গহন কুসুম কুঞ্জে পর্ব-১১

0
157

#গহন_কুসুম_কুঞ্জে
১১.

বাসটা তাদের নামিয়ে দিল চৌরাস্তার মোড়ে। এখান থেকে তাদের পথ ভিন্ন। দিনের বেলার ব্যস্ত পথটা এখন খাঁ খাঁ করছে। অসম্ভব নিরবতা চারদিকে। বিশ্বাস হতে চায় না এই পথ দিনের বেলা অজস্র যানবাহন আর লোকের সমাগমে মুখর হয়ে থাকে। কয়েকটা দূরপাল্লার গাড়ি প্রবল গতিতে পেরিয়ে গেল তাদের। তনয়ার এখন ভীষণ শীত করছে। সে দুই হাতের তালু ঘষল। স্বরূপ আঁড়চোখে সেটা দেখেও চুপ করে রইল। তনয়া এবার সত্যিই একটু কষ্ট পেল। একটুও কি মায়া হচ্ছে না তার? নাকি নিষ্ঠুর হবে বলে পণ করে বসে আছে?

তনয়া মনখারাপটা গিলে ফেলে জিজ্ঞেস করল, “এখন কিসে চড়ে যাব?”

“তোমার যদি প্রাইভেট জেটে চড়ে যেতে হয় তাহলে অর্ডার দিতে পারো, ব্যবস্থা করব।”

অন্য সময় হলে তনয়া হেসে ফেলত। কিন্তু এখন মাঝরাতে লোকটার কথার সুর তার মন আরও খারাপ করে দিল। চোখে পানি চলে এলো তনয়ার। সে চোখের পানি লুকাতে অন্যদিকে তাকাল। সোডিয়াম বাতির আলোয় স্বরূপ তা ঠিকই দেখতে পেল, তবে কোনো কথা বলল না৷ সে চিন্তায় আছে। একটা যানবাহন চাই। এখান থেকে দিনের বেলায় লোকাল বাস পাওয়া যায়৷ এখন সেসব নেই। শুধু দূরপাল্লার বাস যাচ্ছে, যারা তাদের জন্য এক মুহূর্ত দাঁড়ানোর কসরত পর্যন্ত করবে না। একটা কিছু যদি পাওয়া যেত! এত রাতে একটা মেয়েকে নিয়ে সে কোথায় যাবে? একা হলে আলাদা কথা ছিল।

উল্টে বাড়ি চলে গেলে ভালো হতো বোধহয়। কিন্তু সেক্ষেত্রে একদিন দেরি হয়ে যেত। বাড়ি গিয়ে অনুষ্ঠানের সবকিছু তাকে আর মাকে মিলে করতে হবে। নইলে মায়ের একা খুব চাপ হয়ে যাবে। এসব ভেবেই রিস্কটা নিয়েছিল সে। কিন্তু কোথাকার কী?

অনলাইনেও কিছুক্ষণ খুঁজল স্বরূপ। নাহ, কোনো সার্ভিস তাদের নিয়ে এত রাতে যেতে রাজি নয়। এতসব ঝামেলায় এই মেয়ের ন্যাকা কান্নাকে পাত্তা দেবার কোনো ইচ্ছেই স্বরূপের হলো না।

যে গাড়িই আসছে, স্বরূপ হাত তুলে সেটাকে থামাবার চেষ্টা করছে। অনেকগুলো গাড়ি চলে গেল, তাকে সাড়া দিল না কেউ। হতাশ হয়ে পড়তে লাগল সে ক্রমাগত৷ এদিকে পাশে তনয়া খানিক পরপর নাক টানছে। সর্দি লেগে গেল নাকি কষ্টে চোখের পানির সাথে নাকের পানি একাকার হয়ে যাচ্ছে কে জানে! স্বরূপ এতক্ষণে নিজের গায়ের কোট খুলে তনয়ার গায়ে জড়িয়ে দিল। তনয়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে ছিল না সেটা নেবার, বরং এতক্ষণ মনে হচ্ছিল স্বরূপ যদি কোটটা তাকে দেয়ও, সে ওর মুখের ওপর ছুঁড়ে দেবে। কিন্তু গায়ে কাঁটা দেয়া শীত আর কষ্টের মাঝে ওই উষ্ণতাটুকু তাকে এতটা আরাম দিল যে চাইলেও সে ঝেড়ে ফেলতে পারল না। বরং গায়ে জড়িয়ে নিল ভালো করে। স্বরূপের পারফিউমের ঘ্রাণ লেগে আছে কোটে। যেন মনে হতে লাগল স্বরূপই তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। মিহি সুবাস আর উষ্ণতায় তার মন খারাপ ভাবটা অনেকটা দূর হয়ে গেল।

স্বরূপের ভুরু কুঁচকে আছে। সে ভীষণ চিন্তায় আছে বোঝা যাচ্ছে। তনয়ার চিন্তা হচ্ছে না। অদ্ভূত এক রকমের ভরসা তার মন জুড়ে বসে আছে। পাশের মানুষটা তার কোনো ক্ষতি হতে দেবে না, সে জানে। চিন্তাটা মনে দোলা দিতেই মন খারাপের শেষ রেশটুকু কেটে গেল। একটা ট্রাক আসতে দেখে হাত তুলল স্বরূপ। ওর সাথে সাথে তনয়াও হাত তুলল প্রথমবারের মতো।

ওদের অবাক করে দিয়ে ট্রাকটা থামল। স্বরূপ তনয়ার দিকে অদ্ভূত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে এগিয়ে গেল ট্রাকের কাছে। ড্রাইভারের সাথে কিছু কথাবার্তা বলে তনয়ার কাছে এসে তার হাত ধরে টানল। “চলো, ট্রাকে করে অনেকদূর যাওয়া যাবে।”

ওরা উঠল ট্রাকের পেছনে। ট্রাকে ফল বহন করে নেয়া হয়। এখন যাচ্ছে খালি। পেছনে খড় বিছানো। তাতেই দু’জন গিয়ে বসল। ট্রাক ছাড়ল। হু হু করে বাতাস দিচ্ছে। প্রচন্ড শীত লাগতে শুরু করেছে। খোলা আকাশের নিচে ট্রাকটা ছুটে চলেছে। ওপরের দিকে তাকালে এক আকাশ ভর্তি তারার মেলা দেখা যায়। সেই তারার আলোয় স্বরূপের মুখটা দেখা যাচ্ছে। বেচারা এখন শীতে কাঁপছে। হাই তুলতেও দেখা গেল বার কয়েক।

তনয়া স্বরূপের একটা হাত ধরে বলল, “চলো শুয়ে পড়ি। কোটটা গায়ের ওপর দিয়ে রাখলে আর শীত লাগবে না।”

“ওটা যে কোনো একজনের গায়ে দেয়া যাবে।”

“উহু, আমি ব্যবস্থা করছে। তুমি কাত হয়ে শোও এখানে।”

খড়ের ওপর শুয়ে পড়ল স্বরূপ৷ তনয়াও তার পাশে শুয়ে পড়ল। ওর ডান হাত কোটের এক হাতে ঢুকিয়ে স্বরূপের বা হাত ঢোকাল অন্য হাতে। দুজন মাঝখানে জড়োসড়ো হয়ে রইল। স্বরূপ অন্য হাতে কিছু খড় নিয়ে নিজের মাথায় বালিশের মতো বানিয়ে নিল। তারপর হাতটা ছড়িয়ে দিয়ে তার ওপর তনয়াকে মাথা রাখতে বলল। দু’জন তখন খুব কাছাকাছি চলে এলো। পরষ্পরকে জড়িয়ে ধরে রাখল। এখন আর শীত করছে না। আরামদায়ক উষ্ণতা ছড়িয়ে পড়েছে শরীর আর মন জুড়ে৷

তনয়া স্বরূপের বুকে মুখ গুঁজে কী একটা যেন বলল। স্বরূপ শুনতে পেল না। কেন যেন হঠাৎ মেয়েটার জন্য মমতায় আর্দ্র হলো তার হৃদয়। ইচ্ছে হলো ওকে ডেকে কিছু একটা বলতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর বলা হলো না। ভাঙাচোরা পথে ট্রাকের দুলুনিতে আর আকাশের তারা দেখতে দেখতে ঘুম চলে এলো দু’জনের চোখেই৷

স্বরূপের গায়ের ঘ্রাণটা ভীষণ ভালো লাগে তনয়ার। সে দু’দিনেই ঘ্রাণটার সাথে এত পরিচিত হয়ে গেছে যে নিজের গায়ের ঘ্রাণ বলে ভ্রম হয় তার। ভোর হতে খুব বেশি দেরি নেই আর। কালো আকাশ ফ্যাকাসে হয়ে আসছে। বেশ খানিকটা ঘুমিয়ে উঠেছে তনয়া। স্বরূপ তখনো ঘুমে। ওর ভারী নিঃশ্বাস পড়ছে তনয়ার কপালে। এত ভালো লাগছে সবকিছু!

এত ভালোর মধ্যেও তনয়ার চোখ ভরে এলো জলে। হঠাৎ সব থেকেও কী এক শূন্যতায় ডুবে গেল যেন। শূন্যতার কারন আর কিছুই নয়, তাকে জড়িয়ে থাকা মানুষটা তাকে ভালোবাসে না, এটাই কারন। আহা! যদি স্বরূপ তাকে একটু ভালোবাসত! ভালোবেসে একবার কপালে চুমু খেত! এই রাতটা আরও কোটি গুণ সুন্দর হতে পারত!

ভোরের আলো ক্রমশ ফুটতে শুরু করল। তারাগুলো নিভে যেতে থাকল একটা একটা করে। নির্নিমেষ সেদিকে তাকিয়ে রইল তনয়া। ভোরের সতেজ বাতাস তার চোখমুখ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। তবুও স্বরূপের নিঃশ্বাস সে আলাদা করতে পারছে। চোখ তুলে ওকে দেখার চেষ্টা করল তনয়া। বাচ্চাদের মতো লাগছে। তনয়া মানুষটার প্রতি দুর্বল হচ্ছে একটু একটু করে, প্রতিটা মুহূর্তে!

ট্রাক থামল একসময়। দুলুনি থেমে যেতেই চোখ খুলল স্বরূপ। কোটের বন্ধনি থেকে মুক্ত করল নিজেকে। সে উঠে বসতেই ড্রাইভার এসে ডাকাডাকি শুরু করল। তনয়াও উঠল। নেমে পড়ল দু’জন। স্বরূপ ভাড়া মিটিয়ে দিল।

একটা বাজারের কাছে এসে থেমেছে ট্রাক। তনয়ার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হচ্ছিল, এরপর কেমন করে যাবে। কিন্তু রাতের সেই ত্যাড়া উত্তর আবার পাবার ভয়ে কিছুই বলল না৷

স্বরূপের এখন মন ভালো। সে তনয়ার মনের কথা আন্দাজ করতে পেরেই হয়তো নিজে থেকেই বলল, “এখন যেতে অসুবিধা হবে না। বাসে যাওয়া যায়, আবার স্টিমারে করে নদী পার হয়েও চলে যাওয়া যায়। নদীর রাস্তাটাই সোজা রাস্তা৷ বাসে গেলে ঘুরপথে যেতে হবে। তোমার যদি পানিতে ভয় না থাকে তাহলে নদীপথে যাব।”

তনয়া খুশিতে আটখানা হয়ে বলল, “অবশ্যই আমরা নদীপথে যাব!”

স্বরূপ মুচকি হেসে বলল, “ঠিক আছে। তার আগে চলো খেয়ে নেই। খিদেয় মারা যাবার অবস্থা হয়েছে।”

একটা হোটেল খুলেছে দেখা গেল। আটা মাখছে দোকানী। তারা গিয়ে বসলে লোকটা তাড়াতাড়ি রুটি বেলতে শুরু করল। গরম পরোটা আর সবজি-ডাল দিয়ে খাওয়াটা ভালোই জমল। খোলা আকাশের নিচে সতেজ বাতাস আর ভোরের স্নিগ্ধ পরিবেশ তনয়ার ভেতরটা পর্যন্ত শান্ত করে দিল। তার ওপর প্রবল ক্ষুধার পর খাবারটা অমৃতের মতো মনে হতে লাগল।

স্বরূপও খেল পেট ভরে। তারপর দুই কাপ চায়ের অর্ডার দিল।

মাটির ভাড়ে চা এলো। স্বরূপ চায়ের ভাড় তুলে নিয়ে বলল, “চলো যেতে যেতে খাই। ঘাটে আগে পৌঁছাতে পারলে প্রথম স্টিমারটা ধরা যাবে।”

ওরা চায়ে চুমুক দিতে দিতে হাঁটতে শুরু করল। একধারে সবুজ ঘাসে ছাওয়া পথ। পথের ওপাশে লম্বা লম্বা গাছের সারি শুরু হয়েছে। অন্যপাশে নেমে গেছে পথটা। শুরু হয়েছে ধানক্ষেত।

একসময় তনয়া চায়ের ভাড়টা বাম হাতে নিয়ে ডান হাত দিয়ে স্বরূপের বা হাতটা জড়িয়ে ধরল। কাজটা করতে তার এত ইচ্ছে করছিল যে স্বরূপের ইচ্ছে অনিচ্ছে পাত্তা দেবারও কোনো ইচ্ছে হলো না তার। স্বরূপের প্রতিক্রিয়া দেখতে সে তাকাল না পর্যন্ত। হাঁটতে লাগল নিজের মনে।

স্বরূপেরও ব্যাপারটা কেন যেন ভালো লাগল। তনয়ার কাছাকাছি থাকলে তার মনটা অদ্ভুত রকমের হালকা হয়ে থাকে। সে সহজ গলায় জিজ্ঞেস করল, “সাঁতার জানো?”

“উহু।” জবাব দিল তনয়া।

“তাহলে পানিতে যেতে চাইলে যে? ভয় লাগছে না?”

“তুমি পাশে থাকলে আমার কোনোকিছুতে ভয় লাগে না।”

“ডায়লগটা একটু ফিল্মি হয়ে গেল না?”

তনয়া স্বরূপের চোখে চোখ রেখে বলল, “কাল রাত থেকে তো দেখছ, এখনো বোঝোনি? তুমি যতটুকু সময় ছিলে না তখনই ভয় পেয়েছি। তুমি পাশে থাকার সময় ভয় দেখেছ আমার চোখে?”

স্বরূপ তনয়ার চোখের দিকে চেয়েই বলল, “না। কিন্তু আমি তোমার চোখে দুঃখ দেখেছি তনয়া। তুমি খুব ভালো মেয়ে। কিন্তু আমার জন্য নও৷ আমি তোমাকে ডিজার্ভ করি না!”

তনয়া মৃদু হেসে বলল, “আল্লাহ সবার জোড়া ঠিক করে দিয়েছেন। আমার তাঁর ওপর পূর্ণ আস্থা আছে।”

স্বরূপ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। সত্যিই কি তাই? তনয়াই কি তার ভাগ্যে ছিল? তবে আগে এলো না কেন? কেন জীবনের শুরুতে ভুল মানুষকে ভালোবেসে এতটা সময় এলোমেলো হয়ে গেল?

(চলবে)

সুমাইয়া আমান নিতু

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে