ওয়ারদূন আসরার পর্ব-০৪

0
1250

#ওয়ারদূন_আসরার
#লাবিবা_ওয়াহিদ
“০৪”

——————————-

কমলা দেবী কিছুটা রিয়েক্ট করে বলে,”ওরে আমার সোয়ামী ডা কতো কষ্ট পাইতাসে আইয়ো সোয়ামী ভিত্রে আইয়ো ও মল্লিকা আমার সোয়ামির লেইগা সরবত লইয়া আহো।”

জাইফ ভেতরে ঢোকার পর যীনাত ভেতরে আসতে নিলেই কমলা দেবী থামিয়ে বলে,”ওই ছোকড়ি তোরে আই আইতে কইনাই আগে নিজের পরিচয় দে।”

দেবনাথ দেব কিছুটা বিরক্তি সুরে বলে,”উফফ দিদি এমন করছো কেন ও আমার বন্ধুর নাতিন হয়। গতকাল এক দুর্ঘটনায় ওর পুরো পরিবার শেষ হয়ে গেছে।”

দেবনাথ দেবের কথায় যীনাতের চোখ বেয়ে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ে। কমলা দেবী সহ উপস্থিত সবাই যীনাতের দিকে তাকায়। সকলের মনেই কিছুটা দয়া কাজ করছে শুধু কমলা দেবী বাদে। দেবনাথ দেব যীনাতকে নিয়ে ভেতরে আসে এবং কাজের মেয়ে মিনিকে ডাকে।

– মিনি।

– জ্যা কর্তা কন।

– যীনাতকে দক্ষিণের শেষের ঘরটায় নিয়ে যা আর ঘর পরিষ্কার করা লাগবে না আমি আগেই করিয়ে রেখেছি।

– আইচ্ছা! দিদিমনি আফনে আমার লগে আইয়েন।

যীনাত মিনির পিছে পিছে উপরে চলে গেলো। এবার কমলা দেবী বলে,”মাইয়াডার উপ্রে এতো দরদ কেন ভাই তোর? আর মাইয়াডা ওমন ঘুমটা দিয়া রইসে ক্যান? মাইয়া কি মুসলিম?”

– সেটা তোমার না জানলেও চলবে। মেয়েটা বিপদে আছে, আপাতত তাকে ভালো রাখার চেষ্টা করো অনেক কষ্ট সহ্য করেছে।

– বাবা আপনি চিন্তা করবেন না আমি মেয়েটার খেয়াল রাখবো।(সরবত নিয়ে আসতে আসতে)

– হুম তোমার উপর ভরসা রেখেছি বউমা।

বলেই দেবনাথ দেব নিজের রুমে চলে যায়। মল্লিকা দেবী জাইফকে সরবত দিয়েই উপরে চলে যায় যীনাতের কাছে। যীনাত তখন মাত্র ফ্রেশ হয়ে বসেছে। মল্লিকা দেবী দরজায় দাঁড়িয়ে বলে,”আসবো!”

যীনাত চট করে দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে মধ্যবয়সী মহিলা যাকে ওই কমলা দেবী সরবত বানাতে পাঠিয়েছিলো। যীনাত হাসার চেষ্টা করে বলেন,”আসুন অনুমনি নেয়ার প্রয়োজন নেই।”

মল্লিকা দেবী যীনাতের হাসি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলো। যার গতদিন পরিবার হারালো সে আজ এতোটা শক্ত সত্যি অবাক করার মতো।মল্লিকা দেবীও একটা হাসি দিয়ে বলে,”তোমার নাম কি মা?”

– জ্বী জাফিয়া যীনাত।

– বাহ বেশ সুন্দর নাম তো কিন্তু যীনাত নাম তো…

– হুম আন্টি ঠিক ধরেছেন আমি সনাতন ধর্মাবলম্বীর নই। এখন যদি আপনারা আমার সত্যি টা জেনে রাখতে না চান আমি চলে যাবো। শুধু শুধু আপনাদের বোঝা হয়ে থাকতে চাইনা।

যীনাত নিচের দিকে তাকিয়ে খুবই শান্ত সুরে কথাগুলো বললো। মল্লিকা দেবী খুবই মুগ্ধ হয়ে দেখছে। মেয়েটা যেমন সুন্দর তেমনই তার ভদ্রতা। চেহারার মায়ায় আগেই পড়ে গেলো এখন কথার মায়ায়। মল্লিকা দেবী মুচকি হেসে বলে,”না মা বোঝা কেন হবে আমরা তোমাকে নিজের মেয়ের মতোই ভালোবাসবো। আমার তোমাকে বেশ ভালো লেগেছে। জানো আমার একটা মেয়েও আছে সে কখনো আমার সাথে ভালো ব্যবহার করেনি।”

যীনাত অবাক হয়ে মল্লিকা দেবীর দিকে তাকিয়ে বলে,”কেন?”

মল্লিকা দেবী ছলছল চোখে কিছুটা তাচ্ছিল্যের সুরে বলে, “আমি একজন এতিম মেয়ে মা তবে আমার পড়াশোনা অনেক ভালো ছিলো ভালো জবও করতাম। সেই থেকেই আমার শাশুড়ী আমায় পছন্দ করে। সে আমার জাতপাত না দেখেই বিয়ে দিয়েছিলো রিকেশের বাবার সাথে। আর আমার মেয়ে বড় হওয়ার পর জানতে পারে আমি এতিম সেই থেকে আমার সাতগে দুর্ব্যবহার করে।”

আর কিছু বলতে না পেরে আঁচলে নিজের চোখের জল মুছলো মল্লিকা দেবী। যীনাত চুপচাপ শুনলো এবং মনে মনে ধিক্কার জানালো ওই মেয়েকে। কি করে পারে নিজের জম্মদাতা মায়ের সাথে এমন আচরণ করতে? যীনাত কৌতুহল বশত জিজ্ঞেস করলো,”আপনার মেয়েকে তো দেখিনি আন্টি।”

– সে এখানে থাকে না। সে যাইহোক তুমি তো কোনো জামা-কাপড় আনোনি মা তোমার জন্য কি শপিং করতে যাবো?”

মিনি তখনই হাতে কিছু ব্যাগ নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো আর বললো,”না কর্তামা আফনের কোনো খানে যাওন লাগতো না ছোটদাদা আর হাতে দেহেন কতোডি ব্যাগ ধরাইয়া দিসে দিদিমনির জন্য।”

মল্লিকা দেবী হেসে বলে,”বাহ বেশ ভালো তো। দেখেছো যীনাত আমার ছেলের কান্ড। সে কতোদিকে খেয়াল রাখে!”

যীনাত উত্তরে শুধু একটা মুচকি হাসি দেয়। ভেতরে যে কি চলছে সেটা একমাত্র যীনাতই জানে। যীনাত বুঝে নিয়েছে এগুলো দায়িত্বের থেকেই তাকে দিয়েছে জাইফ।

তারপর অনেকক্ষণ যীনাত এবং মল্লিকা দেবী কথা বললো। মল্লিকা দেবী বেশ ভালো যীনাতকে একদমই মনে করতে দেয়নি তার অতীতের কথা। মন খুলে হেসেছে আজ যীনাত। দরজা থেকে দেবনাথ দেব দেখছে যীনাতের হাসি। আহহ কতোদিন পর মেয়েটা প্রাণ খুলে হাসছে।

জাইফ বারান্দায় দাঁড়িয়ে যীনাতের হাসি দেখছে আর নিজেও মুচকি মুচকি হাসছে। যীনাতের হাসিতে জাইফ আলাদা এক তৃপ্তি পাচ্ছে কিন্তু কেন সেটা জাইফের অজানা। জাইফ চুপচাপ হাসি দেখছে আর ভাবছে,”এই চেহারায় কান্না নয় হাসিটাই স্যুট করে। আমি কি আপনার কষ্টের ভাগিদার হবো যীনাত?”

রাতে খাবার টেবিলে সবাই একসাথে। একে একে সবার সাথে যীনাত পরিচিত হলো। বয়স্ক বলতে দেবনাথ দেব আর কমলা দেবী। কমলা দেবী বিধবা হওয়ার পর থেকেই ভাইয়ের বাড়িতে থাকে। কমলা দেবীর দুটো ছেলে মেয়ে। ছেলে পরিবার নিয়ে অস্ট্রেলিয়া থাকে আর মেয়ে দুইবছর আগে মারা যায়। তবে তার মেয়ের একটা মেয়ে আছে যে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে নাম তার স্নিদ্ধা। স্নিগ্ধার মা মারা যাওয়ার পর তার বাবা নতুন বিয়ে করেছে তাই স্নিগ্ধা নানুবাড়ি তেই থাকে। স্নিগ্ধা আর যীনাত প্রায় এক বয়সী। দেবনাথ দেবের এক ছেলে যার নাম নিকেশ। নিকেশের দুই ছেলে এক মেয়ে। রিকেশ, স্বর্না আর জাইফ। স্বর্না হলো সবার ছোট। তবে স্বর্ণা এখানে থাকে না সেও নাকি হোস্টেলে থেকেই পড়াশোনা করে।

কমলা দেবী খেতে খেতে বলে,”তুই কিন্তু আমারে ঠাকুমা কইবি না কইয়া দিলাম আগেই।

– তাহলে তুমি ঠাম্মি বইলো কেমন?

– ওই লিকপিকে শিং ঠাম্মি ক্যা কইবো?

কমলা দেবীর এমন কথায় যীনাত বিষম খায় এমন অবস্থা। এই বয়সে সে এভাবে গালাগাল করে? জাইফ যীনাতের দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলে,”ও আমার কমলা বউ তুমি এমনে কথা কইলে আমি কিন্তু তোমার লগে সব সম্পর্ক শেষ কইরা দিমু।”

যীনাত ড্যাবড্যাব করে জাইফকে দেখছে। ওরা এতো বড় ঘরের হয়েও কি করে এভাবে কথা বলে তা বুঝতে হিমশিম খায় যীনাত। তবুও না হেসে পারে না মিটমিট করে হাসে। জোরে হাসলে এখানে ঘোর বিপদ সে বেশ ভালো বুঝতে পারে।

– ও আমার সোয়ামী এইডা তুমি কি কইলা? আইচ্ছা যাও কাউরে কিচ্ছু কইতাম না। এহন খাও আই তোমারে খাওয়াই দেই তইলে ভালোবাসা বাড়বো।

জাইফ যীনাতের দিকে একবার তাকিয়ে আবার কমলা দেবীর দিকে তাকিয়ে বলে,”নাহ আজ তোমার সাথে রাগ করেছি তাই খাবো না!”

– ওই ছ্যামড়া তোরে কয়বার কমু আর লগে শুদ্ধ ভাষায় কথা কইবি না।

– বউ তুমি আমার সামনে আমার ভাইরে এমনে সোয়ামী কইয়ো না আর দিল ফাইট্টা যায় গো ফাইট্টা যায়।

– ওই তুই আবার আগো ভিত্রে সতান হইতে আইছিস?

– সতান কি গো বউ?(ভ্রু কুচকে)

– এতো মানে কইতে পারুম না। তুই কোনো মাইয়া না যে তোরে সতীন কমু তাই তোরে সতান কইলাম।

কমলা দেবীর কথা শুনে রিকেশ হো হো করে হেসে দিলো সাথে সবাই। নিকেশ হাসি থামিয়ে যীনাতের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে,”মা এটা নিজের পরিবারই মনে করবে। আমরা সবাই সবার আপনজন আর কখনো যদি সমস্যা হয় আমায় বলবা আমি সবসময় বাবা হিসেবে তোমার পাশে আছি।”

– আর ভাই হিসেবে সবসময় তোমার পাশে থাকবো বোন।(রিকেশ)

যীনাত এতো এতো মানুষের ভালোবাসা পেয়ে আল্লাহ’র দরবারে অনেক শুকরিয়া জ্ঞাপন করে। জাইফ আড়চোখে যীনাতের হাসি মুখ টা দেখছে। সবার খাওয়া শেষে যে যার রুমে চলে যায়।

যীনাত রুমে যাচ্ছিলো ওমনি খেয়াল করে জাইফও তার পিছে পিছে আসছে। এতে যীনাত কিছুটা ঘাবড়ে গেলো কোনো মতলব নেই তো? যীনাত তৎক্ষনাৎ পিছে ফিরে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে বলে,”কি হচ্ছে কি আপনি আমার পিছে পিছে আসছেন কেন?”

– ওহ রিলেক্স আমি আপনার পিছে পিছে কেন যাবো মাথার স্ক্রু কি ঢিলা হয়ে গেছে আপনার?

– কিহ বললেন আপনি আমার মাথার স্ক্রু ঢিলা?(নাক ফুলিয়ে)

– আমি তো তাই দেখছি!

– আপনাকে যদি এখন না থামাতাম তাহলে তো আপনি আমার রুম অব্দি চলে যেতেন তারপর…

বলেই একটা গিললো যীনাত। তারপর আবার বলে,”দেখেন বিয়ে করেছেন বলে যা ইচ্ছা তাই করতে পারেন না।”

– আপনার মনে হয়না আপনি সবকিছু দুই লাইন বেশি বুঝেন ওইদিকে শুধু আপনার একার ঘর না এর অপজিটের রুমটা আমার ওকে? আর বিয়ে করেছি ঠিকই এখনো কিন্তু আপনাকে স্পর্শ করার কথাও বলিনি।

এবার যীনাত কিছুটা লজ্জা পেলো তারপর কোনোরকম কথা না বলে রুমে চলে যায়। আর জাইফ সেখানে দাঁড়িয়েই নিশব্দে হাসলো তারপর নিজেও রুমে চলে গেলো।

– পাহ… পানি!
পানির তৃষ্ণায় পাগল হয়ে যাচ্ছে যীনাত তবুও সামনে থাকা মানুষ টা তার দিকে পানি এগিয়ে দিলো না। যীনাত কিছুটা কাঁপা কাঁপা হাত এগিয়ে নিতে যাবে লোকটি গ্লাসটা আরো সরিয়ে দেয় যাতে করে যীনাত পানি নিতে না পারে।
– বাচার খুবই ইচ্ছা বুঝি? তাহলে আমাকে বিয়ে কর।
যীনাত যেনো কথাই বলতে পারছে না এতোটাই গলা শুকিয়ে এসেছে। তবুও খুবই ধীরে বললো,”আমার জীবন থাকতে কোনো অমানুষকে বিয়ে করবো না।”
যীনাতের কথায় লোকটি ঘর কাঁপিয়ে হেসে উঠে। হাসির শব্দতে যীনাতের মাথা ধরে গেলো। কি করবে সে নিজেই বুঝতে পারছে না। নিজের গায়ে শক্তি পর্যন্ত নেই! কি করে শক্তি থাকবে তার তাকে যে প্যারালাইসিস এর ইনজেকশন দিয়ে দিয়েছে ওই অমানুষ টা। কি চাইছে এই বদমাইশ টা সেটা যীনাত বুঝতে সক্ষম হচ্ছে না। সে কখনোই এমন অমানুষ, সাইকো কে বিয়ে করবে না যে কিনা নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য যীনাতের মতো একজন অসহায় মেয়েকে এভাবে প্যারালাইজড করে।

পানি না পাওয়ায় যেনো যীনাত আরও দুর্বল হয়ে গেলো। শেষবার শুধু এইটুকু বলে দিলো,”আমি যদি একবার বেচে ফিরি তোর মতো কুলাঙ্গার কে হয় আমার হাতে মরতে হবে না হয় ওই ‘ওয়ারদূন আসরার’ এর সাহায্যে!

বলেই যীনাত জ্ঞান হারালো। সঠিক বলা যাচ্ছে না সে আদৌ জ্ঞান হারিয়েছে নাকি কোমায় গেছে। লোকটি আবার চিৎকার করে হেসে বলে,”আমার তোকে চাই যীনাত! তোর আর আমার মাঝে যদি *ওয়ারদূন আসরার* ও আসে আমি তাদের হাতে তাকে তুলে দিবো!! আমাকে আমার কার্য হাসিলের থেকে কেউই আটকাতে পারবে না।”

বলেই সে রুমে এসির পাওয়ার আরও ৩৫ডিগ্রি বাড়িয়ে দরজা লক করে চলে গেলো।

-এতো ঠান্ডায় কোন মানুষ বেচে থাকতে পারে?? মানুষ কি করে এতোটা টর্চার কারো প্রতি করতে পারে? আল্লাহ তুমি সহায় হও তুমিই পারবে একমাত্র মেয়েটাকে বাচাতে।

যীনাত লাফ দিয়ে উঠে বসলো আর ভয়ে হাঁপাতে থাকে। উপরে ফ্যান চলছে তবুও যেনো ঘেমে একাকার হয়ে গেলো। তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে আসছে তার তাই কাঁপা কাঁপা হাতে বেডসাইড থেকে পানি নিতে যায় ওমনি ঘড়িটা হাতে লেগে পড়ে যায়।

জাইফ বেলকনিতে বসে ল্যাপটপে অফিসের কাজ করছিলো ওমনি কোনো শব্দ শুনে আশেপাশে তাকায়। বেশ বুঝতে পারলো আওয়াজ টা যীনাতের রুম থেকে আসছে তাই ল্যাপটপ রেখে ওইভাবেই একপ্রকার ছুটে চলে গেলো যীনাতের রুমে। যীনাতের রুমের সামনে এসে দেখে……..

——————————

চলবে!!!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে