Wednesday, July 16, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1571



ওয়ারদূন আসরার পর্ব-০৪

0

#ওয়ারদূন_আসরার
#লাবিবা_ওয়াহিদ
“০৪”

——————————-

কমলা দেবী কিছুটা রিয়েক্ট করে বলে,”ওরে আমার সোয়ামী ডা কতো কষ্ট পাইতাসে আইয়ো সোয়ামী ভিত্রে আইয়ো ও মল্লিকা আমার সোয়ামির লেইগা সরবত লইয়া আহো।”

জাইফ ভেতরে ঢোকার পর যীনাত ভেতরে আসতে নিলেই কমলা দেবী থামিয়ে বলে,”ওই ছোকড়ি তোরে আই আইতে কইনাই আগে নিজের পরিচয় দে।”

দেবনাথ দেব কিছুটা বিরক্তি সুরে বলে,”উফফ দিদি এমন করছো কেন ও আমার বন্ধুর নাতিন হয়। গতকাল এক দুর্ঘটনায় ওর পুরো পরিবার শেষ হয়ে গেছে।”

দেবনাথ দেবের কথায় যীনাতের চোখ বেয়ে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে। কমলা দেবী সহ উপস্থিত সবাই যীনাতের দিকে তাকায়। সকলের মনেই কিছুটা দয়া কাজ করছে শুধু কমলা দেবী বাদে। দেবনাথ দেব যীনাতকে নিয়ে ভেতরে আসে এবং কাজের মেয়ে মিনিকে ডাকে।

– মিনি।

– জ্যা কর্তা কন।

– যীনাতকে দক্ষিণের শেষের ঘরটায় নিয়ে যা আর ঘর পরিষ্কার করা লাগবে না আমি আগেই করিয়ে রেখেছি।

– আইচ্ছা! দিদিমনি আফনে আমার লগে আইয়েন।

যীনাত মিনির পিছে পিছে উপরে চলে গেলো। এবার কমলা দেবী বলে,”মাইয়াডার উপ্রে এতো দরদ কেন ভাই তোর? আর মাইয়াডা ওমন ঘুমটা দিয়া রইসে ক্যান? মাইয়া কি মুসলিম?”

– সেটা তোমার না জানলেও চলবে। মেয়েটা বিপদে আছে, আপাতত তাকে ভালো রাখার চেষ্টা করো অনেক কষ্ট সহ্য করেছে।

– বাবা আপনি চিন্তা করবেন না আমি মেয়েটার খেয়াল রাখবো।(সরবত নিয়ে আসতে আসতে)

– হুম তোমার উপর ভরসা রেখেছি বউমা।

বলেই দেবনাথ দেব নিজের রুমে চলে যায়। মল্লিকা দেবী জাইফকে সরবত দিয়েই উপরে চলে যায় যীনাতের কাছে। যীনাত তখন মাত্র ফ্রেশ হয়ে বসেছে। মল্লিকা দেবী দরজায় দাঁড়িয়ে বলে,”আসবো!”

যীনাত চট করে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে মধ্যবয়সী মহিলা যাকে ওই কমলা দেবী সরবত বানাতে পাঠিয়েছিলো। যীনাত হাসার চেষ্টা করে বলেন,”আসুন অনুমনি নেয়ার প্রয়োজন নেই।”

মল্লিকা দেবী যীনাতের হাসি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলো। যার গতদিন পরিবার হারালো সে আজ এতোটা শক্ত সত্যি অবাক করার মতো।মল্লিকা দেবীও একটা হাসি দিয়ে বলে,”তোমার নাম কি মা?”

– জ্বী জাফিয়া যীনাত।

– বাহ বেশ সুন্দর নাম তো কিন্তু যীনাত নাম তো…

– হুম আন্টি ঠিক ধরেছেন আমি সনাতন ধর্মাবলম্বীর নই। এখন যদি আপনারা আমার সত্যি টা জেনে রাখতে না চান আমি চলে যাবো। শুধু শুধু আপনাদের বোঝা হয়ে থাকতে চাইনা।

যীনাত নিচের দিকে তাকিয়ে খুবই শান্ত সুরে কথাগুলো বললো। মল্লিকা দেবী খুবই মুগ্ধ হয়ে দেখছে। মেয়েটা যেমন সুন্দর তেমনই তার ভদ্রতা। চেহারার মায়ায় আগেই পড়ে গেলো এখন কথার মায়ায়। মল্লিকা দেবী মুচকি হেসে বলে,”না মা বোঝা কেন হবে আমরা তোমাকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসবো। আমার তোমাকে বেশ ভালো লেগেছে। জানো আমার একটা মেয়েও আছে সে কখনো আমার সাথে ভালো ব্যবহার করেনি।”

যীনাত অবাক হয়ে মল্লিকা দেবীর দিকে তাকিয়ে বলে,”কেন?”

মল্লিকা দেবী ছলছল চোখে কিছুটা তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, “আমি একজন এতিম মেয়ে মা তবে আমার পড়াশোনা অনেক ভালো ছিলো ভালো জবও করতাম। সেই থেকেই আমার শাশুড়ী আমায় পছন্দ করে। সে আমার জাতপাত না দেখেই বিয়ে দিয়েছিলো রিকেশের বাবার সাথে। আর আমার মেয়ে বড় হওয়ার পর জানতে পারে আমি এতিম সেই থেকে আমার সাতগে দুর্ব্যবহার করে।”

আর কিছু বলতে না পেরে আঁচলে নিজের চোখের জল মুছলো মল্লিকা দেবী। যীনাত চুপচাপ শুনলো এবং মনে মনে ধিক্কার জানালো ওই মেয়েকে। কি করে পারে নিজের জম্মদাতা মায়ের সাথে এমন আচরণ করতে? যীনাত কৌতুহল বশত জিজ্ঞেস করলো,”আপনার মেয়েকে তো দেখিনি আন্টি।”

– সে এখানে থাকে না। সে যাইহোক তুমি তো কোনো জামা-কাপড় আনোনি মা তোমার জন্য কি শপিং করতে যাবো?”

মিনি তখনই হাতে কিছু ব্যাগ নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো আর বললো,”না কর্তামা আফনের কোনো খানে যাওন লাগতো না ছোটদাদা আর হাতে দেহেন কতোডি ব্যাগ ধরাইয়া দিসে দিদিমনির জন্য।”

মল্লিকা দেবী হেসে বলে,”বাহ বেশ ভালো তো। দেখেছো যীনাত আমার ছেলের কান্ড। সে কতোদিকে খেয়াল রাখে!”

যীনাত উত্তরে শুধু একটা মুচকি হাসি দেয়। ভেতরে যে কি চলছে সেটা একমাত্র যীনাতই জানে। যীনাত বুঝে নিয়েছে এগুলো দায়িত্বের থেকেই তাকে দিয়েছে জাইফ।

তারপর অনেকক্ষণ যীনাত এবং মল্লিকা দেবী কথা বললো। মল্লিকা দেবী বেশ ভালো যীনাতকে একদমই মনে করতে দেয়নি তার অতীতের কথা। মন খুলে হেসেছে আজ যীনাত। দরজা থেকে দেবনাথ দেব দেখছে যীনাতের হাসি। আহহ কতোদিন পর মেয়েটা প্রাণ খুলে হাসছে।

জাইফ বারান্দায় দাঁড়িয়ে যীনাতের হাসি দেখছে আর নিজেও মুচকি মুচকি হাসছে। যীনাতের হাসিতে জাইফ আলাদা এক তৃপ্তি পাচ্ছে কিন্তু কেন সেটা জাইফের অজানা। জাইফ চুপচাপ হাসি দেখছে আর ভাবছে,”এই চেহারায় কান্না নয় হাসিটাই স্যুট করে। আমি কি আপনার কষ্টের ভাগিদার হবো যীনাত?”

রাতে খাবার টেবিলে সবাই একসাথে। একে একে সবার সাথে যীনাত পরিচিত হলো। বয়স্ক বলতে দেবনাথ দেব আর কমলা দেবী। কমলা দেবী বিধবা হওয়ার পর থেকেই ভাইয়ের বাড়িতে থাকে। কমলা দেবীর দুটো ছেলে মেয়ে। ছেলে পরিবার নিয়ে অস্ট্রেলিয়া থাকে আর মেয়ে দুইবছর আগে মারা যায়। তবে তার মেয়ের একটা মেয়ে আছে যে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে নাম তার স্নিদ্ধা। স্নিগ্ধার মা মারা যাওয়ার পর তার বাবা নতুন বিয়ে করেছে তাই স্নিগ্ধা নানুবাড়ি তেই থাকে। স্নিগ্ধা আর যীনাত প্রায় এক বয়সী। দেবনাথ দেবের এক ছেলে যার নাম নিকেশ। নিকেশের দুই ছেলে এক মেয়ে। রিকেশ, স্বর্না আর জাইফ। স্বর্না হলো সবার ছোট। তবে স্বর্ণা এখানে থাকে না সেও নাকি হোস্টেলে থেকেই পড়াশোনা করে।

কমলা দেবী খেতে খেতে বলে,”তুই কিন্তু আমারে ঠাকুমা কইবি না কইয়া দিলাম আগেই।

– তাহলে তুমি ঠাম্মি বইলো কেমন?

– ওই লিকপিকে শিং ঠাম্মি ক্যা কইবো?

কমলা দেবীর এমন কথায় যীনাত বিষম খায় এমন অবস্থা। এই বয়সে সে এভাবে গালাগাল করে? জাইফ যীনাতের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলে,”ও আমার কমলা বউ তুমি এমনে কথা কইলে আমি কিন্তু তোমার লগে সব সম্পর্ক শেষ কইরা দিমু।”

যীনাত ড্যাবড্যাব করে জাইফকে দেখছে। ওরা এতো বড় ঘরের হয়েও কি করে এভাবে কথা বলে তা বুঝতে হিমশিম খায় যীনাত। তবুও না হেসে পারে না মিটমিট করে হাসে। জোরে হাসলে এখানে ঘোর বিপদ সে বেশ ভালো বুঝতে পারে।

– ও আমার সোয়ামী এইডা তুমি কি কইলা? আইচ্ছা যাও কাউরে কিচ্ছু কইতাম না। এহন খাও আই তোমারে খাওয়াই দেই তইলে ভালোবাসা বাড়বো।

জাইফ যীনাতের দিকে একবার তাকিয়ে আবার কমলা দেবীর দিকে তাকিয়ে বলে,”নাহ আজ তোমার সাথে রাগ করেছি তাই খাবো না!”

– ওই ছ্যামড়া তোরে কয়বার কমু আর লগে শুদ্ধ ভাষায় কথা কইবি না।

– বউ তুমি আমার সামনে আমার ভাইরে এমনে সোয়ামী কইয়ো না আর দিল ফাইট্টা যায় গো ফাইট্টা যায়।

– ওই তুই আবার আগো ভিত্রে সতান হইতে আইছিস?

– সতান কি গো বউ?(ভ্রু কুচকে)

– এতো মানে কইতে পারুম না। তুই কোনো মাইয়া না যে তোরে সতীন কমু তাই তোরে সতান কইলাম।

কমলা দেবীর কথা শুনে রিকেশ হো হো করে হেসে দিলো সাথে সবাই। নিকেশ হাসি থামিয়ে যীনাতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,”মা এটা নিজের পরিবারই মনে করবে। আমরা সবাই সবার আপনজন আর কখনো যদি সমস্যা হয় আমায় বলবা আমি সবসময় বাবা হিসেবে তোমার পাশে আছি।”

– আর ভাই হিসেবে সবসময় তোমার পাশে থাকবো বোন।(রিকেশ)

যীনাত এতো এতো মানুষের ভালোবাসা পেয়ে আল্লাহ’র দরবারে অনেক শুকরিয়া জ্ঞাপন করে। জাইফ আড়চোখে যীনাতের হাসি মুখ টা দেখছে। সবার খাওয়া শেষে যে যার রুমে চলে যায়।

যীনাত রুমে যাচ্ছিলো ওমনি খেয়াল করে জাইফও তার পিছে পিছে আসছে। এতে যীনাত কিছুটা ঘাবড়ে গেলো কোনো মতলব নেই তো? যীনাত তৎক্ষনাৎ পিছে ফিরে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে বলে,”কি হচ্ছে কি আপনি আমার পিছে পিছে আসছেন কেন?”

– ওহ রিলেক্স আমি আপনার পিছে পিছে কেন যাবো মাথার স্ক্রু কি ঢিলা হয়ে গেছে আপনার?

– কিহ বললেন আপনি আমার মাথার স্ক্রু ঢিলা?(নাক ফুলিয়ে)

– আমি তো তাই দেখছি!

– আপনাকে যদি এখন না থামাতাম তাহলে তো আপনি আমার রুম অব্দি চলে যেতেন তারপর…

বলেই একটা গিললো যীনাত। তারপর আবার বলে,”দেখেন বিয়ে করেছেন বলে যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন না।”

– আপনার মনে হয়না আপনি সবকিছু দুই লাইন বেশি বুঝেন ওইদিকে শুধু আপনার একার ঘর না এর অপজিটের রুমটা আমার ওকে? আর বিয়ে করেছি ঠিকই এখনো কিন্তু আপনাকে স্পর্শ করার কথাও বলিনি।

এবার যীনাত কিছুটা লজ্জা পেলো তারপর কোনোরকম কথা না বলে রুমে চলে যায়। আর জাইফ সেখানে দাঁড়িয়েই নিশব্দে হাসলো তারপর নিজেও রুমে চলে গেলো।

– পাহ… পানি!
পানির তৃষ্ণায় পাগল হয়ে যাচ্ছে যীনাত তবুও সামনে থাকা মানুষ টা তার দিকে পানি এগিয়ে দিলো না। যীনাত কিছুটা কাঁপা কাঁপা হাত এগিয়ে নিতে যাবে লোকটি গ্লাসটা আরো সরিয়ে দেয় যাতে করে যীনাত পানি নিতে না পারে।
– বাচার খুবই ইচ্ছা বুঝি? তাহলে আমাকে বিয়ে কর।
যীনাত যেনো কথাই বলতে পারছে না এতোটাই গলা শুকিয়ে এসেছে। তবুও খুবই ধীরে বললো,”আমার জীবন থাকতে কোনো অমানুষকে বিয়ে করবো না।”
যীনাতের কথায় লোকটি ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠে। হাসির শব্দতে যীনাতের মাথা ধরে গেলো। কি করবে সে নিজেই বুঝতে পারছে না। নিজের গায়ে শক্তি পর্যন্ত নেই! কি করে শক্তি থাকবে তার তাকে যে প্যারালাইসিস এর ইনজেকশন দিয়ে দিয়েছে ওই অমানুষ টা। কি চাইছে এই বদমাইশ টা সেটা যীনাত বুঝতে সক্ষম হচ্ছে না। সে কখনোই এমন অমানুষ, সাইকো কে বিয়ে করবে না যে কিনা নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য যীনাতের মতো একজন অসহায় মেয়েকে এভাবে প্যারালাইজড করে।

পানি না পাওয়ায় যেনো যীনাত আরও দুর্বল হয়ে গেলো। শেষবার শুধু এইটুকু বলে দিলো,”আমি যদি একবার বেচে ফিরি তোর মতো কুলাঙ্গার কে হয় আমার হাতে মরতে হবে না হয় ওই ‘ওয়ারদূন আসরার’ এর সাহায্যে!

বলেই যীনাত জ্ঞান হারালো। সঠিক বলা যাচ্ছে না সে আদৌ জ্ঞান হারিয়েছে নাকি কোমায় গেছে। লোকটি আবার চিৎকার করে হেসে বলে,”আমার তোকে চাই যীনাত! তোর আর আমার মাঝে যদি *ওয়ারদূন আসরার* ও আসে আমি তাদের হাতে তাকে তুলে দিবো!! আমাকে আমার কার্য হাসিলের থেকে কেউই আটকাতে পারবে না।”

বলেই সে রুমে এসির পাওয়ার আরও ৩৫ডিগ্রি বাড়িয়ে দরজা লক করে চলে গেলো।

-এতো ঠান্ডায় কোন মানুষ বেচে থাকতে পারে?? মানুষ কি করে এতোটা টর্চার কারো প্রতি করতে পারে? আল্লাহ তুমি সহায় হও তুমিই পারবে একমাত্র মেয়েটাকে বাচাতে।

যীনাত লাফ দিয়ে উঠে বসলো আর ভয়ে হাঁপাতে থাকে। উপরে ফ্যান চলছে তবুও যেনো ঘেমে একাকার হয়ে গেলো। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে আসছে তার তাই কাঁপা কাঁপা হাতে বেডসাইড থেকে পানি নিতে যায় ওমনি ঘড়িটা হাতে লেগে পড়ে যায়।

জাইফ বেলকনিতে বসে ল্যাপটপে অফিসের কাজ করছিলো ওমনি কোনো শব্দ শুনে আশেপাশে তাকায়। বেশ বুঝতে পারলো আওয়াজ টা যীনাতের রুম থেকে আসছে তাই ল্যাপটপ রেখে ওইভাবেই একপ্রকার ছুটে চলে গেলো যীনাতের রুমে। যীনাতের রুমের সামনে এসে দেখে……..

——————————

চলবে!!!

ওয়ারদূন আসরার পর্ব-০৩ | বাংলা রোমান্টিক ভালোবাসা গল্প

0

#ওয়ারদূন_আসরার
#লাবিবা_ওয়াহিদ
“০৩”

——————————-

যীনাত চুপ করে ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো আকাশের তারার ভিরে নিজের ভাইকে খুঁজে যাচ্ছে। যীনাতের ছোটবেলার স্বভাব এখনো কাটেনি। ছোটবেলায় যখন দাদী মারা গেছিলো সে আকাশের যেকোনো একটা তারার সাথে বেশ বকরবকর করতো আর আজ এক তারার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগে,”উমমম…. হ্যাঁ ওই তারাটা বেশি ঝলমল করছে এর মানে আমার ফুয়াদ ওই তারাটাই! কেমন আছিস ভাই? ভালো তো থাকবি-ই কিভাবে আমাকে একা ফেলে চলে গেলি। জানিস ভাই আমি ভালো নেই। এই সমাজ টা বড্ড স্বার্থপর রে। এই সমাজ বিপদে কারো পাশে দাড়াতে নয় উল্টো কথার খোটায় মেরে ফেলতে পারে। কেন আমাকে একা ফেলে চলে গেলি? আমাকেও তোর সাথে নিয়ে যেতি আমি যে আর পারিনা এসব যন্ত্রণা সহ্য করতে।”
বলেই ডুকরে কেঁদে উঠে যীনাত।

এইদিকে,,

– দাদু আসবো?

দেবনাথ দেব পত্রিকা পড়ছিলেন এর মাঝে কেউ ডাকতেই দরজার দিকে তাকায়। দরজায় জাইফ দাঁড়িয়ে। দেবনাথ দেব পত্রিকা ভাজ করতে করতে বলে,”এসো এসো পারমিশন নেয়ার কি আছে?”

দাবনা দেবের অনুমতি পেয়ে জাইফ দাদু পাশে গিয়ে বসলো। দেবনাথ দেব জিজ্ঞেস করে,”কিছু বলবে?”

– জ্বি দাদু। আসলে একটা বিষয় নিয়ে অনেকটা কনফিউজড।

– কোন বিষয়?

– তুমি আমাকে কেন কখনো কোনো পূজো বা আমাদের রীতিতে থাকতে দাওনি?

দেবনাথ দেব তখনই মুখ টা গম্ভীর করে ফেলে এবং বলে,”তুমি কি কখনো এগুলো পালন করেছো যে আমায় এটা বলছো?”

জাইফ মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে,”ইয়ে মানে আমার তো এগুলোতে ইন্টারেস্ট নেই কিন্তু তবুও তুমি…”

– তোমার যেমন ইন্টারেস্ট নেই তাই তোমায় বসতেও দেইনা বুঝেছো? আমি পছন্দ করিনা কোনো কিছুতে জোর করা।

দুজনের মাঝে নিরবতা। কিছুক্ষণ পর নিরবতা ভেঙে জাইফ বলে,”একটা কথা তোমাকে বলতে চাই দাদু, আসলে আমার কেন জানি ইসলাম ধর্মের প্রতি টান অনুভব হয়। কিন্তু কেন সেটা আমি আজও বুঝিনি আর….”

– আর….

জাইফ মাথা নিচু করে বলে,”আমি নামাজ শিখে মাঝে মধ্যেই লুকিয়ে নামাজ পড়ি।”

কথাটা শুনে দেবনাথ দেব আশার আলো দেখতে পেলো। দেবনাথ দেব হেসে বলে,”তুমি যে কি করেছো তা তোমার ধারণার বাইরে। আমি যে এতোদিন এটাই চেয়েছিলাম। গুড জব মাই সান!”

জাইফ ভেবেছিলো তার দাদু তাকে বকবে কিন্তু এর উল্টো টা যে হবে তা কখনো জাইফ ভাবতেই পারেনি।

এমন সময়ই দেবনাথ দেবের ফোনে কল আসে। তিনি রিসিভ করে বলে,”হ্যালো!”

————————–

– কখন?

—————————

– বাহ বেশ ভালো তাহলে এখন কি করনীয়?

—————————-

– ওকে আমি নিয়ে আসছি, জ্বি, ঠিক আছে বাই।

বলেই দেবনাথ দেব খুবই আনন্দিত হয়ে ফোন রাখলো এবং জাইফকে তাড়া দিয়ে বললো,”জাইফ রেডি হয়ে নেও আমাদের এক জায়গায় যেতে হবে।”

– আমি রেডিই আছি দাদু চলো তুমি।

তারপর দুজন একসাথে নিচে নামে। নিচে নামতেই মল্লিকা দেবী একটা পূজোর থালা নিয়ে জাইফের সামনে এসে দাঁড়ায় এবং বলে,”আজ তোর মঙ্গলের জন্য শিব ঠাকুরের পূজো দিয়ে এসেছি বাবা আয় তোকে চন্দন টা দিয়ে দি।”

বলেই মল্লিকা দেবী চন্দন দিতে এগিয়ে আসলে জাইফ দু’পা পিছিয়ে গেলো এবং অনেকটা অস্বস্তিতে পড়ে গেলো। দেবনাথ দেব জাইফের অস্বস্তি বুঝতে পেরে মল্লিকা দেবী কিছুটা কঠোর হয়ে বলে,”বউমা আমাদের কাজ আছে যেতে দাও আর তুমি জানো না এসবে জাইফের অস্বস্তি হয় তবুও কেন বারবার ওকে অস্বস্তিতে ফেলো? তুমি তো ওর মা তোমার তো বোঝা উচিত।”

– হ্যাঁ আমি তার মা! মা হয়ে কি করে সন্তানের খারাপ চাই আপনিই বলুন? আমার ছেলেটার যদি কোনো বিপদ ছুঁতে না পারে তার জন্যই তো…

দেবনাথ দেব আর কিছু বলতে না দিয়ে জাইফকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে! কথায় কথা বাড়বে যা দেবনাথ দেব চায়না। দেবনাথ দেব চলে যেতেই মল্লিকা দেবী আঁচলে নিজের চোখ মুছে। দূর থেকে কমলা দেবী সবটা দেখে কোমড়ে আঁচল গুজে বলে,”দেখসোস নি তোর শোউড়ের লম্বা পা, এই ছ্যাড়া রে কহনো পুজার মন্ডবে বইতে দিলো না তো দিলোই না আবার কয় অস্বস্তিতে পড়ে। ক্যা বে আ্যরাও তো কতো বছর ধরে এগুলা পালন করে আসছি আগো তো কিছুই হয়না তইলে এমান নাডকের কি আছে! অমঙ্গল গোওও অমঙ্গল! ঠাকুক তুমি ঠাডা ফেলাও আ্যই উইটা যাই।”

রিকেশ দেব শিড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলে,”ওগো কমলা বউ আমার তুমি উইঠা গেলে আমার কি হইবো?আমি যে তোমারে ছাড়া বাচতে পারুম না। আর তুমি সক্কাল সক্কাল এমন চিল্লাও ক্যা? তোমার সোয়ামির ঘুম ভাঙি গেছে এহন তুমি কিতা শাস্তি তোমার ঘাড়ে লইবা?”(কিছুটা মজার সুরে)

– ওই তুই একদম মোরে বউ কইবি না আই খালি আর জাইফের বউ তুই আমাগো মইদ্দে বাম হাত ঢুকাস ক্যারে?

– নিজেকে তোমার আঁচলে বাধার ল্যাইগা কমলা বউ!

– হ্যাহ ঢং!

বলেই কমলা দেবী নিজের ঘরে চলে গেলো আর রিকেশ হেসে দিলো। রিকেশের এমন ফাইজলামি দেখে মল্লিকা দেবী বলে,”এমন করে কেন জ্বালাস? উনি তো আমাদের গুরুজন।”

– গুরুজন বলে আমার ভাইকে যা ইচ্ছা তাই বলবে নাকি? তাইতো এমন করি আর জানো মা ঠাকুমার সাথে মজা নিতে বেশ ভালো লাগে।

– হ্যাঁ হয়েছে এখন আয় খেয়ে নিবি।

– জাইফ কোথায়?

– তোর দাদুর সাথে কোথায় যেনো গেলো।

– ওহ আচ্ছা! তাহলে খেতে দাও আমার অফিসে জরুরি মিটিং আছে।

★অবশেষে আসলো যীনাতের ২২তম জম্মদিনের আগের দিন★

সকাল থেকেই বাড়িতে অনেক তোড়জোড় খেয়াল করেছে যীনাত। কিন্তু সবাই কি নিয়ে এতো আয়োজন করছে সেটাই বুঝতে পারছে না। মাগরিবের নামাজ শেষে ছোট চাচী যখন তাকে কিছু পোশাক দিয়ে গেলো তাতে যীনাতের বুঝতে বাকি নেই আবারও সবাই তার বিয়ের প্ল্যানিং করছে। ব্যাপারটা ভেবে যীনাতের মাথায় রাগ চড়ে গেলো। সে একটা বোম ফাটাবে ভেবে নিচে চলে গেলো। মেইন দরজার দিকে চোখ যেতেই দেখলো একটা ছোট্ট ফুটফুটে বাচ্চা তার দিকে তাকিয়ে আছে। অল্প সময়ই বাচ্চাটার জন্য যীনাতের মায়া জম্মে গেলো আর ওমনেই বাচ্চাটা চলে যাচ্ছে আর যীনাত বাচ্চাটার পিছে পিছে গেলো কারণ সে একবার হলেও বাচ্চাটাকে কোলে নিবে বলে ঠিক করেছে। এভাবে প্রায় দূরে আসতেই পেছনে খুব জোরে কিছু ফাটার শব্দ হলো আর সেই শব্দ শুনে যীনাত তাড়াতাড়ি পিছে ফিরে তাকায়। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে বাড়িতে যা দেখে যীনাতের চোখ বেয়ে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে। আপনজন এভাবে তাকে ছেড়ে যাবে ভাবতেই চিৎকার দিয়ে উঠে। বাচ্চাটার দিকে আর খেয়াল নেই যীনাতের।এমন সময়ই দেবনাথ দেব জাইফ আর হুজুর যীনাতের সামনে এসে হাজির হয়। যীনাত জোরে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির দিকে যেতে নিলে হুজুর জোর করে আটকে রেখে বলে,”এভাবে যেয়ো না যীনাত জীবনটা বড্ড কঠিন। কিছু পেতে হলে অনেক কিছু হারাতে হয়। এটা জীবন মৃত্যুর খেলা! এখানে এভাবে হেরে গেলে চলবে না। ”

যীনাত যেনো কোনো কথাই শুনছে না। তার চোখে হাজারো স্মৃতি ভেসে উঠছে আর বারবার আব্বাজান, আম্মাজান, চাচী, চাচা বলে চেঁচাচ্ছে। এভাবে আপন মানুষ গুলো কি করে তাকে ছেড়ে চলে গেলো? হে আল্লাহ কার কি ক্ষতি করেছি যার জন্য সবসময় প্রিয় মানুষ গুলোকে হারাতে হচ্ছে?

যীনাতের অবস্থা দেখে এবার জাইফের চোখ বেয়েও কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে। চোখের সামনে একটা মেয়ে তার সবকিছু হারিয়ে ফেলেছে। মেয়েটাকে ছায়া দেয়ার মতো কেউ যে রইলো না।

হুজুর তড়িঘড়ি করে বলে উঠে,”যীনাত এদিকের বিষয় পরে দেখা যাবে এখন তুমি আমার সাথে এসো। আর মাত্র কয়েক ঘন্টা বাকি।”

– কিসের কয়েক ঘন্টা? এখানে আমার পরিবার শেষ হয়ে গেছে আর আপনি বলছেন “বিষয়!” কি করে পারছেন এভাবে বলতে হুজুর?

– দেখো যীনাত তোমার পরিবারের মতো আমিও যেকোনো সময়ে তাদের হাতে মারা পড়তে পারি। তাই বলছি তাড়াতাড়ি আমার সাথে মসজিদে এসো হাতে বেশি সময় নেই।।

একপ্রকার জোর করেই হুজুর আর জাইফ যীনাতকে মসজিদে নিয়ে গেলো। যীনাতের অবস্থা খারাপের দিকে যাচ্ছে। শেষে উপায় না পেয়ে হুজুর একটা চিঠি যীনাতের হাতে দিয়ে বলে,”নেও এটা পড়ো তোমার বাবার লেখা শেষ চিঠি।”

যীনাত কাঁপা কাঁপা হাতে চিঠি টা নিলো এবং খুবই করুণ সুরে বলে,”এটাতে কি লেখা হুজুর?”

– জানিনা হয়তো তার শেষ কিছু ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন।

যীনাত এবার চিঠিটা পড়ে। পড়ার পর যীনাত একদম নিশ্চুপ হয়ে যায় শুধু অবাধ্য চোখ থেকে দু’এক ফোটা পানি বেরোলো। তারপর চিঠিটা বুকে জড়িয়ে পাথরের মতো হয়ে বলে,”আমার এখন কি করবো হুজুর? আমি…”

যীনাতকে কিছু বলতে না দিয়ে হুজুর বলে,”তোমাকে এই মুহূর্তে বিয়ে করতে হবে! বেশি সময় নেই যীনাত যা করার জলদি করো।”

– কাকে?

– জাইফকে! যে তোমার পাশে বসে।

যীনাত জাইফের দিকে না তাকিয়েই বলে,”যা করার করুন।”

যীনাত যেনো বেচে থাকাটাই ভুলে গেছে। কোন এক অদৃশ্য দেয়ালের কারণে আজ তার মৃত্যুর পথ টা খোলা নেই। হয়তো আত্নহত্যা মহাপাপ তাই! নইলে সে যে কবেই পরাপারে পারি দিতো।

চিঠিতে লেখা ছিলো,
“মা আমি তোর বাবা ফয়েজ। চিনেছিস আমায়? হয়তো চিনে নিবি আমার লেখা দেখে। যখন চিঠিটা তোর হাতে থাকবে তখন হয়তো আমি এই দুনিয়ায় থাকবো না। তুই একদম ভেঙে পড়বি না মা। আমার কিছু ইচ্ছে ছিলো জানিস হয়তো পূরণ হবে না তবুও তোকে বলছি। তোর সামনে অনেক বিপদ মা, তুই যখনই চিঠিটা পাস না কেন তোর ২২ বছর পূরণের আগে যে করেই হোক তুই বিয়ে কর নইলে তোর আশেপাশে যারা আছে এবং থাকবে তারা সবাই-ই ধ্বংস হয়ে যাবে। তুই কি চাস তোর জন্য অন্যরা প্রাণ হারাক? কখনো নিজের জেদকে প্রশ্রয় দিবি না, যা করবি বিবেক দিয়ে ভাববি এবং ঠান্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নিবি। কারণ তোর আগমন বিপদে শুধু তোর বিবেক-বুদ্ধিই তোকে সাহায্য করবে। আমি জানি আমার মেয়ে অনেক ধৈর্যশীল এবং বুদ্ধিমতি। পারলে বাবাকে ক্ষমা করে দিস! জানিস তো পৃথিবীটা বড্ড স্বার্থপর, নিজেদের স্বার্থের জন্য তারা সব করতে পারে। আমি এখনো জানিনা কে আমাদের এবং তোর পরম শত্রু। তবে এইটুকু বলবো তোর ভাইকেও খুন করা হয়েছে এবং আমাকে/আমাদের! পরীক্ষা তোর মা, বুদ্ধিমত্তার সাথে সব জয় কর এবং শত্রুদের কঠিন শাস্তি দে। আল্লাহ তোর সহায় হোক তোকে তোর বিপদে সাহায্য করুক সেই দোয়া-ই করি। এখন আমার শেষ ইচ্ছে পূরণ কর মা ২২তম জম্মদিনের আগে বিয়েটা সেরে ফেল তোর হুজুরের সাথে যোগাযোগ করে। তিনি উত্তম ছেলেকেই তোর জীবনসঙ্গিনী করবে সেই আস্থা আছে আমার। বিবাহিত জীবনে সুখী হ! ভালো থাকিস নিজের খেয়াল রাখিস আর হ্যাঁ আবারো বলছি কোনো পরিস্থিতিতে ভেঙে পড়বি না কখনো মনে রাখবি আল্লাহ আছেন পাশে।

ইতি তোমার
আব্বাজান!

অবশেষে ফয়েজের ইচ্ছায় যীনাত এবং জাইফের বিয়ে সম্পন্ন হলো। হুজুর জোরে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠে। বাইরে থেকে দেবনাথ দেবও শুনতে পায় এবং মলিন হাসি দেয়। যীনাত অন্যমনস্ক হয়ে বলে,”হুজুর!”

– হ্যাঁ যীনাত বলো।

– শেষবারের জন্যও কি কাউকে দেখতে পারবো না?(ছলছল চোখে)

যীনাতের কথায় যেনো হুজুর এবং জাইফ দু’জনেরই কলিজা কেঁপে উঠে। সত্যিই তো মেয়েটা আজ বড্ড অসহায়। শেষবারের জন্যেও পরিবারের কাউকে একবারের জন্যেও দেখতে পারলো না। বুকটা চিনচিন করছে বেশ। আল্লাহ কেন পুরো পরিবারটা কেড়ে নিলেন আপনি? বেচারী মেয়েটার যে কোনো দোষই নেই।

নিকেশ ম্যানশনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে দেবনাথ দেব, জাইফ এবং যীনাত(আনমনে)। যীনাত যেনো কোনো পাথরের মূর্তি হয়ে আছে। যে যেভাবে বলছে সে সেভাবেই চলাফেরা, কাজ করছে। সে যে নিজের মধ্যে নেই। দেবনাথ দেব আর জাইফের সাথে একটা মেয়ে দেখে কমলা দেবী দরজার সামনে এসে বলে,”কি করে দাদা এই আবার কোন ল্যাঙ রে অইয়া আইসোস হ্যানে।”

– ল্যাঙ কোন ধরণের ভাষা দিদি মেয়ে বলো আর ওকে ভেতরে ঢুকতে দাও মেয়েটা অনেক ক্লান্ত।

– না আর দাদা। আগে আই জানমু এই ছোকড়ি কে তারপর তোগো ভিত্রে আওয়ার অনুমতি দিমু।

মহিলাটির কথা শুনে এতোক্ষণে যীনাতের ধ্যান ভাঙে। সামনে তাকিয়ে দেখে একজন বয়স্ক মহিলা যে কিনা সাদা সুতি শাড়ি বাঙ্গালী স্টাইলে পড়া। মাথায় বউদের মতো ঘোমটা। পিছে দেখতে পায় একজন মহিলা। সকলের পোষাক আষাক দেখে যীনাত বেশ ভালোই বুঝেছে সে হিন্দু কোনো পরিবারে এসেছে। যীনাত অবাক হলো না কারণ সে আগে থেকেই জানতো সে এখানে আসবে। হয়তো তার তাদের সাথে কিছুদিন অস্বস্তি হবে কিন্তু পরে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে। তবে যীনাত একটা টু’শব্দও করলো না।

– আহ কমলা বউ তুমি এতো প্রশ্ন ক্যান করো? আগে ঢুকতে তো দাও তারপরে যা মন চায় জিগাও উফফ পা তক ব্যথা হয়ে গেলো আমার।

জাইফের কথায় যীনাত জাইফের দিকে তাকালো আবার চোখ সরিয়ে বুড়ির কাহীনি দেখায় মনোযোগী হলো।

কমলা দেবী….

——————————-

ওয়ারদূন আসরার পর্ব-০২ | বাংলা ভালোবাসার গল্প

0

#ওয়ারদূন_আসরার
#লাবিবা_ওয়াহিদ
“০২”

——————————-

জাইফকে নিয়ে অলরেডি কানাকানিও শুরু হয়ে গেছে। হুজুরসহ জাফিয়ার পুরো পরিবারও হা করে তাকিয়ে আছে জাফিয়াও যেনো এর ব্যতিক্রম নয়। আদৌ এতো সুন্দর ছেলে আছে? সকলের এভাবে তাকিয়ে থাকাটা জাইফ পাত্তা দিলো না কারণ এরকম অনেক ঘটনার সম্মুখীন সে হয়েছে তাই নতুন করে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে চায়না সে। দেবনাথ দেব সকলের উদ্দেশ্যে বলে,”কি দেখেছেন আপনারা আমার নাতিকে?”

হুজুরের ধ্যান ভাঙলো দেবনাথ দেব এর কথায়। তারপর সে গলা পরিষ্কার করে বলে,”আপনার নাতির নাম?”

– জাইফ আহরার ইজায।

হুজুর যেনো আরেকটা শক খেলো। সে কিছুতেই যেনো কিছু মেলাতে পারছে না পরে সে দেবনাথ দেবকে বললো তার সাথে আলাদা কথা বলতে চায়। দেবনাথ দেব নির্ভিয়ে বলে,”চলুন আমার এতে আপত্তি নেই।”

তারপর হুজুর এবং দেবনাথ দেব কোথায় যেনো চলে গেলো আর জাইফ পড়লো আরেক ঝামেলায়। সে এখন কি করবে? জাইফ উপায় না পেয়ে মেইন দরজার দিকে তাকালো সেখানে জাইফের কিছু গার্ড আছে। জাইফ ইশারা করতেই তারা কয়েকজন ভেতরে আসে এবং তাদের বসকে সন্তুষ্ট করতে তার আশেপাশে থাকে আর জাইফ চুপচাপ একটা চেয়ারে বসে আছে। জাইফ বেশ শান্ত স্বভাবের এবং বেশ ধৈর্যশীল। ছোট থেকেই সে কাউকে না মানলেও তার দাদুকে বেশ মানে এবং সম্মান করেন। দাদুর উপর তার সম্পূর্ণ বিশ্বাস এবং আস্তা আছে।

জাফিয়ার কোনোদিকে খেয়াল না করে তার ভাইয়ের পাশে গিয়ে আবার বসে। ফুয়াদের মাথায় রক্তে ভরা যেনো ফুয়াদের মাথায় ভারি কিছু পড়েছে। জাফিয়ার চোখ দিয়ে অনবরত জল পড়ছেই। কাঁপা কাঁপা হাত দিয়ে ফুয়াদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। চোখের সামনে ভাইয়ের সাথে কাটানো প্রতিটা স্মৃতি ভেসে উঠছে। কতো দুস্টামি করেছে মায়ের হাতে মার খেয়েছে ফাইজলামির জন্য। শেষে দুজনে না কেঁদে খিলখিক করে হেসেছে। হাতে বা পায়ে ব্যথা পেলে দুইজন দুইজনের সেবা করতো। আর আজ! কি থেকে কি হয়ে গেলো। জাফিয়ার মা কিছুক্ষণেই জ্ঞান হারালো। জাফিয়া চিৎকার করে “মা” বলে উঠে। চাচীরা খালামনিরা সবাই মিলে জাফিয়ার মায়ের জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করছে। আর জাফিয়া কেঁদে কেঁদে শুধু আম্মা আম্মা করছে। ফয়েজও চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। অনেক কষ্টে জ্ঞান ফেরালো। জ্ঞান ফিরতেই জাফিয়ার মাকে বেশ দূর্বল দেখালো। জাফিয়া তো বারবার বলছে,”আমি বিয়ে করবো না আমি এখানেই থাকবো আমি কোথাও যাবো না আমার ভাইকে ছাড়া।

আরও অনেক পাগলামি শুরু করে। শেষে সে নিজেও জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। ছেলে মেয়ে স্ত্রীর করুণ অবস্থা ফয়েজ কিছুতেই মানতে পারছে না। কি করবে সে আজ নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে তার। শেষে উপায় না পেয়ে জাফিয়াকে নিজের রুমে ধরাধরি করে নিয়া যাওয়া হলো। আর জাফিয়ার মাকেও টেনেটুনে জ্ঞরে নিয়ে যাওয়া হলো নইলে হীতে বিপরীত হতে পারে। তারা চলে যেতেই ফয়েজ চুপচাপ ফুয়াদের মাথার কাছে বসলো আর তার ভাইয়েরা তাকে শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করতে থাকে।

কিছুক্ষণের মাঝেই হুজুর আর দেবনাথ দেব আসলো। হুজুর যা বোঝার বুঝেছে তবে তাদের বলেছে যেনো বিয়েটি কিছুদিন পর করা হয় কারণ এমনেই আজ অনেক বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেছে জাফিয়া আর বড় ধাক্কা সহ্য করতে পারবে না। দেবনাথ দেব বুঝতে পেরে জাইফকে নিয়ে সেখান থেকে চলে আসলো। তারা চলে যেতেই হুজুর দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। তারপর ফয়েজকে বলে সকলকে যেতে বললো। ফয়েজ সকলকে বলে দিলো আজ কোনো বিয়ে হবে না আপনারা আসতে পারেন।

বিয়ে হবে না শুনে শুরু হলো তোলপাড়। মহিলারা ছাড়লো না ফয়েজকে কথা শুনাতে।

– তোমার মেয়ে একটা অভিশাপ তাই সব বিপদ ডেকে আনে কে জানে কবে তোমাদের কুড়ে খায়। পারলে একে ঠেঙ্গিয়ে বিদায় করো নাহয় বনবাসে পাঠিয়ে দাও তবুও বিপদ ডেকে এনো না।

জাফিয়ার ছোট চাচা এগিয়ে এসে বলে,”সেটা আপনাদের ভাবতে হবে না আপনারা নিজেদের মেয়েদের গিয়ে সামলান তারপর আমাদের মেয়েদের দিকে আঙুল তুলবেন! গিয়ে দেখেন আপনাদের মেয়েরা কেমন ফষ্টিনষ্টি করে আর আপনারা আসছেন আমাদের আম্মাজানকে কথা শুনাতে? আপনাদের দাওয়াত দেয়া হয়েছে দোয়া দেয়ার জন্য কথা শুনানোর জন্য নয়! আপনারা আসতে পারেন আর কখনো যেনো আপনাদের বাড়ির ত্রিসীমানায় না দেখি!”

– কি বললে কি তুমি? দেখিও তোমাদের পরিবারের কখনো ভালো হবে না ওই মেয়ের জন্য!

– সেটা আমরা বুঝে নিবো।

মহিলাগুলো নিজেদের অপমান সহ্য করতে না পেরে চলে গেলো রাগে ফুসতে ফুসতে। একে একে আরও অনেকেই চলে যান। হুজুর এগিয়ে এসে বলেন,”ভাইজান আমার সাথে মসজিদে আসুন! আর আপনারা ফুয়াদের গোসলের ব্যবস্থা করুন আজকেই জানাজা পড়ানো হবে।”

হুজুরের কথামতো ফয়েজ হুজুরের সাথে মসজিদে আসে। ফয়েজ বলে,”আমাকে এখানে ডেকে নিয়ে আসার কারণ?”

– যীনাতের বড় বিপদ আছে সামনে। ফুয়াদ বা তাদের এক্সিডেন্ট কোনো দুর্ঘটনা নয় সবটাই পরিকল্পনা মাফিক কাজ!

ফয়েজ ভয়ে ভয়ে বলে,”এ.. এর মানে কি হুজুর?”

– যীনাতকে যেই বিয়ে করতে আসবে তারই প্রাণ যাবে আর ফুয়াদের মৃত্যু টাও স্বাভাবিক নয় তা আমি বেশ বুঝতে পারছি। শুনো তোমাকে বলি, যীনাতের বিয়ের উপর অনেক কিছুই ডিপেন্ড করে আছে যা আমরাও জানিনা। কিছু বছর আগের কথা মনে আছে? যীনাত নিজের স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলো তার উপর তাকে যে এই অবস্থা করেছে তাকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি। তার কারণ আমিও জানি। তোমার থেকে একটা বিষয় গোপন রেখেছিলাম। যে যীনাতকে হাসিল করতে চেয়েছিলো তাকেও খুব নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু এর মাঝের ঘটনা আমি বলতে পারবো না যে সে যীনাতের সাথে ঠিক কি করেছে। তা একমাত্র যীনাতই বলতে পারবে কিন্তু যীনাতেরই যে সেই স্মৃতি নেই। সে কোমায় চলে যাওয়ার কারণে তার মাঝের কিছু স্মৃতি মুছে যায়।

– এখন আমরা কি করবো হুজুর?

– দেখো কিছুদিন পরই যীনাতের ২২বছর পূরণ হবে তার আগে যেভাবেই হোক যীনাতকে বিয়ে দিতে হবে। কারণ যারা এসব ঘটনার পিছে আছে তাদের প্রথম টোপ যীনাত! যীনাতকে তাদের যেকোনো মূল্যেই চাই নইলে তারা সবকিছু ধ্বংস করতেও পিছপা হবে না। তাই ১০দিনের আগেই বিয়ে সম্পূর্ণ করতে হবে কারণ ১০দিন পরপরই যীনাতের ২২ বছর পূরণ হবে।

– কিন্তু হুজুর এই অবস্থায় কেই বা বিয়ে করবে আমার মেয়েকে? তারা যে আগেই সেইসব ছেলেকে মেরে ফেলবে।

– ছেলে আছে আর সেটা ওই জাইফ আহরার ইজায!

– মানেহ আবার সেই হিন্দু ছেলেটা?

– আহা!! হিন্দু কই পাচ্ছো তুমি? ওর নামটা বুঝতে পারছো না আদৌ কোনোরকম হিন্দু মনে হয় তাকে? সে যাইহোক তার দাদুর কাছে যা তথ্য পেয়েছি তাতে নিশ্চিন্তে ওদের বিয়ে দিতে পারো তবে সময় নাও।

– যদি তাকেও মেরে ফেলে?

– নিশ্চিন্তে থাকো আমার মন বলছে তেমন কিছুই হবে না উল্টো যীনাত সুরক্ষিত থাকবে। আর বাসার পরিস্থিতি ভালো না।

এবার ফয়েজ ফুয়াদের কথা ভেবে হু হু করে কেঁদে দিলো। হুজুর তাকে সামলানোর চেষ্টা করছে বারবার। একসময় হুজুরও নিজের চোখের জল আটকাতে পারে না।

[যারা নায়িকার নাম নিয়ে কনফিউজড তাদের জন্য, “নায়িকার নাম জাফিয়া যীনাত। পরিবারের সবাই তাকে যীনাত নামেই ডাকে আর জাফিয়া বাইরে প্রকাশ হয়।” আশা করি আর কোনো প্রশ্ন থাকবে না।]

পরদিন সকালে,,

জাফিয়া একমনে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। হাতে কালকে ফুয়াদের মাথার রক্ত এখনো লেগে আছে। রক্ত গুলো শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে। কাল রাতেই ফুয়াদকে দাফন করা হয়। জাফিয়ার রাতে ঘুম ভাঙ্গতেই সে আবার পাগলামি শুরু করে দেয়। পরে কোনো উপায় না পেয়ে জাফিয়াকে জোর করে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দেয়া হয়। তাতে জাফিয়া আস্তে আস্তে ঘুমে ঢলে পড়ে৷ জাফিয়া সকালে উঠে চুপচাপ বসে আছে। পরে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ওযু করে নিলো। কাযা নামাজ পড়ে খুব কাঁদলো মোনাজাতে এবং ভাইয়ের জন্য দোয়া করলো৷ ঘন্টার পর ঘন্টা জায়নামাজে বসে চোখের জল ফেললো। একসময় আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। জাফিয়ার ছোট চাচী জাফিয়াকে খাবার দিতে এসে অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখলো আর সাথে সাথে চিৎকার দিলো। সবাই রুমে আসে এবং চটজলদি জাফিয়াকে ধরাধরি করে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ডাক্তারকে ডাকা হলো। ডাক্তার এসে জাফিয়াকে চেকআপ করে বলে,”দেখুন কিছু বছর আগে জাফিয়ার ব্রেইনে খুব বড় সমস্যা হয়েছিলো তার উপর এখন এভাবে জ্ঞান হারাচ্ছে এটা কিন্তু মটেও ভালো লক্ষণ নয়। তাকে একা রাখবেন না কোনোকিছুতেই। এবং কোনোরকম কষ্ট দেয়ার চেষ্টা করবেন না সব ভুলাবেন তাকে নইলে স্পট ডেডও হতে পারে। যাইহোক আমি কিছু মেডিসিন লিখে দিচ্ছি তাকে খাওয়াবেন আর ঠিকমতো খাবার খাওয়াবেন উনি অনেকটাই দুর্বল।

বলেই ডাক্তার চলে গেলো।ফয়েজ মাথায় হাত দিয়ে ভাবছে সে কি করবে। মেয়ের যা করুণ অবস্থা তার উপর বেশি সময়ও নেই কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। জাফিয়ার মাও নিজেকে সামলে নিয়েছে মেয়ের জন্য তবুও পারে না বেশি শক্ত থাকতে। এক ছেলেকে হারিয়েছে এখন মেয়েকে হারাতে পারবে না।

এভাবেই কিছুদিন কেটে যায়। এই কয়েকদিনে প্রতিদিন দুবেলা করে কেউ না কেউ কথা শুনিয়ে গেছে। জাফিয়া বিষয়টা বেশ ভালোভাবে খেয়াল করেছে। তাই সে বুকে এক পাথর বসিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করেছে। কারণ এমনেই তার পরিবার শোকাহত তার উপর এভাবে নিজের জন্য বাবামাকে বারবার অপমানিত হতে হচ্ছে এখন যদি জাফিয়া নিজেকে কন্ট্রোল না করে তাহলে আরও করুণ অবস্থা হবে। আজ সকালে জাফিয়া নিজেকে স্বাভাবিক করে সোফার রুমে চুপচাপ বসেছিলো এর মাঝেই জাফিয়ার সাথে যার বিয়ে হওয়ার কথা ছিলো তার মাসহ পুরো ফেমিলি এসে হাজির এবং অনেকরকম কথা শোনায় যা গায়ে লাগার মতো। জাফিয়া চুপচাপ মাথা নিচের দিকে দিয়ে অঝোরে চোখের জল ফেলছে। ছেলের মা দূরে জাফিয়াকে বসে থাকতে দেখে সে ছুটে জাফিয়ার কাছে যায় এবং জাফিয়ার গালে চড় বসিয়ে দেয়। জাফিয়া গালে হাত দিয়ে ছলছল চোখে মহিলার দিকে তাকায়। মহিলাটিকে আরও কিছু মহিলা ধরে রেখেছে যেনো জাফিয়ার কাছে ঘেষতে না পারে৷ ছেলের মা জোরে চিৎকার করে বলে,”তোকে আমি ছাড়বোনা। তোর জন্য আমার কোল খালি হয়েছে অকালে আমি আমার ছেলেকে হারিয়েছি। তুই যে এতোটা অভিশাপ আমাদের পরিবারে ডেকে নিয়ে আনবি তা জানলে আমি তোকে ছেলের বউ করা তো দূরে থাক কখনোই তোর দিকে ফিরেও তাকাতাম না।”

জাফিয়ার ছোট চাচা এবার হুংকার ছেড়ে বলে,”ব্যাস!! অনেক বলেছেন আপনারা। আপনারা কি মানুষ? আপনাদের সাহস কি করে আমাদের আম্মাকে এসব বলার তার কি দোষ এখানে? সবটা আল্লাহর ইচ্ছা কয়বার বলবো আপনাদের? নিজেদের বিবেককে ধরে বাচুন! এভাবে অন্য একটা মেয়েকে দোষারোপ করার কোনো মানেই হয়না। আপনারা কতোটুকু জানেন আমাদে রমেয়ে সম্পর্কে? আপনাদের প্রিয়জন হারিয়েছে আমাদের কি হারায়নি? এখনই আপনারা বের হোন বাড়ি থেকে নইলে আমি আপনাদের ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করবো।”

মহিলাগুলো আরও কিছু বলে চোখের জল ফেলতে ফেলতে চলে গেলো। তারা চলে যেতেই জাফিয়া ধপ করে ফ্লোরে বসে কাঁদতে থাকে। দূরে জাফিয়ার মা আঁচলে মুখ গুজে কাঁদছে। সে যে সহ্য করতে পারছে না মেয়ের এমন অবস্থা। জাফিয়া চিল্লিয়ে শুধু এইটুকু বলে,”কিসের এতো পরিক্ষা নিচ্ছেন আপনি মাবুদ?”

——————————–

চলবে!!!

(অনেকের অনেক প্রশ্ন রয়েছে এবং অনেকে অনেক ধরণের কথা বলেছেন কিন্তু আমি কিছু বলিনি আর বলবোও না। সকলের নিজের মতামত প্রকাশের অধিকার আছে। তবে এক্টা কথা আমি আগেও বলেছি এখনো বলছি এক পর্ব দিয়ে পুরো গল্প বিচার করবেন না। কিছু পর্ব যাক আপনাদের ধারণা পালটে দেয়ার চেষ্টা করবো ইন শা আল্লাহ। আর হ্যাঁ ‘ওয়ারদূন আসরার’ মানে হলো ‘গোলাপ রহস্য’! কেমন লাগছে জানাবেন।)

ওয়ারদূন আসরার পর্ব-০১ | বাংলা ধারাবাহিক গল্প

0

#ওয়ারদূন_আসরার
#লাবিবা_ওয়াহিদ
“সূচনা পর্ব”

০১.
– বিয়ে টা কি সিঁদূর দিয়ে হবে?

– কখনো না! আমি মুসলিম হয়ে কখনোই ওই লাল রঙ মাথায় মাখবো না আমি ইসলামিক রীতিতেই বিয়ে করবো নইলে আমি এই বিয়ে করবো না!

– মা একটু বুঝ!

– কোনোকিছু বুঝতে চাইনা আমি আব্বুজান কি করে পারছো এতো বড় গুনাহ করতে বলতে পারো? কেন এতো বড় গুনাহর ভাগীদার করছো?

– ঠিক আছে এখানে তাহলে কাগজে কলমেই তোমাদের বিয়ে সম্পন্ন হবে।

কিছুক্ষণ আগের কথা,,,

আজ জাফিয়ার বিয়ে! বিয়ে উপলক্ষে চারপাশটা আনন্দ-উল্লাসে থাকা উচিত ছিলো কিন্তু তার পরিবর্তে চারপাশে সকলের আত্মৎনাৎ, বুক ফাটা কান্না। জাফিয়া বিয়ের আসরে বসতেই ৪ জন লোক তার ভাইকে কাফনের কাপড়ে জড়িয়ে সকলের সামনে রাখলো। জাফিয়া দৌড়ে তার ভাইয়ের কাছে এসে ভাইয়ের দিকে একপলক তাকায় তারপর লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”আ…আমার ভা..ভাইয়ের কি হয়েছে?”
জাফিয়ার মা ততোক্ষণে ফুয়াদের(ফায়রুজের ভাই)মাথার কাছে এসে মরণ কান্না জুড়ে দিলো। কোন মা-ই বা অকালে নিজের সন্তানের চলে যাওয়া সহ্য করতে পারে? যাকে আদর ভালোবাসা সোহাগ দিয়ে বড় করেছে সে এভাবে চলে যাবে সে যে কল্পনায়ও ভাবেনি। ফুয়াদ ১৬ বছর বয়সী! জাফিয়ার কথায় একজন লোক মাথা নিচু করে বলে,”আমরা ফুয়াদকে রক্তাক্ত অবস্থায় বাগানে পেয়েছি এর বেশি আমরা কিছুই জানিনা!”

লোকটার কথায় জাফিয়া আর নিজেকে সামলে উঠতে পারেনা! চিৎকার দিয়ে ধপ করে বসে পড়ে ভাইয়ের কাছে! এভাবে নিজের ভাইকে অকালে হারাবে কখনো সে ভাবেনি। উপস্থিত সকলের মাঝে শোকের ছায়া। কিছুক্ষণ কান্নার পর জাফিয়া মূর্তির মতো বসে রইলো। কথায় আছে না, “অল্প শোকে কাতর, অতি শোকে পাথর!” জাফিয়ার বাবা ফয়েজ দূরে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেলছে! জাফিয়ার ছোট চাচা দৌড়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে খুবই ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,, “ভাইজান(জাফিয়ার বাবা) যীনাতের বর রোড এক্সিডেন্ট করেছে এবং ঘটনাস্থলে ছেলেটা আর তার বন্ধুরা নিহত হয়।”
চাচার এমন কথায় পুরো বিয়েবাড়ি যেনো নিস্তব্ধ হয়ে গেলো।

বিয়ের দিনে এতো দুর্ঘটার জন্য মানুষ এখন জাফিয়ার দিকে আঙুল তোলা শুরু করলো। সকলে বলাবলি শুরু করে,”মেয়েটা একটা অমঙ্গলের বস্তা! দেখিস না বিয়ের দিনই ভাইটাকেও খেলো সাথে নিজের হবু স্বামীকেও! কেমন অপয়া হলে এভাবে মানুষ মারে চিন্তা করতে পারিস? এই মেয়ে আস্তা অলক্ষী! এ যেই ঘরেই যাবে তাদের সবাইকে মেরেই ছাড়বে, না বাপু এর থেকে দূরে থাকা লাগবে, না জানি কবে আমরা আবার এই মেয়ের ভাগীদার হই।”

সব কথোপকথন ফয়েজের কানে আসছে কিন্তু চেয়েও কিছুই বলতে পারছে না কি বলবে সে?সে নিজেও যে কোনোকিছু বলার মতো অবস্থায় নেই। ওইদিকে কাজী সাহেব তাড়া দেয়া শুরু করে বলে,”কি হলো ছেলে কই? বিয়ে তো দিতে হবে নাকি?”

এবার ফয়েজ কি করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। আজ যদি তার মেয়ের বিয়ে না হয় তাহলে সম্মান তো যাবেই সাথে মেয়েটার জীবনও নষ্ট হয়ে যাবে। অতি আদর ভালোবাসায় বড় করেছে মেয়েকে সে কষ্ট পাক তা যে কখনোই চায়না। ছেলেও কম আদরের ছিলো না কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেলো আল্লাহ তায়ালা ভালো জানেন! উপায় না পেয়ে ফয়েজ সবার কাছে মিনতি করে যেনো কোনো যুবক ছেলে তার মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয় কিন্তু কেউ ভয়ে এক পাও এগোলো না যদি কোনোভাবে এই মেয়ে তাদের জীবনে বীপর্যয় ডেকে আনে? তাই সবাই নাকোচ করে দেয়! ফয়েজ এবার না পেরে ধপ করে সবার মাঝে বসে পড়ে। কেঁদে কেঁদে কবলে,”হে আল্লাহ এ কেমন পরীক্ষা নিচ্ছেন আপনি আমাদের পরিবারের উপরে? কি দোষ করেছে আমার ছেলে মেয়ে দুটো যাদের জীবন এমন হয়ে গেলো! আমার ছোট ছেলে টা কে নিয়ে নিলেন এখন আমার মেয়েটাকে কেন সবার ঘৃণার পাত্রী বানাচ্ছেন? সে তো সবসময় আপনারই ইবাদতে মশবুল ছিলো!! তার প্রতিদান আপনি এভাবে দিলেন?”

বলেই হাটু গেড়ে বসে কাঁদতে লাগে! এমন সময়ই তার কাধে কেউ হাত রাখে ফয়েজ সাথে সাথেই চোখে অশ্রু নিয়ে পিছু ফিরে তাকায়। যিনি হাত রেখেছেন তিনি আর কেউ নন প্রভাবশালী মেয়র মিস্টার দেবনাথ দেব। বয়স তার ৭৭ এর কাছাকাছি। এই বয়সেও তিনি অনেক ফিট এবং পরশ্রমী। ফয়েজ উঠে দাঁড়ায় এবং দেবনাথ দেব কে বলে,”আপনি?”

– হ্যাঁ আমি সবটা দেখেছি এবং শুনেছি তোমাকে একটা প্রস্তাব দিতে চাই।

– কিসের চাচা?

– আমি আমার ছোট নাতিনের জন্য তোমার মেয়েকে চাচ্ছি! আমি চাই আমার নাতিনের সাথে তোমার মেয়ের এই মুহূর্তে বিয়ে হোক!

সকলে অবাক হয়ে দেবনাথ দেবের দিকে তাকায়! অবাক হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ দেবনাথ দেবের পুরো পরিবার সনাতন ধর্মের অনুসারী। কি করে একজন মুসলিম মেয়ে একটা হিন্দু ছেলেকে বিয়ে করবে এটা যে চরম অপমান ইসলামের দৃষ্টিতে। দেবনাথ দেব সকলের প্রশ্ন বুঝতে পেরে বলে,”আমি জানি আপনাদের মনে কি প্রশ্ন আছে। তবে এইটুকু বলবো এখানে কোনোরকম কারো ধর্মকে অপমান করে বিয়ে হবে না মেয়েটার ধর্ম ঠিক থাকবে আর ছেলেরও।”

হঠাৎ একজন লোক বলে উঠে,”এটা কি করে সম্ভব মেয়র সাহেব? আপনারা বড় ঘরের মানুষ ঠিক আছে কিন্তু আপনাদের ধর্ম আর মেয়েটার ধর্ম সম্পূর্ণ আলাদা সেখানে আপনি কি করে…”

লোকটিকে বলতে না দিয়ে দেবনাথ দেব কঠোর ভাবে বলে,”এতো যখন আপনাদের ধর্ম নিয়ে চিন্তা তাহলে আপনাদের মাঝে থেকে কেউ কেন এগিয়ে আসলো না মেয়েটাকে বিয়ে করতে? জবাব দিন? হ্যাঁ আমরা মানুষ কিন্তু আপনারা আপনাদের অমানুষ রূপ টা দেখিয়েই চলেছেন। এখানে একজন মধ্যবয়সী লোক সবার সামনে কেঁদে বুক ভাসালো কই আপনারা কেউ তো তার দিকে এগিয়ে আসলেন না? আমরা অন্য ধর্মের হলেও নিজেদের মাঝে একটা মনুষ্যত্ববোধ আমাদের আছে! আর আমি আমার এরিয়াতে কোনো মেয়েকে এভাবে অপমান হতে দিবো না যেখানে আপনারা মেয়েটাকে অপবিত্র বলছেন! দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে স্বাভাবিক তাই বলে মেয়েটার কি দোষ এখানে? সবই উপরওয়ালার ইচ্ছা এখানে কারো হাত থাকে না। আর আমি যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমি আমার ছোট নাতিনের সাথেই জাফিয়ার বিয়ে দেবো মানে দেবোই। আমরা অন্য ধর্মের অনুসারী বলে কি মানুষ নই?”

সকলে দেবনাথ দেবের কথায় একদম চুপ হয়ে গেলো। এদিকে ফয়েজ কি বলবে কিছুই ভেবে পায়না। সকলকে চুপ থাকতে দেখে দেবনাথ দেব বলে,” আশা করছি এখানে কারো আপত্তি নেই!”

– আমার আপত্তি আছে!

সকলে জাফিয়ার দিকে তাকালো। জাফিয়া চোখ মুছে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,”আমার ভাই এখানে মারা গেছে সেখানে আপনারা আমার বিয়ে নিয়ে পড়ে আছেন? ”

– দেখো মা আমরা তো তোমার ভালোর জন্যই বলছি আজ যদি তোমার বিয়ে না হয় তোমার জীবন টা যে শেষ হয়ে যাবে মা।

– আব্বাজান আপনার সব কথা আমি শুনি কিন্তু এবার পারবো না! আমার ভাই….

বলে আবার ডুকরে কেঁদে উঠে। ফয়েজ মেয়েকে শান্তনা দিয়ে বলে,”এভাবে কাঁদিস না মা আল্লাহ যার আয়ু যতোটুকু রেখেছে তারা ততোটুকু সময়ই যে বাচবে সময় হলে তারা ঠিকই চলে যাবে। আর তোর ভাইটা যে কষ্ট পাচ্ছে! ফুয়াদের কতো ইচ্ছে ছিলো নিজের বোনের বিয়ে দেখবে এভাবে তার ইচ্ছা অপূর্ণ করো না!”

– কিন্তু বাবা আমি অন্য ধর্মের ছেলেকে কখনোই বিয়ে করবো না। এতে আল্লাহ আমার উপর নারাজ হবেন তা আমি কখনোই চাইনা।

একজন হিন্দু মহিলা বলে উঠে,”এতোই যদি তোমার আল্লাহকে নিয়ে ভয় তাহলে তোমার সেই আল্লাহ কেন তোমাকে এমন বিপদে ফেললো?”

জাফিয়া শত কষ্টের মাঝে একটা মুচকি হাসি দিয়ে বলে,”আল্লাহ আমার ধৈর্য্যের পরিক্ষা নিচ্ছেন এবং তিনি কখনোই কারো খারাপ চান না। তিনি আমার তকদিরে যা লিখেছেন আমার সাথে তাই হচ্ছে এ নিয়ে আমার কোনো অভিযোগ নেই। আর আপনি অন্য ধর্মের অনুসারী হয়ে আমার প্রভুকে কটুকথা শোনানোর আগে ১০বার ভেবে নিবেন এখন চুপ থাকলেও পরের বার আল্লাহর কসম আমি আপনাকে কোনো প্রকার ছাড় দেবো না।”

জাফিয়ার এমন রুক্ষতা মহিলাটির গা জালিয়ে ছেড়েছে। দেবনাথ দেব শান্ত কন্ঠে বলে,”তোমার জন্য এখন এই পথ টাই খোলা আছে তাই বলছি রাজি হয়ে যাও!”

– ক্ষমা করবেন দাদু আমি কখনোই পারবো না নিজের ধর্মকে ত্যাগ করে আপনার নাতিনকে বিয়ে করতে!

– এখানে ত্যাগ করার বিষয় কেন আসছে? আমরা কেউ তো তোমার ধর্মকে ছাড়তে বলছি না শুধু বলছি তুমি আমার নাতিনকে বিয়ে করবে। আমি নিজে কথা দিচ্ছি কেউ তোমাকে কোনোরকম জোর করবে না তোমার ধর্ম বদলাতে! তুমি তোমার ইবাদত নিজের মতো করে করবে।

– আপনাকে আমি কি করে বোঝাই ইসলামে অন্য ধর্মের কাউকে বিয়ে করতে নেই এটা দ্বন্দনীয় অপরাধ!

-(আর আমি তোমায় আমি কিভাবে বোঝাই যীনাত আমার নাতিনটা যে তোমার জন্য পুরোই যোগ্য! তোমার আগমন বিপদ থেকে জাইফই বাচাতে পারবে। আর জাইদ যে তোমার মতোই….নাহ কাউকে বলতে পারবো না আমি সত্যটা এতে করে যে আরও সমূহ বিপদ!)

এমন সময়ই জাফিয়ার শিক্ষক এলাকার ইমামসাহেব আসলেন। জাফিয়া সালাম দিলে তিনি সালামের উত্তর নিলেন। জাফিয়া ছোট থেকে তাকে খুব মানেন।তিনি সবটা শুনে কিছুটা চিন্তায় পড়ে গেলেন। একে তো ফুয়াদের জানাজাও বাকি তার মাঝে জাফিয়ার বিয়ে। হুজুর কিছুক্ষণ চিন্তা ভাবনা করে শান্ত গলায় বলে,”আমি আপনার নাতিনকে দেখতে চাই সে কি বিয়েতে এসেছে?”

– হ্যাঁ এসেছে দাঁড়ান আমি এখনই তাকে সামনে আনছি!

বলেই তিনি অন্যদিকে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর ফিরেও এলেন এক সুদর্শন যুবক কে নিয়ে। যুবকটা এতোটাই সুন্দর যে চারপাশের মানুষ হা করে তাকিয়ে আছে। ছেলেটার রূপের রশ্মি যেনো জ্বলজ্বল করে সকলকে জানান দিচ্ছে তার সৌন্দর্য! সকলে অনেকটাই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

——————————–

চলবে!!!

পরিশিষ্ট পর্ব-২২ এবং অন্তিম অধ্যায় দ্বিতীয় / শেষ অংশ

0

#গল্পের_নাম: পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_২২ (অন্তিম অধ্যায়–দ্বিতীয়/শেষ অংশ)

অহি সরে আসতে নিতে রোদ্দুর তার হাত চেপে,চোখ বন্ধ রেখে ঘুমজড়ানো কন্ঠে বলল,

—“আমি তোকে অনেক অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি রে অজান্তা!”

অহি রোদ্দুরের নাক আলতো করে ছুঁয়ে দিল।তারপর লজ্জামিশ্রিত মুখে বলল,

—“আমিও এই পাগলটাকে খুউউউব ভালোবাসি!!”

রোদ্দুর চোখ খুলল।পিটপিট করে অহির দিকে চেয়ে বলল,

—“জীবন নামক উপন্যাসের শেষ অধ্যায়ে গিয়ে যখন তোমার শরীরের উজ্জ্বলতা কমে গিয়ে চামড়া ঢলঢলে হয়ে যাবে,রেশমের মতো লেপ্টে থাকা কৃষ্ণ চুলগুলো সাদা হয়ে যাবে,মাতাল করা হাসিতে ঘায়েল করা সব দাঁত ঝরে যাবে,ঘন পল্লবঘেরা চোখের দৃষ্টি যখন ক্ষীণ হয়ে আসবে,ফোলা ফোলা গালগুলো ঝুলে যখন তিল ঢেকে যাবে,একপাশের টোল খাওয়া সুন্দর মুখোশ্রী যখন থলথলে হয়ে যাবে তখন আরো একবার নতুন করে প্রেমে পড়বো তোমার।

প্রথম প্রেমের মতো সেই একটু লজ্জা, অনেকখানি ভালোলাগা নিয়ে তোমায় কল্পনা করো,হুট করে নিশিরাতে ডায়েরি লিখতে বসবো,ক্ষণে ক্ষণে বেসুরো কন্ঠে গান ধরবো,তোমার প্রেমে আবার এলোমেলো হবো!

প্রথম প্রেমের মতো সেই একই অনুভূতি নিয়ে, একই আবেগ নিয়ে রাত জেগে তোমার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকবো।সেই একই শিহরণ নিয়ে অপেক্ষা করবো তোমার প্রথম হাত স্পর্শের!সেই একই মায়া লুকিয়ে চোখে চোখ রাখবো তোমার।যে মায়ায় তুমি ঘায়েল হতে বাধ্য!

আচ্ছা, তুমিও কি তখন এমন করে আমার জীর্ণ হাড় গোড়ের ‘এই আমি’ তে প্রেমে পড়বে?”

অহি ছলছল চোখে রোদ্দুরের বুকে হাত রেখে বলল,

—“হুঁ!”

বাইরে থেকে শাহিনুরের কন্ঠ কানে আসতে রোদ্দুর হাত ছেড়ে দিল অহির।অহি মুচকি হেসে ইশারায় চা, নুডলস খেতে বলে বাইরে বের হয়ে গেল।

————————-

দুপুরের নামাজের পর পর মিলাদ শুরু হলো।গ্রামের বহু মানুষ এসেছে।দূর দূরান্ত থেকেও অনেকে এসেছে।বদলগাছি গ্রামের পূর্ব পাড়ার মসজিদের ইমাম সাহেব মিলাদের হুজুর।পাঁচ গায়ে হুজুরের নাম ডাক তা শাহিনুরের অজানা নয়!

মিলাদের আয়োজন করা হয়েছে বাড়ির নিচের পতিত ক্ষেতটাতে।এতদিন ঘাসজাতীয় কিছু ছিল।যা সব গরু খেয়ে ফেলেছে।এখন ফসলবিহীন।সেখানেই চারপাশে ছাউনি তৈরি করে চটের কাগজ বিছিয়ে জায়গা বানানো হয়েছে।শাহিনুরের কাঠের বেঞ্চ, টেবিল আনার ইচ্ছে ছিল।কিন্তু সেগুলোতে তো নামাজ আদায় করা যাবে না।পরে এই ব্যবস্থা!

মিলাদ শেষের দিকে তক্তপোশের উপর বসে থাকা হুজুর মোনাজাত ধরলেন।মোনাজাতে তিনি রোদ্দুরের জন্য দোয়া করলেন।

মোনাজাত শেষে খানাপিনার ব্যবস্থা করা হলো সাদা ভাত,গরুর মাংস,খাসির মাংস, সিদ্ধ ডিম, দই ডালসহ আরো কিছু!কাপড় দিয়ে তৈরি বহির্গমন গেটের সামনে একটা চেয়ারে রোদ্দুরকে বসিয়ে রাখা হলো।একজন একজন করে খাওয়া শেষে রোদ্দুরের মাথায় হাত বুলিয়ে গেল।রোদ্দুর রাগে ফেটে পড়ার মতো অবস্থা!পৃথিবীতে সেই একমাত্র ব্যক্তি হয়তো যার বিয়েতে এসব হচ্ছে।কিন্তু কিছু করার নেই।তার মায়ের কড়া হুকুম।এই নিয়ে রোদ্দুরকে হাজার খানেক মানুষ ছুঁয়ে দিল!

সন্ধ্যার দিকে কাজী ডেকে হৈ হুল্লোড় করে রোদ্দুর আর অহির বিয়ে হয়ে গেল।অহি যখন কাঁদতে কাঁদতে কবুল বলল তখন তার কানে দূর থেকে কোকিলের কুহুকণ্ঠ ভেসে এলো।রাতের বেলা কোকিলের ডাক?সে কি ভুল শুনলো?

——————

রাতের বেলা রোদেলা রুমে ঢুকে দেখল রুম অন্ধকার।সে কি!রুম অন্ধকার কেন?এই রুমটাতেই তো গতকাল সে, ছিনজা আর অহি ঘুমিয়েছিল।রোদেলা অন্ধকার হাতড়ে দেয়াল ধরে সুইচ খুঁজতে নিতে দরজার ছিটকিনি লাগানোর শব্দ কানে আসলো।সে ভয়ার্ত কন্ঠে বলল,

—“কে?”

সঙ্গে সঙ্গে কেউ একজন তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে নিল।তার গায়ের গন্ধ রোদেলার চেনা।সে থতমত খেয়ে বলল,

—“আপনি?আমাকে একটু বাইরে যেতে হবে।রোদ্দুর এখনো ঘরে ঢোকেনি!ওর আজ বাসর রাত!”

সাদিদ রোদেলার ঘাড়ে চুমু দিয়ে বলল,

—“আ’ম ইন লাভ মিস রোদেলা জান্নাত!আমি তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি!”

রোদেলা ছটফট করতে করতে বলল,

—“ছিনজা কোথায়?আমাকে বাইরে যেতে হবে!”

—“ছিনজা শ্বাশুড়ি মায়ের কাছে থাকবে বলেছে।তুমি আর রুম থেকে বের হতে পারবে না।আজ তুমি সাদিদের হাতে বন্দী।”

রোদেলাকে ছেড়ে সাদিদ সুইচ টিপে লাইট অন করতেই রোদেলা চমকে গেল।কারণ এই রুমটাও ফুলে ফুলে সাজানো।অনিন্দ্য সুন্দর লাগছে পরিবেশটা!একটু ভীতি,একটু অনুভূতি,একটু লজ্জা!সব মিলিয়ে রোদেলা পাগল হয়ে যাচ্ছে।রুমের ডেকোরেশন কি সাদিদ একা করেছে?কেন করেছে?সেজন্যই কি সন্ধ্যার পর থেকে রুমটা লক ছিল?

সাদিদ হাঁটু গেড়ে রোদেলার সামনে বসে পড়তে রোদেলা বাঁধা দিল।মানুষটা তার স্যার!সাদিদ মানলো না।বুক পকেটে থেকে একটা রিং বের করে রোদেলার হাতে পড়িয়ে তাতে চুমু খেল।রোদেলা সরে যেতে চাইতে সাদিদ উঠে দাঁড়িয়ে টেনে ধরলো।ঘোর লাগা কন্ঠে বলল,

—“তোমার প্রথম দেখার পর থেকেই আমার স্বপ্ন ছিল বাসর রাতে তোমার সালামের উত্তর দিবো।অবশেষে, পরিশিষ্টে তোমাকে পেয়েছি।আজ সালাম করবে?সালাম করলে আমার সব আনসার পেয়ে যাব!”

রোদেলা ইতি উতি করে দীর্ঘক্ষণ পর ক্ষীণ কন্ঠে বলল,

—“আসসালামু আলাইকুম! ”

সাদিদ মিষ্টি হেসে রোদেলার কপালে চুমু খেয়ে বলল,

—“ওয়ালাইকুম সালাম।”

——————

রোদ্দুর দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই সটান দরজার ছিটকিনি লাগাল।তার হাত পাসহ সম্পূর্ণ শরীর মৃগী রোগীদের মতো কাঁপছে।সে শেষ!আজ তাকে কেউ হয়তো বাঁচাতে পারবে না।দ্রুত পাঞ্জাবির পকেট থেকে সাদা রুমালটা বের করে চোখ বেঁধে নিল সে।আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিল অহিকে সে বিয়ের সাজে দেখবে না।দেখলেই নির্ঘাত হার্ট অ্যাটাক। বন্দুকের গুলি মিস হতে পারে,কিন্তু আজ অহিকে দেখে তার হার্ট অ্যাটাক মিস হবে না।

তার বুকের ঢিপঢিপ শব্দ ছাপিয়ে কানে ওয়াশরুমের পানি পড়ার শব্দ আসলো।অহি কি ট্যাপটা ভালো করে বন্ধ করতে পারেনি!

সে সামনে হাত বাড়িয়ে এদিক ওদিক হয়ে বলল,

—“ইয়ে মানে অজান্তা আছিস?হাতটা একটু ধরে বেডে বসিয়ে দে তো!”

অহি বসেছিল ফুলের বিছানায়।রোদেলা আপু ভয়ানক সুন্দর করে রুমটা সাজিয়েছে।সে এক হাত ঘোমটা দিয়ে বিছানায় বসে ছিল এই আশায় যে রোদ্দুর ভাই তার ঘোমটা সরিয়ে মুখটা দেখবে।সে শাড়ি পড়েছে।বিয়ের সাজে নাকি তাকে ভয়ংকর সুন্দর লাগছে।সবাই বলেছে সেটা!কিন্তু রোদ্দুর ভাই তাকে দেখবে না?সে তো এই মানুষটার জন্যই সাজ নিয়ে বসে আছে।

সে উঠে গিয়ে বলল,

—“রোদ্দুর ভাই, এসব কি?চোখ বেঁধে রেখেছেন কেন?”

রোদ্দুর তার চোখ বাঁধার কারণ না বলে বিরক্ত কন্ঠে বলল,

—“রোদ্দুর ভাই কেন শুধু? দাদাভাই, মামাতো ভাই, চাচাতো ভাই,ফুপাতো ভাই, খালাতো ভাই,আম ভাই, জাঁম ভাই, কুত্তা ভাই, বিলাই ভাই সব ভাই বলে ডাক!জগতের যত শব্দ আছে প্রতিটার সাথে ভাই লাগিয়ে দে!যত্তসব!আসছে!রোদ্দুর ভাই?আজকের রাতেও তোর ভাই না বললে চলতো না অজান্তা?”

অহি অবাক কন্ঠে বলল,

—“আপনি আমার সাথে চেঁচিয়ে কথা বলছেন কেন রোদ্দুর ভাই!”

রোদ্দুর হতাশ হলো।নাহ!এই মেয়ে তাকে জীবনেও ভাই বলা বাদ দিবে না।থাক!আজকের রাতে রাগারাগি করে লাভ নেই।ভাই বলুক!যতখুশি বলুক!হাজার বার বলুক!সে সামনে হাতড়ে এগিয়ে যেতেই পড়তে পড়তে নিজেকে সামলে নিল।রোমান্টিক গলায় বললো,

—“অজান্তা!একটু হাতটা ধর না!আমি দু চোখে অন্ধকার দেখছি।প্লিজ!”

অহি উত্তর দিল না।রোদ্দুর বুঝতে পারছে অহি হয়তো মন খারাপ করেছে।সে বেসুরো কন্ঠে বলল,

—“ও বেবি কাম কাম টু মি…..
আমি তোমার স্বামী হলে তুমি স্ত্রী!”

অহি খিলখিল করে হেসে ফেলল।কয়েক পা এগিয়ে এসে রোদ্দুরকে জড়িয়ে ধরলো।তার বুকের ভেতর অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করছে।মানুষটাকে তার পাশে পেয়েছে।পরিশিষ্টে নিজের করে পেয়েছে।দূরে কোথাও আবারো কোকিলের ডাক শুনতে পেল অহি।যেন সুরে সুরে প্রকৃতির তালে তালে তাকে অভিনন্দন জানিয়ে যাচ্ছে।সে মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করলো,তার বিবাহিত জীবন যেন ভালোবাসায় পরিপূর্ণ থাকে।রোদ্দুরকে সে আরো শক্ত করে চেপে ধরলো।

হঠাৎ রোদ্দুর অহিকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে বাঁধা চোখে ডান হাতটা অহির সারামুখে বিচরণ করলো।অহি মুখটা একটু সরিয়ে বলল,

—“চোখের মধ্যে আঙুল দিচ্ছেন কেন রোদ্দুর ভাই?”

—“ইয়ে মানে তোর ঠোঁট কইরে অজান্তা।একটু চুমু টুমু দিতে চাইলাম।খারাপ ভাবিস না আমাকে!ইয়ে মানে……”

অহি চরম বিরক্তি নিয়ে এক টানে রোদ্দুরের চোখ থেকে বাঁধনটা সরিয়ে ফেলল।রোদ্দুর চোখ খুলে অহিকে বিয়ের সাজে দেখে বড় বড় চোখে বলল,

—“ও মাই গড!কি সাংঘাতিক লাগছে তোকে!দূরে গিয়ে দাঁড়া!”

অহি আরো কাছে এগিয়ে এলো রোদ্দুরের।রোদ্দুরকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরে মুখটা নিচু করলো তার।তারপর ফট করে রোদ্দুরের ঠোঁটে চুমু খেল।

—————-

#পরিশিষ্ট

‘পাগলের কারখানা’ র নাম পাল্টে “পরিশিষ্ট ভবন” রাখা হয়েছে বছর চারেক হলো!এই বিগত চার বছরে তেমন কিছু পরিবর্তন হয়নি।শুধু নতুন দুটো সদস্য যুক্ত হয়েছে।রোদেলা-সাদিদের ছেলে আর রোদ্দুর-অহির মেয়ে।

রোদ্দুর-অহির পিচ্চি মেয়েটার আজ জন্মদিন।দুই বছরে পা রাখবে সে।সেই উপলক্ষে পরিশিষ্ট ভবনে বড়সড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।দুপুরে কেক কাটা হয়েছিল।ঘনিষ্ঠরা বাদে সবাই খাওয়া শেষ করে চলে গেছে।কিন্তু সমস্যা হয়েছে একটা ছোট্ট বিষয়ে।ফকির পাওয়া যাচ্ছে না।

শাহিনুর কাটা মাছের মতো ছটফট করছে।সে গত পরশু দিন গুলিস্তানের পীরসাহেবের কাছে গিয়েছিল।তার কলিজার টুকরো নাতনিটার জন্মদিন উপলক্ষে দোয়া চাইতে।পীরসাহেব তাকে বলেছে অনুষ্ঠান শেষে যেন পাঁচ-সাত জন ফকির মিসকিন খাওয়ানো হয়!রোদ্দুর গেছে সেই দুপুরে ফকির খুঁজতে।কিন্তু বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে চলল তার ফেরার নাম নেই!

শাহিনুর ধপ করে সোফায় বসে বলল,

—“কুটি আমার মাথায় আইস ব্যাগ চেপে ধর!”

কুটি রান্নাঘর থেকে আইস ব্যাগ হাতে দৌঁড়ে এসে শাহিনুরের মাথায় ধরলো।তারপর সান্ত্বনা দেয়ার ভঙ্গিতে বলল,

—“বড় মা!বেশি টেনশন কইরেন না তো!ঢাকাত পয়সা আর ফকিন্নি বৃষ্টির ফোঁটার মতো অগুনতি।যেনে হেনে পাওয়া যায়।”

—“তাহলে রোদ্দুর এখনো আসছে না কেন?”

—“আসবে গো বড় মা!”

কুটির কথা প্রমাণ করার জন্যই হয়তো রোদ্দুর সঙ্গে সঙ্গে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল।আজ অনুষ্ঠান উপলক্ষে দরজা খোলা।কিন্তু রোদ্দুরের দিকে নজর পড়তেই শাহিনুর চমকে উঠলো।রোদ্দুরের থুতনিতে ব্যান্ডেজ,এক চোখ ফোলা,কপালের কাছে জখম হয়ে আছে।তাকে দেখে শাহিনুর দৌঁড়ে গিয়ে বলল,

—“বাপ,কি হইছে তোর?এক্সিডেন্ট করছিস?”

রোদ্দুর মায়ের হাত ধরে সোফায় বসে বলল,

—“মা চিন্তা করো না তো।সামান্য মারামারি হয়েছে একজনের সাথে।হালকা চড় থাপ্পড়।”

—“কি কান্ড!কার সাথে?”

—“আজকাল ঢাকা শহরে ফকির পাওয়া দূরুহ দেখছি।ময়লা টিশার্টের গলার কাছে বেশ কয়েক জায়গায় ফুটো দেখে এক লোককে ফকির ভেবে বাসায় ডেকেছি আর সে কি রাগারাগি।তার নাকি ঢাকায় বাড়ি-গাড়ি আছে।প্রচুর টাকা আছে।ফকির বলায় ক্ষেপে যায় আর আমার সাথে মারামারি হয়।আমি তো আর সিনেমার হিরো না যে খালি মেরে আসবো।নিজেও খেয়েছি।তাছাড়া লোকটার গায়ে প্রচুর শক্তি।মতিজান কোথায় মা?”

মতিজান রোদ্দুর আর অহির মেয়ের নাম।এই নাম পীরসাহেব রেখেছে।শাহিনুর পৃথিবী উল্টে গেলেও নাতনির নাম অন্য কিছু রাখবে না।তবে সে বলেছে তারা চাইলে স্কুলে অন্য নাম দিতে পারবে।কিন্তু বাড়িতে সবাইকে মতিজান বলেই ডাকতে হবে।

মতিজানকে ঘুম পাড়িয়ে অহি নিচে নেমে রোদ্দুরকে দেখেই চমকে যায়।রোদ্দুর ইশারায় তাকে শান্ত হতে বলে।তারপর অহিকে ডেকে উপরে উঠে যায়।

—“বড় মা!ফকির আইছে।”

কুটির চিল্লানিতে শাহিনুর সদর দরজার দিকে তাকালো।একে একে আটজন ফকির ঢুকলো।তার পেছনে সাদিদ তার দুই বছরের ছেলে সায়েমকে কোলে নিয়ে আর ছিনজার হাত ধরে ভেতরে ঢুকলো।

—“মা,ওদের নিয়ে পার্কে ঘুরতে গিয়ে এদের পেলাম আর নিয়ে আসলাম।”

সাদিদের কথায় শাহিনুর প্রচুর খুশি হলো।ফকির গুলোকে ডাইনিং এ বসতে বলে সাদিদকে বলল,

—“তুমি অনেক ভালো কাজ করেছো বাবা।এই রোদেলা সাদিদকে আজ নিজ হাতে খাইয়ে দিবি!”

সাদিদ লজ্জা মিশ্রিত চোখে সোফায় গিয়ে বসলো।ফজিলা আর কুটি সবাইকে খেতে দিল।শাহিনুর ঘুরে ঘুরে তদারকি শুরু করলো।হঠাৎ মধ্য বয়স্ক এক লোক প্লেট থেকে হাত সরিয়ে বলল,

—“বাড়িত রান্না করা পোলা খামু না।কাচ্চি খামু!”

শাহিনুর বুকে হাত দিয়ে চিৎকার করে বলল,

—“কুটি আমায় ধর!আমায় ধর!এ কি যুগ আসলো?ওরে কেউ কাচ্চি আনার ব্যবস্থা কর!”

রাতেরবেলা ছোট্ট করে গানের আসর বসানো হলো।বেসুরো কন্ঠে যে যেমন পারলো সে তেমনই গাইলো।ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ুয়া অপূর্ব বলল,

—“এবার রোদ্দুর ভাইয়া আর সাদিদ ভাইয়া ডুয়েট গাইবে।”

রোদ্দুর গান গাইতে নিতেই অহি তার হাতে চিমটি কেটে ফিসফিস করে বলল,

—“রোদ্দুর ভাই,তোমার এই বেসুরো কন্ঠ আমি বাদে আর কাউকে শুনাবে না প্লিজ!”

—“অজান্তা রে!রাতে তোর খবর আছে।তুই আগে রুমে চল!স্যরি,তুমি আগে রুমে চলো বউ!”

অহি হাসতে নিয়েও হাসলো না।প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সাদিদ রোদেলার দিকে চেয়ে আড়ালে তার হাত চেপে ধরে বলল,

—“অ্যাইসা লাগা মুঝে প্যাহলে দাফা
তানহা মে হো গেয়ি ইয়ারা
হোও….অ্যাইসা লাগা মুঝে প্যাহলে দাফা
তানহা মে হো গেয়ি ইয়ারা
হু পারেসান সি…..”

হঠাৎ শাহিনুর এক ধমক দিয়ে বলল,

—“স্টপ!থেমে যাও!গানের কি শ্রী!এই কুটি!তুই গা তো…মায়াবন বিহারিণী, হরিনী……”

সবাই একযোগে হেসে উঠলো।সেই ফাঁকে অপূর্ব ক্যামেরায় চোখ লাগিয়ে “পরিশিষ্ট ভবনের” সবার হাস্যোজ্জ্বল দূর্দান্ত একটা ছবি ক্লিক করে ফেলল।আগামী প্রতিটা সকাল, প্রতিটা দিন তাদের এভাবে হাসিমুখে কাটুক!

★সমাপ্ত★

আসসালামু আলাইকুম।অবশেষে গল্পটি শেষ হলো।সবাই অনেক অনেক ভালোবাসা দিয়েছেন গল্পটাকে।সবার প্রতি কৃতজ্ঞ!পরিশিষ্ট ভবনের সবার মতো আপনাদেরও প্রতিটা সকাল, প্রতিটা দিন দূর্দান্ত কাটুক।

পরিশেষে, ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।

পরিশিষ্ট পর্ব-২১ এবং অন্তিম অধ্যায় প্রথম অংশ

0

#গল্পের_নাম: পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_২১ (অন্তিম অধ্যায়–প্রথম অংশ)

গ্রামের নাম বদলগাছি।অনেকটা আধুনিক,কারেন্ট আছে!থেকে থেকে কদাচিৎ ইট, সিমেন্টের ঘরবাড়ি দেখা যায়।চারিদিকে সবুজের সমারোহ।মাঠে সবুজ ধানগাছের সারি আর গাছপালার সবজত্ব চারিদিকে ঠিকরে পড়ছে যেন।সবুজ রঙ চোখে অন্য ধরনের প্রশান্তি এনে দেয়!

অহিরা বদলগাছি গ্রামে যখন পৌঁছাল তখন শেষ বিকেল।সূর্য পশ্চিম কোণে ডুবুডুবু!বাস থেকে নেমে মাটির রাস্তা ধরে সবাই সারি সারি হাঁটা ধরলো।মিনিট বিশেক হাঁটলেই বাড়ি পাওয়া যাবে।

ছিনজা খিলখিল করে হাসছে আর দৌঁড়াদৌঁড়ি করছে।পড়ে টড়ে হাঁটু ছিলে ফেলতে পারে এই ভয়ে রোদেলা চুপসে আছে।সে একটুপর পর ছিনজাকে বারণ করছে।কিন্তু ছিনজা কোনো বারণ শুনছে না।সে কারো হাত ধরে হাঁটবে না।একা একা হাঁটবে,লাফাবে!

রোদেলা পেছন ঘুরে তাকাল।সাদিদের যেন মেয়ের দিকে নজর নেই।সে এখন অহির বাবা আর তার বাবার সাথে হাত নেড়ে নেড়ে গল্প করতে ব্যস্ত।ভালোই ভাব জমে গেছে।

অহি ছিনজাকে থামানোর চেষ্টা করছে।রোদেলা দ্রুত হেঁটে অহির কাছাকাছি হলো।কুটি এখন ছিনজার সাথে সাথে দৌঁড়াদৌঁড়ি করছে।

অহি রোদেলার দিকে চেয়ে হাসিমুখে বলল,

—“আপু কেমন লাগছে?”

রোদেলা অহির হাত চেপে ধরে বলল,

—“অহি রে!আমি ঠিক আছি!অনেক ভালো লাগছে।তোর কি হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে?”

—“না আপু!সামান্য একটু রাস্তা!আপু তোমার খবর বলো!সাদিদ ভাইয়ের সাথে কেমন সময় কাটছে?”

রোদেলা লজ্জা মিশ্রিত চোখে একবার পেছন ঘুরে সাদিদের দিকে তাকালো।সাদিদ তখন তার দিকেই চেয়ে ছিল।চোখে চোখ পড়তে রোদেলা সামনে তাকাল।অহিকে বলল,

—“পিচ্চি!তুই কিভাবে বুঝতে পারলি যে আমার সেই স্বপুরুষ সাদিদ?”

—“আপু সেদিন রিসেপশনে সাদিদ ভাইকে দেখে অজ্ঞান হয়ে যেতেই আমার মনে কিছুটা খটকা লাগে।সাদিদ ভাইয়ের চোখেও কিছু একটা ছিল।তোমাকে নিজের বুকে আগলে নেয়া দেখে আমার কেমন যেন লাগে।তারপর একটু খোঁজ খবর নেই!সব ইনফরমেশন মিলে যায়!তোমাকেও সাদিদ ভাইয়ের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করলে কেমন ছটফট করো।ব্যস!বুঝে গেলাম।তারপর সাদিদ ভাইয়ের সাথে সরাসরি কথা বলে আরো সিউর হলাম।রোদ্দুর ভাইকেও সব জানালাম।বাকিটুকু রোদ্দুর ভাই সাহায্য করলো।”

রোদেলা হাসলো।মাথা নিচু করে বিড়বিড় করে বলল,

—“তোদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ থাকবো না।তোদের সাহায্য ফিরিয়ে দিবো।তোদের জন্য সারপ্রাইজ আছে!”

হাঁটতে হাঁটতে তারা বাড়িতে পৌঁছে গেল।পুরনো ভিটে।চারিদিকে প্রচুর গাছগাছালি আর ছনের বনে ঘেরাও করা অদ্ভুত সুন্দর বাড়ি।শাহিনুরকে দেখেই জামিল আর তার বৌ এগিয়ে এলো।বুকে জড়িয়ে নিল সবাইকে।প্রায় বছর দুই পর তারা গ্রামে ঘুরতে এসেছে।শাহিনুরের বাবার কোনো ছেলে ছিল না।ছোটবেলা থেকে ইয়াতিম জামালকে ছেলের নজরে দেখেছে।টুকটাক কাজ করে দিতো সে!

শাহিনুরের বাবা মা মারা যাওয়ার পর জামাল এ বাড়িতেই বউ বাচ্চা নিয়ে থেকে যায়।এখন তার একটা ছেলে পড়াশোনা করে বিদেশে চাকরি করে।প্রচুর টাকা রোজগার করে।জামাল তার ছোট দুটো ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখেই আছে!

শাহিনুর ঘুরে ঘুরে বাড়ি দেখলো।তার সঙ্গী হয়েছে কুটি!বাড়িতে দক্ষিণ দিকে একটা টিনের ঘর।মাঝখানে বেড়া দেয়া।একরুমে চকিতে চকচকে চাদর বিছানো।পাশের সামান্য ছোট রুমে প্রচুর খড়ি,লাকড়ি রাখা আছে।সাথে রান্নাঘর।গ্যাসেরও ব্যবস্থা আছে। পশ্চিম আর উত্তর দিক মিলে বিশাল বড় এক তলা বিল্ডিং!সবমিলিয়ে আটটা রুম।মাঝে মাঝে তারা গ্রামে আসে সেজন্য বেশি করে রুম করা হয়েছে।এর মধ্যে দুটো রুমের সাথে এটাচড্ বাথরুম দেখে শাহিনুর খুশি হলো।

—“বড় মা!এতগুলান মানুষ আটটা রুমে আটবো?”

শাহিনুর স্বাভাবিক ভাবে বলল,

—“না হলে তুই আর তোর বড় বাজান উঠানে ঘুমাবি!বাপ মেয়ে রাতের তারা দেখবি!”

—“আপনে কি যে কন না বড় মা!তারচেয়ে আপনে বাজানের লগে সারাডা রাত উঠানে মাদুর পাইতা জোসনা দেখবেন।”

—“আমার জোসনা দেখার বয়স আছে?চল গাধা!খাতা কলম নিয়ে বসতে হবে।অনেক কিছু লিস্ট করতে হবে।খাতা কলম এনেছিস তো?”

—“জে বড় মা!”

বাড়িতে মোটর আছে।দক্ষিণের টিউবওয়েলের সাথে মোটর সেট করে তার সাহায্যে মদিনা ট্রাংকে পানি উঠানো হয়।সেখান থেকে প্রতিটি ওয়াশরুমে পানির ব্যবস্থা করা আছে।শাহিনুর ফ্রেশ হলো সবার পরে।ওয়াশরুমে ঢুকে অবাক হলো।একদম ঝকঝকে।নাহ!কারো সমস্যা হবে না।সবার দিন ভালো কাটবে।

রাতের খাওয়ার পর সবাই গল্প করতে বসলো।রোদেলা মায়ের থেকে লুকিয়ে অহি আর রোদ্দুরকে মুক্ত করে বাইরে বের করে দিল।ছাদে টাদে গল্পগুজব করুক!

সাদিদ রুমের এক কোণায় প্লাস্টিকের চেয়ারে অসহায় ভাবে বসে আছে।একটুপর পর রোদেলার দিকে তাকাচ্ছে।রোদেলার মায়ের কড়া হুকুম এখানে জোড়ায় জোড়ায় থাকা যাবে না!সে ভেবেছিল গ্রামে এলে সময় ভালো কাটবে,এই সুযোগে হয়তো রোদেলার একটু কাছাকাছি ও যেতে পারবে।কিন্তু সমীকরণ পুরো উল্টে গেল।

ছিনজা ঘুমিয়ে পড়েছে।রোদেলা তাকে শুইয়ে দিয়ে মায়ের পাশে বসলো।রোদ্দুর আর অহি বাদে সবাই রুমে আছে।রোদেলা গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

—“আমি এখন একটা কথা বলবো।কারো প্রেশার যেন হাই হয়ে না যায়।”

বেশ কয়েক জোড়া চোখ তারদিকে বড় বড় করে তাকালো।রোদেলা এক নজর সাদিদের দিকে চেয়ে আবার সামনে তাকালো।তারপর এক নিঃশেষে বলল,

—“আমি ভাবছি কি গরু দিয়ে তো সবাইকে খাওয়ানোই হবে।বড়সড় অনুষ্ঠান তো হবেই।এই উপলক্ষে রোদ্দুরের বিয়ে দিয়ে দিলে কেমন হয়?”

শাহানা চাপা স্বরে বলল,

—“মেয়ে কই পাবি রে রোদু?”

—“মেয়ে আছে তো খালামণি।তোমার মেয়ে।অজান্তা অহি।’

সবার মধ্যে পিনপতন নিরবতা।হঠাৎ আশরাফ হোসেন বলল,

—“মা রোদেলা!রোদ্দুরের পছন্দের মেয়ে আছে।ও একটা মেয়েকে পছন্দ করে।মেয়ে নাকি হিরের টুকরো।কিঞ্চিৎ সমস্যা মেয়ের বাবাকে নিয়ে।মেয়ের বাবার মাথায় একটু সমস্যা আছে।”

রোদেলা আমতা আমতা করে বলল,

—“ঘটনা হয়েছে কি খালু!রোদ্দুর আপনার মেয়েকে ভালোবাসে!ওরা দুজন দুজনকে অনেক আগে থেকেই ভালোবাসে।”

কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো ব্যাপারটা ধাতস্থ করতে সবার।তারপর ঘরে ছোটখাটো একটা ভূমিকম্প ঘটে গেল।আশরাফ হোসেন বাজখাঁই গলায় বললো,

—“হলি কাউ!রোদ্দুর তাহলে বলেছে আমার নিউরনে সমস্যা আছে?আমি মেন্টাল?কিন্তু মন ভালো?কি সাংঘাতিক!হবু শ্বশুর মশাইকে পাগল বলে?শাহানা!আমার হাত ধরো?আমি চোখে অন্ধকার দেখছি!’

তার কথা শেষ হতে না হতে শাহিনুর ধমকে বলল,

—“কুটি আমার আইস ব্যাগ নিয়ে আয়।এক্ষুনি মাথার সিঁথি বরাবর চেপে ধর।”

কুটি মুখ ভেঁচকে বলল,

—“বড় মা!আমরা গেরামে আছি।আপনের আইস ব্যাগ ঢাকাত রইছে।কলপাড়ে চলেন।মাথায় ঠান্ডা পানি ঢালমু!”

—————–

অন্ধকার রাত!মিটিমিটি তারা জ্বলছে আকাশে।গ্রামের শীতল হাওয়া চামড়া ভেদ করে ভেতরে ঢুকছে যেন।দূরে যতদূর চোখ যায় ঘন গাছপালা।গ্রাম্য মাটির অদ্ভুত মিষ্টি বুনো একটা গন্ধ নাকে লাগছে।রোদেলা আর সাদিদ ছাদে দাঁড়িয়ে আছে।

সাদিদ আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,

—“তোমার মনে হয় না আমার শ্বাশুড়ি মা একটু বেশি বেশি করছে?পর্যাপ্ত রুম থাকতেও কেন আমাকে শ্বশুর আর খালুশ্বশুরের সাথে ঘুমাতে হবে?তাও আবার তাদের মাঝে?”

রোদেলা মুচকি হাসলো।তার মায়ের মাথায় যত্তসব অদ্ভুত অদ্ভুত বুদ্ধি।তিনি কুটিকে সাথে নিয়ে খাতা কলমে একটা লিস্ট করেছে।সুবিশাল সে লিস্ট।যে কয়েকদিন গ্রামে থাকা হয়, রাতের বেলা কে কার সাথে ঘুমাবে সে লিস্ট!লিস্টে সাদিদের নাম পড়েছে তার শ্বশুর দের সাথে। রোদ্দুর আর অপূর্বকে টিনের ঘরটাতে থাকতে বলা হয়েছে।কারণ পরশু দিন রোদ্দুর আর অহির বিয়ে।বিয়ের পাত-পাত্রীদের কাছাকাছি থাকতে দেয়া যাবে না।একজন উত্তর দিকে তো আরেকজন দক্ষিণ দিকে।তার মায়ের কথা সবাই মানতে বাধ্য!

কেমন সব ছেলেমানুষী করে তার মা।কে বলবে এই মেয়ে ছোটবেলায় টপ স্টুডেন্ট ছিল!তার বাবার সাথে দেখা হবার পর তাকে এমন ভালোবাসলো যে পড়াশোনা সব ছেড়ে দিল।তাকে হাজার চেষ্টা করেও পড়ানো যায় নি।রোদেলা হেসে বলল,

—“আমার মায়ের মধ্যে থেকে কিশোরী ভাবটা এখনো যায় নি।দেখলেন না হুট করে গরু জবাই করে গ্রামের মানুষ দের খাওয়াতে চাইলো।আমার বাবাও রাজি হয়ে গেল!”

—“তুমি কার সাথে ঘুমাবে?”

—“ছিনজা, আমি আর অহি!”

—“তাহলে শ্বাশুড়ি মা?”

—“মা কুটির সাথে ঘুমাবে।সাথে হয়তো ফজিলা খালা।কোনো এক অদ্ভুত কারণে মা আ কুটি সবসময় ঝগড়া করে।আবার দুজন কাছাকাছি ও থাকে।”

সাদিদ অসহায়ের মতো বলল,

—“গ্রামে কতদিন থাকতে হবে এভাবে?”

—“চার পাঁচদিন হয়তো বা!কেন আপনার ভালো লাগছে না?”

—“হা হা।অনেক ভালো লাগছে।”

সাদিদের অদ্ভুত হাসির শব্দে রোদেলা তার দিকে তাকাল। তারপর সামান্য একটু এগিয়ে যেতে সাদিদ সাবধান করে বলল,

—“ছাদে রেলিং নেই।এত কিনারে যাবে না!”

রোদেলার পরণে পাতলা শাড়ি।প্রচুর শীত লাগছে তার।অনেক্ক্ষণ হলো দুজন ছাদে।সে শাড়ির আঁচলে দু হাত ঢেকে বলল,

—“নিচে চলুন!আমার শীত লাগছে প্রচুর!”

সাদিদ রোদেলার দিকে তাকালো।আজ আকাশে অর্ধ বৃত্তের মতো চাঁদ।সেই চাঁদের আবছা আলো রোদেলার মুখে এসে পড়েছে।তাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে।চুলগুলো হাত খোঁপা করা।কিঞ্চিৎ আলো চুলে পড়েও চিকচিক করছে।তাকে কেমন আলোময়ী লাগছে।সে বার বার সাদিদের জীবনে ফিনিক আলো নিয়ে আসছে।

সাদিদ কেমন ঘোরের মধ্যে চলে গেল।তার অদ্ভুত এক ইচ্ছে জাগছে মনের কোণে।ইচ্ছে টাকে প্রাধান্য দিয়ে দু পা এগিয়ে গিয়ে রোদেলাকে পেছন থেকে জড়িয়ে নিল নিজের বুকের মাঝে!

রোদেলা চমকে উঠলো।তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।হাত পা ঠকঠক করে কাঁপছে।তার আটাশটা বসন্তে প্রথম কোনো ছেলে এত কাছে।সেই ছেলেটা আর কেউ নয়! তার ঝাকড়া চুলের স্বপ্ন পুরুষ!

সাদিদ রোদদেলার কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে করে বলল,

—“শীত একটু কমেছে?”

রোদেলা চোখ বন্ধ করে বলল,

—“আমায় ছাড়ুন।দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না!প-পরে যাব কিন্তু! ”

রোদেলার শরীরের কাঁপুনি সাদিদ টের পেল।রোদেলা কেমন নিস্তেজ হয়ে পড়ছে।সে এক হাতে রোদেলাকে ঘুরিয়ে নিজের বুকে শক্ত করে জড়িয়ে নিল।রোদেলা দুহাতে সাদিদের শার্ট আকড়ে নিজের সম্পূর্ণ ভর তার উপর ছেড়ে দিল।

——————-

আজ অনুষ্ঠান!গরু জবাই করে যোগাড় যন্ত্র হবে।সাথে সন্ধ্যায় গ্রামের মানুষের আশীর্বাদে রোদ্দুর আর অহির বিয়েটা হবে।কিন্তু সূর্যের আলো ফুটার আগেই একটা অঘটন ঘটে গেল।অনুষ্ঠান উপলক্ষে জামাল দূরের গ্যাসের হাট থেকে সে গরুটা এনেছিল, জবাইর আগে পরীক্ষা করে দেখা গেছে গরুর পেটে বাচ্চা।পরে সেটা আর জবাই করা হয়নি।এখন জামাল ছুটছে নতুন গরুর খোঁজে!

শাহিনুর সিঁড়িতে গালে হাত রেখে বসে আছে।কুটি তার পাশে গিয়ে মিনতি স্বরে বলল,

—“বড় মা!মাথায় পানি ঢালমু?”

শাহিনুর চেঁচিয়ে বললো,

—“তোর মাথায় ঢাল যা!”

—“বড় মা!মন খারাপ করচেন ক্যা?এইডা তো শুভ!পীরসাবগো নেক নজর পড়ছে হিম দাদার জীবনে।সেজন্যি গরু পেরেগনেন্ট হইছে।গরুর সংসার হইবো।গরু মা হইবো!এইডা তো ভালা।”

শাহিনুরের মন খারাপ ভাব অনেকখানি কমে গেল।সত্যি তো!গরুটা মা হচ্ছে এটা তো সুখবর!তিনি উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

—“কুটি,এদিকে আয়!তোকে একটা চুমা দেই।”

—“লাগতো না বড় মা!বাজান ডাহে আপনেকে!”

কুটি চলে যেতেই জামাল বিশাল বড় এক ষাঁড় নিয়ে হাজির হলো।কসাইরা সোৎসাহে ছুরিতে ছুরি ঘঁষা দিল।

রোদ্দুর এখনো ঘুম থেকে উঠেনি।সারা রাত শক্ত চৌকিতে তার ঘুম হয়নি।ভোর রাতের দিকে একটু ঘুমিয়ে পড়েছিল।অহি সবার থেকে লুকিয়ে এক কাপ চা আর বাটিতে একটু নুডলস নিয়ে রোদ্দুরের রুমে ঢুকলো।

রোদ্দুর ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমিয়ে আছে।মুখটা তেলে চিকচিক করছে।আজ তাদের বিয়ে।আজকের সকালটা অহি অন্য ভাবে শুরু করতে চাইলো।সে মুখটা নিচু করে রোদ্দুরের কপালে চুমু খেল!

সরে আসতে নিতে রোদ্দুর চোখ বন্ধ রেখেই তার হাত চেপে ঘুমজড়ানো কন্ঠে বলল,

—“আমি তোকে অনেক অনেক অনেক বেশি ভালোবাসি রে অজান্তা!”

(চলবে)

পরিশিষ্ট পর্ব-২০

0

#গল্পের_নাম: পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_২০

দরজা খুলে অহিকে দেখেই রোদ্দুরের বুকে ব্যথা শুরু হলো।অহির হাসিতে সে নিশ্চিত খুন হয়ে যাবে।সে অপলক অহির দিকে চেয়ে রইলো।অহির পাশ থেকে অপূর্ব বলল,

—“ভাইয়া, দরজা থেকে সরে দাঁড়ান।নাকি ভেতরে ঢুকতে দিবেন না?”

রোদ্দুর থতমত খেয়ে সরে দাঁড়াল।সবাই ভেতরে ঢুকলো।রোদ্দুর অপূর্বর মাথায় হালকা করে চাটি মেরে শাহানাকে বলল,

—“খালামণি,মা রান্নাঘরে!বাকি সবাই ঘুমায়!”

শাহানা বলল,

—“রোদেলারা এখনো এসে পৌঁছায়নি?”

—“না!”

শাহিনুর আর কিছু বলল না।রোদ্দুর অহির দিকে চেয়ে কিছু একটা ইশারা করলো।অহি তাকে পাত্তা দিল না।

অহির কলেজ টিচার বাবা আশরাফ হোসেন রোদ্দুরকে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ করে বলল,

—“তোমার মা বলল যে তোমার পাগলামি সেরে গেছে।এখন সুস্থ হয়ে গেছো।কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে না!এতবড় মুরুব্বি মানুষকে দেখেও সালাম দিচ্ছো না!তোমার সাথে আমার বহুদিন পর সাক্ষাৎ হলো!”

রোদ্দুর হিমশিম খাচ্ছে।তার টিচারবেশী খালুর সবার থেকে শ্রদ্ধা আর সালাম পেয়ে অভ্যস্ত।একটু তো খেয়াল রাখা উচিত ছিল!সে ঝটপট বলল,

—“আসসালামু আলাইকুম বাবা!স-স্যরি!খালুজি!”

আশরাফ হোসেন গম্ভীর চোখে সোফায় গিয়ে বসলেন।হাত নেড়ে রোদ্দুরকে পাশে বসতে বললেন।হঠাৎ পাশে কুটিকে শুয়ে দেখে চমকে বলল,

—“হলি কাউ!এ এখানে ঘুমিয়ে কেন?”

তার মৃদু চিৎকারে কুটির ঘুম ভেঙে গেল।সে উঠে আশরাফের দিকে আগুনঝরা দৃষ্টিতে তাকাল।তার কত সাধের ঘুম!আশরাফের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিজের রুমে গেল।ফ্রেশ হতে হবে!

ততক্ষণে রোদ্দুর খালুর পাশে বসে গেছে।আড়চোখে রান্নাঘরের দিকে বার বার তাকাচ্ছে।কারণ অহি আর ছোটখালা রান্নাঘরে ঢুকেছে।

—“রোদ্দুর! ”

—“জ্বি খালুজি!”

—“শাহিনুর আপা বহুদিন আগে মাঝরাতে ফোন দিয়ে প্রচুর কান্নাকাটি!তোমার নাকি মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে।ঠিকমতো খেতে পারছো না,কোনো কাজে মনোযোগ দিতে পারছো না,হুটহাট গান ধরো,রাত জেগে চোখের নিচে কালি ফেলো,হুট করে কবিতা আওড়ায়,বিড়বিড় করে কার সাথে যেন কথা বলো ইত্যাদি!তোমার মায়ের ধারণা তোমায় মহিলা জ্বীনে ভর করেছে।সেজন্য তিনি পীরসাহেবের শরণাপন্ন হয়েছিলেন।কিন্তু আমার ধারণা তুমি নতুন করে কারো মায়ায় জড়িয়েছো!”

রোদ্দুর খুকখুক করে কাশলো।আশরাফ হোসেন চশমাটা খুলে বুকপকেট থেকে টিস্যু বের করে তার কাচ পরিষ্কার শুরু করলেন।তারপর গম্ভীর গলায় বললেন,

—“তোমার খালার প্রেমে যখন আমি পড়ি তখনও আমার সেইম অবস্থা হয়েছিল।খেতে পারি না,কিচ্ছু করতে পারি না,সারাক্ষণ মাথার মধ্যে শাহানা ঘুরে বেড়ায়,দৌঁড় ঝাপ করে!কি এক্টা অবস্থা।তুমি এর আগে ভুল মানুষের প্রেমে পড়ে নিজেকে কষ্ট দিয়েছো।সাথে আমাদের সবার বেইজ্জতি করেছো।এখন বলো,তুমি এবার কোন শয়তানের বাচ্চার প্রেমে পড়েছো?মেয়ের বাবা-মার ব্যাকগ্রাউন্ড পরীক্ষা করতে হবে!বাবা মা পাগল ছাগল কি না,বেদ্দপ কি না,রাজনীতির সাথে জড়িত কি না ইত্যাদি আরো অনেক কিছু!বুঝতে হবে আম গাছে আম ধরে,আঙ্গুর ধরে না!”

রোদ্দুরের প্রচুর হাসি পাচ্ছে।সে নিজেকে সামলে রান্নাঘরের দরজায় আরেক নজর দিল।অজান্তার ওড়নার ঝুলন্ত এক অংশ চোখে পড়ছে।তারপর শান্ত কন্ঠে বলল,

—“খালুজি,আপনি ঠিক ধরেছেন।নতুন করে ইয়ে মানে…বুঝতেই পেরেছেন।তবে মেয়ে অনেক ভালো।পৃথিবীতে একজনই আছে।কিন্তু সমস্যা হলো মেয়ের বাবাকে নিয়ে।”

—“হলি কাউ!মেয়ের বাবা চোর ডাকাত,গুন্ডা-বদমাশ রাইট?”

—“ইয়ে মানে!তেমন না!এমনিতে অনেক ভালো।কিন্ত মাথায় একটু গোলমাল আছে।দু একটা নিউরনে সমস্যা! তাছাড়া মন ভালো! ”

—“চিন্তার বিষয়!আচ্ছা যাও!সমস্যা নেই।মেয়ের বাবার সাথে কথা বলিয়ে দিয়ো আমায়।মেয়ে পাগল না হলেই হলো।তুমি তো আর মেয়ের বাবাকে বিয়ে করবে না।বিয়ে করবে মেয়েকে!মেয়ের বাবা পাগল হলেও সেটা ফেস করবে তোমার শ্বাশুড়ি!কি বলো?”

—“একদম খাঁটি কথা বলেছেন খালুজি!”

আশরাফ হোসেন চোখে চশমা দিয়ে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালেন।যাওয়ার আগে বললেন,

—“তোমার বাবাকে ঘুম থেকে টেনে উঠিয়ে নিচে পাঠাও তো।নয়টা বাজতে চলল!”

রোদ্দুর মাথা নেড়ে ধুপধাপ পা ফেলে উপরে গেল।কয়েক মিনিট আগে অহি রান্নাঘর থেকে বের হয়ে উপরে উঠেছে।সে প্রায় দৌঁড়ে রোদেলা আপুর রুমে ঢুকলো।কিন্তু আশাহত হলো সে।রোদেলা আপুর রুমে অপূর্ব শুয়ে শুয়ে ফোনে গেইম খেলছে।

রোদ্দুরকে দেখেই অপূর্ব বলল,

—“বুবু এ রুমে নেই!”

রোদ্দুর পাত্তা না দিয়ে বলল,

—“কি রে অপূর্ব!তুই নাকি ইদানীং তোর স্কুলের একটা মেয়েকে লাইন মারার চেষ্টা করছিস?”

—“ভাইয়া,সব মেয়ের তো আর অপূর্বর মতো ভাই নেই যে লুকিয়ে দরজা খুলে নিজের বোনকে দেখার ব্যবস্থা করে দিবে!উল্টো আমাকে গাছে ঝুলিয়ে রাখবে!”

রোদ্দুর মাথা চুলকাতে চুলকাতে বের হয়ে আসলো।অহি কোথায় গেল?সে দ্রুত ছাদেও একটা চক্কর দিয়ে আসলো।নাহ!নেই!পরমুহূর্তে ক্ষীপ্রপায়ে নিজের রুমে ঢুকলো।

অহি ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে হিজাবে পিন গাঁথছিল।অহিকে দেখে যেন তার মনের ভেতর শান্তির বন্যা বয়ে গেল।রোদ্দুর বিছানায় বসে আড়চোখে অহির দিকে তাকিয়ে বলল,

—“কি করছিস অজান্তা?”

অহি শান্ত গলায় বললো,

—“হিজাব খুলে নতুন করে বাঁধছি।”

রোদ্দুর বিরক্ত কন্ঠে বলল,

—“বাসায় কি রুম টুমের অভাব পড়েছে?তোর যত খোলাখুলির কাজ সব আমার রুমে করতে হবে?”

অহি হাসতে নিয়েও হাসলো না।গম্ভীর কন্ঠে বলল,

—“আপনি কেমন আছেন রোদ্দুর ভাই?”

অহির ছোট্ট একটা প্রশ্নে রোদ্দুরের হার্টবিট দ্বিগুণ বেড়ে গেল।সে শক্ত হাতে বেডশিট চেপে বলল,

—“রাতে ফোন করলাম,ধরিসনি কেন?”

অহির হিজাব বাঁধা শেষ।সে ঘুরে দাঁড়িয়ে রোদ্দুরের দিকে তাকালো।হাসিমুখে বলল,

—“আপনি সারাদিন আমার খোঁজ নেননি সেজন্য!আমি এতগুলো কল করলাম!টেক্সট করলাম বাট আপনি?একটারও উত্তর দিলেন না!তারপর আপনার হুট করে গভীর রাতে মনে পড়বে আর ফোন দিবেন!আমি রিসিভ কেন করবো?”

—“আমি দিনে ব্যস্ত ছিলাম।”

—“আমিও রাতে ঘুমাতে ব্যস্ত ছিলাম।”

অহির হাসিমুখের এই উত্তর যেন রোদ্দুরের বুকে আগুন ধরিয়ে দিল।এই আগুন সে অহিকে দিয়েই নেভাবে।জ্বলন্ত চোখে একবার দরজার দিকে তাকালো।দরজা ভেড়ানো!

সে সটান উঠে অহির দিকে এগিয়ে গেল।এক টানে অহির হিজাব এলোমেলো করে দিল।অহি বিস্ময় ভরা কন্ঠে বলল,

—“এত কষ্ট করে বাঁধলাম আপনি এলোমেলো করে দিলেন কেন?”

—“আমি যে এত কষ্টে নিজেকে গুছিয়ে রাখি,সেই আমিকে এলোমেলো করে দেয়ার সময় একবার মনে হয় না আমারো কষ্ট হয়?”

অহি মায়াভরা দৃষ্টিতে রোদ্দুরের চোখে চোখ রাখলো।আলতো করে ডান হাতটা রোদ্দুরের বুকে ছোঁয়াল।রোদ্দুর আর সইতে পারলো না।এক ঝটকায় অহিকে বুকে জড়িয়ে নিল।

রোদ্দুরের হাত ক্রমেই শক্ত হয়ে আসছে।অহির গলার কাছে একটা সুঁচ পিন বিঁধছে অনেকক্ষণ হলো।সে সরে আসতে চাইলো।কিন্তু রোদ্দুর ছাড়লো না।সুঁচ পিন গেঁথে যাচ্ছে গলায়।সে হাঁসফাঁস করে বলল,

—“রোদ্দুর ভাই ছাড়ুন!সুঁচ পিন আমার গলায় বিঁধে যাচ্ছে।”

—“বিঁধুক!আমারো বুকে বিঁধছে।”

—“আমি ব্যথা পাচ্ছি।”

—“আমিও পাচ্ছি!”

—“আমি সহ্য করতে পারছি না।”

অহি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে রোদ্দুর আরো চেপে ধরে বলল,

—“আমিও সইতে পারছি না।”

অহি আর পারলো না।রোদ্দুরের বুকে এক কামড় বসাতে সে ছেড়ে দিয়ে ছিটকে সরে গেল।তোতলানো স্বরে বলল,

—“অজান্তা,তুই কি পাগল?”

অহি সেদিকে কান না দিয়ে ডান হাতের আঙুল গলায় বুলালো।একটা আঙুল সামনে এনে দেখে এক ফোঁটা রক্ত!সে চমকে বলল,

—“রোদ্দুর ভাই, আপনি একটা পাগল!শুধু পাগল নয়!মহাপাগল!এই দেখুন সুঁচ বিঁধে আমার কাঁধের কাছে থেকে রক্ত বের হয়েছে।”

—“আমারো তো বুকে বের হয়েছে।পিন এখনো গেঁথে রয়েছে।”

সত্যি সত্যি রোদ্দুরের বুকের ডান পাশে একটা সুচ খাড়া হয়ে গেঁথে আছে।কিন্তু রোদ্দুরের মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই।অহি মৃদু চিৎকার করে বলল,

—“আপনি একটা পাগল!বদ্ম উন্মাদ।আপনাকে আমি মরে গেলেও বিয়ে করবো না।”

বলেই এক দৌঁড়ে বের হয়ে গেল অহি।রোদ্দুর বাঁধা দিল না।সে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পিনটা খুললো।রক্ত বের হয়নি।তবে একটু ব্যথা পেয়েছে।সে তো ভেবেছিল, এমনেই বুকে জ্বালাপোড়া করছিল।সত্যি সত্যি সুঁচ গেঁথে গেছে ধারণাতে ছিল না।

ড্রেসিং টেবিলের উপর অনেকগুলো সুঁচ পিন, সেফটিপিন এখনো ছড়ানো ছিটানো।অহি তুলে নিতে হয়তো ভুলে গেছে।

রোদ্দুর বিছানায় বসে দরজার দিকে তাকালো।দরজা সামান্য খোলা।অহি রাগ করেছে কি না সে বুঝতে পারছে না।যদি রাগ করে সত্যি সত্যি?তাহলে কিভাবে ভাঙাবে?হঠাৎ রোদ্দুরের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

দ্রুত বিছানা থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে ওয়াইফাই অন করলো।তারপর ইউটিউবে ঢুকে হিজাব টিউটোরিয়াল দেখা শুরু করলো।অহি তো সবসময় হিজাব পড়ে।তার রাগ ভাঙ্গানোর জন্য হিজাব পড়া শেখা যায়!

টেনে টেনে তিনটে ভিডিও দেখে রোদ্দুর রুমে ওড়নাজাতীয় কিছু খুঁজলো।প্র্যাক্টিকাল শিখতে হবে।কিন্তু রুমে কোনো ওড়না না পেয়ে সে লম্বা টাওয়ালটা হাতে নিল।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভিডিও টা অন করে ফোনটা চোখের সামনে রেখে নিজের মাথায় টাওয়াল পেঁচালো।

অনেক চেষ্টার পর, প্রায় চল্লিশ মিনিট পর রোদ্দুর মাথায় পাওয়ালটা হিজাবের মতো পেঁচাতে সক্ষম হলো।আয়নায় সামনে পিছে ঘুরে ঘুরে,বিভিন্ন ভঙ্গি করে নিজেকে দেখতে লাগলো।পরমুহূর্তে হাসিমুখে বলল,

—“বাহ!সুন্দর তো!ছেলেদেরও এভাবে হিজাব বেঁধে বাইরে বের হওয়া উচিত।অজান্তাকে হিজাব বেঁধে দিলে নিশ্চিত অনেক খুশি হবে!”

হঠাৎ কারো গগনবিদারী চিৎকারে ভ্রু কুঁচকে তাকায় রোদ্দুর।এক হাত দরজাতে রেখে বিস্ফারিত নয়নে,মুখ হা করে রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে আছে অপূর্ব!

অপূর্ব এসেছিল ব্রেকফাস্টের জন্য রোদ্দুরকে ডাকতে।রোদ্দুর ভাইয়াকে এভাবে সাদা ফুলেল ট্রাউজার,কালো ফতুয়ার সাথে মাথায় হিজাব পড়তে দেখে ভয় পেয়ে গেল।রোদ্দুর কয়েক পা এগিয়ে এসে অপূর্বকে বলল,

—“হেই ব্রোহ!দেখ তো হিজাব বাঁধা কেমন হয়েছে?”

অপূর্ব এক চিৎকার দিয়ে রুম থেকে বের হলো।নিচে নামতে নামতে বলল,

—“রোদ্দুর ভাই আবার পাগল হয়ে গেছে!তার মাথা এখনো ঠিক হয়নি।”

——————–

বাস আগে থেকেই ভাড়া করা ছিল।প্লান ছিল সকাল নয়টার বাসে সবাই রাজশাহী যাবে।কিন্তু সবাই এক জায়গা হতে হতে সাড়ে নয়টা বেজে গেল।দশটার দিকে তারা সবাই বাসে উঠলো।

বাস ছেড়ে দিয়েছে।জানালা দিয়ে ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে।এতক্ষণে শাহিনুর স্বস্তি পেল।সে বসেছে জানালা ঘেঁষে।তার বাম পাশে কুটি।কুটি শাহিনুরকে অভারটেকে করে মুখ বাড়িয়ে জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

শাহিনুর বিরক্ত হয়ে বলল,

—“এই কুটি!মুখের সামনে এসে নিঃশ্বাস ছাড়বি না।পৃথিবীতে কি জায়গা কম পড়েছে যে তোর বিষাক্ত গরম কার্বনডাই-অক্সাইড আমার মুখে ফেলতে হবে?”

কুটি শাহিনুরের দিকে চেয়ে বলল,

—“বড় মা এমন করেন ক্যা?একটা জিনিস শান্তিতে দেখতে দেন না।আপনে একটা অশান্তি!”

—“কুটি খবরদার!আমার রাগ উঠাবি না।তোকে কিন্তু জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিব।”

কুটি সোজা হয়ে বসে বলল,

—“আমারে ফ্যালতে গিয়া নিজেও পইড়েন না আবার!আপনার যা শরীল!”

—“কি!তুই আমাকে মোটা বললি?আমি তোর কাছে বসবো না।ড্রাইভার গাড়ি থামান।এক্ষুণি থামান!আমি সিট পাল্টাব!”

শাহিনুরের চিৎকারে বাসের সবাই নড়াচড়া শুরু করেছে।ছোট্ট একটা বাসভর্তি শুধু তারা নিজেরাই।অহির পরিবার,রোদেলার নতুন পরিবার, অহির ফুপুর পরিবার আর রোদ্দুর রা!সবমিলে বিশ জনের মতো!সবগুলো চোখ শাহিনুরের উপর।

ততক্ষণে ড্রাইভার গাড়ি সাইড করেছে।পান খাওয়া কুচকুচে ঠোঁটের মাঝবয়েসী এক ড্রাইভার ঘাড় ঘুড়িয়ে বলল,

—“কেউ কি পিচ্ছাব করবনি?তাড়াতাড়ি শ্যাষ করেন ভাইসাবগণ!”

ড্রাইভারের পাশে বসেছিল অপূর্ব।ড্রাইভার আরো কিছু বলতে নিতে সে কনুই দিয়ে গুঁতো দিয়ে থামিয়ে দিল।দুই মিনিটের মধ্যে সিট পরিবর্তন করা হলো!মাঝামাঝি জায়গা রোদেলা আর সাদিদ পাশাপাশি বসেছিল।শাহিনুর উঠে গিয়ে সাদিদকে উঠিয়ে দিয়ে বলল,

—“সবসময় বউয়ের আঁচল ধরে থাকতে হবে কেন?বাসেও পাশাপাশি বসতে হবে?যাও তোমার শ্বশুর মশাইয়ের পাশে গিয়ে বসো।উনি একা আছেন!”

রোদেলা মায়ের হাত চেপে অনুরোধের স্বরে বলল,

—“মা!একটু থামো!”

সাদিদ লজ্জা মিশ্রিত মুখে উঠে একদম পেছনের সিটে গিয়ে তার নিঃসঙ্গ শ্বশুর মশাইয়ের পাশে বসলো।শাহিনুর রোদেলার পাশে ধপ করে বসে পড়লো।হঠাৎ করেই তার চোখ বামপাশের তিন নাম্বার সারিতে গেল।রোদ্দুর আর অহি পাশাপাশি বসে আছে।শাহিনুর বাজখাঁই গলায় বললো,

—“এই রোদ্দুর! তুই এত মানুষের মধ্যে অহির কানে কানে কি কস?যা,উঠ!পিছনে তোর খালুর পাশে গিয়ে বস!”

রোদ্দুর অসহায় মুখ নিয়ে উঠে গিয়ে তার খালু আশরাফ হোসেনের পাশে বসলো।শাহিনুর ঠিকমতো বাসে বসে বলল,

—“ড্রাইভার সাব!গাড়ি ছাড়ুন!আর কোনো থামাথামি নাই!”

(চলবে)

পরিশিষ্ট পর্ব-১৯

0

#গল্পের_নাম: পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_১৯ (বোনাস পার্ট)

রোদেলা কলেজ থেকে ফিরলো ক্লান্ত শরীরে।ড্রয়িং রুমের টেবিল থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে খেয়ে সোফাতে বসে পড়লো।সে এখন আছে সাদিদের বাড়িতে!

তাদের বিয়ের আজ একুশ তম দিন।বাবার বাড়িতে সাত দিনের মতো থেকে গত সপ্তাহে ফিরেছে এখানে।আশপাশে চোখ ঘুরিয়ে সে ছিনজাকে খুঁজলো।কোথাও দেখতে পেল না।উঠে রান্নাঘরে এগিয়ে গিয়ে বুয়াকে বলল,

—“খালা,ছিনজা কোথায়?”

মধ্য বয়স্কা এক মহিলা কাজ করে এ বাড়িতে।তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল,

—“ছিনজা তো ঘুমায়।সেই এগারোটার সময় ফিরছে স্কুল থেকে! ”

—“আর বাবা কোথায়?”

—“বড় সাব তো বাইরে বের হইলো দেখলাম।”

রোদেলা আর ঘাঁটলো না।নিজের রুমে ঢুকে গেল।ছিনজা বিছানায় হাঁটু মুড়ে শুয়ে আছে।রোদেলার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।ছিনজার কপালে চুমু দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।কি সুন্দর নিষ্পাপ চেহারা!এত সুন্দর একটা মেয়েকে পাশে নিয়েই তো কয়েক জনম কাটিয়ে দেয়া যায়!

সাদিদ এখনো ফেরেনি কলেজ থেকে।তার কাজ আছে আরো!কলেজ যাওয়ার সময় তারা একত্রে যায়।কিন্তু ফেরার পথে আলাদা ফেরে।প্রায় দিনই সাদিদের কাজ পড়ে যায়।

রোদেলা ওয়াশরুমে ঢুকলো।শাওয়ার ছেড়ে তার নিচে দাঁড়াল।ঠান্ডা পানির স্পর্শ পেতেই তার ক্লান্তিভাব অনেকখানি উবে গেল।

সাদিদের সাথে তার সম্পর্কের তেমন উন্নতি হয়নি।এক বাসায় রয়েছে, কলেজ করছে নিয়মিত,টুকটাক প্রয়োজনীয় কথা হচ্ছে, ছিনজার সাথে হৈ হুল্লোড় হচ্ছে! ব্যস!এইটুকুই।

রোদেলা মাথায় টাওয়াল পেঁচিয়ে বের হলো।তার পরণে সবুজ রঙের সুতি শাড়ি।বিয়ের পর থেকে সে শাড়ি পরা শুরু করেছে।মাথার চুল ঝেরে এক পলক ছিনজার দিকে তাকালো।ছিনজা ঠোঁট উল্টে ঘুমাচ্ছে।এগিয়ে গিয়ে গায়ে চাদর টেনে সে নিচে নামলো কিছু খাওয়ার জন্য!

আধঘন্টা ধরে রোদেলা ছিনজার পাশে ঘুমানোর চেষ্টা করছে।কিন্তু দু চোখে ঘুম ধরা দিচ্ছে না।আরো কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে সে উঠে দাঁড়ালো।

সাদিদের রুমটা বেশ বড়।দক্ষিণের দেয়াল ঘেঁষে একপাশ করে দুটো বুকশেলফ।প্রচুর বই তাতে!রোদেলা এগিয়ে গিয়ে পুরো বুকশেলফ ঘাঁটাঘাঁটি করলো।কিছু একটা পড়ে দু চোখকে ক্লান্ত করতে হবে।দু চোখ ক্লান্ত হলেই ঘুম আসবে!

হঠাৎ অনেকগুলো বইয়ের আড়ালে মোটা ফ্রেমের পুরনো এক ফটো এলবাম নজরে এলো রোদেলার।আগ্রহ নিয়ে ময়লা ঝেরে হাতে নিল সে!যাক!কিছুটা সময় কাটানোর সঙ্গী পাওয়া গেল।

রোদেলা ফটো এলবামটা হাতে নিয়ে ছিনজার পাশে খাটে হেলান দিয়ে বসলো।তারপর এলবাম খুললো।

প্রথম বেশকিছু পাতায় সাদা কালো ছবি।সাদিদের নানা-দাদার কারো।কয়েক পাতা উল্টাতে সে সাদিদের মায়ের ছবিও দেখতে পেল।সাত-আট বছরের সাদিদকে পাশে নিয়ে উঠা ছবি।রোদেলা ছবিটাতে পরম মমতায় হাত বুলালো।এরপর সাদিদের প্রাপ্ত বয়সের বহু ছবি।যার বেশিরভাগ বিদেশে তোলা।কিছু ভার্সিটি লাইফের।ঢাকা ইউনিভার্সিটির কার্জল হল ব্যাকগ্রাউন্ডে দেখে চিনলো।

শেষের দিকে একটা ছবি উল্টো করে রাখা।সাদা পৃষ্ঠা দেখা যাচ্ছে শুধু।কৌতুহল নিয়ে ছবিটা টেনে বের করলো রোদেলা।চোখের সামনে মেলে ধরতেই তার পিলে চমকে উঠলো।কারণ ছবিখানা তার।তাও আবার কলেজ লাইফের।যখন তার সতেরো বছর বয়স ছিল!

কাঁপা কাঁপা হাতে ছবিটা উল্টে পাল্টে দেখা শুরু করলো রোদেলা।ছবিতে হোয়াইট কালারের কলেজ ড্রেস পরিহিত কিশোরী রোদেলা।

রোদেলার দু চোখ ফেটে অশ্রু ঝরা শুরু হলো।কত শত স্মৃতি তার এই সতেরো বছর বয়সটাকে ঘিরে।হঠাৎই তার মাথায় এলো এই ছবিটা সাদিদের কাছে কেন?এমন ছবি তো রোদেলার কাছে কখনো ছিল না।সত্যি বলতে সে নিজে থেকে ইচ্ছে কৃতভাবে কলেজের কোনো স্মৃতি রাখেনি।তাহলে সাদিদ তার ছবি পেল কোথায়?তাছাড়া ছবিটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে আড়ালে থেকে লুকিয়ে তোলা।ছবিতে রোদেলা কলেজ লাইব্রেরীতে বই খুঁজছিল।তখন আড়ালে থেকে তোলা।তার সম্পূর্ণ মুখটা আসেনি!

তবে কি সাদিদ রোদেলার থেকে সত্যি কিছু লুকিয়ে রেখেছে?এর উত্তর একমাত্র সাদিদ দিতে পারবে।রোদেলা ছটফটে মন নিয়ে সাদিদের জন্য অপেক্ষা শুরু করলো!

———————–

সন্ধ্যাবেলা সাদিদ ফিরলো।ঘর্মাক্ত ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় মেলে দিল।পায়ের জুতা পর্যন্ত খুললো না।রোদেলা ছিনজাকে ড্রয়িং রুমে পড়াচ্ছিল।সাদিদকে রুমে ঢুকতে দেখে সেও এলো।

সাদিদ অর্ধেক শরীর বাইরে আর অর্ধেক শরীর বিছানায় রেখে শুয়ে আছে।মুখটা কেমন চুপসানো।অনেক ধকল যাচ্ছে হয়তো।কিছুদিন পর স্টুডেন্টদের ফাইনাল এক্সাম!রোদেলার বড্ড মায়া হলো!

সে টাওয়ালটা হাতে ধরে বলল,

—“ফ্রেশ হয়ে আসুন।হালকা নাস্তা করে রেস্ট নিন!”

সাদিদ চোখ না খুলেই বলল,

—“রোদ,রোদ্দুর ফোন দিয়েছিল।আগামী শুক্রবার সবাই মিলে গ্রামে যাবে।তোমাদের নানুবাড়ি!রাজশাহীতে আর কি!আমাদেরও যেতে বলল সাথে।তোমায় কিছু বলেছে?”

—“না তো!হঠাৎ নানুবাড়ি যাবে কেন?কেউ তো বেঁচে নেই।অবশ্য নানুর ভিটেতে জামাল চাচা তার পরিবার নিয়ে থাকে।নানুর কোনো ছেলে নেই।আমার মা আর শাহানা খালামণি শুধু!”

—“তোমার মা নাকি কিসের মানত করেছে।রোদ্দুরের জন্য।গরু জবাই করে গ্রামের দুঃস্থ মানুষকে খাওয়াবে।কোন পীরসাহেব যেন বলেছে!”

রোদেলা ব্যাপারটা জানতো না।সে ভীষণ অবাক হয়ে বলল,

—“রোদ্দুরের আবার কি হয়েছিল?মানত করেছে কেন?”

সাদিদ বিছানায় উঠে বসলো।রোদেলার দিকে চেয়ে বলল,

—“জানি না।ফোন দিয়ে বিস্তারিত শুনে নাও।যাবে?চলো ঘুরে আসি!শুক্রবার তো হলিডে।সাথে শনিবার আর রবিবার দুজন লিভ নেই?”

রোদেলা ভেবে বলল,

—“ঠিক আছে।ছিনজা কখনো গ্রাম দেখেনি।অনেক খুশি হবে ও!”

—“তাহলে আমরাও যাচ্ছি।পাক্কা!এখন দেখো তোমার শ্বশুর মশাই সাথে যাওয়ার বায়না ধরে কি না!”

—“সমস্যা কি!বাবাও যাবে!”

সাদিদ উবু হয়ে পায়ের জুতা খুলল।তারপর মুচকি হেসে রোদেলার থেকে টাওয়ালটা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলো।ছিটকিনি লাগাতে নিতে রোদেলা হঠাৎ মনে পড়ায় চেঁচিয়ে বলল,

—“ছিটকিনি লাগাবেন না!কথা আছে!”

সাদিদ অবাক হয়ে বলল,

—“গোসল করে এসে শুনি!”

—“নাহ!এক্ষুনি শুনবেন!আপনি একটা বজ্জাত! ”

—“তারপরের টুকু বলো!”

—“আপনি বলেছিলেন যে আমার সতেরো বছর বয়সের সময় আপনি আমাকে অন্যান্য স্টুডেন্টদের মতোই সাধারণ ভাবে ট্রিট করতেন।আমার আর অন্য দের মধ্যে আলাদা কোনো অনুভূতি কাজ করতো না।তাহলে আমার কলেজের ছবি আপনার কাছে এলো কি করে?তাও আবার লাইব্রেরি থেকে লুকিয়ে তোলা?”

সাদিদের চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেল।সে বিস্ফারিত কন্ঠে বলল,

—“তুমি জানলে কি করে?তুমি কি আমার পুরো শেলভ তন্নতন্ন করে ঘেঁটেছো?”

—“আপনি বলুন,আমার ছবি আপনার কাছে ছিল কেন?”

সাদিদ কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল,

—“আরে ধুর!কি দেখতে কি দেখেছো।ওসব কিছু না!”

—“একদম কথা ঘোরানোর চেষ্টা করবেন না।”

সাদিদ অসহায়ের মতো চেয়ে বলল,

—“আসলে তুমি আমার প্রথম ভালোলাগা ছিলে।কলেজ প্রথম দিন ক্লাসে ঢোকার সময় তুমি বললে,’স্যার আসতে পারি?’ চিকন সুতীক্ষ্ম মিহি সুর আমার যুবক মনে গিয়ে আঘাত করলো।আমি ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখি ফুটন্ত গোলাপ দাঁড়িয়ে আছে।প্রথম দেখাতেই তোমায় আমার ভালো লেগে গেল।প্রচন্ড ভালো লেগে গেল।সেদিনের পর থেকে সবসময় আমার মাথায় তোমার ভয়ার্ত চেহারাটা ভেসে বেড়াতো!তোমার চাহনি আমাকে ঘায়েল করে দিতো।আমি বুঝতে পারতাম তুমিও আমায় নিয়ে স্বপ্ন দেখো!কিন্তু আমি জানতাম কিছুদিন পর আমাকে বিদেশে বিভুইয়ে পাড়ি জমাতে হবে।সেজন্য নিজে থেকে আর হাত বাড়াই না।তোমার সাথে অন্যান্য মেয়েদের মতোই বিহেভ করি!তাছাড়া ওটা তোমার অল্প বয়সের আবেগ মনে করেছিলাম।

কিন্তু তুমি তখনো আমার মাথায় জোঁকের মতো বসেছিলে।জীবনের প্রথম ভালোলাগা,প্রথম ভালো বাসা যে ছিল!সেদিন লাইব্রেরিতে তোমাকে দেখে লুকিয়ে ফোনে একটা ছবিও তুলে ফেলি।কেন তুলি জানি না!শুধু এটুকু জানতাম তোমার সাথে আমার মিল হবে না!

বিদেশে যাওয়ার আগে তোমার ছবি প্রিন্ট করি।তুমি প্রিয়জনদের ফটো এলবামের বিশেষ জায়গায় জায়গা করে নাও।কিন্তু বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ি।কিচ্ছু পারি না।সারাদিন ক্লাস,নতুন ভাষা শেখা,ইংলিশ শেখা,ল্যাব,থিসিস সব নিয়ে চরম ব্যস্ত হয়ে পড়ি।আস্তে আস্তে তোমার থেকে দূরত্ব সৃষ্টি হয়।মাঝে মাঝে মন খারাপ হলে বা যেদিন তুষারপাত হয় বা কখনো মাঝরাতে ফট করে এলবাম খুলে বসতাম।তোমাকে তখন অনেক কাছের মনে হতো!

এরপর চার বছর পর যখন বাড়িতে আসি তখন কয়েক ঘন্টার মধ্যে ছিত্তিমার সাথে বিয়ে হয়ে যায়।ছিত্তিমাকে আমি বিয়ের পর ভালোবাসি!তারপরের গল্প তো তোমার জানা!”

সাদিদ দ্রুত ওয়াশরুমের দরজা আটকে দিল।এপাশে রোদেলা ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো।সাদিদ তার থেকে সবসময় কেন সব লুকিয়ে রাখে?তার দু চোখ বেয়ে জল গড়ে।বুকের ভেতর ভালোলাগার অনুভূতি হয়।তাহলে সেও সাদিদের প্রথম ভালো লাগা ছিল?

চোখ মুছে সে চিল্লিয়ে বলে,

—“আপনি একটা বজ্জাত!সেদিন ছাদে কেন মিথ্যে বললেন?”

সাদিদ ওয়াশরুমের ফ্লোরে হাঁটু ভাজ করে বসে ছিল।সে দরজার দিকে চেয়ে বলল,

—“আমি সেদিন সত্যিটা বললে তুমি বিশ্বাস করতে না রোদ!তোমার মনে সন্দেহ হতো,আমি হয়তো নিজের জন্য মিথ্যে বলছি!আমার জীবন থেকে অনেক প্রিয় মানুষ হারিয়ে গেছে।নতুন করে আর কাউকে হারাতে চাই না!”

—“আপনি একটা ফাজিল, বেহায়া বজ্জাত লোক।আপনাকে আমি কখনো ক্ষমা করবো না।আপনি আজ পর্যন্ত কোনোদিন আমার সালামের উত্তর দিননি!যেন সালামের উত্তর দিলেই রোদেলাতে ফেঁসে যাবেন!”

—“আজ সালাম দাও!উত্তর দিবো!”

রোদেলার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।সে চোখ মুখ মুছে বলল,

—“আমি আর কোনোদিন আপনাকে সালাম দিবো না!”

——————–

আজ শুক্রবার!শাহিনুর সকাল থেকে চেঁচামেচি শুরু করেছে।কিন্তু কাউকে জাগাতে পারছে না!কেউ ঘুম থেকে উঠছে না কেন?রেডি হচ্ছে না কেন?সবাইকে তো নয়টার বাসে রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে!

শাহিনুর রান্নাঘরের সাথের লাগোয়া ঘরটার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রেগে চিৎকার করলো,

—“এই কুটি?ফজিলা?তোরা কি খাবি বল?আমি রান্না করি!তোরাই তো এ বাড়ির মানুষ।আমি তো কাজের লোক।বল কি খাবি!”

কুটি ঢুলুঢুলু চোখে বের হয়ে আসলো।শাহিনুরকে দেখেও না দেখার ভান করলো।সে শাহিনুরকে অভারটেক করে সোফায় শুয়ে পড়লো।শুয়ে একটা হাই তুলে বলল,

—“বড় মা!গরম গরম পরোটা আর গরুর কলিজা ভুনা করেন তো!”

শাহিনুরের রাগে ফেটে পড়বে অবস্থা!এ বাড়ির কেউ তাকে মান্য করে না।সে এতটা ভালোবাসা দিয়ে ফেলেছে?কেউ তাকে গোণতির মধ্যে রাখে না।সে অচিরেই এ ‘পাগলের কারখানা’ ছাড়বে!

সে কি!বাড়িটার নাম তো চেঞ্জ করা হয়নি!তার রোদ্দুর তো ভালো হয়ে গেছে।এখন সবসময় হাসিখুশি থাকে।বৃষ্টি নামক ঝঞ্ঝাটের কথাও স্মরণ করে না।এ সব কিছু পীরসাহেবের উছিলায় হয়েছে।শাহিনুর মনে মনে পীরসাহেবকে ধন্যবাদ দিল।

সোফার দিকে চেয়ে মাথা গরম হয়ে গেল। কুটি আবার ঘুমিয়ে পড়েছে।রান্না না করুক,ফ্রেশ হয়ে রেডি হবে তো!ওকেও তো যেতে হবে!শাহিনুর রাগান্বিত গলায় বললো,

—“আমি এখন পাতলা খিচুড়ি রান্না করবো।দেখি তোদের দেয় কে?একা রান্না করবো,একা খাবো!তারপর একা রাজশাহী যাব।তোরা সব কটা মরার মতো ঘুমা!”

তিনি রান্নাঘরে ঢুকে গেলেন।কুটি এক চোখ খুলে একবার রান্নাঘরের দিকে তাকালো।পরমুহূর্তে মুখ হাত দিয়ে চেপে হেসে ফেলল।মানুষটা এত ভালো কেন?

রোদ্দুর নিচে নেমে রান্নাঘরে উঁকি দিল।তার চোখে মুখে বিন্দু বিন্দু জলরাশি।এগিয়ে গিয়ে শাহিনুরের শাড়ির আঁচলে মুছে ফেলল।

রোদেলা,রোদ্দুর দুটোই দিনের মধ্যে অন্তত একবার তার শাড়ির আঁচলে মুখ মুছবে।শাহিনুর এতে প্রচুর খুশি হয়।কিন্তু ছেলেমেয়ের বুঝতে দেয় না।আজও বিরক্ত গলায় বলল,

—“বাড়িতে কি কাপড়চোপড়ের অভাব পড়েছে?পড়লে বল! ভিক্ষা করতে বের হই।”

রোদ্দুর, রোদেলাও মিথ্যের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সত্যটা বুঝতে পারে।সে জন্য বার বার একই কাজ করে।রোদ্দুর দু হাত ঘষে বলল,

—“মা,অজান্তার সাথে কথা হয়েছে?”

—“একি কান্ড!আমার তো ধারণাতেই ছিল না।এই,তুই বেশ কিছু দিন হলো খালি অহি অহি করিস কেন?হুট করে ও বাড়ি চলে যাওয়া,এটা ওটা করা!কি সাংঘাতিক!পীর সাহেবের কাছে যেতে হবে আবার!”

রোদ্দুর বিড়বিড় করে বলল,

—“তোমার পীরসাহেবকে বলো,আমি যেন খুব তাড়াতাড়ি অজান্তাকে বুকে জড়িয়ে ঘুমাতে পারি।মানে বিয়েটা যেন হয়।”

মুখে বলল,

—“তোমার রুচি এত খারাপ মা?ইয়াক থু!অজান্তার চেহারা তো ছাগলের মতো।ওকে আমি পছন্দ করবো!ছি!আমি রুচি এত খারাপ নয়!”

—“এক চড় খাবি!তোর চেহারা দেখেছিস?তিন রাস্তার মোড়ে ছেঁড়া জামা গায়ে ভিক্ষা করা ছেলেটার চেহারাও তোর চেয়ে সুন্দর! ”

রোদ্দুর কিছু বলার আগেই কলিং বেল বাজলো।শাহিনুর ইশারা করতে রোদ্দুর দ্রুত পায়ে হেঁটে গেল।সে জানে কে এসেছে!চারদিন পর আজ সরাসরি দেখবে!

দরজা খুলে অহিকে দেখেই রোদ্দুরের বুকে ব্যথা শুরু হলো।

(চলবে

পরিশিষ্ট পর্ব-১৮

0

#গল্পের_নাম: পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_১৮

রোদেলা এলোমেলো চুলে, ঘুম ঘুম চোখে অহির পেছন পেছন নিচে নামলো।ড্রয়িং রুমের সোফায় চোখ পড়তে চমকে উঠলো সে!সাদিদ এত রাতে কেন এসেছে?রোদেলা সামনে গিয়ে দাঁড়াতে সাদিদ এক নজর তার দিকে চেয়ে চোখ নামিয়ে নিল।সে উসখুস করছে।এখান থেকে ছুটে পালালে যেন বাঁচে।

কেউ কোনো কথা বলছে না।মনে হচ্ছে শোক দিবস উপলক্ষে নিরবতা পালন করছে!নিরবতা ভেঙে মুজিবুর রহমান প্রথম মুখ খুললেন!

—“বাবা সাদিদ!তুমি হঠাৎ এত রাতে? আই উইশ কোনো দূর্ঘটনা ঘটেনি!”

ফজিলা খালা সাদিদের হাঁটুতে চাপ দিয়ে বলল,

—“একদম ভয় ডর পাইবা না।চউখের পলকে কইয়া দেও!তুমি তো আর চুরি করতে আসো নাই বাপ।আর কেউ চুরি করতে আইসলে কলিং বেল চাইপা হগ্গল রে জাগায় না!”

ফজিলার মুখের কথা কুটি কেড়ে নিয়ে বলল,

—“খালা ডাকাইতরা তো সবাই রে জাগাইয়া গলায় রাম দা ধইরা ডাকাতি করে!”

শাহিনুর কুটিকে ধমক দিয়ে বলল,

—“তুই কথা না বলে ঠিক জায়গা আইস ব্যাগ চেপে রাখ।মাথায় ধরতে বলেছি।কপালে ধরোস কেন?”

কুটি নড়েচড়ে ঠিকমতো আইস ব্যাগ মাথায় ধরলো।সবাই চুপ হয়ে যেতে সাদিদ আমতা আমতা করে বলল,

—“আসলে ছিনজাকে আলাদা কোথাও এর আগে রাখা হয়নি।সবসময় আমার কাছেই থাকতো।আজ হঠাৎ এত দূরে সেজন্য ঘুম আসছিল না আমার।”

সবার যেন হুট করে মনে পড়লো সাদিদ চলে গেলেও ছিনজা রোদেলার কাছে রয়ে গেছে।সে বায়না ধরেছিল রোদেলা আন্টির সাথে থাকবে।কিছুতেই যাবে না।

সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো।অহি এগিয়ে এসে বলল,

—“সাদিদ ভাই, আপনি কি ছিনজাকে এখন দেখবেন?ও রোদেলা আপুর রুমে ঘুমায়।কোনো কান্নাকাটি করেনি।অনেক রাত পর্যন্ত আমরা গল্প করেছি।”

সাদিদ এক পলক রোদেলার দিকে চেয়ে বলল,

—“আসলে আমার এত রাতে আসার আরো একটা কারণ আছে।মিস রোদেলার রুমে আমি আমার চশমাটা রেখে গেছি।চশমা ছাড়া স্টাডি করতে সমস্যা হয়।কাল কলেজ যাওয়ার সময় লাগবে।”

শাহিনুর বিস্ফারিত নয়নে বলল,

—“তুমি আমার মেয়ের রুমে কি করছিলে?”

—“তেমন কিছু না আন্টি!”

—“তেমন কিছু করতে চেয়েছিলে?”

সাদিদ অবাক হয়ে শাহিনুরের দিকে তাকালো।থতমত খেয়ে বলল,

—“আন্টি বিকেলে একটু ফ্রেশ হওয়ার দরকার ছিল।তখন ওনার রুমের ওয়াশরুমে গিয়েছিলাম।হাত মুখ ধোয়ার সময় শার্টের পকেট থেকে চশমাটা বেসিনের উপর রেখেছিলাম।মিস রোদেলা আপনি কি পেয়েছেন?”

রোদেলাও অবাক হয়ে বলল,

—“হুঁ!আমি চশমা পেয়েছি এবং তুলে রেখেছি।আপনার কি বাসায় আর কোনো চশমা নেই?এটার জন্য রাত তিনটের সময় আসতে হবে?”

সাদিদ উসখুস করে এদিক ওদিক তাকাল।তার নিরবতাই রোদেলাকে ধাক্কা দিল।বুঝিয়ে দিল সে বোকার মতো প্রশ্ন করেছে।সাদিদ স্যারকে এভাবে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলতে পারে না সে!

সে দ্রুত রুমে গিয়ে একটুপরই চশমা নিয়ে নামলো।সাদিদের হাতে ধরিয়ে বলল,

—“এবার তাহলে সাবধানে যান।নাকি ছিনজাকে দেখে যাবেন?”

সাদিদ উঠে দাঁড়িয়ে তৎক্ষনাৎ বলল,

—“না না থাক!ছিনজা যেহেতু ঘুমাচ্ছে ঘুমাক।আমি বরং যাই।সকালে বাবা এসে নিয়ে যাবে।”

রোদ্দুর এতক্ষণ চুপ থাকলেও এবার বলল,

—“অনেক রাত এখন সাদিদ ভাই।এত রাতে ড্রাইভ করে যেতে হবে না।আপনি বাকি রাতটুকু এখানেই থেকে যান।অজান্তা,গেস্ট রুম গুছানো আছে কি না দেখে আয় তো!”

অহি চলে গেল।সাদিদ সোফায় বসে পড়ে বলল,

—“তার কিন্তু প্রয়োজন ছিল না।”

শাহিনুর বিড়বিড় করে বলল,

—“বজ্জাত ছেলে,বিছানায় শুয়ে পড়ে বলিস তার কোনো প্রয়োজন ছিল না।আমি বরং বাড়ি গিয়ে ঘুমাই!”

তার কথা অবশ্য কারো কানে পৌঁছাল না।কয়েক মিনিট পরেই জটলা ভেঙে গেল।ড্রয়িং রুমের সাথের রুমটাতে সাদিদের থাকার ব্যবস্থা করা হলো।

শাহিনুরের রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে রোদেলা বলল,

—“মা,আমাকে ডেকে পাঠালে কেন?ঘুমাতে হবে আমার!মাথা ধপ ধপ করছে।”

শাহিনুর বিছানায় আধ শোয়া হয়ে খাটে হেলান দিলেন।রোদেলার দিকে চেয়ে বললেন,

—“মাথা কি তোর একার ধপ ধপ করছে?আমাদের করছে না?বিছানায় এসে বোস।কথা আছে!”

শাহিনুর কি কথা বলবে তা রোদেলা কিছুটা আন্দাজ করছে।নিজেকে প্রস্তুত করে হেঁটে গিয়ে মায়ের পাশে বসলো।এক পলক ওয়াশরুমের দরজায় তাকিয়ে বলল,

—“মা, বাবা কোথায়?”

—“স্টাডি রুমে।একবার ঘুম ভেঙে গেলে তোর বাপের আর সহজে ঘুম আসে না।পড়তে পড়তে বাকি রাতটুকু ওখানেই কাটিয়ে দিবে।”

—“মা,কিছু একটা বলবে তুমি।তাড়াতাড়ি বলো!”

এটুকু বলে রোদেলা হাই তুলল।সে মায়ের কাছে নিজেকে খুবই ক্লান্ত প্রমাণ করতে চাইছে।কারণ সে চাচ্ছে, এরপর তার মা যেই টপিকটা নিয়ে কথা বলবে সেটা না বলুক!

শাহিনুর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রোদেলার দিকে চেয়ে বলল,

—“আমি তোর এই বিয়েতে রাজি নই রোদু!তুই কেন আমার কথা মানতে চাইছিস না?সাদিদের মতো অমন বদের হাড্ডি ছেলের সাথে আমি তোর কিছুতেই বিয়ে হতে দিবো না।”

রোদেলা অসহায় চোখে মায়ের দিকে তাকালো।আজ রাতে তার বিয়ে পাকাপোক্ত হয়ে গেছে সাদিদ স্যারের সাথে।চারদির পর বিয়ে।রোদ্দুর আর অহি কিভাবে সবাইকে বুঝিয়েছে রোদেলা জানে না।শুধু জানে সবাই রাজি,তার মা বাদে!সে নরম গলায় লজ্জার জলাঞ্জলি দিয়ে বললো,

—“মা,আমি ওই বদের হাড্ডি ছেলেটাকে ভীষণ ভালোবাসি।ওকে ছাড়া আমার লাইফে দ্বিতীয় কারো চিন্তাও করতে পারি না।”

—“রোদু,ওই ছেলেটা তো ঠিকই সংসার করেছে বউ বাচ্চা নিয়ে।কোনো একটা দূর্ঘটনা বশত বউটা মারা গেছে।আর তোর কাছে ফিরে এসেছে।যদি না আসতো?বউ যদি বেঁচে থাকতো তাহলে তাদের নিয়েই তো সংসার করতো।তুই তখন কি করতি রে?”

—“তুমি জানো আমি কি করতাম মা!সারাজীবন এভাবেই একা একা বেঁচে থাকতাম।ভেবে নিতাম সেটাই আমার নিয়তি।তিলে তিলে শেষ হয়ে যেতাম হয়তো!একটু বোঝার চেষ্টা করো মা!ওই মানুষটা যেমনই হোক,আমি ওকে ছাড়া আমার জীবন কল্পনা করতে পারি না।”

শাহিনুর শক্ত কন্ঠে বলল,

—“তুই যাই বলিস,অমন স্বার্থপর ছেলের সাথে আমি তোর বিয়ে দিবো না মানে দিবো না।”

রোদেলা মায়ের হাত ধরে বলল,

—“মা,বাচ্চাদের মতো কোরো না প্লিজ।এসব নিয়তির খেলা।সৃষ্টিকর্তা হয়তো আমার একাকী দুঃখের ভার সইতে না পেরে নতুন করে সাদিদকে পাঠিয়েছে।তুমি তাকে গ্রহণ করার সুযোগ দাও মা।আমাদের জন্য দোয়া করো।”

শাহিনুর রোদেলার হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দিয়ে রাগী গলায় বললো,

—“আমি রাজি না মানে রাজি না।এক বাচ্চার বাপের সাথে তোর বিয়ে দিবো না আমি।ওই ছেলে তোকে কোনোদিন ভালোবাসতে পারবে না।সাথে এতোবড়ো একটা বাচ্চা আছে!”

রোদেলা মাকে জড়িয়ে ধরলো।জড়িয়ে ধরে বলল,

—“এত সুন্দর ফুলের মতো একটা বাচ্চাকে তুমি হিংসে করছো মা?অথচ এমন একটা বাচ্চার মায়ায় জড়িয়েই তুমি কিন্তু বাবার সংসারে এসেছিলে।অন্য একটা মায়ের সন্তানকে পরম মমতায় বুকে আগলে বড় করলে।তুমিও তো তখন একবারের জন্যও ভাবোনি যে বাবা তোমাকে ভালোবাসবে কি না!একটা বাচ্চার টানে তুমি নিজের সব বিসর্জন দিয়ে বাবাকে বিয়ে করলে!”

শাহিনুর রোদেলাকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে দুহাত চেপে ধরে বলে,

—“এসব কি বলছিস তুই?”

শাহিনুর থরথর করে কাঁপছে।চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে।সে লাল চোখে আবার পানির বন্যা।রোদেলা মাকে আবার জড়িয়ে অশ্রু সজল নয়নে বলল,

—“আমি সব জানি মা।আমি তোমার গর্ভের সন্তান নই।বাবা বিদেশে থাকাকালীন সময়ে একটা মেয়ের সাথে তার প্রেমের সম্পর্ক হয়।তাদের বিয়ে হয়।তার কয়েক বছর পর আমার জন্মের সময় কিছু একটা অঘটন ঘটে।মা মারা যায়।আমার দেড় মাস বয়সের সময় আমাকে নিয়ে বাবা বাংলাদেশ চলে আসে।বাবা তখন ইউনিভার্সিটির প্রফেসর।কাকতালীয় ভাবে তুমি বাবার একমাত্র মাতৃহীন সন্তানের কথা জানতে পারো।তারপর নিজের জীবন, ক্যারিয়ার সব বিসর্জন দিয়ে বাবাকে বিয়ে করো।

আমাকে মায়ের স্নেহ দিয়ে লালন পালন করো।এর দু বছর পর তোমার গর্ভে রোদ্দুর আসে।তুমি কখনো আমাকে আলাদা নজরে দেখোনি।সবসময় নিজের সবটা দিয়ে আগলে রেখেছো আমাদের দু ভাই বোনকে।ঘুণাক্ষরেও টের পেতে দাওনি তোমার সাথে আমার রক্তের সম্পর্ক নেই!আমি সত্যিই অনেক ভাগ্যবতী মা।যে তোমার মতো একটা মানুষের সাক্ষাৎ পেয়েছি।তার ছায়াতলে বড় হয়েছি।তোমার সান্নিধ্যে আসতে পেরেছি।”

শাহিনুর কাঁদছে।রোদেলাকে জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

—“এসব তোকে কে বলেছে?এসব তো আমি আর তোর বাবা ছাড়া কেউ জানে না!সবাইকে বলেছিলাম তোর বাবার সাথে আমার পূর্বেই প্রেমের সম্পর্ক ছিল।লুকিয়ে বিয়ে করেছিলাম আমরা।এ সন্তান আমার গর্ভের!আসলে তখন আমার বাবা আর ছোটমা দুজনই বেঁচে ছিল।শাহানাকে নিয়ে গ্রামে থাকতো।আমি ঢাকাতে হলে থাকতাম।সেবার ছোটখাটো একটা ঘটনার জন্য দেড় বছর পর গ্রামে যাই।তোর বাবাকে আর তোকে নিয়ে যাই।প্রথমে সবাই অনেক আপত্তি করলেও পরে মেনে নেয়!দু একজন হয়তো সন্দেহ করেছে।কিন্তু কেউ জিগ্যেস করেনি!তুই কেমনে জানলি রে রোদু?আমি সারাজীবন তোর থেকে সত্যিটা লুকিয়ে রাখতে চেয়েছি।আমি তোকে কষ্টে দেখতে পারবো না!”

—“কিভাবে জেনেছি জানতে চেয়ো না মা।তুমি শুধু আমার বিয়েতে অমত করো না মা।আমি কষ্টে থাকবো না মা!”

—“প্রকৃতি কেনো একই ঘটনা দু বার ঘটাতে চাইছে!আমার সাথে যা ঘটেছে তা আমার মেয়ের সাথে কিভাবে ঘটতে দিবো?”

অনেক্ক্ষণ পর রোদেলা মাকে ছেড়ে শাহিনুরের চোখের জল মুছে দিয়ে বলল,

—“মা,তুমি একদম কান্না করবে না।তোমার কলিজার টুকরো ভালো থাকবে মা।একটা সময় সাদিদ আমাকে ভালোবেসেই গ্রহণ করবে।ও যতই স্বীকার না করুক!ওর চোখে আমি আমার জন্য ভালোবাসা দেখেছি আজ থেকে দশ বছর আগে মা!মা,সৃষ্টিকর্তা হয়তো আমার পরীক্ষা নিবে।তোমার ভালোবাসার একটু প্রতিদান দিতে!ছিনজাকে আমি সবটা দিয়ে আগলে রাখবো না।আমি সুখী হবো মা!সুখী হবো!”

শাহিনুর মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বলল,

—“দোয়া করি,তুই সুখী হ।সাদিদ তোকে নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসুক।ভালোবাসুক!”

——————-

চারদিন পর অনেকটা ঘরোয়া ভাবে বিয়ের আয়োজন করা হলো রোদেলার।বিয়েতে উপস্থিত রইলো শুধু অহিদের পরিবার।রোদেলার দাদা দাদী বেঁচে নেই।তার একমাত্র ছোট কাকু বিদেশে সেটলড!বউ বাচ্চা নিয়ে আমেরিকার নিউজার্সি শহরে থাকে।তার বিয়ে উপলক্ষে বিয়ের দিন সন্ধ্যায় বিশাল বড় এক গিফট বক্স পাঠালেন!সামনের বছর উইন্টার সিজনে দেশে ফেরার কথাও বললেন!

অনেক দূরের আত্মীয় বলতে এসেছে অহির ফুপি-ফুপা।তারা চিটাগং সিটিতে থাকে।শাহিনুরের সাথেও অনেক ভালো সম্পর্ক বলে এসেছে।

বিয়েতে সবচেয়ে খুশি দেখা যাচ্ছে ছিনজাকে।সে তার নতুন মাকে বিভিন্ন ভাবে টর্চার করছে।রোদেলার কোল থেকে নামছেই না।ছিনজাকে কোলে নিয়েই রোদেলা কবুল বলে দিল!

বিয়ে শেষ হতে গ্রুপ ফটো তোলার জন্য সবাইকে ডাকা হলো।ছবি তুলবে অহির ফুপির সাথে আসা তাদের গাড়ির ড্রাইভার।

অহি গাউনের ওড়নাটা ঠিকভাবে নিয়ে রোদ্দুরকে খুঁজলো।সে বিয়ে উপলক্ষে শাড়ি পড়েছিল।কিন্তু রোদ্দুর এক পলক দেখেই তাকে ধমকে শাড়ি খুলাল।শাড়ি পড়লে নাকি তাকে ছাগলের মতো দেখা যায়।পরে সে লাল রঙের গাউন পড়েছে।অহি ঠিক করে রেখেছে বিয়েতেও সে শাড়ি পড়বে না।রোদ্দুরের পছন্দ নয়!

সবাই দাঁড়িয়ে পড়েছে সারিবদ্ধ ভাবে।রোদ্দুর দাঁড়িয়েছে রোদেলার আপুর পাশে।অহি এক দৌঁড়ে গিয়ে রোদ্দুরের গা ঘেঁষে দাঁড়াল।রোদ্দুর চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

—“গা ঘেঁষে দাঁড়াবি না।সরে দাঁড়া!”

অহি মুচকি হেসে রোদ্দুরের আরো কাছে দাঁড়াল।ওড়না হাতে পেঁচিয়ে লুকিয়ে রোদ্দুরের আরো ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়াল।রোদ্দুর মোচড়ামুচড়ি করে বলল,

—“ঘেঁষাঘেঁষি করার ইচ্ছে থাকলে রুমে গিয়ে করবি অজান্তা।এত মানুষের সামনে কেন?সরে দাঁড়া!”

—“আচ্ছা, সরছি!”

বলেই অহি ডান হাতে রোদ্দুরের পেটে সুড়সুড়ি দিল।রোদ্দুর ছিটকে বলল,

—“স্টপ!”

ড্রাইভারবেশী ক্যামেরাম্যান ক্যামেরা থেকে চোখ সরিয়ে বলল,

—“ভাইসাব,মাছের মতো লাফান ক্যান?তিনডা ছবি নষ্ট করছেন?”

সবাই রোদ্দুরের দিকে কপট রাগী চোখে তাকাল।রোদ্দুর শাহিনুরকে টেনে এনে তার আর অহির মাঝে দাঁড় করিয়ে হাসার চেষ্টা করলো।

(চলবে)

পরিশিষ্ট পর্ব-১৭

0

#গল্পের_নাম: পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_১৭

সাদিদ ফ্লোরে বসে পড়েছে।সে কান্না করছে।বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে।ক্ষণে ক্ষণে তার শরীর কেঁপে উঠছে।তার কষ্টগুলো যেন অন্ধকার ছাপিয়ে চারপাশে বিরহের করুণ সুর ধরেছে।দূরে কোথাও একটা কুকুর অনবরত ডেকে যাচ্ছে।

রোদেলার হাত পা শক্ত হয়ে গেছে।অনেক কষ্টে সে রেলিং থেকে নিজের হাত ছাড়ায়।এগিয়ে এসে সাদিদের সামনে বসে পড়ে।সাদিদের মুখের দিকে ভেজা দৃষ্টিতে তাকায়!তার মানে এতদিন শুধু সে একা কষ্ট পায়নি।এ মানুষটা তার চেয়ে ভয়ংকর মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে দিন কাটিয়েছে।হোক না সে অন্য কারো জন্য কষ্ট পেয়েছে!রোদেলা সাদিদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেও দেয় না।মানুষটাকে সামলে উঠার সময় দেয়।

সাদিদ নিজেকে সামলে নেয়।বাম হাতে চোখ মুখ মুছে বলে,

—“ছিত্তিমার চলে যাওয়ার পর একদিকে বিধ্বস্ত মন,অন্য দিকে ছিনজার প্রাণ সংকট!দুটো মিলে যেন আমার করুণ দশা!দেড় মাস ছিনজাকে হসপিটালের স্পেশাল কেয়ারের জন্য রাখি।তারপর বাড়িতে এনে আমি আর বাবা মিলেই সব সামলাতে থাকি।নতুন করে মহিলা কাজের লোক নিযুক্ত করি!

তিন মাসের ছুটিতে দেশে ফিরেছিলাম আমি।ছুটি শেষ হতে বাবাকে আর ছিনজাকে নিয়ে কানাডা পাড়ি জমাই।দুজন মহিলা নিযুক্ত করি ছিনজার খেয়াল রাখার জন্য। তাছাড়া আমি তো আছিই!আমি ইউনিভার্সিটি গেলে বাবা সবসময় ছিনজার পাশেই থাকতো।আমি তখন ইউনিভার্সিটিতে রিসার্চার হিসেবে যোগ দিছি।দিনের বেশিরভাগ সময় ল্যাবে কাজ করি।তারপর বাসায় ফিরেই ছিনজার পাশে থাকি।এভাবে বাকি দিনগুলো কাটছিলো।

কিছুদিন আগে বাবা বায়না ধরে,দেশে ফিরবে।একেবারের জন্য।বাবা ছিনজাকে সারাদিন বাংলা শিখাতো।সে স্পষ্ট বাংলায় আমাকে হুমকি দেয়,তার দেশে যাবে।আমারও তখন ইউনিভার্সিটিতে কাজের প্রেশার বেড়ে যাচ্ছে।ঠিক মতো ছিনজাকে সময় দিতে পারি না।সেজন্য সব ছেড়ে ছুঁড়ে দেশে চলে আসলাম।ঢাকায় একটা ফ্ল্যাট কিনে সেখানেই থাকি এখন।প্রায় আট মাসের মতো হলো দেশে ফিরেছি।প্রথম যখন ছিনজাকে নিয়ে বাংলাদেশ আসলাম,তখন ওর গায়ের রং কাগজের মতো সাদা ছিল।এ কয়েক মাসে দেশী আবহাওয়ায় একটু চেঞ্জ হয়েছে!”

চারপাশে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে।অন্ধকারের নিজস্ব আলোতে চারপাশ স্পষ্ট।সাদিদ পকেট থেকে টিস্যু জাতীয় কিছু বের করে নাক মুছলো।পুনরায় আবার বলল,

—“তোমাদের কলেজে যখন আমার জয়েন করার কথা হয় তখন ভাইস প্রিন্সিপালের থেকে সব ডিটেইলস শুনি।উনি আমায় কলেজের গত বছরের একটা ম্যাগাজিন হাতে ধরিয়ে সব উল্টে পাল্টে বুঝিয়ে দেয়।এক পর্যায়ে নাড়াচাড়া করতে করতে হঠাৎ তোমার ছবিতে চোখ আটকে যায়।

আমি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকি।তোমাকে বড্ড চেনা চেনা লাগছে।কোথায় দেখেছি যেন!কিন্তু মনে করতে পারি না।মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়।পরের সময়টুকুতে স্যারের কথায় আর মনোযোগ দিতে পারি না।সেদিন রিশেপশনের সময় তোমায় এক নজর দেখেই চিনতে পারি তোমার কলেজে আমি গেস্ট টিচার ছিলাম।তবে তোমার হঠাৎ করে সেন্সলেস হওয়া আমাকে প্রচন্ড ভাবায়।

অনেক কৌতূহল জন্মে।সেজন্য তোমারে ব্যাপারে সব ইনফরমেশন যোগাড় করে ফেলি এবং জানতে পারি যে কোন একটা অজ্ঞাত কারণে তুমি আজও বিয়ে করোনি।আমার তখন বুঝতে বেগ পেতে হয় না।কারণ আমি তোমার সতেরো বছর বয়সের আমায় নিয়ে তোমার স্বপ্ন দেখার বিষয়টি বুঝতে পারতাম।বুঝতে পেরেই কিন্তু তোমায় আর দশটা মেয়ের মতোই ট্রিট করতাম।কোনো আলাদা ফ্যাসিলিটিজ দিতাম না যাতে তুমি ভুল ধারণা পোষণ করো।তাছাড়া আমি ভেবেছিলাম এটা বয়সের দোষ।একটু বড় হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

কিন্তু সেই কিশোরী বয়সের আবেগ টাকে যে এত প্রাধান্য দিবে স্বপ্নেও ধারণা করি।যদি কোনো ভাবে আমাকে তোমার সত্যিকার অনুভূতির কথা জানাতে হয়তো আমাদের গল্পটা অন্য রকম হলেও হতো!

তোমাকে সেদিন আমার কেবিনে ডেকে কিছু বলার সুযোগ করে দিলাম।কিন্তু তুমি আমাকে না চেনার ভান করলে।এরপর অহির সাথে আমার একটা এপয়েন্টমেন্ট হয়।অহি নিজে থেকে আমার সাথে যোগাযোগ করে।হয়তো কোনোভাবে তোমার ব্যাপারটা ধরতে পেরেছিল।”

রোদেলা বিস্ময় নিয়ে বলে,

—“তার মানে সেদিন হাতিরঝিল আপনার সাথে হওয়া কাকতালীয় কিছু নয়।সব প্রি প্লান ছিল?”

—“অনেকটা তেমনই!অহির থেকে যতটা জানতে পারি তাতে বুঝতে পারি যে তোমার পক্ষে এ জীবনে আর কারো মায়ায় জড়ানো সম্ভব না।এতগুলো বছর একটা মানুষকে না দেখে,না ছুঁয়ে, কথা না বলে শুধু অনুভব করে এতটা ভালোবেসে গেছো!নিজের সবটা উজাড় করে তাকে নিয়ে কল্পনার শহর সাজিয়েছো।তাকে পাবে কি পাবে না এমন হাজারো অনিশ্চয়তা জেনেও তার প্রতি তোমার অনুভূতির বিন্দুমাত্র নড়চড় হয়নি,ভবিষ্যতেও হবে না।তুমি এত পাগল কেন?কেন?

জানো রোদেলা,সেদিন অহির থেকে সব শুনে তীব্র আত্মগ্লানিতে ডুবে যাই। দিন-রাত ঘুমাতে পারি না।কোনো কাজ করতে পারি না।শুধু বুকের ভেতর ক্ষততে জ্বালা পোড়া করে।এই শহরেই কেউ একজন প্রতিটা সেকেন্ড আমার কথা ভাবে,আমায় নিয়ে স্বপ্ন সাজায়,আমার নামে শ্বাস নেয়,নিঃশ্বাস ফেলে যা আমায় প্রচন্ড পীড়া দেয়!নিজেকে ক্ষুদ্র, অস্তিত্ব হীন মনে হয়।

কিন্তু আমি তো এতদিন দিব্যি ভালো ছিলাম।ছিত্তিমার শোক কাটিয়ে উঠেছিলাম অনেক আগেই!তার সাথে কাটানো অতি অল্প সময়ের স্মৃতিও সময়ের নিষ্ঠুরতার কাছে হার মেনে ফিকে হয়ে গেছে।আমি তো ছিনজাকে নিয়ে, বাবাকে নিয়ে হাসি তামাশায় দিন কাটিয়ে দিচ্ছিলাম।এইতো বেশ ছিলাম।এই জীবনে আর কারো হাত ধরার ইচ্ছেও মরে গেছিল।

কিন্তু এই তুমি আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিলে।নতুন করে তীব্র মানসিক যন্ত্রণার কারণ হলে।সবসময় তোমার কষ্টে মনে অপরাধ বোধের সৃষ্টি হয়।ঘুমাতে পারি না,কাজ করতে পারি না,খেতে পারি না!কি একটা বাজে অবস্থা।

নিজের অপরাধ বোধ থেকে মুক্তির জন্যই ছিত্তিমার শেষ আবদার পূরণের কথা ভাবলাম।ছিত্তিমা মৃত্যুর আগে আমার হাত আকড়ে বলেছিল, ‘এই পৃথিবীর কেউ একজন আপনাকে আমার থেকে বেশি ভালোবাসে।যদি কখনো তার সামনা-সামনি হোন,তাকে গ্রহণ করে নিয়েন।আপনি তার হাতটা না ধরলেও আপনার হাতটা তাকে ধরতে দিয়েন।’

এখন বুঝতে পারছি ছিত্তিমা তোমার কথা বলেছে।মৃত্যুর আগে মানুষ দিব্যশক্তি লাভ করে না জানি না।হয়তো ভবিষ্যৎ দেখতে পারে।তবে এটুকু জানি যে ছিত্তিমা তোমার কথা বলেছে।”

রোদেলা নিশ্চুপ হয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে আছে।তার প্রতিত্তর দেয়ার শক্তিটুকু নেই যেন!সাদিদ তার মুখপানে চেয়ে বলে,

—“তুমি যদি অন্য কাউকে সুখী হতে তাহলে আমার আফসোস থাকতো না।কিন্তু আমি জানি তুমি আমাকে না পেলে চিরকুমারী থেকে যাবে।আর কোনো পুরুষের গলায় বরমাল্য দিবে না।যেটা আমার জন্য আরো যন্ত্রণা দায়ক!রোদেলা,আমি ছিনজাকে আকড়ে ধরে বাকি জীবনটা পাড়ি দিতে পারবো।কিন্তু তুমি অবিবাহিত একটা মেয়ে, একাকী জীবন যুদ্ধে হাঁপিয়ে উঠবে।একা একা জীবন নামক দূর্গম জার্নিটা সমাপ্ত করতে পারবে না।প্রতি পদে পদে বিপদ আর লাঞ্ছিত হবে।একট্ সময় তুমি চরম নিঃসঙ্গতায় নিমজ্জিত হবে।

জীবন নাম ট্র্যাকটা পাড়ি দিতে তোমার পাশে কাউকে প্রয়োজন যে তোমার দুঃখ বুক পেতে নিবে,নিজের জীবন বাজি রেখে তোমায় সব বিপদ থেকে প্রটেক্ট করবে,তোমায় ভরসা দিয়ে আগলে রাখবে।

রোদেলা,আমি আমার জন্য নয়!তোমার জন্য তোমার পাশে থাকতে চাই।ছিনজার জন্য নয়, তোমার জন্য তোমার পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়াতে চাই!আমার হাত ধরার অধিকার তোমায় দিলাম।তুমি কি আমার হাত ধরবে?”

রোদেলা কান্না করছে।সে উঠে গিয়ে রেলিং চেপে দাঁড়াল।দৃষ্টি প্রসন্ন করে সামনের অন্ধকারে যেন কিছু একটা হাতড়ে বেড়াচ্ছে।সাদিদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কবিতার লাইন বলা শুরু করলো,

“তুমি যাবতীয় দুঃখকে ছুঁড়ে দাও
আমি বুক পেতে নেবো
বুক ভাঙবেনা ।
দুয়ার বন্ধ করলেই
আমি ফিরে যাবো নির্বিকার ,
অস্বীকার করো মেনে নেবো ।

এলবামে স্মৃতি নেই বলে
আদৌ দুঃখ করিনা ,
সোনালি নিসঙ্গতায় আমার
বিচিত্র দুঃখের সমাবেশ সঞ্চয় – ।
ব্যথা দাও , বুকে রাখবো
ব্যথায় ভাঙবেনা বুক
বুকে ব্যথা আছে ।

-রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্”

রোদেলা কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না।সে নিঃশব্দে কান্না করছে যা সাদিদের বুঝতে অসুবিধা হলো না।সে উঠে গিয়ে রোদেলার থেকে খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াল।গম্ভীর গলায় বললো,

—“রোদেলা,আমার গল্পের পরিশিষ্টে হয়তো তুমি আছো বলেই ছিত্তিমা পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেল।আমি তোমাকে নিয়ে নতুন করে গল্প সাজাতে চাই।তুমি কি তোমার গল্পের পরিশিষ্ট আমায় নিয়ে রচনা করবে?তোমার গল্পের পরিশিষ্টে আমায় স্থান দিবে?”

রোদেলা শব্দ করে কেঁদে উঠলো।দু হাতে শক্ত করে রেলিং চেপে ধরলো।এতক্ষণে সাদিদের মুখে হাসি ফুটে উঠলো।রোদেলার মতো একটা স্ট্রং একটা মেয়ে কত ছেলেমানুষি কাজ করে!সে শার্টটা টেনে টুনে ঠিক করলো।কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে রোদেলার কাছাকাছি দাঁড়ালো।

মনে মনে গুনগুন করে বলল,

“মন গড়া অভিযোগ…
জানি ভুলে যাবি তুই……
কাছে এসে আলতো করে…
যদি তোর হাতটা ছুঁই!!”

সাদিদ ডান হাত বাড়িয়ে চট করে রোদেলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল।তারপর নরম গলায় বললো,

—“এত অভিমান আমার উপর রোদ?আমি তো জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে যাব!”

রোদেলা আর পারলো না।নিজের সব অভিমানের গোড়ায় জল ঢেলে ডান হাতে সাদিদের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলো।যত ঝড়,ঝঞ্ঝা আসুক কখনো এই হাত ছাড়বে না।এই হাতটা যে তার একমাত্র নিরাপদ আশ্রয়স্থল।তার অনেক সাধনার ফল!

———————

মাঝরাতে দরজার উপর ধুমধাম কড়াঘাতে ঘুম ভেঙে গেল রোদ্দুরের।কপাল কুঁচকে এপাশ ওপাশ হয়ে চারপাশে হাতড়ে ফোন খুঁজলো।বালিশের চিপায় পেয়ে গেল।

রাত ৩ টা বেজে ২১ মিনিট।এত রাতে আবার কে দরজা ধাক্কায়?যার ইচ্ছে সে ধাক্কাতে থাকুক।ক্লান্ত হয়ে থেমে যাবে।রোদ্দুর উল্টো ঘুরে আবার চোখ বন্ধ করলো।সঙ্গে সঙ্গে তার কানে অহির গলা ভেসে আসলো।মৃদুস্বরে বার বার বলছে,

—“রোদ্দুর ভাই!রোদ্দুর ভাই!দরজা খুলুন।”

স্প্রিংয়ের মতো তড়িৎ গতিতে উঠে বসলো রোদ্দুর।অজান্তা এত রাতে কেন তাকে ডাকছে?সে এক দৌঁড়ে দরজা খুলে দেখে অহি দাঁড়িয়ে আছে।ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই অহি তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,

—“বাব্বাহ আপনার ঘুম!সেই কখন থেকে ডাকছি।”

—“তুই দেখলি না কত রাতে ঘুমিয়েছি?ছাগলের মতো তাও ডাকছিস কেন?কি এমন দরকারী কথা যা রাত তিনটেয় ঘুম ভাঙিয়ে বলতে হবে?সকালে বললে হতো না?”

—” না হতো না!”

—” অজান্তা,কি বলবি উগ্লে ফেল তাড়াতাড়ি!বাসার কেউ দেখলে আজ রাতেই বিয়ে পড়িয়ে দিবে।”

—“খালামণিই তো আপনাকে ডাকতে পাঠালো।”

—“সে কি!কেন?”

—“আমাদের দুজনকে আজ রাতেই বিয়ে দিয়ে দিবে !”

রোদ্দুর বিরক্ত গলায় বললো,

—“অজান্তা,এত রাতে ঘুম থেকে টেনে উঠিয়ে এসব কোন ধরনের পাগলামি করছিস?থাপ্পড় চিনোস?যা রুমে যা!”

রোদ্দুর দরজা বন্ধ করতে নিতে অহি বাঁধা দিল।হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলল,

—“ড্রয়িং রুমে আপনাকে ডাকছে মশাই!সবাই ড্রয়িং রুমে।খালামণির মাথায় আইস ব্যাগ চেপে আছে কুটি!তার মাথা গরম হয়ে গেছে।”

—“সে কি!মায়ের আবার কি হলো?”

—“কারণ সাদিদ ভাই এত রাতে নিজের বাসা থেকে গাড়ি ড্রাইভ করে এখানে এসেছে।ড্রয়িং রুমে বসে আছে এখন।সেটা দেখেই খালামণির মাথা গরম হয়ে গেছে। ”

—“রাত আটটার সময় না গেল! আজ মাত্র দুজনের বিয়ে ঠিক হলো,আর আজ রাতেই এসে হাজির?চল, নিচে যাই তো!”

রোদ্দুর অহিকে সাথে করে নিচে নামে।নিচে মোটামুটি একটা জটলা।সাদিদ সোফার মাঝে বসে আছে।তার একপাশে মুজিবুর রহমান।আরেক পাশে ফজিলা খালা।শাহিনুর বসে আছে সাদিদের মুখোমুখি।তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সাদিদের দিকে চেয়ে আছে।তার মাথায় আইস ব্যাগ ধরে কুটি বিস্ফারিত নয়নে সব অবলোকন করছে।

রোদ্দুর চারপাশে তাকিয়ে রোদেলাকে কোথাও দেখতে পেল না।সে বলল,

—“রোদ আপু কই?কুটি গিয়ে আপুকে ডেকে আন তো!কুটি থাক!অজান্তা যা!”

(চলবে)