Tuesday, July 22, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 213



গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-০৫

0

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৫.

স্বরূপরা সবাই চলে যাবার পর সে রাতে তনয়ার অদ্ভূত এক অনুভূতি হচ্ছিল। কাউকে বলে সে সেই অনুভূতি ব্যাখ্যা করতে পারবে না৷ মনে হচ্ছিল তার বুকের ভেতরটা রাতের আকাশের মতো আঁধার। তার ভেতর হঠাৎ একটা দুটো তারা জ্বলজ্বল করে উঠছে৷ শীতল, মিষ্টি কিংবা ঝিমঝিম করা একটা রাত তার জীবনে এসেছে৷ স্বরূপের সাথে এরপর আর কথা হয়নি৷ ওর শেষ কথাটা শুনে তনয়ার রাগ হয়নি। হাসি পেয়েছে। স্বরূপের সাথে কি তাকে সারাজীবন এভাবে ঝগড়া করে যেতে হবে? নাকি কোনোদিন সেও তাকে গুছিয়ে, যত্ন করে ভালোবাসবে? স্বরূপ নিশ্চয়ই ভাবছে সে আর কোনো ছেলে খুঁজে না পেয়ে পাগল হয়ে তাকে বিয়ে করেছে! এই ভুলটা কি তার ভাঙানো উচিত?

রাত একটার দিকে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল এলো। তনয়া ঘুম চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধরবে কি ধরবে না ভেবেও ধরে ফেলল। কোনো ইমারজেন্সি হতে পারে।

“হ্যালো।”

ওপাশ থেকে স্বরূপ বলে উঠল, “তুমি তনয়া তো?”

“ওহ তুমি! কেন গলা শুনে চিনতে পারোনি?”

“তুমি আমাকে হঠাৎ তুমি বলতে শুরু করলে কেন?”

“বাঃ! বিয়ে হয়ে গেছে। তুমি বলব না?”

“হু, তা বলতে পারো। ঠিক আছে রাখলাম।”

“কিন্তু এত রাতে ফোনটা করলে কেন?”

“আমার কাছে তোমার নাম্বার ছিল না৷ এবং যতদূর মনে হয় তোমার কাছেও আমার নাম্বার ছিল না। এখন নিলাম মায়ের কাছ থেকে।”

“এখন ক’টা বাজে খেয়াল আছে?”

স্বরূপ ঘড়ি দেখে বলল, “একটা! খেয়াল ছিল না৷ ঘুমিয়ে পড়েছিলে নাকি?”

“হুম। আমি বারোটার আগে ঘুমাই।”

“সিন্ডারেলা!”

“কেন আপনি কখন ঘুুমান?”

“আবার আপনিতে চলে গেলে?”

“অভ্যাস নেই যে তুমি বলার তাই।”

“আপনিই ঠিক আছে। বেশ একটা ডমিনেটিং ভাইব পাওয়া যায়৷ তুমি করে বললে মনে হয় তুমি আমাকে ঠিকঠাক সম্মান করছ না।”

তনয়া হেসে ফেলে বলল, “ঠিকঠাক সম্মান দেয়ার জন্য আর কী কী করতে হবে?”

“ক’দিন পর তো আমার বাসায়ই এসে থাকবে। তখন লিস্ট করে দেব।”

“আপনার বাসা তখন আমারও বাসা হবে।”

“ভুল। ওমেন এম্পাওয়ারমেন্টের যুগ চলছে। এখনকার মেয়েরা হাজবেন্ডদের সাথে সব খরচ শেয়ার করে। তুমি আগে সেরকম করবে, তারপর তোমারও সমান সমান অধিকার হবে।”

“কী বলেন এসব!”

“মোটেও এসব আমি বলি না। এসব নারীবাদী আপুরা বলে।”

“আপনি নারীবাদীদের দেখতে পারেন না?”

“আমি নারীদেরই তেমন একটা দেখতে পারি না।”

“গ্রেট। তাহলে মাঝরাতে একটা নারীকে ফোন করে কথা বলছেন কেন?”

“আমি প্রথমেই রেখে দিতাম। তুমি কথা বাড়িয়েছ।”

“ওকে। সব দোষ আমার। মাথা পেতে নিলাম৷ কিন্তু প্রশ্নটার উত্তর তো পাইনি।”

“কোন প্রশ্ন?”

“এখনো ঘুমাননি কেন?”

“কারন আমি সিন্ডারেলা না। ড্রকুলা।”

“রক্তখেকো?”

“হ্যাঁ।”

“কাদের রক্ত খান?”

“যারা আগে আগে ঘুমায় তাদের।”

“ধুর!”

“রাখছি।”

“শেষ প্রশ্ন!”

“আগে ভেবেছিলাম তুমি আমার জীবনের শান্তি নষ্ট করবে৷ এখন দেখছি ভুল ভাবছিলাম।”

“তো এখন কী ভাবছেন?”

“এখন মনে হচ্ছে সর্বপ্রথম নষ্ট হবে আমার কান৷ তোমার বকবক শুনতে শুনতে…”

“উফ!”

“প্রশ্নটা করবে নাকি রাখব?”

“আপনি কি সিরিয়াস ওই ব্যাপারটাতে?”

“কোন ব্যাপার?”

“ওইযে বললেন, খরচ সমান সমান বহন করতে হবে..”

“হুম। সিরিয়াস।”

“কিন্তু আমি তো এখনো কোনো চাকরি করি না। পড়াশুনাই শেষ হয়নি।”

“সেটা তোমার সমস্যা। সেজন্য আমার সাথে আগে কথা বলে নেয়া উচিত ছিল। তা তো বলোনি৷ এবার তুমি কী করবে সেটা তুমি ভেবে বের করবে।”

“ওহ, ওকে!”

“বাই। গুড নাইট।”

তনয়া পাল্টা কোনো অভিবাদন জানাল না। সত্যি কথা বলছে নাকি এই লোক?

ফোন রাখার পর স্বরূপ হো হো করে কিছুক্ষণ হাসল। ভয় পাওয়ানো গেছে মেয়েটাকে। এত সহজে ভয় পেয়ে যাবে কে জানত! এত শখ করে বিয়ে করেছে এখন বুঝুক কাকে করেছে!

*****

স্বরূপের ফ্ল্যাটে আসর বসেছে বহুদিন পর। সব বন্ধুরা একত্র হয়েছে, শুধু সজীব বাদে। সে এখানকার পড়াশুনা শেষ করেই পাড়ি জমিয়েছে ফিনল্যান্ড৷ এখন আরও পড়ছে, পড়েই যাচ্ছে। বাকিদের মোটামুটি গোছানো সংসার হয়েছে। স্বরূপ বাদে সবারই বিয়ে থা হয়ে গিয়েছিল৷ এখন তারও হলো। আজ তারা শুধু বন্ধুরা একত্র হয়েছে। সংসার, বাচ্চা সব রেখে ইউনিভার্সিটির জীবনে ফেরার একটা সাময়িক চেষ্টা।

এমনিতেও বিয়ে উপলক্ষে কিছু আত্মীয়স্বজন এসেছেন। মহিলারা বসার ঘরের মেঝেতে বসে পিঠা বানানো আর গল্পগুজবে ব্যস্ত। কেউ কেউ রান্নাঘরে চুলার পাশে খুন্তি নাড়ছে ব্যস্তভাবে। স্বরূপের মনেও অনেকদিন পর একটা উৎসব ভাব হচ্ছে। মা এলে এমনিতেও তার কাছে বাড়ি ভরা ভরা মনে হয়। আজ তো খালা, চাচী আর মামীরাও এসেছেন। সবার ভীষণ আদরের স্বরূপ। সবাইকে খুশি দেখে তার ভেতরকার বিতৃষ্ণাটা কিছুটা হলেও কেটেছে।

রান্নাঘর থেকে আরেক প্রস্থ চা আর মাংস পিঠা এসে হাজির হতেই অঙ্কুর দুটো পিঠা নিয়ে মুখে পুরল। খাদক বলে তার সুনাম এখনো সে অক্ষুন্ন রেখেছে। বরং পাল্লা দিয়ে ভুড়ি বাড়ছে। তার বউয়ের রান্নার হাতও নাকি অসাধারণ। অঙ্কুরের ধারণা তার মতো সুখী মানুষ পৃথিবীতে আর একটাও নেই। যদিও রোগ ইতিমধ্যে তাকে ধরে ফেলছি ফেলছি করছে।

মিলি পিঠায় হাত দিল না। এমনিতেই মজা পেয়ে চারটা খেয়ে ফেলেছে। এর বেশি হলে ডায়েটের বারোটা বেজে যাবে। তার জীবনটা ঠিক সরল নয়৷ স্বামীর সাথে বনিবনা নেই। লোকটা বিয়ের তিন বছরের মাথায় কেমন বদলে গেল! অফিসের সুন্দরী কলিগের সাথে দিনরাত এত কথা তার! মিলি যথেষ্ট সুন্দরী। তাও এখন নিজের দিকে আরও বেশি নজর দেয়। কেউ যেন বলতে না পারে স্বামী তার আটপৌরে দশা দেখে বিরক্ত হয়ে পিঠটান দিয়েছে।

অন্যরা খেতে খেতে গল্প করছে। কেউ নিজের সংসারের, তো কেউ অতীতের।

তবে আজ সবার মূল আকর্ষণ স্বরূপের দিকেই। সে আজকের হিরো। বিয়ের পাত্র বলে কথা! কায়েস জিজ্ঞেস করল, “স্বরূপ, হানিমুনে কোথায় যাবি?”

“নো হানিমুন।”

“মানে কী?”

“কোথাও যাচ্ছি না আমি। বিয়েটা করছি তাই বেশি, আবার হানিমুন!”

রূপা বিরক্ত গলায় বলল, “তোর ইচ্ছে নাই থাকতে পারে। আমার বোনের ইচ্ছে অনিচ্ছের দাম দিবি না?”

স্বরূপ সরু চোখ করে বলল, “তুই হচ্ছিস ভিলেন৷ তুই তনয়াকে কী খাইয়ে রাজি করিয়েছিস সত্যি করে বল তো?”

“কিচ্ছুই না।”

স্বরূপ ছাড়বার পাত্র নয়। সে এবার ভালো করে কথা ধরল, “তুই কোনোভাবে ওকে আমার অতীতের কথা বলিসনি তো?”

রূপা আমতা আমতা করে বলল, “না না, তা কেন বলব?”

“সত্যি করে বল।”

“সত্যিই!”

স্বরূপ মোটেও বিশ্বাস করল না। বলল, “মেয়েটা কি তাহলে আমাকে সিম্প্যাথি দেখাতে বিয়ে করল? কথাটা এতদিন মাথায়ই আসেনি। তোকে দেখে মনে পড়ল। যদি ভিলেনগিরি করে থাকিস, তোর বোনের খবর আছে।”

রূপা একটু মন খারাপের সুরে বলল, “স্বরূপ, আমি অনেক ভরসা করে ওকে তোর জন্য সিলেক্ট করেছি। ওর মতো ভালো মেয়ে লাখে একটাও হয় না। তুই যদি ওকে কষ্ট দিস তাহলে আমি সারাজীবনের জন্য ওর কাছে ছোটো হয়ে যাব।”

স্বরূপ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমি কেন কষ্ট দিতে যাব? তোর দোষ। তোর উচিত ছিল তোর ওয়ান ইন আ মিলিয়ন বোনকে সুযোগ্য পাত্র দেখে বিয়ে দেয়া।”

কঙ্কা দুই হাত তুলে বলল, “গাইজ, বিয়ে হয়ে গেছে। এখন এই ফালতু বকে কোনো লাভ নাই। স্বরূপ পাস্ট ভুলে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ। তুই সামনে এগিয়ে যেতে না পারলে কেমন মানুষ বল!”

“পাস্টের কথা আসছে না৷ আমার কাউকে বিশ্বাস করার ক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে।”

রূপা বলল, “তোর কিছু করতে হবে না। তুই শুধু ওকে কষ্ট দিস না।”

“ওকে।”

“প্রমিজ?”

স্বরূপ ভেবে রেখেছিল আজ রাতে সবাই চলে গেলে মাঝরাতে ফোন করে তনয়াকে আরেকটু ভড়কে দেবে। কিন্তু সিদ্ধান্তটা বাতিল করতে হলো। বলল, “প্রমিজ!”

“থ্যাংস দোস্ত।”

“তোরা আমাকে বন্ধু বলিস কেন আল্লাহ জানে। তোরা হলি একেক পিস শত্রু।”

সবাই হেসে উঠল। চায়ে চুমুক দিয়ে আড্ডা চলতে লাগল অন্য বিষয়ে। কিন্তু বেশিক্ষণ আর চলল না৷ বাড়ি থেকে সবারই কমবেশি ফোন চলে এলো। বিশেষ করে মেয়েদের দ্রুত বাড়ি যাবার তাড়া। বাচ্চা রেখে এসেছে তারা।

সবাই এক এক করে বিদায় নেবার পর শুধু মিলি রয়ে গেল। তার তাড়া নেই। তাকে কেউ কল করে বলেনি, এখনো কেন আসছ না? তবুও বাড়ি ফিরতেই হয়। সে উঠল ধীরেসুস্থে।

স্বরূপ মিলির বিষয়টা জানে। সে বলল, “চল তোকে এগিয়ে দিয়ে আসি।”

মিলি রাজি হলো। রিকশা পেতে কিছুদূর হাঁটতে হয়। ব্যস্ত শহরেও শীতের রাতটা থমথমে হয়ে আছে। স্বরূপ বলল, “সাফাত ভাই এখনো ঠিক হয়নি?”

“নাহ। আমি আর কিছু বলি না এখন। যা করছে করুক।”

“তুই ওর সাথে এখনো আছিস কেন? খারাপ লাগে না?”

“চাইলেই সম্পর্ক ভাঙা যায় না স্বরূপ।”

“কেন যায় না? তোর বাবা মা যথেষ্ট সাপোর্টিভ।”

“তাতে কী? বাবার দু’বার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে৷ আমি সাফাতকে ডিভোর্স দেব শোনামাত্র তার হার্ট চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে। মায়েরও হাই প্রেশার। একবার ঝগড়া করে বাড়ি চলে যাওয়ার পর আমি না ফেরা পর্যন্ত তার প্রেশার নরমাল হয়নি। তুই বল, আমি কী করতে পারি?”

“কিন্তু আছিস কেমন করে? এভাবে থাকা যায়?”

“জীবনটাই এডজাস্টমেন্টের। এখন তো মনের কষ্টের সাথে লড়াই করে থাকছি। ডিভোর্স হলে পুরো সমাজের সাথে লড়তে হবে।”

স্বরূপ হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিকভাবে ধরা গলায় বলল, “আচ্ছা মিলি, তুই যখন প্রথমবার ব্যাপারটা ধরতে পারলি তখন তোর কেমন লেগেছিল?”

মিলি কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। তারপর স্বরূপের হাত ধরে বলল, “সেটা বিষয় না। আসল বিষয় কী জানিস, আমার সাথে যাই হোক, আমার ভেতরকার বিশ্বাস কিন্তু নষ্ট হয়ে যায়নি। আমি এখনো বিশ্বাস করি পৃথিবীতে বিশ্বাসযোগ্য পুরুষ মানুষ আছে। তার উদাহরণ আমার বাবা, ভাই, তোরা। তেমনই তোরও এটা মেনে নেয়া উচিত যে পৃথিবীতে বিশ্বাসযোগ্য নারীও আছে। তোর মাও নারী। মাকে এত ভালোবাসিস, তবু নারী জাতির প্রতি এত বিদ্বেষ কেমন করে ধরে রেখেছিস বল তো?”

স্বরূপ কিছু বলল না। একটা খালি রিকশা দেখতে পেয়ে ডাক দিল। মিলি চলে গেল।

স্বরূপ আস্তে আস্তে ফিরতি পথ ধরল। মোবাইল পকেটে, অথচ স্বরূপ শুনতে পেল তৃতীয় কলটা। এর আগে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিল! তনয়া ফোন করেছে।

“কেমন আছেন?”

“ভালো। তুমি?”

“আমিও ভালো। কী করছেন?”

“হাঁটছি।”

“কোথায়?”

“রাস্তায়।”

“এই শীতের রাতে? কেন?”

“ইচ্ছে বলে।”

“ঠান্ডা লাগবে তো। বাসায় চলে যান।”

“ফোন করেছ কেন?”

“কথা বলতে।”

“বলা শেষ?”

“না। বাড়িতে কী চলছে? মা কী করছেন?”

“জানি না। তনয়া, রাখছি।”

“খুব খারাপ লাগে আমার সাথে কথা বলতে?”

“না, এখন ইচ্ছে করছে না।”

স্বরূপ ফোন রেখে দিল।

তনয়ার মনটা খারাপ হয়ে গেল। একটু কথা বললে কী হতো? কাবিন হবার পর থেকেই তার স্বরূপের জন্য একগাদা মায়া জন্মে গেছে। সারাক্ষণ তার সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করে। তার কাছাকাছি থাকতে ইচ্ছে করে। অথচ দেখা তো দূরে থাক, স্বরূপ ঠিকমতো কথাও বলে না। যাকগে, আর মাত্র দু’দিন। তারপরেই সে শ্বশুরবাড়ির দিকে রওনা হবে।

ভাবনাটা মনে আসতেই ভেতরে ভেতরে লজ্জা পেয়ে যায় সে। সবাই যদি জানতে পারে সে শ্বশুরবাড়ি যাবার জন্য পাগল হয়ে আছে, তাহলে কী লজ্জার একটা ব্যাপার হবে ভাবা যায়! বাইরে বাইরে তো খুব ভাব ধরে আছে সবাইকে ছেড়ে যাবার কষ্টে মরে যাচ্ছে!

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-০৪

0

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৪.

বারান্দায় বিকেলের রোদে বসে চুল শুকাতে শুকাতে হাওয়াই মিঠাই দুটো খাচ্ছিল তনয়া। দুই হাতে দুটো। তার অনেকদিনের ইচ্ছে ছিল এভাবে হাওয়াই মিঠাই খাওয়ার। নেহায়েতই লোকে পাগল বলবে বলে কখনো খায়নি।

এই বারান্দায় অনেকটা সময় পর্যন্ত রোদ থাকে বলে মা এখানে আচার শুকাতে দিয়েছে। আকাশ পরিষ্কার। চিকন একটা সাদা মেঘের রেখা দূর আকাশের প্রান্তে ভেসে আসে আলতোভাবে। সূর্যের আভা কমলা হয়ে আসছে। তনয়ার মনটা কেমন কোমল হয়ে আছে৷ ছাড়া ছাড়া চিন্তাগুলো হুটহাট আসছে যাচ্ছে মনে আলতো রেখাপাত করে।

তার জীবনে প্রথম প্রেমে পড়া বলে কিছু ছিল না। তবে কিছু ঘটনা মনে না রেখে থাকা যায় না৷ ওইযে রাস্তার পাশের বড় কদম গাছটা, ওটার আড়ালে ছেলেটা দাঁড়িয়ে থাকত রোজ বিকেলে। তনয়া বিরক্ত হতো, আবার কেমন মজাও লাগত। সে জানালা দিয়ে একটু পরপর লুকিয়ে দেখত ছেলেটা আছে নাকি চলে গেছে।

মুখচোরা ছেলেটা কিছুই বলতে পারেনি তাকে। শুধু দেখে গেছে৷ এরপর একদিন সে হুট করে মরে গেল! মা যখন বলছিলেন অমুক ছেলেটা ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে মরে গেছে, তখন কী ভীষণ অবাক হয়েছিল তনয়া! ছেলেটার মা বাবার সম্পর্ক ভালো ছিল না৷ রোজ বাড়িতে অশান্তি হতো। সহ্য করতে না পেরেই…তনয়ার মনে হয়েছিল আহারে, ছেলেটাকে একবার যদি জিজ্ঞেস করা হতো, তুমি কেমন আছো? ইচ্ছে করলেই সে জিজ্ঞেস করতে পারত। কিন্তু কখনো ইচ্ছেটাই হয়নি। সে হয়তো একটু মমতার আশায়, একটু ভালো থাকতে ওর কাছে আসতো!

কিংবা ইউনিভার্সিটির পবিত্র! কয়েকটা বছর একসাথে পড়াশুনার পরেও তনয়ার বিন্দুমাত্র ধারণা হয়নি ছেলেটা তাকে কতটা পছন্দ করে! বিদায় অনুষ্ঠানের দিন সে খুব আবেগ নিয়ে বলেছিল, “বিশ্বাস কর তনু, ধর্ম ছাড়া পৃথিবীর আর যে কোনো কিছু ছাড়তে হলে আমি তোর জন্য ছাড়তে পারতাম। চলে যাচ্ছি আজ৷ তুই খুব ভালো থাকিস। তোর জন্য পৃথিবী হয়তো আরও অনেক ভালোবাসা জমা করে রেখেছে অন্য কারো কাছে।”

পবিত্র চলে গেছে ইংল্যান্ড৷ যাওয়ার আগেই তনয়াকে ফেসবুক থেকে ব্লক করে দিয়েছে।

ভালোবাসা বোধহয় পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্বোধ্য বিষয়গুলোর একটা।

“তনু…কী কিনে এনেছিস দেখালি না যে…”

মা ঢুকলেন ঘরে। ঘর থেকে বারান্দায়। ওর হাওয়াই মিঠাই দুটো তখন শেষের পথে। মা হেসে বললেন, “তুই কি বাচ্চা?”

“না। আমি তো একটাই কিনেছিলাম৷ পরে দুটো কিনে দিল..”

“কে?”

“স্বরূপ।”

“দেখা হয়েছিল ওর সাথে?”

“হুম।”

“তারপর?”

“তারপর কী?”

“সব ঠিকঠাক?”

তনয়া প্রশ্নটা বুঝতে পারল না। বলল, “হুম। কোনো সমস্যা নেই।”

মা চারশো ভোল্ট বাল্বের মতো জ্বলে উঠলেন হঠাৎ করে। তারপর ‘আলহামদুলিল্লাহ’ পড়ে প্রস্থান করলেন। তনয়া বোকার মতো তাকিয়ে রইল। ঘটনাটা কী হলো?

একটু পর ফোন এলো রূপার। প্রথমেই সে জিজ্ঞেস করল, “স্বরূপ কি তোর প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক দিয়েছে?”

“হ্যাঁ তা দিয়েছে..”

রূপাও ওপাশ থেকে বলল, “আলহামদুলিল্লাহ।”

তনয়া কিছুক্ষণ বোকার মতো বসে রইল। তারপর ভাবল ব্যাপারটা আরো ঘেটে যাবার আগে থামাতে হবে। সে মোটেও বদ ছেলেটাকে বিয়ে করবে না! সে যখন বাবার ঘরের দিকে গেল তখন দরজার কাছে দাঁড়িয়েই শুনতে পেল বাবা দারুণ খুশি খুশি গলায় কাকে যেন ফোনে বলছেন, “এবার ভাই আমার মেয়ের বিয়েটাও ভালোয় ভালোয় দিতে পারব। চমৎকার পাত্র পেয়েছি। কী যে শান্তি লাগছে বলে বোঝাতে পারব না।”

তনয়ার চোখে পানি চলে এলো। সে আর কিছুই বলল না৷ চলে গেল নিজের ঘরে। বাবার এত আনন্দটাকে সে আবারও অসম্মতি জানিয়ে নষ্ট করে দিতে পারবে না! বাবা বুঝতে দেননি। কিন্তু তার এই গলার স্বর বুঝিয়ে দিচ্ছে তিনি কতটা চাপ থেকে মুক্তি পেয়েছেন!

তনয়া ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে অনেকক্ষণ কাঁদল। তারপর মনে হলো, তার হাতে আসলে কিছুই নেই। যা হচ্ছে সেদিকে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তার ভাগ্য।

*****

স্বরূপ জানালার পাশে ইজি চেয়ারে বসে চোখ বন্ধ করে কী একটা ভাবছিল। ঘরে একটা শব্দ হলো। ইঁদুর কি? বড় ফ্ল্যাটটা খাঁ খাঁ করে সারাক্ষণ। সে বাদে আর কারো বাস নেই এখানে। অবশ্য কিছু ইঁদুর, তেলাপোকা আর একগাদা মশা তাকে সঙ্গ দিতে থেকে যায়। এদের ঝেঁটিয়েও তাড়ানো মুশকিল! মানুষগুলোও এমন করে থেকে যেত যদি!

লোপার সাথে বিচ্ছেদের পর স্বরূপ আগের ফ্ল্যাটটা বিক্রি করে বড় একটা ফ্ল্যাট কিনেছে। ভালো চাকরি, একার আয়, এমন কোনো বিলাসদ্রব্য নেই যা সে কেনেনি। অথচ বাসাটাতে কোনো শান্তি লাগে না তার। মা এলে কিছুটা ভালো লাগে, এখন মাও নেই। মা বেশিদিন থাকতেও পারেন না। তার নিজের প্রতিষ্ঠা করা স্কুল আছে। সেই স্কুলের পেছনে সারাদিন চলে যায়। মা প্রায়ই ওকে বলেন গ্রামে চলে যেতে। কিন্তু গ্রামে গিয়ে সে করবেটা কী? হাল চাষ করার সামর্থ তো তার নেই।

তবে এই জীবনটা আর যাই হোক, ঝামেলাযুক্ত নয়। এদিকে সবাই তার জীবনে ঝামেলা তৈরি করার জন্য হাত ধুয়ে লেগে গেছে। কোথা থেকে যেন একেকটা মেয়ে ধরে এনে দেখিয়ে বেড়াচ্ছে। স্বরূপ কিছুতেই তাদের বোঝাতে পারছে না যে সে নতুন করে কাউকে ভালোবাসতে চায় না৷ ভালোবাসতে পারবেও না। এডজাস্ট করে থাকা, বউয়ের নিত্যনতুন আবদার পূরণ করা, রোজকার ন্যাকামি সহ্য করা এসব ইচ্ছে তার মরে গেছে।

শেষবার দেখা মেয়েটা ভালোই ছিল। তবে তার কেন যেন এসব নিষ্পাপ চেহারার মেয়েদের আরও বেশি বিশ্বাস হয় না। লোপার চেহারা কি কম নিষ্পাপ ছিল? অথচ মেয়েটা বের হলো বিশ্বাসঘাতক, ব্যভিচারিনী। সেই ঘটনার পর তিনটা বছর স্বরূপ সারারাত ঘুমাতে পারনি। চোখ বুজলেই ওই দৃশ্যটা মনে পড়ে যেত। তার দম বন্ধ হয়ে আসত। মনে হতো সারা শরীর জ্বলে যাচ্ছে!

গত দেড় বছর ধরে এসব আর হয় না। বরং একটা নির্লিপ্ততা চলে এসেছে জীবনের প্রতি। কিছুই ভালো লাগে না টাইপ হতাশার জীবন।

আবারও রান্নাঘরের দিক থেকে ভেসে আসা শব্দে উঠে পড়ল সে। সেদিকে যেতে গিয়ে মোবাইলের নোটিফিকেশন লাইট জ্বলতে নিভতে দেখে ফোনটা তুলে নিল হাতে। এমনিতে তার মোবাইল সাইলেন্ট থাকলেও হাতে থাকে বলে কল ধরতে অসুবিধা হয় না। আজ দূরে ছিল। এই ফাঁকে ফোন এসেছে মোট চল্লিশটা। মা আর বন্ধুবান্ধবের ফোন৷ ভয় পেয়ে গেল স্বরূপ। তাড়াতাড়ি ফোন করল মাকে।

মা যে খবরটা জানালেন তাতে তার মাথার চুল দাঁড়িয়ে গেল। গা জ্বলতে শুরু করল। মনে মনে বলল, “ইডিয়ট! পিওর ইডিয়ট! এতকিছুর পরেও একটা মেয়ে বিয়েতে রাজি হয় কোন সুখে?”

ইচ্ছে হলো তনয়াকে ফোন করে চেঁচামেচি করতে। কিন্তু নাম্বার নেই তার কাছে। ফোনটা ছুঁড়ে ফেলল বিছানায়। তারপর চলে গেল বাথরুমে। শাওয়ার ছেড়ে নিচে দাঁড়াল।

এখন শীত পড়তে শুরু করেছে। রাতের পানি আরও ঠান্ডা। তবুও তার গরম লাগছে। নির্ঝঞ্ঝাট জীবনে এ কোন আপদ আসতে চলেছে!

********

পরের বেশ কয়েকটা দিন কেমন করে যেন কেটে গেল! তনয়ার সাথে স্বরূপের কথা হলো না আর৷ তনয়াও ভয়ে তাকে ফোন করল না। এদিকে দুই পরিবারের সরব আয়েজনে বিয়ের দিন ঘনিয়ে আসতে থাকল। তাদের অনেকদিন পর দেখা হলো। বিয়ের কাবিননামায় সই করবার দিন।

স্বরূপ সকাল থেকেই প্ল্যান করছে কী করে তনয়াকে একটা শিক্ষা দেয়া যায়। বড়সড় একটা ধমক দিলে কেমন হয়? নাকি কাবিননামায় সই করার পর কানের কাছে গিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বাংলা সিনেমার মতো বলবে, “তোমাকে আমি স্ত্রীর কোনো অধিকার দেব না। আমার বাড়িতে তোমাকে থাকতে হবে পাশের বাড়ির লোকের মতো।” আরও নানা প্ল্যান করে সেগুলো প্ল্যান এ, বি, সি ক্যাটাগরিতে মনে মনে সাজিয়ে সে তনয়াদের বাড়ির দিকে রওনা দিল।

প্রাথমিক আপ্যায়নের পর যখন তনয়াকে বসার ঘরে আনা হলো তখন স্বরূপের মুখে আপনাআপনি তালা লেগে গেল।

মিষ্টি রঙের শাড়িতে তনয়াকে এত স্নিগ্ধ দেখাচ্ছিল যে স্বরূপ ইচ্ছে করেও বেশিক্ষণ চোখ সরিয়ে রাখতে পারছিল না৷ তার ওপর ওর চেহারায় বাড়তি একটা কোমলতা আছে যা সবার থাকে না৷

সইটই হয়ে যাবার পর ওদের কথা বলার জন্য একটা ঘরে ঢুকিয়ে দেয়া হলো কিছুক্ষণের জন্য। স্বরূপ প্ল্যানগুলো সব ভুলে চুপচাপ বসে রইল। তনয়া কী বলবে তাই বুঝতে পারল না। সে ভেবেছিল স্বরূপ তাকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না দেখে ভারি অবাক হলো।

একসময় জিজ্ঞেস করল, “আপনি ঠিক আছেন?”

স্বরূপ ঠিক সেই মুহূর্তে যেন সব ঘোর কাটিয়ে তার বাস্তব মূর্তিতে ফেরত আসতে পারল। বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “হ্যাঁ। গরু কুরবানি দেখেছ?”

“জি?”

“দেখেছ কি না?”

“হ্যাঁ।”

“কুরবানির পর তারা কী করে?”

“কী করবে? কিছু করার ক্ষমতাই থাকে না।”

“সেম সিচুয়েশন হিয়ার।”

তনয়া হেসে ফেলল। স্বরূপ ভুরু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “তুমি একটা ইমোশনাল ফুল।”

“কেন?”

“তোমাকে যা মারাত্মক দেখাচ্ছে! আমার মতো আধা রোবট জাতীয় প্রাণী বিয়ে না করলে ভালোবাসায় চাপা পড়ে মরে যেতে।”

তনয়া লজ্জা পাবে কি না বুঝতে পারল না। লোকটা কি প্রশংসা করছে? বোকার মতো বলল, “তাহলে ভালোই হলো। মরে গিয়ে কাজ নেই।”

স্বরূপ উঠে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল, “মাথাভর্তি পাটের আঁশ। বুঝবে কেমন করে?”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-০৩

0

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
৩.

তনয়া ঠান্ডা মেজাজের মানুষ৷ কিন্তু প্রচন্ড রেগে গেলে তার মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। রাগের মাথায় কী করে বসে নিজেও জানে না৷ সেরকমই পাগলাটে রাগ মাথায় চড়ে গেছে তার স্বরূপের কথা শুনে। সে উল্টোদিক ঘুরে কখন চলতে আরম্ভ করেছে নিজেও জানে না। কোনদিকে যাচ্ছে সে খেয়াল পর্যন্ত নেই। হঠাৎ কী একটা হলো, মাথা চক্কর দিয়ে উঠল। তারপরেই মনে হলো কে যেন তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কোথায়৷ এদিকে মাথার ভেতর প্রচন্ড শব্দে সাইরেন বাজছে।

যখন সম্বিত ফিরল, মাথা কাজ করতে শুরু করল, তখন সে দেখল ফুটপাতের ওপর বসে আছে। স্বরূপ তার হাত ধরে রেখেছে। তনয়া তাকাতেই সে জিজ্ঞেস করল, “পানি খাবে?”

তনয়ার কেমন যেন ক্লান্ত লাগছে। রাস্তার অনেকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে মাথা নাড়ল। খাবে না পানি।

স্বরূপ বলল, “গাড়ির নিচে পড়তে আরেকটু হলেই। এমন কেন করছিলে? আমি উল্টোপাল্টা বলেছি, আমাকে গাড়ির নিচে ফেললেও বুঝতাম। অপরাধীর শাস্তি নিজের মাথা পেতে নিতে এই প্রথম দেখলাম। চোখ সার্থক!”

নিজেকে গাড়ির নিচে ফেলার কথাটা স্বরূপ এত সিরিয়াস মুখ করে বলল যে তনয়ার রাগ পড়ে গেল। তবে বাইরে সেটা প্রকাশ করল না। স্বরূপ বলল, “চলো সামনের খাবারের দোকানে গিয়ে বসি। ওরা দুর্দান্ত স্যান্ডউইচ বানায়। খেতে খেতে তোমার প্রশ্ন শুনব। নাকি করবে না? না করতে ইচ্ছে হলে করো না। কিন্তু তোমাকে দেখে ঠিক সুস্থ মনে হচ্ছে না৷ এতটা পথ যেতে পারবে না একা। আবার আমার সাথে তো যাবেই না।”

তনয়ার হাসি পেয়ে গেল। কিন্তু সামলে নিল এবারও। মাথাটা এত জোরে চক্কর দিয়েছিল যে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবারও কেমন টলে উঠল সে। অগত্যা স্বরূপের হাত ধরে উঠতে হলো।

খাবারের দোকানে ভিড় আছে, তবে তারা যেতেই কোণার দিকের একটা টেবিল খালি হয়ে গেল। সেখানে গিয়ে বসল তারা৷ স্বরূপ দুটো স্যান্ডউইচ আর কোল্ড ড্রিংসের অর্ডার দিল।

কেউ কোনো কথা বলল না অনেকক্ষণ। খাবার চলে এলো। তনয়া এবার বলল, “আমি খাব না।”

“ওমা, খাবে না তো এসেছ কেন?”

তনয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আপনাকে প্রশ্নগুলো করতে।”

“শিওর?”

“হুম।”

“তখন করবে না বলে এখন মত বদলালে কেন?”

“সামনে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। ভাগ্য পেছন দিকে ঠেলে দিয়েছে তাই। এবার কথা শেষ না করে গেলে আবার দেখা হয়ে যাবে।”

স্বরূপ মুখে একগাদা খাবার নিয়ে যা বলল তা এরকম শোনাল, “হু, আবার ডেখা হয়া উচিট হবে ড়া..”

তনয়া এবারও হাসি চেপে কোল্ড ড্রিংসের গ্লাসটা টেনে নিয়ে চুমুক দিয়ে সময় নষ্ট না করে বলে ফেলল, “প্রশ্নগুলো সাধারণ জ্ঞানের মতো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণী কোনটি টাইপ না। অন্যরকম। এগুলো কোথা থেকে পেয়েছি সেই গল্প কাউকে বলিনি। সে যাক, প্রশ্ন করি।

ধরুন আপনি হঠাৎ কোনো কারনে খুব আর্থিক সমস্যায় পড়লেন৷ এতটাই দরিদ্র হয়ে গেলেন যে তিন বেলা খাবার জোটে না। দীর্ঘদিন এরকম চলার পর কেউ আপনাকে বলল সে আপনাকে ভাগ্য বদলে দেবার একটা পাথর দেবে, সেই পাথর ধারণ করে আপনার দিন ফিরবে। কিন্তু বিনিময়ে তাকে আপনার সবচেয়ে দামি জিনিসটা উপহার দিতে হবে৷ আপনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি এত দরিদ্র যে খেতে পাই না৷ আমার কাছে দামি জিনিস আসবে কোথা থেকে? তখন সে বলল, আমি এমন একটা জিনিস চাই যার বদলে পৃথিবীর সব নীতিকে কিনে ফেলা যাবে৷

এবার প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, সেই দামি জিনিসটা কী? দ্বিতীয় প্রশ্ন, আপনি উত্তরে কী বলবেন?”

স্বরূপ হেসে বলল, “সহজ প্রশ্ন।”

“হ্যাঁ সেটারই উত্তর জানতে চাই।”

“প্রথমটার উত্তর হলো সততা। কারন সততাই সর্বোত্তম নীতি। আর দ্বিতীয় উত্তরটা হলো, আমি পাথরে বিশ্বাস করি না। হা হা হা।”

তনয়া খানিকটা অবাক হলো। তার প্রশ্নটা সহজ ছিল এটা সত্য। তবে বেশিরভাগ মানুষ উল্টোপাল্টা উত্তর দিয়েছে৷ প্রথমটার উত্তর অনেকে বলতে পারলেও দ্বিতীয় ক্ষেত্রে তারা বলেছে তারা প্রস্তাবটা ফিরিয়ে দেবে কারন তারা সৎ! তারপর ইনিয়ে বিনিয়ে নিজেদের সততার সার্টিফিকেট নিজেরাই দিয়েছে৷ অথচ প্রশ্নটা কুসংস্কার নিয়ে ছিল। আবার অনেকে প্রথমটাও বলতে পারেনি কারন তারা হয়তো নিজেদের দামি জিনিস বলতে চারিত্রিক দিকটা ভাবতেই পারেনি।

এই প্রথম সে একটা সঠিক উত্তর পেল। তার মনে হলো, এই উত্তরটা আরও অনেকেই জানত। সে বেশ বুদ্ধিমান মানুষদেরও প্রশ্নটা করেছে। কিন্তু তারা অন্য কোনো কারনে উত্তর দিতে পারেনি। কী কারন? তারা তার জন্য পারফেক্ট ছিল না এজন্য? ভাগ্য কি তাকে জোর করে বোঝাতে চাইছে এই পাগল লোকটা তার জন্য পারফেক্ট?

নাহ, তারচেয়ে বরং বলা যেতে পারে লোকটা তার চোখ খুলে দিয়েছে৷ এই ঠুনকো দুটো প্রশ্ন দিয়ে কাউকে বিচার করা যায় না। বিচার করতে হয় তার ব্যবহার আর ব্যক্তিত্ব দেখে। কথায় বলে, দুর্জন বিদ্বান হলেও পরিত্যাজ্য৷

“শুনতে পাচ্ছো?”

তনয়া যখন তাকাল তখন দেখল প্লেট দুটো খালি। স্যান্ডউইচ দুটো উদরসাৎ করে ভদ্রলোক কোন ফাঁকে যেন তার হাত থেকে কোল্ড ড্রিংস সরিয়ে নিয়ে সেটাও সাবাড় করছে। আশ্চর্য লোক!

তনয়াকে তাকাতে দেখে স্বরূপ চোখ বড় করে বলল, “তুমি কি এটা খেতে? আমি ভেবেছিলাম খাবে না। যাকগে, আমার আধখাওয়া জিনিসে নিশ্চয়ই চুমুক দেবে না। মজার ব্যাপার কী জানো, আমার এক প্রেমিকা ছিল, সে আমার মুখ লাগানো বোতলে পানি খেত না। ভাবতাম সে খুব খুঁতখুঁতে মানুষ। তারপর তাকে এমন এমন জিনিস খেতে…”

তনয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে স্বরূপ এবারের মতো মুখ বন্ধ করে ফেলল। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “চলো তোমাকে রিকশায় উঠিয়ে দিয়ে আসি।”

“কোনো প্রয়োজন নেই। আমি যেতে পারব।”

ছেলেটা যেন শুনতেই পেল না। তনয়ার শপিং ব্যাগগুলো নিয়ে হাঁটা ধরল বাইরের দিকে। তনয়া পেছন পেছন গেল। তার সবকিছু কেমন যেন তেঁতো লাগছে।

রিকশায় বসার পর স্বরূপ বলল, “এক মিনিট। একটা কথা বলব৷ এই পর্যন্ত আমি যা যা বলেছি সেজন্য এক্সট্রিমলি স্যরি। আমি মেয়েদের পছন্দ করি না, তবে উত্যক্তও করি না। তোমাকে আজেবাজে কথা বলেছি কতকটা বিয়ে ভাঙার জন্য। তোমাদের বাড়ির বড়রা আমাকে বেশ পছন্দ করে ফেলেছে। তাদের সাথে তো আর উল্টোপাল্টা আচরন করা যায় না। এদিকে আমার বাড়ির লোক আর বন্ধুরা পাগল হয়ে গেছে বিয়ে দিতে। ফাইনালি বলেছে তোমার সাথে সেটিং না হলে আর জোরাজুরি করবে না। তাই আর কোনো অপশন ছিল না। যা যা বলেছি ভুলে যেও। আর একটা ভদ্রলোক দেখে বিয়ে করে ফেলো। আশা করছি আমাদের আর দেখা হবে না।”

তনয়া জিজ্ঞেস করল, “আপনি প্রশ্ন দুটোর সঠিক উত্তর জানতে চান না?”

“না আমি ভুল উত্তর দিতে পেরেছি এটা জেনেই খুশি লাগছে। বিদায়।”

স্বরূপ বিদায়বেলায় খুব সুন্দর করে হাসল। তনয়া ওর চোখের ভেতর দিয়ে হৃদয়ের ভেতরের আরও অনেকটা যেন দেখে নিল এক ঝটকায়।

পথে যেত যেতে তনয়ার কেমন বিষাদমাখা মন খারাপ হতে লাগল। মানুষটা যতক্ষণ ছিল ততক্ষণে নরম শীতের চাদরের মতো যেন জড়িয়ে ছিল কোনো এক অনুভূতি৷ এখন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। এরকম আর কখনো কারও জন্য হয়নি তার। কেন লাগছে এমন?

বাড়ি ফিরে শপিং ব্যাগগুলো খুলতে গিয়ে দেখল একটা অতিরিক্ত ব্যাগ। ব্যাগের ভেতর দুই প্যাকেট হাওয়াই মিঠাই!

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-০২

0

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
২.

রাতে খেতে বসে তনয়া খেয়াল করল অনেকগুলো আইটেম হয়েছে। মা এত করল কখন? এমনিতে মেহমান এলে সে যথেষ্ট সাহায্য করে, কিন্তু আজ যেহেতু তাকে দেখতে এসেছিল, তাই মা রান্নাঘরে ঢুকতে দেয়নি। এতক্ষণ বোধহয় ভাবার সময় দিল। এবার খাবার টেবিলে বসে সিদ্ধান্ত জানতে চাইবে।

তনয়া মাঝেমধ্যে ভাবে তার মতো ভাগ্য নিয়ে খুব কম মানুষই জন্মায়। আশেপাশে এত অসুখী, হতাশ আর টক্সিক লোকজন দেখতে দেখতে সে যখন নিজের ঘরের দিকে তাকায় তখন সেখানে প্রশান্তিমাখা একরাশ অক্সিজেনের বয়ে যাওয়া টের পায় সে। মা বাবার ঝগড়া সে আজ অবধি দেখেনি। তাকে ছেলেবেলা থেকেই সেই বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ তারা দিয়েছেন যেটা যে কোনো মানুষ পেতে চাইবে। তাই তো তার বিয়ের কথা শুরু হবার পর থেকে তার কাছ থেকে কখনো কোনো বিষয় লুকোছাপা হয়নি। যা কথা হয়েছে, তার সামনে হয়েছে। প্রতিটা ক্ষেত্রে তার মতামত নেয়া হয়েছে।

আজ খাবার টেবিল ভর্তি৷ খালা খালু আছেন, আছে রূপা আপু আর তার বর ফয়সাল ভাইয়া। আজ কি তাদের সামনে তার বিয়ের কথা তোলা হবে? হতে পারে। সম্বন্ধটা যেহেতু রূপা আপুর হাত ধরেই আসা।

তনয়ার অনার্স শেষ হলো সবে কিছুদিন। মাস্টার্সে তাদের ডিপার্টমেন্টে তেমন ক্লাস করতে হয় না৷ পরীক্ষাগুলো সময়মতো দিলেই হয়। নোটস জোগাড় করে রেখেছে সে৷ তবে পড়ায় কোথায় মন বসে? জীবনটা কেমন যেন সব কিছু থেকেও নেই এর মতো ম্যাড়ম্যাড়ে একঘেয়ে হয়ে গেছে। একমাত্র এডভেঞ্চার কী হতে পারে? বিয়ে?

এই পর্যন্ত অনেক বিয়ের সম্বন্ধই এসেছে। দেখাদেখিও হয়েছে বিস্তর। তবে একটা জায়গাতেই সবটা আটকে গেছে। তনয়া বারবার পাত্রপক্ষকে ফিরিয়ে দিয়েছে। সে যেন ঠিক মনমতো কাউকে পাচ্ছে না। যার সাথেই সে কথা বলছে, তার মনে হচ্ছে তারা ঠিক তনয়াকে দেখে পছন্দ করছে না। পছন্দ করছে ওর বাবার সম্পত্তি আর সম্মান দেখে। এখন পর্যন্ত কাউকে সে তার করা দুটো প্রশ্নের ঠিকঠাক উত্তর দিতে দেখেনি। প্রশ্ন দুটো সে সবাইকে করেছে। শুধু আজকের উজবুক লোকটাকে বাদ দিয়ে। প্রশ্ন করার সময়ই বা কোথায় পাওয়া গেল?

হড়বড় করে উল্টোপাল্টা বকে চলে গেল সে। কী যেন বলছিল? “আজকালকার দিনে এসব বিয়েটিয়ে কে করে? যাদের আইকিউ কম তারাই এসব নিয়ে মাথা ঘামায়। পড়াশুনা করে ক্যারিয়ার গড়াটাই মেইন ফোকাস হওয়া উচিত। এখন বিয়ের আগেই বিয়ের চাহিদা পূরণ হয়ে বিয়ে দিয়ে আদৌ কোনো লাভ হবে কী?”

এসব কথার প্রতিবাদ করেনি তনয়া। বিরক্ত হয়ে শুনছিল। শুধু শেষ কথাটা খুব গায়ে লেগেছিল তার। লোকটা বাঁকা হেসে বলেছিল, “তোমাকে আমি বিয়ে করতে পারি যদি তুমি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারো তুমি ভার্জিন।”

তনয়া দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বলেছিল, “গো টু হেল!” তারপর ছুটে চলে এসেছিল ছাদ থেকে।

পেছনে লোকটা পাগলের মতো হাসছিল।

“তনু, শুনতে পাচ্ছ?” বাবার ডাকে সম্বিত ফিরল তনয়ার। সে একমনে বিকেলের কথা ভাবছিল আর ভাতের ওপর এলোমেলো আঁকিবুঁকি করছিল।

মাথা তুলে সে বলল, “স্যরি বাবা। কিছু বলছিলে?”

“তোমার মতামত জানতে চাইছিলাম। কেমন লাগল স্বরূপকে? আমার তো বেশ লেগেছে। ভালো দেখতে, চমৎকার ক্যারিয়ার। কথা শুনে মনে হলো চিন্তাভাবনাও বেশ গোছানো।”

তনয়া মনে মনে বলল, “ছাই! হাতির মাথা! এমন লোককে ভালো লাগল কী করে!”

মাও বাবার সাথে যোগ দিলেন, “আমারও কিন্তু খুব ভালো লেগেছে। পাটিসাপটা পিঠা কী মজা করেই না খেল! নিজে থেকে আরও দুটো চেয়ে খেল। এক্কেবারে আদুরে ছেলে!”

তনয়া এবার মনে মনে বলল, “মা-টাও না! যাকে মনমতো খাওয়াতে পারবে সেই তার চোখে ভালো মানুষ হয়ে যাবে!”

এবার ফয়সাল ভাইয়া যোগ দিলেন, “অনেকদিন ধরেই চিনি ওকে। ছেলেটা ভীষণ রকমের সৎ।”

তনয়া মনে মনে বলল, “সেজন্যই জানে না মেয়েদের সাথে কিভাবে সদ্ব্যবহার করতে হয়!”

রূপা কিছুই বলছিল না। চুপ করে চেয়েছিল তনয়ার দিকে। এত এত প্রশংসায় ভাসাভাসির মধ্যে দিয়ে টুপ করে ‘আমার ভালো লাগেনি’ বলে দেয়া যায় না৷ রূপার কথা শুনে খানিকক্ষণের জন্য তার মন দুর্বল হলেও ভেতরে ভেতরে সে ঠিকই জানে, ছেলেটার সাথে তার বনিবনা হবে না। এমন বিয়েতে লাভ কী? সে ছোট্ট সুন্দর একটা সংসার চায়। সেখানে ভালোবাসার পাশাপাশি একে অপরের প্রতি সম্মান মিলেমিশে থাকবে।

তনয়া একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমি এখনো শিওর নই। আমার তোমাদের মতো এত ভালো লাগেনি।”

কথাটা শোনার পর কেউই আর কোনো মন্তব্য করল না।তনয়া খেয়াল করল বাবার মুখটা কিছুটা নিষ্প্রভ হয়ে গেল। তার হঠাৎ মনে হলো, বাবা কি এক মুহূর্তের জন্য হলেও পস্তাচ্ছেন? তার কি মনে হচ্ছে, মেয়েকে বেশি ছাড় দিয়ে ভুল করে ফেলেছেন? তার থেকে বরং অনেক বাবাদের মতো জোর করে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিলেই ভালো করতেন? তার কেন যেন মন খারাপ হয়ে গেল।

রূপা এতক্ষণে কথা বলল, “আচ্ছা তনু, তুই তো এখনো শিওর হতে পারিসনি৷ কিন্তু না-ও তো করিসনি। তুই আরও সময় নে। আমি এখনই ওদের কিছু বলব না।”

মা এবার জিজ্ঞেস করলেন, “ওরা কি তনুকে পছন্দ করেছে?”

“অপছন্দ করার কোনো কারনই নেই।”

সেই রাতে তনয়া শুতে গেল দেরিতে৷ ফয়সাল ভাইয়া এলে অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দেয়া হয়। তিনি নিজেই স্পেশাল কফি বানান, গান গেয়ে শোনান, আর তার ঝুলিতে আছে দেশ-বিদেশভ্রমণের বিচিত্র সব গল্পের পসরা। তনয়ার খুব ভালো লাগে সেসব শুনতে। কিন্তু আজ সে যেন কিছুতেই মন দিতে পারল না। রাতে শুয়েও এসবই এলোমেলো ভাবতে লাগল।

ঘুমের মাঝে স্বপ্নে দেখল তুলোর মতো মেঘপুঞ্জ তাকে ঘিরে ধরে আছে। সে হাত দিয়ে মেঘ সরাবার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। মেঘের দল ফিসফিস করে কী যেন বলছে। বাতাসের তোড়ে শব্দগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে কানে আসার আগেই। মেঘের ওপাড় থেকে কে যেন চিৎকার করে বলছে, “তোমার কি আইকিউ কম? সামান্য মেঘ কেটে বেরিয়ে আসতে পারছ না?”

**********

তিনদিন পর তনয়া নিউমার্কেটে গেল জামাকাপড় কিনতে৷ এবার শীতে তাদের প্ল্যান আছে একবার গ্রামের দিকে যাবে। গ্রামে শীত তুলনামূলকভাবে বেশি। এদিকে ঢাকায় শীত কম পড়ে বলে তার শীতের জামাকাপড় কেনা হয় না অনেকদিন। ফুটপাত থেকেই একটা ডেনিম জ্যাকেট বেশ পছন্দ হয়ে গিয়েছে তার। সেটাই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখার সময় চোখ গেল একটা লোকের দিকে। ঠিক চিনল সে। স্বরূপ! গায়ে হালকা হলুদ রঙের পাঞ্জাবি, চোখে সানগ্লাস! কী দারুণ লাগছে তাকে! দেখতে তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছে করে৷ কাকে যেন ফোনে ট্রাই করেও পাচ্ছে না।

তাকে অন্যমনষ্ক দেখে দোকানদার জিজ্ঞেস করল, “আপা নিবেন না?”

তনয়া চোখ ফিরিয়ে জ্যাকেটে মন দিল। ওই লোককে নিয়ে এখন মাথা ঘামাবার কোনো অর্থ হয় না। জ্যাকেটটা কেনার পর আবার সেদিকে তাকিয়ে দেখল স্বরূপ চলে গেছে৷

তনয়া আরও কিছু শপিং করল। কয়েকটা ফ্লোরাল প্রিন্টের ওড়না পেয়ে কিনে ফেলল, একটা ঘড়ি কিনল, দুটো লিপস্টিকও কিনে ফেলল। শেষে একটা হাওয়াই মিঠাই কিনে খেতে খেতে পা বাড়াল বাইরে। রিকশা খোঁজার দিকে মন তার।

রাস্তার ওপাশে নীলক্ষেতের ফুটপাতে চোখ গেল বোধহয় হলুদ রঙটা দেখেই। কোথায় যেন শুনেছিল হলুদ রঙ দূর থেকেও ফোকাসে চলে আসে?

ছেলেটা বসে আছে ফুটপাতে। ওকে ঘিরে কয়েকটা পথশিশু। কোনো মজার গল্প বলছে কি? বাচ্চাগুলো হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে। তনয়ার একবার ইচ্ছে হলো গিয়ে দেখে। আবার ইচ্ছেটা বাতিল করে দিল সে। লোকটাকে পাত্তা দেবার কোনো মানে নেই। অবশ্য সে কাছে গেলে লোকটা নিজেই তাকে পাত্তা দেবে না এই সম্ভাবনা প্রবল।

তনয়া রিকশা খুঁজতে লাগল। আজ কোনো রিকশাই যাত্রাবাড়ী যেতে রাজি হচ্ছে না। কী সমস্যা?

হঠাৎ কে যেন ওর ওড়না ধরে মৃদু টান দিল। কোনো বদ ছেলের কাজ ভেবে ঝট করে ফিরে তাকিয়ে তনয়া দেখল একটা বাচ্চা। বাচ্চাটা ঠিক ভিক্ষা চাইতে আসেনি। ওর মুখে হাসি। হাসি হাসি গলায় সে বলল, “আপা, আপনারে বাঈয়ে ডাকে।”

“কোন ভাই?”

বাচ্চাটা আঙুল দিয়ে সোজা দেখাল। সেখানে সানগ্লাস পরা হলুদ পাঞ্জাবি দাঁড়িয়ে আছে। তনয়াকে তাকাতে দেখে এগিয়ে এলো সে। বাচ্চাটাকে বিদায় করে দিয়ে বলল, “ভালো হয়েছে তোমাকে পেয়ে গেলাম। রূপা জ্বালিয়ে মারছে। তোমার সাথে আরেকবার কথা বলতে বলছে। আমি ভেবেছিলাম তুমি বাড়িতে না করে দেবে। কিন্তু তা করোনি৷ ঝুলিয়ে রেখেছ। তোমার নাকি দুটো কোশ্চেন আছে, সেগুলোর উত্তর দিতে পারলে আমার ছুটি। ফোন করতে চেয়েছিলাম, নাম্বার হারিয়ে ফেলেছি। প্রশ্নগুলো ঝটপট করে ফেলো তো।”

রূপা তনয়াকেও বলেছিল ও যে প্রশ্নগুলো সব পাত্রকেই করে থাকে সেগুলো স্বরূপকে করতে। স্বরূপ নিজেই নাকি যোগাযোগ করবে। করেনি বলে কথাটা ভুলেই গিয়েছিল তনয়া। এখন মনে পড়ল৷ সামনে যখন পড়েছে, করে ফেলতে আর দোষ কী?

সে বলল, “একটু নির্জন জায়গায় যাওয়া যাবে? এখানে এত ভিড়ের মধ্যে সিরিয়াস আলাপ করা যায় না।”

স্বরূপ চোখ মটকে জিজ্ঞেস করল, “ঠিক কতটা নির্জন চাও?”

তনয়ার ইচ্ছে করল লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে চলে যেতে। সে নেহায়েতই ভদ্র বলে কাজটা করতে পারল না। কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “কোনো প্রশ্ন নাই। চলে যান আপনি।”

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-০১

0

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
১.

“এরকম অদ্ভুত স্বভাবের নাকউঁচু ছেলেটার সাথে তুমি আমাকে জেনেশুনে বিয়ে দিতে চাও? তুমি চাইছ কী? সে তোমার বন্ধু হলে আমিও তোমার বোন।” কথাটা বেশ অভিমানী সুরেই বলল তনয়া।

রূপা গায়ের চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে নিল৷ দোলতার বারান্দা থেকে পূব আকাশের চাঁদটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কোমল আলোর ছোঁয়া মেখে আছে আকাশজুড়ে। রূপা একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তুই জানিস, আমি স্বরূপের জন্য তোর থেকে ভালো আর কাউকে ভাবতেই পারছি না। ও যতই নাকউঁচু ভাব দেখাক না কেন ওর মতো ভালো ছেলে তুই পুরো জীবন খুঁজলেও পাবি না।”

তনয়া এবার নড়েচড়ে বসল। “আহা! তাই নাকি? তোমার এই ভালো ছেলে প্রথমদিন এসেই আমাকে কী জিজ্ঞেস করেছে জানো?”

“কী?”

কথাটা ভেবেই যেন তনয়ার গা জ্বলে গেল। বলল, “জিজ্ঞেস করেছে আমি কোন ব্র্যান্ডের পারফিউম ইউজ করি।”

“তো তাতে সমস্যাটা কোথায়?”

তনয়া দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “পারফিউমের নাম বলার পর জিজ্ঞেস করেছে, এটা কে কিনে দিয়েছে? বয়ফ্রেন্ড? এত দামি জিনিস কেনাও বয়ফ্রেন্ডকে দিয়ে? সে তো এতদিনে ফকির হয়ে গেছে বোধহয়।”

রূপা হো হো করে হেসে ফেলল। হাসির এক পর্যায়ে হঠাৎ করেই যেন হোঁচট খেয়ে চুপ হয়ে গেল। মুখ অন্ধকার হয়ে গেল তার।

তনয়া জিজ্ঞেস করল, “কী হলো তোমার?”

রূপা বলল, “কিছু না। একটা কথা মনে পড়ে গেল। বাদ দে। তুই রাজি হয়ে যা প্লিজ!”

“যাতে তোমার জীবনের প্রথম ঘটকালি সাকসেসফুল হয়? না বাবা আমি তা কিছুতেই হতে দেব না।”

“তুই জানিস না স্বরূপকে কত কষ্ট করে রাজি করিয়েছি আমরা।”

“কষ্ট কেন? সে কি বিয়ে করতে চায় না?”

“না। সে মেয়েদের মোটেও পছন্দ করে না।”

তনয়ার আবারও গা জ্বলে গেল। “মানে কী? একটা ছেলে, যে মেয়েদের দেখতে পারে না তার সাথে তুমি জোর জবরদস্তি করে কেন আমার বিয়ে দিতে চাও? তোমার সমস্যাটা কোথায়?”

রূপা এতক্ষণে তনয়ার মুখোমুখি বসল। বলল, “আচ্ছা তোকে একটা ঘটনা বলি।”

“কোন ঘটনা?”

“স্বরূপের জীবনের ঘটনা।”

তনয়া হাত নেড়ে বলল, “আই অ্যাম নট ইন্টারেস্টেড।”

রূপা হেসে বলল, “তোর ইন্টারেস্টের খবর জানতে চাইনি। বলছি, শোন।”

রূপা মনে মনে ঘটনাটা গুছিয়ে নিল। তনয়ার দিকে একবার তাকাল। কী মিষ্টি মুখ মেয়েটার! দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। তনয়ার সবটাই মাধূর্যে মোড়া। ওর চাহনি থেকে শুরু করে কাজ করার ঢঙ, হাসি থেকে শুরু করে মনমানসিকতা সবটাই এত সুন্দর যে রূপার রীতিমতো ঈর্ষা হয়। যদিও রূপা দেখতে তনয়ার চেয়ে সুন্দর, তবুও সে জানে, বাকিসব দিক দিয়ে তনয়া তার থেকে অনেক এগিয়ে। তার এই ছোটো খালার মেয়েটাকে সে ভীষণ পছন্দ করে। তবে ছোটো বলে পছন্দটা স্নেহের মধ্যে দিয়েই প্রকাশ পায়।

সে বলতে শুরু করল, “তুই তো জানিসই, স্বরূপ আমার ইউনিভার্সিটির বন্ধু। যদিও সবাই বলে ইউনিভার্সিটিতে সত্যিকারের বন্ধু হয় না, তবুও আমরা কয়েকজন সত্যিই প্রাণের বন্ধু হয়ে রয়ে গেছি। আমাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রাণোচ্ছল ছেলে ছিল স্বরূপ। ওর মতো খোলা মন আর চমৎকার মানসিকতার ছেলে আজকের যুগে পাওয়া মুশকিল। ও ছিল আমাদের দলের অঘোষিত দলনেতা। তবে সেরকম আচরণ তার ছিল না। সবার বিপদে সে সবার আগে পাশে গিয়ে দাঁড়াত। যে কোনো ক্ষেত্রে, হোক দুষ্টমি, কিংবা সিরিয়াস বিষয়, সবার সামনে থাকত সে। আমরা ওর ঘাড়ে দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়ে গা হাত পা ছেড়ে বসে থাকতাম। সে দায়িত্ব নিত, সেই সাথে আমাদেরও কান ধরে উঠিয়ে ছাড়ত। ও কখনো কারো মন খারাপ হতে দিত না। হলেও সেটা বেশিক্ষণ টিকতে দিত না। আর ও এখন নিজেই চিরস্থায়ী মন খারাপের জগতে ঢুকে গেছে। আমরা হাজার চেষ্টা করেও তাকে সেখান থেকে বের করতে পারিনি।”

তনয়াকে আগ্রহী হতে দেখা গেল। “কী করে এমন বদলে গেল?”

“একটা এক্সিডেন্টের পর। এটাকে দুর্ঘটনা বলব নাকি দুর্ভাগ্য জানি না। তবে ওটাই সবকিছু বদলে দিয়েছিল। তোর ভাষায়, ওই নাকউঁচু ছেলেটা যখন সেকেন্ড ইয়ারে উঠল, তখন প্রেমে পড়ল। সাধারণ প্রেম না, একেবারে সাইক্লোনোর মতো তীব্র প্রেম! পাগলের মতো ভালোবাসত সে মেয়েটাকে। মেয়েটার নাম ছিল লোপা। এক বছরের জুনিয়র ছিল। ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট। ওরা বলা চলে দু’জন দু’জনার প্রেমে পড়েছিল। তুমুল প্রেম চলেছিল পুরো চারটা বছর।

স্বরূপের ঢাকায় কিছুই ছিল না। বাড়ি ছিল গ্রামে। সেই ছেলে লোপার জন্য, ওর সুখ সুবিধার জন্য কষ্ট করে চার বছর কাটিয়ে একটু একটু করে টাকা জমিয়েছিল সংসারের জন্য। পার্ট টাইম চাকরি করত অনলাইনে। সেখান থেকে পাওয়া সব টাকা জমিয়ে রাখত। মাস্টার্সের পাশাপাশি অফলাইনেও একটা চাকরিতে ঢুকল। মাস্টার্স শেষ করার পরপরই ঢাকায় ছোটোখাটো একটা ফ্ল্যাট কিনে ফেলল সে। সেটা সাজাল অল্প অল্প জিনিস দিয়ে। কিন্তু লোপার কাছে গোপন রাখল সবটা৷ চেয়েছিল হঠাৎ জানিয়ে চমকে দেবে।

আমরা স্বরূপের সাথে ওর ফ্ল্যাটে গিয়ে আড্ডা দিতাম, ওকে গোছাতে সাহায্য করতাম। আর ও নতুন জীবনের কথা বলত। কত স্বপ্নই না দেখেছিল ছেলেটা! ওর গলায় ভবিষ্যতের কথা শুনলে সত্যিই পৃথিবীটা রঙিন মনে হতো। তারপর…” বলতে বলতে গলাটা কেঁপে গেল রূপার।

তনয়ার কেমন কষ্ট হচ্ছিল শুনে। শেষটা নিশ্চয়ই সুখের হয়নি। হলে আজকের পরিস্থিতি অবশ্যই হতো না। সে জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছিল তারপর?”

“স্বরূপ মাস্টার্স শেষে ভালো একটা চাকরিতে ঢুকল। যেহেতু তার টুকটাক বেশ ভালোই অভিজ্ঞতা ছিল, দারুণ একটা চাকরিও পেয়ে গেল। চাকরির প্রথম মাসের বেতন পাওয়ার দিন আমাদের সবাইকে নিয়ে সে প্ল্যান করল লোপাকে সারপ্রাইজ দেবার আর তাকে বিয়ের জন্য প্রপোজ করার।

লোপার তখন অনার্স শেষ, মাস্টার্স চলছে। সে আর হলে থাকে না, একটা বাসা ভাড়া নিয়ে একা থাকে। ঠিক হলো হঠাৎ গিয়ে উপস্থিত হব। হলামও৷ স্বরূপের কাছে লোপার বাসার চাবি ছিল। চুপিচুপি ঢুকে গেলাম আমরা। কিন্তু ঢুকে যা দৃশ্য দেখলাম তার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলাম না।”

“কেন?” বলতে গিয়ে তনয়া খেয়াল করল তারও গলা কাঁপছে। মেয়েটা কি মরে পড়েছিল?

রূপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “লোপাকে আমরা একটা লোকের সাথে অন্তরঙ্গ অবস্থায় পেলাম। কী ভয়ানক বিষয় ভাবতে পারিস?”

তনয়া চুপ হয়ে গেল। সে সত্যিই ভাবতে পারছে না৷

রূপা বলল, “লোকটা ছিল লোপার ডিপার্টমেন্টের লেকচারার৷ ইভেন, আমরা পরে জানতে পেরেছিলাম লোপা গোপনে টাকার বিনিময়ে অনেক মানুষকেই সার্ভিস দিত।

এরপর থেকেই আমাদের বন্ধুটা কেমন যেন হয়ে গেল। সবই ঠিকঠাক, আবার কিছুই যেন ঠিক নেই। এখন ওই অবস্থা থেকে অনেকটা বেরিয়ে এলেও সে আমাদের, মানে তার কিছু মেয়ে বন্ধু, আর ফ্যামিলি বাদে আর কোনো মেয়েকেই পছন্দ করে না। সহ্যই করতে পারে না। কিন্তু সব মেয়েরা তো আর লোপার মতো নয় তাই না? আমি ওকে একদিন বলেছিলাম, তোকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মেয়েকে এনে দেখিয়ে দেব মেয়েরাও কী চমৎকার হতে পারে! ও হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল।

তনয়া বিশ্বাস কর, আমি তোর খারাপ চাই না৷ আমি শুধু দুটো সুন্দর মনের মানুষকে মেলাতে চাই। ও যাই বলুক, ওর ভেতরের মনটা পুরোপুরি মরে যায়নি৷ ও এখনো ভালোবাসতে জানে। শুধু ক্ষতটা একটু বেশিই গভীর হয়ে গেছে।”

তনয়া স্বরূপের মুখটা কল্পনা করল। ছেলেটা দারুণ দেখতে! ওর এক দেখায় পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। কী মায়াকাড়া চোখদুটো! দেখলেই ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। তবে গা জ্বালানো কথাবার্তা শুনেই ও ছেলেটাকে বিয়ে করার ইচ্ছে পুরোপুরি বাতিল করে দিয়েছিল। কিন্তু এখন আবার নতুন করে ভাবতে ইচ্ছে করছে। মানুষের কষ্ট কখনোই সহ্য করতে পারে না তনয়া। তার হঠাৎ খুব ইচ্ছে হলো, মানুষটার গভীর ক্ষততে হাত বুলিয়ে কিছুটা সান্ত্বনা দিয়ে আসতে। বিকেলের অসহ্য লাগা মুখটার জন্য এখন এত মায়া লাগছে কেন?

সে রূপার দিকে তাকিয়ে দেখল রূপা গভীর চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তনয়া তাকাতেই সে বলল, “তুই ভেবে বলিস। প্রয়োজনে আবার দেখা করতে পারিস ওর সাথে। তোকে সবই বললাম। আর জোর করব না। বাকিটা তোর ইচ্ছের ওপর ছেড়ে দিলাম।”

রূপা উঠে চলে গেল। ওর দু’বছর বয়সী ছোট্ট মেয়ে ঘুম থেকে উঠে কাঁদতে শুরু করেছে।

তনয়া রেলিংয়ে হেলান দিয়ে গোল চাঁদটার দিকে তাকাল। কী করা উচিত তার?

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

মনে পড়ে তোমায় সন্ধ্যে বেলায় পর্ব-১৩ এবং শেষ পর্ব

0

#মনে_পড়ে_তোমায়_সন্ধ্যে_বেলায়

#পর্ব_১৩

#নুজাইফা_নূন

-“উৎস ফারুক চৌধুরীর সাথে মিটিং শেষ করে নিজেদের মধ্যে আলাপ করতে থাকে। তাদের আলাপচারিতার মধ্যে নাতাশা সেখানে এসে উপস্থিত হয়। নাতাশা কে দেখে ফারুক চৌধুরী বললো,

-” কিছু বলবে মামনী?”

-” আচ্ছা পাপা মম সবসময় ম্যামের সাথে এতো খারাপ ব্যবহার কেন করে বলো তো? ম্যাম কতো ভালো একটা মেয়ে। অথচ মম সবসময় ম্যাম কে বাজে কথা বলে।”

-” কেন মা ? কি হয়েছে??”

-” ম্যাম বারবার বলেছে সে আজকে পড়াতে আসতে পারবে না। কিন্তু মম এটা কিছুতেই মানতে রাজি নন। একদিন না পড়লে কি এমন ক্ষতি হতো বলো তো পাপা?হয়তো ম্যাম অসুস্থ্য। এজন্যই তিনি আসতে চাইছেন না‌।”

-” তুমি বরং আদ্রিকে কল দিয়ে বলে দাও যে আজকে তার পড়াতে আসতে হবে না।পাপা না করে দিয়েছে।”

-” আদ্রি নামটা শোনা মাত্রই চমকে উঠে উৎস।উৎস গল্পে গল্পে ফারুক চৌধুরী কে বললো,

-” এই আদ্রি টা কে?”

-” আদ্রিকা খন্দকার। নাতাশার হোম টিউটর।খুব‌ই ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট। অনেক সহজ, সরল ভদ্র মেয়েটা। পার্সোনাল ভাবে তাকে আমার খুবই ভালো লাগে। কিন্তু আমার ওয়াইফ কেন জানি মেয়েটাকে পছন্দ করেন না।”

-” ফারুক চৌধুরীর কথা শুনে উৎসের বুঝতে বাকি রইলো না তিনি ঠিক কার কথা বলছেন ‌।উৎস তবু ও শিওর হ‌ওয়ার জন্য বললো,

-” আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আমি একটা কথা বলতে পারি?”

-” অবশ্যই।”

-” এই আদ্রির কোনো ছবি হবে ? না মানে আমি একজন আদ্রি কে চিনি।সেই আদ্রি আর এই আদ্রি একজন কিনা সেটাই দেখবো ।”

-” উৎসের কথা শোনা মাত্রই নাতাশা তার ফোন থেকে আদ্রির একটা ছবি বের করে উৎসের হাতে দিলো।ছবিটা দেখা মাত্রই উৎসের হার্ট বিট বেড়ে গেলো। তার হাত কাঁপতে শুরু করলো।উৎস মনে মনে বললো, এটাই তো আমার সন্ধ্যে কন্যা।তার মানে সেদিন সন্ধ্যে বেলায় আমি আদ্রি কে দেখেছিলাম।আদি কে নয়।আদি আমাকে মিথ্যা বলেছে ।ঠকিয়েছে আমাকে।আর আমি কিনা আদ্রি কে ভুল বুঝলাম। আমি কিভাবে আমার ভালোবাসা কে চিনতে পারলাম না?এখন আমি আদ্রির মুখোমুখি কিভাবে দাঁড়াবো? আমার এই ভুলের জন্য আমি কখনোই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না।”

_________________________________________

-“আদ্রি নাতাশা কে পড়ানোর জন্য তাদের বাড়ি এসে ড্রয়িং রুমে উৎস কে দেখে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়।সে তৎক্ষণাৎ বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই উৎস এসে আদ্রি কে জড়িয়ে ধরলো। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে যায় আদ্রি‌।আদ্রি মনে করে উৎস হয়তো তাকে আদিতা ভেবে জড়িয়ে ধরেছে। এজন্যই সে উৎসের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বললো,

-” আপনি আবারো ভুল করছেন উৎস।আমি আদিতা না।আদ্রি।”

-” আমি জানি তুমি আদ্রি‌।সাথে এটাও জানি তুমিই আমার সন্ধ্যে কন্যা।যার সাথে এক সন্ধ্যে বেলায় এই চোধুরী ভিলায় আমার দেখা হয়েছিলো।”

-” এসব আপনি কি বলছেন উৎস? ”

-” তুমি যে আমার সন্ধ্যে কন্যা, এটা তুমি জানার পরেও এতো বড় একটা সত্যি আমার থেকে কেনো লুকিয়ে গেলে আদ্রি ? কেনো আমাকে তিলে তিলে পুড়িয়ে মা’র’লে ? বুঝতে পেরেছি।আমি তোমাকে না চিনে কষ্ট দিয়েছিলাম। এজন্যই তুমি আমার উপর প্রতিশোধ নিলে তাই না?”

-” আদ্রি ঠিক কি উত্তর দিবে জানা নেই তার।সে তো নিজেও জানতো না সেই উৎসের সন্ধ্যে কন্যা।উৎস যে মেয়েটা কে নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসে সেই মেয়েটা আদি নয় , বরং সে নিজেই।আদ্রি কি বলবে বুঝতে না পেরে বললো, আমি নিজেও জানতাম না আমিই আপনার সন্ধ্যে কন্যা।আদি আমাকে বলেছিলো আদির সাথে ও কোনো এক সন্ধ্যে বেলায় আপনার দেখা হয়েছিল। এজন্যই আপনি আদি কে সন্ধ্যে কন্যা বলে ডাকেন।”

-” জানো আদ্রি আমি না অনেক বোকা।তোমার বোন টা আমাকে কতো সহজে বোকা বানিয়েছে।তোমার সাথে যখন আমার দেখা তখনি তোমার মায়াবী চোখের মায়ায় পড়ে যাই আমি। কিন্তু তোমার নাম , পরিচয় কিছুই জানা ছিলো না আমার।আমি পরের দিন আবারো সেই জায়গায় ছুটে আসি।যেখানে তোমার আমার প্রথম দেখা হয়েছিল ‌। ঠিক তখনি আমি তোমার মতো কালো বোরকা পরা একটা মেয়েকে এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখি। দারোয়ান আঙ্কেল এর কাছ থেকে জানতে পারি মেয়েটার নাম আদিতা। ব্যাস আমি সেদিন ই তোমাদের বাড়ি তে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাই। কিন্তু প্রথম থেকেই আদি কে নিয়ে আমার মনে সন্দেহ জেগেছিলো।আবার এটাও মনে হচ্ছিলো, হয়তো সবটা আমার মনের ভুল। তবে আজ বুঝতে পারছি আমি সঠিক ছিলাম‌।আমি তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি।তোমাকে অপমান, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেছি‌‌।আমি খাঁটি সোনা চিনতে ভুল করেছিলাম ‌।আমি জানি আমি যা করেছি।সেটা ক্ষমার অযোগ্য। তবুও বলছি পারলে আমাকে তুমি ক্ষমা করে দাও বলেই উৎস আদ্রির পা জড়িয়ে ধরলো।আদ্রি তৎক্ষণাৎ নিজের পা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,

-” ছিঃ ছিঃ এসব আপনি কি করছেন উৎস? আপনি মানুন বা না মানুন আমি আপনাকে আমার স্বামী হিসেবে মনে প্রাণে বিশ্বাস করি‌।আপনার প্রতি কোনো অভিযোগ নেই আমার।আপনি আমার সাথে যা যা খারাপ করেছেন,সেসব না হয় আমাকে একটু ভালোবেসে উষুল করে দিবেন।”

-” উৎস তৎক্ষণাৎ আদ্রি কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো, তোমাকে আর কোনো কষ্ট দিবো না আমি।আজ থেকে তোমার সুখের দিন শুরু হলো।কথা দিচ্ছি আমি বেঁচে থাকতে তোমার চোখে পানি আসতে দিবো না। নতুন করে সবটা শুরু করবো আমরা।দেখো আমরা অনেক ভালো থাকবো।অনেক।”

__________________________________________

-” ভাইয়া তুমি রোজ সন্ধ্যে বেলায় এখানে এসে চোখের পানি কেন ফেলো বলো তো? যা হবার হয়ে গিয়েছে। তুমি হাজার চোখের পানি ফেললে , কান্না করলেও যে চলে গিয়েছে ‌।সে আর ফিরে আসবে না ভাইয়া। তুমি কেনো বুঝতে চাইছো না ভাবিমণি আমাদের মাঝে নেই।আজ‌ থেকে পাঁচ বছর আগেই সে মা’রা গিয়েছে। তুমি কি ভুলে গিয়েছো সেই দিন টার কথা?”

-” সে দিনটার কথা আমি চাইলেও ভুলতে পারি না উপমা।সেদিন ই আমি জানতে পেরেছিলাম আদ্রিই আমার সন্ধ্যে কন্যা।আমরা নতুন করে বাঁচার অঙ্গীকার করেছিলাম।বিয়ের পর প্রথম বার কিছু সময় দুজন একান্তে কাটিয়েছিলাম।দুজনে মিলে আড্ডা , খাওয়া দাওয়া,শপিং শেষ করে গাড়িতে বসার পর দেখি আমার পকেটে ফোন নেই।আমার ফোন ভুলে কোনো দোকানে রেখে চলে এসেছিলাম।আমি আদ্রি কে গাড়িতে বসিয়ে রেখে আবারো শপিং মলে গিয়েছিলাম। মলের বেশ খানিকটা দূরে আমার গাড়ি দাঁড় করিয়ে রেখেছিলাম।আমি মল থেকে বের হতেই দেখি দেখি রাস্তায় আনুমানিক চার বছরের একটা বাচ্চা ছেলে কান্না করছে‌। আর দূর হতে একটা ব্রেকফেল করা মালবাহী গাড়ি বাচ্চাটার দিকে ধেয়ে আসছে।আদ্রি হয়তো সেটা দেখেই বাচ্চা ছেলে টাকে বাঁচাতে গিয়েছিলো। কিন্তু মেয়েটা তাকে বাঁচাতে গিয়ে নিজের প্রাণ টায় দিয়ে দিলো।আদ্রি ছেলেটা কে কোলে নিয়ে দৌড় দিতে গেলেই বোরকার সাথে বেঁধে রাস্তায় পড়ে যায়।যার ফলস্বরূপ বাচ্চা ছেলে টা দূরে গিয়ে ছিটকে পড়ে।ভাগ্যক্রমে ছেলেটা বেঁচে গেলেও বেঁচে ফেরে নি আমার সন্ধ্যে কন্যা।আমি চিৎকার করে দৌড়ে এসে ও কিছু করতে পারি নি। চোখের সামনে মালবাহী গাড়ি টা আমার সন্ধ্যে কন্যার কোমল দেহ পিষে দিয়ে চলে যায়।আমি দৌড়ে গিয়ে আদ্রির মাথাটা আমার কোলের উপর রাখতেই আদ্রি কাঁপা কাঁপা স্বরে বলেছিলো,

-” আমাকে একবার ভালোবাসি বলবেন উৎস?আমি ভালোবাসি বলে আদ্রির কপালে চুমু দিতেই আদ্রি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।বিশ্বাস কর উপমা আমি যদি জানতাম আদ্রি কে ভালোবাসি কথাটা বললেই আদ্রি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে‌।তাহলে আমি কখনোই আদ্রি কে ভালোবাসি কথাটা বলতাম না।”

-” যা হবার হয়েছে ভাইয়া।এখন সেসব ভেবে কোনো লাভ নেই। তুমি বাসায় চলো তো।সবাই তোমার জন্য টেনশন করছে।”

-” তুই যা। আমি আমার সন্ধ্যে বেলা টা আমার সন্ধ্যে কন্যার সাথে কাটাতে চাই।”

-” উপমা জানে হাজার বার বললেও উৎস এখন বাসায় ফিরবে না। পাঁচ বছর যাবৎ তার বাসার সবাই এটা দেখে আসছে। উৎস রোজ সন্ধ্যে বেলায় আদ্রির কবরের পাশে বসে থাকে‌। নিজের মতো করেই বকবক করে।কখনো বা উচ্চস্বরে হেসে উঠে।কখনো বা হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করে।তার মুখে সবসময় একটা কথায় আওড়াতে শোনা যায় #মনে_পড়ে_তোমায়_সন্ধ্যে_বেলায় ।

‌ ‌ ‌ ‌ 🌼🌼 সমাপ্ত 🌼🌼

মনে পড়ে তোমায় সন্ধ্যে বেলায় পর্ব-১২

0

#মনে_পড়ে_তোমায়_সন্ধ্যে_বেলায়

#পর্ব_১২

#নুজাইফা_নূন

-“উৎস , আদ্রি দুজনে দুজনের মতো খাচ্ছে এমন সময় আদ্রির নানি এসে বললো, এ কি রে আদু?তোরা আলাদা আলাদা থালে খাচ্ছিস ক্যা রে? বিয়ার পর সোয়ামী ব‌উ দুজনে এক থালে খাতি হয়।তাইলে দুজনের মধ্যে মায়া, মমতা,প্রেম ভালোবাসা, মহব্বত বাড়ে। তার কথা শুনে মনে মনে উৎস তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো, আমার জীবনে যার কোনো অস্তিত্ব ই নেই। তার প্রতি কি আদৌ আমার মায়া , মমতা, ভালোবাসা বাড়বে?আদ্রি উৎসের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে বললো,

-” ঐ বাড়িতে আমরা তো এক‌ই প্লেটে খাই নানী।কিন্তু এখানে সবার সামনে খেতে উনি ইতস্তত বোধ করছেন। নতুন জায়গা, নতুন মানুষ। বুঝতেই তো পারছো।”

-” ওমা সেকি কথা? সেকি বেডি মানুষ নি? ব্যাডা মানুষের ইতস্তত বোধ করার কি আছে?”

-” হয়তো লজ্জা পাচ্ছে।”

-“আমরা পরের মানুষ নি?আমরা আমরাই তো।আমাগের সামনে আবার কিসের লাজ লজ্জা?”

-” থাক না নানী। তুমি আর জোর করো না বলতেই উৎস সবাইকে অবাক করে দিয়ে নিজের প্লেট থেকে এক লোকমা খাবার আদ্রির মুখের সামনে তুলে ধরে।উৎস তাকে নিজের হাতে খাইয়ে দিবে।এটা স্বপ্নেও ভাবেনি আদ্রি।আদ্রির খুশিতে চোখে পানি চকচক করে উঠে।যা দেখে উৎস বললো, নাও হাঁ করো। উৎস কথাটা বলা মাত্রই আদ্রি কালবিলম্ব না করে উৎসের হাতের খাবার নিজের মুখে পুরে নিয়ে তৃপ্তি সহকারে খেতে থাকে।তার কেমন যেন সুখ সুখ অনুভব হয়‌।সবটা স্বপ্নের মতো লাগে আদ্রির।আদ্রি নিজেকে সঠিক প্রমাণ করতে নিজে নিজের গায়ে চিমটি কা’টে‌। যখন ব্যাথা পায়, তখন বুঝতে পারে সে স্বপ্নে নয় ,বাস্তবে রয়েছে।আদ্রির এমন আকাশ কুসুম চিন্তার মধ্যে হুট করে উৎস বলে উঠলো,

-” আমি তোমাকে খাইয়ে দিলাম।এবার আমাকে ও খাইয়ে দাও।কথাটা শোনা মাত্রই চোখ বড়বড় হয়ে যায় আদ্রির‌।আদ্রি প্লেট থেকে এক লোকমা খাবার তুলে উৎসের মুখে দিতে গিয়ে হাত পা ক্রমশ অবশ হয়ে আসে তার।আদ্রির কাঁপা হাত দেখে উৎস নিজেই আদ্রির হাত থেকে খাবারের লোকমা মুখে পুরে চিবোতে থাকে।এক প্রকার ভয়, লজ্জা , অস্বস্তি নিয়ে খাবার শেষ করে আদ্রি দ্রুত নিজের রুমে এসে দুহাতে নিজের মুখ ঢেকে নিয়ে বললো,

-” ইশ্ আজকে সকাল থেকে একটা পর একটা অঘটন ঘটে যাচ্ছে।আমার তো লজ্জায় ম’রে যেতে ইচ্ছে।এত কিছুর পরেও আমি মানুষ টার সামনে দাঁড়াবো কিভাবে?তার চেয়ে বরং মানুষ টা রুমে আসার আগেই আমি নাতাশা কে পড়াতে চলে যাই।তাহলে আর মানুষ টার মুখোমুখি হতে হবে না আমাকে।হ্যাঁ তাই করি বলে আদ্রি আলমারি খুলে তার পছন্দের বোরকা টা খুঁজতে থাকে।আদ্রি সবে মাত্র বোরকা টা হাতে নিয়েছে ঠিক তখনি দরজা লাগানোর শব্দ শুনতে পায়।আদ্রি তৎক্ষণাৎ পেছনে ফিরে উৎস কে দেখতে পায়।উৎস কে দেখা মাত্রই আদ্রি আলমারি বন্ধ করে ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই উৎস আদ্রির হাত ধরে টান দেয়‌।আদ্রি তাল সামলাতে না পেরে উৎসের শার্ট খামচে ধরে।যা দেখে উৎস বললো,

-” এসব কিছু তোমার প্ল্যান করা তাই না? তুমি ঐ বুড়িদের এ সব কিছু শিখিয়ে পড়িয়ে দিয়েছো তাই না?”

-” এসব আপনি কি বলছেন উৎস? আমি কেন নানী কে এসব শিখিয়ে দিবো?”

-” কেন আবার? আমার স্ত্রীর অধিকার পাবার জন্য।যাতে করে আমার কাছাকাছি আসতে পারো।আমার স্ত্রী হয়ে উঠতে পারো। কিন্তু তুমি যতোই চেষ্টা করো না কেন সফল হতে পারবে না।আমি কখনো তোমাকে আমার স্ত্রী হিসেবে মেনে নিবো না ।কখনোই না বলে উৎস এক প্রকার আদ্রি কে ছুঁড়ে নিচে ফেলে দেয়।যার দরুন আদ্রি কোমড়ে আবারো বেশ ব্যাথা অনুভব করে। কিন্তু উৎস কে ব্যাপার টা বুঝতে না দিয়ে আদ্রি নিচ থেকে উঠে উৎস কে কিছু বলতে যাবে তার আগেই উৎসের ফোন বেজে উঠে।উৎস ফোনে বাবা নামটা জ্বলজ্বল করতে দেখে ফোন নিয়ে বাইরে এসে কল রিসিভ করে বললো,

-” কিছু বলবেন মিস্টার জাহিদ তালুকদার?”

-” আমি তোমার বাবা হয় উৎস।আর কতো অভিমান করে থাকবে আমার উপর? কতো গুলো বছর হয়ে গিয়েছে তুমি আমাকে বাবা বলে ডাকো না।আমি সবসময় চাতক পাখির মতো বসে থাকি ।মনে হয় এই বুঝি আমার উৎস আমাকে বাবা বলে ডাকবে।বাবা ডেকে আমার অশান্ত হৃদয় টা করবে। কিন্তু না। দিন ,মাস , সপ্তাহ , বছর পেরিয়ে যায়।অথচ আমার ছেলে আমাকে বাবা বলে ডাকে না। তুমি তো বিয়ে করেছো।দোয়া করি খুব শীঘ্রই আল্লাহ তায়ালা তোমাকে যেন সন্তান দান করেন।নিজে যখন বাবা হবে, তখন আমার জ্বালা , আমার কষ্টটা বুঝতে পারবে উৎস। বুঝতে পারবে বাবা ডাক শোনার মধ্যে কতো শান্তি পাওয়া যায়।”

-” জাহিদ তালুকদারের কথায় উৎসের চোখ ভিজে আসে। জাহিদ তালুকদারের সাথে অভিমান করে তাকে বাবা বলে ডাকে না উৎস।এতে নিজেও ভেতরে ভেতরে যন্ত্রনা ভোগ করে। কিন্তু সেটা কাউকে বুঝতে দেয় না। উৎস সন্তর্পণে চোখের পানি মুছে বললো, কি জন্য ফোন দিয়েছেন সেটা বলুন।”

-“তুমি দেশে ফেরার পর থেকেই তোমাকে বলছি আমার বিজনেস এর দায়িত্ব নাও।আমার নিজের ও তো বয়স হয়েছে।কখন কি হয়ে যায়, কিছু বলা যায় না।আমি যাচ্ছি তুমি একটু একটু করে বিজনেসে ইনভলব হ‌ও।”

-” এতো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা না বলে , আমাকে কি করতে হবে তাই বলেন?”

-” আজকে ফারুক চৌধুরীর সাথে আমার একটা মিটিং ছিলো।একটা হোটেলে মিট করার কথা ছিলো আমাদের। কিন্তু হুট করে ফারুক চৌধুরী নাকি একটু অসুস্থ্য হয়ে পড়েছেন।তাই আমাকে তার বাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছেন।আমি চাই আজকের ডিল টা তুমিই ফাইনাল করো।”

-” ঠিক আছে।”

-” থ্যাংক ইউ সো মাচ বেটা‌।আমি লোকেশন পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

-” তার কোনো প্রয়োজন নেই।আমি ফারুক চৌধুরী কে চিনি।তার মেয়ে নাতাশার জন্মদিনের পার্টিতে আমি সেখানে গিয়েছিলাম বলে ফোন কেটে দিয়ে আদ্রির রুমে এসে দেখে আদ্রি তার শার্ট প্যান্ট গুছিয়ে রাখছে। উৎস ব্যাপার টা দেখেও না দেখার ভান করে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে ফারুক চৌধুরীর সাথে মিট করতে যাওয়ার জন্য রেডি হয়।তাকে রেডি হতে আদ্রি মনে করে উৎস হয়তো তাকে রেখেই বাড়ি চলে আসতে চাইছে। তবুও শিওর হবার জন্য আদ্রি উৎসের দিকে এগিয়ে এসে বললো,

-” আপনি কি তখনকার ব্যাপার টা নিয়ে রেগে আছেন? সামান্য একটা বিষয় কে ইস্যু করে কাউকে কিছু না জানিয়ে ঐ বাড়িতে চলে‌ যাচ্ছেন?আমি ও কি যাবো আপনার সাথে? আমরা তো আজকেই এ বাড়িতে এলাম‌।কটা দিন থাকি এখানে?আদ্রি একটার পর একটা প্রশ্ন করতে থাকে। কিন্তু উৎস কোনো উত্তর দিচ্ছে না দেখে আদ্রি আবারো বললো, কোথায় যাচ্ছেন আপনি? কি হলো কথা বলছেন না কেন?”

-” তোমাকে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য ন‌ই আমি।”

-” আপনাকে না দেখতে পেলে‌ , বাবা মা তো জিজ্ঞেস করবে আপনার কথা।তখন আমি তাদেরকে কি জবাব দিবো??”

-” আদিতার বিষয়ে সত্যিটা না জানা পর্যন্ত আমি এই বাড়ি থেকে কোথাও যাচ্ছি না। তুমি এই বিষয়ে নিশ্চিত থাকো বলে উৎস বেরিয়ে পড়ে।তার যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে আদ্রি ও বোরকা হিজাব পরে নাতাশার বাড়িতে আসার জন্য বেরিয়ে পড়ে।”

চলবে ইনশাআল্লাহ।।

মনে পড়ে তোমায় সন্ধ্যে বেলায় পর্ব-১১

0

#মনে_পড়ে_তোমায়_সন্ধ্যে_বেলায়
#পর্ব_১১
#নুজাইফা_নূন

-“আদ্রি উৎসের হাতে কাপড় দেওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সাবানের উপর পা পিছলে গিয়ে উৎসের গায়ের উপর পড়ে।উৎসের পায়ের তলায় ও শ্যাম্পু ছিলো।উৎস ব্যালেন্স রাখতে না পেরে আদ্রি কে নিয়ে নিচে পড়ে যায়। না চাইতেও কিছু সময়ের জন্য দুজনের অধর এক হয়ে যায়।ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে যায় আদ্রি। জীবনের প্রথম অধরে অধর ছুঁয়েছে তার। মূহুর্তের মধ্যে লজ্জায় দু গাল রক্তিম হয়ে উঠে। উৎসের চোখে চোখ রাখার সাহস হয় না তার।আদ্রি উৎসের চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিতেই হুঁশ ফিরে উৎসের ‌।উৎস তড়িঘড়ি করে উঠতে গিয়ে বুঝতে পারে তার পরণে থাকা টাওয়ালের গিট ঢিলে হয়ে এসেছে। যেকোনো সময় খুলে যেতে পারে।উৎস সন্তর্পণে আদ্রির উপর থেকে উঠে দেয়ালে পরাপর কয়েক টা ঘুষি মেরে দিয়ে বললো, ড্যাম ইট! আজ যে কার মুখ দেখে উঠেছিলাম?একটার পর একটা অঘটন ঘটে যাচ্ছে।সব এই ঠকবাজ মেয়েটার জন্য।মেয়েটার গালে কষে দুইটা থা’প্প’ড় দিতে পারলে মনটা একটু শান্ত হতো।”

-” আদ্রি ভেবেছিলো উৎস হয়তো তার হাত ধরে তাকে নিচ থেকে তুলবে। কিন্তু উৎস নিজে উঠে গেলেও আদ্রি সেখানে ঠাঁই পড়ে থাকে। এদিকে আদ্রির ভেজা কাপড়ে গা চুলকাতে শুরু করে।আদ্রি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে আবারো পা পিছলে ফ্লোরে পড়ে যায়।যার দরুন ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠে আদ্রি।আদ্রির আর্তনাদ কর্ণপাত হতেই উৎস আদ্রির কাছে ছুটে এসে আদ্রির দিকে নিজের হাত বাড়িয়ে দেয়।আদ্রি উৎসের হাত না ধরে নিজেই আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ায়।ব্যাপারটাতে বেশ অপমান বোধ করে উৎস।উৎস কিছু বলতে গিয়েও আদ্রির অশ্রুভেজা চোখের দিকে তাকিয়ে বলতে পারে না।আদ্রি চোখের পানি মুছে বললো, আমি বাইরে যাচ্ছি।আপনি তাড়াতাড়ি চেঞ্জ করে নিন।আপনি চেঞ্জ করে বের হলে আমি চেঞ্জ করবো।”

-” তুমি বরং আগে চেঞ্জ করে নাও।না হলে তোমার ঠান্ডা লেগে যাবে।”

-” উৎসের কথা শুনে আদ্রি কোনো কথা না বাড়িয়ে থ্রিপিস চেঞ্জ একটা শাড়ি পরে রুমে এসে কোমড়ে মুভ ক্রিম লাগানোর চেষ্টা করে। কিন্তু সে ব্যর্থ হয়।উৎস চেঞ্জ করে বেরিয়ে দেখে আদ্রি কোমড়ে মুভ লাগানোর চেষ্টা করছে।উৎস কে দেখেই আদ্রি নিজের শাড়ি ঠিক করে নেয়।উৎস তৎক্ষণাৎ আদ্রির হাত থেকে মুভ ক্রিম নিয়ে আদ্রি কে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে নিজেই আদ্রির কোমড়ে ক্রিম লাগিয়ে দেয়।আদ্রি আবেশে চোখ করে বিছানার চাদর খামচে ধরে।তার ভেতরে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। বারবার কেঁপে কেঁপে উঠে আদ্রি। শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে যায়।এর‌ই মধ্যে আদ্রির ফোন বেজে উঠে।আদ্রি ফোনের স্ক্রিনে নাতাশা নামটা জ্বলজ্বল করতে দেখে। নাতাশা সহ তার বাবা মা কিছুদিনের জন্য গ্ৰামের বাড়িতে গিয়েছিলো। এদিকে আদ্রির বাড়িতে বিয়ের ঝামেলা ছিলো।এজন্যই কয়েকটা দিন আদ্রি বাকি দুইটা টিউশনি থেকে ও ছুটি নিয়েছিলো। আজকেই তার ছুটির শেষ দিন। আগামীকাল থেকে আবারো তাকে পড়াতে যেতে হবে। উৎসের স্পর্শ সহ্য হচ্ছিলো না আদ্রির।আদ্রি বারবার উৎসের থেকে পালাতে চাইছিলো। কিন্তু সেটা মুখে বলতেও পারছিলো না।অবশেষে নাতাশার কল পেয়ে আদ্রি যেন আকাশের চাঁদ হাতে পায়।আদ্রি ফোন নিয়ে বাইরে এসে কল রিসিভ করে সালাম দিতেই অপর প্রান্ত থেকে ইতি চৌধুরী বললো ,

-“আমার বেবি ব‌ই খাতা নিয়ে টেবিলে ওয়েট করছে‌।জলদি পড়াতে এসো।”

-” আপনারা গ্ৰাম থেকে চলে এসেছেন?”

-” হ্যাঁ।”

-” কিন্তু ম্যাম আপনাদের তো আজকে আসার কথা ছিলো। আর আমার আগামীকাল থেকে পড়াতে যাওয়ার কথা।”

-” আমি কবে ফিরবো কি ফিরবো না সেটা নিশ্চয় তোমার থেকে জেনে নিবো না।এ কয়দিনে আমার বেবির অনেক পড়া মিস হয়ে গিয়েছে।তুমি দ্রুত চলে আসো।”

-” সরি ম্যাম।আমি আজকে আসতে পারবো না।”

-” আসতে পারবে না মানে কি? তোমাকে মাস শেষে এতো গুলো টাকা দেওয়া হয়।আমি কোনো এক্সিউজ শুনতে চাইছি না।এক ঘন্টার মধ্যে তোমাকে যেন আমার বেবির পড়ার টেবিলে পাই।আদ্রি কিছু বলার আগেই ইতি চৌধুরী সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।আদ্রি বাড়িতে এতো মেহমান রেখে কিভাবে বাড়ি থেকে বের হবে বুঝতে পারে না।আদ্রি কে চিন্তিত দেখে আদ্রির বাবা এসে বললো,

-” তোকে এমন চিন্তিত লাগছে কেন মা?”

-” আর ব‌ইলো না বাবা‌। নাতাশা আম্মু কল দিয়েছিলো।তিনি এমন ভাব করেন যেন আমি তার মেয়ের টিউটর না।তার বাড়ির কাজের লোক।তিনি গ্ৰামে যাওয়ার আগে বলে গিয়েছিলেন পনেরো তারিখ থেকে পড়াতে যেতে।হুট করে এখন কল দিয়ে বলছেন এক্ষুনি পড়াতে যেতে হবে।”

-” আচ্ছা মা তুই আমাকে একটা কথা বল তো। তুই কি এই সম্পর্ক টা মেনে নিয়েছিস? নাকি এই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছিস?”

-” না বাবা। বাঙ্গালী মেয়েদের বিয়ে একবার ই হয়।বিয়েটা যখন হয়েই গিয়েছে‌।তখন আর আমার ফেরার কোনো রাস্তা নেই বাবা।মেয়েরা বিয়ের পর স্বামীর সাথে আপোষ করে চলতে না পারলে, ডিভোর্স এর পর পুরো পৃথিবীর সাথে আপোষ করে চলতে হয়।আমি না হয় আমার স্বামীর সাথেই আপোষ করে চলবো।কথাটা শোনা মাত্রই সজল খন্দকার আদ্রি কে নিজের বুকে টেনে নিয়ে বললো,

-” আমি তোর মুখ থেকে এটাই শুনতে চেয়েছিলাম মা।তোর এখন বিয়ে হয়েছে, সংসার হয়েছে।এখন আর তোর বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিউশনি করাতে হবে না।আমি তোর শ্বশুর বাড়ি সম্পর্কে যতোটা শুনেছি।তারা মনে হয় না তোকে এখনো টিউশনি করাতে দিবে। তুই আজকেই সবাই কে বলে আসবি, তুই আর পড়াতে পারবি না।”

-” কিন্তু বাবা কয়েক মাস পরে তিন জনের ই পরীক্ষা।আমার ও তো একটা দায়িত্ব আছে।আমি এইভাবে মাঝপথে সবাইকে ছেড়ে আসতে পারি না বাবা।”

-” ঠিক আছে মা। তুই যা ভালো মনে করিস ।তাই কর।তবে এখন জামাই কে নিয়ে খেতে আয়‌। অনেকক্ষণ হলো তোরা এসেছিস। কিন্তু এখনো তোদের নাস্তা পানি দেওয়া হলো না। তুই আর দেরি করিস না মা‌।জামাইকে নিয়ে আয়‌।আমি গিয়ে দেখি শায়লা কি করছে?”

-“তুমি যাও।আমি আসছি বাবা।”

-” উৎস , আদ্রি আসা উপলক্ষে শায়লা পাকন পিঠা, তেলে ভাজা পিঠা, নকশি পিঠা, দুধচিত‌ই পিঠা, পাটিসাপটা পিঠা , ভাপা পিঠাসহ আরো হরেক রকমের পিঠা বানিয়েছেন।তিনি বড়লোক জামাই কে কিছুতেই হাতছাড়া করতে চাইছেন না।তাই তো তিনি সালমা তালুকদারের কাছে ফোন করে উৎসের পছন্দের সব খাবার রান্না করেছেন।আদ্রি উৎস কে নিয়ে আসতেই শায়লা খন্দকার ফ্লোরে একটা মাদুর পেতে দেয়। মাদুর দেখে উৎসের চক্ষু চড়কগাছ হয়ে যায়।সে কখনো নিচে বসে খায় নি।আদ্রি উৎসের সমস্যা বুঝতে পেরে উৎস কে অনুনয় বিনয় করে বললো,

-” প্লিজ একটু মানিয়ে নিন‌‌।না হলে এতো গুলো মানুষ কষ্ট পাবে।প্রতিত্তরে উৎস কোনো কথা না বলে চুপচাপ মাদুরে বসে পড়ে। যা দেখে খুশিতে চোখ ছলছল করে উঠে আদ্রির।”

-” উৎস , আদ্রি দুজনে দুজনের মতো খাচ্ছে এমন সময় আদ্রির নানি এসে বললো, এ কি রে আদু?তোরা আলাদা আলাদা থালে খাচ্ছিস ক্যা রে? বিয়ার পর সোয়ামী ব‌উ দুজনে এক থালে খাতি হয়।তাইলে দুজনের মধ্যে মায়া, মমতা,প্রেম ভালোবাসা, মহব্বত বাড়ে। তার কথা শুনে মনে মনে উৎস তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো, আমার জীবনে যার কোনো অস্তিত্ব ই নেই। তার প্রতি কি আদৌ আমার মায়া , মমতা, ভালোবাসা বাড়বে??”

চলবে ইনশাআল্লাহ।।

মনে পড়ে তোমায় সন্ধ্যে বেলায় পর্ব-১০

0

#মনে_পড়ে_তোমায়_সন্ধ্যে_বেলায়
#পর্ব_১০
#নুজাইফা_নূন

-“আদির মধ্যে কি এমন আছে , যা আমার মধ্যে নেই?আমরা দুজনেই টুইন।দেখতে ও এক‌ই রকম। বাবা মা ছাড়া আমার আত্মীয় স্বজনেরা আমাদের দুজনকে গুলিয়ে ফেলে। এমনকি প্রথম বার আমার মুখ দেখে আপনি ও আমাকে আদি মনে করেছিলেন।তাহলে কেন আমাকে নিজের স্ত্রী হিসেবে মেনে পারছেন না উৎস?”

-” আদ্রির এমন প্রশ্নে অতি দ্রুত ব্রেক কষে উৎস।উৎস আদ্রির অশ্রুভেজা নয়নের দিকে তাকাতেই আচমকা বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠলো।আদ্রির চোখের পানি সহ্য হলো না উৎসের।উৎস পকেট থেকে রুমাল বের করে দিয়ে আদ্রির হাতে দিয়ে বললো,

-” জেনে শুনে বিষ পান করেছো তুমি।এখন যতোই গলা জ্বলুক কান্না কাটি করে কোনো লাভ হবে না। তুমি খুব ভালো করে জানতে এই বিয়েটা হলে আমাদের তিন তিন টা জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। তবুও তুমি বিয়েটা করেছো।এখন চোখের পানি ফেলে কোনো লাভ হবে না।”

-” জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না উৎস।আদি তো একটা বারের জন্যও আপনার কথা ভাবে নি।তাহলে আপনি কেন আদির কথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছেন? আর আমাকে ও কষ্ট দিচ্ছেন?”

-“সন্ধ্যে কন্যা কে যদি আমি ভালোবাসতাম।তাহলে হয়তো তাকে আস্তে আস্তে ভুলে গিয়ে নতুন করে সবটা শুরু করতে পারতাম। কিন্তু ধীরে ধীরে আমি বুঝতে পারলাম আমি তাকে ভালোবাসি নি।আমি তার মায়ায় পড়েছি।আর মায়া বড্ড খারাপ জিনিস।না দেয় ভুলে থাকতে।আর না দেয় ভালো থাকতে।আমি আদির পেছনে লোক লাগিয়েছি।সে যদি পাতালেও থাকে। তবুও আমি পাতাল খুঁড়ে হলেও তাকে বের করে নিয়ে আসবো।আমার মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে তাকে। দাঁড়াতেই হবে।তোমার বাড়ির যাওয়ার সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য এটাই।আদি কে খুঁজে বের করা।”

-” প্রতিত্তরে আদ্রি কিছু না বলে বাইরের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ফেলতে লাগলো। ঘন্টা খানেক পর তারা নিজেদের গন্তব্যে এসে পৌঁছালো।আদ্রি গাড়ির মধ্যে থেকেই দেখতে পেলো তার বাবা মা , আত্মীয় স্বজন সহ আরো অনেকেই তাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে।উৎস গাড়ি থামাতেই আদ্রি দরজা খুলে দৌড়ে গিয়ে সজল খন্দকার কে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিলো।আদ্রি কে কান্না করতে দেখে তিনি আদ্রি কে বুকের সাথে চেপে ধরলেন।তার চোখ থেকেও দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো।তিনি সন্তর্পণে চোখের পানি মুছে আদ্রির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,

-” কেমন আছিস মা?”

-” আদ্রি কিছু বলার আগেই আদ্রির নানি এগিয়ে আদ্রি কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বললো,

-” আমার শরীর ভালা না থাকায় আদুর বিয়েতে আইতে পারি নাই।তয় শুনছিলাম আদুর নাকি মেলা বড়লোক বাড়িতে বিয়া হ‌ইছে।দেখছিস না আদু কতো দামি শাড়ি, গয়না পিন্দে আছে।একদম রানীর নাহাল লাগছে আমার আদু কে।এতো বড়লোক বাড়িতে বিয়া হবার পরেও কেউ খারাপ থায়ে নাহি?”

-“আদ্রি তার নানীর কথা শুনে চোখের পানি মুছে বললো, তুমি ঠিকই বলেছো নানী।আমি অনেক ভালো আছি। ঠিক ততোটাই ভালো আছি।যতোটা ভালো থাকার কথা আমার ছিলো না।”

-” দোয়া করি সারাজীবন সুখে শান্তিতে সংসার কর। সোয়ামী সোহাগি হ। তার কথায় আদ্রি মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,আমার কপালে স্বামীর আদর ভালোবাসা নেই গো নানী।”

-” আদ্রি কে নিয়ে সবার এতো আদিখ্যেতা দেখে রাগে গজগজ করতে লাগলো উৎস।উৎস দরজা খুলে বের হতেই সবাই উৎস কে ঘিরে ধরলো।উৎস না চাইতেও দাঁতে দাঁত চেপে সবার সাথে মত বিনিময় করে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করলো।আদ্রির বিয়েতে তেমন আত্মীয় স্বজন না আসলেও আদ্রি আসবে শুনে আদ্রির কাজিন , নানী , ফুফু সহ আরো অনেকেই এসেছে। তাদের সর্বমোট তিন টা রুম।আদ্রির রুম বাদে বাকি দুইটা রুমে মেহমান গিজগিজ করছে।আদ্রি অন্য রুম খালি না পেয়ে উৎস কে নিজের রুমে নিয়ে আসে।উৎস আদ্রির রুমে প্রবেশ করতেই তার মধ্যে একটা ভালো লাগা কাজ করে।আদ্রির রুম টা একদম পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখা।রুমে তেমন কোন আসবাবপত্র নেই।একটা খাট, একটা ড্রেসিং টেবিল, একটা আলমারি, একটা পড়ার টেবিল। টেবিলের উপর পাঠ্যব‌ইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন রাইটারের গল্পের বই ও রয়েছে।উৎস ব‌ই পত্র দেখেই বুঝতে পারলো আদ্রি পড়ুয়া মেয়ে।উৎস কে এদিক ওদিক তাকাতে দেখে আদ্রি বললো,

-” জানি আমাদের এখানে থাকতে আপনার কষ্ট হবে। কিন্তু একটু মানিয়ে নিবেন ।আর একটা কথা।আপনি যে আমাকে পছন্দ করেন না।এটা আপনি আমি জানি।অন্য কেউ তো জানে না।আপনার কাছে আমার একটা অনুরোধ।আপনি এই ব্যাপার অন্য কাউকে বুঝতে দিবেন না। অন্তত যে কটা দিন আমরা এখানে আছি।একটু ভালো ব্যবহার , একটু ভালো করে কথা বলবেন আমার সাথে। তাহলেই হবে।”

-” আদ্রির কথায় উৎস ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে লাগেজ থেকে কাপড় বের করে ওয়াশরুমে চলে যায়। উৎস ফ্রেশ হতে গিয়ে একেবারে শাওয়ার নিয়ে নেয়। কিন্তু বিপত্তি ঘটে তখনি যখন উৎস চেঞ্জ করতে যায়।উৎস চেঞ্জ করতে গিয়ে দেখে সে তাড়াহুড়ো করে শার্ট প্যান্ট এর বদলে আদ্রির জামা , সেলোয়ার নিয়ে এসেছে।উৎস কি করবে ভেবে না পেয়ে নিজের চুল টেনে ধরে কিছুক্ষণ ওয়াশরুমে পায়চারি করতে থাকে।দেয়ালে ঘুষি দেয় নিজেকে শান্ত করার জন্য। কিন্তু উৎস নিজেকে শান্ত করতে না পেরে দরজা খুলে দেখে আদ্রি শাড়ি চেঞ্জ করে একটা সুতি থ্রিপিস পরেছে। অনেক মায়াবী লাগছে তাকে দেখতে।উৎস আদ্রি কে ডাকবে কি ডাকবে না ভাবতে ভাবতেই হুট করে আদ্রির সাথে তার চোখাচোখি হয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ উৎস বোকার মতো ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করে দেয়।উৎসের এহেন কার্যে আদ্রি যেন বোকা বনে যায়।আদ্রি কিছু একটা ভেবে ওয়াশরুমের কাছে এগিয়ে এসে বললো,

-” এই আপনি কি আমার চেঞ্জ করা দেখছিলেন?”

-” আশ্চর্য! আমি তোমার চেঞ্জ করা দেখতে যাবো কেন?”

-” তাহলে দরজা খুলে আপনি উঁকি দিচ্ছিলেন কেন?আপনি নিশ্চয়ই আমার চেঞ্জ করা দেখছিলেন।এখন ধরা পড়ে মিথ্যা কথা বলছেন।”

-” আমার খেয়ে দেয়ে কাজ নেই আমি তোমার চেঞ্জ করা দেখতে যাবো।বাই দ্যা ওয়ে তুমি তো জানতে আমি ওয়াশরুমে আছি। তবুও রুমের মধ্যে কেন চেঞ্জ করছিলে?”

-“আদ্রি মনে মনে বললো, সত্যিই তো।এই ব্যাপার টা আমার মাথাতেই ছিলো না। ভেবেছিলাম উনার দেরি হবে।এই সুযোগে আমি চেঞ্জ করে নিতে পারবো। কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়বে কে জানতো?

-” কি হলো? কথা বলছো না কেন?”

-“আমি আপনাকে কৈফিয়ত দিতে বাধ্য ন‌ই।আমার রুম , আমার ইচ্ছা।”

-“উৎসের ইচ্ছে হলো আদ্রির গালে কষে দুইটা থা’প্প’ড় দিতে। কিন্তু উৎস নিজেকে শান্ত করে বললো, কুল ডাউন উৎস‌।কুল ডাউন। বেশি মাথা গরম করলে আজ তোর ইজ্জতের ফালুদা হয়ে যাবে। শ্বশুর বাড়ি এসে ব‌উয়ের জামা, সেলোয়ার পরে ঘুরতে হবে।উৎস গলার স্বর নিচু করে বললো,

-” আদ্রি।”

-” উৎসের মুখে আদ্রি নাম শুনে আদ্রির গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। অন্য রকম ভালোলাগা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো তাকে।আদ্রি তোতলাতে তোতলাতে বললো,জ্বি বলুন।”

-” আমার একটা হেল্প করতে হবে।”

-” আপনি বললে আমি আমার প্রাণ টাও আপনাকে দিয়ে দিতে পারি উৎস।”

-“আপাতত প্রাণ দিতে হবে না‌।প্যান্ট দাও।”

-” মানে?”

-” আমি ভুলে শার্ট প্যান্ট এর বদলে তোমার সেলোয়ার কামিজ নিয়ে এসেছি।”

-” কথাটা শোনা মাত্রই আদ্রি হাসতে হাসতে বললো,
ভালোই তো হয়েছে। আজকের মতো সেলোয়ার কামিজ পরে ঘুরুন।”

-” এটা কিন্তু খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে আদ্রি বলেই উৎস সাবান শ্যাম্পু নিচে ছুঁড়ে ফেলে দেয়।সাবান গিয়ে দরজার সামনে পড়ে।ঠিক তখনি আদ্রি শার্ট প্যান্ট নিয়ে দরজায় টোকা দেয়। উৎস গিয়ে দরজা খুলে দেয়।আদ্রি উৎসের হাতে কাপড় দেওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সাবানের উপর পা পিছলে গিয়ে উৎসের গায়ের উপর পড়ে।উৎসের পায়ের তলায় ও শ্যাম্পু ছিলো।উৎস ব্যালেন্স রাখতে না পেরে আদ্রি কে নিয়ে নিচে পড়ে যায়। না চাইতেও কিছু সময়ের জন্য দুজনের অধর এক হয়ে যায়।।”

চলবে ইনশাআল্লাহ।।

মনে পড়ে তোমায় সন্ধ্যে বেলায় পর্ব-০৯

0

#মনে_পড়ে_তোমায়_সন্ধ্যে_বেলায়
#পর্ব_০৯
#নুজাইফা_নূন

-” একি! আপনি দরজা বন্ধ করছেন কেন?”

-” রোমান্স করবো বলে।”

-” রোমান্স মানে??”

-” প্রতিত্তরে উৎস কিছু না বলে নেশা ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আদ্রির দিকে এক পা এক করে আগাতে লাগলো। উৎসের এমন চাহনি দেখে শরীর শিরশির করে গাঁয়ে কাটা দিয়ে উঠলো আদ্রির।আদ্রি উৎস কে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে এক পা এক পা করে পেছাতে লাগলো।এক পর্যায়ে আদ্রি শাড়িতে বেঁধে পড়ে যেতে গেলেই উৎস আদ্রির কোমড় আঁকড়ে ধরলো।এতেই যেন আদ্রির হাত পা কাঁপতে শুরু করলো।আদ্রি নিজের ব্যালেন্স রাখতে না পেরে উৎসের শার্ট খাঁমছে ধরলো।যা দেখে উৎস আরো শক্ত করে আদ্রির কোমড় চেপে ধরে নিজের কাছে টেনে নিয়ে এসে আদ্রির কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,

-” আমাদের বিয়ের সবে মাত্র দুটো দিন হয়েছে।আমরা এখনো নববিবাহিত দম্পতি।আর নববিবাহিত দম্পতি যখন একত্রে রোমান্স করে,তখন দরজা বন্ধ করে রাখতে হয়।এই সামান্য ব্যাপার টাও বোঝো না তুমি? মাথামোটা একটা বলে উৎস আদ্রির ওষ্টের দিকে নিজের ওষ্ট এগিয়ে নিয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ আদ্রি নাহহহ বলে চিৎকার দিয়ে হাত দিয়ে নিজের ওষ্ট চেপে ধরে ‌।আদ্রির চিৎকার শুনে উৎস আদ্রির দিকে এগিয়ে এসে বললো,

-” আমাকে দরজায় দেখে এভাবে চিৎকার দিয়ে উঠলে কেন?আমি বাঘ না ভাল্লুক যে আমাকে দেখে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে দিতে হবে?তোমার এমন চিৎকার শুনে পাশের রুমে থেকে নানু কি না কি মনে করে বসবে তিনিই জানেন?

-“আদ্রি মনে মনে বললো, হায় আল্লাহ! তার মানে সবটা আমার ভাবনা ছিলো। ছিঃ ছিঃ আমি এই মানুষ টাকে নিয়ে এসব ভাবতে পারলাম?এখন তাকে কি জবাব দিবো আমি?আদ্রির থেকে রেসপন্স না পেয়ে উৎস আবারো বললো,

-“তুমি কি জেগে জেগে আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছিলে নাকি?উৎসের প্রশ্নে আদ্রি থতমত খেয়ে বললো, হ্যাঁ না মানে না । আমার বয়েই গেছে আপনাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে।”

-” ভেরি গুড।আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখলেও সেটা তোমার স্বপ্ন‌’ই থেকে যাবে।আমি কখনোই তোমাকে আমার স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারবো না।আর না পারবো আমার সন্ধ্যে কন্যা কে ভুলে যেতে।”

-” উৎসের কথা শুনে আদ্রি মনে মনে বললো,আপনার এই সন্ধ্যে কন্যার ব্যাপার টা বড্ড ভাবাচ্ছে আমাকে। নাতাশার জন্মদিনের পার্টিতে সন্ধ্যে বেলায় আপনার সাথে আমার দেখা হয়েছিলো।সেদিন কল্পনায় নয় , বরং বাস্তবে আপনি আমার কোমড় আঁকড়ে ধরেছিলেন। কিছু সময়ের জন্য দু জোড়া চোখ এক হয়েছিলো।সেই হিসেবে আমি আপনার সন্ধ্যে কন্যা।কিন্তু আদি বলেছিলো আদির সাথেও নাকি আপনার দেখাটা সন্ধ্যে বেলায় হয়েছিলো কোনো এক পার্টি তে।আপনি আদি কে পার্টিতে দেখেই পছন্দ করে আমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলেন।ব্যাপার টা কেমন যেন গোলক ধাঁধার মতো লাগছে আমার কাছে।যাই হোক ।বিয়েটা যখন হয়েছে, তখন আমি আমার অধিকার ছাড়ছি না।এটা জি বাংলার সিরিয়াল নয় যে একজনের চার টা স্বামী থাকবে।আপনাকে যখন তিন কবুল বলে বিয়ে করেছি।তখন আমৃত্যু আপনার সাথেই থাকবো।সেটা আপনি চান বা না।আমি সহজ সরল হতে পারি।তাই বলে ভাববেন না আপনাকে এতো সহজে ছেড়ে দিবো।”

-” আদ্রি কে চুপ থাকতে দেখে উৎস বললো, আমার কাছে প্রতিটা সেকেন্ডের মূল্য অনেক বেশি।তোমার এসব নাটক দেখার সময় বা ইচ্ছা কোনটাই আমার নেই।অতি দ্রুত নিচে আসো বলে উৎস বেরিয়ে গেলো।উৎস যাওয়ার সাথে সাথেই আদ্রি লাগেজ নিয়ে নিচে এসে দেখে‌ সাজিন সবে মাত্র স্কুল থেকে ফিরেছে।আদ্রি কে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখেই সাজিন দৌড়ে এসে আদ্রি কে জড়িয়ে ধরে বললো, তুমি কোথাও যাচ্ছো নতুন ব‌উ?”

-” আদ্রি নিচু হয়ে সাজিনের গালে চুমু দিয়ে বললো,
হ্যাঁ সোনা।বাবার বাড়িতে যাচ্ছি।”

-” আমি ও যাবো তোমার সাথে।”

-” আদ্রি কিছু বলতে যাবে তার আগেই ঝর্ণা তালুকদার দৌড়ে এসে সাজিন কে আদ্রির থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, তুমি কোথাও যাবে না সাজিন।দু দিন পর তোমার পরীক্ষা শুরু হবে।”

-” ও যেতে চাইছে যাক না কাকিমা।”

-” তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে আদ্রি? দু দিন পর বরের মুখ দর্শন করতে পেরেছো।একটা সুযোগ পেয়েছো নিজেদের মধ্যে সব ঠিক করে নেওয়ার। কিন্তু তুমি যদি সাজিন কে তোমাদের সাথে নিয়ে যাও, সেই সুযোগ টা হাত ছাড়া হয়ে যাবে।”

-” কিন্তু কাকিমা সাজিন!”

-” কোনো কিন্তু নয়।আমি সাজিনের মা।আমি সাজিন কে ঠিক সামলে নিবো। তুমি তোমার বর কে সামলাও। নিজের আঁচলের তলায় বেঁধে নাও।ঝর্ণা তালুকদারের কথায় আদ্রি তৎক্ষণাৎ তাকে জড়িয়ে ধরে বললো,

-” আপনি অনেক ভালো কাকিমা।কতো সহজে আমাকে আপন করে নিয়েছেন।আমি ভেবেছিলাম বিয়েটা যেভাবে হয়েছে তাতে হয়তো কেউই আমার সাথে ভালো করে কথায় বলবে না।”

-” আমি ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।খুব‌ই সাধারণ ভাবে জীবনযাপন করেছি।সত্যি বলতে আদিতার চলাফেরা, পোশাক দেখে আমার আদিতা কে পছন্দ হয়েছিলো না। বারবার মনে হচ্ছিলো আদিতার সাথে উৎসের বিয়ে হলে উৎসের জীবন টা নষ্ট হয়ে যাবে।আমি বারবার চাইছিলাম বিয়েটা যেন ভেঙ্গে যায়। যখন বিয়েটা হয়ে গেল তখন উৎসের কথা ভেবে খুব খারাপ লাগছিলো। কিন্তু পরমুহূর্তেই পাত্রী বদলের কথা শুনে মনটা ভালো হয়ে গিয়েছিল।জীবনে অনেক সুখী হ‌ও আদ্রি‌।স্বামীর আদর ভালোবাসায় পরিপূর্ণ হয়ে উঠুক তোমার সংসার।”

-” আমি এখন আসি কাকিমা।”

-” ঠিক আছে যাও।”

-” আদ্রি একে একে সবার থেকে বিদায় নিয়ে নিচে এসে দেখে উৎস কারো সাথে ফোনে চিৎকার চেঁচামেচি করছে‌। চেহারায় রাগের ছাপ ফুটে উঠেছে।আদ্রি একটু এগিয়ে গিয়ে শুনতে পেল উৎস বলছে,

-” নাম্বার ট্র্যাক করা যাচ্ছে না মানে ? যেভাবেই হোক ওকে খুঁজে বের করো।আমি একটা বারের জন্যে হলেও আদিতার মুখোমুখি দাঁড়াতে চাই।আমি আদিতার মুখ থেকে শুনতে চাই আমার কোথায় ভুল ছিলো? কেন ছলনা করলো আমার সাথে? আমার সত্যি টা জানতে হবে বলতেই আদ্রির দিকে উৎসের চোখ পড়ে।উৎস তৎক্ষণাৎ কল কে’টে দিয়ে ফোন নিজের পকেটে ঢুকিয়ে বললো,

-” আমাকে কি তোমার বেতন ভুক্ত কর্মচারী মনে হয়? দশ মিনিট ধরে আমি এখানে অপেক্ষা করছি।এবার কি নিজে থেকে গাড়িতে বসবে নাকি কোলে করে নিয়ে বসাতে হবে?প্রতিত্তরে আদ্রি কিছু না বলে চুপচাপ গাড়ির পেছন সিটে গিয়ে বসে পড়ে।যা দেখে উৎস রেগে গিয়ে আদ্রির হাত ধরে টেনে বাইরে বের করে দিয়ে বললো,

-” আমি তোমার ড্রাইভার না ।ওকে?”

-” গাড়িতে বসলে ও দোষ ।না বসলে ও দোষ।আমি যাবো টা কোথায়?”

-” সামনের সিটে গিয়ে চুপচাপ বসে পড়ো। উৎসের কথা আদ্রি ও ভদ্র মেয়ের মতো চুপচাপ গাড়িতে বসে পড়লো‌।উৎস এসে নিজের সিট বেল্ট লাগিয়ে বললো, সিট বেল্ট লাগিয়ে নাও।”

-” আদ্রি কয়েকবার সিট বেল্ট লাগানোর চেষ্টা করে লাগাতে না পেরে এ পর্যায়ে হাল ছেড়ে দিয়ে বললো, এসবের কোনো প্রয়োজন নেই আমার।”

-” উৎস তৎক্ষণাৎ আদ্রির দিকে ঝুঁকে সিট বেল্ট লাগিয়ে দিয়ে বললো, নাচতে না জানলে উঠোন বাঁকা।কথাটা কর্ণপাত হলো না আদ্রির।আদ্রি এক ধ্যানে উৎসের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,আপনি যতোবার আমার সংস্পর্শে আসেন ততোবার আমার ভালো লাগা কাজ করছে।আমি নতুন নতুন অনুভূতির সাথে পরিচিত হচ্ছি।আমার যদি ক্ষমতা থাকতো আমি এই সময়ে ঘড়ির কাঁটা থামিয়ে দিতাম।তাহলে অন্তত কিছু সময় আমাদের হতো‌। একান্তই আমাদের।”

চলবে ইনশাআল্লাহ।।