Wednesday, July 16, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1573



পরিশিষ্ট পর্ব-০৬

0

#গল্পের_নাম: পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_৬ (বোনাস পার্ট)

অহি টলমল পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে সদর দরজার কাছে গেল।যত সূরা পারে সব মনে মনে পড়ে দরজা খুলল।সঙ্গে সঙ্গে রোদ্দুর ভাইয়ের বাজখাঁই গলা কানে এলো!

—“ফাঁসির কাষ্ঠে উঠেছিলি নাকি?এতক্ষণ লাগে দরজা খুলতে?তোর হাড় গোড় আজ আমি মাংস থেকে আলাদা করবো।”

অহি দু চোখে ঝাপসা দেখছে।তার সম্পূর্ণ শরীর থরথর করে কাঁপছে।চোখে অন্ধকার নেমে আসছে।সে ভয়ার্ত গলায় গড়গড় করে বলল,

—“রোদ্দুর ভাই, আমায় মাফ করুন।আমায় মাফ করুন।আমি ওসব পাঠাইনি।এই কাঠের দরজা ছুঁয়ে বলছি আমি ওসব পাঠাইনি।আমার আইডি হ্যাক হয়েছে।হ্যাঁ,আমার দোষ নেই!আমায় ক্ষমা করু……”

বাকিটুকু শেষ করার আগেই অহি শরীর এলিয়ে দিল।পড়ে যেতে নিতেই রোদ্দুর ঝটপট হাত বাড়িয়ে ধরে ফেলল।

রোদ্দুরের চোখে মুখে ভয় ছড়িয়ে পড়লো।সে অহির গালে আস্তে করে থাপড় মেরে বলল,

—“অজান্তা!হেই অজান্তা!তোর আবার কি হলো?চোখ খোল!চোখ খোল!কিছু দেখে ভয় পেয়েছিস?কি সব আবোল তাবোল বকছিস?কি পাঠসনি?”

অহি চোখ খুললো না।রোদ্দুর তাকে পাঁজা কোল করে সোফায় শোয়ালো।একি মুসিবতে পড়লো?দরজা খুলতে দেরি করছিল বলে সে ভেবে রেখেছিল দু একটা চড়, থাপ্পড় দিবে।আগের রাগও রয়েছে।তার ফোন কেন পিক আপ করছে না সেসব জিজ্ঞেস করবে।মেয়ে তো তার আগেই অজ্ঞান!

সে রান্নাঘর থেকে পানির জগ এনে অহির মাথায় দিল একটু।চোখে মুখে পানির হালকা ছিটা দিতেই অহি ধড়ফড় করে উঠে বসলো।তার শরীর কাঁপছে।চোখ মুখ ইতোমধ্যে লাল হয়ে গেছে।

রোদ্দুরকে সামনে দেখে আরো ভয়ে কুঁকড়ে গেল।চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু বের হলো।রোদ্দুর বুঝতে পেরে পানির জগটা মেঝেতে রেখে অহির মাথাটা নিজের কাঁধে চেপে ধরে বলল,

—“অজান্তা ভয় কেন পাচ্ছিস এত?কিছু হয়েছে?বল আমায়!”

অহির শরীরের কাঁপুনি আস্তে আস্তে থামলো।সে চোখ মুছে হালকা স্বরে বলল,

—“আমি ওসব ইচ্ছে কৃত ভাবে পাঠাইনি রোদ্দুর ভাই।অন্য কেউ ফাজলামো করে পাঠিয়েছে।আমায় ক্ষমা করুন!”

রোদ্দুর কপাল কুঁচকে বলল,

—“দিব এক চড়!কি সব ছাই পাস বলছিস?কিছু খেয়েছিস অজান্তা?”

অহিরও কপাল কুঁচকে উঠলো।সে রোদ্দুরের কাঁধে থেকে মাথা সরিয়ে তার মুখপানে তাকালো।এত স্বাভাবিক কেন?রোদ্দুর ভাই কি তাহলে মেসেজটা দেখেনি?

মুহূর্তে অহির সারা মুখে হাসি ছড়িয়ে পড়লো।যাক বাবাঃ!এ যাত্রায় সে হয়তো বেঁচে গেল।সে দ্রুত রোদ্দুরের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে একটু দূরে গিয়ে বসলো।

রোদ্দুর এখনো কপাল কুঁচকে অহির দিকে চেয়ে আছে।অহিকে তার স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না।কেমন উদ্ভট আচরণ করছে।এই কাঁদছে তো এই হাসছে!

সে একটু অহির কাছাকাছি বসে বলল,

—“অজান্তা তুই ঠিক আছিস তো?এত বড়ো বাসায় তোকে একা রেখে এরা কিভাবে যায়?কবে যে এদের আক্কেল হবে কে জানে!তোর কি জ্বর টর?”

বলেই সে অহির কপালে হাত রাখলো।ঠান্ডা হাতের স্পর্শ পেয়ে অহি কেমন কেঁপে উঠে।দ্রুত হাতটা সরিয়ে বলে,

—“আমি একদম ঠিক আছি।আসলে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখে একটু ভয় পেয়েছিলাম।”

—“আহ!তাই বল!আমি তো ভেবেছিলাম কি না কি হয়ে গেল।সাত মিনিট দরজার বাইরে দাঁড়িয়েছিলাম।এমন রাগ উঠেছিল না!তুই যদি সেন্সলেস না হতি তাহলে এতক্ষণে আমার হাতের পাঁচটা আঙুল তোর গালে ফুটে উঠতো!”

অহি মাথা নিচু রেখে বলল,

—“আপনি হঠাৎ আমাদের এখানে কেন?অফিস যাননি?”

—“আমি ছুটিতে আছি।বাবা একাই সব সামলাচ্ছে।তুই এখন তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নে।”

অহি অবাক হয়ে রোদ্দুরের দিকে তাকালো।রোদ্দুর হাত দুটো সোফায় এলিয়ে দিয়ে রিলাক্স হয়ে বসলো।চোখ দুটো বন্ধ করে বলল,

—“রোদেলা আপু নিয়ে যেতে বলেছে তোকে।আপুর কলেজে কি যেন একটা প্রোগ্রাম।দুপুর দুটো থেকে আরম্ভ।নে, চট জলদি রেডি হ।”

—“আমি যাব না রোদ্দুর ভাই।আমার প্রোগ্রাম ট্রোগ্রাম ভালো লাগে না।”

রোদ্দুর চোখ না খুলেই বলল,

—“আমি অসহায়।তোর কথা রাখতে পারবো না রে।রোদ আপুর পারমিশন।সোজা কথায় না গেলে জোর করে কোলে তুলে নিয়ে যেতে বলেছে।সময় বেশি নেই।তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নে।পায়ে হেঁটে যাবি নাকি…….”

—“বাসায় তো কেউ নেই।খালি বাসা রেখে যাব কিভাবে?যদি চুরি হয়ে যায়?”

—“হবে না।খালুর সাথে কথা হয়েছে।দুপুরে কলেজ ছুটি হয়ে যাবে।আর একটাও কথা না।দশ মিনিট সময় দিলাম।রেডি হয়ে নে।আমি এই দশ মিনিট একটু ঘুমাব।কয়েক দিন হলো অফিসের কাজের চাপে ঘুমানোর সময়ও পাই না।”

রোদ্দুর চোখ বন্ধ রেখেই সোফায় পা টান করে ঘুমিয়ে পড়লো।অহি উঠে গিয়ে জায়গা করে দিল আরো।কয়েক সেকেন্ড রোদ্দুরের মুখের দিকে চেয়ে উপরে উঠে গেল।

কিছুক্ষণ পর ব্যাগ কাঁধে নিচে নামল অহি।হিজাবে শেষ পিনটা গেঁথে বলল,

—“রোদ্দুর ভাই উঠুন।আমি রেডি।”

রোদ্দুর উত্তর দিল না।সে এখন গভীর ঘুমে।ক্ষণে ক্ষণে ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ আসছে শুধু।অহি কাঁধের ব্যাগটা অন্য সোফায় রেখে গভীর মনোযোগে রোদ্দুরের দিকে তাকালো।কতগুলো দিন পর এত কাছে থেকে দেখছে!

সে বিড়বিড় করে বলল,

“গাছে গাছে পাখিরা গাহিছে কুজন,
চলো আরো একবার প্রেমে পড়ি দুজন!
অ-প্রেম কেটে গিয়ে ফুটুক প্রভাত
চলো আরো একবার হাতে রাখি হাত!”

~অজান্তা

হঠাৎ মনে পড়তেই অহি রোদ্দুরের আশপাশে ফোনটা খুঁজলো।কিন্তু কোথাও চোখে পড়লো না।বুকপকেটে নেই,প্যান্টের পকেটও উঁচু নয়।তাহলে?বাসায় রেখে এসেছে হয়তো!অহি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে রোদ্দুরের দিকে তাকালো।

রোদ্দুর ভাইয়ের সমস্ত শরীরে ক্লান্তি ভর করেছে।মুখটা আগের থেকে শুকিয়ে গেছে।চোখের নিচে কালো দাগ বসেছে।রোদ্দুর ভাই কি এখনো বৃষ্টি আপুর কথা ভেবে রাত জাগে?

অহির বুক কাঁপে।বার বার মনে হয়, মানুষটাকে শক্ত করে জড়িয়ে যদি তার সব দুঃখ নিজের করে নিতে পারতো!

সে পণ করে।একবার মানুষ টাকে কাছে পাওয়ার পর আর দূরে যেতে দিবে না।একটানা সাত দিন সব বাদ দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে থাকবে।তার বুক থেকে মাথা উঠাবে না। কোনো কষ্টকে ছুঁতে দিবে না।সবসময় ভালোবাসায় ডুবিয়ে রাখবে।সবসময় নিজের সাথে বেঁধে রাখবে।

হাত ঘড়ির দিকে তাকায় অহি।দুটো বাজতে মোটামুটি অনেক সময় বাকি।মানুষটা আর একটু ঘুমাক।সে রোদ্দুরের থেকে কয়েক হাত দূরে বসে তার মুখের দিকে অপলকভাবে চেয়ে থাকে।গুনগুন করে গেয়ে উঠে,

“অন্ধ হয়ে তোমায় আমি বেসেছি যে ভালো,
নাই বা থাকুক দু চোখ আমার, না বা থাকুক আলো!”

——————

রোদেলা আজ কালো রঙের সিল্কের শাড়ি পড়েছে।গলায় চিকন চেইনের সাথে ছোট্ট একটা লকেট।চুলগুলো ছাড়া।আর কোনো অর্নামেন্টস নেই।এতটুকু তেই তাকে পরীর মতো লাগছে।কিশোরী মেয়েদের মতো ঝলমল করছে।অহি মুগ্ধ হয়ে বলল,

—“আপু,তোমাকে কি সুন্দর লাগছে!তোমার মনের মতোই তুমি সুন্দর।তুমি এত সুন্দর কেন?”

রোদেলা কিশোরী মেয়েদের মতো খিলখিল করে হাসে।অহির মাথায় একটা চাটি মেরে বলে,

—“তোর দেখার চোখ সুন্দর রে অহি।সেজন্য আমাকে ভালো লাগছে।”

অহি কিছু বলতে নিতেই গাড়ি থেমে যায়।তারা কলেজে পৌঁছে গেছে।অহি রোদেলার শাড়ির রঙের সাথে ম্যাচিং করে আজ কালো রঙের লম্বা গোল জামা পড়েছে।সাথে কালো হিজাব।

রোদেলা গাড়ি থেকে নামলো।অহি তার পাশে এসে পলকহীন নয়নে কলেজ দেখলো।পুরো কলেজ ফুলে ফুলে ছেঁয়ে গেছে।আজ দ্বিতীয় বারের মতো সে এই কলেজে ঘুরতে এলো।

দুজন ভেতরে হাঁটা ধরলো।ভেতরটা মানুষে গিজ গিজ করছে।টিচার,স্টুডেন্ট সবমিলিয়ে হাজার মানুষ।একটা প্রিন্সপালের রিসিপশন যে এত জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে পালন করে তা অহির অজানা ছিল।

সে রোদেলার হাত চেপে ফিসফিস করে বলল,

—“আপু,নতুন প্রিন্সিপাল ইয়াং নাকি বয়স্ক মানুষ?”

—“আমি কিভাবে বলবো রে পাগলা?বিদেশ টিদেশ থেকে হরেক রকমের ডিগ্রি নেয়া নাকি।তাহলে তো বয়স্ক মানুষই হওয়ার কথা!”

গার্ডিয়ান সাড়িতে অহিকে বসিয়ে রোদেলা বলল,

—“অহি সোনা!এখানে চুপচাপ বসে থাকো।আমি টিচার্স রুম থেকে ঘুরে আসি।দেখি,কোন কাজ আছে কি না আমার।”

—“হুঁ!”

—“তুই কিন্তু এখান থেকে নড়বি না।এত মানুষের ভিড়ে হারিয়ে গেলে খুঁজে পাওয়া অনেক টাফ হবে।এখানেই বসে থাকবি,কেমন?”

—“আপু,তুমি যাও।আমি এখানেই থাকবো।”

রোদেলা চলে গেল।অহি চুপচাপ চারিদিকে তাকালো।ফোনটা বের করে দেখলো,রোদ্দুর ভাই এখনো মেসেজ চেক করেনি।মেসেজটা চোখে পড়লে কি যে হবে কে জানে!অহির গা দিয়ে চিকন ঘাম বের হওয়া শুরু হলো।

আধ ঘন্টার মধ্যে অনুষ্ঠান শুরু হলো।রোদেলা স্টেজের উপর বিশাল বড়ো এক ফুলের বুকে হাতে দাঁড়িয়ে আছে।নতুন প্রিন্সিপালকে ফুল দিয়ে বরণ করার দায়িত্ব তার উপর পড়েছে।সমস্ত টিচার্সদের মধ্যে সেই একমাত্র ইয়াং নাকি সেজন্য!

রোদেলা চক্ষু ডান দিকে সামান্য ঘুরিয়ে অহির দিকে তাকালো।অহি ঝলমলে মুখে হাত নাড়লো।রোদেলা মুচকি হাসে!

তার পা ধরে আসছে।অনেক্ক্ষণ হলো এভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে।প্রিন্সিপালের স্টেজে উঠার খবর নেই।প্রিন্সিপাল কলেজে এসে পৌঁছেছে মিনিট বিশেক আগে।সে খবর রোদেলার কানে এসেছে।কিন্তু স্টেজে কেন আসছে না?টিচার হওয়ার এই এক ঝামেলা।দুদিন পর পর এটা ওটা উপলক্ষে ঘন্টার পর ঘন্টা উপর মহলের লোকদের গুরুগম্ভীর বকবকানি শুনতে হয়।শুধু শুনলে হয় না,মনোযোগী হওয়ার ভান ধরতে হয়!

রোদেলার ভাবনার মাঝে চারিপাশ করতালিতে মুখরিত হয়ে গেল।হাজারো হাতের শব্দে তার কান ঝাঁ ঝাঁ করা শুরু হলো।শব্দ যেন মধ্য পর্দা ভেদ করে মস্তিষ্কে প্রতিটি নিউরনে গিয়ে আঘাত হানছে।রোদেলা চোখ বন্ধ করে আবার খুলল।

ভাইস প্রিন্সিপাল তার নাম ধরে ডাকছে।ক্রমাগত স্পিকারে বলে যাচ্ছে, অত্র কলেজের সম্মানিত নতুন প্রিন্সিপাল,জুলকারনাইন সাদিদ,বিএসসি,এমএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়;পিএইচডি, কানাডা!উনাকে ফুল দিয়ে বরণ করে নিচ্ছে এই কলেজের ইংরেজির প্রফেসর মিস রোদেলা জান্নাত!

স্পিকারে ঘোষিত নাম শুনে রোদেলার মাথা ঘুরছে।সে অগোছালো ভাবে হেঁটে সামনে এগিয়ে গেল।চারিদিক থেকে করতালির আওয়াজ ছাপিয়ে এক গুচ্ছ ক্যামেরার ফ্ল্যাশ জ্বলে উঠলো।কেউ একজন তার হাতে রাখা বুকেটার একপাশ ধরলো।

অনেক কষ্টে রোদেলা চোখ তুলে তাকালো।ফুলের একপাশ ধরে রাখা স্যুট,বুট পরিহিত হাস্যোজ্জ্বল চেহারার মানুষটিকে দেখে তার অন্তরাত্বা কেঁপে উঠলো।

মানুষটি হাসি মুখেই তার চোখের দিকে তাকালো।সেই চেনা চোখ, সেই পরিচিত হাসি!যে হাসিতে রোদেলা বহু বছর আগে ঘায়েল হয়েছে।

রোদেলার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে আসছে।গা গুলাচ্ছে।বমি বমি পাচ্ছে।নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।টেনে টেনে দু তিনবার শ্বাস নিয়েই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা নিষ্ঠুর মানুষটার উপর চোখ বন্ধ করে হেলে পড়লো!

(চলবে)

পরিশিষ্ট পর্ব-০৫

0

#গল্পের_নাম: পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_০৫

—“অজান্তা, খাইয়ে দে তো আমায়!আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করি।ক্ষুধায় শেষ আমি!”

অজান্তা আবার চমকায়।তার হাত কাঁপে।রোদ্দুর ভাই কি বিকেলের কথা ভুলে গেছে?এতদ্রুত ভুলে গেল?কিভাবে সম্ভব?

রোদ্দুর এক মনে ফোনে কি যেন করছে।দেখে মনে হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ কিছুই!কয়েক সেকেন্ড পর সে ফোন থেকে চোখ সরিয়ে অহির দিকে তাকালো।ভ্রু কুঁচকে বলল,

—“খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেন ?নে বোস।খাইয়ে দে।”

রোদ্দুর একটু সরে গিয়ে অহির জন্য জায়গা করে দেয়।তার ধমকেই অহি বসে পড়ে। প্লেটটা বেডে রেখে ভাত মাখানো শুরু করে।তিন রকমের ভর্তা দিয়ে সাদা ভাত শুধু।তরকারি রান্না হয়েছে আজ।কিন্তু অহি জানে রোদ্দুর ভাই ভর্তা বেশি পছন্দ করে।

শুটকি ভর্তা দিয়ে সে ছোট্ট করে একটা লোকমা করে রোদ্দুরের মুখের সামনে ধরে।আজ প্রথম সে রোদ্দুরকে খাইয়ে দিবে।তার যেন বিশ্বাসই হতে চায় না।যেই মানুষটা থেকে সবসময় পালিয়ে বেড়াতো,কিভাবে যেন সেই মানুষটার এত কাছাকাছি যাচ্ছে!

রোদ্দুর ভাতের লোকমা টা মুখে পুড়ে চিবিয়ে চিবিয়ে খায়।একটুপর ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বলল,

—“অজান্তা,তোকে বললাম ভাত খাইয়ে দে।আর তুই সঙ্গে সঙ্গে ভাত মাখানো শুরু করলি।হাত ধোয়ার প্রয়োজন বোধ করলি না?”

অহি জিভ কাটে।ছি!মনেই তো ছিল না।তার নিজের উপর বড্ড রাগ হয়।এতটা বেখেয়ালি মানুষ কিভাবে হয়?সে নিচু হয়ে দ্রুত হাতের ভাত ছাড়িয়ে বলে,

—“মনে ছিল না।এক্ষুনি হাত ধুয়ে নিচ্ছি।”

রোদ্দুর হো হো করে হেসে উঠে।অহি মুগ্ধ হয়ে তার দিকে চেয়ে থাকে।মানুষটা হাসলে সাথে চোখও হাসে।কি অনিন্দ্য সুন্দর সে দৃশ্য!এই মানুষটার হাসির শব্দও এত সুমধুর কেন?কানে মৃদু ঝংকার তুলে যায়।

সে বিড়বিড় করে বলে,

“তুমি হাসলে আমার ঠোঁটে হাসি
তুমি আসলে জোনাকি রাশিরাশি
রাখি আগলে তোমায় অনুভবে
বলো কি করে বোঝাই ভালোবাসি!”

রোদ্দুরের কানে তা পৌঁছাল না।সে প্রাণ খুলে হাসছে।হাসতে হাসতেই বলল,

—“তুই এতটা ডাফার আমি তো জানতাম না রে!ভাত মাখানো শেষ।এখন বলছিস হাত ধুবি!”

হঠাৎ করেই রোদ্দুরের হাসি থেমে যায়।অনেকটা বসন্তের পাগলা হাওয়ার মতো।হুট করে শুরু হয়ে হুট করে শেষ হয়ে যায়।

রোদ্দুর যেন ভুল করে হেসে ফেলেছিল।এক ধরনের অপরাধ বোধ জেগে উঠেছে তার সারা মুখ জুড়ে।সে ফোন নিয়ে পুনরায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে।

অহি বুঝতে পারে।সে ভাতের আরেক লোকমা তার মুখে পুড়ে দিয়ে অপরাধী সুরে বলে,

—“আমার হাত পরিষ্কার ছিল রোদ্দুর ভাই।মাত্র শাওয়ার নিয়েছি।”

—“তুই খেয়েছিস তো?”

অহির মুখে অযাচিত হাসি ফুটে উঠে।মাথা নেড়ে বলে,

—“হুঁ!”

তারপর বেশ কিছুক্ষণ দুজনের কেউ কোনো কথা বলে না।একটুপর রোদ্দুর নিজে থেকে জিজ্ঞেস করলো,

—“আমার জন্য বাসার সবাই চিন্তিত, তাই না রে অজান্তা?”

অহি কিছু বলে না।কি না কি বলে ফেলবে,আর রোদ্দুর ভাই আবার রাগ করবে।সে শুধু মাথা নেড়ে সায় জানায়।

রোদ্দুর নিজে থেকে বলে,

—“এভাবে নিজের জন্য এতগুলো মানুষকে কষ্ট দিয়ে লাভ নেই।ভাবতেছি কাল থেকে অফিস করবো।”

—“সেটা খুবই ভালো সিদ্ধান্ত।”

—“তোরা সবাই আমাকে খাওয়ানো নিয়ে ব্যস্ত।কিন্তু কেউ একবারের জন্যও জিগ্যেস করলি না হুট করে আমি খাওয়া বাদ দিলাম কেন?”

অহির চোখে মুখে ছটফটানি ভাব ছড়িয়ে পড়ে।সে অন্য দিকে তাকিয়ে বলল,

—“কেন?”

—“সাত দিন পর আজ ভোরে অনলাইনে ঢুকেছিলাম।উদ্দেশ্য বৃষ্টির আপডেট জানার জন্য।ভেবেছিলাম ও হয়তো আমাকে সমস্ত সোস্যাল মিডিয়ায় ব্লক করে দিয়েছে।কিন্তু না!কোনো জায়গা তেই ব্লক করেনি।উল্টো আমার ম্যাসেন্জারে ওর বিয়ের পিক পাঠিয়ে রেখেছে।”

—“কি!বৃষ্টি আপু ইতোমধ্যে বিয়ে করে নিয়েছে?”

—“হ্যাঁ রে।তাও আবার ওর সেই বেস্টফ্রেন্ডকে।শাকিল না কি যেন নাম!ওদের দুজনকে আমি মাঝে মধ্যে একসাথে দেখতাম।বৃষ্টিকে কিছু বলতেই ও বলতো,বন্ধু মানুষ।এভাবে ধোঁকা দিবে ঘুনাক্ষরেও টের পাইনি।এই আমি কে,এই রোদ্দুর হিমকে ও ধোঁকা দিয়েছে?এটা ভাবা যায়?”

রোদ্দুরের চোখের কোণ ভিজে গেছে।সাদা আলো সেখানটায় প্রতিফলিত হয়ে বালির মতো চিকচিক করছে।অহি মানুষটার ব্যথা অনুভব করতে পারছে যেন!

রোদ্দুর নিজেকে সামলে বলে,

—“বুঝলি অজান্তা!সকালবেলা ভেতরটা পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছিল।কেমন যেন পাগল পাগল আর শূন্য লাগছিল নিজেকে।সেজন্য ভাবলাম,নিজেকে শারীরিক ভাবে কষ্ট দিবো।তাতে যদি মনের কষ্ট একটু কমে!এবং অবাক করা বিষয় হলো তাতে সত্যি মনের কষ্ট কমতে শুরু করলো।দুপুরের দিকেই বৃষ্টির কষ্ট ছাপিয়ে ক্ষুধার কষ্ট মাথাচাড়া দিয়ে উঠছিল।রাত হতে হতেই অনেকখানি কমে গেছে।আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি বৃষ্টিকে ভোলার জন্য, ওকে উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য, অন্য কাউকে বিয়ে করবো।কি বলিস?”

অহির হাত থেমে যায়।বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠে।রোদ্দুর ভাই তাহলে আবার অন্য কাউকে বিয়ে করবে?

অহি প্লেটের বাকি ভাতটুকু রোদ্দুরের মুখে পুড়ে দিয়ে বলল,

—“বিয়ে করবেন, ভালো কথা।এতদ্রুত মেয়ে কোথায় পাবেন?”

—“তোরা খোঁজ নিবি।রোদ আপু আছে,তুই,মা, খালামণি,খালু সবাই আছে।বাইরে গিয়ে রোদ আপুকে পাঠিয়ে দিস তো।কথা বলবো।”

অহি উঠে দাঁড়ালো।প্লেট গুছিয়ে হাতে নিয়ে সামনে পা বাড়াতেই রোদ্দুর ধমকে বলল,

—“পানি খাওয়াবে কে?টেবিল থেকে পানির গ্লাস দিয়ে যা।আমি ভেবেছিলাম তুই হয়তো একটু পরিবর্তন হয়েছিস।না তো!তুই তো সেই আগের মতই বেয়াদব আছিস।হুট করে কিছু না বলেই চলে যাচ্ছিস।”

অহি থামে।তার পা ভারী হয়ে গেছে।গলা দিয়ে কোনো কথা বের হচ্ছে না।নিজেকে কেমন অসাড় অসাড় লাগছে।সে এগিয়ে গিয়ে টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে রোদ্দুরের হাতে ধরিয়ে দিল।

রোদ্দুর এক চুমুকে পানিটুকু শেষ করে বলল,

—“নিচে প্লেট রেখে আরেক বার আমার রুমে আসিস তো।রান্নাঘর থেকে সরিষার তেল নিয়ে আসবি।আমার মাথায় সরিষার তেল ঘষে দিবি।আমি একটু ঘুমাব।অনেক দিন হলো ঘুমাতে পারি না।”

অহি দৃঢ় কন্ঠে বলল,

—“আমি পারবো না রোদ্দুর ভাই।অন্য কাউকে বলুন।”

অহির কাঠ কাঠ জবাব শুনে চমকে তার মুখপানে তাকায় রোদ্দুর।কয়েক সেকেন্ড পর বলে,

—“তুই হঠাৎ এমন কঠিন হয়ে গেলি কেন?আমি কি তোকে ভুল কিছু করতে বলেছি?মাথায় একটু জাস্ট তেল দিয়ে দিতে বলেছি।কবে জানি তোদের বাসায় গিয়ে দেখলাম, অপূর্বর মাথায় বিলি কেটে দিচ্ছিস।সেজন্য বললাম।অপূর্ব আর আমার মধ্যে তফাৎ কোথায়?মেয়ে জাতি মানেই অদ্ভুতের কারখানা। যা যা!লাগবে না।তুই রোদ আপুকে পাঠিয়ে দে।আপু দিয়ে দিবে।”

অহি কিছু বললো না।দাঁতে দাঁত চেপে কান্না আটকালো।সে বড় হয়ে গেছে।কিছুদিন পর তার বয়স বাইশে পড়বে।এই বয়সে হুটহাট কান্না করা একদম সাজে না।

সে অসাড় পা দুটোকে টেনে টেনে প্লেট হাতে বাইরে বের হয়ে গেল।একবারের জন্যও পিছন ফিরে তাকালো না।ভোর হলেই সে এ বাসা থেকে চলে যাবে।আর কোনোদিন পা রাখবে না।

——————

অহি নিজের বাসায় তার বিছানায় শুয়ে ফোন নিয়ে নাড়াচাড়া করছে।এই ভোরবেলাতেই ‘রোদ্দুর হিম’ নামক মানুষটার ফেসবুক আইডি পনেরো বারের মতো দেখা হয়ে গেছে।

এক মাসের বেশি হলো সে ও বাসা থেকে চলে এসেছে।আর যায় নি।ইতোমধ্যে নতুন করে রোদ্দুরের বিয়ের তোড়জোড় চলছে।ডজন ডজন মেয়ে দেখা হচ্ছে।সেসব মেয়ে খালামনির নাকি পছন্দ হচ্ছে না।রোদ্দুর এবার নাকি পরিবারের পছন্দের মেয়েকে বিয়ে করবে।

কিন্তু কেউ একটি বারের জন্যও অহির নামটি উচ্চারণ করছে না।রোদেলা আপু,অপূর্ব এ দুটো মানুষ তো অন্তত জানে সে রোদ্দুরকে ভালোবাসে।কিন্তু তারাও কেমন নির্বাক রয়েছে।

বিগত এক মাসে রোদ্দুর বেশ কয়েকবার মেয়ে দেখার জন্য অহিকে ফোন করেছে।কিন্তু সে ইচ্ছে করে ফোন রিসিভ করেনি।কেন করবে?মানুষটা তাকে কেন বোঝে না?সে যে সামনাসামনি রোদ্দুর ভাইকে প্রোপোজ করবে সে সাহসও নেই।ভয় লাগে।যদি বৃষ্টি আপুর সতো প্রথমেই রিজেক্ট করে দেয়?তাহলে সে মুখ দেখাবে কি করে?

অহি এক লাফে বিছানা থেকে উঠে সারা রুমে পায়চারি করলো।কয়েক বার বেলকনিতে গিয়েও ঘুর ঘুর করলো।কি করবে কিছু বুঝতে পারছে না।ভেতরটা কেমন অশান্ত!আজ তার মা কাজের লোকসহ সবাইকে নিয়ে আবার খালামণির বাসায় গেছে।সদরঘাটের ওদিকে নাকি মেয়ে দেখতে যাবে।

অহি কয়েক সেকেন্ড এক জায়গা দাঁড়িয়ে গভীর কিছু চিন্তা করলো।টেবিলের উপর রাখা জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে ঢকঢক করে শেষ করলো।তারপর বিছানা থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে বেলকনিতে বসলো।

রোদ্দুর হিম নামক আইডির ম্যাসেন্জারে ঢুকে বাংলায় টাইপ করলো,

“রোদ্দুর ভাই, এবার যদি আমাকে রেখে অন্য কাউকে বিয়ে করিস তাহলে তোকে একদম খুন করে ফেলবো।তারপর নিজের গলায় দড়ি দিবো।আমার গল্পের প্রথম পাতায়, মাঝামাঝিতে বা শেষ অধ্যায়ে তুই না থাকলেও পরিশিষ্টে তোকে চাই।শুধু তোকে চাই।রোদ্দুর হিমকে চাই।”

এটুকু লিখে সেন্ড করে দিল।অহির হাত পা কাঁপছে।এভাবে লেখা কি খুব প্রয়োজন ছিল?রোদ্দুর ভাই কি না কি ভাববে কে জানে?

অহি নেশাখোর দের মতো টলতে টলতে রুমে ঢুকলো।বিছানায় গা এলিয়ে দিল।তার মাথা ঘুরছে।সাথে পুরো পৃথিবী!

চোখ বন্ধ করে ফোনটা হাতে নিল।দ্রুত ম্যাসেন্জারে ঢুকে ম্যাসেজটা রিমুভ করতে চাইলো।কিন্তু হলো না।সে ফোনটা এক ঢিল দিয়ে বিছানার অপরপাশে ফেললো।তারপর নিজেকে জঘন্য ভাষায় গালি দিল।

মিনিট দশেক পরেই তাদের বাসার কলিং বেল বাজা শুরু হলো।অহি চমকে চোখ খুলে বড়ো বড়ো করে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকে।এই সময় আবার কে এলো?

রোদ্দুর ভাই না তো?আল্লাহ গো!

অহি এক লাফে বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করে ভেতরে ঢুকে বসে রইলো।সদর দরজার ওপাশে কেউ অনবরত কড়া নেড়ে যাচ্ছে।ভেঙে ফেলবে প্রায়!কিন্তু কেউ খুলছে না কেন?

পরমুহূর্তে অহির মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেল।বাসায় তো সে বাদে দ্বিতীয় কেউ নেই!

(চলবে)

রিচেক করা হয়নি।ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।🥰🙂

পরিশিষ্ট পর্ব-০৪

0

#গল্পের_নাম : পরিশিষ্ট
#লেখিকা : অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_০৪

রোদ্দুর কোনো কথা না বলে অহিকে একটানে রুম থেকে বের করে দিয়ে তার মুখের সামনে ঠাস করে দরজা আটকে দেয়।অহি কিছু বলার সুযোগটাও পায় না।

সে ফের দরজায় টোকা দিতে নিয়েও হাত ফিরিয়ে আনে।রোদ্দুর এখন অনেক রেগে আছে।রাগের বশে তাকে চড়, থাপ্পড় মারতে পারে আবার।যেটা খুবই লজ্জাজনক হবে!

অহি নিচে নেমে আসে।সোফায় শাহিনুর আধ শোয়া হয়ে আছে।রোদেলা পাশে বসে মায়ের মাথায় তেল পানি ঘষে দিচ্ছে।অহিকে দেখেই রোদেলা ঝটপট বলে,

—“কি রে!খাওয়াতে পারলি কিছু রোদ্দুরকে?”

রোদেলা রোদ্দুরের থেকে বয়সে দুই বছরের বড়ো।তার বয়স কয়েক মাস পর আটাশে পড়বে।কিন্তু এখনো বিয়ে করেনি।তাকে বিয়ের জন্য অনেক জোরজবরদস্তি করেও রাজি করানো যায় নি।বাধ্য হয়ে তার আগেই রোদ্দুরের বিয়ের আয়োজন করা হয়েছিল।

অহি ডাইনিং এর চেয়ার টেনে এনে খালার মুখ বরাবর বসে। খালাও অধির আগ্রহ নিয়ে তার মুখপানে চেয়ে আছে।রোদ্দুর খেয়েছে কি না তার উত্তর জানতে চায়।

খালাকে দুশ্চিন্তা মুক্ত করার জন্য অহি বলে,

—“খালামণি, রোদ্দুর ভাই খাচ্ছে।আমি দেখে এসেছি।খেয়ে ঘুমাবে একটু।সেজন্য আমি চলে আসলাম।”

শাহিনুর ব্যথাতুর গলায় বললো,

—“চারপাশে কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছি না আমি।আমার দুটো মাত্র সন্তান।তার একটা পণ করেছে জীবনে বিয়ে করবে না।আরেকটার বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে পাগলপ্রায় অবস্থা।”

এটুকু বলেই তিনি কিশোরী মেয়েদের মতো নাক টেনে কান্না শুরু করলো।রোদেলা বিরক্ত হয়ে বলল,

—“মা,আমি কবে বলেছি যে, আমি জীবনে বিয়ে করবো না?বলেছি যে, তোমরা যে ছেলে ধরে আনো তাদের আমার পছন্দ হয় না।আর অপছন্দের কিছু নিয়ে আমি সারাজীবন একত্রে সংসার করতে পারবো না।”

—“তা তুই কাউকে পছন্দই কর না!তোর পছন্দের কাউকেই নিয়ে আয়।বিয়ে দিয়ে চিন্তামুক্ত হই আমরা।”

রোদেলা কিছু বলতে নিতেই অহি থামিয়ে দিল।নরম গলায় বললো,

—“আপু, তুমি খালাকে ধরো।রুমে শুইয়ে দিয়ে আসি।”

দুজন দুপাশ থেকে ধরে শাহিনুরকে রুমে নিয়ে শুইয়ে দিয়ে আসে।তারপর দুজন রোদেলার রুমে ঢুকে।

এ বাসায় আসলে অহি রোদেলার রুমই নিজের করে নেয়।থাকার মতো অসংখ্য ফাঁকা রুম থাকলেও অহি রোদেলা আপুর সাথেই থাকে।আপু অনেক মজার মানুষ।আর প্রচুর জ্ঞান।জ্ঞানীদের মতো গুছিয়ে, কি সুন্দর করে হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলে।অহি মুগ্ধ হয়ে তার প্রতিটা কথা শোনে।

আর রোদেলার প্রতিটি কথা সে বেদ বাক্যের মতো মানে।

রোদেলা আপুর ইংরেজিতে অনার্স, মাস্টার্স শেষ তিন বছর হলো।এখন ঢাকার টপ প্রাইভেট কলেজের ইংরেজির প্রফেসর।নিজেদের বিজনেসে তাকে জব করতে বলেছিল।কিন্তু আপু রাজি হয়নি।

তার নাকি শিক্ষকতা প্রচুর ভালো লাগে।

রোদেলা রুমে ঢুকেই এক লাফে বিছানায় উল্টো হয়ে শোয়।কিছুক্ষণ গড়াগড়ি করে বলে,

—“রোদ্দুর এখনো কিছু খায়নি,তাই নারে অহি?”

অহি চমকিত হয়।নিজেও আপুর পাশে শুয়ে বলে,

—“তুমি কিভাবে বুঝলে আপু?”

—“ছাড় না!বুঝতে পেরেছি আমি।তোকে নিশ্চয়ই কোনো একটা কারণে রেগে মেগে ঘর থেকে বের করে দিয়েছে।আমরা দুজন একই মায়ের গর্ভের হয়েও কতটা আলাদা দুজন, দেখছিস অহি?রোদ্দুর প্রচন্ড রাগী, জেদি,কথা বলতে চায় না বেশি,বললেও মুখের উপর ঠাস করে সব বলে দেয়।আর আমি ওর থেকে পুরো ভিন্ন।শান্ত,বোকা টাইপের,রাগ-জিদ কিচ্ছু নেই,বাচাল,অগোছালো ভাবে বকবক করতে থাকি সবসময়।সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটো চরিত্র।”

—“তুমি জানো আপু,তুমি মানুষ হিসেবে অসাধারণ।আমাকে যদি পাঁচ জন ভালো মানুষের লিস্ট করতে দেয় তাহলে এক নাম্বারে তুমি থাকবে আপু।”

রোদেলা হেসে বলে,

—“আমাকে এক নাম্বার স্থান দিয়ে দিলি?তাহলে তোর রোদ্দুর ভাইকে কয় নাম্বারে রাখবি?নিজের ভালোবাসার মানুষকে এক নাম্বারে রাখবি না,এটা কেমন কথা?”

অহির সারামুখে লজ্জা ছড়িয়ে পড়ে।রোদেলা আপু তাহলে তার ব্যাপারটাও ধরে ফেলেছে?সে কিছু না বলে চোখ বন্ধ করে।

রোদেলা অহির দিকে না তাকিয়েই বলে,

—“বেশি চিন্তা করিস না।বৃষ্টি রোদ্দুরের জন্য সঠিক ব্যক্তি ছিল না।ব্যাপারটা ভাইও কিছুদিন পর বুঝতে পারবে।আসলে বৃষ্টি রোদ্দুরকে ছেড়ে চলে যাওয়ায় যতটা না কষ্ট পেয়েছে তার চেয়ে বেশি ইগো তে লেগেছে।এতগুলো মানুষের সামনে বিয়ে ভেঙে যাওয়া চূড়ান্ত অপমানকর।কিছুদিন গেলেই ভাই ঠিক হয়ে যাবে।নতুন করে তখন নিজের করে নিস।তুই তো আর ছোট নেই অহি।প্রকৃতি কিন্তু সব মানুষকে সেকেন্ড চান্স দেয় না।এবার রোদ্দুর অন্য কারো হওয়ার আগেই নিজের আঁচলে বেঁধে নিস।”

রোদেলা থামে।অহি শোয়া অবস্থাতেই হাত বাড়িয়ে বালিশ টেনে আনে।একটা নিজের মাথার নিচে দিয়ে আরেকটা রোদেলার মাথার নিচে দেয়।তারপর একপাশ হয়ে রোদেলার দিকে তাকায়।

চিকন ভ্রু যুগল,একটু মোটা নাক,পাতলা ঠোঁট,ফর্সা ত্বক,আর ঝলমলে চোখ দুটো নিয়ে কি সুন্দর চেহারা রোদেলা আপুর।যে কেউ রোদেলা নামক মানুষটাতে আটকে যাবে!রোদেলা আপুর সবকিছুতে অহি মুগ্ধ।

সে রোদেলার ঘন চুলে হাত বুলিয়ে বলে,

—“আপু,তুমি এত ভালো কেন?তোমার মন এত সুন্দর কেন?জানো,যেই মানুষটা তোমায় পাবে সে এই পৃথিবীর সবচেয়ে লাকি পারসন হবে!”

রোদেলা হাসে।কি প্রাণবন্ত সে হাসি!হাসতে হাসতে অহির নাকে আলতো করে ছোঁয়।

অহি ফের বলে,

—“আচ্ছা, আপু!এতগুলো বসন্ত পেরিয়ে গেল।অথচ সত্যিই কি তোমার কাউকে পছন্দ হয়নি কোনোদিন?ইট,পাথরের শহরের এত এত প্রেমিক যুগলের ভীড়ে তোমার একবারের জন্যও কারো হাত ধরতে ইচ্ছে হয়নি?”

রোদেলা পাশ ফিরে অহির মুখোমুখি হয়।হাসি হাসি মুখে বলে,

—“বাদ দে এসব।তোকে একটা গল্প বলি।একটা মেয়ের গল্প।সদ্য ১৭ তে পা রাখা প্রাণোচ্ছল একটা মেয়ে। নতুন কলেজে উঠেছে তখন সে।নতুন কলেজ,নতুন পরিবেশ, নতুন টিচার,নতুন বন্ধুবান্ধব।এত এত নতুনত্বের মাঝেও মেয়েটা নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছিল না।বহু কষ্টে এক মাস ক্লাস করার পর সে যখন সিদ্ধান্ত নেয় টিসি নেবে তখন তার জীবনে একটা মীরাকল ঘটে।একদিন একটু লেটে ক্লাসে ঢুকতে গিয়ে দেখে নতুন এক শিক্ষক।ঝাকড়া চুলের সদা হাস্যোজ্জ্বল এক সুদর্শন ছেলে।

কি মনে করে যেন ছেলেটি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে প্রথম দেখাতেই স্মিত হাসলেন।ব্যস!সেই হাসিতেই কিশোরী মেয়েটা ঘায়েল।তাকে নিয়ে মস্তিষ্কে জলজ্যান্ত এক সংসার সাজাতে বসলো।একটু সময়, সুযোগ পেলেই কল্পনার শহর খুলে বসতো।ক্লাসে হা হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকতো।

তিন মাসের মাথায় হুট করে স্যারটা আসা বন্ধ করে।কিশোরী মেয়েটা দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়।এর ওর মুখে শুনতে পায়,স্যারটা নাকি এ বছরই ভার্সিটি কমপ্লিট করেছে এবং পিএইচডির জন্য কানাডা চলে গেছে।বিদেশ যাওয়ার মাঝের তিন মাস কলেজে গেস্ট টিচার হিসেবে ছিল।

ব্যস!কিশোরী মেয়েটার মনটা ভেঙে চুড়ে, খান খান হয়ে যায়।মস্তিষ্কে স্বযত্নে সাজানো প্রথম ঘর বাঁধা সংসারটা ঝড়ো বাতাসে দুমড়ে মুচড়ে যায়।কিশোরী মেয়েটার সব অভিমান গিয়ে জমা হয় টিচারবেশী ছেলেটার উপর।কেন, মেয়েটির থেকে বিদায় নিয়ে যায় নি?তবে কি সে মেয়েটির মনের ভাষা পড়তে পারেনি?না পারলে কেন মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আশকারার হাসি দিত?কেন টুকটাক কথা বলে তার কল্পনার শহরে রামধনু উঠাতো?

সেই থেকে কিশোরী মেয়েটার কি যেন হয়ে গেল।তার বয়স বাড়লো ঠিকই, কিন্তু ছোট্ট মনটাতে আর কাউকে বসাতে পারলো না কোনোদিন!”

রোদেলা কাঁদছে।নিরব,নিঃশব্দ সে কান্না।সে কান্নার আওয়াজ যেন অহির কান অবধিও পৌঁছে না।শুধু থেকে থেকে তার শরীর কেঁপে উঠে।অহি ডান হাতে রোদেলার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে শুধু।

অহির দু চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকায়।তার রোদ আপুরো এত কষ্ট?কই, কাউকে তো কখনো বুঝতে দেয় না?তার বাচ্চাদের মতো ওই খিলখিল হাসির আড়ালে লুকানো কষ্টের পাহাড়টা কেন কারো চোখে পড়েনি?

অহি মনে মনে আওড়ায়—

“ক্ষত শুকিয়ে গেলেও কিছুটা
চিহ্ন তো থেকেই যাবে
পোড়া স্মৃতির মতো
অথবা সঞ্চিত বিষাদ।
তুমি তো আঙুল তুলেই দেখিয়ে দিলে
অথচ বললে না
কোন পথে যেতে হবে আমাকে
কোন দিকে!

কবিতাঃকোন পথে যেতে হবে আমাকে
-রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্”

চারিদিকে সন্ধ্যা নামা শুরু হয়েছে।রুমটা অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে।তবুও অহি উঠে আলো জ্বালায় না।যাদের মনের শহরে এত এত অন্ধকার, বাহ্যিক আলো কি তা দূর করতে পারবে?

———————-

রাতের বেলা এক প্লেট খাবার হাতে নিয়ে রোদ্দুরের দরজার সামনে দাঁড়ায় অহি।অনেক সাহস করে এসেছে সে।বিকেলের পর এক সেকেন্ডের জন্যও দেখা হয়নি দুজনের!

দরজায় টোকা দিতেই খুলে গেল।ভেড়ানো ছিল শুধু।বাহ!অবস্থার একটু বোধ হয় উন্নতি হয়েছে।দরজা যেহেতু খুলে রেখেছে।

রোদ্দুর বিছানায় শুয়ে ফোন টিপছিল।তার ভ্রু যুগল কুঁচকানো।পরণে কালো টিশার্ট আর কালো ট্রাউজার।টিশার্টের কলার উঁচু নিচু হয়ে আছে।মাথার চুল গুলো শাওয়ারের পর ব্রাশ করা হয়নি।এলোমেলো ভাবে কপাল লেপ্টে আছে।

অহি যে ভেতরে ঢুকে সেটা এখনো অনুভূতিতে আসেনি।অহির মন খারাপ হয়ে গেল।সে কত মনোযোগ দিয়ে মানুষটার খুঁটিনাটি পরীক্ষা করে।আর মানুষটা!তার দিকে কোনো নজরই নেই।সে কি রঙের জামা পড়ে,কি ফুল খোঁপাতে গুঁজে,চোখে কাজল দেয় কি না এসব কিচ্ছু খেয়াল করে না।

রোদ্দুর ভাই তার ব্যাপারে এত উদাসীন কেন?তার ডান চোখের কোণার তিলটা কি রোদ্দুরের কখনো নজরে এসেছে?ঠোঁটের দুই ইঞ্চি উপরের বাদামি তিলটাতে কি কখনো চুমু খেতে ইচ্ছে হয়নি?

এই যে সে এখন রোদ্দুর ভাইয়ের প্রিয় রঙের কথা মাথায় রেখে পার্পল কালারের থ্রি পিস পড়েছে।এত রাতে শাওয়ার নিয়ে মাথার চুল ছেড়ে রেখেছে এসব কি নজরে পড়ে না?

অহি নিঃশব্দে হেঁটে গিয়ে রোদ্দুরের মাথার কাছে দাঁড়ায়।অনেক কষ্টে মুখ খুলে বলে,

—“রোদ্দুর ভাই, আপনার খাবার।খেয়ে নিন!”

রোদ্দুর এক লাফে উঠে খাটে হেলান দিয়ে বসে।চোখে মুখে গম্ভীর গম্ভীর ভাব।ফোন থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই বলে,

—“অজান্তা,খাইয়ে দে তো।আমি একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করি।ক্ষুধায় শেষ আমি!”

অহি আবার চমকায়।তার হাত কাঁপে।রোদ্দুর ভাই কি বিকেলের কথা ভুলে গেছে?

(চলবে)

পরিশিষ্ট পর্ব-০৩

0

#গল্পের_নাম : পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_০৩ (বোনাস)

অহিকে দেখে কেউ অবাক হয় না।যেন তারা ধরেই নিয়েছিল এই অসময়ে সে আসবে।রোদ্দুরের পাশে থাকবে।অহি ইশারায় কি হয়েছে জিগ্যেস করতেই তার খালা এসে তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়।অহি খালার মুখ সামনে এনে মাথা নেড়ে কাঁদতে বারণ করে।

চোখের জল নিজ হাতে মুছে দেয়।তার খালা শাহিনুরের ভারিক্কি চেহারা।কয়েক মাস হলো ডায়াবেটিস ধরা পড়েছে।ডায়াবেটিস ধরা পড়ার পর থেকেই যেন হু হু করে তার মেদ বেড়ে যাচ্ছে।সামান্য বাতাসটুকু গ্রহণ করেই যেন ওয়েট বেড়ে যাচ্ছে।খালা এখন অল্পতে হাঁপিয়ে উঠে।

একটু কান্না করতেই তার ফর্সা মুখ, গাল লাল হয়ে গেছে।বড়ো বড়ো করে শ্বাস নিচ্ছে।অহি খালাকে জড়িয়ে বলল,

—“খালামণি,তুমি নিচে যাও।আমি দেখছি।”

তারপর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রোদ্দুরের বড় বোন রোদেলাকে বলল,

—“আপু,খালামণিকে নিচে নিয়ে যাও।প্রেশার হাই হয়ে যাবে।”

রোদেলা একপাশ থেকে মাকে জড়িয়ে বলল,

—“অহি রে!তুই একদম ঠিক সময়ে এসেছিস।আমি তোর কথাই ভাবছিলাম।এই দেখ,তোকে ফোন করার জন্য ফোনও হাতে নিয়েছি।”

অহি একটু হাসার চেষ্টা করলো।তার খালা শাহিনুর রোদেলার হাত ধরে নিচে নেমে গেল।

অহি মাথার হিজাবটা খুলে চুলগুলো আলগা করলো।বিচ্ছিরি গরম লাগছে!ওড়নাটা কাঁধের দুপাশে ঝুলিয়ে দরজায় টোকা দিল।

ওপাশ থেকে কোনো প্রতিত্তর আসলো না।অহি দরজায় আঘাতের পরিমান বাড়িয়ে দিল।সঙ্গে সঙ্গে রোদ্দুর বাজখাঁই গলায় বললো,

—“একদম শব্দ করবে না।মাথায় কিন্তু রক্ত উঠে যাচ্ছে।চুপচাপ রয়েছি, তোমরা সেটা থাকতে দিবে না।তাইতো?”

রোদ্দুরের কথা শেষ হতেই ঘর থেকে বিকট একটা শব্দ হলো।কিছু একটা ভাঙার শব্দ।এপাশ থেকে অহির পিলে চমকে উঠল।কি রাক্ষস রে বাবা!

সে মৃদু স্বরে বলল,

—“রোদ্দুর ভাই, আমি!আমি!অজান্তা অহি!”

রোদ্দুর কোনো উত্তর দিল না।অহি পাশে তাকিয়ে দেখে ফজিলা খালা।মধ্যবয়স্কা মহিলা,যিনি প্রায় দুই যুগ ধরে
এ বাসায় কাজ করে আসছে।তাকে ছোটবেলা থেকেই খুব আদর করে।

অহি ফজিলাকে বলল,

—“খালা,তুমি নিচে থেকে খাবার নিয়ে আসো বরং।আমি দেখছি।”

ফজিলা দ্রুত পায়ে নিচে নেমে গেল।অহি দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজায় হাত রাখে।সে মানুষটা একটু শান্তিতে,নিরিবিলিতে থাকতে চায়।কিন্তু কেন জানি ঝামেলা একদম তার পিছু ছাড়ে না।

কি হতো যদি রোদ্দুর ভাই শুরু থেকেই তাকে ভালোবাসতো?তার মনের মনিকোঠায় রাখতো?বুকে আগলে রাখতো?খুব ক্ষতি হয়ে যেত কি?

রোদ্দুর ভুল মানুষকে ভালোবেসে কষ্ট পাচ্ছে।আর সে রোদ্দুরকে ভালোবেসে কষ্ট পাচ্ছে।হিসেব বরাবর।সত্যিই প্রকৃতি সাম্যাবস্থা পছন্দ করে।

অহি ফের দরজায় মৃদু কড়া নেড়ে ভাঙা গলায় অনুরোধ করলো,

—“রোদ্দুর ভাই, প্লিজ দরজাটা খুলুন।আমি একা আছি।আশপাশে কেউ নেই।”

কয়েক মিনিট নিরবতার পর রোদ্দুর দরজা খুললো।সাতদিন পর রোদ্দুরকে দেখে অহির বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো।একি চেহারা হয়েছে রোদ্দুর ভাইয়ের?

এই কয়েক দিনে মনে হচ্ছে ওজন বেশ কমে গেছে।তালগাছের মতো লম্বা লাগছে শুধু।দাড়ি,গোঁফ আর মাথার চুলে এমাজনের জঙ্গল হয়ে গেছে যেন।চোখ দুটোতে কেমন ছন্নছাড়া ভাব।চোয়াল ভেঙে গেছে।চেহারায় কেমন অবিশ্রান্ত আর সন্ন্যাসী সন্ন্যাসী ভাব।মনে হচ্ছে জগৎ সংসারের কোনো কিছুতেই তার কিচ্ছু যায় আসে না।

অহি আলগোছে বলে ফেলল,

—“একি চেহারা হয়েছে আপনার?”

রোদ্দুর কোনো উত্তর দিল না।এলোমেলো ভাবে পা ফেলে দরজা থেকে সরে দাঁড়াল।অহি ভেতরে ঢুকে দেখে রুমের যাচ্ছে তাই অবস্থা।

এখানে,ওখানে সব এলোমেলো, ছড়ানো ছিটানো।কাপড় চোপড় সব মেঝেতে পড়ে আছে।ফুলদানি গুলো ভেঙে টুকরো টুকরো।পুরনো একটা ডায়েরির পৃষ্ঠা ছেড়া ছেড়া।পাশেই এক মুঠ ছাই।হয়তো আগুন জ্বালিয়ে কিছু পোড়ানো হয়েছে।

অহি ওয়ারড্রব থেকে বেছে বেছে কাপড় বের করে রোদ্দুরের হাতে ধরিয়ে বলল,

—“রোদ্দুর ভাই, গোসল করে আসুন।”

রোদ্দুর অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল।অহি তার দৃষ্টিকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে তাকে টেনে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে দিল।

রোদ্দুর অবাক কন্ঠে বলল,

—“কি রে অজান্তা।তোর হঠাৎ এত সাহস কোথা থেকে আসলো?তুই না এতদিন আমাকে দেখলে ইঁদুরদের মতো গর্তে লুকিয়ে পড়তি।আজ হঠাৎ কেমন অধিকা৷ দেখাচ্ছিস!ব্যাপার কি?আমি ট্রমাতে আছি বলে আমায় ভয় পাবি না?”

অহির বুকের ভেতর তোলপাড় শুরু হলো।রোদ্দুর ভাই তো ঠিকই বলেছে।সে এতদিন রোদ্দুরের থেকে দূরে দুরে থেকেছে।তাকে দেখলেই কেমন ধমনীর মধ্যে দিয়ে শীতল রক্ত বয়ে যেত।আজ কি না রোদ্দুরের সাথে মুখে মুখে কথা বলছে।

সে অন্য দিকে চেয়ে বলে,

—“আপনাকে ভয় পাওয়ার কি আছে?”

—“তুই সত্যি আমাকে ভয় পাস না?তাহলে অন্য দিকে তাকিয়ে কেন কথা বলিস?চোখে চোখ রেখে কথা বল।”

অহি মনে মনে বলে,

—“আপনার চোখে চোখ রাখলে তো আমি শেষ হয়ে যাব রোদ্দুর ভাই।কেন বোঝেন না আপনি?কেন আমার ভালোবাসা বুঝতে পারেন না?”

সে মুখে কোনো কথা না বলে দ্রুত ওয়াশরুমের দরজা বাইরে থেকে লক করে নিঃশ্বাস ফেলল।তাকে সাবধানে কথা বলতে হবে।রোদ্দুর ভাই যেন কিছুতেই টের না পায় যে সে রোজ তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে।তাকে নিয়ে কল্পনার শহর সাজায়।

অহি দ্রুত মেঝের কাপড় চোপড় উঠিয়ে এক পাশে রাখলো।রুমটা আজ সে নিজ হাতে গোছাবে।

ফজিলা খাবারের প্লেট হাতে ভেতরে ঢুকে বলল,

—“আম্মা,আপনে এসব ক্যান করেন?আমি পরিষ্কার কইরা দিচ্ছি।দাঁড়ান।”

অহি বাধা দিয়ে বলে,

—“খালা,তোমার কিছু করতে হবে না।আমি পরিষ্কার করবো।তুমি খাবারটা কর্ণারের টেবিলে ঢেকে রাখো।রোদ্দুর ভাই গোসল করে।”

ফজিলা খাবার প্লেট টেবিলে রেখে ফিসফিস করে অহিকে বলে,

—“সেই সক্কাল থেইকা কেউ দরজা খুলতে পারলো না।আমি তুমি আইসা চউক্ষের পলকে খুইলা ফেললা।তুমি কি পোলাডারে জাদু করছো অহি মা?তবে হগ্গলে অনেক খুশি হইছে।”

অহি মিষ্টি একটা হাসি দেয়।সে যদি সত্যি সত্যি রোদ্দুরকে জাদু করতে পারতো!নতুন করে তার মায়ায় ফেলতে পারতো!তাহলে কত ভালো হতো।

মিনিট তিরিশেক বাদে ওয়াশরুমের দরজায় ধাক্কা পড়ে।অহি বিছানার চাদর টান করে দ্রুত গিয়ে বাইরে থেকে ছিটকিনি খুলে দেয়।

রোদ্দুর ট্রাউজার পড়ে মাথা মুছতে মুছতে বের হয়।তার চোখে মুখে এক রাশ বিরক্তি।যেন চারপাশের সবকিছুতে সে বিরক্ত।

অহি আড়চোখে একবার রোদ্দুরের দিকে চেয়ে লজ্জায় চোখ সরিয়ে নেয়।রোদ্দুর খালি গায়ে বের হয়েছে।ঘরে যে এত বড়ো একটা মেয়ে গুটিশুটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকে তার খেয়াল নেই।

অহির মাথা ঘুরছে।কেমন যেন বমি বমি পাচ্ছে হঠাৎ করে।হাত পা কেমন অসাড় হয়ে আসতে চাইছে।সে কয়েক পা এগিয়ে বিছানার এক কোণায় বসে পড়লো।

রোদ্দুর ড্রেসিং টেবিলের সামনে নিজের দিকে একবার পরখ করে বলল,

—“অজান্তা,আমি অনেক রোগা হয়ে গেছি তাই নারে?”

অহি তার দিকে না তাকিয়েই বলল,

—“হুঁ।খাওয়া দাওয়া সব ছেড়ে দিলে তো এমন হবেই।”

—“তুই বেলকনির দিকে কেন তাকিয়ে আছিস?নাকি ওদিকে আরেকটা আমি আছি?”

অহি চোখ তুলে একবার রোদ্দুরের দিকে তাকায়।রোদ্দুরকে এখন অনেকটা ফ্রেশ লাগছে।চোখে মুখে থেকে উদ্ভ্রান্ত ভাবটা অনেকখানি চলে গেছে।

সে চট করে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলে,

—“রোদ্দুর ভাই, কিছু খান।”

—“খাব না রে।আমি চব্বিশ ঘণ্টার অনশন করছি।মাত্র সতেরো ঘন্টা হয়েছে।একেবারে ডিনার টাইমে খাব।”

—“একদম ঢং করবেন না।এমন ভাব করছেন যেন আর কারো বিয়ে ভেঙে যায় না।বছরের পর বছর সংসার করার পর বউ অন্যের সাথে পালিয়ে যান তারা কিভাব৷ বাঁচে?”

অহি একটানে বলার পরেই জিভ কাটে।ছি!কি বলতে কি বলে ফেলেছে।চোখ বন্ধ করে নিজেকে জঘন্য একটা গালি দেয়।

সঙ্গে সঙ্গে রোদ্দুর তার হাত চেপে রাগান্বিত কন্ঠে বলে,

—“তোর মনে হচ্ছে আমি ঢং করছি?”

অহি ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে দেখে রোদ্দুরের দু চোখ অগ্নিকুণ্ডের মতো জ্বলছে।সে তোতলানো স্বরে বলে,

—“আ-আসি আসলে তা বো-বোঝাতে চাই নি।”

রোদ্দুর কোনো কথা না বলে তাকে একটানে রুম থেকে বের করে মুখের সামনে ঠাস করে দরজা আটকে দেয়।

(চলবে)

🖤 কেমন হচ্ছে জানাবেন সবাই।রিচেক করিনি।ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।🥰

পরিশিষ্ট পর্ব-০২

0

#গল্পের_নাম : পরিশিষ্ট
#লেখিকা: অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_০২

রোদ্দুরের বাহুতে অহি একটা ধাক্কা দিতে সে চোখ বন্ধ রেখেই অহির হাত চেপে ধরলো।জড়ানো গলায় বললো,

—“ঘুমাতে দে আমায় অজান্তা।নইলে তোর খবর আছে।বাসা থেকে পালিয়ে এসেছি একপ্রকার।একটু নিরিবিলি থাকার জন্য।সবাই আমার দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে যা অসহ্যকর।আমার রুমের সব ভাঙচুর করে এসেছি।”

—“আপনি এখানে এসেছেন সবাই জানে?”

—“জানি না।”

—“রোদ্দুর ভাই, কিছু খাবেন?কখন খেয়েছেন?”

—“এক ঘুষি দিয়ে নাক ফাটিয়ে ফেলবো অজান্তা।বিরক্ত করতে বারণ করেছি।”

অহি আর বিরক্ত করে না।সাবধানে রোদ্দুরের হাতের ভাঁজে চেপে রাখা নিজের বন্দী হাতটা মুক্ত করতে চায়।কিন্তু রোদ্দুর ছাড়ে না।

হাল ছেড়ে চুপচাপ বেডে বসে রোদ্দুরের মুখপানে চেয়ে থাকে।তার খুব ইচ্ছে হয় রোদ্দুরের চুলে বিলি কেটে দিতে।হাত বাড়িয়েও গুটিয়ে নিয়ে আসে।কোথায় যেন বাধা!

মিনিট দশেক পর রোদ্দুরের ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ কানে আসে অহির।যাহ!রোদ্দুর ঘুমিয়ে পড়েছে।তার মানে মেডিসিন অতিদ্রুত তার কাজ শুরু করেছে।সে একপ্রকার জোর করেই রোদ্দুরের থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেয়।মাকে ফোন দিয়ে সব বৃত্তান্ত জানতে হবে তার!রোদ্দুর যে এখানে সেটাও জানাতে হবে।

পায়ের নিচ থেকে সাবধানে চাদরটা উঠিয়ে রোদ্দুরের গলা অবধি জড়িয়ে দেয়।সরে আসার আগে আরেকবার রোদ্দুরের মুখ পানে চাইতেই তার ভয়ংকর একটা ইচ্ছে জাগে।নিজের লাগামছাড়া ইচ্ছেকে দমন করতে না পেরে রোদ্দুরের কপালে গভীর এক চুমু বসিয়ে দেয়।

তারপর অতিদ্রুত টেবিল থেকে ফোনটা হাতে নিয়ে বের হয়ে যায়।

—————-

বিকেল বেলা পা দিয়ে বেলকনির কাচ ঠেলে ভেতরে ঢুকে অহি।তার এক হাতে এক কাপ চা।আর ডান হাতে হুমায়ূন আহমেদ স্যারের একটা বই।”রোদনভরা এ বসন্ত”! অষ্টম বারের মতো বইটি পড়া শুরু করেছে সে।

বেলকনির মাঝ বরাবর রাখা ছোট্ট টেবিলের উপর বইটা রেখে সে চেয়ার প্রকৃতিপানে বসে পড়লো।চায়ের কাপে এক চুমুক দিতেই সামান্য ভালো লাগার অনুভূতি হলো।

কিছুদিন হলো তার মন খচখচ করছে।অনেক চেষ্টা করেও রোদ্দুরের সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি।আজ এক সপ্তাহের মতো হলো অহি রোদ্দুরকে দেখে না।রোদ্দুরের কোনো খোঁজ নেই।সেই যে সেদিন রাতে তার রুমে ঘুমিয়েছিল।সকালবেলা সে পাশের রুম থেকে জেগে উঠে গিয়ে দেখে রোদ্দুর নেই।কাজের লোকের মাধ্যমে জানতে পারে ভোরবেলা সূর্য উঠার আগেই চলে গেছে।

কিন্তু কোথায় গেছে তা কাজের লোক জানে না।শুধু যেতে দেখেছে।একরাশ টেনশন নিয়ে সে রোদ্দুরের নাম্বারে ফোন দেয়।ফোন সুইচট অফ বলে।পরে সে খালাকে ফোন দিয়ে জানতে পারে রোদ্দুর বাসায় ফিরেছে এবং এখন নিজের রুমে দরজা আটকে আছে।

অহি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

এই সাতদিনে সে অনেক বার রোদ্দুরের ফোনে কল দিয়েছে।কিন্তু রোদ্দুরের ফোন সেদিনের পর থেকে বন্ধ।সবার সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিন রাত নিজের রুমে থাকে।অহির বড়ো মায়া হয়!

রোদ্দুরের যে মেয়েটার সাথে প্রেমের সম্পর্ক ছিল তার নাম বৃষ্টি।অসম্ভব সুন্দর গড়নের একটা মেয়ে।অহি যে বছর রোদ্দুরের ভার্সিটিতে অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি হয় সেই বছরই রোদ্দুরের ভার্সিটির পাঠ চুকে যায়।বাবার বিজনেসে তখন ঢুকে পড়ে।

আর বৃষ্টি রোদ্দুরের এক বছরের জুনিয়র হওয়ার কারণে অহির সাথে প্রায়ই ভার্সিটিতে কথা হতো।কোনো কোনোদিন রোদ্দুর যখন অফিস থেকে সোজা ভার্সিটি এসে বৃষ্টির সাথে দেখা করতো,দূর থেকে সেসব দেখে অহির বুক পুড়তো!এখন অহি থার্ড ইয়ারে।ততদিনে বৃষ্টির পড়াশোনা শেষ বলে দু পক্ষের সম্মতিতে বিয়ের ডেট ফাইনাল হয়।কিন্তু বিয়েটা হয় না!

হুট করেই অহির অস্থির লাগতে শুরু করে।সে রোদ্দুরকে দেখবে।তাও আবার এক্ষুনি!সে এক চুমুকে বাকি চা টুকু শেষ করে দ্রুত নিচে নামে।যতদ্রুত সম্ভব রোদ্দুরের কাছে পৌঁছাতে হবে তাকে।

মানুষ তীব্র সুখ এবং তীব্র দুঃখের সময় কাউকে পাশে চায়।রোদ্দুরের দুঃখের সময় এখন তাকে প্রয়োজন।বড্ড প্রয়োজন।

রান্নাঘরে উঁকি দেয় অহি।তার মা খালার বাসা থেকে ফিরেছে চারদিন হলো।সে নিঃশব্দে মায়ের পেছনে গিয়ে বলে,

—“মা!আমি খালামনির বাসায় যাব।”

তার মা শাহানা বেগম চুলায় করলার ভাজি বসিয়েছে।তার বাবা ঢাকার নামকরা কলেজের ফিজিক্সের টিচার।তিনি আবার কাজের লোকের হাতের রান্না খায় না।সেজন্য ছোটবেলা থেকে অহি দেখে যাচ্ছে তার মা পরম যত্নে সবার জন্য রান্না করে।

শাহানা বেগম চুলার আঁচ একটু কমিয়ে মেয়ের দিকে ফিরে তাকালেন।ভেজা হাত দুটো শাড়ির আঁচলে মুছে বললেন,

—“তোর কাজকর্ম তো কিছুই আমি বুঝতে পারি না।হিমের বিয়ের সময় কত করে বললাম চল যাই,চল যাই!কিন্তু নানা রকম অজুহাত দেখিয়ে গেলি না।আর এখন ও বাড়ির সবার মানসিক অবস্থা ভালো না।তুই এখন ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে যাবি।বলি,তোর আক্কেল কবে হবে রে?”

—“মা,তুমি এমন ভাবে বলছো যেন আমি সত্যি সত্যি ও বাসায় গিয়ে নাচা শুরু করবনি।”

—“তোকে দিয়ে বিশ্বাস আছে?আচ্ছা যা।ড্রাইভারকে বল।নিয়ে যাবে।আর ও বাড়ি গিয়ে বেশি পাকনামো করিস না।”

অহি মায়ের সামনে থেকে সরে আসে।ধুপধাপ পা ফেলে নিজের রুমে যায়।চার মিনিটের মাথায় ছোট্ট একটা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে নিচে নামে।

—“বুবু, কই যাস?”

অহি সিঁড়ির ডানপাশে তাকিয়ে দেখে অপূর্ব।অপূর্ব তার ছোট ভাই।ক্লাস নাইনে পড়ে।সদ্য গোঁফ উঠছে যার জন্য সে সবসময় সবার থেকে লুকিয়ে থাকতে চায় লজ্জায়।তারা এই দু ভাই বোনই!

অহি তার কাছাকাছি গিয়ে বলে,

—“তুই কখন এলি?ক্রিকেট খেলতে না গিয়েছিলি শুনলাম?”

—“মাত্র এলাম।তুমি কি রোদ্দুর ভাইদের বাসায় যাও?”

—“হুঁহ।যাবি তুই?চল যাই।”

অপূর্ব মুখে হাত রেখে ফিসফিস করে বলে,

—“না।তুমি যাও।তোমার ওখানে রোদ্দুর ভাই আছে।আমার তো কিছুই নেই।”

অহি হাত উঠিয়ে মারার আগেই সে এক দৌঁড়ে রুমে চলে যায়।অহি মুচকি হাসে!মাকে বলে গাড়িতে উঠে।

রোদ্দুর ভাইদের বাসা হাতিরঝিল।তারা থাকে মোহাম্মদ পুর।মধ্যবর্তী দূরত্ব বেশি নয়।দ্রুত পৌঁছে যাবে।

—————-

রোদ্দুর ভাইদের বাসার সামনে গাড়ি থামতেই নেমে পড়ে অহি।সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উপরে তাকাতেই একটা প্লেটলেট চোখে পড়ে।সেখানে খোদাই করা ‘নিশ্চিন্ত ভবন’।

অহি অবাক হয় না।এ বাসার নাম দুদিন পর পর পরিবর্তন করা হয়।আর এই কাজটা তার পিএইচডি ধারী খালু সাহেব করেন।বাসার সমসাময়িক পরিস্থিতি উপর ভিত্তি করে অতি উৎসাহের সাথে কিছুদিন পর পর নতুন প্লেটলেট লাগায়।

কিন্তু সে অনুযায়ী এবার লাগানোর কথা ‘অনিশ্চিন্ত ভবন’।কারণ এখন তো রোদ্দুর ভাইয়ের এ অবস্থায় কেউ নিশ্চিন্ত থাকার কথা না।

সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে কলিং বেলে চাপ দেয়।সঙ্গে সঙ্গে খুলে যায় দরজা।মনে হয় ওপাশে কেউ যেন দরজা খোলার জন্যই হাত বাড়িয়ে অপেক্ষা করছিল।

দরজা খুলেছে রোদ্দুর ভাইদের বাসার কাজের মেয়ে কুটি।কুটির ভালো নাম পারভীন।কিন্তু সে নাম এখন ডাইনোসরের মতো বিলুপ্ত।সবাই তাকে কুটি বলেই ডাকে।১৭-১৮ বছর বয়সের গোলগাল চেহারার প্রাণোচ্ছল একটা মেয়ে।

অহিকে দেখেই চমকে বলল,

—“আফা, আপনে?”

অহি ভেতরে ঢুকে বলল,

—“কুটি কেমন আছো?”

—“ভালা আফা।আপনে কেমুন আছান?”

—“আমিও ভালো কুটি।কাউকে তো দেখছি না।সবাই কোথায়?”

—“সবাই উপ্রে হিম দাদার দরজার সামনে।দাদা দরজা খুলতাছে না।বলতাছে খাইবো না।আইজ সারাডা দিন কিচ্ছু খায় নাই।”

অহির বুকের ভেতর ব্যথা হয়।এক সেকেন্ড বিলম্ব না করে ধুপধাপ পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়।

(চলবে)

পরিশিষ্ট পর্ব-০১

0

#গল্পের_নাম:পরিশিষ্ট
#লেখিকা : অজান্তা অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_০১

–“রোদ্দুর ভাই, এতরাতে আপনি আমাদের এখানে কেন?আপনার না আজ বিয়ে ছিল?”
রোদ্দুর কিছু না বলে দু পা এগিয়ে এসে অহিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।অহি চমকে যায়।ভীষণ চমকে যায়।তার মাথায় কিছুই ঢুকছে না।তার জানামতে আজ রোদ্দুরের বিয়ে এবং হিসেব অনুযায়ী তাকে এতক্ষণে বাসর ঘরে থাকার কথা।কিন্তু বাসর ঘর ফেলে রোদ্দুর তার বাড়িতে?কেন?

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে রোদ্দুরের ফোঁপানো শব্দ অহির কানে বাজে।অহি আরেক দফা চমকায়।রোদ্দুরের মতো স্ট্রং একটা ছেলে কান্না করছে?তাহলে কি কোনো ভাবে বিয়েটা হয়নি?কনে পালিয়েছে বা অন্যকিছু?

নিজের ভেতর এক ধরনের ভালো লাগা কাজ করে অহির।তার রোদ্দুর ভাই তাহলে বিয়ে করেনি!সে দুহাত রোদ্দুরের পিঠে রেখে জড়িয়ে ধরে।তার নিজেরো চোখের কোণে অশ্রু চিকচিক করে।

–“অজান্তা,ও আমায় নাকি ভালোবাসে না।এতদিন নাকি প্রেমের অভিনয় করেছে।শেষ মুহুর্তে সব ভেস্তে দিয়ে চিঠি লিখে পালিয়েছে।বৃষ্টি প্রথমবার যখন আমায় প্রোপোজ করেছিল,ভার্সিটির সবার সামনে ওকে রিজেক্ট করেছিলাম।সেই অপমানের প্রতিশোধ নেয়ার জন্যই ও নাকি তিনটে বছর ভালোবাসার নাটক করেছে। ”

রোদ্দুরের ভেজা কন্ঠ কানে আসে অহির।রোদ্দুরের সব কথা ছাপিয়ে তার মুখে অজান্তা ডাকটা যেন প্রতিধ্বনি হয়ে বার বার কানে বাজে।ছোটবেলা থেকেই রোদ্দুর তাকে অজান্তা বলে ডাকে।কখনো অহি বলে ডাকেনি।

রোদ্দুরের যেন হুশ নেই।কিন্তু অহির পা ধরে এসেছে।তাছাড়া রোদ্দুর নিজের সম্পূর্ণ ভর তার উপর ছেড়ে দিয়েছে।এভাবে আর কিছুক্ষণ থাকলে নিশ্চিত পা ভেঙ্গে পড়ে যাবে।

–“রোদ্দুর ভাই,আমায় ছাড়ুন।একটু বেডে বসুন।”

অহির কথায় কর্ণপাত করে না রোদ্দুর।যেরকম ছিল, তেমনই থাকে।অগত্যা সে নিজে থেকে রোদ্দুরকে ঠেলে নিজের বেডে বসায়।নিজেও ধপ করে রোদ্দুরের পাশে ধপ করে বসে বড় বড় করে শ্বাস নেয়।তারপর বলে ফেলে,

–“একটুর জন্য তো আমার শ্বাসটাই চলে যাচ্ছিল।এভাবে কেউ জড়িয়ে ধরে?”

রোদ্দুর তার দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকায়।তা দেখেই অহি ভয় পেয়ে যায়।সঙ্গে সারামুখে লজ্জার আভা ছড়িয়ে পড়ে।ছি!কি বলতে কি বলে ফেলেছে।

নিজেকে সামলে সেন্টার টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি এনে রোদ্দুরের সামনে ধরে বলে,

–“রোদ্দুর ভাই, পানিটা খান।”

রোদ্দুর দ্বিরুক্তি না করে পানির গ্লাস হাতে নেয়।ঢকঢক করে পুরো গ্লাস শেষ করে।অহি তার দিকে পূর্ণদৃষ্টি দেয়।

রোদ্দুরের চোখ ফোলা ফোলা।মুখে এখনো শুষ্ক পানির বলিরেখা।চোখের মণি অস্বাভাবিক লাল হয়ে গেছে।পরণের পাজামা পাঞ্জাবির ভাঁজ এলোমেলো হয়ে গেছে।চুল গুলো অবিন্যস্ত।তবুও কি সুন্দর লাগছে তাকে!এতসুন্দর মানুষ কি পৃথিবীতে দ্বিতীয় কেউ আছে?

অহি বড়ো করে ঢোক গিলে।

রোদ্দুর তার মায়ের সৎ বোনের ছেলে।তার নানাভাই দুই বিয়ে করেছিল।রোদ্দুর ভাইয়ের মা ছিল প্রথম পক্ষের।আর তার মা দ্বিতীয় পক্ষের।কিন্তু দু বোনের সম্পর্ক এক আত্মার। বড় খালা তার মাকে খুবই ভালোবাসে,নিজেই কোলে পিঠে করে মানুষ করেছে তার মাকে।দু পরিবারের মধ্যে খুবই ভালো সম্পর্ক।

ছোটবেলা থেকে দু পরিবারের মধ্যে যাতায়াত ছিল অনেক ঘন ঘন।রোদ্দুর ভাইয়ের থেকে সে বয়সে অনেক ছোট।

‘রোদ্দুর হিম’ নামক মানুষটার অতিরিক্ত রাগের জন্য অহি তাকে ছোটবেলা থেকেই ভয় পায়।যতটা সম্ভব দূরে দূরে থাকে। ছোটবেলা থেকে কুকুর তার ভীষণ অপছন্দের। সে যখন ক্লাস ফোরে তখন রোদ্দুর একবার ইচ্ছে করে তার কোলে নিজের পোষা কুকুর ছেড়েছিল।সেই কুকুর আবার তাকে আঁচড়ে দিয়েছিল।সেদিন কি যে ভয় পেয়েছিল!

তারপর থেকে ইচ্ছে করেই রোদ্দুর নামক ভয়ানক প্রাণীটাকে সে এভোয়েড করে চলতো।তাকে নিয়ে কোনো আলাদা ফিলিংস কাজ করতো না।

কিন্তু সেদিন যেন হুট করে সব চেঞ্জ হয়ে গেল।চেনা রোদ্দুর যেন তার কাছে অচেনা হয়ে গেল।তাকে নিয়ে অন্য রকম স্বপ্ন বোনা শুরু করলো।

সে তখন সদ্য ক্লাস টেনে উঠেছে।সারাদিন বাদল ঝরা শ্রাবণের এক সন্ধ্যায় কলিং বেলের শব্দে দরজা খুলে দেখে রোদ্দুর দাঁড়িয়ে আছে।একদম কাকভেজা হয়ে।

রোদ্দুরের সমস্ত শরীর বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ে ফ্লোরে বন্যা বানিয়ে ফেলছে।তার চুলগুলো জবজবে হয়ে কপালে লেপ্টে আছে।ভ্রু যুগল বেয়ে পানির ধারা।চোখের পাতা ভিজে ভারী হয়ে আছে যেন।খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি গুলো যেন স্বগর্ভে দাঁড়িয়ে আছে।রক্তিম ঠোঁটের উপর অযাচিত বিন্দু বিন্দু জলরাশি।যেগুলো যেন অহিকে চুম্বকের মতো তার দিকে টানছে।

কতক্ষণ এভাবে তাকিয়ে ছিল জানা নেই।রোদ্দুরের ধমকে সে দরজা থেকে সরে যায়।

তারপর যেন তার কি হয়ে যায়।মনের ভেতর অন্য রকম অজানা অনুভূতি হয় রোদ্দুরকে ঘিরে।প্রতিরাতে স্বপ্ন দেখা,তাকে কল্পনা করতে করতে ঘুমিয়ে যা-ওয়া তার নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়।

একটা সময় সে বুঝতে পারে সে রোদ্দুর হিম নামক মানুষটাকে ভালোবেসে ফেলেছে।কিন্তু ততদিনে রোদ্দুর নিজেকে অন্য কারো মায়ায় জড়িয়ে ফেলেছে।

তাই তার এক তরফা ভালোবাসা পূর্ণতা পায়নি।

—“এভাবেই সামনে দাঁড়িয়ে থাকবি?”

রোদ্দুরের কথায় ঘোর কাটে অহির।ব্যতিব্যস্ত হয়ে রোদ্দুরের হাত থেকে গ্লাস নিয়ে টেবিলে রাখে।ফের তার পাশে এসে বসে বলে,

—“রোদ্দুর ভাই, সব ঠিক আছে?”

—“কিচ্ছু ঠিক নেই।আর হবেও না।আমি সেই বিকেল থেকে কান্না করতে করতে ক্লান্ত এখন।আমি এখন ঘুমাব।তোর রুমে আসার আগে ঘুমের ট্যাবলেট খেয়েছি।চিন্তা করিস না।২০ এমজির একটা খেয়েছি মাত্র।”

অহিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই রোদ্দুর বিছানায় গা মেলে দিল।অহি ঝটপট বলল,

—“রোদ্দুর ভাই, আপনি গেস্ট রুমে যান।এটা আমার রুম।বাসায় কাজের লোক বাদে আর কেউ নেই।সব আপনাদের বাসায়।আপনি না হয় যে কারো রুমে ঘুমান।কিন্তু আমার রুমে নয়।উঠুন!”

রোদ্দুর উত্তর দেয় না।অহি রোদ্দুরের বাহুতে ধাক্কা দিতেই………

(চলবে)

মায়া পর্ব-১৩ এবং শেষ পর্ব

0

#মায়া
#পর্ব_১৩(শেষ পর্ব)
#ওয়াহেদ_মাহমুদ

অনেক দিন পরে আজ বর্ষা মায়ের সাথে দেখা করতে আসছে। কিন্তু ভাই ওয়াহেদের বাসায় এসে দেখে মা নেই। তাই ভাবি আফসানাকে বলে

মা কোথায় আছে ভাবি। কোথাও তো দেখছি না কেন?

জবাবে আফসানা বলে কেন তুমি জানো না? তোমার আম্মা বাসায় নেই। এক সপ্তাহ বাসায় আসবে না। তোমাদের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়েছে কোনো এক কাজে। আসতে দেরি হবে।

বর্ষা তখন বলে মায়ের ফোনে কল দিলে বন্ধ দেখাই কেন? আমাকে তো কিছু বলেনি মা। আর মা তো চোখে দেখতে পারে না তাহলে গেল কিভাবে আর আসবে কিভাবে। আপনি আমার কাছে থেকে কী কিছু লুকাতে চাচ্ছেন?

আফসানা তখন বলে তোমার মায়ের ফোন নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আত্মীয় বাসা থেকে ফিরে আসলে তখন তোমার ভাইয়া তোমার মাকে ফোন কিনে দিবে। আর তোমার কাছে থেকে কেন কোন কিছু গোপন রাখবো বলো? তোমার ভাইয়া দিয়ে এসেছে আবার কয়েকদিন পরে গিয়ে নিয়ে আসবে। তুমি কিছু চিন্তা করো না।

অনেক জার্নি করেছ তুমি এবার রেস্ট নাও যাও। পরে কথা হবে তোমার ভাইয়া কিছুক্ষণ পরেই চলে আসবে।

আর কিছু না বলে বর্ষা রুম চলে যায়।

কিছুক্ষণ পরে ওয়াহেদ চলে আসে বাসায়। ওয়াহেদ বাসায় আসলে আফসানা বলে।

তোমার বোন আসছে আজ বাসায়। কিছুক্ষণ আগেই এখানে এসেছে।

ওয়াহেদ তখন বলে তাহলে তো দেখা কথা দরকার। যাই আমি গিয়ে দেখা করে আসি।

আফসানা তখন ওয়াহেদকে থামিয়ে বলে। দাঁড়াও আগে আমার কথা শুনে যাও।

হ্যাঁ কি কথা বলো তাড়াতাড়ি।

তোমার বোন এসে আগেই আমাকে বলেছিল তার মা কোথায় দেখছি না কেন আর ফোনে কল দিলে যায় না কেন। আমি তখন তোমার বোন বর্ষা কে বলি তোমার আম্মা বাসায় নেই। দূর সম্পর্কের এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়েছে। এখন আপাতত এক সপ্তাহ বাসায় আসবে না। আর বাসায় আসলে তুমি তোমার আম্মা কে ফোন কিনে দিবে।

ওয়াহেদ তখন আফসানাকে বলে তুমি বর্ষাকে মিথ্যা কেন বললে? সত্যটা কেন বলে দিলে না। আর এক সপ্তাহ পরে আম্মু কে না পেলে তখন কি করবে তুমি? আর সত্য কখনো চাপা থাকে একদিন না একদিন প্রকাশ পাবেই।

আফসানা তখন বলে তখন যা হয় দেখা যাবে। আর তোমার বোন এক সপ্তাহ এখানে থাকছে না। কাল না হয় পরশু চলে যাবে।

ওয়াহেদ তখন বলে বর্ষা তো তোমার উপর সন্দেহ করবে। মা তো চোখে দেখতে পারে না। তাহলে একা কিভাবে যাবে আর কিভাবে আসবে।

আফসানা তখন বলে তুমি কিছু চিন্তা করিও না। আমি সব বুঝিয়ে দিয়েছি। বলেছি যে তুমি দিয়ে এসেছ আবার তুমি গিয়ে নিয়ে আসবে‌।

তারপর রাতে খাবার টেবিলে বর্ষা ওয়াহেদ কে মায়ের কথা বলে। তারপর ওয়াহেদ ও আফসানার মতো করে বর্ষা কে বুঝিয়ে দেয়। তার পরের দিন বর্ষা চলে যায় আর বলে মা আসলে আমাকে ফোন দিবে। তারপর আমি মায়ের সাথে দেখা করব।

তারপর অনেক দিন পার হয়ে যায়। হার্ট অ্যাটাক করে সুরাইয়ার বাবা মারা যায়। সুরাইয়ার আপন বলতে পূর্ণতা ছাড়া আর কেউ নেই। সুরাইয়ার বাবা মারা যাওয়ার পরে সুরাইয়া কে অনুরোধ করে বলে আমার চোখ দুটো যেন সুরাইয়ার শ্বাশুড়ি কে দান করে। আমার চোখ দিয়ে যদি তোর শ্বাশুড়ি দেখতে পাই তাহলে তার অনেক উপকার হবে।

তারপর সুরাইয়া বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে শ্বাশুড়ি কে বলে আপনার কেউ পরিচিত থাকলে তার নাম্বার টা দেন। আপনার জন্য চোখ পাওয়া গিয়েছে। সুরাইয়ার শ্বাশুড়ি অনেক খুশি হয় আর জানতে চায় কে দিয়েছে তাকে চোখ। তখন সুরাইয়া বলে সময় হলে জানতে পাবেন। সুরাইয়ার শ্বাশুড়ি তখন ওয়াহেদের নাম্বার না দিয়ে মেয়ে বর্ষার নাম্বার দেয়।

অনেক দিন হয়ে যায় কিন্তু বর্ষার কাছে ফোন দেয় না। তাই বর্ষা আবার ভাইয়ের বাড়িতে যায়। ভাইকে প্রশ্ন করার সময় ঠিক তখনি একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসে। আর বলে আপনার মায়ের জন্য চোখ পাওয়া গিয়েছে প্লিজ তাড়াতাড়ি এই বৃদ্ধাশ্রমে চলে আসেন। বর্ষা কিছু বুঝতে পারে না আর বলে আমার মা কেন বৃদ্ধাশ্রমে থাকবে? আপনার কিছু ভুল হচ্ছে।

সুরাইয়া তখন ফোন টা শ্বাশুড়ি কাছে দেয় আর বলে আপনার মায়ের সাথে কথা বলেন। কথা শুনে বর্ষা বলে এটাই তো আমার মায়ের কন্ঠ কিন্তু আমার মা বৃদ্ধাশ্রমে কেমন করে গিয়েছে?

তারপর ভাইয়ের কাছে থেকে সব জানতে পারে। তারপর বর্ষা ঘৃণা দৃষ্টিতে ভাই আর ভাবির দিকে তাকিয়ে বলে ছি ছি আপনারা এতটা নিচ নামতে পারেন ভাবতেই পারি না। অত্যন্ত একবার বলতে পারতেন আমাকে। দরকার হলে আমি আমার মাকে আমার কাছে রাখতাম।

তারপর সবাই মিলে বৃদ্ধাশ্রমে যায়। কিন্তু কাউকে দেখতে পাই না। সুরাইয়া কারোর সামনে আসে না আর কি কি করতে হবে সব ফোনে বলে। আর হাসপাতালে সবকিছু ম্যানেজ করে রেখেছে। সুরাইয়ার ফ্রেন্ড ওই হাসপাতালে ডাক্তার আর সেই অপারেশন করবে। তাই সুরাইয়ার কে বেশি কষ্ট করতে হয়নি।

অপারেশন হয়ে যায় বেশ কয়েকদিন। কিন্তু কেউ জানতে পারে না কে দান করেছে এই চোখ। আর আমাদের এতো বড় উপকার করলো। যেদিন চলে আসবে হাসপাতাল থেকে সেদিন ডাক্তার কে জিজ্ঞেস করে কে দান করেছে আমার মাকে এই চোখ।

তখন ডাক্তার হাসি দিয়ে বলে। সুরাইয়ার বাবা মারা যাওয়ার পরে এই চোখ দুটি আপনাকে দান করা হয়েছে। আর এসবের পিছনে মূল সুরাইয়ার।

তখন সবাই চমকে উঠে। কারোর মুখ দিয়ে আর কথা বাহির হয় না। কিছুক্ষণের জন্য সবাই নিস্তব্ধ হয়ে যায়। সুরাইয়ার শ্বাশুড়ির তখন আর বুঝতে বাকি রইলো না মাঝে মাঝে বৃদ্ধাশ্রমে সুরাইয়া দেখতে আসতো। কতটা নরম মনের মানুষ হলে এতো নির্যাতনের পরেও এতো বড় উপকার করতে পারে। সবাই অনেক অবাক হয়।

বর্ষা তার মাকে ভাইয়ার কাছে না রেখে নিজের সাথে করে নিয়ে যায়। ওয়াহেদ তখন বলে মা আমাদের কাছে থাকুক। সমস্যা হবে না। বর্ষা তখন বলে আমি চাই না আমার মাকে আবার বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসেন। আমি মাকে আমার কাছে রাতে চাই।

ওয়াহেদ তখন আফসানাকে বলে আজ তোমার জন্য বোনের কাছে আমার কথা শুনতে হলো। তোমার জন্য বৃদ্ধাশ্রমে মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছি। আর তোমার জন্যই বর্ষার সাথে মিথ্যা বলেছি। আফসানা তখন হাসি দিয়ে বলে। আর সে জন্যই তোমার মা চোখ পেয়েছে দেখতে পেয়েছে। বৃদ্ধাশ্রমে না দিয়ে আসলে পাইতো না🙄। এভাবে বেশ অনেক বছর কেটে যায়।

২৫ বছর পর।

সুরাইয়ার মেয়ে পূর্ণতা অনেক বড় ডাক্তার হয়েছে। সুরাইয়ার শ্বাশুড়ি ১৫ বছর আগে মারা গিয়েছে। ওয়াহেদ আফসানার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই সুরাইয়ার। পূর্ণতা আজো জানে না তার বাবা কে। আর জানতেও চায়নি। কারণ সুরাইয়া কখনো তার সন্তান কে বাবার অভাব বুঝতে দেয়নি। পূর্ণতার কাছেই সুরাইয়া একজন আর একজন মেয়ে।

পূর্ণতা হাসপাতাল থেকে রাতের ডিউটি শেষে বাসায় এসে মাকে বলে জানো মা আজ কি হয়েছিল।

হ্যাঁ বলো কি হয়েছিল।

আজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য দু’জন এসেছিল। স্বামী স্ত্রী মেয়েটা একদম প্রায় তোমার বয়সের। একমাত্র ছেলে কিন্তু মা বাবার খোঁজ রাখে না।‌ বৃদ্ধাশ্রমে থাকে দুজনেই। চিকিৎসা করানোর জন্য এসেছিল। দেখে অনেক খারাপ লাগছিল। স্বামী টা হাঁটতে পারে না হুইলচেয়ারে বসে থাকে। আমি অনেক সুন্দর করে চিকিৎসা করে দিয়েছি। আর জানো মা হাসপাতালে আমার স্টাফ বলেছিল ওই ছেলেটার সাথে নাকি আমার চেহারার অনেক মিল আছে। তাই আমি বলে দিয়েছি। সব চিকিৎসা আমি করব। অনেক খুশি হয়েছে দুজন। আমি উনাদের সাথে ছবি উঠেছি। চিকিৎসা খরচ আমি দিব ভালো করি নাই মা?

সুরাইয়া তখন বলে হ্যাঁ মা অনেক ভালো করেছ। আর কই ছবি দেখি।

সুরাইয়া ছবির দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এটা আর কেউ না হুইলচেয়ারে বসে আছে ওয়াহেদ আর পাশে দাঁড়িয়ে আছে আফসানা। সুরাইয়ার মন চায় ওয়াহেদ আর আহসানকে তার এখানে নিয়ে আসতে।‌ কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও আনতে পারবে না। কারণ সুরাইয়া কখনো চায় না পূর্ণতা জানতে পারু এই ছেলেটা তার বাবা।

বি.দ্র: ভুল ত্রুটি ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত যারা পাশে ছিলেন অনেক অনেক ধন্যবাদ তাদেরকে)

মায়া পর্ব-১২

0

#মায়া
#পর্ব_১২
#ওয়াহেদ_মাহমুদ

পূর্ণতার দ্বিতীয় জন্মদিন উপলক্ষে সবাই মিলে বৃদ্ধাশ্রমে যায়। প্রতিবারের মতো এবারও কেক বা কোনো পার্টি দেয়া হয়নি জন্মদিন উপলক্ষে। বৃদ্ধাশ্রম গিয়ে সুরাইয়া হঠাৎ তার শ্বাশুড়ি কে দেখতে পাই। সুরাইয়া বুঝে উঠতে পারছে না এখানে তার শ্বাশুড়ি কি করছে।

তারপর সুরাইয়া বৃদ্ধাশ্রম এর কেয়ার টেকার এর কাছে গিয়ে তার শ্বাশুড়ি সম্পর্কে জানতে চাই। আর এখানে কে রেখে দিয়েছে তাকে।

কেয়ারটেকার তখন বলে তার ছেলে এখানে রেখে গিয়েছেন।

বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে সুরাইয়ার, ওয়াহেদ কিভাবে এমন একটা জঘন্য কাজ করতে পারে।

সুরাইয়া তখন কেয়ারটেকার কে বলে তা কি কেউ এখানে দেখতে আসে।

কেয়ার টেকার তখন বলে না উনাকে তেমন কেউ দেখতে আসে না সপ্তাহে একদিন বা দুইদিন উনার ছেলে ওয়াহেদ দেখতে আসে।

তারপর আরো অনেক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে সুরাইয়া, তার থাকা-খাওয়া কেমন খাওয়া-দাওয়া কেমন কি এসব বিষয়ে।

কেয়ার টেকার তখন বলে উনি চোখে দেখতে পারে না এক্সিডেন্টে উনি উনার দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।

কথাটা যেন সুরাইয়ার বিশ্বাস হচ্ছে না। তখন সুরাইয়া বুঝতে পারে কেন তাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে যাওয়া হয়েছে।
নিশ্চয় এটা আফসানার কাজ ওয়াহেদকে উল্টপাল্টা বুঝিয়ে শাশুড়িকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গিয়েছে।

সুরাইয়ার বাবা তখন সুরাইয়াকে বলে এটাতো তোর শ্বাশুড়ি এখানে কিভাবে আসলো। তুই গিয়ে কথা কথা বল। দরকার হলে বাসায় নিয়ে চল।

মা-বাবা তার মনে হয় প্রয়োজন হবে না আমি বাসায় নিয়ে যেতে পারবো না সবাইকে তার পাপের শাস্তি ভোগ করা উচিত। কপালে যেটা লেখা আছে সেটা অবশ্যই হবে কেউ ঠেকাতে পারবে না।

সুরাইয়া তখন বাবাকে বলে আমার শাশুড়ি একটা বাস এক্সিডেন্টে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছে সে জন্যই থাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গিয়েছে।

তারপর সুরাইয়া তার শ্বাশুড়ির সামনে গিয়ে বলে কেমন আছেন? কন্ঠ কিছুটা চেঞ্জ করে বলে যাতে বুঝতে না পারে চোখে না দেখলেও দশ বছর ধরে একসাথে এক বাসায় ছিল। কন্ঠ অবশ্যই পরিচিত।

সুরাইয়ার শাশুড়ি তখন বলে হ্যাঁ মা ভালো আছি তুমি কেমন আছো?

আমিও ভালো আছি আপনার বাসায় কি আপনার ছেলে নেই।

হ্যাঁ আমার ছেলে আছে

তাহলে আপনি এখানে কেন আপনি আপনার ছেলের সাথে বাসায় থাকবেন।

এটা আমার পাপের শাস্তি মা জীবনে যা অন্যায় করেছি তার শাস্তি অবশ্যই ভোগ করতে হবে আমার ছেলে আমার সাথে যে অন্যায় করেছে আমি চাই না সে পাপের শাস্তি ভোগ করুক আর আমার মত বৃদ্ধাশ্রমে থাক। আমি তাকে মাফ করে দিয়েছি।

তারপর সুরাইয়া বলে আপনি কি এমন পাপ করেছেন যার জন্য আপনাকে এই বয়সে এত বড় শাস্তি ভোগ করতে হচ্ছে।

তারপর সুরাইয়ার শ্বাশুড়ি বলে আমি অনেক বড় পাপ করেছি মা। একজন মেয়ে হয়ে দুজন মেয়ে জীবন নষ্ট করে দিয়েছি। যদি তাদের কে কাছে পেতাম তাহলে দরকার হলে পা ধরে মাফ চেয়ে নিতাম।

সুরাইয়ার চোখ দিয়ে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পানি পড়ছে। আর ভাবতে থাকে এই মহিলা তো আমার কাছে থেকে আমরা স্বামী কে ছিনিয়ে নিয়েছে। আমার সন্তানকে বাবা অধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে। তাহলে এই মহিলার জন্য আমার চোখ দিয়ে কেন পড়েছে? নিজের কাছে নিজেই প্রশ্ন করে সুরাইয়া। তারপর সুরাইয়ার অন্তর থেকে শুধু একটা কথায় আসে অনুশোচনা আর নিজের ভুলের শাস্তি।

তারপর সুরাইয়া বৃদ্ধাশ্রমের সবাইকে খেতে দেয়। আর শ্বাশুড়ি কে নিজ হাতে খেতে দেয়।

সুরাইয়ার শ্বাশুড়ি সুরাইয়া কে বলে আমি প্রায় চার মাস আছি কেউ আজ পর্যন্ত এভাবে এসে সবাই কে খেতে দেয়নি। তুমি কেন সবাই কে এভাবে খেতে দিচ্ছ এতো সুন্দর করে।

সুরাইয়া তখন বলে আসলে আজ আমার মেয়ের জন্মদিন সেই জন্যই প্রতি জন্মদিনে এভাবে বৃদ্ধাশ্রমে এসে আমাদের মতো মা বাবাদের জন্য অল্প একটু খাওয়া দাওয়া ব্যবস্থা করি পরিবার মিলে।

সুরাইয়ার শ্বাশুড়ি তখন বলে। তোমার মেয়ের কত বছর বয়স মা?

আমার মেয়ের আজ দুই বছর পূর্ণ হয়েছে।

সুরাইয়ার শ্বাশুড়ি তখন তখন মনে মনে ভাবে সুরাইয়ার মেয়ে করা। তখন বলে আমারও একটা নাতনি ছিল সে মনে হয় এখন তোমার মেয়ের বয়সের হবে।

সুরাইয়া তখন বলে ছিল কিন্তু এখন নেই কেন। কি হয়েছে আপনার নাতনির।

সুরাইয়ার শ্বাশুড়ি তখন বলে এখনও আছে কিন্তু আমার কাছে নেই আমার নির্যাতনে সে তার মেয়ে কে নিয়ে আমার বাসা থেকে চলে গিয়েছিল। এখন জানি না কোথায় আছে তাঁরা দুজন। কিভাবে কথা তাঁরা। আমি সব সময় দোয়া করি তারা যেন, সবাই সুখে থাকুক। তাদের উপর অবিচার করে আমি যে পাপ করেছি সেই শাস্তি এখন ভোগ করছি। তাদের কে কাছে পেলে মাফ চেয়ে নিতাম। তারা যদি মাফ না করে তাহলে মৃত্যুর পরেও শান্তি হবে না আমার।

সুরাইয়া তখন তার শ্বাশুড়ি কে বলে হয়তো তারা আপনাকে মাফ করে দিয়েছে।

কিন্তু কারোর উপর এতো নির্যাতন করাও পরেও কিভাবে মাফ করতে পারে আমার মতো পাপি কে।

সুরাইয়া তখন বলে যে নির্যাতন সহ্য করতে পারে সে মুখ বুঝে মাফ করতেও পারে।‌ যারা চুপ থেকে নির্যাতন সহ্য করতে পারে তারা নরম মনের মানুষ হয়। যদি কঠিন মনের মানুষ হতো তাহলে বাসা থেকে চলে যেত না। উল্টা সেই আপনাকে নির্যাতন করত।৭২৪

অনেক কথা বলে কিন্তু।‌ কিন্তু সুরাইয়ার শ্বাশুড়ি এখনো জানে না এটা তার ছেলের বোউ ছিল। একজন অজানা মানুষ হয়ে শ্বাশুড়ির সাথে কথা বলে। আর সুরাইয়া বুঝতে পারে। তার উপর তার শ্বাশুড়ি যে নির্যাতন করেছিল তার জন্য সত্যিই অনেক অনুতপ্ত হয়েছে । এবং শ্বাশুড়ি কে মাফ করে দেই সুরাইয়া।

বৃদ্ধাশ্রম থেকে চলে আসার সময় সুরাইয়ার বাবা সুরাইয়াকে বলে তুই তোর শ্বাশুড়ি কে বৃদ্ধাশ্রম থেকে বাসায় নিয়ে চল। এখানে থাকতে অনেক কষ্ট হয়।

সুরাইয়া তখন বলে না বাবা আমি বাসায় নিয়ে যেতে পারব না। আমার সাথে যা অন্যায় করেছে আমি সেই অন্যায়ের মাফ করে দিয়েছি। আমি চাই না আমার সন্তান এটা জানতে পারুক তার দাদি এমন ছিল।প্রয়োজন হলে আমি মাঝে মাঝে এসে দেখে করা খাইয়ে দিব এখানে এসে।

সুরাইয়ার বলে আমি একটা কথা বলতাম।

হ্যাঁ বাবা বলো?

অনেক দিন হয়েছে আমার বাসায় যাওয়া হয়নি। অনেক ইচ্ছা হয় যেতে। তোমার মায়ের স্মৃতি আছে ওই বাসায়।

সুরাইয়া তখন বলে আচ্ছা ঠিক আছে বাবা চলো আজ আমরা তোমার ওখানে যাবো। আর রাতেও তোমার ওখানে রাতে থাকব।

এর পর থেকে সুরাইয়া যখন সময় পাই তখন শ্বাশুড়ির সাথে এসে দেখা করে যায়। রান্না করে নিয়ে আসে আর খাইয়ে দিয়ে যাই। কিন্তু নিজের পরিচয় দেয়নি সুরাইয়া। কারণ কিছু কিছু বিষয় অজানা থাকাই ভালো। আর বৃদ্ধাশ্রমের কেয়ার টেকার কে সুরাইয়া বলে যাই আমি এখানে উনার সাথে দেখা করতে আসি এটা যেন ওয়াহেদ সাহেব বা অন্য কেউ জানতে না পারে।

অনেক দিন পরে আজ বর্ষা মায়ের সাথে দেখা করতে আসছে। কিন্তু ভাই ওয়াহেদের বাসায় এসে দেখে মা নেই। তাই ভাবি আফসানাকে বলে মা কোথায় ভাবি।

জবাবে আফসানা বলে,,,

চলবে,,,

বি.দ্র: ভুল ত্রুটি ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন।

মায়া পর্ব-১১

0

#মায়া
#পর্ব_১১
#ওয়াহেদ_মাহমুদ

মেয়ের সন্তান হওয়ার খুশির সংবাদ শুনে বর্ষার মা বর্ষার বাসায় রওনা হয়। কিন্তু যাওয়া পথে যেই বাসে বর্ষার মা ছিল, সেই বাস এক্সিডেন্ট করে। অনেক মারাত্মক ভাবে আহত হয়। তারপর বাসে যারা ছিল সবাইকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

কিন্তু এদিকে বিকাল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায় বর্ষার মা আসে না। বর্ষার আর বর্ষার শ্বশুর বাড়িতে সবাই দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। এখনো কেন আসছে না? এতোক্ষণ তো পৌঁছে যাওয়ার কথা ছিল। আর কোন উপায় না পেয়ে বর্ষা তাঁর ভাই ওয়াহেদের কাছে ফোন দেয়।

হ্যালো ভাইয়া মা কোথায়? বাসায় আছে?

মা কেন বাসায় থাকবে? মা তো তোদের বাসায় গিয়েছে। আর আমরা কালকে যাচ্ছি তোদের বাসায়। একসাথে যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু মা আজ চলে গিয়েছে। শ্বশুর বাড়িতে ছিলাম তাই যেতে পারিনি। না হলে একসাথে যেতাম।

কিন্তু ভাইয়া মা সেই কখন বাসা থেকে বাহির হয়েছে এখনো আমাদের এখানে আসিনি।

তোর ওখানে নেই তাহলে কোথায় যেতে পারে। ফোন দিয়েছিস।

হ্যাঁ দিয়েছিলাম কিছুক্ষণ আগে কিন্তু ফোন বন্ধ দেখাই। অনেকবার ফোন দিয়েছি।

দুই দিন ধরে মায়ের কোন খোঁজ নেই। হাসপাতাল থেকে আজ বাসায় চলে আসে বর্ষা তার মেয়ের সাথে। বাসায় সবাই চিন্তিত মাকে নিয়ে। আজ সকালে গিয়ে পুলিশ রিপোর্ট করে এসেছে ওয়াহেদ।

বিকালে পুলিশের থেকে খবর আসে দুই দিন আগে একটা বাস এক্সিডেন্ট হয়েছিল। ওখানে অনেকেই আহত হয়েছে আবার অনেকেই নিহত হয়েছে। আহতদের চিকিৎসা চলছে আর নিহতদের মর্গে রাখা হয়েছে। আমরা সঠিক বলতে পারছিনা আপনার মা নিহত নাকি আহত। আর আপনার মায়ের কোনো ছবি ছিল না আপনাদের কাছে সেজন্য আপনি আমাদের ছবি দিতে পারেননি।

তাই আপনার মা নিহত হয়েছে নাকি আহত হয়েছে সেটা জানার জন্য আপনাদের অতি তাড়াতাড়ি হাসপাতাল আসতে হবে।

তারপর সবাই ছুটে হাসপাতালে উদ্দেশ্যে রওনা দেয় বর্ষা বাসায় থেকে যায় তার সিজার করা হয়েছিল সেজন্য হাসপাতালে যেতে পারিনি। বাস একসিডেন্টে নিহতদের সংখ্যা অনেক বেশি ছিল তাই প্রথমে সবাই মর্গে যায়। কিন্তু মর্গে ওয়াহেদের মাকে খুঁজে পাওয়া গেল না। তারপর সবাই কিছুটা আশা পেল হয়তো বেঁচে আছে।

চিকিৎসাধীন রত রোগীদের কাছে গিয়ে ওয়াহেদ তার মাকে খুঁজে পাই। ডাক্তার বলেছে তার মা আর কোনদিন চোখে দেখতে পাবে না দৃষ্টি শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।

ওয়াহেদ তখন বলে দুটা চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছে নাকি একটা চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছে।

আপনার মায়ের দুটা চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আর চোখে দেখতে পাবে না। যদি কেউ আপনার মায়ের জন্য চোখ দান করে তাহলে দৃষ্টি শক্তি ফিরে আসবে। দুটা চোখ দান করার প্রয়োজন নেই। যদি কেউ একটা চোখ দান করে তাহলে ওই এক চোখ দিয়ে সবকিছু দেখতে পারবে। আর যদি কেউ দুইটা চোখ দান করতে পারে তখন অনেক ভালো। সেটা আপনারা পরিবারের কেউ হোক বা বাহিরের কেউ হোক সমস্যা নেই।শুধু তাদের সম্মতি থাকা লাগবে।

কয়েকদিন হাসপাতালে থাকার পর বাসায় নিয়ে আসে ওয়াহেদ তার মাকে। কিন্তু চোখ দান করার জন্য কেউ ছিল না। এক্সিডেন্ট হয়েছে প্রায় দশ দিন হয়ে গিয়েছে।‌ ওয়াহেদের বোন বর্ষা এসেছ তার মাকে দেখার জন্য।

কেমন আছো মা?

কেমন আর থাকতে পারি। অনেক ইচ্ছা ছিল তোর মেয়েকে দেখার জন্য কিন্তু দেখার জন্য তো আমার চোখ নেই। তোর মেয়েকে দেখার ইচ্ছা আর পূরণ হলো না। তোর মেয়েকে আমার কোলে একটু দিবি।

বর্ষা তার মেয়েকে মায়ের কোলে দেই।

আচ্ছা বর্ষা তোকে তো হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল এবোরশন করানোর জন্য। তাহলে তোর মেয়ে কিভাবে হলো। আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না।

আসলে এটা আমার শ্বাশুড়ি আর আমার স্বামীর সাজানো একটা নাটক ছিল। তোমার আর ওয়াহেদ ভাইয়ার ভুলটা বোঝানোর জন্য। সুরাইয়া ভাবির মেয়ে হয়েছিল বলে ভাইয়া দ্বিতীয় বিয়ে করে। সুরাইয়াকে অনেক নির্যাতন করা হয়। আফসানা ভাবির মেয়ে হবে শুনে তুমি বলেছিলে এবোরশন করিয়ে নিতে। সেই জন্যই আমরা এবোরশনের নামে এমন করেছিলাম।

আসলে কি জানো মা ছেলে মেয়ে কোনটি হবে এটা আল্লাহর হাতে। এটা স্বামী স্ত্রীর হাতে না। তোমার নিজের মেয়ের জন্য তোমার যতটা ভালোবাসা, দয়া, মায়া ঠিক তেমনি তারাও তো কারো মেয়ে তাদের প্রতি তো তাদের বাবা মায়ের ভালোবাসা, দয়া, মায়া আছে।

আজ সুরাইয়ার বান্ধবী মারিয়ার মেয়ে সন্তান হবে আলট্রাস্নোগ্রাফের মাধ্যমে জানা যায়। এর আগেও একটা সন্তান আছে মারিয়ার সেটাও মেয়ে এটাও মেয়ে হবে। কিন্তু মারিয়ার স্বামীর বিন্দু মাত্র আফসোস নেই। প্রথম সন্তান মেয়ে হওয়ার পরে সবাই চায় দ্বিতীয় সন্তান ছেলে হোক। দ্বিতীয় সন্তান মেয়ে হলে অনেকেই আফসোস হয়। কিন্তু মারিয়ার স্বামী যেন আরো খুশি। এখন থেকেই অফিস হাফ ডিউটি করে। বাসায় কাজের জন্য কাজের লোক রেখেছে। আর মারিয়ার স্বামী তাড়াতাড়ি রাতে চলে আসে যাতে মারিয়ার সমস্যা না হয়।

এসব দেখে সুরাইয়ার অনেক ভালো লাগে। আর আফসোস হয় নিজের প্রতি। সবাই চায় এমন একটা স্বামী পেতে যে সব সময় স্ত্রীর পাশে থাকুক।

এভাবে বেশ অনেকদিন কেটে যায়। একটা সময় সুরাইয়ার উপর অনেক নির্যাতন করেছিল তার শ্বাশুড়ি, কিন্তু এখন সময় পরিবর্তন হয়েছে। ছেলের বোউ এর কাছে নির্যাতন হয় শ্বাশুড়ি বাসার একজন অবহেলিত মানুষ আফসানার শ্বাশুড়ি।

রাতে যখন ওয়াহেদ বাসায় আসে তখন আফসানার বলে এভাবে আর কত দিন চলবে? আমি আর একদম সহ্য করতে পারছি না।

ওয়াহেদ তখন বলে কেন কি হয়েছে? তোমার কোন সমস্যা হয়েছে কী?

সমস্যা আর কি হবে। সমস্যা আমার তো কিছুই না। সমস্যা হলো তোমার মায়ের।

মা আবার কি করেছে?

আমার ছোট একটা বাচ্চা আছে। আর তোমার মা তো চোখে দেখে না। এখন আমি আমার ছেলে কে দেখব নাকি তোমার মা কে দেখব। প্রতিদিন গোসল করানো বাথরুমে নিয়ে যাওয়া নিয়ে আসা। খাইয়ে দেয়া, গোসল করিয়ে কাপড় চোপড় ধুয়ে দেয়া। এক কথায় তার সবকিছুই আমাকে করতে হয়।

ওয়াহেদ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে। তাহলে এখন আমি কি করতে পারি। তুমি যদি না পারো তাহলে আমি তো আর করতে পারব না।

আমি কি কখনো বলেছি তোমাকে করতে। এক কাজ করতে পারো? তাহলে সবকিছু সমাধান হয়ে যাবে।

কি কাজ?

তোমার আম্মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রাখে আসো। আর তাছাড়া তো কিছু করার নেই। আমার ছোট বাচ্চা আছে। সবকিছু একসাথে সামলিয়ে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব না।

তোমার মাথা ঠিক আছে আফসানা। এসব কি কথা বলো। এসব করলে মানুষে কি বলবে। মানুষ থুতু ফেলবে আমাদের উপর।

আফসানা তখন রাগান্বিত হয়ে বলে। আমি কিছু জানি না লোকে কি বলবে। হয় তুমি তোমার মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসবে না হয় আমাকে ভুলে যাবে।

ওয়াহেদ তখন বলে আমাকে দুইদিন সময় দাও দেখি কি করা যায়।

অনেকক্ষণ ভাবতে থাকে ওয়াহেদ। কি করবে বুঝতে পারছে না।কয়েকদিন পরে ওয়াহেদ তার আম্মার কাছে বলে। আমি সারাদিন অফিসে ব্যস্ত থাকি। রাতে এসে তোমাকে সময় দিতে পারি না। তোমার বোউ মা সারাদিন ব্যস্ত থাকে বাচ্চা নিয়ে তোমার প্রতি তার নজর থাকে না বেশি। তোমার এখানে থাকতে সমস্যা হচ্ছে আমি জানি। তাই আমি ঠিক করেছি তোমাকে ভালো একটা বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসি। ওখানে তুমি ভালো থাকবে। গল্প করার জন্য মানুষ পাবে। তাড়াতাড়ি সময় কেটে যাবে।

ওয়াহেদের মা তখন বলে তোমার যেটা ভালো মনে হয় করো। আর ভাবতে থাকে এটাই মনে হয় আমার কপালে ছিল, পাপের শাস্তি। অন্যায় যা করেছি তার শাস্তি ভোগ করতেই হবে।

তারপর ওয়াহেদ তার মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে।

প্রায় অনেকদিন পার হয়ে যায়। আজ পূর্ণতার দ্বিতীয় জন্ম বার্ষিকী। আগের বারের মতো এবারো কেক কাটা হয়নি পার্টি দেয়া হয়নি। সবাই একসাথে বৃদ্ধাশ্রমে যায়। ১০৪৫

চলবে,,,,

(বি.দ্র: ভুল ত্রুটি ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন।

মায়া পর্ব-১০

0

#মায়া
#পর্ব_১০
#ওয়াহেদ_মাহমুদ

হঠাৎ করেই আফসানা শ্বাশুড়ি কে বলে মেয়ে হবে শুনে তখন তো ঠিকই বলেছিলেন এবোরশন করে নিতে। প্রথমে তো আসলেন না। ছেলে হয়েছে শুনে এখন আসছেন। আমার ছেলেকে এখানে রেখে দিন। আমি চাই না আপনি আমার সন্তানকে কোলে নিন। প্রথমে নিজের মন ঠিক করবেন তারপর কোলে নিবেন।

শ্বাশুড়ি যখন কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই ওয়াহেদ দুজনকে চুপ করিয়ে দেয়। তোমরা দুজন কি শুরু করলে। এটা তোমাদের বাড়ি না এটা হাসপাতাল এখানে অত্যন্ত চুপ থাকো, তারপর বাসায় কি যা ইচ্ছা করিও। হাসপাতালে কয়েকদিন থাকার পর বাসায় চলে আসে আফসানা আর মেয়েকে নিয়ে।

রাতে ওয়াহেদ অফিস থেকে বাসায় ফিরে আসে। খাবার টেবিলে সবাই খাওয়া দাওয়া করছিল তখন ওয়াহেদের বোনের বাসা থেকে ফোন আসে যে, ওয়াহেদের বোন প্রেগন্যান্ট এসে দেখে যেতে। সবাই অনেক খুশি। ওয়াহেদের মা বলে মেয়েকে আমার এখানে নিয়ে আসবো। ওখানে থাকলে কাজ করতে হবে। এখানে থাকলে কাজ করা লাগবে না আমি সব সময় দেখে শুনে রাখব।

তখন আফসানা বাঁকা হাসি দিয়ে বলে দোয়া করি আপনার মেয়ের শ্বাশুড়ি যেন, আপনার মতো না হয়। আপনার থেকে ভালো হবে আশা করি।

শ্বাশুড়ি তখন বলে আমার মতো বলতে কি বোঝাতে চাও তুমি, আর আমার থেকে ভালো মানে?

ও মা আপনি এখনো বুঝতে পারেন নাই। বলতে চাচ্ছি আপনার মেয়ের যদি মেয়ে হয় তাহলে আপনার মেয়ের শ্বাশুড়ি যাতে না বলে যে বোউ মা তুমি এবোরশন করে নাও। আর যদি বলে এবোরশন করতে, তাহলে তখন আপনি কি করবেন?

আফসানার শ্বাশুড়ি তখন আর কিছু বলে না চুপ করে থাকে। যেই শ্বাশুড়ি সব সময় চোখ উপরের তাকিয়ে কথা বলতো সেই শ্বাশুড়ি আজ নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। আর মুখে কোনো কথা নেই।

আফসানা তখন আবার হাসি দিয়ে বলে কি হলো শ্বাশুড়ি মা আর কোন কথা বলছেন না কেন?

শ্বাশুড়ি তখন খাবারের টেবিল থেকে উঠে চলে যায় আর বলে আজ আমার শরীর অনেক খারাপ। রেস্টের প্রয়োজন, চলে গেলাম আমি।

আজ পূর্ণতার বার্থডে। দেখতে দেখতে এক বছর পূর্ণ হয়ে গেল পূর্ণতার বয়স। আজকের এই দিনে জন্মগ্রহণ করে পূর্ণতা। আর আজকের দিনে স্বামীর অধিকার থেকে বঞ্চিত হয় সুরাইয়া। সবকিছু যেন ধুলার সাথে মিশে যায় । আরো অনেক কথা চিন্তা করতে থাকে সুরাইয়া। কিন্তু এখন এসব কথা চিন্তা করে আর কি হবে। যা হয়েছে সবকিছু মানিয়ে নিতে হবে। আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে।

বার্থডে উপলক্ষে কেক বা পার্টি দেয়া হয়নি। সুরাইয়া নিজে, বাবা, পূর্ণতা, মারিয়া আর মারিয়ার স্বামী, সন্তান সবাই একটা পরিবারের মতো। সবাই মিলে একটা বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে সবার মাঝে খাবার পরিবেশন করেন পূর্ণতার জন্মদিন উপলক্ষ্যে। বৃদ্ধাশ্রমের মানুষের মধ্যে খুশি গুলো ভাগ করে নেই পরিবারের সাথে।

এভাবেই দেখতে দেখতে প্রায় আরো চার মাস চলে যায়। আজ সবাই মিলে ওয়াহেদের বোনের শ্বশুরবাড়ি গিয়েছে। ওয়াহেদের মা মেয়ের বাড়িতে গিয়ে জানতে পারে। তার মেয়ের মেয়ে সন্তান হবে।‌ শ্বশুর বাড়ি থেকে নির্যাতন করে সব সময়। তাদের ছেলে সন্তান চায় কিন্তু মেয়ে সন্তান হবে। ওয়াহেদের বোন বর্ষা কে তার শ্বাশুড়ি বলে এবোরশন করে নিতে। এটাই তার জন্য ভালো।

বর্ষার মা তখন বলে এবোরশন কেন করবে আমার মেয়ে। ছেলে হবে নাকি মেয়ে হবে এটা নির্ধারিত করে আল্লাহ। এখানে আমার মেয়ের দোষ কোথায় এখানে। আমি থাকতে আমার মেয়েকে এবোরশন করতে দিব না।

বর্ষার শ্বাশুড়ি তখন বলে বাহ ভুতের মুখে রাম রাম। লজ্জা করছে না এসব কথা বলতে। সবকিছু কি ভুলে গিয়েছেন। সুরাইয়া মেয়েটার উপর কত নির্যাতন করছেন আপনি শুধুমাত্র মেয়ে সন্তান হওয়ার জন্য। আর আফসানাকে তো বলেছিলেন এবোরশন করে নিতে। আপনার মেয়ের জন্য কত চিন্তা আর অন্যের মেয়ের জন্য শুধু নির্যাতন। আপনি একটাও কথা বলবেন না। বর্ষার এবোরশন তো হবেই। আজ বর্ষাকে এবোরশন করানো হবে।

বর্ষা মায়ের কাছে এসে অনেক কান্নাকাটি করে। বর্ষা মায়ের কাছে এসে বলে আমি এবোরশন করাতে চাই না কিন্তু তারা আমাকে জোর করে এবোরশন করাতে চায় আর সবকিছু তোমার দোষ। তুমি অন্যের মেয়ের উপর নির্যাতন করেছিলে বলে সেই পাপের শাস্তি আজ আমাকে ভোগ করতে হচ্ছে।

আজ বিকালে বর্ষাকে নিয়ে যেতে হবে এবোরশন করাতে। বর্ষার মা কান্না করছে। অনেক করে মানা করছে বর্ষার শ্বাশুড়ি কে, যাতে বর্ষার এবোরশন না করানো হয়। কিন্তু কোনো কথায় কাজ হচ্ছে না। ওয়াহেদের মা ওয়াহেদের কাছে গিয়ে বলে তুই তো কিছু বলতে পারিস, তোর বোন কে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে এবোরশন করাতে।

ওয়াহেদ তখন করুণ কন্ঠে বলে আমার কিছু করার নেই মা। আমাদের পাপের শাস্তি এখন আমার বোন তোমার মেয়েকে ভোগ করতে হচ্ছে। মনে আছে মা সুরাইয়ার কথা। দশ বছর পর মেয়ে সন্তান হয়েছিল। অনেক মানুষের তো সন্তান হয় না। আমাদের তো দশ বছর পরে হয়েছিল। কিন্তু মেয়ে সন্তান হওয়ার কারণে আমি আর একটা বিয়ে করি। তুমি তো অনেক নির্যাতন করেছিলে সুরাইয়ার উপরে।

আফসানা মেয়ে হবে যখন শুনেছিলে তখন তো আফসানা কে এবোরশন করতে বলেছিলে। আফসানার যখন সন্তান হয়েছিল তখন একেবারে জন্য দেখতে গিয়েছিলে না। তারাও তো কারোর মেয়ে কারোর বোন হয়। ঠিক তোমার আমার মতো।

এখন আমার কিছু করার নেই। তুমি যদি চাও বর্ষা এই বাড়িতে সুখে থাকুক তাহলে তারা যেভাবে করতে চায় করুক। সবকিছু মেনে নাও।

ঘন্টা দুয়েক পরে হাসপাতাল থেকে বর্ষার হাসব্যান্ড এর ফোন আসে বর্ষার শ্বাশুড়ির কাছে এটা বলার জন্য যে, বর্ষার এবোরশন ঠিক মতো হয়েছে। কয়েক ঘন্টার মধ্যেই বাসায় চলে আসবে। বর্ষার শ্বাশুড়ি এসে বর্ষার মা, ভাইয়া আর ভাবিকে বলে দেয় বর্ষার এবোরশন ঠিক মতো হয়েছে। চিন্তা না করতে।
বর্ষার মা, ভাইয়া আর ভাবি তখনই বাসায় চলে আসে। বর্ষার সাথে দেখা না করেই। বর্ষার মা কান্না করছে আর ভাবছে আমার পাপের শাস্তি আমার মেয়ের কপালে লেখা ছিল। আমি যদি সুরাইয়ার সাথে নির্মমভাবে ব্যবহার না করতাম, যদি সুরাইয়াকে নির্যাতন না করতাম, যদি খারাপ সময় সুরাইয়া পাশে থাকতাম, যদি ওয়াহেদের দ্বিতীয় বিয়েতে সম্মতি না দিতাম তাহলে আজ এই দিন দেখতে হতো না। আমি এসবের প্রতিবাদ করতে পারতাম তাহলে আমার মেয়ে সুখে থাকত। তার সন্তান পৃথিবীর মুখ দেখতে পারত। কিন্তু তা আজ হলো না। কিন্তু আমিই তো অপরাধী এসব প্রতি প্রতিবাদ করার মতো যোগ্যতা আমার নেই।

এর মাঝে প্রায় দশ মাস পার হয়ে যায়। এর মধ্যে বর্ষার সাথে কথা হয়নি বর্ষার মায়ের। বর্ষার মা অনেকটা পরিবর্তন হয়েছে। আফসানার সাথে খারাপ ব্যবহার করে না। সব সময় নরম সুরে কথা বলে। আর মাঝে মাঝে সুরাইয়ার জন্য আফসোস করে। কিন্তু কিছু করার নেই যে। দাঁত থাকতে দাঁতের মর্ম সবাই বুঝে না।

দুপুরে দিকে বর্ষার ফোন আসে মায়ের কাছে। ফোনের ওপাশ থেকে হেসে হেসে বর্ষা বলে মা আজ আমার মেয়ে হয়েছে সিজার করে, তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলে আসো ভাইয়া আর ভাবির সাথে।
বর্ষার মা তখন বুঝতে পারছে না এবোরশন করার পরেও বাচ্চা কিভাবে হবে। ছয় মাস আগে তো এবোরশন করানো হয়েছিল বর্ষার। আর কিছু না ভেবে বর্ষার মা হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। ওয়াহেদ আজ বাসায় ছিল না আফসানার সাথে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছে। তাই বর্ষার মা একাই রওনা দেয়। কিন্তু যাওয়া পথে সেই বাসে করে যাচ্ছিল সেটা এক্সিডেন্ট করেছে।

বর্ষার তো এবোরশন করানো হয়েছিল তাহলে কিভাবে ছয় মাস পরে বাচ্চা হয়?

বর্ষার মা এক্সিডেন্ট করেছে তাহলে কি মারা যাবে নাকি বেঁচে থাকবে?

চলবে,,,,,,

বি.দ্র: ভুল ত্রুটি ক্ষমা দৃষ্টিতে দেখবেন।