Tuesday, July 22, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 212



গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-১৫+১৬

0

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
১৫.

শেষ রাতে ঘুম ভাঙল তনয়ার। গতকালের রেশ মনের মধ্যে কেমন যেন ভয় জাগিয়ে রেখেছে তার। সে ডেকে তুলল স্বরূপকে। “কী হয়েছে?” ঘুম জড়ানো গলায় প্রশ্ন করল স্বরূপ।

তনয়া উত্তর দিল, “নামাজ পড়ব।”

“পড়ো!” বলে উল্টোদিকে ফিরে শুল স্বরূপ।

তনয়া এবার ধাক্কা দিল তাকে। “তুমিও পড়বে। ওঠো!”

“এখন উঠতে পারব না। ঘুম হয়নি।”

“পরে ঘুমিও আবার, এখন ওঠো, প্লিজ!”

স্বরূপ তনয়ার বালিশটা টেনে নিয়ে মাথর ওপর চেপে ধরে কম্বলটা আরেকটু টেনে নিল।

তনয়ার এবার রাগ হতে লাগল। আস্ত পাজি লোক তো! সে স্বরূপের হাত ধরে টানাটানি করল কিছুক্ষণ, কাতুকুতু দেয়ার চেষ্টা করল, ঘরের লাইট অন করে দিল, ওর চোখের সামনে মোবাইলের ফ্ল্যাশলইট অন করে ধরে রাখল। শেষ পর্যন্ত কিছুতেই কাজ না হওয়ায় পানি ছিটিয়ে দিল চোখেমুখে।

স্বরূপ এবার উঠে বসে চোখ ডলতে ডলতে বলল, “কাল রাতে যদি তোমাকে ঘুমাতে দেই তো আমার নাম স্বরূপ না।”

“ওকে, তোমার নতুন নামকরণের ভার আমাকে দিও প্লিজ! আমার অনেক ইচ্ছে ছিল আমার বরের নাম হবে ঝন্টু মিয়া।”

“উইল ইউ শাট আপ?”

“নো।”

স্বরূপ উঠে বাথরুমে ঢুকল। তনয়া একটু পর বাথরুমের দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলল, “ওযু করে বের হবে কিন্তু… তুমি কি ওযু করতে পারো?”

“না না, সব তো তুমি একাই পারো।” ভেতর থেকেই চেঁচিয়ে বলল স্বরূপ।

একটু পর বের হলো সে। দেখে মনে হলো ওযু করেই বের হয়েছে। তনয়া জিজ্ঞেস করল, “মসজিদে যাবে?”

“না, মসজিদ অনেক দূর। ততক্ষণে সময় শেষ হয়ে যাবে।”

“কাল আরও তাড়াতাড়ি ডেকে দেব তাহলে৷ এখন একটু অপেক্ষা করো। আমি ওযু করে আসি। একসাথে নামাজ পড়ি।”

দু’জন একসাথে নামাজ পড়ল। ভোরের আলো ভালো করে ফুটলে তনয়া জানালার পর্দা সরিয়ে দিল। ভোরের স্নিগ্ধ শীতল বাতাস ছুঁয়ে গেল তাকে। ঘরটাও আলোকিত হলো। সে মশারি তুলে বিছানা ঝাড়ল, ঘরটা সুন্দর করে গুছিয়ে ফেলল। স্বরূপ জানালার পাশে একটা চেয়ার টেনে বসে রইল। তনয়ার কাজ শেষ হলে সে বলল, “জানো, অনেকদিন পর ফজরের নামাজ পড়লাম।”

“কেমন লাগছে?”

স্বরূপ সেটার উত্তর না দিয়ে বলল, “ধন্যবাদ।”

দু’জনের আর কথা হলো না৷ চুপচাপ পাশাপাশি বসে রইল তারা। তনয়ার গতদিনের ট্রমা অনেকটা কেটে গিয়েছে। যদিও মন থেকে বিষয়টা মুছতে অনেক সময় লাগবে, তবুও প্রাথমিক ভয়টা কেটে যেতেই শান্তি লাগছে।

গ্রামের মানুষের কাজকর্ম দ্রুত শুরু হয়। জানালা দিয়ে লোকজন দেখা যাচ্ছে সেই আলো ফোটার পর থেকেই। সবাই ভোর থেকে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সন্ধ্যা হতে হতে কাজ শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ে। তাদের শহুরে জীবনটাও এমন হলে বেশ হতো! চেষ্টা করা যায় না কি? স্বরূপকে বলে দেখতে হবে তো! মায়ের ডাক শুনে সে বেরিয়ে গেছে একটু আগেই। আজ বাড়িতে তাদের বিয়ে উপলক্ষে খাওয়াদাওয়া হবে। তনয়াকেও তৈরি হতে হবে। রোদের দেখা মিললে সে গোসল করে ফেলল।

*

তনয়া বিয়েতে বিশাল মেকআপ বক্স উপহার পেয়েছে। স্বরূপের হয়ে কেনাকাটা করে দিয়েছে তার বন্ধুরা। এই মেকআপের জিনিসগুলো যে কিনেছে তার চয়েজ অসাধারণ! সব ভালো ব্র্যান্ডের জিনিস। লিপস্টিকের পুরো সেট দিয়েছে। তাতে এত সুন্দর সব রঙ যে তনয়ার খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে!

সে যখন সাজতে বসেছে তখন গ্রামের অনেক মেয়েরাই এসেছে তাকে সাহায্য করতে। কিন্তু এসব প্রোডাক্ট দেখে কেউ ধরতে সাহস পায়নি। তনয়া একাই সাজগোজ করেছে। তারপর নিজেই বলেছে অন্য যারা সাজবে তারা যেন তার কাছে এসে বসে।

এরপর শুরু হলো তার সাজানো। শেষ আর হয় না। তনয়ার মনে হলো সে ভয়াবহ একটা ভুল করে ফেলেছে। বিশাল লাইন পড়ে গেছে সাজবার। তবুও সে হাসিমুখেই অনেককে সাজিয়ে দিল।

একসময় চাচী এসে হায় হায় করে বললেন, “এইটা কী হয়? বউ মানুষ সবাইরে সাজাইতাছো কেন? বিয়া ওগো না তোমার?”

তনয়া হেসে বলেছে, “সাজাই না চাচী, সমস্যা কী?”

“না কুনু দরকার নাই। যা সব, বাইর হ এইখান থেকা।”

তিনি ছাগল তাড়াবার মতো করে সবাইকে তাড়িয়ে দিয়ে বললেন, “তুমি একটু জিরাও। পরে বাইরের ঘরে নিয়া যাব। অনেক আত্মীয়স্বজন আসতেছে। খাওয়া হইয়া গেলেই তারা বউ দেখব।”

চাচী বের হয়ে গেলে তনয়া মোবাইলটা নিয়ে বসল। মাকে ফোন করে কথা বলে নিল। কাল থেকে কথা হয়নি। মায়ের কাছে গতকালের ঘটনা বলতে চায় না সে৷ এমনিতেই ট্রেন মিস করার ঘটনা শুনে মা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। একমাত্র মেয়ে বলেই তার এত ভয়। তনয়ারও খারাপ লাগছে। বিয়ের পর থেকে মায়ের সাথে একটুও দেখা হলো না। এতদিন তো সে মাকে ছেড়ে কখনো থাকেনি।

ফোন রেখে তনয়ার খুব কষ্ট হচ্ছিল। মা বাবাকে আজ দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। কিন্তু মা অসুস্থ বলে আসতে পারেননি তারা। তনয়ার বাড়ি যেতে যেতে আরও চার পাঁচদিন। এতদিন মাকে না দেখে থাকতে হবে। তার চোখে পানি চলে এলো।

“আরে আরে নতুন বউ কাঁদে কেন?” গ্রাম্য পরিবেশে শহুরে একটা আওয়াজ তনয়াকে একটু অবাক করল। সে চোখ তুলে দেখল স্বরূপের বন্ধু মিলি। সব বন্ধুবান্ধবকেও দাওয়াত দেয়া হয়েছিল। তবে সবারই দেখা গেছে কোনো না কোনো সমস্যা। সকালে বলছিল স্বরূপ ওদের কথা। তবে মিলি আপু যে আসবে সেটা বলেনি।

মিলি কাছে এসে তনয়ার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল, “বাড়ির কথা মনে পড়ছে?”

তনয়া মাথা নাড়ল। মিলি তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “পড়বেই তো। কিন্তু কাঁদলে কি মা আসবে বলো? আরও তার কষ্ট হবে। তুমি খুশি থাকো, দেখবে মাও খুশি থাকবে।”

তনয়া হাসার চেষ্টা করল। মিলি বলল, “তোমাকে যা সুন্দর লাগছে মেয়ে! তোমার বরের তো সারাদিন তাকিয়ে থাকার কথা। কোথায় সে? এসে তো দেখলাম না।”

তনয়া অভিমান করে বলল, “আপনার বন্ধু কি আর সেরকম মানুষ নাকি?”

মিলি ম্লান হেসে বলল, “ও খুব ভালো মানুষ তনয়া। তুমি যদি ওকে ঠিকঠাক বোঝো তাহলেই আর একথা মনে হবে না।”

তনয়ার গতকালের কথা মনে হলো। মিলি আপু হয়তো সত্যিই বলছে।

*

দিনটা ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে কেটে গেল। সন্ধ্যার অনেকটা পর যখন সব মেহমান চলে গেছে, তখন ঘরে ঢুকল তনয়া। ইচ্ছে হলো কোনো জাদুমন্ত্রবলে যদি শাড়িটা বদলে নরম জামা হয়ে যেত! আহা!

স্বরূপের দেখা নেই। এখনো হয়তো কাজ করছে। তনয়ার ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। যদিও সে বসেই ছিল, তবে কখনো কখনো বসে থাকাটাও খুবই যন্ত্রণাদায়ক।

সে উঠে কাপড় বদলে মেকআপ ধুয়ে এলো। বিছানার চাদর বদলে ফেলল। আজ এত মানুষ এসেছে যে এটাতে শোওয়া যেত না৷ কাজ করতে করতে সে আরও বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়ল। বালিশে মাথা রাখতেই চোখে ঘুম জড়িয়ে এলো।

হঠাৎ একটা শব্দে চমকে উঠল সে। নাঁকি একটা সুরে কেউ যেন গান গাইছে। কান পাতল তনয়া। গান? নাকি কিছু একটা বলছে? গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তার। বিছানায় পা উঠিয়ে বসল। আবারও ভালো করে শোনার চেষ্টা করল। একসময় কথাগুলো একটু একটু করে স্পষ্ট হয়ে এলো, “স্ব…রূ…প… কো…থা…য়. .তু…মি… তোমা…র…ঘ…রে…কে…এটা… তু…মি…নে…ই…কে…নো…. ও… স্ব… রূ…প… তু… মি…বি… য়ে.. কে…নো… ক…রে…ছো…আমি…তোমাকে…বলেছিলাম…না… স..তী…নে…র…ঘর…করবো…না…”

তনয়া অস্ফুটে বলল, “কে? কে কথা বলে? কে?”

কণ্ঠটা একটু থামল। তারপর কাচের চুড়ি ভাঙার মতো রিনরিনে কণ্ঠে কে বলে উঠল, “আমি চন্দ্রা…চন্দ্রাবতী… তোমার সতীন গো সতীন…”

তনয়া বুঝতে পারছিল না শব্দটা আসছে কোথা থেকে। তবে কি স্বরূপ সত্যিই বলেছিল? কেউ আছে এরকম? ঘরের আলো অন্যরকম লাগছে। মনে হচ্ছে চারদিকে ছায়ারা জেগে উঠে নাচানাচি করছে। তনয়া ফুঁপিয়ে উঠল। ভয়ে তার গা শিরশির করছে। কতক্ষণ এভাবে কাটল জানে না তনয়া।

একসময় দরজা খুলে গেল। স্বরূপ ঢুকে তাকে দেখে উদ্বিগ্ন মুখে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে তনয়া? আবার কিছু হয়েছে?”

তনয়া ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল তাকে। ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। স্বরূপ তার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগল, “আরে কাঁদো কেন? কেউ কিছু বলেছে?”

তনয়ার শান্ত হতে একটু সময় লাগল। তারপর সে সব খুলে বলল। স্বরূপকে খুব চিন্তিত মনে হলো। সে কিছুক্ষণ গুম হয়ে থেকে বলল, “আচ্ছা একটা কাজ করো তো…” বলতে বলতে পকেট থেকে মোবাইল বের করল সে। কী একটা অ্যাপ বের করে তনয়ার মুখের সামনে মোবাইল ধরে বলল, “কিছু একটা বলো।”

“কী বলব?”

বলার পরেই অদ্ভূত একটা ব্যাপার হলো। অদৃশ্য কোথাও থেকে নাঁকি সুরে ভেসে এলো, “কী…ব…ল…বো…”

তনয়ার কয়েক সেকেন্ড লাগল বিষয়টা বুঝতে। সে প্রচন্ড রাগে স্বরূপের দিকে তাকিয়ে দেখল সে হাসতে হাসতে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। তনয়া বালিশ দিয়ে ইচ্ছেমতো তাকে মারতে শুরু করল। স্বরূপের হাসি তাতে থামল না। তনয়ার এরপর বলা সব কথা প্রতিফলিত হয়ে নাঁকি সুরে ফিরে ফিরে আসতে লাগল। স্বরূপের হাসিও বাড়তে লাগল। একসময় তনয়া ক্লান্ত হয়ে থেমে গেল। তারও এখন নিজের বোকামিতে হাসি পাচ্ছে। সে জিজ্ঞেস করল, “কেন করলে এটা?”

স্বরূপ কোনোমতে বলল, “নাম বদলে ঝন্টু হতে চাই না বলে।”

“তোমাকে আমি আজ থেকে ঝন্টুই ডাকব। হুহ…”

স্বরূপ পেট চেপে বলল, “ডেকো, আমি তোমাকে ডাকব ভুতু।”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
১৬.

স্কুলের মাঠের এক কোণে বিশাল দেবদারু গাছের তলায় বসে তনয়া স্কুলের গল্প শুনল। সকালবেলা সে মায়ের সাথে আবদার করে তার স্কুল দেখতে চলে এসেছে। মা এসেই ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। বেশ কিছুদিন তিনি ছেলের বিয়ের জন্য স্কুলে আসতে পারেননি। প্রচুর কাজ জমে গেছে। তনয়া দেখে এসেছে তার টেবিলে ফাইলের স্তুপ আর অপেক্ষারত দর্শনার্থীদের ভিড়। তনয়া বলে এসেছে সে একাই ঘুরেফিরে দেখবে।

মা অবশ্য একা ছাড়েননি তাকে। স্কুলেরই এক শিক্ষিকাকে বলেছেন তনয়াকে সব ঘুরে দেখাতে। স্কুলশিক্ষিকা সুরমাকে বেশ পছন্দ হয়ে গেছে তনয়ার। মেয়েটার বয়স তার কাছাকাছি। এই গ্রামেরই মেয়ে। তার পড়ানোর বিষয় বাংলা। মেয়েটা ঘুরেফিরে সব দেখল তনয়াকে। প্রতিটা ক্লাসরুম, ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে, তাদের কমনরুম, একচিলতে বাগান। সুন্দর গোছানো স্কুল৷ ঘুরেফিরে তারা দেবদারু গাছের নিচে এসে বসলে সুরমা তাকে গল্পটা বলল।

এর আগে ওদের গ্রামে কোনো স্কুল ছিল না। ওরা যারা পড়াশুনা করত তাদের যেতে হতো দুই গ্রাম পরে সরকারি স্কুলে। সেখানেই একসময় শিক্ষকতা করতেন স্বরূপের মা, মানে সুরাইয়া বেগম। শিক্ষকতার কাজটা তার খুবই পছন্দ ছিল। প্রতিদিন এতটা হেঁটে যেতেন পড়ানোর খাতিরে।

সেবার ভয়াবহ বন্যা হয়েছিল। বন্যায় গ্রামের রাস্তাঘাটের অবস্থা এত খারাপ হয়েছিল যে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। স্কুলও অনেকদিন বন্ধ রয়েছিল। কিন্তু যখন খুলল, তখনো এই গ্রাম থেকে স্কুলে যাওয়ার পথ সুগম হলো না। ছাত্ররা তবু পড়ার তাগিদে কয়েক মাইল হেঁটে ঘুরে যেত। ছাত্রীদের পড়া বন্ধ হয়ে গেল। বন্ধ হয়ে গেল সুরাইয়া বেগমের স্কুলে পড়ানোও। তিনি বেশ ভেঙে পড়লেন।

তার স্বামী তাকে ভীষণ ভালোবাসতেন৷ স্ত্রীর কষ্ট তার সহ্য হলো না। তিনি কথা দিলেন, এই গ্রামেই তিনি স্কুল করে দেবেন। সেই স্কুলেই তার স্ত্রী শিক্ষকতা করবেন।

তিনি ছিলেন সাধারণ চাকুরে। অল্প কিছু বেতন পেতেন মাস শেষে৷ চাকরির টাকায় তার পক্ষে স্কুল করা সম্ভব ছিল না। তিনি নিজের পৈতৃক সম্পত্তির বড় একটা অংশ বিক্রি করে দিলেন। স্কুল হলো।

গ্রামের লোকজন প্রথম প্রথম তার এই কান্ডে হাসাহাসি করতে বাকি রাখল না। কতকিছুই না বলেছিল তারা! সেসব এখন অতীত। স্কুলটা আস্তে আস্তে চলতে শুরু করেছিল। সুরাইয়া বেগমের দক্ষতায় এখন এই স্কুলটাই কয়েক গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে ভালো স্কুল।

কিন্তু দুঃখেত বিষয় হলো, স্কুলটা ভালো করে চলতে শুরু করার আগেই সুরাইয়া বেগমের স্বামী মারা গিয়েছিলেন। তবে দু’জনের স্বপ্ন আর ভালোবাসা এখনো বেঁচে আছে।

তনয়া চারদিকে তাকিয়ে দেখল কী সুন্দর পরিবেশ! বাচ্চাদের কলকাকলিতে মুখরিত স্নিগ্ধ শীতল বাতাস। ওর মন ভরে গেল। সে স্কুলেই বসে রইল মায়ের কাজ শেষ হওয়া অবধি। টিফিনের সময় মায়ের সাথে বসে বাড়ি থেকে আনা খাবার খেল।

মা বোধহয় তখনই স্বরূপকে ফোন করেছিলেন৷ একটু পর তনয়া দেখল স্বরূপ এসেছে। সাথে মিলি। গতকাল রয়ে গিয়েছিল সে। মিলি অসম্ভব সুন্দর। তনয়ার থেকেও অনেক বেশি সুন্দর। ওকে তনয়ার এত ভালো লাগে! কিন্তু আজ এই গ্রামের পরিবেশে তার পশ্চিমা পোশাক বেমানান লাগছে।

ওরা একসাথে ঘুরতে বের হলো। এখান থেকে অটোরিকশায় করে বড় বিলে যাওয়া যায়। সেখানে নাকি অজস্র পদ্ম ফোটে।

ওরা বড় বিলে পৌঁছুল বিকেলে। তখন দুপুরের চড়া রোদ নরম হয়ে এসেছে। পাড়ে দাঁড়িয়ে যতদূর চোখ যায় শুধু পদ্ম আর পদ্ম। ওরা একটা নৌকা ভাড়া করে উঠে পড়ল। তনয়া শাড়ি পরে এসেছে। নীল রঙের শাড়ি। পরিবেশ অনুযায়ী খুব মানিয়ে গেছে। মিলি বারবার আফসোস করল, কেন যে শাড়ি পরে এলাম না!

