চক্ষে আমার তৃষ্ণা পর্ব-২৬+২৭

0
139

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-২৬
৮১.
পুতুল এখন কেমন লাগছে?ভালো লাগছে তো।

পুতুল মাথা নাড়িয়ে বুঝালো।এখন ভালো লাগছে।

তোমার জন্য তোমার মামা গঞ্জ থেকে ডাক্তার সাহেবকে বাসায় নিয়ে আসছে।আমি তারে বলছিলাম তোমাকে নিয়ে ডাক্তার কাছে যেতে।কিন্তু তুমি না করেছো।তাই তোমার মামা নিজেই ডাক্তার নিয়ে বাসায় হাজির।সে ডাক্তার নিয়ে এসে দেখে তুমি ঘুম।আমি ডাকতে চাইলাম।কিন্তু তোমার মামা বারণ করলেন।ডাক্তার তোমাকে দেখে নিলেন।আর কি কি সমস্যা বলতেই মেডিসিন দিলো?আর সেটা দিতেই জ্বর ছেড়ে দিল।

পুতুল মামীর কথাগুলো মন দিয়ে শুনতে লাগল।তাকে নিয়ে এতকিছু হয়ে গেছে।অথচ জ্বরে ঘোরে জন্য সে বুঝতে পারে নিই।

এখন যখন জ্বর সেড়ে গেছে।তাহলে উঠে পড়।মাগরিবের আজান এই দিলো ব’লে।নামাজ পড়ে মাথায় ঘোমটা দিয়ে বাহিরে আসো।বাড়িতে অতিথি আছে।তারা তোমায় দেখতে চায়!মামী চলে যেতেই কাপড়টা পাল্টে নিলো।ঘাম দেওয়াতেই শরীরটা হালকা লাগছে।এই মুহূর্তে গোসল করতে পারলে শান্তি লাগতো।পুতুলের ভাবনার মাঝেই দূর মসজিদ থেকে মাগরিবের আজানের শব্দ ভেসে আসছে।পুতুল উঠে ওযু করে নেয়।মামীর কথা মতো নামাজ পড়ে মাথায় ওড়না দিয়ে বের হয়ে আসে।চারদিকে ছোট ছোট বাচ্চাদের ছোটাছুটি।তারা কেমন আনন্দে আতখানা?নিজ চোখে দেখাতেও যেন এক রকম শান্তি পায়।পুতুল মিষ্টি করে হেসে এগিয়ে যায় বড়দের মাঝে।রেনুর পরিবার পুতুলকে পেয়ে খুশি হন।মেয়েটি মুখে সালাম দিতে পারেনি।কিন্তু হাতের ইশারায় বুঝিয়েছে সালাম দিয়েছে।সবার ব্যাপারটা বুঝতে টাইম লাগে।এইদিকে তার মেয়ের ঘরে কোনো কন্যা সন্তান নেই।রেনুর এই মেয়েকে কতটা আহ্লাদে লালন পালন করছে।তা রেনুর মা লতিফা বেগম বিকেলেই বুঝতে পারেন।আজ বিকালে রেনু কিভাবে দূর সম্পর্কে মামী শ্বাশুড়ি সাথে কথা কা*টাকা*টি করছিলো।এক প্রকার তর্কা বির্তক চলছিল।অথচ মনোয়ার বেগম মুখেমুখে আজ পর্যন্ত কেউ কখনো কথা বলতে কিংবা বলার সাহস করেনি।কিন্তু তার মেয়ে সেটা করেছে।আর সেটা করেছে ব’লেই তাকেও সেই মহিলা কথা শুনিয়েছে।বলেছেন,বেয়াদব মেয়ে জম্ম দিয়েছি।

তার ভাবতে ওহ অবাক লাগে।মেয়েকে সে একদম নরম কাঁদা মাটি মতো গড়েছিলেন। এবং সুপাত্র হাতে দান করেছেন।স্বাধীন একজন সুপাত্র।এটা তিনি নিরদ্বিধায় বলতে পারেন।এমন জামাই সবার কপালে জুটে না।সে কি সুন্দর নিজের পরিবার এবং বোনের ছেলে,মেয়েকে কোলে পিঠে মানুষ করছে।
এই গ্রামে এসে তিনি স্ব চোখে দেখতে পেয়ে চোখ দুইটা শীতল হয়ে যায়।এই আদুরী মেয়েটা তার মেয়ে এবং মেয়ে জামাই এর কলিজা।মা মরা মেয়েটির মাথার ছায়া।এদের কিছু হয়ে গেলে মেয়েটা ছায়াটাও সরে যাবে।
আল্লাহ তুমি এতিমের প্রতি রহম হইয়ো।সব বিপদ থেকে হেফাজতে রেখো।

৮২.
মনোয়ার বেগমের মুখেমুখে কেউ তর্ক করুক এটা তিনি মেনে নিতে পারেন না।কিন্তু আজ সামন্য মেয়ের জন্য তাকে এভাবে বোয়ালমাছের মতো গিলে ফেলতে চাইলো।তিনি রেগে গেছেন।বিছানার ব্যাগ পত্র গুছিয়ে অর্ধেক রাস্তায় চলে যান।আবার কি মনে করে অর্ধেক রাস্তা থেকে ফিরে আসেন।রেনু ব্যাপরটা প্রথম থেকেই লক্ষ্য করছে।কিন্তু কিছু ব’লে নিই।এখন ফিরে আসতেই।নিজে হেঁটে মামী শ্বাশুড়ি মুখের সামনে গ্লাস ধরে।মনোয়ারা বেগম কপাল কুঁচকে বলল,

এটা কি আনছো?বিষ!তোমার মাইয়া নিয়া কথা বলছি দেইখা আমারে বিষ দিয়া মারতে চাও?

তওবা,তওবা।কি ‘যে বলেন না মামী মা?আমি আপনাকে বিষ দিবো।আমার মাথাটা আমার গর্দানে থাকবে তোও?মনোয়ার বেগম চোখ বড় করে তাকতেই রেনু মিটমিটিয়ে হেসে বলল,

না মানে আপনার ভাইগ্না আর আমার স্বামী আমায় আস্ত রাখবে।কি বলেন না মামী মা?আমি দেখলাম আপনি ব্যাগপত্র নিয়ে বের হয়ে গেলেন।আবার দুই মিনিট পর ফিরে আসলেন।ভাবলাম আপনি হয়তো ক্লান্ত হয়ে গেছেন।তাই আপনার জন্য লেবু শরবত করে নিয়ে আসলাম।আচ্ছা আপনি কি এখান থেকে চলে যেতে চাইছিলেন?আমার কথায় রাগ করলেন না-কি?

চইলা কেন যামু?আইছিলাম বেড়াইতে।তাই বেড়াই যামু।তুমি বেশি কথা কও!যাও এইহান
থেইক্যা?রেনু চলে যেতে নিলে ডাক দিয়ে বললেন।

দাঁড়াও।শরবত দিতে আইসা।না দিয়া চইলা যাও কেন?ওইটা রাইখা তারপর যাও।

জি,মামী মা।

রেনু শরবতের গ্লাসটা রেখে চলে যায়।রেনু চলে গেছে কি-না উঁকি মে’রে দরজার বাহিরে দেখে নিলেন।কেউ নাই দেখে।খাটে বসে ঠান্ডা পানির শরবত টুকু খেয়ে নেন।রেনু জালানার সামনে দাঁড়িয়ে সবটাই দেখে হেঁসে উঠে।পরক্ষণেই নিজের মুখ চেপে ধরেই এখান থেকে সরে যায়।যদি মনোয়ারা বেগম একবার বুঝতে পারে রেনু সবটা দেখে নিয়েছে।তাহলে বারোটার খবর করে ছাড়বে।

আপু লুঙ্গি ধরে হাঁটতে কষ্ট হয়।এই প্যারা এখানে না দিয়ে মাথায় তুলে দিলে কেমন হয়?

সাজুর অদ্ভুত কথায় পুতুল চোখ বড় বড় করে তাকায়।
সাজু’র এমন কথায় মিলনের হাত ফসকে লুঙ্গি জায়গারটা জায়গায় পড়ে যায়।নিচে সব ঠিকঠাক আছে দেখে সাজুর দিকে তাকিয়ে বলল,

ওই মাথায় তুলে দিবি মানে?

আমার লুঙ্গি দুই হাত দিয়ে ধরে সুয়ে বসে থাকতে ভালো লাগছে না।সাজু’র কষ্ট হচ্ছে। তার চোখে মুখে বিরক্তির ছাপ।
পুতুল কিছু ভেবে নিজের মামীর কাছে ছুটে যায়।

৮৩.
পুতুল ছোট আয়না সামনে দাঁড়িয়ে আছে।মায়ের শাড়ি গায়ে জড়িয়ে নিয়েছে।কিন্তু শাড়িটি ভালোভাবে পড়তে পারেনি।কোনোরকমে পেঁচিয়ে নিয়েছে।রেনু,পুতুলের ঘরে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।উচ্চস্বরে হেঁসে এগিয়ে আসে।

বাহ,তোকে দেখতে দারুণ লাগছে।কিন্তু শাড়ি’টা আরেকটু গুছিয়ে পড়লে আরও ভালো লাগবে।দাঁড়া আমি পড়িয়ে দিচ্ছি।রেনু শাড়িটি সুন্দর করে কুঁচি দিয়ে পুতুলকে পড়িয়ে দিলো।

পুতুলের লম্বা চুলগুলো খোপা এলিয়ে দিলো।মাথায় হিজাব পরিধান করে বলল,

মা শা-আল্লাহ।আমাদের পুতুলকে একদম অপ্সরী লাগছে।ভাইদের মন ভালো করতে এই প্রথম তোকে দেখলাম শাড়ি পরতে।যা নবাব দুই পুত্র সাথে দেখা করে আয়।তাদের কেউ উঠোনে নামা।তবে সাবধানে।পুতুল ভাইদের সামনে যেতেই সাজু,মিলন চোখ দুটো ঝাপটিয়ে তাকিয়ে বলল,

আপু বেশে কোনো এক পরী।

সত্যি মিলন।রুপকথার গল্পের মতো লাগছে।যেখানে রাজা,রানী তিন পুত্র এবং এক কন্যা ছিল।আপু কি সেই রুপকথার রাজকন্যা?আমার কি রাজকন্যার ভাই?

পুতুল,মিলন,সাজু কে ধরে বারান্দায় বসিয়ে দিলো।নানু এসে তাদের সাথে বসে গল্প করতে লাগল।দুই ভাইয়ের মাঝে বসে পুতুলও চুপচাপ গল্প শুনতে লাগল।তাদের সাথে একে একে সবাই যোগ হলো।কিন্তু মনোয়ারা বেগম আসলেন না।তিনি দূরে সরে থাকলেন।রেনু ছোট ছেলেকে কোলে নিয়ে মায়ের সামনে বসতেই মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।সবার সাথে মানকি সাহেবও যোগ দিয়েছেন।তবে একটু দূরত্ব বজায় রেখে শুয়ে পড়লেন আরামসে।
গল্প শেষে সবাই একসাথে হেসে উঠে।আবার হাসি লুফে নিতে আনন্দে ব্যাস্ত হয়।হাসি মজায় সময়টা বেশ চলে যায়।লতিফা বেগম শাড়ি আঁচল সরিয়ে টাকার থলি বের করে পুতুলের হাতে দুটো কচকচে পঞ্চাশ টাকা নোট ধরিয়ে চলে যান।বাড়ি সামনে হাওয়াই মিঠাই আসতেই নিজের এবং ভাইদের জন্য কিনে নেয়।

মিলন,সাজু উঠে আসতে না পারলে কি হবে? পুতুল দুইজনের হাতেই হাওয়াই মিঠাই তুলে দিয়েছে।সেটা খেতে বেশ মজা।একটু করে কামড়ে মুখে দিতেই কেমন মিলিয়ে যাচ্ছে।পুতুল মুখে পুরে খেতেই দরজা নিচ দিয়ে ছোট্ট দুইটা হাত বাড়িয়ে তার আঁচল টেনে ধরে।পুতুল তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলেই সে সরে যায়।আবার উঁকিঝুকি মারে।পুতুল দরজাটা হালকা সরাতেই দেখে তাদের ছোট মিয়া হাসছে।দাঁতবিহীন হাসিটায় কি মায়া পুতুল জানে না?তবে তাকে কোলে নিতে বেশ টানছে।পুতুল দরজা খুলে ছোট মিয়াকে কোলে নিয়ে গালে বেশ কয়েকটা চুমু বসিয়ে দিলো।ছোট হাতদুটো তার গলা পেঁচিয়ে ধরেছে।যার মানে পুতুল ছাড়তে চাইলেও সে ছাড়বে না।পুতুল গালের সাথে নরম তুলতুলে গালটা লাগিয়ে কোলটা দখল করেছে।দুই ভাইয়ের সাথে সাথে ছোট ভাই তার আদরের ভাগ বোনের থেকে নিতে হাজির হয়েছে।রেনু আড়ালে থেকেই দুই ভাই বোনের ভালোবাসা দেখছে।মূলত রেনু ছোট ছেলেকে কোল থেকে নামিয়ে দরজা সামনে দিয়ে গেছেন।

৮৪.
পুতুল,রিফাতকে নিয়ে ব্যাস্ত।সাজু নিজের হাওয়াই মিঠাই এবং পুতুল তার আরেক হাতে দেওয়া মিঠাই গপাগপ খেয়ে ফেলছে।মিলন সাহেব মানকি সাহেবের সামনে গেছে।তাকে বিরক্ত না করলে পেটের ভাত হজম হচ্ছে না।মিলনের কাজে মানকি সাহেব বেশ বিরক্ত হন।বারবার দূরে সরে যাওয়ার পরেও বিরক্ত করছে।এক সময় রেগে গিয়ে তার পায়ে কামড় বসিয়ে দেন।মিলন চিতকার করে বাড়ি মাথায় তুলে।মানকি একটা কামড় দিয়ে ছেড়ে দেয়।কিন্তু মিলন সাহেব গালাগালি দিতে দিতে নিজেও কুত্তা গায়ে কামড় বসিয়ে দেয়।
বাড়িতে একটা হৈ হুল্লোড় পড়ে যায়।মানকি সাথে এক প্রকার হাতাহাতিতে রক্ত ভেসে ওঠে লুঙ্গিতে।সাজ্জাদ দৌড়ে মিলনকে নিয়ে ছুটে সদর হাসপাতালে।পুতুল ভাইয়ের অবস্থা দেখে থরথরিয়ে কেঁপে ওঠে।সাজ্জাদ মামার পিছনে সেও ছুটছে।

চলবে..

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-২৭
হাসপাতালে করিডোরে বসে কাঁদছে পুতুল।ভিতরে ভাইয়ের টিটমেন্ট চলছে।সাজ্জাদ মামা পুতুলকে যত বোঝাচ্ছে।যে মিলনের কিছু হবেনা।ততই ফুফিয়ে কেঁদে ওঠে।অতিরিক্ত কান্না ফলে চেহারা লাল হয়ে আছে।দেখতে ভীষণ কিউট লাগছে।তার গায়ে শাড়ি মাথায় হিজাব পরা কন্যা।ইতিমধ্যেই স্বাধীন এসে পড়েছে।পুতুল মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

কিছু হবে না।আমি আছি।ডাক্তার কেবিন থেকে বের হয়ে আসলেই স্বাধীন,সাজ্জাদ কথা বলতে লাগল।

মিলন গাল ফুলিয়ে বসে আছে ঘরে কোনে।আজ একসপ্তাহ হবে তাকে হাসপাতাল থেকে বাসায় নিয়ে আসছে।মানকি সাহেব তার আশেপাশে আসলেই খ্যাকখ্যাক করে উঠে।বেচারা মানকি সাহেব মিলনের রেগে থাকার কারণ বুঝতে পেরেছে কি না জানা নেই?কিন্তু মিলন চিতকার চেচামেচি করে থামতে দেখে সে-ও খেউ খেউ শুরু করতো।তাদের মাঝে মাখোমাখো একটা ভাব ছিল সেটা আগের থেকে কমেছে।পুতুল নিজের পড়াশোনা আর হাতের কাজ নিয়ে ব্যাস্ত থাকলেও পরিবারকে সময় দিতে ভুলে না।স্বাধীনের শ্বশুর বাড়ি লোকেরা সবাই চলে গেছে।কিন্তু শ্বশুর মশাই আসেনি।তিনি ব্যবসার কাজে গাজীপুর ছিলেন।তিনি আসতে পারেনি ব’লে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।তবে সময় পেলেই সে কোনো একদিন আসবেন।

৮৫.

বিলের সাধারণ পানিতে হালকা বাতাসের ঝাপটা।এই বাতাসে কেঁপে ওঠে জল।সৃষ্টি হয় জল তরঙ্গ।স্বাধীন জাল দিয়ে বিল থেকে মাছ তুলছে।দুপুরে বউ,বাচ্চাদেরকে একসাথে নিয়ে খাওয়াদাওয়া করবে।স্বাধীন বাড়িতে আসতেই মিলন,সাজু,পুতুল এক সঙ্গে হাজির হয়।স্বাধীন,রেনুকে ডেকে মাছগুলো হাড়িতে তুলে দেয়।ছেলেমেয়ে গায়ে এখনো স্কুলের জামা পরিধান।তারা সবে বাসায় ফিরেছে।প্রতিদিনের মতোও মিলন,সাজু দুষ্টুমিতে মেতে আছে।কিন্তু পুতুল চুপচাপ দাঁড়িয়ে।কারণ কি?স্বাধীন পুকুরে গেলো গোসল সাড়তে।আর ছেলেমেয়েকে বলল,

-; গোসল সেরে নিতে!যোহরের আজান এই দিয়ে দিলো ব’লে।স্বাধীন,পুতুলের মুখটা চুপসে যাওয়ার ব্যাপারটা বুঝতে পারলোনা না।পরে এই বিষয়ে কথা বলবে।মামা চলে যেতেই পুতুল নিজের রুমে গিয়ে জামা পাল্টে বের হলো।ভাইদের গোসলের কথা ব’লে মামীর কাছে গেলো।তার হাতে হাতে মাছগুলো কুটে দিতেই তাড়াতাড়ি হয়ে যায়।

পুতুল মাছ কুটা শেষ।এবার তুই গোসল করে নে।আমি মাছটা ধুয়ে এখনই হাঁড়িতে চড়িয়ে দিচ্ছি।পুতুল মাথা নাড়িয়ে চলে যায়।মেয়ের ভাবভঙ্গি দেখার সময় রেনু পায়নি।সে তাড়াতাড়ি করতে ব্যাস্ত।ভাত রান্না আরো আগেই হয়েছে।কিন্তু তরকারি রান্না করার মতো ঘরে কিছু ছিলো না।তাই স্বামী মাছ নিয়ে আসতেই এত তাড়াহুড়ো।যোহরের আজান দিলেই এরা নামাজ পড়ে এসেই বলবে খিতে পেয়েছে।ভাত খেতে দেওয়।

আচ্ছা মামা গরিবের স্বপ্ন দেখতে মানা কেনো?গরিবের কি স্বপ্ন থাকতে নেই?গরিব ব’লে কি আমি স্বপ্ন দেখতে পারি না।পুতুলের এমন প্রশ্নের কি জবার দিবে স্বাধীন বুঝতে পারছে না?হাতের মাঝে ছোট্ট সাদা কাগজ।তার মাঝে কালো কলমের দুই,তিন লাইনের শব্দগুলো লিখা।রাতে মেয়ের রুমে আসতেই মেয়ের বইয়ের মাঝ পাতায় একটু লুকিয়ে রাখা সাদা কাগজের অংশ।বাকিটা বাহিরে বের হয়ে আছে।স্বাধীন পুরো কাগজটা মেলে ধরতেই লেখাগুলো দৃশ্যমান হয়।পরের কাগজের লেখাগুলো পড়েই স্বাধীন কয়েক মুহূর্তের জন্য চুপ হয়ে যায়।

কাগজে লিখা কথাগুলো…!
আজ আমাদের স্কুলের শ্রেনী শিক্ষক প্রশ্ন করেন।বড় হয়ে কে কি হতে চাও?তা তোমরা মুখে নয়,কাগজে লিখে দেখাও।সবাই সবার কথা লিখে ছিল।আমিও লিখেছি।কিন্তু সবার বেলায়ই স্যার খুশি হলেন।কিন্তু আমার বেলায় তার উল্টো হলো।স্যার আমার কাগজটা মেলে ধরে বলল,

ডাক্তার।তুমি ডাক্তার হতে চাও?
পুতুল মাথা নাড়িয়ে যতটা খুশি মনে তাকিয়ে ছিল।ততটাই ভেঙে পড়ে পরবর্তী কথাগুলো শুনে।

পুতুল,তুমি কথা বলতে পারোনা।তোমার এই স্বপ্ন দেখা বারণ।আজ যদি দশটা বাচ্চাদের মতো কথা বলতে পারতে তাহলে তোমার ইচ্ছেটায় গুরুত্ব থাকত।স্যারের কথায় সবাই হেঁসে ছিল।স্যার ধমক দিতেই সবাই চুপচাপ হয়ে যায়।আর স্যার আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

মন খারাপ করো না।তুমি একে তোও কথা বলতে পারো না।তার ওপর গরিব বাবার সন্তান।দুনিয়ার সম্পর্কে তোমার ধারণা কম।রোহিতপুর গ্রাম থেকে বেড়ে ওঠা কন্যার ডাক্তার হওয়াটা মুখের কথা নয়।তবুও দোয়া করি।ডাক্তার না হলেও অন্য কিছু করতে পারো।জীবন কারো জন্যই থেমে থাকে না।আমরা জীবিকার তাগিদে একটা না একটা পদ ঠিকই বেছেই নেই।
প্রথম পিরিয়ডের ঘন্টা বেজে জানান দিলো সময়ই শেষ।স্যার চলে যেতেই পুতুল নিচু মাথা ওপরে তুলে।তার দুই চোখে অথৈই নোনা জলে টইটম্বুর।একটু ছুয়ে দিতেই সে আপনিই ইচ্ছায় টপ করে পড়ে যাবে।অথচ কেউ জানতেই চাইলোনা।সে কেনো ডাক্তার হওয়াটা বেছে নিলো?

৮৬.
মা।আমার মা।চোখের সামনে মায়ের লাশটা পরে।শুনতে পাই,অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণে মায়ের মৃত্যু হয়েছে।ঠিক সময় চিকিৎসাটা সে পায়নি।ডাক্তার অবধি পৌছাতে একটু দেড়ি হলো।আমার মা পুরোপুরি চিকিৎসা না পেয়ে কষ্ট পেতে পেতে দমটা ছেড়ে দিলো।আমার মা মারা গেলো।ডাক্তার পারেনি আমার মা’কে বাঁচাতে।আমি মা’কে হারিয়েছি।আমার মা যদি ঠিকঠাক চিকিৎসা পেতো।তাহলে আজ আমার পাশে আমার মা-ও থাকতো।মা হারালাম।ভাই পেলাম।কিন্তু মনের ভিতরের ঘা’টা শুকায়নি।এরমধ্যেই ছোট রিফাত মামীর গর্ভে এলো।ঘরের মধ্যেই মামীর ওই আতনার্দ এখনো কানে বাজে।মামীর সেই চিতকার আমাকে শান্তি দেয়না।কিন্তু আমি সেই সময় মামীর পাশে থাকতে পারেনি।মামীর কষ্ট দেখে মায়ের কষ্টগুলোর কথা মনে পড়ে যায়।আজও আমি শান্তি পাইনা।
স্বাধীন ওই পেজের নিচের লিখা টুকু পড়ে থমকে যায়।হাত থেকে থেকে কাজটা পড়ে যেতে নিলে ধরে ফেলে।মনযোগ দেয় শেষের লাইনগুলোতে।

মামা আমি ডাক্তার হতে চাই?আমার স্বপ্নটা তুমি পূরণ করে দেও না।তুমি তো সবাইকে ভালো রাখো।সবাইকে হাসিখুশিতে রাখতে চাও।তোমার হাতে ম্যাজিক আছে।তোমার হাতের ছোঁয়ায় সবকিছুর সমাধান হয়ে যায়। সেই ম্যাজিকে দ্বারায় আমার ইচ্ছেটা পূরণ করে দেও না।

স্বাধীন মেয়ের লিখার এই কথাগুলোর কি উওর দিবে জানা নেই?চোখ দুটো বুঝে নিতেই ভেসে ওঠে।

মামা আমি ডাক্তার হব।রোহিতপুর গ্রাম থেকে বেড়ে ওঠা কন্যার ডাক্তার হওয়ার গল্পটা সবাইকে জানাতে এবং দেখাতে চাই।গ্রাম থেকেও পড়াশোনা চালিয়ে নিজের ইচ্ছে পূরণ করা যায়।

স্বাধীন এখন কি করবে বুঝতে পারছে না?মেয়ের স্বপ্ন পূরণ।সেটা কি স্বাধীন পূরণ করতে পারবে?নিজের বাবা মারা যাওয়ার পর তার পড়াশোনা হলো না।তবুও কতটা আশা ছিল।সেই সব মিথ্যে হলো।তার মতোই কি তার মেয়ের সাথে একই ঘটনা হবে?তার পুরনো ক্ষততে মলম লাগিয়ে শুকিয়ে ফেলেছে।কিন্তু মেয়ের এই ক্ষতটা কি দিয়ে সাড়াবেন?

৮৭.
পাচঁ বছর পর….

সময় কখনো কারো অপেক্ষায় থাকে না।সে নিজ গতিতে চলে।সময় যখন নিজ গতিতে এগিয়ে তাহলে অতীত নিয়ে পরে থাকার মানে কি?সেটা তোও বোকার কাজ।দেখতে দেখতে সময় এগিয়ে গেছে।সেই ছোট্ট পুতুল আর ছোট নেই।বড় হয়ে গেছে।সামনে সতেরোতে পা দিবে।নতুন বছরের একমাস পর এসএসসি পরীক্ষা শুরু।মামার কথায় পুতুল সাইন্স গ্রুপ নিয়ে পড়াশোনা করছে।স্বপ্ন তার ডাক্তার হওয়া।কিন্তু মামা পারবে তোও?তার স্বপ্ন অবধি টেনে নিতে।পুতুলের পড়াশোনা জন্য এখন নকশিকাঁথায় কাজ তুলতে পারে না।তবে মামী তার কাজে সাহায্য করে।সংসারের কাজ শেষ করেই সময় নিয়ে নকশিকাঁথা সুই,সুতোর বুনন তুলে।স্বাধীন মামা সেইসব ঢাকায় বিক্রি করতে যায়।আবার ফিরে আসে হাসি মুখে।কখনো কখনো হতাশা হয়ে।যেমনটা পাচঁ বছর আগে হয়েছিল।অল্প টাকার পুঁজিতে লাভ না হলেও চালান উঠেছিল।তবুও কাজ থেমে নেই।কাজ চলছে পুরো থমে।একদিন এই কাজগুলো ঢাকা,শহর ছেড়ে বিদেশে মাটিতে নাম করবে।
পুতুল পড়াশোনা পাশাপাশি ভাইদের খেয়াল রাখে।আগে ছিল দু’জন।এখন ভাইদের দলে তিনজন হয়েছে।এদের নিয়েই তার সময়গুলো দ্রুত চলে যাচ্ছে।তাছাড়া মামা,মামী রয়েছে।তারা কঠোর পরিশ্রমই।তাদের কাজ নিয়ে ভুল ধরার সাহস নেই।

হৃদয় ছোঁয়ার যে স্বপ্ন নিয়ে শুরু হয়েছিল এ পথচলা।একে অপরের কাছে আসার উষ্ণতায়,ভালোবাসা আর বিশ্বাসে অটুট বন্ধনে ছায়া ঘেরা পুতুল নামক রমনীর মধ্যেই জীবন সর্ব সুখ।যার মুখে কথা নেই।তবুও চোখের ভাষায় কত কত কথার ফুল ঝুড়ি সাজায়।তার বয়সী কত মেয়ের জীবনে প্রেম এসেছে।আবার চলেও গেছে।আবার বিয়ের ফুল ফুটেছে।তার সুন্দর চেহারা জন্যও কত সম্বদ্ধ এসেছে।কিন্তু কথা বলতে না পারায় তারা নিজেরাই চলে গেছে।এতে পুতুলের আপসোস নেই।সে এতে শান্তি পায়।তার পড়াশোনা মনোযোগ। এছাড়া বাহিরের কোনোকিছু তাকে টানে না।

চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে