গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-১৯+২০

0
186

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
১৯.

তনয়ার ঘুম ভাঙল কলিংবেলের শব্দে। সে উঠে ঝিম ধরে কয়েক মুহূর্ত বসে থাকল। তারপর ওড়না খুঁজে নিয়ে দরজা খুলতে গেল। দূরী খালা এসেছেন। দূরী খালার সাথে ওর বিয়ের পরদিন পরিচয় হয়েছিল। উনি একবেলা এসে বাড়ির সব কাজ করে দিয়ে যান। ফ্ল্যাটের একটা চাবিও ওনার কাছে থাকে।

তনয়া দরজা খুলেই হাসিমুখের দেখা পেল। খালা ঘরে ঢুকে নিজের ঘরের মতোই কাজ করতে শুরু করলেন। তিনি যখন ওদের বেডরুমের বিছানা গোছাতে গেলেন, তনয়ার খুব লজ্জা লাগল। বিছানার চাদর দেখলেই বোঝা যাবে এর ওপর দিয়ে বেশ ঝড়ঝাপটা পার হয়ে গেছে। সে তাড়াতাড়ি বলল, “খালা, রান্নাঘরের হাঁড়ি-পাতিল আপনি ধুয়ে ফেলুন। আমি এটা করছি।”

খালা নিজের মতো কিছু একটা বুঝে নিয়ে চলে গেলেন৷ তনয়া তাড়াতাড়ি বিছানা গুছিয়ে ফেলল।

দূরী খালার সাথে সাথে থেকে সে নিজের সংসারটাও চিনতে শুরু করল একটু একটু করে। প্রতিটা শোপিস, ফুলদানির ফুলগুলো আর দেয়ালে ঝোলানো পেইন্টিং দেখল সময় নিয়ে। বারান্দাগুলো একেবারে ফাঁকা। গাছ লাগানো যায়৷ ওরা দার্জিলিং থেকে এলেই এখানে গাছ গালাবে সে। কী কী গাছ লাগালে সুন্দর হবে এখন থেকেই কল্পনা করে নিল।

এর মধ্যে সকালের নাস্তা হিসেবে দুটো ব্রেড কোনোমতে খেয়ে কড়া এক কাপ কফি নিয়ে ডিভানে বসে আরাম করে চুমুক দিল। এই ফ্ল্যাটে কেমন একটা ঝিরঝিরে শান্তি আছে। তার নিজের সংসার বলেই কি সে এরকম শান্তি অনুভব করছে?

দূরী খালা এলেন। তার মুখের সাথে হাসিটা টেপ দিয়ে যেন জুড়ে দেয়া। “খালা, আজকা কী রানবাম?”

“আজকে রান্নাবান্না থেকে আপনার ছুটি খালা। আমিই রান্না করব। আপনি বরং একটু কাটাকুটি করে দিয়ে যান।”

“কী কাটতাম?”

তনয়া উঠে গিয়ে সব দেখিয়ে দিয়ে এলো। এখন শান্তির সাথে সুখ সুখ ভাবও হচ্ছে। এখন থেকে সে বাড়ির মালকিন। একটা আস্ত সংসারে তার কথামতো রান্না হবে, কাজ হবে। ভাবা যায়! তনয়ার মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ল। এভাবে তো আগে ভেবে দেখা হয়নি!

*

স্বরূপের খোঁটা মনে আছে তনয়ার৷ “কোনোদিন তো কিছু রান্না করে খাওয়ালে না!”

ইশ! যেন কত সময় পেয়েছে! আজ খাওয়াবে ভালো করে। দুপুরে তনয়া রান্না করেনি। গতকাল মায়ের দেখা খাবারের কিছুটা বেচে ছিল। সেগুলো খালি করে একটু টিভি দেখে বিকেলের দিকে রান্না করতে গেল।

অনেকগুলো আইটেম করল, বিশেষ করে সে যেগুলো ভালো পারে সেগুলো। গতকাল দেখেছে, স্বরূপ ভর্তা পছন্দ করে। সে তিন রকমের ভর্তা করেছে, টমেটো ভর্তা, ডাল ভর্তা আর ডিম ভর্তা৷ শিলনোড়া থাকলে আরও করতে পারত, কিন্তু জিনিসটা এই বাড়িতে নেই। ব্লেন্ডার মেশিনের ভর্তা তার একটুও ভালো লাগে না।

গরুর মাংস বিশেষ কায়দায় বেশি করে পেঁয়াজ দিয়ে ভুনা করল, সাথে খুব অল্প মসলায় রান্না করা চিংড়ি, মটরশুঁটি দিয়ে বড় মাছ, ঝাল চচ্চড়ি আর সাদা ভাত।

সব শেষে ঘরে এসে সময় নিয়ে গোসল করল সে। সুন্দর একটা জামা পরল। চোখে কাজল দিল। পারফিউম সে সাধারণত মাখে না ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞার জন্য। তবে স্বামীর সামনে নিশ্চয়ই মাখা যায়! খুব সুন্দর ঘ্রাণওয়ালা সুগন্ধি উপহার পেয়েছিল সে। সেটা মেখে নিল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তনয়ার মনে হলো, বিয়ে হলে মেয়েরা সুন্দর হয়ে যায় কথাটা তাহলে মিথ্যে না! তার নিজেরই নিজেকে আগের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি সুন্দর লাগছে!

*

অপেক্ষা শেষ হলো। স্বরূপ এলো। সারাদিনের ক্লান্তির ছাপ চোখেমুখে। গতরাতে ঘুম হয়নি সেটার প্রভাবও আছে। তনয়াকে দেখে মৃদু হেসে সে ভেতরে চলে গেল।

গোসল সেরে খানিক বিশ্রাম নেয়া হয়ে গেলে তনয়া বলল, “খাবে না?”

“হুম খুব ক্ষুধা লেগেছে। সারাদিন বলতে গেলে কিছু খাওয়া হয়নি। এত চাপ যাচ্ছে না!”

“আহারে! চলো খাবে। আমি নিজে রান্না করেছি।”

স্বরূপের মুখ উজ্জ্বল হলো। “তাই নাকি? তাহলে তো এক্ষুনি বসতে হচ্ছে!”

টেবিলে খাবারের বহর দেখে চোখ কপালে উঠল স্বরূপের। “এতকিছু!”

“হ্যাঁ। তোমার জন্য।”

স্বরূপেটা মন মায়ায় আর্দ্র হলো। মেয়েটা কত কষ্ট করেছে! সে হাত ধুতে গেল। তখনই ফোনটা বাজল।

স্বরূপ ফোন ধরতে গেল। তনয়ার একটু বিরক্ত লাগল। খেয়েও তো কথা বলা যেত। এখন নিশ্চয়ই কোনো আকাশ ভেঙে পড়েনি!

কিন্তু ওর ভুল ভাঙল। স্বরূপ ভীষণ উত্তেজিত স্বরে কথা বলছে। তনয়া দৌড়ে গেল শোবার ঘরে। স্বরূপ ততক্ষণে একটা শার্ট গায়ে চড়িয়ে ফেলেছে। ফোনে কাকে যেন বলছে, “আমি রওনা হচ্ছি।”

তনয়া ওর হাত ধরে ফেলল, “কোথায় যাবে এখন?”

“মিলির মা স্ট্রোক করেছেন৷ অবস্থা ভালো না। হাসপাতালে যেতে হবে।”

তনয়া বলল, “আমিও যাই?”

“না না, তুমি গিয়ে কী করবে? কাউকে চেনোও না। তুমি থাকো। অবস্থা ভালোর দিকে গেলেই আমি চলে আসব৷ আর কোনো অসুবিধা নেই, ভয় পেও না। এই বিল্ডিং খুবই সেইফ।”

তনয়া আর কিছু বলার খু্ঁজে পেল না। স্বরূপ চলে গেল। টেবিলের খাবারগুলো পড়ে রইল অযত্নে। খাবার মানুষ চলে গেছে।

তনয়া অনেক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করল। স্বরূপ এলো না। কোনো ফোন করল না, ফোন রিসিভও করল না।

তনয়া যখন খাবারগুলো তুলে রাখছিল, তখন ওর চোখে পানি চলে এলো। সে সত্যিই ভীষণ যত্ন করে রান্না করেছিল!

আবার খারাপও লাগল নিজের স্বার্থপর চিন্তার জন্য। ওদিকে একজনের মা মরতে বসেছে, আর সে খাবার নিয়ে ভাবছে!

*

স্বরূপ ফিরল সকালে। ততক্ষণে অফিসের সময় প্রায় হয়ে এসেছে।

“মিলি আপুর মা কেমন আছেন?”

“ভালো না। শরীর একপাশ প্যারালাইজড হয়ে গেছে। কথাবার্তাও বন্ধ।”

স্বরূপ দ্রুত গোসল করে তৈরি হয়ে নিল। ততক্ষণে তনয়া নাস্তা বানিয়ে ফেলেছে। স্বরূপ নাস্তার টেবিলের দিকে তাকাতেই হঠাৎ মনে পড়ে গেল গতকাল তনয়া তার জন্য অনেক রান্না করেছিল। সে তনয়ার দিকে করুণ দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, “স্যরি তনয়া, কাল কিছু খেতে পারিনি৷ এখনো সময় নেই একদম।”

সে টেবিলে বসল না। শুধু সিদ্ধ ডিম এক গ্লাস দুধ দিয়ে গিলে নিয়ে দৌড় দিল।

তনয়ার মনে হয়েছিল গতদিনের মতো একটা চুমু অন্তত কপালে জুটবে! তাও হলো না।

গতরাতে ঘুম হয়নি, খাওয়াও হয়নি৷ এখন আর ভালো লাগছে না। আলস্য ভর করেছে শরীরে।

সে চুপচাপ গিয়ে শুয়ে পড়ল। সারাটা দিন এভাবেই কাটল তার। দূরী খালা কী করছে আজ দেখলও না। সংসারের প্রতি মন কি তবে সংসার করা মানুষটার ওপর নির্ভর করে? সম্পর্ক ভালো থাকলে বস্তুগত সুখ পাওয়া যায়, না থাকলে না? কিন্তু তাদের সম্পর্ক তো খারাপ হয়নি, শুধু তনয়ার মন খারাপ হয়েছে।

*

বিকেলের দিকে রূপা এলো তনয়ার সাথে দেখা করতে। সে মূলত মিলির মাকে দেখতে এসেছিল। ওদের বাসা কাছে হওয়ায় চলে এসেছে। রূপা এসে অনেক গল্প করল। একগাদা গল্প, সব সংসারের।

যাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করল, “কেমন লাগছে তনু?”

“ভালো।”

“ভালোবাসাবাসি হচ্ছে?”

তনয়া হাসল, “হ্যাঁ হচ্ছে। কিন্তু তোমার বন্ধু এখনো ভাবে Love is just a myth!”

“ও একটা মাথামোটা।”

“ঠিক বলেছ!”

দুই বোন একসাথে হাসল।

তনয়ার মন ভালো হয়ে গেল।

রাতে স্বরূপ ফিরল, তবে কিছুক্ষণের জন্যই। আবার রওনা দিল হাসপাতালে। তবে আজ খেয়ে গেল। তনয়া গতকালের রান্নাই গরম করেছিল। কিন্তু খেয়ে স্বরূপ কোনো মন্তব্য করল না। তার মন যেন অন্য কোথাও চলে গেছে।

তনয়া অভিমানে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে বারান্দায় বসে রইল। স্বরূপের দরজা খোলার শব্দ পেয়ে চুপচাপ বিছানায় গিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। সে জেগে আছে দেখলে নিশ্চয়ই কোনো কথা বলবে। কথা বলার ইচ্ছে এখন আর তার হচ্ছে না।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
২০.

ভোরে স্বরূপ ঘুম থেকে উঠে দেখল তনয়া বারান্দায় বসে আছে চুপচাপ।

“এত সকালে উঠে গেছো যে?” প্রশ্ন করল সে।

তনয়া উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করল, “নাস্তা করবে তো? কী খাবে?”

“যা বানাবে তাই।”

“পরোটা করি?”

“তোমার ইচ্ছে!”

তনয়া উঠে চলে গেল। স্বরূপ প্রতিদিন সকালে ট্রেডমিলে দৌড়ায় আধঘন্টা। কয়েকদিন হয়ে গেল নানা ঝামেলায় সেটা বন্ধ হয়ে আছে। সকাল সকাল খানিকটা এক্সারসাইজ করলে দিনটা ভালো কাটে। এক্সারসাইজ করে পরোটা খাওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু তনয়া শখ করে বানাচ্ছে যখন, সে খাবে।

স্বরূপ ব্যায়াম শেষে খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে গোসলে ঢুকল। ততক্ষণে তনয়া টেবিল সাজিয়ে ফেলেছে। সে স্বরূপকে ডাকতে এসে সে দেখল স্বরূপ গোসলে গেছে। তনয়া এই ফাঁকে বিছানা গুছিয়ে ফেলল। স্বরূপ বের হলো। তার পরনে সাদা তোয়ালে বাদে আর কিছুই নেই। তনয়া একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিল। ইশ্ লজ্জাটজ্জা একদম নেই!

স্বরূপ খেয়াল করল তনয়া লজ্জা পাচ্ছে। সে জামাকাপড় না পরে ঘরে ঘুরঘুর করতে লাগল, ভাবটা এমন যেন খুব কাজ করছে! কিন্তু তনয়ার মধ্যে কোনো অনুভূতি দেখা গেল না। এবার সে পেছন দিক থেকে ওর খুব কাছে এসে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, “কী করছো?”

স্বরূপের চুলের পানি তনয়ার ঘাড়ে পড়তেই তার শরীর শিরশির করে উঠল। কিন্তু স্বরূপের ওপর যে কষ্টটা জমা ছিল সেটা সরে গেল না। অভিমানের বরফ গলল না। সে সরে গেল ওর কাছ থেকে। বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, “এরপর কিন্তু খাবার সব ঠান্ডা হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি এসো।”

স্বরূপ কিছুটা আশাহত হলো। সে কী এমন অপরাধ করে ফেলেছে?

খেতে বসে এবার খুব প্রশংসা করল স্বরূপ। পরোটার খুব সুন্দর ভাজা হয়েছে, শেইপ পারফেক্ট হয়েছে, এত মজার পরোটা সে বহুদিন খায়নি, পরোটার সাথে যে ঝুরি ঝুরি আলুভাজি করা হয়েছে সেটাও দারুণ হয়েছে, ডিমটা পারফেক্টলি পোচ হয়েছে ইত্যাদি…

কিন্তু তনয়ার ভাবের কোনো পরিবর্তন হলো না। সেও খেতে বসেছে। চুপচাপ খাচ্ছে।

স্বরূপ এবার বলল, “অফিসে যাবে তনয়া? সারাদিন একা একা বোর হয়ে লাভ কী?”

তনয়া অবাক হয়ে বলল, “অফিসে যাব মানে?”

“মানে আমাদের অফিসে বেবী কেয়ার সেকশন আছে৷ নতুন মায়েরা তাদের ছোটো বাচ্চা নিয়ে আসে। আমি তোমাকে নিয়ে যাব। একটা অ্যাপ্লিকেশন করে দেব, অতিসত্ত্বর নিউ ওয়াইফ সেকশন খোলা হোক!”

তনয়ার হাসি পেলেও সে মুখ কোনোমতে গম্ভীর রেখে বলল, “আজ আমি ইউনিভার্সিটিতে যাব।”

“হঠাৎ?”

“তুমি কি ভুলে গেছো আমি পড়াশুনাও করি?”

“তা করো, কিন্তু এতদিন তো যাওনি। তার ওপর আগামীকাল আমাদের ফ্লাইট।”

“সেটা তো বিকেলে। আমি কিছুটা গোছগাছ করেছি। বাকিটা রাতে আর কাল দিনে হয়ে যাবে। ইউনিভার্সিটিতে যাব নোটস কালেক্ট করতে। আবার অনেকদিন গ্যাপ পড়ে গেলে নোটসগুলো পাব না। কিছু কেনাকাটাও আছে। ওখানে তো অনেক শীত। শীতের কাপড় বেশি করে নিতে হবে। ফেরার সময় মার্কেট হয়ে আসব।”

স্বরূপের যেন মনে পড়ল হঠাৎই, “আরে তাই তো! কেনাকাটা করার সময় থাকতে পারলে ভালো হতো, কিন্তু আজ আবার একটা মিটিং আছে অন্য শাখায়। সেখান থেকে ফিরতে ক’টা বাজবে কে জানে!”

“সমস্যা নেই। আমিই পারব।”

স্বরূপ আর কথা বাড়াল না। থাকুক মন খারাপ করে। সে আর কী বা করতে পারে!

তবুও বের হবার আগে তনয়ার কাছে এসে কপালে চুমু খেল। তনয়া যেন একটু হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু হাসল না। দু’জনেই বিমর্ষ মুখে বিদায় পর্ব সারল।

তনয়ার ইউনিভার্সিটিতে যেতে আরেকটু দেরি আছে। সে ভাবল দুপুরের জন্য টুকটাক কিছু করে রাখবে। মন খারাপ হলে সে নিজেকে ব্যস্ত করে ফেলে, যাতে ব্যাপারটা আর মনে না পড়ে। স্বরূপ এত কথা না বলে শুধু এই দু’দিনের জন্য ছোট্ট করে ‘স্যরি’ বললেই কাজ হয়ে যেত। সে চেয়েছিল স্বরূপ বুঝুক তার কেন মন খারাপ হয়েছে। কিন্তু তা না, ফাজলামি টাইপ কথা বলে হাসানোর চেষ্টা! এসবের কোনো প্রয়োজন তো তার নেই।

*

স্বরূপের মিটিং দ্রুতই শেষ হয়ে গেল। এগারোটার দিকে রওনা দিয়ে দিল নিজের অফিসের দিকে। পথে তনয়ার ইউনিভার্সিটি পড়তেই সে সেখানে নেমে পড়ল। তনয়া হয়তো এখানেই। হাতে কিছুটা সময় আছে। ওর সাথে নাহয় শপিংয়ে যাওয়া যাবে। খওয়াদাওয়াও একসাথে করে ফেলে একেবারে লাঞ্চের পর অফিসে যাওয়া যাবে।

তনয়াকে ফোন করল সে।

“হ্যাঁ বলো।”

“কোথায় তুমি?”

“ইউনিভার্সিটিতে।”

“কী করো?”

“যা করতে এসেছি…”

স্বরূপ বলল না সে কাছাকাছিই আছে। সারপ্রাইজ দেয়া যায় একটা। সে দোকান থেকে ডেইরি মিল্ক আর কিটক্যাট কিনল। দুটোর ওপর স্টিকি নোট আটকে লিখল, “I’m sorry!”

এবার সে ক্যাম্পাসের ভেতর ঢুকল। ছোটো ক্যাম্পাস। কাউকে খুঁজে বের করতে দশ মিনিটের বেশি লাগার কথা নয়। তবে তার দশ মিনিটও লাগল না।

ক্যান্টিনেই দেখা গেল তনয়াকে। স্বরূপ দূর থেকে দেখল। একটা ছাতার নিচে বসে আছে সে। একা নয়, সাথে একটা ছেলে। দুজন কফি হাতে বসে গল্প করছে। একটু আগেও তনয়া তার সাথে দায়সারাভাবে কথা বলছিল। এই ছেলের সাথে কথা বলছে হাসিমুখে। ছেলেটা হয়তো কোনো জোক বলল। তনয়াকে দেখা গেল খিলখিল করে হাসছে। দু’জনকে দেখে দূর থেকে মনে হবে কাপল। মানিয়েছেও ভালো।

স্বরূপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সেদিকে। তার মাথা ব্যথা করতে শুরু করেছে। বহুদিন আগের ঘটনা মনে পড়ে যাচ্ছে৷ আগেও তার সাথে এরকমই হয়েছে। তনয়াকে সে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল। ভীষণ ভরসা করে ফেলেছিল মাত্র ক’টা দিনেই। অথচ তার মনে রাখা উচিত ছিল, যেখানে কয়েক বছরের সম্পর্কে থেকেও মেয়েদের বিশ্বাস করা যায় না, সেখানে মাত্র কদিনেই একজনকে এতটা বিশ্বাস করা তার কত বড় ভুল ছিল। সে আসলে একটা গর্দভ।

স্বরূপ দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। তার মাথা ফেটে যাচ্ছে এবার। বুকের ভেতরেও অদ্ভুত শূন্যতা আর হাহাকার। তনয়ার হাসি কাঁটার মতো বিঁধছে বুকে।

সে যখন চলে যাচ্ছে, তখন কয়েক পলকের জন্য তনয়ার দৃষ্টি তার ওপর পড়ল। মুহূর্তেই তার মনে হলো এই মানুষটার এরকম মূর্তি সে আগে দেখেনি। চোখদুটো লাল হয়ে গেছে৷ ভাবভঙ্গি মারাত্মক। তনয়া কয়েক মুহূর্ত হতভম্ব হয়ে চেয়ে রইল।

তার পাশে এতক্ষণ জিমি বসেছিল। জিমি ওর সাথেই অনার্স করেছে। খুব ভালো স্টুডেন্ট। একই সাথে দুর্দান্ত হিউমার। ওর সাথে কথা বলে কেউ না হেসে থাকতে পারে না। আবার ছেলেটার মন একইসাথে খুবই স্বচ্ছ। তনয়ার সাথে তার শুরু থেকেই ভালো বন্ধুত্ব। এখন ওর কাছ থেকেই তনয়া সব নোট, সাজেশন জোগাড় করে। আজও সেজন্যই এসেছিল৷ কিন্তু তনয়ার মন খারাপ দেখে জিমি কাজের চেয়ে বেশি কথা বলছিল। তাকে হাসানোর চেষ্টা করছিল৷ জিমির মতো মানুষেরও অনেকটা সময় লেগে গিয়েছিল তনয়াকে স্বাভাবিক করতে। কিন্তু আচমকা কী হয়ে গেল জিমিও বুঝল না।

তনয়া ব্যাগ, বইপত্র ফেলে কোনোকিছু না বলেই একদিকে ছুটে গেছে। চোখের পলকেই কোথায় যেন হারিয়ে গেল। কাউকে দেখেই গেছে সম্ভবত। কিন্তু কে সেটা বোঝেনি।

তনয়া যখন গেটের কাছে এসেছে, তখন স্বরূপ একটা সিএনজিতে চড়ে বসেছে। তনয়ার দিকে সে আর ফিরেও তাকায়নি। তনয়া অনেকবার ডাকল, স্বরূপ শুনেও শুনল না। সে ফোন করতে গিয়ে দেখল ফোন ফেলেই এসেছে। আবার ফিরে গেল সে। জিমি পেছন পেছন আসছিল। সে জিজ্ঞেস করল, “কী হলো তোর হঠাৎ করে?”

“পরে বলব।” তনয়া দ্রুত ব্যাগপত্র নিয়ে বেরিয়ে গেল। কিন্তু কোথায় যাবে বুঝতে পারল না। তার তখনো স্বরূপের এরকম কান্ডের ব্যাখ্যা মাথায় ঢোকেনি। সে কি ওর অফিসে যাবে? কিন্তু যদি দেখা না করে? যদি অপমান করে?

তনয়া কিছুক্ষণ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগল। তারপর ভাবল বাসায় ফিরে যাবে।

যাবার পথে অনেকবার সে স্বরূপকে কল করল। কিন্তু প্রতিবারই স্বরূপ ফোন কেটে দিল। একসময় ফোনটা বন্ধ পাওয়া গেল।

বাড়ি ফিরে গোসল করতে ঢুকলে মাথাটা একটু ঠান্ডা হলো তনয়ার। শাওয়ারের পানি ঝরঝর করে তার মাথায় পড়ছিল। তখনকার দৃশ্যটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। স্বরূপকে দেখার আগে সে জিমির কথা শুনে হাসছিল। এটাই কি তবে স্বরূপের খারাপ লাগল? কিন্তু এত ছোটো একটা বিষয়ে কেন সে রাগ করবে? তারও তো বন্ধু আছে। সেবার গ্রামে গিয়ে সে যে পুরো বিকেল মিলি আপুর ছবি তুলে দিল তাতে কি তনয়া কিছু বলেছে? নাকি রাগ করেছে? ওরাও তো গল্প করে, হাসাহাসি করে। তাতে সমস্যাটা কোথায়? এই বাড়াবাড়ির কারন কী?

গোসল করে বের হয়ে তনয়া অনেকক্ষণ কাঁদল। কিছুই ভালো লাগছে না। এলোমেলো ভাবতে ভাবতে একসময় তার সব রাগ গিয়ে পড়ল রূপার ওপর। ওর জন্যই এসব হচ্ছে!

সে রূপাকে ফোন করে ইচ্ছেমতো ঝাড়ল। যা মনে এলো সব বলল। রূপা চুপচাপ শুনে গেল। সবটা শোনার পর তনয়া যখন চুপ হলো তখন রূপা বলল, “তোর আর স্বরূপের মানসিকতা তো আর একরকম হবে না রে…”

“কেন হবে না? এত ছোটো মনের কেন হবে একটা মানুষ? এত সন্দেহপ্রবন লোকের সাথে আমি কিভাবে সারাজীবন থাকব বলো?”

রূপা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “তনু, তুই পুরো ব্যাপারটা আরেকবার ভেবে দেখ। তোর সাথে কিন্তু এর আগেও দুটো ইন্সিডেন্ট হয়েছে। রেলস্টেশনে একটা, আর গ্রামে গিয়ে একটা। গ্রামের ঘটনাটায় স্বরূপ তোকে ব্লেম করতে পারত। কিন্তু করেনি, প্রতিবাদ করেছে৷ তোকে ও কোনো রেস্ট্রিকশনও দিয়ে রাখেনি। ও কি তোর ফোন চেক করে? ফেসবুকের পাসওয়ার্ড চায়?”

“না।”

“তাহলে বোঝ! ও তোকে সন্দেহ করে না। কখনো করেনি। তুই ওর সাথে সকালে রাগ দেখিয়েছিস, ও হয়তো তোর রাগ ভাঙাতেই গিয়েছিল, কিন্তু গিয়ে দেখেছে তুই দিব্যি হাসিখুশি আছিস অন্য এক ছেলের সাথে। ব্যাপারটা উল্টোভাবে তোর সাথে ঘটলে তুইও কিছুটা রিয়েক্ট করতি। আর ওর ব্যাপারটা কিছুটা হলেও আলাদা। ওর একটা পাস্ট আছে, যেটা ওকে খুব ডীপলি এফেক্টেড করে রেখে গেছে।”

রূপা একটু থেমে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বলল, “আমি জানি ব্যাপারটা খারাপ হয়েছে, কিন্তু তবুও বলব, স্বরূপ ছোটো মনের না। এটা শুধুই একটা ভুল বোঝাবুঝি।”

তনয়া ঝাঁঝালো সুরেই বলল, “তুমি সবসময় বন্ধুর পক্ষেই কথা বলো। তোমাকে কিছু বলাটাই ভুল। তুমি ওর পক্ষের উকিল, আমারটা বুঝবে কেন?”

সে রূপাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন রেখে দিল। ইচ্ছে করছে বাড়ি চলে যেতে। কিন্তু একটা কিছু মিমাংসা না করে যাওয়াটা কি ঠিক হবে?

*

স্বরূপ দেরিতে ফিরল। ফিরতে ইচ্ছে করছিল না। সারাদিন সে মাথাব্যথা নিয়ে অনেক কষ্টে কাজ করেছে। এখন আর টিকতে না পেরে ফিরে এসেছে। আর যাওয়ার জায়গাও নেই। বাড়িটা তার একার আস্তানা ছিল৷ এখন যে এসে জুটেছে তার ওপরেই তার রাগ। বিরক্ত লাগছে সব মিলিয়ে।

সে কিছুক্ষণ বেল বাজাল। দরজা খুলল না। বিরক্ত হয়ে চাবি দিয়ে দরজা খুলে ঢুকে গেল সে। সব লাইট জ্বালানো। সে কোথায় ঘাপটি মেরে পড়ে আছে কে জানে!

সব ঘর, বাথরুম খুঁজল স্বরূপ। পেল না কোথাও। তনয়া গেল কোথায়? আজব তো! হাওয়া হয়ে গেল নাকি?

শেষ পর্যন্ত তনয়াকে পাওয়া গেল বারন্দায়। তাও ওদের বেডরুমের নয়, সবচেয়ে কোণার ঘরটার বারান্দায় মেঝেতে শুয়ে আছে সে। বারান্দার আলো জ্বালাল স্বরূপ। তনয়া চোখ খুলল না। স্বরূপ উদ্বিগ্ন হয়ে ওর কাছে এসে বসল। শ্বাস চলছে ওর। মুখটা মলিন। চোখে কান্নার দাগ লেগে আছে। বারান্দায় প্রচন্ড মশা। একেকটা তনয়ার গায়ে বসে রক্ত খেয়ে ফুলেফেঁপে আছে।

স্বরূপ ওর কাঁধ ধরে ঝাঁকাল, “তনয়া! অ্যাই! কী হয়েছে তোমার?”

তনয়া উঠে কয়েক মুহূর্ত কিছু বুঝতে পারল না। সব মনে পড়তে একটু সময় লাগল তার৷ সন্ধ্যার দিকে ভীষণ খারাপ লাগায় এখানে এসে বসেছিল। ভালো বাতাস দেয় এই বারান্দায়। তারপর হঠাৎ কান্না পেতে থাকল তার। কাঁদতে কাঁদতে কখন শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেও জানে না। দুপুরে খায়নি বলে শরীর আরও ক্লান্ত হয়েছিল।

স্বরূপ ওর দিকে তাকিয়ে আছে অবাক হয়ে, “কী হয়েছে বলবে তো?”

তনয়া কয়েক মুহূর্ত স্বরূপের দিকে তাকিয়ে থেকে আচমকা তার বুকে সজোরে ধাক্কা দিল। স্বরূপ অপ্রত্যাশিত আক্রমনে সামলাতে না পেরে মেঝেতে পড়ে গেল। সে হা করে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “সমস্যা কী?”

তনয়ার রাগ তখন মাথায় চড়ে গেছে। সে চিৎকার করে বলল, “তোমার সমস্যা কী? তোমার কি মনে হয় আমি সস্তা মেয়ে? আমি তোমাকে রেখে আরেকজনের সাথে ডেট করতে গেছি? আমার সাথে এরকম কেন করলে তুমি? এত ছোটোলোক কেন তুমি? তোমারও তো বন্ধু আছে, যাদের জন্য নিজের বউকে একা রেখে রাত বিরাতে ছুটে যাও, আমি কিছু বলেছি? কোনোদিন সন্দেহ করেছি? তাহলে আমার সাথে কেন করলে? এত খারাপ ব্যবহার কেউ আমার সাথে কোনোদিন করেনি৷ কেউ আমাকে এত কষ্ট দেয়নি। এত কাঁদায়নি। তুমি একটা জঘন্য লোক! একটা…”

তনয়া আর বলতে পারল না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। তার সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয়েছে তার চরিত্র নিয়ে সন্দেহ করায়। এটাও কেউ করতে পারে? সে কি স্বপ্নেও ভাবতে পারে ধোঁকা দেবার কথা?

তনয়ার লাল টকটকে মুখ, ফুলে ওঠা নাক, চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়া পানি আর ওর দুঃখে ভেঙে আসা চেহারা দেখে স্বরূপের মন ক্রমশ তরল হয়ে এলো। আফসোস হতে লাগল তার। খুব ভুল হয়ে গেছে। সরল মনের একটা মানুষকে সে অনেকটা কষ্ট দিয়ে ফেলেছে৷

তনয়ার জন্য তার এত মায়া লাগল! তনয়ার কাছে এগিয়ে গেল সে। কাঁধে হাত রাখল। তনয়া এক ঝটকায় হাত সরিয়ে দিল। একবার, দুবার, তিনবার…

স্বরূপ এবার জোর করেই দুই হাতে তার মুখটা তুলল। চুমু খেল ঠোঁটে। ভীষণ আবেগে, অনেকটা সময় নিয়ে। বুঝিয়ে দিতে চাইল, সে অনুতপ্ত।

তনয়াও নরম হয়ে এলো, যখন সে বুঝল অশ্রুকণা শুধু তার চোখ দিয়েই প্রবাহিত হচ্ছে না।

শহরটা হঠাৎ তার সব কোলাহল থামিয়ে দিয়েছে। মেঘের আড়ালে এতক্ষণ চাঁদটা ঢেকেছিল। এখন মেঘ কেটে গেছে। জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে বারান্দা। ধুয়ে দিচ্ছে সব গ্লানি, অভিমান আর মনখারাপের দিন।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে