Wednesday, July 23, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 209



চক্ষে আমার তৃষ্ণা পর্ব-৪৬+৪৭+৪৮

0

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৪৬
১৩৩.
মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব,আবার মানুষ সৃষ্টির নিকৃষ্ট মানব।
আপনি এবং আপনার ছেলেকে কিভাবে শিক্ষা দিতে হয়।তা আমি তন্নী তালুকদার খুব ভালো করেই জানি।আপনি আর আপনার আদরের ছেলে কি ভেবেছিলেন?আমাকে ধোঁকা দিবেন আর আমি চুপচাপ মেনে নেবো।হুহু,।আপনি ভুল জায়গায় হাত দিয়েছেন।আমার পরিবার কিংবা আমি অন্যায়ের সাথে আপসোস বিন্দু মাত্র করব না।প্রথমে এই প্রেম প্রেম পাগলামি দেড় বছর ধরে করবে।আমাকে বশে আনবে।তারপর অন্য কাউকে বিয়ে করতে চাইবে।এতটা বোকা নই আমি।সবটা জানতাম এবং খোঁজ নিয়ে এতটুকু বুঝতে পেরেছি।আপনি আর আপনার ছেলে কতটুকু ভালো।আমি তাকে ভালোবাসি।তাই ব’লে সব অন্যায়ের ক্ষমা হবে না।এক এক করে শাস্তি হিসেব বুঝে নিবো।আমি আমারটা বুঝতে জানি।ভাইয়ের আদরের বোন ব’লে কথা।প্রথমে গোপনে বিয়ে তারপর বাচ্চা।এবং ফাইনালি পরিবারের সকলের মতেই দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছি।ভবিষ্যতে আমার সাথে কিছু করার আগে মাথায় রাখবেন।আমাকে নিয়ে গেইম খেলার চেষ্টা করলে ফল খারাপ হবে।আমি পুতুল নই।আমি তন্নি,তন্নি তালুকদার।ওই মেয়েটি গ্রামের সহজ সরল ছিল তাকে নিয়ে সহজেই খেলতে পেরেছেন।আর সে চুপচাপ মেনে নিয়েছে।কিন্তু আমি মেনে নিবো না।কথাটা মাথায় রাখবেন।মাইন্ড ইট।

তন্নী অর্ধেক খাওয়া আপেলটা দেয়ালে ছুড়ে মেরে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো।এইদিকে জেফিন রওয়্যাড রাগে ফুঁসতে থাকেন।এই মেয়েকে কিছুতেই বাগে আনতে পারছে না।যা কিছু করার প্লান করেন।সব উল্টো হচ্ছে।একটু আগে জেভিন সিঁড়িতে তেল ফেলেন।পেটের বাচ্চা নষ্ট হবে ব’লে।কিন্তু হলো উল্টো সেই ফাঁদে তাকে ফেলে দিল।পায়ে হল চোট।এখন হাটতে তার কষ্ট হচ্ছে।

এইদিকে তন্নী আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।পেটে হাত রেখে বলল,

তোমার মাম্মা তোমার কিছু হতে দিবে না।আই প্রমিজ ইউ।চোখ বুঝতেই দুই চোখের পানি ঝড়ে পড়ে।

হঠ্যাৎ ফোন বেজে ওঠে।তন্নী ফোনটা ধরতেই লিখাটা ভেসে উঠে।অর্পণ তালুকদার ইজ কলিং।

হ্যালো।

কি রে শয়তানের নানী আম্মা ভালো আছিস?বিয়ে করে বিদেশে গেলি আর তোও খবর নেই।

ভাই।তুমি এখনও নিজের অভ্যাস বদলালে না।আমি এখন বড় হয়েছি।দুই দিন পর মা ওহ হব।প্লিজ ভাই।

আরে দূর।তুই আমার কাছে সেই ছোট্ট তন্নি আছিস।তোকে মারব,বকবো।আর ভালোবাসব।তোর গলাটা এত ভারী লাগছে কেন?তুই কি কাঁদছিস?কিছু হয়েছে।

কই নাতো।

আমার থেকে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছিস? কি হয়েছে আমায় বল?

কিছুই হয়নি ভাই।আমি ঠিক আছি।আমি রাখছি পরে কথা হবে।

আরে তোকে আসল খবরটা দেওয়া হলো না।হ্যালো,হ্যালো।যা ফোনটা কেটে দিলো।অর্পণ কিছু চিন্তা করে কাউকে ফোন লাগায়।অপরপাশে কেউ ফোন তুলতেই,

তোমাকে যে কাজে রাখা হয়েছে।তার খবর কি?

ওইপাশ থেকে কিছু বলতেই অর্পণের মুখটা গম্ভীর হয়ে যায়।

ওর দিকে খেয়াল রেখো।ওর গায়ে যদি একটা আচর লাগে আমি তোমার খবর করে ছাড়ব।বোন হয় আমার।তার সাথে কিছু করার চেষ্টা ওই পরিবারের কেউ যেনো ভাবতে না পারে।খেয়াল রেখো।রাখছি।অর্পণ ফোন কেটে দিল।

ভাই তুমি শুধুই চিন্তা করছো।আমাদের তন্নী ঠিক থাকবে।ওর সাথে ভুল কিছু হবে না।যার পাশে তোমার মতো ভাই আছে।তার কিসের ভয়?

হুম।আমি জানি আমার কাছের মানুষগুলো তাদের প্রাপ্ত হোক গুলো আদায় করতে জানে।কিন্তু আমার আদূরনী একটু নরম।তাকে আরো শক্ত হতে হবে।সেও নিজের হকের জন্য লড়তে পারবে।

যারা বড় বাড়ি,আর।লাক্সারী গাড়িতে করে চড়ে বেড়ায়।দামী হোটেলে খায়।নরম বিছানায় সুয়ে কোটি টাকা ব্যাংকে রাখার চিন্তা ভাবনা করে।তারা জনগনের কি সেবা করবে?এরা উল্টো জনগনের টাকা খেয়ে বসে আছেন।জনগনের কষ্ট বুঝতে হলে তাদের সাথে মিশতে হয়।জানতে হয়।এবং তাদের সকল সুযোগ সুবিধা ব্যাবস্থা দেখভাল করতে হয়।কিন্তু আমরা উল্টো করি।নাকে সরিষা তেল লাগিয়ে নরম গদিতে ঘুম।আরাম,হারামে পরিনত।মোটা ভুরি করছেন হারাম খেয়ে।আপনাদের কারণেই জনগন আমাদের ওপর থেকে বিশ্বাস,আস্থা হারিয়ে ফেলছে।আমি জনাব অর্পণ তালুকদার আজ এখানে দাঁড়িয়ে লিখিত বয়ানসহ বলছি।আমার সম্পত্তি ছিল।তিন কোটি আটান্ন লাখ পনেরো হাজার তিনশো টাকা।

অর্পণ তালুকদারের কথাটা মিটিং থাকা দলীয় নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে বলে।নিজের আয় এবং ব্যায়ে হিসাব দেন।

জীবন অনেক কঠিন।রাজনীতি আসলেই নিজের একার কথা ভাবলে চলে না।দশের কথাটা ভাবতে হয়।একটা বার সৎ পথে নামুন।আরাম,হারামের হাত টা ছেড়ে নিজের টাকায় চলার চেষ্টা করুন।তখন বুঝবেন জনগনের আসলে কষ্ট কি?

অর্পণ চেয়ার ছাড়া আগে কাগজে লিখিত সই দিয়ে কনফারেন্স রুম ছেড়ে চলে যায়।

এইদিকে হোম মিনিস্টার সামনেই দাঁড়িয়ে অর্পণের করা বয়ান শুনায় তার পি এ খলিল।

নাতির এমন কাজে কি প্রকিয়া দিবেন বুঝতে পারছে না।তার নাতি তার বাপের সম্পত্তি যেটা তার নামে রয়েছে সেটার হিসাব লিখিতভাবে দিয়েছে।কিন্তু তার মায়ের বাড়ির পাওয়া সম্পত্তির হিসাব দেয়নি।সেই সম্পত্তি সে গ্রহণ করেনি।যদি সেটা দিতো তাহলে খুশি হতেন।নাতির এত জিদ একদম তার বাবা অসীম তালুকদারের মতো হয়েছে।নিজেদের সাথে হারাম জড়াবে না।এই পলিটিক্স কেউ সৎ থাকতে পারে না।না চাইতেও জড়াতে হয়।নাতির জন্য চিন্তা হয়।বড় আদরের নাতি ছিল।এক সময় নানাবাড়িতে যার যাতায়াত সব সময় লেগে থাকতো।একদিন এক দূর্ঘটনা পর থেকে আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে গেলো।

যতদিন আমি আছি।ততদিন তোমার ক্ষতি হতে দিব না।খলিল ওর দিকে নজর রেখো।যত টাকা যায় যাক।ওর গায়ে যেন আচর না লাগে।

জি,স্যার।

অপর পার্টি গোপন বৈঠকে বসেছে।তাদের মূল উদ্দেশ্য অর্পণ তালুকদার।এই ছেলে জবে থেকে এসেছে তবে থেকেই বাড়াবাড়ি করছে।এর একটা ব্যাবস্থা নেওয়া দরকার।

রোহিতপুর গ্রামে তার মামা,মামী,তার ভাইয়েরা পুতুলকে খুব মিস করছে।কখনো তাকে ছাড়া থাকে নিই।এই প্রথমবার তাঁকে ছাড়া থাকছে।কষ্ট পাচ্ছে।তাই সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিলো পুতুলকে দেখতে যাবে।স্বাধীনের কথায় সবাই খুশি হলো।ঠিক হলো পরশু দিন রওনা দিবে শহরে।

অর্পণ তালুকদার রাগ নিয়ে দুমদাম করে রুমে প্রবেশ করে।ওয়াশরুমে ঢুকেই গোসল করতে থাকে।তার হঠাৎ এরকম বিভেবিয়ারের কারণে পুতুল হা হয়ে গেছে।রাতের জন্য ময়দা গুলিয়েছে।রুটি আর আলুর দম করবে।কিন্তু আজ এই মশাইয়ের কি হলো?একে তো আজ তাড়াতাড়ি বাড়িতে এসেছে।তার ওপর কোনো কথাবার্তা ছাড়াই তাকে ইগনোর করে চলে গেলো রুমে।পুতুলের রাগ হলো।গাল ফুলিয়ে কিচেনে গিয়ে রুটি বেলতে লাগল।এইদিকে অর্পণ দেয়ালে হাত দিয়ে আঘাত করছে।চোখের সামনে তার ছোট্ট মামার কুৎসিত বিকৃত কথাগুলো মাথায় আসতেই রাগে শরীর কাঁপছে।অনেক হয়েছে।এবার সত্যিটা পুতুলকে জানাতে হবে।আমি এই দু-টানা আর নিতে পারছি না।ওহ নিশ্চয় আমাকে বুঝতে পারবে।আমি আজই বলব,

অর্পণ গোসল শেষ করে রুমে প্রবেশ করে।নিজের পোশাক কোনো রকম চেঞ্জ করে বাহিরে বের হয়।কিচেন রুমে পুতুল কে কাজ করতে দেখে এগিয়ে যায়।

নিজের পিছনে কারো উপস্থিতি বুঝতে পেরে পুতুল ঘুরে তাকায়।অগোছালো কাপড় পরে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।মাথার চুল থেকে এখনো পানি পড়ছে।পুতুল ইশারার বলল,

এসব কি?এমন এলেমেলো কেন?

পুতুলের কথার উওর দিলো না।বরং নিজের মাথার চুল মুছতে পুতুলের ওড়না কোনা টেনে ধরে নিয়েছে।পুতুল বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে।এই লোকের কি হয়েছে আজ এমন অদ্ভুত অদ্ভুত কাজ করে চমকে দিচ্ছে কেন?

পুতুলের কাজ শেষ হতেই তাকে টেনে বুকে জড়িয়ে নিলো।

একটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বলল,

তুমি আজ যেমন করে আমার পাশে আছো।কাল আমার পাশে থাকবে তো।বিশ্বাস করবে আমায়।আমি কাউকে নিয়ে এত টেনশনে থাকি না।যতটা তোমায় নিয়ে থাকি।আমার খুব ভয়।তোমাকে হারানোর ভয়।নিজের রাজনীতির মাঠে শত্রুর অভাব নেই।তার ওপর আমার আপনজনদের মধ্যেই আমার শত্রু লুকিয়ে আছে।আমি বারবার তোমাকে কথাগুলো বলতে গিয়ে আটকে যাই।তোমাকে কিছু বলতে চাই।তুমি সবটা শুনবে তোও।অর্পণের কথায় কোনো আগামাথা বুঝতে পারছে না।তবুও মাথায় নাড়িয়ে সায় দিলো শুনবে।অর্পন কে সোফায় টেনে এনে বসিয়ে দিলো।তার এলেমেলো চুলগুলো চিরুনি বুলিয়ে ঠিক করে দিলো।

পুতুলের ডান হাতটা হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,

পুতুল আমি জানি তুমি তোমার মা’কে খুব ভালোবাসো।তার জায়গাটা তোমার কতটা জুড়ে তা আমরা সকলেই জানি।পুতুল আমি আজ তোমার মায়ের সম্পর্কে কিছু বলতে চাই।আমি এই কথাগুলো বলবার পড়ে তুমি হয়তো আমাকে ঘৃনা করবে।তবু্ও আমি এটা আর নিতে পারছি না।আমি আজ বলব?আর তুমি শুনবে।সবটা ভেবেই তুমি তোমার রায় দিও।

অর্পণের কথার মধ্যে কিছু তোও আছে।বারবার থেমে যাওয়া ঢোক গিলে ফেলা’র মধ্যে কিছু রহস্যের বার্তা আসছে।তিনি কি বলতে চান?বুকের ভিতরটা কেমন ধরফর করছে।কি শুনাতে তার এতটা ব্যাকুলতা।

চলবে….

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৪৭
১৩৪.
পুতুল আমার মামা জনাব শাফকাত খান।যার নামটা আমার নানু মা খুব শখ করে ভালোবেসে রেখেছিলো।সবার ছোট্ট সন্তান ব’লেই তার সব গুনা পার পেয়ে যেতো।তার ছোট্ট ছোট্ট ভুল গুলো কবে এত বড় হলো কেউ বিশেষ নজরে রাখেনি।তাঁকে ছোট্ট বেলা থেকে যদি অপরাধগুলো আঙুল তুলে দেখিয়ে দিত।সে ভুল।তাহলে ওই দিনটাই আসতো না।সেই সময় তোমার জম্ম হয়েছে।তুমি তোমার মায়ের সবে কোল জুড়ে।তখন তুমি একটা ফুটন্ত শিশু।যার চোখে ছিল শত মায়া আর ভালোবাসা।তোমাকে নিয়ে তোমার মা শত লড়াই করে তোমাকে নিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেছেন।

সময়টা ফ্লাগুন মাসের শেষের দিক।ছোট মামা বাংলাদেশে আসে ছুটি কাটাতে।তার জাপানে বিজনেস আছে।তোমার মা,বাবা যেখানে থাকতো।সেই গ্রামে ঘুরতে যান।তোমার মায়ের দিকে তার নজর পড়ে।তোমার মা,তোমার বাবাকে নিয়ে একটা ছোট্ট সংসার গড়ে ছিল।সেই ঘরে হাসি টুকু সে নষ্ট করেছে।হ্যা,পুতুল।তোমার মায়ের সৌন্দর্য দেখে তার মনে কু বাসনা জাগে।সে তখন এটাও জানতো।তোমার মা বিবাহিত তার একটি কন্যা সন্তান রয়েছে।তবুও তার লালসা কমে নিই।তোমার মা’কে পাওয়ার জন্য বিভিন্ন বাজে প্রস্তাব তোমার বাবা-র কাছে দেয়।সেই সময় তিনি তোমার মায়ের সঙ্গে তেমন মিল মোহাব্বত ছিল না।তোমার দাদীর জন্য যে দূরত্ব হয়েছে।সেটা আরো গভীর টেনে নিয়েছেন আমার মামা।আর তখন সংসারের ফাটল আরো বেশি ধরেছে।তোমার মা যখন এসব জানতে পারে তখন অলরেডি দেড়ি হয়ে গেছে।তোমার বাবা চওড়া সুদে মামার থেকে টাকা নিয়ে জুয়া খেলে।সেই সব জুয়া হেরেছে।মামা সেই সুযোগ কাজে লাগিয়েছে।সাদা কাগজে তোমার বাবা আগেই টিপসই করে দিয়েছিল।তাই সে কাগজে মামা নিজের মতো কথা সাজিয়ে বয়ান লিখেছে।কাগজে লিখা রয়েছে তিন মাসের মধ্যে যদি টাকা পরিশোধ না করতে পারে।তাহলে তোমার বাবার জেল হবে।আর মোস্তফা সরোয়ার ভয় পেয়ে যান।শুরু হয় তোমার মায়ের ওপর অত্যাচার।চাপ দিতে থাকে বাপের বাড়ির টাকার এনে দেওয়ার জন্য।কিন্তু তোমার মা কখনোই তার বাবার বাড়িতে পা রাখেনি।তোমার মায়ের গহনাগুলো শেষমেষ বিক্রি করে দেওয়া হলো।মামাকে তিন ভাগের এক ভাগের টাকা দেওয়া হলো।কিন্তু বাকি দুইভাগের টাকা পরিশোধ হয়নি।যার ফলে মাসের পর মাসে গেল।সেই দুই ভাগের টাকা সুদের হারে বাড়তেই লাগল।আবার টাকা পরিমাণ আগের জায়গায় চলে গেলো।এরমধ্যেই মামা বিদেশে চলে গেছে।কিন্তু তোমার মা’কে পাওয়ার বাসনা ছাড়েনি।তোমার বয়স তখন পাঁচ বছর শেষ হয়ে ছয় পা পরেছে।তোমার মা দ্বিতীয়বার সন্তান ধারণ করেন।ভাবেন একটি সুস্থ সন্তান তাকে দিলে তিনি ঠিক হবেন।ভুল পথে আর চলবে না।কিন্তু তোমার মায়ের সব আশায় পানি পড়ে গেলো।তোমার দাদীর অত্যাচারে।তোমাকে অবহেলা করা।যা তাকে কষ্ট দিত।তোমার মুখে একটু ভালো খাবার তুলে দিতে গ্রামের নতুন বাড়ির কাজের জন্য লোক নেয়।হাজিরা আশি টাকা ছিল।
সেখানে তোমার মা নাম দিয়েছিল।তোমাকে আম গাছের নিচে খেলতে দিয়ে একটু দূরে সরে ইট ভেঙ্গেছেন পাথর দিয়ে।হাতে ফোসকা পড়েছে কিন্তু কষ্টকে দমিয়ে কাজ করেছেন।পেটের সন্তান তখন অপুষ্টিতে ভুগছে।সন্তানের মুখে খাবার তুলতে তাকে কষ্ট করতে হয়েছে।সকাল দশটায় কাজ শুরু হতো বিকেল পাঁচটায় কাজ শেষ করতো।দুপুরে একঘন্টা খাবারের জন্য বিরতি ছিল।
সকাল ডাকা ভোরে উঠে বাড়ির সব কাজ সেরে বাহিরে কাজ করেছেন।আবার সন্ধ্যার আগে বাড়িতে ফিরেছে।কিন্তু তার শান্তি কোথাও ছিল না।তোমার মা যে ক’টাকা পেতে সেগুলো তোমার মায়ের থেকে কেঁড়ে নিতে চাইতো তোমার বাবা।তাকে না দিলে চ*ড়,থা*প্পড়,গা*লি।তবুও তিনি ধৈর্য্য ধরেছিলেন।স্বামী ঠিক হবে এই আশায়।কিন্তু আমার মামা সাড়ে চার বছর পর আবার দেশের মাটিতে পা দেন।তোমার বাবাকে জুয়ার আড্ডা থেকে তুলে নিয়ে যান নিজের আস্তানায়।টাকার জন্য চাপ সৃস্টি করেন।পুলিশের ভয় দেখান।শেষে পরিকল্পিত হয় টাকা একসপ্তাহের মধ্যে দিতে হবে। আর না হয় তার বউ রাজিয়াকে এখানে তার ঠিকানায় পাঠাতে হবে।যদি রাজি না হয়।তাহলে বাড়িতে ঢুকেই তার বউকে তুলে আনবে।এবং যতদিন তাদের মন না ভরবে।ততদিন রাজিয়াকে এই পুরাতন গোডাউনে পরে থাকতে হবে।তাদের আয়েশ মিটলেই ছেড়ে দেওয়া হবে।তোমার বাবা তার শর্তে রাজি হননি।কথায় দেয় টাকা ব্যাবস্থা করবেন।কিন্তু টাকার কোনো ব্যাবস্থা হয় না।শেষে তাদের পুকুরের সামনে বড় মাঠের জমিটাকে বন্দক দেওয়া হয়।ঠিক হয় তোমার মা,তার বাবার বাড়ি থেকে টাকা এনে দিলেই ছাড়াবেন।কিন্তু জমিটা হাত ছাড়া হলো।সময় মতো টাকা পরিশোধ না করতে পারায়।সেই রাগ গিয়ে পরে তোমার মায়ের ওপর।আটমাসের গর্ভবর্তী রাজিয়া মা’র খায়।তালাক হয়।অবশেষে আশ্রয় নেয় বাবার বাড়িতে।তোমার মা তোমাকে নিয়ে দূরে চলে যাওয়ার সাহস পায়নি।মোস্তফা এবং আমার মামার চুক্তি স্বাক্ষর থেকে শুরু করে সবকিছু সেই দিন অন্য কারো মাধ্যমে তোমার মা জেনে যায়।নিজের এবং নিজের অনাগত সন্তানের কথা চিন্তা করেই গ্রাম ছাড়া হয়।আর আমি এসব জানতে পারি আমার বড় মামার জনাব নাজিফ হুসাইন খান থেকে।ছোট মামার অপকর্মের কথা জানতে পেরে প্রচুর মারেন।নানীমা আদরের ছেলেকে মা’র খেতে দেখে অজ্ঞান হয়ে যায়।জ্ঞান ফিরে জানতে পারে তার ছোট ছেলেকে এই মাসের মধ্যে বিয়ে দিয়ে একেবারে জন্য জাপানে পাঠাবেন।যাতে আর কোনোদিন বাংলাদেশে পা না রাখতে পারে।ততদিন পর্যন্ত তাকে ঘরে আটকে রাখেন।বিয়ে হতেই এই দেশ ছাড়া করেন।বর্তমানে বউ,বাচ্চা নিয়ে তিনি বিদেশে স্যাটেল।নানাজান তাকে দেশে আনতে যান।কিন্তু আমি তার মুখটা দেখতে চাই না।তার কথা উঠলেই মনে হয় সে পাপী তার পাপের জন্য আমরা দায়ী।তার জন্য তোমার মায়ের এই করুন পরিনতি।তোমার মায়ের কষ্টের পেছনে আমাদেরও কোথায় না কোথাও দায়ী।পুতুল আমি জানি তুমি এসব শুনে ভিতরে ভিতরে কষ্ট পাচ্ছো।কিন্তু আমি কি করব বলো?আমি তোমাকে না ব’লে থাকতে পারিনি।আমার মনে হয়েছে এটা তোমার জানা উচিত।আর তাছাড়া সত্যি কখনো লুকিয়ে রাখা যায় না।সেটা একদিন না একদিন প্রকাশ পাবে।অর্পণ নিজের কথাগুলো শেষ করে পুতুলের দিকে ফিরে তাকাতেই চমকে উঠে।পুতুল ফ্লোরে বসে হাঁটুতে দুই হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে ফুফিয়ে কাঁদছে।মায়ের কথা মনে পড়তেই তার ভিতরটা জ্বলে যাচ্ছে।আল্লাহ কি তার মায়ের কপালে একটু সুখ লিখে রাখেনি?এত কষ্ট সত্যি কি তার পাওনা ছিল?তার মা কোন সুখের আশায় ঘর বেঁধেছেন।কিসের আশায় বেঁচে ছিল।কি পেয়েছেন তিনি?শুধু কষ্ট।কষ্ট ছাড়া তার জীবনে একটু সুখ ধরা দিলে কি হতো?

পুতুলের অবস্থা দেখে অর্পণ তার সামনে ছুটে আসে।তাঁকে ধরে উঠাতে চাইলে পুতুল তার হাতটা ছাড়িয়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে নিজের ঘরের দিকে দৌড় দেয়।দরজা বন্ধ করে সেখানেই পিঠ লাগিয়ে কাঁদতে থাকে।অর্পণ হাজার চেষ্টা করেও পুতুলকে ঘর থেকে বের করতে পারেনি।অর্পণ একটা নিশ্বাস ফেলে পুতুলের দরজার সাথে পিঠ লাগিয়ে বসে।পা দুটো দুই দিকে হালকা ছড়িয়ে বসে পড়ে।দিনের সূর্যের আলোটা রাতের আঁধার কালোতে সেই কখন হারিয়ে গেছে।দরজার দুই পান্তে দুই মানব মানবী বসে আছে।একজন কাঁদছে মায়ের জন্য।আর অন্য জন অপেক্ষা করছে।তার প্রিয়তমা কাঁদুক।কেঁদে মন হালকা হোক।তবুও দরজা খুলে তার কাছে আসুক।তার বুকে মাথা রেখে কাঁদুক।সে অপেক্ষা করবে।

১৩৫.
ক্ষয়ে ক্ষয়ে যাওয়া এ সময়
মানে না তার পরাজয়
জীবন পরে ধুলোতে,হারিয়ে সঞ্চয়
যার কথা ভাসে মেঘলা বাতাসে
তবু সে দূরে তা মানি না
জানি না কেন তা জানি না
জানি না.।

রাত বেড়ে যায় ধীর পায়
বাতাসেরা যেনো অসহায়
শুকনো পাতার নূপুরে কে জেনো ডেকে যায়
যার উষ্ণ আঁচে ভালোবাসা বাঁচে
সে হৃদয় ভাঙ্গে তা মানিনা
জানি না কেন তা জানি না
জানি না.।

প্রত্যেকটা সকালে প্রিয়তমাকে পাশে নিয়ে চায়ের কাপে চুমুক বসিয়ে দিনটা শুরু হতো।কিন্তু আজ দুইদিন ধরে পুতুল তার সামনে আসে না।তার ঘুম ভাঙ্গা আগেই ঘর ছাড়ে।আবার তার ফিরে আসার আগেই নিজের ঘরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে থাকে।প্রিয়তমা অবহেলা তাঁকে পুড়ায়।তবে কি এই কথাগুলো জানিয়ে সে ভুল করলো?তার আপসোস হচ্ছে।কেন বলতে গেলো?কিছু কিছু কথা না ব’লে হয়তো জীবনটা অল্পতেই সুন্দর হতো।সেই বা কি করবে।না ব’লে থাকতেই পারছিল না।এই কথা আজ অর্পণের থেকে না শুনে কাল যদি অন্য কারো কাজ থেকে শুনতো।তখন কি হতো?পুতুলের কষ্ট পেতো।তাঁকে ভুল বুঝতো?হয়তো সে আমার কাছ থেকে এটা আশা করিনি।তবুও ব’লে দিয়েছি।কষ্ট যখন আমার কারণে পেয়েছে।তখন আমি তার মান ভাঙ্গাবো।তার কাছে সবকিছুর জন্য ক্ষমা চাইবো।

সে হয়তো একদিন ঠিক বুঝতে পারবে।অর্পণ আজ নিজের কাজগুলো জলতি শেষ করে নিলো।তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরবে।পুতুলের সাথে তার অনেক কথা জমে আছে।

চলবে…

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৪৮
১৩৫.
রিফাতের গায়ে মারের দাগ।স্বাধীন ছোট্ট ছেলের এমন অবস্থা দেখে আঁতকে ওঠেন।কি করবেন বুঝতে পারছে না?হাঁটুর নিচে পচন ধরেছে।এমন জানোয়ার মতো মেরেছে তার ওপর তাদের একবারও জানানো হয়নি।আজ দুপুরে রিফাত কাঁপতে কাঁপতে বাড়ির উঠোনে রিকশা করে আসে।রিকশা থেকে নামতে গিয়ে মাটিতে পড়ে মা ব’লে কেঁদে ওঠে।রেনু গরুকে ঘাস দিতে নিয়ে হাত থেমে যায়।রিকশা থেকে রিফাত পড়ে গিয়ে মা ব’লে কেঁদে উঠেছে।সবটা দেখে কলিজা মুচড়ে ওঠে।তার আদরের সন্তানের এই অবস্থা কে করেছে।রেনু ঘাস ফেলে দৌড়ে ছুটে আসে।ছেলের মাথাটা মাটি থেকে উঠিয়ে উচ্চস্বরে কেঁদে উটে।বউয়ের কান্নার শব্দে স্বাধীন পুকুর পাড়ে মাছের জাল ফেলে ছুটে আসে।আর আসতেই এসব দেখতে পায়।ছেলেকে ঘরে রেখে ডাক্তার আনতে গঞ্জে যায়।

দেখুন,স্বাধীন সাহেব।সন্তানদের মানুষ করবেন ভালো কথা।কিন্তু সন্তান কোথায় আছে? কি করছে?এগুলো খেয়াল নিজে থেকে না করলে কেউ করবেনা।সন্তান আপনার,সে সন্তানকে এমন অমানুষের মতো মারবে আর আপনি চুপ করে থাকবেন।সন্তানের দোষ থাকলে তাকে শুধরানোর সুযোগ দিতে হয়।কিন্তু এভাবে মারাটা কোনো সমাধান নয়।ডাক্তার ওষুধ দিয়ে চলে যায়।রেনু ছেলের হাত ধরে বসে আছে।গায়ে একশ চার জ্বর। জ্বরটা আবার বেড়েছে।ছেলের কপালে জলপটি দিচ্ছে স্বাধীন।সে গম্ভীর মুখে বসে আছে।তার মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই।তার মনে কি চলছে?

এইদিকে ছোট ভাইয়ের এই অবস্থা দেখে মিলন,সাজু রাগে ফুঁসছে।

আজ তিনদিন পর পুতুল নিজে থেকে দরজা খুলেছে।অর্পণের দিকে নজর না দিয়ে চেয়ার টেনে চুপচাপ টেবিলে খেতে বসে।পুতুলকে দেখে অর্পণ এর মুখে হাসি ফুটে।সে ও অপর চেয়ার টেনে খেতে বসে।খাওয়ার এক পর্যায় পুতুল চিরকুট এগিয়ে দেয়।অর্পণ চোখের ভ্রু নাচিয়ে বলল,এতে কি আছে? পুতুল ওহ অর্পণের দেখাদেখি ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় বলল দেখতে।অর্পণ চিরকুট খুলে।

আমি কাল বাড়িতে ফিরে যাচ্ছি।মামাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।

পুতুলের লিখাটা পড়ে বলল,

কেনো?তোমার কেন যেতে হবে?আমাকে বলো।আমি তাদের এখানে আনছি।

পুতুল মাথা নাড়িয়ে না বলল,

তার শুধু মামাকে না সবাইকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে।আর তার সাথে তার সেই ছোট গ্রামটাকেও খুব মিস করছে।

পুতুলের বলার ভঙ্গি দেখে অর্পণ বিরবির করে কিছু ব’লে।পুতুল শুনতে পায় না।সে নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে গেছে।

গ্রামে এমন ঘটনা নিয়ে বিচার বসেছে।হুজুর কি করে এমন অমানুষের মতো ছাত্রকে মারতে পারে।এটা নিয়ে দুই এক কথায় সমস্যা সমাধান হয়ে যায়।হুজুরকে ছেড়ে দেয়।তাঁকে দুইদিনের মধ্যে গ্রাম ছাড়ার নির্দেশ দেন।কিন্তু এতে মিলন,সাজু,কিংবা স্বাধীন এই ব্যাপারটা সহজভাবে নিতে পারে নিই।

রিফাত এর জ্ঞান ফিরে আসে।সে জানায় এই হুজুরের স্বভাব চরিত্র ভালো না।ছোট মেয়েদের গায়ে হাত দেয়।মেয়েরা তার ভয়ে বাসায় কিছু বলে না।আর ছেলেদের শুধু মারতে থাকে।যতখন পর্যন্ত সে শান্তি না পায়।রিফাতকে ঘুম পাড়িয়ে দুই ভাই একসাথে মাদ্রাসা থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকে।তাদের দুইজনের হাতেই ঢোল কলমি লতা রয়েছে।রাতের আকাশে বড় থালার মতো চাঁদ উঠেছে।সেই চাঁদের আলোয় চকচক করছে কাঁচামাটির রাস্তা।মিলন,সাজু হুজুরের জন্য বিশেষ আয়োজন সাজিয়ে রেখেছে।সে এই পথেই আসবে।

মাথায় টুপি গায়ে সবুজ পাঞ্জাবি।গায়ে আতরের গন্ধে মৌ মৌ করছে।হাতে লাঠি।

হাউমাউখাউ মানুষের গন্ধ পাও।হি,হি,হি।

অদ্ভুত হাসিতে কানটা ধরে গেলো।হুজুর মশাই কিছুটা ভয় পেলেন।একে তো পূর্নিমা রাত।তার ওপরে কোনো মানুষজন নেই।এই ফাঁকা রাস্তায় কে এমন করে হাসে।মনে মনে দোয়া পড়তে লাগলেন।কাঁপা অবস্থায় বলতে লাগল।

কে তুমি ভাই?সামনে আসছো ও না কেন?সাহস থাকলে সামনে আসো।

কি রে আবুল কালামের পোলা?কেমন আছোস তুই? আমারে ডাকোছ।আমি সামনে আইলে হুশ থাকব তোর।আমি এই বট গাছের পেতনী।তোর চৌদ্দ গুষ্টি শুদ্ধো আমারে ভয় পায়।আর তুই আমারে বেইজ্জত করস।তোর সাহস তোও কম না।আমারে দেখতে চাস।তাহলে এই দেখ আমি কে?

সাদা কাপড়ে বিশাল আকারের দৈত্যের মতো উঁচু হাওয়া ভেসে এসে একটু দূরে বিশাল লম্বা চুলগুলো ছেড়ে বসে আছে।দুই পা দুই দিকে ছড়িয়ে দিয়েছে।এমন ভয়ংকর দৃশ্য দেখে হুজুরের কলিজা কেঁপে ওঠে।হুজুর কাঁপতে কাঁপতে বলে।

ওরে বাবা-রে এটা কি রে?

লা ইলাহা ইল্লা আংতা সুবহানাকা ইন্নী কুংতুু মিনাজ জোয়ালিমিন।হুজুর দোয়া পড়তে পড়তে ভয়ে জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যেতেই এক সাথে হি,হি,হি করে হেসে উঠে।

মিলন আমার কাঁধ থেকে তাড়াতাড়ি নাম।হুজুর মনে হয় বেহুশ।

দাঁড়া নামতাছি।মিলন সাজুর কাঁধ থেকে নেমেই নিজের মাথার ওপর থেকে কাক তাড়ুয়ার নামিয়ে সেটার ওপর থেকে লম্বা চুল এবং সাদা কাপড় সরিয়ে হুজুর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

আরে বাশঁস।ভাই এই পল্টি মুরগী দেখি ভয়ের ঠেলায় মাঝ রাস্তায় এক নাম্বার কাম সাইরা লাইছে।হুমমম।ছি,কি বিচ্ছির গন্ধ?

মনে হয় ভয় পাইছে।

ভয় পাইছে মানে খুব ভয় পাইছে।তয় আমগো কাম এহন শেষ হয় নাই।আরো বাকি আছে।ওর জ্ঞান ফিরাও।

হুম।ফিরাচ্ছি।আবার আগের রুপে চল।মিলন,সাজু আবার নিজেদের আসল রুপে চলে আসলো।হুজুরের জ্ঞান ফিরে আসতেই।

কি রে আবুল কালামে পুত।কেমন দেখলি?আমি খুব সুন্দরী পেতনী।তাই না বলল,

হুম,হু..ম খু..ব সু..ন্দ..র

ওমা,তাই বুঝি।চল,এখনই চল।তুই আমারে বিয়া করবি।বিয়ার পর তোরে আমি মানুষের র*ক্ত পান করামু!হেব্বি মজা হইবো।তারপর তোর গাড় ম*টকায়।আমি তোরে ক*টমট করে খামু।আহা মা*নুষের মাং*স সেই স্বাদ।কতদিন হইলো মানুষের মাং*স খাইনা।হুজুর সামনে আরো কয়েক কদম বাড়াতেই।সে উঠে উল্টো পথে দৌড় দেয়।কিন্তু পালাতে পারে না।ঢোলকলমি বারি মারতে মারতে বলল,

কি’রে আবুল কালামের পোলা?আমারে বিয়া না কইরা কই যাস।তোর বিয়া করতেই হইবো।তুই বিয়া না করলে আজকে শেষ।খাড়া তুই।হুজুর নিজের জান নিয়ে পালাতে লাগল।কিন্তু ঢোলকলমি বাড়িতে তার, হাত,পা,পিঠ কোনো কিছু রেহায় পায়নি।তবুও কোনো রকম জান নিয়ে পালালো।হুজুরের পাঞ্জাবি ছিঁড়ে গেছে মা’রের চোটে।সে পালিয়ে দূর হাওয়া হতেই মিলন,সাজু হাসতে হাসতে মাটিতে বসে পড়ে।

হু,মিলন।বেডা খচ্চর।সেই ভয় পাইছে।আর জীবনেও এই গ্রামে আসব না।

১৩৬.
পুতুল গ্রামে যাওয়ার জন্য কাপড়ের ব্যাগ গুছিয়ে রাখল।সকালেই রওনা হবে।এইদিকে অর্পনের রাগ লাগছে,আবার কান্না পাচ্ছে।কিন্তু সে কাঁদবে না।বউ তার ভালোবাসা একটুও বুঝে না।কেমন পাষাণী মেয়ে।বরকে তোও একবার জিজ্ঞেস করতে পারতো।তুমি যাবে?কিন্তু না তা করিনি।উল্টো নিজে একাই মামার বাড়ি চলে যাচ্ছে।অথচ যার মামা শ্বশুর বাড়ি।তাকে একটিবার বলো না।নিষ্ঠুর প্রিয়তমা।

কাল রাতে যার মনটা ছিল খুব খারাপ।এখন তার মুখে হাসি।মুখে মধু।তার এমন পাগলামিতে পুতুল সায় দিলো না।তাতে অর্পণের কি?প্রিয়তমা অবশেষে তাকে নিয়ে যাচ্ছে।এতেই তার আনন্দ ধরে না।সে এত আনন্দ কোথায় রাখবে।কোলবালিশে নাকি কলিজার ভিতরে বুঝতে পারছে না।এই প্রথমবার শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার ব্যাপারটা জোস।

উঠোনে পা রাখতে বাড়ির বারান্দায় ছোট ভাইকে দেখতে পায়।পুতুল নিজে এগিয়ে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে সালাম দিলো।রিফাত ফ্যাকাসে মুখে একটু হাসি দিয়ে বোনের কোলে মাথা রাখল।রিফাতের কাজে পুতুল অবাকই হয়।রিফাত কখনো তাকে এভাবে জড়িয়ে ধরে না।আজ কি হলো?হয়তো ভাইয়ের মন ভালো নেই।তাই ছোট ভাইয়ের কপালে ভালোবাসার পরশ একে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।

এইদিকে নতুন জামাই বাড়িতে আসছে।রেনু তাড়াতাড়ি লেবুর শরবত করে দিলো।অর্পণ লেবুর শরবত অর্ধেক খেয়ে বাকিটুকু রেখে চলে গেলো।পুতুল তার কাজ কর্ম সব দেখেছে।বাকি শরবত টুকু যে তার জন্য বরাদ্দ সেটা আগেই বুঝতে পেরেছে।তাই কোনো বনিতা ছাড়াই চুপচাপ খেয়ে নিলো।

স্বাধীনের সাথে অর্পণ বাজারে এসেছে।স্বাধীনকে কোনো বাজার করতে দেয়নি।বরং নিজের মন মতো বাজার নিয়ে বাসায় পথে এগিয়ে যাচ্ছে।আজ দুপুরে রান্না হবে।টুকরিতে এত বাজার দেখে রেনুর মাথায় হাত।

আল্লাহ এত বাজার কে খাবে?

কেন?আমরা সবাই খাবো।

তাই ব’লে এত বাজার।আল্লাহ এগুলো নষ্ট হইবো।শুধু শুধু এত বাজার করলে।

কোনো নষ্ট হবে না।যা আছে সব রান্না করেন।আজ আমার তিন শালা পেট পুড়ে খাবে।তাদের সাথে আমি,আপনি,আমরা সবাই থাকব।

পুতুল ওড়না দুই পেচ দিয়ে তরকারি কা*টঁতে বসে।রেনু বড় রুই মাছ কা*টছে।মাছের পরে মুরগী মাংস পিছ পিছ করে নিচ্ছে।গরুর মাংস আলাদা বোলে রাখা।মিলন,সাজু আদা,রসুন,এবং পিঁয়াজের খোসা ছাড়িয়ে রাখছে।স্বাধীন অর্পণের এমন বাজার করায় খুশি হয়নি।কিন্তু ছেলেটা খুশি মনে যখন করতে চাইছে তখন না করেনি।তবে অর্পণের পরিবারকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে।তারা আসছে।

দুপুর দুইটা মধ্যে সব রান্না শেষ।সবাই মিলে একসাথে ভোজন করছে।পুতুল শ্বশুর বাড়ি সবাইকে আসতে দেখে সালাম বিনিময় করে।রাবেয়া ছেলের এবং ছেলের বউয়ের খোঁজ খবর নিলো।তারা পড়াশোনা।তার ঢাকার দুই কামরা ছোট্ট সংসার কেমন লাগল?পুতুলের খুশীতেই রাবেয়া খুশী হলেন।

চলবে….

চক্ষে আমার তৃষ্ণা পর্ব-৪৩+৪৪+৪৫

0

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৪৩
১২৭.
অর্পণ হঠাৎ এভাবে রাস্তার মধ্যে প্রপোজ করে বসবে পুতুল ভাবতেই পারে নিই।যে মানুষটাকে নিয়ে তার ভাবার কিংবা সময় দেওয়ার ইচ্ছে নেই।সে না চাইতেও তার সাথে কেন জুড়ে যাচ্ছে?সে এসব চায়না।সে তার স্বপ্ন নিয়ে খুশি ছিল।আজ কেন এরকম হলো?এসব হওয়াটা কি খুব প্রয়োজন ছিল?
পুতুল নিজের চোখের পানি আড়াল করার চেষ্টা করে।কিন্তু আড়াল করতে পারে না।অর্পণের চোখ দুটো তার চোখের মায়া আটকে যায়।অর্পণের থেকে দূরে যেতে চাইলে আজ দূরে যাওয়ার সাহস কেনোও হয়না?মনে মধ্যে কষ্টের ঢেউ।মা,বাবার বিচ্ছেদ।এবং নিজের বিয়ে ভাঙ্গা এসব তাকে আরো কঠিন হতে বাধ্য করে।বারবার মনে হয়!আমিও আমার মায়ের পথে চলছি।যা আমার জন্য সুখকর নয়।তা বরই দুঃখের।

পুতুল,অর্পণের হাত থেকে পালাতে চায়।বেঞ্চ থেকে ব্যাগটা নিয়ে তাড়াহুড়ো করে হাঁটতে চেষ্টা করে।কিন্তু অর্পন তার পিছুপিছু আসছে।পুতুলের পিছ আজ সে ছাড়বে না।তার ভালোবাসা,আজকে তাকে এমপি সাহেব থেকে রাস্তার প্রেম ভিখারি করে ছাড়লো।প্রেয়সীকে পাওয়ার জন্য তার হ্রদয়খানা আজ বড্ড ব্যাকুল।যার একটু ছোঁয়া অর্পণ তালুকদারের মন ঠান্ডা হবে।ফুটবে মুখে হাসি।কিন্তু সামনের নারীটি একটু বেশি অভিমানী একটু জিদ্দি।তবুও আজ সে হার মানবে না।তার ভালোবাসার জন্য আজ প্রেয়সীকে চায়।তার কঠিন আবরণ তৈরি এই শক্ত রুপটাও ভেঙে ফেলতে চায়,তার ভালোবাসা দিয়ে।

বৃষ্টি ইতিমধ্যে থেমে গেছে।একজন হাঁটছে তার গন্তব্যে পৌঁছাতে।আরেকজন,অপরজনকে মানাতে ছুটছে পিছুপিছু।পুতুল কয়েকবার আঙুল তুলে ব’লেছে এখান থেকে চলে যেতে।কিন্তু অর্পণ মানছে না।একসময় পুতুল হাঁটা বন্ধ করে অর্পণকে চোখ রাঙিয়ে ইশারায় বলল,আপনি যাবেন।না-কি আমি পুলিশকে খবর দিব।

পুতুলের কথা মতো নিজের ভিজে যাওয়া ফোনটা পুতুলের হাতে দিয়ে বলল,

-;এই নেও কল কর!পুতুল আশ্চর্য হচ্ছে।পরবর্তী মনে হলো।এই বেডা নিজেই এমপি।তাকে পুলিশের কি ভয় দেখাচ্ছে?

পুতুল ছোট একটা নিশ্বাস ফেলে কয়েক পা এগোতেই স্বাধীনের সামনে পরে গেলো।মামার মুখটা গম্ভীর করে তাকিয়ে আছে।

একবার পিছনে তাকায়।একবার সামনে তাকায়।পিছনে অর্পণ দাঁড়িয়ে।সামনে মামা দাঁড়িয়ে।পুতুল কি করবে বুঝতে পারছে না?এমন সময় হাঁচি আর কাশি একসাথে দিতেই দুইজন দুইদিক থেকে এগিয়ে এসে রুমাল আর গামছা ধরে।পুতুল অসহায় চোখে তাকিয়ে রয়।মনে মনে একটা ঢোকঁ গিলতে থাকে।চোখের পাতা ঝাপ্টিয়ে বলল,

-;লাগবে না।মামা গামছা নামিয়ে নিলেও অর্পণ পুতুলের হাতে রুমাল দিয়ে দুরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে পরে।এইদিকে পুতুলের মুখটা চুপসে গেলো।মামা চোখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে।

এই ছেলে।তুমি আমার মেয়ের পাশে কি করছো?তুমি না গ্রামে তোমার বোনের বিয়েতে ছিলে।তাহলে এখানে কি?

বোনের বিয়ে কালকে খাওয়া শেষ।তাই বাসায় একটু বিশ্রাম নিতে চাইছিলাম।কিন্তু আপনার মেয়ে জন্য পারলাম কই?তালেপুর থেকে সেই ঢাকায় টেনে এনেই ছাড়লো।

-;মানে।আমার মেয়ে তোমাকে কি করলো?যার জন্য তুমি গ্রাম ছেড়ে ঢাকায়।

-;কি আর করবে?আমার হ্রদয় চুরি করেছে।আর সেই হ্রদয় চুরি করে পালিয়ে যাচ্ছে ।

অর্পণের এমন কথায় স্বাধীনের চোখ বড় বড় হয়ে যায়।একবার অর্পণের দিকে তাকায়।আবার পুতুলের দিকে তাকিয়ে বলল,

এসব কি ব’লে?পুতুল দুই পাশে মাথা নাড়িয়ে বলল,সে জানে না।মাথার একসাইডে হাতে রেখে ইশারায় বলল,মনে হয়,পাগল হয়ে গেছে।

পুতুলের ভাবভঙ্গি দেখে অর্পণ বিরক্ত হলো।

-;ওহ কি বলবে?বছরের পর বছর চরকি মতো আমায় দোল দোল দুলুনি,দুলিয়ে বলছে।আমি পাগল।মানে আমি পাগল হয়ে গেছি।এমপি সাহেব একটা পাগল।এই এমপি দ্বারা রাজ্য এতদিন চললো কি করে?জনগণ শেষ পর্যন্ত পাগল এমপিকে ভোট দিয়ে জয়লাভ করালো।

পুতুল তুমি নিষ্ঠুরতমা প্রিয়া সেটা জানতাম।কিন্তু তুমি নিষ্ঠুরতমা পাষাণী সেটা জানতে পারলাম আজ।ইয়া আল্লাহ এ আমি কার প্রেমে পড়লাম?কারে আমি আমার মন,প্রাণ দিলাম।সে এমন ভাব করছে।মনে হচ্ছে আমি ক্রিমিনাল।আর এরা বাপ,বেটি সিআইডি অফিসার।আর আপনি মামু এত গোয়েন্দাগিরি করেন কেন?কোথায় মেয়েকে আমার সাথে বিয়ে দিয়ে বলবেন।বাবা,দীর্ঘঞ্জীবী হও,সুখী হও।

অর্পণের কথা শেষ হতে দেড়ি,পুতুল হাতদুটো দিয়ে নিজের মুখ চেপে ধরে।এই লোকটা কি উল্টোপাল্টা বকবক করে চলছে।এইদিকে স্বাধীন হতভম্ব হয়ে গেছে।অর্পণ বুকের কাছে দুই হাত ভাজ করে বলল,

শুনন মামা মশাই।আমি জনাব অর্পণ তালুকদার।আপনার কন্যা স্বরূপ ভাগ্নীকে বিবাহ করিতে প্রস্তুত।ছেলে হিসেবে মন্দ নই।লাখে আমি এক পিস।মেয়ে আপনার সুখেই থাকিবে।তাহার কোনো কষ্ট করিতে হইবে না।আমি তাহাকে রাজরানি করে রাখিব।

অর্পণের কথার কোনো জবাব না দিয়ে স্বাধীন,পুতুলের হাত টেনে নিতে নিতে বলল,

বাসায় চল।আর তুমি বাসায় যাও।এসব বিষয়ে পরে কথা হবে।

পরে কেন হবে?সবকিছু আজই হবে।আপনার মেয়ে একটা চোর।আমার মনটা চুরি করে সব সময় পালিয়ে যাওয়ার ধান্ধায় থাকে।তা কি আমি বুঝি না ভেবেছেন?

স্বাধীন,পুতুল,ট্রেনে চড়তেই।অর্পণ ভিজা শরীরে বাইকে করে গ্রামে ছুটে।

১২৮.
স্বাধীনের বাড়িতে তালুকদার বাড়ির সবাই হাজির।অসীম তালুকদার ছেলের কাজে বিরক্ত হয়ে বসে আছেন।কিন্তু রাবেয়া খুশিতে বাক-বাকুম।ছেলে বিয়ের জন্য আর অপেক্ষা করতে চায় না।তাইতো ফল,মিষ্ট,দই এবং কাজীকে সাথে করে নিয়ে আসছে।এইদিকে পুতুল গোসল করে মাথা গামছা দিয়ে ভিজা চুলগুলো মুছতে মুছতে রুমে প্রবেশ করে।বাহিরে অনেকের গলা শুনতে পাওয়া যাচ্ছে।
নাকে মুরগী মাংস এবং পোলাও সুগন্ধ আসছে।মিলন,সাজু আজ বেশ আনন্দে রয়েছে।পুতুলের ভাবনার মাঝেই দরজায় ঠকঠক করে কড়া নাড়ার শব্দ পেয়ে মাথায় ওড়না দেয়।স্বাধীন রুমে প্রবেশ করে।স্বাধীনের হাতে লাল বেনারসি।যেটা রাজিয়ার বিয়ের জন্য কি না হলেও দেওয়া হয়নি।আজ মেয়ের জন্য সেটা বের করেছেন।পুতুল অবাক চোখে তাকিয়ে আছে।মামার মুখটা কেমন যেনো।না হাসি,আর না গম্ভীর মুখ।

আম্মা আপনি বড় কেন হলেন?ছয় বছরের সেই ছোট্ট পুতুল কেনো রইলেন না।আপনি আমার এই কাচা মাটির ঘরে ছোট ছোট পা’য়ে যখন হেঁটে হেসে খেলে বেড়াতেন।আমার খুব আনন্দ হতো।মনে হতো আমার আম্মা আপনার মাঝে ফিরে এসেছে।সেই মায়ের প্রতিবিম্ব আপনার মাঝে দেখে কতটা শান্তি পেতাম।কতটা রাত আমি আরামে ঘুমিয়ে কাটিয়েছি তার হিসেব নেই।কিন্তু আজ আপনাকে এই দুই হাত দিয়ে বিদায় জানাতে কষ্ট হচ্ছে।আমি বোধয় মেয়ের বাপ ব’লেই এই কষ্টটা পাচ্ছি।আমার আম্মার জন্য দোয়া রইলো।সে যেনো সুখী হয়।তার সুখেই আমার সুখ।স্বাধীন চোখের পানি মুছে বলল,

তৈরি হয়ে নিন।আজ আপনার বিয়ে।বরপক্ষ চলে আসছে।ওরা আপনাকে নিতে এসেছে।আর আমি আজ সবটা জেনেই তাদের হাতে সহ ইচ্ছায় আপনাকে তুলে দিচ্ছি।আপনার ব্যাপারে কোনো কিছু লুকানো হয়নি।তারা সবটা জেনেই গ্রহণ করতে প্রস্তুত।স্বাধীন চলে যেতেই পুতুল ঠাসস করে বিছানা বসে পড়ে।কি হচ্ছে এসব?সব মাথার ওপর দিয়ে যাচ্ছে।
রেনু পুতুলকে সুন্দর করে শাড়ি পড়িয়ে আঁচল একটু বড় করে টেনে দিলো।মাথায় কালো হিজাব পরিধান করিয়েছে।একেবারে কনে সাজিয়ে রুপান্ত করার চেষ্টা।এই কনের হাতে মেহেদী নেই।চুলগুলো হাত খোপা করে রাখা।চেহারায় সাজ গোছের কোনো প্রশাদর্নী নেই।তার দুই হাতে ছেলে পক্ষ থেকে দুই জোড়া চিকন দামী চুরি।গলায় কোনো অল্ঙ্কার নেই।নাকে ছোট্র নাকফুল।একদম ঘরোয়াভাবেই এবং ময়মুরুব্বি সামনেই খুরমা খেজুর দিয়ে বিয়েটা সম্পূর্ণ হয়েছে।

পুতুল এখনো একটা ঘোরের মধ্যে আছে।মামা তার সাথে এটা কেন করলো জানা নেই? তবে এর পিছনে বড় কারণ অবশ্যই রয়েছে।তা না হলে যে ছেলেকে দুইদিন আগেও সয্য করতে পারতোনা।আজ তার সাথে বিয়ে দিলো।আজ একটু আগেই সে অন্য কারো বউ হয়েছে।সে অর্পণ তালুকদারের বউ।বিশ্বাস করতে পারছে না।পুতুল নিজের ঘরে ছিল।দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দে চোখ তুলতেই দেখে অর্পণ তালুকদারকে।পুতুলকে অবাক শেষ চূড়ায় উঠিয়ে পুতুলকে জড়িয়ে ধরে আনন্দে নাচতে লাগলো।পুতুলের কপালে প্রথম চুমু বসিয়ে দিলো।

একটু আগে যখন আমি কবুল বলছিলাম।বিশ্বাস করো মনে হচ্ছিল আমি কল্পনা দেখছি।তুমি আমার বউ।এটা ভাবতেই কি যে আনন্দ লাগছে বউ।আমি খুশিতে পাগল হয়ে যাব।আজ অবশেষে তোমায় পেলাম।আমার ভালোবাসা।আমার প্রেয়সী আমার ঘরের ঘরণী হয়ে এলো।এতদিন তোমাকে দূর থেকে দেখেই আমার চোখের তৃষ্ণা মিটিয়েছি।আজ সামনে থেকে দেখতে পারব।অর্পণ বকবকানি করছে।এইদিকে পুতুল নিজের সদ্য হওয়া স্বামীর রিয়াকশন দেখে মাথা ঘুরছে।প্রথমে চরকি মতো ঘুরানো এবং তারপর চুমু তার কপালে দিতেই পুতুল বেহুশ হয়ে তার বক্ষে জুড়ে পড়ে আছে।অর্পণ যখন বুঝতে পারলো।তার আনন্দ হাওয়া ফুস।বউকে খাটে শুইয়ে হাত পাকা দিয়ে বাতাস করতে লাগল।

হায় আল্লাহ,আমার চুমুতে এত পাওয়ার,যে বিয়ের প্রথমদিনই বউ বেহুশ।আর আমি তার সেবায় এখন নিয়োজিত।

চলবে…..

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৪৪
১২৯.
পুতুল অজ্ঞান হয়ে বিছানায় পরে আছে।রাবেয়া চেক-আপ করে ছেলের মাথায় হালকা করে থাপ্পড় লাগিয়ে বলল,

বেয়াদব।সত্যি করে বল কি করেছিস?তোর কারণে মেয়েটা অজ্ঞান হয়ে গেছে।

আমি,আমি আবার কি করলাম?একটু লাটিমের মতো ঘুরিয়ে শেষ পাতে একটা চুমু দিয়েছি।ব্যাস এতুটুকুই।

তোর এতটুকুই তার জন্য ভারি পড়ে গেছে।বিয়ে হতে দেড়ি বউকে ঝাটকা দিতে দেরি নেই।

বারে বউ আমার।আমি একটু আদর দিতেই পারি।এতে এত শকটের কি হলো?আর এক চুমুতে বউ অজ্ঞান হলে আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার হবে?আমি কি এই জম্মে বাবা ডাক শুনব না?ছেলেকে বিরবির করতে দেখে আরেক থাপ্পড় তার বাহুতে লাগিয়ে বলল,যা বাহিরে যা।পরে আসবি।অর্পণ মন খারাপ করে বাহিরে চলে গেলো।

কিছুক্ষণ পরে পুতুলের জ্ঞান ফিরে আসে।চোখ মেলে সেই বউ পাগলকে না দেখে সস্তির নিশ্বাস ফেলে।মামা তাকে এ কোন পাগলের গলায় দিল।

আম্মু আপনি ঠিক আছেন?রাবেয়ার ডাকে পুতুল তাকিয়ে ইশারায় বলল,

সে ঠিক আছে।

সারাদিন পেটে কিছু না পড়ায়।আর অতিরিক্ত দূর্বলতার জন্য এমন হয়েছে।কিছু খেয়ে নিন।রাবেয়া হাত ধুয়ে পুতুলের মুখের সামনে খাবার ধরে বলল,নেও হা কর!এমন রোগা-সোগা মেয়ে মানুষকে আমি আমার বাড়িতে ছেলের বউ করে ঘরে তুলবো না।রাবেয়া বক্তব্যে পুতুল অবাক চোখে তাকিয়ে।পুতুলের কৌতুহল বুঝতে পেরে বলল,

আমি অর্পণের আম্মু।তালুকদার বাড়ির বড় বউ রাবেয়া।অসীম তালুকদার আমার স্বামী।

অর্পণের মায়ের কথায় পুতুল আরেকদফা চমকে উঠে।

আর তুমি আমাদের বউমা নও।আমাদের মেয়ে হয়ে যাবে।তবে সেটা আজ নয়।তোমার স্বপ্ন,তোমার লক্ষ্য পূরণ হওয়ার পর।এই বিয়েটা সবকিছু বিবেচনা করেই ঘরোয়াভাবে দেওয়া হ’য়েছে।কি করতাম?একদিকে আমি যেমন অর্পণের মা।আরেকদিকে তোমারও মা হ’য়েছি।দায়িত্ব ও কর্তব্য দু’টোই নিষ্ঠার সাথে পালন করতে চেয়েছি।কাউকে আঘাত করে তার স্বপ্ন ভঙ্গ করে বউ করে নিতে আসতে চাইনি।কিন্তু ছেলের পাগলামি।আর তোমার কথা চিন্তা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।একদিন বিয়ে যখন করতেই হবে তখন সেটা আজ করলে ক্ষতি নেই।নিয়মমতো তুমি তোমার মামার কাছেই থাকবে।কিন্তু শরীয়ত মতে তুমি বিবাহিত।এবং তোমার ঘর,বর দু’টোই আছে।তোমার যখন ইচ্ছে যা খুশি করতে পারো।আমি তোমাকে পুরো স্বাধীনতা দিচ্ছি।
নেও এখন খেয়ে শরীর ঠিক রাখ।নিজের লক্ষ্যে যাওয়ার জন্য।পুতুল খেতে চাইছে না।মুখটা তিতা হয়ে আছে।রাবেয়া মিষ্টি করে হেসে প্লেটের ভাত গুলো ভাগ ভাগ করে নিলো।

একটা লোকমা তুলে বলল,

এটা রাজিয়ার নামে।তোমার জন্মদাত্রী মায়ের জন্য।খেয়ে নেও।মায়ের কথা শুনতেই পুতুল প্রথম লোকমা মুখে নিলো।তার চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে।রাবেয়া নিজের আঁচল টেনে পুতুলের চোখের পানি মুছে কপালে চুমু একে দিলো।

ভাত সামনে নিয়ে কাঁদতে নেই।এতে আল্লাহ নারাজ হন।রাবেয়া দ্বিতীয় লোকমা তুলে বলল,
এটা তোমার মামার নামে।যে মামা ছোট্ট থেকে পুতুলকে আজ এত বড় অবধি করেছেন।যার জন্য আমি আমার মেয়েকে পেয়েছি।তার আম্মাজান।আজ আমার ঘরের
রাজকন্যা হয়েছে।তার স্বপ্নে চলার দিনগুলোতে সাহস দিয়েছে।তার পাশে সব সময় রয়েছে।পুতুল হাসি মুখে দ্বিতীয় লুকমা মুখে নিলো।

তৃতীয় লুকমা পুতুলের সামনে তুলে বলল,

এটা সেই ছোট্ট জানের জন্য।যাকে বাবা নামক অমানুষ পিতার হাত থেকে বাচাঁতে তুলে দিয়েছে মামা,মামীর কোলে।সাজু,সাথে তার ঠাঁই হয়েছে মামী নামক আরেক মায়ের সঙ্গে।তার জম্মের সময়ে তার মা নামক রমনী মৃত্যু হয়েছে।সে জানে না।কিন্তু আমার এই আম্মু তোও সব জানে।আজ জেনেও চুপ শুধু মাত্র মিলনের জন্য।এত বছর ধরে যাদের মা,বাবা জেনেছে।আজ যদি অন্য কেউ তার মা,বাবা এটা শুনে।সে মানতে পারবে না।কষ্ট পাবে ব’লে চুপ।রাবেয়া সাথে কথা বলতে বলতে অনেকটা সময় চলে গেছে।পুতুলের খাওয়া শেষ আরো আগেই।রাবেয়া বলা কথাগুলো তাকে সেই পূরনো ক্ষত মনে করিয়ে দিয়েছে।না চাইতেও রাবেয়া বুকে পরে কান্না করছে।

এই কান্না আজকেই শেষ।এরপর আর কান্না নয়।শুধু হাসি,আর আনন্দ থাকবে।আমি জানি আজ কথাগুলো বলায় তুমি কষ্ট পেয়েছো।বিশ্বাস কর বলতে চাইনি।কিন্তু আমার মনে হলো,তুমি ভাবছো এই বিয়েটা তোমায় করুণা করে দেওয়া হয়েছে।সবাই করুনা করেছে।কিন্তু এসব মিথ্যে।আমরা প্রথম থেকেই সবটা জেনেই মেনেই নিয়েছি।

এতখন হয়ে গেছে পুতুলের কোনো খবর নেই অর্পণ অস্থির হয়ে গেছে।আর থাকতে না পেরে দুম করে রুমে ঢুকে পরে।রুমে প্রবেশ করতেই মায়ের কোলে পুতুলকে দেখতে পায়।তার বক্ষ জুড়ে একটা শীতল হাওয়া বয়ে গেছে।ভীরু পায়ে এগিয়ে আসতেই দেখে তার আদূরনী ঘুমিয়ে আছে।মায়ের কোলে নিজের বউকে এভাবে পরম মমতাময় কোলে ঠাঁই পেতে দেখে নিজেরও লোভ লাগছে।মায়ের অপর পাশে বসে গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে রয়।এভাবে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সেও ঘুমিয়ে পরে।বোনের বিয়ের দুই রাত জাগ্রত ছিল।কিন্তু আজ সব কিছুর সমাধান হয়েছে।তার আদূরনী তার অর্ধাঙ্গিনী তার হয়ে গেছে।একে অপরের সঙ্গে বাঁধা পড়েছে।বিবাহ নামক মিষ্টি সম্পর্কে।যেখানে হালাল করে প্রিয়তমাকে পাওয়া হয়েছে।এই স্বামী,স্ত্রী মিষ্টি সম্পর্ক সত্যি সুন্দর।

১৩০.

ঢাকা কাজের শহর কিংবা বেঁচে থাকার চাবিকাঠি।হ্যা ছোট ছোট গ্রাম থেকে অনেক ছেলেরা জীবিকার তাগিদে এই শহরে মাটিতে পা রাখে।নিজের পরিবার আপনজনের থেকে দূরে ফেলে আসে।তারা সকাল সাতটা মধ্যে কাজের জন্য বের হয়।আর ব্যাচেলার রুমে ফিরে রাত নয়টা কিংবা দশটায়।আবার কখনো কখনো নাইট ডিউটি করে কিছু বাড়তি অর্থর আশায়।এই দুনিয়ায় টাকা যার কাছে আছে।সে মূল্য আরকদর বেশি হয়।যার পকেটে টাকা নেই।তার মুল্য নেই।কারণ সবাই জানে সে ফকির।আজ পুতুল এই শহরে মামাকে ছাড়া প্রথমবার পা রাখছে।তার পাশে রয়েছে অর্পণ তালুকদার।তার হাতের মুঠোয় নিজের ছোট্ট হাতটা শক্ত ধরে রাখা।মনে হচ্ছে সে হাত ছাড়লেই পুতুল হারিয়ে যাবে।সে নিজের প্রিয়তমাকে আগলেই রেখেছে।এমনকি তার স্বপ্ন পূরণ করতে সব কাগজ পত্র তৈরি করে বলল,

সই করতে।পুতুল পুরো কাগজটা পড়ে সই করে দিল।আজ তার মেডিকেল কলেজের প্রথমদিন।সবকিছু আলহামদুলিল্লাহ ভালো হচ্ছে।নিজের স্বপ্নটা এত কাছেই সে ছুটেছে।
পুতুল চোখের পাতা বন্ধ করতেই চোখের সামনে ভেসে ওঠে কাল রাতের দৃশ্যটি।মামা তাকে মেডিকেলে ভর্তি করতে নিজের শেষ সম্ভবলটুকু বিক্রি করতে গঞ্জে যায়।সেই খবর অর্পণের কানে আসে।সে কিছুতেই শেষ অবলম্বন তাদের চাষের জমিটুকু বিক্রি করতে দেয়নি।সে নিজের বিবি ভরণপোষণের দায়িত্ব নিতে যানে।তাই বিয়ে যখন হয়েছে এখন পুতুল মানুক কিংবা না মানুক।অর্পণ তালুকদার তার স্বামী।তাই শরীয়ত মতে সে নিজের স্ত্রী দায়িত্ব নিবে।স্বাধীন প্রথমে দ্বিধা করলেও অর্পণের বুঝে তাকে থামতেই হয়।স্বাধীন বলল,

বউয়ের সব দায়িত্ব যখন তুমি নিয়েছো।তাহলে তাকে নিরাপত্তার দায়িত্ব তোমার।কালকে তুমি নিজে মেডিকেল কলেজে ভর্তি করাবে।স্বাধীনের কথায় অর্পণ সায় দেয়।
আর আজ তারা ঢাকায়।সবকিছু সম্পূর্ণ হতেই পুতুলকে নিয়ে নিজবাস ভবনে উঠে।
একটা তিন কামরার রুম।এড জাস্ট বাথরুম, গোসলখানা।রান্না ঘর আলাদা।এ-ই রুম গুলো তাদের বাড়ির তিন রুমের এক রুমের সমান।এত বড় বাড়িতে এই লোকটা একা থাকতো।পুতুল সবকিছু নিজের হাত দিয়ে ছুয়ে দেখতে লাগলো।কিচেন রুমে এসে পুতুল অবাক।কি সুন্দর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন।অর্পণ ফ্রেশ হয়ে এসে বলল,

তুমি এখানে কি করছো?খিদে পেয়েছে।আচ্ছা তুমি ফ্রেশ হও।আমি রান্না বসিয়ে দিচ্ছি।পুতুলকে যেতে ব’লে অর্পণ ফ্রীজ থেকে মাংস বের করে ভিজিয়ে নিলো।গ্যাস চালু করে ডাল বসিয়ে দিলো।অপর চুলায় ভাত বসানোর জন্য পানি ফুটিয়ে চাল ধুয়ে দিল।এইদিকে পুতুলের মুখটা হা হয়ে গেছে।এই বান্দা রান্না করতে জানে।সবকিছু এত নিখুঁতভাবে কিভাবে করছে।পুতুল চোখ দুটো চুলকে আবার তাকিয়ে রয়।অর্পণ ছু*রির সাহায্যে পিয়াজ কুচি করছে।টমেটো কাটছে।মরিচ,আলু কাটছে।পুতুল দা,বটি দিয়ে কা*টাকা*টি করলেও ছু*রির সাহায্যে কখনো করেনি।আজ স্বামী রুপে এই মানুষকে দেখে হতভম্ব হচ্ছে।এই লোকটা ছোট বেলায় নাকি বাদর ছিল।তার মায়ের মুখে শুনা বানী।পুরো গ্রামের মানুষকে জ্বালিয়ে মারতো।কারো গাছের ফল তোও কারো মুরগী,কবুতর,ছাগল চুরি করতো।তার হাত থেকে কিছুই রেহাই পেতো না।অবশ্য তাদের বাড়িতে গিয়েও রানীকে চুরি করে।আর সেইদিন সে রাগে তার জুতা ছুড়ে মেরেছিল।তখন কি জানতাম?এই লোকটা ভবিষ্যতে আমার জামাই হবে।আবার পড়াশোনা করেছে।রাজনীতি করছে।তাহলে এসব রান্নাবান্না ঘরের কাজ কবে শিখলো?অর্পণ নিজের কাজের মাঝে একবার ঘুরে পিছনে তাকায়।

তুমি এখনো দাঁড়িয়ে কেনো?যাও ফ্রেশ হও।

পুতুল মাথা নাড়িয়ে বলল যাচ্ছি।যেতে যেতে আরেকবার ঘুরে তাকিয়ে গেলো।

চলবে…

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৪৫
১৩১.
জীবনে কি পাব না
ভুলেছি সে ভাবনা
সামনে যা দেখি,জানি না সেকি
আসল কি নকল সোনা?

মিলন আস্তে চল।সামনে লাল গরু দাঁড়িয়ে আছে।মনে হয় তোর গান পছন্দ হয়েছে। দেখ কেমন করে তাকিয়ে আছে?

কি বলিস সত্যি না-কি?মিলন গান বন্ধ করে লাল গরুর সামনে দাঁড়িয়ে বললো।

এই যে লাল টু মিয়া আড়ে আড়ে চাও কেন?আমি তোমার গালফ্রেন্ড নই বুঝলে।মিলনের কথায় গরু কিছু বুঝুক বা না বুঝুক।

হাম্বা ব’লে লেজ নাড়াতে লাগলো।

হুহ,ছি কি গন্ধ?ওই দূর্গন্ধ আসে কোথা থেকে?

সামনে দিকে তাকা।তোর লাল টু মিয়া কাম সাড়তাছে।মিলন তাকাতে দেখে গরু মলমূত্ত ত্যাগ করছে।

ওরে শালা।এই খাট্রাস গরু।তোর শরম করে না।আমার সামনে পটি করিস।ছি গিলুহীন গরু।মাথাটা মোটা কোথাকার?মাথায় নাই বুদ্ধি।দেখ আমার সামনে কি করলো?ওরে তোর শরম নাই আমার তোও শরম আছে।তোরে আদর করে ডাকলাম লাল টু মিয়া।আর তুই আমারে বেইজ্জতি করে ছাড়লি।যা সর।তোর মুখ আমি দেখবো না।সাজু চল চলে যাই।সাজুকে কোনো কথা বলতে না দিয়ে হাত ধরে টানতে টানতে চলে যাচ্ছে।এমন সময় গরু হাম্বা,হাম্বা করতে করতে মিলনের পিছনে রশি ছুটিয়ে দৌড়ে আসতে থাকে।সাজু চিতকার করে বলল।

মিলন,পালা।গরু গুতা দিতে আসছে।সাজুর কথায় দেখার সময় কই?সে লুঙ্গি কাছা মেরে দৌড় দিতে লাগল।পিঁয়াজ ক্ষেত,মরিচ ক্ষেত তালগাছের মাঠ ছেড়ে নদীতে লাফিয়ে পড়ে।

পানির নিচে চল্লিশ সেকেন্ড থেকেই পানির ওপর ভেসে ওঠে।গরুর দেখা না পেয়ে স্ততির নিশ্বাস ফেলে উপরে উঠতেই মাথায় হাত।তার লুঙ্গি কই গেলো?এমন অলিম্পিক দৌড়ে আসছে।বেচারার লুঙ্গি কখন খুলে পড়ছে বুঝতে পারে নাই।এখন উপায়।সে বাসায় ফিরবে কি করে?

এইদিকে সাজু,মিলনকে খুঁজে ফিরছে।কোথায় যে গেলো?খবর নেই।

তোমার নিয়ত যদি ঠিক থাকে একদিন তোমার লক্ষ্য অবধি পৌছাতে তুমি পারবে।
সে যতই বাঁধা বিপদ আসুক না কেনো?

পুতুল মনযোগ দিয়ে মেডিকেল কলেজে পড়ছে।সময় যতই গড়িয়ে যাচ্ছে।ততোই তার স্বপ্ন,আশার হাতছানি পাচ্ছে।পুতুলের নিরাপত্তা পুতুলের সব দায়িত্ব এখন তার স্বামী অর্পণ তালুকদারের।বউ খোজঁ খবরের পাশাপাশি সে নিজের রাজনীতি নিয়ে খুব ব্যাস্ত সময় পার করছে।পুতুলকে তেমন সময় দিতে পারে না।তারা নিজেদের ক্যারিয়ারে ফোকাস করছে।বাকি দুনিয়া যত যাই হোক সেসব দেখার সময় তাদের নেই।এইদিকে অর্পণ রাজনীতিতে এতটা ব্যাস্ত হয়েছে।যে অনেক রাত করে বাড়িতে ফিরে।তার ইচ্ছে করে বউয়ের সাথে দুটো মিষ্টি কথা বলতে।কিন্তু সময় তাদের অনুকূলের বাহিরে চলছে।এত রাতে পুতুলকে বিরক্ত করার চেষ্টা অর্পণ করে না।কারণ সে জানে তার বিবি অনেক রাত অবধি পড়ে।তাই নিজের মতো খাবার নিয়ে খেয়ে শুয়ে পড়ে।কিন্তু দুইজন একই ছাদের নিচে থেকেও আলাদা রুমে থাকছে।তাদের কাগজ কলমে এবং ইসলামিক মতে বিয়ে হলেও এখন তাদের নিজেদের সংসার নিয়ে মাতামাতি নেই।সংসার করার জন্য সারাজীবন পড়ে আছে।তার বিবি স্বপ্ন পূরণ হলেই তাদের সংসার,একটা ভালোবাসার ঘর হবে।যে ঘরের মধ্যে একটা সুন্দর পরিবার থাকবে।মা,বাবা,স্ত্রী,ভাই,বোন,এবং বাকিদের নিয়ে তার দুনিয়ায় হবে।তার ঘরটা হবে খুশির মহল।তার রাজপ্রাসাদ।যেখানে অর্পণ তালুকদার রাজা এবং তার রানী তার বিবি।তার পুতুলজান।আর তাদের ভালোবাসা বন্ধন বা সেতু হবে তাদের সন্তান পারিসা তালুকদার।অর্পণ তালুকদার খুব করে চায়।তার প্রথম সন্তান কন্যা সন্তান হোক।তার নাম ভেবে রেখেছে।সে যেনো তার মায়ের মতো সাহসী,বুদ্ধিমতি মেয়ে হয়।যার মা এমন বাস্তববাধি।তার মেয়েরও সে রকম হওয়া উচিত।

ফজরের আজানের সময় মুয়াজ্জিন ডাকছেন।“আসসালাতু খাইরুম মিনান নাওম” (ঘুম থেকে সালাত উত্তম)।
আজানের প্রথম ডাকেই পুতুলের ঘুম ভেঙে গেছে।পড়ার টেবিল থেকে মাথা তুলতেই মনে পড়ে।কাল রাতে পড়তে পড়তে সে এখানেই ঘুমিয়ে যায়।বিছানায় সে ঘুমাইনি।জানালা খুলতেই দেখতে পায় বাহিরে আলো ফুটছে। আঁধার কালো সরে আলোটা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হতে লাগল।আম গাছ,জাম গাছের ধারে কাকপক্ষী ডাকছিল।ওইদিকটায় ওড়াউড়ি করছে শালিক,দোয়েল,মাছরাঙা পাখি।আস্তে ধীরে জেগে উঠছে দুনিয়াদারি।মানুষ তার জীবিকার তাগিদেই শহরে অলিগলিতে কাজের জন্য বেরিয়ে পড়বে একটুও পড়েই।

পুতুল ওযু করতে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়িয়ে ছিল।এমন সময় অর্পণের কথা মনে পড়তেই তার রুমের দিকে অগ্রসর হয়।কয়েক পা ফেলতেই অর্পণের দরজা সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে।কয়েক পলক তাকিয়ে দরজায় ঠকঠক শব্দ করে।রাতে দেড়ি করে ঘুমানোর জন্য অর্পণের কান সজাগ হলেও চোখ মেলে তাকিয়ে দেখা’র অবস্থায় নেই।চুপচাপ বিছানায় পড়ে রইল।এইদিকে অর্পণের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে পুতুল দরজা হালকা ধাক্কা দিতেই খুলে গেলো।ভীরু পায়ে রুমে প্রবেশ করতেই অর্পণের ঘুমন্ত মুখটা ভেসে ওঠে।কি সুন্দর শান্ত সৃষ্ট হয়ে ঘুমিয়ে আছে?মনে হয় হচ্ছে ভদ্রলোক বহুদিন পর আরামে ঘুমিয়েছে।কিন্তু তার এই ঘুম আজ পুতুল ভাঙ্গতে বাধ্য।মামা,মামী তাকে ফোনে অনেক কিছু বুঝিয়েছে।বিয়ে হয়েছে।অর্পণ তালুকদার তার স্বামী।এই বিয়ে নামক সম্পর্কে আগানোর জন্য কাউকে না কাউকে আগাতেই হবে।সে যদি দুই পা আগাতে পারে।তার ভালোর জন্য সব করতে পারে।তাহলে পুতুল কেন পারবেনা?তার অন্তত এক পা আগানো উচিত।আর এগিয়ে চলার পথে একদিন সবই বদলাবে।এখন এই সংসারটা তার খেলাঘর হলেও পরবর্তী ভালোবাসার ঘর হয়ে উঠবে।এটা তার বিশ্বাস।পুতুল একটা নিশ্বাস ফেলে অর্পণকে ডাকতে লাগল।তার গায়ে হাত বুলিয়ে ধাক্কা দিচ্ছে।অথচ এই কুমুরোকদু লোকটা পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে।তার তোও কোনো হেলদোল নেই।পুতুল কি করবে ভাবচ্ছে?ট্রি টেবিল থেকে পানির বোতল নিয়ে অর্পণের মুখে ছুড়ে মারে।হঠাৎ চোখে,মুখে পানি পড়ায় অর্পণের মুখটা কুঁচকে গেলো।বিরবির করে কি যেনো বলতে লাগল?পুতুল নিচু হয়ে কান পাততেই অর্পণ তালুকদার তাঁকে পেচিয়ে ধরে কম্বলের নিচে টেনে নিলো।পুতুল হতভম্ব।নিজের হুশ হতেই অর্পণের থেকে পালাতে চাইলো।কিন্তু অর্পণ তালুকদার আজ তাকে ছাড়ছে না।
পুতুলের শরীর তরতরিয়ে কাঁপছে।এ কেমন নতুন অদ্ভুত অনুভূতি।পুতুল ঢোক গিলো।নিজেকে ছাড়াতে অর্পণের পেটে জোরে চিমটি কাটে।এত জোরে কাটছে।অর্পণ ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে।পেট ধরে তার বিবির দিকে তাকিয়ে রয়।

এইদিকে অর্পণের কৃতি কল্পাপে পুতুল হেঁসে উঠে।পুতুলকে হাসতে দেখে অর্পণ হা করে তাকিয়ে আছে।মুগ্ধ হয়ে নিজের প্রিয়তমাকে দেখছে।এই দেখায় আলাদা সুখ হচ্ছে।এক অন্য রকম শান্তি পাচ্ছে।বুকের ভেতর ছোট্ট হার্টটা ধুকপুক করছে।পুতুলকে অবাক করে দিয়ে অর্পণ পুতুলের কপালে ভালোবাসার পরশ একে দিল।সময় নষ্ট করে দৌড়ে ওয়াশরুমে ছুটে গেলো।আর পুতুল হা হয়ে স্বামীর পালিয়ে যাওয়া দেখলো।

১৩২.
ফজরের নামাজ পড়তে দাঁড়িয়েছে।অর্পণ আগে পুতুল পিছনে।ফজরের চার রাকাআত সালাত আদায় করে নিচ্ছে।প্রথমে দুই রাকআত সুন্নত এবং দুই রাকাআত ফরজ।
পাখি ডাকা ভোরে কিছুটা আঁধার থাকতেই এই নামাজ পড়া উওম।অথ্যাৎ সকালের আভা ছড়িয়ে পড়ার আগেই এই নামাজ আদায় করে নেওয়া ভালো।আজ দেড়ি হওয়া মসজিদে নামাজ পড়তে যেতে পারিনি।অবশ্য এই বিয়ের একমাস হওয়া পর তার এইদিকটা পরিবর্তন হয়েছে।আগে নামাজের প্রতি টান ছিলো কম।এখন বউয়ের ছোঁয়া তার ঘর,এবং দুটোই কন্টোলে আসছে।আজ বাড়িতেই তার প্রিয়তমাকে সাথে নিয়ে নামাজ আদায় করলো।পুতুলের মাথায় সাদা ওড়না তিন পেচঁ দিয়ে রাখা।সকালের সূর্যের আলোয় বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে।এমন সময় অর্পণ গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ নিয়ে আসে।পুতুল মাথা নাড়িয়ে বলল,এত সকালে সে চা খাবে না।কিন্তু অর্পণ জোর করে দেওয়ায়।বাধ্য হয়ে নিলো।এক চুমুক মুখে দিতেই মনটা সতেজে ভরে গেলো।স্বামীর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল।যার মানে চা টা দারুণ হয়েছে।প্রিয়তমার হাসিতেই অর্পণ খুশি।

সকালের দৃশ্য দেখতে দেখতে বেলকনিতে বসেই চা টা শেষ করে নিলো।সময় গড়াতেই পুতুলকে গাড়িতে করে মেডিকেল কলেজে দিয়ে আসে।পুতুল কে পৌছে দিয়ে নিজের অফিসে ছুটে।

জার্মান….

তন্নী পায়ের ওপর পা তুলে বসে থেকে আপেল খাচ্ছে।আর এইদিকে অন্তর সাহেব বউয়ের কথা মতো থালাবাসন ধুয়ে ট্রে তে রাখছে।ছেলের এই করুণ পরিনতি জেফিন রওয়্যার্ড দেখে রাগে কটমট করছে।

চলবে…

চক্ষে আমার তৃষ্ণা পর্ব-৪০+৪১+৪২

0

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৪০
১২১.
অর্পণ বাবা আমার এতো রাগ ভালো না।তুই শান্ত হ।

তুমি আমাকে শান্ত হতে বলছো।আর তাকে কেনোও কিছু বলতে পারো না?তার বেলায় তোমার মুখে তালা থাকে কেন?সে একশোটা দোষ করলে কিছু না।আমি একটা করলেই যদি সেটা অপরাধ তার কাছে মনে হয়।তবে তাই আমি।তাঁকে ব’লে দেও।আমার কিংবা আমার আপনজনদের দিকে হাত না বাড়াতে।তোমার বাপ জনাব জামশেদ উল্লাহ খান গদিতে বসে মানুষের র*ক্ত চু*ষচ্ছে।এসব করতে বারণ কর।গদিতে বসে এতটা খুশি হওয়া মানুষকে আমার দু-চোখে সয্য হয়না।তার এই খুশিকে দুঃখের পরিণাম করে ফেলব।

এসব কি বলছিস অর্পণ?আস্তে চিতকার কর।তোর বাবা ঘুমিয়ে আছে।এত রাতে হইচই করিস না।যাকে গালাগালি দিচ্ছিস।উনি সম্পর্কে তোর নানাজান হন।আর যাকে কাল পিট বলছিস সে তোর ছোট মামা হয়।

অর্পণ রাগে কটমট করতে করতে বলল,ওরা আমার ক*চু হয়।আমি এসব বেঈমানদের মনে রাখি না।তুমি ওদের হয়ে আমার সামনে সাফাই গাইবে না।রাত অনেক হয়েছে এখন ঘুমাতে যাও।ছেলের রাগ দেখে রাবেয়ার মুখে চিন্তার ছাপ।

রাবেয়া ছেলেকে শান্ত করতে গলাটা হালকা কেশে নরম গলায় বলল,

বলছিলাম কি বাপ?পুতুলকে একদিন আমাদের বাসায় নিয়ে আসব।তোর বাপ বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে একা গেছে আমাকে নেয়নি।পুতুল তোর বাপকে তোর পরিচয়ের মাধ্যমে চিনে।আর আমাকে চিনে ডাক্তার ম্যাডাম ব’লে।সে নিশ্চয় ডাক্তার ম্যাডামকে না করবে না।আফটার অল যাব তার শ্বাশুরী হয়ে,কিন্তু তার সামনে প্রেজেন্ট হব তার ডাক্তার ম্যাডাম হয়ে।মায়ের কথা অর্পণের মনটা ভালো হয়ে যায়।নিজেকে কিছুটা শান্ত করে বলল,

যাচ্ছো,যাও।কিন্তু ভুলেও আমার নাম বলে বসো না।কিংবা পুতুল মা,আমি তোমার শ্বাশুড়ি আম্মা।আমার পা ছুয়ে সালাম কর।তার সামনে এসব বলতে দেড়ি।আর আমার আদূরনী বউ মাটিতে বেহুশ হয়ে পড়তে দেড়ি করবে না।তখন আমার টেনশন,হাইপ্রেশার বেড়ে যাবে।সে আমাকে দু-চোখে সয্য করতে পারে না।তার কাছে আমি ওই টাইপ মহিলাদের মতো।ও-ই যে,গ্রামে কিছু কুটনি পাঁজি মহিলাদের মতো,যাদের অন্তরে বিষ আর মুখে মধু থাকে।অর্পণ কথাগুলো ব’লা শেষ করে গাল ফুলিয়ে উপরে নিজের বরাদ্দ রুমে চলে গেলো।এইদিকে ছেলের কাজে আর কথাবার্তায় রাবেয়া হাসতে হাসতে সোফায় বসে পড়লো।হায় আল্লাহ,তার ছেলে ব’লে কি?

সকালে মুরগী ডাকে গ্রামের মানুষের ঘুম ভেঙে গেছে।তারা ফজরের নামাজ পড়ে দিনের কাজগুলো তাড়াতাড়ি সেড়ে ফেলেছে।সকালের সূর্য সাথে তাদের দৈনিক উঠে পড়ার অভ্যাস।সকালের নাস্তা খেয়ে মাঠের কাজে নেমে পরে।আবার সূর্য পশ্চিম দিকে ডুবতেই যার যার নীড়ে ফিরে যায়।পুতুল নামাজ পড়ে ঘরটা সুন্দর করে গুছিয়ে নিয়েছে।আবার বাহির বের হয়ে দেখলো গাছের পাতা ঝড়ে মাটিতে পড়ে আছে।সেগুলো কুড়াতে,কোমড়ে ওড়না গুছে নিলো।উঠোনের শুঁকনো পাতাগুলো শোলার ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে দেয়।এরমধ্যে মামী উঠে রান্নাঘরে কাটাকুটি করছে।পুতুল হাত ধুয়ে সীলনূরে আদা,রসুন বেটে নিলো।পুতুলের বাটা শেষ।সূর্যের আলোতেই সরিষা,কালিজিড়া,বাদাম,শুকনো মরিচ,আস্ত হলুদ এগুলো বড় গামলায় আর বড় চেনিতে মেলে দিলো।এরপর আমের আচার,জলপাই আচার,চালতা আচার,বরই আচার
রসুনের আচার,বোটমরিচের আচার,সব বয়ামগুলো সারিভাবে রেখে ঘরে আসতেই মামীর ডাক শুনা গেলো।

পু.তু.ল।

পুতুল,মামীর ডাকে ঘর ছেড়ে আসে।মাথা ঘুমটা টেনে উঠোনে আসতেই মামী বলল,

রান্নাঘরে গিয়ে একটু বস।চুলায় ভাতের হাড়ি চড়ানো হয়েছে।একটু পর পর শুকনো কড়ি পাতাগুলো দিলেই হবে।আমি পুকুরের ঘাটে যাচ্ছি।তোমার মামার কাপড়টা ধুয়ে দিতে।পুতুল মাথা নাড়িয়ে জি বুঝাতেই।মামী ঘাটে গেলো।পুতুল নিজের মতোও করে চুলার মুখে পাতা দিচ্ছে।

১২২.
এইদিকে মিলন,সাজু নামাজ পড়ে।গ্রামের অলিগলিতে দুষ্টমি করে বাড়িতে ঢুকতেই চোখের সামনে আচারের বোয়ামগুলো দেখতে পায়।তাদের চোখে মুখে খুশির ঝলক।পুরো বাড়িটা আড়চোখে দেখে নিয়ে চুপিচুপি আচারের বোয়ামের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।ঢাকনা সরিয়ে ডান হাত ঢুকিয়ে দিয়ে চারদিকে তাকাতে লাগল।তাকে কেউ দেখছে কি-না।কিন্তু না কেউ নেই।আমের জেলি থেকে দুই,তিন পিছ নিয়ে সাজু হাতে দিলো।এবার জলপাই আচারের হাত দিয়েছে।এটা টক,জাল খাট্রামিঠা।একবার মুখে দিতেই জিহ্বা পানিতে ভরে উঠে।এত লোভনীয় আচার চোখের সামনে থাকলে কি মাথা ঠিক থাকে?মিলন,সাজুর অবস্থা তাই।জলপাইয়ের পুরো বয়াম নিয়ে পুকুরের ঘাটের দিকে দৌড় দিলো।বাকি আচার গুলো সেইভাবেই পরে রইল।তারা চলে যেতেই পিছনে ডুবন্ত সরষের তেলের আমটা বুদবুদ শব্দ করে মাটিতে পড়তে লাগল।এইদিকে রেনু,স্বাধীনের কাপড় ধুয়ে বাসায় আসতে নিলেই,দেখে তার বাঁদর দুই ছেলে পুকুরের বড় গাছটায় বসে চাকুমচাকুম করে কি জেনো খাচ্ছে?রেনু কাপড়ের বালতিটা ঘাটে রেখে তাদের সামনে গেলো।

হুম…হুম..মজা।ওই সাজু আচার খেয়ে মুখ ভালো করে পরিষ্কার করে নিবি।পুকুর থেকে হাত ধূয়ে যাব।তাহলে মা,আর আপু বুঝতে পারবে না।আমরা আচার চুরি করে খেয়েছি।মিলনের কথা সাজু মাথা নাড়িয়ে সায় দিয়ে আরেকবার জলপাই আচার খেতে মনযোগ দিলো।দুই ছেলের কথা শুনে রেনু গালে হাত দিয়ে বলল,

কি চোররে বাবা?একে তোও চুরি করে খেয়েছে।আবার কি সুন্দর মিথ্যা কথা বানিয়ে ব’লে যাচ্ছে?তবে রে হতচ্ছাড়া।রেনু এগিয়ে এসে দুই হাত দিয়ে দুইজনের কান টেনে ধরতেই আহহহ করে উঠে।মা’কে দেখেই তাড়াতাড়ি পাঞ্জাবি হাতা দিয়ে মুখ মুছে নিলো।সাদা পাঞ্জাবির হাতাতে আচারের দাগ স্পষ্ট।জলপাই আচারের বোয়াম পিছনে লুকিয়ে রাখার কত চেষ্টা।কিন্তু তাদের চেষ্টা বিফলে।রেনু দুই ছেলেকে ধরে বাড়িতে নিয়ে আসতেই পুতুল এগিয়ে আসে।তাদের এই অবস্থা দেখে বুঝতে বাকি নেই।এই চোরই সেই চোর।যারা এর আগেও বেশ কয়েকবার আচার চুরি করে খেয়েছে।এবং তাদের ধরা যায়নি।

পুতুল কোমড়ে দুই হাত রেখে রাগি চোখে তাকিয়ে রয়।বোনের রাগ দেখে মিলন,সাজু দুই কানে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল।সরি।কিন্তু তাদের আপুর রাগ কমলো না।বোনের রাগ ভাঙ্গতে ঠিক হলো মেলায় যাবে।

গ্রামে মেলা বসেছে।সে বিশাল আয়োজন।পুতুলের গায়ে কালো বোরকা।সে কিছু খাবে না।তবে পানি পুড়ি নাম শুনে লোভ লাগছে।বেল পুড়ি,চটপটি,ফুচকা তার ভীষণ প্রিয়।কিন্তু এই পানি পুড়িটা তাদের গ্রামে নামকরা হলে-ও কখনো খাওয়া হয়নি।এটা মেলায় বেশি পাওয়া যায়।কিন্তু অনেক আগে একবার মেলায় আসার পর আর মেলায় আসেনি।এটা নিয়ে দ্বিতীয় বার আসা হলো।এই পানি পুড়ি,ফুচকার থেকে অনেকটাই বড় থাকে।এরমধ্যে আলু,ডিম সেদ্ধ,আর দই থাকে।তার সাথে দেয় সাত রকমের টক পানি।পানির কালারগুলো দেখতে সুন্দর।এবং এক একেকটা পানির স্বাদ সম্পূর্ণ আলাদা।দারুণ খেতে।পানি পুড়ির প্রংশসা শুনে খেতে ইচ্ছে জাগে।মিলন,সাজুর মাঝে পুতুল রয়েছে।স্বাধীনও পুতুলের পাশাপাশি রয়েছে।ভীর ঝাপটা এরিয়ে সাবধানে হেঁটে এগিয়ে পানি পুড়ির দিকে আসতেই তাদের চোখ কপালে।এত ভীর।আপু দেখ,দেখ মেয়েগুলো কত বড় বড় হা করে মুখে দিচ্ছে।মনে হয় তাদের খাবার কেউ চুরি করে নিয়ে যাবে।আরে বাপ আস্তে খা।যেভাবে খাচ্ছিস।মনে হয় কত বছর ধরে বাসায় খাস না।তোদের বাপ,মা কি না খাইয়ে রাখে?রাক্ষস জানি কোথাকার?

মিলন রাক্ষস নয়?বল রাক্ষসী জানি কোথাকার?পুতুল দুই ভাইয়ের মাথায় হাত দিয়ে হালকা বারি দিতেই তারা চুপ।

এইদিকে এমপি সাহেব তার পুরনো বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে।কথা,হাসির মাঝেই চোখে পরে মেলার ভীর কম যেখানে সেখানে মিলন,সাজু,স্বাধীন সাথে আরেকটি মেয়ে বোরকা পরে এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে।বন্ধুদের রেখে এগিয়ে আসতেই স্বাধীনকে বড় করে সালাম দিলো।এইদিকে অর্পণকে দেখে পুতুল অবাক চোখে একপলক তাকিয়ে চোখ সড়িয়ে নিলো।মিলন,সাজুর মনে লাড্ডু ফুটছে।স্বাধীনের সাথে কথা বলার মাঝেই তার প্রিয় রমণীর দিকে আড়চোখে কয়েকবার তাকিয়ে আবার কথা বলতে লাগল।

মেয়ের শখ হয়েছে পানি পুড়ি খাবে।এত ভীর দেখে রোড দিয়ে না এনে চকদিয়ে আনলাম।তারপরও এই দোকানেও ভীর দেখছি।মেয়ে খেতে না পারলে কিনে নিয়ে যাব।

পুতুল খেতে চেয়েছে কিন্তু খাওয়ার পরিবেশ এখানে নেই।এখন উপায়?আর বাসায় নিতে নিতে ঠান্ডা হ’য়ে যা-তা হবে।সেটা ভালো লাগবে না।

আপনার যদি কোনো সমস্যা না হয়।তাহলে আমার গাড়িতে বসে খেতে পারে।আমি আজ গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিলাম।আসলে আপনাদের গ্রামে কিছু কাজ ছিল সেটা শেষ করে বাড়িতে যাব।তখনই পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা হয়।এতখন কথা বললাম।
মেয়ের অস্তি বুঝতে পেরে স্বাধীন মেয়েকে ভরসা দিলেন।সে গাড়ির সামনে থাকবে।এবং মিলন,সাজু তার সাথে থাকবে।

মেলাতে ঘুড়া এবং খাওয়া শেষ হতেই পুতুল বাড়িতে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হলো।তাই স্বাধীন ছেলে,মেয়েকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে যাবেন।

এইদিকে এমপি সাহেব দুই নাম্বারি করে দুই শালার পকেটে একশ করে টাকা ঢুকিয়ে দিলো।তার হাতের গোলাপফুল দেখিয়ে বলল,পুতুল অবধি পৌছাতে।স্বাধীন শুকনো খাবার কিনতে ব্যাস্ত।তখনই মিলন,সাজু পুতুলের হাতে গোলাপ তুলে দেয়।যার মানে এটা তারা তাদের আপুর জন্য কিনেছে।কত বড় ডাহা মিছা কথা!পুতুলও হাসি মুখে হাতে নিলো।

অর্পণ সামনে মাথার চুলগুলো চুলকে,মিষ্টি করে হেসে বিরবির করে বলল,

ভালোবাসিয়া গেলাম ফাঁসিয়া।
করতে হবে এবার বিয়া।
সোনারি চাঁন, পিতলা ঘুঘু।
যাবে কোথায় পালাইয়া।

চলবে…

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৪১
১২৩.
পরের দিন সকালে পুতুল ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে ঘর ছেড়ে উঠোনে পা রাখতেই মামা,মামীর কথা শুনে দাঁড়িয়ে যায়।মামার কথা মতে কাল মাঝরাতে রমিজ মেম্বার গ্রামে ঢুকতেই মাথায় কালো কাপড় পেচিয়ে কারা যেনো খুব মেরেছে?মারের চোটে তার এক হাত,এক পা ভেঙে গেছে।সুস্থ হতে না-কি দুই,তিন মাস লাগবে।শুধু তাই নয় তার ধানের ঘরে আগুন,এমনকি শুকনো মুজুত খাবার যেগুলো পুরো দুই বছরের অনাহাসে ব্যবহার করে কাটিয়ে দেওয়া যাবে।সেসব খাদ্য নষ্ট হয়েছে।কে করেছে?আর কেনো করেছে জানা চায়নি?এইদিকে দুই বছর খাবার নষ্ট এমনকি ধান আগুনে পোড়ায়।গ্রামে খাদ্য সংকট হবে।বিপদে আজ তাঁরাই পড়েছে।যারা কয়েকদিন আগেই পুতুলকে আগুনে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিলো।সেইসব গ্রামবাসীর ঘরে আজ আহার নেই।গ্রামের লোকের সব রাসায়ন পুড়ে ছাই।কি হবে এখন?এসব শুনে পুতুল হতবাক।রমিজ মেম্বারের সবকিছু সাথে সাথে ওইসব পাঁজি লোকেদের খাবার একসাথে মজুত ছিল।যা আজ পুড়ে ছাই।পুতুল দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরে চলে যায়।পুরনো ঘা সে ভুলে নিই।তার সবকিছুই মনে আছে।সে তবুও চুপ ছিল।তার স্বপ্নটা একবার পূরণ হোক।তারপর বাকিসব দেখা যাবে।পুতুল নিজে তাদের শাস্তি দিতে চেয়েছে।অথচ আজ না চাইতেও তাদের কষ্ট দেখতে পাচ্ছে।গ্রামের ময়-মুড়োবীদের একটা কথা আছে।পরের জন্য গর্ত খুঁড়লে
সেই গর্তে নিজেরাই পড়ে।আজ তার প্রমাণ পাচ্ছে।এরা পুতুলের জন্য গর্ত খুঁড়ে এখন নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে আনলো।বেশ হয়েছে।যেমন কর্ম তেমন ফল ভোগ করুক।

বাঁশবাগানে মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই। চাঁদ তো তার জাগায়াই আছে
বাঁশগুলো গেল কই?ওই অর্পণ ভাই আপনাদের বাঁশগুলো কই?

অর্পণ ডান দিকে তাকাতেই মিলন,সাজু তার দেখাদেখি ঘুরে তাকিয়ে হা হয়ে গেলো।কাচা কব্জিরবাশগুলো একটাও আস্ত নেই।সবগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে পড়ে আছে।

কি শালা সাহেব চাঁদ তার জায়গায় ছিল?বাঁশগুলো ঠাঁই রমিজ মেম্বারের শরীরে।এবার ঠিক আছে না!এমন শিক্ষা দিয়েছি না।দ্বিতীয় বার কোনো মেয়ের গায়ে কলঙ্ক দাগ লাগানোর সাহস করবে না।ওর সাহসটা কত বড়।ওহ কার কলিজা হাত দিয়েছে।সেটা আস্তে আস্তে টের পাবে।এটাতো একটু ছোট খাটো নমুনা দেখিয়েছি।পরবর্তী এমন কিছু করলে ওই কু’ত্তার বাচ্চার লা*শ পড়বে।শেষের কথাটুকু বিরবির করে বলায় মিলন,সাজু শুনতে পায় নিই।

অর্পণ নতুন বাটন ফোন কিনে সেটাতে নতুন সিম লাগিয়ে দিয়েছে।

এই ফোনটা রাখ।আগের ফোনটা পুরো নষ্ট হয়ে গেছে।

হুম,ভাইয়া।আসলে আপুর সাথে গ্রামের লোক,আর মেম্বার ওমন করায়,আপনাকে ফোন দিতে বাটন ফোন বের করে হাতে নেই।আর তখন ওতো লোকের ভীরে ফোনটা কখন হাত থেকে ছুটে কার পায়ের নিচে গেছিলো বুঝে উঠতে পারিনি।ফোনটা বেশ কয়েকবার খুঁজেছি।কিন্তু পাওয়া যায় নিই।তার ওপর বোনের সাথে গ্রামের মানুষের ওমন ব্যবহার দেখে কি করব বুঝতে পারছিলাম না।শুধু এতটুকুই মনে ছিল আপনি অবধি পৌছাতে হবে।কারণ আপনি ছাড়া আমাদের বোনকে কেউ অতটা নিরাপত্তা দিতে পারবে না।বাবার গায়ে আঘাত করতেই ভেতরটা কাঁদছিল।কিন্তু ভাই হয়ে আপুর অসম্মান দেখতে পারব না।তাই ভীতুর মতো আপনার কাছে যাই।আজ আমরা বড় হলে হয়তো আমাদের সামনে কেউ আপুর দিকে বাজে আঙুল তুলে দেখতে পারতো না।আপনাকে নিয়ে যখন আমাদের বাসায় ফিরে আসি।তখন কতটা অসহায় হয়ে যাই।মনে হয়েছিলো,আমরা আমাদের আপুকে হারিয়ে ফেলেছি।আর কোনোদিন তাঁকে দেখতে পাবো না।তার মতো করে কেউ আমাদের এত আদর,ভালোবাসবে না।এখনো সেসব ভাবলে খুব কান্না পায়।আপুকে ছাড়া কখনো থাকি নিই।সে চলে গেলে আমরা কি নিয়ে থাকতাম?মিলন,সাজু কথাগুলো বলতে বলতে কাঁদছে।তাদের কান্না করা মুখগুলো কি মিষ্টি?একদম পাকা লাল টমেটোর মতো গাল দু’টো লাল হয়েছে।বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টো করে কাঁদছে।এই দৃশ্যটা অর্পণ তার ফোনে ক্যাপচার করে নিলো।বোনের প্রতি ভাইদের এত টান তাকে অন্য রকম শান্তি দিচ্ছে।অর্পণ দুই শালার চোখের পানি মুছে বুকে টেনে নিলো।

হয়েছে।এবার থামো।আর কান্না নয়।আমার দশটা না পাঁচটা একমাত্ত বউয়ের দুইটা ভাই।তারা যদিও মেয়ে মানুষের মতো কান্না করে।তাহলে ভবিষ্যৎ দুলাভাই এর কষ্ট লাগে।চল এখন বাসায় পৌঁছে দেই।তোমাদের পৌঁছে দিয়ে সবুর মিয়া ঘন্টা বাজাবো!

এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া
কত যত্নে গড়াইয়াছেন কারিগর।
এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া
কত যত্নে গড়াইয়াছেন কারিগর
এই যে দুনিয়া।

ছায়াবাজী পুতুল-রূপে বানাইয়া মানুষ
যেমনে নাচাও তেমনেই নাচি
পুতুলের কী দোষ?
যেমনে নাচাও তেমনি নাচি
যেমনে নাচাও তেমনে নাচি
তুমি খাওয়াইলে আমি খাই
আল্লাহ, তুমি খাওয়াইলে আমি খাই
এই যে দুনিয়া কিসের লাগিয়া
এত যত্নে গড়াইয়াছেন কারিগর

এই যে দুনিয়া

চামারদ গ্রামে সবুর মিয়া লুকিয়ে আছে।কাশেম মাজারের সামনে দিয়ে পাঁচ কদম হাঁটতেই যাত্রাপালার মঞ্চ দেখা যায়।সেখানে বসে যাত্রা দেখছে সবুর মিয়া।অর্পণ যাত্রাপালা ঢুকার আগেই রুমাল দিয়ে মুখ বেধে নিয়ে সামনে এগিয়ে যায়।

বলছিলাম কি ভাই সিগারেট হবে?অপরিচিত কারো গন্ঠ শুনে সবুর মিয়া পাশে তাকিয়ে বলল,

তুমি মিয়া কেডা?তোমারে তোও চিনলাম না।গ্রামে নতুন নাকি।

হুম।এখানে নতুন।তা আপনি কি এই গায়ের?

না,যাত্রা দেখতে মধুপুর থেকে আসছি।আমার গ্রাম রোহিতপুর।

ওহ।বাহিরে চলুন।

কেন?বাহিরে যাব কেন?

আরে চলুন তো?একটা জিনিস দেখাবো।

জিনিস। কি জিনিস?

আছে।

থাকুক পরে যামু।যাত্রা দেইখা লই।

অর্পণের কথায় সবুর লড়তে নারাজ।কিন্তু অর্পণ তার কথায় কানে না নিয়ে টেনে ধরে নিয়ে গেলো।ততখনে মঞ্চের গান শেষের পথে।

১২৪.
বিদেশে পড়তে গিয়েছিল তালুকদার বাড়ির ছোট মেয়ে তন্নী তালুকদার।আজ দেশের মাটিতে পা রেখেছে।সাফিন তালুকদার,এবং মাসুদা তালুকদার মেয়ে কে এতদিন পরে কাছে পেয়ে ভীষণ খুশি।জিহান,রিহান খবর পেয়ে বোনকে দেখতে ছুটে আসে।রাবেয়া হাসপাতালে।এইদিকে অসীম তালুকদারের কাজ পরে যাওয়া গ্রামের বাহিরে আছে।সবার সাথে দেখে করে নিজের রুমে না গিয়ে অর্পণের রুমের দরজায় নক করলো।কিন্তু ভিতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজা খুলে ভিতরে উঁকিঝুকি মারতে লাগল।কিন্তু তার পচ্ছন্দের মানুষটি নেই।তাকে না পেয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেলো।ঘুরে ঘুরে রুমটা দেখতে দেখতে বেডের পাশে দেয়ালে বড় করে অর্পণের ছবি দেওয়া।সেটা দেখে তন্নী খুশি হয়ে গেলো।হাত দিয়ে তার ছবিটি ছুয়ে ডাকলো

ভা.ই.য়া!আমি এসে গেছি।এবার তোমাকে আমার মনের কথাটা ব’লে দিব।বাংলাদেশে এসে তোমাকে আগে খুঁজেছি।কিন্তু তুমি এর্য়ারপোর্টে রিসিভ করতে গেলে না।তুমি না যাওয়া মন খারাপ হয়েছিল।কি এত সারাদিন কাজ কর।যে আমাকে আনতে যাওয়ার সময় হলো না।কিন্তু এখন আমি যেহেতু এসে গেছি তখন কোনো দূরত্ব আর থাকবে না।

এইদিকে পুতুল নিজের হাতের কাপড়ে ব্লকপ্রিন্ট তুলছে।একটা জামাতেই অনেকটা পরিশ্রম যাচ্ছে।এইদিকে নতুন ভার্রসিটিতে এডমিশন নিতে হবে।মামা বই এনে দিবে।পড়াশোনা করতে তার খুব ভালো লাগে।পাশাপাশি রান্না করাটা সে ভালোবেসে পরিবারের জন্য করে।আজও করেছে গিলা,কলিজা,ভুনা।আর কর্ক মুরগীর চামড়া ডাল দিয়ে চড়চড়ি।তরকারির মাখা মাখা হওয়া আলাদা সুন্দর হয়েছে।পুতুলের গিলা,কলিজা খুব পচ্ছন্দের ছিলো।এখনো আছে।কিন্তু ছোট দুই ভাই গিলা,কলিজা খুব পচ্ছন্দ করে।তাই ভাইদের জন্য সে এসব নিজের পাতে এখন আর নেয় না।ওদের জন্য আলাদা তুলে রাখে।সে সামন্য ঝোল দিয়ে তৃপ্তির করে ভাত খেতে পারে।আগে কষ্ট হলেও এখন অভ্যাস হয়ে গেছে।ভাই’রা খেয়ে খুশি হলেই সে খুব খুশি হয়।

এইদিকে আজ বোনের করা রান্না চুরি করে অর্পণের জন্য আলাদা করে তরকারি বাটিতে তুলে বাগান সাইডে নিয়ে দিয়ে আসে।ভালোবাসার মানুষটির রান্না দেখে যত খুশি হয়েছিল।তরকারি দেখে তার হাওয়া ফুঁস। সে এর আগে এমন তরকারি খায়নি।এসব কলিজা,গিলা,মোটা চামড়া তার ইহকালে পছন্দ নয়।কিন্তু প্রিয় মানুষটি যত্ন করে রান্না করছে।তাই ডান হাতটা ধুয়ে অল্প একটু মুখে নিলো।মুখে দিতেই অর্পণ বুঝতে পারলো।রান্নাটা খারাপ নয়।খেতে ভালোই লাগছে।মিলন লাল চালের ভাত আর তরকারি দিয়ে খেতে বলল,মোটা মোটা লাল চালের ভাত দেখে অবস্থা খারাপ।এমন চাল এই প্রথম দেখছে।তবুও দিদাগ্রস্ত হয়ে এক লোকমা ভাত তকরারি সাথে মিক্সি করে মুখে দিতেই মোটা লাল চালের ভাত তার গলা দিয়ে নামাতে কষ্ট হচ্ছে।বাড়ির আদরের ছেলে চিকন চালের ভাত একটু নরম হলে খেতে পারতো না।আজ সেই ছেলে মোটা চালের লাল ভাত গিলছে।সত্যি অদ্ভুত।

পিড়িতে কাঁঠালের আঠা।লাগলে পড়ে ছাড়ে না।

চলবে…

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৪২
১২৫.
তালুকদার বাড়িতে অর্পণ ফিরেছে সন্ধ্যা সাতটায়।নিজের ঘরে দাঁড়িয়ে শার্ট’টের বোতামগুলো একটা একটা করে খুলতে নিলেই পিছনে থেকে দুটো অচেনা হাত পেচিয়ে ধরেছে।অর্পণ কপালে ভাজ ফেলে গা থেকে অচেনা হাতদুটো ছাড়িয়ে নিয়ে ঘুরে তাকায়।

কে?তন্নী!

হ্যা,আমি।কেমন আছো তুমি?

হুম,ভালো।কিন্তু তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি তোর সমবয়সী।সম্পর্কে আমি তোর বড়ো হই।তাই সম্মান দিয়ে কথা বল!

হুম!তোমাকে সম্মান দিতে আমার বয়ে গেছে।শুনো না,তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।

শুনার মতোও হলে অবশ্যই শুনবো।কিন্তু উল্টোপাল্টা ব’লে খবর আছে।কি বলবি বল?আর ব’লেই কে*টে পর!

বলছি,তন্নী নিজের নার্ভাস কাটিয়ে মুখে মিষ্টি হাসি ফুটিয়ে বলল,

আ..মি।

হুম।আমি।তারপর কি?

ইয়ে..মানে..আসলে আমি না ভালোবাসি।আই মিন অ..ন্ত…

তন্নীর কথা শুনে অর্পণ বিরক্ত হয়ে ধমক দিয়ে বলল,

ইয়ার্কি হচ্ছে হ্যা!সেই কখন থেকে ইয়ে,মানে,আমি,ভালোবাসি?এসব কি?আমি তোর বড় হই।আর তুই ভালোবাসার কথা আমাকে বলতে এসেছিস।থাপ্পড়িয়ে গাল লাল করে দিব!বেয়াদব।যা নিজের রুমে যা।যা বলছি।অর্পণের ধমকে তন্নী ঘাবড়ে গেলো।মন খারাপ করে নিজের ঘরের দিকে গাল ফুলিয়ে চলে গেলো।এইদিকে অর্পণের মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেলো।যাকে ভালোবাসি সে বুঝতে চায় না আমায়।আরেকজন আসছে নিজের ভালোবাসা নিয়ে।যতোসব ফাউল।গায়ের শার্ট টেনে খুলে নিচে ফেলে ওয়াশরুমে চলে গেল।এখন মাথা ঠান্ডা করা প্রয়োজন।মাথা ঠান্ডা না হলে নেক্সট মিটিংয়ের জন্য প্রস্তত হতে পারবে না।
ঝর্ণা ছাড়তে মাথায় পানি পড়তে লাগল। চোখে,মুখে পানি পড়তেই চোখ বুঝে নিতেই পুতুলের মুখটা ভেসে ওঠে।

গোসল শেষ করে নিচে নেমে আসে।কফিতে চুমুক বসিয়ে সোফায় পা টান করে বসে।এরমধ্যে রাবেয়া ডিউটি শেষ করে বাসায় আসেন।ছেলের ভাবমূর্তি এত শক্ত দেখে মনে মনে ব’লেন।এর আবার কি হলো?

ছেলের মাথায় হাত রাখতেই চোখ মেলে তাকায়।

মা..!

হুম কি হয়েছে? আমার বাপ আজ এত আপসেট কেন?কিছু হয়েছে?

মায়ের হাতটা ধরে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চুমু বসিয়ে বলল,আমি একটা ভুল করেছি?কাউকে আঘাত করার আগে তার সত্যিটা জানো জরুরি ছিল।আমি ঠিক করিনি।

রাবেয়া ছেলের গালে হাত রেখে বলল,কাকে আঘাত করেছো আব্বু?কি তার অপরাধ?

তার অপরাধ সে কাউকে ভালোবেসেছে।এমনকি বারবার বলতে এসেও কথা শুনেছে। আমি আজ এই হাত দিয়ে তাকে আঘাত করেছি।আমি তার ভাই হয়ে তার ওপরের রাগারাগি করেছি।আমি তন্নীকে মেরেছি।

রাবেয়া ছেলের মুখ প্রাণে তাকিয়ে আছেন।

মা,আমাদের তন্নী কাউকে ভালোবাসে।এমনকি তার সন্তান নিজ গর্ভে ধারণ করেছে।আমাদের না জানিয়ে সে গোপনে বিয়ে আরো ছয়মাস আগে করেছে।আর সে ছেলেটা আর কেউ নয়।আমার বাবার বন্ধু জানে জিগারের ছেলে অন্তর।দিহান সাহেবের ছেলে।যার সাথে আমার ভালোবাসার মানুষটির বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।পুতুলের সাথে বিয়ে ভেঙে দেওয়ার কারণ ছিল আমাদের বোন তন্নী।হ্যা মা,আমাদের তন্নীর সাথে অন্তর এর পরিচয় দুই বছরের বেশি।আর বিয়েতে ওদের মত ছিল না।সেখানে তন্নী আমি ভাবতেই পারছি না।এসব কি হয়ে গেলো?সবটা আরো আগে জানলাম না কেনো?ওকে বিদেশে পড়তে পাঠানো উচিত হয়নি।এমনকি এসব সম্পর্কে জড়িয়ে বিয়ে, বাচ্চা।চাচা,চাচী এখনো এসব জানে না।তাদের রিয়াকশন কেমন হবে বুঝতে পারছো?তাদের আদরের কন্যা তাদের কাছে বিষয়টি লুকিয়েছে।আমি কি করব? বুঝতে পারছি না।

অর্পণের কথা শুনে রাবেয়া চমকে পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা সাফিন এবং তার বিবি মাসুদা মুখ দেখে তব্দা খেয়ে উঠে।কিছু বলার আর বোঝার বাকি নেই।তারা সবটা শুনতে পেয়েছে।দু’তলায় উপরে গালে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে তন্নী কাঁদছে।দ্বিতীয়বারের মতো অর্পণ এর রুমে যখন ঢুকে এবং জোর করে তার মনের সব কথা ব’লতে নেয়।তখনই অর্পণ ঠাসস করে এক গালে থাপ্পড় মেরে দিয়েছে।এতখন ভাই বকেছে, মেরেছে।এখন বাবা,মা তার পুরো ব্যাপারটা শুনেছে।আজ তাকে আস্ত রাখবেনা।ভয়ে ঢোক গিলো।

সাফিন তালুকদার মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারে বসে পড়েন।কিন্তু মাসুদা তালুকদার চুপটি করে ছিলেন না।মেয়ের অপর গালে শক্ত করে কষিয়ে চড় লাগান।আর তাতেই তন্নী উড়মুড়ু করে পরে যেতে নিলেই রাবেয়া ধরে ফেলেন।

মাসুদা কি করছো তুমি?এতো বড় মেয়ের গায়ে কেউ হাত তুলে?শান্ত হও।

ভাবি কি করে শান্ত হব?এই মেয়েকে বিদেশে পাঠালাম পড়তে।আর তিনি প্রেম করে বিয়ে বাচ্চা অবধি সব করে এখন এসেছে পরিবারকে জানাতে।সব যখন তোদের মন মতো করবি।তাহলে আমাদের এখন কেন বলেছিস?যা তুই চলে যা।তোর মতো মেয়েকে আমি চাই না।অসভ্য মেয়ে,মা,বাবার সম্মান নষ্ট করে এখন সাধু সাজা হচ্ছে। ইচ্ছে করছে!তন্নীর দিকে মারার জন্য হাত আবার উঠে।তন্নী ভয়ে বড় চাচীর পিছনে মুখ লুকিয়ে নেয়।

মাসুদা শান্ত হও।এভাবে রাগারাগি করে সমস্যা সমাধান হবে না।ওরা ভুল অবশ্যই করেছে।এমনকি তন্নী গর্ভবতী।এটা চাইলেও অস্বীকার করা যাবে না।আমি তোমার ভাইকে খবর পাঠিয়েছি।সে কাল সকালে বাড়িতে আসছে।সবাই মিলে একটা সিদ্ধান্ত যেতে হবে।আর তাছাড়া দোষ দু’জনের তাই দুই পরিবারকে এটার সমাধান করতে হবে।

ভাবী ওরা কী মানবে?

কেনো মানবে না?সাফিন তুমি আইনের রক্ষক।তুমি শুধু মেয়ে বাবা হয়ে নয়।একজন পুলিশ অফিসার হয়ে ভাব।তারা দু’জন প্রাপ্ত বয়স্ক।এদের নিজস্ব মত রয়েছে।অন্তর এবং তন্নীর এটা আবেগের বয়স নয়।আর যা করার তারা অলরেডি করে ফেলেছে।এখন আমাদের দুই পরিবারের মন সায় না দিলেও মানতে বাধ্য হব।আর যে আসছে তাকেও অবহেলা করতে পারি না।এতে তার তোও কোনো দোষ নেই।আমাদের চোখে তন্নী,অন্তর দোষী হলেও শিশুটি নিষ্পাপ।তার সুস্থভাবে জম্ম এবং পৃথিবীর আলো দেখার অধিকার আছে।

১২৬.
এক সপ্তাহ পর…
আজ তালুকদার বাড়িতে ছোটখাটো বিয়ের আয়োজন হয়েছে।বিয়ে হচ্ছে তালুকদার বাড়ির মেয়ের।অসীম তালুকদার দিহান সাহেবকে সবটা ব’লেন।এবং পরবর্তী দুই পরিবারের মতেই বিয়ে হচ্ছে।জেফিন এর বিয়েতে সায় আছে।গরিব চাষা মেয়ে রেখে জাতের মেয়ে একটা ছেলে চয়েস করায়।তিনি গায় গুই প্রথমে করলেও পরে আপত্তি করতে পারেননি।

এইদিকে বিয়ের আসরে বর বেশে বসে আছে অন্তর,এবং কনে তন্নী।অর্পণ গম্ভীর মুখে সবটা করছে।দুই পরিবারের সামনে বিয়ের আনুষ্ঠানিক শেষ হতেই গেইটের সামনে আসে।পুতুল আজ তালুকদার বাড়িতে পা রাখেনি।দূরে দাঁড়িয়ে বিয়ের সবটাই দেখলো।ছেলে,মেয়ে কবুল বলতেই সে কয়েক পলক তাকিয়ে চলে যেতে নিলেই অর্পণের সামনে পরে গেলো।পুতুলকে দেখে অর্পণ পকেটে ফোন রেখে সামনে ঘুরে এলো।

পু.তু.ল তু.মি!

পুতুলের চোখ দুটো গম্ভীর আর মুখ শক্ত।ঠোটেঁ কোণে তাচ্ছিল্যের হাসি।এই হাসিতেই ব’লে দিচ্ছে তার না হওয়া বর আজ তাদের গ্রামের মেয়েকে ঘরে তুলছে।অবশ্য কোটি টাকার সম্পত্তির মালিকের মেয়েকে বিয়ে অনায়াসে করা যায়।কিন্তু গরিবের মেয়েকে নয়।গ্রামের লোকের কথা শুনে প্রথমে বিশ্বাস না হলেও এখন নিজ চোখে দেখতে পাওয়া সেটা অস্বীকার করবে কি করে?অর্পণ তালুকদার তার বোনকে খুশিমনে বিয়ে দিচ্ছে।সবটা দেখতে পেয়ে ওহ পুতুল চুপ।চুপচাপ গাড়িতে উঠে দুই ভাইকে নিয়ে বাড়িতে ফিরে গেলো।এইদিকে অর্পণ কিছুটা হলেও বুঝতে পারছে।তাঁকে আবার ভুল বুঝলো।গাছের সাথে হাতটা জোর আ*ঘাত করে বলল,শিট,শিট।হাত কে*টে র*ক্ত পড়ছে।অর্পণের সেইদিকে খেয়াল নেই।

বোনকে বিদায় দিতে দিতে অন্তরের পাঞ্জাবি গলারটা ঠিক করতে করতে বলল,

আমাদের দূর্বল ভেবো না দুলামিঞা।আমরা মোটেও দূর্বল নই।তোমার কারণে যদি কোনোদিন আমার বোনের চোখ থেকে এক ফোটা পানি ঝরে।তাহলে সেই দিন বোঝাবো অর্পণ কি চিজ?এটাকে হুমকি ভাবো।কিংবা উপদেশ।

স্বাধীন মেয়েকে হুড়মুড়িয়ে ঘরে ঢুকতে দেখে ওহ চুপ রইলো।গ্রামের লোকের কথা তাহলে মিথ্যে নয়।তাদের সেই বরযাত্রী এখন তালুকদার বাড়ির মেয়ে জামাই।তারা বন্ধু থেকে আত্মীয়তে রূপান্তরিত হয়েছে।

পুতুল নিজের মনকে শক্ত করতে বিছানার চাঁদর খামচে ধরেছে।নিজেকে স্বাভাবিক করতে সিদ্ধান্ত নিলো এই গ্রামের মাটিতে সে আর থাকবে না।সে কাপড়ের ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছে।সকাল হতেই নিজ আসল গন্তব্যে চলে যাবে।শুধু মামাকে জানিয়েছে।

সকাল বেলা পুতুল ঢাকা কমলাপুর রেলস্টেশনের থেকে নেমে গেলো।একটা সিটে ব্যাগটা রেখে তার পাশে নিজে বসে ভাবতে লাগল।এরপর শুরুটা কোথা থেকে করবে?চোখ বুঝতেই মামার কথাগুলো মনে করে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে।যেখানে তার ভবিষ্যৎ পরে আছে।

এইদিকে অর্পণের রাতে ঘুম হয়নি।ভোর হতেই রুহিতপুর গ্রামে ছুটে আসে।আর আসতেই শুনতে পায় পুতুল এই গ্রাম কাল রাতেই ছেড়ে চলে গেছে।কিন্তু কোথায় যাবে?শহরে তার কে আছে?অর্পণ ঢাকায় বাইক নিয়ে ছুটে চলে।আষাঢ়ের বৃষ্টিতে তার পুরো শরীর ভিজে একাকার সেই দিকে মন নেই।মুখে বিরবির করছে।পুতুল ব’লে।

অপরদিকে পুতুল ঢাকা কমলাপুর রেলস্টেশনে বসে আছে।আষাঢ়ের বৃষ্টিতে সে-ও ভিজে একাকার।কিন্তু বৃষ্টিটা আজ তার গায়ে লাগছে না।সে অন্য চিন্তায় ব্যাস্ত।অর্পন নিজের লোকের মাধ্যমে জানতে পারে পুতুলের বর্তমান ঠিকানা।সেখানে পৌঁছে বাইক থেকে নেমে বগিতে এবং সব জায়গায় চেক করতে থাকে।আর অবশেষে ভালোবাসার মানুষটিকে পেয়ে যেতেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে।

পুতুল চোখ মেলে তাকাতেই অর্পণকে সামনে দেখতে পায়।তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই অর্পণ তার হাত ধরে ফেলে।

পুতুল তার হাতটা ছাড়িয়ে নিতে হাত মুচড়ায়।কিন্তু আজ অর্পণ ওহ তাকে ছাড়ছে না।পুতুলের হাতটা শক্ত করে ধরেছে।

অতিরিক্ত বৃষ্টি জন্য সবাই দূরে দাঁড়িয়ে আছে।আশেপাশে কিছুর দেখা মিলছে না।পুতুল মুখ ঘুরিয়ে সামনের রাস্তার প্রানে তাকিয়ে।

পালিয়ে যাচ্ছো।আমি তোও জানি আমার আদূরিনী বউ পালিয়ে যেতে পারে না।সে আর পাঁচটা মেয়ের মতো ভীতু ডিম নয়।সে সাহসী। সে লড়তে জানে।সে আমার আদূরনী।আমার ভালোবাসা।ইয়েস,আমি আমার সাহসী এই ধানিলংকাকে ভালোবাসি।তাকে নিজের করে পেতে চাই।একটিবার শুধু মাএ একটিবার বিশ্বাস করে আমার এই হাতটা শক্ত করে ধরে দেখো।কথা দিচ্ছি তুমি ঠকবে না।আমি আছি তোমার কাছে।তোমার ছায়া হয়ে।শুধুমাত্ত তোমারই জন্য।

কালো বোরকা ভিজে আছে।তার সাথে পুত্তুলের চোখের পানি।সুর্দশন পুরুষটি তার থেকে উঁচু হওয়া তার কপালের চুইয়ে পানির ফোটাগুলো তার কালো বোরকা আবরণে মুখ বরাবর পড়ছে।পুতুল নিজের হাত ছাড়াতে না পেরে মাটিতে বসে পড়ে।অর্পণ তবুও পুতুলের হাতটি ছাড়ে না।বরং পুতুলের বরাবর বসে,উল্টো ওপর হাতটির সাহায্য পুতুলের গালে হাত রাখে।

প্লিজ চলে যেওনা।আমি নিঃশ হয়ে যাবো তুমি বিহীন।আমি তোমাকে ছাড়া একটা মুহূর্ত বাঁচতে পারব না।বিকজ আই লাভ ইউ।আই রেয়লি লাভ ইউ সো মাচ।

চলবে…

চক্ষে আমার তৃষ্ণা পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯

0

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৩৭
১১৫.
অর্পণের পাগলামি দেখে অসীম তালুকদার ছেলেকে টেনে নিয়ে যেতে চাইলেন।কিন্তু অর্পণ এখান থেকে যেতে চায়না।সে যাবে না।

তার পুতুল যে এখনো তার ডাকে সারা দেয়নি।সে যাবেনা।তিনজন পুরুষের সাথে দস্তা দোস্তি করে হাফিয়ে যায়।মাটিতে দুই পা ভাজ করে বসে পড়ে।ছেলের এই কষ্ট মেনে নেওয়া যাচ্ছে না।

এইদিকে রেনুর ঘরের দরজা মিলন,সাজু এসেই আরো আগেই খুলে দেয়।রেনু দরজা খোলা পেয়ে বের হতেই বাড়ির অবস্থা দেখে দরজার সাথে এলিয়ে পরে যান।মিলন,সাজু মায়ের কোমড় জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।

ওরা আমার আপুকে মেরে ফেলেছে।আমার আপু আর নাই।ওই দুষ্ট লোকগুলো খুব খারাপ।খুব খারাপ।আমি এদেরকে ঘৃনা করি।মিলনের কথায় কোনো প্রতি উত্তর রেনু করেনি।ছেলেদের কে সরিয়ে ভীরু পায়ে উঠোনে পা রাখে।স্বামীর কাঁধে হাত রাখতেই হাতটা রক্তে লাল হয়ে যায়।

এই শুনছেন।আপনি এভাবে মরার মতো পড়ে আছেন কেন?আপনি তাড়াতাড়ি উঠুন।ওরা আপনার পুতুলকে মেরে ফেলবে।জলদি যান।ওকে নিয়ে আসুন।ওহ খুব কষ্ট পাচ্ছে।আপনি তোও পুতুলের বাপ।তাইলে বাপের সামনে কি করে মেয়েকে ছিনিয়ে নিল?কি করে?আপনি কেন প্রতিবাদ করলেন না?ওদের কাছ থেকে কেন আমাদের মেয়েকে রক্ষা করতে পারলেন না?কেন আমার মেয়েকে বাড়িতে এসে পুড়িয়ে মারবে।কেন?উঠুন আপনি।আপনার এসব নাটক দেখার সময় আমাদের নেই।আপনি মাটিতে পড়ে ভং করবেন।আর আমি চুপচাপ দেখব।এসব চলবে না।আপনি আমার মেয়েকে নিয়ে আসুন।কোথা থেকে নিয়ে আসবেন আমি জানি না?শুধু জানি আমার মেয়ে ফিরে আসবে।তার স্বপ্নটা এখনোও অসম্পূর্ণ।তার এত বছরের সাধনা এভাবে মিথ্যে হতে পারে না।কি হলো আপনি উঠেন না কেন?বুঝছি।আপনি ভালো কথা শুনবেন।দাঁড়ান দেখাচ্ছি মজা।রেনু রান্না ঘর থেকে কলসি নিয়ে এসে সবটুকু পানি স্বাধীনের মাথায় ঢেলে দিল।

মাথায় হালকা আঘাত লাগায় রক্তগুলো পানির সাথে ধুয়ে যাচ্ছে।চোখে পানি পড়তেই জ্ঞান ফিরে আসে।কিন্তু স্বাধীন কোনো কথা ব’লে না।একধ্যাণে পুড়ে যাওয়া ঘরটার দিকে তাকিয়ে রয়।চোখের সামনে ছোট্ট পুতুলের মুখটা ভেসে ওঠে।তার পুতুল হাঁসছে,খেলছে,দৌড়াচ্ছে।ওই তো,দুই পাশে লাল ফিতা দিয়ে দুটো বেনি করা।সে বাড়ির আঙ্গিনায় বড় আম গাছটার নিচে দাড়িয়ে কি সুন্দর আম কুরাচ্ছে।আবার সেই আম ওড়না আঁচলে তুলে নেয়।ওড়নায় ভরে গেলে বড় বালতিতে রাখতে যায়।আম রাখার সময় নিজেও একটা কাচা আমে কামড় বসিয়ে দিলো।টক আমে তার দাঁত সিরসির করে।তবুও আম খাওয়া বন্ধ হয়নি।মনের সুখে আম খেতে খেতে অপর একটি আম মামার দিকে এগিয়ে দিচ্ছে।যার মানে মামা তুমি খাবে।স্বাধীন না ব’লে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেই সে হাসতে হাসতে হাওয়া মিলিয়ে গেলো।

পুতুল,তার আম্মা কই?মাটি থেকে উঠতে গিয়ে আহহহ করে উঠল।তার পুরো শরীরের মারের দাগ।সে ব্যাথা সয্য করে,দাঁড়ানো চেষ্টা করে।ডাকতে থাকে।

-; আম্মা।আম্মা আপনি কই?আমার পুরো শরীরের মারের দাগ।আম্মা আপনি দেখে যান।আপনার ছেলেরের গ্রামের কিছু পাঁজি লোক মারছে।আমি হাঁটতে পারছি না।আমার খুব কষ্ট হচ্ছে আম্মা।পুরো শরীর ব্যাথায় নীল হয়ে আসছে।আপনি তেল গরম করে আপনার মামীর কাছে দিয়ে যান।সে আমায় যেন ভালো করে মালিশ করে দেয়।আপনি তোও জানেন।দিনের পর দিন বিছানায় পড়ে থাকতে পারবো না।হার খাটাখাটুনির মানুষ আমি।দিন রাত যার পরিশ্রম করে ঘাম ঝড়ে।হালাল পথে অর্থ উর্পাজন করে।সে কি সুয়ে,বসে দিন কাটাতে পারে।আম্মা।আম্মা।ওহ আপনিও আমার কথা শুনে আসছেন না।ঠিক আছে আমি এভাবেই মাটিতে পরে থাকব।যতখন না আপনি আপনার ছেলেকে ঘরে না পাঠাচ্ছেন।ততখন পর্যন্ত আমিও ঘরে যাব না।আমি এভাবে পরে মরে থাকব।যাব না।কোথাও যাব না।

আমমম্মা।

স্বাধীনের চিতকারে রাতটা আরো ভয়াবহ হচ্ছে।রেনু স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে শব্দ করে কাঁদছে।তার পাশে দুই ছেলে কাঁদছে।তাদের কারো দিকে তার মনযোগ নেই।শুধু পুতুলকে খুজঁছে।স্বাধীন আবারও জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেই অসীম তালুকদারের কথামতো জিহান,রিহান তাকে হাসপাতালে নিয়ে ছুটে।অসীম তালুকদার ছেলের পাগলামি সামলাতে পারছেন না।এইদিকে রাবেয়া তার ফোন ধরছে না।কি করবেন মাথা কাজ করা করছে না?কোনোরকম ভাইকে ফোনে সবটা বলতেই সে নিজেই ফোন করে গ্রামের থানা থেকে লোক পাঠাচ্ছেন।সাফিন তালুকদারের কথামতো পুলিশ আসতেই আসতেই সকালের আলো ফুটছে।ফজরের আজান কিছুখন আগেই শেষ হয়ে গেছে।প্রতিদিনের মতো পুতুল আজ ভাইদের ডাকেনি।তাদের নামাজের জন্য বিরক্ত করেনি।আর না নিজে অযু করে নামাজের জন্য দাঁড়িয়েছে।অথচ আজ পুতুল কাউকে না ডাকলেও সবাই জেগে আছে।ভোরের আজানে তাদের নড়চড় নেই।পুলিশ এসেই পুরো বাড়িটা দেখছে।আগুনে পুড়ে যাও ঘরটাতে ভালো করে পরখ করে ফোনে কাউকে তথ্য দিচ্ছে।সেই তথ্য মতাবেগ পুলিশ অফিসার এগিয়ে আসে অসীম তালুকদারের দিকে।থানার ওসি তার কথাগুলো ব’লে চলে যান।অসীম তালুকদার ছেলের শুকনো মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন।অর্পণের পাগলামির জন্য ডাক্তার এই বাড়িতে আনতে খবর নিয়েছিল।কিন্তু,ছুটির দিন হওয়া ডাক্তার নেই।স্বাধীনকে যে ডাক্তার দেখানো হয়েছে।সেই ডাক্তার সাহেবকে এই বাড়িতে এনে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে দেন।অর্পণ গাড়িতে মরার মতো পরে আছে।ঘুমের মেডিসিন শেষ হলেই আবার পাগলামি করবে।চোখের সামনে ছেলের কষ্ট দেখে তার বুক ফাটছে।তাহলে ওই মেয়েটিকে যারা হারালো।তাদের কেমন হচ্ছে?সেইসব ভাবতেই ভিতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হয়।মনে মনে সিদ্ধান্ত নেন।পুতুলের অন্যাকারীদেরকে শাস্তি দিবেন।ওদেরকে উচিত শিক্ষা দিয়ে দিবেন।

১১৬.
আমাদের জীবনে কখনো আঘাত না পেলে না-কি ঘুরে দাঁড়ানো যায় না।আঘাত পায় ব’লে মানুষ নিজেকে সূধরে নেয়।আর এই সূধরে নেওয়াটা মানুষের ধর্ম জ্ঞান হয়ে উঠে।নিজেদের ভুলগুলো সংশোধন করে সামনে চলার দিনগুলোকে আরো সুন্দরময় গড়ে তোলে।রাবেয়া অপারেশন রুম থেকে বের হয়ে যায়।ওটির পোশাক চেঞ্জ করে একটা কেবিনে বসেন।একটি নিষ্পাপ মেয়েকে নিজের চোখের সামনে পুড়তে দেখবেন।তা মানতে খুব কষ্ট হচ্ছিল।ছেলে যাকে ভালোবাসে তাকে একটিবার দেখার শখ জেগেছিল।ভাগ্যিস দেখতে গিয়েছিলেন।তাই তো এই ছোট গ্রামে পা রাখতেই শুনতে পায়।এক অসহায় মেয়ের কান্না।যা তার মতো নরম মনের নারীর সর্বঅঙ্গ কাঁপিয়ে তুলে।মাথায় শুধু একটা চিন্তা ছিল।এই মেয়েটিকে বাঁচাতে হবে।মেয়েটির গল্প এভাবে অসমাপ্ত হতে পারে না।তার লড়াই মাঝ পথে কেন এভাবে থেমে যাবে।সে তো কোনো অন্যায় করেনি।তাহলে তাকে কেন বিনা অপরাধে শান্তি পেতে হবে।যারা দোষী তাদেরকে এটার মূল্য দিতে হবে।তার আগে এই আগুন পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়ার আগে উদ্ধার করতে হবে।রাবেয়া ঘরের পিছনদিক দিয়ে পুতুলকে অনেক কষ্টে বের করতে গিয়েছিল।কিন্তু পিছনে জামার শেষ পাড়ে আগুন লাগতেই কোনো দিক দিশা না পেয়ে পুতুলকে পানিতে ধাক্কা দেন।পুতুল যখন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে ব্যাস্ত।তখন রাবেয়া তাকে বাঁচিয়ে নেন।চারদিকের স্বরগোলে,হৈচৈ কেউ পুতুলের পানিতে পড়ার শব্দটা খেয়াল করেনি।গায়ের কাপড় ছিঁড়া।গ্রামের মহিলারদের টানাটানিতে হয়তো তখন ছিড়ে গেছে।তার ওপর শীতের শেষ সিজনের ঠান্ডা পানিতে পরে যাওয়া কাপাকাপি শুরু,আর দেখতে একদম বাজে লাগছিল।পুতুল পানি থেকে উঠতে গিয়ে টের পায় তার একহাত ভেঙে গেছে।প্রচন্ড ব্যাথা হচ্ছে।রাবেয়া নিজের গায়ের চাঁদর দিয়ে পেচিয়ে পুতুলকে বুকে টেনে নিলো।পুতুলের অবস্থা খারাপ দেখে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নেওয়া হয়।তাকে নরমাল বেডে রেখে টিটমেন্ট করে।অন্য ডাক্তারের আন্ডারে দেওয়া হয়।রাবেয়ার পরিচিত ডাক্তার বান্ধবীকে পুতুলের পুরো ঘটনা বলতেই।তিনি অবাক হন।গ্রামের মানুষ এতটা ডেস্পারেট কেন?জীবন্ত মানুষ পুড়িয়ে মারবে। মাই গড।ভাবতেই কলিজা কেঁপে ওঠে।

পুতুলের জ্ঞান ফিরে আসতেই নিজেকে হাসপাতালের বেডে দেখতে পায়।নিজের মৃত্যুকে এত কাছ থেকে দেখে হার মেনে নিয়েছিল।কিন্তু মা,মামা,মামীর এত কষ্ট এত পরিশ্রম।তার পথে পথে বিপদের সাথে লড়াইয়ের গল্পটা এভাবে ইতি টানবে।মানতে কষ্ট হচ্ছে।সব যখন চোখের সামনে ভেসে ওঠেছিল।পুতুল তখন নিজের মনোভাব পরিবর্তন করে।সে কেনো মরবে?সে মরবে না!তার বাঁচার অধিকার আছে।হার মেনে নেওয়ার নাম জীবন নয়,লড়াই করে বেঁচে থাকার নামই যখন জীবন।তখন সে বাঁচবে।এতো কষ্ট করে তীরে এসে তরী ডুবানোর কথা সে ভাবলো কি করে?সে বাঁচবে।আর সেটা বাঁচার মতোই বাঁচতে হবে।যারা তার সাথে অন্যায় করেছে।তাদের কেউ কৈফিয়ত দিতে হবে।পুতুল এদের কাউকে ক্ষমা করবে না।তার সাথে ওই অর্পণ তালুকদারের খবর আছে।তার হিসাবে অর্পণ তালুকদারও তার হাত থেকে রেহাই পাবেনা।যে মিথ্যে কলঙ্ক তার গায়ে লেগেছে তার খেসারত তাকেও গুনতে হবে।

চলবে….

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৩৮
১১৭.
পুতুল জীবনের কঠিন সময়ে দাঁড়িয়ে আছে।যেখানে কে তার আপন।আর কে তার পর বুঝতে চাইছে না।মা,বাবা-র প্রেমের বিয়ে ছিল।কিন্তু সংসার বেশি দিনের হলো না।মাস কয়েক ব্যাবধানে হেরে গেলো রাজিয়ার দেখা স্বপ্নের ঘর।সেই কাল বৈশাখী ঝড়ের মতো লন্ডভন্ড হলো তার জীবন।তা আর ঠিক হলো না।রাজিয়ার মতো আর কোনো মেয়ে যেন ভালোবেসে ঠকে না যায়।আর কোনো মেয়ে তার স্বপের পুরুষকে পাওয়ার আশায় মা,বাবার সম্মান কে ধূলিসাৎ না করে দেয়।যদি করে তা কিন্তু আহামরি সুখের হয় না।কিন্তু আমাদের মেয়েদের আঠারো পূর্ণ হওয়ার আগেই যে সময়টা যায়।তাতে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি।পর পুরুষের মিষ্টি কথায় ভুল পথে পা দিয়ে দেই।জীবনের মোড়টা তখনই পরিবর্তন হয়।মা,বাবার কোনো কথা তখন আর ভালো লাগে না।এক সময় মনে হয়।তারাই আমাদের শত্রুর।কি অদ্ভুত না।যে মা নয় মাস সন্তানকে গর্ভে নিলো।তার কথা ভাবার সময় নেই।যে বাবা তাকে মানুষের মতো মানুষ করতে দিন,রাত পরিশ্রম করছে।মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে।তার জন্য মায়া,সহানুভূতিটুকু তখন কাজ করে না।প্রেমের জোয়ারে সে ভেসেছে।তার সাথে অনাকাঙ্গিত কিছু না হওয়া পর্যন্ত থামবে না।তারপর একদিন ভালোবাসার মানুষটি তাকে মাঝ পথে ফেলে চলে যায়।তখন নিজের মধ্যে ডিপ্রেশন,হতাশা ছাপ ফেলে।নিজেকে শেষ করে দেওয়ার ইচ্ছে যাকে।নিজের মৃত্যু চাই।অবশেষে নিজ বাড়িতেই নিজের ছোট বেলা মনে পড়ে না।তার বাড়িতে যেখানে ছোট থেকে সে হেঁসে খেলে শৈশব,কৈশর কা*টলো।তার সেই প্রিয় ঘড়টিতে একাত্বিবোধ কিছু সময় কাটতেই।নিজের বিবেকের কাছে হেরে গিয়ে গলায় ওড়না বসিয়ে মারলো টান।পায়ের নিচের চেয়ারটা লাথি মারতেই সেটা ঘরের এক কোণে পরে রইল।ফ্যানের সাথে তার প্রিয় রঙিন ওড়না ঝুলছে।তার সাথে নিজের জীবনটা সেখানেই আ*টকে।নিশ্বাস নিতে না পেরে চোখ উল্টে আসলো।হাত,পা তখন ছোড়াছুড়ি করছে।সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছে কেউ তার ঘরের দিকে ছুটে আসুক।আর তাকে বাঁচিয়ে দিক।কিন্তু কেউ আসলোনা।সবাই নিজেদের কাজ নিয়েই ব্যাস্ত।মা,বাবা জানলো না।তার আদরের কলিজাটা ওই ঘরের দরজা, জানালা বন্ধ করে নিজের জানটা দিয়ে দিয়েছে।যখন জানলো।যখন দেখলো।তখন কি হলো?

তখন,তখন মা,বাবার চিতকারে বাড়ির দেয়ালটাও কেঁপে ওঠে।যে সন্তানকে মা,বাবা বিশ’টা বছর লালন-পালন করলো।মানুষের মতো মানুষ বানাতে চাইলো।সেই সন্তান দুইদিনের প্রেমের জন্য।তাদের বিশটা বছরের
ভালোবাসা।তাদের স্নেহ,মায়া,মমতাকে লাথি মে’রে চলে গেছে না ফিরার দেশে।তবুও মা,বাবা সন্তানের মৃত্যু বছরের পর বছর ঘুরে যায়।তারা ভুলতে পারেনা।নামাজের শেষে মোনাজাত আল্লাহ দরবারে তাদের একটাই চাওয়া।তাদের সন্তান যেন ভালো থাকে।তাদের আযাব,তাদের কষ্ট যেন মা,বাবা নিজের করে চায়।আত্মহত্যা কখনোই সমস্যার সমাধান নয়।আত্মহত্যা করলে শুধু এই সুন্দর পৃথিবী হারাবে না।তোমার আখিরাত,তোমার জান্নাত হারালে। আত্মহত্যা জগন্য।যা আমাদের সবকিছু ঠিক করে দিতে নয়।বরং নিঃশেষ করে দেয়।আরে আত্মহত্যা কেনো করবে?যার জন্য করলে দিন শেষে দেখা যায় সে অন্য কারো সাথে খুব ভালো আছে।মাঝ থেকে তোমার মা,বাবার বুক খালি হলো।যে তোমার ভালোবাসা মাঝ পথে ছেড়ে চলে যায়।তাকে দেখিয়ে দেও।তাঁকে ছাড়া তুমিও দিব্যি ভালো আছো।আর কারো জন্য না হোক।অন্তত যাদের জন্য তুমি এই দুনিয়ায় আসলে তাদের মুখের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থাকো।মা,বাবা-র দিকে মায়া,এবং হাসি নিয়ে তাকালেও সুন্নত আসে।তাদের জন্য নিজেকে ভালো রাখো।এবং নিজেকে শক্ত রাখো।যাতে পরিবর্তিতে তোমাকে কেউ দূর্বল ভেবে আঘাত করা তোও দূরের কথা।তোমার ব্যাপারে কিছু ভাবতে গেলেও দশবার চিন্তা করে।

পুতুলের চোখে এক অন্য সূচনা দেখা যায়।পুতুল নিজেকে একটু একটু করে শক্ত করছে।নিজের সাথে করা অন্যায় জবাব সে ঠিকই ফিরিয়ে দেবে।সেটা সময়ের সাথেই দিবে।পুতুল বাড়িতে ফিরে এসেছে।সেই ঘটনার আজ পনেরো দিন হতে চলল।পুতুল বেঁচে আছে।এবং সুস্থ আছে।এতটুকুতেই বাড়িটায় আবারও প্রাণ ফিরে আসে।সবার মুখে হাসি ফুটে।তাকে নিয়ে মামা,মামী,ছোট তিন ভাইয়ের আহ্লাদে শেষ নেই।কিন্তু মামাকে নিজের সুস্থতার খবরটুকু ব’লে সেই যে ঘরে খিল দিয়েছে।আর বের হয়নি।নিজের ক্যারিয়ার গড়তে পুরোটা সময়ই বইয়ের মধ্যে দিয়েছে।সামনে তার এইচএসসি পরীক্ষা।এরপর তার স্বপ্নের দিকে আরেক পা এগিয়ে যাওয়া।

পুতুলের মনে কি চলছে তা রাবেয়া জানে না।শুধু এতটুকু জানে মেয়েটা বাঁচুক নিজের মতো করে একটু বাচুঁক।তারপর সময় করেই না হয় ছেলের জন্য হাত চেয়ে নিবেন।কিন্তু অর্পণকে হারানোর ভয়টা মনের মাঝে গাড়ো হয়েছে।তাইতো অসীম তালুকদার ছেলের জন্য পুতুলের কাছে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব রাখতেই সে বেঁকে বসে।এসব বিয়ে সাদি সে করবে না।আর যখন শুনলো অর্পণ তালুকদার তাকে ভালোবাসে।সেটা আজ থেকে নয়।অনেক বছর ধরে তখন পুতুলের বিবেক নাড়া দেয়।একে তোও বিয়ে করবে না।তার ওপর প্রেমের বিয়ের কথা, প্রশ্নই আসে না।তখনই সাফ সাফ না করে দেয়। অসীম তালুকদার পুতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

আম্মু আপনাকে জোর করার সাধ্য আমার নেই।আমি শুধু আমার ছেলের দিকটা ভেবেই বলেছিলাম।আপনার দিকটা একবারও ভাবা হয়নি।আসলে মেয়ের বাবা কখনো হয়নি তোও।তাই বুঝতে পারিনি।একটা মাত্র ছেলে।তার কষ্টটা চোখে দেখতে পারছিলাম না।তার কান্না,তার কষ্ট,তার আপনাকে হারানোর ভয়টা।আমি বাবা হয়ে মানতে পারিনি।তাই সেই তালেপুর গ্রাম থেকে ছুটে আসছি। চেয়ারম্যান হয়ে নিজের লোকের দ্বারা প্রস্তাব পাঠাই নিই।ভাবলাম ছেলের জন্য আর কিছু হোক বা না হোক।সে একটা ভালো কাজ করেছে।ওহ আপনার মতো নরম মেয়েকে ভালোবেসেছে।আপনার মতোও মেয়ে যে ঘরে যাবে।তার কষ্ট নামক জন্তনা থাকবে না।
আপনি হচ্ছে আসমানের চাঁদ।আপনাকে আমার বাড়ির পুত্রবধূ করে নয়।একটা মেয়ে করে নিয়ে যেতে চাই।যার অভিভাবক,যার মা,বাবা হওয়ার সৌভাগ্য আমাদের হবে।আমার ঘরে কোনোকিছুরই কমতি নেই।তবে হ্যা,একটা মেয়ের কমতি ছিল।কিন্তু আপনাকে পেলে সেই কমতি আর থাকবে না।আমার একটা মেয়ের বাবা হওয়ার যে ইচ্ছে, যে আপসোস ছিল!তা আর থাকতো না।কিন্তু আপনাকে আমি জোর করতে পারিনা।ছেলের জন্য খারাপ লাগছে।কিন্তু সয়ে নিব।ছেলে হয়তো একটু আকটু পাগলামি করবে।তবুও সমস্যা নেই মানিয়ে নিতে পারব।আজ পর্যন্ত কখনো কেউ আমাকে খালি হাতে ফিরিয়ে দেয় নিই।সেটা নিজ ব্যাবসার কাজে কিংবা মানুষের জন্য সমাজ সেবায়।আমাদের পারিবারিক বিজনেস আমাকে দুই হাতে উচ্চ শেকড়ে টেনে নিয়ে গেছে।সমাজ আর মানুষকে যেমন সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলাম।তেমনই তাদের ভালোবাসা,দোয়া আর সম্মান দুই হাতে কুড়িয়ে পেয়ে ছিলাম।কখনোই খালি হাতে ফিরিয়ে দেয় নিই।এই প্রথমবার কেউ আমাকে ফিরিয়ে দিচ্ছে।আর আমি চুপচাপ মেনে নিলাম।তবে মেয়ের বাবা না হওয়ার আপসোসের পাশাপাশি আরেকটা যোগ হলো।আমি আমার সন্তানের জন্য এই প্রথম কিছু দিতে পারলাম না।সে সব সময় বলতো তার একটা জিনিস চাই।প্রত্যেক জম্মদিনে এটাই তার সর্বপ্রথম ওহ সর্বশেষ বুলি হতো।আমি বলতাম কি চাও।কিন্তু সে বলতো সময় হোক চেয়ে নিব?আর আমি হেঁসে সায় দিতাম।আর আজ তার ত্রিশতম জম্মদিনে তার প্রিয় ভালোবাসার মানুষটিকে চাইছে।কিন্তু আমি তার বেস্ট গিফটটা দিতে পারলাম না।সে অপেক্ষায় থাকবে।কিন্তু তাকে বলার মতো শব্দ আমার মুখে আর আসবে না।তোমার নতুন জীবনের জন্য দোয়া রইলো।

অসীম তালুকদার নিরাশ হয়ে বাড়িতে ফিরে যাচ্ছে।অপরদিকে পুতুল তার যাওয়ার প্রাণে তাকিয়ে রইলো।মানুষটা তার কাছে এক মুঠো আশা নিয়ে এসেছিলো।দেখা করলো কালো পর্দার আড়ালেই দাঁড়িয়ে।কথাও বলল।কিন্তু তার পরবর্তীতে পুতুল নিজ লিখাটায়।তার বক্তব্য জানিয়ে দিতেই অসীম তালুকদারের মুখের হাসি কালো আঁধারে ঢাকা পরে।পুতুল নতুন করে সংসার নিয়ে ভাবতে চায় না।তার ওপর যাকে ঘৃনা করে তাকে ভালোবাসবে কি করে?আর ভালোবাসা সবার জন্য রঙিন হলেও পুতুলের কাছে তা শুধুই নীল বিষ।যার বিষে তার মায়ের মৃত্যু হয়েছিল।তাতে সুখ কম দুঃখের গল্পটা একটু বেশিই।আর এমন জীবন পুতুল চায় না।তাই তোও বাবার মতো লোকটা তার দূয়ার এসে হাত বাড়াতে চাইলো।মেয়ে ব’লে স্বীকৃতি দিতে চাইলো।তাকেই প্রত্যাখান করলো।পুতুল এসব প্রেমের মায়া জড়াবে না।সে তার স্বপ্ন নিয়েই ব্যাস্ত।

চলবে….

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৩৯
১১৯.
পুতুল বিয়ের জন্য অস্বীকার করেছে।রাবেয়া ভিতরে ভিতরে কষ্ট পাচ্ছে।কিন্তু স্বামী ও ছেলেকে বুঝতে দিলো না।অর্পণ নিজের রুমে এসে বসে পড়ে।ছোট নোট বুকে কলম দিয়ে লিখতে থাকে।

তোমার কাছে যেটা নীল বিষ।আমার কাছে সেটা আমারই ভালোবাসা।আমি জেনেবুঝে সেই নীল বিষ নামক প্রেমের বিষকে প্রাণ করেছি।সে আমার আর আমার ভালোবাসাকে গ্রহণ করতে চাইছে না।কিন্তু আমি একবার নয়।তোমার কাছে বারবার ছুটে যাবো।প্রেমে তোও মরেছি।তবুও তোমাকে পাওয়ার আশায় ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখবো।তোমাকে আমার মায়া পড়তেই হবে।সেটা হয়তো আজ কিংবা কাল।

রেনু তুমি এসব কি বলছো?তোমার মাথা ঠিক আছে।পুতুলের জন্য তালুকদার বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসছে।আর আমি জেনে শুনে এত বড় দামড়া ছেলের সাথে বিয়ে দিব।ওই ছেলে ঠিক সময় বিয়ে করলে এতদিনে বাচ্চার বাপও হয়ে যেতো।পুতুলের সাথে কোনোভাবেই যায় না।ছেলের কীর্তিকলাপ যতটুকু গ্রামের মানুষের থেকে শুনেছি।সে যে ততোটাও ভালো নয়।আর সবকিছু জেনে বুঝে আমি ওদের কাছে মেয়ে দিব।কখনো না।ভাগ্নীটা আমার আর তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত এবং মাথাটা আমিই ঘামাবো।তারা আজ এসেছে আমার মেয়ে নিজে প্রত্যাখান করেছে।ফির যদি আসে তবে কিন্তু আমিও ছেড়ে কথা বলবো না।সাহস কত!এত বড়ো ছেলের জন্য আমার মেয়ে চায়।দুনিয়ায় এত মেয়ে থাকতে আমার মেয়েকে কেন চোখে পড়লো?

আচ্ছা আপনি একটুও শান্ত হন।এত অল্প কথায় রাগ কেন করছেন?তাছাড়া আমাদের পুতুল কিন্তু রাজি হয়নি।তাহলে এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ আছে।পুতুল নিজের মতো সবকিছুই যদি গুছিয়ে উঠতে পারে।তাহলে আমাদের ওকে সার্পোট করা উচিত।ওরা কাজটাকে সম্মান দেওয়া উচিত।আর রইলো অর্পনের বয়সের কথা।হ্যা মানছি পুতুলের থেকে বয়সের গ্যাপটা একটুও বেশিই।কিন্তু আমি ওইদিন ওই ছেলেকে আমাদের মেয়ের জন্য যেভাবে কষ্ট পেতে দেখেছি।তাতে খারাপ কিছুই পায়নি।আর সবচেয়ে বড় কথা জম্ম,মৃত্যু,বিয়ে এসব ওপরওয়ালাই ঠিক করে রাখেন।সে ভালো জানেন কার সাথে কার জুড়ি লিখা হবে।আমি আসছি।রেনু নিজের কথাগুলো ব’লেই স্বামীর সামনে থেকে সরে পরে।স্বাধীন বউয়ের চলে যাওয়ার দিকেই তাকিয়ে বিরবির করে কিছু ব’লে চুপ হয়ে যায়।

পুতুলের গায়ে কলেজের ড্রেস।তার ওপর এপ্রোন পড়া।আজ থেকেই তার এইচএসসি পরীক্ষা শুরু।পড়াশোনা নিয়ে খুব ব্যাস্ত সময় পার করছে।বোর্ড পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগেই দ্বিতীয় তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে পুতুল পড়াগুলো মনে মনে রিভিশন দিচ্ছে।ওপর দিকে অর্পণ এক পলকে পুতুলের দিকে তাকিয়ে রয়।ছোট করে নিশ্বাস ফেলে চোখে কালো সানগ্লাস পরে পাশের ছোট চায়ের দোকানের ছেলেটিকে ডাকতেই সে হাজির।

জি,ভাইয়া।

ওর দিকে খেয়াল রেখো।কোনো সমস্যা হলে আমাকে সাথে সাথে জানাবে।আমি আজই ঢাকায় ফিরছি।ওর পরীক্ষা শেষ যে দিন হবে।সেই দিনই আমি ফিরে আসব।তারপরই হবে অর্পণের প্রেমের গল্প কাহিনি।আসছি।

১২০.

সময়টা মে এর শেষের দিক।পুতুলের পরীক্ষা আজ শেষ হয়েছে।আজ প্যাক্টিক্যাল মৌখিক পরীক্ষা এবং লিখিত খাতা জমা দিয়ে বাড়ির পথে ফিরে যাচ্ছে।ছয় সিটওয়ালা টমটমে বসেই চারদিকে সবুজের সমারোহ দেখতে দেখতে দূর থেকে বহুদূর গন্তব্যটি ছুটে চলছে।পিছনে বড় বড় গাছগুলো সারি সারি দাঁড়িয়ে আছে।পুতুলের সাথে আজ স্বাধীন রয়েছে।

স্বাধীন ভাবছে পুতুলকে মেডিকেল ভর্তি করাবে।কিন্তু অনেক টাকার ব্যাপার স্যাপার রয়েছে।এতদিন সব খরচই ভালোই সামলে নিয়েছে।কিন্তু এবার হয়তো আর বেশি টাকা যাবে।টাকা লাগলে লাগুক।মেয়ের স্বপ্ন নষ্ট হতে দিবেন না।প্রয়োজন পড়লে নিজের চাষের শেষ জমিটুকু বিক্রি করে দিবেন।ওটাই ছিলো বাপ,দাদার আমলের তেরো শতাংশ জমি।এক শতাংশ করে হলেও কমছে কম আড়াই লাখ টাকায় বিক্রি করা যাবে।স্বাধীন যখন চিন্তায় ব্যাস্ত তখনই টমটমটিকে অপর পাশ থেকে একটা গাড়ি এসে ধাক্কা দিতেই টমটমে থাকা যাত্রীরা হুড়মুড়িয়ে একজন আরেকজনের ওপর পড়ে গেলো।কেউ আবার হাত,পায়ে ব্যাথা পেলো।পুতুলের হাঁটু ছিলে সাদা সালোয়ার ওপর দিয়ে রক্ত ভেসে ওঠে।আবার স্বাধীন কপালে আঘাত পায়।কিন্তু মেয়ের হাতটা এক হাত দিয়ে শক্ত করে ধরেছে।আর ছাড়ার নাম নেই।হঠাৎ আগ্রমনে পুতুল চমকে উঠে।মামার দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে যায়।মামার কপালের তরল জাতীয় জিনিসটা হাতে তুলে নিতেই ভেসে ওঠে র*ক্ত।পুতুল জানালা দিয়ে বাহিরে মাথাটা বের করে কিছু বুঝতে গেলেই কেউ তাকেই দ্বিতীয় বার আঘাত মাথায় করতে হকিস্টিক উঠায়।পুতুল মাথায় টান দেওয়ার আগেই সে হকিস্টিকের লোকটির হাতে কেউ গুলিয়ে চালিয়ে দেয়।যাত্রীরা যার যার জান বাঁচাতে চলতি টমটম থেকে লাফিয়ে পড়ে।একেকজন পালিয়ে যায়।কিন্তু পুতুল আর তার মামা বের হওয়ার আগেই টমটম ছোট খালের মধ্যে পড়ে যায়।পুতুল বাম হাত দিয়ে মামার হাত ঘামছে ধরে।পুতুল আগেও সুস্থ হলেও স্বাধীনের শরীরের মারের দাগগুলো এখনো শুকায়নি।তার ওষুধ এখনো চলছে।সেই পুরনো ব্যাথার মধ্যে কপালে দ্বিতীয় আঘাত লাগাটা ভালো লক্ষ্মণ নয়।এইদিকে পুরো রাস্তা ব্লক হয়ে গেছে বাসে আগুন, রাস্তা মধ্যে যাকে সামনেই পাচ্ছে তাকেই দুবৃত্তরা আঘাত করছে।পুতুল কি করবে বুঝতে পারছে না?হাত পা,কাপছে।এদিকে স্বাধীনের রক্ত বন্ধ হওয়ার নামই নেই।পুতুল মামার রক্ত বন্ধ করতে নিজের সাদা হিজাবের এক অংশ খুলে মামার মাথাটা চেপেই ধরে আছে। নিজের চারদিকে এত উচস্বরগোল্লে পুতুলের জানটা বের হয়ে যাচ্ছে।পুতুল চোখ বন্ধ করে আল্লাহ নাম নিয়ে দোয়া পড়তে থাকে।

আর ইউ ওকে।

পুতুল চোখের পানি নিয়ে আঁখি পল্লব মেলে সামনে তাকাতেই দেখলো অর্পণ তালুকদার তাদের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।অথচ যে পুতুল,অর্পণ তালুকদারকে ঘৃণা করে।আজ তাকে দেখেই ভরসার সাহস টুকু ফিরে পায়।ঠোঁটের কোণে হালকা হাসি দেখা যায়।কিন্তু অর্পণের সেসবের খেয়াল নেই।পুতুলকে ঠিকঠাক দেখেই স্বাধীনকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে।নিজের গাড়ির পিছনে সিটে মামাকে বসিয়ে দিলো।পুতুলকে পিছনে মামার সাথে বসিয়ে গাড়ি টান দিলো।

অর্পণ কেবিনের বাহিরে পায়চারি করছে।কানে তার ফোন গুছে।সাদা পাঞ্জাবিতে হালকা ছোপ,ছোপ রক্তের দাগ।

হ্যালো ভাই,আমরা যা সন্দেহ করছিলাম।এটা তারই কাজ।

অপর পাশ থেকে কথাটি কানে আসতেই অর্পণের চেহারায় রাগ স্পষ্ট ফুঠে ওঠে।রাগী স্বরেই বলল,

হারামির বাচ্চাদের মরার জন্য পাখনা গজায়ছে।আমি যদি এবার গ্রামে ফিরি না।তাহলে একটাকেও ছাড়বো না।সাত হাত মাটির নিজে গেড়ে ফেলব।ওই রমিজ মেম্বার কি ভেবেছে?একটা অসহায় পরিবারের ওপর জুলুম একের পর এক অন্যায় করে যাবে।আর তাকে এমনই ছেড়ে দেওয়া হবে।ওকে আর ওর চামচাদেরকে গর্ত থেকে টেনে বের করতে কিন্তু আমার এক মিনিট লাগবে না।ফোন রাখ।

অর্পণ প্রথম ফোনটা কে*টে দিয়ে।দ্বিতীয় ফোনটা কাউকে করে বসে।ওপাশ থেকে রিসিভ করে কানে নিয়ে কেউ হ্যালো বলতেই,

অর্পণ বাজ গলায় চিতকার করে বলল,

হোম মিনিস্টার।তোমার পাগলা কুত্তাগুলোকে সামলাও।যদি তুমি তোমার কুত্তাগুলোকে সামলাতে না পারো।তাহলে আমাকে বলো।ভাদ্র’র মাসের কুত্তাগুলোকে কি করে পানিতে নামাতে হয়?তা আমি অর্পণ তালুকদারের খুব ভালো করেই জানা আছে।আমি এর আগেরবার সর্তক করেছি।কিন্তু এরপর কিন্তু কোনো সর্তকবানী থাকবে না।পূর্বের ইতিহাস পূর্ণরাবৃত্তি করার চেষ্টা করোনা।তোমার ছোট ছেলের রহস্য আমি কিন্তু খুব ভালো করেই জানি।আর এবার পূর্বের ইতিহাস পূর্ণরাবৃত্তি হলে বেলণার মাটিতে যেটা হয়নি।এবার সেটা রোহিতপুরের মাটিতে হবে।র’ক্তের খেলা তোমরা শুরু করেছো।আর শেষ যদি আমাকে করতে র’ক্তের ময়দানে নামতে হয়।তাহলে তোমার বংশের শেষ বাতি জ্বালানোর কেউ থাকবে না।

অর্পণের ধমকিতেই হোম মিনিস্টারের কপালে ঘাম জমেছে।তার শ্বাসকষ্ট শুরু হতেই ইনহোনাল মেশিন দিয়ে শ্বাস নিলেন।পাশেই তার পি এ খলিল দাঁড়িয়ে আছে।পকেট থেকে রুমাল বের করে স্যারের দিকে ঘাম মুছতে বাড়িয়ে দিলে।সেটা হোম মিনিস্টার জামশেদ উল্লাহ খান নিয়ে নেন।

স্বাধীনের মাথায় ব্যান্ডেজ করা হয়েছে।চোখ মেলে পুতুলকে সামনে বসে কাঁদতে দেখে উঠার চেষ্টা করেন।পুতুল হাত দিয়ে বুঝালো এখন উঠো না।শুয়ে থাকো।

আম্মা তুমি ঠিক আছো?পুতুল ইশারায় বলল।সে ঠিক আছে।এরমধ্যেই অর্পন ফোনে কথা বলতে বলতে নির্জন এক সাইডে চলে আসছে।তার কথা শেষ করে ফোন পকেটে ভরে কেবিনে পা রাখে।

মামা আপনি কেমন আছেন?

অপরিচিত ছেলের কথায় স্বাধীনের কপালটা কুঁচকে আসে।পরবর্তীতে এই ছেলে তাদের বাঁচিয়েছে।মনে পড়তেই বলল,ওহ।

আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।হঠাৎ বিপদে পড়ে কি করব যখন বুঝতে পারছিলাম না?তখন-ই আপনি এসে আমাদের বাঁচালেন।

আমাকে ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবেন না।আমি আপনার বয়সের অনেক ছোট।আমি আপনাদেরই গায়ের ছেলে।আর রইল বাঁচানোর কথা।সেটা মাত্র উসিলা ছিল।আল্লাহ চেয়েছিলেন ব’লে আমি ওখানে উপস্থিত হতে পেরেছি।বিপদ কখন,কার ওপর আসবে সেটা আমরা পূর্বে কেউ জানি না।বিপদকে সামনে দেখে ভয় পেয়ে গুটিয়ে যাওয়া ভীতুদের কাজ।আমি জানি আপনি একজন সাহসী।মনের সাহসী বড় সাহস।আর ভয় পেলেই মনের বাঘ’ই তারে আগে খায়।আমি আসছি।ভালো থাকবেন।অর্পণ শেষের কথাগুলো পুতুলকে ইঙ্গিত করে আড়চোখে তাকিয়ে ব’লে চলে গেছে।এইদিকে পুতুল হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে।নার্স পুতুলের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,আপনি আসুন আমার সাথে।আপনার হাটুতে রক্ত জমাট বেঁধে আছে।স্বাধীনকে ইশারায় ব’লে যেতে।পাশের কেবিনে নিয়ে তার পা ডেস্টিন করে দিতে দিতে নার্স বলল,

আপনার হাঁটুতে রক্ত জমে আছে।আগে বলেননি কেন?এমপি সাহেব না ব’লে তোও জানতেই পারতাম না।নার্সের কথায় পুতুল অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়।তারমানে সেই লোকটা তার খবরটা রেখেছে।

ডেসিন শেষ হতেই পুতুল বেড সিট থেকে নেমে যেতে নিলেই হাতে ছোট চিরকুট বাড়ি খায়।লাল কাগজের চিরকুট খুলতেই লেখাগুলো স্পষ্ট হয়।

প্রিয় আদূরণী ছোট্ট ছোট্ট খবর আমার নক দর্পণেই এখন থাকে।যাকে ভালোবাসি তার খবর টুকু রাখা আমার দায়িত্ব বলতে পারেন।তার ভালো থাকাতেই আমি ভালো আছি।আপনি আমার মন ভালো রাখার মিষ্টি মেডিসিন।

ইতি অর্পণ তালুকদার।

চলবে….

চক্ষে আমার তৃষ্ণা পর্ব-৩৪+৩৫+৩৬

0

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৩৪
১০৯.
স্বাধীন ভাই একটা ভালো প্রস্তাব আনছি।
স্বাধীন মাটিতে মরিচের চারা বুনছিল।মাথা উঁচু করে দেখে নিলো সবুর মিয়া আসছে।

কিসের প্রস্তাব?

কিসের আবার।বিয়ের প্রস্তাব।

বি.য়ে.র প্রস্তাব!

হ্যাঁ।

কিন্তু আমার তোও বউ আছে।সাথে বাচ্চা ফ্রি।আমি চার ছেলেমেয়ের বাপ।আমাকে মেয়ে দিবে কে?

আরে আপনার কথা কে বলে?আমি তোও আপনার মেয়ে পুতুলের জন্য প্রস্তাব আনছি।

তাহলে ওখানেই থেমে যাও।মেয়ে আমার এখনো ছোট।আঠারো হয়নি।

আরে কি যে কও না মিয়া।গ্রামের মেয়ের আবার আঠারো হওয়া লাগেনি।চৌদ্দ হলেই তোও মেয়ের বিয়ের জন্য উপযুক্ত।শুনোও স্বাধীন ভাই।ছেলের বড় বিজনেস আছে।জাপানে থেকে বিজনেস করে।আমাদের পাশের গ্রামের পোলা।বয়স বেশি না মাত্র পয়ত্রিশ বছর।আগে একটা বিয়া হইছিল।কিন্তু ডির্ভোস হইয়া গেছে।তার ঘরে পাঁচ বছরের ছেলে সন্তান এবং নয় বছরের কন্যা সন্তান আছে।ছেলে যেমন সুন্দর তেমনই ভদ্র।কিন্তু মা একটু অহংকারী।ওই টাকার গরমে আরকি পা মাটিতে পড়ে না।

সবুর মিয়া।মেয়ে আমি বিয়ে দিবো না।একবার যেহেতু বলেছি না।না মানে না।হ্যাঁ কিছুতেই হবে না।আর তুমি কোন সাহসে আমার মেয়ের জন্য ডির্ভোসি ছেলে।আবার দুই বাচ্চার বাপের জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসছো।

স্বাধীন মুখের ওপর না করতেই সবুর মিয়ার মুখ থেকে হাসি গায়েব।তার মুখ কালো হয়ে গেছে।মুখ কালা করেই বলল,

তোও তোমার মেয়ের জন্য এর থেকে ভালো প্রস্তাব পাইবা নিই।

শুনো,স্বাধীন ভাই,বোবা মেয়ে নিয়ে এত ভাব নেওয়া ভালা না।এর আগে বিয়ে হইতে গিয়া বিয়া হইলো না।বিয়ের আসরে বর ছেড়ে চলে গেছে।মেয়ে হইছে বোবা।তার ওপর তোমার তেজ কমে না।দেখবো নিই কে করে তোমার বোবা মাইয়া বিয়া?হু যতও সব।সবুর মিয়া জিদের চটে স্বাধীনের কিছু মরিচ গাছ মারিয়ে চলে যায়।স্বাধীন ছোট নিশ্বাস ফেলে নিজের কাজে আবার মনযোগ দিলো।

রমিজ মেম্বার হুক্কা টানতে টানতে বলল কি রে সবুর কি বলল?

কি আর বলব?বোবা মাইয়ারে না-কি এখন বিয়া দিব না।হুনছি পড়ালিখা করাইবো।

পড়াশোনা করতে মন চাইলে করবে।কিন্তু বিয়া দিতো না কেন?মেয়ের বয়স তোও কম হয়নি।এত ভালা প্রস্তাব দিলাম রাজি হয় নাই।কেন?আমার ভাতিজা খারাপ না-কি?মাসে মাসে তার লাখ লাখ টাকা ইনকাম হয়।

স্বাধীন মাগরিবের নামাজ পড়ে বারান্দায় বসে আছে।কিছু নিয়ে চিন্তায় আছে তা তার মুখের আতল ব’লে দিচ্ছে।রেণু নামাজ শেষ করে বাহিরে আসতেই স্বামীকে বারান্দায় বসে থাকতে দেখে এগিয়ে আসে।কাঁধে হাত রেখে ডাক দেয়।

কি গোও মন খারাপ?

হু..ম।না।এমনই বসে আছি।

কিছু হয়েছে আমায় বলো।

আজ দুপুর বেলা ক্ষেতে যখন কাজ করছিলাম।তখন সবুর মিয়া বিয়ার প্রস্তাব নিয়ে আসে।মেয়ের বিয়ের কথা উঠাবে বুঝতে পেরে কথা ঘুরানো চেষ্টা করেছি।কিন্তু লাভ হয়নি।সবুর মিয়া পুতুলের জন্য রমিজ মেম্বারের ভাতিজার হয়ে বিয়ের প্রস্তাব আনে।

খবর নিয়েছিলাম।ছেলেটা ভালো না।ছেলের মা বউয়ের ওপর অত্যাচার করতো।দিন রাত বাপের বাড়ি নিয়ে গালাগাল আর হাত দিয়ে আ*ঘাত করত।আগের বউকে আ*গুনে পুড়িয়ে মারছে।মাঝখান থেকে বাচ্চা দুটো এতিম হয়েছে।আমি হয়তো পুতুলের বাবা নই।কিন্তু মামা হইয়া নরম,কোমল মাইয়ারে কেমনে দিমু এমন নরপশুর হাতে।মেয়ের বয়স বেশি হয়ে যাচ্ছে।বুড়ি মেয়ে কেউ ঘরে তুলবে না।তার ওপর বিয়ে আসরে বর তাকে ছেড়ে দিয়েছে।নানা জায়গায় থেকে কথা শুনতে পাই।সবই কানে আসে বউ।

তাইলে এখন আপনি কি করবেন?বাড়ি বয়ে এসে পাড়াপ্রতিবেশি আমাদের নিয়ে হাসি,মজা করে।সব দেখেও মানতে পারিনা।পুতুলের জন্য চুপচাপ থাকি।তার ওপর এই কথা শুনে আমার হাত,পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।পুতুলের কি হবে?আমাদের মেয়ের ভাগ্যে কি আল্লাহ সুখ দেয় নাই?আল্লাহ কি এতটাই নিষ্ঠুর হবেন?

স্বাধীন রেগে পিলারে সাথে হাতকে আ*ঘাত করে বলল,
আমি কি করে আমার মেয়েরে ওমন জালিমের ঘরে দিমু।যে কর জান্নাত নয়।জাহান্নাম।প্রয়োজন পড়লে আমি আমার মেয়েকে কে*টে টু*করো টু*করো করে নদী ভাসাইয়া দিমু।তবুও ওমন জালিম পরিবারে আমার মেয়েকে বিয়ে দিব না।একবার শিক্ষা পাইছি।দ্বিতীয়বার আর ভুল করতে চাই না।

স্বামীর কথায় রেনু স্বামীর কাঁদে মাথা রেখে ফুফিয়ে কেঁদে ওঠে।

১১০.
সকাল বেলা পুতুল রেডি হয়েছে।কলেজে যাওয়ার জন্য চার ঘন্টা আগে রওনা দিতে হয়।তাই সকালের খাবার খেয়ে বেরিয়ে পরে।আঁকা পাকাঁ মেঠোপথে হেঁটে যেতেই চোখে পরে মাথার ওপর থাকা বিভিন্ন গাছের দিকে।রাস্তার কিনারে সারিসারি আম গাছ,সুপারি,তালগাছ,জামগাছ,গাব গাছ লাগানো।পুতুল নিজের এলাকার রাস্তা ছেড়ে সামনে এগিয়ে যেতেই মেম্বারের ছেলে,এবং তার কিছু বন্ধুরা তাকে দেখে শিস বাজায়।আবার গলা ছেড়ে গান ধরে।

ও..…টুনির মা তোমার টুনি কথা শুনেনা।
যার তার লগে ডেটিং মারে আমায় চিনেনা।
ও… টুনির মা তোমার টুনিরে বুঝাও না।
দিনে রাইতে মিস কল মারি ব্যাক করে না।
টুনি কলেজে যাইব,টুনি বারান্দায় আইব
টুনিরে দেইখা আমার পরান জুরাইব।

পুতুল রাগী চোখে একবার দেখে সোজা হাটতে নিলে পথ আগলিয়ে ধরে।পুতুল হাত দিয়ে ইশারা করে তার পথ ছেড়ে দিতে।কিন্তু তারা পথ না ছেড়ে বিভিন্ন বাজে অঙ্গভঙ্গি করে।যেটা দেখা পুতুলের রাগে শরীর কাঁপতে থাকে।পায়ের জুতা খুলে হাতে তুলে যেটাকে সামনে পেয়েছে ওটাকেই ধরে ঠাসস ঠাসস করে গালে মুখে বারি মেরে বসে।মেম্বার ছেলে আতাউর বন্ধুকে মারতে দেখে এগিয়ে এসে মুখ দিয়ে বিচ্ছিরি গালি ছুড়ে।যা পুতুলের কানে যেতে দেড়ি,কিন্তুু ঘুরে লাথি মারতে দেড়ি করেনি।তার এক লাথিতে মেম্বার ছেলে পেট ধরে বসে পড়তেই তার পিঠের মধ্যে ঠাসস,ঠাসস করে জুতার বারি মেরে বসে।রাগে ব্যাগ থেকে মরিচের গুড়ো বের করে সব কয়টার চোখে মুখে লাগিয়ে পাশের পুকুরের ধাক্কা মেরে ফেলে দিল।বোনের রাগের বারুদ দেখে মিলন,সাজু দূর থেকে হেসে ওঠে।কানে বাটন ফোনটা চেপেঁ ধরে কাউকে ব’লে।

ভাইয়া,আপু আজকে ক্ষেপছে।মেম্বারে কুত্তা পোলা এবং তার বন্ধুরা সব পানিতে।আপু পায়ের দুইশ টাকার জুতার সেন্ডেলের বারি খেয়ে এক একটার হুস জ্ঞান হইলো ব’লে। মামার কিনে দেওয়া জুতার পুরো দুইশা টাকা উসুল হইয়া গেছে।

ফোনের ওপর পাশে ঢাকায় বসে অর্পণ শব্দ করে হেসে উঠে।তার হাসিতে অফিসের ছেলেপেলে এমনকি তার দুই ভাই তার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে।ঘটনা কি বুঝতে পারছে না?

ঠিকই আছে।যেমন কুকুর তেমন মুগুর।কিছু শয়তানকে টাইট দিতে এমন শেরনীর খুব প্রয়োজন।সিংহ কেনো সব সময় তার শেরনীকে রক্ষা করবে?বর সিংহ ছাড়া যে সিংহিনী লড়তে পারে এটা তারই উদাহরণ।গ্রামে কখন কোথায় যায়,বোনের দিকে সব সময় নজর রাখো।গ্রামে থাকলে দায়িত্ব তোমাদের।আর ঢাকায় পা দিলে সে আমার দায়িত্ব থাকবে।মিলনের থেকে সাজু ফোন টান দিয়ে কানে নিয়ে বলল,

বুঝতে পারছি দুলাভাই।গ্রামে আপনার শালারা আছে চিন্তা নাই।ঢাকায় আপনারা মতো দুলাভাই থাকলে চলবে।আমার আপুকে আপনি সামলাতে পারবেন।অর্পণ হেসে ফোন রেখে দিতে নিলে সাজুর থেকে ফোন নিয়ে মিলন কানে ফোন তুলে বলল,

হ্যালো দুলামিঞা,

হুম,বলুন শালা সাহেব।

বিয়ের সানাই বাজবে কবে?

খুব শ্রীর্ঘই।

সত্যি।

হুম তিন সত্যি।তার স্বপ্ন পূরণ হলেই আমার ঘরে ঘরণী করে নিয়ে আসব।

আপু যদি রাজি না হয়।জোর করে তুলে নিয়ে যাবেন।যেমনটা সিনেমায় হয়।

হুমম না।তুলে আনার দিন শেষ।তার মনটা জয় করে আনতে চাই।

তার মেয়ের সাথে মামা রাজি না হলেও মিছিল করব।হরতাল ডাকব।মামলা দিব।তবুও হবু মামা শ্বশুরের মন জয় করে নিয়ে আসব।

বউয়ের পাশাপাশি হবু মামা শ্বশুরের মন জয় করে নিব।এমন ভালোবাসা দেখে হবু মামা শ্বশুর মোমের মতো গলতে বাধ্য হবেন।মামা শ্বশুর মশাই তার মেয়েকে নিজেই আমার হাতে তুলে দিয়ে বলবেন।

জিতছি জামাই।জিতছি।

মিলন,সাজু ফোনটা মুখের সামনে ধরে বলল,

জিতছি দুলামিঞা।জিতছি।

মিলনের নাচনের ঠেলায় কখন লুঙ্গি খুলে গেছে।খেয়াল করেনি।যখন খেয়াল করে তখন হাঁটুর সামনে লুঙ্গি পরে।ভাঙ্গিস ছোট প্যান্ট পরে থাকায় এবারের মতো ইজ্জত বেঁচে গেলো।

সাজু শব্দ করে হেঁসে মুখে হাত দিয়ে বলল,

মিলনের লুঙ্গি হাঁটু তলে।

মিলন,সাজুকে ধমক দিয়ে বলল,

চুপথাক।

মিলন লুঙ্গি তুলতে তুলতে গান ধরে।

আমি চিৎকার করিয়া হাসিতে চাইয়া করিতে পারিনি চিৎকার।
লুঙ্গি খুলিয়া পরিয়া যাওয়ায় নিজেকে দিয়েছি ধিক্কার।

মিলনের গান শুনে ফোনের লাইনে থাকা অর্পণ আবারও শব্দ করে হেসে চেয়ারে পিঠ লাগিয়ে বলল,

আচ্ছা।ধন্যবাদ শালা সাহেব।এখন রাখছি পরে কথা হবে।ফোন কেটে হাসতেই বিজি।
অর্পণকে এর আগে কেউ এতটা প্রানবন্ত দেখেনি।আজ ছেলেটা মন খুলে হাসছে।সময়গুলো এভাবেই যাক না কেঁ*টে।

চলবে…

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৩৫
১১১.
গাঁজার নৌকা পাহাড়তলী যায়
ও মীরাবাই,গাঁজার নৌকা পাহাড়তলী যায়

মিলন,রোমান ভাইয়ের গান শুনে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে বিরবির করে বলল,

শালা।হারামী।কি গান গায় রে?গান শুনে তোও আমার জান যায়।গলাটা পরিষ্কার করে খ্যাক করে বলে,

ওই থামেন।কি গান ব’লেন এগুলো?আপনার গান শুনে আমি বেহুশ হয়ে যাই।

কেডা রে?রোমান পুকুর পাড়ে আরামে বসে সিগারেট টেনে টেনে গান ধরে।কিন্তু কারো ঝাড়ি খেয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখে মিলন দাঁড়িয়ে।কোমড় হাত রেখে বলল,

রোমান ভাই আপনি।এখানে কি করেন?আমাদের পুকুরের ঘাটে আপনি বসে আছেন।কিন্তু কেন?

কি করুম ভাই?তোর ভাবীর কথা চিন্তা করেই বুক ফাটি যায়।বউ তার বাপের বাড়ি। আর আমি বউরে না পাইয়া মনের সুখে সিগারেট টেনে ফাটা গলায় গান গাই।মনটা বউয়ের জন্য কেমন কেমন করে।

ওহ,মা গো।এ দেখি টু’রু লাভ।

ছোট থেকেই এই গ্রামেই বড় হয়েছি।আজ পর্যন্ত আপনার বউরে আপনি না মেরে ভাত খান নাই।আজ এতটা দরদ।কাহিনি কি?

কি করুম?বউরে না মারতে পারলে শান্তি লাগে না।খালি হাত চুলকায়।

যখন হাত চুলকায়।তখনই আপনার হাতটাতে ওই শীল নূরের পুতা দিয়ে ছেচা মারা দরকার।কথায় কথায় বউ মারে।এখন বউ গেছে গা।ভালোই করছে।দোয়া করি।সে যেন আপনার জীবনে ফিরে না আসে।আমীন।

সকালের ঘুম ভেঙে যেতেই পুতুল উঠে বসে।বেলা কতটুকু হয়েছে তা দেখার জন্য জানালা খুলে দেয়।জানালা খুলতেই এক দমকা বাতাসে কেঁপে ওঠে।বাহিরে কুয়াশায় ঘেড়া।শীত আমেজ ফিরে এসেছে।এতটা ঠান্ডা পড়ছে দেখে পুতুল তাড়াতাড়ি জানালা বন্ধ করে।বিছানায় বসে পড়ে।গায়ের চাদরটা আরো ভালো করে পেঁচিয়ে নেয়।মিলন,সাজু,ঘরে নেই।নিশ্চয় বাহিরে আছে।পুতুল বিছানা গুছিয়ে রাখতে গিয়ে হাতে চিরকুট পায়।চিরকুট খুলে দেখে।

তুমি আমার দেখা সবচেয়ে শক্তিশালী মহিলা যিনি বয়সের সাথে শক্তিশালী হয়ে উঠে।এবং সব খারাপ অনুভূতিকে টেক্কা দেয়।শুভ জন্মদিন আমার পুতুল আম্মা।

চিরকুট পরে পুতুলের মুখে হাসি ফুটে।হালকা ঠান্ডা লাগছে।পুতুল হাঁচি দিতে দিতে ঘর ছেড়ে বাহিরে নামে।সকাল বেলা রিফাত সূরা পাঠ করছে।তা কানে আসে।কি মিষ্টি সুর।কলিজা শীতল করে।এগিয়ে যায় মামা,মামীর থাকার ঘরে।পুতুল এগিয়ে এসে দেখে মামী তার তিন ভাইকে আরবি পড়াচ্ছে।পুতুল খুশি মনে সালাম দিলো।রেনু,পুতুলকে দেখতে পেয়ে কাছে ডাকে।পুতুল এগিয়ে আসতেই তার কপালে চুমু বসিয়ে দিলো।তোমার নতুন দিনটির জন্য অনেক শুভেচ্ছা আর ভালোবাসা।

যাও, হাত মুখ ধুয়ে আসো।আজ নামাজ পড়নি।এখনো পেট ব্যাথা করছে।পুতুল মাথা নাড়িয়ে না বলল।

কয়েকদিন গেলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।আবার নামাজ পড়তে পারবে।পুতুল মাথা নাড়িয়ে কলপাড়ে চলে গেলো।হাত,মুখ ধুয়ে আসতেই।তাদের চার ভাই বোনকে গরম গরম ক্ষীর পায়েস পরিবেশন করে।হাড়ির ঢাকনা সরাতেই ক্ষীর পায়েস গন্ধে জিহ্বায় পানি আসে।মিলন,সাজু পায়েসের গন্ধে পেটে হাত বুলিয়ে নেয়।এতখন হালকা খিদে ছিল।এখন আরো বেশি খুদা লাগছে।তাদের বাটিতে পায়েস তুলে দিতেই মামাও বাজার নিয়ে হাজির হয়।সে-ও ছেলেমেয়ের সাথে যোগ দেন।একসাথে পরিবারের সকল সদস্য আনন্দের সাথে খাবার খাচ্ছে।

কয়েকদিন পর…

তালুকদার বাড়িতে ফুফিয়ে কেঁদে যাচ্ছেন রাবেয়া।একটু পর পর স্বামীর ওপর রাগ ঝাড়ছেন।কিন্তু অসীম তালুকদার বউয়ের রাগ পানি করতে মিষ্টি মিষ্টি কথা তুলছেন। কিন্তু তার মিষ্টি কথায় কাজ হচ্ছে না।সে যাই করে তাতেই বউ ঝাড়ছে।একমাত্র বউ হওয়াই না পারছে বেশি রাগতে আর না পারছে ঠান্ডা করতে।অসীম তালুকদার বউয়ের মন ভালো করতে দৌড়ে চা করে নিয়ে আসেন।

রাবেয়া স্বামীর বানানো চা মুখে দিতেই গড় গড় করে সেটা ফেলে দিল। তার মুখটা এখন তিতা লাগছে।

এই তুমি আমাকে কি খাইয়েছোও?সত্যি করে বলো।এতে কি মিশিয়েছোও?

বিশ্বাস কর।কিছুই মিশাই নিই।চিনি,চা পাতি দিয়ে বানিয়ে আনছি।

এতদিন পর আসছি।কোথায় রাগ ভাঙ্গিয়ে সোনা,বাবু ব’লে ডাকবে।কিন্তু না।বেডা আমির তালুকদারের ছেলে আমাকে বিষ খাইয়ে মারা প্লান করছে।এই তোমরা কে কোথায় আছোও দেখে যাও?আমার স্বামী আমাকে বিষ দিয়ে মারতে চাইছে।বেডা মিথ্যুক।

এতখন ভালোবাসে বউয়ের জন্য কতকিছু করলো।তবুও নাম নেই।সব দোষ পুরুষ মানুষের হলো।এরজন্যই লোকে ব’লে।মেয়ে মানুষের বুদ্ধি হাঁটুর তলে।বিয়ে করলে পাগল হবি।বিয়ের পর টের পাবি।বউ কি চিজ?

রাবেয়া ফ্যাসফ্যাস কান্না দেখে অসীম তালুকদার বিরক্ত হয়ে বলল,

বেশি কিছু দেয় নিই।ইন্দুর মারার বিষ দিয়েছি।এবার খুশি।

স্বামীর কথায় রাবেয়া চোখ বড় বড় করে তাকায়।চিতকার করে বলল,

তুমি আমাকে চা নামের ইন্দুর মারার বিষ খাইয়ে মারতে চাইলে।এটা তুমি পারলে।আজকে তোমার খবর আছে।রাবেয়া জামদানী শাড়ি আঁচল কোমড়ে খুঁজে সারা বাড়িতে অসীম তালুকদারকে দৌড় করিয়ে ছাড়ল।বেচারা একটু দৌড়িয়ে হাঁপিয়ে উঠেন।হাঁপাতে হাঁপাতে বউয়ের সামনে সারেন্ডার করলো।মানে আত্মসমর্পণ করেছে।

এইদিকে ঢাকার কাজ শেষ করে।অর্পণ বাড়িতে ফিরে এসেছে।বাড়িতে এসে মা,আর বাবার ঝগড়া দৃশ্য দেখে মুখ অটোমেটিক হা হয়ে আছে।

বাড়িতে এসব কেলোরকীর্তি হবে।সে কি আর জানত?

১১২.
রাতের বেলা মায়ের কোলে মাথা দিয়ে অর্পণ গল্প করছে।রাবেয়া ছেলের মাথায় চুমু একে বলল,

তা আব্বু এবার কি ঘরে বউ তুলবেন না?বয়স তোও আর কম হলো না।বয়স পেরিয়ে যাচ্ছে।আপনি এতদিনে বিয়ে করলে নাতি নাতনীর মুখ দেখা হয়ে যেতো।

মাথা থেকে মায়ের হাতটা নামিয়ে চুমু খেয়ে বলল।

বিয়ে করব মা।কিন্তু আমার আদুরনী এখনো ছোট।তার স্বপ্ন পূরণ হোক।তার স্বপ্ন পূরণ হলেই তাঁকে ঘরে তুলে আনব।

ছেলের কথায় রাবেয়ার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো।কোল থেকে ছেলেকে উঠিয়ে দিয়ে। পিঠের মধ্যে ঠাসস করে থাপ্পড় মেরে বলল।

ওরে বাবা।আমার আব্বা প্রেম করে।আর আমি জানি না।হুম।আমার আগে এই কথা আর কাকে কাকে বলেছিস।এই কথা কয়জন জানে?

হুম।দুলা শালা ছাড়া আর কেউ জানে না।

কি?আবার শালাদেরকে পটিয়ে ফেলছিস।তুই কি ‘রে?তা যাকে ভালোবাসি।তাঁকে পটিয়েছিস?তাকেঁ বলেছিস মনের কথা।সে জানে!

অর্পণ মায়ের হাতটা ধরে বলল,

সে কিছুই জানে না।এখনো মনের কথা বলা হয়নি।

ছেলের কথায় রাবেয়া ঠাসস করে পিঠের মধ্যে আরেকটা থাপ্পড় মেরে বলল।

আরে গাধার বাচ্চা।এখনো বলিস নিই।ওই মেয়ে তোর মনের কথা জানে না।সে কি আর তোর পথ চেয়ে বসে থাকবে।অন্য কারো বউ হয়ে যাবে না।আমার বাড়িতে যার বউ হওয়ার কথা সে যদি অন্য বাড়িতে পা রাখে।তাইলে তোর খবর আছে।

আরে মা কিছুই হবে না।তার পিছনে অলরেডি গোইন্দায় লাগানো আছে।আর মা তুমি আমাকে এটা কি বলে?আমি গাধার বাচ্চা।তারমানে আমার বাপ অসীম তালুকদার একটা গাধা।

রাবেয়া মুখ ভেঙ্গিয়ে বলল,

হু…হু।গাধারের গাধা বলবো না তোও কি করব?আমি যে পাঁচ বছর তার থেকে দূরে ছিলাম।একবার খোঁজ নিয়েছে।যখন দুইদিন ছিলাম বাপের বাড়ি।একবার খবর নিলো না।রাগে, দুঃখে গেলাম লন্ডনে।রোগীদের দেখেই সময় চলতো।অবসরে সময় রাতটুকু বিশ্রামে চলে যেতো।ডাক্তার হ’য়েছিলাম ব’লে আজ নিজের একটা আলাদা পরিচয় হয়েছে।

হুম তোমার বউ মা ওহ ডাক্তার হতে চায়।এটাই তার একমাত্র স্বপ্ন। রাবেয়া চোখ উজ্জ্বল হয়ে গেলো।হাসিমুখে বলল

সত্যি।

হুম।সত্যি।

আলহামদুলিল্লাহ।মন থেকে দোয়া রইলো।আমার ছেলের বউ ডাক্তার হবে।

সকাল সাড়ে সাতটা বাজে কনকনে ঠান্ডায় মানুষের বের হওয়া দায়।আজ পুতুল সকালে হাঁটতে বের হয়েছে।গায়ে কালো বোরকা তার ওপরে শীতের চাদর মুড়ানো।ফজরের নামাজ শেষ করে বাড়ি থেকে বের হয়েছে।মায়ের কবর থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে মোনাজাত ধরে।অর্পণ বাইক থেকে নেমে মাথায় টুপি পরে।তার গায়ে সাদা পাজামা,পাঞ্জাবি।পুতুলের পাশে দাঁড়িয়ে একপলক তার আদুরিনীকে দেখে নিয়ে মোনাজাতে দুইহাত তুলে দোয়া পাঠ করতে লাগল।

অর্পণ মোনাজাত শেষ করে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে পুতুল এখনো চোখ বুঝে আছে।অর্পণ এক ধ্যাণে তার প্রেয়সীর দিকে তাকিয়ে রইলো।মনে মনে বলল,

আমার রাজ্যের রাণীকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা।ভালবাসার মুকুটে তোমায় সবসময় ভালই মানায়।

তোমার ভালোবাসা ছাড়া আমার জীবন অসম্পূর্ণ থাকবে।তোমার নিঃশর্ত ভালবাসা এবং যত্ন দিয়ে আমায় প্রাণবন্ত করে তোলে।শুভ জন্মদিন আমার আদূরনী।

চলবে…

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৩৬
১১৩.
তোমার ভালোবাসা ছাড়া আমার জীবন অসম্পূর্ণ থাকবে।তোমার নিঃশর্ত ভালবাসা এবং যত্ন দিয়ে আমায় প্রাণবন্ত করে তোলে।শুভ জন্মদিন আমার আদূরনী।জম্মদিনে উইশটা করতে দেড়ি হয়ে গেলো।পরেরবার সবার আগেই আমি তোমায় জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাবো।

পুতুল চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে অর্পণ তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে।পুতুল আগের কথা মনে করতেই ঢোক গিলো।তাড়াহুড়ো করে পিছনে পা ফেলতে হোচঁট খেয়ে পড়তে নিলেই অর্পণ,পুতুলের ডান হাতটা ধরে ফেলে।

চোখের সামনেই কি ঘটে গেলো?পুতুল ভয় পাচ্ছে।আবার নিজের ওপর রাগ হচ্ছে।এই প্রথমবার কোনো পুরুষ তার হাতটা স ইচ্ছা ধরেছে।আর সে অপর হাতটা না সরিয়ে সেই হাতটাকে নিজের অজান্তেই আঁকড়ে ধরলো।
পুতুল হাতটা ছুটিয়ে তাড়াতাড়ি বাড়ির পথে হাঁটতে লাগে।

পুতুলের এমন করায় অর্পণ রাগ করেনি।বরং মুচকি হেসে তার পিছু পিছু হাঁটতে শুরু করে।

আই এম সরি।আসলে আমার সেইদিন অন্য একটা বিষয় নিয়ে একটু রাগ ছিলো।সেই রাগটা তোমার ওপর দেখিয়ে ফেলেছি।যা আমার করা একদম উচিত হয়নি।আই এম রিয়েলি সরি।প্লিজ সরি একসেপ্ট কর।দেখ তুমি যদি আমার সরি একসেপ্ট না কর।তাহলে আমি খুব কষ্ট পাব।আমি মানছি।আমার ওই রকম রিয়াকশন দেওয়টা ভুল জায়গায় ছিল।তার জন্য আমি ক্ষমা প্রার্থী।

অর্পণ এত করে সরি বলাতেই পুতুল চোখ ঝাপটিয়ে বলল,

ইস ওকে।সে পুতুলের ভাষাটা হয়তো ততক্ষণে বুঝে নিয়েছে।

এইদিকে চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলের সাথে পুতুলকে দেখতে পায় সবুর মিয়া।

ওহ তাইলে গ্রামে এসব কাহিনি চলে।এরজন্যই কি স্বাধীন প্রস্তাব মেনে নেয়নি।বড়োলোক বাড়ির পিছনে মেয়েকে লেলিয়ে দিয়ে স্বাধীনের এখন সাধু সাজা হচ্ছে।দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা।

বাহ,বাহ,কি অপরুপ দৃশ্য?দেখলেই মনে হবে গ্রামের মধ্যে প্রেমলিলা চলছে।মেম্বার আপনি চুপ থাকলেও গ্রামের মানুষ কিন্তু চুপ থাকবে না।তারা কিন্তু এসব মানবে না।এটা একটা বিহিত করেন।

রমিজ মেম্বার চেয়ারে বসে বলল,জমি চাইলাম দিলো না।জমিটা টাকা দিয়া কিনতে চাইলাম।তা ওহ মানলো না।চুপচাপ মেনে নিলাম।দাতঁ কামড়ে সয্য করলাম।আবার ভাতিজার জন্য বিয়ের প্রস্তাব দিলাম মানলো না।কিন্তু এখন তোও এসব ফষ্টিনষ্টি মেনে নিবো না।সবুর গ্রামের লোকের কানে একটু কথাটা তুলো।আর হ্যা অবশ্যই ঘি টা যেন বেশি পরে।আজ রাতই হবে ওদের শেষ রাত।আমি ওদের এই এলাকা ছাড়া করব।তারপর সুযোগ বুঝে রাতের শেষ প্রহরের মেরে গুম করে দিব।সকাল হওয়ার আগেই রাজীব হকের বাড়ির সব লোক নিরবংশ হবে।

মেম্বার রমিজের কথায় পুতুলের গায়ে মিথ্যে কলঙ্ক দাগ লাগিয়েছে।পুরো গ্রামে ছড়িয়ে দিয়েছে।চেয়ারম্যান ছেলের সাথে স্বাধীনের ভাগ্নীর অবৈধ সম্পর্ক রয়েছে।গ্রামের লোক ছি,ছি, ছি করতে লাগল।স্বাধীনদের বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়ার পথেই মহিলারা থু, থু মারছে।মহিলাদের ব্যাবহারে পুতুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে সবটা দেখেই এগিয়ে আসে।

দেখ মায়ের মতো নষ্টামি করে সাধু সাজছে।যেনো ভাজা মাছটা ওহ উল্টে খেতে জানে।অথচ পুরো মাছটাই খেয়ে বসে আছে।নষ্টা মেয়ে কোথাকার।

স্বাধীন ঘর থেকে বের হয়ে এমন কটুবাক্য শুনে চিতকার করে।

আপনাদের এত বড় সাহস।আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমার মেয়েকে মিথ্যে দোষারোপ করেন।আমার মেয়ে আপনাদেরটা খায় না-কি পড়ে।যে বাড়ি বয়ে এসে কোথা শুনাচ্ছেন।কোন অধিকারের এসেছেন আমার মেয়েকে কথা শুনাতে?আমি আপনাদের সেই অধিকার দেয়নি।আর একবার আমার মেয়েকে নিয়ে যে কু কথা বলবে।তার জিহ্বা আমি কেটে আমার বাড়ির সীমানায় ঝুলিয়ে রাখব।যান এখান থেকে।

ওহ মা এ দেখি অন্যায় করে গলা বাজি করছে।এই শিক্ষায় শিক্ষিত করছো মেয়েকে।বড়লোক বাড়ির ছেলের পেছনে বোবা মেয়ে লাগিয়ে আবার বড় বড় কথা বলছো।লজ্জা তোমাদের নেই।কিন্তু আমাদের আছে।আমরা আর এই নষ্টা মেয়েকে আমাদের গ্রামে রাখব না।এই মেয়েকে আজই গ্রাম থেকে বের করব।মেম্বার সাহেবকে খবর দিচ্ছি।তিনি যা করার করবেন।কথায় আছে না জোরের মায়ের বড় গলা।অন্যায় করে আবার উচ্চস্বরে কথা বলা বের করছি।

মহিলাদের কথা শেষ হতে দেড়ি।রমিজ মেম্বার গ্রামের ছেলেপেলে এমনকি গ্রামের কিছু লোক নিয়ে স্বাধীনদের বাড়িতে হাজির।তার সাথে গুন্ডা টাইপের লোক নিয়ে এসেছে এদের প্রত্যেকের হাতে বাশঁ,দা,ছুরি।বাড়িতে এত হৈচৈ শুনে মিলন,সাজু,রেনু একটু আগেই ঘর ছেড়ে বের হয়ে আসে।পুতুলকে নিয়ে এমন জগন্য অপবাদ শুনে রেনু মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল,

আমাদের পুতুল কিছু করেনি।আপনারা তাকে ভুল বুঝছেন।
পুতুল তুই চুপ করে আছিস কেন?ওরা যা বলছে সেসব সত্যি নয়।তুই বল,চেয়ারম্যানের ছেলের সাথে তোর কোনো সম্পর্ক নেই।ওরা শুধু শুধু তোকে দোষ দিচ্ছে।আমি জানি তোও।আমাদের পুতুল কিছুই করেনি।

পুতুল দুই চোখের পানি ফেলে মামার দিকে ছুটে গেলো।হাত নাড়িয়ে বলছে,

গ্রামের লোকেরা তাঁকে ভুল বুঝেছে। চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই।সে লোভী নয়।টাকার জন্য সে কাউকে ফাসায় নিই।

স্বাধীন মেয়ের চোখের পানিটুকু মুছে দেওয়ার আগেই পুতুলকে ধাক্কা দিয়ে গ্রামের কিছু মহিলাদের হাতে তুলে দেয়।স্বাধীন ধরতে গেলে তাঁকে গ্রামের পুরুষরা আটকে ধরে রাখে।মেম্বারের ভাড়া করা গুন্ডাগুলো বাঁশ দিয়ে স্বাধীনকে পিটিয়ে যাচ্ছে।মামার চিতকারের পুতুল ছটপট করতে লাগল।সবার কাছে হাত তুলে আকুতি বিনুতি করলো তাকে ছেড়ে দিতে।কিন্তু তাকে ছাড়া হলো না।রেনুকে ঘরে আটক রেখেছে।আর সাজু,মিলনকে খুঁজে পাওয়া যায় নিই।

এই মেয়ের চুল কেটে নেড়া করুন।মুখে চুলকানি মাখিয়ে দশ গ্রাম হাঁটিয়ে এলাকার বাহিরে ছুড়ে মারুন।রাজিয়া তার নাগরের লগে ভাইগা এই খা*নকিরে জম্ম দিয়েছে।মায়ের মতো নটি*মা* একটা।আজকে ওরে এমন শিক্ষা দিমু।গ্রামের মধ্যে এসব কু*র্কাম করা সাহস দ্বিতীয়বার করার কথা কেউ ভাববে না।

মেম্বার কথায় স্বাধীন চিতকার করে।পুতুলকে ছেড়ে দিতে বলে।রেনু দরজা ধাক্কায় খুলে দেওয়ার জন্য।কিন্তু তাদের কথা কেউ শুনে না।মেম্বারের কথা মতো।তারা পুতুলের চুল কেটে নেড়া করার সিদ্ধান্ত নেয়।পুতুল তাদের সামনেই নিশ্চুপ।একটা শক্ত পাথর।তার কানে আসছে মায়ের নামক করা উপরোক্ত কথাগুলো।মামাকে মারার দৃশ্য।রমিজ মেম্বার ইশারা দিতেই।একজন পুরুষ পুতুলের মাথায় পেচানো ওড়না টান মেরে খুলতে গেলেই পুতুল ঘুরে লাথি বসায়।পুতুল একজন পুরুষকে আঘাত করতেই আরেকজন পিছন থেকে বাশঁ দিয়ে পুতুলের পিঠের মধ্যে ঠাসস করে বারি মারে।পুতুল মাটিতে পরে যায়।চোখ দিয়ে পানি পরে।মেয়েটা ব্যাথা কুকিয়ে উঠে।কিন্তু তার কষ্ট দেখা’র জন্য কেউ বসে নেই।সবাই আজ তাকে মেরে ফেলতে এসেছে।

পুতুলের গায়ের ওড়না টান দিয়ে নিতেই পুতুল দৌড়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজা বন্ধ করে।মাটিতে কপাল ঠুকে।কেন তার বেলায় এত কষ্ট?এত মরণ জন্তনা কেন?মনে মনে আল্লাহ কাছে নিজের মৃত্যু কামনা করে বসে।সে আর পারছে না।আজ তার জন্যই তার মামার পরিবারে অশান্তি।গ্রামের লোকেরা তাদের আগেই এক ঘর করেছে।তার অপয়ার জন্য আজ এই ভয়ংকর অবস্থা হয়েছে।সেই দায়ী।পুতুলের ভাবনার মাঝেই নিজের ঘরের মধ্যে কেরাসিন তেলের গন্ধ পেয়ে চমকে উঠে।বাহিরে থেকে গ্রামের লোকেদের শব্দ আসছে।তারা তাঁকে পুড়িয়ে মারবে।পুতুল কান্না মাঝে-ও হেঁসে দেয়।সেই ভালো হবে।
তার জন্য এই সুন্দর পৃথিবী নয়।সে ভুল করেছে।জম্মের সাথে সাথে মরে গেলেই ভালো হতো।বাবা,দাদী তাকে দেখতে পারেনি।আজ যাদের জন্য সে হেঁসেছে,খেলেছে।স্বপ্ন দেখেছে।সেই তাদের কে কত বড় শাস্তি দিলো?আমাকে মাফ করে দিও মামা।আমি পারলাম না নিজের লড়াই একা লড়তে।আমি হেরে গেলাম।আমাকে মাফ করে দিও।আর আসবো না তোমাদের এই সুন্দর পৃথিবীতে।এই পৃথিবীতে আমার মতো বোবা মেয়েটিকে মানায় না।এখানে আমি বড্ড বেমানান।আমি চলে যাচ্ছি মামা।তোমাদের কারো ওপর কোনো রাগ অভিমান রইলো না।শুধু আপসোস থেকে যাবে।আমি
হেরে গেলাম।পুতুল,ইউ আর লু’সার।

দাউদাউ করে আগুনের লেলিহান দাবালনের শিখায় শেষ হয়ে যাচ্ছে একটি বোবা মেয়ে।তার কষ্ট,তার আত্মনাত তার না বলা কথাগুলো আর বলা হবে না।তার স্বপ্ন সেটা অসম্পূর্ণ পরিত্যাক্ত হয়ে গেলো।

এইদিকে অর্পণের বাড়ির সামনে এসেছে সাজু,মিলন।দারোয়ান কিছুতেই ঢুকতে দিচ্ছে না।তার একটাই কথা বড় সাহেব অনুমতি ছাড়া সে কাউকে বাড়ির মধ্যে ঢুকতে দিতে পারবে না।সাজু,মিলন খুব আকুতি করছে।বাহিরে চিতকার চেচামেচি শুনে অসীম তালুকদার বাড়ির বাগান সাইড থেকে বের হয়ে আসেন।দুইজন স্বল্পবয়সী বালকে দেখে এগিয়ে আসেন।

ওদের কে আসতে দেও।দারোয়ান গেইট খুলতেই মিলন,সাজু ছুটে আসে।

অ..র্প..ণ ভাই কোথায়?

তোমরা কে?আর অর্পণকে খুঁজছো কেন?

প্লিজ তার কাছে যেতে দিন।আমার আপুর খুব বিপদ।

অসীম তালুকদার কিছুই বুঝতে পারছেন না।
এই দিকে মিলন,সাজু তাকে বুঝানোর সময় নেই।তারা বাড়িতে ঢুকেই অর্পণকে খুঁজে।অর্পণ দুই ভাইয়ের পাশে বসে ল্যাপটপে ভিডিও কলে পার্টির লোকের সাথে ডিসকাস্ড করছিল।এমন সময় তারই সামনে মিলন,সাজুকে দেখে চমকে উঠে।কিছু বলা আগেই মিলন,সাজু একসাথে ব’লে ওঠে আমার আপুকে বাঁচান।ওরা আপুকে মেরে ফেলবে।অর্পণ কাজ ফেলে ছুটে আসে।

কারা মেরে ফেলবে?

ওরা।মিলন,সাজু বাড়িতে হওয়া ঘটনা বলতে দেড়ি অর্পণের বাড়ি থেকে বের হতে দেড়ি হয়নি।নিজের বাইক নিয়ে ছুটে।অপরদিকে ছেলেকে এলেমেলো দেখে ঠিক লাগলো না।অসীম তালুকদার জিহান,রিহান,এবং মিলন,সাজুকে নিয়ে গাড়িতে উঠেন।উদ্দেশ্য রোহিতপুর গ্রাম।

চোখের সামনেই সব শেষ হয়ে গেছে।বাড়িটা আর বাড়ি নেই।পুতুলের ঘরটা চোখের সামনেই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।অর্পণ পাগলের মতো পুতুলকে ডাকতে লাগল।কিন্তু পুতুল তার ডাকে সাড়া দিচ্ছে না।স্বাধীন মেয়ের মৃত্যুটা চোখের সামনে মেনে নিতে পারেনি।বাড়ির উঠোনেই জ্ঞান হারিয়েছে।রেনু এখনো দরজা খুলে দিতে ব’লছে।আগে চিতকার করায় গলা বসে গেছে।তার গলা দিয়ে জোরে শব্দ করতে পারছে না।বাহিরে এতখন শোরগোল থাকলেও এখন সব নিস্তব্ধ।এ যেন এক মৃতুপুরী।

অসীম তালুকদার পৌঁছে যান। মিলন দের বাড়ি দেখে বুঝতে পারলেন।খারাপ কিছু হয়েছে।কিন্তু নিজ ছেলেকে এমন হন্য হয়ে কিছু খুঁজতে দেখে ডাক দেন।কিন্তু অর্পণ তার ডাকে কথা বলছে না।অর্পণ পাগলের মতো বিহেভিয়ার করতেই হতবাক হন।এইদিকে বাড়ির অবস্থা দেখে মিলন,সাজু চিতকার করে কান্না করছে।

আপু,আপু করে পুতুলকে ডাকছে।

অর্পণ আগুনে পোড়া ঘরটাতে যেতে চায়।সেখান থেকে এখন ধোয়া উড়ছে।অসীম তালুকদার ছেলের পাগলামি দেখে জিহান,রিহানকে ধরতে বলে।তারা ভাইকে পেচিয়ে ধরে।

কিন্তু অর্পণ কাঁদছে।

বাবা আমাকে যেতে দেও।ওই ঘরে আমার পুতুল রয়েছে।ওর খুব কষ্ট হচ্ছে বাবা।আমি না গেলে ওহ আসবে না।আমাকে যেতে দেও।ছাড় আমায়।তোরা আমাকে ছেড়ে দে।আমি পুতুলের কাছে যাব।পুতুল,পুতুল তুমি ভয় পেয়ে ওহ না।তোমার কাছে আমি আসছি।আমি আসছি পুতুল।

আ.ল্লা.হ!তুমি এটা কি করলা?আমার কাছ থেকেই আমার প্রাণটাই কেড়ে নিলা।আমি বাঁচব কি নিয়ে?আমি মরে যাব।আমি মরে যাব তোমায় ছাড়া।

বাবা ওহ বাবা।আমি তোমার দুইটি পায়ে পড়ছি।তুমি আমার পুতুলকে এনে দেও।আমি কথা দিচ্ছি।আমি আমার পুতুলকে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাব।আর কোনোদিন তোমাদের এই গ্রামে ফিরব না।আমার তাকে এখনো বলা হলো না।আমি ভালোবাসি।আমি আমার পুতুলকে খুব ভালোবাসি।পুতুল,আমি তোমাকে ভালবাসি।
অসীম তালুকদার ছেলের পাগলামি দেখে মর্মাহত হন।পুতুলের নামের কোনো মেয়েকে ভালোবাসত।এটা আরো আগে কেনো জানলেন না।আজ যখন জানলো তখন সব শেষ।

চলবে…

চক্ষে আমার তৃষ্ণা পর্ব-৩১+৩২+৩৩

0

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৩১
৯৯.
লীলাবালি লীলাবালি
বড় যুবতী সই গো
বড় যুবতী সই গো
কি দিয়া সাজাইমু তোরে!

পুতুলের গায়ে লাল বেনারসি শাড়ি জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।মাথায় লাল ওড়না দেওয়া।মুখে হালকা মেক-আপ করতে বলা হয়েছিল।কিন্তু পুতুলের কথা তারা শুনে নিই।প্রচুর মেকআপ করায় তার আসল চেহারা লুকিয়ে গেছে।পুতুল মেকআপ পচ্ছন্দ করে না।মামার মুখের দিকে তাকিয়ে বিয়ের সব নিয়ম মেনে যাচ্ছে।তার ভিতর থেকে দীর্ঘ লম্বা শ্বাস বের হয়।পুতুল মন থেকে কেন খুশি হতে পারছেনা?এ কেমন কষ্ট হচ্ছে? পুতুল নিজেই বুঝতে পারছে না।ভেতরে অস্থিরতা কাজ করছে।তবুও মামার মুখের দিকে তাকিয়ে মিথ্যে হাসি মুখে লাগিয়ে রেখেছে।

তালুকদার বাড়িতে বিয়ের আমেজ পাওয়া যাচ্ছে।দিহানসহ তার পুরো পরিবার তালুকদার বাড়িতে।এখান থেকেই তারা বউ আনতে রওনা হয়েছে।তারা আনন্দের সাথে
সব কিছুতেই সামিল হয়েছে।অসীম তালুকদার ছেলের জন্য বাড়িতে রয়েছেন।আজ কয়েকদিন হলো ছেলেটা ঘর অন্ধকার করে বসে আছে।না কিছু বলছে।না ঘর থেকে বের হচ্ছে।অর্পণ যেমনই থাক।ঘর ছেড়ে সব সময় তার বাহিরে আনাগোনা বেশি ছিল।ঘর কম বাহির ছিল তার আপন দুনিয়ায়।সেই ছেলে ঘর থেকে নড়ছে না।ব্যাপারটা অসীম তালুকদারকে চিন্তায় ফেলেছে।

অর্পণ ঘর অন্ধকার করে তাকিয়ে আছে আকাশে দিকে।চোখ বন্ধ করে ছোট নিশ্বাস ফেলে বলতে লাগলো।

আমি তোমাকে পাওয়ার আশায় হয়তো ভালোবাসি নিই।আমি আমার ভালোবাসার মাঝে নিজের সুখ খুঁজেছি।নিজের এক তরফা ভালোবাসা দাবি নিয়ে কখনোই জোর করতে বা তোমাকে ভালোবাসতে বাধ্য করিনি।আমি আমার মতো করে তোমায় নিয়ে মনের মাঝে ছোট্ট সংসার সাজিয়ে ছিলাম।আমি জানতাম না।তোমাকে আমার পাওয়া হবে না।যদি জানতাম তবে চাইতাম না।এই এক পাক্ষিক ভালোবাসায় আমায় কাঁদায়।আমি না পারছি কষ্ট গিলে ফেলতে আর না পারছি ভুলে যেতে।এই পোড়া দহনে আমি পুড়ে পুড়ে অঙ্কার হচ্ছি।আমাকে রেখে দিতে তোমার মায়া।আমি শুধু তোমার হয়ে আজীবন থাকতাম।সব কিছুই সীমার মধ্যে থাকলে ভালো লাগে!কিন্তু আমি সীমাহীন ভাবে তোমাকে ভালোবাসি।আর ভালোবাসি ব’লে তোমার সুখে কাঁটা হব না।তুমি যেখানে থাকো।যার সাথে থাক সুখে থাকো।আমার মনের ছোট্র পিঞ্জিরায় তোমার নামটি সব সময় র’বে।আমি চাইলেও পারব না সবটা মুছে দিতে।বেদনায় এত সুখ আগে বুঝে নিই।আমার একপাক্ষিক ভালোবাসার গল্পটা তোমার জন্যই অজানা থাক।তুমি কোনোদিন জানবে না অর্পণ নামের কেউ তোমায় ভালোবাসত।খুব করে চাইতো।আমি আমার মনের কথা কোনোদিন কাউকে জানতে দিব না।এটা নিজের কাছেই নিজেকে ওয়াদা দিলাম।

১০০.
বধূ সাজে কনে ঘরে বসে আছে।বাহির থেকে শুনা যাচ্ছে বর এসেছে,বর এসেছে।মিলন,সাজু,এগিয়ে দুলামিয়াকে সাদরে গ্রহণ করার জন্য দুই দিক থেকে লাল ফিতা ধরে।যার মানে তাদের ডিমান্ড মেনে এই ফিতা কেটে বাড়িতে ঢুকতে হবে।তাদের চাহিদা ছিল পাঁচ হাজার টাকা।যেটা বর পক্ষ মেনে ফিতা কেটে ঢুকে।রিফাত এক গ্লাস শরবত এগিয়ে দিয়ে বলল।

আরে দুলামিঞা ভেতরে যাবেন।তার আগে এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত খাইয়া যান।ট্রেতে করে সাত গ্লাসে সাত রকম শরবত দেওয়া হয়েছে।বর পক্ষ কনফিউজড।বরকে কোনটা খেতে বলবে?রিফাত চালাকি করে বরের হাতে একটা গ্লাস দিয়ে বাকিগুলো বর পক্ষের বন্ধুদের হাতে তুলে দেওয়া হয়।

মিলন ব’লে, এই শরবত যে খাবে না সে পস্তাবে।এ-তো স্বাদের শরবত মিস করেছেন তো মরেছেন।শরবত হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার থেকে ঠকঠক করে খেয়ে দেখান দেখি!
বর পক্ষ শরবত মুখে দিতেই একেক জনের চোখ,মুখের রং বদলে গেলো।সবাই এক চুমুক দিয়ে গড়গড় করে ফেলে দিল।কি বিচ্ছিরি খেতে?বরকে দিয়েছিল নিমপাতা শরবত।সে শরবত এক চুমুক দিয়ে গিলতে সাহস করেনি।মুখের মধ্যে নিয়ে বন্ধুদের রিয়াকশন দেখে নিজের রিয়্যাক্ট করতে ভুলে গেছে।

রেনু মেয়ে জামাইকে বরণ করে মিষ্টি মুখ করিয়ে দেয়।জামাই মিষ্টি মুখ ভয়ে ভয়ে করেছে।এই বুঝি আবার বিপদে পড়লো।কিন্তু তেমন কিছু হয়নি।বেচেঁ গেছে।স্বাধীন বরকে নিজ আসনে বসিয়ে চলে যায়।গ্রামের লোকেরা আশ্চর্য হচ্ছে।বোবা মেয়ের জন্য এত সুন্দর রাজপুত্র আগমন।তারা কি জেনেশুনে নিচ্ছে এমন মেয়ে।এত ভালো ছেলের জন্য নিশ্চয় মেয়ের অভাব হতো না।এরা মনে হয় ছেলে বাড়ির লোকদের ওপর জাদু করেছে।জাদু না করলে এমন সুপাত্র হাতে পায় কি করে?পাড়াপ্রতিবেশীর গুঞ্জন শুনা যাচ্ছে।স্বাধীন সেইসব কানে তুললো না।বরং কাজিকে বিয়ে পড়াতে বলল।

জেভিন ছেলের কবুল বলাটা নিজ কানে শুনতে চাইলোনা।তার চোখে মুখে বিরক্তি।খুঁজে খুঁজে কনের ঘরে সামনে আসে।দরজা লাগিয়ে কনের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

যতই মুখে মেকআপ লাগাও না কেন?গলায় মালা দেও না কেন?ক্ষেতকে ক্ষেতই লাগবে।গাইয়া মেয়ে একটা।আমার হাসবেন্ড কি দেখে তোমায় পচ্ছন্দ করলো বুঝতে পারছি না?

পুতুল বিদেশি ফর্সা মহিলার কথায় কিছুই বুঝতে পারছে না।ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে রয়।পুতুলের চুপ থাকাটায় আরো বিরক্ত হয়ে জেভিন চলে যায় বারান্দায়।সেখানেই কিছু মহিলা পান খেতে খেতে পুতুলের কথা বলতে থাকেন।

যত চাই কও।বোবা মাইয়ার কপাল খুলছে।একে তোও বাপ,মা মরা মাইয়া।তার ওপর কথা কইতে পারে না।মামা এতিম ভাগ্নীকে বড়লোক ছেলের কপালে জুটিয়ে দিল। মনে হয় টাকার লোভে পড়ে।শুনছি,ছেলের বাপ,মায়ের মেলা টাহা,পয়সা আছে।
জেভিনের কানে এসব কথা আসতেই আকাশ থেকে পড়লো।গালে হাত দিয়ে বলল,

ওহ মাই গড।এত বড় ধোঁকা।এরা দেখছি চিটার,বাটপার।মেয়ের মামা আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলো।এদের টাকার প্রতি এত লোভ।না এই বিয়ে কিছুতেই হতে দেওয়া যাবেনা।এরা চালবাজ।আমি আজই এই বিয়ে ভেঙ্গে দিব।তার আগে পুলিশকে ফোন দিতে হবে।জেভিন পুলিশকে ফোন দিতে দিতে বিয়ের আসরে পৌঁছায়।

১০১.
বন্ধ করুন এই বিয়ে।জেভিন কথায় সবাই চমকে উঠে।দিহান এগিয়ে এসে ব’লে।

আজকে ছেলের বিয়েতে তুমি কি তামাশা শুরু করেছো?

তামাশা আমি নই।এরা করেছে।এদের জিজ্ঞেস কর।এদের কত টাকা চাই?টাকার লোভেই এসব করেছে?কত টাকা পেলে এসব নাটক বন্ধ করবে?পাঁচ লাখ।দশ লাখ,না-কি বিশ লাখ।

জে..ভি..ন।চুপ কর।

কেন চুপ করব?এরা ধোঁকাবাজ।বাটপার।চিটার।টাকা লোভে পড়ে বোবা মেয়েটিকে আমার সুন্দর হ্যান্ডসাম ছেলের গলায় ঝুলিয়ে দিতে চেয়েছে।আমি মা হয়ে এটা মেনে নিবো।একে তোও অশিক্ষিত চাষার গাইয়া মেয়ে।তার ওপর বড় লোক বাড়ির ছেলে দেখে গলায় ঝুলতে যায়।এদেরকে আমি পুলিশে দিব।

দিহান সাহেব নিজের বউকে যত চুপ করাতে চাইছেন।ততই তিনি হাইপার হচ্ছেন।বাড়ির উঠোনে গ্রামের মানুষের ভীর জমেছে।সবাই কানাঘুষা করছে।বাহিরে এত শব্দ শুনে পুতুল ঘর ছেড়ে বারান্দায় দাঁড়ায়।নিজের চোখের সামনে মামাকে বরযাত্রী লোকেরা অপমান করছে।এটা দেখেই কলিজা কেঁপে ওঠে।পুতুল দৌড়ে ছুটে আসে।মামা এবং বরযাত্রী লোকের মাঝে দাড়িয়ে যায়।

চোখের ভাষায় বলছে তাদের অপরাধ কি?

কিন্তু এরপর যে কথাগুলো চারদিক থেকে কানে এসে বিষফোঁড়ন ঘটায়।তাতে পুতুল আর পাঁচটা মেয়ের মতো চোখের পানি ফেলে নিই।বরং শক্ত চোখে তাকিয়ে রয়।দিহান সাহেবের সামনে দাঁড়িয়ে জানতে চায়।

আপনি জানতেন না আমি বোবা?কথা বলতে পারি না।পুতুলের চোখের ভাষাটা তিনি বুঝতে পারেনি।পুতুল একটা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে ভাইকে খাতা,কলম এগিয়ে দিতে বলে।সাজু ছোট নোট বুক,আর কলম বোনের হাতে তুলে দেয়।পুতুল কলম দিয়ে লিখে সেটা দিহান সাহেবের চোখের সামনে ধরেন।

পুতুলের লিখাটা পরে তিনি চোখ নামিয়ে নেন।যার মানে তিনি জানতেন না।পুতুল মামার কষ্ট মাখা মুখটা দিকে না তাকিয়ে বরের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

আপনি ও কি আপনার পরিবারের মতো সবটা জানতেন না।

পুতুলের লিখাটা পরে অন্তর না বলল।

তাহলে না জেনে।কোনো খোঁজ না নিয়ে একটা মেয়েকে বিয়ে করতে চলে আসছেন।এমনটা গল্প,সিনেমাতে হয় শুনেছি।আজ নিজের সাথে হতে দেখছি।পুতুল আবার লিখে সেটা বরের সামনে তুলে ধরে।

এখন আপনারা কি চান?

১০২.
আমরা বিয়েটা ভেঙে দিতে চাই।দেখো আমি বাবা-র এক কথায় তোমার কোনো খোঁজ না নিয়ে বিয়েতে মত দিয়েছিলাম।বাবার কাজে এতটা ভুল হবে আমি যদি একবার জানতাম। কখনোই রাজি হতাম না।একজন শিক্ষিত ছেলে হয়ে তোমাকে যদি বিয়ে করি।লোকে আমায় নিয়ে কটুক্তি করবে।যা আমার পক্ষে
হজম করা সম্ভব নয়।তুমি গ্রামের মেয়ে হওয়াতে আপত্তি ছিল।কিন্তু বাবা বুঝানোর জন্য কোনোরকম রাজি হয়েছিলাম।কিন্তু সেই মেয়ে বোবা হবে।আর এমন মেয়েকে বিয়ে করে বিদেশি বন্ধুদের এবং আত্মীয় স্বজনদের সামনে অপমান হতে চাই না।এমনিতেই কাজিনদের সামনে মান সম্মান শেষ।বিয়েতে ভাগ্যিস অনেক না আসায় বেঁচে গেছি।

বর পক্ষ বিয়ে ভেঙে দিবে শুনে রেনু শাড়ি আঁচলে মুখে গুঁজে কেঁদে ওঠে।স্বাধীনের হাত,পা ঠান্ডা হয়ে আসে।এসব কি হচ্ছে?তার ফুলের মতো মেয়ের গায়ে বিয়ে ভাঙার দাগ লেগে যাবে।সবাই নিন্দা করবে।এতো কষ্ট নিয়ে মেয়েটা বাঁচবে কি করে?
হে আল্লাহ রহম কর!তোমার অসহায় বান্দার প্রতি সহায় হও।

বিয়ে ভাঙ্গার সুর এতখন কানে আসছিল।এখন যেহেতু ছেলে নিজেই ব’লেছে।সে এই বিয়ে করতে পারবেনা।তখন এই কনে সাজে তাকে মানায় না।গলায় থাকা গোলাপ ফুলের মালাটা টেনে ছিঁড়ে ফেললো মাটিতে।

পুতুল ডায়েরিতে কিছু লিখে মামার হাতে কাগজটা খুঁজে দিলো।

মামা তাদের কষ্ট বাড়িয়ে আর লাভ নেই।তারা আমাদের বাড়িতে এসেছিল।না খাইয়ে পাঠিয়েও না।খাইয়ে মেহমানকে রাস্তার পথ চিনিয়ে দেও।

মেয়ের কথায় স্বাধীন নিস্তব্ধ।কি বলবেন কি করবেন বুঝতে পারছে না?মামাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।নিজেই এগিয়ে আসে।দিহান সাহেবকে হাতের ইশারা দিয়ে বলল,

গরিবের বাড়িতে বড়লোকে আত্মীয়তা মানায় না।যদিও ভুলটা আমাদেরই বেশি।তাই সব অন্যায় মাথা পেতে নিচ্ছি।আমি মেয়েটা হয়ত ছোট্ট গ্রামের।কিন্তু আশাটা অনেক বড়।আজ আমাকে নিয়ে যে খেলাটা খেললেন।তা অন্য মেয়ের সাথে করতে যাবেন না।তাহলে তারা এমনই এমনই আপনাদের ছেড়ে দিবে না।আমার সাথে যেটা করলেন।সেটা আমি সারাজীবন মনে রাখব।আপনাদের অবজ্ঞা করার কথা আমার স্মরনে সবসময় থাকবে।
এখন আপনার আসতে পারেন।দরজা ওইদিকে।পুতুল,পূর্ব দিকের দরজা দিকে ইশারায় বুঝিয়ে বলল,তাদের বেরিয়ে যেতে।বর পক্ষ একে একে চলে যেতে নিলেই মিলন বরপক্ষ থেকে নেওয়া টাকাগুলো ফিরিয়ে দিল।

এটা আমাদের দুলামিঞা থেকে পাওয়া হোক ছিল।কিন্তু আপনি আমাদের দুলামিঞা নন।আমরা গরিব হতে পারি।কিন্তু ছোট্ট লোক নই।তাই এই বড়লোকদের টাকা আমাদের চাই না।অন্তরের হাতে টাকাগুলো দিয়ে দেয়।বর পক্ষর সাথে পাড়া প্রতিবেশী চলে যেতেই মিলন,সাজু মেইন গেটের দরজাটা মুখের ওপর বন্ধ করে দেয়।স্বাধীন মেয়ের এই পরিনতির জন্য নিজেকে দায়ী করছে।বিয়ের বাড়ির উঠোনে বসে কপালে হাত দিয়ে কাঁদতে থাকে।পুতুল দৌড়ে এসে মামার দুই চোখের পানি মুছে দিতে দিতে বলল,

তুমি কেঁদো না।তোমার চোখের পানি দেখলে আমার খুব কষ্ট হয়।আল্লাহ যা করেন তা আমাদের ভালোর জন্যই করেন।সবাই আমাকে কথা শুনাচ্ছে।কই আমি তোও এক ফোটা চোখের জল ফেলছি না।

চলবে….

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৩২
১০৩.
তালুকদার বাড়িতে বর পক্ষের সবাই হাজির।বউ ছাড়া সবাই ফিরে এসেছে।অসীম তালুকদার বন্ধুকে কিছু জিজ্ঞেস করতে চান।কিন্তু তিনি মুখ ভাড় করে সোফায় বসে আছেন।জেভিন স্বামীর ওপর চিতকার চেচামেচি করে দোষারোপ করছে।

অন্তর মাথা নিচু করে বন্ধুদের সাথে টুকটাক কথা বলছে।

কি’রে দিহান ছেলে বিয়ে করেছে।আর তোরা মুখ ভার করে বসে আছিস কেন?ছেলের বউ কোথায়?বউমাকে সামনে আন।মুখটা দেখি।

যেখানে বিয়ে হয়নি।সেখানে বউমা আসবে কোথা থেকে?ওরা আমাদের সাথে চিট করেছে।আমাদের ধোঁকায় রেখে ছেলের গলায় বোবা মেয়েটিকে ঝুলিয়ে দিতে চেয়েছে।ভেবেছে পরে ভুঝুংবাঝুং বুঝিয়ে দিলেই বিশ্বাস করে নিবো।মগের মুল্লুক পেয়েছিল।জেভিন রওয়ার্ড কথায় অসীম তালুকদার দিহানের দিকে তাকিয়ে বলল,

কোন বাড়ির মেয়ে?তুই তোও সবটা জেনেই বিয়েতে মত দিয়েছিলি।তাহলে বিয়ের আসর থেকে ছেলেকে নিয়ে চলে আসছি কেন?
একটা মেয়ের গায়ে কত বড় দাগ লাগলো বুঝতে পারছি?দিহান তুই বুঝতে পারছি না!

আশ্চর্য।আপনি ওই মেয়ের কথা চিন্তা করছেন।আর আমাদের কি সর্বনাশ হতে যাচ্ছিলো?তার বেলা কি হবে?আমি চাইছি ওদের পুলিশে দিব।মানহানি মামলায় আসামি করব!

ভাবী একটু ঠান্ডা মাথায় ভেবে দেখুন। আপনারা নিজেরাই আগে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন।তাদের বাড়িতে গিয়ে তাদের কাছে সমদ্ধ রেখেছেন।তারা কিন্তু বিয়ে প্রস্তাব রাখেনি।আর রইলো,মানহানির মামলা ঠুকবেন।সেটা কিন্তু ভুলেও করতে যাবেন না।তাহলে আপনারাই উল্টো ফেসে যাবেন।কারণ বিয়ের পাকা কথা এমনকি বিয়ে আসর পর্যন্ত কনে এবং তার পরিবারকে আশা দিয়ে আপনারাই নিয়েছেন।সেই আসরে বিয়ে আপনারাই ভেঙে এসেছেন।কেন ভেঙেছেন?মেয়ে কথা বলতে পারেনা।হাই ক্লাসের দোয়াই দিচ্ছেন।কিন্তু একবার ভেবেছেন।ওই মেয়েটির কত বড় ক্ষতি হলো?আপনাদের ভুলের জন্য সে কি দ্বিতীয় বিয়ে করার কথা মাথায় আনবে?না,আনবে না।তার জন্য ব্যাপারটা সহজ নয়।তাকে প্রতিপদে কথা শুনতে হবে।বিয়ে আসরে যে মেয়েকে বরপক্ষ না করে দেয়।তারজন্য ভালো প্রস্তাব কি আর আসবে?খোজঁ নিয়ে দেখুন।তাঁকে নিয়ে গ্রামে গ্রামে এতখনে কথা রটে গেছে।সবার মুখে একটা কথাই থাকবে।
নিশ্চয় মেয়ের মধ্যে কোনো খুত ছিল।তাই বর পক্ষ বিয়ে ভাঙ্গছে।সে অপয়া,অলক্ষ্মী।তার জন্য শুভ কোনো অনুষ্ঠানে যাওয়া বন্ধ। সে কোথাও থাকতে পারবেনা।সমাজ থেকে বিতারিত হবে।এসব কিন্তু তার জন্য সাধারণ সমস্যা নয়।কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি সে হতে চলেছে।সেইদিন আমার এই বন্ধু খুব আনন্দের সাথে আমাকে সবটা ব’লেছিল।আমি শুনে খুশি হয়েছিলাম।কিন্তু সে এটা বলেনি।মেয়ে বাকপ্রতিবন্ধী।কিংবা ছেলের সাথে মেয়ের আলাদা কথা বলতে দেওয়া হবে,বা হয়েছে।আর নিজে একটু আশেপাশে খোঁজ নিয়ে যাচাই- বাছাই করা।সেসব না করে এত দূর অবধি আগানো কতটা বোকামির কাজ ভাবতে পারছেন।আপনি ছেলের মা তাতেই আপনার মাথায় আগুন জ্বলছে।একবার ভেবেছেন।তাদের কি অবস্থা?

১০৪.

অসীম তুই আমার বন্ধু হয়ে ওদের কথা ভাবছিস।আমাদের দিকটা দেখছিস না।অনেকেই জানে ছেলের বউ নিয়ে আসছি।যখন বিদেশে যাব।তখন সবাই দেখবে বউ ছাড়া এসেছি।বিয়ে না হওয়ার ব্যাপারটা যখন লোকে জানবে তখন ছি,ছি বলবে।লজ্জায় আমার মাথা কাটাঁ যাবে।

ভাবতে চাই নিই।তুই ভাবতে বাধ্য করেছিস।
কেনো তুই সবটা না জেনে এত দূর অবধি গেলি।

বিশ্বাস কর আমি ওর সাথে সরাসরি কথা বলিনি।মেয়েটি সুন্দর আর মার্জিত,এবং কিছুটা শিক্ষিত এতটুকুই জানতাম।আমার দাদা চান মিয়া মেয়েটি সম্পর্কে সব বলেও মেয়েটি কথা না বলতে পারার ব্যাপারটি জানাননি।যখন আমার হাত ধরে কথা দিয়ে বললেন,মেয়েটিকে অন্তরের বউ করতে।মেয়েটা অসহায়,গরিব।তখন ভাবলাম।গরিব একটা মেয়েকে ছেলের বউ করলে মানুষের সহানুভূতি পাব।মানুষের ধারণা বদলাবে।

তাই নিজেই সবটা করে ফেললি।এখন আপসোস হচ্ছে।কারণ মেয়েটি অসহায় গরিব।আর তার ওপরের কথা বলতে পারেনা।আচ্ছা মেয়েটি কথা না বলার পিছনে ওর কি কোনো হাত ছিল।ওহ জম্ম থেকে না-কি কথা বলতে পারেনা।এটা ওপর ওয়ালার ইচ্ছা।সেখানে আমি,তুই, মেয়েটির কোনো দোষ দিয়ে লাভ নাই।

তাহলে তুই কি বলতে চাস?ওই মেয়েকে ছেলের জন্য আনতাম।আমার জন্য আমার ছেলের জীবন নষ্ট করে দিতাম।

না,আমি সেটা বলিনি।যা করেছিস সেটা ভুল করেছিস।অন্যায় করেছিস।এটা মানতে বলছি।স্বীকার করতে বলছি।

এতোই যখন দরদ।তখন আপনি আপনার ছেলের জন্য ওই বোবা গাইয়া মেয়েকে বউ করে আনুন।

ভাবি এখানে আপনার ছেলের সাথে মেয়েটির কথা আসছে।আমার ছেলের সাথে নয়।তবে হ্যা যদি কোনোদিন এমনও পরিস্থিতি হয়ে থাকে।কিংবা আমার ছেলে সবটা জেনে মেয়েটিকে গ্রহণ করে।তাহলে আমি তাঁকে সাদরে গ্রহণ করব।সেখানে থাকবে না কোনো মিথ্যার আশ্বাস।না থাকবে অবহেলা।

অসীম তালুকদার কথায় বিরক্ত হয়ে জেভিন বলল,

এখানে আর এক মুহূর্ত নয়।কাল সকালেই চলে যাব।

পুতুল টিউবওয়েল চাপিয়ে বালতি ভরে মাথায় পানি ঢালছে।মুখে সাজগোছ পানিতে ধূয়ে যাচ্ছে।এত রাতে পুতুলের সামনে রেনু দাঁড়িয়ে আছে।মেয়েটার মনে কি ঝড় বয়ে যাচ্ছে?রেনু বুঝতে চেষ্টা করে লাভ হলো না।ব্যথ চোখে তাকিয়ে ডাক দিল।

পুতুল এত রাতে গোসল করছো ঠান্ডা লেগে যাবে।পানি গায়ে আর ঢেলো না।চলে আসো।
পুতুলের গোসল সম্পূর্ণ করে কলপাড় ছেড়ে ঘরে যেতে নিলেই রেনু বলল,

তুই ঠিক আছিস।কষ্ট পাচ্ছিস।

পুতুল নিচু মাথাটা উচু করে মামীকে চোখের ইশারায় বলল,

আমি ঠিক আছি।আমি কষ্ট পাচ্ছি না।আমার সাথে যা হওয়ার তা হয়ে গেছে।সেসব ভুলে যেতে চাইছি।বিয়ে নিয়ে আমার মনে অনুভূতিগুলো এখন মৃত মামী।আমি আমার জীবনে আর কাউকে জড়াতে চাই না।আমার ছোট এই জীবনে সুখ পাওয়া থেকে না পাওয়া কষ্টগুলো বেশি।বাবা নামক মানুষটিকে ঘৃনার খাতায় সেই কবে লিখেছিলাম।মনে নেই।আজ নতুন করে আরো একটি ঘৃণার খাতায় নাম উঠে আসলো।সাথে এতটুকু বুঝতে পেরেছি।আমার কপালে ওসব ভালোবাসার মানুষ শব্দটা নেই।কেউ সবটা জেনে আপন করতে আসবে না।যদি কেউ ভুলে ওহ চলে আসে।তাহলে মনে রেখো।ভালোবেসে নয় করুণা করে গ্রহণ করছে।দয়া দেখাচ্ছে।

কিন্তু আমি তোও কারো করুণা,দয়া নিয়ে বাঁচতে চাই না।আমাকে যদি বাঁচতে হয়।তাহলে নিজের সাথে লড়াই করে বাঁচব।এই সমাজের মাঝে থেকে দেখিয়ে দিতে চাই।নিজে নিজেকে ভালোবেসে ওহ বেঁচে থাকা চায়।নিজের লক্ষ্য অবধি যাওয়া চায়।নিজের স্বপ্নটাকে পূরণ করা যায়।পুতুল চাদঁ বিহীন আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে আরো বলল,

আমি আমার আল্লাহ কাছেই সব কথা বলবো।যে যারা আমায় কাঁদায়।যারা আমাকে কষ্ট দেয়।তাদের যেন আমার আল্লাহ দেখে নেয়।

১০৫.
আজ সকালের সূর্য তার তেজ দেখাতে ব্যাস্ত।সূর্য সাহেব আজ কার ওপর রাগ দেখাচ্ছে বুঝতে পারছে না।অর্পণের মুখের ওপর সূর্যের আলো এসে পড়তেই উঠে বসে।কোথায় আছে মনে করতেই মনটা খারাপ হয়ে যায়।আজ সে অনেক দূরে।কাল রাতে গ্রামে থাকায় দম বন্ধ লাগছিলো।তাই একবুক কষ্ট নিয়েই কাউকে না জানিয়ে রাতের আধারেরই গ্রাম থেকে ঢাকায় ফিরে আসে।সিদ্ধান্ত নেয়,সে ওই ছোট গ্রামে আর কোনোদিন ফিরে যাবেনা।কোনোদিন না।

তার ভালোবাসার মানুষটি আজ অন্য কারো ঘরে।সে অন্য কারো ভালোবাসার মায়া ডুবে।সে কোনোদিন জানবেই না।অর্পণ নামের কেউ তাকে খুব করে চাইতো।সেখানে না ছিল দয়া,আর না ছিল করুণা।একবুক নিঃস্বার্থ ভালোবেসেছিল।তার নতুন জীবনের জন্য অনেক অনেক দোয়া রইলো।সে তার নতুন জীবন সঙ্গী সাথেই খুশি থাকুক।আমি না হয় তার থেকে পাওয়া শেষ সৃতি টুকু আঁকড়ে বেঁচে থাকব।পকেট থেকে ছোট রুমালটা হাতে পেচিয়ে বেঁধে নিলো।পাঞ্জাবির হাতাটুকু নামিয়ে ডেকে দিলো।পুতুলের তৈরি নিজের নামটি পাঞ্জাবির হাতার ভিতরে লুকিয়ে রয়েছে।

ভালো থেকেও পুতুল।সুখে থেকো।

এইদিকে একজন নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে যাচ্ছে।সে জানতেই পারলো না।তার প্রিয় মানুষটি অন্য কারো হয়ে যায় নিই।অপরদিকে পুতুল নিজেকে তৈরি করছে নিজের লক্ষ্য অবধি যাওয়া জন্য।

স্বাধীন মেয়ের মুখোমুখি হওয়ার সাহস করতে পারেনি।কয়েকদিন ধরে মুখ লুকিয়ে ভোর হওয়ার আগেই গ্রাম ছাড়া হচ্ছে।আবার মুখ লুকিয়ে রাতের আঁধারের ঘরে এসে চুপটি করে শুয়ে পড়ে।রেনু স্বামীর কাজের জন্য কি বলবে বুঝতে পারছে না।মানুষটার মুখের দিকে তাকানো যায় না।কয়েকদিনে কেমন শুকিয়ে গেছে।মেয়ের চিন্তায় ঠিক মতো খায় না।ঘুমায় না।কেমন ছটপট করে।

চলবে….

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৩৩
১০৬.
পুতুলের বাপ,আমারে আপনি তালাক দিয়েন না।আমার মাইয়ার মুখের দিকে তাকায় রহম করেন।আমি না খাইয়া আপনারর সংসারে আমার পুতুলের নিইয়া আপনার সাথে সারাজীবন থাকুম।তবুও আমারে তালাক দিয়েন না।আমি মইরা যামু।

আজকেই তোরে তালাক দিমু।তুই আমার সামনে আমার মায়ের মুখে মুখে কথা কস।
এক তালাক,দুই তালাক,তিন তালাক বলেই মোস্তফা বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার আগেই রাজিয়ার কোমড়ে জোরে লাথি মেরে চলে যায়।মোস্তফা মুখে তালাক দিতেই রাজিয়া আল্লাহ গোও ব’লে ওখানেই জ্ঞান হারায়।

পুতুল,তোর বাপ আমারে তালাক দিছে।এরপর কেমন থাকুম তার সংসারে?তুই ক?আমি তো এখন পরগাছা।এত ভালোবাসার প্রতিদান আজ বুঝি পাইলাম।বাপ,ভাইয়ের মনে কষ্ট দিচ্ছিলাম না।তার ফল আমি পাইছি।চল,এখান থেকে চইলা যাই।তোরে রাইখা গেলে মা*ইরা ফেলাইব এরা।আমি বাঁইচা থাকতে তোরে এহেনে রাইখা যামু না।মা রা*রি হয়েছি তো কি হইছে?তুই আমার কলিজা মধ্যে থাকবি।আমি তো মা,চাইলেও তোরে ফালাইয়া দিতে পারুম না।এই আল্লাহ দুনিয়ায় কোথাও না কোথাও ঠিক ঠাঁই হইবো,আমগো মা,বেটির।

কালো রাতের আঁধারের ঘুমিয়ে আছে পুতুল। মায়ের পুরোনো কথা এবং দৃশ্যগুলো চোখের সামনে ভেসে ওঠে।ঘুমের মধ্যে পুতুল অস্থিরতাবোধ করে।ঘুম ভেঙ্গে যায়।কপালের ঘাম টুকু মুছে আকাশের চাঁদটির দিকে তাকিয়ে ডাকে।
মা,ওমা তুমি না আমাকে তোমার বুকে টেনে ব’লেছিলে।তোমার হাতটা কখনো আমার মাথার ওপর থেকে যাবে না।আজ কতগুলো দিন চলে গেছে।তুমি আমার পাশে নেই।তোমার কান্না,তোমার কথাগুলো আজ-ও আমার কানে লাগে।আমি চাইলেও তোমায় ভুলতে পারিনি।মা আমি বড্ড ভেঙে পড়েছি।পুতুল কাদঁতে চায় কিন্তু পারেননা।আমার মনটা আমায় দূর্বল করে।মন ব’লে তুমি পারবে না।আর মস্তিষ্ক ব’লে তোমাকে পারতেই হবে।পুতুল তুমি পারবে।এই লড়াই তোমার একার হলেও এখানে তোমার মা,এবং মামা,মামীর প্রতিদান বেশি।তাদের জন্য আজ তুমি ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন বুনো।তারা ছিলো ব’লে তোমার গল্পটা অন্য রকম হ’য়েছে।আর পাঁচটা মেয়ের মতো নরম মাটি তুমি নও।সব জায়গায় কেঁদে বা ভয় পেয়ে হে’রে যাওয়ার গল্পটা তোমার হয়নি।এক অন্য তুমিই জম্ম নিয়েছো।এক অসীম সাহস রাখো।তুমি পারবে পুতুল তুমি পারবে।

১০৭.
অর্পণ মিটিংয়ে রুমে বসে আছে।প্রত্যেকের ফোন সাইলেন্ট রাখা হয়েছে।মিটিং রুমে পার্টির লোকেরা এসেছে।তারা বিভিন্ন আলোচনায় ব্যাস্ত।কিন্তু অর্পণ কেমন যেন গুরু গম্ভীর মুখে বসে আছে।পার্টির সবার কথা বসে শুনছে।কখনো হুম,হা বলে মত দিচ্ছে।অর্পণ এত চুপচাপ হয়ে যাওয়া।দলীয় পার্টির লোক কামরুজ্জামান চৌধুরী বিষয়টা অনেকখন ধরে দেখছে।গরম চায়ে তার জিহ্বা পুড়ে।তাই একটু আগে আনিয়ে রাখা ঠান্ডা চায়ের কাপে আরামসে চুমুক দিয়ে বলল,

অর্পণ।কি ব্যাপার?আজ এত চুপচাপ কেনো?কোনো সমস্যা?সমস্যা হলে বলতে পারো।
কামরুজ্জামানের কথায় সবাই অর্পণের দিকে তাকিয়ে রয়।অর্পণ নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক রাখা চেষ্টা করে কিন্তু পারেনি।গম্ভীর এবং মোটা স্বরে বলল,

কিছুই হয়নি।আমি ঠিক আছি।প্লিজ মিটিং কন্টিনিউ রাখুন।

আজ কয়েকদিন ধরে অসীম তালুকদার ছেলেকে লাগাতার ফোন করেই যাচ্ছেন।কিন্তু ছেলে তার ফোন তুলছে না।আর না বাড়িতে ফিরে আসার কথা মাথায় আনছে।ছেলের বিহেভিয়ার জন্য অসীম তালুকদার অসন্তুষ্ট হন।

মিটিং শেষ হলেই অফিস রুম থেকে বেরিয়ে আসে।এগিয়ে যায় গাড়ির দিকে।পেছনে বসেই ড্রাইভারকে কলেজের দিকে নিতে বলে।পকেট থেকে ফোনটা বের করে সামনে ধরতেই চোখের সামনে বাবার একশ পাচঁটা মিস কল ভেসে উঠে।কিন্তু বাবাকে দ্বিতীয়বার ফোন করার চিন্তা করে না।শুধু হাতে আঙুলের সাহায্য কি-বোর্ড চাপে।ছোট একটা ম্যাসেজ বাবার কাছে পাঠিয়ে দিয়ে ফোনটা পকেটে ভরে রাখে।

কলেজে নবীন বরণ হচ্ছে।পুতুল প্রথমে আসতে চায় নিই।কিন্তু না এলেও গ্রামের মানুষ কথা শুনাতো।ভাবত বিয়ে ভাঙ্গার জন্য ঘরে খিল দিয়েছি।এক কথা থেকে পাঁচ কথা ছড়াবে।তাই নিজেকে তৈরি করে একদম পরিপাটি হয়ে নিজ কলেজের জন্য বের হয়।মামাকে সাথে আনতে ভুলে নিই।তাকে জোর করে নিয়েই বেরিয়েছে।কলেজ গেইটে অবধি মামা তাকে নামিয়ে অন্য একটা কাজে চলে যায়।এইদিকে অর্পণ কলেজের প্রধাণ অতীত হয়ে এসেছে।তার সাথে কামরুলজামান এমনকি দলের ছেলেরা রয়েছে।অতিথি হিসেবে নিজ আসন গ্রহণ করতেই চোখে পরে তৃতীয় সারিতে বসে থাকা পুতুলের দিকে।সে মনযোগ দিয়ে মাইকিংয়ে বলা কথাগুলো শুনছে।অন্য দিকে তার নজর নেই।এইদিকে অর্পণ চমকে উঠে।একপলক তাকিয়ে চোখ সাথে সাথে সরিয়ে নেয়।অন্য কারো বউকে দেখা উচিত নয়।বিয়ে হতে না হতেই মেয়েটা কলেজে চলে আসলো।মনে হচ্ছে সে স্বপ্ন দেখছে।হ্যাঁ,স্বপ্নই হবে।

আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।তাই ভুলভাল দেখছি।পুতুলের দিকে আর একবারও না তাকিয়ে অনুষ্ঠান দ্রুত শেষ করার তাড়া দিল।তার এসব ভালো লাগছে না।সে বের হতে পারলেই যেন বেঁচে যায়।

পুতুলের গায়ে বাসন্তী শাড়ি।মাথায় কালো ওড়না দিয়ে হিজাব পরিধান করা।হাত দু’টোতে রেশমি কাঁচের চুরি।অনুষ্ঠান এখনো শেষ হয়নি।পুতুলের অতিরিক্ত গরম লাগছে তার ওপর মন ভালো লাগছিল না।তাই চলে আসে।কলেজ প্রাঙ্গনে পিছনের দিকটায় এসে দাড়িয়ে রয়।এইদিকে অর্পণের ফোনে জরুরি কল আসে।নিরিবিলি একটুও কথা বলার জন্য কলেজের পিছনে চলে আসে।নিজের ফোনে কথা শেষ করে চলে যেতেই নিলেই আবার চোখের সামনে পুতুলকে হাঁটতে দেখে।ভাবে এটা তার কল্পনা।

নিজের চোখ দুটো হাত দিয়ে চুলকে আবার তাকিয়ে দেখে।না এটা সত্যি। পুতুল এইদিকেই আসছে।পুতুলকে দেখে তার বুকটা ধরপর করে উঠে।বুকের বাম পাশে হাতটা দিয়ে বুকটা শক্ত করে চেপে পালাতে চায়।কিন্তু বেচারা অর্পণ।পালাতে গিয়ে ঠাসস করেই পুতুলের পায়ের সামনেই পরে গেলো।

এইদিকে পুতুল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পরে।চোখের সামনে এমপি সাহেবকে মাটিতে পরতে দেখে হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারছে না।পুতুল এগিয়ে আশার আগেই অর্পণ তাড়াতাড়ি উঠে পড়ে।নিজের হাত দিয়ে পাঞ্জাবিতে থাকা ময়লা পরিষ্কার করতে করতে বলল,

এভাবে তাকিয়ে থাকার মানে কি?জীবনে ছেলে দেখো নিই।এমপি সাহেবের কথায় পুতুল চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রয়।

আবার চোখ বড় বড় করে তাকায়।তুমি কি চোখ দিয়ে ঘায়েল করার ধান্দায় আছো?

পুতুল মাথা নাড়িয়ে না ব’লে।

ওহ বাবা আবার মাথা নাড়িয়ে না বলা হচ্ছে।এই তুমি গ্রাম ছেড়ে এখানে কেনো এসেছো?আমাকে জ্বালাতে,পুড়াতে।তুমি কি বুঝতে পারো না?তোমাকে দেখলেই আমার বুকের ভিতরে অসয্য জন্তনা করে।তুমি আমার সামনে আর কখনোও আসবে না।তোমার জন্য আমাকে পুড়তে হয়।আমি তোমার জন্য আর পুরতে চাই না।দূরে থাকো।স্বামী,সংসার নিয়ে ভালো থাকো।অর্পণ রেগে হনহন করে চলে যায়।পুতুল হা করে তাকিয়ে আছে।এই লোকটা তাকে কি বলল?তার জন্য পুড়ে।কিন্তু কেন?পুতুল আবার কিছু ভাবতে নিলেই অর্পণ তার সামনে আবার এসে দাড়ায়।তার দিকে এক ধ্যাণে তাকিয়ে বলল,

তুমি সত্যি এসেছো?না-কি এটা আমার কল্পনা।যদি কল্পনা হও।তাহলে চোখের সামনে থেকে দূর হও।আমার সামনে আসলেই গুলি করে দিব।

অর্পণ গুলি করে দিবে।এই কথাটা কানে আসতেই পুতুল ঘাবড়ে গেলো।শাড়ির আঁচল ধরে যে পথে এসেছে সেই পথ দিয়ে দৌড়ে চলে যায়।পুতুলের দৌড় দেখে এমপি সাহেব হা করে তাকিয়ে বলল,

এই মেয়ে সত্যি এসেছে।বজ্জাত মেয়েটা আমায় আর শান্তি দিবে না।

১০৮.
অনেকদিন পরে ছেলে নিজ থেকে তাঁকে ফোন করছে ভাবতেই অবাক হয়।অসীম তালুকদার ছেলের ফোন পেয়ে কানে তুলেন।

তোমরা আমার জাত শত্রুর।গ্রামে থাকতে দিবেনা।শহরে আসলেও জ্বালাবা!কেন বাপ?তোমরা আমারে জ্বালানোর জন্য এত উতলা কেন?আমাকে পুড়াতে এত তেল কই পাও?কে দেয় এত টাকা?তোমার বাপ।কিন্তু বুইড়া মরছে উনিশ কটকটি সালে।সে মইরা আমার কপালে তোমারে জুটাইয়া দিয়া গেছে।খবিশ বাপের পোলাটা খবিশ হইছে।তার ঘরে খবিশের বাচ্চা অর্পণ তালুকদার।

এতদিন পরে ছেলে ফোন দিয়েছে।কোথায় সালাম টালাম দিবে।তা না করে কি উল্টাপাল্টা কথা বলছে?অসীম তালুকদার ছেলেকে বলল,

তোমার মাথা ঠিক নেই পড়ে কথা বলো।

আমার মাথা ঠিকই আছে।তোমার ইয়ার গিয়ারে বন্ধুটা কই?তার ছেলেকে বিয়ে করিয়েছে।খুব ভালো কথা।কিন্তু বিদেশে মাটিতে না গিয়ে এখানে কি করছে?

কোথায় আবার চলে গেছে?আর ওর ছেলের বিয়েটা হয়নি।

বিয়ে হয়নি মানে?

হয়নি,মানে হয়নি।অসীম তালুকদার একে একে পুরো ঘটনা বলতেই অর্পণের মনটা খারাপ হয়ে যায়।এতকিছু হয়েছে আর সে জানেই না।পরমুহূর্তেই মুখে হাসি ফুটে।ইয়াহু ব’লে চিৎকার করে উঠে।ফোনের ওপাশে ছেলের হঠাৎ চিতকারে অসীম তালুকদার ভয় পেয়ে যান।বুকে থু থু ছিটান।ধমক দিয়ে বলল,

ইয়ার্কি হচ্ছে।এত সিরিয়াস মোমেন্ট তুমি ফাজলামো কর আমার সাথে।আমি তোমার বিয়াইন লাগি।

আস্তগফিরুল্লাহ।তুমি আমার একমাত্র বাপ লাগো।বিয়াইন হবে কেন?আচ্ছা এখন ফোন রাখছি।পরে কথা বলব।

অর্পণ খুশিতে মনে হয় পাগল হয়ে যাবে।পকেটে ফোনটা রেখে দৌড়ে এদিক থেকে ওদিকে ছুটে যায়।কোথাও পুতুলের দেখা না পেয়ে অনুষ্ঠানে যোগ দেয়।পুতুল এতখন আবৃতি শুনছিল।হঠ্যা অর্পণের চোখে চোখ পড়তেই চোখ নামিয়ে ফেলে।আর অর্পণের ঠোঁটে মুচকি হাসি ফুটে।প্রিয়তমাকে আবার ফিরে পাওয়ার আশায় হাতটা বুকে রেখে দিল।

চলবে…

চক্ষে আমার তৃষ্ণা পর্ব-২৮+২৯+৩০

0

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-২৮
৮৮.
আমার বাবার প্রতি আমার এক আকাশ পরিমাণ ঘৃনা।কারণ আমার প্রতিটা চোখের ঝরা পানির কারণ তিনি।বাবা শব্দ নিয়ে যত ভুলে থাকতেই চাই,ততই সামনে এসে দাড়ায়। মনে করিয়ে দেয়।আমার বিষাদময় জীবনের গল্পটা।আমি পৃথিবীতে এসেছিলাম।শুধু মাএ মায়ের কারণে।আর আজ সে নেই।বাবা নামক মানুষটি আমার পাশে আগেও ছিল না।আর এখনো থাকার প্রশ্নই উঠে না।সে আমার অতীত।অতীত হয়ে থাক।

আজ পুতুল এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে এসেছে।এটাই তার লাস্ট পরীক্ষা ছিল।বাসায় আসতেই শুনতে পায় বিদেশ থেকে তার চাচা এসেছে।তাকে দেখতে চায়।কিন্তু পুতুল তার সামনে যেতে চায়না।তার ওই বাড়ি কিংবা ওই বাড়ির কারো সাথে কোনো সম্পর্ক নেই।বাবা শব্দ তার জন্য মৃত।পুতুল নিজের কথায় অনড়।সে বিন্দু মাত্র ঘর থেকে নড়লো না।তার এমন কথা দিহান সাহেব জানতে বা শুনতে পেলেন না।তিনি স্বাধীনের ঘরের বারান্দায় বসে আছেন।একটিবার পুতুলকে দেখতে চান।কিছু কথা ব’লে চলে যাবেন।কিন্তু পুতুল আসেনি।স্বাধীনের হাতে চিরকুট গুঁজে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে নিজের ঘরেই দাঁড়িয়ে রয়।স্বাধীন চিরকুট পড়ে,ছোট্ট করে নিশ্বাস ছেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।

স্বাধীনকে দেখে দিহান সাহেব দাঁড়িয়ে যান।কিন্তু পুতুলকে দেখতে না পেয়ে বলল,

পুতুল কোথায়?সে কি একটিবার আমার কাছে আসবে না?

স্বাধীন তার প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারেনি।স্বাধীন নিশ্চুপ থাকায় তিনিও খুব হতাশ হন।ছোট করে নিশ্বাস ফেলে বলল,

পুতুলের বড় আব্বু আর নেই।তিনি মারা গেছেন।

স্বাধীন চমকে উঠে।দিহান সাহেব দিকে তাকিয়ে বলল।

কবে মারা গেলেন?

তিনমাস হয়েছে।মৃত্যুর কয়েকমাস আগে থেকেই বিছানায় পড়ে ছিলেন।বিদেশে ডাক্তার দেখিয়ে ওহ কাজ হয়নি।তবে যাওয়ার আগেই তিনি তার শেষ ইচ্ছের কথা জানিয়ে যান।পুতুলের বড় আব্বু শেষ ইচ্ছে ছিল পুতুলের বিয়ে হোক।আর শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী চেয়েছেন,পুতুলের হাত আমার ছেলের জন্য।কারণ দলিল অনুযায়ী পুতুলের আঠারো হতে বেশি বাকি নেই।আঠারো হলেই মেয়ে বিয়ে জন্য উপযুক্ত।পড়াশোনা সে বিয়ের পরেও করতে পারবে।এতে কারো কোনো আপত্তি নেই।কিন্তু সমস্যা ওই দলিল লিখিত তৈরি হওয়া নিয়ে।বিয়ে আঠারো মধ্যেই হতে হবে।যদি আঠারো মধ্যে বিয়ে না হয়।তাহলে সামনে যে ঝড়টা আসবে সেটা আমি কিংবা আপনি,কেউ তাকে রক্ষা করতে পারবনা।

দিহান কথায় স্বাধীন আরেকটিবার চমকে উঠে।পুতুলের বিয়ে নিয়ে সবার এত মাথা ব্যাথা কেন?আর কিসের বিপদের কথা বলছেন উনি?স্বাধীন বুঝতে পারছে না।স্বাধীন না বুঝতে পারায় দিহান সাহেব হতাশ হন।সবটা ডিটেইলসে বলতে পারছেন না।শত হোক নিজেদের রক্তের টান রয়েছে।কিন্তু স্বাধীন বিয়েটা দিতে যত দেড়ি করবে।পুতুলের মৃত্যু ততটাই ঘনিয়ে আসবে।আর পুতুলের কিছু হলে সরোয়ার বংশের কোনো অংশীদার রইবে না।

৮৯.
একজন বাবা হিসেবে বলছি না।একজন মানুষ হিসেবে বলছি।আমার ছেলে অন্তর অতটাও খারাপ নয়।সে শিক্ষিত এবং বেশ মার্জিতভাবেই চলাফেরা করে।তার কথাবার্তায় দেশের প্রতি টান রয়েছে।সে অল্প বয়সে বিদেশের মাটিতে গেছে ঠিকই।কিন্তু দেশের প্রতি অসীম ভালোবাসায় ডুবন্ত।সে দেশে ফিরতে চায়।পড়াশোনা তার শেষ।কিন্তু বিজনেসের কাজের জন্য আসতে দিচ্ছি না।সবে নতুন বিজনেসে ঢুকেছে।এমন সময় দেশে আসা ঠিক হবেনা।আমি বিয়ের ব্যাপারটা অন্তরকে এখনো বলিনি।সে এসব জানে না।আপনার অনুমতি পেলেই জানাবো।

দিহান সাহেবের কথায় স্বাধীন কি বলবে বুঝে উঠতে পারছেনা?একদিকে মেয়ের স্বপ্ন।আর অন্যদিকে বিয়ের জন্য ভালো পাত্র।মেয়েদের বাবারা সব সব সময় মেয়ের জন্য বেস্ট খুঁজে।সেখানে তার মেয়ে’র দূর্বলতার কথা জানে কি না বুঝতে চেষ্টা করছেন।

আমি আমার মেয়েকে এত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চাই না।তাকে কথা দিয়েছি।তার স্বপ্ন পূরণ না হওয়া পর্যন্ত।কোনোকিছুতেই জোর করবোনা।

দেখুন স্বাধীন সাহেব মেয়ে আপনার।আপনার ইচ্ছে বিরুদ্ধে আমি তাকে জোর করতে পারি না।ছেলের বউ নিতে এসেছি।কোনো বিরুদ্ধ করতে নয়।আপনি শান্তি পূর্ণভাবে মেয়ে দিলেই নিয়ে যাব।এখন সময় দিচ্ছি সময় নিন।ভেবে না হয় জানাবেন।আসছি।দিহান উঠতে নিলেই স্বাধীন বলল,

মেহমান হয়ে যখন আমার বাড়িতে এসেছেন।তখন আপ্যায়ণ না করে কিভাবে ছাড়ি?আপনি এখানে থেকে যান।এই ফাঁকে না হয় পুতুলকে দেখে যাবেন।

আপনি থাকতে বলেছেন।এতেই আমি খুশি।কিন্তু আজ উঠতে হবে।আমার বন্ধু অসীম তালুকদারের বাড়িতে যেতে হবে।তাঁকে অলরেডি কথা দিয়েছি।বিজনেসে কিছু কাজ তার সাথে করা বাকি।তাই দুইদিন তার বাসাতেই থাকব।তিন দিনের দিন ফ্লাইট।দিহান সাহেব চলে যেতেই পুতুল রুম থেকে বের হয়ে আসে।কিন্তু স্বাধীন মেয়ের সাথে কোনো কথা না ব’লে হনহনিয়ে বাহিরে রাস্তা পথে চলে যায়।তার মেয়ের প্রতি অভিমান হ’য়েছে।বড়দের সম্মান করে।কিন্তু বাবা-র বাড়ির লোক ব’লে আসবেনা।এটা তোও ঠিক না।

৯০.
বাইকে বসে দুই ঠোঁটের মাঝে সিগারেট নিয়ে একটু পর পর টান দিচ্ছে অর্পন।পড়াশোনা কম্পিলিট না করে রাজনীতিতে পুরোপুরি ডুবে গেছে।সামনে ভোটাভুটি শুরু।কিছু চিন্তা করেই যাচ্ছে।জিসান,রিহান দুই চাচাতো ভাই তার পাশে বসে আছে।

কি’রে ভাই আজ তুই এত চুপচাপ কেন?অর্পন সিগারেটে শেষ টান বসিয়ে ফেলে দিল।ঠোটঁ উচিয়ে সিগারেট শেষ ধোঁয়া ছেড়ে বলল।

তোরা তৈরি হ।বাসায় যাব।দুইদিন থেকেই চলে আসবো।

অর্পন কথায় দুই ভাই একে অপরের দিকে তাকিয়ে বলল,

সূর্য আজ কোন দিকে উঠল ভাই।যার কানে সামনে হাজারবার চিতকার করে বাসায় যাওয়ার কথা ব’লে ওহ যে বাসায় যাবেনা বলত,আজ সে বাসায় যাবে।কাহিনি কি বস?

কাহিনি কিছু না।বাসায় যেতে মন চাইলো তাই যেতে চাইছি।কেন তোদের কোনো সমস্যা?থাকলে বলল,

না,কোনো সমস্যা নেই।তুমি যখন যেতে চাইছো।তখন যাব।এই সুযোগেই তনীকে দেখা হয়ে যাবে।কতদিন ছোট বোনকে দেখি না।জিহান,রিহানের আদরের ছোট বোন।সাফিন তালুকদার এবং মাসুদা তালুকদারের একমাত্র কন্যা।

অসীম তালুকদার চায়ের কাপে চুমুক বসিয়ে বন্ধুর সাথে টুকটাক বিজনেস নিয়ে আলাপে ব্যাস্ত।কথায় কথায় জানতে পারলেন।বন্ধুর ছেলে কে সামনে বিয়ে দিবেন।দিহানের হাসিখুশি মুখ দেখে তার কলিজায় আঘাত লাগল।আজ ছেলেটা যদি ঠিকঠাকভাবে পড়াশোনা করে বিজনেসটাতে মনটা দিতো তাহলে শান্তি পেতেন।ভালো পরিবার দেখে একটা মেয়ে বিয়ে করাতো।এক সময় তার পুত্তের ঘরে ওহ কোল আলো করে নাত বা নাতনি আসতো।অসীম তালুকদারের গভীর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়।তার সবকিছুই আছে।কোনো কিছুর অভাব নেই।কিন্তু সুখ নামক শব্দটা এই বাড়ি থেকে কেমন যেন বিলীন হয়ে গেছে?হাসিখুশি বাড়িটা নিরবতা পালন করছে কত বছর ধরে।ছেলেকে ঢাকায় দিলেন পড়াশোনা করে মানুষ হতে।কিন্তু সে কি করলো?মাঝ পথে পড়া ছেড়ে রাজনীতিতে ডুবে গেলো।এটা বাবা হিসেবে মানতে কষ্ট হয়।নিজে চেয়ারম্যান হয়েছিল গ্রামের মানুষের জন্য।তাদের বিপদে আপদে সাহায্য যেমন করেছেন।ঠিক তেমনই ছেলের জন্য মুখ কালা হয়েছে।গ্রামের যেসব করেছিল।এখন সেসব নেই ব’লে গ্রামের মানুষ শান্তিতে আছে।ছেলেটা বাড়িতে আসেনা।কতদিন হয়ে গেছে।হঠাৎ করে এসে তো একটু চমকে ওহ দিতে পারে।তা না করে ঢাকায় পড়ে আছে।ঢাকায় তার সব।

৯১.
সময়টা গভীর রাত।রাতের আঁধারে দূর থেকে গ্রামকে দেখে চোখ জুড়িয়ে নিলো অর্পণ।চোখ বুঝে নিতেই এক এক করে মনে পড়ে গেলো সেই ছোট বেলার কথা।মায়ের সাথে তার কত সুখময় সৃতি ছিল।বাবার কোলে চড়ে গ্রাম ঘুরা।তাদের কাছেই যত বায়না আবদারের ঝুড়ি।আজ সব কল্পনা।বাস্তবে সে যে বড্ডই একা।কেউ নেই তার পাশে।বাবা ডাকলেই ছুটে এই গ্রামে আসে না।আগে পড়াশোনা নিয়ে ব্যাস্ত ছেলেটা বখাটে ছেলেদের মতোই চলে।একদিন না খেয়ে থাকলে তোমার মতো করে।কেউ ব’লে না মা।

বাবা আমি তোর পছন্দের খাবার রান্না করেছি।খেতে আয়।না খেয়ে পড়লে পড়া মনে থাকে না।খাবার গরম গরম খেতে হয়।ঠান্ডা হলে খেয়ে শান্তি পাবি না।অর্পণ সেই ডাকে পড়া মাঝ পথে থামিয়ে বলত,

মা ডিস্টার্ব কর না।পড়া শেষ করে আসছি।

শরীরে জ্বর আসলে তোমার মতো সারা রাত জেগে কেউ ব’লে না।

তোর কোথায় কষ্ট হচ্ছে আমায় বল বাবা?আমি ম্যাজিক মতোই তোর কষ্ট দূর করে দিব।

অর্পন আয় বাবা তোর মাথায় তেল দিয়ে দেই।আরাম পাবি।অর্পণ এখন মায়ের কথায় আর রাগ করে না।রাগ কবেই পানিতে পরিনত হয়েছে।দূষ্টু অর্পণ দূষ্টমী সেই কবেই ছেড়েছে।রাজনীতির মহলে সবাই জানে অর্পণ গম্ভীর আর রাগী ছেলে হলেও কারো সাথে অন্যায় সে এখন করে না।তাড়াহুড়ো কোনো ডিসিশন সে নেয় না।ঠান্ডা মাথায় সবটা সামলাতে জানে।তাকে ভালো ছেলে হিসেবে জানে দলের ছেলেরা।তবে হ্যা নিজের পরিবারের কাছে যতটা পারে খারাপ প্রমাণ করে?যেমন একটু আগে বখাটে ছেলেদের মতো বাইকে বসে সিগারেট টেনেছে।বাবার ভাড়া করা লোকটা তার পিছন থেকে সরে যেতেই মুখের সিগেরেটটা ফেলেছে।একবার মুখ দিয়ে যেটা ব’লে সেটাই করে।জিদ বাবা-র মতোই পেয়েছে।অর্পণের গম্ভীর মুখের ভাব দেখে দুই ভাই কোনো কথা ব’লে না।চুপচাপ সময় চলছে।

চলবে….

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-২৯
৯২.
বইয়ের পাতা উল্টাতে উল্টাতে ঠোঁট ফুলিয়ে বসে আছে মিলন।পড়া দেখলেই তার মাথা ঘুরায়।ঘুম পায়।হাম ছাড়তে ছাড়তে পাশে তাকাতে দেখে আপু তার দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে আছে।পুতুল কাঠের স্কেল দিয়ে টেবিলে জোরে বারি মারে।যার মানে নো বাহানা।আগে পড়া শেষ কর।পড়া শেষ না হলে ছাড়ব না।

আপু আমার পড়তে ভালো লাগে না।পড়া দেখলেই ঘুম পায়।চোখে সর্রষে ফুল দেখি।এখন তুমি বলল,আমি কি করব?

চলো না আপু কিছু খেলতে যাই।খেলা শেষ হলেই আবার পড়তে বসব।

মিলনের কথায় পাত্তা দিলো না।চোখ দিয়ে ইশারা করে বলল,পড়।মিলন মন খারাপ করে চুপচাপ পড়ায় মনযোগ দেওয়ার চেষ্টা করে।এরমধ্যেই রেনু,পুতুলকে ডাকতেই সে মামীর কাছে চলে যায়।বোনকে বের হতে দেখেই মিলন ঠাস করে বই বন্ধ করে দিলো।
পুরনো কাঠের চেয়ারটায় আরামসে বসে গাইতে লাগল।

ভাল্লাগে না পড়াশোনা,
ভাল্লাগে না রে..!
কি যে করি
মন থাকে শুধু বাহিরে।
ওহ পড়া তুই চইলা যা।
আর ফিরে আসিস না।
তোকে দেখলেই গায়ে ওঠে একশ চার জ্বর।
মাথাটা হয় আমার আউলাঝাউলা।
আমি হই পাবনার পাগল।

মামীর কথা শুনে পুতুল রুমে প্রবেশ করতে নিলেই বেশুরে গলায় গান শুনতে পায়।জোরে কাশি দিতেই মিলনের হাওয়া ফুঁস।চুপচাপ ভদ্রবাচ্চার মতো পড়তে লাগল।আড়চোখে একবার তাকিয়ে দেখলো।বোন দড়জা সামনে দুই হাত ভাজ করে এখনো দাঁড়িয়ে আছে।

স্বাধীন ছাগল আর গরুর জন্য ঘাস কেটে নিয়ে বাসায় ফিরেছে।দু’টো গরু কিনেছে আজ এক সপ্তাহ হবে।ঘামে তার শরীর ভিজে আছে।গোসল করতে হবে।পুতুল,মামার আসার খবর পেতেই এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দিলো।মামা বসে পানি খেয়ে একটু জিরিয়ে নিতেই,মামী ঘর থেকে গামছা আর লুঙ্গি এনে দিতেই মামা গোসলের জন্য পুকুর পাড়ে গেলো।পুকুরের দু’টো ডুব দিলেই মনটা একদম চাঙ্গা হয়ে যাবে।আজ দিহান ভাইয়ের কথাগুলো পুতুলের সামনে তুলবেন।দেখা যাক কি হয়?

৯৩.
জার্মানে বসে নাইট ক্লাবের ক্যাসিনো খেলছে জেভিন রর্য়াড।পাশে তার বান্ধবীরা একটু পর পর উৎসাহিত করছে।কিন্তু জেভিনের মন খেলাতে নেই।সে স্বামী এবং ছেলের বিষয়ে চিন্তি।স্বামী তার বাংলাদেশে গেছে।কোথাকার কোন গাইয়া মেয়ে কে ছেলের জন্য বউ করে আনবেন।আমি থাকতে ইম্পসিবল।ওই গাইয়া চাষার মেয়েকে ছেলের বউ কখনোই করতে দিবো না।আমি আমার পচ্ছন্দের মেয়ের সাথে বিয়ে দিব।

দুপুরে সবাই একসাথে খেতে বসেছে।রেনু মসুরের ডাল,মুলা শাক ভাজি,পেঁপে,আলু দিয়ে তরকারি রান্না করেছে।স্বাধীন খাবার মুখে দিয়ে খেতে খেতে বলল কালকের বিস্তারিত কথাগুলো।মামার মুখ থেকে কথাগুলো শুনে পুতুলের হাত থেকে ভাতগুলো পড়ে যায়।পরবর্তী আবার ভাতের লোকমা মুখে তুলতে লাগলো।মেয়ের এমন চুপচাপ থাকাটা সবাই লক্ষ্য করছে।পুতুল খাবারটা শেষ করে হাত ধুয়ে নিলো।ইশারায় বলল,আসছি।

পুতুল নিজের রুমে গিয়ে কয়েক মিনিট পর ফিরে এসে চিরকুট দিল।স্বাধীনের ততখনে খাওয়া শেষ।পানি দিয়ে হাত ধুয়ে গামছায় হাতটা মুছে নিলো।পুতুলের হাত থেকে চিরকুট খুলে পড়তে লাগল।

মায়ের পরই তোমরা আমার আপনজন।এত বছর ধরে তোমাদের কাছে রয়েছি।কখনো কোনোদিন কষ্ট পেতে দেও নিই।নিজেরা না খেয়ে ওহ আমাদের মুখে খাবার তুলে দিয়েছো।সাজু,মিলন,রিফাত ওরা ছোট্ট ছিল তাই বুঝতে পারেনি।কিন্তু আমিও ছোট ছিলাম।তবে অতটা ওহ ছোট বা অবুজ ছিলাম না।তখন কিন্তু সব বুঝতে পারতাম।আর তোমার এখন অবধি যত কিছু করেছো।তা আমাদের জন্য কল্যাণময় হয়েছে।তখন সবটা বুঝে শুনে ঠিক ভুল বিচার করে এগিয়েছো।তাই সামনে যা করবে।আমাদের ভালোর জন্যই করবে।আমার তোমাদের ওপর পুরোপুরি বিশ্বাস আছে।

পুতুলের কথায় যেন স্বাধীন শান্তি পেলো।তার প্রতি মেয়ের অগাধ বিশ্বাসটাই তার মনোবল আর দ্বিগুণ করলো।

আম্মা আপনি নিশ্চিত থাকেন।আপনার ছেলে আপনাকে নিরাশ করবে না।আপনি এই বিয়েতে মত দিলেই আগাবো।আর যদি না ব’লেন।তাহলেই কোনো কথা আগাবো না।আপনি একদিন সময় নিন।সময় নিয়ে ভেবে জানান।তাড়াহুড়ো কোনো কারণ নেই।স্বাধীনের মুখে হাসি দেখে পুতুলের কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেলো।এতটা খুশি কখনোই দেখেনি।আজ প্রথম এতটা প্রাণবন্তত হাসি দেখছে।এই হাসি এভাবেই থাকুক।

বোনের বিয়ের কথা শুনে সাজু,মিলন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।তাদের ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলছে।তাদের আপুর বিয়ে হবে।ওহ কি মজা হবে?এই খুশিতে রিফাত সামিল হতে পারবে।বেচারা আপু ভক্ত।সে এখন মাদরাসায় থাকে।বাবা তাঁকে মাসে একবার বাসায় আনে।বাড়িতে থেকে দিন দিন পাঁজি হচ্ছিল।তাই তাঁকে দূরে রাখা।তাকে ছাড়া কষ্ট হয়।তবুও স্বাধীন নিজের মনকে বুঝ দেয়।ছেলে একদিন হাফেজ হয়ে আসবে।তাদের মুখ আলোকিত করবে।

৯৪.
পুতুল এডমিশন নিতে কলেজে আসে।তার সাবজেক্ট সাইন্স ছিল।কিন্তু এখন নতুন কলেজে এসে বিপদে পড়েছে।নতুন শিক্ষকরা তাঁকে উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে চিনেন।খবর কাগজে তার ছবি বের হয়েছিল।ছোট্ট গ্রামের মেয়ে পুতুল।ক্লাস এইট জিপিএ -ফাইভ ছিল।দশম শ্রেনীতে গোল্ডেন এ প্লাস আসছে।এর আগেই ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে উপজেলা প্রথম স্থান দখল করেছিল।সবাই তার পড়াশোনা জন্য বেশ প্রশংসা করে।কিন্তু সে কথা বলতে না পারায় নতুন শিক্ষকরা থাকে একটু অবহেলা করে।তারপর অনেক কষ্টে ফরর্ম পেয়ে কাগজ জমা দিয়েছে।ভর্তি সময় বলছে।সে সাইন্স নিয়ে পড়তে পারবে না।সে ডাক্তার হয়ে কি রোগী সেবা করবে।সে তোও নিজেই রোগী।এই কথাটায় পুতুল খুব কষ্ট পায়।তবুও আজ গ্রাম থেকে ঢাকায় আসছে।তার স্বপ্নটা যে এখনো পূরণ করা বাকি।কলেজ প্রাঙ্গণে বসে চোখের পানি ফেলছে।সে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে আছে।হাত থেকে ভর্তির কাগজটা উড়ে গেলো।পুতুল সেটা তুলার আগেই কারো পায়ে নিচে পরে গেলো।নিজের ভর্তির কাগজটা কারো পায়ের নিজে পৃষ্ঠ হতে দেখে শব্দ করে কেঁদে ওঠে।দৌড়ে আসে।অচেনা কারো পায়ের নিজ থেকে কাগজটা নেওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে।অচেনা মেয়ের কান্না শব্দ শুনে অর্পণ কপাল কুঁচকে নিচু মাথাটা তুলতেই অদ্ভুত সু্ন্দরর্যৌ দেখে কপালের ভাজ মিলিয়ে যায়।ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে।কিন্তু পুতুল সামনের ব্যাক্তিটিকে দেখতে মোটে ওহ আগ্রহী নয়।সে নিজের ভর্তির কাগজের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে।যা অর্পণের পায়ের নিচে পৃষ্ঠ হয়েছে।

স্বাধীন মেয়ে কে কলেজের ভেতরে পাঠিয়ে দিয়েছেন।মেইন গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।স্বাধীন ইচ্ছে করলেই পারতো মেয়েকে নিয়ে ভর্তি করিয়ে আসতে।কিন্তু সে যায় নিই।মেয়ে বড় হচ্ছে।তাকে নিজের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে।সে না থাকলে যেন সামলাতে পারে সেইজন্য ইচ্ছে করেই যান নিই।কিন্তু এতখন হয়ে গেলো মেয়েটা বের হচ্ছে না কেনো?স্বাধীন এগিয়ে যাবেন কি না ভাবছেন?

এইদিকে পুতুলের কান্না বন্ধ হয় না।তার ভয় হচ্ছে।এত কষ্ট করে এতদূর এসে সবটা শেষ হয়ে যাওয়া।মানতে পারছে না।কাঁদতে কাঁদতে মুখ লাল করে ফেলছে।অর্পণ তাকে যত বোঝাচ্ছে ততই ফুফিয়ে কেঁদে যাচ্ছে।
অর্পণের কথা পুতুল কানেই তুলছে না।কাঁদামাখা কাগজটা নিয়ে পিন্সিপালের অফিসার রুমের দিকে যেতে লাগল।পুতুল তার ময়লা কাগজটা নেওয়ার জন্য পিছনে দৌড়ে আসতে লাগে।কিন্তু লোকটা হঠাৎ অফিস রুমে ঢুকে পড়ায়।পুতুল আর এগিয়ে যেতে পারলো না।দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।অপরদিকে অর্পণ নিজের কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে পুতুলের দিকে তাকাচ্ছে।তারপর কাজ শেষ হতেই পুতুলের হাতে ভর্তি কর্নফাম কাগজটা তুলে দেয়।পুতুল চোখ বড় বড় করে নতুন ফর্রমে তার সকল ডিটেইলসসহ ভর্তি কাগজ পেয়ে খুশি হয়।নিচে পিন্সিপাল স্যারের সাইন।আরেকজনের সাইন দেখতে পায়।যেখানে লিখা এমপি অর্পণ তালুকদার।

এখন এই কাগজগুলো আর ভর্তি টাকা জমা দিয়ে আসো।আর সাথে রোল নাম্বার জেনে সোজা বাসায় যাও।

পুতুল চলে যেতে নিলে অর্পণ ডেকে ওঠে।

ওই লিলিপুট।এভাবে ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদবে না।দেখতে বাজে দেখায়।মনে হয় আমাদের বাগান বাড়ির পেছনের বড় তাল গাছটায় থাকা পেতনীটা কাঁদছে।

অদ্ভুত নামে পুতুল হতবাক হয়ে যায়।শেষ কথায় চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রয়।অর্পণ নিজের কাজ শেষ করে বাইক নিয়ে চলে যায়।

সবকিছু ভালোভাবে মিটিয়ে রোল জেনে মামার সাথে গ্রামে ফিরে যায়।

চলবে…

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৩০
৯৫.
পুতুল বিয়ের জন্য হ্যা বলতেই স্বাধীন আলহামদুলিল্লাহ বলল।দিহান সাহেবকে খবর পাঠানোর আগেই সে নিজেই স্বাধীনের বাসায় হাজির হয়।মেয়ের রাজি হওয়ার কথাটা জানায়।বিয়ে কথাবার্তা সব ঠিকঠাক চলছে।কথা হয়,ছেলে দেশে ফিরলেই পুতুলের বিয়ে শুরু হবে।সবকিছু বন্দবস্ত করতে বলেন দিহান সাহেব।স্বাধীন তার হাত ধরে বারবার বলতে লাগলেন।তার বিয়ে পরেও যেন পুতুলকে পড়তে দেন।তার স্বপ্ন পূরণ করা হয়।দিহান সাহেব অভয় দিচ্ছেন।পুতুলের স্বপ্ন পূরণ করা হবে।দিহান কথায় কিছুটা শান্তি পান।ঠিক হয় একমাস পরে বিয়ে হবে।এবং পুতুলের এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হলেই বউ নিয়ে বিদেশের মাটিতে চলে যাবে।মেয়েকে অতদূরে দিতে কষ্ট হচ্ছে। তবু্ও তার জন্য এত ভালো ছেলে।হাত ছাড়া করতে চায়নি।এবং তার স্বপ্নের কথা ভেবে স্বাধীন না করতে পারেনি।

অসীম তালুকদার দিহানকে এতটা খুশি মনে গোছগাছ করতে দেখে এগিয়ে আসে।

কি ‘ বন্ধু এত খুশি কেন?

খুশি হব না মানে?আজ তোও আমার খুশির দিন।সামনে ছেলের বিয়ে কত কাজ এখনো বাকি।সেগুলো সেরে আসতে হবে।বউ,ছেলেকে নিয়ে বাংলাদেশে ব্যাক করতে হবে।বাবা থেকে শ্বশুর মশাই হওয়ার ফিলিংসটা জোস।ওইসব তুই এখন বুঝতে পারছিস না।তোর সময় হলে তখন তুই বুঝতে পারবি।আমি আজ রাতেই চলে যাচ্ছি।খুব শ্রীর্ঘই ফিরে আসবো।

দিহান কথায় অসীম তালুকদার মন খারাপ করেন নিই।একমাত্র ছেলেকে নিয়ে এখনও তার আশা আছে।একদিন তার বাড়িতে বউমা আসবে।তিনিও দিহানের মতোও প্রতি নিয়ত অপেক্ষা করছেন।ভাগ্যের চাকায় কি হতে চলেছে জানা নেই?

নিজ অফিস রুমে বসে অর্পণ যতবার কাজে মনযোগ দেওয়ার চেষ্টা করেছে।ততবারই পুতুলের কান্না জড়িত মুখটা ভেসে উঠেছে।কি হচ্ছে তার?পুতুলের অতীত জানার পর থেকেই সে নিজেকে একটু একটু করে বদলাচ্ছে।পুতুলের জন্য আলাদা সফট কর্নার সৃষ্টি আরো আগেই হয়েছে।এখনো মুখে তা প্রকাশ করে নিই।পুতুল তার স্বপ্ন অবধি পৌঁছে যাক।তারপর তার মনের মানুষটিকে জানিয়ে দিবে তার মনের কথা।তাঁকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্ন।তাকে পুরোপুরি একটা কম্পিলিট পরিবার দেওয়া।যেখানে মা,বাবা নামক দুটি মিষ্টি শব্দ থাকবে।
ভাইয়ের মুখে হাসিটাকে লক্ষ্য করছে জিহান,রিহান দুই ভাই।কিন্তু তার খুশি কারণটা বুঝতে পারে নিই।

৯৬.
তোমার লজ্জা পাওয়া উচিত।তুমি আমার ছেলের জন্য ওমন একটা গাইয়া মেয়ে আনবে।আমি এটা মানতেই পারবো না।তবে হ্যা মেনে নিতাম।যদি আমাদের ক্লাসের হতো।ওই মেয়েটা লো ক্লাসের।ওর মধ্যে কোনো যোগ্যতা নেই।একটা গাইয়া আনকালচার মেয়ে।সে কোনোভাবেই আমাদের সাথে যায় না।দিহান ডালিং তুমি বিয়েটা ভেঙে দেও।আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের মেয়ে আছে।যেমন স্মাট তেমনই সুন্দরী।তার চলাফেরা হাইফাই মর্ডেনের।সে আমাদের ছেলের জন্য একদম পারফেক্ট।

দিহান ল্যাপটপের কাজ বন্ধ করে বলল,

জেভিন তোমার সমস্যা কি জানো?তুমি নিজে যা তেমনই সবাইকে পেতে চাও।তোমার পোশাক,তোমার কথাবার্তায় এবং বিদেশি কালচারালে বড় হ’য়েছো।তোমার মধ্যে বাঙালি আনা খুঁজতে যাওয়া নির্বোধের কাজ।তবুও তোমায় ভালোবাসি।আর ভালোবাসিই ব’লে যখন যা ব’লেছো।তাই মেনেছি।কখনো কষ্ট পাওয় এমন কাজ করিনি।কিন্তু তুমি তোমার মতো সবাইকে চালাতে চাইলে হবেনা।আমি তোমার কথা নাচবো ব’লে ছেলেকেও নাচতে হবে তার কোনো মানে নেই।আমি মুখ বুঝে তোমার সব আবদার মেনে নিলেও ছেলের ওপরে কোনো বাহানা শুনব না।সামনে ছেলের বিয়ে তৈরি থাকো।আমরা কয়েকদিনের মধ্যেই ছেলেকে নিয়ে বাংলাদেশে ফিরব।স্বামীকে যতই বুঝাতে চাইছেন ততই তিনি বেঁকে বসছেন।ছেলের বিয়ে না-কি বাংলাদেশেই দিবেন।তিনি রেগে মনে মনে ব’লেন।

আমি দেখব ওই মেয়ে কি করে আমাদের সাথে জড়ায়?একবার বিয়েটা হোক।তারপরে বুঝবে মজা।তুমি শুধু দেখবে এই জেভিন তোমার সাথে কি কি ঘটায়?

আজ অনেকদিন পরে তালুকদার বাড়িতে অর্পণ পা রাখল।ভাইয়ের হঠাৎ গ্রামে ছুটে আসা নিয়ে জিহান,রিহান কিছুই ব’লে না।এতদিন পর ছেলেকে দেখে অসীম তালুকদার হতবিহ্বল চোখে তাকিয়ে থাকেন।ছেলের কাছে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে ছুটে আসেন।বাবা এমন হুর মুরিয়ে সামনে আসায় নিজেকে আবার গম্ভীর মুখ করে দাঁড়িয়ে রয়।বাবাকে কিছু বলতে চাইলে।তিনি প্রশ্ন করেন।

কেমন আছে আমার শের?আমার আদরের একমাত্র সন্তান কি মনে করে আজ তালুকদার বাড়িতে?

কেন আসতে পারি না?

সে তুমি অবশ্যই আসতে পারো।তোমার যখন খুশি তখনই আসতে পারো।এই তালুকদার বাড়ির দরজা তোমার জন্য সব সময় খোলা।

বা.. বা আমি তোমায় কিছু বলতে চাই।

আজ এতদিন পরে ছেলের মুখ থেকে বাবা ডাকটি শুনে চমকে উঠেন।তবুও নিজেকে শান্ত রেখে ছেলের পরবর্তী কথা শুনতে অপেক্ষা করছে অসীম তালুকদার।
কিন্তু অর্পণ তার কথা মুখে বলবার আগেই তালুকদার বাড়ির ল্যান লাইনের মোবাইলটা উচ্চ শব্দে কেঁপে ওঠে।অসীম তালুকদার ছেলের কথা শুনার জন্য অপেক্ষা করছেন।কিন্তু ফোন একটুও পর পরই বেজেই যাচ্ছে। সে আজ থামতেই চাইছে না।এত বাজার
পরেও যখন অসীম তালুকদার এগিয়ে গিয়ে মোবাইলটা রিসিভ করেনি।তখন
অর্পণ এগিয়ে গিয়ে মোবাইলটা কানের কাছে নেয়।

৯৭.
হ্যালো অসীম।আমি দিহান বলছি।আমরা আগামী কালই বাংলাদেশে আসছি।পুতুলের জন্য বিয়ের গহনা থেকে শুরু করে সবকিছুই আনা হচ্ছে।তুই তোও জানিস স্বাধীনের ভাগ্নীর সাথে আমার ছেলের বিয়ে হচ্ছে।এবং সেটা এই সপ্তাহ মধ্যেই পড়েছে।পুতুল আর অন্তরকে যা মানাবেনা।ভাবতেই খুশি লাগছে। মেয়েটা কি শান্ত সৃষ্ট?একদম পরী।আমার ছেলের ভালোবাসা।বিয়ে পরই মেয়েদের আসল ঠিকানা স্বামীর ঘর।সেই পুতুল আজ আমার ছেলের জীবনে পুরোপুরি বাঁধতে চলেছে।

অর্পণের কানটা মনে হয় বিষাক্ত সাপে কামড়ে দিয়েছে।শরীরের রক্ত চলাচল মনে হয় বন্ধ হয়ে গেলো।বুকের ভিতরের ছোট হার্টবিটটা আজ জোরে জোরে বাজছে।মনে হচ্ছে এখুনই বেরিয়ে আসবে।এটা কি শুনলো?তার পুতুল অন্য কারো ভালোবাসা।
তার পুতুলের মনে অন্য কারো বসবাস।হাত থেকে মোবাইল পড়ে গেছে সেই কখন।ওপাশ থেকে দিহান ব’লে যাচ্ছে।

হ্যালো,অসীম আমার কথা শুনতে পারছিস।অনেকবার হ্যালো হ্যালো ব’লে যখন কোনো রেন্সপন্স পেলো না।তখন ফোনটা কেটে গেছে ভেবেই রেখে দিল।পরে আবার ফোন দিবে।

অর্পণের কপাল বেয়ে চিকন ঘাম বেয়ে নিজে পড়তে লাগল।তার চোখ লাল হয়ে উঠেছে।হঠাৎ করে নিজের বুকটা চেপে ধরে।এখানে অসয্য ব্যাথা করছে।কেমন অস্থির লাগছে।অসীম তালুকদার ছেলের এমন অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে যান।ছেলে কে দুই হাতে জড়িয়ে ডাকতে লাগল।

অর্পণ,বাবা আমার কি হয়েছে তোর?এই অর্পণ কথা বল।জিহান,রিহান এতখন বাবা,ছেলেকে আলাদা কথা বলতে দেখে উপরে গিয়েছিল।চাচার এমন চিতকারে দৌড়ে ছুটে আসে।

নিজ চোখের সামনে ভাইয়ের সুন্দর মুখখানা টকটকে লাল হয়ে উঠেছে।বুকটা চেপে কেমন নিশ্বাস ফেলছে।মনে হচ্ছে প্রাণ পাখিটা খাঁচা ছেড়ে উড়াল দিবে।অর্পণ এই অবস্থা দেখে মাসুদা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন।চোখের সামনে এটা কোন অর্পণকে দেখছেন।তাড়াতাড়ি ডাক্তারকে খবর দিলেন।

৯৮.
“হলুদ বাঁটো, মেন্দি বাঁটো,বাঁটো ফুলের মৌ,
বিয়ার সাজে সাজবে কন্যা নরম নরম ব’রে।

সুরমা-কাজল পরাও কন্নার ডাগর নয়নে,
আলতা বিছপা রাঙা দুটি,রাঙা চরণে
ভরা কলস ছলাৎ ছলাৎ ডাঙা এ নিতল।

নদীর ঘাটে এসেছে কিছু মহিলা।তাদের মধ্যে স্বাধীনের বউ আছে।পুতুলের গায়ে হলুদ দিয়ে গোসল করাবে।সেইজন্য পানি নিতে আসছে।পুকুরের পানি নিতে শেষ সিঁড়িতে বসে খালি কলস ডুবিয়ে পানি নিচ্ছে।এত সুন্দর দৃশ্যটা ফটো ক্লিক করছে অন্তর কিছু কাজিনরা।তারা বিদেশে মাটিতে বড় হয়েছে।এর আগে এমন দৃশ্য দেখে নিই।বয়স্ক মহিলাদের দেখলো,হলুদ শিল নুড়িতে পিশে নিয়েছে।এবং সেটা মিহিন হতেই বাটিতে তুলে নিচ্ছে।তাদের মুখে এসব গ্রাম গানগুলো শুনা যাচ্ছে।

পুতুলের গায়ে হলুদ শাড়ি।চুলগুলো হাত কোপা করা।হিজাব ছাড়া কখনো বের হয়নি।আজ এতগুলো পুরুষের সামনে ঘর থেকে বের হতে হবে।ভাবতেই বুকটা হু হু করে কাঁদছে।সে এভাবে বিয়ে করতে চায়নি।তাকে কেন পরপুরুষে দেখবে এবং হলুদ ছুয়ে দিবে।সেসব ভেবেই অস্থির হচ্ছে।মামাকে ঘরে এনেছে।বাড়িতে এত এত কাজ সেখানে থেকে ছুটে এসেছে।পুতুলের অস্থিরতা কারণ বুঝতে পারেন।ধীর পায়ে এগিয়ে এসে মেয়ের কপালে চুমু বসিয়ে বলল,

আমার আম্মাটা কবে এত বড় হয়ে গেলো?এই তোও সেইদিন ছোট ছোট পায়ে সাড়া উঠোনে খেলেছে,দৌড়েছে।সারাদিন খাটাখাটুনি করে বাসায় ফিরতেই লেবু শরবত করে দিয়েছে।লেবু না থাক এক গ্লাস ঠান্ডা পানি অন্তত দিয়েছে।শীত আসলেই আমার গায়ে চাদরে মুড়িয়েছে।আমি আমার আম্মার থেকে কতটা ভালোবাসা পেয়েছি।আজ সেই আম্মাটা না-কি সারাজীবনের মতো পরের ঘরে চলে যাবে।ভাবতেই ভীষণ কান্না পায়।আমার আম্মা এত বড় না হলেই ভালো হতো।আমার আম্মা চলে গেলে আমি কি নিয়ে থাকব।মেয়েরা বড় হয় কেন?আর কেন বাবার মায়া কাটিয়ে চলে যায়।স্বাধীনকে কাঁদতে দেখে পুতুলের কান্না পায়।সে ফুফিয়ে কাদে।মাথা নাড়িয়ে ব’লে সে কোথাও যাবে না?মেয়ে এমন পাগলামিতে সায় দিলো না।অনেক বুঝিয়ে চলে আসেন।একটু পরেই পুতুলের গায়ে এক এক করে হলুদ ছোঁয়া হয়।তবে কোনো পুরুষকে সেখানে যেতে দেওয়া হয়নি।পুতুলের জন্য স্বাধীন নিষিদ্ধ করে।

চলবে…

চক্ষে আমার তৃষ্ণা পর্ব-২৬+২৭

0

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-২৬
৮১.
পুতুল এখন কেমন লাগছে?ভালো লাগছে তো।

পুতুল মাথা নাড়িয়ে বুঝালো।এখন ভালো লাগছে।

তোমার জন্য তোমার মামা গঞ্জ থেকে ডাক্তার সাহেবকে বাসায় নিয়ে আসছে।আমি তারে বলছিলাম তোমাকে নিয়ে ডাক্তার কাছে যেতে।কিন্তু তুমি না করেছো।তাই তোমার মামা নিজেই ডাক্তার নিয়ে বাসায় হাজির।সে ডাক্তার নিয়ে এসে দেখে তুমি ঘুম।আমি ডাকতে চাইলাম।কিন্তু তোমার মামা বারণ করলেন।ডাক্তার তোমাকে দেখে নিলেন।আর কি কি সমস্যা বলতেই মেডিসিন দিলো?আর সেটা দিতেই জ্বর ছেড়ে দিল।

পুতুল মামীর কথাগুলো মন দিয়ে শুনতে লাগল।তাকে নিয়ে এতকিছু হয়ে গেছে।অথচ জ্বরে ঘোরে জন্য সে বুঝতে পারে নিই।

এখন যখন জ্বর সেড়ে গেছে।তাহলে উঠে পড়।মাগরিবের আজান এই দিলো ব’লে।নামাজ পড়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে বাহিরে আসো।বাড়িতে অতিথি আছে।তারা তোমায় দেখতে চায়!মামী চলে যেতেই কাপড়টা পাল্টে নিলো।ঘাম দেওয়াতেই শরীরটা হালকা লাগছে।এই মুহূর্তে গোসল করতে পারলে শান্তি লাগতো।পুতুলের ভাবনার মাঝেই দূর মসজিদ থেকে মাগরিবের আজানের শব্দ ভেসে আসছে।পুতুল উঠে ওযু করে নেয়।মামীর কথা মতো নামাজ পড়ে মাথায় ওড়না দিয়ে বের হয়ে আসে।চারদিকে ছোট ছোট বাচ্চাদের ছোটাছুটি।তারা কেমন আনন্দে আতখানা?নিজ চোখে দেখাতেও যেন এক রকম শান্তি পায়।পুতুল মিষ্টি করে হেসে এগিয়ে যায় বড়দের মাঝে।রেনুর পরিবার পুতুলকে পেয়ে খুশি হন।মেয়েটি মুখে সালাম দিতে পারেনি।কিন্তু হাতের ইশারায় বুঝিয়েছে সালাম দিয়েছে।সবার ব্যাপারটা বুঝতে টাইম লাগে।এইদিকে তার মেয়ের ঘরে কোনো কন্যা সন্তান নেই।রেনুর এই মেয়েকে কতটা আহ্লাদে লালন পালন করছে।তা রেনুর মা লতিফা বেগম বিকেলেই বুঝতে পারেন।আজ বিকালে রেনু কিভাবে দূর সম্পর্কে মামী শ্বাশুড়ি সাথে কথা কা*টাকা*টি করছিলো।এক প্রকার তর্কা বির্তক চলছিল।অথচ মনোয়ার বেগম মুখেমুখে আজ পর্যন্ত কেউ কখনো কথা বলতে কিংবা বলার সাহস করেনি।কিন্তু তার মেয়ে সেটা করেছে।আর সেটা করেছে ব’লেই তাকেও সেই মহিলা কথা শুনিয়েছে।বলেছেন,বেয়াদব মেয়ে জম্ম দিয়েছি।

তার ভাবতে ওহ অবাক লাগে।মেয়েকে সে একদম নরম কাঁদা মাটি মতো গড়েছিলেন। এবং সুপাত্র হাতে দান করেছেন।স্বাধীন একজন সুপাত্র।এটা তিনি নিরদ্বিধায় বলতে পারেন।এমন জামাই সবার কপালে জুটে না।সে কি সুন্দর নিজের পরিবার এবং বোনের ছেলে,মেয়েকে কোলে পিঠে মানুষ করছে।
এই গ্রামে এসে তিনি স্ব চোখে দেখতে পেয়ে চোখ দুইটা শীতল হয়ে যায়।এই আদুরী মেয়েটা তার মেয়ে এবং মেয়ে জামাই এর কলিজা।মা মরা মেয়েটির মাথার ছায়া।এদের কিছু হয়ে গেলে মেয়েটা ছায়াটাও সরে যাবে।
আল্লাহ তুমি এতিমের প্রতি রহম হইয়ো।সব বিপদ থেকে হেফাজতে রেখো।

৮২.
মনোয়ার বেগমের মুখেমুখে কেউ তর্ক করুক এটা তিনি মেনে নিতে পারেন না।কিন্তু আজ সামন্য মেয়ের জন্য তাকে এভাবে বোয়ালমাছের মতো গিলে ফেলতে চাইলো।তিনি রেগে গেছেন।বিছানার ব্যাগ পত্র গুছিয়ে অর্ধেক রাস্তায় চলে যান।আবার কি মনে করে অর্ধেক রাস্তা থেকে ফিরে আসেন।রেনু ব্যাপরটা প্রথম থেকেই লক্ষ্য করছে।কিন্তু কিছু ব’লে নিই।এখন ফিরে আসতেই।নিজে হেঁটে মামী শ্বাশুড়ি মুখের সামনে গ্লাস ধরে।মনোয়ারা বেগম কপাল কুঁচকে বলল,

এটা কি আনছো?বিষ!তোমার মাইয়া নিয়া কথা বলছি দেইখা আমারে বিষ দিয়া মারতে চাও?

তওবা,তওবা।কি ‘যে বলেন না মামী মা?আমি আপনাকে বিষ দিবো।আমার মাথাটা আমার গর্দানে থাকবে তোও?মনোয়ার বেগম চোখ বড় করে তাকতেই রেনু মিটমিটিয়ে হেসে বলল,

না মানে আপনার ভাইগ্না আর আমার স্বামী আমায় আস্ত রাখবে।কি বলেন না মামী মা?আমি দেখলাম আপনি ব্যাগপত্র নিয়ে বের হয়ে গেলেন।আবার দুই মিনিট পর ফিরে আসলেন।ভাবলাম আপনি হয়তো ক্লান্ত হয়ে গেছেন।তাই আপনার জন্য লেবু শরবত করে নিয়ে আসলাম।আচ্ছা আপনি কি এখান থেকে চলে যেতে চাইছিলেন?আমার কথায় রাগ করলেন না-কি?

চইলা কেন যামু?আইছিলাম বেড়াইতে।তাই বেড়াই যামু।তুমি বেশি কথা কও!যাও এইহান
থেইক্যা?রেনু চলে যেতে নিলে ডাক দিয়ে বললেন।

দাঁড়াও।শরবত দিতে আইসা।না দিয়া চইলা যাও কেন?ওইটা রাইখা তারপর যাও।

জি,মামী মা।

রেনু শরবতের গ্লাসটা রেখে চলে যায়।রেনু চলে গেছে কি-না উঁকি মে’রে দরজার বাহিরে দেখে নিলেন।কেউ নাই দেখে।খাটে বসে ঠান্ডা পানির শরবত টুকু খেয়ে নেন।রেনু জালানার সামনে দাঁড়িয়ে সবটাই দেখে হেঁসে উঠে।পরক্ষণেই নিজের মুখ চেপে ধরেই এখান থেকে সরে যায়।যদি মনোয়ারা বেগম একবার বুঝতে পারে রেনু সবটা দেখে নিয়েছে।তাহলে বারোটার খবর করে ছাড়বে।

আপু লুঙ্গি ধরে হাঁটতে কষ্ট হয়।এই প্যারা এখানে না দিয়ে মাথায় তুলে দিলে কেমন হয়?

সাজুর অদ্ভুত কথায় পুতুল চোখ বড় বড় করে তাকায়।
সাজু’র এমন কথায় মিলনের হাত ফসকে লুঙ্গি জায়গারটা জায়গায় পড়ে যায়।নিচে সব ঠিকঠাক আছে দেখে সাজুর দিকে তাকিয়ে বলল,

ওই মাথায় তুলে দিবি মানে?

আমার লুঙ্গি দুই হাত দিয়ে ধরে সুয়ে বসে থাকতে ভালো লাগছে না।সাজু’র কষ্ট হচ্ছে। তার চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ।
পুতুল কিছু ভেবে নিজের মামীর কাছে ছুটে যায়।

৮৩.
পুতুল ছোট আয়না সামনে দাঁড়িয়ে আছে।মায়ের শাড়ি গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে।কিন্তু শাড়িটি ভালোভাবে পড়তে পারেনি।কোনোরকমে পেঁচিয়ে নিয়েছে।রেনু,পুতুলের ঘরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।উচ্চস্বরে হেঁসে এগিয়ে আসে।

বাহ,তোকে দেখতে দারুণ লাগছে।কিন্তু শাড়ি’টা আরেকটু গুছিয়ে পড়লে আরও ভালো লাগবে।দাঁড়া আমি পড়িয়ে দিচ্ছি।রেনু শাড়িটি সুন্দর করে কুঁচি দিয়ে পুতুলকে পড়িয়ে দিলো।

পুতুলের লম্বা চুলগুলো খোপা এলিয়ে দিলো।মাথায় হিজাব পরিধান করে বলল,

মা শা-আল্লাহ।আমাদের পুতুলকে একদম অপ্সরী লাগছে।ভাইদের মন ভালো করতে এই প্রথম তোকে দেখলাম শাড়ি পরতে।যা নবাব দুই পুত্র সাথে দেখা করে আয়।তাদের কেউ উঠোনে নামা।তবে সাবধানে।পুতুল ভাইদের সামনে যেতেই সাজু,মিলন চোখ দুটো ঝাপটিয়ে তাকিয়ে বলল,

আপু বেশে কোনো এক পরী।

সত্যি মিলন।রুপকথার গল্পের মতো লাগছে।যেখানে রাজা,রানী তিন পুত্র এবং এক কন্যা ছিল।আপু কি সেই রুপকথার রাজকন্যা?আমার কি রাজকন্যার ভাই?

পুতুল,মিলন,সাজু কে ধরে বারান্দায় বসিয়ে দিলো।নানু এসে তাদের সাথে বসে গল্প করতে লাগল।দুই ভাইয়ের মাঝে বসে পুতুলও চুপচাপ গল্প শুনতে লাগল।তাদের সাথে একে একে সবাই যোগ হলো।কিন্তু মনোয়ারা বেগম আসলেন না।তিনি দূরে সরে থাকলেন।রেনু ছোট ছেলেকে কোলে নিয়ে মায়ের সামনে বসতেই মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।সবার সাথে মানকি সাহেবও যোগ দিয়েছেন।তবে একটু দূরত্ব বজায় রেখে শুয়ে পড়লেন আরামসে।
গল্প শেষে সবাই একসাথে হেসে উঠে।আবার হাসি লুফে নিতে আনন্দে ব্যাস্ত হয়।হাসি মজায় সময়টা বেশ চলে যায়।লতিফা বেগম শাড়ি আঁচল সরিয়ে টাকার থলি বের করে পুতুলের হাতে দুটো কচকচে পঞ্চাশ টাকা নোট ধরিয়ে চলে যান।বাড়ি সামনে হাওয়াই মিঠাই আসতেই নিজের এবং ভাইদের জন্য কিনে নেয়।

মিলন,সাজু উঠে আসতে না পারলে কি হবে? পুতুল দুইজনের হাতেই হাওয়াই মিঠাই তুলে দিয়েছে।সেটা খেতে বেশ মজা।একটু করে কামড়ে মুখে দিতেই কেমন মিলিয়ে যাচ্ছে।পুতুল মুখে পুরে খেতেই দরজা নিচ দিয়ে ছোট্ট দুইটা হাত বাড়িয়ে তার আঁচল টেনে ধরে।পুতুল তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলেই সে সরে যায়।আবার উঁকিঝুকি মারে।পুতুল দরজাটা হালকা সরাতেই দেখে তাদের ছোট মিয়া হাসছে।দাঁতবিহীন হাসিটায় কি মায়া পুতুল জানে না?তবে তাকে কোলে নিতে বেশ টানছে।পুতুল দরজা খুলে ছোট মিয়াকে কোলে নিয়ে গালে বেশ কয়েকটা চুমু বসিয়ে দিলো।ছোট হাতদুটো তার গলা পেঁচিয়ে ধরেছে।যার মানে পুতুল ছাড়তে চাইলেও সে ছাড়বে না।পুতুল গালের সাথে নরম তুলতুলে গালটা লাগিয়ে কোলটা দখল করেছে।দুই ভাইয়ের সাথে সাথে ছোট ভাই তার আদরের ভাগ বোনের থেকে নিতে হাজির হয়েছে।রেনু আড়ালে থেকেই দুই ভাই বোনের ভালোবাসা দেখছে।মূলত রেনু ছোট ছেলেকে কোল থেকে নামিয়ে দরজা সামনে দিয়ে গেছেন।

৮৪.
পুতুল,রিফাতকে নিয়ে ব্যাস্ত।সাজু নিজের হাওয়াই মিঠাই এবং পুতুল তার আরেক হাতে দেওয়া মিঠাই গপাগপ খেয়ে ফেলছে।মিলন সাহেব মানকি সাহেবের সামনে গেছে।তাকে বিরক্ত না করলে পেটের ভাত হজম হচ্ছে না।মিলনের কাজে মানকি সাহেব বেশ বিরক্ত হন।বারবার দূরে সরে যাওয়ার পরেও বিরক্ত করছে।এক সময় রেগে গিয়ে তার পায়ে কামড় বসিয়ে দেন।মিলন চিতকার করে বাড়ি মাথায় তুলে।মানকি একটা কামড় দিয়ে ছেড়ে দেয়।কিন্তু মিলন সাহেব গালাগালি দিতে দিতে নিজেও কুত্তা গায়ে কামড় বসিয়ে দেয়।
বাড়িতে একটা হৈ হুল্লোড় পড়ে যায়।মানকি সাথে এক প্রকার হাতাহাতিতে রক্ত ভেসে ওঠে লুঙ্গিতে।সাজ্জাদ দৌড়ে মিলনকে নিয়ে ছুটে সদর হাসপাতালে।পুতুল ভাইয়ের অবস্থা দেখে থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে।সাজ্জাদ মামার পিছনে সেও ছুটছে।

চলবে..

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-২৭
হাসপাতালে করিডোরে বসে কাঁদছে পুতুল।ভিতরে ভাইয়ের টিটমেন্ট চলছে।সাজ্জাদ মামা পুতুলকে যত বোঝাচ্ছে।যে মিলনের কিছু হবেনা।ততই ফুফিয়ে কেঁদে ওঠে।অতিরিক্ত কান্না ফলে চেহারা লাল হয়ে আছে।দেখতে ভীষণ কিউট লাগছে।তার গায়ে শাড়ি মাথায় হিজাব পরা কন্যা।ইতিমধ্যেই স্বাধীন এসে পড়েছে।পুতুল মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

কিছু হবে না।আমি আছি।ডাক্তার কেবিন থেকে বের হয়ে আসলেই স্বাধীন,সাজ্জাদ কথা বলতে লাগল।

মিলন গাল ফুলিয়ে বসে আছে ঘরে কোনে।আজ একসপ্তাহ হবে তাকে হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে আসছে।মানকি সাহেব তার আশেপাশে আসলেই খ্যাকখ্যাক করে উঠে।বেচারা মানকি সাহেব মিলনের রেগে থাকার কারণ বুঝতে পেরেছে কি না জানা নেই?কিন্তু মিলন চিতকার চেচামেচি করে থামতে দেখে সে-ও খেউ খেউ শুরু করতো।তাদের মাঝে মাখোমাখো একটা ভাব ছিল সেটা আগের থেকে কমেছে।পুতুল নিজের পড়াশোনা আর হাতের কাজ নিয়ে ব্যাস্ত থাকলেও পরিবারকে সময় দিতে ভুলে না।স্বাধীনের শ্বশুর বাড়ি লোকেরা সবাই চলে গেছে।কিন্তু শ্বশুর মশাই আসেনি।তিনি ব্যবসার কাজে গাজীপুর ছিলেন।তিনি আসতে পারেনি ব’লে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।তবে সময় পেলেই সে কোনো একদিন আসবেন।

৮৫.

বিলের সাধারণ পানিতে হালকা বাতাসের ঝাপটা।এই বাতাসে কেঁপে ওঠে জল।সৃষ্টি হয় জল তরঙ্গ।স্বাধীন জাল দিয়ে বিল থেকে মাছ তুলছে।দুপুরে বউ,বাচ্চাদেরকে একসাথে নিয়ে খাওয়াদাওয়া করবে।স্বাধীন বাড়িতে আসতেই মিলন,সাজু,পুতুল এক সঙ্গে হাজির হয়।স্বাধীন,রেনুকে ডেকে মাছগুলো হাড়িতে তুলে দেয়।ছেলেমেয়ে গায়ে এখনো স্কুলের জামা পরিধান।তারা সবে বাসায় ফিরেছে।প্রতিদিনের মতোও মিলন,সাজু দুষ্টুমিতে মেতে আছে।কিন্তু পুতুল চুপচাপ দাঁড়িয়ে।কারণ কি?স্বাধীন পুকুরে গেলো গোসল সাড়তে।আর ছেলেমেয়েকে বলল,

-; গোসল সেরে নিতে!যোহরের আজান এই দিয়ে দিলো ব’লে।স্বাধীন,পুতুলের মুখটা চুপসে যাওয়ার ব্যাপারটা বুঝতে পারলোনা না।পরে এই বিষয়ে কথা বলবে।মামা চলে যেতেই পুতুল নিজের রুমে গিয়ে জামা পাল্টে বের হলো।ভাইদের গোসলের কথা ব’লে মামীর কাছে গেলো।তার হাতে হাতে মাছগুলো কুটে দিতেই তাড়াতাড়ি হয়ে যায়।

পুতুল মাছ কুটা শেষ।এবার তুই গোসল করে নে।আমি মাছটা ধুয়ে এখনই হাঁড়িতে চড়িয়ে দিচ্ছি।পুতুল মাথা নাড়িয়ে চলে যায়।মেয়ের ভাবভঙ্গি দেখার সময় রেনু পায়নি।সে তাড়াতাড়ি করতে ব্যাস্ত।ভাত রান্না আরো আগেই হয়েছে।কিন্তু তরকারি রান্না করার মতো ঘরে কিছু ছিলো না।তাই স্বামী মাছ নিয়ে আসতেই এত তাড়াহুড়ো।যোহরের আজান দিলেই এরা নামাজ পড়ে এসেই বলবে খিতে পেয়েছে।ভাত খেতে দেওয়।

আচ্ছা মামা গরিবের স্বপ্ন দেখতে মানা কেনো?গরিবের কি স্বপ্ন থাকতে নেই?গরিব ব’লে কি আমি স্বপ্ন দেখতে পারি না।পুতুলের এমন প্রশ্নের কি জবার দিবে স্বাধীন বুঝতে পারছে না?হাতের মাঝে ছোট্ট সাদা কাগজ।তার মাঝে কালো কলমের দুই,তিন লাইনের শব্দগুলো লিখা।রাতে মেয়ের রুমে আসতেই মেয়ের বইয়ের মাঝ পাতায় একটু লুকিয়ে রাখা সাদা কাগজের অংশ।বাকিটা বাহিরে বের হয়ে আছে।স্বাধীন পুরো কাগজটা মেলে ধরতেই লেখাগুলো দৃশ্যমান হয়।পরের কাগজের লেখাগুলো পড়েই স্বাধীন কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে যায়।

কাগজে লিখা কথাগুলো…!
আজ আমাদের স্কুলের শ্রেনী শিক্ষক প্রশ্ন করেন।বড় হয়ে কে কি হতে চাও?তা তোমরা মুখে নয়,কাগজে লিখে দেখাও।সবাই সবার কথা লিখে ছিল।আমিও লিখেছি।কিন্তু সবার বেলায়ই স্যার খুশি হলেন।কিন্তু আমার বেলায় তার উল্টো হলো।স্যার আমার কাগজটা মেলে ধরে বলল,

ডাক্তার।তুমি ডাক্তার হতে চাও?
পুতুল মাথা নাড়িয়ে যতটা খুশি মনে তাকিয়ে ছিল।ততটাই ভেঙে পড়ে পরবর্তী কথাগুলো শুনে।

পুতুল,তুমি কথা বলতে পারোনা।তোমার এই স্বপ্ন দেখা বারণ।আজ যদি দশটা বাচ্চাদের মতো কথা বলতে পারতে তাহলে তোমার ইচ্ছেটায় গুরুত্ব থাকত।স্যারের কথায় সবাই হেঁসে ছিল।স্যার ধমক দিতেই সবাই চুপচাপ হয়ে যায়।আর স্যার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

মন খারাপ করো না।তুমি একে তোও কথা বলতে পারো না।তার ওপর গরিব বাবার সন্তান।দুনিয়ার সম্পর্কে তোমার ধারণা কম।রোহিতপুর গ্রাম থেকে বেড়ে ওঠা কন্যার ডাক্তার হওয়াটা মুখের কথা নয়।তবুও দোয়া করি।ডাক্তার না হলেও অন্য কিছু করতে পারো।জীবন কারো জন্যই থেমে থাকে না।আমরা জীবিকার তাগিদে একটা না একটা পদ ঠিকই বেছেই নেই।
প্রথম পিরিয়ডের ঘন্টা বেজে জানান দিলো সময়ই শেষ।স্যার চলে যেতেই পুতুল নিচু মাথা ওপরে তুলে।তার দুই চোখে অথৈই নোনা জলে টইটম্বুর।একটু ছুয়ে দিতেই সে আপনিই ইচ্ছায় টপ করে পড়ে যাবে।অথচ কেউ জানতেই চাইলোনা।সে কেনো ডাক্তার হওয়াটা বেছে নিলো?

৮৬.
মা।আমার মা।চোখের সামনে মায়ের লাশটা পরে।শুনতে পাই,অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণে মায়ের মৃত্যু হয়েছে।ঠিক সময় চিকিৎসাটা সে পায়নি।ডাক্তার অবধি পৌছাতে একটু দেড়ি হলো।আমার মা পুরোপুরি চিকিৎসা না পেয়ে কষ্ট পেতে পেতে দমটা ছেড়ে দিলো।আমার মা মারা গেলো।ডাক্তার পারেনি আমার মা’কে বাঁচাতে।আমি মা’কে হারিয়েছি।আমার মা যদি ঠিকঠাক চিকিৎসা পেতো।তাহলে আজ আমার পাশে আমার মা-ও থাকতো।মা হারালাম।ভাই পেলাম।কিন্তু মনের ভিতরের ঘা’টা শুকায়নি।এরমধ্যেই ছোট রিফাত মামীর গর্ভে এলো।ঘরের মধ্যেই মামীর ওই আতনার্দ এখনো কানে বাজে।মামীর সেই চিতকার আমাকে শান্তি দেয়না।কিন্তু আমি সেই সময় মামীর পাশে থাকতে পারেনি।মামীর কষ্ট দেখে মায়ের কষ্টগুলোর কথা মনে পড়ে যায়।আজও আমি শান্তি পাইনা।
স্বাধীন ওই পেজের নিচের লিখা টুকু পড়ে থমকে যায়।হাত থেকে থেকে কাজটা পড়ে যেতে নিলে ধরে ফেলে।মনযোগ দেয় শেষের লাইনগুলোতে।

মামা আমি ডাক্তার হতে চাই?আমার স্বপ্নটা তুমি পূরণ করে দেও না।তুমি তো সবাইকে ভালো রাখো।সবাইকে হাসিখুশিতে রাখতে চাও।তোমার হাতে ম্যাজিক আছে।তোমার হাতের ছোঁয়ায় সবকিছুর সমাধান হয়ে যায়। সেই ম্যাজিকে দ্বারায় আমার ইচ্ছেটা পূরণ করে দেও না।

স্বাধীন মেয়ের লিখার এই কথাগুলোর কি উওর দিবে জানা নেই?চোখ দুটো বুঝে নিতেই ভেসে ওঠে।

মামা আমি ডাক্তার হব।রোহিতপুর গ্রাম থেকে বেড়ে ওঠা কন্যার ডাক্তার হওয়ার গল্পটা সবাইকে জানাতে এবং দেখাতে চাই।গ্রাম থেকেও পড়াশোনা চালিয়ে নিজের ইচ্ছে পূরণ করা যায়।

স্বাধীন এখন কি করবে বুঝতে পারছে না?মেয়ের স্বপ্ন পূরণ।সেটা কি স্বাধীন পূরণ করতে পারবে?নিজের বাবা মারা যাওয়ার পর তার পড়াশোনা হলো না।তবুও কতটা আশা ছিল।সেই সব মিথ্যে হলো।তার মতোই কি তার মেয়ের সাথে একই ঘটনা হবে?তার পুরনো ক্ষততে মলম লাগিয়ে শুকিয়ে ফেলেছে।কিন্তু মেয়ের এই ক্ষতটা কি দিয়ে সাড়াবেন?

৮৭.
পাচঁ বছর পর….

সময় কখনো কারো অপেক্ষায় থাকে না।সে নিজ গতিতে চলে।সময় যখন নিজ গতিতে এগিয়ে তাহলে অতীত নিয়ে পরে থাকার মানে কি?সেটা তোও বোকার কাজ।দেখতে দেখতে সময় এগিয়ে গেছে।সেই ছোট্ট পুতুল আর ছোট নেই।বড় হয়ে গেছে।সামনে সতেরোতে পা দিবে।নতুন বছরের একমাস পর এসএসসি পরীক্ষা শুরু।মামার কথায় পুতুল সাইন্স গ্রুপ নিয়ে পড়াশোনা করছে।স্বপ্ন তার ডাক্তার হওয়া।কিন্তু মামা পারবে তোও?তার স্বপ্ন অবধি টেনে নিতে।পুতুলের পড়াশোনা জন্য এখন নকশিকাঁথায় কাজ তুলতে পারে না।তবে মামী তার কাজে সাহায্য করে।সংসারের কাজ শেষ করেই সময় নিয়ে নকশিকাঁথা সুই,সুতোর বুনন তুলে।স্বাধীন মামা সেইসব ঢাকায় বিক্রি করতে যায়।আবার ফিরে আসে হাসি মুখে।কখনো কখনো হতাশা হয়ে।যেমনটা পাচঁ বছর আগে হয়েছিল।অল্প টাকার পুঁজিতে লাভ না হলেও চালান উঠেছিল।তবুও কাজ থেমে নেই।কাজ চলছে পুরো থমে।একদিন এই কাজগুলো ঢাকা,শহর ছেড়ে বিদেশে মাটিতে নাম করবে।
পুতুল পড়াশোনা পাশাপাশি ভাইদের খেয়াল রাখে।আগে ছিল দু’জন।এখন ভাইদের দলে তিনজন হয়েছে।এদের নিয়েই তার সময়গুলো দ্রুত চলে যাচ্ছে।তাছাড়া মামা,মামী রয়েছে।তারা কঠোর পরিশ্রমই।তাদের কাজ নিয়ে ভুল ধরার সাহস নেই।

হৃদয় ছোঁয়ার যে স্বপ্ন নিয়ে শুরু হয়েছিল এ পথচলা।একে অপরের কাছে আসার উষ্ণতায়,ভালোবাসা আর বিশ্বাসে অটুট বন্ধনে ছায়া ঘেরা পুতুল নামক রমনীর মধ্যেই জীবন সর্ব সুখ।যার মুখে কথা নেই।তবুও চোখের ভাষায় কত কত কথার ফুল ঝুড়ি সাজায়।তার বয়সী কত মেয়ের জীবনে প্রেম এসেছে।আবার চলেও গেছে।আবার বিয়ের ফুল ফুটেছে।তার সুন্দর চেহারা জন্যও কত সম্বদ্ধ এসেছে।কিন্তু কথা বলতে না পারায় তারা নিজেরাই চলে গেছে।এতে পুতুলের আপসোস নেই।সে এতে শান্তি পায়।তার পড়াশোনা মনোযোগ। এছাড়া বাহিরের কোনোকিছু তাকে টানে না।

চলবে….

চক্ষে আমার তৃষ্ণা পর্ব-২৩+২৪+২৫

0

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-২৩
৭১.
মিলন পড়া না পেরে দুই কান ধরে দাড়িয়ে আছে।ক্লাস টিচার আজকে বিষণ রেগেছে।মিলন,সাজু তাকে জ্বালিয়ে মারছে।এইতো একটু আগের ঘটনা।মিলন পড়া না পেরে সাজুকে কলম দিয়ে খোচাচ্ছিল।তাই স্যার রেগে ক্লাস থেকে বের করে দেন।ফাজিল দু’টো স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে।

পুতুল ক্লাস রুমের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে দুই ভাইয়ের কান্ড কারখানা।বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথা সমানে ব’লে যাচ্ছে।মনে হচ্ছে একে অপরের সঙ্গে কথা কাটাকাটি করছে।কি হয়েছে বুঝতে পারছে না?তবুও পুতুল তাকিয়ে রয়।এরমধ্যে ক্লাসের স্যার পুতুল যে অমনোযোগী সেটা দেখতে পেয়ে দাড় করায়।জানতে চায় কি সমস্যা?পুতুল মাথা নাড়িয়ে না ব’লে।

সমস্যা নেই যখন পড়ায় মনযোগ দেওয়া।কথাটা শেষ করে স্যার আবার বই দেখে পড়াতে শুরু করেন।পুতুল বইয়ের দিকে মনযোগী হয়।

শেষ পিরিয়ডের ঘন্টা পরতেই একে একে ক্লাস কক্ষ ছেড়ে বের হয়।মিলন,সাজু কান ছেড়ে চুপচাপ ক্লাস রুমে গিয়ে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বের হয়।

দূরে যা?আমার সাথে কথা কবি না।যদি কথা কস?তাহলে মনে করব!তুই মরা মুরগী গু খাস।

ওয়াক্ক।ছি,মিলনের বাচ্চা এগুলো কি বলছিস?

আমি ঠিকই কইছি।আর আমি মিলন।শুধুই মিলন।এখানে মিলনের কোনো বাচ্চাটাচ্চা নেই।তোর আর আমার বাপের তিনখানা বাপ আছে।একটা বাড়িতে।আর বাকি দুইটা স্বাধীনের বাচ্চা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করছে।কথাগুলো শেষ করে দুই ভাই দুইদিকে গিয়ে বসে আছে।

পুতুলের আজ একটু দেড়ি হয়েছে।সে স্কুলের প্রাঙ্খনে দাঁড়িয়ে দুই ভাইকে হাত দিয়ে ডাকতে লাগল।কিন্তু দুইজনই এমন গাল ফুলিয়ে বসে থাকার কারণটা বুঝতে সময় লাগলো।এরা আবার ঝগড়া করছে।উফ,এরা আর ভালো হলোনা।পুতুল রেগে ওদের রেখে হাঁটা শুরু করলো।যার মানে আজকে সে এদের পাত্তা দিবে না।পুতুল একা একা চলে যাচ্ছে ব’লে সাজু,মিলন একসাথে দৌড়ে পুতুলের পিছন পিছনে হাঁটতে শুরু করে।পুতুলের পিছনে সাজু,মিলনকে আসতে দেখে সে হাঁটা বন্ধ করে পিছনে তাকায়।পুতুল দেখাদেখি তারাও পিছনে তাকায়।পুতুল হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলে তারাও হাঁটার গতি বাড়িয়ে দেয়।পুতুল থেমে গেলে তারা ওহ থেমে যায়।এভাবেই পুরো রাস্তা শেষ করে বাড়িতে পা রাখে।

পুতুল প্রতিদিন ভাইদের গোসল করিয়ে দেয়।আজকে সে চুপচাপ।সে গোসল করে নামাজ পড়ে,বিছানা চোখ বুজে সুয়ে আছে।সাজু,মিলন একসাথে মাথা চুলকে একে অপরের দিকে তাকিয়ে রয়।যার মানে আপু আজকে বেশি রাগ করছে মনে হয়।তাদের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছেও না।নিজেরাই গোসল ঘরে গেলো।মাথায় পানি দিয়ে সাবান চোখে লাগিয়ে এমন চিতকার মারছে।পুতুল,রেনু ভয় পেয়ে দৌড়ে আসে।সাজু,মিলন এর কান্ডে দু’জনই ভ্যাবাচ্যাকা গেলো।রেনু রেগে গিয়ে দু’টোকেই পিঠের মধ্যে ঠাসস ঠাসস করে থাপ্পড় লাগিয়ে দিলো।মায়ের হাতের মা’র খেয়ে কলপাড়ে কান্না করছে।একে তোও চোখ জ্বলছে সাবানের ফ্যানার জন্য।আবার পিঠে থাপ্পড় পড়ায় পিঠ জ্বলছে।পুতুল চুপচাপ দুই হাত ভাজঁ করে দাঁড়িয়ে রইল।রেনু,মিলন,সাজুকে গোসল করিয়ে রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে।সাজু তোয়ালে দিয়ে একটু পর পর চোখের আর নাকের পানি মুছে যাচ্ছে।আর মিলন চোখের পানি,নাকের পানি তোয়ালে দিয়ে না মুছে বসে আছে।মনের সুখে কান্না করছে।চোখের পানিতে গাল ভিজে আছে।নাকের সর্দি নাক থেকে বের হয়ে শূন্যে দুলনি খাচ্ছে।তবুও সে পরিষ্কার করবে না।এরজন্য যদি স্বাধীন মিয়ার বাড়ি ডুবে যায় তোও ডুবে যাক।এতে তার কিছু যায় আসে না।

সাজু নাকটা আবার মুছে খাটের ওপর গড়িয়ে কান্দে কান্দে উচ্চস্বরে বলল,

আজ আব্বা নেই ব’লে আমাদের ধরে মারছো।আব্বা খালি বাড়িতে আসুক।আমি বিচার দিমু রে…!ওই আব্বা গোও।রেনু আম্মা আমারে মাইরা লাশ বানাইয়া ফালাইছে।ওরে আব্বা রে…ওই আমার আব্বা গোও।আমারে বাঁচাও গোও…!পুতুল ঘরে ঢুকেই থ হয়ে গেছে।

এই মরা কান্না বন্ধ করবি না-কি শোলার ঝাড়ুটা নিয়ে আসবো।রেনু বারান্দায় দাঁড়িয়ে দুই ছেলেকে ধমক দিচ্ছে।পুতুল কি করবে বুঝতে পারছে না?তার হাতটা অটোমেটিক মাথায় চলে গেছে।

৭২.
রমিজ মেম্বার হুক্কা টানতে টানতে বলল,

কি’রে খবর কি?আজকে কয়েকদিন ধরে দেখছি স্বাধীনের খবর নেই।

ওটা কি মরছে না-কি?

আরে না স্যার।স্বাধীন না-কি ঢাকায় গেছে শুনলাম।

কস কি?এটা তো ভালো খবর!

আগে পুরো কথা হুনেন।

আচ্ছা বল।

সে ঢাকায় গেছে এটা সত্যি।কিন্তু অন্য কামে।ওই যে তার বাড়িতে সুন্দরী পিচ্চি বোবা মাইয়াখানা আছে না।কি যেনো নাম?হয়,পুতুল। মাইয়া নাম পুতুল।সেই মাইয়া না-কি নকশি কাঁথা সেলাই করে।সেগুলো নিয়ে ঢাকায় গেছে।বিক্রি করবে ব’লে।

পুতুল। ওহহহ।ওই বোবা ছেড়ি।যার মা পালাইয়া গেছিলো।তার প্রেমিক নাগরের লখে।

হয়।

নজরে রাখ।স্বাধীন কবে গ্রামে পা রাখে?আসলেই আমারে জানাইবি।

ঠিক আছে।

হুম এখন ভাগ।

আজ পনেরো দিন পর স্বাধীন গ্রামে ফিরে যাচ্ছে।পরিবারের জন্য এতদিন মনটা ছটফট করছে।কেমন আছে তারা,খুব জানতে ইচ্ছে করতো?তবুও খবর নিতে পারেনি।আজ বাসায় গিয়ে সবাইকে একসাথে দেখে চোখ জুড়িয়ে নিবে।সবাইকে দেখে মন শান্ত করবে।কতদিন হইছে বউ,পোলাপান থুইয়া এই অজানা শহরে রাত কাটিয়েছে।কষ্ট লাগতো।তবুও মনরে একটা কিছু দিয়ে বুঝ দিত।কষ্ট কাদের জন্য করছি?তাদের জন্যই তোও এই কষ্ট করা।

পুতুলের পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে।নিজের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত।সংসারের কোনো কাজে তার হাত দেওয়া বারণ।রেনু সাফসাফ জানিয়ে দিয়েছে।পরীক্ষা শেষ হলে যেনো সংসারের কাজে হাত লাগায়।পুতুল মামীর কথাগুলো মেনে নিয়েছে।আর সাজু,মিলন নিজেদের দুষ্টুমি নিয়েই আছে।কিন্তু সেইদিন মায়ের মারের কথা ভুলেনি।সেটা মাথায় রাখছে।আব্বা আসলেই সবটা ব’লে দিবে।

৭৩.
রেনু,সাজু,মিলন,পুতুল আম্মা।তোমরা কই?

রেনু,স্বামীর কন্ঠ পেয়ে দৌড়ে ঘর থেকে বের হয়ে আসে।স্বাধীন কিছু বলার আগেই রেনু উঠোনের মধ্যেই জড়িয়ে ধরে কেঁদে ওঠে।স্বাধীন হাতের ব্যাগটা ফেলে বউকে জড়িয়ে ধরে।কপালে চুমু বসিয়ে বলল,

আরে বউ কান্দ কেন?আমি আইসা পড়ছি তোও।আমি ভালা আছি।

তুমি কেমন ভালো আছোও?তা তোমার মুখ দেখেই বুঝতে পারছি আমি।চেহারা শুকিয়ে কাঠ।সুন্দর মানুষটা কালো হয়ে গেছে। ঢাকায় কি অনেক কষ্ট?এমন শুকিয়ে গেছো কেন?ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করো নাই।

আসলে বউ ঢাকায় তো তুমি নাই।তোমার রান্না খাইতে না পাইরা আমি শুকাইয়া গেছি।

এখন যেহেতু চলে আসছি।তাহলে আমার বউয়ের মজার মজার খাবার খেয়ে ঠিক হয়ে যাব।আমাকে আবার আগের মতো লাগবে।স্বাধীন বউয়ের কথা ঘুরাতে বলল,

তা বাকিরা কই দেখছি না যে?

ওরা আছে আশেপাশেই।তোমার গলা পেলেই চলে আসবে।রেনু,পুতুলকে ডাকতেই মাগরিব নামাজ পড়া শেষ করে।ঘর থেকে বের হয়।দুই বাঁদর আগেই দৌড়ে আব্বাকে জড়িয়ে ধরে।তাদের বিচারের শেষ নেই।স্বাধীন ছেলেদের দেখে পান জুড়িয়ে যায়।সাদা পাজামা -পাঞ্জাবি পড়া।মাথায় সাদা টুপি পরে আছে।দেখেই মনে হচ্ছে।মাএ নামাজ পড়ে এসেছে।রেনু,পুতুলকে ডেকেই ছোট ছেলেকে ঘর থেকে আনতে যায়।

আব্বা আমি তোমারে কত মিস করছি।আম্মা পচাঁ আমাদের ভালোবাসে না।আমারে এমনে এমনে মারছে।মিলন,সাজু হাত পা দেখাতে লাগল।আব্বা,তুমি আম্মার বিচার করবা।স্বাধীন হেঁসে উঠে।

ওহ রেনু!তুমি নাকি আমার ছেলেদের মারছো।হুম,এটা কি ঠিক হইলো?আমার আব্বাগুলো কত ভালো?তারা কি করছে?রেনু ঘর থেকে ছোট ছেলেকে কোলে নিয়ে উঠোনে আসে।

আমি তো ওগো সৎ মা।তাই খালি শুধু মারি। ভালোবাসি না।আর তারা যা করে সব ভালো করে।একদম সাধু বাবা।
পুতুল বারান্দায় এককোনায় চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে।সবার মতো সে দৌড়ে আসেনি।স্বাধীন,রেনুর কোল থেকে ছোট ছেলেকে নিয়ে কপালে চুমু বসিয়ে,আদর করলো কিছুক্ষণ।তারপর রেনু কোলে তুলে দিল।

স্বাধীন এগিয়ে এসে পুতুলের মাথায় হাত রাখে।ডেকে ওঠে।

আম্মা।আম্মা।ওহ আম্মা।আমার আম্মা।কপালে মাঝে একটা চুমু দিয়ে জিজ্ঞেস করে।

আম্মা তুমি কেমন আছো?পুতুল দুই চোখের পানি মুছতে মুছতে ইশারায় বলল,

সে ভালো আছে।পুতুলের চোখের পানি বন্ধ হয় না।সে যতই চোখের পানি মুছে ততই চোখ থেকে আরো বেশি পানি বেরিয়ে আসে।চোখ দু’টো আজ এতটা বেহায়া কেমনে হলো?পুতুল বুঝতে পারে না।এতদিন নিজেকে সামলে নিলেও আজ মামাকে দেখে বেশি আবেগি হয়ে গেছে।

মামাকে হালকা জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে ফুফিয়ে ওঠে।স্বাধীন,পুতুলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।চারদিকে তাকিয়ে দেখে পরিবারের প্রত্যেকের মুখে হাসি লেগে আছে। স্বাধীনের বাড়িতে আজ ঈদের খুশি লেগেছে।
স্বাধীনের চোখ দুটো জুড়িয়ে গেলো।রাতের আধারের ওই আকাশ দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,এটাই আমার জান্নাতের বাগান।আমার সুখ।আমার মতো এতোটা সুখী আর কেউ নেই।আমি পৃথিবীর সেরা সুখী মানুষ।আল্লাহ তোমার নেয়ামত খেয়ে আমি ভালো আছি।সুখেই আছি।শত কোটি শুকরিয়া তোমার দরবারে।

ঘর টা যদি সুখের হয়।
তারে জানি স্বর্গ কয়।
ভালোবাসার মাঝে স্বর্গ,
আর কোথাও নয়?

চলবে…..

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-২৪
৭৪.
অনেক দিন পর স্বামী বাড়িতে এসেছে।রেনু একটুও ভালো কিছু রান্না করার চেষ্টা করে।পোলাও চাউলের খুদ দিয়ে পায়েস বানানো সিদ্ধান্ত নিলো।

তাছাড়া বাঙালির খাবারের তালিকায় পায়েস অন্যতম।বাঙালিদের যেকোনো শুভ অনুষ্ঠানে পায়েস থাকবেই থাকবে!উৎসব আয়োজনে বাঙালির খাদ্যতালিকায় পায়েসের জুড়ি মেলা ভার।বিশেষ দিনে,মিষ্টি মুখ করার জন্য পায়েস আয়োজন বেশি হয়ে থাকে।দুধ পরিমাণমতো চিনি,কাজুবাদাম ও কিশমিশ,দু’টো তেজপাতা।ছোট কয়েকটা এলাচ।সবগুলো একসাথে হাঁড়িতে চড়িয়েছে।

একটা পাত্রে চাল নিয়ে ভিজিয়ে রেখে ঝড়িয়ে নিলো।দুধ ঘন করে নিয়েছে।দুধ ফুটে উঠলে তাতে চাল দিয়েছে।কিছুক্ষণ পর পর চামচ দিয়ে নাড়া দেয়,যাতে পাত্রের তলায় না লাগে।এরপর হয়ে গেলে নামিয়ে নেয়।পায়েস সুগন্ধ পেয়ে সাজু,মিলন রান্না ঘরে উঁকি দেয়।

আম্মা পায়েস রান্না করছে।মিলন,সাজু জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট চেটে বলল,

হুম,ইয়াম্মি।অনেক মজা হবে।কি সুন্দর সুগন্ধ আসছে?কারো ফিসফিস কথার আওয়াজে রেনু ঘুরে দেখতে পায় দুই বাঁদর দাঁড়িয়ে আছে।হাতের খুন্তিটা রাখতে রাখতে বলল,

এখানে কি চাই?

পা…য়ে…স।

এখন না।এশারের আজান পরে গেছে।বাবার সাথে হাত মুখ ধুয়ে নামাজে যাও।নামাজ পরে আসলে খেতে দিবো।

এখন একটুও খেয়ে যাই।

না।আগে যেটা ব’লেছি।ওটা করো।তারপরে তোমাদের কথা শুনা হবে।রেনুকে শত মানানোর চেষ্টা করে ওহ পারলোনা।তাই ওরা চুপচাপ নামাজ পড়তে চলে যায়।

এশার নামাজ পড়ে বাড়িতে আসতেই রাতের খাবার দেওয়া হয়।পায়েস দেয়নি ব’লে ওদের মন খারাপ হয়।রেনু দেখে ওহ না দেখার ভান করে খেদে বলল।

ওরা চুপচাপ খেয়ে উঠে।স্বাধীন দুই ছেলের মন খারাপের কারণ ইশারায় জানতে চাইলে রেনু কিছু ব’লে না।

রাতের খাবার খেয়ে সবাই যখন গল্পের জন্য একসাথে বসেছে।তখনই সবার হাতে হাতে একটা করে পায়েস বাটি তুলে দেয়।পুতুল নিজের বাটি থেকে এক চামচ মুখে দিতে নিলেই মিলন গাল ফুলিয়ে বলল,

আমি খাবো না।তোমরা খাও।মিলনের রাগ দেখে সাজু এক চামচ মুখে দিয়েছিল।সেটা গিলে নিয়ে ঠোঁট দুটো মুছে নিলো।বাটিটা মাটিতে রেখে সে-ও বলল খাবে না।স্বাধীন, পুতুল এদের কাহিনি বুঝতে না পেরে রেনুর দিকে তাকিয়ে রয়।রেনু নিজের বাটির পায়েস চামচ দিয়ে মুখে তুলতে তুলতে বলল।

ঠিক আছে।খেতে হবে না।রেখে দেও।আমি তোমাদেরটা খেয়ে নিবো।এমনইতেই আমার এক বাটিতে পোষাচ্ছে না।তিন বাটি হলে ঠিক পুষে যেতো।কি করব হাঁড়িতে আর পায়েস নেই?তাই মনের সাথে সাথে পেট ভরাতে না পারায় দুঃখ লাগচ্ছিল।কিন্তু এখন কোনো ব্যাপার না।আমারটা সাথে তোমাদের দুইজনের টা ফ্রি।রেনু নিজের দিকে দুই বাটি টেনে নিতে নিলেই মিলন,সাজু তাড়াতাড়ি করে নিয়ে নিলো।কোনো কথা না ব’লে একের পর এক চামচ মুখে ঢুকিয়ে নিচ্ছে।পুরো বাটির পায়েস শেষ করে,রেনুর হাতে সুন্দর করে খালি বাটি দিয়ে চলে গেলো।রেনু মিটিমিটি করে হেঁসে উঠে।দুই ছেলের এতখন এসব করার কাহিনি বলতেই স্বাধীন,পুতুল হেঁসে দেয়।

অনেক রাত হয়ে গেছে।এবার যার যার রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ো।মামীর কথায় পুতুল মাথা নাড়িয়ে চুপ করে ঘরে চলে যায়।নিজ কক্ষে এসে দেখে দুই ভাই চুপচাপ শুয়ে আছে।পুতুল দরজা বন্ধ করে।বাতি সুইচ টিপে বন্ধ করে নিজেও কিছুটা দূরত্ব রেখে চোখ বুজে নিলো।

৭৫.
জামাই আঁটি গ্রাম থেকে রেনু চাচাতো ভাই আসছে।বোনকে দেখে কয়েক দফা কান্নাকাটি করেছে।দশ বছর ধরে দেশের বাহিরে ছিলো।বোনের বিয়ে সময় সে দূর দেশে।আজ সেই বোন নাকি চার ছেলে,মেয়ে’র মা।ভাবতেই অবাক হচ্ছে।

নিজে বিয়ে করেনি।মাথার চুল পড়ে টাক হচ্ছে।তাই তো এবার দেশে ফিরতেই মা,বাবা ছেলেকে বিয়ে দিতে উঠে পড়ে লাগছে।রেনুর ভাইয়ের নাম সাজ্জাদ।বিশ বছর বয়সে দেশ ছাড়ে।এখন ত্রিশ থেকে একটু বয়স বেশি হয়েছে।দেখতে হ্যান্ডসাম লাগে।কিন্তু হ্যান্ডসাম হলে কি হবে মাথার চুল না থাকায় টাকলু আঙ্কেল লাগছে।চুল থাকলে বেশ কয়েকটা রমনী পটলে ওহ পটে যেতো।

এই সাজ্জাদ সাহেবের কোনো রমনী না জুটলেও,বিদেশ থেকে এসে একটা কুকুর ভালোই জুটিয়ে নিয়েছে।তার গায়ের মশম সাদা।নাম দিয়েছে মানকি।এই নাম শুনেই মিলন হাসতেই থাকে।আর মুখ দিয়ে বলতে থাকে।

কুত্তার বাচ্চা ফুটফুটে সুন্দর।মিলনকে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি করতে দেখে মানকি চোখের পলক ফেলে তাকায়।

সাজাদ্দ বোনের বাড়িতে আসার পথে তাঁকেও নিয়ে এসেছে।পুতুল কুকুর দেখলেই ভয় পায়।আর নতুন অতিথি সাথে নতুন মানকি নামক এই প্রানী দেখে চোখ বড় বড় হয়ে গেছে।এই আপদ তাদের বাড়িতে না-কি কয়েকদিন থাকবে।তাই পুতুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে,এর থেকে দশ হাত দূরে থাকবে।

কিন্তু এইদিকে মিলন কুকুরটার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকায়।আবার জিহ্বা বের করে ভেঙায়।লেজ ধরে টানে।কখনো গোফ ধরে টানে।মিলন উল্টাপাল্টা কাজে কুকুরটাও বিরক্ত হয়ে উঠে।সে বেশ কয়েকবার কেউ কেউ করে উঠে।কুকুরের সাথে এমন মাখামাখি ভালো না।সবাই নিষেধ করে।কিন্তু সে শুনলে তোও।যদিও সাজ্জাদ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখে।তবু্ও কুকুরের সাথে এতো মাতামাতি করা ঠিক না।দেখা যাবে সে বিরক্ত হয়ে কিছু করে বসেছে।

সাজ্জাদ,স্বাধীনের সাথে মাঠে গেছে।সে না-কি ক্ষেতে চাষবাস করবে।বাড়িতে মানকিকে রেখে গেছে।এই মানকি সাহেবের কোনো কাজ নেই।সে খায় দায় আর ঘুমিয়ে দিন কাঁটায়।আর রাত হলে সে যা করে সেসব রাতেই বুঝতে পারবে।

সাজ্জাদ মামা বিদেশি চকলেট এনেছে।রেনু মিলন,সাজু হাতে কিছু চকলেট ভাগাভাগি করে দিল।সেই চকলেট প্যাকেট ছিঁড়ে মুখে পুরে,

হুমম ম-ম।সেই স্বাদ।এত স্বাদ ক্যা?এত স্বাদ…।

মিলনের মজা করে চকোলেট খাওয়া দেখে মানকি সাহেব তার লেজ নাড়িয়ে বারান্দা থেকে নেমে মিলনের গায়ের সাথে গা লাগিয়ে দাঁড়ায়।

ওমা গো মা।দেখছো নিই এর কার বারটা।
ওই আমার কাছে কি তোর হ্যা?খুব তোও এতখন ভাব লইয়া আছিলি।মিলনের পাত্তা দেস নাই।এখন আইছেন কেন?দূরে যা।দূরে গিয়া মর গা।শালা ফটকাবাজ।চকলেট লোভী।লোভ কত?আবার আমারটা খাইতে আয়ে।তোরে আমি চকলেট দি.তা.ম না।না মানে না।তোর সাথে আমার কোন সম্পর্ক নাই।সো আমি দিতাম না।আবার আমার চকলেটের দিকে নজর দেস।দাঁড়া তুই।মিলন চকলেটগুলোতে থু থু মেরে দিয়ে বলল,

নে এবার,খাবি।খা।খা না।আমি জানতাম।এই রকম করলে তুই খাইতে পারবি না।তাই ইচ্ছে করে এটা করলাম।মিলন লাস্ট বড় চকলেটটাতে থু থু লাগিয়েছিল।মানকি তখন লেজ নাড়িয়ে উল্টো পথে চলে যাচ্ছিলো।মিলন তখনই মনের আনন্দে মুখে পুরতে নিলেই মানকি ফিরে এসে মিলনের হাতের চকলেট মুখে নিয়ে দৌড় মারে।নিজের মুখে চকলেট যেতে পারেনি।হাত খালি,সেখানে ওহ চকলেট নেই।মিলন একটা চিতকার করে বলল,

কুত্তার বাচ্চা আমার চকলেট নিছে।কুত্তা বাচ্চা একটা লোভী।মিলনের থু থু লাগানো চকলেট খাইছে।লোভী কুত্তা।

মিলন,কুকুরের সাথে পুরো বাড়িতে দৌড়াতে লাগলো।তার উদ্দেশ্য একটাই।কুত্তা বাচ্চার মুখ থেকে চকলেট বের করেই ছাড়বে।কিন্তু মানকি সাহেব ধরা দিলে তো।

৭৬.
ভাই সামনের মাসে সাজু,মিলন ছয় বছরে পা দিবে।তাই বলছিলাম কি?ওদের অল্প বয়স থাকতেই মুসলমানিটা করে ফেলেন।আমি সব ব্যাবস্থা করে রাখব।

হুম ভাই মুসলমানি করাবো।কিন্তু এরা যে দুষ্টুমি করে।দেখা যাবো একে অপরের সঙ্গে মারামারি করে রক্ত বের না করে বসে।

আরে এটা কোনো ব্যাপার না।একবার সুন্নতের কাজটা হয়ে গেলেই তারা নিজেরাই সর্তক থাকবে।সব ঠিক হয়ে যাবে।আর আমি তোও আছিই।সামলে নিতে পারব।

সাজ্জাদ,স্বাধীন বাড়িতে পা রাখতেই দেখে, মিলন দুই হাত দিয়ে কুকুরের মুখ হা করিয়ে কিছু একটা খুঁজছে।আর কিসব ব’লে বকাবকি করছে।

কি মামা কি হয়েছে?আপনি মানকি সাহেব সাথে এমন করছেন কেন?

-;তোমার মানকি গায়ে তোও কোনো কোর্ট,প্যান্ট,টাই পড়া দেখলাম না।তাহলে সে সাহেব হলো কি করে?তোমাকে সাহেব লাগছিল।প্রথম যেইদিন কোর্ট,প্যান্ট,টাই পরে আমাদের বাড়িতে আসছিলা।

কিন্তু এখন তার বিচার কর।তোমার এই মানকি,টানকিং আমার চকলেট খাইছে।তারে ভালোই ভালোই চকলেট পেট থেকে বের করতে বলো।যদি বের না করে।আমি কিন্তু কাচি দিয়ে তার পেট কেটে চকলেট বাহির করমু।
অসভ্য কুত্তা বাচ্চা।লোভী মানিক টানকিং।শরম নাই।অন্যেরটা কাইড়া খায়।ছ্যাছড়া কুত্তা।লোভী জানি কোনহানকার?

মানকি সাহেব মনে হয় মিলনের কথায় অপমান ফিল করলেন।তাইতো মিলনের কথা শেষ হতে না হতেই কেউ কেউ শুরু করে দিলো।যার মানে সে নির্দোষ।মানকি এমন কাজে মিলন রেগে বলল,

একে তোও চুরি করে খাইছে।তার ওপর সিনা জুড়ি করে।লোভী মানকি।অসভ্য।মামা তোমার এই অসভ্য কুত্তাটাকে বাহিরে রেখে আসোও।এ চরম লোভী।এর জায়গায় আমাদের মাঝে হবে না।সাজ্জাদ মিলনকে শান্ত করতে বলল,

মামা শান্ত হও।তোমার জন্য গুড নিউজ আছে।

গুড নিউজ।সেটা আবার কি?খায় না মাথা দেয়?

বলছি।আগে সবাইকে ডেকে আনো।মিলন, রেনুকে ডেকে আনলো।পুতুল তখন স্কুলে আছে।মামা আসার খুশিতে মিলন,সাজু দুইদিন ধরে স্কুলে যায় না।রেনু আসতেই জানানো হলো।সামনের শুক্রবারে সাজু,মিলনের মুসলমানি।তার উপলক্ষে ছোট খাটো খানাপিনা হবে নিজেদের মধ্যেই।বাহিরে লোক আসবে না।শুধু নিজেরাই থাকবে।সেই দিনের জন্য পোলা,মুরগী রান্না হবে।সাথে গরুর গোশত।

সুস্বাদু খাবারের কথা শুনে মিলন,সাজু লাফাতে লাগলো।

থাকতুম থাকতুম বাজায়।
মিলন মিয়ার ঢোল।

আমি মজার মজার খাবার খাবো।ওহ শুক্রবারে আমার মুসলমানি হবে।তোমাদের সবাইকে দাওয়াত দিলাম সবাই আইসো।আসলে ফিড়ি পেতে বসতে দিবো।পান,সুপারি খেতে দিব।সবাই গিফট নিয়ে আসবা।না নিয়ে আসলে কোনো সমস্যা নাই।না খাইয়ে পাঠিয়ে দিবো।

চলবে….

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-২৫
৭৭.
শুনলাম তোমার ননদের মাইয়া এহনো এই বাড়িতেই আছে।তা তাকে কি সারাজীবন বসিয়ে রাখবা না-কি?মাইয়া মানুষ যখন, পরের বাড়িতে পাঠিয়ে দেও না কেন?স্বাধীন এই মাইয়ারে এত দিন খাওয়াছে।এই তো ম্যালা করছে।মাইয়াডারে বিয়া দিয়া ফালাও।

-;মামী মা।আপনি অতিথি মানুষ।অনেকদিন পরে আসছেন।কোথায় একটু আনন্দ,হাসি,মজা করবেন?তা না করে।আপনি আজকের এই শুভ্র দিনে কথাগুলো নিয়ে পড়ে আছেন?

-;রেনু তুমি ব্যাপরটা বুঝতাছো না।আরে পরের মাইয়া,পোলা নিয়ে এত মাতামাতি কিসের?ওদের নিয়ে মাতামাতি কম কর।নিজের ঘরেও দুইখান আছে সেটা কিন্তু ভুইলা যা-ইয়ো না।পরের মাইয়া,পোলার জন্য এত দরদ।আর নিজেরটার প্রতি কোনো দরদ নাই কেন?আবার ঢঙ্গ কইরায় বোবা মাইয়াডারে পড়াইতাছে।বলিই,টাহা কি গাছে ধরছে তোমার সোয়ামীর?এত যখন টাহা পয়সা আছে।আমারে দিয়া দেও।আমি গ্রামে গিয়া গরু কিনি।প্রত্যেক মাসে আমার থেকে লাভ নিয়া আইসো।

মামী মা থামুন।পুতুল আমাদের’টা খায় না, পড়েও না।ওর নিজের টাকায় ওর খরচ চলছে।এমনকি ওর মায়ের নামের সম্পত্তি যতটুকু প্রাপ্ত হোক পাওনা রয়েছে।সেইসব ওপরই ওর বসত ভিটা।ওইযে পশ্চিমে দিকের ছাপড়ার ঘরটা দেখতে পাচ্ছেন।ওটাতে পুতুল থাকে।ঝড় হয়,তুফান বয়।কিন্তু মেয়েটা আমাদের ঘরে এসে একটা রাত কাটাতে রাজি না।সে তার ছোট্ট ঝুপড়ি ঘরে ঘুমিয়ে থাকে।কয়েকদিন আগে বৃষ্টির জন্য যখন ঘরের চালের ফুটো দিয়ে টুপটাপ শব্দ করে পানি পড়ছিল।পুতুল ভাইদের কে নিরাপদে রেখেছে।নিজের ঘরে ছোট মাটির কলস এবং ভাঙ্গা হাঁড়ি পেতেছে।যাতে পানিটুকু মাটিতে কিংবা নিজের গায়ে এসে না লাগে।কিন্তু ঘরে ভিতরে জানালা বেয়ে পানি পড়ছে।বাহিরে ঠান্ডা বাতাসের সাথে বৃষ্টি জ্বালাতন সয্য করা দায় হয়েছে।নিজের গায়ে বৃষ্টির পানি পরে জ্বর এসেছে।জ্বরের জন্য
মেয়েটা বিছানা ছাড়তে পারছে না।আর আপনি তাঁকে নিয়ে আমার কাছে এসেছেন নিন্দা করতে।

পুতুলের হয়ে রেনুর সাফাই গাওয়াটা ভালো চোখে নিলেন না মনোয়ারা বেগম।পানের পিক ফেলতে ফেলতে বললেন।এত চটাং চটাং কথা থামাও।আর মাইয়া মানুষ হইয়া তোমার গলায় দেখি খুব তেজ বাড়ছে।স্বাধীনের ঘরে আইসা মোটা চালের ভাত খাও।তার জন্য বুঝি এত সাহস বাড়ছে না।কলিজাটা মেলা বড় হইছে।এত চটাং চটাং কথা আমার লগে কমাইয়া কও বউ।মাইয়া মানুষের এত তেজ আমার পছন্দ নয়।গুরুজনের প্রতি কোনো শ্রদ্ধা নেই।কেমন শিক্ষা দিয়েছে তোমার বাপ,মা?আর ওই মেয়ের হয়ে এত সাফাই গাইছো।পড়াশোনা করাচ্ছো।দুইদিন পরে তোও ওরে পরের বাড়িতে বিয়া দিমু।তখন হাতে বই থাকব না।হাতে থাকব খুন্তি।মাইয়া মাইনষের আবার এত পড়া লাগে নিই?

কেন মামী মা?মেয়েরা কি পড়াশোনা করে না?মেয়েদের এত ছোট নজরে দেখেন কেন?মেয়েরা চাইলেই সব পারে।একটা ভাঙ্গা সংসার মেয়েরা যেমন নিজ হাতে গড়তে পারে।তেমনই ভাঙ্গতে ওহ পারে।যে মেয়ে পরের বাড়িতে রাঁধতে জানে।আবার সেই হাতে ঘরের বাহিরে শিক্ষা আলো জ্বালাতে পারে।আজকের মেয়েরা ঘরে বাহিরে দু’টো দিকেই সামলাতে জানে।আপনি জানেন মেয়েরা ডাক্তার,পুলিশ,উকালতি থেকে শুরু করে সব কিছুতেই এগিয়ে যাচ্ছে।নারী কোনো দিক দিয়ে পিছিয়ে নেই।

ওহ তা পুরুষের মতোই চালচলন করলেই কি মেয়ে মানুষ,পুরুষ মানুষ হয়ে যায়?তাদের মতোই চলার এত শখ?শোনো বউ,মাইয়া মানুষ হইছে ননীর পুতুল।তারে যে পাত্রের রাখব।সেই পাত্রের আকারে সে ধারণ করব।
আর মাইয়া মানুষের যে পর্দায় রাখতে হয় তা কি ভুইলা গেছো?

৭৮.

না,মামী।আমি আমার মেয়ে এবং ছেলেকে ইসলামের ধর্মীয় শিক্ষায় নিয়োজিত রেখেছি। মেয়েকে পর্দায় রাখার জন্য একটু একটু করে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি।তারা পাচঁ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে।তাদের আরবি শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে।তার পাশাপাশি বাংলা….!

হইছে থামোও তুমি।পাঁচ ওয়াক্তের নামাজের পাশাপাশি আরবি পড়াইছো।এর বাহিরে তুমি কি করছো?একটা সন্তানকে তুমি মাদ্রাসা শিক্ষা গ্রহণের জন্য দিয়েছো।সব দেখি দুনিয়ার আরাম আয়েসের জন্য দিয়েছো।দুনিয়ায় আনন্দ নিয়ে আছো।আখিরাত নিয়ে তোমাদের কোনো চিন্তাই নাই।যদি চিন্তা থাকত।তাইলে মাদ্রাসায় শিক্ষা গ্রহনের জন্য পাঠাতে।যাও তো বউ।আমার চোখের সামনে থেকে দূর হও।তোমার কথা শুনলে মাথা গরম হইয়া যায়।

যাচ্ছি মামী মা।তবে যাওয়ার আগে একটা শেষ কথা ব’লে যাই।আমার কোলে এই সন্তানকে কিন্তু আমি এবং আমার স্বামী মাদ্রাসায় পড়ানোর অনেক ইচ্ছা আছে।
তাকে ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত করব।

আরেকটা কথা।যেটা আমি এবং আমার স্বামী ছাড়া কেউ জানে না।

আমরা পুতুলের বেলায় সর্ব প্রথম চেষ্টা করেছিলাম।গণ শিক্ষায়।যার মাধ্যমে হাফেজি পাস করে বের হবে।কিন্তু তার কথা বলতে না পারার জন্য সব জায়গায় থেকে খালি হাতে ফিরেছিলাম।সর্বশেষ আশার হাতছানি পাই তালেপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে।তা-ই মেয়ের ভবিষ্যতে কথা চিন্তা করেই সেখানেই পড়তে দেওয়া হয়।

তাকে কিন্তু মেয়ে ব’লে কিংবা তার কথা বলতে না পারার জন্য দূর ছাই করিনি।আর তার পোশাক বেশ মার্জিত।সালোয়ার,কামিজ,কেচি বেল্ট এবং মাথায় হিজাব পরিধান করে স্কুলে যায়।কয়েকদিন থাকলেই দেখতে পারবেন।তার পোশাকে কোনো অশালীন কিছু নেই।

একইভাবে বাকি দুই ছেলেকে মাদ্রাসা শিক্ষায় দিতে চেয়েছি।কিন্তু তাদের ইচ্ছে ছিলো বোনের কাছাকাছি থাকা।তা-ই তোও শত চেষ্টা করে ওহ দুই ছেলেকে মাদ্রাসা পড়াতে পারিনি।তাই ছোট ছেলের সাড়ে তিন বছর বয়সে সাধারণত মসজিদ ও মাদ্রাসা ভিত্তিক করে দিব।

মাদ্রাসার প্রাথমিক স্তর মক্তব,নূরানি বা ফোরকানিয়া মাদ্রাসা নামে অভিহিত।ফোরকানিয়া শব্দের মূল ফুরকান যার অর্থ বিশিষ্ট।মিথ্যা থেকে সত্যকে সুস্পষ্টভাবে পৃথক করে বলে পবিত্র কুরআন-এর আরেক নাম আল ফুরকান।প্রাথমিক স্তরের যেসব মাদ্রাসায় কুরআন পাঠ ও আবৃত্তি শেখানো হয় সেগুলিকে বলা হয় দর্‌সে কুরআন।সাধারণত স্থানীয় কোন মসজিদেই আশেপাশের পরিবারের ছোটদের প্রাথমিক পর্যায়ের ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয়।মসজিদের ইমাম ও মোয়াজ্জিনরাই সাধারণত এর শিক্ষক বা উস্তাদ হন।

৭৯.
রেনু কথা শেষ করে।ছোট ছেলেকে নিয়ে পুতুলের ঘরে ঢুকেন।মেয়েটা জ্বরে ঘোরে কেমন নেতিয়ে পড়েছে।এই মেয়েকে নিয়ে তিনি খুব চিন্তিত।স্বামী বাড়িতে আসলেই তাকে আরেকবার বলবেন গঞ্জের ডাক্তার দেখিয়ে আনতে।

লুঙ্গি ধরে দুই ভাই খাটে বসে আছে।একটু পর পর নিজেদের দিকে নিজেরাই তাকায়।পরশু নানু বাড়ির লোকেরা এসেছে।তাদের সাথে সবাই দেখা করে গেছে।হাতে ও বেশ কচকচে দশ-টাকা,বিশ টাকা নোট গুছে দিয়েছেন।টাকা গুলো দুইজনের দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে বসে আছে।তাদের সমবয়সী কিছু ছোট বাচ্চাদের দিকে টাকা ছুঁড়ে মারতে মারতে বলল,

এই নে টাকা।এই তুই নে।এই নে।তোরা চকলেট কিনে খাইস।তুই বরফি খাইস।তুই জুস খাইস।এমন করে সবার মাঝে টাকা ছুঁড়ে মারতে লাগল।সবাই যখন নতুন কচকচে টাকাগুলো মাটি থেকে তুলে হাতে নিতে গেলো।তখনই মিলন,সাজু ওদের হাত থেকে টাকাগুলো নিয়ে নিলো।দরজার সামনে মানকিং সাহেব চোখের পলক একটু পর পর ফেলে তাকিয়ে আছে।আর বাকিরা হা করে তাকাতেই মিলন,সাজু লুঙ্গি ধরে খাটে বসে বলল,

ওই তাকাইয়া আছস কেন?কি কবি ক?তোরা কইলে আমি কমু হ।

মিলন,সাজুর কমকান্ডে কুত্তা কেউ কেউ করে উঠে।
আজ বারে শুক্রবার ছিল।এই জুম্মা দিনেই তাদের সুন্নাতখানা কাজ করে।দুই ভাই গোসল সেরে যোহরে নামাজ পরে আসতেই আসল কাজটা করে ফেলে।সাজ্জাদ মামা,এবং আব্বা দুই ভাইয়ের চোখ হাত দিয়ে ধরতেই কেমন যেনো ব্যাথা পায়।কান্না করে উঠতেই দেখে তাদের কাম সাইরা লাইছে।দুই ভাইয়ের চিতকার চেচামেচি করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলছে।তাদের কান্না থামানোর সাধ্য কারো হয়নি।নানা,নানু এবং বাকিদের মিষ্টি মিষ্টি কথায় কান্না বন্ধ হয়নি।দুইজনের হাতে টাকা দিতেই ঠান্ডা হয়।এবং কান্না আস্তে আস্তে বন্ধ হয়েছে।

৮০.
পুতুল বিছানা ছেড়ে আছরের নামাজটুকুও পড়ে নিয়েছে।জ্বরটা কেমন ছেড়ে দেয় আবার বেড়ে যায়।শরীর প্রচন্ড দূর্বল লাগছে।মুখটা তিতো হয়ে আছে।পেটে কিছু রাখাটা কষ্ট কর।যাকিছু খাচ্ছে সব বমি করে ফেলে দিচ্ছে।বাড়িতে মেহমান আসছে।তাদের কাছে অবতী যাবে সেই ক্ষমতাটুকু নেই।ঘরের কোণে চুপটি করে বসে থাকতেই।দুই ভাই মামার রুম থেকে ডেকে উঠে।

ওই আপু।তুমি কই?এখানে আসো।আমায় নিয়ে যা-ও।আমি যাব তোমার কাছে।

মিলনের ডাক শুনে।পুতুল আসছি টুকু উচ্চস্বরে বলবে সেই সাহস টুকু হচ্ছে না।পুতুলের থেকে সাড়া না পেয়ে মিলন ঠোঁট উল্টে খাটে গাল ফুলিয়ে বসে রয়।স্বাধীন আছরের নামাজ পড়ে বাসায় এসেছে।

শুনছেন।আপনি পুতুলকে নিয়ে একটু ডাক্তার কাছে যাবেন।মেয়েটার গায়ের জ্বর কমছে আবার বাড়ছে।ঠিক মতো খাবরটুকু খাবে সেই অবস্থা নেই।পেটে কিছুই রাখতে পারছে না।স্বাধীন মাথার টুপিটা খুলে পুতুলের রুমে পা দেওয়ার আগেই দরজার বাহিরে দাড়িয়ে কাশির মতো শব্দ করে রুমে পা দেয়।মামার গলা পেতেই পুতুল নিচু মাথা উপরে তোলে।

মামা কপালে হাত দিয়ে জ্বরটা বোঝা চেষ্টা করেন।দেখেন জ্বরটা আবার বাড়ছে।অথচ যোহরে সময় কিছুটা কমেছিল।

আম্মা চলেন!ডাক্তার দেখাবো।

পুতুল মাথা নাড়িয়ে না বলল।যার মানে সে যেতে চায় না।তার ভালো লাগছে না।স্বাধীন পুতুলের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভেবে রুম থেকে চলে যায়।মামা চলে যেতেই টুপ করে চোখ থেকে দু’ফোটা অশ্রু ঝড়ে পড়ে।গায়ে নকশিকাঁথা দিয়ে শুয়ে পড়ে।ঘুমানোর চেষ্টা করে।যদি ঘুমিয়ে চায় তাহলে হয়ত জ্বরটা তাকে কাবু করতে পারবে না।পুতুল ঘুমের চেষ্টা করে।

চোখ মেলে তাকাতেই দেখে মামা তার মাথার সামনে বসে আছে।মাথায় হাত দিতেই দেখতে পায় জল পট্রি মাথায়।তার পাশেই ডাক্তার বসে আছেন।ডাক্তার কি সব যেন মামাকে বলছে?পুতুলের সেইসবে মনযোগ নেই।শরীরটা কেমন হালকা লাগছে।আর গা দেখে মনে হচ্ছে ঘাম দিচ্ছে।নকশিকাঁথা সামনের হালকা অংশ ঘাম লেগে ভিজে আছে।পুতুল উঠার চেষ্টা করলেই মামা নিষেধ করেন।ডাক্তার সাথে মামা বের হয়ে যেতেই একটুও পর মামী রুমে ঢুকেন।ভিজা কাপড় দিয়ে শরীর মুছে দেন।আর গায়ে কাপড়টা পাল্টে নিতে বলল।

চলবে….

চক্ষে আমার তৃষ্ণা পর্ব-২০+২১+২২

0

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-২০
৬২.
ফজরের নামাজ পড়ে জায়নামাজে বসে আছে পুতুল।আজ রাজিয়ার মৃত্যু বার্ষিকী।মানুষটা চলে গেছে কতগুলো বছর চলে গেলো।চোখ বুঝতেই মনে পড়ছে এই তো সেই দিনের কথা।মা তাঁকে নিয়ে মামা বাড়িতে উঠলো।মায়ের সাথে তার কত সুন্দর সুন্দর মূহুর্ত পার হয়েছে।কিন্তু তার ছোট ভাইটা মায়ের ভালোবাসা পায় নিই।ওহ তো জানে না।মা তাকে পৃথিবীর আলো দেখাতে গিয়ে এই সুন্দর ধরনী ছেড়েছেন।

সকাল বেলা মসজিদ থেকে ফজরের নামাজ পড়ে স্বাধীন বাড়িতে পা রাখে।পুতুল গায়ে চাদর জড়িয়ে উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে।ওড়না দিয়ে মাথা ঢাকা।স্বাধীন এগিয়ে আসে।

আম্মা আপনি নামাজ পড়ে ঘুমাতে যান নাই।
পুতুল মাথা নাড়িয়ে না বলল।চিরকুটটা এগিয়ে দিতেই স্বাধীন অবাক হয়ে হাত বাড়িয়ে নিলো।চিরকুটটা খুলতেই ছোট হাতের কিছু অল্পস্বল্প লিখা।স্বাধীন লিখাটুকু পড়ে পুতুল দিকে তাকায়।

আম্মা আপনি মনে রাখছেন এই দিনটার কথা।
আমি তোও মনে করছিলাম আপনি ভুইলা গেছেন।তাই ফজরের নামাজ পড়ে বোনের কবর জিয়ারত করে আসছি।পুতুল ঢোক গিলে মুখ দিয়ে শব্দ বের করা চেষ্টা করে।উ..উ… ছাড়া আরো কোনো শব্দ বের হয়না।কথা বলতে না পেরে ফুফিয়ে কেঁদে ওঠে।স্বাধীন,পুতুলের দুই চোখের পানি মুছে,তার বুকে মাথাটা রেখে জড়িয়ে মাথায় হাত ভুলিয়ে দিতে দিতে বলল।

আম্মা কাঁদে না।চুপ থাকো।আমি তোমারে নিয়া যাইতাছি।

কবর ওপর কয়েকটা ফুল ফুটে আছে,দূর্বলা ঘাস বেশ বড় বড় হয়েছে।পুতুল কবরস্থানের ভিতরে যেতে পারেনি।মেয়েদের কবরে সামনে যেতে নেই।বড় গেইটে সামনে দাঁড়িয়ে দূর থেকে ছাপসা চোখে তাকায়।চোখের পানি টইটম্বুর হতেই দুই হাতে মুছে নিলো।ওই যে,তৃতীয় স্থানে তার মায়ের কবর রয়েছে।তার মায়ের পাশে সারি সারি অনেক কবর রয়েছে।কার প্রিয়জনেরা এখানে কবরে ঘুমিয়ে আছে জানে না।শুধু জানে তার অতি প্রিয় একটি মানুষ এখানে এই কবরে শায়িত।
তার জনম দুঃখী মা।পুতুল গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে মোনাজাত ধরে দুই চোখের পানি ছেড়ে দিল।মোনাজাত শেষে মাটিতে বসে পড়ে।লোহার গেইট হাত ঢুকিয়ে ডাকবার কত আকুতি।তার মা আজ পুতুলের ডাকে সারা দেয় না।যেমন পাঁচ বছর আগে করেছিল।এভাবেই ঘুমিয়ে ছিল বাড়ি উঠোনে।কত ডেকেছে।কিন্তু চোখ মেলে বলে নিই।

পুতুল মা আমার,এই তো আমি।কান্না করে না।তুমি আমার লক্ষ্মী মা।মায়েরা কি কান্না করে?পুতুলকে তার মা আজ-ও আগের মতো হেঁটে এসে বুকে টেনে নেয় নিই।সাদা কাপড় পরে তার মা পর হয়ে গেছে।মায়েরা এত নিষ্ঠুর কেন?তাদের বুকে ধন,তাদের সন্তান ছেড়ে কি করে ঘুমিয়ে আছে এই মাটির কবরে।একটিবার কি মনে পড়ে না সন্তানের কথা?জানতে পারে কি?মা বিহীন এতিম সন্তানগুলো দুনিয়ার মাটিতে কি করে একলা রইবে?স্বাধীন,পুতুলের কান্না দেখে নিজের চোখের পানি লুকিয়ে এগিয়ে আসে।

আম্মা বাসায় চলো।সকাল হয়েছে অনেকক্ষণ।তুমি বাসায় নেই।মিলন,সাজু খুঁজবে তোমায়।চল আম্মা।পুতুল স্বাধীনের কোনো ডাকে সারা দেয় না।স্বাধীন,পুতুলের মাথায় হাত দিতেই চমকে উঠে।পুতুল মায়ের শোকে অজ্ঞান হয়ে গেছে।জ্ঞান নেই।স্বাধীন তারাতাড়ি বাসায় দিকে ছুটে।তার মায়ের মৃত্যু যেইদিন হয়েছিল।মায়ের লাশ কবর দেওয়ার জন্য নিয়ে গেছিলো,এমনভাবে পুতুল অজ্ঞান হয়ে ঘরে কোণে পড়ে থাকে।কেউ জানতে পারেনি এতিম মেয়েটির ওপর কি যাচ্ছে?মামা,বোনকে বিদায় দিতে কবরে নিয়ে গেছে। কি অদ্ভুত তাই না?আমাদের আপন মানুষগুলো একদিন আমাদের কবরে রেখে আসবে।যেমন রাজিয়া বেলায় স্বাধীন ভাই হয়ে রেখে এসেছিল।ঠিক তেমনিভাবে আমার,আপনার।এবং আমাদের সকলের আপনজনেরা এভাবেই একদিন কবরের মাটিতে শায়িত করবে।সেইদিন চিতকার করে বলা হবেনা।তোমরা আমাকে এই মাটির ঘরে রেখে যেওনা। আমি তোমাদের সাথে থাকতে চাই।মা,বাবা,ভাই তোমরা নিয়ে যাও আমায়।আমি একা থাকতে খুব ভয় পাই।যখন দেখবে প্রিয় মানুষগুলো তোমার ডাকে সারা
দিচ্ছে না।তারা কাঁদবে।আহাজারি করতে করতে চলে যাবে।তোমায় রেখে যাবে সাড়ে মাটিতে।

৬৩.
ডাক্তার সাহেবা পুতুলকে কেমন দেখলেন?

দেখুন স্বাধীন সাহেব!মেয়েটি মা হারিয়েছে। হঠ্যাৎ শকটটা নিতে সে পারেনি।আপনার কথা অনুযায়ী এমন ঘটনা আগে ওহ একবার হয়েছে।ঘন্টা পর ঘন্টা জ্ঞান ছিলো না।আজ আবার সেই মায়ের সঙ্গে দেখা করা থেকে শুরু করে পুরনো কথা মনে পড়া।

এতটুকু বাচ্চা মেয়ে।যে বয়সে তার মা,বাবার সাথে থেকে হেসে খেলে সময়গুলো কাটানোর কথা।সেখানে মনের মাঝে পুরনো ক্ষত ঘা রয়েছে।তার ওপর মা হারা সন্তান।বাবা নেই।মানসিক অবস্থা তার কতটুকু ভালো থাকতে পারে বলতে পারেন।আমি জানি আপনি ওকে ভালো রাখার চেষ্টা করেছেন। এবং এখনও করছেন।এতে কোনো ত্রুটি রাখছেন না।পুতুলকে দেখে যতটুকু ধারণা করছি।মেয়েটি ভিতরে ভিতরে গুমরে মরছে।আপনার চোখের সামনে থাকলে হয়তো খারাপ কিছু হচ্ছে না।কিন্তু আপনার চোখের বাহিরে এমন কিছু ঘটেছে বা ঘটছে।যা আপনি জানেন না।সেটা হতে পারে বাড়ি কিংবা বাড়ির বাহিরে।আবার স্কুলের কোনো ব্যাপার নিয়ে ওহ হতে পারে।আশা করব চোখ,কান খোলা রাখবেন।মেয়েটি মা,বাবা নেই।আপনি একমাত্র শেষ ভরসা।আপনার কিছু হয়ে গেলে মেয়েটি ভবিষ্যত খুব একটা সুখের হবে ব’লে আমার মনে হয় না।নিজে সর্তক থাকুন।আর মেয়েটিকে নিরাপত্তায় জোরালো করুণ।হয়তো আপনার চোখ সহজেই কিছু ফাঁকি দিতে পারবে না।

ডাক্তার তার কথা শেষ করে অন্য রোগী দেখতে চলে গেলো।স্বাধীন চিন্তায় পরে যায়।

অসীম তালুকদার সকাল আটটা বাজে বাসায় আসেন।বাড়িতে ঢুকতেই শুনতে পায় তার গুনধর ছেলে কাউকে কিছু না ব’লে হুট করে চলে গেছে।এটা শুনে চিতকার করতে শুরু করেন।

এটা কেমন ভদ্রতা?কাউকে কিছু না ব’লে চলে যাওয়ার মানে কি?কালকে এসেই আজকে হাওয়া।ফাজলামো হচ্ছে না কি?

জিহান,রিহান দুই ভাই একে অপরের দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।যার মানে তারা কিছুই জানে না।অর্পণ হঠাৎ চলে গেলো কেন?কথা ছিল আরো বেশ কয়েকদিন এখানে থাকবে।কিন্তু হঠাৎ এভাবে চলে যাওয়া।

সাফিন ফোন লাগাও গুণধরকে।দেখো সে কোথায় আছে?সাফিন তালুকদার ভাতিজাকে ফোন দিচ্ছেন।কিন্তু অর্পণ ফোন তুলে নিই।দ্বিতীয়বার ফোনে রিং হওয়ার মাঝেই ফোন বন্ধ আসে।যার মানে সে ফোন বন্ধ করে দিয়েছে।অসীম তালুকদার রেগে যান।

এ’কে নিয়ে কি করব আমি?সব সময় দুই ভাইকে নিয়ে যতসব উল্টা পাল্টা কাজ করে।আমার মান সম্মান কিছু রাখেনি।আজ আবার তাদের ওহ সঙ্গে নেয়নি।বাহা..বা কি গুণধর সু পুত্র আমার?

আপনি সব সময় আমার ছেলেটার পেছনে লেগে থাকেন।একবার বাবা হয়ে তাকে বুঝতে চেষ্টা করেছেন।করেন নিই।তা করবেন কেন?আপনি কথায় কথায় বকাঝকা এবং মাঝে মধ্যে গায়ে হাত তুলেন।আমি মা।তাই সন্তানের কষ্ট বুঝতে পারি।আমার সোনা বাচ্চা ছেলে কে নিশ্চয় কিছু ব’লেছেন।তাই কষ্ট পেয়ে সে বাড়ি ছেড়েছে।

অসীম তালুকদার বউকে কিছু না ব’লে হনহন করে দুতলা নিজের রুমে চলে যান।এই মা,ছেলে তাকে পেয়েছে কি?যখন যা করবে মেনে নিবে!

৬৪.
বিকাল বেলা সবুজ ঘাসের বুকে সূর্যের মতো লাল।শেফালী ঘাসে দেপান্তরে মাঠ।অর্পণ বাইকের সাথে পা ঝুলিয়ে বসে আছে।ফোনটা ইচ্ছে করে বন্ধ রেখেছে।আজ সকালে ঘুমটা ভেঙে গেছে।দ্বিতীয় বার চোখে ঘুম আসেনি।বাড়ি থেকে হঠাৎ চলে আসছে।কাউকে কিছু জানা নিই।তার বাপ হয়তো তার চলে যাওয়ার খবর এতক্ষণে পেয়ে গেছে।

অর্পণ তুই এখানে? বাসায় থেকে চলে আসছি কেন?

ভালো লাগছিলো না।তাই ঢাকায় ব্যাক করেছি।পরীক্ষা সামনে।পড়তে হবে।চল হোস্টেলে ফিরে যাই।

তুই পড়ার জন্য চলে আসছি। বিশ্বাস হয় না।

এতে বিশ্বাস করার কিছু নেই।চল।অর্পণ বাইকে উঠে পড়ে।মাহিম বলল,

তুই যা আমি তোর পিছনে আছি।

ওকে।

অর্পণ বাইক টান দিতেই।মাহিম ফোন লাগায় অসীম তালুকদার কে।

আসসালামু আলাইকুম।স্যার,অর্পণকে পেয়ে গেছি।অর্পণ ঢাকায় ফিরেছে।

ওল্লাইকুমুস আসসালাম।ওর দিকে খেয়াল রেখো।অসীম তালুকদার কান থেকে ফোন নামিয়ে রাখেন।একটা মাএ ছেলে।ওর কিছু হয়ে হয়ে গেলে সে বাঁচবে কি নিয়ে?বাবা হয়ে বন্ধুর মতো কখন ছেলের সাথে আচরণ করতে পারেনি।সবসময় গুরু গম্ভীর ভাব মুখে ধরে রাখেন।তিনি ভয় পান।তার অতি আদরে বাঁদর না হয়ে যায়।আর সেই ভয়ের জন্যই ছেলেকে বুকে অবধি জড়িয়ে ধরেন না।রাবেয়া জরায়ুতে টিউমার হয়েছিল।অপারেশন করে ফেলতে হয়েছে।দ্বিতীয় সন্তানের আশা তিনি আর করেন নিই।তার মা,বাবা অপারেশন কথা শুনে নারাজ হলেও ছেলের জন্য বউকে কিছু বলতে পারেনি।তার ওপর পুত্র সন্তান আগেই জম্ম দিয়েছে।হয়তো এরজন্য রাবেয়া প্রতি সন্তুষ্ট প্রকাশ করেন।অথচ অসীম তালুকদারের ঘর আলো করে যেইদিন অর্পণ আগমন ঘটে।অসীম হাসপাতালে দাঁড়িয়ে ব’লেছিল।

ডাক্তার এটা আমার মেয়ে।অসীম তালুকদারের মুখে হাসি লেগেছিল।

মিস্টার তালুকদার আপনার কন্যা সন্তান নয়।পুত্র সন্তান হয়েছে।অসীম তালুকদার অবাক হয়ে যান।ভাবেন।ডাক্তার মিথ্যে ব’লেছে।তাই তোয়ালে থাকা হ্রদ পুষ্ট সন্তানকে চেক করেন।
মেয়ের আশায় যে বাবা বসেছিল।তার পুত্র হয়েছে।যার ভয়ে বউকে আল্টাসোনোগ্রাফি পর্যন্ত করতে দেন নিই।দ্বিতীয়বার বাচ্চার জন্য চেষ্টা করলে জানতে পারে তার স্ত্রী আর কখনো মা হতে পারবে না।তিনি নারাজ হননিই।বরং ছেলেকে দুই হাতে আগলে নেন।দুই বছর পর্যন্ত ছেলে তার কাছে আদরে মানুষ হয়েছে।তারপরে নিজের কাজের জন্য দেশে বাহিরে দিনের পর দিন থাকতে শুরু করে।তখনই ছেলে মায়ের সঙ্গে বেশ মানিয়ে বড় হয়ে উঠেছে।নিজের হুস জ্ঞান বলতে তার মায়ের আঁচল তার প্রিয় হয়ে যায়।আর বাবা সম্পর্কে হয়ে ওঠে একজন শক্ত কঠোর পুরুষ।বাবারা রাগী হয়।তারা কঠোর হয়।তারা কখনোই নরম হয় না।বাবা হয়ে সন্তানের সাথে নরম আচরণটা এখন সময়ের সাথে আসে না।ছেলে বড় হচ্ছে।আর তার মাথার টেনশন বাড়ছে।এলাকায় উল্টা পাল্টা কান্ড ঘটানো থেকে শুরু করে সব কাজ করতে শুরু করেছে।তার সুনামে অসীম তালুকদারের পেট মোচড় মারে।অসীম তার ইহ জম্মে করেন নিই।তা ছেলের দ্বারা অসম্ভবকে সম্ভব করে ছেড়েছে।

চলবে….

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-২১
৬৫.
রাতে বিদ্যুৎ নেই।পুতুল হাতপাখা দিয়ে দুই ভাইকে একটু পর পর বাতাস করছে।বারবার হাত পাখা চালানোর জন্য হাত ব্যাথা হয়ে যায়।পুতুল হাতপাখা নামিয়ে রাখে।

আপু গরম লাগছে।মশা কামড়ায়।
পুতুল কি করবে বুঝতে পারছে না?শীতে কারেন্ট যায় না।গরমের সময় এত জ্বালিয়ে মারে কেন?শীতের সময়টাতে ঠান্ডা কাঁপন ধড়িয়ে দেয়।এক দিক শান্তি লাগে,কারেন্ট নিয়ে প্যারা হতো না ব’লে।আর এখন বিরক্ত লাগছে।কারেন্ট নেই ব’লে।

সময়টা চৈত্র মাস চলছে।দিনের বেলা কাঠ ফাটাঁ রোদ মাথার ওপর থাকে।রাতের বেলা ভ্যাপসা গরমে জান প্রায় শেষ।কপালের ঘাম মুছে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।কিছু কয়লা মাটির হাড়িতে তুলে নেয়।কাগজ পুড়ে ধোঁয়া দিতে থাকে।এতে যদি মশার উত্তপাত কমে।

একে তো গরম,তার ওপর নতুন পাতার সঙ্গে ঝরে পড়া পাতার বিরহবিচ্ছেদ।কেমন একটা রুক্ষ রুক্ষ ভাব!এই যেমন আজকের চৈত্রদিন।দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো।বাইরে ঝিঁঝিপোকার ডাক।তেতে ওঠা রোদ ছিলো। লু হাওয়া বলতে যেমন বোঝায়,তেমন এক গরম বাতাস ঢুকে পড়েছে ঘরের ভেতর। জানালার ওপাশে স্তব্ধ হয়ে আছে আম, কামরাঙা,জারুল,দেবদারু গাছের সারি। প্রত্যেকের গায়ে যেন লেগে আছে নোনতা বুনো গন্ধ।

আপু মশা কমে গেছে।কারেন্ট নেই।পড়া নেই।চলো না আমার বাড়ির উঠোনে খেলতে যাই।পুতুল ইশারায় বলল কি খেলতে চাও?মিলন গালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগল।ভেবেই যাচ্ছে।এই ভাবার শেষ হয় না।পুতুল,ভাইয়ের গাল থেকে হাত নামিয়ে দিলো,

আপু জুতা চুরি খেলি।পুতুল মাথা নাড়িয়ে না বললো।

তাইলে হাঁড়িপাতিল দিয়ে খেলি।আচ্ছা এটা বাদ।চল কাগজের নৌকা বানিয়ে পানিতে ভাসিয়ে দেই।

সাজু বিরক্ত হয়ে বলল,

দূর কি কস?এসব বাদ।নাটায় নিয়ে ঘুড়ি উড়াইয়া আসি।মিলন চোখ ছোট্ট করে বলল,

বলদ,রাইতের বেলা কি ঘুড়ি উড়াবি?চোখে তোও দেখবি না?এখন এক চোখ কানা।পরে দেখবি দুই চোখ কানা হইয়া গেছে।

তাইলে তুই বল,কি খেলবি?

একাধক্কা খেলি।

না।

বরফপানি।

না।

মারবেল দিয়ে খেলি চল।

না।

লাটিম ঘুরানো।

না।

ক্রিকেট খেলি।

না।

ফুটবল!

না।

তুই চুপ থাক বানরের নানা ভাই।সব কিছুতেই খালি না,না করে।

আপু এখন তো গরম পড়ছে।তাইলে পুকুরের ঘাটে পিছলা বানিয়ে সিলিপ কাটি।পানিতে গোসল হলো।আর মন ঠান্ডা হবে।পুতুল সাজুকে না বললো,হাতের ইশারার লুকোচুরি খেলতে চায়।যেহেতু রাত,এটাই সঠিক সময়।বাড়ির বাহিরে যেতে হলো না।খেলতে সুবিধা হলো অন্ধকারের জন্য।এতে মিলন,সাজু সায় দিলো।

৬৬.
পাট ক্ষেতে ছাগল বন্দি।
জলে বন্দি মাছ।
সখা গোও…আমার মন বালা না।

কিছু পুরুষ চিকন চাকন,কিছু পুরুষ বুড়ি ওয়ালা।
টাকা পয়সা থাকলে বেশি।তারা বউ পায় ভালা।
সখা গোও…. আমার মন ভালো না।

কে আমার আব্বার মন খারাপ করলো?কিসের জন্য মন ভালা না আব্বা?বউ লাগবো।

চোখের সামনে বাবাকে দেখেই জিহ্বা কামড় দিলো।উল্টো পথে পালানোর চেষ্টা করলে স্বাধীন ধরে ফেলে।সাজু ভীতুর মতো বলল,

আব্বা ছাড়ো।আর গাইতাম না।

আচ্ছা গাইবেন ভালা কথা।কিন্তু এমন অদ্ভুদ গান কোথা থেকে শুনলেন?না ব’লে কিন্তু ছাড়বো না।

ওই মফিজ মামা থেকে।

এই মফিজ কে?

এইপার থেকে ও-ই পারে নিয়ে যায়।নৌকায় করে সেই মফিজ মামা।সে বৈঠা বাইতে বাইতে বলতো।আমি শুনতেই মুখস্থ করেছি।

আজকের পর যেনো এমন গান গাইতে না শুনি।শুনলে কিন্তু গালটা শক্ত করে টেনে লাল করে দিবো।মনে থাকবে।

সাজু মাথা নাড়িয়ে বলল,

আচ্ছা।

স্বাধীন ছেড়ে দিতেই দৌড়ে পুকুর পাড়ে গিয়ে বসে পড়ে।মিলন বরশি দিয়ে মাছ ধরতে বসেছে।হাতে আছে টসটসে লাল পেয়ারা।সাজুকে এইদিকে আসতে দেখে পেয়ারা কামড় বসিয়ে দিলো।

কি’রে বাঁদরের নানা ভাই।তোর আবার কি হইলো?

কিছু না।

কিছু না হইলে এমন ভ্যাটকা মাছের মতো ভ্যাটকাইয়া আছোত কেন?

কই ভ্যাট কাইলাম?

তোর বাঁদর মুখ দেখে বোঝাই যাচ্ছে।তুই পেঁচা।

আমি পেঁচা হলে তুই কি?

আমি সুন্দর।

তুই সুন্দর।

হুম।আপু বলছে।

আপু সুন্দর তাই আপুর চোখে সব সুন্দরই লাগে।তুই তোও বাঁদরের ভাই বাঁদর!

কি আমি বাঁদর?তবে রে সাজুর বাচ্চা।আজকে তোর একদিন কি আমার একদিন।মিলন পুকুরের কাঁদা মাটিতে হাত দিয়ে কাঁদা মাটি উঠিয়ে সাজুর মুখে ছুঁড়ে মারে।মিলন দেখাদেখি সাজু ওহ কাঁদা ছোড়াছুড়ি শুরু করে।পুতুল পুকুর পাড়ে গিয়ে দেখে মিলন,সাজু কাঁদা দিয়ে ভূত সেজে আছে।পুতুল দুই ভাইয়ের কান্ড দেখে হাসতে থাকে।পুতুলকে হাসতে দেখে দুই ভাই গাল ফুলিয়ে দুইদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে থাকে।

আপু আজকে হাঁসের পুটকি খাইছে।তাই বেশি বেশি হাসতাছে।সাজু’র অদ্ভুত কথায় মিলন রেগে এক ধাক্কা দিলো।মিলন হঠাৎ করে ধাক্কা দেওয়া সাজু পানিতে পড়ে গেলো।

কি কস এগুলো?বাঁদরের নানা ভাই।চুপ থাক।সাজু কোমড় সমান পানিতে পড়ে হা করে তাকিয়ে রয়।মিলন রেগে পুকুরের পানির একটু ওপরে বড় কাঁঠাল গাছে বসে পড়ে।পা পানিতে নামিয়ে দেয়।পুতুল দুটোকে এত ডাকছে তবুও কোনো সাড়া দিচ্ছে না।পুতুল এদের সাথে না পেরে মামাকে ডেকে পাঠায়।

৬৭.
পুতুল পড়াশোনা পাশাপাশি নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে।বাসায় নকশিকাঁথা সেলাই করে।সেগুলো আবার বাজারে বিক্রি হচ্ছে কম দামে।ন্যায্য পাওনা সে পাচ্ছে না।তবুও যা হচ্ছে সে তাতেই খুশি।সামনে শীতের জন্য হয়তো চাহিদা বাড়বে।অর্ডার আরো বেশি আসবে।

‘নকশি কাঁথা’ শব্দের প্রচলন হয়েছে। কাঁথাকে খেতা,কেন্থা ইত্যাদি নামেও অভিহিত করা হয়।

কাঁথা তৈরি হয় সাধারণত পুরনো কাপড়, শাড়ি,লুঙ্গি দিয়ে।সাধারণ কাঁথা বছরের সব সময়ই ব্যবহূত হতে পারে,কিন্তু নকশি কাঁথা বিশেষ উপলক্ষে ব্যবহূত হয় এবং তা পুরুষানুক্রমে স্মারক চিহ্ন হিসেবে সংরক্ষিত থাকে।ভারতের বিহার ও পশ্চিমবঙ্গের কোনো কোনো অঞ্চলে এ ধরনের কাঁথাকে বলে শুজনি। প্রয়োজনীয় পুরুত্ব অনুযায়ী তিন থেকে সাতটি শাড়ি স্তরীভূত করে সাধারণ ফোঁড়ে কাঁথা সেলাই করা হয় এবং সেলাইগুলি দেখতে ছোট ছোট তরঙ্গের মতো। সাধারণত শাড়ির রঙিন পাড় থেকে তোলা সুতা দিয়ে শাড়ির পাড়েরই অনুকরণে নকশা তৈরি করা হয়। তবে কাপড় বোনায় ব্যবহূত সুতাও কাঁথার নকশা তৈরিতে ব্যবহূত হয়, বিশেষত রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে।

আম্মা।পুতুল হাতের নকশিকাঁথা পাশে রেখে মাথা তুলে।

আম্মা এভাবে আপনি কিছুই করতে পারবেন না।নকশিকাঁথা কাজ করছেন ঠিকই।কিন্তু পারিশ্রমিক হিসেবে যেটা আপনার পাওয়ার কথা।সেটা আপনি পাচ্ছেন না।তাই আমি চাইছি।আপনার এই হাতের কাজ গ্রামের এই ছোট্ট ঝুপড়ি ঘরে আটকে না থাকুক।গ্রামে গঞ্জে এটার সীমাবদ্ধ না হোক।তাই আমি চাই আপনার তৈরি করা কাজগুলো ঢাকায় যাক।ঢাকায় এর চাহিদা ব্যাপক।আবার শুনছি।বিদেশের মাটিতে এই নকশিকাঁথা না-কি বিক্রি করা যায়।বিদেশে একবার আপনার হাতে কাজ পৌঁছে গেলে।আপনি ভাবতে পারছেন চমৎকার সময় হাতে চলে আসবে।মামা কথায় পুতুল নিজের হাতের কাজে চোখ বুলিয়ে নেয়।তার তৈরি করা কাজগুলো কি একদিন সারা বিশ্বের কাছে পৌঁছাবে।এটা কি সম্ভব?বার্মন হয়ে আকাশের চাঁদের দিকে হাত বাড়ানোর মতো ব্যাপারটা।প্রত্যাশার থেকে যদি বেশি হয়ে যায়।ভয় হয়।সে কি পারবে নিজের জন্য একটা আলাদা পরিচয় করতে?পুতুলকে চুপচাপ থাকতে দেখে স্বাধীন হাটু গেড়ে পুতুল মাথায় হাত রাখে।

আম্মা আপনি এত চিন্তা কেন করেন?রিজিক এর মালিক আল্লাহ।তিনি আমাদের জন্য যা ঠিক করে রাখছেন তাই হবে।এত ভেবে কাজ নেই।আপনি হ্যা ব’লে দিন।বাকিটা আমি করে নিবো।

পুতুল মাথা উঁচিয়ে ইশারায় বলল,

মামা তুমি কিভাবে কি করবে?ঢাকায় কাউকে যেতে হবে।আর নয়তো কাউকে আনতে হবে।কাউকে রাখার মতো সামর্থ্য আমাদের নেই।

আম্মা আপনি চিন্তা কইরেন না।ঢাকায় মাসে আমি একবার যাব।আমি হব আপনার হ্যাল্পার।আমিই করব সব।পুতুল সাহস করে কিছু বলতে পারছেনা।তবুও কোনোমতে মত দিল।এখন দেখা যাক কি হয়?

বাড়ির সামনে দিয়ে গান বাজিয়ে ছুটে চলছে একজন লোক।পুতুল,স্বাধীন সে দিকে তাকাতেই দেখলো।মিলন,সাজু কিছু কাঁচা পয়সা দিয়ে বরফ জাতীয় কিছু চেটেপুটে খাচ্ছে।পুতুল এসব চিনে না।কিন্তু স্বাধীন তার
শৈশবের সেই পুরনো সৃতিতে ডুবে গেলো।সে ওহ এক সময় ছুটে যেতো বরফকলের কাছে।চার আনা,আট আনা পয়সা দিয়ে কিনে খেতো সাদা বরফ, লাল-সবুজ আইসক্রিম অথবা নারকেল-পাউরুটি দেওয়া মালাই।হিম হিম ঠান্ডায় জুড়িয়ে যেত শরীর।চৈত্র মাসে যাঁরা রোজা রাখার অভিজ্ঞতা পেয়েছেন,তাঁরা জানেন ইফতারিতে লেবুপাতার গন্ধ,চিনি আর বরফ দেওয়া শরবতের স্বাদ কত মধুর হতে পারে! মাথায় ঘোল ঢালা নিয়ে যতই হাসাহাসি করি না কেন,এক শ,দেড় শ বছর আগে চৈত্র–বৈশাখের তীব্র গরমে ঘোল আর মাঠাই ছিল পরম বন্ধু।স্বাধীন এগিয়ে গিয়ে সাজু,মিলনের হাতে সবুজ,গোলাপি মিশ্রনে বরফি তুলে দিলো।সাজু,মিলন নিজেদের তুই হাতেরগুলো চেটেপুটে খাচ্ছে। পুতুল,রেনু,আর নিজের জন্য নিয়ে বাসায় যায়।মামার খাওয়ার ধরণ দেখে পুতুল মুখে দিলো।গরমের দিন এমন বরফিটা মুখে দিতে বেশ লাগছে।খাবারটা ভীষণ মজা।স্বাধীন,রেনু নাম ধরে ডাকতেই বের হয়ে আসে।একসাথে পরিবারের সবাই মিলে বারান্দায় বসে খেতে লাগলো।সবার ঠোঁটগুলো বিভিন্ন রঙের হয়ে আছে।একে অপরের দিকে তাকিয়ে সবাই একসাথে হেঁসে উঠে।শৈশবগুলো মিষ্টি স্মৃতিবিজড়িত দিনগুলো ভীষণ ভাবে মনকে নাড়া দিয়ে যায়।

শৈশবের সেই দিনগুলি,
ফিরবে না হায়।
শত কাজের ফাঁকেও,
এ মন,ছুটে যায়।

চলবে…..

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-২২
৬৮.
স্বাধীন আজ ঢাকায় যাচ্ছে।পুতুল এই চারমাসে দিন রাত পরিশ্রম করে। নকশিকাঁথায় সুই সুতার সাহায্যে একেক রকমের নকশা করেছে।যেগুলো দেখলেই দুই চোখ শীতল হয়ে যায়।মেয়েটা রাতের অর্ধেকটা সময়-ই খেটেছে।জানি না।ঢাকায় এগুলো নিয়ে গেলে আদোও বিক্রি হবে কি না?তবুও এক বুক আশা নিয়ে পরিবারের সকলের থেকে বিদায় নিয়েছে।বিসমিল্লাহ ব’লে বাড়ি ছেড়ে ঢাকাগামী জন্য ট্রেনে উঠে পড়ে।এই ট্রেন ঢাকা কমলাপুর রেলস্টেশনে থামবে।তারপর পুতুলের তৈরি কাজগুলো ঢাকায় ছড়িয়ে দেওয়ার পালা।ফুটপাতে হকারদের মতো স্বাধীনও হকারগিরি করতে নেমেছে।

শহরের পাকাঁ রাস্তার কিনারে জনসমাগমপূর্ণ স্থানে ফুটপাতে বসে এই বেচা কেনা।স্বাধীনের মতো অনেক হকারদের দেখা মিলছে।যারা ভ্যানগাড়িতে করে বিভিন্ন জিনিসপত্র বিক্রি করছে।অনেকে মাথায় থাকা ছোট টুকরিতে ফেরি কিংবা ছোট খাটো দোকানে বিক্রি করে।গ্রীষ্মের রৌদ্র এবং বর্ষার বৃষ্টি হাত থেকে বাঁচতে বড় ছাতা নিচে আশ্রয় কিংবা বড় পলিথিনের আবরণ ব্যবহার করে।অল্প বয়সী কিশোর ছেলেদের হকারগিরি করছে।কেউ ফুচকা,চটপটি,গুমলি পুড়ি বিক্রি করছে।কেউবা আবার চা,পান,সুপারি,সিগারেট বিক্রি করছে।এদের আয় দৈনিক ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা।দৈনিক বেচা কেনা ভালো হলেই হয়।আর যদি ১৫০থেকে ৩০০ টাকা না হয়।তাহলে বাঁচার লড়াইটা কষ্টে হয়ে ওঠে।তাদের থাকতে হয় এই ঢাকা শহরের অলিগলির রাস্তায়।আজ এই ঢাকার বুকে স্বাধীন ফুটপাতের রাস্তায় বিছানা পেতেছে।বেচাকেনার প্রথম দিনটা ভালো হয়নি।তবুও আশা রাখছে নতুন সকালে হয়তো ভালো কিছু হবে।চোখের পাতা জোড়া বুঁজে নিলো।ওইদিকে তার পরিবার কি করছে জানা নেই?

পুতুল রাত জেগে পড়ছে।সামনে তার পরীক্ষা।সময় খুব একটা নেই।চারমাস নকশিকাঁথার কাজের জন্য সময় দিয়েছে।পড়াশোনা এতটা মনযোগী ছিলো না।যার জন্য অনেক পড়া গুলিয়ে বসে আছে।তবুও আবার রিভিশন দিচ্ছে।পরীক্ষা কোনো ভুল করতে সে চায় না।তার রেজাল্ট খারাপ হলে মামার উচু গলায় বলা কথাগুলো মিথ্যে হয়ে যাবে।তার জন্য মামা কম কষ্ট করেনি।এখনও করে যাচ্ছেন।আর সেই মামা মান রাখতে হলেও তাকে প্রত্যেকবারের মতোও এবারও ভালো রেজাল্ট করতে হবে।

রেনু ঘরে আলো জ্বালিয়ে ছোট ছেলেকে বুকে টেনে নিয়ে বসে আছে।

কি করছে মানুষটা?কি খেয়েছে?কোথায় থাকছে কে জানে?একটু যোগাযোগ করতে পারলে শান্তি লাগতো।স্বামীর চিন্তায় রাতে তার গলা দিয়ে ভাত নামে না।বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও কখনো একটা রাত দূরে থাকেনি।দিনে যতই কাজ থাকুক না কেনো?সেই কাজ শেষ করে ঠিকই সন্ধ্যার আগে বাড়ি ফিরে আসতো।মানুষটাকে ছাড়া কোনোদিন একা খাবার খায়নি।আজ সে নেই।একা এই ঘরটায় দম বন্ধ হয়ে আসছে।আল্লাহ তুমি কি আমার ডাক শুনতে পাচ্ছো।আমার স্বামী যেখানে থাকুক না কেন?তাকে তুমি ভালো রেখো।তার ভালোতেই আমার সুখ।সে গ্রামে কিংবা শহরে যেখানে রয়েছে।তাকে সুস্থ রেখো।তিনি বিহীন আমরা এতিম।তিনি ছাড়া আমি,আমরা কেউ ভালো থাকব না।তিনি আমাদের বেঁচে থাকার শেষ সম্বল।সেই সম্বলটুকু তোমার ভরসায় ওতো দূর দেশে পাঠালাম।আল্লাহ আমার স্বামীকে তুমি দেখে রেখো।তুমি ছাড়া আমার কারো কাছ থেকে কিছু যাওয়ার নেই।তুমি আমাদের রব।বিপদ আপদে তোমার কাছেই ছুটে যাওয়া।তোমার নামে সেজদা দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়া।ওহ আল্লাহ তুমি মুখ ফিরিয়ে নিলে আমরা তোমার বান্দা যাব কোথায়?আল্লাহ তুমি তোমার প্রিয় বন্ধু হযরত মোহাম্মদ (সা:) উছিলায় আমাদের হেদায়েত পথে চালিত কর।আমরা শেষ নবীর উম্মত।আমাদের মতো এতো ভাগ্য ভালো আর কখনো কারো হয়নি।দরজার ওইপাশে দাঁড়িয়ে পুতুল মামীর সব কথা শুনতে পায়।এত রাতে মামীর ঘর থেকে কান্নার শব্দ পেয়ে ছুটে আসে।হালকা করে দখিনা দুয়ার ধাক্কা দিতেই মামীকে জায়নামাজে মোনাজাত অবস্থায় দেখতে পায়।পুতুল নিজের কান্না সংযত করে।দূয়ার চাপিয়ে চলে যায়।

৬৯.
প্রতিদিনের মতো সূর্য পূর্বে দিকে উঠেছে।ভোরে মোরগ ফজরের আজান শেষ হতেই ডাকতে শুরু করেছে।পুতুল ঘর ছাড়ু দিয়ে উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছে।মামী চুপচাপ হাড়িতে রান্না বসিয়েছে।প্রতিদিনের মতো আজ রান্না ঘর থেকে মামী কোনো ডাক দেয় নিই।ডেকে বলেননি,পুতুল এটা দিয়ে যা ওটা দিয়ে যা।কাজের সময় হাতের কাছে কিছু পাচ্ছি না।কোথায় কি রাখিস?এখন এক একটা খুঁজে পাওয়া যায় না।

মিলন,সাজু ঘুম থেকে উঠে পড়েছে।বাড়িতে আজ কেমন নিঃশতব্দো।প্রতিদিনে মতো ফজরের নামাজ পড়তে মসজিদে যায়নি।বাবা নেই বলে।পুতুল আপু বাড়িতে নামাজ পড়িয়েছে।মা কেমন চুপচাপ?ছোট ভাইটা প্রতিদিনের মতো কান্না করে বাড়ি মাথায় তোলেনি।সেও কেমন ভদ্র হয়ে গেছে।হাত,পা নাড়িয়ে খেলছে বাড়ির বারান্দায় ছোট খাটে।হয়তো সে ওহ বুঝে গেছে বাবা বাড়িতে নেই।মায়ের মন খারাপ।একটু প্যা পু করলেই পিঠে মার পরতে পারে।তাই শান্ত সৃষ্ট হয়ে আছে।কিন্তু বড় দুই ভাই।মিলন,সাজু কি শান্ত থাকবে? মোটেই না।কলপাড়ে হাত মুখ ধুতেধুতে বলল কি কি করবে সারাদিন?স্কুল শেষে বাড়ি ফিরে চলবে তাদের বিশেষ শলাপরামর্শ আয়োজন।

রেনু খাবার বেড়ে দিতেই মিলন,সাজু চুপচাপ খেয়ে উঠে পড়ে।রেনু আড়চোখে পুতুল প্লেটে তাকায়।

কি হলো?তুমি খাচ্ছ না কেন?খাবার পচ্ছন্দ হয়নি।

পুতুল মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো।যার মানে তার খাবার পচ্ছন্দ হয়নি।

ঠিক আছে।এই খাবার রেখে দেও খেতে হবে না।আমি অন্য কিছু করে দিচ্ছি।রেণু আর কিছু বলতে নিলেই পুতুল সেই সুযোগে হাতের লোকমা ভাতটুকু মামীর মুখে পুরে দেয়।পুতুল জানে,তার মামী কাল থেকে না খাও।এভাবে না খেয়ে থাকলে নিজে ওহ অসুস্থ হবে।ছোট ভাইটা খেতে না পেয়ে কষ্ট পাবে।রেনু রেগে কিছু বলতে পারে না।মুখের খাবার চিবিয়ে খেয়ে পুতুলকে আবার কিছু বলতে নিলেই একই কাজ আবার করে বসে।এভাবেই বেশ কয়েকবার বড় লোকমা তুলে প্লেটের সব ভাত শেষ করে ফেলে।রেনু কিছু বলতে না পেরে দুই চোখের পানি ছেড়ে দেয়।পুতুল তার অন্য হাতে সাহায্যে মামীর চোখের পানিটুকু মুছে দিলো।যার মানে তুমি কেঁদো না।তুমি কাঁদলে আমার কষ্ট হয়।রেনু আর পুতুলের ওপর রাগ করে থাকতে পারে না।দুই হাতে পুতুল কে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে।পুতুল মায়ের মতো মামীর কাছ থেকে ভালোবাসা পেয়ে কেমন চুপটি হয়ে বসে আছে।মামীর গায়ে বুঝি মায়ের গন্ধ লেগে আছে।মামী তাকে জড়িয়ে ধরেছে।মনে হচ্ছে।পুতুল তার মাকে জড়িয়ে গালে গাল লাগিয়ে বসে আছে।

এতটা মায়া কাজ করে কেন?রেনু চেয়ে ও কেন রাগ করতে পারলোনা।এতটা মায়া নিয়ে কেন জন্মেছে পুতুল।

এই মায়া তার ভাই, মামা,মামী দেখতে পায়।কিন্তু বাকিরা ছাড়া।তাদের মধ্যে দুইজন তার রক্ত।তাদের চোখে লোভ দেখা যায়।তারা পুতুলকে আপন ভাবতে পারেনি কেন?কেন আদর দিয়ে একটিবার তাকে বুকে টেনে নেয়নি।বাবা নামক মানুষটাকে আজ চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে ইচ্ছে করছে।তোমার মা,ছেলে দেখে যাও।আমি কতটা সুখে আছি।

৭০.
আমি যদি আজ ছেলে হতাম।আর কথা বলতে পারতাম।তাহলে নিশ্চয় মাথায় করে রাখতে।আমাকে অবহেলা করতে পারতে না।কারণ আমি তোমাদের বংশের বাতি হতাম।শেষ বয়সের বাবার দায়িত্ব নিতাম।কিন্তু আপসোস আল্লাহ তোমাকে কন্যা দান করায় বেজার হয়েছো।ভেবেছো।উচ্ছিষ্ট সে।পরের বাড়ি আমানত হবে।তোমাদের সে দেখবে না।তাই ভেবেছো।আর দিন শেষে কষ্ট দিয়েছিলে আমাকে এবং আমার মা জননীকে।কিন্তু আমার প্রিয় নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন।

প্রথম কন্যা সন্তান হলো সৃষ্টির সেরা উপহার। যার একটি কন্যা সন্তান হবে।সে একটি জান্নাতের মালিক।যার দুটি সন্তান হবে।সে দুই দুইটি জান্নাতের মালিক।আর তিনটি কন্যা সন্তান হবে।সে তিনটি জান্নাতের মালিক।এবং যে তাদেরকে দ্বীনি শিক্ষা দিবে এবং যত্নের সাথে লালন পালন করবে ও তাদের উপর অনুগ্রহ করবে।সেই ব্যক্তির উপর অবশ্যই জান্নাত ওয়াজিব হয়ে যাবে সুবহানাল্লাহ।আল্লাহ যখন বেশি খুশি হন তখন কন্যা সন্তান দান করেন। অনেকেই কন্যা সন্তান চায় না।কিন্তু একজন মেয়ে তার বাবা মাকে যে পরিমাণ ভালোবাসতে পারে।তা একটি ছেলে শত চেষ্টা করলেও পারেনা। কন্যারা ফুলের মতো নিষ্পাপ।তারা বিশ্বকে সৌন্দর্য দিয়ে ভরিয়ে দেয়।কন্যা সন্তানকে অবহেলা নয়।ভালোবাসতে শিখুন।

স্কুল ছুটির পরে বাসায় এসেছে। দুই জনের একজন বাসায় থাকেনি।স্কুলের ব্যাগ বাসায় রেখেই হাওয়া।পাজামা হাঁটু পর্যন্ত মুড়িয়ে সাজু,মিলন আড়ালি ক্ষেতে নেমে গেছে।ছোট ছোট পুটিমাছ হাত তুলতেই ফসকে বের হয়ে যাওয়া মিলনের রাগ হলো।আবার অন্য মাছ ধরতে নামে।সাজু পর পর কয়েকটা পুটিমাছ তুলেছে।সেগুলো মাটির ছোট কলসে রেখে আবার মাছ ধরতে ব্যস্ত হলো।মিলন মাছ না পেয়ে রেগে আগুন।মিলন স্বাধীনের মাছ ধরার ট্যারা নিয়ে এসেছে।টাকি,পুটি,ছোট কই,চিংড়ি পেয়েছে।টাকি,কই ট্যারা দিয়ে মেরেছে।সব শেষে পুকুরের পাশে আসতেই বাইঙ্ মাছ পেয়েছে মিলন।

ওই বাইঙ্ মাছ পাইছি আমি।আজকে বাসায় যাইয়া,গরম ভাত দিয়া ভাজা মাছ কচমচ করে খামু।সাজু পানি দে।দেখ কেমন করছে সে?

মাছটা সাপের মতো মজরাতে শুরু করছে।কাদার জন্য ভালো করে বোঝা যাচ্ছে না।সাজু মিলনের হাতে পানি ছুড়ে মারল।মিলন হাতের ওটা দেখে চিতকার মারল।

ওই মিলন।ওই এটা ছাড়।এটা মাছ না।এটা কানা সাপের বাচ্চা।সাজুর কথায় মিলন হাতের দিকে তাকিয়ে একটা চিতকার দিলো।দিক দিশা না পেয়ে হাতে রাখা ওটা দূরে ছুঁড়ে মেরে পাগলের মতো দৌড় দিতে শুরু করলো।

ওই মিলন দাঁড়া।আমারে থুইয়া যাইস না।আমি আইতাছি।কে শুনে কার কথা মিলন দৌড়ের ওপরে আছে।দুইবার পিছলে ক্ষেতে পড়েছে।আবার উঠে দৌড়ের ওপর আছে।
সাজু হাতে ট্যারা আর মাছের কলসি নিয়ে দৌড়ে পিছনে ছুটে।

চলবে…..