চক্ষে আমার তৃষ্ণা পর্ব-২+৩+৪

0
148

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-২
৩.
মাগরিবের আজান কানে ভেসে আসছে।রেণু হারিকেন আলো জ্বালিয়ে স্বামী দিকে তাকিয়ে আছে।বোনের মুখের ওপর ঠাসস করে দরজা বন্ধ করে নিজেও কেঁদে দেন।যতই হোক ভাই হয়।বোনের জন্য মনটা কাঁদে।

-;বোনকে বের করে নিজেই কষ্ট পাচ্ছেন।একবার ভেবে দেখছেন এই অবস্থায় মেয়েটা কোথায় যাবে?নিজে না খেয়ে বসে আছেন।আর ওর এই অবস্থায় ভরা সন্ধ্যায় বাহিরে রয়েছে।সারাদিন ধরে মনে হয় পেটে দানা,পানি কিছুই পড়েনি।আপনি রাগ না করে ওকে ঘরে আনুন।আমিও একজন মা।মা হয়ে আরেকটা সন্তানকে কষ্ট পেতে দেখে নিজেরই খারাপ লাগছে।আপনি বোনের প্রতি রাগ।কিন্তু তার সন্তানের ওপরে কোনো রাগ নেই।আপনি ওদের.….।

-;রেনু আমার মাথা একদম গরম করব না কইয়া দিলাম?মাথা গরম করলে কিন্তু খুব মাইর দিমু।

স্বামীর কথায় রেণু মুচকি হাসে।এই লোকটা নাকি তাঁকে ধরে মারবে।বি’য়ের তিন বছরের সংসারে একটা উচ্চস্বরে ধমক দিয়ে কথা ব’লেনি।আবার সেখানে নাকি মারবে।স্বামীর কথাটা রেনু কাছে হাস্যকর লাগে।তবুও স্বামী যখন বুঝতে পারলোনা।তখন নিজেই দরজা খুলে বাহিরে বেরিয়ে যায়।স্বাধীন দেখে ওহ কিছু ব’লেনি।

রাতের আঁধারে কোথায় যাবে রাজিয়া?মেয়ে আর নিজের অনাগত সন্তানের কথা চিন্তা করেই ভাইয়ের ভিটায় এখনো বসে আছে।এই বুঝি ভাই বেরিয়ে আসবে।তাকে ঘরে একটু জায়গায় দিবে।কিন্তু সন্ধ্যার আজান পরে যাওয়ার পরও ভাই আসেনা।চোখের পানি ঝড়ে পড়ে।রাতটুকু উঠোনে কাটানোর সিদ্ধান্ত নিলেই।দূর থেকে শিয়ালের হুক্কা হুয়া শব্দ ভেসে আসে কানে।ভয়ে গলা শুকিয়ে আসে।পুতুল মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে বসে আছে।রাজিয়া মেয়েকে বুকের মাঝে শক্ত করে ধরে বসে থাকে।আল্লাহ কে ডাকতে থাকে।আগামী বিপদে হাত থেকে রেয়াই পেতে।এমনই সময় দরজা খুট করে খুলে যায়।ভাবে এই বুঝি ভাই এসেছে।চেহারায় খুশির ঝলক আসে।কিন্তু ভাইয়ের জায়গায় ভাবীকে দেখে মুখটা অন্ধকারে ডেকে যায়।তাকে নিতে ভাই আসেনি।

-;এভাবে না খেয়ে বসে থাকলে হবে বোন।চলো ঘরে চলো।ভাইয়ের রাগ নিয়ে পরে থাকলে হবে।আগে দু মুঠো খাবার মুখে দিয়ে একটু বিশ্রাম নেও।

-;কিন্তু ভাবী,ভাইয়া।

-;উনার কথা এখন না ভেবে নিজের আর সন্তানদের কথা ভাবো।না খেয়ে কতখন থাকবে তুমি।পুতুলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল।সেই কখন থেকে তুমি ও না খাওয়া আম্মু।ভিতরে এসো আম্মু।রেনু,রাজিয়া আর পুতুলকে নিয়ে ঘরে ঢুকে।তাদের নিয়ে ঘরে ঢুকেই পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে খাবার খাইয়ে বিছানায় ঘুমাতে ব’লে চলে যায়।

রেণু নিজেদের শোয়ার করে আসতেই স্বাধীন মুখ ঘুরিয়ে বলল,

-;সেই তুমি আমার কথার অবাধ্য হইলা বউ।

-;তাহলে কি করতাম?আপনার মতো হাত গুটিয়ে বসে থাকতাম।আমি না হয়,হাত গুটিয়ে বসে থাকতাম।কিন্তু বাহিরে ওরা থাকলে শেয়াল মামাতো আর চুপ থাকতো না।ওরা ঠিকই হামলা করতো।আপনি দয়া করবেননা।তাই ব’লে আপনার বউ হয়ে আমি চুপ থাকতে পারি না।আমার যেটা ঠিক মনে হয়েছে,সেটাই করেছি।এটা নিয়ে আপনি আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন।স্বাধীন না খেয়ে গাল ফুলিয়ে বসে থাকে।স্বামীর মুখ ভার দেখে স্বামীর পাশে বসে তার গালে হাত রাখলো।

-;এত রাগ করেন ক্যান?আপনি দিন দিন রাগী হয়ে যাচ্ছেন।আমি কিন্তু এমন রাগী স্বামীকে ভালোবাসি নিই।আমি আমার শান্ত সৃষ্ট বোকা স্বামীকে খুব ভালোবাসি।আপনি মুখ ঘুরিয়ে রাখলে আমরা কোথায় যাব বলুন?আপনি ছাড়া আমাদের কে আছে?এত রাগ করে থাকলে কিন্তু আমিই কালই বাপের বাড়ি একা একা চলে যাব।আপনি সাথে না থাকলে যখন আব্বা,আম্মা জিজ্ঞাসা করবে।আপনি নেই ক্যান?তখন কিন্তু বলবো।আপনি আমার সাথে ঝগড়া করছেন।তাই চলে আসছি।

-;আমি তোমার সাথে ঝগড়া কখন করলুম।

-;করেন নিই।

-;না।

রেনু আর কিছু বলতে নিলেই একমাত্র ছেলে ঘুম ভেঙে যায়।কান্না করে উঠে।তাই স্বামীকে কিছু না ব’লে চুপচাপ ছেলেকে শান্ত করতে করতে স্বামীকে ইশারায় বলল ঘুমিয়ে পড়তে।

৪.
ফজরের আজানের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে পুতুলের। মা ক্লান্ত থাকায় এখনো পরে পরে ঘুমাচ্ছে।তার ঘুম আর না আসায় বাহিরে বের হতেই মোরগে ডাক শুনতে পায়।আরো শুনতে পায় কাকের কা কা ব’লে উঠা ডাক।মাথার ওপর মগডাল বসে কালো কাকটি কা কা করছে।সেই দিকে তাকিয়ে পুতুল।কাকটি এক ডাল থেকে ওপর ডালে বসে ঠোকর দিচ্ছে পায়ে খাবারের জন্য।স্বাধীন ফজরের নামাজ পড়তে যাবে।মাথায় সাদা টুপি পরে বের হয়ে আসে।পুতুলকে এমন ওপর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে আসে।

-;এখান কি করোস?মামার ডাকে পুতুল মনোযোগ সরে যায়।মুখ তুলে মামার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রয় কয়েক পলক।

-;কি রে কথা কস না কেন?স্বাধীনের কথার কোনো জবাব না দিয়ে ঘরে দিকে দৌড় মারে পুতুল।কালকে মা’কে বকেছে মামা নামের এই লোকটা।আজকে তাকে কি খুব বকবে?তাই ভয় পেয়ে যায়।পুতুলের চলে যাওয়া দেখে,স্বাধীন মসজিদের পথে রওনা দেয়।

আমায় একবার যেতে দে না
আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়ে।
যেথায় কোকিল ডাকে কুহু
দোয়েল ডাকে মুহু মুহু
নদী যেথায় ছুটে চলে আপন ঠিকানায়।
একবার যেতে দেনা আমায় ছোট্ট সোনার গাঁয়ে।

সকালের সতেজতা ঠান্ডা বাতাসে মন প্রান জুড়িয়ে যায়।সময়টা চলছে অক্টোবর মাসের শেষের দিক।শীত আসার পূর্ব আভাস এখনই দিচ্ছে।বর্ষা ঋতু সময় সেই কখন চলে গেছে।ছোট ছোট আঁকাবাঁকা পুকুরের পানি কমতে শুরু করেছে।সেখানে ছোট ছোট মাছ ধরতে নেমেছে গ্রামের অল্পবয়সী ছেলে মেয়েরা।পুতুল বাড়ির উঠোনে দাঁড়িয়ে দেখছে সেসব।তার ভীষণ আনন্দ লাগছে।ইচ্ছে করছে পানিতে নেমে তাদের সাথে মাছ ধরতে।কিন্তু ভয় পাচ্ছে।যদি মামা আবার এসে ধমক দেয়।তখন মামা চলে যেতেই আবার ঘর ছেড়ে বাড়ির আঙ্গিনায় দাঁড়িয়ে আছে।দূরের মাঠে নতুন নতুন ধান বুনছে কৃষকেরা।কি ধান বুনছে তা জানে না পুতুল।শুধু দু’চোখ ভরে দেখছে সবকিছু।বাবার বাড়িতে থাকতে তাকে ঘর থেকে দাদি বের হতে দিতেন না।একে তো কথা বলতে পারে না।তার ওপর পাড়া প্রতিবেশী কথা তুলবে।তার ভয়ে তাকে ঘরে বন্দী থাকতে হতো।কিন্তু মামার বাড়িতে এসে প্রথমে খারাপ লাগলেও এখন খুব ভালো লাগে।অবাক চোখে গ্রামটাকে দেখে।দুই গ্রামে পার হয়ে যে গ্রামটা ছিল সেখানে ছিল তার বাবার বাড়ি।আর এখন এটা তার মামার বাড়ির।তার মায়ের কোনো বাড়ি নেই?আর না তার কোনো বাড়ি আছে।

-;পুতুল মা।কই তুমি?

মায়ের ডাক কানে আসতেই দৌড়ে আসে মায়ের কাছে।মায়ের কাছে বসতেই মা তার সারা মুখে আদর মেখে দেয়।পুতুলের তখন অনেক আনন্দ লাগে।মায়ের মতো করে সেও মায়ের মুখে অনেকগুলো ছোট ছোট চুমু বসায়।

-;তোমার মামী খাবার খেতে ডেকে গেছে সেই কোন বেলায়।এতখন না খেয়ে বাহিরে কি করছিলে।পুতুল মায়ের সঙ্গে হাতের ইশারায় কথা বলছে।তার দেখা ছোট গায়ের কথা।যে গায়ে সবুজ লতায় ঘেরা।মায়া ভরা কিছু সৃস্তি চোখের সামনেই ভেসে ওঠে রাজিয়ার।মনে পড়ে যায়।তার ভাই আর সে ছোট বেলায় কত কিছু করেছে।সেই ছেলেবেলা কথা আজও ভাবলেই মনে হয়।ইস আরেকবার, শুধু আরেকটিবার ছোট বেলা ফিরে যেতে পারতাম।তাহলে আমার ছোট কৈশোরকে আমি দুই হাতে আগলেই রাখতাম।নিজের ভুলগুলো শুধরে নিতাম।বাপ,ভাইয়ের মাথা নত।কখনোই নিচু করতাম না।কতটা সুখী ছিলাম তখন।মা ছিলো না ব’লে বাপ,ভাই কখনোও তাকে অবজ্ঞা,অবহেলা করেনি।দুই হাতে আগলে রাখতেন তারা।কিন্তু একটি মানুষকে ভালোবেসে আজ তার কি পরিনতি?বাপ হারালাম।ভাই থেকে ওহ হারানো।স্বামী নামক লোকটা তার জীবনটা শেষ করে দিলো।নিজের জীবনের সব রঙিন সুখ চুষে মেরে ফেলেছে।আজ তার জন্য মেয়েটি অবহেলায় বড় হবে।তার কিছু হয়ে গেলে এই পুতুলের কি হবে?

৫.
হাত মুখ ধুয়ে খাবার প্লেটের সামনে বসেছে পুতুল।পাশে তার মা’কে বসিয়েছে।মামি খাবার বেড়ে দিচ্ছে।চাল,ডাল দিয়ে ভুণা খিচুড়ি রান্না করেছে।বেশ কয়েকটি পদের ভর্তা করেছেন তিনি।জুইঁ আলু ভর্তা,চ্যাপ্যা শুটকি মাছের ভর্তা আর আর লাল লাল শুকনো মরিচের ভর্তার নাম ছাড়া আরো কোনো নামই জানে না।তাই মামীর দিকে জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়।পুতুলকে অবাক করে দিয়ে মামী বলল,

-;এটা লাউ শাকের ভর্তা,কাঁঠালের বিচির ভর্তা।আলু ভর্তা,সজনে পাতার ভর্তা।মোটা ডাল সিদ্ধ করে হাতে মাখানো ভর্তা।চ্যাপ্যা শুটকি ভর্তা।কালিজিরা ভর্তা।আর সবর্শেষে লাল শুঁকনো মরিচের ভর্তা।যেটা সীল নূরে রেখে শুকনো মরিচের সাথে রসুন বেশি করে দিয়ে পিষে তৈরি করতে হয়।

লাল মরিচের ভর্তা দিকে তাকিয়ে আছে পুতুল।মনে পড়ে যায়,দাদী তাকে লাল মরিচের ভর্তা ইচ্ছে করে খাওয়াতো।যাতে সে বেশি ভাত মুখে দিতে না পারে।পেটে খিদে থাকা শর্তে ওহ সেই ঝাল ভাতগুলো পানি দিয়ে শুধু গিলতো।নাকের পানি,চোখের পানি এক হয়ে অশ্রু ঝড়ে পরতো।মা পাশে না থাকলেই দাদী ইচ্ছে করে প্রায় কষ্ট দেওয়ার জন্য এমন কিছু করতো।মেয়ের এমন দৃষ্টি রাজিয়া বুঝতে পারে।একদিন পুকুর পাড় থেকে কাপড় ধুয়ে এসে যখন শ্বাশুড়ির এমন কু কৃতী স্ব চোখে দেখতে পায়।তখনই বুঝতে পারে তারা বোবা মেয়েটির না বলা কষ্টগুলো।

চলবে….

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৩
রেণু পুতুলের চুলগুলো বেনি করে দিচ্ছে।এতটুকু মেয়ের মাথায় কি ঘন চুল?আর কি সুন্দর সফট।মায়ের মতো দেখতে হয়েছে মেয়েটা।রুপের কোনো কিছুর কমতি নেই।চেহারায় কেমন আদরিনী ভাব।মেয়েটিকে দেখলেই তার গাল দু’টোতে শুধু চুমু বসাতে ইচ্ছে করে।পুতুল বড় হলে একদম কল্পনার দেশের সেই রাজকুমারি মতো লাগবে।এমন রাজকুমারী জন্য বুঝি,কোনো রাজকুমার ঘোড়ায় চড়ে নিশ্চয়ই আসবে।হঠাৎ পুতুল দিকে তাকিয়ে কিছু মনে পড়ে যায়।রেনু মন থেকে গভীর একটা দীর্ঘ নিশ্বাস বের হয়।মেয়েটি কথা বলতে পারেনা।আল্লাহ তাকে সব দিক থেকে পরিপূর্ণ করলেও একদিকে শূন্য করেছে।তার কথা না বলার জন্য তাকে যদি কেউ অবজ্ঞা,অবহেলা করে।তখন কি হবে?না,না আমি এসব কি ভাবছি?আল্লাহ নিশ্চয়ই তার জন্য উত্তম কিছু ভেবে রেখেছেন।

৬.
রাজিয়া বাবা কক্ষে বসে আছে।বিছানায় হাত দিতেই মনে হলো বাবার শরীরের সুগন্ধ এখনো লেগে আছে এই ঘরে।এই বুঝি বাবা, মা ব’লে ডাক দিবে।রাজিয়া ফুফিয়ে কান্না করে।

-;আব্বা…আব্বা!আপনি কই আব্বা?এই দেখেন।আপনার ঘরে আপনার মেয়ে রাজিয়া আইছে।এখন থেইকা আপনি আমারে যা বলবেন আমি সব শুনমু।আপনার কথার বাহিরের একটা টু শব্দ করুম না।আপনি যা শাস্তি দিবেন আমি সব শাস্তি মাথা পাইতা নিমু।তবুও আপনি ফিইরা আসেন।

আব্বা আপনি আমার সাথে রাগ কইরা সত্যিই চইলা গেলেন।একটি বার মাফ চাওয়ার সুযোগটুকু দিলেন না।আমি দোষী আব্বা।আপনার কথা না শুইনা মাঝ নদীতে ঝাপ দিছিলাম।সেই নদী আমারে ডুবাইয়া দিছে।আমার সব,সুখ শান্তি কাইড়া নিছে।আমি একটুও ভালা নাই আব্বা।আব্বা আমারে মাফ কইরা দেন।আমি আর ভুল করমু না আব্বা।রাজিয়া বিছানা সুয়ে কাঁদছে।তার আব্বা আর নেই।তাঁকে আর মা ব’লে ডাকবে না।শুধু একটি ভুলের কারণে আজ বাবা তার পাশে নেই।একদিকে বাপ,ভাই।আর অন্য দিকে স্বামী নামক লোকটা।

-;আমি চলে আসায় সে হয়তো ভালোই আছে।আমাকে এখন আর দরকার নেই।দুইদিন পর হয়তো নতুন কোনো রমনীকে বিয়ে করে ঘরে তুলবে।আমাকে তার মনেই পড়বে না।আমি তার প্রয়োজন ছিলাম।প্রিয় জন হতে পারিনি আব্বা।আব্বা আপনারে কান্দাই আমি সেই সংসারে সুখী হতে পারি নাই।আপনার প্রত্যেকটা চোখের পানির মূল্য আমারে অভিশাপ দিয়া গেলো আব্বা?আমারে হতভাগী কইরা দিলো?

রেণু,রাজিয়া কান্নার শব্দে পেয়ে দৌড়ে আসে।

-;রাজিয়া।

-;ভাবী।আমার আব্বা আমার সাথে রাগ কইরা দুনিয়ায় ছাড়ছে।আমি আমার আব্বারে মেলা কষ্ট দিছি।সেই কষ্টের কারণে আমার আব্বা আজ আর নাই।আমি মাইয়া হইয়া বাপরে কবর ঘরে শুয়াছি।আমি তার মাইয়া নই।আমি রাক্ষসী।আমি আমার আব্বারে খাইয়া ফেলছি।আমারে তোমরা মাইরা ফালাও।আমি আর বাচঁতে চাই না।

-;শান্ত হও বোন।আল্লাহ মাল আল্লাহ লইয়া গেছে।আমাদের সবাইরে একদিন এই সুন্দর পৃথিবী ছাড়তে হইবো।কেউ আগে যাইবো কেউ আবার পরে যাইবো।দুইদিনের দুনিয়া কেউ চিরস্থায়ী নয়।কান্না করলেই কি তিনি ফিরে আসবেন?না তোও।তাহলে কান্নাকাটি করে কোনো লাভ আছে।লাভ নাই।নামায পড়।আর আল্লাহ দরবারে আব্বার লাইগা বেশি কইরা দোয়া কর।কুরআন পড়।তিনি সবকিছুর মালিক।

৭.
তোমারে যা যা বলাম ঠিক তাই করবা ঘটক।
একটা কথার এইদিক সেইদিক হইলে খবর আছে তোমার।আমি আমার ছেলের জন্য সেরা মাইয়া আনমু।মাইয়ার মা’ইরে বল’বা কি কি দেওন লাগবো?

সলিমুল্লাহ পান খাওয়া লাল দাঁতগুলো বের করে হাসে।ঘটকগিরি তার পেশা।গ্রামে গ্রামে ছাতা নিয়া হাটেন।আর সুন্দর সুন্দর মাইয়া খুঁজে এনে ছেলের মায়েদের কানে তুলেন।বিয়ে করানো জন্য।একটা খিলিপান বানিয়ে পকেটে ভরেন।আর মাথা নাড়ান।শাহাদাৎ আঙুলের মাথায় সাদা চুন।আরেকটা পান মুখে পুরে বলল,

-;আপনি কোনো চিন্তা কইরেন না আপা।আপনি যেমন বলছেন।ঠিক তাই বলুম।একটা কথার নড়চড় হইবোনা।

-;তাইলে আজ আসো ঘটক।

-;যাবো।কিন্তু যাওয়ার আগেই যদি কিছু টাকা দিতেন।বুঝেন তোও একেবারে খাট ফাটা রোদ্দুরে খালি হাতে আইছি।আমি আবার খালি পকেটে কোনো জায়গায় যাইতে পারিনা।শরমের তো একটা ব্যাপার স্যাপার আছে না-কি।নাসিমা বেগম শাড়ি আঁচলে গিটঠু দেওয়া।সেখান থেকে দুইশত টাকা বের করে দেন।

ঘটক টাকাটা নিয়ে পকেটে ভরে রাস্তার পথ মাপে।মোস্তফা সরোয়ারের জন্য পাত্রী দেখা হয়ে গেছে।এখন বিয়ে সানাই বাজিয়ে বউ ঘরে তুলে আনার পালা।নাসিমা বেগম মোটা যৌতুক নিয়ে ছেলেকে বিয়ে দিবেন।সুন্দরী রমনী ঘরে আসবে।তার সাথে ঘরের দামী জিনিসপত্র আর মোটা অংঙ্কে টাকা।

বুক চিন চিন করছে হায়।
মন তোমায় কাছে চায়।

ঘটক সরোয়ারের গলা শুনে মুখটা ভেঙ্গায়।
হুম আইছে নবাবের পুত্র।তার আবার বুক চিন চিন করে।

-;কি ‘রে ঘটক?তোর খবর কি?আমার জন্য মাইয়া ঠিক করছোস?না-কি….

-;না,না।কি যে বল না মিয়া!একবারে আসল রতন আইনা দিমু।রতনে রতন চিনবো।আর শুয়োর চিনবো কচু।

-;কি বলি তুই?ঘটকের বাচ্চা তোরে আমি খাইয়া ফালামু।

-;আরে আরে রাগ করেন ক্যান।আমি শুধু কথার কথা বলছি।আপনার মা যেমন আপনারে নিয়া রত্ম গর্ভা।তেমনই আপনি রতন।আর রতনে জন্য রতন আনুম।এতে দোষের কি আছে?আজকে তাইলে আসি।ঘটক জট চলতি কেটে পরে।সরোয়ারের লুঙ্গি হাঁটু পর্যন্ত উঠিয়ে নিয়ে ছিল।ঘটকরে ঘনো ধোলাই দেওয়ার জন্য।কিন্তু চলে যাওয়া লুঙ্গি হাঁটু নিচে নামিয়ে নিলো।বাড়িতে ঢুকার আগেই গালি দিলো।

-;ঘটক শালার বাচ্চা।

ঘটক তিন রাস্তায় উঠে সরোয়ার বাড়ি দিকে তাকিয়ে বলল,

-;হুম আইছে।আমারে নাকি খাইয়া ফালাইবো।আমি কি মাছ,মাংস নাকি যে তেল নুন ছাড়া খাইয়া ফালাবি।বেয়াদবের বাচ্চা।

৮.

কি গোও স্বাধীন মিয়া।শুনলাম তোমার বোন নাকি আইছে।তা বাপ,ভাইয়ের মুখে চুলকানি দিয়ে চইলা গেছিলো।আবার আইছে পোয়াতি হইয়া।লগে ছোট একখানা মাইয়া দেখলাম। ওটা কি তোমার ভাগ্নী না-কি?

স্বাধীন ধানের জন্য জমিতে সেচ দিচ্ছিলো।এমন সময় উপরোক্ত কথাগুলো শুনে হাত থেমে যায়।মাথা তুলে তাকাতেই রমিজ মেম্বারে দেখতে পায়।তবুও কোনো কথা না ব’লে কাজে আবার হাত লাগায়।

মেম্বারের কথার উত্তর না দেওয়া।আবার বলল,

-;যার লগে পালা গেছিল।সে না-কি তোমার বোনের বাড়ি থেইকা বাহির কইরা দিছে?কথাটা আছা না-কি।

-;আমার বোনের বাহির করছে।না-কি করে নাই।সেটা নিয়া আপনার এত মাথা ব্যাথা ক্যান মেম্বার সাব?আপনি নিজের চরকায় তেল দিন।আমার বোনরে নিয়ে ভাবার জন্য আমি আছি।তার ভাই তার লগে আছে।

-;ওহ।তাইলে তুমি ভাই হইয়া তার পাশে খাঁড়াইবা।আর আমাদের গ্রামের যে বদনাম হইছিল।তার কি হইবো?রোহিত পুরে মাইয়া হইয়া।নতুন চওড়া পোলার লগে ভাইগা গেছিল।

-;সেটা আমার এবং আমার ঘরের ব্যাপার।আপনি এসব কথা না ব’লেই খুশি হব।

-;তুমি একটা শিক্ষিত পোলা হইয়া।মুর্খ মাইষের মতো কথা কও।

-;আমার ঘরের কথা পরে কাছে বলা পচ্ছন্দ নয়।এতে যদি মনে হয় আমি মূর্খ।তবে তাই।

স্বাধীনের ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলা মেম্বারের পচ্ছন্দ হইলো না।মেম্বার চলে যেতেই ক্ষেতের কাজ শেষ করে বাড়িতে যায়।

ভর দুপুর বেলা গরম গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের সাথে সর্ষের ইলিশ দেখে পুতুলের আনন্দের শেষ নেই।এটা তার বিষণ প্রিয় খাবার।যদিও সে এই মাছের কাটাঁ বেছে খেতে পারে না।মা বেছে দিলেই পেট ভরে সেইদিন ভাত খেতো।বাবার বাড়িতে এই মাছটা সহজে রান্নাই হতোনা।অথচ সকালে মামা নিজের হাতে বাজার করে দিয়ে গেছে।বউকে দিয়ে আগেই জিজ্ঞেস করে নিয়েছিল।ভাগ্নী তার কি খেতে পছন্দ করে?আজ তার পচ্ছন্দের রান্না করা হয়েছে।যদি ওহ ইলিশ মাছটা খুব দাম।এতো দাম দিয়ে গরিবরা খেতে পারেনা।তবু্ও ভাগ্নীর জন্য ছোট আকারে একটি ইলিশ মাছ এনেছে।যার দাম বর্তমানে ছয়শত
টাকা।মাছের মাথা আর লেজ মিলিয়ে পাঁচ পিছ মাছ হয়েছে।

৯.
এখন বাজে দুপুর দুইটা।স্বাধীন গোসল করে যোহরে নামাজটা তাড়াতাড়ি পরে নিলো।খাবার খেতে বসেছে।তার প্রচন্ড খিদে পেয়েছে।ভাত মেখে মুখে এক লোকমা তুলতে নিয়ে সেই ভাত প্লেটে রেখে।বউকে জিজ্ঞাসা করলো।

-;রাজিয়া ভাত খেয়েছে।

-;হুম!

-; আর তুমি খেয়েছো?

-;

-;কি হলো কথা বলছো না কেনো?

-;আপনি আগে খান।আমি পরে খাইয়া নিমু নিই।

-;তাই।আমাকে ছাড়া কখনো তুমি খেয়েছো।সকালে ভোর সাড়ে সাতটা আমাকে খাইয়ে তারপরে খাবার মুখে তুলেছো।আর এখন বলছো পরে খাবে।বেলা কতটা হলো খেয়াল আছে।একটু পরেই দিবে আছরের আযান।তুমি আমার সাথে খেতে বসো।দাঁড়াও আমি তোমার জন্য ভাত নিচ্ছি।স্বাধীন ভাতের পাতিলের টাকনা সরাতে দেখতে পায়।একটি ভাত ও অবশিষ্ট নেই।

রেনু মাথা নিচু করে ফেলে।তার স্বামী যে হঠাৎ ভাতের পাতিলে হাত দিবে।একটুও বুঝে উঠতে পারেনি।

-;তুমি আমায় মিথ্যে ব’লে বউ।

-;আসলে ঘরে চাল শেষ হয়ে গেছে।তোমায় সকালে বলব একটুও খেয়াল ছিল না।তারপর বাজার থেকে আসলে যখন।তখন তোমার হাতে কোনো টাকা নেই।সব বাজারে শেষ।তাই আমিও তোমায় কিছু বলিনি।

-;সকালে টাকা নেই দেখে কথাটা ব’লে না।রাতে খাবার আসবে কোথা থেকে?

-;আসলে পাশে বাড়ির ভাবীকে ব’লে রাখছি।তিনি রাতের জন্য দুই পটের চাল দিবে।তাই ভাবলাম কাল সকালেই বলব।

-;হুম।এই দিকে এসোও।হা কর।

-;কি?

-;বলছি হা কর?রেণু হা করতেই প্রথম লোকমা বউয়ের মুখে তুলে দিল।তুমি আমার বাচ্চার মা।তোমাকে না খাইয়ে রাখলে আমার ছেলেটা ওহ কষ্ট পাবে।তোমরা কষ্টে থাকলে আমি ওহ ভালো থাকব না।আর কখনো আমার থেকে কিছু লুকিয়ে রাখবা না।যত কষ্ট হোক আমাকে সব বলবা।কথাটা শেষ করে নিজেও একই প্লেটে খাবার ভাগ করে খেলো।দূর থেকে এমন দৃশ্য দেখে রাজিয়া চোখ দুটো জুড়িয়ে গেলো।

স্বামী,স্ত্রী ভালোবাসা বুঝি একেই ব’লে।শত কষ্টের মাঝে থেকেও ভালোবাসা কোনো কমতি নেই।এদের মতো সুখি কয়জনই বা হয়।

চলবে…

#চক্ষে_আমার_তৃষ্ণা
#ইয়ানুর_আক্তার_ইনায়া
#পর্ব-৪
১০.
আমাদের সমাজে রাজিয়া,রেণু মতো কিছু মেয়েরা আছে।যারা টাকা খোঁজে না।একটা ভালো মনের মানুষ খোঁজে।একটা ভালোবাসার হাত খুঁজে।যাকে বিশ্বস্ত করে বাকিটা জীবন পার করে দিতে পারে।যে হাত আঁকড়ে ধরেছে তা মৃত্যু আগ পর্যন্ত ছাড়ে না।টাকায় যদি সুখ কেনা যেতো।তাহলে পৃথিবীতে বিশ্বাস,ভালোবাসা নামক বস্তুটি থাকতো না।

স্বামী,স্ত্রীর সম্পর্ক পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পবিত্র সম্পর্ক।যখন স্বামী,স্ত্রীর মাঝে ভালোবাসা থাকে।তখন সেই পরিবারটা অনেক সুন্দর হয়।এবং তাদের সন্তানরা অনেক ভালোভাবে বেড়ে উঠতে পারে।একটা পরিবারে সুন্দর পরিবেশ তখনই গড়ে ওঠে যখন স্বামী,স্ত্রীর মাঝে আন্ডারস্ট্যান্ডিং ভালোবাসাও বিশ্বাস থাকে।এবং সময় থাকতে ভালোবাসার মানুষটাকে যত্ন নেয়া দরকার।কারণ যেদিন সেই ভালোবাসার মানুষটা থাকবে না।সেদিন আফসোস করা ছাড়া আর কোন কিছুই করার থাকে না।

“ইকড়ি মিকড়ি চাম-চিকড়ি,
চামের কাঁটা মজুমদার,
ধেয়ে এল দামোদর।
দামোদরের হাঁড়ি-কুঁড়ি,
দাওয়ায় বসে চাল কাঁড়ি।
চাল কাঁড়তে হল বেলা,
ভাত খাওগে দুপুরবেলা।
ভাতে পড়ল মাছি,
কোদাল দিয়ে চাঁছি।
কোদাল হল ভোঁতা,
খা কামারের মাথা।”

রেণু সন্ধ্যা বেলা ছেলেকে সরিষা তেল মাখছিল।স্বাধীন মাগরিবের নামাজ পড়ে চাল নিয়ে আসবে ব’লেছে।তাই স্বামী না আশা পর্যন্ত ছেলের হাতে,পায়ে তেল মালিশ করছে।পুতুল পাশে বসে বাবুর হাত পা নাড়াচাড়া দেখছে।মুখ দিয়ে কিসব অদ্ভুত আওয়াজ করে।সেসব শুনতে ভালোই লাগছে।মামী ছড়া বলতে বলতে ছেলের তেল দেওয়া শেষ করে।পুতুল মুখে হাসি ফুটে।

-;পুতুল মা,একবার গিয়ে দেখে এসো।তোমার মায়ের নামাজ পড়া শেষ হয়েছে কি-না।সে কখন বসেছে নামাজে এখনো উঠে আসলো না।তুমি একটু দেখে এসোও।

মামী বলতে দেড়ি পুতুল দৌড়ে মায়ের ঘরে যেতে দেড়ি করলো না।রুমে আসতেই দেখে মা জায়নামাজে ঘুমিয়ে পড়েছে।চোখে তার পানি দৃশ্যমান।পুতুল মায়ের চোখের পানি নিজের হাত দিয়ে মুছে দিতে নিলেই রাজিয়ার ঘুম ভেঙে যায়।মেয়েকে দেখে বলল,

-;আমার মা’টা কি করে হুম?লুকিয়ে বুঝি মায়ের চোখের পানি মুছে দেওয়া হচ্ছে।এই দিকে এসে বসো।পুতুল বসে পড়তেই তিনবার সূরা ইখলাস,দুইবার আয়তুল কুরসি পড়ে মেয়ের পুরো শরীরে পর পর তিনবার ফু দিয়ে দিলো।

-;আল্লাহ যেনো আমার মায়ের সকল বালা মসিবত দূর করে দিক।

১১.
স্বাধীন ভাই বাসায় আছেন না-কি?একটু বাহিরে আসুন।কথা আছে।

-;কেডা ডাকে? দাঁড়া আইতাছি।

স্বাধীন বাহিরে হারিকেন নিয়ে আসতেই।
-;আরে সুমন তুমি।এত রাইতে আমার বাড়ি।কি মনে করে আইলা?

-;মেম্বার,মাদবরের কাছে বিচার দিছে।কাল সকালে আপনাদের পরিবারের সবাইকে মাদবের বাড়িতে ডাকছে।আপনার নামে বিচার বসাবে।

-;আমার নামে বিচার?আমার অপরাধ কি? কি করেছি আমি?

-;সেটা কালকে মাদবরে বাড়িতে গেলেই জানতে পারবেন।সুমন চলে গেছে।স্বাধীন চিন্তায় পড়ে গেল।

সকাল নয়টা মাদবরে বাড়িতে বিচার বসেছে।রাজিয়া,রেনু,পুতুল মহিলা আসনে দাঁড়িয়ে আছে।পর্দা ওপাশে দাঁড়িয়ে শুনছে এলাকার গুনি মান্য লোকদের কথা।স্বাধীন পুরুষদের প্রথম সারিতে!দুই হাত পিছনে ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে।

-;মেম্বার যা বলো তা শুনলাম।তুমি তোমার বোনরে বাড়িতে জায়গায় দিয়েছো।তা মিয়া তুমি কি গ্রাম নিয়ম নীত ভুলে গেছো?তোমার বোনের জন্য গ্রামের মেয়েরা বিশৃঙ্খল পথে যাইবো।তা আমরা মাইনা নিবো কেন?আমরা চাইনা আমাদের গ্রামের মেয়েরা পথভ্রষ্ট হোক।তোমার বোনের মতো এই গ্রামের মেয়েরা পরপুরুষ সাথে পালিয়ে যাক।এটা কোনোদিন মাইনা নিমুনা।তাই আজ রাতের মধ্যেই তুমি তোমার বোনরে গ্রাম ছাড়তে বলবা।যদি না ছাড়ে তাহলে কিন্তু খুব খারাপ হইবো।

-;মাদবর চাচা আপনি রায় দিয়েছেন আমি এবং গ্রামের সকলে তা শুনছে।কিন্তু আমার বাবা বেঁচে থাকতে যে কথা দিয়ে গেছে।তার কথা কিভাবে ফেলে দেই কন?

-;কি বইলা গেছে তোমার বাপ?একটু খুইল্লা বল দেখি।

-;আপনি তো জানেন আমরা এক ভাই এক বোন।এতে আর কোনো অংশীদার নেই।আব্বা মৃত্যু আগে সম্পত্তির দলিল লিখিত করে গেছেন।সেখানে উল্লেখযোগ্য করা হয়েছে তার সম্পত্তি ছেলে,মেয়ের দু’জন উভয় প্যাপ্ত হক।আমি তোও আমার সমস্ত সম্পত্তি ভাগ বুঝে নিয়েছি।কিন্তু তার মেয়ে ভাগের অংশের দাবিদার আমি নই।আব্বা বলেছিলেন।তার মেয়ের সেই সংসারের বেশিদিন ঠিকতে পারবেনা।ঠিক চলে আসবে।যদি ফিরে আসে গ্রামে কেউ তাকে গ্রহণ করুক বা না করুক।তার ভাগের অংশের জায়গায় একটা ঘর তুলে দিতে।সেখানে সে নিজের মতো থাকবে।সমাজের সাথে তার কোনো লেনদেন হবে না।সমাজ থেকে বিতারিত এক ঘরে ঠাঁই হইবো।কারো সাথে তার কোনো কথা নাই।গ্রামের মেয়ে হয়ে যখন পালাইয়া গেছে।এটা তার শাস্তি হইবো।আর যদি ফিরে এসে!আবার যদি অন্য কোথাও চলে যায়?তাহলে সে তার শাস্তি থেকে বেঁচে গিয়ে ভালোই থাকবে।মাঝ থেকে তারা সাজা মাফ।আর আব্বা খুব কষ্ট পাইবো।এখন আপনারা ভাবেন তাকে শাস্তি দিবেন।না-কি গ্রাম ছাড়া করবেন।এই যে তার লিখিত দলিল।মাদবরের সামনে টেবিলের ওপর দলিল রাখলাম।আমার কথা বিশ্বাস না হইলে স্ব চোখে দেইখালন।স্বাধীনের কথা শুনে মেম্বারের কপালে সূক্ষ ভাজ পড়ে।স্বাধীন যে চালাকি করে তার খেল খতম করবে।একটু ধারণা ছিল না।স্বাধীনের কথায় সবাই চিন্তায় পড়ে গেল।

-;সত্যি তোও গ্রাম ছেড়ে চলে গেলে সে আরো ভালো থাকবে।কিন্তু গ্রামে রাইখা সাজা দিলে সব মাইয়াগো ভুল করার সাহস পাইবো না।তাই মাদবর দলিল অনুসারে নিজের বক্তব্য পেশ করেন।

-;রাজিয়া এই গ্রামে থাকব এক ঘরে।কেউ তার সাথে মিশতে পারবে না।যদি মিশবার চেষ্টা করে তাহলে তার সাজা হইয়া যাবো সঙ্গে সঙ্গে।মাদবরে কথার ওপর গ্রামের মানুষ আর কোনো কথা বলতে পারলো না।তার সিদ্ধান্ত ওপর সবাই মান্য করল।কিন্তু মেম্বার মিয়ার শান্তি লাগলো না।সে ভরা মজলিস থেকে হনহন করে চলে গেলো।সবাই চলে যেতেই স্বাধীন বিজয়ের হাসি দিলো।আর যাই হোকনা কেন?সে বোনকে একলা পথে আর ছাড়বে না।এতে যত বিপদসংকুল হোকনা কেন?

-;তোরা সাবধানে বাড়িতে যা আমি আইতাছি।
ভাইয়ের কথা সায় দিয়ে বাড়ি পথে হাঁটা ধরলো রাজিয়া।শরীরটা তার আজকাল ভালো যায় না।মনে মাঝে ভয় হয় সে তার সন্তানকে সুষ্ঠুভাবে দুনিয়ায় আনতে পারবে তোও?

১২.

রোহিতপুর গ্রামে ঘটক সাব আসছেন।মুখে তার পান।সাড়া রাস্তার পথে পিক ফালায়।আর স্বাধীনদের বাড়ি খোঁজ করেন।

স্বাধীন উকিল সাহেবের সামনেই বসে আছে।
উকিল সাহেব দলিলটা পড়ে স্বাধীন দিকে তাকিয়ে বলল,

-;আর ইউ শিয়র।তুমি এটাই করতে চাও।

-;হ্যা।আমি সবটা ভেবেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।এই দলিল অনুসারে আপনি দু’টো দলিল লিখিত তৈরি করুন।একটা রাজিয়া অপরটি স্বাধীন।

-;ওকে হয়ে যাবে।তবে সময় লাগবে।নামজারী,রেজিষ্ট্রেশন,দলিল সব মিলিয়ে দুটো করে ভাগে প্রচুর টাকা টালতে হবে।এই মুহূর্তে এত টাকা তোমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব।তোমার কষ্ট হবে স্বাধীন।

-;হোক।তবুও সব কিছু করুন।

-;তিন,চারমাস মধ্যেই তুমি তোমার সব কাগজ পএ পেয়ে যাবে।

-;ধন্যবাদ।আসছি।

-;এটা কিন্তু ঠিক নয় স্বাধীন।তুমি আমার বন্ধু হও।কোনোদিন তুমি আমার সাথে ঠিক করে দুটো কথা অন্তত বলোনি।এতে আমার দোষ কোথায়?হ্যা মানছি আমি,এক সময় রাজিয়াকে আমার ভালো লাগতো।সেই অবধি সীমা রেখেছি।কখন তা পার করিনি।শুধু বিয়ে ব্যাপারটা তোমার আব্বাকে জানিয়ে রেখেছিলাম।পড়াশোনা শেষ করেই আমাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিল।যে অনুভূতি তার জন্য অনুভব করতাম।সে বুঝতে পারেনি।কেউ তার অপেক্ষা করছিল।সাতটা বছর চলে গেল।কিন্তু তুমি সেই একই রকম সরল,হাসি খুশি রইলেনা।রাজিয়া চলে যাওয়ার,চার বছর পর আমি মায়ের কথায় তার বান্ধবী মেয়ে বিয়ে করেছি।চারটি বছর তোও কম নয়।তুমি বিয়ে করেছে তিন বছর হলো।আমরা কি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারি না আগের মতোও?সব ভুলে কি বন্ধু সম্পর্ক আবার গড়ে তোলা যায় না।

-;আপনি একজন সম্মানিত ব্যক্তি।আপনার সাথে আমার মতো গরিব চাষার ছেলের বন্ধুত্ব জমে না।

-;স্বাধীন আমার কথা শোন।স্বাধীন চলে যেতেই হতাশার শ্বাস ফেললো রাদিফ শেখ।
তুই আজ ও আমায় বুঝতে পারলি না।

১৩.
রাজিয়া চোখের সামনেই ঘটক সলিমুল্লাহ দাঁড়িয়ে।তাঁকে দেখেই চমকে উঠে ভেতর রুমে চলে যায়।স্বাধীন ছোট্ট মোড়া টেনে বসতে দিলো।

-;বসতে আসি নাই।কিছু কথা ব’ইলা চইলা যামু।

-;কি কথা ব’লেন?

-;তোমার বোন জামাই আবার বিয়ার পিরিতে বসতাছে।তা কি জানো?এবার মা,পোলা মিইলা মাইয়া বাড়ি থেকে মোটা অংঙ্কে টাকা আর ঘরের জিনিসপত্র চাইছে।তাদের চাহিদা ব্যাপক।এতো চাহিদা আমি জীবনেও দেখি নাই।

পনেরো লাখ টাকা যৌতুক হিসেবে চাইছে।ছেলের জন্য মোটরবাইক।ঘরে জিনিসপএ সেগুন কাঠের তৈরি।এমন আর কত চাহিদা তাদের।মাইয়ার বাপের বিদেশি টাকা,পয়সা অনেক।তাদের এসব চাহিদা মেটানোর ক্ষমতা আছে।কিন্তু আপনাদের ব্যাপারটা তাদের কাছ থেকে লুকিয়ে বিয়ে ঠিক করছে।এখন আপনি যদি সকল প্রমাণ নিয়ে সব সত্যি কথা ব’লেন।তাহলে মা,ছেলের হাজতবাস নিশ্চিত।

-;বিয়া কবে?

-;সামনের শুক্রবার।

-;ঠিক আছে আমি এটা নিয়ে পড়ে ভেবে দেখবো।

-;আচ্ছা তাইলে আসি।ওহ আরেকটা কথা। বলছিলাম যে,আমি যে আইসা আপনারে খবরটা দিয়েছি।এটা জেনো তারা না জানে!

-;হুম জানবে না।

চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে