Wednesday, July 16, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1572



পরিশিষ্ট পর্ব-১৬

0

#গল্পের_নাম: পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_১৬ (বোনাস পার্ট)

সিঁড়ির শেষ ধাপ পার হতেই সাদিদ স্যারের চোখে চোখ পড়লো রোদেলার!মুহুর্তে বুকের ধড়ফড়ানি আরো বেড়ে গেল।সে এগিয়ে যেতেই ছিনজা দৌঁড়ে এসে তার কোলে উঠলো।

রোদেলা আড়ষ্ট ভঙ্গিতে একটু হাসার চেষ্টা করলো।ছিনজার কপালে চুমু দিয়ে সামনে দাঁড়িয়ে সালাম দিল দুজনকে।বরাবরের মতো সাদিদ স্যার এবারও তার সালামের উত্তর দিল না।ছিনজার দাদু রোদেলাকে দেখেই হাসিমুখে বলল,

—“ওয়ালাইকুম সালাম মা!কেমন আছো মা গো?”

—“আমি ভালো আঙ্কেল!আপনি কেমন আছেন?”

—“আমিও অনেক ভালো।পাশে এসে বসো তো!”

রোদেলা মৃদু হেসে ছিনজাকে কোলে নিয়ে পাশে গিয়ে বসলো।সাদিদ স্যার হুট করে পরিবার সাথে নিয়ে কেন তার বাসায় এসেছে তার সমীকরণ মেলাতে পারছে না রোদেলা!

সবাই চুপচাপ নিরবতা পালন করে যাচ্ছে যেন!হঠাৎ রান্নাঘর থেকে শাহিনুর এসে সামনের সোফায় বসলো।ছিনজার দাদুকে প্রশ্ন করলো,

—“দাদা,আমি রোদেলার মা!”

—“আমি দেখেই চিনতে পেরেছি।রোদেলার সাথে আপনার চেহারার অনেক মিল আছে!”

রোদেলার মায়ের মুখ চুপসে গেল।পরক্ষণে তিনি হাসার চেষ্টা করে বললেন,

—“জ্বি দাদা!”

—“আমি এনামুল হক!আর কাউকে দেখছি না।আপনার ছেলে, তারপর রোদেলার বাবা!এরা কোথায়?”

—“রোদেলার বাবা আজ অফিস থেকে ফিরেই হাঁটতে বের হয়েছে।আর ছেলেটা আমার ছোট বোনের বাড়ি গেছে।অফিস থেকে বাড়ি আসেনি।কি একটা দরকারে যেন ও বাড়ি গেছে।এসে পড়বে সবাই!”

কুটি রান্নাঘর থেকে বের হয়েছে।রোদেলার কোলে মিষ্টি বাচ্চা দেখেই তার লোভ জাগলো।একটু কোলে নেয়ার লোভ!

রোদেলা ছিনজাকে নিয়ে উঠে পড়লো।ফ্রিজ থেকে আইসক্রিম বের করে ছিনজার হাতে দিয়ে বলল,

—“আজ আন্টি এতো চুপচাপ কেন?”

ছিনজা মুখ ফুলিয়ে বলল,

—“আন্টি পঁচা।আমি আন্টির সাথে কথা বলবো না।”

—“কেন মা?আন্টি কি করেছে?”

—“আন্টি সেদিন আসার সময় বলেছিল যে রোজ আমার সাথে দেখা করবে।আমাদের বাসায় যাবে।কিন্তু সে যায় নি।সে পঁচা।কারণ পাপা বলেছে যে কথা দিয়ে কথা রাখে না সে পঁচা!”

রোদেলা হেসে ফেলল।এতটুকু একটা মেয়ে।কিন্তু কি সুন্দর পাকনা পাকনা কথা বলে।এটা অবশ্য সত্যি যে সে সেদিন ছিনজাকে অনেক বুঝিয়ে তবে ছাড়া পেয়েছিল।আজ দুই সপ্তাহের মতো হলো সে ছিনজার সাথে আর দেখা করেনি।মেয়েটার রাগ করারই কথা!মেয়েটা কেন জানি তার বাধক হয়ে গেছে।

রোদেলা ছিনজার গাল টেনে বলল,

—“পাপা বলেনি,যারা রাগ করে তারাও পঁচা!কিন্তু তুমি তো লক্ষী মেয়ে।”

—“তাহলে আমি আর রাগ করবো না।”

—“আন্টি কিভাবে বুঝবে যে তুমি আর রাগ করবে না?”

ছিনজা রোদেলাকে জড়িয়ে তার গালে একটা চুমু দিয়ে দিল।তারপর হেসে বলল,

—“আমি আর রাগ করে নেই!তুমি আমায় নামিয়ে দাও।আমি আইসক্রিম খাব।”

রোদেলা নামিয়ে দিতেই কুটি তাকে লুফে নিল।কোলে নিয়ে বলল,

—“বাবু,কাঁদে না।ওলে লে!চলো,আমরা সোফায় বইসা তোমারে গল্প শোনাই!”

কুটি ছিনজাকে কোলে নিয়ে ডাইনিং এর চেয়ার টেনে বসলো।রোদেলা সেদিকে পা রাখতে সাদিদ পেছন থেকে গলার স্বর খাদে নামিয়ে ডাক দিল।

—“মিস রোদেলা!”

—“জ্বি,বলুন!”

—“আমার একটু ইমার্জেন্সি!যেতেই হবে!”

রোদেলা অবাক হয়ে বলল,

—“কোথায় যাবেন স্যার?কোনো মিটিং পড়েছে?অবশ্যই যান!আমাকে বলতে হবে কেন?”

সাদিদ ইতস্তত করে চারপাশে এক নজর তাকিয়ে বলল,

—“একটু ওয়াশরুমে যাব মিস রোদেলা।আপনার বুদ্ধি তো দেখি ছিনজার থেকেও কম!”

রোদেলা ভীষণ লজ্জা পেল।তারপর বলল,

—“উপরে আসুন!”

সাদিদ যেন এটার অপেক্ষাই করছিল।সে রোদেলার পেছন পেছন দ্রুত পায়ে হেঁটে গেল।রোদেলার রোদ্দুরের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে বলল,

—“এটাতে যান।নিচেও আছে।কিন্তু পরিষ্কার আছে কি না জানা নেই!”

—“এটা কি আপনার রুম?”

—“জ্বি না।এটা আমার ছোট ভাইয়ের।”

সাদিদ ঢুকতে নিয়ে থেমে গেল।দু একবার খুকখুক করে কেশে বলল,

—“মিস রোদেলা!আপনি কি আমায় আপনার রুমটাতে নিয়ে যাবেন?ইট’স ইমার্জেন্সি!”

—“কিন্তু আমার রুম বোধ হয় একদম অগোছালো।আ…..”

—“আমি কোনো দিকে তাকাব না।সোজা আপনার ওয়াশরুমে ঢুকে যাব!”

রোদেলা আর বাঁধা দিল না।সাদিদকে নিজের রুম দেখিয়ে চলে আসতে নিতে সাদিদ বলল,

—“মিস রোদেলা জান্নাত!নিচে যাবেন না।একটু ছাদে গিয়ে অপেক্ষা করুন প্লিজ!আমি আসছি।কিছু কথা আছে!”

রোদেলা মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। একূল ওকূল ভাবতে ভাবতে ছাদে উঠে গেল।

উত্তর দিকের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়াল রোদেলা।সন্ধ্যা হবে হবে!সূর্য ডুবে গেছে পশ্চিম কোণে।কিন্তু অন্ধকার এখনো চারপাশ ঘেরাও করতে পারেনি!

তার মাথায় প্রচুর প্রশ্নেরা এসে জড়ো হচ্ছে।সাদিদ স্যার তাকে কি বলতে পারে?কি এমন বলবে যে নিরিবিলি আসতে বলল?

সাদিদের জন্য রোদেলার অপেক্ষার প্রহর যেন শেষ হতে চায় না।সে ছটফট করতে থাকে!ছাদের এ মাথা থেকে ও মাথা চক্কর দিতে থাকে।তার নিজের মাথা ঘোরা শুরু হয় কিন্তু সাদিদ ছাদে আসে না!ভুলে গেছে নাকি?

অনেক চিন্তা করে যখন রোদেলা সিদ্ধান্ত নিল নিচে নেমে যাবে তখন সাদিদের দেখা মিলল।সাদিদের দিকে চোখ পড়তে রোদেলা কেঁপে উঠলো।একি অবস্থা উনার?মাথার চুল সম্পূর্ণ ভেজা।বোঝা যাচ্ছে এতক্ষণ মাথায় পানি ঢেলেছে নিজে নিজে।চোখ গুলো লাল লাল।চুলের পানিতে আকাশি রঙের শার্টটার অনেকখানি ভিজে গেছে।শার্টের ইন টিন কিচ্ছু ঠিক নেই।

রোদেলা বিস্মিত কন্ঠে বলল,

—“স্যার, আর ইউ অলরাইট?”

সাদিদ এগিয়ে এসে বলল,

—“আমি ঠিক নেই!আপনাকে আজ কিছু কথা বলবো।সেজন্য নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম।মিস রোদেলা,আপনি কি আপনার ওড়নার এক অংশ দিয়ে একটু মাথা মুছতে দিবেন?”

—“কি!”

—“আসলে আমার সাইনোসাইটিসের সমস্যা আছে।ভেজা চুলে থাকলে ঠান্ডা লেগে যাবে।”

—“রুমে তো টাওয়াল ছিল!”

—“এত কিছু খেয়াল করিনি।ওয়াশরুমে খুঁজলাম পেলাম না।”

রোদেলা অনিচ্ছা নিয়ে নিজের ওড়নার ডান অংশ এগিয়ে ধরলো।সাদিদ চোখ বন্ধ করে মাথাটা মুছে নিল।রোদেলার বুক কাঁপে!সাদিদ স্যার এমন কিছু বলবে না তো,যা সে মেনে নিতে পারবে না?

ধীরে ধীরে সাদিদের অবয়ব ঝাপসা হতে লাগলো।কারন চারপাশ ক্রমেই অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে।সাদিদ রেলিং এ হাত রেখে সামনে দৃষ্টি মেলল।রুদ্ধ কন্ঠে বলল,

—“রোদেলা তোমাকে আমার জীবনের কিছু গল্প শোনাই!

রোদেলার সারা শরীরে শিহরণ বয়ে গেল।সাদিদ স্যার তাকে কত গুলো বছর পর তুমি করে বলল!সে রেলিং শক্ত হাতে চেপে ধরে!

সাদিদ ফের বলে,

—“আমি পড়াশোনা করি ঢাকাতে হলে থেকে।বাবা মা সিলেট থাকতো। ফিজিক্সে অনার্স,মাস্টার্স করে কানাডা চলে যাই উচ্চ শিক্ষার জন্য।আমি হলাম বাবা-মার একমাত্র সন্তান।আমার স্কুল শিক্ষক বাবার স্বপ্ন ছিল আমাকে বিদেশে পড়ানোর।তার সেই স্বপ্ন নিজের মধ্যে লালন করে বিদেশ চলে যাই!বিদেশে সময় গুলো অনেক ভালো কাটছিলো।পার্ট টাইম জব করি।প্রচুর টাকা ইনকাম করি।নিজের খরচ বাদে সব বাসায় পাঠাই।ভার্সিটি যাই আর পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকি।সময় গুলো কেমন দ্রুত কাটছিলো।

আজ থেকে ছয় বছর আগে আমার ইউনিভার্সিটিতে ইমার্জেন্সি কল করে দেশে আসতে বলা হয়।আমি কিছু জানতাম না।আমার ইউনিভার্সিটির প্রক্টর আমার হাতে পাসপোর্ট আর টিকেট ধরিয়ে দিয়ে বলে,’ইমার্জেন্সি দেশ থেকে ঘুরে আসো!’ সঙ্গে সঙ্গে আমার রক্ত শীতল হয়ে যায়।আমি বুঝে যাই,বাসায় কিছু একটা হয়েছে।সেই কিছু একটা যে এতটা কষ্টকর কিছু ধারণাতে ছিল না।

দেশে ফিরে দেখি আমার মা মারা গেছে।সাত দিন লাইফ সাপোর্টে ছিল মা।কিন্তু আমি চিন্তা করবো বলে আমাকে জানানো হয়নি।”

সাদিদ থেমে যায়।তার গলা ধরে এসেছে।রোদেলার চোখ ঝাপসা হয়েছে অনেক আগে।সে একটু এগিয়ে এসে সাদিদের পাশে দাঁড়ায়।খুব ইচ্ছে হয় সাদিদের হাতটি শক্ত করে ধরে সান্ত্বনা দেয়ার।কিন্তু সাহসে কুলায় না।

সাদিদ নিজেকে সামলে আবার মুখ খুলে,

—“মাকে নিজ হাতে দাফন করে আসি।নিজে একটু বুক উজাড় করে কান্না করার ফুরসত পাই না।আমি ভেঙ্গে পড়লে বাবাকে সামলাবে কে?নিজের কষ্ট গুলো লুকিয়ে বাবাকে সামলাই।এর মধ্যে ইউনিভার্সিটিতে আবেদন করে পনেরো দিনের ছুটি ম্যানেজ করি।কিন্তু তবুও মনে চিন্তা হতে থাকে।পনেরো দিন তো দেখতে দেখতে চলে যাবে।আমি চলে গেলে বাবাকে দেখবে কে?এর মধ্যে বাবার মাথায় কোনো আত্মীয় আমায় বিয়ে করানোর পোকা ঢুকিয়ে দেয়।একদিন সন্ধ্যা বেলা বাবা এসে আবদার করে নতুন বউ ঘরে তোলার।বাবার মুখের দিকে চেয়ে হ্যাঁ বলে দিই।বাবার পাত্রী আগে থেকেই ঠিক করা ছিল হয়তো।কারণ সে রাতেই ঘরোয়া ভাবে পিতৃ-মাতৃহীন একটা মেয়ের সাথে আমার বিয়ে হয়ে যায়।

বাসর ঘরে ঢুকে দেখি বাচ্চা একটা মেয়ে।বয়স পনেরো-ষোলো!সদ্য দশম শ্রেণীতে উঠেছে।আমার বড্ড মন খারাপ হয়ে যায়।মনে মনে ভাবি আর মাত্র সাতদিন পর তো চলে যাব।এতটুকু একটা মেয়ে কিভাবে সব সামলাবে?

সেদিন আমি বিছানায় বসে তার নাম জিজ্ঞেস করতেই কেঁদে গঙ্গা বানিয়ে ফেলে!ভয়ে আর ঘাটি না।পরের দিন বাবার মুখে থেকে তার নাম শুনি।ওর নাম ছিল ছিত্তিমা।ছয়দিন আমরা দুজন দু গ্রহের প্রাণীর মতো থাকি।সে শুধু আমাকে ভয় পায়,আমার থেকে আড়ালে থাকে।কিন্তু আমার বাবার সাথে ঠিকই ভাব জমে।

আগামীকাল রাত তিনটেয় আমার কানাডার ফ্লাইট।তখন আমরা গ্রামের বাড়ি থাকতাম।সকাল দশটাতে আমাকে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিবো।সেই রাতে তাকে সাহস করে বললাম,’কাল আমি চলে যাব।তুমি বাবার সাথে থেকো।আর বাবার যত্ন নিয়ো।আমি রেগুলার ফোনে কথা বলবো।’এটুকু বলে আমি কাপড় চোপড় গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।হঠাৎ করে দমকা হাওয়ার মতো ছিত্তিমা এসে আমায় পেছন থেকে জড়িয়ে কেঁদে দিল।আমি এত পরিমাণ অবাক হলাম যে আমার হাত থেকে গোছানো কাপড় খসে পড়ে গেল।আমি ঘুরে তাকে পরম যত্নে বুকে জড়িয়ে নিলাম।

সেই রাতে আমার আর কাপড় গোছানো হলো না।আমাদের মধ্যে অন্য কিছু হলো।একদম অন্য কিছু!নতুন এবং গভীর কিছু।সেই রাতের সাক্ষী হিসেবেই আজকের ছোট্ট ছিনজা!”

রোদেলা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে।কেন করছে সে জানে না।সাদিদের হয়তো সেদিকে নজর নেই।রোদেলা কান্না করতে করতে বলল,

—“তারপর?ছিত্তিমার কি হলো?”

—“পরেরদিন দশটায় আমি ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।রওনা হওয়ার আগে বাবার পা ছুঁয়ে সালাম করলাম।আর আমার পিচ্চি বউটার ভেজা চোখের পাতায় চুমু দিয়ে বিদায় নিলাম।কানাডা পৌঁছে আমার কি যেন হয়ে গেল।অনেক চেঞ্জ হয়ে গেলাম।সবসময় ফুরফুরে মেজাজে থাকি।দেশে নিয়মিত যোগাযোগ করি।বাবা আর ছিত্তিমার সাথে সবসময় কানেক্টেড থাকি।বিদেশে যাওয়ার পর বুঝতে পারি আমি আমার পিচ্চি বউয়ের কাছে কিছু একটা রেখে গেছি।সেই কিছু একটা হলো আমার ‘মন’।বুঝতে পারি আমি তাকে প্রচন্ড ভালোবেসে ফেলেছি।

এর প্রায় তিন মাস পরেই আমার জন্য আরো একটা সুখবর অপেক্ষা করছিল।সেদিন কানাডাতে প্রচুর তুষাড় পড়ছিল।রাস্তা ঘাটে কয়েক মিটার উঁচু হয়ে তুষাড় জমেছে।আশপাশের বাড়িঘর বরফ খনির মতো মনে হচ্ছে।তুষাঢ় ঝরা সেই সন্ধ্যায় ছিত্তিমা আমায় ফোন করে চুপিচুপি বলে,’আপনি বাবা হতে চলেছেন!”‘ ব্যস!আমার খুশি আর ধরে কে!কেমন অন্য রকম অনুভূতি।ছিত্তিমার প্রতি একরাশ কৃতজ্ঞতায় মন ভরে যায়।যেন পারলে আমি তাকে আমার জীবন দিয়ে দেই!

এর পরের সময়টাতে আমি প্রচুর পরিশ্রম করতে থাকি।টাকা জমাতে থাকি।কাগজাদি ঠিক করতে থাকি।বাচ্চা হলেই বাবাকে আর ছিত্তিমাকে কানাডা নিয়ে আসবো।ছিত্তিমার ডেলিভারির আনুমানিক ডেট মাথায় রেখে টিকেট কেটে রাখি দেশে ফেরার।ওই সময়টাতে তার পাশে থাকতে হবে যে!

অক্টোবর মাসের সতেরো তারিখ আমি দেশে ফিরি।এয়ারপোর্টে নেমে চারপাশে খুঁজে বাবাকে পাই না।বাবার সাথে কথা হয়েছিল যে তিনি কার ভাড়া করে রেডি থাকবেন।কিন্তু বাবা আসেনি!বুকের ভেতর পাথর চাপা কষ্ট হয়।আট ঘন্টার ট্রেন জার্নি করে সিলেট পৌঁছাই।বাসায় গিয়ে শুনি ছিত্তিমাকে হসপিটালে এডমিট করা হয়েছে।মুহুর্তে আমি দু চোখে অন্ধকার দেখি।জিনিসপত্র সব ফেলে হসপিটালে দৌঁড়াই।

গিয়ে দেখি ছিত্তিমাকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হয়েছে।তার নরমাল ডেলিভারি হচ্ছে না।ফিটাসে কিছু একটা গোলমাল হয়েছে।বাবা এনামুল হক উদ্ভ্রান্তের মতো অপারেশন থিয়েটারের সামনে বসে আছে।বাবাকে জড়িয়ে ধরে আমি হাউমাউ করে কান্না করতে থাকি।কেন করি জানি না। হয়তো আমার মন জেনে গিয়েছিল যে ছিত্তিমাকেও মায়ের মতো হারাতে বসেছি!

রাত ন’টার সময় ছিত্তিমাকে কেবিনে স্থানান্তর করা হয়।ততক্ষণে আমার সব ভরসা শেষ।কারন ইতোমধ্যে ডাক্তার রা বলে দিয়েছে যে, অল্প বয়সে প্রেগনেন্সির জন্য তার শরীরে নানা জটিলতা দেখা দিয়েছে।ছিত্তিমার শরীর ব্লাড গ্রহণ করছে না।কিন্তু জ্ঞান আছে।

আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে অনেক আকগেই।উদ্ভ্রান্তের মতো হয়ে গেছি।কেউ একজন আমাকে বলল,চাঁদের মতো আপনার একটা মেয়ে সন্তান হয়েছে।আমি সেদিকেে নজর দেই না।পাগলের মতো ছুটে ছিত্তিমার কাছে যাই।কি বিধ্বস্ত চেহারা হয়েছে ওর!মনে হচ্ছে একদিনে বয়স বেড়ে গেছে।ওর মুখে এক গাদা নল লাগানো।আমি কাঁদতে কাঁদতে ওর মুক্ত হাত টা বুকে জড়ালাম।ছিত্তিমার দু চোখের কার্নিশ বেয়ে জল ঝরছে।আমি দুহাতে মুছে দিয়ে ওর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালাম।ইশারায় বুঝালাম,তোমার কিচ্ছু হবে না।আমি এসে গেছি।

তার মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো।মুখের মাস্ক খুলে আমায় শেষ বারের মতো কিছু বলে অন্য ভুবনে চলে গেল।”

সাদিদ ফ্লোরে বসে পড়েছে।সে কান্না করছে।বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে।ক্ষণে ক্ষণে তার শরীর কেঁপে উঠছে।

(চলবে)

😓😓😓😓

পরিশিষ্ট পর্ব-১৫

0

#গল্পের_নাম: পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_১৫

অহি উঠে দাঁড়ালো।আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে বার কয়েক আঙুল চালালো।তারপর মাথায় কাপড় দিয়ে হাঁটা ধরলো।দরজার কাছে পৌঁছাতে রোদেলা ভেতরে ঢুকে বলল,

—“কই যাস রে অহি?”

রোদেলার বিধ্বস্ত চেহারা অহির নজর এড়ালো না।মেয়েটা এত কেন পরিশ্রম করে?মুখটা কেমন চুপসে আছে।রাত বারোটার কাছাকাছি।এখনো ঘুমানোর কোনো তাড়াহুড়ো নেই।আবার তো ভোরবেলা উঠতে হবে!

অহি হাঁটতে হাঁটতে বলল,

—“আপু তুমি বসে রেস্ট নাও একটু।আমি চা করে আনছি।”

বলে সে সিঁড়ি দিয়ে নামলো।

ড্রয়িং রুম অন্ধকার।কুটি হয়তো লাইট বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়েছে।এ বাসায় কুটি আর ফজিলা খালা রান্নাঘরের সাথের রুমটাতে থাকে।এর আগে রুমে একটা বড় খাট ছিল।সেখাতে দুজন একসাথে ঘুমাতো।কিন্তু মাঝে একদিন বাগড়া ধরে কুটি।ফজিলা খালার ঘুমানোর নাকি শ্রী নাই।বুকের আঁচল টাচল ঠিক থাকে না।একত্রে ঘুমাতে পারবে না।সেজন্য সে খালুকে আলাদা বিছানার কথা বলে!পরে অনেক ভেবে স্টিলের দুটো সিঙ্গেল খাটের ব্যবস্থা করা হয়েছে।এখন দুজন একই রুমে দু বিছানায় ঘুমায়।

অহি রান্নাঘরে সুইচ টিপে লাইট অন করলো।সাবধানে ডেকচিতে পানি দিয়ে চুলায় বসালো।সে শব্দ করতে চাচ্ছে না।কারো ঘুম যেন ভেঙে না যায়।ডিনারের পরপরই কুটি আর ফজিলা খালা ঘুমের অতলে হারিয়ে যায়!

কিছুক্ষণ পর গরম চা ছেঁকে তিনটা কাপে ঢাললো অহি।রং চা!রোদেলার আপুর কাপে এক চামচ চিনি,রোদ্দুর ভাইয়ের কাপে দেড় চামচ চিনি আর নিচের কাপে দু চামচ চিনি দিয়ে টুংটাং আওয়াজ তুলে নাড়াচাড়া করলো।

রান্নাঘরের লাইট বন্ধ করে ফোনের আলো জ্বলাল।তারপর ট্রে টা হাতে নিয়ে বাইরে কয়েক পা এগুতে কেউ পেছন থেকে ঝাপটে ধরলো।

অহি কিছু বলার আগেই কুটির কন্ঠ কানে আসলো।কম্পিত কন্ঠে বলছে,

—“ভূত ধরছি।হিম দাদার রুমের ছায়ার মতন ভূতটা ধরছি।আইজ ভূতের রক্ষে নাইক্কা!ওঝা ডাইক্যা ভূত বোতলে ভরমু!”

অহির ফোনটা ফ্ল্যাশ জ্বালানোর পর মুখে আটকানো ছিল।সে একহাতে ট্রে ধরে আরেক হাতে ফোন হাতে নিয়ে মুখ মুক্ত করে বলল,

—“কুটি!ছাড়ো তো আমায়।আমি অহি!”

—“অ্যা?”

—“ছাড়ো কুটি!আমাকে বোতলে ভরতে পারবে না।”

কুটি অহিকে ছেড়ে দিল।অহি ঘুরে নিজের মুখে ফোনের আলো ধরে বলল,

—” কুটি,চিনতে পেরেছো আমাকে?আমি কুঁজো ভূত নই!”

কুটি কিছু বললো না।লজ্জিত মুখে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে।অহি এক কাপ চা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,

—“ভূত দেখলে তো!এখন সহজে ঘুম আসবে না।তার চেয়ে চা খাও রুমে গিয়ে।”

কুটি খুশি হয়ে চায়ের কাপটা হাতে নিয়ে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসলো।অহি বলল,

—“কুটি লাইট জ্বালিয়ে আরাম করে খাও।সাথে অল্প সাউন্ড দিয়ে টিভিও দেখতে পারো।কুঁজো ভূত ফের ডিস্টার্ব করলে তোমার কাপে থেকে তাকেও এক চুমুক চা দিয়ো।”

—“আফা,আপনে যান।আমার অন্ধকারে বইসা চা খাইতে অনেক মজা লাগে।কিন্তু আলিস্যার জন্যি বানান অয় না।”

অহি মুচকি হেসে উপরে উঠে গেল।।সে বেশ বুঝতে পেরেছে কুটি ইচ্ছে কৃত ভাবে তাকে ভূত ভেবে আটকেছিল।তার মূল উদ্দেশ্য ছিল চা খাওয়া।

রোদ্দুরের দরজায় হালকা টোকা দিয়ে অহি ভেতরে ঢুকল।রোদ্দুর ভাইও রুম অন্ধকার করে শুয়ে আছে।তার রুমে বেলকনিতে সবুজ বাতি জ্বালানো থাকে রাতের বেলা।কারণ বেলকনিতে চারটে কোয়েল পাখি আর দুটো লাভ বার্ডস আছে।

বেলকনির আলোর কিছুটা অংশ রুমে এসেছে।অন্ধকার হলেও সব বোঝা যাচ্ছে।অহি তবুও সুইচ টিপে বলল,

—“রোদ্দুর ভাই, আপনার জন্য চা করেছি!”

রোদ্দুর এক হাত কপালে আর এক হাত মাথার নিচে রেখে শুয়ে আছে।তার চোখ বন্ধ।অহির ডাক সে শুনতে পেয়েছে।বন্ধ চোখে বলল,

—“তুই চৌদ্দ মিনিট বত্রিশ সেকেন্ড পর রুমে এসেছিস!অথচ রোদ আপুর রুম থেকে আমার রুমে আসতে সাতচল্লিশ সেকেন্ড লাগে।”

—“আপনার জন্য চা করছিলাম রোদ্দুর ভাই।”

—“ভালো করেছিস।নিজেই চুমুক দিয়ে খেয়ে নে।”

—“আপনি কি রাগ করেছেন?”

রোদ্দুর পাশ ফিরে শুলো।শান্ত কন্ঠে বলল,

—“না!”

অহি চায়ের কাপটা টেবিলের উপর রাখলো।সে চলে যাবে কি না বুঝতে পারছে না।রুমে আসার পর রোদ্দুর ভাই এক পলকের জন্যও তার দিকে তাকায়নি।চোখই খুলেনি!তাছাড়া অহির মনে চিন্তা হচ্ছে।খালামণি খালু ঘুমিয়ে পড়েছে।যদি কোনোভাবে তাদের মনে সন্দেহ জাগে?শুধু রোদেলা আপু জানে সে রোদ্দুর ভাইয়ের রুমে!

—“রোদ্দুর ভাই, আমি তাহলে যাই।”

রোদ্দুর চোখ খুলল।কিন্তু পাশ ফিরে অহির দিকে তাকালো না।সে আগে থেকে শপথ করে রেখেছে অহির দিকে তাকাবে না।এবার যদি অহির মতো সেও উল্টা পাল্টা কিছু করে ফেলে?

সে দেয়ালের দিকে চেয়ে বলল,

—“ড্রেসিং টেবিলের নিচের ড্রয়ারে দেখ মুভ আছে।পায়ে লাগিয়ে নিবি!আর গিয়ে রোদ আপুর থেকে ব্যথার ট্যাবলেট খেয়ে নিস।না হলে কিন্তু সকালে পা ফেলতে পারবি না।”

—“আমি কি আপনার পায়ে মুভ লাগিয়ে দিবো?”

রোদ্দুর চোখ বন্ধ করলো।সে অহিকে পায়ে মলম লাগিয়ে দেয়ার জন্যই ডেকেছিল।কিন্তু এখন মত চেঞ্জ করে ফেলেছে।এই মেয়ে ছুঁয়ে দিলেই সে কেমন জানি হয়ে যায়!

সে নরম গলায় বললো,

—“অজান্তা!রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।যাওয়ার সময় আমার রুমের দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে যাস!”

অহি ড্রয়ার খুলে একগাদা মেডিসিনের মধ্য থেকে মুভটা বের করলো।এক নজর রোদ্দুরের দিকে তাকালো।মৃদু স্বরে বলল,

—“শুভ রাত্রি রোদ্দুর ভাই।”

তারপর লাইট বন্ধ করে রুম থেকে বের হয়ে গেল।অহি বের হতেই রোদ্দুর এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠলো।টেনে টেনে শ্বাস নিল।মেয়ে টা আশপাশে থাকলেই সে কেম জানি হয়ে যায়।গুছিয়ে রাখা সব কথা অবিন্যস্ত হয়ে যায়।আজ অবধি অজান্তাকে তার একবারও মুখে ভালোবাসি কথাটা বলা হয়নি।ভেবে রেখেছিল আজ ফট করে বলে দিবে।কিন্তু কিছুতেই বলতে পারলো না।

টেবিলে এখনো চায়ের কাপ রয়ে গেছে।রোদ্দুর উঠে গিয়ে কাপটা হাতে নিল।তারপর বেলকনিতে গিয়ে বসলো।আজ রাতে তার ঘুম হবে না।মস্তিষ্কে অজান্তাকে নিয়ে সংসার সাজাতে সাজাতে রাত পেরিয়ে যাবে।

সামনের অন্ধকারের দিকে তাকালো রোদ্দুর।সমস্ত অন্ধকার ছাপিয়ে সে যেন সব জায়গা অজান্তার মুখটা দেখছে।চোখের সামনে শুধু একটা রমণী!

সে মুচকি হাসলো।প্যান্টের পকেট থেকে ফোনটা বের করে বাংলায় টাইপ করা শুরু করলো।

“আমার প্রতিটি অস্থির, দম বন্ধ করা সন্ধ্যায় তোমায় পাশে চাই!তোমার উপস্থিতি আমার অস্থিরতা দূর করে দিবে!তোমার একটুখানি পরশে আমার দমবন্ধ ভাব নিমেষে উধাও হয়ে যাবে।

হাজারো ক্লান্তি নিয়ে মন খারাপের বিকেলে অফিস থেকে ফিরেই তোমায় পাশে চাই।তুমি এগিয়ে এসে বিষণ্ণ নয়নে বুকে, বাহুতে হাত বুলিয়ে দিবে।চোখের পলকে আমার সব ক্লান্তি ফুস!

মাঝরাতে হুট করে যদি কোনো দুঃস্বপ্নে ছটফট করি,তুমি মাথাটা বুকে চেপে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে।আমাকে বুঝিয়ে দেবে যে তুমি আমার পাশে আছো!সবসময়!

রাত জেগে কাজ করতে করতে যদি শক্তি হারিয়ে ফেলি তখনো তোমায় পাশে চাই।তোমার উপস্থিতি,ঠোঁটের স্পর্শ আমায় পুনরায় শক্তি যুগিয়ে যাবে।

আমার অসুস্থের দিনগুলোতে তোমায় পাশে চাই। জ্বরে পড়লে তুমি রাত জেগে আমার সেবা করবে,আমার পাশে থাকবে।ক্ষণে ক্ষণে তাপমাত্রা পরিমাপের অজুহাতে কপালে তোমার ছোঁয়া পেতে তোমাকে পাশে চাই।ভীষণ ভাবে চাই!

পরিশেষে, আমার সমস্ত সুখে,দুঃখে,সমঝোতায়, সবকিছুতে তোমাকে পাশে চাই।যা নতুন, যা পুরাতন!সব অনুভূতির সাক্ষী হতে তোমাকে পাশে তাই।মিসেস রোদ্দুর হিম অজান্তাকে চাই!তুমি আমার রোজান্তা (রোদ্দুর + অজান্তা)ফরএভার!!”

এতটুকু লিখে আননোন নাম্বার থেকে সেন্ড করে দিল
এর আগেও এসএমএস পাঠিয়েছিল।সে সামনাসামনি অজান্তাকে তুমি করে বলতে পারে না।এভাবে বলাতেও সে শান্তি পায়।আহা!জীবন এত সুন্দর কেন?

————————–

কলেজ থেকে ফিরে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল রোদেলা।বিকেলের দিকে তার ঘুম ভাঙে শাহিনুরের চিৎকারে।

গায়ে থেকে কম্বল না সরিয়েই বলে,

—“কি হয়েছে মা?কেউ হার্ট অ্যাটাক করেছে?”

শাহিনুর সমানে কাঁপছে।তার প্রেশার সত্যি সত্যি হাই হয়ে গেছে।সে হাঁফাতে হাঁফাতে বলল,

—“করেনি!কিন্তু এক্ষুণি করবে রে রোদু!”

রোদেলা ঝট করে চোখ খুলে বলল,

—“কে মা??”

—“আমিহ!আমি!”

—“কি সাংঘাতিক।তোমার আবার কি হলো?”

—“রোদু রে!তোর প্রিন্সিপাল আইছে বাড়িতে!”

—“অহ!”

পরক্ষণেই এক লাফে বিছানা ছেড়ে উঠলো রোদেলা।কম্পমান কন্ঠে বলল,

—“ক-কি বললে মা?ক- কে এসেছে?”

শাহিনুর বিছানায় বসে পড়লো।বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনা সে।বসে বলল,

—“সুদর্শন,রাজপুত্তরের মতো একটা ছেলে।সাথে ফুলের মতো একটা পিচ্চি মেয়ে।আর সাথে আধ বুইড়া একটা লোক।এসে তো বলল যে তোর কলেজের প্রিন্সিপাল।তোর সাথে দেখা করতে এসেছে।তবে কোনটা প্রিন্সিপাল জানি না।”

রোদেলার মাথা শূন্য হয়ে যাচ্ছে।সাদিদ স্যার হঠাৎ ফ্যামিলি নিয়ে তার বাসায় কেন?তাও আবার কোনো আগাম খবর না দিয়ে?দুপুরেও তো রোদেলা কলেজে ছিল।তখন তো কিছু বলেনি।

শাহিনুর রোদেলাকে তাড়া দিয়ে বলল,

—“নিচে যাস না ক্যান?যাহ!ভালো মন্দ রান্না করতে হবে
প্রিন্সিপাল মানুষ বলে কথা।কি কি রান্না করা যায় বলতো?”

রোদেলা উত্তর দিল না।শাহিনুর ফিসফিস করে বলল,

—“আমার কি মনে হয় জানিস রোদু?বুইড়া প্রিন্সিপাল তার বড় ছেলেকে সাথে নিয়ে ছোট ছেলের জন্য হয়তো তোকে দেখছে আসছে।একটু সাজগোছ করে নিচে নাম।আমি যাই!রান্না চড়িয়ে দেই!”

বলেই শাহিনুর লজ্জা মিশ্রিত মুখে রুম থেকে বের হয়ে গেল।যেন রোদেলাকে নয়,তাকে দেখতে এসেছে!

দশ মিনিট পর রোদেলা অগোছালো মনটাকে একটু স্থবির করে নিচে নামলো।সিঁড়ির শেষ ধাপ পার হতেই সাদিদ স্যারের চোখে চোখ পড়লো।

(চলবে)

রিচেক করা হয়নি।বানান ভুল ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।😍

পরিশিষ্ট পর্ব-১৪

0

#গল্পের_নাম: পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_১৪

রোদ্দুর এক পলক উথাল পাথাল করে দেয়া বিস্তর ক্ষমতার মানুষটির দিকে চেয়ে বলে,

—“হাত ধরেছিস মানলাম।এরপর যেন কোলে উঠতে চাইবি না।তা কিন্তু মেনে নিবো না।আগেই বলে রাখলাম।”

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে রোদ্দুরের হাতে টান পড়ল।হালকা ঘুরে চেয়ে দেখে অহি আবার নিচে বসে পড়েছে।অবাক হয়ে বলল,

—“আবার বসে পড়লি কেন অজান্তা?আজ কি বাসায় ফেরার ইচ্ছে নেই?”

—“আছে রোদ্দুর ভাই।বাসায় গিয়ে টানা সতেরো ঘন্টা ঘুম দিবো।”

—“তো?হাঁটছিস না কেন?তাড়াতাড়ি উঠ।”

—“আমি আর হাঁটবে পারবো না রোদ্দুর ভাই।আমায় কোলে করে নিয়ে চলুন।”

—“কি সাংঘাতিক!এই ছিলো তোর মনে?”

অতঃপর বিস্ফারিত নয়নে চারপাশে পরখ করলো রোদ্দুর।সন্ধ্যার পর এখানে আরো মানুষের ঢল নেমেছে।জোড়া, জোড়া ছাড়া! সব ধরনের মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে।এত মানুষের সামনে অহিকে কোলে নেওয়া জাস্ট ইম্পসিবল!

সে অহির দিকে চেয়ে অনুরোধের কন্ঠে বলল,

—“অজান্তা লিসেন!এটা বিদেশ নয়,বাংলাদেশ!এত মানুষের মধ্যে তোকে কোলে নিয়ে যাওয়া কেমন দৃষ্টিকটু দেখায়।তুই আর একটু কষ্ট কর।দশ মিনিটের মতো গেলে রিকশা পাব।”

অহি চিন্তিত গলায় বললো,

—“তাই তো!তাহলে রোদ্দুর ভাই, আপনি কথা দিন যে বাসার সামনে গিয়ে মূল ফটক থেকে সদর দরজা পর্যন্ত কোলে করে নিয়ে যাবেন?”

রোদ্দুর হেসে ফেলল।অন্ধকার ছাপিয়ে সে হাসির সুর চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে।অহি কান পেতে শোনে।যেন এই পরিবেশে হাসিটা একদম উপজীব্য!

রোদ্দুর হাসি থামিয়ে বলে,

—“তোর হঠাৎ এত কোলে উঠার শখ জাগলো কেন?”

—“আপনি মনে করিয়ে দিলেন তাই!”

—“এতো দেখছি নিজের বিপদ নিজে ডেকে আনলাম।আচ্ছা এখন হাঁট!কোলে নিবো তখন!”

বলে রোদ্দুর অহির হাতে টান দিল।কিন্তু অহি তারপরও উঠলো না।সে মন খারাপ করে নিচের দিকে চেয়ে আছে।রোদ্দুর চারপাশ এক নজর দেখে চট করে মাথা নিচু করে অহির ডান গালে গভীর এক চুমু বসিয়ে দেয়!তারপর অহির হাত ছেড়ে হেঁটে সামনে এগিয়ে যায়।

অহির সর্বত্র মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়ে।দ্রুত উঠে দৌঁড়ে রোদ্দুরের সমানে সমানে হাঁটতে থাকে!

——————-

বাসার কাছে রিকশা থামতে রোদ্দুর অহির থেকে হাত ছাড়িয়ে নেমে পড়ে।ওয়ালেট বের করে ভাড়া দেয়।রিকশা উল্টো ঘুরে চলে যেতে সে অহিকে বল,

—“চল!বাসার সবাই আজ অনেক বকা দিবে রে!অনেক রাত হয়ে গেছে।”

—“কই রাত হয়েছে?”

রোদ্দুর উত্তর না দিয়ে হাঁটা ধরে।বেশিদূর আগাতে পারে না।অহি তার হাত টেনে ধরে।এদিকটা অন্ধকার!অন্ধকারে রোদ্দুর বিস্মিত চোখে অহির দিকে তাকায়।অহির মুখ স্পষ্ট নয়!তাকে অনেকটা ছায়া মানবীর মতো লাগছে!তাকে ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করছে!গভীর ছোঁয়া!

রোদ্দুর ঢোক গিলে বলে,

—“দাঁ-দাঁড়িয়ে পড়লি কেন অজান্তা?”

অহি উত্তর না দিয়ে দু পা এগিয়ে এসে রোদ্দুরকে জড়িয়ে ধরে।রোদ্দুরের হাত নিজের অজান্তে অহির পিঠে চলে যায়।অহিকে দু হাতে আষ্টেপৃষ্টে নিজের সাথে জড়িয়ে নেয়!অহি ফিসফিস করে বলে,

—“আপনাকে এক পৃথিবী ধন্যবাদ রোদ্দুর ভাই।”

রোদ্দুর উত্তর দেয় না।সে চোখ বন্ধ করে আছে।ভেতরে অন্য ধরনের অনুভূতি হচ্ছে।কয়েক সেকেন্ড পর অহির মতোই ফিসফিস করে বলে,

—“অজান্তা!আমার এত কাছে আসিস না।প্লিজ!”

অহি আরো শক্ত করে রোদ্দুরকে জড়িয়ে ধরে।কয়েক মিনিট পর অহি হঠাৎ মৃদু শব্দ করে আর্তনাদ করে।রোদ্দুর দ্রুত ছেড়ে দিয়ে চিন্তিত গলায় বলে,

—“কি হলো অজান্তা?ব্যথা ট্যথা পেয়েছিস কোথাও?”

অহি রাগী কন্ঠে বলে,

—“এভাবে কেউ পায়ের উপর ভর দিয়ে জড়িয়ে ধরে?দিলেন তো বুট দিয়ে পায়ের পাতা একদম পিষে!আপনি এত গাধা কেন রোদ্দুর ভাই?”

রোদ্দুর আমতা আমতা করে বলল,

—“ইয়ে মানে স্যরি রে!খেয়ালে ছিল না।বেশি ব্যথা পেয়েছিস?”

—“রোদ্দুর ভাই! আপনার ডান পা এখনো আমার কড়ে আঙুলের উপর!”

রোদ্দুর এক পলক নিচের চেয়ে দ্রুত দু পা পিছিয়ে যায়।মনে মনে নিজেকে জঘন্য একটা গালিও দেয়।পুনরায় আবার এগিয়ে এসে এক ঝটকায় অহিকে কোলে তুলে নিয়ে হাঁটা ধরে।

অহি প্রথমে অবাক হলেও মুহুর্তে খুশি হয়।রোদ্দুর ভাই তাকে কোলে তুলে নিয়েছে যেন বিশ্বাস হতে চায় না!তার কপালে এত সুখ সইবে তো!

সে দুহাতে রোদ্দুরের গলা জড়িয়ে ধরে।এই মানুষটাকে সে কখনো কষ্ট পেতে দিবে না।নিজের সবটা দিয়ে বাকি জীবনটাতে আগলে রাখবে!

সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রোদ্দুর অহিকে নামিয়ে দেয় কোল থেকে।কিন্তু অহি তার গলা ছাড়ে না।দুহাতে আরো শক্ত করে ধরে।রোদ্দুরের মাথাটা নিচু হয়ে আসে।সে ইশারায় গলা ছাড়তে বলে কলিং বেলে চাপ দেয়!

অহির দিকে পুনরায় তাকানোর আগেই অহি নিষিদ্ধ ও ভয়ংকর একটা কাজ করে। রোদ্দুরের সারামুখে এলোপাথাড়ি চুমু খেয়ে ছেড়ে দিয়ে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়!রোদ্দুর আর চোখ তুলে অহির দিকে তাকাতে পারে না।সে যেন হাওয়ায় ভাসছে!বুকের ভেতর ধড়ফড় করছে।তার হার্ট অ্যাটাক আজ কেউ আটকাতে পারবে না।কেউ না!

একহাতে বুক চেপে আরেক হাতে অনবরত কলিং বেলে চাপ দেয়!কেউ খুলছে না কেন?

দরজা খুলতেই রোদ্দুর এক দৌঁড়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দেয়!ভাগ্যিস ড্রয়িং রুমে তেমন কেউ ছিল না।নইলে তার হঠাৎ এমন আচরণে সবাই আরেক দফা অবাক হতো!

——————-

শাওয়ার নিয়ে অহি মাথার চুল মুড়িয়ে বের হয়।রোদেলা আপু এখনো রুমে আসেনি।কিন্তু রোদেলা আপুর সাথে তার অনেক কথা জমে আছে।অনেক কিছু জিগ্যেসও করতে হবে।সাদিদ স্যারের সাথে সময় কিভাবে কাটলো,কি কি কথা হলো সব!

সে বাসায় ফিরেই শুনেছে রোদেলা আপু নাকি স্ট্যাডি রুমে কিছু একটা দরকারী কাজ করছে।

এ বাসায় একটা ছোট্ট রুম আছে যেটা লাইব্রেরির মতো অনেকটা।প্রচুর বই দিয়ে ভর্তি।সংস্কৃত থেকে শুরু করে মিয়ান সভ্যতার পুরনো সব বই আছে।এই সবকিছু তার খালু সংগ্রহ করেছে।তিনি প্রতি রাতের খানিকটা অংশ লাইব্রেরীতে বই পড়ে কাটিয়ে দেয়!

অহি মাথার চুল ঝেরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে।আয়নায় নিজের প্রতিকৃতির দিকে তাকায়।সে কি অনেক বেশি সুন্দর?কই নাতো!কেমন ফোলা ফোলা গাল,একটু বোঁচা নাক!একপাশের টোল টাও বেশি বোঝা যায় না।রোদ্দুর ভাই তাতেই মুগ্ধ হয়ে গেল?

অহি আর আয়নায় তাকাতে পারে না।তার লজ্জা লাগে।ভীষণ লজ্জা লাগে।এমনিতেই মানুষটার সামনে সে কত নির্লজ্জ কাজ করেছে।এখন মুখ দেখাবে কি করে?

মোবাইলের টুং আওয়াজে ঘোর কাটে অহির।ড্রেসিং টেবিল থেকে উঠে পড়ে।বিছানার উপরে আধ শোয়া হয়ে বালিশের তলা থেকে ফোনটা হাতে নেয়।একটা এসএমএস এসেছে আননোন নাম্বার থেকে!এটা যে রোদ্দুর ভাইয়ের নাম্বার তা অহির বুঝতে বাকি রইলো না।কারণ এই নাম্বার থেকেই তার রোদ্দুর ভাইকে কনফেশনের মেসেজটা পাঠিয়েছিল!

সে মেসেজটা পড়া শুরু করলো।

“নিজেকে ভেঙে চুড়ে,সম্পূর্ণ টুকরো টুকরো করে তোমায় ভালো বেসে ফেলেছি।আমার মন নামক ছোট্ট শহরটা আজ শুধু ‘তুমি’ নামক মানুষটার দখলে।এখন তোমার নৈশব্দিক পদচারণার গুঞ্জনে আমার শহরে অন্ধকার কাটিয়ে ভোর হয়।তোমার প্রসারিত ঠোঁটের একটুখানি হাসি সূর্য হয়ে আলো ছড়ায়!তোমার ভারী নিঃশ্বাসের গন্ধ মেখে আমার শহরের দিন কাটে।

তোমার ঘন পল্লবঘেরা আড়চোখের একটুখানি চাহনি আমার শহরে ফকফকে জোসনা হয়ে ঝরে পড়ে।তোমার বাঁকা ঠোঁটের একটুখানি হাসি,আমার শহর তোলপাড় করে দেয়!তোমার এলোচুলের একটু দোলা,আমার শহরে পাগলা হাওয়া বইয়ে দেয়।তোমার হঠাৎ হঠাৎ লজ্জা মিশ্রিত মুখ,ফাগুনের আগুনে ভাসিয়ে দেয় আমার শহর!

তেমনি তোমার হঠাৎ হঠাৎ কুঁচকানো কপালের গভীরতা মেপেই আমার শহরে বৃষ্টি ঝরে।শেষ বিকেলের চায়ের কাপ হাতে নিয়ে উদাস হয়ে প্রকৃতি পানে তাকিয়ে থাকা তোমার মন খারাপের বিকেল আমার শহর এলোমেলো করে দেয়।বিষণ্ণতার ডাকে ছেয়ে যায় আমার শহর।ফের তুমি যখন মুচকি হাসো, আমার শহর যেন প্রাণ ফিরে পায়।

এভাবেই আমার শহরের নামহীন প্রতিটি স্তরে শুধু ‘তুমি’ নামক মানুষটার বিচরণ!আমার শহরে তোমার নিমন্ত্রণ রইলো।এক সমুদ্র ভালোবাসা নিয়ে দরজায় কড়া নেড়ো।আমি দু হাতে তোমায় বুকে আগলে নিবো।আমার রাজ্যের আমার মায়াপরীকে।ভালোবাসি!ভালোবাসি!ভালোবাসি!”

এইটুকুই লেখা।অহির বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে।সুখের ঝড়,ভালোবাসার ঝড়!সে ফোনটা বুকের উপর নিয়ে বিড়বিড় করে বলল,

—“আমায় পাগল করে দেবেন না রোদ্দুর ভাই।একদম পাগল করে দিবেন না।আমি পাগলামি শুরু করলে তখন সামলাতে পারবেন না!”

আবার টুং করে মেসেজের আওয়াজ আসলো।সে দ্রুত ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো এবার ‘রোদ্দুর ভাই’ নাম দিয়ে সেইভ করা সেই পুরাতন নাম্বার থেকে এসএমএস এসেছে।বাংলায় লেখা…

“অজান্তা!যেখানেই থাকিস না কেন দুই মিনিটের মধ্যে আমার রুমে আয়।দরজায় টোকা দিতে হবে না।দরজা খোলা!দুই মিনিটের এক সেকেন্ড যেন নড়চড় না হয়।

আদেশক্রমে
রোদ্দুর হিম”

অহি হেসে ফেলল আবারো।মানুষটা তাকে নিয়ে এ কি খেলা শুরু করলো?প্রেম কথোপকথন এক নাম্বার দিয়ে।আর ঝাড়ি দেয় আরেক নাম্বার দিয়ে!

সে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো।

(চলবে)

প্রেমে পড়েছে মন প্রেমে পড়েছে…..(উল্টা সেন্টি ইমোজি)

পরিশিষ্ট পর্ব-১৩

0

#গল্পের_নাম: পরিশিষ্ট
#লেখিকা:অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_১৩ (বোনাস পার্ট)

অহি এগিয়ে এসে রোদ্দুরের হাত চেপে ধরে বলল,

—“রোদ্দুর ভাই টিকেট কেটেছি!”

অহি ছুঁয়ে দিতে রোদ্দুরের সমস্ত শিরায় শিরায় যেন ইলেকট্রিক শক লাগলো।এই মেয়ে নির্ঘাত বিদ্যুতের কারখানা।সে এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে বলল,

—“টিকেট কেন কিনলি?”

—“ফেরীতে উঠার জন্য।এই মাথা থেকে শুরু করে উত্তর দিকে সোজা উত্তর দিকে গিয়ে নামবো।ওদিকে অনেক সুন্দর সুন্দর গাছপালা।ভালো লাগবে রোদ্দুর ভাই।চলুন।”

—“এই শোন!সবসময় কানের কাছে রোদ্দুর ভাই, রোদ্দুর ভাই করবি না তো!যেকোনো একটা বলে ডাকবি।হয় রোদ্দুর, না হয় ভাই।তোর চয়েস…কোনটা বলে ডাকবি!”

অহি খিলখিল করে হেসে বলল,

—“আমার রোদ্দুর ভাই বেশি পছন্দ।ওটা বলেই ডাকবো।”

—“তোকে আমি তাহলে অজগর বলে ডাকবো।অজগর একটা!”

—“অজগর নিঃশ্বাস দিলে নাকি মানুষ মরে যায়।আপনিও মরে যান।”

বলেই অহি একটু এগিয়ে আসলো।রোদ্দুরের মুখের কাছাকাছি মুখ এনে সাপের মতো ফোঁস করে বেশ কয়েকবার নিঃশ্বাস ছাড়লো।রোদ্দুর মাথাটা একটু পিছিয়ে কাত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।এই মেয়ের মাথায় শর্ট সার্কিট আছে।দু তিনটে তার ছেঁড়া।না দু-তিনটে নয়!অন্তত হাজার খানেক তার ছেঁড়া!

ঘাটে অসংখ্য ফেরী বাঁধা।অহি রোদ্দুরের তোয়াক্কা না করে একজনকে টিকেট দেখাল।তিনি বলে দিলেন কোন ফেরীতে উঠতে হবে।সে তিন নাম্বার সারির প্রথম ফেরীতে উঠে বসলো।

রোদ্দুর প্রবল অনিচ্ছা নিয়ে ফেরীতে উঠে অহির পাশে বসলো।ছোট্ট ফেরী।দেখেই কেমন ভয় ভয় লাগে!যেকোনো সময় ডুবে যেতে পারে মনে হচ্ছে।

হইহই করে একদল যুবক-যুবতী উঠলো।ফেরী ভরে গেছে।আর কোনো বসার জায়গা খালি নেই।ফেরী ছেড়ে দিল।

অহি কর্ণারে বসেছে।কর্ণার দিয়ে জানালার মতো কাটা।জানালা দিয়ে হু হু বেগে বাতাস বইছে।বাতাসে অহির হিজাবের একটা অংশ বার বার রোদ্দুরের মুখে দোলা দিয়ে যাচ্ছে।তার ভেতর কেমন অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছে।অন্য রকম, প্রশান্তি,ভালো লাগা আর পরম সুখের অনুভূতি।এ রকম টুকরো টুকরো হাজারো অনুভূতির সাক্ষী হতে চাইলেও তার পাশে বসা থাকা মেয়েটিকে সে সারাজীবন নিজের পাশে চায়!

সামনে বসা একটা ছেলে ফোনে গান বাজাচ্ছে।এই পরিবেশের সাথে যেন গানটা একদম মানানসই।

“যেই তোমার হাওয়া আমাকে ছুঁলো,
উড়ে গেল মন পায়রা গুলো
তাও কেন দেখেও দেখোনি…….”

রোদ্দুরের মনের ভেতরও গানের লাইন গুলো ভেসে বেড়াচ্ছে।অহির দিকে আড়চোখে তাকালো সে।মেয়েটির দিকে এখন সরাসরি তাকাতেও কেমন লজ্জা লাগে।আগে তো এমন হতো না!তবে কি এটা নতুন সম্পর্কের রেশ?

অহি জানালার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।তার বুকের ভেতর সুখের ঝড় যাচ্ছে।এই হাতিরঝিল সে বহুবার এসেছে।হাতিরঝিলের প্রতিটি গাছ থেকে শুরু করে ধূলিকণা পর্যন্ত তার পরিচিত।কিন্তু কোনোবারই এত ভালো লাগেনি।সে বেশ বুঝতে পারছে,তার এই ভালো লাগার,নতুন অনুভূতির সম্পূর্ণ ক্রেডিট তার পাশের মানুষটার।

ফেরী ছুটে চলেছে উত্তর দিকে।স্রোতের বিপরীতে যাওয়ার কারণে হালকা পানি ছিঁটে আসছে অহির গায়ে।এতে তার আরো ভালো লাগছে।সে নদীর দিকে তাকিয়েই ডান হাত দিয়ে রোদ্দুরের হাতটা চেপে ধরলো।

রোদ্দুর চমকে উঠলো।কিছু বলতে নিয়েও চারপাশে তাকিয়ে থেমে গেল।নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো।কারণ অনেকে আড়চোখে তাদের দেখছে আর নিজেরা হাসাহাসি করছে।সে আস্তে করে মুখের সামনে হাত রেখে ফিসফিস করে বলল,

—“অজান্তা,হাত ছাড়। সবাই দেখছে!”

রোদ্দুরের মুখে অজান্তা ডাকটা অহিকে তোলপাড় করে দেয়।বাঁধভাঙা ঢেউয়ের মতো ভেসে যেতে ইচ্ছে করে দূর থেকে সূদুর!সে চাপা হেসে বলল,

—“দেখুক!তাতে আমার কি?আমি আমার হবু বরের হাত ধরেছি।তাতে তাদের কেন জ্বলে?”

—“অজান্তা,কথা শোন আমার।হাত ছাড়!বাসায় গিয়ে আমার রুমে তোকে তিন ঘন্টা সময় দিবো।তখন হাত ধরে বসে থাকিস।আমি কারো হাসাহাসির বস্তু হতে চাই না।হাত ছাড়!”

—“ছাড়বো না।পারলে ছাড়িয়ে দেখান।আমি দুই হাত দিয়ে ধরবো।”

অহি সত্যি সত্যি রোদ্দুরের বাম হাত নিজের হাঁটুর উপর নিয়ে দুই হাতে শক্ত করে ধরে বসে রইলো।রোদ্দুর এবার নিজে থেকে অহির ডান হাতটা চেপে ধরে।হাত ধরেই সিটের আড়ালে নিয়ে অহির ওড়না দিয়ে ঢেকে স্তূপ করে রাখে।চট করে কেউ আর বুঝতে পারবে না।

তার কাছে ভালোবাসার সঙ্গাটা অন্য রকম।খুবই ব্যক্তিগত!এমনই ব্যক্তিগত যা লোকচক্ষুর আড়ালে রাখতে হয়,জনসম্মুখে তার প্রাইভেসি, আগ্রহ কমে যায় হয়তো!অহি তার ব্যক্তিগত আপন মানুষ।তাকে ঢেকে সবসময় সবার আড়ালে রাখতে চায়।অহির প্রতি তার ভালোবাসাটা,অনুভূতিটা সে একমাত্র অহি ছাড়া আর কাউকে দেখাতে চায় না।

অহি রোদ্দুরের আঙুলের ভাঁজে নিজের আঙুল ঢুকিয়ে দেয়।সে অবাক হয়।রোদ্দুর ভাই তার হাত ধরতেও ভয় পায়?এত কিসের ভয় মানুষটার!

রোদ্দুর এক পলক ওড়নার আড়ালে থাকা হাত দুটির দিকে তাকায়।সামান্য হাত ধরার অনুভূতি এত প্রগাঢ়,এত ভরসার, এত বিশ্বাসের তার জানা ছিল না।অহির হাতটা সে এভাবে সারাজীবন ধরে রাখতে চায়।হোক না তা লোকচক্ষুর আড়ালে!

ডান হাতে ফোনটা বের করে রোদ্দুর ফোন স্ক্রল করে।অহিকে আস্তে করে বলে,

—“অজান্তা!”

অজান্তা তার দিকে সম্পূর্ণ ঘুরে বলে,

—“বলুন রোদ্দুর ভাই।”

—“আমার দিকে তাকিয়ে বলতে হবে না।সামনে তাকিয়ে বা অন্য দিকে তাকিয়ে কথা বল।”

—“কেন?আপনি লজ্জা পান?ছেলেদের তো লজ্জা পেতে নেই।ছেলেরা হবে নির্লজ্জ।”

—“তোর লাজ লজ্জা কিছুই নেই।তোর মতো যদি আমিও নির্লজ্জ হই তাহলে কি হবে ভেবে দেখেছিস?”

অহি রোদ্দুরের দিকে তাকিয়েই বলল,

—“ভাবাভাবির কি আছে?বি প্র্যাক্টিক্যাল রোদ্দুর ভাই!একটু আমার মতো নির্লজ্জ হয়ে দেখান।”

রোদ্দুর ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অহির দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকাল।অহির মুখ হাসি হাসি।রোদ্দুর কিছুক্ষণ চেয়ে চোখ সরিয়ে নিল।ও চোখে তাকিয়ে থাকার মতো শক্তি তার নেই।ডুবে যাবে,একদম তলিয়ে যাবে সে।

ফের ফোনের দিকে চেয়ে কথা ঘোরানোর জন্য বলল,

—“তোর পড়াশোনার কি অবস্থা রে অজান্তা?”

—“একদম ঘোলাডাইল।আমার আর পড়তে ইচ্ছে করে না রোদ্দুর ভাই।আমায় তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেলুন।কবে বিয়ে করবেন?”

রোদ্দুর খুকখুক করে কাশে।কি সাংঘাতিক মেয়ে।এর তো মুখে বুলি ফুটেছে।যা মন চায় তাই বলে দিচ্ছে।তার মানে অহি তাকে এখন আর বিন্দুমাত্র ভয় পায় না?কি মুসিবত!তাহলে কি সে-ই বাকিটা জীবন একে ভয় করে চলবে?

—“রোদ্দুর ভাই! ”

—“বলে ফ্যাল।”

—“আপনার কয়টা বেবি নেয়ার ইচ্ছে?আগেই বলে রাখি,এসব নিয়ে কিন্তু পরে আর তর্ক করা যাবে না।আমার এগারোটা বেবি নেয়ার শখ।”

—“ও মাই গড!”

রোদ্দুর আর পারলো না।জোরে জোরে কাশা শুরু করলো।তার কাশির শব্দে সবাই ঘাড় ঘুড়িয়ে তার দিকে তাকাল।রোদ্দুর চোখের পলকে অহির থেকে হাত সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো।ফেরীর কর্ণারে গিয়ে দাঁড়াতে মাঝি বলল,

—“ভাই, নড়াচড়া কইরেন না বেশি।ডুবে যেতে পারে!”

অগত্যা রোদ্দুর ফের অহির পাশে এসে বসলো।তবে এবার দুজনের মাঝে অনেক দূরত্ব রেখে।একেবারে কুঁজো হয়ে একটু জায়গা নিয়ে!

অহি বুঝতে পেরে বলল,

—“রোদ্দুর ভাই, কাছে আসুন।”

রোদ্দুর বিড়বিড় করে বলল,

—“হোয়াট?”

—“বলছি,কাছে এসে বসুন তো।পড়ে যাবেন!”

—“পড়ে যাবো না।”

—“আরে পড়ে যাবেন।এদিকে সরে বসুন।মাঝে মাঝে ঝাঁকুনি হচ্ছে তো।”

—“নিচে পড়ি পড়বনি।চুপচাপ থাকো।”

অহি আর জোর করলো না।বেশ কিছুক্ষণ পর ফেরী থেমে গেল।গন্তব্যে এসে গেছে।

——————

সন্ধ্যার আযানের শব্দে ঘোর কাটে রোদ্দুরের।বাসায় ফিরতে হবে তো!

অহি আশপাশে থাকলেই সে কেমন ঘোরের মধ্যে চলে যায়।চারপাশ অন্য রকম লাগে।কেমন অদ্ভুত রকমের সে অনুভূতি!কিন্তু সে এসব অহিকে বুঝতে দিতে চায় না।বুঝলেই অহি হয়তো তাকে ক্ষেপাবে!

—“অজান্তা উঠ!তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরতে হবে।”

অহি উঠতে চায় না।তারা এতক্ষণ একটা রাস্তা থেকে একটু দূরে গাছের নিচে বসে ছিল।দুপুরে ব্রিজের কাছের রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করে নিয়েছিল দুজন একত্রে!তারপর থেকেই দুজন চুপচাপ বসে আছে।আহামরি কথাও হয়নি।চুপচাপ দুজন পাশাপাশি বসে থাকারও যেন অন্য রকম অনুভূতি!

রোদ্দুর তাড়া দেয়।

—“অজান্তা উঠে পড়।রোদ আপু বিকেলেই বাসায় পৌঁছে গেছে।আমরা এখনো পৌঁছাইনি।চরম বকা দিবে।আমি একা থাকলে সমস্যা ছিল না।সাথে তুই আছিস,তাতে মেয়ে মানুষ!কিছু হয়ে গেলে?চল তো!”

অহি উঠে দাঁড়ায়।দুজন পাশাপাশি হাঁটা ধরে।অহি হঠাৎ প্রশ্ন করে,

—“রোদ্দুর ভাই,খালামণি,খালু যদি আমাদের সন্দেহ করে?যদি বিয়ে পড়িয়ে দেয় দুজনকে?ধরুন আজ রাতেই তাহলে?”

—“তুই এত বিয়ে নিয়ে পড়েছিস কেন?অনার্স কমপ্লিট কর।তারপর দেখা যাবে!”

—“সে কি!অনার্স শেষ হতে তো এখনো এক বছরের উপরে দেরি।থার্ড ইয়ারের সেকেন্ড সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষাই তো এখনো হয়নি।”

রোদ্দুর কিছু বলল না।তবে মনে মনে হিসেব টা কষে একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলল।সত্যিই তো!একটু বেশি দেরি হয়ে যায় না?এই মেয়েটা কাছে আসলেই তো তার পৃথিবী উলোটপালোট হয়ে যায়।এতদিন থাকবে কিভাবে?

—“রোদ্দুর ভাই আর হাঁটতে পারছি না।”

রোদ্দুর দাঁড়িয়ে পড়ে।অহি নিচে বসে পড়েছে।হেঁটে অনেকখানিই এসেছে তারা।তারা ব্রিজ থেকে উল্টো দিকে অনেক খানি এসেছিল।এখন ব্রিজের কাছে গিয়ে রিকশা নিতে হবে।এখান থেকে পাওয়া যাবে না।

অনেকখানি রাস্তা!রোদ্দুরের নিজেরই কষ্ট হচ্ছে হাঁটতে।হেঁটে তেমন তার অভ্যাস নেই।অহিরও সেইম অবস্থা।রোদ্দুরের মন খারাপ হয়ে যায়।তার জন্য নয়।অহির জন্য!

সে অহির দিকে চেয়ে নরম কন্ঠে বলে,

—“আর একটু কষ্ট কর অজান্তা!সামনেই ব্রিজ।ওখান থেকে রিকশা নিয়ে সোজা বাসা।অনেক রাত হয়ে যাবে রে।তাড়াতাড়ি চল!”

অহি উঠে দাঁড়ালো।পায়ের জুতো খুলে হাতে নিল।সে খালিপায়ে হাঁটবে।এতে একটু ভালো লাগবে।রোদ্দুর কিছু বললো না।শুধু অহির হাতের জুতোজোড়া নিজের হাতে নিল।অহি ছাড়তে চাইলো না।সে জোর করেই নিল।

রোদ্দুর হাঁটার বেগ একটু কমিয়ে দিল।তার পাশের কলিজার কষ্ট হচ্ছে।

চারিদিকে অন্ধকার ঘনীভূত হয়েছে।কিছু কিছু জায়গা রাস্তার ধারের বড় বড় সোডিয়াম আলোতে আলোকিত।গাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে আলো পড়ে অদ্ভুত সব প্রতিমূর্তি গঠন করছে।নদীর কুচকুচে কালো পানিতে বিভিন্ন রকমের আলো পড়ে চিকচিক করছে।কালো জলটাও এমন অনিন্দ্য সুন্দর মনে হচ্ছে।অহি,রোদ্দুর দুজনেই কেমন টান অনুভব করলো।এই পথ-ঘাট,এই প্রকৃতি তাদের হাজারো অগোছালো অনুভূতির চিরসাক্ষী হয়ে থাকবে।

কিছু দূর যেতেই অহি রোদ্দুরের শার্টের পেছনের অংশ চেপে ধরলো।রোদ্দুর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে থেমে গেল।এই মেয়েটা এমন কেন?হুটহাট কেমন ছুঁয়ে দেয়!সে কি বোঝে না এতে তার বুকের ভেতর তোলপাড় হয়?

—“থামলেন কেন?হাঁটুন!”

অহির কথায় রোদ্দুর বলে,

—“তুই পেছন থেকে শার্ট খামচে ধরে রাখলে হাঁটবো কিভাবে?”

—“জানি না!ওভাবেই হাঁটুন।আমার হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে।নাহলে হাত ধরতে দিন।”

—“মনে হচ্ছে তোকে নিয়ে এখন পাহাড় টাহাড় ট্রেকিং করতে উঠবো।নে হাত ছাড়!শার্ট ধর!স্যরি!শার্ট ছাড়,হাত ধর!”

রোদ্দুর হাত বাড়িয়ে দেয়।অহি হাসিমুখে তার হাত ধরে।দুজনে আবার হাঁটা ধরে।রোদ্দুর এক পলক উথাল পাথাল করে দেয়া বিস্তর ক্ষমতার মানুষটিকে বলে,

—“হাত ধরেছিস, মানলাম।এরপর যেন কোলে উঠতে চাইবি না।সেটা কিন্তু মেনে নিব না।আগেই বলে দিলাম।”

(চলবে)

পরিশিষ্ট পর্ব-১২

0

#গল্পের_নাম: পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_১২

সকালবেলা রোদেলার ঘুম ভাঙলো অহির ডাকে।চোখ না খুলেই ঘুমজড়ানো কন্ঠে বলল,

—“এত ভোরে জ্বালাস কেন পাখি?”

অহির মুখে হাসি ফুটে উঠলো।রোদেলা আপু তাকে যখন যা মনে চায় তাই বলে ডাকে।কিছুদিন হয়তো পাখি বলে ডাকবে।সে মন খারাপ করে বলল,

—“আপু উঠো তো এখন।তোমার ভোর এখন নেই।দশটা বাজে প্রায়!”

রোদেলা এক লাফে উঠে চিন্তিত গলায় বললো,

—“তোরা কেউ ডাকিস নি কেন রে?আমার কলেজে যেতে হবে তো।প্রথম পিরিয়ডে সি গার্লস সেকশনে আমার ক্লাস!সাদিদ স্যার অনেক স্ট্রং!কেউ দেরিতে গেলে কিভাবে যেন বুঝে যায়।মনে হয় সিসিটিভি ফুটেজ চেক করে সবসময়।”

—“কেন?তোমায় কি কোনোদিন বকা দিয়েছে নাকি আপু?”

রোদেলা মাথার চুলগুলো হাত খোঁপা করতে করতে বলল,

—“পাখি রে!গত পরশুদিন আমি ক্লাস নিচ্ছি ছেলেদের।হুট করে রুমে ঢুকে পড়লো।আমি তো ভয়ে শেষ।একদম কাঁপা-কাঁপি অবস্থা।মার্কার নিয়ে বোর্ডে কিছু একটা লিখছিলাম।ভয়ে হাত থেকে মার্কার নিচে পড়ে গেল।শুধু পড়লে তাও হতো।গড়িয়ে ওনার পায়ের কাছে গেল।উনি নিজেই হাত দিয়ে উঠিয়ে আমার সামনে ধরে বললেন,’মিস!একটু সাবধানে সব করবেন।এত ভয় পেলে চলে?’

আমি জড়তা নিয়ে মার্কার হাতে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করলাম।কখন উনি রাউন্ড শেষে চলে যাবে!কিন্তু উনি করলো জানিস?”

অহি রোদেলার থেকে মুখ লুকিয়ে হাসছে।হাসি থামিয়ে কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করলো,

—“কি করলো আপু?”

—“আরে হিরোদের মতো হেঁটে একদম পিছনের বেঞ্চে গিয়ে বসলেন।তারপর আমার দিকে চেয়ে হাসলেন।গালে হাত রেখে বললেন,’মিস রোদেলা, আপনি ক্লাস নিন।দেখি কেমন পড়ান।আমিও করি।কি করাচ্ছেন?ট্রান্সফরমেশন অফ সেন্টেন্স?আচ্ছা,করান!’

এদিকে আমার অবস্থা শেষ।মুখ দিয়ে কোনো কথা বের হয় না।ছেলেগুলো ফাজিলের মতো মুখ টিপে হাসছে।স্যারও হাসছে।আমি অনেক কষ্টে মুখ খুললাম।খুলেই মুসিবতে পড়লাম।কিচ্ছু মনে নেই!সেন্টেন্স কাকে বলে সেটাই ভুলে গেছি।বুঝতে পারছিস কি অবস্থা?”

অহি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না।হো হো করে হেসে দিল।রোদেলা চোখ পাকিয়ে অহির দিকে তাকালো।অহি হাসতে হাসতেই বলল,

—“স্যরি আপু।তোমার ওই অবস্থা ইমাজিন করে আমান বড্ড হাসি পাচ্ছে।”

—“তুই তাহলে হাসতে থাক।ততক্ষণে আমি রেডি হয়ে কলেজে যাই।”

রোদেলা উঠে দাঁড়ালো।আজ যে হলিডে তা রোদেলা আপুর এখনো খেয়ালে আসেনি সেটা অহি বেশ বুঝতে পারছে।এর আগে এক শুক্রবারে রোদেলা আপুর নাকি কলেজের গেটে তালা দেখে মনে পড়েছে আজ শুক্রবার।আজও যে শুক্রবার সেটা মনে নেই!

দশ মিনিটের মাথায় রোদেলা রেডি হয়ে নিচে নামলো।তার পরণে সাদা-কালোর কম্বিনেশনের থি পিস।মাথার চুলগুলো পেছনে উঁচু করে ক্লিপ দিয়ে আটকানো।সামনে ছোট করে কাটা চুলগুলো ঘাড়ের কাছে ঝুলে আছে।

—“তোরা কোথাও যাবি একত্রে?”

অহি আর রোদ্দুর দুজন দু সোফায় বসে ছিল।দুজনে মুখ তুলে রোদেলার দিকে তাকালো।রোদেলা আবার বলল,

—“দুজন নতুন পোশাক পরে ফিটফাট হয়ে বসে আছিস
ব্যাপার কি?কাজী অফিসে যাওয়ার ধান্দা নাকি?”

রোদ্দুর গম্ভীর হয়ে ফোন চালানোয় মনোযোগ দিল।যেন রোদ আপুর কথা সে শুনতেই পায়নি।তার আর অহির ব্যাপারটা রোদ আপু জানার পর থেকেই রোদ্দুর লজ্জা পায়!

অহি দ্রুত উঠে দাঁড়িয়ে রোদেলার হাত টেনে বলল,

—“আপু,আজ হলিডে।তোমার কলেজ বন্ধ।মাথাতে নেই?”

রোদেলা মনে মনে নিজেকে বকা দিল।একি মন হয়েছে তার?কিছুই মনে থাকে না।এখন নিশ্চিত সবাই তাকে নিয়ে মজা নেবে।

অহি মুচকি হেসে রোদেলার কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে বলল,

—“কি আপু?কলেজে কি এমন আছে যে শুক্রবারও মাথায় নেই?যাওয়ার জন্য একদম রেডি?”

—“অহি!মার খাবি কিন্তু! ”

রোদেলা লজ্জা মিশ্রিত মুখে নিচের দিকে তাকালো।ঘুরে উপরের দিকে যেতে নিতে অহি আবার টেনে ধরলো।বলল,

—“আপু,আমরা এখন ঘুরতে যাব এবং তুমিও সাথে যাবে।রেডি তো হয়েই আছো।চলো!”

রোদেলা এতক্ষণে যেন বুঝতে পারলো।অহির দিকে চেয়ে চোখ পাকিয়ে বলল,

—“তার মানে আমাকে রেডি করার জন্যই তুই সকালবেলা বললি না যে আজ শুক্রবার, তাই তো?তুই তো ভারী দুষ্ট হয়ে গেছিস রে পাখি!”

রোদ্দুর ফোনটা নিজের প্যান্টের পকেটে রেখে উঠে দাঁড়ালো।সে আজ কালো চেক শার্ট পড়েছে।হাতা ফোল্ড করে বলল,

—“রোদ আপু!হাতিরঝিল যাব।হাঁটা ধরো।”

—“সেকি!তুইও যাবি?”

—“ইয়ে মানে,হ্যাঁ আপু।তোমরা দুজন মেয়ে মানুষ।একা ছাড়া যাবে না।সেজন্য আমি যাচ্ছি।”

রোদেলা অহির গাল টেনে রোদ্দুরের দিকে তাকালো।হাসিমুখে বলল,

—“ব্যস!এই একটা কারণ?ভালো তো।চল!”

অহি বলল,

—“কারো খাওয়া হয়নি তো।খালামণি বকা দিবে।নাস্তা করে রওনা দিই।”

——————–

ওরা গাড়ি নিয়ে বের হয়নি।দুটো রিকশা করে হাতিরঝিল রওনা দিয়েছে।আগের রিকশায় অহি আর রোদেলা।তার পিছন পিছন রোদ্দুর একা অন্য রিকশায় এসেছে।

দুপুর হয়ে গেছে প্রায়।খাঁ,খাঁ রোদ থাকার কথা।কিন্তু আজ রোদ নেই।আকাশ অনেকটা মেঘলা।তবে বৃষ্টি আসার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।

রোদেলা এগিয়ে গিয়ে ব্রিজটাতে দাঁড়াল।ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে।তাতে ওড়নার আঁচল উড়ছে।সাথে চুল।রোদেলা চুলগুলো কানের পাশে গুঁজে দিয়ে জলের দিকে তাকালো।ব্রিজের নিচের জল কালো।তবে দূর্গন্ধ নেই।

অহি, রোদ্দুর এসে রোদেলার পাশে দাঁড়াল।অহির ফোন হাতে কি যেন করছে।হঠাৎ ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বলল,

—“আপু,ওদিকে চলো তো।বসার মতো জায়গা গুলো আছে না!ওখানে বসবো।”

অহিকে অনুসরণ করে পেছন পেছন দুজন হেঁটে গেল।অহি এগিয়ে গিয়ে বসলো।রোদেলা তার পাশে বসে রোদ্দুরকে বলল,

—“হাতিরঝিলে আজ দিয়ে কতবার আসলি?হাজার বার!নোংরা, দূর্গন্ধযুক্ত কালো পানি ছাড়া দেখার মতো কিছুই নেই।”

রোদ্দুর বলল,

—“আমি কি আসতে চেয়েছি নাকি আপু?অজান্তা জোর করলো!”

অহি রোদ্দুরের কথা কানে না নিয়ে রোদেলার এক হাত চেপে উত্তরের দিকে তাকালো।আঙুল উঁচিয়ে বলল,

—“আপু,ওই দেখো!কি কিউট একটা বাচ্চা মেয়ে।”

অহি জানে তার রোদ আপু বাচ্চাদের জন্য পাগল।যতবার আপুর সাথে বাইরে বের হয়েছে ততবার বাচ্চা দেখলেই হুশ থাকতো না রোদ আপুর।কোলে নিতো।পারমিশন নিয়ে ছবিও তুলতো।

রোদেলার বাচ্চা মেয়েটার দিকে চোখ পড়তেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো।উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,

—“অহি,ও তো ছিনজা!ওকে তো আমি চিনি!”

অহি,রোদ্দুর দুজনে চমকে উঠলো।ততক্ষণে রোদেলা মেয়েটার কাছে গেছে।মেয়েটা ইট, সিমেন্টের তৈরি বসার জায়গা বসে আছে।হাতে একটা চিপসের প্যাকেট।রোদেলা হাত বাড়িয়ে কোলে নিয়ে বলল,

—“ছিনজা বাবু কেমন আছে?”

বাচ্চা মেয়েটা খিলখিল করে হাসছে রোদেলাকে দেখে।ছোট ছোট হাতে রোদেলার গলা জড়িয়ে বলল,

—“আন্টি,আমি ভালো।তুমি কেমন আছো?”

রোদেলা ছিনজার নাক টেনে বলল,

—“এতক্ষণ ভালো ছিলাম না।কিন্তু ছিনজা বাবুকে দেখে ভালো হয়ে গেছি।কিন্তু তুমি একা কেন?দাদু কোথায়?”

—“আজ তো দাদু আসেনি।দাদু বাসায়।আমি আজ পাপার সাথে এসেছি।”

—“তা পাপা কোথায় ছিনজা?”

ছিনজা পেছনে হাত বাড়িয়ে বলল,

—“তোমার পেছনে আন্টি।”

রোদেলা মাথা ঘুরিয়ে যাকে দেখলো সঙ্গে সঙ্গে তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল যেন।মুখের হাসি উধাও হয়ে গেল নিমেষে।

সে তোতলানো স্বরে বলল,

—“সাদিদ স্যার,আপনি?আসসালামু আলাইকুম।”

সাদিদ ভ্রু কুঁচকে রোদেলার দিকে চেয়ে আছে।যেন হিসেব মেলাচ্ছে।সে এগিয়ে এসে ছিনজার হাত ধরে বলল,

—“মিস রোদেলা জান্নাত।আপনি কি আমার মেয়েকে আগে থেকেই চিনতেন?”

রোদেলা ছিনজাকে কোল থেকে নামিয়ে দিল।আশপাশে মাথা ঘুরিয়ে অহি আর রোদ্দুরকে খুঁজলো।এরা দুটো আবার কোথায় গেল?তাকে এমন বিপদের মাঝে ফেলে?ছিনজা তাহলে সাদিদ স্যারের মেয়ে?

রোদেলা ধপ করে বসার জায়গাটে বসে পড়লো।সে যতই চাচ্ছে সাদিদ নামক মানুষটার থেকে দূরে থাকতে,ততই পরিস্থিতি ঠেলে তাকে সামনে এনে দিচ্ছে।আজ হলিডের দিনেও এমন দেখা হওয়ার কি খুব দরকার ছিল?

সাদিদ ছিনজাকে মাঝে রেখে রোদেলার পাশে বসে পড়লো।রোদেলার দিকে চেয়ে বলল,

—“মিস রোদেলা, আমি কিছু জিগ্যেস করেছি।”

—“আসলে,আ-আমার ছিনজার সাথে পরিচয়ের বেশিদিন হয়নি।এক মাসের মতো হবে হয়তো।সেদিন বাচ্চাদের পার্কের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম।ছিনজা োর দাদুর সাথে খেলেছিল।আমার আবার বাচ্চা খুবই পছন্দ।ছিনজাকে দেখে ভালো লাগল,সেজন্য এগিয়ে গিয়ে ওকে কোলে নিলাম,কথা বললাম।চকলেটও দিলাম।আপনার বাবার সাথে গল্প টল্প করে চলে আসলাম।মাঝে আর দেখা হয়নি।আজ দেখা হলো!আপনার বাবা কেমন আছে স্যার?উনি অনেক ভালো মানুষ।”

—“বাবা,ভালো।”

কেউ আর কোনো উত্তর কথা বললো না।হঠাৎ করেই রোদেলার দু চো বিস্ফারিত হয়ে গেল।সেদিন তো সাদিদ স্যারের বাবা বলেছিল যে ছিনজার মা নেই।ছিনজার জন্মের সময়ই ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে মারা গেছে।তার মানে সাদিদ স্যার এখন একা ছিনজাকে বড় করছে?

রোদেলার মাথা ঘুরছে।সে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

—“স্যার,আমি আসছি।”

সামনের এগুনোর আগেই ছিনজা চিপস খাওয়া বাদ রেখে বলল,

—“আন্টি তুমি যাবে না।আজ সারাদিন আমার সাথে থাকবে।”

রোদেলা একি মুসিবতে পড়লো!সে ছিনজার দিকে চেয়ে বলল,

—“এমন করে না ছিনজা বাবু।সবাই পঁচা বলবে তো।তুমি না গুড গার্ল?আমি অন্য দিন সারাদিন তোমার সাথে কাটাব।আজ যাই?”

ছিনজা তার ওড়নার এক কোণা চেপে ধরে নাকি সুরে বলল,

—“আমি কিন্তু কেঁদে দিবো।আন্টি,তুমি আজ আমার সাথে ঘুরবে।”

সাদিদ মেয়ের মাথার চুল গুলো এলোমেলো করে মুচকি হাসলো। রোদেলার দিকে চেয়ে বলল,

—“থেকে যান মিস রোদেলা।আজ আমরা তিনজন ভালো কোনো রেস্টুরেন্টে লাঞ্চ করবো একত্রে।”

রোদেলা অসহায় দৃষ্টি নিয়ে বসে পড়লো ছিনজার পাশে।

———————

—“রোদ্দুর ভাই, ফেরীতে উঠবো।”

—“কেন?”

—“আজব?ফেরীতে মানুষ কেন উঠে?পানি দেখব।”

রোদ্দুর কপাল কুঁচকে অহির দিকে তাকালো।এই মেয়েকে সাথে নিয়ে একা কোথাও যাওয়া যাবে না।তাকে পাগল করে দেবে।সে শক্ত কন্ঠে বলল,

—“পানি জীবনে দেখিসনি অজান্তা?পানি দেখার কি আছে?”

—“দেখেছি।কিন্তু এমন কালো কুচকুচে, দূর্গন্ধযুক্ত পানি দেখিনি।আজ সেটা দেখবো।”

—“তো এখান থেকেই দেখ না।ফেরীতে উঠতে হবে কেন?”

—“আমি সাঁতার জানি না বলে এতদিন উঠিনি।কিন্তু আজ উঠবো।আজ আপনি পাশে থাকবেন যে!”

রোদ্দুর হাঁটতে হাঁটতে বলল,

—“অজান্তা!আমিও সাঁতার জানি না।আয় উঠতে হবে না।রোদ আপুকে খুঁজতে হবে।তুই আমার বোনটাকে কার সাথে না কার সাথে পাঠালি কে জানে!আমার বোনের কিছু হলে তোকে কিন্তু কামড়ে খেয়ে ফেলবো অজান্তা!”

—“কাকে কামড়াবেন?”

বয়স্ক পুরুয়ালী কন্ঠ শুনে ঘাড় ঘুড়িয়ে রোদ্দুর তাকিয়ে দেখে অহি পেছনে নেই।এক বাদামওয়ালা তার কামড়ানো প্রসঙ্গে খুব কৌতূহল দেখাচ্ছে।

মানুষটার সামনের দুটো দাঁত পড়ে গেছে।কিন্তু দেখে মনে হচ্ছে তার দাঁত পড়ার বয়স এখনো হয়নি।সে ফাঁকা দাঁতের পাটি বের করে আবার বলল,

—“কাকে কামড়াবেন ভাইসাহেব?আশপাশে তো কাউকে দেখি না।”

—“আপনাকে কামড়াব।খুশি?”

—“এইডা কি কন ভাই সাহেব? তার চেয়ে বরং আমি বিশ ট্যাকার বাদাম দেই।হেই বাদাম কামড়ান।”

রোদ্দুর কিছু বলল না।সে চেয়ে আছে কাউন্টারের দিকে।অহি ফেরীতে উঠার জন্য টিকেট কাটছে।রোদ্দুরের মাথায় রক্ত উঠে গেল।মেয়ে এত পেকে গেছে?

অহি টিকেট দুটো হাতে হাস্যোজ্জ্বল মুখে এগিয়ে আসছে।তার গায়ে নীল রঙের পর্যন্ত গাউন।মাথায় নীল হিজাব পেঁচানো।গায়ের ফিনফিনে নীল ওড়নার দুপাশ বাতাসে পাল তোলা নৌকার মতো উড়ছে।টানা টানা চোখ দুটো অনবরত হেসে যাচ্ছে।দূর থেকেই ঠোঁটের উপর বাদামি তিলটা উঁকি দিচ্ছে।রোদ্দুরের চোয়াল শিথিল হয়ে আসলো।বুকে তীব্র ব্যথা শুরু হলো।ভালোবাসার ব্যথা!এই মেয়েকে সে কিভাবে আঘাত করবে?প্রতিনিয়ত সে নিজেই তো ‘অজান্তা’ নামক রমণীতে খুন হচ্ছে!

অহি এগিয়ে এসে রোদ্দুরের হাত চেপে বলল,

—“রোদ্দুর ভাই, টিকেট কিনেছি।”

(চলবে

পরিশিষ্ট পর্ব-১১

0

#গল্পের_নাম: পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_১১

রোদ্দুর আমতা আমতা করে বলল,

—“তাই তো!আগে তো ভেবে দেখিনি।ও হ্যাঁ!আপু, ও আসলে ভূত দেখে ভয় পেয়েছে।তাই না রে অজান্তা?”

অজান্তা এতক্ষণে চোখ তুলে তাকালো।রোদ্দুরের দিকে এক নজর চাইলো।রোদ্দুরের চোখে মুখে অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে।চোখ দিয়ে যেন বার বার বলছে,

—“প্লিজ,এ যাত্রায় বাঁচিয়ে দে।”

অহি মাথা নিচু করে গাল মুছলো।তারপর স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

—“রোদ্দুর ভাইয়ের রুম অন্ধকার ছিল।ছায়ার মতো কিছু একটা দেখেছি।”

তারপর রক্ত চক্ষু নিয়ে রোদ্দুরের দিকে তাকালো।সবার চোখ মুখ দেখে মনে হচ্ছে কথাটা তাদের বিশ্বাস করতে বেগ পেতে হচ্ছে।ফজিলা খালা বলেই ফেলল,

—“মা অহি!পুরুষ ভূত নাকি মাইয়া ভূত ছেল?”

অহি জবাব দেয়ার আগে কুটি বলল,

—“ও খালা!পুরুষ ভূত।বিড়িদ্ধ ভূত।কুঁজা হইয়া পা ফালায়!”

সবাই আগ্রহ নিয়ে কুটির দিকে তাকালো।ফজিলা সন্দেহ নিয়ে বলল,

—“তুই কেমতে জানলি রে কুটি?”

কুটি হাত নেড়ে নেড়ে বলল,

—“আমি জানুম না?আমি হইলাম গিয়া গন্ধ শুইকা বইলা দিতে পারি কোন বাড়িত ভূত আছে! এ বাড়ির আসার পর থেইকা আমারে ঘুমের মধ্যে বুইড়া একটা ভূত ডিরিস্টার্ব করতো।পরে একদিন স্যান্ডেলের ফটাফট শব্দে বাইর হইয়া দেহি এক কুঁজো ভূত।পরিচয় জিগাইতেই কইল,উনি নাকি হিম দাদার পূর্বপুরুষ।উনার নাম হইলো গিয়ে ছক্কেল পরামাণিক।উ…..”

রোদ্দুর এক ধমক দিয়ে কুটিকে থামিয়ে দিল।কুটি মেয়েটা মুহূর্তে নতুন গল্প ফেঁদে বসে।তার গল্প বানানোর প্রতিভা অসাধারণ।

এতক্ষণে মুজিবুর রহমান মুখ খুললেন।চোখের চশমাটা টেনে নাকের ডগায় এনে তার উপর দিয়ে কুটির দিকে তাকালেন।তারপর বেশ গম্ভীর কন্ঠে বললেন,

—“মা,কুটিরন।আমার পূর্বপুরুষের চার ঘর পর্যন্ত সবার নাম জানি আমি।তাহাদের মধ্যে ছক্কা না কি যেন নাম বললে?ছক্কা ফক্কা কেউ ছিল না।”

কুটি হাত কচলাতে কচলাতে বলল,

—“আমি কেমনে কমু বড় বাজান।বুইড়া ভূতও যে মিছা কথা কইবে তা তো ধারণার মধ্যি ছিল না।কি যুগ আইলো গো!ভূতরাও মিছা কথা কয়।”

ফজিলা ফের কিছু একটা বলতে নিতে রোদ্দুর থামিয়ে দেয়। তারপর শাহিনুরকে বলে,

—“আর একটা কথাও না।মা,টেবিলে খাবার রেডি করো।অপূর্ব আয় তো!আমার পাশে বসবি তুই আজ।”

——————

অহি রোদেলার রুম চিন্তিত মুখে বসে আছে।রোদেলা রুমে নেই।কিচেনে কফি করতে গেছে।রাতের বেলা ঘুমানোর আগে চা,কফি কিছু একটা পান করে ঘুমানো তার অভ্যাস হয়ে গেছে যে তা অহির অজানা নয়।তবে অহি রোদ্দুর হিম নামক মানুষটাকে কেন জানি ভয় পাচ্ছে।এরকম সাংঘাতিক মানুষের সাথে একই ছাদের তলায় থাকাটাও বিপদজনক মনে হচ্ছে।

রুমের দরজায় কারো ছায়া পড়লো।অহি চমকে বলল,

—“কে?রোদ আপু?”

কেউ উত্তর দিল না।তবে মিনিট দুয়েক পর রোদ্দুর ভেতরে এক পা রেখে বলল,

—“অজান্তা!কি করিস?”

অহি ভয়ে কুঁকড়ে গেল।কোনো উত্তর দিল না।রোদ্দুর দু পা ভেতরে রেখে বলল,

—“তুই অনেক ভয় পেয়ে গেছিলি না রে?”

তারপর নিজের মাথা চুলকে বলল,

—“আসলে ব্যাপার হলো কি…….রোদ আপু তোকে ছাদে ডাকে।কফি টফি কিছু একটা নিয়ে উপরে উঠতে দেখলাম।”

বলেই রোদ্দুর চোখের পলকে উধাও হয়ে গেল।অহি একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিজের ফোনের দিকে তাকালো।রাত সাড়ে এগারোটার কাছাকাছি।

গায়ের ওড়নাটা চাদরের মতো করে জড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো সে।মাথার চুলগুলো পেছনে নিয়ে খোপা করে বড় ক্লিপ লাগালো।তারপর ফোনটা নিয়ে রুম থেকে বের হলো।ছাদে উঠার সিঁড়ি রোদ্দুর ভাইয়ের রুমের পাশ দিয়ে।অহি দরজার সামনে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়ালো।দরজা ভেতর থেকে আটকানো।

তারপর বড় বড় পা ফেলে ছাদে উঠে গেল।

ছাদে জনমানবের চিহ্ন নেই।অহি তবুও চারিদিকে নজর বুলালো।ছাদে লাইট জ্বালানো নেই।অাজ আকাশে মস্ত বড়ো চাঁদও নেই।তবুও চারপাশ একদম পরিষ্কার।চাদে সে বাদে দ্বিতীয় কেউ নেই।তাহলে কি রোদ্দুর ভাই মিথ্যা বলল?

অহি এগিয়ে গিয়ে দক্ষিণের রেলিং ধরে দাঁড়াল।রোদ্দুর ভাইদের দু তলা বাসা।আশপাশে কাছাকাছি আর কোনো বাড়ি নেই।সামান্য একটু দূরে একটা ছিমছাম বিল্ডিং চোখে পড়ে।বিল্ডিংয়ের তিন তলায় আলো জ্বলছে।

—“দড়ি কেনার টাকা আছে তো অজান্তা?”

আচমকা কন্ঠ শুনে চমকে গেল অহি।পেছন ঘুরে দেখে রোদ্দুর দাঁড়িয়ে আছে।সে বুকে এক দলা থুথু দিয়ে বলল,

—“এভাবে কেউ ভয় পাইয়ে দেয়?”

রোদ্দুর বিড়বিড় করে বলল,

—“তুই যে ভূতের মতো যেখানে সেখানে উদয় হোস তা৷ বেলা?”

সে এগিয়ে এসে অহির থেকে কয়েক হাত দূরত্ব বজায় রেখে রেলিং এ হাত রেখে দাঁড়ায়।সামনের দিকে তাকিয়ে বলে,

—“তুই বল,দড়ি কেনার টাকা আছে তো?”

অহি কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন করে,

—“কিসের দড়ি?দড়ি কিনবো কেন?”

—“তুই তো সেকেন্ডে সেকেন্ডে ভালোই ভং ধরতে পারিস!তোকে নিয়ে সংসার করতে গেলে তো মুসিবতে পড়তে হবে রে।”

—“কি সব বলছেন রোদ্দুর ভাই?”

—“রোদ্দুর ভাই, তুই যদি এবার আমাকে রেখে অন্য কাউকে বিয়ে করিস তাহলে তোকে একদম খুন করে ফেলবো।তারপর নিজের গলায় দড়ি দিবো।তাই বললাম!দড়ি টড়ি কিনে রাখিস আগে থেকেই।আমি কিছুদিন পর অন্য একজনকে বিয়ে করছি।”

এটুকু বলেই রোদ্দুর হাই তুলল।অহির কাঁপা-কাঁপি অবস্থা।রোদ্দুর ভাই এসব জানলো কি করে?মেসেজ তো সিন করেনি তাহলে?কোনোভাবে কি তাহলে তার ফোন থেকেই দেখেছে?দেখেও এত নির্লিপ্ত কেন?এতক্ষণে তো কানের নিচে দুটো দেয়ার কথা!

তার মানে আননোন নাম্বার থেকে যে ম্যাসেজ গুলো পাঠানো হয়েছিল সেগুলো রোদ্দুর ভাইয়ের নাম্বার?অহি আর চিন্তা করতে পারছে না।ধপ করে নিচে বসে পড়লো।

রোদ্দুর দু পা এগিয়ে এসে স্বাভাবিক ভাবে বলল,

—“তাহলে দড়ি কিনে রাখিস।টাকা না থাকলে আমার থেকে নিস।পরে শোধ করে দিবি!যা!ভুলেই গেছিলাম।তুই উপরে চলে গেলে টাকা শোধ করবে কে?আচ্ছা, যা।আমি দড়ি কেনার টাকাটা ফিতরা হিসেবে দিব।”

অহি অনেক কষ্টেও চোখের জল আটকাতে পারলো না।তার ফিলিংসকেও এভাবে হাসির খোরাক বানাচ্ছে রোদ্দুর ভাই?

সে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

—“আপনি এত নিষ্ঠুর কেন রোদ্দুর ভাই?”

রোদ্দুর অহির থেকে কিছুটা দূরে নিজেও পা ভাঁজ করে বসে পড়লো।তারপর কাঠ কাঠ গলায় বললো,

—“তুই আমাকে ভালোবেসে কি করেছিস রে অজান্তা?কিচ্ছু করিস নি।উল্টো এমন ভাব নিয়ে চলতি,যেন আমি তোর রক্তের ভাই।তিন লাইনের একটা বাক্যে তিন বার করে রোদ্দুর ভাই, রোদ্দুর ভাই করতি!আমার বাপেরও তো ক্ষমতা নেই তোর ফিলিংস বোঝার।শোন অজান্তা!পৃথিবীতে কেউ তোর নিরবতা বা নিঃশব্দতার পেছনের গল্প খুঁজতে যাবে না।তোর সাইলেন্সের আড়ালে লুকানো শব্দভান্ডার বোঝার ক্ষমতা কারো নেই।তাই কাউকে কিছু বলতে চাইলে মুখ ফুটে বলতে হয়।না হলে ওই মানুষটার আড়ালেই সব থেকে যায় সারাজীবন।”

—“এখন তো জানেন।”

—“কি জানি?”

—“ওটা!”

—“কোনটা?মুখে বল!হাতে সময় নেই কিন্তু।”

অহি শেষ মেষ বলেই ফেলল,

—“আমি আপনাকে ভালোবাসি রোদ্দুর ভাই।”

রোদ্দুর সঙ্গে সঙ্গে অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে তাকাল।অহির এই একটা বাক্য তাকে হাওয়ায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল।তার হাত পা কাঁপছে।হৃদপিণ্ডের ধুকপুক শব্দ যেন বেড়ে চলেছে।নাহ!আজ হয়তো অজান্তার হাতে ধরা পড়েই যাবে।মনের ভেতর অন্য ধরনের ভালো লাগা কাজ করছে।চোখের সামনে যেন হাজারো রঙের প্রজাপতি ডানা মেলে উড়ছে।সে চোখ বন্ধ করলো।

অহির বুকের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে গেল।রোদ্দুর ভাই তাহলে তাকে রিজেক্ট করবে।তাই তো?এই ভয়টাই তো এতদিন পেত সে।তার কান্নার বেগ বেড়ে গেল।

কান্নার শব্দে রোদ্দুর পেছন ঘুরে তাকাল।স্বাভাবিক গলায় বললো,

—“তোকে একটা রূপকথার গল্প শোনাই অজান্তা।কান্না থামিয়ে শোন।এক দেশে ছিল এক রাজকুমার। রাজকুমার ছোটবেলা থেকেই একটু রাগী ছিল।হুটহাট রেগে যেত।সেজন্য তার তেমন বন্ধু মানুষও ছিল না।বড় হওয়ার পর সেই দেশের এক দাসী মেয়ে রাজকুমারকে প্রেমের প্রস্তাব পাঠায়।রাজকুমার বহু মানুষের সামনে মেয়েটাকে কিছু কটু কথা বলে রিজেক্ট করে।দাসী মেয়েটা পণ করে।যে করেই হোক,রাজকুমারকে কষ্ট দিতে হবে।তখন সে নানা উপায়ে রাজকুমারকে ইমপ্রেস করার চেষ্টা করে।একটা সময় রাজকুমার দাসী মেয়েটার মায়ায় জড়িয়ে তাকে বিয়ে করতে চায়।কিন্তু বিয়ের দিন দাসী মেয়েটা ছল চাতুরী করে পালিয়ে যায়।রাজকুমারের হৃদয় ভেঙে চুরমার হয়ে যায়।

তখন অন্দরমহলের এক রাজকুমারী এসে রাজকুমারের পাশে দাঁড়ায়।তার ক্ষত মোছার চেষ্টা করে।কিন্তু রাজকুমার এত অন্ধ ছিল যে রাজকুমারীর চোখের ভাষা বুঝতে পারেনি।এর বেশ কিছুদিন পর রাজকুমার একদিন হঠাৎ রাজকুমারীকে শাড়ি পরিহিত অবস্থায় দেখে বেঁহুশ হয়ে যায়।তার চোখ আটকে যায় রাজকুমারীতে।সর্বপ্রথম রাজকুমারীকে দেখে তার অন্য ধরনের ফিলিংস হয়।একদম অন্য ধরনের ফিলিংস যার সাথে সে অপরিচিত।এমনকি দাসী মেয়েটার জন্যও তার সেসব অনুভূতি হতো না।

তারপর থেকে রাজকুমার কেমন পাগল পাগল হয়ে যায়।যেই মানুষটাকে সবাই ভয় পেত,সেই কি না এক রমণীকে যমের মতো ভয় পাওয়া শুরু করলো।রমণীটা তার শয়নে, স্বপনে এসে হানা দিতো।চোখ খুললেও তাকে দেখে,বন্ধ করলেও তাকে দেখে।কি এক্টা অবস্থা।ক্রমেই রাজকুমারের ছটফটানি ভাব বেড়ে গেল।একটা সময় সে বুঝতে পারলো রাজকুমারীকে সে ভালোবেসে ফেলেছে।তারপর সে লুকিয়ে রাজকুমারীর ঘুমের সময় তাকে দেখে আসতো।একদিন হঠাৎ রাজকুমারীর ফোন হাতে নিয়ে ঘেঁটে জানতে পারে রাজকুমারীও তার জন্য পাগলপ্রায়।তাকে ভালোবাসে।

ব্যস!রাজকুমারের খুশি আর ধরে কে।সেদিন বাসায় ফিরেই সারারাত রোমান্টিক গান গেয়ে গেয়ে নেচে গেল সে।বুকের ভেতর সে কি ভালোলাগা।নতুন স্বপ্ন, নতুন সংসার।সবকিছু রাজকুমারীকে ঘিরে।কিন্তু একটা সমস্যা হলো রাজকুমার সারা দুনিয়ার সামনে একরকম,আর তার ভালোবাসার কাছে অন্য রকম।সে পৃথিবীতে রাজকুমারীকে ভীষণ ভয় পায়।তাকে ছুঁয়ে দিতে ভয়,জড়িয়ে ধরতে ভয়,হাতে হাত রাখতে ভয়!সবকিছুতে শুধু ভয় আর ভয়।”

রোদ্দুর মুখ ঘুরিয়ে আবার অন্য দিকে তাকালো।অহির কান্না অনেক আগেই থেমে গেছে।সে কেমন ঘোরের মধ্যে চলে গেছে যেন।নিজের কানকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে।রোদ্দুর ভাইও তাকে ভালোবাসে?

রোদ্দুর ভাইয়ের তাকে ছুঁতে ভয় থাকলেও তার তো নেই।সে এক লাফে উঠে রোদ্দুরের সামনে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল।

রোদ্দুর চোখ বন্ধ করলো।তার হা পা মেয়েদের মতো কাঁপছে।এর আগেও একবার না দুবার অহিকে জড়িয়ে ধরেছে সে।কিন্তু এমন অদ্ভুত অনুভূতি হয়নি।

অনেক্ষণ পর অহি রোদ্দুরের বুকে মাথা রেখেই অবাক হয়ে বলল,

—“আপনার হার্টবিট এত বেড়ে গেছে কেন রোদ্দুর ভাই?কেমন ধাড়াম ধাড়াম শব্দ হচ্ছে।আমার মাথাও যেন ঠেলে সরিয়ে দিতে চাইছে।”

রোদ্দুর এক ঝটকায় অহিকে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো।তার গাল, কান আবার লাল হয়ে গেছে।অহি দেখতে পেলে নিশ্চিত ক্ষেপাবে।সে পা বাড়িয়ে বলল,

—“এক চড় খাবি উল্টাপাল্টা কথা বলা।চল,নিচে যাই।”

অহি পেছনে থেকে রোদ্দুরের ডান হাত টেনে ধরে বলল,

—“এত তাড়াতাড়ি যাবেন রোদ্দুর ভাই?কত প্রতীক্ষার পর আপনাকে পেলাম।”

—“তো? আর কি করতে চাস?জড়িয়ে ধরলি নির্লজ্জের মতো তাতে হলো না?”

অহি মুখ টিপে হাসছে।সে বেশ বুঝতে পারছে দাবার চাল উল্টে গেছে।এতদিন সে রোদ্দুরকে ভয় পেত,এখন রোদ্দুর তাকে ভয় পায়।তার কাছে যাওয়াতে ভয় পায়।

অতি রোদ্দুরের হাত ধরেই তার সামনে গেল।পায়ের উপর ভর দিয়ে উঁচু হয়ে বলল,

—“চুমু খাব।”

রোদ্দুর ছিটকে পেছনে সরে বলল,

—“ও মাই গড।কি সাংঘাতিক।তু-তুই নিচে যা তো অজান্তা।”

—“যাব না।চুমু দিবেন, তারপর যাব।”

রোদ্দুর আরো দু পা পিছিয়ে গিয়ে ফ্লোরে বসে পড়লো।কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,

—“তুই আমায় নির্ঘাত হার্ট অ্যাটাক ঘটিয়ে মেরে ফেলবি অজান্তা।আই হেইট ইউ।”

অহি এগিয়ে গিয়ে মুখটা নিচু করে রোদ্দুরের বাম গালে একটু চুমু দিয়ে দৌঁড়ে নিচে নেমে গেল।

রোদ্দুর গালে হাত রেখে ছাদে শুয়ে পড়লো।এই মেয়েটা নিশ্চিত তার পৃথিবী উলোটপালোট করে দিবে।

(চলবে)

পরিশিষ্ট পর্ব-১০

0

#গল্পের_নাম: পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_১০ (বোনাস পার্ট)

রোদ্দুর ভাই পাঠায়নি তো?অহির হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে চিন্তায়।হঠাৎ ফোন হাতে নিয়ে নিজের ম্যাসেন্জারে ঢুকলো।উদ্দেশ্য রোদ্দুর ভাইকে পাঠানো মেসেজ চেক সিন করেছে কি না দেখা।

ম্যাসেন্জারে ঢুকে অহির মাথায় চিন্তার ছোট খাটো একটা পাহাড় জমে গেল।কারণ রোদ্দুর ভাই মেসেজ এখনো সিন করেনি!তাহলে এটা কার কাজ?

এই মেসেজ যে সে রোদ্দুর ভাইকে পাঠিয়েছে সেটা তো সে ছাড়া আর দ্বিতীয় কেউ জানে না!এমনকি রোদেলা আপুও না!

এই রহস্যের সমাধান করার জন্য রোদ্দুর ভাইকে লাগবে।অহি আবারো রোদ্দুর ভাইদের বাসায় যাওয়ার জন্য ব্যাগ গুছানো শুরু করলো।আজ দুটো বইও সঙ্গে নিল।কিছুদিন পর সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা!সে মনে মনে ঠিক করে রাখলো রোদ্দুর ভাই যেমন ব্যবহারই করুক না কেন,কিছুদিন সে থাকবেই!

রোদ্দুর ভাই সেই যে তার জন্মদিনের পরের দিন ভোরে চলে গেছে আর তার সাথে দেখা হয়নি।আজ এগারো দিন হতে চলল তার!

——————–

রোদ্দুর ভাইদের বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে সন্ধ্যা হয়ে গেল অহির।আজ সে একা নয়।সাথে অপূর্ব এসেছে।সদর দরজার সামনে দাঁড়াতেই অপূর্ব হাত উঁচিয়ে বলল,

—“বুবু,দেখো!খালুজি নিশ্চিন্ত ভবনের জায়গা কি লিখেছে!”

অহি তাকালো।দরজার একদম উপরে লেখা,” পাগল হইতে সাবধান”।তার নিচে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা,’এ বাড়ির একজন কিছুদিন হলো মেন্টালি সিক।তাহার হইতে সাবধান।’

অহি কলিং বেলে চাপ দিয়ে বলল,

—“অপূর্ব রে।খালু মেন্টালি সিক বলতে তাকে বুঝিয়েছে?খালামণিকে?”

—“আমার তো তাই মনে হয় বুবু।হয়তো খালামণির সাথে খালুর আবার ঝগড়া হয়েছে।সেজন্য ইচ্ছে করে এসব লাগিয়েছে।”

এটুকু বলেই অপূর্ব ফিক করে হেসে ফেলল।অহি কিছু বলার আগেই দরজা খুলে গেল।দরজা খুলেছে ফজিলা।

অহি সোফায় বসতেই তার খালামণি এসে দফায় দফায় কান্না করলো।প্রথম দফায় খালুর নামে হাজারো নালিশ।এটা নতুন কিছু নয়!আর দ্বিতীয় দফায় যেটা বলল সেটা শুনে অহি নিজেও চমকে উঠলো।

জন্মদিনের সময় অহিদের বাসা থেকে ফেরার পর থেকেই রোদ্দুর ভাই নাকি কেমন জানি আচরণ করছে।মাঝে মাঝে একা বিড়বিড় করে।হুট করে আনমনা হয়ে যায়।কখনো আবার গুনগুন করে গান গায়।

অপূর্ব ফিক করে আবারো হেসে দিল।শাহিনুর রাগী চোখে তাকাতেই সে আমতা আমতা করে বলল,

—“খালামণি,রোদ্দুর ভাই কি গান গায়?”

শাহিনুর বুঝদারের মতো বলল,

—“আমি কি অত বুঝি নাকি?তবে কুটি বলেছে রোমান্টিক গান গায়।কিন্তু ও তো আগে কোনোদিন গান গাইতো না!সত্যি সত্যি হয়তো জ্বীনে ভর করেছে।কিন্তু আমি পীর সাহেবের কাছে নিয়ে যেতে চাচ্ছি ও রাজি হচ্ছে না।”

—“বাহ!রোদ্দুর ভাইয়ের থেকে আজ রাতেই গান শুনবো।কি বলো বুবু?”

অহি চোখ পাকিয়ে অপূর্বকে উপরে পাঠিয়ে দিল।শাহিনুর আবার বলল,

—“ছেলেটার যে হঠাৎ করে কি হলো রে অহি?আমার সোনার টুকরো ছেলে!”

শাহিনুর আঁচল চেপে আবার কান্না শুরু করলো।অহি তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,

—“খালামনি,তুমি কান্না করবে না একদম।আমরা সবাই এসেছি।দেখি ব্যাপারটা কি!রোদ্দুর ভাই কি বাসায়? ”

—“না!অফিস থেকে ফিরেনি।তোর খালুও আসেনি।”

—“অফিস তাহলে ঠিক ঠাক করছে।এটা ভালো! ”

—“অহি রে।তোকে একটা কথা বলি।কাউকে বলবি না কিন্তু।আমি কাউকে না জানিয়ে গুলিস্তানের এক পীর সাহেবের কাছে গেছিলাম।উনি বলেছে একটা মাঝারি দেখে গরু জবাই করে ফকির খাওয়ালে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

—“সে কি!”

—“হ্যাঁ রে!কি করা যায় বল তো?পীর সাহেবের কথা বলে কথা!ফেলনা কিছু নয়।”

অহি খালার পিঠে হাত রেখে বলল,

—“খালামণি,তুমি একদম চিন্তা করবে না।রোদ্দুর ভাইয়ের সুস্থতা বলে কথা।এক গরু কেন,প্রয়োজনে দুই গুরু জবাই হবে।”

শাহিনুর সন্দেহের দৃষ্টিতে বলল,

—“তুই বলছিস?তোরা তো আবার দু পাতা ইংলিশ শিখে পীর টীর মানিস না!”

—“কে বলেছে মানি না!আলবাত মানি।হাজার বার মানি।তুমি বরং আমাকে একবার তোমার পীর সাহেবের কাছে নিয়ে যেয়ো।”

শাহিনুর খুশিতে ঝলমল করছে।অহিকে কিছুক্ষণ বুকে জড়িয়ে রান্নাঘরের দিকে রওনা দিল।আজ রাতের ডিনারে দেখা যাবে, খালা অহির স্পেশাল ডিশ রান্না করেছে।

অহি মুচকি হেসে উপরে চলে গেল।রোদেলা আপু নাকি ঘুমাচ্ছে।কলেজ থেকে মাথা ব্যথা নিয়ে আজ নাকি ফিরেছে।

——————

রোদ্দুর অফিস থেকে ফিরে সোজা নিজের রুমে ঢুকলো।আজ বড্ড ক্লান্ত।হাতের ফাইলটা টেবিলের উপর রাখলো।গলার টাই খুলে বিছানায় ঢিল দিতেই সেদিকে চোখ পড়লো।অহি গুটিশুটি হয়ে পা ঝুলিয়ে বসে আছে।

রোদ্দুর অবাক হলো না।শার্টের বাটন খুলতে খুলতে বলল,

—“এতক্ষণ অফিসে জ্বালাচ্ছিলি এখন সোজা বেডরুমে চলে এসেছিস?থাক!তোকে পড়োয়া করে কে!সেখানে খুশি সেখানে থাক।”

বলেই রোদ্দুর নিজের শার্ট খুলে অহির মুখে ছুঁড়ে মারলো।অহি ঘর্মাক্ত শার্টটা মুখের সামনে থেকে সরিয়ে নাক সিঁটকে বলল,

—“রোদ্দুর ভাই, আপনি তো দেখি সত্যি সত্যি পাগল হয়ে গেছেন?এমন আচরণ করছেন কেন?”

রোদ্দুরের অহির সম্পূর্ণ কথা কানে গেলো না।গায়ের স্যান্ডো গেঞ্জিটা একটানে খুলে অহির দিকে ছুঁড়ে মেরে বলল,

—“বাহ!তোর কত উন্নতি হয়েছে রে অজান্তা!এতদিন শুধু হুটহাট, যেখানে সেখানে তোর চেহারা ভেসে উঠতো।এখন তো দেখি মুখে বুলিও ফুটেছে।”

অহি রোদ্দুরের উদাম শরীর দেখে লজ্জায় মিইয়ে গেল।রোদ্দুর ভাই কি সত্যিই তাকে মেয়ে মনে করে না?এতটুকু লাজ লজ্জা নেই? অবাক হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

—“রোদ্দুর ভাই, আপনি আমার সামনে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছেন?”

—“তুই না আমার স্বপ্নে খালি গায়ে নাচানাচি করিস তার বেলা?এখন আমার খালি গা দেখে লজ্জা পাওয়ার ভান ধরছিস কেন?তুই তো নির্লজ্জ!”

অহি দু হাতে মুখ ঢেকে বলল,

—“ছি!”

রোদ্দুর নিজের প্যান্টের বেল্ট খুলতে খুলতে বলল,

—“ছি ছি করা?এখন আমি প্যান্টও খুলবো।দেখি তুই এরপরো কিভাবে আমার সামনে থাকিস!”

বলেই একটানে প্যান্টের জিপার খুলে ফেলল।অহি সমস্ত শক্তি দিয়ে এক চিৎকারে রুম থেকে বের হয়ে গেল।দরজা এখনো নড়ছে।অহির চিৎকারের শব্দ এখনো কানে আসছে।রোদ্দুর অবাক হয়ে ভাবল,এটা কি হলো?অজান্তার তো অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার কথা।এর আগে তো এতদিন তাই ঘটেছে।চিৎকার চেঁচামেচি করলেই নাই হয়ে যেত।আজ হঠাৎ দরজা দিয়ে পালাল কেন?দরজা তো এখনো নড়ছে?তাহলে কি অজান্তা সত্যি সত্যি এখানে ছিল?শিট…….

রোদ্দুর এক নজর নিজের দিকে তাকিয়ে বিছানায় ঝাপ দিল।বিছানার চাদর টেনে নিজেকে সম্পূর্ণ ঢেকে ফেলল।ছি!অহি ওকে এখন কি না কি ভাবছে!অহিকে এখন মুখ দেখাবে কি করে এখন?

নিচে থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ আসছে।রোদ্দুর বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো।চোখে মুখে হালকা পানি ছিটিয়ে বের হলো।হাতের কাছে রাখা ফুল হাতা টিশার্টটা গায়ে দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালো।

মুখের দিকে ভালো করে এক নজর দেখে নিচের দিকে তাকালো।নাহ!প্যান্টের জিপার লাগানো আছে।তারপর বেশ স্বাভাবিক ভাবে নিচে নামলো।

ড্রয়িং রুমে ভিড় জমে গেছে।অহিকে ঘিরে ছোটখাটো একটা জটলা।পিএইচডি ধারী থেকে শুরু করে পড়াশোনার প না জানা সবাই।সবার মাঝে সোফায় শাহিনুরকে জড়িয়ে অনবরত চোখের জল ফেলছে অহি।রোদেলা একপাশে থেকে অহির পিঠে হাত বুলাচ্ছে।

রোদ্দুর কাছে গিয়ে কপাল কুঁচকে বলল,

—“এখানে কিসের জটলা?”

কেউ উত্তর দিল না।তবে অহি বাদে বাকি সবাই এক জোড়া করে চোখ দিয়ে রোদ্দুরকে গিলে ফেলল।

রোদ্দুর কপাল কুঁচকেই বলল,

—“সবাই আমার দিকে এভাবে কেন তাকাচ্ছো?আমি কি করেছি?”

হঠাৎ অপূর্বর দিকে চোখ পড়তে হেসে বলল,

—“আরে অপূর্ব যে!হোয়াটসঅ্যাপ ব্রো!কেমন আছিস?”

অপূর্ব মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকালো।রোদেলা নিরবতা ভেঙে বলল,

—“রোদ্দুর, অহিকে কিছু বলেছিস?তোর রুম থেকে ভয় পেয়ে দৌঁড়ে বের হয়েছে।কিছু জিজ্ঞেস করছি।বলছেও না।কিছু করেছিস?”

—“হে হে হে।আমি কি করবো রোদ আপু?ও তো তেলাপোকা দেখে ভয়ে চিৎকার দিয়েছে।তাই না রে অজান্তা?”

অজান্তা কিছু বললো না।রোদেলা বলল,

—“রোদ্দুর।আমি জানি অহি তেলাপোকা ভয় পায় না।তাছাড়া ও প্রাণীবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করছে।দুদিন পর পর জীবন্ত তেলাপোকা কাটে।”

রোদ্দুর আমতা আমতা করে বলল,

—“তাই তো!আগে তো ভেবে দেখিনি।ও হ্যাঁ!আপু ও আসলে ভূত দেখে ভয় পেয়েছে।তাই না রে অজান্তা?”

(চলবে)

পরিশিষ্ট পর্ব-০৯

0

#গল্পের_নাম: পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_০৯

দ্বিকবিদিক হারিয়ে এক দৌঁড়ে অপূর্বর রুমে ঢুকতেই কারো সাথে ধাড়াম করে ধাক্কা খেল রোদ্দুর।ডান হাতের ব্যথা পাওয়া জায়গায় হাত বুলিয়ে সামনে না তাকিয়েই বিরক্ত গলায় বললো,

—“কোন শালী রে!দেখে চলতে পারিস না?”

সঙ্গে সঙ্গে তার মাথায় হালকা একটা থাপ্পড় পড়লো।দ্রুত চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে সামনে তার পিএইচডি ধারী বাবা ড. মুজিবুর রহমান দাঁড়িয়ে আছে।কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে তার বাবা নিজেকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মনে করে এবং সবসময় বুক উঁচিয়ে হাঁটে।

রোদ্দুর মাথায় হাত রেখে অগোছালো ভাবে বলল,

—“বাবা!তুমি এত সকালে এখানে কেন?বাসায় যাও নি তোমরা?”

মুজিবুর রহমান একটা হাই তুলে বলল,

—“তোর শরীরের তাপমাত্রা কমেছে?এখন কত ডিগ্রি? ”
—“কত ডিগ্রি জানি না বাবা।তবে জ্বর নেই।একদম স্বাভাবিক।”

—“আমি তিন মিনিট দাঁড়ালাম।থার্মোমিটার দিয়ে মেপে এ্যকুরেট টেম্পারেচার বলবি।তোর মাকে গিয়ে আবার বলতে হবে!”

রোদ্দুর বিস্ফারিত নয়নে বলল,

—“মা কোথায়?”

মুজিবুর রহমান বিছানায় গিয়ে পা তুলে বসলেন।চোখ দুটো বন্ধ করে যোগব্যায়ামের ভঙ্গি করলেন।তারপর শীতল গলায় বললেন,

—“গতরাতে বারোটার দিকে আমি আর তোর মা বাসায় চলে গিয়েছিলাম।তোর জ্বর,সেজন্য তোর মা যেতে চাইলো না।কিন্তু ওদিকে খালি বাসা।শুধু কাজের লোক দুটো রয়েছে।বলা তো যায় না বিপদ আপদের কথা।পরে তোর খালার কথায় আমরা দুজন চলে গেলাম।কিন্তু সারা রাত তোর মা ঘুমাতে দেয়নি।আযানের সময় আমাকে লাথি দিয়ে উঠিয়ে পাঠিয়েছে।তোর টেম্পারেচার মেপে থার্মোমিটার সাথে করে নিয়ে যেতে বলেছে।তাড়াতাড়ি কর!”

রোদ্দুর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।সে যে বড় হয়ে গেছে তা তাদের মা বাবাকে কে বোঝাবে!এখনো তার বাবা তুই তুকারি করে,দু একটা চড় থাপড়ও কপালে জুটে মাঝে মধ্যে।

সে এগিয়ে গিয়ে বগলের নিচে থার্মোমিটার চেপে বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো।বেলকনিতে দাঁড়াতেই রোদ্দুরের সব ধরনের অস্থিরতা দূর হয়ে গেল।বাইরের হিমশীতল বাতাসে পুরো ভেতর বাহির শীতল হয়ে গেল।

চারিদিকে ফর্সা হয়ে গেছে।তবে সূর্য এখনো উঠেনি।অল্প অল্প কুয়াশায় মোড়ানো সকালটা রোদ্দুরের অন্য রকম ভালো লাগতে শুরু করলো।বার বার মনে হলো,আজকের সকাল আর অন্যান্য দিনের সকাল এক নয়।

কিছুক্ষণ পর সে ভেতরে এসে থার্মোমিটার টেবিলের উপর রেখে বলল,

—“বাবা!এই যে!”

মুজিবুর রহমান উত্তর দিল না।রোদ্দুর তাকিয়ে দেখে তার পিএইচডি ধারী বাবা কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমের দেশে তলিয়ে গেছে।

সে রুমের দরজা ভিড়িয়ে নিচে নামলো।এক কাপ চা খেতে হবে।কেউ বোধ হয় ঘুম থেকে উঠেনি।নিজেরই চা করতে হবে।

রোদ্দুর সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে গুনগুন করে গান ধরলো।

“ক্ষতি নেই…..
কাছে না বলে তুমি চলে এলে…
দেখো সেই…
খুশি সাজাবো আমি হাজার ফুলে….
প্রতিদিন,সবসময় দেখা বেশি হলে বড় ভালো হয়… ”

একরাশ ভালো লাগা নিয়ে রান্নাঘরে পা রাখতেই চমকে উঠলো সে।অহি কোমড়ে ওড়না পেঁচিয়ে হাত নেড়ে নেড়ে টুংটাং আওয়াজ তুলে কি যেন করছে!

রোদ্দুরের ডান হাত আপনা-আপনি বুকে চলে গেল।তার হার্টবিট আবার ক্রমাগত ট্রেনের হুইসেল বাজিয়ে যাচ্ছে।হাত পা কাঁপছে।শরীরের ভরটুকু পা আর ধরে রাখতে চাইছে না।সে দরজার ঠেস দিয়ে নিজের ভরটুকু ছেড়ে বুকে চাপ দিয়ে ধরলো।হার্টবিটের শব্দ যেন অহির কানে না যায়!

অহির থেকে দৃষ্টি সরাতে পারছে না সে।যেন চোখ দুটোর উপর তার নিজের নিয়ন্ত্রণ নেই।অন্য কেউ নিয়ন্ত্রণ করছে।অহিকে কেমন বউ বউ লাগছে।চুল হাতখোঁপা করায় ঘাড়ের অনেকখানি উন্মুক্ত।কফি কালারের রঙটা যেন ঠিকরে পড়ছে।

অহি একটু পর পর সামনের অবাধ্য চুলগুলো আঙুলের সাহায্যে কানের পাশে গুঁজে দিচ্ছে।রোদ্দুর আর পারলো না।ধপ করে দরজা ধরে ফ্লোরে বসে বলল,

—“ও মাই গড!”

হালকা শব্দে অহি পেছন ঘুরে তাকায়।রোদ্দুরকে ওভাবে ফ্লোরে বসে থাকতে দেখে চোখ বড় বড় হয়ে যায়।দৌঁড়ে এসে বলে,

—“রোদ্দুর ভাই, এভাবে বসে আছেন কেন?বুকে হাত কেন?হার্টের এ্যাটাক ট্যাটাক হবে নাকি?আল্লাহ গো!”

রোদ্দুর ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,

—“অজান্তা,আমার থেকে দশ হাত দূরে দাঁড়িয়ে কথা বল।যাহ!পিছিয়ে যাহ!আমি ঠিক আছি!”

অহি ভয়ে কিছুটা পিছিয়ে গেল।রোদ্দুর ভাই কাল থেকে কেমন অস্বাভাবিক আচরণ করছে!সে ভয়ার্ত স্বরে বলল,

—“বুকে হাত কেন রোদ্দুর ভাই?বুকে ব্যথা করছে নাকি?শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে?”

—“বললাম তো আমি ঠিক আছি।আর বুকে হাত রাখবো নাকি পা উঠিয়ে রাখবো সেটা সম্পূর্ণ আমার ব্যাপার।”

অহি কিছু না বলে জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে এগিয়ে দিয়ে বলল,

—“পানিটুকু খান!ভালো লাগবে!”

রোদ্দুর ধমকে বলল,

—“বললাম না কাছে আসবি না!পিছিয়ে যা!”

অহি ধমকে কেঁপে উঠলো।কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

—“রো-রোদ্দুর ভাই!আপনি ফ্লোরে বসে কেন?”

—“ইচ্ছে হয়েছে বসেছি।প্রয়োজনে শুয়ে থাকবো।তাতে তোর কোনো সমস্যা আছে?”

—“ন-না!তা নেই।কিন্তু ফ্লোরে তো অনেক ময়লা।”

রোদ্দুর ভুলবশত অহির দিকে তাকালো।এলোমেলো চুল,ভয়ার্ত চোখ-মুখ,কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম,কাঁপা কাঁপা ঠোঁট!সব মিলিয়ে অন্য রকমের সুন্দর লাগছে।তাকে মুহূর্তে ঘোরে ফেলতে পারে!সে দ্রুত চোখ সরিয়ে শক্ত কন্ঠে বলল,

—“ময়লা তাতে কি?তোকে কি বলবনি আমায় শাওয়ার করিয়ে দে?নাকি বলবনি আমার ড্রেসগুলো ধুয়ে দে?বলবো তো না!এখন আমি ফ্লোরে শুয়ে থাকবো।”

বলেই অহিকে চমকের শীর্ষ পর্যায়ে রেখে রোদ্দুর দরজা বরাবর ফ্লোরে শুয়ে পড়লো।বড় বড় করে শ্বাস টানলো।শুয়ে চোখ বন্ধ করে বিড়বিড় করলো।

অহি কেঁদে দিয়েছে প্রায়।বৃষ্টি আপুর শোকে অবশেষে মানুষটা পাগল হয়ে গেল?সে মুখে হাত রেখে রোদ্দুরকে ডিঙিয়ে এক দৌঁড়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে উঠতে বলল,

—“কে কোথায় আছো?বের হও তাড়াতাড়ি! রোদেলা আপু বের হও!রোদ্দুর ভাই পাগল হয়ে গেছে!রোদ্দুর ভাই পাগল হয়ে গেছে।হসপিটালে নিতে হবে।”

পাঁচ মিনিটের মাথায় সবাই ঘুম ঘুম চোখে ড্রয়িং রুমে হাজির হলো।নিচে নেমে কোথাও রোদ্দুরকে খুঁজে পাওয়া গেল না।রোদেলা ফোন বের করে রোদ্দুরকে ফোন দিল।রোদ্দুর ফোন রিসিভ করলো না।কিন্তু এক মিনিট পরেই টুং করে একটা এসএমএস আসলো।

“রোদ আপু!আমি বাসায় যাচ্ছি।একটু দরকারি কাজ আছে।”

রোদেলা একটা হাই তুলে ম্যাসেজটা পড়লো।তাকে রেডি হতে হবে। কলেজে যেতে হবে।

মুজিবুর রহমান অহিকে বলল,

—“মা-জননী! তুমি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছো।আমি আর একটু ঘুমিয়ে নেই এখান থেকে।বাসায় গেলে তোমার খালামণি ধমকা ধমকি করবে!”

সবাই যার যার মতো হাই তুলে রুমে চলে গেল।অহি চিন্তিত মুখে দাঁত দিয়ে হাতের নখ কাটা শুরু করলো।এটা কি হলো?

———————

দুপুরের দিকে রোদেলার ক্লাস শেষ হলো।কলেজ শেষ হতে এখনো দেড় ঘন্টার মতো বাকি।কিন্তু এই দেড় ঘন্টায় তার আর কোনো ক্লাস নেই।

টিফিনের পরে তার একটা ক্লাস। বি বয়েজ শুধু।আর টিফিনের আগে চারটা।এই মোট পাঁচটা ক্লাস ডেইলি।

রোদেলা ব্যাগ থেকে পানির পট বের করে গলা ভেজালো।এই দেড় ঘন্টা বসে থাকতে হবে শুধু শুধু।কলেজ টাইম শেষ হলে তখন বাসায় যেতে পারবে।

নিজের ডেস্কে বসে পেপার হাতে নিল।গতকালের পেপার।পেপার পড়ার অভ্যাস তার নেই।কোনোকালে ছিলও নাহ!এখন সময় কাটানোর জন্য চোখ বুলালে দোষের কি!

—“মিস রোদেলা ম্যাম!”

রোদেলা ঘাড় ঘুড়িয়ে দরজার দিকে তাকালো।আকাশী রঙের ইউনিফর্ম গায়ে অল্প বয়স্ক একটা ছেলে।এটা তো নতুন প্রিন্সিপাল মানে সাদিদ স্যারের পিয়ন।এ কলেজে প্রতিটি পিয়নের এক রকমের ইউনিফর্ম।

সে স্বাভাবিক কন্ঠে বলল,

—“হ্যাঁ,বলুন।”

ছেলেটা হাতে রাখা খাতাতে চোখ বুলিয়ে বলল,

—“ম্যাম,আপনাকে সাদিদ স্যার দেখা করতে বলেছে।কলেজ শেষে।অর্থাৎ আড়াইটার সময়।ম্যাম,একটু টাইমলি আসার চেষ্টা করবেন।”

রোদেলা মাথা নেড়ে সায় জানালো।ছেলেটা চলে যেতেই তার কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠলো।সাদিদ স্যার তার সাথে কেন দেখা করতে চাচ্ছে?

সাদিদ স্যার এ কলেজে এসেছে আজ সতেরো দিন।এই সতেরো দিনে রোদেলা তার ধারে কাছেও ঘেঁষেনি।সেই যে রিসিপশনের দিন দেখা হয়েছিল।আর হয়নি!রোদেলা ইচ্ছে করে তার থেকে পালিয়ে বেড়িয়েছে।কারণ সে খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছে মি. জুলকারনাইন সাদিদ ম্যারিড এবং তার পাঁচ বছরের একটা মেয়ে আছে।

রোদেলার চোখ দিয়ে অশ্রু বের হলো।তার এক তরফা ভালোবাসা তাহলে পূর্ণতা পেল না।ভালোবাসা এমন কেন?সবসময় ভুল মানুষকে বেছে নেয়!সে সাবধানে টিস্যু দিয়ে চোখ মুছে নিজেকে স্ট্রং করলো।সাদিদ স্যারকে তাকে ফেস করতে হবে!

২ টা বেজে ৩৬ মিনিটে রোদেলা সাদিদের কেবিনের দরজায় টোকা দিয়ে বলল,

—“আসবো স্যার?”

সাদিদ কি যেন লিখছে।দরজার দিকে না তাকিয়ে বলল,

—“জ্বি,অবশ্যই!”

রোদেলা ভেতরে ঢুকে সাবধানে দরজা ভিড়িয়ে দিল।তারপর কাচের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে সালাম দিল।সাদিদ সালামের উত্তর না দিয়ে বলল,

—“প্লিজ, সিট ডাউন।”

রোদেলা আড়ষ্ট ভঙ্গিতে চেয়ার টেনে বসলো।কেবিনটা এসি করা।তার শীত শীত লাগছে।গায়ের ওড়না দিয়ে হাতের ফাঁকা অংশ ঢেকে ফেলল সে।

সাদিদ প্রথমবার চোখ তুলে তাকালো।স্ট্রেইট বলল,

—“মিস রোদেলা জান্নাত,রাইট?আমার জানামতে আপনার কলেজ ছুটির আগে কোন ক্লাস ছিল না।কিন্তু আপনি ছয় মিনিট লেট করে কেবিনে ঢুকলেন!”

রোদেলা উত্তর দিল না।এক নজর সাদিদের দিকে তাকাল।সাদিদ আজ কালো ফ্রেমের চশমা পড়েছে।কি সুন্দর জ্ঞানী মানুষদের মতো লাগছে!

—“মিস রোদেলা জান্নাত!আপনি কি কারণে কলেজ ছাড়তে চাচ্ছেন?”

—“কোনো কারণ নেই স্যার।”

—“এটা বললে তো হবে না।আপনাকে প্রোপার কজ দেখিয়ে কলেজ ছাড়তে হবে।কারণ এতে কলেজের মানোন্নয়নে আমরা সোচ্চার হবো।আপনার মন চাইলো আর আপনি জয়েন করলেন,আবার মন চাইলো না তো রেজিগনেশন নিয়ে নিলেন।এটা হবে না!”

—“স্যার আমি মন মর্জি কলেজে ঢুকিনি।এক্সাম দিয়ে, ভাইভা দিয়ে, দুটো ডেমো ক্লাস করিয়ে চাকরি পেয়েছিলাম।এখন আর করতে চাই না।”

সাদিদ চশমার কাচ পরিষ্কার করে আবার চোখে পড়লেন।তারপর সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে রোদেলার দিকে চেয়ে বললেন,

—“মিস!আপনাকে কি আমি চিনি?”

রোদেলা যেন জানতো যে সাদিদ স্যার এই প্রশ্নটা করবে।সে স্বাভাবিক ভাবে বলল,

—“জ্বি না!”

—“কেন জানি আপনার চেহারাটা একটু পরিচিত মনে হয়।বাই দ্য ওয়ে,আপনার পেপারস গুলো দেখলাম গতকাল।আপনি যে কলেজে ছিলেন,ওই কলেজে আমি তিন মাসের মতো ক্লাস নিয়েছিলাম।এবং কাকতালীয় ভাবে সালটা আপনার সাথে মিলে গেছে।আপনি তখন ইন্টার প্রথম বর্ষে ছিলেন।আমি পদার্থ বিজ্ঞান ক্লাস নিতাম।আপনার কিছু মনে পড়ে?”

—“না স্যার!মনে পড়ে না।আপনি হয়তো অন্য সেকশনে ক্লাস নিয়েছিলেন।”

তারপর কয়েক মিনিট দু’জনে চুপ।সাদিদ ঘোর ভেঙে বলল,

—“মিস রোদেলা আপনি আসতে পারেন।আপনি এই মুহুর্তে কলেজ ছাড়তে পারবেন না।কিছুদিন পর এক্সাম সবার।কলেজের রেপুটেশনের দিকটা খেয়াল রাখতে হবে আমাকে।এই মুহুর্তে নতুন টিচার ইনভলভ করা অনেক টাফ।আপনি আসুন!”

রোদেলা উঠে দাঁড়ালো।দরজার কাছে গিয়ে সালাম দিয়ে বেরিয়ে গেল।

——————–

অহি ছটফট করছে।কারণ তার ফোনে তিনটে আননোন নাম্বার থেকে একই মেসেজ এসেছে।মেসেজ দুটো এমন..

“রোদ্দুর ভাই,এবার যদি আমাকে রেখে অন্য কাউকে বিয়ে করিস তাহলে তোকে একদম খুন করে ফেলবো।তারপর নিজের গলায় দড়ি দিবো।আমার গল্পের প্রথম পাতায়,মাঝামাঝিতে বা শেষ অধ্যায়ে তুই না থাকলেও পরিশিষ্টে তোকে চাই!শুধু তোকে চাই!রোদ্দুর হিমকে চাই।”

এইটুকুই।একি মেসেজই তিনটে আননোন নাম্বার থেকে এসেছে।অহির হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে!এটা কার কাজ? রোদ্দুর ভাই না তো?

(চলবে)

পরিশিষ্ট পর্ব-০৮

0

#গল্পের_নাম : পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_০৮ (বোনাস পার্ট)

অহি ওয়াশরুমের দরজার এপাশ থেকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে চিন্তিত গলায় বলল,

—“রোদ্দুর ভাই, আপনার আবার কি হলো?এমন করছেন কেন?”

রোদ্দুর ওপাশে থেকে আস্তে করে বলল,

—“তুই হঠাৎ এত সুন্দর হয়ে গেলি কিভাবে?ইটস মিরাকল!ও মাই গড!”

অহি শুনতে পেলো না।চেঁচিয়ে বলল,

—“কি বলছেন শুনতে পাচ্ছি না।জোরে বলুন।”

রোদ্দুর উত্তর দিল না।দরজা ধরে উঠে বেসিনের সামনে দাঁড়ালো।আয়নাতে নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকাতেই হকচকিয়ে গেল।আপনা-আপনি ডান হাত নিজের গালে চলে গেল।একি!তার গালদুটো মেয়েদের মতো লাল হয়ে গেছে কেন?

হন্তদন্ত হয়ে ট্যাপ খুলে চোখে মুখে পানি দিল।তারপর আয়নার দিকে তাকালো।কি সাংঘাতিক!লাল আভা যাচ্ছে না কেন?এভাবে নতুন বউদের মতো লাল টুকটুকে গাল নিয়ে সে বাইরে বের হবে কিভাবে?

এত গরম লাগছে কেন?বাম হাতে সে শার্টের উপরের দুটো বাটন খুললো।কই?গরম ভাব তো তাও যাচ্ছে না।কেমন হাঁসফাঁস লাগছে।হাত বাড়িয়ে ঝরনা ছেড়ে দিয়ে তার নিচে দাঁড়াল সে!

মিনিট চল্লিশেক পর ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ কানে আসলো অহির।সে দরজা খোলার অপেক্ষাই করছে।ইতোমধ্যে দু বার নিচে থেকে ঘুরে এসে দরজা ধাক্কিয়েছে।কিন্তু রোদ্দুর ভাই দরজা খুলেনি। ঝটপট বিছানা ছেড়ে উঠে সে রোদ্দুরের দিকে তাকালো।

রোদ্দুরের কাহিল অবস্থা।কালো রঙের শার্টটা শরীরে লেপ্টে আছে।চুলগুলো বেয়ে বেয়ে পানি পরছে।বুকের বেশ খানিকটা উদাম।মাথা, টাথা কিচ্ছু মুছেনি।ভেজা কাপড়ের পানিতে ফ্লোরে বন্যা হয়ে যাচ্ছে।

অহি বিস্ফারিত নয়নে মুখে হাত রেখে চেয়ে রইলো।এর আবার হঠাৎ করে কি হলো?এক দৌঁড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে শার্ট, প্যান্ট পরেই শাওয়ার নিয়ে নিল?

অহি অবাক কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

—“একি অবস্থা আপনার?”

রোদ্দুর উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে অন্য দিকে তাকালো।সে ভেবে রেখেছে, যতক্ষণ এ বাসায় থাকবে অহির দিকে আর তাকাবে না।

—“একি!আপনার চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে কেন রোদ্দুর ভাই?এতক্ষণ এভাবে কেউ শাওয়ার নেয়?কবে আপনার সুবুদ্ধি হবে?দেখি,জ্বর এসে গেছে কি না!”

অহি পায়ের উপর ভর দিয়ে সামান্য উঁচু হয়ে রোদ্দুরের কপালে হাত রাখতে নিতেই সে ছিটকে দু পা পিছনে সরে গেল।তোতলানো স্বরে বলল,

—“কথায় কথায় গায়ে হাত দিতে চাস কেন অজান্তা?এক চড়ে মুন্ডু ঘুরিয়ে দিব।গায়ে হাত দিবি না খবরদার।আমি ছোট রয়েছি নাকি?”

—“কি?”

—“কি কি করছিস কেন?তুই একটা বেয়াদব,বেশরম মেয়ে।তোর মতো বেহায়া মেয়ে আমি দুটো পৃথিবীতে দেখিনি।তুই একটা গায়ে পড়া মেয়ে।”

—“আমি আবার কার গায়ে,কখন পড়লাম?আজব!”

—“এক্ষুনি তো পড়তে নিয়েছিলি!”

—“সে কি!কখন?আচ্ছা বাদ দিন!আমি যেমন হই না কেন,তাতে আপনার কোনোদিন কিচ্ছু আসবে, যাবে না।কিন্তু আপনি এই ভেজা কাপড়ে বেশিক্ষণ থাকলে নির্ঘাত জ্বর আসবে।চেঞ্জ করুন।”

—“করবো না!জ্বর আসে আসুক।তাতে তোর কি!আমি আজ সারা রাত এভাবে থাকবো।তাতে তোর সমস্যা আছে?”

—“রোদ্দুর ভাই, আপনি পাগল হয়ে গেছেন।কি বলছেন এসব?”

—“হুঁ,আমি তো পাগলই।আর তুই সুস্থ মানুষ হয়ে পেত্নীদের মতো সাজ দিয়েছিস।তোকে দেখতে কি বিশ্রী লাগছে!ইয়াক থু!”

বলেই বড়ো বড়ো পা ফেলে বাইরে বের হয়ে গেল রোদ্দুর।অার অহি হা হয়ে তাকিয়ে রইলো।এসব কি হচ্ছে চারপাশে?

——————

সন্ধ্যার পর পরই রোদ্দুরের হাড়গোড় কাঁপিয়ে জ্বর আসলো।হুট করে এভাবে জ্বর আসায় সবাই চিন্তিত।থার্মোমিটার দিয়ে মেপে দেখা গেল জ্বর ১০৪° এর কাছাকাছি।

ডিনারের আগে বেলুন ফুটিয়ে, স্প্রে করে অহি তার বাইশ তম জন্মদিনের কেক কাটলো।রোদ্দুর উপস্থিত রইল না তাতে।সবাই যার যার মতো উইশ করলো।কিন্তু কোথায় যেন সুর কেটে গেছে।সবাই থমকে থমকে অানমনা হয়ে যাচ্ছে।

সবাই হালকা পাতলা করে ডিনার সারলো।ডিনার শেষে ঘরোয়া ভাবে গানের আয়োজন করার প্লান ছিল।সেটা আপাতত স্থগিত রাখা হলো।

অহির বাবা বেশ কয়েকবার ডাক্তার ডাকার কথা বললো।কিন্তু রোদ্দুর বেগ ধরেছে।পৃথিবীর পাখা গজিয়ে উড়া শুরু করলেও সে ডাক্তার দেখাবে না।তার নাকি কঠিন অসুখ হয়েছে।এ অসুখ ডাক্তারে সাড়বে না।পরে কেউ আর জোর করেনি।

রাতের বেলা অহির মা শাহানা জোর করে রোদ্দুরকে স্যুপ করে খাওয়ালো।তারপর মেডিসিন খাইয়ে দিল।রোদ্দুর খালার হাত ধরে বলল,

—“খালা,আমার কঠিন অসুখ হয়েছে।আমি হয়তো মরে যাব!”

শাহানা রোদ্দুরের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,

—“বাবা!এসব বলতে হয় না।তোমার কিচ্ছু হবে না।এই যে ওষুধ খাইয়ে দিলাম।কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্বর থাকবে না।তুই ঘুমা তো!”

—“খালা,আমার হুট করে কি যেন হয়ে গেছে।আমাকে নিশ্চিত পরী থুক্কু জ্বীনে ভর করেছে।তুমি বরং কাল সকালে কবিরাজ ডেকে ঝাড় ফুঁকের ব্যবস্থা করো।”

—“আচ্ছা,ঠিক আছে।সকালে দেখা যাবে।তুই ঘুমা এখন।”

রোদ্দুর সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করলো।হঠাৎ মনে পড়ায় চোখ বন্ধ রেখেই বলল,

—“খালা,খেয়াল রেখো!কোনো পরী টরী যেন রুমের ভেতরে না ঢুকে।এ বাসায় আর আসা যাবে না।হুট করে চোখের পলকে আমায় ফুস করে ধরে পরীস্থানে নিয়ে যাবে!ফুস!”

শাহানার বড্ড মায়া হলো।তিনি তিন বার আয়াতুল কুরসী পড়ে রোদ্দুরের মাথায় ফু দিল। ছেলেটা জ্বরের ঘোরে আবোল তাবোল বকছে।আহারে!

অহি দরজায় হালকা শব্দ করে ভেতরে ঢুকলো।ছোট বেলা থেকে তার অভ্যাস হয়ে গেছে অন্য রুমে প্রবেশ করার আগে মৃদু শব্দ করা।সে অলরেডি ড্রেস চেঞ্জ করে ফেলেছে।কফি কালারের সূতির থ্রি পিস গায়ে।ওড়নাটা ভালো করে গায়ে জড়িয়ে এগিয়ে আসলো।

রোদ্দুরের দিকে চেয়ে শাহানাকে বলল,

—“রোদ্দুর ভাইয়ের সাথে ঘুমাবে কে মা?”

শাহানা বেশ স্বাভাবিক গলায় বললো,

—“কেন?কেউ না ঘুমালে তুই ঘুমাবি নাকি?”

—“মা!তুমিও কি রোদ্দুর ভাইয়ের মতো পাগল হয়ে গেলে?”

—“এই,আমাকে একদম পাগল বলবি না!তোর বাপের থেকে শিক্ষা পেয়েছিস, না?দিনের ভেতর হাজার বার নিজে পাগল বলে শান্তি পায় না,এখন মেয়েকে দিয়েও বলাবে?এরকম হলে কিন্তু আমি এ বাড়ি থাকবো না।আগেই বলে রাখলাম।”

—“মা,চেঁচামেচি করবে না প্লিজ।বাবা গরম জল চাচ্ছে।দিয়ে আসো।আমি এখানে আছি!”

—“দাঁড়া!গরম জল এখন তোর বাপের পাছায় ঢালবো।আমায় দাসী পেয়েছে?চব্বিশ ঘন্টা হুকুম করবে!”

—“মা,কিসব ভাষা ইউজ করছো?রোদ্দুর ভাই আছে এখানে!”

—“থাকুক!তোর বাপ কি করেছে জানিস?গতকাল রাতে একটু বলছিলাম,ওগো!টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি দাও তো!আমায় বলে কি জানিস?বলে,উঠে গিয়ে খেয়ে নাও!নড়াচড়া না করে তো শুধু ভুড়ি বাড়াচ্ছো!কি বজ্জাত দেখেছিস!”

অহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

—“হ্যাঁ,দেখলাম।তুমি এখন যাও তো মা।”

শাহানা অনিচ্ছা নিয়ে চলে গেল।অহি একটা চেয়ার টেনে রোদ্দুরের শিয়রের পাশে বসলো।রোদ্দুর এখন অপূর্বর রুমে শুয়েছে।অপূর্বকে আশপাশে দেখা যাচ্ছে না।অন্য রুমে ঘুমিয়ে গেল নাকি?

রোদ্দুর ঘুমাচ্ছে।মুখটা পান্ডুর মতো ফ্যাকাসে হয়ে গেছে।অহি ডান হাতটা হালকা করে রোদ্দুরের কপালে রাখতেই চমকে গেল।গা তো জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে।মেডিসিন খাওয়ার পরেও কমছে না কেন?ছেলেটা কি যে করে না!কি দরকার ছিল ওতক্ষণ ভেজার?

বাটিতে অল্প পানি নিয়ে তাতে এক টুকরো কাপড় ভিজিয়ে রোদ্দুরের কপালে দিল।রোদ্দুর ঘুমের ঘোরে শিউরে উঠলো।

রোদ্দুর ঘুমের ঘোরে বিড়বিড় করে কিছু একটা বলল।অহি কান পেতেও তা বুঝতো পারলো না।

————————

ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই নিজের মাথা চেপে ধরলো রোদ্দুর।মাথার ভেতর কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।বিছানায় উঠে বসে পাশে তাকালো।

পাশে কেউ নেই।সে বেলকনির কাচের ফোঁকর দিয়ে বাইরে দৃষ্টি মেলল।সূর্য এখনো উঠেনি!

রোদ্দুর ঘেমে একাকার হয়ে গেছে।গায়ের তাপমাত্রা স্বাভাবিক একদম।সে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।হুট করেই তার মাথায় অস্পষ্ট একটা দৃশ্য ভেসে উঠে।রাতের বেলা সে যখন ঘুমিয়ে ছিল, তখন অহি তার দিকে ঝুঁকে কিছু একটা করছিল।হ্যাঁ!তার সারামুখে এলোপাতাড়ি চুমু খেয়েছে!কি সাংঘাতিক!

রোদ্দুর এক টানে গায়ের উপর থেকে কম্বল সরিয়ে অহির রুমের দিকে পা বাড়াল।অহিকে আজ উচিত শিক্ষা দিতে হবে।তার ঘুমের সুযোগ নিয়ে….

অহির রুমের দরজা খোলা।রোদ্দুর ভেতরে ঢুকে চারিদিক তাকাল।অহি রুমে নেই।সে তবুও চেঁচিয়ে বললো,

—“অজান্তা!সাহস থাকলে সামনে আয়!আমার জ্বরের সুযোগ নিয়ে চুমু খাওয়া!তোর চুমুর আমি দফারফা না করলে আমার নামও রোদ্দুর হিম নয়!তোর কলিজা কত বড়ো, আমি সেটা আজ দেখেই ছাড়বো!বের হ!বের হ বলছি!”

ওয়াশরুমের দরজা খুলে রোদেলা বের হলো।তার চোখে মুখে পানি।কপাল কুঁচকে বলল,

—“এত্তো ভোরে চিল্লাফাল্লা করছিস কেন রোদ্দুর?তোর কবে যে জ্ঞান হবে!ছাড়!কি যেন বলছিলি?অহি তোকে চুমু টুমু খেয়েছে না কি যেন?”

রোদ্দুর মিইয়ে গেল।রোদেলা আপু এ রুমে কি করছে?অহি কোথায়?সে মিনমিন করে বলল,

—“ইয়ে মানে আপু।মনে হচ্ছিল অহির মতো দেখতে কেউ আমার ঘুমের ঘোরে…… ”

—“এক রাতের জ্বরে দেখি তোর সম্পূর্ণ মাথা আউলে গেছে।অহি তো সারারাত আমার সাথে ছিল।আমরা দুজন গেস্ট রুমে একসাথে ঘুমিয়েছি।এ রুমে অপূর্ব ছিল রাতে।”

—“তার মানে আমি স্বপ্নে দেখেছি অহি……ও মাই গড!”

রোদ্দুর এক দৌঁড়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল।যাওয়ার সময় দরজার সাথে একটা বাড়িও খেল।কিন্তু তার খেয়াল নেই।দ্বিকবিদিক হারিয়ে এক দৌঁড়ে অপূর্বর রুমে ঢুকতেই কারো সাথে ধাক্কা খেল!

(চলবে)

পরিশিষ্ট পর্ব-০৭

0

#গল্পের_নাম : পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_০৭

রোদেলা টেনে টেনে দু তিনবার শ্বাস নিয়ে চোখ বন্ধ করে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নিষ্ঠুর মানুষটির উপর হেলে পড়লো।

মঞ্চে উপবিষ্ট সকল মানুষসহ সামনের দর্শক সারিতে গুঞ্জন শুরু হলো।সাথে চাপা উত্তেজনা।অহি সব মানুষকে সাইড করে হাঁফাতে হাঁফাতে স্টেজে উপস্থিত হলো।তার নিজেরো হাত পা কাঁপছে।

সে সবাইকে সরিয়ে রোদেলার হাত ধরে বলল,

—“রোদেলা আপু,কথা বলো!কথা বলো আপু!কেউ একজন একটু সাহায্য করুন।পানি দিন কেউ একটু! ”

রোদেলা নতুন প্রিন্সিপালের বুকের উপর হেলে আছে।নতুন প্রিন্সিপাল বাম হাতে হালকা করে রোদেলাকে ধরে আছে।তিনি শীতল গলায় অহিকে বললো,

—“মিস!ভয় পাওয়ার কিছু নেই।আজ অত্যধিক গরম পড়েছে।সেখানে উনি চুল ছেড়ে রেখেছেন।সেজন্য সেন্সলেস হয়ে গেছে জাস্ট।আপনি বরং উনাকে টিচার্সদের রেস্টিং রুমে নেয়ার ব্যবস্থা করুন।”

এক নাগাড়ে বলে ভাইস প্রিন্সিপালের দিকে তাকালেন।উনি স্পিকারে সবাইকে ক্রমাগত শান্ত হতে বলছেন।

পরিস্থিতি অনুকূলে আনার জন্য অন্য একটা টিচার এসে রোদেলাকে পাঁজা কোল করে নিয়ে স্টেজ থেকে নেমে গেল।দুজন মহিলা টিচার এবং অহি তাদের পিছন পিছন গেল।

কিছুক্ষণের মধ্যেই চারিপাশ শান্ত হয়ে গেল।সবাই আগের মতো আগ্রহ নিয়ে নতুন প্রিন্সিপালের দিকে তাকালো।সাদিদ একটু সামনে এসে মুচকি হেসে সবার উদ্দেশ্যে হাত নাড়লো।প্রথম দিনই এরকম কিছু ঘটবে তা তার ভাবনা তে ছিল না।

——————-

রোদেলার জ্ঞান ফিরেছে।সে শুয়ে আছে কলেজের প্রাথমিক চিকিৎসালয়ে।কলেজের কোনো স্টুডেন্ট হুট করে অসুস্থ হয়ে পড়লে এখানে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়।দিনের বেলার জন্য সার্বক্ষণিক একটা বয়স্ক এসবিবিএস রাখা আছে।

রোদেলার বাম হাতে স্যালাইন লাগানো হয়েছে।সে আধো ঘুম,আধো চৈতন্যে আছে।তার চোখের সামনে স্যুট,বুট পড়া একজনের চেহারা ভেসে উঠছে বার বার।

অহি রোদেলার মাথার চুলে আঙুল চালিয়ে বলল,

—“আপু,এখন কেমন লাগছে তোমার?একটু বেটার ফিল করছো?”

রোদেলা পিটপিট করে চোখ খুললো।অহির দিকে চেয়ে জোরপূর্বক হেসে বলল,

—“আমি একদম ঠিক আছি। তোকে অনেক ভয় পাইয়ে দিয়েছিলাম, তাই নারে?”

—“শুধু আমি না আপু!তুমি সবাইকে ভয় পাইয়ে দিয়েছো।আমি হাউমাউ করে কাঁদতে নিয়েছিলাম।তোমাদের নতুন প্রিন্সিপাল বলল,ভয় পাবেন না।উনার কিছু হয়নি।”

রোদেলা চমকে বলল,

—“আমাকে এখান অবধি কে নিয়ে এলো অহি?”

—“তোমার ডিপার্ট্মেন্টের এক টিচার আপু।ওই যে টাকলা করে।এর আগের বার তোমার সাথে যখন কলেজে এসেছিলাম তখন কিছু কথা হয়েছিল ওনার সাথে।”

রোদেলা চোখ বন্ধ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।ফের চোখ খুলে বলে,

—“ড্রাইভার কাকাকে গাড়ি নিয়ে আসতে বল অহি।আমি বাসায় যাব।”

—“আপু,স্যালাইন তো এখনো শেষ হয়নি।আধ ঘন্টা পর যাই।”

—“নাহ!আমি এক্ষুনি যাব রে।এখানে থাকলে দমবন্ধ হয়ে মারা যাব!”

অহি আর জোর করলো না।ফোন হাতে নাম্বার ডায়াল করতে করতে বাইরে বের হয়ে গেল।

রোদেলার কানে গানের আওয়াজ ভেসে আসছে।কেউ একজন আবেগ ঝরা কন্ঠে গেয়ে যাচ্ছে,

“আমি হবো রাত আর তুই হবি চাঁদ,
জোসনায় ঘর আমাদের!
তুই হলে রোদ আমি রংধনু হই,
ছিলো সে শহর আমাদের!”

রোদেলার চোখের কোণ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু বের হয়ে কানের কাছে পৌঁছায়।সে ডান হাতে মুছে বড়ো বড়ো করে শ্বাস নেয়।সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে।তার মানে অনুষ্ঠান শেষের দিকে।

দরজায় মৃদু টোকার আওয়াজে সেদিকে তাকায় রোদেলা।

কেউ একজন শীতল পুরুষালি গলায় বলে,

—“ভেতরে আসলাম!”

রোদেলা উত্তর দেয়ার আগেই সাদিদ ভাইস প্রিন্সিপালকে সাথে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে।রোদেলা উত্তেজিত হয়ে এক লাফে উঠে বসে।সঙ্গে সঙ্গে তার হাতের সুঁচে টান পড়ে রক্ত উঠে।

সাদিদ দ্রুত এগিয়ে এসে রোদেলার হাতটা টান করে হুকুমের সুরে বলে,

—“মিস রোদেলা, আপনি ব্যস্ত হবেন না।শুয়ে পড়ুন।”

রোদেলা শুয়ে পড়ে।তার মাথা কাজ করছে না।অহিটা কোথায় গেল?এরা প্রিন্সিপাল মানুষ।তার সালাম দেয়া উচিত।সে কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,

—“আসসালামু আলাইকুম স্যার!”

সাদিদ উত্তর নিল না।ভাইস প্রিন্সিপাল বয়স্কা মানুষ।চুলে বহু বছর আগেই পাক ধরেছে।তিনি সালামের উত্তর দিয়ে বললেন,

—“রোদেলা, তোমাকে বহু বার বলেছি শরীরের যত্ন নিবে।তোমাকে মেয়ের মতো মনে করি।কিন্তু তুমি তো আমার একটা কথাও শোনো না।আজ তোমার গাফিলতির জন্য কি একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হলো সবাইকে।”

রোদেলা নরম গলায় বললো,

—“আমি স্যরি!”

সাদিদ একটু পিছিয়ে গিয়ে বলল,

—“মিস,রোদেলা। আপনার শরীরের কন্ডিশন বেশি ভালো মনে হচ্ছে না।আপনি বরং তিনদিনের লিভ নিন।”

রোদেলা চোখ তুলে সাদিদের দিকে তাকালো।এতগুলো বছর পর দেখছে।অথচ চেহারায় বিন্দুমাত্র পরিবর্তন আসেনি।আরো সুন্দর হয়েছে মানুষটা!মাথার চুল আরো ঘন হয়েছে।জগতের সমস্ত মায়া যেন একত্রে হয়ে দু চোখে ভর করেছে।কপালের ডান সাইডের কাটা দাগটা আরো উজ্জ্বলতা বাড়িয়েছে।রোদেলা চোখ সরিয়ে নেয়।

সাদিদ নিজেই ভাইস প্রিন্সিপালের দিকে ঘুরে বললেন,

—“স্যার!আপনি মিস রোদেলার ছুটির সব ব্যবস্থা করুন।আমি আসছি।”

বলেই গটগট করে চলে গেল।একবারও পেছন ঘুরে তাকালো না।

কিছুক্ষণ পর অহি এসে বলল,

—“আপু,জব্বার কাকা গাড়ি নিয়ে এসে গেছে।”

——————-

আজ সোমবার।অহির জন্মদিন আজ।সব ঘরোয়া ভাবে করা হবে।দুই ফ্যামিলির মানুষ শুধু।তারা আর রোদেলা আপুদের পরিবার।

রোদেলা কলেজ থেকে সোজা এখানে চলে এসেছে।বিকেলের দিকে তার পরিবারের সবাই আসবে।সে একেবারে শাওয়ার নিয়ে নতুন ড্রেস পড়ে বের হলো।এ বাসায় হুটহাট চলে আসে বলে কিছু জামাকাপড় সবসময়ই রাখে।

অহি দু কাপ কফি নিয়ে রোদেলার রুমে আসলো।রোদেলা তাদের বাসায় আসলে গেস্ট রুমে বেশির ভাগ সময় থাকে।ঘুমানোর সময় দুজন একসাথে ঘুমায়।

—“আপু,তোমার কফি!”

রোদেলা মাথা মোড়ানো টাওয়ালটা সরিয়ে রেখে কফি হাতে নিল।বিছানায় বসে এক চুমুক দিয়ে বলল,

—“এটাই এখন প্রয়োজন ছিল।তুই কিভাবে যেন আমার মনের কথা বুঝে যাস!”

অহি নিজেও আপুর পাশে বসে নিজের কাপে চুমুক দিল।তারপর আপুকে বলল,

—“তোমার কলেজে সময় কেমন কাটে?”

—“তোকে একটা কথা বলি অহি।কাউকে বলবি না কিন্তু।তোকেই প্রথম বলছি।আমি ওই কলেজে আর চাকরি করবো না।রেজিগনেশন লেটারের সব ব্যবস্থা করেছি।”

—“সে কি!কেন আপু?তোমার তো কলেজটা ভীষণ প্রিয় ছিল?”

—“কারণ টা পরে বলবো অহি।তুই যা এখন।আমি ঘুমাব।খু্ব ক্লান্ত!”

রোদেলা সত্যি সত্যি হাই তুলল।কফির কাপে শেষ চুমুক দিয়ে বিছানায় গুটিশুটি হয়ে বাচ্চাদের মতো পা ভাঁজ করে শুয়ে পড়লো।

অহি উঠে দাঁড়ালো।কয়েক পা এগুতেই রোদেলা চোখ জোড়া বন্ধ রেখেই বলল,

—“শুভ শুভ্র জন্মদিন কলিজা!দোয়া করি,খুব শীঘ্রই রোদ্দুর পাগলাটা যেন তোর ভালোবাসা বুঝতে পারে।আর লাইটটা বন্ধ করে দিয়ে যা।”

অহি লজ্জা পেয়ে মুচকি হাসলো।লাইটটা বন্ধ করে নিঃশব্দে রুম থেকে বের হয়ে গেল।রোদেলা আপু কেন যে তাকে সবসময় লজ্জায় ফেলে?

নিচে রান্নার তোড়জোড় চলছে।অহির মা কাজের লোকেদের সাথে নিয়ে রান্না করছে।অহি এক নজর চারপাশে চোখ বুলিয়ে উপরে উঠে গেল।রোদ্দুর ভাইদের আসার সময় হয়েছে।আজ সে শাড়ি পড়বে।

শাওয়ার নিয়ে টাওয়ালটা বেলকনিতে শুকাতে দিল অহি।দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়েছে অনেক আগেই।রোদের তেজ কমে গেছে।গোধূলি লগ্নের এই শেষ বিকেলটা যেন শুধুমাত্র রোমান্টিকতার জন্যই সৃষ্টি!ইশ!এমন একটা বিকেলে যদি হুডতোলা কোনো রিকশায় সে আর রোদ্দুর ভাই পাশাপাশি থাকতো!কারণ ছাড়াই সে হুট করে রোদ্দুরের হাত চেপে ধরতো তখন।কখনো বা চুলগুলো এলোমেলো করে দিতো!

“আটকে তোকে রাখতে চাইছি খুব সকালে আমার,বিকেলে আমার!”

গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে রুমে ঢুকলো অহি।ওয়ারড্রবের কাপড়ের সারি থেকে বেছে বেছে সবুজ রঙের,কালো পাড়ের শাড়ি বের করলো।

রোদ্দুর অহিদের বাসায় ঢুকেই প্রথমে রোদেলা আপুর খোঁজ করলো।রোদেলা ঘুমাচ্ছে শুনে অপূর্বের সাথে কিছুক্ষণ দুষ্টুমি করলো।তারপর অহির রুমের দিকে পা বাড়ালো।

অহির রুমের দরজা ভেতর থেকে আটকানো।রোদ্দুর বিরক্ত হলো।দিনে দুপুরে এরা দরজা বন্ধ করে কি করে তা আল্লাহ মালুম!সে কপাল কুঁচকেই দরজার উপর একের পর এক আঘাত করলো।

সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল।রোদ্দুর হেলাফেলা করে ভেতরে ঢুকে অহির বিছানায় বসলো।ড্রেসিং টেবিলের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত গলায় বললো,

—“এই অসময়ে দরজা বন্ধ করে কি করিস বল তো?প্রেম ট্রেম করিস নাকি?বয়ফ্রেন্ড আছে?”

অহির মনটা খারাপ হয়ে গেল।আশাহত হলো সে।নাহ!মানুষটা তাকে আর কোনোদিন বুঝবে না।একে দিয়ে আর কোনো আশা ভরসা নেই।এখন পর্যন্ত তার দিকে চোখ তুলে তাকায়নি।

মনে মনে বলল,

“জগতের সব মানুষের ব্যাপারে তোমার কত্তো কৌতূহল রোদ্দুর ভাই।শুধু আমার ব্যাপারে তুমি এতো নির্লিপ্ত কেন?”

কন্ঠে একরাশ বিষণ্নতা ঢেলে মুখে বলল,

—“শাড়ি পড়ছিলাম রোদ্দুর ভাই।”

রোদ্দুর মাথা ঘুরিয়ে অহির দিকে তাকালো।সঙ্গে সঙ্গে তার চক্ষু কোটর থেকে বের হওয়ার উপক্রম হলো।অহিকে আজ জীবন্ত পরীর মতো লাগছে।তাকে এ পৃথিবীর মানুষ বলে ভ্রুম হচ্ছে।

সবুজ রঙের শাড়ি ফর্সা ত্বকে ফুটে উঠেছে।চোখে গাঢ় কাজল।ডান গালে টোল খাওয়া গর্ত, ভেজা ভেজা পাপড়ি গুলো চোখের উজ্জ্বলতা যেন বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে।টানা টানা ভ্রু যুগল যেন কাছে যাওয়ার জন্য আহ্বান করছে।ঠোঁটের হালকা পার্পল শেডের লিপস্টিক আর অবিন্যস্ত ভেজা চুলে অহিকে যেন অপ্সরীদের থেকেও সুন্দর লাগছে।ঠোঁটের উপরের বাদামি তিলটা যেন রোদ্দুরকে চুম্বকের মতো টানছে।এই প্রথম তার অহিকে ছুঁয়ে দিতে মন চাইলো।অন্য রকমের ছোঁয়া।

সে নিজের অজান্তে উঠে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বলল,

—“ও মাই গড!ও মাই গড!ও হঠাৎ করে এতো রূপবতী হলো কি করে?”

অহি চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে রোদ্দুর গভীর মনোযোগে তার দিকে চেয়ে আছে।চোখে মুখে অন্য ধরনের ঘোর।পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে আর বিড়বিড় করে কি যেন বলছে।

—“রোদ্দুর ভাই, আপনি ঠিক আছেন?”

বলে সে কয়েক পা এগিয়ে যেতেই রোদ্দুর চিৎকার করে ডান হাত সামনে এনে বলল,

—“খবরদার,কাছে আসবি না অজান্তা!ওখানেই থাক।এক পা নড়বি না।একদম কাছে আসবি না বলে দিলাম!”

অহি বারণ শুনলো না।সে বেশ বুঝতে পারছে কোনো একটা কারণে রোদ্দুর ভাই তাকে প্রচন্ড ভয় পাচ্ছে।সে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,

—“আপনি কি অসুস্থ?দেখি জ্বর এসেছে কি না?”

অহি হাত বাড়ানোর আগেই রোদ্দুর এক দৌঁড়ে ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।দরজায় ঠেস দিয়ে বসে পড়লো সে।তার বুকের ভেতর তোলপাড় হচ্ছে।এটা কি হলো তার সাথে?বুকের ধুকপুকানি যেন বেড়েই চলেছে।সে বুকের বা পাশে হাত দিয়ে চেপে বলল,

—“ও মাই গড!ও মাই গড!”

(চলবে)

মনে তো হচ্ছে রোদ্দুর অহির প্রেমে কাইত!আপনাগো কি মনে হয়? 🙃