জীবনে কত ধরণেরই স্মৃতি থাকে। কিন্তু কারো মৃত স্মৃতি করবীর ভাণ্ডারে নেই। ছোটোবেলা থেকে একা একা থাকার ফলে কখনো, কোনো কাছের মানুষকে মৃত অবস্থায় সে দেখেনি। তাই কোনো আপন মানুষের মৃতদেহ ঠিক কতটুকু যন্ত্রণা দেয়, তা সম্পর্কে তার ধারণা নেই বললেই চলে। এবং সেই ধারণা না থাকায় সে এলাকার ভীড়ের ভেতর আবছা ভাবে লাশ বাহী খাটটা দেখেই বড়ো দমবন্ধকর অনুভূতি অনুভব করল। একবার ভাবল টিউশন করাতে চলে যাবে। সন্ধ্যার দিকে ফিরতে ফিরতে নিশ্চয় লাশটি কবর দিতে নিয়ে যাওয়া হবে। কিন্তু পরক্ষণেই যেন কি ভেবে আর গেল না। বরং ধীরে ধীরে পাশ কাটিয়ে নিজের বিল্ডিং এর দিকে পা বাড়াল। আমেনা খালা তো বললেনই, বিন্দু অপেক্ষা করছে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকার চেয়ে বিন্দুর কাছে যাওয়া বেশি ভালো মনে হলো তার।
কিন্তু করবী ভাবনা অনুযায়ী পাশ কাটিয়ে শেষমেশ আর যেতে পারল না। তার আগেই গগণ বিদারক চিৎকারের কণ্ঠটি তার ভীষণ পরিচিত মনে হলো। থেমে গেল করবীর পা। অতঃপর দ্রুত ভীড় ঠেলে ছুটে গিয়ে দাঁড়াল লাশটির সামনে। সাদা কাপড়ে মোড়ানো লাশটি দেখে পা কাঁপে করবীর। শরীরও যেন ঝাঁকিয়ে উঠে কেমন করে। মাথা ঘুরিয়ে যায় কড়া আতুরের ঘ্রাণে। করবী অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করল কেবল, “আমেনা খালা!”
করবীর যেন বিশ্বাস হতে চায় না। লাশটি তার আমেনা খালার। কই, একটু আগেই তো সে আমেনা খালার সাথে কথা বলল! আমেনা খালা তাকে কতই না আদর করলেন! ওর কী মতিভ্রম হচ্ছে? ভুল দেখছে কী? নাহলে আধাঘন্টা আগেও যে মানুষটারে চোখের সামনে দেখলো সে মানুষটা কীভাবে লাশ হবে? এটা কী আদৌ সম্ভব?
করবীর ভাবনার মাঝে কেউ একজন ছুটে এসে আকস্মিক জড়িয়ে ধরল তাকে। করবীর ভাবনা ছুটল, বি স্ফো রিত নয়ন যুগল মেলে সে বুকের মাঝে থাকা মানুষটার দিকে চাইল। বিন্দু মেয়েটা জাপটে ধরেছে তাকে। কেমন হাউমাউ করে কাঁদছে মেয়েটা! করবীর মায়া হলে। হাত রাখল বিন্দুর মাথায়। অবাকের ছায়া কণ্ঠে ধরে রেখেই উদাস কণ্ঠে শুধাল,
“খালার কী হয়েছিল? কীভাবে হলো?”
বিন্দুর কাঁদতে কাঁদতে দম বন্ধের উপক্রম হলো। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
” জানিনা আপা, জানিনা। কাইল রাইতেও তো দেখলাম সুস্থ আছে। কিন্তু আইজ সকালে ঘুম থেইকা জাগাইতে গিয়া দেহি আম্মা নড়েচড়ে না। ঠান্ডা হইয়া আছে তার শরীর। আমার আম্মা আমারে ফাঁকি দিল, আপা? আমার আম্মা আমারে একলা কইরা দিতে পারল?”
করবীর ভীষণ কান্না এলো। বাঁধ ভাঙা কান্না। যতদিন যাবত চেনে আমেনা খালাকে, মহিলা রাগী কিন্তু ভীষণ ভালোও। করবী মায়ের আদর চিনতো না, আমেনা খালা শিখেয়েছিল সে আদর। অথচ সে মানুষটা কি-না আর নেই? তাও কিছুক্ষণ আগেও যে মানুষটার সাথে তার এত কথা হলো!
বিন্দুর কান্নার দাপট বাড়ল। কাঁদতে কাঁদতে কত কথা বলল! কোন গরমে বিন্দু গ্রামের এক বাড়ি থেকে আম চুরি করেছিল বিধায় তার আম্মা তার হয়ে ঝগড়া করেছিল! কোন শীতে বিন্দুর ভীষণ জ্বর হয়েছিল বিধায় আম্মা সেই ভোরের কুয়াশায় খালি পায়ে হেঁটে মেয়ের নামে মানত করতে গিয়েছি শীত উপেক্ষা করে। শীত, গ্রীষ্ম- এর সব গল্পই বলল। গলিতে ভীড় ধীরে ধীরে কমলো। বিন্দুর আহাজারি নীরবে শুনল করবী। আটকালো না মেয়েটাকে। ছোট্টো হুতুমও কী ভীষণ কান্না! মৃত্যুর মতন ভারী শব্দটাও যেন বাচ্চা মেয়েটি উপলব্ধি করতে পারছিল।
করবী কেবল এক ধ্যানে তাকিয়ে রইল খালার ফ্যাকাশে মুখটির দিকে। সবটাই যেন মিথ্যে মনে হচ্ছে তার। চোখের সামনে কত স্নেহের দৃশ্য ভেসে উঠলো! একবার করবীর হাত পুড়ে গিয়েছিল রান্না করতে গিয়ে। এই খালাই দুনিয়ার ছুটোছুটি করেছে তাকে নিয়ে। যার জন্য খালার এক বাসার কাজও ছাড়তে হয়েছিল অতিরিক্ত বন্ধ দিয়েছে বলে।
আবার কখনো কখনো খালা শুটকি ভর্তা করে করবীকে ডেকে পাঠাতেন। করবী গেলে পাটার মাঝে ভাত মেখে করবী, বিন্দু এবং হুতুমকে মুখে তুলিয়ে খাইয়ে দিতেন। আবার আদর করে বলতেন, “পাটা মোছা ভাত যেই মজা! তুমি না আইলে বিন্দু ওগোরেও খাইওয়াইতে পারি না। তোমার তো এইডা খুব পছন্দের।”
আবার কোনোদিন যদি মাছ রান্না হতো বিন্দুদের ঘরে, করবীর জন্য একটা টুকরো হলেও রাখতো।
সব সুন্দর স্মৃতি ভেসে উঠলো চোখের উপর! ভুল করেও কোনো খারাপ স্মৃতি আশেপাশেও এলো না। মৃত্যু কত পবিত্র! সে যাকে ছুঁয়ে যায় তার সকল খারাপ কাজই মানুষ ভুলে যায়। লাশের সামনে দাঁড়িয়ে কখনো মানুষ সেই মৃত ব্যাক্তি সম্পর্কে খারাপ কথা ভাবতেও পারে না।
ধীরে ধীরে দিন গড়িয়ে রাত হলো। লাশ নেওয়ার মতন মানুষ বিন্দুদের এই শহরে নেই। সেই ভাবনায় যখনই করবীর মন ভীত হলো ঠিক তখনই হীরণ উপস্থিত। সাদা পাঞ্জাবি পরনে তার। তার সাথে আরও ছেলেপেলেও এসেছে। হীরণ আজ চোখে চোখ রাখেনি। এসেই মাথা নিচু করে এক সাইডে দাঁড়াল। তার সঙ্গের একটি ছেলে এসে করবীকে ডাকল,
“আপু, লাশটি তো নিতে হবে। রাত হচ্ছে। আমরা সব বন্দোবস্ত করে এসেছি। আপনারা অনুমতি দিলেই নিয়ে যাবো।”
করবী উত্তরের আশায় তাকাল বিন্দুর দিকে। মেয়েটা কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত প্রায়। চোখ ফুলে গেছে অনেক। কিন্তু কণ্ঠে তেজ,
“হীরণ ভাইয়ের সাহায্য লাগব না। হেয় যেন এইখান থেকে চইল্যা যায়।”
হীরণের চোখ অত্যাধিক লাল। সেই লাল আস্তরণের নিচে তুমুল অনুশোচনা গ্রাস করে আছে। করবী বুদ্ধিমতী। বিন্দুর চেয়ে তার বয়স বেশি। তার বোঝার ক্ষমতাও বেশি। হীরণের প্রতি বিন্দুর অভিমান আছে আর তার হলো রাগ আছে। অভিমানের চেয়ে রাগের তেজ বেশি। তবুও করবী এই মুহূর্তে কোনোরকম রাগারাগিতে গেল না। বরং বিন্দুকে আগলে ধরল, ভরসা দিল,
“খালার শেষ কাজটা ভালো ভাবে সম্পন্ন হোক, বিন্দু। এখন জেদ দেখাস না।”
বিন্দুর অভিমানী চোখ টলমল করে উঠল। ঠোঁট ভেঙে কেঁদে বলল,
“এই হীরণ ভাইয়ের লাইগ্যা আমার আম্মা এই কয়টা দিন অনুশোচনায় পুইড়া মরছে। প্রতিদিন খালি কইছে ‘বিন্দুরে, মা হারা মাইয়াড্যারে এমনে সবার সামনে সম্মানহানি কইরা আমি বড়ো পাপ করছি। আমার এই পাপের ক্ষমা হইবো না। মাইয়াড্যা ফুলের মতন পবিত্র কিন্তু আমার লাইগ্যা তার চরিত্র নিয়া এলাকার মানুষ কথা কওয়ার সাহস পায়ছে। আমার এই পাপ আল্লাহ্ ক্ষমা করবো না’- এসব বলে এ ক’টা দিন আম্মা কত অনুশোচনা করছে গো, আপা। আমার আম্মা এই অনুশোচনায় তো মরলো। আপা তুমি আমার আম্মাডারে মাফ কইরো।”
করবীও বিন্দুর কান্নায় সাথী হলো। ভেঙে আসা কণ্ঠে বলল,
“আমি খালারে ক্ষমা করে দিছি, বিন্দু। তুই এসব বলিস না।”
হীরণ কথা শেষ করতেই বিন্দু স্থান, কাল, পাত্র ভুলে ধপ করেই জড়িয়ে ধরল হীরণ ভাইকে। কী সে কান্না মেয়েটার! হীরণ আজ বাঁধা দিল না। বেশ খানিকক্ষণ কান্নার পর করবী বিন্দুকে টেনে নিল নিজের কাছে হীরণের ইশারায়। অতঃপর লাশ নিয়ে হীরণরা যাত্রা শুরু করল। বিন্দুর কণ্ঠ যেন ছিঁড়ে যায় এমন চিৎকার করল মেয়েটা। কাঁদল করবীও। একহাতে বিন্দু আরেক হাতে হুতুমকে জড়িয়ে রাখল সে। বিন্দুর সে কী আহাজারি!
” আম্মা, আম্মা গো, তোমারে কহনো সুখ দিতে পারি নাই। আমি তো জানি, তুমি কত কষ্ট নিয়া পৃথিবী ছাড়লা! আম্মা, আমি তোমার অক্ষম সন্তান গো। আমার জন্য গ্রাম ছাড়লা এখন ছাড়লা পৃথিবী। আমি তোমারে এমনই অশান্তি দিলাম জীবনে!”
হুতুম মেয়েটা করবীর পেট জড়িয়ে কাঁদলো। বার বার করবীকে প্রশ্ন করল, “বিন্দুর মা তো চইল্যা গেল, এহন আমার ঘুম না আইলে কে ঘুম পারাইবো? বাণীর মা, মানুষ মইরা যায় ক্যান? আল্লাহ কী জানেনা? মানুষ মইরা গেলে আমাগো কষ্ট হয়!”
করবী স্বান্তনার ভাষা পেল না। হীরণদের ভীড় কমতেই করবী খেয়াল করল দূরে দাঁড়িয়ে হাসছে আমেনা খালা। পান খাওয়া দাঁত তার! কী নিখাঁদ হাসি! দু’হাতে বিদায় নিচ্ছে। চোখ দিয়ে ইশারা করে কী যেন বলছে! করবী ফ্যালফ্যাল করে সেখানে তাকিয়ে রইল। ভার্সিটির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আমেনা খালাই তো এখানে দাঁড়িয়ে আছেন। করবী নীরবে দেখল। তার হাতেই যেন হুতুম আর বিন্দুর দায়িত্ব দিয়ে খুশি হলেন মানুষটা। করবী জানে, খালাকে কেবল সেই দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু কীভাবে? তার উত্তর নেই। কারণ আধ্যাত্মিক কিছু জিনিসের কখনো বিশ্লেষণ হয় না।
করবীর শরীর সুস্থ হয়েছে বেশ ক’দিন হলো। শরীর সুস্থ হতেই আবার ব্যস্ত হলো নিজের অভাব-অনটনের জীবনে। দারিদ্র্যের ঘরে রোজগার করা ব্যাক্তি অসুস্থ হওয়া মানেই ভাঙা প্রাচীর থেকে আরেকটু অভাব গলিয়ে পড়া। করবীদের ক্ষেত্রেও তা হলো। তার অসুস্থতায় হাতে থাকা টাকা গুলো খরচ হয়ে যাওয়ায় আজকাল আরও বেশি খারাপ দিন কাল যাচ্ছে। ঘরে আলুও নেই। বাবা-মেয়ে কোনোরকমে ভাত ফুটিয়ে দু’টো লঙ্কা মেখে খেয়ে চালিয়ে দিচ্ছে। তার উপর অসুখের সময় হীরণও বেশ কিছু টাকা খরচ করেছে। সেগুলো পরিশোধ করার একটা ভারী চিন্তা তার মাথায় বোঝার মতন ভার হয়ে লেপটে আছে।
আজকেও করবী সকাল সকাল উঠে তৈরী হয়ে নিল। নিত্য পরিহিত পোশাক গুলো ধুতে দিয়েছে। শুকোয়নি। আলমারিতে তিন সেট জামা আছে অবশ্য। কিন্তু এই বৃষ্টি কাঁদার রাস্তায় ভালো জামাগুলো তার পরতে ইচ্ছে হলো না। অনেক ভেবে চিন্তে সে গাঢ় বেগুনি রঙের বাটিক ছাপার বহু পুরোনো একটি শাড়ি বের করল। এই শাড়িটা এইচএসসিতে গোল্ডেন পাওয়ার খুশিতে বাবা তাকে উপহার দিয়ে ছিলেন। গাঢ় বেগুনি রঙটা সময়ের বিবর্তনে নিজের ঝকঝকে রূপ হারিয়েছে। কিছুটা মেটে হয়ে গিয়েছে। তবে করবীর অতি সুন্দর; ফর্সা শরীরে শাড়িটা যেন বহুগুণ সৌন্দর্য লাভ করেছে। শাড়ির সাথে মিলিয়ে ব্লাউজও পরেছে। ভারী কেশ গুচ্ছ কোমড় ছাড়িয়ে উড়ছে নিজ মনে। করবীর আজ ভীষণ সাজতে ইচ্ছে হলো। শাড়ি পরলে মনটা কেমন নিজে নিজে শৌখিন হয়ে পড়ে। তার উপর একটি চাকরির ইন্টারভিউও আছে আজ। একটু পরিপাটি হয়ে গেলে হয়তো চাকরিটা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে! যদিও এই কেনা-বেচার বাজারে, মোটা অঙ্কের ঘুষ না দিলে চাকরি হওয়ার সম্ভাবনা শূন্য পার্সেন্ট। তবুও ক্ষীণ আশা মনে তো রাখতেই হয়! আশা না থাকলে যে জীবন চলবে না।
ভীষণ সুন্দর সাজগোছ করে তৈরী হলো মেয়েটা। ঘনপল্লব বিশিষ্ট ছোটো ছোটো চোখ গুলোতে মোটা করে কাজলও দিলো। সিঁথি করল মাঝ বরাবর। সারা শরীরে অলঙ্কার বলতে কেবল নাকের ছোটো পাথরের নোসপিনটাই আছে। কপালে টিপ লাগাতেও ভুলল না।
এমনেতেই করবী সীমাহীন সৌন্দর্যের প্রতীক বলা যায়। তার উপর আজ বেগুন রঙটা যেন সেই সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিলে বহুগুণ। তৈরী হয়েই ও দেখা করতে গেল বাণীর সাথে। বাণী তখন ঝিমচ্ছিল। করবী গিয়ে খাঁচাটা নাড়তেই পাখিটা সজাগ হলো। যথারীতি বলল,
“সই, সই, সই, মনের কথা কই?”
পাখি আদৌও দোয়া করতে পারে কি-না করবীর জানা নেই। তবুও সে এই অবুঝ প্রাণীটির উপর ভরসা রাখে। তারপর ব্যস্ত হাতে খাঁচাটিকে ছোটো বারান্দার এক কিনারায় আড়াল করে রেখেই ছুটে রান্নাঘরে৷ তৈয়ব হোসেন মেয়ের অসম্ভব রূপ দেখে শঙ্কিত হন কিন্তু বুঝতে দেন না।
ভাত খেতে বসে প্লেটে মাছ দেখে চমকায় করবী। পরে জানতে পারে বিন্দু এসে মাছ দিয়ে গেছে। কৃতজ্ঞতায় চোখ ভারী হয় তার। ইশ্, এত মানুষের এত ঋণ সে কখনো মিটাতে পারবে? হয়তো পারবে না। একসময় তার টাকা হবে ঠিকই, কিন্তু ভালোবাসার ঋণ টাকা দিয়ে কখনো শোধ করা যায় না।
করবী অনাকাঙ্খিত চোখের জল গুলো বহু প্রচেষ্টায় লুকিয়ে ভাতটুকু শেষ করল। তারপর বাবাকে সালাম করেই ছুটল। তৈয়ব হোসেন মনে মনে মেয়ের জন্য অনেক দোয়া করেন। অভাব কিংবা মানুষ, সবকিছুর কালো ছায়া যেন মেয়েটার থেকে দূর হয়ে যায়।
করবী সিঁড়ি বেয়ে নামে দ্রুত। বিন্দু কিংবা আমেনা খালা কেউই এখন আর বাসায় নেই। পেটের দায়ে ভোরেই তারা ছুটে কর্মস্থানে। নাহয় সে তাদের থেকেও দোয়া নিয়ে যেতো।
হুতুম আদুরে ভঙ্গিতে উপর-নীচ মাথা নাড়ায়। যার অর্থ, হ্যাঁ। করবী টাকাটা নিতে দোনোমোনো করে। তখনই ছোটো হুতুম বিজ্ঞ স্বরে বলে,
“বিন্দুবালা কইছে, তুমি যেন হাইট্টা না যাও। হের জন্য ও তোমারে টেকাটা দিয়া গেছে। বুজছো। নিতেই কইছে তোমারে।”
করবীর চোখে ভোরে উঠে অযাচিত অশ্রুতে। মুখে লেগে থাকে বহু পুরোনো সেই কৃতজ্ঞতার হাসি। টাকাটা নিয়ে সে হুতুমের ফুলো ফুলো গালে চপাস করে একটা চুমু খায়। বাচ্চাটার অত্যাধিক কোঁকড়া সোনালি চুল গুলো গুছিয়ে দেয় আলগোছে। তারপর কিছুক্ষণ জাপটে ধরে রাখে বুকের মাঝে। এতক্ষণ তার যেই বুক ধড়ফড় ব্যাপারটা ছিল, এখন আর সেটা অনুভব করতে পারল না। নিমিষেই যেন উধাও হয়ে গেল। চাকরি না হলেও আজকের দিনটা তার আর খারাপ যাবে না। এমন স্বর্গ মুখ দেখলে কারই বা দিন খারাপ যাবে?
(২১)
ইন্টারভিউ যথেষ্ট ভালো হয়েছে তবে করবী জানে, এই চাকরিটাও তার হবে না। ইন্টারভিউ তো কেবল আনুষ্ঠানিকতা মাত্র! চাকরি এখন এমনেই হয়ে যায়। কেবল অর্থ থাকলেই হয়। চাকরির ইন্টারভিউ ছিল দশটায়। ইন্টারভিউ দিয়ে যেতে হয়েছে কলেজ। কিছুদিন পর ইনকোর্স পরীক্ষা। তারই খোঁজ নিতে এসেছে। আর কয়েকটা দিন পর মাস্টার্স ফাইনাল পরীক্ষা। এরপর কী করবে সে? দিন দিন অভাব কেবল বাড়ছেই। কোনো দিকদিগন্ত তো পাচ্ছে না! কলেজ থেকে গিয়েছে টিউশনি করাতে। দু’টো টিউশনি আছে এখন। বাকি গুলো অসুস্থতার জন্য বাদ দিয়ে দিয়েছে তাকে। বাচ্চাদের নাকি পড়াশোনোর ক্ষতি।
টিউশনি বাসা থেকে বের হয়েই করবী বড়ো রাস্তা ধরল। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। তন্মধ্যেই তার ব্যাগে থাকা আধভাঙা ফোনটা বেজে উঠল। করবী রাস্তার এক সাইডে দাঁড়িয়ে ব্যাগ থেকে ফোন করল। ফোন বের করতেই দেখল তিমিরের নাম্বার। যা অজান্তেই করবীর ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে দিল। লোকটা এখন রোজ নিয়ম করে কল দেয়। খোঁজ নেয়। যা না চাইতেও করবীকে প্রশান্তি দেয়। স্বস্তি দেয়। যেমন আজ দিল।
করবী বেশি অপেক্ষা না করেই ফোনটা রিসিভ করল। রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে তিমিরের স্বচ্ছ কণ্ঠ ভেসে এলো,
“মাথায় ফুল দিলে আরেকটু বেশি সুন্দর লাগতো তোমাকে।”
তিমিরের অপ্রত্যাশিত কথায় বিস্ময়ে হা হয়ে গেল করবীর মুখ। কথাও যেন বের হচ্ছিল না। তবুও অস্ফুটস্বরে কেবল উচ্চারণ করল,
“আপনি কীভাবে বুঝলেন?”
“কীভাবে বুঝলাম তা পরের ব্যাপার। সঠিক বুজেছি কি-না তা বলো।”
করবী হাসল। লজ্জায় লাল হলো গাল। ছোটো করে বলল, “হুম”।
ব্যস্ তার সেকেন্ডের মাথায় সে অনুভব করল তার মাথায় কিছু একটা লাগাচ্ছে কেউ। করবী ঘাড় ঘুরাতে নিলেই বাঁধ সাধলো পরিচিত কণ্ঠ,
“নড়বে না। তাহলে লাগাতে পারব না।”
করবী অক্ষরে অক্ষরে তা মানল। সত্যিই সে আর নড়লো না। ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল বিপরীত পক্ষের পরবর্তী নির্দেশনা না আসা অব্দি। তিমির নিবিড় হাতে ফুলটা বাঁধল। তারপর মুচকি হেসে করবীর সামনে এসে দাঁড়াল। মুগ্ধ কণ্ঠে বলল,
“মাশআল্লাহ্ তোমার চুল ভীষণ সুন্দর।”
করবী লজ্জা পেল ঠিক কিশোরীর ন্যায়। ডানে-বামে তাকিয়ে লজ্জা কাটানোর চেষ্টা করল। তিমির করবীর সে চেষ্টা দেখে হাসল। মেয়েটাকে আজ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরতম নারী লাগছে। যার রূপে অনায়াসে গলে যাবে কঠিন বরফ। মোহমুগ্ধ কণ্ঠে তিমির বলল,
“আজ স্বয়ং চাঁদ মাটিতে যে!”
করবী লজ্জায় নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল। তিমির তা দেখে হাসল নৈশব্দে। তার আলতো হাত ছুঁয়ে দিল করবীর হাত গুলো। হাস্যরসাত্মক কণ্ঠে বলল,
“দোষ নিও না, রক্তকরবী। এই অধমের এতো বড়ো স্পর্ধা ক্ষমা করো। কিন্তু আজ একটু আধটু অপরাধ হলেও আমি তা মেনে নিবো বিনা যুদ্ধে। তবুও এই অসাধারণ সুন্দর মেয়েটির হাত না ধরে নিজের আত্মাকে কষ্ট দিতে পারছি না। সে তুমি আমাকে নষ্ট পুরুষ ভাবতেই পারো। তোমার সান্নিধ্য পেতে আমি হাজার বার নষ্ট হতে রাজি।”
তিমিরের এহেন কথায় খিলখিল করে হেসে উঠল করবী। হাতের মুঠো নিজ ইচ্ছেয় শক্ত করল। এ যেন নীরবে প্রশ্রয় দেওয়া। সোডিয়ামের আলো যেন আজ আরও ঝলমল করে উঠল। চারপাশে কেমন রঙিন আলো ঝলমল করছে। নাকি করবীর প্রেমে পড়া চোখ সবকিছুতেই রঙ খুঁজে পাচ্ছে?
–
গলির কিছুটা আগে এসেই করবী হাত ছাড়লো। তিমিরের থেকে বিদায় নিয়ে ঢুকলো গলির ভেতর। গলিতে আসতেই দেখা মিলল বিন্দুর। মেয়েটাও মাত্র কাজ থেকে ফিরল। করবীকে দেখেই গাল ভোরে হাসল সে। চকচক করে উঠল মেয়েটার চোখ। উত্তেজিত কণ্ঠে বলল,
“আরে আপা, তোমারে তো পুরা নায়িকা লাগতাছে? হায় আল্লাহ, এই রূপে নজর যেন না লাগে। এমন অপ্সরার লাহান রূপ তোমার আপা! হীরণ ভাইরেই বা কী দুশ দিমু কও? আমারেই তো মনে পোলা হইলে তোমারে তুইল্যা নিয়া বিয়া করতাম।”
বিন্দুর বলার ধরণে হেসে ফেলল করবী। ছোটো চ ড় দিয়ে শুধাল,
“তোর হীরণ ভাই বোকা বলে আমার পেছন লাগে। চালাক হলে তার একমাত্র ধ্যান, জ্ঞান হতিস তুই। তোর মতন কেউ ভালোবাসতে পারে আদৌও? এমন করে ভালোবাসা পায়ে ঠেলে কারা জানিস? বোকারা।”
“করো নাই বলতাছো? এই যে হীরণ ভাই যে তোমারে ভালোবাসে, এমন করে আদৌও কেউ ভালোবাসতে পারে কও? তার ভালোবাসাও তো তুমি মূল্য দেও না।”
“মূ্ল্য দিলে তোর কষ্ট হবে না, বিন্দু?”
“হীরণ ভাই সুখী হলে আমার ক্যান কষ্ট থাকবো, আপা?”
কথাটা বলতেই বিন্দুর কণ্ঠ কাঁপল। ভেতর ভেতর যে এই উত্তরটা দিতে তার কতটুকু যন্ত্রণা হয়েছে তা করবী ভালো করেই আন্দাজ করতে পারল। তাই কষ্ট কমাতে বলল,
“মজার ব্যাপার কী জানিস, বিন্দু? অনেক সুন্দর যারা, তাদেরকে মন-প্রাণ থেকে কেউ ভালোবাসে না। বেশিরভাগ মানুষ তার রূপে মুগ্ধ হয় যায় এবং তার নাম দেয় ভালোবাসা। আমার এই রূপ কোনোদিন এসিডে ঝলসে গেলে দেখবি আমাকে ভালোবাসার মতন হয়তো কেউ নেই। কেউ না। কিন্তু এমন অত্যাধিক সুন্দর না যারা, তাদের ক্ষেত্রে একটা ব্যাপার দারুণ আছে। তা হলো— কেউ যদি তাদের ভালোবাসে বলে দাবী করে তবে বলা যায় সে সত্যিই ভালোবাসে। কারণ এক্ষেত্রে মুগ্ধতার তো কোনো উপায় নেই। তবে আমি চাই, হীরণ তোকেই ভালোবাসুক। আর জানি, একদিন ও তোকে পৃথিবীর সবথেকে বেশি ভালোবাসাটা দিবে।”
বিন্দুর কথাটা শেষ হতেই কোথা থেকে যেন হীরণ ছুটে এলো। এই মানুষে পরিপূর্ণ গলিটিতে এসেই চারপাশ না তাকিয়ে করবীর চুলের মাঝে থাকা ফুলের খোপাটা টেনে ছিঁড়ে ফেলল। সাথে কয়েকটা চুলও নির্দয়তার সাথে ছিঁড়ে গেল। করবী হতভম্ব। হীরণ কেমন ফোঁসফোঁস করতে করতে করবীর হাত মুঠ করে ধরল। দাঁত কিড়মিড় করে বলতে লাগল,
“আমার না হলে তুমি কারো না। কারো না।”
বিন্দু ছুটে গেল। হীরণের শক্ত হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করল। বার কয়েক বললও ছাড়তে কিন্তু হীরণ ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। পাড়া প্রতিবেশীর মানুষরা ভীড় জমালো। রাস্তা ভোরে গেলে মুহূর্তেই। এসব মানুষ যে পরবর্তীতে রসিয়ে রসিয়ে এই ঘটনাকে আরও বড়ো করবে তা আর বুঝতে বাকি রইল না বিন্দুর। দিশে না পেয়ে বিন্দু সর্বশক্তি প্রয়োগ করে ধাক্কা দিল হীরণের বুকে। কেমন আক্রোশ নিয়ে বলল,
“তুমিও কাপুরুষ, হীরণ ভাই। কাপুরুষ। নারীর গায়ে যে পুরুষরা হাত দেয় তারা সবাই কাপুরুষ। ছিঃ, ছিঃ। তুমিও ভুল মানুষ। তুমিও ভুল।”
#চলবে…..
#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ত্রয়োদশ
কলমে: মম সাহা
বিনা পয়সায় মজা লুটতে ভীড় জমলো মানুষের। আগ্রহী, কৌতূহলী দৃষ্টি গুলো যেন কাঁটার মতন বিঁধল করবীর শরীরে। হীরণের চোখের সাদা অংশটুকু ততক্ষণে লাল রঙ ধারণ করেছে। করবী হাত ছাড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত রেখেই ভীষণ শক্ত কণ্ঠে বলল,
“এই মুহূর্তে আমার হাতটা না ছাড়লে আপনার গালে চ ড় বসাতে আমি দু’বার ভাবব না।”
ব্যস্, বাক্যটুকু আগুনে ঘি ঢালার কাজ করল। হীরণ হাতটা আরও শক্ত করে টেনে ধরল। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলল,
“তোমার যা ইচ্ছে করো। আমিও দেখবো তুমি আমার নাহয়ে কার হও।”
বিন্দুর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছে বহুক্ষণ আগেই। সে এবার হীরণের টি-শার্ট টেনে ধরল। মেয়েটার চোখ জলে টলমল করছে। কোনোরকমে অস্ফুটস্বরে বলল,
“ছাইড়্যা দেন আপারে। আপনি কোন সাহসে আপার ইজ্জত নিয়া টান দিছেন, কন? আপনি কী অমানুষ হইছেন? এই আপনারে আমি এত ভালোবাসলাম?”
হীরণের সামগ্রিক রাগ এবার যেন লেলিহান দাবালনের মতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। তার পুরুষালী শক্ত হাতের চড়টা গিয়ে পড়ল বিন্দুর ডান গালে। বিন্দুর যেন সমগ্র পৃথিবী ঝনঝন করে উঠল। হতভম্বতার গাঢ় বাতাস ছুঁয়ে গেল পুরো জনস্রোতকে। বাদ গেল না করবীও। হীরণ মুখ ঝামটি মেরে বলে উঠল,
” কে বলেছে তোকে ভালোবাসতে? আমি বলেছি? আমি কাপুরুষ হলে তুই কী? ভালো মানুষ? তুইও তো নির্লজ্জ, বেহায়া মেয়েমানুষ। তাই তো আমি না করা স্বত্তেও আমার পিছনে পরে থাকিস।”
বিন্দু যেন মুহূর্তেই ভাষাহারা হয়ে গেল। ভালোবেসেছে বলে আজ এমন ভাবে কলঙ্কিত হতে হলো? এই দাম দিল ভালোবাসা তাকে? এই দাম?
আজ আমেনা খালা বাড়ি ফিরে ছিলেন সন্ধ্যার আগেই। ঘরে বসে তিনি রান্না করছিলেন। কিন্তু মহল্লার হৈচৈ-এর ভারী শব্দ তার কানে এসেও বারি খায় যার ফলস্বরূপ তিনি নিচে ছুটে এসে ছিলেন। কিন্তু নিচে এসে এমন দৃশ্য দেখতে হবে তিনি ভাবতেই পারেননি। ভরা বাজারে সম্মানহানির এহেন দৃশ্য উনার মাথা নত করে ফেলছিল। হয়তো উনারা গরীব কিন্তু তাই বলে ভরা মানুষের ভীড়ে তার মেয়ে এমন ভাবে মা র খাবে একটা যুবক ছেলের হাতে? ছি! এমন দৃশ্য দেখার আগে সে অন্ধ হলো না কেন?
ঝামেলার মোড় এবার বিশ্রী ভাবে ঘুরে গেল। আমেনা খালা গিয়ে বিন্দুর চুলের মুঠি টেনে ধরলেন সাথে ক্ষমা চাইলেন হীরণের কাছে। করবী আমেনা খালাকে বুঝানোর জন্য বলল,
“বিন্দুকে ছাড়েন, খালা। ও কিছু করেনি। ওর দোষ নেই।”
“অর দোষ নাই কেডা কইছে? অর অবশ্যই দোষ আছে। অর সবচেয়ে বড়ো দোষ ঐ তোমার মতন অপ্সরার লগে মিশছে। আইজক্যা না অয় তোমার লগে মিশতো, আর না ভরা বাজারে অরে মাইর খাইতে হইতো। মা** যেমুন মাইনষের লগে মিশবি হেমুনই তো হইবো। মানুষ তোরে রাস্তার মাইয়্যা বানায় দিল।”
আমেনা খালার প্রথম কথা গুলো যতটা না করবীকে আঘাত করল তার পরের কথা গুলো তারচেয়ে দ্বিগুণ অপমানে আচ্ছাদিত করল তাকে। ভীড়ের মাঝে দু-চার মহিলা সহমত পোষণ করে আরেকটু বাজে ইঙ্গিতে বলল,
“হ হ হুতুইম্যার আম্মা, ঠিক-ঐ কইছেন। বিন্দুর বয়স হইলো কম। ঐ কী এতকিছু বুঝে? এই মাইয়্যা হইলো সেয়ানা। এত বয়স হইলো অহনো বিয়া না কইরা ঘুরে। কিছু কইলেই কেমন দাঁত কিড়মিড় কইরা জবাব দেয়। মা নাই ঘরে। বাপ একটা ল্যাংড়া, ঘরবন্দী। মাইয়্যা নাকি সংসার চালায়। কোন জায়গায় কোন আকাম কইরা সংসার চালায় আল্লাহ্ মালুম। আমরা লাগে কিছু বুঝিনা। আর হীরণ পোলাডা তো সারাক্ষণ মহল্লাতেই থাকে, কই কহনো তো কোনো মাইয়্যার লগে এমুন করতে দেহি নাই। অর লগেই কেন করল? নিশ্চয় এমন জ্বালা ধরা রূপ দিয়া ভুলাইছে। এহন তো আমাগো ঘরের বেডাগোরেও সাবধানে রাখতে হইবো দেহি।”
এমন ঘৃণিত ইঙ্গিতপূর্ণ কথার বিপরীতে করবীর চিৎকার করতে মন চাইলো, বলতে ইচ্ছে হলো অনেককিছু। কিন্তু সে অনুভব করল তার গলা দিয়ে কথা আসছে না। শরীর কেবল অনবরত কাঁপছে। জীবনের প্রথম এত ঘৃণা ভরা বাণ ছুটে এসেছে বলেই হয়তো হজম করতে কষ্ট হচ্ছে! যেদিন বাড়িওয়ালা আবদুল ওরে ছুঁয়ে খারাপ ইঙ্গিত করেছিল— সেদিনও বোধহয় করবীর এতটা ঘৃণা ধরেনি শরীরে, আজ যতটা ধরল। একজন নারী হয়ে কীভাবে আরেকজন নারীকে এতটা অপমান করা যায় তা-ই কেবল ভেতর ভেতর করবীকে ভাবিয়ে অবাক করে তুলল।
সেখানে আরও হয়তো কথা বাড়ার ছিল কিন্তু করবী পরাজিত সৈনিকের ন্যায় এক পা, দু’পা টেনে কেবল বেরিয়ে এলো সবকিছু পিছনে ফেলে। করবীর মাথা শূন্য শূন্য লাগছিল। পেছন থেকে হীরণের চেঁচামেচি পাওয়া যাচ্ছিল। হয়তো উপস্থিত জনতাদের উদ্দেশ্যে সেই হিংস্রতা ছিল। কিন্তু করবীর একটিবার সাহস করে আর ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার ইচ্ছে হলো না৷ তার কেবল মনে হলো, ঘাড় ঘুরালেই দেখতে পাবে কতগুলো নোংরা দৃষ্টি তার চরিত্র টেনেহিঁচড়ে ছিড়ে ফেলার খেলায় মেতেছে। সেই এই খেলা দেখতে পারবে না। কখনোই না।
করবী ক্লান্ত পা গুলো টেনে যখন নিজের ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল তখন অদ্ভুত ভাবে আবিষ্কার করল দরজাটা খোলাই আছে। করবীর মন ভীত হলো। বাবা কী কিছু আঁচ করেছেন? ভয়, শঙ্কা নিয়ে সে ঘরে ঢুকতেই চিন্তা হ্রাস পেল। নাহ্, বাবা ঘুমাচ্ছেন। কিন্তু অবেলায় তো বাবা ঘুমান না! করবী গিয়ে বাবার শরীরে হাত রাখল। শরীরটাও তো স্বাভাবিক আছে।
করবী অন্ধকার রুমেই বেশ কতক্ষণ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। ভাগ্যিস বাবা ঘুমিয়ে আছেন, যদি এসব কথা শুনতেন, দেখতেন তাহলে নিশ্চয় মানুষটা আর সহ্য করতে পারতেন না।
বিধ্বস্ত শরীরটা টেনে ঘরের বাহিরে চলে গেলো মেয়েটা। নিজের রুমে গিয়ে দরজা দিল। কিন্তু একবার যদি বাবার অন্ধকার রুমের আলো জ্বালাতো তবে সে দেখতে পেতো, অসহায় বাবা মেয়ের অপমানে বোকার মতন কেঁদেছেন। নিজের অক্ষমতাকে অভিশাপ ভেবে কতটা হা-হুতাশ করেছেন!
(২২)
বাহিরে বৃষ্টি হচ্ছে তুমুল গতিতে। অসময়ে যেন কালবৈশাখি ঝড়ে প্রকৃতি দিশেহারা। ছন্নছাড়া বৈরী বাতাস চারপাশ জুড়ে বিরাজমান। করবী পরীক্ষার হলে বসে থেকে শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে বাহিরে। প্রকৃতির এই অশান্ত রূপে সে যেন নিজের চূর্ণবিচূর্ণ মনকে খুঁজে পাচ্ছে। গত কয়েকদিনের বিধ্বস্ত প্রায় মনটা বড়ো যন্ত্রণা দিচ্ছে তাকে। এমন ধ্যানে কাটিয়ে দিল মেয়েটার পরীক্ষার অধিকাংশ সময়টুকু। মনমতো পরীক্ষাটাও শেষ করা হলো না তার!
পরীক্ষা শেষ হতেই সবার প্রথম হল ছেড়ে বেরিয়ে এলো সে। চোখের নিচে কালী জমেছে তার। মনে হচ্ছে যেন গাঢ় কুহেলি ছক কষছে বড়ো কৌতূহলে। শুভ্র রাঙা গাল গুলোতে অযত্নের দু-একটি ব্রণ উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। বেশ কয়েকদিন হলো তার সাথে বিন্দুদের কোনো কথাবার্তা হয় না। সেও ব্যস্ত থাকে ভীষণ। টিউশন, কলেজ, পরীক্ষা, বাকি সময়টুকু নতুন বাসা খুঁজতে খুঁজতেই কেটে যায়। তারপর যখন পৌঁছায় বাসায় তখন আর মন ভরসা দেয় না, সাহস করে এক তলা ডিঙিয়ে চিলেকোঠার ঘরটায় যাওয়ার। আত্মসম্মানে যে গাঢ় দাঁগ জখম করেছে, সে দাগ যে এত সহজে মুছবার নয় তা করবী ভালো করেই আন্দাজ করতে পেরেছে।
“আমাকে এভাবে ইগ্নোর করার কারণ কী জানতে পারি?”
করবীর পা থেমে গেল। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল কণ্ঠের মালিকটির দিকে। তার মনে হলো, তার সামনে দাঁড়ানো পাঞ্জাবি পরা ছেলেটি পৃথিবীর সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ।
তিমির দু’পা এগিয়ে এলো। ভরাট তার কণ্ঠস্বর, “কী ব্যাপার! কথা বলছো না কেন?”
করবীর মুগ্ধতার ঘোর কেটে গেলো। চোখের সামনে ভেসে উঠল সেদিনের রাস্তায় তার চরিত্র নিয়ে রংতামাশা খেলার দৃশ্যটি। শিউরে ওঠল সে। আর কোনো ভাবে এত অপমানিত হতে পারবে না সে। তাই আলগোছে কথা ঘুরানোর জন্য বলল,
“ব্যস্ত ভীষণ।”
“কতটা ব্যস্ততা তা আমিও জানতে চাই। কী এমন কারণে ব্যস্ত যে আমাকে তুমি দেখেও দেখছো না?”
করবী উত্তর খুঁজে পেল না। কিন্তু ভেতর ভেতর তার ভালো লাগার স্বত্তা অবহেলায় শক্ত হয়ে গিয়েছে। বেশ অনেকক্ষণ চুপ থেকে সে স্বাভাবিক স্বরে জবাব দিল,
“আপনাকে দেখতেই হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা কখনো তো আমার ছিলোও না।”
করবীর রাশভারি কণ্ঠে চমকে গেল তিমির। এই প্রথম বুঝি মেয়েটা এমন ভাবে কথা বলল তার সাথে! এত রূঢ়ভাষী তো ও কখনো ছিল না!
তিমির বিস্মিত কণ্ঠে বলল, “বাধ্যবাধকতা ছিল না কিন্তু কোথাও তো একটা অদৃশ্য বাঁধন ছিল তাই না?”
“কই? আমার তেমন মনেহয় না।”
করবীর শক্ত জবাবে তিমির আহত হলো। দু’হাতে করবীর ডান হাতটা ধরতেই করবী ছিটকে দূরে সরে গেল। চোখের উপর আবারও সেইদিনের দৃশ্য ভেসে ওঠল। সেদিন না সে হাত ধরে হাঁটতো আর না এতটা অপমান, অপদস্ত তাকে হতে হতো।
তিমির যেন আজ চমকের উপর চমক পাচ্ছে। করবীর বদলে যাওয়া রূপ। টানা কিছুদিনের অবহেলা যেন তার মানতে কষ্ট হচ্ছে। মেয়েটা এত শক্ত কখনোই ছিল না। তবে কী তার এলাকায় গিয়ে যে ঘটনা শুনেছে সেটা সত্যি! মেয়েটার সাথে কেউ খারাপ আচরণ করেছে? কিন্তু তিমিরের আর জিজ্ঞেস করা হলো না। তার আগেই সব ছাত্র-ছাত্রীদের উপচে পড়া ভীড়ে নিজ ইচ্ছায় হারিয়ে গেল করবী।
কলেজের গেইটের সামনে দ্রুত পায়ে আসতেই আবারও থেমে গেল করবীর পা। আমেনা খালা দাঁড়িয়ে আছে ঝুম বৃষ্টিতে। করবী অবাক হলো এসময়ে এখানে মানুষটাকে দেখে। একবার মনে হলো গিয়ে কথা বলবে, আরেকবার মনে ভয় হলো— আমেনা খালা কী তাকে ভার্সিটির সবার সামনে আবার অপমান করার জন্য এখানে এসে়ছেন? করবী কি করবে বুঝতে না পেরে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল এক জায়গায়।
তবে হাসি মুখে তার দিকে এগিয়ে এলো আমেনা খালা নিজেই। এসেই বরাবরের মতন আদুরে স্বরে বলল,
“কি গো, আমারে দেইখাও গেলা না কেন আমার কাছে? গোসসা বুঝি কমে নাই তোমার? আম্মার উপর কেউ এত রাইগ্যা থাহে কও?”
“হেইড্যা তো তুমি আমারে খুশি করার লাইগ্যা কইতাছো। আমি কী আর হেইড্যা না বুইঝ্যা! তয় আম্মা, রাগ কইরা থাইকো না খালার উপর। খালা বড়ো বোকা মানুষ তো তাই তোমারে দুক্কু দিয়া ফালাইছি। মাফ করো আমারে, আম্মা।”
কথা শেষ করেই ভদ্রমহিলা হাত জোর করলেন।
করবী মহিলার হাত চেপে ধরল, ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
“ছি! ছি! খালা, আমার পাপ বাড়াবেন না। আপনি এভাবে ক্ষমা চাইলে আমার পাপ হবে যে!”
“আম্মা, তোমারে হেইদিন যা সব বলছি তা কখনোই ক্ষমা হয় না। তবুও, ক্ষমা না চাইলে আমার আত্মা বড়োই জ্বালাতন করছিলো। খচখচ করতাছিল। আমারে ক্ষমা কইরো, আম্মা।”
“আমার কোনো রাগ নেই, খালা। আপনি আর ক্ষমা চাইবেন না।”
আমেনা খালা দু’পা পিছনে গেলেন। ঘাড় কাঁত করে বললেন,“তুমি যাও আম্মা, আমার একটা কাজ আছে। তুমি গেলে বিন্দুডা একটু শান্তি পাইবো।”
কথাটা শেষ করেই আমেনা খালা হাঁটা ধরলেন। মধ্যবয়স্ক এই নারীটিকে আজ অন্যদিনের তুলনায় খুব বেশি বৃদ্ধ দেখালো। মনে হলো যেন নুইয়ে নুইয়ে হাঁটছেন। বয়স মনে হলো কিছু দিনেই অনেকটা বেড়ে গিয়েছে!
করবী আজ আর টিউশনিতে গেল না। কী মনে করে রিকশা নিয়েই ছুটলো। অথচ আজ তার নতুন বাসার এডভান্স দেওয়ার কথা ছিল।
রিকশা গলির মোড়ে আসতেই মানুষের ভিড়ের জন্য আর ঢুকতে পারল না। করবীর মন কেমন যেন খচখচ করল। তার চোখে কেবল আমেনা খালার সেই হলদেটে চোখ গুলো ভেসে উঠতে লাগল। খালা তো ভীড়ের কথা কিছু বললেন না! এলাকায় কী হলো?
করবীর আর বেশি ভাবতে হলো না কী হলো নিয়ে। তার আগেই মানুষের ভীড়ের ফাঁকফোকরে লাশ বাহী খাটটি তার দৃষ্টিগোচর হলো। সাদা কাপড়ে মোড়ানো লাশটির উপর বিরাট ছাতা লাগানো। আতুরের ঘ্রাণে ভোরে গেছে চারপাশ। স্বজন হারানোর চিৎকারও ভেসে আসছে। করবী ভ্রু কুঁচকালো, কার লাশ এটা!
(১৭)
বৃক্ষের যৌবন তখন বৃষ্টির জলে ধুয়ে শুদ্ধ থেকে শুদ্ধতম হয়ে উঠেছে। সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে বৃষ্টির অবশিষ্ট ফোঁটা গুলো। মনে হচ্ছে যেন শিশির বিন্দু। দুপুর হলেও আকাশ মুখে ফুটেনি হাসি। মেঘেদের অগোছালো জমাটবদ্ধতার কারণে চারপাশ ঢেকে আছে তুমুল আঁধারে। তবে বৃষ্টি নেই এখন। বৃষ্টির অদ্ভুত গন্ধটি মাটি থেকে উঠে এসে পরিবেশে একটি মায়াময় আবহ তৈরী করেছে।
করবী শুয়ে আছে তার রুমে। অন্ধকার রুমটা বৃষ্টির কল্যানে কিছুটা স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে প্রায়। যদিও বিন্দু কিছুক্ষণ আগে মুছে গিয়েছিল তাও লাভ হয়নি। মোছার পর আরেকবার দমফাটা বৃষ্টি এলো, অতঃপর যেমনের রুম তেমন হয়ে গিয়েছে।
রান্নাঘর থেকে তেলের ছ্যাঁত ছ্যাঁত শব্দ ভেসে আসছে। মাঝে মাঝে বাসন-কোসনের শব্দও পাওয়া যাচ্ছে। বাবা বোধহয় রান্না করছেন। মাছ ভাজার কড়া ঘ্রাণটা করবীর অসুস্থ নাকে এসে লাগছে। গা গুলাচ্ছে তার। জ্বর এলেই তার কোনো খাবারের গন্ধ সহ্য হয় না। বমি পায়। মাঝে মাঝে তো বমি করে ভাসিয়ে দেয়। তবে সচারাচর তার শরীর খুব সহজে অসুস্থ হয় না। এবার কেন হলো কে জানে!
শুয়ে থাকতে থাকতে পিঠ ব্যাথা হয়ে যাওয়ায় উঠে বসল সে। অসুস্থ পায়ে নড়বড়ে ভাবে দাঁড়াল মেঝেতে।
করবীর জ্বর নিয়ে কাটলো দু’দিন। শুধু কী তাই? এই দু’দিন সবচেয়ে বেশি ব্যস্ত কেটেছে হীরণের। কখনো বাজার করেছে, কখনো ঔষুধ এনেছে, কখনো দীর্ঘসময় দাঁড়িয়ে কেবল জ্বর কমার অপেক্ষা করেছে।
করবীর আজ জ্বরটা কিছুটা কমেছে। শরীরের উত্তাপও ক্ষীণ। জ্বরে মেয়েটার চেহারায় দেখা দিয়েছে মলিনতার ছাপ। চোখের নিচে পড়েছে অস্বচ্ছ কালির প্রলেপ। মনে হচ্ছে যত্নের কাজল অযত্নে লেপ্টে গেছে। তন্মধ্যেই করবীর ভাঙাচোরা মোবাইলটা সশব্দে বেজে উঠল। করবী ডান-বামে তাকিয়ে মোবাইলটা আবিষ্কার করল টেবিলের উপর। অসুস্থ পায়ে, দুর্বল শরীরটা টেনে নিয়ে খুব কষ্টে সে টেবিলের সামনে গেলো। অপরিচিত নাম্বারটি চোখে পড়তেই ভ্রু কুঁচকালো। ফোনটা রিসিভ করার আগেই কেটে গেল। করবী মোবাইলটা আবার আগের স্থানে রাখতে নিলেই নতুন উদ্যমে বেজে উঠল কল। এবার কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করেই রিসিভ করল সে। কল রিসিভ হতেই অপর পাশ থেকে একটি গম্ভীর পুরুষালী ভরাট কণ্ঠ ভেসে এলো,
“রক্তকরবী, বলছো?”
করবীর প্রথমে ঠিক বোধগম্য হলো না মানুষটা কে! কিন্তু কণ্ঠ শোনাল বেশ পরিচিত। সে কিছুক্ষণ সময় নিয়ে জবাব দিল,
“জি? কে বলছেন?”
প্রশ্নের জবাবে অপর পাশে কেবল নীরবতা পাওয়া গেলো। তারপর কয়েক সেকেন্ডের নীরবতা পেরিয়েই অপর পাশ আবার সরব হলো,
“তিমির। তুমি অসুস্থ?”
তিমির নামটা প্রতিধ্বনিত হতেই করবী হাত কেঁপে উঠল কিঞ্চিৎ। বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডের গুঞ্জন বাড়ল দ্রুত গতিতে। নিজেকে সামলালো সে খুব কষ্টে। আধো আধো ভাঙা কণ্ঠে জবাব দিল,
“এই আরকি, সামান্য।”
করবী মানুষটাকে চিনতে পেরে তপ্ত একটি শ্বাস ফেলল। কোনোরকমে কথা ঘুরিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, একটি প্রয়োজনীয় অনুষ্ঠান ছিল তাই যেতে হয়েছে।”
“সেদিন বৃষ্টিতে ভেজার জন্য এমন ঠান্ডা লেগেছে?”
“ঐ আরকি।”
“তাহলে ঠিক আছে। ভবিষ্যতে আমি নাহয় ছাতা হলাম। ভেজার সঙ্গী তো অনেক হয়, ছাতা হতেই বা ক’জন পারে! জ্বর আর ছুঁতে পারবে না তোমায়। এই আমি কথা দিলাম এক দুপুরে। এই কথা চিরদিন থাকবে, যেমন করে থাকে দুপুর সকালের পরে।”
ভালো লাগার শিরশির অনুভূতিতে করবীর অসুস্থ শরীর ভোরে উঠল। মন তড়িৎ গতিতে সুস্থ হয়ে গেলো। কিন্তু সে বুঝত দিলো না তা বিপরীত পক্ষের মানুষটিকে। বরং খুব দ্রুত ‘রাখছি’ বলেই বিচ্ছিন্ন করল কলটি। বারান্দার কোল ঘেঁষে বিদ্যুৎ চমকানোর জ্বলজ্বল আলোটি এসে ছুঁয়ে গেলো করবীর মন্ত্রমুগ্ধ হওয়া চোখ গুলোকে।
করবীর মুগ্ধতা কেটে গেল বাবার কথার শব্দে। বাহির ঘর থেকে বাবা যেন কার সাথে কথা বলছেন! করবী অপেক্ষা করল না। অসুস্থ শরীর নিয়েই এগিয়ে গেল রুমের বাহিরে। দেখল হীরণ দাঁড়িয়ে আছে। চোখ-মুখ শুকিয়ে আছে ছেলেটার। তৈয়ব হোসেন ব্যস্ত স্বরে বলছেন,
“এলে আবার চলে যাচ্ছ যে, বাবা? করবী কী ঘুমে এখনো? কথা বললে না যে ওর সাথে!”
হীরণের যে রাজ্যের ব্যস্ততা। যেতে-যেতে বলল,
“একটা কাজ পড়েছে। যেতে হবে, চাচা।”
কথা বলে এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে চলে গেলো ছেলেটা। তৈয়ব হোসেন ওর যাওয়ার পানে তাকিয়ে বেশ প্রসন্ন স্বরে বলল,
“ছেলেটা না থাকলে যে কী হতো! নিজের ছেলের মতন সাহায্য করেছে।”
করবী নিশ্চুপে সবটা দেখল। হীরণ কী ওর কথা বলার সময় শুনেছিল সবটা? হয়তো তাই চলে যাচ্ছে! করবী ফিরে এলো ঘরে। হীরণের প্রতি ওর কৃতজ্ঞ হওয়ার কথা অথচ ওর কোনোরকমের অনুভূতিই কাজ করে না ছেলেটার জন্য!
সিঁড়ি দিয়ে নামতেই বিন্দুর সাথে মুখোমুখি হলো হীরণ। বিন্দু গলা উঁচু করে কথা বলার আগেই লোকটা মুখ লুকিয়ে পালাল। বিন্দুর মনে হলো হীরণ ভাইয়ের চোখে যেন রাজ্যের অশ্রু। হীরণ ভাইয়ের কী আজ মন খারাপ! কাঁদছিলো কী সে? এ নিয়ে চিন্তা হলো মেয়েটার খুব।
কী অদ্ভুত তাই না? যারে আমরা চাই সে মূল্য দেয় না, আর যারে চাই না সে আমাদেরকে তার জীবন ভেবে বসে থাকে!
#চলবে
#বুকপকেটের_বিরহিণী
কলমে: মম সাহা
একাদশ পর্ব:
(১৮)
বাহিরে আঁধার করা দুপুর দেখেই খিচুড়ি চড়েছে চুলোয়। তার ঘ্রাণে জুড়িয়ে যাচ্ছে চারপাশ। ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে কেবল অথচ বৃষ্টি নেই। বাতাসও নেই। কেবল থম মেরে থাকা এক গম্ভীর প্রকৃতি।
তিমির তার বারান্দায় থাকা ইজিচেয়ারটা ঘরে নিয়ে এলো। নাহয় বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে যাবে। এটা তার ভীষণ প্রিয় একটা বস্তু। চেয়ারটি এনে, একপাশে রাখতেই ঘরে অন্য কারো উপস্থিতি টের পেল সে। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখল তার মা তাসনীম বেগম দাঁড়িয়ে আছেন খাটের সাথে। তিমিরের শীতল মেজাজে দপ করেই আগুন জ্বলে উঠল। সে শরীর ঘুরিয়ে আবারও বারান্দায় চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই তাসনীম বেগম ডাকলেন ছেলেকে,
“শোন তিমির, কথা ছিল।”
তিমিরের বড়ো ইচ্ছে হলো অভদ্র হতে। মায়ের কথা না শোনার ভাণ করতে। কিন্তু শেষবেলায় গিয়ে সে অভদ্র হতে পারল না। অনিচ্ছা স্বত্তেও দাঁড়িয়ে রইল। ছেলেকে দাঁড়াতে দেখে যেন কিছুটা ভরসা পেলেন তাসনীম বেগম। বললেন,
“কেমন কাটছে তোর দিনকাল?”
“এটা নিশ্চয় আপনার কথা না? যা বলার ভাবভঙ্গিমা ছাড়ায় বলুন।”
ছেলের কথার ধাঁচ বেশ মানে লাগল তাসনীম বেগমের। তিনি রেগে গেলেন কিছুটা,
“মায়ের সাথে কেউ এভাবে কথা বলে?”
“মা! কে মা?” তিমিরের কণ্ঠে শ্লেষাত্মক প্রশ্নটি শুনে হতভম্ব হলেন তাসনীম বেগম। কিংকর্তব্যবিমুঢ় কণ্ঠে বললেন,
“কে তোর মা, তা ভুলে যাচ্ছিস নাকি?”
“কেবল ভুলে যাচ্ছি না, অলরেডি ভুলে গিয়েছি। বুজেছেন আপনি?”
“তুই আমার সাথে এমন আচরণ করতে পারিস না।”
“পারি, পারি। একশবার পারি। হাজারবার পারি।”
তিমিরের কণ্ঠের উগ্রতা আকাশ ছুঁলো। সাথে বিশাল দা ন বী য় এক লাথিও পড়ল তার পছন্দের ইজি চেয়ারটায়। এমন ভয়ঙ্কর লাথিতে শখের চেয়ারটি শব্দ করেই আছাড় খেল এবং ভেঙে গেলো তার একটি পায়া।
এমন বিশাল শব্দে ছুটে এলো তিমিরের ভাবী বিদিশা। হতভম্ব শাশুড়ি এবং উগ্র তিমিরকে দেখে তার যা বুঝার বুঝা হয়ে গেছে। কিন্তু তিমিরের পছন্দের চেয়ারটির এমন দশা দেখে বেশ চমকালো সে। অবাক স্বরে বলল,
“কী করলে এটা তুমি, ভাইয়া! তোমার শখের চেয়ারটি…..”
“এই একমাত্র নারী যার জন্য আমাকে আমার সকল শখের জিনিস খোয়াতে হয়েছে এবং হবে। উনি কখনো আমার স্বস্তি, আমার সুখ সহ্য করতে পারেননি। কখনো না।”
কথা শেষ করেই গটগট করে বেরিয়ে গেল তিমির। তাসনীম বেগম পিছু ডাকলেন না। তার মুখ রইল শক্ত, কঠিন এবং নিরুত্তর। বিদিশা গিয়ে চেয়ারটা উঠিয়ে ঠিক জায়গায় রাখল কোনোমতে হেলিয়ে। বারান্দার দরজাটা টেনে লাগিয়ে দিল নিঃশব্দে। শাশুড়ির দিকে না তাকিয়ে ক্ষীণ স্বরেই বলল,
“আম্মু, ঘরে যান।”
“তুমি দেখলে বউ! ও কেমন করল আমার সাথে! আমি কী ভুল করেছি বলো তো? নিজের সন্তানের জীবনের সিদ্ধান্ত কি আমি নিতে পারি না?”
“পারেন আম্মৃ, অবশ্যই পারেন। ঠিক ততক্ষণ অব্দি সিদ্ধান্ত নিতে পারেন যতক্ষণ অব্দি সেই সিদ্ধান্ত সন্তানের আত্মাকে মেরে না ফেলে। কিন্তু যখন বাবা-মায়ের সিদ্ধান্ত সন্তানের সবচেয়ে প্রিয় সুখ কেড়ে নেয়, তখন সেটা আর সিদ্ধান্ত হয় না, আম্মু। তখন সেটা হয় ভুল।”
“তোমার মনেহয়, বাবা-মা কখনো সন্তানের খারাপ চায়? ভুল সিদ্ধান্ত নেয়?”
বিদিশা হাসল। উত্তর দিল না আর। তার শাশুড়ি একরোখা মানুষ। তিনি বরাবরই মনে করেন বাবা-মা কখনো ভুল হতে পারেন না। অথচ উনার এই ভাবনা যে বিরাট ভুল সেটা উনি মানতেই চান না কখনোই। তিনি বুঝতেই চান না, বাবা-মাও মানুষ এবং মানুষ মাত্রই ভুল। সবসময় বাবা-মা সঠিক হবেন তার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আর একমাত্র এই কারণে তাসনীম বেগম আর তার সন্তানের মাঝে এত বড়ো দেয়াল তৈরী হয়ে গিয়েছে। যখন একটা সম্পর্কে দু’জনের মাঝে অন্তত একজনের যদি মাথা নত করার বা মেনে নেওয়ার ক্ষমতা না থাকে তাহলে সেটা যত মধুর সম্পর্কই হোক না কেন, বেলা শেষে সেটারও ঘূণে ধরবেই।
তাসনীম বেগম তার পুত্রবধূর উত্তর শোনারও অপেক্ষা করলেন না। বড়ো বড়ো পা ফেলে চলে গেলেন নিজের ঘরে। বিদিশা নিস্তব্ধ হাতে তিমিরের গোছানো ঘরটা আরেকটু গুছিয়ে দিল। এই পরিবারটি সুন্দর হতে পারতো আরও অথচ সামান্য রাগ,ক্ষোভের জন্য আজ কেমন ছন্নছাড়া সব!
(১৯)
করবীর জ্বরটি বেশ শক্ত-পোক্ত ভাবেই শরীর আষ্টেপৃষ্ঠে বাসা বেঁধেছে বলে ডাক্তার নিজেই বললেন তাকে কিছু টেস্ট করাতে। জ্বর কিছুটা কম থাকায় করবী টেস্ট করাতে রাজি হয় না। তাছাড়া টাকা-পয়সারও একটা ব্যাপার আছে। কিন্তু করবীর এই সিদ্ধান্তে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল বিন্দু এবং হীরণ। বিকেল হতেই বিন্দু এসে উপস্থিত। করবীর না করা স্বত্তেও জোর করে করবীকে তৈরী করিয়ে নিল। তারপর ছুটল হসপিটালের উদ্দেশ্য। করবী সিঁড়ি ডিঙিয়ে নিচে আসেই দেখে হীরণ দাঁড়িয়ে আছে। সাথে আছে ছোটো হুতুম ও বাণীও। করবী ভ্রু কুঁচকালো, বাণীকে শুধাল,
”তুই এখানে কেন?”
বাণীকে করা প্রশ্নের উত্তর দিল হুতুম,
“বাণীর মা, বাণীরে আমি আনছি। আমরা সবাই গেলে বাণী একলা কষ্ট পাইবো না? ও তো ভাববো ওরে আমরা ভালা পাই না। সেইজন্যই তো আমি নিয়া আসলাম ওরে।”
বাণী মনের আনন্দে পাখা ঝাপটে বলল, “ঠিক, ঠিক।”
করবী এবার হীরণের দিকে তাকাল। দৃষ্টি হলো কঠিন। কণ্ঠেও শক্ত ভাব রেখে বলল,
“আপনি এখানে কেন?”
হীরণ হুতুমের ছোটো হাতটা নাড়ানোতে মনযোগ দিয়ে উত্তর দিল,
“বিন্দু একলা পারবে না তোমাকে নিতে।”
“আপনাকে তো কেউ আসতে বলেনি।”
“তোমার মনে হয় আমাকে কেউ কিছু করতে বলার পর আমি সেটা করব?”
করবী কথা বাড়াল না। এক পা আগাতে নিয়ে সে অনুভব করল তার মাথা আকষ্মিক ঘুরে উঠছে। চোখ-মুখ অন্ধকার হয়ে আসতেই সে আঁকড়ে ধরল হীরণের হাত।
করবীর এ অবস্থা দেখে হীরণও জাপ্টে ধরল তাকে। এগিয়ে এলো বিন্দু। চোখে-মুখে তার একরাশ চিন্তা,
“কী হলো, আপা! কী হলো?”
করবী সময় নিয়ে সামলালো নিজেকে। দিকভ্রান্ত দেখা গেল হীরণকেও। বিড়বিড় করল চিন্তায়,
“কী যে এক জ্বর দিলো তোমারে! আমার একদম ভালো লাগছে না তোমায় এমন দেখতে। এই জ্বর আমাকে দিতো তা-ও তুমি সুস্থ থাকতে। পাগল পাগল লাগে নিজেকে, তোমায় এ অবস্থায় দেখে।”
হীরণের বিড়বিড় করে বলা কথাটা ততটাও ধীর ছিল না। যার ফলস্বরূপ তা করবী ও বিন্দু দু’জনেই শুনতে পেল। করবী এই অসুস্থ অবস্থাতেও জেদ দেখালো, ছাড়িয়ে নিতে চাইল হাত। কিন্তু মুঠো শক্ত রাখল হীরণ। যেন তার অধিকার আছে এই শক্ত মুঠো করে ধরে রাখার।
সবটাই নীরব চোখে দেখল বিন্দু। নৈশব্দে হাসল। কেমন এক ঘোর লাগা কণ্ঠে করবীর উদ্দেশ্যে বলল,
“আহা আপা, হাতটা ছাড়াইতে চাইতাছো ক্যান? থাক না এমন। একজনের রোগে-শোকে আরেকজনের পাগল পাগল লাগবো, এমন মানুষ কী সবাই পায় বলো? তোমার তো হেই ভাগ্য হইছে। আর তুমি কি-না রাগ দেহাও!”
করবী অসহায় চোখে দেখল বিন্দুকে। আর কেউ না জানুক, সে তো জানে বিন্দু হীরণকে কতটা পছন্দ করে। মেয়েটা নিশ্চয় ভীষণ কষ্ট থেকে এই কথাটা বলেছে।
হীরণও কী বুঝল বিন্দুর ব্যাথা! মনেহয় তো না। সে আগের মতনই শক্ত হাতে ধরে রইল করবীকে। বাণী তার চঞ্চল কণ্ঠে বলতে লাগল,
“বোকা হীরণ, বোকা হীরণ।”
তন্মধ্যেই করবীদের বাড়ির নিচতলার রুম থেকে ভাড়াটিয়া মহিলা বেরিয়ে এলেন। হীরণের হাতের মুঠোয় করবীর হাতটা দেখে কেমন নাক-মুখ কপালে উঠালেন। ‘হায় হায়’ করে বললেন,
“এহনের মাইয়্যা গো তো শরম লজ্জা বলতে কিছুই নাই। পরপুরুষের হাত ধইরা রাখছে কেমনে, দেহো! আর আমাগো সময়, আমরা জামাইয়ের দিকেও চোখ তুইল্যাই তাকাই নাই। হাত ধরমু তো দূরের কথা।”
মহিলার এমন লাগামহীন কথায় করবীর রাগ হলো। সে টেনে হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চাইল। অথচ তাকে অবাক করে দিয়ে, তাদের দু’জনের হাতের মুঠটি শক্ত করে ধরল বিন্দু। বোকা বোকা হেসে মহিলাকে বলল,
“আপনার যেন কয়ডা পোলাপান, চাচী?”
এহেন অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্নে অবাক হলেন মহিলা। কপাল আগের ন্যায় কুঁচকে রেখেই বললেন,
“সাত মাইয়া, তিন পোলা। মোট দশজন।”
“আর একটা বাদ রাখলে কেন? আর একটা হলেই তো এগারো জনের একটা ফুটবল টিম হয়ে যেত।”
হীরণের ঠোঁটকাটা ঠাট্টায় চোখ বড়ো বড়ো করল করবী। কিন্তু মহিলা বোধহয় মশকরাটা ধরতে পারলেন না। সে বেশ দুঃখী দুঃখী হয়ে বললেন,
“আছিলো বাপজান, আরও দুইটা মাইয়া হইছিলো। কিন্তু ওরা জন্মের পরই মইরা গেছে। নাহয় আইজ বারোডা পোলাপাইন থাকত আমার।”
এবার হীরণের চেয়েও আরেকটু বেশি ঠোঁটকাটা হলো বিন্দু, তার ডাগর ডাগর নয়ন যুগল মেলে দুষ্টু কণ্ঠে বলল,
“ভাগ্যিস চাচী, আপনাগো যুগে আপনারা শরম পাইতেন। জামাইয়ের দিকে চোখ তুইল্যা তাকাইতেন না। হাত না ধইরাই যার বারোডা পোলাপাইন হইছে, হাত ধরলে জানি তার কী হইতো! দেশের অর্ধেক ভাগে তাইলে খালি আপনাগো পোলাপানই থাকতো।”
বিন্দুর এমন ঠাট্টায় হা হা করে হেসে উঠল হীরণ। বিন্দুর মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে বাহবাও দিল সে। এবার শরম পেলো মহিলাও। দ্রুত সে বকতে বকতে স্থান ত্যাগ করল। করবী হতবিহ্বল হয়ে গেল। ধমকে বলল,
“অসভ্য হচ্ছিস, বিন্দু!”
কিন্তু সেই কথা শোনার সময় কী আর বিন্দুর আছে? সে হীরণের মুখের দিকে তাকিয়ে, মুগ্ধ কণ্ঠে বলল,
“হীরণ ভাইয়ের এমুন হাসি দেখতে আমি অসইভ্যর চেয়ে বেশি কিছুও হইতে রাজি আছি, আপা।”
করবী হতাশ হলো। ভালোবাসা যে ভীষণ অন্ধ, তার প্রমাণ তো বিন্দুও। নাহয় এতটা বোকা বোকা মুগ্ধতা কারো মাঝে থাকে আদৌও?
রাতের রাস্তায় শূন্য চোখে কেবল তাকিয়ে রয়েছে কুকুর। এছাড়া এই পথে আর কোনো জনমানসের চিহ্ন নেই। কুকুরটা থেকে-থেকে কয়বার উচ্চস্বরে ডাকছ তারপর আবার চারপাশ শুনশান নীরবতায় চুপ হয়ে যাচ্ছে।
কুকুরটার পাশেই বসে আছে বিন্দু। চিন্তায় কপালে তার ভাঁজ! কাজ থেকে আজ ছুটি পেয়েছি দেরিতে যার ফলে বেশ খানিকটা রাতই নেমে গিয়েছে বলা যায়। গাড়ি-ঘোড়া না পাওয়াতে হেঁটেই বাসায় পৌঁছানোর মত ঠিক করেছিল কিন্তু এতেই বাঁধলো বিপত্তি। তাড়াতাড়ি বাসায় পৌঁছানোর জন্য বড়ো রাস্তা ছেড়ে ধরেছিল গলির পথ। এই অন্ধকারে দ্রুত পা চালিয়ে এগুতে গিয়েই বিপদটা হলো। রাস্তার কিনারে থাকা ইটের সাথে পা আটকে ঠাস করে পড়ে গেলে রাস্তায়। বেশ ভালোভাবে মচকে গেলো পা-টাও। ব্যাথায় মুখ দিয়ে বের হলো চিৎকার। অথচ সাহায্য করার জন্য আশেপাশে কেউ ছিল না কেবল অবুঝ কুকুরটি ছাড়া। মচকে যাওয়া পা নিয়ে উঠে দাঁড়াতে গিয়েই সে খেয়াল করল পায়ে জোর পাচ্ছে না। এত ব্যাথা পেয়েছে যে পায়ে শক্তিই দিতে পারছে না। তারপর আর কী, অসহায় হয়ে ঠাঁই বসেই রইল।
বিন্দুর ব্যাথার মাঝেই কুকুরটা আবার শব্দ করে ডেকে উঠল। এতে চমকে উঠল মেয়েটা। বেশ ঘাবড়েও গেলো আচমকা এমন শব্দে। সাথে সাথে বুকে থুতু দিল সে। কুকুরটার দিকে তাকিয়ে শাসনও শুরু করল,
কুকুরটা কী জানি কী বুঝল! বিন্দুর ধমকে একদম চুপ হয়ে গেলো। উঁচিয়ে রাখা মাথাটাও নামিয়ে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে রইল। মায়া হলো বিন্দুর। আহারে! ধমক দেওয়াতে কী ও কষ্ট পেল? কতক্ষণ আড় চোখে তাকিয়ে রইল কুকুরটার দিকে। অবশেষে না পেরে সে আবার ডাকল,
“থাক, কষ্ট পাইছ না। এদিকে আয় তো। তোরে ধমক দিতে চাই নাই। ভয় পাইছিলাম দেইখ্যা দিছি। রাগ করিছ না। তুই তো আমাগো হুতুমের থেইক্যাও ভালা। হুতুমরে তো একটা ধমক দিলে হের বিপরীতে দুইডা ধমক খাইতে হয়। কিন্তু তুই কি সুন্দর মাইন্যা নিলি আমার ধমক! জানছ, কেউ এমন ভাবে আমারে মানে নাই এ পইযন্ত। না না, ভুল কইছি। করবী আপা আমারে আবার বেশ মানে। একমাত্র হের কাছে গেলেই মনে হয় আমি মানুষ। নাহয় হীরণ ভাই আমার লগে যেমুন করে! আমার না মাঝে মাঝে অনেক কান্দন পায়, জানোছ?”
শেষের কথার সুরে ছিল অবুঝ অভিমান৷ মন খারাপের রেশ। কুকুরটা এবারও বিন্দুর কথা মানল। অলস গা ঝেরে বিন্দুর গা ঘেঁষে বসল। এতে খুশি হলো বিন্দু। ব্যাগ থেকে বিস্কুটের প্যাকেটটা বের করল। প্যাকেটটা ছিঁড়তে ছিঁড়তে আবার কুকুরটিকে বলল
“এই বিস্কুটটা হুতুমের লাইগ্যা নিছিলাম। হেয় আবার অপেক্ষায় থাহে আমি কহন যামু, হের লাইগ্যা কিছু নিমু। হের ভাগের অর্ধেক বিস্কুট তোরেও দিলাম। নে খা…”
কথাটা বলেই সে সত্যি সত্যি অর্ধেকটা বিস্কুট কুকুরটির মুখের সামনে রাখল। কী বিস্ময়কর দৃশ্য! মানুষ কখনো মানুষের ভালোবাসার ভাগ কুকুরকে দিতে পারে? পারে না। মানুষের উচ্ছিষ্টটুকুই যদি কুকুর খায় তাও সহ্য করতে পারে না সেখানে নিজেদের ভাগ দিবে তা অসম্ভব। অথচ এই অসম্ভব কাজটুকু নির্দ্বিধায় করে ফেলল বিন্দু। কুকুরকে বিস্কুট দিল, সাথে গল্প শুনালো তার কত সুখ দুঃখের! হীরণ ভাই কবে কালো শার্ট পরেছিল আর তার বুকের মাঝে ধুকপুকানি বেড়ে ছিল তা বলল। কবে মার্কেটে একটা নীল রঙের শাড়ি পছন্দ হয়েছিল আর দামাদামি করে টাকার অভাবে রেখে এসেছিল সেই শাড়িটি, সেই গল্পটিও বলতে বাদ রাখল না এই বেনামি কুকুরটিকে। কুকুরটিও ফ্যালফ্যাল চোখে গিলল সকল কথা, গল্প কিংবা বলা যায় ব্যাথা!
গল্প করতে করতে রাত আরও ঘনীভূত হলো অথচ হুঁশ নেই সেদিকে মেয়েটার। হাতে থাকা বাটন ফোনটা বন্ধ। এটা দিনের বেশিরভাগ সময়ই বন্ধ থাকে এ আর নতুন কিছু না। কথা বলতে বলতেই বিন্দু অনুভব করল এই শুনশান রাস্তায় চপল পায়ে কেউ এগিয়ে আসছে। কয়েকটি পদধ্বনি। বিন্দু যেন আশার আলো দেখতে পেল। সে ভুল করেও একবার ভাবলো না এখানে যারা আসছে তারা খারাপ মানুষও হতে পারে। ভালো মানুষদের এই এক সমস্যা। তারা নিজেদের ভালো মন দিয়ে বিচার করে বিধায় না ঠকা অব্দি তাদের কাছে পৃথিবীর সকলেই ভালো মানুষ। এমনকি ঠকে গেলেও এরা নিজেদের দোষী ভাবে। ভাবে, তার কারণেই হয়তো বিপরীত পক্ষ তাকে ঠকিয়েছে।
বিন্দুর আশার আলো সত্যি হলো। পথ ধরে আসা মানুষ গুলো আর কেউ নয়, করবী ও হুতুম। হুতুমের চঞ্চল পা প্রায় ছুটছে বললেও হয়। কোঁকড়া কোঁকড়া বাদামী চুল গুলো ছুটার তালে লাফাচ্ছে যেন!
করবী বিন্দুকে দেখতে পেয়ে প্রায় ছুটেই এলো। ভয়ার্ত তার মুখমন্ডল। কিছুটা হড়বড়িয়ে বলল,
“কিরে, তুই এত রাতে এখানে বসে আছিস কেন? তোকে আমরা তন্নতন্ন করে খুঁজছি।”
বিন্দু অভিযোগ করল, “আমি ঝগড়া করি না-কি এই হুতুম করে!”
“হ, হ, এহন তো সব আমারই দুশ আর তুই হইলি অনেক ভালা।”
হুতুমের দু-হাত নাড়িয়ে কথার ভঙ্গিতে এবার না হেসে পারল না বিন্দুও। তারপর করবীর সাহায্য কোনোমতে উঠে দাঁড়াল সে। হুতুমের ছোটো হাত ধরে রওনা দিল গন্তব্যে। পথে রেখে গেলে একা কুকুরটিকে আরও সঙ্গীহীন করে। যে বিন্দুর যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। হয়তো এমন একটা বোকা-সোকা মেয়েকে দেখার তৃষ্ণা তারও ভীষণ!
বাসার কাছে পৌঁছাতেই আমেনা খালা মেয়েকে রাস্তার মাঝেই সশব্দে চ ড় মারলেন। করবী থাকায় এ যাত্রায় বেশি মারতে পারলেন না। কিন্তু মেয়ের পায়ে ব্যাথা শুনতেই মহিলার রণমূর্তি থিতিয়ে গেল। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি আদুরে হলো তৎক্ষণাৎ। বাকি পথটুকু সে-ই হলো মেয়ের ভরসার কাঁধ। করবী হুতুমের হাত ধরে বেশ দ্রুতই এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে কারণ গলির মোড়ে হীরণকে দেখেছে সে। আজ হীরণ চুপচাপ। হুতুমকেও কিছু বলেনি না বলেছে বিন্দুকে। করবীর তো ভয়ে পেট মোচড় দিচ্ছে। ভার্সিটিতে ঐ দৃশ্যের পর হীরণ অবশ্য সাথে সাথেই ভার্সিটি ত্যাগ করেছিলো কিন্তু সারাটা দিন ভয়ে কাটাতে হয়েছে করবীকে। এই বুঝি হীরণ আক্রোশে ফেটে পড়ে ভয়ঙ্কর কিছু করে ফেলল!
(১৪)
অপরাহ্নের ডাহুক তখন বিরহী স্বরে ডাকছে খুব দূরে। করবী নতুন টিউশনির বাসাটা থেকে বের হলো। এত অমায়িক অভিভাবক সচারাচর দেখাই যায় না এই শহরে। এত অসাধারণ একটা টিউশনি পেয়ে যাবে হুট করে তা তার কল্পনাতেও ছিল না। বিকেলের গগণ বক্ষ নীলাভ হওয়ার কথা হলেও এখানের আকাশ রঙহীন। গম্ভীর গম্ভীর বাউণ্ডুলে মেঘের আনাগোনায় ভোরে গেছে আকাশ। বিকালটাকেই যেন সন্ধ্যে মনে হচ্ছে। করবী ছাতা আনেনি সঙ্গে। বের হওয়ার সময় আকাশ ছিল ঝকঝকে পরিষ্কার। হুট করে আকাশের মন উদাস হবে সে কীভাবে জানবে?
টিউশনির বাসা থেকে বেরিয়েই সে বড়ো রাস্তায় উঠলো। এখন একটা মোবাইল শপে যাবে। একটা মোবাইল কিনতে হবে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। ব্যস্ত পায়ে বড়ো রাস্তায় উঠেই সে একটি মোবাইল শপে ঢুকল। সাড়ে তিন হাজার টাকা দিয়ে একটি সুন্দর মোবাইল কিনে নিল। বাটন ফোন। মোবাইল কিনে শপ থেকে বেরুতেই দেখে ঝুম বৃষ্টিতে ডুবে আছে শহর। আকাশ ডাকছে ঘন ঘন। করবীর ছোটো মুখটি ফ্যাকাশে হলো। কিছুদিন পর পরীক্ষা, এখন সর্দি-জ্বর বেঁধে গেলে সমস্যা। তার উপর হাতে এখন টাকাও নেই। করবীর চিন্তিন মুখ শুকিয়ে এলো। এত সুন্দর বৃষ্টিও তার কাছে বিরক্তির ঠেকল। ঠিক তখনই পরিচিত পুরুষালী ভরাট কণ্ঠ ভেসে এলো,
“কী করছো?”
কণ্ঠটি তিমিরের। করবীর সেটা মুখস্থ। তাই তো তৎক্ষণাৎ ঘাড় ঘুরালো না। রয়েসয়ে ঘুরালো। স্মিত হেসে উত্তরে বলল,
“অপেক্ষা করছি।”
তিমির হাসলো। ডান ভ্রু উঁচু করে বলল, “কার?”
“বৃষ্টি কমার।”
তিমির এবার এগিয়ে এলো, দাঁড়ালো খুব নিকটে। একদম পাশাপাশি। নড়লে চড়লে গায়ের সাথে গা লেগে যাওয়ার মতন কাছাকাছি। নিকটে এসেই নিঃশব্দে করবীর ডান হাতে থাকা বাজারের ব্যাগটা নিয়ে নিল। করবী বাঁধ সাধলো,
“আমি পারব।”
তিমির তেমন গা করল না কথাটা। একপলক তাকালো কেবল। করবী এই টিউশনি বাসায় আসার আগেই বাজার করেছিল। ঘরে বাজার ফুরিয়েছে অনেকদিন তাই বাজার দিয়ে আসার সময় প্রায় পুরো মাসের প্রয়োজনীয় জিনিস মোটামুটি কিনে নিয়েছিল। এমন বৃষ্টি হবে জানলে কখনোই কিনতো না।
তিমির করবীর থেকে একটু, নামমাত্র সামনে দাঁড়াল। এমন ভাবে দাঁড়ালো যে বৃষ্টির ছাঁট আর গায়ে লাগল না মেয়েটার। তিমিরের দৃষ্টি মেয়েটার দিকেই। টান টান কণ্ঠে শুধালো,
“এই দোকানে এসেছিলে কেন?”
করবী আদ্র স্বরে জবাব দিল, “বোনের জন্য মোবাইল কিনতে।”
“তোমার বোনও আছে?”
করবী উপর-নীচ মাথা নাড়াল। অর্থাৎ আছে। সময় পেরুলো নিজ গতিতে। বৃষ্টি কমার বিপরীতে তা পাল্লা দিয়ে কেবল বাড়লোই। তিমির এবার আলগোছে করবীর হাতটা ধরল। ধীর কণ্ঠ বলল,
“সামনে আমার গাড়ি আছে। এখানে দাঁড়িয়ে থাকল লাভ হবে না। চলো তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিই।”
করবীর হতভম্ব স্বর, “তাহলে তো প্রথমেই গাড়ির কথা বলতে পারতেন।”
তিমির এবার মেয়েটার বোকা বোকা দৃষ্টি দেখে শব্দ করেই হাসল। মেয়েটার মাথায় আদুরে হাতে রেখে বলল,
“প্রথমেই গাড়ির কথা বললে গল্প বাড়ার আগেই তো সমাপ্তি হতো। আমি তো কেবল তোমার সঙ্গ চাওয়ার বাহনা খুঁজছিলাম।”
অম্বরে বিজলি চমকালো এবার রূপালী আলোয়। মেয়েটার মায়া মুখের লজ্জাবৃত ছন্দ দৃষ্টি এড়ালো না তিমিরের। আজকাল তার ঐ মুখেতেই যে শান্তি লাগে বুঝাবে কেমন করে?
#চলবে…….
#বুকপকেটের_বিরহিণী
কলমে: মম সাহা
নবম পর্ব:
বর্ষণ ধারায় ধরিত্রীর লতার মতন অঙ্গ ভিজে নবযৌবনা লাভ করেছে যেন। নিঃসঙ্গ কাকটি হতে শুরু করে পথের ধারে বসে থাকা পাগলটাও নেত্র যুগল বন্ধ করে ধুয়ে মুছে ফেলছে নিজেদের সকল ক্লান্তি, সকল উদাসীনতা। আবার খুব কাছেই বজ্রপাত হলো।
নৈশব্দের মুগ্ধতা ঝেড়ে লাজুকলতার আভা কিছুটা সরিয়ে ফেলল করবী। নিভু নিভু স্বরে ডাগর নয়ন দু’টো পথের মাঝে নিবদ্ধ করে বলল,
“গাড়ি লাগবে না। আমি যেতে পারব।”
তিমির পলকহীন তাকিয়ে হাসল। মেয়েটার উত্তর তার আগেই জানা ছিল। তবে সে জোর করল না। বরং প্রশ্রয় দিল,
“তাহলে চলো। ভিজেই যাওয়া যাক।”
তিমিরের সম্মতিতে ঘাড় বাঁকিয়ে আবছা ভাবে তাকাল করবী। তারপর ছোটো করে একটা শ্বাস ফেলল,
“আপনার যেতে হবে না। আমার অভ্যাস আছে।”
“সে তো আমি অস্বীকার করিনি। তবে, একদিন অভ্যাস ভাঙলে খুব ক্ষতি হবে বলে মনে হয় না।”
মেয়েটা প্রতিবাদ করতে চাইল। বলতে চাইল, তার অভ্যাস ভাঙতে ইচ্ছে হয় না। পরে অভ্যাস ভাঙার বদঅভ্যেস অশান্তিতে ভুগাবে। কিন্তু বলা হয় না আর। তিমিরের সঙ্গ তার বেহায়া মন ভীষণ ভাবে চাচ্ছে। যেমন ভাবে খড়ার জমিন বৃষ্টি চায় ঠিক তেমন ভাবে।
তিমির গলা ঝাড়ল। ফিচলে কণ্ঠে বলল,
“আসো, একদিন অভ্যাস ভেঙে আমার সাথে হেঁটে দেখো, ভালো না লাগলে বলো আমাকে। আমি নাহয় দু-পা পিছিয়ে হাঁটবো।”
করবীর আর বাকি কথা সম্পূর্ণ করা হয় না। বা’হাতের তালুতে থাকা ঘনিষ্ট পুরুষালী হাতটার দিকে সে তাকায়। লোকটার ধরে রাখা হাতটার মুঠোর ভাঁজ কোমল তবে দৃঢ়। করবীর মন দ্বিধায় ভুগে, এত দৃঢ় বাঁধন ক্ষাণিকের হয়, না দীর্ঘস্থায়ী?
(১৫)
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হলো, সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। বৃষ্টির আজ কোনো থামার নাম নেই। অক্লান্ত ভাবে তার বিচরণ ঘটছে কেবল। তিমির বসে আছে তার ঘরে। হাতে মোটা ইংরেজি কোনো একটা বই। তার ধ্যান সেখানেই নিবদ্ধ। কপালে গাঢ় ভাঁজ।
তন্মধ্যেই তার ঘরের দরজায় টোকা পড়ল। বিরক্ত হলো তিমির। কণ্ঠস্বর খানিকটা উঁচুতে তুলল, শুধাল, “কী সমস্যা?”
তখনই দরজা ঠেলে ঢুকল বিদিশা। হাতে তার খাবারের প্লেট, বলল,
“খেতে হবে না? সারাদিন কপাল কুঁচকে বসে থাকলেই হবে?”
তিমির মেয়েলি রিনরিনে কণ্ঠে চোখ উঠিয়ে চাইল। অতঃপর হাতের বইটা কিঞ্চিৎ বন্ধ করে বলল,
“খাওয়ার ইচ্ছে নেই, ভাবী। নিয়ে যান।”
তিমিরের কথা বিদিশা তেমন গা করল বলে মনে হলো না। বরং সে এগিয়ে এসে খাবারের প্লেটটা রাখল ছোটো টেবিলটার উপর। কিছুটা নিবিড় কণ্ঠেই বলল,
“খেয়ে নিও তো। না খেয়ে থাকলে অশান্তি লাগবে। রাতে আর ঘুম হবে না।”
“এমনেও যা শান্তিতে আছি, বাপরে।”
কথাটা তিমির বেশ তাচ্ছিল্য করেই বলল। কণ্ঠের মাঝে কেমন হেয় ভাব। বিদিশা ঠোঁট উল্টালো। শাসনের ভঙ্গিতে বলল,
“চুপচাপ খাবার খেয়ে তারপর ঘুমাবে। খাবের প্লেট যেন খালি পাই। আর কোনো কথা শুনতে চাই না।”
অতটুকুন মেয়ের শাসনের ভঙ্গিতে হাসল তিমির। বিদিশা তার বড়ো ভাইয়ের বউ হলেও বয়সে বেশ ছোটো। কিন্তু মেয়েটা সম্পর্ক সামলানোতে পাক্কা গিন্নী।
তিমিরকে হাসতে দেখে বিদিশা যেন ভরসা পেল। সাহস করে শাশুড়ির শিখিয়ে দেওয়া কথাটা উগড়ে দিতে চাইল,
“একটা মেয়ের ছবি……”
বাকিটা আর বলা হলো না। তিমিরের চেহারার অভিব্যক্তি বদলাতেই থেমে গেলো সে। মুখটা শুকিয়ে আমসির মতন হয়ে এলো। আমতা-আমতা করতে লাগল সেখানেই।
তিমির তড়িৎ গতিতে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। কর্কশ গলায় বলল,
“আপনি আপনার শাশুড়িকে বলবেন আপনারে যেন এসব কথা শিখিয়ে পড়িয়ে না দেয়। আপনি আমার কাছে অন্তত ঠিক থাকুন।”
“এভাবে কথা বলো না। উনি তোমার মা।”
“সেটাই আমার সবচেয়ে বড়ো দুর্ভাগ্য।”
বেশ অবজ্ঞা করেই কথাটা বলে বারান্দায় চলে গেলো তিমির। বাক্যটাতে যেন রাজ্যের অভিযোগ, অভিমান বিনি সুতোর মালার মতন গেঁথে রাখা ছিল। বিদিশা হতাশ চোখে একবার তিমিরের প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরালো ঘরের ভেজানো দরজাটায়। তার শাশুড়ি বাহিরেই দাঁড়িয়ে আছেন। কী জানি, মানুষটা শুনতে পেয়ে কেমন কষ্ট পেলেন!
(১৬)
মধ্যরাত….
বৃষ্টির টুপটাপ ছন্দের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ল করবীর জ্বর। মেয়েটার বৃষ্টি সহ্য হয় না। কোনো এক অচেনা কারণে তার শৌখিন বৃষ্টির সাথে হয়তো একটি নিবিড় মনমালিন্য রয়েছে। সেজন্য বৃষ্টিতে ভিজলেই তার জ্বর উঠে। যেমন-তেমন জ্বর নয়। গা কাঁপিয়ে জ্বর আসে। ফর্সা শরীর উত্তাপে লাল হয়ে যায়। প্রায় হুঁশ থাকে না বললেই চলে।
আজও ব্যাতিক্রম হয়নি। তুমুল জ্বরে মেয়েটা প্রায় বেহুঁশ বলা যায়। তৈয়ব হোসেন কোনো রকমে সিঁড়ির কোণায় গিয়ে হাঁক-ডাক করে বিন্দুকে জানালেন সে খবর। ব্যস্, হন্তদন্ত হয়ে বিন্দু, হুতুমসহ আমেনা খালাও নেমে এলো এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করেই। আমেনা খালা অভিজ্ঞ হাতে মেয়েটার মাথায় জলপট্টি দেওয়া শুরু করল। হাত-পা মুছিয়ে দিতে লাগল বিন্দু। হুতুমের চোখে ক্ষণে ক্ষণে জমছে জল।
ঠোঁট উল্টে কেবল বার বার আতঙ্কিত মনে প্রশ্ন ছুঁড়ছে,
“বিন্দুর মা, কী হইলো বাণীর মা’র? বাণীর মা আইজক্যা আমারে দেইখাও হাসলো না ক্যান? বাণীর মা ঠিক হইয়া যাইবো তো?”
আমেনা খালা জলপট্টি দিতে দিতে ছোটো হুতুমকে আশ্বাস দেয়,
“কিচ্ছু হইবো না তোর বাণীর মায়ের। সামান্য জ্বর।”
হুতুম তবুও ভরসা পায় না। ঠোঁট উল্টে চেয়ে থাকে করবীর ফ্যাকাশে মুখমন্ডলে। রাত বাড়ার সাথে সাথে যখন জ্বর না কমে আরও বাড়তে লাগল তখন দমে গেলেন আমেনা খালাও। বিন্দুরে তাড়া দিয়ে বললেন,
“যা তো আম্মা, একটু দেখ গিয়া বড়ো রাস্তার কোণার ফার্মেসীডা খোলা নি। থাকলে একটু ডাক্তাররে আইস্যা দেইখ্যা যাইতে ক। মাইয়্যাডার তো জ্বর কমার নামই লইতাছে না।”
মায়ের দমে যাওয়া দেখেই বিন্দুর আত্মা শুকিয়ে গেলো। মা এত সহজে দমে যাওয়ার মানুষ তো নন। তার মানে আপার অবস্থা গুরুতর। এবার হুতুমের মতন চোখে জল এলো বিন্দুরও। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“আম্মা, আপা ঠিক হইয়া যাইবো তো?”
নিজের এত বড়ো মেয়েকেও ভ্যা করে কাঁদতে দেখে এবার ধমক দিলেন আমেনা খালা। শক্ত কণ্ঠে বললেন, ”তুই বইয়্যা বইয়্যা এহন মরা কান্দন না কাইন্দা গিয়া ডাক্তার আন। আর সামাইন্য জ্বর হইলে মাইনষের কিছু হয় না। যা তুই।”
বিন্দু অপেক্ষা করল না। ব্যস্ত পায়ে ছুট লাগালো। বিন্দুর সাথে যাওয়ার বায়না ধরল হুতুমও। বিন্দু আজ না করল না। এমন বিপদে তার একলা চলতে পা কাঁপে। তা-ও হুতুমটা থাকলে একটু তো ভরসা পাবে। তৈয়ব শেখ ব্যতিব্যস্ত বিন্দুর হাতে ছাতা দিলেন। মাথায় স্নেহের হাত রেখে বললেন,
“তোমার ভালো হোক, মা।”
অসহায় বাবাকে দেখে বিন্দুর ঠোঁট ভেঙে আরও কান্না এলো কিন্তু সে কাঁদলো না। বরং সেই বাবার ভরসা হয়ে উঠলো নিমিষেই,
“তুমি চিন্তা কইরো না, চাচা। আপার কিচ্ছু হইবো না।”
তৈয়ব হোসেন হাসলেন। তাকে মোটেও বিচলিত দেখা গেলো না। বরং সে ঝলমলে কণ্ঠে বললেন,
“তোমরা থাকতে আমার কিসের চিন্তা গো, মা? আমার রক্তকরবী অনেক ভাগ্য নিয়ে আসছে, তাই তো তোমাদের পেয়েছে।”
বিন্দু কান্না নিয়েই হাসল। চোখ মুছেই ছুটল বাহিরে।
মধ্যরাত হওয়ায় প্রায় শুনশান গলি। মাথার উপর ছাতা ধরে হুতুমকে নিয়েই সে ব্যস্ত পায়ে গলি পেরিয়ে রাস্তায় উঠলো। চঞ্চল পায়ে রাস্তায় উঠতেই নিরাশ হলো সে। ফার্মেসী বন্ধ। বড়ো রাস্তাটাও ফাঁকা, শুনশান। বিন্দু খেঁই হারালো। এখন কী করবে? ডাক্তারকে সে কোথায় পাবে এখন!
বিন্দুকে দিকভ্রান্ত দেখালো। কী করবে, না করবে বুঝে উঠতে পারল না তার ছোট্টো ব্রেন। অসহায় চোখে হুতুমের দিকে চাইল সে। হুতুমও তার দিকে তাকিয়ে আছে। বিন্দুকে তাকতে দেখে নিষ্পাপ হাসল বাচ্চাটা। বিন্দুকে বলল,
“মন খারাপ করিছ না, বিন্দুবালা।”
বিন্দু জাপটে ধরল হুতুমকে। এই একাকীত্বে এই ছোটো সঙ্গীটিকে তার ভীষণ আদরে আদরে ভরিয়ে দিতে ইচ্ছে হলো। ঠিক তখনই ছন্নছাড়া পুরুষালী কণ্ঠটি ভেসে এলো,
“এ্যই, তোরা রাতে বাইরে ক্যান? তোদের ঘর-বাড়ি নাই?”
আচমকা শুনশান রাস্তায় শক্ত ধমকে চমকে গেলো বিন্দু। ভয় পেলো হুতুমও। বিন্দু পিছু ফিরে চাইল। পিছু ফিরতেই হীরণের লাল লাল চোখ গুলো দৃষ্টিগোচর হলো। হীরণকে দেখতেই আশার আলো দেখল যেন বিন্দু। হড়বড়িয়ে বলল,
“হীরণ ভাই, করবী আপার না ম্যালা জ্বর উঠছে। মানুষটার হুঁশ নাই। ডাক্তাররে নিতে আইছিলাম। কিন্তু দোকান তো বন্ধ হইয়া গেছে।”
বিন্দুর কথা মনযোগ দিয়ে শুনল হীরণ। করবীর অসুস্থতার কথা শোনার পরই তাকে অস্থির দেখা গেল। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,
“বৃষ্টিতে আরও হাত ধরে হাঁটতে বল, তাইলে জ্বর ভালো হয়ে যাবে।”
হীরণের অস্ফুট কথার মানে বুঝল না বিন্দু। জিজ্ঞেস করল, “কী?”
হীরণ কথা বাড়ালো না। হুতুমকে ছোঁ মেরে বাইকে উঠিয়ে ফেলল। তাড়া দিয়ে বলল,
“আমি ডাক্তাররে নিয়া আসি। তুই যা। এত রাইতে তোর এলাকা ঘুরতে হইবো না। বেক্কল মাইয়া। তোর কাছে না আমার নাম্বার আছে? এমনে সময় তো হুদাই কল দেছ। আজকে দরকারের সময় দিতে পারলি না? তোর তো খালি রাস্তায় বের হওয়ার সুযোগ পেলেই হয়। বে কু ব একটা। সোজা বাসায় যা। আমি আসতাছি ডাক্তার নিয়া।”
কথাটা বলেই বাইক স্টার্ট দিল হীরণ। শা করে নিমিষেই চোখের পলকে চলে গেলো সে। বিন্দু কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইল। বিড়বিড় করে কেবল বলল,
“হীরণ ভাই, সবকিছুতে আমারই দোষ খুঁইজ্যা পায়।”
তারপরের ঘটনা সবটাই ঘটলো হীরণের মাধ্যমে। বিন্দু বাসায় পৌঁছানোর পনেরো মিনিটের মাঝেই হীরণ ডাক্তার নিয়ে উপস্থিত হলো। ডাক্তার চেক-আপ করলেন। জ্বর পরীক্ষা করলেন। তারপর ওষুধ লিখে বিদায় হলেন। ডাক্তারকে আবার সহিসালামত পৌঁছানোর কাজটাও এই লোক করল। বৃষ্টিতে ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে গিয়েছে লোকটার টি-শার্টটা। ডাক্তারকে পৌঁছে দিয়ে এই মধ্যরাতেই কোথা থেকে ওষুধ খুঁজে বের করে সেটাও নিয়ে আসলো। ভিজতে ভিজতে মাথার চুল গুলো দিয়ে অব্দি টপটপ করে পানি পড়ছে। অথচ সেদিকে তার ধ্যান নেই। পারলে হয়তো সে এখনই করবীকে সুস্থ করে ফেলে।
এই সবটাই বিন্দু নীরব চোখে দেখল। হীরণ প্রয়োজনীয় কাজ গুলো করেই বাসার নিচে গিয়ে দাঁড়াল। বলে গেলো প্রয়োজনে তাকে ডাকতে। সে আছে।
রাত পেরিয়ে ভোর হবে হবে ভাব। করবীর জ্বরটা স্থিতিশীল। আমেনা খালা মাথার কাছেই ঘুমিয়ে আছেন। হুতুম ঘুমিয়েছে করবীর পাশ বালিশে। তৈয়ব হোসেন আধভাঙা কাঠের চেয়ারটায় বসে ঝিমুচ্ছেন। ঘুম নেই বিন্দুর। সবাইকে ঘুমুতে দেখেই সে নিচে নামল সিঁড়ি ভেঙে। হীরণ ভাইকে জানাতে হবে তো, আপার জ্বর নেমেছে। লোকটা আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবে?
সিঁড়ি ডিঙিয়ে নিচে নামতেই দেখল হীরণ তার বাইকে বসে আছে। বৃষ্টির ছাঁটে আবার ভিজেছে নতুন করে। লোকটা কী পাগল হলো? এত ভিজলে তো নিজেই অসুস্থ হয়ে যাবে! চিন্তিত বিন্দু এগিয়ে গেলো নিঃশব্দে। নিজের গায়ের ওড়নার অবশিষ্ট অংশ দিয়ে হীরণের ঝাঁকড়া চুল গুলো মুছে দিতে উদ্যোত হলো।
আচমকাই বিন্দুকে এতটা ঝুঁকতে দেখে মাথা পেছালো হীরণ। বিন্দুর হাত ঝারা দিয়ে বলল,
“এ্যই মেয়ে, কী করছিস? গায়ের উপর এসে পড়ছিস কেন?”
প্রাত্যহিক জীবনের প্রত্যাশিত দিনটির মতন আজকের দিনটি নয় করবীর। আজকের দিনটি ভিন্ন এবং মন ভালো দিন। প্রায় অনেকদিন তার জীবনে এত ভালো দিনের আগমন নেই। আকাশে মেঘ ভাসছে মহা সরোবরে। চারদিকে বোধহয় শিউলি ফোঁটা মুগ্ধতা। করবী বিকেলে ঘর থেকে বেরুতেই তাদের গলি পেরিয়ে একটা বড়ো রাস্তায় উঠতেই একজন ভদ্রমহিলা তাকে ডাকলেন। টুকটাক জিজ্ঞেস করেই জানালেন, তিনি প্রায় করবীকে দেখেন আসতে যেতে। শুনেছেন করবী টিউশন করায় তাই তিনি এসেছেন করবীর কাছে। তার মেয়ের জন্য একজন শিক্ষক প্রয়োজন। করবী যেন আকাশের চাঁদ পেয়ে গেল হাতে। নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী। বেতন ঠিক হলো সাড়ে ছয় হাজার। করবীর কাছে ব্যাপারটা অপ্রত্যাশিতই ছিল বটে। হুট করে এত ভালো কিছু পেয়ে যাবে সে বুঝতে পারেনি। আনন্দ ভাগ করতে ইচ্ছে করল তার। এবং সেই মোতাবেক সে কল দিল বিন্দুকে। অপরপাশে বিন্দু বোধহয় একটু ব্যস্ত তাই প্রথমবার কলটা রিসিভ হলো না। করবী দ্বিতীয়বার আবার কল দিল। এবার দীর্ঘক্ষণ কল বাজার আগেই রিসিভ হলো। অপর পাশ থেকে বিন্দুর স্বচ্ছ কণ্ঠ,
“আরে আপা, এহন কল দিছো যে? কিছু কী হইছে? কোনো সমস্যা হইছে, আপা?”
করবী হাসল। জবাব দিল,
“কোনো সমস্যা না। তুই কী এখন ছুটি নিয়ে আসতে পারবি, বিন্দু? একটা খুশির খবর আছে।”
“কী খবর, আপা?”
“তুই এলেই বলব। কলে বলে মজা নেই।”
“ছুটি হয় আটটায়। এহন চাইরটা বাজে। দাঁড়াও, মালিকরে বইল্যা এহনই ছুটি নিতাছি। তোমার খুশির খবর আর আমি থাকমু না তা কী হয় নাকি! আইতাছি।”
করবী ব্যতিব্যস্ত হয়ে বলল, “তোর অসুবিধা হলে আসিস না, বিন্দু।”
“আমার কিয়ের অসুবিধা? তুমি এত চিন্তা কইরো না তো। আমি আইতাছি।”
করবীকে আর কথা বলার সুযোগ দিল না বিন্দু। তার আগেই কল বিচ্ছিন্ন হলো। করবী তার গলিতে ফিরে গেল। সেখানে ক্রিকেট খেলছিল এক ঝাঁক ছেলেপেলে। তাদের মাঝে একজনকে ডেকে হুতুমকে নিয়ে আসতে বলল। করবী বলতেই ছেলেটা ছুট লাগালো। করবী মিনিট কয়েক দাঁড়াতেই হুতুম চলে এলো। তার গায়ে লাল রঙের ফ্রকটা। করবী যেটা বানিয়ে দিয়েছিল। বাচ্চাটা কি তবে বুঝে গিয়েছে করবী আজ তাকে ঘুরতে নিবে! হুতুমের দারুণ বুদ্ধি। এতটুকু একটা মেয়ে অথচ তার আই-কিউ লেভেল অসাধারণ। হুতুমের পেছনে আসতে দেখা গেলো বাণীকেও। কী সুন্দর আনন্দ নিয়ে উড়তে উড়তে আসছে! করবী হাসল। তার আনন্দ, দুঃখ ভাগ করার পৃথিবী হয়তো ছোট্টো কিন্তু আফসোস নেই তাতে। মানুষ গুলো যে নিখাঁদ!
করবীও বিপরীতে হাসল। বলল, “হুতুম যদি চায় তাহলে নিতেই পারি।”
হুতুম আনন্দে লাফিয়ে উঠল। থেমে নেই বাণীও। কি জানি কি বুঝলো এই দু’টো নিষ্পাপ প্রাণ! কোন আনন্দে তারা হৈ-হুল্লোড় শুরু করল!
হুতুম, বাণীসহ করবী গেল একটি ব্রীজের উপর। তাদের বাসা থেকে খানিক দূরত্বেই ব্রীজটা। বিকেল হলেই রঙবেরঙের সাজে সেজে উঠে এই ব্রীজ। মনেহয় যেন মেলা হচ্ছে। আধাঘন্টার মাঝে উপস্থিত হলো বিন্দুও। আজকেও মেয়েটা গাঢ় সবুজ রঙের একটি জামা পড়েছে। কোঁকড়া চুল গুলো ছেড়ে রাখা। লাল টুকটুকে লিপস্টিক ঠোঁটে ছড়ানো। বিন্দু আসতেই করবীর আনন্দ ভাগ করার উত্তেজনা বাড়ল। প্রায় লোক সমাগম ভুলেই ও জড়িয়ে ধরল বিন্দুকে। খুশিতে আত্মহারা হয়ে বলল,
“জানিস বিন্দু, আমি আজকে ভীষণ খুশি।”
বিন্দু হাসল, “এত খুশি ক্যান, আপা? বলো এবার।”
“আমি একটা নতুন টিউশনি পেয়েছি। বেতন, সাড়ে ছয় হাজার টাকা। আমার দুঃখের দিন বোধহয় ফুরিয়ে আসছে, বিন্দু। ফুরিয়ে আসছে।”
করবীর চেয়েও বোধহয় দ্বিগুণ খুশি হলো বিন্দু। প্রায় কিছুটা চেঁচিয়েই উঠল সে। যেন হিমালয় পেয়ে গেছে হাতের মুঠোয়। বিন্দুকে আনন্দে চিৎকার করতে দেখে লাফালো হুতুম ও বাণীও। করবী অবাক চোখে দেখল ওদের। আজকাল পৃথিবীতে এমন মানুষও আছে যারা অন্যের খুশিতে আনন্দিত হয়! বিন্দুকে না দেখলে সে জানতোই না পৃথিবীতে কেউ কেউ আজও নিঃস্বার্থ ভাবে পাশে থাকে।
ব্রীজের একটি ফুচকার স্টলে ঢুকল করবী ওরা। এক ঝাঁক তরুণ সেখানে বসে মহা আনন্দে গান বাজনা করছে। মূলত এটা দেখেই হুতুম বায়না জুড়ে ছিল এই দোকানটাতে আসার জন্য। অবশ্য বায়না করার ফলস্বরূপ তার পিঠে একটা কিলও দিল বিন্দু। কিন্তু থেমে নেই হুতুমও। কেমন ঝগড়ুটে মহিলাদের মতন ঝগড়া করল বিন্দুর সাথে! করবী খিলখিল করে হাসল কেবল। এই মেয়ে দু’টো একদমই বনে না। দু’টো যেন দু’টোর শত্রু। অথচ করবী জানে, বিন্দু বুকে নিয়ে না ঘুমালে হুতুমের ঘুম হয় না।
হুতুমের গান-বাজনার প্রতি প্রচুর ঝোঁক। গান গাইতেও পারে মেয়েটা ভীষণ সুন্দর। আর তার নাচের সাথে তো কারো জুড়ি মেলা ভার! এত দারুণ এক্টিভ বাচ্চা সচারাচর দেখাই যায় না। গান-বাজনা পেতেই সে লাফাতে লাফাতে সেখানে চলে গেলো। বিন্দু ও করবী বসল তরুণদের দল থেকে কয়েকটা চেয়ার দূরে। পাল্লা দিয়ে গান, গিটার বাজছে। হুতুমও নাচছে সমান তালে। ব্রীজটা ত্রুটিপূর্ণ এবং অপ্রয়োজনীয় হওয়ায় এখানে গাড়ি-ঘোড়ারও লেশমাত্র চিহ্নটুকুও নেই। হুতুম এবার নাচ ছেড়ে গান ধরল। ভীষণ সুরেলা কণ্ঠ তার! থেমে গেল তরুণদের গিটার, থেমে গেল বাদ্য। সন্ধ্যার সূর্য তখন তার বিদায় ধ্বনিতে মুখরিত। এক ঝাঁক শ্রোতা নির্বাক, মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল চাঁদের মতন মেয়েটার দিকে। হুতুমের অপরিপক্ক কণ্ঠ তখন সুর তুলেছে,
“ঐ চাঁদের টিপে মন ভোলেনা মা।
দোলনা দোলে, মন দোলেনা মা।
রাতের চোখে ঘুম যে নামে,
চাঁদের পাশে,মেঘ যে থামে
আমার পাশে নেইতো তুমি মা…
তোমায় ছাড়া ঘুম আসেনা মা
মাগো তোমায় ছাড়া, ঘুম আসেনা মা…..”
ভীড় জমেছে তবে নিস্তব্ধতার। সন্ধ্যার রঙিন আলোয় বুঝা গেলো ভীড়ের মাঝে কারো কারো অশ্রু চিকচিক করছে। হয়তো ওদেরও মায়ের কথা মনে পড়েছে হুতুম কিংবা করবীর মতন! করবী খেয়াল করল বিন্দু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মুখে ওড়না চেপে রাখায় কান্নার শব্দরা বন্দি হয়ে গেছে। করবী অবাক হলো। বিন্দুকে সে কখনো কাঁদতে দেখেনি তবে আজ এই সামান্য গানেই কাঁদছে কেন মেয়েটা? করবী প্রায় অবাক হয়েই বিন্দুর কাঁধে হাত রাখল। বিন্দুর যেন হুঁশ হলো। কিছুটা থতমত খেয়ে কান্না থামিয়ে দিল তবে থামল না গা কাঁপানো হেঁচকিটা। করবীর বিস্ময় ভোরা কণ্ঠ,
“এভাবে কাঁদছিস কেন, বিন্দু?”
বিন্দু নিজেকে সামলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করল তবে তেমন সক্ষম হলো বলে মনে হলো না। বরং গা কাঁপানো কণ্ঠে বলল,
“আমার হুতুমটার ভালো হোক, আপা। ভালো হোক।”
এই বিন্দুর গাঢ় কণ্ঠ করবীর বড়ো অচেনা। অপরিচিত। হুতুমের দিকে তাকানো বিন্দুর চোখ দুটোর মাঝে যে অসহায়ত্ব, মায়াটা যেন অন্যরকম, অন্য ধরণের। তবে কেমন ধরণ তা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না করবী। তার মাঝেই সকলের আহ্লাদ কুড়িয়ে ছুটে এলো হুতুম। বিন্দুর গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আনন্দে দিশেহারা হয়ে বলতে লাগল,
“দেখ বিন্দুবালা, সবাই আমারে কত্তো আদর করছে। সব্বাই আমার ম্যালা প্রশংসা করছে। ওরা আমারে চকলেটও দিছে, বিন্দু।”
বিন্দু কোনো কথা বলল না। ঠাস করে চ ড় বসালো হুতুমের গালে। হুতুম টলমলে চোখে চাইল। চ ড়ের কারণ না জানা করবীরও যেন বিস্ময় ধরছে না শেষে। হুতুমের ঠোঁট উল্টে এলো কান্নারা। অভিমানী হলো স্বর,
“আমারে ক্যান মারলি, বিন্দুবালা? আমি তো তোর কাছে এহন আইসক্রিম চাই নাই।”
“এতক্ষণে রাত হয়েছে মনে হলো? সেদিন দেখলাম সিএনজি করে এলাকায় ঢুকছো অন্ধকারে। তা, তখন রাত ছিলো না বুঝি?”
হীরণের বাঁকা নজর, বাঁকা কথায় ভয়ের শীতল স্রোত বয়ে গেল করবীর শরীর জুড়ে। লোকটা কী তবে জেনে ফেলল! নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল করবী। কপাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া বিন্দু বিন্দু ঘামকে উপেক্ষা করে বলল,
“হ্যাঁ ছিল। আমার রোজগার করে খেতে হয়। সেজন্য যদি রাত করেও ফিরতে হয় তাহলেও আমার কিছু করার নেই। আপনাদের মতন তো বাপের অঢেল টাকা নেই যে এলাকা এলাকা জুড়ে ঘুরে বখাটেপনা করলেই পেট ভরবে। আমাদের পেট চালানোর জন্য বাবার রোজগার নেই। তাই আরাম আয়েস করে ঘরে থাকতে পারিনা।”
“বিয়ে করে নিলেই তো পারো, রুবী। বিয়ে করো আমাকে। কথা দিলাম, তুমি বিয়ে করলে আমি বখাটে থেকে সভ্য হয়ে যাব। তুমি আসলে আমি সব ছেড়ে দিব। আমাকে ভালো করে নিলেই তো পারো, রুবী!”
শেষের কথাটায় কেমন আবদারের সুর ছিল যেন! কেমন আকুতি মাখানো সেই স্বর! কিন্তু ছুঁতে পারল না করবীর হৃদয় দুয়ার। বরং সে এসব আবেগ উপেক্ষা করেই বাড়ির ভেতর চলে গেল। একমাত্র এই ছেলেটার জন্য এলাকার মানুষ তাকে বাঁকা চোখে দেখে। তার রূপ নিয়ে শ্লেষ কটাক্ষের প্রবণতা বাড়ে। লোকটাকে আশকারা দিলেই মাথায় উঠবে।
করবী উপেক্ষা করলেও একজন আক্ষেপ ভোরা দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল হীরণের লাল চক্ষু যুগলে। এই কথা গুলো তার জন্য হলে কতই না ভালো হতো! আবার নিজের ভাবনায় মনে মনে হাসলো বিন্দু। কী সব আকাশকুসুম ভাবছে সে! তা আদৌও হয় না-কি? তেলে জলে কী কখনো মিশ খায়? আপা হলো বেজায় সুন্দরী অথচ সে কয়লা। সেজন্য আপা প্রেম পেলে সে লাঞ্ছনা পাবে সেটাই স্বাভাবিক।
কিন্তু হীরণের লাল চোখ গুলো দেখে বড়ো মায়া হলো ওর। একটু কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
”তোমার কী শইলড্যা ভালো না, হীরণ ভাই?”
হীরণ করবীর যাওয়ার পথ থেকে চোখ ঘুরিয়ে তাকাল বিন্দুর পানে। কিছুটা মুখ ঝামটি দিয়ে বলল,
“না আমার শইলড্যা ভালা না, কালা। সর তুই। সবুজ রঙে ক্ষেত সেজে বসে আছোছ। কোনো কৃষক দেখলে পরে চাষ করতে চলে আসবে। দূর হ চোখের সামনে থেকে।”
বিন্দু সরল দু-পা। ঠোঁট ফুলিয়ে বলল, ”তুমি হুতুম, আপার সাথে কত সুন্দর কইরা কথা কও। আমার লগে এমন করো ক্যান?”
“কারণ তুই আপাও না, হুতুমও না। তুই ভুতুম। সর এখান থেকে। তোরে দেখলেই আমার সাত পুরুষের নাম আমি ভুলে যাই। একটা মানুষের এমন রঙের জামা কেমনে পরতে মন চায় আমারে বুঝা। খাচ্চরের মতন পছন্দ।”
হীরণের তাচ্ছিল্য না বুঝেই হয়তো খুশি হলো বিন্দু। বীণা এতক্ষণ চুপ থাকলেও এই কটাক্ষ মেনে নিল না। উড়তে উড়তে বলল, “গা ধা হীরণ। গা ধী বিন্দু।”
রাতের খাওয়া-দাওয়া শেষ হয়েছে বেশ অনেকক্ষণ। করবী বই পড়ছিলো। তার রাতের নিত্যদিনের রুটিনই এটা। আজও ব্যাতিক্রম হয়নি। তবে কিছুক্ষণ আগেই বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হতেই সে বারান্দায় গিয়ে বসলো। পুরো এলাকা তখন অন্ধকারে নিমজ্জিত। শুনশান নীরবতায় খা খা করছে চারদিক। করবীর রাত অপছন্দ তাও এমন ঘুটঘুটে অন্ধকার রাত! কিন্তু অপছন্দের জিনিসও আজকাল অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। সয়ে গিয়েছে মস্তিষ্কে। দূর হতে দূর অব্দি, মৃত বিল্ডিং গুলো ছাড়া কিছুই তেমন দেখা যাচ্ছে না। জোছনা নেই এক ফোঁটা। আকাশের কী মন খারাপ?
এই নীরবতা ভেদ করেই হৈচৈ ভেসে এলো। মারধোরের শব্দও শোনা গেল ভীষণ। বিন্দুর কান্নার শব্দ আসছে। আজকেও কী মেয়েটাকে মারছে ওর মা? করবী কান খাড়া করল। হ্যাঁ, বিন্দুর কান্নার শব্দের সাথে মহিলার কণ্ঠও পাওয়া যাচ্ছে। নিস্তব্ধ রাত হওয়ায় সব কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। মহিলা ভীষণ বাজে ভাষায় গালাগালিও করছেন। করবী মনযোগ দিতেই শুনল মহিলার গলা,
“মা* আমি মরি খাইট্টা আর তুই ফূর্তি করছ? মাইনষেরে টেকা দিয়া বেড়াছ। তোর বাপ একটা দশ বছর ধইরা বিছনাতে পইড়্যা আছে আর তুই টেকা কামাইয়া মাইনষের হাতে দেছ। আরে কালী তোর টেকা না দিলেও হেই মাইয়ার জীবন চলবো। রূপ দেইখ্যা নাগররা এমনেই আইবো। তোরে কে নিবো? কে নিবো ক? নাই রূপ নাই কিছু। কলঙ্ক আছে খালি…..”
মহিলা বোধহয় আরও অনেক কিছু বললেন কিন্তু শুনলো না করবী। কান চেপে ধরল সে। ছিঃ তার জন্য মেয়েটা মার খাচ্ছে! তাকে সাহায্য করার অপরাধে? করবী নিজের মুখ চেপে ধরল। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে মহিলার কথায়। সে সুন্দর বলে তার কোনো সমস্যা নেই জীবনে এটা মানুষ কীভাবে ভেবে নেয়? সুন্দর বলেই কী সে পুরুষদের মাথা ঘুরিয়ে জীবন কাটায়? তার এত কষ্টের মূল্য কই তাহলে? সবাই তো ভাবেই সে রূপ দেখিয়ে বিশ্ব কিনে ফেলেছে!
সুন্দর হওয়ার এই এক অপরাধ। মানুষ ভাবে সুন্দরদের জীবনে কোনো দুঃখই নেই! অথচ মানুষ জানেনা, সুন্দর হওয়াটাই কারো কারো জন্য সবচেয়ে বড়ো দুঃখের। যে মেয়েটার মাথার উপরে বড়ো ভাইয়ের ছায়া নেই, বাবা একজন স্ট্রেচারের সাহায্য ছাড়া এক কদম আগাতে পারে না, সেই মেয়ে জানে সুন্দর হওয়ার অপরাধে কত শাস্তি ভোগ করতে হয় তাকে প্রতিনিয়ত।
এসব ভাবনার মাঝেই করবী অন্ধকার রুমে প্রবেশ করল ওর বাবা। অন্ধকার হাতড়ে মেয়ের দিকে একটা খাম এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“এই টাকা গুলো বিন্দুকে দিয়ে দিস। মেয়েটা আমাদের থেকে বেশি অসহায়।”
করবী হতভম্ব। বাবা তো টাকার কথা জানতেন না! তবে?
#চলবে…….
#বুকপকেটের_বিরহিণী
কলমে: মম সাহা
সপ্তম পর্বঃ
যামিনীর অম্বরে আঁধার তখন ঘনীভূত। তৈয়ব হোসেন বসে আছেন মেয়ের পাশে। একমাত্র সম্বল বাবাটির বুকেই করবীর অসহায়ত্বরা ঠাঁই পেল। তৈয়ব হোসেন মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। বরাবরই তিনি গম্ভীর প্রকৃতির। মেয়ের সঙ্গে কথা বলার সময় তিনি বন্ধু হতে পারেন না। বাবা হয়েই কথা বলেন। তবে মেয়েকে সর্বোচ্চ ভাবে ভরসা দেওয়ার চেষ্টা করেন যেন মেয়ের এই বিশাল পৃথিবীতে একা না লাগে।
তৈয়ব হোসেন হাসলেন। যুবক কালে তিনি ছিলেন প্রচন্ড বুদ্ধিমান লোক। লোকে ভালো-মন্দের বিচার বিশ্লেষণ করতে কতবার তার কাছে আসতো! অথচ তিনি বুঝবে না তার অগোচরে তার সন্তানই কী করছে। তা কী হয়?
“জানলাম কোনো এক ভাবে। যখন বিন্দুর সাথে দুঃখ করছিলিস তুই, তখনই শুনলাম। বাবাকে একটি বার জানালি না কেন তোর যে এত গুলো টাকা হারিয়েছে?”
করবী চুপ থাকে। তার বাবা বিচক্ষণ। মেয়ে কেন টাকার কথা জানায়নি সেটা তিনি ভালো করেই বুঝতে পেরেছেন। তাই নতুন করে বাবাকে সে আর বলল না কিছু।
তৈয়ব হোসেন এবার তাড়া দিলেন,
“এখনই গিয়ে মেয়েটার টাকা গুলো দিয়ে আয়, মা। আমাদের বাপ-মেয়ের সংসার, দু’বেলা না খেলেও কিছু হবে না। আর ওদের কত গুলো পেট। আমাদের চেয়ে ওদের সমস্যা বেশি।”
“সেই উত্তরের এখন তেমন কোনো প্রয়োজন যে নেই, মা। তুই টাকাটা দিয়ে আয়। মেয়েটা নাহয় আরও মার খাবে।”
করবীর মনে খচখচ রইল কিন্তু সে আর বসে থাকল না। খামটা নিয়েই ছুটল বিন্দুদের উদ্দেশ্যে। তৈয়ব হোসেন অন্ধকারে মেয়ের চলে যাওয়া অবয়বের দিকে তাকিয়ে রইলেন নির্নিমেষ। তার কী সুন্দর পরীর মতন মেয়ে! এত সুন্দর সন্তানের চোখের নিচের চিন্তার দাগ গুলো তিনি বুঝবেন না তা কী করে হয়? বাবাটা ঘরে থাকে বলে বুদ্ধিও কী লোপ পেয়েছে নাকি যে মেয়ের আড়ালের কথা বুঝবেন না? দীর্ঘশ্বাসে ভারী হলো রজনীর ক্যানভাস। তৈয়ব হোসেন চোখ বন্ধ করলেন। মেয়েটা অবিকল মায়ের মতন হয়েছে। ওর মায়েরও তো এমন সুন্দর রূপ ছিল! স্ত্রীর কথা মনে পড়তেই ফতুয়ার বুকের পকেট থেকে তিনি স্ত্রীর ছবি বের করলেন। আফসোস করে বললেন,
“মিনু, তোমার মেয়েটা তোমার মতনই সুন্দর হয়েছে, জানো? তুমি থাকলে আমরা বাবা-মেয়ে একটা কূল পেতাম। সংসারটা এমন ছন্নছাড়া হতো না।”
অথচ ছবির মিনু জবাব দেন না। কিন্তু তার চোখ দু’টো যেন হাসছে। অসম্ভব সুন্দর নারীদের স্তব্ধ মুখের দিকে তাকালেও মনেহয় কত কথা যেন বলছে সে মুখ, সে চোখ!
সিঁড়ি ডিঙিয়েই ভীরু পায়ে ছাঁদের দরজায় দাঁড়াল করবী। পরিবেশ পরিস্থিতি বুঝার জন্যই এই বিরতি নেওয়া। আলোহীন রাত হলোও মানুষ অবয়ব দেখা যায় বিনাবাধায়। আর সে জন্যই চিলেকোঠার ঘরটার সামনে যে একটা ছিমছাম মেয়েলি শরীর দাঁড়িয়ে আছে তা বুঝতেও বাকি রইল না করবীর। চিলেকোঠার দরজা বন্ধ। হয়তো বিন্দুকে শান্তি দেওয়া হয়েছে সারারাত বাহিরে কাটানোর। এসব নতুন না। তাছাড়া গ্রীষ্মকালীন রাত অবলীলায় কাটিয়ে দেওয়া যায় খোলা আকাশের নিচে বসে। এতে আরাম বোধ হয়। কিন্তু শীতকালেই এই ব্যাপারটা বড়ো অমানবিক হয়ে যায়।
করবী ধীর পায়ে বিন্দুর কাছে পৌঁছালো। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
এই মাঝ রাতে এমন হিমশীতল মেয়েলি কণ্ঠে বিন্দুর চমকে যাওয়া কিংবা ভয় পাওয়া উচিত ছিল। অথচ এর একটাও তার মাঝে দেখা গেল না। বরং তার বিনিময়ে পাওয়া গেল বেশ ঝলমলে কণ্ঠ,
“আমি জানতাম তুমি যে এইহানে আইবা। তাই কষ্ট কইরা আর নিচে যাই নাই-কা।”
করবী বিন্দুর কথায় অবাক হলো কিঞ্চিৎ, “তুই কীভাবে জানলি আমি যে আসবো?”
এবারের প্রশ্নে একশ আশি ডিগ্রি ব্যাসার্ধে ঘাড় ঘুরালো বিন্দু। বলল,
“প্রতিবার আমি মাইর খাওয়ার পর তোমারে দেহি ছাঁদের দরজায় দাঁড়ায় থাহো কেমন অসহায়ের মতন। মাঝে মাঝে তো আমার হাসি পায়। ভাবি, মাইর আমি খাইলাম না তুমি!”
বিন্দু কথা থামিয়েই হাসলো নিঃশব্দে। তার হাসির সঙ্গী হলো করবীও। ছোটো চ ড় দিল পিঠে। মুখ ঘুরিয়ে বলল,
“রসিকতা করিস না। ব্যাথা বেশি পেয়েছিস?”
“আরে আপা, এ গুলা কোনো ব্যাপার হইলো? আমার তো এসব গায়েই লাগে না।”
বিন্দু বেশ গা ঝেরেই উত্তরটি দিল কিন্তু করবী জানে বিন্দু মিথ্যা কথা বলছে। বিন্দুর চিৎকারই বলে দিয়েছিল সে কতটা ব্যাথা পেয়েছিল তখন। তবুও, পরিস্থিতি ঘুরানোর বিরাট ক্ষমতা মেয়েটার মাঝে আছে।
করবী এবার তার হাতের খামটা এগিয়ে দিল,
“নে টাকা গুলো। খালাকে দিয়ে দিস। শুধু শুধু কত গুলো মার খেলি!”
“ছিঃ ছিঃ আল্লাহ্! আপা, তুমি টেকা দিতে আইছো ক্যান?”
“টাকাটা তোদের প্রয়োজন, বিন্দু। নে টাকা গুলো। আমাদের সমস্যা সামলে নিয়েছি আমরা। নে, ধর।”
বিন্দু হাত বাড়াল না। বরং ঠাঁই দাঁড়িয়ে থেকেই বলল,
“আপা, আমার আম্মার কথায় কষ্ট পাইও না গো। আমার আম্মা অভাবের তাড়নায় এমন করে। নাহয় হেয় এত খারাপও না।”
মা’কে ভালো প্রমাণ করার কী আপ্রাণ চেষ্টা মেয়েটার চোখে-মুখে। করবী এগিয়ে এলো তাই। বিন্দুর হাতে জোর করে টাকার খামটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“খালাকে আমি মোটেও খারাপ ভাবছি না। মানুষ অতিরিক্ত চিন্তায় থাকলে কখনো কখনো এমন রেগে যায়। আমি বুঝি সেসব। তুই টাকাটা নিয়ে নে। আমাদের তো দরকারের সময় দিয়েছিলিস। এখন দরকার শেষ। তুই খালাকে এই টাকা গুলো ফেরত দিস।”
“আপা, তুমি আমার আম্মারে অনেক খারাপ ভাবতাছো আমি জানি। কিন্তু আমার আম্মা এত খারাপ না। হেয় আছিলো বিশাল জমিদারের মাইয়্যা। আইজ ভাইগ্য দোষে এইহানে আনছে তারে তার ভাইগ্য। হেই মানুষটা মাঝে মাঝে ক্লান্ত হইয়া এমন করে। তুমি কষ্ট নিও না গো। তার হইয়া আমি ক্ষমা চাইতাছি।”
কথাটা বলে সত্যি সত্যিই ক্ষমা চাইল বিন্দু। তাও হাত জোর করে। করবী তাই কিছুটা রেগে গেল। ধমকে বলল,
“এসব কী করছিস, বিন্দু? চ ড় লাগাবো একটা। খালাম্মা ভালো মানুষ আমি বুঝি। তার আচরণে আমি মোটেও কষ্ট পাইনি। তুই এসব করে আমাকে ছোটো করিস না।”
“তাইলে টেকাটা তুমি নিজের কাছে রাহো। এহন আমাগো সত্যি কইরাই এই টেকার দরকার নাই। যদি কোনো দিন লাগে তোমার কাছ থেইক্যা ফেরত নিমু। আমাগো সাহায্য নেওয়া-দেওয়া কী এত সহজে শেষ হইবো কও? তোমারে আমার কসম, টেকাটা রাহো, আপা। নাহয় আমি বুঝমু তুমি ম্যালা কষ্ট পাইছো দেইখ্যাই টেকাটা দিতাছো।”
করবীর পথ বন্ধ হয়ে গেল। অবশেষে না পেরে টাকাটা আবার নিজের কাছেই ফেরত নিল। বিন্দু মেয়েটা ভীষণ ভালো। বর্তমান পৃথিবীতে অহরহ এত ভালো মনের মানুষ দেখা যায় না। বিলুপ্ত প্রায় বলা যায়। ভালো মানুষ হলেই তো যন্ত্রণা পেতে হয়। তাই আজকাল সবাই ভালো মানুষ হওয়ার ঝুঁকি এড়িয়ে চলছে। সবারই তো সুখে থাকার অধিকার আছে। সুখে থাকতে হলে যদি খারাপ মানুষও হতে হয়, তাতেও আজকাল যে কারো আপত্তি নেই।
তারপর রাত বাড়ল। করবী যেতে চায়নি বিন্দুকে একা রেখে। বিন্দুর সাথেই থাকত চাইলো। কিন্তু নাকচ করল বিন্দু। সে করবীকে জোর করে নিচে পাঠালো। এবং বলল,
“আমি এইহানে একা থাহুমও না, আপা। আমার এই পৃথিবীতে সঙ্গী হয়তো কম কিন্তু একবারে শূন্য না।”
করবী সেটারও প্রমাণ পেলো। যখনই সে দরজা পেরুলো ঘাড় ঘুরাতেই দেখলো ছোটো ছোটো পায়ে একটা বাচ্চা এগিয়ে যাচ্ছে বিন্দুর কাছে। কেমন যত্ন করে বিন্দুর মারের জায়গা গুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে আলগোছে! সারাদিন ঝগড়া করা দু’টো মানুষ কেমন দু’জন দু’জনের ব্যাথা ভাগ করে নিচ্ছে এই মধ্য রাতে! করবী দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই মেয়ে গুলোর অনেক ভালো হোক— প্রার্থনাটুকু করেই সে নিজের বাসার দিকে পা বাড়াল।
১২.
ভার্সিটির চত্বরে পা ঝুলিয়ে বসে আছে করবী। হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিল মাত্র এগারোটা। একটা ক্লাস করার জন্য কতদূর পথ হেঁটে আসল! অথচ একটা ক্লাস হবে জানলে সে কখনোই আসতো না। অবশ্য নোটিশ তো দিয়েছিলই কিন্তু তার স্মার্ট ফোন না থাকায় সে এটা সম্পর্কে অবগত ছিল না। তার উপর তার কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধু বান্ধবও নেই যে এই ব্যাপারটা জানিয়ে দিয়ে তার এত বড়ো উপকারটা করবে।
বেলা বাড়ায় পাল্লা দিয়ে বেড়েছে খিদেটাও। চত্বরের খুব দূরে দূরে বসে আছে ছাত্র-ছাত্রীরা। একেকজন একেক কাজে মশগুল। করবী ব্যাগে হাত দিল। আসার সময় আমেনা খালা মানে বিন্দুর মা তাকে এই টিফিন বক্সটা ধরিয়ে দিয়েছিলেন এবং বলে ছিলেন,
করবী অবশ্য কিছুটা অবাকও হয়েছিল মহিলার আচরণে। ভদ্র মহিলা এমনই। হুট করে রেগে যান। আবার এত মায়া দেখান মাঝে মাঝে! করবীর তো কখনো সখনো মনে হয় এটা তার নিজের মা বুঝি!
সে ধীর হাতে ব্যাগ থেকে টিফিন বক্সটা বের করল। বেশ মাঝারি আকারের টিফিন বক্সটি খুলতেই দেখলো সেখানে ঠাঁসা তার পছন্দের বৌয়্যা ভাত এবং শুঁটকি মাছের ভর্তা, বেগুন ভর্তা সহ তিন চার পদের ভর্তা। নিজের এত প্রিয় খাবারটা দেখে করবীর তর সইলো না। হাত ধুইয়েই এক লোকমা চালান করে দিলো মুখে। সুস্বাদু খাবারের ছোঁয়া পেতেই চোখ দু’টো আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে গেল। প্রথম লোকমাটা গিলেই চোখ মেলতেই দেখল তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে পার্থিব ও তিমির। চোখ মেলেই তাদের দেখে করবী কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল। থতমত খেলো নিমিষেই। জিজ্ঞেস করল,
তার খাওয়ার দৃশ্য যে দেখেছে ওরা তা ভালো করেই বুঝতে পারল করবী। আমতা-আমতা করে বলল,
“হ্যাঁ, নিন না। শেয়ার করছি। আসুন।”
পার্থিব আর অপেক্ষা করল না। হাত ধুয়েই এক লোকমা মুখে তুলে নিল। সাথে জোর করে তিমিরের মুখে এক লোকমা চালান করল। আমেনা খালার রান্নার হাত ভীষণ ভালো। তাই খাবারটি মুখে দিতেই প্রাণ জুড়িয়ে এলো দুজনেরই। পার্থিব ভীষণ আগ্রহী হলো। এটা ওটা জিজ্ঞেস করা আরম্ব করল এই নতুন খাবারটির বিষয়ে। সাথে তিমিরের টিফিন বক্সটিও খুলল সে নিজে। তিনজনের খাবার ভাগাভাগি হলো নিঃসংকোচে। পার্থিব বেশ বন্ধুসুলভ হওয়ায় করবীর সংশয় কেটে গেলো নিমিষেই। ডুবে গেলো দু’জন ভীষণ আড্ডায়।
তিমির এক ধ্যানে তাকিয়ে রইল করবীর দিকে। অনেক গুলো বছর আগে ঠিক এ জায়গাতেই তিমিরের গল্প ছিল অন্যরকম। অথচ আজ সে গল্পের ছিটেফোঁটাও অবশিষ্ট নেই। অথচ সেই গল্পের প্রধান চরিত্রের নারী অবয়বের সাথে আজকের নারী অবয়বটির ভীষণ মিল। তিমির যেন এক মুহূর্তের জন্য ভুলেই বসলো, তার গল্পের সমাপ্তি হয়েছে আজ বহুদিন। এবং সেই ভুল থেকে ভুলো মন করে বসল একটা বিব্রতকর কাজ। করবীর ঠোঁটের পাশে লেগে থাকা খাবার টুকু সে মুছে দিল নিজের হাতে। এবং ঠিক সেই মুহুর্তেই থেমে গেল আড্ডা। করবী তো বিস্মিত হলো সাথে বাদ গেল না পার্থিবও। বন্ধুর দিকে সে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইল। হুশ হলো তিমিরের। সে বোকার মতন কাজ করে ফেলেছে। কিন্তু সে কাউকে বুঝতে দিল না। বরং এমন ভাব করল যেন এটা স্বাভাবিক, প্রায় সময়ই সে এই কাজটা করে।
লজ্জায় নুইয়ে এলো করবী। সুন্দর গাল গুলোতে দেখা দিল গোলাপী আভা। মনে হলো যেন গোলাপ ফুলের পাপড়ি! ঠিক সেই মুহুর্তে, আবেগ-অনুভূতির এলোমেলো সময়টাতেই করবীর ফোনে ম্যাসেজ এলো। করবী নিচু অক্ষি যুগল ফোনের দিকে দিতেই তার লজ্জা রাঙা মুখ নিমিষেই মলিন হয়ে গেলো। গোলাপী প্রেম কেটে ধরা দিল ভয়। ভীত চোখে চারপাশ তাকাতেই খেয়াল করল দূরে বসে রক্ত লাল চোখ নিয়ে তাকিয়ে আছে হীরণ। অথচ ঠোঁটে বাঁকা হাসি।
সকাল সকাল তৈরী হলো করবী। এইতো, সময় মাত্র সাড়ে আটটা। ওর ঘুম ভেঙেছে ভীষণ ভোরে। সারারাত ঠিক মতন ঘুম হয়নি। এ আর নতুন কী? প্রায় সময়ই তার ঘুম হয় না। এমন নয় যে ঘুম আসেনা। ঘুম আসে ঠিকই কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই যেন চোখের পাতায় নৃত্য করে অভাব, অনটন আর দুশ্চিন্তা। তারপর ঘুম যে কোথায় ছুটে পালায় আর আসেনা। তাছাড়া খুব ছোটোবেলা থেকেই করবীর ঘুম নিয়ে সমস্যা। ওর মা যখন হারিয়ে গেলো, তখন ওর বয়স চার। আধো কণ্ঠে ভীষণ পাকা পাকা কথা বলতো। দুষ্টুমি করতো বাড়ি-উঠোন জুড়ে। মা-বাবার একমাত্র আহ্লাদের সম্পদ ছিল কি-না সে! এরপর একদিন তার রূপকথার মতন জীবনে আছড়ে পড়লো ভয়ঙ্কর কালবৈশাখী ঝড়। মা হারিয়ে গেলেন হুট করে। তারপর থেকে সমাজ তাকে কেমন বাঁকা নজরে দেখা আরম্ভ করল। যেখানেই পেতো, সেখানেই ছোটো করবীকে সকলে উৎসুকতা নিয়ে প্রশ্নে জর্জরিত করত— কিরে, তোর মা হুট করে কোথায় গেল? কারো সাথে পালিয়ে গিয়েছে নাকি? শুনলাম তোর বাবা বলছেন, তোর মা মারা গেছেন? তোর মা’কে যেদিন পাওয়া গেল না সেদিন রাতেই নাকি শহরের এক জায়গায় একটা মহিলার মাথাহীন লা শ পাওয়া গেলো সেই লা শটা নাকি তোর মায়ের ছিল? আরও কত কী…….
ছোটো করবী ফ্যালফ্যাল নয়নে প্রশ্ন গুলো শুনতো। উত্তর জানতো না বিধায় কেবল শুনেই যেত। তারপর উত্তরের আশায় বাবার কাছে আসতো, জানতে চাইতো তার চাঁদের মতন সুন্দর মা কোথায় গেল? কেমন করে মিলিয়ে গেলো এই কালের গহ্বরে? বাবা চুপ থাকতেন। কখনো কখনো আগলে নিতেন মেয়েকে বুকের মধ্যিখানে। তারপর ঐরকম একটা অসুস্থ পরিবেশে থাকতে থাকতে করবী অসুস্থ হয়ে গেলো একবার। অন্ধকার রুমে একা বসে ‘মা,মা’ করতো। কারো সামনে আসতো না, কান্না করতো। রোগ যখন ভয়াবহ হলো, ডাক্তার বললেন এই পরিবেশ থেকে দূরে নিয়ে যেতে। পরিবেশ বদলালেই, ভাবনা বদলালেই ছোটো মেয়েটা সুস্থ হয়ে যাবে। তারপর আর কী? ছেড়ে এলো সোনার শৈশবের অর্ধাংশ সুখে কাটানো বাড়ি, ছেড়ে এলো প্রিয় জায়গা, ছেড়ে এলো বন্ধু-বান্ধব। এরপর তার বাবা আর কখনো কোনো আত্মীয় স্বজনের সাথে যোগাযোগ করেননি। সেই যে আলাদা হলো, এরপর তারা চিরজীবন বাবা-মেয়ের পরম আত্মীয় হয়ে কেবল দু’জনই অবশিষ্ট রইল দু’জনের জন্য।
ভোরে উঠেই আজ রান্নার কাজটা সে সেড়ে ফেলেছিল। বাবা আজ নাহয় একটু বিশ্রাম নিলেন। রান্না শেষ করেই তৈরী হয়ে নিল সে। আজ সাড়ে নয়টায় ভার্সিটিতে একটা ক্লাস আছে। তারপর আবার দেড়টায় একটা। ভার্সিটি শুরু হয়েছে বেশ খানিকটা দিন তো হলো। ক্লাসে না গেলে পড়াশোনাটা ঠিক আয়ত্তে আনা যাবে না। তাই সকাল সকালই তৈরী হয়ে নিল। করবী প্রায় রেডি হয়েছে তন্মধ্যেই তাদের দরজায় টোকা পড়ল। একবার, দু’বার নয়, বেশ কয়েকবার। পাছে বাবার ঘুম ভেঙে না যায় সে ভয়ে করবী দ্রুত ছুটে গেলো দরজা খোলার জন্য। দরজাটা খুলতেই চার বর্ষীয়া, টিনটিনে শরীরের মেয়ে- হুতুমকে চোখে পড়ল। ময়লাটে একটা ফ্রক পড়নে, শ্যামলা আদলের মেয়েটি তার বড়ো বড়ো আশ্চর্য সুন্দর রকমের চোখ দু’টি মেলে হাসল। সরু ঠোঁট দু’টো কেমন নাটকীয়তার সাথে নাড়িয়ে বলল,
“এই যে বাণীর মা, তোমারে বিন্দুবালা যাইতে কইছে। তোমার লগে নাকি হের কথা আছে।”
হুতুমকে দেখেই গাল ভোরে হাসল করবী। এই হুতুমকে তার বেশ পছন্দ। হুতুম বিন্দুর বোন। বিন্দুর চেহারা অবয়বের সাথে হুতুমের পুরো মিল। তারা যে দু’জন দু’জনের আত্মীয় তা চেহারা দেখেই স্পষ্ট বুঝা যায়। কিন্তু দু’জনের মাঝে কিছু পার্থক্য রয়েছে। বিন্দুর চোখের মনি কালো মিচমিচে হলেও হুতুমের চোখের রঙ গাঢ় বাদামী। বিদেশীদের যেমন হয় না? তেমন। এবং চুল গুলো কোমড় অব্দি তাও মাঝামাঝি রকমের সোনালী। কী যে সুন্দর লাগে বাচ্চাটাকে! মনেহয় জলজ্যান্ত পুতুল। গরীবের ঘরের মিষ্টি পুতুল। করবীর মাঝে মাঝেই মনেহয়, হুতুম যদি কোনো বড়োলোকের ঘরের মেয়ে হতো তাহলে হয়তো হুতুমের গায়ের রঙটা সঠিক যত্নে দারুণ ঝলমলে হয়ে যেত। কিন্তু ভাগ্যের ফের! এত সুন্দর পরীটা জন্মালো একদম হতদরিদ্রের ঘরে। যাদের দিন আনে দিন খায় অবস্থা। শখ করে বাচ্চা যত্ন করার সময় কই তাদের? সেজন্য গায়ের রঙটা কিছুটা মলিন হয়ে গিয়েছে বাচ্চাটার।
“তুমি কী যাইবা? নাকি বিন্দুবালারে বলমু তুমি দরজা খুইল্যা দাঁড়াইয়া ভাইব্যা ভাইব্যাই দিন কাটাই ফেলতাছো?”
হুতুমকে যেতে বলা হলেও সে গেলো না। বিজ্ঞদের মতন দু’হাত আড়াআড়ি ভাবে বুকের মাঝে গুঁজে বলল,
“না, তোমার যা কাজ আছে তা এহনি সমাধান কইরা আহো। বিন্দু কইছে তোমারে সঙ্গে লইয়্যাই যাইতে।”
করবী কপাল চাপড়ালো। বাচ্চাটা এত পাকা! অবশেষে সে এক ছুটে ঘরে গিয়ে একটা ছোটো জামা নিয়ে এলো। জামাটা এনেই হুতুমের হাতে দিয়ে বলল,
“ধরো, তোমার জন্য এটা বানিয়েছি আমি নিজের হাতে। আজকে সুন্দর করে গোসল করে এ জামাটা পরবে কেমন? তারপর সন্ধ্যাবেলা আমি এলে, আমরা ঘুরতে যাব। কী বলো?”
আকস্মিক জামাটা পেয়ে হুতুম যেন আকাশের চাঁদ পেয়ে যাওয়ার মতন খুশি হয়ে গেলো। উল্লাসিত মনে এক ছুটে চলে গেলো সিঁড়ি ডিঙিয়ে ছাঁদে। করবী দরজাটা বাহির থেকে আটকিয়ে পেছন-পেছনই গেল।
বিন্দু তখন রান্না-বান্নায় ব্যস্ত। আজ তাদের মা বাসায় নেই। যে বাড়িতে ভদ্র মহিলা কাজ করেন, সে বাড়ির বউয়ের বাচ্চা হবে তাই মাঝে মাঝেই সেই বাড়িতে থেকে যেত হয় উনাকে। এবং ঘরে বিন্দুর প্যারালাইজড বয়স্ক বাবা আছেন। যিনি দিন-রাত একটানা শুয়ে থাকেন। যেদিন ওদের মা’কে সেই বাড়িতে থেকে যেতে হয় সেদিন এই প্যারালাইজড বাবাকে খাওয়ানোর দায়িত্ব পরে ছোট্টো হুতুমের হাতে। করবীর মাঝে মাঝে অবাক লাগে। এই ছোটো মেয়ে, যার নিজে হাতেই খাওয়ার কথা না সে কি-না এই মানুষটাকে খাইয়ে দেয়! পৃথিবীতে কত দার্শনিক ঘটনাই ঘটে। কেবল লোক সমাজে রটে না বলে এই বিস্ময়কর ঘটনা গুলো সকলের অজানাই থাকে।
করবীকে দেখেই বিন্দু রান্না রেখে উঠে আসল। হাসল,
“আপা, তোমারে একটা দরকারে ডাকছি।”
“কী দরকার? বল না?”
বিন্দু ছুটে ঘরে গেল। ঘর থেকে কিছু একটা নিয়ে আবার বাহিরে ছুটে এলো হন্তদন্ত পায়ে। করবীর দিকে তার ডান হাতে থাকা কিছু টাকার নোট এগিয়ে দিয়ে বলল,
“এইহানে সাড়ে তিন হাজার টেকা আছে, আপা। তোমার তো টেকার সমস্যা কয়ডা দিন ধইরা, তুমি রাহো টেহাডি। কাইল বেতন দিছিল। তোমার লাইগ্যা এই টেহাডি আলাদা কইরাই রাখছিলাম।”
করবী টাকা গুলো নিল না। বরং হাত সরিয়ে নিয়ে বলল,
“এই না না বিন্দু, তোদেরই কত সমস্যা তার মাঝে আমাকে টাকা দিচ্ছিস কেন?”
“আরে রাহো তো,আপা। আমার লগে তোমার কী হেই সম্পর্ক যে টেহা নিতে পারবা না? তোমার বিপদে যদি সাহায্যই করতে না পারি তাইলে এই টেহা রোজগার কইরা কী লাভ!”
“না, তোর কষ্টের টাকা, বিন্দু। আমি কোনো একটা ব্যবস্থা করে নিবো।”
বিন্দু এবার টাকা গুলো জোর করেই করবীর হাতে গুঁজে দিল,
“হুনো, টেহা কেউই এমনে এমনে পায় না, সবার কামানোই লাগে। সবারই শ্রম দিতে হয়। এই যে তুমি কামাও, হেইড্যা কী মাগনা-মাগনা কামাও? না। কষ্ট কইরাই কামাও। খালি তোমার কষ্ট আর আমার কষ্ট একটু আলাদা। আমি করি অসম্মানের চাকরি। গার্মেন্টসের কাম। আর তুমি করো সম্মানের কাম, মেডাম।”
করবী বিন্দুকে তৎক্ষণাৎ বুকে জড়িয়ে ধরল। কম্পনরত কণ্ঠে বলল,
“আমি এই ঋণ ভুলবো না, বিন্দু। ভুলবো না।”
৭.
ভার্সিটির ক্লাস শেষ হতেই করবী হন্তদন্ত পায়ে বের হলো। আজকে সে খামে করে এক হাজার টাকা নিয়ে এসেছে তিমির নামক লোকটাকে শোধ করে দিবে বলে। সেই টাকাটা দেওয়ার জন্যই এত হন্তদন্ত হয়ে বের হওয়া।
পুরো ভার্সিটি ঘুরেও আজ তিমিরের খোঁজ পেল না করবী। মাথার উপর সূর্য তখন তার সমগ্র তেজ দু-হাতে দান করতে ব্যস্ত। করবীর অতি সুন্দর মুখমণ্ডল গরমে লাল হয়ে গেলো। ঘামে ভিজে একাকার হলো সুতির জামাটাও। সে হাতের চিকন ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখল সময় প্রায় বারোটার বেশি। তাই আর সাত-পাঁচ না ভেবে ক্যাম্পাস ছাড়ল। ভেবে নিল পরবর্তীতে দেখা হলে টাকাটা ফেরত দিবে। ক্যাম্পাস ছেড়েই কলেজের পার্শ্ববর্তী গলি ধরে হাঁটা আরম্ভ করল। এখান দিয়ে গেলে একটু সময় সাশ্রয় হয়। আর সময় বাঁচলে তারও লাভ। দ্রুত পড়িয়ে বাসায় যেতে পারে। নাহয় খিদে নিয়ে এত বেলা অব্দি চলাফেরা করা সম্ভব হয়ে উঠে না।
ব্যস্ত রাস্তায় করবীর শান্ত বিচরণ হুট করেই অশান্ত হয়ে গেলো। অতিরিক্ত সূর্যের তেজ আর খিদে সহ্য করতে না পেরে তার মাথা ঘুরে উঠল। এবং জ্ঞানশূন্য হয়ে লুটিয়ে পড়ল পথের ধারে। ব্যস্ত রাস্তা ব্যস্তই রইল, উৎসুক জনতাদের ভীড় বাড়ল। কিছু কিছু মানুষ কেবল ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে দেখলো এক ভয়ঙ্কর সুন্দর রূপসীকে। এত সুন্দরও মেয়ে হয় আদৌও? মনে হচ্ছে পথের ধারে লুটিয়ে আছে কোনো অপ্সরা। রঙ উঠে মেটে নীল হওয়া সুতির জামাটাতেও এই মেয়েকে লাগছে স্বর্গের নন্দনকাননের সবচেয়ে সুন্দর ফুলটি।
কলেজের আইডি কার্ডটি শনাক্তকরণ করে কয়েকজন কলেজে খোঁজ পাঠালো। এত পথচারীর মেলা জমলো তবে কেউ মেয়েটাকে ছুঁয়ে অব্দি দেখল না আদৌ বেঁচে আছে না ম রে গিয়েছে অথচ চোখ দিয়ে গিলে খেলো কত শকুন!
৮.
আজ কারখানা বন্ধ থাকায় বিন্দু দুপুরের দিকে বাজার করতে বেরিয়ে ছিল। তার সাথে বের হওয়ার বায়না ধরলো হুতুমও। হুতুমের সঙ্গে বের হলো বাণীও। বাণীর আবার ঘুরার শখ। ঘুরবে, উড়বে আর বকবক করবে।
বিন্দুর বাজার শেষ হতেই হুতুম বায়না ধরল,
“বিন্দুবালা, আমারে আইসক্রিম কিইন্যা দে।”
হুতুম মুখ কালো করলো,“তুই খোডা দিবি না একদম। আমি কইলাম বিন্দু’র মা-রে কমু।”
“গিয়া ক আমার মা’রে। আমি ডরাই না-কি?”
“ডরাছ না তুই? বিন্দুর মা যহন তোরে ধুমধাম কিল দেয় তহন কান্দছ ক্যান?”
হুতুমের উচিত জবাবটা ঠিক পছন্দ হলো না বিন্দুর। সত্যি কথা বলার অপরাধে হুতুমের পিঠে ধুম করে কিল পড়ে গেল একটা। তারপর বেশ জোরে গাল টেনে বলল,
“আয় খাওয়াচ্ছি তোর মরার আইসক্রিম।”
হুতুম মহা আনন্দে নেচে উঠলো। কিন্তু বাণীর বোধহয় পছন্দ হলো না বিন্দুর আচরণ। তাই কয়েকবার আওড়ালো,
“অসভ্য বিন্দু। অসভ্য বিন্দু।”
আইসক্রিম কিনে দোকান থেকে বের হতেই পাশের টং দোকানে হীরণকে দেখল বিন্দুরা। বরাবরের মতনই মনের আনন্দে সিগারেট ফুঁকছে সে। হীরণকে দেখেই মুখটা ঘষেমেজে নিল বিন্দু। হাতে থাকা ব্যাগটা থেকে গাঢ় গোলাপী একটা লিপস্টিক বের করেই ঠোঁটে লেপে নিল সে। আয়না ছাড়া লিপস্টিক দেওয়ার ফলে কিছু লিপস্টিক ছড়িয়ে গেলো ঠোঁটের বাহিরেও। তারপর হেলতে দুলতে সে উপস্থিত হলো টং দোকানে,
“আরে হীরণ ভাই, তুমি এইহানে যে!”
বিন্দুর কণ্ঠটি যেন নিমতেতো ঠেকলো হীরণের কাছে। সে বিন্দুর দিকে এক পলকও তাকালো না। তবে সিগারেট ফেলে দিল হুতুমকে দেখেই। তারপর দু’হাতে হুতুমকে টেনে নিয়ে বলল,
“কিরে হুতুম পেঁচা, তুই এই রোদে রাস্তায় বের হইছোছ ক্যান? পরে তো কাইল্যা হইয়া যাবি বিন্দুর মতন।”
মুখ ঝামটি দিয়ে বলল হীরণ। এবারও হীরণের কথা পছন্দ হলো না বাণীর। তাই সে আবার বলল,
“বে য়া দ ব হীরণ, বে য়া দ ব। ভালো বিন্দু, সুন্দর বিন্দু।”
#চলবে……..
#বুকপকেটের_বিরহিণী
নৈকট্যতার পঞ্চম পর্ব:
কলমে: মম সাহা
৯.
হসপিটালের করিডোরে অস্তায়মান সূর্যের কিঞ্চিৎ কিরণের আভা বুঝিয়ে দিল একটি ব্যস্ত দিনের সমাপ্তি হচ্ছে। করবীর মাথা ঝিমঝিম করছে। ডাক্তার বললেন, প্রেশারটা কমেছে অনেক। তাই হয়তো মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল! তবে কে আনল তাকে এইখানে? অন্তঃস্থলে প্রশ্ন উদিত হতেই তার সামনে ঝলমলে হাসি নিয়ে উপস্থিত হলো পার্থিব। এসেই চঞ্চল কণ্ঠে শুধাল,
“ভালো আছো এখন, করবী?”
করবী মাথা নাড়াল। সে যেই বেডে শুয়ে আছে তার আশেপাশে আরও এমন বেড পনেরো-বিশটা। সেই কারণেই রোগী এবং তাদের আত্মীয় স্বজরের হৈচৈ-এর কারণে মাথাটা আরেকটু ভার হলো তার। তবুও কিছুটা অস্ফুট স্বরে উত্তর দিল,
“ভালো আছি। আপনি এখানে?”
“তুমি জ্ঞান হারানোর পরেই তো ক্যাম্পাসে খবর গেল। তারপর আমরা কয়েকজন এসে তোমাকে রাস্তায় জ্ঞানশূন্য পেলাম। বাসা থেকে খেয়ে আসোনি, করবী? এমন বোকামো কেউ করে? একটা বিপদ হয়ে যেতে পারতো।”
করবী কথা ঘুরানোর জন্য চাপা হাসল। বলল, “খাবো না কেন? খেয়েছিলাম তো।”
“সে তুমি কতটুকু খেয়েছ তা তোমার রিপোর্টই বলে দিয়েছে।”
এবারের জবাবটা এলো অন্যকারো কণ্ঠ থেকে। করবী মাথা হেলিয়ে পার্থিবের পেছনে তাকাতেই দেখল তিমির দাঁড়িয়ে আছে। তার একটি হাতে ডকুমেন্ট একটা। হয়তো রিপোর্ট গুলো। আরেক হাতে বিশাল দানবীয় আকারের একটি পলিথিন ব্যাগ। যেটা দেখেই বুঝা যাচ্ছে এর ভেতরে রঙবেরঙের ফল দিয়ে ভোরা।
করবী আমতা-আমতা করল, “আসলে তাড়াতাড়ি বের হতে গিয়ে খেতে মনে ছিল না।”
“তোমার যে পাকস্থলীতে আলসার আছে, সেটা মনে আছে তো?”
করবী এবার আরও হতভম্ব হলো। তার যে পাকস্থলীতে ছোটো আলসার দেখা দিয়েছিল সে-কথা তো ও কাউকে, কখনো জানায়নি। তবে ভদ্রলোক জানলো কীভাবে?
করবীর দ্বিধাদ্বন্দে আচ্ছাদিত মুখমন্ডল দেখে তিমির বোধহয় কিছুটা আঁচ করতে পারল। তাই সেই সংশয় পরিষ্কার করতেই সে কিছুটা ব্যাখ্যার্থে বলল,
“আমি জানতাম না, ডাক্তার জানালেন। এখানে আসার পর তোমার বেশ কয়েকটা পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে। সেই সুবাধেই জানা। তা, যার আলসার আছে সে কীভাবে খালি পেটে থাকে আমাকে একটু বুঝাও? এটা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ জানোনা?”
শেষের প্রশ্নটুকু বেশ কৈফিয়তের ভঙ্গিতেই ছুঁড়ল তিমির। করবী মাথা নত করল। আশপাশ হাতড়ে অজুহাত খুঁজতে গিয়েই ফিরে এলো অজুহাত বিহীন। এমন অস্বস্তিকর পরিবেশকে শীতল করতেই পার্থিব বলল,
“থাক তিমির, হয়তো ওর তাড়াহুড়ো ছিল তাই খায়নি। বাদ দে।”
তিমির বাদ দিল অবশেষে। ঠিক তন্মধ্যেই করবীর ছোটো ভাঙাচোরা ফোনটা বেজে উঠল। করবী এদিক ওদিক ঘুরল ফোনের খোঁজে কিন্তু পেল না। অথচ রিংটোনের শব্দটা বেশ কাছ থেকেই আসছে বুঝা যাচ্ছে। ঠিক তখনই তিমির নিজের পকেট থেকে করবীর ফোনটা বের করে এগিয়ে দিল। করবী কৃতজ্ঞতার হাসি দিয়েই ফোনটা রিসিভ করল। ফোন রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে ঝাঁঝালো একটা কণ্ঠস্বর শোনা গেল,
“এই তুমি কী আর পড়াইবার পারবা না? না পড়াইবার পারলে কইয়া দিবার পারো না? কোনো দায়িত্বজ্ঞান নাই তোমার। কয়টা বাজে দেখছো? কখন আসবা কও দেখি?”
করবী কিঞ্চিৎ লজ্জা পেল তার ছাত্র’র মায়ের কথায়। তাছাড়া তার ফোনটা নষ্ট হওয়ার কারণে অপর পাশের শব্দটা ভীষণ বেশি শোনা যায়। হয়তো পার্থিব এবং তিমিরও সেটা শুনেছে। করবী লাজুক স্বরে বলল,
“আন্টি আর চল্লিশ মিনিটের মাঝে আসছি।”
“কোথাও যেতে পারবে না বলে দাও।”
তিমিরের রুক্ষ, কঠিন স্বরে করবী চোখ উল্টে তাকাল। মিনমিন করে বলল,
“যেতেই হবে।”
“কোথাও যেতে হবে না। তুমি বলো যে এখন পারবে না। ফাস্ট।”
করবী আমতা-আমতা করল। এই মহিলা ভয়ঙ্কর। তাকে এখন এই কথা বললেই উনার কথার ট্রেন বুলেটের গতিতে ছুটবে। এদিকে তিমিরও তাকিয়ে আছে শক্ত চোখে। করবী কিছুক্ষণ দোনোমনা করে অবশেষে ভদ্রমহিলাকে বলল,
“আজকে না আসলে সমস্যা হবে, আন্টি?”
মহিলা রেগে গেলেন বোধহয়। ফুল্কির বেগে বললেন,
“আজকে না, আর কোনোদিনও আসবার প্রয়োজন নাই।”
কথাটা বলেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করলেন ভদ্রমহিলা। অসহায় চোখে তাকাল করবী। টিউশনিটা আজ গেলো বুঝি। কীভাবে যে সংসার চলবে! তপ্ত এক শ্বাস ফেলল সে। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। এখন আর এত চিন্তা নিতে পারছে না সে। আর কত?
তিমির গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “শিক্ষকতার পেশা সম্মানের। যেখানে সম্মানই নেই, সেখানে এই পেশার মর্ম কী রইল?”
করবী হতাশ চোখে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল সাদা ঝকঝকে ফ্লোরে। উদাস ভঙ্গিতে উত্তর দিল,
“পেটে খিদে থাকলে, সম্মানের পাঠ কেবল নথিবদ্ধ বিদ্যা মনেহয়। সম্মান দিয়ে আর যাই হোক সংসার চলে না।”
করবীর মলিন কথায় নিবিড় হয়ে গেলো পরিবেশ। কেউ আর টু শব্দটুকুও করল না। ডাক্তার এলেন আবার। করবীকে আরেকটু পরীক্ষা নিরীক্ষা করলেন। কিছুদিন বিশ্রামের পরামর্শ এবং কিছু ওষুধপত্র লিখেই ছুটি দিয়ে দিলেন।
হসপিটাল থেকে বেশ সাবধানের সাথেই বের করল তিমির। ভীষণ যত্নে। এতটা যত্ন বহুদিন তাকে কেউ করেনি। প্রাপ্তবয়স্ক করবী কিছুটা বয়স ভুলে নির্লজ্জ হলো যেন! আড়চোখে প্রায় চার-পাঁচবারই তিমিরকে দেখল। শেষবার তো চোখে চোখও পড়ল। এবার সে একটু লজ্জা পেল। ইশ্, লোকটা কিছু ভেবে না বসে!
হসপিটাল থেকে বেরিয়েই করবী বিনীত স্বরে কৃতজ্ঞতা জানাল ওদের। বলল,
“রিকশা করে দিলেই চলে যেতে পারব। আপনাদের আজ বেশ ভোগান্তিতে ফেললাম।”
“পা গ ল নাকি? তোমাকে এ অবস্থায় আমরা একা ছাড়বো নাকি? বাসা অব্দি পৌঁছে দিয়েই তবে আমরা যাব।”
করবী এবার আতঙ্কিত হলো। বাবা অব্দি অসুস্থতার খবর পৌঁছানো যাবে না। এতে বাবা চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পরবে। তাই সে অমত করল। বলা যায় সাহায্য করার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করল সংশয় নিয়ে,
“না না, পারব আমি।”
“পারলে, যাবে। সমস্যা নেই। এখন কিছু খেতে হবে। আমরা দুপুর থেকে না খাওয়া। তুমিও তো খাওনি, তাই না?”
পার্থিব বলল, “হ্যাঁ ভাই, ভালো কথা মনে করেছিস। আমারও ভীষণ খিদে পেয়েছে।”
“তাহলে চল, সামনের হোটেলে গিয়ে কিছু খাওয়া যাক।”
খিদে পেলেও করবী স্বীকার করল না। বরং ছলচাতুরীর ছক সাজাল কীভাবে ঋণের ভার আর বাড়ানো না যায় সেটার। কিন্তু ধোপে টিকল না সেই ছক। পৌঁছাতে দিল না তিমির। তিনজন মিলে গেল খাবার খেতে।
বেশ অনেকটা দিন পর করবীর খাবার প্লেটে সুস্বাদু মাংস উঠলো। কতদিন পর ঠিক মনেও করতে পারল না মেয়েটা। চুঁইঝালের খাসির মাংস করবীর অনেক প্রিয় খাবার কিন্তু অনেক মাস কিংবা বলা যায় বছর, এই খাবারটি খাওয়ার সামর্থ্য হয়নি তার। বাবারও তো ভীষণ প্রিয় এই মাংসটা। যাওয়ার সময় নাহয় নিয়ে যাবে বাবার জন্য একটু। অনেক হয়েছে হিসেব-নিকেশ, বাবাটা তো তার শখ পূরণ করার অনেক চেষ্টা করেছে তবে সে কেন বাবার এই ক্ষুদ্র পছন্দ অপরিপূর্ণ রাখবে?
করবী বেশ প্রশান্তি নিয়েই খেলো। খাবারের মাঝে একজনের খাবার প্যাকেট করেও দিতে বলল। পার্থিব তখন মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করেছিল,
“ছোটো ভাই-বোনের জন্য নাকি?”
করবী মাথা নাড়াল, খেতে খেতে উত্তর দিল, “বাবার জন্য।”
করবীর উত্তরে তিমির একবার কেবল চোখ উঠিয়ে তাকিয়ে ছিল। তারপর আবার নিজ খাওয়ায় মননিবেশ করেছিল৷ খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই বাড়ির পথ ধরল ওরা। পার্থিবের কল আসায় করবীর দায়িত্ব পুরোটাই তিমিরের কাঁধে দিয়ে সে ব্যতিব্যস্ত ভাবে গন্তব্যের দিকে রওনা দিল। কিন্তু করবীর দ্বিধাদ্বন্দ মন। এখন রাত আটটা। এই সময় যদি ও এলাকায় তিমিরের সঙ্গে যায় তবে কেউ কিছু আবার বলবে না তো! ওদের এলাকার মানুষ আবার এ-ওর পিছে লাগতে পছন্দ করে ভীষণ। করবী এত সুন্দরী অথচ বিয়ে করছে না বলেও তো প্রায় প্রায় কত কানাঘুষা করে ওরা। করবীর সংশয় ভোরা মনের খবর বোধহয় কিছুটা আঁচ করতে পারল তিমির। শুধালে,
“কোনো সমস্যা?”
করবী ধীরেসুস্থে জবাব দিল, “আসলে এত রাতে যদি কারো সাথে দেখা হয়, আর আপনাকে আমার সঙ্গে যদি কেউ দেখে তাহলে হয়তো খারাপ কথা উঠবে।”
করবীর দ্বিধা যুক্ত কথায় এই প্রথম তিমির হাসলো। লম্বা-চওড়া মানুষটা বাচ্চাদের মতন খিলখিল করে হাসল। ভীষণ প্রাণ খোলা সেই হাসি। করবী তাজ্জব বনে গেল। কী সুন্দর হাসি লোকটার! চুপচাপ তিমির এবং হাস্যোজ্বল তিমির, দু’জন যেন দু’টি ভিন্ন মানুষ। একজনের সাথে আরেকজনের যেন কোনো যোগসূত্র নেই। করবী হতভম্ব হয়ে শুধাল,
“কী হলো?”
তিমির হাসি থামাল। তবুও ঠোঁট জুড়ে লেপ্টে আছে সেই হাসির রেশ। বলল,
“সিএনজি দিয়ে গেলে তো আর সমস্যা নেই তাই না? তোমার এলাকার মানুষও দেখল না, আর সমস্যাও হলো না।”
করবী তাও বার কয়েক না করল কিন্তু তিমির এক কথার মানুষ। সে সিএনজি ভাড়া করল। তারপর উঠে পড়ল দু’জনেই। মাঝে বেশ খানিকটা দূরত্ব রেখেই বসল। করবীর বেশ ঘুম ঘুম পাচ্ছে। এই এক বাজে স্বভাব তার। ভাত খেলেই ঘুমে ধরে। শরীরটা এখনও আরাম ভুলতে পারেনি।
পুরো রাস্তায় চুপচাপ রইল দু’জনেই। আসার পথে ডাক্তারের দেওয়া ওষুধ গুলোও কিনে দিল তিমির। করবী মনেমনে হিসেব কষলো ঠিক কত টাকার ঋণ উঠলো ঘাড়ে। অতঃপর টাকার বিরাট অঙ্ক ফলাফলে মিলতেই হতাশ হলো। মনে মনে সৃষ্টিকর্তার প্রতি অভিযোগ করে বলল— গরীবরে কেন যে তুমি অসুখ দাও আল্লাহ্। অসুখ গরীবরের জন্য মৃত্যুর চেয়েও ভয়ানক যে!
সিএনজি বাড়ির কাছে আসার আগেই করবী ঘুমে বিভোর হয়ে পড়ল। ডাকল না তাকে তিমিরও। বরং আলগোছে মেয়েটার হেলে যাওয়া মাথার ভরসা হয়ে এগিয়ে দিল নিজের কাঁধটা। সোডিয়ামের আলো সিএনজির জানালা ভেদ করে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে মেয়েটার হলুদাভ ফর্সা মুখটা। যখনই সোডিয়ামের উষ্ণ আলো মুখে পড়ছে তখনই যেন মেয়েটার রূপ জ্বলজ্বল করে উঠছে। মনে হচ্ছে অর্ধ-খষিত শুকতারা। তিমির তার সকল ধরা – বাঁধা নিয়ম ভেঙে তাকাল সেই মুখের দিকে। বড়ো বড়ো চোখের পাপড়ি গুলো কী ভীষণ সুন্দর লাগছে! ছোটো মুখটি পুতুলের মতন যেন সুন্দর। সচারাচর এত সুন্দর মানুষ দেখা যায় না। তিমিরের দেখেছে বলে মনেও পড়ে না। মনে হয় একটু বিশেষ ভাবেই যেন বিধাতা এই রূপ গড়েছেন।
সিএনজি এসে বাড়ির কাছে পৌঁছাতেই তিমির তার কাঁধে থাকা করবীর মাথাটা আলগোছে সরিয়ে নিল। অতঃপর নিরাপদ দূরত্বে এসে মৃদু স্বরে ডাকল। ডাকতে গিয়ে অবশ্য খেয়াল করল মেয়েটা ঘুমের চোখেও কেমন যেন দুশ্চিন্তা করছে। কিসের একটা চিন্তায় কপাল কুঁচকে রেখেছিল। তিমির ধীরেই ডাকল। আর খুব অবাকের ব্যাপার হলো মেয়েটা এক ডাকেই ঘুম থেকে উঠে গেল। এত বিভোর ঘুম কীভাবে এত ধীর আওয়াজেও ভেঙে গেল! তিমির কিছুটা অবাকই হলো বটে।
ঘুম ভাঙতেই করবী হাসল। সুন্দর হাসি। সদ্য ভোরের ফুটে উঠা পুষ্পের ন্যায়। বেশ নরম কণ্ঠে বলল,
“সরি সরি, চোখ লেগে গিয়েছিল।”
তিমির বুঝল, মেয়েটা চাচ্ছে না সে নামুক এখানে তাই সেও আর আগ বাড়িয়ে কিছু বলল না। ভাঙাচোরা দোতলা বাড়িটার ভেতরে যাওয়া অব্দি সিএনজিটা ঠাঁই এক জায়গায় থেমে রইল। তারপর করবী নিজের ঘরে প্রবেশ করতেই দূর থেকে সিএনজির শব্দ শুনতে পেল। লোকটা বোধহয় এতক্ষণে গেল।
করবীর হাতে এত জিনিস দেখেই তৈয়ব হোসেন চমকালেন। অবাক কণ্ঠে বললেন,
“কিরে মা, এত ফলমূল যে! এতকিছু কিনতে গেলি কেন? আমার শরীর তো যথেষ্ট সুস্থই আছে। শুধু শুধু টাকা অপচয় করলি।”
বাবার প্রশ্নে করবীর বুকের ভারী ভাব হালকা হলো। যাক, বাবা কিছু বুঝতে পারেননি। সে খাবার গুলো রান্নাঘরে রাখতে রাখতে বলল,
“বাবা, আমি আনিনি। এগুলো দিয়েছে এক স্টুডেন্টের বাসা থেকে। তুমি এক কাজ করো তো, এখানে একটার মধ্যে অনেক খানি মাংসের তরকারি আছে। আমাদের জন্য কিছু রেখে বাকিটা হুতুমদের দিয়ে আসো। ওরাও তো ভালোমন্দ তেমন খায় না। হুতুমটা মাংস পেলে খুশি হবে অনেক। বিন্দুরও তো মাংস প্রিয় ভীষণ।”
তৈয়ব হোসেন মাথা নাড়ালেন। মেয়ের এমন মহৎ মনের পরিচয়ে খুশিই হলেন। ভেতর ভেতর গর্বে বুকটা ফুলে উঠল তার। মেয়েটার যদি টাকা থাকতো, নিশ্চয় সেই টাকা দিয়ে মেয়েটা কত মানুষের উপকার করতো! কিন্তু দুর্ভাগ্য, উপরওয়ালা যাদের টাকা নেই তাদের দেন বড়ো মন। আর যাদের টাকা আছে তাদের দেন ছোটো মন।
পথের ধারে ঝিমিয়ে এসেছে রোদ। একটি ক্লান্ত সন্ধ্যা তখন। শহরের পথ-ঘাট সেজে উঠেছে কৃত্রিম আলোয়।
করবী টিউশনি করিয়ে বের হয়েছে মাত্র। তার ভীষণ লজ্জা লাগছে। টিউশনির বাসায় স্টুডেন্টের আম্মুর কাছে সে আগামী মাসের বেতন অগ্রীম চাইতেই মহিলা কেমন উগ্র আচরণ দেখালেন। মুখ ঝামটি দিয়ে বললেন, ‘এত টেকা টেকা না কইরা একটু ভালো কইরা পড়াইবার মন দিলেও তো পারো। আমার পোলার হাতের লেখা দিনদিন বাজে হইতাচে হেইটা দেখবার পারো না? তাছাড়া আমরা কী হেই(সেই) মানুছ যে টিচারদের টেকা পয়ছা ছময় মতন দিবার পারি না।’
করবী আর কথা বাড়ালো না। এই স্টুডেন্টের মা একদম জন্মসূত্রে ঢাকার বাসিন্দা। তাই তার কথাবার্তায় আঞ্চলিক ভাব-সাব এবং আচার-আচরণে কিছুটা রুক্ষতা আছেই। তাই মহিলার সাথে আর কোনো কথা না বাড়িয়েই সে বাড়ি ত্যাগ করল। তার কাছে যদি সামান্য কিছু টাকা থাকতো তাহলে সে জীবনেও এ বাড়ির দিকে ফিরে তাকাতো না। শিক্ষকতা পেশা সম্মানের, সেই সম্মানই যদি না পায় তবে এ’ পেশা করানোর মানে হয় না। কিন্তু কী করার! পেটের জন্য কখনো পিঠের মাইর সহ্য করতে হয়। পেট চালানোর জন্য সম্মান কখনো সখনো বিসর্জন দিতে হয়। তবে মধ্যবিত্তের যে সম্মান বেশি দামী!
বাকিদের কাছে অগ্রীম বেতনের কথা বলেনি সে, ভেবেছিল এই পরিবারটি যেহেতু বেশ স্বচ্ছল তাই চাইলেই মেডামের বেতন তারা হয়তো মাসের আগেই দিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু করবী বুঝেনি, এদের অর্থ থাকলেও যে মানসিকতায় অনেক ঘাটতি আছে। বুকে একরাশ দীর্ঘশ্বাস এবং মাথায় এক ঝাঁক চিন্তা নিয়ে সে যখন ফুটপাতে হাঁটা আরম্ভ করল ঠিক তখন পেছন থেকে তার ডাক এলো,
“মেডাম, একটু দাঁড়ান।”
করবী দাঁড়ালো। পিছনে ফিরে দেখলো তার বারো বছরের ছাত্রটি দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। হয়তো ছুটে এসেছে বলে ক্লান্ত হয়ে গেছে। কিন্তু মাত্রই তো ওদের বাসা থেকে বের হলো, তাহলে কোন কারণে আবার ছেলেটি এখানে এলো? করবীর ভাবনার মাঝেই সুন্দর গোলগাল ছোটো ছেলেটি এগিয়ে এলো। মেডামের পাশে দাঁড়িয়ে সে এক গাল হাসল। করবী বাচ্চাটির মায়ের আচরণ ভুলে ছেলেটির ফুলো ফুলো গাল গুলো টেনে দিয়ে আদুরে কণ্ঠে বলল,
“অর্পণ, তোমার এখানে কী? কোনো কাজে এসেছো?”
অর্পণ মাথা নাড়াল উপর-নীচ। তারপর ব্যস্ত ফুটপাতে একবার চোখ ঘুরিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল,
“মেডাম, তুমি কী কষ্ট পেয়েছো আম্মুর কথায়? কষ্ট পেয়ো না, তুমি তো জানো আম্মু কেমন!”
করবী ভারী অবাক হলো অর্পণের এমন কথায়। ছেলেটা বেশ চঞ্চল ও দুষ্টু। প্রথম যেদিন ও গেল পড়াতে, সেদিন করবীর হাতে কামড় লাগিয়ে দেয় অর্পণ। চুল টেনেও ধরেছিল। কিন্তু করবী ধমকা ধমকি করেনি মোটেও। তারপর এই বাঁদর ছেলে কীভাবে কীভাবে যেন করবীর ভক্ত হয়ে যায়। দীর্ঘ পাঁচ বছর সে এই মেডামকে ছাড়া আর কিছু কল্পনাও যেন করতে পারেনা। বাচ্চাটিও কি তবে তার মায়ের এমন পর্দা হীন আচরণে লজ্জা পেলো!
করবীর ভাবনার মাঝে অর্পণের কণ্ঠ ভেসে এলো,
“মেডাম, শুনো…….”
করবী ভ্রু উঁচু করে শুধায়, “কী?”
অর্পণ তখন সাবধানী হাতে পকেট থেকে টাকা বের করে। এক হাজার টাকার তিনটি কচকচে নোট। সেটা করবীর সামনেই অন্য পকেট থেকে খাম বের করে টাকা গুলো খামের ভেতর ঢুকিয়ে করবীর হাতে দেয়। তারপর গাল ভর্তি হাসি দিয়ে বলে,
“নেও তোমার সম্মানী। আব্বুর কাছ থেকে জন্মদিন উপলক্ষে এটা নিয়েছিলাম। বলেছিলাম বন্ধুদের খাওয়াবো। কিন্তু আমার বন্ধুদের খাওয়ার থেকেও তোমার এইটা বেশি প্রয়োজন, তাই তুমি রেখে দাও। তোমাকে যখন আম্মু দিবে সম্মানী, তখন নাহয় আমারটা আমাকে শোধ করে দিও? বুঝোই তো প্রেস্টিজ ইস্যু। বন্ধুরা নাহয় খেপাবে।”
করবী অবাক হয়। বিস্ময় পৌঁছে যায় আকাশ অব্দি। সে দ্রুত খামটা অর্পণের দিকে বাড়িয়ে দেয়,
“এমা, অর্পণ! তুমি তোমার টাকা কেন আমাকে দিয়েছো, বোকা ছেলে? মেডামের অতটাও প্রয়োজন নেই টাকা। তুমি রেখে দাও এগুলো। আর কখনো এমন করবে না কেমন? যাও বাসায়।”
করবী টাকাটা দিলেও অর্পণ নিল না। বরং মাথা নামিয়ে ফেলল। খুব ধীরে বলল,
“আম্মুর কাছে টাকা চাওয়ার সময় যে তোমার চোখ থেকে পানি পড়েছিল সেটা আম্মু না দেখলেও আমি দেখেছি। তুমি নেও এটা, মেডাম। পরে শোধ দিয়ে দিও, কেমন?”
কথাটা বলেই বাচ্চাটা ছুটে চলে গেলো। করবী বার কয়েক পিছু ডাকলেও বাচ্চাটির মাঝে থামা থামির কোনো ভাব দেখা গেলো না। ছেলেটার ছুটন্ত শরীরের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে করবীর চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। একটা বারো বছরের বাচ্চাও আজ তার দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে? সৃষ্টিকর্তা একটা পথ বন্ধ করলে আরো সাতটা পথ খুলে দেন- কথাট মিথ্যে নয়। অথচ তাও আমরা কত অভিযোগ করি!
করবীর সকালের লোকটার কথা মনে পড়লো। কতজনের কাছে সে ঋণী হয়ে যাচ্ছে! তাও আমরণ কৃতজ্ঞতা নিয়ে।
৩.
করবীর ছোটো বারান্দায় এখন রজনীর তমসা খেলা করছে। ঝিঁঝি ডাকছে অনবরত। ঘরে কারেন্ট নেই। ইদানীং রাত হলে কারেন্ট থাকে না। গরম বাড়ছে তো তাই। করবী মাত্রই খাওয়া দাওয়া করে বেতের চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো। আসার সময় ছোটো ছোটো দু’টি রুই মাছ নিয়ে এসেছিল। বাবা সেগুলোই রান্না করেছে। করবীই কেটে-বেঁটে দিয়েছে, রান্নাও করতে চেয়েছে কিন্তু বাবা দেয়নি। বাবা হয়তো বুঝে মেয়ের ক্লান্তির ইতিহাস। রান্না সুস্বাদু হলেও করবী খেতে পারেনি তেমন। ক্ষুধা বেশি থাকায় অল্পতেই পেট ভোরে গেছে। তাছাড়া আজকাল অনেকদিন পর পর মাছ খেতে পাচ্ছে তো, তাই মাছের প্রতি কেমন অভক্তি এসে গেছে। অথচ এই করবীই আগে মাছের মাথা না হলে ভাত খেতো না।
সারাদিনের অজস্র ক্লান্তি যেন ঝরঝর করে লুটিয়ে পড়ল শরীরের প্রতিটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গে। পুরুষ মানুষ বলে, নারীদের আর কি চিন্তা? বেকারত্ব কেবল থাকে পুরুষদের। দায়িত্ব তো থাকে কেবল পুরুষদের। কিন্তু পুরুষ যদি একবার পরিবারের সে মেয়েটিকে দেখতো, যার মাথার উপর বড়ো ভাই নেই, বাবার নেই রোজগার…… তার প্রতিদিনের যুদ্ধটা কত ভয়ঙ্কর হয়। প্রতিনিয়ত তার বাঁচতে হয় সমাজের সাথে যুদ্ধ করে, মানুষের লোলুপতার সাথে যুদ্ধ করে এবং নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ করে। পুরুষেরা এই ক্ষেত্রে একটা জিনিস থেকে বেঁচে গেছে। তাদের অন্তত প্রতিনিয়ত কারো লোভের সাথে যুদ্ধ করা লাগছে না। নিজের চরিত্রে দাগ লাগার ভয়ে তটস্থ থাকা লাগছে না।
বারান্দার গ্রিল ভেদ করে সামন্যই বাতাস আসছে তবে এতটুকুই শরীরকে প্রশান্তি দিচ্ছে। সেই প্রশান্তিতে করবীর চোখ লেগে যায়। ঝিমুতে ঝিমুতে এক সময় তলিয়ে যায় ঘুমের দেশে। ঘুমের মাঝেও মেয়েটা কী ভেবে যেন বার কয়েক শিউরে ওঠে। তৈয়ব হোসেন বারান্দার দরজায় দাঁড়িয়ে সবটাই দেখে। বার কয়েক দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগে। বাবা হয়ে সন্তানের দুঃখ চোখ মেলে দেখা ছাড়া তার উপায় নেই আর! কী দুর্ভাগা সে!
করবী ঘুমের মাঝে বার কয়েক কেঁপে কেঁপে উঠে। কি জানি, মধ্যবিত্তের এই সিন্ড্রেলা কোন রাক্ষসীর স্বপ্ন দেখে ভয় পাচ্ছে৷ অবশ্য গরীবের জন্য বড়ো রাক্ষসী তো তার অভাব অনটন। তৈয়ব হোসেন মেয়ের মাথায় হাত রাখতেই ঘুমন্ত মেয়েটির কপালের ভাঁজ শিথিল হয়ে আসে। ভরসার হাত টুকু পেতেই মেয়েটি নিশ্চিন্তে ঘুমায়। কারণ মেয়ে তো জানে, বাবা গরীব হোক কিংবা বড়োলোক…. তার কাছে তার মেয়ে সবসময় রাজকন্যা। আর বাবা কখনো সেই রাজকন্যার ক্ষতি হতে দিবে না।
৪.
টাকা হারানোর কথাটা গোপনেই রাখল করবী। বাবা অসুস্থ, এর মাঝে এই খবরটা পেলে বাবা চিন্তায় হয়তো আরও অসুস্থ হয়ে পরবে। তাই সে সিদ্ধান্ত নিল বাড়িওয়ালার সাথে কথা বলবে। যদি আরও কয়েকটা দিন সময় চেয়ে নেওয়া যায় তাহলে তো খারাপ হবে না।
সময়টা সকাল আনুমানিক দশ-টা। যথারীতি নিয়মে তৈরী হলো করবী। নিয়ম অনুযায়ী বারান্দায়ও গেলো। বাণী নামক টিয়া পাখিটা আবারও ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে বলল,
“সই, সই, সই, মনের কথা কই?”
করবী সম্মতি জানালো। তবে মনের কথা বলতে পারার অনুমতি পেয়েও বাণী মনের কথা বললো না। অনুমতিকে আপোষ করে গেলো নিঃসংকোচে। করবী হাসল। যেদিন বাণী প্রথম কথা বলল স্পষ্ট, সেদিন তার সাথে দু’টি অবাক ঘটনা ঘটেছিল। রাস্তায় একটি ছোটো বাচ্চা হারিয়ে গিয়েছিল। সে বাচ্চাটিকে তার বাবা-মা এর কাছে পৌঁছে দিয়েছিল। বাচ্চাটির মা বেশ আন্তরিকতার সাথে করবীকে বার বার কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিল। এবং পরবর্তীতে দুই বছরের সেই মেয়ে বাচ্চাটির নাম নতুন করে সেই ভদ্রমহিলা রেখেছিলেন- করবী। যেহেতু করবীর মাধ্যমে নতুন করে আবার নিজের কন্যাকে খুঁজে পেয়েছিল। এরপর অবশ্য ওদের সাথে করবীর আর দেখা হয়নি৷ ওরাও করবীর বাসা চিনতো না যে আসবে। করবীরও আর সময় হয়ে উঠেনি যাওয়ার। এবং দ্বিতীয়টি হলো, করবীর বাবা তৈয়ব হোসেনের মুখটা হালকা বাঁকিয়ে গিয়েছিল একবার মিনি স্ট্রোক করে। অনেক চেষ্টার পরও পুরোপুরি মুখটা সোজা হয়নি। অথচ সেদিন তৈয়ব হোসেনের মুখটা নিজে নিজে সোজা হয়ে গেলো। অবিশ্বাস্যকর ভাবে ভদ্রলোক আগের মতন পরিষ্কার কথাবার্তা বলতে শুরু করল।
সে যুক্তি অনুযায়ী করবীর মনেহয় বাণী যেদিন মনের কথা বলতে পারবে সেদিন হয়তো আরেকটি আশ্চর্যজনক কিছু ঘটবে। হয়তো আরও একটি বিস্মিত কিছু। করবী তাই দিন গুনে, মনে মনে ভাবে বাণী আরো কয়েকদিন সময় বেশি নিয়ে তারপর মনের কথা বলতে শিখুক। এখনও করবীর দুঃখগুলো বাঁধ ভাঙেনি। যেদিন বাঁধ ভাঙবে, পুরো পৃথিবী অসহায় লাগবে, সেদিন নাহয় এই আশ্চর্য জনক ঘটনা দ্বিতীয়বার ঘটবে। করবীর আবারও ধৈর্য ধরার অনুপ্রেরণা জাগবে।
আজকে কোনোমতে খাবার খেয়েই বেরিয়ে গেলো করবী। প্রথমে টিউশনি গুলো একে একে শেষ করল। চারটা টিউশনি করিয়ে বের হতে হতে বাজল আনুমানিক সাড়ে চারটা। যেহেতু প্রতিটা স্টুডেন্টের বাসা অনেকটা দূরে দূরে এবং হেঁটে আসা যাওয়া লাগে তাই বেশ খানিকটা সময়ই লেগে যায় টিউশন করাতে। টিউশনি শেষ করিয়েই সে রওনা দিল বাড়িওয়ালাদের বাসার উদ্দেশ্যে। সে যে এলাকায় থাকে সে এলাকায় বাড়িওয়ালারা থাকেন না। অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। যাদের টাকা আছে তারা প্রাধান্য দেয় বিলাসবহুল জীবনকে আর যাদের টাকা নেই তার সবটুকু উজাড় করে দেয় একটু বেঁচে থাকাতেই। সেই শর্তানুযায়ী বাড়িওয়ালারা বিলাসবহুল জীবন চাইবে সেটাই স্বাভাবিক।
করবীকে বাড়িওয়ালার বাসা অব্দি যেতে হয়নি। এলাকায় ঢুকতেই দেখা পেলো বাড়িওয়ালার। বাড়িওয়ালাকে দেখতেই সে মাথায় কাপড় দিল। যথেষ্ট শালীনতা বজায় রেখেই সে মার্জিত ভঙ্গিতে সালাম দিল,
“চাচা, আসসালামু আলাইকুম। আমি কোর্ট লেনের গলিতে থাকি আপনাদের চড়ুই ভিলাতে। দু’তালায়।”
বাড়িওয়ালা আন্তরিক হাসি দিলেন, “হ্যাঁ চিনেছি, চিনেছি। কবরী?”
করবীর মলিন হাসি আরও মলিন হলো। বলল, ” কবরী না চাচা, করবী আমার নাম।”
”ঐ তো, একই হলো। তা বলো কী বলবে? ভাড়াটা এনেছো?”
ভাড়ার কথা উঠতেই করবীর মুখটা ছোটো হয়ে এলো। দোনোমনা করে বলল,
“আসলে চাচা, আমাকে কী আর কয়েকটা দিন সময় দিবেন? আমি ভাড়ার টাকাটা অন্য একটা জরুরী কাজে ব্যয় করে ফেলেছি। আপনি কয়েকটা দিন সময় দিলে আমার সুবিধা হতো। এক সপ্তাহ সময় দিন, আমি জোগাড় করে দিয়ে যাব?”
সে কথাটা বেশ অস্বস্তি নিয়ে বলেই ভীরু চোখে বাড়িওয়ালার দিকে তাকালো। সে ভেবেছিল বাড়িওয়ালা তার এমন কথায় রেগে যাবেন। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। বরং ভদ্রলোকটির বিস্তৃত হাসি আর প্রশস্ততা লাভ করল। তিনি করবীর বাহুতে ডান হাত রেখে কেমন কামনার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
“বাড়ি ভাড়া না দিলেও তো হয়। আমার ঐ একটা ভাড়া না পেলেও কিছু আসে যায় না। তোমার এমন রূপ, এমন দেহ, এমন যৌবন থাকতে তুমি আমাকে ভাড়া দিতে চাও! বরং চলো, ভাড়ায় ভাড়ায় কাটাকাটি করে ফেলি? আমি বাসা ভাড়া দিলাম আর তুমি দেহ ভাড়া। কেমন হবে?”
কথাটা থামতেই লোকটার লোভনীয় চাহনিতে ঘিনঘিন করে উঠল করবীর শরীর। কি জানি কি হলো, সদা সকল পরিস্থিতিতে ঠান্ডা থাকা মেয়েটা ভয়ঙ্কর মূর্তি ধারণ করল। সশব্দে বাবার বয়সী লোকটার গালে চ ড় বসিয়ে দিলো। নিস্তব্ধ এলাকায় এই চ ড়ের শব্দে যেন শহরের নিঃসঙ্গ কাকও ভীত হলো। অথচ করবীর দৃষ্টি তীর্যক। রাগে শরীর তার কাঁপছে। সে এক দলা থুথু মেরে বলল,
“তোর জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে ফেলবো। পাপী লোক।”
থেমে নেই ভদ্রলোকটিও। বরং আক্রোশে ফেটে পড়ে বলল,
“এই মাসেই আমার বাড়ি খালি করবি মা*। আর তোর রূপ কীভাবে এই রুহুল বেপারীর বিছানায় আসে কেবল সেটাই দেখিস।”
করবী আর কথা বাড়ায় না। ছুটে চলে যায় সেই স্থান থেকে। ঘৃণা-অপমানে তার মাথা ঘুরে আসে। এই নিষ্ঠুর শহরে নারীর বেঁচে থাকা যে বড়ো কষ্টের। বড়ো যন্ত্রণার। এই বুঝি প্রাণ নিলো শকূণে আর ইজ্জত নিলে পুরুষে!
হাঁটতে হাঁটতে ফুরায় না এই পথ। দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হয় গন্তব্যে পৌঁছানোর রাস্তা। করবী ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে যায়। ফুটপাতের কিনারায় থাকা ছোটো প্লে গ্রাউন্ডটাতে গিয়ে বসে। ব্যাগের ভেতর থাকা ফোনটা অনবরত বাজছে। নিশ্চয় বাবা কল করেছে! কিন্তু করবীর ফোনটা রিসিভ করার শক্তি হয়। ব্যাগের চেইন খুলে ছোটো বাটন ফোনটা হাতে নেয়। বাবা লেখাটা ঝাপসা হতে থাকে চোখের পাতায়। তার বড়ো ইচ্ছে করে বাবাকে নালিশ দিতে। হাহাকার করে বলতে- এ পৃথিবী করবীদের ভালো থাকতে দিচ্ছে না, বাবা। এ পৃথিবীর যে বাণীর মতন মন নেই।
কিন্তু সব কথা যে আর বলা হয় না শেষ অব্দি। যেমন বলা হলো না এই কথাটিও। ঠিক সেই মুহূর্তে করবীর মুখের সামনে একটি পানির বোতল এগিয়ে দেয় কেউ। পুরুষালী ভরাট কণ্ঠে বলে,
“যুদ্ধে নেমে কাঁদতে নেই, রক্তকরবী। অপরপক্ষ তাহলে দুর্বল ভাববে যে!”
করবী অবাক হয়। অবাক নয়নে তাকিয়ে দেখে গতদিনের সেই শ্যামবর্ণের পুরুষটি দাঁড়িয়ে আছে। ঠোঁটে তার মিহি হাসি।
#চলবে
#বুকপকেটের_বিরহিণী
কলমে: মম সাহা
তৃতীয় পর্ব:
সন্ধ্যার নিয়ন আলো ঝিমানো। এক ধারে বসে থাকতে থাকতে করবীর বিকেল পেরিয়ে সন্ধ্যা হয়েছে। সে এক ধ্যানেই বসা। তার সামনেই তিমির নামক লোকটা উনার একজন বন্ধু নিয়ে পুরো পার্কের এতিম, অসহায় বাচ্চা গুলোর সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছে। তাদের প্রত্যেকের হাতেই একটা করে প্যাকেট যেখানে সাদা চিকন চালের ভাত, আলু ভাজা আর দুই টুকরো করে মাংসের তরকারি। সাত-আটজন বাচ্চা সাথে উনারা দু’জন। করবীর হাতের বোতলটায় পানি এখনো অর্ধেক। লোকটিই তাকে পানির বোতলটা দিয়েছিল। করবী অবাক হলো। তিমির নামক লোকটাকে দেখলে মধ্যবিত্ত মনে হয় না। উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেই মনেহয়। তার বন্ধুর মাঝেও একটা বনেদি ভাব আছে। অথচ কী সুন্দর দু’জন জাত-পাতের ভেদাভেদ ভুলে শিশুদের সঙ্গী হয়েছে! লোকটা কী প্রায়ই আসে এখানে? জিজ্ঞেস করা হলো না আর এই প্রশ্নটি।
ওদের খেতে দেখে করবীর পেটেও খুদারা নৃত্য করে উঠলো। তার সারাদিনের অভুক্ত থাকার গল্প মনে পরলো। তন্মধ্যেই তিমিরের পাশে থাকা তার বন্ধু পার্থিব ডাকল করবীকে,
“করবী, আসো। আমাদের সাথে যুক্ত হও।”
করবী হাসলো, আন্তরিকতার সাথে বলল,
“এইতো, দেখছি। চোখের শান্তি মিলছে।”
পার্থিবও প্রতুত্তরে হাসলো। আর ডাকল না। ততক্ষণে করবীর ফোনে শ’ খানেক কল চলে এসেছে। করবী এবার শরীর ঝারা দিয়ে উঠে দাঁড়াল। না, আর এখানে বসে থাকা যাবে না। বাবাটা বোধহয় চিন্তায় শেষ। করবী তপ্ত শ্বাস ফেলে বিদায় নিতে গেল তিমিরদের কাছে,
“আমি আসছি তাহলে। আমার বাসায় যেতে হবে।”
করবী ডানে-বামে মাথা নাড়াল। কৃতজ্ঞতার সাথে বলল, “ধন্যবাদ, ধন্যবাদ ভাইয়া। আমি যেতে পারবো। আপনি খাবারটা শেষ করুন।”
পার্থিব তবুও জোরাজুরি করল কিন্তু তিমির রইল নির্লিপ্ত। পার্থিবের অতিরিক্ত জোড়াজুড়ির এক পর্যায়ে তিমির শান্ত স্বরে বলল,
“তুই না থাকলেও ও একা যেতে পারবে। এতদিন যেমন গিয়েছে। একা হাঁটার সাহস টুকু ওর আছে। তুই খা।”
পার্থিব চুপ হয়ে গেলো এরপর। করবী যেন স্বস্তি পেলো। মনের যেই জোরটা সে হারিয়ে ফেলেছিল তা-ই যেন আবার খুঁজে পেলো। ঠিকই তো, সে তো একা হাঁটার সাহস বহু বছর ধরে রপ্ত করেছে, তবে আজ কেন পারবে না? নির্ভরতা পেলেই নির্ভরশীল হওয়া মোটেও উচিত কাজ নয়। এতে নির্ভরশীলতা হারালে মানুষ একা হয়ে যায়। তিমির নামক লোকটা করবীকে করবীর মতনই ট্রিট করছে। এটা খারাপ নয়, বরং বেশ ভালো একটা ব্যাপার। সবসময় সবাই আমাদেরকে আমাদের নিজস্বতার সাথে মিলাতে পারে না। যারা পারে, তারা অসাধারণ। কিন্তু তবুও….. করবীর কোথাও একটা খটকা লেগেই যাচ্ছে। তার এত সুন্দর রূপকেও যে পুরুষ চোখ নামিয়ে সম্মান করে সে শুধুই অসাধারণ নাকি অন্যতম? মনের প্রশ্ন মনে রেখেই করবী হাঁটা ধরল।
ঝিমিয়ে আসা রাস্তা, ঝিম ধরা এই মস্ত শহর এত বেশি অসুন্দর নয়, পাষাণও নয়। এই শহরের বুকেও কেউ কেউ বড্ড কোমল, বড্ড আদুরে। করবী তপ্ত শ্বাস ফেললো। যুদ্ধ করতে করতে কেটে গেল আরেকটি দিন। আর কতকাল এই যুদ্ধ চলবে? নিজের সাথে নিজের, জীবনের সাথে নিজের, সমাজের সাথে নিজের? আর কতকাল কেটে যাবে তপ্ত শ্বাস ফেলে ফেলে! আর কতকাল সুখ দেখবে বলে অপেক্ষায় থাকবে লাশের পাশে বসে থাকা শকুনের মতো? আর কতকাল? আর কতকাল? এই শহর করবীর প্রশ্নের জবাব দেয় না। কেবল নিশ্চুপ সঙ্গী হয়ে ফ্যালফ্যাল করে দেখতে থাকে তাকে।
করবী চলে যেতেই পার্থিব খেতে খেতে বলল,”এভাবে বলার কি ছিল? দিয়ে আসলে এমন কী ক্ষতি হতো? আর মেয়েটা কিন্তু বেশ সুন্দরী, বল? এতটা সুন্দর সচারাচর দেখা যায় না।”
তিমিরের কথায় আশ্চর্যজনক ভাবভঙ্গি করল পার্থিব। এত সুন্দর মেয়েকেও যে খেয়াল করে না সে আদৌও পুরুষ না মহা পুরুষ!
পেটের কথা পেটে না রেখেই পার্থিব বিস্ময় ভোরা কণ্ঠে বলল,
“তুই আদৌও পুরুষ তো ভাই?”
কথাটার বিপরীতেই সশব্দে চ ড় পড়ল তার বাহুতে। তারপর আবার খেতে আরম্ভ করল দু’জনেই।
৫.
দিন যায় দিনের নিয়মে। প্রকৃতির নিয়মে সকাল থেকে রাত হয় এবং রাত থেকে আবার সকাল। করবীর দিনও চলে যাচ্ছে সেই নিয়মেই। কিন্তু দিনের ছন্দে এগিয়ে যাওয়া করবীর জন্য হয়ে পড়েছে চ্যালেঞ্জের। আর যাই হোক, তিন হাজার টাকা দিয়ে তো আর সংসার চালানো যায় না!
সময়টা ঠিক ঝাঁঝালো দুপুর। করবী বসে আছে তার বারান্দায়। হাতে একটি বই। খুব মনোযোগ দিয়ে সে বইটি পড়ছে। বাসায় কারেন্ট নেই। রান্নাঘরে শোনা যাচ্ছে খুটখাট শব্দ। বাবা হয়তো রান্না করছে। বাবাটা কেন জানি করবীকে রান্নাঘরে ঢুকতেই দেয় না। ভাবে আগুনের তেজ হয়তো মেয়েটা নিতে পারবে না। অথচ বাবা তো আর জানে না প্রতিনিয়ত সমাজের তেজে পুড়ে পুড়ে খাঁটি হয়ে উঠছে তার মেয়ে। সব আগুন যে পুড়িয়ে ছাই করে না। কিছু কিছু আগুন খাঁটিও করে। কিছু পুড়ে যাওয়া ভালো। কিছু উত্তপ্ততা ভালো।
আজ দিনটি শুক্রবার, তাই করবী বাসাতেই রয়েছে। গরমে ঘেমে নেয়ে একাকার অবস্থা। গ্রীষ্মকালের এই সময়টা বাতাসও কেমন যেন উষ্ণ বয়। আর দুপুরের দিকে তো প্রকৃতি যেন ঝিম ধরে থাকে। কোথাও কোন বাতাস নেই। দূর থেকে কর্কশ কণ্ঠে ডেকে যায় কেবল কাক। কেমন হইচই নেই, কোলাহল নেই মনে হয় যেন নিশার স্বপ্নের মতোই নিস্তব্ধ সব।
বাণী পুরো বারান্দা জুড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে। একটু পর পর এসে করবীর নাম ধরেই ডাকছে স্পষ্ট ভাবে। বাণী অনেক কথাই নকল করতে পারে কেবল মনের কথাটিই আর বলতে পারে না। ঠিক গম্ভীর এই গ্রীষ্মের দুপুরে করবীদের দরজার কড়া নাড়ল কেউ। একবার, দু’বার না, বার কয়েক। করবীর বইয়ে ডুবে থাকা মস্তিষ্ক সজাগ হয়ে উঠল৷ তাদের বাসায় তো কেউ আসে না সচারাচর। তাও এমন ভরদুপুরে! তবে কে এলো? বাড়িওয়ালা কী? করবীর মনে এবার ভয় ঢুকে গেল। বাবাকে সে সেদিনের কথা কিচ্ছু বলেনি। যদি আজ বাড়িওয়ালার কথায় সেদিনের পরিস্থিতি আঁচ করে ফেলে তাহলে তো বিপদ। বাবা হয়তো এটা মানতে পারবে না। তড়িৎ গতিতে তাই উঠে দাঁড়াল সে। প্রায় কিছুটা ছুটে গেলো দরজার দিকে। একবার রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল বাবা কী করছে। যখন দেখল তার বাবা রান্নাতেই ব্যস্ত, দরজার শব্দ শুনেনি তখন সে স্বস্তির শ্বাস ফেলল। এই ভয় নিয়ে বেঁচে থাকা যায় আদৌও!
করবী নিজেকে ধাতস্থ করল। ধীর হাতে খুলল দরজা খানা। মাথায় তার ঘোমটা টানা। তার পেছনেই বাণী উড়ে বেড়াচ্ছে। দরজা খুলতেই এলাকার ছোটো একটা টিনটিনে পিচ্চিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল। ছেলেটা করবীকে দরজার সামনে দেখতেই সাথে সাথে বলল,
“নিচে হীরণ ভাই দাঁড়ায় আছে, ভাবী। আপনারে যাইবার কইছে। আপনাগো বাড়ির নিচেই হেয় আছে।”
ছেলেটা কথাটা উগড়ে দিয়েই ছুটে চলে গেলো। যেন রাজ্যের কাজ ফেলে এসেছে সে। হীরণের কথা শুনতেই করবীর মুখ-চোখ অন্ধকার হয়ে এলো। আবারও উঁকি দিয়ে রান্নাঘরে তাকাল। দেখল এবারও বাবা রান্নায় নিমগ্ন। শুনতে পায়নি কিছু। আসলে রান্নাঘরটা মেইন দরজা থেকে একটু ভেতরের দিকে বলে দরজা অব্দি দেখা যায় না রান্নাঘর থেকে। তাই বাবা বুঝেনি হয়তো। করবী আলগা হাতে দরজাটা টেনে দিল। কিছুটা স্বাভাবিক হয়েই চলে গেলো নিচে। ধীরে ধীরে স্যাঁতস্যাঁতে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতেই তাদের বাড়ির আধখোলা গেইটার সামনে বাইকের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখল হীরণ নামের ছেলেটিকে। বরাবরের মতনই ছেলেটি সিগারেট ফুঁকছে। হাতে রুমাল প্যাচানো। শার্টের বোতাম খোলা। ভেতরের কালো রঙের গেঞ্জিটি দেখা যাচ্ছে। কাটা ডান ভ্রু টা কুঁচকানো। কিছু ভাবছে হয়তো। করবী মাথা উঁচু করল, মুখের আদল আগের তুলনায় বেশ খানিকটা শক্ত করে জিজ্ঞেস করল,
“কী ব্যাপার! ডেকেছেন কেন?”
করবীকে দেখেও ছেলেটা সিগারেট ফেলল না। আগের ন্যায় ফুঁকতে লাগল। কেবল পরিবর্তন হলো তার ধোঁয়া ছাড়ার স্থান। এতক্ষণ সোজা ধোঁয়া ছাড়লেও এখন মুখটা কিছুটা ডানদিকে ফিরিয়ে ধোঁয়া উড়াচ্ছে৷ যেন করবীর মুখে না লাগে। প্রশ্ন করে চুপ রইল করবী উত্তরের আশায়। হীরণ মনমতন সিগারেট ফুঁকে অবশেষে সিগারেটটা ছুঁড়ে মারল রাস্তায়৷ সেটা পা দিয়ে পিষতে পিষতে বলল,
“শুনলাম নতুন বাসা দেখছো?”
করবী থমকালো। এই ভয়টাই পাচ্ছিল সে। এই হীরণ অব্দি না আবার খবরটা পৌঁছে যায়। কিন্তু যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধ্যে হয় নিয়ম অনুসারে এখানেও সন্ধ্যে হলো। নিজের ভয়টা নিজের ভেতরই মাটি চাপা দিয়ে করবী মৃদুমন্দ কণ্ঠে শুধাল,
“কে বলেছে?”
“তুমি কী ভাবো আমাকে খবর দেওয়ার লোকের অভাব?”
“যে খবরটা দিয়েছে, ভুল দিয়েছে। এমন কিছুই না।”
করবীর কথা শেষ হতেই ঝংকার তুলে হাসল লোকটা। বাইকের গ্লাসে তাকিয়ে চুল ঠিক করতে করতে বলল,
“ভুল দিলে তোমার মঙ্গল কিন্তু ঠিক দিলে তোমার জন্য ভয়ঙ্কর হবে। আমার চোখের সামনে থেকে দূরে যাওয়ার চেষ্টাও করো না। ফল ভালো হবে না, রুবী।”
লোকটির শীতল কণ্ঠের হুমকির বিপরীতে করবী জবাব দিল না। তবে বাণী করবীর মাথার উপর উড়তে উড়তে বার কয়েক বলল,
“অসভ্য হীরণ, অসভ্য হীরণ।”
বাণীর কথায় হীরণ মুখ কুঁচকালো। কিছুটা ধমকে বলল,
“রুবী, তোমার এই টিয়ারে কিন্তু আমি একদিন মায়ের ভোগে পাঠিয়ে দিব। এটার মুখ এত চলে!”
করবী বাণীকে ইশারা দিল। ডাকল, চুপ করতে বলল। কিন্তু বাণী আর শুনল কই? সে নিজের মতন বলতেই লাগল।
ঠিক সেই মুহূর্তে ধুপধাপ শব্দ করে সিঁড়ি থেকে নেমে আসতে দেখা গেলো বিন্দুকে। করবীদের বিল্ডিং এর ছাঁদের এক কোণায় যে রুমটা, সেখানেই থাকে বিন্দুরা। ষোলো-সতেরো বর্ষীয়া মেয়েটি। গায়ের রঙ বেশ চাপা। পড়ণে তার কটকটে হলুদ রঙের একটি সুতির থ্রি-পিস। গলায় পুঁতির মালা। কানেও সেই পুঁতির কানের দুল। ঠোঁটে চকচকে লাল রঙের লিপস্টিক দেওয়া। নাকে মাঝারি আকারের একটা নাকফুল। আপাত দৃষ্টিতে তাকে ভীষণ সেকেলে এবং বিদঘুটে দেখতে লাগছে। কালো গায়ে এই একটা রঙও মানাচ্ছে না। ঢেউ ঢেউ চুল গুলোতে চুপচুপে করে তেল দেওয়ার কারণে গায়ের কালো রঙটা আর তেলতেলে কালো দেখাচ্ছে। তবে করবী বিশেষ কোনো অদৃশ্য কারণে মেয়েটাকে পছন্দ করে। দেখা যায় তাদের দু’জনের অবসর সময় কাটে দু’জনের সঙ্গে টুকটাক কথা বলে। দু’জনের বয়সের মোটামুটি পার্থক্য থাকলেও দুঃখ ভাগ করার সময় তারা হয়ে যায় সমবয়সী।
বিন্দু সিঁড়ি বেয়ে নেমেই ঝলমলে হাসি দিল। চিকচিক করা অক্ষি যুগল দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখল হীরণকে। এরপর লাজুকলতার ন্যায় লজ্জা লজ্জা নিয়ে শুধাল,
“হীরণ ভাই যে! ভালো আছো?”
হীরণ বিরক্ত নিয়ে একবার বিন্দুর দিকে তাকাল, অতঃপর তার কথা শুনতে পাইনি ভাব করেই করবীকে বলল,
“বিকেলের দিকে তোমার বাসায় বাজার পাঠাবো। শুনেছি সেদিন বাজারে গিয়েছিলে মাছ কিনতে! বাজার পাঠালে কোনো রকম নাটক করা ছাড়া সেগুলো নিবে।”
করবী এতক্ষণ বিন্দুর দিকে তাকিয়ে থাকলেও এখন বিস্ফোরিত নয়ন ফেলল হীরণের দিকে। হীরণ কী কোনো ভাবে করবীকে অক্ষম ভাবলো? করবীর ভালো খাবার কেনার সাধ্য নেই সেটা বুঝাতে চাইল?
মনে-মনে প্রশ্ন গুলো ভেবেই করবীর রাগ উঠল ভীষণ। ফর্সা মুখ লাল টুকটুকে হয়ে গেলো। চোখ-মুখে কাঠিন্যতা ছেয়ে গেল। বলল,
“আমারে কী আপনার অক্ষম মনেহয়? সারাদিন খাটাখাটুনি করে যা আয় করি তাতেই আমার হয়ে যায় যথেষ্ট। আপনাকে এত আগ বাড়িয়ে সাহায্য করতে হবে না।”
কথা শেষ করেই ধপধপ পায়ে চলে গেল করবী। পেছনে বাণীও গেলো বলতে বলতে,
“অসভ্য হীরণ, অসভ্য হীরণ।”
বিন্দু তাকিয়ে রইল ড্যাবড্যাব করে হীরণের দিকে। হীরণ করবীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রাগে লাথি দিল সামনের দেয়ালটাতে। যখন দেখল বিন্দু তার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে তখন সে আরও রেগে গেল। চেঁচালো,
“এমন হাভাইত্যার মতন তাকায় আছোছ ক্যান? খাইয়া ফেলবি আমারে? নে খা। অসভ্য মেয়ে। যা, বাসায় যা। তোর এই ক্যাটক্যাটে হলুদ রঙটা দেখে আমার মাথা ঘুরাচ্ছে। অসভ্য বিন্দু।”
হীরণ জবাব দিল না। বেশ গতিতে বাইকটা স্টার্ট দিয়ে শাঁ করে ছুটে চলে গেল। বিন্দু তবুও তাকিয়ে রইল। বাণী বারান্দা থেকে বার বার বলতে লাগল,
“অসভ্য হীরণ, অসভ্য বিন্দু। অসভ্য হীরণ, অসভ্য বিন্দু…… ”
হবে এক শিউলি ফোঁটা ভোর, কৃষ্ণচূড়ায় আবিষ্ট এক পৃথিবী। সেদিন ছিল করবীর মাস্টার্সে ভর্তি হওয়ার শেষ তারিখ। বকুলের আঙিনা যদিও পুষ্পরেণু দিয়ে ভোরে উঠেছিল কিন্তু করবীর মনে ছিল একরাশ পৃথিবী ভাঙা দুশ্চিন্তা। টিউশনির সব টাকা মাস্টার্সের ভর্তির পেছনেই দিতে হচ্ছে, অথচ মাসের আজ সবে পাঁচ দিন অতিবাহিত হয়েছে। বাকি মাস টুকু চলবে কীভাবে?
করবীর ব্যস্ত রুনুঝুনু ভাবনায় ঝনঝনিয়ে ছন্দপতন হলো তার বাবার কণ্ঠে,
“রক্তকরবী, খেতে আয়।”
করবী ব্যস্ত হাতে কাগজপত্র গোছগাছ করে নিল দ্রুত। কাঁধে ব্যাগটা নিয়েই ছুটে গেল বারান্দায়। তার ছোটো ঘরের মধ্যবিত্ত বারান্দায় জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে বলার মতন কিছুই নেই। আছে একটি শূন্য পাখির খাঁচা আর দু’টি বেতের চেয়ার। পাখির খাঁচা শূন্য বলে যে করবীর পাখি নেই তেমনটা নয়। সকাল হলেই করবী খাঁচা খুলে দেয়। তার পোষমানা বন্ধু টিয়াপাখিটি তখন হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসে খাঁচা থেকে। পাঁচ-ছ’ হাত বারান্দাটিতেই ডানা ঝাপটিয়ে উড়তে থাকে মনের সুখে। পাখিটির উড়ার গতি দেখলে মনে হবে না এটি বারান্দা, বরং মনে হবে এটি খোলা আকাশ।
এই পাখি ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারটা বেশ অদ্ভুত হলেও করবীর তার পেছনে বেশ শক্ত-পোক্ত একটি যুক্তি আছে৷ তার ভাষ্যমতে— বন্দিনীর মনে কখনো প্রেম জাগে না। প্রেম জাগে তো মুক্তিচারিণীর মনে। বন্দিনী সদা চেষ্টা করে কীভাবে বাঁধন মুক্ত হওয়া যায়, কীভাবে একটু প্রাণ খুলে বাঁচা যায়। আর বাঁধন মুক্ত থাকার ভাবনায় সে এতই মগ্ন থাকে যে ভালোবাসার গাঢ় হিসেব-নিকেশ কষার আর সুযোগ হয়ে উঠে না। কিন্তু মুক্তিচারিণী তো সদা মুক্ত। সে সর্বক্ষণ আকাশ-পাতাল ঘুরে এসে দিনশেষে একটি আশ্রয়স্থল চায়। যেখানে একটু বাঁধন থাকবে, একটু ভালোবাসা থাকবে, একটু প্রেম থাকবে। যার পায়ে শিকল সে ভালোবাসাকেও কারাগার ভাবে। আর যার ডানায় উড়ার স্বাধীনতা সে ভালোবাসাকে নিজের দিনশেষের নীড় ভাবে।
আর এই যুক্তি অনুযায়ীই করবী তার পাখিটিকে প্রতিদিন খাঁচা খুলে উড়তে দেয়। চলে যাওয়ার অনুমতি দেয় বহুদূর। কিন্তু পাখিটি যায় না। সারাদিন বারান্দায় ডানা ঝাপটাঝাপটি করে স্বেচ্ছায় ফিরে যায় খাঁচায়। পাখিটির থেকে যাওয়ার এই নিয়মে করবী হাসে। অবাক চোখে তাকিয়ে সে উপলব্ধি করে, ‘যে থাকতে চায় সে ছোটো বারান্দাকেও আকাশ ভেবে থেকে যায়। আর যে না থাকার সে আকাশকেও খাঁচা ভেবে মুক্তি চায়।’
বারান্দায় চঞ্চল ডানায় উড়ে বেড়ানো টিয়াটি করবীকে দেখেই বার কয়েক আহ্লাদে ডানা ঝাপটালো। তার আদুরে কণ্ঠে ডাকল,
“সই সই, মনের কথা কই?”
করবীর উত্তর শুনেও টিয়াটি তার আর মনের কথা বলে না। বলবে কীভাবে? সে যে কেবল এতটুকুই বলতে শিখেছে বাবার কাছ থেকে! বাকিটুকু যখন শিখবে, তখন টিয়াও নিশ্চয় তার মনের কথা বলবে। আচ্ছা, টিয়াটিরও কী মন আছে? হয়তো আছে। মন আছে বলেই তো করবীর ভালোবাসা বুঝে থেকে গেছে। মন না থাকলে তো সে কবেই উড়াল দিত, বিশাল আকাশের খুঁজে। এই পৃথিবীতে সকলেরই মন আছে। ঘাস, পাতা, আকাশ, নদীর……. কেবল মন নেই মানুষের। তাই তো তারা বিশাল পেলেও বিস্তরের লোভে উড়ে যায়। প্রেম, ভালোবাসার পিছুটানও তাকে আটকে রাখতে পারে না।
যথারীতি টিয়াপাখির থেকে বিদায় নিয়ে করবী উপস্থিত হলো রান্নাঘরে। ছোট্টো রান্নাঘর তাদের। সেখানেই তারা বাবা-মেয়ে পেট পুরে, মন ভোরে খেয়ে নিতে পারে। বাবা-মেয়ের ছোটো এই সংসার। ছোটো দু’টো ঘর, একটি ছোটো টিয়ার ছোটো বারান্দা নামক আকাশ আর ঘূণেধরা কয়েকটি আসবাবপত্র ছাড়া তেমন কিছুই নেই। হ্যাঁ, আরেকটি জিনিস অবশ্য আছে, তা হলো আধ পুরোনো এই রুমের পাঁচিল জুড়ে অভাব-অনটনের এক মুঠো সুখ।
গরম ভাতে সিদ্ধ আলুর অর্ধেকটা ঘি দিয়ে মাখিয়ে মুখে পুরে নিতে নিতে করবী বাবাকে শুধাল,
“বাজার লাগবে, আব্বা? কিছু তো নেই মনেহয়। আমাকে বলো কী লাগবে, নিয়ে আসব।”
তৈয়ব হোসাইন তখন ডাল নামাচ্ছিলেন। মেয়ের কথায় এক গাল হেসে বললেন, “দু’টো ডিম নিয়ে আসিস তো। গত চার-পাঁচ দিন যাবত এক আলু সিদ্ধ দিয়েই ভাত খাচ্ছিস। সারাদিন এত খাটাখাটুনি করিস, শরীরে তো শক্তি লাগবে না-কি!”
করবী মাথা নাড়ায়, আবারও ভাত মুখে পুরে নিয়ে বলে, “ভাবছি আজ মাছ আনবো। ডাক্তার বললেন তোমার প্রোটিনের অভাব। মাছ-মাংস আনতেই হবে।”
মেয়ের কথায় বড়ো বিরক্ত হলেন যেন বাবা। মুখ-চোখ কুঁচকে বললেন, “ডাক্তারদের কথা ধরিস না তো এত। আজকালকার ডাক্তারদের ভরসা হয় না। একবার তোর হালিম চাচাকে ডাক্তার বলল তোর চাচার নাকি ক্যান্সার, বেশিদিন বাঁচবে না। অথচ তোর হালিম চাচা বেশিদিন বাঁচল, শেষমেশ মরল স্ট্রোক করে।”
করবীর এই গল্প মুখস্থ। এটা নতুন না। যতবার সে তার বাবাকে ডাক্তারের কথা বলে, ওষুধের কথা বলে, খাবারের কথা বলে ঠিক ততবার তার বাবা এই গল্প শুনাবেন। কিন্তু সে তো জানে, তার বাবা যে ভিতর ভিতর জানেন মেয়ের একেকটা দিন কত যুদ্ধ করে যায়! তাই মেয়ের কাঁধের চিন্তার ভার কমাতে এসব গল্প বুনেন। বেঁচে থাকার যুদ্ধে কিছুটা ধৈর্য আরেকটু বাড়ানোর গল্প সাজান।
করবীর খাওয়া শেষ হয় ঝটপট। মুখ ধুয়েই উঠে যায় ব্যস্ততা নিয়ে। বাবার ওষুধের প্রেসক্রিপশনটা আলগোছে ব্যাগের ভেতর নিয়ে নেয়। বাবার কাছ থেকে বিদায় নিয়েই বেরিয়ে যায় বাসা থেকে।
ব্যাগে টাকা মোট তেরো হাজার৷ তার মাঝে পাঁচ হাজার চলে যাবে বাসা ভাড়ায়, আর থাকবে আট হাজার। ভর্তির জন্য লাগবে চার হাজার এবং অবশিষ্ট হাতে থাকবে আর চার হাজার। এই ব্যয়বহুল বাজারে চার হাজার টাকা দিয়ে সে কীভাবে মাস পার করবে তার কিছু কাল্পনিক হিসেব করে নেয়। কিন্তু হিসেব শেষে বিরাট গড়মিল। এত অল্প টাকায় মাস টেনে নেওয়া যে সম্ভব নয়! হতাশার শ্বাস ফেলে। টিউশনি করিয়ে আর হবে না। একটা চাকরি অন্তত পেতেই হবে।
নিম্ন-মধ্যবিত্তের এই অভাব অনটনের হিসেব মিলাতে মিলাতে করবী চলে এলো মেইন রাস্তায়। মেইন রোড থেকে তাদের বাড়িটা বেশ খানিকটা ভেতরে। এবং বহু পুরোনো দু’তালার এক ফাটল ধরা দালান সেটা। বাড়িটিতে মোট চারটা পরিবার থাকে এবং চারটা পরিবারেই করবীদের মতন। টাকা-পয়সা থাকলে কেউ এমন একটা বাড়িতে থাকতে চাইতো না। নেই বলেই থাকে। বাড়ি ভাড়াও তো কম। শহরে এতে কমে সচারাচর বাসা পাওয়া যায় না।
করবী ঘড়িতে সময় দেখল। অনেকটাই দেরি হয়ে গিয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব কলেজ পৌঁছাতে হবে। তাই আজ টাকা-পয়সার হিসেব না করেই বাস ধরল। রঙ থিতিয়ে আসা ওড়নাটা দিয়ে ঘর্মাক্ত মুখটা মুছে নিল। আজকাল বড্ড গরম পড়েছে! নাকি তার শরীর এখনো আরামপ্রিয়! শরীর কী ভুলে গেছে? বাবার যে রোজগার নেই বহুদিন!
২.
ভার্সিটির কাজ মেটাতে মেটাতে করবীর প্রায় লেগে গেল অনেকটা সময়। তখন অন্তরিক্ষে ভানুর তেজ বেশ। ঘড়ির কাটায় সময়টা দেখে নিল- ৪:২০। তার পেট ক্ষুধায় মুচড়িয়ে এলো। সেই সকাল আটটায় খেয়েছে, খিদে লাগা স্বাভাবিক। অথচ তার এখন পড়াতে যাওয়ার সময় হয়েছে। বাসায় গিয়ে খেয়ে আসবে তা সম্ভব না। বাহিরে হোটেলে খাওয়ার বিষয়টাকে তার টাকা অপচয় বলে মনে হলো।
অতঃপর সাত-পাঁচ না ভেবে সে কলেজের সামনের পার্কটাতে ঢুকে পড়ল। একটি খোলামেলা চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে গিয়ে বসল। একটি শুকনো রুটি আর চায়ের অর্ডার দিয়েই কিছুক্ষণ ঝিমিয়ে নিল। করবী দেখতে বেশ সুন্দর। অপ্সরা কিংবা পরীর মতন। মুখে কোনো প্রসাধনী ছাড়াই তাকে মনে হচ্ছে রূপকথার সিন্ড্রেলা। মাঝারি আকারের চুল গুলো ঢিলে খোপায় ছেড়ে রেখেছে কাঁধে। চোখে আছে গতদিনের কাজলের লেপ্টে যাওয়া কিছুটা ছায়া। করবীর ঝিমিয়ে যাওয়া মুহূর্তেই তার চা আর রুটি এলো। ভীষণ খিদে থাকায় সে বেশ তাড়াহুড়ো করেই খাবারটা খেলো। এতটুকু খাবারেই তার রক্ষসের মতন খিদেটা নিভে গেলো দ্রুত৷ সে উঠে গেলো বিল দিতে এবং ঠিক সেই মুহূর্তেই ঘটল বিপত্তি। বিল দিতে গিয়ে সে আবিষ্কার করল তার ব্যাগে অবশিষ্ট টাকা গুলো নেই। কোথায় গেল? করবীর বুকে হুট করেই মোচড় দিয়ে উঠল। ততক্ষণে দোকানদার তাড়া দিলেন,
”আফা, ট্যাকা ডা দেন।”
করবী ব্যাগ তন্নতন্ন করে খুঁজল। একবারের জায়গায় দু’বার। দু’বারের জায়গায় চারবার। কিন্তু টাকাটা নেই, নেই। তার এখনো মনে আছে ভর্তির টাকাটা দেওয়ার সময়ও বাকি টাকা গুলো ছিল। তারপর……. ভিড়ে দাঁড়িয়ে ফর্মালিটি গুলো পূরণ করার সময়ই কী তার টাকা গুলো কেউ নিয়ে নিল! করবীর মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। আসার সময় বাড়িওয়ালাকে পায়নি বলে বাসা ভাড়াটাও দিতে পারেনি, সব টাকা ব্যাগই ছিল। তার এক মাসের সম্বল। সব শেষ হয়ে গেলো, সব শেষ।
দোকানদার হয়তো করবীর লাল হয়ে যাওয়া মুখমন্ডল দেখে কিছু আঁচ করতে পারলেন। আর মানুষের স্বভাব অসহায়কে আরও অসহায় করে দেওয়া। সেই স্বভাব অনুসারেই দোকানদার হাঁক-ডাক শুরু করলেন। প্রয়োজনের তুলনায় বেশিই রুক্ষ হয়ে বললেন,
“ট্যাকা না থাকলে আপনারা খাইতে আসেন ক্যান? ট্যাকা দেন। নাহয় কিন্তু খবর আছে।”
দোকানদারের আকস্মিক হাঁক-ডাকে করবী আরও দিকভ্রান্ত হলো। প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে মলিন কণ্ঠে বলল,
“চাচা, আমার টাকাটা পাচ্ছি না। একটু আগেও টাকা গুলো ছিল। এখন পাচ্ছিনা।”
দোকানদার খেপলেন, “মগের মুল্লুক নাকি? আমার ট্যাকা দিবেন এহনি। আপনাগো ধান্দা আমরা জানিনা ভাবছেন।”
করবী হাতজোড় করল, মিনতি স্বরে বুঝানোর চেষ্টা করল কিন্তু দোকানদার বুঝতে নারাজ। একে একে রঙ্গ তামাশা দেখতে মানুষের ভিড় বাড়ল। কেউ করবীর হয়ে সুপারিশ করল টাকাটা মাফ করে দেওয়ার আর কেউ দোকানদারের হয়ে হুমকিধামকি দিল।
ঠিক এই মুহূর্তে এসে লজ্জায়-অপমানে করবীর মাথা ঘুরে গেল। ইশ্, জীবন তার পরীক্ষা এমন বাজে ভাবে নিচ্ছে! শেষমেশ কিনা সম্মানের নিলামি দেখতে হচ্ছে। হাহ্।
ঠিক সেই মুহূর্তে বাক-বিতন্ডার একই ধরণের কথার বিপরীতে একটি ভিন্ন কথা ভেসে এলো,
“কত টাকা হয়েছে? আমি দিচ্ছি।”
ব্যস্, সকল উৎসুক দৃষ্টি ঘুরে গেল সেই ব্যাক্তির দিকে। করবীও তাকাল ফ্যালফ্যাল করে। একটি পাঞ্জাবি পরিহিত শ্যামলা বর্ণের সুপুরুষ এগিয়ে এলো। একশ টাকার একটি নোট দোকানদারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“ভার্সিটির সামনে দোকান বসিয়ে ছাত্র-ছাত্রীর দুঃখই যদি না বুঝেন তাহলে তো আপনার এই দোকান এখানে টিকবে না, চাচা। রাখুন টাকাটা। ওর বিলটা রেখে বাকি টাকাটাও রেখে দিয়েন নিজের কাছে। ভবিষ্যতে আবার কেউ এমন বিপদে পড়লে তাকে এমন বিভ্রান্তিতে ফেলবেন না। আমার এই টাকাটা ধরুন তার জন্য আগে থেকে দিয়ে রাখলাম।”
জনসমাগম অবাক নয়নে তাকিয়ে রইল। সেই সুন্দর চিন্তার পুরুষটি এবার জন সমাগমের অবাক দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে বলল,
“ভিড় না করে কেউ একজন সাহায্য করলেই তো পারতেন। মানুষের বিপদে মজা নেওয়ার মতন অমানবিকতা নিয়ে বেঁচে না থাকলেও পারেন আপনারা।”
ব্যস্, এতটুকু কথাতেই ভিড় খালি হয়ে গেলো। জনশূন্য হয়ে গেলো জায়গাটি। কেবল একধারে বহুক্ষণ যাবত এখানে বসে ঝিমুতে থাকা কুকুরটিই অবশিষ্ট রইল।
আগন্তুকের এহেন সাহায্যে কৃতজ্ঞতায় নুইয়ে গেল করবী। বারংবার বলতে লাগল,
“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি না থাকলে কী যে হতো! ধন্যবাদ।”
আগন্তুক মুচকি হাসল। করবীর হাতে পাঁচশ থাকার একটি নোট ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“এটা রাখো। টাকা তো বোধহয় হারিয়ে ফেলেছো, রাস্তায় তোমার প্রয়োজন হতে পারে। পরে সময় করে নাহয় শোধ করে দিও।”
করবী দোনোমনা করে টাকাটা নিল। এখন অতিরিক্ত আত্মসম্মান দেখানো মানেই আবারও রাস্তায় কোথাও না কোথাও সম্মানহানির মুখোমুখি হওয়া। এরচেয়ে টাকাটা নিয়ে নেওয়াই উত্তম। করবী টাকাটা নিল এবং সাথে আগন্তুকের ফোন নাম্বারটিও নিল৷ কথা দিল খুব দ্রুতই পরিশোধ করে দিবে টাকাটা। অপরিচিত লোকটি হাসল, ঘাড় কাঁত করে বলল,
“দিও সময় করে। সমস্যা নেই। আমাকে ভার্সিটিতেই পাবে। আমি ভার্সিটির পুরোনো স্টুডেন্ট। সকলে তিমির ভাই বলেই ডাকে। নাম বললেই হবে। আজ যাই। আমার কাজ আছে।”
করবী ঘাড় কাঁত করল। তবে কিছু একটা মনে হতেই বলল,
“আমার নাম করবী। পরে যদি না চিনেন তাই নামটা জানিয়ে রাখলাম। ধন্যবাদ দিয়ে ছোটো করব না, স্যার। কখনো যেন আপনার উপকারে আসি, দোয়া করবেন।”
তিমির ঘাড় কাঁত করল, খানিক হেসে বলল, “স্যার ডেকে এত ফর্মাল হওয়ার প্রয়োজন নেই, রক্তকরবী। তুমি আসতে পারো এখন।”
করবী আর কথা বাড়াল না। লোকটা তার সাথে কথা বাড়াতেও চায় না বুঝতেই সে পথ ধরল। পেছন থেকে সে তিমির নামক লোকটার রাশভারী কণ্ঠ শুনতে পেলো। লোকটা কাউকে ডেকে যেন বলছে, ‘ইমন, কলেজের সামনে এমন দোকানদার বসে কীভাবে? উনার একটা ব্যবস্থা করে দে শীগ্রই। এমন অস্বস্তিতে ফেলা মানুষজনের প্রয়োজন নেই এখানে।’
আর কিছু বলছে লোকটা কিন্তু করবী শুনতে পায়নি। অনেকটা পথ যাওয়ার পর সে আবার পিছু ফিরে দেখলো। কিন্তু শ্যামবর্ণের সেই সুদর্শন পুরুষটি ভুল করেও তাকায়নি একটি বার। তবে করবী তাকিয়েছে। তার চব্বিশ বছরের জীবনে সে এই প্রথম কোনো পুরুষকে দ্বিতীয়বার ঘুরে দেখেছ। অথচ সে পুরুষ কি-না একবারও চাইলো না? এই প্রথম কেউ বোধহয় করবীর আগুন ফুল্কির মতন রূপ দেখেও আগ্রহ নিয়ে তাকালো না!
গুটি গোমড়া মুখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো সরণের দিকে। রাগবে না হাসবে তা নিয়ে চোখেমুখে বিভ্রান্তি। সরণ সেসবে নজর দিল না। নিজের কাজে মন দিলো। কাপড় বদলানো হলে রুমে এনে ভেজা ব্যাণ্ডেজ় বদলে নতুন ব্যাণ্ডেজ় করে দিয়ে খাবার আনলো সামনে। গুটি একটি খাবারের থালা দেখে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনার খাবার কোথায়?”
সরণ ভাত মেখে গুটির মুখের সামনে ধরে বলল,
“প্লেট দেখে কি মনে হয়? সবগুলো তোমার একার জন্য?”
গুটি চেয়ে দেখল যতগুলো খাবার আছে অনায়াসে দু’জনের হয়ে যাবে। খাবারের পরিমাণ খেয়াল করেনি। সরণ গুটির সাথে সাথে নিজেও খেতে লাগল। একবার গুটির মুখে দিচ্ছে, একবার নিজে খাচ্ছে। গুটির অদ্ভুৎ শান্তি অনুভব হচ্ছে। পৃথিবীর সব সুখ যেন সরণের হাতে ধরে থাকা ভাতের থালায়। এইযে আঙ্গুল গুলো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে মানুষটা ভাত মাখছে, এ যেন পৃথিবীর সর্বোচ্চ সুন্দরতম এক দৃশ্য। ভালোবাসলে মানুষ এতো বোকা বোকা চিন্তা কেন করে? প্রশ্নটা করে নিজমনে হাসলো গুটি। যার আঙ্গুল ছোঁয়া ভাত তাকে শ্রেষ্ঠ অনুভূতি দিচ্ছে তাকে কি করে চড় মেরে বসলো! আচ্ছা, সারাদিন ভিক্ষে করে রাতে দুমুঠো ভাত নিয়ে বসেও কি কেউ এমন তৃপ্তি পায়? গুটির চোখ আবারও ভিজে উঠলো। চড় মারার দৃশ্যটা বারবার ভেসে উঠছে চোখের সামনে। সরণ শেষবারের খাবারটুকু থালা পরিষ্কার করে হাতে তুলে নিয়ে গুটির মুখের সামনে নিয়ে বলল,
“ব্যাপারটা মন্দ না। মেরেও জিতলে, কেঁদেও জিতে যাচ্ছো। ওয়েট, আমি গ্লিসারিন নিয়ে আসছি। চোখে দিয়ে আমিও তোমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাঁদবো।”
গুটি ভাত মুখে নিয়ে হেসে উঠলো। চোখে অনুতাপের জল ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি। তাতে সঙ্গ দিল কাশি। ভাত মুখে নিয়ে হাসতে গিয়ে গলায় আঁটকে গেছে। সরণ তড়িঘড়ি জল খাওয়ালো। গুটির কাশি খানিক কমলে সরণ খুব কাছে এসে বসলো। দু’হাতে বাড়িয়ে বলল,
“জলদি বুকে আসো।”
গুটি যেন মূর্ছা গেল, এমনভাবে নেতিয়ে পড়লো সরণের বুকে। বাহুবন্ধন হলো অতিব দৃঢ়। সরণ সময় নিয়ে চুমু খেল কপাল বরাবর। বাহুবন্ধনের চেয়েও দৃঢ়তর কন্ঠে বলল,
“অতীতকে বিসর্জন দাও গুটি। আজ থেকে, এই মুহুর্ত থেকে হোক মনে রাখার দিন। আমাদের স্মৃতিতে না থাকুক বাবলু সাহা আর না থাকুক বীরেন তালুকদার। তুমি আর আমি মিলে, আমরা। আমরা আমাদের ভালোবাসা দিয়ে নতুন স্মৃতি গড়ে নেবো।”
গুটি মাথা নেড়ে সায় জানালে সরণ পুনরায় বলল,
“বাবলু সাহাকে কি করবো?”
বাবার নাম শুনে বুকে একটা মোচড় দিলো গুটির। কোনরকমে বলল,
“আপনি যা ভালো বোঝেন।”
সরণ নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,
“আমি যা ভালো বুঝি?
গুটি মাথা নাড়লো।
“নিজের বাপকে নিয়ে যা বুঝি, তোমার বাপকে নিয়ে নিশ্চয়ই তার থেকেও মারাত্মক কিছুই বুঝবো। যে তোমাকে নারী পাচারকারীদের হাতে তুলে দিতে উন্মাদ হয়েছিল, বীরেন তালুকদারের সঙ্গে বিয়ে দিতে উঠেপড়ে লেগেছিল, কোনটাই করতে না পেরে টাকা খোয়ানোর রাগে পুলিশের কাছে মিথ্যে বলে ফাঁসিয়ে প্রতিশোধ নিতে চেয়েছিল, তাকে আমি দয়া দেখিয়ে খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে পারবো না। আর ছেড়ে দিলে নিশ্চিত আবার তোমাকে বিপদে ফেলার চেষ্টা করবে প্রতিশোধ নিতে।”
সরণ খাবারের প্লেট হাতে উঠে চলে যেতে লাগলে গুটি বলল,
“মানুষ তো একটা কুকুরকেও দু’বেলা ভাত দেয়, ওই মানুষটাকেও না-হয় দিলেন। হোক উচ্ছিষ্ট, তবুও খেয়ে পরে বেঁচে থাকুক পৃথিবীর কোন এক প্রান্তে।”
সরণ পিছু ফিরে গুটির চোখে চোখ রেখে তাকালে গুটি টলটলে চোখ আর মুখভর্তি হাসি নিয়ে বলে উঠলো,
“আমার কথা ছাড়া ওই মানুষটাকে আপনি শেষ করবেন না, আমি জানি। করার হলে আগেই করতেন। আর আমিও তাকে যতোই ঘৃণা করি, মেরে ফেলার কথা বলতে পারবো না, কখনোই না। পুলিশেও যে আপনি দেবেন না, তা আমি জানি। তাহলে আমার বিপদ হতে পারে, তাই তো? বাকি তাহলে থাকে কী?”
সরণ চলে গেল। হয়তো জবাব তার কাছে নেই। অথবা আছে কিন্তু দেবে না। তবে পরিকল্পনা অবশ্যই আছে। মুখে আর বলবে না, যা করার করে দেখাবে।
মাসখানেক কেটে গেল ভালোবাসার আবহে। গুটি আর সরণের সংসার জীবনের আবহাওয়া কখনো রঙিন আসমানের গাঢ় রঙধনু তো কখন ঝুম বৃষ্টির উষ্ণতায় কাবু এক জোড়া চড়ুই। কিন্তু বাবলু সাহার কি হলো? জানে না গুটি। জিজ্ঞেস করার সাহস পায় না। যদি শুনে সরণ মেরে ফেলেছে নিজ হাতে, সহ্য করতে পারবে না। বাবা মরে গেছে কথাটার চেয়ে সরণ বাবাকে মেরে ফেলেছে কথাটা বেশি পুড়াবে তাকে। এই এক মাসে ইশ্বরের কাছে বহুবার বাবার মৃত্যু কামনা করেছে। চেয়েছে এমনিই নাই হয়ে যাক মানুষটা। সরণ যেন নিজ হাতে মানুষটাকে খু ন করে পাপের বোঝা কাঁধে না নেয়। এ-ই কদিনে গুটি খুব ভালো করেই বুঝে গেছে সরণের রাগ খুব চাপা। সহজে কমে না, আবার বহিঃপ্রকাশও করে কম।
সরণ গুটিকে কতটা ভালোবাসে তা গুটি প্রতি টা মুহুর্তে অনুভব করতে পারে। তার জীবনে আছে বলতে তো মাত্র দু’জন মানুষ। গুটি আর মানিক। পৃথিবীতে যার জীবনে হাতেগোনা এক দু’জন আপনজন থাকে, সে জানে আপনজনের মূল্য। জানে কদর করতে, জানে আগলে রাখতে, জানে ভালোবাসতে। আর যার আপনজনের অভাব নেই, সে করে অবহেলা।
গুটির দিন আজকাল মহা আড়ম্বরে কাটে। সকালের জলখাবারের দায়িত্ব সরণ আর মানিকের। আর দুপুরের রান্নার ভাড় গুটির। এটুকু দায়িত্ব নিতেও যুদ্ধ করতে হয়েছে বাকি দু’জনের সাথে। যেহেতু মানিক আর সরণ দু’জনেই দারুণ রান্না করতে জানে তাই হাত গুটিয়ে বসে থাকতে তারা রাজি নয়। শেষমেশ গুটি ভাগ করে নিয়েছে রান্নার কাজ। সকালে গুটি বসে বসে শুধু দুই বন্ধু রূপী ভাইয়ের কাণ্ড দেখে আবার মাঝেমাঝে অংশও নেয়। তবে দল ভাগ হলে সবসময় সে মানিকের পক্ষে। সরণ তখন মুখ বাঁকিয়ে মানিককে বলে,
“আমার মেয়ে আসলে তোকে ডাকবে কংস মামা আর তোর বোনকে ডাকাবো সৎ মা বলে। তখন আমার দলও ভারী৷ হবে।”
গুটি প্রথম প্রথম লজ্জা পেত। এখন আর পায় না। সরণের মুখে আমার মেয়ে, আমার মেয়ে শুনতে শুনতে লজ্জা টজ্জা উবে গেছে। আজও পেল না। উল্টো তর্ক করে বলে,
“আমার ছেলে হবে। আর ছেলে হলে সে থাকবে আমার দলে।”
সরণ জোর দিয়ে বলল,
”আমার মেয়েই হবে। আমি তাকে নাম ধরে ডাকবো না, মা বলে ডাকবো। আমার মা!”
গুটি আর মানিক দু’জনেই মুচকি হাসলো। সরণের চোখমুখে উপচে পড়া আনন্দ, উচ্ছাস। মানিক ব্লেন্ডারে জুস বানাচ্ছিলো, এরমধ্যে একটা কল আসায় হাত ধুয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল। সেই ফাঁকে সরণ করলো সুযোগের সদ্ব্যবহার। গুটিকে হেঁচকা টানে বুকে নিয়ে এসে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো। গুটির ছটফটানি দেখে কে! কিন্তু সরণ তাতে পাত্তা দিলে তো। গুটি কবজিতে কামড় দিলেও ছাড়লো না। উল্টো গুটির দাঁতে টোকা দিয়ে বলল,
“ইস! আগের জন্মে পিঁপড়া ছিলে না মৌমাছি? সুযোগ পেলেই কামড়!”
“ছাড়বে না দেবো আরেকটা?”
“ছাড়বো কেন? একটা মাত্র বউ আমার, পারলে চব্বিশ ঘণ্টা জড়িয়ে ধরে বসে থাকতাম।”
“উফফ! ভাই চলে আসবে। একবার দেখে ফেললে আর মুখ দেখাতে পারবো না।”
“আমি তোমার মুখে লাভ বাইট তো দিচ্ছি না, মুখ দেখাতে প্রবলেম কোথায়?”
“আমার মাথায়! ছাড়ুন…”
“তোমার ভাই যা সতর্ক, এক মাইল দূর থেকে যক্ষা রোগীর মতো কাশতে কাশতে রুমে ঢোকে। তাকে নিয়ে আবার এতো ভয় কীসের? ও আসার দু’মিনিট আগেই টের পেয়ে যাবে ও আসছে। এবার চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকো। রান্নায় মনোযোগ দিতে দাও। ভালো না হলে তোমার দোষ। সব তোমায় দিয়ে খাওয়াবো।”
“আর ভালো হলে?”
“ভালো হলে আমার দোষ। তখন বেশিটুকু আমি খাবো।”
এরমধ্যেই শুরু হলো মানিকের বিখ্যাত কাশি। সরণ ছেড়ে দিল গুটিকে। আঁচল আর চুল ঠিক করে দিয়ে মানিককে বলল,
“ডাক্তার দেখা ভাই আমার, যক্ষায় পেয়েছে তোকে।”
গুটি ছ্যাৎ করে উঠলো। রাগী কন্ঠে বলল,
“খালি রোগবালাই ডেকে আনবে। এসব আকথা-কুকথা বলতে মানা করিনি?”
“রোগের এতো ঠ্যাকা? ডাকলেই চলে আসবে!”
“ডাকবেন কেন?”
“ডাকলেই আসবে কেন? এতো ছ্যাঁচড়ামি তো ভালো স্বভাব নয়। আর তুমি এই আপনি আর তুমি সম্বোধনের খিচুড়ি পাকানো বন্ধ করবে কবে?”
এমনিতে গুটি আর সরণের এমন দুষ্টুমিষ্টি ঝগড়ায় সবচেয়ে বেশি মজা নেয় মানিক। কিন্তু আজ কেমন চুপসে আছে দেখে গুটি জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে ভাই? কোন সমস্যা?”
মানিক আমতা আমতা করে সরণের দিকে তাকালো। কিন্তু সরণ একমনে রান্না করছে। ডেকে বলল,
“সরণ, একটু এদিকে আসবি।”
সরণ কোন প্রশ্ন ছাড়াই রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এলো। গুটিকে বলে গেল, “রান্নাটা কমপ্লিট করো।”
গুটি ভীষণ চিন্তিত। কিন্তু তাকে যেহেতু ডাকেনি তাই পিছু গেল না আর।
এদিকে সরণ ড্রয়িংরুমে এসেই মানিককে কিছু বলতে না দিয়ে বলে উঠলো,
“শশ্মানে নেওয়ার ব্যবস্থা কর, আমি গুটিকে নিয়ে আসছি।”
মানিক অবাক ভঙ্গিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
“এটা সত্যিই আত্মহত্যা ছিলো তো?”
“হানড্রেড পার্সেন্ট।”
“তাহলে…”
“যা, গুটি খেয়ে নিক কিছু তারপর আসছি আমরা।”
সরণ গুটির কাছে গিয়েই কোলে তুলে নিলো। টেবিলে বসিয়ে দিয়ে খাবার বেড়ে বসে পড়লো চেয়ার টেনে। গুটিকে কিছু জিজ্ঞেস করার অবকাশ না দিয়ে চটজলদি ভাত মেখে খাওয়াতে শুরু করলো। সরণ সাধারণত নিজেও খায় গুটিকেও খাইয়িয়ে দেয়, আজ নিজে না খেয়ে শুধু তাকে খাওয়াচ্ছে দেখে অবাক হলো। তবে গুটিকেও খুব বেশি সময় নিয়ে খাওয়ালো না। অল্প পরিমাণে খাইয়িয়ে হাত ধুয়ে উঠে পড়লো। গুটিকে বলল,
“বাইরে যাবো একটা কাজে, আমার সঙ্গে চলো।”
গুটি জিজ্ঞেস করলো,
“কোথায়?”
“যেতে যেতে বলছি।”
“জামাটা পাল্টাবো না।”
“নো নিড।”
গুটির হাত ধরে জলদি বেরিয়ে পড়লো সরণ। গাড়ি এক টানে গিয়ে থামলো একটা আধ পুরোনো বাড়ির সামনে। অল্প কয়েকজন ছেলেপেলে দেখা গেল। পরিবেশ কেমন থমথমে। গাড়ি থেকে নেমে ভেতরে ঢোকার আগে সরণ গুটির হাত মুঠোয় নিয়ে শক্ত করে ধরলো। আরেক হাতে কাঁধ জড়িয়ে ধরে বলল,
“বি স্ট্রং।”
ততক্ষণে গুটির মনে জান দিয়ে দিয়েছে কি হতে চলেছে। ভেতরে ঢোকার আগেই ধূপ চন্দনের গন্ধ অনেক কিছু বলে দিয়েছে। গুটির পা আঁটকে আসছে। সরণ আগলে নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো গেট পেরিয়ে। ঢুকতেই চোখে পড়লো কাকে যেন শুইয়ে রাখা হয়েছে। পা হতে মাথা অব্দি চাদর টানা। গুটি সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই একজন মুখ থেকে চাদর সরিয়ে দিল। গুটি থম মেরে বসে রইলো। চোখ উপচে জল পড়তে লাগলো আপন ধারায়। কিন্তু মুখে কোন শব্দ নেই। গুটির মস্তিষ্ক জুড়ে বাবাকে নিয়ে বহু স্মৃতি ঘুরতে লাগল। কিন্তু কোন স্মৃতিই সুমধুর নয়। বরং, বড্ড বেশিই তিক্ত। তবুও এতো কষ্ট কেন হচ্ছে? বুকটা এতো জ্বলছে কেন? পাশ থেকে একটা ছেলে এসে সিসিটিভির ফুটেজ দেখালো সরণকে। যেখানে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে বাবলু সাহা নেশাদ্রব্য চাইছো উন্মাদের ন্যায়। পাগলের মতো এদিক সেদিক করছে। নিজের শরীর নিজেই খামচে কামড়ে রক্তাক্ত করছে। এক পর্যায়ে দেয়ালের সঙ্গে মাথায় একটা বারি মারতেই নিচে পড়ে গেল। পড়তেই দ্বিতীয় আঘাত আর তারপর মৃত্যু। গুটি চেয়ে দেখল। সরণকে বলল,
“আমি বাসায় যাবো।”
বলতে বলতেই জ্ঞান হারালো গুটি। যতোই হোক বাবা তো! মানুষ টা আর নেই। ইচ্ছে করছিলো চিৎকার করে কাঁদতে। কিন্তু কো যেন বাঁধা দিয়ে বলছিলো,
“এই মানুষটার জন্য চিৎকার করে কাঁদবি গুটি? অশ্রু বৃথা যাবে না? এ তো মানুষ রূপী জানোয়ার। বাবা নামের কলঙ্ক। কাঁদিস না গুটি, লোকে হাসবে।”
কিন্তু মন কি মানে? বুক তো জ্বলছে। জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে। মনপোড়া গন্ধের ঝাঝ হয়তো আর নিতে পারলো না। জ্ঞান হারালো। কি হতো যদি মানুষটা ভালো হতো? হয়তো দুনিয়া উল্টে যেতো না। কিন্তু গুটি একটু মন খুলে কাঁদতে পারতো। বাবা বলে শেষবারের মতো ডাকতে পারতো। সরণের বুকে আছড়ে পড়ে বলতো পারতো,
“আমার বাবাটা আর নেই।”
গুটির জ্ঞান ফেরানোর কোন চেষ্টা করলো না সরণ। বরং ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখলো। যখন গুটির ঘুম ভাঙলো ততক্ষণে শেষকৃত্যের কাজ সমাপ্ত। গুটি জেগে উঠে আর কাদলো না। চুপচাপ শুয়ে রইলো সরণকে আঁকড়ে ধরে। বেশ অনেক্ক্ষণ পর শুধু জিজ্ঞেস করলো,
“মুখাগ্নি কে করেছে?”
সরণ বলল,
“মানিক।”
ব্যাস আর কোন কথা হলো না। দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে একে অপরের নিঃশ্বাস গুনতে লাগল। সরণ মনে মনে বলল,
“সরি গুটি। নিজে হাতে মারিনি ঠিকই, কিন্তু মরতে বাধ্য করেছি। বেশি কিছু করিনি, শুধু একটু বাধ্য জামাতা হয়েছিলাম। যত নেশা করতে চেয়েছে করতে দিয়েছি। দিনরাত নেশা করতে করতে যখন আসক্তির চরম পর্যায়ে, তখন বন্ধ করে দিয়েছি সব। ব্যাস, আর কিছু করিনি। কিচ্ছু না।”
বছর খানিক পরের কথা। কোন এক শীতের মধ্যরাতে ছাদে বসে আছে দু’জন কপোত-কপোতী। অন্ধকারে ছায়ার মতো লাগছে মানুষ অবয়ব দু’টো। আমাবস্যা গেল গতকাল। আলোর আ-ও নেই। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এমন পরিবেশে রাতের বেলা ছাদে আসা মানে ভূতের সঙ্গে নিশ্চিত সাক্ষাৎ। এমনটাই বলে সরণকে ধরে বেঁধে নিয়ে এসে বসে আছে গুটি। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ কোন ভূত বাবাজীর আগমন না ঘটায় গুটি উঠে পড়লো। বিরক্ত সুরে বলল,
“ধুর, সঙ্গে এক ভূত নিয়ে এসেছি আর কে আসবে? এটা দিয়েই সারাজীবন কাজ চালাতে হবে।”
“হুম, এই ভূত এখন রোমান্টিক মুডে আছে। বেডরুমে যাবে না ছাদেই এডভেঞ্চার ফিল করাবো?”
গুটি দৌড়ে পালালো। সরণ পিছু ছুটলো। নিঃশব্দে দু’জনে এদিক সেদিক ছোটাছুটি করতে লাগলো পুরো ছাদ জুড়ে। পুরো শহর জুড়ে নিস্তব্ধতা। শুধু সরণের আঙ্গিনায় দু’জোড়া পায়ের আওয়াজে মুখরিত পুরো ছাদ। এরমধ্যেই সিঁড়ি দিয়ে ছাদে উঠছিলো মানিক। ছাদে কারও দৌড়াদৌড়ির ধুপধাপ আওয়াজ শুনে সেখানেই জ্ঞান হারালো। পাশের বিল্ডিংয়ে তার গার্লফ্রেন্ড থাকে। ফোন করে বলেছিল ছাদে আসতে, একটা জিনিস দেখাবে। কিন্তু মানিক বড্ড ভূতে ভয় পায়। আসতে চাইছিলো না, তবুও গার্লফ্রেন্ডের চাপে আসতে হয়েছে। আর আসতেই এই পরিণতি। ওদিকে সরণ আর গুটি দুম করে কিছু একটা পড়ার শব্দ পেয়ে সিঁড়িতে এসে দেখে মানিক অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। ওদিকে ফোনে বেজে যাচ্ছে অনবরত। সরণ কিছু একটা টের পেয়ে কপাল চাপড়ালো। যা বোঝার বুঝে গেছে। কল রিসিভ করে বলল,
“নিতু, তোমার মানিক ভূতের ভয়ে জ্ঞান হারিয়েছে।”
ওপাশ থেকে কি বলল তা শুনতে পেল না গুটি। সরণকে তাড়া দিয়ে বলল,
“ভাইকে রুমে নিয়ে চলো জলদি, জ্ঞান ফেরাতে হবে। ইশ, কোথায় কোথায় ব্যাথা পেল কে জানে!”
সরণের রোমান্টিক মুডে জল ঢেলে মানিক চড়ে বসলো কাঁধে। সরণ বিড়বিড়িয়ে গালি দিয়ে বলল,
“শালা মানুষ আর ভূতের দৌড়ের পার্থক্য বুঝিস না। কোথায় বউকে কোলে নেবো বলে দৌড়াচ্ছিলাম, অথচ কোলে উঠে এলি তুই।”
কয়েকদিন পর থেকে হটাৎ করেই গুটির শরীর খারাপ হতে লাগল। যেমন বমি তেমন অরুচি। ডাক্তার দেখিয়ে জানা গেল নতুন অতিথি আসছে ঘরে। গুটির চেয়েও বেশি উচ্ছসিত আর আনন্দে পাগল প্রায় সরণ। কি করবে কি বলবে সব যেন ভুলে বসেছে। এক লহমায় গুটির সকল দায়িত্ব কেড়ে নেওয়া হলো। রান্নাবান্না থেকে সকল কাজ সরণ আর মানিক ভাগাভাগি করে নিলো। গুটির কাজ শুধু হুকুম করা। দু’জন মিলে গুটিকে এমনিতেই মাথায় করে রাখতো, এবার তো যেন আকাশে তুলে রাখে এমন অবস্থা। একটা সময় ছিল গুটির নিজেকে শূন্যলতা মতে হতো। যেখানে ছুঁয়ে দিতো সেখানেই যেন ধ্বংস নামতো। এখন আর মনে হয় না। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবতী মনে হয় গুটির। খুশিতে কান্না আসে। আগেও তো কত কাঁদত। কিন্তু চোখের জল গড়াতো কত-শত আফসোসে। গুটি এখন রোজ সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে, এই সুখের অশ্রু কোনদিন শেষ না হোক। আজীবন বহাল থাকুক।
“হ্যা ঠিক বলছেন। আগে বলুন বাবার সাথে কি করেছেন?”
“করিনি, করবো।”
“মানে?”
“মেরে ফেলবো।”
আৎকে উঠলো গুটি। সপাটে চড় মারলো সরণের গালে। সরণ নত মস্তকে বন্ধ করে নিল চোখ। গুটি হতভম্ব! চড় মেরে নিজের হাত নিজেই মুচড়ে ধরলো। হাতটাকে নরকের কীটের চেয়েও ঘৃণ্য মনে হলো যেন। সরণের বুকে আছড়ে পড়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো গুটি। সরণ এক হাতে আলতো করে আগলে নিয়ে থমথমে গলায় বলল,
“আমি কিছু মনে করিনি।”
অথচ সরণের মুখভঙ্গি ভিন্ন কিছু বলছে। উঠে চলে যেতে লাগলে গুটি পা আঁকড়ে ধরলো। সরণ তড়িঘড়ি গুটির হাত তার পা থেকে ছাড়িয়ে শুইয়ে দিয়ে বলল,
“আমার ওষুধ নিতে হবে। আসছি একটু পর।”
আর এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না সরণ। বাহানা দিয়ে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে। গুটি হাওমাও করে কেঁদে উঠলো দু’হাতে মুখ চেপে। বিড়বিড়িয়ে বলতে লাগল,
“কি করলাম আমি! কি করলাম! হায় ভগবান! ওনার মন ভাঙলাম আমি। অপমান করলাম। উনি কষ্ট পেয়েছেন। ভীষণ কষ্ট পেয়েছেন। কি করে মারলাম?”
এরমধ্যেই মানিক ঢুকলো কেবিনে। রাগে বড় বড় শ্বাস টানছে। রাগে কাঁপতে কাঁপতে দ্রুত গতিতে গুটির মুখোমুখি হয়ে মৃদু চিৎকারে বলল,
“তোমার বাবাকে যে এখনও বাঁচিয়ে রেখেছে তাই তো আমি জানতাম না। জেল থেকে বেরিয়েই তো মেরে দেওয়ার কথা। এমনটাই বলেছিল সরণ। লোকটা যা করেছে আর যা যা করতে যাচ্ছিল তাতে এমন লম্পট, লোভী আর অমানুষ বাবা পরিচয় পাওয়ার যোগ্যই না। আর না বেঁচে থেকে পৃথিবীর বোঝা বাড়ানোর যোগ্য। পৃথিবীর বুকে বোঝা হয়ে বেঁচে থাকতেও মিনিমাম যোগ্যতা লাগে। যা ওই অমানুষটার নেই।”
গুটি ফোপাঁতে ফোপাঁতে চোখ মুছলো। কিছু বলতে চাইলে মানিক থামিয়ে দিয়ে বলল,
“চুপ! একটা কথাও না। সরণকে চড় মারলে তুমি! ও কতটা কষ্ট পেয়েছে ধারণা করতে পারছো?”
গুটির গাল পুনরায় ভিজে উঠলো। অশ্রু বইতে লাগল একই ধারায়।
“যেদিন রাতে গ্রাম থেকে তোমায় নিয়ে আমরা ফিরলাম, সেদিন হসপিটাল থেকে শুরু করে তোমার গ্রামের কোনায় কোনায় লোক লাগিয়ে এসেছিল সরণ। তোমার বাবার পিছনে চব্বিশ ঘণ্টা লোক লেগে ছিল। কি কি সামনে এসেছে জানো?”
গুটির চোখেমুখে আতংক ছড়িয়ে গেল। মানিক ভারী শ্বাস টেনে বলল,
“যেদিন পালালে তারপরের দিন বিয়ের কথা ছিল বীরেন তালুকদারের সাথে। বিয়ের পর কোথায় থাকতে জানো?”
গুটির জবাবের অপেক্ষায় নেই মানিক। বলে উঠলো,
“কি ভাবছো? বীরেন তালুকদারের বাড়ি? উহুম, থাকতে কোন পতিতালয় অথবা বিদেশের যাত্রাপথে। তোমাকে তোমার বাবা শুধু বীরেন তালুকদারের কাছে বিক্রি করেনি। মেয়ে পাচারকারী এক চক্রের কাছেও বিক্রি করেছিল। বীরেন তালুকদার বলেছিল তার সঙ্গে তোমার বিয়ে হয়ে গেলে তারপর মার্কেটের দলিল আর নগদ টাকা হাতে দেবে। তাই তোমার বাবার প্ল্যান ছিল আগে ওই বুড়োর সঙ্গে তেমার বিয়ে হয়ে যাবে তারপর দলিল আর টাকা হাতে পেয়ে গেলে বীরেন তালুকদারের চোখ ফাঁকি দিয়ে কোনভাবে নারী পাচারকারীদের হাতে তুলে দেবে তোমাকে। আর তোমার হারিয়ে যাওয়ার দোষ বীরেন তালুকদারের ঘাড়ে চাপিয়ে তারপর টাকা নিয়ে গা ঢাকা দেবে। কিন্তু তুমি তো বিয়ের আগের রাতেই পালালে। তোমার বাবা হয়ো উঠলো উন্মাদ। এতো এতো টাকা খোয়ানোর শোকে জঘন্য প্ল্যান করলো। পরেরদিন বীরেন তালুকদার মারা গেল আর তোমার বাবা ক্ষোভ মিটাতে পুলিশের কাছে কমপ্লেইন করলো তোমার বিরুদ্ধে। সে নাকি নিজে চোখে দেখেছে তুমি তাকে মেরে পালিয়েছো। সেই খবর সরণ পেতেই সবার আগে লোক লাগিয়ে নিজের নাম পুলিশ অব্দি পৌঁছে দিল। যে মানুষটাকে কোনদিন বাবা বলে পরিচয় দেয়নি সেই মানুষটাকে নিজের বাবার পরিচয় দিয়ে তারপর খুনের দায় নিজের ঘাড়ে নিলো। তোমার বাবা নেশাগ্রস্ত তাই তার কথার চেয়ে বাবা ছেলের বছরের পর বছর যোগাযোগ বিহীন সম্পর্ক আর মাকে নিয়ে বাবা ছেলের শত্রুতা বেশি প্রাধান্য পেল পুলিশদের কাছে। তোমার খোঁজ বাদ দিয়ে তাই সরণকে গ্রেফতার করে পুলিশ। নয়তো তুমি থাকতে জেলে। আর নয়তো কোন…..”
“আমার বাবা…”
এতটুকু বলেই কাঁদতে কাঁদতে ভেঙে পড়লো গুটি। মানুষটা অসৎ, নেশাখোর। তাই বলে এতোটা অমানুষ? মানিক শান্তনা দেওয়ার মতো ধৈর্য পেল না। সে ভীষণ রেগে আছে। সরণকে চড় মেরেছে তা কোনভাবেই মানতে পারছে না। ছোটবেলায় সরণের মা রাস্তা থেকে তুলে এনেছিল তাকে। মানুষ করেছে নিজের ছেলের মতো। কখনো ভেদাভেদ করেনি নিজের ছেলের সাথে। সরণও সর্বদা নিজের ভাই বলেই মেনে এসেছে। মা’কে তো আগলে রাখতে পারেনি, বন্ধু নামক ভাইটিকে তাই ফুলের মতো আগলে রাখতে চায়।
গুটি কাঁদতে কাঁদতে হটাৎ জ্ঞান হারালে মানিকের টনক নড়লো। ডাক্তার ডাকলো সঙ্গে সঙ্গে। সরণকে হসপিটালে কোথাও খুঁজে না পেয়ে ফোন করলো। কিন্তু রিসিভ হলো না। কিছুক্ষণ বাদে সরণের কল এলে মানিক শুধু বলল,
“গুটি কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়েছে।”
সাথে সাথে কল কেটে গেল। দশ মিনিটের মধ্যে সরণ হসপিটালে ফিরল। এসে গুটির কেবিনে ঢোকার আগে হটাৎ কি ভেবে যেন থমকে দাঁড়ালো। মানিককে জিজ্ঞেস করলো,
“ওর বাবার সম্পর্কে সব বলে দিয়েছিস?”
মানিক মাথা নেড়ে সায় জানালে চোখ বন্ধ করে শ্বাস ছাড়লো সরণ। ধীর পায়ে গুটির কেবিনে ঢুকে বসে রইলো মাথার কাছে।
ঘণ্টাখানিক বাদে গুটির জ্ঞান ফিরলেও মরার মতো লেপ্টে রইলো বিছানায়। কারও সঙ্গে কোন কথা বলল না। না প্রশ্ন করলো আর না হাউমাউ করে কাঁদল। শুধু সরণের হাত আঁকড়ে দু’ফোটা চোখের জল ফেলেছিল নিঃশব্দে। দুফোঁটা জল যেন দু’হাজার বার সরি বলে দিল মুহুর্তের মধ্যে।
দু’দিন পর গুটিকে নিয়ে বাসায় ফিরলো সরণ। তবে আগের ফ্ল্যাটে নয়। সামনের এপার্টমেন্টটা মানিকের। সেখানে উঠলো আপাতত। ওই ফ্ল্যাট মেরামত করতে হবে। তাই আর এই অবস্থায় গুটিকে নিয়ে উঠলো না ওখানে। মানিক সরণের ফ্ল্যাটে চলে গেল থাকতে। এমনিতেও এই ফ্ল্যাটেই সবসময় থাকতো দু’জন মিলে। তার ফ্ল্যাট তো খালিই পড়ে থাকতো সর্বদা।
ভর দুপুরের বৃষ্টি আর রোদ একত্রে ছুঁয়ে দিচ্ছে গুটির ক্লান্ত শরীর। রোদবৃষ্টি হালকা বাতাসের সঙ্গে ঝাপটা মেরে আছড়ে পড়ছে পুরো বারান্দা জুড়ে। গুটি অনিমেষ তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। সেখানে রোদ আর বৃষ্টি দু’টোই আছে। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকবে না গুটি জানে। হয় রোদ চলে যাবে না-হয় বৃষ্টি থেমে যাবে। আর নয়তো হারিয়ে যাবে দু’জন একত্রে। রোদ-বৃষ্টির মিলন তো ক্ষণিকের। যেমন তার আর সুখের সন্ধি খুবই অল্প সময়ের। একসঙ্গে টেকেই না। হাসফাস করে চলে যায় সুখ অন্যত্র। নিজেকে শূন্য মনে হয় গুটির। বাবার মুখটা যতবার চোখের সামনে ভেসে উঠে, ততবার ছিন্নভিন্ন হয় ভেতরটা। আর যখন মনে হয় ওই মানুষটার জন্য সরণকে চড় মেরেছে, অপরাধবোধে মরে যেতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে হাত কেটে শরীর থেকে আলাদা করে দিতে। বাবা নামক মানুষটাকে ছোটবেলা থেকে নেশা করতে দেখে বড় হয়েছে সে। কতবার যে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে তার হিসেব নেই। প্রতিবার গুটির ঠাকুমা ছাড়িয়ে আনতো। ছেলে তো, ফেলে দিতে পারতো না। তারপর যখন সে মারা গেল, তারপরের বার নেশাদ্রব্য বিক্রি করতে গিয়ে মাতাল অবস্থায় পুলিশের হাতে ধরা পড়ে বেশ কয়েক মাস জেল খেটে এলো। ততদিনে গুটি নিজেকে সামলাতে শিখে গেছে। টিউশনি আর হাতের কাজ থেকে বেশ ভালো আয় করা শুরু করেছে। গুটির বাবা তারপর থেকে লোকসমক্ষে নেশা ছেড়ে দিল। ঘরে বসে নেশা করা শুরু করলো। প্রথমদিকে গুটির রাগ হতো, অভিমান হতো, টাকা দিতে চাইতো না। কিন্তু নেশা করতে না পেরে যখন পাগলের মতো নিজেকে আঘাত করতো, কামড়ের দাগে শরীর ভরিয়ে ফেলত, তখন সইতে পারতো না বাবার কষ্ট। নিজেই নেশা করার জন্য টাকা দিয়ে দিত। বড্ড দুর্বল ছিল যে তখন। তারপর যত দিন যেতে লাগল কঠিন হতে থাকল গুটি। যদিও সমস্ত কাঠিন্যতা ছিল উপরে উপরে। ভেতরটা তো সর্বদা ছিল মোমের মতো। একটা সময় বাবাকে নেশা করার জন্য টাকা দেওয়া বন্ধ করে দিল গুটি। এমনকি কথা বলাও প্রায় বন্ধ করে দিল। তারপরও তার নেশা করা বন্ধ হয়নি। কীভাবে চালাতো নেশার খরচ তা জানতো না গুটি। এখন বুঝতে পারছে। তখন থেকেই কোন না কোন অনৈতিক কর্মকান্ডে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছিল। গুটি যদি জানতো, নেশার খরচ বন্ধ করে দিলে তার বাবা এমন কাজে যুক্ত হয়ে পড়বে, তবে সে নিজেই সারাজীবনের জন্য দায়িত্ব নিয়ে বাবার নেশার খরচ দিয়ে যেত। মাকে বড্ড মনে পড়ছে। জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেল। সাথে নিয়ে কেন গেল না? কেন একা চলে গেল? আচ্ছা, বাবাকে সত্যি খু ন করবে সরণ? মেরে ফেলবে?
সরণ খাবারের প্লেট হাতে রুমে এসে গুটিকে পেল না। বারান্দায় এসে গুটিকে মেঝেতে বসে ভেজা অবস্থায় পেয়ে রেগে গেল। ধমকে বলে উঠলো,
“আর ইউ ম্যাড? ব্যাণ্ডেজ় তো ভিজে গেছে।”
গুটি কেঁপে উঠলো। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ব্যাণ্ডেজ়ের কথা মনে পড়ায় তড়িঘড়ি উঠে দাঁড়াতে চাইলে হটাৎ মাথা ঘুরে উঠলো। এমনিতেই শরীর দুর্বল, তারওপর অনেক্ক্ষণ বসে ছিল মাথা ঝুঁকিয়ে। তাই আচমকা উঠতে গিয়ে চোখে অন্ধকার দিয়ে মাথা ঘুরে উঠেছে। সরণ পাঁজা কোলে তুলে নিল গুটিকে। রুমে নিতে নিতে বলল,
“আমি এখনও মরিনি। এতো শোক পালন কার জন্য?”
গুটির চোখেমুখে হটাৎ তেজ খেলে গেলো। লাফিয়ে নামার চেষ্টা করলো কোল থেকে। ততক্ষণে চোখ জোড়াও অশান্ত হয়ে ভিজে উঠেছে। সরণ শান্ত কন্ঠে বলল,
“কান্না করবে করো। মেয়েরা শাড়ী গয়না চেয়ে বায়না করবে, না দিলে কান্নাকাটি করবে। সুইট সিচুয়েশন কিউট সিন। কিন্তু তা না করে এসব কি? কথা পছন্দ না হলে ইউ ক্যান কিস মি। মুখ বন্ধ করার বিউটিফুল ওয়ে। বাট কাঁদতে কেন হবে?”
মনে মনে লজ্জায় গুটিয়ে গেলেও সরণকে বুঝতে না দিয়ে কঠিন করলো চোখমুখ। চোখ পাকিয়ে বলল,
“এসব অলক্ষুণে কথা আর কখনো বলবেন না।”
“বললে মুখ বন্ধ করে দিও, সিম্পল।”
গুটির প্রতিক্রিয়া হলো দেখার মতোন। কিন্তু সরণ পাত্তা দিলো না। সরাসরি ওয়াশরুমে নিয়ে নামালো। ডানদিকের সুইচ টিপে বলল,
“নিজে নিজে চেঞ্জ তো করতে পারবে না এই হাতে, আমাকেই করিয়ে দিতে হবে। তাহলে বারান্দায় বসে ভেজার কারণ কি দাঁড়ালো?”
কথাটা বলেই দু’বার ভ্রু নাচালো। গুটিকে রাগিয়ে দিতে সরণের দুষ্টু মুখভঙ্গি ও দুষ্টু আলাপ, কোনটাই কাজে দিল না। উল্টে গুটি যেন আরও শান্ত হলো। সরণের গলা জড়িয়ে ঘাড়ে মুখ চেপে বলল,
“পাল্টে দিন শাড়ী।”
গুটি এই তেজস্বিনী রূপ নিচ্ছে তো এই কোমলমতী রূপে সঁপে দিচ্ছে নিজেকে সরণের বাহুডোরে। সরণ মুচকি হেসে পুনরায় গুটিকে কোলে তুলে নিল। ভেতরে ঢুকে দরজা লাগাতে গেলে গুটি বাঁধা দিয়ে মিনমিন করে বলল,
“লাইটটা…”
সরণ পাত্তা দিল না। দরজার সিটকিনি তুলে দিয়ে বলল,
“হানিমুনে যাচ্ছি না যে লাইট অফ করতে হবে। যে কাজে যাচ্ছি, অন্ধকারে করতে গেলে কোথায় না কোথায় হাত লেগে যায়! তারপর বটি নিয়ে দৌড়ানি না দাও! যা বউ আমার, বিশ্বাস নেই।”