Tuesday, July 22, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 210



চক্ষে আমার তৃষ্ণা পর্ব-১৭+১৮+১৯

0

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-১৭
৫২.
পুতুলের স্কুল শুরু হয়ে গেছে৷সে এখন পড়াশোনা করছে।আগে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার ম্যাম,স্যারেরা তাকে কত ভালোবাসত।কিন্তু হাইস্কুল পিন্সিপাল ম্যাম থেকে শুরু করে অনেকেই তাঁকে পছন্দ করে না।তাদের একটা কথাই কানে আসে।পুতুল এখানে বড্ড বেমানান।তাদের সাথে তার মিল নেই।সবাই কথা ব’লে মনের ভাব প্রকাশ করে।একে অপরের সঙ্গে কত কথা ব’লে।কিন্তু সেখানে পুতুল কথা শুনতে পারলেও বলতে পারেন না।এই কথা বলার ত্রুটি সবাই কেন ধরে বসে থাকে।সবাই কেন তাদের একজন ভাবতে পারে না?কেন এত অবহেলা করে।তার যে কষ্ট হয়।কেন কেউ বুঝতে চেষ্টা করে না?পুতুল টিফিন পিরিয়ডে ক্লাস রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে চোখের কোনে পানিটুকু মুছে নিলো।
নিজেকে স্বাভাবিক করে বেঞ্চে বসে কোনো রকম একটু খাবার পানি দিয়ে গিলে নিলো।বাসা থেকে টিফিন পিরিয়ডে জন্য খাবার দেওয়া হয়।সে যদি খাবারটা না খায়।মামা ঠিক বুঝে যাবে।তাই নিজে যতটুকু গিলতে ফেরেছে।ততটুকু শেষ করে বাকিটা ব্যাগে রেখে দিল।

কদম গাছের নিচে দাড়িয়ে আছে পুতুল।প্রচন্ড গরম লাগছে।ভাইদের স্কুল ছুটি হতেই বাড়ি পথে পা বাড়ায়।পুতুল ক্লাস সাড়ে সাতটা থেকে বারোটা পর্যন্ত হয়।আর সাজুদের ক্লাস দশটা থেকে বারোটা।সকালে পুতুল এবং তার দুই ভাই আলাদা আসলেও যাওয়াটা একসাথে হয়।বাসায় পৌঁছে তিনজনই স্কুল ড্রেস পাল্টে বিশ্রাম নিলো।যোহর আজান পড়তেই দুই ভাইকে গোসল করিয়ে,নিজেও গোসল করে নামাজ আদায় করলো।মামী শরীরটা এখনো পুরোপুরি সুস্থ নয়।সিজারের বাচ্চা হওয়া তার হাঁটাচলা কম করে।বেশি হাঁটলে সেলাইতে টান লাগে।তাই বেশি হাঁটাহাটি বারণ।বেবিকে বেশিখন কোলে রাখতে পারে না।শুধু খাবার খাওয়া সময় বেবি কোলে নেওয়া হয়।আর বাচ্চা হয়তো মায়ের কষ্ট বুঝতে পারে।তাই দিনের বেশিভাগ সময় ঘুমিয়ে কাটায়।ঘুম ভাঙ্গলে চোখ খুলে খেলতে থাকে।যদি পেটে খিদে পায়।তাহলে কান্না করে।এছাড়া সে একদম শান্ত সৃষ্ট বাচ্চা।বাকি দুই ভাইয়ের মতো নয় সে।বাচ্চার নাম মায়ের নামের প্রথম অক্ষর “র” দিয়ে রাখা হয়েছে।মোঃরিফাত।আজ সাজু,মিলন টিভি দেখতে গঞ্জে যাবে।গ্রামে বিদ্যুৎ এসেছে কয়েকদিন হলো।সাদা কালো ছোট টিভিতে হানিফ সংকেত ইত্যাদি অনুষ্ঠান শুরু হবে সন্ধ্যার পর।পুতুলের ওমন ছোট বাক্স টিভি দেখতে ইচ্ছে করে।কিন্তু সে মেয়ে মানুষ।গঞ্জে টিভি দেখতে গেলে গ্রামের মানুষ ব্যাপারটা ভালো চোখে দেখবে না।তাই নিজের ছোট চাওয়া প্রশয় দিলো না।আর দিলেও কিছু হতো না।

৫৩.
এশার আজান দিয়েছে অনেকখন।পুতুল হাতের কাজগুলো দ্রুত শেষ করে।অযু করে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলো।মোনাজাত শেষ করে জায়নামাজ ভাজ করে আলনায় রাখতেই,মিলন,সাজু স্বাধীনের হাত ধরে নাচতে নাচতে বাড়িতে চলে আসছে।তিন জনকে একসাথে দেখে পুতুল হাতের ইশারা সালাম দিলো।

আস-সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।

মিলন,সাজু,স্বাধীন তিনজন একসাথে জবাব নিলো।

ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ।

স্বাধীন বারান্দার মোড়ায় বসতেই পুতুল এক গ্লাস ঠান্ডা পানি এগিয়ে দেয়।স্বাধীন মুচকি হেসে পানিটুকু প্রান করে।

রেনু খাবার খেয়েছে আম্মা।পুতুল মাথা নাড়িয়ে বল হ্যা খেয়েছে।

স্বাধীন খাবারের জন্য ঘরে চলে যেতেই।সাজু,মিলন একসাথে পুতুল কাছে গঞ্জের আলাপ নিয়ে বসে।তাদের আলাপ শেষ করে খাবার জন্য ঘরে যায়।মাটিতে পাটি বিছিয়ে নেয়।ভাত,তরকারি পেয়ালাগুলো বোনের দেখাদেখি নিজেরাও এগিয়ে নিয়ে আসে।স্বাধীন হাতমুখ ধুয়ে আসতেই খাবার বিসমিল্লাহ ব’লে মুখে তুলে।পুতুল সবার জন্য খাবার বেড়ে নিজেও খাবার মুখে তুলতে নিলেই হঠাৎ কারো চিতকারে হাত ফসকে ভাতগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে যায়।ততক্ষণে স্বাধীন,সাজু,মিলনের খাবার বন্ধ হয়ে গেছে।স্বাধীন দৌড়ে ছুটতেই,পুতুল হাতটা ধুয়ে দৌড়ে বের হয়।পাশের বাড়িতে কি হয়েছে দেখার জন্য?

সুমনা নামের মেয়েটি গলায় ওড়না দিয়ে ফাঁস দিয়েছে।মুখ দিয়ে কিসব পড়ছে।জিহবা বের হয়ে আছে।বাবার মতেই বিয়ে করেছিল।বিয়ে গন্ধ যার শরীরে এখনোও।হাতে রাঙা মেহেদী।সেই মেয়েটি ফ্যানের সাথে ঝুলছে।
পুতুল চারদিকে তাকায়।মেয়েটি মা জ্ঞান হারিয়েছে।বাবা কপাল চাপড়াচ্ছে।ঋণ করে ধুমধামে মেয়েকে বিয়ে দিলো।অথচ ঋণ পরিশোধ করা হলো না।মেয়ে তার লাশের পরিনত ঠিকই হলো।পুতুল আরো কিছু ভাবার আগেই স্বাধীন তার হাত টেনে বাড়িতে নিয়ে যায়।

আম্মা আপনি বাড়িতে থাকেন।ঘর ছেড়ে বের হবেন না।আমি দেখে আসছি।কি হয়েছে? পুতুল কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল আচ্ছা।কিন্তু চোখের সামনে ওমন ভয়ংকর কিছু দেখে পুতুলের বাসায় বসে থাকতে মন সায় দিচ্ছে না। সাজু,মিলনকে খাবার খাইয়ে ঘুমাতে দিয়ে চুপিচুপি ঘর থেকে বের হয়ে যায়।সুমনাদের বাড়ির মেইন গেটের দরজাটা হালকা খুলতেই দেখতে পায়।বাড়িতে পুলিশ এসেছে।মেয়েটি লাশ ততক্ষণে ঘর থেকে বাহিরে নামিয়ে মাটিতে পাটি বিছিয়ে শুয়ানো হয়েছে।পুলিশ কথা শুনে মনে হচ্ছে পোস্ট মর্ডেম জন্য হাসপাতালে নিবে।কাটাছিড়া পর নাকি মেয়েটির লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।কারো প্রতি কোনো সন্দেহ থাকলে পুলিশের কাছে জানাতে বলল।সুমনা শ্বশুর বাড়ি লোকদের ওহ খবর দেওয়া হয়েছে।তারা প্রায় চলে এলো ব’লে।

৫৪.
ঘরে যার নব সুন্দরী বধূ।সে বাহিরে পর নারীতে আসক্ত হয় কি করে জানা নেই পুতুলের।সুমনা মারা যা-ওয়ার সাত দিন পার হয়ে গেছে।সুমনা বর আগে থেকেই পরকীয়া করতো।সেই মেয়ে না-কি তিনমাসের অন্তঃসত্ত্বা।সেটা কোনোভাবে সুমনা জানতে পারে।ভালোবেসে যে স্বামীকে নিয়ে ঘর বাঁধলো।দিন শেষে সে ধোঁকা দিল।সুমনা মানতে পারেনি।বাবার বাড়িতে নায়ের হয়ে এসেছিল।কিন্তু বের হলো লাশ হয়ে।
পুতুল খারাপ লাগছে।মেয়েটি,মা,বাবার দিকে ফিরে তাকানো যায় না।সন্তান ছাড়া তারা কতটা অসহায়।সুমনা বড় ভাই কাজের সূত্রে ঢাকা পরেছিল।বোনের মৃত্যু খবর পেয়ে ছুটে আসে।সুমনা স্বামীকে জেলে নেওয়া হয়েছিল।কিন্তু তারা ক্ষমতাশালী হওয়া ছেড়ে দিলো।দশ লাখ টাকা বিনিময়ে সুমনা,শ্বশুর ছেলেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান।সুমনা শ্বশুর সেখানকার পুলিশ অফিসার ছিলেন।এখন রির্ডাড।সরকার থেকে বসে বসে টাকা থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাসায়ন পান।তিনি প্রচুর সম্পত্তির মালিক।সুমনা বাবা হাজার চেষ্টা করে ওহ পারে নিই।মেয়েকে ন্যায় পাইয়ে দিতে।সে ব্যর্থ।

সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে।অসময়ে বৃষ্টি আগমনে কিঞ্চিত বিরক্ত পুতুল।জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখে কৃষকের ফসলের ধান নষ্ট হচ্ছে।এই বৃষ্টি না আসলেই ভালো হতো।কত মানুষের ক্ষতি হচ্ছে।মিলন,সাজু আবদারে হাঁড়িতে খিচুড়ি চড়িয়ে দেয়।চাল,তিন পদের ডাল,মিষ্টি কুমড়ো ও আলু ছোট ছোট টুকরো দিয়ে আজকে এই খিচুড়ি।কিছুখন পর ঢাকনা সরাতেই খিচুড়ি গন্ধ আসছে।ভালোই হবে মনে হচ্ছে।গরম তেলে বেগুন ছেড়ে ভাজতে লাগল।ঘরে যা ছিল সবকিছু দিয়ে মোটামুটি খাবার আয়োজন হলো।মামী জলপাই আচার করেছিল।জলপাই শেষ হলেও তেল রয়ে গেছে।পিয়াজ কুচিকুচি করে কেটে নিলো।লবণ দিয়ে হালকা ঢলে তাতে জলপাই তেল ঢেলে একটা মজাদার খাবার করে নিলো।

মিলন,সাজু মজা পেয়ে খাবার বেশি খেয়ে ফেলেছে।মিলন পেট ফুলে ঢোল হয়ে গেছে।সাজু, মিলন কে খ্যাপাতে বলল,

থাকতুম থাকতুম বাজায়।মিলন মিয়া ঢোল।

মিলন ঠোঁট উল্টে বলল,

-;আমার পেটে বাচ্চা।মিলন মিয়ার বাচ্চা।মিলন মিয়ার বাচ্চা।

মিলন কথাটা বলতে বলতে বিছানায় শুয়ে কেঁদে ওঠে।

ওরে বাপরে খুদা বেশি লাগছিল।তাই শখ করে আরেকটু খেতে গিয়েছিলাম।এখন আমার এটা কি হলো?পেটে আমার বাচ্চা।লোভে পরে পাপ করে ফেলছি।ওরে মা,পেট আমার পেটের জায়গায় থাকতে চায় না কেন?কেন বাপ কেন?আমার পেট ফেটে গেলো রে।ওরে তোরা কেউ আমারে ধররেএ।

মিলন কাজে সাজু বসে শব্দ করে হাসছে।পুতুল চোখ বড় বড় করে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।কি সবর্নাশা কথা ব’লছে?এসব কি কথা ছিঁড়ি?পুতুল ভাইকে বলল,বাড়ি বারান্দায় হাঁটতে।হাটাহাটি আস্তে আস্তে করলে ঠিক হয়ে যাবে।পুতুল কথায় মিলন পেটটা ধরে বাড়ির বারান্দায় আস্তে আস্তে হাঁটতে লাগে।সাজু,মিলন মতো করে পেটে হাত দিয়ে হেঁটে হেঁটে বলল,

আসছে গোপাল,যাচ্ছে গোপাল।

মিলন গাল ফুলিয়ে বলল,আপু,সাজুকে কিছু বলো।ওহ আমায় ক্ষ্যাপায় কেন?আমি কিন্তু ওকে খুব মারবো।পঁচা ছেলে ভাগ।

-;তুই ভাগ।গোপাল ভাড় একটা।আগে আগে পেট চলছে।পেটুক একটা।আর বেশি খাবি।

পুতুল,সাজুর কান টেনে ধরে হাতের ইশারা বলল।মারব কিন্তু।

-;আপু লাগছে আমার।ছাড়।আচ্ছা আর বলবো না।ছাড় আপু।পুতুল কান ছেড়ে দিতেই সাজু দৌড়ে ঘরে চলে যায়।পুতুল হাঁটু গেড়ে ভাইয়ের ফুলো পেটে হালকা করে চিমটি কাটে।মিলন চিতকার করে বলল,

ওরে মা,পেট আমার ফেটে গেলো।
তুমিও খুব পচাঁ আপু।রাগ করে মিলন বারান্দায় ছেড়ে ঘরে চলে যায়।পুতুল মিটমিটে হাসে।

চলবে…..

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-১৮
৫৫.
আয় বৃষ্টি ঝেঁপে,
ধান দেব মেপে।
ধানের ভিতর পোকা,
জামাই বাবু বোকা।

গ্রামে মেলা বসেছে।সেখানে চড়কি থেকে শুরু করে বিভিন্ন খেলনা হাট দেখা যাচ্ছে।মিলন খেলনা পুতুল হাতে তুলে নিয়েছে।যেখানে এক মেয়ে কনে সাজে তার বরের পাশে বসে আছে।খেলনা পুতুল হাতে নিয়ে নড়াচড়া করতে করতে উপরোক্ত কথাগুলো ব’লে খিলখিল হাসিতে ফেটে পড়ে।পুতুল কপাল কুঁচকে হাতের ইশারা বলল,

কি হয়েছে তোর?

দেখ আপু পুতুলটা তোমার মতো করে বউ সেজেছে।পুতুল মিলনের মাথায় আস্তে থাপ্পড় মেরে ইশারায় বলল,

চুপ থাক ফাজিল।টিভিতে ওইসব ছবি দেখে দেখে এসব বলছিস।

মিলন মাথা কষে বলল।

তুমি মারলে কেন?এই পুতুলের মতো করে তোমারও বর আসবে দেখে নিও।মিলন কথা পাত্তা দিলো না।নিজের মাপের আকাশী চুরি হাতে পড়ে মিষ্টি করে হাসলো।স্বাধীন এসে দেখে পুতুলের হাতে রেশমী চুরি।

-;আম্মা পচ্ছন্দ হয়েছে।পুতুল মাথা নাড়িয়ে সায় দিলো।স্বাধীন পাঞ্জাবি পকেটে হাত দিয়ে দেখে মাত্র বিশ টাকা পড়ে আছে।মন খারাপ করে পুতুল দিকে তাকাতেই,পুতুল বুঝতে পারে।মামা কাছে কোনো টাকা নেই।তাই মন খারাপ করলোনা।মিষ্টি হেসে আস্তে করে একের পর এক চুরিগুলো খুলে রেখে দিল।মামা হাতের বিশ টাকা নিয়ে মামার পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে রেখে দেয়।আরেকটু আগেই স্বাধীন মেলার ভিতর থেকে দুই পদের নিমকি আদা কেজির মতো নিয়েছে।সেটা নিয়ে সবাই বাড়িতে ফিরে গেলো।কিন্তু মিলন বারবার পিছনে ঘুরে রেশমি চুরিগুলো দিকে তাকায়।বাড়িতে ঢুকেই চুপচাপ গালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগল।কিছু মনে পড়তেই সাজু দিকে তাকিয়ে চোখ,মুখ উজ্জল হয়ে ওঠে।মিলন দৌড়ে রুমে ছুটে।সাজু পিছুপিছু চলে আসে।পুতুল ঘরে নেই।সেই সুযোগে ছোট মাটির ব্যাংক ভেঙে ফেলে।দুই টাকা থেকে শুরু করে পাঁচ টাকা কয়েন পেলো।সবগুলো হাতে তুলে দুই হাতের মুঠোয় নিয়ে স্বাধীনের রুমে ছুটে।স্বাধীনকে গুনে দিতে ব’লে।কত টাকা জমা হয়েছে।স্বাধীন গুনে দেখে।সত্তর টাকা হয়েছে।মিলন ভীষণ আনন্দ হয়ে টাকাগুলো নিয়ে মেলার দিকে ছুটে যায়।সাজু ও তার পিছু নেয়।হাতের সত্তুর টাকা দিয়ে কাচের রেশমি চুরি দিতে বলে।দোকানদার বলল,

-;এক মুঠো কাচের চুরি চল্লিশ টাকা।

দোকানদারের তখনকার কথা মনে পড়তেই হাসি মুখে দুই মুঠো চুরি সত্তুর টাকায় দিয়ে দেন।মিলন হাসিমুখে দৌড়ে ছুটে চলে যায়।সাজুও রওনা হয়।পুতুল রুমে এসে ব্যাংক ভাঙ্গা দেখে।এটা মিলনের কাজ বুঝতে পারে।নিশ্চয় মেলায় কিছু পচ্ছন্দ হয়েছে।যা মামা কিনে দিতে পারেনি।তাই এখন কিনতে ছুটেছে।পুতুল ভাঙ্গা টুকরোগুলো উঠিয়ে সব পরিষ্কার করে নেয়।নিজের পড়ার টেবিলে বসতেই মিলন রুমে প্রবেশ করে।ভাইয়ের ছোট দুই হাতে রেশমী চুরি দেখে পড়ার টেবিল ছেড়ে পুতুল দাড়িয়ে যায়।বোনের সামনেই দুই মুঠো কাচের চুরি রাখে।পুতুলের আর কিছু বুঝতে বাকি নেই।তার ভাই তার জন্য কাচের চুরি আনতে গিয়েছিল।খুশিতে দুই চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করে।কাঁপাকাপা দুই হাতে ভাইয়ের দুই গাল ধরে কপালে ভালোবাসার স্পর্শ একে দেয়।আজ এতটা খুশি লাগছে পুতুল কোন ভাষায় প্রকাশ করবে বুঝতে পারছে না।তার ঈদের দিনের মতো আনন্দ লাগছে।ভাইয়ের জমানো টাকায় তার জন্য প্রথম উপহার।সে গ্রহণ না করে কিভাবে থাকবে?

-;আপু পড়বে না।

পুতুল মাথা নাড়িয়ে দিল।যার মানে সে পড়বে।মিলনকে সামনেই বসিয়ে দুই হাতে রেশমী চুরি পড়ে নিলো।সুন্দর দুই হাতে রেশমী চুরি কেমন সুন্দর মানিয়েছে?মিলন ভীষণ খুশি হয়েছে।সুখের মূহুর্তগুলো একটু বেশিই সুন্দর হয়।

৫৬.

স্বাধীন ভাই কোথায় যাচ্ছেন?
এই তো ভাই মেয়ে,আর ছেলেদের আনতে এগিয়ে যাচ্ছি।

ওহ।তাদের ওই পাশের গ্রামে পড়তে দিয়েছেন।ওই পাড়ের চেয়ারম্যান সাহেব বাড়ি চিনেন।

হ্যা চিনি।অসিম তালুকদার।তাদের বেশ নামডাক।

সেই ছেলে বছরখানিক আগে ঢাকায় পড়তে গিয়েছিল।এখন আবার গ্রামে আসছে।সঙ্গে তার দুই চাচাতো ভাই।এরজন্যই এলাকার মানুষ ভয়ে থাকত।ছেলে একটা গুন্ডা।

মানে।কার কথা বলছেন?

আরে চেয়ারম্যান ছেলে অর্পণ কথা বলছি।এই ছেলে না-কি ঢাকায় রাজনীতি করে।

ওহ।কিন্তু যারা পড়াশোনা করতে ঢাকায় যায়।তারা কি গুন্ডা হয়?

আরে সবাই না হলে কি হবে?এই ছেলে ছোট বেলা থেকে গুন্ডা।বাপ এলাকার চেয়ারম্যান।তার চাচা সাফিন তালুকদার খুলনা জেলার পুলিশ অফিসার।চাচী পাচঁ বছর ধরে হাইস্কুলে মাস্টারগিরি করে।লোকটার কথা শুনে স্বাধীন চিন্তা পরে গেলো।পুতুল,এবং দুইছেলেকে নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না তো।

ঢাকা থেকে চেয়ারম্যান সাহেবের ছেলে আসছে।পাঁচ বছর আগে ছেলেকে ঢাকায় অনেক কষ্টে পড়তে পাঠিয়ে ছিল।আজ ছেলে গ্রামে আসছে।রাবেয়া ছেলে আসার খবর শুনে নিজ হাতে রান্না বসিয়ে দিলো।বাবা,ছেলে এই লড়াই তার ভালো লাগে না।তবুও ছেলের ভালো জন্য চুপচাপ স্বামীর সাথে রাগ করে।বাবার বাড়িতে কিছুদিন পরে ছিল।কিন্তু বেশিদিন স্বামীর সাথে রাগ করে রাবেয়া থাকতে পারেনি।ছেলে ঢাকায় যাওয়ার দুই সপ্তাহের মাথায় তালুকদার বাড়িতে চলে আসে।অসীম তালুকদার বউয়ের সব দেখে ওহ কিছু ব’লে নিই।পরিবেশ সময়ের সাথে ঠান্ডা হয়েছে।

বাইক নিয়ে তিন ভাই এলাকা ঘুরে বেড়াচ্ছে।গ্রামের সাথে তাদের পুরনো কত দূষ্টুপণা সৃতি জড়িয়ে আছে।

নিজের পুরনো হাইস্কুলে প্রাঙ্গনে পা রাখে অর্পণ।হারুন মাস্টার খবর নিতেই জানতে পারে।সে ফেনীতে টান্সফার হয়েছে।বাকি শিক্ষকদের সাথে কথা ব’লে স্কুলটা ঘুরে দেখতে থাকে।দ্বিতীয় তলায় ষষ্ঠ শ্রেনীর “ক” শাখা পার হয়ে “খ” শাখা সামনে দিয়ে যেতে নিলেই জানালার পাশে পুতুলকে দেখতে পায়।কোথায় দেখেছে ঠিক মনে করতে পারছে না।হাই স্কুলের প্রিন্সিপাল ম্যাম অর্পণকে দেখে এগিয়ে আসে।অর্পণ তুমি বাসায় যা ও নিই।ভাইজান কিন্তু তোমার ওপর খুব রাগ করবে আব্বু।বাসায় যাও।তোমার আম্মিজান বাসায় অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।অর্পণ আঙুল তুলে ইশারায় পুতুল দিকে তাক করে বলল,

-;চাচী এই মেয়েটি কে?

অর্পণ হাত বরাবর তাকিয়ে মাসুদা তালুকদার কপাল কুঁচকে যায়।এক প্রকার বিরক্ত হয়ে বলল,

-;তুমি ওকে চিনবে না আব্বু।ওহ রোহিতপুর থেকে এখানে পড়তে আসে।নাম পুতুল।

-;রো..হি..ত..পুর। নামটা শুনতেই অর্পণের কিছু মনে পড়ে যায়।শয়তানি হাসি দিয়ে চোখে স্নানগ্লাস পরে বের হয়ে যায়।মাসুদা তালুকদার পুতুল দিকে আরেকবার তাকিয়ে চলে যায়।এতখন ধরে তাঁকে নিয়ে কথা হয়েছে।সেই দিকে পুতুলের কোনো খেয়াল নেই।সে মনযোগ দিয়ে খাতায় অঙ্ক করতে ব্যাস্ত।একটা অঙ্গ বারবার করেও হচ্ছে না।এক পর্যায় উত্তর মিলে যেতেই বিজয় হাসি ঠোঁটে ফুটে ওঠে।স্যারকে খাতা দেখিয়ে ব্যাগ গোছাতেই ছুটির ঘন্টা পরে যায়।

৫৭.?
কারো একদিন হবো
কারো এক রাত হবো
এর বেশি কারো রুচি হবে না
আমার এই বাজে স্বভাব কোনোদিন যাবে না,,

জিহান গান বন্ধ করতে একটা ইটের টুকরো ঢিল মারতেই জিহান মাথার পিছন সাইটে লাগে।
আ.বে কোন হালায় রে।
তোর বাপ হালায়।যা সর।বসতে দে।
কি মামা?এত খুশি কেন?খবর কি?
অর্পণ,জিহান হাত থেকে পানির বোতল নিয়ে সব মাথায় ঠেলে দিলো।
জিহান,রিহান বাইককে বসা ছিল।অর্পন কাজে জিহান,রিহান দাঁড়িয়ে যায়।
পুরনো শত্রুকে এতদিন পরে পেয়েছি।এত সহজে পাবো আশা রাখিনি ইয়ার।জিহান কিছু বলতে নিবে।তখনই পুতুল কদম গাছের নিচে এসে দাড়াতেই,সাজু,মিলন চলে আসে।দুই ভাইকে নিয়ে সামনে এগোতে কয়েক পা ফেলে।ঠিক সে সময় পিছন থেকে ডেকে ওঠে।

ওই লিলিপুট।পুতুল এমন অদ্ভুত নাম শুনে পাত্তা দিলো না।হেঁটে চলে যেতে নিলে আবার একই ডাক।মিলন পিছনে তাকিয়ে দেখে লম্বা তিনটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।

-;আপু,লম্বুগুলো মনে হয় নির্মা ওয়াশিন পাউডার খেয়েছে।তাই দিন দুপুরে এমন করছে।তুমি এখানে সাজু সাথে দাঁড়াও আমি আসছি।বাম হাতের সাহায্যে মাথার ছোট চুলগুলো পিছনে ঠেলে পেন্টের পকেটে দুই হাত দিয়ে বড় ছেলেদের মতো ভাব নিয়ে এগিয়ে গিয়ে বলল,

-;কি ভাই?কি সমস্যা?দিন দুপুরের আমাদের স্কুল মাঠে কি?স্যারের কাছে বিচার দিলে না।পাছা পিঠিয়ে লাল করে দিবে।

-;ওলে বাবু সোনা ব’লে কি?আমাদের পাছা পিটিয়ে লাল করবে!তার আগে তুমি ভাবতে থাকোও সোনা।এখন তিন জন একসাথে তোমাকে ধরলে তুমি পালিয়ে বাঁচতে পারবে।
এবার একটু মিলন নড়েচড়ে দাঁড়িয়ে রইল।এরা তিনজন একসাথে তাকে ধরলে সে বাঁচবে কি করে?আর বোনকে সেফ করবে কি করে?দূর থেকে স্বাধীন কে আসতে দেখে মিলনের ভাবনা চলে যায়।এখান থেকে চলে যাওয়ার আগেই পেট মোচড় মারে।কিছু চিন্তা করেই হাসি চলে আসে।পিছনে ঘুরে চলে যাওয়ার আগেই বায়ু দূষণ করে দৌড় মারে।তিন ভাই দূগর্ন্ধে মুখে হাত দেয়।তাদের পেট মোচড় মেরে বমি আসতে চায়।ওয়াক্ক ওয়াক্ক করতেই তিন ভাইয়ের অবস্থা খুব খারাপ।

চলবে….

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-১৯
৫৮.
আব্বু জলতি চলো।পিছনে তিন পাগলা কুত্তা আসছে।আমাকে দেখলেই কামড়ে দিবে।স্বাধীনের হাত টেনে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে সরে যায়।পুতুল,সাজু নীরব দর্শক।কি হলো ব্যাপারটা তাদের মাথায় ঢুকে নিই?

ভাই এটা কি ছিল?গ্রামে আসতে না আসতেই একটা পিচ্চি ছেলে আমাদের তিন ভাইকে ঘোল খাওয়ালো।ছি,ওয়াক্ক পেট মোচড়ে বমি পাচ্ছে।আল্লাহ আমার ইজ্জত শেষ।

অর্পণ রাগে ফুঁসতে লাগল।একজন লিলিপুট জুতা মারে।আরেকজন বায়ুদূষণ করে।এদের ভাই,বোনের কি করা যায় ভাবছে অর্পণ?পিচ্চি কান্ড মনে পড়তেই,মুখ চেপে বোতলের বাকি পানিটুকু নিজ মাথায় ঢেলে বাড়ির দিকে রওনা হয়!আজ কি বাজে অভিজ্ঞতা হলো ছি।

বাসায় পা রাখতে খিলখিল করে হাসিতে ফেটে পড়ে মিলন।স্বাধীন হা হয়ে তাকিয়ে আছে।ছেলেটা এইভাবে হাসছে কেন?পাগল হলো না কি?

আব্বা কি হয়েছে আপনার?এইভাবে হাসেন কেন?

কিছু না আব্বু।এমনই হাসতে মন চাইলো আরকি?কথাটা শেষ করে ঘরে যায়।স্বাধীন নিজের কাজে জন্য বেরিয়ে পরে।পুতুল মিলনের পাগলামির কথা আর জিজ্ঞেস করলো না।এই পাঁজি ছেলে মাঝে মধ্যে এমন অদ্ভুত কান্ড করে বসে থাকে।সাজু,মিলনকে চেপে ধরতেই।গড়গড় করে কাহিনি ব’লে দিল।সাজু,মিলন সাথে হেঁসে উঠে।

-;বেশ করেছিস।আমাদের বোনকে লিলিপুট বলবে কেন?কোন এঙ্গেল থেকে তাকে লিলিপুট লাগে।লম্বু বেটা কোথাকার?

তালুকদার ভবনে পা রেখেই কারো সাথে কোনো কথা অর্পণ বললো না।নিজের রুমে ঢুকে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে গেছে এক ঘন্টা হলো।এখনো ওয়াশরুম থেকে বের হয়নি।
রাবেয়া তালুকদার ছেলেকে এসে কয়েকবার ডেকে গেছে।সে কোনো রেসপন্স করেনি।বেলা যখন দুপুর দু’টো কাঁটার বেশি,তখনই
নিজেকে শান্ত করে রুমে ছেড়ে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসে।রাবেয়া ছেলে কে খাবার দিতে দিতে আড়চোখে তাকায়।আজকে বাবা,ছেলের দেখাই হয়নি।তাহলে রাগ করলো কার সাথে?রাবেয়া বুঝতে পারছে না।
অর্পণ চুপচাপ খাবার মুখে তুলে খেতে লাগলো।

৫৯.
স্বাধীন মিয়া কি খবর?কেমন আছো?তুমি শিক্ষিত মানুষ হয়ে কেন যে গ্রামে পড়ে আছো?ঢাকায় চল।শহরের বাতাস তোমার গায়ে লাগলে বুঝতে পারবা।টাকায় সুখ,টাকাই ধর্ম।ঢাকা শহরের লাল,নীল বাতি দেইখা চোখ জুড়াইয়া যাইবো।বড় দালানে এসির নিচে বসে আরামে দিন কাটবো।

টাকায় যদি সুখ পাওয়া যেতো।তাহলে গ্রামের মানুষ এই গ্রামে থেকে চাষবাস করে খেতো না।সবাই টাকার জন্য গ্রামে ছুটতো।যেমন আপনি এবং আপনার ছেলে ছুটেছেন ঢাকায়।আপনার মতো মানুষদের জন্য ঢাকা শহরের এত জ্যাম লাগছে।ঢাকা শহরের এত কোলাহল।অতিরিক্ত লোকসংখ্যা বাড়ছে।ঢাকা শহরে হয়তো টাকার মেশিন আছে।কিন্তু এই মাটি,বায়ু,শান্ত পরিবেশ নেই।নদী,খাল বিলের পানিতে যে মাছ রয়েছে তার
স্বাদে আমি কাবু।ঢাকার চাষ করা মাছে আমার রুহ শান্তি পাবে না ভাই।এই গ্রামে আমার জম্ম।এই গ্রামে আমার শৈশব,কৈশোর কেটেছে।আমি এতেই খুশি।আমার ঢাকা পছন্দ নয়।শুধু শুধু ঢাকায় গিয়ে ঢাকার লোকজনের বিরক্ত কারণ হতে চাই না।আমি যাওয়া মানে আমার জন্য আরেকটু অতিরিক্ত জ্যাম হবে।জমিল চৌকিদার স্বাধীনকে কাবু করতে আরেকটু কিছু বলল।কিন্তু যুতসই না হওয়া চলে গেলেন।

স্বাধীন বাশঁ কেটে চারদিকে বেড়িবাঁধ দিয়ে দিলো।কলাগাছে কলা এসেছে।এখন ছোট ছোট।কিন্তু ইদানীং কলা চুরি হওয়া,বাধ্য হয়ে বাঁশ কেটে এনে চারদিকে আটকে দিলো।

কি জমিল?কাজ হলো।

না,মেম্বার সাহেব।টাকা লোভ দেখিয়ে কাজ হয়নি।

লেগে থাকো।আমার এই জমিটা চাই।স্বাধীন সরে পড়লে নিশ্চয় জমিটা পাবো।

আর যদি কাজ না হয় মেম্বার!তাহলে।

যদি আপোসসে না হয়।তাহলে ছিনিয়ে নিবো।
প্রয়োজনে স্বাধীনের লাশ পড়বে এই জমিতে।ওর রক্তে মাটি লাল হোক।আমি তাই চাই।পুরোনো কথাগুলো কিছুই ভুলিনি।আজকের মতো লেগে থাকো।এক,দুইবার কথায় কাজ না হলে শেষ করে দিবো।একদম জানে মেরে ফেলবো শূ**য়োরে বাচ্চাকে।

রেনু বসে বসে কাঁথায় নকশা করছে।শরীরটা এখন ভালো হয়েছে।সব কাজই করতে পারে।

পুতুল আম্মু কোথায় তুমি?

পুতুল ওড়নায় ভিজে হাতটা মুছতে মুছতে রেনু ঘরে ঢুকে।মামীর এক ডাকে সে হাজির।

আম্মু তোমার মামা সেই যে তোমাদের স্কুল থেকে বাসায় দিয়ে গেলো।এখনো এলোনা কেন?রাত অনেক হয়েছে।

পুতুল ইশারায় বলল চলে আসবে মামী।চিন্তা করো না।

ওই আপুরে তুই কই?তাড়াতাড়ি আয়।আমি ফাটা বাঁশে আটকে গেছি।

এটা মিলনের গলা না,বাদরটা আবার কি করলো?পুতুল দেখে আসো।আবার কি করেছে?

পুতুল উঠোনে আসতেই দেখতে পায়।তার বাঁদর ভাই প্যান্ট ধরে লাফাচ্ছে।কিন্তু কেন?সামনে যেতেই মিলন বলল,

আপু বাচাঁও।
পুতুল কিছু বলার আগেই স্বাধীন বাসায় ঢুকে।পুতুলকে চলে যেতে বলল।মিলনের প্যান্টের চেইন টান দিতেই সে বাথরুমে দৌড়।

এই ছেলের সবকিছুতেই তাড়াহুড়ো।আস্তে ধীরে কাজ কি করা যায় না?সব কিছু নিয়ে বাঁদরামী।কলপাড়ে হাত মুখ ধৌত করতে করতে বলল,

পুতুল আম্মা ভাত বাড়ো।খুব খুদা লাগছে।স্বাধীন কলপাড় থেকে চলে যেতে নিবে।সে সময়ই মিলন বাথরুম থেকে বের হয়।

আহা কি শান্তি?পেটে হাত ভুলাতে ভুলাতে বাথরুম থেকে বের হতে হতে কথাটা বলে হাসি দিলো।স্বাধীন মিলনের কান টেনে ধরে।

এই যে আব্বা আপনি ভালো হবেন না।বড় হচ্ছেন।জ্ঞান,বুদ্ধি একটু মাথায় রাখুন।

আমি আবার কি করলাম?আমার হিসু পেয়েছে।আমি হিসু করবো না।

না।আপনি কিছু করে নিই।যত দোষ,নন্দ ঘোষ এই স্বাধীনের।

৬০.
তালুকদার বাড়িতে আসর বসেছে।অসীম তালুকদার,রাবেয়া,অর্পণ,জিহান,
রিহান,মাসুদা,সাফিনকে পেয়েই আড্ডা জমেছে।তিন ছেলে আসবে শুনেই সাফিন আগেই রওনা দিয়েছিল।তাই সময় মতো বাড়িতে আসতে পেরেছে।

অর্নাস প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা সামনেই শুরু।এরপর কি করবে চিন্তা করেছো?

-;জি,চাচ্চু।অর্নাস শেষ হলেই,মাস্টার্স করার পাশাপাশি কিছু করতে চাই।

সেই কিছুটা কি অর্পণ?রাজনীতি।বাবার প্রশ্নে তাকায় অর্পণ।মাথা উঁচু করে মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়।

হুম।

রাজনীতি তুমি বুঝো কতটুকু।আমি যতটুকু জানি এবং পূর্বের অভিজ্ঞতায় থেকে বলতে পারি।তুমি এখনো উপযুক্ত নও।পড়াশোনা করছো।তাতেই ফোকাস করো।দেশের জন্য কিছু করার সময় এখনো অনেক পড়ে আছে।আর তাছাড়া তোমার বয়স কত।একুশ বছর পূর্ণ হবে কাল বাদে পরশু।সেইজন্য বাসায় পার্টি রাখা হয়েছে।অর্নাস চার বছর ব’লে কিন্তু চার বছরে শেষ হয় না।অর্নাস শেষ করতে কিন্তু ছয় থেকে সাত বছর লেগে যায়।তারপরে মাস্টার্স করবে।তাই বাবা হিসেবে একটা রিকুয়েষ্ট করছি।এই মূহুর্তে রাজনীতি থেকে সরে আসো।অসীম তালুকদার ছেলের থেকে কোনো উত্তর পেলেন না।ছেলের সাথে রাগ করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলেন।অর্পণ চুপচাপ বসে রইলো।সাফিন,অর্পণ ভাতিজা এবং দুই ছেলের সাথে কথা বলায় মশগুল হলো।চাচার সাথে তার সম্পর্কটা অন্য রকম।একজন ফ্রেন্ডের মতো তার সাথে মিশতে পারলেও বাবা ছেলের সম্পর্ক দা,বটি মতো।রাবেয়া স্বামীর পিছনে ছুটে ধরতে পারলেন না।বাসায় ফিরলে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবেন ব’লে মন স্থির করলেন।এখন ছেলেকে সময় দেওয়া দরকার।সামনে ছেলের পরীক্ষা।ছেলেটা আবার চলে যাবে।কবে আসবে ঠিক নেই?এখন কোনোমতেই টেনশন দেওয়া যাবে না।

সবাই যার যার ঘরে চলে যেতেই অর্পণ সোফায় টান টান হয়ে শুয়ে পড়ে।রাবেয়া ছেলের মাথাটা কোলে নিয়ে নিলেন।মাথা হাত বুলিয়ে দিতেই ঘুমের দেশে পাড়ি দেয়।

৬১.

শীতের সকালে কুয়াশা ঘেরা।শীতের সকাল দিগন্তের পার বেয়ে গাছপালার উপরে কুয়াশা পড়েছে।দূর্বলা ঘাসের ওপর শিশির জমে আছে।পাখির কিচিরমিচির শব্দ হচ্ছে।এত কুয়াশা ভেদ করে যেখানে কিছু দেখা যাচ্ছে না।একটু এগিয়ে দেখে সেখানে একটি মেয়ে গায়ে চাদর জড়িয়ে
ঘাসের শিশির মাড়িয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।লম্বা কালো কেশীনি চুলগুলো ছেড়ে দিয়েছে।পায়ে তার একজোড়া নূপুর।সেখান রিমিঝিম শব্দ শুনা যাচ্ছে।অর্পণ একটু একটু করে সামনে এগিয়ে রমনীকে ছোঁয়ার চেষ্টা করতেই সে দৌড়ে পালিয়ে গেলো।দূর জঙ্গল থেকে কাজল কালো চোখ দুটো মেলে তাকিয়ে তার প্রাণে।মেয়েটি মিষ্টি হাসির শব্দ সাথে তার মিষ্টি কন্ঠ সুর তুলে।কানে বাজে মিষ্টি গলার আওয়াজ।

কোন এক শীতের সকালে আমি তোমায় নিয়ে হারাবো গ্রামগঞ্জের শিশির ভেজা পথে।
তুমি প্রাণ সখা হয়ে হাতে হাতটি রেখো মোর।
জায়গায় দিও তোমার বাহুডোরে।

অর্পণ এক পা সামনে এগোতেই মেয়েটি গায়েব হয়ে গেছে।অর্পণ পাগলের মতো ছুটে।কিন্তু তার নাগাল নেই।কোথায় হারালো কেশিনী?

ফজরের আজানের শব্দে অর্পণের ঘুম ভেঙে যায়।বিছানায় উঠে বসতেই দেখতে পায়।সাড়ে পাঁচটা বাজে।তারমানে এতক্ষণ
স্বপ্ন দেখছিলাম।শিট।

চলবে….

চক্ষে আমার তৃষ্ণা পর্ব-১৪+১৫+১৬

0

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-১৪
৪৩.
দেখতে দেখতে আরো তিনটা মাস চলে গেছে।পুতুলের পরীক্ষা শেষ হয়েছে।সে এখন সারাদিন বাড়িতে থাকে।রেণু শরীরটা আজকাল ভালো যায় না।দুই একদিন মধ্যেই মনে হয় নতুন অতিথি আসতে চলেছে।তার আবার বিষণ তাড়া।এই কয়েকদিন রেনুকে ঠিক মতো ঘুমাতে দেয় নিই।বিছানায় পিঠ লাগাতে গেলেই বেবি কিক মা’রে।রেনু ওরে,মাগো ব’লে চিৎকার করে বিছানায় বসে পড়ে।ব্যাথায় কান্না করতে থাকে।স্বাধীন,বউয়ের কান্না দেখে নিজের কাছে খারাপ লাগে।রেনুকে বুঝাতে গেলেই উল্টো বউ তাকে বকাবকি করে।সেইদিন রাগারাগি করে বলল,

-;তিন তিনটা বাচ্চা থাকতে আবার একটা বাচ্চা।এটা নিয়ে চার চারটা বাচ্চা হবে।আপনার বুদ্ধি হাটুর নিচে গেছে।ইচ্ছে করছে,আপনার মাথাটা ফাটিয়ে ফেলতে।বাচ্চা হালি হালি নিলেই হবে।মানুষ আর করা লাগবে না।আমার চোখের সামনে থেকে দূরে যান।রেনু খিটখিটে মেজাজ দেখে স্বাধীন চুপ করে রইল।কিছু বলল না।বাচ্চা লাগার কয়েকমাস ভালোই চলছিল।সাত মাসে পরতেই বউ তার রগচটা হয়ে যাচ্ছে।এসব যে মুড সুয়িং জন্য হচ্ছে তা বুঝতে পারছে।সাজু পর আর কোনো বাচ্চা রেনু নিতে চায়নি।পুতুল,মিলন,সাজু এই তিনজনকে নিয়ে সে খুশি থাকতে চেয়েছে।কিন্তু স্বাধীন আরেকটা সন্তানের আসায় বউকে একটু বেশি ভালোবেসে ছিল।তার পরিনতি আজ তার চোখের সামনে।এখন বউ কথায় কথায় বকাবকি করে।অথচ বিয়ে আগেই এই মেয়ে তার জন্য পাগল ছিল।বিয়ে ঠিক হওয়ার পর লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা।খাবার পাঠানো এমনকি সাথে প্রেমপত্র পাঠাতো।রাজিয়া চলে যাওয়া।বাবা মৃত্যু।তাদের ছাড়া তখন তার নিঃসঙ্গ জীবনে রেনু নামক রমনী আগমন ঘটেছিল।মেয়েটি ভালোবাসায় তাঁকে সকল কষ্ট ভুলতে বাধ্য করেছিল।মনেমনে আল্লাহ দরবারে লাখ লাখ শুকরিয়া জানিয়ে ছিল।এমন একটা জীবন সঙ্গী পাঠানোর জন্য।

নাসিমা বেগম পুতুলের জন্য ছেলে দেখা শুরু করেছেন।তাদের সুবিধা মতো ছেলে খোঁজ পেয়েছেন একটা,দুইটা।তাদের মধ্যে প্রথম একটা ছেলের মা,বাবা নেই।চৌষট্টি জেলায় ঘুরে ফিরে।আর কাজ করে সপ্তাহে দুই,তিন দিন।কাজ করে যে টাকা পায়,জুয়া খেলে সব উড়িয়ে দেয়।তার বয়স প্রায় চব্বিশ এর কাছাকাছি।সিগেরেট খাওয়ার জন্য ঠোটঁ দুটি কালো হয়ে গেছে।নাম তার মিন্টু।আর দ্বিতীয় ছেলেটি পুতুল থেকে অনেক বড়।অবশ্য ছেলে বলা যায় না তাঁকে পুরুষ বলা যায়।তার বয়স একত্রিশ।এবং পিঠে মেরুদণ্ডে একটু সমস্যা রয়েছে।যার জন্য গুজা দিয়ে হাঁটে।গ্রামের লোক তাকে গুজা ব’লে ডাকে।তার ভালো নাম রবিন।

মেয়ের জন্য দুই ছেলে কে পচ্ছন্দ হয়েছে।মোস্তফা বিয়েটা একত্রিশ বয়সের লোকের সাথে দিতে চাইলো।পরবতর্তী মত পাল্টে মোস্তফা সরোয়ার প্রথম ছেলে মিন্টুকে ঠিক করলো।

-;মা মিন্টু নামক ছেলেটিকে খবর দেন।বিয়ে হইবো আমাগো পুতুলের লগে।নাসিমা ছেলের কথায় সায় দিলো।

৪৪.
সন্ধ্যায় মিন্টুকে খবর দিতেই সে হাজির মোস্তফা সরোয়ার বাড়িতে।এই বাড়ির ভবিষ্যৎ জামাই ব’লে কথা।তাই একটু আপ্যায়ন করার ব্যাবস্থা করতে নাসিমা চুলা কাছে যান।এইদিকে মোস্তফা সরোয়ার মেয়ে জামাই পেয়ে কথায় মশগুল হলো।

-;তুমি তো সবই শুনলা।আমার মাইয়া কিন্তু যেমন সুন্দরী তেমন গুণবতী।পড়াশোনা করছে।ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত।শুধু কথা বলতে পারে না।এছাড়া বাকি সবকিছু ভালোই।বিয়ের দিন তোমার চাহিদা মতো সবকিছু দেওয়া হবে।যা যা চেয়েছো।এসব ছাড়া তোমার কিছু বলার থাকলে বলতে পারো।

মিন্টু মাথা নাড়িয়ে না বলল।তার কিছু বলার নেই।চালচুলোহীন ছেলেকে কেউ মেয়ে দিচ্ছে।সাথে টাকা,পয়সা রয়েছে।তার জন্য এটাই অনেক।তার ওপর মেয়ে সুন্দরী আছে।কথা না ব’লে মানিয়ে নিবে।

-;চাচা যদি অনুমতি দেন।তাইলে পুতুলের সাথে আমি একা কথা কইতে চাই।

-;পুতুল বাড়িতে নাই।মামা বাড়ি বেড়াতে গেছে।তাছাড়া মেয়ে আমার রাজি আছে।আলাদা করে কিছু বলার দরকার নাই।তাছাড়া বিয়ে দিন বউকে সামনাসামনি দেখে নিও।মোস্তফা কথা কাটিয়ে নিলো।এরমধ্যেই নাসিমা নাস্তা নিয়ে আসে।বিয়ের পাকাপাকি কথা সেড়ে চলে যায় মিন্টু।মোস্তফা হাসতে থাকে।

-;মা সামনে পুতুলের বিয়া।সময় নাই।ওরে বিয়া দিমু।কিছু কিনাকাটি করতে মন চাইলে করেন।তারপর আমার ঝামেলা শেষ।

-;কিন্তু স্বাধীনকে আটকায় রাখবি কেমনে?

-;সেটা ভাবা হয়ে গেছে।শুনো।নাসিমা কান পাততেই।ছেলে,মোস্তফা তার প্ল্যানের কথা জানিয়ে দিলো।ছেলের কথাই নাসিমা বেগম খুশি হলেন।

এক পরিবার খুশির সংবাদ শুনতে প্রহর গুণছে।আর অন্য পরিবার তাদের খুশিটুকুর উপরে গ্রহ লাগাতে বসে আছে।

৪৫.
তালেপুর সরকারি স্কুলে শিশু শ্রেনিতে সাজু,মিলন ভর্তি হয়েছে।তাদের ক্লাস চলছে দারুণ।আজকে নতুন স্যার এসেছে।তাদের ক্লাসে পড়াচ্ছেন।কিন্তু সাজুকে শান্তি মতো ক্লাস মিলন করতে দিচ্ছে না।একটু পর পর সাজুর পিঠে চিমটি কাটে।মিলন মিটিমিটি হাসি দেয়।সাজু,মিলন এদের কান্ড কারখানা নতুন স্যার দেখতে পেয়ে কান ধরে দাড় করান।কিন্তু এরা চুপচাপ নেই।দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে একে অপরের সঙ্গে কথা ব’লে যাচ্ছে।স্যারের ক্লাসে একটুও মনযোগ নেই।মিলন একটা কথাই।স্যার যেহেতু দাঁড় করিয়ে রেখেছে।আজকে সে মনযোগ দিবে না।দাঁড়িয়ে কথা নিজেও বলছে।এবং সাজুকে বলতে বাধ্য করছে।স্যার,সাজু সামনে দাঁড়িয়ে বলল।

-;আচ্ছা তুমি বলো।একপাশে চৌধুরী সাহেবের বাড়ি।অন্য পাশে খান সাহেবের বাড়ি।বাড়ি মাঝখানে একটা দেয়াল রয়েছে। এবং দেয়ালের ওপর একটি মোরগ এমন ভাবে ডিম পারলো।যে এইদিকে পরলো না, ওইদিকে পরলো না।দেয়ালের মাঝে আটকে আছে।এই ডিমটার মালিক কে?সাজু গালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগল।বলল,

-;ডিমটার মালিক আমি।কারণ ডিমটা দেয়াল থেকে যাতে না পরে তাই মোরগের দুই পায়ে সুপারগ্লু লাগিয়ে দিয়েছি।আমার ডিম খুব প্রিয় স্যার।একটা জায়গায় দশটা সে পারলেও কোনো সমস্যা নাই।

-;উল্টাপাল্টা বলে কনফিউজ করো না।সঠিকটা বলো।কি পারলে না?আচ্ছা তুমি আরেকটা বলো।মিলনকে জিজ্ঞেস করলো।

-;কোন প্রানী লেজ দিয়ে ভাত খায়?

-;স্যার,ভাত আমি,আম্মু আব্বু,আপু,সাজু,সবাই খাই।তাহলে কি আমাদের এক একটা করে লেজ আছে?হায় আল্লাহ,স্যার আপনার ওহ কি লেজ আছে? কিন্তু কোথায়?সামনে,পিছনে নাকি ডানে,বামে।বাসায় যেয়ে আপুকে বলবো। আপু জানো,আমাদের নতুন স্যারের ইয়া বড় লম্বা লেজ আছে।কিন্তু স্যার দেখায় না।তুমি গেলে স্যার দেখাবে মনে হয়।
মিলন অদ্ভুত কথায় ক্লাসে বাচ্চাগুলো হেসে দিলো।আর নতুন স্যার মিলন এর কথায় লজ্জা পেয়েছেন।আর নিজের ভুল বুঝতে পারলেন। এসব ছোট বাচ্চাদের ধাঁধা ধরলে পারবে কোথা থেকে?যারা পুরো বইয়ের অক্ষর ভালো করে এখনো বুঝতে পারে না।তাদের জন্য এটা কঠিন।এবং মজা টাইপ।

৪৬.
রেনু সকাল দশটা থেকে পানি ভাঙ্গছে।ব্যাথা করছে প্রচুর।নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না।এইদিকে বিছানা পড়ে কাতরাচ্ছে রেনু।কাউকে ডাক দেওয়ার মতো অবস্থা নেই।তবুও কিছু করার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়।যদি হাতের নাগালে কিছু পায়।যেটা সাহায্যে বাহিরে পুতুলের কানে শব্দ পৌঁছে যাবে।কিন্তু হাতে নাগালে কিছু আসে না।রেনু কেঁদে অস্থির।মনের ভিতরে তোলপাড় হচ্ছে।কি করবে বুঝতে পারছে না?মনে মধ্যে সাহস সঞ্চয় করে।আল্লাহ কে ডাকতে লাগল।বিপদে তিনি একমাত্র ভরসা।এছাড়া তার কোনো উপায় সে দেখতে পারছে না।

সকালের এটো থালাবাসন ধুতে কলপাড়ে আসে পুতুল।মামী একা ঘরে।তার ঘরে খাওয়ার পানি সব সময় রাখতে হয়।বাবু পেটে আসার পর থেকেই বেশি বেশি পানি প্রাণ করেন।এসময় তার নাকি গলা শুকিয়ে যায়।আজ তাড়াহুড়ো সেটাও দেওয়া হয়নি।কি মনে করে,পুতুল থালাবাসন হাত থেকে নামিয়ে রাখে।খাবার পানি জগে ভরে মামীর ঘরে দিকে ছুটে যায়।রুমে ঢুকার আগেই কারো কান্না শব্দ পেয়ে চমকে উঠে।রুমের দরজা হালকা ধাক্কা দিতেই খুলে যায়।পুতুল দেখতে পায় রেনু কান্নামাখা মুখ।শরীর অর্ধেক বিছানা আর অর্ধেক বাহিরে।হাত থেকে জগ পড়ে যায়।দৌড়ে মামী মাথাটা কোলে নিয়ে কিছু বলার আগেই।রেনু অস্পষ্ট স্বরে বলল,

-;তোমার মামাকে ডাক দেও পুতুল।এতটুকু ব’লে রেনু আর কিছু বলতে পারেনা।কথা হারিয়ে ফেলে।নিশ্বাস বড় বড় করে টানতে থাকে।মনে হয় এখনই প্রাণ পাখিটি উড়াল দিবে।পুতুল,মামী মাথা বিছানায় রেখে দৌড়ে ছুটে চলে মামা কাছে খবর দিতে।কিন্তু মামা অবধি সে পৌঁছে যেতে পারেনি।আমন ধানের ক্ষেতেই ওতপাতা হায়নাদের দল।পুতুল মুখ চেপে জঙ্গলের গভীরে টেনে নিয়ে গেছে।এইদিকে স্বাধীন বাসায় লাঙ্গল রাখতে এসে রেনু এই অবস্থা দেখতে পায়।পুতুলের খোঁজ করতে বেশ কয়েকবার নিজের ঘর থেকে ডাক দেয়।কিন্তু পুতুল তার ডাকে আজ সারা দেয় নিই।স্বাধীন,পুতুল সাড়া শব্দ না পেয়ে রেনুকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে চলে।বাসায় এসে হয়তো পুতুল কে দেখতে পাবে।তখন জিজ্ঞেস করে নিবে।সে কোথায় ছিল ?এখন রেনু এবং তার অনাগত সন্তানকে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে গেল।

চলবে….

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-১৫+১৬
৪৭.
স্বাধীন হাসপাতালে বসে আল্লাহকে ডাকছে। সকল সমস্যা সমাধান হয়ে যাক।একদিকে মেয়েটা বাড়িতে নেই।কোথায় গেছে জানে না?অন্যদিকে সে বউকে নিয়ে হাসপাতালে পরে আছে।অপারেশন রুম থেকে ডাক্তার সালেহা খাতুন বের হয়ে আসেন।

-;মিষ্টার স্বাধীন।মা,এবং বাচ্চা দু’জনই বিপদে আছে।বাচ্চা নরমালে হবেনা।আমাদের সিজার করতে হবে।কারণ বেবি মায়ের বুকের কাছে চলে এসেছে।এবং তার পজিশন উল্টো রয়েছে।আর সেইজন্যই আপনাকে কাগজে সই করতে হবে।সেখানে উল্লেখ থাকবে।আপনার বউ এবং বাচ্চা অপারেশন রুমে মারা গেলে তার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দায়ী থাকবে না।যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার দ্রুত করুন।আমাদের হাতে সময় নেই।স্বাধীন বোনের মুখটা কথা ভেবেই হাত,পা ঠান্ডা হয়ে আসছে।কি করবে বুঝতে পারছে না?আজ আবারও একই পরিস্থিতি তার সামনে এসে দাড়িয়েছে।বোনকে জীবিত অবস্থায় বাড়িতে নিতে পারেনি।আজ তবে কি…?

-;মিষ্টার স্বাধীন কি ভাবছেন?কাগজে সই করে দিন।আপনি যত দেড়ি করবেন।আমাদের কাজ ততই দেড়ি হবে।স্বাধীনের চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে।কাঁপা হাতে কাগজে সই করতেই।নার্স কাগজটা নিয়ে চলে গেলো।ডাক্তার তার ওটিতে কাজ শুরু করে দিয়েছেন।

এইদিকে পুতুল পাগলের মতো গভীর জঙ্গলে দাপিয়ে যাচ্ছে।নিজেকে ছাড়ানোর জন্য।কে বা কারা তাঁকে জোর করছে জানে না।তার মাথায় একটা চিন্তা তাকে বাঁচতে হবে।চোখের সামনে সবার হাসি মুখগুলো ভেসে ওঠে।তার,মা,মামা স্বপ্ন পূরণ করা এখনো বাকি।এখান থেকে পালাতে হবে।মামা শিখানো কৌশল কাজে লাগিয়ে দুই হাতের আঙুল ঢুকিয়ে দিলো একজন আক্রমণকারীর চোখে।সে পুতুল কে ছেড়ে নিজের চোখ নিয়ে ব্যাস্ত হলো।সেই সুযোগে পুতুল দুই হাতের সাহায্যে নিজের মুখের কাপড়টা টেনে খুলে ফেলে।আরেকজন তাঁকে ধরতে এলেই ডান পা দিয়ে লাথি বসিয়ে দিলো পুরুষটির গোপন জায়গায়।তাদের দুইজনকে কুপোকাত করেই এক ধলা থু থু মেরে দৌড় দিতে নিলেই,পিছন থেকে একজন চুলের মুঠি ধরে পর পর দুই গালে ঠাসস করে থাপ্পড় মারে।পুতুল থাপ্পর খেয়ে মাথা ঘুরতে থাকে।চোখের সামনে অন্ধকার দেখে।তাকে এই ঘনো গভীর জঙ্গলে টেনে এনেছে এই দুইজন।তাহলে তৃতীয় ব্যাক্তিটি কে?তা দেখার জন্য পুতুল পিটপিট করে চোখ খুলতেই দেখতে পায়।অমানুষ পিতা তারই সামনে দাঁড়িয়ে আছে।কি ভয়ংকর তার হাসি?মনে হচ্ছে রুপকথার কোনো রাক্ষস তাকে মেরে ফেলতে তার দিকে একটু একটু করে এগিয়ে আসছে।পুতুলের আর কিছু মনে নেই।সে ততক্ষণে জ্ঞান হারিয়ে কাঁদা মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়েছে।

৪৮.
গ্রামবাংলায় একটা কথা প্রচলিত আছে।’মা মরলে বাপ হয় তাঁলই”।কথাটা কি সত্যি হয়?
সবার জন্য সত্যি হয় না।কিন্তু পুতুলের মতো মেয়েদের জন্য এই কথাটা সত্যি।আজ পুতুল এর বিয়ে।গায়ে তার লাল বেনারসি।মাথায় লাল ওড়না দিয়ে ঘোমটা বড় করে টানা হয়েছে।মুখে কোনো সাজসজ্জা নেই।মেয়েটি কেমন কাঠ পুতুলের মতো বসে আছে।জ্ঞান ফিরে আসতেই নিজেকে আবিষ্কার করে একটা ভাঙা বাড়িতে।তাঁকে আটকে রাখা হয়েছে।পালানোর চেষ্টা করতেই মোস্তফা সরোয়ার ঘরে ঢুকে।তাঁকে দেখেই পুতুলের মাথাটা গরম হয়ে যায়।হাতের কাছে যা পায় তা ছুড়ে মারে।কিন্তু এতে সরোয়ার এর কিছু হয় না।বরং উচ্চস্বরে হেঁসে উঠে।পুতুল সামনে কিছুটা নিচু হয়ে কিছু বলতেই পুতুল চমকে উঠে।পিতা নামক অমানুষটার গলা দুই হাত দিয়ে ধরতে গেলেই পাশের রুম থেকে দুটো বাচ্চার কান্না শব্দ পেতেই হাত থেমে যায়।পুতুল নিজের জন্য ভয় পায় না।কিন্তু ওদের সাথে খারাপ কিছু হলে পুতুল নিজেকে কোনোদিন মাফ করতে পারবে না।তাই অমানুষ পিতার কথায় নিজেকে ঠেলে দেয় অনিশ্চিত ভবিষ্যতে দিকে।মাথা নাড়িয়ে সায় দেয় বিয়ে নামক নাটককে।

অপারেশন রুমের লাইট অফ হতেই স্বাধীন বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়।ওটি থেকে ডাক্তার বের হতে ছুটে যায়।

– ;আলহামদুলিল্লাহ,অপারেশন সাকসেসফুল।মা এবং সন্তান দুইজনই সুস্থ আছেন।আপনার ওয়াইফ এর এখনো জ্ঞান ফিরে নিই।তাকে একটু পর কেবিনে শিফট করা হবে।নার্স ওনার বাচ্চাকে নিয়ে আসুন।

সাদা তোয়ালে করে একটা শিশুকে কোলে করে নার্স নিয়ে এলো।তাকে কোলে নিতেই স্বাধীন হাত বাড়িয়ে দেয়।নবজাতক শিশুকে কোলে নিয়ে খুশি হয়।পুতুল জন্য তার মনটা পুড়ছে।তাঁকে একটা পলক দেখতে ইচ্ছে করছে।এখন বউ,বাচ্চা ভালো আছে। ডাক্তারের সাথে কথা ব’লে রেনু কাছে আসে।রেনু জ্ঞান ফিরেছে।

-;আপনি একা এখানে।ওদের আনেন নিই।

-;চিন্তা করো না বউ।পুতুল আছে।সে তার দুই ভাইকে ঠিক সামলে নিতে পারবে।তুমি আরাম কর।বাবু তোমার পাশে রইলো।আমি বাড়ি থেকে আসছি।রেনু সায় দিতেই।স্বাধীন বাড়ির দিকে ছুটে।

-;আম্মা,আম্মা আপনি কই?বাহিরে আসেন।আপনার ছেলে আসছে।তাকে পানি দিয়ে যান।কিন্তু ভিতর রুম থেকে পানি নিয়ে পুতুল আসে না।পুরো বাড়ি নীরব।তার দুই ছেলেকে ওহ কোথাও দেখা যাচ্ছে না।স্বাধীন বাড়ির আশেপাশে সব জায়গায় খোঁজে।না তাদের কারো দেখা নেই।স্বাধীন ভয় পেয়ে যায়।পাগলের মতো পুরো গ্রামে খুঁজতে বের হয়।রাস্তায় যার সাথে দেখা হচ্ছে।তাকেই জিজ্ঞেস করে।

-;এই যে ভাই আমার মেয়েকে দেখছেন।ওহ কথা বলতে পারেনা।ওর নাম পুতুল।বয়স এগারো।কিন্তু কেউ বলতে পারলো না।

পুতুল এই গ্রামে নাই।কোথাও নাই।স্বাধীন খুঁজতে খুঁজতে হয়রান।আবার সন্ধ্যায় বাড়িতে পা রাখে।ভাবে এই বুঝি পুতুল বাড়িতে আছে।কিন্তু না।পুতুল নেই।কলপাড়ে সকালের থালাবাসন যেভাবে রাখছিল সেভাবেই পড়ে আছে।

৪৯.

কাজী বিয়ে সম্পূর্ণ কাজ শেষ করে কবুল বলতে ব’লে।ছেলে কবুল বলে দেয়।কিন্তু পুতুল কোনো শব্দ করেনা।মোস্তফা সরোয়ার ভয় দেখায় কিন্তু কাজ হয় না।পুতুল চুপ করে আছে।

-;কি’রে তুই নাটক করিস আমার সাথে?কবুল বল।আর সই কর।পুতুল চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে থাকে।যার মানে কবুল, বলবে না আর সই সে করবে না।মোস্তফা মেয়ের গায়ে হাত তুলতে নিলেই,এরমধ্যেই পুলিশ অফিসার উপরে নিশানা করে গুলি ছুড়ে মারে।কানের সামনে বিকট শব্দ হতে সবাই কানে হাত দিয়ে বসে পড়ে।মোস্তফা চিতকার করে বলল।

-;কে

-;তোর জম?

কুড়াল হাতে স্বাধীন দাঁড়িয়ে আছে।মোস্তফা অবাক হয়।স্বাধীন এখানে আসলো কি করে?এই জায়গার খবর তোও কেউ জানেনা।
মোস্তফা ভালো করে তাকাতেই দেখলো ছোট দুই বাচ্চা স্বাধীনের পিছন থেকে বের হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।তাদের সাথে পুলিশকে দেখা যাচ্ছে।এরা পালালো কি করে?পুতুল দিকে তাকায়।পুতুল মাথা থেকে ওড়না সরিয়ে দাঁড়িয়ে যায়।পুতুলকে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে ধমক লাগা মোস্তফা।

-;কই যাস তুই?বিয়া না হওয়া পর্যন্ত এক পা-ও নড়লে খবর আছে।

-;কি করবেন আপনি?এতটুকু মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছেন।আপনি জানেন না বাল্য বিবাহ অন্যায়।আঠারো বছর আগে কোনো মেয়ে কে বিয়ে দিতে নেই।আঠারো আগেই বিয়ে দিলে এতে কতটা ঝুঁকি আপনি বুঝেন।
আর এই ছেলে তুমি কোন সাহসে এতটুকু মেয়ে কে বিয়ে করতে এসেছো।কনস্টেবল এই ছেলেকে এরেস্ট কর।মিন্টু ভয় পেয়ে সত্যি শিখার করে বলল,

-;আমার কোনো দোষ নাই।মোস্তাফা চাচা তার মেয়ের সাথে আমার বিয়ে দিতে চাইছে।বিয়ে পর যৌতুক হিসেবে বিশ হাজার টাকা আমার হাতে তুলে দিবেন ব’লেছে।

-;কি?যৌতুক দেওয়া এবং নেওয়া আইনগত অপরাধ।আর মেয়েটা এত ছোট তাকে কি করে বিয়ে দিতে চাইছেন?এটা বাল্য বিবাহ।

-;বিয়া দিমু না কি করুম,স্যার।মেয়েরা পরিবারের বোঝা।এজন্য তাদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়া ভালো।কারণ তাদের প্রধানত কাজই হল,স্বামীর খেদমত করা,সন্তান লালন-পালন করা।

-;ভুল।মেয়েরা বোঝা হয় না।আমার আম্মা আমার জন্য বোঝা নয়।আমার মাথার তাজ।আমার ঘরের আলো।তাকে এই বয়সে বিয়ে দিয়ে তার কোমল মনটাকে দূষিত করতে চাই না।হ্যা মেয়েদের একটু বয়স হলেই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়।বিয়ে হলেই তাদের বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে।এরপর তারা তাদের বন্ধু বা পরিবারের সাথে ঠিক মতো দেখা করতে পারে না।তাছাড়া শ্বশুর বাড়িতে সবার সম্মান তাকেই রাখতে হয়।কিন্তু তার সম্মানের কথা কেউ ভাবে না।এভাবে দিনের দিনের পর তারা শোষণের শিকার হয়।তাদের কিছুই বলার থাকে না।আর আমি এসব জেনেশুনে আমার আম্মাকে বিপদগামী করতে চাই না।তারে পড়া লিখা করাতে চাই।মানুষের সেবায় তারে নিয়োজিত করতে চাই।এখন এই বিয়ে অবধি তার সীমাবদ্ধ নয়।তার স্বপ্ন পূরণ এখন বাকি স্যার।আমি আমার আম্মা নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখেছি।যা পূরণ হওয়ার আগেই তাকে বিয়ে নামক সম্পর্কে বাঁধনে বেঁধে দিতে চাই না।তার সপ্ন পূরণ হলেই আমি নিজেই তাকে যোগ্য সুপাত্র হাতে দান করব।স্বাধীন কথায় পুলিশ অফিসার মুগ্ধ হন।নিজের সন্তান নয়।তবুও তার কত চিন্তা।আর এই লোকটা বাবা হয়ে তার কষ্ট বুঝতে পারলোনা।

৫০.
মেয়েরা কখন বিয়ে করবে,কাকে বিয়ে করবে এগুলো বেছে নেওয়ার অধিকার প্রতিটা মেয়ের থাকা উচিত।আইন দ্বারা বাল্য বিবাহ নিষেধ করা হয়েছে তবুও বাল্য বিবাহের প্রকোপ অনেক বেশি দেখা যায় বাল্য বিবাহ কাকে বলে না জানার কারণে।এজন্য আগে মেয়েদের নিজেদের সংগ্রাম করতে হবে এবং সাথে কিছু পদক্ষেপ মেনে চলতে হবে।বাল্য বিবাহ পাশাপাশি যৌতুক প্রথা চলে আসছে যুগ যুগ ধরে।

বিবাহ হলে যৌতুক দিতে হবে এটা তো আমাদের দেশের সংস্কৃতিতে পুরো মিশে গেছে।মেয়ে পক্ষ গাড়ি,বাড়ি,টাকা-পয়সা দিবে ছেলে পক্ষকে।তবে এই যৌতুকের পরিমাণ কম হবে যদি মেয়ের বয়স কম হয়। এজন্য পিতামাতা তাঁর সন্তানকে অল্প বয়সে বিয়ে দিয়ে দেয় যৌতুক থেকে বাঁচতে। তাছাড়া যৌতুক যদি ঠিক মতো প্রদান না করতে পারে।তাহলে মেয়েদের উপর নির্যাতন করা হয়।বাল্য বিবাহ কাকে বলে না জানার কারণে এর ফলে অনেকে মেয়ে মারাও যায়।অল্প বয়সে বিবাহ,যৌতুক কারণে কত মেয়ে মারা যাচ্ছে তার হিসেবে নেই।

কোন ব্যক্তি জেনে শুনে যদি বাল্য বিবাহ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন।সেই ব্যক্তির মোট দুই বছরের জেল হতে পারে।সাথে পঞ্চাশ হাজার টাকাও জরিমানা হতে পারে।তাই যাঁরা বিয়ের অনুষ্ঠানে পরিচালনা করেন তাঁরা আগে নিশ্চিত হয়ে নিবেন বিয়েটা বাল্য বিবাহ কি-না।এই এদের সবাইকে থানায় নিয়ে চলো।

-;দাড়ান স্যার।এতখন যখন থাকতে পেরেছেন।আরেকটু দাঁড়িয়ে শুনে যান মা, ছেলে অপকর্মের কথা।শুনে যান এক মেয়ে এতিম হওয়ার গল্প।

পুতুল আজ চুপ থাকতে পারলো না।মামা দিকে তাকিয়ে মনে পড়ে গেলো পুরনো অতীত।মায়ের কান্না,কষ্টের দিনগুলো কথা।

স্বাধীন বলতে শুরু করে পুরনো অতীত।
রোহিতপুর কন্যা রাজিয়া সাথে প্রেম করে মোস্তফা সরোয়ার।রাজিয়া বাবা মেয়ের প্রেমঘটিত খবর বুঝতে পেরে অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক করেন।রাজিয়া,মোস্তফা প্রেমে এতটা পাগল ছিল।বাপ,ভাইয়ের কথা মাথা রাখে নিই।দুইজন পালিয়ে বিয়ে করে।বিয়ের কয়েকমাস ভালোই চলছিল।আমার বোন যখন এই জানোয়ার সত্যিটা জানতে পারে।জামাই জুয়াখেলে।রাজিয়া মায়ের গহনা শেষ সম্বলটুকু জুয়া হারে।রাজিয়া তবুও ভালোবেসে তাকে ভালো পথে ফিরিয়ে আনতে চেয়েছিল।কিন্তু এই মোস্তফা ভালো হয় নিই।দিন দিন অত্যাচার বেড়ে যায়।শত কষ্টের মাঝে জম্ম হয় পুতুল মেয়েটির।রাজিয়া ভাবে হয়তো সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে সে শুধরে যাবে।কিন্তু সে শুধুরে যায়নি।বরং তাকে মা,ছেলে অবজ্ঞা,অবহেলা করে।রাজিয়া মেয়েকে কোলে পিঠে করে মানুষ করে।ধীরে ধীরে বুঝতে পারে পুতুল আর পাঁচটা বাচ্চার মতো নয়।সে কথা বলতে পারে না।মেয়েকে নিয়ে রাজিয়া কোনোমতো সময় চলে।কিন্তু মা,ছেলে লোভ বেশি ছিলো।
রাজিয়া তখন অন্তসত্বা।বাপের বাড়ি থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা আনতে ব’লে চাপ সৃষ্টি করে। কিন্তু সে রাজি হয় না।বাপ,ভাইয়ের মুখে চুলকানি মেখে চলে আসছিল।সে কোনো মুখে বাপ,ভাই কাছে টাকা চাইতে যাবে।তার সেই মুখ ছিলো না।তাই সে বাপের বাড়ি থেকে টাকা আনতে পারবে না। সাফসাফ জানিয়ে দেয়।কিন্তু মোস্তফা সরোয়ার না শব্দ পচ্ছন্দ হয় নিই।সে আটমাস অন্তসত্বা রাজিয়া ওপর নির্যাতন চালায়।শুধু মাত্র যৌতুকের টাকা জন্য।আমার বোন কেঁদেছে।তাদের একটু দয়া, মায়া হয়নি।বরং মায়ের উস্কানীমূলক মন্তব্য জন্য মোস্তফা আরো আঘাত বেশি করে।এক পর্যায় মুখে তিন তালাক দিয়ে বসে।বোন আমার মানতে পারেনি।জ্ঞান হারিয়ে শ্বশুর বাড়ি ভিটায় পরে থাকে।ছোট পুতুলের বয়স তখন ছয় বছর।মা’কে জড়িয়ে কেঁদেছে।এক সময় যখন তাদের খবর কেউ রাখল না তখন আমার বোন বাপের বাড়ি চলে আসে।এরা যৌতুক জন্য যা কিছু করতে পারে।গর্ভবতী স্ত্রীকে মেরে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। তারা মানুষ হতে পারে না।এক একটা অমানুষ।যৌতুক এদের কাছে সব।আমার বোনকে তালাক দিয়ে দ্বিতীয় বিয়ে করতে যায়।তাদের কেউ ধোকা রেখে ছিল।যা আমি গিয়ে সত্যিটা ব’লে দেই।কনের বাবা আলতাফ হোসেন তাকে পুলিশ দিয়েছিল।খবর নিলেই জানতে পারবেন।মা,ছেলে পাঁচ বছর জেলে খেটেছে।কিন্তু এদের কোনো লজ্জা নেই।এরা আমার বোনের খুনি স্যার।ওদের জন্য আমার রাজিয়াকে হারিয়েছি।আমার একমাত্র আদরের বোন আজ কবর ঘরে।তার পেটের সন্তান নিয়ে মারা গেছে।আমি ভাই হয়ে বাঁচাতে পারিনি।এই মেয়েটি এতিম হয়ে গেছে। পাঁচ বছর মেয়েটা আমার কাছে মানুষ হয়েছে।তার লিখা,পড়া থেকে শুরু করে সব কিছু আমি করে আসছি।তাহলে তার সম্পূর্ণ দায়িত্ব যেখানে তার মা মারা যাওয়ার আগেই আমার হাতে দিয়ে গেছে।সেখানে এরা অধিকার দেখায় কোন সাহসে।জম্ম দিলেই কি পিতা হওয়া যায়?
যায় না স্যার।পুতুল আমার মেয়ে।ওর সবকিছুতে আমার অধিকার বেশি।আমি ওর মা,আমি ওর বাবা।এই পৃথিবীতে আমি ওর সব।সেখানে অন্য কারো হস্তক্ষেপ আমি পচ্ছন্দ করব না।মেয়ে যেহেতু আমার।তারজন্য মাথাটা অবশ্যই আমি ঘামাবো।অন্য কাউকে সেই অধিকার আমি দেয়নি।আজকের পর থেকে যে আমার এবং আমার মেয়ের মাঝে দেয়াল হওয়ার চেষ্টা করবে।তাকে কিন্তু আমি ছেড়ে কথা বলবো না।বারবার অন্যায় করবে।আর বারবার তাকে ছেড়ে দিবো।এটা ভাবা সম্পূর্ণ ভুল।তাই আমি রাজিয়া খু*ন এবং পুতুলকে বাল্যবিবাহ জোর করে দেওয়ার জন্য মামলা করতে চাই।তারা কোন কারণে এমন জগন্য কাজ করছে তা আমার বুঝতে বাকি নেই।

রাজিয়া মারা গেছে শুনে মোস্তফা সরোয়ার মাটিতে ঠাসস করে পড়ে গেলো।নাসিমা অবাক হয়ে মুখে কাপড় দিলেন।পুলিশ সবকিছু শুনেই তাদের জেলে নিলো।এবং যেহেতু বাল্য বিবাহ এখানে হচ্ছিল।তাই বর পক্ষসহ জেলে নিলো।বাল্যবিবাহ শাস্তি অনুযায়ী দুই বছর জেল এবং পঞ্চাশ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে।পুলিশ,স্বাধীনের বয়ান অনুযায়ী মা,ছেলের কোমড়ে দড়ি বেঁধে নিয়ে যায়।পুতুল দৌড়ে মামা বুকে ঝাপিয়ে পড়ে।আজ তার মায়ের কথা মনে পড়ছে।এই লোকটা তার মা’কে শান্তিতে থাকতে দেয়নি।মায়ের জন্য হ্রদয় পুড়ছে।তার মা কতটা কষ্ট নিয়ে মারা গেছে।সেইসব স্মৃতি মনে আসতেই কলিজা কেঁপে ওঠে।আজ বুঝি সব কিছুর সমাপ্ত হলো।

৫১.
মোস্তফা সরোয়ার যখন তাকে হুমকি দিয়ে চলে যায়।তখন দুই ভাইকে কি করে বাঁচাবে সেই চিন্তা বিভোর পুতুল?দুই ঘরে মাঝে ভাঙ্গা জানালা দিয়ে মিলন,সাজুকে চোখ,হাত,পা বাঁধা পড়ে থাকতে দেখে মাটিতে।পুতুল নিজের শরীরের ক্ষত কথা চিন্তা করে না।ভাঙ্গা দরজা আরেকটু ভাঙ্গার জন্য কিছু খুঁজতে থাকে।হাতের কাছে আধ ইটের টুকরো পেয়ে সেটা দিয়ে আঘাত করে।জঙ্গ ধরা জানালা খুলে যেতে পুতুল ওহ ঘর ছেড়ে মিলন,সাজু কাছে চলে আসে।তাদের চোখ, হাত,পায়ে বাঁধন খুলে দিতেই দুই ভাই,বোনকে জড়িয়ে ধরে।পুতুল ওদের শান্ত করে এখান থেকে পালাতে ব’লে।পুতুল যে এখানে আছে এই খবর স্বাধীন অবদ্ধি পৌঁছাতে বলে।মামা পারবে এই বিয়ে নামক নাটক থেকে তাকে বাঁচাতে।পুতুল যতটুকু আন্দাজ করলো।তাতে মনে হলো তাদের এক থেকে আরেক গ্রামে রাখা হয়েছে। গ্রাম দুটো পাশাপাশি। দুই গ্রামের মাঝে বড় সড়ক রাস্তা রয়েছে।মোস্তফা তাদের কে নিজেদের বাড়িতে রাখে নিই।কারণ স্বাধীন তাদের না পেলে সরোয়ার বাড়িতে যাবে।তাই চালাকি করে পাশাপাশি গ্রামে ভাঙ্গা পুরনো বাড়িতে রেখেছে।পুতুল বুদ্ধিতে বিকাল বেলার মধ্যেই মিলন,সাজু ওই গ্রাম ত্যাগ করে।নিজেদের গ্রামে ঢুকেই বাড়ির পথে রওনা হয়।ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গেছে।স্বাধীন সন্ধ্যা বাসায় এসে যখন পুতুলকে না পেয়ে মনটা খারাপ হয়।ঠিক সেই সময় দুই ভাই বাড়িতে পা রাখে।এবং জানায় আজ রাতেই এশারের পর পুতুল বিয়ে।স্বাধীন শুনেই চমকে যায়।এসব কে করেছে মিলন,সাজু জানে না?শুধু জানে পুতুল বড় বিপদে রয়েছে।স্বাধীন পুলিশকে সাথে নিয়ে তখনই রওনা দেয়।পুতুল তার মামা আসা পর্যন্ত বিয়ে নাটকটি চালিয়ে যায়।মামা পুলিশ নিয়ে আসতেই সে দেহে প্রাণ ফিরে পায়।তারপর যা হওয়ার তাই হয়েছে।

চলবে….

চক্ষে আমার তৃষ্ণা পর্ব-১১+১২+১৩

0

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-১১
৩৪.
মামা গাছের কাঁচা তেঁতুল পেরে দিয়েছে।মামী সেই কাঁচা তেঁতুল মাটির চুলায় পুরিয়েছে।সরিষার তেল আর লবণ দিয়ে মাখিয়ে দিতেই পুতুল মুখে পুরে নিচ্ছে।তার টক অনেক পছন্দ।একদম মায়ের মতো।মা যেমন কদবেল খেতে পছন্দ করতো।সে ওহ পচ্ছন্দ করে।রেণুও তেঁতুল খাচ্ছে।সে একটু খেয়ে দাঁত ধরে গেছে।আর এই পিচ্চি মেয়ে টক খেয়েই যাচ্ছে।রেণু পুতুলের হাতে একটু তেঁতুল তুলে দিয়ে বাকিটা ঘরে নিয়ে খেল।এত টক খাওয়া ভালো না ব’লে।এইদিকে পুতুল মামীর কাজে অভিমাণ হলো।হাতের বাকি তেঁতুলটুকু শেষ করে।ঘরে দিকে ছুটে। মামী কাছে আবার গেলো।যদি কোনোরকম বুঝিয়ে আবার একটু পায় সেই আশায়।

মিলন ঘুমিয়ে আছে।আর সাজু বিছানায় খেলছে।রেনু আড়চোখে তাকাতেই দেখলো পুতুল চুপিচুপি ঘরে ঢুকে দাঁড়িয়ে আছে।রেণু দেখতে পেয়ে ওহ চুপ রয়েছে।রেণু ছেলের কাপড় ভাজ করে আলনায় রাখছে।পুতুল তার দেখাদেখি কাপড় ভাজ করে আলনায় রাখে।রেণু তাকে কিছু না বলায় তার উপস্থিতি বুঝাতে কাশি দেওয়ার মতো শব্দ করল।

-;কি রে পুতুল ঠান্ডা লেগেছে বুঝি।তুলসীপাতা রস দিব।তুলসীপাতা রস আদা দিয়ে খেলে একদম ঠান্ডা কেন?ঠান্ডার বাপও চলে যাবে।পুতুল গাল ফুলিয়ে মাথা দুলিয়ে না বলল।

-;ঠান্ডা লাগেনি বেশ।রেনু আবার চুপচাপ নিজের কাজ করতে লাগল।পুতুল,মামীর কাজে বিরক্ত হয়ে কাপড় হাত থেকে রেখে দিল।রেনু একটা হাম দিয়ে আবার শুয়ে পড়তে নিলেই পুতুল পা মেলে গালে হাত দিয়ে বসে রইল।যার মানে সে তাকে ঘুমাতে দিবে না।মামীর আঁচল এক হাত দিয়ে টেনে ধরে অপর হাত দিয়ে ইশারা বলল,তেঁতুল দিতে।সে খাবে।কিন্তু রেণু বুঝতে পেরে ওহ না বুঝার নাটক করতে লাগল।

-;আমার ঘুম পাচ্ছে।তুই সাজু সাথে খেল।আর না হয়,আমার সাথে ঘুমিয়ে থাক। দুপুরের ভাত ঘুমটা দেওয়া প্রয়োজন বুঝলি।এতে আরাম পাওয়া যায়।রেণু পুতুলের পা সরিয়ে সুয়ে পড়তেই।পুতুল,রেনু চোখ দুই হাত দিয়ে টেনে মেলে দিচ্ছে।যার মানে তোমার ঘুম বন্ধ।আগে আমার তেঁতুল খাওয়া।তারপর তোমার ঘুম।রেনু জোর করে চোখ বন্ধ করতে নিলে পারেনা।রেনু হেসে উঠে।আর পুতুলের পেটে কাতুকুতু দিতেই সে ওহ খিলখিল করে হেসে দেয়।

-;পাঁজি মেয়ে।আমার ঘুম নষ্ট করেছো।যাও তোমার সব তেঁতুল আমার।

পুতুল মাথা নাড়িয়ে না বল।যার মানে পুতুলের সব।মামী তেঁতুলের পেয়ালাটা বের করতে দেড়ি।পুতুল খেয়ে শেষ করতে সময় নিলো না।কেমন শব্দ করে খাচ্ছে?তার খাওয়া দেখে রেনু খেতে আবার ইচ্ছে করছিল।কিন্ত ততখনে পেয়ালা দিকে তাকিয়ে দেখে সবটা শেষ করে ফেলেছে।

৩৫.
পুতুলের কপাল ফেটে রক্ত পড়ছে।তার সহপাঠীরা তাঁকে ব্যথা দিয়েছে।আজ একটুও তাড়াতাড়ি আসায় সামনে বসে পড়ে।কিন্তু কে জানতোও তারা তাঁকে আঘাত করে বসবে।পুতুল ব্যথা পেয়ে এক হাত দিয়ে কপাল ধরে কাঁদছে।মামা কাল নতুন একটা জামা কিনে দিয়েছিল।আজ সেই নতুন জামাটায় ফোঁটা ফোঁটা রক্তের দাগ।ইয়াসমিন ম্যাম আজ আসেনি।স্কুলের কাজের জন্য শিক্ষক ট্রেনিং দিতে উপজেলা গেছেন।হেড স্যার কে দপ্তরি মহিলা খবর দিয়ে আনেন।হেড স্যার পুতুলের এই অবস্থা দেখে পকেট থেকে রুমাল বের করেন।রক্ত পড়া বন্ধ করতে কপালে রুমাল চেপে ধরে।তখনো পুতুল কাঁদছে।পিন্সিপাল স্যার সব সময় শান্ত স্বভাবের মানুষ।তিনি বাচ্চাদের সাথে রাগারাগি,চেঁচামেচি পচ্ছন্দ করেন না।কিন্তু পুতুলের এই কাহিনিতে তিনি রেগে যান।সেটা মুখে প্রকাশ করেন না।শান্ত স্বরে বলল,এই ক্লাসের প্রত্যেকটা বাচ্চাদেরকে তার অফিস রুমে যেতে।পুতুলের কপালের রক্ত বন্ধ করতে তুলোতে মেডিসিন লাগিয়ে স্পর্শ করতে ব্যথা কুকিয়ে উঠে।

-;খুব ব্যথা করছে।একটু সয্য কর।আমি ওষুধ লাগিয়ে দিয়েছি।ব্যথা কমে যাবে।পুতুলের মাথায় ব্যান্ডেজ করে চেয়ারে বসিয়ে দিলো।পুতুল চুপচাপ বসে আছে।

-;এবার বলল,তোমার পুতুলের সাথে এটা কেন করছো?আমার কথার উওর দেও।একটা কথা মিথ্যে ব’লে খবর আছে তোমাদের।

-;স্যার আমরা কেউ ইচ্ছে করে ওকে ধাক্কা দেয়নি।

-;ধাক্কা দেও নিই।ওহ এমনই ব্যথা পেয়েছে?

-;কি হলো কথার উত্তর দিচ্ছো না কেন?

স্যার প্রতিদিন এসে আমরা আগে বেঞ্চে বসি।আজ একটু দেড়ি হয়েছে।এসে দেখি এই মেয়েটা আমাদের জায়গায় বসে আছে।তাই আমরা ওকে সরতে বলি।কিন্তু কথা না শুনায় আমার এক বন্ধু ধাক্কা দিয়েছে।আর তখনই,

-;তাই আঘাত করবে।এই শিক্ষা দেওয়া হয় তোমাদের।আর বেঞ্চের সিট কি তোমাদের নামে রেজিষ্ট্রেশন করা?তোমরা বসতে পারবে।অন্য কেউ বসতে পারবেনা।ওর নাম পুতুল।বারবার মেয়েটি মেয়েটি করবে না।আজকে যে কাজটা করেছো তা অন্যায়।দ্বিতীয় বার এমন কাজ করলে স্কুল থেকে বের করে দিবো।যাও যার যার ক্লাসে।আমি অন্য শিক্ষক পাঠাচ্ছি।সবাই চলে যেতেই পুতুল উঠে দাঁড়ায় চলে যাওয়ার জন্য। তখনই মান্নান স্যার ব’লে।তুমি বস।আমি নিয়ে যাব তোমায়।ফোন করে,অফিস রুম থেকে অন্য শিক্ষক পাঠান।আর তিনি নিজে পুতুল কে ক্লাস রুমে নিয়ে যায়।

৩৬.
হেড স্যারকে দেখে সবাই দাঁড়িয়ে সালাম জানায়।কিন্তু স্যার প্রথম বেঞ্চের সব কয়টাকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখে।আর বাকিদের বসতে ব’লে।পুতুলকে সরি বলার পরে ওই পাঁচ জনকে বসতে দেওয়া হয়।
মান্নান স্যার পুতুলকে সামনে বেঞ্চে বসিয়ে দিলেন।এবং যাওয়ার আগেই বলে যান।এখন থেকে সব সময় পুতুল এই বেঞ্চে বসবে।যার আপত্তি আছে সে পিছনে দ্বিতীয়,তৃতীয় বেঞ্চ বসতে পারে।পুতুল মন খারাপ করে ক্লাস করতে থাকে।তার জন্য বাকি পাঁচ জন বকা খেলো।ওদের দিকে একবার মাথা ঘুড়িয়ে তাকাতেই সব কয়টা একসাথে মুখ বাকাঁয়।পুতুল ভয়ে সামনে তাকিয়ে ক্লাস মনযোগ দেয়।

ছুটির ঘন্টা পড়তে সবাই বেরিয়ে যায়।পুতুল সবার আগে বের হয়ে আসে।ওই পাঁচ জন যদি আবার কিছু করে।সেই ভয়টা মনের মধ্যে বাসা বাঁধে।কদম গাছটি নিচে বেশিখন দাঁড়িয়ে থাকতে হয় নিই।মামা চলে আসছে।

পুতুলের মাথায় বেন্ডেজ দেখে স্বাধীন হাটু গেড়ে বসে।

-;আম্মা আপনি ব্যথা পাইলেন কি করে? এসব কেমনে হইলো?

পুতুল ইতস্তত বোধ করছে।কি বলবে বুঝতে পারছে না?তবুও একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে।পুতুল মামাকে শান্ত করতে কিছু বলবে।তার আগেই স্কুলের দপ্তরি আরাফাতের আম্মু,স্কুলে আজকে হও প্রত্যেকটা ঘটনা ব’লে দেন।

স্বাধীনের মুখ কালো হয়ে যায়।পুতুলকে পড়তে দিয়েছে।কিন্তু এমন রোজ রোজ এসব হলে সমস্যা কমবে না।উল্টো বাড়তে থাকবে।
স্বাধীন মুখ কালো করেই বলল,

-;ওরা খুব বেশি ব্যথা দিছে আপনারে।আপনি কি খুব কষ্ট পাইছেন?কষ্ট পাইয়েন না আম্মা।আপনি আজ কষ্ট পাচ্ছেন।একদিন দেখবেন তারাই আপনার সাথে বন্ধুত্ব করে নিবে।আপনার গল্পটা এখন থেকে শুরু হয়ে গেছে।আমার আম্মা।আমার পুতুল আম্মার লড়াই।
এক রাজকন্যা লড়াই।এক মা।এক নারী রাজিয়া।যার জীবন কষ্টে গেছে।দুনিয়ায় ছাড়ছে।কিন্তু সন্তান ছাড়ে নাই।সেই মায়ের সন্তান আপনি।যার চক্ষে তৃষ্ণা।যার হাতে জাদু।তার জাদুর ছোয়া সব একদিন বদলে যাবে।আপনার কষ্টের দিন শেষ হবে একদিন।
মামা কথায় কি মায়া আছে পুতুল জানে না?কিন্তু মামা যখন স্যারদের মতো বড় বড় ভাষণ দেয়।তার শুনতে ভালো লাগে।সে সব কথা মন দিয়ে শুনে।এই কথাগুলো শুনতেই তার মনটা কেমন যেন হয়ে যায়।ভেতর থেকে শব্দ বের হতে চায়।চিতকার করে বলতে মনে চায়।

আমি পারব মামা।তুমি দেখে নিও।আমি পারব।

পুতুলকে নিয়ে বাসায় পৌঁছানোর পথেই ডাক্তার দেখিয়ে আনে স্বাধীন।ক্ষতটা গভীর নয়।তাড়াতাড়ি সেড়ে যাবে।

মোস্তফা সরোয়ার এবং তার মা জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে।পাচঁ বছর পর মুক্তি পেয়ে মা,ছেলে খোলা আকাশের নিচে নিশ্বাস নিচ্ছে।কতদিন হয়ে যায়,তারা জেলে বন্দী ছিল।আলতাফ হোসেন এবং স্বাধীন পুলিশ হাতে তুলে না দিলে বোধহয় ভালোই থাকত।এবার যখন ছাড়া পেয়েছে।ভাই,বোন দু’জনকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার প্ল্যান করে নিয়েছে।রাজিয়াকে আরো কঠিন শাস্তি দেওয়ার কথা ভেবেই শয়তানি হাসি দিলো।তার দ্বিতীয় সন্তান দুনিয়ায় এসে গেছে এতদিনে নিশ্চয়।এই বাহানায় রাজিয়া বাপের বাড়ি পা রাখবে।মোস্তফা মাকে বাসায় পাঠিয়ে,রাজিয়া বাড়িতে পথে হাঁটা ধরে।এখন তার উদ্দেশ্য রাজিয়া ক্ষতি করা।রাজিয়া ক্ষতি মানে স্বাধীনের ওপর পুরনো রাগটা মিটিয়ে নেওয়া।

চলবে….

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-১২
৩৭.
ফজরের আজান হয়ে গেছে।হেমন্ত রানী দূয়ারে কড়া নাড়ছে।শীতের অবস্থান হেমন্তের পর বসন্তের আগে।হেমন্তের ফসল ভরা মাঠ যখন শূন্য ও রিক্ত হয়ে পড়ে,তখনই বােঝা যায়,ঘন কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে শীত আসছে।উত্তরের হিমেল হাওয়ায় ভর করে হাড়ে কাপন লাগিয়ে সে আসে তার নিজস্ব রূপ নিয়ে।প্রকৃতিতে সৃষ্টি হয় এক ভিন্ন সৌন্দর্য।এ সৌন্দর্য পূর্ণতা পায় শীত সকালে।
পুতুল ফজরের আজান শেষ হতেই কাঁথা ছেড়ে মাথায় ওড়না দিয়ে ঘোমটা দিলো।বিছানা ছেড়ে পায়ে স্যান্ডেল পরে কলপাড়ে আসে।ওযু করে নামাজে দাঁড়ানো আগেই মিলন,সাজুকে টেনে উঠালো।ফজরের নামাজের জন্য মামা ওঠে গেছে।তাদের দুইজনকে ডাকতে এই এলো ব’লে।পুতুল এত ডাকছে এদের কোনো নড়চড় নেই।পুতুল বুদ্ধি করে মাটির কলস থেকে ঠান্ডা পানি গ্লাসে উঠিয়ে নিলো।ওদের মুখে ওপর পানি ফেলতেই,

-;ওরে সাজুর বাচ্চারে।তুই আবার হিসু আমার মুখের ওপর করেছিস।শালা তোর কপালে বউ নাই।সর তুই।মিলন কথা শেষ করেই সাজুকে লাথি দিয়ে খাট থেকে ফেলে দিল।সাজু মুখ কালো করে বলল।

-;মিথ্যে কথা।আমি হিসু করিনি।তুই প্রত্যেকবার হিসু করে আমার নাম দিস।তুই এত পঁচা কেন?

-;আমি পঁচা না-কি তুই পঁচা?তুই সব সময় এমন করিস বেয়াদব।মিলন বাকি কথা শেষ করার আগেই পুতুল ঠাসস করে ভাইয়ের পিঠে থাপ্পড় মেরে বসে।রাগী চোখে তাকাতেই দুটোই চুপচাপ উঠে পড়ে।স্বাধীন ডাক দিতেই গরম কাপড় আর মাথায় টুপি পড়িয়ে দুই ভাইয়ের কপালে চুমু একে দেয়।তারা চলে যেতেই পুতুল নামাজ দাঁড়িয়ে পড়ে।মাথায় ওড়না হিজাবের মতো করে পড়তেই মেয়েটিকে শুভ্রময় লাগছে।

৩৮.
সকালে সূর্যমামা যখন উকি দেয় গাছ ও ঘাসের উপর তখন রাতের ঝরা শিশির সােনার মতাে জ্বল জ্বল করতে থাকে।শীতের সকালের এক অসাধারণ আকর্ষণ সরষে ফুলের হলুদ মাঠ।সকালের সূর্যালােক যেন তার নিপুণ হাতে প্রতিটি সরষে গাছকে নবরূপে ঢেলে সাজায়।পশু-পাখি সূর্যের আলাে দেখে আনন্দিত হয়।কৃষকরা গরু ও লাঙল নিয়ে মাঠে যায়।তাদের হাতে শােভা পায় তুঙ্কা।ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সূর্যের মুখ দেখার জন্য বারবার জানালার ফাঁকে উঁকি মারে।কোথাও বা ছেলেমেয়েরা খড় সংগ্রহ করে আগুন জ্বালিয়ে শীত নিবারণ করে,আর হাসি-তামাশায় মেতে উঠে।বৃদ্ধ লােকেরা রোদ পােহায়।কিছু লােক খেজুরের রস বিক্রি করতে বের হয়।অনেকেই ঘরে তৈরি পিঠা ও খেজুরের রস খেতে পছন্দ করে।বেলা বেশি হওয়ার সাথে সাথে শীতের সকালের দৃশ্য ধীরে ধীরে মিলিয়ে যায়।বেলা বেড়ে চলে, কুয়াশা দূরীভূত হয় এবং লােকেরা তাদের নিজ নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।স্বাধীন দুই বাদরকে নিয়ে নামাজ পড়ে বাড়িতে পা রাখতেই ভাপা পিঠার গন্ধ পাওয়া যায়।পুতুল,রেণু মিলে ভাপা পিঠা তৈরি করছে।মাএ তিন চারটা পিঠে হয়েছে।বাকি পিঠাগুলো তৈরি করতে একটু সময় লাগবে।কিন্তু মিলন,সাজুর ধৈয্য নেই।হাঁড়ি থেকে পিঠা নিয়ে তাতে কামড় বসিয়ে দিয়েছে।পিঠা খেতে খেতে বলল।

-;হুম,পিঠা মজা।

পুতুল মিষ্টি হাসি দিলো।মামীকে দিয়ে মামার জন্য তিনটা পিঠা পাঠিয়ে বাকিগুলো শেষ করে নিলো।এগারো বছরের ছোট মেয়েটি আজ সংসারে কাজে পারদর্শী।পড়াশোনা চলছে এখনো।সামনে সমাপনী পরীক্ষা।

রেনু সাত মাসের উঁচু পেট নিয়ে স্বামীর সামনে দাঁড়িয়ে পিঠা এগিয়ে দেয়।স্বাধীন বউকে ধরে আস্তে করে চেয়ারে বসিয়ে দিলো।রেনু’র পা ফুলে গেছে।শরীরে পানি এসেছে।দ্বিতীয়বার মা হচ্ছে রেনু।চেহারা কেমন গুল মুল হয়ে গেছে।বেশি কাজ করতে পারে না।অল্পতেই হাঁপিয়ে উঠে।পুতুল বাসায় যতখন থাকে সব কাজই করে রাখে।সে প্রতিদিন সকালে ফজরের নামাজ পড়েই বাড়ি,ঘর,উঠোন ঝাড়ু দেয়।থালাবাসন ধুয়ে রাখে।সকালে হাড়িতে করে রান্না চড়িয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে,দুই ভাইয়ের পড়াশোনা থেকে সবই খেয়াল রাখে।তার কোনো অভিযোগ নেই।মেয়েটি এতটা ভালো কেন?জানা নেই রেনুর।

-;বউ তোমার কি বেশি খারাপ লাগে?আমার থেকে কিন্তু কিছু লুকিয়ে রাখবা না।

-;উত্তেজিত হচ্ছ কেন?আমি ঠিক আছি।খারাপ লাগলে জানাবো।তুমি আছো তোও।

-;আমি থেকেও তো আমার বোনকে সেই দিন বাঁচাতে পারিনি।কতটা কষ্ট নিয়ে দুনিয়ায় মায়া ত্যাগ করেছে।ভাই হয়ে রক্ষা কোথায় করলাম?

-;ওইসব পুরনো কথা কেন মনে রাখ?ভুলে যা-ও না।

-;সব কথা চাইলে কি ভুলে যাও যায়?আমার সামনেই সন্তান দুটো মা বিহীন কষ্ট পায়।আমি বুঝতে পারি।

রেনু,স্বাধীনের মন ভালো করতে কথা ঘুরিয়ে বলল,

-;পুতুল কিন্তু প্রাইমারি স্কুল শেষ হয়ে আসছে।নতুন স্কুলে ভর্তি করানোর কথা কিছু ভাবলেন।

-;হ্যা,তালেপুর হাইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দিবো।

-;এই যা,শুধু কথা বলছি।আপনার জন্য ভাপা পিঠা এনেছিলাম।সেটা দিতে ভুলে গেছি।খেয়ে বলুন কেমন হয়েছে?আজকের পিঠা পুতুল তৈরি করেছে।আমি শুধু হ্যাল্প করেছি।কিভাবে,কতটুকু দিয়ে করতে হবে।স্বাধীন হালকা গরম পিঠা মুখে দিয়ে বলল।

-;আম্মার হাতের রান্না দারুণ হয়েছে।

৩৯.
পুতুল পড়তে বসেছে।সামনে পরীক্ষা।মামা মান,সম্মানের কথা চিন্তা করেই এত মনোযোগ দিচ্ছে।কোনোমতে মামাকে তার রেজাল্ট নিয়ে নিরাশ করতে চায় না।এত কষ্ট সব কি এমনই এমনই বৃথা যেতে দিবে?কখনোই না।সে দেখিয়ে ছাড়বে।পড়াশোনা তার জন্য বেস্ট অপশন ছিল।আর এখনো আছে।এই পড়াশোনা জন্য তাকে মানুষেরা কম কথা শুনাতে ছাড়ে নিই।সবার সকল অত্যাচার সব মুখ বুঝে সয্য করেছে।প্রতিদিন ক্লাসে মনযোগী হতে হয়েছে।ওই পাঁচজন তাকে শান্তি মতো পড়তে দেয় নিই।কখনো বই,খাতা ছিঁড়ে ফেলছে।কখন তাকে কটুকথা শুনিয়েছে।তার দোষ একটাই ছিল।সে কেন তাদের সাথে শত্রুতা করলো।অথচ পুতুল নিজে থেকে কিছুই করে নিই।তবুও কথা শুনতেই হতো।পাঁচ বছর হয়ে এলো তার স্কুল জীবনের সমাপ্তি হতে চলেছে।আবার নতুন স্কুল,নতুন পরিবেশ হবে।সেখানে কি অপেক্ষা করছে তার জন্য?জানা নেই।তবুও সে পড়বে।তার স্বপ্ন পূরণ সে করবে।সব চিন্তা বাদ দিয়ে পড়ায় মনযোগ দিলো।

রাজিয়া,আরে এই রাজিয়া বাহিরে আসো।দেখে যাও তোমার স্বামী আইছে।

উঠোন থেকে কারো গলার শব্দ পেয়ে পুতুল বই বন্ধ করে দিলো।মাথায় ওড়না দিয়ে ঘর থেকে বের হতেই চমকে উঠে।মোস্তফা সরোয়ার তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।মুখে হাসি,হাতে মিষ্টির প্যাকেট।এই লোকটা এতদিন বাদে এই বাড়িতে কেন এসেছে?পুতুল জানতে চায় না।এই লোকটার মুখ সে কোনোদিন দেখতে চায় নিই।আজ সেই লোকটা তার সামনেই মিথ্যে হাসি নিয়ে দিব্যি দাঁড়িয়ে।রাগে শরীর কাপছে।চোখ দিয়ে পানি আসছে।পুরনো অতীত মনে হতেই।মায়ের মুখটা ভেসে ওঠে। এই লোকটা দায়ী।তার মায়ের খু*নি।এরজন্য আজ তাদের মাঝে মা নেই।তাদের মা,ছেলের জন্য দিন,রাত তার মা কষ্ট পেয়েছে।কেঁদেছে।তার মায়ের কান্না স্বাক্ষী সে নিজে হয়েছে।আজ তাদের জন্য সে এবং তার ভাই এতিম।তার মা’কে কেঁড়ে নিয়ে।আজ আবার কেন এসেছে?চিতকার করে বলতে ইচ্ছে করছে।

কেন এসেছেন?মাঝ নদীতে ফেলে দিয়ে এতদিন পরে দেখতে এসেছেন।বেঁচে আছি না-কি মরে গেছি।আমি আপনার এই মুখ দেখতে চাই না।আপনি একজন প্রতারক।মিথ্যেবাদী।একজন জুলুম কারী।পুতুলের গলা দিয়ে একটা কথা বলতে পারলোনা।আজ খুব করে আপসোস হচ্ছে!আল্লাহ কেন তার গলায় স্বর দিলেন না।গলার আওয়াজ থাকলে কথা তুলে ধরতো বাবা নামের অমানুষটার সামনে।এমন লোককে অপমান করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিতো।কিন্তু পুতুল মুখ দিয়ে চেষ্টা করে ওহ একটা শব্দ বের করতে পারেনি।

পুতুল রাগে দুঃখে মামাকে ডাকতে ক্ষেতে দিকে গেলো।সবুজ ধানের সীমানা পেরিয়ে আলু ক্ষেতের সামনে দাঁড়িয়ে মামাকে হাত দিয়ে ডাকতে লাগল।কিন্তু তার ইশার বা কোনো শব্দ স্বাধীনের কানে যায় নিই।সে নিচু হয়ে ক্ষেতের মাঝে উল্টো দিক হয়ে কাজ করে যাচ্ছে।পুতুল ডাক মামার কানে পৌঁছায় না।পুতুল আলুর ক্ষেতে নেমে গেলো।কাদামাটিতে তার পা,গায়ের থ্রী পিছ নষ্ট হচ্ছে।সেই দিকে মনযোগ নেই।সে মামাকে তার উপস্থিতি বুঝাতে ব্যাস্ত।হাতের বাহুতে ছোট একটি নরম হাত পড়তেই স্বাধীন ঘুরে তাকিয়ে চমকে যায়।পুতুলের চেহারা লাল হয়ে আছে।অতিরিক্ত কান্না ফলে কোনো কিছু বলার মতো অবস্থা নেই।স্বাধীন ভয় পেয়ে গেলো।বাড়িতে কিছু হলো কি?

-;আম্মা কি হয়েছে?আপনি কান্না করছেন কেন?বাড়িতে সব ঠিক আছে তো।রেণু কিছু হয়েছে?আপনি কান্না বন্ধ করুন।আমায় খুলে বলুন।পুতুলের কান্না বন্ধ হয়না।স্বাধীনের টেনশন বেড়ে যায়।ক্ষেতের কাজ ফেলে বাড়ির দিকে দৌড় লাগায়।পুতুল তার পিছনে ছুটে চলে।

চলবে….

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-১৩
৪০.
বারান্দায় বসে পায়ের ওপর পা তুলে আপন মনে পা নাচিয়ে যাচ্ছে মোস্তফা সরোয়ার।রেণু দিকে আড়চোখে তাকিয়ে পুরো শরীরে চোখ বুলিয়ে শয়তানি হাসি দিলো।তার এমন কাজে রেনু অস্তিত্বটা দ্বিগুণ বেড়ে যায়।গায়ের কাপড় দিয়ে নিজেকে ভালোভাবে মুড়িয়ে নিয়ে পুতুল আর স্বামী অপেক্ষা করতে লাগল।লোকটাকে তার সুবিধার লাগছে না।আসার পর থেকেই উল্টা পাল্টা কথা বলে যাচ্ছে।ইচ্ছে করছে সীল নোরা দিয়ে মাথাটা ফাটিয়ে দিতে।অসভ্য কোথাকার!

স্বাধীনের ভয়ে বুক কাপছিল।বাড়িতে পা রেখেই বউকে খোঁজ করে।বউকে ঠিকঠাক দেখে দম ছাড়ে।কিন্তু মোস্তফা সরোয়ার কে চোখের সামনে দেখে মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে।

-;তুই।তুই এখানে আমরা বাড়িতে কোন সাহসে আসছিস?আমার বাড়িতে আসার সাহস পেলি কি করে?বের হ আমার বাড়ি থেকে।তোকে আমি পুলিশ কাছে দিবো।তোর মতো অমানুষ আমার বাড়িতে পা দিয়ে জায়গাটা নষ্ট করে ফেলেছিস।আমার বাড়িতে তোর জায়গায় হবে না।

-;আরে ভাইজান রাগ করেন কেন?আমি থাকতে আসি নাই।চইলা যামু।আমার জিনিস আমাকে বুঝিয়ে দিন।

-;তোর জিনিস মানে?

-;এই যে আপনার সামনে আমার মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আমার বউ,বাচ্চা সবইতো আপনার বাড়িতে।তাদের কে আমার হাতে তুলে দিন।আমি চলে যাই।পুতুল মা বাবার কাছে আসো। মোস্তফা,পুতুলের দিকে হাত বাড়াতে,পুতুল ভয় পেয়ে কয়েক কদম পিছনে চলে যায়।স্বাধীন চিতকার করে উঠে।

-;কে তুই?আর কিসের বউ,বাচ্চা?

-;আরে আপনি ভুইলা গেছেন।কিন্তু আপনার বোন ভালো করেই জানে আমি কে?তারে ডাক দেন।সেই বলব আমি কে?

-;তালাক দেওয়ার পর কিসের বউ?রাজিয়া এখানে নেই।এখন তুই বিদায় হ।

-;রাজিয়া কই গেছে?

-;সেটা তোকে বলার প্রয়োজনবোধ করছি না।

-;ওহ,বুঝতে পারছি।আমি তালাক দিছি দেইখা তোর বোন অন্য আরেকজনের সঙ্গে ভাগছে না-কি।শালী আমারে দিয়া হ….মোস্তফা কথা শুনে স্বাধীন নাক বরাবর ঘুসি মেরে বসে।স্বাধীন করা হঠাৎ আঘাতে মোস্তফা সরোয়ার বসে পড়ে।রেণু,স্বামী রাগ দেখে ভয় পেয়ে মুখে হাত দেয়।পুতুল একটু দূরে মোমের পুতুল মতো দাঁড়িয়ে আছে।মোস্তফা উঠে দাঁড়ানোর আগেই আবার একটা ঘুসি লাগিয়ে শার্টের কলার ধরে বাড়ির উঠোনে বাহিরে ছুড়ে মারে।

-;তোর মতো কুকুর রাস্তায় মানায়।ঘরে শোভা পায় না।আমার বোনকে নিয়ে আরেকটা কথা ব’লে তোর জিহ্বা আমি কে*টে নিবো।

-;আজকে যাচ্ছি।কিন্তু কাল আমি আবার আসব।আমার বউ,বাচ্চা চাই।তাদের না নিয়ে আমি যাবো না।

-;আমি স্বাধীন বেঁচে থাকতে তোর হাতে ওদের কোনোদিন তুলে দেব না।তোর যা করার করে নে।আমি ভয় পাই না।

মোস্তফা সরোয়ার নাকের আর ঠোঁটের রক্ত মুছতে মুছতে চলে যায়।এইদিকে পুতুল ঘরে ঢুকেই কান্না ভেঙে পড়ে।এই লোকটা জন্য তার মা বেঁচে নেই।আজ আবার এসেছে।নিশ্চয় তাকে জোর করে নিয়ে যাবে।পুতুল মনে ভয় ঢুকেছে।সে নিজেকে শান্ত করতে পারছেনা।লোকটা কোনোভাবে তার ভাইয়ের খোঁজ পেলেই নিয়ে যাবে।তার কাছ থেকে ভাইকে কেড়ে নিবে।পুতুল দৌড়ে মামা কাছে যায়।মামা পায়ে হাত দিয়ে বারবার ইশারা করছে।তার ভাইয়ের পরিচয় জেনো ওই লোকটা জানতে না পারে।একবার জানতে পারলেই ওরা নিয়ে যাবে তার কাছ থেকে।পুতুল ইশারা বুঝতে পেরে স্বাধীন শান্ত হতে বলল।কিন্তু মেয়েটা শান্ত হচ্ছে না।ফুফিয়ে কান্না করছে।

৪১.
সাজু আর মিলন বাসায় ছিলো না।খেলাধুলা করে এসে দেখে আপু কান্না করছে।আপুকে কান্না করতে দেখে দৌড়ে দুই ভাই আসে।

-;আব্বু,আপু কান্না করছে কেন?আম্মু,আপু কান্না করে কেন?

-;আপু কি ব্যাথা পেয়েছে?

মিলন,আর সাজুকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেনু।বলল,

-;আপু সামনে পরীক্ষা তাই চিন্তায় কান্না করছে।রেজাল্ট যদি খারাপ হয়।

মিলন,রেণু গাল ধরে বলল,

-;আম্মু,আপুর রেজাল্ট একটুও খারাপ হবেনা তুমি দেখে নিও।আপু ভালো করবে।মিলন, সাজু দুই দিক থেকে বোনকে জড়িয়ে ধরে।

একটু দূর থেকে স্বাধীন,রেণু সবটাই দেখে।রাজিয়া মারা যাওয়ার পর পুতুল তার ভাইকে কোলে পিঠে করে মানুষ করে।কিন্তু মিলন বড় হতেই স্বাধীনকে আব্বু এবং রেনুকে আম্মু ডাকতে শুরু করে।এই পাঁচ বছরের ছেলেটি জানতেই পারেনি।তার মা তাকে দুনিয়ার আলো দেখাতে গিয়ে নিজের মায়া ত্যাগ করেছে।স্বাধীন পরবর্তী বলতে চাইলে পুতুল বলতে নিষেধ করে।এতটুকু বয়সে যখন জানবে তার মা নেই।সেই ধাক্কাটা সামলাতে পারবে না।তাই পুতুল জন্য রেনু,স্বাধীন কখনোই আর কিছুই ব’লে নিই।গ্রামের সবাই এক সময় রাজিয়া ব্যাপারটা জানলেও গুরুত্ব দেয় না।সবাইকে স্বাধীন ব’লেছে।তার দুই ছেলে এক মেয়ে।পুতুল জানে সে তার মায়ের এক মেয়ে।তার কোনো ভাই নেই।তার মায়ের সাথে সাথে তার ভাই মারা গেছে।এটাই এতদিন মেনে এসেছে।সরোয়ার পরিবার কেউ জানুক তার ভাই বেঁচে আছে।এটা সে চায় না।আর চায় না ব’লে নিজের অনুভূতি লুকিয়ে রাখে।মিলন জানে রাজিয়া তার ফুপু ছিল।এটা তার ফুপুর মেয়ে।সে তাদের দুই ভাইয়ের আপু।আর কারো নয়।সাজু যেমন একটু শান্ত সৃষ্ট।তেমনই মিলন চঞ্চল চটপটে ছেলে।

৪২.
মোস্তফা মার খেয়ে বাড়িতে পা রাখতেই নাসিমা দৌড়ে আসে।ছেলে এমন আঘাত কেমতে পেলো জানে না?কিছু বলতে নিলেই মোস্তফা রাগে কটমট করতে থাকে।

পাঁচ বছর পর জেল থেকে বের হয়ে সেলুন থেকে চুল,দাঁড়ি কাটিয়ে গেলাম।আর আমাকে কি-না অপমান করে বের করে দিলো।খুব দেমাগ দেখায়।ওদের দেমাগ আমি ভাইঙ্গা যদি গুড়া না করছি তোও।আমার নাম মোস্তফা সরোয়ার না।মা,ছেলে দেখা শুরু করেন।পুতুলকে আমি বিয়া দিমু।

-;কি কস তুই?স্বাধীন শুনলে খবর আছে।

-;কি করব আমার?আমার বা*ল করতে ও পারব না।আইন মতে আমি ওর বাপ।তাই আমি যা কমু তাই হইবো।মা’ইয়া বোবা।অল্প বয়সী সুন্দরী আছে।চালচুলোহীন ছেলে দেখ।পঙ্গু পোলা হইলেও হইবো।বিয়া ওর এই বছর দিমু।

-;শুনছি।তোর মাইয়া পড়ে।তার কি হইবো?

-;মাইয়া মানুষ এত পইড়া কি করব?দিন শেষে পরে বাড়িতে গিয়া চুলা গুতাইবো।ওর পড়া লাগব না।সব বাদ।বিয়া দিমু।পরে বাড়িতে যাইয়া ঘর সংসার করব।

-;আইচ্ছা তুই শান্ত হ।বিয়া দিমুনি।তয় আমার একটা কথা বলার ছিল।পুতুল আর কোনো ভাই,বোন নাই।এই সুযোগে পুতুল হাত করতে হইবো।আঠারোতে পা দিলেই আমাদের নামে বাড়ির সম্পত্তি লেইখা নিতে হইবো।সম্পত্তি না পাইলে দুইদিন পর রাস্তায় নামতে হইবো।ফকির হইতে চাস।

-;কেন ফকির কেন?পুতুলকে রাজি করাও।যেভাবেই হোক।সম্পত্তি আমাদের হলেই হলো।এরপর ওহ মরলো না বাঁচলো।তাতে আমার কি?

সারাদিন চলে গেলো পুতুল ঘরে ঢুকার পর আর ঘর থেকে বের হয়নি।খাবার মুখে তুলে নিই।রাতে খাবার রেনু বেড়ে দিতেই মিলন,সাজু আপু কাছে খাবার নিয়ে যায়।

-;আপু,আপু উঠ।তোমার জন্য খাবার আনছি।তাড়াতাড়ি খাও।

পুতুল মাথা নাড়িয়ে না করে দিল।সে খাবার খাবে না।কিন্তু মিলন,সাজু পুতুল কথা শুনতে রাজি নয়।দুইজন ঘরে আসার আগেই সাবান দিয়ে হাত ভালো করে ধুয়ে আসছে।ভাত সাথে লাউ শাক মাখিয়ে বোনের মুখে তুলে দিল।যার মানে হা কর।পুতুল দুইবার মাথা নাড়িয়ে না করে।কিন্তু মিলন হাতে খাবার তুলে বলল।

-;ওরে আল্লাহ আমার হাত ব্যাথা হইয়া গেল। তাড়াতাড়ি মুখে নেও।আমার এতটুকু হাত।তোমার জন্য কতক্ষণ ধরে রাখব বাপ।

মিলন কথা শুনে পুতুল চোখ বড় বড় হয়ে গেলো।সাজু পাশে বসে হাসছে।পুতুল বুঝতে পারছে।তাকে না খাইয়ে এ থামবে না।তাই চুপচাপ খাবারটা মুখে পুরে নিলো।

একবার মিলন খাবার খাওয়াচ্ছে।আরেকবার সাজু খাবার মুখে তুলে দিচ্ছে।এভাবেই এক প্লেট ভাত শেষ হয়েছে।রাতের খাবারের সাদা ভাত,লাউ শাক ভাজি,আর মুসুরি ডাল ছিল।
তবুও এই খাবারটাতে শান্তি রয়েছে।এটা কষ্টের টাকায় কেনা।হালাল খাবার অল্পতেই পেট ভরে যায়।আর হারাম টাকায় যতই খাবার খাওয়া হয় না কেন?তবুও অভাব অপূর্ণ থাকে।মনে হয় পেট ভরে নিই।আরও খাবার প্রয়োজন ছিল।

দুই ভাইকে ঘুম পারিয়ে পশ্চিম দিকের জানালা খুলে পুতুল দাঁড়িয়ে রয়।আজ তার দুই চোখে ঘুম নেই।শীত শীত করছে তবুও জানালা খুলে দাড়িয়ে আছে।আকাশে বিশাল আকৃতির চাঁদ উঠেছে।তার চারপাশে তারা জ্বলজ্বল করছে।সেই চাঁদ দিকে তাকিয়ে থাকতেই দেখতে পায়।মায়ের হাসিমুখখানা।পুতুল মায়ের মুখটা মনে করেই হাসে,আবার কাঁদে।সামনে তার জন্য কি অপেক্ষা করছে জানে না?পাঁচ বছর সবকিছু ভালোই চলছিল।তাহলে আবার পাঁচ বছর পর কেন এলো?তার বাবা নামক লোকটা জন্য ঘৃনা ছাড়া কিছুই নেই।সেই লোকটা তার জন্য তার ভাইয়ের জন্য সুবিধাজনক নয়।কে জানে সামনে তার সাথে কি হতে চলেছে?

চলবে…

চক্ষে আমার তৃষ্ণা পর্ব-৮+৯+১০

0

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৮
২৫.
সকালে মোরগদের ডাকে পুতুলের ঘুম ভেঙে যায়।বিছানায় ভাইকে ছোট হাতে ঠিক করে দিয়ে বিছানা ছেড়ে ওঠে।রাণী কাচাঁ মাটির ঘরে পাটের বস্তা ওপর আরাম পেয়ে ঘুম।পুতুল ঘর ছেড়ে বাহিরে বের হতেই দেখে মামী রান্না করছে?মামীকে একটা মিষ্টি হাসি উপহার দিল।

-;পুতুল মা।ভাই কি এখনো উঠেনি?

পুতুল মাথা নাড়িয়ে না বল!যার মানে ভাই এখনো ঘুম।

-;আচ্ছা।তুমি হাত মুখ ধুয়ে আসো।খাবার প্রায় হ’য়ে এলো।পুতুল চলে যেতে নিলেই রেনু আবার তার পায়ের দিকে তাকিয়ে ডাকল।এই পুতুল দাঁড়াও।তোমার পায়ের জুতা কোথায়?

পুতুল রাতের কথা মনে পড়তেই চোখ বড়সড় করে ফেলেছে।রাতের আজব মানুষের জন্যই তো রানী তার ঘরে সারারাত ছিল।মামীর জুতা কথা বলতেই
চুপসে গেলো।এখন কি বলবে সে?মিথ্যে সে বলতে পারবেনা।

-;বুঝেছি রাতে মনে হয় হারিয়ে ফেলেছো।আচ্ছা তুমি যাও।আমি জুতাটা পরে খুঁজে দেব।পুতুল মাথা নাড়িয়ে তাড়াতাড়ি চলে যায়।

পুতুল বালতি ভরা পানি থেকে মগ দিয়ে পানি তুলো।এক জায়গায় বসে দাঁতের মাজন দিয়ে দাঁত পরিষ্কার করতে লাগল।

লিলিপুট একখান জুতা দড়ি দিয়ে গাছে ঝুলিয়ে রেখেছে অর্পণ।ছোট ছোট ইটের টুকরো পুকুরে ফেলতে ফেলতে বলল,

-;অসভ্য মেয়ে মানুষকে তার পাওনা শাস্তি না দিয়ে আমি এই গ্রাম ছাড়ছি না।তোমার কপালে শনি লেগে গেছে লিলিপুট।অর্পণ কি চিজ বুঝতে পারো নিই?এবার বুঝবে তুমি।

সকাল হয়ে গেলো এখনো তিন তিনটা ছেলে উধাও আছে।কোথায় গেছে কোনো খবর নেই?একে তো অন্যায় করেছে।আবার লুকিয়ে রয়েছে।এদের সাহস দেখে আমি হতবাক হচ্ছি।

আর সাফিন তুমি,তাদের খোঁজে বের করতে পারলে না।

-;ভাইয়া পুরো গ্রামে আমাদের লোক লাগিয়েছি।কিন্তু কেউ সঠিকভাবে বলতেই পারেনি।আমার মনে হয়,ওরা গ্রামে নেই। আর গ্রামে থাকলে অবশ্যই ধরা পড়বে।

-;আসসালামু আলাইকুম চেয়ারম্যান সাহেব।বাড়ি ভিতরে আসতে পারি?

-;কে?

-;আমি হারুন মাস্টার।

-;হারুন মাস্টার এত সকালে কেন?ভেতরে আসুন।

-;জি আসতে হলো।?

-;হঠাৎ।

-;আপনার ছেলে জনাব অর্পণ তালুকদার স্কুল ঠিক মতো যায় না।আপনি স্কুলে যেয়ে হাজিরা খাতা দেখলেই বুঝতে পারবেন।অনুপস্থিতিতে ভরা।তার ওপর দশম শ্রেণি টেস্ট পরীক্ষা দিয়েছে নামে মাএ,গনিতে ফেল আসছে।বাকি সাবজেক্টে টেনেটুনে পাশ করছে।আর তার সাথে দুই ভাই গোল আলু পাইছে একই সাবজেক্টে।টেস্ট পরীক্ষা যে এত খারাপ করছে।তারে কি বোর্ড পরীক্ষা বসতে দেওয়া যায়?আপনি বলুন!হারুন মাস্টার তার অভিযোগ বলে চলে যায়।

চেয়ারম্যান সাহেব অসিম তালুকদার রেগে নিজেই ছেলের জন্য গাড়ি নিয়ে বের হলো।সাফিন ভাইয়ের সাথে যাচ্ছে।সে যেভাবে রেগে আছে।কিছু উল্টাপাল্টা না করে বসে।

২৬.
এই মেয়েকে আমাদের স্কুলে ভর্তি করানো যাবেনা।

-;কেন?কেন করানো যাবেনা?কি সমস্যা?

-;দেখো স্বাধীন,তুমি শান্ত হও।এভাবে শুধু শুধু রেগে যাচ্ছ।মেয়েটি সমাজ থেকে বিতারিত।তাঁকে এবং তার মা কে এক ঘর করা হয়েছিল।তা তুমি ভুলে গেলেও গ্রামের মানুষ কিন্তু ভুলে নিই।নেহাৎ ওর মায়ের মৃত্যুতে গ্রামের কিছু মহিলা শেষ অর্ন্তিম কাজে সাহায্য করেছে।এবং জানাজায় উপস্থিত হয়ে ছিলো।আর সেটা কিন্তু গ্রামের মেয়ে এক সময় ছিল ব’লে।আমি ওকে ভর্তি নিলে আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি পড়বে।এই স্কুলের শিক্ষকতায় আমার সংসার চলে।তোমার জন্য নিজের পরিবারকে না খাইয়ে রাখতে পারব না।আর তাছাড়া মেয়েটা বাক প্রতিবন্ধী।সে কথা বলতে পারেন না।কানে শুনে না।এমন স্টুডেন্ট এখানে কোনোভাবেই এলাউ নয়।ওর জন্য বাকি স্টুডেন্ট সমস্যা হবে।

-;পুতুল হতে পারে আর দশটা বাচ্চাদের মতো নয়।কিন্তু তাই ব’লে এতটা অবজ্ঞা করা কি ঠিক সবুজ?আমি হতবাক হয়ে যাই।তুমি,আমি এক সময় একই সাথে পড়াশোনা করেছি।তোমার পরীক্ষা ফ্রী দেওয়ার মতো পরিস্থিতি ছিল না।অথচ সেই আমি তোমার সেমিস্টারে পরীক্ষা টাকা জোগার করে দিয়েছিলাম।ভাগ্যিস তোমার মতো এতটা নিমুক হারাম হতে পারিনি।দ্বিতীয় বার দেখে নিলাম।তুমি,রাফিদ এদের কে আমি আমার কলিজা কেটে খাওয়ালে মনে হয় কম হতো।
আজ চলে যাচ্ছি।আর যাওয়ার আগেই একটা কথা ব’লে যাই।আজ যাকে তুমি এবং তোমরা সবাই অবহেলা করলে,একদিন তারজন্যই আপসোস করবে।আমার কথা মিলিয়ে নিও।আমি স্বাধীন আজ কথা দিয়ে যাচ্ছি।পুতুল কথা বলতে না পারার জন্য ওর পড়াশোনা পিছিয়ে থাকবে না।ওকে আমি নিজের হাতে গৌরব।এমনভাবে মানুষ করব।সবাই একদিন তাকে আপন করে নিতে বাধ্য হবে।আমি দেখিয়ে দিবো।পুতুল নিজের লড়াই নিজে লড়তে পারে।আমার বোন নেই ব’লে।মামা হয়ে তাকে দূর ছাই করব।আমি এমন পাষাণ নই।আমি আমার শেরা ঠাঁই দিয়ে যাব।স্বাধীন পুতুলের হাতদুটো ধরে বলল।

-;আম্মা,আপনি পারবেন না।আপনার এই ছেলের জন্য দেখিয়ে দিতে।আপনার এই মামার মুখ রাখতে পারবেন না?

এতখন দুইজনের কথাই পুতুল সবটা শুনে মাথা নিচু করে কাঁদছিল।আজ তার জন্য মামাকে কতগুলো কথা শুনতে হচ্ছে।সে কি পারবে মামার বলা প্রত্যেকটা কথার মান রাখতে?এই ছোট্ট জীবনে তাঁকে যে বেঁচে থাকতে হলে লড়াই করতে হবে।সে যদি পিছুপা করে তাহলে কি হবে?

পুতুলের নীরবতা দেখে স্বাধীন হাঁটু ভেঙে অফিস রুমে সব শিক্ষকের সামনে বসে পড়ে।দুই হাতে পুতুলের চোখের পানি মুছে বলল,

-;আপনি পিছুপা হলেন তোও হেরে গেলেন আম্মা।এই লড়াই আপনার।যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই যে ভয় পেয়ে ময়দান ছাড়ে।সে কখনো বিজয়ী হয় না।আপনারা পিছিয়ে যাওয়া মানে হেরে যাওয়া।আপনি হেরে গেছেন তোও মরে গেছেন।আপনি কি ভীতু আম্মা?আপনি কি ভয় পাচ্ছেন?আপনি কি আমার কথার মূল্য বুঝতে পারছেন না?আমি জানি এই ছোট্ট মাথায় আপনার অনেক চাপ পড়ছে।কিন্তু আমি যে নিরুপায় আম্মা।আজ আমি আছি।কাল আমি না ওহ থাকতে পারি। আমরা এই পৃথিবীতে এসেছি স্বল্প সময়ের জন্য।আমাদের একদিন আসল ঠিকানা ফিরে যেতে হবে।আমি না থাকলে আপনি নিজে নিজেকে নিরাপত্ত রাখতে পারবেন।আমি তার ব্যবস্থা করে যাব।আমি জানি আম্মা। এই কঠিন কঠিন কথাগুলো আপনার মস্তিষ্কে চাপ নিতে এখন পারছে না।কিন্তু একদিন ঠিকই এই কঠিন কথাগুলো মানে আপনি বুঝতে পারবেন।

২৭.
স্বাধীন পুতুলকে কোলে নিয়ে গ্রামের স্কুল ছেড়ে চলে এসেছে সেই কখন।কিন্তু তার রেশ রয়ে গেছে স্কুল অফিস রুমে এখনো।স্বাধীন কথাগুলো ওই অফিস রুমের কিছু শিক্ষকের মন ছুয়ে গেছে।কিন্তু হেড স্যার যেখানে তার বন্ধু হয়ে ভর্তি করলো না।তখন তারা চুপচাপ সবটা নিরবে দেখে গেলো।তাদের খারাপ লাগছে এই ছোট মেয়েটি জন্য।সত্যি কি মেয়েটি পড়তে পারবে না?ছোট পুতুল কথা বলতে পারেন না,এটা কি তার অপরাধ?
পুতুল বাসায় এসে ভাইকে বিছানায় পা মেলে দুই হাতে কোলে নিয়ে কাঁদছে।সে কি করবে বুঝতে পারছে না।আজ মায়ের কথা বড্ড বেশি মনে পড়ছে।মা তাকে একা ফেলে কেন চলে গেলো?মা তার পাশে থাকলে সে সাহস পেতো।মায়ের হাসিতে দুনিয়ার সবচেয়ে কঠিন কাজ ওহ পানির মতো সহজ লাগত।কিন্তু মা নেই।তার বাবা থেকেও নেই।এই কষ্টগুলো একটু একটু করে বুকের বাম পাশে জ্বালা ধরিয়ে দিচ্ছে।

জেলে বসে মা,ছেলে সাজা কাটছে।তাদের মুক্তি কবে হবে জানা নেই?এমন সময় পুলিশ দারোগা এসে জানালো বড় স্যার নাসিমা বেগম কে ডাকছে।তিনি বের হয়ে অফিস রুমের সামনে আসতেই নিজের চাচা শ্বশুর চানঁ মিয়া মশাইকে দেখে আমতা আমতা করল।

-;চাচা আপনি এখানে?

-;হুম দেখতে এলাম তোমায়।কতটা ভালো আছো জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনবোধ করছি না।নিজ চোখে দেখা যাচ্ছে।লজ্জা নেই তোমার।একটা নারী হয়ে এত ছলনা কেমন কর?নারী হয়ে এক নারী ঘর ভাঙ্গলে।আবার আরেক নারীকে মিথ্যে আশা দিয়ে বিয়ের আসর পযন্ত টেনে আনলে।আমাদের সরোয়ার বাড়িটা তুমি কলঙ্ক করে দিলে।তোমাকে আমার ভাই শখ করে তার ছেলের জন্য বউ করেছিল।কিন্তু তুমি বস্তি থেকে উঠে এসে বস্তি রয়ে গেলে।তোমার আবভাব আমার ভাতিজা বুঝতে পেরেছিল।তাই তাড়াতাড়ি বিদায় নিয়েছে।আর যাওয়ার আগেই তার গুনধর ছেলে তোমার জন্য অমানুষ হবে সেটা জানতোও।তাই তার সন্তানের ঘরে বংশের প্রথম সন্তান দুনিয়ায় যে আসুক।মেয়ে কিংবা ছেলে।তার নামে এই সম্পদ।যে বাড়িতে এতদিন ছিলে সেই সাত
শতাংশ জমি,তোমার নাতি পুতুলের নামেই হয়ে গেছে।তার বিয়ে আঠারো বয়সে কোনো যোগ্য পুরুষ সাথে হলে,সেই সম্পত্তির অংশীদার তার স্বামী হবে।মেয়েটি কথা বলতে পারেনা ব’লে কম অত্যাচার করো নিই।তুমি মেয়ে হয়ে মেয়েদের কষ্টে কষ্ট পাও না।ধিক্কার তোমায়।তুমি এবং তোমার ছেলে জেলে পঁচে মর।আর যদি কোনোদিন ছাড়া পাও।সেইদিন সরোয়ার বাড়িতে পা রাখবে না।আমি এটা বলতেই নাতির ঘরে ছেলে অন্তরকে নিয়ে এসেছি।তাঁকে নিয়ে পুতুল সাথে দেখা করতে যাচ্ছি।দেশ ছাড়ার আগেই অসহায় মেয়েটিকে একটিবার না দেখলে শান্তি পাবো না।আমরা পুরো পরিবার বিদেশে চলে যাচ্ছি।

-;অন্তর চলো।তোমাকে একজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবো।যার নাম পুতুল।

-;পু..তু.ল।

চলবে…

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৯
২৮.
ছোট পুতুলকে নিয়ে চিন্তা করছে স্বাধীন। কাল একবার নদীর ওপারের স্কুল যাবে কথা বলতে।সেখানে দেখি কি ব’লে?দুপুরের খাবার খেয়ে স্বাধীন আবার নিজের কাজে চলে যায়।স্বাধীন চলে যেতেই একটা গাড়ি স্বাধীনদের বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে রাখল।বাকিটা পথ হেঁটে আসতে হবে।কারণ রাস্তা সরু আর চিকন।এখানে গাড়ি নেওয়া সম্ভব নয়।গাড়ি থেকে নেমেই হাঁটতে হাঁটতে উঠোনে দাঁড়ায়।রেণু নিজের ছেলে কে ঘুম পাড়িয়ে, রাজিয়া ছেলেকে কোলে নিয়ে বোতলের দুধ খাওয়াচ্ছে।এমন সময় অচেনা দুইজনকে ভর দুপুর বেলা দেখে পুতুলকে দেখতে পাঠালো।কে এসেছে পুতুল জানেনা?তবুও মামীর কথায় ঘর ছেড়ে বাহির আসে।তাঁকে দেখে চানঁমিয়া জড়িয়ে ধরে আদর করতে নিলে সে ভয় পেয়ে পিছনে চলে যায়।পুতুল কে পিছনে চলে যেতে দেখে তিনি ডাকেন।

-;আমায় তুমি ভয় পেলে পুতুল।ভয় পেয়ে ও না। আমি তোমার কোনো ক্ষতি করতে আসেনি।আমি চানঁমিয়া তোমার দাদুর বাড়ির লোক।সম্পর্কে তোমার বড় আব্বু হই।আর এই যে আমার পাশে যাকে দেখছো।সে তোমার বড় ভাই অন্তর।অন্তর এই সেই পুতুল যার কথা তোমাকে আমি একটু আগে ব’লেছিলাম।অন্তর হাই দিলো।কিন্তু পুতুল কোনো কিছু না ব’লে চুপটি করে রইল।রেনু ততক্ষণে পুতুলের ভাইকে কোলে নিয়ে বাহিরে এসে অচেনা দুই জনকে দেখে বলল,

-;আপনারা কারা?কাকে চাই?

-;জি,আমরা পুতুলের দাদুর বাড়ির লোক।পুতুলের মা’কে একটু ডেকে দিবেন।কিছু জরুরি কথা ব’লে চলে যাব।রেনু কি বলবে বুঝতে পারছে না?তবুও মুখ ফুটে বলল।

-;রাজিয়া এখানে থাকেনা।

-;রাজিয়া থাকেনা মানে।সে কোথায় গেছে?সেখানের ঠিকানা দিন।আমরা কথা বলব।

-;সেখানে মৃত্যুর আগে কেউ যেতে পারে না।রাজিয়া এই পৃথিবীতে নেই।সে মারা গেছে একমাসের বেশি হ’য়ে গেছে।

চানঁমিয়া চমকে দিলো।তিনি পিছনে থাকাতেই রাজিয়া ভাই স্বাধীনকে দেখতে পান।

-;মারা..গেছে।কিন্তু কিভাবে?এটা কিভাবে হলো?

-;যে স্বামীকে ভালোবেসে বিয়ে করে ছিল।তার সেই স্বামী তাকে মেরে ঘর ছাড়া করে।আটমাসের গর্ভবতী রাজিয়া চোখের পানি নিয়ে ভাইয়ের কাছে আসে।ভন্ড,প্রতারক স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে খবর।এবং তার কয়েকদিন পরই কলপাড়ে পা পিছলে পড়ে আহত হয়।অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণের জন্য সে এবং তার সন্তান দু’জনই মারা গেছে।আমি পারিনি তাকে এবং তার সন্তানকে বাঁচাতে।রেনু আর পুতুল দুইজনই চমকে স্বাধীন দিকে তাকিয়ে রয়।ওদের চোখে,মুখে একটাই প্রশ্ন।স্বাধীন মিথ্যে বলল কেন?

স্বাধীন কথায় তিনি মর্মাহত হন।চোখে তার হতাশা ছাপ।ছোট নিশ্বাস ফেলে বলল।

-;রাজিয়া স্বামী রাজিয়া মৃত্যু খবরটা জানে?

-;না।আর জানাতে চাই না।কারণ বেঁচে থাকতে যার খবর তারা রাখার প্রয়োজনবোধ করে নিই।আর সে যেখানে মারা গেছে।তাতে তাদের কিছু যায় আসবেনা।বরং ঝামেলা থেকে মুক্তি পেয়ে গেছে।আমি চাই না আমার বোনের ব্যাপারে কেউ আর কিছু জানুক।পুতুল মা তাদের জন্য পানি নিয়ে এসো।অনেক দূর থেকে এসেছেন।তারা নিশ্চয় খুব ক্লান্ত।পুতুল মাথা নাড়িয়ে ঘরে পানি আনতে গেলো।

-;আশা করি আপনাদের আর কিছু বলার নেই।গরিবের বাড়িতে দুপুরে এসেছেন।না খেয়ে যাবেনা।রেনু তাদের খেতে দেও।

-;দাঁড়াও স্বাধীন।আমার কথা এখনো শেষ হয়নি।চানঁ মিয়া কিছু কাগজ বের করে দিলেন।স্বাধীন কাগজটা না নিয়ে চুপচাপ গম্ভীর মুখে তাকিয়ে রইলো।

-;এখানে সরোয়ার বংশের কন্যা পুতুলের নামে সম্পত্তি ভাগ লিখা আছে।পুতুলের দাদা
তার বংশের কথা চিন্তা করেই দলিল লিখিত করে গেছেন।সেখানে ছেলে কিংবা মেয়ে। প্রথম যে সন্তান আসবে।তার নামেই ই সম্পত্তি হয়েছে।যেহেতু প্রথম সন্তান মেয়ে এবং পরবর্তী আর কোনো সন্তান নেই।তাই এই হক পুতুলের।পুতুলের আঠারো পূর্ণ হলেই সে সম্পত্তির মালিক হবে।তার বিয়ে যদি কোনো ছেলের সাথে হয়।তাহলে সে ওহ তার অংশীদার হবে।

২৯.
আপনি মিথ্যে কেন ব’লেন?রাজিয়া নেই ঠিক আছে।কিন্তু তার ছেলে মারা গেছে?
স্বাধীন,রেণুর দিকে তাকিয়ে বলল,

-;আমি যা করেছি ঠিক করেছি।কারণ সরোয়ার বংশধর হিসেবে তাদের ছেলে আগমনে মোস্তফা এবং তার মা এই বাড়িতে কোনভাবে পা রাখুক।তা আমি চাই না।মিলন পুতুলের ভাই।মিলন কে নিতে এই বাড়িতে ছুটে অবশ্যই আসবে।কিন্তু পুতুলের জন্য তাদের মন পুড়বে না।আর আমার বোনের শেষ চিহ্ন তাদের হাতে তুলে দিতে পারবো না।তাই আমি মিথ্যে বলেছি।তারা লোভের জন্য আসবে।পুতুলের পর মিলনই তাদের শেষ ভরসা হবে সম্পত্তের ভাগের অংশের জন্য।একটা মিথ্যে যদি সবকিছুর সমাধান হয়ে যায়।তাহলে সে মিথ্যেই ভালো।

-;আপনি ভুলে যাচ্ছেন।সত্যিটা মিথ্যে ব’লে ঢেকে রাখা যায় না।একদিন না একদিন সত্যিটা প্রকাশ পেয়ে যায়।

-;পরে যদি সত্যিটা প্রকাশ পায়।ততক্ষণে আমি পুতুলের বিয়ে দিয়ে দিবো।আর আমি তখন সত্যিটা সবাইকে জানিয়ে দিবো।তুমি ভয় পাও কেন?আমি থাকতে তোমাদের সাথে খারাপ কিছু হতে দিবোনা।ভরসা রাখ।

-;ভরসা,বিশ্বাস করি ব’লেই চুপ ছিলাম। আপনি পাশে থাকলে আমাদের কিসের ভয়?আপনি আছেন তো আমি আছি।আপনি নেই তো আমরা নেই।

-;তাহলে আজকের কথাগুলো এখানেই সমাপ্ত কর।পুতুলের বিয়ে দিলে তখণ ভাবা যাবে।শুনো,কালকে আমি পুতুল কে সাথে নিয়ে নদীর ওপারে স্কুলের শিক্ষকের কাছে যাবো।আমি চাই পুতুল পড়ুক।অনেক অনেক পড়ুক।পড়াশোনা করে নিজের ভবিষ্যত নিজে গড়ুক।মানুষের মতো মানুষ হোক।শুধু পুতুল নয় রেনু।আমাদের দুই ছেলে সাজু,মিলন পড়বে।ওদের আমি পড়াবো।যে স্বপ্ন পূরণ আমার হয়নি।সেটা ওরা অর্জন করুক।আমি একদিন গৌরব করে বলতে পারব।আমি আমার তিন সন্তানকে পড়াশোনা করিয়েছি।আবার মানুষের মতো মানুষ বানিয়েছি।তাদের চোখে ধনী,গরিব,বড় ছোট ব’লে কিছু না থাকুক।তাদের চোখে সবাই সমান মানুষ মানুষের জন্য একটু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিক।বিশ্বাস, ভরসা,আস্থায় বাঁচব।

৩০.

অসিম তালুকদার নদীর এপারে রোহিতপুর গ্রামের পথে রওনা হয়েছেন।
এইদিকে রাত হতেই জিহান,রিহানকে নিয়ে সারাদিন না খাওয়া অর্পণ।লিলিপুটকে শিক্ষা দিতেই আজ চুপচাপ পুকুর পাড়ে বসে ছিল।কোনো কিছুতেই তার মনোযোগ ছিলো না।রাগে,কষ্টে কারো বাড়িতে যেতে ভুলে গেল।
কারো কোনো ক্ষতি করেনি।তাদের সারাদিন ধরে না খাওয়া খিদে পেট মোচড় মারছে।পেটের মধ্যে কেমন বুদবুদ শব্দ করছে।রাতের আঁধার নেমে আসে চারদিক থেকে শিয়াল ডাক।কেমন ভয়ংকর অবস্থা? শেয়ালের হাঁক জন্য ঘর ছেড়ে রাতে বের হওয়া মুশকিল।কেউ যদি বাড়ির উঠোনে পাঁচ মিনিটের বেশি দাঁড়িয়ে থাকতে চায়।তাহলে শিয়ালের আক্রমণ থেকে বাঁচা সম্ভব নয়।সে আঘাত করে বসে।ইদানীং শিয়ালের উৎপাত বেশি বেড়ে গেছে।পুতুল তার ভাইকে জড়িয়ে ধরে ঘরে বসে আছে।মামীর ডাক দিয়ে গেছে।তাদের ঘরে শোয়ার জন্য। কিন্তু পুতুল আসেনি।এই ঘরে তার মা ছিলো।মায়ের গন্ধ এখন এই ঘর থেকে পায়।সে এই ঘর ছেড়ে যেতে চায় না।আর ভাইকে ওহ দিতে চায় না।
তাই রেনু চলে গেছে।স্বাধীনের দুপুরে শরীরটা একটু বেশি খারাপ লাগায় তাড়াতাড়ি কাজ থেকে চলে আসে।এখন রাতে অসুস্তা বেড়েছে।স্বাধীন শরীরটা ভালো না থাকায় একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে।এই দিকে পুতুলের মধ্যে ভয়ে ঢুকে গেছে।তার হাত,পা কাপছে।কি করবে বুঝতে পারছে না?তবুও জিদ ধরেছে।মামাদের রুমে যাবে না।কারণ তাদের খাটটা বেশি একটা বড় নয়।তিন জনের শোয়ার খাটে সে এবং ভাই গেলে মামাকে নিচে মাটিতে শুতে হবে।এখন ঠান্ডা পড়ে।এই সময় মাটিতে ঘুমালে আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে।তাই সেই রুমে না গিয়ে নিজের রুমে চুপচাপ শুয়ে রইলো।

পুতুলের চোখ বুঝে নিতেই শিয়ালের ডাক ভেসে আসে তাদের উঠোন থেকে।উঠোনের পূর্ব দিকে বাথরুমে চাক বসানো।সেইদিকে চারদিকে কলাগাছে ঘেরা।সে জায়গায় থেকে কেমন ভয়ংকরভাবে ডাকছে।মনে হচ্ছে শব্দগুলো আরো সামনে এগিয়ে আসছে।ভাইকে দুই হাতে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ফুফিয়ে কেঁদে ওঠে।মনে মনে মায়ের শেখানো দোয়া পড়তে থাকে।
».
আল্লা-হুম্মা ইন্নী আসআলুকাল ‘আফওয়া ওয়াল- ‘আ-ফিয়াতা ফিদ্দুনইয়া ওয়াল আ-খিরাতি।আল্লা-হুম্মা ইন্নী আসআলুকাল ‘আফওয়া ওয়াল-‘আ-ফিয়াতা ফী দ্বীনী ওয়াদুনইয়াইয়া,ওয়া আহ্‌লী ওয়া মা-লী, আল্লা-হুম্মাসতুর ‘আওরা-তী ওয়া আ-মিন রাও‘আ-তি। আল্লা-হুম্মাহফাযনী মিম্বাইনি ইয়াদাইয়্যা ওয়া মিন খালফী ওয়া ‘আন ইয়ামীনী ওয়া শিমা-লী ওয়া মিন ফাওকী। ওয়া আ‘ঊযু বি‘আযামাতিকা আন উগতা-লা মিন তাহ্‌তী

● “হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট দুনিয়া ও আখেরাতে ক্ষমা ও নিরাপত্তা প্রার্থনা করছি। হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট ক্ষমা এবং নিরাপত্তা চাচ্ছি আমার দ্বীন, দুনিয়া,পরিবার ও অর্থ-সম্পদের।হে আল্লাহ! আপনি আমার গোপন ত্রুটিসমূহ ঢেকে রাখুন।আমার উদ্বিগ্নতাকে রূপান্তরিত করুন নিরাপত্তায়।হে আল্লাহ! আপনি আমাকে হেফাযত করুন আমার সামনের দিক থেকে, আমার পিছনের দিক থেকে,আমার ডান দিক থেকে,আমার বাম দিক থেকে এবং আমার উপরের দিক থেকে।আর আপনার মহত্ত্বের অসিলায় আশ্রয় চাই আমার নীচ থেকে হঠাৎ আক্রান্ত হওয়া থেকে”।

শিয়ালের একটা শব্দ নয় বেশ কয়েকটা শব্দ আসছে।শিয়াল কতগুলো বাহিরে জানা নেই।একটু পর দামদুম শব্দ হচ্ছে।মনে হয় ঘরে চাল ভেঙে ঘরে ঢুকে যাবে।পুতুল আর নিতে পারলোনা।চিতকার করতে চাইলো পারছে না।ভয়ে কপাল বেয়ে ঘাম ছুটে আসে।এরমধ্যেই মিলনের ঘুম ভেঙে যায়।ছোট দুধের শিশুর উচ্চস্বরে কান্না করছে।সেটা বাহিরে পশুর ভয়ে না-কি বোনের কষ্ট বুঝতে পেরে কান্না করছে জানা নেই।কিন্তু পুতুল আর ঠিক নেই।হাত থেকে ভাই ছিটকে খাটের বিছানায় পড়ে।আর পুতুল তার পাশে বেহুশ হয়ে যায়।

চলবে….

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-১০
৩১.
জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পরে নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করে।পাশে হাত দিতেই ভাইকে না পেয়ে পুতুল অস্থির হয়ে যায়।কান্না করে ওঠে।রেনু পুতুল কে জড়িয়ে ধরে শান্ত করতে করতে বলল,

-;তোমার ভাই ঠিক আছে।তার কিছুই হয়নি।এই যে দেখ তোমার মামার কোলে শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে।

পুতুল তার ভাইকে কোলে নিতে হাত বাড়িয়ে দেয়।স্বাধীন পুতুলের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে মিলনকে কোলে তুলে দিতেই ভাইকে জড়িয়ে ধরে আদর করে।কপালে হালকা ব্যথা পেয়েছে।কপালটা কেমন লাল হয়ে গেছে।তার ভাই কি খুব কষ্ট পেয়েছে?পুতুল অসহায় চোখে ভাইকে দেখে যায়।

রেণু,স্বাধীন এত বুঝাচ্ছে কিন্তু কাজ হচ্ছে না।পুতুল নিজেকে দায়ী করতে লাগল।
স্বাধীন পুতুলের মাথায় হাত রেখে বলল,

কাল রাতে শিয়াল ডাক শুনতে পেয়েছো তাই না।কিন্তু শিয়ালের মতো দেখতে হলেও শিয়াল ছিল না।ওই জঙ্গিলী পশুগুলো,বেলালদের বাড়ির গোয়াল ঘরের আস্ত গরু খেয়ে ফেলেছে।রাতে গোয়াল ঘরে ঢুকে এমন বিভৎস কর্মকান্ড করেছে।কিন্তু শিয়াল ছিল না।ধারণা করা হচ্ছে ওটা বাঘথাবা।এমন নামই শুনতে পেয়েছি।স্বাধীন পুতুলের মাথায় হাত রেখে বলল,

-;আজ থেকেই তোমরা দু’জন আমাদের সাথে ঘুমাবে।দুই খাট একসাথে বিছানো হবে।এটা নিয়ে আর না বলবে না।আমি তাহলে খুব রাগ করব।খাবার খেয়ে তৈরি হও।আমরা বের হব।

পুতুল মাথা নাড়িয়ে আচ্ছা বল।

৩২.
আম পাতা জোড়া জোড়া
মারবো চাবুক চড়বো ঘোড়া
ওরে বুবু সরে দাড়া
আসছে আমার পাগলা ঘোড়া
পাগলা ঘোড়া খেপেছে
চাবুক ছুড়ে মেরেছে।
উফফ বড্ড লেগেছে।

ইয়াসমিন ম্যাম ছোট বাচ্চাদের থেকে ছড়া শুনছেন।পুতুল স্কুল প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে সবটাই শুনতে পায়।তার স্কুলটা বেশ পচ্ছন্দ হয়েছে। কিন্তু এই স্কুল কি তাঁকে রাখবে।ম্যাম কি ওদের মতো তার সাথে কথা বলবে?তাঁকে নিয়ে যদি মজা করে।তাই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে।এরমধ্যেই স্বাধীন তাকে ডেকে নিয়ে গেলো।

গায়ে তার সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি।মাথায় টুপি।চোখে চশমা।মাথার চুল পাকা।দাড়ি বেশ বড় বড়।লোকটা মামা সাথে হেসে কথা ব’লছেন।কিছু কাগজপত্র তৈরি করে মামার থেকে সই নিয়ে বলল।

পুতুল এখানে পড়তে পারবে।যেহেতু এই বছর প্রায় শেষ।বাচ্চাদের পরীক্ষা ডিসেম্বরের এক তারিখ থেকে শুরু।তাই আগামী বছর জানুয়ারীতে তার ভর্তি হবে।বাসায় বসে পড়াশোনা করা-ও স্বাধীন।

-;জি স্যার আমি ওকে পড়াবো।আজ আসি স্যার।তাদের কথায় বুঝতে পারলো তার এখানে ভর্তি হবে।পুতুল মামার হাত ধরে লাফিয়ে লাফিয়ে স্কুল থেকে বের হয়।সে খুব খুশি তার ভাব ভঙ্গিতে প্রকাশ পাচ্ছে।স্বাধীন খুশি হলো।মেয়েটা পড়তে পারবে বলে আজ কত খুশি হয়েছে।নতুন জায়গায়,নতুন স্কুল।নতুন জামা,বই,চক,বোর্ড।সব কিছু সে পাবে।

আর্দশ লিপি বই,চক,বোর্ড নিয়ে বাসায় পড়াতে লাগল স্বাধীন।সে আওয়াজ করে পড়তে না পারলেও।লিখাটা আয়ত্তে এনেছে।
হাতের লিখা প্রথমে খারাপ হতো।বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পর মোটামুটি ভালো হয়েছে।এখন দিনের অর্ধেকটা সময়ই তার পড়াশোনা যায়।বাকিটা ভাই,আর মামীর কাজের সাহায্যে হাত লাগায়।এটুকু বয়স থেকে সংসারের কাজগুলো বুঝে নিতে শুরু করছে।তার একটু কাজের ভুল করার চেষ্টা করে না।কাজে মনোযোগ দেখে রেণু অবাক হয়।মেয়েটা কথা না ব’লে কি হবে?কাজে,এবং পড়াশোনা করার ইচ্ছে দেখা যায়।তার ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিচ্ছে স্বাধীন,রেনু।দেখতে দেখতে নতুন বছর চলে এসেছে। পুতুল স্কুলে ভর্তি হলো।তার পড়াশোনা করতে খুব ভালো লাগে।বেশ সাচ্ছন্দ্যবোধ করে।স্বাধীন ছেলের ছয় মাস শেষ হলো।সে সাড়া উঠোনে হাপুর পারে।কিন্তু হাঁটতে পারে না। চার হাত,পা দিয়ে সারা বাড়িতে খেলা তার নিত্য রুটিন।এই দিকে মিলন বসতে চেষ্টা করে কিন্তু পারেনা।।দুই ভাই কি যে দুষ্টুমী করে?একসাথে সুয়ে রাখলে একজন, আরেকজনকে হাত,পা গাল,চুল টেনে ধরে।একজন হাসে ব্যাথা দিয়ে।অপরজন ব্যাথা পেয়ে কেঁদে বাড়ি মাথায় তুলে।মিলনটা খুব পাঁজি হয়েছে।সুযোগ পেলে নিজের বিছানায় হিসু করে দেয়।ঠান্ডা বিছানা সুয়ে থাকবে না।সে সাজুর বিছানায় গড়িয়ে এসে সুয়ে এক পা সাজুর ওপর তুলে দেয়।রেণু দুই ছেলের কান্ডে হাসতে থাকে।স্বাধীন দুই ছেলের কাহিনি দেখে চোখ জুড়িয়ে নেয়।

৩৩.
ফেব্রুয়ারীতে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের এসএসসি পরীক্ষা শুরু হবে।অর্পণ পুরো দমে পড়ছে।রোহিতপুর থেকে তাকে তুলে এনেছে।অসিম তালুকদার শুধু এনেই থামেনি।তিন ভাইকে মেরে কাঠের ব্যাট ভেঙে ফেলেছে।সাফিন বড় ভাইকে থামাতে গিয়ে নিজেও একটা আঘাত পিঠে খেয়েছে।তিন ছেলে রেজাল্ট খারাপ করেছে।আবার গ্রামে সব অকাজের জন্যই শিক্ষা দিলো।ভবিষ্যতে যাতে এগুলো না করে।রাবেয়া ছেলের মার দেখেই বেহুশ।জ্ঞান ফিরতেই কান্নাকাটি এবং স্বামীকে গালাগালি করেছে।অসিম তালুকদার বউকে ধমক দিলেন।কিন্তু লাভ হয়নি।ছেলেকে কেন মারবে?সেটার জন্য বাবার বাড়িতে বিচার পাঠিয়ে দিয়েছেন।তারপর থেকেই মায়ের বাপের বাড়ি যাও বন্ধ করে দিয়েছেন অসিম তালুকদার।

অর্পণ জিদ ধরেছে।সে ভালো রেজাল্ট করে দেখাবে।অসিম তালুকদার ওপর জিদ করেই এত মনোযোগ তার পড়াশোনা প্রতি।হারুন কে ব’লে ফরম ফ্লিলাপ করেছেন অসিম তালুকদার।

পড়া শেষ করে খাবার টেবিলে বসে অর্পণ।তার মা খুশি মনে ছেলেকে খেতে দেন।অর্পণ চুপচাপ খেয়ে নেয়।অসীম তালুকদার ছেলের গতিবিধি লক্ষ্য করছেন।ছেলে কখন কোথায় যায়?সব খবর টাইম টু টাইম চলে আসছে।ছেলের অগোচরে ছেলের পেছনে যে চব্বিশ ঘণ্টা গোয়েন্দা লাগিয়েছেন।

নতুন স্কুলে সামনেই মামা নামিয়ে দিয়ে স্যারকে ব’লে চলে গেছে।যাওয়ার আগে ব’লে গেলো।সে ছুটির সময় নিতে আসবে।
পুতুলের থেকে সবাই বড় এবং একটু উগ্র টাইপের।পুতুল ক্লাস রুমে আসতেই তার সাথে কেউ মিশতে এবং একসাথে বসতে চায় না।তাকে দেখে ক্লাসের বাচ্চারা অনীহা প্রকাশ করছে।পুতুল মন খারাপ করে পিছনে বসে পড়ে।ইয়াসমিন ম্যাম ক্লাস করতে এসে দেখে।একটি মেয়ে একা একটি বেঞ্চে পিছনে সিটে বসে আছে।

-;কি ব্যাপার তুমি পিছনে কেন?সবার সাথে বস।

-;পুতুল চুপ।

-;মিস আমরা ওর সাথে বসতে চাই না।মেয়েটা পঁচা।

ইয়াসমিন ম্যাম পুতুলের পোশাক দিকে একবার চোখ বুলিয়ে,অন্য বাচ্চাদের পোশাক দিকে তাকিয়ে বলল।

-;এটা কেমন আচরণ তোমাদের?আমি তোমাদের কাজ থেকে এটা আশা করি নিই।একজনের পোশাক দেখেই তাকে বিবেচনা করে নিলে।সে খারাপ।সে হতে পারে গরিব।কিন্তু তার পোশাক বেশ পরিপাটি মার্জিত।সে কোনো ধনীর দুলালিই নয়।তোমরা তোমাদের বাবার কাছে এক একজন পিন্সেস।কিন্তু এই পুতুলের বাবা নেই।তার মা নেই।সে মামার কাছে থাকে।মামা যা খায়।তাকেও তাই খাওয়া।সে মামার কাছে বড় হচ্ছে।সে ভালো আছে।

পুতুলের সাথে মিশতে চাও না।ঠিক আছে। কিন্তু যদি দেখি কেউ খারাপ আচরণ তার সাথে করেছো।পানিশমেন্ট দিবো।যে আগে আসবে সেই আগেই বসবে।আগে এসে,পিছনে বসলে এবং তা আমার কানে গেলে খবর আছে।মনে থাকে যেন।

ইয়াসমিন ম্যাম সবাইকে পড়াশোনা বুঝিয়ে দিয়ে পুতুল সামনে দাঁড়ায়।মিসকে দেখে মাথা নিচু করে।পুতুলের হাতের লিখা দেখে।এবং বাকি লেখাগুলো কীভাবে লিখতে হবে বুঝিয়ে দিলেন?পুতুল চুপচাপ বুঝে।সেইভাবেই করতে লাগল।

মার্চ মাস চলছে।পুতুলের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা শুরু হবে।পুতুল পড়াশোনা করতে ভালো লাগছে।স্কুল যেতে প্রথমে খারাপ লাগলেও এখন ভালো লাগে।ইয়াসমিন ম্যামের সাথে তার সম্পর্ক ভালোই জমেছে।সে একটু আকটু বুঝতে পারে।এবং ম্যামের কথা মতো সব করতে পারে।এইদিকে অর্পণ পরীক্ষা শেষ।সে স্কুল এসেছে স্যার সাথে কথা বলতে।

স্কুল মেইন গেটের ডান পাশেই সরকারি স্কুল। বাম পাশে কিন্ডারগার্টেন।মেইন গেইট রাস্তা ধরে পাচঁ মিনিট সোজা গেলেই হাইস্কুলের মাঠ দেখতে পাওয়া যায়।চার তলা ভবনটি তার শিক্ষা জীবনের দশ বছরের সমাপ্তি টেনে দিয়েছে।এই হাইস্কুলের পিছনে দেয়াল অর্ধেক ভাঙ্গা।সেই দেয়াল টপকে টিফিন পিরিয়ডে পালিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিত।মাঝে মধ্যে স্কুল থেকে দূরে দাঁড়িয়ে বন্ধুদের সাথে দুই একদিন সিগারেট টেনেছে।যেটা অসীম তালুকদার এখনো জানে না।জানলে খবর আছে।

হারুন স্যার সাথে কথা ব’লে কিছু অংঙ্ক বুঝে নিয়ে বাড়ি পথে ফিরে আসতে নিলেই পুতুলকে দেখতে পায়।এই ফাজিল মেয়ে তার এলাকায় কি করছে?দুই বিনুনি করে গোল ফরাকে পড়ে বসে আছে।বাহিরের কদম ফুল গাছের নিচে।সে এগিয়ে কিছু বলার আগেই স্বাধীন এসে পুতুল কে কোলে নিয়ে চলে যায়।
অর্পণ রেগে পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করে বাসায় চলে যায়।

চলবে….

চক্ষে আমার তৃষ্ণা পর্ব-৫+৬+৭

0

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৫
১৪.
সলিমুল্লাহ চলে যেতেই রাজিয়া দুই চোখের পানি ঝড়ে পড়ে।এটাই তো হওয়ার কথা ছিল।বন্ধ কামরায় বসে সবটাই সে শুনতে পেয়েছে।মানুষটা তার এত পাষাণ।যার জন্য জীবন যৌবন সব শেষ করলো।সে নাকি দ্বিতীয়বার ঘরে বউ তুলছে।একটিবার তার খবর নিলোনা।নিজের মেয়ে আর ভবিষ্যতে আসা সন্তানের কথা সে ভুলে গেছে।তার এই অবহেলায় রাজিয়া নরম মনটা একটু একটু করে পাথরের পরিনত হচ্ছে।ঘৃনা হচ্ছে এমন একটি মানুষকে সে ভালোবেসে ছিল।পরিপূর্ণ সংসার গড়ে তুলতে চেয়েছিল।

ইয়া রহমান,ইয়া রহিম,ইয়া জাল জালালি ওয়াল ইকরাম,”ইয়া গাফফার” ইয়া সাত্তার, “ইয়া জব্বার,ইয়া ওয়াদুদ,ইয়া আজিজু,ইয়া আজিম,ইয়া হান্নানু,ইয়া মান্নান হে আমার রব,হে আমার সৃষ্টি কর্তা।

আপনার পবিত্র নামগুলোর উছিলায়, আপনার তাওহীদের সাক্ষী লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু এর উছিলায়,আপনার বন্ধু ও হাবীব হযরত মুহম্মদ (সঃ) এর উম্মত হিসেবে আমাদের সকলের মনের নেক ইচ্ছে গুলো পূরণ করে দেন।অভাব,ঋণ দূর করে দিন।
আমার মতো যারা যারা বিপদে আছে তাদের সকল কে তুমি বিপদ থেকে মুক্ত করে দাও।আমাদের মানসিক কষ্ট,দুঃখ দূর করে দাও।আমাদের রিযিকে বরকত দান করুন।বাবা মা পরিবারের সকলকে নেক হায়াত দান করুন।আমিন।

ফজরের নামাজে রাজিয়া সাথে পুতুল নামাজ পড়তে উঠেছে।খোদার দরবারে মায়ের সাথে সে ওহ মুনাজাতে তুই হাত তুলেছে।আজ জুম্মার দিন।সময় দেখতে দেখতে চলে যাচ্ছে।রাজিয়া,পুতুলের এই বাড়িতে দশ দিন পূর্ণ হলো।আজ মোস্তফা সরোয়ারের বিয়ে।রাজিয়া মন থেকে গভীর দীর্ঘ নিশ্বাস বের হয়।সময়ের সাথে নিজেকেও পরিবর্তন পথে নামিয়েছে রাজিয়া।আজ থেকে স্বামী নামক নরপশুটাকে চিরদিনের জন্য ভুলে যাবে।ভুলে যাবে সাড়ে ছয় বছরের সংসারটাকে।যে সংসার এবং সংসারের মানুষটাকে সে আপন ভেবেছিলো।কিন্তু তাদের আপন সে যখন হতেই পারেনি।তখন তার মধ্যে মায়া,মোহাব্বত শব্দ সে আর রাখতে চায় না।মোস্তফা সরোয়ার তার কাছে মৃত।আজ এবং এখন থেকে জানবে তার স্বামী নেই।সে কোনো এক দূ*র্ঘটনা মারাত্মকভাবে খু*ন হয়েছে।

১৫.
মাথা পাগড়ি,গায়ে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে চলো বিয়ের আসনে।পাচঁশত জন লোক আসবে বরযাত্রী সাথে।কিন্তু সেখানে এক হাজার জন লোক এসেছে।বরের মায়ের কথা অনুযায়ী কনে পক্ষ পাচঁশত জনের খাবার আয়োজন করেছে।এখন বাকি পাঁচশত জনের খাবার কথা থেকে দিবে।কনে পক্ষ প্রচন্ড রেগে গেলো।কিন্তু কনের বাবা ব্যাপারটা সামলাতে আবার বাকিদের খাবার তৈরি আয়োজন জন্য লোক নিয়োগ দিল।

নিজেদের ফার্ম থেকে মুরগি ধরে এনে জবাই করে রোস্টের জন্য হাঁড়ি বসিয়ে দিলো।একটা গরু মেয়ে বিয়ের জন্য আনছে।যতটুকু লাগবে ব্যবহার করা হবে।আর বাদ বাকিটুকু এতিমখানা দান করবেন।কিন্তু এত মানুষ আসায়,পুরোটা হাঁড়িগুলোতে জায়গায় দখল করে নিলো।তা ওহ যদি না হয়,কনের বাবা নিজে গরুর মাংস আনতে বাজারের যাবেন।তবু্ও মেয়ের সুখ চান।ছেলেটা গরিব হলে কি হবে?ছেলেটার আচরণ ব্যবহার ভালো।তিনি মেয়ে দেখার দিন ভালো করে যাচাই-বাছাই করে বিয়েতে মত দেন।ছেলের না-কি কোনো চাওয়া নেই।ছেলের মা’ই নাকি ছেলের এবং ছেলের বউ জন্য কিছু জিনিস চেয়েছে।আর সাথে জামাই নতুন ব্যাবসা শুরু করব।তার জন্য পনেরো লাখ টাকা দাবি।মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করেই সব দিতে রাজি হয়েছেন।কিন্তু তিনি হয়তো ভুলে গেছেন।টাকা দিয়ে মেয়ে সুখ নয়।দুঃখের ভাসিয়ে দেওয়ার ব্যাবস্থা করছেন।মেয়ে তার সুখে থাকবেনা।বরং কষ্ট হবে তার নিত্যদিনের জীবন সঙ্গী।

-;বলছিলাম বেয়াইন সাহেব।খাবার আয়োজন প্রায় হয়ে গেছে।খাবার তৈরি হতে হতে মিষ্টি মুখ করে বিয়ের কাজটা যদি শুরু করতেন।যদিও দোষ তাদের ছিল।তাই নাসিমা বিয়ের দিন কোনো ঝামেলা না করে মত দিল।
বর পক্ষ খাবার না খেয়ে রাজি হলো, আপাতত বিয়েটা মিঠে যাক।তারপরে সবাই পেট ভোজন করবে।

কাজী দুই পরিবারে অনুমতি নিয়ে কাগজপত্র তৈরি করে বর পক্ষ কাছ থেকে সই নিলো।
কন্যার কাছ থেকে সই আনতে যাবে এমন সময় স্বাধীন উপস্থিত হয়।মোস্তফা সরোয়ার স্বাধীনকে দেখে গলার কাঁটা বিঁধলে যেমন করে তেমন করে উঠে।নাসিমা বেগম স্বাধীন দেখে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে রয়।তার এত কিছু করা সব বিধা যাবে তা মেনে নিতে পারবেন না।তাই এগিয়ে স্বাধীনকে কিছু বুঝাতে চাইলে স্বাধীন পাত্তা দিলো না।

১৬.
ঘরে এক বউ থাকতেই যে স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করতে চায়।তাকে কি করা উচিত বলুন চাচা?কনে পক্ষের বাবা হতভম্ব হয়ে যান।কি বলছে এই ছেলে?তার মাথায় কিছু টুকছে না।

-;আপনি বুঝতে পারছেন না তাইতো।আমি বুঝাচ্ছি আপনাকে।স্বাধীন মোস্তফা সরোয়ার গ্রাম থেকে এবং নিজের গ্রাম থেকে প্রায় পঞ্চাশ জন লোক নিয়ে আসছে।তাদের সামনেই বরকে টেনে আসন থেকে নামিয়ে দুই গালে ঠাসস করে চড় লাগায়।

-;এই কুলাঙ্গার আমার বোনের জামাই।যার একটা বউ আছে।একটা ছয় বছরের মেয়ে সন্তান আছে।এমনকি বউটা আবার মা হতে চলেছে।সে আট’মাসের বেশি অন্তসত্বা।তাকে নির্মমভাবে মেরেছে।শুধু মাএ টাকার জন্য।এদের মা,ছেলের এত লোভ চাচা আপনি ভাবতেই পারবেনা।আপনি কার হাতে মেয়ে তুলে দিচ্ছেন?একটু খবর নিয়ে দেখুন।এই আমার সাথে তার গ্রামে বিশজন লোক আসছে।তাদের জিজ্ঞেস করুন।কি নির্মমভাবে তারা বউ নির্যাতন করে?আমার আদরের বোনটাকে পালিয়ে বিয়ে করেছে।আমার মায়ের যত গহনা ছিল সব তার জুয়ার ঘরে হেরে আসছে।

শুধু তাই নয়,আমার বোনটা তাকে ভালোবেসে ছিল ব’লে তার হাত ধরে ঘর ছাড়ে।কিন্তু আজ সেই আদরের দুলারি পরিনতি খুব খারাপ।যে বোনের গায়ে আমি কোনোদিন হাত তোলা দূরের কথা একটা ধমক পর্যন্ত দেয়নি।সে বোনের শরীরের মা’রের দাগ স্পষ্টভাবে ঝলঝল করছে।আমার বোনটার গর্ভে তার অনাগত সন্তান রয়েছে।তা ওহ একটু রেহাই দেয়নি।এতটা নি*ষ্ঠুর আর ব*র্বরত।আমার বোনটা ভালোবাসার অন্ধ হয়ে তারে ভালো পথে ফিরে আনতে চেয়েছিলো।তাদের সাড়ে ছয় বছরের সংসার ছিল।কিন্তু এই ডায়নী মহিলা নাসিমা বেগম আমার বোনকে মারতে ছেলেকে উৎসাহ দিত।এমন একটা দিন যায়না যে টাকা বাপের বাড়ি থেকে আনতে অত্যাচার করে নিই।মা হয়ে কম অত্যাচার করেননি আমার বোনটার ওপর।তার কথায় ছিল বিষ।যা মানুষের বুকটা ছু*রি মতো এসপার ওসপার করতে পারতো।এই দুর্রন্ত মহিলা নিজেকে অনেক চালাকচতুরভাবে।ছেলে নামে জিনিসপত্র হাতিয়ে নেওয়া।এমনকি পনেরো লাখ টাকা দাবি সেসব ছেলের বউ নামে মাএ নেওয়া।আসল কথা হলো জুয়া খেলতে নামবে।দিন শেষে যখন হাতে কিছু থাকবে না।তখন আবার বাপের বাড়ি টাকা আনতে নির্যাতন শুরু করবে।এমন অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ মেয়েকে ঠেলে দিবেন।সেখানে অসাধ্যের মত কতগুলো অমানুষে বসবাস।তাদের স্বাথে ব্যবহার হবে আপনার মেয়ে।তারপর দিনের পর দিন মেয়ে নির্যাতন সইতে না পেরে গলায় দড়ি দিবে।তখন পারবেন নিজেকে মাফ করতে।বাপ হয়ে আপনার কি একটু কষ্ট লাগবে না?মেয়ে এই দুনিয়া সুখ পায়নি।আর ওই দুনিয়ায় আজাব হবে গলা দড়ি দিয়ে মরার জন্য।আমার বোন তার একমাত্র মেয়ে আর অনাগত সন্তানের জন্য বেঁচে আছে।এই দুই সন্তান না থাকলে হয়তো কবে হারিয়ে ফেলতাম আমি আমার আদরের বোনটাকে।
আর কেউ ডাকতো না ভাইজান ব’লে।আমি ভাইয় হয়ে বোনের কান্না মুখটা প্রতিদিন দেখি।সে জায়নামাজে বসে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে কাঁদে।তার এই কান্নার শেষ নেই। তার একটি ভুলের মাশুল তাকেই দিতে হচ্ছে।
আমি পারিনি ভাই হয়ে তার কষ্ট দূর করতে।সে কষ্ট পায়।বাবা হারিয়েছে।ভাই ফিরে ওহ তাকায় না।এতটা মানসিকভাবে তার জীবন কাটছে।

-;এসব মিথ্যে কথা।আমি কিছুই করিনি। এ আমার নামে ষড়যন্ত্র করে এসব বলছে।মা তুমি কিছু বলছো না কেন?

ছেলের কথায় নাসিমা তাল মিলিয়ে ব’লে।

-; হ এই পোলা মিছা কথা কয়!তারা মিথ্যা অপবাদ দিতাছে।আমাগো সুখ সয্য করতে না পাইরা।এরা লোক ভাড়া কইরা আনছে।শুনছে,বড় লোক পরিবারে মাইয়া আনতাছি।তাই এমন অমানবিক কাজ করতাছে।আমি তোমারে জেলে দিমু বান্দর পোলা।আবার আমারে ডায়নি কস।তোর জিহ্বা কাইটা লবণ দিয়া একদম কচকচ কইরা খাইয়া ফালামু।

-;আমি মিছা বলছি না আছা বলতাছি।তা গ্রামের লোক ভালো জানে।কি মিয়ারা আপনার ব’লেন আমি মিথ্যে বলছি?

১৭.
গ্রামের লোক একে একে সত্যি কথা বলতেই নাসিমা বেগমের মুখটা ফাটা বেলুনের মতো চুপসে যান।ছেলেকে রেখেই এখান থেকে কেটে পড়ার ধান্দা করে।সবাইকে সামনে ফেলে নিজেকে পিছনের দিকে নিতে শুরু করে।তার পিছানো দেখে স্বাধীন মোস্তফা সরোয়ারকে নিজ গ্রামের লোকের হাতে তুলে দেন।দৌড়ে এসে নাসিমা বেগমের হাত ধরে ব’লে।

-;এই-যে আপনি কোথায় পালাচ্ছেন?আপনি তোও এই সকল নাটের গুরু।আপনি না থাকলে হবে।নাসিমা বেগমকে কনের মায়ের হাতে তুলে দিতেই সকল মহিলা মিলেই উত্তম পাত্তম দিতে শুরু করে।ঐদিকে মোস্তফা সরোয়ারকে দুই গ্রামের মানুষ মে’রে পাজামা,পাঞ্জাবি ছিড়ে ফেলছে।মাথা টুপি মারের চোটে কোথায় পড়ছে খবর নেই।কনে পক্ষের মধ্যে থেকে কয়েকজন জুতা ছুড়ে মারে।তাদের নিশানা মতো মোস্তফার গালে আর মুখে জুতা পরে।পিছন থেকে মেয়েরা ঝাড়ুর বারি দিয়ে ভাঙ্গা কোমড় আরোও ভেঙে দেয়।পাবলিকের এমন গণধোলাইয়ের কথা সারাজীবন মনে রাখবে মা,ছেলে।

সেই কখন স্বাধীনের কথা শুনে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে বসে পড়েন কনের বাবা আলতাফ হোসেন।মেয়ে সুখ দেখতে গিয়ে মৃত্যু ডেকে আনছিলেন।এই ছেলেটা ঠিক সময় না আসলে হয়তো এর থেকে বড় সর্বনাশ হয়ে যেতো।আল্লাহ ঠিক সময় তাকে হয়তো পাঠিয়ে দিয়েছেন।কিন্তু এদের মা,ছেলেকে এত সহজে ছাড়া যায় না।এদের শাস্তি পেতে হবে।আলতাফ হোসেন ভাতিজাকে ফোন লাগাতে বলেন।এরমধ্যেই পুলিশকে খবর দেওয়া হলো।

-;সবাই থামুন।এদের পুলিশে দেওয়ার ব্যাবস্থা করা হয়েছে।

আলতাফ হোসেন মোস্তফা সরোয়ার সামনে এসে পায়ের জুতা খুলে দুই গালে আর পিঠে ঠাসস,ঠাসস করে বারি মেরে বলল,

-;ধোঁকাবাজের শাস্তি এটা।তোর মতো জা*নোয়ারদের হাতে আমার মেয়েকে তুলে দেওয়ার থেকে ঘরে বসিয়ে রাখা অনেক ভালো।এই কে আছিস,একে উল্টো করে গাছের সাথে বাঁধ।পুলিশ না আশা পর্যন্ত এভাবে থাকুক।আর এই মহিলাকে তোমরা মেয়েরা ঘরে মধ্যে আটকে রাখো।

চলবে….

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৬
১৮.
আলতাফ হোসেন এগিয়ে এসে স্বাধীন এর সামনে দাঁড়িয়ে বলল।
-;তোমাকে কি ব’লে ধন্যবাদ দিবো?আমি সত্যি জানি না।আজ তুমি আসায় হয়তো আমি আমার মেয়েকে শয়তানটার হাত থেকে বাঁচাতে পারলাম।

-;আমি যখন জানতে পারলাম।আমার বোনের জামাই।বোনকে মেরে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে নতুন করে আবার বিয়ে করছে।তখন রাগ হয়।আমার বোনের জীবন নষ্ট করে। আরেকটা মেয়ে’র জীবনে নরক আনতে চলেছে।তাই চুপচাপ বসে থাকতে পারিনি।গ্রামের লোকদের নিয়ে এসে বিয়েটা বন্ধ করা দরকার ছিল।নিজের বোনকে রক্ষা করতে না পারলেও আরেকটা মেয়ে কে রক্ষা করতে পেরেছি।আর এতেই আমার কিছুটা শান্তি লাগছে।এরমধ্যেই পুলিশের জিপ গাড়িটা হাজির হলো।আলতাফ হোসেন বাড়ির উঠোনে।মোস্তফা সরোয়ার এবং তার মা’কে গাড়িতে তুলে দেওয়া হয়েছে।নারীর নির্যাতনে কেস করেছে স্বাধীন।আলতাফ হোসেন কনে পক্ষকে মিথ্যে ব’লে বিয়ে নামে ছলনা।আর যৌতুক জন্য মামলা দায়ের করেন।এখন মা, ছেলে জেলে পঁচে মরবে।

মা,ছেলের কাজ সমাপ্ত করে বাড়ির পথে রওনা হয়।বাড়িতে পা রাখতেই দেখতে পায়
রেনু অপেক্ষা করছে।

-;আপনি সারাদিন কোথায় ছিলেন?সকাল দশটায় বেড়িয়েছেন।বেলা গড়িয়ে রাত প্রায় শেষের দিকে।তবুও আপনার খবর নাই। আপনার জন্য চিন্তায় চিন্তায় আমার হাত,পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিলো।

-;শান্ত হও তুমি!আমি ঠিক আছি।একটা কাজ ছিল তাই বেড়িয়ে গেছিলাম।কাজটা শেষ করে আসতে এতটা দেড়ি হয়েছে।খাবার সাজাও।আমি কলপাড়ে হাত মুখ ধৌত করতে গেলাম।

রেনু খাবার সাজিয়ে দিতেই স্বাধীন বিসমিল্লাহ ব’লেই খাবারটা তৃপ্তির সাথে খেতে লাগলো।স্বামীর এত আনন্দের সাথে খাবার খাওয়া দেখে নিজেই অবাক হয়ে প্লেটে দিকে একবার তাকায়।আরেকবার স্বামীর দিকে তাকায়।প্লেটে সাদা ভাত,লাল শাক ভাজি,আর ছোট ছোট টেংরা মাছের ঝোল।এত স্বাদ করে কখনো খাবার খেতে দেখেনি।কিন্তু আজ কি হলো এমন?স্বাধীন খাবার শেষ করে বউ দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা মুচকি হাসি উপহার দিল।এর মানে খাবারটা দারুণ হয়েছে।স্বামীর তৃপ্তির খাওয়া দেখে রেনুর কলিজাটা ঠান্ডা হয়ে যায়।

১৯.
রাজিয়া ঘুমিয়ে আছে।স্বাধীন বোনের কপালে চুমু একে দরজাটা লাগিয়ে চলে যেতেই রাজিয়া চোখ খুলে।

-;ভাই এতো রাতে আমার ঘরে কি মনে করে? কপালে হাত স্পর্শ করতেই মনে পড়ে যায় ছেলেবেলার কথা।রাজিয়া ঘুমের মাঝে যখন থাকে।ভাই তখন প্রতিদিন সকালে কপালে চুমু একে বলতো।

যত বিপদে পড়োনা কেন?মনে রাখবে তোমাকে আগলে রাখতে,তোমার সব বিপদে ঠাল হয়ে থাকতে তোমার ভাই আছে।সে ছিল।আর ভবিষ্যতেও থাকবে।

তারমানে ভাইটার ধারালো লোহার মতো মনটা তার জন্য একটু একটু করে নরম হচ্ছে।আবার আগের পুরনো রুপে ফিরছে।রাজিয়া খুশিতে দুই চোখের পানি গাল বেয়ে ঝড়ে পড়ে।শত কষ্টের মাঝেও এটুকু সুখ ধরা দিলো।আজ নিশ্চিতে একটা শান্তির ঘুম দিবে।

নভেম্বর মাস চলছে।এই মাসেই একেবারে শেষের দিকে রাজিয়া ডেলিভারি পড়ছে।ডাক্তার কাছে নেওয়া কথা।সেসব সবটাই ঠিক করে রাখা হয়েছে।

কিন্তু হঠাৎ করে রাজিয়া কলপাড়ে পা পিছলে পড়ে যায়।স্বাধীন ক্ষেতের কাজের জন্য বের হতে নিলেই কিছু পরে যাওয়ার শব্দ পেয়ে দৌড়ে আসে।চোখের সামনে বোনকে ব্যাথায় কাতরাতে দেখে কলিজা কেঁপে ওঠে।রক্তের স্রোতে ততক্ষণে মেখে যাচ্ছে কলপাড়।স্বাধীন মাথার গামছা খুলে বোনকে জড়িয়ে কোলে তুলে সদর হাসপাতালে দিকে দৌড়ে যাচ্ছে।

হাসপাতালে ব্যানগাড়িতে করে রাজিয়াকে আনার পথেই জ্ঞান হারিয়েছে।তার অবস্থা খুব খারাপ।যে ডাক্তার রাজিয়াকে এর আগে দেখছিল।তিনিই স্বাধীনকে বলল,

-;রোগীর অবস্থা খুব একটা ভালো না।আমাদের ইমারজেন্সীতে নিতে হবে।মা,এবং সন্তান দুইজন বিপদের মুখে।আল্লাহ ওপর ভরসা রাখুন।ডাক্তার কথা শুনে স্বাধীন ঢোক গিলে।কি বলছে ডাক্তার?তার বোন বাঁচবে তো!

২০.
এক সেকেন্ডের নাই ভরসা।
দুই দিনের দুনিয়ায় মানুষ করে
কতই না রং তামাশা।
চোঁখ বুঝিলে দুনিয়া আঁধার।
তবু ও মানুষ করে কতই না অহংকার।
সাদা কাঁপড় পঁড়ে একাকি থাকবে কবরে।
তবু ও মানুষের মন থাকে টাকার নেশায় পঁড়ে।

বড়ই পাতার গরম জলে গোসল করানো হচ্ছে।বাড়ি চারদিকে আগরবাতি,ধুপকাঠির সুগন্ধে ভরে গেছে।তেরপাল টানিয়ে মহিলারা রাজিয়ার শেষ গোসল করিয়ে দিচ্ছে।

মিস্টার স্বাধীন আপনার বোন একটি ছেলে সন্তান জম্ম দিয়েছে।

-;ডাক্তার আমার বোন কেমন আছে?

-;পা পিছলে পরার কারণে মারাত্মকভাবে আঘাত খেয়েছেন।যার জন্য তার শরীর থেকে প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণ হচ্ছে।আমরা হাজার চেষ্টা করে ওহ তার রক্ত পড়া বন্ধ করতে পারিনি।উনি বাচ্চা জম্ম দিয়ে অপারেশন রুমে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন।আই এম সরি মিস্টার স্বাধীন।সি ইজ ডেইড।

বোনের মৃত্যু খবর কানে আসতেই দৌড়ে ছুটে যায় অপারেশন রুমে।কি সুন্দর চোখ দুটো বন্ধ করে ঘুমিয়ে আছে,তার আদরের একমাত্র বোন।যে আর কোনোদিন ভাইয়া ব’লে ডাকবে না।বলবেনা,ভাইয়া আমাকে মাফ করে দেও।আমি ভুল করেছি।সে সাধের এই দুনিয়া ছেড়ে পরপারে পারি দিয়েছে।একটিবার ভাবলো না।তার আদরের সন্তানদের কি হবে?কতটা কষ্ট বুকের মধ্যে জমা রেখে দুনিয়ায় মায়া ত্যাগ করলো।আহা এমন মৃত্যু কেন দিলে খোদা?

সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে রাজিয়াকে যখন খাটে শুয়ে রাখা হলো।ছোট পুতুল মায়ের মুখে হাত দিয়ে ডাকছে।তার চোখে কতটা আকুলতা।চোখ বেয়ে ঝড়ে পড়ছে পানি।একবার মামা দিকে ছুটে যাচ্ছে।আরেকবার মায়ের গায়ে সাদা কাপড়ের অংশ ধরে টানছে।তার মায়ের গায়ে এমন অদ্ভুত পোশাক কেন?এই কাপড়ে মা’কে কোনোদিন সে দেখে নিই।তার মা তার ডাকে কথা বলছে না কেনো?ভিতরের ঘর থেকে একটি শিশুর কান্না ভেসে আসছে।সে শিশু মায়ের ভালোবাসা পেলো না।তার চিতকার করে কান্নার শব্দ কাঁপিয়ে দিচ্ছে রাজিব হকের বাড়ির ভিটা।স্বাধীন কান্না করছে।তার মন কিছুতে মানছে না।এসব মিথ্যে হোক।তার বোনটা ফিরে আসুক।বোনের প্রতি আর রাগ করে থাকবেনা।কিন্তু না,সে ভাই কিংবা আদরের সন্তানের ডাক।কারো ডাকেই সে সাড়া দিচ্ছে না।

২১.
আপনি শান্ত হন।আপনি এভাবে কাঁদলে ওদের কে শান্ত করবে।আপনি ছাড়া ওদের এই দুনিয়ায় কেউ রইলো না।আপনি ওদের ওপর ভরসার হাত।রাজিয়া জানাজা পড়াতে হবে।এভাবে মাটির ওপর বেশিক্ষণ রাখা ঠিক নয়।তাকে যত তাড়াতাড়ি কবর দিবেন।তার আজাব তত কম হবে।আপনি নিজেকে একটু শক্ত করুন।স্বাধীন মাথা নাড়িয়ে চোখের পানি মুছে ঘরে দিকে ছুটে যায়।স্বামীর এমন চলে যাও তাকিয়ে দেখে রেণু।একটু পর স্বামীর কোলে রাজিয়া সন্তানকে দেখা যায়।সে উঠোনে রাজিয়া কোলের উপরে বাচ্চাটা রাখতেই কান্না একটু একটু করে কমে আসে।সে মায়ের বুকে চুপচাপ হয়ে গেলো।পুতুল একবার ছোট বাচ্চাটাকে দেখে নিজেকে ছাড়াতে চাইলে পাশের মহিলা ছাড়ে না।তারা পুতুলকে ধরে রেখেছে।মায়ের জন্য মেয়েটা পাগলামি করছে।তাকে থামানো কষ্ট কর।

মায়ের পরশ পেয়ে দুধের শিশু ঘুমিয়ে গেছে।স্বাধীন বোনের কোল থেকে ভাইগ্নাকে নিয়ে রেনু’র আরেক হাতে সপে দিলো।দুই ছেলেকে কোলে নিয়ে বসে আছে রেণু।সে চোখের পানি লুকিয়ে রাখার বৃথা চেষ্টা করছে।

আশহাদু আল লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা-শারীকালাহু ওয়াশহাদু আন্না মুহাম্মাদান আ’বদুহু ওয়া রাসূলুহু।কালিমা শাহাদাত পড়তে পড়তে স্বাধীন বোনের লাশ কাঁধে তুলে নিলো।তার সাথে আরো কিছু লোক একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে।মা’কে কাঁধে নিয়ে চলে যেতে দেখে পুতুল পাগল হয়ে উঠেছে।মা’কে কিছুতেই যেতে দিবেনা।সে মা’কে চায়।তার মা’কে নিয়ে সবাই কোথায় যাচ্ছে?তার মায়ের সঙ্গে তাঁকে কেন নিলো না?তাঁকে কেন ফেলে গেল।পুতুল গলা ফাটিয়ে চিতকার করতে চায়।কিন্তু মুখ দিয়ে একটি শব্দ বের হয়না।তার দুই চক্ষে তৃষ্ণা।তার মা’কে না পাওয়ার কষ্টে মাটিতে কপাল দিয়ে একেপর এক আঘাত দিতে থাকে।পা দিয়ে মাটিতে কই মাছের মতো দাপাদাপি করে।কিন্তু তাঁকে একজন মহিলা সামলাতে পারছেনা।সে আরেক মহিলার সাহায্যে ছোট বোবা মেয়েটিকে ঘরে রেখে বাহির থেকে দরজা লাগিয়ে দেয়।পুতুল দরজা ধাক্কা সে মা যাবে।কিন্তু কেউ তার ডাক শুনলো না।মা মা করতে করতে মাটিতেই বেহুশ হয়ে পড়ে রইলো।তার খবর কেউ নিলোনা।মা,বাবা ছাড়া পুতুল মেয়েটির জীবনটা কেমন হবে?

চলবে…..

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৭
২২.
রাজিয়া নেই সাতদিন পার হয়ে গেছে।পুতুল স্বাভাবিক হয়নি।সে বিছানায় জ্বরে পুড়ছে।রেণু ছোট ছোট দুই বাচ্চা সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে।তার ওপর পুতুলের জ্বরটা কোনোভাবেই কমছে না।ওষুধে কোনো কাজ করছে না।মেয়েটা জ্বরে ঘোরে মা’কে খুঁজে।মা ছাড়া তার দুনিয়ায় অন্ধকার।নরম তুলতুলে শরীরটা শুকিয়ে গেছে।চেহারা তার বিষাদের ছায়া।

-;মেয়েটি এভাবে থাকলে মরে যাবে।আপনি দেখেন কিছু করতে পারেন কি-না!স্বাধীন মাথা নাড়িয়ে ব’লে দেখছি।

স্বাধীন দুপুর বেলা ছোট ঘুমন্ত শিশুটিকে নিয়ে পুতুলের সামনে গেল।পুতুল বিছানায় চুপচাপ হয়ে পড়ে আছে।স্বাধীন খাটে একপাশে বসে ডাকল।

-;আম্মা…আম্মা।দেখো কারে নিয়ে আসছি তোমার কাছে।পুতুল আম্মা দেখ।

পুতুল চোখ মেলে একটু তাকিয়ে আবার মুখ ঘুরিয়ে নিলো।এর মানে সে তাকাবে না।তার ভালো লাগেনা।কিন্তু স্বাধীন চুপচাপ হয়ে থাকলো না।ছোট বাচ্চাটাকে পুতুলের পাশে নিয়ে সুয়ে দিয়ে বলল।

-;ভাইয়ের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে আম্মা।তুমি ছাড়া ওর কে আছে বল?তুমি ওর বোন।তোমার কাছে মায়ের গন্ধ পায় ব’লে।রোজ রাতে তোমার বিছানায় তোমার পাশে রেখে যাই।কিন্তু তুমি জ্বরের ঘোরে বলতেই পারোনা।সে মায়ের মতো বড় বোনকে কাছে পেয়ে শান্তিপ্রিয় হয়ে গেছে।তোমাকে পেলে সে একদম নিরবতা পালন করে।এটাই তো বোনের প্রতি ঠান,মায়া,ভালোবাসা।তুমি মুখ ঘুরিয়ে নিলে ভাইটা যাবে কার কাছে?তুমি কি চাও?তোমার ভাইয়া তোমার মায়ের মতো দূরে চলে যাক।ভাইকে একটু আদর কর।

পুতুল উঠে বসতে চেষ্টা করে।কিন্তু শরীর দূর্বল দেখে বসতে পারেনা।আবার বিছানায় পড়ে যায়।স্বাধীন,পুতুলকে উঠিয়ে পেছনে একটা বালিশ দিয়ে খাটে বসালো।ছোট ছোট নরম হাত দুটি বাড়িয়ে দেয়।যার মানে সে ভাইকে কোলে নিবে।স্বাধীন কোলে তুলে দিতেই টুপ করে একফোঁটা পানি ভাইয়ের চোখে পাতায় পড়ে।আর অবুঝ শিশুটি বোনের কোলে এসে কি সুন্দর চোখ মেলে তাকিয়ে রয়।হাত,পা নড়াচড়া করছে।দেখে মনে হচ্ছে।সে সবচেয়ে নিরাপদ স্থানে রয়েছে।এই সুন্দর মুহূর্তটা দেখে স্বাধীনের পুরনো কথা মনে পড়ে যায়।সে চোখের পানি লুকিয়ে রাখার বৃথা চেষ্টা করছে।এই তো সেই দিন।বাবা তাকে নিয়ে ফজরের নামাজ পড়ে বাড়িতে আসতেই শুনতে পায়।ছোট একটি শিশুর কান্না।যে চোখ বুঝে কান্না করে সারা বাড়ি মাথায় তুলতো।বাবা তার হাতে ছোট নরম তুলতুলে শরীরটা তুলে দিয়ে বলেছিল।

-;স্বাধীন।এটা তোমার বোন।তাকে মাথায় তুলে রাখবে।

হ্যা,স্বাধীন বোনকে কোলেপিঠে মানুষ করেছে।মাথায় পর্যন্ত তুলে রেখেছে।মাটিতে বোনকে সহজে রাখেনি।মাটির পিপড়াই যদি তার বোনকে কামড়ে দেয়।আজ সেই বোনটা কোথায় সুয়ে আছে?সাড়ে দিন হাত মাটির ঘরে।

২৩.
জিহান লালটা না কালাটা ধর।আজকেই এইটারে চিকেন ফ্রাই করুম।পার্টি হবে মামা।
লাল মুরগী ছেড়ে কালোটা ধরতে গেলে হাতের মধ্যে ঠুকরে কুক..কু..রুক্কু করে উঠে।বাড়ি ভিতর থেকে চোর চোর ব’লে রমেশ রায় দৌড়ে ছুটে আসে।কালোটা শব্দ করতেই অর্পণ,জিহান,রিহান তিনটা উঠে পরে দৌড়।

-;অর্পণ ভাই আজকে গেছি।মুরগী চুরি করতে গিয়া ধরা খাইলাম।আজকে শেষ।এতখনে রমেশ রায় মনে হয় বাড়িতে বিচার পাঠিয়ে দিয়েছে।

রমেশের বাচ্চাটা যদি আজকে বিচার দেয়।তাইলে ওর খবর আছে।

চেয়ারম্যান সাহেব,চেয়ারম্যান সাহেব বাড়িতে আছেন না-কি!রাতের বেলা চেয়ারম্যান বাড়ি দুয়ারে কয়েকজন লোক হাত,পা ভাঙ্গা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে।

-;আপনার পোলায় তার বাদর ভাইদের নিয়ে আমার পেয়ারা বাগানে গেছিল।আমার গাছের সকল পেয়ার চুরি করছে।আমি বাঁধা দেওয়া।আমার কপালে,মুখে পেয়ারা মারছে।দেখেন আমার অবস্থা।

-;আমার গাছের ডাব চুরি করছে।গাছে উঠে সকল ডাব পারছে।আমি বাধাঁ দেওয়া।আমার গাছের ডাব দিয়ে আমার হাত,পা ভাঙ্গছে।

-;আমার পুকুরের মাছ চুরি করছে

-;আমার মুরগী চুরি করতে গেছিলো।তারে স্ব চোখে দেখছি।সে আমারে দেইখা পালায়ছে।

চেয়ারম্যান সাহেব গম্ভীর স্বরে ব’লেন।আর কার কি ক্ষতি হয়েছে?

-;মসজিদের নামাজ পড়ে বের হতেই দেখি আমাদের সবার জুতা নেই।কে নিয়েছে জানি না?আমি মসজিদের ইমাম আজকে গঞ্জের বাজারে গেছিলাম।আর সেখানে আপনার অসভ্য ছেলে তার ভাইদের নিয়ে জুতা বগল থাবা করে বিক্রি করছে।এক জোড়া জুতা আশি টাকা।আমি আমার আগের জুতার মতো এক জোড়া জুতা কমে পেয়ে কিনে নিলাম।বাসায় এসে দেখি আমার জুতা আমার কাছেই আসছে।মাঝখানে আশি টাকা গেলো।আমি এর বিচার চাই।

সবার অভিযোগ শুনে রাগে কপাল চাপড়ান অসিম তালুকদার।আর ছেলেকে বকতে থাকেন।ছেলেটাকে নিয়ে সে কি করবে?এমন তেরামি সে যদি তার বাপের আমলে করতো।মেরে পিঠের ছাল তুলতো।আর এই তার গুণধর ছেলে বাপের নামডাক সব ডুবিয়ে ছাড়ছে।আজকে বাসায় আসুক ওর খবর আছে।

সবাইকে জরিমানা দিয়ে বাড়িতে ঢুকেই বউয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,

-;হতচ্ছাড়া বাড়িতে পা রাখলেই আমাকে ডাক দিবে।ওহ কি পেয়েছে?প্রতিদিন এসব বদনাম করবে।আর আমি সব মেনে নিবো।

-;আহা আপনি রাগ করছেন কেন?ওহ বাচ্চা ছেলে।এই বয়সে দুষ্টুমি করবে না তো।তাহলে কবে করবে?আপনার মতো বুড়ো বয়সে।

-;রাবেয়া,আমার মাথা গরম করবে না।বেশি বাড় বেড়েছে তোমার ছেলে।তুমি ওকে আল্লাদ দিয়ে মাথা তুলেছো।তোমার জন্য ছেলের এই অত পতন।

-;আপনি,আপনি এত বড় কথাটা বলতে পারলেন।দশটা না পাচঁটা না।আমার একটা মাএ সন্তান।আমি একটু বেশি আদর করি।তাই ব’লে আমি ওকে আল্লাদ দিয়ে মাথায় তুলেছি।আমি কালই বাপের বাড়ি চলে যাব।থাকবো না এই সংসারে।এই সংসারের লোক আমার আর আমার ছেলের সুখই সয্যই করতে পারেনা।রাবেয়া স্বামীর ওপর অভিমান করে দরজা লাগিয়ে বসে কাঁদতে লাগলো।

-;ভাইজান,ভাবি রেগে গেল।

-;সাফিন,বাদ দেও তোমার ভাবীর কথা।সে এমনই,ছিদকাদূনী মহিলা একটা।
তিন বাঁদরকে ধরে নিয়ে আসো।এদের একটা ব্যাবস্থা করতে হবে।

-;জি,ভাই।আমি খোঁজ নিচ্ছি।

দোস্ত তোরা পালা।সাফিন চাচা তোদের তিনটারে খুঁজতাছে।একবার হাতের কাছে পাইলে খবর আছে।চেয়ারম্যান সাহেব আজকে তার বাপজান অর্পণ এর ওপর বেশি খ্যাপা।

-;আমার নামে বিচারটা কে দিলো সেটা আগে বল?

-;মনে হয় রমেশ রায়।

-;রমেশের বাচ্চা তোর খবর আছে!

-;রমেশের খবর পরে কর!আগে পালা।বন্ধুু সাফাত থেকে খবর পেয়ে তিন ভাই নদীতে ঝাপ দিয়ে নদীর ওপারে রোহিতপুর গ্রামে দিকে সাঁতরে যেতে লাগল।নদীর পানি কমে যাওয়া অতটা গভীর নয়।নদীর মাঝেই একটু বেশি পানি।আর কিনারায় কোমড় সমান পানি।

২৪.
রাতের বেলা ভাইকে নিয়ে বসে আছে পুতুল।তার জ্বর কমতে শুরু করেছে।হারিকেন আলো প্রায় শেষের দিকে।চোখটা ঘুমের জন্য মেলে রাখায় দায়।রাতে মামী জোর করে দুই লোকমা ভাত তুলে খাইয়েছে।এরপর ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে।এখন একটু ঘুমাতে পারলে বেশ শান্তি লাগবে।কিন্তু তার ঘুমটা গভীর হওয়ার আগেই ছাগলের ডাক কানে ভেসে আসে গোয়াল ঘর থেকে।এমন সময় ছাগলগুলো ডাকছে কেন?মামা বাসা নেই।মামী তার রুমে বাবুকে ঘুম পাড়াতে গেল।মনে হয় চোখ লেগে গেছে তাই কিছুই টের পায়নি।পুতুল ভাইয়ের ওপর একটা কাঁথা দিয়ে দিলো। দরজাটা খুলে মাথাটা একটু বের করে আবার ভিতরে ঢুকিয়ে নেয়।বাহিরে চাঁদের আলোয় কিছুটা পরিষ্কারের মধ্যে কেমন যেন অদ্ভুত দৃশ্যতে চোখ আটকে যায়।ছাগলের রশি ধরে টানছে দুই অদ্ভুত লোক।তাদের পা থেকে মাথা পর্যন্ত গাছ লতাপাতা দিয়ে ঢাকা।এটা আবার কি জিনিস?পুতুল ভেবে পায়না।একজন তার আদরের রাণীকে কাঁধে নিয়ে হাটতে দেখে নিজের পায়ের জুতা খুলে রাগে ঝুড়ে মারে।মুখের ওপর ছোটো একটা জুতা দেখে উহু শব্দ করে উঠে অর্পণ।তার মুখের ওপর এমন লিলিপুট জুতাখানা কে মারলো?পুতুল ভয় না পেয়ে আদরের রাণীকে কোলে নিয়ে তার ঘরে ঢুকেই দরজাটা ঠাসস করে লাগিয়ে দেয়।দরজার শব্দে রেনু’র ঘুমটা ভেঙে যায়।ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।ততখনে তিন ভাই ছাগল রেখেই হাওয়া।

পুতুল রাণীকে জড়িয়ে ধরে বসে আছে।রাজিয়া সাথে এই বাড়িতে তার থাকার পঞ্চম দিনই রানীর জম্ম হয়।ছাগলের বাচ্চার নামটা তার মায়ের দেওয়া।রানী।তাই এটার প্রতি তার মনটা একটু বেশিই নরম।

অর্পণ ঠোঁট ধরে পুকুর পাড়ে বসে সমানে দুই বেনীওয়ালিকে বকে যাচ্ছে।

আজ পর্যন্ত কেউ তাকে একটা থাপ্পড় মারেনি।সেখানে কি-না এই লিলিপুট একখানা জুতা ছুড়ে মারে।তাও আবার কাকে?মিষ্টার অর্পণ তালুকদারকে।এই লিলিপুট জুতার মালিককে আমি দেখে নিবো।অসভ্য মেয়ে মানুষ।

চলবে….

চক্ষে আমার তৃষ্ণা পর্ব-২+৩+৪

0

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-২
৩.
মাগরিবের আজান কানে ভেসে আসছে।রেণু হারিকেন আলো জ্বালিয়ে স্বামী দিকে তাকিয়ে আছে।বোনের মুখের ওপর ঠাসস করে দরজা বন্ধ করে নিজেও কেঁদে দেন।যতই হোক ভাই হয়।বোনের জন্য মনটা কাঁদে।

-;বোনকে বের করে নিজেই কষ্ট পাচ্ছেন।একবার ভেবে দেখছেন এই অবস্থায় মেয়েটা কোথায় যাবে?নিজে না খেয়ে বসে আছেন।আর ওর এই অবস্থায় ভরা সন্ধ্যায় বাহিরে রয়েছে।সারাদিন ধরে মনে হয় পেটে দানা,পানি কিছুই পড়েনি।আপনি রাগ না করে ওকে ঘরে আনুন।আমিও একজন মা।মা হয়ে আরেকটা সন্তানকে কষ্ট পেতে দেখে নিজেরই খারাপ লাগছে।আপনি বোনের প্রতি রাগ।কিন্তু তার সন্তানের ওপরে কোনো রাগ নেই।আপনি ওদের.….।

-;রেনু আমার মাথা একদম গরম করব না কইয়া দিলাম?মাথা গরম করলে কিন্তু খুব মাইর দিমু।

স্বামীর কথায় রেণু মুচকি হাসে।এই লোকটা নাকি তাঁকে ধরে মারবে।বি’য়ের তিন বছরের সংসারে একটা উচ্চস্বরে ধমক দিয়ে কথা ব’লেনি।আবার সেখানে নাকি মারবে।স্বামীর কথাটা রেনু কাছে হাস্যকর লাগে।তবুও স্বামী যখন বুঝতে পারলোনা।তখন নিজেই দরজা খুলে বাহিরে বেরিয়ে যায়।স্বাধীন দেখে ওহ কিছু ব’লেনি।

রাতের আঁধারে কোথায় যাবে রাজিয়া?মেয়ে আর নিজের অনাগত সন্তানের কথা চিন্তা করেই ভাইয়ের ভিটায় এখনো বসে আছে।এই বুঝি ভাই বেরিয়ে আসবে।তাকে ঘরে একটু জায়গায় দিবে।কিন্তু সন্ধ্যার আজান পরে যাওয়ার পরও ভাই আসেনা।চোখের পানি ঝড়ে পড়ে।রাতটুকু উঠোনে কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলেই।দূর থেকে শিয়ালের হুক্কা হুয়া শব্দ ভেসে আসে কানে।ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে।পুতুল মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে বসে আছে।রাজিয়া মেয়েকে বুকের মাঝে শক্ত করে ধরে বসে থাকে।আল্লাহ কে ডাকতে থাকে।আগামী বিপদে হাত থেকে রেয়াই পেতে।এমনই সময় দরজা খুট করে খুলে যায়।ভাবে এই বুঝি ভাই এসেছে।চেহারায় খুশির ঝলক আসে।কিন্তু ভাইয়ের জায়গায় ভাবীকে দেখে মুখটা অন্ধকারে ডেকে যায়।তাকে নিতে ভাই আসেনি।

-;এভাবে না খেয়ে বসে থাকলে হবে বোন।চলো ঘরে চলো।ভাইয়ের রাগ নিয়ে পরে থাকলে হবে।আগে দু মুঠো খাবার মুখে দিয়ে একটু বিশ্রাম নেও।

-;কিন্তু ভাবী,ভাইয়া।

-;উনার কথা এখন না ভেবে নিজের আর সন্তানদের কথা ভাবো।না খেয়ে কতখন থাকবে তুমি।পুতুলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল।সেই কখন থেকে তুমি ও না খাওয়া আম্মু।ভিতরে এসো আম্মু।রেনু,রাজিয়া আর পুতুলকে নিয়ে ঘরে ঢুকে।তাদের নিয়ে ঘরে ঢুকেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে খাবার খাইয়ে বিছানায় ঘুমাতে ব’লে চলে যায়।

রেণু নিজেদের শোয়ার করে আসতেই স্বাধীন মুখ ঘুরিয়ে বলল,

-;সেই তুমি আমার কথার অবাধ্য হইলা বউ।

-;তাহলে কি করতাম?আপনার মতো হাত গুটিয়ে বসে থাকতাম।আমি না হয়,হাত গুটিয়ে বসে থাকতাম।কিন্তু বাহিরে ওরা থাকলে শেয়াল মামাতো আর চুপ থাকতো না।ওরা ঠিকই হামলা করতো।আপনি দয়া করবেননা।তাই ব’লে আপনার বউ হয়ে আমি চুপ থাকতে পারি না।আমার যেটা ঠিক মনে হয়েছে,সেটাই করেছি।এটা নিয়ে আপনি আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।স্বাধীন না খেয়ে গাল ফুলিয়ে বসে থাকে।স্বামীর মুখ ভার দেখে স্বামীর পাশে বসে তার গালে হাত রাখলো।

-;এত রাগ করেন ক্যান?আপনি দিন দিন রাগী হয়ে যাচ্ছেন।আমি কিন্তু এমন রাগী স্বামীকে ভালোবাসি নিই।আমি আমার শান্ত সৃষ্ট বোকা স্বামীকে খুব ভালোবাসি।আপনি মুখ ঘুরিয়ে রাখলে আমরা কোথায় যাব বলুন?আপনি ছাড়া আমাদের কে আছে?এত রাগ করে থাকলে কিন্তু আমিই কালই বাপের বাড়ি একা একা চলে যাব।আপনি সাথে না থাকলে যখন আব্বা,আম্মা জিজ্ঞাসা করবে।আপনি নেই ক্যান?তখন কিন্তু বলবো।আপনি আমার সাথে ঝগড়া করছেন।তাই চলে আসছি।

-;আমি তোমার সাথে ঝগড়া কখন করলুম।

-;করেন নিই।

-;না।

রেনু আর কিছু বলতে নিলেই একমাত্র ছেলে ঘুম ভেঙে যায়।কান্না করে উঠে।তাই স্বামীকে কিছু না ব’লে চুপচাপ ছেলেকে শান্ত করতে করতে স্বামীকে ইশারায় বলল ঘুমিয়ে পড়তে।

৪.
ফজরের আজানের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে পুতুলের। মা ক্লান্ত থাকায় এখনো পরে পরে ঘুমাচ্ছে।তার ঘুম আর না আসায় বাহিরে বের হতেই মোরগে ডাক শুনতে পায়।আরো শুনতে পায় কাকের কা কা ব’লে উঠা ডাক।মাথার ওপর মগডাল বসে কালো কাকটি কা কা করছে।সেই দিকে তাকিয়ে পুতুল।কাকটি এক ডাল থেকে ওপর ডালে বসে ঠোকর দিচ্ছে পায়ে খাবারের জন্য।স্বাধীন ফজরের নামাজ পড়তে যাবে।মাথায় সাদা টুপি পরে বের হয়ে আসে।পুতুলকে এমন ওপর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে আসে।

-;এখান কি করোস?মামার ডাকে পুতুল মনোযোগ সরে যায়।মুখ তুলে মামার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রয় কয়েক পলক।

-;কি রে কথা কস না কেন?স্বাধীনের কথার কোনো জবাব না দিয়ে ঘরে দিকে দৌড় মারে পুতুল।কালকে মা’কে বকেছে মামা নামের এই লোকটা।আজকে তাকে কি খুব বকবে?তাই ভয় পেয়ে যায়।পুতুলের চলে যাওয়া দেখে,স্বাধীন মসজিদের পথে রওনা দেয়।

আমায় একবার যেতে দে না
আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়ে।
যেথায় কোকিল ডাকে কুহু
দোয়েল ডাকে মুহু মুহু
নদী যেথায় ছুটে চলে আপন ঠিকানায়।
একবার যেতে দেনা আমায় ছোট্ট সোনার গাঁয়ে।

সকালের সতেজতা ঠান্ডা বাতাসে মন প্রান জুড়িয়ে যায়।সময়টা চলছে অক্টোবর মাসের শেষের দিক।শীত আসার পূর্ব আভাস এখনই দিচ্ছে।বর্ষা ঋতু সময় সেই কখন চলে গেছে।ছোট ছোট আঁকাবাঁকা পুকুরের পানি কমতে শুরু করেছে।সেখানে ছোট ছোট মাছ ধরতে নেমেছে গ্রামের অল্পবয়সী ছেলে মেয়েরা।পুতুল বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে দেখছে সেসব।তার ভীষণ আনন্দ লাগছে।ইচ্ছে করছে পানিতে নেমে তাদের সাথে মাছ ধরতে।কিন্তু ভয় পাচ্ছে।যদি মামা আবার এসে ধমক দেয়।তখন মামা চলে যেতেই আবার ঘর ছেড়ে বাড়ির আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে আছে।দূরের মাঠে নতুন নতুন ধান বুনছে কৃষকেরা।কি ধান বুনছে তা জানে না পুতুল।শুধু দু’চোখ ভরে দেখছে সবকিছু।বাবার বাড়িতে থাকতে তাকে ঘর থেকে দাদি বের হতে দিতেন না।একে তো কথা বলতে পারে না।তার ওপর পাড়া প্রতিবেশী কথা তুলবে।তার ভয়ে তাকে ঘরে বন্দী থাকতে হতো।কিন্তু মামার বাড়িতে এসে প্রথমে খারাপ লাগলেও এখন খুব ভালো লাগে।অবাক চোখে গ্রামটাকে দেখে।দুই গ্রামে পার হয়ে যে গ্রামটা ছিল সেখানে ছিল তার বাবার বাড়ি।আর এখন এটা তার মামার বাড়ির।তার মায়ের কোনো বাড়ি নেই?আর না তার কোনো বাড়ি আছে।

-;পুতুল মা।কই তুমি?

মায়ের ডাক কানে আসতেই দৌড়ে আসে মায়ের কাছে।মায়ের কাছে বসতেই মা তার সারা মুখে আদর মেখে দেয়।পুতুলের তখন অনেক আনন্দ লাগে।মায়ের মতো করে সেও মায়ের মুখে অনেকগুলো ছোট ছোট চুমু বসায়।

-;তোমার মামী খাবার খেতে ডেকে গেছে সেই কোন বেলায়।এতখন না খেয়ে বাহিরে কি করছিলে।পুতুল মায়ের সঙ্গে হাতের ইশারায় কথা বলছে।তার দেখা ছোট গায়ের কথা।যে গায়ে সবুজ লতায় ঘেরা।মায়া ভরা কিছু সৃস্তি চোখের সামনেই ভেসে ওঠে রাজিয়ার।মনে পড়ে যায়।তার ভাই আর সে ছোট বেলায় কত কিছু করেছে।সেই ছেলেবেলা কথা আজও ভাবলেই মনে হয়।ইস আরেকবার, শুধু আরেকটিবার ছোট বেলা ফিরে যেতে পারতাম।তাহলে আমার ছোট কৈশোরকে আমি দুই হাতে আগলেই রাখতাম।নিজের ভুলগুলো শুধরে নিতাম।বাপ,ভাইয়ের মাথা নত।কখনোই নিচু করতাম না।কতটা সুখী ছিলাম তখন।মা ছিলো না ব’লে বাপ,ভাই কখনোও তাকে অবজ্ঞা,অবহেলা করেনি।দুই হাতে আগলে রাখতেন তারা।কিন্তু একটি মানুষকে ভালোবেসে আজ তার কি পরিনতি?বাপ হারালাম।ভাই থেকে ওহ হারানো।স্বামী নামক লোকটা তার জীবনটা শেষ করে দিলো।নিজের জীবনের সব রঙিন সুখ চুষে মেরে ফেলেছে।আজ তার জন্য মেয়েটি অবহেলায় বড় হবে।তার কিছু হয়ে গেলে এই পুতুলের কি হবে?

৫.
হাত মুখ ধুয়ে খাবার প্লেটের সামনে বসেছে পুতুল।পাশে তার মা’কে বসিয়েছে।মামি খাবার বেড়ে দিচ্ছে।চাল,ডাল দিয়ে ভুণা খিচুড়ি রান্না করেছে।বেশ কয়েকটি পদের ভর্তা করেছেন তিনি।জুইঁ আলু ভর্তা,চ্যাপ্যা শুটকি মাছের ভর্তা আর আর লাল লাল শুকনো মরিচের ভর্তার নাম ছাড়া আরো কোনো নামই জানে না।তাই মামীর দিকে জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়।পুতুলকে অবাক করে দিয়ে মামী বলল,

-;এটা লাউ শাকের ভর্তা,কাঁঠালের বিচির ভর্তা।আলু ভর্তা,সজনে পাতার ভর্তা।মোটা ডাল সিদ্ধ করে হাতে মাখানো ভর্তা।চ্যাপ্যা শুটকি ভর্তা।কালিজিরা ভর্তা।আর সবর্শেষে লাল শুঁকনো মরিচের ভর্তা।যেটা সীল নূরে রেখে শুকনো মরিচের সাথে রসুন বেশি করে দিয়ে পিষে তৈরি করতে হয়।

লাল মরিচের ভর্তা দিকে তাকিয়ে আছে পুতুল।মনে পড়ে যায়,দাদী তাকে লাল মরিচের ভর্তা ইচ্ছে করে খাওয়াতো।যাতে সে বেশি ভাত মুখে দিতে না পারে।পেটে খিদে থাকা শর্তে ওহ সেই ঝাল ভাতগুলো পানি দিয়ে শুধু গিলতো।নাকের পানি,চোখের পানি এক হয়ে অশ্রু ঝড়ে পরতো।মা পাশে না থাকলেই দাদী ইচ্ছে করে প্রায় কষ্ট দেওয়ার জন্য এমন কিছু করতো।মেয়ের এমন দৃষ্টি রাজিয়া বুঝতে পারে।একদিন পুকুর পাড় থেকে কাপড় ধুয়ে এসে যখন শ্বাশুড়ির এমন কু কৃতী স্ব চোখে দেখতে পায়।তখনই বুঝতে পারে তারা বোবা মেয়েটির না বলা কষ্টগুলো।

চলবে….

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৩
রেণু পুতুলের চুলগুলো বেনি করে দিচ্ছে।এতটুকু মেয়ের মাথায় কি ঘন চুল?আর কি সুন্দর সফট।মায়ের মতো দেখতে হয়েছে মেয়েটা।রুপের কোনো কিছুর কমতি নেই।চেহারায় কেমন আদরিনী ভাব।মেয়েটিকে দেখলেই তার গাল দু’টোতে শুধু চুমু বসাতে ইচ্ছে করে।পুতুল বড় হলে একদম কল্পনার দেশের সেই রাজকুমারি মতো লাগবে।এমন রাজকুমারী জন্য বুঝি,কোনো রাজকুমার ঘোড়ায় চড়ে নিশ্চয়ই আসবে।হঠাৎ পুতুল দিকে তাকিয়ে কিছু মনে পড়ে যায়।রেনু মন থেকে গভীর একটা দীর্ঘ নিশ্বাস বের হয়।মেয়েটি কথা বলতে পারেনা।আল্লাহ তাকে সব দিক থেকে পরিপূর্ণ করলেও একদিকে শূন্য করেছে।তার কথা না বলার জন্য তাকে যদি কেউ অবজ্ঞা,অবহেলা করে।তখন কি হবে?না,না আমি এসব কি ভাবছি?আল্লাহ নিশ্চয়ই তার জন্য উত্তম কিছু ভেবে রেখেছেন।

৬.
রাজিয়া বাবা কক্ষে বসে আছে।বিছানায় হাত দিতেই মনে হলো বাবার শরীরের সুগন্ধ এখনো লেগে আছে এই ঘরে।এই বুঝি বাবা, মা ব’লে ডাক দিবে।রাজিয়া ফুফিয়ে কান্না করে।

-;আব্বা…আব্বা!আপনি কই আব্বা?এই দেখেন।আপনার ঘরে আপনার মেয়ে রাজিয়া আইছে।এখন থেইকা আপনি আমারে যা বলবেন আমি সব শুনমু।আপনার কথার বাহিরের একটা টু শব্দ করুম না।আপনি যা শাস্তি দিবেন আমি সব শাস্তি মাথা পাইতা নিমু।তবুও আপনি ফিইরা আসেন।

আব্বা আপনি আমার সাথে রাগ কইরা সত্যিই চইলা গেলেন।একটি বার মাফ চাওয়ার সুযোগটুকু দিলেন না।আমি দোষী আব্বা।আপনার কথা না শুইনা মাঝ নদীতে ঝাপ দিছিলাম।সেই নদী আমারে ডুবাইয়া দিছে।আমার সব,সুখ শান্তি কাইড়া নিছে।আমি একটুও ভালা নাই আব্বা।আব্বা আমারে মাফ কইরা দেন।আমি আর ভুল করমু না আব্বা।রাজিয়া বিছানা সুয়ে কাঁদছে।তার আব্বা আর নেই।তাঁকে আর মা ব’লে ডাকবে না।শুধু একটি ভুলের কারণে আজ বাবা তার পাশে নেই।একদিকে বাপ,ভাই।আর অন্য দিকে স্বামী নামক লোকটা।

-;আমি চলে আসায় সে হয়তো ভালোই আছে।আমাকে এখন আর দরকার নেই।দুইদিন পর হয়তো নতুন কোনো রমনীকে বিয়ে করে ঘরে তুলবে।আমাকে তার মনেই পড়বে না।আমি তার প্রয়োজন ছিলাম।প্রিয় জন হতে পারিনি আব্বা।আব্বা আপনারে কান্দাই আমি সেই সংসারে সুখী হতে পারি নাই।আপনার প্রত্যেকটা চোখের পানির মূল্য আমারে অভিশাপ দিয়া গেলো আব্বা?আমারে হতভাগী কইরা দিলো?

রেণু,রাজিয়া কান্নার শব্দে পেয়ে দৌড়ে আসে।

-;রাজিয়া।

-;ভাবী।আমার আব্বা আমার সাথে রাগ কইরা দুনিয়ায় ছাড়ছে।আমি আমার আব্বারে মেলা কষ্ট দিছি।সেই কষ্টের কারণে আমার আব্বা আজ আর নাই।আমি মাইয়া হইয়া বাপরে কবর ঘরে শুয়াছি।আমি তার মাইয়া নই।আমি রাক্ষসী।আমি আমার আব্বারে খাইয়া ফেলছি।আমারে তোমরা মাইরা ফালাও।আমি আর বাচঁতে চাই না।

-;শান্ত হও বোন।আল্লাহ মাল আল্লাহ লইয়া গেছে।আমাদের সবাইরে একদিন এই সুন্দর পৃথিবী ছাড়তে হইবো।কেউ আগে যাইবো কেউ আবার পরে যাইবো।দুইদিনের দুনিয়া কেউ চিরস্থায়ী নয়।কান্না করলেই কি তিনি ফিরে আসবেন?না তোও।তাহলে কান্নাকাটি করে কোনো লাভ আছে।লাভ নাই।নামায পড়।আর আল্লাহ দরবারে আব্বার লাইগা বেশি কইরা দোয়া কর।কুরআন পড়।তিনি সবকিছুর মালিক।

৭.
তোমারে যা যা বলাম ঠিক তাই করবা ঘটক।
একটা কথার এইদিক সেইদিক হইলে খবর আছে তোমার।আমি আমার ছেলের জন্য সেরা মাইয়া আনমু।মাইয়ার মা’ইরে বল’বা কি কি দেওন লাগবো?

সলিমুল্লাহ পান খাওয়া লাল দাঁতগুলো বের করে হাসে।ঘটকগিরি তার পেশা।গ্রামে গ্রামে ছাতা নিয়া হাটেন।আর সুন্দর সুন্দর মাইয়া খুঁজে এনে ছেলের মায়েদের কানে তুলেন।বিয়ে করানো জন্য।একটা খিলিপান বানিয়ে পকেটে ভরেন।আর মাথা নাড়ান।শাহাদাৎ আঙুলের মাথায় সাদা চুন।আরেকটা পান মুখে পুরে বলল,

-;আপনি কোনো চিন্তা কইরেন না আপা।আপনি যেমন বলছেন।ঠিক তাই বলুম।একটা কথার নড়চড় হইবোনা।

-;তাইলে আজ আসো ঘটক।

-;যাবো।কিন্তু যাওয়ার আগেই যদি কিছু টাকা দিতেন।বুঝেন তোও একেবারে খাট ফাটা রোদ্দুরে খালি হাতে আইছি।আমি আবার খালি পকেটে কোনো জায়গায় যাইতে পারিনা।শরমের তো একটা ব্যাপার স্যাপার আছে না-কি।নাসিমা বেগম শাড়ি আঁচলে গিটঠু দেওয়া।সেখান থেকে দুইশত টাকা বের করে দেন।

ঘটক টাকাটা নিয়ে পকেটে ভরে রাস্তার পথ মাপে।মোস্তফা সরোয়ারের জন্য পাত্রী দেখা হয়ে গেছে।এখন বিয়ে সানাই বাজিয়ে বউ ঘরে তুলে আনার পালা।নাসিমা বেগম মোটা যৌতুক নিয়ে ছেলেকে বিয়ে দিবেন।সুন্দরী রমনী ঘরে আসবে।তার সাথে ঘরের দামী জিনিসপত্র আর মোটা অংঙ্কে টাকা।

বুক চিন চিন করছে হায়।
মন তোমায় কাছে চায়।

ঘটক সরোয়ারের গলা শুনে মুখটা ভেঙ্গায়।
হুম আইছে নবাবের পুত্র।তার আবার বুক চিন চিন করে।

-;কি ‘রে ঘটক?তোর খবর কি?আমার জন্য মাইয়া ঠিক করছোস?না-কি….

-;না,না।কি যে বল না মিয়া!একবারে আসল রতন আইনা দিমু।রতনে রতন চিনবো।আর শুয়োর চিনবো কচু।

-;কি বলি তুই?ঘটকের বাচ্চা তোরে আমি খাইয়া ফালামু।

-;আরে আরে রাগ করেন ক্যান।আমি শুধু কথার কথা বলছি।আপনার মা যেমন আপনারে নিয়া রত্ম গর্ভা।তেমনই আপনি রতন।আর রতনে জন্য রতন আনুম।এতে দোষের কি আছে?আজকে তাইলে আসি।ঘটক জট চলতি কেটে পরে।সরোয়ারের লুঙ্গি হাঁটু পর্যন্ত উঠিয়ে নিয়ে ছিল।ঘটকরে ঘনো ধোলাই দেওয়ার জন্য।কিন্তু চলে যাওয়া লুঙ্গি হাঁটু নিচে নামিয়ে নিলো।বাড়িতে ঢুকার আগেই গালি দিলো।

-;ঘটক শালার বাচ্চা।

ঘটক তিন রাস্তায় উঠে সরোয়ার বাড়ি দিকে তাকিয়ে বলল,

-;হুম আইছে।আমারে নাকি খাইয়া ফালাইবো।আমি কি মাছ,মাংস নাকি যে তেল নুন ছাড়া খাইয়া ফালাবি।বেয়াদবের বাচ্চা।

৮.

কি গোও স্বাধীন মিয়া।শুনলাম তোমার বোন নাকি আইছে।তা বাপ,ভাইয়ের মুখে চুলকানি দিয়ে চইলা গেছিলো।আবার আইছে পোয়াতি হইয়া।লগে ছোট একখানা মাইয়া দেখলাম। ওটা কি তোমার ভাগ্নী না-কি?

স্বাধীন ধানের জন্য জমিতে সেচ দিচ্ছিলো।এমন সময় উপরোক্ত কথাগুলো শুনে হাত থেমে যায়।মাথা তুলে তাকাতেই রমিজ মেম্বারে দেখতে পায়।তবুও কোনো কথা না ব’লে কাজে আবার হাত লাগায়।

মেম্বারের কথার উত্তর না দেওয়া।আবার বলল,

-;যার লগে পালা গেছিল।সে না-কি তোমার বোনের বাড়ি থেইকা বাহির কইরা দিছে?কথাটা আছা না-কি।

-;আমার বোনের বাহির করছে।না-কি করে নাই।সেটা নিয়া আপনার এত মাথা ব্যাথা ক্যান মেম্বার সাব?আপনি নিজের চরকায় তেল দিন।আমার বোনরে নিয়ে ভাবার জন্য আমি আছি।তার ভাই তার লগে আছে।

-;ওহ।তাইলে তুমি ভাই হইয়া তার পাশে খাঁড়াইবা।আর আমাদের গ্রামের যে বদনাম হইছিল।তার কি হইবো?রোহিত পুরে মাইয়া হইয়া।নতুন চওড়া পোলার লগে ভাইগা গেছিল।

-;সেটা আমার এবং আমার ঘরের ব্যাপার।আপনি এসব কথা না ব’লেই খুশি হব।

-;তুমি একটা শিক্ষিত পোলা হইয়া।মুর্খ মাইষের মতো কথা কও।

-;আমার ঘরের কথা পরে কাছে বলা পচ্ছন্দ নয়।এতে যদি মনে হয় আমি মূর্খ।তবে তাই।

স্বাধীনের ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলা মেম্বারের পচ্ছন্দ হইলো না।মেম্বার চলে যেতেই ক্ষেতের কাজ শেষ করে বাড়িতে যায়।

ভর দুপুর বেলা গরম গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের সাথে সর্ষের ইলিশ দেখে পুতুলের আনন্দের শেষ নেই।এটা তার বিষণ প্রিয় খাবার।যদিও সে এই মাছের কাটাঁ বেছে খেতে পারে না।মা বেছে দিলেই পেট ভরে সেইদিন ভাত খেতো।বাবার বাড়িতে এই মাছটা সহজে রান্নাই হতোনা।অথচ সকালে মামা নিজের হাতে বাজার করে দিয়ে গেছে।বউকে দিয়ে আগেই জিজ্ঞেস করে নিয়েছিল।ভাগ্নী তার কি খেতে পছন্দ করে?আজ তার পচ্ছন্দের রান্না করা হয়েছে।যদি ওহ ইলিশ মাছটা খুব দাম।এতো দাম দিয়ে গরিবরা খেতে পারেনা।তবু্ও ভাগ্নীর জন্য ছোট আকারে একটি ইলিশ মাছ এনেছে।যার দাম বর্তমানে ছয়শত
টাকা।মাছের মাথা আর লেজ মিলিয়ে পাঁচ পিছ মাছ হয়েছে।

৯.
এখন বাজে দুপুর দুইটা।স্বাধীন গোসল করে যোহরে নামাজটা তাড়াতাড়ি পরে নিলো।খাবার খেতে বসেছে।তার প্রচন্ড খিদে পেয়েছে।ভাত মেখে মুখে এক লোকমা তুলতে নিয়ে সেই ভাত প্লেটে রেখে।বউকে জিজ্ঞাসা করলো।

-;রাজিয়া ভাত খেয়েছে।

-;হুম!

-; আর তুমি খেয়েছো?

-;

-;কি হলো কথা বলছো না কেনো?

-;আপনি আগে খান।আমি পরে খাইয়া নিমু নিই।

-;তাই।আমাকে ছাড়া কখনো তুমি খেয়েছো।সকালে ভোর সাড়ে সাতটা আমাকে খাইয়ে তারপরে খাবার মুখে তুলেছো।আর এখন বলছো পরে খাবে।বেলা কতটা হলো খেয়াল আছে।একটু পরেই দিবে আছরের আযান।তুমি আমার সাথে খেতে বসো।দাঁড়াও আমি তোমার জন্য ভাত নিচ্ছি।স্বাধীন ভাতের পাতিলের টাকনা সরাতে দেখতে পায়।একটি ভাত ও অবশিষ্ট নেই।

রেনু মাথা নিচু করে ফেলে।তার স্বামী যে হঠাৎ ভাতের পাতিলে হাত দিবে।একটুও বুঝে উঠতে পারেনি।

-;তুমি আমায় মিথ্যে ব’লে বউ।

-;আসলে ঘরে চাল শেষ হয়ে গেছে।তোমায় সকালে বলব একটুও খেয়াল ছিল না।তারপর বাজার থেকে আসলে যখন।তখন তোমার হাতে কোনো টাকা নেই।সব বাজারে শেষ।তাই আমিও তোমায় কিছু বলিনি।

-;সকালে টাকা নেই দেখে কথাটা ব’লে না।রাতে খাবার আসবে কোথা থেকে?

-;আসলে পাশে বাড়ির ভাবীকে ব’লে রাখছি।তিনি রাতের জন্য দুই পটের চাল দিবে।তাই ভাবলাম কাল সকালেই বলব।

-;হুম।এই দিকে এসোও।হা কর।

-;কি?

-;বলছি হা কর?রেণু হা করতেই প্রথম লোকমা বউয়ের মুখে তুলে দিল।তুমি আমার বাচ্চার মা।তোমাকে না খাইয়ে রাখলে আমার ছেলেটা ওহ কষ্ট পাবে।তোমরা কষ্টে থাকলে আমি ওহ ভালো থাকব না।আর কখনো আমার থেকে কিছু লুকিয়ে রাখবা না।যত কষ্ট হোক আমাকে সব বলবা।কথাটা শেষ করে নিজেও একই প্লেটে খাবার ভাগ করে খেলো।দূর থেকে এমন দৃশ্য দেখে রাজিয়া চোখ দুটো জুড়িয়ে গেলো।

স্বামী,স্ত্রী ভালোবাসা বুঝি একেই ব’লে।শত কষ্টের মাঝে থেকেও ভালোবাসা কোনো কমতি নেই।এদের মতো সুখি কয়জনই বা হয়।

চলবে…

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৪
১০.
আমাদের সমাজে রাজিয়া,রেণু মতো কিছু মেয়েরা আছে।যারা টাকা খোঁজে না।একটা ভালো মনের মানুষ খোঁজে।একটা ভালোবাসার হাত খুঁজে।যাকে বিশ্বস্ত করে বাকিটা জীবন পার করে দিতে পারে।যে হাত আঁকড়ে ধরেছে তা মৃত্যু আগ পর্যন্ত ছাড়ে না।টাকায় যদি সুখ কেনা যেতো।তাহলে পৃথিবীতে বিশ্বাস,ভালোবাসা নামক বস্তুটি থাকতো না।

স্বামী,স্ত্রীর সম্পর্ক পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পবিত্র সম্পর্ক।যখন স্বামী,স্ত্রীর মাঝে ভালোবাসা থাকে।তখন সেই পরিবারটা অনেক সুন্দর হয়।এবং তাদের সন্তানরা অনেক ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারে।একটা পরিবারে সুন্দর পরিবেশ তখনই গড়ে ওঠে যখন স্বামী,স্ত্রীর মাঝে আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভালোবাসাও বিশ্বাস থাকে।এবং সময় থাকতে ভালোবাসার মানুষটাকে যত্ন নেয়া দরকার।কারণ যেদিন সেই ভালোবাসার মানুষটা থাকবে না।সেদিন আফসোস করা ছাড়া আর কোন কিছুই করার থাকে না।

“ইকড়ি মিকড়ি চাম-চিকড়ি,
চামের কাঁটা মজুমদার,
ধেয়ে এল দামোদর।
দামোদরের হাঁড়ি-কুঁড়ি,
দাওয়ায় বসে চাল কাঁড়ি।
চাল কাঁড়তে হল বেলা,
ভাত খাওগে দুপুরবেলা।
ভাতে পড়ল মাছি,
কোদাল দিয়ে চাঁছি।
কোদাল হল ভোঁতা,
খা কামারের মাথা।”

রেণু সন্ধ্যা বেলা ছেলেকে সরিষা তেল মাখছিল।স্বাধীন মাগরিবের নামাজ পড়ে চাল নিয়ে আসবে ব’লেছে।তাই স্বামী না আশা পর্যন্ত ছেলের হাতে,পায়ে তেল মালিশ করছে।পুতুল পাশে বসে বাবুর হাত পা নাড়াচাড়া দেখছে।মুখ দিয়ে কিসব অদ্ভুত আওয়াজ করে।সেসব শুনতে ভালোই লাগছে।মামী ছড়া বলতে বলতে ছেলের তেল দেওয়া শেষ করে।পুতুল মুখে হাসি ফুটে।

-;পুতুল মা,একবার গিয়ে দেখে এসো।তোমার মায়ের নামাজ পড়া শেষ হয়েছে কি-না।সে কখন বসেছে নামাজে এখনো উঠে আসলো না।তুমি একটু দেখে এসোও।

মামী বলতে দেড়ি পুতুল দৌড়ে মায়ের ঘরে যেতে দেড়ি করলো না।রুমে আসতেই দেখে মা জায়নামাজে ঘুমিয়ে পড়েছে।চোখে তার পানি দৃশ্যমান।পুতুল মায়ের চোখের পানি নিজের হাত দিয়ে মুছে দিতে নিলেই রাজিয়ার ঘুম ভেঙে যায়।মেয়েকে দেখে বলল,

-;আমার মা’টা কি করে হুম?লুকিয়ে বুঝি মায়ের চোখের পানি মুছে দেওয়া হচ্ছে।এই দিকে এসে বসো।পুতুল বসে পড়তেই তিনবার সূরা ইখলাস,দুইবার আয়তুল কুরসি পড়ে মেয়ের পুরো শরীরে পর পর তিনবার ফু দিয়ে দিলো।

-;আল্লাহ যেনো আমার মায়ের সকল বালা মসিবত দূর করে দিক।

১১.
স্বাধীন ভাই বাসায় আছেন না-কি?একটু বাহিরে আসুন।কথা আছে।

-;কেডা ডাকে? দাঁড়া আইতাছি।

স্বাধীন বাহিরে হারিকেন নিয়ে আসতেই।
-;আরে সুমন তুমি।এত রাইতে আমার বাড়ি।কি মনে করে আইলা?

-;মেম্বার,মাদবরের কাছে বিচার দিছে।কাল সকালে আপনাদের পরিবারের সবাইকে মাদবের বাড়িতে ডাকছে।আপনার নামে বিচার বসাবে।

-;আমার নামে বিচার?আমার অপরাধ কি? কি করেছি আমি?

-;সেটা কালকে মাদবরে বাড়িতে গেলেই জানতে পারবেন।সুমন চলে গেছে।স্বাধীন চিন্তায় পড়ে গেল।

সকাল নয়টা মাদবরে বাড়িতে বিচার বসেছে।রাজিয়া,রেনু,পুতুল মহিলা আসনে দাঁড়িয়ে আছে।পর্দা ওপাশে দাঁড়িয়ে শুনছে এলাকার গুনি মান্য লোকদের কথা।স্বাধীন পুরুষদের প্রথম সারিতে!দুই হাত পিছনে ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে।

-;মেম্বার যা বলো তা শুনলাম।তুমি তোমার বোনরে বাড়িতে জায়গায় দিয়েছো।তা মিয়া তুমি কি গ্রাম নিয়ম নীত ভুলে গেছো?তোমার বোনের জন্য গ্রামের মেয়েরা বিশৃঙ্খল পথে যাইবো।তা আমরা মাইনা নিবো কেন?আমরা চাইনা আমাদের গ্রামের মেয়েরা পথভ্রষ্ট হোক।তোমার বোনের মতো এই গ্রামের মেয়েরা পরপুরুষ সাথে পালিয়ে যাক।এটা কোনোদিন মাইনা নিমুনা।তাই আজ রাতের মধ্যেই তুমি তোমার বোনরে গ্রাম ছাড়তে বলবা।যদি না ছাড়ে তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হইবো।

-;মাদবর চাচা আপনি রায় দিয়েছেন আমি এবং গ্রামের সকলে তা শুনছে।কিন্তু আমার বাবা বেঁচে থাকতে যে কথা দিয়ে গেছে।তার কথা কিভাবে ফেলে দেই কন?

-;কি বইলা গেছে তোমার বাপ?একটু খুইল্লা বল দেখি।

-;আপনি তো জানেন আমরা এক ভাই এক বোন।এতে আর কোনো অংশীদার নেই।আব্বা মৃত্যু আগে সম্পত্তির দলিল লিখিত করে গেছেন।সেখানে উল্লেখযোগ্য করা হয়েছে তার সম্পত্তি ছেলে,মেয়ের দু’জন উভয় প্যাপ্ত হক।আমি তোও আমার সমস্ত সম্পত্তি ভাগ বুঝে নিয়েছি।কিন্তু তার মেয়ে ভাগের অংশের দাবিদার আমি নই।আব্বা বলেছিলেন।তার মেয়ের সেই সংসারের বেশিদিন ঠিকতে পারবেনা।ঠিক চলে আসবে।যদি ফিরে আসে গ্রামে কেউ তাকে গ্রহণ করুক বা না করুক।তার ভাগের অংশের জায়গায় একটা ঘর তুলে দিতে।সেখানে সে নিজের মতো থাকবে।সমাজের সাথে তার কোনো লেনদেন হবে না।সমাজ থেকে বিতারিত এক ঘরে ঠাঁই হইবো।কারো সাথে তার কোনো কথা নাই।গ্রামের মেয়ে হয়ে যখন পালাইয়া গেছে।এটা তার শাস্তি হইবো।আর যদি ফিরে এসে!আবার যদি অন্য কোথাও চলে যায়?তাহলে সে তার শাস্তি থেকে বেঁচে গিয়ে ভালোই থাকবে।মাঝ থেকে তারা সাজা মাফ।আর আব্বা খুব কষ্ট পাইবো।এখন আপনারা ভাবেন তাকে শাস্তি দিবেন।না-কি গ্রাম ছাড়া করবেন।এই যে তার লিখিত দলিল।মাদবরের সামনে টেবিলের ওপর দলিল রাখলাম।আমার কথা বিশ্বাস না হইলে স্ব চোখে দেইখালন।স্বাধীনের কথা শুনে মেম্বারের কপালে সূক্ষ ভাজ পড়ে।স্বাধীন যে চালাকি করে তার খেল খতম করবে।একটু ধারণা ছিল না।স্বাধীনের কথায় সবাই চিন্তায় পড়ে গেল।

-;সত্যি তোও গ্রাম ছেড়ে চলে গেলে সে আরো ভালো থাকবে।কিন্তু গ্রামে রাইখা সাজা দিলে সব মাইয়াগো ভুল করার সাহস পাইবো না।তাই মাদবর দলিল অনুসারে নিজের বক্তব্য পেশ করেন।

-;রাজিয়া এই গ্রামে থাকব এক ঘরে।কেউ তার সাথে মিশতে পারবে না।যদি মিশবার চেষ্টা করে তাহলে তার সাজা হইয়া যাবো সঙ্গে সঙ্গে।মাদবরে কথার ওপর গ্রামের মানুষ আর কোনো কথা বলতে পারলো না।তার সিদ্ধান্ত ওপর সবাই মান্য করল।কিন্তু মেম্বার মিয়ার শান্তি লাগলো না।সে ভরা মজলিস থেকে হনহন করে চলে গেলো।সবাই চলে যেতেই স্বাধীন বিজয়ের হাসি দিলো।আর যাই হোকনা কেন?সে বোনকে একলা পথে আর ছাড়বে না।এতে যত বিপদসংকুল হোকনা কেন?

-;তোরা সাবধানে বাড়িতে যা আমি আইতাছি।
ভাইয়ের কথা সায় দিয়ে বাড়ি পথে হাঁটা ধরলো রাজিয়া।শরীরটা তার আজকাল ভালো যায় না।মনে মাঝে ভয় হয় সে তার সন্তানকে সুষ্ঠুভাবে দুনিয়ায় আনতে পারবে তোও?

১২.

রোহিতপুর গ্রামে ঘটক সাব আসছেন।মুখে তার পান।সাড়া রাস্তার পথে পিক ফালায়।আর স্বাধীনদের বাড়ি খোঁজ করেন।

স্বাধীন উকিল সাহেবের সামনেই বসে আছে।
উকিল সাহেব দলিলটা পড়ে স্বাধীন দিকে তাকিয়ে বলল,

-;আর ইউ শিয়র।তুমি এটাই করতে চাও।

-;হ্যা।আমি সবটা ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।এই দলিল অনুসারে আপনি দু’টো দলিল লিখিত তৈরি করুন।একটা রাজিয়া অপরটি স্বাধীন।

-;ওকে হয়ে যাবে।তবে সময় লাগবে।নামজারী,রেজিষ্ট্রেশন,দলিল সব মিলিয়ে দুটো করে ভাগে প্রচুর টাকা টালতে হবে।এই মুহূর্তে এত টাকা তোমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব।তোমার কষ্ট হবে স্বাধীন।

-;হোক।তবুও সব কিছু করুন।

-;তিন,চারমাস মধ্যেই তুমি তোমার সব কাগজ পএ পেয়ে যাবে।

-;ধন্যবাদ।আসছি।

-;এটা কিন্তু ঠিক নয় স্বাধীন।তুমি আমার বন্ধু হও।কোনোদিন তুমি আমার সাথে ঠিক করে দুটো কথা অন্তত বলোনি।এতে আমার দোষ কোথায়?হ্যা মানছি আমি,এক সময় রাজিয়াকে আমার ভালো লাগতো।সেই অবধি সীমা রেখেছি।কখন তা পার করিনি।শুধু বিয়ে ব্যাপারটা তোমার আব্বাকে জানিয়ে রেখেছিলাম।পড়াশোনা শেষ করেই আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।যে অনুভূতি তার জন্য অনুভব করতাম।সে বুঝতে পারেনি।কেউ তার অপেক্ষা করছিল।সাতটা বছর চলে গেল।কিন্তু তুমি সেই একই রকম সরল,হাসি খুশি রইলেনা।রাজিয়া চলে যাওয়ার,চার বছর পর আমি মায়ের কথায় তার বান্ধবী মেয়ে বিয়ে করেছি।চারটি বছর তোও কম নয়।তুমি বিয়ে করেছে তিন বছর হলো।আমরা কি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারি না আগের মতোও?সব ভুলে কি বন্ধু সম্পর্ক আবার গড়ে তোলা যায় না।

-;আপনি একজন সম্মানিত ব্যক্তি।আপনার সাথে আমার মতো গরিব চাষার ছেলের বন্ধুত্ব জমে না।

-;স্বাধীন আমার কথা শোন।স্বাধীন চলে যেতেই হতাশার শ্বাস ফেললো রাদিফ শেখ।
তুই আজ ও আমায় বুঝতে পারলি না।

১৩.
রাজিয়া চোখের সামনেই ঘটক সলিমুল্লাহ দাঁড়িয়ে।তাঁকে দেখেই চমকে উঠে ভেতর রুমে চলে যায়।স্বাধীন ছোট্ট মোড়া টেনে বসতে দিলো।

-;বসতে আসি নাই।কিছু কথা ব’ইলা চইলা যামু।

-;কি কথা ব’লেন?

-;তোমার বোন জামাই আবার বিয়ার পিরিতে বসতাছে।তা কি জানো?এবার মা,পোলা মিইলা মাইয়া বাড়ি থেকে মোটা অংঙ্কে টাকা আর ঘরের জিনিসপত্র চাইছে।তাদের চাহিদা ব্যাপক।এতো চাহিদা আমি জীবনেও দেখি নাই।

পনেরো লাখ টাকা যৌতুক হিসেবে চাইছে।ছেলের জন্য মোটরবাইক।ঘরে জিনিসপএ সেগুন কাঠের তৈরি।এমন আর কত চাহিদা তাদের।মাইয়ার বাপের বিদেশি টাকা,পয়সা অনেক।তাদের এসব চাহিদা মেটানোর ক্ষমতা আছে।কিন্তু আপনাদের ব্যাপারটা তাদের কাছ থেকে লুকিয়ে বিয়ে ঠিক করছে।এখন আপনি যদি সকল প্রমাণ নিয়ে সব সত্যি কথা ব’লেন।তাহলে মা,ছেলের হাজতবাস নিশ্চিত।

-;বিয়া কবে?

-;সামনের শুক্রবার।

-;ঠিক আছে আমি এটা নিয়ে পড়ে ভেবে দেখবো।

-;আচ্ছা তাইলে আসি।ওহ আরেকটা কথা। বলছিলাম যে,আমি যে আইসা আপনারে খবরটা দিয়েছি।এটা জেনো তারা না জানে!

-;হুম জানবে না।

চলবে…

চক্ষে আমার তৃষ্ণা পর্ব-০১

0

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#সূচনা_পর্ব

১.
আট’মাসের অন্তসত্বা রাজিয়া তার ছ’বছরের পুতুল মেয়েকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ভাইয়ের ভিটায়!গায়ে তার কালচে মারের দাগ।বাবা’র অমত থাকা শর্তে ও ভালোবাসার টানে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিল।বাবা মানতে পারেনি।একমাএ মেয়ে”র এমন কাজে মনে খুব আঘাত পান।এবং অসুস্থ হয়ে পড়েন।মৃত্যুর আগে বিয়েটা সম্পূর্ণ অস্বীকার করে ত্যাজ্য করে যান মেয়েকে।বিয়ে”র কয়েক মাস ঘুরতে না ঘুরতেই জামাই জুয়াড়ি,নেশাখোর জানতে পারে রাজিয়া।তবুও ভালোবেসে ফিরাতে চায় মোস্তফা সরোয়ার কে।কিন্তু সে ভালো পথে ফিরেনি।উল্টো বউয়ের বাপের বাড়ি থেকে যতটুকু গহনা পেয়েছিল।সে সব গহনা জুয়ায় গো হারা হেরেছে।

আর বেশ কয়েকদিন ধরে বাপের বাড়ি থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা চাইতে বলে মানসিক চাপ সৃষ্টি করে।রাজিয়া বাপের বাড়ি এককানা কড়ি আনতে পারবে না।মোস্তফা সরোয়ার মুখের ওপর সরাসরি না করে দেয়।যার স্বরূপ তার শরীরে এমন বিবস্ত্র দাগ।ছোট্র পুতুলের সামনে যখন তার বাবা মায়ের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়।তখন ছোট পুতুল ভয়ে কাঁপতে থাকে।লুকিয়ে থাকে খাটের তলায় কিংবা ঘরের এক কোণে।মায়ের গায়ে মা”রের দাগের স্বাক্ষীয় সে নিজেও বেশ কয়েক বার হ’য়েছে।সে মুখে বলতে পারেনি।

-; আমার মা’কে মেরো না বাবা।কারণ,সে ছোট ভিতু প্রাণী।সে শুনতে পারে।কিন্তু মুখে বলতে পারে না।সে বাকপ্রতিবন্ধী।চোখে দেখতে পায় এবং শুনতে পায়।
কিন্তু বলতে পারে না।আজ যখন বাবা মা”কে মেরে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলোও।তখন সে নিশ্চুপ মূর্তি।চোখ দু”টো ছলছল করে উঠে।মায়ের ছে”ড়া শাড়ির কোনা খামচে ধরে টেনে বাহিরে চলে আসার পথেই বাপের বিটায় একদলা থু*থু ফেলে পুতুল।আর জীবনেও আসবেনা সরোয়ার পরিবারে কাছে।পুতুলের ব্যবহার দেখে সরোয়ারে মা নাসিমা বানু তেলে বেগুনের মতো জ্বলে উঠে।দৌড়ে আসে ছেলের কাছে বউ আর নাতির নামে কা”নে বি*ষ ঢালতে।

-;দেখছিস বাঁজান।কত বড় বেয়াদব ছেমরি।দে দে আর দুই খান লাগা ওর গালে।মা যেমন ছি”লান।তার ঘরেও হয়েছে ছি”লানের জি।লাথি মাইরা বাহির কর বা”ন্দির বাচ্চারে।আমি তোরে আবার বিয়া করামু বাজান।সুন্দর লাহান পরি আনমু।সাথে মোটা অঙ্কের যৌতুকের টাকা আরও ঘরের জিনিস আইবো।তুই যদি এই প্রেমের বিয়া না করতিস।তাহলে আজ তোর কপাল সোনার কপাল থাকতোও।পায়ের ওপর পা তুলে তুই রাজ করতিস।এহন বুঝ কেমন লাগে?তার ওপর মাইয়া হওয়াছে মা*গিতে।তোর র*ক্ত চুইসা খাও নের লাইগা।দেখ পেটের”টা ও আবার মাইয়া হইবো।এইটার মতো বোবা,লেংঙরা,কু’রা হইবো।এই মাইয়া জীবনে বিয়া দিতে পারতি না।কেডা করবে ওরে বিয়া।বোবা মাইয়া কে নিবো ঘারে।তাই কইতাছি বিদায় কর।এগুলোরারে জলতি বাহির কর।আমি তোরে আবার বিয়া দিমু বাপ।

-;আম্মা আপনি এসব কি বলেন?আল্লাহ”র দোয়াই লাগে আপনি চুপ করেন।আপনার কারণে আমি সরোয়ার পরিবারের শত লাঞ্ছনা,কুঞ্জনা সয্যে করে পড়ে ছিলাম।স্বামীর সাথে সংসার করব ব”লে!বাপের বাড়ি ছেড়ে আপনার ছেলে হাত ধরে পালিয়ে আসছি।এখন আপনি বলছেন বের করে দিতে।বের হয়ে কোথায় যাবোও আম্মা?আমার যে আর যাওয়ার জায়গায় নাই।বাপ,ভাইয়ের মুখে চুলকালি মাইখা হাত ধরেছিলাম তার।আর কথায় কথায় আমার মেয়ে কে গালাগালি দেওয়া বন্ধ করুন।

আমাকে যা বলার বলুন।আমার মেয়ে কে এর মধ্যে কেনোও টানছেন।মেয়েরা বাবাদের ঘারে বোঝা হয়না আম্মা।বারবার কেনো ভুলে যান আপনারা।ওর শরীরে কিন্তু আপনাদের রক্ত বইছে।সে সরোয়ার বংশের মেয়ে।মেয়ে”কে মানুষ মতো মানুষ করলে সে এই বংশের আলো বাতি হবে।তাকে নোংরা কথা বলে তার মন মানসিকতা নষ্ট করবেনা।
আর গর্ভের সন্তান ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে সেটা নির্ধারণ করেন মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীন।তিনি খুশী হলে কন্যা সন্তান দান করেন।কিন্তু আপনাদের কন্যা সন্তান নিয়ে হায় হুদাস এর শেষ নেই।কেনোও আম্মা মেয়েরা কি মানুষ নয়!তাদের নিচু চোখে কেনো দেখেন?যেখানে আপনি নিজেও একজন মেয়ে।আমরা মেয়েরা মেয়েদের শএু হ’য়ে দাঁড়ায়।আপনার মতো কিছু শ্বাশুড়ি কারণে আজ মেয়েরা পরের বাড়িতে সুখে নেই।আপনি মেয়ে জাতির কলঙ্ক।

-;হায়,হায় আমার ঘরে কা”লনাগিনী আসছে।এই কালনাগিনী আমার সব শেষ করে দিবে।আমার ছেলের সামনে,ছেলের বউ আমারে অপমান করছে।আর ছেলে দাঁড়ায় দাঁড়ায় সব দেখতাছে।আমার এখন নদীতে ডুইবা মরা উচিত।ছেলে বউ পাগল হয়ে গেছে।এহন আর মায়ের দরকার কি?আজ এর একটা বিহিত হওন লাগব।এর বিহিত না করলে কিন্তু গলায় ভরা কলসি লাগিয়ে নদীতে ঝাঁপ দিমু আমি।

মায়ের উস্কানিমূলক কথায় রেগে চিতকার করে লাকড়ি কাটারি ঘর থেকে লাকড়ি নিয়ে মারতে আসে।মায়ের সামনেই বউয়ের গায়ে হাত তুলে।রাজিয়া ব্যাথা সয্য করতে না পেরে মোস্তফার পায়ে ওপর পড়ে।কিন্তু মোস্তফা থামেনি।উল্টো বলল,

-;আজকেই তোরে তালাক দিমু।তুই আমার সামনে আমার মায়েরে কথা শুনাস।এক তালাক,দুই তালাক,তিন তালাক বলেই মোস্তফা বাসা থেকে বের হয়ে যায়।মোস্তফা মুখে তালাক দিতেই রাজিয়া আল্লাহ গোও ব’লে ওখানেই বেহুস হয়ে যায়।আর নাসিমা ছেলের কাজে আড়ালেই মুচকি হাসে।

চোখে,মুখে পানি পেতেই চোখ খুলে রাজিয়া।পুতুল কাঁদছে।মা মা ব’লে হাত বুলিয়ে ডাকার আকুতি তার চোখে।শরীরের শক্তি নেই।ব্যাথা শরীরের মেয়ে কে বুকে টেনে শান্ত করতে লাগল।মা,মেয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিল।তাদের জীবনের পরিহাস দেখে।
সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চল,কতক্ষণ বেহুস পড়ে ছিল রাজিয়া জানা নেই।তবে যোহর আজান পড়তেই মাথায় কাপড় টানে।মুখে বুলি আওড়ায়,

-;এতক্ষণ বেহুস হ’য়ে পড়ে আছি মাটিতে।আর আম্মা সেটা দেখেও আমাকে আর আমার মেয়েকে একটু ঘরে নিলোও না।আম্মা এত নিষ্ঠুর কেনো?তাদের মনে কি কোনো দয়া,মায়া নাই।যৌতুকের টাকাই কি তাদের কাছে সব?কিছু সময় চুপচাপ থাকার পড়।আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়।নিজের গায়ের কাপড়টা গায়ে ভালোভাবে জড়িয়ে মেয়ের এক হাত ধরে বলল,

-;চল পুতুল।

ছোট্ট পুতুল মায়ের কথায় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।মেয়ের চোখের ভাষা বুঝতে পেরে একটু ঝুঁকে নিচু হয়ে বল,

-;তোর বাপ আমারে তালাক দিছে।এরপর কেমন থাকুম তার সংসারে?তুই ক?আমি তো এখন পরগাছা।এত ভালোবাসার প্রতিদান আজ বুঝি পাইলাম।বাপ,ভাইয়ের মনে কষ্ট দিচ্ছিলাম না।তার ফল আমি পাইছি।চল,এখান থেকে চইলা যাই।তোরে রাইখা গেলে মা*ইরা ফেলাইব এরা।আমি বাঁইচা থাকতে তোরে এহেনে রাইখা যামু না।মা রারি হয়েছি তো কি হইছে?তুই আমার কলিজা মধ্যে থাকবি।আমি তো মা,চাইলেও তোরে ফালাইয়া দিতে পারুম না।এই আল্লাহ দুনিয়ায় কোথাও না কোথাও ঠিক ঠাঁই হইবো,আমগো মা,বেটির।

২.
তুই,তুই এখানে কোন সাহসে আইছোস?বাপ,ভাইয়ের মুখে চুলকানি মাইখা ছাইড়া তোও চইলা গেছিলি।তাহলে আবার কেন আমার দুয়ার আইসা খাঁড়াইছোদ?

-;ওহ ভাইজান আমরে একটু জায়গায় দেও।তুমি ছাড়া এখন আমার যাওয়ার কোনো জায়গায় নাই।সরোয়ার আমারে তালাক দিছে।আমি আমার মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাব?একটু দয়া কর।

-;দয়া করব তোকে।কেন করমু দয়া?তুই তোও আমাদের জন্য একটু দয়া করিস নিই।তোর জন্য আমার মুখের হাসিটা চলে গেছে। তোর জন্য আমি এতিম হইছি।তাই এখানে তোর কোনো জায়গায় হবেনা।তুই এখনই বাইর হইয়া যা আমার বাড়ি থেইকা।তোর এই মুখ আমি দেখতে চাইনা।তোর জন্য আমি বাপ ছাড়া।তোর জন্য আব্বা কষ্ট পাইতে পাইতে মইরা গেলো।আমার হাতে ওপর আব্বা শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করছে।

ভাইয়ের কথা রাজিয়া চমকে উঠে।

-;আব্বা… আব্বা মইরা গেছে মানে?ওহ আল্লাহ এটা তুমি কি কও ভাইজান?এত বড় মিথ্যে কথা বইলো না।তুমি…তুমি আব্বারে ডাক দেও।আমি তার সাথে কথা বলমু।একটিবার তারে ডাক দেও।আব্বা ডাক শুনি না কত বছর হয়ে গেছে।আব্বা,আব্বা আপনি কই?ঘর থেকে বাইরে আসেন।আমি আপনার রাজিয়া।দেইখা যান আমি আইছি আব্বা যান।আমি আইছি।রাজিয়া কান্নায় স্বাধীন মন গলে না।

রাজিয়া উচ্চস্বরে ডাকে ভেতর থেকে স্বাধীন বউ রেণু বের হয়ে আসে।রাজিয়াকে চিন্তে না পারায় দুধের শিশুকে কোলে নিয়ে দুয়ারে দাঁড়ায়।

-;চিতকার কইরা লাভ নাই।এখন কান্দিস ক্যান?তোর জন্য আমি আমার আব্বারে হারাইছি।কেন চইলা গেলি বোন?ঐ জুয়ারি সব খবর আব্বা জানত।আর জানত বইলা তার হাতে তোরে তুইলা দিতে চায় নাই।তোর লাইগা ভালো সমন্ধো ঠিক করা রাখছিলো অন্য ছেলের সাথে।কিন্তু তুই তার প্রেমে অন্ধ হয়ে তারে নিয়ে ভাইগা গেলি।একটিবার পিছনে ফিরে আব্বা মুখটা যদি দেখতি।তাহলে বুঝতি একমাত্র কন্যার শোকে বিছানায় পড়েন আব্বা।আমার আব্বা মেয়ের এমন কাজে কষ্টে মরে যান।আমি পারি নাই তারে বাঁচাইতে।গ্রামের মানুষ অনেক কথা শুনাইছে বাড়ি বয়ে এসে।এসব আব্বা নিতে পারে নাই।বুকের ব্যাথা বুকে লইয়া ঘরে বইসা থাকতো।তুই চলে যাওয়ার তিন দিন পর-ই তার মৃত্যু হয়।সদরের হাসপাতালে আর নিতে পারি নাই।বাড়িতে তার শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করে।আমি ভুলি নাই আব্বা কথা।তাই তোরে
আমি এই বাড়িতে জায়গায় দিমু না।তোর জন্য এই বাড়ির দরজা বন্ধ।তুই তোর পথ আগেই বেছে নিয়েছিস।স্বাধীন,বউ,বাচ্চা নিয়ে ঘরে ঢুকেই বোনের মুখের ওপর ঠাসস করে দরজা বন্ধ করে দেয়।ছোট পুতুল মায়ের আহাজারি দেখে নিজে ওহ কেঁদে ওঠে।

চলবে।

গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-৩৯ এবং শেষ পর্ব

0

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৩৯.

আজ আষাঢ় মাসের আঠারো তারিখ। তনয়ার জন্মদিন। এই প্রথমবার তার নিজের জন্মদিন একেবারেই মনে ছিল না। সকালে মা বাবা ফোন করে উইশ করায় মনে পড়েছে৷ তারপর ফেসবুকে বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের শুভেচ্ছা পাওয়া গেছে। কিন্তু সবাইকে ধন্যবাদ জানানোর সময়টা পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়েটা বড় দুষ্টু হয়েছে। মাকে এক মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল হতে দিতে চায় না। অবশ্য বাবা বাসায় থাকলে ভিন্ন কথা। তখন বাবাই তার সব। ক্ষুধা ছাড়া তখন মা চেনে না।

মেয়ে এখন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তনয়া জিজ্ঞেস করল, “কিরে, কী দেখিস?”

মেয়ে হাসল। মাড়ি বের করা মিষ্টি হাসি। ওর হাজারটা নাম রাখা হয়েছে। কোনোটাই ফাইনাল নয়। ওরা গুল্টু, মিষ্টু, দুষ্টু এসব বলে চালিয়ে দিচ্ছে।

তনয়া জিজ্ঞেস করল, “আমাকে হ্যাপি বাড্ডে বলবি না?”

আবারও হাসি।

“তোর বাবাকে আজকে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখব। আমার জন্মদিন ভুলে গেছে।”

মেয়ের হাসি বন্ধ হয়ে গেল। তনয়া ভাবল, ও কি সত্যিই বুঝতে পারল সে কি বলছে? মেয়ে তো বাবা পাগল পুরো! দেখতেও বাবার মাতো। বেশি হাসলে নাক কুঁচকে যায় যখন, তখন বোঝা যায় বাবার হাসিটা কার্বন দিয়ে কপি করে এর ওপর বসিয়ে দেয়া হয়েছে। এখন বোধহয় বাবার বিপদ বুঝে চুপ করে গেছে।

তনয়া আবারও বলল, “বাবাকে বলবি না কিন্তু কিছু। আজকে ওর খবর করে ছাড়ব!”

মেয়ে চোখ কটমট করে তাকাল। তনয়া ভারি অবাক হলো। এ তো দেখি সব বোঝে!

সে মোবাইলের টুং শব্দ পেয়ে চোখ সরাল। ওর এক কাজিন ফ্যামিলি গ্রুপে মেসেজ পাঠিয়েছে, “রূপা আপু, তুমি আমাকে স্বরূপ ভাইয়ার মতো একটা বর খুঁজে দেবে। না হলে আড়ি!”

তনয়ার ভুরু ওপরে উঠে গেল। বাবা! ওনার স্বরূপ ভাইয়া এমন কোন মহান কাজটি করলেন?

অন্য একজন লিখেছে, “হ্যাঁ লেখাটা কত রোমান্টিক! আমি দুবার পড়লাম।”

লেখা? তনয়ার কপালে ভাজ পড়ল। কোন লেখার কথা বলছে এরা? সে কৌতুহল নিয়ে ফেসবুকে ঢুকে দেখল স্বরূপের একাউন্ট থেকে লম্বা একটা লেখা পোস্ট হয়েছে। তনয়া পড়ল। একবার, দুবার, তিনবার… প্রতিবারই কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেল তার। মেয়ে প্রথমে অবাক হয়ে ভাবছিল মায়ের আবার কী হলো? কাঁদে কেন? একটু পরে সে নিজেও কাঁদতে শুরু করল। কিন্তু পুনরায় অবাক হয়ে কান্না থামিয়ে দিল। কারন মা তার কান্না থামানোর কোনো চেষ্টাই করছে না৷ হয়েছেটা কী?

*

স্বরূপ লিখেছে-

আমি সম্প্রতি বাবা হয়েছি। সবাই জানে আমার একটা বাচ্চা। কিন্তু আসলে আমার বাচ্চা হয়েছে দুটো। একটা ছোট্ট, মাত্র চার মাস বয়সী। আরেকজন আজ ছাব্বিশে পা দিল।

প্রতিদিন অফিস শেষে বাসায় ফিরে দেখি দুই বাচ্চা ঝগড়া করে একে অপরের ওপর অতিষ্ঠ হয়ে বসে আছে। আমি গেলে দু’জন একত্রে নালিশ জানায়। একজন ট্যাঁ ট্যাঁ করে বলতে থাকে মা তাকে কত বিরক্ত করেছে। জোর করে গোসল করিয়েছে, ঘুমাতে চায়নি তবুও ঘুম পাড়িয়েছে, চোখ গরম দেখিছে। আর বড় বাচ্চা কাঁদো কাঁদো হয়ে জানায় ছোটোটা তাকে কত জ্বালিয়েছে। খেতে দেয়নি, খাবার সময় পটি করে বসে থেকেছে, দুপুরে একফোঁটা ঘুমায়নি, সন্ধ্যায় অযথা কেঁদে কান ঝালাপালা করে দিয়েছে, ইত্যাদি।

তখন আমি দু’জনকে একত্রে সামলাই। ছোটজন আমার কোলে এলেই খুশি। বড়জনকে কোলে নেয়া সম্ভব না, তাই তার জন্য রোজ একটা করে ক্যাডবেরি নিতে হয়। তাতে ছোটোজনের লোভ এখনো লাগেনি, আর ক’দিন পর লাগবে। তখন খরচ বাড়বে। দুটো চকলেট কিনতে হবে।

ছোটোজন আমার কোলে আসার আধঘন্টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ে। আমার কোল খুব আরামের কি না! তখন বড়জন খাবার বেড়ে দেয়, আমরা আরামে খাওয়াদাওয়া করি।

এরপর বড়জন তেল আর চিরুনি নিয়ে এসে হাজির হয়। তার চুলে তেল দিয়ে বেনী করে দিতে হবে। সে সারাদিনে সময় পায়নি। সত্যিই তো। দুষ্টু পাখিটা মাকে নিজের কাজ করতে দেয় না। কতদিন তো গোসলও করতে পারে না বড়জন। আমার মায়া হয়। আমি সুন্দর করে চুল বেঁধে নেই। সে খুশি হয়ে আমাকে পারিশ্রমিক হিসেবে একটা চুমু দিয়ে যায়।

দুষ্টু পাখি খুব রাত জাগে। একটু পরপর সে হিসু করে তার ডায়পার ভেজায়, তারপর এক পেট ক্ষুধা নিয়ে বিকট চিৎকার দেয়। আমরা যখন নতুন বাবা মা হয়েছি, তখন ভয় পেয়ে যেতাম। এখন সামান্য পুরাতন হয়েছি বলে ওর চিৎকারে অভ্যাস হয়ে গেছে।

ওর মা তখন ওকে খাওয়ায়, হেঁটে হেঁটে ঘুম পাড়ায়, আবার এক দেড় ঘন্টা পর তার চিৎকার!

মাঝেমধ্যে আমি উঠি। মায়ের থেকে ওকে নিয়ে হাঁটাহাঁটি করে ঘুম পাড়াই। ওর মা চোখ গরম করে তাকায়, বলে সকালে অফিস আছে, ঘুমাও। আমার ঘুমাতে ইচ্ছে করে না। সকাল থেকে তো তারও মায়ের ডিউটি আছে। অবশ্য মায়ের ডিউটি চব্বিশ ঘন্টাই থাকে।

আমি ভেবেছিলাম ডীল করে নেব৷ রাতে একবার ওর মা জাগলে একবার আমি জাগব। কিন্তু সেটা পুরোপুরি সম্ভব নয়। দুষ্টু পাখির খাবার তো আমার কাছে নেই। মাকে তাই উঠতেই হবে।

আমি আমার মাকে ফোন করলে জিজ্ঞেস করি, আমি কি এত দুষ্টু ছিলাম? মা হেসে বলেন, তোর মেয়ে তোর থেকে লক্ষ গুণ ভালো। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, তাহলে পেলেছ কেমন করে? মা উত্তর দেয়, রক্ত পানি করে।

কথাটা সত্য! দুষ্টু পাখির বাবা হয়ে এটা বুঝতে পেরেছি। আমার মনে হয় একটা বাচ্চা পালার চেয়ে অফিসে সারাদিন কাজ করা ঢের আরামের। তাই দুষ্টু পাখির মায়ের সাথে আজকাল আর রাগ করতে পারি না।

আমি অবাক হয়ে দেখি, সারাদিন আর কিছু পারুক না পারুক, দুষ্টু পাখির মা ঠিকই রান্নাবান্না সব করে। আমি বাসায় ফিরলে গরম ভাত, তরকারি সবই পাই। যে চুল বাঁধার সময় পায় না সে এসব কখন করে? আমি জিজ্ঞেস করি। সে বিরক্ত হয়ে বলে, এতকিছু তোমাকে বলার সময় নেই।

ভোরবেলায় দুষ্টু পাখি ঘুমায়। আমি গোসল করতে করতে তার মা রুটি বানিয়ে ফেলে। সে গরম রুটি একটা একটা করে ভেজে টেবিলে দিয়ে যায়৷ আমি খেতে থাকি। প্রতিবার সে এলে আমি একটা বড় টুকরো তার মুখে গুঁজে দেই।

রুটি খাওয়া শেষে সে দু’কাপ চা নিয়ে আসে। চা খেতে আমাদের সময় লাগে বারো মিনিট। এই বারো মিনিট আমরা সব ভুলে নিজেদের মতো থাকি। সেদিন দুষ্টু পাখির মা বলছিল, দেখেছ, আমাদের একান্ত সময় কমে গিয়ে মাত্র বারো মিনিটে এসে দাঁড়িয়েছে?

আমি ভাবলাম, তাই তো! বাকি পুরোটা সময় আমরা বাবা মা হয়ে যাই। শুধু দিনের এই বারো মিনিট আমাদের নিজস্ব সময়৷

এত কথা বলার কারন একটাই, বারো মিনিটকে আরেকটু দীর্ঘায়িত করতে চাই৷ এই ধরুন, পনেরো কিংবা বিশ মিনিট। দুষ্টু পাখির মায়ের আজ শুভ জন্মদিন। উপহার হিসেবে তাকে একটা রুটি মেকার কিনে দিলে কেমন হয়? দ্রুত রুটি বানানো হয়ে যাবে। তাহলে একসাথে সকালের নাস্তা খাওয়া যাবে। বলুন তো, কোন ব্র্যান্ডের রুটি মেকার সবচেয়ে ভালো হবে?

ও হ্যাঁ, দুষ্টু পাখির মাকে শুভেচ্ছা জানতে ভুলবেন না।

(সমাপ্ত)

সুমাইয়া আমান নিতু

গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-৩৮

0

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৩৮.

ঝড়বৃষ্টি কমল না, বরং ক্রমেই বাড়তে লাগল। বাবা ফোন করে জানালেন, তিনি ফিরতে পারবেন না। স্বরূপ যেন রাতটা থেকে যায়।

রাত বাড়তেই তনয়ার ক্ষুধা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। সে রান্নাঘরে ঢুকল। এখানে আসার পর থেকে মনমেজাজ আর শরীর খারাপ থাকায় রান্নাঘরের দিকে আসার ইচ্ছেও হয়নি। মা-ই মুখে তুলে খাইয়েছে৷ খাবার কিছু আছে কি না কে জানে!

তনয়া দেখল দুপুরের রান্না অল্পই আছে। স্বরূপ এসেছে বলে হয়তো মুরগি ভিজিয়ে রেখেছিলেন মা। রান্নার সময় হয়নি। তনয়া ভাবল এটাই রেঁধে ফেলা যাক। তার আগে কিছু খেতে হবে। সে দুপুরের বেঁচে যাওয়া ভাত আর তরকারি বেড়ে নিয়ে খেতে বসল।

স্বরূপ গোসল করতে গিয়েছিল। এই গরমেও সে সারাদিন গোসল করার সুযোগ পায়নি। সে গোসল সেরে বের হয়ে দেখল তনয়া ঘরে নেই। তাকে পাওয়া গেল রান্নাঘরে। টুলে বসে ভাত খাচ্ছে। কী আরাম করে কাঁচামরিচে কামড় দিচ্ছে! স্বরূপের ভারি ভালো লাগল।

তাকে দেখে তনয়া কিছুটা লজ্জা পেল। বলল, “স্যরি, তোমাকে রেখে খাচ্ছি। খুব খিদে পেয়েছিল। তোমার জন্য রান্না করব এখন।”

স্বরূপ হেসে বলল, “দরকার নেই মিসেস সিন্ডারেলা, আপনি আরাম করে খেতে থাকুন। আমি রান্না করছি।”

তনয়া উঠতে গেল, “সেকি! না না, তোমার কিচ্ছু করতে হবে না, যাও তো!”

স্বরূপ তাকে জোর করে বসিয়ে দিল। বলল, “ইটস ওকে তনয়া! তুমি জানো আমি রাঁধতে পারি।”

“তাই বলে এই বাসায়?”

“আমার বাসায় গিয়ে তুমি রাঁধতে পারলে তোমার বাসায় আমি পারব না কেন?”

“আজব আজব সব যুক্তি!”

“আমি মানুষটাই আজব।”

স্বরূপ রাঁধতে লেগে গেল। তনয়ার খাওয়া শেষ হলে সেও হাত লাগাল। স্বরূপ কাটাকুটি করে ফেলেছে। তনয়া রান্না বসিয়ে দিল। অনেকদিন পর দুজন একসাথে রান্না করল।

রান্না শেষে স্বরূপ নিজের জন্য খাবার বেড়ে নিল। তনয়ার জন্য নিল না। তনয়ার আবারও খিদে পেয়েছিল। কিন্তু কিছু বলল না। ভাবল, স্বরূপ না জানি কী বলবে! একটু আগেই তো সে খেল।

স্বরূপ প্লেট নিয়ে খাবার টেবিলে চলে গেল। তনয়াও গেল পিছু পিছু। তনয়াকে সে নিজের সামনে বসাল। তারপর ভাত মাখিয়ে ওর মুখের সামনে ধরে বলল, “হা করো।”

তনয়া বলল, “আমি তো মাত্রই খেলাম, তুমি খাও।”

“উহু, আমার সাথে খেতে হবে। নয়তো আমি খাব না।”

তনয়া আর না করল না৷ এত ধৈর্যও নেই। একে খিদে পেয়েছে, তার ওপর কতদিন পর স্বরূপের হাতের রান্না তার হাতেই খাবে! সে খেয়ে নিল। মুখে খাবার নিয়ে চোখে পানি চলে এলো তার।

স্বরূপ বলল, “এই না, একটুও কাঁদবে না। বলেছি না আর কোনো কান্নাকাটি নয়!”

তনয়া চোখ মুছল। একটু আগে তাকে থামাতে স্বরূপের ভালোই কসরত করতে হয়েছে। বহু কিছু করেও যখন তনয়ার কান্না থামছিল না, তখন সে তনয়ার লিপস্টিক মেখে মাথায় ওড়না জড়িয়ে খানিক নেচে দেখিয়েছে৷ অতঃপর তনয়ার কান্না থেমে হাসির দেখা মিলেছে।

খাওয়াদাওয়া শেষে ঘুমুতে গেল তারা। ঝড় বহু আগে থামলেও বৃষ্টির বিরাম নেই। স্বরূপ জানালার পাল্লা সামান্য খুলে হাত বাড়িয়ে দিল বাইরে। বৃষ্টিভেজা হাতে তনয়ার গাল ছুঁয়ে দিল। তনয়া সামান্য কেঁপে উঠল।

স্বরূপ বলল, “সুইটহার্ট, এটা আমাদের প্রথম রাত যেটা আমরা একসাথে কাটাব, আর সাথে থাকবে ছোট্ট সোনামণি।”

“উহু, আগেও এমন রাত এসেছে।”

“কিন্তু তখন আমরা তার উপস্থিতির ব্যাপারে জানতাম না তাই না?”

স্বরূপ কাছে এসে তনয়ার পেটে হাত বুলিয়ে বলতে শুরু করল, “তুই কি বাবার ওপর অনেক রাগ করেছিস?”

তনয়া উত্তর দিল, “হ্যাঁ।”

“তোমাকে জিজ্ঞেস করিনি।”

“ওর বয়স কত জানো? মাত্র বারো সপ্তাহ। তাই ওর হয়ে আমি সব বলব।”

“ও কি নড়াচড়া করে না?”

“উহু। এখনই না।”

“কাঁদে না?”

“ধুর!”

“হাসেও না?”

“তুমি একটা পাগল।”

“প্রথম বাচ্চা আমার। সব কি জানি?”

“তো আমার কি আগে আরও বাচ্চা হয়েছে?”

“না, দুজনেরই প্রথম। এজন্যই তো আনাড়ি। বিশ্বাস করো, আমাদের দশ নম্বর বাচ্চা হওয়ার সময় আমি মোটেও এই প্রশ্নগুলো করব না।”

তনয়া চোখ বড় বড় করে তাকাল। “দশ নম্বর!”

“হ্যাঁ, আমার তো ইচ্ছে আছে টোটাল দশটার।”

“বাকি নয়টার জন্য আরেকটা বিয়ে করে নিও। গুড নাইট।” বলে তনয়া বিছানায় একপাশ ফিরে শুয়ে পড়ল।

স্বরূপ বাতি নিভিয়ে শুতে এলে তনয়া বলল, “শোনো! তোমাকে আমার দায়িত্ব দিয়ে গেছে মা বাবা। কোনোভাবেই দায়িত্বের সুযোগ নেওয়া যাবে না। ওই কর্ণারে গিয়ে শুয়ে থাকো।”

স্বরূপ কাঁধ ঝাঁকাল, “As Your wish!”

তনয়া শুয়ে প্রতিদিনকার মতো দোয়া পড়ে সারা গায়ে ফু দিল। তারপর হাত পা ছড়িয়ে দিয়ে লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস নিতে শুরু করল।

ঘরে একটা মৃদু সবুজ আলো জ্বলছে। তাতেই স্বরূপ এসব কার্যকলা দেখতে পাচ্ছে। তার বেশ আগ্রহও হচ্ছে। এভাবে কি ঘুমিয়ে যাবে নাকি? তনয়ার নিঃশ্বাস ভারী হতে থাকল। স্বরূপের একসময় মনে হলো মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু তার চোখে তো ঘুম নেই। কতরাত শান্তিতে ঘুমাতে পারে না!

সে এপাশ ওপাশ করতে করতে একসময় তনয়ার পাশ ফিরে অবাক হয়ে দেখল তনয়া তাকিয়ে আছে।

“একি! ঘুমাওনি?”

“ঘুম আসতে দেরি হয়।” উত্তর দিল তনয়া৷

স্বরূপ হতাশ গলায় বলল, “এককালের সিন্ডারেলার এখন এত কসরত করেও ঘুম হয় না?”

“না। একটা রাক্ষস সব ঘুম খেয়ে ফেলেছে।”

“স্যরি।”

“স্যরি শব্দটা পঁচিয়ে ফেলেছ।”

স্বরূপ নিচু গলায় বলল, “ঘুম আনার একটা লাস্ট ট্রিকস অ্যাপ্লাই করতে পারো।”

“কোনটা?”

স্বরূপ কাছে গিয়ে তনয়াকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, “এবার চেষ্টা করে দেখো ঘুম আসে কি না।”

তনয়া সরে গেল না। চুপ করে পড়ে রইল। তার আবার কান্না পাচ্ছে। কিন্তু কাঁদা যাবে না।

একসময় ঘুম এলো দু’জনের চোখেই। কখন সেটা নিজেরাও বুঝতে পারল না।

*

পরদিন স্বরূপ তনয়ার খালা, যে কিনা রূপার মা তাকে দেখতে তাদের বাড়িতে গেল। হাসপাতাল থেকে সকালেই রিলিজ করে দেয়া হয়েছে তাকে। সেখানে গিয়ে রূপার সাথে দেখা হয়ে গেল। অনেকদিন তার সাথে দেখা নেই।

স্বরূপকে দেখে রূপা কোনো কথা বলল না। কঠিন দৃষ্টিপাত করে ভেতরে চলে গেল। রূপার স্বামী ফসয়াল স্বরূপের সাথে বসে গল্প জুড়ে দিল। ফয়সাল মানুষ ভালো আর ভীষণ আলাপী। আসর জমিয়ে ফেলতে সময় লাগে না। আর কথা শুনতেও ভালো লাগে। তবুও স্বরূপের মনোযোগ সরে যেতে থাকল। রূপার হয়েছে কী? সে কি তনয়া আর তার ঘটনায় রেগে আছে?

বের হবার একটু আগে রূপাকে পাওয়া গেল। সে তার বাচ্চাকে সুজি খাওয়াচ্ছিল। স্বরূপ গিয়ে পাশে বসে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নিল।

রূপা বিরক্ত গলায় বলল, “দেখছিস না খাওয়াচ্ছি।”

“খাওয়াস। আমি চলে যাচ্ছি। খাবার তো এখানেই থাকবে।”

“ঠান্ডা হয়ে যাবে। ছাড় ওকে।”

“তুই রেগে আছিস কেন?”

রূপা এই কথায় দারুণ রেগে গিয়ে বলল, “তোর জন্য লজ্জায় আমার মাথা কাটা গেছে। খালা খালুর কাছে তোর নামে ভালো কথা বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলেছিলাম৷ আর তুই কী করেছিস? এরকম হবে জানলে জীবনেও তোর বিয়ের ঘটকালি করতে যেতাম না। তনয়ার সমানে আমি লজ্জায় যাইনি। আমি ওকে কী বলেছিলাম জানিস? বলেছিলাম তোর মতো ছেলে ও হাজার খুঁজলেও পাবে না। আর তুই শেষ পর্যন্ত এই করে ছাড়লি! ছি! আমি তনয়াকে দেখতে যেতেও পারিনি ভয়ে।”

“স্যরি।”

“ফালতু কোথাকার! তুই বলেছিলি না, তনয়াকে কোনোরকম জুলুম করবি না?”

“ইচ্ছে করে করিনি।”

“কেন করলি?”

“হয়ে গেছে। তুই জানিস মাথা গরম হয়ে গেলে আমি উল্টোপাল্টা বিহেভ করে ফেলি।”

রূপা আরেকটু চড়ে গিয়ে বলল, “আচ্ছা? বুঝলাম। কিন্তু তুই কাল মিলির সাথে ছবি পোস্ট করেছিস কেন? তোর কি মনে হয় তুই এখনো ভার্সিটিতে পড়িস যে বন্ধুবান্ধবের সাথে যখন তখন ছবি দিয়ে দিবি? শ্বশুরবাড়ির লোকের সাথে অ্যাড আছে না তোর? জানিস কতগুলো কাজিন আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেছে ঘটনা কী? কেউ কেউ ভেবে বসে আছে তনয়ার সাথে ছাড়াছাড়ির পর মিলির সাথে তোর রিলেশন! যা তা অবস্থা! মায়ের মাথা ফাটায় ব্যাপারটা থেকে সবার মনোযোগ সরে গেছে। তুই কি আজীবন মাথামোটা থাকবি?”

স্বরূপ ক্লান্ত গলায় বলল, “এতকিছু কি আমি বুঝে করেছি?”

“আহারে! বাচ্চার বাবা হয়ে যাচ্ছো, আর কিছু বোঝো না।”

“সত্যিই বুঝিনি।”

“তনয়ার রাগ ভাঙিয়েছিস?”

“মনে তো হয় ভেঙেছে।”

“ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যাবি না?”

“হ্যাঁ। ভয়েই কিছু জিজ্ঞেস করিনি। যদি না করে দেয়? এখন গিয়ে বলব।”

“যা তাহলে।”

স্বরূপ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তুই আমার জন্য লজ্জা পেয়েছিস সেজন্য স্যরি। আর আমার জন্য তনয়াকে খুঁজে দিয়েছিস বলে থ্যাংস। তুই চিন্তা করিস না। তনয়া একদিন নিজে এসে তোকে বলবে তুইও ওর জন্য সবচেয়ে ভালোটাই করেছিস। আই প্রমিজ!”

*

“ফিরে চলো না তনয়া। প্লিজ! বাসাটা খাঁ খাঁ করে।”

“আমার ভালো লাগে না কিছু৷ ওখানে গেলে একা হয়ে যাব।”

“তুমি চলো, আমি মিতাকে নিয়ে আসব। ভালো লাগবে তখন।”

“আমার সব ভালোলাগা মরে গেছে।”

“তনয়া! আমি ভেবেছিলাম আমাদের মধ্যে সব ঠিক হয়ে গেছে।”

“হয়েছে। কিন্তু আমার যে ফিরতে ইচ্ছে করছে না। আমি কেমন যেন হয়ে গেছি। কিছুই ভালো লাগে না।”

“বাসায় চলো, ভালো লাগবে।”

“আমার খুব কান্না পায়। মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে পারি। ওখানে গেলে কাকে পাব?”

“আমি আছি তো!”

“তুমি তো মা নও।”

স্বরূপ হতাশ হয়ে পড়ল। এক ঘন্টা ধরে বোঝানোর চেষ্টা করে সে ব্যর্থ। কিছুতেই কেন যেতে চাইছে না ও? ইনসিকিউরিটি? ভয়? অভিমান? কোনটা?

স্বরূপ মাথা নিচু করে উঠে দাঁড়াল। দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ল বাইরে। মনের ভারটা আবার ফেরত এসেছে। তনয়া এমন করল কেন?

তনয়ার মন একদিকে খুব চাইছিল স্বরূপের সাথে চলে যেতে। আবার আরেক দিকে কেমন জড়িয়ে ধরা ভয় তাকে বলছিল, যেতে হবে না। এই তো ভালো! এই ছেলে আবার অমন করলে বাচ্চাটা বাঁচবে তো? সে স্বরূপকে বিশ্বাস করে। কিন্তু রেগে গেলে ওর যে আরেকটা রূপ বের হয় তাকে বিশ্বাস হয় না।

তনয়া জানালা ধরে বাইরে তাকাল। নিচে স্বরূপকে দেখা গেল বের হয়ে গাড়ির দিকে যেতে। গাড়িতে চড়ে বসল সে। কিন্তু গাড়িটা চলে গেল না। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তনয়ার মনে হলো স্বরূপ ড্রাইভ করতে পারছে না। তার হাত কাঁপছে। সে কাঁদছে। গতকালও কাঁদছিল স্বরূপ। ওই মানুষটা প্রবল আবেগী, ভালোমানুষ, ভালোবাসার মানুষ। কিন্তু….

স্বরূপ চোখ মুছে সোজা হয়ে বসে স্টিয়ারিং ধরল শক্ত হাতে। এত ইমোশনাল সে কবে থেকে? কখন থেকে চেষ্টা করেও কেন নিজেকে সামলাতে পারছে না?

বড় করে নিঃশ্বাস নিল সে। গাড়িতে স্টার্ট দিল। তখনই মেসেজের টুং শব্দটা কানে গেল তার। স্টার্ট বন্ধ করে মেসেজবক্স খুলল। তনয়ার মেসেজ,

“চলে যাচ্ছো যে বড়! আমি কি ব্যাগ গোছাতে পারি? গুছিয়ে না দিলে যাব কী করে?”

স্বরূপ গাড়ি থেকে বের হয়ে ওপরের দিকে তাকাল। তনয়া হাসিমুখে কাঁদছে। তারও চোখে জল। তবে ভেতরে অসম্ভব প্রশান্তি।

(আগামী পর্বে সমাপ্য)

সুমাইয়া আমান নিতু

গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-৩৬+৩৭

0

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৩৬.

দ্বিতীয় কলিংবেলটা বাজল কয়েক সেকেন্ড পরেই। রওনক বিরক্ত হয়ে উঠল। দরজা খুলে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল সে। বাইরে যে দাঁড়িয়ে আছে তাকে এখানে এই মুহূর্তে সে কষ্মিনকালেও আশা করেনি।

তাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাফাত জিজ্ঞেস করল, “মিলি এখানে?”

রওনক কথা বলতে পারল না। সরে গেল দরজা থেকে। ভেতরে ঢুকল সাফাত। মিলি সোফায় বসে বাঁকা হেসে তার দিকে তাকাল। সাফাত অত্যন্ত রূঢ় গলায় বলল, “সমস্যা কী? এখানে কেন আসতে বলেছ?”

“বসো। বলছি।”

“বসবার সময় নেই।”

“আহা বসো, তোমার প্রিয় গার্লফ্রেন্ড, না স্যরি শয্যাসঙ্গীকে মিস করছ নাকি?”

রওনক এগিয়ে এলো, “হচ্ছেটা কী এসব?”

“সেটা আপনি একটু পরেই বুঝতে পারবেন।”

সাফাত আর রওনক দুজনেই অবাক হয়ে রহস্যময়ীর দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা চাইছে কী? সাফাত খেয়াল করল মিলিকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। এত সেজেছে কেন? মানুষকে দেখাতে ইচ্ছে করে রূপ?

আবারও বাজল কলিংবেল। রওনক এগিয়ে গেল। দরজা খুলতেই ওপাশ থেকে মানুষটা ঝাঁপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরল তাকে। কাঁদতে কাঁদতে রওনকের মুখে চুমু খেতে থাকল। বলল, “ঠিক আছো তুমি বেইবী? ভালো আছো? তোমার এক্সিডেন্ট হয়েছে শুনলাম…”

মেয়েটা প্রথমে খেয়াল করেনি ভেতরে আরও মানুষ আছে৷ যখন দেখল তাদের, তখন ঝট করে সরে গিয়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো দাঁড়িয়ে গেল।

সাফাত আর মিলি চেয়ে চেয়ে দেখছিল সাফাতের প্রেমিকা শিখাকে।

সাফাত চিৎকার করে উঠল, “হোয়াট দ্য হেল ইজ গোইং অন?”

দরজা খোলাই ছিল। এবার স্বরূপ ভেতরে ঢুকে সবার দিকে চেয়ে বলল, “হ্যালো!”

মিলি হাসল। বলল, “বোস। কাহিনী বলি। তুই তো জানিস হালকা পাতলা। পুরোটা বললে বুঝবি।”

সাফাত চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “পুরোটা কী?”

মিলি একটু কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিয়ে বলল, “শিখা আর রওনক বিবাহিত৷ তাদের প্রেমের বিয়ে ছিল। বিয়েটা হয় আরও প্রায় নয় বছর আগে৷ ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন ফার্স্ট ইয়ারে তারা বিয়ে করে।”

সাফাত শিখার দিকে চেয়ে বলল, “কিন্তু শিখা, তুমি..তুমি তো বলেছিলে…”

মিলি বলল, “ও নিজেকে অবিবাহিতা বলেই বরাবর পরিচয় দিয়ে আসছে। বিয়ের কথা এমনকি ওর পরিবারও জানে না। সম্ভবত বিয়ের কয়েক বছর পর তারা একে অপরের ওপর আগ্রহ হারায় এবং বিভিন্ন মানুষের সাথে সম্পর্কে জড়ায়৷ ওরা নিজেরা এক্ষেত্রে নিজেদের কাছে সৎ ছিল। দু’জনই জানত অপরজন কখন কাকে ডেট করছে।

রওনক বাবার বিজনেসের উত্তরাধিকার হয়েছে। কিন্তু তার ফুর্তিবাজ স্বভাব৷ প্রচুর টাকা সে তার প্রেমিকাদের পেছনে খরচ করে। শিখা বুদ্ধিমতী। সে বুঝতে পারে এভাবে চলতে থাকলে একসময় রওনকের কিছুই থাকবে না৷ এদিকে শিখার লেটেস্ট আবিষ্কার ছিল সাফাত। সাফাত তার পুরানো কলিগ৷ সে বহুদিন অবজার্ভ করার পর বুঝতে পারে সাফতের ধৈর্য আছে, কাজের ডেডিকেশন আছে, সে অনেকদূর যাবে৷ এদিকে তার পৈতৃক সম্পত্তিও কম নয়৷ শিখা তাই ঠিক করল সে রওনককে ছেড়ে দিয়ে সাফাতকে বিয়ে করবে৷

এমনিতে রিলেশনে থাকলেও সে কোনে ছেলের সংসার ভাঙত না৷ কিন্তু সাফাতকে বিয়ে করতে হলে আমাকে পথ থেকে সরাতেই হতো। এজন্য সে খুব ডেস্পারেট হয়ে ওঠে। অল্প সময়েই এদের নোংরামি তুঙ্গে উঠে যায়। সাফাত মানুষ হিসেবে খারাপ ছিল না, কিন্তু একটা ট্রেইনড মেয়ের ক্রমাগত ছলাকলা ইগনোর করার মতো শক্ত মানসিকতাও রাখত না৷ শিখা ওকে ভড়কেছে, আমার বিরুদ্ধে কানপড়া দিয়েছে৷ শেষে আমার বাসায় এসে উঠেছে৷

রওনক আবার এতকিছু জানত না৷ শুধু জানত সাফত শিখার বর্তমান বয়ফ্রেন্ড। শিখার থেকেই সে আমার কথা জানতে পারে। আমার ছোটো ছোটো ডিটেইলস সম্ভবত সাফাতের থেকে শিখা হয়ে রওনকের কাছে পৌঁছায়। আমাকে তার পছন্দ হয়৷ সে আমার সাথে ফ্লার্টিং করার চেষ্টা করতে থাকে।”

সাফাত যেন এতকিছু দেখে শুনেও মানবে না। সে তার মনপ্রাণ দিয়ে শিখাকে বিশ্বাস করে বসে আছে। শিখার কাছে গিয়ে সে হাত ধরে বলল, “শিখা, এসব কি সত্যি? কেমন করে হয়? তুমি তো আমাকে ভালোবাসো। সত্যটা তুমি বলো। একজন এসব মিথ্যে কথা বলবে আর তুমি কিছুই বলবে না?”

শিখা চুপ করে রইল। তার বোধহয় কথা সাজিয়ে বলার ক্ষমতা হারিয়ে গেছে।

মিলি তার ব্যাগ থেকে কাগজ বের করল যেটা রওনকের আলমারি থেকে পাওয়া গেছে। রওনক আর শিখার বিয়ের সার্টিফিকেট। আর অ্যালবামে তাদের বেশকিছু যুগল ছবি।

সাফাতকে দেখিয়ে বলল, “এরপরেও বিশ্বাস না হলে তোমার মরে যাওয়া উচিত৷ এত কম ব্রেইনওয়ালা লোকের সাথে এতদিন থেকেছি ভেবে নিজের ওপর রাগ লাগছে।”

স্বরূপ এবার জিজ্ঞেস করল, “তুই এতকিছু বের করলি কী করে?”

“এরা নিজেরাই এসে ধরা দিয়েছে। আমার সাথে ফ্লার্ট করার চেষ্টা করছিল রওনক। প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে আমার এক স্কুলফ্রেন্ড, তুই চিনিস হয়তো রিফাতকে, আইটি সেকশনে চাকরি করে। ওকে বলেছিলাম নাম্বার ট্রেস করে লোকটার পরিচয় বের করে দিতে। তবে রওনক চালাক। সে ইন্টারনেট থেকে নিজের মতো নাম্বার বানিয়ে কল করত যেগুলোর বাস্তবে অস্তিত্ব নেই। তবে সে ভুল করে একবার নিজের নাম্বার থেকেই কল করে ফেলে। তখনই ধরা খায়৷

ওর কললিস্ট আমাকে দিয়েছিল রিফাত। সেখানে আমও শিখার নাম্বারটা দেখি৷ সাফাতকে রাত বিরাতে কল করা এই নাম্বার আমার পরিচিত। তখন বুঝতে পারি এদের লিংক আছে।

এরপর বাকি গল্পের কিছুটা গোয়েন্দাগিরি করে বের হয়ে গেছে, কিছুটা আন্দাজ করে নিয়েছি।”

স্বরূপ জোরে হাততালি দিল, “প্রাউড অফ ইউ মাই ফ্রেন্ড।”

মিলি হেসে বলল, “তোর প্ল্যানটাও খারাপ ছিল না। দুজনকে টোপ ফেলে এনেছি। রওনককে নিচে পাঠিয়ে কাগজটা জোগাড় করেছি। এসব তো তোরই আইডিয়া ছিল।”

স্বরূপ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তাহলে যাওয়া যাক! এদের প্রবলেম এরা সলভ করুক বসে বসে।”

ওরা তিনজনের কেউই কিছু বলল না। দাঁড়িয়ে রইল যার যার মতো। মিলি আর স্বরূপ বেরিয়ে গেল। যাবার সময় সাফাত খেয়াল করল মিলির জামাটা কালো রঙের। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, প্রিন্সেস ডায়ানার কথা। সেও তার স্বামীর পরকীয়ার কথা জানার পর কালো রঙের ড্রেস পরে পার্টিতে গিয়েছিল যেটা পরিচিত ‘রিভেঞ্জ ড্রেস’ হিসেবে। ডায়ানার স্বামীর কখনো আফসোস হয়েছে কি না জানে না, কিন্তু তার নিজের মনে হলো, সে সবকিছুই হারিয়েছে।

*

তনয়ার খুব ভোরে ঘুম ভেঙে যায়। রাতে এখন জোর করে ঘুমানোর চেষ্টা করে। ইউটিউব দেখে দেখে কিছু পদ্ধতিতে ঘুম আনানোর চেষ্টা করলে ঘুম একসময় চলে আসে। সবচেয়ে কাজ করে সব চিন্তাভাবনা মাথা থেকে দূর করে হাত পা রিলাক্স করে লম্বা লম্বা শ্বাস নিলে। বাচ্চার কথা ভেবে মনটাও সে ভালো রাখার চেষ্টা করে। তবে ঘুম যত রাতেই আসুক না কেন, ভেঙে যায় কাকভোরে।

ইদানিং ঘুম থেকে উঠেই তার প্রচন্ড খিদে লাগে। মনে হয় পেটের ভেতর ড্রাম বাজতে থাকে। ফল বা বিস্কুট খেলে খিদে মোটেও যায় না। মা তাই নামাজ পড়তে উঠে আগে ভাত বসিয়ে দেন৷ আগের দিনের তরকারি গরম করে রাখেন কিংবা ডিম ভেজে দেন৷

খাওয়া শেষে শান্তি লাগে তনয়ার। শরীরে আরাম লাগতে থাকে। সে এরপর এক কাপ চা বা কফি বানিয়ে নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসে। সকালের সতেজতা তাকে দিনের অর্ধেকটা সময় ভালো রাখে।

সমস্যা শুরু হয় দুপুরের পর থেকে। কেমন যেন অবসাদ গ্রাস করতে থাকে তাকে একটু একটু করে। কিছুই ভালো লাগে না। কিছুই সহ্য হয় না। সে ছটফট করতে থাকে। মায়ের সাথে বসে, বাবার সাথে বসে, ঘরে শুয়ে থাকে, মোবাইল/ টিভি দেখার চেষ্টা করে, সবকিছুই বিরক্ত লাগে। এমনও না যে স্বরূপের কথা তার মনে পড়ে। ওর কথা ভাবলে আরও অসহ্য লাগে। তার কেন যেন মনে হয় দিন দিন ডিপ্রেশন পেয়ে বসছে তাকে। কিন্তু এখন এরকম হলে চলবে? বাচ্চার কথাও তো তাকে ভাবতে হবে।

স্বরূপ যখন রাতে এসে বসে থাকত, প্রথম প্রথম সে দেখা করত। কিন্তু সেই একই কথা, “আমি স্যরি, অনেক ভুল হয়ে গেছে। ফিরে চলো, ফিরে চলো, ফিরে চলো…”

তনয়ার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হতো, “কেন ফিরব? বাচ্চাটা না থাকলে তুমি ফিরতে বলতে? ওর খবর জানার আগে দেখতে এসেছিলে?”

সে অবশ্য কিছু বলত না। চুপচাপ স্বরূপের কথা শুনত। ওর ঘ্যানঘ্যান শুনলে রাতে আর ঘুম আসত না। মাথার মধ্যে একটাই গান বাজতে থাকত, “ফিরে চলো..ফিরে চলো…”

একসময় সে দেখা করা বন্ধ করে দিল। তারপরেও স্বরূপ রোজ আসত। তনয়ার কান্না পেত ওকে দেখলে। শুধু মনে হতো ওর জন্য তার বাচ্চাটার এত কঠিন অবস্থা। যদি সেদিন মিসক্যারেজ হয়ে যেত? কার দোষ হতো?

এরপর স্বরূপ আসা বন্ধ করে দিল। তনয়ার তাতেও অস্বস্তি। সন্ধ্যা থেকে মনে হতো, আজ আসবে। এসে বসে থাকবে। তনয়া কখনো উঁকি দিয়ে দেখে আসত তাকে। ওকে দেখলে আরও কষ্ট হতো, তবুও। কী এক অদ্ভূত পরিস্থিতি! সে বুঝতে পারে না।

একদিন সে সকাল সকাল বসেছে বারান্দায়। হঠাৎ গলির একপাশে পার্ক করা কালো গাড়িটা চোখে পড়ল তার। স্বরূপের গাড়ি এটা! দূর থেকেও চিনতে পারল তনয়া।

এরপর খেয়াল করল মানুষটাকেও৷ দোকানের ঝাঁপি আর বৈদ্যুতিক খুঁটির আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে চিনতে অসুবিধা হলো না৷ সে অবশ্য খুব চেষ্টা করেছে নিজেকে লুকোবার, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে৷

তখন থেকে তনয়া প্রতিদিনই তাকে আসতে দেখে। ওর কাজকর্ম দেখে তার এত হাসি পায়! ভাবে তনয়া তাকে দেখে না৷ তনয়া ইচ্ছে করেই না দেখার ভান করে থাকে। কিন্তু দেখতে পায় সবই। নিজের বউকে দেখতে কত লুকোছাপা! হাস্যকর!

তনয়ার এই সকালের অভিসার মন্দ লাগে না। রাতে তাকে যতটা অসহ্য লাগে তেমন সকালে লাগে না। বরং ভালোই লাগে।

এখন সন্ধ্যা৷ তার আবারও সেই অস্বস্তি শুরু হয়েছে। এমন লাগে কেন? কেন মনটা এত ভার হয়ে থাকে?

মোবাইল হাতে ফেসবুকে ঢুকল সে। স্বরূপের পোস্ট পড়ল সবার সামনে। সে অনেকদিন কোনো পোস্ট বা ছবি দেয় না৷ আজ দুটোই দিয়েছে। ব্যাপার কী?

পোস্টটা অতি আজব!

“শহর থেকে আপনি সব মশা মেরে ফেলতে পারবেন না। কিন্তু একটিও যদি মারেন, ধরে নিতে পারেন একজন মানুষকে ডেঙ্গু থেকে বাঁচিয়ে দিলেন।”

তনয়া কিছুই বুঝল না। কমেন্ট দেখেও মাথায় কিছু ঢুকল না।

আর যে ছবি পোস্ট করেছে সেটাতে স্বরূপ একা না, ওর সাথে মিলি। হাসিমুখের সেলফি। মিলিকে ভয়াক সুন্দর লাগছে। এই ছবির ক্যাপশনে লেখা, মিশন সাকসেসফুল৷

তনয়ার ভীষণ কৌতুহল হলো। ঘটনাটা কী? স্বরূপকে জিজ্ঞেস করা যাবে না। সে কি মিলিকে একটা ফোন করবে?

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৩৭.

মিলিকে কয়েকবার ফোন করেও পাওয়া গেল না। তনয়া কৌতুহল চেপে রাখল। কখনো না কখনো তো পাওয়া যাবে তাকে। সে জানালার বাইরে তাকাল। সন্ধ্যার শেষ আলোটুকু মুছে গেছে কখন যেন৷ তারা ফোটেনি আজ। আকাশ মেঘে ঢেকে আছে।

মা ডাকলেন৷ “তনয়া…চা খেতে এসো…”

তনয়া উঠল। চায়ের সাথে কী করেছে মা? এত ক্ষুধা লাগে তার এখন! চব্বিশ ঘন্টার বারো ঘন্টা বোধহয় সে খাওয়ার কথাই ভাবতে থাকে।

ওদের বাড়িতে সন্ধ্যার চা নাস্তা বরাবর বসার ঘরেই করা হয়৷ টি টেবিল ঘিরে সোফায় বসে কথা বলতে বলতে চা খাওয়া হয়, কখনো টিভিতে ভালো প্রোগ্রাম চললে সেটা দেখা হয়৷ তবে তনয়ার ওই ঘরোয়া আড্ডাটাই ভালো লাগে। আজ বন্ধের দিন। বাবা বাসায়ই আছেন। বাবা থাকলে আসর জমে যায়। বাবা ভালো গল্প জানেন না, তবে যতটুকুই কথা বলেন, মন ভরে যায়।

তনয়া বসার ঘরে গিয়ে দেখল বাবা বসে আছেন৷ হাতে একটা বই৷ বইয়ের নাম ‘মানসিক শান্তি কেন পাচ্ছেন না?’

তনয়া বইয়ের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, “এটা আজ কিনে এনেছ বুঝি?”

“হুম। বিকেলে হাঁটতে বের হলাম, তখন পেয়ে গেছি সবুজের বইয়ের দোকানে।”

তনয়া কৌতুহলী হয়ে উঠল, “ভালো নতুন বইয়ের কালেকশন এসেছে?”

“কি জানি! খেয়াল করিনি।”

“বাবা, তুমি কি খুব অশান্তিতে আছ?”

“না তো মা।”

“তাহলে এই বইটা পড়ছো কেন?”

বাবা হেসে বললেন, “নামটা ইন্টারেস্টিং লাগল তাই।”

তনয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার বিয়ের সময় বাবা খুব স্বস্তি পেয়েছিলেন। ভেবেছিলেন ভালো পাত্রের হাতে মেয়ে তুলে দিচ্ছেন, এবার তিনি নিশ্চিন্ত। কিন্তু ক’দিন যেতে না যেতেই সে বাড়িতে ফিরে এসেছে। বাবা নিশ্চয়ই এটা আশা করেননি। বাবা তাকে ভীষণ সাপোর্ট করেন এটা সত্যি, আবার তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তাও কম করেন না৷ মায়ের কাছে সে শুনেছে, বাবা নাকি স্বরূপকে আচ্ছামতো ঝাড়ি দিয়ে এসেছে৷ বাবা তাকে এতটা ভালোবাসে যে সে যেতে চায় না বলে তাকে কখনো স্বরূপের সাথে জোর করে পাঠিয়ে দেয়নি। স্বরূপের সাথে দেখা করার জন্য পর্যন্ত জোর করেননি৷ এরকম সাপোর্ট ক’জন পায়? বেশিরভাগ বাবা মা তো ‘মানিয়ে নে’ বলেই উদ্ধার পেতে চায়। মেয়ের মানসিক অবস্থার কথা ভাবে না। বাবা মা যতই তাকে সাপোর্ট করুক, তারাও ভেতরে ভেতরে চান তার স্বরূপের সাথে মিলমিশ হয়ে যাক৷ সে স্বামীর বাড়িতে ফিরে গিয়ে সুখে সংসার করুক। সম্ভবত স্বরূপ তাদের এতটা বিশ্বাস অর্জন করে ফেলেছে। এখন শুধু তার রাজি হবার পালা। সে নিজেকে প্রশ্ন করে, তার কি চলে যাওয়া উচিত? গেলে কি সে এই অসহ্য ডিপ্রেসড লাইফ থেকে মুক্তি পাবে? স্বরূপের ওপর বিতৃষ্ণা যে এখনো কাটেনি তার কী হবে?

চায়ে চুমুক দিয়ে বাবা বললেন, “আজকের একটা নিউজ দেখেছ তনয়া?”

“কোনটা? আমি নিউজ দেখি না।”

“না দেখলে কোনটা জিজ্ঞেস করলে কেন? ঠিক নিউজ না, বিজ্ঞাপন। লালটিলায় নতুন একটা রিসোর্ট হয়েছে। ভেতরটা খুবই সুন্দর। পাশে একটা নদী বয়ে গেছে। নৌকাভ্রমণের ব্যবস্থা আছে। ছোটো ছোটো কুটিরে থাকার ব্যবস্থা৷ ঘরগুলো মাটির, তবে ভেতরটা আধুনিক। এইসব আরকি। যাবে? চলো সবাই মিলে ঘুরে আসি।”

তনয়ার ইচ্ছে করে না এসব কিছুই। কিন্তু বাবা তার মন ভালো করার জন্য কী না করতে চাইছে। সে আগে হলে যেরকম উৎসাহে লাফিয়ে উঠত, সেরকম উৎসাহে চোখমুখ উজ্জ্বল করে বলল, “অবশ্যই যাব।”

“নেক্সর ফ্রাইডে?”

“ওকে ওকে!”

তনয়া ধীরেসুস্থে চা শেষ করে পেয়ালার শেষ কেকের টুকরোটা হাতে নিয়ে কামড় বসাল। এমন সময় ডোরবেল বাজল। মা ইদানীং জামাকাপড় বানানো শিখছেন৷ সপ্তাহে তিনদিন এক মহিলা এসে শিখিয়ে দিয়ে যায়। তারই আসার সময় এটা। মা উঠে দরজা খুলে দিলেন। তনয়া তখন কেকের পুরোটা একেবারে মুখে পুরে দিয়েছে। গেট খোলার পরপর যখন স্বরূপ ভেতরে ঢুকল তখন তার মুখ ফোলা। না পারছে চিবুতে, না পারছে গিলতে।

স্বরূপ ওর চেহারা দেখে হেসে ফেলল।

বাবা বললেন, “আরে স্বরূপ যে, এসো এসো। তনয়ার মা, নতুন করে চা নাস্তা আনো তো।”

মা আগেই রান্নাঘরে গিয়ে দরজি আন্টির জন্য রাখা চা ঢেলে নিয়ে এলেন। পিরিচ গুলো ভর্তি করে দিলেন।

দেখা গেল স্বরূপ ক্ষুধার্ত ছিল। একটু পরেই প্লেটগুলো খালি হতে থাকল। তনয়ার অবশ্য ইচ্ছে করছিল ভাগ বসাতে, নেহায়েতই পার্সোনালিটির প্রশ্ন বলে কিছু করল না। তবে মন চাইল একটু কেক খেতে। উঠে গিয়ে খেয়ে আসবে নাকি? স্বরূপ সব খেয়ে এক পিস কেক আবার রেখে দিল কেন?

বাবা স্বরূপের সাথে টুকটাক কথা বলে কাজের অজুহাত চলে গেলেন৷ মা রান্নার কথা বলে রান্নাঘরে গেলেন। রয়ে গেল স্বরূপ আর তনয়া।

স্বরূপ তার দিকে কেকের টুকরো এগিয়ে দিয়ে বলল, “খাও।”

তনয়া মুখ ঘুরিয়ে নিল, “থ্যাংস!”

স্বরূপ তার একেবারে সামনে পিরিচটা রেখে দিয়ে বলল, “কেকটা যা মজা! তুমি না খেলে আমিই খেয়ে নেব৷ আজ যা ধকল গেল!”

তনয়ার চাপা দেয়া কৌতুহল আবার মাথাচাড়া দিল। সে না জিজ্ঞেস করে থাকতে পারল না, “কিসের ধকল?”

“জানতে চাও? লম্বা স্টোরি।”

“ইচ্ছে হলে বলো।”

স্বরূপ মুচকি হাসল। সে দুই তিনদিন ধরে লক্ষ্য করেছে তনয়া তার সকালের অভিসার ধরে ফেলেছে। আঁড়চোখে সেও তার দিকে তাকায়। সে না এলে অপেক্ষা করে বসে থাকে। মাঝেমধ্যে মুচকি হাসে। আজ সে ভেবেই এসেছিল একেবারে খালি হাতে ফিরে যেতে হবে না।

সে কাহিনীটা বলা শুরু করেছে, এমন সময় মা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলেন৷ বললেন, “তোর খালা মাথা ঘুরে পড়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছে। কি কান্ড দেখ! হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে।”

“বলো কী!”

“হ্যাঁ৷ আমি যাচ্ছি এখন৷ তোর বাবাও যাবে।”

“আমিও যাব।” বলে উঠল তনয়া।

“তোকে ডাক্তার বেড রেস্ট দিয়েছে না? তুই কোথায় যাবি আবার? তোকে একা রেখে যেতে পারতাম না। ভাগ্যিস স্বরূপ চলে এসেছে। তোরা থাক, আমরা যাই। রাতে আমি যদি নাও ফিরি, তোর বাবা ফিরে আসবে। স্বরূপ বাবা, তুমি ততক্ষণ থেকো।”

স্বরূপ সবকটা দাঁত বের করে বলল, “মা আপনি যান। আমি থাকতে কোনো চিন্তা নেই।”

মা চলে যেতেই তনয়া স্বরূপের হাতে জোর চিমটি দিয়ে বলল, “আমার খালা অসুস্থ আর তুমি এমন দাঁত কেলিয়ে হাসছ কেন? অসভ্য কোথাকার!”

স্বরূপ মুখ গম্ভীর করে বলল, “স্যরি স্যরি।”

মা বাবা বেরিয়ে গেলে স্বরূপ দরজা আটকে দিয়ে এসে বসল। বলল, “কাহিনীটা বলি এবার? একেবারে শ্বাসরুদ্ধকর স্টোরি।”

তনয়া গলায় ইচ্ছে করে নিরুৎসাহ ঢেলে বলল, “আচ্ছা।”

স্বরূপ বলতে শুরু করল, “গতকাল রাতে হঠাৎ মিলি ফোন করে বলে বসল কে নাকি তাকে রুমডেটের ইনভাইটেশন দিয়েছে, সে সেখানে যাবে। আমার তো চোখ কপালে! বলে কী মেয়ে! পরে শোনাল আসল কাহিনী…”

স্বরূপ বলতে বলতে খেয়াল করল তনয়া কেকের টুকরোটা মুখে পুরে দিয়েছে। হয়তো নিজের অজান্তেই। মেয়েটা কিছুটা মোটা হয়েছে। পেট বোঝা যায় না এখনো, তবে চোখমুখ অন্যরকম হয়ে গেছে। ভীষণরকম আদুরে লাগছে তাকে। মোটাসোটা টেডি বিয়ারের মতো। ইশ! বাসায় থাকলে সারাদিন একে জড়িয়ে ধরে বসে থাকা যেত!

তনয়া হা করে কাহিনী গিলছিল। এবার বলল, “আচ্ছা, তাহলে এখন সাফাত ভাইয়া কী করবে?”

“সেটা তার ব্যাপার।”

“আর মিলি আপু?”

“জিজ্ঞেস করেছিলাম৷ বলেছে আর কিছুই করবে না।”

“সাফাত ভাইয়া যদি তাকে ফিরিয়ে নিতে চায়? ডিভোর্স তো হয়নি।”

“জানি না। খুব সম্ভবত যাবে না। যে একবার চিট করতে পারে সে বারবারই পাবে।”

“হুম।” দীর্ঘশ্বাস ফেলল তনয়া।

এমন সময় জানালার পাল্লা জোরে ধাক্কা খেল। ঝড়ো বাতাস বসে গেল ঘরে। স্বরূপ উঠে জানালা লাগিয়ে দিল। “আজ দিনে যা গরম পড়েছিল! বোঝাই যাচ্ছে ঝড় হবে।”

তনয়াও উঠল। স্বরূপ বলল, “আমি করছি, তুমি উঠো না।”

তনয়া পাত্তা দিল না। মা বাবার ঘরের জানালাগুলো আটকে দিয়ে এসে দেখল স্বরূপ তার ঘরের জানালা বন্ধ করছে।

তনয়াকে ঢুকতে দেখে স্বরূপ একটু সংকুচিত হয়ে বলল, “জানালা বন্ধ করতে এসেছিলাম।”

“ঠিক আছে।”

তনয়া বিছানায় বসে পড়ল। স্বরূপও বসল। স্বরূপ এবার যেন অন্যরকম গলায় বলল, “আজ আমার খুব শান্তি লাগছে জানো?”

“কেন?”

“পুরানো কথা তুলব বলে আগেই স্যরি৷ তুমি প্লিজ ট্রমাটাইজ হয়ে যেও না। আমি খুব ইমোশনাল টাইপ ছিলাম একসময়। এখন অন্যরকম হয়ে গেছি যদিও। লোপার সাথে সেই ঘটনার পর বরাবরই ইচ্ছে ছিল ওর ওপর একটা প্রতিশোধ নেবার। কিন্তু বিভিন্ন কারনে পেরে উঠিনি। আজ সাফাতের যেমন চেহারা হয়েছিল, সেটা দেখেই শান্তি পেয়েছি। সাফাত আরও শাস্তি পাবে। প্রতিটা চিটারের সাথে এমন হওয়া উচিত। আমি আমার সাথে হওয়া অন্যায়ের কোনো প্রতিকার করতে পারিনি৷ কিন্তু অন্য কেউ পেরেছে সেটা দেখে ভালো লাগছে। আমার ভেতরে সবসময় একটা চাপা রাগ ছিল, অশান্তি ছিল, সেটা মিটে গেছে। সাফাতকে ইচ্ছেমতো গালাগাল করেছি ফেরার সময়। ও কিছুই বলেনি। ব্যাপারটা আরও আরামের ছিল। আর এই কথাটা কারো সাথে শেয়ার করারও ভীষণ ইচ্ছে করছিল। তাই চলে এলাম। তুমি ছাড়া আর কে আছে আমার এসব বলার মতো?”

শেষ কথাটা স্বরূপ এত আন্তরিকভাবে বলল যে তনয়ার চোখে পানি চলে এলো। সে অশ্রু লুকাতে অন্যদিকে চাইল। স্বরূপ আরও কাছে চলে এলো তার। হাত ধরল। তনয়া মৃদু প্রতিবাদ করতে গিয়েও করল না। ভেঙেচুরে কান্না পাচ্ছে তার।

আকাশ গর্জন করে উঠল। প্রবল ধারায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করল। লোডশেডিং হওয়ায় অন্ধকারে ডুবে গেল নগরী। আবার যখন বিদ্যুৎ চমকালো, তখন সেই আলোয় দেখা গেল তারা দু’জন খুব কাছাকাছি বসে এখন। দুজনেই কাঁদছে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু