Sunday, August 3, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 156



শূন্যলতা পর্ব-১২

0

#শূন্যলতা
#গুঞ্জন_চৈতি
পর্ব-১২

গুটির জ্ঞান ফিরেনি এখনও। গুলি লেগেছে হাতে, আর ইটের উপর পড়ে আঘাত লেগেছে মাথায়। তাতে সেলাই পড়েছে তিনটে। আর সরণের হাতে পায়ে আর মাথায় ব্যাণ্ডেজ় পড়েছে বেশ কয়েক জায়গায়। রডের আঘাতে ছেয়ে গেছে পুরো শরীর। কোথাও শুভ্র ব্যাণ্ডেজ় চিঁড়ে উঁকি দিচ্ছে লোহিত রক্ত। আর মনে কড়া নাড়ছে ক্ষোভের প্রলয়। গুটির হাতে গুলি লেগেছিল জিহাদের বন্দুক থেকেই। জিহাদ জ্ঞান হারানোর আগে এলোপাথাড়ি দু’টো গুলি ছুড়েছিল। তার একটা লাগে গুটির হাতে। সরণ ঠিক করে নিয়েছে, জিহাদকে শুধু আইনের শাস্তি নয়, নিজে হাতেও শাস্তি দেবে। তারজন্য যতদূর যেতে হয় সে যাবে। যদি গুলিটা গুটির হাতে না লেগে অন্য কোথাও লাগতো! ভাবতেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো।

“সরণ, তুই তোর কেবিনে গিয়ে রেস্ট নে। গুটিদির জ্ঞান ফিরলে আমি ডেকে দেব।”
সরণের জন্য আলাদা কেবিন নেওয়া হলেও সরণ তাতে এক মুহুর্ত বসেওনি। মানিকের কথা কানে না নিয়ে গুটির পাশ গলিয়ে শুয়ে পড়লো। আলতো করে গুটির শরীরটাকে আগলে নিয়ে বলল,
“আমি চাই ও চোখ খুলে প্রথমে আমাকে দেখুক।”

এমন সময় হসপিটালে উপস্থিত হলো, ফখরুল ইসলাম। সরণ বিচলিত হলো কিনা বোঝা গেল না। ফখরুল ইসলাম সরাসরি কেবিনে ঢুকে এলে সরণ উঠে এগিয়ে এলো। শাসিয়ে বলল,
“খবরদার! এদিকে ভুলেও এগোবেন না। নতুন কোন নোংরা খেলায় মাততে চাইলে ক্যারি অন। আ’ম রেডি ফর এভরি কাইন্ড অফ সিচুয়েশনস।”
“কুল। আমি এখানে জিহাদের চাচা হয়ে আসিনি। এসেছি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে।”
“হোয়াট?”
“আমরা কি এখানেই কথা বলবো?”
ফখরুল ইসলাম কথাটা মানিককে উদ্দেশ্য করেই বলল। মানিক তা টের পেয়ে বিরবির করে বলল,
“কথা বলার জন্য বাসরঘরের ব্যাবস্থা করবো নাকি।”
সরণ ক্রুদ্ধ স্বরে বলল,
“যা বলার এখানেই বলুন। এখানেই……”
“দেখো, তোমার ঝামেলা জিহাদের সঙ্গে, আমার সঙ্গে নয়। আমি তোমার কোন ক্ষতি করিনি। বরং উপকারই করিছি। জিহাদকে তো একদম অন দ্য স্পটে পুলিশ ধরেছে। ওর বাঁচার চান্স নেই। তুমি ওর বিরুদ্ধে যা খুশি করো, শুধু আমাকে জড়িয়ো না। জিহাদের সঙ্গে আমার নাম জড়িয়ো না। তার বিনিময়ে তোমায় পলিটিকসে পাকাপোক্ত করার দায়িত্ব আমার। তোমার আমাকে প্রয়োজন। আমি তোমার পলিটিকাল লাইফের বিগ সাপোর্ট হতে পারি।”
“আমার না আপনাকে প্রয়োজন আর না আপনার সাপোর্ট। এখান থেকে চলে যান। আপনাকে আমি কোর্টে দেখে নেব।”
“ভুল করছো সরণ। আমি কিন্তু এমন অনেক কিছুই জানি যা তুমি আমাকে বলোনি।”
“হুমকি দিচ্ছেন? আমিও অনেক কিছু জানি যা আপনি না আমাকে বলেছেন আর না দেশের জনগণকে। প্রমাণ হাতে বসে আছি। হাত উপুর করবো নাকি?”
“সরণ! যে খুনের দায়ে জেলের বাতাস লাগালে গায়, সেই খুন যে তোমার বউয়ের হাতে হয়েছে, সেই নিউজ লিক করতে আমার দু’মিনিটও লাগবে না।”
“এক্ষুনি বের না হলে আমার ছেলেপেলে ডাকতে হবে।”
“ভয়ডর নেই কোন? যে বউকে বাঁচাতে খুনের দায় নিজের ঘাড়ে নিলে তাকে যদি ফাঁসিয়ে দিই?”
“আপনি আপনার বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্যকে বীরেন তালুকদারের খুনে ফাঁসিয়ে আমাকে বাঁচিয়েছেন। এখন যদি এই সত্যি তাদের সামনে আসে, আপনি বাঁচবেন তো? ছাড়বে আপনাকে? শেয়াল কুকুরের মতো ছিঁড়ে খাবে না? গুটিকে তো আমি বাঁচিয়ে নেব। কারণ খু ন টা ছিল ওর আত্মরক্ষার একটা পদক্ষেপ।”
ফখরুল ইসলামের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সরণ বলল,
“কিছু কাজ দেব, যদি হয় ঠিকঠাক, তবে ছেড়ে দেব আপনাকে। কিচ্ছু ফাঁস করবো না।”
“কি কাজ? দেখো…..”
“আপনার মতো আবর্জনার কীট নই আমি। ভালো কাজই দেব। এলাকার কিছু উন্নয়নমূলক কাজ। এখন বিদায় হন। সময়মতো আমি দেখা করে কাজের লিস্ট দিয়ে দেব।”

ফখরুল ইসলাম চলে গেলে সরণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে গুটির দিকে ফিরতেই দেখল গুটি চোখ মেলে চেয়ে আছে। মানিক বাইরে চলে গেল দু’জনকে একলা ছেড়ে। সরণ ছুটে গিয়ে গুটির কপালে চুমু খেল। কপালে কপাল ঠেকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কেমন লাগছে এখন? মাথায় ব্যাথা করছে? আর হাতে?”
সরণের প্রশ্নের উত্তর দিল না গুটি। কি যেন ভাবল কিছুক্ষণ। অতঃপর দু’হাতে আঁকড়ে ধরলো সরণের মাথা। হটাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামার মতো হুহু করে কেঁদে উঠলো। কান্নারত অবস্থায় সরণকে আঁকড়ে ধরে বলল,
“এতো লুকোচুরি কেন? কারণ বলতে পারেন? যাকে সব বলা যায় না তাকে ভালোবাসা যায়?”
“ষুহহহহ।”
গুটির ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে চুপ করালো সরণ। বলল,
“এই কথা আমি বেঁচে থাকতে তো দূর, মরে গেলেও বলবে না। আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি তা প্রকাশের কোন উপায় আমার জানা নেই। শুধু এতটুকু বলব, আমার হৃৎস্পন্দন তোমার উপর নির্ভরশীল। তুমি চাইলে সে চলমান, না চাইলে স্থবির।”
“এটা আমার প্রশ্নের উত্তর?”
“এসব জানলে তুমি কষ্ট পেতে, টেনশন করতে…”
“এসব হচ্ছে না? বলতে চাচ্ছেন টেনশন দেননি? কষ্ট দেননি? আমি খুব ভালো আছি? যখন ওরা বলছিল আপনি বেঁচে আছেন কিনা তার ঠিক নেই, তখন আমার কেমন লেগেছিল ধারণা করতে পারেন? এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিল আমি হারিয়ে ফেলেছি আপনাকে। মনোবল ফেরাতে নিজের সঙ্গে নিজেকে যুদ্ধ করতে হয়েছে। কোথায় যান, কি করেন, কি হচ্ছে আপনার সাথে কিচ্ছু জানি না আমি। কিচ্ছু জানান না। এভাবে….. ”
গুটির মাথা বুকে চেপে ধরে সরণ তড়িঘড়ি বলল,
“সরি, সরি, সরি….. সরি ফর এভরিথিং। প্লিজ শান্ত হও।”
ক্রমেই অস্থিরতা বাড়তে লাগল গুটির। ফোপাঁতে ফোপাঁতে বলল,
“এই অনুভূতিগুলো কেমন হয় জানেন?”
“আর কখনো কিছু লুকোবো না, প্রমিসসসস।”
“আমার খুনের দায় আপনি কেন নিলেন? আপনার জেল হলে আমি বুঝি খুব সুখে থাকতাম? খুব আনন্দে থাকতাম?”
“আমার কিচ্ছু হতো না। ট্রাস্ট মি, সব জেনে-বুঝেই মাঠে নেমেছিলাম।”
“আমাকে পাগল মনে হয় আপনার? পুলিশ…..”
গুটি থামলো। বলা ভালো, থামতে হলো। সরণের ঠোঁট থামিয়ে দিল তাকে। আলতো চুমু খেয়ে চট করে শুয়েও পড়লো ওর পাশে। বলল,
“কাম ডাউন সুইটহার্ট। কাম ডাউন। আমার কিচ্ছু হয়নি। আর হবেও না। এই আত্মবিশ্বাস ছিল বলেই খুনী হিসেবে নিজের নামটা নিজের লোক দিয়েই পুলিশ অব্দি পৌঁছিয়ে ছিলাম।”
“কী!”
গুটি আৎকে উঠলো। সরণ বুকে হাত দিয়ে অসহায় ভঙ্গিতে বলল,
“এমন লুক দিয়ো না বউ, এখানে লাগে।”
গুটি চোখ মুছে চোখ পাকালো।
সরণ গুটির হাত আঁকড়ে ধরে হাতের উল্টো পিঠে চুমু খেল। ধীরে ধীরে মুখভঙ্গি খানিক ভার হয়ে এলো। গম্ভীর গলায় বলল,
“বীরেন তালুকদার যখন প্রথম প্রথম বিয়ের প্রস্তাব দিতো, তোমার বাবা রাজি হতো না কেন?”
গুটি খানিক অপ্রস্তুত হলো। ওই মানুষটার নাম শুনলে নিজেকে খুনী খুনী লাগে। অপরাধবোধ জাগে না, তবে অস্বস্তি হয়। রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা আর আফসোসের মিশ্র অনুভূতিতে আহত হয় মন মস্তিষ্ক।
“কারণ, তার নেশার খরচ আর সংসার খরচ চালাতাম আমি৷ বিয়ে দিলে ওসব কে সামলাতো?”
নিজেকে সামলে বলল গুটি। সরণ কিঞ্চিৎ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে উঠলো,
“তাহলে যে মানুষ তোমায় বিয়ে দেবে না বলে বীরেন তালুকদারের সঙ্গে তর্কাতর্কি থেকে হুমকিধামকি অব্দি গিয়েছে, সে কি করে শেষমেশ রাজি হলো? পাগল হয়ে উঠলো তার সাথে তোমার বিয়ে দেওয়ার জন্য।”
“জানি না। তবে বাবার ভাষ্যমতে বীরেন তালুকদারের সাথে বিয়ে হলে নাকি রাজরাণী হতাম আমি। তার তো অনেক টাকা পয়সা।”
“বাজারের বরইতলার সামনে যে ছোটখাটো মার্কেট হচ্ছিল নতুন, সেটা তোমার বাবার নামে হচ্ছিল। জানো সেটা?”
“কী! নাতো। বাবার নামে মার্কেট! অসম্ভব! ওটা তো বীরেন তালুকদারের জায়গা ছিল।”
“ওই মার্কেট আর নগদ এক লক্ষ টাকার বিনিময়ে তোমার বাবাকে বিয়ের জন্য রাজি করিয়েছিল বীরেন তালুকদার। সোজা কথায়, কিনে নিয়েছিল। মার্কেটের লিগ্যাল পেপার আর নগদ টাকা বিয়ের দিন দেওয়ার কথা ছিল।”
“এজন্য বাবা হটাৎ করে এতো বদলে গেল?”
“তোমার বাবাকে তুমি কতটা ভালোবাসো?”
গুটি নিরুত্তর রইলো। সরণ বলল,
“এর আগে একদিন এমনি জিজ্ঞেস করেছিলাম। আন্সার পাইনি। আজ পাবো?”
“ভালোবাসি না, ঘৃণা করি। তবে মন থেকে অভিশাপ দিতে পারি না। ভেতর থেকে আসে না। মনে হয় একদিন সব ঠিক হবে। তার নিজের রক্তই তো আমি। নেশা করে বলে আর পাঁচটা বাবার মতো নয়। এই কথা বলেই নিজেকে শান্তনা দিয়ে আসছি কয়েক বছর হলো।”
সরণ আচমকা বলে উঠলো,
“যদি কখনো জানতে পারো আমি তোমার বাবাকে খু ন করেছি, আমায় আর ভালোবাসবে না?”
আৎকে উঠলো গুটি। স্বাভাবিকের তুলনায় দ্বিগুণ বড় হয়ে গেছে চোখ। এক ঝটকায় সরণের থেকে সরে এসে চোখে চোখ স্থির করে ধীর কন্ঠে বলল,
“ব..বাবা বেঁচে আছে তো?”
সরণের দৃষ্টি গুটির অন্তর আত্মায় কাঁপন ধরালো। সেখানে অকুতোভয় ও দৃঢ়তা দেখতে পাচ্ছে গুটি। সরণ খুব স্বাভাবিক কিন্তু গম্ভীর মুখভঙ্গিতে গুটিকে বুকে টেনে নিল। মাথায় চুমু দিয়ে বলল,
“তুমি সেদিন বাড়ি থেকে পালিয়েছিলে কেন? অসহনীয় দিন তো তোমার কতই গেছে, পালাওনি তো। সেদিন কেন পালালে?”
গুটি শুঁকনো ঢোক গিলে বড় শ্বাস টানলো। মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল,
“আপনাকে খুব ভয় লাগছে। কি করেছেন বাবাকে? বাবা বেঁচে আছে তো?”
সরণের জবাবের অপেক্ষা সইলো না গুটির। পুনরায় অস্থির গলায় বলল,
“সে না মানুষ হিসেবে যোগ্য আর না বাবা হিসেবে। তবুও সে আমার বাবা। এই পৃথিবীতে আমার আপনার আগে এবং পরে ওই বাবা নামক মানুষটা ছাড়া আর কেউ নেই। বাবাকে কি করেছেন?”
সরণ একরোখা কন্ঠে বলল,
“সেদিন কেন পালিয়েছিলে? রাতের অন্ধকারে কেন বেরিয়েছিলে অজানা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে? তোমার বাবার জন্য নয়কি? জোর করে বীরেন তালুকদারের সাথে পরেরদিন বিয়ের তারিখ ঠিক করেছিল না? মন্দিরে বিয়ের কথা ছিল, রাইট? সেজন্য ওইদিন রাতেই আমার ঠিকানা মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলে বিপদ মাথায় নিয়ে। আর তোমার বাবা তোমার পালানোর খবর টের পেয়ে বীরেন তালুকদারকে জানায়। সে পথ আটকায় বিলের মাঝখানে। আর শুরু করে অসভ্যতামি। ঠিক বলছি তো?”
“হ্যা ঠিক বলছেন। আগে বলুন বাবার সাথে কি করেছেন?”

(চলবে)

শূন্যলতা পর্ব-১১

0

#শূন্যলতা
#গুঞ্জন_চৈতি
পর্ব-১১

ঠিকই মুহুর্তের মধ্যে লোকগুলো অব্দি খবর পৌঁছে গেল যে— মানিক বাসায় নেই। ফিরে আসতে বলা হলো তাঁদের। কিন্তু ততক্ষণে তারা দরজা ভেঙে ফেলেছে। দলের লিডার রিফাত তখন এরমধ্যেই সোফায় গিয়ে বসে পড়েছে। ফেরত যেতে বলেছে তো কি হয়েছে? এতো কাঠখড় পুড়িয়ে ঢুকেছে, এমনি এমনি চলে যাবে? মোটেও না। এই ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে সেদিন তাকে চড় মেরেছিল সরণ। জিহাদ কিচ্ছু বলেনি। তাই আজ জিহাদের মর্জিতে এলেও ফিরে যাবে নিজের মর্জিতে। রিফাত হটাৎ ঘূর্ণিঝড় হয়ে যেন আছড়ে পড়লো পুরো কক্ষ জুড়ে। পুরো কক্ষ লণ্ডভণ্ড করে সোফা জুড়ে বসালো কয়েক ঘা রাম দা এর কো প। দেয়ালে দেয়ালেও কোপ পড়লো অজস্র। মুহুর্তের মধ্যেই এক টুকরো নরকে পরিণত হলো ড্রয়িংরুম। সবাইকে হুকুম দিলো প্রতিটা কক্ষকে নরক সাজাতে। কিন্তু হটাৎ লোডশেডিংয়ে থামতে হলো সবাইকে। রিফাত ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালালো। বাকিরা কেউ ফোন নিয়ে আসেনি। সবাই যার যার ফোন গাড়িতে রেখে এসেছে। তারা এমন পরিবেশে এমন ঘটনায় অংশ নেয় সবসময় ফোন রেখে এসেই।

রিফাত ফ্ল্যাশ চালু করতেই কি যেন হলো। সবাই মিলে একযোগে চিৎকার করে উঠলো। আচমকা সবার চিৎকারে রিফাত খানিক কেঁপে উঠলেও, প্রকাশ করলো বিরক্তি। বলল,
“এই চুপ! চিল্লাচ্ছিস কেন?”
সবাই মিলে একসাথে একই কথা বলে উঠলো,
“পিছনে ভূত ভাই, পিছনে ভূত!”
রিফাত রাগে অকথ্য ভাষায় গালি দিলো। অন্ধকারে যেখানে পারে সেখানেই ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর হুকুম দিয়ে পা বাড়ালো সরণের কক্ষের দিকে। ওই ঘরটা নষ্ট করবে সে নিজ হাতে। বহুবার অপমান করেছে তাকে সরণ। গায়ে হাত তোলাও বাদ রাখেনি। সরণকে তো হাতের নাগালে পাবে না, ওর শখের বাড়িটা আজ শেষ করে দিয়ে যাবে।

কয়েক পা আগাতেই পিচ্ছিল কোন তরলে পা দিয়ে পিছলে পড়ে গেল রিফাত। হাত ফসকে মোবাইল গিয়ে কোথায় পড়লো তৎক্ষনাৎ ঠাওর করে উঠতে পারলো না। সমস্ত শরীর যেন জ্বলে উঠলো চিনচিনে ব্যথায়। গা হাত-পা ডলতে ডলতে ব্যাথায় ককিয়ে উঠে ডাকলো বাকিদের। দু’জন এগিয়ে এলে দু’জনের অবস্থা রিফাতের মতোই হলো। এরমধ্যেই সবাই টের পেল শুধু পিচ্ছিল নয়, ধারালো কিছু ছড়িয়ে আছে চারিদিকে।
কয়েকজন ভয়ে দরজার দিকে দৌড়ালে সবাই একে একে আছড়ে পড়লো একে অপরের উপর। তৎক্ষনাৎ একটা বিশাল গোল বেঁধে গেল। প্রত্যেকের মনে চাপা ভয়। রিফাত বাদে বাকিরা পাচ্ছে ভূতের ভয়, রিফাত পাচ্ছে সরণের ভয়। তার মনে ভয় ঢুকে গেল সরণ চলে এলো নাতো? কিন্তু সে আসবে কোথা থেকে? এতক্ষণে আদোও বেঁচে আছে কিনা তারই তো ঠিক নেই। হয়তো পরকালে চলেও গেছে বেচারা। আর এলেও তো এভাবে লুকিয়ে চুরিয়ে কিছু ঘটানোর মতো ছেলে সরণ নয়। তাহলে কে? সরণ কিংবা মানিক না হলে আর কে হতে পারে? আর তো কেউ নেই ওদের! হটাৎ নুপুরের শব্দে মুখরিত হয়ে উঠলো চারিদিক। ঘোর ভাঙলো রিফাতের। মৃদু চিৎকারে ককিয়ে উঠলো কয়েকজন। আচমকা শুরু হওয়া নুপুরের ঝমঝম শব্দ সেই আচমকাই থেমে গেল। শুরু হলো কান্নার শব্দ। আত্মা কাঁপানো ভয়ংকর সে কান্না। এরপর একযোগে শুরু হলো ভয়ংকর কান্না আর বিকট হাসি। কিছুক্ষণের মধ্যে তাতে যোগ হলো বিকট চিৎকারের আওয়াজ। গা ছমছমে ভয়ংকর পরিবেশ। সবার সঙ্গে এবার রিফাতের অবস্থাও করুন। ভয়ংকর এই পরিবেশ থেকে বাঁচতে দু-তিন জন সাহস করে দরজার দিকে যাওয়ার চেষ্টা করলেও খুঁজে পেল না দরজার টিকিটিও। এমনিতেই ঘুটঘুটে অন্ধকার।তারওপর ভয়ের তাড়নায় দিক হারিয়ে বসেছে সকলে। একেকজন একেকদিকে ছোটাছুটি করে রক্তারক্তি ঘটালো নিজেরাই। প্রত্যেকেই ক্ষতবিক্ষত হলো মেঝেতে পরে। মেঝেতে পা রাখাই যাচ্ছে না। এরমধ্যেই হটাৎ দু’জনের নিথর শরীর আছড়ে পড়লো রিফাত ও বাকিদের উপর। একেকজন বিলাপ করতে লাগল ভয়ে। ভয়ের মাত্রা এবার আকাশ ছুঁলো সকলের। সকলে যেন বুঝে গেল, দু’জন মরেছে বাকিরাও মরবেই। কারও রেহাই নেই। কারও না। ভূতের ভয়ে এবার শতভাগ মরমর হলো সকলে। এতোক্ষণ যাও সন্দেহ ছিল এখন আর কেউ সন্দেহের অবকাশ পেল না।
আকস্মিক সমস্ত চিৎকার আর হাসি-কান্নার বিকট আওয়াজ থেমে গেল। শোনা গেল দু’তিন পা নুপুরের আওয়াজ। অতঃপর শোনা গেল একটি নারী কন্ঠ। বজ্রের ন্যায় কম্পন তুলে থেমে থেমে ভাঙা গলায় কে যেন বলল,
“আমার ছেলে কোথায়? আমার সরণ কোথায়?কোথায় আমার ছেলে?”
ক্রন্দনরত হতবিহ্বল অবস্থায় সকলে। তবুও কারও বুঝতে অসুবিধা হলো না তাদের এই অবস্থার পিছনে সরণের মৃত মা। হু হু করে বাড়তে লাগল চিৎকার করে ভীতু কান্নার আওয়াজ। পুনরায় একই কথার বজ্রাঘাত যেন আছড়ে পড়লো চারিদিকে।
“আমার ছেলে কোথায়? আমার সরণ কোথায়?”

সবার মধ্যে থেকে একজন ছেলে কম্পনরত কন্ঠে বলে উঠলো,
“সরণ জিহাদের বাড়িতে আছে। বাগান বাড়িতে। কিন্তু বেঁচে আছে কিনা জানি না। আজকে ওরে খু ন কইরা ঢাকার বাইরে ফালাইয়া আসার কথা।”
আরেকজন বলল,
“তবে এইসবে আমরা কেউ জড়িত না। এইসব জিহাদের কাজ। আমরা খালি মানিকরে নিতে আসছিলাম। আর কিছু জানি না। আমাদের যাইতে দেন। দোহাই লাগে আমাদের ছাইড়া দেন।”
“কেন? কেন আমার ছেলেকে মারতে চায়? কি করেছে ও?”
এই বিষয়টা রিফাত ছাড়া বাকিরা জানে না। তাই রিফাত বলে উঠলো,
“জিহাদের চাচা ফখরুল ইসলাম একজন সংসদ সদস্য। এলাকার এমপি। জিহাদকে রাজনীতিতে পাকাপোক্তভাবে দাঁড় করাতে চায় নিজের পেছনে। কিন্তু সরণ তাতে নানাভাবে বাঁধা দিচ্ছে। জিহাদের নানান কর্মকান্ড ফাঁস করার চেষ্টায় আছে সরণ অনেকদিন থেকে। আর নিজেও পাকাপোক্ত ভাবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে রাজনীতিতে। তাই সবাই মিলে ওকে সরানোর প্ল্যান করেই ফেলেছিল এরমধ্যেই সরণ নিজে আসে ফখরুল ইসলামের কাছে। বলে, ও খুনের দায়ে খুব শীগ্রই জেলে যেতে চলেছে, ওকে যেন রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রয়োগ করে যেভাবেই হোক বাঁচিয়ে নেয় ফখরুল ইসলাম। তাহলে রাজনীতি থেকে নিজেই সরে যাবে। আসবে না জিহাদ আর ফখরুল ইসলামের মাঝে। আর যদি বাঁচাতে না পারে তাহলে জিহাদের বিরুদ্ধে যা যা দুর্নীতির ও মেয়ে ঘটিত কাণ্ডের তথ্য প্রমাণ আছে তা ফাঁস করে দেবে। এই ডিলে ফখরুল ইসলাম রাজি হয় আর কেসটাকে ঘুরিয়ে সরণকে বাঁচিয়েও নেয়। কিন্তু জিহাদ পুরোনো ঝামেলার জের ধরে ঝামেলা করে আর ঠিক করে মেরে ফেলবে সরণকে। আজ ফখরুল ইসলামের সঙ্গেই শেষ সাক্ষাৎ ছিল, সামনে মাসের মধ্যে দেশ ছাড়ার কথাও ছিল সরণের। কিন্তু সরণকে শেষমেষ ধোকা দিয়ে কিডন্যাপ করে নেয় জিহাদ। আর আমাদের পাঠায় মানিককে ধরে নিতে। ও বেঁচে থাকলে জিহাদের বিপদ। তাই মানিকের খোঁজে আমাদের আসা। আমি এটুকুই জানি, আর কিছু জানি না।”

সবাই মৃদুস্বরে কাঁদতে কাঁদতে জীবন ভিক্ষা চাইতে লাগল। কিছুক্ষণ পার হলো একই গতিতে। হটাৎ পরিবেশ শান্ত হয়ে গেল। হাট করে দরজা খোলার আওয়াজে সচকিত হলো সকলে। সাহস করে কয়েকজন অন্ধকারেই এগোনোর চেষ্টা করলো কিন্তু ক্ষতবিক্ষত পায়ে আরও দ্বিগুণ আঘাত লাগায় খুব একটা এগোতে পারলো না কেউ। আকস্মিক আলো জ্বলে উঠলো। ঘরময় আলো জ্বলে উঠতেই মেঝেতে ফ্যানাভর্তি সাবান জলে নিজেদের আবিষ্কার করলো সকলে। চারিদিকে অজস্র ছোট বড় পেরেকের যেন মেলা বসেছে। অগণিত পেরেক আর সাবান জলে পুরো মেঝে ডুবে আছে। খুব বেশি ভাবার সময় পেল না কেউ। উপস্থিত হলো পুলিশ। একে একে উদ্ধার করে থানায় নেওয়া হলো সকলকে। পরে জানা গেল যে দু’জনকে সবাই মৃত ভেবেছিল তারা আদতেও মৃত্যুকে ছুঁতে পারেনি। ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছিল শুধু। কিন্তু কি থেকে কি হলো তা নিয়ে সবাই উলটপালট হয়ে আছে। কেউ ভুলতে পারছে না সেই মুহুর্ত।

জিহাদের বাগান বাড়ি সুনসান নীরবতায় ঘেরা। কোন পাহারাদার নেই, নেই কোন গার্ড। শুধু গেটে একজন দারোয়ান বসে বসে ঝিমোচ্ছে। তা দেখে বেশ অবাক হলো মানিক। গুটিও আশা করেছিল অনেক অনেক গার্ড থাকবে।

মানিক তখন জিহাদকে আসতে বলেই রওয়ানা হয়েছিল বাসার উদ্দেশ্যে। এরমধ্যে গুটি বলেছিল বিল্ডিংয়ে লোডশেডিং করাতে। বাকিটা নাকি সে সামলে নেবে। মাথায় আকাশ সমান চিন্তা আর হাতে জান নিয়ে ফিরছিল। মাঝপথে পুলিশও নিয়েছিল সাথে। বাসায় ঢুকে গুটির থেকে সব শুনে এক মুহুর্তও আর দেরি না করে সাথে পুলিশ আর গুটিকে নিয়ে এসেছে জিহাদের বাগান বাড়িতে।

গুটি আশপাশে ঘুরে দেখে মানিককে বলল,
“ওই কৃষ্ণচূড়া গাছ বেয়ে ভেতরে যাওয়া যাবে। আমি যাবো ভেতরে।”
পুলিশ তার অনুমতি দিল না। একে একে কয়েকজন অফিসার গাছ বেয়ে দেওয়ালের ওপাশে চলে গেল। গুটি এভাবে হাত-পা গুটিয়ে টিকতে পারলো না। মানিকের নজর এড়িয়ে দেয়ালের অপর পাশে আরেকটা গাছ বেয়ে সাবধানে ঢুকে পড়লো ভেতরে। বুঝতে পারলো বাড়ির পেছন দিকে আছে সে। বাগান পেরিয়ে ভেতরে ঢুকতেই চমকে উঠলো চাপা স্বরের হুমকিতে।

“একদম নড়বি না। ওপাশ দিয়ে পুলিশ ঢুকেছে বাড়িতে। এপাশ দিয়ে আমার সঙ্গে চুপচাপ দেয়াল টপকাবি। নয়তো তুই আমার কীর্তি ফাঁস করার আগে তোর বউ আর জিগর কা দোস্ত মানিককে আমি শেষ করে দেবো। আমার লোক কিন্তু তোর বাড়ির ভেতরে। ভুলিস না এটা। তোর বউও আমার কব্জায়, মানিকও আমার কব্জায়। চুপচাপ হাট।”

জিহাদ নিজেই ভয়ে সিটিয়ে আছে। সিসিটিভিতে পুলিশের আগমন টের পেয়েই চলে এসেছে উল্টোদিকে। আর সরণকে ঝিমিয়ে রেখেছে মিথ্যা হুমকি দিয়ে। কিছুক্ষণ আগ পর্যন্তও সরণের বিয়ের বিষয়ে কিছু জানতো না। জানতে পারলো অল্প কিছু সময় আগে। তাও সরণের ফোন ঘেটে।

গুটি আড়াল থেকে আধো অন্ধকারে অস্পষ্ট দেখতে পেল দু’জন পুরুষ অবয়ব। তারমধ্যে একজন সরণ। হাত বাঁধা সরণের। মাথাও কালো কাপড় দিয়ে গলা অব্দি বাঁধা। তবুও চিনতে ভুল হলো না গুটির। জিহাদ সরনকে টানতে টানতে তার দিকেই আসতে লাগল। গাছের আড়ালে লুকিয়ে পড়লো গুটি। জিহাদ যখন তার পাশ দিয়ে যেতে লাগল পা বাড়িয়ে জিহাদকে ফেলে দিল মাটিতে। সরণের হাত ধরে থাকায় সরণও পড়লো তবে মাটিতে পড়তেই হাত ছাড়িয়ে নিল জিহাদের থেকে। এরমধ্যেই গুটি পাশ থেকে ইট তুলে নিয়ে অন্ধকারেই এক নাগাড়ে মারতে লাগল জিহাদের মাথায়। জিহাদের চিৎকারে বগানের প্রতিটা কোনা যেন জেগে উঠলো। এরমধ্যেই শোনা গেল দু’টো গুলির আওয়াজ। ভারি কিছু মাটিতে আছড়ে পড়ার আওয়াজও শোনা গেল। সরণ কিছু দেখতে পাচ্ছে না, হাতও খুলতে পারছে না। তৃতীয় ব্যাক্তি কে তাও জানে না। গুটির উপস্থিতিও টের পায়নি। তবুও অন্ধকার হাতরে গাছের আড়ালে দাঁড়ালো যাতে তার গায়ে না লাগে গুলি। এরমধ্যেই মানিক আর পুলিশও ছুটে এলো এপাশে। সাথে এলো দারোয়ানও। মানিক টর্চ হাতে গুটি বলে চিৎকার করে ছুটে আসলে টনক নড়লো সরণের। সরণকে সুস্থ অবস্থায় পেয়ে ভিজলো যেন মানিকের শুঁকিয়ে যাওয়া আত্মা। কিন্তু গুটি তো ঠিক নেই। গুলি লেগেছে গুটির। মাটিতে পড়ে আছে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারিদিক। সরণ ততক্ষণে গুটির নাম ধরে ডাকতে ডাকতে অস্থির হয়ে উঠেছে। মানিক আগে সরণের হাতের বাঁধন খুলে মাথার কাপড় সরালো। সঙ্গে সঙ্গে মানিককে ঠেলে সরিয়ে গুটির কাছে ছুটে গেল সরণ। জ্ঞান নেই গুটির। সরণের বুকে মাথা রেখে হৃৎস্পন্দনের অস্বাভাবিক গতি অনুভব করতে পারার আগেই যেন হারিয়ে গেল অতল গহ্বরে। সরণ এক মুহুর্তও দেরি না করে কোলে তুলে নিল। নিজের গায়ে অজস্র মারের দাগ আর যন্ত্রণা ভুলে গুটিকে নিয়ে ছুটলো হসপিটালে। গুটির বন্ধ চোখ সহ্য হচ্ছে না সরণের। রক্তাক্ত গুটিকে তো সে চায়নি। চায়নি তো!

(চলবে)

শূন্যলতা পর্ব-১০

0

#শূন্যলতা
#গুঞ্জন_চৈতি
পর্ব-১০

ভোরের সূর্য পৃথিবীতে পদার্পণ করেই যেন চাক্ষুষ সাক্ষী হলো নিষ্পাপ, নিঃস্বার্থ, স্বচ্ছ ভালোবাসার। একদিকে উদীয়মান চিরন্তন সূর্যদেবতা, অন্যদিকে অস্তমিত গুটির সমস্ত দুঃখ, কষ্টের দুঃসময়।

গুটির নিদ্রা ভঙ্গ হলো বেশ বেলা করে। ঘড়ির সবচেয়ে ক্ষুদে সদস্য তখন দশের ঘরের অতিথি। চোখ খুলে বিছানা খালি পেয়ে উঠেই সোজা ওয়াশরুমে চলে গেল। স্নান সেরে বের হলো পেটিকোট আর ব্লাউজের উপর টাওয়াল পেঁচিয়ে। ওয়াশরুমের চপচপে ভেজা মেঝেতে শাড়ী পড়া যায় নাকি? একদমই না। এদিকে শাড়ী বাছাই করতে গিয়ে শুরু হলো সময় বিলাস। ওয়ারড্রবে এতো শাড়ী! গুটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সবগুলো শাড়ী উল্টেপাল্টে দেখলো। ধারণা করলো, তিন চারটে নতুন কেনা হলেও বাকি সব সরণের মায়ের। খয়েরী জমিনে কালো পার, তাতে পাতার নক্সা। আচলটায় রঙধনুর সাত রং। পুরোনো দিনের শাড়ী তা বোঝাই যাচ্ছে। এটাই বেছে নিল গুটি। পড়া শেষে মাঝখানে সিঁথি করে মোটা করে সিঁদুর পড়লো। নতুন বউ হিসেবে একটু সাজতে ইচ্ছে হলেও লজ্জা ভর করলো। সরণ কি ভাববে? ড্রেসিং টেবিল একদম মেয়েলি জিনিসপত্র দিয়ে ভরপুর। নিশ্চয়ই মানিকের কাজ এগুলো। এতোসব ব্যাবহার করতে না জানলেও, কাজল পড়তে খুব পছন্দ করে সে। কাজলটাই তুলে নিলো। ভাবল, খুব অল্প করে লাগাবে। কিন্তু দিতে দিতে দুই চোখের কাজলে সামঞ্জস্যতা বজায় রাখতে গিয়ে মোটা করেই দেওয়া হয়ে গেল। গুটি ভাবল, মুখ ধুয়ে ফেলবে। দরকার নেই এতো সাজার। কিন্তু এরমধ্যেই দরজায় ধাক্কা পড়লো। গুটি মুখ ধোঁয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে দরজা খুলতে গেল। মনে মনে কল্পনা করতে লাগল, সরণের মুখোমুখি হবে কীভাবে? কি বললে কি জবাব দেবে? রাতের মুহুর্তগুলো লজ্জায় থামিয়ে দিতে চাইলো পা। কিন্তু দরজার ওপার কড়া নাড়া থামেনি। দরজা খুলে মানিককে খাবারের থালা হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। মানিক বলল,
“ভেতরে আসবো গুটিদি?”
গুটি মাথা নেড়ে সায় জানালে মানিক ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
“পায়ের ব্যাথা কতদূর? ভালোর দিকে?”
“খুব একটা ব্যাথা নেই। অনেকটা কমেছে।”
“আচ্ছা খাবারটা খেয়ে নাও, ওষুধ দেবো। বেলা হয়েছে অনেক আরও আগে খেতে হতো।”
“আমি নিজে নিয়ে নেব ওষুধ, তোমায় কষ্ট করে দিতে হবে না।”
“সরণ আমায় কেলাবে। গতকাল ওষুধ মিস দিয়েছো শুনে যা ঝাড়ি ঝেড়েছে। আজ রিস্ক নেব না।”
গুটির দৃষ্টি খুঁজছে সরণকে। কিন্তু সরাসরি জিজ্ঞেস করতে সংকোচ হচ্ছে। তাই আগে জিজ্ঞেস করলো,
“তুমি খেয়েছে?”
“আমি তো কোন সকালে খেয়েছি। আমি আবার রান্না করতে করতেই অর্ধেক খেয়ে ফেলা ক্যাটাগরির মানুষ। অপেক্ষা আমার সয় না।”
“আর উনি?”
“উনি?”
“তোমার ভাই?”
“আমার ভাই?”
মানিকের দুষ্টুমি বুঝতে পেরে চোখ পাকালো গুটি। মানিক দাঁত বের করে হেসে সমর্পণের ভঙ্গিতে বলল,
“তোমার উনিও আমার মতোই। রান্না হতে হতে চুলা থেকেই ভক্ষন শুরু করে দেওয়া পাবলিক। সকাল সকাল খেয়েদেয়ে বেরিয়েছে একটা কাজে।”
বাসায় নেই শুনে একটু মন খারাপ হলো। সকালে উঠেনি বলে কি রাগ করেছে? আগে আগে ঘুম থেকে ওঠা উচিত ছিল। খাবারটাও তারই রান্না করা উচিত ছিল।
“আচ্ছা, রান্নাটা কে করেছে?”
“সবসময় তো আমরা দু’জন মিলেই রান্না করি, আজ সরণ একা রান্না করেছে বউকে খাওয়াবে বলে। আমি অবশ্য পাশেই ছিলাম।”
গুটি মনে মনে লজ্জায় নেতিয়ে গেল। কোথায় সে রান্না করবে তা না তার জন্য সরণ সকাল সকাল উঠে রান্না করেছে। ছি! প্রতিজ্ঞা করলো, এখন থেকে রোজ সকাল সকাল উঠে সেই রান্না করবে। সরণকে কখনো রান্নাঘরে ঢুকতে দেবে না। কেন যে এতো বেলা করে ঘুম ভাংলো!

খাওয়া শেষ হলে মানিক নিজ হাতে ওষুধ বের করে দাঁড়িয়ে থেকে খাওয়া দেখে তারপর গেল। তবে যাওয়ার আগে একটা ফোন ধরিয়ে দিয়ে গেল হাতে। মিনিট খানেক বাদেই কল এলো সরণের। গুটি দুরুদুরু বুকে চাপা আনন্দ আর রক্তিম ঠোঁট চাপা হাসিতে কল রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো হৃদয় কাড়া কন্ঠস্বর।
“বউয়ের ঘুম কেমন হলো?”
“আপনি কখন আসবেন?”
ছটফটানো আওয়াজ গুটির। সরণ শান্ত গলায় বলল,
“কাজ শেষ হলেই চলে আসবো। ব্রেকফাস্ট করেছেন?”
“গতকাল না বললাম, আমায় আপনি করে বলবেন না।”
“আমিও তো বলেছি, আপনি বললে আমিও বলবো।”
“আচ্ছা, আমি চেষ্টা করবো।”
“তাহলে আমিও চেষ্টা করবো।”
কিছুক্ষণ নিরব রইলো দু’জন। পিনপতন নীরবতা ভেঙে সরণ বলল,
“ওষুধ খেয়েছো?”
“হ্যা। ভাই দাঁড়িয়ে থেকে খাইয়ে গেছে।”
“নাপা?”
“নাপা?”
“রাতে না বলেছিলাম।”
গুটি মিইয়ে গেল। লজ্জায় দু’চোখ টিপে বলল,
“খেয়ে নেব।”
“এক্ষুনি খাবে, রাইট নাউ। ওয়ারড্রবের উপরেই রেখে এসেছি, চেক করো।”
“হুম পেয়েছি।”
গুটির ওষুধ খাওয়া হলে পুনরায় কিছুক্ষণ চুপ রইলো দু’জন। এবারও নিরবতা ভঙ্গ করলো সরণ।
“মিস মি?”
“নাতো।”
“ওহ, তাহলে তো লেট করে ফিরলেও নো প্রবলেম আই থিংক।”
“মিস করছি না, তবে জলদি ফিরবেন।”
“মিস না করলে জলদি কেন ফিরবো? হোয়াই?”
গুটি ফট করে বলে উঠলো,
“আমি শাড়ী পড়ে সেজেছি।”
কথাটা বলেই দাঁতে জিভ কাটলো। এটা কেমন কথা বলল! শাড়ী পড়েছে বলে জলদি কেন আসবে? ঝোঁকের বসে ফোনও কেটে দিল গুটি। ফোন কেটে পড়লো আরও লজ্জায়। ফোন কেন কাটলো? কি ভাবছে সরণ? ভাবছে সে লজ্জা পেয়ে ফোন কেটেছে৷ সত্যিই তো লজ্জা পেয়ে ফোন কেটেছে। কিন্তু তা ভাবার সুযোগ কেন দিলো? ধুর!

গুটির পাহাড়সম চিন্তা ভাবনার মধ্যেই পুনরায় ফোন বাজল। সরণ কল করেছে আবার। গুটি রিসিভ করে তড়িঘড়ি আগে আগে বলল,
“ভুলে কেটে গেছে। আমি কাটিনি।”
সরণের নির্লজ্জ চাপা হাসি যেন দূর থেকেই দেখতে পাচ্ছে গুটি।
“শাড়ী পড়ে সেজে আমাকে জলদি আসতে বললে। আমি কি এটাকে শাড়ী খুলে সাজ নষ্ট করার নিমন্ত্রণ ধরে নেব?”
গুটি ফোন কানে নিয়েই বসা থেকে ধপ করে শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজলো। সরণ ফের বলল,
“কল কি আবার ভুলে কেটে যেতে চলেছে?”
গুটি প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বলল,
“এবার কাটলে দ্বিতীয় বার কল ঢুকবে না। বাসার দরজা খুলবে কিনা তাও গ্যারান্টি দিতে পারছি না।”
“আহা, নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিনি বলে বউয়ের গোসা হলো? ওকে মাই সুইট লেডি, বাসায় ফিরেই সবার আগে তোমার নিমন্ত্রণ রক্ষা করবো। হ্যাপি?”
গুটি কপাল চাপড়ে রাগী স্বরে বলল,
“আপনি একটা…”
“ইয়োর সুইট হাসবেন্ড?”
গুটি জবাব না দিয়ে প্রশ্ন ঘুরালো। বলল,
“কোথায় গিয়েছেন সকাল সকাল? আমায় ডাকলেন না কেন?”
“রাতে বউটা আমার ঘুমাতে আর পারলো কই? তাই সকালে আর ডাকিনি।”
“আপনি জীবনেও ভালো হবেন না। সব কথাতেই এক সুর!”
এরমধ্যেই সরণের ওপাশ থেকে কয়েকজনের গলার আওয়াজ শোনা গেল। সরণ তাড়াহুড়ো করে বলল,
“রাখছি গুটি। সাবধানে থেকো। নিজের খেয়াল রেখো। আ’ল কামিং সুন। লাভিউ।”
গুটি এক মুহুর্ত ভাবলো প্রতুত্ত্যরে লাভিউ টু বলবে কিনা, কিন্তু ততক্ষণে কল কেটে গেছে। না কাটলেও অবশ্য গুটির দ্বারা লাভিউ টু বলা হতো না।

গুটির সারাদিন কাটলো বেশ ব্যাস্ততায়। এ ঘর সে ঘর গোছগাছ আর রান্নাবান্না করে অর্ধেক দিন পার হলো। পাশাপাশি মানিকের সাথে আড্ডাও চলেছে জমিয়ে। তবে সরণকে ছাড়া গুটির সময় বড্ড পানসে কাটলো। মায়ের শাড়ী আর চোখের কাজল যেন বৃথা গেল একজনের প্রশংসা কুড়াতে না পেরে। দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যা, অতঃপর রাত। সরণের দেখা নেই। ফোনও দুপুরের পর থেকে বন্ধ। গুটি দু-তিনবার জিজ্ঞেস করেছে মানিক কিছু জানে কিনা। মানিকের থেকে জবাব না পেয়ে থেমে ছিল সারা বিকেল। কিন্তু রাত যত বাড়তে লাগল গুটি তত অস্থির হতে লাগল। ওদিকে মানিক নিজেও জানে না সরণ কোথায় আছে কি অবস্থায় আছে। সরন যেখানে গিয়েছিল সেখান থেকে এগারোটায় বেরিয়ে গেছে বলে জানতে পেরেছে। তারপর তো ফিরে আসার কথা৷ মানিক তো তাই জানে। এদিকে গুটিকে বাসায় একা রেখে বের হতে মানা করেছে সরণ। কোনভাবেই একা ছাড়তে মানা করে গেছে। বাইরে খুঁজতে যাওয়া অতিব প্রয়োজন। কিছু জায়গায় ফোন না করে স্ব শরীরে খোঁজ নেওয়াও আবশ্যক। কয়েকজনকে দিয়ে ওদিকে খোঁজ চালালেও ফলাফল যখন শুন্য, মানিক তখন অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিল গুটিকে একা রেখেই যাবে সরণের খোঁজে। গুটির কাছে কাউকে রেখে যাবে এমন বিশ্বস্ত কেউ নেই। আর সরণের বিয়ের কথা কেউ জানেও না। তবে গেটের সামনে কয়েকজন ছেলেপেলে ঠিক করলো। গুটির কথা না বলে বলল বাসায় কিছু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আছে যার খোঁজে কেউ না কেউ আসতে পারে। কড়া পাহারা দিতে বলল। অতঃপর বের হলো সাংবাদিক শুভংকর দাসের বাড়ির উদ্দেশ্যে। সেখানেই আগে যেতে হবে।

এদিকে গুটির মনে বাসা বেঁধেছে দুশ্চিন্তা। বারংবার উটকো চিন্তারা অবিশ্বাস হয়ে ছুঁতে চাচ্ছে মন মস্তিষ্ক। গুটি অবিচল। কোনভাবেই সরণকে অবিশ্বাস করতে রাজি নয়। অবিশ্বাসকে দূরে ঠেলে দিতেই মস্তিষ্ক বলে উঠে, তাহলে নিশ্চয়ই কোন দূর্ঘটনা ঘটেছে? ঠিক আছে তো সে? এমন হাজারও দুশ্চিন্তায় ভেতরটা প্রায় লণ্ডভণ্ড। বাড়ির ভেতর টিকতে না পেরে মানিকের নিষেধাজ্ঞা অবজ্ঞা করে বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। এখানে দাঁড়িয়ে পথ চেয়ে থাকলে কি জলদি আসবে সরণ? ফিরবে এক্ষুনি?

গেটের চারপাশে হটাৎ আট দশজন ছেলেকে ঘুরঘুর করতে দেখে সন্দেহ হলো গুটির। অন্ধকারে ওকে কেউ দেখতে না পেলেও ছেলেগুলোকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। রুমে ফিরে মানিককে কল করে বিষয়টা জানালো। মানিক অভয় দিলে ফের বারান্দায় যেতেই চমকে গেল। গেটের সামনে সেই আট দশজন ছেলেকে ঘিরে আছে প্রায় ত্রিশজন লোক। চোখের পলকে রক্তারক্তি কাণ্ড শুরু হয়ে গেল। আৎকে উঠে মানিককে কল করে না পেয়ে নিচের ঘটনা ভিডিও শুরু করলো। কিন্তু একে একে আট দশজনকে যখন গেটের ভেতরে ঢুকতে দেখল তখন টনক নড়লো গুটির। আগের ছেলেগুলো যদি মানিকের ঠিক করা থাকে আর তাঁদের মেরে বিল্ডিংয়ে ঢোকা মানে তো বিপদ তারই। আবারও কল করলো মানিককে। এবারও ব্যাস্ত দেখালো, তবে রিসিভ হলো। গুটি গড়গড়িয়ে সংক্ষিপ্ত বর্ণনা করতে করতেই দরজায় আওয়াজ হতে লাগল দুমদাম বিকট আওয়াজে। গুটি এক মুহুর্তের জন্য দিশেহারা হয়ে উঠলো। মৃদু চিৎকারে কেঁদে উঠলো তৎক্ষনাৎ। ওদিক থেকে মানিকের নাম ধরে ডাকছে লোকগুলো। তার মানে, গুটির খোঁজে নয় এসেছে মানিকের খোঁজে। এটা বুঝতে পেরে মানিক আগে শান্ত করলো গুটিকে। ভরসা দিয়ে বলল যতক্ষণ সম্ভব লুকিয়ে থাকতে। শীগ্রই চলে আসবে সে। মানিক নিজেও জানে সে যেতে পারবে না এতো জলদি। বাসা থেকে অনেক দূরে আছে। তাই যা করতে হবে দূর থেকেই করতে হবে। বুদ্ধি করে জিহাদকে কল করলো। একটা ঠিকানা দিয়ে বলল দেখা করতে চায়। ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের ঠিকানার যথাযথ প্রমাণও দিল। ব্যাপারটা তার জন্য প্রাণ সংশয়ের হতে পারে। তবুও কাজটা করলে কেননা সে জানে, জিহাদ থেকে খবরটা ওই লোকগুলো অব্দি পোঁছে যাবে যে মানিক বাসায় নেই। বিপদমুক্ত হবে গুটি। ঠিকই মুহুর্তের মধ্যে লোকগুলো অব্দি খবর পৌঁছে গেল যে মানিক বাসায় নেই। ফিরে আসতে বলা হলো তাঁদের। কিন্তু ততক্ষণে তারা দরজা ভেঙে ফেলেছে।

(চলবে)

শূন্যলতা পর্ব-০৯

0

#শূন্যলতা
#গুঞ্জন_চৈতি
পর্ব-৯

“পন্থাটা পুরোনো, একটু ফিল্মি, কিন্তু কার্যকরী।”
সরণ নড়লো চরলো না, প্রতিক্রিয়াও শুন্য। দু’জনের মাঝের কয়েক ইঞ্চি দুরত্ব ঘুচিয়ে শুধু একটা মাত্র কাজ করলো, মাথা উঁচিয়ে শব্দ করে চুমু খেলো গুটির ঠোঁটে। গুটি এক মুহুর্ত থমকে থেকে উঠতে গেলে টান দিয়ে ফেলে দিল বুকের উপর। অতঃপর হলো সেই, যা চেয়েছিল সরণ। বুকের সঙ্গে জাপ্টে ধরে আরাম করে মিইয়ে গেল নরম বিছানায়। একটু বেশি মিইয়ে গেল গুটি। ভেতরের অবস্থা তার ভীষণ নড়বড়ে। পেটের ভেতর মোচড়াচ্ছে। পুরো শরীরে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছে অনবরত। আর সরণ? সে অনুভূতি কুড়াতে বন্ধ চোখে শ্বাস গুনছে যেন। নাকি ফন্দি আঁটছে আর কি করে বশ করা যায় বাঘিনীকে? কিজানি! হয়তো তাই হবে।

“মিসেস সরণ তালুকদার।”

গুটি নিরব। কোন প্রত্যুত্তর নেই। গুটিকে বুকের বাঁপাশে গুটিয়ে রাখতে কতটা সক্ষম হয়েছে সরণ, তার প্রমাণ মিলল গুটির নিরবতা ও নিরবে বুকে মাথা গুঁজে বিলীন হওয়ায়। চোখ বন্ধ করে রেখেছে সে। দীপ্তিময় আদোলে মায়া আর প্রশান্তির সংমিশ্রণে দারুন আভা ফুটে উঠেছে। সরণ পাশ ফিরল। গুটিকে বুকে নিয়েই পাশ ফিরল। ফিসফিসিয়ে বলল,
“আমায় ভালো তো বাসেন, বিশ্বাস কেন করেন না? বীরেন তালুকদারের রক্ত বয়ে বেড়াই বলে? বিশ্বাস করুন, ক্ষমতা থাকলে শরীর থেকে রক্ত আলাদা করে ফেলতাম। মুক্তি নিতাম এই পরিচয় থেকে।”
গুটি জবাব দিল না। হয়তো জবাব খুঁজছে। সরণ পুনরায় বলল,
“সেদিন রাতে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিলেন আমার কাছে আসবেন বলে। কতটা বিশ্বাস করলে কেউ এভাবে কারও ভরসায় ঘর ছাড়তে পারে! তখন আমাদের যোগাযোগ ছিল না। আপনার ফোন নিয়ে নিয়েছিল আপনার বাবা। যোগাযোগ বিহীন সম্পর্কে আকাশ সমান বিশ্বাস রেখে জাস্ট একটা ঠিকানা মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন আমার কাছে আসবেন বলে। সেই বিশ্বাস, ভরসা সব এক লহমায় হারিয়ে গেল বীরেন তালুকদারের ছেলের পরিচয়ে। হয়ে গেলাম মিথ্যাবাদী। সত্যিই কি আমি মিথ্যাবাদী? কোন একটা কথা যেচে না বলা আর মিথ্যে বলা এক?”

“আপনি তো সব জানতেন। আমাকে দূর থেকে সাহায্য করেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন, সাহস যুগিয়েছেন, সাথ দিয়েছেন। ভেঙে পড়েছি বলার আগেই আগলে নিয়েছেন। কত কথা বলিনি, বুঝে নিয়েছেন। খুবই অল্প সময়ের পরিচয়ে আমায় এক জনমের ভালোবাসা উপহার দিয়েছেন। ওই লোকটা কীভাবে আমার জীবন ওষ্ঠাগত করে তুলেছিল সব শুনতেন, আমি রোজ বলতাম আপনাকে। বীরেন তালুকদারের একটা ছেলে আছে যে ছাত্রদলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, যার নাম ভাঙিয়ে বীরেন তালুকদার গ্রামের পরিবেশ ধীরে ধীরে কব্জা করছে, তাও বলেছিলাম। তখনও তো বলেননি আপনিই সেই ছেলে।”
“আপনি যদিও আমার ব্যাপারে কখনো কিছু জিজ্ঞেস করেননি, জিজ্ঞেস করলেও বলার প্রশ্ন ছিল না। কারণ, ওই নরকের কীটটাকে আমার বাবা বলে আমি কোনদিনই মানতাম না। আমার বড় হতে যার পরিচয় লাগেনি, বড় হওয়ার পর তার পরিচয় আমি সেধে আপনাকে দিতাম না গুটি। আমার মাকে হাত-পা বেঁধে ফেলে রেখে একই ঘরে পরনারী নিয়ে রাত কাটিয়েছে ওই লোক। আমার মায়ের চোখের সামনে অন্য নারী…”

সরণ আচমকাই থেমে গেল। সমাপ্ত হলো না কথা। গুটিকে সরিয়ে দিল বুক থেকে। গুটিসুটি মেরে বিড়াল ছানার মতো নিজে এবার গুটির বুকে জায়গা করে নিলো। গুটির সর্বাঙ্গে কাঁপন ধরিয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিল। গুটির ভেতরে কোন ঝড় চলছে আর কত নম্বর বিপদসংকেতের আভাস তা যেন টের পাচ্ছে না স্বয়ং গুটিও। মন, মস্তিষ্ক, শরীর সব মোমের ন্যায় গলছে ক্রমশঃ। গঙ্গার ন্যায় বইতে শুরু করবে যেন এক্ষুনি।

“আমাকে ভালোবাসেন না গুটি?”
সরণের প্রশ্নে দিগ্বিদিক হারিয়ে বসলো গুটি। উপর নিচ মাথা নেড়ে ফুঁপিয়ে উঠলো। চোখ উপচে অধৈর্য্যের বান ভাঙতে শুরু করলো অচিরেই। আর কতো? আর কতো দুরত্ব রবে? সব ঠিক থাকলে আজ দু’জনের সম্পর্ক হতে পারতো স্বচ্ছ। স্বল্প রাগ অল্প অভিমান আর দ্বিধা ও সন্দেহ মিলিয়ে ব্যাঞ্জন এক অনুভূতির বসে পড়ে গেছে। দ্বিধা কাটিয়ে দুরত্ব কমছেই না। আজ আর দুরত্ব নয়। সরণকে বুকের মাঝখানটায় আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মৃদু কন্ঠে স্বগতোক্তির সুরে ‘ভালোবাসি’ বলে। সরণ খানিক চমকালো কিনা বোঝা গেল না। এক মুহুর্ত তর না সয়ে মাথা তুলে গাঢ় চুম্বন এঁকে দিল ভ্রুদ্বয়ের ঠিক মাঝ বরাবর। গুটির চোখে শুরু হলো অশ্রুদের আন্দোলন। সরণ কি যেন চেয়ে দেখলো। হয়তো বোঝার চেষ্টা করলো গুটির মুখে স্বস্তি আছে না অস্বস্তি। গুটির বন্ধ দু’চোখে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। নিজেকে সামলে গুটি আচমকাই সরণের ঠোঁটে হাত চেপে থামিয়ে দিল। ঘন ঘন শ্বাস নিতে নিতে বলল,
“আমার অজানা এমনকিছু যদি থেকে থাকে যা আমি মেনে নিতে পারবো না, তবে থেমে যান। আর এগোবেন না। আর যদি এমন কিছু না থাকে যা আমি জানার পর আমাদের সম্পর্কে কোন আঁচ আসবে বা আপনার প্রতি বিতৃষ্ণা কিংবা অসম্মান আসবে, তবে ঠিক ততটা ভালোবাসুন যতটা ভালোবাসা পৃথিবীর সব সুখকে ফিকে করে দিতে পারে। ততটা কাছে আসুন যতটা কাছে আসার পর আর দূরে যাওয়া যায় না। শুরুটা বিশ্বাস আর ভরসা দিয়ে হোক। আপনাকে ভরসা করে দায়িত্ব দিলাম, বেছে নিন কি করবেন।”

সরণের এক মুহুর্ত লাগল না সিদ্ধান্ত নিতে। তৎক্ষনাৎ অধরবন্দী করলো গুটিকে। কয়েক মুহুর্তের বন্দী জীবন কাটলো সরণের ওষ্ঠ কারাগারে। যখন ছাড়া পেল, তখনও বন্দিত্বের শৃঙ্খলের রেষ ধমনী জুড়ে বিচরণ করছে অবাধ্য শিশুর ন্যায়। গুটি নিজেকে ধাতস্থ করার সময় পেল না, দ্বিতীয় বার গাঢ় চুম্বনে লিপ্ত হলো সরণ।
গুটি অপ্রস্তুত ছিল। প্রথম স্পর্শের অনুভূতি সামলে নিতে না নিতেই দ্বিতীয় দফা আক্রমণে দু’হাতে খামচে ধরলো সরণের চুল। দু’জনের ভারী নিশ্বাসের উঠানামা পাল্লা দিয়ে আড়াল করে নিল সরণের চুলে জেঁকে বসা মৃদু যন্ত্রণা। সরণের উন্মাদনা বাড়তে লাগল। সরণ আচমকাই ঠোঁট ছেড়ে দিয়ে গুটির কপালে কপাল ঠেকিয়ে ভারী শ্বাস টেনে বলল,
“আমায় থামিয়ে দিন গুটি। থামান আমাকে। নয়তো শেষ হয়ে যাবেন।”

গুটি লাজুক ভঙ্গিমায় সরণের বুকে মুখ লুকালো। শক্ত হাতে আবদ্ধ করলো বাহুবন্ধনে। ভারী শ্বাসের উঠানামায় ত্রস্ত দু’জন। সরণ ইঙ্গিত পেয়ে গেছে। আর দেরি কীসের? গুটির উন্মুক্ত কাঁধে ঠোঁট ছোঁয়ালো। একবার, দু’বার, বারবার। বাড়তে লাগলো চুমুর সংখ্যা। পুরো শরীর জুড়ে বিচরণ করতে লাগল একে অপরের অস্তিত্ব। শক্ত হতে লাগল গুটির হাতের বাঁধন। নরম হতে লাগল শরীর, মন ও মস্তিষ্ক। এক হলো দুটো সত্তা।

.

ভোরের আগ মুহুর্তে দুঃস্বপ্ন দেখে চিৎকার করে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসার চেষ্টা করলো গুটি। সরণের পুরুষালী বাহুবন্ধন ভেদ করে উঠতে পারলো না। সরণ তড়িঘড়ি উঠে বসে বুকে জড়িয়ে শান্ত করলো গুটিকে। জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে। জবাব না পেয়ে এক গ্লাস জল দিয়ে বলল পুরোটা খেতে। ঘেমে জবজবে অবস্থা পুরো শরীরের। পড়নের কামিস ভিজে মেয়েলি অবয়ব ফুটে উঠেছে। সরণের নজর সেসব পিছু ফেলে গুটির চোখে মত্ত হলো। এ চোখে ভয় যেন মানায় না। মানায় শুধু তেজ। শুইয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“দুঃস্বপ্ন দেখেছেন?”
গুটি মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে গুটিসুটি মেরে সরণের বুকে জায়গা করে নিল। বিড়াল ছানার মতো জাপ্টে শোয়া গুটির চুলে সরণ বিলি কাটতে লাগল আঙ্গুল নেড়ে। গুটির মনোযোগে বিঘ্ন ঘটিয়ে বলল,
“আর একটু প্রেশার দিলে নিশ্চিত বুক চিঁড়ে ভেতরে ঢুকে যাবেন।”
নিশ্চুপ গুটি। সরণ আবার বলল,
“আমার কাছে একটা ওষুধ আছে, যা একবার খেলে সব দুশ্চিন্তা উবে যাবে। এক ডোজই ইনাফ, লাগবে?”
গুটি হটাৎ ফুপিয়ে উঠলো। হাতের বন্ধন হলো আরও শক্ত। কাঁদতে কাঁদতে অস্থির গলায় বলতে লাগল,
“আমার কপালে সুখ সয় না। আপনি সইবেন তো? এমনকিছু নেই তো যা আমাকে টেনেহিঁচড়ে রোজ দুঃস্বপ্ন দেখাতে বাধ্য করবে। যদি থেকে থাকে, তবে আমার অজানাই থাক। আমি চাই না শুনতে। আমি শুধু আপনাকে চাই। আপনাকে নিয়ে সুখী হতে চাই। ছোট্ট একটা সংসার হোক শুধু আমার নামে। আমি পারবো না আর ধোকা সইতে। আর পারবো না।”
“শান্ত হন প্লিজ। এমন কিচ্ছু হবে না। আপনাকে কেউ ধোঁকা দেবে না গুটি। আপনাকে নিয়ে সুখের সর্বোচ্চ সীমা অতিক্রম করবো আমি। শান্ত হোন।”
গুটি শান্ত হলো না। সরণ বেছে নিল ভিন্ন পন্থা। ডুব দিল গুটির ওষ্ঠ পদ্মে। গুটির খুব বেশি সময় লাগলো না সরণের ডাকে সারা দিতে। ভোরের সূর্য পৃথিবীতে পদার্পণ করেই যেন চাক্ষুষ সাক্ষী হলো নিষ্পাপ, নিঃস্বার্থ, স্বচ্ছ ভালোবাসার। একদিকে উদীয়মান চিরন্তন সূর্যদেবতা, অন্যদিকে অস্তমিত গুটির সমস্ত দুঃখ, কষ্টের দুঃসময়।

(চলবে)

শূন্যলতা পর্ব-০৮

0

#শূন্যলতা
#গুঞ্জন_চৈতি
পর্ব-৮

মধ্যরাতে জ্ঞান ফিরলো গুটির। শক্তপোক্ত মানিক এবার অসহায় বোধ করতে লাগলো। গুটির কতশত প্রশ্নের সম্মুখীন তাকে হতে হবে। সামলাতে পারবে তো? নড়েচড়ে বসলো মানিক। কিন্তু মনের ভাবনা বাস্তব হলো না। গুটির জ্ঞান ফেরার পর না করলো কোন প্রশ্ন, না হলো উতলা। আলগোছে উঠে বসলো চুপচাপ। মানিক শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“খারাপ লাগছে?”
গুটি উত্তর না দিয়ে বলে উঠলো,
“ওনাকে ধরে নিয়ে গেল আর উনি কোন প্রশ্ন করলেন না, আপনাকে চুপ করিয়ে দিলেন, পুলিশও বেশি কিছু বলল না। উনি আগে থেকেই জানতেন এসব হবে, তাই-না?”
মানিক জবাব দিলো না। গুটি মাথায় হাত চেপে বসে রইলো। পুনরায় প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হলো না তবে উত্তর সাজাতে ইচ্ছে করলো। মনে মনে ভাবতে ইচ্ছে করলো কি হতে চলেছে তার সাথে? কি যেন ভাবতে ভাবতে হটাৎ মানিককে বলে উঠলো,
“ভুল পথের ফুল হয়ে ফোঁটার চেয়ে ঠিক পথের ঝরা পাপড়ি হয়ে পায়ের ধুলো মেখে অনাদরে পড়ে থাকা ঢের ভালো। সঠিক মানুষ না জুটলেও সঠিক পায়ের ধুলো অন্তত জোটে কপালে।”
মানিক অনেক কিছু বলতে গিয়েও বলল না। ভরসার চাহনিতে মুচকি হেসে চলে গেল নিজ কক্ষে। গুটি বসে রইলো ভোরের অপেক্ষায়।

পরের দিন সকাল হতে না হতেই গুটি মানিকের সঙ্গে থানায় যাওয়ার জেদ ধরলো। মানিকের একটাই কথা, সরণের বারণ আছে। সকাল থেকে দুপুর অব্দি গুটি জেদ দেখিয়ে বসে রইলো গো ধরে। থানায় গিয়ে বিস্তারিত জানতে চায় আর কথা বলতে চায় সরণের সাথে। বিশ্বাস, অবিশ্বাস আর অনিশ্চিয়তায় ক্লান্ত সে। কিন্তু মানিককে কোনভাবে টলাতে পারলো না। দুপুরে মানিক কোন এক বিশেষ প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে গেলে গুটি একটুখানি খবরের আশায় টিভির সামনে বসলো। খবরের চ্যানেল ঘেটে যা জানতে পারলো তাতে খেই হারালো গুটি। চিন্তায় কুল-কিনারাহীন। ছাত্রনেতা সরণ তালুকদার বাবার খুনের দায়ে আটক! খবরটা গুটিকে ছন্নছাড়া করে তুললো। বীরেন তালুকদার মরে থাকলে খুনী তো সে নিজে, সরণ কি করে খুনী হতে পারে? নানান আশংকা আর চিন্তা মিলিয়ে বুকের বাঁপাশ ভারী হতে লাগলো। মস্তিষ্ক হয়ে উঠলো ভীতসন্ত্রস্ত। প্রতিটা খবরের চ্যানেলে কমবেশি একই খবর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চলছে। সরণের অতীত নিয়ে চলছে টানাহেঁচড়া। গুটি অধৈর্য্যে হয়ে নিজে নিজেই থানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। আগের দিনের সেই কালো বোরকাটা পড়ে নিয়েছে বেরোনোর আগে। এদিকে মানিক বাসায় ফিরে গুটিকে না পেয়ে দিশেহারা। চলন্ত টিভিতে খবরের চ্যানেল দেখে বুঝে নিল গুটি কতটা জেনেছে। বুঝতে পারলো থানার দিকেই গেছে। গাড়ি নিয়ে বের হলো থানার উদ্দেশ্যে।

একজন সিএনজি চালকের সাহায্যে থানা অব্দি পৌঁছোলো গুটি। থানার ভেতরে ঢুকলো ভয়ে ভয়ে। ঢুকতে গিয়ে নিজের বাবাকে চার-পাঁচজন লোকের সাথে বের হতে দেখে চমকে গেল। নিজেকে আড়াল করে এক কোনে গিয়ে দাঁড়ালো। তার বাবা এখানে কেন? যাদের সাথে বের হলো তাদের মধ্যে একজনকে চিনেও ফেলল তৎক্ষনাৎ। গতকাল ড্রয়িংরুমে অনেকের ভীড়ে একজন ছিলো এই লোকটা। আরও কিছুটা ভেতরে যেতে উদ্যত হলে পেছন থেকে হাতে টান পড়লো। মানিক চলে এসেছে। গুটিকে দেখতে পেয়েই আলগোছে হাতে ধরে বাইরের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
“চুপচাপ চলো গুটিদি। সরণ খুব রেগে যাবে।”
গুটি এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে থানার ভেতরে চলে গেল বড় বড় পা ফেলে। মানিক থানার ভেতরে দাঁড়িয়ে পারলো না জোর করে কিছু বলতে, আর না পারলো জোর করে কিছু করতে। পিছু পিছু ছুটে গিয়ে শুধু বলল,
“ওকে কুল, আমি দেখা করিয়ে দিচ্ছি। তুমি কোন স্টেপ নিও না আর মুখও খুলবে না।”
গুটি নিজেও বুঝতে পারছিলো না কি করবে। তাই মানিকের কথামতো পিছু নিলো। মানিক একজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলে অনায়াসে কথা বলার ব্যাবস্থা করে দিলো। গুটি খুব একটা কড়াকড়ি টের পেল না থানার পরিবেশে। মনে হলো যেন থানায় আসা আর এসে একজন খুনের অভিযুক্তের সঙ্গে দেখা করা যেন ভাতমাছ।

গুটি সরণের মুখোমুখি হয়ে কিছু বলতে অব্দি পারলো না, সরণ ধমকে উঠলো গুটির পেছনে দাঁড়ানো মানিককে। হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ওই জানোয়ারটা মাত্র বের হলো, গুটিকে দেখেনি তো?”
মানিক মাথা নেড়ে না করলে গুটির দিকে সরণ তাকালো। চোখ দুটো শুধু দেখা যাচ্ছে। ভেজা চোখে চিন্তার স্যাঁতসেঁতে আদোল। তবুও মনকাড়া। ভেজা চোখ জোড়ায় দৃষ্টি কায়েম রেখেই মানিককে বলল,
“ঘুষখোড়টার ছুঁক ছুঁক স্বভাব আছে। ওটাকে একটু সাইডে নিয়ে যা।”
মানিক চলে গেলে গুটিকে হাতের ইশারায় কাছে এসে দাঁড়াতে বলল সরণ। গুটি এলো না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। সরণ মুচকি মুচকি হেসে বলল,
“একটা গোপন কথা, কেউ শুনে ফেললে মুশকিল। প্লিজ, কাম ক্লোজ।”
গুটি চোখ মুছতে মুছতে কাছে এসে দাঁড়ালে সরণ বলল,
“গতকাল বিয়ে হয়েছে আমাদের, হিসেব অনুযায়ী আজ ফুলসজ্জা। ভাইয়ের সঙ্গে বাসায় গিয়ে বউ সাজুন, আমি আসছি।”
গুটির হাত-পা নিশপিশ করে উঠলো রাগে। এদিকে কি দিয়ে কথা শুরু করবে বুঝেও উঠতে পারছে না। তারওপর সরণের দুষ্টু চাহনিতে দুষ্টু কথা। মিশ্র অনুভূতি গুটির। সরণ এবার সিরিয়াস মুখভঙ্গিতে বলল,
“বাসায় যান, আমি চলে আসবো। আমার জন্য দুশ্চিন্তা করে করে ধকল নেবেন না গুটি, রাতে এমনিতেও বেশ ধকল যাবে।”
এটুকু বলে গাল ফুলিয়ে মিচকে একটা হাসি দিল সরণ। গুটি হতবিহ্বল সরণের এমন পরিস্থিতিতে এমন আচরণ আর কথা শুনে। গুটির মুখভঙ্গি যখন দৃঢ় হলো সরণ তখন বুঝলো গুটি প্রশ্নের বান ভাঙতে প্রস্তুত। ওমনি ব্যাঘাত ঘটাতে বলে উঠলো,
“বাসায় যান, আমি আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তবেই আপনাকে আপনার থেকে চেয়ে নেবো। যান গুটি। প্লিজ। এখানে কোন প্রশ্ন করবেন না।”
এতটুকু বলেই সরণ মানিককে ডাক দিলো। গুটি সরণকে ভর্ৎসনা করে বলল,
“থানার চৌদ্দ শিকের পেছনে বসে ফুলসজ্জার আলাপ! কি সোজা না?”
“বউ চাইলে বাকি আলাপ বিছানায় সারবো। আই হ্যাভ নো প্রবলেম।”
“বাবা এখানে কেন এসেছিল?”
“বাসায় যান গুটি।”
এপর্যায়ে সরণের মুখভঙ্গি হলো কঠিন। কন্ঠ দৃঢ়। ততক্ষণে মানিকও চলে এসেছে।
“বাসায় যান। সব প্রশ্নের উত্তর সময়মতো পাবেন। মানিক নিয়ে যা ওনাকে।”
গুটির ভীষণ ইচ্ছে করলো জেদ দেখাতে। কিন্তু কোথাও একটা আটকালো। তারওপর পায়ে ভীষণ ব্যাথাও করছে। হাজারটা প্রশ্নের জবাব না নিয়ে শেষমেশ চলে গেল সরণের সামনে থেকে। তবে যেতে-যেতে কানে এলো মানিককে বলা সরণের কথা,
“বাসায় গিয়ে একটা পেইন কিলার দিস ওনাকে। আর সেলাইটা চেক দিস।”

গুটি বাসায় এসে অবাক। ড্রয়িংরুম ভর্তি ফুলের গোডাউন। মানিক থতমত মুখে ফুলগুলো গুটির রুমে নিয়ে বলল,
“আপাতত ওই রুমে যাও, এই রুমে এখন কাজ আছে।”
গুটি যখন একলা বেরিয়ে গিয়েছিল থানায় যাবে বলে, মানিক তখন ফুল কিনতেই গিয়েছিল। এসে গুটিকে না পেয়ে ফুলগুলো ড্রয়িংরুমে ফেলেই তড়িঘড়ি বেরিয়েছিল গুটিকে খুঁজতে।
গুটি বিরক্ত ছিল। এবার লজ্জাও পেল। আবার মাথাভর্তি চিন্তা। চুপচাপ চলে গেল পাশের রুমে।

রাত যখন এগারোটা ছুঁই ছুঁই, গুটি তখন ঘুমে বিভোর। চিন্তারাজ্য থেকে কখন ঘুমের রাজ্যে চলে গেছে, গুটি তা নিজেও জানে না। ঘুমের মাঝে আচমকা টের পেল কারও বাহুডোরে আবদ্ধ হওয়ার মৃদু অনুভূতি। তাকিয়ে বুঝে উঠতে যতটা সময় নিলো, ততক্ষণে সে হাওয়ায় ভাসছে। অর্থাৎ সরণের পাঁজাকোলে তখন আঁটসাঁট সেঁটে আছে। ঘুমের রেষ কাটিয়ে চিৎকার করতে করতেও চুপ করে গেল গুটি। অপ্রস্তুত হয়ে চারদিকে তাকিয়ে মানিকের খোঁজ করলো। এদিকে বুকের বাঁপাশ ধুপধাপ লাফাচ্ছে। সরণ গুটির মনোভাব বুঝে ফিসফিস করে বলল,
“আপনার ভাইকে বাসা থেকে বের করা হয়েছে৷ সে এখন সামনের এপার্টমেন্টে আছে।”
গুটির সময় জ্ঞান আপাতত নেই। রাত ঠিক কটা বাজে জানে না। তবুও ধরেই নিল এখন মধ্যরাত। বলল,
“এই মধ্যরাতে থানা থেকে পালিয়েই এসেছেন নিশ্চয়ই?”
সরণ বন্ধ রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“চাপার জোরটা হাতে ট্রান্সফার করুন তো৷ দরজাটা ধাক্কা মারুন।”
গুটি খুব জোরে ধাক্কা মারলো দরজা। দরজা খুললে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো সামনে। কাঁচা ফুলের গন্ধটা চট করেই নাকে এসে ধাক্কা দিলো। তেজ কিছুটা কমে এলো গুটির। সরণ রুমে ঢুকে গুটিকে বিছানায় বসিয়ে ওয়ারড্রব থেকে দু’টো প্যাকেট বের করে দিয়ে বলল,
“ঝটপট রেডি হোন তো। বউ সাজবেন।”
রাগে ফেটে পড়লো গুটি। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,
“আমারে কি পাগল মনে হয়? পাগল? ফুলসজ্জার রঙ লাগছে মনে, হ্যাঁ?”
“বউ সেজে খাটের ঠিক মাঝখানটায় বসবেন। মাথায় ঘোমটাটা মাস্ট। আর ওই কাঁচা ফুলের গয়নাগুলোও। আমি ঘোমটাটা তুলবো, আপনি হাসবেন। অল্প করে। এই এইটুকুনি। তারপর আমি আপনার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়াবো। গতকালের মতো মাঝখানে কোন হাত থাকবে না। চুমুটা ছোঁবে, আপনাকে আর আমাকে একত্রে। তারপর আপনাকে বুকের ঠিক মাঝখানটায় জড়িয়ে নিয়ে আরাম করে সব বলবো। যদি শুনতে চান আরকি। নয়তো গেলাম আমি শুতে।”
হাই তুলতে তুলতে সরণ বিছানার বালিশ ঠিক করতে লাগল। গুটি আশ্চর্যজনক চাহনিতে চেয়ে আছে। লজ্জা আর রাগে কান্না পাচ্ছে গুটির। মাথায় জেদও চাপছে। ইচ্ছে করছে লোকটার হাত-পা বেঁধে গলায় চা কু ধরে বলতে,
“সব বলবি না দেবো ভবলীলা সাঙ্গ করে?”
গুটি দারুণ জেদ দেখিয়ে বলল,
“আমি এসব কিচ্ছু করবো না। ভাল চানতো এমনিই বলুন, নয়তো আমি…..”
“নয়তো আমি?”
গুটির দু-হাত আচমকা পিছু মুড়িয়ে বলল সরণ। অপ্রস্তুতভাবে গুটি বন্দী হতেই রাগ বেড়ে তার আকাশচুম্বী। পা দিয়ে সরণের পায়ে আঘাত করে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। ব্যার্থ হলে নখ বসালো সরণের হাতে। সরণ তাতে আরও জাপ্টে ধরে বলল,
“বউ সাজতে হবে না, ঘোমটাও দিতে হবে না, ফুলের গয়নাও দিলাম বাদ, একটু হাসতে তো পারেন, নাকি? হাসতে হাসতে বুকে চলে আসুন, বাকিটুকু স্যাক্রিফাইস করে নিচ্ছি।”
গুটি আচমকা হাত নাড়তে গিয়ে চিৎকার করে উঠলো। সরণ চিন্তিত হয়ে হাত ছেড়ে কি হয়েছে তা জিজ্ঞেস করতেই সরণকে বিছানায় ফেলে দিল গুটি। সরণের দু’হাত চেপে ধরতেও সময় নিল না। কুটিল হেসে দাঁতে দাঁত চেপে গুটি বলল,
“পন্থাটা পুরোনো, একটু ফিল্মি, কিন্তু কার্যকরী।”
সরণ নড়লো চরলো না, প্রতিক্রিয়াও শুন্য। দু’জনের মাঝের কয়েক ইঞ্চি দুরত্ব ঘুচিয়ে শুধু একটা মাত্র কাজ করলো, মাথা উঁচিয়ে শব্দ করে চুমু খেলো গুটির ঠোঁটে। গুটি এক মুহুর্ত থমকে থেকে উঠতে গেলে টান দিয়ে ফেলে দিল বুকের উপর। অতঃপর হলো সেই, যা চেয়েছিল সরণ। বুকের সঙ্গে জাপ্টে ধরে আরাম করে মিইয়ে গেল নরম বিছানায়। একটু বেশি মিইয়ে গেল গুটি। ভেতরের অবস্থা তার ভীষণ নড়বড়ে। পেটের ভেতর মোচড়াচ্ছে। পুরো শরীরে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছে অনবরত। আর সরণ? সে অনুভূতি কুড়াতে বন্ধ চোখে শ্বাস গুনছে যেন।

(চলবে)

শূন্যলতা পর্ব-০৭

0

#শূন্যলতা
#গুঞ্জন_চৈতি
পর্ব-৭

“সুন্দর একটা সকাল চাই না আপনার? ভীতিহীন বিকেল, চিন্তামুক্ত রাত? আমি সব এনে দেবো। সকালের রোদ আর রোদের প্রখরতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমি আপনার সব স্বপ্ন পূরণ করবো। শুধু একবার হ্যাঁ বলুন।”
বেশ খানিক্ষণ চুপ করে রইলো গুটি। সরণের ধৈর্য ভাঙলো। মৃদু স্বরে বলল,
“সে সামথিং….”
“যদি হ্যাঁ বলি আজই বিয়ে করবেন? আজই সব?”
“আপনার কথার ধরন পাল্টে গেল গুটি। শহুরে কথার আদোল! তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, ফিচেল হাসি। আমি বেড শেয়ারের কথা বলিনি, লাইফ শেয়ার কথা বলেছি। আমার দিকে এভাবে তাকাবেন না।”
“উত্তর দিন না।”
“এবার কন্ঠ নরম, চোখের দৃষ্টি তে বিনা আগুনের ধোঁয়াশা। কি চাইছেন গুটি?
“আমি রাজি বিয়েতে, কিন্তু নিজেকে সঁপে দেওয়ার আগে নিজের জন্য কিছু চাইবো না?”
“কি চান?”
“আপনি রাজনীতি করেন। আজ বেঁচে আছেন, কাল মরেও যেতে পারেন। তখন আমার কি হবে? আপনার যেখানে যা আছে, মানে টাকা পয়সা, জায়গা-জমি সব আমার নামে করে দিতে পারবেন? বিয়ের আগেই। পরে না।”
সরণ অদ্ভুত গাম্ভীর্যপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
“তাহলে আপনি রাজি বিয়েতে?”
“হুম।”
সরণ কিছু সময় তাকিয়ে থেকে পকেট হাতড়ালো। ফোন পেল না। বিছানার ওইদিকটায় গুটির সামনে পড়ে থাকতে দেখে বাইরে বেরিয়ে গেল। মানিকের ফোন হাতে নিয়ে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ঢুকলো পুনরায় কক্ষে। গুটির সামনে দাঁড়িয়ে দ্রুত গতিতে কিছু একটা টাইপ করলো। কিয়ৎকাল বাদে মেসেজ টোন বেজে উঠলো গুটির সামনে পরে থাকা ফোনটায়। গুটি চেয়ে দেখলো না। বুঝলো না মেসেজটা সরণই পাঠিয়েছে। যেহেতু ওটা তার নিজের ফোন নয়, তাই মেসেজ টোনে সচকিত হয়ে ফোন পরখ করার প্রশ্নই আসে না।
সরণ ফোনটা পকেটে চালান করতে করতে গুটিকে বলল,
“আচ্ছা, যা চাইছেন সব দেবো। আমার যা কিছু আছে সব লিখে দেবো আপনাকে। এবং তা বিয়ের আগেই।”
গুটি কয়েক সেকেণ্ড চুপচাপ তাকিয়ে রইলো। উপহাস করে বলল,
“এমন স্বার্থপর প্রস্তাবে যে এক কথায় রাজি হয়, সে নিজেও স্বার্থপর। আমি কোন স্বার্থপরকে বিয়ে করবো না। টাকা দিয়ে ভালোবাসা কিনতে চাওয়া মানুষের কাছে আমি বিক্রি হবো না, না আমার ভালোবাসা বিক্রি হবে!”
“যদি না বলতাম রাজি হতেন? হ্যাঁ করতেন বিয়েতে?”
“একদম না। না করলে বুঝে নিতাম একটা লোভী আপনি।”
সরণের ঠোঁটে খেলে গেল মন ভোলানো হাসি। চৌকস ব্যাক্তিত্বের সুদর্শন যুবকটি দু’হাত পকেটে গুঁজে মুচকি মুচকি হাসতে হাসতে এগোতে লাগল গুটির দিকে। গুটির কপাল কুঁচকে এলো। ওড়না ঠিক করে ঠিকঠাক বসতে বসতে সরণ এসে দাঁড়ালো খুব কাছে। গুটি বসা বিছানায়, সরণ বিছানা ঘেঁষে ঝুঁকে গেল গুটির সামন বরাবর। তড়িৎ বেগে সরতে গিয়ে পায়ে খানিক ব্যাথা পেলেও চিৎকার গিলে গুটি বলে উঠলো,
“কাছে আইল খু ন অইবেন খু ন।”
গুটি ফিরে গেল আঞ্চলিক ভাষায়। তার হুমকি শেষ হতে হতে সরণ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। গুটির সামনে যে ফোনটা ছিল সেটা নিতেই ঝুঁকেছিল। ফোনটা হাতে নিয়ে নিজের কপালে দু’টো ঠোকর মারলো সরণ। ঠোঁটে সেই হৃদয়কাড়া হাসি। ফোনের লক খুলে গুটির সামনে ধরলো। গুটি চমকে আরও কিছুটা দূরে সরে যাচ্ছিল, ফোন এগোতে দেখে ছোঁ মেরে নিয়ে নিল। তবে স্ক্রিনে বেশিক্ষণ চোখ রাখতে পারলো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই তেড়ে গেল সরণের দিকে। সরণ পালানো তো দূর, ল্যাম্পপোস্টের ন্যায় খুঁটি গেঁড়ে দাঁড়িয়ে থেকে এগিয়ে দিল নিজেকে। যেন বুক পেতে এবার গু লি নেওয়ার পালা। আর নয়তো দেওয়ার পালা। গুটি হাঁটু গেঁড়ে বসে কলার চেপে ধরলো সরণের। রাগে চিৎকার করে বলল,
“কি মনে করেন নিজেরে? সবজান্তা….”
গুটির কথা বন্ধ হলো আচমকা। সরণ উল্টো হাতে চেপে ধরেছে গুটির কপাল। গুটি রাগ দেখানোর সময় পেল না, পেল না প্রতিক্রিয়া দেখানোর সুযোগ। তার আগেই সরণ চুমু বসালো গুটির কপালে রাখা নিজের হাতের উল্টোপিঠটায়। গুটি ঢোক গিলতে গিলতে যে সময়টুকু নিল, ততক্ষণে চলে গেল সরণ কক্ষের বাইরে। গুটি রইলো একভাবে। ধীরে ধীরে চুপটি করে বসলো। ঠোঁট তো তাকে ছোঁয়নি, উত্তপ্ত নিঃশ্বাসও ছোঁয়নি তার কপাল। তবুও ঘামতে লাগল গুটি। শিরদাঁড়া বেয়ে শিহরণ বইতে লাগল প্রতিবার, যতবার কানে বাজতে লাগলো মৃদু চুমুর আওয়াজ আর এতোটা কাছ থেকে পাওয়া পুরুষালী গায়ের গন্ধ। গুটি ভুলে গেল ঝগড়া এখনও বাকি আছে। কিছুক্ষণ উদভ্রান্তের ন্যায় বসে থেকে ফোনে সরণের দেখানো মেসেজটিতে পুনরায় চোখ বুলালো। গুটি যা বলেছে সেই কথাগুলোই অগ্রিম মেসেজে লিখে অতঃপর জবাব দিয়েছে সরণ। লিখেছে,

“আমি রাজি হলে বলবেন এমন সেলফিশ একটা প্রোপোজালে রাজি হয়েছি মানে আমিও সেলফিশ। তারপর বলবেন ভালোবাসা টাকা দিয়ে কিনতে চেয়েছি আমি। আর যদি রাজি না হই তাহলে বলবেন লোভী। গাছের আর তলার মাগনা খাওয়া লোভী পুরুষ। যে নিতে রাজি বাট দিতে নয়। রাইট? জবাব যাই দিই, ঘাড়ে চেপে মাথা ঠিকই আলাদা করবেন।”
এতটুকু পড়ে থামলো গুটি। তখন এতটুকুই পড়েছিল। অনেকটা নিচে আরও একটু লেখা আছে। সেটুকু তখন পড়েনি। এখন চোখ বুলালো সেখানে।

“আই হ্যাভ মাই বিউটিফুল উডবি ওয়াইফ, আই, মি, এন্ড মাইসেল্ফ। আমার এই আমি আর সে ছাড়া আমার বলতে কেউ নেই। তাকে তো দেবো না, নট ইভেন হার রিফ্লেকশন অর শ্যডো। সো, নিলে আমাকে নিতে পারেন। এছাড়া দেওয়ার মতো আর কিছু নেই তেজস্বিনী। নেবেন আমাকে? উদার মনে দিয়ে দেবো। আমি শুধু হ্যান্ডসাম নই, হাম্বল প্লাস রোমান্টিক। নিলে আফসোস করতে দেবো না। ট্রাস্ট মি, ইউ উইল লাভ মি।”

লেখাটুকু পড়তে পড়তে গুটির মুখে কখন লজ্জা আর হাসি ভর করেছে তা গুটি নিজেও জানে না। হাসি থামলো মানিকের নম্বরটা ‘মাইনকার চিপা’ নামে সেইভ দেখে। বড় করে শ্বাস নিয়ে আবারও হেসে ফেলল। হাসি আর সরলোই না। একদম না। সাথে খানিক ভিজলো চোখের দুয়ার। চোখেমুখে আনন্দের দ্যুতি ছড়াচ্ছে ভীষণ দ্রুত।

সারা দুপুর আর দু’জনের দেখা হলো না, কথা হলো না। মানিক এসে খাবার দিয়ে গেল দুপুরের। গুটি খুব করে চাইলো মানিক নিজে থেকে বলুক সরণ কোথায়। কিন্তু মানিক এলো নিঃশব্দে, গেলও নিঃশব্দে। গুটির এক আকাশ লজ্জা নিয়ে ছটফট করতে লাগল একা একা। ভাবল, তার কি মেসেজের রিপ্লাই করা উচিত? কোন জবাব না পেয়েই হয়তো সামনে আসছে না সরণ। ফোন হাতে নিতে মনে পড়লো কাকে জবাব দেবে? যাকে দেবে তার ফোন তো এখানে। মানিকের ফোন কি আর এখনও আছে তার কাছে? ফেরত দিয়ে দিয়েছে হয়তো। বেশ কিছুক্ষণ অপ্রয়োজনীয় বিরহ নিয়ে বসে থেকে হটাৎ মনে হলো সে কিছুটা অদ্ভুত ব্যাবহার করছে। সে তো কাঠখোট্টা, কঠিন মুখছোটা মেয়ে। লজ্জাবতী লতা তো নয়। নিজেকে মনে মনে দু’টো গালি দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাইরে গেল। মানিককে ড্রয়িংরুমে পেয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করলো,
“উনি কোথায়?”
মানিক এগিয়ে এসে বলল,
“আরে গুটিদি, তুমি পায়ে হেঁটে বাইরে এসেছো কেন? সেলাই কাঁচা, ব্লিডিং হবে তো!”
গুটি চমকে উঠলো ডাকটা শুনে। মনে পড়লো সরণ একদিন বলেছিল তার ছোট ভাইয়ের শখ পূরণ করতে রেডিমেড একটা ভাই জোগাড় করে ফেলেছে সে। বয়সে তার থেকে বড় হলেও, বড় বোনের অভাবে সে বড় দিদি বলেই নাকি মানে। ছোট করে ডাকে গুটিদি বলে। কিন্তু কে সে তা বলেনি। বলেছিল, তাকে সামনে পেলে নিজেই চিনে নিতে পারবেন। নিশ্চিত হতে ভাইয়ু বলে ডাকার কথা বলেছিল শুধু। গুটি জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ভাইয়ু বলে উঠলো কিছুটা প্রশ্নের সুরে। যেন প্রশ্ন করলো সে ভাইয়ু কিনা? মানিক উত্তর নিয়ে মাথা নেড়ে হাসলো। গুটির চোখ ভিজে উঠলো আবার। কোনমতে দৃষ্টি আড়াল করে বলল,
“উনি কোথায়?”
“চলে আসবে দি, তুমি খেয়ে নাও। তোমার ওষুধ আছে দুপুরে।”
গুটি চলে গেল ভেতরে। বুক ভরা মন কেমন করা প্রসন্নতার মেলা বসেছে। আবেগি মেলা।

সারাদিন পর সন্ধ্যায় সরণ বাড়ি ফিরলো এক গাদা শপিং ব্যাগ নিয়ে। গুটির চোখ জুড়ালেও নিজেকে মেলে ধরতে পারলো না আগের গুটি রূপে। জড়তায় জড়িয়ে রইলো। আগ বাড়িয়ে কথা বলল সরণ। কয়েকটা শপিং ব্যাগ হাতে দিয়ে বলল,
“বউ সাজতে পারো?”
গুটি অস্বস্তি লুকিয়ে ছোঁ মেরে ব্যাগ ক’টা নিয়ে বলল,
“সাজতে পারি, তবে সাজলে বউয়ের মতো লাগবে না সঙের মতো তা জানি না।”
“একটু পর সিঁথিতে সিঁদুর উঠলে এমনিতেই বউ হয়ে যাবে।”
গুটি নত করে নিলো দৃষ্টি। সরণ বলল,
“আজ থেকে সাজবে তুমি, আর তা নষ্ট করবো আমি। দারুণ না ব্যাপারটা?”
“আপনি যাবেন এখান থেকে?”
কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই গুটি নিজেকে আপনমনে প্রশ্ন করলো,
“আমি এমন চিল্লাচ্ছি কেন?”
গুটি অস্বস্তি লুকাতে গিয়ে হতবিহ্বল হয়ে পড়ছে দেখে সরণ টিপ্পনী কাটলো।
“লজ্জা পেলে মেয়েরা চিল্লাচিল্লি করে, জানা ছিল না! মেয়েরা কখন কখন চিল্লায় বলো তো?”
গুটি আগের ফর্মে ফিরে গেল মুহুর্তেই। সরণের দিকে এগোতে এগোতে তেজি গলায় বলে উঠলো,
”জায়গামতো একটা দিলেই বুঝতে পারবেন কখন কখন চিল্লাতে হয়। সকালেরটা মনে নেই?”

দু’জনকে ব্রেক টানালো মানিক এসে। সরণের আনা নতুন পাঞ্জাবি পড়েছে মানিক। তাই দেখাতে এসেছে। গুটির সামনে গিয়ে বলল,
“গুটিদি, ভালো লাগছে?”
গুটি মাথা নেড়ে সায় জানালে সরণ বলল,
“কার পছন্দ দেখতে হবে তো।”

মানিক আর সরণ বেরিয়ে গেলে গুটি তড়িঘড়ি ব্যাগ থেকে শাড়ী বের করলো। আরও পেল কিছু কসমেটিকস। তবে কোন গয়না নেই। যা পেল তাই দিয়ে সাজতে বসলো। সাজগোজ শেষ হতেই সরণ এলো একটা সোনার চেইন আর ছোট্ট এক জোড়া কানের দুল নিয়ে। গুটিকে বলল,
“আমার মায়ের, পড়িয়ে দিই?”
গুটির সজ্জা সম্পূর্ণ হলো না। হাত খালি। সরণকে সেদিকে চেয়ে থাকতে দেখে বলল,
“শাখা-পলা পড়বো তো, তাতেই হবে। আর কিছু লাগবে না।”
সরণের চোখেমুখে তৃপ্তি ছেয়ে গেল। তিনজন রওয়ানা হলো মন্দিরের উদ্দেশ্যে, তবে আলাদা আলাদা। গুটি বের হলো শাড়ীর উপর দিয়ে কালো বোরকা পড়ে। সরণ কেন এমনটা করালো তা জানে না গুটি, জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করেনি। যখন বলবে, তখন নিশ্চয়ই সবই বলবে। তাকে প্রশ্ন করার সুযোগই হয়তো দেবে না।

বেশ দূরের একটা ছোটখাটো মন্দিরে বিয়ে সম্পন্ন হলো সরণ আর গুটির। কিন্তু বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার পাঁচ মিনিট পেরোতে না পেরোতেই আলাদা হয়ে গেল দু’জন। আচমকা পুলিশ এসে এরেস্ট করলো সরণকে। গুটি হাতের মুঠোয় দুনিয়া পেয়ে হাত মুঠো করে ধরতেও পারলো না, তার আগেই সব হারিয়ে বসলো। নানান আশংকা আর ভীতিতে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে রইলো মন্দিরের মেঝেতে। মানিক দিশেহারা। কাকে সামলাবে? সরণ মানিককে গুটির দায়িত্ব দিয়ে চলে গেল পুলিশের সাথে খুনের আসামি রূপে। তবে যাওয়ার আগে বলে গেছে, এখনই জ্ঞান না ফেরাতে। থাকুক কিছুক্ষণ নিশ্চিন্তে। না থাকুক জ্ঞান।

(চলবে)

শূন্যলতা পর্ব-০৬

0

#শূন্যলতা
#গুঞ্জন_চৈতি
পর্ব-৬

সরণের দ্রুত হেঁটে আসার শব্দে তড়িঘড়ি ফোন রাখলো গুটি। সোজা হয়ে বসে বড় করে শ্বাস টানলো। যেন চুরি করতে গিয়ে এক্ষুনি ধরা পড়তে পড়তে বেঁচেছে। সরণ এরমধ্যেই ল্যাপটপ হাতে ঘরে ঢুকে পড়েছে। গুটির সামনে ল্যাপটপ রেখে গুটিকে বলল,
“এই ফোল্ডারে শাহরুখ খানের প্রায় ত্রিশ প্লাস মুভি আছে। আপনার যেটা খুশি দেখতে পারবেন।”
গুটির শাহরুখ খানকে ভীষণ পছন্দ। একদিন বলেছিল সরণকে। সেই কথা মনে রেখেছে সরণ। তবে মুগ্ধ হওয়ার সুযোগ পেল না। সদ্য জলে পড়া অভিব্যক্তি নিয়ে বলল,
“আমি জীবনে ল্যাপটপ ছুয়্যাও দেহি নাই। কেমনে কি করা লাগে আমি জানি না।”
সরণ একবার ঘড়িতে সময় দেখে গুটিকে বলল,
“আচ্ছা আমি শিখিয়ে দিচ্ছি। জাস্ট কোন মুভিটা দেখবেন সেটা সিলেক্ট করে প্লে করবেন, সিম্পল।”
তেজস্বিনীর তেজ লেজ গুটিয়ে হাওয়া হলো। চুপসানো আতংকিত আদোলে কোনা চোখে চেয়ে রইলো ল্যাপটপের স্ক্রিনে। গুটির মনে হচ্ছে সে হাত দিলেই ল্যাপটপ নষ্ট হয়ে যাবে। যদি উল্টোপাল্টা কিছু করে বসে! এতোই সোজা নাকি? মুহুর্তেই শিখে ফেলা যায়? তবে ভীতির বহিঃপ্রকাশ করতে রাজি নয়। স্ক্রিনে নজর বুলিয়ে মুভির নাম পরখ করে শান্ত কন্ঠে বলল,
“মে হুনা দিলেই হবে। আমাকে শেখাতে হবে না। আপনি দিয়ে চলে যান।”
সরণ মুভিটা দিয়েও সারতে পারলো না। দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো মানিক।চিন্তিত চেহারায় ডেকে বলল,
“সরণ জিহাদ এসেছে।”
চোখমুখ শক্ত হয়ে উঠলো সরণের। গুটিকে বলল,
“যতক্ষন না আমি নিজে আসছি, রুম থেকে বের হবেন না।”
সরণ কথাটা বলে দরজা অব্দি গিয়ে আবার ফিরে এলো। অস্থির ও কঠিন কন্ঠে গুটিকে পুনরায় বলল,
“নো মিনস নো। অবাধ্যতা করবেন না।”
“এতো সমস্যা থাকলে বাইরে থিকা লাগাইয়া যান দরজা।”
সরণ কথা না বলে বেরিয়ে গেল। তবে বাইরে থেকে দরজা লাগালো না। মানিকও সঙ্গে সঙ্গে চলে গেলে গুটি অনুভব করলো বুকের ভেতর অদ্ভুত দোলাচল। সন্দেহ আর আগ্রহ জুটি বেঁধে অস্থির করে তুললো তাকে। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে ড্রয়িংরুমের কথোপকথন শোনার ইচ্ছেয় দরজার পাশে দাঁড়ালো। শুনতে পেল না তেমন কিছুই। খুব সাধারণ কথাবার্তা চলছে। গুটি প্রায় পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে বিছানায় চলে এলো। আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। এক পায়ের ভরে কতক্ষণ আর দাঁড়ানো যায়? কিন্তু বিছানায় ফিরে আসার কয়েক মিনিটের মধ্যে হইচই শুনে চমকে উঠলো গুটি। প্রায় দশ বারোজনের কন্ঠে শোনা যাচ্ছে হুমকি আর গালিগালাজ। তার মধ্যে সরণের কণ্ঠ নেই। সরণ কোথায়? মারামারি বাঁধলো কি? খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বাইরে যেতে গিয়ে থেমে দাঁড়ালো। সরণের শেষ কথা মনে পড়লো। গেল না বাইরে। ফিরে এসে বিছানায় বসেও শান্তি পেল না। অধৈর্য হয়ে দরজার বাইরে গিয়ে উঁকি দিল ড্রয়িংরুমে। অবাকের মাত্রা ছাড়ালো গুটির। ভেবেছিল দশ বারো জন হবে, কিন্তু ড্রয়িংরুমে তো প্রায় ত্রিশ চল্লিশজন ছেলেদের গরম আবহাওয়া চলমান। এক চিলতে ফাঁকা নেই কোথাও। সরণকে দেখতে পেল চুপচাপ পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু চোখেমুখ শক্ত। কিছুক্ষণের মধ্যে খালি হতে শুরু করলো ড্রয়িংরুম। একে একে সবাই চলে গেলে সরণের সঙ্গে রইলো মানিক এবং আরও একটি ছেলে। যাকে গুটি চেনে না। সরণ মানিককে ধীর আওয়াজে কিছু একটা বলে গুটির রুমের দিকে আসতে লাগলে গুটি তড়িঘড়ি রুমের ভেতরে যেতে গিয়ে পুনরায় সকালের সেই ঘটনা ঘটালো। দুম করে আছাড় পড়া যাকে বলে। শরীরের সমস্ত ভর ক্ষতবিহীন পায়ে নিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে হুট করে দু’পায়ে ভর দিয়ে ছুটতে গেলে ধপাস করে পড়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। এরমধ্যেই সরণ সামনে এসে দাঁড়ালে গুটি মনে মনে কপাল চাপড়ালো। সরণ গুটির হাত ধরে সাহায্য করলো উঠতে। গুটি কোন হুমকি ধামকি দিল না। হাতও ছাড়ালও না। পরিস্থিতির গম্ভীরতাকে বাড়াতে চায় না সে। গুটিকে দাঁড় করিয়ে বিছানায় গিয়ে আগে আগে বসলো সরণ। গুটি পাশে গিয়ে দুরত্ব বজায় রেখে বসলে দু’হাতে দু’চোখ চেপে ধরা অবস্থায় গুটিকে বলল,
“বাইরে যেতে মানা করেছিলাম।”
“আমাকে কেউ দেখেনি।”
“কিছু জিজ্ঞেস করতে চাও?”
“উহুম।”
“কিচ্ছু না?”
“আপনি ছাত্রদলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। কোন একটা উচ্চ পদে আছেন জানি। এইসব বুঝি কম, গুছাইয়া কইতে পারমু না। কিন্তু এটুকু বুঝি, রাজনীতি মানেই এইসব।”
“কোনসব?”
“যেইসব হইলো মাত্র।”
“কিসব হলো মাত্র?”
“আপনি না কলেজ যাইবেন, যান। মাথা খাইয়েন না।”
“যে কাজে যেতাম তাতো হলোই। এখন আর না গেলেও চলবে।”
গুটির খুব প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে। কি হলো, কি হতে যাচ্ছে, কোন বিপদ হবে নাতো? ছেলেগুলো কারা? কতকিছু বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু মন সায় দিচ্ছে না। ছুতো গাঁথছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আর অভিমান তো গায় গায়। সব ভাবনা ঝেড়ে বলল,
“আপনি আমারে তুমি তুমি করতাছেন।”
সরণ মেঝের দিকে তাকিয়ে ছিল। গুটির কথার প্রত্যুত্তরে শুধু হাসলো কিঞ্চিৎ। গুটি তা মনোযোগ দিয়ে দেখল। দেখে বলল,
“সেই দশ মিনিট কি আর নিবেন না কোনদিন?”
“দিতে যখন চান, সবটুকুই দিন না।”
“কি?”
“সব। সবটুকু।”
“আমার পা একটু ঠিক হইলে আমি চইলা যামু।”
পাল্টে গেল সরণের মুখভঙ্গি। কাঠ কাঠ কন্ঠে বলল,
“ঘর তো ছেড়েছিলেন আমার কাছে আসবেন বলেই। তাহলে কেন এমন করছেন?”
গুটি চমকালো। দৃষ্টি লুকালো এদিক থেকে সেদিক। সরণ খানিক এগিয়ে এসে গুটির মুখোমুখি হয়ে বলল,
“ওইদিন রাতে বাড়ি থেকে বের হওয়ার আগে আমাকে ফোনে না পেয়ে দারোয়ান চাচাকে ফোন করেননি? খোঁজেননি আমাকে? বলেননি আপনি আসছেন আমার কাছে?”
গুটি জবাব না দিয়ে সরে বসলে সরণ আরও কাছে গিয়ে বলতে লাগল,
“আমার হাতে সময় খুব কম গুটি। টক টু মি।”
“সময় কম মানে?”
“আমি আমার একান্ত কাছের মানুষ ছাড়া পার্সোনাল কিছু শেয়ার করি না। পার্সোনাল বিষয় জানতে হলে পার্সোনাল মানুষ হতে হবে। হবেন?”
“আমার কাছে মিথ্যা বলা আর সত্য লুকানো এক। আপনি দিনের পর দিন আমার সাথে কথা কইছেন অথচ কন নাই আপনি বীরেন তালুকদারের….”
“ষুউউউ… সে আমার কেউ নয়। তার নামের সঙ্গে বাবা শব্দটা জুড়বেন না।”
সরণ ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে কথাটা বলতেই গুটি চুপ করে গেল। সরণ পুনরায় বলল,
“আগে কি করেছি কেন করেছি সেসবের কৈফিয়ত আমি শুধুমাত্র আমার বউকে দিতে চাই। বিয়ে করবেন আমাকে?”
গুটির বুক কাঁপছে উত্তেজনায়। এক হাতে কোনমতে মুখ চেপে আড়াল করতে চাইলে সরণ হাত টেনে সরিয়ে দিল। গুটির এবার লজ্জা লাগতে লাগলো ভীষণ। সরণ ধীর কন্ঠে আবারও বলল,
“বিয়ে করবেন আমায়?”
গুটি কিজানি ভেবে বলে উঠলো,
“যদি না করি?”
“তবে আপনাকে সেইফলি অন্য কোথাও শিফট করবো। দেন লাইফ যেমন চলছে চলবে। আর যদি জবাবটা হ্যাঁ হয়, তবে আজকে এই শহরে আমার আর আপনার শেষ রাত।”
গুটির দৃষ্টিতে এবার ভয়। বিপদের আশংকা আর অজানা ভয়ে বলে উঠলো,
“কোন সমস্যা?”
“একটু আগে কি বললাম? আমি আমার কাছের মানুষ ছাড়া পার্সোনাল কথা শেয়ার করি না। পার্সোনাল বিষয় জানতে হলে পার্সোনাল মানুষ হতে হবে।”
“যার ভরসায় ঘর ছাইড়া আইছি আর যার ঘরে আছি, মানুষ দুইজন এক। কিন্তু আমার বিশ্বাস তো ভাগ হইয়া গেছে। আপনি অস্বীকার করলেই আপনার পরিচয় মুইছা যায় না৷ পুরা গ্রামের মানুষ জানে বীরেন তালুকদার একমাত্র পোলা সরণ তালুকদার বিশাল এক নেতা। সেই পাওয়ারে পাওয়ারফুল বীরেন তালুকদার মেম্বার হইছে। আমি বীরেন তালুকদারের ছেলের বউয়ের পরিচয় কোনদিন মানতে পারুম না।”
“যে মানুষটি আর বেঁচে নেই, তার পরিচয় মুল্যহীন।”
চমকে উঠলো গুটি। উত্তেজিত কন্ঠে বলল,
“বাঁইচা নাই মানে? আপনি না বলছিলেন মরে নাই।”
“যখন বলেছিলাম তখন বেঁচে ছিল। এখন আর নেই।”
গুটির মিশ্র অনুভূতির তিক্ততায় বুক ভারী হয়ে এলো। নিজেকে খুনী বলে আপনমনে ডেকে উঠলো দু’বার।
“আমার হাতে সময় খুব কম গুটি। আর এদিক সেদিক করে কথা আগাতে চাচ্ছি না। সোজাসাপটা জবাব দিন। আমাকে বিয়ে করবেন?”
“আমি…আমার…”
“সুন্দর একটা সকাল চাই না আপনার? ভীতিহীন বিকেল, চিন্তামুক্ত রাত? আমি সব এনে দেবো। সকালের রোদ আর রোদের প্রখরতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আমি আপনার সব স্বপ্ন পূরণ করবো। শুধু একবার হ্যাঁ বলুন।”

(চলবে)

শূন্যলতা পর্ব-০৫

0

#শূন্যলতা
#গুঞ্জন_চৈতি
পর্ব-৫

“সুন্দর কন্ঠ শুনে মানুষ বাপের নাম ভুলে যায়, জানা ছিল না। যাইহোক, মনে পড়লে জানাবেন, ওকে? এটুকু বলে কল কেটেছিলেন তিনি। কিছুক্ষণ রাগে গজগজ করে আমি কল করলে তিনবারের বেলায় রিসিভ করে কি বলেছিলেন জানেন? বলেছিলেন, বাপের নাম মনে পড়েছে তাহলে? তাও আবার এতো জলদিই। শার্প ব্রেইন আপনার। কিন্তু মাফ করবেন, আপনার বাপের নাম দিয়ে আমার কাজ নেই। আমার যাকে প্রয়োজন সে আপনি নন তা বুঝেছি। রঙ নাম্বারে কল যাওয়ার জন্য সরি। আর হ্যাঁ, ফ্রীতে মেয়ে মানুষের নাম্বার পেয়েছেন বলে ঠুসঠাস কল করবেন না। ইভটিজিং আর ব্ল্যাকমেইল এর মামলা ঠুকে দেব। রাখছি। খবরদার যদি একটা কল আসে!”
“চুপ করেন! চুপ! অসহ্য লাগতাছে আমার। আমার চারপাশের প্রত্যেকটা মানুষ ধোঁকাবাজ। প্রত্যেকটা মানুষ। প্রথমে বীরেন মেম্বার, তারপর বাবা, তারপর যুথি আর তারপর আপনি। আমার শেষ ভরসা কিনা আপনি আছিলেন! ভাবতেও গা গুলাইতেছে আমার। চুপ চুপ চুপ!”
দু’হাতে মাথা চেপে ধরে চিৎকার করে উঠলো গুটি। সব বিষের মতো লাগছে। এখন মনে হচ্ছে জলে ডুবে মরে কেন গেল না? এর থেকে তো মরণ ভাল ছিল।
“পরিচয় দিইনি বলে আমি ধোঁকাবাজ নই গুটি। আর শেষ ভরসা মানে?”
“চুপ করতে কইছি না আমি? চুপ।”
“আমি কখনো কোন মিথ্যা তো বলিনি। প্রথমদিনের পর আপনি কখনো আমার পরিচয় জানতে চাননি গুটি। আমার ঠিকানাটাও আমি নিজে দিয়েছিলাম…”
“আপনের সাথে আমার আর একটা কথাও নাই। একটাও না। হয় নিজে বাইর হন হাসপাতাল থিকা, নয় আমি বাইর হইয়া যাই।”
“গুটি…”
“চুপ।”
সরণ চলে গেল গুটির সামনে থেকে। গুটি কাঁদতে কাঁদতে বেড থেকে নেমে দাঁড়াতেই মৃদু চিৎকার করে বসে পড়লো মেঝেতে৷ দুম করে দৌড়ের ওপরে পা রাখায় আঘাত লেগেছে ক্ষতস্থানে। সাপে কাটার ক্ষতর পাশে কাঁটাযুক্ত লতার আঁচড় আর শক্ত কিছুর আঘাতও আছে। সেই আঘাতে সেলাই পড়েছে চারটে।
সরণ সাথে সাথেই ছুটে এলো ভেতরে। গুটিকে ধরতে গেলে গুটি না করলো। হুমকি দিল। শুনলো না সরণ। পাঁজা কোলে তুলে বেডে শুইয়ে দিয়ে বলল,
“নিজে থেকে পরিচয় দিই নি বলে ধোঁকাবাজ বলেছেন, এখন কোলে তুলেছি বলে মেয়েবাজ বলবেন না যেন। কিংবা চরিত্রহীন। তাহলে আমিও বলব, আমার কোলে উঠবেন বলেই অসুস্থ পা নিয়ে নামার নাম করে মেঝেতে পড়েছেন। আপনি পড়ে না থাকলে আমি কোলে নিতাম না নিশ্চয়ই?”
“জানের মায়া করেন সরণ তালুকদার। খুব খারাপ মাইয়ার পাল্লায় পড়ছেন। বাপ খুন হইতে হইতে বাঁইচা গেছে, মেম্বার তো চিতায় উঠে উঠে ভাব। চিতায় না উঠলেও ছেঁচা কিন্তু ঠিকি জায়গামতো খাইছে।”
“এই ডায়লগটা দারুণ দিয়েছেন তবে আগেরটা বেশি জোশ ছিলো। আবার বলুন না একটু। কি যেন ছিল? উমমম, বাপের যেডা ছেঁচা গেছে, আপনের হেইডা কাটা না যায়। ক্ল্যাপ ক্ল্যাপ!”
বলেই হুহু করে হেসে উঠলো সরণ। ভীষণ নাটকীয় ভঙ্গিতে শেষ বাক্যটুকু বলেছে। গুটির রাগ কেন যেন নিভে যাচ্ছে। জ্বলে উঠছে অন্যকিছু। এটাকেও হয়তো রাগই বলে, তবে অন্যরকমের। অতীতের কিছু মুহুর্ত মনে পড়তেই গা জ্বলুনি দিয়ে উঠলো দ্বিগুণ। মনে হলো যেন গায়ে কেউ আগুন দিয়েছে। দাঁত কিড়মিড়িয়ে ধীর আওয়াজে বলল,
“ঠান্ডা মাথায় কই, আমার সামনে থিকা যান।”
“যাবো। গিভ মি অনলি টেন মিনিটস। দশ মিনিট আমাকে কথা বলার সুযোগ দিলে যা বলবেন সব শুনবো।”
“কি আত্মবিশ্বাস! দশ মিনিট পট্টি পড়াইলেই আমার রাগ ধুইয়া জল হবো?”
“দশটা মিনিট দিয়ে তো দেখুন।”
“আচ্ছা দিমু। কিন্তু কবে আর কহন তা আমার সিদ্ধান্ত। এহন সরেন আমার চেখের সামনে থিকা।”

সরণ চলে গেল বাইরে। দিনটা পার হলো। পার হলো রাতও। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত দশ মিনিট আর পেল না সরণ। জোরপূর্বক কিছু বলতে গেলে গুটি অস্বাভাবিক বেপরোয়া হয়ে উঠে বিধায় সরণ পারছে না গুটিকে মানাতে। পরেরদিনটার সারাদিন পার করলো গুটি হাসপাতালে বসে। যেখানে ভোরে ঢাকা যাওয়ার কথা সেখানে সন্ধ্যা অব্দি সরণ কথা বলারই সুযোগ পেল না। রাতে দুঃসাহস দেখিয়ে সরণ একটি কান্ড করে বসলো। একজন নার্সকে হাত করে কড়া ডোজের ঘুমের ইনজেকশন দেওয়ালো গুটিকে। অতঃপর ঘুমের মধ্যে গুটি পৌঁছে গেল ঢাকায়। রাতটা গুটির পার হলো সরণের কোলে মাথা রেখে গাড়ির মৃদু ঝাঁকুনিতে। গুটি তা জানতেও পারলো না বুঝতেও পারলো না। সকালে যখন চোখ খুললো, চারদিকে তখন হাসপাতালের রংচটা দেয়ালের পরিবর্তে রঙিন দেয়াল আর দেয়াল জুড়ে দু’জনের স্থিরচিত্র দেখতে পেল। একটা ছোট বাচ্চাকে নিয়ে নাজেহাল মায়ের নানান মুহুর্তের স্মৃতি। চারদিকে তাকিয়ে যখন টের পেল সে আর হাসপাতালে নেই, ঘুমের রেষ তখন বহুদূরে। রাগে কাঁপতে লাগল গুটি। হুড়মুড়িয়ে বিছানা থেকে নামতে গেলে গতকালের ঘটনা পুনরাবৃত্তি ঘটলো। পরে গেল মেঝেতে। সেলাইয়ের জায়গাটায় যেন মোচড় দিয়ে কামড়ে ধরেছে। ধপাস করে ওঠা শব্দ শুনে ওমনি ছুটে এলো সরণ। চোখমুখ দেখে বোঝাই যাচ্ছে সদ্য ঘুম ভাঙা আতংকিত আদল। গুটিকে পা ধরে ঠোঁট কামড়ে ধরে বসে থাকতে দেখে সামনে এসে দাঁড়িয়ে কপাল চেপে ধরে বিড়বিড়িয়ে বলল,
“আবার কোলে নেব? কাল কাটার হুমকি দিয়েছে, আজ না কেটেই দেয়!”
গুটি স্পষ্ট শুনলো কথাখানা। রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দিলো না। নিরুত্তেজ থেকে নিজে নিজেই বিছানা ধরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো। সরণ ধরতে এলে ভাল পায়ের হাঁটু গেঁড়ে দিল সরণের দু’পায়ের মাঝখানে। সরণ “আউউউউ” বলে চিল্লিয়ে উঠলো দু-হাত চেপে ধরে। গুটি হিসহিসিয়ে বলল,
“মাফ করবেন, কাঁচি, বটি, রাম দা কিচ্ছু সাথে নাই। থাকলে ছেঁচা দিতাম না। পরেরবার অবশ্যই লগে বটি, কাঁচি কিছু একটা রাখার চেষ্টা করমু।”
সরণ খুব কষ্টের মাঝেও গাল ফুলিয়ে হেসে উঠলো। বিছানায় এসে বসলো আরও দ্বিগুণ কষ্টে। গুটির রণমুর্তি তার এই হাল করবে জানলে একশো গজ দূরে থেকে আজকের দিন পার করতো। ধারণা ছিল গুটি মুখে চেঁচামেচি না করে রাগ দেখাবে অন্যভাবে, কেন যে সাবধান হলো না! মান সম্মান পানি পানি হয়ে গেল।
গুটি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আপনের সাহস দেখলাম, এহন ধৈর্য দেখমু।”
“যা দেখতে চান সব দেখাবো, সব। শুধু আমার ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়াবেন না।”
গুটি ভয়ংকরভাবে তাকালো সরণের দিকে। সরণ মুখ লুকিয়ে বলল,
“না বলে ঢাকা আনার জন্য সরি।”
গুটি চারদিকে চেয়ে বলল,
“ওইটা কি বাথরুম?”
“হুম, আমি নিয়ে যাই?”
“সুস্থ আছেন? আরেকবার ছুইতে আইলে আর থাকপেন না। দূরে থাকেন আমার থিকা।”
গুটি দেয়াল ধরে ধরে এক পায়ে ভর দিয়ে বাথরুমে চলে গেলে সরণ শুয়ে পড়লো বিছানায়। শুয়েই হেসে দিলো। আগে যখন কথা বলতো, তখন টের পেতো মেয়েটার তেজ। মনে মনে ডাকতোও তেজস্বিনী বলে। কিজানি আর কি কি হবে সামনে।

গুটি মিনিট পাঁচেক পর বাথরুম থেকে বেরিয়ে বিছানায় এসে বসলো। সরণ সোজা হয়ে বসলে গুটি কঠোর গলায় বলল,
“দশ মিনিট সময় দিলাম। কন কি কইবেন।”
সরণ থতমত খেলো। আমতা আমতা করে বলল,
“এভাবে হুট করে।”
“তাইলে পুরোহিত ডাইকা আনেন। পঞ্জিকা দেইহা সময় দিই।”
সরণ দুষ্টু হেসে বলল,
“সে ঠিক সময় আনা হবে। এখন আগে ব্রেকফাস্ট করুন, ওষুধ আছে আপনার। তারপর ঠান্ডা মাথায় কথা বলবো।”

খাওয়া দাওয়া শেষ করে সরণ গুটিকে ওষুধ দিতে গেলে গুটি প্রেসক্রিপশন চেয়ে নিজে ওষুধ খেয়ে নিল। তারপর বলল,
“এহন কন কি কইবেন।”
সরণ এবার বলল,
“তিনদিন ভার্সিটি যাইনি, ওদিকে একটু ঝামেলা হয়েছে। আমাকে এক্ষুনি একটু বেরোতে হবে।”
“আমি এতো বড় বাসায় একলা থাকতে পারমু না।”
“মিস করবেন আমাকে?”
গুটি বড় বড় চোখ করে তাকালে সরণ কথা ঘুরিয়ে বলল,
“ঘন্টা দুয়েক লাগবে। একটু এডজাস্ট করে নিন প্লিজ। আমি ল্যাপটপে মুভি দিয়ে যাচ্ছি, সময় কেটে যাবে। আর আসার সময় আপনার জন্য ফোন কিনে আনবো। আপাতত আমারটা রাখুন।”

গুটির পাশে ফোন রেখে পুনরায় বলল,
“ডায়েলে মানিকের নম্বর আছে, কোন প্রয়োজন হলে ফোন করবেন। ও আমার সাথেই থাকবে।”

গুটি কি বলবে ভেবে পেল না। সরণ যেতে যেতে দরজায় দাঁড়িয়ে বলল,
“প্রয়োজন ছাড়াও কল করতে পারেন। আমি কিছু মনে করবো না।”
গুটির চিবুক শক্ত হতে হতে সরণ কেটে পড়লো। গুটি কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হাতে তুলে নিলো মোবাইল। কোন লক দেওয়া নেই। হয়তো ছিল, তাকে দেবে বলেই লক তুলে ফেলেছে। আঙ্গুল ঠেলে ফোনে ঢুকে সবার আগে ঢুকলো মেসেজ বক্সে। পরপর কিছু সিম কোম্পানির মেসেজের নিচে চাপা পড়া অবস্থায় পেল দু’জনে পুরোনো কথোপকথন। নম্বর সেভ দেখাচ্ছে তেজস্বিনী নামে। নামটা একটু থামালো তাকে। কিছুক্ষণ থমকে থেকে ভেতরে ঢুকলো। তার তরফের মেসেজ খুব অল্প এবং ছোট ছোট। সরণের পাঠানো মেসেজগুলো ইয়া বড় বড়। একটা মেসেজে চোখ আঁটকে গেল গুটির।

“কখনো ভেঙে পড়বেন না গুটি। ভাঙা বস্তু জোরা দিলে চিহ্ন থেকে যায়, দাগ মেটে না। মানুষের ক্ষেত্রেও তাই। একবার ভেঙে পড়ে যেই দাগ মানুষ কুড়িয়ে নেয়, সেই দাগ আজীবন বাধ্য করে বারংবার ভেঙে পড়তে। শক্ত হয়ে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণার বদলে উপহাস জোটে আজীবন। আর এই উপহাস বাইরে থেকে নয়, ভেতর থেকে আসে। কোনদিন মেটে না ব্যার্থতার চিহ্ন। ভেঙে পড়েছেন তো মরেছেন। ভুলেও ভেঙে পড়বেন না। মৃত্যুর আগ অব্দি নিজেকে সব থেকে সুখী মানুষটা ভাবুন। একটা হাত না থাকলে ভাবুন, ভাগ্যিস আরেকটা হাত আছে। কারও তো দু’টো হাতই অক্ষম। যা নেই তা নিয়ে দুঃখী না হয়ে যা আছে তা নিয়ে সুখী হোন। অতীতের একটা অপ্রাপ্তি নিয়ে হতাশ না হয়ে দশটা প্রাপ্তি নিয়ে খুশি হোন। আমি হলফ করে বলতে পারি, মানুষ অতীত হাতড়ে দশদিনের দশটি ঘটনা কিংবা প্রাপ্তি খুঁজলে, তার একটা হবে আফসোসের আর নয়টাই হবে সুখানুভূতির। নিরপেক্ষ মনে খুঁজে তো দেখুন।”

(চলবে)

শূন্যলতা পর্ব-০৪

0

#শূন্যলতা
#গুঞ্জন_চৈতি
পর্ব-৪

“আপনি এতো রাতে বিলের মধ্যে কি করছিলেন?”
গুটি ধীর গলায় বলল,
“বাড়ি থেকে পালাচ্ছিলাম।”
এই পর্যায়ে মুখটা ছোট হয়ে গেল সরণের। বিস্মিত চাহনি দিয়ে আশাহত কন্ঠ বলল,
“কার সাথে? কাউকে ভালোবাসেন?”
“বাসি তো। নিজেকে ভালোবাসি। তাই নিজের সাথে পালাচ্ছিলাম।”
এপর্যায়ে স্বল্প হাসি ঠাঁই পেল গুটির ঠোঁটে। কিন্তু সে হাসি জুড়ে তাচ্ছিল্য টের পেল সরণ। তবে সরণের ঠোঁটের হাসি দেখা গেল স্বচ্ছ জলের ন্যায় টলটলে।
“ওই জানোয়ারটা বেঁচে আছে না মরেছে? একটু খবর এনে দিতে পারবেন?”
সরণ বলল,
“আকাঙ্ক্ষিত নিউজ কোনটা? বেঁচে থাকলে খুশি না মরে গেলে?”
“বেঁচে থাকুক। শত বৎসর বেঁচে থাকুক। কোনদিন বলতে তো পারবে না একটা মেয়ে এমন হাল করেছে ওর। বিয়ে বিয়ে করে মরেছে এতোদিন, বিয়ের যোগ্য আর রইলো কই? আমি ওর অক্ষম জীবনযাপন দেখতে চাই। কম মেয়ের জীবন নষ্ট করেনি জানোয়ারটা।”
“কুল, হাইপার হবেন না।”
“আমি ঠিক আছি।”
“আচ্ছা, আপনি পালিয়ে যাচ্ছিলেন কোথায়?”
“জানি না।”
“হোয়াট? এতো রাতে একলা এক কাপড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন কোন গন্তব্য ছাড়াই?”
“আপনি না চিনে না জেনে আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। সেই কৃতজ্ঞতায় যা জানতে চেয়েছেন, বলেছি। কিন্তু এই প্রশ্নের জবাবটা দিতে পারছি না, দুঃখিত।”
সরণ বড় কিছুর আঁচ পেল। কি যেন ভেবে জানা সত্বেও প্রশ্ন করলো,
“আপনার পরিবারে আছে কে কে?”
গুটি সময় নিয়ে ভীষণ ধীরে আওয়াজে বলল,
“বাবা… আর আমি।”
“কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে?”
“হচ্ছে একটু…”
“রেস্ট নিন তাহলে। আমি বাইরে যাচ্ছি।”
সরণ উঠে চলে যেতে লাগলে পিছু ডাকলো গুটি। মৃদুস্বরে বলল,
“আপনার ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করতে পারি?”
সরণ এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
“কি জানতে চান?”
“কে আপনি? আমাদের গ্রামে তো কখনো দেখিনি আপনাকে। ঘটনাস্থলে খুব জলদি এসে পৌঁছেছিলেন, মানে কাছাকাছি কোথাও ছিলেন।”
“আমি একজন মানুষ। আপনার গ্রামে থাকি না, তাই দেখেননি আগে কখনো। ঢাকা থেকে গতকাল গ্রামে এসেছিলাম একজনের খোঁজে। গ্রামে ঢোকার পথে লাক বাই চান্স দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয়ে যাই।”
“মানুষ! মানুষটার নাম?”
“শুনে চমকাবেন না তো?”
“মানে?”
“মামুষটার নাম, সরণ।”
গুটির মুখভঙ্গি পরিবর্তন হলো। কপাল জুড়ে চিন্তার ভাজ সন্তর্পণে আড়াল করে বলল,
“সরণ কি? তালুকদার?”
“ইয়েস। সরণ তালুকদার।”
গুটির বিস্ময় বেড়ে আকাশচুম্বী। বুকটা হটাৎ-ই ভারী হয়ে উঠলো। নিছক কাকতালীয় ঘটনা এমনও হয়? গুটি ঘামতে লাগল হটাৎ করে। আমতা আমতা করে বলে উঠলো,
“আপনার বাবা…”
“ষুহ….”
ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে বাঁধ সাধলো সরণ। বলল,
“ভুলটা দ্বিতীয়বার করবেন না। উনি আমার বাবা না।”
গুটির ভয় কমলো না। উল্টো বাড়লো। সরণের শেষ কথা ভয়ংকর রকমের উপহাস মনে হলো তার কাছে। আতংকে বুক কাঁপছে। কিছুক্ষণের পিনপতন নীরবতা অন্ত করে সরণ বলল,
“কাল আমার সঙ্গে ঢাকা যাচ্ছেন আপনি। যাওয়ার আগে বাবার সাথে দেখা করতে চাইলে বলবেন।”
“না, একদম না। বাবাকে বলবেন না কিছু। আমার খোঁজ যেন কেউ কোনমতেই না পায়।”
“তিনি নিশ্চয়ই চিন্তায় আছেন।”
“তা নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আমি আপনার সাথে যাচ্ছি না। সাহায্য করেছেন, ধন্যবাদ। সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো। কিন্তু হুকুম চালানোর চেষ্টা করবেন না। আর আপনি চাইলে আমাকে পুলিশে দিতে পারেন। আমি সব সত্য পুলিশের কাছেই বলবো কিন্তু আমার দুর্বলতা জেনে গেছেন বলে ব্যাবহার করার চেষ্টা ভুলেও করবেন না। তাহলে বাবার মতোই হাল হবে। কিংবা তার থেকেও খারাপ।”
গুটি মনে মনে যতই ভয়ে সিটিয়ে পড়ুক তা প্রকাশ করলো না মোটেও। তবে তেজ দেখিয়ে কোন লাভ হলো বলে মনে হলো না। কেননা সরণ এমনভাবে চেয়ে হাসছে যেন খুব মজার কথা বলেছে সে। সরণ মিটিমিটি হেসে বলল
“হুকুম করলাম কখন? আমি…”
গুটি কথা শেষ করার সুযোগ না দিয়ে চট করে বলল,
“আপনি যে কাজে গ্রামে এসেছিলেন সেই কাজ করুন। হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আমি আমার মতো থাকতে চাই। আর যদি ব্ল্যাকমেইল করার হয় সরাসরি করুণ ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে নয়।”
সরণের বলা হলো না, আমি আপনার খোঁজেই এসেছিলাম গুটি। তবে এটুকু বলল,
“ব্ল্যাকমেইল করবো? মানে করতে বলছেন?”
গুটি খানিক চিৎকার করে উঠলো। বলল,
“ফাইজলামি করবেন না এক্কারে। নিরীহ না আমি। দুর্বল ভাববেন না আমারে। বিপদে ফালানোর ধান্দা থাকলে ঝটপট আসল রূপে আহেন, আর বাপের চরিত্র নিয়া আফসোস থাকলে সাহায্য করছেন ভাইবা খুশি মনে রাস্তা ছাড়েন। কিন্তু সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করলে বাপের থিকাও খারাপ অবস্থা বানামু। বাপের যেডা ছেঁচা গেছে, আপনের হেইডা কাটা না যায়।”
সরণ শুকনো গলায় বিষম খেলো। কাশতে কাশতে দম খাটো হয়ে আসছে কিন্তু হাসি আটকাতে পারলো না। হেসে উঠলো উচ্চস্বরে। হাসপাতালের কথা মাথায় রেখে খুব কষ্টে হাসির শব্দ গিলে নিলে দরজার সামনে মানিক ছিল পাহারায়, মানিকের চাপা হাসি কানে এলো গুটির। গুটির ভয়ের মাত্রা ক্রমেই বাড়তে লাগল। দু’জনের হাসি তার কাছে বিপদের আগাম বার্তার ন্যায়। অচেনা শহুরে মানবের সঙ্গে এতোক্ষণ ভদ্রতার সহিত প্রমিত ভাষায় সুন্দর মতো কথা বললেও রাগে বেরিয়ে এসেছে আঞ্চলিক ভাষা। ঢাকা কেন নিতে চায় তাকে? ঢাকা নিয়ে বেচে দেবে? না ব্যাবহার করবে? উদ্দেশ্য কি? নানান ভাবনায় মাথা ভনভনিয়ে উঠলো। এদিকে সরণের হাসির শব্দ কমলেও হাসি কমেনি। শব্দহীন হেসে যাচ্ছে অনবরত। মুখভঙ্গি এমন, যেন কিছুটা লজ্জাও পেয়েছে। সরণ হাসতে হাসতেই বলল,
“আমি বাপু ভীতু মানুষ, এভাবে ভয় দেখালে হার্ট অ্যাটাক করতে পারি কিন্তু।”
গুটির এবার ভয়ের থেকেও রাগ বাড়তে লাগল বেশি। সরণের হাসি যেন বড়ই কাটা হয়ে গায়ে বিঁধছে। সরণ তা বুঝতে পেরে চুপচাপ গুটির পায়ের কাছে বসলো। আরাম করে পা ভাজ করে মুখোমুখি বসে গুটিকে বলল,
“একটা গল্প শোনাই?”
গুটি হ্যা না কিচ্ছু বলল না। সরণ বলতে লাগল,
“হটাৎ একদিন, আননোন নম্বর থেকে একটা কল আসে। রিসিভ করে কানে তুলতেই তেজি কন্ঠ শুনতে পাই; বীরেন তালুকদারের ছেলে সরণ তালুকদার বলছেন? ব্যাস, গেল মাথা গরম হয়ে। যার পরিচয় আমি নিজে দিই না তার ছেলের পরিচয়ে কল! দিলাম মুখের উপর কল কেটে। ওপাশের তেজস্বিনী এতোই রেগে গেলেন যে আবারও কল দিলেন। আমি রিসিভ করলাম না। তবে কল আসা বন্ধ হলো না। কল আবারও আসলো। তিনবারের বেলা আবার রিসিভ করলাম। ওপাশের পরিবেশ তখন খুবই উত্তপ্ত। তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দিলেন একটা ধমক দিয়ে। বললেন, রঙ নম্বর হলে বলুন তারপর কল কাটুন। আর বীরেন তালুকদারের ছেলে হলে বলুন হ্যাঁ আমি বীরেন তালুকদারের ছেলে। দ্বিতীয় দফা মাথা গরম হলো। তরতর করে বাড়তে লাগল রাগ। আমি কিনা বলব আমি বীরেন তালুকদারের ছেলে? তার রাগের আগুনে ঘি ঢেলে প্রত্যুত্তর ছাড়াই আবার কাটলাম কল। একদম মুখের উপর চটাস করে। আমার ফোনে ফের কল এলো তৎক্ষনাৎ। এক বার দু’বার রিং হয়ে কেটে যাওয়ার পর তিনবারের বেলা রিসিভ করলাম। টের পেলাম কি ভয়ানক রেগে আছেন তিনি। রাগে ফোঁস ফোঁস করছেন। বুঝে গিয়েছিলাম মুখের উপর কল কাটা তার ভীষণ গায়ে লাগে। তাই কথা বলার সুযোগ দিলাম আবারও কল কাটবো বলে। যাকে বলে নিরব প্রতিশোধ। মনে মনে ঠিক করলাম এবার কল কেটেই ব্লকলিস্টে জায়গা দেবো। কত বড় সাহস! বীরেন তালুকদার এর ছেলে বলে পরিচয় দেয়। এসব ভেবে আমি কল কাটার অপেক্ষায় যখন, তখন ওপাশ থেকে এমন কথা কানে এলো যে আমি শক খেয়ে গেলাম। রাগ দেখানোর আগেই তিনি কল দিলেন কেটে। নিরব প্রতিশোধ। এবার আমি কল করলাম, একবার, দু’বার তারপর তিনবারের বেলা রিসিভ করতেই দ্বিতীয় শক, দ্বিতীয় ছক্কা। কি তেজ! যেন এক টুকরো লাভা। টগবগিয়ে ফুটছে আমায় পুড়িয়ে দেবে বলে।”

এটুকু বলে থামলো সরণ। গুটি বিস্ফোরিত নজরে চেয়ে আছে। সমস্ত হিসেব তার লন্ডভন্ড। মিলছে না বিন্দুমাত্র।

(চলবে)

শূন্যলতা পর্ব-০৩

0

#শূন্যলতা
#গুঞ্জন_চৈতি
পর্ব-৩

“ভাই যে লোকেশন বলছেন সেই লোকেশন থেকে একটু দূরে একটা মাইয়া পাইছি। পাড়ে অজ্ঞান অবস্থায় পইরা ছিল। এলাকার পোলা সিফাত ছিল লগে, ওয় বলতাছে মাইয়ারে ও চিনে। নাম নাকি গুটি।”

সরণ চমকে উঠলো তৎক্ষনাৎ। গুটি? গুটি ছিল ওটা? সরণ তড়িঘড়ি ছেলেটাকে বলল,
“চেক হার লেগ, ইমিডিয়েটলি। পা কি ফুলে আছে?”
“ভাই, মাইয়া মানুষ। পড়নে সেলোয়ার। কোতায় দেখমু আর কেমনে দেখমু কন? আপনে আহেন, বাইকে আইলে দশ মিনিটও লাগবো না। তারপর দুই মিনিটের আাটাপত(হাঁটা পথ)। আপনে আইহা চেক দেন।”
সরণ কল কেটেই রওয়ানা হলো। দশ মিনিটের পথ পাঁচ মিনিটে পার করে বাইক রেখে দৌড়াতে লাগল উঁচু মাটির পথ বেয়ে। নদীর পাড়ে পৌঁছে এক মুহুর্ত ব্যয় করলো না। সবাইকে কিছুটা দূরে দাঁড়াতে বলে গুটির সেলোয়ার হাঁটুর কিছুটা নিচ অব্দি গুটিয়ে পর্যবেক্ষণ করলো পায়ের অবস্থা। পা ফুলে একাকার। সরণ বোধ করলো শরীরও কিছুটা ফুলে উঠেছে। কামড়ের দাগ বলছে সাপটা বিষাক্ত ছিল। রক্তপাতও হচ্ছে। সরণ তৎক্ষনাৎ কোলে তুলে হাঁটা দিল সামনে। ততক্ষণে মানিক এম্বুলেন্স নিয়ে হাজির। এম্বুলেন্স তাদের সঙ্গেই ছিল। এম্বুলেন্সে করেই ঢাকা থেকে গ্রামে এসেছে সে। সরণ খোঁজ লাগিয়েছিল যার দ্বারা, সে জানিয়েছে স্থানীয় হাসপাতালে সাপে কামড়ানোর চিকিৎসা মিলবে না। এখানে এভিএস এর ব্যাবস্থা নেই। জেলা শহরে যেতে হবে। তাই প্রায় এক ঘন্টার পথে রওয়ানা হলো সদর হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। সরণ ভীষণ চিন্তিত গুটিকে নিয়ে। কি থেকে কি হয়ে গেল। আর একটা রাত কোনমতে পার হয়ে গেলেই তো সব ঠিক হয়ে যেত। কিংবা হয়তো ঠিক হতো না, তবে এতোটা বিপর্যস্ত পরিস্থিতিও নিশ্চয়ই হতো না।

“আচ্ছা, যে মেয়েটার সঙ্গে তোর ফোনে কথা হতো এটাই যে সেই মেয়ে তা তুই শিওর? গুটি তো অন্যকারও নামও হতে পারে।”

ঘোর চ্যুত হলো সরণ। চিন্তার জাল চিঁড়ে বেরোতেই জড়িয়ে গেল নতুন জালে। সত্যি তো, এই মেয়ে কি সেই মেয়েই? সেই গুটি? সেই তেজস্বিনী? মানিককে বলল,

“আই ডোন্ট নো। আমি যেই গুটিকে চিনি এই মেয়ে সেই গুটি কিনা তা চেনার উপায় নেই। খোঁজ নেওয়ারও সুযোগ নেই।”
“তাহলে এতো হাইপার হচ্ছিস কেন তুই? তাও একটা অচেনা মেয়ের জন্য। সাহায্য করবি কর, বাট এভাবে নিজের জীবন বাজি রেখে…”
“আমি জলে ঝাঁপ দিয়েছিলাম আততায়ীকে ধরবো বলেই। তখন ভেবেছিলাম আততায়ী আমার চেনা কেউ। কিন্তু বীরেন তালুকদারের আক্রমণকারী হিসেবে একটা নারী অবয়বকে পেয়ে বুঝে গিয়েছিলাম ভিক্টিম আসলে বীরেন তালুকদার নয়, ভিক্টিম ওই মেয়েটা। নিশ্চিত নোংরামি করতে চাচ্ছিলো, মেয়েটা দিয়েছে মেইন পয়েন্ট ফাটিয়ে। মেয়েটাকে বাহবা দেওয়া উচিত। পাড়ের লোকগুলো মেয়েটাকে পেলে ছিঁড়ে খেতো, তাই মেয়েটাকে বাঁচাতে নদীর দিকে নিয়ে এসেছি। অন্ধকারে মুখও দেখতে পাইনি তখন। আর নাম পরিচয় জিজ্ঞেস করার মতো সিচুয়েশনেও ছিলাম না।”
“এখন কি করবি?”
“আগে মেয়েটার চিকিৎসা হোক। তারপর দেখা যাবে।”
“তোর বাবাকে দেখতে যাবি না?”
“বেঁচে আছে?”
মানিক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আছে। তবে অবস্থা ক্রিটিকেল।”
“তোর কি মনে হয়? বাঁচবে?”
“মনে হয় না।”
“তাহলে যাবো। আগে গুটি একটু সুস্থ হোক।”
মানিক আর কথা বাড়ালো না। ড্রাইভারকে তাড়া দিয়ে বসে রইলো চুপচাপ। সরণ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল গুটিকে। গোলগাল মুখজুড়ে মায়াবী প্রলেপ, উজ্জ্বল শ্যামলা বর্ণের গায়ের রঙে রোদে পোড়া কালচে আভা, নাকটা সরু, ঠোঁট জোড়া পাতলা। সারামুখে একটাও তিল নেই। তিল না পেয়ে সরণ যেন খানিক হতাশ হলো। মেয়ে মানুষের মুখে আবার তিল থাকবে না কেন? এমন হয় নাকি? গালে ঠোঁটে চার পাঁচেক তিল তো থাকা চাই। যদি তার চেনা সেই গুটি হয়, তাহলে সুস্থ হলে বলবে,
“তিল ছাড়া মেয়ে মানুষ আমার পছন্দ নয়। একদম না।”

মনে মনে কথাটা বলে দ্বিগুণ অস্থির হয়ে উঠলো সরণ। পায়ের অবস্থা ভালো নয়। খুব বাজেভাবে ফুলে উঠেছে। রক্তক্ষরণও বাড়ছে। বিষ পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ছে। বাঁচাতে পারবে তো?

এক ঘন্টার পথ পাড়ি দিয়ে সদরে নেওয়ার পর চিকিৎসা শুরু হলো গুটির। ক্ষানিক পর জানা গেল বিষ প্রায় পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়েছে। পায়ের অবস্থাও ভালো নয়। সাপে কামড়ানোর পর ক্ষতস্থান নাড়াচাড়া করতে নেই। স্থির রাখতে হয়। নয়তো রক্ত চলাচলের মাধ্যমে দ্রুত বিষ পুরো শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু গুটিকে অনবরত সাঁতার কাটতে হয়েছে পা নেড়ে। তাই দ্রুত বিষ ছড়িয়েছে, আর ফুলেছে সময়ের তুলনায় চারগুণ বেশি। অবস্থা তাই ভীষণ খারাপ।

রাতের মতো রাত বাড়তে লাগলো। গুটির অবস্থার কোন উন্নতি নেই। উল্টো অবনতি হচ্ছে। মানিক রাত একটার দিকে বাবাকে দেখতে যাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিলো সরণকে। সরণ বলল,
“আমি যে গ্রামে এসেছি তা কেউ জানে?”
“তুই যাদের জানিয়েছিস তাদের বাইরে কেউ জানে না।”
“আমাকে ঝাঁপ দিতে কেউ দেখেছে?”
“না। তুই তো অনেকটা দূর থেকে জলে নেমেছিলি।”
“তাহলে দেখতে যাওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। সো, দেখতে যাওয়া ক্যান্সেল। যদি বেঁচে থাকে, কাল ভাববো কি করা যায়।”
মানিক অবাক হলো না। স্বাভাবিকভাবেই মাথা নেড়ে সায় জানালো।

রাত পার হলো আপন গতিতে। সকাল বেলা ডাক্তারের কাছ থেকে খবর পেলো গুটি এখন বিপদমুক্ত। তবে শরীরের অবস্থা আগে থেকেই দুর্বল থাকায় তুলনামূলক বেশি নেতিয়ে পড়েছে মেয়েটা। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে মানিককে কিছু ফল আর খাবার আনতে পাঠিয়ে গুটির সঙ্গে দেখা করতে গেল সরণ। কয়েকটা বেড পার করে গুটির মাথার পাশে দাঁড়াতেই চোখ খুলে তাকালো গুটি। চোখ ভর্তি জল ছিল, তাকাতেই গড়িয়ে পড়লো জলটুকু। সরণ জিজ্ঞেস করলো,
“ব্যাথা করছে বেশি? কাঁদছো… কাদছেন কেন?”
গুটি উঠে বসার চেষ্টা করলে সরণ বাঁধা দিয়ে বলল,
“পা নাড়াবেন না। রাইট নাও, ইট’স ব্যাড ফর ইউর হেলথ। আমি কি ডাক্তার ডাকবো? বেশি খারাপ লাগছে?”
“উহুম। আমি ঠিক আছি। আমি আপনার সাথে একটু আলাদা কথা বলতে চাই। সুযোগ হবে?”
“এখানে সম্ভব নয়?”
“না।”
আধঘন্টার মধ্যে ভেতরের দিকে শিফট করা হলো গুটিকে। মোটে ছয়টা বেড ভেতরেট রুমে, ছয়টাই খালি। ভেতরটা টাইলস বসানো নয় আর রঙচটা বলে বাইরেটা রোগী দিয়ে পরিপূর্ণ না হলে এখানে রোগী রাখা হয় না। লোক দিয়ে যথাযথ দায়িত্বের সাথে পরিষ্কার করিয়ে তারপর গুটিকে আনা হয়েছে।

“ফিলিং কমফোর্টেবল নাও?”
গুটি জবাব না দিয়ে দুর্বল কন্ঠে সরাসরি প্রশ্ন ছুড়লো,
“আপনি আমাকে বাঁচালেন কেন?”
সরণ ভ্রু কুঁচকে বলল
“বাঁচিয়ে ভুল করেছি বলছেন?”
“আমি কৃতজ্ঞ আপনার কাছে। ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট করবো না। কিন্তু যেখানে পুরো গ্রাম আমাকে খুঁজছিল মেম্বারের আততায়ী রূপে, আপনি সেখানে আমাকে পেয়েই নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিলেন আততায়ী আমিই। তাহলে গ্রামের মানুষদের হাতে আমাকে তুলে দিয়ে বাহবা না কুড়িয়ে এতো ঝুঁকি নিয়ে বাঁচালেন কেন? আমরা একে অপরকে চিনিও না। অন্ধকারে নিশ্চয়ই আমার মুখটাও দেখতে পাননি। হয়তো শুধু টের পেয়েছিলেন আততায়ী একটা মেয়ে, কোন পুরুষ নয়…”
“এতো ডিটেইলস বলতে হবে না। প্রশ্ন বুঝতে পেরেছি। জবাব দেওয়ার মতে স্পেশাল তেমন কিছু নেই। ইচ্ছে করেছে, বাঁচিয়েছি। ব্যাস।”
“কোন প্রশ্ন নেই?”
“বীরেন মেম্বারের ভবিষ্যৎ ছেঁচে অন্ধকার করা নিয়ে কোন প্রশ্ন নেই। তবে আপনাকে নিয়ে আছে।”
লজ্জা পেল গুটি। মাথা নত করে বলল,
“কি প্রশ্ন?”
“নাম কি আপনার?”
অদ্ভুত চোখে তাকালো গুটি। আশংকা করেছিল না জানি কোন গোপন প্রশ্ন করে বসবে। বিস্ময় আড়াল করে নাম বলল,
“গুটি।”
নাম শুনে আশ্বস্ত হলো সরণ। দ্বিগুণ আশা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“শুনেছিলাম, মেম্বার নাকি বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিল? জোরজবরদস্তি করছিল দু’মাস হলো?”
সরণ প্রশ্নটা করে মুখিয়ে রইলো জবাবের আশায়। গুটি মাথা নেড়ে সায় জানাতেই চোখ জোড়া জ্বলজ্বল করে উঠলো। এই গুটি তবে সেই গুটিই। কোন ভুল হয়নি তাহলে। তড়িঘড়ি জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি এতো রাতে বিলের মধ্যে কি করছিলেন?”
গুটি ধীর গলায় বলল,
“বাড়ি থেকে পালাচ্ছিলাম।”
এই পর্যায়ে মুখটা ছোট হয়ে গেল সরণের। বিস্মিত চাহনি দিয়ে আশাহত কন্ঠ বলল,
“কার সাথে? কাউকে ভালোবাসেন?”

(চলবে)