একজীবন শেষ পর্ব
একজীবন
পর্বঃ ৭ (শেষ পর্ব)
★
খুব ভোরবেলা ঘুম ভাঙার অভ্যেস আমার, ফজরের নামাজটা পড়েই নিজের পড়ালেখাটুকু শেষ করে নিতে হতো বাবার বাড়িতে থাকতে! এরপর তো সারাদিন ছুটোছুটি, স্কুল ফেরত বাড়ি এসে আবার ঘরের কাজকর্ম, ছোটো ভাইটার দেখাশোনা- আর পড়ার ফুরসতটাই মিলতো না! সেই অভ্যাসটা এখনো যায়নি। এ ক’দিন ভোরে উঠে নামাজটা পরে নিয়েই ছাদে চলে যেতাম, ভোরের হিম হিম পরিবেশটা এত ভাল্লাগে! আজ তো ছাই সেই ইচ্ছাটাও মরে গেছে, একলা একলা আর কাঁহাতক ছাদে ঘুরে বেড়ানো যায়? যে শালিক সঙ্গী খুঁজে পায় তার বুঝি আর একা চড়ে বেড়াতে ভালো লাগে?
কিন্তু এই ট্যাটনা হাবাটার ঘুম ভাঙানো যায় কীভাবে! নভেম্বর মাস চলে, গ্রাম এলাকা বলে এখানে ভাল শীত পড়েছে এরমধ্যেই….ঠান্ডা পানি এনে গায়ে ফেলে দেয়া যেতো কিন্তু সত্যি বলতে মায়া হচ্ছে বেচারার জন্য! নাহ! সবে জ্বর ছেড়ে উঠেছে এখন এই শীতে পানিটানি মারা যাবেনা। ধুর! থাকুক ঘুমিয়ে। জেগে গেলেই তো রাজ্যের অদ্ভুত অদ্ভুত সব আলাপ জুড়ে বসবে আর ওদিকে আমার হৃদপিণ্ডটার বারটা বেজে যাবে ধুকপুক করতে করতে, এরচে বরং ঘুমিয়ে থাকতেই যা বলার বলে নিই, তারপর ছাদে এক ঘুরান দিয়ে আসি!
-‘হাবাচন্দ্র, ক্যাবলাকান্ত, দস্যু সর্দার! দিব্যি তো নিষ্পাপ ফুলটির মত ঘুমাচ্ছো, কে বলবে যে তুমি এক নাম্বারের ট্যাটন! খালি ত ফটফট করো, দুনিয়ার এত কিছু বোঝ আর মন বোঝ না, কচুর ডাক্তার তুমি! কালকে যে জোর করে আমার ওপর ডাকাতি ফলালে, এখন যদি আমি তার প্রতিশোধ নিই আটকাতে পারবে? উহ-হু! পারবেনা! এখন আমি তোমার কপালে, তারপর নাকে তারপর দুই গালে আর তারপর… ’
-‘শুধু বলেই যাবে না কিছু করবে? কতক্ষণ মরার মত পরে আছি আশায় আশায়!’- হাত নেড়ে নেড়ে আবোলতাবোল বলে যাচ্ছিলাম আমি, খপ করে হাতটা ধরে নিয়ে বলল সে! ফিচলে ছেলেটা তারমানে এতক্ষণ জেগে ছিলো! কী খারাপ, কী খারাপ!
-‘আপনি আসলেও একটা খারাপ, একটা অসভ্য, একটা …. একটা…’
-‘একটা কী? হাবাচন্দ্র? ক্যাবলাকান্ত? নাকি দস্যু সর্দার? নাকি সবগুলাই?’
-‘জানিনা! ছাড়েন, আমি যাব!’
-‘কই যাবা এখন? সবাই ঘুমে কাদা… ওহ! ম্যাডাম তো আবার ভোরে ছাদে যান!’
-‘এটাও জানা হয়ে গেছে!’
-‘আমি হাত গুনতে জানি!’
-‘তাই? নিন গুনে দেখান ত আমার হাত’- দুই হাত সামনে মেলে দিয়ে বললাম।
খানিক্ষণ বুঝদারের মত চেয়ে চেয়ে হাত দুটো দেখলো সে। তারপর-
-‘নাহ, এতদূর থেকে দেখা যাচ্ছেনা, কাছে আসতে হবে’- বলে এক ঝটকায় নিজের দিকে টেনে নিলো, আমার ঝুঁকে থাকা কণ্ঠের চারিদিকে দুই হাতের বন্ধনী তৈরী করে ফিসফিসিয়ে বললো-
-‘আপনার হাত বলছে-
অচিন দেশের অচিন পাখি, আমি কেমন করে বাঁধি?
সোনার বেড়ি, রুপার খাঁচা বৃথাই তারে সাধি!
-‘এটাও কি নির্মলেন্দু গুণের কবিতা?’
-‘নাহ! এটা আনিসেন্দু দোষ-এর লিখা, নির্মলেন্দু গুণ নয়!’
আচ্ছা! ফিচলেটা নিজে বসেবসে পয়ার বাঁধছে তারমানে! বেশ, তুমি ফিচলে হলে আমিও তোমার যোগ্য ‘অর্ধাংগী’- মনেমনে ফন্দি এঁটে সরল মুখ করে বললাম-
‘নাহ! এটা তো আমি পড়েছি আগে, আমার চেনা কবিতাটা!’
-‘কীহ! এটা আমি মাত্র বানালাম ভেবে ভেবে, মিছেকথা!’- হাবাটা বোধহয় দ্বিধায় পরেছে, এর আগে তো কোনোদিন এভাবে মিথ্যেমিথ্যি ফাঁদে ফেলেনি তাই এই ডাহা মিথ্যাটাও অবিশ্বাস করতে পারছেনা! আসলেই ক্যাবলা!
-‘অন্যের লিখা নিজের নামে চালিয়ে দিচ্ছেন! আপনাকে তো ভালমানুষ জানতাম আমি!’- রীতিমত কঠিন গলায় বললাম।
-‘আচ্ছা, বেশ। তবে পরের লাইনগুলি বলো শুনি! তবে বিশ্বাস করব…’
-‘দাঁড়ান, মনে করতে হবে!’
খানিকক্ষণ মাথা চুলকে নিয়ে বললাম-
‘সোনা-রুপা, পান্না-চুনি তাই কি পাখি চায়?
ভালোবাসার বেড়ি হতো, পরতো পাখি পা’য়!’
ক্যাবলার চোখ ততক্ষণে রসগোল্লা হয়ে গিয়েছে!
-‘আচ্ছা! এই কথা! ষোড়শীর পেটে পেটে এত বুদ্ধি, আর আমি কীনা আঠারোর অপেক্ষায় বসে আছি! সন্ধিচুক্তি বাতিল….!
শেষমেশ আর ছাদে যাওয়া হলোনা আমার, বদলে বিষপিঁপড়ের ছোবলে সর্বাংগ জ্বলেপুড়ে গেলো!
★
সকালে সাজুখালা এলে আমিও তার সাথে রান্নাঘরে গেলাম সাহায্য করতে। দুমুঠো দুধ-রুটি মুখে দিয়েই আনিস দৌড়ে বেরিয়ে গেছে, প্রতি শুক্রবার সকাল সকালই সদর হাসপাতালে যেতে হয় তাকে। আজকে শুক্রবার, বাড়িতেই থাকবে সবাই তাই খাবারের আয়োজনটাও একটু ভাল করতে হবে। মাঝে মাঝে নূরজাহান দাদীর কথা খুব মনে পরে, সেইযে একবার গেলাম এরপর আর যাওয়াই হলোনা! অবশ্য ভালমন্দ রান্না হলে সাজুখালাকে দিয়ে দাদীর বাড়িতে পাঠিয়ে দিই প্রায়ই। আজকেও সাজুখালাকে বলে সব একটু বেশি বেশি রান্না করিয়ে নিয়েছি, সময় সুযোগ মিললে আমিই নিয়ে যাব নয়ত সাজুখালাকে দিয়েই পাঠিয়ে দেব। মনে মনে এসব ভাবছি কিন্তু কোথাও একটা খচখচে অনুভূতি হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছি না। সকাল থেকে কিছু একটা খটকা লাগছে কোথাও, ঠিক বুঝতে পারছি না খটকাটা কোথায়! কি যেন নেইনেই বলে মনে হচ্ছে…
-‘আইজকা খালাম্মার কুনু সাড়াশব্দ পাইনা। সক্কালবেলাডা চিল্লাচিল্লি ছাড়া গ্যালো আইজকা আমার, দিনডা মনেহয় ভালা যাইব আইজকা!’- সাজুখালার উছ্বসিত কথায় ভাবনার সুতো কাটে আমার।
ওহ! তাইতো! আলেয়া খাতুনের চিৎকার চেঁচামেচি নেই আজ, তাই এমন খালি খালি মনে হচ্ছে! রান্না প্রায় শেষ, এখনো ওঠেনি না কি! যাকগে, আমার কী? সকালটা শান্তিতে গেলো এইই ঢের!
★
অন্যদিনের চেয়ে আজ আলেয়া খাতুনকে বেশি প্রাণবন্ত আর হাসিখুশি লাগছে! সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলছেন, কোনো বকাবকি, চিৎকার-চেঁচামেচি নেই এমনকি আমার সাথেও বেশ ভালভাবেই কথা বলে যাচ্ছেন। রাক্ষুসী শূর্পনখার তবে সুমতি হলো বোধহয়! সকালের নাস্তাপর্ব শেষে আমাকে ডেকে বললেন-
-‘আইজ ত অনেক খাবার বেশি হইসে, দুপুরের আগে আগে তুমার দাদীরে কিছু নিয়া দিয়াইসো আর তুমিও দাদীর লগেই দুপুরের খানা খাইয়া আইসো, হেয় একলা থাকে….। সাজুরে দিয়া তো পেরায়ই পাঠাও, আইজকা নিজেই যাইও। বন্ধের দিন আছে, হেরে দেইখ্যাও আইলা…’
শেষমেশ এই বাক্য! এই মহিলার মুখে! আমার চোখ রীতিমত রসগোল্লা হয়ে গেছিলো বোধহয়, কোনোরকমে ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালাম আমি! আনিস হাঁদারাম টা থাকলে ভালো হতো, একসাথে যাওয়া যেতো! কিন্তু প্রতি শুক্রবারই সদর হাসপাতালে যেতে হয় তাকে, বিকেলের আগে ফিরতে পারেনা। আজও সেখানেই গিয়েছে।
এ বাড়ি থেকে দাদীর বাড়িতে যেতে সেই বাঁশঝাড়টা পেরুতে হয়- ভাবতেই কেমন গা গুলিয়ে আসে আমার! সাজুখালাকেও একগাদা কাপড়-চোপড় ধুতে বসিয়ে দিয়েছে, রুপাটাও বাড়িতে নেই-বাবার বাড়ি বেড়াতে গেছে! অবশ্য এই দিনদুপুরে আর কি-ই বা এমন হবে? তাছাড়া খশরুকে সেদিনের পর আর দেখিওনি, বোধহয় শিক্ষা হয়েছে শয়তানটার! এইটুকুই তো রাস্তা, তাতে দিনের আলো- একটা ব্যাগে খাবারগুলি ভরে নিয়ে একাই রওনা দিচ্ছিলাম। মিশু এসে পথ আটকালো হঠাত।
-‘তুমারে একলা ছাড়ন যাইবনা, দাদাভাইয়ের নিষেধ আছে! আমিও যামু সাথে, চলো!’
-‘কেন অযথা খাটনি করবেন মিশুআপা! আমার সমস্যা হবেনা…’
-‘দাদাভাই যদি শুনে তুমারে একলা ছাড়সি,আমারে ধইরা ঘারাইবো! বারবার বইলা গেসে যতদিন আমি আছি আমার ভরসায় তুমারে রাখতেসে, এই মাসের বেতন হইলেই তোমার জন্য মোবাইল কিনা দিবো তখন আর… ‘
আমি রসগোল্লা চোখ করে তাকাতেই জিব কেটে থেমে গেলো মিশু।
-‘কিহ! এইসব বলছে সে আপনারে?’
-‘আমারে না করসিলো জানাইতে, মনের ভুলে বইলা দিসি। অরু,তুমি কইলাম দাদাভাইরে কইও না কিছু! আর ফোন একটা দরকার ও তুমার, আমি ত আর সবসময় এইখানে থাকুম না, বিপদ-আপদে অন্তত দাদাভাইরে সাথে সাথে জানাইবার পারবা…’
-‘কী যে সব কাজকর্ম করেন আপনেরা দুই ভাইবইনে! আচ্ছা চলেন যাই এখন, খাবার এইগুলা ঠান্ডা হইলে দাদীর আবার গরম দিতে হইব পরে! কিন্তু আপনে আমার সাথে গেলে আপনের আম্মা আবার রাগ করব না তো? দেখেন…’
কথাটা বলে শেষ ও করতে পারিনি, আলেয়া খাতুনের রণমূর্তিটা একেবারে সটান আমাদের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো, নিশ্চিত এখন দু’কথা শুনিয়ে দেবে মিশুকে আর আমাকে…
কিন্তু কী অদ্ভুত সব ব্যাপার হচ্ছে আজ সকাল থেকে! আলেয়া খাতুন নিজে যেচে এসে বরং হাসিহাসি মুখ করে মিশুকে বললেন-
‘যা তো মিশু মা অর লগে নূরি দাদীর বাড়িত। আনিসে ত অরে একলা ছাড়তে মানা কইরা গ্যাসে বারবার…’
সত্যি, সকাল থেকে একের পর এক চমক! আর নেয়া যাচ্ছেনা।
-‘আম্মার হইসে কী আজকা? যাদুটোনা করসে নি হেরে কেউ? সকাল থিকা এত মধু ঝরতাসে গলায়…ঘটনা ভাল্লাগতাসে না কইলাম আমার! তুমি একটু সাবধানে থাইকো অরু!’ – বাইরে বেরিয়েই আমার হাত ধরে বললো মিশু।
-‘আরে ধুর! আপনে অযথা চিন্তা করতেসেন মিশু আপা, আম্মা হয়ত আমারে মাইনা নিসেন!’
★
-‘দাদী! ও দাদী! বাড়িতে আছেন নাকি?’- দাদীর উঠানটায় যেয়ে দাঁড়ালাম অবশেষে আমরা!
-‘ক্যাডা? ও নাতিন তুই! কতদিন পর আইলি, মিশুও আইসস লগে, তয় তর জোড়ায় কই?’
-‘জোড়ায় নাই! গ্রামে গ্রামে ডাক্তরি কইরা বেড়ায় আপনের নাতিয়ে, আমার জন্য সময় আছেনি তার?’
-‘শ্যাম যদি হইত পোষাপাখি প্রানসখি
শ্যাম যদি হইত পোষাপাখি ।।
রাখিয়া হৃদয়পিঞ্জরে পুষিতাম যতনকরে
এ জনমের মতো হইতাম সুখি , প্রান সখি ।।’- দাদী আচমকা মাথা নেড়ে নেড়ে গান ধরলেন! এদিকে দাদীর কান্ড দেখে মিশু মুখে হাতচাপা দিয়ে হাসছে!
-‘ধুরু দাদী! জ্বালাইয়েন না তো! পোষাপাখি! এমনেই যার ফটফট কথার জ্বালায় বাঁচিনা, তারে পোষাপাখি বানায়া আরো মরি!’-শেষ অংশটুকু বিড়বিড়িয়ে বললেও দাদীর কানে ঠিক পৌঁছে যায়!
-‘ক্যাডায় জ্বালায় তরে? আনিসে নি? স্বোয়ামীর জ্বালায় যদি না জ্বলিবে রাই, বৃথা তুমার নারী জনম জেনে রাখো তাই!’
-‘কত্ত শোলক জানেন আপনে? সারাদিন খালি শোলক গাইতেই থাকেন!’
-‘কি করুম বইনে? আমারে ত জ্বালানির কেউ নাই!’- দাদী কপট দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
-‘কে বলছে কেউ নাই? এইযে আমরা আইসা পরসি জ্বালাইতে! আপনের সাথে আজকে দুপুরে খাবো, সব নিয়াসছি। চলেন বসি!’- মিশু বললো ফট করে।
-‘আয় বয়! তরে আইজকা নাগালের কাছে পাইসি যখন তখন সব শিখায়া দিমুনে… ’
-‘কী শিখাইবেন আপনে? আমি পারি সব!’- আমি সগর্বে উত্তর দিলাম।
-‘হের নমুনা ত দেখতাসিই! গলায় দাগ-নিশান বানায়া ঘুরতাসো, উদুইল্যা মাইয়া কুনহানকার, বয়স হইসে বুদ্দি অয়নাই! আনিস্যাডারও তালতওবা নাই… ’
দ্রুত শাড়ির আঁচলটা দিয়ে দুই প্যাঁচে কাঁধের কাছটা ঢেকে নিলাম আমি, মিশু ততক্ষণে হাসি চেপে না রাখতে পেরে হোহো করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছে!
★
-‘কুনদিক দিয়া এর সময় গেলগা ট্যার ও পাইলাম না! নূরি দাদী এক্কারে আউলাঝাউলা, এত কথা কয়! শুনতে শুনতে সময় যায়গা…’
বাড়ি ফেরার পথে মিশু বলে।
-‘হু! তবে দাদী খুব ভাল মানুষ আর বেশ চালাক চতুর ও!’
-‘হ! বয়স হইলে কি হইব, এখনো টনটনা!’
দুপুরের রোদটা মরে গেছে, শান্ত একটা বিকেলের আরম্ভ হচ্ছে কেবল। আশেপাশে সব নিস্তব্ধ, মাঝেমাঝে ঝলক ঝলক পূবের হাওয়া বয়ে যাচ্ছে… গ্রামের পথঘাটগুলি এত সুন্দর লাগে মাঝেমাঝে! মিশুর সাথে হাঁটতে হাঁটতে কখন বাড়ি ফিরে এসেছি বলতেও পারবনা। উঠোনে অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করছিলেন আলেয়া খাতুন, পেছন দিয়ে যে আমরা এসে দাঁড়িয়েছি সেটাও টের পাননি। ঘুরে তাকিয়ে আমাদের দেখতে পেয়েই যেন চমকে গেলেন!
-‘এত দেরি হইল তুমাগো আইতে! সইয়ে আইসিল মিশুরে দ্যাখতে তা ত সে বাড়িত আছিলোনা, এই পিঠাডি দিয়া গ্যাসে। নেও তুমি একটা খাও মিশু এইডা খা…- বলে দু’জনের হাতে দুইটা পিঠা ধরিয়ে দিলেন উনি! কী আজব, এই মহিলা আমাদের জন্য পিঠার বাটি হাতে উঠানে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন এতক্ষণ! এ তো পরে ধীরে সুস্থে বসেও খাওয়া যেতো… অদ্ভুত!
-‘আনিসে এখনো আসেনাই, পিঠা খাওয়া হইলে যাও ঘরে গিয়া বিশ্রাম নেওগা। আর মিশু আমার লগে চল, সইয়ের বাড়িত যামু একটু!’
-‘মা আমি মাত্র আসছি এখন আর যামুনা, আপনে যান!’
-‘সই তরে দেখবার চাইসে, এইবার আইয়া ত দেখাও করস নাই! চল চল, কাইলকা ত আবার যাবিগা শ্বশুরবাড়িতে,আইজকা দেখাডা কইরা আসি চল!’ – মিশুকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলি বলেই আমার দিকে ঘুরলেন আলেয়া খাতুন।
-‘কী হইল, মিশু খায়া ফালাইলো তুমি এখনো পিঠা হাতে নিয়া দাঁড়ায়া আছো ক্যা? ভাল বানাইসে পিঠাডি, আকবর আর আনিসের জন্যিও রাখসি… খাও খাও… বলে একপ্রকার জোর করেই প্রায় আমার মুখে ওটা গুঁজে দিয়ে একপ্রকার টেনেই মিশুকে নিয়ে গেলেন বগলদাবা করে!
★
আনিস এখনো ফেরেনি, রুপাটাও বাপের বাড়ি গেছে দু’দিন হলো, এই প্রথম পুরো বাড়িটাতে আমি একদম একা! একটু ভয় ভয় লাগলেও বেশ ভালও লাগছে সাথে, যাই ছাদে যেয়ে ঘুরে আসি! গত শুক্রবার কিছু গাছের চারা লাগিয়েছিলাম ছাদে টব বসিয়ে… রোজ ভোরে যেয়ে জল-পানি ছিটিয়ে আসি। আজ তো যাওয়া হয়নি, এই সুযোগে যেয়ে দেখে আসি একবার!
পিঠেটায় দ্বিতীয়বার কামড় বসাতেই একটা তিতকুটে স্বাদ জিহবায় এসে লাগলো… কেমন যেন একটা তেতো তেতো অনুভূতি! নাহ, বাকিটা আর খাওয়া সম্ভব নয়… ছাদ থেকে বাড়ির পেছনে ফেলে দিলাম ওটা। গাছগুলি ভালই ডালপালা ছেড়েছে। ধুর! আসার সময় মনে করে বালতিতে গাছের জন্য পানি নিয়ে এলেই হতো, যাকগে এখন নিচে যেয়ে নিয়ে আসি…
প্যাঁচানো মরচে ধরা লোহার সিঁড়িটার মাথায় দাঁড়াতেই মাথাটা কেমন ঘুরে উঠলো, রেলিং ধরে সাবধানে নামছিলাম, চোখের সামনে সব কেমন ঘুরছিলো মনে হলো… একহাতে শক্ত করে রেলিংটা ধরে কোনোমতে সোজা দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলাম, সামনে একটা আবছা মানব অবয়ব,পরিচিত কিন্তু…কিন্তু না, পছন্দ করিনা আমি একে একদমই, এগিয়ে আসছে আমার দিকে… দৌড়ে পালানো উচিত আমার মস্তিষ্ক সাবধান করছে বারবার অথচ চোখের সামনে সবকিছু কেমন ঘোলাটে হয়ে আসছে…. ব্যস এটুকুই শেষ পরিপূর্ণ স্মৃতি আমার! এরপর সব কেমন আবছা…
★
জেগে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছি আমি, কিন্তু অদ্ভুত ঘোরের মত ঘুম আমাকে ধীরে ধীরে কাবু করে দিচ্ছে। লোকটা ততক্ষণে এগিয়ে আসে আমাকে ধরে ফেলেছে, হ্যাঁচকা টানে আমাকে নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে সোজা আমার ঘরের দিকে যাচ্ছে। একটা বোঁটকা গন্ধ তার গায়ে, বিচ্ছিরি এই দুর্গন্ধটা আমি আগেও পেয়েছি… সেদিন বাঁশঝাড়ে…
খশরু!
চকিতে মস্তিষ্কের একটা কোণ সজাগ হয়ে ওঠে আমার, কিন্তু শরীরের বাকি অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো নিঃসাড়। মস্তিষ্কের সজাগ অংশটা বারবার যেন সতর্ক করে দিচ্ছে আমাকে, কিন্তু আমার এতদিনের বিশ্বস্ত হাত-পা সহ শরীরের প্রত্যেকটা অস্থি-পেশী যেন আজ বিদ্রোহ করেছে… সামান্য নাড়াচাড়ার ক্ষমতাটুকুও আজ বড় আকাঙ্ক্ষিত মনে হচ্ছে আমার!
ঘরে ঢোকার সময় দরজার সাথে ঠকাস করে মাথাটা বাড়ি খেলো আমার, মুহুর্তের জন্য হাত দুটোও যেন সচল হয়ে উঠলো। দু’হাতে খশরুর গলাটা পেছনে ধাক্কা দিয়ে সরাতে গেলাম, কিন্তু ততক্ষণে একটা কাপড়ের দলার মত আমাকে ছুঁড়ে বিছানায় ফেলে দিয়েছে পশুটা!
-‘ত্যাজ কতো শালীর! হারামজাদি, বে…..’- খশরুর উচ্চারিত কুৎসিত শব্দগুলো যেন একদলা নোংরা মাছির মত উড়ে বেড়াচ্ছে ঘরে, এদের ভেতর দিয়েই বেরোতে হবে, নিজের ঘর থেকে আজ নিজেরই পালাতে হবে আমায়… যত দ্রুত সম্ভব! কিন্তু প্রচণ্ড ঘুমের অনুভূতি আমাকে বিবশ করে দিচ্ছে যে…
-‘এমুন অবস্থা করুম, তর পরাণের স্বামী আর তরে ঘরে নিবনা শালী, …’- খশরু হাঁপাচ্ছে আর হাসছে, হায়েনার হাসি- কোথায় যেন পড়েছিলাম… আহ, মাথাটা আউলে গেছে একদম আমার। আমাকে পালাতে হবে, যেভাবেই হোক…. একবার বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলাম… আনিস! আনিস কই? কমলাপুরে থাকবে… আমাকে যেতে হবে…
অতীত আর বর্তমান মিলেমিশে জট পাকিয়ে ফেলেছে মাথার ভেতরটা! এরমধ্যেই একটা নোংরা বিষধর সাপের মত হাতের স্পর্শে সমস্ত সত্তা রি-রি করে ওঠে আমার। গোঙানোর মত শব্দ করতে থাকি আমি, খশরু দ্রুত কিছু একটা মুখে গুঁজে দেয়, দুর্গন্ধভরা কাপড়টা মুখ থেকে ছুঁড়ে ফেলতে চাই কিন্তু খশরুর জান্তব হাতটা বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। প্রচণ্ড ঘোরের মধ্যে আমার দুর্বল শরীরটা শেষমেশ হাল ছেড়ে দেয়, মস্তিষ্কের সজাগ অংশটা নিস্তেজভাবে তখনো সাবধান করে চলেছে……
…
…..
……..
কতক্ষণ পার হয়েছে জানিনা, বোধহয় অনন্তকাল! চোখ মেলতেই মিশুকে দেখলাম, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ওর পাশে আরেকটি মেয়ে…চেনা মুখ, কোথায় দেখেছিলাম? যাকগে, সে যে খুশি হোক… আর কেউ নেই?
আর কেউ…
-‘বেশি শীত করছে অরু? ফ্যান কমিয়ে দেবো?’- একটা গমগমে কণ্ঠে স্বস্তি ফেরে আমার।
আহ! এইতো সেই কণ্ঠস্বর! শিয়রে বসে চুপচাপ মাথায় বিলি কাটছিলো এতক্ষণ, তাই দেখতে পাইনি। ঘাড় ঘুরাতেই দেখলাম সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে আমার কপালের ওপর দিয়ে ঝুঁকে আছে মুখটা… একটা শান্ত, শুভ্র মুখ!
মাথাটা কেমন জট পাকিয়ে আছে, ঠিক কীভাবে এখানে এসে ঘুমিয়ে গেলাম, এরা সবাই কীজন্য এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছে সব কেমন অদ্ভুত লাগছে! কিছুই মনে করতে পারছিনা। গলাটা তেতো লাগছে, ঢোঁক গিলে বললাম-
-‘পানি খাবো!’
আনিস দৌড়ে পানি এনে দিলো। উঠে বসতে যেয়ে টের পেলাম হাতে স্যালাইন লাগানো, আধশোয়া হয়ে পানির গ্লাসটা হাতে নিলাম। ওদিকে মিশু তখনো কেঁদেই চলেছে, সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে আরেকবার তাকাতেই মনে পরলো কোথায় দেখেছি একে- খশরুর নতুন বিয়ে করা বউ এই মেয়েটা!
খশরু!
এক পলকে অনেকগুলো দৃশ্য আবছা, সাদাকালো ছবির মত ভেসে উঠলো চোখের সামনে… আমি ছাদে গেছিলাম গাছগুলো দেখতে, পানির জন্য নিচে নামতে যেয়ে মাথাটা কেমন ঘুরে গেলো তারপর একজন কেউ এগিয়ে আসছিলো… তারপর… তারপর…
হায় খোদা!
★
খয়েরী মলাটের ডায়েরীটা নিয়ে দৌড়ে নিচতলায় যায় মেয়েটা!
–‘তারপর?’- উস্কোখুস্কো রুক্ষ চুল, জবার মত লাল টকটকে চোখের নিচে কালি- দৌড়ে আসা মেয়েটা উদগ্রীব হয়ে প্রশ্ন করে।
কম্পিউটার ডেস্কে কাজ করতে থাকা থাকা শাড়ি পরা মহিলা চোখ তুলে তাকায়, বুকের কাছে সাদা নেমপ্লেটে সোনালি অক্ষরে ওর নাম ঝলমল করে ওঠে- ‘ঊষা।’
-‘তারপরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত শাহনাজ! এরকম একটা ঘটনার পর যা হওয়া উচিত, তাই হয়েছিল সেদিন!’- গমগমে গলায় উত্তরটা দিয়ে সরু চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে ঊষা।
-‘আমি জানতাম! সব মিথ্যে, সবাই মিথ্যে প্রবোধ দিচ্ছে আমাকে! আমি জানি অরুকে আনিস আর ফেরত নেয়নি,ভাসিয়ে দিয়েছিলো খড়কুটোর মত… সব মিথ্যে! সত্যিকারের ভালোবাসা বলে কিছু নেই, কিচ্ছুনা…সব শরীরসর্বস্ব!’- শাহনাজ দু’হাতে মুখ ঢেকে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।
–‘সে যদি তুমি এরকম ভাবো তবে তাই-ই! কিন্তু, আপাতত আমার কাউন্সেলিং এর অংশটুকু শেষ। তুমি তো জানোই আমি এখানকার নার্স। ডায়েরিটা পড়া শেষ হলে দু’জন ডক্টর মিলে এই পোস্ট ট্রমাটিক কাউন্সেলিংটার বাকি অংশ সম্পূর্ণ করবেন। চোখটা মুছে ২০৫ নাম্বার রুমে চলে যাও, আমি বলছি তোমার ভালো লাগবে!’
শাহনাজ মেয়েটা চোখ মুছে দাঁড়ায়, তারপর নেশাগ্রস্তের মত হেটে যায় দোতলায়। একটা ভয়ংকর দুর্ঘটনার পর post traumatic stress disorder- এ ভুগছিলো সে বহুদিন ধরে। অনেক চেষ্টার পরেও সতের বছরের এই মেয়েটাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে না পেরে আজ সকালেই ওকে এই ট্রমা সেন্টারটায় নিয়ে এসেছিলেন ওর বাবা আতিফুস সালাম।
★
২০৫ নাম্বার রুমের সামনে যেতেই দরজার গায়ে সাঁটানো মাঝারি আকৃতির নেমপ্লেটটার দিকে চোখ পরে শাহনাজের।
‘ডক্টর অরুন্ধতী রহমান!’- নামটা পরে বুকের রক্ত ছলাত করে ওঠে শাহনাজের। এক ঝটকায় দরজাটা খুলতেই চোখ পড়ে শান্ত, সুন্দর চেহারার মেয়েটির দিকে। শাহনাজকে দেখেই চোখেমুখে একটা মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে দিয়ে মেয়েটি কবিতার মত গলায় বলে
–‘শাহনাজ! তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম মামনি! এসো বসো!’
–‘আপনি! আপনি অরু? অরুন্ধতী? আনিসের অরু… আপনি?’
-‘হ্যা, আমিই অরু!’
-‘আর আনিস? সে চলে গেছে তো আপনাকে ছেড়ে, না? আমি জানি সে চলে গেছে,আমাকেও ফেলে চলে গেছে…’
– ‘আরেকজন ডক্টর যিনি তোমার কাউন্সেলিং এর দায়িত্বে আছেন তার নামই আনিস,আনিসুর রহমান!’
অরুন্ধতী যেন আচমকা একটা বোমা ফাটিয়েছে, হতবিহ্বল দৃষ্টিতে শাহনাজ তখন তাকিয়ে আছে অরন্ধতীর দিকে। ডক্টর অরুন্ধতী ততক্ষণে ফোন বের করে কাউকে ডাকছিলেন, খানিক বাদেই সৌম্য চেহারার আরেকজন ডক্টর প্রবেশ করেন ঘরটায়।
–‘কেমন আছ শাহনাজ? আমি ডক্টর আনিস!’
–‘কিন্তু.. আপনি..’
-‘ভাল মেয়ের মত চোখটা মুছে বসো, বলছি সব! সদর হাসপাতালে ছিলাম সেদিন আমি, দ্রুত কাজ গুছিয়ে বাড়ি যেতে যেতে বিকেল হয়ে যায়। বাড়িতে ঢোকার একটু আগেই মিশু আর ঊষার সাথে দেখা হয় আমার, ঊষা হচ্ছে সেই খশরুর বউ মেয়েটা! দু’জনে দৌড়ে যাচ্ছে আমাদের বাড়ির দিকে, আমাকে দেখে হাউমাউ করে কিছু একটা বললো দু’জনে মিলে। কতটা বুঝলাম কতটা বুঝলাম না, কিন্তু কিছু একটা হয়েছে এটুকু বুঝে দৌড় লাগালাম বাড়িতে। ভেতরে ঢুকতেই আমার ঘর থেকে একটা মৃদু গোঙানির আওয়াজ কানে এলো, তারপর একটা কর্কশ পুরুষ গলায় কতগুলো বিশ্রী গালি…
ঘরের দরজাটা লাগানো ছিলো, তবে ভাগ্য ভালো সেটা প্লাস্টিক বোর্ডের দরজা। রান্নাঘর থেকে বড় দা এনে দুটো কোপ দিতেই চুরমুর করে ভেঙে পড়ে।ভেতরে অরু তখন অজ্ঞান, আর খশরু শয়তানটাও সেখানে। দরজা খুলতেই খশরু লাফিয়ে ওঠে, ঊষাকে দেখে নিরাপদ আশ্রয় ভেবে ওর পেছন দিয়ে বের হবার চেষ্টা করে। মিশু ততক্ষণে দৌড়ে অরুর কাছে গেছে, আমি খশরুকে ধরতে যাই কিন্ত তার আগেই শাড়ির আঁচলের নিচ থেকে রামদা টা বের করে খশরুর ঘাড় বরাবর কোপ বসিয়ে দেয় ঊষা! কোন ফাঁকে মাটিতে পরে থাকা দা টা কুড়িয়ে নিয়েছিলো মেয়েটা…
অরুর জ্ঞান ফেরার আগেই এগুলো হয়ে যায়। ওর প্রেশার লো, তাতে কড়া ঘুমের ঔষধ খাওয়ানো হয়েছে বুঝতে পেরে সাথে সাথে দ্রুত স্যালাইনের ব্যবস্থা করি।
শয়তানটার লাশ তখনো ঘরের বাইরেই পড়ে ছিলো, ওটাকে ফেলে রেখে আগে অরুর জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করি আমি।
খশরুর এত সাহসের পেছনে অবশ্য আলেয়া খাতুন ও ছিলেন। নাম ধরে বললাম কারণ আমি তাকে মা বলে ডাকি না আর এখন! গ্রামে ভাল চিকিৎসার অভাবে আমাকে জন্ম দিতে যেয়ে আমার মা মারা যান, সেজন্য নিজের কষ্ট সহ্য করেও আমি গ্রামেই থেকে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারজন্য অরুকে এতবড় খেসারত দিতে হবে জানলে… সে যাক! পরদিনই আমি অরুকে নিয়ে ঢাকা চলে আসি।
এরপরের ঘটনা আমাদের দু’জনের সংগ্রামের। অরুও তোমার মত হয়ে গেছিলো জানো শাহনাজ? কথা বলতো না ঠিকমত, খেতে চাইতো না, পালিয়ে যেতে চাইত সব ছেড়ে আর নয়ত মরে যেতে চাইতো! দু’টো বছর, পুরো দু-টো বছর আমাদের জীবন থেকে ঝরে গেছে এজন্য! একটু একটু করে আস্তে আস্তে অরুকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনেছিলাম আমরা সবাই মিলে- আমি,মিশু আর নূরজাহান দাদী! আমাদের প্রাণান্তক চেষ্টা শেষে সফল হলো!
সেই অরু কলেজে ভর্তি হলো, ঢাকা বোর্ডের সেরা রেজাল্টটা হাতে নিয়ে দেশের সবচেয়ে নামকরা মেডিকেল কলেজটায়ও চান্স পেলো! আমি নিজেই সেখানে চান্স পাইনি, কিন্তু আমার অরু দেখিয়ে দিলো সবাইকে!
মেডিকেলের এতগুলো ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে সেই মেয়েটা প্রথম জায়গাটা কেড়ে নিলো নিজের প্রচণ্ড জেদ আর পরিশ্রম দিয়ে! অথচ ক’বছর আগে এই মেয়েটা আত্নহত্যা পর্যন্ত করতে চাইতো! দিনরাত ওকে চোখে চোখে রাখতাম আমরা তিনজনে মিলে, মিশু তো ওর পরিবার, স্বামী-সন্তান সব নিয়ে আমার পাশেই বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতো তখন! বটগাছের মত ছিলেন দাদী, একচুলের জন্যও অরুকে একলা হতে দিতেন না…সে এক বিষন্ন, বিপর্যস্ত ইতিহাস শাহনাজ! সে তোমার না শুনলেও চলবে, শুধু এটুকু জেনো- সেদিন যদি বিষাদের স্রোতে সেই গ্রামের বউ অরু ভেসে যেতো তবে আজকের এই ডক্টর অরুন্ধতী নামের তারাটা কি এভাবে এত আলো ছড়াতে পারতো? তুমিও কি সেই একই ভুল করবে যেটা অরু সেদিন করতে চেয়েছিলো? যে শয়তানটা তোমার জীবনকে নষ্ট করে দিতে চায় তার সেই ইচ্ছেটা যদি তুমি পূরণ করে দাও তবে তো তারই জিত হলো! তোমার বাবা,মা, ছোট বোনটা- এদের কথাটা ভেবে দেখো একবার… ‘- ডক্টর আনিস কথা বলে চলেন, যেন এই সব কথাগুলি মুখস্থ তার। কিন্তু এই ছোট্ট ঘরটার প্রতিটা ইট জানে মনের কী ভীষণ গহীন থেকে এক-একটা ধ্বনি, এক-একটা শব্দ ভেসে আসছে তার কণ্ঠনালী বেয়ে! এত বছর, এত্তগুলো বছর পেরিয়ে গেছে তবু এখনো সেদিনের ঘটনাগুলো একদম জীবন্ত মনেহয়! মিশুর কাছেই পরে জেনেছে আনিস, আলেয়া খাতুনের সাথে খশরুদের বাড়িতে যাবার পরপরই ঊষা মিশুকে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে যায়। কাঁদতে কাঁদতে বলে কিছুক্ষণ আগেই খশরুকে আলেয়া খাতুনের সাথে ফোনে কথা বলতে শুনেছে ও, যতটুকু বুঝেছে সম্ভবত আজই অরুকে নিয়ে গ্রামে বদনাম রটাবে ওরা। ফোনে কথা শেষ করেই খশরু দৌড়ে বেরিয়ে যায়, ঊষা দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছিলো কী করবে,কাকে জানাবে। এরপর মিশুকে ঢুকতে দেখে দৌড়ে যায়। আলেয়া খাতুনের আচরণে মিশুর এমনিতেই সন্দেহ হচ্ছিলো, ঊষার কথা শুনে ওকে নিয়ে পড়িমরি করে বাড়ির দিকে ছুটে যায় সে। তখনই আনিসের সাথে দেখা হয় আর তারপর…
★
খুনের দায়ে ঊষাকে যখন পুলিশের গাড়িতে ওঠানো হচ্ছিলো, মিশু তখন সকলের সামনে জোর গলায় বলে ওঠে আলেয়া খাতুন এরচেয়ে বেশি দোষে দোষী। মিশুর সাক্ষ্যেই তাকেও গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে আলেয়া খাতুন নিজের দোষ স্বীকার করে যে সাক্ষ্য দেন তা অনেকটা এরকমঃ
‘খশরুয়ে আমারে কইসে অরুরে নিয়া পলায়া যাইবো, তারপর অরুরে বিয়া করবো! অরুর ব্যাগ গুছায়া রাখতে কইসে, আর অরুরে অষুধের পিঠাটা খাওয়াইতে কইসে। আমি সকালে অরুরে নূরিদাদীর বাড়িত পাঠায়া সব গুছাইসিলাম, হেরপর খশরুয়ে আইলে আমি অরে ভিত্রে লুকায়া রাইখা মিশুরে নিয়া গেসিলামগা… খশরুয়ে এইরকম করব জানলে আমি কুনুদিনি এইসব করতাম না…’
ঊষার সাজা অনেকটা কমে আসে সবার সাক্ষ্যপ্রমাণে।
আনিসের জন্মদাত্রী মায়েরা কেবল দুই বোন ছিলেন, তাদের বাবা ছিলেন আড়তের বড় ব্যবসায়ী। নানার তরফ থেকেই ঢাকার অদূরে বেশ খানিকটা জমিসহ একটা পুরনো বাড়ি পেয়েছিল আনিস। সেটাকেই সংস্কার করে একপাশে নিজেদের থাকার ব্যবস্থা করেছে, আর অন্যপাশে ছোট্ট একটা ট্রমা সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছে। জেল থেকে মুক্তি পাবার পর ঊষাকে এখানেই নিয়ে এসেছে আনিস আর অরু। ওদের সাথেই ঊষা কাজ করছে নার্স হিসেবে।
★
সপ্তাহ দু’য়েকের জন্য এখানেই থেকে যায় শাহনাজ। এরমধ্যেই বেশ অনেকটা সুস্থ হয়ে গেছে সে। সন্ধ্যার কোচিং শেষে বাসে করে বাসায় ফিরছিলো শাহনাজ সেদিন, বাসের ভেতরেই…। সমস্ত সংবাদ মাধ্যমে ফলাও করে খবরটা ছাপা হয়েছিলো, দোষী ড্রাইভার আর হেল্পারকে গ্রেফতার ও করা হয়েছে কিন্তু এই প্রচন্ড যন্ত্রণার মধ্যে বিষের শিশি ঢেলে দিয়ে শাহনাজের চূড়ান্ত ক্ষতিটা করেছে আরেকজন- সুমন্ত! এই ঘটনার পর দু’বছরের ভালোবাসার সম্পর্ক এক মূহুর্তে ছিন্ন করে মেয়েটাকে একদম খাদের কিনারায় ঠেলে দিয়েছিলো, অরুন্ধতি আর আনিসের আপ্রাণ প্রচেষ্টায় একটু একটু করে ফেরানো গেছে মেয়েটাকে!
★
-‘নাতিন বোলই খা,বোলই খা! হাতে নিয়া নুন
নাতিন আমাল পইলা গেছে বোলই গাছে থুন!’- ঝাঁকড়া চুল দুলিয়ে মাথা নেড়ে নেড়ে আধো আধো গলায় গান গাচ্ছে দু’বছরের বাচ্চা মেয়েটা! পাশে বসে বসে নূরজাহান বেগম লাঠি ঠুকে ঠুকে তাল দিচ্ছেন, মনে মনে ভাবছেন
‘আইজকা অরু আর আনিসে আইলে গেদির গানডা শুইনা চমকায়া যাইব! হুহু, নূরজাহান বেগম যত শোলক আর গান জানে, সবডি এই গেদিরে শিখায়া তবে মরবো!’
তাল পেয়ে বাচ্চাটা ততক্ষণে কোমর দুলিয়ে নাচতে আরম্ভ করে দিয়েছে, প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে নূরজাহান বেগম দেখছেন- ‘আহা! এক্কারে আনিসের মুখটা যেন কাইটা বসায়া দিসে মাইয়াডার চেহারায়!’
★
সমাপ্ত!
নোটঃ যে আপুদেরকে এক জীবনে অরুন্ধতীর মত বিভীষিকার মুখোমুখি হতে হয়েছে, ‘একজীবন’ গল্পটা তাদের জন্য উৎসর্গিত। নিশ্চয়ই এই কষ্টের পর আল্লাহ আপনাদের জন্য সুখ লিখে রেখেছেন, এক জীবনে না হোক অন্য জীবনে, ইহজনমে না হোক পরজনমে!
শুধু হাল ছাড়বেন না, প্লিজ!
একজীবন পর্ব ৭এবং শেষ
একজীবন
পর্বঃ ৭ (শেষ পর্ব)
★
খুব ভোরবেলা ঘুম ভাঙার অভ্যেস আমার, ফজরের নামাজটা পড়েই নিজের পড়ালেখাটুকু শেষ করে নিতে হতো বাবার বাড়িতে থাকতে! এরপর তো সারাদিন ছুটোছুটি, স্কুল ফেরত বাড়ি এসে আবার ঘরের কাজকর্ম, ছোটো ভাইটার দেখাশোনা- আর পড়ার ফুরসতটাই মিলতো না! সেই অভ্যাসটা এখনো যায়নি। এ ক’দিন ভোরে উঠে নামাজটা পরে নিয়েই ছাদে চলে যেতাম, ভোরের হিম হিম পরিবেশটা এত ভাল্লাগে! আজ তো ছাই সেই ইচ্ছাটাও মরে গেছে, একলা একলা আর কাঁহাতক ছাদে ঘুরে বেড়ানো যায়? যে শালিক সঙ্গী খুঁজে পায় তার বুঝি আর একা চড়ে বেড়াতে ভালো লাগে?
কিন্তু এই ট্যাটনা হাবাটার ঘুম ভাঙানো যায় কীভাবে! নভেম্বর মাস চলে, গ্রাম এলাকা বলে এখানে ভাল শীত পড়েছে এরমধ্যেই….ঠান্ডা পানি এনে গায়ে ফেলে দেয়া যেতো কিন্তু সত্যি বলতে মায়া হচ্ছে বেচারার জন্য! নাহ! সবে জ্বর ছেড়ে উঠেছে এখন এই শীতে পানিটানি মারা যাবেনা। ধুর! থাকুক ঘুমিয়ে। জেগে গেলেই তো রাজ্যের অদ্ভুত অদ্ভুত সব আলাপ জুড়ে বসবে আর ওদিকে আমার হৃদপিণ্ডটার বারটা বেজে যাবে ধুকপুক করতে করতে, এরচে বরং ঘুমিয়ে থাকতেই যা বলার বলে নিই, তারপর ছাদে এক ঘুরান দিয়ে আসি!
-‘হাবাচন্দ্র, ক্যাবলাকান্ত, দস্যু সর্দার! দিব্যি তো নিষ্পাপ ফুলটির মত ঘুমাচ্ছো, কে বলবে যে তুমি এক নাম্বারের ট্যাটন! খালি ত ফটফট করো, দুনিয়ার এত কিছু বোঝ আর মন বোঝ না, কচুর ডাক্তার তুমি! কালকে যে জোর করে আমার ওপর ডাকাতি ফলালে, এখন যদি আমি তার প্রতিশোধ নিই আটকাতে পারবে? উহ-হু! পারবেনা! এখন আমি তোমার কপালে, তারপর নাকে তারপর দুই গালে আর তারপর… ’
-‘শুধু বলেই যাবে না কিছু করবে? কতক্ষণ মরার মত পরে আছি আশায় আশায়!’- হাত নেড়ে নেড়ে আবোলতাবোল বলে যাচ্ছিলাম আমি, খপ করে হাতটা ধরে নিয়ে বলল সে! ফিচলে ছেলেটা তারমানে এতক্ষণ জেগে ছিলো! কী খারাপ, কী খারাপ!
-‘আপনি আসলেও একটা খারাপ, একটা অসভ্য, একটা …. একটা…’
-‘একটা কী? হাবাচন্দ্র? ক্যাবলাকান্ত? নাকি দস্যু সর্দার? নাকি সবগুলাই?’
-‘জানিনা! ছাড়েন, আমি যাব!’
-‘কই যাবা এখন? সবাই ঘুমে কাদা… ওহ! ম্যাডাম তো আবার ভোরে ছাদে যান!’
-‘এটাও জানা হয়ে গেছে!’
-‘আমি হাত গুনতে জানি!’
-‘তাই? নিন গুনে দেখান ত আমার হাত’- দুই হাত সামনে মেলে দিয়ে বললাম।
খানিক্ষণ বুঝদারের মত চেয়ে চেয়ে হাত দুটো দেখলো সে। তারপর-
-‘নাহ, এতদূর থেকে দেখা যাচ্ছেনা, কাছে আসতে হবে’- বলে এক ঝটকায় নিজের দিকে টেনে নিলো, আমার ঝুঁকে থাকা কণ্ঠের চারিদিকে দুই হাতের বন্ধনী তৈরী করে ফিসফিসিয়ে বললো-
-‘আপনার হাত বলছে-
অচিন দেশের অচিন পাখি, আমি কেমন করে বাঁধি?
সোনার বেড়ি, রুপার খাঁচা বৃথাই তারে সাধি!
-‘এটাও কি নির্মলেন্দু গুণের কবিতা?’
-‘নাহ! এটা আনিসেন্দু দোষ-এর লিখা, নির্মলেন্দু গুণ নয়!’
আচ্ছা! ফিচলেটা নিজে বসেবসে পয়ার বাঁধছে তারমানে! বেশ, তুমি ফিচলে হলে আমিও তোমার যোগ্য ‘অর্ধাংগী’- মনেমনে ফন্দি এঁটে সরল মুখ করে বললাম-
‘নাহ! এটা তো আমি পড়েছি আগে, আমার চেনা কবিতাটা!’
-‘কীহ! এটা আমি মাত্র বানালাম ভেবে ভেবে, মিছেকথা!’- হাবাটা বোধহয় দ্বিধায় পরেছে, এর আগে তো কোনোদিন এভাবে মিথ্যেমিথ্যি ফাঁদে ফেলেনি তাই এই ডাহা মিথ্যাটাও অবিশ্বাস করতে পারছেনা! আসলেই ক্যাবলা!
-‘অন্যের লিখা নিজের নামে চালিয়ে দিচ্ছেন! আপনাকে তো ভালমানুষ জানতাম আমি!’- রীতিমত কঠিন গলায় বললাম।
-‘আচ্ছা, বেশ। তবে পরের লাইনগুলি বলো শুনি! তবে বিশ্বাস করব…’
-‘দাঁড়ান, মনে করতে হবে!’
খানিকক্ষণ মাথা চুলকে নিয়ে বললাম-
‘সোনা-রুপা, পান্না-চুনি তাই কি পাখি চায়?
ভালোবাসার বেড়ি হতো, পরতো পাখি পা’য়!’
ক্যাবলার চোখ ততক্ষণে রসগোল্লা হয়ে গিয়েছে!
-‘আচ্ছা! এই কথা! ষোড়শীর পেটে পেটে এত বুদ্ধি, আর আমি কীনা আঠারোর অপেক্ষায় বসে আছি! সন্ধিচুক্তি বাতিল….!
শেষমেশ আর ছাদে যাওয়া হলোনা আমার, বদলে বিষপিঁপড়ের ছোবলে সর্বাংগ জ্বলেপুড়ে গেলো!
★
সকালে সাজুখালা এলে আমিও তার সাথে রান্নাঘরে গেলাম সাহায্য করতে। দুমুঠো দুধ-রুটি মুখে দিয়েই আনিস দৌড়ে বেরিয়ে গেছে, প্রতি শুক্রবার সকাল সকালই সদর হাসপাতালে যেতে হয় তাকে। আজকে শুক্রবার, বাড়িতেই থাকবে সবাই তাই খাবারের আয়োজনটাও একটু ভাল করতে হবে। মাঝে মাঝে নূরজাহান দাদীর কথা খুব মনে পরে, সেইযে একবার গেলাম এরপর আর যাওয়াই হলোনা! অবশ্য ভালমন্দ রান্না হলে সাজুখালাকে দিয়ে দাদীর বাড়িতে পাঠিয়ে দিই প্রায়ই। আজকেও সাজুখালাকে বলে সব একটু বেশি বেশি রান্না করিয়ে নিয়েছি, সময় সুযোগ মিললে আমিই নিয়ে যাব নয়ত সাজুখালাকে দিয়েই পাঠিয়ে দেব। মনে মনে এসব ভাবছি কিন্তু কোথাও একটা খচখচে অনুভূতি হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছি না। সকাল থেকে কিছু একটা খটকা লাগছে কোথাও, ঠিক বুঝতে পারছি না খটকাটা কোথায়! কি যেন নেইনেই বলে মনে হচ্ছে…
-‘আইজকা খালাম্মার কুনু সাড়াশব্দ পাইনা। সক্কালবেলাডা চিল্লাচিল্লি ছাড়া গ্যালো আইজকা আমার, দিনডা মনেহয় ভালা যাইব আইজকা!’- সাজুখালার উছ্বসিত কথায় ভাবনার সুতো কাটে আমার।
ওহ! তাইতো! আলেয়া খাতুনের চিৎকার চেঁচামেচি নেই আজ, তাই এমন খালি খালি মনে হচ্ছে! রান্না প্রায় শেষ, এখনো ওঠেনি না কি! যাকগে, আমার কী? সকালটা শান্তিতে গেলো এইই ঢের!
★
অন্যদিনের চেয়ে আজ আলেয়া খাতুনকে বেশি প্রাণবন্ত আর হাসিখুশি লাগছে! সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলছেন, কোনো বকাবকি, চিৎকার-চেঁচামেচি নেই এমনকি আমার সাথেও বেশ ভালভাবেই কথা বলে যাচ্ছেন। রাক্ষুসী শূর্পনখার তবে সুমতি হলো বোধহয়! সকালের নাস্তাপর্ব শেষে আমাকে ডেকে বললেন-
-‘আইজ ত অনেক খাবার বেশি হইসে, দুপুরের আগে আগে তুমার দাদীরে কিছু নিয়া দিয়াইসো আর তুমিও দাদীর লগেই দুপুরের খানা খাইয়া আইসো, হেয় একলা থাকে….। সাজুরে দিয়া তো পেরায়ই পাঠাও, আইজকা নিজেই যাইও। বন্ধের দিন আছে, হেরে দেইখ্যাও আইলা…’
শেষমেশ এই বাক্য! এই মহিলার মুখে! আমার চোখ রীতিমত রসগোল্লা হয়ে গেছিলো বোধহয়, কোনোরকমে ঘাড় কাত করে সম্মতি জানালাম আমি! আনিস হাঁদারাম টা থাকলে ভালো হতো, একসাথে যাওয়া যেতো! কিন্তু প্রতি শুক্রবারই সদর হাসপাতালে যেতে হয় তাকে, বিকেলের আগে ফিরতে পারেনা। আজও সেখানেই গিয়েছে।
এ বাড়ি থেকে দাদীর বাড়িতে যেতে সেই বাঁশঝাড়টা পেরুতে হয়- ভাবতেই কেমন গা গুলিয়ে আসে আমার! সাজুখালাকেও একগাদা কাপড়-চোপড় ধুতে বসিয়ে দিয়েছে, রুপাটাও বাড়িতে নেই-বাবার বাড়ি বেড়াতে গেছে! অবশ্য এই দিনদুপুরে আর কি-ই বা এমন হবে? তাছাড়া খশরুকে সেদিনের পর আর দেখিওনি, বোধহয় শিক্ষা হয়েছে শয়তানটার! এইটুকুই তো রাস্তা, তাতে দিনের আলো- একটা ব্যাগে খাবারগুলি ভরে নিয়ে একাই রওনা দিচ্ছিলাম। মিশু এসে পথ আটকালো হঠাত।
-‘তুমারে একলা ছাড়ন যাইবনা, দাদাভাইয়ের নিষেধ আছে! আমিও যামু সাথে, চলো!’
-‘কেন অযথা খাটনি করবেন মিশুআপা! আমার সমস্যা হবেনা…’
-‘দাদাভাই যদি শুনে তুমারে একলা ছাড়সি,আমারে ধইরা ঘারাইবো! বারবার বইলা গেসে যতদিন আমি আছি আমার ভরসায় তুমারে রাখতেসে, এই মাসের বেতন হইলেই তোমার জন্য মোবাইল কিনা দিবো তখন আর… ‘
আমি রসগোল্লা চোখ করে তাকাতেই জিব কেটে থেমে গেলো মিশু।
-‘কিহ! এইসব বলছে সে আপনারে?’
-‘আমারে না করসিলো জানাইতে, মনের ভুলে বইলা দিসি। অরু,তুমি কইলাম দাদাভাইরে কইও না কিছু! আর ফোন একটা দরকার ও তুমার, আমি ত আর সবসময় এইখানে থাকুম না, বিপদ-আপদে অন্তত দাদাভাইরে সাথে সাথে জানাইবার পারবা…’
-‘কী যে সব কাজকর্ম করেন আপনেরা দুই ভাইবইনে! আচ্ছা চলেন যাই এখন, খাবার এইগুলা ঠান্ডা হইলে দাদীর আবার গরম দিতে হইব পরে! কিন্তু আপনে আমার সাথে গেলে আপনের আম্মা আবার রাগ করব না তো? দেখেন…’
কথাটা বলে শেষ ও করতে পারিনি, আলেয়া খাতুনের রণমূর্তিটা একেবারে সটান আমাদের মাঝখানে এসে দাঁড়ালো, নিশ্চিত এখন দু’কথা শুনিয়ে দেবে মিশুকে আর আমাকে…
কিন্তু কী অদ্ভুত সব ব্যাপার হচ্ছে আজ সকাল থেকে! আলেয়া খাতুন নিজে যেচে এসে বরং হাসিহাসি মুখ করে মিশুকে বললেন-
‘যা তো মিশু মা অর লগে নূরি দাদীর বাড়িত। আনিসে ত অরে একলা ছাড়তে মানা কইরা গ্যাসে বারবার…’
সত্যি, সকাল থেকে একের পর এক চমক! আর নেয়া যাচ্ছেনা।
-‘আম্মার হইসে কী আজকা? যাদুটোনা করসে নি হেরে কেউ? সকাল থিকা এত মধু ঝরতাসে গলায়…ঘটনা ভাল্লাগতাসে না কইলাম আমার! তুমি একটু সাবধানে থাইকো অরু!’ – বাইরে বেরিয়েই আমার হাত ধরে বললো মিশু।
-‘আরে ধুর! আপনে অযথা চিন্তা করতেসেন মিশু আপা, আম্মা হয়ত আমারে মাইনা নিসেন!’
★
-‘দাদী! ও দাদী! বাড়িতে আছেন নাকি?’- দাদীর উঠানটায় যেয়ে দাঁড়ালাম অবশেষে আমরা!
-‘ক্যাডা? ও নাতিন তুই! কতদিন পর আইলি, মিশুও আইসস লগে, তয় তর জোড়ায় কই?’
-‘জোড়ায় নাই! গ্রামে গ্রামে ডাক্তরি কইরা বেড়ায় আপনের নাতিয়ে, আমার জন্য সময় আছেনি তার?’
-‘শ্যাম যদি হইত পোষাপাখি প্রানসখি
শ্যাম যদি হইত পোষাপাখি ।।
রাখিয়া হৃদয়পিঞ্জরে পুষিতাম যতনকরে
এ জনমের মতো হইতাম সুখি , প্রান সখি ।।’- দাদী আচমকা মাথা নেড়ে নেড়ে গান ধরলেন! এদিকে দাদীর কান্ড দেখে মিশু মুখে হাতচাপা দিয়ে হাসছে!
-‘ধুরু দাদী! জ্বালাইয়েন না তো! পোষাপাখি! এমনেই যার ফটফট কথার জ্বালায় বাঁচিনা, তারে পোষাপাখি বানায়া আরো মরি!’-শেষ অংশটুকু বিড়বিড়িয়ে বললেও দাদীর কানে ঠিক পৌঁছে যায়!
-‘ক্যাডায় জ্বালায় তরে? আনিসে নি? স্বোয়ামীর জ্বালায় যদি না জ্বলিবে রাই, বৃথা তুমার নারী জনম জেনে রাখো তাই!’
-‘কত্ত শোলক জানেন আপনে? সারাদিন খালি শোলক গাইতেই থাকেন!’
-‘কি করুম বইনে? আমারে ত জ্বালানির কেউ নাই!’- দাদী কপট দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
-‘কে বলছে কেউ নাই? এইযে আমরা আইসা পরসি জ্বালাইতে! আপনের সাথে আজকে দুপুরে খাবো, সব নিয়াসছি। চলেন বসি!’- মিশু বললো ফট করে।
-‘আয় বয়! তরে আইজকা নাগালের কাছে পাইসি যখন তখন সব শিখায়া দিমুনে… ’
-‘কী শিখাইবেন আপনে? আমি পারি সব!’- আমি সগর্বে উত্তর দিলাম।
-‘হের নমুনা ত দেখতাসিই! গলায় দাগ-নিশান বানায়া ঘুরতাসো, উদুইল্যা মাইয়া কুনহানকার, বয়স হইসে বুদ্দি অয়নাই! আনিস্যাডারও তালতওবা নাই… ’
দ্রুত শাড়ির আঁচলটা দিয়ে দুই প্যাঁচে কাঁধের কাছটা ঢেকে নিলাম আমি, মিশু ততক্ষণে হাসি চেপে না রাখতে পেরে হোহো করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছে!
★
-‘কুনদিক দিয়া এর সময় গেলগা ট্যার ও পাইলাম না! নূরি দাদী এক্কারে আউলাঝাউলা, এত কথা কয়! শুনতে শুনতে সময় যায়গা…’
বাড়ি ফেরার পথে মিশু বলে।
-‘হু! তবে দাদী খুব ভাল মানুষ আর বেশ চালাক চতুর ও!’
-‘হ! বয়স হইলে কি হইব, এখনো টনটনা!’
দুপুরের রোদটা মরে গেছে, শান্ত একটা বিকেলের আরম্ভ হচ্ছে কেবল। আশেপাশে সব নিস্তব্ধ, মাঝেমাঝে ঝলক ঝলক পূবের হাওয়া বয়ে যাচ্ছে… গ্রামের পথঘাটগুলি এত সুন্দর লাগে মাঝেমাঝে! মিশুর সাথে হাঁটতে হাঁটতে কখন বাড়ি ফিরে এসেছি বলতেও পারবনা। উঠোনে অস্থির ভঙ্গিতে পায়চারি করছিলেন আলেয়া খাতুন, পেছন দিয়ে যে আমরা এসে দাঁড়িয়েছি সেটাও টের পাননি। ঘুরে তাকিয়ে আমাদের দেখতে পেয়েই যেন চমকে গেলেন!
-‘এত দেরি হইল তুমাগো আইতে! সইয়ে আইসিল মিশুরে দ্যাখতে তা ত সে বাড়িত আছিলোনা, এই পিঠাডি দিয়া গ্যাসে। নেও তুমি একটা খাও মিশু এইডা খা…- বলে দু’জনের হাতে দুইটা পিঠা ধরিয়ে দিলেন উনি! কী আজব, এই মহিলা আমাদের জন্য পিঠার বাটি হাতে উঠানে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন এতক্ষণ! এ তো পরে ধীরে সুস্থে বসেও খাওয়া যেতো… অদ্ভুত!
-‘আনিসে এখনো আসেনাই, পিঠা খাওয়া হইলে যাও ঘরে গিয়া বিশ্রাম নেওগা। আর মিশু আমার লগে চল, সইয়ের বাড়িত যামু একটু!’
-‘মা আমি মাত্র আসছি এখন আর যামুনা, আপনে যান!’
-‘সই তরে দেখবার চাইসে, এইবার আইয়া ত দেখাও করস নাই! চল চল, কাইলকা ত আবার যাবিগা শ্বশুরবাড়িতে,আইজকা দেখাডা কইরা আসি চল!’ – মিশুকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলি বলেই আমার দিকে ঘুরলেন আলেয়া খাতুন।
-‘কী হইল, মিশু খায়া ফালাইলো তুমি এখনো পিঠা হাতে নিয়া দাঁড়ায়া আছো ক্যা? ভাল বানাইসে পিঠাডি, আকবর আর আনিসের জন্যিও রাখসি… খাও খাও… বলে একপ্রকার জোর করেই প্রায় আমার মুখে ওটা গুঁজে দিয়ে একপ্রকার টেনেই মিশুকে নিয়ে গেলেন বগলদাবা করে!
★
আনিস এখনো ফেরেনি, রুপাটাও বাপের বাড়ি গেছে দু’দিন হলো, এই প্রথম পুরো বাড়িটাতে আমি একদম একা! একটু ভয় ভয় লাগলেও বেশ ভালও লাগছে সাথে, যাই ছাদে যেয়ে ঘুরে আসি! গত শুক্রবার কিছু গাছের চারা লাগিয়েছিলাম ছাদে টব বসিয়ে… রোজ ভোরে যেয়ে জল-পানি ছিটিয়ে আসি। আজ তো যাওয়া হয়নি, এই সুযোগে যেয়ে দেখে আসি একবার!
পিঠেটায় দ্বিতীয়বার কামড় বসাতেই একটা তিতকুটে স্বাদ জিহবায় এসে লাগলো… কেমন যেন একটা তেতো তেতো অনুভূতি! নাহ, বাকিটা আর খাওয়া সম্ভব নয়… ছাদ থেকে বাড়ির পেছনে ফেলে দিলাম ওটা। গাছগুলি ভালই ডালপালা ছেড়েছে। ধুর! আসার সময় মনে করে বালতিতে গাছের জন্য পানি নিয়ে এলেই হতো, যাকগে এখন নিচে যেয়ে নিয়ে আসি…
প্যাঁচানো মরচে ধরা লোহার সিঁড়িটার মাথায় দাঁড়াতেই মাথাটা কেমন ঘুরে উঠলো, রেলিং ধরে সাবধানে নামছিলাম, চোখের সামনে সব কেমন ঘুরছিলো মনে হলো… একহাতে শক্ত করে রেলিংটা ধরে কোনোমতে সোজা দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিলাম, সামনে একটা আবছা মানব অবয়ব,পরিচিত কিন্তু…কিন্তু না, পছন্দ করিনা আমি একে একদমই, এগিয়ে আসছে আমার দিকে… দৌড়ে পালানো উচিত আমার মস্তিষ্ক সাবধান করছে বারবার অথচ চোখের সামনে সবকিছু কেমন ঘোলাটে হয়ে আসছে…. ব্যস এটুকুই শেষ পরিপূর্ণ স্মৃতি আমার! এরপর সব কেমন আবছা…
★
জেগে থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছি আমি, কিন্তু অদ্ভুত ঘোরের মত ঘুম আমাকে ধীরে ধীরে কাবু করে দিচ্ছে। লোকটা ততক্ষণে এগিয়ে আসে আমাকে ধরে ফেলেছে, হ্যাঁচকা টানে আমাকে নিজের কাঁধে তুলে নিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে সোজা আমার ঘরের দিকে যাচ্ছে। একটা বোঁটকা গন্ধ তার গায়ে, বিচ্ছিরি এই দুর্গন্ধটা আমি আগেও পেয়েছি… সেদিন বাঁশঝাড়ে…
খশরু!
চকিতে মস্তিষ্কের একটা কোণ সজাগ হয়ে ওঠে আমার, কিন্তু শরীরের বাকি অঙ্গ প্রত্যঙ্গগুলো নিঃসাড়। মস্তিষ্কের সজাগ অংশটা বারবার যেন সতর্ক করে দিচ্ছে আমাকে, কিন্তু আমার এতদিনের বিশ্বস্ত হাত-পা সহ শরীরের প্রত্যেকটা অস্থি-পেশী যেন আজ বিদ্রোহ করেছে… সামান্য নাড়াচাড়ার ক্ষমতাটুকুও আজ বড় আকাঙ্ক্ষিত মনে হচ্ছে আমার!
ঘরে ঢোকার সময় দরজার সাথে ঠকাস করে মাথাটা বাড়ি খেলো আমার, মুহুর্তের জন্য হাত দুটোও যেন সচল হয়ে উঠলো। দু’হাতে খশরুর গলাটা পেছনে ধাক্কা দিয়ে সরাতে গেলাম, কিন্তু ততক্ষণে একটা কাপড়ের দলার মত আমাকে ছুঁড়ে বিছানায় ফেলে দিয়েছে পশুটা!
-‘ত্যাজ কতো শালীর! হারামজাদি, বে…..’- খশরুর উচ্চারিত কুৎসিত শব্দগুলো যেন একদলা নোংরা মাছির মত উড়ে বেড়াচ্ছে ঘরে, এদের ভেতর দিয়েই বেরোতে হবে, নিজের ঘর থেকে আজ নিজেরই পালাতে হবে আমায়… যত দ্রুত সম্ভব! কিন্তু প্রচণ্ড ঘুমের অনুভূতি আমাকে বিবশ করে দিচ্ছে যে…
-‘এমুন অবস্থা করুম, তর পরাণের স্বামী আর তরে ঘরে নিবনা শালী, …’- খশরু হাঁপাচ্ছে আর হাসছে, হায়েনার হাসি- কোথায় যেন পড়েছিলাম… আহ, মাথাটা আউলে গেছে একদম আমার। আমাকে পালাতে হবে, যেভাবেই হোক…. একবার বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলাম… আনিস! আনিস কই? কমলাপুরে থাকবে… আমাকে যেতে হবে…
অতীত আর বর্তমান মিলেমিশে জট পাকিয়ে ফেলেছে মাথার ভেতরটা! এরমধ্যেই একটা নোংরা বিষধর সাপের মত হাতের স্পর্শে সমস্ত সত্তা রি-রি করে ওঠে আমার। গোঙানোর মত শব্দ করতে থাকি আমি, খশরু দ্রুত কিছু একটা মুখে গুঁজে দেয়, দুর্গন্ধভরা কাপড়টা মুখ থেকে ছুঁড়ে ফেলতে চাই কিন্তু খশরুর জান্তব হাতটা বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। প্রচণ্ড ঘোরের মধ্যে আমার দুর্বল শরীরটা শেষমেশ হাল ছেড়ে দেয়, মস্তিষ্কের সজাগ অংশটা নিস্তেজভাবে তখনো সাবধান করে চলেছে……
…
…..
……..
কতক্ষণ পার হয়েছে জানিনা, বোধহয় অনন্তকাল! চোখ মেলতেই মিশুকে দেখলাম, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ওর পাশে আরেকটি মেয়ে…চেনা মুখ, কোথায় দেখেছিলাম? যাকগে, সে যে খুশি হোক… আর কেউ নেই?
আর কেউ…
-‘বেশি শীত করছে অরু? ফ্যান কমিয়ে দেবো?’- একটা গমগমে কণ্ঠে স্বস্তি ফেরে আমার।
আহ! এইতো সেই কণ্ঠস্বর! শিয়রে বসে চুপচাপ মাথায় বিলি কাটছিলো এতক্ষণ, তাই দেখতে পাইনি। ঘাড় ঘুরাতেই দেখলাম সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে আমার কপালের ওপর দিয়ে ঝুঁকে আছে মুখটা… একটা শান্ত, শুভ্র মুখ!
মাথাটা কেমন জট পাকিয়ে আছে, ঠিক কীভাবে এখানে এসে ঘুমিয়ে গেলাম, এরা সবাই কীজন্য এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছে সব কেমন অদ্ভুত লাগছে! কিছুই মনে করতে পারছিনা। গলাটা তেতো লাগছে, ঢোঁক গিলে বললাম-
-‘পানি খাবো!’
আনিস দৌড়ে পানি এনে দিলো। উঠে বসতে যেয়ে টের পেলাম হাতে স্যালাইন লাগানো, আধশোয়া হয়ে পানির গ্লাসটা হাতে নিলাম। ওদিকে মিশু তখনো কেঁদেই চলেছে, সামনে দাঁড়ানো মেয়েটির দিকে আরেকবার তাকাতেই মনে পরলো কোথায় দেখেছি একে- খশরুর নতুন বিয়ে করা বউ এই মেয়েটা!
খশরু!
এক পলকে অনেকগুলো দৃশ্য আবছা, সাদাকালো ছবির মত ভেসে উঠলো চোখের সামনে… আমি ছাদে গেছিলাম গাছগুলো দেখতে, পানির জন্য নিচে নামতে যেয়ে মাথাটা কেমন ঘুরে গেলো তারপর একজন কেউ এগিয়ে আসছিলো… তারপর… তারপর…
হায় খোদা!
★
খয়েরী মলাটের ডায়েরীটা নিয়ে দৌড়ে নিচতলায় যায় মেয়েটা!
–‘তারপর?’- উস্কোখুস্কো রুক্ষ চুল, জবার মত লাল টকটকে চোখের নিচে কালি- দৌড়ে আসা মেয়েটা উদগ্রীব হয়ে প্রশ্ন করে।
কম্পিউটার ডেস্কে কাজ করতে থাকা থাকা শাড়ি পরা মহিলা চোখ তুলে তাকায়, বুকের কাছে সাদা নেমপ্লেটে সোনালি অক্ষরে ওর নাম ঝলমল করে ওঠে- ‘ঊষা।’
-‘তারপরের ঘটনা খুব সংক্ষিপ্ত শাহনাজ! এরকম একটা ঘটনার পর যা হওয়া উচিত, তাই হয়েছিল সেদিন!’- গমগমে গলায় উত্তরটা দিয়ে সরু চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে ঊষা।
-‘আমি জানতাম! সব মিথ্যে, সবাই মিথ্যে প্রবোধ দিচ্ছে আমাকে! আমি জানি অরুকে আনিস আর ফেরত নেয়নি,ভাসিয়ে দিয়েছিলো খড়কুটোর মত… সব মিথ্যে! সত্যিকারের ভালোবাসা বলে কিছু নেই, কিচ্ছুনা…সব শরীরসর্বস্ব!’- শাহনাজ দু’হাতে মুখ ঢেকে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।
–‘সে যদি তুমি এরকম ভাবো তবে তাই-ই! কিন্তু, আপাতত আমার কাউন্সেলিং এর অংশটুকু শেষ। তুমি তো জানোই আমি এখানকার নার্স। ডায়েরিটা পড়া শেষ হলে দু’জন ডক্টর মিলে এই পোস্ট ট্রমাটিক কাউন্সেলিংটার বাকি অংশ সম্পূর্ণ করবেন। চোখটা মুছে ২০৫ নাম্বার রুমে চলে যাও, আমি বলছি তোমার ভালো লাগবে!’
শাহনাজ মেয়েটা চোখ মুছে দাঁড়ায়, তারপর নেশাগ্রস্তের মত হেটে যায় দোতলায়। একটা ভয়ংকর দুর্ঘটনার পর post traumatic stress disorder- এ ভুগছিলো সে বহুদিন ধরে। অনেক চেষ্টার পরেও সতের বছরের এই মেয়েটাকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে না পেরে আজ সকালেই ওকে এই ট্রমা সেন্টারটায় নিয়ে এসেছিলেন ওর বাবা আতিফুস সালাম।
★
২০৫ নাম্বার রুমের সামনে যেতেই দরজার গায়ে সাঁটানো মাঝারি আকৃতির নেমপ্লেটটার দিকে চোখ পরে শাহনাজের।
‘ডক্টর অরুন্ধতী রহমান!’- নামটা পরে বুকের রক্ত ছলাত করে ওঠে শাহনাজের। এক ঝটকায় দরজাটা খুলতেই চোখ পড়ে শান্ত, সুন্দর চেহারার মেয়েটির দিকে। শাহনাজকে দেখেই চোখেমুখে একটা মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে দিয়ে মেয়েটি কবিতার মত গলায় বলে
–‘শাহনাজ! তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম মামনি! এসো বসো!’
–‘আপনি! আপনি অরু? অরুন্ধতী? আনিসের অরু… আপনি?’
-‘হ্যা, আমিই অরু!’
-‘আর আনিস? সে চলে গেছে তো আপনাকে ছেড়ে, না? আমি জানি সে চলে গেছে,আমাকেও ফেলে চলে গেছে…’
– ‘আরেকজন ডক্টর যিনি তোমার কাউন্সেলিং এর দায়িত্বে আছেন তার নামই আনিস,আনিসুর রহমান!’
অরুন্ধতী যেন আচমকা একটা বোমা ফাটিয়েছে, হতবিহ্বল দৃষ্টিতে শাহনাজ তখন তাকিয়ে আছে অরন্ধতীর দিকে। ডক্টর অরুন্ধতী ততক্ষণে ফোন বের করে কাউকে ডাকছিলেন, খানিক বাদেই সৌম্য চেহারার আরেকজন ডক্টর প্রবেশ করেন ঘরটায়।
–‘কেমন আছ শাহনাজ? আমি ডক্টর আনিস!’
–‘কিন্তু.. আপনি..’
-‘ভাল মেয়ের মত চোখটা মুছে বসো, বলছি সব! সদর হাসপাতালে ছিলাম সেদিন আমি, দ্রুত কাজ গুছিয়ে বাড়ি যেতে যেতে বিকেল হয়ে যায়। বাড়িতে ঢোকার একটু আগেই মিশু আর ঊষার সাথে দেখা হয় আমার, ঊষা হচ্ছে সেই খশরুর বউ মেয়েটা! দু’জনে দৌড়ে যাচ্ছে আমাদের বাড়ির দিকে, আমাকে দেখে হাউমাউ করে কিছু একটা বললো দু’জনে মিলে। কতটা বুঝলাম কতটা বুঝলাম না, কিন্তু কিছু একটা হয়েছে এটুকু বুঝে দৌড় লাগালাম বাড়িতে। ভেতরে ঢুকতেই আমার ঘর থেকে একটা মৃদু গোঙানির আওয়াজ কানে এলো, তারপর একটা কর্কশ পুরুষ গলায় কতগুলো বিশ্রী গালি…
ঘরের দরজাটা লাগানো ছিলো, তবে ভাগ্য ভালো সেটা প্লাস্টিক বোর্ডের দরজা। রান্নাঘর থেকে বড় দা এনে দুটো কোপ দিতেই চুরমুর করে ভেঙে পড়ে।ভেতরে অরু তখন অজ্ঞান, আর খশরু শয়তানটাও সেখানে। দরজা খুলতেই খশরু লাফিয়ে ওঠে, ঊষাকে দেখে নিরাপদ আশ্রয় ভেবে ওর পেছন দিয়ে বের হবার চেষ্টা করে। মিশু ততক্ষণে দৌড়ে অরুর কাছে গেছে, আমি খশরুকে ধরতে যাই কিন্ত তার আগেই শাড়ির আঁচলের নিচ থেকে রামদা টা বের করে খশরুর ঘাড় বরাবর কোপ বসিয়ে দেয় ঊষা! কোন ফাঁকে মাটিতে পরে থাকা দা টা কুড়িয়ে নিয়েছিলো মেয়েটা…
অরুর জ্ঞান ফেরার আগেই এগুলো হয়ে যায়। ওর প্রেশার লো, তাতে কড়া ঘুমের ঔষধ খাওয়ানো হয়েছে বুঝতে পেরে সাথে সাথে দ্রুত স্যালাইনের ব্যবস্থা করি।
শয়তানটার লাশ তখনো ঘরের বাইরেই পড়ে ছিলো, ওটাকে ফেলে রেখে আগে অরুর জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করি আমি।
খশরুর এত সাহসের পেছনে অবশ্য আলেয়া খাতুন ও ছিলেন। নাম ধরে বললাম কারণ আমি তাকে মা বলে ডাকি না আর এখন! গ্রামে ভাল চিকিৎসার অভাবে আমাকে জন্ম দিতে যেয়ে আমার মা মারা যান, সেজন্য নিজের কষ্ট সহ্য করেও আমি গ্রামেই থেকে যেতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারজন্য অরুকে এতবড় খেসারত দিতে হবে জানলে… সে যাক! পরদিনই আমি অরুকে নিয়ে ঢাকা চলে আসি।
এরপরের ঘটনা আমাদের দু’জনের সংগ্রামের। অরুও তোমার মত হয়ে গেছিলো জানো শাহনাজ? কথা বলতো না ঠিকমত, খেতে চাইতো না, পালিয়ে যেতে চাইত সব ছেড়ে আর নয়ত মরে যেতে চাইতো! দু’টো বছর, পুরো দু-টো বছর আমাদের জীবন থেকে ঝরে গেছে এজন্য! একটু একটু করে আস্তে আস্তে অরুকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনেছিলাম আমরা সবাই মিলে- আমি,মিশু আর নূরজাহান দাদী! আমাদের প্রাণান্তক চেষ্টা শেষে সফল হলো!
সেই অরু কলেজে ভর্তি হলো, ঢাকা বোর্ডের সেরা রেজাল্টটা হাতে নিয়ে দেশের সবচেয়ে নামকরা মেডিকেল কলেজটায়ও চান্স পেলো! আমি নিজেই সেখানে চান্স পাইনি, কিন্তু আমার অরু দেখিয়ে দিলো সবাইকে!
মেডিকেলের এতগুলো ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে সেই মেয়েটা প্রথম জায়গাটা কেড়ে নিলো নিজের প্রচণ্ড জেদ আর পরিশ্রম দিয়ে! অথচ ক’বছর আগে এই মেয়েটা আত্নহত্যা পর্যন্ত করতে চাইতো! দিনরাত ওকে চোখে চোখে রাখতাম আমরা তিনজনে মিলে, মিশু তো ওর পরিবার, স্বামী-সন্তান সব নিয়ে আমার পাশেই বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতো তখন! বটগাছের মত ছিলেন দাদী, একচুলের জন্যও অরুকে একলা হতে দিতেন না…সে এক বিষন্ন, বিপর্যস্ত ইতিহাস শাহনাজ! সে তোমার না শুনলেও চলবে, শুধু এটুকু জেনো- সেদিন যদি বিষাদের স্রোতে সেই গ্রামের বউ অরু ভেসে যেতো তবে আজকের এই ডক্টর অরুন্ধতী নামের তারাটা কি এভাবে এত আলো ছড়াতে পারতো? তুমিও কি সেই একই ভুল করবে যেটা অরু সেদিন করতে চেয়েছিলো? যে শয়তানটা তোমার জীবনকে নষ্ট করে দিতে চায় তার সেই ইচ্ছেটা যদি তুমি পূরণ করে দাও তবে তো তারই জিত হলো! তোমার বাবা,মা, ছোট বোনটা- এদের কথাটা ভেবে দেখো একবার… ‘- ডক্টর আনিস কথা বলে চলেন, যেন এই সব কথাগুলি মুখস্থ তার। কিন্তু এই ছোট্ট ঘরটার প্রতিটা ইট জানে মনের কী ভীষণ গহীন থেকে এক-একটা ধ্বনি, এক-একটা শব্দ ভেসে আসছে তার কণ্ঠনালী বেয়ে! এত বছর, এত্তগুলো বছর পেরিয়ে গেছে তবু এখনো সেদিনের ঘটনাগুলো একদম জীবন্ত মনেহয়! মিশুর কাছেই পরে জেনেছে আনিস, আলেয়া খাতুনের সাথে খশরুদের বাড়িতে যাবার পরপরই ঊষা মিশুকে টেনে নিজের ঘরে নিয়ে যায়। কাঁদতে কাঁদতে বলে কিছুক্ষণ আগেই খশরুকে আলেয়া খাতুনের সাথে ফোনে কথা বলতে শুনেছে ও, যতটুকু বুঝেছে সম্ভবত আজই অরুকে নিয়ে গ্রামে বদনাম রটাবে ওরা। ফোনে কথা শেষ করেই খশরু দৌড়ে বেরিয়ে যায়, ঊষা দ্বিধাদ্বন্দে ভুগছিলো কী করবে,কাকে জানাবে। এরপর মিশুকে ঢুকতে দেখে দৌড়ে যায়। আলেয়া খাতুনের আচরণে মিশুর এমনিতেই সন্দেহ হচ্ছিলো, ঊষার কথা শুনে ওকে নিয়ে পড়িমরি করে বাড়ির দিকে ছুটে যায় সে। তখনই আনিসের সাথে দেখা হয় আর তারপর…
★
খুনের দায়ে ঊষাকে যখন পুলিশের গাড়িতে ওঠানো হচ্ছিলো, মিশু তখন সকলের সামনে জোর গলায় বলে ওঠে আলেয়া খাতুন এরচেয়ে বেশি দোষে দোষী। মিশুর সাক্ষ্যেই তাকেও গ্রেফতার করা হয়। পরবর্তীতে আলেয়া খাতুন নিজের দোষ স্বীকার করে যে সাক্ষ্য দেন তা অনেকটা এরকমঃ
‘খশরুয়ে আমারে কইসে অরুরে নিয়া পলায়া যাইবো, তারপর অরুরে বিয়া করবো! অরুর ব্যাগ গুছায়া রাখতে কইসে, আর অরুরে অষুধের পিঠাটা খাওয়াইতে কইসে। আমি সকালে অরুরে নূরিদাদীর বাড়িত পাঠায়া সব গুছাইসিলাম, হেরপর খশরুয়ে আইলে আমি অরে ভিত্রে লুকায়া রাইখা মিশুরে নিয়া গেসিলামগা… খশরুয়ে এইরকম করব জানলে আমি কুনুদিনি এইসব করতাম না…’
ঊষার সাজা অনেকটা কমে আসে সবার সাক্ষ্যপ্রমাণে।
আনিসের জন্মদাত্রী মায়েরা কেবল দুই বোন ছিলেন, তাদের বাবা ছিলেন আড়তের বড় ব্যবসায়ী। নানার তরফ থেকেই ঢাকার অদূরে বেশ খানিকটা জমিসহ একটা পুরনো বাড়ি পেয়েছিল আনিস। সেটাকেই সংস্কার করে একপাশে নিজেদের থাকার ব্যবস্থা করেছে, আর অন্যপাশে ছোট্ট একটা ট্রমা সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছে। জেল থেকে মুক্তি পাবার পর ঊষাকে এখানেই নিয়ে এসেছে আনিস আর অরু। ওদের সাথেই ঊষা কাজ করছে নার্স হিসেবে।
★
সপ্তাহ দু’য়েকের জন্য এখানেই থেকে যায় শাহনাজ। এরমধ্যেই বেশ অনেকটা সুস্থ হয়ে গেছে সে। সন্ধ্যার কোচিং শেষে বাসে করে বাসায় ফিরছিলো শাহনাজ সেদিন, বাসের ভেতরেই…। সমস্ত সংবাদ মাধ্যমে ফলাও করে খবরটা ছাপা হয়েছিলো, দোষী ড্রাইভার আর হেল্পারকে গ্রেফতার ও করা হয়েছে কিন্তু এই প্রচন্ড যন্ত্রণার মধ্যে বিষের শিশি ঢেলে দিয়ে শাহনাজের চূড়ান্ত ক্ষতিটা করেছে আরেকজন- সুমন্ত! এই ঘটনার পর দু’বছরের ভালোবাসার সম্পর্ক এক মূহুর্তে ছিন্ন করে মেয়েটাকে একদম খাদের কিনারায় ঠেলে দিয়েছিলো, অরুন্ধতি আর আনিসের আপ্রাণ প্রচেষ্টায় একটু একটু করে ফেরানো গেছে মেয়েটাকে!
★
-‘নাতিন বোলই খা,বোলই খা! হাতে নিয়া নুন
নাতিন আমাল পইলা গেছে বোলই গাছে থুন!’- ঝাঁকড়া চুল দুলিয়ে মাথা নেড়ে নেড়ে আধো আধো গলায় গান গাচ্ছে দু’বছরের বাচ্চা মেয়েটা! পাশে বসে বসে নূরজাহান বেগম লাঠি ঠুকে ঠুকে তাল দিচ্ছেন, মনে মনে ভাবছেন
‘আইজকা অরু আর আনিসে আইলে গেদির গানডা শুইনা চমকায়া যাইব! হুহু, নূরজাহান বেগম যত শোলক আর গান জানে, সবডি এই গেদিরে শিখায়া তবে মরবো!’
তাল পেয়ে বাচ্চাটা ততক্ষণে কোমর দুলিয়ে নাচতে আরম্ভ করে দিয়েছে, প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে নূরজাহান বেগম দেখছেন- ‘আহা! এক্কারে আনিসের মুখটা যেন কাইটা বসায়া দিসে মাইয়াডার চেহারায়!’
★
সমাপ্ত!
নোটঃ যে আপুদেরকে এক জীবনে অরুন্ধতীর মত বিভীষিকার মুখোমুখি হতে হয়েছে, ‘একজীবন’ গল্পটা তাদের জন্য উৎসর্গিত। নিশ্চয়ই এই কষ্টের পর আল্লাহ আপনাদের জন্য সুখ লিখে রেখেছেন, এক জীবনে না হোক অন্য জীবনে, ইহজনমে না হোক পরজনমে!
শুধু হাল ছাড়বেন না, প্লিজ!
একজীবন পর্ব ৬
একজীবন
পর্বঃ ৬
★
এই ঘরটা একেবারে পূর্বমুখী, ভোরের নরম রোদটা মুখে পরতেই ঘুম কেটে গেলো। বেশ ঠান্ডা পরেছিল গতকাল রাতে। খাটের ওপর শুয়েও কাঁথামুড়ি দিয়ে থাকতে হয়েছে। বিছানা থেকে নিচে পা ফেলতেই চোখে পড়লো আনিস হাবুচন্দ্র মেঝতে গুটিশুটি পাকিয়ে ঘুমাচ্ছে এখনো, শীতে একেবারে কুঁকড়ে গেছে বেচারা! এ ঘরে একটা কাঁথা, সারারাত আমি যেটা গায়ে জড়িয়ে আরামে ঘুমিয়েছি। ওদিকে ক্যাবলা আনিসটা মেঝেতে পাতা বিছানার চাদরের ই এক মাথা দিয়ে কোনোমতে গায়ে মুড়ি দিয়েছে! বুকের ভেতরটা মুহূর্তেই মোচড় দিয়ে উঠলো আমার। এত নির্বিবাদী, এত গোবেচারাও মানুষ হয়? আমি নাহয় কাথামুড়িয়ে ঘুমিয়েই ছিলাম সারারাত, সে নিজে তো অন্তত খাটের এক কোণায় এসে শুতে পারতো!
তাড়াতাড়ি কাঁথাটা নিয়ে তার গায়ে চাপা দিই, ভালো কর চারদিক ঢেকে মুড়িয়ে দিয়ে উঠতে যাব ঠিক তখনি নাড়াচাড়ায় তার হাতের একাংশ আমার হাতে এসে পরে। ইশ! জ্বরে সারা শরীর পুড়ছে! খোদা!- কার অপরাধের শাস্তি তুমি কাকে দিচ্ছো! দৌড়ে যেয়ে গামছা ভিজালাম, মাথায় জলপট্টি দিয়ে অন্তত তাপ তো কমানো যাক- ঘুম ভাঙ্গলে নাহয় ঔষধপত্রের ব্যবস্থা করা যাবেখন!
মাথায় ঠান্ডা গামছাটা ছোঁয়াতেই বাঁশপাতার মত তিরতির করে উঠলো তার চোখের পাতাজোড়া, খানিক বাদেই পিটপিট করে চোখ মেললেন!
-‘কী করছো? আমি ঠিক আছি… উঠবো এখন, সরো!’
-‘গলা দিয়ে তো স্বরটাও বেরোচ্ছেনা ঠিকমত, ব্যাঙের মত শোনা যাচ্ছে! এই জ্বর গায়ে নিয়ে পণ্ডিতি শুরু না করলে হয়না? যেমন ঘুমিয়ে ছিলেন তেমন ঘুমিয়ে থাকেন, বেশি ফটফট করলে ভালো হবেনা বললাম!’
ক্যাবলাটা তার ঐতিহাসিক ফিচলে হাসিটা ঝুলালো ঠোঁটে, আমি নিশ্চিত এখন একটা না একটা হাবিজাবি আলাপ শুরু করবে সে!
-‘দিচ্ছো তো ঐ শুধু কপালটুকু মুছিয়ে! জ্বরে যেখানটায় পুড়ে যাচ্ছে সেখানে যখন হাতটাও ছোঁয়াবেনা তখন আর অযথা খাটাখাটনি কেনো?’
-‘বয়স তো কম হয়নাই, এখনো বদমাইশি কমেনা আপনার, না? একটা না একটা বদমাইশি আলাপ না করলে হয়না না? কীকী ঔষধ দিতে হবে বলে দেন… আমি খুঁজে নিয়ে আসি!’
-‘আমার চুল পেকেছে তোমার জন্য,
আমার গায়ে জ্বর এসেছে তোমার জন্য,
আমার ঈশ্বর জানেন- আমার মৃত্যু হবে তোমার জন্য।
তারপর অনেকদিন পর একদিন তুমিও জানবে….’
আমি জানিনা সেসময় ঠিক কী হলো আমার, কোন দুঃখের ভূত উড়ে এসে বসলো আমার বুকের ভেতর, আমি ঝরঝর করে কেঁদে ভাসিয়ে দিলাম সব! জ্বরতপ্ত কপালটার ওপর একরাশ শ্রাবণধারার মতো ঝরে যাওয়া ফোঁটায় ফোঁটায় অশ্রুজলের আভাসে বোধহয় সম্বিত ফিরলো উনার, চমকে উঠে বসলেন লাফ দিয়ে। বামহাতে চোখজোড়া আড়াল করে দৌড় লাগাতে যাব, খপ করে আমার ডানহাতটা চেপে ধরলেন উনি!
-‘এই বোকা মেয়ে! কান্নার কী হয়েছে? এটাতো নির্মলেন্দুর কবিতা আমি এমনিতেই শুধু বললাম, সত্যি সত্যি কী…’
-‘না সত্যি সত্যিই! আমার জন্যই জ্বর হয়েছে আপনার! আমার জন্য মেঝেতে…’
-‘আগে কান্না থামাও মেয়ে! পরে বলো যা বলার, যা খুশি! তুমি তো এক কোণায় যেয়ে শুতে, আমি চাইলেই খাটের অন্য কোণাটা ব্যবহার করতে পারতাম,ইচ্ছে করেই করিনি! এতে তোমার দোষ কই? বললাম তো ভুল হয়েছে,আর বলবনা কবিতা যাও!’
-‘কেন যাননি তবে আপনি?’
-‘কোথায় যাইনি?’
-‘উপরে… খাটে, ঘুমাতে!’
-‘কারোওওণ, খাটের উপরে জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি থাকে যে!
বালিকা, তোমার আধফুট দূরত্বে থেকে ঘুমটা অন্তত আসবে না আমার, আর যা-ই আসুক!’
-‘আপনি একটা অসভ্য! মানুষ জ্বর হলে চুপচাপ পরে থাকে আর আপনি যা খুশি তাই বলে যাচ্ছেন কখন থেকে!’
-‘এইসব জ্বর ঠান্ডা দেখতে দেখতে চোখ পচে গেছে বুঝলে? রোগবালাই এখন আর কোনোরকম লাগেনা, দুই-তিনদিনে আপনা আপনিই ছেড়ে যাবে! White blood cell গুলিকে একটু সময় দাও, ওরা তো আছেই ফাইট করার জন্য! আর…’
-‘আর?’
-‘আর, শুকরিয়া করো যে যা খুশি তাই ‘বলে’ যাচ্ছি কেবল, যা খুশি তাই করে গেলে কিন্তু বিপদে…’
-‘ধুর! আপনার কাছে আসাটাই ভুল হয়ে গেছে আমার! হাতটা ছেড়ে দিন, আমি উঠবো… কাজ আছে আমার!’
-‘সন্ধিচুক্তি যখন করেইছি তখন হাত তো ছাড়তেই হবে ম্যাডাম! কিন্তু একবার যুদ্ধ ঘোষণা হলে পরে হাজার অনুরোধেও ছাড়বানা বলে দিলাম’- আলতো করে একবার চাপ দিয়ে হাতটা ছেড়ে দিলেন উনি, এত গরম তার হাতটা! জ্বর যেন চূড়ান্তে উঠেছে!
-‘গায়ে পানি ঢেলে নাস্তা করবেন আসুন, আপনার জন্য সারপ্রাইজ আছে!’- বলে উঠে পরলাম আমি। রাতে ভিজিয়ে রাখা পিঠাগুলো খাটের নিচ থেকে বের করে টেবিলে নিয়ে রাখলাম। ভালমতই জানি এগুলো নিয়ে হুলুস্থূল হবে আজ, কিন্তু এই ক’বছরে এটা বুঝে গেছি যতদিন নরম হয়ে সহ্য করে যাবো ততই এদের অন্যায় আচরণ বেড়ে যাবে। তাই ঠিক করেছি এখন থেকে সম্মুখ সমরের পথই বেছে নেবো!
★
-‘আনিসের মায়ে ক্যাটক্যাট করলেও হের মনডা ভালা বুঝছো বউমা! কাইলকা না না কইলেও ঠিকি আমার জন্য দুধচিতই পিঠা বানায়া রাখসে’- খেতে বসে সহাস্যে বললেন শ্বশুরমশাই। ওদিকে আলেয়া খাতুনের চোখমুখ পুরো মরিচ-লাল হয়ে আছে। আচমকা এমন অযাচিত প্রশংসা পাবার পরে মুখ ফুটে বলতেও পারছেন না যে এগুলো উনি বানাননি আবার না বলেও থাকা যাচ্ছেনা! খেলা পুরো জমে গেছে, আমিও স্রোতের দিকেই নৌকো ভাসালাম!
-‘হ্যাঁ বাবা! মা-ই তো বসে বসে এসব বানালেন আবার আমাকে বললেন চুপচাপ লুকিয়ে ভিজিয়ে রাখতে, সকালে বের করতে! সত্যিই, বেশ মজা হলো না বলেন?’
-‘হ, হ! আমি ত এক্কারে বেক্কল হইয়া গেসি দেইখা…’
-‘চুপচাপ খাইয়া উডেন, এত রসের কিছু হয়নাই এইখানে!’- আলেয়া খাতুনের ধমকে শ্বশুরের হাসি মিইয়ে আসে। তবে সবদিক দিয়ে এই বেশ ভালো হলো, পিঠাগুলো সবার অগোচরে আমি বানিয়েছি জানিয়ে অশান্তি তৈরি করার চেয়ে এটাই বরং সুন্দর সমাধান হলো…কিন্তু আমার পোড়ামন! এও মনে চায় যে উনি অন্তত জানুন যে এগুলো আমার হাতের বানানো… উনার ছোটমাকে লুকিয়ে বহু কষ্টে শুধু উনার প্রিয় বলে এগুলো বানিয়েছে একজন- আহা এই সত্যিটুকু যদি কেউ অন্তত তাকে জানিয়ে দিতো!
★
আলেয়া খাতুন সম্ভবত খেপেছেন, সকাল থেকেই আছড়া আছড়ি করে কাজ করে গেলেন, সাজুখালাকে অযথাই দু’কথা শুনিয়ে দিলেন। যার ওপর চটেছেন সেই আমাকে কিছু বলতে পারছেন না বলে কেবল গুমরে গুমরে ফুলছিলেন, টের পেলেও চুপচাপ থেকেছি আমি। হুহ, যেমন কুকুর তেমনি মুগুর হওয়া চাই, না হয়তো আনিস হাবাচন্দ্রটাকে আজীবন কলুর বলদ হয়েই থাকতে হবে! সেই যে বাড়ি থেকে কিছু টাকা নিয়ে বেরিয়েছিলাম, সেখানে হাত ই দেয়া হয়নি এখনোও! আমার সব খরচাপাতি তো উনি করেই যাচ্ছেন…আজ সেখান থেকে কিছু টাকা বের করে সাজুখালাকে দিয়ে কবুতরের বাচ্চা কিনিয়ে আনালাম। জ্বরমুখে হালকা স্যুপ হয়ত ভাললাগবে, বেকুবটা তো জ্বর গায়েও দিব্যি টিনের ঘরে রোগী দেখতে বসে গেছে, এদিকে চিন্তার যন্ত্রণায় আমার মরণের দশা!
আলেয়া খাতুন বারকয়েক এদিকে ঘুরে গেছেন, বোঝার চেষ্টা করছেন আমি কী করছি! অথচ সকালের ঘটনার পর নিজে সেধে কথাটিও বলতে পারছেন না তাই জিজ্ঞেসও করতে পারছেন না আমায় কিছু! সেজন্যই বোধহয় কিছুক্ষণ পর রুপাকে শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠিয়ে দিলেন-
-‘কি করো অরু? কইতরের বাইচ্চা না এইডা?’- আমার হাতে ধরা কবুতরটার দিকে তর্জনী নির্দেশ করে রুপা।
-‘হ্যা ভাবী! উনার রাত্রে থিকা জ্বর আসছে, তাই ভাবলাম স্যুপ করে দেই।’
-‘স্যুপ জিনিসটার নাম শুনছি অনেক কিন্তু বানাইতে পারিনা। আমারে শিখায়া দেন না একটু! ’
রুপা মেয়েটা বেশ সরল সোজা, অত সাতে পাঁচে নেই! দিব্যি পাশে বসে বসে স্যুপ বানানো শিখতে লাগলো। খানিক বাদে নিজের মনেই বলে উঠলো-
‘আনিস ভাইএর জন্যি মায়া লাগে বুঝলা অরু। আহা জন্মের সময় বেচারা মায়েরে হারাইসিলো, তারপর এতগুলা দিন ত কেউই আছিল না নিজের কইতে! মিশুয়ে দাদাভাই কইয়া অজ্ঞান আছিল, হইলে কী হইব আম্মার জন্যি কিছু করতে পারত না! আল্লায় বোধহয় তুমারে আর আনিসবাই রে মিলায়া দিসে…’
-‘বিষ, বিষ! বিষের গাছ ঢুকসে আমার সংসারে! অখন আমার পোলার বউডারেও বিষাইতাসে!’- আচমকা একটা চিৎকারে থমকে গেল রুপা। ঘাড় ঘুরাতেই দেখলাম আলেয়া খাতুন রণমূর্তি ধারণ করেছেন।
-‘শহরের বেদ্দপ মাইয়া, নিজের মায়েরে খাইসে অখন আমার সংসারে নজর পরসে! এতবছর যেন আনিসের চলেনাই, এতবছর যেন হেয় না খায়া না পইরা থাকসে! দুইদিনের বৈরাগী, ভাতেরে কয় অন্ন! আনিসেরে বশ করছে অখন রুপার কানেও বিষমন্তর ঢালতাসে- আসুক আইজকা অগো বাপে বাড়িতে এর একটা বিহিত যদি না করসি…’
-‘আপনে খামোখাই এমন করতেসেন! আমি রুপারে কিছুই বলিনাই! আর রুপাও এমন কিছু বলেনাই যেটা কেউ জানেনা, সবারই চোখ-কান আছে…’
আমার কথা শেষ না হতেই কেউটের মত ফোঁসফোঁস করে উঠলেন আলেয়া খাতুন-
‘কী কইলা তুমি? হাডুর বয়সী মাইয়া তুমি আমারে চোখ-কান দেখাও? তা ত করবাই, নিজে ত মা-খাগি আর জুটায়া নিসো আরেকজনেরে। অপয়া পুলা, জন্মাইয়াই আমার বইনডারে খাইলো, আমার জুয়ান বইনডা না মইরা এই অপয়া পোলাডা মরলেও তো পরাণডা জুড়াইতো…আমার সংসারে আগুন লাগাইলে অভিশাপেই ঐ পোলার মরণ হইব কইয়া দি…’
-‘ছিহ! এই আপনে উনার মা? পেটে না ধরেন, যারে পাইলা-পুইষা বড় করলেন তারে নিয়ে এইগুলা বলতে একবার বাঁধলো না আপনের? অনেক্ষণ ধইরা আপনে যা খুশি বলতেসেন আমারে, আমি জবাব দিইনাই। তারমানে এইটা না যে আপনে উনারে নিয়াও যা মুখে আসে বলবেন! পেটের ছেলে আপনেরও আছে, আর অভিশাপ আমিও দিতে পারি- এইটা মাথায় রাইখা এরপরে থেকে কথা বলবেন।’ – সম্ভবত এই কথাগুলিই তখন বলেছিলাম আমি, টের পাচ্ছিলাম দুই চোখ বেয়ে ঢল নেমেছে ততক্ষণে। পরে অবশ্য শুনেছিলাম, আমার কথাগুলি নাকি চাবুকের মত আছড়ে আছড়ে পড়েছিল সেদিন। কার থেকে শুনেছিলাম? কার থেকে আবার! ক্যাবলাকান্ত যে ঠিক তখনই মিশুকে সাথে নিয়ে হেলেদুলে বাড়ি ফিরছিলেন!
মিশু বেড়াতে এসেছে এ বাড়িতে, বেছে বেছে আজ এই সময়েই বেচারিকে আসতে হলো! আমি তখন সাপের মত ফুঁসছিলাম, আলেয়া খাতুন যদি সমবয়সী হতেন তো হয়ত মারামারিই লেগে যেতো ততক্ষণে! রাগে গা হাত-পা কাঁপছিলো আমার, মিশু দৌড়ে এসে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বসায় আমাকে। আর যে এলে রাগ গলে জল হতো, সেই হাবাগংগারাম তখন দেবদারুর মত ঠায় দাঁড়িয়ে উঠোনে!
-‘অরু বসো এইখানে! চিল্লায়া লাভ নাই, উলটা নিজেই খারাপ হইবা। মায়েরে আমি চিনি, হের লগে পারতে হইলে যত নিচে নামন লাগব অত নামতে তুমি পারবানা বইন! মাথা ঠান্ডা করো, যা করতাসিলা হেইডা শেষ করো। আমি দাদাভাইরে নিয়া ঘরে যাইতাসি…’
রুপা ওদিকে ফ্যাচফ্যাচ করে কাদছে। মিশুই ওকে আর আনিসকে টেনে ঘরে নিয়ে গেলো। আলেয়া খাতুনকেও শাসিয়ে গেলো-
‘আমি য্যান আর একটা কথাও না শুনি আম্মা! ঘরে চলেন!’
★
সকালটা খারাপ গেলেও বিকালটা অনেকদিন পর বেশ ভালো কাটলো আজ! ডাক্তার সাহেবকে জোর করে ধরেবেঁধে ঘরে বন্দি করে রাখা হয়েছে, মিশুই উদ্যোক্তা আমি কেবল সরব সমর্থক ছিলাম এই কাজে! ঝাল ঝাল মুড়িমাখা দিয়ে বিকেলে জমিয়ে আড্ডা দেয়া গেছে মিশু আর রুপাকে সাথে নিয়ে, চারজনে মিলে। কিন্তু রাত হতেই ক্যাবলাটা সেই পুরানো ক্যাবলামি করে মেজাজটা খিঁচড়ে দিলো একদম! শুতে যাবার সময় সেই চাবি দেয়া কলের পুতুলের মত চাদর পেতে মেঝেতে বিছানা করা শুরু করে দিলো। আমিও কম যাই না, খাট থেকে এক ঝটকায় নিজের বালিশটা নিচে ফেলে দিলাম!
-‘এটা কেমন হলো? বালিশ ফেললে যে?’
-‘এতা তেমুন হলু? বালিত ফেল্লে দে?’- চোখ মুখ কুচকে ভেংচি কাটলাম আমি।
-‘উত্তর দেবেনা? আমায় রিপিট করবে?’
-‘উত্তুল দেবেনা? আমার লিপিত কব্বে?’
-‘আচ্ছা! বেশ! অরু না না, অরুন্ধতি আনিসকে ভালবাসে… এবার বলো?’
লোকটা তো আচ্ছা বদ!
-‘সরুন,আমি মেঝেতে শোব! আপনি উপরে যান!’
হোহো করে হেসে সে বললো
-‘জানতাম পারবেনা বলতে! বলতে পারলে যাব উপরে, নয়ত যাবনা!’
-‘বয়েই গেছে আমার বলতে! আমি মেঝেতেই শোব, সে আপনি খাটে যান, না যান…’
-‘ও বাবা! আমি খাটে না গেলেও মেঝেতেই শোবে আমার সাথে? এত সাহস থাকবে তো বাকি রাত?’
-‘অসভ্য আলাপে আমার সময় নেই!’- বলে ঘাড় ঘুরিয়ে মেঝের এক কোণায় শুয়ে পরলাম। মন জানে, গোটা রাতটাই আমি ঐ মুখের দিকে চেয়ে কাটিয়ে দিতে পারতাম কিন্তু মনের কথা যদি মুখেই বলে দিই তবে আর নারীর আজন্ম অপবাদ- ছলনার ষোলকলা পূর্ণ হবে কেমন করে?
-‘আমার জন্য এতটা না করলেও পারো তো, অরু! শুধু শুধু ছোটমার সাথে লেগে গেল তোমার,মিশুটাও এরকম করতো আগে, এখন তুমি!’ – মুহূর্তেই তার গলাটা কেমন বিষাদমাখা শোনালো। বুকের ভেতরটা ছ্যাৎ করে উঠলো আমার।
-‘কিছুই করিনি আমি আপনার জন্য…’
-‘সে আমি জানি! সবাই না জানলেও আমি জানি সেদিন সবার চোখের অলক্ষ্যে ঐ পিঠাগুলো তুমিই বানিয়েছিলে! আর আজ তো নিজেই দেখলাম…’
ও খোদা! এ তো তলে তলে তালতলায় যাওয়া ছেলে, আর আমি নাকি একে হাবাগোবা ভেবে বসে আছি! এও ধরে ফেলেছে যে সেদিনের সেই কাজ আমার করা!
-‘কে বলেছে আপনাকে আমি ঐ পিঠা বানিয়েছি? বয়েই গেছে আমার আপনার জন্য বেগার খাটনিতে! কে হন আপনি আমার….’
অন্যপাশে মুখ ঘুরিয়েই বানিয়ে-ছানিয়ে মিছে কথাগুলো অনর্গল বকে যাচ্ছিলাম, ঠিক তখনই একটা প্রবল দস্যুর আক্রমণে মুখের কথা মুখেই রয়ে গেলো আমার! এক ঝটকায় আমাকে পাশ ফিরিয়ে নিজের দুই হাত আমার দুইদিকে চওড়া করে দিয়ে একটা দুর্ভেদ্য দুর্গের ভেতর আমাকে বন্দি করে নিলো দস্যুটা। মৃদু উত্তপ্ত দুই হাত শেকলের মত চেপে ধরলো আমার দুই হাতের তালু, তারপর যেন দখলদারের দাবি নিয়ে প্রশ্ন করলো-
‘কেনো মিছে কথা বলছো অরু? আমি তোমার কী হই সে তুমি আমার চে ভালো জানো, জানোনা?’
এ প্রশ্নের কি উত্তর হয়? আর হলেও বা সে ছাই আমার পোড়া মগজে এলে তো! প্রচণ্ড একটা বিবশ অনুভূতি আমার পুরো অস্তিত্বকে ততক্ষণে গ্রাস করে ফেলেছে!
-‘আমি জানি অরু, আমি জানি তুমি কী চাও! অধিকারের জোর দাবি নিয়ে তোমার সমগ্র সত্তা একান্ত আমার করে নেবার জন্য ছটফট কি আমিও কম করছি অরু? শীতে কেঁপে মরেছি তবু তোমার উষ্ণতার ভাগ চাইতে যাইনি,কেন জানো? যে আগুন অহর্নিশ তোমার বুকের ভেতর জ্বলছে, সে আগুনে সবার আগে আমিই যে ঝাঁপ দিয়েছি অরু! তোমার উষ্ণতার ভাগ চাইতে গেলে সেই আগুনে যে তুমি জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যেতে, সে আমি জানি বলেই যাইনি! মাত্র পনের বছর বয়স তোমার, সভ্যতা বলো আইন বলো সবই আমাদের দু’জনের মাঝে বাঁধা…’
-‘ষোলো! গতকাল আমার জন্মদিন ছিলো…’
-‘কীহ! এই কথা এতক্ষণে বলার সময় হলো মহারাণীর? আগে বলোনি কেন?’
-‘কী হতো বললে? মা চলে যাবার পর আমার জন্মদিন কেউ করেনা আর…কারো কিছু যায় আসেনা আর…’
-‘আমার যায় আসে, অরু!’- ডাকাতটার দুই হাতে যেন অসুরের জোর ভর করেছে, রীতিমত পিষে ফেলছে আমার কব্জি জোড়া!
-‘উফ! লাগছে হাতে!’
-‘লাগুক, এটা আমায় না জানানোর শাস্তি।’- মুখে একথা বললেও হাতের জোর কমিয়ে এনেছে গণ্ডারটা! ভেবেছিলাম হয়ত ছেড়ে দেবে এবার, কিন্তু এযে আসন্ন ঝড়ের আগ-মুহুর্তের নিস্তব্ধতা তা কে জানতো?
আচমকা একজোড়া উত্তপ্ত ঠোঁটের সবল আক্রমণ যেন পুড়িয়ে দিয়ে গেলো আমার চোখ,নাক, গাল…সমস্ত মুখটা! আর শেষে ঠোঁটজোড়াও…
-‘আর এটা উপহার! জন্মদিনের!’
আমার সমস্ত ছেলেমানুষি রাগ, জেদ যেন এক লহমায় কেউ ধুয়ে মুছে দিলো, একটা বৈশাখী ঝড়ের তাণ্ডব এসে আমার ভেতর-বাহির সব কেমন লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেলো! তিরতির করে কাপছিলো আমার পুরো শরীর,বুকের ভেতরে যেন যুদ্ধের দামামা বাজাচ্ছিল কেউ! আমার সম্পূর্ণ সমর্পণ বোধহয় সম্বিত ফেরালো তার, হঠাৎই আমায় মুক্ত করে দিয়ে বললো-
-জেদ করোনা আর, যাও খাটে শুয়ে চুপচাপ ঘুমিয়ে পরো এখন, আর জেগো না!’
দখলদার দস্যুর হাত থেকে নিষ্কৃতির বদলে তার বন্দিত্বের আরাধনায় ছটফট করে- এমন পোড়ারমুখো মন জগতে আর কারো আছে?
বন্দিত্বের নীরব দাবি নিয়ে অনড় সেখানেই পড়ে রইলাম, শেষমেশ আমারই জিত হলো। দস্যুরাও হার মানে তবে!
★
একরাশ ভাললাগায় পরদিন সকালটা ঘুম ভাঙালো আমার। নিজের মানুষটার ঘুমন্ত অবচেতন আলিঙ্গনও বুঝি এতো মধুর হয়? জ্বরটাও একদম নেমে গেছে তার!
-‘একজীবনে এত সুখ কপালে রেখেছিলে বলেই কি আগে আগে দুঃখের ভাড় পূর্ণ করে নিয়েছিলে খোদা?’- মনে মনে হাজার শোকর জানিয়ে প্রশ্ন করলাম অন্তরীক্ষে।
-‘দুঃখের ভাড় এখনো ভরেনি, কানায় কানায় ভরলে তবে সুখের দেখা পাবি!’- হয়ত এই উত্তরটাই ভাগ্য দিয়েছিলো সেদিন,আমি শুনতে পাইনি! বৈশাখের প্রচণ্ড দাবদাহে এক পশলা বৃষ্টির সন্ধান পেয়ে ভুলেই গেছিলাম- কালবৈশাখী এখনো আসেনি…
★
আগামী পর্বে সমাপ্য। কপি বা শেয়ার না করার জন্য অনুরোধ করা হলো।
একজীবন পর্ব ৫
একজীবন
পর্বঃ ৫
★
শয়তানটা সর্বশক্তি দিয়ে আমার মুখে কাপড় গুঁজে রেখেছে আর নিজের পকেট হাতড়াচ্ছে- খুব সম্ভবত কোনো অস্ত্র বা ছোরা বের করতে চাচ্ছে পকেট থেকে! এই সুযোগটা হারানো যাবেনা, শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে ডান পা দিয়ে আমার পেছন বরাবর লাথি কষিয়ে দিলাম একটা। সম্ভবত জায়গামতোই লেগেছে- শয়তানটার হাতটা শিথিল হয়ে এলো! প্রচণ্ড ভয়ে বুকের ভেতর অবশ অনুভূতি হচ্ছে, চোখের সামনে সব অস্পষ্ট মনে হচ্ছে…বোধহয় জ্ঞান হারাব আমি! শেষ চেষ্টা হিসেবে কনুই দিয়ে ওর নাক বরাবর গুঁতো মেরে পেছন ঘুরে দৌড় দিতেই কারো সাথে জোরে ধাক্কা খেলাম। সর্বনাশ! সাথে সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে এসেছে শয়তানটা! এখন?
আমার ডান হাতটা ধরে হ্যাঁচকা টানে নিজের পেছনে নিয়ে গেলো আমাকে লোকটা। বাম হাতটা মুঠো পাকিয়ে লোকটার কোমরের নিচ বরাবর ঘুষি লাগাতে যাবো…ঠিক তখনই আবিষ্কার করলাম আমাকে পেছনে রেখেই খশরুর দিকে এগিয়ে গেলো সে! পেছন থেকে দেখেই চিনলাম এই লোক আর কেউ না, আনিস! খশরু ততক্ষণে পকেট থেকে ছোরা বের করে নিয়েছে। এক হাতে নিজের নাক চেপে ধরে অন্য হাতে ছোরাটা নিয়ে জানোয়ারের মত গোঁ গোঁ শব্দ করছে শয়তানটা। দ্রুতহাতে ওর ছোরা ধরা হাতের কব্জি বরাবর ধরে কীভাবে যেন মোচড় দিলেন উনি, সাথে সাথে ধপ করে মাটিতে পরে গেলো ছোরাটা! তারপর খশরুর বুক আর পেটের ঠিক মাঝামাঝি বাম হাতে একটা ঘুষি। ‘ঠকাস!’ করে একটা শব্দ হলো, কাটা কলাগাছের মত মাটিতে লুটিয়ে পরলো খশরু!
-‘বুক আর পেটের মাঝামাঝি- সোলার প্লেক্সাস, ঠিকমত মারতে পারলে এক আঘাতেই কাত করা যায়।’- আমার দিকে ঘুরে কথাগুলি বললেন উনি। উপরিউপরি এতগুলো ঘটনার ঘনঘটায় আমি তখন দিশেহারা। সম্ভবত হাঁ করে তাকিয়ে ছিলাম সামনের দিকে, কারণ উনি হেঁটে এসে দুইহাতে আমার মাথা আর চোয়াল ধরে আলতো চাপ দিয়ে বললেন-
‘বাঁশঝাড়ের পোকামাকড় ঢুকে যাবে মুখে, চলো বাড়ি চলো! এই বদমাইশটাকে নিয়ে চিন্তা করতে হবেনা, জ্ঞান ফিরলে আপনিই সুস্থ হয়ে যাবে। পিছন পিছন আসতে পারবে নাকি হাত ধরে নিয়ে যেতে হবে?’
-‘আসবো মানে পারতে আসব…ধুর!পারবো, আসতে পারবো!’
সারা পথ চুপচাপ উনার পেছন পেছন হেটে বাড়ি ফিরলাম। ভেবেছিলাম খশরু হয়ত সব শুনে মেনে নিয়েছে, আর যন্ত্রণা করবেনা! কিন্তু বদমাইশ জানোয়ারটা একটুও শোধরায়নি! ভালরকম শাস্তি হয়েছে ওটার আজকে, এরপরেও কি আদৌ শোধরাবে ইতরটা?
★
বিয়ে বিয়ে আমেজ কাটতে সেদিনের পরে আরো দিন দুয়েক চলে গেলো। খশরুর ঘটনাটা বাড়িতে কাউকে বলিনি, আনিসই নিষেধ করেছেন- অযথা সবাই চিন্তা করবে বলে। প্রায় সব আত্নীয়রা চলে গেলে বাড়িটা প্রায় ফাঁকা হয়ে এলো- মিশু এখনো যায়নি, ও বাদে কেবল আমি, আমার শ্বশুড় আর শ্বাশুড়ি আলেয়া খাতুন, আমার দেবর আকবর আর তার স্ত্রী রুপা এবং ক্যাবলাকান্ত আনিসভাই- এই জনা ছয় প্রাণী পরে রইলাম বিশাল পুরনো আমলের বাড়িটাতে। ঐ বাঁশঝাড়ের ঘটনাটা বাদ দিলে এই দু’দিন বেশ ভালই কেটেছে আমার, দিনে নতুন বউ সেজে ঘুরে বেড়ানো আর রাতে মরার মত ঘুম! আনিসভাই তো মেঝেতে পার্মানেন্ট বাসস্থান গেড়ে বসেছেন, আমি খাটে। টুকটাক এদিক-সেদিক কথাবার্তা ছাড়া তেমন গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথাও হয়নি উনার সাথে আমার! বেশ আছ দু’জনে দু’জনের মত করে। আজকে সকাল সকাল উঠে রান্নাঘরে গেলাম, সাজুখালা রুটি বেলছে মেশিনের মত তরতর করে।
-‘আমি ভেজে দিই রুটিগুলো? দ্রুত হবে..’
-‘হ দ্যান ভাবী! তাইলে আমার ভালাই হয়, কাজ আগায়!’
এক এক করে রুটিগুলো ভাজতে আরম্ভ করলাম, তারপর ফ্রিজ খুলে ছয়টা ডিম বাটিতে করে নিয়ে আসলাম ভাজার জন্য।
-‘ডিম এতডি আনসেন ভাবী? বড় ভাইয়ে ত খায়না ডিম!’- সাজুখালা বললেন।
-‘ক্যান? ডিম খায়না ক্যান? অদ্ভুত ত!’
একটা অর্থহীন শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকান সাজুখালা, তারপর মেঝের দিকে চোখ নামিয়ে ফিসফিস করে বলেন-
‘দিলে ত খাইব! দশ বচ্ছর ধইরা কাজ করি এই বাড়িত…মিশু খালাও অনেক চেষ্টা কইরাও পারেনাই… খালাম্মা হেরে ফিরিজের জিনিস ছাড়া কিছু দেয়না সকালে…’
সৎ মা কী জিনিস সে আমি ভালই জানি, সাজুখালার কথায় বুঝলাম আনিসের অবস্থাও আমার মতই। দু’দিন হলো এ বাড়িতে পা রেখেছি, আমার পক্ষে তো আর সবকিছু বদলে ফেলা সম্ভব না! তাই ফিরে যেয়ে দুটো ডিম আবার ফ্রিজে রেখে এলাম, বাকি সবার জন্য ডিমভাজি করে সাজুখালাকে জিজ্ঞেস করলাম-
‘দেন আপনের বড় ভাইরে কি দিবেন দেন। বাটিতে নিয়ে ঢাকনা দিয়ে রাখি!’
-‘অইযে ফিরিজে কাইলকা রাইতের তরকারি আছে হেইডি…’
-‘মানে! আলাদা কোনো ভাজিভুজিও করেন না ওর জন্য?’
-‘খালাম্মায় না করতে কইলে আমি ক্যামনে করুম? আর আগের তরকারিডি নষ্ট হইব কেউ না খাইলে…’
-‘কেউ না খাইলে ফালায়া দিবেন! উনারে একলা বাসি তরকারি খাইয়া শেষ দিতে হবে- এইটা কেমন নিয়ম! সরেন দেখি, আমারে দুইটা বড় আলু দেন এইদিকে…কারোর কিছু করতে হবেনা। আমিই পারব!’
আমি জানিনা সেসময় ঠিক কী মনে হচ্ছিলো আমার! সৎ মায়ের অত্যাচার তো জীবনে কম সহ্য করিনি! আমি নিজেই তো বাসিপচা খেয়ে, স্টোর রুমে বড় হওয়া মেয়ে… অথচ আজকে দুইদিনের চেনাজানা একজনের একবেলার খাওয়া আমার কাছে এত গুরুত্বের হয়ে গেলো কী করে? অদ্ভুত তো!
যাকগে, মরুকগে! রান্নাবান্নার অভ্যাস আমার আছে, ভালই আছে! ফটফট করে দুটো বড় আলু ছিলে, ঝিরিঝিরি করে কেটে, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ দিয়ে ভাজি বসিয়ে দিলাম। মিনিট তিরিশের মধ্যে ঘ্রাণ ছড়িয়ে ভাজিটা হয়ে এলো, ততক্ষণে বাকিরাও ঘুম ভেঙে উঠে পরেছে। যার যার পাতের খাবারগুলি নিয়ে টেবিলে বসে গেল সবাই, গরম গরম ভাজিটার উপরে হালকা ধনেপাতা আর ঘি ছড়িয়ে দিয়ে সিরামিকের হাফপ্লেটে নিয়ে আনিসের সামনে রাখলাম আমি, নিজের জন্যেও নিলাম।
-‘বাহ আলুভাজিডা ত খুব ঘ্রাণের হইসে, আমারেও একটু দিও অরুভাবী!’- খেতে বসতে না বসতেই আনিসের ছোট ভাই আকবর বললো। আকবর আর ওর স্ত্রী রুপার প্লেটে ভাজি দিতে না দিতেই আলেয়া খাতুনের চিকন কণ্ঠ কানে এলো আমার-
-‘আলুভাজি কই পাইলা বউ?’
-‘উনি নাকি ডিম খায়না, তাই আলুভাজি করলাম!’
-‘ক্যান! ফিরিজে কাইলকার তরকারি নাই?’
-‘আছে মা! কিন্তু সকাল সকাল বাসি খাবার দিয়ে মুখ খোলা তো ভালনা! সেই তরকারি নাহয় আমিই দুপুরে খেয়ে নেবখন…’
আলেয়া খাতুন হতভম্ব দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইলেন! সেই দৃষ্টি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে আমি নিজের খাওয়া চালিয়ে যেতে লাগলাম। সবচে অদ্ভুত কাজটা করলেন আনিস বোকাচন্দর, মিনমিন করে বলে ফেললেন-
‘আচ্ছা, আমিই বের করে নিচ্ছি ফ্রিজ থেকে। ভাজি লাগবেনা…’
-‘লাগবেনা মানে কি দাদাভাই? সারা জনম চেষ্টা কইরাও যে কাজ আমি করতে পারিনাই সেইটা যদি আজকে তর বউ করে,আর কিছু না পারস তারে অন্তত সমর্থন টা দিস! চুপচাপ ভাজি দিয়া খাবি তুই এখন, আর অরুভাবী! দুপুরেও ঐ বাসি জিনিস তুমার একলা খাওয়ার দরকার নাই, খাইলে সবাইই খাইব নাইলে কেউনা!’- মিশুর গলায় আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস শুনে বাকি সবাই চুপ হয়ে গেলো একদম! বাকি সময়টুকু শান্তিমতই কাটলো।
★
আনিস বাইরে যেতেই উনার ঘর গোছানোর কাজে নামলাম আমি। একেবারে যাচ্ছেতাই দশা ঘরের! মনে হয়না কেউ কোনোদিন গুছিয়েছে! এক পলিথিন ভর্তি ধূলো-ময়লা জমিয়ে নিয়ে বাইরে ফেলতে যাচ্ছি, ঠিক তখনই আলেয়া খাতুনের কণ্ঠ কানে আসে-
‘হাডুর বয়সী মাইয়া, সে কিনা আমার লগে টেক্কা নেয়! নিজের প্যাটের মাইয়াডা ত হইসে আনিছছ্যার চ্যালা! অখন আরেকজন আইয়া জুটসে! আমার এতদিনের সংসার এত সুজায় ভাইসা যাইতে দিমুনা, আমিও কইয়া থুইলাম তোরে সই!’
আলেয়া খাতুন থামতেই একটা পরিচিত গলা কানে আসে-
-‘মাইয়াডা ত ভালানা আলেয়া! আমাগো খুশরুর লগে বিয়া দিবার চাইসিল, তা আমার অত পছন্দ হয়নাই। এই মাইয়াই খুশরুর পিছনে ফেউয়ের মত ঘুরতো! রুপের ঝলক ত ভালই আছে, তাই দেইখা খুশরুও গইল্লা গেসিলো! আমি সাফ সাফ কইয়া দিসিলাম এই মাইয়ারে আমার পুলার লগে বিয়া দিমুনা,অপয়া অলক্ষী একটা! আনিসের মাথাডা খাইয়া বাড়ি থিকা পলায়া আইয়া বিয়া বইলো- এইডা কুনু ভদ্র মাইয়ার কাম আলেয়া, তুইই ক?’
ওহ! খশরুর মায়ের সাথেই তাহলে কথা বলছেন আমার শাশুড়ি! তাইতো বলি গলাটা চেনা চেনা লাগছে কেন! মিথ্যুক মহিলা আবার একগাদা মিছেকথা বানিয়ে বলছেন! যেমন ছেলে তেমন তার মা- বেয়াদব অসভ্য পরিবার একটা! রাগে গা জ্বলে যাচ্ছিলো আমার, ময়লাভর্তি পলিথিন হাতে নিয়েই গটগট করে বেরিয়ে একদম ঐ মিথ্যুক মহিলার নাক বরাবর দৌড়ে যাই। ইচ্ছে করে ধাক্কা লাগিয়ে ধূলো-ময়লা ভরা পলিথিনটা উপুর করে উনার শাড়ির ওপর ফেলে দিই!
-‘অ্যা ছিছিছিছি! মাইয়া চউখে দেখনা নাকি? দিলা তো আমার অজুডা নষ্ট কইরা!’
-‘কুটনি বুড়ি! তোমার আবার অজু-নামাজ কীসের?’- বিড়বিড়িয়ে বলেই দৌড়ে উঠোন পেরিয়ে বাইরে বেরোলাম আমি।
-‘কী কইলা! কী কইলা? অই মাইয়া দাঁড়াও দাঁড়াও…- পেছনে খশরুর মা চিল চিৎকার করছেন!
★
আনিস লোকটা….উঁহু ছেলেটা (বয়স অত বেশি না যে লোক ডাকবো, ছেলেই মিলছে ভালো!)- আসলেই একটা বোকাচন্দর, ক্যাবলাকান্ত! বাড়িতে আয় রোজগার সবচে বেশি তার, বিদ্যা-বুদ্ধিতেও বাকি সবার চে’ আগানো অথচ এই বাড়ির সবচে গুরুত্বহীন লোকটা হলো সে! একবেলা খায় তো দুইবেলা খায়না, বিকেলে সবাই নাস্তা খায় সে তখন বাইরে রোগী দেখে বেড়ায়, রাতে খেতে বসে সবার শেষে…মুড়োটা, পেটিটা বাকিরা খেয়ে নিয়ে লেজ আর ঝোল যেটুকু বাকি থাকে তাই দিয়ে নিরুপদ্রবে খেয়ে নিয়ে নিজের ঘরে চলে আসে। তা সেই ঘরখানাও আবার আমার দখলে এখন, মেঝেতে বিছানা করে কোণায় জুবুথুবু হয়ে রাতটা কাটায় সে…সকাল হতেই আবার একই রুটিন! আমার হয়েছে চৌদ্দ জ্বালা, চোখের সামনে মানুষটার এই একলা জীবন না পারি সইতে, অথচ কিছু যে করব তার উপায় কই? সেই অধিকারটুকু থাকলে তো! এই তো এক নামেমাত্র বিয়ে তার আবার অধিকার-হুহ! হওয়ার মধ্যে যা হলো, আমায় নিয়ে উপজেলার একটা স্কুলে ভর্তি করে দিলেন উনি। ভর্তির দিন ফিরতি পথে বইখাতা, ব্যাগপত্র ও কেনা হলো, এও বলে দিলেন- ভাল রেজাল্ট হলে আমার মেডিকেলে পড়ে ডাক্তার হওয়ার সব দায়িত্ব নাকি উনার…শুধু আমার আর বলে ওঠা হলোনা-
‘যে জন দেয়না দেখা
যায় যে দেখে ভালোবাসে আড়াল থেকে
আমার মন মজেছে সেই গভীরে
মন মজেছে সেই গভীরে
গোপন ভালোবাসায়
আমার সকল নিয়ে বসে আছি
সর্বনাশের আশায়।’
★
যত দিন যাচ্ছে তত বেশি করে বিয়ের রাতে মিশুর বলা কথাগুলির মানে বুঝতে পারছি! এ বাড়িতে পদে পদে আনিসকে অপদস্থ করা হয়। যদিও বাড়ির খরচের সবচেয়ে বড় অংশটা সে-ই বহন করে, কিন্তু সবদিক দিয়ে সবচে বেশি সুযোগ সুবিধা ভোগ করে আলেয়া খাতুনের নিজের পেটের ছেলে আকবর আর তার স্ত্রী রুপা! সকালের নাস্তার ব্যাপারটা আমি নিজের সুবিধামত ঘুরিয়ে নিয়েছি, প্রতিদিনই কিছু না কিছু ব্যবস্থা করি নিজেদের জন্য কিন্তু বাদবাকি দিকগুলো এত বেশি এলোমেলো হয়ে আছে যে ওতে হাত দিতে গেলে যে অধিকারের দাবিটুকু লাগে সেটুকু এখনোও পাইনি। অথচ দিনের পর দিন উনাকে এইভাবে অসম্মানিত হতে দেখতেও ভাল লাগেনা! বিকেলের দিকে পদার্থবিজ্ঞান বইটা পড়তে পড়তে এসব হাবিজাবি ভাবছি বসে বসে, আলেয়া খাতুনের ডাকে ঘোর কাটে আমার।
-‘অরু? ও অরুন্দতি, এইদিকে আসো!’
উনার ঘরে গেলাম আমি।
-‘মাগরিবের আযানের বাদে আইজকা সই আইবো আমাগো এইখানে বেড়াইতে! পোলা বিয়া করাইসে, নতুন বউরে নিয়া মিষ্টিমুখ করতে আইব। এট্টু পায়েশ আর পিঠা বানামু, রান্নাঘরে যাও আমি আইতাসি!’
আমার শ্বশুর পাশেই বসে ছিলেন। পিঠার নাম শুনতেই হাসিমুখ করে বললেন-
‘ও মিশুর মা, কইতাসি শীত ত পড়ব পড়ব করতাসে, এট্টু দুধচিতই পিঠা বানাইবানি? আইজকা রাইতে ভিজায়া রাখলে সকালে ফুলা ফুলা পিঠা.. আনিসের ও খুব পসন্দ… ‘
-‘আকবরের দুই চউখের বিষ দুধচিতই পিঠা, দুধের গন্ধ তো হেয় সইবার ই পারেনা! হুদামুদি এই ব্যাগার খাটনি অখন খাটবার পারুম না, শখ হইলে বাপে পুতে বানায়া খানগা যান!’- শ্বাশুড়ি মুখ ঝামটা দিয়ে উঠে এলেন।
আনিস তারমানে একলা না, আমার শ্বশুরটাও একই নায়ের মাঝি! এই আলেয়া খাতুনের প্রবল প্রতাপের সামনে এরা দু’জনেই ভেড়া বনে গেছে! মনে মনে ঠিক করে নিই, এসপারওসপার যা করার আমাকেই করতে হবে এবার…
পায়েশটা চুলায় বসিয়ে দিয়ে পানিতে চালের গুঁড়ো গোলাতে বললেন আলেয়া খাতুন, তেলের পিঠা ভাজবেন।
-‘আপনি যান, আমি তেলের পিঠা বানায়ে রাখব।’- আমি উত্তরে বললাম।
-‘হ রান্ধনের হাত ত ভালাই তুমার, ত্যালের পিঠা বানাইবার পারতো ঠিকমত?’
-‘পারি!’
-‘আচ্ছা তাইলে আমি গেলাম, আসরের নামাজটা পইরা আসি গিয়া।’
-‘আপনের আর না আসলে চলবে, আমি ডাক দিবনে আপনেরে সব শেষ হইলে…’
উনি চলে যেতেই আমার কাজ শুরু করে দিলাম। বেশি করে চালের গুঁড়ো গুলিয়ে এক চুলায় তেলের পিঠা অন্যটায় চিতই পিঠা ভাজতে আরম্ভ করলাম। দুধ জ্বাল দিয়ে ঠান্ডা হবার জন্য আমার ঘরে নিয়ে রেখে এলাম এক ফাঁকে। এদিকে ততক্ষণে দুইরকম পিঠাই বানানো শেষ, চিতই পিঠার বাটিটা আমার ঘরে রেখে এসে আলেয়া খাতুনকে রান্নাঘরে ডাকলাম। উনার হাতে সব বুঝিয়ে দিয়ে আমি আমার ঘরে চলে এসে পিঠাগুলিকে ভিজিয়ে ঢাকনা দিয়ে খাটের তলায় রেখে আবার পড়তে বসে গেলাম।
★
মাগরিবের পরপর সেই ‘সই’ এলেন, খশরুর মা! ভালই মিলেছে, রতনে রতন চেনে আর শুয়োরে চেনে কচু! দুই জাঁদরেল মহিলা সই পাতিয়ে বসে আছেন! খশরু বেয়াদবটাকে আবার এর মধ্যে বিয়েও করিয়ে ফেলেছেন মহিলা, কমবয়েসী মেয়েটাকে বেশ সরল সোজা বলেই মনে হলো দেখে আমার! আহারে, বেচারির কপালটা এই বয়সে পুড়লো!
কুটনি বুড়ি খশরুর মা ছেলের বউয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে বাড়ি মাতিয়ে গেলেন। তারা বিদায় নেবার আগ দিয়ে আলেয়া খাতুন আমায় ডেকে বললেন-
-‘অরু! আকবরের জন্যি চাইরডা পিঠা রাইখা বাকিডি সই-রে বাক্সে কইরা দিয়া দেও, হের বাড়িত নিয়া যাউক।’
আমি কোনো জবাব না দিয়ে গোটা পনের তেলের পিঠা আলাদা রেখে বাকি কয়েকটা বক্সে ভরলাম।
-‘কিগো! আর পিঠা কই? এত কম ক্যা বাক্সে?’- আলেয়া খাতুনের চিকন চিৎকার কানে এলো!
-‘আব্বার জন্য আর আপনের বড় ছেলের জন্যও রাখসি মা! খালি আকবর ভাইএর জন্য রাখলে ক্যামনে হবে!’
পুরো ঘরে পিনপতন নিস্তব্ধতা নেমে এলো যেন। খশরুর মা তার ডান হাতটা তুলে হাঁ করা মুখের কাছে নিয়ে গেলেন-
‘ও মালোমা! কত কী দেখুম, চিতি পিঠার চাইর ঠ্যাং! দুইদিন হয়নাই বিয়া হইসে এখনি জামাইএর জন্যি পুইড়া যায়! আমাগোর য্যান আর বিয়া হয়নাই, আমাগো য্যান আর জামাই নাই! তলে তলে এত দূর! সই, আগেই কইতাসি এইবার টাইট দে নাইলে পরে পস্তাবি। না তর প্যাটের পুলা, তার আবার বউ- যে কীনা বাপ মায়ের বাড়ি থিকা পলায়া আইয়া জামাইর বাড়িত উইঠা বইসে, তার এত দেমাগ? যেমন বালপাকনা পোলা হইসে আনিসে হের তেমন বেহায়া বউ, আগেই কইয়া রাখতাসি…’
-‘আমার যদি দরদ থাকে তো নিজের জামাইএর জন্যই আছে, আপনের এত জ্বলে ক্যান? নিজের ছেলেরে গিয়া টাইট দেন যান! রাস্তাঘাটে মেয়ে মানুষ দেখলেই তো ছোঁক ছোঁক করে, আসছেন আরেকজনরে জ্ঞান দিতে! মেহমান, মেহমানের মত থাকেন, উনারে নিয়া কোনো বাজে কথা বলবেন না!’- বাহিরঘর ছেড়ে নিজের ঘরে চলে এলাম আমি, দড়াম করে মহিলার মুখের ওপর দরজাটা লাগিয়ে দিলাম। কাজের কাজ হয়েছে যেটা, আসতে সময় পিঠার বাটিটাও সাথে করে নিয়ে এসেছি…আমি সব করতে রাজি আছি কিন্তু উনারে বঞ্চিত হইতে দেখতে পারবনা- এইটা আলেয়া খাতুন যত দ্রুত বুঝে ততই মঙ্গল!
ঘরে ঢুকতেই দেখলাম ক্যাবলাকান্ত আনিস বড় বড় চোখে ড্যাবড্যাব করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে! এই লোক তো ঘুমিয়ে ছিল,ঘুম ভেঙে উঠেছে কখন কে জানে!
-‘নেন! পিঠা খান! সব খাইয়েন না আবার হাবার মত, আব্বা আর আকবর ভাইএর জন্য রাখবেন।’- বাটিটা তার দিকে বাড়িয়ে দিলাম আমি।
-‘এত যুদ্ধ করে এগুলা না আনলেও চলতো, আমি তো…’
মাথায় যেন শর্ট সার্কিট হয়ে গ্যালো আমার! যার জন্য করি চুরি সে কয় চোর! শাড়ির আঁচলটা কোমরে পেঁচিয়ে যুদ্ধংদেহী চেহারা করে আনিসের একদম সামনে যেয়ে দাঁড়ালাম, নাকের সামনে ডানহাতের তর্জনী উঁচিয়ে কিড়মিড় করে বললাম
-‘যুদ্ধের য ও দেখেন নাই আপনে! ভদ্র মানুষের মত চুপচাপ এইগুলা খাবেন, নাইলে সবই দেখবেন বলে দিলাম!’
আনিস মাথা নিচু করে তার সেই বিখ্যাত ফিচলে হাসিটা দিলো, তারপর বামহাতে আমার তর্জনীটা খাবলে ধরে মৃদু গলায় বললো-
‘সব দেখবো বলেই বসে আছি সেই কবে থেকে! খেলাম না তোমার পিঠা, দেখাও কী দেখাবা…’
ইশ! কী বিচ্ছিরি অবস্থা! মোচড়ামুচড়ি করতে যেয়ে উলটে নিজের আঙুলেই ব্যথা পেলাম, জলহস্তীটার হাত থেকে একচুল ছুটতে পারলাম না! উলটে আমার কোমরে প্যাঁচানো আঁচলটা খুলে দিয়ে তাতে নিজের মুখটা মুছে নিলো সে। তারপর বাতাসের গলায় বললো-
-‘এবারের মত অল্পের উপরে ছাড়লাম, নাবালিকা তুমি সাবালিকা হলে বাকি যুদ্ধ ঘোষিত হবে,আপাতত সন্ধি করো!’
তারপর আস্তে করে আঙুলটা ছেড়ে দিয়ে পিঠার বাটিটা নিয়ে বসলো।
আমার বুকের ভেতর ততক্ষণে একশো হাতুড়ি মাথা কুটে মরছে!
★
কপি বা শেয়ার না করার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে।
একজীবন পর্ব ৪
একজীবন
পর্বঃ ৪
★
-‘আর কত ঘুমাবি, উইঠা মুখহাত ধুইয়া নে যা! আইসা পরসি পরায়…’
দাদীর চিল্লাপাল্লাতে ঘুমটা কেটে গেল আমার। ট্রেনের ঝাঁকুনিতে কখন ঝিমিয়ে গিয়েছিলাম নিজেও বলতে পারবনা। ট্রেনের বাথরুম থেকে একরকম ফ্রেশ হয়ে এলাম হাতমুখ ধুয়ে, সিটে এসে বসতেই পাশ থেকে টিস্যু বাড়িয়ে দিলো কেউ একজন…ঘাড় ঘুরাতেই দেখলাম আর কেউনা দাদীর আনিস দাদাভাই আমার দিকে টিস্যু বাড়িয়ে বসে আছেন! টিস্যুতে চেপে মুখটা হালকা মুছতে না মুছতেই ঝিকঝিক শব্দে ট্রেনটা থেমে যেতে শুরু করলো।
-‘দাদী আপনে অরুরে নিয়ে এক রিকশায় যান, আমি আরেকটা নিয়া আসতেসি। আপনেদের ত বাজার টাজার ও করতে হইবো, অনেকদিন ত বাড়িতে থাকেন না। আমি নিয়া আসতেসি সব, আপনেরা আগাইতে থাকেন।’- ট্রেন থেকে নেমে রিকশা ডেকে বললেন আনিসভাই। তারপর দাদীকে আর আমাকে তুলে দিয়ে রিকশাওয়ালাকে সাবধানে চালাতে বলে বাজারের দিকে হাঁটা ধরলেন।
-‘আফনেরা কি ডাক্তর সাবের বাড়িতেই যাইবেন নাকি অন্য জাগাত যাইবেন?’- খানিক বাদে রিকশাওয়ালা প্রশ্ন করলেন।
-‘না,না! আমাগ বাড়িত যামু, তুমি চালাও আমি কইয়া দিতাসি রাস্তা’- দাদী তড়িৎ গতিতে জবাব দিলেন।
-‘ডাক্তার সাহেবটা আবার কে দাদী?’- আমি অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলাম।
-‘ওমা! আফায় যে কি কয়…আফনেগো যে রিশকাত তুইল্লা দিলো…’
-‘মিয়া তুমি বেশি কতা কইওনা ত, মন দিয়া রিশকা চালাও’- দাদীর রামধমকে রিকশাওয়ালা কথা শেষ করতে পারলোনা।
-‘কিগো দাদী? উনারে কথা শেষ করতে দিলেন না ক্যান?’- দাদীর দিকে তাকালাম আমি।
-‘আরে এরা কী কয় না কয়! অই আনিসের দাদায় ডাক্তর আছিলো, কবিরাজি করত আরকি! হেইল্লিগা জিগাইসে কই যামু…’- দাদী নিচুগলায় উত্তরটা দিয়েই আরেক প্রসঙ্গে চলে গেলেন।
-‘শুন, তুই বাড়িত যায়া শুইয়া ঘুম দিবি একটা। আনিসে বাজার আনলে আমি রান্ধন বাড়ন শ্যাষে ডাক দিমুনে…’
-‘না আমি ট্রেনে বহুত ঘুমাইসি দাদী! আপনে ঘুমায়েন বাড়িতে যাইয়া, আমি রানতে পারব!’
★
-‘দাদী! ও দাদী! বাজার আনসি, এইগুলা রাখো আর একটু পানি খাওয়াও! এত্ত গরম আজকে বাইরে…’
উঠানে আনিসভাইয়ের গলা পেয়ে দৌড়ে রান্নাঘর ছেড়ে দাদীর ঘরে গেলাম আমি। দাদী তো ঘুমে কাদা! শেষমেশ পানির জগ আর গ্লাস হাতে আমাকেই বের হতে হলো
-‘দাদী ঘুমায়। আমার কাছে দেন ব্যাগ গুলা সব, পানিটা ধরেন’- গ্লাসটা ভরে বাড়িয়ে দিলাম আনিস সাহেবের দিকে।
-‘শুকরিয়া!’- বলে উঠানের দাওয়ায় বসেই এক ঢোকে পানিটুকু সাবাড় করলেন আনিস, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন-
-‘আচ্ছা আমি আসি তবে! কিছু লাগলে জানাবেন আমাকে…উমম…জানাবেন কীভাবে আপনার কাছে তো ফোন-টোন ও নাই…- ক্যাবলাকান্তের মত মাথা চুলকাতে লাগলেন উনি।
-‘সমস্যা হবেনা, দাদী আছেন ত! এমনিতেই যথেষ্ট।করেছেন, আর অযথা ঋণ বাড়াবেন না প্লিজ!’
আনিস বোকাচন্দের মত খানিক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন, তারপর বাইরের দিকে পা বাড়ান।
বাজারের ব্যাগটা নিয়ে পেছনে ঘুরতে না ঘুরতেই বোকাচন্দের গলা কানে আসে আমার-
‘আচ্ছা, আপনার সাথে কথা ছিলো…সময় হবে এখন?’
-‘হ্যা বলুন!’- ঘুরে দাঁড়ালাম আনিস সাহেবের মুখোমুখি।
-‘আসলে মানে…খুবি বিব্রতকর পরিস্থিতি। কিন্তু আপনার মতটা সবচে ইম্পরট্যান্ট তাই…’
-‘এত ইতস্তত করার কিছু নাই বিশ্বাস করেন! যে বিশাল উপকার আপনি করেছেন আমার, এরপর যদি বলেন এখন বিনিময়ে আপনার দাসীবৃত্তি করতে হবে আমি তাতেও রাজি…’
-‘দাসীবৃত্তির প্রয়োজন নেই, ঘরকন্না টুকু করতে পারলেই চলবে’- ফট করে কথাটা বলে বসলেন আনিস! আমি চমকে চোখ ওঠাতেই উনার চোখে চোখ পড়ে গেলো, আমার চোখের ভেতর দিয়ে একেবারে যেন অন্তরের মাঝখানে ভেদ করছে ঐ দৃষ্টি! পুরোপুরি বোবা হয়ে গেলাম।
-‘মার্জনা করবেন! মুখ ফসকে…আসলে আমার এভাবে বলাটা ঠিক হয়নি! আসলে ট্রেনে দাদীর কথাগুলিও ত সত্যি…আমি নিজের হয়ে প্রতিজ্ঞা করতে পারি আমার কাছে সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় থাকবেন আপনি…কিন্তু খশরু বদটার নজর একবার এই বাড়িতে পরলে… মানে আমি আসলে…’
-‘আমি রাজি!’- কোনোক্রমে শব্দদুটো বলে বাজারের ব্যাগটা ডানহাতে চেপে রান্নাঘরের দিকে দৌড় লাগালাম। পেছনের বোকাচন্দ তখনোও দেবদারু গাছের মত সোজা হয়ে দাঁড়ানো।
কী ছাই রান্না করব, বুকের ভেতর ভূমিকম্প চলছে যেন! অদ্ভুত তো! একরকম নিরুপায় হয়েই বছর চল্লিশের বুড়ো (যদিও দেখতে আরো কম বয়সী লাগে!), গ্রামের স্কুলের অঙ্ক মাস্টারের গলায় জীবনের নামে ঝুলে পরতে হচ্ছে মাত্র পনের বছর বয়সে আমায় অথচ খারাপ লাগার লেশটুকু মাত্র নেই! তা নেই নাহয় এক কথা, খারাপ লাগছে না মানলাম কিন্তু ভাল কেন লাগছে এটাই ত ছাই বুঝে পাচ্ছিনা! দ্রুমদ্রুম শব্দে যেন কেউ ঢাক পেটাচ্ছে হৃদপিণ্ডটার ওপরে, হাত-পা অসাড় হয়ে আসছে- এই বুঝি এক অসহায় মেয়ে যে কীনা বাধ্য হয়ে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে তার লক্ষণ? আমি তো জানি এসব প্রেমে পড়বার লক্ষণ, ভালবাসার কুঁড়ি ফোটার লক্ষণ… জীবনের নতুন অধ্যায়ের প্রথম সূর্যোদয়ের লক্ষণ!
★
‘হলুদ বাটো,মেন্দি বাটো,বাটো ফুলের মৌ
বিয়ার সাজে সাজবে কইন্যা,নরম নরম বৌ- গো!’
-ভোরবেলা থেকে বাজতে বাজতে এই বিচ্ছিরি, ক্ষ্যাত গানটা একদম কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে! আজ সকালে আমার গায়ে হলুদ, আর বিকেলেই বিয়ে! ওদিকে বাবা, ছোটমা আর খশরুদের কী অবস্থা জানিনা, এদিকে সেই টেনশনে দাদী রীতিমত অস্থির! খশরু গ্রামে ফিরে আসার আগে কোনোরকমে বিয়েটা সেরে ফেলতে হবে, তাই এত তাড়াহুড়ায় সব করা হচ্ছে। এর মধ্যেই কোত্থেকে নতুন শাড়ি কাপড়, এক সেট স্বর্ণের গয়না আর বিয়ের বাজারের ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে! দাদীর সোনারভাই আনিসই বোধহয় করেছে সব।
দুপুরের দিকেই বরযাত্রী এসে পৌঁছলো, এদিকে ভোরবেলা পুকুরের ঠান্ডা পানিতে গোসল আর তারপর ভেজা হলুদ মাখামাখির পর ঠান্ডা লেগে আমার বারটা বেজে গিয়েছে! কোনোরকমে ‘হ্যাচ্চো হ্যাচ্চো’ করতে করতে কবুল কবুল বলে ফেললাম…ব্যাস! ক্যাবলাকান্ত মাস্টারটার সাথে জীবন গেঁথে গেলো আমার!
মেয়েপক্ষ বলতে এক দাদী, তা তিনি একাই একশো! কেঁদে কেটে বাড়ি মাথায় তুলে নিলেন! এক ফাঁকে আমায় দূরে ডেকে নিয়ে বললেন-
‘আল্লাহর রহম আছে নাতিন তর উপরে, খরশু বজ্জাতটায় অহনো আসেনাই! ভালয় ভালয় বিয়াটা মিটসে, এখন আইলেও ঝাঁটাপিটা কইরা অরে দূর কইরা দিমু!’
সত্যি বলতে এই খশরুর ব্যাপারটা নিয়ে আমারো বেশ ভয় ছিলো মনে মনে,আল্লাহ মালিক! সব ভালয় ভালয় হয়েছে… কে জানে সামনে এখন কী অপেক্ষা করছে কিন্তু অন্তত খশরু শয়তানটার বদনজর থেকে তো বাঁচা গেলো- এইই বা কম কী!
চৌদ্দ রকমের রীতিনীতি শেষে গ্রাম সম্পর্কের ভাবীরা আর আমার ছোট ননদ আমায় ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে গেলো। মিশু- মেয়েটার নাম, আমার ননদ হয় যে সম্পর্কে। বেশ হাসিখুশি আর চঞ্চল, বছরখানেক আগেই বিয়ে হয়েছে ওর। আমাকে বাসরঘরে বসিয়ে দিয়ে হাত ধরে কলকল করে বলল-
‘তুমি তো আমার চে বয়সে ছোটই মনেহয়! তা যাইহোক, দাদাভাইয়ের বউ মানে আমার ভাবী তুমি! একটা কথা বলি মনে রাইখ, এই বাড়িতে কেউই তুমার আপন না এক দাদাভাই ছাড়া! দাদাভাই বড় একলা মানুষ, দুনিয়াতে ওর সবচে কাছের ছিলাম আমি। আমার বিবাহের পর…যাকগা, তোমার যেমন দাদাভাই ছাড়া কেউ নাই দাদাভাইএর ও কিন্তু তেমন তুমি ছাড়া কেউ নাই! সব ভাইঙ্গা বললাম না, দুইদিন গেলে আপনাতেই বুঝবা! খালি মনে রাইখো, মেয়ে মানুষ আর যাই সহ্য করুক, স্বামীর অপমান সহ্য করা তার সাজে না! আসি!’
সারাদিনের ধকলে আমার মাথা কাজ করছিলো না, তার ওপর জ্বর-ঠান্ডা বসে গেছে বুকে। মিশুর কথার পুরো মর্মার্থ উদ্ধার করার আগেই গুটগুট করে বোকাচন্দর এসে হাজির! আরে আজব তো, বুকের ভেতর আবার কে যেন হাতুড়ি-বাটালি নিয়ে খেলছে…
-‘আপনাকে তো ধড়াচূড়া পরিয়ে নাজেহাল করে রেখেছে, ডানের দরজা দিয়ে বেরোলে কিছুদূরেই বাথরুম পাবেন। যান ফ্রেশ হয়ে আসুন!’- হাবলাচন্দ্রের এই হচ্ছে প্রথম কথা বউ-এর প্রতি।
শাড়িকাপড় ছেড়ে সুতি থ্রি-পিস পরে হাতমুখ ধুয়ে এলাম, বেশ ফ্রেশ লাগছে এখন! যদিও মাথাটা দপদপ করে ব্যথা করছে, আর সম্ভবত জ্বর ও আসছে! ঘরে ঢুকতেই দেখি হুলুস্থুল কাণ্ড, মেঝে জুড়ে বিছানা পাতা!
-‘ইয়ে মানে, লাইট টা নিভিয়ে দিলেই ভাল হবে, বাইরে ত সকলে আছে! আমি নিচে বিছানা পেতে নিয়েছি, আপনি খাটে ঘুমিয়ে যেতে পারেন!’- ক্যাবলার দ্বিতীয় কথা বাসর রাতে!
-‘আচ্ছা, ধন্যবাদ! আর একটা কথা, সম্পর্কে আর বয়সে আমি আপনার অনেক ছোট, আমাকে তুমি করে ডাকলে খুশি হবো!’
-‘ওহ..থ্যাংকু! হ্যা সেটাই ভাল হবে, নয়ত বাকি সবাই সন্দেহ করবে আবার’ বলে বোকারামের মত একটা হাসি লটকে আমার দিকে তাকিয়ে রইল ক্যাবলা হাবাটা।
-‘কিছু বলবেন?’
-‘ অ্যা! না মানে.. না কিছুনাহ!’- বলে লাইট নিভিয়ে মেঝেতে শুয়ে পরলেন উনি, খানিক বাদেই মিহি নাক ডাকার শব্দ কানে এলো!
★
ভোরবেলা চোখ মেলতেই নিজেকে এক অদ্ভুত অবস্থায় আবিষ্কার করলাম! খাটের হেডরেস্টে মাথা রেখে হেলান দিয়ে বসে আছেন আনিস সাহেব আর তার পায়ে মাথা রেখে এতক্ষণ ঘুমাচ্ছিলাম আমি! ধড়মড়িয়ে উঠতে গিয়ে টের পেলাম আনিসের হাতের আঙুলের ভেতর আমার একগোছা চুল আটকে আছে। চুলে টান পরতেই ‘ওহ, মাগো!’- বলে জট ছাড়াবার জন্য হাত বাড়ালাম আর ঠিক সেই সময়েই আনিসও হুড়মুড় করে উঠে নড়েচড়ে বসতে গেলেন- কপালে কপালে গুতো খেয়ে তবে শান্ত হলাম দু’জনেই!
-‘আপনি ত মহাবদ! চোরের মত খাটে চলে এসছেন! আপনি না মেঝেতে বিছানা করলেন তবে আবার…’
-‘আরে আরে! আস্তে আস্তে! সারারাত ত জ্বরের ঘোরে নেচে-কুঁদে অস্থির হয়েছ! শেষে উপায় না পেয়ে তোমার মাথায় জলপট্টি দিতে হয়েছে আমায়! যত খারাপ ভাবছো অতটা খারাপ না, নয়ত জ্বরের ছুতো দিয়ে চাইলে তোমার গা-হাত-পা কিংবা পুরো শরীরই মুছিয়ে দিতে পারতাম… ডাক্তার হিসাবে সেটুকু করলেও রোগী হিসেবে আমায় পরে চার্জ করতে পারতে না কিন্তু তুমি!’- শেষ অংশটুকু ভেজা বেড়ালের মত মিনমিন করে বলেই আমার চোখের একদম ভেতর দিয়ে অন্তরের ভেতর সেই অন্তর্ভেদী দৃষ্টি ছুড়ে দিলো লোকটা। উফ! অসহ্য!
-‘করেন তো প্রাইমারি স্কুলে অঙ্কের মাস্টারি, আর মেয়েমানুষ দেখলে গা-মোছানো ডাক্তার হতে ইচ্ছে করে? তা এতই যখন বিনাবাধায় নারী রোগী ছুয়ে দেখার শখ তখন ডাক্তারিটা পড়লেও তো পারতেন! আপনার খায়েশ ও পূরণ হতো, আমারও এখন কিছু সুবিধে হতো…’
কথা শেষ না হতেই খেয়াল করি অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন আনিস!
-‘জ্বরের ঘোরে মাথাটাও গেছে আপনার! দুইটা ঔষধ দিচ্ছি, এটা খাবার পর খাবেন সকালে। আর এই লাল পাতাটা এন্টিবায়োটিক, তিন দিন দেখুন জ্বর কমে কিনা। না কমলে তখন এটা খেতে হবে…যেহেতু এন্টিবায়োটিক তাই এটার সাতদিনের কোর্স পুরো কমপ্লিট করবেন যদি খান!’- বলে আমার দিকে দুটো ঔষধের পাতা বাড়িয়ে দিলেন উনি। জ্বরের চোটে জিহ্বা শুকিয়ে আসছিলো আমার, ঔষধ দুটো হাতে নিয়ে পাশে রেখে দিলাম।
তিনদিন দেখা লাগলো না, বিকেলের মধ্যেই জ্বরটা নেমে এলো আমার। মাস্টার সাহেবের ঔষধ তো দেখছি ভালই কাজ করেছে! বাড়িটা এখনো কাছের আত্নীয় স্বজনে ভরা, দুপুরের খাবার শেষে সবাই যে যার মত গড়িয়ে নিচ্ছিল। পুরনো আমলের বড় দোতলা বাড়ি…ছাদে যাবার জন্য প্যাঁচানো লোহার সিঁড়ি- এই প্যাটার্নটা আমার ভীষণ পছন্দের! সিঁড়ি বেয়ে তরতরিয়ে ছাদে উঠে গেলাম, এমাথা-ওমাথা বারকয়েক চক্কর দিয়ে উত্তরের রেলিং ধরে দাঁড়াতেই চোখ আটকে গেলো একটা টিনশেড একচালা ঘরের দিকে… প্রায় বিশ পঁচিশ জন মানুষের জটলা ঘরের সামনে। আর ঘরের জানালা দিয়ে একটা পরিচিত মুখের আদল দেখা যাচ্ছে…আনিস সাহেব! এই লোকের ত এখন স্কুলে থাকার কথা! কৌতূহলের কাছে পরাজিত হয়ে পায়েপায়ে নিচে নামলাম আমি, টিনের ঘরটার জানালার পাশ দিয়ে উঁকি দিতেই চোখ ছানাবড়া হবার উপক্রম! একজন একজন করে লোক আসছে যারা কিনা নানা রোগের রোগী আর আনিস মাস্টার তাদের ঔষধ পথ্য ধরিয়ে দিয়ে বিদেয় করছেন! এই লোকের দাদা নাকি কবিরাজ ছিল, সেও কি মাস্টারির পাশাপাশি কবিরাজি ব্যবসা ধরলো নাকি? আমি ধৈর্য ধরে জানালার পাশে অপেক্ষা করতে থাকলাম লোকজন কমে যাবার এবং আনিস মাস্টারের চলে যাবার। নিতান্ত থাকতে না পেরে বারকয়েক উঁকিঝুঁকি মেরেছি যদিও!
খানিক্ষণ বাদে লোকজন কমে এলে আনিস মাস্টার ও বেরিয়ে গেলেন, যাবার সময় দরজায় সাইনবোর্ড লটকে গেলেন- ‘আজকের মত রোগী দেখা শেষ’। অদ্ভুত ব্যাপার, ঘরের দরজা না আটকেই কেবল ভেজিয়ে রেখে গেলেন। যাকগে! আমার সুবিধাই হলো, পা টিপে টিপে ঘরটাতে ঢুকে গেলাম!
দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে ঘরটাতে ভালমত চোখ বুলালাম। একটা টেবিল সাথে চেয়ার, গোটা দুয়েক বড় কাঠের আলমারি, একটা স্টেথোস্কোপ, অনেক রকম ঔষধপত্র…মানে পুরো একটা ডাক্তারের চেম্বার যেন! টেবিলটার ওপরে একটা সীলমোহর, ওল্টাতেই নাম নজরে এলো
‘ডক্টর আনিসুর রহমান
M.B.B.S,……
কীহ! এই লোক এম.বি.বি.এস করা ডাক্তার!
-‘আমি নাহয় চোরের মত মেঝে ছেড়ে খাটে যাই, তুমি যে ডাকাতের মত একজনের ঘরে ঢুকে বসে আছো?’- একটা গম্ভীর গলায় ঘরটা গমগম করে ওঠে যেন। চমকে আমার হাত থেকে সীলমোহরটা মেঝেতে পড়ে যায়, ঘাড় ঘুরাতেই দেখি আনিস লোকটা ফিচলে হাসি মুখে ঝুলিয়ে দাঁড়ানো আমার পেছনে!
-‘আমি মানে…আমি! আপনি এখানে কী করেন? আপনি ডাক্তার হলেন কবে?’
-‘কীহ! উলটে আমার ওপরেই চোটপাট দেখাচ্ছে মেয়ে!’
-‘না মানে, দাদী ত বলেছিলো আপনি গ্রামের স্কুলের অঙ্ক মাস্টার! আমি তো তাই… ‘
-‘দাদী এসব বলেছিল! অঙ্ক আমার দুই চোখের বিষ! আমি মেডিকেলে পড়েছি তারপর এখানে এসে প্র্যাক্টিস করছি তা-ও বছরখানেক হবে!’-উনি অবাক গলায় বলেন।
-‘কী অদ্ভুত! দাদী তবে এতবড় মিছে কথা…কী বললেন? মাত্র বছরখানেক আগে আপনি পাশ করে বেরিয়েছেন? আপনার না চল্লিশ বছর বয়েস! এতদিন লাগে বুঝি ডাক্তারি পড়তে!’
হোহো করে হেসে দিলেন লোকটা!
-‘এইসব আবোলতাবোল কথা কে বলেছে তোমাকে? দাদী?’
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই মাথা চুলকে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে কিছু একটা চিন্তা করেন উনি।তারপর বলেন-
‘আচ্ছা বেশ, চলো দেখি দাদীর বাড়িতে যেয়ে সব খোলাসা করে আসি!’
★
-‘হ কইসিই ত! আনিসের বয়স কম আর আনিসে গেরামের সেরা ডাক্তর- হেইডা কইলে কি তর ছোটমায় জীবনে আনিসের লগে তরে বিয়া দিতে রাজি হইত মুখপুড়ি? হের বইনের মাইয়ার জন্য পোলাডারে ধইরা বাইন্ধা নিয়া যাইত না? এইল্লিগা মিছা কথা কইসি!’- পান চিবুতে চিবুতে গাল নেড়ে নেড়ে বললেন দাদী।
-‘আমাকে ত বলতে পারতেন দাদী!’- আমি আহত গলায় বললাম।
-‘ক্যা! তরে কমু ক্যা? ডাক্তার শুইনা বিয়া করবি তাইজন্যি? হুহ! ধন-সম্পদ দেইখা যে বিয়া হয় হেইডা বিয়া না, হেইডা কিনাবেচা! এইযে তুই আনিসরে বুইড়া মাস্টার জাইনাও বিয়া করলি হের মানে কি হইল ক’ তো? হের মানে হইল আজকা যদি আনিসের কিছু হইয়াও যায়, আনিসে যদি আর ডাক্তরি করবার নাও পারে তাও তুই হের লগে জোড়া বাইন্ধা থাকবি! কারণ হের বিদ্যা বুদ্দি দেইখা তুই হেরে বিয়া করস নাই, মন দেইখা করসস… মন! হেরে ভালবাইসা করসস…’
-‘ধুর! দাদী আপনে এত আবুলতাবুল বকতে পারেন!’
-‘আসবে তুমার মনের মানুষ সই লো,
হাতে নিয়া মালা…
কুঞ্জবনে যায়া সই…’
দাদী মাথা নেড়ে নেড়ে গান ধরলেন, ওদিকে হোহো শব্দে হেসে চলেছেন ক্যাবলাকান্ত আনিস… আর এদিকে চূড়ান্ত বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আমার ত্রাহি ত্রাহি দশা!
★
-‘আমার বয়স এখনো তিরিশ হয়নাই! সার্টিফিকেটে আরেকটু কম…’- রাস্তায় বের হয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে লোকটা।
আমি মাথা নিচু করে হেঁটে চলেছি, কী একটা ভীষণ অদ্ভুত অবস্থা! উনার পেছন পেছনই যাচ্ছিলাম, মাটির দিকে চোখ ছিল বলে বুঝিনি সামনে যে বাঁশঝাড়, দু’পা ফেলতেই ডান হাতটা ধরে হ্যাঁচকা টানে কেউ ঝাড়ের ভেতর নিয়ে যায় আমাকে। এক টুকরো কাপড় দিয়ে মুখটা পেঁচিয়ে ধরে কেউ, কানের কাছে দুর্গন্ধে ভরা একটা মুখের অস্তিত্ব ফিসফিস করে-
‘খবরদার টু শব্দ করবিনা! শালী…! এক্কারে কল্লাটা ফালায়া দিমু!’
খশরু!
আমার হাত পা অবশ হয়ে আসে, শরীরের সর্বশক্তি একত্রিত করে চিৎকার দেয়ার শেষ সাহসটুকু সঞ্চয় করতে চাই আমি …
★
কপি/শেয়ার না করার জন্য অনুরোধ করা হলো।
একজীবন পর্ব ৪
একজীবন
পর্বঃ ৪
★
-‘আর কত ঘুমাবি, উইঠা মুখহাত ধুইয়া নে যা! আইসা পরসি পরায়…’
দাদীর চিল্লাপাল্লাতে ঘুমটা কেটে গেল আমার। ট্রেনের ঝাঁকুনিতে কখন ঝিমিয়ে গিয়েছিলাম নিজেও বলতে পারবনা। ট্রেনের বাথরুম থেকে একরকম ফ্রেশ হয়ে এলাম হাতমুখ ধুয়ে, সিটে এসে বসতেই পাশ থেকে টিস্যু বাড়িয়ে দিলো কেউ একজন…ঘাড় ঘুরাতেই দেখলাম আর কেউনা দাদীর আনিস দাদাভাই আমার দিকে টিস্যু বাড়িয়ে বসে আছেন! টিস্যুতে চেপে মুখটা হালকা মুছতে না মুছতেই ঝিকঝিক শব্দে ট্রেনটা থেমে যেতে শুরু করলো।
-‘দাদী আপনে অরুরে নিয়ে এক রিকশায় যান, আমি আরেকটা নিয়া আসতেসি। আপনেদের ত বাজার টাজার ও করতে হইবো, অনেকদিন ত বাড়িতে থাকেন না। আমি নিয়া আসতেসি সব, আপনেরা আগাইতে থাকেন।’- ট্রেন থেকে নেমে রিকশা ডেকে বললেন আনিসভাই। তারপর দাদীকে আর আমাকে তুলে দিয়ে রিকশাওয়ালাকে সাবধানে চালাতে বলে বাজারের দিকে হাঁটা ধরলেন।
-‘আফনেরা কি ডাক্তর সাবের বাড়িতেই যাইবেন নাকি অন্য জাগাত যাইবেন?’- খানিক বাদে রিকশাওয়ালা প্রশ্ন করলেন।
-‘না,না! আমাগ বাড়িত যামু, তুমি চালাও আমি কইয়া দিতাসি রাস্তা’- দাদী তড়িৎ গতিতে জবাব দিলেন।
-‘ডাক্তার সাহেবটা আবার কে দাদী?’- আমি অবাক গলায় জিজ্ঞেস করলাম।
-‘ওমা! আফায় যে কি কয়…আফনেগো যে রিশকাত তুইল্লা দিলো…’
-‘মিয়া তুমি বেশি কতা কইওনা ত, মন দিয়া রিশকা চালাও’- দাদীর রামধমকে রিকশাওয়ালা কথা শেষ করতে পারলোনা।
-‘কিগো দাদী? উনারে কথা শেষ করতে দিলেন না ক্যান?’- দাদীর দিকে তাকালাম আমি।
-‘আরে এরা কী কয় না কয়! অই আনিসের দাদায় ডাক্তর আছিলো, কবিরাজি করত আরকি! হেইল্লিগা জিগাইসে কই যামু…’- দাদী নিচুগলায় উত্তরটা দিয়েই আরেক প্রসঙ্গে চলে গেলেন।
-‘শুন, তুই বাড়িত যায়া শুইয়া ঘুম দিবি একটা। আনিসে বাজার আনলে আমি রান্ধন বাড়ন শ্যাষে ডাক দিমুনে…’
-‘না আমি ট্রেনে বহুত ঘুমাইসি দাদী! আপনে ঘুমায়েন বাড়িতে যাইয়া, আমি রানতে পারব!’
★
-‘দাদী! ও দাদী! বাজার আনসি, এইগুলা রাখো আর একটু পানি খাওয়াও! এত্ত গরম আজকে বাইরে…’
উঠানে আনিসভাইয়ের গলা পেয়ে দৌড়ে রান্নাঘর ছেড়ে দাদীর ঘরে গেলাম আমি। দাদী তো ঘুমে কাদা! শেষমেশ পানির জগ আর গ্লাস হাতে আমাকেই বের হতে হলো
-‘দাদী ঘুমায়। আমার কাছে দেন ব্যাগ গুলা সব, পানিটা ধরেন’- গ্লাসটা ভরে বাড়িয়ে দিলাম আনিস সাহেবের দিকে।
-‘শুকরিয়া!’- বলে উঠানের দাওয়ায় বসেই এক ঢোকে পানিটুকু সাবাড় করলেন আনিস, তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন-
-‘আচ্ছা আমি আসি তবে! কিছু লাগলে জানাবেন আমাকে…উমম…জানাবেন কীভাবে আপনার কাছে তো ফোন-টোন ও নাই…- ক্যাবলাকান্তের মত মাথা চুলকাতে লাগলেন উনি।
-‘সমস্যা হবেনা, দাদী আছেন ত! এমনিতেই যথেষ্ট।করেছেন, আর অযথা ঋণ বাড়াবেন না প্লিজ!’
আনিস বোকাচন্দের মত খানিক্ষন আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন, তারপর বাইরের দিকে পা বাড়ান।
বাজারের ব্যাগটা নিয়ে পেছনে ঘুরতে না ঘুরতেই বোকাচন্দের গলা কানে আসে আমার-
‘আচ্ছা, আপনার সাথে কথা ছিলো…সময় হবে এখন?’
-‘হ্যা বলুন!’- ঘুরে দাঁড়ালাম আনিস সাহেবের মুখোমুখি।
-‘আসলে মানে…খুবি বিব্রতকর পরিস্থিতি। কিন্তু আপনার মতটা সবচে ইম্পরট্যান্ট তাই…’
-‘এত ইতস্তত করার কিছু নাই বিশ্বাস করেন! যে বিশাল উপকার আপনি করেছেন আমার, এরপর যদি বলেন এখন বিনিময়ে আপনার দাসীবৃত্তি করতে হবে আমি তাতেও রাজি…’
-‘দাসীবৃত্তির প্রয়োজন নেই, ঘরকন্না টুকু করতে পারলেই চলবে’- ফট করে কথাটা বলে বসলেন আনিস! আমি চমকে চোখ ওঠাতেই উনার চোখে চোখ পড়ে গেলো, আমার চোখের ভেতর দিয়ে একেবারে যেন অন্তরের মাঝখানে ভেদ করছে ঐ দৃষ্টি! পুরোপুরি বোবা হয়ে গেলাম।
-‘মার্জনা করবেন! মুখ ফসকে…আসলে আমার এভাবে বলাটা ঠিক হয়নি! আসলে ট্রেনে দাদীর কথাগুলিও ত সত্যি…আমি নিজের হয়ে প্রতিজ্ঞা করতে পারি আমার কাছে সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় থাকবেন আপনি…কিন্তু খশরু বদটার নজর একবার এই বাড়িতে পরলে… মানে আমি আসলে…’
-‘আমি রাজি!’- কোনোক্রমে শব্দদুটো বলে বাজারের ব্যাগটা ডানহাতে চেপে রান্নাঘরের দিকে দৌড় লাগালাম। পেছনের বোকাচন্দ তখনোও দেবদারু গাছের মত সোজা হয়ে দাঁড়ানো।
কী ছাই রান্না করব, বুকের ভেতর ভূমিকম্প চলছে যেন! অদ্ভুত তো! একরকম নিরুপায় হয়েই বছর চল্লিশের বুড়ো (যদিও দেখতে আরো কম বয়সী লাগে!), গ্রামের স্কুলের অঙ্ক মাস্টারের গলায় জীবনের নামে ঝুলে পরতে হচ্ছে মাত্র পনের বছর বয়সে আমায় অথচ খারাপ লাগার লেশটুকু মাত্র নেই! তা নেই নাহয় এক কথা, খারাপ লাগছে না মানলাম কিন্তু ভাল কেন লাগছে এটাই ত ছাই বুঝে পাচ্ছিনা! দ্রুমদ্রুম শব্দে যেন কেউ ঢাক পেটাচ্ছে হৃদপিণ্ডটার ওপরে, হাত-পা অসাড় হয়ে আসছে- এই বুঝি এক অসহায় মেয়ে যে কীনা বাধ্য হয়ে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছে তার লক্ষণ? আমি তো জানি এসব প্রেমে পড়বার লক্ষণ, ভালবাসার কুঁড়ি ফোটার লক্ষণ… জীবনের নতুন অধ্যায়ের প্রথম সূর্যোদয়ের লক্ষণ!
★
‘হলুদ বাটো,মেন্দি বাটো,বাটো ফুলের মৌ
বিয়ার সাজে সাজবে কইন্যা,নরম নরম বৌ- গো!’
-ভোরবেলা থেকে বাজতে বাজতে এই বিচ্ছিরি, ক্ষ্যাত গানটা একদম কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে! আজ সকালে আমার গায়ে হলুদ, আর বিকেলেই বিয়ে! ওদিকে বাবা, ছোটমা আর খশরুদের কী অবস্থা জানিনা, এদিকে সেই টেনশনে দাদী রীতিমত অস্থির! খশরু গ্রামে ফিরে আসার আগে কোনোরকমে বিয়েটা সেরে ফেলতে হবে, তাই এত তাড়াহুড়ায় সব করা হচ্ছে। এর মধ্যেই কোত্থেকে নতুন শাড়ি কাপড়, এক সেট স্বর্ণের গয়না আর বিয়ের বাজারের ব্যবস্থা করা হয়ে গেছে! দাদীর সোনারভাই আনিসই বোধহয় করেছে সব।
দুপুরের দিকেই বরযাত্রী এসে পৌঁছলো, এদিকে ভোরবেলা পুকুরের ঠান্ডা পানিতে গোসল আর তারপর ভেজা হলুদ মাখামাখির পর ঠান্ডা লেগে আমার বারটা বেজে গিয়েছে! কোনোরকমে ‘হ্যাচ্চো হ্যাচ্চো’ করতে করতে কবুল কবুল বলে ফেললাম…ব্যাস! ক্যাবলাকান্ত মাস্টারটার সাথে জীবন গেঁথে গেলো আমার!
মেয়েপক্ষ বলতে এক দাদী, তা তিনি একাই একশো! কেঁদে কেটে বাড়ি মাথায় তুলে নিলেন! এক ফাঁকে আমায় দূরে ডেকে নিয়ে বললেন-
‘আল্লাহর রহম আছে নাতিন তর উপরে, খরশু বজ্জাতটায় অহনো আসেনাই! ভালয় ভালয় বিয়াটা মিটসে, এখন আইলেও ঝাঁটাপিটা কইরা অরে দূর কইরা দিমু!’
সত্যি বলতে এই খশরুর ব্যাপারটা নিয়ে আমারো বেশ ভয় ছিলো মনে মনে,আল্লাহ মালিক! সব ভালয় ভালয় হয়েছে… কে জানে সামনে এখন কী অপেক্ষা করছে কিন্তু অন্তত খশরু শয়তানটার বদনজর থেকে তো বাঁচা গেলো- এইই বা কম কী!
চৌদ্দ রকমের রীতিনীতি শেষে গ্রাম সম্পর্কের ভাবীরা আর আমার ছোট ননদ আমায় ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে গেলো। মিশু- মেয়েটার নাম, আমার ননদ হয় যে সম্পর্কে। বেশ হাসিখুশি আর চঞ্চল, বছরখানেক আগেই বিয়ে হয়েছে ওর। আমাকে বাসরঘরে বসিয়ে দিয়ে হাত ধরে কলকল করে বলল-
‘তুমি তো আমার চে বয়সে ছোটই মনেহয়! তা যাইহোক, দাদাভাইয়ের বউ মানে আমার ভাবী তুমি! একটা কথা বলি মনে রাইখ, এই বাড়িতে কেউই তুমার আপন না এক দাদাভাই ছাড়া! দাদাভাই বড় একলা মানুষ, দুনিয়াতে ওর সবচে কাছের ছিলাম আমি। আমার বিবাহের পর…যাকগা, তোমার যেমন দাদাভাই ছাড়া কেউ নাই দাদাভাইএর ও কিন্তু তেমন তুমি ছাড়া কেউ নাই! সব ভাইঙ্গা বললাম না, দুইদিন গেলে আপনাতেই বুঝবা! খালি মনে রাইখো, মেয়ে মানুষ আর যাই সহ্য করুক, স্বামীর অপমান সহ্য করা তার সাজে না! আসি!’
সারাদিনের ধকলে আমার মাথা কাজ করছিলো না, তার ওপর জ্বর-ঠান্ডা বসে গেছে বুকে। মিশুর কথার পুরো মর্মার্থ উদ্ধার করার আগেই গুটগুট করে বোকাচন্দর এসে হাজির! আরে আজব তো, বুকের ভেতর আবার কে যেন হাতুড়ি-বাটালি নিয়ে খেলছে…
-‘আপনাকে তো ধড়াচূড়া পরিয়ে নাজেহাল করে রেখেছে, ডানের দরজা দিয়ে বেরোলে কিছুদূরেই বাথরুম পাবেন। যান ফ্রেশ হয়ে আসুন!’- হাবলাচন্দ্রের এই হচ্ছে প্রথম কথা বউ-এর প্রতি।
শাড়িকাপড় ছেড়ে সুতি থ্রি-পিস পরে হাতমুখ ধুয়ে এলাম, বেশ ফ্রেশ লাগছে এখন! যদিও মাথাটা দপদপ করে ব্যথা করছে, আর সম্ভবত জ্বর ও আসছে! ঘরে ঢুকতেই দেখি হুলুস্থুল কাণ্ড, মেঝে জুড়ে বিছানা পাতা!
-‘ইয়ে মানে, লাইট টা নিভিয়ে দিলেই ভাল হবে, বাইরে ত সকলে আছে! আমি নিচে বিছানা পেতে নিয়েছি, আপনি খাটে ঘুমিয়ে যেতে পারেন!’- ক্যাবলার দ্বিতীয় কথা বাসর রাতে!
-‘আচ্ছা, ধন্যবাদ! আর একটা কথা, সম্পর্কে আর বয়সে আমি আপনার অনেক ছোট, আমাকে তুমি করে ডাকলে খুশি হবো!’
-‘ওহ..থ্যাংকু! হ্যা সেটাই ভাল হবে, নয়ত বাকি সবাই সন্দেহ করবে আবার’ বলে বোকারামের মত একটা হাসি লটকে আমার দিকে তাকিয়ে রইল ক্যাবলা হাবাটা।
-‘কিছু বলবেন?’
-‘ অ্যা! না মানে.. না কিছুনাহ!’- বলে লাইট নিভিয়ে মেঝেতে শুয়ে পরলেন উনি, খানিক বাদেই মিহি নাক ডাকার শব্দ কানে এলো!
★
ভোরবেলা চোখ মেলতেই নিজেকে এক অদ্ভুত অবস্থায় আবিষ্কার করলাম! খাটের হেডরেস্টে মাথা রেখে হেলান দিয়ে বসে আছেন আনিস সাহেব আর তার পায়ে মাথা রেখে এতক্ষণ ঘুমাচ্ছিলাম আমি! ধড়মড়িয়ে উঠতে গিয়ে টের পেলাম আনিসের হাতের আঙুলের ভেতর আমার একগোছা চুল আটকে আছে। চুলে টান পরতেই ‘ওহ, মাগো!’- বলে জট ছাড়াবার জন্য হাত বাড়ালাম আর ঠিক সেই সময়েই আনিসও হুড়মুড় করে উঠে নড়েচড়ে বসতে গেলেন- কপালে কপালে গুতো খেয়ে তবে শান্ত হলাম দু’জনেই!
-‘আপনি ত মহাবদ! চোরের মত খাটে চলে এসছেন! আপনি না মেঝেতে বিছানা করলেন তবে আবার…’
-‘আরে আরে! আস্তে আস্তে! সারারাত ত জ্বরের ঘোরে নেচে-কুঁদে অস্থির হয়েছ! শেষে উপায় না পেয়ে তোমার মাথায় জলপট্টি দিতে হয়েছে আমায়! যত খারাপ ভাবছো অতটা খারাপ না, নয়ত জ্বরের ছুতো দিয়ে চাইলে তোমার গা-হাত-পা কিংবা পুরো শরীরই মুছিয়ে দিতে পারতাম… ডাক্তার হিসাবে সেটুকু করলেও রোগী হিসেবে আমায় পরে চার্জ করতে পারতে না কিন্তু তুমি!’- শেষ অংশটুকু ভেজা বেড়ালের মত মিনমিন করে বলেই আমার চোখের একদম ভেতর দিয়ে অন্তরের ভেতর সেই অন্তর্ভেদী দৃষ্টি ছুড়ে দিলো লোকটা। উফ! অসহ্য!
-‘করেন তো প্রাইমারি স্কুলে অঙ্কের মাস্টারি, আর মেয়েমানুষ দেখলে গা-মোছানো ডাক্তার হতে ইচ্ছে করে? তা এতই যখন বিনাবাধায় নারী রোগী ছুয়ে দেখার শখ তখন ডাক্তারিটা পড়লেও তো পারতেন! আপনার খায়েশ ও পূরণ হতো, আমারও এখন কিছু সুবিধে হতো…’
কথা শেষ না হতেই খেয়াল করি অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন আনিস!
-‘জ্বরের ঘোরে মাথাটাও গেছে আপনার! দুইটা ঔষধ দিচ্ছি, এটা খাবার পর খাবেন সকালে। আর এই লাল পাতাটা এন্টিবায়োটিক, তিন দিন দেখুন জ্বর কমে কিনা। না কমলে তখন এটা খেতে হবে…যেহেতু এন্টিবায়োটিক তাই এটার সাতদিনের কোর্স পুরো কমপ্লিট করবেন যদি খান!’- বলে আমার দিকে দুটো ঔষধের পাতা বাড়িয়ে দিলেন উনি। জ্বরের চোটে জিহ্বা শুকিয়ে আসছিলো আমার, ঔষধ দুটো হাতে নিয়ে পাশে রেখে দিলাম।
তিনদিন দেখা লাগলো না, বিকেলের মধ্যেই জ্বরটা নেমে এলো আমার। মাস্টার সাহেবের ঔষধ তো দেখছি ভালই কাজ করেছে! বাড়িটা এখনো কাছের আত্নীয় স্বজনে ভরা, দুপুরের খাবার শেষে সবাই যে যার মত গড়িয়ে নিচ্ছিল। পুরনো আমলের বড় দোতলা বাড়ি…ছাদে যাবার জন্য প্যাঁচানো লোহার সিঁড়ি- এই প্যাটার্নটা আমার ভীষণ পছন্দের! সিঁড়ি বেয়ে তরতরিয়ে ছাদে উঠে গেলাম, এমাথা-ওমাথা বারকয়েক চক্কর দিয়ে উত্তরের রেলিং ধরে দাঁড়াতেই চোখ আটকে গেলো একটা টিনশেড একচালা ঘরের দিকে… প্রায় বিশ পঁচিশ জন মানুষের জটলা ঘরের সামনে। আর ঘরের জানালা দিয়ে একটা পরিচিত মুখের আদল দেখা যাচ্ছে…আনিস সাহেব! এই লোকের ত এখন স্কুলে থাকার কথা! কৌতূহলের কাছে পরাজিত হয়ে পায়েপায়ে নিচে নামলাম আমি, টিনের ঘরটার জানালার পাশ দিয়ে উঁকি দিতেই চোখ ছানাবড়া হবার উপক্রম! একজন একজন করে লোক আসছে যারা কিনা নানা রোগের রোগী আর আনিস মাস্টার তাদের ঔষধ পথ্য ধরিয়ে দিয়ে বিদেয় করছেন! এই লোকের দাদা নাকি কবিরাজ ছিল, সেও কি মাস্টারির পাশাপাশি কবিরাজি ব্যবসা ধরলো নাকি? আমি ধৈর্য ধরে জানালার পাশে অপেক্ষা করতে থাকলাম লোকজন কমে যাবার এবং আনিস মাস্টারের চলে যাবার। নিতান্ত থাকতে না পেরে বারকয়েক উঁকিঝুঁকি মেরেছি যদিও!
খানিক্ষণ বাদে লোকজন কমে এলে আনিস মাস্টার ও বেরিয়ে গেলেন, যাবার সময় দরজায় সাইনবোর্ড লটকে গেলেন- ‘আজকের মত রোগী দেখা শেষ’। অদ্ভুত ব্যাপার, ঘরের দরজা না আটকেই কেবল ভেজিয়ে রেখে গেলেন। যাকগে! আমার সুবিধাই হলো, পা টিপে টিপে ঘরটাতে ঢুকে গেলাম!
দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে ঘরটাতে ভালমত চোখ বুলালাম। একটা টেবিল সাথে চেয়ার, গোটা দুয়েক বড় কাঠের আলমারি, একটা স্টেথোস্কোপ, অনেক রকম ঔষধপত্র…মানে পুরো একটা ডাক্তারের চেম্বার যেন! টেবিলটার ওপরে একটা সীলমোহর, ওল্টাতেই নাম নজরে এলো
‘ডক্টর আনিসুর রহমান
M.B.B.S,……
কীহ! এই লোক এম.বি.বি.এস করা ডাক্তার!
-‘আমি নাহয় চোরের মত মেঝে ছেড়ে খাটে যাই, তুমি যে ডাকাতের মত একজনের ঘরে ঢুকে বসে আছো?’- একটা গম্ভীর গলায় ঘরটা গমগম করে ওঠে যেন। চমকে আমার হাত থেকে সীলমোহরটা মেঝেতে পড়ে যায়, ঘাড় ঘুরাতেই দেখি আনিস লোকটা ফিচলে হাসি মুখে ঝুলিয়ে দাঁড়ানো আমার পেছনে!
-‘আমি মানে…আমি! আপনি এখানে কী করেন? আপনি ডাক্তার হলেন কবে?’
-‘কীহ! উলটে আমার ওপরেই চোটপাট দেখাচ্ছে মেয়ে!’
-‘না মানে, দাদী ত বলেছিলো আপনি গ্রামের স্কুলের অঙ্ক মাস্টার! আমি তো তাই… ‘
-‘দাদী এসব বলেছিল! অঙ্ক আমার দুই চোখের বিষ! আমি মেডিকেলে পড়েছি তারপর এখানে এসে প্র্যাক্টিস করছি তা-ও বছরখানেক হবে!’-উনি অবাক গলায় বলেন।
-‘কী অদ্ভুত! দাদী তবে এতবড় মিছে কথা…কী বললেন? মাত্র বছরখানেক আগে আপনি পাশ করে বেরিয়েছেন? আপনার না চল্লিশ বছর বয়েস! এতদিন লাগে বুঝি ডাক্তারি পড়তে!’
হোহো করে হেসে দিলেন লোকটা!
-‘এইসব আবোলতাবোল কথা কে বলেছে তোমাকে? দাদী?’
আমি মাথা নেড়ে সম্মতি জানাতেই মাথা চুলকে নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরে কিছু একটা চিন্তা করেন উনি।তারপর বলেন-
‘আচ্ছা বেশ, চলো দেখি দাদীর বাড়িতে যেয়ে সব খোলাসা করে আসি!’
★
-‘হ কইসিই ত! আনিসের বয়স কম আর আনিসে গেরামের সেরা ডাক্তর- হেইডা কইলে কি তর ছোটমায় জীবনে আনিসের লগে তরে বিয়া দিতে রাজি হইত মুখপুড়ি? হের বইনের মাইয়ার জন্য পোলাডারে ধইরা বাইন্ধা নিয়া যাইত না? এইল্লিগা মিছা কথা কইসি!’- পান চিবুতে চিবুতে গাল নেড়ে নেড়ে বললেন দাদী।
-‘আমাকে ত বলতে পারতেন দাদী!’- আমি আহত গলায় বললাম।
-‘ক্যা! তরে কমু ক্যা? ডাক্তার শুইনা বিয়া করবি তাইজন্যি? হুহ! ধন-সম্পদ দেইখা যে বিয়া হয় হেইডা বিয়া না, হেইডা কিনাবেচা! এইযে তুই আনিসরে বুইড়া মাস্টার জাইনাও বিয়া করলি হের মানে কি হইল ক’ তো? হের মানে হইল আজকা যদি আনিসের কিছু হইয়াও যায়, আনিসে যদি আর ডাক্তরি করবার নাও পারে তাও তুই হের লগে জোড়া বাইন্ধা থাকবি! কারণ হের বিদ্যা বুদ্দি দেইখা তুই হেরে বিয়া করস নাই, মন দেইখা করসস… মন! হেরে ভালবাইসা করসস…’
-‘ধুর! দাদী আপনে এত আবুলতাবুল বকতে পারেন!’
-‘আসবে তুমার মনের মানুষ সই লো,
হাতে নিয়া মালা…
কুঞ্জবনে যায়া সই…’
দাদী মাথা নেড়ে নেড়ে গান ধরলেন, ওদিকে হোহো শব্দে হেসে চলেছেন ক্যাবলাকান্ত আনিস… আর এদিকে চূড়ান্ত বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আমার ত্রাহি ত্রাহি দশা!
★
-‘আমার বয়স এখনো তিরিশ হয়নাই! সার্টিফিকেটে আরেকটু কম…’- রাস্তায় বের হয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে লোকটা।
আমি মাথা নিচু করে হেঁটে চলেছি, কী একটা ভীষণ অদ্ভুত অবস্থা! উনার পেছন পেছনই যাচ্ছিলাম, মাটির দিকে চোখ ছিল বলে বুঝিনি সামনে যে বাঁশঝাড়, দু’পা ফেলতেই ডান হাতটা ধরে হ্যাঁচকা টানে কেউ ঝাড়ের ভেতর নিয়ে যায় আমাকে। এক টুকরো কাপড় দিয়ে মুখটা পেঁচিয়ে ধরে কেউ, কানের কাছে দুর্গন্ধে ভরা একটা মুখের অস্তিত্ব ফিসফিস করে-
‘খবরদার টু শব্দ করবিনা! শালী…! এক্কারে কল্লাটা ফালায়া দিমু!’
খশরু!
আমার হাত পা অবশ হয়ে আসে, শরীরের সর্বশক্তি একত্রিত করে চিৎকার দেয়ার শেষ সাহসটুকু সঞ্চয় করতে চাই আমি …
★
কপি/শেয়ার না করার জন্য অনুরোধ করা হলো
একজীবন পর্ব ৩
একজীবন
পর্বঃ ৩
★
ফণা তোলা গোখরোর মত খশরুর নোংরা হাতটা যেন ছোবল দেয় আমার বাম হাতের ওপর। ওর হাতের ভেতর আমার কব্জিসহ হাত ডুবিয়ে নিয়ে কচলাতে শুরু করে ইতরটা, ফিসফিস করে বলে-
‘তর হাতটা কী নরম রে অরু…হাতেই যদি এত সুখ তাইলে…’
প্রচণ্ড রাগে সারা গা জ্বলছিল তখন আমার, একটা বিবমিষা আর বমি বমি ভাব উগলে আসছিল পেট বেয়ে, ডান হাত দিয়ে সজোরে খশরুর হাতে চিমটি কাটি আমি। ‘আআহ’- শব্দ করে ঝটকা দিয়ে হাতটা সরিয়ে নেয় খশরু, সেই ফাঁকে দৌড়ে নিজের ঘরে চলে আসি। দরজা বন্ধ করে দ্রুত জায়নামাজটা পেতে নামাজে দাঁড়িয়ে যাই। সাত বছর বয়েস থেকে আমাকে নামাজ পড়তে শিখিয়েছেন আমার মা, অসুস্থ হয়ে মৃত্যুর আগে বারবার বলে গেছেন- ‘আল্লাহর হাতে তোরে দিয়ে যাইতেসি মা, যখনি বিপদ আপদ দেখবি, নফল নামাজ পইরা আল্লাহর কাছে হাত পাতবি…’
নানা-নানী অনেক আগেই গত হয়েছেন। আমার মা তাদের একমাত্র সন্তান হওয়াতে মামা-খালাদের জোরটাও নেই আমার! নূরজাহান দাদী, যিনি দু’সপ্তাহ যাবত এ বাড়িতে এসে রয়েছেন, তার পক্ষেও আমার খাওয়া-পরা, আর পড়ালেখার দায়িত্ব নেয়া সম্ভব না! এই বাড়ি ছেড়ে যদি পালাতেও চাই, তবু কোথায় যাব আমি? আমি জানিনা এই ভয়াবহ বিপদ থেকে কীভাবে উদ্ধার পাওয়া সম্ভব, আল্লাহ তো আর ম্যাজিক করে কারো বিপদ দূর করেন না কিন্তু চোরকাদার মত চারদিক থেকে যে অমাবস্যা আমাকে ঘিরে ফেলছে, এর থেকে মুক্তি পেতে হয়ত ম্যাজিক ই লাগবে!
নামাজ শেষে সিজদায় যেয়ে কাদছিলাম একমনে, বাহির ঘরে তখনও হাসিঠাট্টার আওয়াজ কানে আসছে। হঠাৎ মনে হলো মাথার ওপর কিছু একটা উড়ে এলো, খসখস শব্দে চুলের ওপর ছুটাছুটি করছে কিছু একটা। মাথা তুলতেই দেখি সেই কাগজটা- আনিস বুড়োটা যাবার আগে যেটায় তার ফোন নাম্বার লিখে দিয়ে গিয়েছিলেন! আচমকাই বিদ্যুৎ খেলে যায় মাথায়… সম্ভবত এটাই শেষ উপায় নিজেকে বাঁচানোর!
পা টিপে টিপে বাবার ঘরে চলে যাই পেছনের বারান্দা দিয়ে, সবাই তখনো বাহিরের ঘরে খাওয়াদাওয়ায় ব্যস্ত! কাপা হাতে বাবার ফোনটা তুলে নিয়ে ডায়াল করি…০১৯২…
জলদগম্ভীর একটা গলার শব্দ ভেসে আসে ওপ্রান্ত থেকে- ‘হ্যালো, আসসালামুআলাইকুম!’
★
-‘কিরে নাতিন, ব্যাগে এইসব ভরতাসস ক্যা? জামা কাপড়, চিরুনি…কই যাবি? হারামজাদা খশরুটা কি আজকাই তরে নিয়া যাবার চায়? অর কান দুইটা ধইরা…’
-‘আস্তে দাদী! খশরু এখনো কিছু বলেনাই, তুমি এইদিক শুনো…কাউরে বলবানা কিন্তু! আজকে ফাঁকফোকরমত বাড়ি ছাইড়া যাবগা আমি, তুমি যেমনে পারো সাহায্য করো।’
-‘বয়সী জোয়ান মাইয়া, একলা একলা কনে যাবি? তর কি মাথামুথার ঠিক আছে ছেমরি? এক খশরুর পাল্লা ছাড়তে রাস্তায় নামবি? হেইখানে হাজার হাজার খশরু..’
-‘থাকুক হাজার হাজার খশরু, একটা আনিস ত পাবো নাকি? তুমার সন্নের টুকরা আনিসের ভরসায় ঘর ছাড়তাসি দাদী। আমার কপাল খারাপ হইলে সে আমারে ভাসায়া দিব, ভাইসা যাবো! তাও শেষ চেষ্টা না কইরা হাল ছাড়ব না, বইলা দিলাম!’
দাদীর চোখ ততক্ষণে কপালে উঠে গেছে! মুখে হাতচাপা দিয়ে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলেন-
‘আনিস ভাই এর কাছে যাবি বইনে? এতদিনে সুমতি হইল তর! আহা, ঘরে আইসিল দেবতা তারে খালি হাতে ফিরায়া দিসস…অহন কিনা আবার তার কাসেই যাবি! যা বইনে যা, আমি ব্যবস্থা কইরা দিমু।’
কীভাবে কী ব্যবস্থা হবে আমিও জানিনা, সম্ভবত দাদীও জানেন না! তবু, ডুবন্ত মানুষ তো খড়কুটো পেলেও আঁকড়ে ধরে।
★
-‘আপনেরা কাবিন করাইবার চান ভালা কথা, তয় নতুন শাড়ি গয়না ছাড়া আমি নাতিনরে বিয়া দিবার পারুম না!’- বাহির ঘরে লাঠি নেড়ে নেড়ে বললেন দাদী। এদিকে আমি ভেতরের ঘরে সব গোছগাছ করে খাটের তলায় লুকিয়ে রেখেছি। দাদী বলেছেন কিছু একটা ব্যবস্থা করবেন আমাকে বাড়ির বাইরে পাঠানোর, সেই অপেক্ষায়…
-‘এত কিছুর কী দরকার, খালা! আমরা আমরাই ত…’ ছোটমা মিনমিন করেন সামান্য। কিন্তু দাদীর রোখ চেপে গেছে ততক্ষণে।
-‘এইডা কি কইলা ছোটবউ? নিজের মাইয়া হইলে পারতা পুরান কাপড় দিয়া বিদায় দিবার? মুরুব্বির মুখেমুখে তর্ক কর যে আবার? আফনেরা শুনেন, মাইয়ার পছন্দ মত শাড়ি গয়না কিনন লাগব কইয়া দিলাম। আমিও লগে যামু, চলেন অখনি চলেন।’ – নিজের কথা শেষ করেই মাথা নাড়তে নাড়তে দাদী আমার ঘরে চলে এলেন।
-‘কত বড় ব্যাগ বানাইসস নাতিন? বেশি বড় ব্যাগ নেওন যাইবনা, সন্দেহ করব..’
-‘চিন্তা কইরনা দাদী, খালি সামান্য টাকাপয়সা, আমার মায়ের কতগুলা জিনিস আর দুইটা জামা নিসি। আমার হাতব্যাগেই জায়গা নিসে!’
-‘বুদ্ধিশুদ্ধি ত কম না ছেমড়ি! সোন্দর কইরা সব গুছগাছ করসস! কিজন্যি যে অইদিন আনিসরে ফিরাইলি নাতিন…যাকগা, সুজা হাতে ভাত খাসনাই অহন ঘুরায়া খাবি, তাও খা বইন!’ – আপনমনে গজগজ করতে করতে কাপড় পালটে নেন দাদী। গ্রাম থেকে আসার সময় তিনটা শাড়ি আর অল্প কিছু জিনিস এনেছিলেন, ছোট পোটলায় সেগুলো বেঁধে নিয়ে শাড়ির তলায় লুকিয়ে ফেলেন। তারপর বাইরে এসে গলা খাঁকারি দেন-
-‘কিগো খরশুর মা, চলেন বাইর হই!’
দাদীর পেছন পেছন আমিও এসে দাঁড়িয়েছি। খশরুর মা বিরক্তির সাথে বিড়বিড় করতে করতে সোফা ছেড়ে ওঠেন, ইতর খশরুটাও মায়ের পিছুপিছু উঠে দাঁড়ায়।
-‘দাদী আফনে মায়ের লগে যান, আমি আর অরু এক রিশকাত যামু!’- নিচে নেমে দাঁত বের করে বলে ইতরটা।
-‘অই বেদ্দপ পুলা, খবরদার আবজাব কথা কইবিনা! লাঠিডা দেখতাসস? তর পিঠে ভাঙ্গুম কইলাম! বিয়ার আগে এত শখ কিয়ের, নাতিন আমার লগে যাইব। তুই যা তর কটকটি বেগম মায়ের লগে…’
খশরু মুখ কালো করে অন্য রিকশায় ওঠে। দাদীর প্ল্যানটা মোটামুটি বুঝে গেছি আমি, চুপচাপ দাদীর সাথে আমিও রিকশায় উঠে যাই।
-‘অই রিশকাডা আগে যাইব, আফনে পেছন পেছন যাইবেন। তয় আস্তে চালাইবেন, অগো লগে যাইবেন না।’- আয়েশ করে রিকশায় বসেই দাদী বলেন রিকশায়ালা চাচাকে উদ্দেশ্য করে। খানিকদূর যেতেই বেশ অনেকটা তফাত তৈরী হয় দুটো রিকশার মধ্যে।
-‘আনিসে কই আইব? কই নামলে তর সুবিধা হয় বইন?’- দাদী জিজ্ঞেস করেন আমায়।
-‘কমলাপুর স্টেশনে থাকতে বলসি আপনের আনিস দাদাভাইরে। আমারে সামনের আরামবাগ মোড়ে নামায়া দিয়েন, আমি সেইখান থেকে চিনি! কিন্তু আমারে নামায়া দিয়া আপনে বাসায় ফিরবেন কেমনে দাদী? ছোটমা ত আপনেরে ছাইড়া কথা বলবেনা!’
-‘হুর বোকা মাইয়া, আমিও তগো লগে গেরামে যামুগা।অই বাড়িত আর কেডায় আছে যে যামু? তর ভেড়া বাপটারে দেখলেই থাপড়াইতে মনে চায়। আনিস ত আমগো গেরামের ই পুলা, অর লগেই গেরামে যায়া বইয়া থাকুম। তারপর আসুক তর বাপ আর ছোডমা, এক্কারে ধুইরা দিমু!’
-‘বাব্বা, বয়স হইলে কী হইব, বুদ্ধি তো আপনের ষোল আনা দাদী!’
-‘হুহ, নূরজাহান ব্যাগম অত সোজা জিনিস না বুঝসস নাতিন! তাইতো কই,আমার উফরে ভরসা কর, আনিস পোলাডা আসলেও সন্নের টুকরা…ঠকবিনা নাতিন!’
আরামবাগ মোড় থেকে আমরা কমলাপুরের দিকে রিকশা ঘুরাই, খবিশ খশরুরা ততক্ষণে আরেকদিকে রওনা করেছে…
★
সকাল এগারটার দিকে আনিস মাস্টারকে ফোন দিয়েছিলাম, এখন বাজে প্রায় তিনটা! আধ ঘন্টা যাবত স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছি দাদির সাথে, গ্রাম থেকে আসতে সম্ভবত আরও অনেক্ষণ লেগে যাবে আনিস লোকটার! আদৌ কি আসবে সে? দাদীর ‘সন্নের টুকরা’-র ভরসায় প্রতিকূল স্রোতে গা তো ভাসিয়ে দিলাম, এরপর? কিছুদিন আগেই এই আনিসকে প্রত্যাখ্যান করেছি আমি, আজ আমার একটা ফোনে কেন সে সব কাজকর্ম ফেলে এতদূর ছুটে আসবে? ঝোঁকের মাথায় দাদীর আনিস ভাইটির উপর ভরসা করে সব ছেড়ে ত চলে এলাম, এখন যদি সে না আসে তবে কোন চুলায় যেয়ে যে আমার মরতে হবে কে জানে!
আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে চোখটা লেগে এসেছিলো আমার, কতক্ষণ কেটে গেছে টের ও পাইনি। তন্দ্রা কাটে দাদীর গুঁতো খেয়ে-
-‘ঐ ছেড়ি, আমার উপরে পইড়া যাইতাসস ত! উইঠা সইরা বয়! খিদা লাগসে, তর হাত ধইরা ত এইহানে আইয়া পরলাম, অখন খাওয়াবি না কিছু?’
-‘আপনে আমার হাত ধইরা আসছেন, আর আমি আসছি আপনের সন্নের টুকরা আনিসের ভরসায়। আমারে বইলা লাভ নাই দাদী, অল্প কিছু টাকা আনসি- আপনের আনিসবাই যদি না আসে তখন এডি দিয়াই আপনের আর আমার রাহাখরচ দিতে হইব গ্রামে যাইতে। খানাদানার বিলাসিতা আপনের আনিসবাই আসলে কইরেন নাইলে নাই…’
-‘আবুইদ্যা ছেরি! আনিস তরে কথা দিসে না যে হেয় আইব? তাইলে সে আইবই-ই কইয়া দিলাম। অখন কাউন্ঠামি না কইরা যা অই দুকান থিকা রুটি কিনা আনতো, যা যা…’-লাঠি নেড়ে নেড়ে দাদী একরকম জোর করেই পাশের হোটেলে পাঠান আমাকে। সত্যি বলতে ক্ষিদে আমারো লেগেছে, কিন্তু এই অল্প কয়টা টাকাই আমার সম্বল! আনিস সাহেব আসলে আপাতত একটা সমাধান হতো,কিন্তু এখনই খেয়েদেয়ে টাকা কমিয়ে ফেললে পরে যদি উনি না আসেন, তখন?
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে দুটো রুটি আর একটা ভাজি দিতে বলি হোটেলে। টাকা দিতে যাব ঠিক তখনই পেছন থেকে ভারী গলায় কেউ গমগম করে ওঠে-
‘আরো দুইটা রুটি আর একটা ভাজি দেন, সাথে ডিমও। বিল আমি দিচ্ছি!’
সেই চেনা কণ্ঠটা! হৃদপিণ্ডটা ধ্বক করে গলার কাছে চলে আসে লাফ দিয়ে, ঘাড় ঘুরাতেই দেখি দাদীর সন্নের টুকরা আনিসভাই আমার পেছনে দাঁড়ানো!
★
ট্রেনে উঠে বসে আছি আমরা তিনজন- দাদী, আমি আর আনিসভাই! দূরের জার্নিতে আমার বমি হয় সাধারণত, তাই জানালার পাশের সিটটাতে বসেছি আমি। ওদিকে দাদীও আজগুবি বায়না ধরেছেন, তারও জানালার ধারেই বসতে হবে- তাই মুখোমুখি জানালার ধারের সিটটা দখলে নিয়েছেন তিনি। বেচারা আনিসভাই চুপচাপ দাদীর পাশে বসতেই একটা রামধমক খেলেন-
‘অই হতভাগা পুলা, তুই এইহানে বইলে পরে আরেক ব্যাডা আইয়া নাতিনের পাশে বসবো না? জোয়ান মাইয়া, পরপুরুষের লগে ঢেসাঢেসি কইরা এতদূর যাইবনি বেয়াক্কল কোনেকার? যা অরুর ধারে যায়া বয়, যা!’
আনিসভাই কাঁচুমাচু মুখ করে আমার পাশে সরে এসে রীতিমত জুবুথুবু হয়ে বসলেন। জানালা দিয়ে বাইরে দেখছিলাম আমি, আসলে দেখছিলাম বললে ভুল হবে- তাকিয়ে ছিলাম কেবল! একশ ভাবনার ঝড় বইছিল মনের ভেতর, কী ভীষণ অনিশ্চিতের পথে চলছি আমি আজ কেবল আমার মা নেই বলে! আহ, যাদের মা আছে তারা কি কখনও ভেবেছে কত বড় নিয়ামতটুকু তারা বিনামূল্যে পেয়ে যাচ্ছে?
-‘অই ছেরি, চুল সামলায়া বয়! পোলাডার চোখেমুখে বাড়ি দিতাসে চুলে! আর তুই বেটা কাঙ্গালের মত চায়া আছস ক্যা নাতিনের দিকে, আইজ বাদে কাইল ত বিয়াই করবি তহন পরাণ ভইরা দেহিস অরে। তাম-শা!’- দাদীর শাসনবাণে ধ্যান ভাঙে আমার, মুখ টিপে হাসছেন দাদী। আনিসভাই ক্যাবলার মত মাথা নিচু করে ফেলেছেন আমার চোখে চোখ পরতেই, আমিও দ্রুত হাত টেনে নিজের চুলগুলি গুছিয়ে বেধে ফেলি সাথে সাথে। দাদী যে মাঝে মাঝে এমন বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে!
-‘তর মায়ে জানে অরে যে নিয়া যাইতাসস বাড়িতে? বিয়া করন ছাড়া ত সোমত্ত মাইয়া ঘরে তুলবার পারবিনা, মাইনষে আকথা কুকথা কইব। দুই-চাইরদিন আমার কাছে থাউক অরুয়ে, তর মায়েরে জানাইয়া আমাগো বাড়িত থিকাই অরে বিয়া কইরা তুইলা নিয়া যাবি।’
-‘দাদী, অরুর এখনো বিয়ের বয়স হয়নাই! আইনগতভাবে এই বিয়ে বৈধ হবেনা। সাবালিকা হওয়া পর্যন্ত সে আপনের কাছেই থাকুক, এরপর নাহয় বিয়েশাদির কথা…’
আনিসের কথা শেষ না হতেই দাদী খেঁকিয়ে ওঠেন-
‘সর সর! ময়রারে আর মিষ্টি বানানি শিখাইস না দাদা! বিয়ার আবার বয়স! অরুর বয়সে দুই বাচ্চার মা হইসিলাম…কালে কালে কত তামশা দেখতে হইব!’
আনিসভাই প্রত্যুত্তরে কিছু বলেনা, খানিক বাদে দাদীই আবার মুখ খোলেন-
‘বিয়া না হইলে এই রুপের রাণীরে আমি আমার কাছে কেমনে রাখুম ক? গেরামে কত রকমের মানুষ, তারচে বড় কথা খশরু দুইদিন বাদে গেরামে ফিরা আইলে তখন অরুরে আমি কেমনে অগো হাত থিকা বাঁচামু! আমার সামর্থ্য থাকলে নাতিনরে আমিই পড়ায়া লেখায়া ডাক্তর বানাইতাম হুহ! আইজ-কাইলের মধ্যে তুই যদি মাইয়াডারে বিয়া কইরা একটা সামাজিক পরিচয় না দেস তাইলে অর আর যাওনের জায়গা থাকব? ভাইবা চিন্তা ক’ দেহি দাদাভাই?’
-‘আহ দাদী! উনার গলায় জোর করে ঝুলায় দিবেন নাকি আপনে আমারে? বাদ দেন না এইসব কথা, কাল পরশু কী হবে সেইটা কাল পরশুই দেখা যাবে…’-
রীতিমত অপমানিত বোধ হচ্ছিল আমার! আমি কি বাজারের মাছ তরকারি নাকি, যে কারো বাড়ির ফ্রিজে ঢুকে তবে আমার গতি হবে নয়ত পচে মরব? আর এই আনিস মাস্টার বুড়োটাও ত কম যায়না! যদিও কথা সে সত্যই বলেছে কিন্তু দাদীর কথাও ত মিথ্যা না! না এই বয়সে আমার বিয়ে হওয়া সম্ভব আর না দাদীর পক্ষে খশরু শয়তানটার হাত থেকে বেশিদিন আমাকে আগলানো সম্ভব…
★
একজীবন পর্ব ২
একজীবন
পর্বঃ ২
★
-‘তুমার এমুন হিন্দু হিন্দু নাম রাখসে ক্যাডায়? অরুন্দতি- কইতেও ত মুখে আটকায়, মুসলমান মাইয়ার নাম এমুন হইব ক্যা?’- বাহিরঘরে বসতে না বসতেই আলেয়া খাতুনের প্রশ্নবাণ ছেঁকে ধরে আমাকে।
-‘আমার মা রেখেছিলেন…’
আমার কথা শেষ না হতেই আলেয়া খাতুনের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ কানে আসে।
-‘অহহ-! হেয় ত মইরা গ্যাসে, তুমারে একটা বিছসিরি নাম দিয়া থুইয়া গ্যাসে! তা যাউকগা, চেহারাসুরুত ত মাশাল্লা ভালই তুমার, তা রান্নাবান্না কিছু পারো নাকি খালি রুপেই লক্ষী?’
-‘নাতিন আমার সব কাজ কর্ম পারে। কিগো বউ কওনা ক্যা কিছু, বাঁশের কঞ্চির মত খাড়ায়া আছ যে!’- দাদী খেঁকিয়ে ওঠেন। ছোটমাকে একদমই সহ্য করতে পারেন না দাদী, আগেও টের পেয়েছি আমি।
-‘হুঁ! হুঁ, হুঁ! অরুই তো বাসার প্রায়য় সব কাজ করে, খুব গোছালো! কোনো সমস্যা হবেনা…’
-‘হাইটা দেখাও দেখি। আর আফনে- অর চুলডি খুইলা দেহান দেহি… ‘ ছোটমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন আলেয়া খাতুন। রাগে, অপমানে বুকের ভেতরটা রীতিমত জ্বলছিলো আমার! ঠিক তখনি গম্ভীর অথচ শান্ত একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পাই-
‘আহ মা! এতসবের তো দরকার নেই! কেনাবেচা করতে তো আসিনি… দাদী আপনি উনাকে নিয়ে যেতে পারেন। আমাদের আর কিছু জানার নেই, উনার কিছু জানার থাকলে তা জিজ্ঞাসা করতে পারেন।
আড়চোখে দেখলাম আনিস বুড়োটা কথাগুলো বলছে। ওদিকে আলেয়া খাতুনের মুখ চুন হয়ে আছে, নাক মুখ কুঁচকে কোনোরকমে বসে আছেন তিনি।
বাব্বাহ, বুড়োর তো বেশ চটক আছে!- চকিতেই একটা সম্ভাবনার দরজা খুঁজে পেলাম আমি! এই লোকটাকে বাগে আনতে পারি যদি,তাহলে হয়ত এযাত্রা বাঁচা যেতে পারে…
-‘উনার সাথে আমার কথা আছে, এই ঘরে আসতে বলেন দাদী! উনারে একলা আসতে বলবেন…
ভেতর ঘরে যেয়েই কথাগুলি বলে ধপ করে বিছানায় বসে পড়লাম।
-‘মা লো মা,কত রংগ দেখুম! এই কয় বিয়া বসুম না এই কয় ঘরে আনেন…ছেমড়ির মতি তো সুবিধার না!’- ঠোঁটে আঁচল চেপে হাসিমুখে ফোড়ন কেটে বেরিয়ে গেলেন দাদী। আমি চুপচাপ খাটে পা ঝুলিয়ে বসে আছি, মনের ভয় মনে চাপা দিয়ে চোখ মুখ টান টান করে…
-‘আসবো?’- টক টক শব্দে দরজায় টোকা পরে, সাথে।সেই গুরুগম্ভীর মেঘের মত গলার স্বরটা!
-‘হ্যাঁ আসুন।’- উঠে দাঁড়িয়ে দরজা পর্যন্ত এগোই আমি।
আনিস লোকটা ভেতরে এসে ফাঁকা চেয়ারটা টেনে বসে নেয় নিজেই। একদম সামনাসামনি দেখে বেশ চমকে গেলাম, বাচ্চা বাচ্চা চেহারা লোকটার, চল্লিশ বলে তো একদমই মনে হচ্ছেনা! হোকগে যা খুশি, আমার কী!
-‘শুনুন, আমার বয়স মাত্র পনের! লিগ্যালি এই বিয়েটা এমনিতেই হবেনা, আর যদি হতোও তবু আমি এতে রাজি নই! এত বয়স ডিফারেন্সে…
অন্যদিকে নজর ঘুরিয়ে কথাগুলি বলছিলাম আমি, আড়চোখে লোকটার দিকে তাকাতেই থেমে যাই। ভ্রু কুচকে অবাক চোখে আমার কথাগুলো গিলছে!
-‘আ.. আমি তো শুনেছি আপনি সাবালিকা মানে তোমার বয়স ১৮! আর রাজি-অরাজির ব্যাপারটাও জানা ছিলনা… দাদী তো এতকিছু বলেননি…’
আংকেল বয়সী লোকটা রীতিমত তোতলাচ্ছে!
-‘আচ্ছা বেশ, আমি তবে সবাইকে না করে দেবো,বলব আমার ভাল লাগেনি মেয়েকে! তোমার মানে আপনার চিন্তা করতে হবেনা, কনের অমতে তো আর বিয়ে হতে পারেনা!’- শেষ কথাগুলি বলার সময় একটা ছোট্ট কিন্তু নিষ্প্রাণ হাসি মুখে লটকে ছিলো লোকটার।
হঠাৎ করে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো… কতদিন, কতবছর পর আমায় এতটা গুরুত্ব দিচ্ছে কেউ! এতটা আগ্রহ নিয়ে অক্ষরে অক্ষরে আমার বলা কথাগুলি শুনছে…কতদিন! আমি কিনা তার প্রত্যাখ্যানের খবর তাকেই জানাচ্ছি- অথচ দিব্যি সবটুকু নিজের ঘাড়ে নিয়ে নিচ্ছে সে! কোথাও বড় কোনো ভুল হচ্ছে না তো আমার? ভাবতে ভাবতেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম লোকটার দিকে, ততক্ষণে চেয়ার ছেড়ে উঠে দরজা পর্যন্ত পৌঁছে গেছে সে। কী মনে হতেই ঘুরে দাঁড়ায়, পকেট হাতড়ে একটা চারকোণা সাদা কাগজ বের করে। তারপর বুকপকেটে রাখা কলমটা নিয়ে খসখস করে কিছু একটা লিখে আমার দিকে বাড়িয়ে দেয় কাগজটা-
-‘আমার ফোন নাম্বারটা অন্তত রাখুন। যেকোনো সুবিধা-অসুবিধার কথা নির্দ্বিধায় জানাতে পারেন… বয়সের পার্থক্যের কারণে হয়ত বন্ধু হতে পারবনা, অন্তত আত্নীয় ভেবে হলেও যথাসাধ্য চেষ্টা করব।’
তারপর হনহন করে হেটে বেরিয়ে যায়। খানিক বাদে তাদের চলে যাবার শব্দ কানে আসে আমার।
★
-‘রুপনগরের রাজকইন্যা, তার কি আর আনিস ফানিস ফে মনে ধরব? আমরা য্যান আর বাপ মার কথামতো বিয়া বসিনাই! নিশ্চিত কানপড়া দিয়া বিয়াডা ভাগাইসে… আমিও শ্যাষ দেইখা নিমু কইলাম! এত আয়োজন, এত খাটাখাটনি কইরা শেষমেশ এই! এক আনিস গেসে দশ আনিস আনুম… কতজনরে কানপড়া দিবি আমিও দেইখা নিমু…’
রান্নাঘরের সব গুছাচ্ছিলাম আমি, ঝড়ের মত সেখানে এসে কথাগুলো শুনিয়ে গেলেন আমায়। আমি সেদিকে কান না দিয়ে নিজের কাজ করতে লাগলাম, যেন একটা শব্দও শুনিনি আমি। নিজের মনেই গজগজ করে আবার ঝড়ের বেগে রান্নাঘর ছাড়লেন ছোটমা, আমি জানি এখন বাবা আসবেন- একই কথা অন্য সুরে শুনতে হবে আবার আমায়!
-‘কিরে অরু, আনিসরে ডাইকা নিয়া কিছু কইসস নি তুই? সব ত ভালাই চলতাসিল, তর ঘর থিকা বাইর হইয়া বিয়াডা ভাইঙ্গা দিল যে অরা বড়?’- খানিক বাদেই বাবা এসে প্রশ্ন করলেন।
-‘আমি কি জানি বাবা! তারা বিয়ে ভাঙসে আপনে তাদেরই জিজ্ঞাস করেন ক্যান ভাঙসে। আমি কেমনে বলব!’ – কাজ করতে করতেই জবাব দিই আমি।
-‘হুউ! ঘাস খায়া ত বড় হইনাই, হাওয়া-বাতাস কুনদিক দিয়া কুনদিকে যায় আমরাও বুঝি!’- বলে বাবা বেরিয়ে গেলেন। এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমি, কাজগুলো গুছিয়ে নিজের স্টোর রুমটাতে যেয়ে বই হাতে নিয়ে শুয়ে পড়লাম।
-‘সুজা সরল পোলাডা আমার লিগা আজকা অপমান হইল! অই ছেমরি, বিয়া করবিনা আগে কইতে পারস নাই? পোলাডারে ভাগায়া অখন বই পড়স, কত বড় ভুল করতাসস অখন বুঝবিনা…বুঝবি যেদিন সেইদিন সময় থাকবনা কইয়া দিলাম!’- মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বলে চলেছন দাদী, আনিস মাস্টার চলে যাবার পর থেকে দাদী আউলে গেছেন!
-‘আপনে একটা দোজবর, চল্লিশ বছরের বুইড়া নিয়াসবেন আর আমি রাজি হইয়া যাব, এইটা তো না দাদী! আমার… ‘
-‘হুর ছেরি! কিয়ের দোজবইরা! আনিসের বিয়া হইসেনি আগে! কয় বছর আগে জানি, একবার বিয়ার কথাবার্তা সব ঠিকঠাক হইসিল, তা হেই বউ ও তর মত টেডি আছিল! এক্কারে বিয়ার দিন, আনিসরা বরযাত্রা যায়া দেখে মাইয়া হেইদিন সকালেই কার লগে জানি ভাইগ্যা গ্যাসে! ছেমরি, ভাগবি যখন বিয়ার আগেই ভাইগা যাইতি, পোলাডারে এমনে অপমান কইরা যাওনের কি দরকার আছিল?’- দাদীর কণ্ঠে স্পষ্ট হতাশার সুর।
‘হের পর আনিসে আর বিয়ার নাম ও মুখে আনেনাই, আলেয়া খাতুন ও পোলার বিয়া চেষ্টা করেনাই! আনিস হের বড় পোলা, বড়ডারে রাইখ্যা ছোট পোলা আর মাইয়ার বিয়া দিয়া দিসে, তয় আনিসরে বিয়া করানির কথা ভুলেও মুখ দিয়া বাইর করত না বেডি! করব ক্যা, সৎ পোলা না?…
বুকের ভেতরটা ছলাৎ করে ওঠে আমার! সৎ ছেলে- মানে?
-‘কী বললেন দাদী? কে কার সৎ ছেলে…?’
-‘আরে ঐ আনিসের নিজের মায়ে ত অরে জন্ম দেওনের সময়ই মইরা গ্যাসিলগা! হেরপর তার বাপে এই আলেয়ারে বিয়া কইরা আনে, আনিসের আপন খালা হয় এই আলেয়া! আনিসের মায়ের আপন ছোড বইন, আনিসেরে লালন পালনের লিগা তাই হেরেই বিয়া করল আনিসের বাপ! খালা হইলে কী হইব,সৎ মা কী কোনোদিন আপন হয়? হয়না…হয়না… আনিসে ত আর বিয়াই করত না, আমি জোরাজুরি কইরা কইলাম বাপধন,আমার নাতিনডার অনেক কষ্ট। হের ঘরেও তর মত সৎ মা, তুই নাহয় দিনের বেলা ইশকুলে অফিসে থাকস, সৎ মায়ের জ্বালা টের পাস না! নাতিনে আমার উঠতে বইতে জ্বলে, মাইয়াডারে তুই বিয়া কইরা খালি উদ্ধার কর, নাইলে কইথিকা কুন অগামগা ধইরা আইনা অরে বিয়া দিব অর মায়ে- হেইডা কি আমার সইজ্য অইব?’
বলতে বলতে চোখ মোছেন দাদী। এতসব ঘটনার কিছুই ত আমি জানতাম না! দাদীর কথায় শুধু আমার দিকে চেয়ে লোকটা আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছিলো, আর আমি কিনা তাকে…ছিছিছি!
★
এরপর প্রায় সাত দিন পার হয়ে গেছে, এই বাড়িতে আমার থাকাটা যেন বিষবৎ হয়ে গেছে! ছোটমায়ের গঞ্জনা চরম মাত্রায় পৌছেছে, সাথে ইদানিং বাবাও যুক্ত হয়েছেন! গতকাল রাতে খাবার টেবিলে রীতিমত কাঁদিয়ে ছেড়েছেন দু’জনে মিলে আমায়, আমি নাকি মা-খাগি অপয়া, এই বাড়ি থেকে যত দ্রুত আমাকে তাড়ানো যাবে ততই বাড়ির মঙ্গল হবে। ছোটমায়ের হাত ধরে টেবিলে মাথা কুটে বলেছিলাম- ‘বাড়ির সব কাজ করে দেব আমি, এখন যেমন করি আরো করব! শুধু দুইবেলা খাবার আর স্কুলে যাওয়া- এটুকু যেন করে তারা আমার জন্য। আমার মায়ের খুব শখ ছিল আমায় ডাক্তার বানাবে…শুধু ঐটুকু সময় তারা আমাকে দিক…
লাভ হয়নি! ছোটমা স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, এই মাসের ভেতরই বিয়ে দেবেন আমার- তা সে যে পাত্রই হোক! সারারাত মেঝেতে শুয়ে শুয়ে আল্লাহর কাছে কেঁদে কেঁদে বলেছি- মায়ের মত আমায়ও নাহয় নিয়ে যাও, এই জাহান্নামে আর কতদিন থাকব আমি? কিন্তু, সৎ মা আর আপন (!) বাবার মত আল্লাহও বোধহয় এখন আর আমার কথা শোনেন না…
★
-‘আফনে অরুরে তৈরী কইরা নিয়াসবেন। পোলায় আমার ফুপাত ভাই, কুনু সমস্যা হইবনা! ফুফা ফুফু রে নিয়া পোলায় আইজকা অরুরে দেখবার আইবো, পছন্দ হইলে আজকাই কাবিন করায়া পোলারে এইহানে রাইখা দিমু অরুর লগে। কাইলকা উঠায়া দিয়া দিমু…’
দাদীকে উদ্দেশ্য করে কথাগুলি বললেন ছোটমা, আমি পাশেই দাঁড়ানো ছিলাম। আনিস মাস্টার ভদ্রলোক ছিলো তাকে নাহয় বুঝ দিয়ে বিদেয় করা গেছে। কিন্তু ছোটমায়ের ফুপাত ভাইটাকে চিনি আমি, একে বিদেয় করা সহজ হবেনা। খশরু- নাম লোকটার। যেমন জঘন্য কথাবার্তা তেমন বিশ্রী আচরণ, আর মেয়েমানুষ দেখলেই ছোঁক ছোঁক করার স্বভাব! কিন্তু এই লোকের ত বউ ছিলো, তাহলে…
-‘অই নাতিন, আয় আমার লগে আয়।’- বলে দাদী টেনে আমাকে ঘরে নিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলেন।
-‘অভাগী হতচ্ছাড়ি! নিজের কপালডা এমনে পুড়লি? তর ছোডমায়ের হেই ফুফাত ভাইরে চিনস না তুই? খশরু? আমগ গেরামের ই পুলা, ছিছিছি- স্বভাব চরিত্তের কুনু গাছপাথর নাই পুলার! মাইয়া মাইনষের পিছে ফেউএর মত ঘুরে, দুই বছর সংসার কইরা এই স্বভাবের জন্যি আগের বউডা গেসেগা! অখন হের গলায় যায়া ঝুলগা যা ছেমড়ি, আনিসের মত সোনার পোলাডারে ত হারাইলি…’
আমিও জানি, এই অসভ্য জানোয়ার খশরু কোনোদিনই আমার কথা শুনবেনা, এই বিয়েটা আজই হয়ে যাবে! আনিস মাস্টার তো এর তুলনায় বেহেশতি পাত্র ছিলো, দাদী তো সবদিক ভেবেই তাকে এনেছিলেন! ছোটমা যে আমায় একদম অথৈ সমুদ্রে ভাসিয়ে দেবেন, দাদী নিশ্চই সেটা টের পেয়েই আনিস মাস্টারকে ধরে এনেছিলেন…হায় আল্লাহ! কী ভয়ংকর ছেলেখেলা করলাম আমি নিজের জীবনটা নিয়ে?
★
-‘মাইয়া ত আমগ ঘরের ই, ছুডুবেলায় খশরুর সাথে কত খেলাইত…হেহেহে’- পান খাওয়া লাল দাত বের করে কথা বলে চলেছেন খশরুর মা, ছোটমায়ের ফুপু। খশরু হারামিটা ছোটবেলা থেকেই আমার দুই চোখের বিষ, অথচ দিব্যি কটকট করে মিথ্যে বলে যাচ্ছেন এই মহিলা!
মাথায় ভোঁতা যন্ত্রণা হচ্ছে আমার, মিনিট দুয়েক হয়েছে বাহিরঘরে এনে বসিয়েছে আমায়। দাদী এখনো ফ্যাচফ্যাচ করে কাদছেন ভেতরে, এদিকে খশরুর অদ্ভুত বিচ্ছিরি চাহনিটা যেন গিলে খাচ্ছে আমাকে! ছোটমা খাবার গুছিয়ে আনতে গেলেন, বাবাকেও ইশারাতে সাথে নিয়ে গেলেন আর ঠিক তখনি বলা নেই কওয়া নেই খশরু ইতরটা এক লাফে কর্ণারের সোফা ছেড়ে আমার ঠিক পাশে এসে বসে পড়ল!
-‘কিরে অরু, তুই ত মেলা সন্দর হইয়া গ্যাসস! মেলাদিন বাদে তরে দ্যাখলাম! আমারে পসন্দ করস আগে কইলেই পারতি,অই মাতারিডারে আর বিয়া করতাম না। শালী বহুত যন্ত্রণা দিসে.. যাউকগা, তর ত বয়স কম, গা গতরও ভালা…’ বলে নির্লজ্জের মত নিজের ডান চোখটা টিপে দেয় খশরু, প্রচণ্ড ঘৃণায় আমার সমস্ত সত্তা রিরি করে ওঠে। দুই চোখ বেয়ে টপটপ করে জল ঝরছে আমার, এর মাঝেই আবছা চোখে পরে একটা লালসায় ভরা কালসাপের মত খশরুর ডান হাতটা এঁকেবেকে আমার হাত বরাবর এগোচ্ছে…
★
কপি করা নিষেধ।