Thursday, August 21, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 2002



ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_৯

0

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_৯
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

সকাল বেলা মিনু বেলীকে দেখে অনেকটাই অবাক হয়ে যায় । সে ভেবেছিল আজ সকালে এখানে অন্যকিছু হবে । হয়তো সে দেখবে তার বেলী ভাবী আর নেই । তাই রান্নাঘরে বেলীকে দেখে অনেক চমকে যায় মিনু । মিনু এদিক ওদিক তাকিয়ে পা টিপে টিপে বেলীর কাছে যায় ।

– ওই ভাবী , ভাবী,,,,,,,?
– জ্বি , বলো মিনু , ঘুম ভেঙেছে তোমার ?
– আপনে কি বেলী ভাবী ,,,,?
– এটা কি বলো মিনু ?
– একটা চিমুর দেই ?
– এই মিনু কিসব বলো আবলতাবল ?
– ব্যাথা ফাইলে চিক্কুর দিয়েন ,

এইবলে মিনু বেলীর হাতে একটা চিমটি কাটে ৷ চিমটিটা বেশ জোরে কাটে সে আর বেলীও ব্যাথা পেয়ে উফফফ করে উঠে । এইবার মিনুর বিশ্বাস হয় যে এটাই আসল বেলী । এতক্ষণ সে বেলীকে বেলী নয় বেলীর ভূত ভেবেছিল ।

– চিমটি দিলা কেন ?
– আমি ভাবছি আপনে ভূত , যাক আল্লাহ সারাইছে । আপনে মরেন নাই , বাইচা আছেন ।
– কি সব বলো উলটাপালটা । যাও চোখে মুখে পানি দিয়ে আসো ।
– ভাবী ফিডাইছে নি আপনেরে ভাইয়ে ?
– মারবে কেন আমাকে ?
– হেইতে তো কতায় কতায় ফিডায় আপনেরে ।
– হ্যাঁ , তবে কাল মারে নাই ।
– কিয়াচ্ছে তাইলে ,

এইবার বেলী আসলেই বিরক্তবোধ করছে । মিনু উল্টাপাল্টা বলা শুরু করলে করতেই থাকে তো করতেই থাকে । বন্ধ আর হয় না । এদিকে ইরফানের জন্যে সব নাস্তা বানিয়ে টেবিলে সাজিয়ে দেয় বেলী । কিছুক্ষণ পর ইরফান রুম থেকে বেরিয়ে সোজা বেরিয়ে যায় বাসা থেকে । হ্যাঁ আজ ইরফান নাস্তা না করেই অফিসে চলে গেছে । বেলীর উপর থেকে রাগটা এখনও কমাতে পারেনি ইরফান । তার চিন্তা অনুযায়ী বেলী তাকে অপমান করেছে । বেলী তাকে কথা দিয়ে অপমান করেছে । সে জন্যে আজ সে বেলীর দিকে একবারের জন্যে তাকায় নি । ইরফানের এইভাবে না খেয়ে চলে যাওয়াটাও বেলীর সহ্য হয়নি । হয়তো কাল রাতে যা হয়েছিল তা ইরফানের পছন্দ হয়নি । কিন্তু বেলী কি করতে পারে , সে যে অসহায় । কাল ধরা দিলে যন্ত্রণা যে আরও কয়েকগুন বেড়ে যেতো তার । সেই যন্ত্রণা হয়তো বেলীকে একেবারেই শেষ করে দিত । মিনু এসে বেলীকে এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বেলীর সাথে কথা বলে ,

– ভাবী,,,,,, ও ভাবী,,,,,,?
– হু ,
– ভাইয়ে খাইয়া গেলো না ?
– উহু ,
– কিল্লাই , খাইয়া গেলো না কিল্লাই ?
– হয়তো অভিমান নয়তো রাগ ।
– অভিমান আবার রাগ , বাপুরে বাপু এডি মাতাত ঢুকে না আমার , কি হইছে খুইল্লা কইবেন নি একটু ?
– অভিমান যা প্রিয়জনের সাথে করা যায় , আর রাগ যা অপছন্দের মানুষের সাথে করা যায় । এখন আমি তো তোমার ভাইয়ের প্রিয়জন নই তাই অভিমানটা আমার জন্য প্রযোজ্য না । তাই রাগটাই হয়তো আমার জন্যে বরাদ্দকৃত ।
– কিছুই বুঝি নাই ,
– খেয়ে নেও , খেয়ে একটু হাতে হাতে সাহায্য করো আমাকে ।
– আইচ্ছা ।

এইদিকে অফিসে কাজ করে যাচ্ছে ইরফান । প্রমোশন হয়েছে তার , তার এই প্রমোশনে কোথাও না কোথাও বেলীও জড়িত । বেলী তার হয়ে সেম্পল বানিয়েছে তা যে সবার এত পছন্দ হবে ভাবে নি সে । অফিসের সবাই ইরফানকে বাহবা তো দিচ্ছে কিন্তু ইরফান তো জানে এই বাহবার আসল হকদার আসলে কিন্তু বেলী । আবার বেলীর কালকে রাতে বলা কথা গুলোও মনে পড়ে যায় ইরফানের । বেলী তাকে অপমান করেছে , তাই বেলীর উপর রাগও হচ্ছে । এরই মাঝে একটা ফোন আসে । ফোন হাতে নিতেই দেখে রুবির বাবা জাফর সাহেব ফোন দিয়েছেন । ভদ্রলোক আর সময় পেলেন না , না চাইতেও ফোনটা রিসিভ করে ইরফান ।

– আসসালামু আলাইকুম ,
– ওয়ালাইকুম আসসালাম , ইরফান কেমন আছো ?
– ভালোই , আপনি ?
– ভালো , বাসায় আসতা যদি । রুবিকে নিয়ে যাও ।
– রুবি কি ৪/৫ বছরের বাচ্চা যে আমি ও-কে নিয়ে আসবো ।
– ইরফান রাগারাগি তো অনেক হইছে , এইবার আসো ।
– আগেরবার আপনার মেয়েকে ধমক দেয়াতে আমাকে নিয়ে দরবার বসাইছেন , এইবার তো থাপ্পড় দিয়েছি , পারলে কেইস করেন ।
– ইরফান,,,,,,,,,,,,,,?
– আপনি কোন যুক্তিতে আমাকে আপনার বাসায় আসতে বলেন , আপনার মেয়ে রাত ১০ টার পর একা একা বাসা থেকে বের হয়ে গেছে , আপনার মেয়ের বিষ কত খেয়াল করছেন আপনি ? আর ও ১০০ টার মধ্যে ৯০ টা বলে মিথ্যা । ও যখন খুশি বের হয় যখন খুশি বাসায় আসে । ওর ছেলে বন্ধুদের অভাব নেই । মেয়ে বন্ধুদের কথা তো বাদই দিলাম । আমি কষ্ট করে টাকা কামাই করি আর আপনার মেয়ে তা তুষের মত উড়ায় । কেন আমার টাকার কি কোন বরকত নেই ? শুনেন , আপনার মেয়ে আমাকে কি ওর গোলাম পাইছে ? ২৪ ঘন্টা আমাকে বেলীর নামে নানান রকম কথা বলে যার মধ্যে ১০০ টাই মিথ্যা বলে । আর আমিও বলদের মত ওর কথা শুনে ওই মেয়েটাকে মারধর করছি মেয়েটা টু-শব্দ অবদি করে নাই এই পর্যন্ত । এত মিথ্যা কেন , আমি এখন অপরাধী হয়ে গেছি , কেন প্রথম বিয়ে করলাম আর প্রথম বিয়ে করার পর কেনই বা দ্বিতীয় বিয়ে করলাম । আপনার মেয়েকে একটা চড় মারাতে আপনার মেয়ে বাপের বাড়িতে গিয়ে উঠেছে । একবার কি এটা ভেবে দেখছেন যেই মেয়েটাকে আজকে ৭ টা মাস আমি আপনার মেয়ের কথায় কত গালমন্দ করছি কত মারছি ওই মেয়ে তো চুপ করে পড়ে আছে । এক কাজ করেন , আপনার মেয়েকে কেবিনেটের মধ্যে সাজিয়ে রেখে দিন , দয়া করে আমাকে বিরক্ত করবেন না । রাখতেছি , আসসালামু আলাইকুম ।

লাইন কেটে দেয় ইরফান । ইরফান লাইন কাটার পর , জাফর সাহেব গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে যান । পরিস্থিতি ঘোলাটে আকার ধারণ করেছে । এখন যতই ঠিক করতে চাইবে ততই আরও সমস্যা বাড়বে । তাই আপাতত চুপ থাকাটাই শ্রেয় মনে করছেন জাফর সাহেব । মেয়ে যখন সতীনের ঘর বেছে নিয়েছে তখন তিনি কি করবেন আর । নিজেকে ব্যর্থ বাবা ভাবা ছাড়া আর কিছুই করণীয় নেই তার ।

অন্যদিকে , রুবির বাবার লাইন কাটার পর ল্যাপটপ নিয়ে কাজ করতে যাবে আবার ফোনটা বেজে ওঠে ইরফানের । এইবার মেজাজ বিগড়ে যায় । কে ফোন করেছে না দেখেই রিসিভ করে চেচিয়ে ওঠে ইরফান ।

– এই কেএএএ ?
– হেলো বাজান আমি , বেলীফুলের মায় ।

কথাটা শুনে থতমত খেয়ে যায় ইরফান । তাড়াতাড়ি কান থেকে মোবাইল সামনে এনে দেখে বেলীর মায়ের নাম্বার । অবশ্য নাম্বার সেভ করে নাই শুধু লাস্টে 359 এই তিনটা ডিজিট দেখে চিনতে পেরেছে যে এটা বেলীর মায়ের নাম্বার । ইরফান মন মনে লজ্জিত তার একবার নাম্বার দেখা উচিত ছিল , এইভাবে চেঁচানো উচিত হয়নি তাও একজন মায়ের বয়সী মহিলার সাথে । ইরফান নিজেকে দমিয়ে নিয়ে কথা বলে ,

– আসসালামু আলাইকুম , জ্বি কেমন আছেন ?
– ভালা আছি বাজান , তোমরা কেমন আছ ?
– জ্বি ভালো , কিছু বলবেন ?
– হ বাজান , বেলীফুলে কই ?
– বেলী তো বাসায় আর আমি অফিসে ।
– বাজান একটা কতা কইবার চাইছিলাম আমি ?
– হ্যাঁ বলেন ,
– আইজ্জা তো বুধবার , শুক্কুরবারে বেলীফুলের বাপের মিত্তুবাসসিকি , তোমার বাবায় মনে অয় ফোন দিবো তোমাগোরে ।
– ওহ আচ্ছা ,
– তই বাজান মাইয়াডারে লইয়া যদি আসতা গেরামে ?
– আমার তো অফিস , কিভাবে আসি ?
– আরে বাজান এমনে কইও না , মাইয়াডার বাপের মিত্তুবাসসিকি মাইয়াডায় না আইলে মনডা ছোড অইয়া যাবে বাজান ।
– আচ্ছা আমি বাসায় গিয়ে বেলীকে বলবো আপনার সাথে কথা বলতে কেমন ?
– আইচ্ছা বাজান , তইলে রাহি এহন ?
– জ্বি আচ্ছা ,
– ভালা থাহো তোমরা ,

বেলীর মায়ের লাইন কাটার পর কিছুক্ষণ ইরফান মাথা নিচু করে রাখে । অনেক কিছুই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে তার । ইরফান সবটা জানে না তবে তার বাবার কাছে শুনেছিল বেলীর বাবা মারা যাওয়ার দুইমাস পরই বেলীকে তার সাথে বিয়ে দেয়া হয় । বেলীর বাবার সাথে তার বাবা কথা দেয়ার ১৫ দিনের মাথাতেই বেলীর বাবার এক্সিডেন্ট হয় আর সেখানেই spot death ঘটে ।

– বেলী তখন এতিম ছিল , সদ্য বাবাকে হারিয়ে এতিম হয়ে যাওয়া মেয়েটাকে আমার উপর ভরসা করে ওর সব দায়িত্ব আমাকে দেয়া হয়েছিল । আর সেই আমি কিনা বিয়ের রাতেই ও-কে ? আর তারপর একদিন জুতা দিয়ে পর্যন্ত মেরেছিলাম । বাপ মরা এতিম মেয়েটা সেইদিনও চুপ ছিল আর আজও চুপ করেই আছে । কেন বুঝলাম না সেদিন ওর কষ্টটা ? কেন দেখলাম না ওর বাবা হারানোর হাহাকারটা । বেলী আমার কাছে অবহেলিত , আসলেই অবহেলিত সে আমার কাছে । তাকে তার হক দিতে কার্পণ্য করলাম আমি ৷ অথচ এই বেলীই আমার জন্যে আজও ভেবে যাচ্ছে ।

এইসব ভাবছে আর মনে মনে আফসোস করছে ইরফান । ঝোকের বশে রুবির সাথে সম্পর্ক করা আর বিয়েও করে ফেলা । সবটাই ছিল তার ভুল পদক্ষেপ । তবে এখন অনেকটাই দেরি হয়ে গেছে ।

[ বিঃদ্রঃ একটা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে বাবা না থাকা টা যে কতটা কষ্টের তা একমাত্র তারাই বুঝে যাদের বাবা নেই । এবার সে ছেলে হোক কিংবা মেয়ে । সেই পরিবারে যদি ছেলে থাকে তাহলে হয়তো একটু হলেও চিন্তা কম থাকে । কিন্তু যেই পরিবারে ছেলে না থেকে দুই থেকে তিনটা মেয়ে থাকে তাদের অত্যন্ত কষ্টের মাঝে দিন কাটাতে হয় । কেউ একজন বলেছিলেন , বাবা না থাকাটা তেমন কিছু না , ঘুরে দাঁড়ানোটাই প্রয়োজন । হ্যাঁ আমিও মানি তা কিন্তু একবার এটা কি ভেবে দেখেছি আমরা প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়েদের কি হয় , তাদের মধ্যেই হয়তো একজন হয় যে বেলী হয়ে জন্মায় । যাদের শিক্ষাটাও ঠিকঠাক মত হয় না । সংসারের দায় সাড়তে গিয়ে মেয়ের ভালোর জন্য দুঃখিনী মা তো বিয়ে দিয়ে দেয় কিন্তু সবার কপালে বর ভালো পড়ে না । কেউ জুয়ারি , কেউ বা মদের নেশায় মাতাল , কেউ বা বউ পিটানোতে ওস্তাদ আর নয়তো কেউ বা নোংরা পল্লীতে যেতে মগ্ন এইসবই কপালে জুটে । ঘুরে দাঁড়ানোর ব্যাপারে আমিও একমত , কিন্তু আমরা কতটা নিরাপদ । যেখানে নিজের ঘরেই আমরা নিরাপদ নই । যেখানে বাবার সমতুল্য শিক্ষকের হাতে ধর্ষিত হতে হয় , সেখানে কোথাও চাকরি করাটাও যে ১০০% নিরাপদ তাও কিন্তু নয় । তবুও আমরা নারীরা পিছিয়ে থাকার পাত্রী নই । আলহামদুলিল্লাহ আমরাও সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছি । ১০০% এর মধ্যে হয়তো ৫০% মেয়েরা নিজেরাই নিজেদের কর্মসংস্থান খুজে নিচ্ছি । আর বাকি ৫০% এর মধ্যে ৩০% স্বামীর ঘরে আলহামদুলিল্লাহ হয়তো ভালো থাকি আর বাকি ২০% হয়তো কেউ স্বামীর ঘরে কষ্ট , অনাহার , কিংবা অত্যাচার হয়ে অকালেই প্রাণ হারাচ্ছি । মাথার উপর বাবার ছায়া থাকাটা অত্যন্ত আবশ্যক । বিশেষ করে মেয়েদের । একজন বাবা আর বড় ভাই থাকলে একবার মেয়েকে চোখের দেখা দেখে তো আসতে পারে । আর যাদের কপাল থেকে আল্লাহ পাক এই দুটো জিনিস কেড়ে নেন তাদের কপাল হয়ে ওঠে বেলীর মত । আবার অনেক জায়গায় বাপ মা মরা এতিম মেয়েও শ্বশুরবাড়িতে রাজরানীর মত দিন কাটাচ্ছে ৷ তারাই সেই ৩০% এর একজন । আল্লাহ পাক সকল মা বোনকে ভালো এবং সুস্থ থাকার তৌফিক দান করুন । সকল মা বাবাকে সুস্থ রাখুন । আল্লাহ পাক সকল মৃত বাবা মাকে জান্নাতবাসী করুন । আমীন ]

বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে আছে ইরফান । আজ বেলীকে একবারের জন্যেও ডাকে নি ইরফান । কফির জন্যেও বলেনি কিছু । বেলী দরজা খুলার পর সেইযে রুমে এসেছে আর বের হয় নি ইরফান । বেলী ইচ্ছা করেই কফি বানিয়ে রুমের সামনে গিয়ে দরজায় নক করে । ইরফানের সাড়া পেয়ে রুমে যায় বেলী । ইরফান তখন বিছানায় শুয়ে আছে । ‘ আপনার কফি ‘ বলে বিছানার পাশে রাখা টেবিলের উপর কফির মগটা রেখে দরজার কাছে যেতেই ইরফান ডাক দেয় বেলীকে ।

– দাঁড়া ,

ইরফানের ডাকে পা জোড়া সেখানেই থেমে যায় বেলীর । পিছনে ফিরে ইরফানের দিকে তাকায় সে । ইরফান তখন মোবাইলে কি যেনো করছিল ।

– জ্বি ,
– তোর মা ফোন করছিল , নেহ কথা বল ।
– মা ফোন দিছিলো , কখন ?
– দুপুরে , নেহ কথা বল ।

রাজ্যের সবটুকু সুখ হয়তো তার কপালে ছিল এই মুহুর্তে তার তেমনটাই মনে হচ্ছে । তখন ইরফান আবার বলা শুরু করে ,

– সেইদিনও একবার ফোন দিছিল , কাজের চাপে বলতেই ভুলে গেছিলাম আমি ।
– সমস্যা নাই , রিসিভ করে না তো ?
– আবার কল ব্যাক কর ।
– কিভাবে করে ?
– কেন তুই টাচ মোবাইল ইউজ কর‍তে পারস না ?
– আমি কখনো চালাই নাই মোবাইল , মায়ের আর বাবার বাটন মোবাইল ছিল ওইগুলাই দেখছি ।
– ওহ , দে আমার কাছে ।
– মোবাইল টা ভালোই বড় ,
– হ্যাঁ , feature 6.5 IPS LCD touch screen .
– ওহ , মায় ধরছে ?
– নাহ ,
– আরেকবার দেন ।

বেলীর কথায় ইরফান আরেকবার ফোন দেয় বেলীর মায়ের নাম্বারে । কিছুক্ষন পর বেলীর মা ফোন রিসিভ করে আর ইরফানও বেলীকে মোবাইলটা এগিয়ে দেয় । হাসি মুখে মায়ের ফোনটা কানে নিয়ে ‘ হ্যালো ‘ বলে ওঠে বেলী ।

– হ্যালো মা ,
– হেলো বেলীফুল ,
– মা কেমন আছ ?
– আমি ভালা আছি , তুই কেমন আছস ?
– আমিও ভালা আছি মা , কি করো মা তুমি ?
– পানি আনতাম গেছিলাম ।
– খাইছো নি মা ?
– হ , তোরা খাইছত নি ?
– এহনও খাই নাই মা , একটু পরেই খামু ।

বেলীর কথা শুনে ইরফান বেলীর দিকে তাকিয়ে আছে । বেলী একই মুখে দুই ধরনের কথা বলতে পারে । মায়ের সাথে কথা বলছে সে তাই আঞ্চলিক ভাষায় আবার এখানে সবার সাথে শুদ্ধ ভাষায় । বেলী যদি তেমন পড়াশোনার সুযোগ পেত তাহলে হয়তো রুবির থেকেও উপরে যেতে পারতো । তারপর হঠাৎ করেই বেলী বলে ওঠে ,

– আমি কেমনে আসমু মা ?
– তুই আইবি না ?
– ওর তো অফিস আছে মা ,
– জামাইরে বল যাতে আফিসের থিকা ছুটি নেয় ।
– দেখি মা , কাইলকা জানামু তোমারে কেমন ?
– আইচ্ছা ,
– রাখি তাইলে , ঘুমাইয়া যাও মা ।
– হু ,

বেলী জানালার পাশে এসে কথা বলছিল । খুব আস্তে আস্তেই বলছিল । কিন্তু তবুও কিভাবে জানি ইরফানের কানে পৌঁছে যায় তার কথা গুলো । এইদিকে বেলীর বুক ফেটে কান্না আসছিল , দেখতে দেখতে তার বাবা মারা গেছে একটা বছর হয়ে গেছে । বাবার মুখে বেলীফুল ডাকটা এখনও তার কানে বাজে । চোখের পানি গুলো কোন রকম আটকে ইরফানকে মোবাইলটা দিয়ে রুম থেকে চলে যেতে নেয় বেলী । তখনই ইরফান আবার ডাক দেয় ,

– কিরে , কিছু না বলেই চলে যাচ্ছিস যে ?
– আসলে ,
– কি ?
– মা বলতেছিল শুক্রবারে বাড়িতে যাইতে । আমার বাবার প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী । মিলাদ দিবে মা ।
– তুই কি বললি ?

ইরফানের কথায় মাথা নিচু করে রাখে বেলী ।

– যাবি তুই ?
– আপনার তো অফিস আছে ।
– তুই যেতে চাস ?
– অনেকদিন মারে দেখি না ।
– ঠিকাছে কাল আমি হাফ টাইম করবো অফিসে । বিকালে যাবো আমরা ।

ইরফানের মুখ থেকে এই কথাটা শুনে বেলী যে কত্ত খুশি হয়েছে যা বলার মত না । মুখে প্রকাশ না করলেও চোখের পানি পড়তে তার দুই মিনিটও লাগে নি বেলীর । আজ প্রায় ৭ মাসের উপর হয়েছে সে তার মাকে দেখে নাই । তাই চোখের পানি আটকাতে পারে নি সে । ইরফানকে কি বলবে বুঝতেছে না বেলী । আর ইরফানও বেলীর চোখের পানি গুলো দেখে নেয় ।

– কাঁদিস না , নিয়ে যাবো কাল । কেমন ?
– আচ্ছা ।
– যাহ গিয়ে জামাকাপড় গুছিয়ে নে ।
– হু ,
– বেলী শুন ?
– হু ,

ইরফান কিছুক্ষণ বেলীর দিকে তাকিয়ে আছে । বেলীর মুখের দিকে তাকালে একটা শান্তি আসে মনে । বেলী আসলেই তেমন সুন্দর না তবে ওর মনটা পবিত্র আর এটাই ওর আসল সৌন্দর্য । একটু কাঁদাতেই কেমন মায়া লেগে গেছে চেহারাটায় । আর এতটা দিন যে সে মারতো তখন জানি বেলীর কেমন লাগতো । তবুও কিছুই বলতো না বেলী ।

– কিছু বলবেন ?
– তুই মন খারাপ করিস নাহ ।
– এখন আর মন খারাপ লাগে না । এখন শুধু বাবাকে মনে পড়ে অনেক । বাবার মুখের ‘বেলীফুল ‘ ডাকটা আজও কানে ভাসে । বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে তখন । কান্নাও করি পরে আবার সব ঠিকঠাক । আমার বাবা আমাকে ফাঁকি দিয়ে আর আমার মাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছে । এমন জায়গায় গেছে যেখানে বাবা বলে ডাক দিলেও আমার বাবা আর শুনতে পারবে না আর সাড়াও দিবে না । আর বেলীফুল বলে ডাকবে না । বাবা যখন বেলীফুল বলে ডাক দিত তখন আমি সাড়া না দিলে বলতো আমার মা ডায় কইরে , আমার ফুল ডায় কই । এখন আর কেউ বলে না আমাকে আমার মা ডায় কই , আমার ফুল ডায় কই৷

এইসব বলতে বেলী গুমরে কেঁদে ওঠে । এক দৌড়ে ইরফানের রুম থেকে বেরিয়ে যায় সে । ইরফান কিছুই বলার সুযোগ পায় নি । বিছানায় বসে মুখে হাত দিয়ে কিছু একটা ভাবছে সে । কেন জানি আজ নিজের বুকেও হাহাকার লাগছে ইরফানের । চোখ দিয়ে এক ফোটা পানিও পড়ে গেছে । কিন্তু কি যেনো ভেবে তার পর পরই কাকে যেনো একটা ফোন করে সে ।

.
.

চলবে…………….

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_৮

0

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_৮
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

ইরফানের চাওয়াটা কি আদৌ সঠিক নাকি পুরোটাই আবেগ বুঝতে পারছে না বেলী । তাহলে কি এইজন্যই মিনুকে অন্য রুমে শুতে বলেছিল ইরফান । বেলীর হাত পা গুলো ঠান্ডা হয়ে আসছে । ইরফান বেলীর সামনে দিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দেয় । যা দেখে বেলী আরও চমকে যায় । ঘরে লাইটটাও বন্ধ । বেলী লাইট জ্বালাতে গেলে ইরফান বেলীর হাত ধরে নেয় । ইরফান বেলীর হাত ধরেই বুঝতে পারে যে বেলীর হাত পা সব ঠান্ডা হয়ে গেছে । সে বুঝে যায় বেলী ভয় পাচ্ছে । তবে মুখে কিছুই বলছে না ।

– লাইট বন্ধ থাকুক ,
– অন্ধকার তো ?
– ড্রীম লাইট তো জ্বলতেছে ।
-…………..
– ভয় পাচ্ছিস ?
– নাহ কেন ভয় পাবো ।
– বস এইখানে ,

ইরফান বেলীর হাতটা ধরে নিয়ে বেলীকে বিছানায় বসায় । বেলী তখন একদম চুপচাপ হয়ে মাথা নিচু করে বসে থাকে ।

– ” গরীবের রক্ত তো তাই শরীরে থাকতে চায় না ” কথাটার মানে কি ছিল রে ?
-…………….
– কিরে বল ,
-…………….
– হাতটা কিভাবে কাটলি ?
-…………….
– বলবি না ?
– কি ,
– হাতটা কিভাবে কাটলি ?
– অসাবধানতাবশত ছুরিটা লেগে গেছিলো ।
– ওহ ,

কিছুক্ষণ ওইভাবেই বসে থাকে বেলী আর ইরফান । ইরফান কি বলবে , কোথা থেকে শুরু করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না সে । সামনে দীর্ঘ পথ কিন্তু পারি দেয়ার মত কেউ নেই তার । তদ্রুপ বেলীও একদম চুপ করে বসে আছে । কিছু বলার নেই তার । সব কথা কেন যেন বুক অবদি এসে আটকে আছে তার । গলা অবদি উঠছেই না কিছু । এইবার ইরফানই বলতে শুরু করে ,

– তোকে যদি বলি , আমার তোকে চাই তখন কি করবি তুই ?
-…………..
– কিরে আজকে কি নিরব থাকার ডিসিশন নিয়েছিস নাকি ?
– শুনতেছি ,,,,,,
– শুনলে উত্তর দিতে হয় , তা তো জানিস ।
– উত্তর নেই ।
– কেন ?
– বেলীফুল সেইদিনই ঝরে গেছে যেইদিন সে তার বাবাকে হারাইছে । দ্বিতীয়বার বেলীফুল সেইদিনই ঝরে গেছে যেইদিন সে তার স্বামীর কাছ থেকে ভালোবাসার বদলে জুতার বারি খেয়েছে । তৃতীয়বার বেলীফুল সেইদিনই ঝরে গেছে যেইদিন তার স্বামী তার দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে ঘরে প্রবেশ করেছিল । বেলীফুল বার বার ঝরে যাচ্ছে , কোনদিন জানি সারাজীবনের জন্য ঝরে পড়ে যায় , কে বলতে পারে তাই না ?

বেলী শান্ত গলায় কথা গুলো বলে গেছে আর ইরফান শান্ত মস্তিষ্কে বেলীর কথা গুলো শ্রবণ করছে । আজ সে শুনবে , হ্যাঁ সে শুনবে আজ বেলীর সব কথা । বেলীকে আজ নিজের সব মনের কথা ব্যাক্ত করতে হবে তার কাছে । ইরফান চায় বেলী আজ বলুক । তাই আবারও বেলীকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে ,

– তারপর ?
– তার আর পর নেই ,
– তুই ভালো নেই , তাই না ?
– বালাই ষাট , কে বললো ভালো নেই আমি । আমি খুব ভালো আছি , নিয়ম করে স্বামীর মা’র , সতীনের হাতে চড় থাপ্পড় , আজেবাজে কথা গিলে আমি আলহামদুলিল্লাহ বেশ আছি ।
– তারপর ?
– আর কিছু না ৷ রাত অনেক হয়েছে , রুমে যান আর ঘুমিয়ে পড়েন ।

ইরফান বেশ বুঝতে পেরেছে বেলী তার থেকে দূরে থাকতে চাইছে । কিন্তু ইরফান কেন জানি বেলীর প্রতি খুব আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে । তার আজ বেলীকে চাই , এইবার তা যে করেই হোক আর যেভাবেই হোক । বেলীর বাম হাতটা নিজের হাতের ভাজে নিয়ে নেয় ইরফান ।

– আজ যদি তোর সাথে ঘুমাতে চাই , তখন ?
– এখানে ঘুমাইতে পারবেন না , তোশকটা শক্ত , আর আপনি তো ফোমের বিছানাতে ঘুমাইতে অভ্যস্ত ।
– ওইটা ফোমের বিছানা না , ওটা মেট্রিক্স যা জাজিমের মত হয় ।
– ওহ , তাইলে আর কি , যান ঘুমান গিয়ে ।

এই বলে বেলী উঠে যেতে নিলে ইরফান শক্ত করেই বেলীর হাত ধরে নেয় ।

– উঠে যাস কেন , এখনে বসতে বলছি না ?
– রাত অনেক হলো , আপনার কাল অফিস আছে ।
– আমার অফিসের কাজ কি তুই করতে যাবি ?
– নাহ ,
– তাহলে , এত পেরেশানি কেন তোর ? নাকি থাকতে চাস না আমার কাছে , কোনটা ?
– কি জানি ,
– মনকে জিজ্ঞাসা কর ?
– মনের ঘরে তালা দেয়া , আজকাল খবর রাখি না ।

ইরফান আর কথা বাড়ায় নি । বসা অবস্থাতেই বেলীকে কোলে তুলে নেয় ইরফান । বেলী কয়েকবার বারণ করে তবুও শুনেনি ইরফান । বেলীকে কোলে তুলে নিজেই অনেক অবাক , বেলীর ওজন এত কম হবে ভাবেই নি ইরফান । বিছানায় এনে শুইয়ে দেয় বেলীকে সে ।
তারপর গায়ের থেকে ওড়নাটা সরিয়ে বেলীর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে ইরফান । বেলীর চোখের মধ্যে পানি গুলো চিক চিক করছে । গভীর নিরবতায় চেয়ে আছে শান্ত চোখ জোড়া তার দিকে । এ যেন এক কালচে পরী । এরই মাঝে বেলী একটা ঢোক গিলে । ইরফান বেলীর দিকে একটু ঝুকে যায় , তারপর নিজেই বেলীর কানের কাছে এসে বেলীর গালে হাত রেখে বলে ,

– আমি শুধু তোর সাথে মিশতে চাই । তোর মাঝে বিচরণ করতে চাই । স্বাদ নিতে চাই তোর ঘ্রাণের । আর কিছু না বিশ্বাস কর , আর কিছু না ।

বলতে বলতে ইরফান বেলীর গাল থেকে ঘাড়ে হাত দেয় । আচমকা ঘাড়ে হাত দেয়ায় বেলী নড়ে উঠে আর হাল্কা চিৎকার দিয়ে ফেলে । যা ইরফানও আশা করেনি । বেশ অবাক হয়ে যায় ইরফান ।

– হায় হায় গো যা ভাবছিলাম আমি , আমার ফুলের মত ভাবীডারে ফিডাইতাছে অসিভ্য বেডাডায় । এল্লিগাই তো আমারে অন্য রুমে হোয়াইছে । আল্লায় সারাইছে উইড্ডা গেছি আমি । আমি ঘুমাইয়া গেছি আর হেইতে এই সুযোগে ভাবীরে ফিডাইতাছে । একবার দরজা খুলুক খালি , আইজ্জা আর ছাড়ুম না । এক্কেরে থানার বেডাগোরে খবর দিমু ।

চাপা গলায় নিজে নিজে বক বক করছে মিনু । মিনু তখন বেলীর দরজায় কান পেতে শুনছিল তাদের রুমে কি হচ্ছে । মিনুর ঘুমটা হঠাৎ করেই ভেঙে যায় , ঘুম ভেঙে গেলে বেলীকে দেখতেই সে বেলীর রুমে আসে , এসে দেখে দরজা আটকানো । বুদ্ধি করে ইরফানের রুমে উঁকি দেয় মিনু , দেখে ইরফান সেখানে নেই তাই সে এসে কান পেতে থাকে বেলীর দরজায় । এসে শুনে বেলী চাপাস্বরে চিৎকার দিয়ে উঠে । তাই মিনুও ভাবতে শুরু করে নেয় ইরফান মনে হয় বেলীকে মানে তার ভাবীকে মারছে । আর এইদিকে ইরফান উঠে লাইট জ্বালায় দেখার জন্যে বেলী হঠাৎ চিৎকার দিল কেন । ইরফান তো কিছুই করে নি । শুধু আবাগের বশে হাতটা গাল থেকে গলায় চলে গেছে আর তাতে চিৎকার দেয়ার মত মেয়ে বেলী নয় । নিশ্চয়ই কিছু তো হয়েছে যার জন্যে বেলী এমন করেছে । আর ইরফান সেই কিছুটাই দেখবে আজ ।

ইরফান লাইট জ্বালিয়ে বেলীর কাছে এসে বসে । আর এই ফাঁকে ওড়নাটা দিয়ে আবার নিজেকে আবৃত করে নেয় । আর ওদিকে দরজার নিচ দিয়ে লাইটের আলো দেখে মিনুও ফ্লোরে শুয়ে পড়ে । দরজার নিচের ফাঁক দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে ভেতরে ইরফান কি করছে বেলীর সাথে । দরজার নিচে অল্প একটু ফাঁক সেই ফাঁকের মধ্যে মিনু পারে না তার পুরো মাথাটাই ঢুকিয়ে দেয় ।

– ধুর , ছাতার মাতা এইডার ভিত্রে দিয়া কিছুই দেহা যায় না । কিছু দেহা যায় না কিল্লাই , ভাবীরে কিয়াত্তাছে আল্লায় জানে । ভাল্লাগে না আর , মনডায় চায় দরজার ভিত্রে বারি মারি কিন্তু আমারেই ফরে যদি মাইরা লায় । হায় হায় গো মইরা যাইতাম চাই না এত্ত তাত্তারি ।

মিনু এইসব আবলতাবল বলছে আর দেখার চেষ্টা করছে ।
ইরফান দেখার চেষ্টা করছে বেলীর গলায় কি হয়েছে । অন্যদিকে বেলী একেবারে উঠে বসেই গেছে । ইরফান জোড়াজুড়ি করছিল তাকে অনেক ।

– কি হয়েছে , দেখি আমি ।
– কিছু হয় নাই ,
– তাহলে চিৎকার করলি কেন ?
– এমনিতেই ,
– কিছু হয় নাই , এমনিতেই , তাহলে ওড়না পরেছিস কেন ?
– শীত লাগে ,
– এইবার ঠাটিয়ে চড় মারবো একটা ।
– সহ্য করার মত ক্ষমতা আর শক্তি দুটোই আছে ।

ইরফান আর সহ্য করতে পারে নি । টান দিয়ে ওড়নাটা সরিয়ে নেয় বেলীর গা থেকে । তারপর ঘাড়ে নজর দেয় সে । দিনের বেলায় সে যতক্ষনই বাসায় থাকে বেলী তার সামনে মাথার কাপড় দিয়ে সব ঢেকে রাখে আর রাতে তারা আলাদা ঘুমায় । তাই ক্ষতস্থান গুলো ইরফানের নজর থেকে সহজেই আড়াল হয়ে যায় । সেইদিনের মা’রের দাগ বেলীর গলায় । কালো হয়ে আছ আর বেশ খানিকটা ফুলে আছে স্থানটা । ইরফান বুঝে যায় এই জায়গাটায় এইজন্যই ব্যাথা । হয়তো ভুলবশত তার হাতটা সেখানেই লেগেছে ।

– এটা এমন হয়ে আছে যে ?
– থাক ,
– মলম লাগাস নাই ?
– মিনু লাগিয়ে দিত ,
– কি মলম লাগাইছিস , যে এমন হয়ে আছে ।
– আপনি ঘুমাতে যান ।
– বার বার এক কথা বলতেছে , এইখানে চুপ করে বসে থাক আমি আসতেছি ।

মিনু ইরফানের পায়ের আওয়াজ পেয়ে আর দরজার ফাঁক দিয়ে ইরফানের পা দেখতে পেয়ে হুরমুর করে উঠে তাড়াতাড়ি সরে যায় । ইরফান দরজা খুলে নিজের রুমে যায় , সেখান থেকে একটা স্প্রে আর একটা মলম নিয়ে আবার বেলীর রুমে ফিরে আসে । এসেই দরজা লাগিয়ে দেয় সে । বিছানায় এসে একদম বেলীর কাছে বসে যায় ইরফান । তারপর বেলীর ক্ষতস্থানে হাল্কা স্প্রে করে দেয় । স্প্রের পানি গুলো পড়াতে জ্বলে ওঠে আর বেলী সহ্য করতে না পেরে সেলোয়ারে খামচি মেরে ধরে রাখে ।

– বেশি জ্বলবে না , একটু সহ্য কর
– আমার সহ্য শক্তি আলহামদুলিল্লাহ , সমস্যা নাই ।
– দেখি শুয়ে পড় ।

ইরফান বেলীকে কাত করে শুইয়ে দেয় । তারপর পেছন থেকে বেলীর জামার চেইনে হাত দিতেই বেলী আবার উঠে বসে যায় ।

– কি হলো ?
– আপনি এমন কর‍তেছেন কেন ?
– কি করলাম আবার আমি ?
– চেইন খুলেন যে ?
– যার ঘাড়ে এমন আঘাত তাকে তো এলোপাথাড়ি লাথি ঘুষি চড় থাপ্পড় কম মারি নি , সেই চিহ্ন গুলো আজকে দেখতে মন চাইছে অনেক ।

ইরফানের কথায় স্তব্ধ হয়ে যায় বেলী । চুপ করে মাথা নিচু করে রাখে সে । ইরফান আবার শুইয়ে দেয় বেলীকে । বেলী ওপাশে মুখ করে চোখ মুখ খিটে শুয়ে আছে । আর ইরফান বেলীর জামার চেইনটা খুলে দেয় । চেইনটা দুপাশে সরিয়ে দেয় ইরফান । বেলী তখন না পারছে উঠে যেতে না পারছে শুয়ে থাকতে । কিন্তু এইভাবে সেও সহ্য করতে পারছে না । চেইনটা খুলার পর ইরফানের চোখের সামনে তখন বেলীর উন্মুক্ত পিঠ ছিল । যা দেখে সহজেই কোন ছেলের কাম-সাধণা জেগে উঠবে । কিন্তু এখানে সম্পূর্ণ বিপরীতটা ঘটলো । বেলীর পিঠে অনেকগুলো ছোপ ছোপ দাগ । ইরফানের এক সেকেন্ডও সময় লাগে নি বুঝতে যে এইগুলো সব তার মা’রের চিহ্ন । যা সহজেই যে কারো চোখে পানি এনে দেয়ার মত । ইরফান বেলীর ব্রা এর হুক খুলে দেয় । বেলী তখন আরও খিটে যায় । বিয়ের ১০ মাস পরে এই প্রথমবার সে আর তার বর এতটা কাছাকাছি এসেছে । এর আগে ইরফান এমন করে কাছে আসে নি কখনো । বেলী ভেবেছিল হয়তো রুবি নেই সেইজন্যেই ইরফান তার কাছে এসেছে । কিন্তু এটা বুঝে নি যে শারিরীক চাহিদা তো যে কোন মুহুর্তেই মেটাতে পারে কিন্তু শারীরিক চাহিদার থেকে প্রয়োজন মনের চাহিদা । যা একজন মানুষকে অন্য একজন মানুষের প্রতি আকর্ষিত করে । ইরফান মলম দিয়ে ভালো করে বেলীর পিঠ টা ডোলে দেয় । পুরো রুম জুড়ে শুধু নিরবতা । ঘড়িতে তখন ২ টা বেজে ১০ মিনিট । ইরফান হুক লাগিয়ে দিয়ে জামার চেইন টেনে দেয় । তারপর উঠে লাইট অফ করে দিয়ে এসে আবার বেলীর পাশে শুয়ে পড়ে । বেলী তখনও ওপাশে মুখ করে আছে । ইরফান বেলীর একদম কাছে চলে আসে ।

– বেলী ,,,,,,,?
-…….
– কিরে ঘুমিয়ে গেছিস নাকি ?
– উহু ,
– এইদিকে ফের ,
– আমার ঘুম আসে ।

বেলীর কন্ঠস্বর তখন অন্যরকম শুনা যাচ্ছিল । বেলী তখন হয়তো কাঁদছিল । তাই গলা বসে গেছে ।

– বেলী এইদিকে ফের ,
– আমার ঘুম আসে তো ?
– এইদিকে ফিরতে বলছি আমি ,,,

ইরফানের কথায় এইবার এই দিকে ফেরে বেলী । অন্ধকারের মধ্যেও বেলীর মুখটা দেখতে পাচ্ছে ইরফান ।

– কাঁদছিস যে ?
– কই ?
– তোকে হয়তো বেশিই কষ্ট দিয়ে ফেলছি , তাই না ?
-…………
– এতটা পাথর কিভাবে হলাম , কবে হলাম টেরও পেলাম না জানিস ।
-…………
– আমাকে অনেক ঘেন্না করিস তাই না রে ?
– ঘেন্না করলে এইদিকে থাকতাম না ।
– আমি অনেকটা অমানুষ রে , আমার কাছে থাকলে তো মরে যাবি তুই ।
– কপালে এইভাবে মরণ থাকলে মরবো , এতে কি করা যাবে ।
– একটা সত্যি কথা বলবি আজকে বেলী ?
– বলেন ,
– আমাকে ভালোবাসিস ?
– জানা নাই ,
– কেন ?
– বেলীফুল আজ মৃত
ঝরে গেছে গাছ থেকে
তাকে খোঁজ করা আর
মরিচিকার পেছনে ছুটা
দুটোই সমান কথা

ইরফান অবাক হয়ে যায় বেলীর কথায় । বেলী এইভাবে সাজাতে পারে তা জানতো না ইরফান ।

– ভালো বললি তো ।
– ইন্টার পাশ টা করতে পারি নাই , পেটে একটু হলেও বিদ্যা আছে ।

বেলীর দিকে তাকিয়ে আছে ইরফান । মেয়েটা কতটা সরল সোজা । কতটা শান্ত , যার মুখের দিকে তাকালে সারা রাজ্যের শান্তি চলে আসে । ইরফানের আজ ইচ্ছে হচ্ছে বেলীতে মিশে যেতে । এক হাত দিয়ে বেলীর মাজায় টান দেয় ইরফান । এতে বেলী অনেকটাই ইরফানের কাছে চলে আসে । বেলী গাঢ় নজরে ইরফানের দিকে তাকিয়ে আছে ।
মনে পড়ে যায় , তার নিজের চোখে দেখা প্রতি সকালে রুবির ভেজা চুলগুলো । তার মনে পড়ে যায় গত তিন আগে বেধড়ক মারধরের কথা । তার মনে পড়ে যায় আজ ১০ টা মাস এক অসহ্য নীয় যন্ত্রণার কথা । চাইলেই কি স্বামীকে সবটা দেয়া যায় ? চাইলেই কি সেই স্বামীকে নিজের শরীরটা দেয়া যায় সে স্বামী তারই সামনে অন্য রুমে সতীন নিয়ে সংসার করে ? এইসব ভেবে হঠাৎই নিজেকে ইরফানের থেকে সরিয়ে নেয় বেলী ।

– আমি অসুস্থ , আপনি ঘুমিয়ে পড়েন ।

এই বলে বেলী ওপাশে মুখ ফিরিয়ে নেয় । ইরফানেরও মেজাজ খারাপ হয়ে যায় ।

– সরে গেলি ? আমার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে গেলি ?
– কাল যখন রুবি আপু আসবে আপনি আবার আমায় ভুলে যাবেন । রুবি আপুর কথায় আমায় এসে মারবেন । কুকুরের মত আচরণ করবেন আমার সাথে । বিশ্বাস করেন এতে আমার কষ্ট হয় না , একটুও কষ্ট হয় না । শুধু কষ্ট হয় আপনার এই পাল্টে যাওয়া দেখলে । রুবি আপু অনেক ভালো মানুষ তাকেই ভালোবাসুন । আমি তো আপনার ঘরের বান্দি মাত্র । আমার জন্যে না হয় লাথি ঘুষি টাই ঠিক আছে । আদর সোহাগ আমার কপালে জুটে না ।

বেলী ফোপাতে ফোপাতে বহুত কষ্টে এইসব কথা বললো । এইবার ইরফানের মেজাজ আরও খারাপ হয়ে গেছে । সে বেলীর একদম কাছে চলে আসে । সে নিজের করে পেতে চায় বেলীকে আজ । কিন্তু সে এটা মানতে পারছে না যে বেলীর মনের অবস্থা এই মুহুর্তে কি । দিক বিক না পেয়ে বেলী তার পুরো শরীরকে আলগা করে দেয় । তাকিয়ে আছে সে ইরফানের দিকে । ইরফানের চোখে আজ ঘোর লেগেছে । বেলীকে কাছে পাওয়ার ঘোর ।
তখন বেলী শুধু একটা কথা বলার জন্যে মুখ খুলে ,

– আমি অসুস্থ , তবুও এমন করতেছেন । ঠিকাছে যেমন ভালো মনে করেন তেমনই করেন । আমি বাঁধা দিবো না । আপনি আমার স্বামী আমার শরীরে উপর আপনার অধিকার আছে । আমি বাঁধা দিবো না ।
– আমি তোকে জোর করে পেতে চাই না বেলী । তোর সম্মতিতে চাই ,
– মন থেকে সম্মতি আসতেছে না , তবে বাঁধা দিবো না । যা মন চায় করতে পারেন আপনি ।

ইরফান আর সহ্য করতে পারে নি । দ্রুত উঠে বসে পড়ে সে । খাটের কার্নিশের সাথে একটা ঘুষি মারে ইরফান । তারপর সোজা রুম থেকে বেরিয়ে যায় সে । আর বেলী সেখানেই পড়ে বালিশ চাপা দিয়ে কাঁদতে থাকে । তবে আজ বেলীর উপায় ছিল না , সত্যিই উপায় ছিল না । যদি উপায় থাকতো ফেরাতো না সে ইরফানকে । তবে বেলী জানে ইরফান আবার বদলে যাবে । রুবি আসলেই সে আবারও বদলে যাবে । তখন হয়তো বেলীর ছায়াও তার পছন্দ হবে না । তখন যাতে নিজেকে সামলাতে কষ্ট না হয় তারই চেষ্টা করলো বেলী । কিন্তু এইসব কিছু ভাবতে গিয়ে সে ইরফানকে কষ্ট দিয়ে ফেলছে এটাই সব থেকে কষ্টের তার কাছে ।

[ বিঃদ্রঃ বর্তমান সমাজে পুরুষরা যারা একাধিক বিয়ে করেন তাদের দুটো সংসার সামলাতে হয় । এই বউয়ের মন রাখতে অন্য বউকে অবহেলা করা তাদের কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে । সেখানে কিছু নারী আছে রুবির মত যারা নিজের টাই বুঝবে আর কিছু নারী আছে যারা বেলীর মত । নিজে কষ্টে থেকেও চায় স্বামী তার ভালো থাকুক । অনেকেই বলে এখনকার যুগে এমন নারী আছে নাকি । আমি বলবো আছে । হাজারে একজন আছে যে পুরোপুরি বেলী হতে পারে আর সেই পুরুষটিই ভাগ্যবান যার কপালে একজন বেলী জুটে । আর সেই একজন বেলীই অভাগী যার কপালে শেষ ভাগ টা অন্ধকার কবর দখল করে নেয় ]

.
.

চলবে………….

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_৭

0

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_৭
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

সকাল বেলা উঠে বেলী সব নাস্তা বানিয়ে টেবিলে সাজিয়ে রেখে দিয়েছে । আজ ইরফানের জন্যে একটি বিশেষ দিন । প্রেজেন্টেশন টা সবার পছন্দ হলেই এই প্রজেক্ট অনুযায়ী তাদের কাজ হবে । এর সাথে ইরফানেরও প্রমোশনটা হয়ে যাবে । সব কিছু মাথায় রেখেই আজ বেলীর আয়োজন । ইরফান লাচ্ছা সেমাইটা খুব পছন্দ করে তাও ডুবো দুধে । আর বেলী সেমাইটা দারুণ বানায় । তাই আজ সেমাইও বানিয়েছে । আজ মনে হচ্ছে ইরফানের থেকে বেলীর উদ্বিগ্নতা বেশি ।
রুমে ইরফান রেডি হচ্ছে । ফরমাল পরে পাক্কা সাহেব সাহেব লাগছে তাকে । সাদা শার্ট সাথে নেভিব্লু ব্লেজার । সব মিলিয়ে অসাধারণ লাগছিল ইরফানকে ।
সব গুছিয়ে নিয়ে নিজেকে পরিপাটি করে রুম থেকে বের হয় ইরফান । নাস্তা করতে টেবিলে এসে দেখে এলাহী কারবার । ইরফান যা যা ভালোবাসে সব বানিয়েছে বেলী । ইরফান এইসব দেখছে আর ভাবছে ,

– এক রুবি , যে কিনা একটা থাপ্পড় দেয়াতে বাপের বাড়ি গিয়ে বসে আছে । খোঁজ খবর তো নেয়-ই না , আসারও নাম নেই । আর এক এই মেয়েটা , শত অবহেলা , শত মা’র খেয়েও আমার কথা ভেবে যায় নির্দ্বিধায় । আমার কি প্রয়োজন , কিসে আমি ভালো থাকি সবটাই তার জানা । আর এই মেয়েটাকে গ্রাম্য , অশিক্ষিত , গরীব মানুষ ভেবে কত অপমান , কত মারধর করেছি আমি । কতটা নির্বোধ হলে এইসব করতে পারলাম । এমনকি জিদ করে আরেকটা বিয়েও করে ফেললাম । ওর বয়সটাই বা কতটুকু ছিল , যার এখন প্রতিটা মুহুর্ত হাসার কথা তার মুখ থেকে হাসি নামক জিনিসটা কেড়ে নিয়ে নিলাম আমি । আর সে নিরবে চুপ করে থাকে । সত্যিই হাজারো মেয়ে রুবি হতে পারে , কিন্তু একজন মেয়ে বেলী হতে হাজারবার জন্ম নিতে হয় হয়তো হবে ।

ইরফান এর ভাবনায় ছেদ পরে মিনু ডাকে ,

– ও ভাই , ভাই ???
-……..
– ভাই , ও ভাই,,,,,,,,???
– হু,,,,,,, হু
– দাড়াইয়া আছেন যে ভাই , বসেন । নাস্তা কইরা লন ।
– এত নাস্তা বেলী বানিয়েছে ?
– হ ভাই ,
– এত কিছু কিভাবে খাবো ?
– সব কিছুর থিকা একটু একটু কইরা খাইয়া নেন , আর সেমাইডাও খাইয়েন ডুবা দুধে বানাইছে ভাবী । সেই সকাল থিকা সব বানাইছে ভাবী ।
– বেলী কোথায় ?
– ভাবী আইতাছে , আপনে খাইয়া নেন ।

ইরফান ভেবেছিল বেলী অন্তত এখন তার সামনে থাকবে । কিন্তু বেলী রুমে বসে আছে । বিষয়টা ইরফানের কাছে খটকা লাগছিল , কিন্তু হাতে সময়ও নেই তার । তাই নাস্তা খেতে বসে যায় সে । প্রত্যেকটা আইটেম থেকে কিছু কিছু খেয়ে নেয় সে । তবুও তৃপ্তি পাচ্ছে না সে , হয়তো তৃপ্তিটা বেলীর আগমনেই ঘুচে যেতো । আজ বেলীকে একটু ট্রাই করবে সে । সেমাইটা খেয়ে পানি খেয়ে ঘড়িতে টাইম দেখে নেয় ইরফান । গাড়ি আসতে এখনও ১০ মিনিট বাকি । ইরফান উঠে বেলীর রুমে যায় ।
দরজার কাছে দাঁড়িয়ে দেখে বেলী বিছানায় ওপাশ ফিরে বসে কি যেনো করতেছে ।

– বেলী,,,,,,,,,,,?

ইরফানের মুখ থেকে নিজের নামটা শুনে চমকে যায় সে । কেঁপে ওঠে সে , বেলী এমনিতেও একটু ভীতু , আচমকা কেউ এসে ভাউ করলেও সে লাফিয়ে উঠে । গরীব ঘরের আদরের রাজকুমারী ছিল সে আর আজ সে স্বামীর ঘরের কাজের মেয়ে হয়ে গেছে । তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে পিছনে ফিরে দাঁড়ায় বেলী ।
ইরফান বেলীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে । ওড়না দিয়ে সুন্দর করে দুই পেচ দিয়ে ঘোমটা দেয়া তার মাথায় । এইভাবে বেলীকে খুব সুন্দর লাগে । আবার ওড়না ছাড়াও ভালো লাগে দেখতে । হাত দুটো দিয়ে জামাটা মুষ্টিবদ্ধ করে রেখেছে সে । ইরফান ধীর পায়ে বেলীর সামনে এসে দাঁড়ায় ।

– কিছু বলবেন ?
– হু , নাস্তার টেবিলে গেলি না যে ?
– মিনু তো ছিল , আসলে আমি একটু কাজ করতেছিলাম ।
– টাই টা ঠিক করে বেঁধে দে ।

ইরফানের এমন কথায় হতভম্ভ হয়ে যায় বেলী । হঠাৎ টাই বাঁধার কথা বললো তাও আবার আজকেই । কিন্তু আজকেই তো,,,,,,,

– কিরে বেঁধে দে ,
– বাঁধা আছে তো ,
– ঠিক করে দে টাই টা ।

বেলীর প্রচন্ড ভয় লাগছিল । এখন হাত উপরে উঠাবে কিভাবে সে । উঠালেই তো ইরফান দেখে ফেলবে । আর দেখার পর যদি প্রশ্ন করে তখন কি হবে ? এরই মাঝে আবারও ইরফানের তাড়া ,

– কিরে , একটু পরে গাড়ি চলে আসবে , বেঁধে দে ঠিক করে ।
– ঠিকই তো আছে ,
– টাইতে হাত দিয়ে ঠিক করে দে বেলী ।

অগত্যা হাত টা কাঁপতে কাঁপতে ইরফানের বুকের কাছে আনে বেলী । আর তখনই ইরফানের চোখে অন্য কিছু পড়ে । বেলীর ডান হাতের অনামিকা আঙুলে পুরো ব্যান্ডেজ করা । হাতের দিকে তাকিয়ে আবার সে বেলীর মুখের দিকে তাকায় । ইরফান । সে জানতো বেলীর কিছু একটা হয়েছে যার কারণে বেলী নাস্তার টেবিলের কাছে ছিল না । বেলীর মুখটা একদম শুকনো হয়ে আছে । ইরফান অনেকটা শান্ত গলাতেই বেলীকে প্রশ্ন করে ,

– কিভাবে কাটলি ?
-…………
– কিরে , বল কিভাবে কাটলি ?
– গরীবের রক্ত তো তাই শরীরে থাকতে চায় না ।
– এইটা উত্তর ?
– টাই ঠিক আছে এখন ?
– গরীবের রক্ত তো তাই শরীরে থাকতে চায় না কথাটার জবাব রাতে পাবি , আসতেছি ।

ইরফান রুম থেকে বেরিয়ে যায় । বেলীর মনে ভয় ঢুকে যায় । হয়তো রাতে এসে আবারও মারবে বেলীকে ইরফান । এমনটাই ধারনা তার । তবে আপাতত সব কিছু ভুলে গিয়ে আজকে ইরফানের জন্যে মন থেকে দোয়া পড়ছে বেলী । অসুস্থতার কারণে নামাজ পড়তে পারছে না সে । তাই মনে মনে দোয়া পড়ে বেলী । বেলীর একটাই চাওয়া ।

– ‘ হাসবুনাল্লাহ ওয়া নি’মাল ওয়াকিল ‘
হে আল্লাহ পাক আপনিই আমাদের জন্যে যথেষ্ট এবং আপনিই উত্তম সাহায্যকারী । আল্লাহ পাক আজ যেনো মানুষটা সফল হতে পারে । তাকে আপনি সকল বিপদ আপদ থেকে রক্ষান করুন এবং তাকে সফলতা দান করুন ।

ঠিক সেই মুহুর্তে মিনু দরজার সামনে থেকে বলে উঠে ,

– মরইন্না দোয়া আছে নি ?

কথাটা শুনে চমকে যায় বেলী । অবাক নজরে মিনুর দিকে তাকিয়ে থাকে সে । হঠাৎ মরার কথা কেন বললো সে ।

– এইসব কি বলো মিনু ?
– না মানে কইছিলাম , মরার আগের দোয়া থাকলে পইড়া লন , কওন যায় না কোন সময় না সময় মাইরা লায় আপনেরে ।
– এইভাবে কেন বলতেছো মিনু ? উনি আমার গায়ে হাত তুলে তা ঠিক তবে আমাকে একেবারে মেরে ফেলবেন না তিনি ।
– হ , হাচাই তো । আরে ভাবী এইসব আপনের মত আলাভোলারাই কয় গো ভাবী । ভাইয়ে জানি কেমন হইয়া গেছে , চুপচাপ । নিশ্চয়ই মাতায় পেলেন করতাছে আপনেরে কিভাবে মারন যায় ।
সি আই ডি ‘ র মইদ্যে এই সব দেহায় ।
– তুমি আর এইসব দেখবা না । এইসব দেখে আর উলটাপালটা চিন্তাভাবনা মাথায় আনে ।
– হ হ , হের সোয়ামীরে লইয়া কিছু কওন যায় না এক্কেরে । এত ভালাবাসা ঠিক না , এই কইলাম আমি । এত ফিডায় তহন কই থাহে ভালাবাসা ।
– রান্নাঘরে যাও আমি আসতেছি ।
– হুহ উচিত কথা কইলেই আমি ভালা না , কি আর করনের আছে আমার । আমি তো ভালা না ভালা লইয়াই থাহেন ।

মিনুর এমন পাকা পাকা কথায় এক গাল হেসে দেয় বেলী । তারপর নিজের রুম গুছিয়ে নিয়ে রান্নাঘরে যায় বেলী । কিন্তু মনটা উদ্বিগ্নতায় ভরপুর । স্বয়ং আল্লাহ পাকই জানেন অফিসে কি হচ্ছে এখন ।

অন্যদিকে ,

রুবিকে তার বাবা এবং মা উভয়েই বোঝাতে বোঝাতে ক্লান্ত । তারা যতই বোঝাচ্ছে সে কিছুতেই মানছে না । জাফর সাহেব সর্বপ্রকার মেয়েকে বুঝিয়েও কোন দিক করতে পারছেন না ।

– তুমি কি চাইছো রুবি , তোমার সংসার টা ভেঙে যাক ?
– বাবা সে আমাকে চড় মেরেছে ।
– মেরেছে তো কি হয়েছে , তোমার প্রোভোকেশনেই তো বেলীকে মারে ইরফান , তা তুমি না হয় একটা চড় খেলেই । তাতে সমস্যা কি ?
– বাবা,,,,,,,,,,?
– স্বামীর ঘর ছেড়ে বাবার বাসায় বসে আছো । তো বেলী কি সুযোগ পাবে না এই সুযোগে ইরফানকে হাত করার ।
– কখনোই না , ইরফান তো বেলীকে ঘেন্না ছাড়া আর কিছুই করে না ।

তখনই রুবির মা বলে ওঠে ,

– বার বার মানা করছিলাম বিবাহিত ছেলের সাথে প্রেম করিস না করিস না , শুনছোস আমার কথা ? এখন সতীন নিয়ে সংসার করস ।
– ওহহহ মা , থামবা ।
– আমি বললেই থামবা , আরেক মেয়ের ঘর নষ্ট করছিস , আল্লাহ তোর সাথে কি করে দেখ এখন ।
– বাবা দেখলা মা কিভাবে বললো ?
– ভুল কিছু বলে নাই তোমার মা । কাল সকালে চলে যাবা ইরফানের কাছে ।
– আমি যাবো না , যতক্ষন না ও আমার পা ধরে ক্ষমা না চায় ততক্ষণ অবদি আমি কোথাও যাবো না ।
– তাহলে বাপের বাড়িতে বসে থাক সারাজীবন ।

মায়ের এমন কথায় রুবি জেদ দেখিয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা লক করে দেয় ।

– এই মেয়ের যে কি হবে , আল্লাহ পাকই ভালো জানেন ।
– মেয়ের শিক্ষায় ঘাটতি আছে তাই মেয়ে এমন হয়েছে ।
– আমাকে কথা শুনাচ্ছো নাকি তুমি ?
– তুমি মেয়ের মা , তুমি বর্তমান থাকাকালীন সময়ে সে কিভাবে বিবাহিত ছেলের পাল্লায় পড়ে ?
– বিবাহিত ছেলে কি ধোয়া তুলসীপাতা ? যে মেয়ে ইশারা করলো আর ছেলেও গলে গেলো ?
– অবশ্যই গলে যাবে । একটা মেয়ে ইশারা করবে আর ছেলে কি বসে থাকবে । তোমার মেয়ে জানতো না ওই ছেলের বউ আছে ।
– তোমাকে যখন বলেছিল , তখন নিজে চুপ ছিলা কেন ? এখন আমার দোষ দাও কেন ?
– দোষ ছেলেরও দোষ মেয়েরও মাঝে থেকে ওই গরীম এতিম মেয়েটা কষ্ট পাচ্ছে । দেখবা অভিশাপ লাগবে আমাদের৷, ওই মেয়ের অভিশাপ ।
– ওই মেয়েও কম যায় না । চলে গেলেই তো পারে ?
– তুমি মা হয়ে কিভাবে বলো এইসব কথা , তা তোমার মেয়েও তো চলে আসতে পারে ? নিজের কাছে রেখে মেয়েকে বানিয়েছো আল্ট্রামর্ডান । দুই হাতে টাকা উড়ানো , বন্ধু বান্ধবী নিয়ে আমোদ ফূর্তক করা এইসব শিখিয়েছো , এখন মেয়ে এইসব ছাড়তে পারে না ।
– দেখো রুবির বাবা , আমি কোন বলে দেই নাই যে বিবাহিত ছেলের সাথে প্রেম করতে আর তাকেই বিয়ে করতে । অতএব আমাকে বলবা না এইসব । আমি কিটি পার্টিতে যাবো আজকে ।
– ওই তো , এইসব পার্টি পুর্টি করেই জীবন পার করলা আর মেয়েকেও বানিয়েছো তেমন ।

রুবির বাবা মায়ের মাঝে রুবিকে নিয়ে তর্ক লেগে যায় । আর তার একপর্যায়ে রুবির মা চলে যায় রুমে আর রুবির বাবা বাসা থেকেই বেরিয়ে যায় ।

[ বিঃদ্রঃ একজন মা-ই কিন্তু পারেন তার সন্তানকে মানুষের মত মানুষ করে তুলতে । কারণ বাবারা সব সময় কাছে থাকেন । এখনকার যুগে কিছু কিছু মায়েরা আছেন যারা সন্তানকে এত বেশিই আহ্লাদি করে লালন পালন করেন যারা পরবর্তীতে এমন এক একটা রুবি তৈরি হয় । আবার কিছু কিছু সন্তান আছে হাজারো শাসনের মধ্যে থেকেও জানোয়ার তৈরি হয় , যার উৎকৃষ্ট উদাহরণ আবরার হত্যার খুনিরা । কারো বাবা ভ্যানচালক কারো বাবা অনেক কষ্টে ছেলে মেয়েকে মানুষ করছেন , তারা কিনা অন্য মায়ের কোল খালিই করে দিল সারাজীবনের জন্যে । আবার কারো বাসাতে নাকি টিভিই নাই যাতে করে নাকি সে ভিক্টিমের খবরই দেখেন নাই , তার সন্তান বুলেটে পড়ে । কিছু কিছু বাবা মায়ের প্রশ্রয়ে সন্তান উচ্ছন্নে যায় আবার কিছু কিছু পারিশ্রমিক বাবা মায়ের সন্তানও উচ্ছন্নে চলে যায় । আর কিছু কিছু মেয়ে হয় যারা জন্ম থেকেই একরোখা ছাড়পোকা যারা এক একটা রুবি তৈরি হয় ]

রাত প্রায় ৯ টা বাজছে ঘড়িতে । কিন্তু আজ ইরফান এখনও আসে নাই । অন্যান্য দিন তো ৮ টার পর পরই চলে আসে । তাহলে আজ এত দেরি কেন ? বেলীর চিন্তা বেড়েই যাচ্ছে । এই যাবত প্রায় ১৫ বার বারান্দায় গেছে বেলী । দেখার জন্যে ইরফান আসে কিনা । মিনু তখন টিভিতে সিরিয়াল দেখছে । বার বার বেলীর বারান্দায় যাওয়া দেখে মিনুও বিরক্ত হয়ে যায় ।

– ভাবী কি অইছে আপনের ? এমন করতেছেন কিল্লাই ?
– এই মিনু দেখো ৯ টা ৫ বেজে গেছে , আজকে এখনও আসে নাই যে মানুষটা ?
– হায়রে আল্লাহ , এই বেডির শরম লইজ্জা কিছুই নাই । বেলাজা মাতারি এইদিকে আইয়েন , আর বইয়া বইয়া নাটক দেহেন আইয়েন ।
– কি বলো এইসব তুমি মিনু ?
– ভাবী ভাইয়ে দেহেন গিয়া হেই শয়তানির বাসায় গেছে গা । এখন শয়তানি হেইডার মা শয়তানি মিল্লা ভাইয়েরে ফাম দিবো আর ভাইয়েও ফাম নিবো । দেইক্ষেন আমার কতাই মিলবে ।
– কিযে বলো না তুমি আজকাল মিনু আর শুনো মানুষ হচ্ছে আশরাফুল মাখলুকাত তাদের শয়তান বলতে হয় না ।
– ভাবী হুনেন , সেই আশরাফুল মাখলুকাত যদি শয়তানের মত কাম করে তারে শয়তান কা আরও কত্ত কিছু কওন যায় । ওহন নাটক চাইতাছি কতা কইয়ে না ।

মিনু নাটক দেখায় মন দিচ্ছে । আর অন্যদিকে বেলীর মনে ভয় আরও গাঢ় হচ্ছে । এরই মাঝে হঠাৎ করেই ডোরবেল বেজে ওঠে । বেলীই যায় দৌড়ে । তাড়াতাড়ি দরজা খুলে দেয় সে । ইরফান দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাহিরে । ইরফানকে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বেলী । তবে মানুষটাকে বড্ড বেশিই ক্লান্ত দেখাচ্ছিলো ।

– আসছেন আপনি , এত দেরি হলো যে ?
– আগে এক মগ কফি বানা , আমি শাওয়ার নিয়ে আসছি । মাথা প্রচুর পরিমানে ধরে আছে ।
– আচ্ছা ,

বেলী এক দৌড়ে গিয়ে কফি বানাইতে থাকে । মিনুও দেখতেছে সব , হাল্কা মলিন হাসি দিয়ে সেও মনে মনে বলে ,

– আল্লাহ পাক তারে যে এত সরল সোজা কিত্তে বানাইলো । জামাই যা কয় তাই হুনে , জামাই তো ভালা না কোনদিন জানি মাইরাই ফালায় । বেচারি এইডাই বুঝপার পারে নাহ । জামাই যা কয় তাতেই হ হ করে । সহজ সরল মাইয়া মানুষ ।

মিনুর মনের ভয় তার বেলী ভাবীকে কোনদিন জানি ইরফান মেরেই ফেলে । কিন্তু বেলী তো তা বোঝে না । এটাই মিনুর খারাপ লাগে ।
বেলী কফি বানিয়ে ইরফানের রুমে যায় । ইরফান তখন গোসল করে বের হয় , ইরফান তখন মাথার পানি গুলো মুছতেছে । তখনই বেলী রুমে যায় ।

– আপনার কফি,,,,,,,?
– থ্যাংকস রে , এত ধকলের পরে এই কফিটার সত্যিই প্রয়োজন ছিল ।
– খেয়ে নেন ।
– বেলী,,,,,,,,?
– জ্বি ,
– ‘ স্বপ্ননীড় ‘ প্রজেক্টটা সাইন হয়ে গেছে ।
– বুঝলাম না ঠিক ।
– বুঝলি না ?
– উহু ,

কফির মগে চুমুক দিয়ে বেলীর সামনে গিয়ে দাঁড়ায় ইরফান । তারপর হাল্কা হেসে বেলীর চোখের দিকে তাকায় ইরফান ।

– তোর দেয়া নামটাই রেখেছি প্রজেক্টের । বস নামটা শুনে খুব খুশি হলেন । আমাদের কোম্পানির পরবর্তী প্রজেক্টের নাম হচ্ছে ‘ স্বপ্ননীড় ‘। আর হ্যাঁ আরেকটা কথা , আমার প্রমোশনটাও হয়ে গেছে আজকেই বস ডিক্লেয়ার করে দিলো ।
– আলহামদুলিল্লাহ , আমি বলেছিলাম না আপনাকে , ঠিক হবে সব ।
– হ্যাঁ , সবটাই ঠিক হয়েছে ।
– আচ্ছা আপনি কফি খেয়ে আসেন , আমি টেবিলে ভাত দিতেছি ।
– বেলী দাঁড়া ,
– জ্বি , কিছু বলবেন ?
– কি চাই তোর , আজ যা চাস মুখ ফুটে বল ।
– চাইছি তো কাল রাতে ।
– বেলী ,,,,,, শাড়ি গহনা কিংবা অন্য যা কিছু চাই বলতে পারিস ।
– এইসব কিছুই চাই না আমার , আমার যা চাই তা বলছিলাম তো কালকে । আপনি খাইতে আসে , আমি ভাত বাড়তেছি ।

ইরফানের কথা এড়িয়ে গিয়ে বেলী রুম থেকে বেরিয়ে যায় । বেলী যেই কথা গুলো বলে গেলো কথা গুলো কি অভিমানের কথা নাকি বেলীর মনের কথা কিছুই বুঝতে পারছে না ইরফান । তবে এতটুকু বুঝতে পেরেছে বেলীর সাথে করা অন্যায় গুলোর জন্যে তাকে ক্ষমা চাইতে হবে বেলীর কাছে । আর তা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ।
ইরফান ডাইনিং টেবিলে বসে আছে । বেলী ভাত সহ সব কিছু এগিয়ে দিচ্ছে ইরফানকে । ইরফান কিছুক্ষণ বেলীর দিকে তাকিয়ে আছে । তারপর কি যেনো একটা ভেবে বেলীর সামনেই মিনুকে ডেকে আনে ইরফান ।

– জ্বে ভাই , আমারে ডাকছেন ?
– হু ,
– কি ভাই , কন ।
– আজকে তুই গেষ্ট রুমে থাকিস ।

কথাটা শুনে বেলীর কলিজায় এক কামড় দেয় । আর তার থেকেও বড় কথা মিনুর তো কলিজার সব পানি নাড়াচাড়া দিয়ে উঠে । ইরফান হঠাৎ করেই কেন আজকে মিনুকে গেষ্ট রুমে শুতে বললো । মিনু বেলীর দিকে তাকায় আর বেলীও মিনুর দিকে তাকায় । মিনু চোখের ইশারায় বেলীকে বোঝাতে চাচ্ছে হয়তো আজ রাতই বেলীর শেষ রাত । ইরফান হয়তো আজ রাতেই বেলীকে মেরে ফেলবে । তাই মিনুকে আলাদা শুতে বলেছে । এইদিকে বেলীও বিচলিত , হঠাৎ করে ইরফানের আজ কি হলো ? মিনু কথা ঘুরিয়ে নিয়ে নিজেই বলা শুরু করে ,

– ভাই আমার একলা হুইতে ডর লাগে তো ,
– কিসের ডর আবার , বাসায় আমি আছি তোর ভাবী আছে , কিসের ডর আবার ।
– ভাবী আছে সমিস্যা নাই কিন্তু আপনে আছেন এইডাই আসল সমিস্যা (গুনগুনিয়ে)
– এই মিনু কি বলিস গুনগুন করে ।
– কই কি কইচি আবার , আমি ভিত্রের রুমে হুইতাম না , আমার ডর করে ।
– আচ্ছা তাহলে তুই বেলীর রুমে ঘুমাস , বেলী গেষ্ট রুমে ঘুমাবে ।
– কিল্লাই , ইরাম কিল্লাই ?
– কি কিল্লাই কিল্লাই করছিস , আর তোকে না কতবার বলছি নরমাল ভাষায় কথা বলতে ।

মিনুর মনে এইবার পুরোপুরি দাগ কেটে যায় , যে আজ রাতেই ইরফান বেলীকে মেরে ফেলবে । তাই বেলীকে , চোখে ইশারা করে । তখন আবার বেলী বলা শুরু করে ।

– মিনু তো রোজ আমার কাছেই ঘুমায় তাহলে আজ কেন অন্য ঘরে ঘুমাবে ?
– আমি বলেছি তাই ,
– কিন্তু ও তো ভয় পায় ।
– পাবে না ভয় । এখন মিনু তুই কোন রুমে থাকবি ভেবে দেখ ।

এই বলে ইরফান খাবার টেবিল থেকে উঠে নিজ রুমে চলে যায় । ইরফান যেতে না যেতেই মিনু শুরু করে দেয় ,

– দেখছেন ভাবী দেখছেন৷, কইছিলাম না মাইরা ফালাবে , আমারে অন্য রুমে দিয়া আপনেরে মাইরা ফালাইবো গো ভাবী ।
– কি সব বলো না তুমি । আমাকে মেরে ফেললেও তুমি দেখবে না মারলেও তুমি দেখবে , বাদ দাও । উনি যা বলছে তাই করো , আজকে বরং গেষ্ট রুমেই ঘুমাও ।
– কিন্তু আপনে ,
– যা আছে কপালে ।

রাত প্রায় ১২ টা নাগাদ বাজবে । মিনু চিন্তা করতে করতে গেষ্ট রুমেই ঘুমিয়ে গেছে । আর অন্যদিকে রুমে শুয়ে শুয়ে বেলী ভাবছে আজকে হঠাৎ মিনুকে কেন অন্য রুমে ঘুমাইতে বললো ইরফাজ । এপাশ ওপাশ করেও ঘুম আসছে না বেলীর । এরই মাঝে দরজায় টোকা পড়ে , বেলী দরজা খুলে দিয়ে দেখে ইরফাজ , টাউজারের পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে । অনেকটাই চমকে যায় বেলী ইরফাজকে দেখে ।

– ভেতরে আসতে পারি ?
– এটা আপনার বাসা , সেই হিসাবে রুমগুলাও আপনার , আসেন ।
– ঘুমাস নাই এখনও ?
– শুইছিলাম , এখনি ঘুম আসতো ।
– ওহ , তখন বললাম কি চাই তোর কিছুই বললি না ?
– আমার কিছু চাই না । আর যা চাওয়ার ছিল চেয়েছি তো ।
– আজ যদি আমি তোর কাছে কিছু চাই , দিবি আমাকে ?
– এমন কিছু চাইয়েন না যা আমি দিতে পারবো না । আর যদি আমার জীবনটা চান সহজেই দিয়ে দিবো , তবুও এমন কিছু চাইয়েন না যা আমার আয়ত্তের বাহিরে ।
– জীবন চাইবো না কারণ এই জীবনটাই তো আমার ।
– মানে ??
– যদি বলি আমি তোকে চাই , তখন কি করবি তুই ??

ইরফানের কাছ থেকে এমন কথা আশা করেনি বেলী । এই কথাটা পুরোটাই তার আশপাশের জগত থেকে অনেক দূরে ছিল যা বেলীর ধারণাতেই ছিল না । যেই মুহুর্তটা প্রত্যেক নারী আশা করে তার স্বামীর কাছে । সেই মুহুর্তটা যে এইটা হবে জানা ছিল না বেলীর । আর মুহুর্তটা যে আজকের রাতটা হবে তাও জানা ছিল না বেলীর ।।

.
.

চলবে………………

[ লেখিকার কিছু কথা –

আসসালামু আলাইকুম ,

‘ ঝরে যাওয়া বেলীফুল ‘ আমার এই যাবত লিখার মধ্যে একদম ভিন্ন একটি উপন্যাস । যা কিছুদিন আগেই লিখা শুরু করেছিলাম । আলহামদুলিল্লাহ ৬ পর্বতেই সবার মনে জায়গায় করে নিয়েছে এই উপন্যাসটি । এই উপন্যাসের মাধ্যমে আমি আমাদের সমাজের কিছু বাস্তবতা তুলে ধরার চেষ্টা করছি মাত্র । জানি না কতটুকু সফল হতে পেরেছি । তবুও চেষ্টা করে যাচ্ছি অবিরত ।

এইবার আসি পাঠক সমালোচনায় । আমি এই উপন্যাসটিতে এখন পর্যন্ত কারো কাছ থেকে সমালোচনা পাই নি ৷ এটা আমার কাছে অনেক কিছু আলহামদুলিল্লাহ । আমার এই যাবত লিখা ১৪ টি ফেসবুক উপন্যাসের মাঝে এমন কোন পাঠক নেই যে আমার লিখা নিয়ে সমালোচনা করেছে । তবে যেখানে ৯৫% ভালোবাসা পেয়েছি সেখানে ৫% সমালোচনা আমার জন্যে ভালো কিছু । কারণ পাঠক সমালোচনা না করলে আমি আমার ভুল গুলো সংশোধন করে নিতে পারি না । তাই সমালোচনা করা ভালো আমার কাছে । এটা পাঠকের অধিকার বলে আমি মনে করি । সে তার মতামত পোষণ করবেন এটাই স্বাভাবিক । আর এটা আমি শান্তির দৃষ্টিতেই দেখি এতে সন্দেহ নেই ।

এইবার আসি উপন্যাস দীর্ঘ/ছোট করার ব্যাপারে । ২/৫ জন বলেছেন গল্প দীর্ঘ না করাই ভালো , তাদের জন্যে বলি – উপন্যাস ৬/৭ কিংবা ৭/৮ পর্বের হয় না । অনুগল্প ১/১০ পর্বের এর মাঝে থাকে । আর আমি অনুগল্প লিখছি না । আপনারা অন্তত এতটুকু বুঝবেন যে কোনটা ছোট গল্প কোনটা উপন্যাস আর কোনটা অনুগল্প । তাই প্রত্যেকের কাছে বিনীত অনুরোধ আমার গল্প দীর্ঘ কিংবা ছোট করার ব্যাপারে আমাকে বলবেন না । বিষয়টি সম্পূর্ণ আমার ব্যাক্তিগত । যদি অতিরিক্ত বিরক্তিবোধ করেন একদম আপনার ছোট বোন ভেবে একটা কমেন্ট করবেন আমি গল্প অফ করে দিবো । তবুও এমন কিছু বলবেন না যাতে আমার লিখার মন মানষিকতা নষ্ট হয় । কারণ আমি লিখছি আপনারা পড়ছেন । তাই আমিই হয়তো ভালো বুঝবো কোথায় গিয়ে এর সমাপ্তি ঘটবে ।

এখন আসি অভিযোগের ব্যাপারে , অনেকের অভিযোগ আমি কেন রেগুলার দিচ্ছি না এবং আমার পর্ব গুলো কেন ছোট হচ্ছে । তাহলে বলি , ভাইয়ারা/বোনেরা আমিও তো মানুষ । আমারও তো সুযোগ সুবিধা আছে । আমিও তো পরিবার নিয়ে থাকি । আমারও ব্যাক্তিগত কিছু কাজ থাকতে পারে । তাই হয়তো এক দুইদিন বাদ যেতে পারে । অবশ্য আমি গল্প না দিতে পারলে আগাম নোটিশ দিয়ে দেই । আমি গতকালও আমার আইডিতে বলে দিয়েছিলাম যে আমি গল্প দিতে পারবোনা । তবুও অনেকেই কথা শুনিয়েছেন । লিখালিখি করি বলে কি নিজের সব কিছু ববিসর্জন দিয়ে দিবো ? আর গ্রুপে বা পেইজে গল্পের ব্যাপারে ছোট খাটো স্ট্যাটাস দেয়া আমার কাছে ভালো লাগে না । এতে করে গ্রুপের সৌন্দর্যতা নষ্ট হয় । আর যেই গ্রুপ অথবা পেইজ আমার লিখাটাকে এত প্রাধান্য দিয়ে এপ্রুভ করেছে আমি সেই গ্রুপ অথবা পেইজকে ছোট করতে পারবো না । এখন থেকে গল্প না পেলে একবার অন্তত আমার আইডিতে গিয়ে দেখে আসবেন আমি যদি জানিয়ে দেই তাহলে দেখবেন আর না জানাই তাহলেও দেখবেন । আপনাদেরকে তো একটু হলেও আমার সুবিধা অসুবিধা গুলো দেখতে হবে , তাই না ?

এইবার আসি একজনের কথার উত্তরে , কেউ একজন বলেছিলেন আমায় তবে আইডির নাম বলে সবার কাছে তাকে ছোট করবো না । তার মতামত ” আপনার বিঃদ্রঃ আপনার গল্পের থেকেও বড় ” তাহলে বলি ভাইয়া আপনি খেয়াল করলে দেখতে পারবেন বিঃদ্রঃ তে আমি কি বলি । যদি আপনি বুঝতেন তাহলে এমন কথাটা বলতে পারতেন না । বিঃদ্রঃ নিয়ে আপনার একার সমস্যা হতে পারে তবে বাকিদের নেই । তাই আপনি দূরত্ব বজায় রাখবেন ।

এইবার আসি ইনবক্সের কথা নিয়ে , অনেকেই নক করেন আমার ইনবক্সে । আমি সবার ম্যাসেজের রিপ্লাই হয়তো দেই না । আমি সময়ের কারণে দিতে পারি না আবার আমার বিরুদ্ধে আমার কাছের মানুষের অনেক অভিযোগ আছে তা হচ্ছে আমি ইনবক্সের ম্যাসেজের রিপ্লাই দেই না । আসলেই আমার ইনবক্সে কথা বলতে ভালো লাগে না । আবার যাদের সাথে বলি তাদের সাথে বলি । তাই এ নিয়ে আমি অত্যন্ত দুঃখিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী সবার কাছে যারা নক দেন আমাকে । আমি চেষ্টা করবো সবার ম্যাসেজের রিপ্লাই দেয়ার জন্যে ।

ফ্রেন্ড রিকুয়েষ্ট অনেকেই দেন । হয়তো এক্সেপ্ট হয় না বলে রাগ করেন । একজন বলেছেন “আপনাকে রিকুয়েষ্ট দিছি এক্সেপ্ট করেন নাই তাই হা হা রিয়্যাক্ট দিছি” আরেকজন বলেছেন “এটা কেমন ব্যবহার রিকুয়েষ্ট এক্সেপ্ট করেন না” ভাই আপনার একাউন্ট পুরা দমে ফেইক হলে আমি কেন এক্সেপ্ট করতে যাবো । যারা আমার কাছে রিয়েল ইউজার মনে হয় এবং আইডিতে সব প্রমাণ থাকে তাদেরটাই এক্সেপ্ট করি ।

এইবার আসি চুরির ব্যাপারে । আমার লিখা গুলো অনেকেই কপি করেন । আমার আপত্তি নেই এই বিষয়ে । তবে নিজের নাম বসান এটাতেই ঘোর আপত্তি । কেন নিজের নাম বসান । আমি কি কষ্ট করে লিখি নাই ? আমার কষ্টের মূল্য কই দিলেন চোর ভাইয়ারা । তাও কিছু বলি না । কারণ কথায় আছে কয়লার ময়লা ধুলেও যায় না । এদের অবস্থা এই রকম ।

অবশেষে বলি , আমি সামাজিকতা বুঝি তাই সমঝোতার মাঝে লিখি । আমার দ্বারা স্বস্তা রোমান্স ঢেলে দিয়ে লুতুরপুতুর করা গল্প লিখা হয় না আর হবেও না । ভালো লাগলে পড়বেন না পড়লে আপত্তি নেই । আমার যদি কোথাও ভুল হয়ে থাকে আপনারা আমাকে আপনাদের ছোট বোন অথবা বড় বোন কিংবা বন্ধু অথবা সমবয়সী ভেবে আমার ভুল গুলো ধরিয়ে দিবেন । কারণ আপনারা আমার ভুল গুলো বললেই আমি নিজেকে শুধরাতে পারবো ।

এর থেকে বেশি আর কিছুই বলার নেই । যদি বেশি বলে থাকি তাহলে দুঃখিত । ভালো থাকবেন প্রত্যেকে আর ভালো রাখবেন নিজের পরিবার এবং প্রিয় মানুষটিকে । আর আমার জন্যে দোয়া করবেন ।

আসসালামু আলাইকুম ? ]

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_৬

0

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_৬
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

আজ দুইদিন হলো রুবির খবর নেই । ইরফানও রেগে ফোন করেনি তাকে । মাঝে জাফর সাহেব (রুবির বাবা) ফোন করে বাসায় যেতে বলেছেন ইরফানকে । কিন্তু ইরফানই যায় নি । রুবির বলা মিথ্যা কথা গুলো মেনে নিতে পারেনি ইরফান । সে এমনিতেও মিথ্যা পছন্দ করে না তার উপর না বলে টাকা খরচ করে আরেকজনের উপরে চাপিয়ে দিয়েছে । এর জন্যে আরও বেশি রাগ ইরফানের । তাই ইচ্ছা করেই যায় নি সে ।
অফিস থেকে এক গাদা কাজ নিয়ে বাসায় ফিরেছে ইরফান । বেলীর শরীরটা দুদিন পর ভালোই আছে এখন । তাই দৌড়ে দৌড়ে সব কাজই করতে পারে সে ।
আর বেলীকে দেখে ইদানীং বড্ড বেশি মায়া হয় ইরফানের । মনের মাঝে লুকিয়ে থাকা ভালো লাগাটা বের হয়ে আসতে বেশি সময় নেয় না ।
ইরফান নিজের রুমে ফ্রেশ হয়ে নেয় । বেলী সেই সময়েই কফি হাতে রুমে যায় । ইরফান তখন খালি গায়ে শরীরের পানি মুছতেছে । ইরফানকে ওই অবস্থাতে দেখে অনেকটাই ইতস্তত বোধ করে বেলী । বেলীর ইতস্তত বোধ করা দেখে ইরফান টি-শার্ট টা পরে নেয় ।

– আপনার কফি ,
– রেখে দে ,
– হু ,

বেলী চলে যেতে নিলে ইরফান ডাক দেয় তাকে ।

– বেলী শুন ,
– জ্বি
– তোর একটা জিনিস আমার কাছে আছে ,
– জিনিস ! কি জিনিস ?

এরপর ড্রয়ার থেকে কানের দুলটা নিয়ে আসে ইরফান ।

– হাত পাত ,
– কি জিনিস আছে ,
– হাত পাত আগে ,

বেলী হাত পাতলে ইরফান বেলীর এক কানের দুলটা বেলীর হাতে দেয় ।

– এই জিনিসটা ,
– হায় আল্লাহ এইটা আপনার কাছে ছিল ।
– হ্যাঁ
– আমি কত খুজছি এইটা , আমার বাবার শেষ স্মৃতি এইটা । অনেক কষ্টে টাকা জমিয়ে বানিয়ে দিছিলো ।
– ওহ ,
– আচ্ছা , কি খাবেন রাতে ?
– দুপুরে রান্না করস নাই ?
– ভাত রান্না করছিলাম , আর কালকের রান্না করা তারকারি ছিল , তাই খেয়ে নিছি আমি আর মিনু ।
– ফ্রিজে তো মোটামুটি সবই রাখা আছে বেলী তাহলে কালকের রান্না করা জিনিস কেন খাস তুই ।
– ফেলে দেয়ার থেকে খেয়ে নেয়া টা ভালো । আপনি কি খাবেন , বলেন আমি রান্না বসাবো ।
– মাছ ভুনা করিস ,
– আচ্ছা ।

বেলী রুবির থেকে অনেকটা আলাদা । অপচয় করতে একদম চায় না । ল্যাপটপ নিয়ে বসে যায় ইরফান । এক মনে কাজ করতেই আছে তো করতেই আছে । ল্যাপটপ থেকে কাজ শেষ করে আড়মোড়া দেয় ইরফান । ঘড়ির দিকে চোখ পড়তেই দেখে রাত ১১ টা বেজে ৫৫ মিনিট । তার মানে ১২ টা বাজতে আর মাত্র ৫ মিনিট । বেলী কি এখনও রান্না করে নাকি৷। একবার এসে ডেকেও গেলো না । কান থেকে হেডফোন খুলে ডাইনিং টেবিলে যায় ইরফান । বেলী সেখানেই সোফায় বসে কাত হয়ে আছে । ইরফান গিয়ে আস্তে করে নাড়া দেয় বেলীকে । ইরফানের ছোয়া পেয়ে বেলী উঠে যায় ।

– কিরে , রাত ১২ টা বেজে গেছে আমাকে ডাকলিও না , আর এখানে বসে ঘুমিয়ে গেছিস ।
– কয়েকবার গেছিলাম রুমে , ডাকছিলামও , আপনি কানের মধ্যে হেডফোন লাগিয়ে কাজ করতেছিলেন । ভাবলাম কাজ শেষ হলে আবার ডাক দিবো , আর আমিই ঘুমিয়ে গেছি ।
– হায়রে , চল
– আসেন
– মিনু কোথায় ?
– সে খেয়ে দেয়ে ঘুম ।
– ওহ ,

বেলী ইরফানকে ভাত বেড়ে দেয় । প্রয়োজনীয় সব কাছে এনে দেয় । ইরফান খাওয়ার দিকে তাকিয়ে আবার বেলীর দিকে তাকায় ।

– তুই খাইছিস ?
– হু
– সত্যিই খেয়েছিস ?
– হু
– ইদানীং মিথ্যা বলস তুই , রুবিকে চড় মেরেছিলাম কিন্তু মিথ্যা বলার কারণে ।
– আর আমি সত্য বলার পরেও লাথি খাই ,
আপনি খেয়ে নেন ।

বলে বেলী রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছিল । ওমনি ইরফান বেলীর হাতটা ধরে নেয় ।

– কিছু বলবেন ?
– তোর সাথে একদিন বসেও ভাত খাওয়া হয় নাই , রুবির সাথে সময় মিলে না । আমি বরাবর খাবার একাই খাই । আজ না হয় তুই আমার খাওয়ার সাথী হলি ।
– মানে ,
– আমার সাথে বসে খেতে হবে আজকে তোকে ।

কথাটা শুনে কলিজায় একটা মোচড় দিয়ে উঠে বেলীর । বিয়ের প্রায় ১০ মাস পর ইরফান নিজ থেকে বেলীকে তার সাথে ভাত খেতে বলেছে । অনুভূতি টা ঠিক কি রকম বলে তা বুঝতে পারছে না বেলী । কিছুক্ষণ ইরফানের দিকে তাকিয়ে আবারও নজর নিচে নামিয়ে ফেলে সে ।

– কিরে , বসবি না ?
– আপনি খান , আমি এখন আর খাবো না ।
– আমি কি এতই খারাপ নাকি যে আমার সাথে বসে ভাত খাওয়া যায় না ।
– নাহ নাহ তা কেন হতে যাবে ?
– তাহলে খেতে বস ।
– হু ,

কথা না বাড়িয়ে খেতে বসে যায় বেলী । ইরফান আড় চোখে বেলীর খাওয়ার ধরণ দেখে । এর আগে কখনো ইরফান বেলীকে খেতে দেখে নি । যতক্ষন ছিলো শুধু মারধর আর বকাবাধ্য করে গেছে মেয়েটাকে । মেয়েটাও যেমন , চুপচাপ মানিয়ে নিয়েছে সবটা । এমনকি সতীনের সাথে সংসার করতে হবে সেইটাও মানিয়ে নিয়েছে সে । একবারের জন্যেও প্রতিবাদ করেনি বা না জানিয়েছে নিজের আপত্তির কথা । গত সাতটা মাস যাবত চোখের সামনে নিজের স্বামীকে তার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে এক রুমে থাকতে দেখেছে । প্রাত্যহিক সতীনের ভেজা চুল দেখতে হয়েছে তাকে । তবুও নিজের অধিকারের দাবি নিয়ে একবারের জন্যেও দাঁড়ায় নি সামনে এসে । ওর মত মেয়ে খুব কমই আছে , বা পাওয়া যায় । ইরফান কথা গুলো মনে মনে ভাবছে । ঠিক এক চামচের মত ভাত নিয়েছে আর একটু ডাল ।

– মাছ নিবি না ?
– উহু ,
– কেন ?
– ডালটা দিয়েই খাই ।
– মাছে কি সমস্যা ?
– কিছু না , আপনি খান । আরেক টুকরা দিবো ?
– নাহ থাক ।

কোন রকম খেয়ে উঠে যায় বেলী । ইরফান বেশ বুঝতে পারছে বেলী তার সামনে থাকতে চায় না । অবশ্য এইসবের একমাত্র কারণ ইরফানের করা খারাপ ব্যবহার গুলো । তাই সেও আর কিছু বলে নাই ।

আব কিছু গুছিয়ে পরিষ্কার করে বেলী শুতে যাবে এমন সময় দেখে ইরফান ড্রইং রুমে কিছু জিনিসপত্র নিয়ে বসেছে । ঘড়িতে প্রায় ১ টা বাজে । এই সময়ে কি কাজ করবে আবার । কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ইরফানকে দেখছে বেলী । এরই মাঝে ইরফান আবারও ডাক দেয় বেলীকে ।

– বেলী শুন তো ?
– হু ,
– আমার রুমে যা , সেলফের উপরে দেখবি একটা সাদা কৌটা রাখা আছে নিয়ে আয় ।
– হু ,

কৌটা এনে ইরফানের কাছে রাখে বেলী । অনেকগুলা জিনিসই রাখা আছে টি-টেবিলের উপরে । বেলী তাকিয়ে আছে সেইগুলার দিকে । বেলীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ইরফান নিজ থেকেই বেলীকে বসতে বলে ।

– কিরে দাঁড়িয়ে আছিস যে , বস এইখানে ।
– এইগুলা দিয়ে কি করবেন ?
– হাউজ বিল্ডিংয়ের প্রজেক্ট এর জন্যে । কাল অফিসে প্রেজেন্টেশন ।
– ওহ , বাড়ি বানাবেন ?
– হা হা , নাহ রে পাগলী । এটা যাস্ট একটা সেম্পল হবে ।
– ওহ ,

ইরফানের মুখ থেকে পাগলী শব্দটা বেলীর বুকে গিয়ে লাগে । তাকিয়ে আছে মানুষটার দিকে বেলী ।

– মানুষটাকে কত শান্ত লাগে দেখতে । কিন্তু কে বলবে এই মানুষটার হাতে কারণে অকারণে মা’র খেতে হয় আমার । আমার মনের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ভালোবাসাটা সে কখনো দেখবে না । নাহ কখনো জানতে চাইবে আমি কি চাই ? রুবিকে আপুকে মানুষটা খুব ভালোবাসে , তাহলে আমাকে কি একটু ভালোবাসতে পারে না সে ? বিয়ের পর থেকে অপমান , অবহেলা আর মারধর জুটে এসেছে এই পোড়া কপালটায় আমার । আমার জনম দুঃখি মা’টা ভাবে আমি স্বামীর ঘরে রানী হয়ে আছি । অথচ আমার মা তো আর জানে না আমার জীবনের এই ৭ টা মাস কিভাবে কাটছে ।

এইসব ভাবতে ভাবতে অজান্তেই চোখের পানি এসে যায় । মুখ মুছার ছলে চোখের পানি গুলো মুছে নেয় বেলী ।

– সেম্পল হলে তো বানাইতে হবে ।
– হ্যাঁ ,
– তাহলে নিবেন কিভাবে ?
– কাল অফিসের গাড়ি আসবে ,
– ওহ ,
– কাল যদি প্রেজেন্টেশন টা ভালো হয় , তাহলে প্রমোশন টা পাক্কা ।
– আলহামদুলিল্লাহ হয়ে যাবে ।
– কিভাবে সিউর হলি ?
– মন বললো , হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ ।

ইরফান একবার বেলীর মুখের দিকে চেয়ে আছে । বেলীর মুখটা আসলেই মায়ায় ভরা । উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের হলেও দেখতে মাশা-আল্লাহ । মনে মনে এখন আফসোস হয় ইরফানের । যদি তখন সে একটু বাস্তবিকতার সাথে ভাবতো তাহলে আজ হয়তো বেলী একাই তার ঘরে থাকতো । কিন্তু ভালোবাসা নামক পোকার কামড়ে সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেছে । বেলী ফোম গুলো হাত দিয়ে ধরতে চাচ্ছে , কিন্তু ইরফানের ভয়ে ধরতে পারছে না । তাই অনুমতি নিতেই ইরফানের দিকে তাকায় সে ।

– এইগুলা একটু ধরি ?
– ধর ,

ফোম গুলো হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করে নেয় ।

– আমি না ক্লাস টেনে থাকতে একটা বাড়ি বানাইছিলাম । ওই যে গার্হস্থ্য অর্থনীতির ব্যবহারিক পরীক্ষার সময় ।
– ওহ ,
– আমি সাহায্য করি ?
– তুই পারবি না তো , এটা অন্য রকম ।
– কি রকম ,

ইরফান ল্যাপটপ থেকে একটা ঘরের ছবি দেখিয়ে বলে ,

– এই রকম বানাতে হবে ।
– আপনি পারবেন ?
– হ্যাঁ , পারবো তো ।
– আমিও পারবো , বানাই ?

বেলীর কন্ঠস্বরটা ছোট । চিকন স্বরে কথা বলে সে । আবদার গুলো দেখলে যে কারো চোখে পানি আসার মত । ইরফান কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে বেলীর দিকে । তারপর হ্যাঁ বলে দেয় । রাজ্য জয় করা হাসি দিয়ে ফোম গুলোতে গ্লু লাগাতে থাকে বেলী । ইরফানও সাহায্য করছিল বেলীকে ।
প্রায় দেড় ঘন্টা বেলী বাড়ি টা বানিয়ে ফেলে । একদম হুবুহু ল্যাপটপে থাকা ছবিটার মত । হস্তশিল্পে বেলীর হাত পাকা , কারণ বেলীর বাবা একজন কাঠমিস্ত্রি ছিলেন ।

– বাড়ি তো হয়ে গেলো , নাম কি দিবি এই বাড়ির ?
– ‘ স্বপ্ননীড় ‘

অজান্তেই কথাটা মুখ থেকে বেরিয়ে যায় বেলীর । ইরফান চুপ করেই তাকিয়ে থাকে বেলীর দিকে । পরে বেলী কথা কাটিয়ে নেয় ।

– মা,,,,মা,,, মানে , নাম যে কোন একটা দিয়ে দিয়েন ।
– ‘ স্বপ্ননীড় ‘ নাম টাই থাকবে ।
– ঘুমিয়ে যাইয়েন , আসছি

এই বলে বেলী উঠে যেতে নেয় ,

– বেলী শুন ,
– জ্বি ,
– কাল যদি প্রজেক্টটা হয়ে যায় , তাহলে কি চাই তোর ?
– কিছুই না ।
– বল , কি চাই তোর ?
– যদি চাই , দিবেন ?
– হ্যাঁ ,

ইরফান জানে বেলী বেশি দামি কিছু চাইবে না তাই নির্দ্বিধায় বলে ফেলছে হ্যাঁ ।
বেলীও তার ইচ্ছামত তার চাওয়া গুলো ব্যক্ত করে ।

– আপনি যখন আমাকে মারবেন আমি কাঁদবো না , একদম কাঁদবো না , শুধু ছাড়তে বলবেন না , সহ্য করতে পারবো না । আসছি , ঘুমিয়ে যাইয়েন ।

এই কথা বলে সেইখান থেকে চলে যায় বেলী । ইরফান একদম স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে বেলীর চলে যাওয়ার দিকে ।

[ বিঃদ্রঃ হয়তো এই হয় কিছু নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে । যারা বিয়েকে অনেক সম্মান এবং স্বামীকে অনেক শ্রদ্ধা করে । তারা মা’র খেতে প্রস্তুত থাকে তবে সংসার ছাড়তে রাজি নয় । বর্তমান যুগের মেয়েরা আমরা ভাবি করলাম না স্বামীর ঘর খেলাম না স্বামীর ভাত , নিজে কামাই করে খাবো । আসলে বলা যতটা সহজ একজন মেয়ের পক্ষে করা ততটাই কঠিন । তবুও আজকের যুগে মেয়েরা পিছিয়ে নেই । কারণ আমাদের ঘুরে দাড়াতেই হয় এবং হবে । সব কথার শেষ কথা , আমরা নারী……… দিনশেষে আমরাই বিজয়ী ]

.
.

চলবে……………….

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_৫

0

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_৫
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

রান্নাঘর থেকে পানি নিয়ে আসে মিনু । ইরফান তখনও দাঁড়িয়ে আছে সেখানে । মিনু গরম পানি রেখে দরজার কাছে এসে দাঁড়ায় ।

– ভাই আপনে যান ফ্রেশ হইয়া নেন , আমি ভাবীর গা ডা মুইছা দিয়া খাবার দিমু নে ।
– ওর কি বেশি খারাপ লাগে ? তাহলে ডক্টর খবর দেই ।
– নাহ থাউক , ডাক্তারে জিগাইলে কি কইবেন আপনে ? যে বউরে ফিডাইছেন । মানুষ জানাইয়া কি লাভ ভাই । আমিই ভাবীরে মালিশ কইরা দিমু নে । আপনে যান এইখান থাইকা ।

মিনু দরজা বন্ধ করে দেয় । ইরফান মাথা নিচু করে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে । নিজের রুমের দিকে পা বাড়াতেই বেলীর রুম থেকে আর্তনাদ ভেসে আসে ।

– ও মাগো ,,,,,,
– ভাবী বেশি ব্যাথা করে ?
– মিনু ডইলো না , আর পানি দিও না জ্বলে ।
– ভাবী রক্ত গুলি মুইছা দেই ।
– ও মাগো,,,,,,,, মিনু আস্তে ,
– আইচ্ছা ভাবী ।
– আহহহ , ও মাগো,,,,,,
– ভাবী এত মাইর কেমনে সহ্য করেন আপনে , ব্যাথা ফাওয়ার ফরেও এমনে খিট্টা থাহেন কেমনে আপনে ?

ইরফান আর দাঁড়ায় নি সেইখানে । সোজা রুমে চলে আসে । এসে কিছুক্ষণ পায়চারি করে , আর তারপর কি যেন ভেবে দেয়ালের মধ্যে জোরে নিজের হাত দিয়ে একটা ঘুষি মারে ইরফান । এতটা নির্দয় সে কবে থেকে হয়েছে তাও শুধু বেলীর সাথে , কেন ? কিছুক্ষণ পর ওয়াসরুমে যায় ইরফান । শার্টের বোতাম গুলো খুলে শার্টটা খুলতে যাবে ওমনি শার্টে লেগে থাকা ছোট একটা জিনিসে নজর যায় ইরফানের । ছোট আর চিকুন একটা কানের বাউচি । বাউচিটা হাতে নেয় ইরফান । কিছুক্ষণ ভাবার মনে পড়ে তার বেলীর কানে সেইদিন এমন দুল দেখেছিল সে । বেলী যখন রাতে পানি খেতে আসছিল । তার মানে আজকে মারার সময় হাত পা ছুড়তে গিয়ে বাউচির হুক খুলে গিয়ে তার শার্টের মধ্যে আটকে যায়
। ভাবতেই চোখ বন্ধ করে নেয় ইরফান , এতটাই নির্দয়ের মত মেরেছে সে বেলীকে , কে জানে কানের কোন ক্ষতি হয়েছে কিনা ।
শাওয়ার নিয়ে রুমে আসে ইরফান । ক্ষুধাও লাগছে ভিষণ তার । কিন্তু বেলী কি খাবার দিবে টেবিলে ? তার কিছুক্ষণ পরই মিনু এসে ডাক দেয় ,

– ভাই আছেন নি ?
– হ্যাঁ মিনু আয় ,
– ভাই খাবার দিছি , আসেন
– যা আসছি

মোবাইলটা চার্জে দিয়ে ইরফান খেতে যায় । টেবিলে সব খাবার সাজানো কিন্তু তবুও কেন জানি ইরফানের ভালো লাগছে না । মিনু টেবিলটা সাজিয়েছে ঠিকই কিন্তু বেলীর মত না ।

– মিনু ,
– জ্বে ,
– ভাতের বোল টা এইদিকে দে ,
– নেন ভাই ,
– জুঠা ফালানোর প্লেট কই ?
– দেই নাই ?
– কই আর দিলি ,
– আনতাছি

মিনুকে বলে বলে সব করায় ইরফান । এক প্রকার বিরক্ত হয়ে গেছে সে । এইভাবে বলে বলে করানো যায় নাকি ? বেলী হলে সব করে রাখতো । মনে মনে ভাবছে আর খাচ্ছে ইরফান ।

– তোরা খাবি না ,
– ভাবী ঘুমাইয়া গেছে আমি আর খামু না ।
– ওহ ,

ইরফান কয়েক লোকমা খেয়ে খাবার টেবিল থেকে উঠে যায় । অন্যান্য দিন তৃপ্তি নিয়ে খায় সে কিন্তু আজ তার খাবার মনে হয়েছে গলা দিয়েই নামছে না । তাই দ্রুতই উঠে যায় সে । মিনু সব গুছিয়ে নিয়ে বেলীর রুমে চলে যায় ।
রাত প্রায় ৪ টার বেশি বাজে , ইরফানের চোখে ঘুম নেই । বার বার বেলীর মুখটা ভেসে আসছে তার চোখের সামনে কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো রুবি যে চলে গেছে তাতে তার কোন মাথা ব্যাথাই ছিল না । সে এপাশ ওপাশ করছে কিন্তু তার ঘুম আসছে না । টেবিলের উপরে থাকা বেলীর কানের ছোট দুলটা নজরে যায় তার । দুলটার দিকে তাকিয়ে আছে সে পলকহীন চোখে । কিছুই বুঝতে পারছে না সে , কেন এতটা অত্যাচার করে সে বেলীর উপরে । আর বেলীই বা কেন মা’র খেয়েও পড়ে আছে তার কাছে । চারদিকে আজানের শব্দ শুনা যাচ্ছিলো তখন । ইরফান বুঝে যায় পুরো একটা নির্ঘুম রাত পার করলো সে । ফজর নামাজের আজান পড়ে গেছে , নিশ্চয়ই বেলী এখন উঠবে । কারণ এর আগেও একদিন সে দেখছে বেলী ফজর নামাজ আদায় করার কোরআন শরীফ পড়ে । ইরফান বিছানা থেকে নেমে স্যান্ডেল জোড়া পরে নিয়ে রুম থেকে বাহিরে যায় ।
বেলীর রুমের দরজা খোলা । অন্যান্য দিন তো দরজা আটকানো থাকে আজ খোলা কেন , আর আজ বেলী উঠে নাই ? প্রশ্ন গুলো কৌতুহল জাগায় ইরফানের মনে । পরে ভাবে এই কাজ মিনুর । মিনু অনেক ভুলভাল কাজ করে থাকে , হয়তো দরজা দিতে ভুলে গেছে মেয়েটা । ইরফান বেলীর রুমের দরজার সামনে আসে , নিচে মিনু কাথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে আর খাটের উপরে বেলী এপাশ ফিরে গালে হাত দিয়ে ঘুমাচ্ছে । ড্রীম লাইটের আলোতে সব কিছুই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে । প্রায় ৫ টা বাজে আজ বেলী উঠে নাই কেন নামাজ পড়তে ? প্রশ্নটা বার বার মনে খচ খচ করছিলো ইরফানের । আগের বারও তো মা’র খেয়েও নামাজ পড়তো তাহলে আজ কেন পড়লো না । ভাবতে ভাবতে নিজের রুমে যায় ইরফান । চুপ করে শুয়ে শুয়ে বেলী কেন নামাজ পড়তে উঠলো ন সেই কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখ লেগে গেছে বলতেই পারেনি ইরফান ।

সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নেয় ইরফান । অফিসে তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে হবে তাকে । প্রজেক্ট নিয়ে সারাক্ষণই ব্যস্ত সে । তার উপর , উপরমহল থেকেও অনেক চাপ আসছে তার । কিন্তু নাস্তা কি পাবে সে ? বেলী যদি নাস্তা না দেয় ? এইসব ভাবতে ভাবতে ডাইনিং টেবিলের কাছে যায় সে । অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে টেবিলের দিকে ইরফান । আগের মত করে সব সাজানো আছে টেবিলে , ঠিক যেমন বেলী সাজায় তেমনটাই আছে । রান্নাঘরের দিকে হাক্লা উঁকি দেয় সে , দেখে সেখানে মিনু আর বেলী দাঁড়িয়ে আছে । সেই আগের মত মাথায় ওড়নাটা দুই পেচ করে পরা । পরোটা , ডিম ভাজি , গাজর আর আলুর মিক্সড ভাজি , জুস সহ সব কিছু দেয়া আছে টেবিলে । ইরফান মোবাইলটার ঘড় দেখে টেবিলে বসে পড়ে । মিনুর হাত দিয়ে চা পাঠিয়ে দেয় বেলী তবুও নিজে সামনে যায়নি ।

– ভাই আপনের চা ।
– রাখ ,

মিনু দিয়ে চলে আসে । ইরফান আরও একবার রান্নাঘরের দিকে তাকায় । দেখে বেলী ওইদিকে মুখ করে রান্না করতেছে । ইরফান আর কিছু না বলেই খেয়ে চলে যায় । ইরফান চলে গেলে বেলীও সব কাজ শেষ করে বিছানায় এসে শুয়ে যায় ।
অন্যদিকে , অফিসে বসের কাছে ইচ্ছামত ঝাড়ি খেয়েছে ইরফান । হাউজ বিল্ডিংয়ের প্রজেক্টটা অনেক জরুরী । আর এর সাথে জড়িয়ে আছে ইরফানের প্রমোশন । বাসায় এত সমস্যার কারণে বেচারা কাজ ঠিক মত করতে পারেনি বলে বস ঝেড়েছে । বসের কেবিন থেকে এসে নিজের কেবিনে বসে পড়ে ইরফান । এমন সময় হঠাৎ আননোন নাম্বার থেকে ফোন আসে । ইরফান ফোন রিসিভ করার পর একজন ভদ্রমহিলার কন্ঠস্বর শুনা যায় ।

– হেলো ,,,,,,
– হ্যালো কে বলছেন ?
– বাজান আমি , বেলীর মায় কইতাছিলাম ।

এই সময়ে বেলীর মাকে একদম আশা করেনি সে । কিন্তু এই সময়ে হঠাৎ বেলীর মায়ের ফোন । তবুও কথা বলে ইরফান ।

– জ্বি বলুন ,
– কেমন আছো বাজান ?
– জ্বি ভালো , আপনি ?
– ভালা আছি , বাজান বেলীফুলে কই , একটু কতা কইতাম ।
– আমি তো অফিসে , ও বাসায় ।
– আসলে কাইলকা দুফুরে মাইয়াডায় একটা নাম্বারের তন ফোন দিছিলো , জিগাইলাম কার মোবাইল কইলো দোহানের মোবাইল । বাজান ওরে একটা মোবাইল দিতা , আমার লগে একটু কতা কইতো । মন ডা আনচান আনচান করে মাইয়াডারে কত দিন হইছে দেহি না ।

বেলীর মায়ের এমন কথায় হতভম্ব হয়ে যায় ইরফান ।।

– তার মানে কাল দুপুরে বেলী তার মায়ের সাথেও কথা বলেছিল । আর আমি রুবির কথায় এইভাবে বেলীকে………. [ মনে মনে ]

– হেলো বাজান ,
– জ্বি বলুন , নাম্বার পেলেন কোথায় আমার ?
– তোমার আব্বার কাছ থেকে নিছিলাম ।
– আচ্ছা আমি বাসায় গিয়ে বেলীর মাখে কথা বলিয়ে দিবো আপনাকে ।
– আইচ্ছা বাজান আইচ্ছা , তাইলে রাহি এহন ?
– জ্বি ভালো থাকুন ।
– তোমরাও ভালা থাহো ।

এইবলে ইরফান লাইনটা কেটে দেয় । অফিসের কাজে মন দেয় । অন্যদিকে একা ঘরে বেলী কঁকিয়ে মরছে । ব্যাথায় আর যন্ত্রণার চোটে কাঁদছে মেয়েটা । বাসাতে একটা মোবাইলও নেই যে ইরফানকে ফোন দিবে মিনু ।
রাত ৮ টার পর ইরফান বাসায় আসে । মিনু দরজা খুলে দেয় । ইরফান মিনুর মুখের দিকে তাকায় , মিনু মুখটা গম্ভীর করে আছে । তাই নিজ থেকেই প্রশ্ন করে ,

– মিনু বেলী কোথায় ?
– শুইয়া আছে , আপনে ফেরেস হোন ভাই , কফি আনতাছি । আর আইজ্জা আমি বানামু , খারাপ অইলে বইকেন না ।

এইটা বলে মিনু রান্নাঘরে চলে যায় । ইরফান দরজা লাগিয়ে বেলীর রুমের দিকে যায় । খাটের মধ্যে উপুর হয়ে শুয়ে আছে মেয়েটা । এক পায়ের সেলোয়ার উপরে উঠা , গায়ে ওড়না নেই । ইরফান যখন অফিস থেকে বাসায় আসে ওই সময় বেলী নামাজে থাকে । ইরফান প্রায় সময়ই দেখেছে কিন্তু আজ বেলী নামাজও পড়ছে না এইভাবে শুয়ে আছে , কারণ টা উপলব্ধি করে পারেনি ইরফান ।
নিজের রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে নেয় ইরফান । এর মাঝে আজ সারাদিনেও রুবির খবর নেয় নি সে । আর রুবিও নেয় নি ।
কফি নিয়ে রুমে আসে মিনু ।

– ভাই আপনের কফি ,
– দে ,
– ভাই এইডা ভাবী আপনেরে দিতে কইছে ।
– আর কইছে আজকেই লাগবো , আপনেরে আরও আগেই কইতো কিন্তু মোবাইল নাই কি দিয়া কইবো ।
– কিসের কাগজ এটা ?
– আমি জানি না ভাই , আপনে আইনা ভাবীরে দিয়া আইসেন ।
– আচ্ছা যা তুই ।

মিনু গেলে ইরফান কাগজের ভাজটা খুলে । ভাজে একটা জিনিসের নাম উল্লেখ ছিল , আর এক পাতা ‘এলজিন’ ট্যাবলেটের নাম লিখা ছিল । ইরফান এখন বুঝেছে বেলীর নামাজ না পড়ার কারণ । বেলীর মা গ্রাম্য হলে কি হবে মেয়েকে সব ধরনের ভালো জিনিস দেয়ার চেষ্টা করেছেন সব সময় । বেলীর হাতের লিখায় মুগ্ধ ইরফান । হাতের লিখাটা অনেক সুন্দর ছিল । ইরফান আর দেরী করেনি সোজা নিচে নেমে হাটা শুরু করে । মোড়ের মাথার সামনে ফার্মেসি আছে সেখানেই যায় ইরফান । প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো কিনে সাথে একটা হট ওয়াটার ব্যাগও কিনে নেয় । যত তাড়াতাড়ি হাটা যায় হেটে বাসায় পৌঁছায় ইরফান । মিনু তখন নাটক দেখে টিভিতে । ইরফান সোজা বেলীর রুমে ঢুকে যায় । বেলী তখন ওপাশ ফিরে আছে । কয়েকবার ডাকে বেলীকে ইরফান । সাড়া দেয়নি বেলী , হয়তো লজ্জায় তাকাতে পারেনি । ইরফান ততটাও বোকা নয় বুঝে যায় সবটা সে । তাই নিজে নিজেই বলা শুরু করে ।

– এখানে ওইটার থেকেও ভালোটা আছে । আর এলজিন তিন পাতা আছে দিন দুইটা করে খেলেই হবে । হটব্যাগটা দিয়ে ছ্যাক দিলে ব্যাথা কমে যাবে হয়তো । আর আজ রাতে খাওয়া দাওয়া করবো না আমি , কিছু বাড়তে হবে না আমার জন্যে ।

এইটা বলে ইরফান রুম থেকে বেরিয়ে যায় । ইরফান বের হলে বেলী তাড়াতাড়ি উঠে ওয়াসরুমে যায় । ইরফান রুমে এসে একটা কথাই ভাবতে থাকে , বেলী এতটা চাপা স্বভাবের কেন ? হয়তো ওর মাঝে এমন কিছু দেখেছিল তার বাবা দেখেছিলেন যার জন্যে বেলীকে তার সাথে বেঁধে দিয়েছে ।
কিন্তু ঝোকের বসে কিছু ভুল পদক্ষেপও অনেক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় ।

অনেক রাতে টিভির আওয়াজে রুম থেকে বের হয় ইরফান । ইরফান তখন ল্যাপটপে কাজ করছিল । ড্রইং রুমে টিভি চলতেছে । মিনু সেখাই সোফার মধ্যে টিভি চালিয়ে ঘুমিয়ে গেছে । রুবি না থাকলে মিনু এ বাড়িতে ভালোই স্বাধীনভাবে চলতে পারে । ইচ্ছামত টিভি দেখা আর যা মন চায় খেতে পারে । বেলী কিছুই বলে না আর না বলে ইরফান । টিভি অফ করে সামনে পা বাড়াতেই দেখে বেলীর রুম থেকে আওয়াজ আসতেছে । ইরফান একটু এগিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে বেলী নিচে বসে উপুর হয়ে আছে । দুই হাত দিয়ে পেটে চাপ দিয়ে ধরে কাঁদছে বেলী । ব্যাথাটা হয়তো অনেক বেড়ে গেছে । আজ মিনুও ড্রইং রুমে ঘুমাচ্ছে । যন্ত্রনার চোটে নিচে এসে পড়ে আছে মেয়েটা । ইরফান প্রথমে দেখে ভয় পেয়ে যায় । ওই মুহুর্তে ইরফান কি করবে না করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না সে । ধীর পায়ে এগিয়ে যায় সে বেলীর দিকে । বেলী তখনও ফ্লোরে মুখ গুজে আছে আর ব্যাথার চোটে কাঁদছে । ইরফান বেলীর পিঠে হাত রাখার পর পরই বেলী ফ্লোরে মুখ গুজেই বলা শুরু করে ,

– মিনু আমাকে ধরো , আমার আর সহ্য হচ্ছে না । আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মিনু । অনেক ব্যাথা করছে ।

কথাটা ইরফানের বুকে গিয়ে লাগে । বেলী ভেবেছে হয়তো তার কান্নার শব্দ শুনে মিনু উঠে আসছে । বেলী কেঁদেই যাচ্ছে তল পেটে হাত দিয়ে । পরক্ষনেই ইরফানের মনে পড়ে যায় কাল রাতে মাইরের সময় এলোপাথাড়ি লাথি দিয়েছিল , লাথি গুলো পেটে পড়ে নাই তো আবার । ইরফান আর দিক বিক না ভেবে বেলীকে কোলে তুলে নেয় । এইভাবে হঠাৎ কারো কোলে চড়ে বেয়াক্কেল হয়ে যায় বেলী । ইরফানের দিকে তাকিয়ে আছে বেলী । ইরফানও বেলীর দিকে তাকিয়ে আছে । চোখ মুখ ফুলে একাকার বেলীর । বিছানায় শোয়ানোর পরেও বেলী চাপা স্বরে ‘ ও মাগো ‘ বলে পেটে চেপে ধরে । ইরফান বেলীর কাধে হাত দিয়ে ,

– একটু সহ্য করো , আমি আসতেছি ।

ব্যাথার ঘোরেও ইরফানের মুখ থেকে বেরিয়ে আসা ‘ তুমি ‘ শব্দটা বেলীর কানে জোরেই গিয়ে লাগে । তখনও বেলীর চোখ বেয়ে পানি পড়ছে । কিছুক্ষন পর , ইরফান হট ওয়াটার ব্যাগে করে গরম পানি আনে । এনে বেলীর তল পেটে দিতে চায় । কিন্তু বেলী হাত সরায় নি । তাই ইরফানই জোর করে হাত সরিয়ে নিয়ে গরম পানির ছ্যাক দিয়ে দিচ্ছে । প্রায় অনেক্ষণ যাবত ছ্যাক দিয়ে দেয়ার পর ব্যাথাটা অনেকটাই দমে যায় বেলীর । তবে নিরবে কাঁদছে সে । এই প্রথম ইরফান তার একটু হলেও সেবা করেছে ।

– ব্যাথা কমছে ?
– …………
– কি হলো ব্যাথা কমে নাই ?
– কমছে ,
– ট্যাবলেট খাবা ?
– তুই টাই ঠিক আছে , অভ্যাস হয়ে গেছে শুনতে শুনতে ।

ইরফান এই কথাটা শুনে উঠে যাওয়া নেয় , তখনই বেলী কিছু বলে ,

– শুনেন ,,,,,,,?
– হু ,
– আমি যদি মরে যাই , আপনি কি খুব ভালো থাকবেন ?
-…………
– বলেন না , আমি যদি মরে যাই আপনি ভালো থাকবেন তো ? বিশ্বাস করেন এত মা’র আর নিতে পারি না । আর পারি না নিতে । তার থেকে বরং মেরেই ফেলেন । আমি মরে গেলে আমার লাশটা আমার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েন । বিশ্বাস করেন আমার পুরো শরীরটা ব্যাথা হয়ে গেছে । আর পারি না ব্যাথা সহ্য করতে ।

ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে কেঁদে কথা গুলো এক নাগারে বলে দেয় বেলী । আর ইরফানের চোখ থেকে কেন জানি হঠাৎ করেই দুই দন্ড পানি বেয়ে পড়ে যায় ।
ইরফান আর এক মুহুর্তও দাঁড়ায়নি সেখানে । সোজা বেরিয়ে নিজের রুমে চলে যায় । আর বেলী তখন কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে যায় ।

[ বিঃদ্রঃ আজকের ব্যাথাটা কেন ছিল সেটা হয়তো সবাই উপলব্ধি করতে পেরেছেন বিশেষ করে মেয়েরা । মান্থলি অসুস্থতার সাথে প্রত্যেক মাসে সবাই লড়াই করে আসছি আমরা । এই অসুস্থতায় যার ব্যাথা হয় সেই আসলে বুঝে ব্যাথা কি জিনিস । এতটাই ব্যাথা অনুভব হয় যে এক এক সময় মনে হয় যেন নিজের শরীরের মাংস নিজে কামড়ে নেয় । এই যন্ত্রণাটা এতটাই কষ্টের হয় যে পুরো শরীরটাকে কুচকে দেয় । নারীজাতিকে আল্লাহ পাক এমন যন্ত্রণা দিয়েই তৈরি করেছেন যাতে নারী জাতির জন্যে পুরুষদের মনে একটু হলেও সম্মান আসে । কিন্তু আমাদের সমাজে এমন অনেক পুরুষ আছেন যারা নারীদের সম্মান কি করবে তাদের সম্মান নিতেই ব্যস্ত যার বাস্তব উদাহরণ গুলো প্রায় প্রতিদিনই আমরা টিভির হেডলাইনে দেখে থাকি । আবার কিছু কিছু পুরুষ আছেন যারা নিজেদের থেকেও নারীজাতিকে সব সময় সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে যাচ্ছেন । যেমন এক পুরুষ এস এস সি পাশ করেও বউকে মাস্টার্স অবদি পড়িয়েছেন এখন সেই বউ সরকারি হাই স্কুলের শিক্ষিকা । দুটি সন্তান নিয়ে সুখের সংসার তাদের । আবার কিছু কিছু পুরুষ আছেন যারা ইরফানের মতও হয়ে থাকেন যারা বউ পিটিয়ে আবার সেই বউয়ের সেবা করতেও দ্বিধা করেন না । এই কথা গুলোর অর্থ হচ্ছে আমাদের সমাজে সব ধরনের নারী এবং পুরুষ আছেন । ভালো খারাপ উভয় মিলেই তো জীবন । তাই না ? আমার কথা গুলো হয়তো কিছু কিছু ভাইয়াদের মনে কষ্ট দিবে । তার জন্যে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত । কিন্তু কষ্টের হলেও এটাই সত্যি । ]

.
.

চলবে…………….

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_৪

0

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_৪
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

ইদানীং অফিসে কাজের এত প্রেশার বেড়েছে যে বেচারা ইরফান এর রাত দিন এক করে কাজ করা লাগে । হাউজ বিল্ডিং এর প্রজেক্ট টা নিয়ে আজকে একটা সপ্তাহ ইরফান দৌড়াদৌড়ির মাঝে আছে । অন্যদিকে রুবি উরাধুরা টাকা উড়াচ্ছে ।
সন্ধ্যায় বাসায় এসে চেঁচামেচি শুরু করে ইরফান । বহুত মেজাজ খারাপ তার । বাসায় এসে সরাসরি রুবির উপরে রাগারাগি করা শুরু করে সে । বেলী আজ নিজের ঘরেই আছে । ওযু করে এসে জায়নামাজে দাঁড়িয়েছে মাত্র । এশার নামাজ পড়বে বলে । আর ওই রুমে চিল্লাপাল্লা চলছে ।

– রুবি তুমি টাকা তুলছো ?
– কিসের টাকা ?
– কিসের টাকা মানে ? আমার এ.টি.এম কার্ড দিয়ে টাকা তুলো নাই তুমি ? পুরো ২৫ হাজার টাকা উইড্রো করা হয়েছে আজকে ।
– কি জানি আমি তো তুলি নি ?
– কার্ড কোথায় ?
– ড্রয়ারেই তো আছে ।
– টাকা তুলবে কে তাহলে ।

রুবি কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলা শুরু করে ,

– আমি যখন ওয়াসরুমে ঢুকেছিলাম বেলী রুমে আসছিল । পরে দেখলাম বেলী বাহিরে গেছে , তারপর আমি ঘুমিয়ে গেছি , তাহলে এর মিনিং কি দাঁড়ায় ইরফান ?
– তার মানে বেলী ??
– হতেই পারে , অসম্ভবের কিছু না ।
– কিন্তু ও পিন নাম্বার জানবে কিভাবে ?
– আরে আজব তো , আমরা তো কতবারই জোরে জোরে বলেছি ।
– এত দিন সুযোগ পায় নি আজ কাজে লাগিয়ে ফেলছে ।

রুবি জানতো ইরফানের মেজাজ খারাপ থাকলে সে সব কথা বিনা বাছবিচার না করেই হুটহাট সিদ্ধান্তে উপনীত হয় । তাই সে শুকনো পাতায় আগুনের চিঙ্গাড়ি দিয়েছে মাত্র । আর আগুন দাউ দাউ করে জ্বলা শুরু হয়ে গেছে । ইরফান টাই টা খুলে সোজা বেলীর রুমে যায় । বেলী তখন রুকু ছেড়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র ওমনি বেলীকে টেনে নিয়ে সামনে দাড় করায় ।

– আমার রুমে গেছিলি আজকে ?
– হু , ঝাড়ু দিতে ,
– বাহিরে গেছিলি কেন ?
– এমনি গেছিলাম ।
– এমনি , এমনি গেছস তুই ?
– হু

হু বলার সাথে সাথে বেলীর গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে দেয় ইরফান । বেলী থাপ্পড়টা খেয়ে মাটিতে পড়ে যায় । ইরফান এইবার এলোপাথাড়ি শুলার ঝাড়ু দিয়ে ইচ্ছামত বারি দিচ্ছে বেলীকে । বেলী বুঝতেই পারছে না কোন অপরাধের জন্যে তাকে মারা হচ্ছে । মাগো মাগো করে চাপা স্বরে আর্তনাদ করছে মেয়েটা ।

– তোর সাহস হয় কিভাবে ?
– মাগো ,
– চুপ একদম চুপ , তুই কোন সাহসে আমার এ.টি.এম কার্ডে হাত দিছস ।
– আমি জানি না কিছু , কসম আল্লাহর আমি জানি না কিছু ।
– টাকা তুলে কি করছিস বল , বল টাকা কাকে দিছিস ।
– কিসের টাকা , এইসব কি বলেন ?
– চুপ খবরদার মিথ্যা বলবি না । একদম মেরে ফেলে রাখবো । তোকে আমিই তো সব কিনে এনে দিলাম তুই কোন সাহসে আমার রুমে ঢুকলি । চোর কোথাকার , যেই ঘরে খাস ওই ঘরেই চুরি করস ।
– খোদার কসম আমি এইসব করি নাই আপনি শুনেন , আমি কিছুই করি নাই ।
– আজকে তোকে মেরেই ফেলবো আমি , মেরেই ফেলবো ।

এই বলে এলোপাথাড়ি লাথি শুরু করে দেই ইরফান । ধাক্কা দেয়ায় খাটের কোণা গিয়ে মাথায় লাগে বেলীর । হাল্কা ফেটে রক্তও বেরিয়ে আসে কপাল থেকে । শলার ঝাড়ু দিয়ে মারাতে হাতে আর গলার নিচে কয়েকটা শলা ভেঙে ঢুকে যায় । বেলী তখন চোখে মুখে অন্ধকার দেখছে ।
সেই সময়ই মিনু দৌড়ে আসে । ইরফানের মারার মাঝে দিয়েই বেলীকে জড়িয়ে ধরে মিনু ।

– ভাই কি করতাছেন , ভাই থামেন থামেন ।
– ওই তুই সর , সর রখান থেকে । আজকে ও-কে মেরেই ফেলবো ।
– কেন ভাবী কিয়াচ্ছে ?
– চুরি করছে , আমার খেয়ে আমার পরে আমার ঘরেই চুরি করে ওয় ।
– ভাই এইসব কি কন আপনে ?
– সর তুই , না হয় তোকেও বের করে দিব বাসা থেকে ।
– ভাই থামেন আগে । আর আমার থাকার ইচ্ছাও নাই ।
– ওয় চোর , আমার রুম থেকে চুরি করছে , এত টাকা দিয়ে করছে কি ওয় ?
– ভাই আপনে এইসব কি কন , ভাবী টাকা পাইবো কই থাইকা ?
– এ.টি.এম কার্ড দিয়ে ২৫ হাজার টাকা তুলছে ।
– আপনের মাতায় সমিস্যা ?
– এক থাপ্পড়ে গালের দাত ফালিয়ে দিবো বেয়াদব । কাজের মেয়ে কাজের মেয়ের মত থাক ।
– ভাই আমি কামের মাইয়া আমি জানি , আপনে তো তার থাইকাও খারাপ ।
– মিনু,,,,,,,,?

অনেক তর্কবিতর্ক করে মিনু ইরফানের সাথে । তারপর মিনু অনেক রেগে যায় । বেলী ফ্লোরেই শুয়ে আছে ।

– বেলী ভাবীরে ছোট ভাবী ডাইকা ঘরে নিয়া পা টিপাইছে । পরে ভাবী আইসা পরছে । পরে ঘর ঝাড়ু দিতে গেছিলো । আমিই বেলী ভাবীরে নিয়া বাহিরে গেছিলাম , বেশি দূরে যাই নাই । তাও ভাবী বাসার নিচেই ছিল আমি গিয়ে ভাবীর জামা কাপড় গুলা আনছি টেইলার্সের দোকান থাইকা । হেরফরে ছোট ভাবী বাহিরে গেছে গা ফিরছে সন্ধ্যার আগে দিয়া । আসার সময় হাতে অনেকডি ব্যাগ আছিলো । এইবার তারে গিয়া জিগান সে মিছা কতা কিলিগা কইছে বেলী ভাবীর নামে । হেতিও তো বেলী ভাবীরে অনেক গালমন্দ করে থাপ্পড় মারে তখন কিছু দেহেন নি আপনে । হেতির কতায় আইয়া নির্দোষ মাইয়াডারে এমনে ফিডাইলেন । যাইয়া দেহেন ছোট ভাবী ঘরে বইয়া বইয়া তার মায়েরে এইসব কয় আর হাসে । হুনেন ভাই৷, আমি রত খাইটা খাই আমার কামের অভাব পড়তো না তয় আল্লাহ একজন আছে উপরে । এইডা মনে রাইখেন ।

মিনুর কথা গুলো শুনে ইরফানের পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায় । এইসব কি বললো মিনু । এত দ্রুত এতগুলা কথা কিভাবে বলে দিলো মিনু । ইরফান ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে । ওই দিক মুখ করে পরে আছে বেলী । মিনু মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে আর নিরবে কাঁদছে । এতটা নির্মম ভাবে কেউ কাউকে মারতে পারে তা জানা ছিল না মিনুর ।
ইরফান নিজের রুমের দরজার কাছে যায় । রুবি তখন রিলেক্স মুডে ম্যাগাজিন পড়ছে । রুবির ধারণা ইরফান হয়তো আজ বেলীকে জনমকার মা’র মারছে । রুবি অনেক খুশি এতে । ইরফান রুমের মধ্যে এসে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে রুবির দিকে । রুবির মুখে দারুণ খুশির ছাপ ।
এখন ইরফান বলা শুরু করে ।

– তুমি যে এত ভালো মিথ্যা বলতে পারো জানা ছিল না তো ।

ইরফানের কথা চোখ বড় করে তাকায় রুবি । ইরফানের মুখ থেকে এমন কথা আশা করেনি সে ।

– মানে ?
– টাকা খরচ করলা তুমি , নাম দিলা বেলীর , কেন ?
– কি সব বলো উলটাপালটা , কার্ড তো বেলী নিয়েছে ।
– তুমি বাসা থেকে বের হও নাই ?
– একদমই না ।
– তুমি কি আমাকে আর কত হিপোক্রিয়েট বানিয়ে রাখতে চাও ?
– দেখো ইরফান অতিরিক্ত কথা আমার পছন্দ না ।
– দুপুরে বাসা থেকে বের হলে তুমি , ফূর্তি করলা তুমি , শপিং করলা তুমি , আর আমাকে একটা বানোয়াট গল্প শুনিয়েছো যে বেলী টাকা উইড্রো করছে ।
– আমার নামে কান ভারী করে ওই মেয়ে , ওর সাহস কত বড় ? আজ ওর খবর করে ছাড়বো আমি ।
– খবরদার রুবি , খবরদার ওই রুমে যাবা না । ব্লাডি মিথ্যাবাদী , ওই বেচারি তো মা’র খেয়ে চুপ করে পড়ে আছে মাটিতে তবুও তোমার নামে একটা কথাও বলেনি , আর তুমি রুবি তো খুব ভালো করেই বেলীকে আমি সহ্য করতে পারি না তাই তুমি ইচ্ছা করে ও-কে আমার হাতে মাইর খাওয়াও , তাই না রুবি ।
– স্যাট আপ , স্যাট আপ ইউ ফুল !

ইরফানের আর সহ্য হয়নি । রুবিকে খাট থেকে নামিয়ে ঠাটিয়ে এক চড় বসিয়ে দেয় ।

– বেয়াদব , অনেক সহ্য করেছি । আর না , আমার টাকা পয়সা গুলো তুষের মত উড়িয়ে আরেকজনের ঘাড়ে দোষ চাপাও , কেমন মেয়ে মানুষ তুমি ।
– তুমি আমার গায়ে হাত তুললা ?
– হ্যাঁ তুললাম , তুললাম আমি হাত । কি করবা এখন ? তোমাকে তো একটা চড় দিয়েছি মাত্র আর তোমার কান কথা শুনে আমি গর্দভ যে ইচ্ছামত দিনের পর দিন বেলীকে টর্চার করেছি তার বেলায় কিছু না , তাই না ?
– মিষ্টার ইরফান আহমেদ তোমাকে যদি আমি জেলের ভাত না খাওয়াইছি আমি এক বাপের মেয়ে না ।
– তোমার মত মেয়ে মানুষ এর থেকে কি আর করতে পারে । যাও তোমার ধনী বাপের কাছে গিয়ে নালিশ করো আর আমার নামের বিচারসভার আয়োজন করো । যাও ,
– অবশ্যই যাবো , তোমার আর ওই থার্ড ক্লাস মেয়ের রাতের ঘুম যদি আমি না হারাম করি আমার নাম রুবি না ।

[ বিঃদ্রঃ আমাদের সমাজে এমন অনেক মেয়েই আছে যারা এইভাবে স্বামীর আয়ের উৎস গুলো এইভাবেই শেষ করে । নিজেদের ইগো আর নিজেদের গাম্ভীর্য্যতা বজায় রাখার জন্যে স্বামীর কি আছে না আছে তা না দেখেই টাকা পয়সা উড়াতে থাকে । এইসব নারীদের জন্যেই কিছু কিছু পরিবার ধ্বংস হয়ে যায় । সতীন যে সতীনের শুত্রু হয় উক্ত বাক্যটি একদম মিথ্যা নয় । এইভাবেই কান ভারী করে এক বউ অন্য বউকে তার স্বামীর চোখের বালি বানিয়ে দেয় । আর স্বামীরা যদি হয় ইরফান টাইপ তাহলে এইভাবেই মা’র খেতে হয় হাজারো বেলীকে । আজকের পর্বে উল্লেখিত বিষয় দুটো বাস্তবসম্মত । একদম নিজ চোখে দেখা , তাই গল্পের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলতে একটু চেষ্টা করলাম মাত্র ]

এইসব বলে রুবি বাসা থেকে বের হয়ে যায় । রাত প্রায় ১০ টা ৩০ বাজে । এত রাতে একা একা বের হয়ে যায় রুবি । গন্তব্যস্থল বাপের বাড়ি । আজ এই প্রথম ইরফান তার কথা আমলে নেয় নি , উল্টো তাকে চড় মেরেছে । এইটা তার সহ্য হয় নি । ইরফান অনেক বদমেজাজি ছেলে । তার অল্পতেই মেজাজ বিগড়ে যায় । খাটের উপরে বসে পড়ে ইরফান । মাথা পুরো হ্যাং হয়ে আছে তার । সেলারি যা পায় তার বেশি অর্ধেকটাই রুবি খরচ করে । সেভিংস হতে হতেও হয় না । আজ এক সাথে ২৫ হাজার টাকা তোলায় তার মাথা গরম হয়ে গেছে । হুট করেই বেলীর কথা মনে পড়ে । সেইদিন রাতে বলেছিল গা হাত পা ব্যাথা করে তার কিন্তু আজ এলোপাথাড়ি লাথি গুলো মেরেছে ইরফান । তার জানা নেই মেয়েটা কি অবস্থায় আছে এখন । অফিস থেকে এসে চেঞ্জও করে নি সে । স্থির হরে বসে থাকতে না পেরে বেলীর রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় । মিনু তখন হাত পা টিপে দিচ্ছিলো বেলীর আর কাঁদছে ।

– ভাবী , ও ভাবী
-…………
– ভাবী গো , কতা কন না কা ? ও ভাবী
-…………
– ভাবী এইদিকে ফিরেন শলার মাতাডি বাইর কইরা দেই , ছাই এইদিকে ফিরেন ভাবী ।
-…………

মিনু ঘুরিয়ে দেয় বেলীকে । উল্টাপাল্টা লাথি দেয়ায় পুরো শরীর নিথর হয়ে আছে বেলীর । হয়তো শরীরের যন্ত্রণার জন্যেই চুপ করে চোখ বন্ধ করে আছে বেলী । মিনু হু হু করে দেয় আবারও ।

– কেমন কইরা ফিডাইলো ? আরে শলাডি কেমনে ঢুইক্কা গেছে । ভাবী ও ভাবী …..
-…………

পরে মিনু আস্তে আস্তে করে হাত আর গলা থেকে শলার মাথা গুলো বের করে দেয় । বের করার সময় ব্যাথায় কঁকিয়ে উঠে বেলী । ইরফান তখনও দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল । বেলীর কঁকিয়ে উঠার আওয়াজে পর্দার কাপড় গুলো মুষ্ঠিবদ্ধ করে নেয় ইরফান৷। মেয়েটা কতটা কষ্টে আর ব্যাথার পরে এইভাবে আর্তনাদ করে উঠতে পারে । ইরফান যে ততটা মনুষ্যবিহীন পুরুষ সে এখন উপলব্ধি করতে পারছে ।
মিনু গরম পানি আনতে যাবে বলে দরজার কাছে যায় । তখনই ইরফানকে দেখে ।

– এমনে কেউ কাউরে ফিডায় নি ভাই , ভাবী কাউরে কিছুই কয় না , ঘরের একটা কোণার মইধ্যে ফইড়া থাহে , হেরফরেও এমনে ফিডান তারে । মইরা গেলে একদিন বুঝবেন ভাই । দেইখেন আমি কইলাম তো বুঝবেন একদিন আপনে ।

এইটা বলে মিনু রান্নাঘরে চলে যায় । আর ইরফান দরজা থেকেই বেলীর দিকে তাকিয়ে আছে । হাতের কয়েক জায়গা থেকে ফোটা ফোটা রক্ত , কপালটাও ফুলে রক্তগুলোও শুকিয়ে আছে । বেলী তখনও চুপ করে দম খিটে শুয়ে আছে ।

.
.

চলবে………………….

[ আসসালামুয়ালাইকুম , প্রথমেই সরি জানাচ্ছি দেরি করে দেয়ার জন্যে । আসলে ব্যস্ত ছিলাম । টিউশন সেরে এক ঘন্টার মাঝে লিখে পোস্ট করলাম । ভুল হলে ক্ষমা করবেন সবাই । সরি ,,,,, ]

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_৩

0

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_৩
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

রাতে ইরফান বাসায় এসে দেখে রুবি বাসায় নেই । এমনিতেই অফিসে প্রেজেন্টেশনের চাপ ছিল । তার উপর বাসায় এসে দেখে বউ নাই মেজাজ আরও গরম হয়ে গেছে । এক কাপ কফির জন্য বেলীকে প্রায় ৫/১০ বার ডেকেছে ইরফান । বেলীও সাড়া দেয় নাই । মেজাজ আরও খারাপ হয়ে যায় ইরফানের । বাসায় পরা রাবারের স্লিপারটা হাতে নিয়ে বেলীর রুমের দিকে যায় সে । আজকে বেলীকে জুতোপেটা করবে ইরফান । মিনু তখন ড্রইং রুমে বসে স্টার জলসায় ‘ কে আপন কে পর ‘ সিরিয়াল দেখছিল । মিনু আবার স্টার জলসা , জি-বাংলা বলতে অজ্ঞান । টিভিতে এইসব দেখে আর সিরিয়ালের ভিলেনদের ইচ্ছামত গালমন্দ করে সে ।
ওদিকে স্যান্ডেলটা নিয়ে রুমের সামনে গিয়ে দেখে দরজাটা আটানো , পুরোপুরি লক না । ইরফান বাহিরে দেখেই বকাবকি করতেছে ,

– নবাবজাদি দরজা দিয়ে আরাম করতেছে আজকে ওর আরাম ছুটাবো আমি , এত ডাকার পরেও সাড়া দেয় নি ।

ইরফান দরজাটা জোরে ধাক্কা মেরে খুলে দেয় । ‘ বেলী ‘ বলে রুমে ঢুকেই দেখে বেলী জায়নামাজে সিজদাহে আছে । ওড়নাটা দুই পেচ দিয়ে পুরো হাত ঢেকে নামাজ পড়তেছে বেলী । ইরফান পুরো থ হয়ে যায় । সে কাকে জুতা দিয়ে মারবে । ইরফান হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকায় , ৮ টা বাজে তার মানে এখন এশা নামাজের ওয়াক্ত । বুঝতে পারে যে বেলী নামাজে থাকার জন্য সাড়া দিতে পারে নি । জুতা টা আস্তে করে হাত থেকে নামিয়ে নেয় ইরফান । রুম থেকে বেরিয়ে ইরফান মিনুর কাছে যায় । মিনু তখন সিরিয়াল দেখছে আর একা একা বক বক করছে ।

– কেমন অসিভ্য মাতারি , জবারে কেমনে কথা শুনায় । আহারে জবা মাইয়াডা কামের মানুষ দেইখা কি হইছে হেয় তো এহন এই বাড়ির বউ , এই বৌদি না ফৌদি এই মাতারি ডা আসলেই খারাপ ।

এরই মাঝে ইরফান ডেকে বসে মিনুকে ,

– এই মিনু ?
– জ্বে , কিছু কইবেন ভাই ?
– এক কাপ কফি করে দে তো , আর সারাদিন এইগুলি কি দেখস ?
– কে আপন কে পর , মাতারি ডা অনেক খারাপ ভাই , জবারে দেখতে ফারে না । জবা ছেমড়ি ডার কফাল আমাগো বেলী ভাবীর মত

এটা বলেই জিহবায় কামড় দেয় মিনু । টিভি অফ করে দিয়ে তাড়াতাড়ি পাশ কাটিয়ে যেতে নিলে ইরফান আটকায় তাকে ।

– রুবি কখন বের হইছে বাসা থেকে ?
– ছোড ভাবী বিকালে বের হইছে ।
– ওহ ,
– বেলী ভাবী কই ভাই ,
– ঘরে তুই থাকস , তুই জানস না । সারাক্ষণ টিভি আর সিরিয়াল নিয়ে থাকলে জানবি কিভাবে । বেলী নামাজ পড়ে ।
– আইচ্ছা আমি বানাইয়া দিতাছি

মিনু যেতেই নেয় ওমনি ইরফানের হাতের জুতাটা দেখে ফেলে । মিনুও সব বুঝে যায় । জুতাটা কি কাজে ব্যবহার করতো ইরফান তাও জানে মিনু ।

– ভাই জুতা নিছেন কিত্তে , বেলী ভাবীরে বাইরাইবেন নাহি ?
– তুই তোর কাজ কর , যা । আমি ফ্রেশ হতে যাই , কফিটা রুমে রেখে আসিস ।
– আইচ্ছা ।

ইরফান রুমে এসে টাওয়াল নিয়ে ওয়াসরুমে ঢুকে যায় । প্রায় ১০ মিনিট পরে কফির মগ হাতে বেলী রুমে ঢুকে ।
কফিটা মিনু-ই বানাতো , কিন্তু বেলী নামাজ শেষ করেই রান্নাঘরের দিকে যায় সে ।

– মিনু তোমার ভাই আসছে ?
– হ , হেই কোন সময়ই তো আইছে ।
– রুমে গেছিলো , আমি নামাজের মাঝে ছিলাম তাই উত্তর দিতে পারি নি ।
– হাতের জুতাডাও দেহেন নাই ?
– মানে ,
– মানে সেতের ছোড বউ বাহিরে গেছে আপনেরে আইসা ডাকছে আপনি সাড়া দেন নাই তাই জুতা নিয়া গেছিলো বাইরাইতে ।
– ওহ ,
– হুদা ওহ কইলেন ।
– কি আর করবো , এইসব তো পানি ভাত আমার কাছে । তুমি কি করো ?
– কইলো কপি বানাইয়া দিয়া আইতাম ।
– আচ্ছা যাও , তুমি নাটক দেখো আমিই বানিয়ে নিয়ে যাচ্ছি ।
– আইচ্ছা ।

তখন বেলীই কফি বানিয়ে নিয়ে যায় । সারা রুমে জায়গায় জায়গায় রুবি আর তার বরের ছবির ফ্রেম । দেয়ালে টাঙানো , বিছানার পাশে থাকা টেবিলে রাখা , সবত্র জায়গাতেই তাদের ছবি টাঙানো । নিজের বরের পাশে সতীনের ছবি । বুকের ভেতর আগুন জ্বললেও ঠোঁটে হাসি টা অবিচল । ভালোবাসার মাত্রা বেশি না হলেও অল্প তো আছে । সেখানেই জ্বালাটা বেশি ।
এরই মাঝে ইরফান ওয়াসরুম থেকে বের হয়ে যায় । আর দেখে বেলী দাঁড়িয়ে আছে হাতে কফির মগ ।

– কিরে তুই ?
– আপনার কফি ,
– রাখ টেবিলে ,
– হু ,

বেলী চলে যেতে নিলে ইরফান বলে ওঠে ,

– আজকে অফিসে অনেক চাপ ছিল , তোর জামার কাপড়ের কথা একেবারেই ভুলে গেছি । কাল আনবো ,
– আচ্ছা ,

রাত প্রায় ১০ টায় রুবি বাসায় আসে । কিছু শপিং ব্যাগ সাথে তার । ইরফানকে রুমে দেখে বলে ,

– কখন এলে ?
– দুই ঘন্টা হবে ,
– ওহ ,
– এত রাত করে ফিরলা ।
– ফিরতেই পারি , বন্ধুদের সাথে ঘুরলাম , খেলাম , শপিং করলাম ।
– ওহ ,
– একটা নেকলেস কিনেছি ।
– ভালো করেছো ।
– তুমি খেয়েছো ?
– নাহ , তোমার জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম ।
– ওহ তাহলে খেয়ে নেও , আমি খেয়ে আসছি ।
– ভালো করেছো ।
– আমি ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়বো , ওকে ?
– হুম ।

রুবি ওয়াসরুমে ঢুকে যাওয়ার পরে ইরফান ডাইনিং রুমে যায় । বেলী টেবিল সাজাচ্ছিল সেখানে ।

– প্লেট একটা দে , আরেকটা সরা ।
– রুবি আপু খাবেন না ?
– নাহ খেয়ে আসছে ও ।
– জ্বি আচ্ছা ,

খেতে বসে যায় ইরফান । বেলী ভাত বেড়ে দুই রকমের ভাজি , মুরগীর ঝোল সব সামনে এগিয়ে দেয় । ভাতে হাত দিয়ে বেলীর দিকে তাকায় সে । পাশে দাঁড়িয়ে টুকিটাকি নাড়াচাড়া করছিল সে । বেলীর হাত গুলো ইদানীং কাঁপে ।

– তুই খাইছিস ?
– পরে খাবো নে ,
– কোন পরে খাবি ?
– আপনি খেয়ে যান , আমি আর মিনু খেয়ে নিবো নে ।

আর কিছুই বলে নি ইরফান । চুপচাপ খেয়ে চলে যায় সে । রুমে গিয়ে দরজা আটকে দেয় ইরফান ।

পরদিন সন্ধ্যার পর ইরফান বাসায় এসে আগে বেলীর রুমে যায় । বেলী তখন কোরআন শরীফে ইয়াসিন সূরা পাঠ করছিলো । ইরফান রুমে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বেলী বলে ডাক দেয় । ইরফানের ডাকে এদিক ফিরে চায় সে । কোরআন শরীফ বন্ধ করে মোনাজাত দিয়ে উঠে যায় বেলী ।

– কিছু বলবেন ?
– এই নে তোর কাপড় ,
– আচ্ছা ।
– সাথে স্নো আর তেলও রাখা আছে ।
– শুধু জামার কাপড় চাইছিলাম এত কিছু আনলেন যে ?
– বানাবি কোথায় এইগুলি ?
– মিনুর কাছে দিয়ে দিবো , ও সেলাই করে আনবে ।
– আচ্ছা তাহলে এই টাকাটা রাখ , সেলাইয়ের টাকা দিয়ে দিস ।
– পরে চেয়ে নিবো নে ।
– রাখ এখন , পরে না-ও থাকতে পারে ।

টাকাটা দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে যায় ইরফান । রুবি তখন পা এর উপর পা তুলে ম্যাগাজিন পড়ছে । ইরফানকে দেখেই শুরু করে ।

– ইদানীং কি ভালোবাসা বেড়ে গেছে নাকি ?
– মানে ?
– বাসায় এসেই বড় বউয়ের ঘরে ঢুকে গেলে , তাই বলছিলাম আর কি ।
– ওর জন্যে কয়টা জামার কাপড় এনেছিলাম , ওইগুলাই দিতে গেছি ।
– বাহ বাহ , আবার জামার কাপড়ও আনো নাকি ।
– এত কথা কেন বলতেছো রুবি ।
– কি এত কথা বললাম , তুমি কেন যাবা ওই ঘরে হ্যাঁ কেন যাবা ।
– রুবি এই পুরা বাসাটাই আমার , ওকে ?
– তো ? তাই বলে তুমি ওই শালীর রুমে যাবা ?
– রুবি , বড্ড বেশি করতেছো কিন্তু ?

রুবির প্রচন্ড পরিমাণ মেজাজ খারাপ লাগে । তার কথা হচ্ছে বেলীকে কিছুই দেয়া যাবে না । ইনফ্যাক্ট সে একেবারেই বেলীকে বের করে দিতে চায় । রুবি বুঝতে পেরে গেছে কোথাও না কোথাও ইরফানের মনে বেলীর জন্যে মায়া দয়া আছে । আর যেটা তার একদম পছন্দ না । ইরফান যখন বেলীকে মারধর করে সেটা দারুণ ভাবে এঞ্জয় করে রুবি । আর সে এমন কিছু কিছু কর্মকান্ড করে যার পুরো দায়ভার গিয়ে পরে বেলীর উপরে । বেচারি সাদা-সিধে মেয়েটাও বোবা হয়ে থাকে তখন ।

[ বিঃদ্রঃ আমাদের সমাজে এমন কিছু নারী আছে , যারা নিজেরা মেয়ে হওয়ার পরেও অন্য মেয়ের ঘর নষ্ট করে । এক বউ আরেক বউয়ের নামে উষ্কানিমূলক কথা বলে স্বামীর কান ভারী করে তুলে । এক সতীন অন্য সতীনের ছায়াও মারায় না । এমনকি ছেলে মেয়েদের মাঝেও হিংসার বীজ বপণ করে দেয় । বহু বিবাহ , কিংবা পরকীয়া নারী অথবা পুরুষ এইসব ঘটে যাওয়া ঘটনা গুলো আমাদের সমাজে অহরহ ঘটছে । আমরা একটু চিন্তা করলে দেখবো আমাদের আশেপাশেও এইসব মানুষের অভাব নেই , যেখানে নারীরাই নারীদের শত্রু । যেখানে নারীরাই অন্য নারীর সম্ভ্রম লুণ্ঠনের চেষ্টায় মত্ত্ব । আমার ব্যাক্তিগত মতামত একজন পুরুষ দ্বারা নারী ধর্ষিত হয় শরীরে , কিন্তু একজন নারী দ্বারাও আরেকজন নারী ধর্ষিত হয় তা হচ্ছে মনে । যে ছেলেটা বিবাহিত জেনেও আপনি হাত বাড়িয়ে দিচ্ছেন একবারও কি ভেবেছেন তার একটা বউ আছে অথবা সে হতেও পারে সন্তানের বাবা । একজন মা যখন বাচ্চার টিউশন টিচারের সাথে পালিয়ে যায় তখন কি সেই মায়ের মনে তার সন্তানগুলোর মুখ ভেসে ওঠে না , তার মনে কি এটা আসে না যে আমার স্বামী বহু কষ্টে থেকে আমাদের শখ আহ্লাদ গুলো পূরণ করে । একজন পুরুষ ঘরে স্ত্রী রেখেও বাহিরে মেয়েদের সাথে লেপ্টে থাকে তার কি ঘরে থাকা স্ত্রীকে মনে পড়ে না যে আমার বউটা তো আমার অপেক্ষাতেই আছে । কাউকে উদ্দেশ্য কিংবা ছোট করার উদ্দেশ্যে বলি নি , বাস্তবতা তুলে ধরেছি মাত্র । আর এই গল্পটা এই ধারাবাহিকতা মেনেই এগুবে । নিজের দেখা কিছু ঘটনাকেও এড করা হচ্ছে এই গল্পে । আমার দ্বারা কারো মনে আঘাত হলে অথবা আমি নিজের অজান্তে কারো মনে কষ্ট দিয়ে থাকলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী ]

রাত প্রায় আড়াইটা । বেলীর ঘুম টা ভেঙে যায় । শরীরটা অনেক ব্যাথা তার । মারধরের ব্যাথা গুলো ইদানীং রাত হলেই বাড়ে তার । নিচে মিনু ঘুমায় । আর খাটে বেলী । খাট বলতে শুধুই খাট যাতে একটা তোশক আর সস্তা বিছানার চাদর , একই স্বামীর স্ত্রী হয়ে সে পায় অবহেলা অপর স্ত্রী পায় সুখ । রুবির খাটে দামী মেট্রিক্স , বেড শীট , কোন কিছুর অভাব নেই । আর বেলীর ঘরে তেমন কিছুই নেই । শরীরের ব্যাথায় উঠে বসে বেলী । গলাটা শুকিয়ে গেছে তার , একটু পানি খেলে ভালো লাগতো সাথে একটা নাপা ট্যাবলেট , খেলে যদি ব্যাথাটা কমে । আস্তে আস্তে খাট থেকে নেমে ওষুধের পাতা থেকে ওষুধ নিয়ে দরজা খুলে ডাইনিং রুমের দিকে যায় সে । পুরো বাসাটাই অন্ধকার । তেমন কিছুই দেখতে পাচ্ছে না বেলী । তাও হাতড়ে হাতড়ে এগিয়ে গেছে টেবিলের সামনে । ওয়ালে হাত রেখে রান্নাঘরের লাইট জ্বালায় বেলী । রান্নাঘরের লাইট অন করে সামনে তাকাতেই বেলী আৎকে উঠে ।

– ও মা গোওওও , কেহ ওইদিকে ?

আসলে ইরফান তখন লেপটপে অফিসের কাজ করছিলো । ড্রইং রুমে সোফায় বসে আরামসে কাজ করছিলো ইরফান । এইভাবে হঠাৎ আলো দেখায় ভয় পেয়ে যায় বেলী । আর তাছাড়া এমনিতেও বেলীর আত্মা ছোট । অল্পতেই ভয় পায় সে । বেলীর হাল্কা চিৎকারে ইরফান তাকায় ওর দিকে । লেপটপ রেখে ডাইনিং রুমের দিকে আসতে আসতে বেলীকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে ,

– ওই চিৎকার দেস কেন ?
– আপনি এত রাতে এইখানে কি করেন ?
– তুই কি করস ?
– একটু অয়ানি খাইতে আসছিলাম ।
– ওহ , আমি কাজ করতেছিলাম । এত ঘামছিস কেন তুই ?
– এমনিতেই ।

ইরফান দেখে বেলী তার ওড়নাটা বুকের মাঝে ভাজ করে সুন্দর করেই পরে আছে । রাতে শোয়াতে চুল খুলে শুইছে । তাই সেই চুল খোলা অবস্থাতেই আছে তবে এলোমেলো । ইরফান চুলের দিকে নজর দিলে দেখে বেলীর হাটু অবদি চুল । ইরফান যখন বেলীর চুল দেখছিলো তখন চুল পিঠ অবদি ছিল এত বড় হয়েছে স্র দেখেও নি । কারণ বেলী দিনের বেলায় মাথায় ওড়না দুই পেচ দিয়ে রাখে । আর ওইদিন মারার সময় বেলীর চুল খোপা করা ছিল । তাই খেয়াল করে নি । ইরফান দেখছে বেলীর জগ থেকে পানি ঢালতেও লেট করছে কারণ ওর হাত গুলো কাঁপছে , কালও দেখছিল তার হাত কাঁপছে ।

– ভালো করে ঢাল , পানি পড়বে তো ?
– হু

বেলী ততটাও ফর্সা না । আবার একেবারে কালো না উজ্জ্বল শ্যামলা রঙের অধিকারীনি সে । ইরফান বেলীর ঘাড়ে নজর করে । সেইদিনের বেল্টের বারির দাগ কালো হয়ে আছে তার ঘাড়ে , মুখটাও শুকনা তবে গালের দাগ গুলো ঝাপসা হয়ে গেছে । ইরফানের সামনে পানি খায় বেলী আর ট্যাবলেটটাও ।

– কিসের ওষুধ খেলি ।
– গা হাত পা ব্যাথা করতেছিল , তাই নাপা খাইলাম ।
– ওহ , সেইদিনের মা’র টা বেশিই হয়ে গেছিল । মাথা গরম হয়ে গেলে কিছুই ঠিক থাকে না আমার ।
– আমাকে মেরে হাত সুখ পেলে ক্ষতি কি ?
– এত মা’র খেয়ে পড়ে থাকিস কেন ?
– যাওয়ার জায়গা আছে ?
– ডির্ভোস দিতে চাইতেছি , তাতেও রাজি হোস না কেন ? ডির্ভোস মানে কি বুঝোস ?
– রুবি আপুর মত ইংলিশে অনার্স না করলেও পেটে বিদ্যা আছে টুকিটাকি । ডির্ভোস মানে তালাক এতটুকু বুঝি । কিন্তু আমি চাই না আপনি আমাকে ডির্ভোস দেন । আমি প্রয়োজনে বাসায় কাজ করেই খাবো । আপনার বাসায় তো কাজের লোকও লাগবে আমিই তো আছি কাজের লোক হিসাবে তবুও ডির্ভোস দিয়েন না আর আমিও সাইন করবো না ।

বেলীর আজকের কথা গুলো শুনে অনেকটাই অবাক ইরফান । যেই বেলী চুপচাপ পড়ে থাকতো সেই বেলী এমন কথা বলবে ভাবে নি সে । ইরফান আবারও বলা শুরু করে ,

– রোজকার অশান্তি একদম ভালো লাগে না আমার । তাহলে তুই গ্রামে চলে যা ।
– গ্রামে গেলে আব্বা কষ্ট পাবে । আর আমি তো অশান্তি করি না ।
– তুই করস না ঠিক আছে , কিন্তু রুবি করে । আর ভালো লাগে না আমার ।
– রুবি আপু কিছু বললে আমাকে এসে মেরে যাইয়েন । জানেন তো , পাগলেও নিজের ভালো বুঝে । আর স্বামীর ভাগ পাগলেও দেয় না , একবার ভেবে দেখেন তো আপনার হাতে কয়েক দফা মা’র খেয়ে তার উপর আপনাকে রুবি আপুকে দিয়ে দিছি আমি কেমন পাগল । আমি নিজেকে পাগল ভাবি না । কারণ আগেই বলছি পাগলেও স্বামীর ভাগ কাউকে দেয় না । তাহলে আমি পাগল না আমি হলাম বদ্ধ উন্মাদ । ঘুমাই পড়েন ,

আজ ইরফান বেলীর কথায় একদম স্তব্ধ হয়ে যায় । বেলী আজ প্রথমবার এত গুলো কথা বলেছে ইরফানকে । আসলে দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে পিঠও তখন কথা বলতে শেখে । বেলী হেটে যাচ্ছিলো তখনই আটকায় ইরফান ।

– শুন ,
– হু
– তোর কি শরীর বেশি খারাপ ?
– নাহ আমি ভালোই আছি ।
– শরীর খারাপ থাকলে বল , আমি ডক্টরকে বলে ওষুধ এনে দিবো ।
– আমরা গরীব মানুষ , পিডা-ই আমাদের ওষুধ । আপনে মারা ব্যাতিত আমার রুমে হুটহাট ঢুকিয়েন না । রুবি আপুর যা অপছন্দের হয় তা করিয়েন না ।

বেলী রুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেয় । বেলীর নাক মুখ অনেকটাই ফুলা দেখাচ্ছিল । সোফায় বসে দুই হাত মাথায় দিয়ে নিচু হয়ে ভাবছে ইরফান । কি করবে সে ? কেউই জানে না যে সে দুই বিয়ে করেছে । দুই জায়গায় দুই রকম । কামরাঙ্গীরচরে সবাই জানে রহমান আলীর ছেলে তার বাবার কথায় এক গরীব মেয়ে বেলীকে বিয়ে করেছে । আর অন্যদিকে ঢাকায় সবাই জানে ইরফান আহমেদ বিয়ে করেছে তবে তার বউ প্রভাবশালী এক ধনী লোকের মেয়ে রুবি ইয়াসমিন । দুই জায়গায় দুই রকম পরিচয় তার । আবার বেলীর কথাও ভাবছে সে । এতটা মারধর না করলেও পারতো বেলীকে , আর বেলীও যেমন মা’র শুরু করলে চুপ করে মা’র সহ্য করে যতক্ষণ না মা’র শেষ হয় । কিন্তু কি করবে ইরফান , রুবি যেইভাবে কথা তাকে বলে তার রাগ উঠে যায় ।
ইরফানের অবস্থা এখন , দুই ফুল এক মালি টাইপ । আবার দুই নৌকায় পা দিয়ে চলার মত । অবশ্য এটাও ভুল । ইরফান একজনকে নিয়েই আছে সে হচ্ছে তার দ্বিতীয় স্ত্রী রুবি । তাহলে প্রথম স্ত্রী বেলীর অস্তিত্ব কি তার জীবনে ? প্রশ্ন হাজার কিন্তু উত্তর একটারও নেই , উত্তরের কাগজটা শূন্য পড়ে আছে ।

.
.

চলবে…………………..

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_২

0

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_২
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

রুমে শুয়ে শুয়ে আগের কথা ভাবছে বেলী । বাসর ঘরে সেদিন বসে ছিল সে । ইরফান রুমে তো এসেছিল ঠিক , কিন্তু সেখানের ঘটনা গুলো ঘটেছিল উল্টো । ইরফান এসে সোজা শুয়ে পড়ে । বেলী তখনও বসা খাটে । এরই মাঝে একটা ফোন আসলো ইরফানের মোবাইলে , ফোনটা হাতে নিয়ে বাহিরে চলে যায় সে । আর তারপর যখন রুমে আসে তখন হয়তো ইরফান না কোজ এক দানব রুমে ঢুকেছিল । ইরফান খাটের এপাশ ঘুরে হাতে ধরে টেনে নিচে ফেলে দেয় বেলীকে । অকথ্য বিশ্রী ভাষায় কথাও বলে । আর তার শেষ কথা টা ছিল ,

– তুই যদি এক বাপের জন্মের হয়ে থাকিস আমার আশেপাশেও ঘেষবি না ।

আর তারপর দিনই ইরফান চলে যায় । মুখ বুজে সব টা সহ্য করে নেয় বেলী । বিয়ের ঠিক ১ মাস পর ইরফান আবার বাড়ি আসে তাও রহমান আলীর কথায় । সেইবার রাতে বেলী ভুল করে ইরফানের গায়ে দুধ ঢেলে দেয় । আর তার শাস্তি বেশি কিছু ছিলো না , শুধু পায়ের থেকে জুতা খুলে জুতা দিয়ে মেরেছিল নিজের সদ্য বিয়ে করা বউটাকে ।
সেইবার একদিন থেকেই আবার চলে যায় ইরফান । আর তারপর লাস্ট আসে রহমান আলীর শরীর খারাপ হওয়ার পর । সেইবার আসার পরই রহমান সাহেব ইরফানকে বাধ্য করে বেলীকে নিয়ে ঢাকা থাকার । ইরফান শত না করার পরেও রহমান আলী কিছুই শুনেন নি এবং শুনতেও চান নি । জোর করেই বেলীকে ইরফানের সাথে ঢাকা পাঠিয়ে দেয় । আর যার ফল স্বরূপ আজ সে কুকুরের মত মা’র খায় ইরফানের কাছে ।

এইসব ভাবতে ভাবতে ঘুম চলে আসে বেলীর । শরীর ব্যাথা থাকা কারণে ঘুম চলে আসছে চোখে । মিনু ফাঁক দিয়ে একবার দেখে গেছে বেলীকে । মিনু মেয়েটা ইদানীং এক রকম আতংকে থাকে । ইরফান যেইভাবে মারে বেলীকে । কোন দিন জানি দেখে একেবারে মেরেই ফেলে । এই ভয়ে থাকে সারাদিন ।
বিকেলের শেষ দিকে ঘুম ভেঙে যায় বেলীর । ওযু করে নামাজ পড়ে রান্না ঘরে যায় সে । সন্ধ্যায় তারা আসলেই কফি চাইবে , বলার সাথে সাথে হাজির না করলে আবার মারবে । তাই আগে ভাগে সব করে রাখবে বেলী ।

মাগরিব নামাজের পর ইরফান আর রুবি বাসায় আসে । কলিংবেল বাজার সাথে সাথে মিনু গিয়ে দরজা খুলে । রুবি সোজা নিজের রুমে চলে যায় । ইরফান ড্রইং রুমে বসে । সোফায় বসে এ.সি টা ছেড়ে দেয় সে । এরই মাঝে বেলী কফি নিয়ে আসে । কফির মগটা ইরফানের হাতে তুলে দেয় বেলী । হাত বাড়িয়ে কফির মগটা নিতে গিয়ে বেলীর হাতে নজর পড়ে ইরফানের৷ বেল্টের বারির দাগ এখনও লাল হয়ে আছে । এটা দেখার পর একবার বেলীর মুখের দিকেও নজর দেয় ইরফান । মুখটা ফুলে একাকার হয়ে আছে । আজকে বোধ হয় মা’রের পরিমান টা বেশিই হয়ে গেছিলো । মুখে কিছুই বলে নি ইরফান । বেলী সেইখান থেকে চলে যেতে নিলে ইরফান ডেকে দেয় । ইরফানের ডাকে কলিজায় কামড় পড়ে বেলীর । বেলীর ধারণা আবার হয়তো মারবে । সেই এক জায়গায় ভয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মেয়েটা । আবার ডাকে ইরফান ,

– বেলী , শুন তো ?
– জ্বি ,
– রুবিকেও কফি দিয়ে আয় ।
– জ্বি আচ্ছা ,

বেলী রুবির রুমের সামনে গিয়ে দরজায় নক করে ।

– এই কে ?
– আপু আমি , বেলী ।
– কি চাই ?
– কফি দিতে আসছিলাম ,
– ভেতরে আয় ,

রুবিও কুকুর বেড়ালের মত ব্যবহার করে বেলীর সাথে । বয়সে এবং পড়ালেখায় অনেক এগিয়ে আছে রুবি । ইংলিশের উপর অনার্স কমপ্লিট করা , দেখতে শুনতেও খারাপ না , বাপের ভালো টাকা পয়সা যার কারণে মানুষকে মানুষ মনে করে না । আর বেলী , বেলী তো তার দু’চোখের বিষ । শুধু ইরফান তাকে আগে বিয়ে করার জন্যে সে প্রথম বউ আর রুবি দ্বিতীয় বউ । যদিও কয়েক দফা বলা হয়েছিলো বেলীকে ডির্ভোস দিতে , কিন্তু ইরফান চেয়েও দিতে পারে নি । কারণ গ্রামে তার বাবা রহমান আলী শুনলে তাকে হয়তো ত্যাজ্যপুত্র করে দিবে । এমনকি রহমান আলী এখনও জানে না যে ইরফান আরও একটা বিয়ে করেছে এখানে ।
রুমের মধ্যে গিয়ে বেলী কফির মগটা টেবিলের উপর রেখে চলে আসতে নিলে রুবি বেলীকে আটকে ধরে । বেলীর সামনে এসে বেলীর বাম গাল টা নিজের হাতে ধরে । আর তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বেলীকে বলে ,

– লজ্জা থাকলে আর কখনো আমার বেড টি দিতে দেরি করবি না । আজকের মা’রের কথা মনে থাকলে ।
– হু ,
– মনে থাকবে ? ঠিক সকাল ১০ টায় আমার বেড টি চাই আমার বিছানার পাশে ।
– থাকবে ,
– যাহ এখান থেকে ।

রুবি ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয় বেলীকে । চোখের পানি মুছতে মুছতে রান্না ঘরে ঢোকে বেলী । বেলীকে দেখে মিনু বুঝে যায় , কিছু একটা হয়েছে ।

– আবার কিছু কইছে ওই নবাবের বেটি ?
– মিনু আস্তে বলো বোন , শুনলে তোমাকে বের করে দিবে ।
– দেক বাহির কইরা , আমার কি আসে যায় , আমার কি আপনের মত কইলজা ছোড নি , তা কি কইছে সে ?
– কিছুই বলে নাই ।
– দেহি আমার দিকে তাকান তো ,

মিনু বেলীর মুখটা ধরে তার দিকে ঘোরায় । বেলীর মুখটা আসলেই অনেক মায়ায় ভরা । মিনু কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে , তারপর আবার বলে ,

– ভাইয়েরে ভালাবাসেন ?

মিনুর কথায় চোখ বড় করে তাকায় বেলী । মিনু এইসব কি বলে ? আসলে এইটাই যে বেলীর মনের কথা । কিন্তু মিনু বুঝে ফেললো কিভাবে ?

– মিনু কি সব বলো ?
– আপনে ভালাবাসেন ভাইয়েরে , এইজন্যেই তার এমন পিডা খান । ভাবী একটা কথা কই ?
– বলো ,
– আপনেরে মাইরাই ফেলাইবো ভাইয়ে । ভাবী এহনও সময় আছে , যান গা ।
– কই যাবো মিনু ? যাওয়ার মত কোন জায়গা আছে ? গ্রামে যাইতে পারবো না সেইদিকে তার বাবায় আছে । আর আমার মা ? তার কাছে থাকলেও মানুষে অনেক বাজে বাজে কথা বলবে ।
– শরীরডা তো আছে , রত তো আছে , কাম কইরা খাইবেন । তবুও আর মাইর খাইয়েন না ।
– কিন্তু আমি তাকেও ছাড়তে পারবো না ।
– কিহ , ধুর বেয়াক্কেল মাতারি , যান যান মরেন গিয়া , আমার কি ? আপনেরে মাইরা ফালাইয়া রাইখা যাইবো আর আমি গিয়া মলম লাগামু । হায়রে ভালাবাসা রে , ফিছা মারি এমন ভালাবাসার কফালে ।

মিনু রেগে মেগে বক বক করতে করতে কাজে মন দেয় । বেলী রুমে যায় , দরজা এটে দিয়ে ওড়নায় মুখ চেপে কেঁদে দেয় ।
বেলী সত্যিই নিরুপায় । কি করবে সে ? আবেগের কাছে সে বাঁধা । ভালোবাসে অনেক ইরফানকে , যদিও সে জানে ইরফান তাকে শুধুই তার বাসার বান্দি ভাবে , বউ সে কখনোই হতে পারবে না । তবুও কেন জানি বেলী ছাড়তে পারে না ইরফানকে ।

[ বিঃদ্রঃ সমাজে এখনও কিছু কিছু মেয়ে আছে যারা ভালোবাসা আর আবেগকে প্রাধান্য বেশি দেয় । যার জন্যে প্রতি বছর কম করে হলেও ৫০% স্ত্রীর মৃত্যু ঘটে স্বামীর হাতে । অনেকেই বলে , বিশেষ করে আমাদের মত মেয়েরা কিংবা আমি নিজেই বলি এমন স্বামীর কাছে না থাকলে কি হয় , কাজ করে খেলেই তো হয় , কিন্তু আসলে যার যার পরিস্থিতি সে সে বুঝে । কতটা অসহায় পরিস্থিতি হলে একটা মেয়েকে সতীন নিয়ে ঘর করতে হয় কিংবা স্বামী দ্বারা নির্যাতিত হতে হয় , আর মেয়েরাও অনেকটা হিংস্র যারা অন্যের সংসার এইভাবে নষ্ট করে । গল্পটা আমাদের সমাজের প্রাচীন এবং বর্তমান কিছু প্রেক্ষাপটে বানানো সাথে কিছু সত্যতা/বাস্তবতা এবং কিছুটা কাল্পনিকতার মিল রেখে লিখা হয়েছে । কারো জীবনের সাথে মিলে গেলে লেখিকার দোষ নেই ]

সকাল সকাল উঠে নাস্তা বানিয়ে টেবিলে সাজিয়ে রাখে বেলী । রোজ সকাল ৯ টায় অফিসে যায় ইরফান । এই ৭ মাসে ইরফান শুক্রবার ব্যাতিত সপ্তাহে ৬ দিনই একা নাস্তা করে । কারণ তার দ্বিতীয় স্ত্রী ঘুম থেকে উঠে সকাল ১০ টায় । তার পক্ষে সকাল সকাল উঠা ইম্পোসিবল ব্যাপার আর নাস্তা বানানো তো অসম্ভব ব্যাপার । এই ৭ মাসে সে একবারও রান্নাঘরে ঢুকে দেখেও নি রান্নাঘরের চেহারাটা কেমন ? ইরফান একাই ঘুম থেকে উঠে শাওয়ার নিয়ে রেডি হয়ে নাস্তা খেয়ে অফিসে চলে যায় । তার বাঁধা বান্দি বেলী তো আছেই , সেই সব করে দেয় ।
আজও ব্যাতিক্রম কিছু হয় নাই । বেলী সব সাজিয়ে রাখে , মিনু দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করছে রান্নাঘরে । ইরফান শার্টের হাতা ঠিক করে ব্লেজার হাতে নিয়ে নাস্তার টেবিলে বসে । ইরফান বলার আগেই তার সামনে সব হাজির করে রাখে । ইরফানের সকালবেলা দুধ চা না হলে চলেই না । আর বেলী চা + কফি দুইটাই ভালো বানায় , যদিও ইরফান কখনো প্রশংসা করেনি এইসবের । তবে সেও মানতে বাধ্য হয় যে হ্যাঁ বেলী চা টা ভালোই বানায় । নাস্তা করতে করতে এক হাত দিয়ে কলারের নিচের বোতামটা খুলতে গিয়ে একদম পুরো ছিড়েই ফেলে ইরফান ।

– ধুর , মেজাজটা কেমন লাগে এখন , তাড়াতাড়ির সময় দেরি হয়ে যায় ।

বেলী সাইডে দাঁড়িয়ে ছিল বিধায় দেখে সব । আর মিনু রান্নাঘর থেকে সবটাই খেয়াল করে । মুচকি হাসি দিয়ে ভেতরেই বক বক করে সে ।

– এক্কেবারে ভালা হইছে , হারামজাদা অসিভ্য বেডা । বিয়া একটা কইরা আবার আরেকটা করছে , বউডারে জানোয়ারের মত ফিডায় , এক্কেরে ভালা হইছে । এই বেডায় এক জানোয়ার আর এইডার ছোড বউডা আরও বদমাইশ ।

ইরফানের চৌদ্দ গুষ্টিকে তুঙ্গে তুলে দেয় মিনু । যদিও আস্তে আস্তে বলেই নিজের ক্ষোভ প্রকাশ করে মিনু । কারণ ইরফান বা রুবি কারো সামনেই এইস বলার ক্ষমতা নেই তার । তাই নিজে নিজেই বলে । এইদিকে বেলী ফ্লোর থেকে বোতামটা কুড়িয়ে হাতে নেয় । ইরফান একা একাই বলতে থাকে ।

– আজকে প্রেজেন্টেশন আর আজকেই এমন হতে হলো , ধুর

বেলী ইরফানের বিরক্ত হওয়া দেখে নিজেই বলে ওঠে ,

– আমি লাগিয়ে দেই ?
– এখন আবার শার্ট খুলতে হবে , লাগাতে গেলে শার্টের ইস্ত্রিটাও নষ্ট হয়ে যাবে ।
– আপনি নাস্তা খান , আমি সুই-সুতা নিয়ে আসি । শার্ট খুলতে হবে না , এমনিতেই লাগানো যাবে ।

ভেতর থেকে সবটাই শুনে নেয় মিনু । বেলীর উপর অতিরিক্ত মেজাজ খারাপ লাগছে তার ।

– এহহহহহ , হের এক্কেরে আদর বাইয়া বাইয়া পড়ে । এহন হের পেয়ারের ছোড বউরে উডাইয়া লাগাইতে ফারে না । শয়তান এইডা নামাজ কালাম তো ফড়েই না চিত্তায়া পইড়া ঘুমায় । অসিভ্য বেডি কোনহানের ।

এই বলে বোতামটা হাতে নিয়েই বেলী রুমে যায় সুই-সুতা আনতে । প্রায় ৫ মিনিট হয়ে যায় বেলীর আসার খবরও নেই । ইরফানের নাস্তা খাওয়াও শেষ হয়ে যায় । কিছুক্ষন বসে থেকে নিজের রুমে যায় ইরফান । রুবি তখনও ঘুমাচ্ছে । রুবিকে ডাকতে থাকে সে ।

– রুবি , এই রুবি,,,,,,?
-…….
– আরে এই রুবি , শুনছো ?
– কি হয়েছে ডাকো কেন ?
– শার্টের বোতামটা লাগিয়ে দেও না ।
– শার্টের কি অভাব পড়ছে ঘরে , আরেকটা পরে যাও ।
– কি সব বলো ঘুমের তালে , আজকে আমার প্রেজেন্টেশন । তাই তো এই শার্ট পরছি আমি ।
– ঘুমাইতে দিবা একটু , আমি তোমার বোতাম লাগানোর জন্যে ঘুম নষ্ট করবো নাকি , যাও সরো এখান থেকে । পারলে নিজে লাগিয়ে নাও ।

ধমক টমক দিয়ে আবার ঘুমিয়ে যায় রুবি । ইরফানের মেজাজ সেই লেভেলের চড়ে গেছে । ওর মন চাইছে রুবি এক লাথি মেরে খাট থেকে ফেলে দিতে । কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও উপায় নেই । একবার জোরে ধমক দিয়েছিল বলে রুবির বাবা ইচ্ছামত ঝেরেছিল ইরফানকে । বড়লোকের মেয়ের এই একটা সুবিধা , বাপের অঢেল টাকা পয়সা থাকলে জামাইকে পাত্তা দেয় না । এখানে রুবিও তেমনটাই । ইরফান নিজের রুম থেকে বেরিয়ে বেলীর রুমে যায় । গিয়ে দেখে বেলী তখনও সুচে সুতা গাঁথছে । ইরফান রুমের ভেতরে যায় ,

– তুই এখনও সুতা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস ?
– আসলে আমি ভুলেই গেছিলাম এইগুলা কোথায় রাখছি , খুজতে খুজতে এই মাত্রই পাইলাম , এখনি সেলাই করে দিচ্ছি ।
– তাড়াতাড়ি কর ।
– এই তো হয়ে গেছে , এখনি লাগিয়ে দিবো ।

এই বলে বেলী ইরফানের সামনে যায় । কাঁপা কাঁপা হাতে ইরফানের বুক অবদি উঠায় নিজের হাত জোড়া । যথাস্থানে বোতামটা রেখে সুই গাঁথে বেলী । ইরফান খেয়াল করছে বেলীর হাত প্রচন্ড কাঁপছে । ইরফান একবার বেলীর মুখের দিকেও তাকায় । বেলী সব সময় মাথায় ওড়না পরে থাকে । দুই পেচ দিয়ে চুল গুলো ঢেকে সে ওড়না পরে সব সময় । গালের দিকে নজর দিয়ে দেখে কালকের মা’রের দাগ গাঢ় হয়ে আছে ।

– তুই এইভাবে যে কাঁপছিস , কখন না জানি আমার বুকেই সুই গেঁথে দেস ।
– ভয় নাই আমি কারো বুকে মনে আঘাত করি না ।
– মুখে কিছু দেস না ? এমন কালসে হয়ে আছে কেন ? স্নো বা কিছু কি নাই ?

ইরফানের এমন কথায় বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো বেলীর । কান্না পাচ্ছিলো ভিষণ সেই মুহুর্তে , কিন্তু তবুও সে চুপ করে আছে । লাস্ট কবে স্নো মেখেছিল সেইটাও ভুলে গেছে সে । ইরফান সাইডে তাকিয়ে কোন স্নোর বক্স খুজে পায় নি । ওমনি তোতলাতে তোতলাতে বেলী কিছু বলে ,

– একটা কথা বলতাম ?
– বল ,
– আমার দুইটা জামা লাগতো ?
– কেন , জামা নাই ?
– বাড়ি থেকে যেইগুলা আনছিলাম সেই গুলাই এতদিন পরছি , জামা গুলা ছিড়ে গেছে । আর কয়েকটার রঙ জ্বলে গেছে । আমাকে সুতির জামা কিনে দিলেই হবে ।
– কেমন সুতির জামা পরবি ?
– ৬০ টাকা গজের গজ কাপড় গুলা আছে না গ্রামে পাওয়া যাইতো , ওই রকম এনে দিলেই হবে ।
– আচ্ছা দেখি পাই কিনা ,

বোতাম লাগিয়ে দেয়ার পর ইরফান রুম থেকে বেরিয়ে যায় । কয়েক সেকেন্ডের মাথায় আবার রুমে ঢোকে সে ।

– কয় গজ লাগে তোর ?

পিছনে ফিরে তাকায় বেলী , ইরফানকে আবার রুমে আসতে দেখে অবাক সে । তারপর ইরফানের ডাকে কথার উত্তর দেয় ,

– জ্বি ,
– কয় গজ লাগে তোর ?
– জামা ওড়না সেলোয়ার সব গুলাতেই আড়াই গজ লাগে ।
– আচ্ছা ,

বেরিয়ে যায় ইরফান । তারপর সোজা নিচে চলে যায় সে । বেলীর রুমের জানালা দিয়ে নিচের সব কিছুই দেখা যায় । পর্দার আড়ালে ইরফানকে এক নজর দেখবে বলে নিচে তাকায় সে । ইরফান তখনও নিচে দাঁড়ানো ছিল । আজ ইরফানকে ভালোই দেখাচ্ছিলো । সাদা ফরমালে অনেক সুন্দর লাগছিলো তার বরটাকে । এরই মাঝে মিনু এসে পিছন থেকে বেলীর গায়ে হাত রাখে ।

– কিছু বলবা মিনু ?
– আপনে মানুষ হইবেন কবে ?
– মানে ,
– ফিডা খাইতে খাইতে কি লজ্জা শরমের মাতা খাইছেন আপনে ?
– কি হইছে বলবা তো ।
– কি দরকার ডা আছিলো ভাইয়ের জামার বোতাম লাগানোর । আমি তো দরকার দেখলাম না ।
– আমি তো দেখছি ।
– এহন হের ছোড বউ কই যহন প্রয়োজন পড়ে তহন আপনের কাছে আহে , আর ছোড বউয়ের কান কতা হুইন্না আপনেরে গুম্মুর গুম্মুর লাগায় । বেডা বজ্জাত কোনহানকার ।
– থাক না মিনু , মানুষটার আজ অফিসে কি জানি আছে । আর আমি মনের মধ্যে হিংসা রাখতে পারি না । বাদ দাও ,
– আমি যে কই আপনে বেয়াক্কেল মাতারি কতা ডা আমি ভুল কই না আপনে আসলেই বেয়াক্কেল মাতারি । তো যান এহন আপনের সতীনের বেড ঠি লইয়া যান , নবাবজাদি বিছানায় নইয়া চা পান করবো ।
– মিনু কোনদিব জানি সব শুনে ?
– শুনুক গা তাতে আমার কি ? আমি ডরাই না কাউরে ।

এ বলে মিনু রুম থেকে বের হয়ে যায় । আর বেলীও কফি নিয়ে রুবির রুমে যায় । দরজায় নক করার পর রুবি ভেতরে যেতে বলে । রুবি তখন বিছানায় বসেছিল
। বেলীকে দেখে রুবি একটা হাসি দেয় । রুবির ভেজা চুল গুলো বেলীর ভেতর টাকে ফালা ফালা করছিল , তাড়াতাড়ি কফির মগটা রেখে বেরিয়ে যেতে নিলে রুবি ডাক দিয়ে বসে ,

– যাস কই তুই , আমি কি বলছি যেতে ?
– কিছু লাগবে ?
– নাকি আমার ভেজা চুল তোর সহ্য হয় না কোনটা ?
– হাতে কাজ তো , তাই আর কি ।
– আফসোস লাগে তোর জন্যে , তোর বর আমারও বর । ফারাক হচ্ছে তোর বর আমাতে মত্ত্ব , আর তোকে দেখতেই পারে না । প্রতি রাতে সে আমাতে লেপ্টে থাকে আর প্রতি রাতে তুই একা ঘরে কাতড়াস । আফসোস লাগে রে বড় আফসোস লাগে তোর জন্যে ।
– আমি আসতেছি কফিটা খেয়ে নিন ।

এই বলে বেলী রুম থেকে বেরিয়ে যায় । দৌড়ে নিজের ঘরে এসে বিছানায় উপুর হয়ে পড়ে । বুকে হাত দিয়ে মুখে বালিশ চেপে চিৎকার করে কাঁদে বেলী ।

– এমন টা তো হওয়ার কথা ছিল না । তবে কেন এমন হলো , বাবা আমাকেও সাথে করে নিয়ে যাইতা । এতিম করে কেন গেলা বাবা । এখন আমি কার বুকে মাথা রাখবো বাবা ।

.
.

চলবে………………….

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল সূচনা_পর্ব

0

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
সূচনা_পর্ব
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

ব্যাথাযুক্ত ক্লান্ত শরীরটা ফ্লোরে পড়ে আছে বেলীর । আজকেও মার খেয়েছে সে ইরফানের হাতে । তবে আজকের মা’রের পরিমাণটা বেশিই ছিলো । আজ বেলীর অপরাধ ছিলো সে রুবির বেড-টি দিতে দেরি করে ফেলেছে । রুবি বেলীর সতীন । বেলীর স্বামী ইফরানের দ্বিতীয় পক্ষ সে । বড়লোক ঘরের মেয়ে রুবি । ভালোবেসে বিয়ে করেছে ইরফানকে । এটা জানা সত্ত্বেও যে ইরফান বিবাহিত । রুবি এমন একজন নারী যে কিনা কোন পয়েন্ট বাদ রাখে না যেই পয়েন্ট অনুযায়ী ইরফান বেলীকে মারতে পারে । প্রতি পদে পদে নানা রকম মিথ্যা কথা বলে বলে বেলীকে মা’র খাওয়ায় রুবি । বেলী সবটাই মুখ বুজে মেনে নেয় । বেলীর প্রতিবাদ করার মত সেই শক্তি আর সাহস নেই । রুমের ফ্লোরে শুয়ে থেকে ব্যাথায় ছটফট করতে থাকা বেলীকে দেখার মত কেউই নেই এই বাড়িতে । তবে কাজের মেয়ে মিনু এক একবার এসে ধরে উঠায় যখন ইরফান বেলীকে এইভাবে মেরে রেখে যায় । আজকেও ব্যাতিক্রম কিছু ঘটেনি । ইরফান রুবিকে নিয়ে চলে যাওয়ার পর মিনু দৌড়ে গিয়ে এসে রুমে ঢোকে । গায়ের ওড়নাটা সাইডে পড়ে আছে । হলুদ সুতির জামার উপরে রক্তের হালকা ছোপ ছোপ দাগ হয়ে গেছে । পুরো শরীর ধরে কুচকে শুয়ে থাকা বেলীকে দেখে মিনুর চোখেও পানি চলে আসে । এদিক সেদিক তাকিয়ে মিনু বেলীকে তুলে খাটে নিয়ে বসায় । বেলীর ফর্সা গাল গুলোতে ইরফানের হাতের ৫ আঙুলের ছাপ পড়ে আছে । নাক মুখ দিয়ে লালা চলে আসছে । পুরো মুখটা ফুলে আছে তার । কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ কখনো এভাবে বউ পেটায় না তার উপর হয় যদি উচ্চ শিক্ষিত । মিনু বেলীর চোখ মুখ মুছে দেয় ।

– ভাবী , জামাটা খুলেন ।
– উহু
– রক্ত গুলি মুইছা দেই , দিয়া সেভলন লাগাইয়া দিমু ।
– লাগবে না মিনু , চলো রান্না ঘরে যাই । ওনারা এসে খাবেন তো ।
– আপনার কি মাতায় সমিস্যা , এই শরীর নিয়া রান্না ঘরে যাইবেন আর তারা আজকে বাহিরে খাইবো এত অস্থির হইয়েন না ।
– ওহ ,
– আপনে জামা খুলেন , আমি গরম পানি নিয়া আসি ।

মিনু গরম পানি আনতে গেলে বেলী ঢুকরে কেঁদে দেয় । কি বেলী কি হয়ে গেলো ? বাবা ভালোবেসে বেলীফুল ডাকতো , আর আজ সেই বাবার আদরের মেয়েটা স্বামীর ঘরে এসে সতীন নিয়ে সংসার করে । আর প্রতিদিন নির্মমতা সহ্য করে । বেলীর মুখ দিয়ে তখন একটা কথাই বেরিয়ে আসে ,
” বাবা আমাকেও নিয়ে যাইতা তোমার সাথে ”
এরই মাঝে মিনু গরম পানি নিয়ে চলে আসে । দেখে বেলী সেইভাবেই বসে আছে । মিনু কাছে গিয়ে বসে ।

– ভাবী ও ভাবী ,
– হুউউ ,
– কি ভাবেন , দেহি জামাটা খুলেন ।

মিনুর কথায় জামাটা খুলে বেলী । বুকের উপরে জামাটা দিয়ে ঢেকে রাখে সে । মিনু পিছনে গিয়ে ব্রা এর হুক খুলে দেয় । হুক খুলতে গিয়ে আৎকে উঠে সে । এইভাবে বুঝি কেউ কাউকে মারে । আজকে মারছে বেল্ট দিয়ে । মিনু ক্ষতস্থানে হাত দিতেই বেলী নড়ে ওঠে । মিনু বুঝে যায় যে , তার ভাবীর ব্যাথা করছে । গরম পানি দিয়ে হালকা চেপে চেপে পুরো ক্ষতস্থান থেকে রক্ত সরিয়ে দেয় আর তারপর ওয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে দেয় সে ।

– মিনু ফ্যানটা চালাও , পুরো পিঠ টা জ্বলে আমার ।
– ফাটা জায়গা তো তাই জ্বলে ভাবী আপনে জামা পইরেন না ।
– হু ,
– ভাবী একটু শুইয়া থাকেন । আইজকার রান্না আমি কইরা নিমু ।
– নাহ মিনু , জানতে পারলে আবার মারবে আমাকে ।
– আহারে ভাবী ,
– কি করবো বলো , মারধর যা-ই করে খেতে তো দেয় , এইটাই অনেক ।
– কোন দিন দেখমু মইরা রইছেন ।
– আচ্ছা বাদ দাও এইদিকে আসো , আমার ব্রায়ের হুকটা লাগাও হাতে অনেক ব্যাথা পিছন অবদি যায় না ।
– আইচ্ছা ।

অনেক কষ্টে জামা পরে রান্না ঘরে যায় বেলী । দিনে না খাক , তার বর আর তার বরের বউ রাতে এসে তো খাবে । সেই ভেবেই রান্না করা । পুটি মাছের ঝোল , কাকড়োল ভাজি আর ভাত করেছে তার আর মিনুর জন্যে । ইরফান আর রুবির জন্যে বাসমতি চালের ভাত আর চিকেন করে রেখেছে ।
রান্না শেষ করে উঠতে উঠতে আজান পড়ে যায় । মিনুকে বলে সে রুমে যায় । গোসল করে নামাজ পড়ে নিবে বেলী । বেলী ইসলাম সাইড টা বেশি মানে । যত যাই হোক না কেন নামাজ , কোরআন শরীফ পড়বে সে । রুমে এসে গোসল করে নামাজের জায়নামাজে দাঁড়ায় বেলী ওইদিকে মিনু সব গুছিয়ে নিয়ে ঘর টাও মুছে ফেলে ।
১২ রাকাত নামাজ শেষ করে জায়নামাজে বসে দোয়া দুরূদ পাঠ করে বেলী । তারই মাঝে মনে পড়ে যায় এক বছর আগের কথা গুলো । কত সুন্দর একটা পরিবার ছিল বেলীর । বাবা মা আর সে । অভাবে থাকলেও দিন চলতো বেশ ।
কামরাঙ্গীরচর এলাকায় সুখে শান্তিতে বড্ড ভালোই ছিল মেয়েটা । বেলীর বাবা জব্বার মিয়া ছিলেন কাঠমিস্ত্রী , আর বেলীর মা রাবেয়া বেগম রান্নার কাজ করতেন , রান্নার কাজ বলতে ব্যাচেলর্স মেয়ে ছেলেদের মেস গুলোতে রান্না করে দিতেন । বেলী ছিল জব্বার আর রাবেয়ার একমাত্র সন্তান । টানাটানির সংসারে বেলীকে ইন্টার অবদি পড়াতে পেরেছিলেন তারা তার মাঝে আবার ইন্টার পরীক্ষাটাও দিতে পারি নি টাকার অভাবে । তারপর আর পড়াশোনা করে নি বেলী । সারাদিন পর জব্বার ঘরে ফিরে মেয়ের হাসি মাখা মুখ টা দেখলেই খুশি হয়ে যেতেন । নাম রেখেছিল ভালোবেসে বেলী , আর আদর করে ডাকতেন বেলীফুল বলে । বাড়ির উঠানে এসেই ডাক দিতেন বেলীফুল বলে , আর বাবার কথার আওয়াজ পেয়ে বেলীও দৌড়ে চলে আসতো বাবার কাছে । বাপ-মেয়ের আহ্লাদিপণা দেখে মা রাবেয়া বেগমও খুশি হতেন ।
একদিন দুপুরের খাবার দিতে বেলী তার বাবা দোকানে যায় আর সেখানেই রহমান আলী বেলীকে দেখে । রহমান আলী অনেক ভালো মানুষ ছিলেন । সেই এলাকায় তার বহুল পরিচিতি । বেলীকে দেখে মনে ধরেছিল তার । এমন ছয়-ছোট্ট মেয়েই তার ছেলের সাথে যায় । তাই তিনি জব্বারকে ডেকে নিয়ে সব বিস্তারিত কথা বলে পাকা করে নেন । সেদিন রাবেয়া মানে বেলীর মাও অনেক খুশি হয়েছিলেন । গরীবের মেয়ে যদি তার মা-হারা ছেলের জীবনে আসে তাহলে তার ছেলের ভালোই হবে এটা ভেবেই ভদ্রলোক বিয়ে ঠিক করেন । কিন্তু প্রকৃতির বর্বরতার কাছে হার মানতে হয় কিছু কিছু স্বপ্নকে । বিয়ে ঠিক হওয়ার পর একদিন বিকেলে কাজ থেকে আসার সময় ট্রাকের নিচে চাপা পড়েন জব্বার । সেখানেই তার মৃত্যু ঘটে । শোকার্ত বেলী আর রাবেয়া বেগম পাথর হয়ে যায় ।
অন্যদিকে , রহমান আলীর এক কথা । কথায় তার নড়চড় হবে না । বিয়ে এই মেয়ের সাথেই দিবেন তিনি তার ছেলের । জব্বারের মৃত্যুর পর রহমান আলী বেলীর মাকে ভরসা দেন । আর ছেলেকে খবর দিয়ে গ্রামে আনান । ছেলে যখন শুনে তার বিয়ে একটা অজপাড়া গায়ের মেয়ের সাথে তখন ছেলে সরাসরি না করে দেয় । কিন্তু রহমান আলীও কম জেদি না । তিনিও জোর করেই যাচ্ছেন ।

– দেখুন বাবা , আপনার কথা রাখতে গিয়ে আমি এমন একটা মেয়েকে বিয় করতে পারি না ।
– বেলী অনেক ভালো মেয়ে ।
– সে ভালো নাকি খারাপ আমি জনতেও চাই না । আর তাছাড়া আমি গ্রেজুয়েট ছেলে ভালো চাকরিও করছি আমারও পছন্দ থাকতে পারে ?
– তোমার পছন্দ যে আমার পছন্দ হবে তেমন টাও কথা না ।
– তাহলে আপনার পছন্দ কি করে আমার পছন্দ হবে বাবা , বুঝার চেষ্টা করেন আমি পারবো না বিয়ে করতে ।
– দেখো ওর বাবা মারা যাওয়ার আগে আমি কথা দিয়ে রাখছি এখন ওর বাবা নেই , আমি কথার বরখেলাপ করতে পারবো না ।
– বাবা বিয়ে যদি হয়েও যায় ওই মেয়ে শান্তি পাবে না কিন্তু ।
– পড়াশোনা শিখে ভালো চাকরি করে কি এতই লায়েক হয়ে গেছো নাকি । মা মরা ছেলেকে মানুষ করতে কি আমার কষ্ট হয়নি ।
– দেখুন বাবা আমি আর তর্ক চাই না ।
– বিয়ে এই মেয়েকেই করতে হবে , এটা মনে রাখো ।

রহমান আলী এক রকম জোর করেই ছেলের সাথে বেলীর বিয়ের সব আয়োজন করেন । আর ছেলেও ক্ষোভে ক্ষুব্ধ হয়ে বিয়ের পিড়িতে বসেছিল । শুক্রবার জুমার নামাজ এর পর বিয়ের কার্যক্রম শুরু হয় । বিয়েতে সব খরচ রহমান আলী নিজে করেন । বাশের বেড়ার এক পাশে একটা ব্যানার টাঙানো হয় যাতে লিখা ছিল ” আজ বেলী ও ইরফানের শুভ বিবাহ ” । বেলীর বাবা মারা যাওয়ার দুই মাসের মাথাতেই ইরফানের সাথে বেলীর বিয়ে হয় । বিয়ের পর রাতে যখন বেলীকে ইরফানের রুমে রাখা হয়েছিলো ,,,,,,। আজও মনে পড়লে দুচোখ ভিজে যায় বেলীর ।
এরই মাঝে দরজায় টোকা পড়ে । ধ্যান ভেঙে দরজার দিকে তাকায় বেলী । মিনু দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে ।

– কিছু বলবা মিনু ?
– ২ টা ৩০ বাজে , নামাজ এহনও হয় নাই আপনের ?
– হ্যাঁ হইছে ।
– তাইলে আসেন ভাত বাড়ছি আমি ।
– আসতেছি ।

মিনু মেয়েটা যথেষ্ট ভালো আর ভদ্র । রুবিকে সে একদম দেখতে পারে না । কারণ ইরফানের অবর্তমানে রুবি বেলীর সাথে যা যা করে সব কিছু স্বাক্ষী এই মিনু । মিনু কয়েকবার বলতেও চেয়েছিল কিন্তু বেলীর নিষেধে সে আর মুখ খুলে নি ।
নামাজের মোনাজাত শেষ করে জায়নামাজ ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় বেলী । পুরো শরীরটা ব্যাথা হয়ে আছে তার । কয়টা ভাত খেয়ে নিয়ে নাপা টেবলেট খেয়ে নিবে ।
আস্তে আস্তে হেটে ডাইনিং রুমে যায় বেলী । আজকে বাসায় কেউ না থাকায় টেবিলে বসেই ভাত খায় বেলী আর মিনু । ইদানীং ভাত খেতে গেলে গলার মাঝখানটায় ভাত আটকে থাকে বেলীর । ইরফান মারার সময় প্রায়ই গলায় চাপ দেয় না হয় গায়ের ওড়না দিয়ে ফাঁস দেয় । গলার ব্যাথায় ঠিক মত খাবারও গিলতে পারে না বেলী ।
ভাত খেতে বসে গলার অসহ্য যন্ত্রনায় চোখের পানি ছেড়ে দেয় বেলী । বেলীর কান্না দেখে মিনুরও খানা বন্ধ হয়ে যায় ।

– আর কাইন্দেন না তো ভাবী । কতদিন কইলাম যান গা যান গা , হুনেন নাই আমার কথা । আবার আমারেও কিছু কইতে দেন না ভাইয়েরে । তাইলে হুদ্দাই কান্দেন কিত্তে । কাইন্দেন না ,

মিনুর কথায় অশ্রুসজল চোখে তাকায় বেলী ।

Protected: আশালতা

0

This content is password protected. To view it please enter your password below: