Tuesday, July 22, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 211



গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-৩৪+৩৫

0

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৩৪.

স্টিয়ারিংয়ে শক্ত হয়ে বসে যাওয়া আঙুলগুলো সাদা হয়ে আছে। স্বরূপের হাত সামান্য কাঁপছে। মাকে নিয়ে সাবধানে হাসপাতালে পৌঁছাতে পারলে হয়। কী হয়েছে তনয়ার? খারাপ কিছু? কথাটা ভুলে থাকতে ইচ্ছে করছে স্বরূপের। অন্তত হাসপাতালে পৌঁছুনো পর্যন্ত। অথচ বুকের ভেতর জোরে জোরে হাতুড়িপেটা হচ্ছে। সে মাকে আরেকবার জিজ্ঞেস করল, “তোমাকে ওরা কিছুই বলেনি?”

মা কাঠ কাঠ গলায় বললেন, “তুই গাড়ি চালাতে থাক।”

স্বরূপও সেটারই চেষ্টা করছে। কিন্তু গলা শুকিয়ে আসছে। ওর বাবা বলেছিলেন জ্বর হয়েছে। এখন কি সেটা খুব খারাপ পর্যায়ে চলে গেছে?

হাসপাতালের সামনে এসে গাড়ি পার্ক করে নামার সময় মা তার হাত চেপে ধরলেন। স্বরূপ অবাক হয়ে বলল, “কী হয়েছে?”

“খবরটা তোকে জানাইনি আমি।”

স্বরূপ সোজা হয়ে বসে বলল, “তুমি জানো কী হয়েছে?”

“হ্যাঁ।”

অস্থির হয় উঠল স্বরূপ, “তাহলে বলছো না কেন?”

মা চোখ বেয়ে নেমে আসা অশ্রু মুছে বললেন, “তনয়া প্রেগন্যান্ট.. কাল রাতে মাথা ঘুরে বাথরুমে পড়ে গিয়েছিল। এখন কী হয়েছে জানি না। তুই ভালোমন্দের জন্য তৈরি থাক…”

কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্বরূপের চোখের সামনে সবকিছু ব্ল্যাঙ্ক হয়ে গেল। সে ঠিকমতো কিছু ভাবতে পারল না৷ তারপর যখন মায়ের দিকে তাকাল, দেখল মা কাঁদছে। স্বরূপের চিৎকার করতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু একটা শব্দও করতে পারল না৷ শুধু বোবা দৃষ্টিতে শূন্যের পানে চেয়ে রইল।

বাচ্চা! ওর একটা বাচ্চা আসার কথা পৃথিবীতে! যার আসাটা অনিশ্চিত হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগমনবার্তা না শুনেই কি তবে মৃত্যুসংবাদ শুনতে হবে? স্বরূপ পাথরের মতো জমে গেল। বুকের ভেতরটা বরফ হয়ে গেছে। ভয় আর আতঙ্ক চেপে ধরেছে একসাথে।

একটা বাচ্চার তার কত শখ তা কাউকে বলে বোঝাতে পারবে না। সে বিয়ে না করলেও একটা বাচ্চাকে দত্তক নিত পালার জন্য। তনয়াকে কতবার সে ছোটোখাটো হিন্টস দিয়েছে এ ব্যাপারে, তনয়া বুঝতে পারেনি। সে বোঝানোর চেষ্টাও করেনি। জানত, একটা সময় ঘর আলো হবেই। কিন্তু…

মা এবার স্বরূপকে জোরে ধাক্কা দিলেন। “যাবি না?” স্বরূপ বসেই রইল স্থাণুর মতো। মা তাকে টেনে নিয়ে গেলেন ভেতরে। দোতলায় উঠতেই তনয়ার মা বাবাকে পাওয়া গেল। মা একপাশে দাঁড়িয়ে আঁচল দিয়ে চোক মুছছেন। বাবা পায়চারি করছেন অস্থিরভাবে।

স্বরূপের পা চলছে না৷ সে সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে গেল। পা দুটো প্রচন্ড ভারী হয়ে আছে। টন টন পাথর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে বুকে। এমন লাগছে কেন?

তার মা গিয়ে তনয়ার মাকে ধরলেন, “কী হয়েছে আপা? সব ঠিক আছে তো?”

তনয়ার মা মলিন গলায় বললেন, “ঠিক নাই। প্রেশার কমে মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল।”

“আর বাচ্চাটা? বাচ্চাটা ঠিক আছে?”

“আছে, তবে অবস্থা ভালো না। কিছু বলা যায় না। অল্প ব্লিডিং হয়েছে। রক্তশূন্যতাও নাকি দেখা গেছে। রক্ত দেয়া হচ্ছে।”

তনয়ার বাবা এগিয়ে এসে বললেন, “থ্রেটেনড এবরশন। এখন অনেক যত্ন নিতে না পারলে কী হবে বলা যায় না।”

স্বরূপ ধীরে ধীরে হেঁটে এসে মেঝেতেই বসে পড়ল। তার জন্যই এসব হয়েছে, হচ্ছে। সে নিজেকে কী করে ক্ষমা করবে?

বাবা এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “তনয়া কি তোমার ওখানে থাকতে ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করত না?”

স্বরূপ একটু ভাবল, মনে পড়ল না কিছু।

বাবা ওর ফাঁকা দৃষ্টি দেখে যা বোঝার বুঝে নিয়ে বললেন, “খাওয়ার অনিয়ম হয়েছে খুব!”

স্বরূপ ওভাবেই বসে রইল। মা তাকে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলেন, তেমন একটা লাভ হলো না। স্বরূপের বারবার মনে হচ্ছে, সব হারিয়ে গেছে। হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে তার জমানো সবকিছু…

বিকেলের দিকে স্বরূপ তনয়ার প্রথম কথা হলো। তনয়ার অবস্থা একটু ভালোর দিকে যাওয়ার পর বাবা তাকে জিজ্ঞেস করে নিয়েছেন সে স্বরূপের সাথে কথা বলতে চায় কি না। তনয়া অনেকক্ষণ ভেবেচিন্তে বলেছে পাঠিয়ে দিতে।

স্বরূপ যখন ঢুকল তখন বাকিরা বেরিয়ে গেল। স্বরূপ বিছানার কাছে এসে দাঁড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে গেল।

এই সেই তনয়া যে তার সাথে ছিল? কেমন করে এমন হয়ে গেল?

তনয়ার শরীর শুকিয়ে এতটুকুন হয়ে গেছে। চোখের নিচে গভীর কালি পড়েছে, ঠোঁটজোড়া শুষ্ক, গায়ের রঙ ফ্যাকাসে। স্বরূপ দাঁড়িয়েই রইল অনেকক্ষণ। বিশ্বাস করতে পারছে না কিছু৷

আচমকা যেন একটা বিষমাখা তীর এসে তার বুকে বিঁধে গেছে। তনয়া এতদিন চোখের আড়াল ছিল, সে তাকে মিস করেছে, কিন্তু এমনটা কল্পনাও করেনি। আজ সামনে থেকে দেখে সহ্য করতে পারছে না।

সবচেয়ে অসহ্যকর বিষয় হচ্ছে, তনয়ার এই অবস্থা শুধুমাত্র তার জন্য হয়েছে। তার অবহেলার কারনে হয়েছে।

স্বরূপের মাথা থেকে সব বেরিয়ে গেল। কোথাকার কোন বিশ্বাসঘাতকতা, বিশ্বাসহীনতা, মেল ইগো, এমনকি বাচ্চাও। শুধু মনে রইল তনয়া। এই একটা মেয়ের সাথে সে খুব বড় ভুল করে ফেলেছে। ভুলটা একদিনে হয়নি৷ সে বিয়ের পর তনয়ার নামমাত্র খেয়াল রেখেছে, ভালোবাসি না বলে হাজারবার কষ্ট দিয়েছে, তার ভালোবাসার কোনো দাম দেবার প্রয়োজনও মনে করেনি৷ আর সবশেষে কতগুলো বাজে কথা শুনিয়েছে৷ অথচ তারা একসাথে অল্প কদিনে কত কত সুন্দর সময় কাটিয়েছে গোনা যাবে না। সে কেন ফুলের মতো একটা মেয়েকে এমন বানিয়ে দিল? সে যে ইচ্ছে করে করেছে তাও নয়…

সে টলোমলো পায়ে তনয়ার বেডের পাশে মেঝেতে বসে পড়ল। ওর হাত আঁকড়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কাঁদতে লাগল। অনেক কথা বলতে চাইলেও কোনো কথা তার মুখ দিয়ে বের হলো না৷

তনয়া চুপ করে দেখল স্বরূপকে। একে দেখে এত মায়া হয় তার! কিন্তু আজ এভাবে কাঁদতে দেখেও যেন তার ভেতরটা সে স্পর্শ করতে পারছে না। ও কেন এসেছে? বাচ্চার কথা শুনে? বাচ্চার খুব শখ স্বরূপের। পথেঘাটে ছোটো ছোটো বাচ্চা দেখলে এগিয়ে গিয়ে আদর করে আসে। নিজের বাচ্চা হলে কী কী করবে সেসব আকারে ইঙ্গিতে নানা সময় বলেছে। ওই ফেসবুকের ছবির কমেন্টে সেই মেয়েটাকেও বলেছিল। বোধহয় তাকেও একই কথা বলত!

তনয়া ওর হাতটা ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করল, কিন্তু স্বরূপ ছাড়ছে না। তনয়া অধৈর্য হয়ে বলল, “হাতে ক্যানোলা লাগানো। স্যালাইন দেয়া হচ্ছে। ব্যথা পাচ্ছি তো!”

স্বরূপ হাত ছেড়ে দিল। তনয়ার চোখে চোখ রাখল। চোখের গভীরতা হারিয়ে গেছে। হারিয়েছে নাকি সে নিজেই নষ্ট করেছে?

স্বরূপ করুণ চোখে চেয়ে বলল, “তুমি আমাকে ক্ষমা করবে তনয়া? আমি স্যরি। কতবার স্যরি বললে বোঝনো যাবে আমি সত্যিই অনুতপ্ত জানি না। আমার মুখ দেখাবার জায়গাও নেই।”

তনয়া নিষ্পৃহ গলায় বলল, “কাঁদছ কেন? বাবু ভালোই আছে।”

“কিন্তু তুমি তো ভালো নেই।”

“সেটা তোমার কনসার্ন নয়। তবে ভালো থাকব এখন থেকে। চেষ্টা তো সবসময় ছিল, শুধু সময়টা খারাপ যাচ্ছিল।”

স্বরূপ তনয়ার মুখে হাত বুলিয়ে বলল, “আর খারাপ সময় থাকবে না৷ এখন যা সময় আসবে, সবটা হবে বেস্ট।”

তনয়া তিক্ত হেসে বলল, “তাই নাকি? হতেও পারে। যদি কারো প্রাক্তন অন্তত আমার বাচ্চার জীবনে না ঢুকে পড়ে।”

স্বরূপ আহত চোখে তাকাল। “কী বলছ তুমি!”

তনয়া বলল, “আচ্ছা তোমার বাচ্চার খুব শখ ছিল তাই না? তুমি চেয়েছিলে তোমার আর ওই মেয়েটার সংসার হবে, বাচ্চা হবে, সেটা হলো না বলে তোমার খুব কষ্ট লাগে তাই না?”

স্বরূপ মাথাটা ঝুঁকিয়ে ফেলে বলল, “আমি জানি না তুমি কেন বলছ এসব। প্রাক্তনের কথা উঠছে কেন?”

“স্যরি। আর বলব না।”

“তনয়া ওর সাথে আমার কোনো ধরনের যোগাযোগ নেই। এমনকি মনে মনেও আমি ওর জন্য বিন্দুমাত্র কিছু ফিল করি না। তুমি কেন ওর কথা তুলছো?”

“বললাম তো আর তুলব না।”

“তনয়া… তুমি আমার সাথে যাবে না?”

“কোথায়?”

“তোমার সংসারে।”

“আমার কোনো সংসার নেই।”

“আছে। তুমি নিজের হাতে সাজিয়েছ।”

“নেই৷ তুমি আমাকে বলেছিলে তোমার বাসায় আমি জবরদখল করে রেখেছি। তোমাকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছি না। ওটা আমার সংসার কবে হলো আবার?”

স্বরূপের মনের কাঁটাটা আরেকটু গভীরে গেঁথে বসল। কথাগুলো কত ভারী! অথচ সে নিজেই একসময় এসব বলেছে!

“আমি স্যরি তনয়া! সত্যিই স্যরি!”

তনয়া চোখ বুজে বলল, “আমার খুব ক্লান্ত লাগছে। আর কথা বলতে পারব না। চলে যাও তুমি।”

স্বরূপ আর কথা বলার চেষ্টা করল না। তনয়ার মুখ দেখে মনে হলো না সে আর কোনো কথা শুনবে। যাবার আগে তনয়ার হাতে আর কপালে চুমু খেল স্বরূপ। তনয়া চোখ পর্যন্ত খুলল না। মুখের রেখা শক্ত হয়ে আছে। স্বরূপ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে গেল।

স্বরূপ সেদিন অনেকটা সময় নিয়ে নামাজ পড়ল। সেজদায় পড়ে সে এত কাঁদল যত সে হয়তো কোনোদিনই কাঁদেনি। তনয়ার জন্য আর বাচ্চার জন্য দোয়ায় শুধু একটা কথাই বলে গেল, “আল্লাহ ওদের সুস্থ রাখুন, শান্তি দিন। আমাকে ক্ষমা করুন।”

মসজিদ থেকে বের হয়ে এলোমেলো হাঁটতে হাঁটতে স্বরূপের মনে হলো তার জীবনটা কেমন অন্যরকম লাগছে। এতদিন কী একটা গরল জমেছিল মনে। অবিশ্বাসের, অসুন্দরের। আজ কান্নার সাথে সব ধুয়ে গেছে। এটাও বিশ্বাস হয়েছে, তার তনয়াকে প্রয়োজন। শুধু জীবন বা শরীরের প্রয়োজন নয়, মনেরও প্রয়োজন। তনয়া যতদিন তার সাথে হেসে কথা না বলবে ততদিন পর্যন্ত তার প্রায়শ্চিত্ত হবে না। সেই প্রায়শ্চিত্তের দিনটা কি কোনোদিন আসবে? তনয়া কি কখনো জানবে সে বাচ্চার কথা ভেবে না, তাকে ভালোবেসে এসেছিল?

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৩৫.

তনয়া পরের দিনে রিলিজ পেয়ে গেল। বাসায় যাবার সময়ও স্বরূপ আরেক দফা বোঝাতে এলো তাকে। তনয়ার বাবাকেও অনেক অনুরোধ করল ওকে যেন তার সাথে যেতে দেয়া হয়। কিন্তু তনয়া কিংবা তার বাবা কেউই রাজি হলো না৷ স্বরূপ বাসায় ফিরল শূন্য হাতে।

এদিকে ওদের ঝামেলা দেখে স্বরূপের মা মিতাকে কোচিংয়ে ভর্তি করিয়ে একই সাথে একটা মেয়েদের হোস্টেল দেখে সেখানে তাকে রেখে গেলেন৷ তার মনে হয়েছে, মিতাকে স্বরূপের কাছে একা একা রেখে যাওয়াটা উচিত হবে না৷ স্বরূপ যদিও বিষয়টা পছন্দ করেনি, কিন্তু মা রাজি হলেন না। ছেলের ওপর বিশ্বাস আছে তার। কিন্তু যুগের ওপর একদম নেই।

মা পাঁচদিন থেকে চলে গেলেন। মা যাওয়ার পরপরই স্বরূপকে একাকীত্ব চেপে ধরল। বাসায় ফিরলেই মনে হয় এটা একটা জ্যান্ত কবরখানা। তনয়াকে দেখতে ইচ্ছে করে, বাচ্চাটা কেমন আছে, কোন পর্যায়ে আছে সব জানতে ইচ্ছে করে। কল্পনায় সে দেখে তনয়া এখানেই আছে। তারা খুনসুটি করছে, বাচ্চার নাম কী হবে, ছেলে হবে নাকি মেয়ে, দেখতে কার মতো হবে এসব নিয়ে ঝগড়া করছে।

এরপর অফিস শেষে তার প্রতিদিনের রুটিন হয়ে দাঁড়াল তনয়াদের বাসায় যাওয়া। যাওয়া হয় ঠিকই, তবে তনয়া তার সাথে কথা বলে না। সে একশটা কথা বললে একটা জবাব দেয়। তাও কাঠ কাঠ জবাব। স্বরূপ তাতেও খুশি ছিল। কিন্তু কয়েকদিন যেতে না যেতেই তনয়া দেখা করাও বন্ধ করে দিল।

স্বরূপ ওদের বাসার ড্রইংরুমে ঘন্টা ধরে বসে থাকে। তনয়া আসে না। তার রুমে যাওয়ার সাহস হয় না স্বরূপের। একবার যেতে চেয়েছিল, তনয়া বেশ অপমান করে বলে দিয়েছে তার বাসায় তার বেডরুমে যেন কেউ পারমিশন ছাড়া না ঢোকে।

স্বরূপ বসে থাকলে তনয়ার মা এসে কথা বলত শুরুর দিকে। এখন তিনিও আর আগ্রহ পান না। স্বরূপ একাই বসে থাকে। তনয়ার বাবা এলে ওর সাথে চা খান, দু’একটা কথা বলেন, তারপর চলে যান নিজের ঘরে।

স্বরূপ একসময় বাসায় ফেরে। ভালো লাগে না কিছুই। মাঝরাতে তনয়াকে এলোমেলো মেসেজ পাঠায়,

“কেমন আছো?”
“তোমার একটা ছবি দেবে?”
“বাবু কেমন?”
“ওকে বলে দিও বাবা দেখতে গিয়েছিল।”
“ও কি বাবার কথা বলে?”
“তুমি কি ওকে বাবার কথা জানিয়েছ?”
“I love you.”
“I miss you.”
“Do you miss me?”
“Don’t you love me?”

তনয়া কখনো দেখে, কখনো না দেখেই রেখে দেয়।

স্বরূপ এক ভোরে গাড়ি নিয়ে তনয়াদের বাসার সামনে উপস্থির হলো। তনয়ার বারান্দার দিকে তাকিয়ে রইল একদৃষ্টিতে। তাকে দেখা হয় না অনেকদিন।

স্বরূপকে খুব বেশি অপেক্ষা করতে হলো না। তনয়া বারান্দায় এসে দাঁড়াল। ওর বারান্দায় কিছু গাছ আছে। সেগুলোর গায়ে হাত বুলিয়ে একসময় রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। তিনতলার ওপরে থাকা তনয়াকে একটু অস্পষ্ট দেখা গেলেও স্বরূপ প্রাণভরে দেখে নিল। দিনটা এত চমৎকার কাটল তার!

এরপর থেকে সে সকালেই যায়। তনয়াকে দেখা হয় রোজ। তাকে তনয়া দেখে ফেলেনি। দেখলে হয়তো বারান্দায় আসা বন্ধ করে দিত।

*

মিলি আয়নায় আরেকবার চোখ বুলিয়ে নিল। লিপস্টিকের শেড আরেকটু গাঢ় হলে কেমন হয়? বেশ হয়! নিজেকে আরেক ধাপ বেশি আত্মবিশ্বাসী মনে হয়। মিলি একটা কালো রঙের ড্রেস পরেছে৷ বেশ দামী ড্রেস। চোখে নীলচে সবুজ কন্টাক্ট লেন্স পরেছে। তাকে আগুন সুন্দরী লাগছে। আজ সেই লোকটার সাথে দেখা করতে যাবে, যে নিজেকে হিমালয় বলে পরিচয় দিয়েছে। লোকটা সোজা ফ্ল্যাটে ইনভাইট করে বসেছে। মিলির মন উত্তেজনায় কাঁপছে। আজ দারুণ আনন্দ হবে!

নিচে নেমে দেখল গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। চড়ে বসল সে।

“You’re looking amazing!”

মিলি হাসল। সে জানে, তাকে ঠিক কী কী করলে সুন্দর দেখায়।

গাড়ি থেকে নেমে সোজা ভেতরে ঢুকে লিফটে চড়ল মিলি। পনেরো তলায় ফ্ল্যাট। লিফট থেকে নেমে ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে মোবাইলের ক্যামেরাতে নিজেকে একবার দেখে নিল সে৷ “হুম পারফেক্ট!”

ডোরবেল চাপল। দরজা খুলে গেল কয়েক সেকেন্ড পর। লোকটাকে প্রথম দেখল মিলি। বেশ সুদর্শন, সুঠামদেহী লোক, স্বীকার করতেই হবে। মিলিকে দেখে সে কয়েক সেকেন্ড হা করে তাকিয়ে রইল। তারপর হাসিমুখে বলল, “Welcome! আজকে আমার ছোট্ট পাখির বাসা ধন্য। পৃথিবীর সবচেয়ে গর্জিয়াস নারীর পদার্পন হতে যাচ্ছে৷ প্লিজ ভেতরে আসুন।”

মিলি ভেতরে ঢুকল। এয়ার ফ্রেশনারের সতেজ সুবাস ঘরময়। পাখির বাসাটা দেখবার মতো। দামী সোফাসেট, ঘরভর্তি অ্যন্টিক, প্রমাণ সাইজের ঝাড়বাতি। রুচি আছে, তবে এত জাঁকজমক বাহুল্য। লোকটা হাসিমুখে বলল, “বসুন। ড্রিংস চলবে?”

মিলি হাসল, “না। কফি চলবে।”

লোকটা চোখ নাচাল। তারপর রান্নাঘরে চলে গেল। মিলি বসেই রইল। জানালা দিয়ে ব্যস্ত অজস্র দানালকোঠা চোখে পড়ছে। লোকটা মিনিট পাঁচেকের মধ্যে কফি নিয়ে উপস্থিত হলো।

মিলি জিজ্ঞেস করল, “আপনার আসল নামটা জানতে পারি এবার?”

“রওনক। আমার পুরো নাম রওনক চৌধুরী।”

“নাইস নেইম!”

“কফি ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”

“সমস্যা নেই। আমার গরম পছন্দ নয়।”

“এসির টেম্পারেচার কমিয়ে দেব?”

“নো থ্যাংস! ইটস পারফেক্ট!”

“বাই দ্য ওয়ে, ড্রেসটা আপনার গায়ে চড়তে পেরে বেশ গর্জিয়াস হয়ে উঠেছে!”

মিলি হেসে কফিতে চুমুক দিল। কিছু বলল না।

কফি শেষ হবার আগেই রওনকের মোবাইল বেজে উঠল। সে বোধহয় কলটা কেটে দিত, আবার শেষ মুহূর্তে কী ভেবে কাটল না। রিসিভ করে কথা বলে একটু বিরক্ত হয়ে মিলিকে বলল, “আপনি কি একটু অপেক্ষা করবেন প্লিজ? আমি নিচ থেকে আসছি। কেউ একজন আর্জেন্টলি দেখা করতে চাইছে। প্লিজ কিছু মনে করবেন না।”

“না না, যান। আমি ঠিক আছি।”

“জাস্ট পাঁচ মিনিটে ব্যাক করছি। এনজয় ইয়োর কফি।”

রওনক বেরিয়ে গেলে দরজা আটকে গিল মিলি। তারপর অত্যন্ত দ্রুততার সাথে তার বেডরুমে ঢুকল। ওয়ারড্রব, টেবিলের ড্রয়ের খুঁজে কিছুই পেল না। আলমারির চাবিটা খুঁজতে লাগল। সেটা পাওয়া গেল বেডসাইড টেবিলের ড্রয়েরে একটা কী কেসে।

চাবি দিয়ে দ্রুত হাতে আলমারি খুলল সে। তন্নতন্ন করে খুঁজতে লাগল একটা ক্লু। ঘড়ি দেখল একবার। চার মিনিট হয়ে গেছে। স্বরূপ লোকটাকে কতক্ষণ আটকে রাখতে পারবে কে জানে!

আলমারির একেবারে শেষের তাকে একটা ফাইল পাওয়া গেল৷ ফাইলটা বের করে খোলার সময় কলিংবেল বেজে উঠল। বুকটা ধ্বক করে উঠল একবার৷ “নাহ, এখন দরজা খোলা যাবে না৷”

সে ফাইলটা খুলল। পেয়ে গেল যা চেয়েছিল। অতিরিক্ত হিসেবে পাশেই একটা অ্যালবামও পেল। স্বস্তির নিঃশ্বাস বেরিয়ে গেল মিলির বুক থেকে। সে বিশাল একটা ব্যাগ এনেছে। সেটাতে ফাইল আর অ্যালবাম এঁটে গেল। তাড়াতাড়ি ঘরটা গুছিয়ে ফেলল সে। কোনোরকমে বেসিন থেকে হাত আর গলায় সামান্য পানি ছিটিয়ে টিস্যু হাতে দরজা খুলতে গেল। খুলেই মুখটা করুণ করে বলল, “স্যরি। ওয়াশরুমে ছিলাম।”

রওনক হাসল। “ইটস ওকে ডিয়ার। আমি ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম আপনার কী হলো ভেবে।”

ওরা আবারও সোফায় গিয়ে বসল। লোকটা কীসব হাবিজাবি বকবক করে গেল, মিলির ঠিকঠাক কানে গেল না। সে অপেক্ষা করছে দ্বিতীয় কলিংবেলের আওয়াজের। পাঁচটা তো বাজে। আসবে তো সে?

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-৩২+৩৩

0

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৩২.

মাকে কোনোরকমে সামাল দেয়া গেলেও মায়ের প্রশ্ন আর শেষ হয় না। রাতের খাবারের জন্য তেমন কিছুই বাকি ছিল না৷ স্বরূপ কিছু একটা রাঁধতে রান্নাঘরে ঢুকল। মাছ মাংস রাঁধতে দেরি হবে৷ দ্রুত হবে কোনটা? ডিম? ডিম ভাজি নাকি ভুনা? স্বরূপ মাথা চুলকে ভাবছে, এমন সময় মায়ের গলার আওয়াজ পাওয়া গেল, “তনয়ার জামাকাপড় এই ঘরে কেন?”

স্বরূপের মনে পড়ল তনয়া তার জামাকাপড় মিলিকে পরতে দিয়েছিল। সব গেস্টরুমেই রয়ে গেছে। হায় হায়!

মাকে মিলির কথাটা বুঝিয়ে বলল স্বরূপ। মা প্রশ্ন করতে থাকলেন, “মিলি কবে গেছে? তনয়া কবে গেছে? একই দিনে কেন?” ঘাপলাটা বোধহয় ধরার চেষ্টা করছেন। শেষে বললেন, “মিলিকে এখানেই থাকতে হবে কেন? পৃথিবী থেকে ওর আত্মীয়স্বজন, মেয়েবন্ধু সব গায়েব হয়ে গেছে নাকি?”

স্বরূপ দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ হয়ে গেল।

খাওয়াদাওয়া শেষে মা মিতাকে নিয়ে শুতে চলে গেলে স্বরূপ নিজের ঘরে ঢুকল। মোবাইল হাতে নিয়ে এলোমেলো ঘাটাঘাটি করতে গিয়ে আবিষ্কার করল, তনয়া একটু আগেই নিজের প্রোফাইলের ছবিটা বদলে দিয়েছে। সেখানে এখন টলটলে চোখের ঠোঁট উল্টানো এক বাচ্চার ছবি। স্বরূপ কিছুক্ষণ সেদিকে চেয়ে রইল। তনয়ার ছোটোবেলার ছবি নাকি এটা? কত কষ্টেই না আছে মেয়েটা! স্বরূপের মনটা আরও একবার আর্দ্র হলো। খুব ইচ্ছে করছে এখন তনয়ার সাথে কথা বলতে।

সে মেসেজ পাঠাল, “তনয়া..”

সীন হয়ে গেল সাথে সাথেই। তবে উত্তর এলো না।

সে উৎসাহ পেয়ে আবার লিখল, “কেমন আছ?”

“প্লিজ রিপ্লাই দাও!”

“চলে এসো। আর কতদিন এভাবে থাকবে?”

“তনয়া!”

“কল করি?”

“ধরো না কেন?”

“আই অ্যাম স্যরি! আর কোনোদিন ওরকম ভুল হবে না। আমি সেদিন বুঝতে পারিনি কী করেছিলাম।”

“আমি ঘুমাতে পারি না, খেতে পারি না, কোনোকিছুতেই মনোযোগ দিতে পারি না। তোমাকে ভীষণ মিস করছি! একটা রিপ্লাই অন্তত দাও।”

“আমি তোমাকে কাল আনতে যাব। আসবে তো? মা এসেছেন। তোমাকে খুঁজতে খুঁজতে হয়রান হচ্ছেন।”

স্বরূপের প্রথম মেসেজটা দেখে তনয়ার একটা হার্টবিট মিস হয়েছিল। সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে পরের মেসেজ দেখতে থাকল। সত্যিই কি সে স্যরি? এতদিন পর মনে হলো ভুল করেছে?

কিন্তু শেষ দুটো মেসেজ দেখে তার গা জ্বলে গেল। এর মানে সবকিছু তার নিজের জন্য! মা এসেছে বলে এখন তনয়াকে দরকার হয়ে পড়েছে। প্রথমদিন থেকে সে যে ফোন হাতে তীর্থের কাকের মতো বসেছিল তখন তো কারো মনে হয়নি মেসেজ দিয়ে কেমন আছ জিজ্ঞেস করার। এখন ঠেকায় পড়ে সবই সম্ভব হচ্ছে। তিক্ত হয়ে গেল তনয়ার মন। সে উত্তর দেবে না ভেবেও উঠে বসে টাইপ করতে শুরু করল।

স্বরূপ কোনো রেসপন্স না দেখে মোবাইল রেখে শুয়ে পড়েছিল। মিনিট দশেক পর মেসেজের টুং শব্দ হতেই সে তড়াক করে উঠে বসল। তনয়াই পাঠিয়েছে।

“তোমার ঘুম, তোমার খাওয়া, তোমার মনোযোগ, তোমার মা, সবই তো তোমার। আমার কোনটা বলতে পারো? তুমি আপাদমস্তক স্বার্থপর ছিলে, এখনো আছ। আমার ফিলিংসের মূল্য তুমি কখনোই দাওনি। নিজে ভালো ছিলে বলে একসাথে ছিলে। তোমার কাছে আমি কখনোই কি কিছু ছিলাম?

তুমি বাজি ধরেছলে দু’বছর পর তোমাকে বিয়ের জন্য আফসোস করব। কিন্তু আমি এখনই আফসোস করছি। তুমি বাজিতে জিতেছ। Congratulations!”

স্বরূপ মেসেজটা দেখে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। তনয়া সবসময় এত মিষ্টি করে কথা বলে যে তার কাছ থেকে এরকম বাক্য সে কখনোই আশা করেনি। তনয়াকে সে একটু বেশিই সহজভাবে নিয়ে ফেলেনি তো?

সে নিজের মেসেজগুলো পড়ল আবার। খুবই হাস্যকর লাগছে। এভাবে রাগ ভাঙাতে যাওয়ার মতো বোকামি আর হয় না। তার ওপর সে মনের কথা প্রকাশ করতে পারছে না। উল্টোপাল্টা বলায় কথগুলো ভীষণ পলকা মনে হচ্ছে।

সারারাত সে দুচোখের পাতা এক করতে পারল না৷ মনে হলো পৃথিবীতে সবাই তনয়ার পক্ষে চলে গেছে। তাকে একা নির্বাসনে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। কেউ তাকে বোঝার চেষ্টা করছে না। কেউ একবারও ভাবছে না সে নিজেও কষ্ট পাচ্ছে। কষ্টটা প্রকাশ করতে পারছে না, কাউকে বোঝাতে পারছে না, নিজের কাছেও এতদিন স্বীকার করেনি। কিন্তু কষ্টটা হচ্ছে তো!

তনয়ার মেসেটাও তার কাছে বড় কঠিন মনে হয়েছে। তার এটা প্রাপ্য ছিল, সে নিজেও কঠিন হয়েছে। তবুও একটা আঘাত তো পেল!

আচ্ছা সে যে ভাবত, প্রেম হবে উত্তাল, প্রবল, প্রচন্ড বেদনার; ঠিক সেই অনুভূতিগুলো কি তার এখন হচ্ছে না? নিজের সব আত্মগর্ব, সব অহংকার, কাঠিন্য ত্যাগ করে তার কি ইচ্ছে করছে না তনয়ার কাছে চলে যেতে? কেন তবে? স্বরূপের চোখে পানি চলে এলো। সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে!

সে ভালোবাসায় জড়াতে চায় না। ভালোবাসায় অনেক কষ্ট। একই কষ্ট বারবার সে কেন পাবে?

*

তনয়া কুশনের কভারে সুতার কারুকাজের ওপর হাত বুলিয়ে যাচ্ছে। তার মন বিক্ষিপ্ত, অন্যমনষ্ক। বাবা মা আজকে চেপে ধরেছেন৷ এতদিন তারা হয়তো ভেবেছিলেন ওরা নিজেরাই ঠিক করে ফেলবে সবকিছু। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সবকিছু হাতের বাইরে চলে যাওয়ার আগে দেখতে হবে।

বাবা আবারও জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার ভয় কিসের? বলতে চাচ্ছো না কেন কী হয়েছে?”

তনয়া চুপ করে রইল।

“তোমার সাথে কি ওর কথাবার্তা পুরোপুরি বন্ধ?”

তনয়া মাথা নিচু করে ফেলল।

বাবা হঠাৎ রেগে গিয়ে বললেন, “ফাজলামো নাকি? এতদিন হয়ে গেল সে তার স্ত্রীর খোঁজ নিতে এলো না একবারো। যোগাযোগও নেই! তার বউ যে অসুস্থ সে খবরও রাখে না। তার কী এমন রাজকার্য? কী এমন হয়েছিল তোমাদের মধ্যে?”

তনয়া এবারো চুপ করে রইল।

“তাকে নতুন খবরটা দিয়েছ?”

“না।”

বাবা এবার তনয়ার পাশে বসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “স্বরূপ কি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছে মা?”

আদর পেয়ে তনয়া আর নিজেকে আটকাতে পারল না। বাবার বুকে মাথা রেখে কেঁদে ফেলল।

বাবা ওকে শান্ত করে ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করলেন, “কী করেছে সে? আমাকে বলো? বাবা সব ঠিক করে দেবে।”

তনয়ার এবার মনে হলো বলে দেয়াই ভালো। স্বার্থপর লোকটাকে সে কেন ডিফেন্ড করে যাবে? সে সবটাই বলল একটু একটু করে।

বাবা ভেতরে ভেতরে তপ্ত হয়ে উঠলেও মেয়ের সামনে প্রকাশ করলেন না। বললেন, “থাক, তুমি কষ্ট পেও না। নতুন মানুষটার কথা ভাবো। তুমি কষ্ট পেলে তো তারও কষ্ট হবে তাই না? আমরা আজ রাতে বের হবো কেমন? আইসক্রিম খাব, ঘুরব, শপিং করব, তারপর কাল তোমার খালামণির বাসায় বেড়াতে যাব। অনেক আনন্দ হবে। বাকি সব ভুলে যাও।”

তনয়া এত দুঃখের মাঝেও হেসে ফেলল। বাবার কাছে সে এখনো ছোট্ট স্কুলগার্ল রয়ে গেছে। যাকে আইসক্রিম কিনে দিলে সে সব কষ্ট ভুলে যায়।

*

বাবা অফিসের জন্য বেরিয়ে যাবার পরপরই স্বরূপের মা উপস্থিত হলেন তনয়াদের বাসায়। সাথে মিতা। তার প্রথম থেকেই সন্দেহ হচ্ছিল কিছু একটা হয়েছে। ছেলে কিছু বলছে না দেখে নিজেই পুত্রবধূর সাথে দেখা করতে চলে এসেছেন।

তনয়ার মায়ের সাথে কুশল বিমিময় শেষে তিনি তনয়াকে দেখতে চাইলেন। তনয়া শুয়েছিল। স্বরূপের মা এসেছে শুনে ছুটেই এলো। মাকে দেখে কেন যেন খুব কষ্ট হলো তার। শাশুড়ী হলেও খুব ভালো এই মানুষটা৷ তনয়া জড়িয়ে ধরল তাকে। মা তাকে খুব যত্নে ধরে রাখলেন। তার অভিজ্ঞ চোখ তনয়াকে দেখেই বুঝে ফেলল সুখবরের আগমনবার্তা। তবে সরাসরি কিছু জিজ্ঞেস না করে খবরাখবর জানতে চাইলেন।

প্রায় ঘন্টা দুয়েক পর সেখান থেকে ফিরলেন মা আর মিতা। ততক্ষণে মায়ের সবটা জানা শেষ। তিনি বুঝতে পারছেন না কী করবেন৷ তবে সবার আগে ছেলেকে কানে ধরে ওই বাড়িতে পাঠাতে হবে। এই সময়ে কেউ রাগারাগি করে? এত আলগা রাগ ছেলেটা রাখে কোথায়?

তনয়ার কথা শুনে মনে হলো না সে এত সহজে মানবে৷ এই সময়টাতে খুব নরম মেয়েরাও কঠিন হয়ে ওঠে। অবহেলা সহ্য করতে পারে না৷

তারও বেশি কিছু বলার ছিল না৷ দোষ তার ছেলেরই। তিনি তবুও ওর হয়ে ক্ষমা চেয়ে এসেছেন। তনয়ার মাকে আশ্বাস দিয়ে এসেছেন, সব ঠিক হয়ে যাবে দ্রুত।

*

স্বরূপ আজও কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারছিল না। বসের ঝাড়ির ভয়ে তবু কাজ করে যাচ্ছিল৷ কিন্তু এরপরের ঘটনা তাকে বেশ নার্ভাস করে দিল। তার মোবাইলে তনয়ার বাবার নাম্বার থেকে কল এলো।

“আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল।”

“ওয়ালাইকুমুস সালাম। তুমি কোথায়?”

“অফিসে।”

“আজ লাঞ্চ টাইমে আমার অফিসে এসো। কথা আছে।”

“আঙ্কেল আজ অফিসের পর আমি তনয়াকে আনতে যাব। তখনই কথা বলি?”

বাবা অসম্ভব গম্ভীর গলায় বললেন, “তনয়া এখন কোথাও যাবে না৷ তোমার তাকে আনতে যেতে হবে না। তুমি আমার অফিসের সামনে ঠিক দুপুর একটায় উপস্থিত থাকবে।”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৩৩.

বাবার অফিসের সামনেই ছোটো একটা কফিশপে বসেছে তারা। এখানে শুধু কফিই পাওয়া যায় বলে লাঞ্চটাইম ভিড় কম। তবুও কোনার দিকের একটা টেবিলে বসেছে তারা৷

বাবা সময় নষ্ট করলেন না৷ বসতে বসতে জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের মধ্যে কী হয়েছে?”

স্বরূপ তনয়ার বাবার এই রূপ আগে দেখেনি৷ তিনি বরাবরই তার প্রতি বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ ছিলেন৷ এই মানুষটার স্বভাবও খুব নমনীয় বলে স্বরূপের মনে হতো তনয়া বাবার মতো হয়েছে। তবে আজ পরিস্থিতি উল্টো। ভদ্রলোকের চেহারা রীতিমতো মারমুখী।

স্বরূপ বলল, “একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে।”

“তাই? সামান্য ভুল বোঝাবুঝির জন্য মেয়ে বাড়িতে এসে পড়ে আছে? জ্বর বাঁধিয়ে ভুগছে?”

স্বরূপ অবাক হলো৷ বলল, “তনয়ার জ্বর হয়েছে?”

“আরও অনেক কিছুই হয়েছে। তুমি তো তাকে জিজ্ঞেস করোনি কী হয়েছে।”

স্বরূপ মাথা নিচু করে রইল। বাবা, জিজ্ঞেস করলেন, “ভুল বোঝাবুঝি কী নিয়ে হলো?”

“আমিই একটু রুড হয়ে গিয়েছিলাম।”

“রুড হওনি, তুমি তাকে অসম্মানজনক কথা বলেছ।”

“আঙ্কেল তখন আমার মাথার ঠিক ছিল না।”

“কেন? তনয়া কী করেছিল যে তোমার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল?”

“ওর জন্য না…”

“তাহলে? অন্য কারো রাগ ওর ওপর ঝেড়েছ?”

“স্যরি আঙ্কেল!”

“তনয়াকে স্যরি বলেছ?”

“বলেছি।”

“কখন?”

“গতরাতে।”

“গতরাতে স্যরি বলার কথা মনে হলো? তোমার এই ব্যবহারটা কবের ছিল? কতদিনের পুরানো?”

স্বরূপ চুপ করে রইল। বাবা বললেন, “হিসেবও ভুলে গেছ মনে হচ্ছে?”

ওপাশে নিরবতা।

বাবা একটু চুপ করে থেকে বললেন, “তনুর যখন জন্ম তখন আমার স্ট্রাগলিং টাইম চলছিল৷ যেখানে চাকরি করতাম সেখান থেকে ছাঁটাই হয়ে গিয়েছিলাম। নতুন চাকরি পাচ্ছিলাম না। তনুর মা ছোটো একটা চাকরি করে সংসার চালাত। চার বছর বেকার ছিলাম সে সময়। মানুষের কথা আর তনুর মায়ের কষ্ট দেখে মনে হতো মরে যাই। শুধু মেয়েটার কথা ভেবে বেঁচে ছিলাম। মা চাকরিতে গেলে সে সারাক্ষণ আমার কাছেই থাকত। বাবা ছাড়া কিছুই বুঝত না মেয়ে। ও যখন আমার দিকে চেয়ে হাসত, মনে হতো পৃথিবীতে আর কিচ্ছু চাই না৷ বড় আদরের মেয়ে আমার।

ও যখন ক্লাস ফোরে পড়ে তখন একবার জ্বরে পড়ল। জ্বরের সময় আমাকে কাছ ছাড়া করতে চাইত না। আমি শুধু ওর জন্য রিস্ক নিয়ে হলেও অনেকদিন ছুটি কাটালাম। সপ্তাহখানেক পর মেয়েটা মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠলেও স্যুপ ছাড়া কিছু খেতে পারত না৷ পুরো এক মাস ভুগেছিল তনু। সেই এক মাস আমিও স্যুপ ছাড়া কিছু মুখে দিতে পারিনি।

আমার হার্টে ছোট্ট একটা সার্জারি হয়েছিল। সে সময় ঠিক এমন করেই সে সারাক্ষণ পাশে থেকেছে। আমি যা খেতে পারতাম সেটুকু খেয়ে থেকেছে। এক মুহূর্তের জন্যও চোখের আড়াল করতে চাইত না৷ মেয়ে ছাড়া কে এত আপন হয় বলো?

আমি দোয়া করব তোমার একটা মেয়ে হোক, তুমিও বুঝবে এত আদরের মেয়েকে বিয়ের পর কষ্ট পেতে দেখে কেমন লাগে।”

“আঙ্কেল…” বলতে বলতেও থেমে গেল স্বরূপ। বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, “বাবা, আমার নিজের বাবা নেই। খুব ছোটোবেলায় মারা গেছেন। বাবার আদর ছাড়া একা বর হয়েছি। আমার জীবনটাও একেবারে সহজ ছিল না। সবসময় আমরা যা কাজ করি সেটা কি নিজের কন্ট্রোলে থাকে? ভুল তো মানুষেরই হয় বলুন? আমি খুবই লজ্জিত এবং দুঃখিত। আপনি প্লিজ আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি তনয়াকে নিয়ে যেতে চাই। কথা দিচ্ছি, এরপর আর এমন হবে না।”

বাবা একটু ভেবে বললেন, “বুঝলাম৷ কিন্তু একটা ব্যাপার কী জানো, তোমার এইযে নিজেকে কন্ট্রোল করার ক্ষমতাটা নেই, এই স্বভাবটা পরিবর্তন করতে হবে। তুমি ওকে অসম্মানজনক কথাবার্তা বলেছ। মেয়েটা অনেক আঘাত পেয়েছে। এ ধরনের কথাবার্তা তার সাথে কখনোই বলা হয় না। তুমি একবার এসব বলেছ, রাগ কন্ট্রোল করতে না পারলে আবারও বলবে। বলার সময় চেতনা কাজ করবে না, অবচেতন মন ভাববে কী আর হবে, বড়জোর বউ বাড়ি ছাড়বে, আবার গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে এলেই হবে।”

“না বাবা এরকম হবে না।”

“আমার মনে হয় তোমার নিজের ওপর কাজ করাটা অনেক জরুরি। সমাজ বলো বা ধর্ম, কোনোটাই তোমাকে অকারনে স্ত্রীকে অপমান করার অধিকার দেয়নি। সাদা চোখে ব্যাপারটা খুব ছোটো মনে হয়। এসব অহরহ হচ্ছে। কিন্তু তাই বলে ব্যাপারটাকে জাস্টিফাই করা যাবে ন। তুমি যদি সত্যিই ভালো একজন স্বামী হতে চাও তাহলে ভুলের উপলব্ধি খুব জরুরি। ভুল উপলব্ধির পর তনয়ার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিও। সে তোমাকে ভালোবাসে, তোমার সাথে থাকতে চায়। তাকে সম্মানের সাথে রাখা তোমার দায়িত্ব। বিয়ে করে হাত পা ছেড়ে দিয়ে বসে থাকলে তো হলো না, অনেক দায়িত্ব আছে মাই বয়!”

বাবা চলে গেলে স্বরূপ ঝিম ধরে বসে রইল অনেকক্ষণ। সব কথা মাথায় ঘুরছে।

হঠাৎ মনে পড়ল অফিসে ঘন্টাখানেকের কথা বলে এসেছে। এদিকে দু’ঘন্টা পার হয়েছে। সে উঠল। জীবনটা বড় বেশি যন্ত্রণা দিচ্ছে!

*

মিলির অফিসে একটা পার্সেল এলো বিকেলের দিকে। খুব সুন্দর র‌্যাপিং পেপারে মোড়া বাক্স। কে পাঠিয়েছে লেখা নেই। মিলি আগ্রহ নিয়ে খুলল। অনেকদিন কোনো উপহার পায় না সে। কে সেই সহৃদয় ব্যক্তি যার তাকে হঠাৎ উপহার দিতে ইচ্ছে হলো?

প্যাকেট খোলার পর ভেতর থেকে দুটো জিনিস বের হলো। দুটো দেখেই মিলি বেশ অবাক হলো। একটা চিঠি আর একটা পারফিউমের শিশি। পারফিউমটা তার সবচেয়ে পছন্দের। ফরাসি ব্র্যান্ড। এই ব্র্যান্ডটা সে ভীষণ পছন্দ করলেও অতিরিক্ত দামী বলে খুব কম ব্যবহার করে। তার আগের বোতলটা রয়ে গেছে ফেলে আসা সংসারে৷

চিঠির ভাঁজ খুলল মিলি। কয়েক লাইন লেখা, “পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর মানুষটির জন্য সামান্য উপহার। আশা করি আপনার পছন্দ হবে। কিছু মানুষকে কমদামী জিনিসে একদম মানায় না।”

মিলির চেহারা কঠিন হয়ে উঠল। সেই লোকটাই! কিন্তু নেহায়েতই উটকো লোক মনে হচ্ছে না। মেয়ে পটানোর জন্য একুশ হাজার টাকার পারফিউম পাঠাতে কলিজা লাগে। নিশ্চয়ই ওড়ানোর জন্য টাকাপয়সা একটু বেশিই হয়ে গেছে।

লোকটার ফোন এলো একটু পরেই।

“পছন্দ হয়েছে?”

মিলি মিষ্টি সুরে বলল, “খুব! ধন্যবাদ।”

“জানতাম পছন্দ হবে।”

“আপনার সাথে দেখা করতে চাই।”

“তাই? করব, এত তাড়া কিসের?”

“আপনাকে একটা রিটার্ন গিফট দেব। আমার শুধু গিফট নিতে ভালো লাগে না। আমার ব্যাপারে এত জানেন, এটাও নিশ্চয়ই জানেন যে আমি উপহারদাতাকে খালি হাতে যেতে দেই না?”

লোকটা হাসল। বলল, “এত তাড়া নেই। কিছুদিন পর দেখা করি। তখন উপহার নেয়া যাবে।”

“উহু, আজই। দেখা না করতে চাইলে আমার অফিসের সামনে আসুন ছয়টার দিকে, আমি বের হয়ে গিফট রেখে যাব।”

“যথা আজ্ঞা!”

ছয়টা পাঁচে বের হলো মিলি। হাতে পারফিউমের বোতল। বের হয়ে আশেপাশে তাকাল। কাউকে দেখে মনে হলো না তাকে খেয়াল করছে। মনে হবারও কথা নয়। লোকটা সাবধান।

সে বিল্ডিংয়ের সামনে রাখা পাতাবাহার গাছের গোড়ার পুরো পারফিউমের শিশি উপুড় করে দিল। তারপর বোতলটা ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলে একটা রিকশায় চড়ে বসল।

রাতে লোকটার ফোন এলো।

“আপনার রিটার্ন গিফট দেখে আমি ইমপ্রেসড।”

“ধন্যবাদ।”

“জেদি মেয়েই ভালো লাগে আমার।”

“কিন্তু আমার পেছনে পড়ে থাকা ছ্যাঁচড়া লোকজন পছন্দ নয়।” বলে ফোনটা কেটে দিল মিলি। এই লোক আবার ফোন করবে। জ্বালিয়ে শেষ করে দেবে!

*

স্বরূপ অফিস শেষে তনয়াদের বাসার দিকে রওনা দিল। তার মেজাজ চড়ে আছে। রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম। তার ওপর দুপুরে তনয়ার বাবার একগাদা ঝাড়ি, সেখান থেকে অফিসে গিয়ে বসের ঝাড়ি, সব মিলিয়ে তার মাথা গরম হয়ে গেছে। গাড়িগুলো পুরোপুরি নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক ইঞ্চিও নড়ছে না গত বিশ মিনিট ধরে।

গাড়ির জানালায় টোকা পড়ল। একটা…দুটো…তিনটে…

স্বরূপ পাত্তা দিল না৷ কিন্তু যে টোকা দিচ্ছে তার ক্ষান্তি নেই। সে একপ্রকার অসহ্য হয়ে জানালা খুলল। বাচ্চা একটা ছেলে। হাতে পানির বোতল। ফোকলা দাঁত বের করে সে বলল, “ভাইয়া পানি লইবেন? ঠান্ডা পানি আছে।”

স্বরূপ অত্যন্ত তিক্ত গলায় বলল, “তোদের কি সমস্যা হ্যাঁ, মানুষকে শান্তিতে থাকতে দিবি না? দেখছিলি জানালা খুলছিলাম না, তারপরেও টোকা দিয়ে যাচ্ছিলি৷ কোনো পানি কিনব না। যা ভাগ এখান থেকে! বেয়াদব পোলাপান!”

বাচ্চাটা ছোটো। এই আচমকা ঝাড়ি খেয়ে তার মুখ ছোটো হয়ে গেল। মাথা নিচু করে সরে গেল সে। স্বরূপের জানালার কাচ তুলে দিতে দিতে মনে হলো, সে কেন এটা করল? কাজটা কি খুব খারাপ হয়ে গেল না? বিনা কারনে বাচ্চাটার সাথে এমন ব্যবহার করা কি ঠিক হলো? হয়তো বাচ্চাটা এতিম, ঠিকমতো খেতে পায় না।

ভীষণ অপরাধবোধ নিয়ে সে কাচ নামিয়ে এদিক ওদিক চাইল। বাচ্চাটাকে দেখতে পেল না।

জ্যাম ছুটে গেলে সে গাড়ি ঘুরিয়ে নিজের বাসার দিকে রওনা দিল। তনয়ার বাবা ঠিকই বলেছিলেন। তার এখনো ভুলটা ঠিকঠাক উপলব্ধি হয়নি৷ এখনো শোধরাবার বাকি আছে। আজ তনয়া যদি ফিরে আসেও, কাল সে আবার ওরকম আচরণ করবে না এমন কোনো গ্যারেন্টি নেই।

বাড়ি ফিরে স্বরূপ চুপচাপ মায়ের রান্না খেয়ে নিল। মা তাকে কী যেন বলতে চাইছিলেন। স্বরূপ শুনল না। বলল, “প্রচন্ড মাথাব্যথা করছে মা। কাল ছুটির দিন, কাল শুনব।”

মাও আর জোরাজোরি করলেন না৷

*

গভীর রাতে এলোমেলো ফেসবুক ঘাটছিল তনয়া। রাতে ঘুম আসে না। ভূতের মতো জেগে থেকে চোখের নিচে কালি পড়েছে। অনেক চেষ্টা করেও ঘুম আনানো যায় না৷

ওর এক বন্ধু প্রোফাইলে নিজের ছোটোবেলার ছবির সাথে বাচ্চার ছবি জোড়া লাগিয়ে পোস্ট করেছে৷ ঠিক একইরকম দেখতে দুটো বাচ্চা। কে বলবে মা মেয়ে! শুধু ছবির কোয়ালিটির পার্থক্য।

তনয়ার মাথায় এলো, তার বাচ্চাটা কার মতো দেখতে হবে? তার মতো নাকি বাবার মতো? দুজনের ছোটোবেলার ছবি একত্র করে রাখলে বাচ্চা হবার পর মিলিয়ে নেয়া যাবে।

তনয়া উঠে অ্যালবাম থেকে নিজের ছোটোবেলার ছবি বের করে মোবাইলে সেটা থেকে ছবি তুলে নিল। আবার শুয়ে পড়ল সে। স্বরূপের কি ছবি আছে? এখন তো চাওয়া যাবে না।

হঠাৎ মনে পড়ল স্বরূপের প্রোফাইলে সে ওর ছোটোকালের একটা ছবি দেখেছে! অনেক আগের আপলোড করা। সেটা নিশ্চয়ই এখনো আছে। তনয়া স্বরূপের প্রোফাইলে ঢুকল। শুরুতেই লেখা, “What is love?”

তনয়ার গা জ্বলে গেল। মনে মনে বলল, তোর ভালোবাসার গুষ্টি কিলাই! বাচ্চাটা তোর মতো দেখতে হলেই ভালো হবে। তোকে কাছেও আসতে দেব না, ছুঁতেও দেব না। দূর থেকে দেখে চলে যাবি আর কাঁদবি। দারুণ হবে! বদ কোথাকার!

সে ছবির অপশনে গিয়ে স্ক্রল করতে থাকল। বেশ কয়েক বছর আগের সেই ছোট্টবেলার ছবিটা একসময় সে খুঁজে পেল। দুটো মাত্র দাঁতে কি বিশাল হাসি দিয়ে রেখেছে! চোখ জুড়িয়ে গেল তনয়ার৷ ছবিটা সেভ করে রাখল সে।

ছবিতে অনেকগুলো কমেন্ট এসেছে। সে ক্লিক করল সেখানে। প্রথমেই যে কমেন্টটা ভেসে উঠল সেটা করেছে লোপা চৌধুরী নামের একজন। এই কি সেই লোপা? কমেন্টে লেখা, “ওরে আমার বাবুটা, এত্ত কিউট! উফ! চুমু খেতে ইচ্ছে করছে।”

স্বরূপ সেখানে উত্তর দিয়েছে, “খেতেই পারো। এনি টাইম!”
– আমি তোমার কথা বলিনি, বাচ্চাটার কথা বলেছি।
– বাচ্চাটাই যে আমি।
– উহু, মানি না।
– যখন তোমারও সেম টু সেম একটা হবে তখন বুঝবে এটা বাচ্চা বাকি বাচ্চার বাবা।
– ইশ! কমেন্টে কী দুষ্টুমি কথাবার্তা রে বাবা!
– আচ্ছা পছন্দ না হলে মিষ্টি কথা বলব? I love you.
– I love you too baccha/ bacchar baba.

তনয়া কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইল। কেন সে এটা দেখল? কেন আজই দেখল? তার এত রাগ হতে থাকল যে ফোনটা ছুঁড়ে ফেলে দিল দূরে। সেটা দেয়ালে লেগে ভেঙে নিচে পড়ল।

তনয়ার কাঁদতে কাঁদতে বিড়বিড় করতে লাগল, “তুমি আমার সাথে এমন কেন করলে আল্লাহ? আমার কী দোষ ছিল? অতীতে ধাক্কা খাওয়া একটা মানুষকে বিয়ে করে কি ভুল করেছি আমি? তুমি সেজন্য আমার ওপর এত রাগ? এই ছবি তো আমি আগেও দেখেছি। বিয়েরও আগে। কই তখন তো এসব দেখাওনি৷ তাহলে এখন কেন?”

কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেল তনয়ার। কিছুতেই এই প্রাক্তন প্রেমিকযুগলের ন্যাকা কথাবার্তা মাথা থেকে বের করতে পারল না৷

অনেকটা সময় পেরিয়ে গেলে সে একটু শান্ত হলো। ওয়াশরুমে যাওয়া প্রয়োজন। সে উঠল। বাথরুমের আলো জ্বেলে ভেতরে গিয়ে দাঁড়াতেই হঠাৎ মনে হলো পৃথিবীটা দুলছে। চোখের সামনের সবকিছু তিরতির করে কাঁপছে। পড়ার আগে সে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করল। কিন্তু হাতে কিছুই ঠেকল না।

*

স্বরূপ আবারও স্বপ্নটা দেখছিল৷ এবারও সে পা পিছলে গেল। ফুলটা ছুটে গেল হাত থেকে। সেটা ভেসে যাচ্ছে অতলে। হঠাৎ ফুলটা বদলে গিয়ে আস্ত মানুষে পরিণত হলো। তনয়া….

চেঁচিয়ে উঠে বসল স্বরূপ। ঘেমে গেছে। দরজায় অবরত আঘাত পড়ছে। লাফিয়ে উঠে দরজা খুলল সে৷ মা ঝড়ের মতো ঢুকে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, “তনয়া হসপিটালে…”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-৩০+৩১

0

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৩০.

স্বরূপ ভোরের দিকে বারান্দায় রকিং চেয়ারে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। যখন ঘুম ভাঙল তখন রোদ উঠে গেছে। তড়িঘড়ি করে ঘরে ঢুকে ঘড়ি দেখে মাথায় হাত দিল। দশটা বাজে! কত দেরি হয়ে গেল! কিভাবে টের পেল না বুঝতে পারল না স্বরূপ। এমন কখনো হয় না তার সাথে। অবশ্য একটা কারন আছে, সে খুব অদ্ভূত একটা স্বপ্ন দেখছিল।

স্বপ্নে সে একটা ঝর্ণার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। ঝর্ণার পানি অত্যন্ত স্বচ্ছ। নিচের কালচে পাথর দেখা যাচ্ছে। ঝর্ণার পাশে চমৎকার শুভ্র রঙের একটা ফুল ফুটে আছে। জায়গাটায় তার মতোই অসংখ্য দর্শনার্থী। তারা সবাই ফুল তোলার চেষ্টা করছে। কিন্তু ফুলটা এমন জায়গায় ফুটেছে যেখানে যাবার পথ অসম্ভব পিচ্ছিল। কেউই সফল হচ্ছে না৷ স্বরূপ নিজেও গেল। বেশ কয়েকবার পিছল খেতে খেতেও আশ্চর্যজনকভাবে ফুলটা পর্যন্ত পৌঁছে গেল সে। তুলে নিল হাতে। তার চারপাশ যেন আলোকিত হয়ে উঠল ফুলের সৌন্দর্যে। সে জিজ্ঞেস করল, “এই ফুলের নাম কী?” কেউ একজন উত্তর দিল, “তনয়া।” স্বরূপ তনয়াকে নিয়ে ফেরার চেষ্টা করল। কিন্তু এবার আর আগের মতো পথটা সহজ মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে ফিরতে গেলেই সে পিছলে যাবে। ফুলটা পড়ে যাবে হাত থেকে। কিছুতেই এটাকে হাতছাড়া করা যাবে না।

ড্রাইভ করতে করতে স্বপ্নটাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল স্বরূপের। এত জীবন্ত স্বপ্ন সে বহুদিন দেখেনি। স্বপ্ন এত স্পষ্ট মনেও থাকে না, এটা মনে আছে। যেন একটু আগেই সে সেই পাহাড়ের পাশে ঝর্ণার ধারে ছিল।

অফিসে ঢুকে একগাদা কাজের মধ্যে ডুবে যাবার আগ পর্যন্ত স্বপ্নটা স্বরূপকে ভাবাল। তারপর একসময় ভুলে গেল সবকিছু।

লাঞ্চটাইমে স্বরূপের মনে পড়ল গতকাল তনয়ার মা ফোন করেছিলেন। তাকে কলব্যাক করা দরকার। সে করিডোরে একাকী একটা কোন বেছে নিয়ে কল করল। কিন্তু কলটা কেটে দেয়া হলো। সে আরও কয়েকবার চেষ্টা করল। প্রতিবারই একবার রিং বাজার পর কেটে দেয়া হচ্ছে। স্বরূপের মনে হলো কাজটা তনয়ার। সে এবার তনয়ার মোবাইলে কল করল। একই ঘটনা ঘটল। কল কেটে দিচ্ছে বারবার। “আচ্ছা, বলো না কথা। দেখি কতদিন না বলে থাকতে পারো।” নিজের মনেই বলল স্বরূপ৷ তারপর খেতে চলে গেল। সকালে না খাওয়ায় প্রচন্ড ক্ষুধা লেগেছিল। কিন্তু ক্যান্টিনের খাবার আজ একেবারই খাওয়া যাচ্ছে না।

মাঝে অনেকদিন তনয়া তাকে বাসার খাবার প্যাক করে দিয়েছে৷ তাতেই অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে। নইলে এই ক্যান্টিনের খাবার সে গত কয়েক বছর ধরে সোনামুখ করে খেয়ে আসছিল৷ স্বরূপের মনে হলো, মানুষের বেশি আরাম পাওয়া উচিত না। আরাম তার স্বভাবচরিত্র বিগড়ে দেয়। মাছের কাটলেটের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। এই জিনিস তনয়া একটু বেশিই ভালো বানায়।

*

তনয়ার জ্বর ভোরের দিকে কমেছে। সারারাত মা জেগে পাশে বসেছিলেন। তনয়া ভোরের দিকে উঠে দেখেছে মা খাটের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে আছেন। মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে তনয়ার মনে হয়েছে, পৃথিবীতে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা শুধুমাত্র মা বাবার পক্ষেই সম্ভব। এরা না থাকলে আর কেউই রইবে না তার।

জ্বর আর এলো না। সে সকালে ঘিয়ে ভাজা পরোটা আরাম করে খেল। তারপর এক কাপ চা খেল টেলিভিশন দেখতে দেখতে। স্বরূপের চিন্তা জোর করে মাথা থেকে সরিয়ে রাখল।

মায়ের সাথেও অনেকক্ষণ গল্প হলো এরপর। কিন্তু স্বরূপের কথা না সে তুলল, না মা এই নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলেন। স্বস্তি পেল তনয়া। স্বরূপের ব্যবহারের কথা তাদের বললে তারা মোটেও খুশি হবেন না। আরও চিন্তায় পড়ে যাবেন। তারচেয়ে ভাবুক না সে ঝগড়া করে এসেছে৷

দুপুরের দিকে মায়ের মোবাইলে স্বরূপের কলটা দেখে চমকে গেল তনয়া। মা তখন গোসলে। সে মায়ের ঘরের জানালার পাশে বসে আচার খাচ্ছিল। হঠাৎ জনাবের ফোন। ওর নামটা দেখেই গা জ্বলে গেল তনয়ার। তাকে ফোন করার প্রয়োজন মনে করেনি। ওই ছেলে তো জানেও না সে বাপের বাড়িতে এসেছে নাকি মরে গেছে! জানার চেষ্টাও করেনি। এখন এসেছে ফোন করতে। কোন দুঃখে করেছে কে জানে! কিছু জানতে হবে না ওর। ও থাকুক ওর স্পেস নিয়ে, রাগ নিয়ে, অতীত নিয়ে। তনয়া কল কেটে দিল।

বিকেলের দিকে সে আকাশ দেখছিল। পাশের বাড়ির একঝাঁক কবুতর তখন আকাশজুড়ে ঘুরে ঘুরে উঠে যাচ্ছে। কখনো অনেক ওপরে উঠে যাচ্ছে, আবার কখনো নিচে নেমে আসছে। এদের দেখতে দেখতে হঠাৎই সেই রাতের ঘটনা চোখের সামনে ভেসে উঠল। আবারও যেন সে ফিরে গেল সেখানে। স্বরূপের হাত ধরার পর সে তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল তাকে। চমকে উঠল তনয়া। ফিরে এলো বাস্তবে। বাবার বাড়ির বারান্দায়, যেখান থেকে কবুতরের ওড়াউড়ি দেখা যায়। না, স্বরূপ কোথাও নেই।

*

সন্ধ্যার মুখে বাসায় ঢুকল স্বরূপ৷ ব্যাগ রেখে ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে সন্ধ্যেটা দেখল মনোযোগ দিয়ে। কোনো পরিবর্তন হয়েছে কি তার জীবনের? পুরো ফ্ল্যাটটা খাঁ খাঁ করছে। যেন ভেতরের দিকে তাকালে তাকে গিলে খেতে আসবে৷ সে একা একা বহুদিন এখানে থেকেছে। কখনো এমন লাগেনি।

একটা গোলাপ গাছে নতুন ফুল এসেছে৷ চমৎকার প্যাটার্ন! শৈশবে এর রঙ থাকে হলদেটে আর কমলার মিশেলে, মাঝবয়সে হতে থাকে গোলাপি আর ঝরে যাবার আগে হয় রক্তের মতো টকটকে। তনয়া প্রতিটা ফেজের ছবি তুলে রাখে। সেও তুলে রাখল। তনয়া ফিরতে ফিরতে হয়তো রঙটা অন্যরকম হয়ে যাবে৷ সে মোবাইলটা হাতে নিয়ে আরেকবার কল করল। এবারও কলটা কেটে দেয়া হলো।

স্বরূপের আজ আর রাঁধতে হলো না। দূরী খালাকে বলে রেখেছিল, তনয়া যতদিন না থাকে ততদিন আগের মতো রেঁধে রেখে যেতে। সে শুধু সবকিছু গরম করে নিল। একটা কাঁচামরিচও ধুয়ে নিল প্লেটে। এটার অভ্যাস তাকে কে করিয়েছে? মনে করতে চাইল না স্বরূপ। একটা জিনিস নিয়ে সারাক্ষণ ভাবার তো কোনো মানে নেই।

সে আগে টিভি দেখতে দেখতে খেত। তনয়া জোর করে টেবিলে বসে খাওয়ার অভ্যাস করিয়েছে৷ এখন আর খাবার সময় টিভি দেখতেও ইচ্ছে করে না৷

আবারও তনয়া! জোর করে চিন্তাটা দূর করার চেষ্টা করল সে। অফিসের কাজগুলোর কথা ভাবতে লাগল। মা কেমন আছেন? ক’দিন মায়ের সাথে কথা হচ্ছে না। মাও কল করছেন না, কারন কী?

প্লেট ধুয়ে রেখে এসে মোবাইল হাতে নিল মাকে কল করতে। ডায়াল করে কানে দিতেই কয়েকবার রিং হয়ে কেটে গিয়ে নারীকণ্ঠ বলতে থাকল, “The number you have dialled is busy now…” অবাক হয়ে সে স্ক্রিনের দিকে তাকাল। মায়ের বদলে তনয়াকে ফোন করেছে। সবকিছুর একটা লিমিট থাকে। সে ফোনটা বিছানায় ছুঁড়ে ফেলল।

*

রং নাম্বারে কলটা আজ তৃতীয়বারের মতো এলো। মিলি ঘুম জড়ানো গলায় রিসিভ করে বলল, “কে বলছেন?”

ওপাশ থেকে মৃদু একটা স্বর বলল, “ডিসটার্ব করলাম?”

মিলি নাম্বারটা খেয়াল করল। হ্যাঁ এটাই৷ ফোন করে হাবিজাবি বকবক করে। সম্ভবত এই লোকের কোনো কাজকর্ম নেই। তার নাম্বার কোথায় পেয়েছে কে জানে? দুনিয়াটা ফালতু লোকে ভরে গেছে। সে কথা বাড়াল না। কল কেটে দিয়ে নাম্বারটা ব্ল্যাকলিস্টে ফেলে দিল।

আজকের ঘুমটা তার ভালো হয়েছে। সেই পুরানো ঘর, পুরানো বিছানা, নরম কোলবালিশ, এসির পছন্দমতো টেম্পারেচার, দক্ষিণের জানালা, হালকা রঙের পর্দা, ড্রেসিং টেবিলের বিশাল আয়না, সব আগের মতোই আছে। গত দু’রাত মা বাবার চিন্তায় ঘুম হয়নি। তবে আজ আর চিন্তা নেই। তাদের সে বলে ফেলেছে, সাফাতের সাথে থাকতে ভালো লাগছে না৷ কয়েকদিন আলাদা থাকবে মনের দূরত্ব কমিয়ে নিতে। বাবা মা এত স্বাভাবিকভাবে নিলেন যে মিলির বিশ্বাস হতে চায়নি। সে আবারও বলেছিল, যতদিন ইচ্ছে থাকব কিন্তু! প্রশ্ন করতে পারবে না। ওরা খুশি হয়ে রাজি হয়েছে। মেয়েকে কাছে পাবার লোভেই হয়তো। কেন যে এতদিন শুধু শুধু ভয় পাচ্ছিল!

ফোনটা আরেকবার চেক করল সে। তনয়ার পাঠানো ফিরতি মেসেজটা সে কতবার পড়েছে জানে না। তবুও পড়তে ইচ্ছে করে। তনয়া লিখেছে,

“আপু, তোমার দুঃখিত হবার কিছু নেই। আমি তোমার ওপর কোনো রাগ করিনি, রাগ পুষে রাখার প্রশ্নই আসে না। তোমার জন্য আমাদের মধ্যে কিছু হয়নি এটা যেমন বলা যায় না, আবার তোমার জন্যই সব হয়েছে সেটাও বলা যায় না। তুমি পরোক্ষভাবে ছিলে, তবে সমস্যাটা তোমার উপস্থিতি নয়, তোমার পরিস্থিতি ছিল। তোমার ঘটনাটা আমার সাথে তোমার বন্ধুর সম্পর্কটার আসল চেহারা বুঝিয়ে দিয়েছে। ওপর দিয়ে সেটা ভীষণ সুন্দর মোড়কে ঢাকা হলেও ভেতরটা ফাঁপা ছিল। তুমি না এলে বুঝতেই পারতাম না। ধোঁকায় থেকে যেতাম। তুমি বরং আমার উপকার করেছ। সেদিন যে বললে, ভালো হয়ে থাকলে মানুষ সস্তা ভেবে বসে। তুমি জানো কথাটা কত দামি?

তোমার সাথে আমার একটা মিল আছে। তুমি আমি দুজনেই বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। আদরটা তাই অনেক বেশি। সেজন্যই হয়তো বুঝেছিলে আমি কষ্ট পাব। খুব দ্রুতই বুঝে গেছি বলে বেঁচে গেছি নাকি হেরে গেছি জানি না, তবে ভালোই হয়েছে৷ অন্ধ হয়ে কতদিন থাকতাম বলো! তোমার জন্য আমি অনেক দোয়া করি৷ তুমিও আমার জন্য দোয়া করো।”

মোবাইল রেখে আরেকবার চোখ বুজবে, তখনই আবার ফোন বাজল। অচেনা নম্বর। ধরল সে, “হ্যালো।”

কোনো কথা শোনা গেল না। তার পছন্দের একটা মিউজিক শোনা গেল। গিটার বাজাচ্ছে কেউ। সুন্দর সুর। গুনগুন করছে সেই সাথে। কিছুক্ষণ পর কথা বলল লোকটা। সেই একই লোক। “ব্লক করে দিলেন যে তখন? এবারও যাতে না করেন সেজন্য ঘুষ দিয়ে নিলাম৷ পছন্দ হয়েছে?”

মিলি জিজ্ঞেস করল, “কে আপনি?”

“পরিচয় না জানলে কথা বলা যায় না?”

“না।”

“ধরুন আমার নাম হিমালয়।”

“নাম ধরাধরির কোনো প্রয়োজন দেখছি না৷ ফালতু কথা বলতে আমাকে ফোন করবেন না। বাজে কথা বলে নষ্ট করার মতো সময় সবার থাকে না।”

কল কেটে এই নাম্বারটাও ব্লক করল মিলি। এরকম গাদাগুচ্ছের রং নাম্বার, লাইন ধরে পড়ে থাকা ছেলে সামাল দেবার অভ্যাস তার আছে। ছোটোবেলা থেকে এই কাজ করে সে অভ্যস্ত এবং বিরক্ত৷ কিন্তু বিয়ের পর এসব একেবারেই কমে গিয়েছিল। সে কারো দিকে ফিরে চেয়েও দেখত না। লোকে তাকে অহংকারী ভেবে দূরে দূরে থাকত। কিন্তু হঠাৎ এই লোক উদয় হলো কোথা থেকে? লোকটা কি জানে সে এখন সাফাতের সাথে থাকছে না? জানল কেমন করে জানে? এই কথা তার কাছের বন্ধুরা ব্যতীত আর কারোই জানার কথা নয়। লোকটা তবে কে?

*

আজ তার নবম নির্ঘুম রাত। সময়ের সাথে সাথে প্রতি রাতে তার দীর্ঘশ্বাস ভারী হয়েছে। তনয়াকে সে আনতে যায়নি, দুদিন ফোন করার পর প্রতিবারই কেটে দিলে আর ফোনও করেনি। সে অভ্যস্ত হবার চেষ্টা করছে। আগের মতো হয়ে যাবার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। এতটাই জুড়ে বসেছিল মেয়েটা? প্রতিরাতে প্রায় ভোরের দিকে আবছা তন্দ্রামতো আসে। তন্দ্রার ঘোরে সে তনয়াকে ছুঁতে হাত বাড়ায়। কিন্তু হাতে ঠেকে শূন্য বিছানা। একটা কাঁটার মতো বুকে বিঁধে জেগে উঠছে মেয়েটা। বাকি রাত স্বরূপের কেটে যায় বারান্দায় রকিং চেয়ারে।

দুদিন ঘুমের ঔষধ খাবার চেষ্টা করেছিল। তাতে হিতে বিপরীত হয়েছে। দুঃস্বপ্ন দেখে বারবার ঘুম ভেঙেছে তার। সাথে মাথায় জমা হয়েছে তীব্র ব্যথা। প্রতিবার একই স্বপ্ন। সে একটা পাথরে পা দিয়ে পিছলে পড়ে যাচ্ছে অতলে। কেউ একজন তাকে টেনে তুলছে। কিন্তু হাতের ফুলটা ভেসে যাচ্ছে স্রোতের টানে।

স্বরূপ আজও স্বপ্নটা দেখল। ঘুমিয়েছিল কখন মনে পড়ছে না। ঘড়িতে তিনটে দশ বাজে। এত রাতে কি তনয়া জেগে? একবার কথা বলতে ইচ্ছে করছে। সে ডায়াল করল তনয়ার নাম্বারে। একবার বাজল, তারপর সেই চিরচেনা স্বর জানিয়ে দিল ওপাশের মানুষটি ব্যস্ত। পরে চেষ্টা করতে। তনয়া কি জেগে ছিল তবে? সে কি মেয়েটাকে একটু বেশিই কষ্ট দিয়ে ফেলেছে?

স্পেস চেয়েছিল সে। কিন্তু সেই স্পেস তাকে হা করে গিলে খেতে আসবে তা কে জানত!

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৩১.

স্বরূপ ক’দিন ধরে অফিসের কাজে গোলমাল করে ফেলছিল। ঠান্ডা মাথায় কিছুই করতে পারছিল না৷ পারার কথাও নয়, বহুদিন সে ঘুমাতে পারে না। মাথা গরম হয়ে থাকে সারাক্ষণ। আজ বস তাকে ইচ্ছেমতো ঝাড়লেন। স্বরূপ কিছু বলতে চাইলে বললেন, “আপনার অযুহাত শোনার সময় আমার নেই। ঠিকঠাক কাজ করতে পারলে করুন, না পারলে আমাদের অনেক অপশন আছে।”

স্বরূপ নিজের ডেস্কে ফিরে মাথা চেপে বসে রইল। আধঘন্টা ধরে চেঁচিয়েছে লোকটা। এত কড়া ভাষা! মাথা ধরে যায়। বস বলেই একটা মানুষ অন্য একজনকে এভাবে হেনস্তা করতে পারে? এত সহজ? তার দিকটা একটা বারও ভেবে দেখল না লোকটা? কথাগুলো ভালোভাবেও বলা যেত। নিজের বাসার ফ্রাস্ট্রেশন এখানে এসে ঝাড়ে!

এলোমেলো ভাবতে ভাবতে হঠাৎ একটা অপরাধবোধের বাতাস ধাক্কা দিয়ে গেল তাকে। সে সেদিন তনয়ার সাথে এরচেয়েও খারাপভাবে কথা বলেছিল। আজ তবুও তার অনেকগুলো দোষ আছে। সেদিন তনয়ার আদতে কোনো দোষ ছিল না। মেয়েটা শুধু তাকে কাছে ডাকছিল। আর কিছুই তো নয়। সেও অন্য একটা বিষয়ের রাগ ওর ওপর ঝেড়েছে।

স্বরূপের হঠাৎই যেন চোখ খুলে গেল। এতদিন তার মনে হচ্ছিল ওদের মধ্যে ঝগড়া হয়েছে, তার জের ধরে তনয়া চলে গেছে। কিন্তু আজই প্রথমবার মনে হলো, ঝগড়াটা একতরফা ছিল, শুধুই তার পক্ষ থেকেই।

সে পুরুষ মানুষ, আবেগ নিয়ন্ত্রণ সে মেয়েদের তুলনায় অনেক ভালোই পারে। তবুও বসের চেঁচামেচি শুনে অসহ্য লাগছে। তনয়া তো মেয়ে। তার ওপর এত নরম মনের। সে তার নিষ্ঠুর আচরণে নিশ্চয়ই ভীষণ কষ্ট পেয়েছে?

সে তনয়াকে সত্যিকার অর্থেই অত্যন্ত পছন্দ করে। ওর ছোটো ছোটো কাজ, কথা, ছেলেমানুষী, আহ্লাদ সবটা তার পছন্দ। অথচ এই ক’দিন সে কিসের মধ্যে ছিল যে একটা বিস্বাদের ছায়া তার মনের ভেতরটা দেখতে দিচ্ছিল না?

অপরাধবোধে মাথা নিচু হয়ে আসছিল স্বরূপের। তনয়া কি অনেক কষ্ট পেয়েছে? খুব কেঁদেছে নিশ্চয়ই। বেচারি এত ভালো একটা মেয়ে! না জানি কত অভিমান জমিয়ে বসে আছে!

কিন্তু এটা বুঝতে তার এতটা সময় লেগে গেল কেন?

সেদিন সে প্রচন্ড রেগে ছিল৷ তনয়াকে সে রাগের মাথায় ঠিক কী কী বলেছে নিজেরও মনে নেই। শুধু মনে পড়ছে শেষে তনয়ার চোখভর্তি পানি দেখে সে কান্না নিয়েও কিছু একটা বলেছিল।

স্বরূপের নিজেরই চোখে পানি চলে আসছে। ইচ্ছে করছে ছুটে চলে যেতে৷ কিন্তু আজ কাজ ফেলে গেলে আগামীকাল নির্ঘাত টার্মিনেশন লেটার হাতে বসে থাকতে হবে।

*

হাসপাতালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কৃত্রিম আলোয় বাইরের একচিলতে বাগান দেখছিল তনয়া৷ চমৎকার কিছু মৌসুমি ফুল ফুটে আছে। যে কোনো গাছ দেখলে তার প্রথমে নিজের ছোট্ট বারান্দা-বাগানের কথা মনে পড়ে। কেমন আছে গাছগুলো?

সন্ধ্যের শেষ আলো কখন নিভে গেছে! তারাগুলো জ্বলজ্বল করছে কান্নার মতো। ওদের পাশাপাশি দেখা গেলেও আসলে ওরা একে অপরের থেকে বহু আলোকবর্ষ দূরে। ওদের কি একাকী লাগে না? কত হাজার কোটি বছর ধরে এই এভাবেই নিঃসঙ্গ তারারা কোনো কৃষ্ণগহ্বরের চারদিকে ঘুরে ঘুরে মাথা কুটে মরছে, ক্ষয়ে যাচ্ছে, ঝরে যাচ্ছে…

মানুষও কি তাই নয়? সারাজীবন সে সুখ নামক কৃষ্ণগহ্বরের চারদিকে ঘুরে যায় কিসের আশায়? কতটুকুই বা পায় তার থেকে?

বাবা-মা কোথায় যেন গেছেন ওকে রেখে। তনয়ার মনে হলো তারা ডাক্তারের সাথে কোনো গোপন পরমার্শ করতে গেছেন। সেসব কথা তারা তাকে জানতে দিতে চান না।

ওরা ফিরে তনয়া আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করল, “কী বললেন ডাক্তার?”

বাবা গম্ভীর মুখে বললেন, “বলেছে তোমার কানে ধরে ঘুম পাড়াতে।”

তনয়া হেসে বলল, “কানে ধরলে ঘুম আসবে?”

“আসবে মানে? ঘুমের বাবা আসবে।”

তনয়া খুব সাবধানে গাড়িতে উঠে বসল। সে তো আর একা না যে ধুপধাপ যা খুশি করে ফেলবে। একটা ছোট্ট মানুষও তার সাথে আছে। যদিও সে এখনো পুরোপুরি মানুষের আকৃতি পায়নি, ৭ সপ্তাহ বয়সের মানুষটি নাকি একটি মুড়ির দানার সমান বড় হয়েছে, তবুও তনয়ার মনে হলো এই খুদে মানুষটি তাকে ভালোবেসে দু’হাতে জড়িয়ে রেখেছে।

সন্দেহটা তনয়ার অনেক আগেই হয়েছিল। তার পরীক্ষার মধ্যে পিরিয়ডের ডেট পড়ায় সে বেশ প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিল লম্বা লম্বা পরীক্ষাগুলো কিভাবে দেবে সেটা ভেবে। কিন্তু পিরিয়ড মিস হলো! এমনটা সচরাচর হয় না। তার ওপর খাওয়াদাওয়ায় অরুচি আর বমি বমি ভাব তো হতোই। স্বরূপকে সে কয়েকবার বলতে চেয়েছে কথাটা। কিন্তু বলা হয়ে ওঠেনি৷ এমনকি সে শেষদিনও এটাই বলতে চেয়েছিল। স্বরূপ যদি একবার শুনত, এখন পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারত!

দীর্ঘশ্বাস ফেলল তনয়া। পরিস্থিতি এখন কেমন? সে বুঝতে পারে না। কতগুলো দিন হয়ে গেল, স্বরূপ একবারও এলো না৷ তার তো ভীষণ ইচ্ছে করে ওকে দেখতে। স্বরূপের কি একবারের জন্যও ইচ্ছে হয় না তাকে দেখার? সম্পর্কটা এতটা ঠুনকো নিশ্চয়ই ছিল না। তবে? সে চলে এসেছে মানে কি স্বরূপ ধরে নিল সে তাকে ছেড়ে চিরতরে চলে এসেছে? বোধহয় বোঝা মুক্তির আনন্দে সে বেশ আরামে আছে। মা বাবার চোখ এড়িয়ে তনয়া চোখের পানি মুছে ফেলল। মুখটা হাসি হাসি করে বাইরে তাকাল। মা বাবা ভয়ানক দুশ্চিন্তায় আছেন। এতদিন কিছুই বলেননি। আজ না বলে ছাড়বেন না।

তনয়ার জ্বরটা ভালুকের মতো আসছিল যাচ্ছিল ক’দিন ধরে। এই একেবারে নেই, আবার দেখা যেত রাত বিরাতে বিকট রূপে হাজির! বাবা ডাক্তার দেখাতে নিয়ে এলে ধরা পড়ল সে প্রেগন্যান্ট। খবরটা শোনার পর থেকে তনয়া বহু কষ্টে নিজেকে ধরে রেখেছে৷ তার ভয়ানক কান্না পাচ্ছে। ভেতর থেকে কষ্টগুলো পাক খেয়ে উঠছে, সে প্রবল মানসিক শক্তি দিয়ে কান্নাকে পরাজিত করে স্বাভাবিক মুখে বসে আছে৷

বাড়ি ফিরে সে নিজের ঘরে চলে গেল। মাকে বলল ঘুমাবে। তাকে যেন বিরক্ত না করে কেউ।

মা একটু পরে ওর জন্য গরম দুধ নিয়ে এসে দেখলে ঘর ভেতর থেকে বন্ধ।

তিনি চিন্তিত হয়ে স্বামীর কাছে গিয়ে বললেন, “জামাইকে আসতে বলো। সে আমার ফোন ধরেনি৷ এখন কথা বলা খুব জরুরি। এসব কী হচ্ছে?”

বাবা গম্ভীর মুখে বললেন, “আগে মেয়ের সাথে কথা হোক, তারপর ওরটা শুনব।”

*

স্বরূপ অফিস ছুটির পর সন্ধ্যায় শ্বশুরবাড়িতে চলে গেল। কিন্তু গিয়ে দেখল বাসা তালা দেয়া। পাশের ফ্ল্যাটে জিজ্ঞেস করলে তারা কিছুই বলতে পারল না। নিচে দারোয়ান জানাল সবাই বিকেলের দিকে বেরিয়ে গেছে। কোথায় গেছে সে জানে না। স্বরূপ ঘন্টা দুয়েক অপেক্ষা করল। ফোন সে দুপুরেও কয়েকবার করেছে, বারবারই কেটে দিয়েছে তনয়া৷ এখন আবার করলে রিং বেজে বেজে শেষ হয়ে গেল। কোনো সাড়া এলো না। একসময় স্বরূপের মনে হলো ওরা হয়তো রাতে ফিরবে না। আর অপেক্ষা করে লাভ হবে না। সে ফিরতি পথ ধরল।

বাড়ি ফিরে গোসল করে নামাজ পড়তে গেল স্বরূপ। মসজিদে মিলাদ পড়ানো হয়েছে। সবাইকে জিলাপি দিচ্ছে। জিলাপি দেখে স্বরূপের মনে পড়ল তনয়া খুব পছন্দ করে। কী যে খুশি হয় মসজিদের জিলাপি পেলে! সে দুটো নিল।

ফ্ল্যাটের সামনে পৌঁছে একবার কলিংবেল চেপেই তার মনে পড়ল বাসায় কেউ নেই। হঠাৎ বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। সে এতক্ষণ ধরে ভেবেছে বাসায় গিয়ে তনয়াকে পাবে। তাকে জিলাপি খেতে দেবে। আগে পরের কিছুই মনে ছিল না এতক্ষণ। এটা কেমন করে হলো? কেন সে পুরোপুরি ভুলে গিয়েছিল তনয়া নেই?

জিলাপি দুটো আর খাওয়া হলো না। সেগুলো একটা পিরিচে করে ফ্রিজে রেখে দিল সে। কাল তনয়াকে নিয়ে আসবে। তখন ও খেতে পারবে।

*

স্বরূপের ঘুম ভাঙল কলিংবেলের শব্দে। সে সোফায় বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিল মাত্র কয়েক মিনিট আগে। এখন জেগে উঠে মাথা ভোঁতা লাগছে। রাত বাজে সাড়ে এগারোটা। এই সময়ে কে এসেছে? তনয়া?

স্বরূপ উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে গেল দরজা খুলতে। সে ধরেই নিয়লছিল তনয়া এসেছে। দরজা খুলে হা হয়ে গেল।

মা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। তার পেছনে মিতা। সাথে একগাদা ব্যাগপত্র। মা ওর ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া মুখের দিকে চেয়ে একগাল হেসে বললেন, “কেমন সারপ্রাইজ দিলাম, হু?”

স্বরূপ অনিশ্চিতভাবে মাথা ঝাঁকাল। সারপ্রাইজই বটে!

মা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করলেন, “তনয়া কোথায়?”

স্বরূপ ঢোক গিলল। মাকে সে এখনো প্রচন্ড ভয় পায়। সে কী করেছে জানলে মা তাকে কাঁচা খেয়ে ফেলবে। আমতা আমতা করে সে জানাল, “তনয়া তো… ওর বাবার বাড়িতে গেছে.. তোমরা আসবে জানলে যেত না।”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-২৮+২৯

0

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
২৮.

মিলি এই ঝামেলার মধ্যেও অফিস কামাই করে না। উল্টো সে যখন অফিসে যায় তাকে দেখলে বোঝা যায় না এতকিছু তার ওপর দিয়ে যাচ্ছে। বেশ ফিটফাট আর স্বাভাবিক থাকে। তনয়া অবাক হয় ওকে দেখলে। খুব শক্ত মনমানসিকতা না থাকলে এটা সম্ভব না৷ তার নিজের সাথে এরকম হলে সে কেঁদেই অর্ধেক হয়ে যেত। অথচ সে মিলিকে কাঁদতে দেখেছে দুই একবার। তাও চোখে পানি আসার পরপরই সে মুছে ফেলে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে। এটা আবার একদিক দিয়ে খারাপও, কারন কষ্ট ভেতরে চেপে রাখতে রাখতে ভেতরটা শুকিয়ে মন মরে যায়।

ওরা অফিসের জন্য বেরিয়ে গেলে তনয়া একা হয়ে যায়। কেন যেন এখন তার আর আগের মতো সবকিছুতে মন বসে না। বরং শুয়ে শুয়ে দিন কেটে যায়। শুধু একবার কষ্ট করে ওঠে রান্না করার জন্য। গাছগুলোতে আগের মতো যত্ন নিতে ইচ্ছে করে না। কী হলো তার?

হতে পারে সবকিছুর কারন স্বরূপ। সে তনয়ার সাথে ঠিকমতো কথাই বলে না। মিলির ঘটনাটা তাকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে দিয়েছে। হয়তো ভাবছে তনয়াও কোনোদিন মিলির স্বামীর মতো করবে! এসব ভাবলে তনয়ার আরও খারাপ লাগতে থাকে৷ নাহ্ আজ স্বরূপ এলে সে এসবের সমাপ্তি ঘটাবেই। আর ভালো লাগছে না। ঘরের ভেতরটা গুমোট দীর্ঘশ্বাসের আড্ডা হয়ে উঠেছে।

আজ সে আগেভাগে রান্নাবান্না শেষ করল। গাছগুলোর যত্ন নিল। সময় নিয়ে গোসল করে সুন্দর একটা শাড়ি পরল। দূরী খালার সাথে গল্পগুজব করল। ফোনে মা বাবার সাথে অনেকক্ষণ কথা বলল। সব মিলিয়ে ওর মন ভালো রইল।

সন্ধ্যায় স্বরূপ ফিরলে তাকে সুন্দর করে চা বানিয়ে দিল। সাথে মাখন দেয়া টোস্ট। স্বরূপ ভালো চা খুবই পছন্দ করে। চায়ে চুমুক দিয়ে সে বলল, “বাহ! চমৎকার হয়েছে। তো, ব্যাপারটা কী?”

তনয়া একটু হেসে বলল, “কিসের ব্যাপার?”

“মনে হচ্ছে কিছু একটা হচ্ছে।”

“কী হবে?”

“সাজগোজ করেছ যে?”

“খেয়াল করেছ তাহলে!”

স্বরূপ চোখ মটকে বলল, “তুমি কি আমাকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করছ?”

তনয়া রহস্য করে বলল, “বলতে পারো…”

“ওহ, কয়েকদিন তো দূরে দূরে আছি। কত আর ভালো লাগে তাই না?”

দুজনেই হাসল। স্বরূপ চা শেষ করতে করতে অফিসের জরুরি একটা কল আসায় উঠে বারান্দায় চলে গেল। তনয়া গেল কাপ পিরিচ ধুয়ে রাখছে৷ এর মধ্যে মিলি চলে এলো। তনয়া মিলির জন্য চা বসিয়ে দিল। সাথে রাতে খাবার জন্য ভাতও বসাল।

স্বরূপ ততক্ষণে ল্যাপটপে বসে গেছে। অফিসের একটা মেইল সেন্ড করে খেয়াল করল দরজায় টোকা পড়েছে। পর্দার ওপাশ থেকে মিলি বলল, “আসতে পারি?”

স্বরূপ বলল, “আরে, আয়।”

মিলি ঘরে ঢুকল। বিষন্ন মুখ। আজ চেহারাটা একটু বেশিই বিমর্ষ লাগছে।

স্বরূপ জিজ্ঞেস করল, “নতুন কিছু হয়েছ?”

“আমি উকিলের সাথে কথা বলেছি ডিভোর্সের বিষয়ে। সাফাতকে আজ নোটিশ পাঠিয়ে দিলাম। পেয়েছে কিনা কনফার্ম হতে কল করলাম, রিসিভ করল সেই মেয়ে। বলল, সাফাত ওয়াশরুমে গেছে। আমি আর কিছু বলিনি জানিস, কল কেটে দিয়েছি।”

স্বরূপ খেয়াল করল ওর হাত কাঁপছে রাগে। চেয়েও কিছু বলতে পারল না।

মিলি মৃদু স্বরে বলল, “ওটা আমার বাসা ছিল স্বরূপ। ঘরের প্রতিটা ইঞ্চি আমার হাতে সাজানো। ও এতদিন যা করেছে, লুকিয়ে করেছে৷ আমার সামনে তো ভালোই থাকত। এখন সব খোলাখুলি চলছে। যেন হুট করেই সবটা জবরদখল হয়ে গেল। ছেড়ে আসতে হবে জানতাম, কিন্তু এভাবে তা তো ভাবিনি।”

স্বরূপ দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “তুই আবার মহান সাজছিস। একবার বল, ওকে সাইজ করে দেই। মেয়েটাকেও দেখে নেব।”

মিলি বাঁকা হাসল, “এত সহজ না স্বরূপ। ও এত অল্পতে পাড় পেয়ে যাবে না। ওর জন্য অনেক বড় শিক্ষা অপেক্ষা করে আছে।”

“তুই কোন ভিত্তিতে বলছিস ও একটা শিক্ষা পাবেই? হতেও তো পারে সারাজীবন তোকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ভালো থাকল?”

মিলির হাসিটা এবার চওড়া হলো। সে বলল, “আমি কোনোদিন কাউকে জ্ঞানত কষ্ট দেইনি। আল্লাহর ওপর পুরো বিশ্বাস আমার আছে। হ্যাঁ, আমি ধর্মের সব নির্দেশ ঠিকমতো পালন করি না, কিন্তু আমার বিশ্বাসে কোনো ঘাটতি নেই। আমি জানি, আল্লাহ আমাকে ন্যায়বিচার দেবেন। সেটারই অপেক্ষা করছি। তোদের বিচার আমার চাই না।”

স্বরূপ মিলির দিকে তাকিয়ে রইল। এই মেয়েটাকে সে কখনোই বুঝতে পারেনি। সে নরম নাকি কঠিন এটা পর্যন্ত বোঝা শক্ত।

মিলি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “যাকগে, তোর সাথে শেয়ার করতে ইচ্ছে হলো কথাটা। তাই করলাম। মা বাবাকে কী বলব সেটাও অলমোস্ট ঠিক করে ফেলেছি।”

“কী ঠিক করেছিস?”

“বিশেষ কিছু না। আমি দুই-তিনদিনের মধ্যে চলেও যাব। নিজেকে সামলাতে সময় লাগছে এই যা! যখন বুঝব ঠিকঠাক হয়ে গেছি, তখন বাড়ি চলে যাব। মায়ের কোলে ঘুমালে একটু শান্তি লাগবে বুঝলি!”

“হুম।”

মিলি উঠে চলে গেল নিজের ঘরে। তনয়া চা নিয়ে গিয়ে দেখল মিলি জানালার পাশে বসে রাতের আকাশ দেখছে। সে বলল, “আপু চা এনেছি।”

মিলি হঠাৎ বলল, “তনয়া, একটা কথা বলি তোমাকে?”

“বলো আপু।”

“এত ভালো হয়ে থেকো না৷ একটু খারাপও হতে শেখো। পৃথিবীতে ভালো মানুষের দাম খুব কম। সবাই সস্তা ভেবে বসে।”

তনয়া কিছু বলার মতো খুঁজে পেল না। চুপচাপ বেরিয়ে গেল।

রাতের খাবারের পর সব গুছিয়ে তনয়ার ফুরসত মিলল শোবার ঘরে ঢোকার। স্বরূপ মোবাইলে কী যেন দেখছে। তনয় শোবার প্রস্তুতি নিতে বাথরুমে ঢুকল।

স্বরূপ সোশ্যাল মিডিয়া ঘাঁটছে কোনো কারন ছাড়াই। তার শরীর জ্বলছে। মাথা কাজ করতে চাইছে না। তার সাথে যেটা ঘটেছিল সেই ঘটনাটা এতদিন ধরে চাপা আগ্নেয়গিরির মতো ভেতরে জমা ছিল। সে ভেবেছিল আগুন নিভে গেছে। কিন্তু না, জেগে উঠছে আবার। মানুষ কেমন করে নির্মমভাবে ধোঁকা দিতে পারে? দিনের পর দিন মিথ্যে বলতে পারে? আরেকটা মানুষকে ভেঙেচুরে শেষ করে দিতে পারে?

লোপার সাথে তার শেষবার ভালোভাবে কথা হয়েছিল সেই বিশেষ দিনেই সকালবেলা। আহ্লাদী গলায় মেয়েটা তাকে বলছিল, একা একা ঘুমাতে তার কী ভীষণ খারাপ লাগে! বিয়ের পর সে স্বরূপকে এক মুহূর্তের জন্যও ছাড়বে না। স্বরূপ সেই শেষবারের মতো লোপাকে বলেছিল, “ভালোবাসি।” এরপর এই শব্দ সে আর উচ্চারণ করার সাহস পায়নি। কোনোদিন হয়তো পাবেও না।

সেই মেয়েই বিকেলবেলা অন্য লোকের বাহুলগ্না হয়েছিল তার নিজেরই সেই তথাকথিত একলা বিছানায়। পৃথিবীর সবকিছুর ওপর থেকে বিশ্বাস উঠে গিয়েছিল তার। মিলির সাথেও কি এটাই হয়নি? মিলি সেদিন জলদি বাসায় না ফিরলে কি জানতে পারত তারই বিছানায় অন্য কারো সাথে তার স্বামীর অভিসার চলে?

চিন্তাগুলো মাথায় দপদপ করছে ওর। মোবাইলটা ছুঁড়ে ফেলল দূরে। কঠিন মুখে বসে রইল।

তনয়া ততক্ষণে শুতে চলে এসেছে৷ সে একপাশে শুয়ে হাত বাড়িয়ে স্বরূপকে ডাকল। স্বরূপ তাকাল না তার দিকে। তনয়া ওর হাত ধরে ঝাঁকুনি দিল, “কী হলো তোমার? শোবে না?”

“না।”

“কেন?” উঠে বসল তনয়া।

“ভালো লাগছে না।”

তনয়া ওর কপালে গালে হাত দিয়ে তাপমাত্রা দেখে বলল, “কী হয়েছে বলোতো? চোখ লাল কেন? শরীর খারাপ লাগছে?”

স্বরূপের রাগটা বের হয়ে আসতে চাইছিল। সে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না৷ ধাক্কা দিয়ে ওকে সরিয়ে দিয়ে বলল, “তোমার সমস্যা কী? এত গায়ে পড়া স্বভাব কেন? সব বিষয়ে নাক গলাতে হবে কেন? আমি কি আমার বাসায় চাইলেও একটু একা থাকতে পারব না?”

তনয়ার চোখ পানিতে ভর্তি হয়ে গেল। এত কড়া ভাষায় এমন মেজাজ দেখিয়ে স্বরূপ কখনোই তার সাথে কথা বলেনি। সে তবুও ঠোঁট কামড়ে বলল, “আমি কী করেছি?”

স্বরূপ গলা আরেকটু চড়িয়ে বলল, “কিছুই করোনি তুমি। আমাকে এবার একটু একা থাকতে দিয়ে উদ্ধার করো! মাথা ফেটে যাচ্ছে আমার। তোমার ন্যাকামি দেখার সময় বা ইচ্ছে কোনোটাই নেই। পরিস্থিতি বোঝো না তুমি? সবসয়ম তো একরকম ভালো লাগে।”

তনয়ার গাল বেয়ে তখন চোখে পানি গড়িয়ে পড়ছে। স্বরূপ যেন হঠাৎ খুব নির্দয় হয়ে উঠল। লোপাও সেদিন খুব কেঁদেছিল তার সামনে। পায়ে ধরেছিল। কাঁদতে কাঁদতে ওর জামা ভিজে গিয়েছিল। কথাটা মনে হতেই স্বরূপের রাগ আরও বাড়ল। বলল, “কিছু হলেই তো চোখের পানিতে পৃথিবী ভাসিয়ে দিয়ে সব ঠিক করে ফেলতে চাও। আদৌ কিছু হয় চোখের পানি দিয়ে? ভুলটা ভুলই থাকে।”

সে উঠে ড্রয়ের থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করে নিয়ে বারান্দায় চলে গেল।

তনয়া স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। চোখ দিয়ে আপনাআপনি পানি গড়িয়ে পড়ছে। তার সাথে কেউ কোনোদিন এভাবে কথা বলেনি। বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে হওয়ায় তার গায়ে ফুলের টোকা পর্যন্ত পড়তে দেননি তারা। অথচ আজ কতগুলো কঠিন কথা শুনতে হলো। স্বরূপ যেভাবে চিবিয়ে চিবিয়ে মুখ কঠিন করে কথাগুলো বলছিল, তনয়ার মনে হচ্ছিল প্রতিটা কথা কাঁটার মতো বিঁধছে তার গায়ে। এমন কী করেছে সে? কিছুই তো করেনি। অন্য কারো রাগ তার ওপর এভাবে কেন ঝাড়া হবে? সে তো রাগ করার মতো কোনো কথা পর্যন্ত বলেনি। ভুল করলে ভুলের মাশুল হিসেবে কথাগুলো নেয়া যেত নাহয়। কিন্তু বিনা কারনে এসব কেন সে সহ্য করবে?

তনয়া কাঁদতেই থাকল। তার মাথায় স্বরূপের কথাগুলো প্রতিধ্বনিত হতে লাগল বারবার। মাথা ব্যথা হতে লাগল ক্রমশ। প্রায় সারারাত সে এভাবেই বসে ফুঁপিয়ে কাঁদল। মনের কোথাও ক্ষীণ আশাও ছিল স্বরূপ হয়তো এসে এক্ষুনি ক্ষমা চাইবে। কিন্তু সারারাতে একবারের জন্যও স্বরূপ ঘরে ঢুকল না। বারান্দায়ই সিগারেট পুড়িয়ে রাত কাটিয়ে দিল।

তনয়া একসময় বসে থাকতে না পেরে শুয়ে পড়ল। খুব দু্র্বল লাগছে। কাঁদার শক্তিও একসময় শেষ হয়ে গেছে। তবে ঘুম এলো না।

স্বরূপ সকালে ঘরে এসে অফিসের জন্য তৈরি হয়ে বেরিয়ে গেল। মিলিও বোধহয় ওর সাথেই বের হলো। তনয়া ঘুমের ভান করে পড়ে রইল। উঠল না, কথা বলার প্রশ্নই আসে না।

ওরা অফিসের জন্য বেরিয়ে গেলে তনয়া উঠল। তার মন বিষিয়ে উঠেছে। স্বরূপ সন্ধ্যায় ফিরেও নিশ্চয়ই একই মূর্তিতে থাকবে। ওর সাথে কথা বলারও রুচি হচ্ছে না। স্বরূপ ঠিকই বলে, সে তাকে ভালোবাসে না। ভালোবাসলে এভাবে কথা বলা যায় না। তারা শুধু কিছু ভালো সময় একসাথে ভাগ করে নিয়েছে। স্বরূপ তার দায়িত্ব পালন করে গেছে এই-ই! এর বেশি কিছু নয়। তনয়ার ক্রমশ মন ভারী হতে লাগল। বারবার স্বরূপের কথা কানে বাজছে৷ না, এখানে আর বেশিক্ষণ থাকবে না সে। চলে যাবে। যার বাসা তাকে একা থাকতে দিয়ে চলে যাবে সে। থাকুক, নিজের যতটা স্পেস লাগে ততটা নিয়ে সে ভালো থাকুক।

তনয়া নিজেকে টেনে ওঠাল কষ্ট করে। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ব্যাগে ভর্তি করে নিয়ে সে গাড়ি ডেকে বাপের বাড়িতে রওনা দিল।

তনয়ার কোনো ইচ্ছে ছিল না এভাবে বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবার। একদিন আগেও কল্পনা করেনি এমন হতে পারে। গাড়িতে উঠে বারবার মনে হচ্ছিল, স্বরূপ একবার নিজের ভুলটা বুঝুক! তাকে স্যরি বলুক। ভালো করে কথা বলুক।

সে বারবার ফোন চেক করে গেল। কিন্তু কোনো কল বা মেসেজ এলো না।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
২৯.

তনয়া ভেবেছিল স্বরূপ সন্ধ্যায় ফিরে তাকে না পেয়ে অবশ্যই ফোন করবে। কিংবা তাকে নিতে চলে আসবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। সে মোবাইল হাতে জানালার পাশে বসে সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত কাটিয়ে দিল।

তনয়াকে হঠাৎ চলে আসতে দেখে আর ওর কান্না দেখে মা বেশ ভয় পেয়ে গেছেন৷ তনয়া কিছু বলছে না দেখে তার আশঙ্কা আরও বাড়ছে। স্বরূপকে ফোন করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তনয়া শক্তভাবে নিষেধ করেছে স্বরূপের সাথে যোগাযোগের কোনো চেষ্টা না করতে৷ তিনি একটু পরপর এসে মেয়েকে দেখে যাচ্ছেন। রাত দশটায় যখন খেতে ডাকতে গেলেন তখন দেখলেন তনয়া বিছানায় চুপচাপ শুয়ে আছে। তার গায়ে ভীষণ জ্বর।

*

স্বরূপ অনেকবার কলিংবেল চাপল। দরজা খুলল না। আবারও কেঁদেকেটে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে কি না এই আশঙ্কায় সে চাবি দিয়ে দরজা বাইরে থেকে খুলে ভেতরে ঢুকল। তবে ভেতরে পা দিয়েই তার মনে হলো তনয়া নেই। শোবার ঘরে গিয়ে ভালো করে দেখে বুঝল তনয়া ইচ্ছে করেই চলে গেছে। ঘরে তার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর জায়গা ফাঁকা। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল স্বরূপ। এজন্যই বিয়ে করতে চায়নি সে৷ নিজের তিতকুটে জীবনে অন্য কাউকে জড়ানোর কোনো ইচ্ছেই তার ছিল না। সে তো ইচ্ছে করে বিয়ে করেওনি, অন্যরা জোর করেছে, আর যাকে করেছে তারও ইচ্ছে ছিল। এখন তাকে দোষ দিয়ে তো লাভ নেই।

স্বরূপের গতকালের মেজাজ এখন অনেকটা ঠান্ডা। ভেবেছিল আজ ফিরে তনয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করবে। কিন্তু ভালোই হলো। কয়েকদিন আলাদা থাকা উচিত। অন্তত তার মেজাজের উন্নতি হওয়া পর্যন্ত। এখানে থাকলে বরং আরও ঝগড়াঝাটি হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। সে ফোন করবে ভেবেও করল না। চলে যাওয়ার সময় তো তাকে বলার প্রয়োজন মনে করেনি। এখন সেই বা কেন যেচে পড়ে খোঁজ নিতে যাবে!

স্বরূপের ক্ষুধা লেগেছিল। রান্নাঘরে গিয়ে দেখল কিছুই রান্না হয়নি। সে ক্লান্ত শরীর নিয়েই রান্না বসিয়ে দিল। অল্প কিছু হলেও করতে হবে। মিলিও তো খাবে।

মিলি ফিরল একটু রাত করে। এসে যখন জানতে পারল তনয়া নেই, তখন সে একটু গম্ভীর হয়ে গেল। বলল, “আমি থাকায় তোদের কোনো সমস্যা হয়েছে?”

“তোকে নিয়ে কিছু না। অন্য বিষয়ে ঝগড়া হয়েছে।”

“তাই বলে চলে গেল?”

স্বরূপ বলল, “এটা কোনো ব্যাপার না। একসাথে থাকলে ঝগড়া হয়ই। তুই হাতমুখ ধুয়ে খেতে আয়।”

খেতে বসে মিলি অনেকদিন পর স্বাভাবিক সুরে কথা বলল। তাকে বেশ সতেজ লাগছে আজ। স্বরূপের রান্নার বেশ প্রশংসা করল সে। দুজন একসাথে টেবিলটাও গুছিয়ে ফেলল।

স্বরূপ খাওয়ার পর নিজের ঘরে গিয়ে শুয়েছিল, তখন মিলি দরজায় টোকা দিল, “আসতে পারি?”

স্বরূপ উঠে বসে বলল, “হ্যাঁ আয়।”

মিলি ঢুকল। তাকে দেখে স্বরূপের মনে হলো সে সাজগোজও করেছে। কারন কী?

মিলি বিছানায় বসে খুব সহজ গলায় বলল, “বাবা মাকে কী বলব ঠিক করে ফেলেছি।”

“কী বলবি?”

“আগে আমার দিকে তাকা। কী মনে হয়?”

“কী মনে হবে?”

“আরে আমাকে দেখে কি মনে হচ্ছে, আমি কোনো শোকের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি?”

স্বরূপ একটু ভেবে বলল, “তোর চেহারা আগের থেকে খারাপ হয়ে গেছে।”

“আর কথা শুনে কী মনে হয়?”

“স্বাভাবিক।”

“হ্যাঁ, এভাবেই বাসায় যাব। ভাব দেখাব সব ঠিকঠাক আছে। কয়েকদিন এমনিতেই থাকব৷ হাসিখুশিভাবে দিন কাটাব। তারপর একসময় দুজনকে বুঝিয়ে বলব যে সাফাতের সাথে কোনোভাবেই বনিবনা হচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করেও আমরা ব্যর্থ। সবাই তো সবকিছু পারে না। এত স্লোলি বিষয়টা বোঝাব যে তাদের একেবারে পুরো ধাক্কাটা লাগবে না। আর সত্যি কথা বলার তো প্রশ্নই আসে না।”

“কিন্তু আঙ্কেল আন্টি যদি কথা বলতে চায় সাফাত বা তার পরিবারের সাথে?”

“সাফাত তো আর নিজের দোষ স্বীকার করবে না৷ আর ওর পরিবারের লোক মা বাবার কথা জানে। তাদের আমি বলে দিয়েছি তাদের কিছু না বলতে। তারা কিছুই জানবেন না।”

“যাক, ভালো।”

“তোকে আর তনয়াকে কী বলে ধন্যবাদ দেব জানি না। সেদিন বাড়িতে গেলে আমি এভাবে যেতে পারতাম না৷ তোদের কাছে কৃতজ্ঞ রইলাম৷ এখন তুই ওঠ। আমাকে পৌঁছে দিয়ে আয়।”

স্বরূপ অবাক হয়ে বলল, “এখন যাবি?”

“হ্যাঁ।”

“আগে তো বলিসনি।”

“প্ল্যান অন্যরকম ছিল। ভেবেছিলাম পরশু যাব। আরেকটু সময় নেব। কিন্তু আজই যেতে হবে। তনয়া যেহেতু নেই, আমাদের এক ফ্ল্যাটে থাকাটা উচিত হবে না।”

স্বরূপ রেগে গিয়ে বলল, “তুই এত বেশি বুঝিস কেন? আমি মেয়ে হলে কি তুই থাকতিস না? বন্ধুত্বের মধ্যে ছেলে মেয়ের পার্থক্য হবে কেন?”

মিলি একটু হেসে শান্ত স্বরে বলল, “তোর সাথে যে তনয়া কিভাবে থাকে! এত শর্ট টেম্পার কেন তুই? শোন, আমার বাসায় যদি সাফাতের কোনো বান্ধবী এসে থাকত, আমি কখনোই মেনে নিতাম না। তনয়া তো অনেক বড় মনের। সে কতদিন আমাকে থাকতে দিল। আমাদের মনে কোনো সমস্যা নাই থাকতে পারে, কিন্তু বায়োলজিকালি আমরা অপজিট জেন্ডার এবং আমাদের কোনো রক্তের সম্পর্কও নেই। তাই এভাবে থাকাটা অনুচিত। তাছাড়া সমাজ বলেও একটা বিষয় আছে। আর সবচেয়ে বড় কথা, তনয়ার প্রতি আমার অনেকটা কৃতজ্ঞতাবোধ আছে। সেকথা ভাবলে আমি থাকতে পারি না।”

“তোকে দেখতে আধুনিক মনে হলেও ভেতরে ভেতরে তুই অনেক কনজার্ভেটিভ রয়ে গেছিস।”

“হ্যাঁ রে, ঠিক ধরেছিস। নইলে এই দশা দেখতে হতো না। সাফাত যা করছে, আমিও তাই করতাম। ওপেন রিলেশনশিপে থাকতাম৷ আর বাইরে বাইরে ম্যারেটাল স্ট্যাটাসও বজায় থাকত। কিন্তু সবাই তো সবকিছু পারে না। আমি ভেতরে ভেতরে পাক্কা ঘরোয়া বাঙালি নারী। যে যাকগে, এখন উঠতে হবে।”

“তার মানে তুই সত্যিই চলে যাবি?”

“হ্যাঁ। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে। খাওয়ার জন্য আরও দেরি হলো। কিন্তু তুই নিজের হাতে রান্না করেছিস দেখে না খেতে যেতে পারলাম না৷ তাড়াতাড়ি করে রেডি হয়ে যা, আমি ড্রইংরুমে বসছি।”

স্বরূপ কাঁধ ঝাঁকাল, “ওকে!”

স্বরূপ তৈরি হতে হতে মিলি তনয়ার মোবাইলে একটা মেসেজ পাঠাল,

“তনয়া, আমাকে নিয়েই হয়তো তোমাদের মধ্যে ঝামেলা হয়েছে। আমি আসলে বুঝতে পারিনি এমন কিছু হতে পারে। আগেই বোঝা উচিত ছিল। আমার নিজের সংসার ভাঙার পর আমি চাই না আমার শত্রুর সাথেও এমনটা হোক। আর তুমি তো আমার শুভাকাঙ্ক্ষী। আমি চলে যাচ্ছি নিজের ঠিকানায়। তুমিও নিজের ঠিকানায় ফিরে এসো। আর আমার কারনে কষ্ট পেয়ে থাকলে ক্ষমা করে দিও।”

*

গাড়িটা মিলিদের বাড়ির সামনে আসতেই মিলি বলল, “ভেতরে যেতে হবে না, এখানেই রাখ। তোকে ভেতরে যেতে বলছি না সেজন্য স্যরি। মা বাবাকে জানতে দিতে চাই না যে তোর সাথে এসেছি।”

“ইটস ওকে! অন্য সময় আসব।”

মিলি গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে যেতে গিয়েও আবার বসে পড়ে বলল, “স্বরূপ একটা অ্যাডভাইজ দেই। আজকের দিনে লয়্যাল জীবনসঙ্গী পাওয়া কত বড় ভাগ্যের বিষয় তুই জানিস না। যারা পায় না তারা জানে। তাই নিজের সম্পর্ককে হেলাফেলা করিস না৷ তোর মধ্যে কোনো আর্জ দেখলাম না বউকে ফিরিয়ে আনতে। এসব বিষয়ে যত সময় নষ্ট করবি, সম্পর্ক তত ফিকে হতে থাকবে। তনয়া ভালো মেয়ে। তুই ওকে ভালো রাখলে নিজে তারচেয়েও ভালো থাকবি।”

স্বরূপ শুনল। কিছু বলল না৷ মিলি বেরিয়ে চলে গেল গেটের ভেতর।

স্বরূপ ফোন ফেলে এসেছে ভুলে। রাত বাজে এগারোটা৷ বাড়ি ফিরতে ফিরতে স্লো একটা মিউজিক চালিয়ে দিল সে৷ তনয়ার কথা সত্যিই মনে পড়ছে। ও পাশে থাকলে হাবিজাবি কথা বলত, হাসত, দুষ্টুমি করত। এমনিতে বাসায় ফিরে তাকে পাওয়া যায়। আজ তাও যাবে না। স্বরূপের একবার মনে হলো শ্বশুরবাড়িতে চলে যায়৷ তারপর আবার কী মনে করে গাড়িটা নিজের বাসার দিকেই নিয়ে চলল। তনয়ারও বোঝা উচিত সব পরিস্থিতিতে একরকম রোমান্টিকতা চলে না৷ সবারই একটা পার্সোনাল স্পেস থাকা উচিত।

*

তনয়ার জ্বর কমছে না দেখে ভয় পেয়ে তার মা স্বরূপকে বার কয়েক ফোন করলেন৷ ভাবলেন সে এলে হয়তো মেয়েটা একটু সুস্থ হবে। না জানি কত ঝগড়া করে এসেছে! কিন্তু স্বরূপ ফোন তুলল না৷

তনয়া সারাদিন কিছু খায়নি। মা ওর শিয়রে বসে মাথায় জলপট্টি দিতে দিতে বারবার ডাকতে লাগলেন, “মা, ও মা, একটু তাকাও৷ কিছু খেতে ইচ্ছে করে? একটা কিছু মুখে দিলে তো ঔষধটা খাওয়াতে পারি।”

তনয়া অনেকক্ষণ পর চোখ খুলে চাইল। বলল, “খাব।”

“কী খাবে মা?”

“ভাত খাব।”

মা তাড়াতাড়ি ভাত নিয়ে এলেন। কয়েক লোকমা ভাত মুখে তুলে দিলেন। কিন্তু তনয়া খেতে পারল না৷ বমি করে ফেলল। তার আরও দুর্বল লাগছে এখন।

*

বাসায় ফিরে স্বরূপ দেখল তনয়ার মায়ের মোবাইল থেকে বেশ কয়েকটা মিসড কল। তাও অনেকক্ষণ আগের। হয়তো মিটমাট করাতে ফোন করেছিলেন। ঘড়ি দেখল সে। বারোটা বাজে৷ এখন আন্টিকে ফোন করাটা উচিত হবে না। হয়তো শুয়ে পড়েছেন। তারচেয়ে কাল করা যাবে।

সে বিছানা গুছিয়ে শুয়ে পড়ল। কিন্তু কিছুতেই ঘুম এলো না। ইনসমনিয়া কি ফিরে এলো? সে গতরাতে ঘুমায়নি, আজ সারাদিন কাজ করেছে, তবুও চোখে ঘুম নেই। তনয়া কি সাথে করে তার ঘুমও নিয়ে গেছে?

বিয়ের পর থেকে স্বরূপের ঘুম ভালো হতো। বিছানায় শুয়ে তনয়ার গায়ের ঘ্রাণে ঘুম চলে আসত। স্বরূপ একসময় বিছানায় গড়াগড়ি খেতে খেতে বিরক্ত হয়ে বারান্দায় চলে গেল।

তনয়ার লাগানো গাছে হাস্নাহেনা ফুল মাতাল করা ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে। যেদিন প্রথম এই গাছটাতে ফুল ফুটেছিল, তনয়া বাচ্চাদের মতো খুশি হয়েছিল। ওর মোবাইলের গ্যালারি ভর্তি এসব ফুলের ছবি।

আশ্চর্য তো! গতকালও এই বারান্দায় পুরো রাত কাটিয়েছে স্বরূপ। কাল তো এসব দেখে তনয়ার ছোটো ছোটো ব্যাপারগুলি মনে পড়েনি৷ সে ঘরেই ছিল সেজন্য? কে জানে!

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-২৬+২৭

0

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
২৬.

গাড়ির জানালা দিয়ে হাত বের করতেই কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি ভিজিয়ে দিল তার হাত। নীল রঙের চুড়ির রিনরিনে ধ্বনির সাথে বৃষ্টির সুর মিশে যাচ্ছে। আর কোনো শব্দ নেই। গাড়িটা মসৃনভাবে চলছে হাইওয়ে ধরে। চারদিকে এত সবুজ যে চোখ জুড়িয়ে যায়। তনয়া স্বরূপের দিকে তাকাল। খুব আনন্দ নিয়ে সে ড্রাইভ করছে। ঠোঁটের কোণে হাসি লেগে আছে।

গতকালই তারা গাড়িটা পেয়েছে। আর গতকালই তনয়ার পরীক্ষা শেষ হয়েছে। আজ ভোরবেলা স্বরূপ ওকে তুলে দিয়ে পাগল করে ফেলেছে বের হবে বলে। তনয়া চাইছিল একটু ঘুমাতে, কিন্তু স্বরূপের এই পাগলাটে শখটাতে বাঁধা দিতেও ইচ্ছে করছিল না। অগত্যা সে উঠে তৈরি হয়েছে।

তৈরি হতে গিয়ে সে প্রথমবার খেয়াল করেছে ক’দিনে তার চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল পড়ে গেছে। গালের হাড় বেরিয়ে পড়েছে। গায়ের রঙও অনুজ্জ্বল হয়ে আছে। মনটাই খারাপ হয়ে গেছে তার। স্বরূপকে সেকথা বলতেই স্বরূপ বলেছে, “কি জানি, তোমাকে তো একরকমই লাগে।”

তনয়া আর কথা বাড়ায়নি। সব চোখ সবকিছু ডিটেক্ট করতে পারে না বোধহয়। তনয়ার আজ আর সাজতে ইচ্ছে হয়নি। গোসল করে নীল শাড়ি পরেছে। সাথে চোখে মোটা করে কাজল, অল্প কিছু ডিজাইনার গয়না আর হাতভর্তি নীল চুড়ি।

ওকে তৈরি দেখে স্বরূপ মুখে কিছু না বললেও তার দুই সেকেন্ড থমকে তাকিয়ে থাকাটা তনয়ার চোখ এড়ায়নি। তার ওটু্ুকুতেই চলবে।

অনেকটা ড্রাইভ করে আসার পর একটা চায়ের দোকানের সামনে গাড়ি থামাল স্বরূপ। জিজ্ঞেস করল, “চা খাবে?”

“অবশ্যই।”

“নামি চলো।”

ওরা চায়ের দোকানে ঢুকতেই আবার ঝেঁপে বৃষ্টি নামল। ভেতরে বসে মাটির ভাড়ে চুমুক দিতে দিতে তনয়া খেয়াল করল রাস্তার অপর পাশে একটা লম্বা কদম ফুলের গাছ। সেটা ভর্তি হয়ে আছে সোনারঙা বলের মতো কদম ফুলে। গানটা মনে পড়ে গেল তার, “বাদল দিনের প্রথম কদম ফুল….”

হুমায়ূন আহমেদের কোনো বইতে হয়তো এরকম একটা লেখা পড়েছে সে, বর্ষার প্রথম কদম যদি কেউ তার ভালোবাসার মানুষকে দেয়, তাহলে সেই ভালোবাসা অটূট থাকে।

তনয়া স্বরূপের হাত চেপে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, “আমার কদম ফুল চাই!”

স্বরূপ ভুরু কুঁচকে গাছের দিকে চেয়ে তারপর তনয়ার দিকে চাইল। “এই বৃষ্টির মধ্যে গাছের মাথায় কে উঠবে?”

“প্লিজ! প্লিজ! প্লিজ!”

“তুমি উপায় বলো, আমি ব্যবস্থা করি। আমি গাছে চড়তে পারি। কিন্তু বৃষ্টিতে গাছটা পিচ্ছিল হয়ে আছে। পড়ে হাড়গোড় ভাঙার শখ অন্তত এই মুহূর্তে নেই। এখানে বুড়ো চাওয়ালা ছাড়া আর কেউ নেই। তিনি নিশ্চয়ই কদম পেড়ে দেবেন না।”

তনয়া এবার একটু দমে গেল। ওরা আবার গাড়িতে চড়ে রওনা দিল সামনে। বৃষ্টিধোয়া অসম্ভব সুন্দর পথঘাট। তনয়ার মনে হলো প্রকৃতি তাদের জন্যই নিজেকে সাজিয়ে বসে আছে। ডেকে ডেকে বলছে, আমাকে দেখো, চোখ ভরে দেখো।

তনয়া একসময় স্বরূপকে বলল, “তোমাকে একটা জরুরি কথা বলার ছিল।”

“কী কথা?”

তনয়া কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে বাইরের দিকে চেয়ে রইল। কেমন করে বলবে?

স্বরূপ আবার জিজ্ঞেস করল, “কী কথা বললে না?”

“পরে বলব।”

ওরা আরও অনেকদূর যাবার পর একটা ছোট্ট রেস্তোরাঁয় ভাত, ভর্তা আর হাঁসের মাংস দিয়ে দুপুরের খাবার সারল। এরপর ফিরতি পথ ধরল। তনয়া এত খেয়ে ফেলেছিল যে শরীর ভার হয়ে আসছিল। সে গাড়িতে বসে আর চোখ খোলা রাখতে পারল না, ঘুমিয়ে পড়ল।

যখন ওর ঘুম ভাঙল তখন বিকেল হয়ে এসেছে। আকাশ প্রচন্ড ভার। আবার একগাদা জল ঢালার প্রস্তুতি নিয়ে বসেছে। তনয়া প্রথমটায় কিছু বুঝল না, হঠাৎ খেয়াল হলো, তার ডান হাতে একটা বেলীফুলের মালা জড়ানো। সে দন্ত বিকশিত এক হাসি দিয়ে বলল, “কখন পরালে এটা?”

“একটু আগেই। পেয়ে গেলাম হঠাৎ। তবে কদম জোগাড় করতে পারিনি।”

“প্রয়োজন নেই। কদমের তো ঘ্রাণ নেই বেলীর মতো। এটাই সবচেয়ে সুন্দর।”

স্বরূপ হাসল। মেয়েটা কত অল্পতে খুশি হয়!

হঠাৎই আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামল। অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না সামনে। যদিও দিন এখনো বেশ খানিকটা বাকি। আকাশের রঙ হয়েছে গাঢ় বেগুনী। স্বরূপ রিস্ক নিয়ে ড্রাইভ করতে চাইল না। বৃষ্টি কমা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে গাড়ি থামিয়ে রাখল রাস্তার পাশে।

তনয়া ঠিক এই সুযোগটা সকাল থেকে খুঁজছিল। সে তার জায়গা থেকে উঠে এগিয়ে গিয়ে আচমকাই চুমু খেল স্বামীর ঠোঁটে। ঠিক সিনেমার মতো। তারপর খিলখিল করে হেসে ফেলল। স্বরূপ আর ছাড়ল না তাকে। মনে মনে সে বলল, সময়টা এখানেই থেমে গেলে খুব একটা খারাপ হতো না…

*

পরদিন স্বরূপের অফিস তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে গেলে সে বিকেলের দিকেই চলে এলো। হাতমুখ ধুয়ে সটান চলে গেল রান্নাঘরে।

তনয়া পিছু পিছু গিয়ে দেখল সদ্য নিয়ে আসা বাজারের ব্যাগ থেকে সে বড় চিংড়ি বের করছে।

তনয়া এগিয়ে গিয়ে বলল, “আমি করছি। তুমি রেস্ট নাও।”

“না, আমি রান্না করব।”

“এখন কী রান্না করবে?”

“স্যুপ। কয়েকটা চিংড়ি বেছে-কেটে দাও তো!”

“আমি স্যুপ রান্না করতে পারি।”

“না, আমার অনেক ক্ষুধা লেগেছে।”

“সেজন্য নিজের হাতে রাঁধতে হবে?”

“হুম। নিজে হাতের রান্নার ক্ষুধা।”

“বাহ! বেশ!”

“জানো তনয়া, আজকে আমার মোবাইলে বারবার স্যুপের অ্যাড আসছিল।”

“এজন্য এত খেতে ইচ্ছে করেছে?”

“হ্যাঁ তবে হঠাৎ স্যুপের অ্যাড আসছিল কেন বলতে পারো?”

“কেন?”

“কারন আমার স্যুপ পছন্দ।”

“তোমার যে স্যুপ পছন্দ এটা আমিও জানি না। মোবাইল জানবে কেমন করে?”

“সেটাই তো আসল কথা। আজ কলিগরা আলোচনা করছিলাম কার কী পছন্দ। আমি স্যুপ বলেছিলাম। তখনই জেনে ফেলল।”

“ওহ তাই বলো।”

“এর থেকে কী বুঝলে?”

“কী বুঝলাম?”

“আমাদের কোনো প্রাইভেসি নেই। ওরা সব শোনে।”

“এটা তো জানা কথাই।”

“তুমি যেসব ক্রিঞ্জি ভালোবাসার কথাটথা বলো না, ওগুলো ওরা শুনে ফেলে। তারপর হাসাহাসি করে।”

“ইশ! কে হাসাহাসি করে? আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স হাসতে পারে?”

“পারবে না কেন, ওরা সব পারে।”

“আজেবাজে কথা বন্ধ করবে?”

“মনে আছে গতকাল গাড়িতে বসে কী কী বলছিলে?”

তনয়া রেগে গিয়ে স্বরূপকে জোরে চিমটি দিয়ে চিৎকার করে বলল, “মুখ বন্ধ করবে তুমি?”

“আচ্ছা আচ্ছা! কিন্তু ওইযে পরীক্ষার মধ্যে একদিন বললে…”

স্বরূপ কথা শেষ করতে পারল না। কলিংবেল বাজল।

তনয়া গেল দরজা খুলতে। দরজা খুলে অবাক হয়ে দেখল মিলি দাঁড়িয়ে আছে। ওর চেহারা পুরোপুরি বিধ্বস্ত। মনে হচ্ছে একটা ঝড় বয়ে গেছে ওর ওপর দিয়ে।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
২৭.

বেশ অনেকটা সময় লাগল মিলির স্বাভাবিক হতে। সে যেন কোনো ঘোরের মধ্যে আছে। সেই ঘোর থেকে বের হবার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।

তনয়া আর স্বরূপ তার দুই পাশে বসে আছে। তারা বুঝতে পারছে না কী করবে। শুধু মিলিকে জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে কী হয়েছে।

মিলি একসময় কথা বলতে পারল। তনয়াকে বলল, “এক গ্লাস পানি দেবে?”

তনয়া পানি নিয়ে এলো। মিলি পানি এক চুমুক খেয়ে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, “তেঁতো লাগছে।”

স্বরূপ জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে বলবি? আঙ্কেল আন্টি ঠিক আছেন?”

মিলি মাথা ওপর নিচ করল। “ওরা ভালো আছে।”

“তবে?”

মিলি থেমে থেমে বলল, “আজ অফিসে তাড়াতাড়ি ছুটি হয়েছে। আমি বাসায় চলে গিয়েছিলাম। ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ ছিল। ভেবেছি বাসায় কেউ নেই। চাবি দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে দেখি আমাদের বেডরুমের দরজাও ভেতর থেকে বন্ধ।”

“কে ছিল ভেতরে?”

“ওদের দুজনের হাসির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছিল। মেয়েটার ব্যাগ ছিল ডাইনিং টেবিলের ওপর। মেঝেতে ওর ওড়না পড়েছিল। আর কিছু কি বলার বা বোঝার বাকি থাকে?”

সবাই চুপ করে রইল। দৃশ্যটা ভেবেই তনয়ার বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। সে দেখল স্বরূপের চোখ লাল হয়ে গেছে। ঠিক একই জিনিস প্রত্যক্ষ করার ভাগ্য তারও একসময় হয়েছিল।

মিলি বলল, “আমি যে গিয়েছিলাম সেটা ওদের জানতে দেইনি। চলে এসেছি। আমি বুঝতে পারছি আমার অবস্থা ভালো না। বাড়িতে এই অবস্থায় যাওয়া সম্ভব না। মা বাবা দুজনের কেউই সহ্য করতে পারবে না৷ আমি কোথায় যাব বুঝতে পারছিলাম না৷ তোর বাসা কাছে দেখে এখানে চলে এলাম।”

স্বরূপ উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চল, ওদের হাতেনাতে ধরব আজকে।”

মিলি কাঁপা গলায় বলল, “না, দরকার নেই। আমি আর ওখানে যাব না।”

“সবকিছুর একটা লিমিট থাকে মিলি! একজনকে বিয়ে করে আরেকজনের সাথে শোবে আর আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখব? চিটিং করে এমনি পার পেয়ে যাবে? এত সহজ সবকিছু? বিয়েটা কি ওর কাছে ফাজলামো মনে হয়? ওকে একটা শিক্ষা না দিয়ে ছাড়ব না আমি।”

মিলির চোখে পানি চলে এসেছিল। সে গাল থেকে পানি মুছে বলল, “সে অনেক আগেই লিমিট পার করে ফেলেছে স্বরূপ। আজকেরটা তারই একটা নমুনা ছিল মাত্র।”

“তুই প্রশ্রয় দিয়ে আরও বাড়তে দিয়েছিস।”

মিলি হঠাৎ রেগে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, “কেউ নিজের সংসার চোখের সামনে ভাঙাটা প্রশ্রয় দেয় না স্বরূপ! আমি দিনের পর দিন চেষ্টা করেছি ওকে বোঝানোর, ওই মেয়েকে বোঝানোর। কী না করেছি! তুই তো জানিস আমি কোনোদিন কাউকে কিছু রিকোয়েস্ট পর্যন্ত করি না। আর ওর কাছে হাজার বার হাত জোড় করে মিনতি পর্যন্ত করেছি। কোনো মেয়েই চায় না তার সংসার ভেঙে যাক। আমি শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করেই হাল ছেড়েছি। আজ গিয়ে ধরলে কিছুই হবে না। সব হাতের বাইরে চলে গেছে।”

স্বরূপ বসে পড়ে বলল, “তুই এখন কী করতে চাস?”

“এখন আর কিছু করার নেই৷ ওই বাড়িতে আমি আর যেতে পারব না। সম্ভব না।”

“তাহলে?”

“মা বাবাকে বলতেই হবে। কিন্তু কীভাবে কী বলব সেসব ভাবতে হবে। একটু সময় লাগবে। সেই সময়টা… সেই সময়টুকু আমি তোর বাসায় থাকি?”

মিলির চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিল স্বরূপ। এত অসহায় চোখ সে কমই দেখেছে। বলল, “তোর যতদিন ইচ্ছে থাক। সমস্যা নেই।”

মিলি তনয়ার দিকে তাকাল। তনয়া ওর হাত ধরে বলল, “তুমি থাকো আপু। আমাদের অসুবিধা হবে না।”

মিলি দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরে বলল, “আমি একটু বিশ্রাম নেব।”

স্বরূপ তনয়াকে বলল, “একটা ঘর ঠিক করে দাও ওর জন্য।”

তনয়া সব ঘর গুছিয়েই রাখে। তবুও গেস্টরুমের চাদর বদলে ঘরটা আরেকবার সাফ করে দিল। মিলি কোনো কাপড়চোপড় আনেনি। সে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “আপু তোমাকে আমার জামা দেব? একটু ঢিলে হবে হয়তো।”

মিলি মৃদু হাসার চেষ্টা করে বলল, “দিও। দুই সেট দিলেই হবে।”

তনয়া কয়েক সেট জামা মিলির ঘরে রেখে এলো। মিলি তারপর উঠে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

তনয়া রান্নাঘরে গিয়ে দেখল স্বরূপ গম্ভীর মুখে খুন্তি নেড়ে যাচ্ছে। তনয়া জিজ্ঞেস করল, “কতদূর হলো?”

“হচ্ছে।”

“তুমি এরকম মুড অফ করে থেকো না প্লিজ।”

স্বরূপ কিছু বলল না। তার মেজাজ প্রচন্ড খারাপ হয়ে আছে। বেশি কথা বললে হয়তো তনয়ার ওপর রাগ ঝেড়ে বসবে। তাই চুপ করে রইল। কিন্তু তনয়া কথা বলেই যাচ্ছে। স্বরূপ একটু পর ওর কথার মাঝখানেই বলল, “দেখো তো স্যুপটা। মাথাব্যথা করছে আমার।”

তনয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কী এক ঝামেলা শুরু হলো!

*

পরদিন স্বরূপদের সব বন্ধুরা একত্র হলো সন্ধ্যার দিকে। স্বরূপই সবাইকে ডেকেছে কোনো একটা সমাধান বের করার জন্য। মিলি যদিও নিষেধ করেছিল, স্বরূপ শোনেনি। এদিকে মিলির তার স্বামীকে ফোন করে বলে দিয়েছে, সে আর তার বাড়িতে যাবে না।

সাফাত খুশিই হয়েছে। সে চাইছিল মিলি তাকে ডিভোর্স দিক। তাহলে কেউ বলতে পারবে না সে বউকে ছেড়েছে, বরং বলে বেড়াবে তার বউকে তাকে ছেড়ে চলে গেছে।

এসবকিছু নিয়েই কথাবার্তা হচ্ছিল আজ। মিলি চুপচাপ বসেছিল মাথা নিচু করে। জোর আলাপ আলোচনা হচ্ছিল। রূপাও এসেছে। সে তনয়ার কাছে রান্নাঘরে গেল। তনয়া সবার জন্য নাস্তা বানানোয় ব্যস্ত ছিল।

রূপা গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “তোর খবর বল।”

তনয়া হাসল, “ভালো।”

“বলেছিলাম না যে স্বরূপের মতো ভালো ছেলে তুই খুঁজলেও পাবি না? কথা কি মিলছে?”

তনয়া মুখ টিপে হেসে বলল, “মনে তো হয়..”

রূপা ওর সাথে কাজে হাত লাাগল, “তারপর সংসার করতে কেমন লাগছে? প্রতিদিন রান্না করতে ভালো লাগে?”

“খুব!”

“এখন লাগবেই, বুঝলি? এরপর বাচ্চাকাচ্চা হবে, গ্যাঞ্জাম বাড়বে, তখন রোজ রান্না করতে অসহ্য লাগবে।”

তনয়া আবারও হাসল। “তোমার বন্ধু আছে তো, আমি না পারলে সে করবে।”

“ও রাঁধতে পারে?”

“হুম। ভালো রাঁধে।”

“বাহ! এ তো জানতাম না।”

ওরা বেশ খানিকক্ষণ সাংসারিক গল্প করল। একসময় মিলির প্রসঙ্গ উঠলে রূপা বলল, “কী মানুষ কী হয়ে যায় ভাবা যায় না। মিলিকে দেখে বিশ্বাস হয় না ও আগের সেই মিলি।”

“মিলি আপু আগে কেমন ছিল?”

“আমাদের সবার থেকে স্মার্ট। ওর পেছনে কত ছেলে ঘুরেছে কোনো হিসেব নেই। ও কাউকে পাত্তা দিত না। নিজের মতো থাকত। ওর ড্রেসআপ, ফিগার দেখলে আমাদেরই চোখ ধাঁধিয়ে যেত এমন অবস্থা ছিল৷ আর ছেলেরা তো খাবি খেত। এখন ওকে যা দেখছিস তার থেকে দশগুণ বেশি সুন্দর ছিল ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময়।”

“কী বলো!”

“হুম! ছবি দেখাব তোকে। তখন বুঝবি। এইযে ওর বর, সাফাত ভাই, সে তো পাগল ছিল পুরো। আমাদের দুই ব্যাচ সিনিয়র। পুরো চার বছর ওর পেছনে ঘুরেছে। কত যে পাগলামি করেছে বলার মতো না। সুইসাইড পর্যন্ত করতে গেছে দু’বার। শেষে মিলি ধরা দিয়েছে। তারপর বিয়ের কয়েক বছরের মাথায় এই অবস্থা। মানুষের কোনো বিশ্বাস নেই রে তনয়া। কার ভেতরে কী আছে কে বলতে পারে!”

তনয়ার গায়ে কাঁটা দিল ব্যাপারটা ভেবে। মিলি আপুর কেমন লাগছে কে জানে!

*

আলাপ আলোচনার তেমন কোনো ফল হলো না। সবাই মিলে সাফাতের সাথে বসতে চাইল, কিন্তু মিলি নিষেধ করে দিল। বলল, “ওর প্রতি আমার আর কোনো ইন্টারেস্ট নেই। ও যা করেছে তার জন্য আমি কোনো আইনি ব্যবস্থাও নিতে চাই না। সিম্পল ডিভোর্স দেব।”

অঙ্কুর বলল, “কিন্তু কেন? তুই কেন একটা শিক্ষা দিতে চাইছিস না? ওর জন্য এত মায়া করার কী আছে?”

মিলি নিস্পৃহ গলায় বলল, “কোনো মায়া নেই আমার। যে মেয়েটার সাথে ও রিলেশনে আছে, ওর সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছি আমি। ফালতু একটা মেয়ে। ছেলেদের মাথা চিবিয়ে খেতে এক্সপার্ট। এক পুরুষের সাথে থাকা ওর ধাঁতেই নেই। সাফাতকে বিয়ে করতে চায় তার টাকার জন্য। আমিও চাই বিয়েটা হোক। তারপর বুঝবে কত ধানে কত চাল। আমাকে কিছু করতে হবে না। ওর সাধের প্রেমিকাই ওর বারোটা বাজাবে। আমি শুধু দেখতে চাই পরের নাটক।”

“তুই ওকে এটা বোঝাতে পারিস তো!”

“কম বোঝাইনি। কিন্তু চোখ থাকতে অন্ধকে কিছু বলে লাভ নেই৷ ও জাস্ট ব্লাইন্ড হয়ে আছে। কী খাইয়েছে কে জানে! যখন নেশা কাটবে তখন দেখবে চারদিকে সব অন্ধকার। ওর ফ্যামিলির সবাই সব জানে। সবাই আমাকে সাপোর্ট করে। যখন মাঝ নদীতে খাবি খাবে তখন ওর পরিবারও বাঁচাতে আসবে না। ওভারল, আমি কিছুই করতে চাই না। চাই ও ওর নিজের ডেকে আনা নিয়তির ফাঁদে পড়ে সবচেয়ে বড় শিক্ষাটা পাক।”

স্বরূপ জিজ্ঞেস করল, “আর আঙ্কেল আন্টির বিষয়টা?”

মিলি একটু চুপ থেকে বলল, “আমারে আরেকটু ভাবতে হবে।”

বেশ রাত হয়ে এলে ওদের সভা ভাঙল। সবাই যার যার বাড়িতে চলে গেল।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-২৪+২৫

0

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
২৪.

তনয়ার সত্যিকারের একটা নতুন জীবন শুরু হলো এবার। বিয়ের পর থেকে একটার পর একটা ব্যস্ততা তাকে থিতু হতে দিচ্ছিল না৷ এবার যেন প্রথমবার সে হাত পা ছড়িয়ে আরামসে নিজের সংসারটা ভালো করে দেখল। গুছিয়ে এখানে জাঁকিয়ে বসার একটা চিন্তা তাকে বেশ আনন্দই দিল। এই যে পর্দাগুলো, বদলে ফেলবে সে। গাছ লাগাবে। দেয়ালের রঙ বদলে দেবে। ফার্নিচারগুলো সুন্দর, তবে বিন্যাস ভালো হয়নি, ঠিক করতে হবে। কত কাজ!

তনয়া রোজ মার্কেটে যায়। এটা সেটা কিনে আনে। রান্নাঘরের টুকিটাকি, নতুন কোনো শোপিস, পেইন্টিং কিংবা বই। প্রথম প্রথম সে নিজের জমানো টাকাই খরচ করত৷ আর স্বরূপ এত ব্যস্ততার মধ্যে খেয়ালই করেনি ঘরে কী হচ্ছে। হঠাৎ এক শুক্রবার তার মনে হলো বসার ঘরটা অনেকটা বদলে গেছে। সে অবাক হয়ে তনয়াকে ডাকতে শুরু করল।

তনয়া তখন রান্নাঘরে ময়দা মাখছে। ইউটিউব থেকে প্রাপ্ত এক বিশেষ রেসিপি তৈরি হচ্ছে স্বরূপের জন্য। অখন্ড মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিল সে, মাঝে ছেদ পড়ল। ময়দা হাতেই তনয়া এসে জিজ্ঞেস করল, “তোমার সমস্যা কী? সকাল সকাল ষাঁড়ের মতো চেঁচাচ্ছ কেন?”

স্বরূপ চোখ সরু করে বলল, “আমি ষাঁড় হলে তুমি নিশ্চয়ই গাভী!”

“উফ! কী হয়েছে সেটা বলবে?”

“ঘরটা তো আগে এমন ছিল না। এই দুটো ফুলদানি আর দেয়ালের ছবিটা নতুন এসেছে তাই না? আর খাবার ঘরের ঘড়িটাও!”

তনয়ার মনে হলো স্বরূপ তার বাড়ির এই পরিবর্তন পছন্দ করছে না। সে কিছুটা সংকুচিত হয়ে বলল, “হ্যাঁ, কেন খারাপ হয়েছে?”

স্বরূপ আরেকবার চারদিকে চেয়ে বলল, “না, সুন্দর হয়েছে। কিন্তু কবে করলে বলো তো?”

“একটু একটু করে করেছি।”

“বাহ! কিন্তু টাকা পাচ্ছো কোথায়?”

“আমার টাকা আছে।”

“তুমি যে বড়লোক তা জানি। কিন্তু এসব কিনতে থাকলে যে সম্পদ কদিনেই ফুরিয়ে যাবে তা বুঝতে পারছো? তারপর কী করবে?”

“জানি না।”

“বাবার কাছ থেকে নিয়ে নিজের সংসার সাজাবে?”

“জানি না।”

“আমারই ভুল। আমার উচিত ছিল তোমাকে কিছু টাকা দেবার। একেবারে মনে ছিল না।”

তনয়া বলল, “বিয়ের আগে যে বলেছিলে সংসারে সমান সমান কন্ট্রিবিউট করতে হবে।”

স্বরূপ হাসল। সোফায় গা এলিয়ে বসে পায়ের ওপর পা তুলে বলল, “সেজন্য কন্ট্রিবিউট করছো নাকি? কিন্তু এসব তো তোমার বাবার টাকা। তোমার টাকা কই?”

“চাকরি করলে তারপর…”

“তনয়া একটা কথা বলি?”

“বলো।”

“তুমি চাকরি করতে চাইলে আমি কখনোই নিষেধ করব না৷ সেটা তোমার ইচ্ছে। কিন্তু আমার পরামর্শ চাইলে বলব, তুমি এভাবেই সুন্দর।”

“এভাবে বলতে?”

“এইযে এলো খোঁপা, কপালে ঘাম, ভোরবেলা উঠে নাস্তা বানাতে বসে যাওয়া, এই তনয়া ভীষণ সুন্দর। আমি জানি না কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে পরিপাটি হয়ে অফিসে গিয়ে প্রেজেন্টেশন দেয়া আত্মবিশ্বাসী তনয়ার চেহারা কেমন হবে। আমাকে ভুল বুঝো না। আমার নিজের মা কর্মজীবী মানুষ। তোমাকে বাড়িতে বসিয়ে রাখার মতো মানসিকতা আমি রাখি না। শুধু বলতে চাই, তোমার যদি ইচ্ছের ঘাটতি থাকে, তাহলে প্রোফেশনাল লাইফে যাবার কোনো জোর নেই। তুমি পায়ের ওপর পা তুলে থাকতে পারো।”

তনয়া মনে মনে হাসল। সে এবার সোফায় বসে গা এলিয়ে দিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বলল, “তাহলে বাকি রান্নাটা তুমিই করো।”

স্বরূপ কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে হেসে ফেলল। দুজনেই হাসল কিছুক্ষণ। তারপর তনয়া উঠলে স্বরূপও উঠে রান্নাঘরে গেল। খাবার দু’জন মিলেই তৈরি করল। শেষে যেটা তৈরি হলো সেটা খুবই জঘন্য খেতে হলেও দু’জন হাসিমুখে সাবাড় করল।

রাতে স্বরূপ তনয়ার হাতে কিছু টাকা গুঁজে দিয়ে বলল, “এখন থেকে যা লাগবে, এখান থেকে খরচ করবে।”

“এটা কি আমার হাতখরচ?”

“বলতে পারো।”

“ধরো, আমি চাকরি করলাম। তখনও কি এভাবে টাকা দেবে?”

“তুমি চাইলে দেব।”

তনয়া হেসে বলল, “মানুষ কত অলস তুমি জানো? তোমার কি মনে হয় এত পেয়ে পেয়ে এরপর আমার ইচ্ছে করবে চাকরির জন্য পড়াশুনা করতে? এমনিতেই পড়ায় কোনো মন নেই। সারাদিন ঘর সংসার নিয়েই আছি। তুমি আমার মাথাটা খেয়ে ফেলেছ।”

“কেমন করে খেলাম?”

“কচকচ করে চিবিয়ে খেয়েছ।”

স্বরূপ হেসে বলল, “শার্পনারের ভেতর মাথা ঢুকিয়ে দিয়ে ক্ষয়ে হয় এখন শার্পনারের দোষ দিলে হবে? তুমি একা একা পাগল হচ্ছো। আমি কিছু করিনি।”

তনয়া আর কিছু বলল না। স্বরূপের কথা সত্য। সে এটাও জানে, সবার দ্বারা সবকিছু হয় না। সে চাইলেও তার শাশুড়ীর মতো ক্যারিয়ার গড়তে পারবে না। চাইলেও দিনরাত পড়ে চাকরির জন্য দৌড়াতে পারবে না। সে হয়তো হতে পারবে একজন পারফেক্ট হাউজওয়াই। হাউজওয়াইফ শব্দটা এখন অনেকে ক্ষুদ্রার্থে বলে। ছোটো করে দেখে। কেন বাপু? চাকরিও তো মানুষ সংসারের জন্য, সম্মানের জন্য করে। যে দুটোই ঘরে থেকেও পেয়ে যাচ্ছে তার দোষ কী? বরং সবার বাইরের জগতে কম্পিটিশন করে দৌড়ে দৌড়ে জীবনটা শেষ করে দেয়ার ইচ্ছে নাও থাকতে পারে। তার ভাবভঙ্গি স্বরূপ ভালেই বোঝে। তাই তো পালে হাওয়া দিতে বলে দিল, চাকরি না করলেও চলবে।

টাকাটা সে ব্যাগে তুলে রাখল। এই টাকা দিয়ে সে কী করবে তাও ঠিক করে রাখল। সেজন্য ছুটির দিন লাগবে। কিন্তু স্বরূপের বেরসিক অফিস সপ্তাহে একদিন কষ্টেসৃষ্টে ছুটি দেয়। সেদিনের অপেক্ষা ছাড়া উপায় নেই

*

তনয়া কদিনে অনেক গাছও লাগিয়েছে। একটা বারান্দায় সব পাতাবাহার, একটায় সব ফুলের গাছ। বারান্দাগুলো বড় বলে এখনো অনেকটা ফাঁকা রয়ে গেছে। অনেকটা সময় তনয়ার বাগানের পেছনে চলে যায়। এদের রোজ যত্ন লাগে। পাতা ছেটে দাও, পানি দাও, মাটি একটু খুঁচিয়ে দাও, কোনটায় ফুল আসছে তার একটু আলাদা যত্ন নাও। তাদের শোবার ঘরের লাগোয়া দক্ষিণমুখী বারান্দায় ফুলের গাছগুলো লাগানে। প্রচুর বাতাস থাকে সবসময়। তনয়ার ভারি ভালো লাগে ফুলের সাথে সময় কাটাতে। সে এরপর একটা দোলনা কিনবে। দু’জন এঁটে যাবে এমন। তার পরিকল্পনা শেষ হতে চায় না।

গতরাতে বৃষ্টি হয়েছিল। আকাশ আজও খানিকটা ভার। সাথে ভীষণ বাতাস। গাছগুলোতে আজ আর পানি দেবে না তনয়া। শুধু মরা পাতাগুলো সাফ করছিল সে। সাথে গুনগুন করছিল কী একটা সুর। কোথায় শুনেছে নিজেও জানে না।

ফোনের শব্দে উঠল সে৷ কে আবার সকাল সকাল?

দেখল শাশুড়ী মা। ফোন ধরে কুশল বিনিময় শেষে মা বললেন, “একটা কথা ছিল গো মা।”

“বলুন মা।”

“মিতার জন্য তো অনেক করলে। আরেকটু করো। ওকে পড়তে পাঠাব তোমাদের কাছে। এদিকে তো ভালো কোচিং নেই। ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার কত যে ইচ্ছে মেয়ের! তা তোমাদের কাছে থাকলে ভালো কোচিংয়ে পড়ে পরীক্ষা দিতে পারবে।”

তনয়া খুশি হয়ে বলল, “পাঠিয়ে দিন না। কোনো সমস্যা নেই।”

“আচ্ছা। আমি আগেই বলে রাখলাম। ওর তো এইচএসসি এখনো শেষ হয়নি। হলেই পাঠিয়ে দেব। তোমরা ব্যবস্থা করে রাখো।”

“আচ্ছা মা।”

মিতার সাথেও ফোনে কথা হলো তনয়ার। সকাল সকাল ভারি ভালো লাগল তার। মাঝে মাঝে একা লাগে। মিতা এলে দারুণ হবে!

*

বৃহস্পতিবার রাতে দেখা গেল পূর্ণিমা পড়েছে। আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারদিক। এই শহরে আলাদা করে পূর্ণিমা চোখে পড়ে না। আজ পড়ল তার কারন লোডশেডিং। আজকাল লোডশেডিং বড্ড বেড়েছে। বিদ্যুৎ ঘাটতি না কী যেন সমস্যা। স্বরূপ ভীষণ বিরক্ত। রাত বিরাতে কারেন্ট চলে গেলে উঠে বসে রাগে গজগজ করতে থাকে। গালাগাল করতে থাকে অথরিটিকে। দেশটা নাকি শেষ হয়ে যাচ্ছে। নানা হাবিজাবি রাজনৈতিক প্যাচাল। তনয়ার বিরক্ত লাগলেও সে শোনে। স্বরূপ খুব আগ্রহ করে ওকে বোঝায়। ও বুঝল কি না খেয়ালও করে না। সে বলতে পেরেই খুশি।

ইদানীং গরম পড়ে যাচ্ছে বলে লোডশেডিং হলে জানালা খুলে দিতে হয়। জানালা খুললে আবার ঝাঁকে ঝাঁকে মশা হাজির। ডেঙ্গুর ভয় আছে। স্বরূপ বলেছে জানালায় আর বারান্দায় নেট লাগিয়ে দেবে। তনয়ার ঘোর আপত্তির জন্য ব্যাপারটা থেমে আছে। স্বরূপ কিছুটা বিরক্ত। মাঝে মাঝে বলে বসে সে, “তোমার অতিরিক্ত রোমান্টিসিজমের জন্য কবে যেন ডেঙ্গু হয়ে মরে যেতে হবে! তখন ভালো করে আকাশ দেখো।”

তনয়া পাত্তা দেয় না। হাসে শুধু। রাগ হলে স্বরূপকে যা সুন্দর লাগে! সে কখনো কখনো ইচ্ছে করে রাগায়। ওর রাগান্বিত মুখের ছবিও তুলতে চেষ্টা করেছে, কিন্তু সফল হয়নি। স্বরূপ বেশি রেগে গেলে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। হাতটাত চেপে ধরে কামড়ে দিতে আসে। যদিও ব্যাপারটা ডমেস্টিক ভায়োলেন্স না হয়ে শেষমেশ রোমান্টিক সীনে গিয়ে দাঁড়ায়।

আজ লোডশেডিংয়ের পর জানালা খুলতেই দেখা গেল মস্ত চাঁদ। তনয়া তাড়াতাড়ি বসার ঘরে গিয়ে পর্দা সরিয়ে দিল। আলোয় ভেসে যাওয়া ঘর। কী সুন্দর! আহা!

সে স্বরূপকে শোওয়া থেকে জোর করে তুলে নিয়ে এলো। স্বরূপ খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে তনয়ার পাগলামিতে। সে হাই তুলতে তুলতে বসার ঘরে আসে। সত্যিই সুন্দর লাগছে। কিন্তু তার চোখে প্রকৃতি এত সুন্দর হয়ে ধরা দেয় না। বরং আগামীকাল অফিস নেই ভেবে আরামে তার চোখ বন্ধ হয়ে আসতে চায়।

তনয়া ওর হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বলে, “চোখ খোলো! কত সুন্দর জ্যোৎস্না দেখো!”

“তুমি দেখো।”

স্বরূপ তনয়ার কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুজে ফেলে। তনয়া মাথাটা সরায় না। নিজের মনেই বলে, “একটা পাখি আছে জানো, চাঁদের আলো খায়। সে আজকের জ্যোৎস্না পেট ভরে খেতে পারবে তাই না? আমারও খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।”

“কী?”

“যা কিছু সুন্দর লাগে সব। এই যেমন চাঁদের আলো, সুন্দর ফুল, বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যা আর..তোমাকে…”

স্বরূপ উঠে বসে চোখ গোল করে বলল, “আমাকে? তা খাও না, কে নিষেধ করেছে?”

সে নিজের মুখটা এগিয়ে দেয়।

তনয়া হেসে দুই হাতে ওকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে বলে, “যাও তোহ!”

স্বরূপ বলে, “চাঁদটা দেখেছ? আজকের চাঁদ সুকান্তের ভাষায় ঝলসানো রুটি। শহরের কত লোক আজ না খেয়ে শুয়েছে গুনে শেষ করা যাবে না হয়তো। ওদের কাছে মনে হচ্ছে চাঁদটা আলো না হয়ে রুটি হয়ে ধরা দিলে বেশি কাজে দিত।”

তনয়া সোজা হয়ে বসে বলল, “ভালো কথা মনে করেছ। আমার ইচ্ছে ওদের জন্য কিছু করার।”

“তুমি আমি কী বা করতে পারব বলো!”

“যতটুকু পারি। এই ধরো পথশিশুদের এক বেলা খাওয়ালাম। কিংবা বৃদ্ধ রাস্তায় পড়ে থাকা মানুষকে কিছু কিনে দিলাম।”

স্বরূপ মাথা দুলিয়ে বলল, “আগে আমি প্রায়ই পথশিশুর একটা গ্যাংয়ের সাথে সময় কাটাতাম। বিয়ের পর তোমাকে সময় দিতে গিয়ে ওদের থেকে দূরে সরে গেছি।”

“চলো না কাল যাই।”

স্বরূপ তনয়ার নাক টেনে দিয়ে বলল, “ওক্কে সুইটহার্ট।”

স্বরূপ প্রথমবার তনয়াকে এমন কিছু ডাকল। এর আগে মজা করে সিন্ডারেলা, ভুতু, মাথামোটা ইত্যাদি ডাকলেও এভাবে কখনো ডাকেনি। তনয়া লজ্জায় বেগুনী হয়ে গেল। স্বরূপ বিষয়টা খেয়াল করে তনয়ার আরেকটু কাছ ঘেঁষে এলো। কানে কানে বলল, “চাঁদের আলো আমাকে বলে গেছে, এত সুন্দর সময়টা আজেবাজে কথা বলে নষ্ট না করতে। অনেক জরুরি কাজ পড়ে আছে…”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
২৫.

পরের দিন ওরা সকালে বের হয়ে ফিরল বিকেলে। সারাদিন পথে পথে ঘুরেছে৷ সেদিন স্বরূপের দেয়া টাকার সাথে তনয়া নিজের কিছু টাকা মিলিয়ে দান করেছে যাকেই অভাবী পেয়েছে তাকে। দুপুরে একগাদা পথশিশুদের সাথে বসে ফুটপাতে বসে খাবার খেয়েছে৷ বিকেলটা বলা চলে ঘুরে কাটিয়েছে৷ সন্ধ্যায় ফিরে তনয়া খেয়াল করল ওর পা আর চলছে না। ব্যথায় ভারী হয়ে আসছে।

কোনোমতে গোসল করে এসে সে শুয়ে পড়ল। স্বরূপ জিজ্ঞেস করল, “হলো কী?”

“পা ব্যথা।”

স্বরূপ কিছু না বলে নিজেও ফ্রেশ হয়ে এলো। তারপর চা বানিয়ে নিয়ে এলো দুজনার জন্য। তনয়াকে উঠিয়ে বসে চা খেতে খেতে আজকের দিনেরই আলোচনা হলো। চা শেষ হলে স্বরূপ নিজেই সব নিয়ে গেল ধুয়ে রাখতে। তারপর রাতের খাবারের আয়োজনে লেগে গেল। খুব বেশি কিছু না, ভাত, আলুভর্তা আর ডাল।

রান্না শেষে তনয়াকে জোর করে ওঠাল সে৷ ততক্ষণে নামাজের সময় হয়েছে। স্বরূপ বেরিয়ে গেল নামাজ পড়তে। তনয়া ওযু করে নামাজ পড়ে নিল। স্বরূপ ফিরল হাতে জিলাপি নিয়ে। কে যেন মসজিদে মিলাদ পড়িয়েছে।

তনয়া ভীষণ আগ্রহ করে খেল দেখে স্বরপ হেসে জিজ্ঞেস করল, “তোমার জিলাপি পছন্দ?”

“খুব!”

“আচ্ছা এবার খাবে চলো। আজ জলদি শুয়ে পড়ব।”

“ওকে!”

খাওয়া শেষে স্বরূপ এবারও তনয়াকে কিছুই করতে দিল না। নিজেই সব গুছিয়ে রাখল। ওকে একটা প্যারাসিটামল খাইয়ে শুইয়ে দিয়ে গেল।

দু’জনেই ক্লান্ত ছিল, বিছানায় মাথা দিতেই চোখে ঘুম জড়িয়ে এলো।

স্বরূপের ঘুমটা ভাঙল মাঝরাতে। কেন ভাঙল? মনে হলো ক্ষীণ কোনো শব্দ তাকে বিরক্ত করছিল। শব্দটা কিসের? কিছুক্ষণ খেয়াল করে বুঝতে পারল ওটা তনয়ার কাছ থেকে আসছে। ও অস্থিরভাবে পা দুটো বারবার এপাশ ওপাশ করছে। স্বরূপ মৃদু স্বরে ডাকল, “তনয়া…”

জবাব এলো, “হু?”

“পায়ে ব্যথা কমেনি?”

“উহু।”

পায়ে হাত পড়তেই চমকে উঠে সরে যেতে চাইল তনয়া। “আরে! করো কী?”

“তুমি ঘুমাও। আমি একটু টিপে দেই।”

তনয়া স্বরূপকে ঠেলে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করে বলল, “তুমি ঘুমাও প্লিজ! এটা কী করছো?”

“চুপ, একদম চুপ। শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করো।”

স্বরূপের শক্ত হাত তনয়াকে ধরে শুইয়ে দিল। পা টিপে দিতে থাকল। এবার তনয়ার আরামে চোখ বুজে এলো আপনাআপনি।

জানালা দিয়ে আসা মৃদু আলোয় তনয়ার মুখটা আবছা দেখা যায়। স্বরূপের ভীষণ মায়া হলো ওকে দেখে। সে দুপুর থেকেই অবাক হয়ে আছে। সে নিজে নাহয় গ্রামে বড় হয়েছে, তার অত বাছাবাছি নেই। কিন্তু তনয়া কেমন করে ফুটপাতে বসে বাচ্চাগুলোর সাথে একসাথে খেল! মেয়েটা সারাদিন ছুটোছুটি করেছে। বুঝতে দেয়নি কষ্ট। এখনো ব্যথায় ঘুমাতে পারছিল না, তবুও তাকে ডাকেনি। এত নরম মনের একটা মেয়েকে তার কাছেই আসতে হলো? সে কি ওকে ডিজার্ভ করে? চমৎকার কোনো ছেলের সাথে তনয়ার বিয়ে হতে পারত। যে ওকে ভীষণ ভালোবাসত। ওর মতো করে পাগলামি করত, দিনরাত ভালোবাসি বলত।

চিন্তাটা একবার মাথায় আসতেই স্বরূপের শরীরে সামান্য ঝাঁকুনি দিয়ে গেল। নিজের চিন্তার জন্য নিজের ওপরেই রাগ লাগছে। অন্য কাউকে তনয়ার পাশে ভাবার ক্ষমতা তার নেই। যত্তসব বাজে চিন্তা! যা হয়েছে ভালো হয়েছে। সে নিজেই ওর বর হিসেবে ভালো। অন্য কেউটা আসছে কোথা থেকে?

তনয়া এবার ক্ষীণ স্বরে বলল, “ব্যথা কমেছে এখন।”

“তুমি ঘুমাওনি।”

“না, তোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাব। আসো প্লিজ!”

স্বরূপ এবার শুতে গেল। মাথার চিন্তাটা যাচ্ছে না। সে জিজ্ঞেস করল, “তনয়া, তোমার যদি এমন কারো সাথে বিয়ে হতো যে তোমাকে খুব ভালোবাসত, তাহলে ভালো হতো না?”

তনয়া স্বরূপের গলা জড়িয়ে বলল, “নাহ।”

“কেন?”

“তোমার চেয়ে বেশি কেউ ভালোবাসতেই পারে না।”

“সেকি! আমি তোমাকে ভালোবাসি একথা কখন বললাম?”

“সব বলতে হয় না।”

তনয়া ঘুমিয়ে গেল। স্বরূপ জেগে ভাবতে লাগল, সে ভালোবাসে? কেমন করে? তনয়া যত সহজ ভাবছে তত সহজ না। আজকের বিষয়টাকে বড়জোর বলা যায় empathy.

*

তনয়ার পরীক্ষার রুটিন দিয়েছে এটা সে জানল পরীক্ষার মাত্র এক সপ্তাহ আগে। সে সংসার নিয়ে এতই ব্যস্ত ছিল যে পড়াশুনার একটা অংশ ঝুলে আছে ভুলেই গিয়েছিল। এক সকালে তার বান্ধবী ঝুমি ফোন করে জিজ্ঞেস করল, “কিরে তুই কি পরীক্ষা দিবি না?”

তনয়া অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, “পরীক্ষা কবে?”

“সামনের সপ্তাহে।”

“আমাকে কেউ বলল না কেন?”

“কেউ কি আলাদা করে কাউকে বলে? সবাই খোঁজখবর রাখে। ফেসবুক গ্রুপে কবেই রুটিন দিয়েছে। মেসেঞ্জারে আলাপ আলোচনা হচ্ছে। তুই কিছুই দেখিসনি? এতদিনেও তোর কোনো রেসপন্স না পেয়ে আমি ভাবলাম তুই পরীক্ষা দিবি না। এজন্য ফোন করলাম।”

তনয়া ভারি অবাক হলো। ফেসবুকে সে থাকে না তেমন একটা। আর মেসেঞ্জারে পড়াশোনার গ্রুপে সারাদিন টুংটাং মেসেজের জ্বালায় সে মিউট করে রেখে দিয়েছে। সেজন্য কিছুই জানে না। এটা এখন কাকে বোঝাবে?

তনয়া দুঃখিত গলায় বলল, “আমি দেব পরীক্ষা। তুই একটু বস একদিন আমার সাথে। বুঝিয়ে দে কিছু। পাশ তো করতে হবে।”

“ঝুমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ” আমরা রোজই ক্যাম্পাসে যাই। তুই এলেই সবাইকে পাবি।”

রাতে তনয়াকে অন্যমনষ্ক দেখে স্বরূপ জিজ্ঞেস করল, “ঘটনা কী?”

তনয়া সব খুলে বলতেই স্বরূপ এত বড় একটা হা করল যে তনয়ার মনে হলো যে ওর মুখের ভেতর আস্ত ফুটবল ঢুকিয়ে দেয়া যাবে।

অনেকক্ষণ পর কথা বলল স্বরূপ। “আমি জীবনে এমন মানুষ দেখিনি। যারা পড়াশুনার ধারেকাছেও থাকে না তারাও এত কেয়ারলেস হয় না তনয়া। ভারী স্যাড!”

“স্যরি।”

“আমাকে স্যরি বলছ কেন? নিজেকে বলো।”

“ওকে।”

“পরীক্ষার বইপত্র কিছু আছে?”

“বই পড়ার সময় কোথায়? কাল গিয়ে নোটস জোগাড় করব।”

“তাই করো। কাল থেকে পড়তে বসবে। আর কোনো ফাঁকিবাজি না। ফেল করলে তোমার তো তোমার, আমারও কোনো মানসম্মান থাকবে না।”

তনয়া কাঁচুমাচু মুখে বলল, “এখন একেবারেই পড়তে ইচ্ছা করে না।”

স্বরূপ অদ্ভূতভাবে তার দিকে তাকাল। কিছুই বলল না।

পরদিন তনয়া ইউনিভার্সিটিতে গেল পরীক্ষার নোটস জোগাড় করতে। একেকজনের থেকে একেকটা নোট নিয়ে ফটোকপি করল। ভাগ্যিস পরীক্ষার ফর্ম ফিলআপের একদিন বাকি ছিল। সেজন্যও অনেকটা সময় বেরিয়ে গেল। সারাদিন দৌড়াদৌড়ি করে যখন বাসায় পৌঁছুল তখন সে বেশ হাঁপিয়ে উঠেছে।

পৌঁছে দেখল স্বরূপ বাসায়। সাথে আরও কিছু লোক। হচ্ছেটা কী?

শোবার ঘরে ঢুকে ঘটনা বুঝতে পারল। পড়ার টেবিল আনা হয়েছে। সেটা সেট করে দিতেই লোকগুলো এসেছে।

তনয়া বলল, “এর আবার কী দরকার ছিল? খাবার টেবিলে বসেও পড়া যেত। ক’দিন আর পরীক্ষা থাকবে?”

স্বরূপ বলল, “মা বলেছে টেবিল চেয়ার আনতে।”

“অপ্রয়োজনীয় খরচ।”

“কিন্তু মায়ের কথা অন্য।”

“কী কথা?”

“তোমার পড়াশুনা শেষ হলে কী হবে, আরও মানুষ বাসায় আসবে, তাদের পড়াশুনা হবে এখানে।”

“ওহ মিতা তো আসছে।”

“তুমি একটা মাথামোটা।”

“মিতা ছাড়া আর কে এসে পড়াশুনা করবে শুনি?”

“মিতা কি আমাদের বেডরুমে বসে পড়বে?”

“না, তো?”

“ভাবো ভাবো। সবসময় আমরা বর্তমান মানুষদের নিয়ে কেন ভাবব? ভবিষ্যত মানুষদের নিয়েও ভাবতে পারি।”

তনয়া এবারও ঠিকঠাক বুঝতে পারল না। মানুষের আবার বর্তমান ভবিষ্যৎ কী?

*

দুদিনেই তনয়া বুঝতে পারল তার জীবনটা নরক হয়ে গেছে। সে একটা জ্যান্ত অগ্নিকুণ্ডে বসে আছে। স্বরূপ তাকে রুটিন করে দিয়েছে। কোনদিন কোন সাবজেক্ট কতটুকু পড়বে এসব ঠিক করে দিয়ে সে অফিসে যায়। অফিস থেকে ফিরে পাই পাই করে পড়াশুনার হিসাব নেয়। অফিসে থাকলে আগে বড়জোর একটা কল করত সে। এখন চার পাঁচবার কল করে জিজ্ঞেস করে পড়াশুনার কী খবর৷ এটা বাদে আর একটা শব্দও বলে না।

রান্নাবান্নাও তাকে করতে দেয় না। দূরী খালাকে বলে দিয়েছে, তিনিই রান্না করে দিয়ে যান। তনয়ার মোবাইলের Wellbeing অ্যাপ রোজ চেক করে দেখে সে কতক্ষণ স্ক্রিনটাইম দিয়েছে। মোটকথা, তনয়ার অবস্থা চিঁড়েচ্যাপটা। এদিকে পড়াশোনা মাথায় ঢুকতে চায় না। মন এদিক ওদিক চলে যায়। জানালা দিয়ে যে নারকেল গাছের ডাল দেখা যায় সেটার দিকে ঘন্টা ধরে চেয়ে থাকতেও ভালো লাগে।

স্বরূপ রোজ তাকে বকা দেয়। পড়া না হলে ঘুমাতে যায় মাঝখানে দুটো বালিশ দিয়ে। তনয়ার কান্না পায়। তবু কান্না গিলে রাত জেগে পড়ে। কিছুই করার নেই।

অসম্ভব রকমের পড়াশুনার পর প্রথম পরীক্ষাটা তনয়ার ভালোই হলো। প্রশ্ন যদিও কঠিন হয়েছিল, তবুও তনয়া অনেক কিছুই লিখতে পারল। পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে প্রথমেই তার মনে হলো, স্বরূপ এই কড়াকড়িটা না করলে সে নির্ঘাত ফেল করত!

পরীক্ষার হল থেকে বের হয়েই যার কথা ভাবছিল তার দেখা পাওয়া গেল। ভুরু তুলে সে জিজ্ঞেস করল, “কেমন হলো?”

“ভালো।”

“আইসক্রিম খাবে?”

“চলো।”

আইসক্রিম খেতে খেতে বাসায় ফেরার পথে তনয়ার মনে হলো আবার আগের স্বরূপকে ফেরত পেয়েছে। কিন্তু বাসায় পা দিয়ে ভুল ভাঙল। আবার যে কী সে!

পরীক্ষা চলল একের পর এক। স্বরূপও মাঝেমধ্যে ওর সাথে রাত জানে। বেশি রাত হলে দুধ গরম করে দেয়, নুডলস বানিয়ে আনে। তনয়ার এখন পড়াশোনা অনেকটা অভ্যাস হয়ে এসেছে। একটা পরীক্ষা ভালো হলে পরেরটা আরও ভালো দেবার আগ্রহ চলে আসে।

এভাবে একের পর এক পরীক্ষা চলতে থাকল। এর মধ্যে একটা মজার কান্ড ঘটল।

স্বরূপ বাসায় ফিরল খুব উত্তেজিত হয়ে। তনয়া কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই বলল, “জানো, কী হয়েছে?”

তনয়ার মনে হলো ও একটা দশ বছরের শিশুর সাথে কথা বলছে যে তার ভীষণ কাঙ্ক্ষিত খেলনাটি খুঁজে পেয়েছে৷

সে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

“তুমি রকিবকে চেন? আমার বন্ধু। রূপারও বন্ধু।”

“হ্যাঁ চিনি।”

“ও আমেরিকা সেটেল হয়ে গেছে। দ্রুতই চলে যাবে।”

“তো?”

“ওর গাড়িটা বিক্রি করে দিয়ে যাবে। আমি বলেছি আমি নেব।”

“সেকেন্ড হ্যান্ড?”

“হ্যাঁ, নতুন কেনার টাকা জোগাতে কত বছর লাগবে কে জানে! সেকেন্ড হ্যান্ডই চলবে। আর ওর গাড়িটা একদম নতুন। আমি কেনার সময় সাথে ছিলাম। দারুণ পছন্দ হয়েছিল।”

“কিন্তু সেটার জন্যও তো অনেক টাকা লাগবে।”

“অল্প অল্প করে দেব। ওর তাড়া নেই কোনো।”

“বাহ! দারুণ তো!”

স্বরূপ হাতে হাত ঘষে বলল, “দারুণ মানে! ফ্যান্টাস্টিক!”

তনয়া ওর খুশি দেখে হেসে ফেলল। স্বরূপ বলল, “গাড়িটা পেয়ে যাব সপ্তাহখানেকের মধ্যেই। তোমার পরীক্ষাও শেষ হবে। শেষ পর্যন্ত ভালো পরীক্ষা দিতে পারলে তোমাকে লং ড্রাইভে নিয়ে যাব।”

“তুমি ড্রাইভিং পারো?”

“ডিয়ার তনয়া, আমি ড্রাইভিং শিখেছি আরও পাঁচ বছর আগে।”

“তখন তোমার গাড়ি ছিল?”

স্বরূপ হাসল, “নাহ, উবার চালাতাম।”

“ওহ।”

“টাকাপয়সার সমস্যার জন্য না, গাড়ি চালানোর জন্য।”

তনয়া অদ্ভূত চোখে তার দিকে তাকাল। শখ বটে!

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-২২+২৩

0

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
২২.

ওরা যখন পৌঁছুল তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। মা স্কুলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ওরা এলে ওদের খাইয়ে বিশ্রাম নিতে বলে স্কুলে চলে গেলেন। বললেন বিকেলে কথা হবে।

রাতে ঘুম না হওয়ায় দুজনই ক্লান্ত ছিল। লম্বা একটা ঘুম দিল ওরা। উঠতে উঠতে দুপুর গড়াল। তনয়া উঠে জানালার পাশে বেশ কিছুক্ষণ থম ধরে দাঁড়িয়ে থাকল৷ ওদের জানালা দিয়ে কিছুদূরে চাষের জমি দেখা যায়। জমির ওপর দিয়ে ক’টা সাদা বক উঠে গেল। বিকেলের রোদে প্রকৃতি নরম আলস্যে ডুবে আছে। রাস্তার একধারে আরাম করে একটা কুকুর ঘুমিয়ে আছে। কোনো একটা পাখি ডাকছে মিষ্টি সুরে। সুরটা অচেনা। কিন্তু ভারি সুন্দর। শালিক পাখিও দেখা গেল কয়েকটা। তনয়া গুনল। এক..দুই..তিন..চার… জোড়া শালিক!

আজ ওদের কোথায় থাকার কথা ছিল আর ওরা কোথায়! তবুও মনটা আরামদায়ক উষ্ণতায় বেশ ভালো লাগতে শুরু করেছে। গতদিনের মন খারাপ ভাব কেটে গেছে।

অঘটনের কোনো আঁচ ওরা এখন পর্যন্ত পায়নি। এত শান্ত সুন্দর পরিবেশে এমন কী হতে পারে? অবশ্য অবিশ্বাসও হয় না তনয়ার৷ এখানে এসেই গতবার কী ভয়ানক অভিজ্ঞতা তার হলো!

শরীরটা কেমন ঝিম ধরেছিল ওর। জামাকাপড় নিয়ে গোসলে ঢুকে গেল।

মা তাড়াতাড়ি ফিরলেন আজ। ছেলের ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। বিকেল হয়ে গেছে। এখনো দুপুরের খাওয়া হয়নি। ঘুমাচ্ছে হয়তো এখনো। তিনি দরজায় টোকা দিলেন, “ওঠ তোরা। কত ঘুমাবি?”

স্বরূপের ঘুম এমনিতেই হালকা হয়ে এসেছিল। মায়ের ডাকে উঠে দরজা খুলল।

“তনয়া কোথায়?”

“বাথরুমে বোধহয়।”

“ওহ। তুইও ফ্রেশ হয়ে খেতে আয়।”

স্বরূপ মায়ের হাত ধরে খাটে বসিয়ে বলল, “কী হয়েছে সেটা আগে বলো।”

মা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “অনেক কিছু। সংক্ষেপে বলি। তোর চাচা জহির তালুকদারের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছিল। সে বহুদিন আগের কথা। এখনো ধার শোধ হয়নি, বরং সুদে আসলে বেড়ে বারো লক্ষ টাকা হয়ে গেছে। তোর চাচা দিন আনি দিন খাই মানুষ, সে এত টাকা কেমন করে শোধ করবে? শোধ দিতে না পারলে জমি যাবে। অল্প কিছু জমিই তো তার সম্বল। এবার জহির তালুকদার একটা নতুন প্রস্তাব দিয়েছে।”

“কী প্রস্তাব?”

“তার ছেলে সিরাজের সাথে মিতার বিয়ে দিতে হবে। দিলে সে সব টাকা মাফ করে দেবে।”

“মানে?”

“মানেটা সহজ। তোর সাথে গতবার ঝামেলা হয়েছে। তোকে বা তোর বউকে সে কিছু করতে পারবে না, তোরা শহরে থাকিস। আমাকেও কিছু করতে পারবে না, করলে গ্রামের লোক ছিঁড়ে ফেলবে। তাই আমাদেরই পরিবারের দুর্বল জায়গায় হাত দিয়েছে। মিতা সেদিন তনয়ার সাথেই ছিল বলে ওর ওপরে আক্রোশও আছে। জহির তালুকদারের মতো লোক বারো লাখ টাকা মাফ করে দেবে এমনি এমনি? এক পয়সাও সে কাউকে ছাড় দেয় না। তুই ভাবতে পারিস বিয়ের পর ওরা মিতার সাথে কী কী করবে?”

স্বরূপ অবাক হয়ে বলল, “সে তো আর জোর করে মেয়ে নিতে পারবে না। বিয়ে না দিলেই হলো।”

“এত সহজ নাকি? তোর চাচা রাজি। চাচীও নিমরাজি। এদিকে মিতা মেয়েরা প্রতিদিন আমার কাছে এসে কাঁদে। আমি ওকে বলেছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে সাহায্য করব। এদিকে ওকে নরকে ঠেলে দেয়ার প্রস্তুতি চলছে।”

স্বরূপ গুম হয়ে বসে রইল।

মা বললেন, “তোকে ডেকেছি কারন তোর হাত ধরেই এই ঝামেলার শুরু। জানি তুই তোর জায়গায় পুরোপুরি ঠিক ছিলি। কিন্তু আমিও আর কোনো উপায় দেখছি না। অনেক বুঝিয়েছি তোর চাচাকে। এখন তুই বলে দেখ। ওরা এই শুক্রবারেই বিয়ে করাতে চায়। আমার চোখের সামনে আমি এসব হতে দেব না।”

তনয়ার বাথরুম থেকে বের হবার শব্দে মা থামলেন৷ তনয়াকে দেখে বললেন, “খেতে এসো তোমরা।”

উঠে চলে গেলেন তিনি। স্বরূপ জামাকাপড় নিয়ে গোসলে ঢুকল। তনয়া কিছু জানতে পারল না। সে চুল মুছে একটু প্রসাধনী মেখে বাইরে বের হলো। মিতাকে দেখে এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে। মিতাও জড়িয়ে ধরল ভাবিকে। কিন্তু ছাড়ল না৷ ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল। তনয়া অনেকবার জিজ্ঞেস করল কী হয়েছে৷ কিন্তু কোনো উত্তর পেল না। কোন দুঃখে এত হাসিখুশি একটা মেয়ে ব্যকূল হয়ে কাঁদছে বুঝতে পারল না তনয়া।

*

সন্ধ্যার পর বৈঠক বসল। স্বরূপের দুই চাচা, চাচী, মিতা আর মিতার বড় ভাই মনসুর এসেছে।

স্বরূপই কথা শুরু করল। “চাচা, এইটা কি ঠিক হচ্ছে? সিরাজের মতো একটা ছেলের সাথে মিতার বিয়ে দিলে ওর জীবনটা নষ্ট হয়ে যাবে না?”

“জীবন তো আল্লাহর হাতে। আল্লাহ চাইলে ও সিরাজের ঘরেও ভালা থাকব। আর বিয়া না দিলে যে বাকি সবাইর না খাইয়া মরা লাগব তার কী?”

“চাচা এখনই আপনি দুই রকম কথা বললেন। আল্লাহ যদি মিতাকে দেখতে পারে তাইলে আপনাদেরও দেখবে। আর ধার আপনি করছিলেন তার দায় মিতা কেন নেবে?”

“ধার কইরা কি আমি একলা খাইছি? সবাই খাইছে। মিতাও খাইছে। ওয় পোলা হইলে কামে লাগায় দিতাম, সংসার চালাইতে পারত। হইছে মাইয়া। তো যেইডা করবার পারে সেইডা দিয়াই সংসারডা বাঁচাক৷ ওরে কি এতদিন পাইলা বড় করি নাই আমরা?”

“চাচা আপনার মনে নাই জহির তালুকদারের দুই নাম্বার বউটার কথা? পিটায়া মেরে ফেলল যে? ওদের বাড়ির কোনো বউ সুখে থাকতে পারছে?”

চাচা তার জায়গা থেকে সরবার কোনো লক্ষণ দেখালেন না। বললেন, “গরীব মানুষের আবার সুখ কিসের? বাঁইচা থাকলেই হইল।”

“তো ওকে তো এমন জায়গায় পাঠাচ্ছেন যেখানে বাঁচা মরারও ঠিক নাই।”

“দেখ স্বরূপ, আমার মাইয়ার লাইগা আমার থেকা তোর দরদ বেশি না। আজকা আমি রাস্তায় আইয়া পড়লে আমার সংসারের আটটা পেট তুই চালাবি না।”

মনসুরের ওপরেও ঋণের বোঝাটা ভারী হয়ে চাপছিল। সে টুকটাক কাজকর্ম করে কিছু টাকা দিতে পারলেও এত বড় ঋণ শোধ করার সক্ষমতা তার ছিল না। রোজ বাপের খোঁটা শুনতে শুনতে তার জীবনটাও অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল৷ তাই প্রস্তাবটা পেয়ে সে বোধহয় বাবার চেয়েও বেশি স্বস্তি পেয়েছে। শুরু থেকেই আগুনে ঘি ঢালার কাজটা সে করে যাচ্ছে দায়িত্বের সাথে। স্বরূপের সামনে এতক্ষণ মুখ খুলছিল না সে। এবার সাহস করে খুলে ফেলল, “ভাই আপনে তো আমগো অবস্থা জানেন না৷ মিতা কি এইখানে অনেক সুখে আছে নাকি? ওর বিয়ার বয়স হইছে। বিয়া দেয়ার টাকাও আমগো নাই। ফ্রিতে দিতে পারলে দিব না কেন?”

চাচা ছেলের সাথে গলা মেলালেন, “হ, ওরা কইছে এক কাপড়ে মাইয়া নিব৷ এমন কথা আর কেউ কইব? ওর বিয়া দিতেও যৌতুক দেওন লাগব। সেই টাকা কই পামু আমরা? এর কাছে বিয়া না দিলে মাইয়া সারাজীবন ঘরে পালা লাগব।”

তনয়া এতক্ষণ দরজার পাশে দাঁড়িয়েছিল চুপচাপ। এবার আর সহ্য করতে পারল না। বলল, “চাচা, মিতা আমাকে বলেছিল ও পড়তে চায়। ভালো পড়াশুনা করে চাকরি করলে সেও আপনাদের সংসারের হাল ধরতে পারবে। মেয়ে তো ফেলনা জিনিস না।”

চাচা তনয়াকে খুব পছন্দ করেন৷ তিনি নরম সুরেই বললেন, “তুমি এর মধ্যে কথা কইয়ো না। বাড়ির বউরা এত কথা কয় না।”

“কেন চাচা? আমি খারাপ কী বলেছি? ওর জীবনটা কেন নষ্ট করছেন? মেয়েটা তো কাঁদতে কাঁদতেই মরে যাবে।”

“ওর লাইগ্যা এত দরদ, তো না দিলাম ওর বিয়া, তুমি আমার ধার শোধ করো। করবা? না করলে আর কথা কইও না।”

তনয়া বলল, “করব।”

ঘরের সবাই ওর দিকে অবাক হয়ে ঘুরে তাকাল। মেয়ে বলে কী!

মা বললেন, “তনয়া, তুমি ঘরে যাও। তোমাকে এখানে কথা বলতে হবে না।”

তনয়া বলল, “না মা, আমি সিরিয়াস! আমার কাছে টাকা আছে। বিয়ের মোহরানার টাকা, তাছাড়া বাবা আমার নামে ফিক্সড ডিপোজিট করে রেখেছেন সেখানেও টাকা আছে। আমি এত টাকা দিয়ে কী করব? টাকার চাইতে একটা মেয়ের জীবন অনেক দামী। আমার বোন নেই। মিতা আমার বোনের মতো। সেদিন ও না থাকলে আমি হয়তো মরেই যেতাম। আমি টাকা দেব মা। এমনি এমনি বলছি না।”

চাচার চোখে পানি চলে এলো। তিনি চোখ মুছে থেমে থেমে বললেন, “না আম্মা, তোমার টাকা আমি নিতে পারমু না। তুমি যে কথাটা কইলা এইডাই অনেক। দোয়া করি অনেক ভালা হউক তোমার।”

“কেন চাচা? কেন নেবেন না?”

চাচা উত্তর দিলেন না।

স্বরূপ চাচার হাত ধরে বলল, “ওর থেকে না নিলেন। আমি দেব। আমি তো আপনার ছেলেই। বাবা চলে যাবার পর এই কথাই বলতেন না আপনি? তাহলে কোনো আপত্তি থাকার তো কথা নয়। আমি ফিরে গিয়েই টাকা পাঠিয়ে দেব৷ আমাকে আগে বললে এত সমস্যা হতো না। ঋণও এত বাড়ত না। আপনি কথা দিন, মিতাকে এখানে বিয়ে দেবেন না।”

চাচা কিছুই বললেন না। এক হাতে স্বরূপের হাত ধরে আরেক হাতে চোখ মুছলেন। ঘরে নিরবতা নেমে এলো। শুধু মিতার কান্নার শব্দ শোনা গেল। সে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।

*

সবাই চলে গেলে মা স্বরূপকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুই কোথা থেকে টাকা দিবি? গাড়ি কিনতে যে টাকা জমাচ্ছিলি সেটা দিয়ে দিবি?”

“হ্যাঁ।”

“কত হয়েছে?”

“দশ লাখ হয়েছে।”

“আর বাকিটা?”

“ধার করব তনয়ার থেকে। কী তনয়া, দেবে?”

তনয়া একটু হেসে বলল, “কেন দেব না?”

মা তনয়ার কাছে এসে ওর মাথায় হাত রেখে বললেন, “তোমাকে তোমার মা বাবা কোথা থেকে এনেছে বলো তো?”

“কেন মা?”

“না, জিজ্ঞেস করতাম। আমিও সেখান থেকে একটা লক্ষী মেয়ে আনতাম।”

স্বরূপ ভুরু কুঁচকে বলল, “কেন তোমার ছেলে কি লক্ষী না নাকি?”

“হ্যাঁ, আমার দুই ছেলেমেয়েই সোনার টুকরা।”

*

তনয়া মায়ের সাথে রান্নাঘরে গেল রাতের খাবার তৈরিতে সাহায্য করতে। স্বরূপ ঘরে চলে গেল৷ আজকের এত কান্ড ছাপিয়ে তার মাথায় তনয়ার কথাগুলো ঘুরছে। ওকে এতদিন মিষ্টি একটা মেয়ে মনে হয়েছে। টুকটুকে সুন্দরী নরম মনের একটা মানুষ। কিন্তু আজকে আরেকটা রূপ ওর মন ভরিয়ে দিয়েছে। স্বরূপের কখনো মনে হয়নি মেয়েরা এতটা বড় মনের হতে পারে। আছে তো অনেকেরই, কিন্তু দেয়ার মানসিকতা ক’জনের থাকে? ইউনিভার্সিটিতে পড়া একটা মেয়ে টাকার মর্ম বুঝবে না এমনও তো নয়। আবার ওদের অঢেল টাকাপয়সাও নেই। এইযে এত দূরের সম্পর্কের জন্য এতটা করতে চাওয়া, এজন্য অনেক সাহস লাগে। শুধু শুধু সে মেয়েটাকে দুর্বল ভাবছিল। সে নিজেই টাকা দেবার কথা বলার সাহস পাচ্ছিল না। অনেকদিন ধরে সে গাড়ি কেনার জন্য টাকাগুলো জমিয়েছিল। এইযে সাহসটা পেল, সেটা তনয়ার জোরেই। দেখা যাবে খুব কঠিন সময়ে আপাত দুর্বল দেখতে মেয়েটাই শক্ত হয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। সে পেছনে পড়ে গেছে।

সৌন্দর্য কিংবা মাধূর্যের প্রতি ভালোলাগা হয়তো কমে যায় সময়ের সাথে, কিন্তু ব্যক্তিত্বের প্রতি সম্মান কখনো কমে না, সময়ের সাথে সাথে বাড়ে।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
২৩.

সকালে চা খেতে খেতে অনেকক্ষণ গল্প হলো মা ছেলের। তনয়া তখনো ঘুমে। বিয়ের চক্করে গতবার মায়ের সাথে জমিয়ে গল্প করা হয়নি স্বরূপের। তাই নামাজ পড়তে ওঠার পর তনয়া আরেক দফা ঘুমের জন্য শুয়ে পড়লেও সে না শুয়ে মায়ের কাছে গিয়ে বসল। আজ স্কুল ছুটি। মা নাস্তা তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পিঠা বানানো হবে।

গতকাল চাল গুড়ো করে আনা হয়েছে। বাজারের দিকে চাল ভাঙানোর মেশিন থাকলেও মা চাল ভাঙাতে দেন জরীর মায়ের কাছে। বিধবা মহিলা স্বামী মারা যাবার পর তার ফেলে যাওয়া সম্পদ বলতে পেয়েছে ওই এক ঢেকি। মায়ের বড় মায়া হয় গ্রামের গরীব মানুষগুলোর জন্য। এত সামর্থ্য না থাকলেও যার জন্য যতটা পারেন, তিনি করেন।

এসব নিয়েই কথা হচ্ছিল দু’জনের। ভোরের মিষ্টি বাতাস বইছিল সাথে। মা জিজ্ঞেস করলেন, “থাকবি ক’দিন? তোর তো অফিসে ছুটি নেয়া আছে।”

“না মা, আজ রাতেই চলে যাব ভাবছি।”

“কেন? ট্যুরটা কি চাইলে এখন দেয়া যাবে?”

স্বরূপ বলল, “না। তা যাবে না৷ ক্যান্সেল করে দিয়েছি পুরোপুরি। ভাবছি অফিসের ছুটিটাও ক্যান্সেল করব। এখন ছুটিটা কাটালে আর এক বছরে ছুটি দেবে না। তনয়ার অনেক মন খারাপ হয়েছে না যেতে পেরে।”

মা হেসে বললেন, “বিদেশে যেতে হবে এমন কোনো কথা আছে? তারচেয়ে এখন দেশেই কোথাও চলে যা। দেশের ভেতর বেড়াতে তো আর ঝঞ্ঝাট নেই। খরচও অত পড়বে না।”

স্বরূপ একটু ভেবে বলল, “না মা, যেখানে যাবার কথা ছিল সেখানেই যাব৷ দেশে তো চাইলে শুক্র শনিবার করে ঘুরে ফেলা যাবে। পরে ওখানে আর যাবার সুযোগ না পেলে?”

“হুম। আচ্ছা এবার বল তো, বিয়ে করবি না বলে যে মাথার পোকা খেয়ে ফেলেছিলি, এবার কী হলো? কে বিয়ে করল? আর কার বিয়ে করে চেহারা ঘুরে গেল?”

স্বরূপ গালে হাত ছু্ঁইয়ে বলল, “চেহারা ফিরেছে মানে?”

“আয়নায় দেখিস না নাকি? তোর চেহারা যে ভূতের সর্দারের থেকে আস্তে আস্তে মানুষ হচ্ছে বুঝিস নাই?”

স্বরূপ কাঁধ ঝাঁকাল, “কে জানে!”

“ঘুম হয়?”

“হুম।”

“আগে কিন্তু হতো না।”

স্বরূপ ভাবল কথা সত্যি। অথচ নিজের এই ব্যাপারটা সে নিজেই ধরতে পারেনি। ঘুম একটা বড় সমস্যা ছিল। যখন একা ছিল, তার ঘুম আসতে অর্ধেক রাত পেরিয়ে যেত। যাও বা ঘুম হতো, শান্তি লাগত না। আজেবাজে স্বপ্নেরা ভিড় করে ঘুমে বাগড়া দিত। অথচ তনয়ার পাশে শুয়ে ওর সাথে হাবিজাবি বকবক করতে করতে সে কখন ঘুমিয়ে পড়ে নিজেও জানে না। তনয়াই কথার মাঝখানে হঠাৎ ঘুমিয়ে পড়ে। ওকে ঘুমন্ত দেখলে স্বরূপেরও ঘুমে চোখ ছোটো হয়ে আসে। অফিসে কে যেন বলছিল তার চোখের ডার্ক সার্কেল কমে গেছে। কোনো প্রোডাক্ট ইউজ করেছে কি না।

গল্পের মাঝে এক বুড়ি এসে হাজির। বুড়ির বয়স হলেও শক্তপোক্ত আছে। হেঁটে হেঁটে গ্রাম পাড়ি দিতে পারে। দুই গ্রামের প্রতিটা বাড়ির গল্প তার জানা।

তার হাতে ছোট্ট পানের বাটা। নিজের বানানো পান কিছুক্ষণ পরপর মুখে না দিলে তিনি কথা বলতে পারেন না।

এসেই তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কেমুন আছো নানা?”

স্বরূপকে বুড়ি বরাবরই আদর করেন। তিনি এলেই স্বরূপ তার পানের বাটা থেকে নিজেই পান বানিয়ে মুখে পুরে দেয়। আজও তাই করল।

বুড়ি প্রশ্নের উত্তরে সে বলল, “আমি তো ভালোই। আপনি কেমন?”

বুড়ি জাঁকিয়ে বসে বলল, “আল্লায় বালা রাখছে। তা বউ কই? শাশুড়ীডা একলা কাম করে, হ্যায় কী করতাছে?”

মা হেসে বললেন, “ঘুমায়।”

বুড়ি একটু মন খারাপ করে বললেন, “এর লাইগ্যাই কইছিলাম শহরের মাইয়া বিয়া করান লাগব না। আমগো গেরামেই কত বালা মাইয়া পইড়া আছে। হেগোর কারো লগে বিয়া দিলে অহন তুমারে মুখে তুইল্যা খাওয়া দিত। একলা কাম কইরা বউরে খাওয়ান লাগতো না।”

স্বরূপ কী বলবে বুঝতে পারল না। মায়ের হাসি চওড়া হলো। বুড়ি সেটা দেখে বললেন, “হাসির কতা কুনডা কইলাম আমি?”

মা বললেন, “খালা, এইটা আমার সংসার। ওরা বেড়াইতে আসছে। দুইদিনের বউরে দিয়া কাজ করাবো কেন? সে কি মাটির চুলায় রাঁধতে পারে? আমি তো পায়ের উপর পা তুলে খেতে ছেলে বিয়ে করাই নাই। বিয়ে করাইছি যাতে ছেলে ভালো থাকে। সে ভালো আছে। দেখেন তার চেহারা ফিরছে না? ব্যস, আমার আর কিছুই লাগবে না।”

বুড়ি স্বরূপের দিকে তাকিয়ে ওর গালে কপালে হাত বুলিয়ে বললেন, “আহারে! পোলাডা কত হুগাইয়া গেছে। তুমি অইলা মডান মা। শিক্ষিত অইয়া চোক্ষে বেশি দেহো। বউ কী না কী খাওয়ায়, মায়ের কাছে থাকলে পোলার চেহারা এমন অয়?”

মা এবারও হাসলেন। কিছুই বললেন না।

বুড়ি সমালোচনায় আরাম না পেয়ে উঠে চলে গেলেন। অন্য বাড়িতে নিশ্চয়ই বউয়ের দেরিতে ওঠা নিয়ে কথা শুরু করলে চমৎকার আসর বসে যাবে!

ওরা মা ছেলে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে হেসে ফেলল। বুড়ি বরাবরই এমন৷ স্বরূপের মায়ের কোনো কথা পছন্দ না হলেই সে বলবে বেশি শিক্ষিত হয়ে তার মাথাটা গেছে! তবে ওরা রাগ করে না৷ বুড়ির মন ভালো। স্বরূপের বাবা মারা যাবার পর যে ক’জন মানুষ সত্যিকারের পাশে থেকেছে ইনি তাদের একজন।

*

আজও ওরা ফিরবে রাতের ট্রেনে। তনয়ার বিকেলের দিকে হঠাৎ মনে হলো, বিয়েতে তাদের অনেক ছবি আছে ঠিকই, কিন্তু মায়ের সাথে ভালো ছবি নেই। কেন নেই? কারন তাদের মা ছবি তোলার সময় বড়ই লাজুক। তার ওপর ফটোগ্রাফারের সামনে পোজ দেয়াতে তো তার মহা আপত্তি!

মা ঘরে বসে স্কুলের কিছু কাজ নিয়ে বসেছিলেন। তনয়া তাকে টেনে নিয়ে এলো। নিজের মেকআপ সামগ্রী দিয়ে কতকটা জোর করেই সাজিয়ে দিল। মা নিজেকে আয়নাতে দেখে লজ্জা পেয়ে ঘোমটা দিয়ে বসে রইলেন। তনয়া বলল, “মা, আজ কিন্তু ছবি তুলব অনেক। আপনার ছেলেই তুলবে, তাই কোনো অযুহাত শুনব না।”

মা করুন চোখে তাকালেন৷ এ কি যন্ত্রণা!

স্বরূপ গ্রামের বন্ধুদের সাথে দেখা করতে গিয়েছিল। তনয়া তাকে ফোন করে বলল, “তাড়াতাড়ি এসো। ইমার্জেন্সি!”

স্বরূপ কিছু বলার আগেই সে ফোন কেটে দিল। স্বরূপ ব্যস্ত হয়ে সাথে সাথে ফোন করল। তনয়া ইচ্ছে করেই ধরল না। সে একপ্রকার হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ফিরল।

তনয়া দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। স্বরূপকে দেখে বলল, “ঘরে গিয়ে দেখো তো মায়ের কী হয়েছে!”

স্বরূপ ছুটে ঘরে ঢুকে দেখে মা নতুন শাড়ি পরে ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। সে ভেবেছিল অসুখবিসুখ হয়েছে। কিন্তু মা তো দিব্যি বসে আছে! কিন্তু ঘোমটা কেন? হচ্ছেটা কী?

তনয়া এসে জোর করে ঘোমটা সরাল। স্বরূপ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তনয়ার ওপর রাগ হয়েও হলো না। মাকে ভীষণ সুন্দর লাগছে। তার মা এত মায়াবী সুন্দর! অথচ তার অতিরিক্ত পরিশ্রম আর আটপৌরে জীবনযাপন সেই সৌন্দর্যকে ঢেকে রেখেছে।

তনয়া বলল, “আমাদের ছবি তুলে দাও এখন।”

*

ট্রেনে বসে ছবিগুলো দেখছিল স্বরূপ। তনয়া আজ তার কাঁধে মাথা রেখে আরামে ঘুমাচ্ছে। তার ঘুম আসছে না কেন যেন। আজ বিকেলটা এত সুন্দর ছিল! আশ্চর্য ব্যাপার হলো, মায়ের সাথে তার কোনো ছবি ছিল না। আজ তোলা হয়েছে। মায়ের মাথার সাথে মাথা ঠেকিয়ে তোলা ছবিটা সবচেয়ে সুন্দর হয়েছে। ছবিটা ওয়ালপেপারে দিতে গিয়ে কী মনে করে দিল না। বরং ওদের তিনজনের কিছু ছবি তুলেছিল টাইমার সেট করে। সেগুলোর একটা দিয়ে রাখল।

তার জীবনে এমন একটা সময় এসেছিল, যখন প্রতি মুহূর্তে মরে যেতে ইচ্ছে হতো। নিজেকে সে রোজ আত্ম-হত্যা থেকে বাঁচিয়ে রাখত একটা মানুষের কথা ভেবে। সেটা ছিল মা।

তবে একাকী শহুরে জীবনে তার সব রঙ উড়ে গিয়েছিল। রঙগুলো একটু একটু করে ফিরে আসছে। যে ফিরিয়ে দিচ্ছে সেও তার জীবনে খুব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠছে।

সে ফেসবুকে ঢুকল। ‘Love is just a myth’ লেখা নিজের বায়োতে চোখ পড়তেই সে নিজেকে প্রশ্ন করল, “What is love?” সে কি ধীরে ধীরে ভালোবাসায় বিশ্বাসী হয়ে উঠছে? নাকি সংশয়বাদী?

লোপার সাথে তার প্রেম ছিল উত্তাল, বাঁধাহীন, প্রবল! প্রেমের জন্য পাহাড় থেকে ঝাঁপ দেয়াও যেন কোনো ব্যাপার ছিল না৷ অথচ তনয়ার জন্য তার কোনো প্রবল আবেগ কাজ করে না। বরং ও পাশে থাকলে শান্তি লাগে। এটা কি প্রেম? নাকি স্বস্তির জায়গা?

লেখাটা পরিবর্তন করল না সে। কল্পকথারাও হয়তো কখনো সত্যি হয়ে যায়। সে অপেক্ষায় রইল। হয়তো হবে। সে উত্তাল ভালোবাসার টানে ছুটে যাবে এই মেয়েটার কাছে। ভাবতে ভাবতে আপনমনেই হাসল স্বরূপ। এও কি সম্ভব?

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-২১

0

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
২১.

সকাল থেকে ভীষণ ব্যস্ত দু’জন। তনয়া যতই বলুক সে অনেক কিছু গুছিয়ে রেখেছে, আদতে সে কী গুছিয়েছে স্বরূপ বুঝতে পারল না। তার মনে হলো মেয়েটা গোছানোর নামে অনেক বেশি এলোমেলো করে রেখেছে। ঘন্টা দুয়েক চেষ্টা করে একসময় স্বরূপ হাঁপিয়ে উঠে বলল, “মাফ চাই! এবার তুমি আমাকে একা কাজ করতে দাও। কাজ তো বাড়িয়ে দিচ্ছো। আচ্ছা তুমি ওখানে ওয়াটার হিটার নিয়ে কী করবে?”

“যদি হঠাৎ কফি খেতে ইচ্ছে করে…”

“কোনো দরকার নাই এসব। কফি ওখানে কিনতেই পাওয়া যায়। আর চায়ের দেশে গিয়ে কফি খেতে যাবে কোন দুঃখে?”

“চা খেতেও তো গরম পানি লাগে…”

“চা কিনে খাওয়া যাবে৷ এসব কেন নেব? আর তুমি এই ব্লাউজগুলি এলোমেলো করে রেখেছ কেন?”

“এর মধ্যে থেকে কোনগুলো নেব বেছে রাখতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তুমি শাড়ি অলরেডি প্যাক করে ফেলেছ।”

“আর ওইযে ইনার…ওসবও কি তুমি ম্যাচিং ম্যাচিং নিতে চাও নাকি?”

তনয়া কিছু না বলে চুপ করে রইল। মনে মনে বলল, “তা তো অবশ্যই। কিন্তু সেটা সরাসরি বললে তুমি কী প্রশ্ন করবে জানা আছে।”

স্বরূপ বলল, “আচ্ছা, প্যাকিংয়ের বিষয়টা আমি দেখছি। তুমি যেটা ভালো পারো সেটা করো। প্লিজ কিছু বানিয়ে আনো, ক্ষুধায় চোখে অন্ধকার দেখছি।”

“কী খেতে চাও?”

“এনিথিং ইউ মেক।”

তনয়া চলে গেল। শর্টকাটে কী বানানো যায়? আচ্ছা প্রেশার কুকারে খিচুড়ি বসিয়ে দিলে তো তাড়াতাড়ি হয়ে যাবে। সাথে ডিমভাজি করে ফেলা যায়। তনয়া কাজে লেগে গেল।

আকাশ আজ মেঘলা। অনেকদিন বৃষ্টি হয় না। আজ তারা চলে যাবে, আজই বৃষ্টি নামবে? রাতে নামলে আর দেখা হবে না। আচ্ছা, ওরা যদি আর না ফিরতে পারে? যদি পথেই কিছু হয়ে যায়?

দার্জিলিংয়ে তো অনেক বৃষ্টি হয় শুনেছে। ওখানে গিয়ে রেইনি ওয়েদার পেলে দারুণ হবে! তনয়া শুধু কক্সবাজারের পাহাড় দেখেছে। আকাশ ছোঁয়া উঁচু পাহাড় বাস্তবে দেখলে কেমন লাগে? তারা দেখতে পারবে তো? সাবধানে যাওয়া হবে তো?

প্রেশার কুকারের সিটি তাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনে। কী সব আবোল তাবোল ভাবনা! আচ্ছা এই ভাবনাগুলো কি শুধু তারই আসে? অন্যরা কি সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই ভাবে?

সে এক ফাঁকে গিয়ে শোবার ঘরে উঁকি দিয়ে এলো। স্বরূপ আপনমনে কাজ করছে। চোখমুখ খুব সিরিয়াস। ভাব দেখে লোকে ভাববে পাশের দেশের আক্রমণ থেকে দেশ রক্ষার মতো বিরাট কাজ করছে! তনয়ার হাসি পেল, কিন্তু সে শব্দ করল না। স্বরূপ আদতেই কতটা সুন্দর সেটা সে হিসেব করতে পারে না। তবে তার চোখে এখন ওকেই পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর পুরুষ বলে মনে হয়। ওর মুখের প্রতিটা ভাজ, হাসি, হাত পা নাড়া, কাজ করা, খাবার মুখে তোলা প্রতিটা ক্ষেত্রে তনয়ার মনে হয়, ও এত সুন্দর কেন? নাকি তার চোখ গেছে? কালো জাদু করে ফেলেছে কি না কে জানে! আচ্ছা কালো জাদুতেই মানুষ বশ হয়? সাদা জাদুতে হয় না? সাদা জাদুটা কি? ভালোবাসা? ‘ভালোবাসা কী?’ এই প্রশ্নের উত্তর কি তবে হবে ভালোবাসা এক প্রকার জাদু। Highly powerful magic!

কুকারের সিটির শব্দ শুনে রান্নঘরে ঢুকল তনয়া। খিচুড়ি হয়ে গেছে। এবার সেটা কিছুক্ষণ এমনি রেখে দিতে হবে। ততক্ষণে ডিমভাজি হয়ে যাবে।

কাজের মধ্যে দিয়ে আবারও তার মাথায় এলোমেলো চিন্তা আসতে থাকল। মা বাবা আসার সময় যদি বৃষ্টি হয়, ওরা আসতে পারবে তো? মা বাবাকে একবার না দেখে গেলে ওর শান্তি লাগবে না। স্বরূপের কথা ভাবে সে। ওর তো বাবাও নেই, আছে এক মা। কেমন করে মা ছেড়ে একা থাকে? অবশ্য গ্রামে গিয়ে ও করবেই বা কী! শাশুড়ী মায়ের স্কুলটা না থাকলে সে নিজেই তাকে নিয়ে আসত। বাড়িতে একজন অভিভাবক থাকলে ভরসা লাগে। তাদের আর কতটুকুই যত্ন করতে হয়? বরং তারাই আরও বেশি খেয়াল রাখে ছেলেমেয়ের। অনেকের শাশুড়ী নিয়ে নানা অভিযোগ শুনে তনয়ার ভয় হতো। তার শাশুড়ীও অমন দজ্জাল হলে? কিন্তু স্বরূপের মায়ের মতো ভালো মানুষ দজ্জাল হতে পারবে কি?

ব্যথার অনুভূতি মস্তিষ্কে পৌঁছুনোর পর তনয়ার এবার হুশ ফিরল। হাত কেটে গেছে। কুঁচি কুঁচি মরিচের সাথে মিশে যাচ্ছে রক্ত!

হাত নাড়তে নাড়তে দ্রুত উঠে পড়ল সে। বেসিনের কল ছেড়ে দিয়ে হাত রাখল প্রবাহিত পানিতে। হাত ভীষণ জ্বলছে। মরিচ লেগে ছিল হাতে। চোখে পানি চলে এসেছে তার। রক্ত বন্ধ হচ্ছে না।

সে শোবার ঘরে গেল। “ফার্স্ট এইড বক্স আছে?”

“কেন?” বলতে বলতে স্বরূপ পেছনে তাকাতেই তনয়ার হাতের রক্ত চোখে পড়ল।

“কী হয়েছে?” এগিয়ে এলো সে।

“কেটে গেছে।”

স্বরূপ দেখল অনেকখানি কেটেছে। তনয়া ঠোঁট কামড়ে চোখের পানি আটকাবার চেষ্টা করছে। এই মেয়েটা এত নরম! কী করে যে এই কঠিন পৃথিবীতে সারভাইভ করবে কে জানে!

সে দ্রুত ফার্স্ট এইড বক্স বের করে আনল। রক্ত বন্ধ হলে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিল। এরপর জিজ্ঞেস করল, “তো হাতটা কাটলেন কেমন করে?”

“একা একাই কেটেছে?”

“একা একা কেমন করে কাটে? নিশ্চয়ই কিছুতে লেগে কেটেছে!”

“ছুরি।”

“কী কাটছিলে?”

“মরিচ।”

“চলো দেখি।”

রান্নাঘরে গিয়ে প্রথমেই উৎফুল্ল হয়ে উঠল স্বরূপ। আরে! খিচুড়ি তো আমার প্রিয় খাবার! কিন্তু তনয়া, তুমি পেঁয়াজ মরিচ কাটছিলে কেন?”

“ডিম ভাজতে।”

“তো ডিম ভাজি কি তোমার রক্তমাখা মরিচ দিয়ে করব নাকি নতুন করে কেটে নেব?”

“ধুর! তুমি রক্ত খাবে কেন?”

“কারন আমি ভ্যাম্পায়ার, ভুলে গেলে নাকি?”

“তাহলে ব্যান্ডেজ না করে আমার রক্তগুলো খেয়ে নিলেই পারতে।”

“আরে তা কী করে হয়? তুমি হলে আমার রিজার্ভ করা ব্লাড ব্যাংক। যখন খাদ্যের অভাব পড়বে তখন তোমাকে খাব।”

“ফালতু কথা বন্ধ করবে?”

“না, আমি যে ক’টা কথা জানি তার অধিকাংশই ফালতু। আমি কী করব?”

কথা বলতে বলতে স্বরূপ নতুন করে মরিচ কেটে ফেলল। ডিম ভাজা শেষ হলে জিজ্ঞেস করল, “তনয়া, তোমার কাছে দুটো অপশন৷ এক. চামচ দিয়ে খাবে, সেক্ষেত্রে ডিমটা আমি ভেঙে ছড়িয়ে দেব। আর দুই…..”

স্বরূপ বলছে না দেখে তনয়া অধৈর্য হয়ে জিজ্ঞেস করল, “আর দুই কী?”

“আমার হাতে খাবে।”

তময়া সবকটা দাঁত বের করে বলল, “দুই।”

“দেখো তোমাকে আমি কত যত্ন করি। সব কাজ করে দেই। তোমার বাবা মা জানলে তোমার বদলে তাদের সব প্রোপার্টি আমার নামে লিখে দেবেন।”

তনয়া চোখ কপালে তুলে বলল, “একদিন খাইয়ে দিয়ে প্রোপার্টি চেয়ে ফেলছ?”

“না না, ওসব আমার দরকার নেই। উল্টে তাদের প্রোপার্টি ফিরিয়ে নিয়ে গেলেও আপত্তি নেই।”

তনয়া মুখ কালো করে বলল, “আমি চলে গেলে তুমি খুশি হবে?”

“আমি মজা করছি তনয়া। তুমি সিরিয়াস হচ্ছো কেন?”

“কিছু মজা শুনতে ভালো লাগে না।”

তনয়া রান্নাঘর থেকে চলে গেল।

স্বরূপ একটু পর একটা প্লেটে খাবার নিয়ে তার কাছে এলো। তনয়া চুপচাপ বিছানায় বসে আছে।

স্বরূপ ডাকল, “খাবার টেবিলে এসো।”

“খাব না।”

“প্লিজ!”

“খাব না।”

“একবার খাও, দুপুরে না খেয়ে থেকো।”

“কোনোবারই খাব না।”

“বেড়াতে যাবে না?”

“না।”

“কী করবে?”

“বাড়ি চলে যাব।”

“আচ্ছা দিয়ে আসব। আগে খাও।”

“খাব না।”

স্বরূপ প্লেট নিয়ে তার পাশে গিয়ে গা ঘেঁষে বসে বলল, “খাইয়ে দিচ্ছি তো! আর তোমাকে বাড়িতে দিয়ে আসব না। এটা তো তোমারও বাসা। আমি তোমাকে ফিরিয়ে দিয়ে আসার কে বলো? নাও হা করো।”

তনয়া হা করল। খাবার মুখে নিয়ে মনে হলো, সে একটু বেশিই আহ্লাদ দিয়ে লোকটাকে মাথায় তুলেছে! কি দরকার ছিল খেয়ে নেয়ার? আরেকটু রাগ করে থাকলে আরেকটু শিক্ষা হতো!

খাওয়াদাওয়া শেষ করে তনয়া ঘর গুছিয়ে ফেলল। স্বরূপ রান্নাঘর গোছাতে গেল। তৈরি হওয়া বাদে আর কোনো কাজ নেই এখন। মা বাবা চলে আসবেন।

ফোনটা বাজল। কার ফোন? তনয়া দেখল স্বরূপের ফোন বাজছে। মা কল করেছেন।

তনয়া রিসিভ করে বলল, “আসসালামু আলাইকুম মা। কেমন আছেন?”

“ওয়ালাইকুমুস সালাম। আলহামদুলিল্লাহ আছি আম্মা। তোমরা কেমন আছ?”

“আমরাও আলহামদুলিল্লাহ ভালো।”

মা এবার আর কোনো কথা না বলে বেশ উদ্বিগ্ন স্বরেই বললেন, “স্বরূপ কই? ওকে দাও তো। অনেক জরুরি দরকার।”

“কী হয়েছে মা?”

মা ওর কথার উত্তর না দিয়ে আবারও বললেন, “স্বরূপকে দাও।”

তনয়া ছুটে গিয়ে স্বরূপকে ফোন ধরিয়ে দিল।

স্বরূপ হ্যালো বলতেই মা বললেন, “স্বরূপ তুই গ্রামে চলে আয়। আজই রওনা দে।”

“মানে? কেন? কী হয়েছে?”

“ঝামেলা হয়েছে। এত বলতে পারব না। এলে জানতে পারবি।”

“কিন্তু আজ তো…”

মা কঠিন স্বরে বললেন, “বেড়াতে পরে যাস। এখন এখানে তোকে প্রয়োজন।”

স্বরূপ বলল, “আসছি।”

সে ফোন রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মা এরকম করে বলছেন মানে ভয়াবহ কিছু হয়েছে। সেটা কী?

তনয়া ওকে ঠেলা দিল, “কী হয়েছে?”

স্বরূপের খুব খারাপ লাগছিল তনয়াকে কথাটা বলতে। বেচারি এত আশা করে আছে। কবে থেকে এই হানিমুন প্ল্যান করা! অথচ…

তনয়া ওর মুষড়ে পড়া চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গেল। বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগল, “কী হয়েছে? কোনো খারাপ খবর?”

স্বরূপ শেষ পর্যন্ত বলল, “সম্ভবত। কিন্তু কী খবর বলেনি। গ্রামে যেতে বলেছে শুধু।”

“আজই?”

“হ্যাঁ।”

তনয়ার খুব কান্না পেতে লাগল। কিন্তু সে সেটা প্রকাশ করল না। নিশ্চয়ই ভয়াবহ কিছু হয়েছে। সে জিজ্ঞেস করল, “কখন রওনা দিচ্ছি?”

“তুমিও যাবে?”

“তোমাকে একা যেতে বলেছে?”

“তা না। কিন্তু তুমি তো ঘুরে এলে সেদিনও।”

“এবার তো ঘুরতে নয়, কাজে যাচ্ছি। তুমি কি আমাকে নিতে চাও না?”

“তুমি যেতে চাইলে আমার আপত্তি নেই।”

স্বরূপ একটু পরে কী একটা কাজে বাইরে গেলে তনয়া নিজের মাকে ফোন করে আসতে নিষেধ করে দিল। মা কারন জিজ্ঞেস করতেই কেঁদে ফেলল। বেশ কিছুক্ষণ একনাগাড়ে কাঁদল সে। মা সান্ত্বনা দিয়ে গেলেন। অনেক কথা বুঝিয়ে বললেন। একটা সময় তনয়ার মন খারাপ কমে এলো। মায়ের সাথে কথা বললে সত্যিই দুঃখ কমে যায়।

এবার তার দুশ্চিন্তা হতে শুরু করল। কী হয়েছে ওখানে যে এত জরুরি তলব?

*

ট্রেনে যেতে যেতে তনয়া নির্নিমেষ চেয়েছিল অন্ধকারের দিকে। স্বরূপ ঘুমিয়ে পড়েছে। বলা চলে মাঝরাতে পুরো ট্রেন ঘুমিয়ে আছে। শুধু সে একা নির্ঘুম।

স্বরূপের হঠাৎ ঘুম ভাঙল। সে তনয়ার বিষন্ন চোখের দিকে তাকিয়ে আবারও দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ওকে এক হাতে জড়িয়ে নিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলল, “তনয়া, আমি তোমাকে খুব দ্রুত বেড়াতে নিয়ে যাব। প্রমিজ!”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-১৯+২০

0

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
১৯.

তনয়ার ঘুম ভাঙল কলিংবেলের শব্দে। সে উঠে ঝিম ধরে কয়েক মুহূর্ত বসে থাকল। তারপর ওড়না খুঁজে নিয়ে দরজা খুলতে গেল। দূরী খালা এসেছেন। দূরী খালার সাথে ওর বিয়ের পরদিন পরিচয় হয়েছিল। উনি একবেলা এসে বাড়ির সব কাজ করে দিয়ে যান। ফ্ল্যাটের একটা চাবিও ওনার কাছে থাকে।

তনয়া দরজা খুলেই হাসিমুখের দেখা পেল। খালা ঘরে ঢুকে নিজের ঘরের মতোই কাজ করতে শুরু করলেন। তিনি যখন ওদের বেডরুমের বিছানা গোছাতে গেলেন, তনয়ার খুব লজ্জা লাগল। বিছানার চাদর দেখলেই বোঝা যাবে এর ওপর দিয়ে বেশ ঝড়ঝাপটা পার হয়ে গেছে। সে তাড়াতাড়ি বলল, “খালা, রান্নাঘরের হাঁড়ি-পাতিল আপনি ধুয়ে ফেলুন। আমি এটা করছি।”

খালা নিজের মতো কিছু একটা বুঝে নিয়ে চলে গেলেন৷ তনয়া তাড়াতাড়ি বিছানা গুছিয়ে ফেলল।

দূরী খালার সাথে সাথে থেকে সে নিজের সংসারটাও চিনতে শুরু করল একটু একটু করে। প্রতিটা শোপিস, ফুলদানির ফুলগুলো আর দেয়ালে ঝোলানো পেইন্টিং দেখল সময় নিয়ে। বারান্দাগুলো একেবারে ফাঁকা। গাছ লাগানো যায়৷ ওরা দার্জিলিং থেকে এলেই এখানে গাছ গালাবে সে। কী কী গাছ লাগালে সুন্দর হবে এখন থেকেই কল্পনা করে নিল।

এর মধ্যে সকালের নাস্তা হিসেবে দুটো ব্রেড কোনোমতে খেয়ে কড়া এক কাপ কফি নিয়ে ডিভানে বসে আরাম করে চুমুক দিল। এই ফ্ল্যাটে কেমন একটা ঝিরঝিরে শান্তি আছে। তার নিজের সংসার বলেই কি সে এরকম শান্তি অনুভব করছে?

দূরী খালা এলেন। তার মুখের সাথে হাসিটা টেপ দিয়ে যেন জুড়ে দেয়া। “খালা, আজকা কী রানবাম?”

“আজকে রান্নাবান্না থেকে আপনার ছুটি খালা। আমিই রান্না করব। আপনি বরং একটু কাটাকুটি করে দিয়ে যান।”

“কী কাটতাম?”

তনয়া উঠে গিয়ে সব দেখিয়ে দিয়ে এলো। এখন শান্তির সাথে সুখ সুখ ভাবও হচ্ছে। এখন থেকে সে বাড়ির মালকিন। একটা আস্ত সংসারে তার কথামতো রান্না হবে, কাজ হবে। ভাবা যায়! তনয়ার মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। এভাবে তো আগে ভেবে দেখা হয়নি!

*

স্বরূপের খোঁটা মনে আছে তনয়ার৷ “কোনোদিন তো কিছু রান্না করে খাওয়ালে না!”

ইশ! যেন কত সময় পেয়েছে! আজ খাওয়াবে ভালো করে। দুপুরে তনয়া রান্না করেনি। গতকাল মায়ের দেখা খাবারের কিছুটা বেচে ছিল। সেগুলো খালি করে একটু টিভি দেখে বিকেলের দিকে রান্না করতে গেল।

অনেকগুলো আইটেম করল, বিশেষ করে সে যেগুলো ভালো পারে সেগুলো। গতকাল দেখেছে, স্বরূপ ভর্তা পছন্দ করে। সে তিন রকমের ভর্তা করেছে, টমেটো ভর্তা, ডাল ভর্তা আর ডিম ভর্তা৷ শিলনোড়া থাকলে আরও করতে পারত, কিন্তু জিনিসটা এই বাড়িতে নেই। ব্লেন্ডার মেশিনের ভর্তা তার একটুও ভালো লাগে না।

গরুর মাংস বিশেষ কায়দায় বেশি করে পেঁয়াজ দিয়ে ভুনা করল, সাথে খুব অল্প মসলায় রান্না করা চিংড়ি, মটরশুঁটি দিয়ে বড় মাছ, ঝাল চচ্চড়ি আর সাদা ভাত।

সব শেষে ঘরে এসে সময় নিয়ে গোসল করল সে। সুন্দর একটা জামা পরল। চোখে কাজল দিল। পারফিউম সে সাধারণত মাখে না ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার জন্য। তবে স্বামীর সামনে নিশ্চয়ই মাখা যায়! খুব সুন্দর ঘ্রাণওয়ালা সুগন্ধি উপহার পেয়েছিল সে। সেটা মেখে নিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তনয়ার মনে হলো, বিয়ে হলে মেয়েরা সুন্দর হয়ে যায় কথাটা তাহলে মিথ্যে না! তার নিজেরই নিজেকে আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি সুন্দর লাগছে!

*

অপেক্ষা শেষ হলো। স্বরূপ এলো। সারাদিনের ক্লান্তির ছাপ চোখেমুখে। গতরাতে ঘুম হয়নি সেটার প্রভাবও আছে। তনয়াকে দেখে মৃদু হেসে সে ভেতরে চলে গেল।

গোসল সেরে খানিক বিশ্রাম নেয়া হয়ে গেলে তনয়া বলল, “খাবে না?”

“হুম খুব ক্ষুধা লেগেছে। সারাদিন বলতে গেলে কিছু খাওয়া হয়নি। এত চাপ যাচ্ছে না!”

“আহারে! চলো খাবে। আমি নিজে রান্না করেছি।”

স্বরূপের মুখ উজ্জ্বল হলো। “তাই নাকি? তাহলে তো এক্ষুনি বসতে হচ্ছে!”

টেবিলে খাবারের বহর দেখে চোখ কপালে উঠল স্বরূপের। “এতকিছু!”

“হ্যাঁ। তোমার জন্য।”

স্বরূপেটা মন মায়ায় আর্দ্র হলো। মেয়েটা কত কষ্ট করেছে! সে হাত ধুতে গেল। তখনই ফোনটা বাজল।

স্বরূপ ফোন ধরতে গেল। তনয়ার একটু বিরক্ত লাগল। খেয়েও তো কথা বলা যেত। এখন নিশ্চয়ই কোনো আকাশ ভেঙে পড়েনি!

কিন্তু ওর ভুল ভাঙল। স্বরূপ ভীষণ উত্তেজিত স্বরে কথা বলছে। তনয়া দৌড়ে গেল শোবার ঘরে। স্বরূপ ততক্ষণে একটা শার্ট গায়ে চড়িয়ে ফেলেছে। ফোনে কাকে যেন বলছে, “আমি রওনা হচ্ছি।”

তনয়া ওর হাত ধরে ফেলল, “কোথায় যাবে এখন?”

“মিলির মা স্ট্রোক করেছেন৷ অবস্থা ভালো না। হাসপাতালে যেতে হবে।”

তনয়া বলল, “আমিও যাই?”

“না না, তুমি গিয়ে কী করবে? কাউকে চেনোও না। তুমি থাকো। অবস্থা ভালোর দিকে গেলেই আমি চলে আসব৷ আর কোনো অসুবিধা নেই, ভয় পেও না। এই বিল্ডিং খুবই সেইফ।”

তনয়া আর কিছু বলার খু্ঁজে পেল না। স্বরূপ চলে গেল। টেবিলের খাবারগুলো পড়ে রইল অযত্নে। খাবার মানুষ চলে গেছে।

তনয়া অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করল। স্বরূপ এলো না। কোনো ফোন করল না, ফোন রিসিভও করল না।

তনয়া যখন খাবারগুলো তুলে রাখছিল, তখন ওর চোখে পানি চলে এলো। সে সত্যিই ভীষণ যত্ন করে রান্না করেছিল!

আবার খারাপও লাগল নিজের স্বার্থপর চিন্তার জন্য। ওদিকে একজনের মা মরতে বসেছে, আর সে খাবার নিয়ে ভাবছে!

*

স্বরূপ ফিরল সকালে। ততক্ষণে অফিসের সময় প্রায় হয়ে এসেছে।

“মিলি আপুর মা কেমন আছেন?”

“ভালো না। শরীর একপাশ প্যারালাইজড হয়ে গেছে। কথাবার্তাও বন্ধ।”

স্বরূপ দ্রুত গোসল করে তৈরি হয়ে নিল। ততক্ষণে তনয়া নাস্তা বানিয়ে ফেলেছে। স্বরূপ নাস্তার টেবিলের দিকে তাকাতেই হঠাৎ মনে পড়ে গেল গতকাল তনয়া তার জন্য অনেক রান্না করেছিল। সে তনয়ার দিকে করুণ দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, “স্যরি তনয়া, কাল কিছু খেতে পারিনি৷ এখনো সময় নেই একদম।”

সে টেবিলে বসল না। শুধু সিদ্ধ ডিম এক গ্লাস দুধ দিয়ে গিলে নিয়ে দৌড় দিল।

তনয়ার মনে হয়েছিল গতদিনের মতো একটা চুমু অন্তত কপালে জুটবে! তাও হলো না।

গতরাতে ঘুম হয়নি, খাওয়াও হয়নি৷ এখন আর ভালো লাগছে না। আলস্য ভর করেছে শরীরে।

সে চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়ল। সারাটা দিন এভাবেই কাটল তার। দূরী খালা কী করছে আজ দেখলও না। সংসারের প্রতি মন কি তবে সংসার করা মানুষটার ওপর নির্ভর করে? সম্পর্ক ভালো থাকলে বস্তুগত সুখ পাওয়া যায়, না থাকলে না? কিন্তু তাদের সম্পর্ক তো খারাপ হয়নি, শুধু তনয়ার মন খারাপ হয়েছে।

*

বিকেলের দিকে রূপা এলো তনয়ার সাথে দেখা করতে। সে মূলত মিলির মাকে দেখতে এসেছিল। ওদের বাসা কাছে হওয়ায় চলে এসেছে। রূপা এসে অনেক গল্প করল। একগাদা গল্প, সব সংসারের।

যাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করল, “কেমন লাগছে তনু?”

“ভালো।”

“ভালোবাসাবাসি হচ্ছে?”

তনয়া হাসল, “হ্যাঁ হচ্ছে। কিন্তু তোমার বন্ধু এখনো ভাবে Love is just a myth!”

“ও একটা মাথামোটা।”

“ঠিক বলেছ!”

দুই বোন একসাথে হাসল।

তনয়ার মন ভালো হয়ে গেল।

রাতে স্বরূপ ফিরল, তবে কিছুক্ষণের জন্যই। আবার রওনা দিল হাসপাতালে। তবে আজ খেয়ে গেল। তনয়া গতকালের রান্নাই গরম করেছিল। কিন্তু খেয়ে স্বরূপ কোনো মন্তব্য করল না। তার মন যেন অন্য কোথাও চলে গেছে।

তনয়া অভিমানে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে বারান্দায় বসে রইল। স্বরূপের দরজা খোলার শব্দ পেয়ে চুপচাপ বিছানায় গিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। সে জেগে আছে দেখলে নিশ্চয়ই কোনো কথা বলবে। কথা বলার ইচ্ছে এখন আর তার হচ্ছে না।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
২০.

ভোরে স্বরূপ ঘুম থেকে উঠে দেখল তনয়া বারান্দায় বসে আছে চুপচাপ।

“এত সকালে উঠে গেছো যে?” প্রশ্ন করল সে।

তনয়া উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল, “নাস্তা করবে তো? কী খাবে?”

“যা বানাবে তাই।”

“পরোটা করি?”

“তোমার ইচ্ছে!”

তনয়া উঠে চলে গেল। স্বরূপ প্রতিদিন সকালে ট্রেডমিলে দৌড়ায় আধঘন্টা। কয়েকদিন হয়ে গেল নানা ঝামেলায় সেটা বন্ধ হয়ে আছে। সকাল সকাল খানিকটা এক্সারসাইজ করলে দিনটা ভালো কাটে। এক্সারসাইজ করে পরোটা খাওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু তনয়া শখ করে বানাচ্ছে যখন, সে খাবে।

স্বরূপ ব্যায়াম শেষে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে গোসলে ঢুকল। ততক্ষণে তনয়া টেবিল সাজিয়ে ফেলেছে। সে স্বরূপকে ডাকতে এসে সে দেখল স্বরূপ গোসলে গেছে। তনয়া এই ফাঁকে বিছানা গুছিয়ে ফেলল। স্বরূপ বের হলো। তার পরনে সাদা তোয়ালে বাদে আর কিছুই নেই। তনয়া একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। ইশ্ লজ্জাটজ্জা একদম নেই!

স্বরূপ খেয়াল করল তনয়া লজ্জা পাচ্ছে। সে জামাকাপড় না পরে ঘরে ঘুরঘুর করতে লাগল, ভাবটা এমন যেন খুব কাজ করছে! কিন্তু তনয়ার মধ্যে কোনো অনুভূতি দেখা গেল না। এবার সে পেছন দিক থেকে ওর খুব কাছে এসে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “কী করছো?”

স্বরূপের চুলের পানি তনয়ার ঘাড়ে পড়তেই তার শরীর শিরশির করে উঠল। কিন্তু স্বরূপের ওপর যে কষ্টটা জমা ছিল সেটা সরে গেল না। অভিমানের বরফ গলল না। সে সরে গেল ওর কাছ থেকে। বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, “এরপর কিন্তু খাবার সব ঠান্ডা হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি এসো।”

স্বরূপ কিছুটা আশাহত হলো। সে কী এমন অপরাধ করে ফেলেছে?

খেতে বসে এবার খুব প্রশংসা করল স্বরূপ। পরোটার খুব সুন্দর ভাজা হয়েছে, শেইপ পারফেক্ট হয়েছে, এত মজার পরোটা সে বহুদিন খায়নি, পরোটার সাথে যে ঝুরি ঝুরি আলুভাজি করা হয়েছে সেটাও দারুণ হয়েছে, ডিমটা পারফেক্টলি পোচ হয়েছে ইত্যাদি…

কিন্তু তনয়ার ভাবের কোনো পরিবর্তন হলো না। সেও খেতে বসেছে। চুপচাপ খাচ্ছে।

স্বরূপ এবার বলল, “অফিসে যাবে তনয়া? সারাদিন একা একা বোর হয়ে লাভ কী?”

তনয়া অবাক হয়ে বলল, “অফিসে যাব মানে?”

“মানে আমাদের অফিসে বেবী কেয়ার সেকশন আছে৷ নতুন মায়েরা তাদের ছোটো বাচ্চা নিয়ে আসে। আমি তোমাকে নিয়ে যাব। একটা অ্যাপ্লিকেশন করে দেব, অতিসত্ত্বর নিউ ওয়াইফ সেকশন খোলা হোক!”

তনয়ার হাসি পেলেও সে মুখ কোনোমতে গম্ভীর রেখে বলল, “আজ আমি ইউনিভার্সিটিতে যাব।”

“হঠাৎ?”

“তুমি কি ভুলে গেছো আমি পড়াশুনাও করি?”

“তা করো, কিন্তু এতদিন তো যাওনি। তার ওপর আগামীকাল আমাদের ফ্লাইট।”

“সেটা তো বিকেলে। আমি কিছুটা গোছগাছ করেছি। বাকিটা রাতে আর কাল দিনে হয়ে যাবে। ইউনিভার্সিটিতে যাব নোটস কালেক্ট করতে। আবার অনেকদিন গ্যাপ পড়ে গেলে নোটসগুলো পাব না। কিছু কেনাকাটাও আছে। ওখানে তো অনেক শীত। শীতের কাপড় বেশি করে নিতে হবে। ফেরার সময় মার্কেট হয়ে আসব।”

স্বরূপের যেন মনে পড়ল হঠাৎই, “আরে তাই তো! কেনাকাটা করার সময় থাকতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু আজ আবার একটা মিটিং আছে অন্য শাখায়। সেখান থেকে ফিরতে ক’টা বাজবে কে জানে!”

“সমস্যা নেই। আমিই পারব।”

স্বরূপ আর কথা বাড়াল না। থাকুক মন খারাপ করে। সে আর কী বা করতে পারে!

তবুও বের হবার আগে তনয়ার কাছে এসে কপালে চুমু খেল। তনয়া যেন একটু হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু হাসল না। দু’জনেই বিমর্ষ মুখে বিদায় পর্ব সারল।

তনয়ার ইউনিভার্সিটিতে যেতে আরেকটু দেরি আছে। সে ভাবল দুপুরের জন্য টুকটাক কিছু করে রাখবে। মন খারাপ হলে সে নিজেকে ব্যস্ত করে ফেলে, যাতে ব্যাপারটা আর মনে না পড়ে। স্বরূপ এত কথা না বলে শুধু এই দু’দিনের জন্য ছোট্ট করে ‘স্যরি’ বললেই কাজ হয়ে যেত। সে চেয়েছিল স্বরূপ বুঝুক তার কেন মন খারাপ হয়েছে। কিন্তু তা না, ফাজলামি টাইপ কথা বলে হাসানোর চেষ্টা! এসবের কোনো প্রয়োজন তো তার নেই।

*

স্বরূপের মিটিং দ্রুতই শেষ হয়ে গেল। এগারোটার দিকে রওনা দিয়ে দিল নিজের অফিসের দিকে। পথে তনয়ার ইউনিভার্সিটি পড়তেই সে সেখানে নেমে পড়ল। তনয়া হয়তো এখানেই। হাতে কিছুটা সময় আছে। ওর সাথে নাহয় শপিংয়ে যাওয়া যাবে। খওয়াদাওয়াও একসাথে করে ফেলে একেবারে লাঞ্চের পর অফিসে যাওয়া যাবে।

তনয়াকে ফোন করল সে।

“হ্যাঁ বলো।”

“কোথায় তুমি?”

“ইউনিভার্সিটিতে।”

“কী করো?”

“যা করতে এসেছি…”

স্বরূপ বলল না সে কাছাকাছিই আছে। সারপ্রাইজ দেয়া যায় একটা। সে দোকান থেকে ডেইরি মিল্ক আর কিটক্যাট কিনল। দুটোর ওপর স্টিকি নোট আটকে লিখল, “I’m sorry!”

এবার সে ক্যাম্পাসের ভেতর ঢুকল। ছোটো ক্যাম্পাস। কাউকে খুঁজে বের করতে দশ মিনিটের বেশি লাগার কথা নয়। তবে তার দশ মিনিটও লাগল না।

ক্যান্টিনেই দেখা গেল তনয়াকে। স্বরূপ দূর থেকে দেখল। একটা ছাতার নিচে বসে আছে সে। একা নয়, সাথে একটা ছেলে। দুজন কফি হাতে বসে গল্প করছে। একটু আগেও তনয়া তার সাথে দায়সারাভাবে কথা বলছিল। এই ছেলের সাথে কথা বলছে হাসিমুখে। ছেলেটা হয়তো কোনো জোক বলল। তনয়াকে দেখা গেল খিলখিল করে হাসছে। দু’জনকে দেখে দূর থেকে মনে হবে কাপল। মানিয়েছেও ভালো।

স্বরূপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সেদিকে। তার মাথা ব্যথা করতে শুরু করেছে। বহুদিন আগের ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে৷ আগেও তার সাথে এরকমই হয়েছে। তনয়াকে সে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল। ভীষণ ভরসা করে ফেলেছিল মাত্র ক’টা দিনেই। অথচ তার মনে রাখা উচিত ছিল, যেখানে কয়েক বছরের সম্পর্কে থেকেও মেয়েদের বিশ্বাস করা যায় না, সেখানে মাত্র কদিনেই একজনকে এতটা বিশ্বাস করা তার কত বড় ভুল ছিল। সে আসলে একটা গর্দভ।

স্বরূপ দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। তার মাথা ফেটে যাচ্ছে এবার। বুকের ভেতরেও অদ্ভুত শূন্যতা আর হাহাকার। তনয়ার হাসি কাঁটার মতো বিঁধছে বুকে।

সে যখন চলে যাচ্ছে, তখন কয়েক পলকের জন্য তনয়ার দৃষ্টি তার ওপর পড়ল। মুহূর্তেই তার মনে হলো এই মানুষটার এরকম মূর্তি সে আগে দেখেনি। চোখদুটো লাল হয়ে গেছে৷ ভাবভঙ্গি মারাত্মক। তনয়া কয়েক মুহূর্ত হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল।

তার পাশে এতক্ষণ জিমি বসেছিল। জিমি ওর সাথেই অনার্স করেছে। খুব ভালো স্টুডেন্ট। একই সাথে দুর্দান্ত হিউমার। ওর সাথে কথা বলে কেউ না হেসে থাকতে পারে না। আবার ছেলেটার মন একইসাথে খুবই স্বচ্ছ। তনয়ার সাথে তার শুরু থেকেই ভালো বন্ধুত্ব। এখন ওর কাছ থেকেই তনয়া সব নোট, সাজেশন জোগাড় করে। আজও সেজন্যই এসেছিল৷ কিন্তু তনয়ার মন খারাপ দেখে জিমি কাজের চেয়ে বেশি কথা বলছিল। তাকে হাসানোর চেষ্টা করছিল৷ জিমির মতো মানুষেরও অনেকটা সময় লেগে গিয়েছিল তনয়াকে স্বাভাবিক করতে। কিন্তু আচমকা কী হয়ে গেল জিমিও বুঝল না।

তনয়া ব্যাগ, বইপত্র ফেলে কোনোকিছু না বলেই একদিকে ছুটে গেছে। চোখের পলকেই কোথায় যেন হারিয়ে গেল। কাউকে দেখেই গেছে সম্ভবত। কিন্তু কে সেটা বোঝেনি।

তনয়া যখন গেটের কাছে এসেছে, তখন স্বরূপ একটা সিএনজিতে চড়ে বসেছে। তনয়ার দিকে সে আর ফিরেও তাকায়নি। তনয়া অনেকবার ডাকল, স্বরূপ শুনেও শুনল না। সে ফোন করতে গিয়ে দেখল ফোন ফেলেই এসেছে। আবার ফিরে গেল সে। জিমি পেছন পেছন আসছিল। সে জিজ্ঞেস করল, “কী হলো তোর হঠাৎ করে?”

“পরে বলব।” তনয়া দ্রুত ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে গেল। কিন্তু কোথায় যাবে বুঝতে পারল না। তার তখনো স্বরূপের এরকম কান্ডের ব্যাখ্যা মাথায় ঢোকেনি। সে কি ওর অফিসে যাবে? কিন্তু যদি দেখা না করে? যদি অপমান করে?

তনয়া কিছুক্ষণ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগল। তারপর ভাবল বাসায় ফিরে যাবে।

যাবার পথে অনেকবার সে স্বরূপকে কল করল। কিন্তু প্রতিবারই স্বরূপ ফোন কেটে দিল। একসময় ফোনটা বন্ধ পাওয়া গেল।

বাড়ি ফিরে গোসল করতে ঢুকলে মাথাটা একটু ঠান্ডা হলো তনয়ার। শাওয়ারের পানি ঝরঝর করে তার মাথায় পড়ছিল। তখনকার দৃশ্যটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। স্বরূপকে দেখার আগে সে জিমির কথা শুনে হাসছিল। এটাই কি তবে স্বরূপের খারাপ লাগল? কিন্তু এত ছোটো একটা বিষয়ে কেন সে রাগ করবে? তারও তো বন্ধু আছে। সেবার গ্রামে গিয়ে সে যে পুরো বিকেল মিলি আপুর ছবি তুলে দিল তাতে কি তনয়া কিছু বলেছে? নাকি রাগ করেছে? ওরাও তো গল্প করে, হাসাহাসি করে। তাতে সমস্যাটা কোথায়? এই বাড়াবাড়ির কারন কী?

গোসল করে বের হয়ে তনয়া অনেকক্ষণ কাঁদল। কিছুই ভালো লাগছে না। এলোমেলো ভাবতে ভাবতে একসময় তার সব রাগ গিয়ে পড়ল রূপার ওপর। ওর জন্যই এসব হচ্ছে!

সে রূপাকে ফোন করে ইচ্ছেমতো ঝাড়ল। যা মনে এলো সব বলল। রূপা চুপচাপ শুনে গেল। সবটা শোনার পর তনয়া যখন চুপ হলো তখন রূপা বলল, “তোর আর স্বরূপের মানসিকতা তো আর একরকম হবে না রে…”

“কেন হবে না? এত ছোটো মনের কেন হবে একটা মানুষ? এত সন্দেহপ্রবন লোকের সাথে আমি কিভাবে সারাজীবন থাকব বলো?”

রূপা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “তনু, তুই পুরো ব্যাপারটা আরেকবার ভেবে দেখ। তোর সাথে কিন্তু এর আগেও দুটো ইন্সিডেন্ট হয়েছে। রেলস্টেশনে একটা, আর গ্রামে গিয়ে একটা। গ্রামের ঘটনাটায় স্বরূপ তোকে ব্লেম করতে পারত। কিন্তু করেনি, প্রতিবাদ করেছে৷ তোকে ও কোনো রেস্ট্রিকশনও দিয়ে রাখেনি। ও কি তোর ফোন চেক করে? ফেসবুকের পাসওয়ার্ড চায়?”

“না।”

“তাহলে বোঝ! ও তোকে সন্দেহ করে না। কখনো করেনি। তুই ওর সাথে সকালে রাগ দেখিয়েছিস, ও হয়তো তোর রাগ ভাঙাতেই গিয়েছিল, কিন্তু গিয়ে দেখেছে তুই দিব্যি হাসিখুশি আছিস অন্য এক ছেলের সাথে। ব্যাপারটা উল্টোভাবে তোর সাথে ঘটলে তুইও কিছুটা রিয়েক্ট করতি। আর ওর ব্যাপারটা কিছুটা হলেও আলাদা। ওর একটা পাস্ট আছে, যেটা ওকে খুব ডীপলি এফেক্টেড করে রেখে গেছে।”

রূপা একটু থেমে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলল, “আমি জানি ব্যাপারটা খারাপ হয়েছে, কিন্তু তবুও বলব, স্বরূপ ছোটো মনের না। এটা শুধুই একটা ভুল বোঝাবুঝি।”

তনয়া ঝাঁঝালো সুরেই বলল, “তুমি সবসময় বন্ধুর পক্ষেই কথা বলো। তোমাকে কিছু বলাটাই ভুল। তুমি ওর পক্ষের উকিল, আমারটা বুঝবে কেন?”

সে রূপাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন রেখে দিল। ইচ্ছে করছে বাড়ি চলে যেতে। কিন্তু একটা কিছু মিমাংসা না করে যাওয়াটা কি ঠিক হবে?

*

স্বরূপ দেরিতে ফিরল। ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। সারাদিন সে মাথাব্যথা নিয়ে অনেক কষ্টে কাজ করেছে। এখন আর টিকতে না পেরে ফিরে এসেছে। আর যাওয়ার জায়গাও নেই। বাড়িটা তার একার আস্তানা ছিল৷ এখন যে এসে জুটেছে তার ওপরেই তার রাগ। বিরক্ত লাগছে সব মিলিয়ে।

সে কিছুক্ষণ বেল বাজাল। দরজা খুলল না। বিরক্ত হয়ে চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঢুকে গেল সে। সব লাইট জ্বালানো। সে কোথায় ঘাপটি মেরে পড়ে আছে কে জানে!

সব ঘর, বাথরুম খুঁজল স্বরূপ। পেল না কোথাও। তনয়া গেল কোথায়? আজব তো! হাওয়া হয়ে গেল নাকি?

শেষ পর্যন্ত তনয়াকে পাওয়া গেল বারন্দায়। তাও ওদের বেডরুমের নয়, সবচেয়ে কোণার ঘরটার বারান্দায় মেঝেতে শুয়ে আছে সে। বারান্দার আলো জ্বালাল স্বরূপ। তনয়া চোখ খুলল না। স্বরূপ উদ্বিগ্ন হয়ে ওর কাছে এসে বসল। শ্বাস চলছে ওর। মুখটা মলিন। চোখে কান্নার দাগ লেগে আছে। বারান্দায় প্রচন্ড মশা। একেকটা তনয়ার গায়ে বসে রক্ত খেয়ে ফুলেফেঁপে আছে।

স্বরূপ ওর কাঁধ ধরে ঝাঁকাল, “তনয়া! অ্যাই! কী হয়েছে তোমার?”

তনয়া উঠে কয়েক মুহূর্ত কিছু বুঝতে পারল না। সব মনে পড়তে একটু সময় লাগল তার৷ সন্ধ্যার দিকে ভীষণ খারাপ লাগায় এখানে এসে বসেছিল। ভালো বাতাস দেয় এই বারান্দায়। তারপর হঠাৎ কান্না পেতে থাকল তার। কাঁদতে কাঁদতে কখন শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেও জানে না। দুপুরে খায়নি বলে শরীর আরও ক্লান্ত হয়েছিল।

স্বরূপ ওর দিকে তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে, “কী হয়েছে বলবে তো?”

তনয়া কয়েক মুহূর্ত স্বরূপের দিকে তাকিয়ে থেকে আচমকা তার বুকে সজোরে ধাক্কা দিল। স্বরূপ অপ্রত্যাশিত আক্রমনে সামলাতে না পেরে মেঝেতে পড়ে গেল। সে হা করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “সমস্যা কী?”

তনয়ার রাগ তখন মাথায় চড়ে গেছে। সে চিৎকার করে বলল, “তোমার সমস্যা কী? তোমার কি মনে হয় আমি সস্তা মেয়ে? আমি তোমাকে রেখে আরেকজনের সাথে ডেট করতে গেছি? আমার সাথে এরকম কেন করলে তুমি? এত ছোটোলোক কেন তুমি? তোমারও তো বন্ধু আছে, যাদের জন্য নিজের বউকে একা রেখে রাত বিরাতে ছুটে যাও, আমি কিছু বলেছি? কোনোদিন সন্দেহ করেছি? তাহলে আমার সাথে কেন করলে? এত খারাপ ব্যবহার কেউ আমার সাথে কোনোদিন করেনি৷ কেউ আমাকে এত কষ্ট দেয়নি। এত কাঁদায়নি। তুমি একটা জঘন্য লোক! একটা…”

তনয়া আর বলতে পারল না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। তার সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়েছে তার চরিত্র নিয়ে সন্দেহ করায়। এটাও কেউ করতে পারে? সে কি স্বপ্নেও ভাবতে পারে ধোঁকা দেবার কথা?

তনয়ার লাল টকটকে মুখ, ফুলে ওঠা নাক, চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া পানি আর ওর দুঃখে ভেঙে আসা চেহারা দেখে স্বরূপের মন ক্রমশ তরল হয়ে এলো। আফসোস হতে লাগল তার। খুব ভুল হয়ে গেছে। সরল মনের একটা মানুষকে সে অনেকটা কষ্ট দিয়ে ফেলেছে৷

তনয়ার জন্য তার এত মায়া লাগল! তনয়ার কাছে এগিয়ে গেল সে। কাঁধে হাত রাখল। তনয়া এক ঝটকায় হাত সরিয়ে দিল। একবার, দুবার, তিনবার…

স্বরূপ এবার জোর করেই দুই হাতে তার মুখটা তুলল। চুমু খেল ঠোঁটে। ভীষণ আবেগে, অনেকটা সময় নিয়ে। বুঝিয়ে দিতে চাইল, সে অনুতপ্ত।

তনয়াও নরম হয়ে এলো, যখন সে বুঝল অশ্রুকণা শুধু তার চোখ দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে না।

শহরটা হঠাৎ তার সব কোলাহল থামিয়ে দিয়েছে। মেঘের আড়ালে এতক্ষণ চাঁদটা ঢেকেছিল। এখন মেঘ কেটে গেছে। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে বারান্দা। ধুয়ে দিচ্ছে সব গ্লানি, অভিমান আর মনখারাপের দিন।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-১৭+১৮

0

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
১৭.

তনয়ার ঘরের বিশাল বুকশেলফটা মনোযোগ দিয়ে দেখছিল স্বরূপ৷ শেষে মন্তব্য না করে থাকতে পারল না সে, “তোমার বইয়ের কালেকশন তো দারুণ!”

তনয়া হাসল। “হ্যাঁ, ছোটোবেলা থেকে জমিয়েছি সব।”

“বই পড়তে ভালোবাসো বুঝি?”

“খুব!”

“আগে তো বলোনি।”

“সময়টা কোথায় পেলাম?”

স্বরূপ বই দেখতে লাগল। আহমদ ছফার বইগুলো দেখে বলল, “এগুলো সব পড়েছ?”

“হ্যাঁ!”

“কেমন লাগে?”

“দারুণ! আমার পছন্দের লেখক।”

স্বরূপ একটু অবাক হয়ে তাকায়৷ তারপর বলে, “আমার মনে হতো মেয়েরা আহমদ ছফা বোঝে না।”

তনয়া ভুরু কুঁচকে বলল, “এর মানে কী? বুঝবে না কেন? মেয়েদের মাথায় কি ঘিলু কম?”

“ঠিক সেটা না..” স্বরূপ কথা ঘোরাল, “আমার আসলে ধারণা ছিল মেয়েরা শুধু প্রেম ভালোবাসার গল্প পড়ে, যেমন শরৎচন্দ্র, কিংবা হুমায়ূন..”

“হুহ…” হাত উল্টে তনয়া বলল, “মেয়েরা সবই পড়ে। পাঠকদের মধ্যে মেয়ে পাঠকই বেশি বুঝলে? এত যে জ্ঞান দিচ্ছো, তোমার নিজের বাড়িতে তো বইয়ের চিহ্নও দেখলাম না।”

“বই পড়ি না অনেকদিন।”

“কেন?”

“ইচ্ছে করে না। ব্যস্ততায় বই পড়ার ইচ্ছে মরে গেছে।”

বলতে বলতে সে ড্যান ব্রাউনের ‘ইনফার্নো’ বইটা টেনে নিয়ে বেতের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসল।

“পড়বে এখন?”

“হুম। এটা অনেক আগের পড়া। খুব পছন্দের ছিল, কিন্তু ভুলে গেছি৷ আরেকবার পড়াই যায়।”

তনয়া খুশি হয়ে বলল, “আচ্ছা পড়ো।”

“তুমি খুশি হচ্ছো কেন?”

“আমার খুব ইচ্ছে ছিল আমার বরও বই পড়বে। তারপর একসাথে বই কিনব, পড়ব, আলোচনা করব।”

স্বরূপ হেসে বলল, “বইপড়া ছেলের অভাব পড়ে গিয়েছিল বুঝি?”

“মানে?”

“এইযে আমাকে বিয়ে করে ফেললে?”

“তোমার সাথে কপালে লেখা ছিল।”

স্বরূপ বাঁকা হাসল। কিছু বলল না। তনয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমি কি তোমাকে খুব বিরক্ত করছি?”

স্বরূপ বই থেকে চোখ না তুলে বলল, “গানের সুরে প্রশ্নটা করো, তাহলে উত্তর দেব।”

তনয়া একটা কুশন ছুঁড়ে মারল স্বরূপের মুখে। তারপর উঠে চলে গেল। স্বরূপ কুশনটা বুকে জড়িয়ে বই পড়ায় মনোযোগ দিল।

কিছুক্ষণ পর তনয়া দুই কাপ কফি নিয়ে ফিরল। একটু আগে সকালের নাস্তা সেরেছে তারা। আজ অনেক রান্নাবান্না হবে। মা আগে থেকেই পাশের বাড়ির ছুটা বুয়া বিনু খালাকে বলে রেখেছিল তাকে একবেলা কাজ করে দিয়ে যেতে হবে। আর ওদের গৃহপরিচারিকা তো আছেই। মা তনয়াকে বললেন তাকে কোনো সাহায্য করতে হবে না। সে স্বামীকে সঙ্গ দিতে পারে।

তনয়া একটু লজ্জা পেয়েই চলে এসেছে।

স্বরূপ কফির কাপ হাতে বলল, “তুমি বানিয়েছ?”

“না, মা বানিয়েছে।”

“তুমি কি রান্নাবান্না পারো না?”

তনয়া একটু অবাক হয়ে বলল, “পারব না কেন?”

“কখনো খাওয়ালে না তো।”

“আশ্চর্য তো! সুযোগ পেলাম কখন?”

“তাই তো! তাই তো!”

স্বরূপে আরও কিছু অসংলগ্ন কথা বলে গেল বই পড়ার ফাঁকে ফাঁকে। তার প্রধান মনোযোগ রইল বইতে। তনয়াও একটা বই নিয়ে বসেছে, পশ্চিমবঙ্গের লেখকের বই। খুব নামডাক হয়েছে বইটার। এটা নিয়ে সিরিজও তৈরি হয়েছে। ইন্দুবালা ভাতের হোটেল। সেই কবে কিনে রেখেছিল তনয়া। আজও পড়া হয়নি।

পড়তে শুরু করে তনয়ার খুব মজা লাগতে শুরু করল। কত রকমের রান্নার বর্ণনা আর সাথে এগিয়ে যাওয়া ইন্দুবালার জীবনের গল্পটা! এক পর্যায়ে তনয়ার চোখে পানি চলে এলো। সে বই বন্ধ করে অন্যদিকে তাকাতেই দেখল স্বরূপ চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বুজে আছে। ওর মুখে এত গভীর বিষাদের ছায়া সে আগে দেখেনি। কিসের এত বেদনা তার?

স্বরূপ অনেকক্ষণ পর চোখ খুলল। তার চোখ লাল। তনয়ার দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে বলল, “ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।”

তনয়া জানে, ও ঘুমায়নি। এইমাত্র একটা মিথ্যে বলল। সে কি এত কাছে থেকেও মানুষটাকে স্পর্শ করতে পারছে না?

বইটা শেলফে রেখে দিয়ে বারান্দায় চলে গেল স্বরূপ। তনয়াও আর কিছু পড়তে পারল না। একটা দীর্ঘশ্বাস ঝুলে রইল ঘরে।

*

দুপুরের খাবারটা জমজমাট হলো। এত পদ দেখে স্বরূপের মাথা ঘুরে যাবার জোগাড়! সে হেসে বলল, “আন্টি, এত পদ দিয়ে আমি জীবনেও খাইনি। এসব এক মাস ধরে খাওয়া যাবে।”

তনয়ার মা হাসিমুখে বললেন, “বিসমিল্লাহ বলে শুরু করো, আজকেই খেতে পারবে।”

স্বরূপ মনে মনে ইন্না-লিল্লাহ পড়ল।

খাবে না খাবে না করেও সে কম খেল না৷ তনয়া খেয়াল করল স্বরূপ বেশ আরাম করে খাচ্ছে। মা আর বাবার যত্নটা সে উপভোগ করছে। ওর চোখেমুখে সকালকার সেই বিষাদের ছিটেফোঁটাও নেই। কী প্রাণবন্ত হাসি! মানুষটা ভালোবাসা ভালোবাসে। তাহলে তাকে কেন নয়? সে কি ভালোবাসতে পারছে না? নাকি তার ভালোবাসা মানুষটাকে স্পর্শ করছে না?

*

সন্ধ্যার দিকে ওরা রওনা দিল নিজেদের বাসায়। মা সাথে খাবারদাবার দিয়ে দিয়েছেন। তনয়ার জিনিসপত্র তো আছেই। স্বরূপ সব জিনিস গাড়িতে তুলতে তুলতে বলল, “তোমাকে নিয়ে বাসা বদলাতে হলে আমার খবর হয়ে যেত। ভাগ্যিস নিজের ফ্ল্যাটে থাকি।”

তনয়া কিছু বলল না। দন্ত বিকশিত হাসি উপহার দিল।

বাড়িতে পৌঁছে তনয়া বড় করে একটা নিঃশ্বাস নিল। যদিও বিয়ে করে এখানেই সে এসেছিল, তবুও এই প্রথম তার মনে হলো এই তো তার সংসার। তার বর্তমান ঘর। নিজের ঘরের মতো শান্তি লাগছে। এর আগে মা চাচীরা থাকায় ভালো করে দেখতে পারেনি তনয়া। আজ ঘুরে ঘুরে সব দেখল। চারটা বেডরুম, সবগুলোই সুন্দর করে সাজানো। রান্নাঘরটা দুর্দান্ত বলা যায়! পুরোটা ঝকঝক করছে। বসার ঘরটা বড়। একপাশে বিশাল জানালায় হালকা রঙের মসৃন কাপড়ের পর্দা টানা। পর্দা সরিয়ে দিতেই আলোজ্বলা শহরের বড় একটা অংশ যেন উন্মুক্ত হলো চোখের সামনে।

সে মনে মনে স্বরূপের রুচির প্রশংসা না করে পারল না। স্বরূপের কথা মনে হতেই নিজেদের বেডরুমে উঁকি দিল সে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে কার সাথে যেন। সে পেছন থেকে গিয়ে জড়িয়ে ধরল স্বরূপকে। স্বরূপের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না। সে ধীরেসুস্থে কথা শেষ করে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “কী হয়েছে?”

“বাসাটা এত সুন্দর করে সাজিয়েছ তুমি! আমি ইম্প্রেসড!”

“তোমাকে ইম্প্রেস করতে তো সাজাইনি।”

তনয়া একটু অপমানবোধ করে বলল, “তা জানি। কিন্তু কাকে ইম্প্রেস করতে সাজিয়েছ শুনি?”

“নিজেকে।” ছোট্ট উত্তর দিল স্বরূপ।

তনয়া ওর কথা কানে নিল না। মাঝেমধ্যে লোকটাকে বিরক্তিকর লাগে। সে জিনিসপত্র একটু একটু করে গোছাতে শুরু করল। স্বরূপের ডাক শুনে একটু পরে উঠে পড়ল। বসার ঘরে গিয়ে দেখল সে দুই কাপ চা বানিয়ে সাজিয়ে রেখেছে। তনয়া যেতেই বলল, “লাইট অফ করে দিয়ে এসে বসো।”

“অন্ধকারে চা খাবে?”

“অফ করো আগে তারপর দেখো কী হয়।”

তনয়া লাইট বন্ধ করে মুগ্ধ হয়ে গেল। বিশাল জানালা দিয়ে চাঁদের আলো গলগল করে ঢুকে যাচ্ছে। আজ বোধহয় পূর্ণিমা। রূপার থালার মতো চাঁদটা আকাশে বসে বিলিয়ে দিচ্ছে সব রূপ।

স্বরূপ জিজ্ঞেস করল, “চা খেতে অসুবিধা হবে?”

“নাহ।” সে পাশে গিয়ে বসে চায়ের কাপ তুলে নিল।

বেশ কিছুক্ষণ নিরবতার পর স্বরূপ বলল, “আজকে যে বইটা পড়তে নিলাম তার সাথে কিছু স্মৃতি জড়িয়ে ছিল। সেজন্যই কিছুটা অন্যমনষ্ক হয়ে পড়েছিলাম সকালে।”

তনয়া মনে মনে বলল, “অন্যমনষ্ক না, কথাটা হবে আবেগী। কিন্তু আপনাকে তো তা বলা যাবে না। বললে বলবেন আপনার আবেগ টাবেগ কিছু নেই।”

স্বরূপ বলে গেল, “ওটা আমাকে একজন উপহার দিয়েছিল জন্মদিনে। পড়ার পর তার সাথে লম্বা আলোচনা হয়েছিল। তোমার বইটা অনুবাদ হলেও আমি পড়েছিলাম ইংরেজিতে। সে ইংরেজি সাহিত্য পছন্দ করত। ছাত্রীও ছিল ইংরেজি সাহিত্যের। ওর জন্যই অনেক বই পড়েছিলাম। চলে যাবার পর আর পড়িনি।”

তনয়া চুপ করে শুনল শুধু। আবার কিছুক্ষণ নিরবতা।

স্বরূপই ফের কথা শুরু করল, “ও সবসময় সেই টিচারের কথা বলত। তার গলায় পোয়েট্রি শুনলে নাকি পাগল পাগল লাগে। আমার রাগ হতো, অভিমান হতো। কিন্তু বুঝিনি মানুষটাই আমার নেই।”

তনয়া স্বরূপের একটা হাত ধরল। একসময় মৃদু স্বরে জিজ্ঞেস করল, “তুমি এখনো ওকে ভালোবাসো?”

স্বরূপ তনয়ার হাতটা আঁকড়ে ধরল। হাত কাঁধে মাথা রেখে বলল, “না তনয়া, ভালোবাসি না। তবে সবটা ভালোবাসা আর বিশ্বাস তার জন্য একটা কাচের জারে জমিয়ে রেখেছিলাম। জারটা ভেঙে গেছে। আমার সব বিশ্বাস আর ভালোবাসা ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। আমার সেই ভালোবাসার টুকরোগুলোর জন্য কষ্ট হয়। কাউকে বিশ্বাস করতে না পারার জন্য কষ্ট হয়। তার দেয়া অপমানের জন্য কষ্ট হয়। আমি ভুলতে পারি না সেসব। তুমি বুঝবে না তনয়া। এতটা বিশ্বাসঘাতকতা চাইলেই ভোলা যায় না।”

তনয়া বুঝল, তার কাঁধ ভিজে যাচ্ছে। স্বরূপ কাঁদছে। ওর ভেতরটা কষ্টে মুচড়ে যাচ্ছে। তবুও তার মাঝে একটা স্বস্তি টের পাচ্ছে সে। ভালোবাসা না থাকুক, স্বরূপ তাকে ভরসা করতে শুরু করেছে। আপন ভাবতে শুরু করেছে। নয়তো এসব কথা তাকে বলত না। তার কাঁধে মাথা রেখে কাঁদতও না।

তনয়া চুপচাপ স্বরূপের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকল যতক্ষণ না তার কান্না থেমে যায়। একসময় সে নিজেই সামলে নিয়ে উঠে বসল। ধরা গলায় জিজ্ঞেস করল, “তোমার খুব খারাপ লেগেছে এসব শুনতে তাই না?”

তনয়া সেই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল, “তুমি আমাকে সব বলতে পারো। যা মনে আসে সব বলে দিলে তুমি হালকা হবে। তোমার মনও। আমি তাতেই খুশি হব।”

স্বরূপ এবারও হাসার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলো। তার অপরাধবোধ হচ্ছে কিছুটা। তনয়ার জায়গায় অন্য কেউ হলে ঝগড়া করত প্রাক্তনের কাহিনী শুনে। আর এই মেয়ে তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে। সে মনে মনে বলল, “তনয়া, তুমি এত আলাদা কেন? তুমি এত ভালো কেন?”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
১৮.

তনয়া যখন চিৎকার করে জেগে উঠল তখন ঘড়িতে আড়াইটা বাজে। ওর চিৎকারের শব্দে ঘুম ভেঙে গেছে স্বরূপের। সে তড়িঘড়ি করে উঠে বসে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে দিল। তনয়া তখন জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। ভয়ানক একটা স্বপ্ন দেখেছে সে।

স্বরূপ তার কাঁধে হাত রেখে বলল, “তনয়া, ঠিক আছো?”

তনয়া একটু ধাতস্থ হলে উত্তর দেয়, হ্যাঁ।”

স্বরূপ তাকে পানির গ্লাস এগিয়ে দিল। জিজ্ঞেস করল, “খারাপ স্বপ্ন দেখেছিলে?”

তনয়া স্বপ্নটা মনে করতে চায় না। পরপর দুটো ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হয়েছে তার৷ একবার স্টেশনে আরেকবার গ্রামে। দুটো মিলে বিভৎস এক স্বপ্নের রূপ নিয়েছে। সে সব ভুলে থাকতে চায়, এমনিতে অনেকটা ভুলে থাকেও, কিন্তু অবচেতন মন বলেও একটা জিনিস আছে! সে ভোলে না।

তনয়া পানিটা এক চুমুকে শেষ করে বলে, “হাবিজাবি স্বপ্ন দেখেছি।”

স্বরূপ আর স্বপ্নের কথা তোলে না। বলে, “শুয়ে পড়ো। লাইট অফ করব?”

তনয়া একটু বিরক্ত হয়েই বলে, “তোমার এত লাইট অফ করতে ইচ্ছে হয় কেন বলবে? একটু আলো থাকলে কী হয়?” বলতে বলতে তনয়ার চোখে পানি চলে এলো।

স্বরূপ অবাক হয়ে বলল, “আমি কি কাঁদার মতো কিছু বলেছি? এরকম রিয়েক্ট করছো কেন মাঝরাতে?”

তনয়া এবার উত্তরই দিল না। বিছানা থেকে উঠে বেরিয়ে গেল। পাশের খালি ঘরে আলো জ্বেলে বসে রইল। তার ইচ্ছে করছে না কোনো কথা বলতে। বরং ভয় করছে। বুক কাঁপছে। বারবার স্বপ্নে দেখা কালো রোমশ হাতের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। একা ঘরে তার আরও ভয় করতে লাগল। কিন্তু স্বরূপের ওপরও রাগ হচ্ছে। রাতে একটা মানুষ ভয় পেয়ে জেগে উঠলে এরকম কড়া সুরে কথা বলবে কেন? তনয়ার সাথে কেউ কোনোদিন জোরে কথা পর্যন্ত বলেনি। তার এবার সত্যিই ভীষণ মন খারাপ লাগতে শুরু করল। সাথে ভয় তো আছেই। চোখের পানি বাঁধ মানতে চাইছে না৷ একসময় সে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল।

*

তনয়া চলে যাবার পর স্বরূপ কিছুক্ষণ হতভম্বের মতো বসে থেকে শেষে শুয়ে পড়ল। রাত দুপুরে মেয়েদের ন্যাকামি সহ্য করতে পারবে না বলেই সে বিয়ে থা করতে চায়নি। শখ করে এই মেয়েই তাকে বিয়ে করেছে। সামান্য কথা সহ্য করতে না পারলে সারাজীবন মা বাবার পুতুপুতু কন্যা হয়ে থাকা উচিত ছিল!

শুয়ে অনেকক্ষণ এপাশ ওপাশ করল স্বরূপ। ঘুমটা হাওয়া হয়ে গেছে। তারচেয়েও বেশি হাওয়া হয়েছে তার বুকের ভেতরটা। খারাপ লাগা জমা হচ্ছে একটু একটু করে। আশ্চর্য তো! সে মেয়েটার ওপরে বিরক্ত হলে তার জন্যই আবার খারাপ লাগবে কেন? যত্তসব বাজে অনুভূতি!

মোবাইলটা টেনে নিল সে। ফেসবুকের পাতা খুলে বসল। আজকাল এই এক জিনিস পৃথিবীর সব ভুলিয়ে দিতে পারে। কত হাসি-ঠান্ডা, বিনোদনে ভর্তি এই জগত! স্বরূপের বড় কঠিন সময়ে এই ফেসবুকিং করে সে লম্বা সময় কাটিয়ে দিত। পরে অবশ্য আরও বেশি হতাশ লাগত, তবুও সময় তো কেটে যেত!

আজ কাটল না। অনেকক্ষণ নিউজফিডে ঘোরাঘুরি করেও সে দেখল ঘড়ির কাটায় অতিবাহিত হয়েছে মাত্র পনেরো মিনিট! অথচ সাধারণত উল্টোটা হয়।

সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, তনয়ার সাথে যে লাইট নিয়ে কথা কাটাকাটি হলো সেই লাইট সে তখন থেকে জ্বালিয়েই রেখেছে, বন্ধ করেনি!

স্বরূপ শেষ পর্যন্ত উঠে বসল। নিজেও বুঝতে পারল না কখন সে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে আর কখন পায়ে পায়ে পাশের ঘরে চলে গেছে।

তনয়া তখনো কাঁদছে। তার জামার সামনের অংশ ভিজে গেছে চোখের পানিতে। স্বরূপের এবার সত্যিই দুশ্চিন্তা হতে লাগল। সে পাশে বসে তনয়ার মাথায় হাত রেখে বলল, “তনয়া, অ্যাই তনয়া…কী হয়েছে তোমার? খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছিলে? নাকি আমার কথায় কাঁদছ? পাগল নাকি তুমি? তনয়া…”

তনয়া মুখ ঘুরিয়ে রাখল। স্বরূপ নরম সুরে কথা বলায় তার অভিমান উপচে পড়ছে। উহু, গলে পড়বে না সে। যদিও রাগ বা অভিমান কোনোটাই দীর্ঘমেয়াদে তার মনে বসে থাকে না। একা একাই উড়ে চলে যায়৷ তার ওপর এখন একজন বসে বাতাস দিচ্ছে!

স্বরূপ হাত দিয়ে চেপে তনয়ার মুখটা ঘোরানোর চেষ্টা করল। তনয়া শক্ত হয়ে রইল। সে এবার উল্টোপাশে গিয়ে বসল। তনয়া সাথে সাথে মুখ ঘুরিয়ে নিল। এবার তার হাসি পাচ্ছে। “কী মুশকিল! এইমাত্র যেসব কান্না ভেতর থেকে বানের স্রোতের মতো ভেসে আসছিল সেসব কোথায় গেল?” নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করল তনয়া। “না রে তনয়া, তোর দ্বারা কিচ্ছু হবে না। তুই একটা চরম বোকা। ইমোশনাল ফুল! না না, আবেগী বেকুব!”

স্বরূপ এদিকে সত্যিই ঘাবড়ে গেছে। সহজ একটা মেয়ে এরকম করছে কেন? গভীর দুঃখ পেয়েছে? সে তো এত কঠোর ব্যবহার কখনো করে না। বরং ওর নরম স্বভাবের জন্য যথাসম্ভব নমনীয় হওয়ার চেষ্টা করে।

স্বরূপ এবার তনয়াকে জোর করে উঠিয়ে কোলে তুলে নিল। রওনা দিল নিজের ঘরের দিকে।

তনয়া প্রথমে চমকে গিয়েছিল। স্বরূপের কোলে চড়ে তার ভারি মজা লাগল। হাসিও পেয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু অনেক কষ্টে হাসি আটকে মুখটা গম্ভীর করে রাখল সে। হয়তো একটু বেশিই অভিনয় হয়ে গিয়েছিল। স্বরূপ ওকে কোলে রেখেই জিজ্ঞেস করল, “তনয়া তোমার কি বাথরুমে যাওয়া প্রয়োজন?”

তনয়া আর পারল না, হেসে ফেলল। স্বরূপ চোখ বাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কাহিনী কী?”

তনয়া এবার স্বরূপের গলা জড়িয়ে ধরে স্বাভাবিক সুরেই বলল, “কিছু না। আমার খুব খারাপ লাগছিল। তুমি মন খারাপ ভালো করে দিয়েছ।”

“আমার জন্যই তো মন খারাপ হয়েছিল।”

“পুরোটা তোমার দোষ নয়। স্বপ্নও তো দেখেছিলাম। কিন্তু তুমি বলো, আর এরকম করে কথা বলবে না? আমার কষ্ট হয়।”

“কিরকম করে?”

“এইযে ধমক দিয়ে…”

“তুমি বয়সে কত ছোটো, একটু আধটু ধমক নাহয় খেলে..”

“না। একটুও না। আমি কোনো ধমক চাই না।”

“কী চাও?” স্বরূপ এবার খানিকটা তরল গলায় বলল।

তনয়া কথা বলল না। তার আবারও হাসি পাচ্ছে। সে বুঝে গেছে, চাইলেও কোনোদিন এই মানুষটার সাথে সে রাগ করে থাকতে পারবে না। ওর মুখ দেখে সব অপরাধ ক্ষমা করে দিতে পারবে। একটু আহ্লাদ করলে নিজেকে মেলে দিতে ওর একটুও সময় লাগবে না। এরকম বিধ্বংসী অনুভূতির কি কোনো মানে হয়?”

ওর ঘোর লাগা চোখের দিকে তাকিয়ে স্বরূপের মনে হলো, মেয়েটা পাগল হয়ে গেছে। সে তো তাবিজ কবচ করেনি৷ এত পাগল হওয়ার কী কারন?

“তুমি কি আজকে আমাকে নামাবে না?” বলতে বলতে খিলখিল করে হেসে ফেলল তনয়া।

স্বরূপ ওকে বিছানায় নামিয়ে দিল। পরক্ষণেই তনয়ার হাসি চাপা পড়ে গেল স্বরূপের ঠোঁটের ভাঁজে।

কিছুক্ষণ পর তনয়া টেবিল ল্যাম্পটা বন্ধ করতে হাত বাড়াতেই স্বরূপ খপ করে ধরে হাতটা সরিয়ে নিয়ে বলল, “আজ তো লাইট বন্ধ হবে না। ওটা আলো ছড়াবেই…”

তনয়া শক্ত মুঠির ভেতর থেকে হাত ছাড়াতে ব্যর্থ হয়ে চোখদুটোই বন্ধ করে ফেলল।

*

ওদের ঘুম হয়েছিল শেষ রাতের দিকে। তনয়া ক্লান্তিতে মড়ার মতো ঘুমাচ্ছিল। ঘুমের মধ্যেই শুনেছে স্বরূপ তাকে বলছে, সে অফিসে যাচ্ছে। তনয়া কোনোরকমে চোখ মেলে দেখেছে মভ কালারের শার্ট, কালো প্যান্ট পরা এক ব্যস্ত মূর্তি ঘোরাফেরা করছে। আরেকটু কষ্ট করে পুরোপুরি চোখ মেলতেই চোখে পড়েছে ওর ব্যাকব্রাশ করা চুলের নিচে সুন্দর মুখে ব্যস্ততার ছাপ, আর একটু ভ্রুকুুটি। আহারে!

তনয়া উঠে বসতে বসতে বলল, “আমার জন্য তোমার এত তাড়াহুড়ো করতে হলো তাই না?”

স্বরূপ ঘুরল তার দিকে। “উঠেছো কেন? তোমার কি অফিস আছে নাকি? ঘুমাও!”

“কিন্তু তুমি খাবে না?”

স্বরূপ ব্যস্তভাবে ঘড়ি দেখল। তারপর এক ছুটে এসে তনয়ার গালে চুমু খেয়ে বলল, “এইতো খেলাম। এখন যাই। তুমি খেয়ে নিও। সব আছে ফ্রিজে।”

তনয়ার চোখে আবার ঘুম জড়িয়ে এলো। ঘুমের সাথে মিশে রইল মিষ্টি পারফিউমের ঘ্রাণ। মনে হলো স্বরূপ আশেপাশেই তো আছে!

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু