থাকবোই। নিজের মানুষ থাকলে ভরসা হয়। সোহেল থাকলে অবশ্য তোদের কাউকেই লাগতো না।”
মানা করতে চাইলেও পারলোনা শরীফ। সোহেলের কথা ভেবেই পারলোনা। বলতে পারলোনা, এইসব পাপের সম্রাজ্যে সে সামিল হতে চায় না।

*****

সারাদিনের ক্লান্তি শেষে নিজের রুমে ফিরলো রণ। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে এখানেই থাকছে সে। কাজ থাকলে ঢাকায় যায়, কাজ সেরে ফিরে আসে। মাঝে মাঝে মায়ের খোঁজও নেয় নিয়ম করে তবে ফিরে আসে এখানেই। বলা যায় এক প্রকার মায়ের কাছ থেকে পালিয়ে থাকা।ক্লান্ত শরীরে কাপড় নিয়ে শাওয়ারে ঢুকলো রণ। বেরিয়ে এসে কাপড় পড়ে রান্নাঘরে এসে কড়া করে এককাপ কফি বানালো। পেটে খিদে থাকলেও খাওয়ার ইচ্ছে হচ্ছে না কোন। তীব্র মাথা ব্যাথায় কাতর হয়ে আছে দুপুর থেকে। কফি নিয়ে ঘরেই ফিরে এলো। কফি খেতে খেতে কি মনে করে মোবাইলের গ্যালারিতে ঢুকলো। আমেরিকায় কিছু ছবি তুলেছিল শুভ্রার। সেগুলো বের করে দেখতে লাগলো। মনটা উচাটন হলো খুব। এতো কাছাকাছি থেকে নিজের বউকে না দেখতে পারার বেদনায় হৃদয় তোলপাড় হচ্ছে। খুব মন চায় মেয়েটাকে কাছে ডাকতে। কিন্তু এবার সবকিছুর একটা হেনস্তা করতেই হবে। এভাবে আর ভালো লাগছে না। কিন্তু সমাপ্তিটা কেমন হবে সেটাই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেনা। তাতে কি শুভ্রার সাথে তার যোগাযোগ চিরদিনের মধ্যে বন্ধ হবে? মনে দ্বিধা। সে কোন সিদ্ধান্ত নিতে চাইলে শুভ্রা কি আদৌও তাকে বুঝবে? অসহ্য হয়ে ফোনটা বন্ধ করে রণ। মাথাটা টনটন করে উঠলো। না পেরে চোখ বুঁজে হেলান দিলো।
“আমাকে না দেখতে পেলে আপনার কষ্ট হয় জানতাম। তাহলে কি করে মাস পার করে ফেললেন মন্ত্রী মশায়?”
রণ চমকে উঠে বসলো। ঘোলাটে দৃষ্টি নিয়ে তাকাতেই সামনে শুভ্রাকে দেখতে পেলো। শান্ত হয়ে নিয়ে রণর দিকে তাকিয়ে আছে সে। রন দেখলো কয়েকদিনে বেশ শুকিয়ে গেছে শুভ্রা। তাতে অবশ্য ওর সৌন্দর্য বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। রণ বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়ে জানতে চাইলো-“তুমি! এখানে?”
শুভ্রা তাচ্ছিল্যভরে হাসলো-“কেন? এখানে আসতে নেই? এখন কাগজে কলমে আপনার বউ আমি। আসতে পারি তো, তাই না?”
রণ কি বলবে ভেবে পেলো না কেবল মাথা দুলালো। সে তৃষিতের মতো শুভ্রাকে দেখতে লাগলো। শুভ্রার দৃষ্টি স্থির-“আমাকে ছাড়া বেশ ভালোই আছেন দেখা যায়। চন্দ্রের সাথে ভালো সময় কাটছে তাহলে?”
রণর ভ্রু কুঁচকে গেলো-“এসব বলতে এসেছ?”
শুভ্রা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে-“নাহ, আপনার জন্মদিনে উইশ করতে এসেছি। উইশ করা হলে চলে যাব।”
এতোক্ষণে রণর ঠোঁটের হাসির আভাস দেখা দিলো-“তো করছো না কেন?”
শুভ্রা ভ্যাবচ্যাকা খায়। রণকে এতোটা শান্ত দেখে নিজেকে অনাহুত মনেহয়। অতি আবেগি হয়ে খামোখাই চলে আসার জন্য আফসোস হয়। সে কঠিন কন্ঠে বললো-“শুভ জন্মদিন মন্ত্রী মশায়।”
রণ হাসলো-“ধন্যবাদ।”
“আমি আসছি তাহলে।”
শুভ্রা উঠে দাঁড়াতেই রণ এগিয়ে এলো দ্রুত পায়ে-“সেকি! কেক না কেটেই চলে যাবে? তাছাড়া শুধু উইশ করলে হবে? গিফট দিতে হবে না?”
শুভ্রা দু’পা পিছিয়ে যান। রণকে আসতে দেখে ওর বুক কাঁপে। তুললিয়ে বললো-“কি কি কিসের গিফট? খবরদার এগুবেন না আমার দিকে। এতোগুলো দিন একবারের জন্যও খবর না নিয়ে এখন কোন অভিনয় করবেন না।”
রণ ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে এসে শুভ্রার কোমড় জড়িয়ে ধরে-“একশোবার ধরবো হাজারবার ধরবো। তুমিই তো বললে তুমি এখনো আমার বউ। তোমার উপর অধিকার আছে আমার।”
“কিসের অধিকার? অধিকার বুঝলে এভাবে আমায় ছাড়া ভালো থাকতে পারতেন না।”
শুভ্রা নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে মোচড়ামুচড়ি করলে রণ আরও শক্ত করে এটে ধরে তাকে। শরীরের সাথে মিশিয়ে নিয়ে ওর চিবুক ধরে চোখে চোখ রাখে-“নিজের শক্তির অপচয় করো না। আমার কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিতে পারবেনা নিজেকে। তাছাড়া আমি ভালো আছি কে বললো তোমাকে? সবসময় বেশি বোঝ। আমি সব ঠিক করার চেষ্টা করছি এইজন্য চুপচাপ আছি।”
শুভ্রা চুপ করে গেলো। দু’জনই একে অপরকে দেখছে। শুভ্রার চোখ ছলছল, দাঁতে ঠোঁট চেপে নিজেকে সামলে নেওয়ার আপ্রান চেষ্টা করছে। রণর সামনে কিছুতেই দূর্বল হবে না সে। রণ হুট করে শুভ্রার কপালে চুমু দেয়। ওর মাথাটা বুকের সাথে জড়িয়ে নেয়-“আর কয়েকটা দিন ধৈর্য্য ধরবে? সব ঠিক করে দেব আমি। বিশ্বাস রাখো আমার উপর।”
শুভ্রা কাঁদছিল, রণর কথা শুনে ফুঁসে উঠলো-“বিশ্বাস! আপনি রেখেছেন আমার উপর? সেই তো আন্টি যা বলেছে তাই তো বিশ্বাস করেছেন। আর আপনি বলছেন বিশ্বাসের কথা?”
“হ্যা বলছি। কাকে বিশ্বাস করেছি কাকে নয় সেসব এখন ব্যখ্যা করে বলবো না শুভ্রা শুধু বলবো একটু ধৈর্য্য ধরো। কিছুদিন পর সব ক্লিয়ার হয়ে যাবে।”
শুভ্রা এবার জোর করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো-“কিভাবে ধৈর্য্য ধরবো বলুন তো? যেখানে আপনি আপনার জন্মদিনে আমাকে এতোবড় উপহার দিলেন?”
“কিসের উপহার দিলাম?”
রণ অবাক হতেই শুভ্রার চোখের সামনে কাগজ মেলে দিলো-“ভাবিনি, আপনার এতো তাড়া আছে। আমি আসায় ছিলাম আপনি ফোন করবেন আমাকে। না হলে নিতে আসবেন। কিন্তু সব ধারণা ভুল প্রমান করে এটা পাঠিয়েছেন। ভালো করেছেন। আসলে ভুল তো আমারই। আপনাকে জোর করে বিয়ে করেছিলাম কিনা।”
“আমি এটা করিনি মানে আমি তুমি ভুল…। আমি তোমাকে ফোন করেছিলাম শুভ্রা। তুমিই মোবাইল ফেলে গেছ। আমি কিভাবে…”
রণর কথা শেষ করতে দেয় না শুভ্রা-“আমাদের সম্পর্ক তো শুরু থেকেই শেষের মতো। এটাই ভালো। রোজ রোজকার ঝামেলা থেকে এমনটাই ভালো হবে। শত্রুর সাথে সংসার হয় না আসলে। আমিই বুঝিনি। যাক, ভুল শুধরে নিচ্ছি। আমি সাইন করে দিয়েছি। আপনার জন্মদিনের গিফটের কথা বলছিলেন না। দিয়ে দিলাম সবচেয়ে দামী গিফট। ভালো থাকবেন মন্ত্রী মশায়।”

চলবে।

#দর্পহরন
#পর্ব-৬১

“আমি এমন কিছু করিনি শুভ্রা। প্লিজ ভুল বুঝো না। আমাকে সময় দাও একটু। শুভ্রা চলে যেয় না।”
রণ ভীষণ চিৎকার করে উঠে বসলো। ঘেমে নেয়ে উঠেছে সে। বুকটা ধড়ফড় করছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। কয়েকবার ঢোক গিললো রণ। পানির তৃষ্ণায় মরমর অবস্থা। নিশ্বাস বন্ধ হবো হবো করছে। অনেক কষ্টে বেড সাইড টেবিলের উপর থেকে হাত বাড়িয়ে বোতলটা নিলো সে। ঢকঢক করে প্রায় অর্ধেক বোতল পানি পান করলো। তারপর চুপচাপ বসে থাকলো। এখনো মাথাটা ঠিকঠাক কাজ করছে না তার। অতি জঘন্য স্বপ্নটা তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে। কি মনে হতে ঘড়িটা দেখলো একবার। সাড়ে এগারো বাজছে। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখলো গায়ে বাইরের কাপড়। গা চিটচিট করছে।
মাথা থেকে চিন্তা দূর করতেই শাওয়ার নিতে উঠে দাঁড়ায় রণ। মনটা চরম বিষন্ন হয়ে আছে। আজ মায়ের সাথে ভীষণ রকম কথা কাটাকাটি হয়েছে। সেটা ভেবে মনটা আরও সংকুচিত হলো রণর। একদিকে শুভ্রা আরেকদিকে মা। কোনদিকে যাবে সেটাই বুঝতে পারছে না। যে জটিলতা ভয় পেত সেটাই এখন সকাল বিকেল মোকাবিলা করতে হচ্ছে। অসহ্য লাগছে জীবন। শরীর বেয়ে নেমে যাওয়া জল যদি সব সমস্যাগুলো শুষে নিতো তাহলে কতইনা ভালো হতো।

শাওয়ার নিতে নিতে টের পেলো ফোনটা বাজছে।
কোনরকমে গা মুছে ট্রাউজার পরে বেড়িয়ে আসতেই থমকে গেলো সে। বিছানার উপর শুভ্রা বসে আছে। রণর মনে হলো তার হ্যালুশিনেশন হচ্ছে। বারবার চোখ ডলে নিলো। পুনরায় তাকিয়ে দেখলো শুভ্রাকে। হ্যা শুভ্রাই। কেমন কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রণকে হতবিহ্বল দেখায়-“তুমি! সত্যিই তুমি এসেছ!”

উদোম গায়ের রণকে দেখে শুভ্রার ঘোর লাগে। চোখের কঠিন দৃষ্টি কোমল হতে শুরু করে। তার দু চোখ থেকে মুগ্ধতা সরাতে পারে না। মানুষটাকে সেই প্রথম থেকেই ভালো লাগতো শুভ্রার? বিয়েটা কি শুধুই জেদ ছিলো নাকি মনের কোনে কোথাও ভালোলাগাটুকুও ছিলো? আজও বুঝে উঠতে পারে না শুভ্রা। তবে যতটা রাগ রণর উপর হওয়ার কথা ছিলে ততটা রাগ সে কখনোই হতে পারেনি। কেন যেন রণকে দেখলে রাগটা আসে না ঠিকঠাক। আজও অভিমান দেখাতে পারলোনা। রণর দেহসৌষ্ঠব শুভ্রাকে মোহাবিষ্টের টানলো। সে আপনাতেই রণর কাছে এসে দাঁড়ালো। ফোঁটা ফোঁটা জল তখনও রণর গা জুড়ে। তাকিয়ে থাকলে একটা শীতল অনুভূতি ছুঁয়ে যাচ্ছে শরীর জুড়ে। শুভ্রা কাঁপা কাঁপা গলায় বললো-“আমাকে ছাড়া দিব্যি ভালো আছেন দেখছি। না আমার খবর নিয়েছেন না নিজের খবর দিয়েছেন। তাহলে যা রটেছে তা সত্যি?”
রণ শুভ্রাকে দেখছে একদৃষ্টিতে। মেয়েটাকে কিছুটা এলোমেলো লাগে। স্বাস্থ্য কমেছে, চেহারায় বিষাদ ছেঁয়ে আছে। পরনে সবুজ রঙা তাঁতের শাড়ী চোখে প্রশান্তি দেয়। হুট করে দুঃস্বপ্নটা মনের কোনো উঁকি দিয়ে গেলো। একদম স্বপ্নের মতোই ঘটছে না সবকিছু? যেন নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করছে রণ। বুকের মধ্যে জেঁকে বসা ভয়ের অনুভূতি ফিরে আসছে। তাকে হতবিহ্বল দেখলো। সে হুট করে শুভ্রার কোমড় জড়িয়ে ধরে কাছে টানলো-“ফোনটা ফেলে গেলে কি করে ফোন দেব শুভ্রা? তবুও তো টিভিতে আমার খবর পাচ্ছ তুমি। আমার কি অবস্থা বোঝ? এতদিনে একবার তোমার দেখা পাইনি।”
শুভ্রার চোখের ঘোর বাড়ে। তবুও শ্লেষের সাথে বললো-“আমাকে দেখার ইচ্ছে হয় আপনার?”
শুভ্রার কথায় কষ্ট পেলেও তা প্রকাশ করলোনা রণ-“খুব হয়। যদি অন্য কাউকে দেখে চোখ জুড়াতে পারতাম তাহলে খুশি হতাম মেয়ে। মনের মধ্যে অহর্নিশ যে চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে তা থেকে রেহাই পেতাম। তোমার অভিশাপ এবার কাজে লেগেই গেলো শুভ্রা। তুমি অভিশাপ দিয়েছিলে আমি যেন কষ্ট পাই। এখন নিশ্চয়ই তুমি খুশি?”
রণর কথাগুলো শুনতে শুনতে হৃদয় তোলপাড় হয় শুভ্রার। সে বলেই ফেলে-“মোটেও এরকম কিছু আমি দোয়া করিনি৷ আর আমার খুশির কথা আসছে কেন? আপনার থেকে দূরে যেয়ে থাকায় যদি আমার খুশি হতো তাহলে আমি আপনার সাথে জুড়ে থাকতে চাইতাম না। আফসোস আমাকে বুঝতে পারেননি আপনি।”
রণ শুভ্রার কপালে চুমু দিলো-“তুমিও তো আমাকে বুঝতে চাইছো না শুভ্রা। বারবার দোষী বানিয়ে দিচ্ছ আমাকে। বিশ্বাস করো আমি দোষী না আর না হতে চাই।”
শুভ্রা হুট করে রণকে জড়িয়ে ধরে। ওর বুকে মাথা রেখে হু হু করে কাঁদে-“আর কতদিন এমন চলবে? আমার ভালো লাগছে না কিছু। একটু শান্তিতে থাকতে পারবো কবে বলতে পারেন? আমি মনেহয় পাগল হয়ে যাবো।”
রণর কষ্ট লাগে। নিজেকে অক্ষম মনেহয়। শুভ্রা ফিসফিস করলো-“সারাদিন সবাই আপনাকে উইশ করলো সেই ভিডিও দেখলাম। অথচ আপনার এবারের জন্মদিনের প্রথম উইশটা আমার হওয়ার কথা ছিলো। সেই আমি কিনা উইশ করতে পারলাম না। আপনার বউ হওয়ার পরেও রাতের আঁধারে চুপিচুপি আপনার কাছে আসতে হলো। এই অপমান মানতে কষ্ট হচ্ছে রণ।”
রণ পরপর কয়েকটা চুমু দেয় শুভ্রার গালে। আর্দ্র গলায় বললো-“আর কয়েকটা দিন শুভ্রা। আমি তোমাকে স্বসন্মানে বাড়িতে তুলবো।”
“কিন্তু আন্টি কখনো রাজি হবে না।”
“মাকে মানাবো আমি। এ দায়িত্ব আমার। তুমি ভেবো না।”
“সত্যি বলছেন?”
অধীনে আগ্রহে জানতে চাইলো শুভ্রা। রণ তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকের মাঝে-“হ্যা। দেখে নিয় তুমি।”

*****

এলাকার নির্বাচনী প্রচারনা বেশ জমজমাট। দুই পক্ষ বেশ জোর দিয়ে প্রচারনা করছে। সালিম সাহেব বড়সড় শো ডাইন করলো। এলাকার ছোট মাঝারি সমস্যা সমাধান করছে নিমিষেই। নির্বাচনের বদৌলতেই অনেকদিনের পুরনো ভাগার পরিস্কার হয়ে গেলো। পুরনো ব্রিজটা সারানো হলো। এলাকায় কয়েকটা গভীর কুপ হয়ে গেলো। তবুও যেন নিজের জন্য যতটা জোরালো আওয়াজ চাইছেন ততটা পাচ্ছেন না।

অপরদিকে সুমনার প্রচারনা কিছুটা ভিন্ন। যেহেতু এটা শিল্পাঞ্চল, গার্মেন্টস এলাকা। সে বুদ্ধি করে প্রতিটা গার্মেন্টসে যাচ্ছে মেয়ে কর্মীদের স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা আছে কিনা দেখতে। যেখানে নেই সেখানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বাধ্য করছে নিজে উদ্যোগ নিচ্ছে। স্কুল কলেজগুলোতে একই কাজ করলো। কিশোর, তরুণ ও যুবকদের প্রোডাক্টিভ বানাতে এলাকায় পাঠাগার ও সংগঠন করার ঘোষণা দিলো। বলাই বাহুল্য, সুমনার উদ্যোগগুলো বেশ প্রসংশা পেলো। অবস্থা এমন দাঁড়ালো যে দু’জনার জনপ্রিয়তা দেখে বোঝার উপায় নাই কে জিতবে।

এমন অবস্থায় খুব সংবেদনশীল একটা ঘটনা ঘটে গেলো। একদিন সকালে সত্যি সত্যি ডিভোর্স লেটার এলো ইব্রাহিম নিবাসে। পুরো বাড়ি জুড়ে শোকের পরিবেশ সৃষ্টি হলো। শুভ্রা যেন দারুণ শক পেলো। সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না। বারবার নেড়েচেড়ে কাগজ দেখতে লাগলো। বলা হয়েছে পুরো কাগজটা যেন শুভ্রা ভালোমতো পড়ে দেখে। কোন শর্তে যদি রাজি না হয় তাহলে জানালে সেই বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। আর যদি আপত্তি না থাকে তাহলে যেন সাইন করে পাঠিয়ে দেয়।

শুভ্রা অবিশ্বাস নিয়ে কাগজটার দিকে তাকিয়ে থাকে। সে রাতে রণ তাকে আশ্বাস দিয়েছিল সব ঠিক করে ফেলবে। এই কি ঠিক করা! শুভ্রা হু হু করে কেঁদে দিলো। দুইদিন সব নাওয়া খাওয়া বন্ধ তার। বুকের ভেতর উথাল পাথাল দুঃখ। নিজেকেই শেষ করে দিতে মন চাইছে। মেয়ের না খেয়ে থাকার কথা শুনে সালিম সাহেব এলো মেয়ের ঘরে-“আম্মাজান, আপনি নাকি খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিছেন?”
শুভ্রা চুপ করে রইলো। সালিম সাহেব ধৈর্য্য ধরে প্রশ্ন করলো-“আম্মাজান, এমনে থাকলে কি সমস্যা সমাধান হইবো? কথা কন। কি চান আপনে?”
“আমি ওনাকে চাই। ওনারে ছাড়া বাঁচবো না আব্বা। বলেন পারবেন ওনাকে আনতে?”
সালিম সাহেব হতবাক। মেয়ে এতোটা নির্লজ্জ হবে ভাবেননি। শুভ্রা এতটুকুতে ক্ষান্ত হলো না। সে বললো-“আপনাকে কতবার তন্ময় ভাইয়ের কথা বলছি আব্বা। আপনি কি ইচ্ছা করেই আমার কথা কানে নেয় নাই? মেয়ের সংসার হোক তা আপনে চান না আব্বা? কেন নিজ হাতে আমার সংসারটা নষ্ট করলেন?”
“আম্মা, এইসব কি বলতেছেন আপনে? ওরা শত্রু জানার পরও আমি মেনে নিছি। আপনে যেমনে চাইছেন তেমনে সব করছি তাও এই কথা বললেন? আর কেমন স্বামীর জন্য পাগল হইছেন আপনে? যে বেটা বউকে এতোদিন ধরে বাপের বাড়ি ফালায় রাখছে। একদিন দেখতে পর্যন্ত আসে নাই। মায়ের কথায় বউকে ছাড়তে পারে তার জন্য এমন করতেছেন? এইদিন দেখার জন্য আপনাকে এতো ভালোবাসছি?”
শুভ্রার চোখ লাল, মুখটা ক্রোধান্বিত। বাবার কথার প্রতিউত্তর দিতে পারলোনা। সালিম সাহেব বললেন-“ডিভোর্স লেটার পাঠাইছে আর আপনে এখনও ওই বাড়ি যাওয়ার আসা রাখেন? মাথায় কি ঢুকছে আপনের? এইবার তো আমি কিছুতেই আপনারে ওইখানে পাঠাবো না আম্মা। আমার সন্মান এতো ঠুনকো না। আপনে ডিভোর্স দিবেন ওই গোলামের পুতরে। মেলা সহ্য করছি আর না।”
শুভ্রা ভয় পেয়ে চমকে উঠলো। বাবার এমন মেজাজি রুপ অনেক দিন পরে দেখলো কিনা। কিছু বলার সাহস করতে পারে না। সে আকুল হয়ে কাঁদতে শুরু করে। এমন কিছু হোক সে কোনদিন চায়নি কিছুতেই চায়নি।

চলবে।

#দর্পহরন
#পর্ব-৬২

শুভ্রা দিনরাত কাঁদে। তার কান্নায় ঘি ঢাললো সংবাদমাধ্যম আর টিভি মিডিয়া। খবর কিভাবে বাইরে গেলো তা কেউ জানে না। তবে দু’দিনের মধ্যে মন্ত্রী আর তার স্ত্রীর বিচ্ছেদের খবর টক অফ দা কান্ট্রিতে পরিনত হলো। টিভি ছাড়লেই এই খবর। শুভ্রা নিজের মেজাজ ধরে রাখতে পারে না। রিমোট আছড়ে দেয় টিভিতে। রণ কি করে পারলো এসব করতে? বড় বড় আশ্বাস দিয়ে কিনা শেষে ধোঁকাবাজি! অথচ সবার উপরে সে রণকে স্হান দিয়েছিল। শুভ্রার নিজেকে পাগল পাগল লাগে। কারো কোন স্বান্তনা আদরই ওর গায়ে লাগছে না। উল্টো বিষের মতো লাগছে। ইচ্ছে করছে সব ধ্বংস করে দিতে। সালিম সাহেব জোর দিচ্ছেন ডিভোর্স পেপার সাইন করতে। শুভ্রা গাঁট হয়ে বসে থাকে। সেই নিয়ে বাপ মেয়েতে তুমুল অশান্তি। সালিম সাহেবকে তন্ময় আরও বেশি করে উস্কে দিচ্ছে। রিমা কার পক্ষ নেবে তাই বোঝে না। একদিকে মেয়ে আরেকদিকে স্বামী। ইব্রাহিম নিবাসের শান্তি যেন বিদায় নিয়েছে।

বাড়িতে তুলতুলই একমাত্র বিন্দাস। খাচ্ছে ঘুমাচ্ছে বই পড়ছে। শরীফ ওকে নিয়ম করে ডাক্তারের কাছে নিচ্ছে। তুলতুলের সময় ঘনিয়ে আসছে দ্রুত। শরীর ভারি হয়েছে। হাঁটাচলায় কষ্ট হয়। তবুও নিয়ম করে হাঁটতে হয় তাকে। শরীফের আদেশে মালা দায়িত্ব পালনে অনড়। সেদিন অসাবধানে হাঁটতে যেয়ে পড়ে যেতে নেয় তুলতুল৷ শরীফ এসে ওকে ধরে ফেলে। তুলতুল অবাক হলো-“আপনি কি সারাক্ষণ আমার পেছনে থাকেন নাকি?”
শরীফ গম্ভীর-“না থাকলে কি হতো তাই ভাবো।”
“আপনার কাজ নেই? আমার পেছনে পড়ে থাকলে কাজ করেন কখন?”
শরীফ হাসলো-‘”সেসব তোমার না ভাবলেও চলবে। শোন তুলতুল, আমি ভাবছি চল্লিশ দিন পার হলেই তোমার সাথে বিয়েটা করে ফেলবো। কি বলো তুমি?”
তুলতুলের হিঁচকি উঠে যায় শরীফের কথা শুনে। একজন ওয়েল এডুকেটেড ছেলে, ভালো চাকরি করতো। এই লোক কি জন্য তার মতো বিবাহিত মেয়েকে বিয়ে করতে চায় সেটাই বোঝে না তুলতুল। মনে মনে করুনা করে কি? নিজের ভাইয়ের অন্যায়ের দায় চুকাতে চায়? ভাবনাটা মাথায় আসতেই তুলতুলের শরীর ভেঙে আসতে চায়। একজনের ভোগের বস্তু আরেকজনার কাছে করুনার। আসলে সে কি কারো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য না?
“কিছু বলছো না যে?”
“কি বলবো? সব সিদ্ধান্ত তো আপনারাই নিচ্ছেন তাহলে আমার বলা না বলায় কিছু আসে যায় কি?”
শরীফ হেসে দেয়-“সবসময় এতো নেগেটিভ ভাবো কেন বলোতো? আমি তো তোমার কথা ভেবে বিয়ে করতে চাইছি। নতুন মা হবে শরীরে হরমোনের হেরফের হবে। তোমার অনেক বেশি বিশ্রাম লাগবে। আমি থাকলে বাচ্চার খেয়াল রাখতে সুবিধা হবে তুমিও পর্যাপ্ত বিশ্রাম পাবে। এখানে অন্য কোন ইস্যু নাই তুলতুল।”
তুলতুল ভ্রুকুটি করলো-“আপনার এতএত ভালো চিন্তা আমার বোঝার কথা না। আর না এগুলো আমি বিশ্বাস করছি। বাচ্চাটা তো আসলে আপনাদেরই। আমি এর বাহক মাত্র। আমি জানি আপনারা যা করতে চাইছেন সবই বাচ্চার ভালোর জন্য।”
শরীফের মুখ মলিন হয়ে গেলো। হতাশা তার চোখেমুখে। কেন যেন সে যাই করে তাতেই তুলতুল ভুল খুঁজে পায়। মানছে সোহেল খারাপ ছিলো অনেক খারাপ আচরণ করেছে তুলতুলের সাথে। তাই বলে সেই দায় শরীফের ভাগ্যে কেন আসবো? শরীফ তো কখনো তুলতুলের সাথে বেয়াদবি করেনি। শরীফ মন খারাপ গলায় বললো-“তোমার কিছু লাগলে মালাকে বলো আমি আসছি।”
শরীফ আচমকা চলে গেলো দেখে তুলতুল অবাক হলো। সে ভেবেছিল আজ আবার নতুন কিছু বইয়ের লিষ্ট ধরিয়ে দেবে শরীফকে কিন্তু সেই সুযোগই পেলো না। তুলতুলের কোন আচরণে কি কষ্ট পেলো শরীফ? তুলতুল কাঁধ ঝাঁকাল। পেলেইবা, তার কি?”

****

“তুহিন, কি অবস্থা? সুমনার আপডেট দে।”
সালিম সাহেবের কথা শুনে তুহিন ঢোক গিললো-“চাচা, আপার কাজের রেসপন্স ভালো। সবাই পছন্দ করতাছে। যদিও ভোট কারে দিব তা বোঝার উপায় নেই।”
সালিম দাঁতে দাঁত চাপে-“বুদ্ধি তো হা*রা*ম*জা*দা জামাই দিতেছে। ওর বুদ্ধি নিয়া সুমনা উড়তাছে। ওর জামাই এর লগে কি হইছে কোন খবর বাইর করতে পারছোস?”
তুহিন মাথা নাড়ে-“সব কিছু ঠিকঠাক। কেমনে খবর বাইর করুম? কোন কিছু পাইতেছি না।”
“কিছু না থাকলে এইখানে পইড়া আছে কেন? বাইর কর খোঁজ। ভুল ছাড়া কোন মানুষ হয় না। অবশ্যই ওর কোন না কোন দূর্বলতা আছে। লোক লাগায়া রাখ কিছু না কিছু পাওয়া যাইবোই।”
তুহিন মাথা দুলায়। সালিম সাহেব খানিকটা সময় ভাবলেন-“শোন, এক কাজ কর। একটা খবর লিক কর।”
তুহিন উৎসাহের সাথে জানতে চাইলো-“কি খবর?”
সালিম সাহেব তুহিনকে কাছে ডাকলো। ফিসফিস করে যা বললো তা শুনে তুহিনের চোখ কপালে-“কিন্তু আপা!”
“আমি সামলায় নিমুনে তুই খালি ম্যাচের কাঠিতে আগুন জ্বালা।”
“আচ্ছা।”
তুহিন চলে গেলো। সালিম সাহেব চেয়ারে দোল খায়। ঠোঁটের কোনে ক্রুর হাসির রেখা। সালিমের মতো পাকা খেলোয়াড়ের সাথে টক্কর দেওয়ার সিদ্ধান্ত ভুল, শত্রু পক্ষ এবার হাড়ে হাড়ে টের পাবে সেটা।

*****

“মা, তুমি এতোটা নিচে নামবে ভাবিনি।”
রণর এমন কথায় জলি অবাক হলো-“কোন বিষয়ে মাকে দোষী ভাবছিস বাবাই?”
“এই যে শুভ্রার সাথে আমার ডিভোর্স নিউজ মিডিয়ায় ঘুরছে এটা নিশ্চয়ই তোমার কাজ। আমাকে বাধ্য করতে চাইছো যাতে বিয়েটা ভেঙে দেই।”
জলি হতবাক হয়ে ছেলেকে দেখলো। তারপর হেসে দিলো-“ছেলেরা বিয়ের পর সত্যিই পাল্টে যায় দেখছি। সবাই বলতো আমি ভাবতাম আমার বাবাই কখনো পাল্টাবে না। কিন্তু আমার ভাবনা ভুল প্রমান করে দিয়ে তুইও পাল্টে গেলি?”
রণ থতমত খায়৷ কি জবাব দেবে মাকে বুঝে পেলো না। তাহলে কি জলি এ কাজ করেনি? কে করেছে তবে? জলির মুখের হাসি বদলে গেছে। চেহারায় গম্ভীরতা-“আপার সাথে কথা হয়েছে আমার। মেয়েটা ডিভোর্স লেটার সই করে পাঠালে তোর আর চন্দ্রের বিয়ের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেবে আপা।”
রণর চোয়াল শক্ত হলো-“তুমি মিছে স্বপ্ন দেখছো মা। এরকমটা কখনোই সম্ভব হবে না।”
“অনেক বলেছ রণ আর না। ভাবো কি তুমি নিজেকে? তুমি যা করছো সব ঠিক আর আমি ভুল? চুল সব এমনিতেই পেকেছে বলে মনেহয় তোমার। প্রথমত তুমি একটা অন্যায় করেছিলে ওই খুনির মেয়েটাকে আঁটকে রেখে। তোমার ভুলের কারণে আমরা পস্তাচ্ছি সবাই। শত্রুর মেয়েকে ঘরে তুলতে হয়েছে। তবুও তোমার মধ্যে অনুশোচনা নেই। শোন, পরিস্কার বলে দিচ্ছি তোমাকে, এরপর তোমার এমন কোন ভুল আর মানবো না আমি। আমি চাই তুমি মায়ের কথা শুনবে বাধ্য ছেলের মতো। আপা যখন আগ্রহ দেখিয়েছেন তার সাথে আত্মীয়তা করতে চাই আমি। এতে তোমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে উন্নতির সাথে সাথে জীবনের নিশ্চয়তা পাবে। আমি নিশ্চিত ওই খুনিটা এবার তোমাকে টার্গেট করবে। তুমি ভুলে যেয় না ওর ছেলেটা মারা গেছে তোমার কারণে। ও নির্ঘাত প্রতিশোধ নিতে চাইবে। এখন তোমাকে একমাত্র আপাই বাঁচাতে পারে। আপার ছত্রছায়ায় থাকলে সালিম কখনো সাহস পাবে না তোমার কিছু করতে।”
“আমি নিজেকে বাঁচাতে পারি মা। অন্য কাউকে প্রয়োজন নেই।”
“তোর বাবাও এসব বলতো বাবাই। তারপর কি হয়েছে নিজের চোখে দেখেছিস। আমি চাই না হিস্ট্রি রিপিট হোক। আত্মবিশ্বাস ভালো তবে অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস না।”
“তুমি খামোখাই ভয় পাও মা। বলছি তো কিছু হবে না।”
“আমি স্বামীকে হারিয়েছি বাবাই সন্তান হারানোর মতো মানসিক জোর নেই আমার। তোর জীবনের বিনিময়ে আপোষ করেছিলাম। বুকে পাথর রেখে মেয়েটাকে বউ বানিয়েছিলাম। কিন্তু আর পারছি না রণ। সত্যি বলতে আমার কষ্ট হয় ওকে দেখলে। আমার বৈধব্যের জীবন মনে পড়ে, তোর কষ্টের কথা মনে পড়ে। আর বেশি কিছু বলতে চাই না আমি। এরপরও তোর যদি এতই নিজের জেদ বজায় রাখতে মন চায় তাহলে বরং আমাকে মেরে ফেল তারপর যা খুশি তাই কর।”
“মা!”
আর্তনাদ করে উঠলো রণ-“মেয়েটাকে ভুল বুঝছো তুমি। ও ওর বাবার মতো নয় মা। শুধু শুধু ওকে সাজা দিয় না। তোমারও দু’টো মেয়ে আছে, তাদের কথা ভাবো মা।”
জলি অটল গলায় বললো-“কোন কিছুই ভাববো না আমি। ওদের তরফ থেকে ডিভোর্স লেটার এলে তোকে সবটা মেনে নিতে হবে রণ।”
“মানে কি মা? কি বলতে চাইছো তুমি?”
“মানে ডিভোর্স লেটার আমি পাঠাইনি। কিন্তু যদি ওই মেয়েটার সাইন করা লেটার আসে তাহলে তোকে মেনে নিতে হবে। জীবনে এগিয়ে যেতে হনে। বল, রাজি আছিস?”
রণকে দ্বিধান্বিত দেখায়। মা ডিভোর্স লেটার না পাঠালে কিসের ভিত্তিতে এতো নিউজ হচ্ছে? কে করছে এসব? কার কি লাভ এতে? আর শুভ্রা কি সত্যিই ডিভোর্স লেটারে সাইন করবে? নিশ্চয়ই না। যদি করে? রণ কি করবে তখন?

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে