Thursday, August 21, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 2001



ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_১৯

0

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_১৯
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

সকালবেলা ঘুম ভেঙেই বেলীর মুখটা দেখতে পায় ইরফান । চুপটি করে গালে হাত দিয়ে ঘুমাচ্ছিল মেয়েটা । বেলীর মুখের মাঝে কিছু তো আছে যার মায়ায় বার বার পড়ে যাচ্ছে ইরফান । ইরফানের ভালো লাগা , মন্দ লাগা , ভালো থাকা , মন্দ থাকা সবটাই যেনো এখন বেলীকে ঘিরে । ঘড়িতে নজর দিয়ে দেখে সকাল সাড়ে ৮ টা বাজে । আজ লেট হয়ে গেছে তার । ডান হাত দিয়ে বেলীর কপাল ছুয়ে দেয় সে , নাহ এখনও জ্বর ছাড়ে নি তবে তেমনও জ্বর নেই । কাল রাতের মেডিসিনটা একটু হলেও কাজ করেছে । তারপর নিজের বুকের উপর থেকে বেলীর বাম হাতটা আস্তে করে সরিয়ে নেয় ইরফান । আস্তে করে বেলীর পাশ থেকে উঠে যায় সে । ফ্রেশ হতে হবে তাকে , অফিসেও যেতে হবে ।
আস্তে করে দরজা খুলে নিজের রুমে যায় ইরফান । গিয়ে অনেকটাই অবাক হয়ে যায় ইরফান । আজ রুবি সজাগ , যেই রুবি দিন ১০ টা বাজেও ঘুম থেকে উঠে না , সেই রুবি সকাল ৯ টা বাজতে উঠে গেল কিভাবে ? ইরফান ততটা পাত্তা দেয় নি । টাওয়াল নিয়ে ওয়াসরুমের দিকে পা বাড়াতে নিলে রুবি আটকায় তাকে ।

– গোসল করবা ?
– মানে কি ?
– সারা রাত তো তার সাথে কাটাইলা , তা এখন তো ফরজ গোসল করতেই হবে তাই না ?

রুবির মন মানসিকতা বার বার ওইদিকেই ইংগিত করে । যা ইরফানের মোটেই ভালো লাগে না । সে কিভাবে এইসব কথা বলতে পারে এইটাই ইরফানের মাথায় আসে না ।

– রুবি , তুমি কি শুধু এক সাথে থাকা মানে সেক্সই বুঝো ?
– সত্যি বললাম বলে জ্বালা ধরে গেছে তাই না ?
– এটা মোটেও সত্যি না , রুবি বেলী অসুস্থ , খুব অসুস্থ । তুমি ভাবলে কি করে এই অবস্থাতে আমি আর ও । রুবি মাঝে মাঝে একটু বেশিই ভেবে বসো তুমি ।
– যাক ভালো , সত্যিকে মিথ্যা বানিয়ে সত্যি বানাতে ভালোই পারো দেখছি ।
– তোমার সমস্যা কোথায় হচ্ছে রুবি ? তোমাকে সহ্য করে বেলী যদি এই ৭ মাস তেকই ছাদের নিচে থাকতে পারে তাহলে আমি একটা রাত শুধু ওর রুমে থেকেছি বলে তুমি এমন হুলস্থূল কান্ড বাধাচ্ছো ।
– কারণ আমি বেলী নই , আর তুমি ওই গাইয়া মেয়ের সাথে আমার কম্পেয়ার করবা না ।
– ও গাইয়া , ও মূর্খ কিন্তু তোমার মত এত আবাল না । ও গাইয়া , ও মূর্খ কিন্তু তোমার মত এত লেইম না রুবি ।
– ওহ রিয়েলি ?
– ইয়েস , রুবি এমন আচরণ করো না যাতে তোমার দিক থেকে আমাকে মুখ ফেরাতে হয় ।
– তাহলে বিয়ে কেন করেছো আমাকে ?
– লাইক সিরিয়াসলি রুবি ? আমি তোমাকে বিয়ে করেছি ? নাকি বিয়েটা দুজনের সম্মতিতে হয়েছিল , কোনটা ?
– যাই হোক , হয়েছিল তো ?
– আজ আর অফিস যাবো না আমি , তোমার সাথে কিছু কথা বলবো আজ আমি । আমি প্রশ্ন করবো , তুমি শুধু উত্তর দিয়ে যাবে ।
– আমার প্রয়োজন নেই ।
– কেন রুবি ? আমি ওয়াসরুমে যাবো ফ্রেশ হতে আর তুমি ফরজ গোসল নিয়ে আসছো । তুমি তো এই ৭ মাস আমার সাথে শুয়েছো , তুমি দেখো নি আমি কখন ফ্রেশ হই কখন গোসল করি ? ওহ সরি সরি , তুমি দেখবে কিভাবে তুমি তো দিন ১২ টা অবদি ঘুমে থাকো ।
– ইরফান বেশি বেশি হচ্ছে ।
– কোনটা বেশি বেশি , কি বেশি বেশি ? আমি যতদিন তোমার সাথে থেকেছি আমাদের মাঝে সেক্স কতবার হয়েছে বলো , সপ্তাহে দুইবার কি তিনবার আবার কোন সপ্তাহে একবারের জন্যেও না । যখন এইসব হতো না তখনও কি আমি ফ্রেশ হইনি ?
-………………
– লুক এট মি রুবি , এইসব নোংরা কথা কেন বলো , বলতে পারো । আমার অপরাধ একটাই আমি কেন দ্বিতীয় বিয়ে করলাম ।
– ওহ এখন অপরাধ হয়ে গেছে , সাধু পুরুষ তুমি ?
– মোটেও না , আমি নিজেকে সাধু কখনও ভাবি নি আর ভাববোও না । একটা কথার জবাব দাও তো রুবি , আমি যে বিবাহিত ছিলাম তুমি কি তা জানতে না ?
– জানতাম তো ?
– আমি কি তোমাকে জোর করে বিয়ে করেছিলাম , নাকি তোমাকে তুলে নিয়ে এসেছিলাম ? তুমি সব জানতে , আমি বিবাহিত আমার বউ আছে সব সব । তবুও কেন পা বাড়ালে ।
– বাহ বাহ , এখন আমি অপরাধী হয়ে গেলাম । চাঞ্চ তুমি নেও নাই ?
– চাঞ্চ দিলে কে না নেয় রুবি ? বলো আমায় কে না নেয় । তুমি চাঞ্চ দিয়েছো , আমি অমানুষ চাঞ্চ নিয়েছি । আর এইসবের মাঝে থেকে ওই নিষ্পাপ মেয়েটা এতদিন কষ্ট পেয়ে গেছে । বিনিময়ে মুখ খুলে নি । কত মেরেছি , এক একবার মেরে অজ্ঞান করে রেখেছি , শরীরের ব্যাথায় মেয়েটা উঠে দাড়াতে পর্যন্ত পারে নি তখন আমি তোমার কাছে খুব ভালো ছিলাম । আর আজ আমি তার একটু সেবা করাতে আমি খুব খারাপ হয়ে গেলাম ।
-…………………
– তুমি মেয়ে সেও মেয়ে । তুমি আমার স্ত্রী এটা যেমন সত্যি , সেও আমার স্ত্রী এটা আরও বড় সত্যি । সব থেকে বড় কথা তুমি একজন মানুষ । কিন্তু তুমি মানুষ হয়ে আরেকজন মানুষের মৃত্যু কামনা করো । নিজে একজন মেয়ে হয়ে অন্য আরেকজন মেয়েকে গালিগালাজ করো , এইসব কি ঠিক করো ? তোমার ভাষণ অনুযায়ী তুমি শিক্ষিত আর বেলী মূর্খ । যেহেতু তুমি এত শিক্ষিত তাহলে মূর্খের মত কথা বলো কেন যে আমায় তাবিজ করা হয়েছে । তার মানে কি আমি বলতে পারি না তুমি এইসবে বিশ্বাস করো ?
– আমি একটা জিনিসই চাই , বেলী নামক কীটপতঙ্গ আমাদের জীবনে থাকবে না ।
– ও-কে কীটপতঙ্গ বলো না । মেয়েটা ৫ ওয়াক্ত নামাজ পড়ে , আল্লাহর কালাম পবিত্র কোরআন পড়ে , ওর সব চলাফেরা শরীয়তের দায়রার মাঝে পড়ে । আমি অধম হয়তো আগে কিছুই দেখিনি ওর । কারণ আমি তো পাগল ছিলাম তাই আসল হিরাকে কাঁচ ভেবেছি আর কাঁচকে হিরা ।
– বাহ বাহ , ও আমার বাল । বুঝলা তুমি ও আমার বাল । আই ডোন্ট কেয়ার এনি বেলী ফেলী ।
– ওকে , তুমি যে কেমন আমি হারে হারে বুঝে গেছি ।
– তাহলে আমায় বিয়ে করেছো কেন ?
– আবারও এক কথা বলে ? বিয়ে কি আমি একা করেছি নাকি তুমিও করেছো । তুমি তো জানতে আমি বিবাহিত , তুমি তো জানতে স্বামীর ভাগ তোমাকেও করতে হতে পারে , তুমি তো জানতে তোমাকে সতীন নিয়ে থাকতে হবে , তাহলে রাজি হলে কেন ? আর বিয়ের কথা আগে কে কাকে বলেছে ভেবে দেখো তো রুবি । তুমি তো চাইলেই পারতে আমায় ইগনোর করতে , তুমি তো চাইলেই পারতে আমায় ছাড়তে , কই তুমি তো ছাড়ার বদলে আরও চেপে ধরেছিলে । বেলী তো এইসব কিছুই জানতো না , তুমি তো জানতে , তাহলে ? তুমি মেয়ে হয়ে অন্যের স্বামীর দিকে হাত বাড়িয়েছো আর আমি শুধু হাতটা ধরেছি কেবল ।
– কি বলতে চাও তুমি ?
– কিছুই না , আমি চাই একটু শান্তি । যা আমি বেলীর কাছ থেকে পাই , আর তোমার কাছ থেকে পেইন পাই । তুমি অন্যের ঘর ভেঙে তার স্বামীকে নিয়ে সুখে থাকার স্বপ্ন যেমন দেখো তদ্রুপ সেই নারীও কখনো না কখনো তার নিজের স্বামীকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে ।

রুবি আর ইরফানের কথোপকথনের মাঝে হঠাৎই ইরফানের ফোন বেজে ওঠে । রুবির দিক থেকে ধ্যান সরিয়ে মোবাইলের দিকে তাকায় ইরফান । মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে অফিস থেকে ফোন , ওইদিকে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সাড়ে ৯ টার উপরে বেজে গেছে । কথা বলতে বলতে সময় কোন দিক দিয়ে পার হয়ে গেছে বলতেও পারবে না সে ।

– আসসালামু আলাইকুম , কামাল ভাই বলুন !
– কোথায় আছেন ভাই ?
– এইতো ভাই বাসায় আছি ।
– অফিস আসবেন না , এত লেট কেন ?
– ভাই ওয়াইফ অসুস্থ ছিল , আর কিছুক্ষনের মাঝেই বের হবো ।
– ওকে ভাই , আসেন তাহলে ।
– জ্বি ভাই ।

ইরফানের কথা শুনে রুবি আরও জ্বলে উঠে যখন ইরফান তার কলিগকে বলেছে ওয়াইফ অসুস্থ । এটা রুবি ঠিক হজম করতে পারেনি । তাই সেও চুপ থাকে নি ,

– আমি তো অসুস্থ নই ।
– তো ?
– তাহলে ওনাকে কেন বললা যে ওয়াইফ অসুস্থ ?
– আরে আজব তো , বউ কি শুধু তুমি একা নাকি বউ তো আরও একজন আছে আমার , সে অসুস্থ । তার কথাই বলছি ।
– আর অন্যকিছু ছিল না ?
– কি ছিল , এত সহজ ভাবে কথা বললাম আর সে বলে আর অন্যকিছু ছিল না ? কি বলা উচিত ছিল আমার , যে ভাই আমার দ্বিতীয় স্ত্রী আমার আর আমার প্রথম স্ত্রীর মাঝে কাল রাতে সেক্স হয়েছে কিনা তার তদারকি করছে । এইটা বলা উচিত ছিল কি ?

ইরফানের এমন কথায় একদম চুপ হয়ে যায় রুবি । রুবি কোন দিক দিয়েই ইরফানকে জব্দ করতে পারছে না । রুবি বার বার ডাইরেক্টলি ইন্ডাইরেক্টলি বেলীকেই টার্গেট করছে । সে বার বার এত কিছু বলেও কোন কাজ করতে পারছে না । আপাতত চুপ হয়ে যায় সে ।
অন্যদিকে আজ মিনু-ই একা একা নাস্তা বানিয়ে রাখে টেবিলে । ইরফান রেডি হয়ে নাস্তার টেবিলে আসে । মিনু সব সামনে সাজিয়ে রেখেছে । তবুও কিছু একটা মিসিং । ইরফান টেবিলে ভালো মত চোখ বুলায় , কিছু তো মিসিং পাচ্ছে সে ।

– কিও ভাই খান না কা ?
– কিছু জিনিস মিসিং ।
– হেইডা কি ?
– মানে কিছু জিনিস দেস নাই তুই ।
– তা কি দেই নাই কন , সবই তো দিছি । খাইয়া লন দেহি ।
– খাচ্ছি , বেলী উঠছে ?
– হু ,
– কখন ?
– আপনে যখন রুমে গেছেন তার পরখানেই উঠছে ।
– মুখ ধুয়েছে ?
– হ ,
– নাস্তা দিছিস ?
– দিয়াইছি , খাইতো না কয় । আমি দিয়াইছি ।
– আচ্ছা ,

ইরফান আজ তেমন কিছু খায়নি । একটা ব্রেড খেয়েছে তাও শুকনো সাথে একটা ডিম । পানি খেয়ে সোজা বেলীর রুমে যায় সে ।
বেলী তখন বিছানায় বসে নাস্তার ট্রে টা দেখছিল । কেমন যেনো ঘিন ঘিন লাগছে তার কাছে এটা তার চোখে মুখেই বুঝা যাচ্ছে যা ইরফানের চোখে সহজেই ধরা পড়ে যায় । সে সামনে গিয়ে দাঁড়ায় বেলীর । বেলী তখন নাস্তার ট্রে থেকে নজর সরিয়ে ইরফানের দিকে তাকায় ।
এক নজরে ইরফানের দিকে চেয়ে আছে সে । ইরফান আজ সাদা শার্ট পড়েছে তাও কালো জিন্স দিয়ে । ইন করা শার্টের আবার হাতা গুলোও ফোল্ড করা । একেবারে ক্লীন সেভও না আবার একেবারে দাড়িতেও ভরে নেই ইরফানের গাল জোড়া । এইভাবেই ভালো লাগছিল তার কাছে তার স্বামীকে । বেলী চেয়ে আছে তার স্বামীর দিকে । আর মনে মনে বলছে ,

– মাশা-আল্লাহ , একদম রাজপুত্র আমার স্বামী । কত সুন্দর দেখায় তাকে ।

বেলীর ভাবনায় ছেদ পড়ে ইরফানের ডাকে । ধ্যান ভেঙে সামনে তাকায় বেলী । ততক্ষণে ইরফান বেলীর পাশে এসে বসে গেছে । নাস্তার ট্রে টা সাইডে রেখে বেলীর কপালে হাত রাখে ইরফান । জ্বর মোটামুটি আছে শরীরে । তবে দেখে মনে হচ্ছে অনেক দুর্বল সে । ইরফান বেলীর গালে আলতো করে ছুয়ে দেয় । আর বলে ,

– কি ব্যাপার , খাচ্ছো না কেন ?
– এইগুলা খাবো না ।
– এইগুলা তো তুমিই রোজ বানাও , ডিম মামলেট , পরোটা , ভাজি , খাও তারপর সকালের মেডিসিনটাও তো খেতে হবে ।
– ডিম ডুম খাবো না , এইগুলাতে গন্ধ । সরান এইগুলা , মিনু কই ?
– কিসের গন্ধ , কি সব বলো তুমি বেলী ।
– ডিম খাবো না ,
– তাহলে শুধু পরোটা আর ভাজি খাও , তাড়াতাড়ি করো ।

বেলী তার নাক সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠিয়ে ফেলে ভাজি দেখে । কেন যেনো বেলী সব কিছুতেই ক্ষুত ধরছে ।

– ভাজি এমন ভর্তা ভর্তা কেন ?

এইবার ইরফানের মেজাজ খারাপ হচ্ছে । বেলী অহেতুক বাচ্চামো করতেছে । না খাওয়ার ধান্দা এইসব বেলীর । মোট কথা সে খাবে না , তাই এইসব করছে । এইদিকে ইরফানেরও অনেক দেরী হয়ে যাচ্ছে অফিসে । বেলীকে খাইয়ে দিয়ে মেডিসিন দিয়ে তারপর সে অফিসে যাবে । আর কোন কথা শুনেনি ইরফান । সোজা পরোটা ছিড়ে ভাজি নিয়ে বেলীর মুখের মধ্যে পুড়ে দেয় সে । তারপরও বেলী তা মুখের মধ্যে রেখেই চাবায় গিলে আর না । তারপর ইরফান পানি দিয়ে গিলতে বলে । বেলীও পানি দিয়ে গিলতে মাত্র একটা পরোটা খায় । ইরফান বেলীকে মেডিসিন দিয়ে মিনুকে ডাকে ।

– জ্বে ভাই ,
– আমি তো এখন অফিসে যাবো , ও-কে দেখে রাখিস ।
– আইচ্ছা ,
– দুপুরে যাতে ও ভাত খায় । কেমন ?
– আরে মাতারি এইডা খবিশ , পোলাপাইনের লাহান করে । খাইতে কইলেও খায় না ।
– আহহহহ , কিসব ভাষা ব্যবহার করিস তুই । যা বলছি তাই করিস ।
– আইচ্ছা , তা এই ডিম খানায় কি দোষ কচ্চিলো , খান নাই কিলিগা ভাবী ?
– তুই এইগুলা নিয়ে যা , ধর ।
– দেন ,

মিনু ট্রে নিয়ে চলে যায় । আর ইরফান বেলীর গালে আলতো করে ছুয়ে দিবে বেলীর দিকে তাকিয়ে থাকে ।

– আমি তোমার কাছে তো ২৪ ঘন্টা বসে থাকতে পারবো না তাই না ? অফিস আছে তো আমার । তুমি খেয়ে নিবে দুপুরে , কেমন ?
– হু ,
– আর হ্যাঁ ,
– কি ?
– কিছু না , ভালোবাসি,,,,,,

এই বলে বেলীর কপালে আলতো করে একটা চুমু দিয়ে দেয় ইরফান । তারপর মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে ,

– একটা কথা বলি ?
– হু ,
– রুবি যদি এই রুমে আসে বা তোমাকে কিছু বলে , চুপ করে থাকার প্রয়োজন নেই । নিজের জন্যে স্ট্যান্ড নিতে শিখো আজ থেকে । আমি যেই ভুল করেছি তা হয়তো শুধরাতে টাইম লাগবে । তবে নিজের জন্যে ভাববে আজ থেকে । অন্যের জন্য নয় এমনকি আমার জন্যেও না । মনে যাতে থাকে , কেমন ?
-…………………
– চুপ করে থাকতে বলি নি তোমাকে , কিছু বলেছি তার উত্তর দেও ।
-………………….

বেলীর চুপ থাকা দেখে ইরফান আর বেশি কিছুই বলে নি । ইরফান জানে বেলীকে যদি রুবি মেরেও যায় তবুও সে কিছু বলবে না । কারণ বেলী এমন এক আল্লাহর বান্দা যে কিনা শত কষ্ট সহ্য করবে কিন্তু পালটা কাউকে কিছু বলবে না । ইরফান আল্লাহ হাফেজ বলে বিদায় নেয় বেলীর কাছ থেকে ।

ইরফান চলে যাওয়ার পর বেলী কেন জানি চুপ করে বিছানায় শুয়ে পড়ে । ইরফানকে ভেবে যাচ্ছে সে । বার বার ইরফানের মুখটা ভেসে আসছে তার সামনে । স্বামীর ভালোবাসা কি সে বিয়ের পর থেকে জানতো না । এই দুই দিনে সে বুঝেছে কেন মেয়েরা স্বামীর ভালোবাসার জন্য মরিয়া হয়ে থাকে । ইরফান সত্যিই তাহলে বদলে গেছে , এইসব ভাবতে ভাবতে আবার ঘুমের ঘোরে চলে যায় বেলী ।

অন্যদিকে , অফিসে বসে থেকেও কাজে মন বসছে না ইরফানের । কেমন আছে বেলী , দুপুরও হয়ে গেছে কি করছে সে এখন , খেয়েছে কিনা , মেডিসিন নিয়েছে কিনা , সব মিলিয়ে এখন এই মুহুর্তে তার মাইন্ড শুধুই বেলীকে ঘিরে চলছে । একটা খোঁজ নিতে পারলে ভালো হতো । অথচ নেয়ার উপায় নেই । বেলীর ফোনও নেই যে ফোন করবে । আবার রুবির ফোনে ফোন দিয়ে বেলীর খবর নেয়া মানে ৪র্থ বিশ্ব যুদ্ধকে যেচে আমন্ত্রণ করা । তাই আর এইসব ফোনের ব্যাপারে ভাবে নি ইরফান ।

বাসায় মিনু বেলীকে ঘুম থেকে তুলে ফ্রেশ করিয়ে ভাত খেতে দেয় । বেলী যেই না ভাতে হাত দিয়েছে ওমনি রুবি হাজির সেখানে । বেলীর সামনে ভাত দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে রুবি ।

– জ্বর একটু হয়েছে , কত নাটক করলি তুই ?
-……………..
– এত অভিনয় কই থেকে শিখছিস ?
-……………..
– ভালো অভিনেত্রী হবি তো তুই ?
-……………..
– কিভাবে স্বামী কেড়ে নিতে হয় তুই ভালোই জানিস , নিজেকে আয়নায় দেখছিস ? কি যোগ্যতা আছে রে তোর ইরফানের সাথে থাকার ?
-……………….
– হ্যাঁ , গিল গিল ভাত গিল । গিলে গিলে হাতি হয়ে যা । তারপর মোটা শরীর দিয়ে ইরফানকে আরও বশ করতে পারবি ।

এইবার বেলীও মুখ খুলতে বাধ্য হয় । একে তো জ্বর দুয়ে শরীর ভালো নেই তার উপর এত কিছু বলছে রুবি । রুবির প্রতিটা কথাই নোংরা ইংগিত সম্পন্ন কথা । সব মিলিয়ে সেও বিরক্ত ।

– রুবি আপু আমি না করতেছি অভিনয় না করলাম নাটক । ওইটা আপনার কাছে মনে হচ্ছে আমার কিছু করার নাই । আর অন্যের স্বামী আমি কেড়ে নিচ্ছি না । আমি যদি বলি আপনি আমার স্বামী কেড়ে নিয়েছেন তখন কি হবে ? আর আমি ভাত এতটাও খাইনা যে হাতি হবো । যদি বলি শরীর দেখিয়ে আমার স্বামীকে আপনি বশ করেছেন , তখন কি হবে ? এতটাও খারাপ কথা বলবেন না যাতে পরবর্তীতে আপনার সাথে কথা বলতে গেলেও রুচিতে বাঁধে ।
– চুপ একদম , একদম চুপ ।
– আমার শরীর আসলেই ভালো নেই , আপনি আপনার রুমে যান ।
– ওহ আমি আসাতে এখন শরীর ভালো না তাই না ?
– দেখেন আপু আমার কথা বলতে ভালো লাগছে না । আপনি আপনার স্বামীকে আপনার আঁচলের তলায় বেঁধে রাখুন । দেখুন আটকে রাখতে পারেন কিনা ? আমি তো আর তাকে বলি না যে আমার কাছে আসো এই সেই । সে আসে এতে আমার হাত নেই । আর হ্যাঁ স্বামীটা আমারও । আমি চুপ থাকি তার মানে এই না যে আমি বলতে পারি না । আমিও বলতে পারি আপু শুধু বলি না ।

বেলীর কথায় রুবির মুখ বন্ধ হয়ে যায় । বেলীর তাকে কথা বলা কথা গুলো জায়গা মত গিয়ে লাগে তার । এতটা বাড়াবাড়ি করে এই রুবি যে একে চুপ করানোর জন্যে অন্য কাউকেও এর মত ভাষা ব্যবহার করতে হয় । আদারওয়াইজ এই আল্লাহর বান্দি থামার পাত্রী না । রাগে ফুলতে ফুলতে বেলীর রুম থেকে বের হয়ে যায় রুবি । রুবি যাওয়ার পর পরই মিনু সেখানে হাজির । মিনুর মুখের ভঙ্গিমাই জানান দিচ্ছে যে সে সব শুনেছে । তাই বেলীও মিনুর হা করার আগেই বলে দিয়েছে ,

– মিনু এখন কিছু বলো না , খুব খারাপ লাগতেছে আমার কাছে । সো কিছু বলো না আর ।
– আমি কি কইতাম আর । সব আপনেই তো কইলেন । উফফফফ ভাবী যা কইলেন না , ওর থোতা মুখ আপনে ভোতা বানাইয়া দিছেন এক্কেরে ভালা করছেন ভাবী এক্কেরে ভালা করছেন । শয়তানি একটা , হেয় এহন পাগল হইয়া গেছে । শয়তানের হাফেজ । হেরফরে খুশি হমু ভাইয়ে এইডারে লাথি মাইরা ঘর থিকা বাইর কইরা দিলে ।
– আহহ মিনু , কি সব বলো । লাথি কেন মারবে তোমার ভাই । ও কি সংসার করতে আসে নাই ? ও কি আমার মত পাগল নাকি যে নিজের স্বামীকে অন্যের হাতে তুলে দিবে । পাগলেও আজকাল নিজের স্বামীর ভাগ দেয় না । সেই জায়গায় ও তো মানুষ ।
– তা আপনে কি ? মানুষ না ? আপনে দিছেন কেমতে ?
– আমার এই কপাল টা আছে না , এই কপালটার দোষ । আমার ভাগ্যে ছিল স্বামীর অবহেলা পাবো পাইতেছি । আমার ভাগ্যে ছিল সতীন নিয়ে ঘর করবো করতেছি । প্রতিনিয়ত এদের কথা শুনতে হবে শুনতেছি । আর কি লাগে ।
– হাত ধুইলেন যে ভাবী , খাইয়া লন ।
– নাহ এইসব নিয়ে যাও আমি আর খাবো না , পেট ভরে গেছে । আর খুব বেশি দরকার ছাড়া আমাকে জাগিও না ।

এই বলে বেলী হাত ধুয়ে ফেলে । এক লোকমা ভাতও পেটে যায়নি মেয়েটার । চুপ করে শুয়ে আছে , আর দুচোখ বেয়ে তার আপনা আপনি পানি পড়ে যাচ্ছে । আজ রুবির কথা গুলোয় আসলেই অনেক কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা । ইরফান বাসায় আসলে ইরফানকে কিছু কথা বলবে বেলী , এটা ভেবেই আস্ত্র আস্তে ঘুমিয়ে যায় সে ।

সারাদিন বেলী রুম থেকে বের হয় নি । রুবিও সোজা দুপুরের পর না খেয়েই বাপের বাড়ি চলে গেছে । সে এখানে এক মুহুর্তের জন্যও থাকবে না । তাই সে চলে যায় ।
রাত প্রায় ৮ টা নাগাদ ইরফান বাসায় আসে । মিনু দরজা খুলেই ইরফানকে সব বলে দেয় । রুবি বেলীকে কি কি বলেছে , বেলী রুবিকে কি কি বলেছে , রুবির চলে যাওয়া , বেলীর সারাদিন না খেয়ে থাকা সব সব বলে দিয়েছে মিনু ।

– মিনু আমার মাথাটা অনেক ধরে আছে , তুই আমার জন্যে কফি বানা । আমি আগে গোসল করবো তারপর বেলীর কাছে যাবো ।
– আইচ্ছা ।

ইরফান গোসল করে ফ্রেশ হয়ে বের হতে হতে মিনুও কফি নিয়ে হাজির হয় ইরফানের রুমে । কফিতে চুমুক দিতে দিতে ইরফান বেলীর রুমে যায় । গিয়ে দেখে বেলী ওপাশে মুখ ফিরিয়ে শুয়ে আছে । ইরফান বেলীর পাশে গিয়ে বসে বেলীর কাঁধে হাত রাখে । তখনই বেলী চোখ খুলে একটা কথা-ই বলে দেয় ,

– আপনি চলে যান রুবি আপুর কাছে । আমার কপালে আপনার ভালোবাসা নেই আমি অভাগী এইভাবেই একদিন শেষ হয়ে যাবো । এভাবেই আমায় জীবনের শেষদিন অবদি কাতড়াতে হবে । কষ্ট পাইতেছি আর পাইতে হবে । তবুও পারবো না অন্য কোন নারীকে কষ্ট দিতে । আপনি রুবি আপুর কাছে চলে যান । আমি আপনাকে ভালোবাসি অনেক কিন্তু আপনাকে বেঁধে রাখতে পারবো না । মন জমিনে আপনার নাম আজীবন থাকবে তবুও অন্য কারো চোখের পানির কারণ হতে পারবো না ।

এই কথাগুলো বলে হু হু করে কেঁদে উঠে বেলী । তখন কেন জানি ইরফানের চোখ দিয়েও পানির স্রোত বয়ে যায় ।

.
.

চলবে…………………..

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_১৮

0

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_১৮
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

বেলীর পুরো শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে । বিছানায় আধ-মরা হয়ে থাকা বেলীকে দেখে বড্ড বেশি মায়া হচ্ছে ইরফানের । শরীর হাত পা কেমন ঠান্ডা হয়ে গেছে বেলীর । অনেক ভয় পাচ্ছে ইফরান । কি করবে না করবে বুঝতে পারছে না সে । নিশ্চুপ হয়ে পড়ে থাকা বেলী একবারের জন্যেও চোখ খুলছে না ।

অন্যদিকে অফিস থেকে এসেই ইরফানের বেলীর রুমে যাওয়া একদম সহ্য হয় নি রুবির । সে রুমের মধ্যে বসে থেকেই নিজের তেজ কমাচ্ছে জিনিসের উপর । সে শুধু অপেক্ষায় আছে কখন ইরফান এই রুমে আসবে আর সে ইরফানকে ধরবে । অনেক হিসেব নিকেশ বাকি আছে তার ইরফানের সাথে । সব কিছুর শোধ তুলতে হবে তাকে । আজ এক্ষুনি এবং এই মুহুর্তে ।

ইরফান তাড়াতাড়ি নিজের রুমে আসে থার্মোমিটার নেয়ার জন্যে বেলীর জ্বর মাপবে বলে । আর কোন রকম চেঞ্জ করে বেলীর কাছে যাবে বলে । কিন্তু ইরফান রুমে আসার সাথে সাথে রুবি দরজা আটকে দেয় । মোট কথা সে এই রুম থেকে আজ ইরফানকে বের হতে দিবে না । রুবিকে দেখে ইরফানের মেজাজ এমনিতেই অনেক খারাপ তার উপর এইভাবে দরজা আটকে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকায় আরও মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে তার । প্রথমে কিছুই বলে নি ইরফান । ওয়াসরুমে গিয়ে কোন রকম ফ্রেশ হয়ে টাউজার আর গেঞ্জি পরে থার্মোমিটার হাতে নিয়ে দরজার কাছে যায় ইরফান । রুবি এত পরিমান ঠ্যাটার ঠ্যাটা যে সে ওইখানেই এখন অবদি দাঁড়িয়ে আছে । এইবার ইরফান আস্তে করেই কথা বলে রুবির সাথে ,

– কি ব্যাপার , এইখানে এইভাবে দাঁড়িয়ে কেন আছো ?
– কোথায় যাচ্ছো তুমি ?
– বেলীর কাছে ।
– কি কারণে , আমি যে তোমার ঘরে আছি , এতে তোমার হয় না ?
– দেখো রুবি রাত সাড়ে ৯ টা বাজে । আমি খুব ক্লান্ত , তার উপর বেলীর প্রচন্ড জ্বর । আমাকে যেতে দাও ,
– ও মরে যাক , তবুও তুমি যাবে না ।

রুবির কথা শুনে ইরফানের পায়ের রক্ত মাথায় চড়ে যায় । এটা কি বললো রুবি , এ কেমন মানুষ যে অন্য আরেক মানুষের মৃত্যু কামনা করে । তবুও নিজের মেজাজ কন্ট্রোলে রেখে ঠান্ডা মাথায় আবারও রুবিকে বোঝাতে থাকে সে ,

– রুবি আমি এখন ঝগড়ার মুডে নাই , প্লিজ আমাকে যেতে দেও ।
– তুমি যাবে না ,
– আমি তো যাবোই রুবি ,
– নাহ যাবা নাহ ।
– তোমার সমস্যা কোথায় ?
– আমার সমস্যা ওই বেয়াদব মেয়েটা , ও কি তাবিজ করেছে তোমাকে যে আমি থাকা স্বত্ত্বেও তুমি ওর দিকে যাচ্ছো । আগে তো ও-কে দেখতেই পারতা না , এখন কি হয়েছে ইরফান ।
– একটা কথা আছে জানো তো রুবি , যার চিন্তাভাবনা যেমন সে বলবেও তেমন । তুমি একজন এডুকেটেড মেয়ে হয়েও এইসব নোংরা মানসিকতার চিন্তাভাবনা নিয়ে পড়ে আছো ।
– হ্যাঁ আমি নোংরা মানসিকতার মানুষ তবুও তুমি যাবা না ওর কাছে ।
– লাষ্ট টাইম বলতেছি আমি , তুমি সরে যাও আর আমায় যেতে দাও ।
– তুমি যাবা না , যাবা না , যাবা না ।
– আমি যাবো , যাবো , যাবো ।
– ইরফান তুমি বদলে গেছো , ওই গাইয়া মেয়েটার জন্যে তুমি বদলে যাচ্ছো ইমরান
– হ্যাঁ , আমি বদলে গেছি । আমি আগে জানোয়ার ছিলাম এখন মানুষ হচ্ছি ।

বিগত ৫ মিনিট যাবত একই বিষয়ে ঘ্যান ঘ্যান করেই যাচ্ছে রুবি যা আর সহ্য হয় নি ইরফানের । ইরফান এইবার ধাক্কা দিয়ে রুবিকে সরিয়ে দেয় ।

– বলেছিলাম না , বেশি বিরক্ত করো না আমাকে ।
– তুমি আমাকে ধাক্কা দিলা ?
– মাত্র তো ধাক্কা দিলাম , এরপর বেশি বাড়াবাড়ি করলে পা ভেঙে হাতে ধরিয়ে দিবো । মাথায় রাখবে কথাটা ।
– ইরফান তুমি যাবা না ,
– আমি যাবো , বিয়ে যেমন দুইটা করেছি । দায়িত্বটাও সমান ভাবেই নিবো আমি ।
– হয় তুমি ওরে রাখবা নয়তো আমায় ।
– তুমি থাকতে চাইলে থাকবে না থাকতে চাইলে চলে যাবে , ব্যাস ।
– ইরফান ,,,,,,,,,,,,?
– গলা নামিয়ে কথা বলো , বার বার বলেছি আমি ক্লান্ত আমি ক্লান্ত , ডিস্টার্ব করো না আমায় । মেয়েটা জ্বরে অচেতন হয়ে পড়ে আছে আর তুমি এখানে আমায় আটকে রেখেছো , এইগুলা কি মানুষের কাজ ?
– আজ হঠাৎ মানুষ হয়ে গেলে , অন্যান্য দিন তো বেলী বলতেই মারধর আর আজ আদর যত্ন , ব্যাপার কি ?
– আগে অমানুষ ছিলাম , এখনও অমানুষই আছি আমি । মানুষ হওয়ার চেষ্টা করছি শুধু । বাকি উত্তর গুলো সময় অনুযায়ী পেয়ে যাবে ।

ইরফান রুবির সামনে দিয়ে বেরিয়ে যায় রুম থেকে । আর রুবি রুমের মধ্যে থেকেই সব তোলপাড় করে ফেলছে । তার একটাই সমস্যা ইরফান কেন বেলীর কাছে যায় । ইরফান এই মুহুর্তে আর অন্য কিছু ভাবতে ভালো লাগছে না । সে এখন থেকে এই মুহুর্ত থেকে শুধুই বেলীকে নিয়ে ভাবছে ।

বেলীর রুমে এসে অচেতন বেলীর শরীরের তাপমাত্রা চেক করার জন্যে থার্মোমিটার কাজে লাগায় ইরফান । ওয়াসরুম থেকে বালতি ভরে পানি নিয়ে আসে বেলীর মাথা ধুইয়ে দিবে বলে । বেলীর শরীরের বিন্দুমাত্র শক্তি নেই যে সে উঠে বসবে বা শুয়ে থেকেই শরীর নাড়াবে । থার্মোমিটারে ১০৩ ডিগ্রী জ্বর দেখে ঘাবড়ে যায় ইরফান । ধরেই জ্বর ১০৩ এ পৌঁছে গেছে । এইজন্যই হুশ নেই বেলীর , হু , হা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছে না সে । ইরফান মিনুর কাছ থেকে পলিথিন নিয়ে এসে বেলীকে ঠিক করে শুইয়ে দেয় বিছানায় । আজ ইরফান কফিও খায় নি । মিনু এসে দেখে ইরফানের কফির মগে কফি পড়ে আছে ।

– ভাই , কফি খাইলেন না ?
– নাহ , নিয়ে যা ।
– আপনের তো কফি না খাইলে হয় না ।
– কফি না খেলে মরে যাবো না , তুই নিয়ে যা । আর ও কিছু খেয়েছে ?
– নাহ ভাই , ভাবী তো কিছুই খায় নাই ।
– আচ্ছা যা , আমি ওর মাথায় পানি দিয়ে দেই আর তুই ওর খাবারের ব্যবস্থা কর ।
– আইচ্ছা ভাই ।

এই সময়েই মিনুর মাথায় চট করে বুদ্ধি আসে । এই সুযোগ , সুযোগটা কাজে লাগাবে সে । আজ রুবি যা যা বেলীকে যা যা বলেছে যা যা করেছে সব বলে দিবে সাথে বাড়তি কথাও বলবে । মিনু মানেই ধামাকা , তাই সে আর সময় নষ্ট করে নি ।

– হায়রে ভাবী , যত কইলাম আমি ধুইয়া দেই আমি ধুইয়া দেই হুনলেন না আমার কতা ।
– কি হইছে , কি ধুয়েছে ও ?
– আর কইয়েন না ভাই , রুবি ভাবী আইয়া এইযে শুরু করছে , বেলী ভাবীরে যা মুখে আইছে তাই কইছে । তারপর ভাবীরে দিয়া সেতির সব জামা কাপড় ধোয়াইছে তাও অবেলায় । এল্লাই মনে হয় জ্বর আইছে ।
– কিহ !!
– হ ভাই , ছে ছে কি বিচ্চিরি গালি দিছে ভাবীরে , ভাবী চুপ কইরা আছিলো । কিছুই কয় নাই । খালি কানছে ,
– তুই যা , বাকি কাজ কর ।

মিনুর কথা গুলো শুনে ইরফানের শরীরটা রাগে কাঁপতে থাকে । ইচ্ছা করছিলো রুবিকে এক লাথি মেরে ঘর থেকে বের করে দিতে । কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও উপায় নেই তার । রুবিও তার স্ত্রী , তার উপর ভালোবেসে বিয়ে তাদের । এখন চাইলেও এইভাবে কিছুই করা সম্ভব না । সব ভুলে গিয়ে বেলীর মাথায় পানি ঢালে ইরফান । মেয়েটা এত অসুস্থতার মাঝেও টু-শব্দও করছে না ।

– তুই এত সহজ সরল কেন বেলী , কেন আমাদের জীবনটা এমন হয়ে গেলো ? আমি এত অবুঝ হয়েছিলাম যে তোকেই বুঝলাম না । এত মারধরের পরেও আমার কাছেই আছিস , এত চুপচাপ কি করে থাকিস তুই ? এত চাপা স্বভাবের কেন তুই বেলী ? আমার মনটা কেন জানি তোর দিকেই ঘুরে যাচ্ছে রে । প্লিজ ভালো হয়ে যা তুই ।

এই কথাগুলো মনে মনে বলতে থাকা ইরফানের অন্তরটা হু হু করে উঠে । বেলীর জন্যে তার মায়া দিনকে দিন বেড়েই চলছে । কেন যেন নিজের মনকে সে বশে রাখতে পারছে না । বার বার মন তার বেলীর দিকেই টানছে । আসলে সবাই ঠিকই বলে , বেলীফুল সবার মাঝে শুধু সুবাস ছড়াতেই পারে বিনিময়ে তার কিছুই চাই না ।

প্রায় এক ঘন্টা সময় নিয়ে ইরফান বেলীর মাথায় পানি দিয়েছে । তারপর টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছে দিয়েছে । শরীরে অনেক তাপমাত্রা বেলীর , তাই ভাবছিল যদি পুরো শরীরটা মুছে দেয়া যায় তাহলে ভালো হতো । এই এত দিনের মাঝে বেলীকে এত অসুস্থ হতে সে আজ দেখলো । ফার্মেসিতেও যাবে সে জ্বরের মেডিসিন নিয়ে আসবে বেলীর জন্যে ।
মিনুকে ডেকে বেলীর কাছে মিনুকে রেখে ইরফান বাসা থেকে বেরিয়ে যায় । ওইদিকে রুবির মেজাজ তুঙ্গে পৌঁছে গেছে । সে এইসব কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না । তার এই মুহুর্তে বেলীকে গিয়ে বিষ দিতে মন চাইছে । কিন্তু উপায় নেই ।

আধা ঘন্টা পর ইরফান মেডিসিন নিয়ে বাসায় আসে । মিনুকে খাবার আনতে পাঠিয়ে দিয়ে সে বেলীর পাশে বসে যায় । বেলী তখনও জ্বরের ঘোরেই আছে । মিনু এইদিক দিয়ে বেলীর শরীরটা মুছে দেয় । মিনু ভাত নিয়ে এলে বহু কষ্টে ইরফান বেলীকে ভাত খাওয়াতে পারে । বেলী তো ঠিকমত বসতেই পারে না ভাত খাবে কি । তার একটাই কথা ,

– এইগুলা সরান সামনে থেকে , আমি খাবো না ।
– মেডিসিন নিতে হবে তো , অল্প কয়টা খাও ।
– খাবো না সরান এইগুলা সামনে থেকে ।
– অল্প কয়টা ভাত খাও বেলী এমন করো না , হা করো ।
– এইগুলা কি ?

তখন মিনু বলে উঠে ,

– অকি ভাবী , আপনেই তো রানলেন , মুরকার মাংস । লন ভাত খাইয়া লন ।
– এইগুলা সরান সামনে থেকে , গন্ধ লাগে এইগুলা ।
– অকি , কি সব কয় মাতারি । ভাবী পোলাপাইনের মত কইরেন না তো । খাইয়া লন হেরফরে ওষুধ খান ।

বেলী খাবেই না , তরকারি দিয়ে তো আরও আগেই খাবে না । তাই ইরফান ভাতে পানি দিয়ে পানিভাত করে খাইয়ে দেয় বেলীকে । বেলীর জ্বরের ঘোর প্রকট হলেও সে বুঝতে পেরেছে ইরফান তাকে খাইয়ে দিচ্ছে । আর ইরফানের হাত থেকে বিয়ের এতদিন পর সে খাচ্ছে । মুহুর্তেই তার চোখে পানি চলে আসে । তবে ইরফান ভাবছে শরীরের যন্ত্রণার জন্য বেলী কাঁদছে । সর্বোচ্চ ৬/৭ লোকমা ভাত খায় বেলী । তারপর আর পেটে যায়নি তার । ইরফানও আর জোর করে নি । যতটুকু পেরেছে খেয়েছে । তারপর ওষুধ খাইয়ে দেয় বেলীকে সে ।

কিছুক্ষণ পর বেলী চাপা আর্তনাদ শুরু করে । পুরো শরীর ব্যাথা তার । ব্যাথার চোটে কাঁদছে সে । ইরফান তখনও বেলীর পাশেই বসা । বেলীর কান্না সহ্য হচ্ছে না তার । আজ রাতে সে ভাতটাও খায়নি । সেই যে বেলীর কাছে বসা ছিল তখন থেকে এখন অবদি বসেই আছে সে । ঘড়ির দিকে নজর দিতে দেখে ঘড়িতে তখন ১২ টা বেজে ৫৫ মিনিট বাজতেছে । এতটা সময় পাড় হয়ে গেছে অথচ ইরফান বলতেও পারবে না । বিছানায় বেলী শরীর ব্যাথায় কাঁদতে থাকে ।

– বেলী কি হইছে ?
– আমার পুরো শরীর ব্যাথা করতেছে । উফফফ রে কি ,
– কোথায় কোথায় ব্যাথা ?
– পুরো শরীরটাই ব্যাথা , আল্লাহ রে ।
– বলো ,
– মাজাটা ফেটে যাইতেছে , পায়ের গিট গুলা ব্যাথা করতেছে ।

জ্বরের সময় অনেকের শরীর হাত পা অনেক ব্যাথা করে । তেমনটাই বেলীর হচ্ছে । এর আগের বারের কথা মনে পড়ে যায় ইরফানের । ঠিক এইভাবেই মান্থের পেইন সহ্য করতে হয়েছিল ও-কে । আর আজ আবার জ্বরের তাড়ণায় পাগল হয়ে যাচ্ছে মেয়েটা । ইরফান মুভ এনে বেলীর হাতে পায়ে মালিশ করে দেয় । বেলীকে কাত করে এক পাশ করে শুইয়ে দিয়ে বেলীর কোমড়ে মুভ মালিশ করে দেয় সে । প্রায় অনেক্ষণ পর বেলী একটু শান্ত হয় । জ্বরটাও একটু নিয়ন্ত্রণে আসে আর শরীর ব্যাথাটা কিছুটা হলেও কমে বেলীর । শুয়ে শুয়ে ইরফানকে দেখছিল বেলী । ভেতরটা কেমন জানি করে উঠে তার । খুব খারাপ লাগছে ইরফানের জন্যে । নিজেকে অনেক বেশি অসহায় মনে হচ্ছে তার । ইরফানের মুখটাও কেমন শুকিয়ে আছে ।

– আপনি খাইছেন ?
– উহু ,
– মিনু কোথায় ?
– গেষ্ট রুমে , ঘুমাইতেছে ।
– চলেন আপনাকে খেতে দেই আমি ।

বেলীর মুখ থেকে এমন কথা আশা করেনি সে । নিজেই অসুখে মরে যাচ্ছে আর এখন সে ইরফানের খাবারের কথা ভাবছে । একি মানুষ নাকি অন্যকিছু । অবশেষে ইরফান নিজেই বলে ,

– কথা কম বলে শুয়ে থাকো ।
– খাবেন না তাই বলে ,
– ক্ষুধা লাগলে খেয়ে নিবো আমি । শুয়ে থাকো তুমি ।
– হু ,

ইরফানের কেন জানি বেলীকে কিছু বলত ইচ্ছে হচ্ছে । বেলীর কাছে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে । বেলীকে জড়াতে ইচ্ছে হচ্ছে ।

– বেলী ,,,,,,,,?
– হু ,
– একটা কথা বলি ?
– হু ,
– আমি তোমাকে ভালোবাসি ।

জ্বরের মাঝেও এমন কথা শুনে শরীরের তাপমাত্রা আরও বেড়ে যায় বেলীর । ইরফানের মুখ থেকে এই কথাটা তাও এই মুহূর্তে সে একদম আশা করেনি । এরই মাঝে ইরফান আবারও বলা শুরু করে ।

– ভালোবাসি তোমাকে আমি !

এর পর বেলীও বলতে শুরু করে ,

– এটা শুধুই আবেগ ,
– আবেগ নয় , সত্যিই আমার মনটা বার বার তোমার দিকে ঘুরে যাচ্ছে ।
– আমরা আর দুজন নেই , আমরা এখন তিন জন কেন বুঝেন না আপনি ?
– তিন জন কিভাবে ?
– আপনার দ্বিতীয় স্ত্রী , সে কি দোষ করেছে , সেও আপনাকে ভালোবাসে ।
– কিন্তু আমি যে তোমায় ভালোবাসি ।
– আপনি আমার ভালোবাসেন না , ভালোবাসলে আমি সতীন নিয়ে সংসার করতাম না ।
– এই ভুল টাই আমার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
– বেলী ফুল ঝরে যায় , দিন শেষ সে ঝরে যায় । আমিও ঝরে যাবো । জানি না কবে তবে আমিও ঝরে যাবো , যাওয়ার আগে আপনাকে অনেক কিছু দিয়ে যাবো ।
– বেলী ,,,,,,,,,?
– ঘুমাবো একটু , অনেক ঘুম পাচ্ছে । আপনি রুবি আপুর কাছে যান ।
– আমি তোমার কাছে এসেছি আর তুমি আমায় ওর দিকে পাঠাচ্ছো , কেন বেলী ?
– বেলীফুল তার সুগন্ধে সবাইকে মাতায় বিনিময়ে সে নিঃশেষ হয়ে যায় ।
– সেই ৯ টা থেকে এখন অবদি আমি তোমার কাছে বসা আর এখন তুমি আমায় রুবির কাছে যেতে বলো ?
– আমার কথা বলতে ভালো লাগে না , আমি ঘুমাবো ।
– ঘুমাও , আমি আছি এখানে ।
– কতক্ষন বসে থাকবেন ?
– শুতেও তো বলছো না ,
– আমি কে যে আমার কাছে শুবেন আপনি ?
– মাইর খাবা কিন্তু ,
– ওইটাই কপালে আছে আমার ।

এই বলে বেলী চুপ করে চোখ বুজে যায় । বুকের ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে তার । মানুষটাকে আজ কেন যেনো খুব কাছে পেতে ইচ্ছ্ব করছে তারও । কিন্তু আবার কেন জানি সংকোচ লাগছে । বন্ধ চোখের কোণা বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে বেলীর । আজ নিজের শরীরে ইরফানের হাতের ছোয়াটার মায়ায় পড়ে গেছে ।

অন্যদিকে ইরফানের মনটাও বেলীর কাছে যেতে চাইছে । বেলীকে জড়াতে চায় সে । বেলী তার বিবাহিতা স্ত্রী । অন্য নারী নয় । তাই সে লাইট অফ করে দরজা লাগিয়ে বিছানায় গিয়ে বেলীর পাশে শুয়ে পড়ে । বেলী টের পেয়েও চুপ করে পড়ে থাকে । ইরফান আচমকাই বেলীকে নিজের একদম কাছে নিয়ে আসে । জড়িয়ে ধরে বেলীকে সে ।

– ছাড়েন ,
– ঘুমাও তুমি ।
– এইভাবে থাকলে আমার ঘুম আসবে না ।
– আমি কি তোমাকে কামড়াচ্ছি নাকি ? চুপ করে শুয়ে থাকো ।

ইরফানের এমন কথায় বেলী চুপ হয়ে যায় । তাই বেশি কিছু বলেনি সে । এমনিতেও অনেক রাত হয়ে গেছে । তার উপর নিজের শরীরও ভালো না । তাই আর বাড়াবাড়ি করেনি সে । হঠাৎ করেই ইরফান বলে উঠে ,

– তোমার প্রতি আমার করা অন্যায় গুলো খুব বেশিই ছিল । হয়তো এর ক্ষমা হয় না । এত মারধর করেছি যে নিজের দিকে তাকাতেও এখন লজ্জা লাগে আমার । বার বার বোঝাতে চেয়েও মনটা বুঝে নাই আমার । বার বার তোমাকেই পেতে চায় । কেন জানি তুমি নামক ফুলটা আমার জীবনে সুবাস ছড়িয়ে দিয়েছো । আমি ভালোবাসি তোমাকে বেলী । তোমাকে ফুল ভেবে নয় ভালোবাসার কলি করে কাছে পেতে চাই আমি । আমি শান্তি পাই তোমার মাঝে বেলী । জানি না কেন , কিন্তু আমি শান্তি পাই তোমার মাঝে ।

বেলীর পিঠের সাথে ইরফানের মুখটা লেগে আছে । বেলীর পিঠের ভেজা ভাবটাই বেলীকে জানান দিচ্ছিলো ইরফানের চোখের পানি তার শরীর স্পর্শ করছে । বেলীর বুকের ভেতরটা কাতর হয়ে আছে । আর সহ্য করতে পারেনি সে । এইদিক ফিরে জ্বরের মাঝেই জড়িয়ে ধরে নিজের স্বামীকে সে । ভালোবাসে বেলী মানুষটাকে । কি করে আর দূরে থাকতে পারে সে । বেলীর জড়িয়ে ধরা দেখে ইরফান আরও জড়িয়ে নেয় বেলীকে । কপালে একটা চুমু দিয়ে বলে ,

– ঘুমিয়ে যাও তুমি , আমি আছি এখানে ।

বেলী চুপ করে চোখ বুজেই ইরফানকে ধরে রেখেছে । আর মনে মনে বলছে ,

– কি ঠিক কি ভুল জানি না । কিন্তু মানুষটাকে আমি ভালোবাসি অনেক । তাজে ছাড়তে পারবো না । ভালোবাসি আমি আপনাকে , অনেক ভালোবাসি ।

পরে নিজেই মুখ খুলে বলে ,

– আমি মরে যাবো আপনাকে ছাড়া । শুধু পালটে যাইয়েন না । আমি মরে যাবো , একদম মরে যাবো ।

বেলীর কথা শুনে বেলীকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি ছেড়ে দেয় ইরফান । তার নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে আসে ,

– ভালোবাসি রে বেলীফুল , তোকে অনেক বেশি ভালোবেসে ফেলেছি আমি । তোকে ছেড়ে কোথাও যাবো না আর তোকেও কোথাও যেতে দিবো না । ভালোবাসি অনেক তোকে ।

বেলীও পরম মমতায় নিজের হাতের বাধনে আবদ্ধ করে নেয় ইরফানকে । সেখানেই আস্তে করে ঘুমিয়ে যায় বেলী ।

.
.

চলবে……………………..

[ বিঃদ্রঃ দয়া করে কেউ হাইপার হবেন না । এটাই বাস্তবতা । স্বামী স্ত্রী শত ঝগড়া মারামারির পরেও এক হয় । আর বাংলাদেশে এখনও অনেক মেয়েরাই আছে যারা সতীন নিয়ে সংসার করে । আমার নিজের চোখে দেখা এমন ৪ টা পরিবার আছে যারা এখনও সতীন নিয়ে ঘর করছে । তাই এটাকে বাস্তবতার দিক থেকে দেখবেন সবাই । একজন পুরুষ একজন নারীর সান্নিধ্য যেমন ছাড়তে পারে না তেমন একজন নারীও তার স্বামীর সান্নিধ্য ছাড়তে পারবে না । তাই সবাই যখন পড়বেন তখন বুঝবেন , আর রইলো কথা রোমান্টিকতা আর কাল্পনিকতা । তাও হালকা পাতলা দেয়া হবে । রোমান্টিকতা ছাড়া গল্প জমে না । আর আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে বিবাহিত আপু+ভাইয়াদেরও কিন্তু রোমান্টিক মুহুর্ত আসে । সো এটাও কিন্তু বাস্তবতার মাঝেই পড়ে । তাই সবাই উপভোগ করবেন ।
আর এখন আলহামদুলিল্লাহ সুস্থ আছি চেষ্টা করবো রেগুলার গল্প দিতে । আপাতত বুলবুলের টেনশনে আছি । কখন না জানি উড়িয়ে নিয়ে যায় । দোয়া করবেন সবাই । আর আমার পক্ষ থেকেও সবার জন্যে দোয়া রইলো ]

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_১৭

0

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_১৭
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

রুবির ব্যবহার গুলো অনেকটা চাড়ালের মত । মেয়ে হয়ে অন্য মেয়ের সাথে তার এমন ব্যবহার গুলো মেনে নেয়ার মত না । বেলী এখানে নিতান্তই অসহায় । তাই ছাড়তেও পারে না থাকতেও পারে না । ইরফানের মুখের দিকে তাকিয়ে পড়ে আছে সে । শত হোক সে তার স্বামী । বিয়ে তো তাকেও করেছে । থাকুক না সতীন ক্ষতি কি তাতে ? স্বামী সংসার কিছুই ছাড়তে পারবে না সে । এখানে দুটো জিনিস বাঁধা হয়ে দাঁড়ায় , এক গ্রামে তার শ্বশুরের সম্মান দুই তার নিজের মায়ের সম্মান । বেলী কাউকে বলতেও পারে নাই যে তার স্বামী বিয়ে আরেকটা করেছে এতে তার শ্বশুরের মান সম্মান সব যাবে আর তার মা হয়তো শোকটাই নিতে পারবে না । আর যাই হোক কোন মা নিশ্চয়ই চাইবে না তার মেয়ে আর যাই হোক সতীন নিয়ে যাতে সংসার না করে সেখানে তার মেয়ে নিজেই সতীনের সাথে থাকছে তাও এক বাড়িতে । এই শোকটা সে মানতে পারবে না । আবার ছেড়ে চলে গেলে আরও বদনাম । গ্রামের সবাই তার মায়ের মুখে চুনকালি মারবে । সব দিক দিয়েই বেলী আটকে পড়ে গেছে । পরিস্থিতি এত খারাপ যে এর বিকল্প কোন পন্থা নেই । যেই পন্থাতে যাবে তাতেই কোন না কোন বাঁধা ।
আর এদিকে মিনুর রুবিকে একদম সহ্য হয় না । মিনু ভেবে রেখেছে আজ ইরফান বাসাতে এলেই রুবির নামে সব বলবে । যা সত্যি তাই বলবে পারলে আরও বানিয়ে বানিয়ে বলবে । মিনু কথা দারুণ বানায় । বেলীকে নিজের রুমে ডেকে পাঠায় রুবি । বেলীও যায় সেই রুমে । বেলীকে রীতিমত চোখের বিষ ভাবে রুবি । কেন জানি তার সহ্য হয় না বেলীকে । তাই সেও চাইছে যে কোন একজন এই বাড়িতে থাকবে । আর সেই একজনটা সে-ই হবে । এর জন্যে যতটা করা লাগবে সে করবে যতটা নিচে নামার সে নামবে । বেলীকে দেখে তার মেজাজ আরও গরম হয়ে যায় তার । বেলীকে টর্চার করে রুবি এক রকম পৈশাচিক আনন্দ পায় তার কারণ , শত কিছু হয়ে গেলেও বেলী টু শব্দ করে না আর ইরফানের কাছে তো ভুলেও বলে না । আর এটারই সুযোগ নেয় রুবি ।

– তোকে যে আমি এতক্ষন ডাকলাম , কানের মধ্যে কি দিয়ে রাখছিস , শুনিস নাই ?
– আমি তো ডাকার সাথে সাথেই আসলাম ।
– বাপরে বাপ, ভালো চোপা লাড়াস তো তুই ? এত সাহস পেলি কোথা থেকে ?
– কিছু বলবেন ?
– কেন কষ্ট লাগে নাকি দাঁড়িয়ে থাকতে ?
– নাহ ,
– তা তোর বাড়িতে ইরফান ছিল ?
– হু ,
– ঘুমিয়েছে কই রাতে ?
– ঘরেই ।
– আর তুই ?
– আমিও ঘরেই ঘুমাইছি ।
– ওহ আচ্ছা এইজন্যই বলি ইরফান রাতারাতি মাগুর মাছ কোথায় পেলো ?

রুবির নোংরা মানসিকতার নোংরা ইংগিত টা বেলীর বুঝতে সময় লাগে নি । খুব বিশ্রী লাগছিল কথা গুলো শুনতে । তাই নিজেই সাহস করে দুইটা কথা বলে ,

– আপনি যা ভাবছেন তা নয় , এইসব কিছুই হয় নাই ।
– সব জান্তা হয়ে গেছিস দেখতেছি ।
– নাহ , শুধু যতটুকু বুঝার তাই বুঝছি , আর কিছু না ।

রুবির মেজাজ আরও খারাপ হয়ে যায় । বিশ্রী ভাষায় বেলীকে গালি দেয় সে । তারপর খাট থেকে এসে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দেয় বেলীকে । চড়টা খেয়েও বেলী সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে । একটা আওয়াজও করে নাই ।

– টিভির মধ্যে যেই রাক্ষুসি গুলা থাকে তেমন হলি তুই । ১০০ রঙ তোর , অভিনয় করস তুই । গ্রামে গিয়ে কি তাবিজ করছিস ইরফানকে , কি তাবিজ করছিস বল ।

রুবির কথা শুনে বেলী অবাক হয়ে যায় । এত শিক্ষিত হয়ে এত বাজে চিন্তা ভাবনা তার মাথায় আসে কিভাবে । তখন বেলী আবারও বলে ,

– যদি তাবিজ করার হতো আমি তার জীবনে আপনার আসার অপেক্ষায় বসে থাকতাম না । তার আগেই তাবিজ-তুমার করে নিজের বশে রাখতাম তাকে । আর আপনি তো তার স্ত্রী যাকে সে আব থেকে বেশি ভালোবাসে অথচ এই আপনি তাকেই বিশ্বাস করতে পারছেন না । এখানে আপনার বিশ্বাস ডগমগিয়ে যাচ্ছে

বেলীর কথা শুনে রুবি চুপ হয়ে যায় । ভাবতে থাকে ওর এত সাহস হয় কিভাবে , যে ও রুবির সামনে মানে তার সামনে দাঁড়িয়ে এত স্ট্রংলি কথা বলে যাচ্ছে । কিভাবে সম্ভব এটা ? সে চায় শুধু সে বলবে আর বেলীকে সব শুনতে হবে এবং মানতে হবে । বেলীকে চুপ করানোর জন্যে আরও বাজে ভাবে বেলীকে একিউজ করে রুবি ।

– অশিক্ষিত থার্ড ক্লাস মানুষ , কি যোগ্যতা আছে তোর যে তুই ইরফানের সাথে দাঁড়াবি । নিজের চেহারা আয়নায় দেখছিস , এই চেহারায় আসছে ইরফানের বউ হতে । ওর সাথে কেবল আমাকেই যায় তোকে নয় ।

এইবার বেলী আরেকটু বলে ,

– আলহামদুলিল্লাহ , আমি অনেক খুশি যে ওনার সাথে কেবল আপনাকেই যায় । আপনি শিক্ষিত দেখতেও সুন্দর । সব গুন আছে আপনার মাঝে তাহলে দাঁড়াতে কেন পারছেন না ওনার সাথে । বিশ্বাস কেন রাখতে পারছেন না ওনার উপর ।
– সেটা তোকে নিশ্চয়ই বলবো না আমি ।
– আইন অনুযায়ী আমি এখনও ওনার স্ত্রী , আমি থাকা অবস্থাতে উনি দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন এটা দিয়ে থানায় মামলা করলে কেইসটা আমার পক্ষেই আসবে । আর আমি পড়াশোনা কম করছি তাই বলে অশিক্ষিত নই । আর অহেতুক আমাকে জ্বালিয়ে কি লাভ বলেন তো ? আমি না আগেও আপনাদের মাঝে ছিলাম না এখনও আছি আর না ভবিষ্যতেও থাকবো । কোন কাজ থাকলে বলবেন আমি সব করে দিবো তবে এইসব বাজে কথা আর বলবেন না ।

এইসব বলে বেলী রুম থেকে বের হয়ে যায় । রুবি সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে এখনও অবদি । বেলীর কথা গুলো তার পুরো শরীরে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে । রুবি ভেবেছিল কি আর হয়েগেছে কি । বেলীর মুখে বুলি ফুটেছে । এইবার রুবির আরও সচেতনতার সাথে খেলতে হবে । এইসবই ভেবে যাচ্ছে রুবি ।

রুমের পাশে দাঁড়িয়ে সব কথা গুলো শুনছিল মিনু । রুবিকে বলা বেলীর কথাগুলো শুনে অনেক খুশি মিনু । এতদিন পর বেলী কিছু তো বলেছে রুবিকে । এটাই বা কম কিসের ? তাই সে আজ একটু হলেও অনেক খুশি । যতটা খুশি সে বেলীর উপর ততটাই ক্ষিপ্ত সে রুবির উপর । কারণ , রুবি আজকে একদম অতিরিক্ত করে ফেলছে । মিনু হাসি মুখে বেলীর রুমে যায় ।

– ভাবী ,,,,,,,,?
– হুম ,
– আইজ্জা তো ফাটাইয়া দিছেন আপনে ।
– কি ?
– ডাইনীটারে ইচ্ছামত কথা শুনাইছেন ,
– ডাইনী কেন বলো , সেও তো মানুষ ।
– মানুষ , কিন্তু কাজ কাম ডাইনীগো মত , তবে আপনে ভালা কাম করছেন শয়তান এইডারে ইচ্ছামত বলছেন ।
– একটা কথা কি জানো তো মিনু , দেয়ালে যখন পিঠ ঠেকে যায় তখন পিঠও কথা বলে । আমার অবস্থাটাও ঠিক ওই রকম । আমি চাই না সে বার বার তার আর ওনার মাঝে আমায় টানুক । আর দেখতে গেলে রুবি আপু তো বেশি হকদার এই সংসারের । আমি কে ?
– আপনে কে মানে ? আপনে তো ভাইয়ের বউ ।
– আমি বউ হলে কি আরেক বউয়ের দরকার পড়তো ওনার মিনু ? আমি তো আমার সবটা উজাড় করে দিয়েছিলাম কিন্তু লাভ কি হলো , বলতে পারো ?
– সবই কপালের দোষ ,
– কপালের দোষ বলেই তো টিকে আছি , একদিন দেখবে আমি আর থাকবো না ।
– এইডা কি কন ভাবী ?
– আমি এখনও থাকতে চাই না , কিন্তু যেতেও পারি না ।
– এডি কইয়েন না ভাবী ।
– যাও কাজ করতে যাও , শরীর টা ভালো লাগছে না আমার একটু ঘুমাবো ।
– আইচ্ছা ,
– আর শুনো , তোমার ভাই আসলে তাকে কফি করে দিও আমি আজ আর বের হবো না কেমন ?
– আইচ্ছা ভাবী ।

[ বিঃদ্রঃ বাস্তব জীবনে আমরা এমন অনেক পরিস্থিতিতে পড়ি যেখান থেকে ওভারকাম করা খুব কঠিন । কথা শুনতে শুনতে মস্তিষ্ক এমন অবস্থায় চলে যায় যেখানে না চাইতেও কথা বেরিয়ে আসে মুখ থেকে । আসলেই যেতে যেতে যখন পিঠটা দেয়ালে আটকে যায় তখন দিক বিক না দেখে না ভেবে পিঠাটাই কথা বলা শুরু করে দেয় । তেমন সাধু ব্যাক্তিও একবার না একবার বলবেই । যে হাজারো হাদিস জানে সেও একবার না একবার একটা হলেও গালি দিবে । আজ বেলীও তেমন , শুনতে শুনতে বড্ড বেশি তিক্ত সে । তাই আজ কয়েকটা কথা শুনিয়ে দিতে সেও বাধ্য হয় । বাঁচতে হলে এভাবেই হয়তো বাঁচতে হবে । যুদ্ধ করে নিজের জন্য হলেও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে । এটাই নিয়ম , সব কিছু নিয়তির উপর ছেড়ে দেয়া যায় কিন্তু নিজের আত্নমর্যাদা আত্নসম্মান নিয়তির উপর ছেড়ে দেয়া যায় না নতুবা নিয়তি বার বার ধোঁকা দিতে থাকে ]

বেলী বিছানায় শুয়ে আছে । শরীরটা আসলেই ভালো লাগছে না তার । পুরো শরীর কাঁপছে তার । শরীরটাও গরম হয়ে আছে । মনে হয় জ্বর আসবে । জ্বরের কথা ভাবতেই একটা কথা মনে পড়ে যায় বেলীর ।
সেদিনও বেলীর জ্বর ছিল , কিন্তু তবুও সেদিন সে কলেজে গিয়েছিল । মোড়ের মাথার সামনে সেদিন রাজু তার জন্যে অপেক্ষা করতেছিল । বেলী সেদিন আস্তে আস্তে হেটে যাচ্ছিলো আর তখনই ,

– কালচে ফুল,,,,,,,,,,,,,?
– কেহহহহহ ,
– কিরে কলিজা এত ছোট কেন তোর ?
– আপনারে না বলছি এমনে হুটহাট ডাক দিবেন না ।
– তোর কলিজা ছোট হইলে আমি কি করবো ,
– কি করবো মানে , আমার এগুলা ভালো লাগে না ।
– তোরে এমন দেখা যায় কি জন্যে , শরীর কি ভালো না ?
– উহু , জ্বর আইসা গেছে
– আহারে , কালির আবার অসুখও করে ।
– এমনে বলেন কেন ?
– তোরে রাগাইতে ভালোই লাগে আমার ।
– ধুর , বাইত যাই গা ।

সেদিন অনেকটা রাগ করেই বেলী চলে আসছিল রাজুর সামনে থেকে । সেদিন রাজুও হেসেছিল বেলীর রাগ দেখে তাই তো জোরে জোরেই বলেছিল ,

– ওই কালিইইইই , দাঁড়া যাস কই , আয় আমি ওষুধ কিনে দিবো
– আপনের ওষুধ আপনিই গিলেন ।

কথাটা শুনে রাজু অনেক হেসেছিল । রাজুর হাসিমাখা মুখটা আজও বেলীর চোখে ভাসে । এইসব ভাবতে ভাবতে বেলীর চোখে ঘুম নেমে আসে ।

রাত ৮ টার পর ইরফান বাসায় আসে । ক্লান্ত শরীরে কলিংবেল বাজানোর পর ভেবেছিল দরজায় বেলীর মায়াবী চেহারাটা দেখবে । কিন্তু দুর্ভাগ্য দরজা খুলে মিনু । মিনুকে দেখে বেশ খানিকটা অবাক হয় ইরফান ।

– কিরে তুই কখন এলি ?
– ১১ টার দিকে , খালি আমি একলা আই নাই আরও একজনও আইছে ।
– কে ?
– নিজে যাইয়াই দেখেন ,
– এক কাপ কফি করে দে ,
– আইচ্ছা ,
– বেলী কোথায় ?
– ঘুমায় ,
– এখন ?
– জানি না আমি

দরজা থেকে ভেতরে গিয়ে নিজের রুমে যায় ইরফান । রুমের ভেতরে গিয়ে খাটের উপর রুবিকে শুইয়ে থাকা অবস্থায় দেখে মেজাজ বিগড়ে যায় ইরফানের । হাতে থাকা মোবাইল টা রেখে রুবির সাথে কথা না বলেই বেলীর রুমে যায় ইরফান । বেলীর রুমে গিয়ে বেলীকে শোয়া অবস্থায় দেখতে পেয়ে কাছে গিয়ে বসে ইরফান । হাত ধরতেই দেখে বেলীর পুরো শরীর জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে । মুহুর্তের মাঝেই ইরফানের সাড়া মুখে চিন্তার রেখা ভেসে ওঠে । উদ্বিগ্ন হয়ে চিন্তিত গলায় বেলীকে কয়েকবার ডাকে ইরফান ।

– বেলী,,,,,,,,?
-………
– এই বেলী , বেলী
– হু,,,,,,,,,

হালকা স্বরে হু করে উঠে বেলী ।

.
.

চলবে…………………..

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_১৬

0

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_১৬
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

সকাল ৮ টা নাগাদ ইরফানের ঘুম ভাঙে । ফ্রেশ হয়ে রেডি হতে হতেই সাড়ে ৮ টা । টেবিলের কাছে গিয়ে দেখে পূর্বের ন্যায় বেলী সব নাস্তা সাজিয়ে রেখেছে । ইরফান আর তেমন কোন কথা বলে নি , নাস্তা খেতে বসে যায় সে । কিছুক্ষণ পর বেলী চা নিয়ে ইরফানের কাছে যায় । চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে ইরফান বেলীর দিকে তাকিয়ে আছে । বেলীকে একা রেখেও যেতে ইচ্ছা করতেছে না তার । অন্যান্য দিন তো মিনু বাসায় থাকে ৷ আজকে সেও নাই । মেয়েটা এখনও আসে নি বাসায় ।

– একা থাকতে পারবা ?
– হু ,
– ভয় লাগবে না ?
– উহু ,
– আমার আজ অফিসে যেতেই হবে না হয় আমি থাকতাম ।
– আমি যখন থাকবো না তখন ?
– মানে ?
– কিছু না , আপনি খান ।

ইদানীং বেলীকে অনেক অচেনা লাগে ইরফানের কাছে । বেলী কি বলে , কি করে , কি বলতে চায় , কি করতে চায় কিছুই বুঝে না সে । তবে বেলীর দিকে তাকিয়ে থাকলে একটা শান্তি আসে মনে তার । দেখতে দেখতে ইরফানের অফিসের সময় হয়ে যায় , তখন আর কিছু না বলেই ইরফান চলে যায় অফিসে । পুরো বাসায় আজ বেলী একা । একা মস্তিষ্কে অনেক কিছুই ভর করে । জানালার কাছে গিয়ে গ্রীলে মাথা ঠেকিয়ে আকাশ দেখছে বেলী । নীল আকাশে কয়েকটা পাখি উড়ে যায় । বেলীর নিজেকে পাখি মনে করতে চায় । পাখিরা যেমন স্বাধীন তেমনি সেও স্বাধীন হয়ে উড়তে চায় । যেখানে থাকবে না কোন কষ্ট , থাকবে না কোন গ্লানি । শুধু দুচোখ ভরা ভালোবাসা আর স্বপ্ন মাখা কিছু মিষ্টি অনুভূতি ।

তুমি উড়বে আকাশে মুক্ত বিহঙ্গ হয়ে
তুমি উড়বে আকাশে শত ভালোবাসার
তারা হয়ে
আমি চাই গো তোমায় আপন করে
যদি দেও একটু সাড়া ভালোবেসে

মুহুর্তের মাঝেই চারটা লাইন মনে পড়ে যায় বেলীর । বহুদিন আগে কেউ একজন মোড়ের মাথার দাঁড়িয়ে তার জন্যে এই চারটা লাইন বলেছিল । লাইনের সাথে সাথে মানুষটার চেহারা টাও মনে পড়ে যায় তার । সেদিনের মানুষটা আপন হতে হতেও হলো না ।
বেলীর রাজুর কথা মনে গেছে । ছেলেটা বড্ড মায়াবী ছিল । এক কথায় বেলীকে খুব পছন্দ করতো সে । তার কাছে বেলী শুধু বেলী ছিল না , তার কাছে বেলী ফুল হয়ে ছিল । বেলীকে সে ফুল বলে ডাকতো , শুধু ফুল । গায়ের রঙ হালকা শ্যামলা রঙের বলে সে বেলীকে কালচে ফুল নাম দিয়েছিল যদিও এটা মজা করে বলতো । এটা বেলীর জানা ছিল । একদিন কলেজ থেকে আসার পথে , পথ আগলে ধরেছিল রাজু । হাতে একটা ঠোঙা নিয়ে । আজও ডাকটা কানে ভাসে বেলীর । রাজুর ডাকে অনেক মায়া ছিল সেইদিন । যখন সে ‘ কালচে ফুল ‘ বলে ডাকতো বুকের ভেতরটা মায়ায় ছেয়ে যেতো । নিজের থেকে ছোট বলে তুই তুই করে ডাকতো বেলীকে সে । সেদিন দুপুরের পথ আগলে ধরাটা ছিল অন্যরকম ।

– কালচে ফুল,,,,,,,,,, দাঁড়া
-……………
– এই দাঁড়া ,
– আপনে আমারে কালচে ফুল ডাকেন কেন ?
– হুর কালি , কালিরে কালি বলবো না তো কি বলবো ?
– হুহ , তাইলে আর ডাকবেন না কখনো ।
– ওরে ওরে কালচে ফুল রাগও করে , ওই দেখো ঢ্যাং ঢ্যাং করে চলে যায় । দাঁড়া না প্লিজ ,
– কি হইছে ?
– এইটা নে ,
– কি এইটা ?
– খুলে দেখ ?

বেলী খুলে দেখে ঠোঙা ভর্তি বেলীফুল রাখা আছে । বেলীফুল গুলো একদম তর তাজা , একদম সতেজ । বেলীফুল গুলো নিজের হাতে পেয়ে বেলী নিজেকে সব থেকে খুশি মানুষ ভাবে সে সময় । ঘ্রাণ নিতে থাকে সে বার বার ।

– রাজু ভাই , আমার জন্যে আনলা ?
– হু ,
– কই থেকে আনলা গো ?
– আমার গাছের ,
– অনেক সুন্দর ফুল গুলা ।
– তোর কাছে এর সৌন্দর্যও ব্যর্থ রে ।

রাজুর কথায় হাসিমুখে মুহুর্তের মাঝেই লজ্জার আবরণ পড়ে যায় । ‘ আমি যাই ‘ বলে বেলী সামনে পা বাড়াতেই রাজুর ডাকে পা জোড়া আটকে যায় তার ।

– কি হইলো ?
– চলে কেন যাস ?
– বেলা বাইরা যাইতাছে , মায় বকবো পরে ।
– কালকে দেখা করবি ?
– কই ?
– মিয়াগো পুকুর পাড়ে ।
– ও মা গো , ওইদিকে যামু না , দেইখা ফেললে মায়ের কাছে খবর যাইবো গা লগে বাবার কাছেও ।
– তাহলে আসবি না ?
– পারলে আসমু ,
– ওই কালি দাঁড়া ,

..

কলিংবেলের আওয়াজে ধ্যান ভেঙে যায় বেলীর । এতক্ষন ভাবনার জগতে ছিল বেলী । অতীতের কিছু কিছু দিক হঠাৎ করে মনে পড়ে মনটাকে কখনো ভালো আবার কখনো খারাপ করে দিয়ে যায় । ওড়নাটা দুই পেচ করে পেচিয়ে মাথায় দিয়ে দরজার কাছে যায় বেলী । দরজা খুলতেই একটা চিৎকার শুনতে পায় বেলী ।

– আয়ায়ামিইইইইই আইয়া ফচ্চি ভাবীইইই
– আরে মিনু !
– হ হ আমি মিনু , আইয়া ফচ্চি ।
– এসো এসো , এত তাড়াতাড়ি কিভাবে আসলা ?
– ও মোর খোদা , আপনে কি কন ভাবী , কয়টা বাজে দেখছেন নি , ১১ টা বাইজ্জা গেছে ।

মিনুর কথায় বেলী ঘড়িতে নজর দেয় । আসলেই ১১ টা বেজে গেছে । কখন যে এত সময় পাড় হয়ে গেল বলতেও পারবে না সে । মিনু আবার তার কথার মেশিন স্টার্ট করে ফেলে ।

– ও ভাবী , কি ভাবেন এত ?
– কই না তো , কিছু না
– ভাইয়ে কই , গেছে গা কামে ?
– হুম ,
– আইচ্ছা কন কি কি কাম করতে হইবে ?
– কিছু করতে হবে না তুমি আগে রেস্ট করো ।
– আরে আমি ঠিকাছি , আইয়েন আইয়েন কইয়া দেন কি কি করা লাগবো ।

এমন সময় ইরফানের রুমের দিকে নজর যায় মিনুর । উকি দিয়ে দেখে রুবি নেই রুমে । এই আবার শুরু করে মেশিন ,

– খবিশডায় কই ,
– কে ?
– রুবি খবিশডায় কই আইয়ে না হেতি ?
– ছিহ মিনু এইসব বলো না , সে খবিশ না সে তো মানুষ তাই না ?
– থামেন থামেন , সতীনের গীত কইয়েন না , আইয়ুক নাইলে মরুক আমার কি , আমি কিডা , আমি তো কামের মাইয়া ।

মিনু মনে মনে ১০০ গালি দিতে দিতে রুবির গুষ্ঠির ষষ্ঠী পূজা করতে করতে কাজে লেগে যায় । বেলীও এইদিকে সব গুছিয়ে দুপুরের রান্নার কাজে লেগে যায় । আজান পড়ে গেলে গোসল করে নামাজে দাঁড়ায় সে । নামাজ শেষ করে মোনাজাত করে যেইনা দাঁড়িয়েছে , ওমনি আবার কলিংবেল বেজে ওঠে । বেলী জায়নামাজ টা রেখে দরজা খুলতে যায় । বেলী দরজা খুলে চমকে যায় । যদিও এটা চমকানোর মত কিছু না । এটা তো হওয়ারই ছিল । দরজায় রুবি দাঁড়িয়ে আছে । বেলীকে সাইডে ধাক্কা দিয়ে রুবি ঘরের মধ্যে ঢুকে যায় । রান্নাঘর থেকে আবার মিনু রুবিকে দেখে ফেলে ।

– শয়তানের নামডা যে কিত্তে নিছিলাম , শয়তানের নাম নিছি সকালে , শয়তান দুফুরে হাজির । এত মানুষ মরে এই শয়তান মরে না । অসিভ্য মাতারি একডা।

ইচ্ছামত রুবিকে বকতে থাকে মিনু । মোট কথা মিনু রুবিকে দেখতেই পারে না । তাই এত কটাক্ষ করে রুবিকে তবে তা অবশ্য রুবির অগোচরেই ।

রুবি এসেই পুরো বাসা মাথায় তুলে নিয়েছে । বেলীর সাথে অনর্থক বাড়াবাড়ি করছে সে । বেলীকে ইচ্ছে করেই বকছে , উউল্টাপাল্টা মুখে যা আসছে তাই বলে যাচ্ছে সে । তবুও বেলী একদম চুপ করে আছে । বেলীর নিজেকে এখানে এখন বড় বেশি অসহায় লাগে । এইভাবে নিংড়ে নিংড়ে মরতে হবে তাকে । অহেতুক চিল্লাচ্ছে রুবি বেলীর উপর ।

বিকেলের শেষের দিকে বেলী রুমে শুয়ে আছে । সারাদিন কাজ করে অনেক ক্লান্তু সে । কাজ করা আগেই শেষ হয়েছিল কিন্তু রুবি এসে আবার তার জামাকাপড় গুলো বেলীকে দিয়ে ওয়াস করায় । এই সব কাজ করতে কর‍তে বেলী খুব ক্লান্ত হয়ে গেছে । শোয়ার পরেও বেলীর চোখে ঘুম আসে নি । ঘুরে ফিরে মাথায় একই ভাবনা কাজ করে যায় । কি হবে তার ভবিষ্যত । কিভাবে থাকবে সে এখানে । এরই মাঝে রাজুর কথা মনে পড়ে তার । রাজুর সাথে শেষ দেখা হয়েছিল আজ থেকে প্রায় ১ বছর আগে যেদিন রাজু একেবারেই ঢাকা চলে আসবে তার আগের দিন সন্ধ্যায় । বেলীকে বাধ্য করেছিল সে তার সাথে দেখা করতে । সেদিন বেলী গিয়েও ছিলো তার সাথে দেখা করতে । চারপাশে অন্ধকার নেমে যায় আর সেই আঁধারের মাঝে চুপিসারে রাজুর সাথে কথোপকথনের ঢল পড়েছিল বেলীর ।

– এই কালি , এত দেরি করলি কেন রে
– তো কি করতাম ?
– মশার কামড় গুলা আমি খাইছি
– ভালো হইছে
-…………..
– রাজু ভাই,,,,,,,?
– হুম ,
– সত্যিই কি কালকে চইলা যাবেন ঢাকা ?
– হু
– আসবেন না আর ?
– আসবো তো ,
– রাজু ভাই ,,,,,,,,,?
– বল ,
– ভয় লাগে অনেক ,
– চাকরি টা আরেকটু পাকা পক্ত করে আবার আসবো তখন তোর বাবার সাথে কথা বলবো আমি ।
– সত্যি তো ?
– হ্যাঁ রে সত্যি , বল কি আনবো তোর জন্যে
– কিছু লাগবো না আমার ,
– কেন ?
– আপনে আসলেই হবে ।

কথা গুলো মনে পড়ে গিয়ে এক গাল হেসে দেয় বেলী । ওইটাই ওদের শেষ দেখা ছিল । কিন্তু পরক্ষণেই মনে পড়ে যায় সে এখন বিবাহিতা । তার স্বামী আছে আর রাজু এখন পর পুরুষ । তাই তার কথা মনে আনাও পাপ । কিন্তু বেহায়া মন টা কেন যেন বেশি করে মনে করিয়ে দেয় তাকে । পরিস্থিতি সব গোলমেলে লাগে বেলীর কাছে । সেই সময় সবে মাত্র মনটা রাজুতে বসেছিল আর তখনই নিয়তি ইরফানকে বসিয়ে দেয় । সেই থেকে সব টাই শেষ । ভাবনার সাথে বাস্তবতার মিল কখনোই ছিল না ।

– আমার নিয়তিই আমায় বার বার ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছে । আমি কি কখনো ভালো থাকতে পারবো না । কপাল টা খারাপ মানি কিন্তু এত খারাপ হবে ভাবি নি । আমার জীবন টা একটা কালো অন্ধকার যেখানে আলোর রেখা নিয়ে দাঁড়ানোর কেউই নেই ।

নিজে নিজেই কথা গুলো সাজাতে থাকে বেলী । ইদানীং মনটাই তার সব থেকে কাছের । মনের সাথেই সব বলা যায় । আত যাই হোক মন কখনো ধোঁকা দেয় না । এরই মাঝে রুবি অনেক জোরে জোরে বেলীকে ডাকতে থাকে ।

– বেলী , ওই বেলী , বেলী , মরছিস নাকি , সাড়া দেস না কেন ?

মরার কথা শুনে বেলীর মুখে একটা হাসি ফুটে উঠে ।

– হ্যাঁ , হয়তো একদিন আমাকেও এই রঙ্গমঞ্চের মায়া ত্যাগ করতে হবে । যত পারো নিংড়ে নাও আমায় । আমি কিছুই বলবো না !!

বেলী এইটা বলতে বলতে তাড়াতাড়ি রুবির কাছে চলে যায় ।

.
.

চলবে…………………….

[ বিঃদ্রঃ অতীত , বড় পিছুটান । অতীত দুই রকমের হয় । কখনো সুখের কখনো বা দুঃখের । যে অতীত মনে পড়ে মুখে হাসি আসে সেই অতীত মনে রাখা বাঞ্চনীয় । আর যে অতীত মনে পড়ে চোখের পানি আসে তা ভুলে যাওয়া কর্তব্য । কারণ অতীতের ছায়া বর্তমানের ভালো লাগা গুলোকে নিমিষেই শেষ করে দেয় । এখানে রাজুও তেমন , তবে রাজুর সাথে আদৌ বেলীর দেখা হবে কিনা তা জানা নেই । বেলীর মত আমরা হাজারো মেয়েরা এটা ভেবেই ব্যাকুল , অতীত ছেড়ে কিভাবে ভালো থাকবো । তবে বেলীরা বাবার দিয়ে যাওয়া কথা রাখতে মায়ের মান সম্মান দেখে নিমিষেই অতীত চেপে বর্তমানকে আপন করে নেই । এই বর্তমানে কেউ সুখী আবার কেউ বা বেলীর মত পিষে মরে প্রতিনিয়ত ]

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_১৫

0

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_১৫
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

গাড়ি আপন গতিতে ছুটে চলছে । শরীরটা তো সাথে যাচ্ছে কিন্তু মনটা গ্রামে মায়ের কাছে পড়ে আছে বেলীর । মায়ের সাথে শুধু একটা রাতই থাকতে পারলো মেয়েটা । আবার সেই ঢাকা শহরের ইট পাথরের মাঝে থাকতে হবে তাকে । বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত ৮ টা ৯ টা বেজে যাবে । বেলীর চুপচাপ বসে থাকা দেখে ইরফানও কিছু বলেনি । সেও হয়তো বুঝতে পেরেছে বেলীর মন খারাপ । তাই সেও বোবার মত বসে আছে বেলীর পাশে । রাস্তার পাশে গাছপালা আর মানুষজন গুলো ছুটে চলছে গাড়ির সাথে । একটু পরেই মাগরিবের আজান পড়ে গিয়ে সন্ধ্যা নামবে চারপাশে । প্রকৃতি তার দিনের আলো ভুলে গিয়ে গোধূলীর আলোয় নিজেকে মাতাবে আপনভাবে ।
হঠাৎই রাজুর কথা মনে পড়ে যায় বেলীর । রাজু মানুষটা এলো তো এলো এমন সময় এলো যেখানে সব কিছুই হাতের বাহিরে । রাজুকে খুব করে মনে পড়ছে বেলীর । রাজুর সাথে তার দেখা সে যখন ইন্টারে পড়ে । রাজু তখন শহরেই থাকতো , মানুষটা কাছে থেকেও দূরে চলে গেলো । ইরফানের ডাকে রাজুর ধ্যান থেকে বেরিয়ে যায় বেলী ।

– বেলী,,,,,,,,,?
– জ্বি
– কিছু খাবা ?
– নাহ ,
– কিছুই খাবা না ?
– উহু

ইরফান আর জোর করেনি তাকে । বেলী চলাচলের পথে কখনোই কিছু খায় না । ইরফান আবার নিজ থেকেই বলা শুরু করে ,

– মন খারাপ ?
– নাহ
– তাহলে চুপচাপ যে ?
– মায়ের কথা মনে পড়তেছে ।
– আবার যাইও এক সময় ,
– হু , রুবি আপু কি আজকে আসবে ?
– জানি না ,
– ফোন দেয় নাই ?
-…………..
– সে আপনার বউ , মান অভিমান ভুলে যান ।
– আর তুমি ?
– আমি তো আজ আছি কাল নেই । ঝরে যাওয়া ফুল কখনো আপন হয় না ।
– মানে ,,,,,,,,,,?
– কিছু না , আপনারা নিজেদের মান অভিমান মিটিয়ে নিন ।

বেলীর কথা শুনে ইরফান আর কথা বাড়ায় নি । বেলীর সব কিছুই ইদানীং অন্যরকম লাগে তার কাছে । আগের বেলী আর এখনকার বেলীর মাঝে অনেক পরিবর্তন । তবে আগের বেলী চুপচাপ ছিল এখনকার বেলীও চুপচাপ তবে এখনকার বেলী চুপচাপ থেকে এমন কথা বলে যা বুকের এপাশে ঢুকে ওপাশ দিয়ে বেরিয়ে যায় । বেলী আবারও চুপ হয়ে যায় , তাই সেও চুপ হয়ে যায় । নিজেকে ঘৃণিত পুরুষ মনে হয় তার এখন , এই শান্তু মেয়েটাকে সে এতদিন এত মারধর করেছে । অন্যায় তো অনেক করা হলো , এখন না হয় প্রায়শ্চিত্ত করা হোক । এইসব ভাবতে ভাবতে ইরফানের সময় কাটছে । আর অন্যদিকে গাড়ি ছুটে চলছে তার আপন গন্তব্যে ।

রাত প্রায় ৯ টা নাগাদ বাস স্ট্যান্ডে বাস এসে থামে । বেলীকে আস্তে আস্তে ডাকে ইরফান । বেলীর এই এক দোষ জার্নি করতে আসলে তার ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই জার্নি শেষ হয় । গাড়িতে উঠে এক ঘুম দেবে আর সেই এক ঘুমেই গন্তব্যস্থলে এসে সজাগ হয় । এর মাঝে গাড়ি তাকে পাতাল কিংবা স্বর্গে নিয়ে গেলেও সে বলতে পারবে না । ইরফানের ডাকে ঘুম ভেঙে এদিক ওদিক তাকায় বেলী ।

– নামবা না ? নাকি ঘুমাতে থাকবা ?
– ঢাকা চলে আসছি ?
– হুম , নামো । ঘুমালে আর কিছুই খেয়াল থাকে না তোমার ।
– এত ঘুম যে কই থেকে আসে আল্লাহ জানে ।
– নামো তাড়াতাড়ি ,
– হু ,

গাড়ি থেকে নেমে একটা সি এন জি ধরে ইরফান এক টানে বাসায় চলে আসবে বলে ।

– বেলী রাত ৯ টা ৩০ বাজে , এখন গিয়ে রান্না করবা কখন , এখানে কোথাও একটা খেয়ে নিলে ভালো হতো না ?
– বাসায় গিয়ে রান্না করেই খাওয়া যাবে ।
– তা যাবে কিন্তু আমি খুব ক্লান্ত , তোমার খাবার রান্নার আশায় বসে থাকবো না আমি ।
– আচ্ছা আপনি যা ভালো বুঝন ।
– হু

ইরফান ইচ্ছে করেই বলেছে কথা গুলো যাতে বেলী এই ব্যাপারে না করতে না পারে । তার শখ জেগেছে বেলীকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে খাবে আর যা রুবির সামনে কখনোই সম্ভব না । তবে সমস্যা ছিল বেলী এর আগে রেস্টুরেন্টে কখনো যায় নি । তবুও ইরফান চেয়েছে আজ সে যাক । তাই বেলীকে নিয়ে street 11 এ চলে যায় ইরফান । সেখানে লিফট ছিল , ইরফান ভেবেছে বেলী লিফটে চড়তে জানে না । তাই সে সিড়ি দিয়েই উঠতে চেয়েছিল । কিন্তু বেলী ইরফানকে চমকে দিয়ে লিফটের সামনে দাঁড়িয়ে যায় ।

– এখানে দাড়ালে যে ?
– উপরে যাবেন না ?
– হুম , কিন্তু এটা তো লিফট ?
– জানি আমি এটা লিফট , আমি আরও একবার লিফটে চড়ছিলাম ।
– কোথায় ?
– ঢাকাতেই ফুফুর বাসায় আসছিলাম একদিন বাবার সাথে । ফুফাতো ভাই বোন আমাকে নিয়ে কই জানি গেছিল সেখানে এমন ঘরের মত ছিল । তখন জানছিলাম এটা লিফট । আসেন এটায় করেই যাই উপরে ।

ইরফান বেলীর কথায় বেলীকে নিয়ে লিফটে চড়ে যায় । কয়েক সেকেন্ড পর লিফটের দরজা খুলে যায় । রেস্টুরেন্টটা একদম লিফটের দরজা বরাবরই । ইরফান বেলীকে নিয়ে রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকে যায় । পাশেই দুজনের একটা টেবিল রাখা আছে ।

– এখানের খাবার অনেক টেস্ট হয় , খেয়ে দেখো , ভালো লাগবে ।
– ওহ , আচ্ছা ।
– কি খাবা বলো ,
– আপনি যা খাবার আনাবেন তাই-ই খাবো ।
– খাবার আনায় না , অর্ডার করতে হয় ।
– ওহ তাহলে করেন ।
– তো কি খাবা বলবা না তুমি ?
– আমি তো জানি না কি পাওয়া যায় ?
– চাইনিজ খাবার , নাম শুনছো কখনো ?
– হ্যাঁ , শুনছি ।
– ওইটার সেট ম্যানু অর্ডার করি ?
– করেন ।

ইরফান দুটো সেট ম্যানু অর্ডার করে দেয় । বেলী রেস্টুরেন্টে হয়তো আসে নি তবে এইসব চাইনিজ , থাই , বাংলা , নাম জানে । কারণ সে ইন্টারমিডিয়েট অবদি পড়াশোনা তো করেছে । তাই ততটা সমস্যা হয় না ।

– তুমি চামচ দিয়ে খেতে পারবা ?
– চামচ দিয়ে খেতে হয় ?
– হ্যাঁ , চাইনিজ খাবার গুলো চামচ দিয়েই খেতে হয় ।
– ওহ ,
– পারবা খেতে , না হয় হাত দিয়েই খেও ।
– সবাই চামচ দিয়েই তো খায় তাহলে আমিও খাবো , সমস্যা নাই ।
– আচ্ছা ।

বেলী আবারও চুপচাপ হয়ে যায় । কিছুক্ষণ পর ওয়েটার পানি নিয়ে আসে । আর বেলীও পানি খেতে শুরু করে দেয় । ইরফান দেখে বুঝে যায় যে বেলীর হয়তো খুব পিপাসা পেয়েছে ।

– এত পানি খাচ্ছো কেন ?
– তেষ্টা পেয়েছিল ?
– গাড়িতে বললেই পারতা ?
-…………

ইরফানের এই কথার জবাব নেই বেলীর কাছে তাই সে চুপ করে বসে আছে । প্রায় ১৫ মিনিট পর ওয়েটার এসে খাবার দিয়ে যায় । বেলী প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছে । একপাশে ভাত এর মত কি যেনো আছে , অন্যপাশে সবজি , এক পাশে মুরগীর বড় একটা টুকরো , আর সাথে ঝোল ঝোল কি যেন আছে । তাকিয়েই আছে প্লেটের দিকে সে । মনে মনে বলতে থাকে ,

– এর থেকে ভালো ছিল ভাত মাছ একটা ভর্তা আর ডাল নিলে । পেট ভরে খাইতে পারতাম ।

বেলীর মনে মনে বলতে থাকা শান্তু চোখের চাহনিতে দেখে ইরফান পুরোটা বুঝিয়ে দেয় বেলীকে ।

– এটার নাম ফ্রাইড রাইস , অনেকটা ভাতের মতই , এটা ভেজিটেবল মানে সবজি , এটা মুরগীর একটা তরকারি এটাকে মাসালা চিকেন বলে আর এইযে বড় পিস টা আছে এটার নাম চিকেন ফ্রাই । চামচ দিয়ে খেতে পারলে খাও না হয় হাত দিয়ে খাও , কোন সমস্যা নাই ।
– হু ,

হু বললেও অনেকটা আন-ইজি ফিল হচ্ছিল তার । পরে দেখলো ইরফান চামচ দিয়ে খাচ্ছে । তাই বেলীও কাঁপা কাঁপা হাতে একটা চামচ তুলে নেয় । তারপর ইরফানকে অনুসরণ করে খাওয়া শুরু করে । এক চামচ মুখে দেয়ার পর বেশ ভালো স্বাদ পায় বেলী । খুব মজার ছিল খাবার টা । তাই ইরফানকে দেখে দেখে সবটা খাবার শেষ করে বেলী । ফ্রাই টা হাত দিয়েই খায় সে । তার পক্ষে চামচ দিয়ে খাওয়া সম্ভব না । খেয়ে হাতটা টিস্যু দিয়ে মুছে নেয় সে । ইরফানই বলেছিল মুছতে তাই সেও মুছে নেয় । হাত মুছার পর ইরফান বেলীকে কোক এর গ্লাসটা এগিয়ে দেয় । বেলীও একটু একটু করে কোক খায় । এর ফাঁকে ওয়েটার এসে বিল দিয়ে যায় । বেলী দেখলো ইরফান ১০০০ টাকার একটা নোট বের করে বিল বইয়ের ভেতরে দিয়ে ওয়েটারকে ডাক দেয় ।

– এক্সকিউজ মি,,,,,,,
– ইয়েস স্যার ,
– এখানে বিল দেয়া আছে উইথ টিপস ।
– থ্যাংকস স্যার ।
– হু ,

ওয়েটার বিল নিয়ে চলে যায় । বেলী অনেকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে । তার ভাবতে কষ্ট হচ্ছে যে দুইজন মানুষ খেলো আর তার বিল ১০০০ টাকা কিভাবে হয় । অথচ বেলী তো জানে না এইসব খাবারের দাম এমনই । ওইদিকে ইরফান তাড়া দিচ্ছে তাকে ।

– তাড়াতাড়ি কোক টা শেষ করো , সাড়ে ১০ টা বাজে অলরেডি ।
– তাহলে আর খাবো না ।
– কেন ?
– আর খাবো না ।
– আচ্ছা তাহলে উঠো ।
– জ্বি ,

ইরফান টেবিল ছেড়ে উঠতে উঠতে একটা কথা ভাবছিল যে , বেলী নিজেকে সব জায়গায় খাপ খাওয়াতে না পারলেও অন্যদের ছোট করে না বা নিজেও ছোট হয় না । মেয়েটার বুদ্ধি আছে ।
অন্যদিকে বেলী টেবিল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পিছনে ঘুরতেই একজনকে দেখতে পায় । সেই একজনকে দেখে বেলীর পায়ের তলার থেকে মাটি সরে যায় । ভদ্রলোক ওইপাশের একটা টেবিলে বসা আছেন৷ প্রায় ৪ জনের মত সাথে । প্রায় এক বছর পর বেলী আজ তাকে দেখতে পেলো । কলিজাটা মুহুর্তের মধ্যেই মুচড়ে উঠেছে বেলীর । এটা কেমন পরিস্থিতি , বেলী যে এখানে এইভাবে তাকে দেখবে
তা সে একবারের জন্যে ভাবে নি । মুখ থেকে আচমকাই বের হয় যায় ,

– রাজু ভাই,,,,,,,,,,,,?

ভাগ্যটা ভালো মুখ দিয়ে আওয়াজ টা আস্তে বের হয়েছে । তাড়াতাড়ি মুখ টা সরিয়ে নিয়ে সে । একটু আগেই যাকে কল্পনা করলো যার কথা মনে করে চোখের কোণায় পানি এলো সেই মানুষটাই এখন তার চোখের সামনে । হ্যাঁ ওই টেবিলে রাজু বসা আছে । বেলী কোন রকম তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসে সেখান থেকে । বেলী চায় নি রাজু তাকে দেখে ফেলুক । তাই সে সেখান থেকে সরে যায় ।

[ বিঃদ্রঃ পৃথিবীটা গোল , এখানে কারো সাথে কখনো না কখনো একবার না একবার দেখা হয়েই যায় । হোক সে শত্রু কিংবা হোক সে বন্ধু অথবা হোক সে একবার চোখের দেখা কোন একজন । পৃথিবীতে এমন অনেক সময় হয়ে যায় যেখানে যাদের সাথে দেখা না হওয়ার দোয়াটা কখনোই পূরণ হয় না । একবার না একবার দেখা হয়েই যায় । এটাই পৃথিবীর নিয়ম । আর এখানে রাজুর সাথে দেখা হওয়াটাও ঠিক ওইরকমই একটা ঘটনা মাত্র , যদিও রাজু বেলীকে এখনও দেখেনি । দেখলে হয়তো সেখানে ঘটনাটা অন্য রকম হতো , এইবার আসি রেস্টুরেন্টের বিষয়ে৷, আমাদের সমাজে এমন অনেকেই আছেন এখন অবদি রেস্টুরেন্টে যান নি । নিম্ন মধ্যবিত্তদের মাঝে যাদের অবস্থান তারা তো একেবারেই যান না । আর যারা যান তারা অনেক সময় নিজেকে সেখানে খাপ খাওয়াতে পারেন না বলে নিজের কাছেই নিজে লজ্জাবোধ করেন , কিন্তু না এখানে লজ্জার কিছু নেই । জরুরী নয় যে আপনাকে সব টা শিখতে হবে , আপনি যেমন আছেন তেমন টাই থাকার চেষ্টা করবেন । আপনি হাত দিয়ে খেতে অভ্যস্ত তাহলে অন্যের জন্যে অভ্যাস কেন পরিবর্তন করবেন । আপনি হাত দিয়েই খাবেন কারণ সব থেকে বড় কথা আপনি বাঙালি । বাঙালিয়ানায় নিজেকে রাখা ভালো , মাছে ভাতে বাঙালি যেমন হয় তেমন হাত দিয়ে খাওয়াই বাঙালির এক ঐতিহ্য ]

ইরফান আর বেলীর বাসায় আসতে আসতে রাত প্রায় ১১ টা বেজে যায় । বেলী সেই তখন থেকেই দম ধরে আছে । এইভাবে হঠাৎ রাজুকে দেখতে পাবে ভাবে নি সে । সে বাসায় এসেও একদম চুপচাপ হয়েছিল । ইরফান নিজের রুমে চলে যায় । বেলী কোন রকম তাড়াতাড়ি বোরখাটা খুলে পুরো বাসা ঝাড়ু দিয়ে ফেলে । ইরফানের রুমে এসে দেখে ইরফান ওয়াসরুমে । ইরফান তখন গোসল করছিল । বেলী তাড়াতাড়ি ইরফানের রুমের সব ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করে দেয় । তিন দিন পুরো বাসা বন্ধ থাকাতে হালকা ভাবসা গন্ধ হয়ে গেছে তাই বেলী পুরো বাসায় স্প্রে করে দেয় । এইসব কাজ করতে বেলী সময় নেয় ২০/২৫ মিনিট । বেলী কাজ খুব দ্রুত করতে পারে । ওইদিকে ইরফান গোসল করে বের হয়ে এসে দেখে তার রুম পুরো ফিটফাট । তার বুঝতে এক সেকেন্ডও লাগে নি এইসব বেলী করে গেছে । ইরফানের নিজেকে কেন জানি বেলীর আশেপাশে রাখতে ইদানীং খুব ভালো লাগে । বেলীকে কাছে পেতেও খুব ইচ্ছা করে কিন্তু স্বপ্নটা এখনও মাথায় জেকে বসে আছে । ইরফান টাওয়াল টা বিছানার উপর রেখে বেলীর রুমের দিকে যায় । আর বেলী সব কাজ শেষ করে ওয়াসরুমে ঢুকে যায় গোসলের জন্যে । ইরফানের টাইমিংটা বিফলে যায় । ইরফান রুমে আসার এক মিনিট আগেই বেলী ওয়াসরুমে ঢুকে যায় । ইরফান এসে পুরো রুম খালি দেখে ওয়াসরুমের দরজার দিকে তাকায় । বুঝতে পারে বেলী ওয়াসরুমে গোসল করতেছে । তাই সেও বসে পড়ে বিছানায় । আজ যদি ভেজা শরীরে বেলীকে একবার দেখা যায় ক্ষতি কি ? ইরফান বেলীর রুমের আশপাশ টা ভালো মত খেয়াল করে । বেলী তার এই বাসায় বিগত ৭ মাস যাবত আছে কিন্তু ইরফান একদিনের জন্যেও খোঁজ খবর নেয় নি বেলী কেমন আছে কিংবা বেলীর কিছু লাগবে কিনা । যা চাওয়ার তাও চাইতো বহু কষ্টে । বেলীর রুমে তেমন কিছুই নেই একটা খাট , তাতে স্বস্তা একটা তোশক আর দুইটা বালিশ , একপাশে একটা আলনা রাখা । আলনাটা এই বাসাতেই রাখা ছিল , আগের ভাড়াটিয়াদের ছিল , সে বেলীর জন্যে কিছুই আনে নি কখনো , এ নিয়ে বেলীরও কোন অভিযোগ ছিল না । এইখানেই বেলীর দোষ , বেলী নিজের জন্য কখনো কিছু দাবী করে না , আর ইরফানের কাছে তো কখনোই না ।

প্রায় ১৫ মিনিট পর বেলী ওয়াসরুম থেকে বের হয় । বের হয়ে খাটে ইরফানকে বসা দেখে অনেকটাই অবাক সে । রাত ১২ টা বেজে গেছে । অথচ ইরফান এখনও ঘুমায় নি কাল তো তার অফিস । অন্যদিকে ইরফান বেলীর দিকে তাকিয়ে আছে , গোসল করে বেলীকে একদম স্নিগ্ধ আর পবিত্র মনে হচ্ছে । এক দৃষ্টিতে এইভাবে ইরফানের তাকিয়ে থাকাটা বেলীকে ভেতর থেকে গ্রাস করে দিচ্ছিল । তাই ইরফানের সামনে থেকে সরে যায় বেলী । আলনার কাছে এসে কাপড় গুছাতে গুছাতে কথা বলা শুরু করে বেলী ,

– ঘুমান নাই এখনও , কাল না অফিস আপনার ?
– হু ,
– তাহলে ঘুমিয়ে পড়েন ।
– কেন তোমার সমস্যা হচ্ছে নাকি ?
– উহু ,

ইরফান উঠে বেলীর কাছে যায় । দুই হাত দিয়ে বেলীর কাধে হাত রাখে সে । ইরফানের এইভাবে স্পর্শ করায় কেঁপে ওঠে বেলী ।

– অন্যায়ের পাল্লা টা কি খুব বেশিই ভারী বেলী ?
-……………….
– কি হলো বলো ?
– আমরা তো এখন ঢাকাতে , আপনি তুই করেই বলেন

ইরফানের মেজাজটা সাথে সাথে বিগড়ে যায় । সাথে সাথে সে বেলীকে ধাক্কা মেরে দূরে সরিয়ে দেয় । বেলীও হালকা স্মিত হেসে তাকায় ইরফানের দিকে ।

– বলেছিলাম না আবেগ দিয়ে সব চলে না , দেখলেন তো । মুহুর্তেই আমার জন্যে নিজের মনে কিভাবে ঘৃণার জন্ম হয় । কাল হয়তো রুবি আপু আসলে এই ধাক্কাটাই লাথিতে রুপ নিবে । আমি নিজেকে মানিয়ে নিছি । আপনি যান ঘুমিয়ে পড়েন ।

চোখে পানি আর ঠোঁটে হালকা হাসি রেখে ইরফানের দিকে তাকিয়ে কথা গুলো বলে দেয় বেলী । ওই মুহুর্তে বেলীকে দেখে ইরফানের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছিলো । বেলীকে তখন একদম অন্য রকম লাগছিল । মনে হচ্ছিলো আল্লাহ পাক যেন তাকে নিজ হাতে গড়ে ইরফানের সামনে দাড় করিয়ে দিয়েছে । ইরফান সোজা রুম থেকে বেরিয়ে যায় । আর নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দেয় , সেই দরজাতেই নিজের হাত দিয়ে এক ঘুষি মারে , বেলীকে এই হাত দিয়েই ধাক্কা মারলো আবার সে । কেন যে রাগটা বশে থাকে না তার । অন্যদিকে বালিশে মুখ চেপে কাঁদে বেলী । একে তো এই পরিস্থিতি তার উপর আজকে এতদিন পর রাজুকে দেখা , আর এখন আবার ইরফান । সব মিলিয়ে বেলী পাগল প্রায় ।

– বাবা দেখতেছো তো তোমার বেলীফুলের কত কষ্ট এখানে । ও বাবা , বাবা আমায় নিয়ে যাবা তোমার কাছে ? তুমি আর তোমার বেলীফুল একসাথে থাকবে বাবা । আর পারি না বাবা , আর পারি না । বেলীফুলের শান্তি নাই বাবা , বেলীফুলের শান্তি নাই ।

এইভাবেই কাঁদছি আর বিলাপ করছে বেলী । তারপর একে টা সময় ঘুমিয়ে যায় বেলী । এই ঘুমটাই এখন তার সঙ্গী । ঘুমে থাকলেই সে সব ভুলে থাকে । তাই হয়তো একেবারেই ঘুমাতে চায় সে ।

.
.

চলবে……………….

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_১৪

0

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_১৪
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

সকাল বেলা প্রায় ৯ টায় ইরফানের ঘুম ভাঙে তাও বেলীর ডাকে । বেলী কয়েকবার ডাকে ইরফানকে । ঘুম থেকে উঠে ভ্যাবলার মত বেলীর দিকে তাকিয়ে থাকে ইরফান । কাল রাতের স্বপ্নটা এখন অবদি তার মস্তিষ্কে ঘুরপাক খাচ্ছে । ইরফানকে এমন দেখে বেলী প্রশ্ন করে ,

– কি হইছে ,
-………..
– এই যে , কি হইছে , এইভাবে তাকিয়ে আছেন যে ?
-…………
– এই যে , কি হলো ? উঠেন , নাস্তা বাড়ছি
– তু,,,তুমি যাও , আমি উঠতেছি ।

বেলী ইরফানের কথায় চলে যায় । আর ইরফান খাটে বসে কাল রাতের স্বপ্নটা নিয়ে ভাবতে থাকে । এটা কি স্বপ্ন ছিল , এমন ভয়াবহ স্বপ্ন তাও বেলীকে নিয়ে । এর আগে কখনো দেখে নি ইরফান । প্রায় ১০ মিনিট পর সে বিছানা থেকে নামে । কল পার গিয়ে দেখে বেলী আগে থেকে ইরফানের জন্যে ব্রাশ , পানি , টাওয়াল সব এনে রাখছে । ইরফান শুধু গিয়ে মুখ ধুবে । বেলীর সব কাজ কেন জানি ইরফানের খুব ভালো লাগে । কিন্তু স্বপ্নের কথা আবারও মনে পড়ে যায় তার ৷ তবুও নিজেকে শক্ত রেখেছে সে । হাত মুখ ধুয়ে ঘরে গিয়ে বসে ইরফান । বেলী নাস্তা দিয়ে রাখছে আর নিজেও সেখানে দাঁড়িয়ে আছে । ইরফান নাস্তা খেতে বসেছে ।

– তুমি খেয়েছো ?
– হু
– বাবা কই ?
– বাজারে গেলো দেখলাম ।
– আচ্ছা শুনো সব গুছাও , বিকেল ৪ টার গাড়িতে যাবো আমরা ।
– সব গুছানোই আছে ।
– ওকে , এটা কি রান্না করছো ?
– দই পেতেছিলাম ।
– কখন আমি যে দেখলাম না ?
– রাতেই পেতে রাখছিলাম ।
– ওহ , এত গুন পাও কই ?
– তবুও মন পাওয়ার গুন নাই,,,,,,,,,,

বেলীর কথাটা আস্তে আস্তে বললেও ইরফানের কানে ঠিকই গেছে । ইরফানের কান হচ্ছে হরিণের কানের মত । খাড়া খাড়া কান তাই তো আস্তে কথাও কানে যায় । বেলী সব কিছু গুছিয়ে রেখে রান্নাঘরের দিকে যায় । ওইদিকে কাজের মহিলাটাও চলে আসে । বেলী তার সাথে কথায় লেগে যায় ।

– কেমন আছেন খালা ?
– আলহামদুলিল্লাহ ভালা আছি , তুমি কিরাম আছ ?
– আমিও ভালো , খালা আপনাকে কি বাবা বেতন কম দেয় ?
– না তো ,
– তাহলে খালা ঘরবাড়ি এত নোংরা রাখেন কেন ? আমি কাল এসে দেখি এই অবস্থা । আজকে সকালে বাবার রুমের , ইরফানের রুমের , সামনের রুমের চাদর পর্দা সব ধুয়ে দিছি । মাকরসার বাসা গুলাও পরিষ্কার করেন না । বাবার বয়স হইছে খালা । আপনার ভরসায় তো তার ছেলে তারে এইখানে রাখছে তাই না ?
– আমি তো সব করি-ই ।
– আপনি সব করলে আমাকে সব করতে হইতো না খালা । বয়স্ক মানুষ একটু দেখে শুনে রাখবেন খালা ।
– আইচ্ছা , আর কি কি কাম আছে কও আমি কইরা দিয়া যাই ।
– আজকে আর কোন কাজ নাই , সব কাজ শেষ করে ফেলছি আমি ।
– এত তাড়াতাড়ি ?
– আমি সেই ভোরে থেকে সব কিছু করছি খালা , আমরা আজকে চলে যাবো । আপনি বাবাকে দেখে রাইখেন খালা , আর কাল থেকে আইসেন ।
– আইচ্ছা , তাইলে আমি যাইগা ।
– আচ্ছা , যান ।

জানালা দিয়ে সবটা শুনে নেয় ইরফান । বেলী সব দিক দিয়েই সম্পূর্ণা । কাজে কর্মে , আচার ব্যবহারে । কেন যেনো আগে বেলীকে মনে ধরলো না ইরফানের । এটা ভেবেই ইরফান এখন মাথা ফাটায় । সবাই ঠিকই বলে বেলী আসলেই ফুল । সদ্য কলি থেকে ফোঁটা এক নিষ্পাপ ফুল , এক নিষ্পাপ বেলীফুল ।

দুপুর প্রায় ১২ টা নাগাদ রুবির ফোন । ইরফান তখন পুকুর ঘাটে বসা , রুবির ফোনগুলো সে দেখতে পাচ্ছে কিন্তু আজকে ইচ্ছে করেই ফোন ধরছে না সে । তার ভালো লাগছে না রুবির সাথে কথা বলতে তাই সে ফোন ধরে নি । প্রায় ৭/৮ টা ফোন দেয় রুবি । ইরফান তখন ফেসবুকে ছিল , রুবি ফোন দেয়ার পর ফেসবুক লগ ইন করে ইরফানকে এক্টিভ দেখতে পায় । ঢাকায় বসা রুবির মাথায় আগুন ধরে যায় । উলটাপালটা টেক্সট করতে থাকে ইরফানকে সে ।

– আমি ফোন দিলে তুমি ফোন ধরো না কেন ?
– আমাকে এখন মজা লাগে না তাই না ?
– লাগবে কিভাবে , এখন তো বউ আরেকটা কাছে আছে , তাই না ?
– গ্রামে বসে থেকে কার বাল ফালাও ?
– বেলী এত ভালো কিভাবে হলো , এইনা ওরে দেখতে পারতা না ?
– ওহ বুঝতে পারছি , বিছানায় ভালো ঝড় তুলতে পারে , তাই না ?
– তা কেমন এঞ্জয় করো , ও-কে যখন খাও ?
– তুমি তো দারুণ খেলোয়াড় , এক সাথে দুইটারেই খেতে পারো , ক্ল্যাপ হবে তোমার জন্য ।
– গাছেরও খাও তলার টাও কুড়াও , বাহ ।
– তোমার সেক্স পাওয়ারের তারিফ করতে হয় , ট্রাস্ট মি । দারুণ পাওয়ার তোমার । ওরে প্রেগন্যান্ট করেই ঢাকাতে নিয়ে এসো , কেমন ?

রুবির মুখ থেকে এমন অশ্লীল আর নোংরা ভাষাগুলো আর সহ্য হয় নি ইরফানের । একজন উচ্চ শিক্ষিত মেয়ের মুখ থেকে এইসব নোংরা মানসিকতার অশ্লীল ভাষা কিভাবে আসে এটাই সন্দেহের । ইরফানের শরীর তখন রাগে কাঁপতে থাকে , এই মুহুর্তে যদি রুবি তার সামনে থাকতো তাহলে সে রুবিকে জবাই দিতো । ইরফান সাথে সাথে ফোন দেয় রুবিকে । রুবিও ফোন রিসিভ করে । ইরফান রুবিকে হ্যালো বলারও সুযোগ দেয় নি । ফোন ধরার সাথে সাথে শুরু করে ইরফান ,

– তুই কি মানুষের বাচ্চা ?
– ওই খবরদার ,
– এই চুপ , জানোয়ার মেয়ে , বেয়াদব মেয়ে কাকে কি বলস তুই , কাকে কি বলস ?
– তোকেই বলি , বুঝোস না তুই ?
– ওয়াও , তুই এখন আমাকে তুই তুকারিও করস ?
– করবো না , তুই করস কেন ? আমাকে কি বেলী পাইছস নাকি তুই ?
– ভাগ্যিস , ভাগ্যিস তুই বেলী না । কারণ তুই বেলীর পায়েরও যোগ্য না ।
– খবরদার ইরফান মুখ সামলাও ,
– এই আমার নাম মুখে নিবি না তুই , তুই এইসব কি লিখছিস , তোর মুখ এত নোংরা কেন ? তুই না ইংলিশে গ্রেজুয়েশন করছিস , তোর মুখ এত খারাপ কেন ?
– তো আমি এত খারাপ এখন ?
– আলবাত খারাপ , শুধু খারাপ না তুই স্বার্থপর মহিলা । তুই কেমন মেয়ে হলে কিভাবে নিজের স্বামীর সেক্স পাওয়ার নিয়ে কথা বলিস , ছিহ !
– ও বলাতে এখন খারাপ হয়ে গেছি ?
– এটা কি ভালো কথা ছিল , কসম আল্লাহর তুই আমার সামনে থাকলে এতক্ষনে তুই জবাই হয়ে যাইতি রে । শুকুর আদায় কর তুই ।
– আমার গায়ে হাত তুলে দেখো খালি একবার , হাতটা মুচড়ে ভেঙে দিতে ক মিনিটও লাগবে না আমার ।
– এতেই বোঝা যায় তুই কত ভালো । কেন এখন হাত ভেঙে দিবি কেন , আমি যখন তোর কথায় বেলীকে মারতাম তখন খুব মজা লাগতো তাই না ?
– বড্ড বেশি বেলী বেলী করতেছো ? আমিও দেখবো কয়দিন এই বেলী থাকে ?
– যে মেয়ের মুখ থেকে এত নোংরা ভাষা বের হয় সে আরও জঘন্য হতে পারে । আর হ্যাঁ , রুবি শুন , বেলী বড্ড বেশিই বোকা না হয় এতদিনে আমি আর তুই জেলে থাকতাম । কারণ আমিই সব থেকে বেশি অপরাধী ওর কাছে । আর যেই পাওয়ারের কথা বললি না তুই ? তাহলে শুন আমি এই ইরফান আহমেদ এখন অবদি শুধু তোকেই ছুয়েছে । আর রইলো কথা সেক্সের , ওইটাও তোর সাথেই করছি তুই ব্যাতিত এখন অবদি অন্য কারো সাথে আমার কিছুই হয় নাই না হয়েছে আমার বিবাহিত বউ বেলীর সাথে না হয়েছে অন্য কারো সাথে । তোর মুখ এত খারাপ এত খারাপ যা ভাবতেও অবাক লাগে । আপাতত আমাকে না করবি ফোন আর না করবি ম্যাসেজ , ভালো থাক ।

ইরফান লাইনটা কেটে দেয় । তার প্রচুর পরিমাণ রাগ উঠেছে । তাই যতটুকু পেরেছে আপাতত ফোনে ঝেড়েছে বাকিটা ঢাকাতে গেলে ।

[ বিঃদ্রঃ কথায় আছে শিক্ষাই আদর্শ , কিন্তু বর্তমানে শিক্ষিত মানুষরাই পশুর মত আচরণ করে । একজন মেয়ে তার উপর শিক্ষিত কিন্তু তার মুখ থেকেই বেরিয়ে আসে যত রকমের নোংরা আর অশ্লীল ভাষা তাও নিজের স্বামীর প্রতি । বর্তমান যুগে এইসব কিছু মেয়ে/মহিলা আছে যাদের শিক্ষার অভাব নেই কিন্তু মনুষ্যত্বের বড় বেশি অভাব । কারণ এরা দম্ভের চোটে নিজেদের অনেক বড় কিছু মনে করে । আর এদের সাথে মিলেও তেমন । ইরফানের মত পুরুষরা পরে এইভাবেই ধরা খায় । নিজে বেশি বুঝলে এইরকম হওয়াটাই অনিবার্য ]

ইরফান পুকুর ঘাট থেকে বাড়ির ভেতরে এসে দেখে তার পাশের বাড়ির চাচাতো ফুফাতো বোনেরা সবাই মিলে বেলীকে ধরেছে । বেলীকে খেলতে বলতেছিল সবাই ।

– ভাবী আসো খেলি ?
– কি খেলবো ?
– কিত কিত ,
– নাহ গো , একটু পরে আজান দিবে আর বাবাও চলে আসবে । গোসল করবো , নামাজ পড়বো ,
– আজান দিতে এহনও এক ঘন্টা বাকি ,
– তোমরা খেলো আমি দেখি ,
– আগে তো খেলতা ভাবী , ঢাকা যাইয়া পাল্টাইয়া গেছো ।
– এমন কিছুই না গো ,
– তাইলে খেলো ,
– আচ্ছা তাড়াতাড়ি করো , বাবা আসার আগে । ৯ এর ঘর বানাও
– চারকোণা খেলবা নাকি ক্রস খেলবা ভাবী ?
– চারকোণা টাই বানাও ,
– আইচ্ছা

বেলীর এক ননদ কিত কিতের ঘর বানিয়ে ফেলেছে । ইরফান দূর থেকেই সব দেখছিল । ইরফান আর সামনে এগিয়ে যায় নি । কারণ সে জানতো তাকে দেখলে বেলী আর খেলবে না । তাই সে দূরেই দাঁড়িয়ে আছে আর দেখছে বেলী কিভাবে খেলে ।

– এই শুনো আমি আগে খেলবো কিন্তু ,
– কেন ভাবী ,
– কি কেন , আমিই আগে খেলবো ,
– তাইলে তো আমরা হাইরা যামু , তুমি তো একেবারেই সব শেষ দেও ।
– আউটও হইতে পারি ?
– তুমি আর আউট ,
– আমিই আগে খেলবো , দেও ।

তারপর বেলী গুটি নিয়ে খেলা শুরু করে । এক্কা দোক্কা তিনকা এক এক করে নয় পর্যন্ত খেলে দেয় । বেলী বরাবর এইধরনের গ্রাম্য খেলা ভালো খেলতে পারে । ওড়নাটাকে পেচিয়ে খুচে তারপর খেলে সে । খেলার সময় লাফানোর জন্য চুল গুলো খুলে যায় বেলীর । তখন তাকে একদম গায়ের মেয়ের মত লাগছিল । ইরফান আর এক মুহুর্তের জন্যেও দেরি করে নি । তাড়াতাড়ি মোবাইলটা বের করে বেলীর কয়েকটা ছবি তুলে । মুগ্ধ নয়নে বেলীর ছেলে মানুষী দেখছে ইরফান । এক সময় আজান পড়ে যায় আর তাদের খেলাও শেষ হয়ে যায় । বেলী তাড়াতাড়ি মাথায় কাপড় দিয়ে ঘরে চলে যায় । লাফানোর কারণে পানির পিপাসা পেয়ে যায় তার । তাই পানি খাওয়ার জন্যে ঘরে যায় সে ।
ইরফান তখন ঘরে গিয়ে বেলীর দিকে চেয়ে আছে । দিনের পর দিন এ যেন এক নতুন বেলী তার সামনে ধরা পড়ছে । তার সামনে এই বেলীফুল একদম চুপচাপ শান্ত কিন্তু অন্যদের সাথে এই বেলীফুল একদম অন্যরকম । দুই জায়গায় দুই রকম চরিত্র তার । ইরফানকে চেয়ে থাকতে দেখে বেলী তাকে ডাক দিয়ে উঠে ।

– কিছু বলবেন ?
-…………
– এই যে ,,
– হু ,
– কিছু বলবেন ?
– এক্কা দোক্কা তো ভালোই খেলতে পারো ।

ইরফানের কথায় থতমত খেয়ে যায় বেলী , তার মানে ইরফান তার খেলা দেখে ফেলছে । তাই তাড়াতাড়ি করে সেইখান থেকে উঠে যায় সে ।

– কল পাড়ে আপনার জন্য পানি তুলে দিতেছি আপনি গোসল করতে আসেন ।

এই বলে বেলী উঠে যায় , তখনই ইরফান হাতটা ধরে নেয় বেলীর ।

– এই বেলীফুল সবার সামনে এত প্রাণবন্ত আর চঞ্চলা তাহলে আমার সামনে এত নুয়ে থাকে কেন ?

বেলী কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে তারপর মাথা তুলে ইরফানের দিকে তাকায় । বেলী অত্যন্ত শান্ত নজরে ধীর গলায় বলে উঠে ,

– এই বেলীফুল আগে হেসে উঠতো , আর এখন এই বেলীফুল প্রতিনিয়ত ঝরে যাচ্ছে । ঝরতে ঝরতে এক সময় হয়তো ঝরেই যাবে । কারণ এই বেলীফুল আর সতেজ নেই এই বেলীফুল হলো ঝরে যাওয়া বেলীফুল ।

.
.

চলবে……………….

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_১৩

0

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_১৩
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

নামটা শুনেই ধপ করে পুকুর ঘাটেই বসে পড়ে বেলী । আজ প্রায় ১০ মাস পর রাজুর কথা আবার মনে পড়লো বেলীর । নিঃশব্দ মুখে শান্ত চোখ জোড় বেয়ে ক্রমাগত পানি গড়িয়ে যায় গাল বেয়ে বেলীর । সারাদিনের পর ক্লান্ত শরীরটা তার এই কথাটার জন্য প্রস্তুত ছিল না । এমন সময় ময়না আবার বলে উঠে ,

– আমি তো পুরাই অবাক হইছিলাম ফোন পাইয়া ।
– কি কইলো সে ?
– তোর কথা জিগাইছে ,
– কি ,,,,,?
– শুনলাম বেলীর বিয়ে হইছে , বেলী কি এখন ঢাকা থাকে ? – এই সব বললো ,
– কি বললি তুই ?
– আমি বলেছি আমি সঠিক জানি না ।
– ভালো করছিস , কখনো বলিসও না ।
– তার কাছে হয়তো ভালোই থাকতি তুই , জানিস চাকরি করে একটা , অনেক ভালো টাকা বেতন পায় ।
– আমি এখন অন্যের বউ রে , এইসব শুনাও গুনাহ । জেনে শুনে গুনাহ কিভাবে করি ।
– ১০ মিনিট কথা বলছিল ৭ মিনিটই তোর কথা বললো ।
– আমার কথা কখনো বলিস না , তার সামনে কখনো হয়তো যাইতে পারবো না ।
– এটা রাখ ,
– কি এটা ?
– রাজু ভাইয়ের নাম্বার ,
– এটা আমার কোন কাজেই লাগবে না , বাদ দে ।
– রেখে দে বেলী , যদি কখনো ভালো লাগে কথা বলে নিস ।

এই বলে ময়না কাগজের টুকরো টা বেলীর হাতে দিয়ে দেয় । তারপর বেলীর সাথে আরও কিছুক্ষণ কথা বলে ময়না বিদায় নেয় । বেলী তখনও ঘাটে বসা । আসর আজান পড়ে যায়৷ কানে আজানের আওয়াজ পেতেই লাফিয়ে উঠে সে । তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে যায় । আজ সন্ধ্যার পর হয়তো তাকে শ্বশুরবাড়িও যেতে হবে কারণ রহমান আলী চান এক রাত তার কাছেও থাকবে তার ছেলে আর ছেলের বউ । বাড়ি এসে নিজের রুমে যায় বেলী । ইরফান তখন ওইদিক ফিরে শুয়ে আছে । আজ সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে মানুষটা । তাই হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে । এইটা ভেবে বেলীও চুপচাপ কোন শব্দ ছাড়া কাজ করে । আস্তে করে নিজের পার্সের মধ্যে ময়নার দেয়া কাগজের টুকরোটা রেখে দেয় । তারপর অযুর উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায় রুম থেকে । কল পার থেকে অযু করে ঘরে এসে নামাজ আদায় করে নেয় বেলী ।
সন্ধ্যা হতে আর বেশিক্ষণ সময় নেই । বেলী সব গুছিয়ে নিয়েছে । কালকেই আবার ঢাকা ফিরতে হবে তাদের । আবার সেই বন্দী জীবন । নিজের স্বামী আর সতীনের সংসারে ফিরতে হবে তাকে । অপরদিকে রাজুর কথা বার বার মনে পড়ে যাচ্ছে । এদিকে ইরফানও খেয়াল করছে বেলী কেমন জানি চুপচাপ হয়ে গেছে । কিন্তু সে কিছু বলেনি বেলীকে ।
মায়ের থেকে একেবারে বিদায় নিয়ে বেলী আর ইরফান বেরিয়ে পড়ে । একটা রিক্সা ধরে উঠে যায় বেলী আর ইরফান । ১০ মিনিটের রাস্তা , তাই বেশি একটা ঝামেলাও হয়নি পৌঁছাতে তাদের । বেলী পুরো রাস্তা চুপচাপ ছিল । ইরফান প্রথমে ভেবেছে তার মায়ের জন্যে মন খারাপ তাই সে আর তেমন কিছু বলে নি ।
বাড়ি পৌঁছে শ্বশুরকে সালাম করে নেয় বেলী । ঘরের ভেতরে গিয়ে বেলী একটু অবাক হয়ে যায় । পুরো ঘর‍টাই এলোমেলো হয়ে আছে । অথচ ইরফান একজন কাজের মহিলা ঠিক করে দিয়েছিল । সেই মহিলা থাকা স্বত্ত্বেও ঘরবাড়ির এই অবস্থা । তাই ইরফান রাগারাগি করে । অন্যদিকে বউয়ের হাতে রান্না খাবেন বলে রহমান আলী বাজার করে এনেছেন বিকালেই । তা দেখেও ইরফান ফোপাতে থাকে । এখন এই সন্ধ্যার পরে বেলীকে আবার চুলার কাছে যেতে হবে । গ্যাস হলে সমস্যা ছিল না কিন্তু সমস্যা হচ্ছে মাটির চুলা বলে । কিন্তু বেলী একবারের জন্যেও বলেনি যে তার রান্না করতে সমস্যা হবে । তাই বুদ্ধি করে আগে আগে ইরফানের রুমের বিছানার চাদর পালটে নতুন চাদর বিছিয়ে পুরো রুম পরিষ্কার করে দেয় বেলী । নয়তো দেখা যাবে ইরফান রাতে বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকবে কিন্তু রুমে আসবে না । এক ঘন্টার মত সময় নিয়ে সব পরিষ্কার করে দেয় বেলী । আর কাল সকাল সকাল উঠে পুরো বাড়ি পরিষ্কার করে দিয়ে যাবে । কারণ তারা দুপুরের বাসে যাবে । এরই মাঝে রহমান আলী ডাক দেয় বেলীকে ।

– বউমা ,,,,,,,, ও বউমা ,,,,,,,,,?
– জ্বি বাবা ,
– এখন কি রান্না করবা ? নাকি কালকে করবা ।
– বাবা এখনি যাইতেছি আমি পাকেরঘরে । আপনার ছেলের রুমটা পরিষ্কার করলাম একটু বাবা ।
– ওহ ,
– বাবা , খালা কি কাজ করে , সব কিছু এমন এলোমেলো কেন বাবা ?
– কি জানি মহিলায় কি ছতরবতর কাজ করে , বুঝি না আমি ।
– আচ্ছা কাল সব বুঝিয়ে দিয়ে যাবো আমি ।
– আচ্ছা ,

শ্বশুরের সাথে কথা বলে বাজারের ব্যাগ নিয়ে বেলী রান্না ঘরে যায় । রান্নাঘরে সব কিছুই রাখা আছে তাদের । এইদিকে ইরফান ওদের বাড়ির ঘাটে বসে আছে । এরই মাঝে রুবির ফোন আসে । আশেপাশে তাকিয়ে ফোন রিসিভ করে ইরফান ।

– হ্যাঁ ,
– কবে আসবা ?
– কাল ,
– তাহলে আমায় এসে নিয়ে যাবা ।
– অসম্ভব , নিজে যেমন গেছো ঠিক তেমন আসবা ।
– মানে কি ?
– মানে আমি যা বললাম তাই । নিজে গেছো আর নিজেই আসবা ।
– আর যদি না আসি ?
– তাহলে আলহামদুলিল্লাহ আমি বেঁচে যাবো ।
– এত সোজা ?
– রাখছি ,

লাইন কেটে দেয় ইরফান । ইদানীং রুবিকে তার অসহ্য লাগে । ইচ্ছে করেই কথা বলে না সে রুবির সাথে । কেন জানি বেলীর আশেপাশে থাকতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে ইরফান । ইরফানের মনের ঘরে তারই অজান্তে এখন বেলীর বিচরণ । তার মনে এক এক সময়ে এক এক ভাবনা , কখনো মন চায় বেলীকে নিয়ে হারাতে ওই দূর অজানাতে আবার কখনো মন চায় নিজেই হারাতে বেলীর মাঝে । বেলীর মাঝে কিছু তো একটা আছে যা ইরফানকে খুব করে টানে ।
মোবাইল টা অফ করে বাড়ির মধ্যে ঢুকতেই দেখে উঠানের এক সাইডে রান্নাঘরে আলো জ্বলছে । ইরফান পা বাড়াতেই দেখে বেলী রান্না করে । একা হাতে এই রাতের বেলা রান্না করছে মেয়েটা । ঢাকাতে তো মিনু সাহায্য করতো কিন্তু এখানে তো একদম একা । বেলী এতইটাই শান্ত যে বেলীর হাতে ঘটি বাটিও শব্দ করতে পারে না । ইরফান কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঘরের ভেতর চলে যায় । নিজের রুমে ঢুকে সে রীতিমত অবাক হয়ে যায় । সব কিছু পরিষ্কার , বিছানার চাদর থেকে শুরু করে রুমে যা যা ফার্নিচার ছিল সব পরিষ্কার করা । এমনকি রুমের পাপসটা পর্যন্ত পরিষ্কার করা । ইরফানও বুঝে যায় এটা বেলী ছাড়া অন্য কারো কাজ না । ইরফান বুঝে উঠতে পারে না , বেলী এত কাজ করে কিভাবে । বেলীর জায়গায় রুবির কাছে যদি তার বাবা আজকে রান্নার আবদার করতো হয়তো এই জীবনেও তার বাবার সেই আবদার পূরণ হতো না । আর সে জায়গায় বেলী বিনা কথায় সব করে ।
এইসব ভাবতে ভাবতেই বেলীর ডাক পড়ে ,

– শুনছেন ,,,,,,,?
-………..
– শুনছেন , ঘুমিয়ে গেছেন ?
– ওহ তুমি , চোখটা লেগে আসছিলো ।
– খাবার বাড়ছি , খেতে আসেন ।
– হু ,

ইরফান বেলীর কথা ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল তার নিজেরই খেয়াল নেই । হয়তো এরই মাঝে বেলীর সব রান্না হয়ে গেছে । ইরফান আর দেরি না করে খেতে চলে যায় সেখানে ইরফানের বাবা ৷ রহমান আলী তার জন্যে অপেক্ষা করছে ৷

ইরফান ও রহমান আলী খাবার খাবে এমন সময় রহমান আলী বেলীকে তাদের সাথে খেতে বলে ,

– বউমা ,,,,,,,?
– জ্বি বাবা ,
– আমাগো সাথে খেয়ে নেও ,
– আপনারা খান বাবা , পরে আমি খেয়ে নিবো ।
– পরে তুমি কি একা একা খাবা নাকি মা , এখনই বসে পড়ো ।
– বাবা আপনারা খান ,
– বাবা বলতেছে তো বসার জন্যে , বসে খেয়ে নিলে কি হবে তোমার ?

ইরফানের এমন কথায় ভয় পেয়ে যায় বেলী । কারণ কথাটা একটু জোরেই বলেছে ইরফান । তাই রহমান আলীও ইরফানকে ডাক দেয় এই ব্যাপার নিয়ে ।

– ইরফান , বউমাকে ধমকাস কেন তুই ?
-…………….
– আমি তো বলতেই আছি , মাতাব্বরি করবি না একদম , এটা আমার মা ।
মা তুমি বসো , আমার সাথে কয়টা খেয়ে নেও ।

শ্বশুরের কথায় বেলীও খেতে বসে যায় । রহমান আলীর অনেকদিনের শখ ছিলেন লাউ চিংরি খাবেন তা আজ বেলী পূরণ করে দিয়েছে । ইরফানের জন্যে আলাদা করে মাছ ভুনা আর চিকেন ঝোল করেছে , আর তার বাবার জন্যে লাউ চিংরি , পুটি মাছ ভাজা , চিংরি ভর্তা করেছে বেলী । বেলী শুধু একটু ভর্তা দিয়ে অল্পকয়টা ভাত খেয়েছে । ইদানীং খাওয়ার প্রতিও তার অরুচি ধরে গেছে । কিছুই খেতে ভালো লাগে না তার ।

– কিরে মা , এই কয়েকটা ভাত নিলি ?
– বাবা এই কয়টাই বেশি ।
– হায় হায় বলে কি ? এমনে খেলে তো অসুস্থ হয়ে যাবি ।
– নাহ বাবা আমি ভালোই আছি ।

ইরফান আড় চোখে নজর দিয়ে বেলীকে দেখে । কিছু তো একটা হয়েছে বেলীর । কেমন জানি লাগছে তাকে , বেলী তো এইভাবে থাকে না । শান্ত থাকে কিন্তু এমন ভাবে থাকে না এটাই ইরফানের খটকা লাগছিল । ইরফান আর কিছু না বলে চুপ করে খেয়ে উঠে যায় । এইদিকে বেলীও সব গুছিয়ে রেখে রুমে যায় । ইরফান তো খাটে শুয়ে মোবাইল টিপছে । ইরফানের দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে বেলী । এই সেই রুম আর এই সেই খাট যেখান থেকে ইরফান বাসর রাতেই তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় আর বলেছিল ” তুই যদি এক বাপের জন্মের হয়ে থাকিস আমার আশেপাশেও ঘেষবি না ” । কথাটা আজও মনে আছে তার । আর তারপর একদিন ভুলবশত দুধ পড়ে যাওয়ায় জুতা মেরেছিল । নিয়তি বড্ড বেশি খেলা করে গেছে বেলীর সাথে । নিয়তি বেলীর কাছ থেকে শুধু নিয়েই গেলো বিনিময়ে কিছু দিয়ে গেলো না । এইসব কিছুক্ষন ভেবে তারপর ফ্লোরেই মাদুর পাততে থাকে বেলী । বেলীর মাদুর পাতা দেখে ইরফান তাকিয়ে থাকে বেলীর দিকে । তারপর অত্যন্ত ঠান্ডা মাথায় নিচু স্বরে বেলীকে ডাক দেয় ইরফান ,

– বেলী,,,,,,,,?
– জ্বি ,
– মাদুর কেন পাতো ?
– এখানেই শুবো ,
– বিছানায় কি হয়েছে ?
– আমি এক বাপের জন্মের ।

কথা শুনেই ইরফান কিছু উপলব্ধি করতে পারে । আর তখনই খাট থেকে নেমে বেলীর কাছে যায় সে । বেলীর বাম হাত টা ধরে আর বলে ,

– কোন রকম তামাশা চাই না , খাটেই শুবে তুমি , যাও ।
– আমি এখানেই ঠিক আছি ।
– এমন আছাড় দিবো , যাও খাটে ।

তবুও বেলী দাঁড়িয়ে আছে সেখানে । ইরফানের মেজাজ খারাপ হয়ে যায় । টানতে টানতে বিছানার কাছে নিয়ে যায় সে বেলীকে । তারপর জোর করে শুইয়ে দেয় বেলীকে ।

– যদি উঠেছো তো , আমার থেকে খারাপ কেউ হবে না ।
– এভাবে জোর করলে কি মুখের কথাটুকু ফেরত নিতে পারবেন । কথায় আছে , বন্দুকের গুলি , ধনুকের তীর , ফেলে দেয়া থুতু আর মুখের কথা কিছুই ফেরত যায় না , শুভ রাত্রি ।

এইটুকু বলে বেলী চোখ বন্ধ করে ফেলে । ইরফান কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে বেলীর দিকে । তারপর নিজেও এপাশে এসে শুয়ে যায় । একটা সময় সেও ঘুমিয়ে যায় ।

গভীর রাতে ইরফানের ঘুম ভাঙে কারো কান্নার শব্দে । ইরফান ঘুম থেকে উঠে দেখে বেলী পাশে কাঁদছে । এত রাতে কি জন্যে এইভাবে কাঁদছে সে , প্রশ্নটা মাথাতে এলেও তাৎক্ষনিত সে কি করবে বুঝতে পারছিল না । অন্যদিকে বেলীও ঢুকরে কাঁদছে । ইরফানের আর সহ্য হয় নি ইরফান বেলীর কাধে হাত দিয়ে বেলীকে এক পাশ থেকে সোজা করে শুইয়ে দেয় ,

– কি হয়েছে ?
-……….
– এত রাতে কাঁদতেছো কেন ?
-………..
– বেলী কি হয়েছে বলো ?
– একটা দাড়িপাল্লা , তার দুটো পাল্লার এক পাশে সুখ আর অন্যপাশে দুঃখ । মাপলে কেন দুঃখের পাল্লাটাই ভারী হয় , বলতে পারেন ?

বেলীর এমন কথায় স্তব্ধ হয়ে যায় ইরফান , ড্রীম লাইটের আলোতে ইরফান বেলীকে দেখছে নিবিড় ভাবে । বেলীর চোখের পানিগুলো চিক চিক করতেছে ।

– বলুন না , কেন সুখের চাইতে দুঃখের পাল্লাটা ভারী হয় ?
– বেলী কেঁদো না
– আমার সুখ চাই ,
– বেলী !!
– হ্যাঁ , আমার সুখ চাই । আজকে আপনার কাছে আমি আমার অধিকার টুকু চাই । দেবেন ?
-…………..
– এই বলেন না , দিবেন ?
-……………
– আমি সহ্য করতে পারি না , এইভাবে থাকতে আমার খুব কষ্ট হয় । আমি মরে যাবো এইভাবে থাকতে থাকতে ।
– বেলী কি সব বলছো ?
– শুনেন না , আজ আমায় একটু ভালোবাসবেন ?
-………….
– এই আমার দিকে দেখেন , আমার আপনাকে চাই , আপনার এই শরীরটা আমার চাই , আপনার অংশ চাই আমি ।
-……………
– শুনতে পাচ্ছেন আপনি , আমার আপনাকে চাই । এতদিন পর আজ চাইছি আপনাকে , দিবেন না আমায় আপনাকে ?
-…………
– ইরফান এইদিকে দেখেন , এক রাতের জন্যে চাই আপনাকে । এই শরীরটা আপনার শরীরকে চায় ইরফান । আমার দিকে তাকান ।
-………….
– ইরফান চুপ করেই থাকবেন ? কিছু বলবেন না ? ইরফান এমন যেন না হয় , আপনি আসলেন আমার কাছে কিন্তু আপনাকে পাওয়ার জন্য আমিই রইলাম না ।

ইরফান আর কথা না বলে থাকতে পারেনি , ওই অবস্থাতেই বেলীকে জড়িয়ে নেয় ইরফান । বেলীও ইরফানকে জড়িয়ে নেয় । আজ বেলী ধরা দিয়েই দেয় তার ভালোবাসার কাছে । ইরফানের স্পর্শ পেয়ে বেলী আরও আঁকড়ে ধরে ইরফানকে । আজ বেলী কাঁদছে , ঢুকরে কাঁদছে আর ইরফানকে বলছে ,

– ইরফান আজ কোন কথা না বলি , আজ শুধু ভালোবাসুন । কোন শর্ত ছাড়া ভালোবাসুন আমায় ।

বেলীর কথায় ইরফান বেলীকে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে । নিজের গায়ের কাথাটা সরিয়ে বেলীর কাথার নিচে ঢোকে ইরফান । বেলীর গায়ের ওড়নাটা সরিয়ে নেয় সে । বেলীর কপালে আলতো করে ভালোবাসার পরশ একে দেয় ইরফান । বেলীর নিঃশ্বাস যেন সেখানেই বন্ধ হয়ে যায় । বেলীর হাতের বন্ধনে নিজের হাত আবদ্ধ করে নেয় ইরফান । শরীরের নিচে দু জোড়া পা একে অপরকে জড়িয়ে নেয় । ইরফানের ডান হাতটা বেলীর গাল গলা কাধ স্পর্শ করে যায় । এক সময় হাতটা বেলীর পিঠে চলে যায় । বেলীর বাম কাধ থেকে ইরফান জামাটা টেনে নিচে নামিয়ে নেয় । বেলী যত শক্ত করে পারে আঁকড়ে ধরে ইরফানকে ।
বাহিরে ডাহুক পাখি ডেকে উঠে , সাথে ঝিঝি পোঁকার শব্দ । আজ আকাশে পূর্নিমার চাঁদ উঠেছে । সেই আলোয় দুটো শরীর মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে । ভালোবাসা গুলো জানান দিচ্ছে । পুরো ঘর জুড়ে চাপা আর্তনাদ । আজ কারো মুখেই কথা নেই শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ ছাড়া । মিলনের মাঝে ক্লান্ত শরীরে ইরফান যখন বেলীকে জড়িয়ে নেয় ঠিক তখনই বেলীর নিঃশ্বাস জোরে জোরে পড়া শুরু করে । একটা সময় বেলীর পুরো শরীর ঠান্ডা হয়ে যায় । বেলী দুই হাত দিয়ে ইরফানের বুকে চেপে ধরে রাখে আর শ্বাস ফেলে । মনে হচ্ছিল তার শ্বাস কষ্ট হচ্ছে । ইরফান বেলীর গালে হাত দিয়ে বেলীকে সেন্সে ফেরানোর চেষ্টা করে । বেলী কথা বলার শক্তিটুকুও হারিয়ে ফেলে । চোখে দিয়ে স্রোত বইছে পানির । ইরফান বুঝতে পারে বেলীর হাত পা সব ঠান্ডা হয়ে গেছে । ইরফান উঠে বেলীর হাতে পায়ে মালিশ করছে । কিন্তু বেলীর শ্বাস আরও বেড়ে যায় । গলা কাটা মুরগির মত তরপাচ্ছে বেলী । কিন্তু কিছুই করতে পারছে না ইরফান । বাবা বাবা বলে কয়েকবার নিজের বাবাকে ডাকে ইরফান কিন্তু তার বাবারও খবর নেই । ইরফান বেলীর হাত পা টিপে দেয় , ডোলে দেয় , বেলীর মুখে শ্বাস দেয় । হঠাৎ বেলী কেশে উঠে । ইরফান বেলীর দুই গাল তার দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে নেয় । ইরফান বুঝতে পারছে যে বেলীর খুব কষ্ট হচ্ছে । মুহুর্তের মাঝে শরীরের সব উত্তেজনা শেষ হয়ে যায় । বেলী বহুত কষ্টে কিছু কথা বের করে মুখ থেকে তবে শ্বাসকষ্টের জন্য সব টা আসে না কথা তবুও চেষ্টা করে সে ।

– বলেছিলাম না , সময় হয়তো না ও থাকতে পারে । আপন করে নিতে আমায় , কত মেরেছেন আমায় , কত আঘাত দিয়েছেন , এখন আপনি মুক্ত , আমি আপনাকে মুক্ত করে দিয়ে চলে গেলাম ।

ইরফান অশ্রু চোখে বেলীকে বার বার ডাকছে । আর বেলীর শ্বাস আরও বেড়ে গেছে , ইরফান বেলীকে বার বার ঝাকড়াচ্ছে কিন্তু এক সময় বেলী নিস্তেজ হয়ে যায় । হাত জোড়া ইরফানের বুক থেকে সরে খাটের মধ্যে পড়ে যায় । ইরফান কয়েকবার বেলী বেলী বলে চিৎকার করে কিন্তু বেলী আর সাড়া দেয় না । নাকের কাছে হাত নিতেই দেখে বেলীর আর নিঃশ্বাস পড়ছে না । বেলী মারা গেছে । হ্যাঁ বেলী মারা গেছে । বেলীর চোখে দিয়ে দম গেছে । শান্ত চোখে ইরফানের দিকে তাকিয়ে আছে সে । এই অন্ধকারেই বেলী তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে ।

..

ঘামার্ত শরীর নিয়ে ইরফান লাফিয়ে উঠে । বেলী বলে চিৎকার করে উঠে সে । তবে সেই চিৎকারের কোন শব্দ হয় নাই । সব কথা যেন আজ ভেতরে রয়ে গেছে । ইরফান এদিক সেদিক তাকায় । নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করে সে । পুরো শরীর কাঁপছে তার । কপালে ঘাম জমে গেছে । তাড়াতাড়ি উঠে লাইট জ্বালায় ইরফান । বেলী তখন ওইদিকে মুখ ফিরিয়ে ঘুমিয়ে আছে । ইরফান দৌড়ে গিয়ে বেলীর পাশে দিয়ে নিচে ফ্লোরে বসে পড়ে । ভালোভাবে বেলীকে দেখছে সে । তারপর বেলীর নাকের কাছে নিজের হাত নিয়ে দেখে । নাহ বেলীর নিঃশ্বাস তো ঠিকই আছে । বেলীর গায়ের কাথাটা হালকা সরিয়ে বেলীর শরীরের দিকে তাকায় সে । শরীরে জামাকাপড় তো ঠিকই আছে । তাহলে তখন এইটা কি ছিল । ইরফানের শরীর তখনও কাঁপছে ।
কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর ইরফান অনুভব করতে পারে যে সে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল । হ্যাঁ , ইরফান স্বপ্ন দেখছিল এতক্ষন ধরে । এক ভয়ার্ত স্বপ্ন , যা কল্পনাতেও আনতে পারেনি সে । এটা কেমন স্বপ্ন দেখলো সে যেখানে তারই সামনে তারই বাহুতে বেলীর মৃত্যু ঘটে গেলো । সে খাটের পাশে টেবিলের উপর পানি দেখতে পায় । গলাটা তার শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে । নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে মনে হচ্ছে তাই সে দ্রুত জগ দিয়েই পানি গুলো খেয়ে নেয় । খুব ভয় করছে তার , এটা কেমন স্বপ্ন দেখলো সে ।

– এটা কি দেখলাম আমি , এমন তো আগে কখনো হয় নি আমার সাথে । স্বপ্নে কারো মৃত্যু দেখলাম তাও বেলীর মৃত্যু । এমন লাগছে কেন ?

মনে মনে বলতে থেকে আবারও বেলীর দিকে যায় সে । মাঝে একবার ঘড়িতেও চোখ বুলায় সে । রাতের শেষ ভাগ চলছে এখন । কিছুক্ষণ পরেই হয়তো মোরগ গুলো ডাকাডাকি করবে । প্রায় ভোরের দিকেই স্বপ্নটা দেখেছে সে । অনেকের কাছে শুনা ভোরের স্বপ্ন নাকি সত্যি হয় যে কোন দিন । যদি এটাও সত্যি হয়ে যায় ? এইসব ভাবা বন্ধ করে আবারও বেলীর পাশে এসে ফ্লোরে হাটু গেড়ে বসে ইরফান । বেলীকে ভালো করে দেখে নেয় সে । আবার চেক করে নাকে হাত দিয়ে । শ্বাস পড়ছে কিনা । তবে সব কিছুই ঠিক আছে । বেলী ঘুমাচ্ছে , শান্ত হয়েই ঘুমাচ্ছে সে ।
ইরফান উঠে লাইট অফ করে দেয় । তারপর আবার শুয়ে পড়ে । কিন্তু তার শরীর এখনও কাঁপছে । বুকটা ধুক ধুক করছে তার । ইরফানও হালকা পাতলা দোয়া দুরূদ পারে । তাই ঘুমানোর আগের দোয়া ” আল্লাহুম্মা বিসমিকা আমুতু ওয়াহিয়া ” পড়তে থাকে । তারপর কোন ফাঁকে যে ঘুমিয়ে পড়ে সে নিজেও জানে না ।

.
.

চলবে…………………

[ বিঃদ্রঃ স্বপ্ন , খুবই ক্ষুদ্র একটা শব্দ । যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন একটা অস্পর্শনীয় অনুভূতি । কথায় আছে শরীর ক্লান্ত থাকলে কিংবা সারাদিন আপনি যা ভাববেন বা কল্পনা করবেন তা রাতে ঘুমানোর পরে আপনার ঠান্ডা মস্তিষ্কে ঘুরপাক খায় । এবং সেই কল্পনাকেই আপনি ঘুমের মাঝে দেখতে পান । এটাই হলো স্বপ্ন । স্বপ্নকে স্পর্শ করা যায় না শুধু অনুভব করা যায় । এই স্বপ্ন আবার কয়ক রকম । আপনি যেমন ভাববেন তেমনটাই দেখবেন । কখনো ভালো স্বপ্ন , কখনো খারাপ স্বপ্ন , এইগুলা নিত্যদিনের ব্যাপার । এর মাঝে আবার কারো কারো স্বপ্ন সত্যি হয় আবার কারো কারো স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায় । অনেক সময় দেখা যায় , ভালো স্বপ্ন পূরণের চাইতে খারাপ স্বপ্নটাই সত্যি হয়ে যায় । আবার অনেকের মধ্যে দেখা যায় নিজের স্বপ্নটা সত্যিও হয়ে যায় । আল্লাহ পাক চাইলে সব সম্ভব । আমরা তো তার বান্দা মাত্র । তবে আমি বলবো , স্বপ্ন যেটাই দেখুন না কেন , ভালো কিংবা খারাপ নিজেকে শক্ত রাখুন । যদি স্বপ্ন নিজের মন মত হয় তাহলে তাকে বাস্তবে রুপদান করার জন্যে কঠোর পরিশ্রম করুন । আর স্বপ্ন খারাপ হলে তাকে এড়িয়ে যান । দৈনিক ৫ ওয়াক্ত সালাত আদায় করুন । আল্লাহ পাক নিশ্চয়ই শান্তি প্রদান করবেন । আল্লাহ পাক বলেছেন , আমি তোমাকে সৃষ্টির সেরা জীব বানিয়েছি , তোমার মস্তিষ্কে জ্ঞান দিয়েছি । তুমি সেইভাবেই অগ্রসর হও । ফলাফল তুমি আপনা আপনিই পাবে । কিন্তু আমরা কয়জন এইসব মানি ? আবার যারা মানার তারা ঠিকই মানে ।
মৃত্যু , প্র‍ত্যেক জীবকেই মৃত্যুর স্বাদ ভোগ করতে হবে । তাই আজ মৃত্যুকেও আনলাম তার কারণ , আমাদের কখন কোথায় আর কিভাবে মৃত্যু লিখা আছে আমরা কেউই বলতে পারি না । তা একমাত্র মহান আল্লাহ পাক জানেন । আমি শুধু বোঝাতে চেয়েছি মাত্র যে কাছের মানুষকে অবহেলা করতে নেই । সময় থাকতেই তার হাত ধরে ফেলা উচিত । নয়তো দেরি হয়ে যায় । তখন মন খুলে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ টাও হয়তো থাকে না । আল্লাহ পাক সবাইকে হেদায়েত দান করুন । আমীন ]

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_১২

0

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_১২
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

রুবির ফোনটা দেখে মুখে বিরক্তি চলে আসে ইরফানের । ফোনটা সে ইচ্ছে করেই রিসিভ করেনি । তাই রুবি ফোন দিয়েই যাচ্ছে তো দিয়েই যাচ্ছে । এই যাবত ১০ বার ফোন দিয়ে ফেলেছে । তাই বাধ্য হয়েই ইরফান ফোনটা রিসিভ করে নেয় ।

– হ্যালো ,
– হ্যাঁ কি হয়েছে ?
– ফোন ধরতে তোমার এতক্ষন লাগে ?
– আমি কি আপনার ফোনের আশায় বসে আছি নাকি ?
– তা কার আশায় বসে আছো , তোমার আরেক বউয়ের দিকে ?
– তোমার মত আজাইরা কাজ নাই আমার , ওকে ?
– কাল শুক্রবার , আমায় এসে নিয়ে যাবা ।
– কেন ? যেমন গেছো , তেমনই আসবা , আর হ্যাঁ আমি গ্রামে আসছি ।
– বাহ বাহ , আমি নেই আর এই সুযোগে ?
– এই সুযোগে মানে , কি এই সুযোগে ?
– কয়বার গেছো তার সাথে বিছানায় ,
– তোমার মত থার্ড ক্লাস চিন্তা ভাবনা নিয়ে আমি কিংবা সে বসে নেই , অত্যন্ত জরুরী কাজে গ্রামে আসছি আর সেও আসছে আমার সাথে ।
– বাসরটা পারলে করে নিও ,
– হ্যাঁ করবো , তোমার সমস্যা ? তোমার সাথেও তো করি , এখন না হয় তার সাথেও করলাম ?
– করো , তোমার মত পুরুষ কয়জন আছে যে এক সাথে দুইটাকেই খায় ।
– স্যাট আপ ইউ ফুল , লজ্জা করে না নিজেকে এত স্বস্তা বানাতে । এই তোরা কি খাওয়ার জিনিস যে আমি খাই ? আর হ্যাঁ এখজ বললে তো বলতে হয় জানতিস তো যে আমি বিবাহিত , আমি বিবাহিত জেনেও কেন প্রেম করছিস , কেন ফাঁদে ফেললি ।
– খবরদার তুই তুকারি করবা না ।
– চুপ , একদম চুপ , ফোন দিবি না আপাতত ।

এইসব বলে লাইন কেটে দেয় ইরফান । বেলী এতক্ষন পাশের রুম থেকে সব শুনতে পেয়েছে । আর সে বুঝেও গেছে কে ফোন দিয়েছে । ভাগ্য ভালো ছিল বেলীর মা বাহিরে ছিলেন । বেলী আর তার পর ইরফানের সামনে যায় নি । ইরফান মোবাইলের ফ্লাইট মুড অন করে মোবাইল চার্জে ফেলে রাখে । বেলীও এই সুযোগে বাহিরে চলে যায় । গ্রামের কিছু চাচি মামি খালা ভাবীরা উঠানে বসা ছিল । বেলীকে দেকে তারা ঠাট্টা জুড়ে দেয় । তাদের মধ্যে একজন ভাবী বেলীকে ইংগিত করে অনেক প্রশ্ন করে । যা সব মজার ছিল ।

– কিরে বেলী স্বামীরে পাইয়া আমাগোরে ভুইলাইবম গেছিস ?
– না গো ভাবী , কাউরেই ভুলি নাই ।
– এহহহহহ কইলেই হইলো , মাইনষে তো একটা ফোনও করে ,
– ভাবী আমি মোবাইল চালাই না গো ।
– এহহহহ কস কি , জামাই মোবাইল দেয় না ?
– দিতে চায় আমিই নেই না , প্যারা লাগে ।
– ওই বেলী ,,,,,,,,?
– জ্বি চাচি ,
– এক বছর হইয়া যাইতাছে নানি কবে বানাবি ?

কথাটা শুনে বেলীর মনটা হাহাকারে ছেয়ে যায় । অপরদিকে গেঞ্জিবার টাউজার পরে ইরফানও ঘর থেকে নামছে এমন সময় এই কথাটা ইরফানেরও কানে যায় । সে সেখানেই দাঁড়িয়ে যায় । বেলীর দিকে তাকিয়ে আছে সে । বেলী একদম স্তব্ধ হয়ে আছে । কোন কথা বলছেনা । চুপ করে আছে ,

– বিয়ের পরে যার কপালে স্বামী সুখের বদলে জুতার বারি জুটে তার কি সন্তান সুখ মানায় ? আমার স্বামীটাই তো আমার নাই , সে তো অন্যের । যে আমার না তার কাছে সন্তান চাই কিভাবে ? আর আমার নিজেরই তো ভরসা নাই , আজ আছি কাল নেই , এর মাঝে অনাগত ভবিষ্যতের কথা ভাবাও উচিত না । একটা প্রাণকে আনতে হলে দুটো প্রাণের মিলন লাগে , সেই দুটো প্রাণেরই তো মিল নাই , সেখানে সন্তান কামনা করি কিভাবে ? (মনে মনে)

বেলীর ভাবনার মাঝে ছেদ পড়ে আরেক ভাবীর ডাকে ।

– ও বেলী ,,,,,,,,?
– হে ,
– তা তোর স্বাস্থ্য এমন কেন ?
– কেমন ভাবী ?
– অসুস্থ অসুস্থ লাগে মনে হয় কত রাইত ঘুমাও না ?
– নাহ ভাবী ঠিকই তো আছি ।
– নাকি আমাগো জামাই রাইতে ঘুমাইতে দেয় না ?

কথাটা বলে সবাই এক সাথে হেসে উঠে । বেলী বুঝেও চুপ করে আছে । অপরদিকে ইরফান দূর থেকে সবটাই শুনতেছে যা বেলী দেখেনি ।

– ওই বেলী ,
– হে ,
– কও না ,
– কি
– জামাই রাইতে কেমনে আদর করে ?
– আইচ্ছা , তাও কইতাম এহন ?
– হ , কও আমরা হুনি ।
– তাইলে হুনো , রফিক ভাই যেমনে রাইতের আন্দারে তোমারে আদর করে তার থাইকাও আরও হাজার গুন বেশি আদর আমার জামাই আমারে করে , তবে আমার ঘরে আন্দার থাহে না আলো থাহে । বুঝলা কিছু ?

বেলীর এমন কথায় সেই ভাবী একদম চুও হয়ে যায় । ইরফান বেলীর মুখে এমন কথা শুনে আটাশ হয়ে যায় । বেলী এমন কথাও বলতে পারে যা তার সম্পূর্ণ অজানা ছিল । অবশ্য বেলী এই কথাটা দিয়ে কি বুঝিয়েছে তা ইরফান খুব ভালো ভাবে বুঝে গেছে । বেলী সঠিক জায়গায় সঠিক কথাটাই বলেছে কিন্তু কেউ বুঝতে পারে নি শুধু ইরফান ছাড়া । ইরফান সেখান থেকেই বেলীকে ডাক দেয় ,

– বেলী,,,,,,,,,,?

ইরফানের গলার আওয়াজ পেয়ে সবাই ঘরের দরজার দিকে তাকায় । সাথে বেলীও । সবার এইভাবে তাকানো দেখে ইরফান কিছুটা হলেও লজ্জা পেয়ে যায় । তবুও আবার বেলীকে ডাক দেয় সে ।

– বেলী একটু রুমে আসো তো ?

এইটা বলে ইরফান ঘরের ভেতরে চলে যায় । ইরফানের ডাকে বেলীর কলিজার পানিটুকু শুকিয়ে যায় । সে ভাবছে তার কোন অন্যায় হয়ে গেছে নাকি হঠাৎ এইভাবে ডাকছে । এখন যদি এইখানে মারধর করে তাহলে তো ওর মা এইসব সহ্য করতে পারবে না । তার থেকে বরং গিয়ে ও-কে শান্ত করার জন্যে আপাতত তাকে ঘরের ভেতর যেতে হবে । বেলী সেখান থেকে উঠে ঘরের ভেতর চলে যায় ।

– জ্বি কিছু বলবেন ?
– ওনারা কি সব বলতেছে ?
– তেমন কিছু না ,
– আর ওইটা কি বললা ?
– কোনটা ?
– হাজার গুন বেশি আদর আমার জামাই আমারে করে , তবে আমার ঘরে আন্দার থাহে না আলো থাহে – এইটা ।
– তাহলে কি বলা উচিত ছিল ?
-………………..
– আমি তো মিথ্যা বলি নাই ,
– সত্যি কি বললা তাহলে ?
– রফিক ভাই অনেক ভালো মানুষ , বউকে অনেক ভালোবাসে । শহরে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কাজ করে । মাসে একবার বাড়ি আসে । আর যত দিন থাকে ততদিন সকালে নাকি ভাবীর ভেজা চুল থাকে , এখনও থাকে । এখন প্রশ্ন হলো আমি কেন এই কথা বললাম ?
– হ্যাঁ ,
– আপনিও তো আমাকে আদর করেন , তবে রফিক ভাইয়ের মত না । আপনার আদর গুলাতে আমার দম বন্ধ হয় আবার রফিকের ভাইয়ের আদরেও ভাবীর দম বন্ধ হয় । তফাৎ টা কই জানেন ? রফিক ভাইয়ের আদরে ভাবীর দম বন্ধ হয় সুখের তাড়নায় আর আপনার আদরে আমার দম বন্ধ হয় যন্ত্রণার তাড়নায় । ভাবী সুখ পায় উষ্ণ স্পর্শে আর আমি সুখ পাই আপনার হাতের থাপ্পড় , লাথি , ঘুষিতে । হলো না এটা আদর , বলেন ?
-……………………
– বাহিরে চাচি বললো , তাদের নানি বানাবো কবে ? আমি তো আর বলতে পারি না সেই সুখটা আমার জন্যে না । কারন আমার কাছে তো আমার মানুষটাই নাই । আমি তো আর বলতে পারি না যে আমার স্বামী তার দ্বিতীয় স্ত্রী নিয়ে সুখেই তো আছে । আমি তো আর বলতে পারি না যে আমি আমার স্বামীর ঘরে বান্দির মত থাকি । বলেন কিভাবে বলি ?

আজ ইরফান স্তব্ধ । বেলী তার কথা দিয়েই বুঝিয়ে দিয়েছে সে তার প্রতিটা দিন কতটা যন্ত্রণার মধ্যে দিন পার করে । বেলী কথাগুলো বলে বেরিয়ে যায় । আর ইরফান সেখানেই বসে থাকে । সব কিছু আগে থেকেই এলোমেলো ছিল আজ আরও গোলমেলে লাগছে তার কাছে ।
রাত প্রায় ১১ টার উপর বাজে । বেলীর মা তার সাধ্যের মধ্যে যতটুকু পেরেছে মেয়ে জামাইয়ের জন্য ততটুকুর বেশি আয়োজন করেছেন । ইরফান ছোট বেলাতেই মাকে হারিয়েছে৷। আজ মা থাকলে হয়তো এতটা উচ্ছন্নে যেতো না সে । আজ মা থাকলে হয়তো সেও বুঝতো একজন নারীর কাছে তার স্বামীর মূল্য কতটা আর একজন স্বামীর কাছে তার স্ত্রীর মূল্য কতটা । নিজের মেয়েকে আর মেয়ে জামাইকে একসাথে বসিয়ে খাওয়াচ্ছেন তিনি । ভাতের লোকমা মুখে দিয়ে ইরফান বুঝে যায় বেলী এত ভালো রান্না কার কাছ থেকে শিখেছে । অসম্ভব ভালো রান্না করেছে বেলীর মা । ইরফান চুপচাপ খেয়ে উঠে চলে যায় রুমে ।
ইরফান চলে গেলে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন বেলীর মা । মেয়ের মুখে আগের মত আর হাসি নেই । তার বেলীফুল কেমন যেনো নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে দিন দিন ।

– বেলীফুল ,
– হে ,
– তুই ভালো আছিস তো মা ?
– হ্যাঁ মা আমি ভালো আছি ।
– জামাই ভালাবাসে নিরে মা ?
– অনেক মা , সে আমায় অনেক ভালোবাসে ।
– যাক আলহামদুলিল্লাহ ,
– হু
– একটা কথা কইতাম ?
– কও না মা ,
– বেশি দেরি হইলে আর বাচ্চা কাচ্চা হয় না রে মা । এইবার একটা বাচ্চা নিয়া নে ?

মায়ের মুখেও একই কথা শুনে দমে যায় বেলী । কি করে বুঝাবে সে , সে স্বামীর ঘরে থেকেও অনিশ্চিত ভবিষ্যত তার । মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বেলী স্মিত হেসে বলে ,

– মা , আগে ঢাকা ফিরি , তারপর ভাববো কেমন ?
– আইচ্ছা ।
– মা ময়নার কি খবর গো ?
– বিয়া হইছে , শ্বশুরবাড়িতে থাহে । জামাই মাশাল্লাহ অনেক ভালা । ঠিক আমার মাইয়ার জামাইর মত ।
– সুখে আছে , তাই না মা ?
– হ , শ্বশুরবাড়ির সবাই অনেক ভালা ।
– ওহ ,

ময়না বেলীর খুব ভালো একজন বন্ধু । স্কুলে এক সাথে পড়াশোনা তাদের৷। কলেজেও সেইম । শুধু বেলী পরীক্ষা দেয় নাই আর ময়না পরীক্ষা দিয়েছে । ময়নারও বিয়ে হয়েছে । তার সাথে দেখা করার খুব শখ বেলীর ।

[ বিঃদ্রঃ একজন মায়ের কাছে তার সন্তানের সন্তান অনেক কিছু হয় । এইবার হোক সে ছেলের বা মেয়ের । এখানে বেলীর মায়ের ইচ্ছেটাও অযুক্তির না । বয়সকালে সব বাবা মা-ই চান নাতি নাতনির মুখ দেখতে । নাতি/নাতনি নানুমনি বলে ডাক দেবে । শুনে মায়ের প্রাণ জুড়াবে । এটাই আমাদের সমাজের সামাজিকতা । সেই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে বেলীর মা ভুল না । কিন্তু যেখানে যার নিজের অস্তিত্বেরই ঠিক নেই সেইখানে নতুন অস্তিত্ব কিভাবে আসবে ? আজ আবেগের বশে এক রাতের সুখে একটা নতুন অস্তিত্ব আসবে হয়তো ঠিক কিন্তু কাল যখন বিবেক বলবে সরে যাও তখন এই অসহ্যকর দুনিয়াতে অনাগত ভবিষ্যতের মাঝে এক নিষ্পাপকে নিয়ে দাঁড়ানোর জায়গা কোথায় । অসহায়ত্বের ফায়দা সবাই নিতে চাইবে কিন্তু সাহায্যের হাতটা কেউ বাড়িয়ে দিবে না । এখানে আবেগ না বিবেক চলে , আর যেখানে বিবেকই বিবেকের কাছে ঘৃণিত সেখানে নিজের প্রতি নিজের বিশ্বাস ডগমগানো ]

রাতের অন্ধকারটা বড্ড দ্বিধা জাগায় মনে । দিন শেষে এই রাতটাই আছে যার কাছে একা নিঃসঙ্গ মনটা ভিখারী হয়ে রয়ে যায় । সারাদিন কি কি করা হয়েছে আর কি কি করা হয় নি তার হিসাব নিকাশ গুলো এই রাতের বেলাতেই খুব মনে পড়ে । আজ ইরফানের চোখে ঘুম নেই । আজ বেলী তার পাশে শুয়ে আছে । তবুও তার চোখে ঘুম নেই । গ্রামে এসে দুজন আলাদা ঘুমালে সবার নজর কাড়বে এই জিনিসটা । আর এইসব ব্যাপার গুলো সবার নজরে একটু বেশিই পড়ে ।
বেলী ওইদিকে মুখ করে শুয়ে আছে । কিন্তু বড্ড অস্থির লাগছে নিজের কাছে বেলীর । চোখ থেকে আপনা আপনি পানি পড়ছে তার৷ তবে নিঃশব্দে । কি আছে তার কপালে ? কিভাবে পারি দিবে বাকি জীবনটা । সবে তো মাত্র জীবনের শুরু । তার উপর আবার আজ রুবির ফোনের আলাপ পেয়ে মনটা ছোট হিয় গেছে তার । হয়তো এবার ঢাকা গেলে আবারও শুরু হবে আগের মত । যন্ত্রণা গুলো চাপা কিন্তু অনেক কষ্টের । না পারা যায় কাউকে বলতে না পারা যায় কাউকে দেখাতে শুধু পারা যায় নিজের বুকের মাঝে লুকিয়ে রাখতে ।

পরদিন সকাল থেকেই সব রান্নার আয়োজন করা হয় । ইরফান আর তার বাবা রহমান আলী সবটা তদারকি করছে । বেলী আজ ঘর থেকে বের হয় নি । ঢাকাতে কোরআন শরীফের ২৭ পারা শেষ দিয়ে আসছিল । আজকে হুজুরদের মিলাদের সাথে সেও বাকি তিন পারা শেষ দিয়ে কোরআন খতম করে বাবার আত্মার শান্তির জন্যে দোয়া চাইবে । সকাল সকাল মায়ের সাথে সব কাজ শেষ করে গোসল দিয়েই আগে ১০ রাকাত নফল নামাজ আদায় করে আর তারপর কোরআন শরীফ নিয়ে বসে যায় বেলী । গুনগুন করে কোরআন শরীফ পাঠ করে বেলী । এর মাঝে কয়েকবার ইরফান রুমে এসেছিল দরকারে । যতবার এসেছে ততবারই দেখেছে বেলী কোরআন পাঠ করতেছে । কোরআন পাঠ শেষ করে যোহরের পরে নামাজ আদায় করে তারপর বেলী রুম থেকে বের হয় । এদিকে বেলীকে দেখে বেলীর মা বলে ,

– বেলীফুল ,,,,,?
– হে মা ,
– জামাই ডাকে ,
– আচ্ছা

মায়ের কথায় ঘরের সাইডে যায় বেলী । গিয়ে দেখে ইরফান সেখানে দাঁড়িয়ে আছে । বেলীকে দেখে ইরফান বেলীর সামনা সামনি হয়ে দাঁড়ায় । বেলীর চোখ মুখ ফুলে একাকার । হয়তো আজকেও কেঁদেছে মেয়েটা । আসলেই আজ বেলী অনেক্ষণ কেঁদেছে । আজকের দিনেই বেলীর বাবা তাদের ছেড়ে চলে গেছিলেন । তাই কষ্ট গুলো আবারও মনে পড়ে গেছে তার ।

– খতম হয়েছে ?
– জ্বি ,
– কান্না করছিলা ?
– নাহ ,

বরাবরের মতই এবারও এড়িয়ে যায় বেলী । তাই ইরফানও আর জোড়াজুড়ি করে নাই ।

– হুজুররা চলে আসবে , আমি আর বাবা হুজুর আর পুরুষদের খাওয়াবো । তুমি মহিলা আর বাচ্চাদের দিকটা দেখো ।
– জ্বি আচ্ছা ।

বলে মাথা নাড়ে বেলী । এবারও ইরফান বেলীর মুখের দিকে চেয়ে আছে । পুরো মুখটাই মায়াবী । একদম শান্ত , ওর মতই হয়তো ওর চোখের পানি গুলো । ঝরতে তাড়াহুড়ো করে না , ওর মতই শান্ত হয়ে ঝরে । বেলী সেখান থেকে বলে যায় ।
সবাই খানার কাজে লেগে যায় । বেলী সবাইকে বেড়ে দিচ্ছে । হঠাৎ করেই কেউ একজন পিছন থেকে ডাক দেয় ,

– বেলীইইইইইইই,,,,,,,,,,,,,,,,,,,

জোরে ডাক দেয়ায় বেলী পিছনে তাকায় । দেখে ময়না দাঁড়িয়ে আছে । নিজের প্রিয় বান্ধবী যার কথা কাল রাতেও সে তার মাকে বললো আজ সেই বান্ধবীই তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে । বেলী দ্রুত হেটে গিয়ে ময়নাকে জড়িয়ে ধরে । আর ময়নাও পরম ভালোবাসায় জড়িয়ে নেয় বেলীকে ।

– কেমন আছিস বেলীফুল ?
– আমি ভালো আছি , তুই কেমন আছিস ময়না পাখি ?
– আমিও আলহামদুলিল্লাহ ।
– বিয়ে করে রানী হয়ে গেছিস ।
– তুইও তো কম রানী হোস নাই ।
– তাই , আয় খেতে বস । আজ আমি নিজে ভাত বেড়ে খাওয়াবো তোকে ।
– খাবো , তোর সাথে অনেক কথা আছে । তোর জামাই কই ?
– আছে , তুই আয় না বস ।
– বসবো , অনেক কথা আছে তোর সাথে ।
– আচ্ছা শুনবো , আগে খেতে বস ।

ময়না অনেক তাড়া দিচ্ছে বেলীকে । হয়তো খুব জরুরী কথা ছিল তার । তাই কোন রকম খেয়ে বেলীকে নিয়ে বাড়ির পাশের পুকুর ঘাটে নিয়ে যায় ময়না ।

– জানিস , কি হইছে ?
– কি ?
– সে ফোন দিছিলো আমারে ?
– কে ?
– রাজু ভাই ।

নামটা শুনে বেলীর বুকে একটা পাহাড় পড়ে যায় । এমনিতেই তো সে মরে আছে তার উপর ময়না এসে খারার ঘা টা দিয়েই দিলো । সেই সময়ে বেলীর পায়ের নিচ থেকে মনে হচ্ছিল সব মাটি সরে যাচ্ছে ।
চোখ থেকে আপনা আপনি গাল বেয়ে দু ফোঁটা পানি পড়ে যায় বেলীর ।

.
.

চলবে…………………

আসসালামুয়ালাইকুম ,

অসুস্থতাকে সাথে নিয়ে গল্প লিখে যাচ্ছি । কেন ? যাতে আপনারা পড়তে পারেন । কিন্তু আপনারা তাও বলেন , এত ছোট কেন , এত ছোট কেন ? আমি আর কত বড় করে দিবো , বলেন তো ? গত দুইটা দিন জ্বর নিয়ে ভুগেছি আর আজ বাম চোখে সমস্যা । তবুও লিখেছি , কারণ আমার পাঠকগুলা বসে থাকে পড়ার জন্যে । দয়া করে আমার সমস্যাগুলোও বুঝবেন । আর হ্যাঁ অনেকেই নেক্সট নেক্সট করেন । এটা খারাপ আমি বলছি না , তবে গল্প যখন শুরু করেছি অবশ্যই তার পরবর্তী পর্বটাও আমি দিবো , তাই না ? তাই দয়া করে নেক্সট নেক্সট করবেন । রাগ করবেন না কেউ , আমি কারো মনে আঘাত দিয়ে কিছু বলি নি । আর দোয়া করবেন আমার জন্যে ।

আর একটা বিষয় পরিষ্কার করি , গল্পে কিছু আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে । গত কালকেই বলবো ভেবেছিলাম মনে ছিল না । আমরা সবাই কিছু শুদ্ধ ভাষা ব্যবহার করি না , আর যারা করি তা তো করি-ই । এখানে গ্রাম্য এবং শহুরে জীবন দুইটাই আছে তাই ভাষাটাও দুই ধরনেরই হবে । তাই দয়া করে বুঝে নিবেন ।

আসসালামুয়ালাইকুম ??

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_১১

0

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_১১
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

গাড়ি ছুটে চলছে চেনা পরিবেশে । সারা রাস্তা বেলী অনেক চুপচাপ করে আছে । ইরফান কত কিছুই সাধলো বেলীকে । কিছুই খেলো না মেয়েটা । শুধু তার আবদার ছিল জানালার পাশের সিট টাতে বসবে । সেখানে বসে সন্ধ্যার আগ পর্যন্ত বাহিরের প্রকৃতি দেখছে সে । সন্ধ্যার পর হঠাৎ করেই ঘুমিয়ে পড়ে বেলী আর সারা রাস্তা ইরফানও বোবা মূর্তির মত বসে ছিল । কতক্ষণ আর মোবাইল চালানো যায় । তাই সে কিছুক্ষন মোবাইল চালায় আবার চুপ করে বসে থাকে । তাদের পাশের দুইটা সিটে এক জোড়া বয়স্ক দম্পতী বসে আছে । তারা কিছুক্ষণ পর পর ইরফান আর বেলীর দিকে তাকিয়ে থাকে । আবার নিজেদের মাঝে কথা বলে । এই ব্যাপারটা কয়েকবার ইরফান খেয়াল করলো । তার একটু অস্বস্তি হচ্ছে তবুও চুপ করে আছে কারণ তারা বয়স্ক মানুষ ।
বার বার তাকাচ্ছে বলে এইবার ইরফান নিজেই তাদের বলে উঠে ,

– জ্বি কিছু বলবেন ,,,,,?

ইরফানের কথায় বয়স্করা অনেকটা ভীতু হয়ে যায় । ইরফান তাদের চেহারা দেখেই বুঝে যায় ব্যাপারটা । তাই নিজেকে আরও রিলেক্স করে হাসি মুখে আবারও জিজ্ঞেস করে ,

– কিছু বলবেন ?

তখনই বৃদ্ধা মহিলা জবাব দেন ,

– না ভাই , কিছু বলুম না ।

ভাই বলাতে ইরফান ভেবে নেয় তাকে নাতির মত ভেবেছে । আর তারাও অনেকটাই বয়স্ক মানুষ । দাদা/নানা , দাদি/নানির মত আর কি । তাই ইরফানও মুচকি হেসে দেয় । ইরফানের হাসি দেখে বৃদ্ধা মহিলা জিজ্ঞেস করে ,

– ওয় কি তোমার বউ ?
– জ্বি ,

তারপর বয়স্ক মহিলা বয়স্ক পুরুষকে বললেন ,

– এক্কেরে আমাগো রাইসুলে আর রাইসুলের বউয়ের মত , তাই না ?
– হ , এক্কেরে রাইসুলের মত দেহা যায় ।

ইরফান সাইড থেকে সব শুনছিলো । তখন হালকা মুচকি হাসি দিয়ে সে মোবাইল টিপছে । তখনই বয়স্ক মহিলা বলে ,

– তোমার নাম কি ভাই ?
– আমার নাম ইরফান ,
– আমাগো নাতি আছে একটা , পুতের ঘরের নাতি নাম রাইসুল এক্কেরে তোমার মত দেহা যায় তারে । তারও এমন একটা বউ আছে ।
– ওহ ,
– আমাগো রাইসুলের বউয়ের নাম মনি তোমার বউয়ের নাম কি গো ভাই ?
– ওর নাম বেলী ।
– মাশাল্লাহ , অনেক সুন্দর নাম । তোমার বউরে কও এট্টু এইমিক্কা চাইতো , এট্টু দেহি ।
– ওইদিক ফিরে ঘুমাচ্ছে তো , উঠলে বলবো , কেমন ?
– আইচ্ছা ।
– তোমরা কই যাইবা ?
– কামরাঙ্গিরচর ,
– ওহ ,
– আপনারা যাবেন কোথায় ?
– আমরা এইতো পরের স্ট্যান্ডে নাইমা যামু
– ওহ আচ্ছা ।

ইরফানের বেশ ভালো লাগছে তাদের সাথে কথা বলে । অন্যদিকে বেলী তো ঘুমে ডুবে আছে । সে বলতেই পারবে না এইসব কিছু । ইরফান ওনাদের সাথে আবার কথায় মন দেয় ।

– তা , দাদার নাম কি ?
– গফুর মিয়া ,
– আর দাদুর নাম ?
– জয়তুন্নেসা ,
– ওহ অনেক সুন্দর নাম তো । তা কপোত কপোতী একা একা কোথায় যাচ্ছেন ?
– ঢাকাতে গেছিলাম নাতির বাসাত , ওই যে কইলাম রাইসুল , তার বাসাত গেছিলাম , এহন বাইত যাইতাছি পুতের কাছে ।
– ওহ , নাতি কি করে দাদা ?
– একটা কোম্পানিতে চাকরি করে ।
– ওহ ,
– আমার নাতি বউ মনি , সেও চাকরি করে আমার নাতির লগে । তারা পেরেম কইরা বিয়া করছে । নাতি বউ অনেক ভালা । আমাগোরে অনেক আদর করে ।
– ওহ , যাক ভালো । তা দাদু কিছু খাবেন ?
– নাহ ভাই কিছু খামু না । বাইত বউয়ে ভাত রাইন্দা রাখছে , বাইত যাইয়া ভাত খামু ।
– ওহ আচ্ছা ।
– আমরা তো আরেকটু ফরে নাইমা যামু তোমার বউরে উডাও তো ভাই , এট্টু দেহি তোমার বেলীফুলরে ।

বয়স্ক মহিলার কথা শুনে ইরফানের বুকের ভেতরটা হু হু করে উঠে । তার বেলীফুল , মহিলা অল্প ভাষাতেই অনেক কিছু বুঝিয়ে দিলেন । তার বেলীফুল , যেই বেলীফুলকে রোজ রোজ সে নিজেই নিংড়েছে অনেক । তার বেলীফুল যেই বেলীফুলকে কারণ ছাড়া অনেক কিছু সহ্য করতে হয়ে এবং এখনও হচ্ছে । হ্যাঁ , তার বেলীফুল , যে কিনা নিঃশব্দে বলে যায় হাজারো না বলা কথা । যা লিখতে বসলে উপন্যাসের পাতা শেষ হয়ে যাবে তবু কথা শেষ হবে না । হ্যাঁ এ তার বেলীফুল , শুধুই তার বেলীফুল । বেলীর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে এক মনে এইসব ভেবে যাচ্ছিলো ইরফান । হঠাৎ করেই বয়স্ক মহিলা আবারও ডাক দেয় ,

– ও দাদুভাই , বউরে কি দেখাইবা না আমাগোরে ?

ওনার কথায় ধ্যান ভেঙে যায় ইরফানের । তারপর বেলীর দিকে হালকা ঝুকে আস্তে করে ডাক দেয় সে বেলীকে ।

– বেলী,,,,,, বেলী,,,,,,?
-…………
– এই বেলী,,,,,,,,,?

তারপর ইরফান আস্তে করে হালকা করে ধাক্কা দেয় বেলীকে । চমকে গিয়ে ঘুম থেকে উঠে যায় বেলী । বেলী ভাবছে হয়তো চলে আসছে তারা ।

– চলে আসছি ?
– আরে নাহ , পাশের সিটের দাদা দাদি র মত বয়স্ক মানুষরা আছে না ?
– হু ,
– তারা তোকে দেখতে চায় , তুই ওইদিকে মুখ ফিরে ঘুমাচ্ছিস , তারা সামনেই নেমে যাবে তাই নামার আগে তোকে দেখতে চায় ।
– ওহ ,

ফিস ফিস করে ইরফান বেলীকে বলে দেয় সবটা । ইরফানের কথায় বেলী নিজে ফ্রী হয়ে তাদের দিকে তাকায় । হাসি মুখে অত্যন্ত ভদ্রতার সাথে সালাম দেয় ওনাদের ।

– আসসালামু আলাইকুম ,
– ওয়ালাইকুম আসসালাম ,
এইডা নি তোমার বেলীফুল দাদু ভাই ?

বয়স্ক মহিলার কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় বেলী । একবার ইরফানের দিকে তাকায় সে । এমতাবস্থায় ইরফান কি বলবে , ভেবে পাচ্ছে না । তবুও হু সূচক মাথা নাড়ে ।

– বাহ , বেশ বেশ । আমাগো মনির মত হের বউডা , তাই না ?
– হ ,
– কি গো দিদিভাই , এত ঘুমাও কা ?
– বাসে উঠলে আমার ঘুম আসে দাদু ,
– ওহ , তোমার জামাইডা মাশাল্লাহ এক্কেরে সাবের বাচ্চার লাহান ।
– দোয়া করিয়েন দাদু ।
– তুমিও এক্কেরে পরীর লাহান । দুজনেরে অনেক সুন্দর মানাইছে ।
– হ আমাগো রাইসুল আর মনির মতন ।
– রাইসুল,,,,,,মনি,,,,,,,?
– রাইসুল ওনাদের নাতি আর মনি নাতি বউ ।

ইরফানের কথায় তখন পুরোটা বুঝে যায় বেলী । তারপর বেশ কিছুক্ষন ওরা কথা বলে । একটা সময় স্ট্যান্ডে বয়স্ক মানুষ দুজন নেমে পড়ে । স্ট্যান্ডে ওনাদের জন্যে ওনার ছেলে অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে ছিলেন , বাস থেকে নামার পর তিনিই এনাদের নিয়ে যান । দুজনের চেহারা মাশা-আল্লাহ নুরানি চেহারা । একদম মায়া মায়া , যাদের দেখলে কলিজাটাও ঠান্ডা হয়ে যায় । হাসি তো একদম চাঁদের আলোর মত । বাস আবার ছেড়ে দেয় । বেলীর এখন আর ঘুম আসছে না বাহিরের প্রকৃতির ঘন অন্ধকার দেখছে সে । এই কালো অন্ধকারের মত এখন তার জীবনটা । চারপাশে শুধু কালো ছায়া ।

রাত প্রায় ৮ টা বেজে যায় বেলী আর ইরফান পৌঁছাতে পৌঁছাতে । ইরফান তার বাবার সাথে কথা বলে সোজা বেলীকে নিয়ে বেলীদের বাড়িতে চলে যায় । বেলী বাড়িতে ঢুকার সাথে সাথে বেলীর মা দৌড়ে এসে নিজের মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন । মাকে এতদিন পর পেয়ে মেয়েও মা বলে চিৎকার দিয়ে উঠে । ইরফান যে সাথে আসে তা তারা ভুলেই গেছে । মেয়ে মাকে জড়িয়ে কেঁদে দেয় আর মাও মেয়েকে পেয়ে নিজের বুক ঠান্ডা করে ।
মা মেয়ের কান্নায় স্তব্ধ ইরফান চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে পাশে । কিছুক্ষণ পর বেলীর মা জামাই মানে ইরফানকে দেখে হাসি দিয়ে কথা বলে । ইরফানের বাবা বার বার বলেছিল বেলীর মায়ের পায়ে হাত দিতে যাতে সালাম করে সে । তাই বেলীর মায়ের পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে ইরফান ।

– কেমন আছ বাজান ?
– ভালো , আপনি
– আর আমার থাহা , আইও ঘরে আইও , বেলীফুল জামাইরে নিয়া আয় ।

বাড়ির উঠানে এসে বেলী খানিকটা অবাক হয়ে যায় । উঠানের এক কোণায় দুইজন বাবুর্চি রান্না করার জন্যে সব ঠিকঠাক করছে । আর দুইজন মহিলা মশলা পিষে দিচ্ছে । গ্রামের আরও কয়েকজন মহিলারাও সেখানে ছিলেন । সবাই বেলীকে দেখে হাসি খুশি ভাবে কথা বলছে । বেলীর মা তখন ঘরে ছিল , বেলী ইরফানকে নিয়ে ঘরে যায় আর নিজে আগে যেই রুমে থাকতো ওই রুমে ইরফানকে নিয়ে গিয়ে বসায় । তারপর বোরখা আর হিজাব খুলে গায়ের ওড়নাটা দুই পেচ দিয়ে পরে মায়ের কাছে আসে ।

– মা , এইসব কি , এত রান্না কিসের ?
– কাইলকা তোর বাবার মিলাদ , তাই ২০ জন হুজুর আর গেরামের কয়েকজন খাওয়াইবো ।
– কে খাওয়াইবো ,
– আর কে তোর জামাই ,
– কিহ !
– হ , বেয়াই সাবে আইজ্জা বেহানে আইছিল , আইয়া কইলো শুক্কুরবারের সব খরচ জামাই দিছে , বড় কইরা মিলাদ দিতে , আমি তো ভাবছিলাম ৫ জন হুজুর খাওয়ামু , আমার যেমন ওসাড় তেমনই তো করুম । মানুষটায় তো আমারে একলা ভাসাইয়া থুইয়া গেছে গা ।

এই বলে বেলীর মা কেঁদে দেয় । আর তার সাথে বেলীও । অন্যদিকে ইরফান বেলীর রুমের মধ্যে বসে আছে । বেশ গুছানো রুমটা । বিয়ের পর এই প্রথমে এইভাবে বেলীদের ঘরে আসছে । এর আগে একদিন বিয়েতে এসেছিলো কিন্তু তখন উঠানেই বসা ছিল সে । বেলীদের টিনের চৌকাঠ করা ঘর , কিন্তু এই রুমটা বেশ গুছানো । হয়তো বেলী আসবে শুনে বেলীর মা গুছিয়ে রাখছে । ইরফান বেশ সুচিবায়ু সম্পন্ন মানুষ । ময়লা , ধুলাবালি কিছুই তার পছন্দ না । কিন্তু এইখানে একদম তার বিপরীত । একটু ময়লাও খুজে পাবে না সে এই রুমে । কিছুক্ষণ পর একটা ট্রে তে করে শরবত , আপেল মালটা নিয়ে আসে বেলী । বেলীকে দেখে ইরফান তাকিয়ে থাকে তার মুখের দিকে , চোখ মুখ আবারও ফুলে আছে তার । নিশ্চয়ই ভেতর থেকে কান্না করে আসছে । ইরফান কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে মুখের দিকে , তারপর বলে ,

– কান্না করছিস ?
– উহু ,
– চোখ মুখ এমন যে ?
– এমনিতেই , মা দিছে খেয়ে নেন ।
– তুই খাবি না ?
– নাহ ,
– ওহ তুই তো আবার হাওয়া খাস ,
– অনেক ধন্যবাদ আপনারে , আমার বাবার প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী এইভাবে পালন করলেন , এত বড় করে মিলাদ দিলেন ।
– ইংলিশে একটা শব্দ আছে , ফর্মালিটি । জানিস ?
– হু ,
– অর্থ বুঝিস ?
– হু ,
– করতে আসিস না আমার সাথে ।
– একটা কথা বলতাম ?
– বল ,
– দুইদিন থাকবো তো , আপনি সবার সামনে আমারে তুমি বইলা কথা বইলেন ।
– দুই দিনের জন্যে বলতে চাই নাই , সারাজীবনের জন্যে চেয়েছিলাম , ঢাকায় কি বলছিলি , ভুলে গেছিস ?
– আপনি এইদিকে তুমি করে ডাকিয়েন নাইলে মা দুঃখ পাবে ।

এইবার ইরফানের মেজাজ খারাপ করে । বিছানা থেকে হুট করেই উঠে বেলীর হাতটা মুচড়ে দেয় । ব্যাথা পাওয়ার পরেও দাত মুখ খিটে আছে । ইরফান বেলীকে একদম নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় । বেলী ব্যাথা পাওয়ার পরেও টলমলে চোখে ইরফানের দিকে চেয়ে আছে । পানিগুলো তার চোখের কোণায় চলে আসছে । হয়তো আরেকটু হলে গাল বেয়ে পড়ে যাবে । ইরফান বেলীর একদম কাছে চলে যায় ।

– যদি ডাকি , তাহলে দুই দিনের জন্যে না , যতদিন বেঁচে থাকবি বা আমি বেঁচে থাকবো ততদিন ডাকবো । এর পরে যদি শুনি একটু আওয়াজ করছিস এই ব্যাপারে তখন দেখবি আমি কতটা খারাপ হই ।
– কতটা খারাপ ? লাথি ঘুষি তো পুরাতন ওষুধ আমার জন্যে । তাহলে কি এইবার শেষ ওষুধটা রাখছেন আমার জন্যে ?
-…………
– চিন্তায় পড়ে গেছেন ? আপনার কাছে আমার জন্যে হয়তো শেষ ওষুধটা মৃত্যু । তাই না ?

আজ কেন জানি বেলী সাহস করে এইভাবে কথা গুলো বলে ফেলল । কথাটা বলে বেলীও বেক্কল হয়ে গেছে । বুঝতে পারে বেলীর গাল বেয়ে চোখের পানিগুলো ঝরে যাচ্ছে । ঠিক বাগানের গাছে ফোঁটা বেলীফুলের মত । ইরফান বেলীর এই কথাটা শুনে বেলীর হাতটা ছেড়ে দেয় । হাতটা ছাড়ার পর বেলী মনে হয় তার জানটা ফিরে পায় । বেলী চলে যেতে নিলে ইরফান আবারও বেলীর হাতটা টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসে । তারপর কেন জানি জড়িয়ে ধরে বেলীকে । বেলী জোড়াজুড়ি করে নাই , কারণ সে জানে এখন জোড়াজুড়ি করেও লাভ নেই , জোড়াজুড়ি করলে সে আরও বেশি করে করবে । তাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে । একবারের জন্যে ইরফানকে ধরেও নি বেলী ।
কিছুক্ষণ পর ইরফান নিজেই ছেড়ে দেয় বেলীকে । নিজেকে ইরফানের থেকে মুক্ত পেয়ে ইরফানের দিকে চেয়ে থাকে বেলী । তারপর নিজেই বলে উঠে ,

– মায়া বাড়াইয়েন না , অনেক কষ্ট হবে আমার পরে । মায়া বাড়াইয়েন না , না হয় আমি আপনাকে ছাড়া বেঁচে থেকেও থাকবো মরা হয়ে ।

কথাটা বলে বেলী দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে যায় । আর ইরফান সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে মূর্তির ন্যায়ে । বেলীর কথাটাও ন্যায় সংগত । ইরফান ক্ষনিকের মায়ায় বাধতে চায় বেলীকে , যেদিকে পরবর্তীতে কি হবে তা বেলী এবং ইরফান দুজনেরই ভালো মত জানা । তাই হয়তো না পারতে বেলী আজ মায়ার কথাটা বলে ফেললো ।
ইরফানের এইসব ভাবনার মাঝেই হঠাৎ তার মোবাইল ফোন বাজতে শুরু করে । ইরফান মোবাইলটা হাতে নেয় । আর দেখে মোবাইলের এক পাশে উঠে আছে Reject মাঝে আছে Slide up to answer আর উপর তার উপর একটা নাম ভেসে উঠেছে । নামটা হচ্ছে Rubi .

.
.

চলবে…………….

[ বিঃদ্রঃ চলার পথে হাজারো মানুষের সাথে দেখা হয় কথা হয় । কেউ কেউ আবার ক্ষনিকের দেখা হয়ে যাওয়ার মাঝেও অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়ে যায় । তেমনি দুটি চরিত্র গফুর মিয়া আর জয়তুন্নেসা । বয়সের সন্ধিক্ষণে এসেও আজ তারা একে অপরের সাথে যুক্ত । আর তাদের নাতি সেও হয়তো ইরফানের মতই একজন তবে সম্পূর্ণ আলাদা । ‘তোমার বেলীফুল ‘ উক্তিটি দিয়ে ইরফানকে যা বুঝিয়েছেন সেটার মর্ম ইরফান কতটুকু বুঝেছে আমার জানা নেই , তবে ভালোবাসার একটা সঠিক সময় এবং সঠিক গন্ডি থাকে । দুই নৌকায় কি পা দিয়ে কখনো মানুষ সামনে এগুতে পেরেছে , পারে নি । হয়তো সাময়িকী ভাবে এগিয়েছে । কিন্তু এক সময় সঠিক গন্তব্যে পৌঁছানোর আগেই হয়তো নৌকা ডুবিতে প্রাণ হারাতে হয় । আবেগের বশে কাছে টেনে বিবেকের তাড়নায় আবার ছুড়ে ফেলে দেয়াটা হয়তো খুব সহজ কিন্তু , যাকে একবার কাছে টেনে আবার ছুড়ে ফেলা হচ্ছে সেই মানুষটা কিভাবে বেঁচে থাকতে পারে ? বেঁচে থাকা যায় কি ? আমার জানা মতে যায় না , বার বার এত কষ্ট এত অপমান এত লাঞ্চনা সহ্য করে বেঁচে থাকা হয়তো যায় কিন্তু জীবন্ত লাশ হয়ে । বরাবরের মতই প্রশ্ন হাজার কিন্তু উত্তরের খাতাটা আজও শূন্য । হাজারের মাঝে একজন বেলীর উত্তরের খাতাটা এই সেই উত্তরের খাতা যার ফলাফলটা হয় বরাবরের মতই শূন্য । আমার কথা গুলো দ্বারা কারো মনে কষ্ট আসলে আমি অত্যন্ত দুঃখিত ]

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল পর্ব_১০

0

ঝরে_যাওয়া_বেলীফুল
পর্ব_১০
লেখিকা : আফরোজা আক্তার

সকাল বেলা ইরফান কি যেনো মনে করে বেলীর রুমের দিকে যায় । তখন বেলী নিজের কিছু জামাকাপড় গুছিয়ে নিচ্ছিলো । মিনুও সেখানেই ছিল । তখনই ইরফান কিছু শুনতে পায় ।

– ভাবী , আপনেরা কি আইজকাই যাইবেন ?
– হু ,
– কবে আইবেন ?
– শনিবারে ,
– তাইলে আমিও কি শনিবারে আইতাম ?
– নাহ তুমি রবিবারেই এসো ।
– আইচ্ছা , ভাবী কি পইরা যাইবেন বাইত ?
– আমি তো বোরখা পরি ।
– এই ফুরান বোরখাডা নি ফরবেন ?
– নতুন পাবো কোথায় ?
– ভাইয়েরে কন ,
– নাহ থাক , যেটা আছে সেটাই পরে যাবো , টাকা অপচয় করে কি লাভ ?
– রুবি ভাবী দুইন্নার টাকা উড়ায় , আর আপনে একটা বোরখা কিনবেন তাতেও অপচয় কন । আপনে মানুষ নাকি রোবট
– তুমি কথা বেশি বলো মিনু । কারো অনুপস্থিতিতে তার সম্পর্কে সমালোচনা করা ঠিক না , কবে বুঝবে তুমি মিনু ?
– থাউক আমি আর কিছু কমু না ।

ইরফান এতক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে ওদের কথাগুলো শুনে । বেলী তেমন হাই ফাই চলাফেরা করে না । একদম নরমাল তার চলাফেরা । মেয়েটার যা প্রয়োজন তার চাইতেও কম প্রকাশ তার । সবটা চায় না সে । ইরফান আর কিছুই বলেনি । বেলীর রুমে যায় সে । বেলী তখন জামাকাপড় গুছিয়ে নিচ্ছিলো ।

– বেলী ,,,,,,?
– জ্বি ,
– তুই জামাকাপড় গুছিয়ে নে , আমি ১ টার মধ্যে চলে আসবো ।
– হুম আচ্ছা ।
– কিছু লাগবে তোর ?
– নাহ ,
– কিছুই লাগবে না তো ?
– নাহ , লাগবে না সব কিছুই আছে ।
– আচ্ছা ।

ইরফান বেলীর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে , কত সহজেই নিজের চাওয়া পাওয়া গুলোকে বিসর্জন দিতে পায়ে সে । হালকা হাসি দিয়ে বেরিয়ে যায় ইরফান ।
অফিসে গিয়ে বসের সাথে কথা বলে দুই দিনের ছুটি নেয় ইরফান । আজকের দিন টা আর শনিবারের দিনটা । শুক্রবার তো এমনিতেই অফ ডে । ভেবেছিল আজকে হাফ টাইম করবে কিন্তু জরুরী কাজ থাকায় আজকেই ছুটি নিয়ে নেয় ইরফান । ছুটি নিয়ে সোজা বেরিয়ে যায় সে অফিস থেকে ।
এইদিকে বেলা সাড়ে ১২ টা । মিনুও রেডি , কিছুক্ষন পরই মিনু চলে যাবে । অনেকদিন হয়েছে সেও বাড়িতে যেতে পারেনি । তাই ইরফান এর কথা অনুযায়ী মিনুও দুইটা দিন নিজের বাড়িতে গিয়ে থেকে আসবে । ইরফান এলেই মিনু বেড়িয়ে যাবে । বেলীও গোসল করে ফ্রী হয়ে নেয় । চুলগুলো অনেক বড় তার , তাই চুলগুলো শুকানোর জন্য ছেড়ে রেখে দেয় বেলী ।
১ টা নাগাদ ইরফানও চলে আসে । ইরফান বাসায় আসলে মিনুও চলে যাবে বলে ইরফানের কাছে যায় ।

– ভাই ,,,,,,?
– মিনু আয় ভেতরে ।
– ভাই তাইলে আমি যাই ,
– এখনি যাবি ?
– হ , নাইলে বাস পামু না । আপনেরা কোন সময় যাইবেন ?
– আমরা ৪ টার বাসে যাবো , আচ্ছা এইটা রাখ । যাওয়ার সময় বাড়ির জন্যে কিছু নিয়ে যাস ।

মিনু দেখে ইরফান তাকে ১০০০ হাজার টাকার একটা নোট সাধে । ইরফানের সব কিছুই ভালো লাগে মিনুর কিন্তু যখন তার বেলী ভাবীকে মারে তখনই মিনু ইরফানের গুষ্টি এক করে । ইরফানের হাত থেকে টাকাটা নেয় মিনু । তখন ইরফান আবার বলে উঠে ,

– বেলী কি করে রে ,
– ভাবী তো রুমে , চুল শুকায় ।
– আচ্ছা তুই তাহলে বেরিয়ে যা ।
– আইচ্ছা ভাই তাইলে আসি ,
– আচ্ছা সাবধানে যা । রবিবারে চলে আসিস ।
– আইচ্ছা ।

মিনু ইরফানের রুম থেকে বেরিয়ে বেলীর রুমে যায় । সেখানে বেলীর সাথে কথা বলে বিদায় নিয়ে বিসমিল্লাহ বলে বেরিয়ে যায় মিনু । বেলী কিছুক্ষণ রুমেই ছিল , তারপর ২ টা বাজে ইরফানের রুমের দরজার সামনে যায় সে । পর্দা সরিয়ে ইরফানকে ডাকে সে ।

– শুনছেন,,,,,,?
– হ্যাঁ ,
– খেতে আসেন , ভাত বাড়ছি
– আসতেছি ,

ইরফান বেলীর ডাকে ডাইনিং টেবিলে যায় । সেখানে সব গুছিয়ে রাখা আছে । বেলী সব সময় টেবিলটা গুছিয়েই রাখে হয়তো । রান্নাঘরের দিকে উঁকি দেয় ইরফান । বেলী তখন রান্নাঘরে সব কিছু গুছিয়ে রাখছে । দুইদিন পর ফিরবে তারা , তাই সব কিছু গুছিয়ে রেখে যাচ্ছে সে । ইরফান বেলীর চুলের দিকে তাকিয়ে আছে । ভেজা চুলগুলো প্রায় অনেকটাই শুকিয়ে গেছে । হাটুর নিচ অবদি চুল বেলীর । মাশা-আল্লাহ চুলগুলো মনে হচ্ছিলো আল্লাহর নিজের হাতে বানানো ।ইরফান কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চেয়ারে বসে পড়ে । চেয়ারে বসেই বেলীকে ডাকে ইরফান ।

– জ্বি ,
– আমি কি কুকুর নাকি ?
– ছিহ ! কি সব বলেন ?
– বাসার কুকুরকে মানুষেরা এইভাবেই ভাত দেয় । ভাত পানি সামনে দিয়ে আরেক জায়গায় সরে থাকে ।

বেলী বুঝে যায় ইরফানের কোথায় সমস্যা হচ্ছে । বেলীর এই কাজটা করা হয়তো উচিত হয়নি । শত হোক কাউকে খাবার দিয়ে তার সামনে থেকে চলে যেতে হয় না
এটা অভদ্রতা করা হয় । ওই ব্যাক্তিকে অসম্মান করা হয় ।

– আসলে আমি রান্নাঘরের জিনিসপত্রগুলা গুছিয়ে রাখতেছিলাম ।
– খাওয়ার পরে কি গুছানো যেতো না ?
– আচ্ছা বসেন আপনি , আমি আছি এখানে ।
– তুই খাবি না ?
– পরে খাবো ,
– বাড়িতে গিয়ে খাবি , তাই না ?
– বাড়ি যেতে যেতে তো সন্ধ্যার পর হয়ে যাবে ।
– তাহলে কোন পরে খাবি ? নাকি আমার সামনে তোর খেতে মন চায় না ।

বেলী বুঝে যায় ইরফানের এখন প্রচুর রাগ উঠে গেছে । তাই সে চুপচাপ খেতে বসে যায় ।

– বেলী , আমি জানোয়ার না ঠিকাছে ? হ্যাঁ হয়তো আমার আচরণ জানোয়ার সুলভ কিন্তু আমিও মানুষ , জানোয়ার নই
– আপনি এইসব কি বলেন ? নেন ভাত খান ।

দুজনে এক সাথে খেয়ে নেয় । খাওয়ার সময় ইরফানের নজর বার বার বেলীর দিকে যাচ্ছিলো । বেলী বরাবরই শান্ত স্বভাবের । খাওয়ার সময়ও শান্ত হয়ে থাকে সে । খাওয়ার পর বেলী সব গুছিয়ে নিজ রুমে চলে যায় । প্রায় ৩ টার মত বেজে গেছে । আধা ঘন্টার মধ্যেই তারা বেরিয়ে পড়বে ৷ তাই কোন রকম রেডি হয়ে নিবে সে । কিন্তু এরই মাঝে বেলীর রুমের দরজায় টোকা পড়ে । বেলী দরজা খুলে দেখে ইরফান দাঁড়িয়ে আছে ।

– কিছু বলবেন ?
– হু , ভেতরে ঢুকতে দে আগে ।
– ওহ , আসেন ।

ইরফান রুমে এসে বেলীকে কিছু প্যাকেট দেয় । বেলীও অবাক ইরফানের হাতের প্যাকেট দেখে । বেশ অনেকগুলোই প্যাকেট দেখতে পাচ্ছিলো বেলী ইরফানের হাতে ।

– কিসের প্যাকেট এইগুলা ?
– খুলেই দেখ কিসের প্যাকেট এইগুলা ।

বেলী প্যাকেট গুলো খুলে বেশ খানিকটা অবাক হয় । দুটো নরমাল সুতি শাড়ি , দুটো হাফ সিল্ক শাড়ি , তার সাথে ম্যাচিং হিজাব , আর একটা দামী বোরখা , এক জোড়া দামী জুতা , তার সাথে আরেক জোড়া সিম্পল স্যান্ডেল , একটা লেডিস হ্যান্ড পার্স সহ সব প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আসছে ইরফান বেলীর জন্যে ।
বেলী জিনিসপত্র গুলো দেখছিল আর বারবার ইরফানের দিকে তাকাচ্ছে । এতকিছু এর আগে কখনো আনে নি ইরফান বেলীর জন্যে ।

– পছন্দ হইছে ?
-………..
– কিরে পছন্দ হইছে ?
– এত কিছু হঠাৎ করে ?
– এমনি আনতে মন চাইলো ।
– কত গুলো টাকা খরচ হলো । কি দরকার ছিল ।
– এগুলোর দাম খুবই সীমিত , টাকা নিয়ে ভাবিস না ।
-…………..
– রেডি হয়ে নে ।
– আচ্ছা ,
– কি পরবি ?
– বোরখা-ই পরি ,
– শাড়ি পরতে পারস না ?
– পারি , কিন্তু ভেজাল লাগে , বোরখা-ই পরি ।
– আচ্ছা পরে নে । তাড়াতাড়ি কর

তারপর ইরফান রুম থেকে বেরিয়ে যায় । বেলীও নতুন একটা সুতির জামা পরে নিয়ে উপরে বোরখা পরে নেয় । আর ইরফানের দেয়া একটা হিজাব পরে নেয় । বেলী অনেক সুন্দর করে হিজাব বাধতে পারে । হালকা লিপস্টিক আর একটু কাজল এটাই বেলীর সাজ । সে রং চং দিতে জানে না । এটাই তার কাছে বেশি কিছু । অন্যদিকে সব গুছিয়ে নেয়ার পর ইরফান তার জামাকাপড় নিয়ে আসে বেলীর রুমে ।

– বেলী ,,,,,,?
– জ্বি ,
– এই ট্রলিতে তোর আর আমার জামাকাপড় গুলো গুছা ।
– কেন ?
– কি কেন , আমরা কি আলাদা জামাকাপড় নিবো নাকি ।
– সব কিছুই তো আলাদা , তাহলে কাপড় এক হয়ে কি হবে ।

বেলীর কথায় ইরফান চুপ হয়ে যায় । তখন নিজেই বেলীর আর তার জামাকাপড় গুলো গুছিয়ে নেয় । বেলী তখন চুপ করে দাঁড়িয়ে ইরফানকে দেখছিল । ইরফানকে আজ দারুণ লাগছিল । কালো শার্ট আর ব্ল্যাক জিন্সে বেশ সুন্দর লাগছিল তাকে । নিজেকে বড্ড বেশি বেমানান লাগছিল ইরফানের সাথে । সত্যিই বড্ড বেশিই বেমানান লাগছিল । তার সাথে হয়তো রুবিকেই দারুণ মানায় । তাই তো সে থাকা সত্ত্বেও রুবিকে ঘরে আনা হয়েছে । নিয়তি বড্ড কঠিন জিনিস । যতই খারাপ হোক না কেন মানতে হয় ।

[ বিঃদ্রঃ একটা মেয়ে কতটা হেরে গেলে নিজেকে তুচ্ছ ভাবতে পারে । কতটা কষ্টে জর্জরিত হলে নিজেকে বেমানান ভাবতে পারে । আমরা নারীরা যতই এগিয়ে যাই না কেন , কোথাও না কোথাও আমাদের পিছিয়ে যেতে হয় । আর সেখানেই আমাদের ব্যর্থতা । কষ্ট পেতে পেতে আমরাও এক সময় ক্লান্ত হয়ে পরি । আর তারপর হাল ছাড়তে হয় এমন হাজারো বেলীকে ]

.
.

চলবে……………….

আসসালামুয়ালাইকুম ,

শরীরে অনেক জ্বর নিয়ে লিখেছি । তাই দয়া করে একটু বুঝে নিবেন । আমি চাইলে না ও দিতে পারতাম । তবুও দিয়েছি কারণ আমার পাঠকরা বসে আছে বলে । সরি , এত ছোট দেয়ার জন্যে , ক্ষমা করবেন এর জন্যে । একটু সুস্থ হয়ে নেই ইনশাআল্লাহ আরও বড় করে দিবো পরবর্তী পর্ব । দোয়া করবেন আমার জন্যে ।

আসসালামুয়ালাইকুম