বিলের মাঝ বরাবর গিয়ে দেখা গেল পাড় দেখা যায় না। যেন পদ্মের একটা সমূদ্রে চলে এসেছে তারা! মিলির জামা ম্যাচ না হলেও সে ছবি তুলতে কার্পন্য করল না। স্বরূপকে ক্যামেরাম্যানের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হলো। তনয়ার ছবি তুলতে ইচ্ছে করল না। সে চুপচাপ মাঝির পাশে বসে রইল। স্বরূপ আর মিলি কয়েকবার তাকে বলল। কিন্তু সে জায়গা থেকে উঠল না। এত সুন্দর পরিবেশ স্মৃতিতে ধারণ করলেই বরং বেশি ভালো লাগবে। অত পোজ দিয়ে ছবি তুলে বড়জোর প্রোফাইলের ছবি বদলে দেয়া যাবে! আর কী লাভ হবে?

ওর খুব বিরক্ত লাগতে লাগল মিলির ওপর। এই মেয়েটা না থাকলে সে স্বরূপের হাত ধরে বসে থাকত। মিহি বাতাস গায়ে মেখে ওর কাঁধে মাথা রেখে দিগন্তে আকাশ আর জল এক হয়ে যেতে দেখত। স্বরূপকে আবদার করত পদ্ম তুলে দিতে। কিন্তু এদিকে ফটোসেশন শেষ হবার নাম নেই।

অপূর্ণ মনোরথেই তনয়াকে ফিরতে হলো। সূর্য তখন পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। অটোরিকশায় বসে ঠান্ডা হাওয়া খেতে খেতে তারা বাড়ি ফিরল। আগামীকাল তারা ফিরে যাবে। আজ শেষ রজনী।

সারাদিন ঘুরে খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল তনয়া। স্বরূপ মায়ের সাথে গল্প করছিল বাইরে। সে ঘরে এসে শুয়ে পড়ল। চোখ লেগে এলো কখন যেন৷

গভীর ঘুমে একসময় তার মনে হলো কেউ তাকে যেন টানছে, কিংবা ঠেলছে। তনয়ার ঘুম আধো আধো ভাঙল। চোখ মেলল না সে। তবে বুঝতে পারল পাশের মানুষটা তাকে টেনে নিয়ে বুকে জড়িয়েছে। অভ্যাস হয়ে গেল এই ক’দিনেই? তনয়ার ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটল।

*

স্টেশনে তনয়াকে নিতে বাবা মা দু’জনেই এসেছেন। ট্রেন থেকে নেমে তাদের দেখতে পেয়েই চিৎকার করে ছুটে গেল তনয়া। জড়িয়ে ধরল মা বাবাকে। ওনারা ওখান থেকেই ওকে নিয়ে যাবে।

স্বরূপের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গাড়িতে চড়ে বসল তনয়া। একদিকে বাসায় যাবার প্রচন্ড আনন্দ আবার অন্যদিকে মনে চাপা কষ্টও কাজ করছে। স্বরূপকে অনেকবার বলা হয়েছিল, সে যাবে না। অফিসে যেতে হবে। কত কী নাকি কাজ আছে! বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি যাবার যে রীতি আছে সেটা পালন করা হলো না। ওদের দার্জিলিং যাবার তারিখ ফিক্সড৷ এখন নাকি অফিসের কাজকর্ম ম্যানেজ করে রাখতে হবে। নইলে এই বিয়ের ছুটির পরপর আবার ছুটি পাওয়া যাবে না।

তনয়া গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। মিলিও এসেছিল ওদের সাথে। সে হাত নাড়ছে। স্বরূপ পাশে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে। তার দৃষ্টি ধোঁয়াশার মতো। তাতে আবেগ খুঁজতে গিয়ে ব্যর্থ হলো তনয়া৷ ওর কি একটুও কষ্ট হবে না? একফোঁটাও না?

*

সারাদিন মা বাবার সাথে কাটিয়ে, মায়ের হাতের রান্না খেয়ে রাতে নিজের ঘরে ঘুমুতে গিয়ে তনয়ার ভারি শান্তি শান্তি লাগল। এতদিন মনে হচ্ছিল সে যাযাবর হয়ে গেছে। আজ শান্তির ঘুম হবে। কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে নরম গদিতে গা ডুবিয়ে আরামে চোখ বন্ধ হয়ে এলেও পরমুহূর্তে চোখ খুলে গেল। সব আছে, তবু কী যেন নেই। তার এতদিনের সঙ্গী কোলবালিশটাকে পছন্দ হচ্ছে না। মনে হচ্ছে পাশে আস্ত মানুষ চাই। মানুষের গায়ের ঘ্রাণ চাই। বুকের উষ্ণতা চাই।

কিন্তু এই কিছুদিন আগেও তো সব ঠিক ছিল৷ এই ঘরে, এই বিছানায় তার সব শান্তি গুটিশুটি হয়ে পড়েছিল।বিয়ে হওয়া মানেই কি তবে নিজের পুরানো অস্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে দেয়া? নিজেকে দু’ভাগ কর ফেলা?

স্বরূপ এখন কী করছে?

*

স্বরূপ ল্যাপটপে কাজ করছিল। প্রচুর কাজ জমেছে। তার পাশে ধূমায়িত কফির কাপ। স্ক্রিন থেকে চোখ সরছে না মুহূর্তের জন্যও। এসব কাজ তাকে সবসময়ই করতে হয়। কখনো খারাপ লাগেনি। আজ লাগছে। পুরোপুরি বিরক্ত লাগছে। তার রাত জাগার অভ্যাস ছিল। অদ্ভূত কারনে জলদি ঘুমিয়ে পড়া সিন্ডারেলাকে জড়িয়ে ধরলে তার ঘুম চলে আসত। আজও আসছে। কিন্তু সিন্ডারেলা নেই। সে জানে, বিছানায় যাওয়ামাত্র তার ঘুম নির্বংশ হবে। কিন্তু এখন একেকটা হাই তোলা তাকে বারবার ঘুমের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। কিন্তু এই ঘুম একা একা ঘুমুবার নয়৷ কী বিরক্তিকর বিষয়!

স্বরূপ একসময় ল্যাপটপ বন্ধ করে বারান্দায় গিয়ে বসল। তনয়ার প্রতি তার আকর্ষণটা সে কী দিয়ে ব্যাখ্যা করবে? শরীরী আকর্ষণ? শুধুই কি তাই? তাই হবার কথা। কারন মেয়েটাকে তার সারাক্ষণ মনে পড়ছিল না। এইযে রাতে ঘুমানোর সময় হয়েছে, এখন মনে পড়ছে। স্বরূপ আস্ত সিগারেট শেষ করতে করতে মস্তিষ্কের জটিল চিন্তা সরলীকরণ করে ফেলল। তনয়ার জন্য সে যা অনুভব করছে তার পুরোটাই জৈবিক প্রয়োজন। আর কিছুই নয়। আরেকটা বিষয় হলো মেয়েটা ভালো। তাই কয়েকদিন একসাথে থেকে ওর একটা প্রভাব তার মনের মধ্যে ছাপ ফেলে গেছে।

উঠে পড়ে আবার ল্যাপটপ অন করল সে। তখনই তনয়ার ফোন এলো। ঘড়িতে বারোটা চল্লিশ।

ফোন ধরে সে বলল, “ঘুমাওনি?”

তনয়া আহ্লাদি স্বরে বলল, “না। ঘুম আসছে না।”

“সিন্ডারেলাদের ঘুম আসতে এত দেরি হয় জানতাম না তো।”

“একটা রাক্ষস ওর ঘুম চুরি করে পালিয়ে গেছে।”

স্বরূপ মুখ দিয়ে চু চু শব্দ করে বলল, “আহারে! তা এখন কী করতে হবে?”

“রাক্ষটাকে এসে ঘুম দিয়ে যেতে হবে।”

“পারলে রাক্ষস বধ করে ঘুম নিয়ে যাও।”

“যাহ! কী বলো!”

“যা মনে হলো তাই।”

“কাল এসো না এখানে। তোমাকে মিস করছি।”

স্বরূপ হেসে বলল, “মিস করলে নিজে চলে এসো। আমি পারব না যেতে।”

“তুমি খুব খারাপ।”

“রাক্ষস জাতি ভালো ছিল কবে?”

“গতকালও ভালো ছিল।”

“খারাপ লোকের সাথে কথা বলতে রাত বিরাতে ফোন করছো কেন?”

“স্যরি, বাই!”

“বাই বাই।”

স্বরূপ ফোন কেটে দিল। তনয়া ভাবেনি এভাবে ফোন কাটবে সে। ভেবেছিল তাকে কিছু বলে মানাতে চেষ্টা করবে। আস্ত পাজি তো!

আধঘন্টা পর তনয়ার নাম্বার থেকে ভিডিও কল এলো। এখনো জেগে! স্বরূপ দেরি করল না। তনয়াকে দেখতে ইচ্ছে করছিল। ছবি বের করতে গিয়েও নিজের মনের সাথে লড়াইয়ে পেরে উঠছিল না। কল ধরে দেখল অন্ধকার। সে বিরক্ত মুখে বলল, “অন্ধকারই যখন দেখাবে তখন ভিডিও কল করেছ কেন?”

তনয়া উত্তর দিল, “তোমাকে দেখতে।”

“দেখা হলো তো? বাই!”

“আরে দাঁড়াও দাঁড়াও। আমাকে দেখবে?”

“দেখাও।”

তনয়া আলো জ্বালিয়ে দিল। স্বরূপ ছিটকে উঠল। মোবাইলটা আরেকটু হলে হাত থেকে পড়ে যেত। ভয়ানক একটা চেহারা দেখা যাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ড লাগল তার বুঝতে যে ওটা তনয়া। কাজল আর লিপস্টিক মেখে ভূত সেজেছে৷

তনয়া খিলখিল করে হাসছে। স্বরূপ দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “প্রতিশোধ?”

“না তো, তুমি আমাকে ভুত ডাকো তাই ভূত হয়ে দেখালাম।”

“ভূত ডাকি না, ভুতু ডাকি।”

“সে যাই হোক, আমাকে কেমন লাগছে বলো।”

“ভূতের এক্সিবিশন হলে প্রেজেন্ট করা যাবে, কেউ সন্দেহও করবে না যে তুমি মানুষ।”

“বাহ! তাহলে ভালো সেজেছি বলো!”

“তুমি যা তাই সেজেছ, খারাপ কী?”

“তুমিও তাহলে ঝন্টু মিয়া সেজে বসে থাকো।”

“কেমন করে সাজে?”

“মুখে ছাগলদাড়ি আর মাথায় চারকোনা টুপি পরলেই চলবে।”

স্বরূপ হাসল। কথা চলল আরও অনেকক্ষণ। স্বরূপের আর কাজ করা হলো না। ফোন যখন রাখল তখন ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে তার।

*

পরপর কয়েকদিন একই রুটিন চলল। সারাদিন দু’জন ব্যস্ত থাকে, রাতে ভিডিও কলে কথা হয়। তনয়াই কল করে। সে প্রথমদিন ভূত সেজেছিল, এরপর থেকে উল্টোপাল্টা সব ফিল্টার দিয়ে রাখে মুখের ওপর। আসল চেহারা স্বরূপকে দেখতে দেয় না। স্বরূপ নানা কথা বলে ফিল্টার সরানোর চেষ্টা করে। তনয়া সরায় না। তার কথা হলো সে স্বরূপকে দেখতে ফোন করেছে। স্বরূপের যদি তাকে দেখতে ইচ্ছে হয় তাহলে যেন নিজে কল করে নেয়।

স্বরূপ করে না। রোজ ইচ্ছে করে, তবুও করে না। একদিন আর থাকতে না পেরে করে ফেলল। তনয়া খুশি হয়ে কল ধরল। কয়েকদিন পর তনয়ার স্বাভাবিক চেহারা দেখে কেমন ভালো লাগতে শুরু করল স্বরূপের। তনয়া বলল, “অবশেষে ফোন করলেন তাহলে!”

স্বরূপ তা স্বীকার করবে কেন? সে বলল, “ভুলে করেছি। আসলে মা’কে ফোন করছিলাম।”

তনয়া সাথে সাথে কল কেটে দিল। স্বরূপ থতমত খেয়ে গেলেও আর কল করল না। তনয়াও সেদিন আর স্বরূপকে কল করল না। তার পরের দিনও না।

স্বরূপের শ্বশুরবাড়ি যাবার কথা ছিল শুক্রবার। সে বৃহস্পতিবার অফিস থেকে ফেরার পথে কী মনে করে শ্বশুরবাড়ির দিকে রওনা দিল। তনয়া দু’দিন ধরে কথা বলছে না। তার রাতের ঘুম তো হচ্ছেই না, কাজকর্মও লাটে ওঠার জোগাড়!

তনয়া স্বরূপের এই অনাকাঙ্ক্ষিত আগমনে সব রাগ ভুলে গিয়ে হাসিমুখে বলল, “ইশ! তুমি কি এই কদিনে আরো সুন্দর হয়েছ?”

স্বরূপ অবাক হয়ে বলল, “সুন্দর হব কেন? কাজের চাপে আরও শুটকি লেগে গেছি।”

“কিন্তু আমার কাছে আগের চেয়েও বেশি সুন্দর লাগছে।”

*

সেই রাতে তনয়ার ঘুম খুব ভালো হলো। তার মনে হলো এতদিনে তার ঘরের শান্তি ফিরে এসেছে। সব আগের মতো হয়ে গেছে। শুধু ওর কোলবালিশটা বদলে গেছে এই যা!

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-১৪

0

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
১৪.

পরদিন সারাদিন তনয়া স্বরূপের দেখা পেল না বললেই চলে। সে ব্যস্ত রইল নানান কাজে। তনয়ার কাজ নেই, সে নতুন বউ বলে কেউ কিছু ছুঁতে দেয় না। গ্রামে তেমন নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না বলে তনয়ার সময়ও কাটছিল না। দুপুরে খাবার সময় তার পরিচয় হলো স্বরূপের চাচাতো বোন মিতার সাথে। মিতার কলেজে পরীক্ষা ছিল বলে সে গতদিন আসতে পারেনি, আজ সকালে পরীক্ষা দিয়ে চলে এসেছে৷ সে এবার এইচএসসি দেবে। বয়সে ছোটো হলেও খুব মিশুক মেয়েটা তনয়ার সাথে মিশে গেল সহজেই। মিতা ওকে বলল বিকেলের দিকে কাজ না থাকলে তাকে নিয়ে ঘুরতে বের হবে। তনয়া জানাল, সে খুশি হয়ে অপেক্ষা করবে।

স্বরূপ দুপুরে খেতে এলো বেশ দেরিতে। কোনোরকমে খেয়ে আবার বেরিয়ে গেল। তনয়ার সাথে কথা হলো না৷ তনয়া বাইরের ঘরে একটু উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল স্বরূপের সাথে একটু কথা বলার আশায়, কিন্তু স্বরূপ তাকে চেনে না এমন ভান করে চলে গেল। এদিকে তাকিয়েও দেখল না। তনয়ার অভিমান হলো। সে স্বরূপকে বিকেলে বের হবার কথা জানাতে চেয়েছিল, জানানো হলো না। যাকগে, ও নিজের মতো থাকুক৷ তনয়া এমনিতেও সঙ্গী পেয়ে গেছে।

বিকেলের দিকে সত্যিই মিতা চলে এলো। সে-ই বাড়ি থেকে অনুমতি আদায় করল। তারপর দুজন বেরিয়ে পড়ল। তনয়ার পরনে সবুজ রঙের একটা শাড়ি৷ গয়নাগাটি তেমন পরেনি, শুধু হাতে গতকাল শাশুড়ীর দেয়া মোটা বালা আর কানে ঝুমকা। শাড়ির আঁচল দিয়ে সুন্দর করে মাথা ঢেকে বের হলো সে। যে কেউ দেখলে বলবে নতুন বউ।

ওরা যত সামনে যাচ্ছিল তনয়ার তত ভালো লাগছিল। গতকাল গাড়ির ভেতর থেকে সবটা দেখা হয়নি। ছোটো ছোটো ঘর, মাটির চুলা, ঝাঁট দেয়া পরিষ্কার একচিলতে উঠোনের বাড়িগুলো গায়ে গা লাগানো৷ একধারে নেমে যাওয়া দিগন্ত বিস্তৃত ধানক্ষেত। দূরে তালগাছের সারি৷ ছোটোবেলায় যেমন গ্রামের দৃশ্য আঁকত, তেমন হাতে আঁকা চমৎকার একটা গ্রাম৷

তনয়ার অনুরোধে অনেকদূর চলে গেল তারা। একটা বড় পুকুরের ধারে এসে থামল। জায়গাটা নির্জন, পুকুরের চারদিকে গাছপালা আর ঝোপঝাড়ে ভর্তি৷ মানুষজন নেই। মিতা জানাল এখানে দুপুরে মহিলারা গোসল করতে আসে৷ এখন পড়ন্ত বিকেল বলে কেউ নেই। সুন্দর হাওয়া দিচ্ছে। ঝিরঝির বাতাসে পুকুরের পানিতে কাঁপন ধরেছে। তনয়া মুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। মিতা তাকে বলল, “চলো এবার ফিরি।”

তনয়া অনুরোধের দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, “একটু থাকি? জায়গাটা এত শান্তির!”

মিতা বলল, “আচ্ছা, কিন্তু বেশি দেরি করা যাবে না৷ সন্ধ্যা হলে বাড়ির সবাই আমাকে খেয়ে ফেলবে।”

সে একটা নিচু গাছের ডাল দেখিয়ে বলল, “চলো এখানে বসি।”

নির্জন জায়গা দেখে বসার পর তনয়া ঘোমটা খুলে ফেলল। চুলের খোঁপাও খুলে দিল। তার ভীষণ সুন্দর রেশমী চুলগুলো মৃদু বাতাসে ঢেউ খেলতে লাগল। ওর শরীর মন জুড়িয়ে যাচ্ছিল। এত শান্তির পরিবেশ উপভোগ করতে ভাগ্য লাগে। তার বারবার বিভূতিভূষণের উপন্যাসের কথা মনে পড়তে লাগল। ‘আরণ্যক’এ এরকম একটা জায়গার কথা ছিল না? সরস্বতী কুন্ডি!

একসময় মিতা উঠে পড়ল৷ “চলো, এরপর অনেক বেশিই দেরি হয়ে যাবে।”

তনয়াও লাফিয়ে নামতে গেল ডাল থেকে। হঠাৎ তার শাড়িতে টান পড়ল। সে কিছু বুঝে ওঠার আগেই একটা হাত ওর কাঁধ ছুঁয়ে গেল। শাড়ির আঁচলটা খসে পড়ল। তনয়া পেছনে ফিরে একজোড়া চকচকে চোখ দেখতে পেল। একটা লোক! মিশমিশে কালো গায়ের রঙ। তনয়ার মনে হলো সে ভূত দেখছে। চিৎকার করে উঠল সে। নিরবতা ভেঙে খানখান হয়ে গেল।

মিতা অন্যদিকে তাকিয়েছিল৷ এসবের কিছুই তার নজরে আসেনি। মাত্র কয়েক মুহূর্তেই সবটা ঘটে গিয়েছিল। সে প্রথম শুনল তনয়ার চিৎকার, তারপর পায়ের নিচে শুকনো পাতার মচমচ শব্দ তুলে দৌড়ে যাওয়া একটা কালো ছায়া।

*****

সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। দু’জন একে অপরের হাত ধরে যখন বাড়ি ফিরছিল তখন আশ্চর্য এক নিস্তব্ধতা যেন ঢেকে দিয়েছিল পথঘাট। কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছিল না৷ পুরো গ্রাম কি ঘুমিয়ে গেল? তারা বহুক্ষণ হেঁটেও যেন বাড়ি পৌঁছুতে পারছিল না৷ অবশ্য তারা গিয়েছিল এমন পথ ধরে যেদিক দিয়ে গ্রামের লোকজন কম চলাচল করে।

হয়তো ওদের ভাগ্য কিংবা কোনো অদৃশ্য টানে পথে তাদের সাথে দেখা হওয়া প্রথম ব্যক্তিটি ছিল স্বরূপ৷ প্রথমে সে ভীষণ অবাক হলো। তারপর কাছে এসে মিতাকে জিজ্ঞেস করল, “তোরা এখানে কেন?”

মিতা উত্তর দিতে পারছিল না৷ তনয়া তখনো কাঁপছে। তার চোখ ভেজা। অন্ধকার তখনো পুরোপুরি জেঁকে বসেনি৷ মৃদু আলোয় স্বরূপের চোখে তনয়ার ফ্যাকাসে মুখের ভাব ধরা পড়ে গেল। সে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে তোমার তনয়া?”

স্বরূপ তনয়ার অপর হাতটা ধরল। ওর এক হাত মিতার হতে ধরা ছিল। দু’জন দু’দিকে দিয়ে তাকে ধরে নিয়ে যখন বাড়ি ফিরল তখন বাড়ির লোক আলো নিয়ে তাদের খুঁজতে বের হতে যাচ্ছে। গমগমে পরিবেশে এসে মিতার ভয় অনেকটা কেটে গেল। তবে বাড়িতে ঢুকেই সবার কাছ থেকে একগাদা বকুনি খেতে হলো তাকে। চুপচাপ শুনে গেল সে৷ একটা শব্দও করল না। তার মুখের ভয়ার্ত ভাবটা কেউ খেয়াল করল না। খেয়াল করলেও তারা ধরে নিত বকা খেয়ে ভয় পেয়েছে মেয়েটা।

স্বরূপ তনয়াকে ঘরে রেখে এসে মিতাকে পাকড়াও করল। “এবার বল, কী হয়েছে?”

মিতা সবটা খুলে বলল তাকে। লোকটাকে সে চিনতে পেরেছিল। এই গ্রামেরই লোক। বখাটে ধরনের। গ্রামের মেয়ে বউদের প্রায়ই উত্যক্ত করে থাকে৷ কিন্তু ওর বাবা ধনী লোক। গ্রামের অনেকেই তার কাছে সুদে টাকা ধার করে, জমি বন্ধক রাখে। কারও সাহস হয় না ওর বিরুদ্ধে কিছু করার৷ লোকটা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে।

স্বরূপ সব শুনে খুব ঠান্ডা গলায় মিতাকে বলল, “তুই তোর ভাবির কাছে গিয়ে বস। আমি আসছি।”

মিতা তার কথামতো ভাবির ঘরে চলে গেল। সেখানে তনয়া একা নয়, কিছু মহিলা বসে খোশগল্প করা শুরু করে দিয়েছিল। তনয়ার মুখের অনেকটা তখনো ঘোমটায় ঢাকা। কেউ খেয়াল করেনি তার চোখে অল্প করে জল কমছে। হাত মৃদু মৃদু কাঁপছে। মিতা ভাবির পাশে গিয়ে বসে তার হাত শক্ত করে চেপে ধরল।

****

সময় কতটা পেরিয়েছিল তাদের খেয়াল নেই৷ একসময় বাড়ির উঠোনে চিৎকার আর ধস্তাধস্তির শব্দে ভেতর থেকে সবাই বেরিয়ে এলো। উঠোনে মিশমিশে কালো একটা লোককে এনে ফেলা হয়েছে। লোকার শরীর রক্তাক্ত। তার ওপর চড়াও হয়ে থাকা স্বরূপের গাল কেটেও রক্ত বের হচ্ছে। কিন্তু তার ওপর কোনো অসুর ভর করেছে যেন। শক্ত-সামর্থ্য গ্রাম্য লোকটাকে সে শুইয়ে ফেলে প্রবল আক্রোশে একেকটা ঘুষি বাগিয়ে দিচ্ছে।

কয়েকজন গ্রামের লোক ওদের পিছু পিছু চলে এসেছিল। বাড়ির লোক আর আশেপাশের আরও কিছু লোক এসে ওদের লড়াই থামাল। স্বরূপের কথামতো লোকটাকে বেঁধে ফেলা হলো উঠানের আমগাছের সাথে।

স্বরূপ তখন হাঁপাচ্ছে। ঘাম আর রক্তে তার শার্ট ভিজে চুপচুপে হয়ে গেছে। তবে সে বসল না। গ্রামের লোকের প্রশ্নের জবাবে বলল, “ও আমার স্ত্রীকে উত্যক্ত করেছে। ও গ্রামের আরও মহিলাদের জ্বালাতন করে। আপনারা কিছু না বললে সেটা আপনাদের ব্যাপার৷ আমি তো সহ্য করব না এসব।”

তার কথায় অনেকেই সায় দিল। কিছু মহিলা সেখানেই বলে ফেলল সিরাজ তাদের সাথে কী কী করেছে৷

মিশমিশে কালো ভূতের মতো অন্ধকারের সাথে মিশে যেতে চাওয়া সিরাজ নামক লোকটা তখনো কুতকুতে হলদে চোখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। স্বরূপের ইচ্ছে হলো ওর চোখদুটো অন্ধ করে দিতে।

স্বরূপের ইচ্ছে ছিল সিরাজের প্রথমে বিচার হবে, তারপর তাকে ছাড়া হবে। কিন্তু সেসব কিছু হলো না। সিরাজের বাবা নিজেই এসে সবার কাছে হাত জোড় করে ক্ষমা চাইলেন। ছেলেকে ছেড়ে দেবার জন্য মিনতি করে বলে গেলেন আর কখনে এমন হবে না৷

লোকটার এমন কান্ডের কারন ছিল। স্বরূপের মা এলাকায় কম প্রভাবশালী নন। গ্রামের একমাত্র স্কুলটা তিনিই গড়েছেন। গ্রামে তিনি বাদে বাকি যে ক’জন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন সবাই স্বরূপের মায়ের পক্ষেই থাকবেন। সেক্ষেত্রে ছেলের এবারের দোষ ঢাকার চেষ্টা করলে উল্টো তিনি নিজেই বিপদে পড়তে পারতেন।

স্বরূপের রাগ কমল না। তবুও সে নিজেকে সামলে নিয়ে ঘরে ঢুকল। তখনো তার গা ভেজা। গায়ে লেগে থাকা রক্তের কতকটা তার, কতকটা সিরাজের। তার মাথা ব্যথা করছিল প্রচন্ড। সারাদিন কাজ করার পর এই ঝক্কিতে কাহিল লাগছিল।

মা তাকে বসিয়ে হাত আর গালের কাটা জায়গা স্যাভলন দিয়ে পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিলেন। তনয়া তখনো চুপচাপ। এক কোণায় দাঁড়িয়ে সবটা দেখছিল সে।

স্বরূপ ঘরে গিয়ে জামা বদলে এসে দেখল খাবার বেড়ে ফেলেছেন মা। ওরা একসাথে বসে খেয়ে নিল। তারপর কিছু লোক স্বরূপের সাথে কথা বলতে চাওয়ায় সে বাইরের ঘরে চলে গেল।

তনয়া নিজের ঘরে গেল না। তার প্রচন্ড ভয় করছে। সে শাশুড়ী মায়ের নিষেধ সত্ত্বেও তার সাথে হাতে হাতে কাজ করল। কাজ শেষে তার ঘরে গিয়ে বসে রইল।

মা বুঝলেন ওর মনের অবস্থা। পাশে বসে সান্ত্বনা দিলেন অনেকক্ষণ। গল্প শোনালেন নিজের। যখন স্বরূপের বাবা মারা গেল তখন তাকেও কম যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়নি। গ্রামের দুয়েকজন লোক উঠেপড়ে লেগেছিল তাকে বিয়ে করতে। কতকিছু সহ্য করেছেন তিনিই জানেন। তনয়া মাকে জড়িয়ে ধরল এবার। এটা তার মা নয়, স্বরূপের মা। তাতে কিছু যায় আসে না। মায়েদের গায়ে মা মা ঘ্রাণটা থেকেই যায়, সে যার মাই হোক না কেন।

*****

স্বরূপ অনেক রাতে ঘরে ফিরল। তনয়াকে না পেয়ে খুঁজতে গিয়ে দেখল সে মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়ে বসে আছে। স্বরূপ যেতেই মা তাকে পাঠিয়ে দিলেন৷

শুয়ে পড়ার আগে তনয়া বলল, “আজকে লাইটটা জ্বালানো থাকুক?”

“না তনয়া। আজও লাইট বন্ধ থাকবে। তোমার ভয় কাটাতে হবে। ভয় জিইয়ে রেখে কোনো লাভ নেই। আর আমি আছি তো।”

স্বরূপ বিছানায় এসে তনয়ার হাত ধরল। ও তখনো কাঁপছে। স্বরূপ জড়িয়ে ধরল তাকে। শক্ত করে ধরে রাখল। তনয়া স্বরূপের বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। বলল, “আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম…ও… ও আমার আঁচল টেনে ফেলে দিয়েছিল…”

স্বরূপ তার মাথা বুকে চেপে বলল, “ভয় নেই। আর কেউ কিছু করবে না তোমার।”

“তুমি থাকবে তো আমার সাথে?”

“হ্যাঁ তনয়া। আমি আর কখনো তোমাকে একা ছাড়ব না। কোনোদিনও না।”

তনয়া কাঁদতে কাঁদতেই একসময় ঘুমিয়ে পড়ল। স্বরূপ ক্লান্ত ছিল। তার চোখেও ঘুম নেমে এলো একসময়। সে আজ একটু আগে তনয়াকে যে ওয়াদা করেছিল সেটা নিজের অজান্তেই করেছিল। সচেতন মস্তিষ্কে যে ছেলেটা মনপ্রাণে চাইছিল মেয়েটা তার সাথে থেকে আফসোস করে মরে যাক, তাকে সে সারাজীবন কাছে থাকার ভরসা দিত না।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-১৩

0

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
১৩.

তনয়ার পা দুটো ব্যথা করছে। ব্যথা করছে মাথাও৷ গতরাতে ভালো করে ঘুম হয়নি। আর আজ আসার পর থেকে সে বসে আছে বউ সেজে। পুরো গ্রামের লোক ভেঙে পড়েছে তাকে দেখার জন্য৷ ভারী একটা কাতান শাড়ি পরে সে বহুক্ষণ ধরে একই ভঙ্গিমায় বিছানার ওপর বসে আছে সেই বিকেল থেকে। পা পর্যন্ত নাড়াবার উপায় নেই। একগাদা মুরুব্বি গোছের মহিলা পান মুখে দিয়ে খোশগল্পে মেতে উঠেছে। তনয়াকে তাদের ভারি পছন্দ হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তনয়ার কাছে তাদের হাজারো প্রশ্ন জমা হয়েছে। বেশিরভাগ প্রশ্ন তনয়া বুঝতে পারছে না৷ গ্রাম্য টানে বলা কথাগুলো তার মাথার ওপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। তার ওপর ব্যথায় মাথার দুই পাশের রগ টনটন করছে।

শাশুড়ী মা তাকে একসময় এই বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন। ঘরে ঢুকে কীসব বলে যেন মহিলাদের দলটাকে বিদায় করে দিলেন। তনয়াকে বললেন, “তুমি তোমার ঘরে চলো। তোমাকে দেখে তো সুস্থ মনে হচ্ছে না৷ আসতে খুব কষ্ট হয়েছে তাই না?”

তনয়া কিছু বলল না৷ কষ্ট তার সত্যিই হয়েছে। নড়তে গিয়ে সে বুঝল, পুরো শরীর ব্যথা। রাতে ট্রাকের দুলুনি আর বিকেলের গরুর গাড়ির দুলুনি শরীরের জয়েন্টগুলোতে ব্যথা বানিয়ে দিয়েছে।

সে যখন ঘরে ঢুকল তখন দেখল স্বরূপ বসে আছে বিছানায়। তার হাতে একটা বই। ভারি মনোযোগ দিয়ে সে কিছু একটা পড়ছে। তনয়াকে একবার চোখ তুলে দেখে আবার বই পড়ায় মনোযোগ দিল। তনয়া এগিয়ে গেল স্যুটকেসের দিকে। শাড়িটা বদলে ফেলা খুব জরুরি।

স্বরূপের কিছুটা খারাপ লাগছিল সকাল থেকেই। তনয়ার হয়তো তার প্রতি অনেক চাহিদা আছে, অনেক আশা আছে। সেসব সে পূরণ করতে পারছে না৷ চাইলেও পারবে না৷ তার এত অনুভূতি নেই। অনুভূতি সব মরে গেছে। মৃত অনুভূতিগুলো আস্তাকুঁড় থেকে খুঁজে এনে তাদের জীবিত করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সে চাইলে বড়জোর কিছুটা অভিনয় করতে পারে। কিন্তু সেটাও এক ধরনের ঠকানো। আর তারও বা কী প্রয়োজন? মেয়েটা তাকে নিজের ইচ্ছেয় বিয়ে করেছে। সে তো জোর করেনি।

*****

ওদের বাড়িটা নতুন৷ আগের টিনের ঘর ভেঙে মাত্র কয়েক বছর আগেই একতলা পাকা দালান তোলা হয়েছে। স্বরূপের ঘরের সাথে এটাচড বাথরুম আছে। বাথরুমে টাইলস লাগানো। বাথরুমটা পছন্দ হয়েছে তনয়ার। সে শাড়িটা খুলে ফেলে ট্যাপ ছেড়ে দিল। প্রচন্ড ঠান্ডা পানি। পানির সাথে যেন বরফকুচি বেরিয়ে আসছে। তাড়াতাড়ি ট্যাপ বন্ধ করে দিল সে। হাতমুখ ধোঁওয়া হলো না৷

ঝুলিয়ে রাখা জামার দিকে হাত বাড়াতে গিয়ে সে প্রথমবার জিনিসটা দেখল। কালো, রোমশ বড়সড় একটা আস্ত মাকড়সা দেয়ালে বসে আছে। তনয়া মাকড়সা প্রচন্ড ভয় পায়। তার ইচ্ছে হলো চিৎকার করতে। কিন্তু গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হলো না৷ কোনোক্রমে সে আস্তে আস্তে দরজার কাছে চলে গেল। দরজার ছিটকিনি খুলে গুলির মতো বেরিয়ে পড়ল বাথরুম থেকে।

স্বরূপ চোখ তুলে হা হয়ে গেল। একি অবস্থা! তনয়া তখন কাঁপছে। তার গায়ের স্বল্প কাপড়ের দিকে তখন নজর নেই। স্বরূপ তার কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রাখল। “তনয়া! কী হয়েছে?”

“মাকড়সা!”

“মাকড়সা?”

“হ্যাঁ।”

স্বরূপ হো হো করে হেসে ফেলল। কেউ মাকড়সা দেখে কেমন করে ভয় পেতে পারে! তবে তনয়ার চেহারা দেখে থমকে গেল। মেয়েটা সত্যিই ভয় পেয়েছে। নইলে এভাবে বের হয়ে আসত না৷

স্বরূপ বাথরুমে ঢুকে মাকড়সাটা মারার জন্য স্যান্ডেল হাতে নিল। তনয়া তখন চেঁচাল, “মারবে না প্লিজ!”

স্বরূপ অবাক হয়ে বলল, “তুমিই তো ভয় পাচ্ছো।”

“সেটা আমার সমস্যা। মাকড়সার না৷ ওকে তাড়িয়ে দাও, তাহলেই হবে।”

স্বরূপ বিড়বিড় করে বলল, “ওকে তাড়াব! ঠিক আছে!”

সে মাকড়সার কাছে গিয়ে বলল, “জনাব মাকড়সা, আপনি কি নিজে থেকে যাবেন নাকি আমি গিয়ে দিয়ে আসব?”

মাকড়সাটা একটু নড়ল৷ স্বরূপ হাত দিয়ে ওটাকে জায়গা থেকে সরিয়ে দিল। মাকড়সা এবার তরতর করে সরে যেতে থাকল। স্বরূপও সাথে সাথে এগুল। “ভাই শুনুন, এরপর থেকে বিশিষ্ট ভদ্রমহিলাদের বাথরুমে ঢুকবেন না৷ এরা বের করে দেবে, কিন্তু জুতোপেটা করতে দেবে না। যাকে বলে, সম্মানের সহিত বের করে দেয়া। আপনার সাথেও তাই হচ্ছে, কী আর করার! আপনি আমার সাথে রাগ করবেন না। আমি কিন্তু কিছু করিনি। সব আমার বউয়ের দোষ। আপনি তো জানেনই বউয়ের কথা না শুনলে কী হাল হতে পারে!”

মাকড়সাটা বোধহয় স্বরূপের বকবক সহ্য করতে না পেরে ঘুলঘুলি দিয়ে বেরিয়ে গেল।

তনয়া হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। স্বরূপ বাথরুম থেকে বেরিয়ে এলে সে ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, “আমি দরজা আটকাব না৷ তুমি কিন্তু তাকাবে না।”

স্বরূপ চোখ বড় করে বলল, “তা কেন? তা কেন? দরজা খুলে রাখলে আমি অবশ্যই তাকাব।”

“আমি ড্রেস চেঞ্জ করব!”

“তাতে আমার কী? আমার ড্রেস তো আর চেঞ্জ করছো না।”

তনয়া ফিচেল হেসে বলল, “চাইলে করে দিতে পারি। দেব?”

স্বরূপ আর কথা না বলে বিছানার দিকে গেল। তনয়া বাথরুমে ঢুকে দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে জামা বদলে নিল। বেরিয়ে এসে বলল, “মাকড়সাটা কিন্তু ছেলে না, মেয়ে। সে বউয়ের যন্ত্রণা বুঝবে কেমন করে?”

“তাহলে আমার কথা শুনে যে চলে গেল?”

“তোমার চেহারা পছন্দ হয়নি, তাই চলে গেছে।”

স্বরূপ সাথে সাথে সিরিয়াস হয়ে বলল, “আমাকে কি খুব খারাপ দেখাচ্ছে? জার্নি করলে চেহারা কেমন একটা হয়ে যায়!”

তনয়া হেসে বলল, “হোক তাতে কী? তোমার তো বিয়ে হয়েই গেছে। চেহারা দিয়ে নতুন কাকে পটাতে চাও?”

“আমার এক প্রেয়সী আছে। গ্রামে এলেই রাতে দেখা করতে আসে।”

“হোয়াট?”

“সত্যি। তবে ও মানুষ নয়, পরী।”

“ধুর!”

“আরে সত্যিই! আমি এতদিন ওর জন্যই তো বিয়ে করিনি৷ আজ ও আসবে। আমি এলেই চলে আসে। তোমাকে ও সতীনের মতো দেখবে। তাই ও আসার আগেই ঘুমিয়ে যাও প্লিজ। ওর জন্য তোমার কোনো ক্ষতি হোক আমি চাই না। ও ঘুমন্ত মানুষদের কিছু করে না।”

কথাগুলো স্বরূপ বলল পুরোপুরি গম্ভীর মুখে। তার কথার ধরন দেখে যে কেউ মনে করবে সে সত্যি কথা বলছে।

চারদিক তখন শুনশান। বাইরে ঝিঁঝি পোকার ডাক বাদে আর কোনো শব্দ নেই। ঘরের ভেতর তনয়া আর স্বরূপ শুধু। ঘরটা বিশাল। সেই তুলনায় আসবাব কম। বড় ঘর হওয়ায় আলোটাও কম উজ্জ্বল লাগছে। তনয়ার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। যদিও সে এসব কথায় বিশ্বাস করে না। ভেতরে ভেতরে ঠিকই জানে, স্বরূপ বাজে কথা বলছে। তবুও কেন যেন ভয় লাগছে।

তবে ভয়টা সে প্রকাশ হতে দিল না৷ বলল, “বাজে কথা যত্তসব!”

“ওর নাম চন্দ্রা।” আবারও গম্ভীর মুখে বলল স্বরূপ।

“পরীতে বিশ্বাস করি না আমি।”

“জ্বীনে তো করো! কোরআন শরিফেই জ্বীনের কথা আছে। ও একটা মহিলা জ্বীন।”

তনয়া এবার একটু একটু বিশ্বাস করতে শুরু করল। স্বরূপ সত্যি বলছে না তো? খুব সিরিয়াস মুখে সে কথা বলছে। মনে হচ্ছে না জোক। সে কি প্র্যাক্টিক্যাল জোক করছে? অসম্ভব নয়। তবুও কেমন যেন লাগছে তনয়ার। সে অনেকটা জোর করেই নিজেকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসিয়ে মুখ, হাত, পায়ে ক্রিম লাগাল, চুল বাঁধল। পুরো সময় সে আঁড়চোখে আয়নার ভেতর দিয়ে স্বরূপের দিলে তাকিয়ে রইল। স্বরূপের মুখ পুরোটা সময়ই বেশ গম্ভীর হয়ে রইল।

বাইরে এমন সময় দুম করে একটা শব্দ হলো। মনে হলো গাছের ডাল ভেঙে পড়েছে। অথচ ঝড় বাদলা কিছুই নেই। তনয়া ভয়ে এক দৌড়ে বিছানায় চলে এলো। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “ওটা কিসের শব্দ?”

“ওর আসার সংকেত।”

“তু…তুমি মজা করছো!”

স্বরূপ ওর দিকে শুধু তাকাল। ওর চোখের ভঙ্গি দেখে মনে হলো সে তনয়াকে ভয় পাওয়াবে না বলে চুপ করে আছে।

তনয়া স্বরূপের কাছ ঘেঁষে এলো। বলল, “আমার কিন্তু ভয় করছে এখন।”

“আচ্ছা, শুয়ে পড়ো। বললাম তো ঘুমাতে দেখলে কিছুই বলবে না।”

“ঘুম আসবে না আমার।”

“চোখ বুজে থাকো।”

“চোখ বুজলেই ঘুম আসে নাকি!”

স্বরূপ আচমকা উঠে গিয়ে লাইট বন্ধ করে দিয়ে এলো। তনয়া ছোটোখাটো একটা চিৎকার দিয়ে বলল, “অ্যাই, লাইট বন্ধ করো কেন?”

“নইলে ঘুমাবে কেমন করে?”

“আমার ভয় করছে।”

স্বরূপ তনয়ার পাশে শুয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল বলল, “ভয় নেই, আমি আছ।”

তনয়া ওকে আরও গভীরভাবে জড়িয়ে ধরল। স্বরূপ মুচকি হাসল। তনয়াকে ভয় পাইয়ে দিতে পেরেছে সে৷ ওকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করছিল তার। যদিও বউ, তবুও জড়তা একটা থেকেই যায়৷ তাছাড়া তনয়ার সামনে সে যেরকম ব্যক্তিত্ব দেখিয়ে চলে তাতে রোজ রোজ কাছে টানলে ও হ্যাংলা ভাববে। ভাববে ওকে ছাড়া স্বরূপের আর চলছে না৷ সেটা ভাবতে দিলে চলবে নাকি? তারচেয়ে তনয়া নিজেই আসুক কাছে।

*****

কিছুটা সময় দু’জন চুপচাপ পড়ে রইল। একসময় স্বরূপ ফিসফিস করে বলল, “ও চলে গেছে।”

“কে?”

“চন্দ্রা।”

“এলো কখন আর গেল কখন?”

“এই মাত্রই। আমাদের ঘুমাতে দেখে চলে গেছে।”

“ওর হিংসে হয়নি?”

“হয়েছে তো। এজন্যই তো কথা বলল না।”

“যাক ভালো হলো।”

“ছাই ভালো! আবার কাল আসবে।”

“আসুক। কাল দেখা যাবে।”

“আজ তোমার কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?”

“ওর জন্য কিছু না। এমনিতে পুরো শরীর ব্যথা।”

“সেবা লাগবে?” স্বরূপ যেন অন্য কোনো ইঙ্গিত করল।

তনয়া বুঝেও না বোঝার ভান করে বলল, “না সেবা লাগবে না। শুধু একটু জড়িয়ে ধরে থাকলেই বড় মেহেরবানি হয়।” বলতে বলতে সে হাই তুলল।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-১২

0

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
১২.

“নৌকায় করে যাওয়া যায় না?” নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে দূরে চলতে থাকা নৌকাগুলোর দিকে তাকিয়ে আপনমনেই বলল তনয়া।

স্বরূপ বলল, “যাবে, তবে অনেক দেরি হয়ে যাবে।”

“একটু দেরি হলে কী যায় আসে?”

“বাড়িতে অনেক কাজ।”

“আমি সাহায্য করব কাজে।”

স্বরূপ তনয়ার পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বলল, “তুমি কোন কাজটা করবে শুনি?”

তনয়া মিষ্টি হেসে বলল, “আমি কী কী করতে পারি তুমি জানোও না।”

“করো যা খুশি৷ কিন্তু এখন নৌকায় যাব না।”

“প্লিজ!”

“নো।”

“তাহলে আমি যাবই না।”

স্বরূপ বিরক্ত হয়ে বলল, “বাচ্চাদের মতো করছ কেন?”

“কারন আমি বাচ্চা।”

“দুদিন পর তোমার বাচ্চা হয়ে যাবে, আর এখন নিজেকে বাচ্চা দাবি করছ!”

তনয়া কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে গিয়েও লজ্জা পেয়ে চুপ হয়ে গেল। স্বরূপও আর কিছু বলল না৷ অনেকক্ষণ দু’জনের মধ্যে কোনো কথা হলো না।

দেখা গেল কোনে স্টিমার এখন ছাড়বে না৷ একটু দেরি হবে। তখনো সকাল পুরোপুরি হয়নি৷ রোদ ওঠেনি। সূর্যটা ঝলমল করে উঠছে অল্প অল্প করে। নদীটাকে বিষন্ন প্রান্তরের মতো লাগছে। স্বরূপ কিছুক্ষণ ভাবার পর ঠিক করল তারা নৌকায় করেই যাবে৷

নৌকা ঠিক করা হলো। শুধু তারা নয় আরও দু’জন একই নৌকায় একই জায়গায় যাবে। তারাও নবদম্পতি। স্বরূপের সাথে ছেলেটার কথাবার্তা হলে জানতে পারল তারা পাশের গ্রামেই থাকে৷ প্রথমবার স্ত্রীকে নিয়ে গ্রামে যাচ্ছে।

নৌকায় চড়ে বসতেই মাঝি ইঞ্জিন চালু করে দিল। পানি কেটে এগিয়ে যেতে থাকল নৌকা। তনয়া কিছুটা মন খারাপ করে বলল, “আমি ভেবেছিলাম বৈঠা বেয়ে নৌকা চালিয়ে নিয়ে যাবে।”

স্বরূপ বলল, “সেই নৌকা দিয়ে যেতে হলে পরেরদিন পৌঁছুতে হবে।”

তনয়া আর কিছু না বলে বাইরে তাকিয়ে রইল। নদীর পাড়ে সবুজ গাছের বন, পাখির ডাক, খোলা আকাশ, অল্প অল্প করে চড়তে থাকা রোদ আর পাশ দিয়ে পার হয়ে যাওয়া নৌকাগুলোকে ফেলে তারা এগিয়ে যেতে থাকল। মাঝে মাঝে সে হাত বাড়িয়ে পানি ছুঁয়ে দিল। ভীষণ ঠান্ডা পানি৷ কোথা থেকে আসছে এই পানি? এই উন্মত্ত স্রোত যাচ্ছেই বা কোথায়? কখনো তো ভেবে দেখা হয়নি।

তনয়া এতটা তন্ময় হয়ে গিয়েছিল যে হঠাৎ হাসির শব্দে সে খানিকটা চমকে তাকাল। তাদের সাথে নৌকায় ওঠা মেয়েটা হাসছে। তার স্বামী কানে কানে কী সব যেন বলছে। মেয়েটা গড়িয়ে পড়ছে হাসতে হাসতে। ওরা ভুলে গেছে আশেপাশে আরও মানুষ আছে। তনয়া স্বরূপের দিকে তাকাল। সে বিরক্ত মুখে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। আচ্ছা, বিরক্ত হবার কী আছে? ওরা যা করছে তাই তো স্বাভাবিক। তাদের মতো দুজন দুই মেরুতে বসে থাকবে নাকি?

তনয়ার এবার মাঝেমধ্যেই প্রকৃতি থেকে মনোযোগ সরে যাচ্ছিল। চোখ ঘুরে ঘুরে সেই নবদম্পতির দিকে আটকে যাচ্ছিল। মেয়েটা আচার খাচ্ছিল, তার স্বামী ভাগ বসাতে চাইছিল বারবার। ওর মুখ থেকে কেড়ে দিয়ে নিজের মুখে পুরে দিচ্ছিল৷ হয়তো প্রকাশ্যে চুমু খেতে পারছিল না বলেই।

ছেলেটার একটা হাত বরাবর মেয়েটার কাঁধ বা কোমর জড়িয়ে রেখেছিল। তার সতর্ক গলা বারবার বলছিল, বেশি নড়াচড়া করবে না তো, পড়ে গেলে কী হবে? তুমি যা ছটফটে!

তনয়ার মন ক্রমশ খারাপ হচ্ছিল। সে রোদ চিকচিকে পানির দিকে তাকিয়ে মন হালকা করার চেষ্টা করে যাচ্ছিল বারংবার৷

হঠাৎ রোদ খানিকটা মলিন হলো। একখন্ড ধূসর মেঘ মাথার ওপর চাদর বিছিয়ে বসল। বৃষ্টি না হলেও রোদটা পড়ে যাওয়ায় আবহাওয়া সেকরমই মনে হতে লাগল।

মেয়েটা এসময় তার স্বামীকে আবদার করে বসল, “একটা গান গাও না প্লিজ! এত সুন্দর ওয়েদার, নদী, এর মধ্যে তোমার গান হলে পুরো জমে যাবে!”

ছেলেটা ইতস্তত করছিল, খানিকটা লজ্জা পাচ্ছিল। কিন্তু মেয়ে নাছোড়বান্দা।

অতঃপর সে গাইল। এত সুন্দর গাইল যে স্বরূপ পর্যন্ত চোখ ঘুরিয়ে মুগ্ধ হয়ে তাকাল তার দিকে।

গলা ছেড়ে চোখ বুজে সে গাইছিল, ” কারা যেন ভালোবেসে আলো জ্বেলেছিল, সূর্যের আলো তাই নিভে গিয়েছিল…আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা, আর কতকাল আমি রব দিশাহারা…”

তনয়ার চোখে পানি চলে আসছিল বারবার। সে চোখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখল যাতে কেউ দেখতে না পারে।

********

ওরা গ্রামে পৌঁছুল বিকেলবেলা। স্বরূপদের গ্রামটা এত সুন্দর! ঢুকতেই তনয়ার মন ভালো হয়ে গেল। এত সবুজ জায়গা সে আগে দেখেছে বলে মনে করতে পারে না৷ প্রচুর বরই, তেঁতুল, খেজুর আর তাল গাছ চোখে পড়ল। আরও অনেক গাছ ছিল, তনয়া কতগুলো ঠিকঠাক চেনেও না। সরু মেঠোপথ, ক্ষেতের আইল আর কোথাও চোখ আটকে না যাওয়ায় দেখা গেল বিস্তীর্ণ আকাশ, যার নীল তনয়ার শাড়ির রঙের সাথে মিলে যায়।

ওরা গরুর গাড়িতে চড়ে যাচ্ছিল। তনয়া কখনো গরুর গাড়িতে চড়েনি৷ এমনকি এই জিনিস দেশে এখনো আছে তাই সে জানত না। গাড়ির দুলুনি তার ভীষণ ভালো লাগছিল। তখনো সামান্য রোদ বিরাজমান ছিল যারা উঁচু গাছগুলোর মাথা আলোকিত করে রেখেছিল। দিন ছোটো বলে অবশ্য রোদটুকু সরেও গেল খানিক পরেই৷ মিঠে বাতাস বইতে শুরু করল। তনয়ার মনে হলো বহুদিন পর সে সুন্দর একটা দিন কাটাল।

স্বরূপ নৌকা থেকেই তনয়াকে খেয়াল করছে। সে আজ উদাস, বিষন্ন, যেন বৈরাগ্য পেয়ে বসেছে তাকে। সে এবার গলা খাকারি দিয়ে ডাকল, “তনয়া…”

তনয়া তার দিকে না তাকিয়েই জবাব দিল, “হু?”

“আফসোস হচ্ছে?”

“কেন?”

“বিয়েটার জন্য?”

তনয়া বুঝল নৌকায় থাকা দম্পতিকে দেখে তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইছে স্বরূপ। হ্যাঁ তার কষ্ট হচ্ছিল বটে, কিন্তু এখন সেটা আর নেই। ক্রমশ ঘনায়মান সন্ধ্যার হাতছানি তাকে অন্য জগতের সাথে মিলিয়ে দিচ্ছিল। যেন এই পৃথিবীতে মানুষ কিংবা তাদের অনুভূতি কিছুই নয়। সবটাই প্রকৃতির দখলে। সে ঘরে ফিরতে থাকা পাখিদের দিকে চেয়ে আনমনেই বলল, “না, কোনো আফসোস নেই।”

স্বরূপ একটু থমকে গেল। তারপর মনে মনে হাসল। তার ধারনা ভেতরে ভেতরে তনয়া আফসোসে মরে যাচ্ছে। অথচ সে জানে না, তনয়া খুব অল্পতেই খুশি হতে জানে। ছোটো ছোটো কারনে সে ভাগ্যকে দোষ দিয়ে বেড়ায় না। বরং কঠিন পরিস্থিতিতেও সে নিজেকে সামলে রাখতে, খারাপ সময়েও ভালো থাকতে জানে। জানে অন্যকেও ভালো রাখতে। মাত্র দু’দিনের সংসারে স্বরূপের সেটা জানার কথাও নয়।

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-১১

0

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
১১.

বাসটা তাদের নামিয়ে দিল চৌরাস্তার মোড়ে। এখান থেকে তাদের পথ ভিন্ন। দিনের বেলার ব্যস্ত পথটা এখন খাঁ খাঁ করছে। অসম্ভব নিরবতা চারদিকে। বিশ্বাস হতে চায় না এই পথ দিনের বেলা অজস্র যানবাহন আর লোকের সমাগমে মুখর হয়ে থাকে। কয়েকটা দূরপাল্লার গাড়ি প্রবল গতিতে পেরিয়ে গেল তাদের। তনয়ার এখন ভীষণ শীত করছে। সে দুই হাতের তালু ঘষল। স্বরূপ আঁড়চোখে সেটা দেখেও চুপ করে রইল। তনয়া এবার সত্যিই একটু কষ্ট পেল। একটুও কি মায়া হচ্ছে না তার? নাকি নিষ্ঠুর হবে বলে পণ করে বসে আছে?

তনয়া মনখারাপটা গিলে ফেলে জিজ্ঞেস করল, “এখন কিসে চড়ে যাব?”

“তোমার যদি প্রাইভেট জেটে চড়ে যেতে হয় তাহলে অর্ডার দিতে পারো, ব্যবস্থা করব।”

অন্য সময় হলে তনয়া হেসে ফেলত। কিন্তু এখন মাঝরাতে লোকটার কথার সুর তার মন আরও খারাপ করে দিল। চোখে পানি চলে এলো তনয়ার। সে চোখের পানি লুকাতে অন্যদিকে তাকাল। সোডিয়াম বাতির আলোয় স্বরূপ তা ঠিকই দেখতে পেল, তবে কোনো কথা বলল না৷ সে চিন্তায় আছে। একটা যানবাহন চাই। এখান থেকে দিনের বেলায় লোকাল বাস পাওয়া যায়৷ এখন সেসব নেই। শুধু দূরপাল্লার বাস যাচ্ছে, যারা তাদের জন্য এক মুহূর্ত দাঁড়ানোর কসরত পর্যন্ত করবে না। একটা কিছু যদি পাওয়া যেত! এত রাতে একটা মেয়েকে নিয়ে সে কোথায় যাবে? একা হলে আলাদা কথা ছিল।

উল্টে বাড়ি চলে গেলে ভালো হতো বোধহয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে একদিন দেরি হয়ে যেত। বাড়ি গিয়ে অনুষ্ঠানের সবকিছু তাকে আর মাকে মিলে করতে হবে। নইলে মায়ের একা খুব চাপ হয়ে যাবে। এসব ভেবেই রিস্কটা নিয়েছিল সে। কিন্তু কোথাকার কী?

অনলাইনেও কিছুক্ষণ খুঁজল স্বরূপ। নাহ, কোনো সার্ভিস তাদের নিয়ে এত রাতে যেতে রাজি নয়। এতসব ঝামেলায় এই মেয়ের ন্যাকা কান্নাকে পাত্তা দেবার কোনো ইচ্ছেই স্বরূপের হলো না।

যে গাড়িই আসছে, স্বরূপ হাত তুলে সেটাকে থামাবার চেষ্টা করছে। অনেকগুলো গাড়ি চলে গেল, তাকে সাড়া দিল না কেউ। হতাশ হয়ে পড়তে লাগল সে ক্রমাগত৷ এদিকে পাশে তনয়া খানিক পরপর নাক টানছে। সর্দি লেগে গেল নাকি কষ্টে চোখের পানির সাথে নাকের পানি একাকার হয়ে যাচ্ছে কে জানে! স্বরূপ এতক্ষণে নিজের গায়ের কোট খুলে তনয়ার গায়ে জড়িয়ে দিল। তনয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না সেটা নেবার, বরং এতক্ষণ মনে হচ্ছিল স্বরূপ যদি কোটটা তাকে দেয়ও, সে ওর মুখের ওপর ছুঁড়ে দেবে। কিন্তু গায়ে কাঁটা দেয়া শীত আর কষ্টের মাঝে ওই উষ্ণতাটুকু তাকে এতটা আরাম দিল যে চাইলেও সে ঝেড়ে ফেলতে পারল না। বরং গায়ে জড়িয়ে নিল ভালো করে। স্বরূপের পারফিউমের ঘ্রাণ লেগে আছে কোটে। যেন মনে হতে লাগল স্বরূপই তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। মিহি সুবাস আর উষ্ণতায় তার মন খারাপ ভাবটা অনেকটা দূর হয়ে গেল।

স্বরূপের ভুরু কুঁচকে আছে। সে ভীষণ চিন্তায় আছে বোঝা যাচ্ছে। তনয়ার চিন্তা হচ্ছে না। অদ্ভূত এক রকমের ভরসা তার মন জুড়ে বসে আছে। পাশের মানুষটা তার কোনো ক্ষতি হতে দেবে না, সে জানে। চিন্তাটা মনে দোলা দিতেই মন খারাপের শেষ রেশটুকু কেটে গেল। একটা ট্রাক আসতে দেখে হাত তুলল স্বরূপ। ওর সাথে সাথে তনয়াও হাত তুলল প্রথমবারের মতো।

ওদের অবাক করে দিয়ে ট্রাকটা থামল। স্বরূপ তনয়ার দিকে অদ্ভূত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এগিয়ে গেল ট্রাকের কাছে। ড্রাইভারের সাথে কিছু কথাবার্তা বলে তনয়ার কাছে এসে তার হাত ধরে টানল। “চলো, ট্রাকে করে অনেকদূর যাওয়া যাবে।”

ওরা উঠল ট্রাকের পেছনে। ট্রাকে ফল বহন করে নেয়া হয়। এখন যাচ্ছে খালি। পেছনে খড় বিছানো। তাতেই দু’জন গিয়ে বসল। ট্রাক ছাড়ল। হু হু করে বাতাস দিচ্ছে। প্রচন্ড শীত লাগতে শুরু করেছে। খোলা আকাশের নিচে ট্রাকটা ছুটে চলেছে। ওপরের দিকে তাকালে এক আকাশ ভর্তি তারার মেলা দেখা যায়। সেই তারার আলোয় স্বরূপের মুখটা দেখা যাচ্ছে। বেচারা এখন শীতে কাঁপছে। হাই তুলতেও দেখা গেল বার কয়েক।

তনয়া স্বরূপের একটা হাত ধরে বলল, “চলো শুয়ে পড়ি। কোটটা গায়ের ওপর দিয়ে রাখলে আর শীত লাগবে না।”

“ওটা যে কোনো একজনের গায়ে দেয়া যাবে।”

“উহু, আমি ব্যবস্থা করছে। তুমি কাত হয়ে শোও এখানে।”

খড়ের ওপর শুয়ে পড়ল স্বরূপ৷ তনয়াও তার পাশে শুয়ে পড়ল। ওর ডান হাত কোটের এক হাতে ঢুকিয়ে স্বরূপের বা হাত ঢোকাল অন্য হাতে। দুজন মাঝখানে জড়োসড়ো হয়ে রইল। স্বরূপ অন্য হাতে কিছু খড় নিয়ে নিজের মাথায় বালিশের মতো বানিয়ে নিল। তারপর হাতটা ছড়িয়ে দিয়ে তার ওপর তনয়াকে মাথা রাখতে বলল। দু’জন তখন খুব কাছাকাছি চলে এলো। পরষ্পরকে জড়িয়ে ধরে রাখল। এখন আর শীত করছে না। আরামদায়ক উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়েছে শরীর আর মন জুড়ে৷

তনয়া স্বরূপের বুকে মুখ গুঁজে কী একটা যেন বলল। স্বরূপ শুনতে পেল না। কেন যেন হঠাৎ মেয়েটার জন্য মমতায় আর্দ্র হলো তার হৃদয়। ইচ্ছে হলো ওকে ডেকে কিছু একটা বলতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর বলা হলো না। ভাঙাচোরা পথে ট্রাকের দুলুনিতে আর আকাশের তারা দেখতে দেখতে ঘুম চলে এলো দু’জনের চোখেই৷

স্বরূপের গায়ের ঘ্রাণটা ভীষণ ভালো লাগে তনয়ার। সে দু’দিনেই ঘ্রাণটার সাথে এত পরিচিত হয়ে গেছে যে নিজের গায়ের ঘ্রাণ বলে ভ্রম হয় তার। ভোর হতে খুব বেশি দেরি নেই আর। কালো আকাশ ফ্যাকাসে হয়ে আসছে। বেশ খানিকটা ঘুমিয়ে উঠেছে তনয়া। স্বরূপ তখনো ঘুমে। ওর ভারী নিঃশ্বাস পড়ছে তনয়ার কপালে। এত ভালো লাগছে সবকিছু!

এত ভালোর মধ্যেও তনয়ার চোখ ভরে এলো জলে। হঠাৎ সব থেকেও কী এক শূন্যতায় ডুবে গেল যেন। শূন্যতার কারন আর কিছুই নয়, তাকে জড়িয়ে থাকা মানুষটা তাকে ভালোবাসে না, এটাই কারন। আহা! যদি স্বরূপ তাকে একটু ভালোবাসত! ভালোবেসে একবার কপালে চুমু খেত! এই রাতটা আরও কোটি গুণ সুন্দর হতে পারত!

ভোরের আলো ক্রমশ ফুটতে শুরু করল। তারাগুলো নিভে যেতে থাকল একটা একটা করে। নির্নিমেষ সেদিকে তাকিয়ে রইল তনয়া। ভোরের সতেজ বাতাস তার চোখমুখ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। তবুও স্বরূপের নিঃশ্বাস সে আলাদা করতে পারছে। চোখ তুলে ওকে দেখার চেষ্টা করল তনয়া। বাচ্চাদের মতো লাগছে। তনয়া মানুষটার প্রতি দুর্বল হচ্ছে একটু একটু করে, প্রতিটা মুহূর্তে!

ট্রাক থামল একসময়। দুলুনি থেমে যেতেই চোখ খুলল স্বরূপ। কোটের বন্ধনি থেকে মুক্ত করল নিজেকে। সে উঠে বসতেই ড্রাইভার এসে ডাকাডাকি শুরু করল। তনয়াও উঠল। নেমে পড়ল দু’জন। স্বরূপ ভাড়া মিটিয়ে দিল।

একটা বাজারের কাছে এসে থেমেছে ট্রাক। তনয়ার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছিল, এরপর কেমন করে যাবে। কিন্তু রাতের সেই ত্যাড়া উত্তর আবার পাবার ভয়ে কিছুই বলল না৷

স্বরূপের এখন মন ভালো। সে তনয়ার মনের কথা আন্দাজ করতে পেরেই হয়তো নিজে থেকেই বলল, “এখন যেতে অসুবিধা হবে না। বাসে যাওয়া যায়, আবার স্টিমারে করে নদী পার হয়েও চলে যাওয়া যায়। নদীর রাস্তাটাই সোজা রাস্তা৷ বাসে গেলে ঘুরপথে যেতে হবে। তোমার যদি পানিতে ভয় না থাকে তাহলে নদীপথে যাব।”

তনয়া খুশিতে আটখানা হয়ে বলল, “অবশ্যই আমরা নদীপথে যাব!”

স্বরূপ মুচকি হেসে বলল, “ঠিক আছে। তার আগে চলো খেয়ে নেই। খিদেয় মারা যাবার অবস্থা হয়েছে।”

একটা হোটেল খুলেছে দেখা গেল। আটা মাখছে দোকানী। তারা গিয়ে বসলে লোকটা তাড়াতাড়ি রুটি বেলতে শুরু করল। গরম পরোটা আর সবজি-ডাল দিয়ে খাওয়াটা ভালোই জমল। খোলা আকাশের নিচে সতেজ বাতাস আর ভোরের স্নিগ্ধ পরিবেশ তনয়ার ভেতরটা পর্যন্ত শান্ত করে দিল। তার ওপর প্রবল ক্ষুধার পর খাবারটা অমৃতের মতো মনে হতে লাগল।

স্বরূপও খেল পেট ভরে। তারপর দুই কাপ চায়ের অর্ডার দিল।

মাটির ভাড়ে চা এলো। স্বরূপ চায়ের ভাড় তুলে নিয়ে বলল, “চলো যেতে যেতে খাই। ঘাটে আগে পৌঁছাতে পারলে প্রথম স্টিমারটা ধরা যাবে।”

ওরা চায়ে চুমুক দিতে দিতে হাঁটতে শুরু করল। একধারে সবুজ ঘাসে ছাওয়া পথ। পথের ওপাশে লম্বা লম্বা গাছের সারি শুরু হয়েছে। অন্যপাশে নেমে গেছে পথটা। শুরু হয়েছে ধানক্ষেত।

একসময় তনয়া চায়ের ভাড়টা বাম হাতে নিয়ে ডান হাত দিয়ে স্বরূপের বা হাতটা জড়িয়ে ধরল। কাজটা করতে তার এত ইচ্ছে করছিল যে স্বরূপের ইচ্ছে অনিচ্ছে পাত্তা দেবারও কোনো ইচ্ছে হলো না তার। স্বরূপের প্রতিক্রিয়া দেখতে সে তাকাল না পর্যন্ত। হাঁটতে লাগল নিজের মনে।

স্বরূপেরও ব্যাপারটা কেন যেন ভালো লাগল। তনয়ার কাছাকাছি থাকলে তার মনটা অদ্ভুত রকমের হালকা হয়ে থাকে। সে সহজ গলায় জিজ্ঞেস করল, “সাঁতার জানো?”

“উহু।” জবাব দিল তনয়া।

“তাহলে পানিতে যেতে চাইলে যে? ভয় লাগছে না?”

“তুমি পাশে থাকলে আমার কোনোকিছুতে ভয় লাগে না।”

“ডায়লগটা একটু ফিল্মি হয়ে গেল না?”

তনয়া স্বরূপের চোখে চোখ রেখে বলল, “কাল রাত থেকে তো দেখছ, এখনো বোঝোনি? তুমি যতটুকু সময় ছিলে না তখনই ভয় পেয়েছি। তুমি পাশে থাকার সময় ভয় দেখেছ আমার চোখে?”

স্বরূপ তনয়ার চোখের দিকে চেয়েই বলল, “না। কিন্তু আমি তোমার চোখে দুঃখ দেখেছি তনয়া। তুমি খুব ভালো মেয়ে। কিন্তু আমার জন্য নও৷ আমি তোমাকে ডিজার্ভ করি না!”

তনয়া মৃদু হেসে বলল, “আল্লাহ সবার জোড়া ঠিক করে দিয়েছেন। আমার তাঁর ওপর পূর্ণ আস্থা আছে।”

স্বরূপ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সত্যিই কি তাই? তনয়াই কি তার ভাগ্যে ছিল? তবে আগে এলো না কেন? কেন জীবনের শুরুতে ভুল মানুষকে ভালোবেসে এতটা সময় এলোমেলো হয়ে গেল?

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-১০

0

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
১০.

পরের স্টেশনে মা চাচীদের সাবধানে বসিয়ে রেখে নেমে পড়ল স্বরূপ। ট্রেনটা ছেড়ে যেতেই ফাঁকা হয়ে গেল স্টেশন৷ শীতের রাত৷ কেউ অপ্রয়োজনে বসে নেই৷ স্বরূপের ভয় করছে। সে স্টেশন থেকে বেরিয়ে গাড়ি খুঁজতে শুরু করল। আজ মনে হচ্ছে পুরো পৃথিবী ঘুমিয়ে আছে৷ শুধু সে একা অতৃপ্ত আত্মার মতো ঘুরছে। তনয়া কী করছে কে জানে! নিরাপদ আছে তো?

স্বরূপের মনে হলো কত যুগ পেরিয়ে গেছে! অথচ মাত্র দশ মিনিটই কেটেছে এর মধ্যে৷ শেষ পর্যন্ত সে একটা সিএনজি দেখতে পেল। লোকটা শেষ ট্রিপ দিয়ে বাড়ি ফিরছিল। স্বরূপকে নিতে প্রথমে রাজি হচ্ছিল না। অনেকটা বুঝিয়ে বলবার পর লোকটার মন নরম হলো। স্বরূপকে তুলে নিয়ে ফাঁকা রাস্তায় সর্বোচ্চ গতিতে ছুঁটে চলল আগের স্টেশনের দিকে৷

স্বরূপ যখন ওয়েটিং রুমে ঢুকছিল, তখন তার বুক ঢিপঢিপ করছে। তনয়াকে পাওয়া যাবে তো? যদি না পাওয়া যায় তবে সে কী করবে? কোথায় খুঁজবে?

এই স্টেশনও অসম্ভব নির্জন। শেষ ট্রেন ছেড়ে গেছে। দুটো কুকুর শুয়ে আছে বাইরে৷ স্বরূপ পায়ে পায়ে ঢুকল ভেতরে। চারদিকে তাকাল। কেউ কোথাও নেই!

স্বরূপ চারদিকটা ভালো করে খুঁজল, ওয়াশরুমগুলো দেখে এলো। কাউকে পেল না। মাথায় হাত দিয়ে বেরিয়ে পড়ল সেখান থেকে।

না, এখনো ভরসা আছে। হয়তো বাসায় চলে গেছে তনয়া৷ সে তনয়ার মায়ের নাম্বারে ফোন করল।

ঘুম ঘুম কন্ঠে তিনি ফোন তুলে বললেন, “হ্যাঁ বাবা বলো, ঠিকমতো ট্রেনে উঠতে পেরেছ? তনয়া ফোন ধরছে না কেন?”

তনয়ার ফোনটা তখনো স্বরূপের পকেটে। কখন বেজেছে তার কানে যায়নি। সে নিজের গলা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে বলল, “জি মা। ও ঘুমিয়ে গেছে। আপনার কল করা দেখে আমি ভাবলাম জানিয়ে দেই।”

“আচ্ছা বাবা। সাবধানে যেও।”

স্বরূপ ফোন রেখে দিল। বেরিয়ে গিয়ে আরেকটা গাড়ি খুঁজতে লাগল। সিএনজিটা চলে গেছে তখনই। হঠাৎ অন্ধকার একটা কোণ থেকে শব্দ শুনতে পেয়ে ফিরে তাকাল সে। এগিয়ে গেল সেদিকে। একটা সিগারেটের আলো সেদিকেই ঘোরাফেরা করছে৷ স্বরূপের মনটা কু ডেকে উঠল। সে জোর গলায় ডাকল, “তনয়া…তুমি ওখানে?”

তনয়া চিৎকার করে কেঁদে উঠল। সিগারেটের আলোটা সেকেন্ডের জন্য স্থির থেকে একদিকে ছুটে চলল। লোকটা পালিয়েছে।

স্বরূপ দৌড়ে গেল সেদিকে। অন্ধকার থেকে একটা অবয়ব ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার বুকে। তনয়া কাঁপছে থরথর করে৷ কাঁদছে পাগলের মতো।

বেশ কিছুটা সময় লাগল তার স্বাভাবিক হতে। তাকে নিয়ে ওয়েটিং রুমে আলোতে গিয়ে বসল স্বরূপ। কিছুটা স্থির হয়ে এলে তনয়া জানাল কী হয়েছিল।

সে এক বাচ্চার মায়ের ব্যাগ পাহারা দিতে দিতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। যখন জেগেছে, তখন স্টেশনে হুড়োহুড়ি লেগে গেছে। ট্রেন চলে এসেছে। সে ছুটে গেছে বাড়ির লোকেরা যেখানে ছিল সেখানে। কিন্তু কাউকে পায়নি৷ এরপর ট্রেনের কাছে গিয়ে খুঁজতে শুরু করেছে। এত বড় ট্রেনের কোথায় খুঁজবে, ট্রেনের কত নম্বর বগিতে তারা উঠেছে কিছুই সে জানত না। এরপর যখন ট্রেন চলতে শুরু করেছে, তখন একটা বগিতে উঠে পড়েছিল। কিন্তু বখাটে ধরনের কিছু লোককে দেখে ভয় পেয়ে আবার নেমে পড়েছে। ট্রেন চলে যাবার পরেই স্টেশন ফাঁকা হয়ে গেছে। তারপর থেকেই একটা লোক তার আশেপাশে ঘুরছে। লোকটার চোখ ফাঁকি দিতেই সে বাইরে অন্ধকারে গিয়ে লুকিয়েছিল। কিন্তু লোকটা তাকে খুঁজে পেয়ে গিয়েছিল৷ আর একটু দেরি হলেই সর্বনাশ হয়ে যেত।

কথাটা বলতে বলতে আবারও কেঁপে উঠল তনয়া। ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল। স্বরূপ তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখল৷ একটু আগে তনয়ার ওপর রাগ হচ্ছিল তার। এখন রাগ হচ্ছে নিজের ওপর। সে কী করে ভুলে গেল নতুন বউয়ের কথা! মনটা ছোটো হয়ে গেল স্বরূপের। সে কি এতই খারাপ লোক? তার আজ মনে হলো, তনয়া মেয়েটা ভালো। ভালো বলেই এখনো তার ওপর ভরসা করে তাকে জড়িয়ে আছে৷

*******

বেশ কিছুটা হাঁটার পর একটা চায়ের দোকান পাওয়া গেল। ঝাঁপ অর্ধেক খোলা। রাতের খাবার তারা খেয়ে বের হয়নি। ট্রেনে খাবার জন্য হাবিজাবি অনেক কিছু সারাদিন ধরে বানিয়ে সাথে নিয়ে নিয়েছেন মা। এখন সেসব তাদের সাথে ট্রেনে যাচ্ছে। তনয়া আর স্বরূপের খিদেয় পেটে ছুঁচো দৌড়াচ্ছে। এতটা উত্তেজনার পর খিদেটা আর বশে আসতে চাইছে না৷

চায়ের দোকানে তেমন কিছু পাওয়া গেল না। দুটো কলা আর দুই কাপ চা খেয়ে তারা আবার সামনের পথ ধরল। ট্রেন ধরতে হলে দ্রুতগামী কোনো যান ধরতে হবে। আর নয়তো ভেঙে ভেঙে যেতে হবে। সকালের অপেক্ষা করার চেয়ে এখন যতটা এগিয়ে থাকা যায় ততই ভালো।

তনয়ার শীত করছে। তার গায়ে পাতলা একটা চাদর ছিল, সেটা কোথায় পড়ে গেছে সে জানেও না। স্বরূপের গায়ে কোট আছে। তনয়ার কয়েকবার ইচ্ছে হলো সেটা চাইতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর চেয়ে উঠতে পারল না। স্বরূপেরও তো শীত লাগবে ওটা দিয়ে দিলে।

কিছুদূর যাবার পর বাসস্ট্যান্ডে এসে পড়ল তারা। একটা বাস মাত্রই ছাড়তে যাচ্ছিল। টিকিট ছাড়া কিছুতেই তারা নেবে না তাদের। স্বরূপ অনেক অনুরোধ করে বেশি টাকা দিয়ে বাসে উঠে পড়ল। বাসের সব সিট ভর্তি। রাতের যাত্রীরা ঘুমিয়ে আছে। সামনের ছোটো একটা সিটে তনয়াকে বসিয়ে দিয়ে পাশে দাঁড়িয়ে রইল স্বরূপ। বাসটা চলতে লাগল দ্রুত গতিতে। তনয়া স্বরূপের একটা হাত ধরে বসে রইল। তার কাছে সবকিছু কেমন যেন অ্যাডভেঞ্চারের মতো মনে হচ্ছে। আহা! এরকম একা রাত যেন স্বপ্নের মতো! ভালোবাসার মানুষটার সাথে অজানার পথে বেরিয়ে পড়া!

স্বরূপ এদিকে বিরক্ত হয়ে আছে। তনয়ার দিকে তাকিয়ে আছে সে। মেয়েটা অল্প অল্প হাসছে। হাসির কী আছে এখানে? এই মেয়ে তার কপালে শনি বয়ে এনেছে। নইলে এই মাঝরাতে খিদে পেটে বাসে ঝুলে ঝুলে যেতে হয়?

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-০৯

0

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৯.

সকালের খাওয়া শেষে সবাই গোছগাছ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রাত এগারোটার ট্রেন৷ স্বরূপের মা বাসে যাতায়াত করতে পারেন না বলে ট্রেনই ভরসা। তনয়া প্রথমবার ট্রেনে যাবে। সে বেশ উত্তেজিত হলেও এই মুহূর্তে ঝামেলায় আছে। কিছুতেই বুঝতে পারছে না কী কী নেবে। বাপের বাড়ি থেকে বিশাল চারটে স্যুটকেসে যাবতীয় জিনিসপত্র এসেছে। মা গুছিয়ে দিয়েছেন। সে জানেও না কোথায় কোন জিনিসটা আছে। তার ওপর কী কী নেবে না নেবে সেটাও একটা প্রশ্ন।

স্বরূপের মা নিজের গোছগাছ নিয়ে ব্যস্ত। এদিকে স্বরূপ সেই যে সকালে বের হয়েছে, তার খবর নেই। তনয়া কয়েকবার তাকে ফোন করল, স্বরূপ ফোন তুলল না৷ তনয়ার ইচ্ছে হলো নিজের চুল ছিঁড়তে। সবগুলো স্যুটকেস খুলে জিনিসপত্র গোছাতে গিয়ে সে আরও এলোমেলো করে ফেলল।

সন্ধ্যা সাতটায় স্বরূপ ফিরল। সাড়ে আটটার মধ্যে রওনা দেবে স্টেশনের উদ্দেশ্যে। স্টেশন কাছেই, তবু আগে পৌঁছে যাওয়া ভালো।

ঘরে ঢুকে অবস্থা দেখে তার মাথায় হাত পড়ল। পুরো ঘর এলোমেলো। শাড়ি, গয়না, কসমেটিকসের ভিড়ে তনয়া বসে আছে। সে নিজেও এলোমেলো। স্বরূপ হতভম্ব স্বরে জিজ্ঞেস করল, “হচ্ছেটা কী?”

“বুঝতে পারছি না।”

“কী বুঝতে পারছ না?”

“কোনটা নেব আর কোনটা নেব না।”

স্বরূপ ঘরের চারদিকে আরেকবার চোখ বোলাল। তার মাথা ঝিমঝিম করছে। সে বিছানায় বসে একটু স্থির হয়ে বলল, “তোমার যে জিনিসগুলো খুব দরকার শুধু সেগুলো নাও।”

“কিন্তু আমার সবই প্রয়োজন।”

“এত জিনিস নিতে চাইলে পুরো ট্রেন ভাড়া করতে হবে।”

“করে ফেলো প্লিজ!”

স্বরূপ তনয়ার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল সে সত্যিই পাগল হয়ে গেছে কি না! তনয়া কাচুমাচু মুখে বলল, “আমি কোনোদিন দূরে জার্নি করিনি। জানব কী করে কিভাবে প্যাকিং করতে হয়? কী কী নিতে হয়?”

“এসব কে গুছিয়ে দিয়েছিল আসার আগে?”

“মা।”

“সবই মা? তোমার সাথে মাকেও নিয়ে আসা দরকার ছিল।”

“আনলেই পারতে।”

“এরচেয়ে সহজ তোমাকে মায়ের কাছে রেখে আসা। বিয়ের আগে কিছু শিখতে টিখতে হয় নাকি!”

তনয়া ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, “এখনই খোঁটা দিচ্ছ? বাকি জীবন কী করবে? হে আল্লাহ! আমাকে এ কী শাস্তি দিলে তুমি!”

স্বরূপ ভুরু কুঁচকে বলল, “ঢং তো ভালোই পারো।”

“বিয়ের জন্য ওইটুকু পারলেই হয়।”

“ওইটুকু ছেলে পটাতে কাজে লাগে। সংসারে নয়।”

“শোনো, বারবার উল্টোপাল্টা কথা বলবে না! সবার চরিত্র একরকম হয় না।”

“আচ্ছা এই টপিক বাদ। কয়টা বাজে দেখেছ? সর্বনাশ! আমার জিনিসপত্রও প্যাক করা বাকি। তুমি একটা…ধ্যাৎ! ওঠো! নতুন শাড়ির ওপর বসে আছো কেন?”

তনয়া উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার নিচে পড়ে সুন্দর শাড়িটা মোটামুটি ভর্তা হয়ে গেছে। আসলে সে এত পাগল হয়েছিল যে এতক্ষণ বুঝতেও পারেনি কোথায় বসে আছে।

স্বরূপ বিড়বিড় করছে রাগে। সেই সাথে কাজও করছে।

একটা স্যুটকেস খালি করে ফেলল সে। তারপর বলল, “সবার আগে জামাকাপড়। আমরা পাঁচদিন থাকব, তাই পাঁচদিনের জামাকাপড় নিলেই চলবে।”

এর মাঝে একদিন অনুষ্ঠান, সেদিনেরটা সহ মোট পাঁচটা শাড়ি নিয়ে নিল সে। তনয়া সেগুলোর সাথে মিলিয়ে ব্লাউজ, পেটিকোট আর অন্তর্বাস গুছিয়ে দিলে স্বরূপ সুন্দর করে ভাজে ভাজে গুছিয়ে ফেলে বলল, “এবার?”

“শাড়ি পরতে ইচ্ছে না হলে সালোয়ার কামিজ পরতে হবে। তাই পাঁচ সেট কামিজ নিতে হবে।”

স্বরূপ চোখ কপালে তুলে বলল, “ফাজলামো নাকি?”

“সত্যি!”

স্বরূপ আর কথা বাড়াল না। সালোয়ার কামিজ নিল। রাতে পরার জন্য নরম জামা নিল। এরপর এক এক করে গোছানো হলো কসমেটিকস, গয়নাগাটি। দুটো স্যুটকেস তালাবদ্ধ করার পর তনয়া আমতা আমতা করে বলল, আরো কিছু জিনিস…”

“আরো কী?”

“একটা হেয়ার ড্রায়ার, স্ট্রেইটনার, আর…”

“আর একটা টিস্যুও নেবার জায়গা নেই। এসবেই চলবে। চুপ করে বসো।”

তনয়া বসে পড়ল। স্বরূপ ওর বাকি জিনিসগুলো আগোছালোভাবেই আলমারিতে তুলে রাখল। গোছানোর সময় নেই। এবার সে নিজের জামাকাপড় গোছাতে শুরু করল।

তিনটা শার্ট, তিনটা টিশার্ট, একটা পাঞ্জাবি, কোট, প্যান্ট, দুটো ট্রাউজার, পারফিউম আর শেভিংয়ের সরঞ্জাম ঢুকিয়ে স্যুটকেস বন্ধ করে দিল। দশ মিনিটের ব্যাপার। তনয়া হা করে দেখল শুধু।

স্বরূপ ওর দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বলল, “কী হলো?”

“হয়ে গেল?”

“জি। হয়ে গেল। এরচেয়ে কম জিনিসেও হয়।”

“ভাগ্যিস ছেলে হয়ে জন্মাইনি!”

স্বরূপ চোখ গোল করে বলল, “আমি ভেবেছিলাম উল্টোটা বলবে, আহারে! যদি ছেলে হয়ে জন্মাতাম!”

“এখানেই তো তোমার আমার চিন্তার পার্থক্য!”

“কিন্তু ছেলে হতে চাও না কেন?”

“ছেলে হয়ে তোমাকে তিনটা স্যুটকেস গোছাতে হলো। আর আমি মেয়ে বলে চুপচাপ বসে দেখলাম। কিছুই করলাম না। এজন্যই ছেলে হতে চাইনি।”

স্বরূপের মুখটা দেখার মতো হলো। সে মুখ বাঁকা করে বলল, “তোমার মতো অলস আর অকর্মা মেয়ে আমি জীবনে দেখিনি। আবার বড়াই করে বলছো!”

“এজন্যই তো আল্লাহ তোমাকে পাইয়ে দিলেন বলো!”

“তোমার কী মনে হয় আমি সবসময় তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে দেব? আর এই ঝামেলা পোহাব না বলে দিলাম।”

“আর দাও বা না দাও, আজ তো দিলে। একদিনেই পয়সা উসুল!”

স্বরূপ কী যেন বলতে যাচ্ছিল, মা ঘরে ঢুকলেন এমন সময়। তনয়াকে দেখে আঁতকে উঠে বললেন, “হায় হায় তৈরি হবে কখন? সাড়ে আটটা বাজতে চলল!”

“এইতো মা এখুনি রেডি হচ্ছি।”

তনয়া জামাকাপড় নিয়ে দ্রুত বাথরুমে ঢুকে গেল৷ স্বরূপ মাকে বলল, “তোমরা সবাই রেডি?”

“আমি তো অনেকক্ষণ আগেই তৈরি হয়ে বসে আছি।”

“তুমি তো লক্ষী মেয়ে। আচ্ছা, বাবা থাকতে তুমি তোমার জিনিসপত্র নিজেই গোছাতে নাকি বাবাকে দিয়ে করাতে?”

মা ইঙ্গিত বুঝে মুখ টিপে হেসে বললেন, “আমার ব্যাগ গোছানো তোর বাবার কোনোদিনই পছন্দ হতো না৷ নিজে থেকেই গুছিয়ে দিত সবসময়।”

স্বরূপ আপনমনেই বলল, “বিষয়টা তাহলে জেনেটিক্যাল। এজন্যই এই অকর্মার ঢেকির জন্য এতকিছু করে ফেলছি। নয়তো আমার কোন ঠেকা পড়েছে…”

“কী বলছিস এসব?”

“না না, কিছু না। চলো সব নিচে নামিয়ে রাখি। গাড়ি চলে আসবে এখুনি..”

*****

স্টেশনে গিয়ে তারা জানতে পারল ট্রেন আসতে এক ঘন্টা লেট হবে। সবাই ওয়েটিং রুমে বসে রইল। তনয়া স্টেশনে আসার পর থেকেই বেশ আগ্রহ নিয়ে চোখ বড় বড় করে সবকিছু দেখছে। স্টেশনে শুয়ে থাকা ভিখিরি থেকে শুরু করে পানির বোতলওয়ালার দিকে ঘুরে ঘুরে তাকাতে লাগল। সবকিছু কেন যেন সুন্দর লাগছে। তার পাশে বসে স্বরূপ বিরক্ত মুখে মোবাইল স্ক্রল করছে। তনয়া মাঝেমধ্যে আঁড়চোখে দেখছে। স্বরূপ আপাতত ভিডিও অপশনে ঘুরছে। সুন্দরী সংবাদ পাঠিয়ে কীসব হাবিজাবি বলছে, সেটা আগ্রহ নিয়ে শুনছে। শুনছে নাকি মহিলাকে দেখছে? ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করেও বুঝতে পারল না তনয়া।

একটু পর আরেকটা ভিডিও এলো। বিদেশী একটা প্রোগ্রাম। মহিলার ওপরে একটা টপস পরেছে যার প্রায় পুরোটাই স্বচ্ছ। এটাও স্বরূপকে বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখতে দেখা গেল। তনয়ার ইচ্ছে করতে লাগল মোবাইলটা ছুঁড়ে ফেলে দিতে।

একপাশে মা, চাচীরা বসে গল্প জুড়েছে, যেসব গল্পের বেশিরভাগ চরিত্রই তনয়ার অচেনা।

সময় কাটতে লাগল। এক ঘন্টা পার হবার পর জানা গেল ট্রেন আরও লেটে আসবে। কখন আসবে কেউ জানে না। তনয়ার ভালোলাগা ক্রমাগত বিরক্তির পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। স্বরূপ মোবাইল থেকে চোখ পর্যন্ত তুলছে না। তার মোবাইলে এখন খাওয়াদাওয়ার ভিডিও চলছে। এক মহিলা বিশাল হা করে তাতে একসাথে চারটে ডিম ঢুকিয়ে দিল!

তনয়ার বমি পেয়ে গেল। এদিকে বাথরুমে যাওয়া দরকার। মহিলারা সবাই একটু আগেই গিয়েছিল। তনয়ার তখন প্রয়োজন হয়নি। এখন না গেলেই নয়। সে স্বরূপের হাত টানল, “ওয়াশরুমে যাব।”

স্বরূপ মোবাইল থেকে চোখ না তুলেই বলল, “কোলে করে নিয়ে যেতে হবে?”

“উফ! শুধু সাথে যাবে।”

“এখানেই তো ওয়াশরুম। নিজের কাজ করতে শেখো। আমি তোমার সার্ভেন্ট নাকি?”

“তুমি একটা নোংরা লোক!”

স্বরূপ দাঁত বের করে হেসে বলল, “বুঝতে বড় দেরি করে ফেললে সুন্দরী…”

তনয়া একাই ওয়াশরুমের দিকে গেল। কিন্তু পাবলিক টয়লেটের যা অবস্থা তা দেখে তার ভেতরের নাড়িভুঁড়ি পাক খেতে শুরু করল। কোনোরকমে বের হয়ে হাতে মুখে পানি দিয়ে একটু সুস্থ হবার চেষ্টা করল সে।

ফিরে যাবার সময় দেখল এক মহিলা বেশ বিপাকে পড়েছেন। তার কোলের ছোটো বাচ্চা কাঁদছে। তনয়া কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, “বাচ্চাটাকে খাওয়াতে হবে।”

“ওইযে রুম আছে তো মায়েদের জন্য৷ ওখানে চলে যান।”

মহিলা বললেন, “আমার ব্যাগগুলো নিয়ে সমস্যায় পড়েছি। সাথে আর কেউ নেই। এগুলো রেখে যাব কার কাছে? ভরসা করার কাউকে পাচ্ছি না।”

তনয়া বলল, “আমি দেখছি, আপনি যান।”

মহিলা খুশি হলেন। তার কোলের বাচ্চা গলা ফাটিয়ে কাঁদছে। তিনি তাড়াতাড়ি ঢুকে গেলেন মাতৃদুগ্ধ পান করানোর ঘরটাতে।

তনয়া বসল। তার এখন ঘুম পাচ্ছে। রাত কত হলো? ঘড়ি নেই তার কাছে। চেয়ারে হেলান দিয়ে হাই তুলল সে। ট্রেন কখন আসবে?

******

ট্রেন হঠাৎই চলে আসায় স্টেশনে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। এতগুলো ব্যাগ তুলতে তুলতে অবস্থা কাহিল হয়ে পড়ল স্বরূপের। সেগুলো তুলে জায়গামতো রেখে নিঃশ্বাস ফেলে বসল সে৷ মোট দুটো ডাবল সিটের কামরা ভাড়া করেছে তারা। ওপর নিচ করে সবার এতেই হয়ে যাবে। বাইরে তখনো ভিড়ভাট্টা, হৈচৈ।

মা অন্য ঘর থেকে এই ঘরে এসে চারদিকে চোখ বুলিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, “অ্যাই স্বরূপ, তনয়া কই?”

স্বরূপ চারদিকে তাকাল। তনয়া নেই। “ওই রুমে নেই?”

“না তো! ও কি ওঠেনি নাকি?”

ট্রেন ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে। স্বরূপ দৌড়ে অন্য রুমে গেল। সেখানে নেই। পুরো বগিতে, ওয়াশরুমে, কোথাও তনয়া নেই। সে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে চোখ বোলাল। কোথাও তনয়াকে দেখা গেল না৷ তনয়ার নাম্বারে ডায়াল করল সে। ফোনটা বেজে উঠল তারই অন্য পকেটে। ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়ে যাচ্ছে দেখে স্বরূপ লাফিয়ে নামতে যাচ্ছিল, তখন মা ধরে ফেললেন তাকে। “করিস কী?”

“মা, ও রয়ে গেছে।”

“রয়ে যাবে কেন? হয়তো ভুলে অন্য বগিতে উঠেছে।”

স্বরূপ বুঝতে পারল না কী করবে। মেয়েটা এত কেয়ারলেস! দেখা হলে সবার আগে সে একটা চড় মারবে।

পরের স্টেশনে যেতে যেতে স্বরূপ পুরো ট্রেন খুঁজে ফেলল। কোথাও তনয়াকে পেল না। যে আশাটুকু ছিল, সেটা নিভে যেতেই ভয় জেঁকে ধরল তাকে। তনয়ার কাছে মোবাইল, টাকা কিছুই নেই। রাত দেড়টায় সে বাড়িতেও ফিরতে পারবে না৷ কী করবে একা একা? অন্য কারো মোবাইল দিয়ে তাকে কল করতেও তো পারে, তা করছে না কেন? বোকা মেয়েটা কোনো বিপদে পড়বে না তো?

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-০৮

0

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৮.

সকালটা ভীষণ অন্যরকম। কারো শরীরের উষ্ণতায় জেগে ওঠা, আলতো করে তাকে ছুঁয়ে দেয়া, ঘুমজড়ানো চোখ খুলে প্রথমবার তাকে দেখা! তনয়ার ভারি ভালো লাগল। মিষ্টি ভালোলাগা তাকে ছুঁয়ে রইল অনেকটা সময়। স্বরূপ ঘুমাচ্ছে। ঘুমের মধ্যে তাকে অগোছালো সুন্দর লাগছে। তনয়া অনেকক্ষণ এভাবেই সুখের একটা আবেশের মধ্যে শুয়ে রইল। তারপর স্বরূপের গালে একটা হাত রাখল।

ওর স্পর্শে চোখ মেলে তাকাল স্বরূপ। প্রথমটায় বুঝতে পারল না কী হচ্ছে। তারপর উঠে বসে বলল, “আরেহ মনেই ছিল না বিয়ে হয়ে গেছে।”

“ঘুমের মধ্যেও মনে থাকবে?”

স্বরূপ কিছু বলল না৷ উঠে বাথরুমে ঢুকে গেল। তনয়াও উঠল। গতকাল মেকআপ তোলা, শাড়ি বদল কিচ্ছু হয়নি। সে শুয়েছিল ওড়না জড়িয়ে! স্বরূপ বের হলে সে গোসল করতে চলে গেল। অনেকটা সময় নিয়ে সুন্দর করে গোসল করল। গতরাতের ভালোবাসার স্পর্শ এখনো শরীর, মনে জীবন্ত! ধোঁয়া ওঠা বাথরুমে বসে তনয়ার সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হতে লাগল।

শাড়ি পরবে সে। কিন্তু বাথরুমে কেমন করে শাড়ি পরা সম্ভব? কোনোরকমে শাড়িটা জড়িয়ে বেরিয়ে এলো। বিশাল ড্রেসিং টেবিল এই ঘরে। সেটার সামনে দাঁড়িয়ে শাড়ি পরতে শুরু করল। স্বরূপ মোবাইলে ব্যস্ত, এদিকে খেয়াল নেই।

তনয়া শাড়ি পরতে অভ্যস্ত নয়। বারবার পেঁচিয়ে যাচ্ছে, উল্টোপাল্টা হচ্ছে। সামলাতে পারছে না এত বড় শাড়িটা। বিরক্ত হয়ে গেল তনয়া। আয়নার ভেতর দিয়ে হঠাৎ চোখ পড়ল স্বরূপের দিকে। সে তাকিয়ে আছে হা করে।

তনয়া তার দিকে ফিরে বলল, “একটু হেল্প তো করতে পারেন!”

স্বরূপ জিজ্ঞেস করল, “এতদিন কে হেল্প করত?”

“মা।”

“মাকে ডাকব?”

“আপনি একটু ধরলেই চলবে।”

স্বরূপ এগিয়ে এসে তনয়াকে জড়িয়ে ধরল। তনয়া অবাক হয়ে বলল, “এটা কী হচ্ছে?”

স্বরূপ তাকে আরো গাঢ় করে জড়িয়ে ধরে বলল, “তুমিই তো বললে ধরতে।”

তনয়া হেসে ফেলল, “শাড়ি ধরতে বলেছি।”

স্বরূপ তাকে ছেড়ে দিয়ে শাড়িটা সুন্দর করে গুছিয়ে পরিয়ে দিল।

তনয়া চোখ গোল করে জিজ্ঞেস করল, “এক্সপিরিয়েন্সড?”

“হুম। আমার পাঁচ নম্বর গার্লফ্রেন্ড শাড়ি পরতে জানত না। তাকে পরিয়ে দিয়ে অভ্যাস করেছি।”

তনয়া ভুরু কুঁচকে তাকাতেই স্বরূপ দুই হাত তুলে বলল, “না না, পাঁচটা গার্লফ্রেন্ড ছিল না। ভুল বুঝো না প্লিজ! মজা করে বললাম। সত্যিটা হলো, আমার এক্স গার্লফ্রেন্ডের সংখ্যা আঠারো জন।”

তনয়া হাসল। স্বরূপ জিজ্ঞেস করল, “তোমার ক’টা ছিল?”

“পাঁচশো আঠারোটা!”

বলে স্বরূপকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

রান্নাঘরে মা-চাচী-খালা-ফুপুরা তখন আসর বসিয়ে সকালের নাস্তা বানাতে ব্যস্ত। ওকে দেখে চাচী আম্মা খুব খুশি হয়ে বললেন, “বউটা এক্কেবারে চান্দের মতোন হইছে।”

মামী মা এগিয়ে এসে বললেন, “দেখি দেখি, কালকে তো মেকআপ ছিল, মেকআপ ছাড়া কেমন দেখি। নাকি এখনও মেকআপ করছো?”

তনয়া জিজ্ঞেস করল, “আমি কী করব?”

শাশুড়ী মা বললেন, “বসে থাকো। খাবার হলে খাবে।”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-০৭

0

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৭.

তনয়ার কেন যেন মনে হচ্ছিল বিয়েতে কোনো না কোনো ঝামেলা বাঁধবে। সে সকাল থেকে চিন্তা মাথায় করে বসেছিল। কিন্তু বিয়েটা সুন্দরভাবেই কেটে গেল। এমনকি বিয়ের ভিডিও, খাওয়াদাওয়া থেকে শুরু করে বিদায় পর্যন্ত এত সুন্দরভাবে হলো যে গাড়িতে উঠে তনয়া নিজের হাতে একটা চিমটি কেটে নিশ্চিত হলো সবটা সত্যি ছিল! কিন্তু ভয় কমল না। রাত এখনো বাকি। আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে আজকের রাত বছরের সবচেয়ে দীর্ঘ রাত!

অবশ্য তার আনন্দও হচ্ছে। প্রচুর ঘোরাঘুরি হবে বলেই মনে হচ্ছে। আগামীকাল গ্রামের বাড়ি, তারপর সেখান থেকে এসে দার্জিলিং! ওদের কোনো প্ল্যান ছিল না বিয়ের পর মধুচন্দ্রিমায় যাবার। কিন্তু দেখা গেল স্বরূপের বন্ধুরা মিলে চমৎকার একটা ট্যুর প্ল্যান করে উপহার দিয়েছে তাদের। প্লেনেট টিকিট থেকে শুরু করে হোটেলে থাকা পর্যন্ত সব বন্দোবস্ত করে রেখেছে। এবার শুধু নির্ধারিত দিনে যাত্রা করা! তনয়ার পাহাড় ভীষণ পছন্দ! স্বরূপেরও কি পছন্দ?

****

বাসর ঘর। অচেনা কোনো বিদেশি ফুল দিয়ে চমৎকার করে সাজানো। শুনেছে স্বরূপের বান্ধবী মিলি ডিজাইনার। তারই ডেকোরেট করা এই বাসর ঘর৷ ঘরে মৃদু একটা আলো জ্বলছে। তাতে যেন বাসরের আবেদন আরো বেড়েছে। কয়েকটা আর্টিফিশিয়াল মোমবাতি জ্বলছে। খোলা জানালা দিয়ে আসছে মৃদু শীতের বাতাস। সবকিছুর মধ্যে তনয়ার ঘুম ঘুম পাচ্ছে। স্বরূপ কোথায় রয়ে গেছে? কেন আসছে না? আজ কি সে আসবেই না? এ কেমন কথা?

তনয়া ঝিমিয়ে পড়ে যাচ্ছিল এমন সময় স্বরূপ ঢুকল। তার গলায় এখনো বিশাল ফুলের মালাটা ঝুলছে। এখনো খোলেনি কেন? আজব তো!

স্বরূপ ঢুলেই বাতি জ্বালাল। বলল, “এই অন্ধকারে বসে আছো কেন?”

তীব্র আলো চোখে এসে পড়ায় চোখ ঢাকল তনয়া। বলল, “মৃদু আলোটা সুন্দর ছিল তো..”

“এভাবেই ঘুমাবে? এই শাড়ি, গয়নাগাটি আর মেকআপ নিয়ে?”

“তা কেন?”

“তাহলে খোলোনি কেন এসব?”

“আপনার জন্যই তো সাজলাম, আপনি ভালো করে দেখেননি পর্যন্ত!”

স্বরূপ হেসে বলল, “আমি ভাবতাম বিয়ের কনেরা সাজে ছবি তোলার জন্য। বরকে দেখানোর জন্য সাজে এমনটা প্রথমবার শুনলাম।”

“দুটোই ইম্পর্টেন্ট।”

“আচ্ছা তাহলে একটু ভালো করে দেখা যাক।”

স্বরূপ হঠাৎ খুব কাছে চলে আসায় তনয়া একটু যেন জড়সড় হয়ে গেল। অদ্ভুত তো! ও মনে মনে চাইছিল মানুষটা কাছে আসুক!

স্বরূপ কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে রইল। তনয়াকে ভীষণ সুন্দর লাগছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। স্বরূপ মুগ্ধ হলো। মুখে ছোট্ট করে বলল, “দেখলাম।”

তারপর উঠে চলে গেল বারান্দায়। যাবার আগে গলা থেকে মালাটা খুলে রেখে গেল। তনয়া বেশ কিছুক্ষণ বসে রইল। কিন্তু স্বরূপের খবর নেই। সে উঠে বারান্দায় উঁকি দিল। বারান্দায় একটা ইজি চেয়ার। তাতে হেলান দিয়ে বসে জনাব সিগারেট টানছেন। কাছে গিয়ে তনয়া জিজ্ঞেস করল, “এটা কী হচ্ছে? আপনি আমাকে রেখে চলে এলেন?”

“কী করতাম? দেবী পূজা? তুমি কী চাচ্ছ বুঝতে পারছি৷ কিন্তু আজ ওসব পারব না। অনেক টায়ার্ড আমি।”

তনয়ার ভীষণ রাগ হলো। সে বলল, “টায়ার্ড হলে গিয়ে শুয়ে পড়ুন। এখানে কী করছেন?”

“আমার রাতে ঘুম আসে না৷ ঘরটা ফুলের জঙ্গল বানিয়ে রেখেছে। তুমি জঙ্গলে ঘুমাতে পারো। আমি এখানেই থাকব।”

“ফুল পরিষ্কার করে দিচ্ছি। চলুন।”

“তার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি এখানেই ভালো আছি।”

“আপনার শীত করছে না?”

“না তো!”

তনয়া আর কথা খুঁজে পেল না। এই লোকটাকে কী করে শায়েস্তা করা যায়? হঠাৎ একটা বুদ্ধি মাথায় খেলে গেল তার। স্বরূপের হাত থেকে সিগারেটটা টেনে নিল সে। যদিও একটু রিস্কি ছিল, তবু পুড়ে যাবার ভয়ে স্বরূপই ছেড়ে দিল ওটা।

তনয়া সিগারেট ঠোঁটে চেপে ধোঁয়া টেনে নেবার চেষ্টা করল। তারপরেই কাশতে শুরু করল। ভীষণ বাজে একটা জিনিস!

স্বরূপ কঠিন স্বরে বলল, “এটা কেন করলে?”

“আপনি খেতে পারলে আমি কেন পারব না? আমিও খাব।”

“তুমি সিগারেট খাবে?”

“হ্যাঁ আপনার সাথে খাব। যখন সিগারেট খেতে ইচ্ছে করব, আমাকেও বলবেন। দুজন একসাথে বসে টানব। দারুণ মজা হবে, কী বলেন!”

“ফাজলামো বন্ধ করো। সিগারেটটা দাও।”

তনয়া দিল না। আবারও এক টান দিয়ে একদফা কাশল। স্বরূপ এবার ওর হাত থেকে সিগারেট কেড়ে নিয়ে নিভিয়ে ফেলে বলল, “আর নাটক করার কোনো প্রয়োজন নেই। আমিও খাব না।”

“তাহলে ঘরে চলুন।”

“একটা রাত কন্ট্রোল করতে পারছ না?”

“না। আজকে রাতটা শুধুই আমাদের দু’জনের হবার কথা। আমি একা ওখানে বসে থাকব আর আপনি এখানে সিগারেটের ধোঁয়ার সাথে প্রাক্তনের শোক ওড়াবেন তা চলবে না। আজকে আমাদের মাঝে কোনো তৃতীয় ব্যক্তি থাকবে না।”

তনয়ার এতদিনের নরম ব্যবহার আজ কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। সে বড় বেশি অধিকারবোধ নিয়ে কথা বলছে। স্বরূপের একইসাথে রাগ হচ্ছে, আবার তনয়ার এই মূর্তি তাকে সমানভাবে আকর্ষণ করছে।

স্বরূপ হালকা গলায় বলল, “ঘরে আসছি। তার আগে তুমি প্লিজ মেকআপটা ধুয়ে ফেলো।”

তনয়া একইভাবে বলল, “আপনি প্লিজ ব্রাশ করে আসুন। সিগারেটের গন্ধ অসহ্য!”

কিন্তু এরা কেউই কারো কথা শুনল না। স্বরূপ তনয়ার হাত ধরে নিজের কাছে টেনে নিল। তারপর কী হয়েছে তনয়ার সবটা মনে নেই। শুধু একগুচ্ছ গন্ধরাজের সুবাসের মতো ভীষণ ভালোলাবার সুবাস তাকে জড়িয়ে নিল। অসহ্য ভালোলাগায় তার মনে হলো, সে মরে যাবে।

রাত তখন গভীর। দুজনেই ক্লান্ত হয়ে শুয়ে আছে। তনয়া স্বরূপের কানের কাছে মুখ এনে বলল, “ভালোবাসি।”

স্বরূপ সহসা কিছু বলল না। বললে সুন্দর সময়টা হয়তো নষ্ট হয়ে যেত। সে মনে মনে বলল, “Love is just a myth!”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-০৬

0

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৬.

“Love is just a myth” – স্বরূপের ফেসবুক প্রোফাইলের বায়ো-তে থাকা লেখাটা কয়েকবার পড়ল তনয়া। সত্যিই কি তাই? কথাটা অনেকবার ভাবায় তাকে। কেন লিখেছে তা তনয়ার জানা। কিন্তু কথাটা কি স্বরূপ মন থেকে বিশ্বাস করে? তনয়া দেখেছে স্বরূপ নিজের মাকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। সেটাও কি মিথ? জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলেও করল না সে৷ বরং আইডিটা ঘুরে আসা যাক।

অনেক পোস্ট শেয়ার করে স্বরূপ। বেশিরভাগই দেশের অর্থনীতি আর রাজনীতি সম্পর্কিত! তনয়া মিনিট দুয়েক ঘুরে বিরক্ত হয়ে আবার ওপরে চলে গেল। ফেসবুক ছবি জমা করে রাখে একটা ফাইলে। সেখান থেকে প্রোফাইলের ছবিগুলো দেখল অনেকটা সময় নিয়ে। একটা বিষয় খুব লক্ষ্য করার মতো।

স্বরূপের একসময়ের ছবিগুলো যেরকম হাসিখুশি আর উৎফুল্ল ছিল, সেটা আর এখন নেই। বরং অনেকদিন সে প্রোফাইলে কালো পর্দা ঝুলিয়ে রেখেছিল। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সেসব দিনে ওর চেহারাটা ছিল নিষ্পাপ মিষ্টি দেখতে। দাড়ি একদমই রাখত না৷ একটা বাচ্চার মতো দেখাত তাকে। এখন অনেকটা পরিণত। এখন যদিও সে আগের তুলনায় সুন্দর দেখতে হয়েছে, তবুও সে সময়ের ছবিগুলোতে যে উৎফুল্ল হাসিটা ছিল সেটা এখন হারিয়ে গেছে। ছবিগুলো নিজের মোবাইলে সেভ করে রাখল সে। মাঝেমধ্যে দেখবে।

আজ গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান হয়ে গেল। আগামীকাল বিয়ে। একসাথে গায়ে হলুদ হয়েছে। পাশে বসে স্বরূপ মোবাইল ঘাটছিল, সেই ফাঁকে সে আইডির নামটা দেখে নিয়েছে। অবশ্য রূপা আপুর কাছে চাইলে হতো, কিন্তু এখন স্বরূপের বিষয়ে মুখ খুললেই যে কেউ বলে বসছে, সে বিয়ের আগেই স্বামী পাগল হয়ে গেছে! আশ্চর্য!

বিয়ের পরদিন তাদের যেতে হবে স্বরূপদের গ্রামে। গ্রামে নাকি তাদের অসংখ্য আত্মীয়স্বজন। ওখানে একটা অনুষ্ঠান না করলেই নয়। হাজার হোক, গ্রামের একমাত্র স্কুলের হেড টিচার হচ্ছেন ওর শাশুড়ী। তাই বিয়ের পরদিনই গ্রামে চলে যাবে তারা৷ ওখানে একটা অনুষ্ঠান সেরে ক’দিন থেকে ফিরবে।

তনয়ার এতক্ষণ পুরো বিষয়টা খুব আকর্ষণীয় লাগছিল, কিন্তু এখন খানিকটা ভয় লাগতে শুরু করল। আচ্ছা, সে বাবা মাকে ছেড়ে কেমন করে যাবে? বাবা মা থাকবেন কেমন করে? চলে যাবার বিষয়টা মাথায় থাকলেও এতক্ষণ উপলব্ধিতে আসেনি। হঠাৎ কেমন একটা দুঃখবোধ ছুঁয়ে গেল তাকে।

তনয়া উঠে গিয়ে বাবা মায়ের ঘরে উঁকি দিল। মা নেই। বাথরুমে ঢুকেছেন হয়তো। বাবা উদাস চোখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে। তনয়া পায়ে পায়ে এগিয়ে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরল। বাবা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন, “আরে, তোর কী হলো আবার?”

বাবার গলাটা বুজে আসায় তনয়া বুঝতে পারল তার চোখে পানি চলে এসেছে। মা বের হলে বললেন, “আমাকে ভুলে গেছ নাকি তোমরা?”

বাবা এক হাত বাড়িয়ে দিতেই মাও এসে জড়িয়ে ধরলেন দু’জনকে। ওদের তিনজনের মিষ্টি পরিবারটা আগামীকাল দুজনে পরিণত হবে!

তনয়ার জন্মের পর মায়ের কিছু শারিরীক সমস্যার কারনে আর কোনো সন্তান তিনি ধারণ করতে পারেননি। তনয়া সারাজীবন লোকের কাছে শুনে এসেছে, “আহারে, একটা ছেলে হলো না৷ মেয়ে তো পর হয়ে যাবে।” তনয়ার তখন খুব রাগ হতো। আজ ওর নিজেরই মনে হলো, মা বাবার একটা ছেলে হলে বেশ হতো!

*****

স্বরূপ মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়েছিল। মা হঠাৎ বললেন, “তুই তো কাল থেকে পর হয়ে যাবি।”

স্বরূপ হেসে বলল, “কেন আমি কি মেয়ে নাকি?”

“বিয়ের পর ছেলেরাও পর হয়।”

“তাই নাকি? জানতাম না তো। কেমন করে?”

“এই যেমন এখন তুই আমার কাছে বসে আছিস। আমাকে ফোন করে ঘন্টা ধরে কথা বলিস৷ বাড়ি ফিরে আমার খোঁজ করিস সবার আগে। বিয়ের পর করবি? বিয়ের পর আগে থাকবে বউ, তারপর মা।”

স্বরূপ উঠে বসে বলল, “মা, তাহলে বিয়েটা ক্যান্সেল করে দেই বলো? আমারও ভালো, তোমারও।”

মা স্বরূপের কান টেনে বললেন, “ওই কপালপুড়ি তোকে কেন বিয়ে করতে রাজি হলো কে জানে! পাজি কোথাকার!”

“ওর কথা বাদ দাও। তোমার তো হিংসে হচ্ছে!”

মা হেসে বললেন, “হিংসে না রে বাবা, হিংসে না। সত্যিটা বললাম। বউ শাশুড়ীর যুদ্ধ তো যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। এর পেছনে কিন্তু এদের কারো দোষ থাকে না। দোষ হয় সময়ের। বউ বিয়ে করে এসে স্বামীর অধিকার পেতে চায়, আর মা তার জায়গা ছাড়তে চায় না৷ এটাই বলেছি। হিংসে করব কেন? এত লক্ষীমন্ত মেয়েটা! আমার ভারি ভালো লেগেছে। দেখিস তোকে ও মানুষ করে ছাড়বে!”

“তার মানে কি আমি অমানুষ?”

“তা খানিকটা আছিস!”

“মা…”

মা স্বরূপের নাক টিপে দিয়ে বললেন, “আমার ছেলে পৃথিবীর সেরা ছেলে!”

“হয়েছে৷ অফিসের জুনিয়ররা যথেষ্ট তেল দেয়। তাদের দলে শামিল হবার প্রয়োজন নাই।”

মা গালে হাত দিয়ে বললেন, “প্রশংসা করলেও দোষ, খারাপ বললেও দোষ। যাই কোথায় বল তো?”

“মা তুমি একটা ড্রামা কুইন!”

“সে আবার কী?”

“বুঝতে হবে না। আমার চুল টেনে দাও তো।”

স্বরূপ মায়ের কোলে মাথা রাখতেই মায়ের ফোন বাজল। তনয়া ফোন করেছে। ফোন ধরে মা গল্প করতে শুরু করলেন। সে গল্প আর ফুরায় না! বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে স্বরূপ উঠে গিয়ে বলল, “তোমার ছেলেটেলে পর হয়নি, আমার মা পর হতে যাচ্ছে!”

মা হাসলেন। কথাটা শুনে ওপাশ থেকে তনয়াও হাসল। স্বরূপের এই অভিমানী গলা তার চেনা নয়।

তনয়ার বান্ধবী লুনার বিয়ে হয়েছে প্রায় দু’বছর আগে। প্রেমের বিয়ে। তবুও সে এখনো বলে, জানিস, প্রতিনিয়ত ওর এমন এমন নতুন বৈশিষ্ট্য বের হচ্ছে না! মনে হয় একটা মানুষকে পুরোপুরি চিনতে সারাজীবন লেগে যায়!

*****

তনয়ার রাতে ঘুম হলো না। অনেক রাত পর্যন্ত সে জেগে জেগে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। রাতের আকাশে কোটি তারা জেগে বসে আছে তারই মতো। আগামীকাল রাতটা কেমন হবে? খুব সুন্দর কিংবা খুব কষ্টকর?

সে আনমনেই স্বরূপকে ফোন করে বসল।

স্বরূপ সাথে সাথেই ফোনটা তুলে বলল, “হাই এক্স সিন্ডারেলা!”

“মানে কী?”

“আগে তুমি তাড়াতাড়ি ঘুমাতে, তাই সিন্ডারেলা ছিলে, এখন দেরিতে ঘুমিয়ে এক্স হয়ে গেছ।”

তনয়া হাসল।

“ফোন করেছ কেন?”

“এমনি।”

“প্রেম করতে?”

“হ্যাঁ করবেন?”

“কিভাবে করতে হয়?”

“আমার কোনো এক্সপিরিয়েন্স নেই।”

“সত্যিই?”

“সত্যি!”

“এদিকে আমার এক্সপিরিয়েন্স জঘন্য!”

“তাহলে আর প্রয়োজন নেই সেকথার।”

স্বরূপ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তুমি ভুল করলে তনয়া।”

“কী ভুল?”

“একসময় বুঝতে পারবে। তখন প্লিজ আমাকে দোষ দেবে না।”

“আপনি ভয় পাইয়ে দিচ্ছেন।”

“সেই চেষ্টা কম করিনি, তবে তেমন লাভ হয়নি।”

“তাহলে আর তার দরকার নেই।”

“তুমি একসময় বুঝবে। তখন পস্তাবে।”

“আমি কখনোই পস্তাব না। আমার কোনো সিদ্ধান্ত আজ পর্যন্ত ভুল হয়নি।”

“কোনোদিন হবেও না এমন কোনো গ্যারেন্টি কার্ড পেয়েছ নাকি?”

“আপনি কি আমাকে চ্যালেঞ্জ করছেন?”

“করছি। চলো একটা বাজি ধরি।”

“বিয়ে নিয়ে বাজি?”

“সেরকম না। তুমি ঠিক দু’বছর পর তোমার বিয়ে করার সিদ্ধান্তের জন্য আফসোস করবে। যদি করো তাহলে আমি বাজিতে জিতব। আর যদি না করো তবে তুমি জিতবে।”

তনয়া ভয়ার্ত গলায় বলল, “বাজি জেতার জন্য আপনি কী কী করবেন?”

“কিচ্ছু না। তোমার বোনকে আমি কথা দিয়েছি তোমার সাথে উল্টোপাল্টা কিছু করব না। কথাটা রাখব। আমি যেমন তেমনই থাকব। দেখা যাক তুমি কী করো।”

“ঠিক আছে, দেখা যাবে।”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু