Sunday, August 3, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 154



বুকপকেটের বিরহিণী পর্ব-৩২+৩৩

0

#বুকপকেটের_বিরহিণী
কলমে: মম সাহা
পর্ব: ৩২ (একাংশ)

(৪২)

ছয়তলা বিশিষ্ট বাড়িটির চতুর্থ তলাতেই বিদিশাদের ফ্ল্যাট। ছিমছাম একটু ফ্ল্যাট। দুটো রুম আছে, একটি মাঝারি আকারের ড্রয়িংরুম আছে সাথে রান্নাঘর। সাদা ঝকঝকে রুম গুলো। করবী বসে আছে বিপাশার রুমের খাটে। টিয়ে রঙের একটি বিছানার চাদর বিছানো রুমটাতে। খাটের সাথে ছোটো টি-টেবিলে শরবত, কেক আর ফল দিয়ে গিয়েছে বিদিশার মা। করবীকে দেখে যে মেয়েটা ভীষণ খুশি হয়েছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। হুতুম বিদিশার বাবা জামাল ভূঁইয়ার সাথে ড্রয়িং রুমে বসে খেলছে।

‘তুমি এসেছ, আমি ভীষণ খুশি হয়েছি, আপু। আমি ভাবতে পারিনি তুমি আসবে।’
বিদিশা যে সত্যিই খুশি হয়েছে তা তার চকচকে চোখ-মুখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। করবী বিদিশার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। কোমল স্বরে বলল, ‘কেন ভাবতে পারনি? আমি কী তোমার কেউ না?’

বিদিশা জিবে কামড় দিল, ‘অমন কথা বলো না, আপু। কয়েকদিনে তুমি আমার অনেকটা আপন হয়ে গিয়েছ।’

করবী হাসল। শরবতের গ্লাসটা হাতে নিয়ে এক চুমুক শরবত পান করল। দৃষ্টি তার বিদিশার দিকেই। মেয়েটার চোখ-মুখ শুকনো। গালে ব্রণ দেখা যাচ্ছে। চোখের নিজে কালি। এমন লাস্যময়ী, সুন্দরী মেয়েটার মুখে এত অযত্নে ছাপ দেখে তার বড়ো মায়া হলো। নরম স্বরে বলল,
‘তোমার শ্বশুর বাড়ি থেকে আর কেউ, কোনো যোগাযোগ করেনি তাই না?’

‘করেছে। আমার দেবর করেছে।’
‘কেউ আসেনি?’
‘ভাইয়া আসতো কিন্তু সে তো এখন শহরের বাহিরে গিয়েছে ব্যবসায়ের কাজে। নাহয় ঠিক দেখা করত।’

করবী ছোটো করে বলে, ‘ওহ্।’

‘আচ্ছা আপু, তোমার সাথে যিনি এলো তিনি কে ছিল? তোমার তো তেমন ভাই টাই ছিল না শুনেছিলাম।’

এবার একটু হোঁচট খেল করবী। হীরণের আসলে কী পরিচয় তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে ভুগল সে। তাই কতক্ষণ সময় কাটল মৌন। অতঃপর ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘বন্ধু।’

বন্ধু কথাটা শুনে ফিক করে হেসে দিল বিদিশা, ‘বন্ধু! বন্ধুই হবে হয়তো! আমি তো কী না কী ভাবলাম!’

করবীর নত মস্তকে বলল, ‘কী ভেবে ছিলে?’

‘এই তো, ভেবেছিলাম প্রেমিক হবে।’
বিদিশার কথাটা যেন ঝনঝনিয়ে কানে বাজল করবীর। তড়িৎ বেগে চোখ তুলে তাকাল। ব্যস্ত কণ্ঠে বলল, ‘না, না, অমন কিছু নয়।’

করবীকে বিচলিত হতে দেখে কিছুটা সন্দিহান চোখে তাকাল বিদিশা। কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বলল, ‘আচ্ছা, আচ্ছা ঠিক আছে। বুঝেছি। তুমি এত বিচলিত হচ্ছ কেন?’

বিদিশার প্রশ্নের জবাব নেই করবীর কাছে। কেন বিচলিত হচ্ছে বলতেও পারল না। কেবল হতাশার শ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে। এই যে বুকের ভেতর একটা সংশয় নিয়ে ঘুরছে সে, সেই সংশয়ের কথা কেমন করে বুঝাবে মানুষকে! এই যে সে যেখানেই ভালোবাসা পাচ্ছে সেখানেই গলে জল হয়ে যেতে চাচ্ছে, এমন কথা শুনলে মানুষ হাসবে না?
হাসবে। অবশ্যই হাসবে। মানুষ তাকে চরিত্রহীন বলে আখ্যায়িত করবে। বলবে তার বড়ো লোভ পুরুষের প্রতি। অথচ তেমনটা নয়। তার যে লোভটা কোথায় সে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না। কার কাছে যাবে সে এই দ্বিধা কাটানোর জন্য? কে কাটাবে!

‘কিছু হয়েছে, আপু? কোনো সমস্যা?’ বিদিশা নরম স্বরে জিজ্ঞেস করল।
করবী ছোটো উত্তর দিল, ‘না।’
‘কোনো সমস্যা হলে আমাকে বলতে পারো আপু। আমরা দু’জনে মিলে নাহয় সমাধান করব!’

বিদিশা সর্বোচ্চ ভরসা দেয়। করবীও যেন কিছুটা ভরসা পায়। জায়গাটা ভীষণ বিশ্বস্ত মনে হয়। সে কিছুটা অনিশ্চেয়তা বোধ নিয়েই বলে,
‘আসলে আমাকে যে দিত এলো সে আমাকে পছন্দ করে। মানে, ভালোবাসে।’

‘বুঝতে পেরেছি। তার চোখ মুখই সে কথা বলে গিয়েছে।’
‘বুঝতে পেরেছিলে!’
‘হ্যাঁ। তা, সে তোমাকে ভালোবাসে মানলাম। আর তুমি?’

ঠিক এই প্রশ্নটা তো তারও মন জুড়েই বিচরিত। সে-ও কী হীরণকে ভালোবাসে? নাকি সবটাই মায়া, মোহ, টান?

মেঘস্বরে সে বলে, ‘আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারি না আমি কাকে আসলে ভালোবাসি।’

করবীর এমন একটা উত্তর বোধহয় বিদিশা আশা করেনি। তাই কিছুটা অবাক নিয়ে বলল, ‘কাকে মানে? আরও কাউকে কী মিন করছ?’

করবী উত্তরে মাথা উপর-নীচ করে। তারপর তিমিরের সাথে প্রথমদিন দেখা হওয়া থেকে বাবার মৃত্যু পর্যন্ত সব ঘটনাই টুকরো টুকরো বলে সে বিদিশাকে। হীরণের কথাও সব বলে। বলতে বাদ রাখে না বিন্দুর স্বচ্ছ প্রেমের কথাটিও। সবটুকুই মনযোগ দিয়ে শোনো বিদিশা। করবীর বাবার মৃত্যুর কথা শুনে তার মন খারাপও হয়।
সকলের গল্প বলেই বিরতি নেয় মেয়ে। মুখেচোখে তার অসহায়ত্ব। ভালোবাসা-বাসি নিয়ে তার বুকের ভেতর যে দ্বিধা তা সেই ক্লান্ত মুখটির দিকে তাকিয়েই বুঝা যায়।

‘এবার বলো তুমি, আসলে আমি কাকে ভালোবাসি? কীই-বা আমি চাচ্ছি? দু’জন মানুষকেই এমন ভাবে আশা দেখানো ভীষণ বাজে ব্যাপার। খারাপ কাজ। ধোঁকা দেওয়ার সমান। কিন্তু আমি নিজেই যে নিজের মন বুজছি না! কাকে সত্যিই আমি ভালোবাসি, কে-ইবা আমার মায়া?’

‘আমি যদি বলি তুমি কাউকেই সত্যিকার অর্থে ভালোবাসো না। সেটা কী তুমি মানবে?’

বিদিশার টানা টানা চোখ গুলো করবীর পুরো মুখমন্ডল জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। করবী ক্লান্ত স্বরে বলল, ‘এমনটা বলার কারণ?’

‘আসলে আপু, আমরা যদি কাউকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসি তাহলে দ্বিতীয় কাউকে ভাবতে পারি না আর। তুমি যদি হীরণ ভাইয়াকে ভালোবাসতেই তাহলে হয়তো আরেকজন তোমার জীবনে আসতে পারত না। আসলে আমরা মানুষেরা বরাবরই ভালোবাসার জন্য পাগল। আমরা ভাবি ভালোবাসা পেলে আমরা দুনিয়া ছাড়ার ক্ষমতা রাখি। আসলে তা-ই। ভালোবাসার লোভ বড়ো লোভ। তার উপর তোমার জীবনে কেউ নেই। মা, ভাই, বোন, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয় স্বজন… কেউ না। তাই তুমি যেখান থেকে একটু স্নেহ, একটু ভালোবাসা পাচ্ছ সেখানেই আটকে যাওয়ার চেষ্টা করছ। যার ফলস্বরূপ দু’জন ব্যক্তির প্রতি তোমার অনুভূতি চলে আসছে। একজন ভাইয়া সুখে-দুঃখে তোমাকে ভালোবাসে গেছে নিঃস্বার্থে। তুমি সেটা জানো। তাই তার প্রতি তোমার মায়া কাজ করছে। অনেকবছর যখন আমরা কিছু পেতে পেতে অভ্যস্ত হয়ে যাই তখন সেটা মনে হয় আমাদের অধিকার। কিন্তু আসলেই কিন্তু তা নয়।
আবার তুমি দ্বিতীয় যে মানুষটার প্রতি টান অনুভব করো সেটা আকর্ষণ থেকে। এই যে হুটহাট বিপদে একজন মানুষ তোমাকে সাহায্য করেছে বিনা স্বার্থে, তোমার প্রতি তার অধিকার দেখিয়েছে তুমি এতেই ভেবে ফেলেছ এই নশ্বর জীবনে তোমার বোধহয় নিজের একটা মানুষ হলো! এবং তাই তার প্রতিও তুমি দুর্বল ভাবছ নিজেকে। আসলে দুর্বলতা একটি আপেক্ষিক বিষয়। আমাদের খুব খারাপ সময়ে কেউ আমাদের সাথ দিলে আমরা তার প্রতি দুর্বল হয়ে যাই। সে যে-ই হোক। তোমার ক্ষেত্রেও তাই। এই যে আগে কখনো তুমি ভাবোনি তুমি হীরণ ভাইয়াকে ভালোবাসো, সেটা কেন? কারণ আগে তোমার সুখে-দুঃখে সে ভালোবেসে গেলেও কোনো বিপদে তাাে পাওনি। তাই দুর্বলও হওনি। আর দুর্বল হওনি বলেই হীরণ ভাইয়া আসলে তোমাকে কতটুকু ভালোবাসে তা উপলব্ধি করোনি। এই যে এখন তোমার এমন একা সময়ে সে সাথ দিচ্ছে তাই তোমার মনে হচ্ছে তুমি তাকে ভালোবাসো। মূলত বিপদে তাকে সাথে পাওয়ার পর দুর্বলতা তৈরি হয়েছে তোমার মনে। যদি ঐ ভাইয়াটা এখন তোমার পাশে থাকত তাহলে বোধহয় জীবনে কখনোই তোমার এমনটা অনুভব হতো না। মূলত মানুষ যখন একা হয়ে যায়, তখন যাকে পায় তাকেই আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চায়। মানুষের স্বভাবই এটা। তুমি তার বাহিরে যে নও।’

বিদিশার এত সুন্দর উপস্থাপনা এবং যুক্তির কাছে করবীর সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব যেন কর্পূরের মতন উবে গেল। মেয়েটা তার চেয়ে বয়সে ছোটো হলেও প্রচন্ড বুঝদার। এতটা বুঝদার বোধহয় সে কখনোই হতে পারবে না।

তাদের কথার মাঝেই বেল বেজে উঠল। বিদিশার মা হাঁক ছেড়ে বলল, ‘বিদু, দেখ কে এসেছে।’

বিদিশা করবীকে বসতে বলে চঞ্চল পায়ে ছুটে গেল। পরপরই ড্রয়িং রুম থেকে ভেসে এলো পরিচিত কণ্ঠ। করবীর বুক ছলাৎ করে উঠল। বিদিশা ছুটে এসে বলল,
‘আপু, আমার দেবর এসেছে। আজ কী সৌভাগ্য আমার! তোমরা সবাই আসছো দেখতে!’

করবীর বুকের হৃদপিণ্ডটা থেমে-থেমে কাঁপল। বিদিশার দেবরের সাথে তিমিরের কণ্ঠের এত মিলে তার মস্তিষ্ক তাজ্জব বনে গেল।

#চলবে

#বুকপকেটের_বিরহিণী
কলমে: মম সাহা
পর্ব: ৩২(বাকিংশ)

আকাশে বড়ো রূপোর থালার মতন চাঁদ উঠেছে। জোছনা হামাগুড়ি দিচ্ছে কংক্রিটের রাস্তায়। মনে হচ্ছে প্রেম বুকে পুষে রাখা শক্ত প্রেমিক দাঁড়িয়ে আছে বৈরাগী ভাবে।
বিন্দু পথের দু’পাশের ফুটপাতটায় বসে আছে। বাড়ি ফেরার তেমন তাড়া নেই শরীরের ভেতরে। আজকাল বড়ো ক্লান্ত লাগে নিজেকে। এই এত জনবহুল শহরটাতে তার ক্লান্তি মোছার মানুষের বড়োই অভাব। আঠারো বর্ষীয়া জীবনটায় আশি বছরের তিক্ততা যেন ভর করে আছে। এই যে শরীরের কোনো অঙ্গে ক্ষত হয়ে যখন সেটা ক্যান্সারে পরিণত হয় ডাক্তার তখন অঙ্গটা কেটে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয়। অথচ এইযে দুঃখটা গোগ্রাসে বুকের ভেতর যন্ত্রণা গেঁথে গেঁথে ক্যান্সার তৈরি করে দিচ্ছে তা কেটে ফেলার কোনো গতি নেই। বাজারে কোনো সস্তার মলমও নেই সেই ক্ষত কমানোর।
বিন্দু তপ্ত শ্বাস ফেলল। রূপালী চাঁদ বুকে নিয়ে হাসতে থাকা মস্ত বড়ো আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘খোদা, চাইর আনার জীবনে দুঃখই দিলা চৌদ্দ আনার। এবার এই জীবন বইয়া নেওয়ার শক্তিও দিও।’

বিন্দুর সৃষ্টিকর্তা নীরবে বোধহয় এই প্রার্থনা শুনে। মস্ত বড়ো আকাশ তো কথা বলতে জানে না। জানলে নিশ্চয় স্বান্তনা দিতো মেয়েটাকে। হু হু করে শূন্য বাতাস বয়ে যায় গা ছুঁয়ে।

‘কিরে, রাস্তার মাঝে এমন করে বসে আছোছ ক্যান? মনে হচ্ছে কুল-কিনারাহীন মানুষ তুই!’

পরিচিত পুরুষটির কথায় মুখ তুলে তাকাতেই ক্লান্ত মনটা শীতলতায় ছেয়ে গেল। যেন খোদা শুনে নিল প্রার্থনা। বাজারে সস্তার মলম হয়ত নেই তাই দুঃখ কমানোর মানুষ পাঠিয়ে দিলেন তিনি।
‘আরে হীরণ ভাই, তুমি এইহানে যে!’

হীরণ বাইকটা আরেকটু সামনে নিয়ে রাখল। তারপর এসে বসল বিন্দুর পাশে। মিছিমিছি কপাল কুঁচকে বলল, ‘ক্যান? এইহানে কী আমার আসা নিষেধ?’

‘আরে না না, কোনো কামে আইছো কি-না জিগাইলাম।’
‘তো কামেই তো আইছি। এই যে তোর লগে বইস্যা থাকার কামে আইছি।’

বিন্দু হা হা করে হাসল। লোকটা তার সাথে কেমন যেন তার মতন নাটকীয় ভঙ্গিতে কথা বলে! টেনে টেনে সুর ধরে।

‘হাসছিস কেন?’
‘তুমি এমন কইরা কথা কইলে আমার হাসি আহে।’
‘কেমন কইরা কইলাম?’

বিন্দু দম নেয়। হীরণ ভাই যে কথা প্যাঁচানোতে বাড়াবাড়ি রকমের অসাধারণ তা মেয়েটার জানা। তাই সে কথা আর প্যাঁচাতে না দিয়ে আগের প্রসঙ্গে গেল, ‘বললে না কীয়ের লাইগ্যা এইহানে আইছো?’

‘তুই কী বধির হয়ে যাচ্ছি, বিন্দু? বললাম না তোর জন্য আসছি। ভাবলাম এপথে যাচ্ছি যেহেতু তোকে নিয়ে যাই।’
‘মিছা কথা কইও না তো!’

হীরণ তাজ্জব বনে গেল। কী অদ্ভুত! মেয়েটা তার সত্যি কথাটাকে বিশ্বাসেই করছে না। হীরণ এবার অধৈর্য আর খানিকটা বিরক্ত হলো, ‘মিথ্যা কথা আমি বলি?’
‘না।’
‘তাইলে তুই কেন বিশ্বাস করছিস না আমি তোকে নিতে আসছি।’

সরল চোখের মিচমিচে কালো রঙের মেয়েটা এবার অদ্ভুত হাসল। মায়া মায়া স্বরে বলল, ‘ক্যান জানি আমার ভালা কিছু বিশ্বাসই হইতে চায় না, হীরণ ভাই। আমার মনডা ফাল দিয়া উডে। কলিজাডা ধড়ফড় কইরা উডে। আমি অবাক হইয়া যাই আমার এমন ভালা ভাইগ্য দেখলে! আমার এমন ভাইগ্যেও হীরণ ভাইয়ের মতন মানুষের সাথ পামু তা আমি মানতেই পারি না।’

বিন্দুর সহজ-সরল স্বীকারোক্তিতে মুখটা ছোটো হয়ে এলো হীরণের। রূপালী চাঁদ প্রেম ছড়ানোর বদলে যেন ছড়িয়ে দিল এক বুক আফসোস। হীরণ অসহায় কণ্ঠে বলে,
‘এমন করে বলছিস কেন, বিন্দু? আমি কী এতটাই খারাপ!’

হীরণের প্রশ্নে ব্যস্ত হয়ে ওঠে বিন্দু। চঞ্চল কণ্ঠে বলে, ‘আরে না, তুমি খারাপ হেইডা কহন কইলাম? খারাপ যে আমার ভাইগ্য, হীরণ ভাই। আপার মতন অমন রাজ ভাইগ্য যে আমার হইল না।’

‘তোর আপার রাজ ভাগ্য?’
‘তা নয় তো কী? যেই ভাইগ্যে হীরণ ভাইয়ের মতন মাইনষের ভালোবাসা আছে হেই ভাইগ্য রাজ ভাইগ্যই তো। অমন কপালের মানুষের দিকে আমার খালি তাকাই থাকতে ইচ্ছা করে জানো? আল্লাহ ক্যান আমারে অমন একটা ভাইগ্য দিল না তা ভাইবা অভিযোগও জমে। কিন্তু এত রাগ, অভিমান, অভিযোগ কইরা কী লাভ তাই না কও হীরণ ভাই? তোমারে তো আর পামু না।’

হীরণ নিরুপায় হয়ে যায় বিন্দুর এমন সরল আফসোসে। চাঁদের আলো পড়া এই অমানিশা গায়ে মেখে হা-হুতাশ করে দুঃখ উড়ানো মেয়েটার দিকে সে তাকিয়ে থাকে পলকহীন। নিজেকে বড়ো পাষাণ লাগে। এমন একটা মানুষের ভালোবাসা স্বীকার করার সাহস তার নেই। কেন যে সৃষ্টিকর্তা যার জন্য মায়া দেওয়ার তার জন্য না দিয়ে অন্য কারো জন্য দিল! এত অদ্ভুত কাজ করল!

করবী বসে আছে বিছানার এক কোণে। বিস্ময়ে টইটুম্বুর তার ভেতরটা। তার সামনেই চেয়ারটাতে বসা তিমির। সে আশ্চর্যের সপ্তম আকাশে চলে গিয়েছে। যদিও বিদিশাকে দু’জনই কিছু বলেনি তবে সে আঁচ করে ফেলেছে এতক্ষণে যে দু’জন দু’জনকে দেখে এতটা হতভম্ব হওয়ার কারণ কী।

‘তুমি ভাবিদের বাসাতে কোন উপলক্ষ্যে? কোন কারণে আমি কিছুই বুজছি না।’
প্রথম কথাটা তিমির বলল। করবীর ভেতরে তখন কালবৈশাখী ঝড়ে লণ্ডভণ্ড হয়ে যাচ্ছে সব। সব হিসেব কার কাছে বড়ো এলোমেলো লাগল। ভাবি বলেছিল তার দেবর নাকি একজনকে ভালোবাসতো। ঘুড়ি বলেছিল ভাবির দেবর নাকি দেবদাস হয়েছে কোনো এক মেয়েকে প্রচণ্ড ভালোবেসে।
তবে কী তিমিরই সেই দেবর! কই? তিমির তো কখনো তাকে এসব বলেনি!

করবী চুপ থাকায় উত্তর দিল বিদিশা, ‘আপু ঘুড়ির মেডাম। আমাদের পাশের ফ্লাটের মেয়ে ঘুড়ি। চিনোই তো ভাইয়া?’

‘বুঝলাম।’

কথা আরও বাড়তো কিন্তু তার আগেই হুতুম কান্না জুড়ে দিল। সে আর থাকবে না এইখানে। সে বাসায় যাবে। বাসায় গিয়ে সে ঘুমাবে। সে আর এ বাসাতে থাকবে না। জামাল ভূঁইয়া কত রকমের বুঝ দিতে চাইলেন কিন্তু বাচ্চাটা বুঝলে তো! টান টান উত্তেজনা টগবগে রেখেই করবীকে বের হয়ে যেতে হলো। যদিও তিমির আসতে চেয়েছিল সাথে কিন্তু করবীর শক্ত-পোক্ত নিষেধে আর যায়নি। তাছাড়া ভাবির সাথে তার জরুরি আলাপও আছে।

করবী বেরিয়ে যেতেই বিদিশা না জানার ভাণ ধরে তিমিরকে শুধাল, ‘আপুকে চেনো কীভাবে, ভাইয়া?’

তিমির একটু দোনোমোনো করছিলো। কতক্ষণ ভেবেচিন্তে সে উত্তর দিল, ‘চিনি। একভাবে।’

ছোটো ছোটো, ভাঙা ভাঙা উত্তরে বিদিশা মুখ লুকিয়ে হাসল।

‘কেবল চেনো নাকি অন্যকিছু?’
তিমির ঠিক এই সন্দেহটাই করেছিল। বিদিশা যে তাকে এমন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে তা আর বুঝার বাকি ছিল না তার। সে সাথে সাথে উত্তর দিল না। রয়েসয়ে, জিরিয়ে জবাব দিল, ‘অন্যকিছু।’

‘অন্যকিছুটা কী? পছন্দ করো?’
‘ভালোবাসি।’

বিদিশা এতটা আশা করেনি। সে ভেবেছিল বড়োজোর তিমির মেয়েটাকে পছন্দ করে বলবে। কিন্তু সরাসরি ভালোবাসার কথাটা স্বীকার করবে ও ভাবেইনি।
কী জানি হুট করে জানা-অজানা ভাবনায় বিদিশার মনটা ছোটো হয়ে গেল। আনমনে বলল, ‘করবী আপুকে কিন্তু ভীষণ পরিচিত একজনের মতন লাগে। তাই না?’

বিদিশার ছোটো প্রশ্নে বুকে কামড় দিলো তিমিরের। যেন একসময় চুরমার হওয়া হৃদপিণ্ডটাতে আবার কেউ আঘাত করল। অতীত, যাকে তিমির বরাবরই অস্বীকার করে এসেছিল নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ চালিয়ে সেই অতীতই যেন রাজকীয় বেশে হাজির হলো এখন। যেই অতীতকে ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা নেই তার। বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস।
‘আশাবরী….?’

‘ধরতে পেরেছিলে?’
‘বহু আগেই।’
‘তবে ভালোবাসাটা কার জন্য? করবী আপুর জন্য না আশাবরীর অবয়বের জন্য? রক্তকরবী হিসেবে তাকে ভালোবাসো নাকি আশাবরীর মতন বলে ভালোবাসো, ভাইয়া?’

যে এক প্রশ্ন তিমির তার বুকে মাঝে দাফন দিয়ে ফেলেছিল, সেই প্রশ্নের নতুন করে মুখ তুলে তাকানোতে দিশে হারা হয়ে গেল সে। কী বলবে, কীভাবে বলবে বুঝে উঠতে পারল না। বুকের ভেতর ভাষাদের তোলপাড় চললেও কণ্ঠ রইল নিশ্চুপ। যেন বাক্যহীনতায় প্রাণ দিয়েছে বাক্ শক্তি।

মৌনতার মাঝেই যেন চতুর বিদিশা উত্তর খুঁজে পেল। কণ্ঠ কিছুটা খাঁদে নামিয়ে বলল,
‘মেয়েটা বড়ো একা। এই পৃথিবীতে নাকি তার কেউ নেই। একজনকে কল্পনা করে আরেকজন মানুষকে ভালোবাসার মতন অন্যায় মেয়েটার সাথে হলে এই পৃথিবীতে নিঃস্ব মেয়েটা বাজেভাবে হেরে যাবে। ও একা তা-ও ও মেনে নিবে। কিন্তু যখন ও ভালোবাসা পাওয়ার পর জানবে ওকে দেওয়া ভালোবাসা গুলো আসলে অন্যকারো, অন্য কাউকে কল্পনা করে ওকে ভালোবেসেছ, মেয়েটা বিশ্বাস করো মরার আগে সেদিন একবার বেঁচে থেকেও মরে যাবে। কাউকে এমন ভাবে ঠকিয়ো না ভাইয়া যেন আল্লাহর দরবারে মানুষ সব দায়ভার ছেড়ে দেয়। একটু ভেবো। তুমি তো বুদ্ধিমান।’

(৪২)

বিন্দু ব্যস্ত হাতে করবীকে বার বার তাড়া দিচ্ছে। করবী রান্নাঘর থেকে ঘাম মুছতে মুছতে এলো। নাক-মুখ কুঁচকে বলল,
‘অমন করছিস কেন? কী হয়েছে?’

‘তাড়াতাড়ি এই ফরমডা পূরণ কইরা দেও না, আপা। হুতুমডারে স্কুলে ভর্তি করামু।’

করবী তার সামনে থাকা সাদা কাগজটা তুলে নিল। বলল,
‘জন্ম নিবন্ধন ফ্রম? আচ্ছা পূরণ করছি।’

কথা শেষ করেই সে হাতে কলম তুলে নিলো। প্রথমেই লিখল হুতুমের নাম। বিন্দু জিবে কামড় দিল, ‘আরে আপা, হুতুমের নাম হুতুম দিছো ক্যান?’

করবী ভ্রু কুঁচকালো, ‘ওর নাম যেটা, সেটা দিবো না?’
‘আরে না, হুতুমের ডাকনাম এইডা। ভালা নাম তো দৃষ্টিনন্দিতা।’
‘দৃষ্টিনন্দিতা! এত সুন্দর নাম! আগে কখনো বলিসনি যে?’

খুশিতে বিন্দুর চোখ চকচক করে উঠল, ‘শখ কইরা রাখছিল ওর বাবা।’
‘আচ্ছা! হুতুমের মায়ের নাম কী দিব?’
ভ্যাবাচেকা খেল যেন বিন্দু। থতমত খেয়ে বলল, ‘কেন? আমার আম্মার নাম দিবা। আমেনা।’
‘তোর আম্মার নাম কেন দিবো? জন্ম নিবন্ধনে তো হুতুমের মায়ের নাম চেয়েছে। মেয়েটাকে কী খাতা-কলমেও অন্যের বলে স্বীকৃতি দিবি? হুতুমের মা যে বিন্দুবালা, তা দুনিয়া জানবে না?’

‘আপা…..!

#চলবে

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ৩৩

কলমে: মম সাহা

ভার্সিটির চত্বরের ঠিক বামপাশে একটি ঘোলাটে জলের পুকুর রয়েছে। সেই পুকুরের পাড় ঘেঁষে রয়েছে দুই-তিনটি গাছ। যেগুলোকে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো হয়েছে। ভার্সিটির ছেলেমেয়েরা সেই গাছের ছায়ায় বসে আড্ডা দেয়। হাসি-তামাশা করে। সুখ-দুঃখ থেকে শুরু করে ভাগ করে নেয় দুপুরের খাবারটাও।
বিদিশা বসে আছে তেমনই একট গাছের নিচে। হাতের মাঝে একটি ইংরেজি বই। তার দৃষ্টি, মনযোগ সবটাই সেখানে নিবদ্ধ। সেই সময়েই ব্যাগের ভেতরটা থাকা ফোনটা বেজে উঠল। বিদিশার তুমুল ধ্যানে বিঘ্ন ঘটালো সেই শব্দ।
বইটা হাতের মাঝেই ভাঁজ করে রেখে ফোনটা বের করে রিসিভ করল বিদিশা। অপরিচিত নাম্বার দেখে প্রথমেই শুধাল, ‘কে?’

অপরপাশ থেকে তৎক্ষনাৎ উত্তর এলো না। উত্তর এলো জিরিয়ে, ‘আমি।’

পরিচিত কণ্ঠ পেতেই কিছুটা চমকাল বিদিশা। তবে সেই চমকে যাওয়ার অনুভূতি বুঝতে দিল না অপরপক্ষের মানুষটাকে। বরং নিতান্তই স্বাভাবিক স্বরে বলল, ‘কোন আমি?’

অপর পাশ আবারও নীরব। রয়েসয়ে বলল, ‘নাম বললে না-ও চিনতে পারেন। যেখানে কণ্ঠই চিনছেন না।’

বিদিশা বুঝেও না বোঝার ভান করে বলল, ‘এত কথা না বলে নামটা বললেই পারেন।’

‘আমি তুষার।’

কথাটা যেন চিবিয়ে চিবিয়েই বলল লোকটা। বিদিশা বুঝল সেই ভোঁতা রাগের আবাহন।

‘হ্যাঁ বলুন। কী দরকার?’

বিদিশার এত স্বাভাবিক স্বর যেন আশা করেনি তুষার। এত গুলো বছরে সে এতটুকু বুঝেছে মেয়েটা বড়োই ভালোবাসে তাকে। তার সাথে এই মুখ দেখাদেখি বিচ্ছেদে হয়তো মেয়েটা উদাস কাটায় দিন। অথচ কই? কণ্ঠস্বরে তো তার কোনোই আভাস নেই!

তুষার আবারও কতক্ষণ চুপ থেকে অতঃপর বলল, ‘আমি দেশ ছেড়ে যাব। তার আগে তো জানতে হবে আপনার মতিগতি। তাই কল দেওয়া।’

প্রথম বারের মতন এবার আর তুষারের দেশ ছেড়ে যাওয়ার কথায় বিদিশার মন ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হলো না। ভাঙা জিনিস আর কীই-বা ভাঙবে? তবে মনের কোণায় জ্বলতে থাকা নিভু নিভু আশার প্রদীপটা এই একটা বাক্যে এক লহমায় নিভে গেল। তবুও সে রইল শক্ত। বুকের ভেতর যেন শ’মণের পাথর বেঁধে উত্তর দিল, ‘আমার মতিগতি বলতে? আমি কী আপনাকে দেশে আটকে রেখেছি?’

‘রেখেছেনই তো! বিয়ে বিয়ে নাটকটা করে।’

তুষারের এমন কথায় ব্যথিত হলো বিদিশা, ‘বিয়ে বিয়ে নাটক!’
‘হ্যাঁ, নাটকই তো।’
‘আপনাকে আমি যদি নাটকেই আটকাতাম তবে দেশে আপনাকে চার বছর আগেই আনাতে পারতাম। যখন চলে গিয়ে ছিলেন তখনই দেশে আসতে বাধ্য করতাম। তারপর আপনার জীবনযাপন হতো জেলে। নাটক করিনি বলেই আজ জিহ্বাটা লাগামহীন কথা বলতে পারল।’

এমন কড়া জবাবে তাজ্জব বনে গেল তুষার। প্রায় ধমকে বলল, ‘মুখ সামলে কথা বলুন।’

বিদিশা হাসল। তাচ্ছিল্য করে বলল, ‘সেম টু ইউ। আমার সাথে চার বছরে যত অবিচার হয়েছে সবকিছুর দায়ভার আমি সৃষ্টিকর্তার উপর তুলে দিছি। আর আপনার উপর আমার কোনো ধরণের আকর্ষণ, আশা কিছুই নেই।’

তুষারের কণ্ঠ নরম হয়ে এলো, ‘নেই…?’

‘থাকলে তো সংসারই করতাম। যেমন চার বছর করেছি। একা একা স্মৃতির সাথে সংসার!’

তুষার আর কিছু বলল না। কল কাটার আগে বলার ভদ্রতাটুকুও দেখাল না। খট করে কেটে দিল কলটা।
বিদিশা জোরে জোরে ক’টা শ্বাস টেনে নেয় বুকের ভেতর। মনের ভেতর মরে যাওয়া ক্ষীণ আশাটার জন্য কিছু সময় উন্মনা রয়। ভুল মানুষের উপর আশা রাখলে এমন ভাবে আশা ভাঙবে তা যে স্বাভাবিক। সে এটা জানেও। তবুও মায়া যে বড়ো ভয়ঙ্কর জিনিস। কাটানো জটিল। ক’বছর লাগবে কে জানে? নাকি এক জীবনও যথেষ্ট হবে না!

বিদিশার ভাবনার মাঝে আবারও ফোন বেজে উঠে। মায়ের নাম্বার দেখে সাথে সাথে রিসিভ করে। ওপাশ থেকে মা ক্রন্দনরত স্বরে বলে উঠে, ‘বিদুরে, তোর মুক্তি হয়ে গেল। তুই মুক্ত। খুশি তো?’

মায়ের কান্নার কারণ জানে না বিদিশা। তবুও মনটা কু ডাকে। সে হতবিহ্বল স্বরে বলে, ‘কী হয়েছে, মা? কী হয়েছে?’

‘তুষার ডিভোর্স পেপার সাইন করে দিয়ে গেল মাত্র। বলেছে তোকে সাইন করে দিতে।’

দিনে দুপুরে যেন অসময়ের বজ্রপাত হলো বিদিশার মাথার উপরে। তার মানে লোকটা তাদের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে, সব সিদ্ধান্ত নিয়েই তাকে কল দিয়েছিল?
বাহ্! মা ভুল বলেছে। মুক্তি বিদিশার নয়, হয়েছে যে সেই মানুষটার। বিদিশা যে সংসার থেকে কখনো মুক্তি চায়নি। অভিমান করে কেবল সাময়িক প্রস্থান নিয়ে ছিল। অথচ তার অভিমানের ভাষা কেউ বুঝল না। বরং অভিমানের শাস্তিস্বরূপ চির বিচ্ছেদ ধরিয়ে দিল।
অজান্তেই মেয়েটার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। এটাই হয়তো শেষ কান্না! কান্নার জন্য তার জীবনে হয়তো আর কোনো দুঃখই অবশিষ্ট থাকবে না। এইতো আজ তো তার মুক্তি। মা বলল মুক্তি হয়েছে তার।
আচ্ছা মুক্তি পেলে কী কারো যন্ত্রনা হয়? কেউ কাঁদে?

_

‘বিন্দু, হুতুমের মতন নিষ্পাপ বাচ্চাটার সাথে এমন অবিচার কেন করতে চাচ্ছিস? কোন কারণে আমাকে বলবি?’

পাথর মূর্তি বিন্দু চুপচাপ বসে থাকে খাটের কোণায়। কথা বলার ভাষা যেন হারিয়েছে সে। করবী বিন্দুর বাহুতে মৃদু ধাক্কা দেয়, ‘কী হয়েছে বল। এমন থম মেরে গিয়েছিস কেন? আমি জেনে ফেলেছি বলে?’

‘কী জানছো আপা তুমি? কী জানছো? তুমি যা জানছো তা ভুল। সবটাই ভুল। তুমিও না কীসব যে কও! পাগল হইলা নাকি?’

বিন্দুর কথা বলার ভঙ্গি বড়োই চঞ্চল। কথা লুকানোর প্রচেষ্টা দুর্বল। তা-ই তা দেখে হাসল করবী। বলল,
‘আমার কাছ থেকে কথা লুকাতে চাচ্ছিস? আমি কী এতই অবুঝ? এমন করছিস কেন সোনা? আপাকে বলবি না?’

করবী আহ্লাদে গলে জল হয়ে যায় মেয়েটা। চোখ টলমল করে নোনা জলে, ‘আপা, আপা গো, আমি যে দূরে সরাইতে চাই নাই অরে। কিন্তু আম্মা কইলো এই সমাজ নাকি বড়ো খারাপ। আমার বিন্দু নাকি কেবল আমার পরিচয়ে বড়ো হইতে পারবো না। বাপের পরিচয়ও লাগবো। কিন্তু কেমনে অর বাপের পরিচয় দিমু আমি! অর যে বাপই নাই।’

করবী হতবিহ্বল হলো। মনে ভেসে উঠল খারাপ চিন্তা। ভারী বিস্ময় নিয়ে বলল, ‘কী বলছিস তুই? আমি কিচ্ছু বুজছি না।’

মাথা নুয়ালো বিন্দু। ঠোঁট কাঁপলো তিরতির বেদনায়। কম্পনরত স্বরে বলল,
‘আমার বিয়া হইছিল, আপা। আমার যহন বয়স তেরোর ঘরে পড়েও নাই তহন আমার বিয়া হইছিল। জীবন চিননের আগেই চিনছি সংসার। নরম দুই হাতে নামাইছি বিরাট ভাতের পাতিল। একটা রাক্ষসের মতন শ্বশুর বাড়ি। ভয়, আতঙ্ক চাইরপাশে। সংসার না করার কত বায়না করছি। কিন্তু ছাড়তে পারি নাই স্বামীর লাইগ্যা। অতটুকু বয়মে আমারে অমন ভালোবাসা দেওয়া মানুষটারে কেমন কইরা ছড়তাম কও? কিন্তু….. ‘

করবীর ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল, ‘কিন্তু কী’

‘তিন মাসের বেশি আমার সংসার যে টিকলো না, আপা। বিধবা হইয়া গেলাম। স্বামীর সোহাগ মাখা সংসার করার আগেই স্বামী মুইছ্যা গেলো জীবন থেইকা। আমার ভাইগ্য আমারে যে কহনো সাথ দেয় নাই, আপা।’

বাহির থেকে হুড়মুড় করে গরম হাওয়া ঢুকছে। জানালায় লাগানো সস্তার পর্দা গুলো উড়ছে। করবীর চোখ-মুখে আকাশ সমান বিস্ময়। কথা বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। বুকের ভেতর থাকা অদেখা হৃদপিণ্ডটা অবিরতি লাফাচ্ছে।
‘বিন্দু, কী বলছিস তুই এসব? তোর বিয়ে হয়েছিল এবং স্বামী মারা গিয়েছে?’

‘হ আপা, হ। আমরা তহন গেরামে থাকতাম। দিন কাল ভালোই কাটতো আমাগো। গরু পালতাম, হাঁস পালতাম। আব্বায় মাডি কাটতো। সুন্দর কইরা চলতো সংসারডা। পদ্মার লগে আছিলো আমাগো বাড়ি। একবার পদ্মায় উডলো উথাল-পাতাল ঢেউ। আমাগো বাড়ির জমিন ভাইঙা তলায় গেলো হেই ঢেউয়ের লগে। তহন সর্বস্ব হারাইয়া আমরা কাঙাল। আব্বায় হেউ শোক মানতে না পাইরা স্ট্রোক করলো। এরপর অসার হইয়া গেল আব্বার দেহ। আমি তহন এগারো বছরের মাত্র। আম্মার হেই কী যুদ্ধ! ছুডু কয়েকটা জায়গা আছিল হেডি বেইচ্চা, হাঁস-মুরগী বেইচ্চা আব্বারে ডাক্তার দেহাইলো। একটা কোনো মতে বাঁশের ঘড় উডাইলো। ভাত খাইতে ভাত পাইতাম না। এর অর বাড়ি গিয়া তাগো ভাতের ফেন আইন্যা খাইতাম। খিদায় পেট বুক লাইগ্যা যায় অবস্থা। আম্মা এই বাড়ি, ঐ বাড়ি গিয়া ধান সিদ্ধ কইরা, বাটাবাটি, কাটাকুটি কইরা আমাগো লাইগ্যা কিছু টেহা আনতো। কহনো বা চাল আনতো।
আমাগো গেরামে আছিলো একটা জমিদার বাড়ি। বিশাল বাড়ি আছিলো হেগো। একদিন হেই বাড়ি থেইক্যা আমার বিয়ার প্রস্তাব আইলো। হেই বাড়ির বড়ো পোলার লাইগ্যা। পোলা না, বেডা কওয়া যায়। বেডার এর আগে বিয়া হইছিল। সতেরো বছরের সংসার করছে এরপর বউ মইরা যায়। হেই বেডার লাইগ্যাই বিয়ার সম্বন্ধ আহে আমার লাইগ্যা। সাদা ধবধবে আছিল তিনি। চোখটি হুতুমের চোখের মতন। চুল গুলাও অমন হালকা বাদামি কোঁকড়াইন্যা। বেডার বয়স তহন হইবো পয়তাল্লিশের বেশি-কম। আম্মারে হেই বাড়ি থেইক্যা সাহাইয্য করবো জানাইছিল। পরে আম্মা গতি নাই পাইয়া আমাগো এক দেড় বছরের কষ্টের জীবনের ইতি টানোনের লাইগ্যা তার কলিজার টুকরাডারে ঐ বয়সে বিয়া দেয়। বাঁচতে যে হইতো আমাগো। আম্মা এমনে কইরা আর কতদিনই বা খাওয়াইতো?
হেই জমিদার বাড়ির সব আছিল রাজাগো আমলের মতো। হুনছিলাম দাদী শাউড়ী আছিলেন এক বিদেশির বউ। এই জন্য আমার শ্বশুর, আমার জামাইয়ের চেহারায় ঐ ছাপটা আছিল। বিয়া হইয়া যহন শ্বশুর বাড়িতে গেলাম তহন কিছুই বুঝি না সংসারের জটিলতা। স্বামীর সোহাগ কারে কয় হেইডাও জানিনা। শ্বশুর বাড়ির মানুষ দেখতাম কেমন কইরা যেন আমার লগে ব্যবহার করে। তবে স্বামী আমারে আদর করতো ম্যালা। জা, দেওর, ভাসুররা দেখতে পারতো না। কারণ আমার যদি পোলাপাইন হয় তাইলে তো সম্পত্তির ভাগ দেওন লাগবো!
শ্বশুর বাড়িতে আমার একমাত্র ভরসা আছিল স্বামী
একদিন হেই মানুষ আমারে ছাইড়া যায়। আমার অইটুকুন বয়সের প্রথম নির্মমতা। স্বামী মইরা যাওনের পর আমার জীবনে নামে দুর্ভোগ। কেউ আমার দুই আনার দাম দিতো না। এর মইধ্যে একদিন পেডে আইলো হুতুম। হগলের যেন মাথাতে আকাশ ভাইঙা পড়লো। সম্পত্তির ভাগ পাওনের মানুষ আইয়া পড়ছে! তারা আমার উপর অত্যাচার এত বাড়াবাড়ি রকমের করল যে আমার গায়ে পইয্যন্ত হাতে তুলছে। কোনোমতেই আমারে বাড়ি থেইক্যা তাড়াতে না পাইরা সবশেষে আমার গায়ে কালি লাগাইলো। কইলো আমার চরিত্রের দোষ। গ্রামে ছি ছি পইড়া গেলো। আমার বাইচ্চা থাকাটা নরক কইরা দিল। তারপর…..’

বিন্দু থামে এবার। হাঁপিয়ে গিয়েছে মেয়েটা। চোখ-মুখে আতঙ্ক। পুরোনো ভয়টার স্মৃতি মনে পড়াতে বোধহয় এই আতঙ্ক। করবী পানি দিল বিন্দুকে। মেয়েটা খেলো। মুখ মুছল ওড়নার কোণ দিয়ে। করবী নরম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘তারপর?’

‘তারপর আর কী? আম্মা আমারে বাঁচানোর লাইগ্যা গ্রাম ছাড়লো। হুতুমরে পেডে লইয়া আইলাম ঢাকায়। চৌদ্দ বছরে জন্ম দিলাম হুতুমরে। আমাগো কষ্টের জীবনে আরেক ইতিহাস হইলো। হুতুম হওয়ার পরেই তো তোমাগো বিল্ডিং এ উডলাম। সবাইরে পরিচয় দিলাম অন্যকিছু। দূর কইরা দিলাম অরে আমার নামের আশপাশ থেইক্যা। অর লাইগ্যাই তো এত যুদ্ধ। ঐ ভালো না থাকলে হইবো কও?’

‘তোর জীবনে এতটা ঝড় অথচ বলিসইনি কখনো! কেন? আমি পর ছিলাম তোর?’

বিন্দু করবীর হাত চেপে ধরল, ‘না আপা, এডি কইও না। আসলে আমি কহনো চাই নাই এডা কেউ জানুক। যা ফালাই দিছি জীবন থেইকা তা জানামু কেমন কইরা কও?’

‘তা-ও তো আমি বুঝেই গেলাম। সত্য যে চাপা থাকে না। ‘
‘তুমি কেমন কইরা জানলা, আপা?’
‘হুতুমের চেহারার সাথে খালার মানে তোর আম্মার চেহারার কোনো মিল ছিল না তাছাড়া ওর চেহারা অবয়ব ছিল অন্যরকম। তোর কিছুটা মিল ছিল। তার উপর তোরা বলতিস তোর আব্বু প্যারালাইজড হয়েছে আট-নয় বছর অথচ হুতুমের বয়স চার! কী অদ্ভুত ভাবে খচখচ করতো ব্যাপারটা। এরপর হুতুম কখনো খালাকে মা ডাকতো না। তোকেও আপু ডাকত না। খালুকে আব্বু ডাকতো না। এমন অদ্ভুত ডাকে খচখচানি বাসা বাঁধে বুকে। এরপর একদিন ব্রীজে হুতুম যখন মা’কে নিয়ে গান গাইল সেদিন তোর চোখে, তোর আচরণে ছিলো ভিন্নতা। মা, মা একটা স্নেহ খুঁজে পেয়েছিলাম আমি। আমার খটকা যে পরিষ্কার হয়ে গেলো সেদিন। একদিন খালা বলল, তোর জীবনে নাকি অনেক কষ্ট, অনেক ঝড় গিয়েছে, সত্য অস্বীকার করে বাঁচতে হচ্ছে তাই তোর যেন খেয়াল রাখি। আমি যেন একে একে দুই করতে পারলাম। যদিও এতটা জানিনি, বুঝিনি, আঁচ করিনি, তবে হুতুমের সাথে তোর যেন টান তা আমি বুঝে গিয়ে ছিলাম।’

বিন্দু হতাশ চোখে তাকিয়ে রইল। অতীত সামনে আসা আদৌ কতটুকু ভালো হবে বর্তমানের জন্য? সবটা কী স্বাভাবিক থাকবে?

#চলবে

বুকপকেটের বিরহিণী পর্ব-৩০+৩১

0

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ৩০
কলমে: মম সাহা

রান্নাঘর থেকে ছ্যাঁত ছ্যাঁত শব্দ ভেসে আসছে। গরম তেলে মাছ ভাজছে বিন্দু। ইলিশ মাছ। আজ কাজ থেকে ফেরার পথে একটি ইলিশ মাছ নিয়ে এসেছে আপার বাড়িতে এসে রান্না করবে বিধায়। করবী গোসল সেরে এসেছে। যেদিন বাহিরে যায় সেদিন সে দু বেলা গোসল করে। নাহয় শরীর বেশ আঠালো লাগে। গরমে ঘুম হয় না রাতে। হুতুম খাটে বসে পড়ছিল। করবী ওর জন্য বই কিনে রেখেছিল সেগুলোই নেড়েচেড়ে দেখছে। ভুলভাল উচ্চারণে অ,আ পড়ছে। করবী বিছানায় এসে বসতেই হুতুম গিয়ে গলা জড়িয়ে ধরল তার। গালের সাথে গাল চেপে বসল আদুরে ভঙ্গিতে। তার আধো বুলিতে বলল,
‘বাণীর মা, বাণী কই গেছে?’

করবী ভেজা চুলে গামছা প্যাঁচাচ্ছিল তখন। হুতুমের কথায় তার হাত থেমে যায়। চোখ ঘুরিয়ে তাকায় বাচ্চাটার দিকে। অবসাদ জাগে তার ঠোঁটে, মুখে, বুকে। হতাশ স্বরে বলে, ‘চলে গেছে।’

‘ক্যান গেছে? তুমি কী তারে বকছিলা?’
হুতুমটার কথা ভীষণ সুন্দর। কেমন যেন পলক ফেলতে ফেলতে মিষ্টি স্বরে কথা বলে! করবী জাপটে ধরে তাকে। খানিক হেসে বলে, ‘বকলেই বুঝি চলে যায় সবাই?’

‘হ, বকলেই যায়। বিন্দুবালা যহন বকে তহন তো আমিও চলে যাই।’
‘তুমিও যাও! কোথায় যাও বলো তো?’
‘আমি বেশিদূরে যাই না বুজছো। আমি যাই মিনিদের বাড়ি। বেশিদূরে গেলে তো বিন্দুবালা আমারে খুঁইজ্যা পাইবো না। পরে তো কানবো। তাই কাছেই থাকি।’
‘কিন্তু বাণীকে তো আমি না বকতেই অনেকদূর চলে গিয়েছে, হুতুম। ও বোধহয় বুঝতে পারেনি ওকে হারিয়ে কেউ কাঁদবে।’

করবীর শান্ত কণ্ঠের কথায় হুতুম কোলে বসেই মাথা তুলে তাকাল। চোখে চোখ রাখল। ছোটো হাত দু’টো দিয়ে চেপে ধরল করবীর গাল গুলো। ঠোঁট উল্টে বলল, ‘তুমি বুঝি বাণীর লাইগ্যা অনেক কানছো? থাক কাইন্দো না। ধইরা নেও আইজ থেইক্যা আমিই তোমার বাণী, আমিই তোমার হুতুম।’

ছোটো মেয়েটির এই বিশাল স্বান্তনায় করবীর চোখ টলমল করে উঠল। ঠোঁট কাঁপল তিরতির করে। মেয়েটাকে বুকে চেপে ধরল দু-হাতের শক্ত বাঁধনে। এমন করে কে তারে আর ভরসা দিবে এই পৃথিবীতে? এমন করে নিষ্প্রাণ আত্মা নিয়ে কে তার পাশে থাকবে? সবাই যে আসে খনিকের জন্য।

বিন্দুর রান্না প্রায় শেষের দিকে। ভাত, মাছের ঝোল, আলু ভাজি নামানো শেষ। এবার চুলায় বসেছে পাতলা ডালের আয়োজন। করবী হুতুমকে ভাত খাওয়াচ্ছে ড্রয়িং রুমে বসে। বিন্দুও সেখানে এসে শসা, পেঁয়াজ কাটতে বসেছে সালাদ তৈরীর জন্য। এক কথায়, দু’কথায় বিন্দু বলল,
‘হীরণ ভাই কিন্তু তোমারে সত্যিই ভালোবাসে, আপা। তুমি হেইডা মানো আর না মানো, আমি কিন্তু মানি।’

করবী ভাত চটকে হুতুমের মুখে তুলে দিচ্ছিল কেবল। তন্মধ্যে এমন কথায় তার হাত থামল। চোখ উল্টে বিন্দুর দিকে তাকাল। মেয়েটার চোখ শসা কাটায়। ঠোঁটে প্লাস্টিকের হাসি ঝুলানো। করবী তপ্ত শ্বাস ফেলে এক লোকমা ভাত হুতুমের মুখে তুলে দিতে দিতে বলল, ‘হুট করে এমন বলছিস যে!’

‘হুট কইরা কই কইলাম? আমি তো রোজই কই। ম্যালা বছর ধইরাই কই। তুমিই তো মানতে নারাজ।’
‘এত মেনে কী হবে!’
‘তুমিও তো তারে একটু ভালোবাসতে পারো, আপা। যে মানুষটা এত ভালোবাসে তোমারে, তারে কী তুমি এক ফোঁটা ভালোবাসা দিতে পারো না?’
‘আমি না বাসলেও চলবে। আমার হয়ে তো তুই বাসছিস।’

বিন্দু এবার সোজা হয়ে টানটান করে বসল। করবীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল, ‘আমারটা তো আমি আমার হইয়া বাসছি। তোমার হইয়া বাসতে পারলে না-হয় বাসতাম। তবে আপা, তোমার হইয়া আমি দুই নলা ভাত বেশি খাইলেও তোমার যেমন পেট ভরব না তেমুন তোমার হইয়া কাউরে ভালোবাসলেও তার মন ভরবো না।’

‘না ভরুক মন। সবার মন ভরানোর দায়িত্ব তো আমাদের না।’
‘সবার মন ভরাইতে হইবো হেইডা কহন কইলাম। কিন্তু যে আমাগো সবকিছুর খেয়াল রাহে তার মন তো ভরাতেই পারি। তাই না?’

করবী প্রসঙ্গ পাল্টাতে চায়, ‘হয়েছে। বাদ দে তো ওদের কথা।’

‘আইচ্ছা আপা, তোমার লগে হীরণ ভাইয়ের প্রথম দেখা কই হইছিল?’

করবী তখন মাছের কাটা বাছছিল। সেদিকেই দৃষ্টি স্থির রেখে বলল, ‘কোথায় আর হবে, নফর চাচার একটা চায়ের দোকান ছিল গলির মোড়ে সেদিকে বসে চা খাচ্ছিল আর আড্ডা দিচ্ছিল। সেখানেই প্রথম দেখা হয়। সে তো বহু বছর আগের কথা।’

‘কী রঙের জামা পরছিল হীরণ ভাই?’
‘ছাঁই রঙের একটা টি-শার্ট ছিল গায়ে। সিগারেট ফুঁকছিল, চা খাচ্ছিল।’
‘হীরণ ভাই বোধহয় সেই দোকানেই বেশি আড্ডা দেয় তাই না?’
‘আরে না, ও তো বেশি আড্ডা দেয় কিন্ডারগার্টেন স্কুলটার সামনে। ওখানেই মূলত ওদের আড্ডার বাহার।’
‘হীরণ ভাই তো তোমার মতন অত পড়ালেহা করে নাই।’
‘সর, কে বলছে তোকে এটা? হীরণ এমবিএ করেছে ফিন্যান্স নিয়ে। ওর পছন্দের সাবজেক্ট। পরে গিয়ে কয়েক মাস ফটোগ্রাফিও করেছিল। ওর তো ফটোগ্রাফি নেশা ছিল। অনেক পছন্দের।’
‘হীরণ ভাইয়ের ছবি তুলা প্রিয় আছিল? কী কও! হের প্রিয় জায়গা কোনডা গো, আপা?’

করবী মুচকি হাসল। আনমনে বলল, ‘সাজেক।’
‘প্রিয় রঙ?’
‘জাম কালার।’
‘প্রিয় ফুল?’
‘রজনীগন্ধা।’
‘প্রিয় মানুষ?’
‘আমি।’ আচমকা উত্তরটা দিয়েই থমকে গেল করবী। ড্যাবড্যাব করে তাকাল বিন্দুর দিকে। বিন্দু তখন উচ্চস্বরে, প্রাণ খুলে হাসতে ব্যস্ত। হাসতে-হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছে প্রায়। অবুঝ হুতুম হাসির গভীরতা অবশ্য বুঝল না কিন্তু বিন্দুকে এমন লাগাম ছাড়া হাসতে দেখে নিজেও হাসা আরম্ভ করল। করবী বুঝল, বিন্দু তাকে কথার জালে ফাঁসিয়েছে ইচ্ছেকৃত।

হাসতে হাসতে চোখে জল জমেছে বিন্দুর। বা’হাতের কনিষ্ঠা আঙ্গুলটি ব্যবহার করে জল মুছতে মুছতে বলল,
‘হীরণ ভাইয়ের পছন্দের ফুল থেইকা শুরু কইরা পছন্দের মানুষরে অব্দি চেনো। বহু বছর আগে প্রথম দেহার দিন কোন রঙের জামা পরছিল হেইডাও পষ্ট (স্পষ্ট) তোমার মনে আছে। আর তুমি কি-না কও তুমি হেরে ভালোবাসো না! হেইডাও আমার বিশ্বাস করতে হইব, আপা? ভালোবাইস্যাও অস্বীকার করার মতন ভীতু তো তুমি না! তাইলে অস্বীকার করো ক্যান? এই বিন্দুর লাইগ্যা? এত মায়া তোমার আমার লাইগ্যা?’

(৪০)

আকাশে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। এদিক ওদিকে মেঘেদের বিচরণ লক্ষ্য করা যাচ্ছে বেশ। করবী বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছে। হুতুম তার পাশে। বাচ্চাটার হাতে কমলা রঙের একটি আইসক্রিম। গত পরশুদিন যে সে বিন্দুর সাথে এসেছে আর যায়নি। বিন্দুও নেয়নি। রেখে গেছে। আপার একলা লাগা ভাব কমাতেই হুতুমকে রেখে যাওয়া।
আইসক্রিম খেতে খেতে হুতুমের ঠোঁটটাও কমলা রঙ ধারণ করেছে। ছোটো কমলা রঙের ঠোঁট গুলো কিঞ্চিৎ নাড়িয়ে করবীর উদ্দেশ্যে বলল, ‘বাণীর মা, আইজ ম্যালা গরম পড়ছে তাই না কও?’

করবী হাঁটতে হাঁটতে ওড়না দিয়ে মুখ মুছল। হুতুমের মুখটাও মুছিয়ে দিল পরম যত্নে। অতঃপর উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ গো, ভীষণ গরম। তুমি হাঁটতে পারছ তো? নাকি রিকশা নিবো?’

‘না, না, রিকশা নিও না।’

হুতুমের ব্যস্ত কণ্ঠের না-তে ভ্রু কুঁচকালো করবী। সন্দিহান কণ্ঠে বলল, ‘ওমা! কেন রিকশা নিব না? তোমার পা ব্যথা হচ্ছে না বুঝি!’

হুতুম গোল গোল চোখে তাকাল, ‘পা ব্যথা হয় না আমার। আর তুমি জানো না এহন রিকশা ভাড়া অনেক চাইব। তোমার কত্ত গুলা টাকা নিবো ওরা।’

ছোটো হুতুমের বিজ্ঞ কথায় তাজ্জব বনে গেল করবী। ডাগর আঁখি তুলে বলল,
‘বাপরে, তুমি রিকশা ভাড়া নিয়েও ভাব?’

এবার কোমরে এক হাত চাপল বাচ্চাটা। নাক, মুখ কুঁচকে বলল, ‘ভাবব না? বিন্দুবালা তো কয়, টেকা কামাইতে নাকি অনেক কষ্ট। মাইনষের গালি, ধমক কত কিছু সহ্য কইরা টেকা কামানো লাগে।’

ছোটো হুতুমের বড়ো বড়ো কথায় প্রাণ খুলে হাসল করবী। মেয়েটা বাচ্চা হতে পারে কিন্তু জ্ঞানে বুদ্ধিতে একদম পরিপূর্ণ। বিন্দুর জীবনে এমন একটা মিষ্টি মানুষের তো প্রয়োজন। নয়তো মেয়েটা বাঁচত কীভাবে? অসুস্থ একটা বাবাকে নিয়ে বছরের বছর পার করতেও তো কত কষ্টই হতো!

‘রক্তকরবী… ‘
ব্যস্ত রাস্তায় নারীকণ্ঠে ভাবনা থেমে গেল করবীর। হাসিও থেমে গেল ডাক শুনে। চোখে-মুখে ভর করল বিস্ময়। অবিশ্বাস্য চোখে পেছনে তাকাতেই মধ্য বয়স্ক মহিলাটিকে চোখে পড়ল তার। চিকন ফ্রেমের চশমা চোখে, হালকা বেগুনি রঙের ছিমছাম সুতি শাড়ি পরনে ভদ্রমহিলার।

করবীর চোখ-মুখ অত্যাধিক শক্ত হয়ে গেল। প্রয়োজনের তুলনায় বেশিই শক্ত। কঠিন থেকে কঠিনতম স্বরে সে শুধাল,
‘আপনার এখানে কী?’

‘সাহেব না-কি আর বেঁচে নেই?’

করবীর চোখের পলক নড়ল মহিলার কম্পমান কণ্ঠে। করবী মুখ ঘুরিয়ে নিল তৎক্ষণাৎ। আশ্চর্য রকমের তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,
‘সে তো মরে গিয়েছিল বহু বছর আগেই। যেদিন আপনি ছেড়ে গেলেন। এতদিন শরীরটাই তো কেবল বয়ে বেড়াচ্ছিল। এখন নতুন করে খোঁজ নিতে এলেন কেন এত বছর পর!’

মহিলাটার চোখে জল থৈথৈ, ‘আমি আজ আবার হসপিটালে গিয়েছিলাম। ওরা জানাল, সাহেব… তুমি কীভাবে একা আছো!’

করবী মহিলার এমন বিচলিত ভঙ্গি দেখে তাচ্ছিল্য হাসল। অবজ্ঞার সাথে বলল, ‘আমি তো একাই। নতুন করে আমার একাকীত্ব নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না। নেহাৎ সেদিন আব্বুর শেষ ইচ্ছে পূরণ করতেই আপনার দুয়ারে ছুটে যাওয়া। নাহয় আপনার ছায়াও রক্তকরবী কখনো ছুঁতো না।’

মহিলাটি করবীর এমন কথার বাণে তাজ্জব বনে গেলেন। বললেন, ‘আমি তোমার…’

করবী থামিয়ে দিল কথা, ‘কেউ নন আপনি আমার। কেবল আমার আব্বুর সাহেবা আপনি। তাছাড়া আপনার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি জন্ম থেকে আব্বু বিহীন পৃথিবীতে কাউকে কল্পনা করিনি। পাইনি পাশে। আজও কেউ নেই আমার।’

‘আমাকে অস্বীকার করো ঠিক আছে কিন্তু নিজের জন্ম তো তুমি অস্বীকার করতে পারো না। আর যার জন্য জন্ম পেলে তাকেই বলছ কেউ না!’

#চলবে

#বুকপকেটের_বিরহিণী
কলমে: মম সাহা

পর্ব- ৩১

‘আরোরা’ ক্যাফেতে বসে আছে করবী। চোখে-মুখে প্রচন্ড অসন্তোষ ভাব। হুতুম সবে গরম স্যান্ডউইচে এক কামড় বসিয়েছে। কামড় বসিয়ে এক অনন্য, অপরিচিত স্বাদে তার প্রাণ জুড়িয়ে এলো। চোখ বন্ধ থাকা অবস্থাতেই বলল,
‘আরেএএ বাণীর মা, এই সন্ডুচটাতো অনেক মজা! কই, বিন্দুবালা যে একদিন আনছিল, হেইদিন এত মজা তো পাই নাই!’

করবী হুতুমের চুল গুছিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘বিন্দু এনেছিল? কবে?’

‘ঐ যে একদিন কই জানি গেল না? হেইদিন। মনেহয় নষ্ট আছিল।’

করবী হাসল, ‘আচ্ছা, এখন এটা খাও। মজা লাগলে আরেকটা আনব।’

হুতুম যেন বেজায় খুশি হলো এমন প্রস্তাবে। চপাস করে একটা চুমু খেয়ে ফেলল করবীর গালে। তা দেখে সামনের মহিলাটা সামান্য অবাকই হলেন। শুধালেন, ‘কে ও?’

করবীর ধ্যান হুতুম থেকে সরে মহিলার উপর পরে। হুবুহু দেখতে তারই মতন ভদ্রমহিলার মুখটি। কেবল পার্থক্য বয়সে। নয়তো মানুষ ভুল করে তাদের যমজ ভেবে ফেলত।

‘বললে না তো কে ও?’
‘সেটা আপনার জানার প্রয়োজন নেই।’ করবীর শক্ত উত্তরে ব্যথিত হলেন বোধহয় ভদ্রমহিলা। বিষণ্ণ স্বরে বললেন,
‘এমন করে কথা বলো না।’
করবীর ঠোঁটে ক্রুর হাসি, ‘আপনি তো এটারই যোগ্য।’

ভদ্রমহিলা পর পর আরও কয়েকবার শ্বাস ফেলে। তার চোখে জল জমে। হেরে যাওয়া যোদ্ধার মতন পরাজয় স্বীকার করে যেন নত মস্তকে। বলে,
‘তুমি তো এ শহরে একা। আমার সাথে চলে আসো।’

‘আপনি কী এটা বলতেই ক্যাফেতে ঢুকতে বলে ছিলেন? এটাই আপনার প্রয়োজনীয় কথা?’

‘হ্যাঁ। তোমার কাছে কী প্রয়োজনীয় লাগছে না?’

‘একদমই না। যে সদ্য বুলি শেখা শিশুকে একলা থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে চলে গিয়েছিল, তার মুখে অন্তত এসব কথা হাস্যকরই লাগে।’

‘আমি তোমার মা, করবী!’

‘সেটাই আমার জন্য বড়ো আফসোসের।’ কথাটা বলেই করবী উঠে দাঁড়াল। হুতুমকে কোলে করে বেরিয়ে গেল ক্যাফে থেকে। নূন্যতম আসছি বলার ভদ্রতাটুকুও দেখাল না। ভদ্রমহিলা সেদিকে তাকিয়ে দু’ফোটা আনুষ্ঠানিকতার অশ্রু ঝরালেন। সন্তানের কাছে এতটা অবজ্ঞার পাত্রী হবেন কখনো কল্পনাও করেননি বোধহয়।

(৪১)

টিভি দেখছে তুষার। কোনো এক খবর চলছে। তাসনীম বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে এসে ছেলের পাশের সোফাটায় নীরবে বসলেন। হয়তো কিছু বলতে চান যা উনার ভাবভঙ্গিতে স্পষ্ট। তবে সেদিকে তেমন ধ্যান দিল না তুষার। তার সকল ধ্যান জ্ঞান যেন সঁপেছে টিভি স্ক্রিনে। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে তিনি গলা পরিষ্কার করলেন। দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলেন সুক্ষ্ম ভাবে। তুষাল বিরক্ত হলো বেশ।

‘কিছু বলার হলে সোজাসাপটা বললেই পারো।’

তুষারের কপালের তিন ভাঁজে তাসনীম বেগম যেন একটু থতমতই খেলেন। কথাে বলার সাহস হারালেন। তবুও যথেষ্ট চেষ্টা করলেন কথা গুছিয়ে বলার। এবং অবশেষে সাহসটুকু সঞ্চয় করে বললেন,
‘বউরে নিয়ে তো কিছু বললে না! কী করবে?’

মায়ের কথায় তুষারের কপালের ভাঁজ আরও ঘন হলো, ‘আমি কী করব!’

‘তুমি কোনো সিদ্ধান্ত জানাও।’

‘আমি কেন সিদ্ধান্ত জানাব? বিয়ের সময় কী আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলে? আমার তখনের সিদ্ধান্ত শুনতে চেয়েছিলে?’

ছেলের রাখঢাক না রেখে ছোঁড়া তীক্ষ্ণ বুলিতে তাসনীম বেগম মাথা নত করলে। ছেলের মন রাখতেই বললেন,
‘আমি কী জানতাম ও এমন করবে! ভেবেছিলাম তো ভালোই হবে।’

‘তো? ভালো নন উনি?’ প্রশ্নটা করেই বাঁকা হাসল তুষার। ঠিক এ মুহূর্তে কী বললে ছেলের মন রাখা হবে বুঝলেন না ভদ্রমহিলা। তাই চুপ রইলেন। এতে তুষারের যেন হাসি আরেকটু প্রশস্ত হলো। বেশ তাচ্ছিল্য করেই বলল,

‘মেয়েটা ভালো না-কি খারাপ সেটা বলতেও দ্বিধা করছ তাই না? এমন নীরব আছো যেন মনে হচ্ছে তুমি পছন্দ করে এনেছিলে যাকে সে অযোগ্য, ভীষণ খারাপ একটা মানুষ। কিন্তু আসলেই কী সত্যি এটা? মোটেও না। বিদিশা খারাপ নন। আমি তার সাথে হয়তো সংসার করিনি, দুদণ্ড ভালো মতন কথাও বলিনি তবুও গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি উনি তোমার ভাবনার চেয়েও বেশি ভালো। একটা মানুষ যতটুকু ভালো হলে তার চলে যায় পাড়াপ্রতিবেশি হা-হুতাশ করে, ঘরের কাজের খালা অব্দি মেয়েটার সুন্দর জীবন কামনা করে, বিদিশা ততটুকু ভালো। যদি খারাপই হতো তাহলে এতগুলো বছর স্বামীর সাথে নূন্যতম যোগাযোগ না করেও এক ধারে সংসার করে যেত না। সমস্যা হলো কী, আমি, তুমি, আমরা… বুক ফুলিয়ে ভালোকে ভালো বলে মর্যাদা করতে পারি না।’

কথা শেষ করে তপ্ত শ্বাস ফেলল তুষার। টিভি স্ক্রিনে আর মনোযোগ স্থাপন করতে পারল না। হুট করেই কেমন বিরক্তি ধরে গেল চারপাশটায়। তেতো হয়ে এলো মগজ। সে উঠে দাঁড়াল। ঘরের দিকে পা বাড়াতেই তাসনীম বেগম ঝলমলে কণ্ঠে বলে উঠলেন,
‘তাহলে বউকে ফিরে আসতে বলি?’

তুষার ঘাড় ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকাল। বড়ো অসহ্য লাগল তার এ মাকে। মায়েদের এতটা অসহ্য হয়তো কোনো সন্তানের কাছে লাগে না। অথচ তুষারের কাছে লাগচ্ছে। কারণ তার মা মারাত্মক রকমের স্বার্থপর একজন মানুষ। সে কেবল নিজের সন্তান, নিজের সংসার, নিজের সুখ.. এসবই ভেবে গেল। তুষার মৃদু স্বরে বলল,
‘তোমার মনে হয় উনাকে ফিরে আসতে বললেই ফিরে আসবে? কখনোই না। ফিরে আসার জন্য উনি যাননি। যতটুকু চিনেছি, আমি বলতে পারব উনি কেমন। আমরা মরে গেলেও উনি আর আসবেন না। তাছাড়া কিছুদিন আগে যে মেয়েটার প্রতি এত অভিযোগ তুলে তাকে বাড়ি ছাড়া করলে, সে মেয়েটাকেই কেন আবার ফেরাতে চাও? আমি বলেছি বলে? আমি তো তাকে ভালো বলেছি কেবল। ভালোবাসি কিংবা ভালো লাগে এটা তো বলিনি। পৃথিবীর এমন কত কোটি কোটি মানুষই ভালো, তাই বলে কী সবার সঙ্গেই আমার সংসার পাতাবে?’

তুষারের শেষের বাক্যটিতে ছিল যেন চরম মুখ ঝামটি। ছোটো হয়ে এলো মায়ের মুখটি। সন্তানের ভালো চাইতে গিয়ে কখন তাদের থেকে এতটা দূরের হয়ে গেল সেটা যেন মায়ের মন বুঝতেই পারল না।

_

ঘুড়িদের বাসায় আজ হুতুমসহ এসেছে। করবী নিয়ে এলো। বাচ্চাটা তো ঘরে একা থাকতে পারবে না তাই। ঘুড়ি অবশ্য বেশ খুশি হয়েছে হুতুম এসেছে বলে। নাহয় তো মুখ বিরস করেই বসে ছিল সারাটাদিন।

হুতুম খেলছে একটি লাল পুতুল দিয়ে। ঘুড়ির জন্মদিনে ওর বাবা ওকে উপহার দিয়েছিল এটা। করবী হুতুমকে খেলতে দিয়ে ঘুড়ির সাথে কথা বলছিল। মেয়েটা কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে ভীষণ চিন্তিত বিধায় সে জিজ্ঞেস করল কী হয়েছে। তখনই ঘুড়ির সে কী কান্না! তার পাশের ফ্লাটের সেই গুরু-গম্ভীর মানুষটার নাকি বিয়ের কথা চলছে। গতকাল লোকটার মা এসেছে ঘুড়ির মাকে বলেছে মেয়ের খোঁজ থাকলে জানাতে। এটা শোনার পর থেকেই ঘুড়ির খাওয়া ঘুম উধাও। করবী সবটাই মনোযোগ দিয়ে শুনল। স্বান্তনা দিয়ে ঘুড়ির কান্নাও থামাল। কিন্তু সে ঠিক বুঝে উঠতে পারল না, যে লোকটার ভাবি ঘর ছেড়ে চলে গিয়েছে সে লোক হুট করে বিয়ের সিদ্ধান্ত কীভাবে নিলো! সে পরিবারের মানুষই বা কীভাবে এমনটা ভাবতে পারল? ঘরের বউয়ের প্রতি কোনো মায়া নেই তাদের! এসব ভেবেই মনের ভেতর একটা ক্ষোভ জন্মালো করবীর। ঘুড়িদের পাশের ফ্লাটের অপরিচিত পরিবারটার প্রতি তার যেন একটা অনীহাই চলে এলো।

ঘুড়িকে ছুটি দিয়ে করবী যখন রাস্তায় নামল তখন বিকেলের প্রায় শেষভাগ। হীরণ এসে দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়। হুতুম মাস্তানকে পেতেই ছুটে গেল। পেছন-পেছন এলো করবী। হীরণ হাসি মুখে হুতুমকে কোলে তুলে নিলো। ভ্রু নাচিয়ে করবীকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘কী ব্যাপার? আজ আসতে বললে যে?’
‘বাইক এনেছ?’

হীরণ উপর-নীচ মাথা নাড়ায়। দূরে দাঁড় করিয়ে রাখা বাইকটা দেখিয়ে বলল, ‘ঐ যে, এনেছি।’

করবী নিজেদের থেকে অতটা দূরে বাইক থামানো দেখে কিছুটা অবাকই হলো যেন! অবাক কণ্ঠেই বলল, ‘অতটা দূরে রেখেছ যে!’

হীরণ মাথা চুলকালো মিছিমিছি। হুতুমের গালে চপাস করে চুমু খেয়ে বলল, ‘ভেবে ছিলাম তুমি হেঁটে যাবে। বাইক দেখলে তুমি আমাকে আর তোমার সাথে হাঁটতে দিবে না। জোর করে বাইকে পাঠাবে। তাই দূরে রেখে ছিলাম। যেন সময় করে মিথ্যে বলে তোমার সাথে হাঁটার সুযোগ পাই।’

করবী তাজ্জব বনে গেল, ‘কী বলছো! বাইকটা যদি চুরি হতো!’

‘হয়নি তো কখনো! এর আগেও তো কতবার রাখলাম।’

করবী কপাল চাপড়াল। কোনো মানুষ ভালোবেসে এমন বোকা হতে পারে হীরণকে না দেখলে বুঝতোই না।

#চলবে

বুকপকেটের বিরহিণী পর্ব-২৮+২৯

0

#বুকপকেটের_বিরহিণী
২৮ এর বিশেষ:
কলমে: মম সাহা

(৩৮)
করবীর ফুলো মুখ। গালের এক সাইডে দেখা যাচ্ছে অযত্নের ব্রণ। চুল গুলো বাউণ্ডুলে, এলোমেলো। নীল রঙের জামাটা ঝকঝকে। ফর্সা শরীরে মনে হচ্ছে যেন একখণ্ড আকাশ জড়ানো। ধীর পা জোড়া হাঁটতে চায় না তবুও জোর করে তাদের টেনে নিয়ে যাচ্ছে। সপ্তাহ খানেক হলো টিউশনিতে যায়নি। আর যে দায়িত্বের প্রতি অবহেলা করা যায় না!
ক্লান্ত বুক চিরে বেরিয়ে আসে তিক্ত শ্বাস। চোখ গুলো টলমল করে ওঠে নোনা জলে। আকাশে অগণিত পাখি উড়ছে। কিচিরমিচির শব্দ কানে লাগছে বড়ো। করবী সেই আকাশের পানে তাকায় এক বুক আশা নিয়ে। এ নতুন নয়। গত কয়েকদিন যাবতই সে পাখির শব্দ শুনলেই ছুটে আসে। আকাশের দিকে পলকহীন তাকিয়ে থাকে। এই বুঝি বাণীটা উড়ে এলো। ভাঙা ভাঙা করে কতগুলো কথা বলল! অথচ এমন কিছুই হয় না। আশার আলো জ্বলতে জ্বলতে নিভে যায় অথচ বাণীটা ফিরে না। এই আটশ কোটির পৃথিবীতে তার নিজের বলতে কেউ নেই— এই বাক্যটির চেয়ে নির্মম বাক্য আর হয়? হয় না বোধকরি।

‘আজ এত দেরি হলো, বাণীর মায়ের!’

খুব নিকটেই একটি পরিচিত পুরুষ কণ্ঠ পেতেই করবী চমকে উঠল। এতটাই ধ্যানে মগ্ন ছিল সে যে বুঝেইনি তার সামনে হীরণ দাঁড়ানো।

করবীকে চমকাতে দেখে হাসল হীরণ, ‘কী ভাবে বাণীর মায়?’

মেয়েটাও হাসির বিপরীতে জোরপূর্বক হাসে। উচ্ছ্বাসহীন কণ্ঠে বলে, ‘কিছু না।’

‘রাস্তার মাঝে এমন করে ভাবতে-ভাবতে হাঁটলে তো গাড়ি তোমাকে উড়িয়ে দিবে।’
‘তাতে খারাপ হবে না বুঝলে!’ ঠোঁটে ঝুলানো বিষাদ হাসিটা আরেকটু গাঢ় হলো মেয়েটার। হীরণ তপ্ত শ্বাস ফেলে। করবীর এত বিপর্যস্ত অবস্থা ছেলেটাকে শান্তি যে দেয় না। কীভাবে মেয়েটাকে বুঝাবে সে এটা?

‘তুমি এখানে কেন? কোনো দরকারে এসেছিলে বুঝি?’ করবীর প্রশ্নে হীরণ মাথা নাড়ায় ডানে-বামে। অর্থাৎ, না। এরপর মুখে বলে,
‘আমি রোজই এখানে আসি।’
হীরণের উত্তরে কিঞ্চিৎ অবাক হয় করবী। ডান ভ্রু টা খানিক উঁচু করে বলে, ‘রোজ আসো? কেন? তুমি না এ সময় এলাকায় আড্ডা দিতে?’

করবীর প্রশ্নে মাথা নিচু কারে হাসে হীরণ। কথার প্রসঙ্গ পালটানোর চেষ্টা করে বলে,
‘চলো হাঁটি। টিউশনে যাবে তো?’
করবী সম্মতি দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। আকাশে তখন সূর্যের তেজ নেই। গরমটাও কমে এসেছে। চারপাশে কোলাহল। বিকেলের ফুটপাতে কিছু কিছু জায়গায় কৃত্রিম আলো জ্বলে উঠেছে।

‘কিছু খাওনি কেন?’
হুট করে হীরণের অদ্ভুত প্রশ্নে ভ্রু দু’টো কুঞ্চিত করল করবী। সে খায়নি একথাটা হীরণ জানলো কীভাবে তা ভেবেই অবাক হওয়া। হীরণ আবার বলে,
‘চলো, কিছু খেয়ে নিই। আমিও খাইনি।’
করবী শুধাল, ‘খাওনি কেন, হুতুমের মাস্তান?’
‘তোমার সাথে খাব বলে।’

করবী ছোট্টো শ্বাস ফেলল, ‘ইচ্ছে নেই।’
হীরণ জোর করল না। বরং শান্ত ছেলের মতন মাথা দুলিয়ে বলল, ‘আচ্ছা।’

‘বললে না, রোজ এ রাস্তায় আসো কেন?’
‘আসি আরকি একটা কারণে।’
‘কবে থেকে আসো? কই দেখিনি কখনো তো!’
‘যেদিন থেকে আমার এলাকার চাঁদটা এই এলাকায় জোছনা দেওয়া আরম্ভ করল, ঠিক সেদিন থেকে।’

করবী ঠিক ধরতে পারল না কথাটা। অবুঝ চোখে তাকিয়ে বলল, ‘কী!’
হীরণ নিশ্চুপ রয়। হীরণের এই নৈঃশব্দ্যতার ভেতরেই যেন করবীর সকল উত্তররা জ্বলজ্বল করে উঠে। করবীর মস্তিষ্ক কথাটা ধরতে পেরেই থেমে যায়। ছেলেটা এতটা পাগলামো করে কেন!

‘এই যে এত অবুঝের মতন করো, ক্লান্ত লাগে না? কতবার প্রত্যাখানের পর একজন মানুষ মুখ ফেরায় বলো তো?’

‘মানুষেরটা তো জানিনা, তবে হীরণ শেষ নিঃশ্বাস অব্দি ফেরাতে পারবে না। ক্ষমা করো।’

হীরণ ভেবেছিল তার এমন একটা কথার পর করবী রেগে যাবে, প্রতিক্রিয়া দেখাবে.. কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। বরং মেয়েটা উন্মনা হয়ে হাঁটল কেবল। হীরণ আবেগ ভোরা চোখে তাকাল। করবীকে চুপ থাকতে দেখে তার প্রেমের সাহস যেন কিছুটা বেড়ে গেল। হুট করে বলল,
‘আচ্ছা, কতবার প্রত্যাখানের পর একজন মানুষ ভালোবাসতে বাধ্য হয় বলো তো!’

করবীর ঠোঁটের কোণায় অনুরাগ দেখা যায়। খুব বলতে ইচ্ছে করে, হীরণের মতন মানুষ হলে মিছে মিছি দুই প্রত্যাখানের পরই ভালোবাসা এসে পরে। প্রথম প্রত্যাখ্যান মন থেকে আর দ্বিতীয়টা দেখানোর জন্য। অমন সোহাগ জানা পুরুষ ক’জনই বা ফেরাতে চায়? কিন্তু বলা হয়ে ওঠে না এই অনুরাগপূর্ণ কথা গুলো। বুকের কোণাতেই থেকে যায় তারা কড়া শাসনের ফলে।

বাকি পথটুকু নীরবই হাঁটে দু’জন। এরপর যখন করবী টিউশনি বাসায় ঢুকতে যায় ঠিক সে সময় ছেলেটা তাকে দাঁড় করিয়ে কোথায় যেন গিয়ে আবার ব্যস্ত পায়ে ফিরে এসে করবীর হাতে কেক, জুস ধরিয়ে দেয়। ভীষণ আবদার ভোরা কণ্ঠে বলে,
‘মনের দুঃখ পেটকে দিয়ে লাভ নেই। বাঁচতে যেহেতু হচ্ছে শুধু শুধু দেহকে কষ্ট দিয়ে লাভ কী? খেয়ে নিও। আমি অপেক্ষায় আছি একসাথে ফিরব। কেমন?’

করবী নিষেধ করল,
‘না না, চলে যাও তুমি। আমি একা যেতে পারব।’

হীরণ মাথা নাড়ায়। বুঝায় সে চলে যাবে। কিন্তু করবীর মন জানে, ছেলেটা যাবে না। এখানেই ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকবে। দুঃখের সময় ছেলেটা রুমাল হতে যে ভালোবাসে!

#চলবে

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ২৯
কলমে: মম সাহা

কেমন যেন সাধ হয় এই ক্লান্ত সংসার ছাড়িবার,
আদেশ নেই প্রস্থানের আর ইচ্ছে নেই রহিবার।

বিদিশার ডায়েরি জুড়ে এই দুটি লাইন লিখা। একবার, দু’বার না, গুনলে হয়তো শতসহস্র বার পাওয়া যাবে। কিন্তু জামাল ভূঁইয়া গুনলেন না। মেয়ের ব্যক্তিগত কষ্ট কোনো বাবা-ই সহ্য করতে পারেন না। তার উপর কষ্টের পরিমাণ কেই-বা যাবে দাঁড়িপাল্লা দিয়ে মেপে দেখতে?

বিদিশা ফ্লোরে বসে আছে খাটে হেলান দিয়ে। বেখেয়ালি বাতাসে উড়ছে ডায়েরির পাতা গুলো। শব্দ হচ্ছে পাতায়-পাতায় সংহারের। জামাল ভূঁইয়া দরজায় দাঁড়িয়ে দেখলেন মেয়ের মন মরা এই দৃশ্য। বুক চিরে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। কিন্তু তিনি মেয়ের দুঃখকে বাড়াতে চাইলেন না। তাই আবার পর্দা ঠেলে ঘরের বাহিরে গেলেন। গলা উঁচিয়ে ডেকে বললেন,

‘কী করো, আম্মু?’ কথা বলতে বলতে ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকলেন। ততক্ষণে বিদিশা দাঁড়িয়ে গিয়েছে। একদম পরিপাটি হাবভাব। একটু আগে অব্দি যে বিদিশা ফ্লোরে মনমরা হয়ে বসে ছিল, সে বিদিশার সাথে এই বিদিশার যেন বহু তফাত। মনে মনে হাসলেন বাবা। মেয়ের চতুরতায় বড়ো খুশিও হলেন। দুঃখ লুকানোর ক্ষমতা সবার নেই। উনার মেয়ের আছে সেটা অবশ্যই গর্বের ব্যাপার।

‘কিছু করছি না, বাবা। কিছু বলবে?’
‘কিছু না বললে বুঝি আসা যায় না? ‘

বাবার কথার প্যাঁচে পড়ে হাসল সে, ‘অবশ্যই যায়। বসো।’

বাবা বসলেন কাঠের চেয়ারটা শব্দ করে টেনে। দু’জন মানুষের ভেতরই কথার পাহাড় অথচ শুরু করার উপলক্ষ না পেয়ে শুনশান নীরব হয়ে স্থির থাকল দু’জন। বাহির থেকে তখন বিদিশার মায়ের নাক টানার শব্ত পাওয়া যাচ্ছে। হয়তো শব্দহীন কাঁদছেন। আজ বিকেলে কিছু আত্মীয় এসে ছিলেন। উনাদের হা-হুতাশ বিদিশার সংসার ভাঙা ঘিরে। মায়ের মন সেই হা-হুতাশে ব্যথিত হয়েছে ভীষণ। মানুষ গুলো যাওয়ার পর থেকেই যে নাক টেনে টেনে নীরব কান্না চলছে, তা এখন জারি রেখেছেন।
বাবা-মেয়ের কান সেই কান্নাতেই আটকে গেল। বিদিশা ছোটো স্বরে বলল, ‘মা বোধহয় কাঁদছে।’

বাবা আনমনে বললেন, ‘হয়তো!’
‘আমি আসাতে তোমাদের বড্ড যন্ত্রণা হয়ে গেল, তাই না বলো?’

জামাল ভূঁইয়ার অন্যমনস্কতা কেটে গেল। চপল চোখ গুলো মেয়ের দিকে স্থির করে বললেন, ‘এমন বলছো কেন?’

‘আমি কই বললাম? মায়ের কান্না বলছে।’
বিদিশা ঠাহর করল তার কথার পরপরই কান্নার শব্দ একদম মৃদু থেকে মৃদুতে চলে গেল। দরজার পর্দাটাও কেঁপে উঠল। কাঁপল নারী ছায়াটাও। মা যে দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে শুনেছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

‘তুমি আসার যন্ত্রণায় এ কান্না নয়। এই কান্না তোমার যন্ত্রণায় অন্তর পুড়ে আঙ্গার হয়ে যাওয়ার। কান্না ধরণ বুঝলে না আজও?’

‘আমার যন্ত্রণা কই হলো? মুক্তিতে কারো যন্ত্রণা হয় না-কি?’

মেয়ের কথা ঘুরানোর কৌশলে বাবা মাথা নাড়ালেন মৃদু। উঠে যেতে যেতে বললেন, ‘মুক্তিতে যন্ত্রণা হয় কে বলল? যন্ত্রণা হয় মৃত্যুতে। আর তোমার সংসারের জীবনের এই মৃত্যুতে তোমার কষ্ট হচ্ছে। আমি বুঝি।’

(৩৯)

ঘুড়ি মন খারাপ নিয়ে পড়তে বসেছে। যেমন-তেমন মন খারাপ না, ভীষণ মন খারাপ। একটি উজ্জ্বল তারা আকাশ থেকে খসে পড়লে যেমন আকাশের মন খারাপ হয় ঠিক তেমন মন খারাপ। করবী এসে বসার পরপরই সে মন খারাপ নিয়ে উঠে গেছে। তারপর এক গ্লাস পানি নিয়ে এসে দিয়েছে। মন খারাপ নিয়েই সব পড়া এগিয়ে দিয়েছে। করবী বেশ খানিকক্ষণ যাবতই ঘুড়ির এই মন খারাপ খেয়াল করছে। অতঃপর বলল,

‘কী হয়েছে বলো তো? আজ আকাশ অন্ধকার কেন?’

ঘুড়ি চঞ্চল চোখে বারান্দা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাল। অন্তরিক্ষের নীরদ তখন আনমনে উড়ছে। বিকেলের কমলা রঙ তখন বুক ফুলিয়ে হাসছে গগণ বক্ষে। কই আকাশ তো অন্ধকার নয়। ঘুড়ির সরল ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো। আর্দ্র স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় অন্ধকার?’

‘এই যে অন্ধকার— চোখ দু’টিতে, অন্ধকার- ঘুড়ির চঞ্চল ঠোঁটে। মনে হচ্ছে মনের ভেতর ঝড়ের ভীষণ তোলপাড়…. এই যে এত এত অন্ধকার, দেখছো না বুঝি?’

করবীর কাব্য গাঁথা কথায় ছোটো মেয়েটির মুখে হাসি ফুটে উঠল। খানিক ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল, ‘ওহ্, আমার কথা বলে ছিলেন! বুঝিইনি।’

‘তা বললে না তো মন খারাপ কেন? কিছু হলো?’
ঘুড়ি ফুস করে শ্বাস ফেলল। হতাশ কণ্ঠে বলল, ‘কেবল কিছু নয়, অনেক কিছু হয়েছে। আপনি তো আসেননি এক সপ্তাহ তাই জানাতে পারিনি।’

‘কী হলো এমন?’
‘ভাবি আছে না? সে চলে গিয়েছে।’

ঘুড়ির কথা বোধগম্য হলো না করবীর। বোকা চোখে তাকিয়ে বলল, ‘কোথায় গিয়েছে?’

‘তার বাবার বাড়ি। একবারের জন্য চলে গিয়েছে।’

করবী কিছুটা অবাক হলো। পুরো ব্যাপারটা তার কাছে অস্বচ্ছ।
‘ভাবী চলে গিয়েছে কেন? কী এমন হলো?’

ঘুড়ি এবার সবটা খুলে বলল। বিদিশার বিয়ের প্রথম থেকে শেষ ভাগের সবটুকু। যেতে যেতে বিদিশা কেমন পাথর হয়ে প্রস্থান নিয়েছে তা বলতেও বাকি রাখেনি। করবীর বড়ো আফসোস হলো মেয়েটার জন্য। চোখ-মুখে উদ্বিগ্নতা দেখা গেল। চাপা স্বরে বলল, ‘ভাবির বাবার বাড়ির ঠিকানা জানো?’

ঘুড়ি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানাতেই করবী জানাল সে ভাবিকে দেখতে যাবে। তা শুনে বায়না জুড়ল ঘুড়িও। করবী রাজি হলো। ঘুড়িকে সাথে নিয়েই বিদিশাকে দেখতে যাওয়ার দিন নির্ধারণ করল। মনে মনে বিদিশার পরিবারটির বিরুদ্ধে বিরূপ প্রভাব পড়ল মনে। এত নিচু মন-মানসিকতা মানুষের! ভাবতেই তার দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।

তখন বিকেল পেরিয়ে সাঁঝ নেমেছে ধরায়। রাস্তার হলুদ, নীল, সাদা আলো গুলো জ্বলে উঠেছে জোনাকির মতন। ফুটপাতের নীল পলিথিনে দোকান গুলোতে বসেছে কত মুখরোচক খাবারের সমাহার। কোথাও বা বসেছে ভ্যান ভর্তি ঝুমকো, নেলপলিশের হাঁট। করবী যখন ঘুড়িদের বাসা থেকে নামল তখন বাজে সাড়ে সাতটা। সিঁড়ি পেরিয়ে গেইটের সামনে তাকাতেই দেখল হীরণ নেই। করবী হাঁপ ছেড়ে যেন বাঁচল। যাক, ছেলেটা কবে এতক্ষণ অপেক্ষা করেনি। তবে কোথাও যেন মনঃক্ষুণ্ন হওয়ার আভাস ধামাচাপা দেওয়ার তুমুল চেষ্টা চলল।
যেই গেইট পেরিয়ে রাস্তায় পা ফেলল ঠিক সেই মুহূর্তে হীরণের হাস্যোজ্জ্বল মুখটি নজরে পড়ল। ঠোঁটে একটি মহা মূল্যবান খাঁদ বিহীন হাসি ঝুলিয়ে বলল,
‘তুমি বুঝি একটু বেশি সময় ধরে পড়াও? প্রায় দু’ঘন্টা পড়ালে।’

‘তা নয়, অনেক বন্ধ পড়েছে বিধায় একটু বেশি পড়ালাম। তুমি যাওনি কেন?’

‘যাওয়ার কথা তো ছিল না।’
‘ছিল।’
‘কখন ছিল?’
‘আমি তো বলে ছিলাম চলে যেতে।’
‘তুমি কী আমায় আসতে বলে ছিলে?’
‘না।’
‘তবে, যাওয়ার কথাও-বা বলবে কেন? যে নিজ ইচ্ছেতে আসে সে যেতে হলে নিজ ইচ্ছেতেই যাবে। তাকে শুধু শুধু যেতে বলে দুঃখ দিও না।’— কেমন দুঃখী দুঃখী একটি কথা হীরণ শুদ্ধতম হাসি দিয়ে বলে ফেলল। অথচ কথাটির ভেতরে ছিল কেমন গাঢ় অভিমান, অভিযোগ! করবী অবশ্য অতটুকু ভেতর ছুঁতে পারল। কিছুটা বিরতি নিয়ে হাঁটা আরম্ভ করল। হাঁটতে লাগল হীরণও। বেশ খানিকক্ষণ রঙিন পথটা হেঁটে পার করল নিশ্চুপে। হীরণ অপরাধী স্বরে বলল, ‘রাগ করেছ?’

করবী বাঁকা চোখে তাকিয়ে বলল, ‘রাগ করার মতন কিছু বলেছ?’
‘না।’
‘তবে রাগ করব কেন?’
‘কী জানি, রুবী! আমি তো বলি ভালোবাসতে পারার মতন কথা অথচ তুমি ভালোবাসো না। তাই বুঝি না কোন কথাতে রাগ করবে আর কোন কথাতে অনুরাগ!’

করবীর রুষ্ট চোখে তাকাল। প্রশ্রয় না দিয়ে বলল, ‘একদম এমন কথা গুলো বলবে না। এসব বললে আমার সাথে কথা বলবে না।’
‘কী অদ্ভুত তাই না? যার জন্য ভালোবাসা সে বুঝে না অথচ গোটা পৃথিবী জানে, হীরণ নামের একটি বখাটে ছেলে ভদ্র রুবীতে মুগ্ধ হয়ে মরেছে। অথচ যার জন্য মরলাম সে এক মুঠো প্রেমও দিল না সমাধিতে।’

করবী চমকে তাকাল। হীরণ এত সুন্দর কথা বলতে পারে তার ধারণাতে ছিল না। ল্যাম্পপোস্টের জ্বলজ্বলে আলোয় শ্যামলাটে হীরণকে তার জনম জনমকার প্রেমের পিয়াসু মনে হচ্ছে। কী মায়া আছে ঐ অবিশ্লেষিত চোখ দু’টোতে, কে জানে? তাকালেই মনেহয় আটকে যাবে মন। ফেঁসে যাবে বুকের ভেতর শাসনে থাকা সেই প্রেম। সোহাগ জানা পুরুষ তখন জেনে যাবে, ভদ্র রুবীর মন অবাধ্য হতে চায়। অভদ্রের হাত ধরে জীবন দেখতে চায়।
কিন্তু এ কথা যে জানতে দেওয়া যায় না। বিধানে নেই। বিন্দুর প্রেমের মানুষকে নিয়ে নিলে মেয়েটা কাকে ধরে বাঁচবে? কাকে দেখে মুগ্ধ হবে? কার জন্যই বা ক্যাটক্যাটে হলুদ রঙের জামা পরবে? বিন্দুর শখ – আহ্লাদ যাকে ঘিরে, তাকে ঘিরে সংসার সাজানো যায় না। উচিত নয়।

হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির সামনে এসে পৌঁছায় তারা। করবীর পা থেমে যায় পরিচিতদের দেখে। একটি ছোটো মেয়ের হাত আঁকড়ে ধরে আছে আরকটি ছোটো হাতকে।

বিন্দুদের আকস্মিক দেখে করবী কিছুটা হোঁচট খায়। ভয়ও হয় খানিক। হীরণকে পাশে দেখে বিন্দুটা কী ভাববে সেটা ভেবে মনও উতলা হয়। অথচ বিন্দুর ঠোঁটের বিশাল হাসি বিশালই থাকে। চঞ্চলা স্বরে বলে,
‘আরে হীরণ ভাই, তুমি এইহানে? আপার লগে আইলা? ভালাই হইছে তুমি আছো আপার লগে। আমার যে কী দুর্ভাগ্য! আপার খারাপ সময়ে থাকতে পারতাছি না। হীরণ ভাই তুমি একটু আপার আগে-পিছে থাইকো কয়ডা দিন। আপার ভালো লাগবো।’

বিন্দুর এত সরলতা, এতটা স্বাভাবিকতা আশা করেনি করবী। ভেবেছিল মেয়েটা একটু হলেও দুঃখ পাবে হয়তো মনে মনে! ততক্ষণে হুতুম এসে বাণীর মায়ের কোমড় জড়িয়ে ধরেছে। হুতুমের মাস্তান গাল টেনে দিল বাচ্চাটার। দূর থেকে দাঁড়িয়ে হাসতে থাকা বিন্দু শুষে নিল চোখের জলটা সবার অগোচরে। নিজে নিজে বিড় বিড় করে বলল—
‘আমি এত স্বার্থপর নাকি যে আমার আপার সুখ দেখলে আমার দুঃখ হইবো! আপার সুখ আর হীরণ ভাইয়ের সুখ যেইহানে আইস্যা থামে, আমি যে তার থেইক্যা বহুদূরে হেইডা কী আর আমি জানি না! জানি। তবুও, ভালোবাসলে একটু তো পাইতে মন চায়ই। ছাঁদের ঘরটায় আমার বালিশের পাশের বালিশটায় তোমারে তো একটু দেখতে মন চায়ই, হীরণ ভাই। তাই বইল্যা তোমারে দুঃখ দিমু না-কি? না আপার সুখ দেইখা জ্বলমু? আমার বালিশের পাশে তোমার বালিশটা চির জীবন নাহয় খালিই থাকব। আমার যে তাও হুতুম আছে। আপার তো কেউ নাই। কেউ না। আপার হইয়া নাহয় তুমিই থাকলা।’

#চলবে

বুকপকেটের বিরহিণী পর্ব-২৬+২৭

0

#বুকপকেটের_বিরহিণী
হীরণ সমাচার পর্ব: ২৬

কলমে: মম সাহা

কিছু মানুষ চির জীবনের জন্য ঘুমিয়ে আছে মাটির ভেতরে। তার সাথে ঘুমিয়ে গিয়েছে কত শখ, কত স্বপ্ন, কত না বলা কথা, কত আফসোস, কত মায়া, আরও কত কী…জায়গাটি কবরস্থান। প্রতিটি মানুষের শেষ গন্তব্য স্থান। যেখানে এসে একদিন সবাইকে থামতে হবে। সবকিছুকে বুকে যত্নে করে পোষ মানিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে হবে এখানে। চির জীবনের ঘুম।
ঠিক এই জায়গাটার চারপাশ জুড়ে যে বেড়া লাগানো, সেই বেড়ার বিপরীতে এক জীবিত পৃথিবী। যেই পৃথিবী প্রতিনিয়ত স্বপ্ন পুষে বুকে, চলছে বহুদূর। শেষ গন্তব্যের কথা ভুলে গিয়ে ক্ষণস্থায়ী গন্তব্যকে পাওয়ার আশায় ছুটছে। এই ছুটার শেষ নেই। তারা ভুল করেও একবার স্মরণ করে না একদিন তাদের ব্যস্ততা এসে ঘুমিয়ে যাবে কবর দেশেতে। একটা সামান্য বেড়া, অথচ দু’টো পৃথিবীকে আলাদা করে দিয়েছে কত গুরুতর ভাবে। সেই বেড়া ধরে ব্যস্ত পৃথিবীর একজন প্রাণী শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে ঘুমন্ত পৃথিবীটির দিকে। কারণ আজ তার শখের মানুষটি ঘুমিয়ে গিয়েছে চির নিদ্রায়। সেই ঘুম কেমন, কতটা একাকীত্বের তা-ই দাঁড়িয়ে দেখছে মেয়েটি।

বাতাস নেই চারপাশে। গুমোট, অস্বস্তিকর একটা গরম পড়েছে। তবে জোছনা রাত। এক আকাশ জুড়ে একটি অর্ধ-খণ্ডিত চাঁদ চুপ করে আছে বিচ্ছেদের দেবদাসের মতন। সেই জোছনার আলো ঝলমল করছে নতুন কবরটার উপর।

‘বাড়ি চলো। ভোর হবে তো কিছুক্ষণ পর।’
এই নিশ্চুপ, অপরিচিত পরিবেশে পরিচিত কণ্ঠে খানিক কাঁপল করবীর শরীরটা। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই চোখে পড়ল হীরণের ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত মুখটি। করবীর অবাক হওয়া উচিত হুট করে এখানে হীরণকে দেখে। বিস্ময়ও প্রকাশ করা উচিত। অথচ সে কিছুই করল না। কেবল নির্জীব কণ্ঠে থেমে থেমে বলল,
‘কখন এলে?’
‘আমি এখানেই ছিলাম।’
‘এখানে ছিলে?’
করবীর মুখে এবার খানিক বিস্ময় দেখা গেল। হীরণ এসে করবীর পাশাপাশি দাঁড়াল। দৃষ্টি রাখল করবীর মুখমণ্ডলে। উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ।’
‘কিন্তু.. কেন?’
‘আমি জানতাম তুমি আসবে।’
করবীও এবার সরাসরি তাকাল হীরণের দিকে, ‘তুমি জানতে আমি আসব! কীভাবে?’
‘যে মেয়েটি তার সকল শখ, আহ্লাদ কেবল উৎসর্গ করেছিল তার বাবার পেছনে, সেই মেয়েটি যে বাবার সাথে এত সহজে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না, সেটা আমি জানি।’

করবীর চোখে জল এলো। কান্নারা এমনই। আহ্লাদ পেলে প্রকাশ্যে আসতে চায়। হীরণ করবীর মনের অবস্থা বুঝল। করবীর ডান হাতটা শক্ত করে ধরল, ‘কেঁদো না। যে চলে গেছে, কাঁদলেও সে ফিরে না।’
ছন্নছাড়া, ভবঘুরে ছেলেটির নিখাঁদ স্বান্তনায় করবীর কান্না থামার বদলে বেড়ে গেল। ফুপিয়ে ওঠল সে,
‘কেন ফিরে না? তারা জানে না, তাদের ছাড়া আমাদের কষ্ট হয়।’
‘জানে। কিন্তু ফিরে আসার যে নিয়ম নাই। থাকলে হয়তো তারা আসতো। এত আপন মানুষকে রেখে যেতে কেই-বা চায় বলো?’

‘আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।’ বাচ্চাদের মতন কী সহজ সরল স্বীকারোক্তি মেয়েটার! হীরণের খারাপ লাগে। তার ডান হাতে থাকা করবীর হাতটাকে সে বাম হাতে বুলিয়ে দেয় স্নেহের ছোঁয়ায়। বলে,
‘তোমার যে খুব কষ্ট হচ্ছে সেটা আমি জানি। বুঝি। মা যখন মারা গেল, তখন আমার কষ্ট বুঝার বয়স হয়নি। একদিন দেখলাম বাবার সাথে মায়ের কী নিয়ে যেন প্রচণ্ড ঝগড়া হলো। ঝগড়া ভয় পেতাম তাই ভয়ে ঘরে গিয়ে দরজা আটকে খাটে গিয়ে শুয়ে পড়লাম। কখন যে ঘুমিয়ে গেলাম বুঝিনি।’
হীরণের কথা থামে। পরপরই ভেসে আসে দীর্ঘশ্বাস। ততক্ষণে করবীর কান্না কিছুটা দমে এসেছে। হীরণের এ’জীবন সম্পর্কে তারা অবগত নয়। তা-ই স্বভাবতই কৌতূহল জন্মালো তার,
‘তারপর?’

হীরণ বুক ভোরে শ্বাস নিল। কষ্টের কথা বলতে তার ভালো লাগে না। তবুও করবীর কষ্ট সামান্য নিয়ন্ত্রণে আনতেই এই কথাগুলো বলা। কারণ মানুষ যখন নিজের কষ্ট নিয়ে প্রচণ্ড হতাশায় ভুগে তখন তাকে অন্যের কষ্টের কথা জানাতে হয়। তখন অন্যের কষ্টের সাথে নিজের কষ্টের তফাত খুঁজে পেয়ে খুব সহজেই নিজের দুঃখটা লাঘব করতে পারে।

হীরণকে চুপ থাকতে দেখে করবী আবার জিজ্ঞেস করল, ‘তারপর?’
‘তারপর আর কি, ঘুম থেকে ওঠলাম প্রচণ্ড চিৎকারের শব্দে। মায়ের ঘর থেকে চিৎকার আসছিল। ছোটো মন ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। দ্রুত মায়ের রুমের কাছে যেতেই জীবনের নির্মম দৃশ্যটুকু দেখে ফেললাম। মায়ের শরীরে দপদপ করে আগুন জ্বলছে। মা নিজেই লাগিয়েছে আগুনটা। আমি মায়ের কাছে ছুটে যেতে চাইলেও দাদী আটকে দেয়। মা-ও এই জ্বলন্ত শরীর নিয়েও বার-বার হাত নেড়ে ইশারা করছিল আমি যেন তার কাছে না যাই। বাড়ির কাজের লোকরা ছুটে গিয়ে পানি আনল। মায়ের শরীরের আগুন নেভালো। কিন্তু ততক্ষণে সবটুকু পুড়ে ছাঁই। মায়ের শরীর, মায়ের দুঃখ, মায়ের অভিযোগ…. সবকিছু।’

কথা থামল। বোবা বাতাস ছুঁয়ে গেল শরীর। করবী তার হাতের তালুতে থাকা হীরণের হাতটা শক্ত করে ধরল। এই শক্ত করা অর্থ হলো আশ্বাস দেওয়া।

‘কষ্ট পেও না।’ ছোটো, ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলল সে।
হীরণ হাসল। আবারও বুক ভোরে কতগুলো বোবা বাতাস টেনে নিল অন্তরে,
‘কষ্ট পাই না। কষ্ট পেয়েও বা আর কী হবে? মা ফিরবে না। তবে একটা জায়গায় আমার আফসোস থেকেই গেছে, জানো। আমি সাত বছর থাকাকালীন মা মরেছিল। মায়ের বিদায়ে কান্না করার জন্য এই পৃথিবীতে কেউ ছিল না। আমি তো ছোটো মানুষ, ভয়ঙ্কর দৃশ্য দেখে ভীত হয়ে গিয়েছিলাম। তাই কান্না করার সুযোগ পাইনি। অথচ আব্বু, দাদী, ফুপি কেউ কাঁদল না। দেখলাম মায়ের লাশ কবরে ওঠার আগেই বাড়িতে বিশাল আড্ডা বসল। সেই আড্ডায় আব্বুর দ্বিতীয় স্ত্রী কেমন আনতে হবে তা নিয়ে আলোচনা করতে ব্যস্ত সকলে। অথচ তখনও বাড়িটায় একজন মানুষের অস্তিত্ব পুড়ে যাওয়ার গন্ধ ছিল। একটা মানুষ এত বছর এই পৃথিবীটাতে ছিল। সংসার গুছানোর তাগিদে নিজেকে কখনো গুছানোর সুযোগ পেল না, সংসারের জন্যই শেষমেশ জীবন দিল অথচ দুর্ভাগ্য দেখো, সেই সংসারেই তার শূণ্যতায় কান্না করার মতন কেউ ছিল না। কেউ না। আমার মায়ের পুরো এক জীবনের মায়া, শ্রম সবই বৃথা ছিল। অথচ চাচার ভাগ্য সেক্ষেত্রে ভালো। তার কবরের দিকে উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকার জন্য একজন মানুষ তিনি পৃথিবীতে রেখে গেছেন।’

করবী স্বান্তনা দেওয়ার ভাষা পেল না। কেবল শক্ত হাতে ধরে রাখল হীরণকে।
হীরণ তপ্ত শ্বাস ফেলল,
‘জানো, আমার আফসোস কী?’
করবী আগ্রহী মনে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, ‘কী?’
‘যে মানুষটা আগুনে ঝলসে যাওয়ার সময়ও আমার কথা ভেবে আমাকে তার কাছে যাওয়ার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল, সে মানুষটার জন্য আমি কিচ্ছু করতে পারিনি। কিছুই না।’

#চলবে

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ২৭ (অর্ধেকাংশ)
কলমে: মম সাহা

(৩৭)
সকাল বেলা ছাদে এসে দাঁড়িয়েছে বিদিশা। সূর্য সবে লাল টুকটুকে রঙ ধরে গগণে হাসতে শুরু করেছে। ভোরের মৃদুমন্দ বাতাস ছুঁয়ে যাচ্ছে শরীর। কর্কশ কণ্ঠে একাধারে একটি কাক ডেকে যাচ্ছে ভোরটিকে পরিপূর্ণ করতে।
হুট করেই ছাদের গেইট খোলার শব্দ পেতেই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল বিদিশা। তাকাতেই তুষারের ঘুম-ঘুম চোখমুখ দৃষ্টিতে এলো। এত সুন্দর পুরুষ মানুষ হয় কি-না তার সন্দেহ। লোকটি প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই সুন্দর বোধহয়।
‘ছাদে যে?’
তুষার প্রশ্নটি বিদিশাকে উদ্দেশ্য করেই করেছে কিন্তু বিদিশা তবুও মুখ ভার করে অন্যদিকে ফিরে তাকিয়ে রইল। তুষার আরেকটু এগিয়ে গেলো। বিদিশা থেকে তিন-চার হাত দূরে প্রাচীরটার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়াল। ঘুম মাখানো কণ্ঠ তার,
‘এত সকালে ছাদে কী করেন?’
বিদিশা উত্তর তো দিল না বরং চলে যেতে উদ্যোত হতেই তুষার বিরক্তিতে চ উচ্চারণ করল, ‘আরেহ্, আপনি কথা বলতে পারেন না না-কি? ‘
‘কেন? কথা বলতে পারলেই আপনার সাথে কথা বলতে হবে এর কোনো বাধ্যবাধকতা আছে বুঝি?’

মেয়েটার ধারালো উত্তরে তুষার দিনে দিনে কেবল তাজ্জবই বনে যাচ্ছে যেন।
‘এভাবে কথা বলেন কেন আপনি?’
‘কীভাবে বলি?’
‘এই যে মাধুর্যহীন।’
‘আপনার সাথে মাধুর্যতা দেখানোর প্রয়োজনবোধ করি না, তাই।’

তুষার যেন আরকিছুই বলার ভাষা পেল না। ঘুম উড়ে গেছে সেই কখন। মেয়েটিকে সে যতটুকু দেখেছে মেয়েটা এত রুক্ষ নয়। সবার বেলাতো নয়ই। এই তো পরশুদিন মধ্যরাতে যখন তিমির বাড়ি ফিরল তখন কী সুন্দর করে যত্ন করে তিমিরকে ভাত বেড়ে দিল। কেন বাড়িতে ফিরেনি দু’দিন তা-ও জিজ্ঞেস করল। তিমিরের ক্লান্ত মুখ দেখে কেমন স্নেহ করল! যদিও তিমির মেয়েটা থেকে বহুগুণ বড়ো তবুও সম্পর্কের দিক দিয়ে মেয়েটা বড়ো অভিভাবকের মতনই আচরণ করল। তাছাড়া ঘুড়ির সাথে থাকলেও তো কত সুন্দর করে মিশে। কিন্তু তার বেলাতে এলেই এমন শক্ত আচরণ করে কেন?
মনের প্রশ্ন মনে রাখল না তুষার। সোজাসাপটা জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি আমার সাথে এমন আচরন করেন কেন?’

বিদিশা ছাদের মাঝ বরাবর এসে থামল। পেছন তাকিয়ে কর্কশ স্বরে বলল, ‘আপনি এটাই প্রাপ্য। সেজন্য।’

‘আমার দোষ কী?’
তুষারের প্রশ্নে এবার হু হা করে অপ্রত্যাশিত ভাবে হাসল বিদিশা। হাসি বজায় রেখেই বলল,
‘আপনার দোষ, আপনি আপনার মায়ের মতনই হয়েছেন।’

বিদিশার উত্তর ধাঁধা। তুষার সে-ই ধাঁধা ধরতে পারল না।
‘মানে!’

বিদিশা তপ্ত শ্বাস ফেলল, ‘আপনার মা যেমন তার ভুলটা কী সেটা উপলব্ধি করতে পারেন না কখনো, ঠিক আপনিও তাই। আপনাদের এই উপলব্ধি করতে না পারার ব্যাপারটাই আপনাদের জীবনের বড়ো ভুল। বড়ো অন্যায়।’

তুষার রেগে গেল এবার, ‘এতই যখন আমরা অন্যায় করেছি, ভুল করেছি তো চলে যাচ্ছেন না কেন?’

বিদিশার ঈগলের মতন তীক্ষ্ণ চোখ জোড়া এবার শীতল হয়ে এলো। কর্কশ মুখমন্ডলটিও নরম হলো। থেমে গেল তার শক্ত-পোক্ত অভিনয়ের চেষ্টাটি। বিড়বিড় করে নিজেই নিজেকে বলল— ঠিকই তো! আমি চলে যাচ্ছি না কেন? থেকে গেছি কীসের আশায়? যেখানে আমি কোথাও নেই সেখানে সংসার পাতার আশায়? হাহ্!

বিদিশার মুখাবয়ব নরম হয়ে আসতেই তুষার অপরাধবোধ অনুভব করল। তার বোধহয় মেয়েটাকে এমন ভাবে বলা উচিত হয়নি।
বিদিশা নিজে নিজেই বিড়বিড় করতে করতে ছাদ থেকে নেমে গেল। যে উত্তর বললে মানুষ দুর্বল ভাববে সে উত্তর নাহয় না-ই বলল। থাকুক কিছু লুকিয়ে।

বাবা বিহীন করবীর ছোট্টো সংসার। শূন্য, নিষ্প্রাণ রুম গুলো। বাবা বলে ডাকলেও সে ডাক প্রতিধ্বনিত হয় দেয়াল গুলোতে। এতটাই ফাঁকা চারপাশ। শোক-শোক করে বাবা বিহীন কেটে গেছে মেয়েটির একটি দিন। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে গিয়েছিল ঠান্ডা ফ্লোরে। যখন জানালা ভেদ করে ভারী রোদ মুখে এসে পড়ল তখনই তার ঘুম ভাঙল। এক কাঁধ ব্যথা হয়ে গিয়েছে। ঘুম ভাঙতেই স্মৃতি ভুলে ডাক দিয়ে বসে অভ্যাসবশত বাবাকে। সেই ডাক চারপাশে ধাক্কা খেয়ে তারই কাছে আবার ফিরে ফিরে আসে। তখন তার মস্তিষ্ক সজাগ হয়। তীব্র শূন্যতায় খা খা করে ওঠে জীবনটা। এ জীবনটাকে মনে হয় হৈমন্তের ধান উঠিয়ে ফেলার পর ফাঁকা জমিনটার মতন। কোথাও কিচ্ছুটি নেই। কেবল আধখষা কিছু স্মৃতি পড়ে আছে জীবনের আনাচে-কানাচেতে।

করবী অভিমান বুকে পুষে উঠে দাঁড়ায়। বারান্দায় ঝিমুনি কাটতে থাকা বাণীর কাছে যায়। কেউ নেই জীবনটায় অবহেলার কাকতাড়ুয়া হয়ে বসে থাকা বাণীটির প্রতিও তার অভিমান জন্মে। সবচেয়ে বুঝদার করবী বাচ্চা হয়ে যায় যেন! বলে,
‘কিরে, আব্বু নেই বলে আজ ডাকলি না আমায়!’

বাণীর ঝিমুনি অব্যাহত থাকে। ফিরে তাকায় না করবীর দিকে। এতে করবীর ভুলভাল অভিমানটি গাঢ় হয়। ধমকে ওঠে সে,
‘কথা বলছিস না কেন? নাকি আব্বু বুলি শিখিয়েছে বলে তার অভাবে বুলিও ভুলে গিয়েছিস?’

বাণী এবার অলস ভঙ্গিতে নড়েচড়ে। তবুও কথা বলে না। করবী উদাস হয়ে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকে। এরপর কী যেন ভেবে খাঁচাটা খুলে দেয়। অভিমানী কণ্ঠে বলে, ‘কথা-ই যদি না বলিস তবে উড়ে যা। বোবা সঙ্গী হয়ে থাকার কী দরকার!’

এবং করবীকে অবাক করে দিয়ে বাণী সত্যি খাঁচা ছেড়ে বেরিয়ে গেল। এবং এক, দুই, তিন সেকেন্ডের মাথায় ডানা ঝাপটে বারান্দার রেলিং গলিয়ে বের হয়ে গেল বারান্দার বাহিরে বিরাট আকাশটার নিচে। করবী কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে কেবল তাকিয়ে রইল। ফাঁকা ঢোক গিলে বলল,
‘শেষমেশ তোরও কি-না আমাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে হলো?’

কথা জানা চঞ্চল বাণী বোবা ভাষাতেই বোধহয় সম্মতি জানাল। তারপর মিনিট খানিক তাকিয়ে থেকেই উড়ে গেল তার পরিচিত ছোট্টো বারান্দাটা ছেড়ে বিশাল অপরিচিত আকাশটাতে। ফিরেও তাকাল না একটি বার। যেন সকল পিছুটান ছিন্ন করে ফেলেছে সে বাবা মারা যাওয়ার সাথে সাথেই। করবীর চঞ্চল চোখ দু’টো বেয়ে বেয়ে নীরব অশ্রুরা ঝরে পড়ল অনবরত। বাণীর এহেন আচরণ তার ভেতরটা যেন চূর্ণবিচূর্ণ করে দিল। তবে কী পাখিরাও মায়া কাটাতে শিখে গেছে মানুষের সান্নিধ্যে থেকে? যেমন করে আব্বু মায়া কাটিয়েছে! কাটিয়েছে আম্মুও….

বিন্দুর আজ মনে বসছে না কাজে। প্রতিদিনের মেশিনের শব্দটি আজ বিরক্তির ঠেকছে। আপাটাকে ছেড়ে আসতে মন চায়নি তবুও বাস্তবতার টানে তাকে আসতেই হয়েছে। ঘরে ছোট্টো একটি বাচ্চা, বৃদ্ধ একজন মানুষও আছেন। রোজগার না করলে মানুষ গুলো কী খাবে? রক্তের সম্পর্কের চিন্তা করতে গিয়ে আত্মার সম্পর্ককে যে একটু পিছনে ফেলতেই হয়! আমাদের জীবনটাই যে এমন। অদ্ভুত, নাটকীয়।

কাজে দু’বার ভুল করে ফেলেছে সে। ম্যানেজার এসে শাসিয়ে গিয়েছেন কড়া ভাবে। তবুও তৃতীয় বারের মতন ভুলটা করে বসল। সেলাই করে ফেলল উল্টো পিঠে। এবার ম্যানেজার রেগে অগ্নিশর্মা। গার্মেন্টসের একটি অদ্ভুত খারাপ নিয়ম আছে। ম্যানেজাররা কর্মীদের খুব বেশিই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করেন। এবং মেয়ে কর্মীদের তো গালি দেওয়ার সময় কোনো রাখঢাকই রাখেন না। বিন্দুর বেলাতেও তা-ই হলো। তৃতীয় বার ভুল করতেই ম্যানেজার রেগে গেলেন। বিন্দুর বসে থাকা চেয়ারের পায়া’তে মৃদু লাথি মারলেন,
‘তোদের কাজে মন থাকলে আসিস কেনরে এখানে? তিন তিনটা মাল নষ্ট করলি। মন যদি না বসে তাহলে কাজ থেকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবো।’

বিন্দু কেঁপে উঠল লাথিতে। ভীত কণ্ঠে ক্ষমা চাইল,
‘বুঝি নাই স্যার। এই বারের মতন মাফ করেন।’
‘হ, আমি তো দান শালা খুলছি। তোরা ভুল করবি আর আমরা মাফ করবো। টাকা কী বলদের *** দিয়ে আসে?’

ম্যানেজারের ভাষা খারাপ। রাগলে আরও বিশ্রী রকমের খারাপ হয়ে যায়। বিন্দু অভ্যস্ত। তাই মাথা নত করে বিনীত স্বরে বলল, ‘আর হইবো না, স্যার। সত্যি কইলাম।’

‘তিনডা মালের ক্ষতি হইলো। এই ক্ষতির টেকা কে দিবো? তোর বাপ?’

বিন্দু উত্তর দিল না আর। কথা বললেই কথা বাড়বে এরচেয়ে সে চুপ থাকলে ম্যানেজার নিজেই চুপ হয়ে যাবে। হলোও তা-ই। কিছুক্ষণ হুমকি-ধমকি দিয়ে ম্যানেজার চুপ করলেন। যেতে-যেতে চাকরি খাওয়ার হুমকিও দিয়ে গেলেন। বিন্দুর গালি-গালাজ শুনে অভ্যাস আছে তবুও খারাপ তো লাগেই। কী ভাগ্য ছিল আর কোথায়ই না এসে পড়ল! সবই ভাগ্যের খেলা। ফুঁস করে হতাশার শ্বাস ছুটে এলো অন্তর থেকে। এত ক্লান্ত লাগে এ জীবন! আঠারো বছরের এ জীবনে আঠারো যুগের দুঃখ চেপে বেঁচে থাকাটা সত্যি কষ্টসাধ্য। তবুও বাঁচতে হয়। এত সুন্দর জীবনের মায়া যে কেউ-ই কাটাতে পারে না।

#চলবে

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ২৭ এর বাকি অংশ
কলমে: মম সাহা
দ্বিপ্রহর শুরু হয়েছে উত্তপ্ত রোদ্দুর অম্বরে নিয়ে। ঘরে বসে অবশ্য সেই রোদ্দুরের প্রখরতা বোঝার উপায় নেই। তার উপর এসি অন। বাহিরে গাঢ় রোদ হলেও ঘরের ভেতরটা শীতল, ঠান্ডা। ঘুড়ি বারান্দায় বসে আছে। গিটারটা হাতে। আজ খুব গিটার বাজাতে ইচ্ছে করছে। বহুদিন পর, কণ্ঠ আজ গাইতে চাচ্ছে। গাইতে চাওয়ার অবশ্য আরও একটি ভিন্ন কারণ আছে। আজ তার মন খারাপ। মন খারাপ হলে তার বরাবরই গাইতে ইচ্ছে হতো। আজও ব্যতিক্রম নয়। বহুদিন পর গিটারে টুং করে সুর তুলল। জুড়িয়ে গেল অন্তরটা। সুর আবার তুলল। এবার ভাঙা সুর না। গলা উঁচুতে ওঠল,
‘বাহির বলে দূরে থাকুক,
ভেতর বলে আসুক না।
ভেতর বলে দূরে থাকুক,
বাহির বলে আসুক না….’

কী করুণ স্বর! কী আকুতি! মনে হচ্ছে হৃদয় থেকে আহ্বান করছে কাউকে খুব কাছে আসার। তার পাশে বসার। দুঃখ মোছার এই আকুতি।
গাইতে গাইতে পুরোটুকু গান মন্ত্রমুগ্ধের মতন শেষ হলো। একবারও ছন্দপতন হয়নি। একবারও থেমে যায়নি কণ্ঠ।

‘সুন্দর হয়েছে তো! ভালো গান জানো তো!’
স্পষ্ট পুরুষালী কণ্ঠ পেতেই ঘুড়ির চোখ খুলে গেলে। ঘাড় ফিরিয়ে তাকাল সেদিকে। তিমির দাঁড়িয়ে আছে। কালো টি-শার্ট পরনে। গোসল সেরে এসেছে বোধহয়। ফ্রেশ দেখাচ্ছে।

ঘুড়ি চমকাল। তিমির নিজে থেকে কখনো কথা বলে না। প্রশংসা তো করে না বললেই চলে। হঠাৎ আজ লোকটার প্রশংসা অমাবস্যার চাঁদ হাতে পাওয়ার মতন মনে হলো। অবিশ্বাস্যকর।

‘গান শিখেছিলে বুঝি?’
উৎসুক নয়নে তাকিয়ে আছে তিমির উত্তরের আশায়। ঘুড়ি গিটার পাশে রেখে চেয়ার ছেড়ে দাঁড়াল। উপর-নীচ মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাল, ‘হ্যাঁ।’

‘দারুণ কণ্ঠ তোমার।’

ঘুড়ির কাছে পুরো ব্যাপারটাই ভ্রম মনে হলো। তিমিরই বহু আগে একদিন তার গান শুনে বলেছিল বিরক্ত লাগছে। অথচ এই মানুষটাই আজ তার গানের প্রশংসা করছে! কী বিষ্ময়কর কান্ড! ঘুড়ির মন ভালো হয়ে গেল আচমকা। এত সুন্দর প্রশংসার পর বোধহয় কারোই মন খারাপ থাকতে পারে না।

তন্মধ্যেই ঘর থেকে তিমিরের ডাক ভেসে আসতেই সে হাসিমুখে বিদায় নিয়ে ঘরের ভেতর চলে গেল। ঘুড়ি দাঁড়িয়ে রইল মন ভালো করা এই সময়টুকু নিয়ে। হুট করে চারপাশটা এত সুন্দর লাগছে!

তাসনীম বেগম বসে আছে সোফায়। চোখ-মুখ বেজায় কঠিন। গুরু-গম্ভীর। তার সামনের সোফাতে বসে আছে বিদিশার বাবা-মা। তারাও চিন্তিত। তিমির ড্রয়িং রুমে এসে বিদিশার বাবা-মা’কে দেখে কিছুটা চমকালো বটে তবে প্রকাশ করল না। বিদিশা ড্রয়িং রুমের এক কোণায় দাঁড়ানো। শক্ত-পোক্ত মুখের আদল। আরেক পাশে ছোটো টুলটাতে বসা তুষার। তিমির বিনয়ী ভঙ্গিতে সালাম করল বিদিশার বাবা-মা’কে। এরপর ভিন্ন একটি সোফাতে গিয়েই বসল। তিমির বসতেই বিদিশার বাবা জামাল ভূঁইয়া প্রথম কথা বললেন,
‘আমাদের মেয়ে জামাই এলো অথচ আমাদের এতদিনে খবর দেওয়া হলো, আপা?’

প্রশ্নটি তিনি তাসনীম বেগমের উদ্দেশ্যেই করলেন। তাসনীম বেগম একবার চোখ ঘুরিয়ে বড়ো ছেলের দিকে তাকালেন। তিনি ঝামেলা করতে চাননি। সবটা ধীরেসুস্থে মিটমাট করতেই চেয়ে ছিলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে বিদিশার ব্যবহার এত অসভ্য হচ্ছে যে তিনি আর বিদিশার বাবা-মা’কে না ডেকে পারলেন না।

মা’কে চুপ থাকতে দেখে তুষার বলল, ‘কাউকেই তো তেমন জানানো হয়নি।’

‘আমরা তো জানার অধিকার রাখি না-কি?’

ভদ্রলোকের প্রশ্নে এবার তিমির অপরাধী স্বরে বলল, ‘আসলেই ভুল হয়েছে আমাদের। ভাইয়া হুট করেই আসছে। সেজন্যই বোধহয় আজ আপনাদের দাওয়াত দেওয়া হয়েছে।’

তিমিরের কথাটা তুমুল তাচ্ছিল্যে উড়িয়ে দিল বিদিশা, ‘দাওয়াত! হাহ্! আমার বাবা-মায়ের তেমন ভাগ্য আছে না-কি?’

বিদিশার রূঢ়ভাষী উত্তরে তিমির ভ্রু কুঁচকালো। অবাক হলো তার বাবা-মাও। তিমির হুট করেই বুঝতে পারল ঘরে কোনো গন্ডগোল হয়েছে যা সম্পর্কে সে অবগত নয়। নাহয় ভাবির কথা বলার ধরণ এমন হতো না। এত বছরে তো হয়নি!

জামাল ভূঁইয়া মেয়ের দিকে তাকালে, কিছুটা চাপা ধমক দিয়ে বললেন, ‘কীভাবে কথা বলছো তুমি!’

তাসনীম বেগম যেন এই মোক্ষম সুযোগটিরই অপেক্ষা করছিলেন। মুহূর্তেই তিনি জবাব দিলেন,
‘আপনাদের মেয়ে এখন এভাবেই কথা বলে। এবং সেজন্যই আপনাদের এখানে আনানো হয়েছে।’

কথাটি যেন বিস্ফোরণ ঘটালো ড্রয়িং রুমের মাঝে। তুষারও অবশ্য অবগত ছিল না মায়ের এমন কান্ড সম্পর্কে। তবে ভাবলেশহীন দাঁড়িয়ে রইল বিদিশা। বিদিশার মা লিপি ভূঁইয়া চট করে সোফা ছেড়ে ওঠে দাঁড়ালেন। তিনি বোধহয় সবটুকুই আঁচ করতে পেরেছেন এতক্ষণে। নারী মন, বড়োই তীক্ষ্ণ। এরা পরিস্থিতি দেখলেই ঘটনা বুঝার সক্ষমতা রাখে। তিনি মেয়ের কাছে গেলেন ভারী রুষ্ট চোখে তাকালেন। বললেন,
‘কী করেছিস, বিদু?’

‘আমি তো তোমাদের ডাকিনি। যে বা যিনি বা যারা ডেকেছে তাদের জিজ্ঞেস করো।’

বেপরোয়া এই মেয়েটিকে বাবা-মায়ের কাছে বড়ো অপরিচিত ঠেকল। মায়ের মন তো ভীত হলো অনেক। মেয়ের সংসার ভাঙার আভাসে কেঁপে উঠল অন্তর। তাই তিনি ধমকালেন,
‘সাবধানে কথা বল। কোথায় কী বলতে হয় জানিস না?’

বিদিশার ভেতর ধমকের কোনো প্রভাব দেখা গেল না। পরিস্থিতি বিপরীতে চলে যাচ্ছিল বিধায় তিমির ওঠে দাঁড়াল। ভদ্রমহিলাকে টেনে এনে বসাল সোফায়, স্থির স্বরে বলল,
‘ঠান্ডা হন, আন্টি। ভাবি হয়তো ডিস্টার্বড্।’

ভদ্রমহিলার মন ঠান্ডা হলো না বরং চঞ্চল হয়ে গেল ভীষণ। জামাল ভূঁইয়া নিজের স্ত্রীকে চোখ দিয়ে ইশারা করলেন ঠান্ডা হওয়ার জন্য অতঃপর নিজেই তাসনীম বেগমকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কী হয়েছে যদি খুলে বলতেন।’

‘কী হয়েছে চোখের সামনেই তো দেখতে পারছেন। আপনাদের মেয়ে আমাদের সাথে এমন অসভ্য আচরণই করে যাচ্ছে। এমন হলে তো…’

বাকি কথা শেষ করলেন না তিনি। অবশ্য শেষ করার প্রয়োজনও নেই কারণ সকলেই কথার ইঙ্গিত বুঝতে পেরে গিয়েছে অনায়াসে।
তিমিরের কাছে সবটাই অস্বচ্ছ এবং নতুন। সে মায়ের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকাল,
‘কী বলছেন এসব?’

‘যা বলছি সবটাই সঠিক। তুমি তো বাড়ি থাকোনি বেশি সময় তাই জানো না ইদানীং ও কী কী করেছে। কোনো বেয়াদবি বাদ রাখেনি।’

‘মুখ সামলে কথা বলুন। ভাবি সম্পর্কে বাজে কিছু বললেন না।’ রীতিমতো রেগে গিয়েছে তিমির। ঘটনা বিগড়ে যাচ্ছে কথার পৃষ্ঠে কথা উঠে। বিদিশা উদাস নয়নে তাকাল। তিমিরকে উদ্দেশ্য করে বলল,
‘ভুল কিছু বলেননি তোমার মা।’

‘হ্যাঁ তুমিই বলো তুমি কী করেছ। আমার ছেলেরা তো আর আমার কোনো কথাই বিশ্বাস করে না।’ তাসনীম বেগমের কণ্ঠে অভিযোগের ছাপ। তিমির রাগে ফুঁসছে,
‘তার জন্য আপনিই দায়ী। কখনো নিজের ভুলটা মানতে শিখলেন না। সবসময় এর ওর ঘাড়েই দিয়ে গেলেন।’

কথার সূচনা এক হলেও তা গুরুতর ঝামেলার দিকে মোড় নিচ্ছিল। তাই বিদিশাই কথা থামানোর জন্য বলল,
‘ভাইয়া, তুমি কিচ্ছু বলো না। আমিও চেয়ে ছিলাম বাবা-মা আসুক। অনেক তো হলো এখানে সংসার করা, আর সাধ নেই। আমি ফিরে যেতে চাই।’

দ্বিতীয় বোমাটা যেন ফাটল এবার। তাসনীম বেগমকে অব্দি সেই ভয়ংকর বাতাস ছুঁয়ে গেল। তিনি ভেবে ছিলেন মেয়েটার বাবা-মাকে আনলে তারা বুঝিয়ে শুনিয়ে গেলে মেয়েটা আবার হয়তো আগের মতন হয়ে যাবে। অথচ তেমন কোনো আশঙ্কাই নেই। এই বিদিশা আর আগের মতন হওয়ার নয়।

বিদিশার মা রেগে গেলেন, ‘ফাজলামো হচ্ছে এখানে? কী বলছিস, বিদু? সংসার কোনো ছেলেখেলা নয়।’

‘আচ্ছা! তাই নাকি? অথচ আমার তো মনে হলো সংসারের নাম দিয়ে এত বছর আমাকে দিয়ে ছেলেখেলাই করানো হলো। তখন তোমার কথা কই ছিলো, মা?’

জামাল ভূঁইয়া বুদ্ধিমান মানুষ। মেয়ের কথা বুঝতে তার সময় লাগল না। তিনি এবার নরম স্বরে মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘তুমি কী চাচ্ছ, মা?’

বিদিশার কঠিন চোখ-মুখ বাবার কথায় নরম হয়ে এলো। যাক অবশেষে কেউ অন্তত জানতে চাইল তার কী চাই! নয়তো এ সংসারে যেমন মূল্যহীন হয়েছিল, কেউ তো মানুষই মনে করতো না। ভাবত খেলার পুতুল।

বিদিশা বাবার কাছে গেল। পাশে গিয়ে বসল। বাবার বুকে মাথা দিয়ে ক্লান্ত স্বরে বলল,
‘আমি একটা শক্ত বুক চাই, বাবা। যেখানে আমি থেকে যেত পারব অনায়াসে। আর এ পৃথিবীতে সেই বুক তোমার ছাড়া আর কারো নেই। এই সংসারে এতগুলো বছর যাবত আমি ছিলাম। এ ঘরের প্রতিটা আনাচে-কানাচে আমি স্বপ্ন পুষে ছিলাম। বিয়ের পরের দিন যে মেয়েটার স্বামী সংসার ছেড়ে চলে যায় সে মেয়েটার এত গুলো দিন এ সংসারে থাকার কথা নয়। তবুও আমি থেকে গিয়ে ছিলাম কোন লোভে কে জানে! বহু সাধ্যসাধনা করেছি এ সংসারকে আপন করতে কিন্তু আমি ব্যর্থ, বাবা। আর যে পারছি না। এই সংসার আমার আপন নয়, বাবা। আমার দম বন্ধ লাগে। আমায় তুমি নিয়ে যাও। আমি আর পারছি না।’

তুষার এতক্ষণ নীরব দর্শক ছিল। এখনও তাই। তবে মনের কোথাও একটা অপরাধবোধ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। কিন্তু তার মস্তিষ্ক সেই অপরাধবোধ মানতে প্রস্তুত নয়।
বিদিশার মা হয়তো কিছু বলতেন কিন্তু তার আগে জামাল ভূঁইয়া তাকে থামিয়ে দিলেন। গমগমে গলায় বললেন,
‘নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে আনো, মা। তোমার আজ ছুটি। আমারই ভুল ছিল। যে ছেলে এমন একটা বিবেকহীন কাজ করতে পারে সে ছেলের ভরসায় তোমাকে রেখে যাওয়া উচিত হয়নি।’

কথাটা ভীষণ মানে লাগল তুষারের। সে সশব্দে টুল ঠেলে ওঠে গিয়ে নিজের রুমের দরজা লাগিয়ে দিলো। তা দেখে জামাল ভূঁইয়া তাসনীম বেগমকে খোঁচা মেরে বললেন, ‘আমার মেয়েকে অসভ্য বলার আগে নিজের ঘর ঠিক করা উচিত ছিল আপনার, আপা। বড়োই দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, আপনাদের রক্তে স্বার্থপরতা বেশি। আমার মেয়েকে আমার চেয়ে ভালো যে কেউ চেনে না!’

#চলবে

বুকপকেটের বিরহিণী পর্ব-২৪+২৫

0

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ২৪

কলমে: মম সাহা

আজ দিনটি ভালো নয়। অন্তরিক্ষে নীরদ মুখ ভার করে বসে আছে ছোট্টো কিশোরের ন্যায়। মনে হচ্ছে মায়ের বকুনি খেয়েছে সে। এক্ষুণি কেঁদে দিবে। মানুষ তখন সেই কান্নার নাম দিবে বৃষ্টি। বিদিশা খাটের এক কোণায় বসে মন ভার থাকা আকাশকে দেখছে। মৃদুমন্দ পবনে ইচ্ছেমতন উড়ছে বাতায়নের কোল ঘেঁষে থাকা জানালার পর্দা গুলো। বিদিশার চোখে নিগড় শূন্যতা। ড্রয়িং রুম থেকে চামচ নাড়ার টুংটাং শব্দ হচ্ছে। হয়তো দুপুরের খাবার তৈরী হয়ে গিয়েছে।
ভাবতে ভাবতেই তাকে ডাকতে এলো কাজের মহিলাটা, ‘বউমা, খাইতে আসেন।’
বিদিশা ধ্যান দিল না সে ডাকে। তার ধ্যান যেন কোনো এক অরণ্যে কিংবা নিবিড় সমুদ্রে। এই জনজীবন থেকে বহুদূরে। ধরাছোঁয়ার বাহিরে।
মহিলাটি আবার ডাকল, ‘খাইতে আহেন, আম্মা। সকালেও খান নাই।’
এবার বিদিশার শ্রবণেদ্রিয়ের পাশাপাশি মস্তিষ্কও সজাগ হলো তবে নড়চড় দেখা গেল না দেহের ভেতর। আগের মতনই দুই হাঁটুর উপর হাত রেখে মাথা ঝুঁকিয়ে তাকিয়ে আছে আকাশে। কেবল প্রাণহীন কণ্ঠে বলল, ‘খাবো না।’
মহিলাটি আর ডাকল না। তার বড়ো মায়া হলো এই মেয়েটির জন্য। বহু বছর যাবত এ বাড়িতে কাজ করার সুবাদে এই পরিবারটির সকল পরিস্থিতি সম্পর্কে সে অবগত। সে দেখেছিল, সদ্য বিবাহিত চঞ্চল মেয়েটি সংসারের দায়িত্ব কেমন কোমল হাতে গুছিয়ে নিয়ে ছিল। স্বামীর প্রত্যাহারের ব্যথা ভুলে সংসারটিকে আগলে নিয়েছিল চড়ুইয়ের বাসার মতন। অপেক্ষা কতটুকু সময়ের জন্য তার নির্দিষ্টতা না জেনেই দিনের পর দিন কেবল অপেক্ষা করে গেছে। অথচ সেই মেয়েটির ভাগ্যেই কি-না শেষবেলা কিছুই মিলল না? অপেক্ষার ফল সবসময় মিষ্টি হয় না তার উজ্জ্বল প্রমাণ যেন সে!
রাবেয়া খাতুনের বুক থেকে পরপর বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। তিনি গিয়ে আক্ষেপের সাথে তাসনীম বেগমকে জানান বিদিশার না সূচক উত্তরটির কথা। বিদিশার না-তে বাড়ির সামান্য গৃহ ভৃত্যের মায়া লাগলেও মায়া হলো না তাসনীম বেগমের। বরং সে ফুঁসে ওঠলেন। গলার স্বর ইচ্ছেকৃত উঁচুতে তুলেই বললেন,
‘খাবে না কেন? এখন কী এ বাড়ির খাবারও রুচিতে নিচ্ছে না? এতদিন তো ঠিক নিয়েছিল।’

বিদিশা ঘর থেকে ঠিক শুনতে পেল তবে উত্তর দেওয়ার প্রয়োজনটুকু বোধ করল না। এতে তাসনীম বেগম অসন্তোষ হলেন। এবার হনহন করে তিনিই গেলেন বিদিশার রুমে। বরাবরের মতন রুমে প্রবেশ করার অনুমতিটুকুও আজ আর নিলেন না। রুমে ঢুকেই প্রশ্ন ছুঁড়লেন,
‘বৈরাগী ভাব ধরেছ নাকি? তোমার কাহিনি তো কিছুই বুজছি না।’
প্রশ্ন এলো একের পর এক। উত্তর দেওয়ার মানুষটি রইল নির্লিপ্ত। তাসনীম বেগম এগিয়ে গেলেন আরও দু’কদম। বিদিশার ভাব-গতিক কিছুই তার স্বাভাবিক লাগছে না। মেয়েটা এতটা উদ্ভ্রান্ত হলো কেন? এবার একটু নরম হলেন তিনি,
‘তোমার ঠিক সমস্যাটা কী বলবে আমাকে?’
বিদিশা এবার জবাব দিল না ফিরেই, ‘আমার সমস্যা নেই।’
‘তাহলে এমন করছ কেন?’
‘কেমন করছি?’ প্রশ্ন করেই তাকাল সে শাশুড়ির দিকে। চোখে চোখ রেখে জবাব চাইল। দৃঢ় সেই দৃষ্টির ভাষা।
তাসনীম বেগম চোখ ঘুরিয়ে ফেললেন। বললেন, ‘আমার ছেলে আসাতে তুমি খুশি হওনি মনে হচ্ছে। তুমি কী চাওনি ও আসুক?’
‘আপনার ছেলের সাথে আমার খুশি কিংবা কষ্টের কোনো যোগসূত্র আদৌ নেই।’
‘নেই!’ তাসনীম বেগম কিংকর্তব্যবিমুঢ়। যে মেয়ে স্বামীর সান্নিধ্য না পেয়েও দিনের পর দিন অপেক্ষা করে গিয়েছে স্বামীর ফিরে আসার সে মেয়ে কিনা বলছে যোগসূত্র নেই?

‘না, নেই।’
তাসনীম বেগমের আর ধৈর্য হলো না বিদিশার খামখেয়ালি মেজাজ মেনে নেওয়ার। তাই তার কণ্ঠ এবার কাঠ কাঠ হলো,
‘না থাকলে চলে যাচ্ছ না কেন?’
বিদিশার দৃষ্টি এবার কাঁপল। খুব ক্ষীণ। হৃদপিণ্ড কেঁপেছে কিন্তু সেটা ক্ষীণ নয় অস্বাভাবিক ভাবে দ্রুত। চলে যাওয়ার হলে সে তো বহু আগেই যেত। সে তো যায়নি। বিনা যত্নে, বিনা প্রেমেও তো সে থেকে গেছে কতগুলো দিন। অথচ আজ কী সুন্দর সাবলীল ভাবে তাকে চলে যাওয়ার নিমন্ত্রণ ছুঁড়ল মানুষটা!
‘যাব। তবে এভাবে নয়।’
‘কীভাবে? কীভাবে যাবে? তোমার এই অশান্তি আর ভালো লাগছে না। আমার ছেলেটা এত বছর পর বিদেশ থেকে এলো, আমি শান্তি চাচ্ছি। তুমি পরের বাড়ির মেয়ে, পরের বাড়িতেই যাও।’
‘তাই যাব, মা। যতই হোক, পর কখনো আপন হয় না।’ তার শেষ বাক্যে কঠোর শ্লেষের আভাস। তাসনীম বেগম কথা বাড়ানোর সুযোগ পেলেন না আর। তার আগেই বিদিশা আগের মতন আকাশ দেখা আরম্ভ করে দিল। পরোক্ষভাবে যেন তাসনীম বেগমকে ঘর ছাড়ার আহ্বান করল। তাসনীম বেগমও তা বুঝলেন। চালাক মানুষ কি-না! সবই বুঝেন। কেবল এতটুকুই বুঝলেন না, যতটুকু বুঝলে পরের বাড়ির মেয়েরও যে মন থাকে সেটা জানতে পারতেন।

(৩৫)

হসপিটালের এক কোণায় চুপচাপ বসে আছে করবী। আশেপাশে কেউ নেই তার। মাথা ঝিমঝিম করছে। গতকাল থেকে এ অব্দি তিমির তার পাশে থাকলেও এখন জরুরী কাজে বেরিয়েছে। যেতেই হবে বলেই গিয়েছে। নয়তো সে যেত না এতটুকু করবী জানে। তার ভীষণ একা লাগছে। এই বিপদের দিনে বিন্দু, হীরণকে কাছে পেলে ভালো লাগতো। কিন্তু কিছু করার নেই। তার ফোনটা গতকাল হাত থেকে পরে যে টুকরো-টুকরো হয়েছিল সেটা আর ঠিক করা হয়নি। সেটা ঘরের মেঝেতেই তেমন ভাবে পড়ে আছে হয়তো! বিন্দুর নাম্বারটা জানা আছে। একবার কল দিয়েছিল তিমিরের ফোন থেকে সকালে কিন্তু যায়নি কলটা। তাই আর দেয়ওনি। মেয়েটা তো সবে সকল দুঃখ কাটিয়ে ওঠেছে, থাক, আর দুঃখে নাহয় সামিল না করল!
করবীর ভাবনার জাল ছিঁড়ল ডাক্তারের কথায়, ‘পেশেন্ট তো আপনার বাবা হন, তাই না?’

করবী প্রথম দফায় চমকে গেলেও নিজেকে সামলে নেয় দ্রুত। মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয়, ‘হ্যাঁ। এখন কেমন আছে, আব্বু?’
মধ্যবয়সী পুরুষ ডাক্তারটি করবীর প্রশ্নে ভ্রু কুঞ্চিত করলেন কিঞ্চিৎ। বললেন,
‘আপনার বাবার কন্ডিশন তো গতকাল রাতেই বলে দিলাম। জানেন না আপনি?’
করবী এবার অবাক হলো। কখন বলল কন্ডিশন! তবে কী সে যখন ঘুমিয়ে ছিল তখন বলেছে? কই, তিমির তো কিছু বলল না! করবীর কণ্ঠে স্বর আসে না। ভয়ঙ্কর কিছুর আভাস পেয়েই কলিজা থমকায়। তবুও সে শুধায়,
‘আমাকে তো বলেনি উনি, হয়তো মনে নেই। আপনি একটু বলুন। আব্বুর শরীর কী বেশি খারাপ?’

‘আপনার আব্বুর হাতে সময় নেই আর। তার এই শ্বাসকষ্টটি আসলে রোগ নয়, এটি তার শেষ মুহূর্তের অবস্থান।’
করবীর পা কেঁপে ওঠে। ধাক্কা খায় যেন প্রচণ্ড বেগে। মাথা চেপে ধরে দু’হাতে। কী ভীষণ যন্ত্রণায় যেন মাথাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে। এত ভারি লাগছে!
ডাক্তারটির চোখে এবার উদ্বিগ্ন দেখা দিল, ‘আপনি ঠিক আছেন তো? এনি প্রব্লেম?’
করবীর শরীর ঠিক নেই। প্রচণ্ড রকমের ঘাম দেয় শরীরে। তবুও সে ঠিক থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করে। সে বেঠিক হলে জীবন চলবে কীভাবে? তার জীবন চালানোর মতন কেউ যে অবশিষ্ট নেই পৃথিবীর বুকে। আব্বু গেলেই নেইটা একবার পরিপূর্ণ হবে।

কিছুটা সময় নিয়ে স্থির করে নিজেকে। দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞেস করে,
‘আব্বুর সময় শেষ তাই না?’
‘হ্যাঁ। কিন্তু একটা অবাককর ঘটনা হলো কোনো মৃত্যুশয্যার রোগী এরকম শ্বাস ওঠার পর বেশিক্ষণ আর থাকেন না। অথচ আপনার আব্বুর রুহ এখনো আছে। আমার মনে হচ্ছে তার কোনো আকাঙ্খা এখনো সজাগ মস্তিষ্কে। তাই সেই আশাটুকু পূরণের জন্য এখনো শ্বাস ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন তিনি। রোগীর মস্তিষ্কে হয়তো বহুদিন যাবত এই ইচ্ছেটা পুষে রাখা। তাই তিনি এতটা যন্ত্রণা সহ্য করেও শ্বাস নিচ্ছেন।’

করবীর কাছে এই প্রতিটা কথাই নতুন। সে ভাবতে আরম্ভ করল আব্বুর কোন ইচ্ছেটা বহুবছর যাবত পুষে রাখা? তেমন কোনো ইচ্ছের কথাতো সে জানে না। আব্বু কখনো বলেওনি। এমন কী ইচ্ছে হতে পারে যার জন্য মানুষটা বেঁচে থাকার এমন আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে!
ডাক্তার চলে যেতেই করবী ধীর পায়ে কেবিনে যায়। শান্ত, নিবিড় আবছা অন্ধকার কক্ষটি দেখেই করবীর লোমকূপ দাঁড়িয়ে যায়। মনে হয় মৃত্যু দূত এসে দাঁড়িয়ে আছে এই রুমটিতে। যেই কোনো মুহূর্তেই আব্বুর প্রাণপাখিটি ছিনিয়ে নিয়ে চলে যাবে সেই দূতটি। করবীর একমাত্র সম্বলটুকু নিয়ে এই দূত চলে যাবে বহুদূর। পৃথিবীর বুকে এরপর বেঁচে থাকার গল্পে সে হবে নিঃস্ব সৈনিক। কেউ প্রতিনিয়ত আর উৎসাহ দেওয়ার জন্য থাকবে না। বাড়ি ফিরতে দেরি হলে কেউ আর রান্না করে খাবার সাজিয়ে বসে থাকবে না। কেউ আর মেয়ের টাকা বাঁচাতে অমুক তমুক চাচার গল্প বানিয়ে বলবে না!
বুকের বা’পাশে থাকা অদৃশ্য হৃদপিণ্ডটি ডুকরে ওঠল। করবী খুব করে দোয়া চাইল, আব্বুর সাথে সাথে যেন থেমে যায় তার এই হৃদপিণ্ডটি। কী আর হবে বেঁচে থেকে। তার বেঁচে থাকাটুকু জুড়ে যে মানুষটি ছিল, সে মানুষটি না থাকলে বেঁচে থেকে আর কী লাভ? করবী জানে অনেক চাওয়ার মতন তার এই চাওয়াটাও অপূর্ণ থেকে যাবে।

বেডের সাথে থাকা চেয়ারটায় বসল সে। চোখে টলমলে অশ্রু। বাবার হাতটা আলগোছে তুলে নিল নিজের হাতের মুঠোয়। কণ্ঠ চেপে ধরে আছে যেন কোন অশরীরী। কথা আসছে না। তবুও জোর করে কথা বলল। শেষ কথা গুলো বলা হোক। নাহয় তো জীবন খাতায় আরও আফসোস বাড়বে।
‘আব্বু, শুনছ…’
ডাকল বাবাকে সে। কণ্ঠ কাঁপছে। বাবা উত্তর দিল না। কিন্তু করবীর মনে হলো বাবা শুনছেন। সেই আশ্বাস থেকে সে আবার কথা বলল,
‘এই যে তুমি আমারে রেখে চলে যাচ্ছ তোমার কষ্ট হচ্ছে না, আব্বু?’
দ্বিতীয় প্রশ্নেরও উত্তর এলো না। করবী উত্তরের আশাটুকুও করে না। ঢোক গিলে কথা বলার শক্তি সঞ্চয় করে। ভাঙা কণ্ঠে বলে,
‘এই যে আব্বু, তুমি যে এত করে বললে ভালো চাকরি পেতে, ভালো চাকরি পেলে আমাদের ঘর সাজাবে, সে প্রতিশ্রুতি রাখবে না? তোমার মেয়ে চাকরি পাবে অথচ তা দেখার জন্য তুমি থাকবে না, তাই না? আচ্ছা আব্বু, তুমি যে চলে যাচ্ছ, আমার জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানানোর একমাত্র মানুষটা যে চলে যাচ্ছে, এরপর পৃথিবী আর আমার জন্মদিন মনে রাখবে বলো? আমাকেই বা মনে রাখার মতন পৃথিবীতে কেউ কেন আর থাকবে, আব্বু? এমন বৃথা জনমে তোমার মতন আব্বু পেয়ে ছিলাম কতই না সৌভাগ্য আমার। তাই না বলো? আচ্ছা আব্বু, এখন মন খারাপ হলে আমার মুখ দেখে আমার দুঃখ বুঝবে কে বলো তো? রাতের বেলা অন্ধকার বারান্দায় যখন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকব তখন কে এসে আমার খোলা বইটা বন্ধ করবে? কে এসে মশার কয়েল জ্বালিয়ে দিয়ে বসে থাকবে আমার পাশে ঘন্টার পর ঘন্টা? খারাপ স্বপ্ন দেখে যখন ঘুমের মাঝে কপাল কুঁচকে আৎকে ওঠব তখন কে মাথায় ভরসা দিয়ে আমার ঘুমন্ত মস্তিষ্ককে ভরসা দিয়ে বলবে, চিন্তা করতে না? আমার মুখ দেখে দুঃখ বুঝতে পারা তুমিটা যাওয়ার পর আমার দুঃখ বুঝবে কে, আব্বু? আমার যেই রাতে ঘুম হয় না, সে-ই রাতে তুমি বিহীন আমি কেমন করে থাকব? আব্বু, যে আঙুল ধরে আমি হাঁটতে শিখলাম, জীবনের এই পর্যায়ে এসে সেই আঙুল ছাড়া আমি আদৌ হাঁটতে পারব? আমার না বুকের ভেতর ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তার চেয়েও বেশি নিজেকে নিঃস্ব লাগছে। জানি তোমারও ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। তোমার আমার এই ছোট্টো দুনিয়ায় মৃত্যু নামক ভয়ঙ্কর শব্দটি না এলে কতই না ভালো হতো তাই না বলো? আব্বু, আমার কষ্ট হচ্ছে গো। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমায় রেখে যেও না, আব্বু। যেও না।’

কথা গুলো বলতে বলতে ভীষণ কান্নায় ভেঙে পড়ল করবী। থামানোর মতন কেউ নেই। কেউ না। এভাবেই পৃথিবীতে একা থেকে যেতে হয় সবাইকে। চিরজীবন কেউ যে কারো ভরসা হয়ে থাকে না।

#চলবে….

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ২৫
কলমে: মম সাহা

(৩৬)
করবীর চুল ভেজা। বারান্দা ছুঁয়ে আসা ল্যাম্পপোস্টের আলোয় চিকচিক করছে ভেজা চুল। পড়নে হলুদ রঙের একটি থ্রি-পিস। বাণীও আজ চুপচাপ খাঁচায় বসে আছে। হাপুস নয়নে তাকিয়ে তাকিয়ে আছে করবীর দিকে। বিদায়ের বার্তা নাকি অবুঝ প্রাণীরা বুঝতে পারে। হয়তো বাণীও বুজেছে। করবীও বুজেছে। বাবার সবটুকু ইচ্ছে এখন নিঃশেষ। আর হয়তো বাঁচবেন না। করবী জানে। তিমির আছে বাবার কাছে। করবী বাড়িতে এসেছে বহুক্ষণ। এখন যাবে। বাণীকে সাথে নিয়ে যাবে। তার আগে ভাঙা ফোনটা চার্জে দেওয়া হয়েছিল সেটা অন করে বিন্দুদের খবর দিতে হবে।
চারপাশে নিঃশব্দতা আলিঙ্গন করে আছে রাতকে। সেই নিঃস্তব্ধতা ভেদ করে বাণী কথা বলে ওঠল,
‘সই, সই, সই,
মনের কথা কই….’
করবী হুট করে বাণীর শব্দে চমকে গেল খানিকটা। বুকের মাঝে দুরুদুরু কম্পন। বাণীটা অনেকদিন পর আবার এই কথাটা বলেছে। বাণী যেদিন এই প্রথম কথাটা উচ্চারণ করে সেদিন করবীর জীবনে মীরাক্কেল ঘটে। বাবা সুস্থ হয়ে যান। আজ আবার বাণী এ কথা বলছে যে? বাণী কী মনের কথা আজ বলতে পারবে?
করবীর মনে তুমুল সংশয়। তবুও সে ঘাড় কাঁত করল। বলল, ‘বল।’
বাণী আবার বলল,
‘সই, সই, সই
মনের কথা কই,
এক জীবনে ভালোবেসে
সুখ পাইলাম কই?’

করবীর শরীরে মৃদু কম্পন দেখা দিল। বাণীর বলা কবিতাটা নিশ্চয় বাবার শেখানো কারণ বাণীকে তিনিই কথা শেখান। বাণী মনের কথা বলতে পেরেছে। তবে সেটা বাণীর মনের কথা না, সেটা বাবার মনের কথা যা বাণীর ঠোঁটে উচ্চারিত হয়েছে। করবীর চোখ টলমল করে ওঠল। এতদিনে তবে বাবার মনের কথা সে জানল! তা-ও বাবার বিদায় বেলা! নাকি বাবা সুস্থ হয়ে ওঠবেন? কারণ গতবার তো বাণী কথা বলল যেদিন সেদিন বাবা সুস্থ হয়ে ওঠেছিল। আজও কী তা-ই হবে?
করবী ছুটে গেল ঘরে৷ ওড়না জড়িয়ে নিল মাথা হতে শরীর অব্দি। কল দিল বিন্দুকে। দু’বার রিং হতেই কল ধরল মেয়েটা। উৎকণ্ঠা মেয়েটির কণ্ঠে,
‘আপা, কই আছিলা তুমি? তোমারে কত গুলান কল দিছি জানো তুমি? তোমাগো বাড়ির সামনে গিয়া হুনলাম তোমরা হাসপাতালে নাকি গেছ। কোন হাসপাতাল, কার কী হইল কিচ্ছু জানিনা। তাও হীরণ ভাই অনেক খুঁজছে। কী হইছে, আপা।’

করবীর কণ্ঠ কাঁপছে। কথা বলতে পারছে না। তবুও অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করল, ‘বিন্দু, আব্বু হসপিটালে। তোরা আয়। আমি ঠিকানা ম্যাসেজ করে দিচ্ছি।’

বিন্দুকে আর কথা বলার সুযোগ না দিয়েই কল বিচ্ছিন্ন করল সে। তারপর বাণীর খাঁচাটা নিয়েই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল। বাবার কাছে পৌঁছাতে হবে। মনের এক কোণে যে আশার দ্বীপ জ্বলেছে তা যেন সত্যি হয় সে নিয়ে কত বার দোয়াও করল।

ঘুড়ির বাবা অফিস ট্যুরে বাহিরে গিয়েছে। মা গিয়েছে কোনো এক বান্ধবীর বিবাহ বার্ষিকীতে। ঘুড়িকে সেধেছেও। সে যায়নি। অপরিচিত মানুষের সান্নিধ্যে যেতে ঠিক ওর ভালো লাগে না। বাবা-মা নেই বিধায় ঘুড়ি বিদিশাকে নিজেদের ফ্লাটে নিয়ে আসছে।
বিদিশার চোখ-মুখ শুকনো। মনমরা হাবভাব। ঘুড়ি অবশ্য জানে মনমরার কারণ কী। তাসনীম বেগম গতকাল এসে তার মায়ের সাথে দুঃখ করে গেছেন। অনেক কিছুই অপ্রাসঙ্গিক বলেছেন যা ঘুড়ির পছন্দ হয়নি। কারণ সে বিদিশা ভাবিকে চেনে। ভাবি কেমন তার এতটুকু ধারণা এ কয়েক বছরে হয়েছে। তাই তাসনীম বগমের কিছু কথা একদম যুক্তিহীন লেগেছিল।

‘ভাবি, চলো আইসক্রিম খেতে যাবে?’
ঘুড়ির প্রশ্নে উদাস বিদিশার ধ্যান নড়ল। চোখের পলক পড়ল। সে ফিরে তাকাল। বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল,
‘এখন?’
‘হ্যাঁ। চলো।’
বিদিশা ফুস করে শ্বাস ফেলল। মেয়েটার উচ্ছ্বাসিত মুখমণ্ডলে তাকিয়ে না করতে ইচ্ছে হলো না। তাই ফ্যাকাসে কণ্ঠে বলল, ‘আচ্ছা, চলো।’
বিদিশা যে রাজি হয়ে যাবে এক কথায় ঘুড়ি সেটা জানতো। মানুষটা যাকে ভালোবাসে তাকে সবটুকু দিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। এত গভীর, আর নিবিড় ভালোবাসা! অথচ কেউ বুঝলে তো!
আসকারা পেতেই ঘুড়ি দ্বিতীয় আবদারটি ছুঁড়ল, ‘চলো এক রঙের শাড়ি পরি।’
বিদিশা আড়চোখে তাকাল। বলল, ‘আমি তো পরেছিই।’
‘না এটা না। আমার কাছে এক রঙের দু’টো শাড়ি আছে। অনলাইন থেকে অর্ডার করেছিলাম। তোমার জন্য আর আমার জন্য। দিইনি তোমাকে। তোমাদের ঘরের অবস্থা একটু গম্ভীর তো, তাই। চলো সেটা পরি।’
ঘুড়ির কথায় ভ্রু দু’টো কিছুটা উপরে তুলল বিদিশা। টানা টানা চোখ দু’টোতে প্রশ্ন,
‘আমার জন্য শাড়ি এনেছ কেন?’
‘ওমা, তোমার কত শাড়ি আমি পরি। তো আমি দু একটা তোমাকে দিবো না? এতটা কিপটে ভেবো না আমাকে।’
‘কিপটে ভাববো কেন? এখন কী তুমি রোজগার করো যে শাড়ি দিচ্ছ? যখন করবে, তখন দিও।’
‘রোজগার না করি, এটা আমার উপহারের টাকা দিয়ে কিনেছি। ভাবি প্লিজ, চলো না।’

মেয়েটার চোখে-মুখে আকুতি মিনতি। বিদিশা এই মায়া মায়া মুখটার আকুতি ফেলতে পারল না। তাই রাজি হলো। সম্মতি দিয়ে বলল,
‘আচ্ছা। চলো।’

সন্ধ্যা তখন রাতের আড়ালে ঝিমিয়ে এসেছে। ফিনফিনে বাতাস বইছে। জোছনার আলো মিশে আছে আসমান জুড়ে। সুন্দর সেই মোহনীয় রঙ। রাস্তার ধারে এক ধ্যানে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোয় জ্বলজ্বল করছে বিদিশার চোখ-মুখ। কালোপেড়ে কাঁঠালিয়া রঙের একটি শাড়ি পরেছে। ঘুড়িও তাই পরনে। ঘুড়ির বয়স কম। উঠতি বয়স মাত্র। এ বয়সে চেহারার গড়ন অতিমাত্রায় আকর্ষণীয় হবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সেই স্বাভাবিককে এক হাত টেক্কা দিয়ে দ্বিগুণ আকর্ষণীয় লাগছে তরুণী বিদিশাকে।

ওরা দু’জন এসে দাঁড়িয়েছে একটি আইসক্রিম স্টলের সামনে। সেখানে সামান্য ভিড় রয়েছে। একটি লেকের কাছে আইসক্রিমের স্টলটি। লেকের শান্ত শীতল বাতাস মনের সুখে উড়ে উড়ে আসছে এখানে। ঘুড়ির কাঁধ সমান চুল গুলো অবাধ্য বাতাসে উড়ছে। বিদিশার চুলে বরাবরের মতন খোপা বাঁধা। দু চারটি চুল কেবল কপাল জুড়ে পড়ে আছে। ঘুড়ি ভিড় ঠেলে গিয়ে আইসক্রিম নিয়ে এলো। সবেই আইসক্রিমে ঠোঁট ডুবিয়েছে দু’জন, তন্মধ্যেই একটি রাশভারী কণ্ঠ পাওয়া গেল,
‘ঘুড়ি, তুমি এখানে যে?’

উষ্ম ঠোঁট দখল করে আছে ঠান্ডা আইসক্রিমটি। সেই অবস্থাতেই চোখ তুলে তাকাল বিদিশা। তাকাতেই থেমে গেল তার মুগ্ধ চোখজোড়া। কালো শার্টের সুদর্শন পুরুষটিকে দেখে হৃদপিণ্ড আবার প্রথমবারের মতন ছলাৎ করে ওঠল।
ঘুড়িও কিঞ্চিৎ অবাক হয়েছিল কিন্তু পরিচিত মানুষটিকে দেখেই গাল ভোরে হাসল। খানিকটা বিস্ময় নিয়ে বলল,
‘আরে, তুষার ভাইয়া! তুমি এখানে!’

ঘুড়ির হাসির বিপরীতে হাসল তুষারও। একঝলক বিদিশার দিকে তাকিয়ে চোখ ঘুরিয়ে নিল। তারপর ঘাড় কাঁত করে বলল,
‘এলাম আরকি। ঘরে বোরিং লাগছিল তাই ভাবলাম এখান থেকে ঘুরে যাই। তুমি কখন এলে?’
ঘুড়ি একবার আড়চোখে বিদিশার দিকে তাকাল। আপাত দৃষ্টিতে বিদিশার মুখ-চোখ দেখে কিছু বুঝার উপায় নেই। সেদিকে তাকিয়েই ও উত্তর দিল,
‘এসেছি এইতো দশ-পনেরো মিনিট হবে। আইসক্রিম খাবে? দাঁড়াও অর্ডার দিই।’
ঘুড়ির প্রস্তাব নাকচ করল তুষার, ‘ না, না, আমি খাই না আইসক্রিম।’
‘আইসক্রিম খাও না? কী বলো! এত মজার একটা জিনিস।’
‘না, তোমরাই খাও। আমার ভালো লাগে না।’
‘ভালো না লাগলেও খেতে হবে। দাঁড়াও আনছি।’ কথা শেষ করে যেই না ঘুড়ি পা বাড়াতে নিবে ঠিক তখনই তার হাত ধরে আটকে দিল বিদিশা। মুখ-চোখ গম্ভীর মেয়েটার। সেই গাম্ভীর্যের রেশ কণ্ঠে ধরেই বলল,
‘যে খাবে না তাকে জোর করছ কেন? দাঁড়াও এখানে। তুমি আর আমি এসেছি এখানে। তৃতীয় কেউ আসেনি। তাই তৃতীয় কাউকে জোর করে রাখবে না।’

বিদিশার শক্ত কণ্ঠে থেমে গেল ঘুড়ি। অস্বস্তি নিয়ে তাকাল তুষারের দিকে। তুষারের কপালে ভাঁজ পড়েছে। সে সন্দিহান কণ্ঠে বলল,
‘আপনার টাকাতে ও খাওয়াচ্ছে না। তাহলে আপনি বারণ করছেন কেন?’
বিদিশা তাকাল তুষারের দিকে। অন্যদিকে চোখ ঘুরিয়ে বলল,
‘কার টাকায় খাওয়াচ্ছে ব্যাপারটা বড়ো না। ব্যাপারটা হচ্ছে বিপরীত পক্ষের মানুষের ইচ্ছে-অনিচ্ছের উপর। কারো অনিচ্ছায় কিচ্ছু করা উচিৎ না। হোক সেটা আইসক্রিম খাওয়ানো কিংবা বিয়ে দেওয়া।’

বিদিশার কঠিন জবাবে তাজ্জব বনে গেল তুষার। গোলগোল চোখে অস্বস্তি নিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল ঘুড়িও। এমন একটা কথার প্রসঙ্গে কার কী বলা উচিত ঠিক বুঝে ওঠতে পারল না কেউ।

_

তৈয়ব হোসেন কখনো মেয়েকে রেখে ভাত খেতেন না। মেয়ে না ঘুমানো অব্দি ঘুমোতেন না। মেয়ে না ফেরা অব্দি দরজার কাছে বসে থাকতেন অপেক্ষায়। দীর্ঘ এক জীবন যেই মানুষটা ছোটো ছোটো ব্যাপারেও নিজের সন্তানের অপেক্ষা করে গেছেন, সেই মানুষটাই শেষবেলায় এসে আর অপেক্ষা করলেন না। বিদায় ক্ষণে মেয়েকে একবার ‘বিদায়’ বললেন না। নিরবে বহুদূরে প্রস্থান নিলেন। মেয়ে আসা অব্দি তিনি রইলেন না।
পুরো হসপিটাল ভয়ঙ্কর আর্তনাদে বিমূর্ত হয়ে গেল। জ্যামের কারণে করবী পৌঁছেছিল সবার শেষে। তার আগে বিন্দু, হুতুম, হীরণ সবাই পৌঁছে গেলেও সে পৌঁছাতে পারেনি। হয়তো ভাগ্য নির্মাতা চাননি বাবার প্রস্থান মেয়েটা চোখ মেলে দেখুক। করবী যখন হসপিটালে এলো তখন বিন্দু হাউমাউ করে কাঁদছিল। হুতুমও হীরণের কোলে মাথা রেখে কাঁদছে। তিমির কাগজপত্র গুছাচ্ছে লা শ নিয়ে ফিরতে হবে বলে।

যা বোঝার করবীর বুঝতে বাকি রইল না। ঠিক পরপরই গগণ বিদারক চিৎকার দিয়ে ওঠল সে। আব্বুর নিষ্প্রাণ দেহটির সামনে বসে কত বিলাপ করল! বাবার হাত চেপে ধরে কত আকুতি করল! তাকে সামলানোর চেষ্টা করল সকলে কিন্তু যে মানুষ তার বেঁচে থাকার শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে ফেলে সে মানুষকে কী স্বান্তনার ভাষায় আটকানো যায়? যায় না।
বাবা নামক সর্বস্বকে হারিয়ে মেয়েটা হয়ে ওঠল উন্মাদ। বার বার বাবার দেহটা ধাক্কাতে লাগল। বাচ্চাদের মতন বলতে লাগল,
‘আব্বু, ফাঁকি দিলে,তাই না? তোমরা সবাই আমার সাথে এমন খেলাই খেললে গো? সবাই এমন করেই ফাঁকি দিলে? আমাকে ভালোবাসার জন্য কেউ রইল না। আব্বু, তুমি জানোনা করবী একা থাকতে পারে না! তার ভয় হয় রাত হলে। এখন কীভাবে একা থাকবে সে, আব্বু? আজ একটা বার ভাবলে না করবীর কী হবে! বাহ্, আব্বু। তুমিও স্বার্থপর হলে। আব্বু ওঠো গো। ও আব্বু ওঠো।’

করবীর পাগলামোতে বিন্দুও নিজেকে সামলাতে অক্ষম হচ্ছে। তবুও ভরসা দিতে হবে বলেই করবীর হাত ধরে আটকানোর চেষ্টা করল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
‘আপা, এমন কইরো না। চাচা কষ্ট পাইবো।’

করবী বিন্দুর হাত ঝারা দিয়ে ফেলে দিল। কান্না রেখে হাসতে আরম্ভ করল। বিকট শব্দে হাসি। হাসতে হাসতে বলল, ‘কষ্ট পাবে না। আমার আব্বুর কষ্টের দিন শেষ। সে যেই বুকভরা কষ্ট নিয়ে বেঁচে ছিল আজ তার মুক্তি। আমার আব্বুর কীসের কষ্ট বল? আব্বুর তো মুক্তি। মুক্তি হয়ে গেছে আব্বুর।’

করবীর ভয়ঙ্কর অবস্থা আরও ভয়ঙ্কর হতে লাগল। হীরণ, তিমির, হুতুম কেউ বাদ রইল না বুঝাতে অথচ মেয়েটা বুঝলে তো! বিড়বিড় করে প্রলাপ বকেই যাচ্ছে। কত কী প্রলাপ!
কেবিনের কোণায় খাঁচার মাঝে নীরব দর্শক হয়ে বসে রইল বাণী। চঞ্চল পাখিটার আজ সকল চঞ্চলতা উড়ে গিয়েছে যেন! তাকে কথা শেখানো সঙ্গীটিকে হারিয়ে গভীর শোকে নিমজ্জিত হয়ে গিয়েছে। কেবল অবুঝ চোখে তাকিয়ে রইল সে। মৃত্যু নামক নির্মল সত্য তার কাছে বড়োই নিষ্ঠুর ঠেকল। নির্মম ঠেকল।

#চলবে

বুকপকেটের বিরহিণী পর্ব-২২+২৩

0

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পূর্ণ মিলন পর্ব: ২২ (অর্ধেকাংশ)
কলমে: #মম_সাহা

(৩২)
বারান্দার শিক গলিয়ে দু’টো অপরিচিত ময়না এসে বসেছে ঘরে। কী সুন্দর তাদের হাবভাব! দেখে মনে হচ্ছে দীর্ঘদিন যাবত একসাথে সংসার করা দম্পতি। বারান্দায় শুকাতে দেওয়া হয়েছিল কতগুলো ভাত। বিদিশার আবার শুকনো ভাত ভাঁজা খেতে ভীষণ ভালো লাগে। ময়না গুলো এসেই মনের সুখে কতগুলো ভাত মুখে পুরে নিল। তাদের পেট ভরতেই আবার কতগুলো মুখে পুরে দুই দম্পতি উড়াল দিল বিশাল আকাশে। বিদিশা তাকিয়ে দেখল এই দৃশ্য। পৃথিবীর সকল মুগ্ধতা যেন এই মুহূর্তে এই বারান্দায় এসে ঠিকরে পড়ছে। ময়না গুলো উড়ে যেতেই সে হাসল। হতাশ শ্বাস বেরিয়ে এলো বুক চিরে। তুষার চাইলে আজ তাদেরও নিশ্চয় একটা সংসার হতো! এমন করে ভাব করেই কেটে যেত সুখের সংসার! অথচ তা হলো কই?
বিদিশা ভাবল। ভাবতে ভাবতে ক্লান্ত হলো। এই যে সে মনের মতন সংসার করতে পারল না তার পিছনে আদৌ সে কতটুকু দায়ী? এক ফোঁটাও নয়। তার জীবনে এক দুপুরের রোদে ঝলসে যাওয়া প্রেম ছিল তুষার। যাকে এক দেখাতেই মন বলেছিল কবুল। অথচ বিসর্জনের ব্যাথা বুকে দিয়ে সে তুষার বিয়ের পরের দিনই মায়ের প্রতি এক বুক অভিমান নিয়ে ঘর ছাড়া হলো। তারপর মাস পেরুতেই দেশ ছাড়ল। অথচ বিদিশা মা ছেলের অভিমানে সংসার করার স্বপ্ন নিয়ে মূর্তির মতন হয়ে গেল। যার ব্যাথা-বেদনা কেউ একবার খতিয়ে দেখার চেষ্টা করেনি। মা নাকি ছেলে হারাল আর ছেলে হারাল মা’কে। আর বিদিশা যে নিজের পুরো জীবনের সুন্দর সময়টা হারাল…. সে হিসেব আজও কেউ করল না।

‘বউ, আসব?’
তাসনীম বেগমের কণ্ঠ পেতেই বিদিশা ভড়কে গেল। চোখের কোণে আসা অশ্রুর বিন্দু লুকিয়ে ফেলতে চাইল গোপনেই। নীল রঙের সুতির শাড়ি পরনে তার। চোখে কাজল, হাতে দু’টো সোনার চিকন চুড়ি। গোছা ভোরা চুলের রাজ খোপা ঝুলছে পিঠে। কান্না লুকিয়ে সে জবাব দিল,
‘আসেন, আম্মু।’

তাসনীম বেগম এলেন। এসেই খাটে বসলেন। ঘিয়ে রঙের শাড়ি জড়ানো তার শরীরে। তিনি শাড়ির আঁচলটা টেনে চোখ মুছলেন। হয়তো কাঁদছিলেন! বিদিশা এগিয়ে এলো শাশুড়ির শুকনো মুখ দেখে। বিচলিত কণ্ঠে শুধাল,
‘কিছু হয়েছে, আম্মু?’

ভদ্রমহিলা নিজেকে সামলে নিলেন। চোখের জল টুকু মুছে নিয়েই বললেন,
‘আমি মনে হয় বড়ো ছেলেটারে না দেখেই মারা যাব।’

বিদিশা চমকাল শাশুড়ির এহেন কথায়। বিয়ের পর এই মানুষটাকেই সে মা ডেকেছে। সবসময় মানুষটার আগেপিছে ছায়ার মতন ঘুরেছে। এই মানুষটার চলে যাওয়ার কথা শুনতেই তার বুক কাঁপল। দ্রুত গিয়ে ধরল শাশুড়ির দু’হাত। বলল, ‘অমন কথা বলছেন কেন, আম্মু?’

‘আমার যে তুষারকে দেখার জন্য প্রাণ কাঁদে, বউ।’

কথাটা বলেই ফ্যালফ্যাল করে কেঁদে দিলেন তিনি। বিদিশা শাশুড়িকে স্বান্তনা দেওয়ার আগেই কলিং বেল বেজে উঠল। অনবরত বাজায় সে শাশুড়িকে বসিয়েই ছুটে গেল দরজার সামনে। মেয়েলি রিনরিনে কণ্ঠে একবার শুধাল, ‘কে?’

অপরপাশ শুনশান নীরবতায় নিমজ্জিত। উত্তর এলো না। বিদিশা আবারও একই প্রশ্ন করল। অতঃপর জবাব না পেয়ে কপাল কুুঁচকে দরজা খুলতেই সে থমকে গেলে। বহুদিন আগের সেই ঝলসে যাওয়া প্রেমের দুপুর যে আজ তার দরজায় ফিরে আসবে এমন করে, সে ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি। টের পেলে এতটা মুখোমুখি দাঁড়ানোর ক্ষমতা হয়তো কখনো করত না।
বিদিশার বুকে দ্রিমদ্রিম শব্দ। অস্ফুটস্বর তার। ডাকল তাসনীম বেগমকে,
‘আম্মু, আম্মু…..’

পুত্রবধূর এমন কণ্ঠ পেতেই তাসনীম বেগম ছুটে এলেন। কণ্ঠে তার উৎকণ্ঠা, ‘কে আসল, বউ!’
বাকি আর কিছু উচ্চারণ করতে পারলেন না ভদ্রমহিলা। তার আগেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন,
‘তুষার, আব্বা, তুমি আসছো! আব্বা গো আমার। মায়ের উপর তোমার এত অভিমান, আব্বা? তুমি সত্যিই আসছো….’

বিদিশা কেবল এক দু পা করে পিছনে গিয়ে জায়গা করে দিল। শাশুড়ি গিয়ে জাপটে ধরলেন ছেলের বুক। হৈচৈ-এ বেরিয়ে এলো তিমিরও। নিজের সবচেয়ে প্রিয় ভাইকে দরজার সামনে দেখে থমকে দাঁড়াল সে-ও। কিন্তু ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই ছুটে গিয়ে ভাইয়ের এক পাশের বুক দখল করে নিল। মা, ছেলে তিনজনেরই যেন আজ পরম আনন্দের দিন। বিদিশা দূর থেকে সবটা দেখল। কেবল দেখেই গেল। যার জন্য তার তীব্র অপেক্ষা, এত বছরের জীবন অনশন, সেই মানুষটার বুকে তাকে রাখার মতন অবশিষ্ট জায়গাটুকু নেই। কেউ একটি বার তাকে বললও না কাছে আসতে, ধরে দেখতে এত তপস্যার মানুষটিকে। সবাই যেন ভুলেই গেল, একটি মেয়ে বহুদিন মুগ্ধ চোখে পৃথিবী দেখেনি স্বামীর বিচ্ছেদে। সে-ই মেয়েটিরও যে ভীষণ অধিকার আছে স্বামীর নৈকট্যের। কেউ একটিবার মনে করল না তার কথা। সংসারে চিরজীবন সবটুকু ত্যাগ করে সে আটপৌরে পুরোনো আসবাব হয়েই রইল তাহলে? সংসারের একজন হতে পারল না। বুকটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে তার। আর সহ্য হলো এই দৃশ্যটুকু। সে নিবিড়েই প্রস্থান নিলো। নিজেকে লুকিয়ে ফেলল তার নিজস্ব রুমটাতে। যেই রুমটা থেকেও হয়তো তাকে কিছুক্ষণ পর বের করে দেওয়া হবে। গোটা একটা জীবনে, বহুদিন অপেক্ষা করে অবশেষে সে কী পেল?
না পেল স্বামীর বুকের একাংশ এমনকি পেল না বহুদিন বাস করা রুমটাকে নিজের বলার অধিকার। হায়রে জীবন! এমন করেই হেলায় হারিয়ে যায়!

#চলবে

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ২২ [বাকি অংশ]
কলমে: #মম_সাহা

(৩৩)

তৈয়ব হোসেনের শরীরটা গত দু’দিন যাবত খারাপ ছিল। হুট করে কোথা থেকে জ্বরের উপদ্রপ হলো। ততটুকুতেই ক্ষান্ত হয়নি অসুস্থতা। সাথে তুমুল শ্বাসকষ্টও শুরু হলো। প্রথম প্রথম শ্বাসকষ্টের মাত্রা তুলনামূলক কম থাকলেও বর্তমানে তা ধারণ করেছে ভয়াবহ রূপ। বাবার সেবা করেই মেয়েটার দিন যাচ্ছে। টিউশনির পার্ট আপাতত বন্ধ রেখেছে। এই অসুস্থ মানুষটাকে সে কীভাবে ঘরে একা রেখে যাবে? কার ভরসাতেই-বা রেখে যাবে!
বাবার মাথার পাশে বসে কত হিসেব কষছে সে। মাসের শেষের দিকটাই পড়াতে না গেলে গার্ডিয়ানরা বেতন দিতে গাইগুই করেন। অথচ বাবার এ অবস্থায় টাকা-পয়সার ভীষণ দরকার। মেয়েটা পর-পর দু’বার দীর্ঘশ্বাস ফেলতেই অসুস্থ তৈয়ব হোসেনের নিষ্প্রাণ কণ্ঠস্বর পাওয়া গেল,
‘মা, কী ভাবিস?’

করবীর ধ্যানে কিঞ্চিৎ টান পড়ল। ভাবনার গহীন সুর ছিঁড়ে গেলে আলগোছে। সে গা-ঝাড়া দিয়ে বসল। বলল, ‘কই, তেমন কিছু না, আব্বু।’

তৈয়ব হোসেন অসুস্থ হাতটা রাখলেন মেয়ের মাথায়। কম্পনরত কণ্ঠে বললেন,
‘মারে, এই বিরাট দুনিয়ায় তোকে বড়ো একলা করেই হয়তো চলে যাবো। বড্ড স্বার্থপর বাবা কিনা আমি!’

বাবার প্রস্থানের কথা শ্রবণ কেন্দ্রে পৌঁছাতেই গা শিরশির করে উঠল করবীর। নিঃসঙ্গ এক জীবন ভেসে উঠল চোখের পাতায়। যেই জীবনে কতগুলো বিবর্ণ বসন্ত আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়া কিছুই নেই। সব শূন্য, ফাঁকা।
বাবা বিহীন পৃথিবী কল্পনা করা করবীর জন্য মৃত্যুর সমান। যা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারে না। করবী আঁতকে উঠল, ‘কী বলছ, আব্বু? দয়া করে এসব বলো না। আমার কে আছে বলো তুমি ছাড়া?’

তৈয়ব হোসেন গাল ভোরে হাসলেন। মেয়ের মাথায় অবিরত হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
‘মারে, যেতে যে আমাকে হবেই। আজ নয়তো কাল। তোকে এত বড়ো পৃথিবীটাই এত একা করে যেতে চাই না। কিন্তু হায়াত যে আমার হাতে নেই।’

‘অমন বলো না, আব্বু। তোমাকে ছাড়া আমি বোধহয় বাঁচতে পারব না।’

‘কে বলেছে পারবি না? অবশ্যই পারবি। কেবল বিকেল হলে তোর একলা লাগবে, সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে ফাঁকা ঘর পাবি, বড়োজোর আমি না থাকায় তোর বারান্দার গোলাপ ফুলের টবটি শুকিয়ে যাবে…. এর বেশি কিছুই হবে না, মা। আমি থাকব না বলে কিছুই থেমে থাকবে না। বরং তোর বোঝা কমবে। পঙ্গু বাবার ভার কমে যাবে কাঁধ থেকে। তখন দেখবি, তুই উপলব্ধি করতে পারবি, আমি নেই বলে কারো কোনো বিরাট ক্ষতি হয়ে যায়নি বরং লাভই হয়েছে। তোর বেঁচে থাকার যুদ্ধে দায়বদ্ধতা কম থাকবে।’

কথা বলতে বলতে তৈয়ব হোসেনের শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বদলে গেল। অস্বাভাবিক ভাবে মানুষটা শ্বাস টানা শুরু করল। যেন পৃথিবীতে কতই না অক্সিজেনের অভাব। বাবার বুকের উঠানামায় এত অস্বাভাবিকতা দেখে করবী ঘাবড়ে গেল। তৈয়ব হোসেনকে বারংবার জিজ্ঞেস করল তার অসুবিধে কোথায় হচ্ছে অথচ মানুষটার অবস্থা হুট করেই এত অবনতিতে গিয়ে ঠেকল যে সে আর প্রকাশ করতে পারছিল না কিছু। চারদিকের বিকেলের ধবধবে রঙও ততক্ষণে ঝিমিয়ে আঁধার হয়ে এসেছে। ঘর জুড়ে কেবল করবীর উৎকণ্ঠার শব্দ আর ফ্যানের শব্দ শোনা যাচ্ছে। আলোও জ্বালানো হয়নি ঘরটায়। করবীর বুক ঠিকরে কান্না আসছে। এতটা অসহায় সে কখনো হয়নি এর আগে। অসহায় হওয়ার আগেই বাবার হাতটি তার মাথায় এসে স্বান্তনা দিয়েছে অথচ আজ সেই হাতই পালিয়ে যাওয়ার ফন্দিফিকির করছে। করবী ছুটে গিয়ে তার ভাঙাচোরা মোবাইলটা বের করল। হীরণের নাম্বারটা বের করে আবার কী মনে করে যেন কল দিল না। কল দিল তিমিরকে। দু’বার রিং হতেই রিসিভ করে তিমির হাস্যোজ্বল কণ্ঠে শুধাল,
‘আরে, রক্তকরবী যে…’

লোকটা বাকি কথা সম্পন্ন করার আগেই করবী কেঁদে দিল। অসহায় স্বরে বলল, ‘আব্বু যেন কেমন করে। আমি একা। একটু আসুন।’

কথাটুকু বলেই মেয়েটা কান্না জুড়ল। তিমিরের কথাটাও শুনল না। হাত থেকে ফোনটা পড়ে সুইচড অফ হয়ে গেল। করবী কেবল তৈয়ব হোসেনের বুক-পিঠ ঢলছিল আর বাচ্চাদের মতন আবদার করছিল,
‘আব্বু, আমারে রেখে যেও না। যেও না, আব্বু। আব্বু, আমি একা থাকতে পারি না যে।’

আরও কতশত আবদার! কিন্তু সকল আবদারের সারাংশ এতটুকুই ছিল যে বাবা নামক বৃক্ষটা যেন শেষ অব্দি শিকড় আঁকড়ে পড়ে থাকেন। তৈয়ব হোসেন কথা বলতে পারছিলেন না অথচ মেয়ের এমন পাগলামো অবস্থা দেখে ঠিকই কাঁদছিলেন। চোখ গুলো দিয়ে গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু।

সন্ধ্যা ধরেছে রাজলক্ষ্মী রূপ। কী সুন্দর লাজুক সন্ধ্যা! কমলা রঙ আকাশের এক কোণে বসে নতুন বউয়ের মতন হাসছে। আর পুরো আকাশ জুড়ে সে হাসির রঙ ছড়িয়ে পড়েছে সন্ধ্যার নাম নিয়ে।
বিদিশা দাঁড়িয়ে আছে বারান্দায়। সবুজ শাড়িটা পড়নে। আজ আর চোখে কাঁজল দেয়নি। যত্ন করে হাত খোঁপাও বাঁধেনি। হাসিকেও বাক্সবন্দী করে উড়িয়ে দিয়েছে অজানায়। চারপাশে মাগরিবের আজান দিচ্ছে। সেই শান্তির ধ্বনি ব্যাতিত আর কিছুই তার কর্ণগোচর হচ্ছে না। এখানেই তার একমাত্র সুখ। নাহয় জীবনে যে পরিস্থিতি আছে, বাঁচার কথা ভাবতে পারছে না।

নীরবতা ভেঙে দরজায় টোকা পড়ল। প্রথমবার শুনতে না পেলেও দ্বিতীয়বার শুনতেই ধীর পায়ে গিয়ে দরজা খুলল। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তাসনীম বেগম। দরজা খুলতেই ভদ্র মহিলার হাসিখুশি মুখে আবছা অন্ধকার দেখা দিল। তিনি কপাল কুঁচকে বললেন,
‘দরজাটা আটকে রেখেছ কেন, বউ? আহা! ঘরটাও অন্ধকার করে রেখেছ যে! কী অদ্ভুত! ভূত-প্রেতে পেয়েছে?’

বিদিশার চোখ তখন তাসনীম বেগমকে পেরিয়ে ড্রয়িং রুমে বসে থাকা তুষারের দিকে। টাউজার আর নীল টি-শার্টে সুপুরুষই লাগছে বটে মানুষটাকে।
বিদিশাকে চুপ থাকতে দেখে অধৈর্য্য হলেন তাসনীম বেগম,
‘কথা বলছ না কেন? মনে হচ্ছে বোবায় ধরেছে!’

বিদিশার দৃষ্টি চঞ্চল হলো। এধার-ওধার ঘুরে শেষমেশ এসে নিবদ্ধ হলে মধ্য বয়স্কা এই নারীর দিকে। সে উদাস চোখে তাকিয়ে বলল,
‘কিছু বলবেন, মা?’

তাসনীম বেগম এবার ফুস করে শ্বাস ফেললেন। চোখ ঘুরিয়ে তাকালেন তুষারের দিকে। ছেলেটার মনযোগ টিভির দিকে। তা দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন তিনি। বললেন, ‘বউ, তুমি যদি ঐ সাইডের রুমটায় গিয়ে থাকতে তাহলে খুব ভালো হতো। তুষারের তো এই ঘরটা অনেক পছন্দের ছিল…’

বিদিশা এবার হু হা করে হেসে উঠল। এত অস্বাভাবিক ভাবে হাসল যে তুষার অব্দি ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল। হন্তদন্ত করে ছুটে এলো দরজার কাছে। তাসনীম বেগম কিংকর্তব্যবিমুঢ়। তাজ্জব কণ্ঠে বললেন, ‘হাসছো যে!’

বিদিশার হাসি যেন থামছেই না। পৃথিবীর সকল হাসির কারণ যেন তার দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে। বহু কষ্টে অবশেষে সেই হাসি সংযত করল। চোখে জলে টইটুম্বুর। যেন বর্ষার ভরা পুকুর। আপাত দৃষ্টিতে দেখে উনারা ভাবল যে হাসতে হাসতে জল জমেছে চোখে। অথচ গাঢ় চোখে দেখলে বুঝতে পারত, ভেতরটা কতটা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর মানুষ এমন ভাবে হাসির উছিলায় কাঁদে।

‘তেমন কিছু না, মা। এমনেই হাসলাম।’
তাসনীম বেগম সন্তুষ্ট হলেন না এমন উত্তরে। বরং বিরক্তি নিয়ে বললেন, ‘কী যে করো না আজকাল! তোমার মতিগতি বুঝা দায়।’

‘আমার মতিগতি বুঝতে পারছেন না, মা! হাসালেন। যাই হোক, আমি রুমটা আজই খালি করে দিবো। এরপর যে থাকার থাকবে।’

বিদিশার উত্তর পছন্দ হলেও খুশি হতে পারলেন না তাসনীম বেগম। তিনি চাননি ছেলের সামনে বিদিশার কোনো ব্যাপারই আসুক। তাই তো গত দু’দিন যাবত মেয়েটা সর্বক্ষণ দোর দিয়ে রাখলেও মাথা ব্যাথা দেখাননি। না খেয়েও, ‘খেয়েছি’ বলার পরও খোঁজ নিয়ে দেখেননি। তিনি পারলে যেন বিদিশাকে অদৃশ্য করে দিতেন। পাছে ভয় পান তিনি, ছেলে যদি আবার বিদিশার রেশ ধরে রাগ করে বাড়ি ছাড়ে!
অথচ মায়ের বোকা মন বুঝলই না ছেলের রাগ বিদিশার উপর ছিল না, ছিল- মায়ের উপর। কেন মা তার মতামতটুকুর গুরুত্ব দিলেন না।

এতক্ষণ যাবত তুষার নিশ্চুপ থাকলেও এখন কথা বলল। মা’কে উদ্দেশ্য করে অবাক স্বরেই বলল,
‘রুম ছাড়তে বলছ যে? উনি রুম ছাড়বে কেন?’
‘রুমের মালিক চলে এসেছে তাই আশ্রিতার বিদায় হবে। এটা না বুঝার কী আছে?’

বিদিশার উত্তরে তাচ্ছিল্য। চোখে-মুখে হতাশা। তাসনীম বেগম চোখ বড়ো বড়ো করে তাকালেন পুত্রবধূর কথায়,
‘কী বলছ এসব! অদ্ভুত সব ভাষা!’
‘আপনি অদ্ভুত আচরণ করলে ভাষাদেরও যে অদ্ভুত হতে হয়, মা।’
‘আমি অদ্ভুত আচরণ করেছি!’ তাসনীম বেগমের চোখে-মুখে বিস্ময়। এ বিদিশা অন্যরকম। উদ্ভ্রান্ত, পাগল। নিজের শেষ সম্বলটুকু হারানোর পর মানুষ যেমন আবেগহীন হয়ে যায়, এই বিদিশা ঠিক তেমন।

‘আপনার রুম ছাড়তে হবে না। আপনি কত যত্ন করে রুম সাজিয়ে তারপর এখানটায় ছিলেন তা দেখেই আন্দাজ করা যায়। আমি এসেছি বলেই আপনার যত্ন বৃথা হয়ে যাবে তেমনটা না। এখানে একসময় আমি থাকতাম এটা ঠিক। তবে সেটা অতীত। আর রুমটায় এখন আপনি থাকেন এটা বর্তমান। মনে রাখবেন অতীত মানেই ভ্রম, কল্পনা। বর্তমান মানেই সত্য। আর আজকের সত্য রুমটা আপনার এবং আপনারই থাকবে। কেমন?’
তুষার কথাটা বলেই প্রস্থান নিল। চোখে এক রাশ প্রশান্তি নিয়ে তাকিয়ে রইল বিদিশা। অথচ তাসনীম বেগম রুষ্ট হলেন। ত্রাসিত চিত্তে বললেন,
‘তোমার এমন আচরণ মোটেও শোভনীয় নয়। এখন তোমার জন্য ছেলেটা আবার আমাকে ভুল বুঝলে! ও তো ভাববে ওর মা খারাপ। তোমাকে সংসারে আনার পর থেকেই আমি ছেলের চক্ষুশূল হলাম। কোন কুক্ষণে যে এসেছিলে!’
শাশুড়ির তিরস্কারে হাসল বিদিশা,
‘জানেন মা? আমার আব্বু ছোটোবেলায় একটা কথা বলতেন, রঙ বদলানোর ধর্ম নাকি গিরগিটিদের। অথচ বড়ো হয়ে দেখলাম আব্বু ভুল জানতেন। মানুষের চেয়ে বেশি রঙ কেউ বদলাতে পারে না। এমনকি গিরগিটিও না।’

কথাটা বলেই ধীর হাতে দরজায় খিল দিল বিদিশা। তাসনীম বেগম দাঁড়িয়ে রইলেন ঠাঁই। তার অন্যায় কোথায় সে যেন দেখতেই পেলেন না।
যেতে-যেতে সবটুকুই শুনল তুষার। মায়ের প্রতি বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস। মা নামক মানুষটা অতিরিক্ত ভালো চাইতে গিয়ে এতটা কঠিন হচ্ছেন যে তার প্রতি আর কারো আবেগই বেঁচে থাকার না।

#চলবে….

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ২৩
#মম_সাহা

হুতুম খেলছে ঘর জুড়ে। বিন্দু রান্না করছে। আজ হীরণের দাওয়াত এ বাসায়। তাই ভালো-মন্দ রান্না হচ্ছে। যদিও করবী আপাকে কল করা হয়েছে কয়েকবারই কিন্তু মানুষটা ফোন তুলছে না। তাই বিন্দু ঠিক করল রান্নাবান্না শেষ করে যাবে আপাদের বাসায় খাবার নিয়ে। পিকনিকের মতন খাওয়া দাওয়া হবে।
খেলতে খেলতে হুট করে হুতুমের নীল ফ্রকটা দরজায় পুরোনো তারকাঁটায় লেগে কিছুটা ছিঁড়ে গেল। ব্যথাও পেল মেয়েটা। বিন্দু তখন মাত্র ভাতের মাড় গালতে নিয়েছিল। হুতুমের চিৎকারে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল সে। কিঞ্চিৎ মাড় পড়ে গেলে নিচে। গরম আঁচ লাগল হাতে। সেখানে ভ্রুক্ষেপ না করেই ছুটে গেল হুতুমের কাছে। দু’ হাতের আঁজলে আগলে নিল মেয়েটাকে। চিন্তিত কণ্ঠে বারংবার শুধাল,
‘কই লাগছে, হুতুম? কই লাগছে?’

হাঁটু কেটে গেছে ভালোই। র ক্তও বের হচ্ছে। ঠোঁট উল্টে কাঁদছে মেয়েটা। বিন্দু বার বার বলেছিল এভাবে ছুটোছুটি করে না খেলতে। পড়ে গিয়ে ব্যথা পাবে। মেয়েটা শুনলে তো! রাগে দুম করে একটা কিল বসিয়ে দিতেই হীরণের আগমন ঘটল। এসেই হুতুমকে মারার দৃশ্য দেখে ছেলেটা ছুটে আসল। এক টানে বাচ্চাটাকে ঘুরিয়ে নিল নিজের কাছে। বিচলিত চিত্তে ধমকে ওঠল বিন্দুকে,
‘মারছিস কেন? কী আজব!’
বিন্দুর চোখে জল টলমল। যতই মারুক তবে এই পৃথিবীতে তার চেয়ে বেশি হুতুমকে কেউ ভালোবাসে না।
হীরণ হুতুমকে থামানোর চেষ্টা করল আদুরে হাতে। চোখ রাঙাল কয়েকবার বিন্দুর দিকে। হুতুম কিছুটা ধাতস্থ হতেই হীরণ আবার ধমকাল বিন্দুকে,
‘বেশি বড়ো সাজার চেষ্টা করিস না? চাচী তোর উপর ওর দায়িত্ব দিয়ে গিয়েছে বলে সবসময় শাসন করবি তা কিন্তু হবে, বিন্দু।’
বিন্দু হীরণের শাসনে মুখ ভেংচাল, ‘শাসন করতেই হইবো। এত দুষ্টামি কেডা সহ্য করব?’
‘তুই সহ্য না করতে পারলে বলে দে, আমি নিয়ে যাই ওকে। তোর এত মাতব্বরি আমার পছন্দ না।’
‘হ, হ, তুমি নিয়া গেলে যাও। কিন্তু অর যত্ন করব কে?’

বিন্দুর প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকালো হীরণ। জবাব দিল, ‘কেন? তোর কী আমারে চোখে লাগে না? আমি নিবো যেহেতু, সেহেতু আমিই যত্ন করব।’
‘তুমি যত্ন করবা?’ প্রশ্নটা করেই খিলখিলিয়ে হেসে ওঠল বিন্দু। হীরণকে যে বিদ্রুপ করেই এই হাসিটা তা আর বুঝার বাকি নেই হীরণের। তাই সে আরও চটে গেল। চোখ রাঙিয়ে বলল,
‘বে ক্ক লের মতন হাসবি না। তোর কী মনেহয় আমি যত্ন নিতে পারব না?’
‘তোমার যত্ন নেওয়ারই কেউ নাই আর তুমি নিবা আরেকজনের যত্ন!’

হীরণ আঁড়চোখে কতক্ষণ তাকিয়ে রইল বিন্দুর দিকে। তারপর ছোটো করে বলল,
‘কে বলল কেউ নাই? এই যে তুই আছিস। যে ঝড়ের দিনে মাথার উপর ছাতা ধরে রেখেছিল আমার জ্বর আসবে বলে, সে থাকতে আমি কেন বলব কেউ নেই?’

হীরণের কথায় চমকে গেল বিন্দু। খুশিতে চকচক করে উঠল চোখদুটো। প্রায় আত্মহারা হয়ে বলল,
‘তার মানে তুমি আমারে কেউ কেউ ভাবো?’

হীরণ চোখ ঘুরিয়ে ফেলল। বিন্দু যেটা ভেবে খুশি হয়েছে হীরণ সে প্রসঙ্গে বলেনি। সে কেবল বুঝাতে চেয়েছিল বিন্দুর মতন নিখুঁত শুভাকাঙ্খী ক’জনেরই বা ভাগ্যে জুটে? অথচ মেয়েটার চঞ্চল মন বুঝে নিল অন্যকিছু! বিন্দুর খুশিতে হস্তক্ষেপ করার ইচ্ছে হলো না আর। তাই ভুলও ভাঙালো না।
অন্যদিকে বিন্দু প্রায় খুশিতে দিশেহারা। বিড়বিড় করে করবীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বলল,
‘আপা, তোমারে ম্যালা ভালোবাসি। তুমি জানো? আমি যারে ভালোবাসি, হেয়ও আমারে কেউ কেউ ভাবে। ইশ্ তুমি থাকলে এই খুশিডা ভাগ কইরা লওয়া যাইতো। তোমারে না কইতে পারলে শান্তি লাগতাছে না। বিন্দুবালা কালা বইল্যা হীরণ ভাই মুখ ফিরায় নাই, আপা। হীরণ ভাই অন্যরকম। এক্কেবারে অন্যরকম।’

(৩৪)

হসপিটালের কড়া ফিনাইলের ঘ্রাণে যেন মানুষ হারানোর একটা বিজ্ঞাপন থাকে। করবীর কেবলই মনেহয় মৃত্যুর যমদূত আশেপাশে থাকে বিধায় হসপিটালের ভেতরে ঢুকলে তার শরীরটা কেমন ভার হয়ে আসে। ফিনাইলের গন্ধে তার মাথা ঘুরে। কবে, কাকে, কীভাবে হারিয়ে ছিল তা মনে পড়ে যায়।
সারাটা বিকেল কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে এসেছে। কাঁদতে কাঁদতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে নিজেও বুঝে উঠতে পারেনি। রাত তখন শেষের দিকে। মৃদু বাতাসে তার শরীর শিরশির করছে। হুট করেই দেখল হসপিটালে খোলা বারান্দাটায় আমেনা খালা দাঁড়িয়ে আছেন। আকাশের আবছা আলোয় অস্পষ্ট আমেনা খালার মুখটি। ঘোমটা দেওয়া চল্লিশোর্ধ্ব নারীটিকে সে চেনে। অনেক কাছ থেকে চেনে। তাই আবছা ছায়ামূর্তি দেখেও সে ধরতে পারল এটা আমেনা খালা। করবী বার কয়েক ডাকল ‘খালা, খালা’ বলে অথচ মানুষটা উত্তর দিল না। কেবল রোবটের মতন বারান্দা থেকে ভেতরে এলেন করবীর সামনে দিয়ে হেঁটেই তৈয়ব হোসেনের কেবিনটাতে প্রবেশ করলেন। আমেনা খালাকে বাবার রুমে যেতে দেখে করবীও ওঠে দাঁড়াল। পিছে পিছে ছুটল কেবিনটায়। অথচ করবী ঢোকার আগেই কেবিনটার দরজা বন্ধ হয়ে গেল। করবী কতবার দরজা ধাক্কালো, কতটা শক্তি দিয়ে অথচ দরজাটা খুলছেই না। কেবিনের দরজার গ্লাস দিয়ে দেখা গেল আমেনা খালা বাবার কাছে গিয়ে বসেছেন। বাবার তখনো শ্বাস চলছে। কিন্তু যেই মুহূর্তে আমেনা খালা বাবার হাত ধরে বললেন, ‘ভাই সাব, চলেন’ ঠিক সেই মুহূর্তে বাবার শ্বাসটা থেমে গেল। বাবা আর বুক ভোরে শ্বাস নিলেন না। ইসিজি মেশিনটার লম্বা দাগ বুঝিয়ে দিল বাবার হয়েছে চিরবিদায়।
করবী পাগলের মতন কেবল দরজা ধাক্কাচ্ছে। চিৎকার করে বলছে,
‘আব্বু, আব্বু যেও না। আব্বু….’

দীর্ঘ একটা স্বপ্ন ভেঙে গেল। করবীর শরীর কাঁপছে মৃদু। ঘেমে চুপসে গেছে তার শরীর। ঘুম ভাঙতেই তিমিরের চিন্তিত মুখটা দৃশ্যমান হলো করবীর চোখে। লোকটা করবীর অগোছালো চুল গুলো কানের পিঠে গুঁজে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করছে,
‘কী হলো? কী হলো? দুঃস্বপ্ন দেখেছ? কী হলো!’

মস্তিষ্ক সজাগ হতেই করবী ঠাহর করল সে তিমিরের বাহুতে ঘুমিয়ে ছিল। এখনও সে অবস্থাতেই আছে। নিজেকে ধাতস্থ করেই সে দ্রুত মাথা উঠিয়ে ফেলল। হম্বিতম্বি করে ওড়না ঠিক করল। জোরে জোরে শ্বাস ফেলল। এত ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখেছে যে এখনো বুক কাঁপছে।
তিমির হয়তো বুঝতে পারল স্বপ্নের ব্যাপারটা। তাই করবীর মাথায় ভরসার হাত রাখল। নিবিড় স্বরে বলল,
‘শান্ত হও। আঙ্কেল ঠিক আছেন। একটু আগেই আমি গিয়ে দেখে এলাম। ঘুমাচ্ছেন।’
‘শ্বাসকষ্টটা কমেছে?’
‘তখনের মতন অতটা নেই তবে এখনো আছে। অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। চিন্তা করো না।’

তিমির ভরসা দিলেও করবী ভরসা পেল না। তার চোখে কেবল ভেসে ওঠছে বিকেলের সেই দৃশ্য। বাবা কেমন শ্বাস টেনে যাচ্ছিলেন। কোনো সাড়াশব্দ নেই, কথা বলতে পারছিলেন না! করবী হাউমাউ করে কেঁদে তিমিরকে ডাকল। এরপর বিশ মিনিটের মাথায়ই তিমির পৌঁছালো তার কিছু মিনিট পর অ্যাম্বুলেন্সও এলো। তিমিরই আনিয়েছিল। এরপর তিমিরের প্রচেষ্টায় বাবাকে হসপিটালে আনা হলো দ্রুত চিকিৎসা শুরু করা হলো। ভাগ্যিস তিমির ছিল। নাহয় সে একা হাতে কীভাবে সবটা সামলাতো! তার যে তখন বড়োই অসহায় লাগছিল!
সেই বিকেল থেকে লোকটা তার সাথে। এখন মধ্যরাত। কিচ্ছু খায়ওনি। করবীর ভাবনার মাঝেই তিমিরের কোমল স্বর পাওয়া গেল,
‘চলো, নিচে যাই। নিশ্চয় সারাদিন কিছু খাওনি? আসো।’

করবী অনীহা প্রকাশ করল, ‘খিদে নেই। আপনি গিয়ে কিছু খান। সেই কখন আসছেন এখনো বাড়িতে যাননি। নাহয় এখন চলে যান। দরকার হলে আবার ডাকব।’
‘চুপ করো। তোমার মনেহয় তোমাকে একা রেখে এখন আমি চলে যাব? অযৌক্তিক কথা বলো না। আসো নিচে যাই। অন্তত আমার জন্য আসো। আমার খিদে পেয়েছে।’

করবীর অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ওঠল। একবার বাবার কেবিনে উঁকি দিয়ে হতাশ শ্বাস ফেলল। তারপর ক্লান্ত পায়ে হাঁটা আরম্ভ করল। এতটা নিঃস্ব লাগছে আজ! মনে হচ্ছে এ দুনিয়ায় তার কেউ নেই। কেউ না। ভেতরে এই একটা অনুভূতি তাকে পুড়িয়ে দিচ্ছে। জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে অন্তর। কেবল মনে হচ্ছে আব্বু ছাড়া এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার কী মানে? কী জন্য বেঁচে থাকবে সে? তার কে আছে নিজের বলতে?

ঠিক সেই মুহূর্তে একটি হাত তার ছোটো, কোমল তালু জড়িয়ে ধরল। ভরসা দিল শক্ত মুঠো,
‘চিন্তা করো না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’
করবী ঠোঁট কামড়ে কান্না আটকায়। মনকে শীতল করতে চায়। তিমিরও ভেতর-ভেতর অপরাধ বোধে ভোগে। যতই সে বলুক সব ঠিক হয়ে যাবে কিন্তু সে তো জানে, কিচ্ছু ঠিক হওয়ার নয়। ডাক্তার জানিয়ে দিয়েছেন হাতে সময় কম। কিন্তু মেয়েটাকে এটা বলা যাবে না। এত শক্ত, কঠিন মেয়েটি এখনই ভেঙে পড়েছে। বাকিটা শুনলে হয়তো আর সামলাতে পারবে না।
রাতের শহরে ভেসে গেল দীর্ঘশ্বাস। কেউ ঘুমুতে ব্যস্ত আর কেউবা চির নিদ্রার খুব কাছাকাছি।

_

তিমির ফিরছিল না। রাত বাড়তে বাড়তে প্রায় শেষের দিকে। সজাগ বিদিশা। আগেও সে তিমিরের বাড়ি ফেরার অপেক্ষা করত। তিমির যতক্ষণ না আসতো সে সজাগ থাকতো। যতই তিমির সম্পর্কে তার দেবর হোক সবসময় সম্মান করেছে বড়ো ভাইয়ের মতন। তিমিরও শ্রদ্ধা করেছে আবার স্নেহও দিয়েছে। এই বাড়িতে এই একটা মানুষ হয়তো বিদিশাকে একটু মানুষ ভেবেছিল।

ড্রয়িং রুমে ড্রিম লাইটের নীল আলো জ্বলছে। যে আলোয় রুমটাকে মায়া পুরী মনে হচ্ছে। সোফায় হেলান দিয়ে শুয়ে আছে বিদিশা।
‘আপনার রুম কী হয়েছে? এখানে শুয়ে আছেন যে!’
গম্ভীর পুরুষালী কণ্ঠে হালকা তন্দ্রাভাব কেটে গেল বিদিশার। চোখ খুলতেই তুষারকে দেখতে পেল। তুষারকে দেখতেই তার চোখ-মুখ কঠিন হয়ে গেল, ‘এ বাড়িতে আমার রুম বলতে কিছু নেই।’

বিদিশার শক্ত-পোক্ত জবাবে কপালে তিন ভাঁজ পড়ল তুষারের। অবাক স্বরে শুধাল,
‘আপনি এভাবে কথা বলেন কেন?’
বিদিশা ভ্রু বাঁকাল, ‘কী ভাবে কথা বলি?’
‘কেমন হিংস্র স্বরে। মনে হয় যেন কাউকে সহ্যই করতে পারছেন না।’
‘পারছি না-ই তো।’
বিদিশার এহেন উত্তরে এবার কিঞ্চিৎ রাগ হলো তুষারের। সে-তো মেয়েটার সাথে যথেষ্ট ভালো ব্যবহারই করছে। তবে মেয়েটার এত দেমাগ কেন হবে?
‘সহ্য করতে না পারলে থাকছেন কেন?’
তুষারের এমন একটা প্রশ্নের আশাই করেছিল বোধহয় বিদিশা। মোক্ষম প্রশ্নটা পেতেই সে উঠে দাঁড়াল। দু’হাত আড়াআড়ি ভাবে বুকে গুঁজে বলল,
‘থেকে ছিলাম একটা জিনিস দেখতে।’
‘জিনিস?’
‘হ্যাঁ।’
‘কী জিনিস?’ তুষারের প্রশ্নের সাথে সাথে জবাব দিল না বিদিশা বরং কিছুটা সময় নিল। তারপর বেশ তাচ্ছিল্য করে বলল, ‘কাপুরুষ দেখতে কেমন হয়।’

বিদিশার উত্তর বোধগম্য হলো না তুষারের, ‘কাপুরুষ? বুঝলাম না। কাপুরুষ কে? কাকে মিন করছেন?’
‘কেন? এটা না বুঝার কী আছে? কাপুরুষ বলতে আমি আপনাকেই মিন করেছি। যে বিয়ে করার ক্ষমতা রাখে অথচ বউকে রেখে বিদেশ চলে যায় সকল দায় দায়িত্ব বিসর্জন দিয়ে।’

বিদিশার এহেন উত্তরে রেগে অগ্নিশর্মা তুষার। ধমকে বলে উঠল,
‘খবরদার। কাকে কী বলছেন ভেবে বলবেন। আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাইনি। আমার অমতে হয়েছে এই বিয়ে।’

এবার বিদিশা সশব্দে হেসে ওঠল,
‘পুরুষের অমতে কখনো পুরুষকে বিয়ে দেওয়া যায় না। এটা সম্ভব না। পুরুষের এতটুকু ক্ষমতা আছে যতটুকু ক্ষমতা থাকলে তার অমতে কিছু করা সম্ভব না। অবশ্যই মত ছিল বিয়ে করার। এরপর বিয়ে করে মান-অভিমানের ঢঙ করে দেশ ছাড়লেন। আপনাদের মা ছেলের এই রাগ-অভিমানে সবচেয়ে বড়ো ক্ষতি হলো কার? আমার। অথচ আমার কোনো দোষ ছিল না। দোষ না করেও আপনার জন্য আমি শাস্তি ভোগ করেছি। যে আমার জীবন নরক বানিয়েছে তাকে আমি নিশ্চয় পুরুষ বলব না? কাপুরুষই বলব।’

তুষার যেন আর কথা খুঁজে পেল না। আসার পর থেকে যে মেয়েটাকে নির্লিপ্ত পেয়েছে সে মেয়েটা হুট করে এতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে সেটা যেন সে বুঝে ওঠতে পারল না।
বিদিশা কথা শেষ করে রুমে যেতেই তাসনীম বেগমের গলা পাওয়া গেল। তিনি সবটা শুনেছেন। তাই কিছুটা উগ্র কণ্ঠেই বলছেন,
‘বউ, তোমারে এই বাড়িতে আনা আমার জীবনের বড়ো ভুল ছিল। অযোগ্যদের যোগ্য স্থানে আনলে যা হয়। আমি শীগ্রই তোমার বাবাকে আসতে বলব…’

ভদ্রমহিলা আরও কিছু বলছিলেন অথচ বিদিশা শোনার প্রয়োজন বোধ করল না। ঘরে ঢুকেই মুখের উপর দরজা দিল। তার শান্তি দরকার। এতদিন সংসার সংসার করে শান্তির খোঁজ করতে পারেনি। এখন করবে। এই সংসার থেকে তার পাওয়ার কিছু নেই তাই সংসারের মায়া সে টেনে ছিঁড়ে ফেলছে। এখন একটু নিজের জন্য বাঁচতে ইচ্ছে করে।

#চলবে

বুকপকেটের বিরহিণী পর্ব-২০+২১

0

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: বিশ
কলমে: মম সাহা

“আপনি আমাকে দেখে এমন চমকে গিয়ে ছিলেন যে!”
নীরবতা ছিন্ন হলো করবীর প্রশ্নে। থতমত খেল বিদিশা। কথা ঘুরানোর অভিজ্ঞ চেষ্টা, ‘পরিচিত লেগেছিল বড়ো!’
“ওহ্! কাকে ভেবে ছিলেন? আপনার কে হয়?”
করবীর প্রশ্নে বিদিশা হতাশ শ্বাস ফেলল। দৃষ্টি তার উড়তে থাকা পর্দায়। হতাশ কণ্ঠে বলল, ‘তেমন কেউ না। মুখ পরিচিত থাকে না অনেক? তেমন।’

করবী আর প্রশ্ন করল না। জানার কৌতূহল তার থিতিয়ে এলো। বিদিশা পরিস্থিতি ঘুরাল নতুন প্রশ্নে, ‘কোথায় থাকেন আপনি?’

‘নওয়াজ গলি। বাড়ি নং- তিন।’

‘কে আছে পরিবারে?’

‘কেবল বাবা।’
করবীর উত্তরে যেন বিদিশার মুখ-মন্ডলে থাকা কালো ছায়া সরে গেল অনায়াসে যা গোপন হলো না করবীর চোখ থেকে। বিদিশা এবার সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। প্রাণচঞ্চল ভাব দেখা গেল তার অঙ্গ জুড়ে। বলল, ‘প্রশ্ন করছি বলে রাগ করবেন না যেন, ভাই।’

করবীর সুন্দর, সাবলীল উত্তর, ‘রাগ করব কেন? কৌতূহল মানুষের থাকবে সেটাই স্বাভাবিক।’
করবীর উত্তরে চকচক করল বিদিশার চোখ। না, মেয়েটা যথেষ্ট ভালো।

‘পড়েন কোথায়?’

‘হিমসাগর ইউনিভার্সিটি। মাস্টার্স পরীক্ষা চলছে।’

বিদিশা এবার চমকাল। অবাক কণ্ঠে বলল, ‘মাস্টার্স দিচ্ছেন!’

করবী স্মিত হাসল, ‘জি, দিচ্ছি।’

‘আপনাকে দেখে বোঝার উপায় নেই। ভেবেছিলাম বড়োজোর অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী।’

এবার করবীর হাসি বিস্তৃতি লাভ করল। বলল, ‘অত ছোটো লাগে নাকি?’

‘লাগে তো। আমি নিজেই এবছর অনার্স ফাইনাল দিবো। আমি আপনার ছোটো তবে! ঘুড়ির ভাবি আমি। আপনি নাম ধরে ডাকতে পারেন।’

‘ভাবি ডাকলে কি রাগ করবেন?’
করবীর সহজ-সরল আবদারে যেন বিদিশার মন পুলকিত হলো। সে দু’কদম এগিয়ে এসে তার দু’হাতে করবীর হাত ধরল। ভীষণ আন্তরিকতার সঙ্গে বলল, ‘আমার শুনতে ভালো লাগবে, আপু। ডেকো।”

করবী বিদিশার এমন আন্তরিকতায় মুগ্ধ হলো। বেগুনি রাঙা সুতি শাড়িতে এই সুন্দর মেয়েটিকে তার নির্ভেজাল মানুষ মনে হলো। কতজন পারে এমন করে মিশতে? মানুষ তো আজকাল অহংকারের খোলসে এমন ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে যে আর ডানা মেলে উড়তে চায় না। তার মাঝে এমন দু’একজন হয়তো থেকে যায় সব অহংকার পিছু ফেলে।

কোমল, গাঢ় সন্ধ্যা নীল শাড়ি জড়িয়ে আসমান জুড়ে যেন হাপিত্যেশ করছে কোন সে ব্যাথায়। বেদনার নীলে আকাশ জর্জরিত। মিহি বাতাস এসে বিনা বিজ্ঞাপনে নিঃশব্দ আলিঙ্গন দিয়ে যাচ্ছে মানব শরীরে। সেই আলিঙ্গনকে সঙ্গী করে বাড়ি ফিরল করবী। দরজার সামনে আসতেই পা থেমে গেল তার। তিন জোড়া পরিচিত জুতো উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে দরজায় এলোমেলো ভঙ্গিতে। করবী ত্রস্ত হাতে বেল বাজাল। সেকেন্ড পেরুতেই ঝড়ের গতিতে দরজা খুলল কেউ। সে কেউটা বিন্দু। টিয়ে রঙের সেলোয়ার-কামিজের গাঢ় কাজল রঙের বিন্দু। যার চোখে পদ্ম পুকুর উপচে পড়ে মায়া নিয়ে।
করবীর আনন্দে চোখ টলমল করে উঠল। ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরল বিন্দুকে। সকল ক্লান্তিরা হামাগুড়ি দিয়ে যেন ছেড়ে গেল দেহ। বিন্দুও জড়িয়ে ধরল তার আপাকে। ভেজা কণ্ঠ,
‘দূরে আইস্যা দূরের মানুষ বানাইয়া ভুইল্যা যাওয়ার ফন্দি আঁটো, আপা? তা তো হইব না।’
করবীরও কণ্ঠ কাঁপছে, ‘তোদের ভুলা যাবে আদৌ?’
‘ভুলতে দিলে-এ না ভুলতে পারবা।’

করবী জড়িয়ে রাখল বিন্দুকে অনেকক্ষণ। এই ব্যস্ত নগরীতে তার বুকের ভেতর কোথায় একটা ধারাল সুঁচ বসে ছিল। সে যাযাবর সুঁচের ইতিহাস বুঝতে পারেনি। এখন বুজছে। এই যে বিন্দুকে জড়িয়ে ধরার পর ব্যাথার অস্তিত্ব বিলীন হচ্ছে, তার মানে এই সুঁচ কাছের মানুষদের দেখতে না পাওয়ার যন্ত্রণায় গেঁথেছে।
আলিঙ্গনে বিন্দু লেপ্টে থাকলেও করবী অনুভব করল ছোট্টো একটি দেহ জড়িয়ে ধরেছে তার পা। করবী না দেখেও অনুমান করল দেহটি কার! বিন্দুকে ছেড়ে সে ছোটো দেহের অধিকারিণীকে কোলে তুলে নিল। ঝলমলে কণ্ঠে বলল,
‘হুতুম বুঝি আমাকে অনেক মিস করেছে?’

হুতুমের বাদামি নয়নে জলের সমুদ্র। টলমলে চোখের মেয়েটি অভিমানী স্বরে বলল, ‘তোমারে না মনে পড়লে কারে মনে পড়ব, বাণীর মা?’

‘তাহলে ক’টা দিন আমার কাছে থেকো?’

‘থাকতে তো মন চায়-ই কিন্তু আমি যে বিন্দুবালারে ছাড়া ঘুমাইতে পারি না। কত না মজা হইতো যদি এক লগে থাকতাম!’

হুতুমের হতাশায় সকলেরই মন খারাপ হয়। কথাটা তো কেবল একা হুতুমের না। সকলের মনেই এই এক টানাপোড়েন, ইচ্ছে আত্মাহুতি দিচ্ছে বারে-বারে। গম্ভীর পরিস্থিতি গমগমে করতে ভেসে এলো পুরুষ কণ্ঠ,
‘আমিও আসলাম। কিন্তু এমনে যে মূল্য পাবো না সেটা বুঝিনি।’
করবী ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে চাইল। হীরণ বসে আছে ড্রয়িংরুমে রাখা চৌকিটাতে। ঠোঁটে নিখাদ হাসি।

করবী হুতুমকে কোলে নিয়েই এগিয়ে গেল হীরণের কাছে। হাসি বজায় রেখেই বলল,
‘মূল্যবান মানুষ সবসময়ই মূল্যবান, নতুন করে আর কী মূল্য দিবো?’

‘তাই বলে একটু জিজ্ঞেসও করবে না কেমন আছি?’ হীরণের কণ্ঠে ফাজলামোর রেশ।
‘আপারে ছাড়া যে তুমি ভালা নাই হেইডা আপা ভালা কইরাই জানে। তাই আপা আর নতুন কইরা জিগায় নাই তোমারে।’
হীরণে প্রতিত্তোরে মজা করেই কথাটা বলল বিন্দু। কিন্তু কথাটা নিখুঁত সত্যি হওয়াই পাংশুটে হয়ে গেল করবীর মুখ। হাসি থেমে গেল হীরণেরও। করবী পরিস্থিতি ঘুরাতে বাহানায় ছুটে গেল রান্নাঘরে। বাবা ততক্ষণে চা বানিয়ে কাপে ঢেলে ফেলেছেন। বিস্কুট সাজিয়েছে প্লেটে। করবীকে দেখেই গাল ভোরে হাসলেন তৈয়ব হোসেন, ‘টাকা আছে তোর কাছে, মা?’

করবী চায়ের ট্রে-টা হাতে তুলে নিল। চোখের পলক ফেলে ইশারায় আশ্বস্ত করল, ‘আছে। চিন্তা করো না। আমি এখুনি বাজার যাব।’
মেয়ের বুদ্ধিমত্তায় খুশি হলেন বাবা। মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, ‘হুতুমটা প্রথম এলো একটু মুরগী আনিস। আর তিমির ছেলেটা একবার দুপুরে এসেছিল ফলমূল নিয়ে। ফোন নাম্বার থাকলেও ওকেও দাওয়াত করে দিস।’
করবী ঘাড় কাঁত করে সম্মতি দিয়েই ছুটল ড্রয়িংরুমে। ওরা ততক্ষণে রুম বদলে ড্রয়িংরুম থেকে বারান্দার রুমে চলে গিয়েছে। বাণীকে ছাড়া আড্ডা জমছে না তাই। অবুঝ পাখি—বাণীরও যেন প্রাণ ফিরে এসেছে ওদের দেখে। ছাড়া ছাড়া শব্দে, ডানা ঝাপটে আনন্দ প্রকাশে ব্যস্ত হয়ে গেল পাখিটা।

করবী সুযোগ বুঝেই বাজারের ব্যাগটা নিয়ে আবার ছুটল বাজারে। সারাদিনের ক্লান্তি তার গা ছেড়ে পালিয়েছে সেই কখন। ওদের দেখলে মনের খোরাক এমনেই মিটে যায়। আর কী লাগে?

বাজার থেকে মুরগীর মাংস নিল, ইলিশ নিল একজোড়া। চকচকে রূপ ইলিশের। বিন্দুর আবার ইলিশ পছন্দ। পুরো বাজার খুঁজে চুনোপুঁটিও নিলো চওড়া দামে। হীরণের পছন্দ। বাবার জন্য শুঁটকি নিল। বাণীর জন্য বাদাম। কেবল থলের এক কোণা খালি রেখে নিলো না নিজের পছন্দের কিছু।
বাজার ভর্তি ব্যাগটা নিয়ে বাড়ির পথ ধরল। ভারে হাত ছিঁড়ে যাওয়ার উপক্রম অথচ মনের আনন্দের কাছে তা বড়োই তুচ্ছ হলো। ঘড়ির কাটায় সময় তখন সাড়ে আটটা। নীল আকাশে তখন ভরা পূর্ণিমা। আজ বুঝি আকাশেরও আনন্দ ভীষণ। করবী তার ভাঙা মোবাইল দিয়ে তিমিরের ফোনটাতেও ছোটো একটি ম্যাসেজ করে দিল। আজ ভরপেট খাওয়া হোক। তারপর নাহয় মাস শেষে বাপ বেটি দু’দিন উপোস করে থাকবে। আজকের আনন্দ সেদিনের খিদে নিশ্চয় মিটিয়ে দিবে।

ম্যাসেজ শেষে মোবাইল ব্যাগে রাখতেই পথের বিপরীতে আনমনে দৃষ্টি গেল তার। চঞ্চল দৃষ্টি সেখান থেকে সরাতেই হৃদয় মাঝে কেমন যেন পরিচিত এক মুখ ভেসে উঠল। করবী আবার সেখানে তাকাল। ততক্ষণে পরিচিত মুখ অদৃশ্য। করবী ভীষণ মিলানোর চেষ্টা করল এ মুখ খানা কার। ভাবতে-ভাবতে হুট করে তার অস্বচ্ছ স্মৃতিতে জেগে বসল ভাবনা। বাবার বুকপকেটে থাকা নারীটির সাথে এই মুখের বড়ো মিল। বড়োই মিল। মৃত মানুষকে সে দেখল? এমন মতিভ্রম হলো তার? যাকে কখনো সে দেখেনি, ভাবেনি তাকে হঠাৎ রাস্তায় কেনই-বা দেখল?

#চলবে…

#বুকপকেটের_বিরহিণী
২০ এর বর্ধিতাংশ
কলমে: #মম_সাহা

নিঃস্ব শহরে দু’চোখ মেলে করবী দেখল, যাকে কখনো দেখার কথা ছিল না তাকেই দেখল সেকেন্ডের জন্য। বুকের উপর দেদার ওঠাপড়া শুরু হলো। শরীরে তখন অনাকাঙ্খিত ঘাম। সে সইতে পারছে না এই দৃশ্য। বার-বার স্মৃতি জানিয়ে যাচ্ছে এই অপ্রত্যাশিত দৃশ্য তার কাছে বড়োই যন্ত্রণার। ফুসফুস অক্সিজেনের অভাবে বার-বার থেমে-থেমে যাচ্ছে। চারপাশে এত স্নিগ্ধ বাতাস থাকতেও মনে হলো পৃথিবী ডুবে যাচ্ছে লেলিহান দাবানলে। সে সইতে পারছে না এ ডুবে যাওয়া। সে দাঁড়িয়ে থাকতে হিমশিম খাচ্ছে তবুও কল লাগাল বাসায়। বাবার কাছে। অপরপাশে ফোন রিসিভ হলো মিনিট ব্যয়েই। করবীর কণ্ঠনালীটা কে যেন চেপে ধরে আছে। তবুও তার বাবাকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো, মা কই? মা যদি মারাই যান তবে তার মৃত্যু কাহিনী কেন বাবা গল্প করে আজও বলেনি? কেন বলেনি?

‘হ্যাঁ রে মা, বাজার করেছিস?’
বাবার প্রশ্নে কল্পনার ধূলিসাৎ হয়। করবী চমকে যায়। মায়ের গল্প শোনায়নি বলে যে বাবাকে সে দোষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ছিল সেই বাবাকেই আর মায়ের কথা বলে হয়ে ওঠে না তার। সে কথা ঘুরায়, ‘বাজার শেষ। আমি আসছি, আব্বু।’
তৈয়ব হোসেনের প্রফুল্ল কণ্ঠ, ‘সাবধানে আসিস।’
ব্যস্, কথা থেমে যায়। সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। অথচ করবীর কত কিছু জানার ছিল! ছোটোবেলার স্মৃতি তার কাছে আবছা কিংবা নেই বললেই চলে। কিন্তু যতটুকু জানে, তার অনেক কাছের মানুষ ছিল। আত্মীয়-স্বজনে ভরপুর তারও একটা জীবন ছিল। তাহলে বাবা কেন সেই জীবনের সাথে বিচ্ছেদ ঘটিয়ে ছিলেন? নিশ্চয় গাঢ় কোনো কারণ আছে। নাহয় বাবা কখনো করবীকে এমন একা জীবন দিতেন না। আর কেউ না জানলেও বাবা তো জানত, তার মেয়েটার খুব কাছের মানুষ প্রয়োজন ছিল। তবুও যেহেতু বাবার এই কঠিন শপথ নিশ্চয় কারণ আছে। মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে সেই কারণ জানা যাবে না। এ যে সঠিক সময় নয় তা করবী ভালো করেই বুঝল। তারপর বুক ভোরে শ্বাস নিল। ছুঁড়ে ফেলল ক্ষাণিকের সেই দৃশ্য। কিন্তু মুছে ফেলতে চাইলেও কী সব মোছা যায়?

বাড়ি ফিরেই সব রান্না করল করবী। বিন্দু অবশ্য টুকটাক সাহায্য করেছে এসে। করবীর নিষেধ সে মানেনি। চঞ্চল হাতে সবকিছু এগিয়ে-পিছিয়ে দিয়ে ছিল। খাওয়া-দাওয়া শেষ করেই ওরা চলে যায়। শূন্য বাসা আবারও খা-খা করে নিদারুণ শূন্যতায়। পুরো পৃথিবী নীরব হতেই করবী গিয়ে বসল বারান্দায়। বাণী ঘুমাচ্ছে। আগের মতন এ বারান্দাতেও চেয়ার আছে। তবে এ বারান্দায় বসলে বিল্ডিং দেখা যায় না। দেখা যায় একটি পার্ক। জন-মানবহীন পার্কটির মাঝে থাকা পুকুরে টলমল করে জোছনা দোলার দৃশ্য করবী নয়ন মেলে দেখে। বৈরাগী তার ভাবনারা। বাবা ঘুমিয়ে গিয়েছে অনেকক্ষণ। ঘুম নেই করবীর চোখে। মা নেই ব্যাপারটা মস্তিষ্কে এভাবে জেঁকে বসেছে যে ঘুম আসছে না। কত চেষ্টা করল মায়ের মুখটা মনে করতে! মনে পড়ল না। কেবল মাথায় অদম্য যন্ত্রণা হলো। ছোটো বেলাতে এই যন্ত্রণা হতো তারপর বহুবছর গেল আর হয়নি। আজ নতুন করে কেনইবা পুরোনো সব ফিরে আসার ঘ্রাণ পাচ্ছে? যা চলে যায় জীবন থেকে তা ফিরে আসা সবসময় কী সুখের হয়? নাকি শোকের হয়? করবী ভাবতে পারছে না কিছু। দু-চোখ মেলে পদ্মহীন পুকুরটাতে তাকিয়ে রইল। জল থৈথৈ পুকুরটাতে কেবল পূর্ণিমা ভাসছে নেই কোনো ফুল। করবীর জীবনের সাথে এই ছোট্টো পুষ্করিণীর কতটা মিল! কেবল অমিল একটায়, পুকুরটার জোছনা থাকলেও করবীর তা নেই। চারপাশ কেবল অন্ধকার, কালো।

বিদিশা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে, এক ধ্যানে। তন্মধ্যেই তার শাশুড়ি তাসনীম বেগম উদ্ভ্রান্ত পায়ে ঢুকল রুমে। চোখে-মুখে চিন্তা। বলল,
‘তুষারের সাথে তিমিরের কথা হয়েছে কি-না একটু জিজ্ঞেস করবে, বউ? ওদের ওখানে নাকি বরফ বৃষ্টি হচ্ছে। মানুষ বাসা থেকে বের হতে পারছে না। ছেলেটা সেই দূরদেশে কেমন আছে, কে জানে!’

শাশুড়ির কথায় বিচলিত দেখা গেল না বিদিশাকে। সে রইল শান্ত নদীর মতন শীতল। অথচ এই শীতলতা সহ্য হলো না তাসনীম বেগমের। সে বিরক্ত হলো, অধৈর্য কণ্ঠে বলল,
‘পরেও তো চুল আঁচড়ানো যাবে। গিয়ে দেখো না তিমির কী বলে।’
‘যাবো। হাতের কাজ শেষ হোক।’
ছেলের বউয়ের এমন উদাসীনতায় বিরক্তি যেন তাসনীম বেগমের হুর হুর করে বাড়ল। অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বলল,
‘স্বামীর প্রতি মায়া-মহব্বত তোমার অন্তরে নেই একটুও। অথচ তোমার সাথে বিয়ে দিয়ে আমি আমার ছেলের শক্র হলাম।’

হিংস্র কণ্ঠে কথাটা বলেই থম মেরে গেল ভদ্রমহিলা। ততক্ষণে চিরুনি থেমে গেছে বিদিশারও। সে আয়নার মাঝেই শাশুড়ির প্রতিবিম্বর দিকে চাইল। শাশুড়ির কাচুমাচু মুখের দিকে তাকিয়ে হাসল খানিক। তবে এ হাসি তাচ্ছিল্যের ত্রাস ছুঁড়ে মারল নিঃশব্দে। বিদিশা হাতের চিরুনি নামিয়ে রেখে খুব ক্ষীণ কণ্ঠে উত্তর দিল,
‘আমি কী বলেছিলাম আম্মু আপনাকে শত্রু হতে?’
তাসনীম বেগম নিশ্চুপ। প্রতিত্তোরের ভাষা নেই।
‘বললেন না যে, আম্মু? আমি কী বলে ছিলাম এমন কিছু করতে?’
‘মুখ ফসকে বেরিয়ে গিয়েছে, বউ।’
‘আম্মু, কাউকে ভুলবশত মেরে ফেললে যেমন বাঁচানো যায় না তেমন মুখ ফসকে বের হওয়া কিছু কথার ক্ষত কখনো মুছে যায় না।’

তাসনীম বেগমের লজ্জায় মুখ ছোটো হয়ে এলো। অপরাধীর মতন চুপসে গেল মানুষটা। নত মস্তকে বলল,
‘আমার কথায় কষ্ট পেও না, বউ। আসলে সন্তানের প্রতি চিন্তা থেকে বলে ফেলেছি।’
কথা শেষ করেই গটগট পায়ে প্রস্থান নিলেন ভদ্রমহিলা। বিদিশার ঠোঁটে তখনও বিষাদ হাসি লেপ্টে। শাশুড়ি বের হতেই সে ধপ করে বসে পড়ল খাটে। বিড়বিড় করে বলল,
‘আপনার এতটা কাছে থেকেও আমি কখনো কেন আপনার সন্তান হতে পারলাম না, আম্মু। কেন ছেলের বউ হয়েই দোষের ভাগীদার হয়ে থাকলাম? অথচ কোথাও আমার কোনো অন্যায় ছিল না। তবুও পুড়তে হলো আমাকে।’
হতাশার তেতো দীর্ঘশ্বাস মিশে গেল স্বচ্ছ বাতাসে। বিদিশার চোখে ভেসে উঠল সুন্দর একটা সংসার হওয়ার কল্পনা। জীবনের প্রথম এক নিঃসঙ্গ দুপুরে সে যেই ছেলেটাকে স্বামী এবং পুরো জীবন ভেবে কবুল বলেছিল, সেই ছেলের ব্যাথার দাগ হয়ে থেকে যাবে কখনো ভাবতে পারেনি। অথচ ভুক্তভোগী হয়েও আসামীর মতন জীবন কাটাল সে? দিনশেষে সবাই সবার সম্পর্ক, আবদার, অভিমান নিয়ে ভালো রইল। কেবল একটি সংসারে ফেলনা আসবাবপত্র হয়ে থেকে গেল সে।
নারীর এমন কত গল্প কেউই জানবে না। কখনোই না।

রাত তখন আড়াইটা। পুরো পৃথিবী ঘুমন্ত রাজপুরী হয়ে গিয়েছে। কেবল এক আকাশ মুগ্ধতা নিয়ে চাঁদ হাসছে অকৃত্রিম। করবীর ঘুম ভেঙে গেল হুট করেই। বাজে একটা স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নটা কেমন ছিল ঠিক ঠাহর করতে পারল না। কেবল কানের মাঝে স্বপ্নের কণ্ঠ গুলো তখনও বাজছে। এত দ্রুত ভুলে গেল স্বপ্নটা! কী নিয়েই-বা দেখেছিল?
ঘুম ভাঙতেই ফোনের রিং টোন নিঃশব্দতা ভেদ করে কানে বাজতে লাগল। মস্তিষ্ক তখনও সচল হয়নি। যখন পুরোপুরি স্থির হলো তখন দ্রুত গিয়ে ফোনটা তুলল। তিমিরের নাম্বার। এত রাতে লোকটার কল দেখে কিঞ্চিৎ কপাল কুঁচকে গেল মেয়েটার। সে সাথে সাথে রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে তিমিরের সুমিষ্ট কণ্ঠ ভেসে এলো, ‘ঘুমিয়ে ছিলে?’
‘হ্যাঁ। চোখ লেগে গিয়েছিল আরকি।’
করবীর উত্তরের পর-পর অপর পাশ থেকে অভিযোগ এলো,
‘এ তো ভারী অন্যায়, মেহমানকে আমন্ত্রণ করে না খাইয়েই ঘুমিয়ে গিয়েছ!’

তিমিরের এহেন কথায় ভ্যাবাচেকা খেল করবী, ‘জি?’
তিমির এবার ভাব-ভঙ্গিমা ছাড়াই সোজাসাপটা বলল,
‘খিদে লেগেছে ভীষণ। আমার ভাগের খাবার গুলো নিয়ে কষ্ট করে নিচে আসবে?’
করবী চমকাল, ‘আপনি কোথায় এখন!’
‘কোথায় আর থাকবো? খাবার খেতে উদাস ভিলার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। যদি একটু মায়া-মমতা হয় তবে দেখা দিও।’

কথাটা বলেই কল কেটে দিল লোকটা। করবী দিশেহারা হয়ে রান্নাঘরে গেল। সুন্দর করে খাবার সাজিয়ে নিয়ে ছুটল বাড়ির নিচে। বাড়ির মেইন গেইট হা করে খোলা। দারোয়ান ঝিমাচ্ছে। নিশ্চয় তিমিরই খুলিয়েছে গেইটটা!
করবী অপেক্ষা না করে পা বাড়ায় পথে। গেইট পেরুতেই সাদা ঝকঝকে গাড়িটা চোখে পড়ে তার। কালো পাঞ্জাবি পরে গাড়িটার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুদর্শন পুরুষটিকেও অতঃপর চোখে পড়ে। করবী বিচলিত পায়ে এগিয়ে যায়। কাছাকাছি গিয়েই শুধায়, ‘এত রাতে!’
‘তুমি ডাকলে আর আমি আসব না?’
তিমিরের কথায় লজ্জায় আবিষ্ট হয়ে মেয়েটা। মিনমিন করে বলে, ‘বাসায় গেলেই পারতেন।’
‘আমার রাস্তায় খেতে অসুবিধা নেই।’

করবী এক হাতে থাকা পানির বোতলটা গাড়ির উপর রাখে। দ্বিতীয় হাতে থাকা খাবারের থালাটা এগিয়ে দেয় তিমিরের দিকে। শুধায়,
‘এত রাত হলো যে?’
‘তুমি জানোনা? রাত গভীর হলে চাঁদের সৌন্দর্যতা বেশি বৃদ্ধি পায়। সেই বেশিটা কতটুকু সেটাই পরীক্ষা করতে এলাম।’
তিমিরের হেঁয়ালি উত্তরের গভীরতা বুঝল না মেয়েটা। বরং বোকা চোখে নিজেও চাঁদের দিকে তাকাল। ঠোঁট উল্টে বলল,
‘কই বেড়েছে? আগের মতনই তো!’
তিমির এবার শব্দ করে হেসে দিল। ফিচলে কণ্ঠে বলল,
‘এই সৌন্দর্য তুমি দেখতে পাবে না। এ সৌন্দর্য দেখতে পায় কেবল প্রেমিক চোখ। এই যে চাঁদের ঘুম ঘুম চোখের ফুলো পাতা, নাকের চটচটে তেল ভাব, ঠোঁটের শুষ্কতা…… এসব তুমি দেখতে পাচ্ছো?’

করবী তিমিরের কথার আগামাথা পেল না। অদ্ভুত চোখ-মুখ করে বলল,
‘চাঁদের চোখ-মুখ হয় নাকি? কী বলছেন? কই আপনার চাঁদের চোখ-মুখ?’

তিমির এক লোকমা ভাত মুখে দিয়ে বলল, ‘নীল ওড়না দিয়ে ঘোমটা দেওয়া চাঁদ। যার সৌন্দর্য ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ঝকঝক করছে। যার জোছনায় প্রেমিক বুকের শিউলি কানন হৃদয়ে ফুল ফুটেছে। দেখতে পাও কী তা? প্রেমের অভাবে কীভাবে আমি রাতের নিশাচর হয়েছি, বুঝতে পারো কী তা, চাঁদ?’

#চলবে…..

#বুকপকেটের_বিরহিণী
২১ পর্ব:
কলমে: মম সাহা

(৩১)
দক্ষিণের আকাশে শরৎ আসার ঘ্রাণ। মেঘ গুলো সব ভাসা ভাসা আসমান জুড়ে। করবীর পড়াশোনার পার্ট চুকেবুকে গেছে। মাস্টার্স পরীক্ষা শেষে প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে দীর্ঘ ছুটি মিলল।
ঘুড়িকে পড়াতে এসেছে আজ একটু তাড়াতাড়িই। দরজা খোলা ছিল। বিদিশা ড্রয়িং রুমে বসে কাথা সেলাই করছিল সেজন্য দরজা খোলা। মেয়েটা গোসল করছে। করবীকে দেখেই গাল ভোরে হাসল বিদিশা, ‘ভালো আছো, আপু?’

করবী হেসে টেবিলে বসল। উত্তর দিল, ‘ভালো। তুমি ভালো আছো, ভাবি?’
‘এই তো ভালো। তুমি বসো, আমি আসছি। ঘুড়িরও বোধহয় গোসল শেষ হলো বলে।’

করবী ঘাড় কাঁত করে সম্মতি দিতেই বিদিশা উঠে গেল। নিরিবিলি ভাব ভেঙে হুট করে একটা গুনগুনিয়ে গানের শব্দ কোথা থেকে এসে যেন মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিল চারপাশে। করবী মনোযোগ দিতেই বুঝল ঘুড়ির কণ্ঠ। মেয়েটা চমৎকার গান জানে তো! কী সুরেলা সুর!
ঘুড়ি গুনগুন করতে করতে বাহিরে এসে করবীকে দেখে বেশ বিব্রতবোধ করল। হাসল খানিক,
‘আসসালামু আলাইকুম, মেম।’
করবী সালামের জবাব দিল। প্রশংসা করে বলল, ‘তোমার গানের কণ্ঠ ভীষণ সুন্দর, ঘুড়ি। গান শিখেছিলে বুঝি?’

ঘুড়ি লাজুক হাসল। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিল, ‘শিখতাম। এখন আর যাই না গানের ক্লাসে।’

করবীর কৌতুহল বাড়ল। বিস্মিত কণ্ঠে বলল, ‘কেন যাও না?’

কেন’র জবাব দিতে গিয়ে ঘুড়ির লজ্জায় মাখো মাখো অবস্থা হলো। করবী দেখল ঘুড়ির হাবভাব। সাবলীল ভাবে প্রশ্ন করল,
‘তোমার বাবা-মা বুঝি পছন্দ করেন না?’

করবীর প্রশ্নে ঘুড়ি চমকাল। থতমত খেয়ে বলল, ‘না, না। তেমন না।’
‘তবে..?’

ঘুড়ি মাথা নামাল, বিড়বিড় করে বলল, ‘বিদিশা ভাবীর দেবর পছন্দ করেন না।’

ঘুড়ির কথা বোধগম্য হলো না করবীর। আরেকজনের অপছন্দ দেখে মেয়েটা গান গাওয়া ছেড়ে দিয়েছে ব্যাপার বড়োই অসামঞ্জস্য লাগল তার কাছে। তবে সে আর প্রশ্ন করল না। ঘুড়ি এসে বসল। নিজ মনে পড়াও শুরু করল। বাহির থেকে তখন উষ্ণ বাতাস আসছে। রুমের পর্দা উড়ছে। চারপাশ নিরিবিলি। ঘর জুড়ে কেবল ঘুড়ির পড়ার শব্দ। ঘুড়ি পড়তে-পড়তে হুট করে চুপ করে গেল। করবী তখন অন্য ধ্যানে মগ্ন। ঘুড়ি দোনোমোনা করে ডাকল,
‘মেম।’
করবীর ধ্যানে ভাঁটা পড়ল। সে কিছুটা ঘোরের মাঝেই বলল, ‘হু, হ্যাঁ?’

‘একদিন বিকেলে আমি গিটার বাজাচ্ছিলাম। বিদিশা ভাবীর দেবর হুড়মুড় করে দরজায় আসলেন আমার। তারপর রুক্ষ কণ্ঠে বলেছিলেন, “ঘুড়ি, গিটারটা ধীরে বাজাও। আমার শব্দ পছন্দ না।” তারপর থেকে আমার গিটারে কখনো সুর উঠেনি।’

ঘুড়ির কথায় করবীর ভ্রু কুঁচকালো। নাক-মুখ কুঁচকে বলল,
‘কী অ ভ দ্র লোকরে! তুমি উনার কথা শুনতে গিয়েছ কেন? অদ্ভুত!’
‘মেম, তাকে অ ভ দ্র বলবেন না। আমি গিটারের সুর তো তার জন্যই বাজতো। সে চায় না বলে আর বাজে না। তাকে মুগ্ধ করতে না পারলে সেই গিটার বাজিয়ে কী লাভ!’

করবীর কাছে এবার ব্যাপারটা স্বচ্ছ। সাদামাটা কাহিনীর ভেতরেও যে প্রেমের একটা গল্প আছে তা আর বুঝতে বাকি রইল না তার। ত্ই সে ফিক করে হেসে দিল। ঘুড়ির গাল টেনে বলল,
‘ও বাবা! এখনই এসব। তোমার কিন্তু বয়স কম, ঘুড়ি। সাবধান।’

ঘুড়িও হাসল তাল মিলিয়ে। ক্ষীণ কণ্ঠে বলল,
‘কেবল ভালো লাগে মেম। এর বেশি কিছু না।’
‘হয়েছে, এবার পড়ো।’

_

গুমোট গরম পড়েছে চারপাশে। হীরণ রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাইকের পাশে সিগারেট ফুঁকছে। চারপাশ থেকে তখন ব্যস্ত মানুষের পদচারণ। সিগারেটে শেষ টান টুকু দিতেই তার সামনে উপস্থিত হলো হুতুম। এসেই আধো কণ্ঠে বলল,
‘মাস্তান, তুমি এইহানে কী করো?’

হীরণ হুতুমকে দেখে নিটোল সুন্দর হাসল, ‘তোমার জন্য দাঁড়ায় আছি।’

‘তুমি কেমন কইরা জানো আমি যে আসুম?’
‘জাদু।’
‘তুমি জাদু জানো?’ হুতুমের চোখে চকচক করছে বিস্ময়। তা দেখে হাসল হীরণ। মাথা উপর-নীচ নাড়িয়ে বলল,
‘তা একটু জানি।’

কথা শেষ করেই হুতুমকে কোলে তুলে নিল হীরণ। চুল গুলো আলগোছে গুছিয়ে দিল। শুধাল,
‘কিছু খাবে?’
হুতুম আদুরে ভঙ্গিতে ঠোঁট উল্টালো। ভাবুক স্বরে বলল,
‘আমি তো বিন্দুবালার লাইগ্যা এইহানে আইসা দাঁড়াইছি। কিছু খাইতে না।’
‘খাও কিছু।’
‘খাবো? কিন্তু বিন্দুবালা যে কইলো, কেউ কিছু সাধলে যেন না খাই।’
‘সেটা তো অপরিচিত মানুষের জন্য। কাছের মানুষদের জন্য এ নিয়ম না।’
হীরণের আশ্বাস বাণীতে যেন হুতুম খুশি হলো। উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,
‘চলো চিপস খাই।’

হীরণ রাজি হলো। হুতুমকে গাড়িতে বসিয়ে বাইক টেনে কিছুটা দূরে নিয়ে গেল। একটা দোকান থেকে চিপস্ আর কোক কিনে মেয়েটার হাতে ধরিয়ে দিলো। হুতুমের কী খুশি! খুশি যেন ধরেই না! বাদামি মনি গুলো খুশিতে চকচক করছে। গোলাপি, চিকন ঠোঁট গুলো বাচ্চাটার মুখের সবচেয়ে সুন্দর অঙ্গ যেন! হীরণ মন্ত্রমুগ্ধের মতন তাকিয়ে রইল। হুতুম মোটেও ওর বাবা-মায়ের মতন হয়নি। বিন্দুর সাথে চেহারা খানিক মিল। বলা যায় বড়ো বোনের আংশিক পেয়েছে। কিন্তু পুরো চেহারায় বিদেশীয়ানা রয়েছে।
হীরণের ভাবনার মাঝেই হুতুম লাফিয়ে উঠল,
‘মাস্তান, দেহো দেহো, বাণীর মা যায়। বাণীর মা, ও বাণীর মা….’

হুতুমের ডাকে হীরণও সেদিকে দৃষ্টি ফেলে। রুবী যাচ্ছে ভেবে সে বার কয়েক ডাকও দেয় তবে মেয়েটা তাদের দিকে ফিরেও চায় না। হীরণের খটকা লাগে, রুবী তো কখনো বোরকা পরে না। তাছাড়া রুবীর ডান গালে থাকা তিলটাও চোখে পড়ল না! কিন্তু একটা মানুষের আদৌ এত মিল হয়! এই অতি আশ্চর্যান্বিত ঘটনায় লোমকূপ দাঁড়িয়ে গেল হীরণের। এতটা মিল কারো মাঝে হতে পারে? হীরণ তৎক্ষণাৎ করবীকে কল করে জিজ্ঞেস করেই জানতে পারে করবী তাদের বাসার গলিতে। বাসায় ফিরছে। তাহলে এই মেয়েটা রুবী না, অন্য কেউ।

তিমির হাঁটছে করবীর পাশে। মেয়েটার চোখে-মুখে চিন্তা। তিমির বেশ কিছুক্ষণ যাবতই খেয়াল করছে করবীর চিন্তিত ভাবভঙ্গি। অবশেষে না পেরে শুধাল,
‘কোনো সমস্যা?’
করবী আচমকা প্রশ্নে থতমত খেল। আমতা-আমতা করে বলল,’না।’
‘নতুন টিউশনিটা তো দেখি আমাদের গলিতেই নিয়েছো!’
করবী কিঞ্চিৎ অবাক হলো, ‘ওটা আপনাদের এলাকা?’
‘হ্যাঁ।’
‘ভালো তো।’
‘একদিন আমাদের বাসায় নিয়ে যাবো। কেমন? যাবে তো?’
শেষের প্রশ্নটায় যেন আকাশ সমপরিমাণ সংকোচ এবং সংশয় ছিল। করবী পূর্ণদৃষ্টিতে তাকাল তিমিরের দিকে। চোখে-চোখ পড়ল। বসন্ত এসে যেন ধরা দিলে বুকের বা’পাশে। হৃদপিন্ড বোধহয় দু-তিনবার শব্দ করতে ভুলে গেল। ব্যস্ত পথ হয়ে গেল রূপকথার রাজপুরী। করবী লাজুক হাসল,
‘যাব।’

করবীর ছোট্টো উত্তরে যেন খুশি হয়ে গেলে তিমির। হুট করে সে একটা বাচ্চামো করে বসল। কাকে যেন কল লাগাল। রাশভারি কণ্ঠে বলল,
‘ভাবি, আপনার শাশুড়িকে বলবেন, তিমির তার গন্তব্য পেয়ে গিয়েছে।’

তিমিরের করা হঠাৎ কাজে করবীর গাল লাল হয়ে গেলে। গোলগোল আঁখিদুটিতে লজ্জা ধরা দিল। মেয়েটা ছুটে চলে গেল বাড়ির ভিতরে। তিমিরের মুখে হাসি। অতীত ফিরে পাওয়ার সুখ তার অঙ্গে-অঙ্গে।

রাতের গহীনে চাঁদ হারিয়ে অমানিশায় ছেয়ে গেছে পৃথিবী। করবী দাঁড়িয়ে আছে তার প্রাণহীন বারান্দায়। চোখ-মুখ শুকনো। তৈয়ব হোসেন বেশ কয়েকদিন যাবতই মেয়ের এহেন উদাসীনতা দেখছেন। সন্তানের এমন উদাসীনতায় তারও যে বুক পুড়ে। অবশেষে আজ না পেরে তিনি উপস্থিত হলেন। বুকের মাঝে অদম্য সাহস সঞ্চার করে এলে। ডাকলেন করবীকে,
‘রক্তকরবী…ঘুমোসনি যে?’

করবীর চমকে যাওয়া উচিত ছিল বাবার অপ্রত্যাশিত কণ্ঠে। কিন্তু সে চমকাল না। বরং ধীর স্বরে বলল, ‘অবশেষে সাহস করলে তবে?’

তৈয়ব হোসেন চমকালেন মেয়ের হেঁয়ালি প্রশ্নে। হয়তো বুঝলেন আবার বুঝলেন না ভাব করে বললেন, ‘কী বলছিস?’
‘আমাকে কেন আঁধারে রাখছ, বাবা? আমার কী সবটা জানার অধিকার নেই?’
তৈয়ব হোসেন বিব্রত হলেন তবে বুঝত দিলেন না। নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রেখে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কী জানার কথা বলছিস?’
‘মা কোথায়, বাবা?’

করবীর সামান্য প্রশ্নে অস্বাভাবিক কম্পন দেখা দিল তৈয়ব হোসেনের মাঝে। বহু কষ্টে তিনি উচ্চারণ করলেন,
‘ম রে গিয়েছে। বেঁচে থাকলে তো সাথেই থাকতো।’
করবী হু হা করে হাসল। ভগ্ন কণ্ঠে শুধাল, ‘দূরে যাওয়া মানেই তো মরে যাওয়া না, তাই না?’

#চলবে

বুকপকেটের বিরহিণী পর্ব-১৮+১৯

0

#বুকপকেটের_বিরহিণী
আঠারো পর্ব:
কলমে: মম সাহা

(২৯)
সারারাত বৃষ্টির পর প্রকৃতি এখন শান্ত। যেমন শান্ত থাকে প্রেমিকা হারানোর পর প্রেমিকের মরুভূমির প্রতিচ্ছবি হৃদয়। শীতল বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে গা। গাছের সবুজ পাতা চুইয়ে পড়ছে জল। সবকিছু নিবিড়, কোমল।
আধভাঙা বাড়িটির সামনে একটা ছোটো গাড়ি থামানো আছে। সে গাড়িটিতে ব্যস্ত হাতে আসবাবপত্র তুলে দিচ্ছে হীরণ। এলাকার সবচেয়ে বেখেয়ালি ছেলেটাই খেয়াল করে যত্ন করে জিনিসপত্র তুলে দেওয়ার ভার নিয়েছে। তার পেছন পেছন হুতুমও ছোটো ছোটো হাতে, ছোটো-ছোটো জিনিসপত্র গুলো এগিয়ে দিচ্ছে। করবী তৈয়ব শেখকে গাড়ির সামনের সিটে বসিয়ে দিল সুন্দর করে। আসবাবপত্র তুলে দেওয়া শেষ হতেই হীরণ শ্বাস ফেলল। ঝলমলে কণ্ঠে বলল,
“দেখো তো রুবী, আর কিছু বাদ পড়ল কি-না!”

করবী বোঝাই ভর্তি গাড়িটির দিকে তাকিয়ে গভীর ধ্যানে মগ্ন হলো। আনমনে বলল, “বাদ পড়েছে তো।”

হীরণ ভ্রু কুঁচকালো, “কী বাদ পড়লো?”

“তোমাদের সকল স্মৃতি! হুতুমের আধো কথা, বিন্দুর বোকামো ভালোবাসা, আমেনা খালার শুটকি ভর্তার গল্প! সব তো বাদ পড়েই গেলো। যেগুলো মহা মূল্যবান সেগুলোই বাদ পড়ল। নিতে আর পারলাম কই?”

হীরণ এহেন উত্তর আশা না করলেও কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না বরং মলিন হাসল, “স্মৃতি নিতে হয় হৃদয়ে করে। তোমার ট্রাকে তো মূল্যবান জিনিসের জায়গা হবে না।”

“স্মৃতির সাথে জড়িয়ে থাকা মানুষ গুলোকে নিতে পারলে ভালো হতো! কেন যে কেবল স্মৃতি নেওয়ারই সাধ্য মানুষের! স্মৃতির সাথে জড়িয়ে থাকা সবকিছুকে কেন যে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা নেই আমাদের!”

“তোমার মুখে আফসোস ভালো লাগছে না, রুবী।”

হীরণের সহজ সরল অভিযোগে করবী হাসল। মাথা নাড়াল, “আচ্ছা, অভিযোগ করলাম না। তা আমাদের বিন্দু কই? সে আপারে বিদায় দিবে না?”

করবী প্রশ্ন করতে দেরি অথচ ধুপধাপ শব্দ করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেরি হলো না বিন্দুর। হাতে তার বড়ো এতটা টিফিনবক্স। শ্বাস ওঠা-নামা করছে দ্রুত। নেমেই সে ঘনঘন শ্বাস নিল। করবীর দিকে টিফিনবক্সটা এগিয়ে দিয়ে বলল,
“নেও আপা, এদিকে তোমাগো খাওন দিয়া দিছি। গিয়া জিনিসপত্র কহন গুছাইবা, রানবাই বা কহন! এইজন্য একটু খাওন দিয়া দিছি। চাচা তো এত বেলা অব্দি না খাইয়া থাকতে পারবো না।”

বিন্দুর ঝঞ্জাটহীন এই ভালোবাসার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকাল করবী, “এসব তোকে কে করতে বলছে? শুধু শুধু কষ্ট করলি।”

“কিয়ের কষ্ট, আপা? তোমারে ছাইড়্যা থাকার কষ্ট থেইক্যা, এই কষ্ট কমই।”

এবার মেয়েটাকে নিঃসংকোচে জড়িয়ে ধরল করবী। ইশ্, এই মানুষ গুলোরে ছেড়ে সে থাকবে কীভাবে? এত ভালোবাসা আদৌ ছাড়া যায়? করবীর দিন যে ভীষণ পানসে হয়ে যাবে ওদের ছাড়া!

“বাণীর মা, তুমি কান্দো ক্যান? তুমিও কী বিন্দুবালা হইয়া গেলা?”

হুতুমের কথায় পরিস্থিতি গম্ভীর থেকে কোমল হলো। করবী এবার বিন্দুকে রেখে হাঁটু মুড়ে বসে জাপ্টে ধরল হুতুমকে। বাচ্চাটা যখন এলো তখন কত বয়স ছিল, এক-দুই মাস! নীলাভ চোখ গুলো, বাদামী চুল গুলোর এই পুতুল বাচ্চাটি ছিল করবীর জীবনের প্রথম প্রেম, প্রথম মুগ্ধতা। মনে হলো যেন সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য দেখেছিল সেদিন। বিন্দুরই-বা বয়স কত ছিল? তোরো-চৌদ্দের সদ্য কিশোরী! নারকেল তেল দিয়ে লেপটানো বেণী মাথায় কালো মিচ নিচে একটি মেয়ে হলুদ জামা পরনে। সে মেয়েটি ছিল করবীর জীবনের দ্বিতীয় প্রেম। প্রেম কী কেবল নারী-পুরুষে হয়? মোটেও না। প্রেমের আভিধানিক অর্থ ভিন্ন। আমরা প্রচলিত যেমর ভাবি তেমন নয়। আবেগ, অনুরাগ, আকর্ষণ, মমতা যার প্রতি জন্মায় সেই আমাদের প্রেম। করবীর জীবনের এই দু’টো প্রেমকে ছেড়ে যেতে হচ্ছে বলো করবীর ভীষণ আফসোস হচ্ছে।

করবীকে চুপ থাকতে দেখে হুতুমই এগিয়ে এলো। দু-হাত বাড়িয়ে বলল, “বিন্দুবালার মতন আমারে আদর করবা না, বাণীর মা?”

এত নিপাট আবেদনের পরে বোধহয় কেউই থেমে থাকতে পারে না। করবীও পারেনি। কেঁদে দিল নিঃশব্দে। হুতুমকে জড়িয়ে বলল,
“তোমার কথা না শুনে আমি কেমন করে থাকব? আমার যে বড়ো কষ্ট হবে।”

“আমারও তো কষ্ট হইবো, বাণীর মা। তুমি ছাইড়া যাইতাছো বইল্যা আমার বুকে না অনেক ব্যাথা হইতাছে। বিন্দুবালার মা ছাইড়া গেছিল আর এমন ব্যাথা হইছিল। বাণীর মা, এমন কইরা তোমরা সবাই কেন আমাগোরে ছাইড়া যাও? আমার নাহয় বিন্দুবালা আছে কিন্তু বিন্দুবালার তো কেউ নাই। ও ক্যামন কইরা একলা থাকবো কও তো?”

এবার সশব্দে ফুপিয়ে উঠল বিন্দু। হীরণ ঘুরে গেলে উল্টে পিঠে। হয়তো কান্না লুকানোর চেষ্টা! বিদায় ক্ষণের বিষাদ গাঢ় হলো। ছেড়ে যেতেই যে হবে, কেবল কেঁদেকেটে বেলা বাড়ল। বাণী তার খাঁচায় ঘুমিয়ে ছিল। আজ বাণীটা কথা বলেনি মোটেও। বোধহয় অবুঝ প্রাণীর মনেও বিচ্ছেদ ব্যাথা বিষের কাঁটার মতন বিঁধেছিল। বিদায়ের শেষ পর্যায়ে বাণী কথা বলল, “অ স ভ্য হীরণ, অ স ভ্য বিন্দু, ভালোবাসি ভালোবাসি।”

ছাড়া-ছাড়া বাক্য অথচ ভালোবাসার গাঢ়তম। ক্রন্দনরত আবেগ আরও বাড়ল। বিন্দু খাঁচাটায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, “বাণী তোরেও আমরা ম্যালা ভালোবাসি।”

বাণী শূন্য চোখে হুতুমের দিকে তাকিয়ে রইল। হুতুমও তাকিয়ে রইল নির্নিমেষ। তাদের দু’জনের জীবনে দু’জনই বোধহয় সবচেয়ে কাছের বন্ধু। করবীর চলে যাওয়াটা কেবল সংক্ষিপ্ত চলে যাওয়াই নয় তার বিশ্লেষণে বন্ধুত্ব বিচ্ছেদ থেকে শুরু করে স্মৃতি বিচ্ছেদ সবই জড়িয়ে ছিল।

বিদায় ক্ষণ সমাপ্ত করে করবী গাড়িতে উঠে বসল আসবাবপত্রের সাথে। তার কোলে বাণীর খাঁচা। হীরণ দূরে দাঁড়িয়ে রইল অনেকক্ষণ। শেষমেশ করবী তাকে ডাকল একদম ধীরে, স্থিরে,
“হুতুমের মাস্তান, শোনো….”

হীরণের চোখ লাল। মুখে জোরপূর্বক হাসি। কাছে এসে বলল, “বলো?”

“শেষবেলায় কিছু বলতে চাও না?”

“আমি একবারে শেষেই নাহয় বলব, রুবী। এখনো তো তোমার বলা বাকি।”

করবী চমকালো হীরণের মনের কথা বুঝে ফেলার চতুরতায়। হতবিহ্বল ভাবে জিজ্ঞেস করল, “আমার কী বলা বাকি?”

“যা বলতে ডাকলে।”

করবী অবাক হলো। হীরণ যে প্রচুর বুদ্ধিমান ছেলে তা সে জানতো কিন্তু এতটা বুদ্ধিমান জানা ছিল না। করবী হতাশ শ্বাস ফেলল, “বিন্দু আর হুতুমের খেয়াল রেখো। আমি বন্ধু হিসেবে তোমাকে এই দায়িত্ব দিয়ে গেলাম।”

“রাখব।”

“বিন্দু যখন এই জায়গায় এলো, আজ থেকে চার সাড়ে চার বছর আগে, তখন মেয়েটা অবুঝ। সেই অবুঝ কালের ভালোবাসা তুমি। আমি জানিনা তুমি তাকে কখনো ভালোবাসবে কি-না তবে এতটুকু জেনো, বিন্দুর জীবন অনেক কঠিন। সেই কঠিন জীবনে বহু বছরের ভালোবাসা তুমি।”

“তবে আমার ভালোবাসার চেয়ে বেশি বয়স না ওর ভালোবাসার। তাই না বলো, রুবী? তবুও দুঃখ! আমার জীবন কঠিন নয় বলে কেউ বুঝল না!”
শেষ কথাটুকু হীরণ ঠাট্টার ভঙ্গিতেই বলল। বলে হাসলোও। তবে হাসল না করবী। বরং মুখ-চোখ অসহায় করে বলল,
“তোমার জীবনও কষ্টের, আমি জানি। রুবী পাষাণ তবে অবুঝ নয়। আমি এটাও জানি, হুতুমের মাস্তান চিরজীবন ভালোবাসা খুঁজে গেছে নানান দরজায়। কিন্তু সৎ মা থেকে শুরু করে নিজের বাবা, কেউ-ই তাকে ভালোবাসেনি। মাঝবেলাতে এসে পাষণ্ড রুবীও ভালোবাসেনি। তাই তো আমি মাস্তানকে ভালোবাসায় ভরপুর একটা মেয়ের কাছে দিয়ে যাচ্ছি। আমার বিন্দু কিন্তু ভীষণ ভালোবাসতে জানে। ভালোবাসা না পাওয়ার যে আফসোস তা তোমার ঘুচে যাবে দেখো। ঘুচে যাবে।”

“কিছু আফসোস থাকুক রুবী। আফসোস না থাকলে যে আমার রুবীকে আমি ভুলে যাব। আমি চাই না, আমার জীবনে আসা এই উত্তম নারীকে আমি ভুলে যাই। রুবী, ভালো থেকো। ভালো থেকো ফুল, মিষ্টি বকুল, ভালো থেকো।”

গাড়ি তার বিদায় ধ্বনি জানিয়ে যাত্রা শুরু করল। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল বিন্দু যেন কেঁদেকেটেই আটকবে দিবে প্রিয় মানুষের বিদায়। হুতুম হীরণের পেটে মুখ গুঁজে কাঁদছে। করবী জড়িয়ে ধরল বাণীর খাঁচাটা। ভেতরটা তার ফেঁটে যাচ্ছে। ঠোঁটে হাসি অথচ মলিন মুখ ভেসে যাচ্ছে বিষাদ অশ্রুতে। বিন্দুর কান্নার দাপট কমাতে হীরণ ওর এক বাহু জড়িয়ে ধরল। করবী যেতে-যেতে সবটুকুই দেখল। খুব নীরবে। খুব একা। অথচ তার চোখ বলে গেল, আঁধারে ফোঁটতে চাওয়া এক প্রেমের ফুল অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেল। কারণ কখনো কখনো একটি অঙ্কুল বিনষ্ট হওয়ার ফলে কয়েকটি ফুল সজীব থাকে। করবী হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাল। বিড়বিড় করে বলল,
“কাঁদিস না বিন্দু, এবার তোর সত্যি সত্যি একটা সংসার হবে। দারুণ সংসার। আমি না-হয় কোথাও পচেগলে বেঁচে থাকব কেবল বাঁচতে হবে বলেই।”

#চলবে

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: উনিশ

কলমে: মম সাহা

(৩০)

বাড়ির নাম— উদাস ভিলা। যেখানে এসে ওঠেছে করবীরা। করবী বুঝে পাচ্ছে না কেন বাড়িটির এমন নামকরণ করা হয়েছে। সাদা ঝকঝকে, ফকফকে পরিস্কার বাড়িটিকে তার কোনো দিক থেকে উদাস মনে হচ্ছে না। বরং হাস্যোজ্জ্বল একটি বাড়ি মনে হচ্ছে। বুকটাও শান্তিতে ভোরে গেছে রুম গুলো দেখে। কী সুন্দর! কী মনোমুগ্ধকর! ওরা আগে যে বাড়িটিতে ছিল, সে-ই বাড়িটির কোণায় কোণায় ফ্যাকাসে দারিদ্রতার চিহ্ন ছিল। অথচ এ বাড়িটা ভিন্ন। অন্যরকম।
করবীরা এখানে আসতেই সব জিনিসপত্র নামানো থেকে শুরু করে গোছগাছ করার দায়িত্ব পালন করেছে তিমির তাও পাঁকা হাতে। কোথায় কোন আসবাবটা রাখা হবে, কীভাবে রাখলে সুন্দর হবে….. এ সবকিছু দায়িত্ব নিয়ে করেছে সে। যদিও করবী বাঁধ সেধেছে কিন্তু লোকটা শুনেনি। কী সুন্দর সবটা গুছাতে সাহায্য করল! তৈয়ব হোসেন মেয়েকে তন্মধ্যে একবার আড়ালে ডেকেছিলেন। বলেছিলেন,
“মা, এত বড়ো বাড়ির ছেলে উনি, উনি বোধহয় এসব এর আগে কখনো করেননি। উনাকে না করে দে এসব করতে। তাছাড়া আমাদের আসবাবপত্রেরও যে করুণ অবস্থা। তোর নিশ্চয় তার সামনে এসব দেখাতে লজ্জা লাগছে?”

করবীকে চিনতে বাবার ভুল হয়েছে বলে করবী হাসল। বেশ অকপটে উত্তর দিল,
“লজ্জা কেন করবে, আব্বু? ভাঙ্গা হোক, নষ্ট হোক, এই জিনিস গুলো কিনতে আমাদের তো কম পরিশ্রম করতে হয়নি! অনেক পরিশ্রম করার পরেই কিনতে পেরেছি। আমাদের যেমন সামর্থ্য তেমন করেছি। কে কী ভাবল তাতে কী আসে যায়? এগুলো তো চুরির জিনিস নয়, পরিশ্রমের।”

মেয়ের এমন চোখ ঝলমলে করা উত্তরে বাবার বুক গর্বে ভোরে উঠেছিল। ক’জন মানুষ নিজের অবস্থানে সুখী হতে পারে?

তিমিরের আগে-পিছে করবীও কাজ এগিয়ে দিচ্ছে। তিমির করবীর পড়ার টেবিলটা ঠিক করছিল। টেবিলের একটা পা বাঁকা হয়ে হেলে যায় বিধায় সে সেটা ঠিক করছে ব্যস্ত হাতে। করবী তার জন্য এক কাপ চা নিয়ে এলো। ঘর্মাক্ত, ব্যস্ত তিমিরের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“চা-টা নিন।”

তিমির ভ্রু কুঁচকে ছিল তখনো। হাতুড়িটা পাশে রেখে চা নিল। এক চুমুক দিতেই তার চোখে-মুখে তৃপ্তি ছড়িয়ে পড়ল। প্রশংসা করে উঠল সে, “এত ভালো চা বানাতে পারো!”

করবী জেসে ঘাড় কাঁত করল। ঠোঁট উল্টে বলল, “ভালো পারি কি-না জানিনা, তবে পারি।”

“কেবল ভালো না, অসাধারণ পারো। ধন্যবাদ।”

তিমির কথা শেষ করার আগেই হাতুড়ি উঠল করবীর হাতে। বিজ্ঞ হাতে শুরু হলো খুটখাট। তিমির নিষেধ করল,
“আহা! ধরছো কেন? পারবে না।”

“গত তিন বছর যাবত এই টেবিলের হেলিয়ে যাওয়া আমিই আটকাচ্ছি। আর আপনি কি-না বলেন পারব না? এই হাত কিন্তু সব পারে।”

করবীে কথায় তীব্র আত্মবিশ্বাস। তিমির তবুও হাতুড়িটা টেনে নিল,
“এই হাত সব পারে তা জানি। তবে আমি চাই এখন থেকে এই হাত ততটুকুই পারুক যতটুকু কোমল। কঠিনটুকু না-হয় আমার জন্য রইল!”

“দায়িত্ব নিয়েন না, কঠিন গুলো কিন্তু বেশিই কঠিন। হাতুড়ি চালানোর চেয়েও বেশি। পারবেন তো?”

তিমির চা খেতে-খেতেই জবাব দিল, “সেটা নাহয় সময় বলুক।” তিমিরের চোখ স্থির হয় তখন করবীর ডান গালের পাশে তিলটায়। আপাদমস্তক সুন্দর একটি মেয়েকে অসম্ভব সুন্দর করতে ভুলভাল জায়গায় বোধহয় এমন কালো মিচমিচে তিল থাকলেই হয়। করবীর এই পলকহীন দৃষ্টিতে অস্বস্তি হচ্ছিল। তাই সে প্রসঙ্গ পাল্টাতে বলল, “বাড়িটির নাম উদাস ভিলা কেন?”

“হয়তো বাড়ির মালিক কখনো বুঝতে পারেননি তার বাড়িতে এমন এক চঞ্চল নারী এসে বাড়িটিকে ধন্য করে দিবে, তাই।”

তিমির কণ্ঠে ঠাট্টার রেষ। করবী আড়চোখে তাকিয়ে হেসে দিল তাই। হাসি মিলিয়ে হাসল তিমিরও। সেই হাসি ছুঁয়ে দিল প্রকৃতিকে। তাই মেঘমুক্ত আকাশেও দেখা দিল হঠাৎ বাতাসের।

“মজা করছেন?”

“তোমার কী সত্যি মনে হলো আমার কথাটা?”

“না, তা কেন হবে?”

“তাহলে আবার জিজ্ঞেস করছ কেন মজা করছি কি-না?”

তিমিরের কথার মারপ্যাঁচে করবী ভ্যাবাচেকা খেল। আঁখি দু’টো হিমশিম খেল বিপরীত দিকের আঁখিদুটিতে তাকাতে। তিমিরের হাসির কণ্ঠ ততক্ষণে চাঙ্গা হয়ে গিয়েছে। হাসির শব্দ ছুঁচ্ছে যেন সিলিং। করবী মুখ ভেংচালো। উঠে যেতে নিলেই তার নরম হাতটি মুঠোতে নিয়ে থামিয়ে দিল তিমির। খালি চায়ের কাপটা ধরিয়ে দিয়ে বলল,
“উদাস ভিলার মালিক হয়তো উদাস ভীষণ। নয়তো বাড়িটি যখন করে ছিলেন তখন হয়তো তার জীবনে উদাস বাতাস বইছিলেন, তাই বাড়ির নাম সেই বাতাসের তালেই রেখে ফেলেছেন। আ’ম নট সিউর। কোনো একদিন নাহয় তুমিই জিজ্ঞেস করে নিও উনাকে।”

করবী সম্মতি দিল। চায়ের কাপ নিয়ে যেতে-যেতে বলল,”টেবিল পরে ঠিক করবেন। এখন হাত-মুখ ধুয়ে আসেন। দুপুর গড়িয়ে গেল যে! খেতে আসুন।”

তিমির তুমুল শব্দে টেবিলে হাতুড়ি চালিয়ে বলল, “মনে হচ্ছে কেন বউ ডাকছে?”

করবী কী শুনল? নাকি শুনল না তা সে মুখ ঘুরিয়ে দেখেরও প্রয়োজন বোধ করল না।

ক্লান্ত, রৌদ্রদগ্ধ একটি আকাশ মাথার উপর ঝিমিয়ে এসেছে। সারাটাদিন তার চলে গেল ভার্সিটি, টিউশন সামলিয়ে। মাস্টার্স ফাইনাল চলছে। পড়াশোনার চাপও যাচ্ছে ভীষণ। টিউশনি বাসা থেকে বের হতেই তার পেট ডেকে উঠল, জানান দিল তীব্র ক্ষুধার। করবী পেটে হাত দিয়ে ঘড়ির দিকে চাইল। সময় সাগড়ে পাঁচটা। আরও একটা টিউশনি নিয়েছে সে। দু’দিন হলো। এখন সে বাসাতেই যেতে হবে। এদিকে খিদেও লেগেছে ভীষণ। নেতিয়ে আসা শরীরটা টেনে সে ঢুকল নতুন টিউশনির বাসায়। ক্লাস নাইনের একটি মেয়েকে পড়ানো শুরু করেছে। মেয়েটির ছোটো পরিবার। মা, বাবা আর ও। মা, বাবা দু’জনেই থাকেন অফিসে। করবীর সাথে কেবল প্রথম দিন ভদ্রমহিলার ফোনে কথা হয়েছে। ব্যস্ত থাকেন ভীষণ। মেয়েটি চুপচাপ স্বভাবের। করবী ঢুকে টেবিলে বসতেই মেয়েটি ওঠে গেল। ছুটে গিয়ে এক গ্লাস পানি এবং একটা ট্রে-তে করে বিস্কুট নিয়ে এলো। সেগুলো করবীর সামনে রাখতেই করবী চমকালো। অবাক হয়ে বলল,
“এগুলো….!”

“ভাবি বলল গতকাল, টিচার আসলে নাকি টিচারকে পানি দিতে হয়। আর খালি পানি দিতে নেই তাই বিস্কুট দিলাম। খেয়ে নিন, মেম।”

করবী বিস্মিত হলো, “ভাবি! কে?”

“পাশের ফ্লাটের ভাবি।ঐ যে যাদের দরজা খোলা দেখেন। সেই ফ্লাটেরই তুষার ভাইয়ার বউ। ভাবির সাথে বেশির ভাগ সময় আমি কথা বলি, আড্ডা দিই।”

করবী আর কিছু না বলেই পানিটা খেল। আস্তে-ধীরে বিস্কুটও খেল। তন্মধ্যেই ড্রয়িং রুমে কেউ একজন প্রবেশ করলেন। যেহেতু ফ্লাটের দরজা খোলাই ছিল। এসেই ঝলমলে কণ্ঠে বললেন,
“আপনিই বুঝি ঘুড়ির নতুন টিচার? ঘুড়ি তো দু’দিনেই টিচারের ভক্ত হয়ে গিয়েছে। তাই পরিচিত হতে এলাম।”

অপরিচিত নারী কণ্ঠ পেতেই করবী ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাল। চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে বলল, “আপনিই কী ঘুড়ির ভাবি?”

করবীর প্রশ্ন করতে দেরি অথচ ঘুড়ির ভাবির হাস্যোজ্জ্বল মুখ ফ্যাকাসে হতে দেরি হলো না। মেয়েটার হাত কাঁপছে যার দরুন হাতে থাকা ট্রে এবং ট্রে-এর সামগ্রীও কাঁপছে। মেয়েটির আকস্মিক পরিবর্তনে ভড়কে গেল করবী। ঘুড়িও ছুটে এলো। ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,
“কী হলো! কী হলো!”

তখনও ভাবি দরদর করে ঘামছে। অস্ফুটস্বরে করবীর দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি, আপনি আশা…..”

করবী অকপটে তার পরিচয় দিল, “আমি রক্তকরবী। কেন? কী হয়েছে?”

ঘুড়ির ভাবি দ্রুত সোফায় বসল। ট্রে-টা রাখল সোফার সামনের সেন্টার টেবিলটায়। শাড়ির আঁচলে মুছল মুখ। কম্পনরত কণ্ঠে বলল, “সরি, সরি, আমি ঘুড়ির ভাবি— বিদিশা। পাশের ফ্লাটেই থাকি।”

#চলবে

বুকপকেটের বিরহিণী পর্ব-১৬+১৭

0

#বুকপকেটের_বিরহিণী
ষোলো পর্ব:
কলমে: মম সাহা

(২৫)
গোধূলি নেমেছে অম্বরের বুকে। কমলা রঙের গোধূলি। ঝকঝকে আকাশ, স্নিগ্ধ বাতাসে ভরপুর চারপাশটা। করবী, বিন্দু, হুতুম, হীরণ, করবীর বাবা, বাণী সকলে মিলেই এসেছে নদীর ধারে ঘুরতে। নদীর অপর পাশে একটি পরিত্যক্ত ব্রীজ আছে যেখানে সন্ধ্যে হলেই রঙবেরঙের আলো জ্বলে উঠে। আড্ডা বসে আনন্দের।
তৈয়ব হোসেন বসলেন নদীর ধারে। বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে তার সমস্যা হয় কি-না! এলাকার আরেকজন মুরব্বি বন্ধু পেতেই তার গল্প জমে উঠলো। করবী বাকিদের নিয়ে উঠল ব্রীজে। বিন্দুর পরনে শাড়ি। নীল রঙের শাড়ি। হালকা নীলে মেয়েটার কৃষ্ণাঙ্গ ঝলমল করে উঠছে যেন। বিন্দুর গোপনে এমন রূপ আছে তা কখনো তার সাদামাটা আস্তরণের ভেতরে থেকে বুঝা যায়নি।

ব্রীজে উঠতে পেরেই যেন আনন্দের সীমা রইল না হুতুম, বাণীর। বিন্দুর ভেতর থেকে উদাসীনতা তখনও কাটেনি। হীরণের পড়নে সেই চিরায়ত পোশাক বুকখোলা কালো শার্ট, তার ভেতরে সাদা টিশার্ট, জিন্স। সুন্দর চুলগুলো এলোমেলো। সকল নীরবতা ভেদ করে হীরণ বলল,
“আইসক্রিম খাবি, বিন্দু?”

বিন্দু চমকালো বোধহয়। বলল, “আমারে কইলা?”

“এখানে তুই ছাড়া আর কারো নাম বিন্দু বুঝি? জানতাম না তো!”

করবীও অবাক হলো। সে কখনো হীরণকে এতটা ভালো ভাবে কথা বলতে দেখেনি বিন্দুর সাথে। হীরণ বিন্দুর বিস্মিত চোখ গুলোর দিকে তাকিয়ে হাসল খানিক। হীরণ সচারাচর হাসেও না।
“আইসক্রিম খাবি কি-না, সেটা ভাবতেই তোর এতক্ষণ লাগে?”

বিন্দুর উদাস বিকেল মুহূর্তেই সুন্দর হয়ে গেল। সে বিস্ময় হেসে বলল, “খামু।”

হীরণ হাসল। ছেলেটার চেখে পাপড়ি গুলো ভীষণ ঘন। দেখতে কী সুন্দর লাগে! করবী কখনো দেখেইনি ছেলেটাকে। আজ দেখেছে আর অবাক হচ্ছে। ছেলেটার বখাটেপনার আড়ালেও সুন্দর একটা হীরণ বাস করে। যা কখনোই দেখার সৌভাগ্য হয়নি।
“তোমরা দাঁড়াও, আমি নিয়ে আসছি।”

বিন্দু ঘাড় কাঁত করলেও করবী বাঁধ সাধলো,
“চলুন, আমিও যাই।”

হীরণ অবাক হলো না। কেবল সম্মতি দিয়েই ব্রীজের বিপরীত পাশে চলে গেল। পেছনে গেল করবীও।

হীরণ আইসক্রিম নিতে-নিতে করবীর উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
“কী বলবে, বলো? নিশ্চয় কিছু বলার জন্যই আমার সাথে এসেছো। এতটুকু তোমাকে আমি চিনেছি।”

হীরণের আজকের আচরণ অবাকের উপর অবাক করল করবীকে। সে কিছুটা অপ্রস্তুত হলো। কিন্তু সেকেন্ডেই সামলে নিল আবার। গলা পরিষ্কার করে বলল,
“ধন্যবা…..”

কথা সম্পূর্ণ করতে দিল না হীরণ। হাত দেখিয়ে থামিয়ে দিল করবীকে। টাকা দোকানদারকে পরিশোধ করে অতঃপর পূর্ণ দৃষ্টিতে চাইল করবীর পানে,
“তোমার মনে হচ্ছে, আমি বিন্দুর সাথে এত আন্তরিকতা দেখাচ্ছি তুমি চেয়েছ বলে? উহু, মোটেও নয়। আমি বিন্দুকে বিন্দুর জন্যই পছন্দ করি। বিন্দুর সাথে আমার এই আন্তরিকতা কেবল বিন্দুর হাসির জন্যই। তোমার কথা রাখতে, কিংবা তোমার কথার জন্য না। আমি এতটাও হৃদয়হীন না যে একটা সদ্য মা-হারা মেয়ের সাথে কঠিন ব্যবহার করব। তবে রুবী, তোমাকে একটা কথা বলি…. আমার ভালোবাসার বিনিময়ে তুমি যে শর্তারোপ করেছ তা আমার ভালোবাসার জন্য অপমানের। আর যে আমার ভালোবাসাকে অপমান করেছে, তাকে আমি ঠিক ভুলে যাব একদিন। মিলিয়ে নিও, রুবী। একদিন তোমাকে ভুলে গিয়ে আমি পৃথিবী থেকে একরাশ দুঃখ ছিঁড়ে ফেলে দিব।”

করবী নিখাদ হাসল, “আমিন।”

হীরণ আহত হলো। তারপর গটগট করে চলে গেল ব্রীজের ওপাশে। করবী হাসল। হাসির অন্তরালে বেরিয়ে এলো দীর্ঘ এক শ্বাস। ব্রীজের ওপাশের দৃশ্যপটে তখন মুগ্ধতা ঝরছে। বিন্দু হাসছে। হুতুমকে কোলে নিয়ে গালে চুমু খাচ্ছে হীরণ। করবী সেদিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে থেকে আনমনে বলল,
“কোন জায়গায় আঘাত করলে মানুষকে দুর্বল করা যায় তা আমার জানা আছে, হীরণ। আর আমি সক্ষম। প্রত্যক্ষ ভাবে না হোক, পরোক্ষ ভাবেই আপনাকে আমি বুঝাবো বিন্দুর ভালোবাসা কতটা সুন্দর। যেমন সুন্দর এই আকাশ, মাটি, ঠিক ততটাই সুন্দর। আমি ক্ষত করার পর যখন বিন্দু প্রলেপ লাগাতে আসবে তখনই আপনি বুঝবেন, প্রলেপ লাগানো মানুষকেই জীবনে রাখা উত্তম সিদ্ধান্ত।”

করবীর ভাবনার মাঝে বিন্দুর ডাক এলো, “আপা, এইহানে আসো।”

হীরণ আবার সাথে-সাথে বিন্দুকে শাসন করল,
“তোরে বলছি না এমনে কথা বলবি না? হুতুমটাও তো এগুলো শিখবো।”

হীরণের মিষ্টি শাসনে জিভে কামড় দিল বিন্দু। বোকা বোকা হেসে বলল,
“তুমি আছো না, তুমি ওরে ঠিকটা শিখাইবা।”

মুহূর্ত আরও রঙিন হয়ে গেল। উদাস বিকেল প্রেমময় হয়ে গেল। বিন্দুর ব্যাথা কমে গেলো যেন অনেকটাই।

(২৬)

তিমির দাঁড়িয়ে আছে পথের ধারে। ঘড়ির কাটায় অপেক্ষার সেকেন্ড পেরুচ্ছে খুব দ্রুত। তিমিরের সীমাহীন অপেক্ষাকে মুক্তি দিয়ে করবী বেরুল টিউশনের বাসা থেকে। তিমিরকে দেখে হাসল গাল ভোরে। দুপুরের রোদ তখন পাংশুটে গরমে নাজেহাল করছে চারপাশ। সেই গরমে করবীর মনে তিমিরের মুখ যেন একরাশ শীতের আকাশ হয়ে এলো।
করবী এগিয়ে এলো। কণ্ঠে খুশি, “এখানে যে?”
তিমির পাঞ্জাবীর হাতা গুটালো। সিল্কি চুল গুলো পেছন দিকে ঠেলে বলল,
“সত্যি বলব না মিথ্যে?”
করবী হাসল, “যা বলে খুশি হন।”
“তাহলে সহজ সরল স্বীকারোক্তি দিলাম— তোমার অপেক্ষায় এই পথ চেয়ে ছিলাম।”

তিমিরের ছন্দে খিলখিল করে হাসল করবী। মুগ্ধতা ঝরে পড়ল টুপ করে গ্রীষ্মের আবহাওয়া জুড়ে।
“আমার অপেক্ষা?”

“হ্যাঁ, তাই তো বলল মন।”

“মনকে বারণ করতে পারেননি? এত অপেক্ষা কিন্তু ভালো নয়।”

“টুকটাক খারাপ হোক। শেষপাতে তোমার একবাটি হাসি পেলেই আমার তেতো অপেক্ষার শান্তি হবে।”

“একবাটি হাসি!” করবীর অবাক কণ্ঠ। ভ্রূদ্বয় কুঁচকেছে।
তিমির স্বাভাবিক স্বরে উত্তর দিল, “তুমি তো মেপে হাসো তাই একবাটিই বললাম। তাছাড়া সেদিন যে রূপ দেখিয়ে ছিলে! আমি বাবা এক বাটির বেশি চাওয়ার সাহস করতে পারছি না।”

তিমিরের কথায় মলিন হয়ে এলো করবীর মুখ-চোখ। সেদিনের আচরণের কথা চিন্তা করে লজ্জিতও হলো বেশ ভালো রকমে। একজনের রাগ আরেক জনকে দেখানো মোটেও সুন্দর কাজ না। করবীর দৃষ্টি নত হলো,
“সেদিন ব্যাক্তিগত কারণে কিছুটা ডিস্টার্ব ছিলাম।”

“সেটা তো সেদিনই চলে গিয়েছে। তাই বলে আজ হাসবে না আর?”

তিমিরের কথার ধরণের করবী না হেসে পারল না। তিমির তখন পকেট থেকে একটি কালো গোলাপ বের করল। করবীর দিকে এগিয়ে দিল নিঃসংকোচে,
“এটা কী নিবে একটু?”

“কোথায় পেলেন?”

“এইতো, সামনের একটি ডালে ঝুলে ছিল। ভাবলাম নিয়ে আসি।”

“গোলাপ ফুলের গাছ আছে এখানে?” করবীর নিষ্পাপ প্রশ্নে এবার তিমির শব্দ করে না হেসে পারল না। ততক্ষণে তার ঠাট্টাও বুঝে ফেলল করবী। দৃষ্টি লুকালো তাই তৎক্ষণাৎ। চোখ ঘুরিয়ে পথে তাকিয়ে মিনমিন করে বলল, “মজা করলেন!”

“না তো! পুরোপুরি ব্যাপারটা আসলে মজা না। কিছুটা সত্যিও। আজকাল পথের মাঝে তো গোলাপ পাওয়া যাচ্ছে। জানো না?”

করবী ঠোঁট উল্টে বলে, “না তো!”

“তা-ও অবশ্য ঠিক, তোমার না জানারই কথা। গোলাপ কী আর জানবে, তাকে যে পথের মাঝে সবচেয়ে সুন্দর ফুলটিই লাগে।”

আবারও তিমিরের বেসামাল ঠাট্টায় লজ্জায় লাল হলো করবী। লজ্জা লুকাতে দ্রুত পায়ে হাঁটা শুরু করল। থেমে নেই তিমিরও। বেসামাল ঠাট্টায় উত্তপ্ত দুপুর সে করে ফেলল মুগ্ধ প্রহর।

প্রতি রাতের মতনই আজ রাতেও করবীর ঘুম ভেঙে গেল। বিদ্যুৎ নেই এলাকায়। চারপাশ গাঢ় অন্ধকারে নিমজ্জিত। ঘুম থেকে উঠেই নিজেকে সে আবিষ্কার করল বারান্দায় থাকা চেয়ারটাতে। ঘাড় কাঁত করে ঘুমানোর ফলে ঘাড়ে বেশ ব্যাথাও অনুভব করল। রাতের সময়টা ঠিক কয়টায় ঘুরছে ঠাহর করতে পারল না সে। প্রায় রাতেই তার ঘুম ভেঙে যায়। কেমন অদ্ভুত অদ্ভুত স্বপ্ন দেখে। কিছু স্বপ্নে সে মা’কে দেখে। মায়ের চেহারা তার মনে নেই তাই স্বপ্নেও সেই মুখ অস্বচ্ছ। সে দেখে মা তাকে নিয়ে কোথাও একটা ঘুরতে যাচ্ছে, রাস্তায় সে পড়ে গেছে। তারপর যার হাত ধরে উঠে, সেই মানুষটা হয় বাবা। স্বপ্নের এই চরিত্র বদলের অর্থ বোধগম্য হয় না তার। মায়ের কথা মনে করার মতন তেমন জাঁকজমকপূর্ণ কোনো স্মৃতিও নেই জমা। এমনও না যে সারাদিন সে খুব মায়ের কথা ভাবে। তাহলে কেন এত পীড়াপীড়ি স্বপ্নে? উত্তর খুঁজে পায় না মেয়েটা।
হাত-পা ঝারা দিয়ে সে ওঠে দাঁড়াল। আড়মোড়া ভেঙে পা বাড়াল বাবার ঘরের দিকে। বাবা ঘুমিয়েছে কি-না দেখার জন্য। কিন্তু বাবার ঘরের সামনে গিয়েই পা থেমে গেল করবীর। বাবার ঘরের দরজা ভিজিয়ে রাখা। হালকা হলদেটে আলোর প্রতিবিম্ব ভেসে আসছে। করবী পায়ের গতি আরেকটু স্থির করল। ধীরে-ধীরে ভিজিয়ে রাখা দরজার ফাঁক গলিয়ে মাথা ঢুকাল। কিঞ্চিৎ অবাক হলো ভেতরের ঘটনা দেখে। তৈয়ব হোসেন খাটে বসে আছেন। হারিকেনের খুব ঢিমে আলোতে কিছু লিখছেন মনযোগ সহাকারে। লিখার মাঝে আবার চোখও মুছছেন। বাবা কি কাঁদছেন?

করবীর চিন্তা হলো খুব। একবার রুমে ঢুকতে নিয়েও কিছু একটা ভেবে আর ঢুকল না সে। তৈয়ব হোসেনের সব ধ্যান যেন সেই লিখাতে। করবীও ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল শেষটুকু দেখার জন্য। বেশ অনেকটা সময় পর তৈয়ব হোসেনের লিখা শেষ হলো। অতঃপর সেই লিখার কাগজটা যত্ন করে ভাঁজ করে ঢুকিয়ে নিলেন ফতুয়ার বুকপকেটে। তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে ঢুকরে কেঁদে উঠে বললেন,
“তুমি আর ক’টা দিন থেকে গেলেও পারতে, সাহেবা।”

করবীর চোখও ভিজে উঠল। বাবা মা’কে চিঠি লিখছেন? মৃত মানুষকে কী চিঠি লিখা যায়? আচ্ছা! বাবাকে তো তার কখনোই জিজ্ঞেস করা হয়নি মা আদৌ মৃত কি-না জীবিত? কী অদ্ভুত! সে কখনো মায়ের কথা আবদার করে জানতে চায়নি কেন?

#চলবে

#বুকপকেটের_বিরহিণী
ষোল পর্বের বর্ধিতাংশ
কলমে: মম সাহা

(২৭)

সকাল হতেই নতুন সমস্যা তার দল-বল নিয়ে আগমন ঘটালো করবীদের দরজায়। নিচ তলার মহিলা সকাল সকাল এসে জানিয়ে গেলেন বাড়িওয়ালা বলেছে এ মাসের মাঝে করবীদের ঘর খালি করতে। দীর্ঘ চার-পাঁচ মাস আগে নাকি বলেছিল করবীকে ঘর ছাড়তে কিন্তু সে ছাড়েনি। এমনকি বাড়িওয়ালার সাথে আর দেখাও করেনি। নিচ তলার ভদ্রমহিলার কাছেই এতদিন ভাড়া দিয়েছিল। আজ সে মহিলা এসেই নোটিশ জানিয়ে গেল।
এমন কিছু ঘটতে পারে তা আগেই আন্দাজ করেছিল করবী কিন্তু এখনই যে ঘটবে তা বুঝতে পারেনি। এত শর্ট নোটিশে বাসা পাওয়াটাও তো কঠিন। তার উপর তাদের যা বাজেট, সে বাজেটে আদৌ এই শহরে বাসা পাওয়া যাবে! করবীর চিন্তিত মুখের আঁধার দূর করতে এগিয়ে এলো তার বাবা। মেয়ের হাতে এক জোড়া স্বর্ণের দুল ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
“এগুলো তোর বিয়ের জন্য আমি রেখে ছিলাম, মা। অথচ মাথার ছাঁদ বাঁচানো যখন সংকটের হয়ে দাঁড়িয়েছে তখন নাহয় বিয়ের কথা পরে ভাবলাম? বিয়েই তো জীবনের সব না, তাই না?”

করবী হতবিহ্বল দৃষ্টি নিয়ে চাইল, “তুমি তো কখনো এই দুল গুলোর ব্যাপারে বলোনি!”

“বলেনি। ভেবেছিলাম আমাদের অভাবের বিশাল থাবা থেকে এগুলো বাঁচিয়ে রাখব।”

“তাহলে বাঁচিয়ে রাখো, বাবা। তুমি নিশ্চয় শখ করে রেখেছিল!”

“সন্তানের সাথে জড়িত সবকিছুই শখের হয়, মা। তবে সবচেয়ে বেশি শখের হয় বেঁচে থাকাটা। আপাতত নাহয় বেঁচে থাকাটা বাঁচালাম। কী বলিস?”

করবী হতাশ নিঃশ্বাস ফেলল। তার কাছে বর্তমানে তেমন টাকা নেই যে নতুন বাসা দেখবে। টিউশনির যা বেতন পেয়েছিল তা দিয়ে বাজার করেছে, হুতুমের শরীরটা অসুস্থ হয়েছিল তাই ডাক্তার দেখিয়েছে, ঘর ভাড়াও দিয়েছে। হাতে সামান্য আছে। যা রেখেছিল আসা-যাওয়ার ভাড়া হিসেবে। সে টাকা দিয়ে তো আর ঘর ভাড়া করা যাবে না! বেশ অসহায় হয়েই করবী দুল জোড়া নিল। হতাশ স্বরে বলল,
“তোমারে ভালো জীবন দিতে না পারার জন্য ক্ষমা করো, আব্বু।”

এতো বড়ো মেয়ের বাচ্চামিতে হাসলেন তৈয়ব হোসেন। মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“তুই-ই তো আমার জীবন, মা। এর চেয়ে ভালো জীবন তো আমার লাগবে না।”

করবী ভীষণ আবেগে বাবার পেট জড়িয়ে ধরল। বলল,
“পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর মানুষটা তুমি, আব্বু।”

_

বিন্দু বেরিয়েছে মাত্র কারখানা থেকে। বের হতে হতেই সময় ঘুরল নয়টার কাটায়। আজ আবার ধর্মঘট ছিল। রাস্তার মাঝে ঝামেলার অভাব নেই। কিন্তু তবুও জীবন বাজি রেখে আসতে হয়েছে পেটের দায়ে। কেবল সে না। তার মতন হাজার খানেক কর্মচারীই বেরিয়ে এসেছে জীবনের মায়া ত্যাগ করে।
বিন্দু রাস্তায় বেরিয়ে ফোনটা বের করল। করবী আপা তাকে নতুন ফোন দিয়েছিল আগের ফোনটা খারাপ হয়ে গিয়েছিল বলে। আম্মা আবার কল দিয়ে না পেলে চিন্তা করতেন। কিন্তু আজ তো তার হয়ে চিন্তা করার কেউ নেই! আজ হয়তো তার দেরি দেখে অনবরত কলও কেউ দিচ্ছে না! হুট করে মাথার উপরের এমন বটবৃক্ষ হারিয়ে ভীষণ ক্লান্ত লাগে এই যুদ্ধবিধ্বস্ত জীবনটিকে। তবুও তো বইতে হবে। তাছাড়া আর গতি যে নেই! আমাদের জীবনের সবচেয়ে নিদারুণ কষ্ট হলো, আমাদের মানুষ হারিয়েও বাঁচতে হয়।

বিন্দু ফোনটা অন করতেই দেখল করবীর আটটা মিসড কল উঠে আছে। এই মিসড কল গুলো দেখে আনমনেই ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল মেয়েটার। যাক, পৃথিবীতে তাকে নিয়েও চিন্তা করার মতন মানুষ আজও আছে! সে কল ব্যাক করতে নিবে তার আগেই পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে এলো,
“বিন্দুবালা, তোর এত দেরি লাগে? তুই জানছ না আমি একা থাকি? আমার ডর লাগে।”

বাচ্চা হুতুমের কণ্ঠ পেতেই চমকে উঠল বিন্দু। হতবিহ্বল হয়ে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখল একটা নীল রঙের হাঁটু সমান ফ্রক পরে, সোনালী চুল গুলো ছেড়ে হাসি-হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে বাচ্চাটা। তার পেছনেই হেলান দিয়ে আছে হীরণ ভাই। বিন্দু দ্রুত দু’কদম এগিয়ে গেল। এই শূন্য সময়টাতে হুতুমের আগমনে যেন সকল শূন্যতা কেটে গেল তার। জাপটে ধরল সে হুতুমকে,
“তুই এইহানে ক্যান এত রাইতে?”

“তুই এত দেরি করছ দেইখ্যাই তো আমারে আইতে হইলো, বিন্দুবালা। বিন্দু’র মা তো আমারে কইয়া গেছিল, তোরে যেন আমি দেইখ্যা রাখি। আমি কী হেই কথা ফালাইতে পারি?”

হুতুমের পাকা-পাকা কথায় বিন্দুর চোখের জল গড়িয়ে পড়ল। ঠোঁটে ঝুলে রইল কত যত্নের হাসি,
“পাকনা বুড়ি নাকি তুই? এট্টুক মাইয়্যা নাকি আমার যত্ন নিবো! বাপরে বাপ।”

হুতুম অসন্তুষ্ট হলো বিন্দুর হাসিতে। বিন্দুর বুক থেকে মাথা তুলে কোমড়ে দু’হাত রাখল। ঠোঁট, চোখ, মুখ ফুলিয়ে বলল,
“তুই কিন্তু আমারে অপমান করতাছোছ, বিন্দুবালা? বাণীর মা তো কয়, যত্ন নিতে বড়ো হওয়া লাগে না, ভালোবাসা থাকলেই না-কি হয়। দেহছ না? বাণীর মা ছুডু হইয়াও তার আব্বার যত্ন নেয়!”

বিন্দু চমকে তাকায়। হুতুমের চোখ-মুখের মায়ায় তাকিয়ে থাকে নির্নিমেষ। এই ছোট্টো জাদুকর তার জীবনে না এলে তার কত সুন্দর জিনিস দেখা হতো না! ভাগ্যিস হুতুম এসেছিল!

বিন্দু এবং হুতুমের কথার মাঝে বাঁধ সাধল হীরণ। বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
“তোদের মন-প্রাণের কথা শেষ হইলে চল এবার। রাত যে বাড়তাছে সেদিকে কোনো খেয়াল নাই, তাই-না?”

হীরণকে দেখে এমনেতেই বিন্দু খুশিতে আহ্লাদী হয়ে ছিল। এখন যেন কথা বলার সুযোগ পেয়ে আহ্লাদে গদোগদো হেসে দিল,
“হীরণ ভাই, তুমি হুতুমরে নিয়া আইছো!”

বিন্দুর বোকাবোকা প্রশ্নে ভ্রু কুঁচকালো হীরণ,
“না, হুতুম উইড়া উইড়া আসছে। ওর তো তোর মতন দুইডা ডানা আছে, তাই না? আহাম্মক।”

হীরণের দেওয়া ‘আহাম্মক’ সম্বোধনেও যেন বিন্দুর খুশি কমল না। বরং তা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ল,
“তুমিও তাইলে আমার কথা চিন্তা করো, হীরণ ভাই?”

হীরণ এহেন প্রশ্নে যেন থমকে গেল। উত্তম জবাবটি খুঁজতে লাগল কিন্তু পেল না। সে সত্যিই কী বিন্দুর কথা ভাবে? না, আবার হয়তো – হ্যাঁ। কিন্তু সেটা বিন্দুর প্রতি ভালোবাসা থেকে না। বিন্দুর প্রতি স্নেহ থেকে, হুতুমের প্রতি মায়া থেকে। বরাবরই এই পরিবারটিকে তার কাছে অসহায় লাগতো। আর সেই অসহায় পরিবারের খুঁটি ছিলেন আমেনা খালা। তিনি মারা যাওয়ার পর পরিবারটা যেন ছাঁদ বিহীন হয়ে গেল। রোদ, বৃষ্টি, ঝড় যেমন করে আঁকড়ে ধরে ছাঁদ বিহীন ঘরকে, তেমন করে যেন দুঃখ, কষ্ট মেয়ে গুলোকে আঁকড়ে ধরতে না পারে তাই কিছুটা ছাউনি হওয়ার চেষ্টা করছে কেবল। ছাঁদ হওয়ার ক্ষমতা তার নেই যে!
হীরণ ধ্যান ছেড়ে বেরুলো। কথা ঘুরিয়ে বলল,
“তুই আসছিলিস না বলে হুতুম, রুবীরা সবাই চিন্তা করছিল। তাই ভাবলাম এসে দেখি। তাই বইল্যা নিজেরে আবার নায়িকা ভাবা শুরু কইরা দিছ না। তোর তো আবার সবকিছুতে বাড়াবাড়ি।”

হীরণের ধমকেও হাসি কমেনি বিন্দুর। মানুষটা যে একটু ভাবছে তা-ও বা কম কীসে? ভালোবাসার মানুষটা ভালো না বাসুক, একটু চোখ তুলে তাকালেই যেন রাজ্যের শান্তি। হীরণ শব্দ করে বাইক স্টার্ট দিতেই বিন্দু ছুটে গিয়ে বসল। হুতুম বসল হীরণের সামনে। হীরণে গলা জড়িয়ে ধরে কৌতূহলী স্বরে জিজ্ঞেস করল,
“আইচ্ছা মাস্তান, আমরা যারে ভালোবাসি হেরাও তো আমাগোরে ভালোবাসে, তাই না? যেমুন, বাণীর মা আমারে ভালোবাসে আমিও তারে ভালোবাসি। বিন্দুর মা আমারে ভালোবাসে আমিও তারে ভালোবাসি। বাণীর নানাভাই আমাকে ভালোবাসে আমিও তারে ভালোবাসি। তাইলে বিন্দুবালা তোমারে একটু ভালোবাসলে তুমি রাগ করো ক্যান? বিন্দুবালা কালা বইল্যা কী তুমি তারে ভালোবাসো না?

ছোটো হুতুমের এমন বিশাল কথা কোথায় গিয়ে যেন ধাক্কা খেল। হীরণ ঠিক ঠাহর করতে পারল। মস্তিষ্কের কোণায় কোণায় যেন, লজ্জা, হতভম্বতা মিশে গিয়ে একাকার হয়ে গেলো। সত্যিই তো, সে আসলে বিন্দুকে ভালো কেন বাসতে পারে না? বিন্দুর গায়ের রঙের জন্য! না তো, তার তো এমন মানসিকতা কখনো ছিল না। তাহলে ভালোবাসতে না পারার কারণটা কী?

#চলবে?

#বুকপকেটের_বিরহিণী
মায়া পর্ব: ১৭
কলমে: মম সাহা

হীরণের চলন্ত বাইকের গতি ঘুরল। বাড়ির পথ না ধরে পথ ধরল অন্য কোথাও যাওয়ার। রাস্তাটা ঠিক চিনল না বিন্দু। চলন্ত বাইকে হীরণ ভাইয়ের শার্ট শক্ত করে ধরে রাখা বিন্দুর যখন টনক নড়ল ভিন্ন রাস্তা দেখে তখনই সে নিস্তব্ধতা ভেঙে চাপা আর্তনাদ করল,
“কই যাও হীরণ ভাই? কই যাও? এইডা তো বাড়ির রাস্তা না।”

হীরণের ধ্যান পথের দিকেই। জবাবে বলল, “তোকে ফেলে দিয়ে আসতে যাই। তুই এত জ্বালাছ। আমার আর সহ্য হয় না।”

বিন্দু আঁতকে উঠল আরও,
“তুমি সত্যিই আমারে ফালায় দিতে যাও?”

“তো! মিথ্যে করে আবার ফালানো যায় নাকি?”

হীরণের দুষ্টৃ কণ্ঠ ধরতে পারল না বিন্দু। বরং সে চোখ-মুখ শুকিয়ে ফেলল চিন্তায়। বোকা বোকা কণ্ঠে বলল,
“আমি কি তোমারে বেশি জ্বালাই?”

হীরণ জবাব দিল না বরং আড়ালে আরেকটু হাসল। বিন্দু মেয়েটা এত বোকা! তার জীবনে বোধহয় এতটা বোকা মানুষ সে কখনো দেখেনি। এই জটিল পৃথিবীতে আদৌ এত বোকা মানুষ বাঁচতে পারে? মোটেও না। এই কঠিন পৃথিবী বোকা মানুষদের জন্য জাহান্নাম। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে দেয় তাদের। তবুও, কোথাও মন বলে এই সরলতা ভীষণ স্নিগ্ধ। এই সরলতায় মন ভালো হয়ে যায় টুপ করে।

বিন্দু থম মেরে গেল অনেকক্ষণ যাবত। সে হয়তো দ্বিধায় পড়ে গিয়েছে। হীরণ ভাই যেহেতু কখনো তার সাথে ফাজলামো করে না তার মানে সত্যিই বলছে। কিন্তু বিন্দুর মন মানতে পারল না হীরণ ভাই তাকে ফেলে দেওয়ার মতন কঠিন কাজও করতে পারে। দ্বিধাদ্বন্দে মেয়েটার মুখ শুকিয়ে এতটুকুন হয়ে গেল। অবশেষে দীর্ঘক্ষণ বাইকটি চলার পর এসে থামল একটি ভিড়ে পরিপূর্ণ জায়গায়। বাইক থামতেই চমকাল বিন্দু। চারপাশ তাকিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে শুধাল,
“এইহানে ক্যান আনছো, হীরণ ভাই?”

হীরণ বিন্দুর উত্তর না দিয়ে বাইক থেকে নামল। নামালো হুতুমকেও। হুতুমের হাত জড়িয়ে ধরল পরম দায়িত্ব অতঃপর জবাব দিল, “তোর নাকি মেলা ঘুরতে মন চায়? সেজন্য আনলাম।”

চারপাশে হৈচৈ, বিশৃঙ্খলা যুক্ত পরিবেশে হীরণের এই বাক্যগুলো যেন গ্রীষ্মের তাপদাহে শীতের নরম ছোঁয়া দেওয়ার মতন শীতল, অবিশ্বাস্যকর। বিন্দু চমকালো,
“তুমি কেমনে জানলা আমার মেলা পছন্দ?”

“তুই যেমন কইরা জানছ আমার মুরগীর কষা মাংস পছন্দ, তেমন কইরা। এবার চল ভেতরে।”

বিন্দুর বিস্ময়ের সীমা রইল না। হীরণ ভাই আজকাল তার এত যত্ন নিচ্ছে তা যেন বড়োই অকল্পনীয়। মা না থাকায় কী এত যত্ন পাচ্ছে সে! আম্মা না থাকারও কী সুবিধা আছে তবে? বিন্দুর বোকা মাথায় প্রশ্নের ঘুরপাক। হীরণ হুতুমের হাত ধরে এগিয়ে গেল সামনে। বিন্দু ফোন বের করতে করতে পেছনে পরে গেল তাদের থেকে। তবুও সে ফোন বের করল। আপার সতেরোটা মিসড কলের পরিবর্তে প্রথম কলটা দিল। এবং রিসিভ হওয়ার সাথে সাথে করবীকে কিছু বলতে না দিয়ে নিজেই প্রফুল্ল বদনে বলল,
“আপা, আমাগোরে যারা দুঃখের সময় যত্ন করে, তারা কী আমাগোরে ভালোবাসে কখনো-সখনো?”

বিন্দুর অদ্ভুত প্রশ্নে অপরপাশ নীরব থাকে। তারপর করবীর মেয়েলি হাসিটা পাওয়া যায়। রিনরিনে কণ্ঠে বিন্দুর মন আকাশ স্বচ্ছ করে দেওয়ার মতন জবাব আসে,
“যারা আমাদের যত্ন নেয় তারা আমাদের ভালো চায়। আর যারা আমাদের ভালো চায় তারা আমাদের ভালোবাসে। ভালো না বাসলে কী কেউ কারো ভালো চায়, বল?”

“তাইলে আপা, তুমি যে হীরণ ভাইয়ের পছন্দ জাইন্যা মুরগীর মাংস রাইন্ধ্যা আমার নাম কইরা তার কাছে পাডাইছো, তুমিও কী তবে হীরণ ভাইরে ভালোবাসো বইল্যাই যত্ন করার নাম কইরা পাডাইছো?”

বিন্দুর বোকা প্রশ্নের আস্তরণে অপরপাশ বহুক্ষণ নিশ্চুপ রয়। বিন্দুর এই অস্বচ্ছ মনের ভাব স্বচ্ছ করে না তার আপা। বরং মিছে ধমক দিয়ে কল কেটে দেয়। বিন্দুর মনে খচখচানি করা একটা কাঁটা বিঁধে থাকে শক্ত হয়ে। আপা সবকিছুর জবাব দিল কিন্তু ‘ভালোবাসে না’ কথাটা কেন বলতে পারল না? তবে কী….. বিন্দু আর ভাবে না। হীরণের তাড়ায় পা বাড়ায় মেলার ভেতরে। ভুলে যায় ফোনের ওপাশে ফেলা একটা মেয়ের দীর্ঘশ্বাস।

(২৮)

নতুন বাসা খুঁজতে ভালো ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছিল করবীকে। সেই ভোগান্তি থেকে তাকে উদ্ধার করল তিমির। বেশ ভালো মানের একটি ফ্ল্যাট ভাড়া করে দিল করবীর সামর্থ্যের মধ্যেই। করবী সেই ফ্ল্যাটে বিন্দুদেরও যাওয়ার কথা বলল কিন্তু বাঁধ সাধলো বিন্দু। কান্নাকাটি করল অনেক মেয়েটা। কিন্তু এই এলাকা ছেড়েও সে যেতে পারবে না। কেন যেতে পারবে না তার উপযুক্ত কারণ যদিও সে দেখাতে পারেনি তবে করবী ভালো করেই জানে, আপার প্রতি ভালোবাসার চেয়েও হীরণের প্রতি ভালোবাসার ঘনত্ব বেশি মেয়েটার মনে। মেয়েটা ভালো করেই জানে, আপার সাথে দুরত্ব বাড়লেও ভালোবাসা কমবে না কিন্তু যদি হীরণের কাছ থেকে মেয়েটা দূরে চলে যায় তবে হয়তো কারণে-অকারণে লোকটা তাকে ভুলে যাবে। বিন্দু চায় না হীরণ ভাই তাকে ভুলুক। ভালো না বাসুক অন্তত মানুষটা তাকে একবেলা মনে করবে এতেই মেয়েটার ঢের চলে যাবে। আর বিন্দু সেই চলে যাওয়ায় ব্যাঘাত ঘটাতে চায় না।

পড়ন্ত সন্ধ্যা বুক পেতে দাঁড়িয়েছে ধরার অন্তরে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সে পড়ন্ত সন্ধ্যায় মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল করবী। আগামীকালই এই বাসাটা ছেড়ে চলে যাবে তারা। তারপর হয়তো সন্ধ্যা আরও দেখা হবে কিন্তু এই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আর মুগ্ধ হওয়া হবে না। যে দেয়ালের কোল ঘেঁষে জন্ম নিয়েছে তাদের কত অভাবের গল্প, সে দেয়ালটি আর কয়েকদিন পর অন্য কারো স্মৃতি আটকাতে ব্যস্ত হয়ে যাবে। তাদের পর এই শূন্য ঘরটিতে হয়তো নতুন কেউ আসবে। তাদের চেয়ে দ্বিগুণ পরিপূর্ণ রাখবে ঘরটিকে। ঘরটাও বোধহয় ভুলে যাবে একটি মেয়ে কিশোরী থেকে তরুণী হয়েছিল এই আধ-খষা বিল্ডিং-এর এই রুমটিতে। পৃথিবীর সবচেয়ে করুন বাক্য হলো— এই পৃথিবী কোনো স্থান শূন্য রাখে না। যেমন তাদের অভাবে শূন্য থাকবে না এই প্রাচীর, এই বারান্দা, এই বিষাদ স্মৃতি জড়িয়ে রাখা ঘরটি।
এমন করেই নতুনের আবির্ভাবে ধুয়েমুছে যায় পুরোনো। এমন করেই মহাকাল লুকিয়ে যায় ইতিহাসে। করবীর মনে কেবল একটা প্রশ্নই বার-বার উঁকি দিচ্ছে, যে ছেলেটা তাকে একটু দেখবে বলে দূর ল্যাম্পপোস্টের সামনে রাতের পর রাত দাঁড়িয়ে থাকতো, সে ছেলেটা এরপর থেকে কোন অজুহাতে নিশি জাগবে? এই ছেলেটার বুকের একপাশ কী করবীর শূন্যতায় পুড়বে? নাকি পূরণ করার জন্য পৃথিবীর তাগিদে তার জীবনে নতুন কেউ আসবে? আরও গাঢ় ভাবে আরও গোপনে? করবীর মতন করে কী তবে ছেলেটা অন্য কাউকে ভালোবাসবে?
কথাটা ভাবতেই করবীর গা শিরশির করে উঠল। কী অদ্ভুত ভাবনা তার! যে ছেলেকে কখনো সে আনমনে ভাবেইনি, তার বুকের ভেতর কে থাকবে সেটা নিয়ে হা-হুতাশ করা কী ওর সাজে? মোটেও না। তবে ভালোবাসা পেতে পেতে একটা লোভের জন্ম নেয়-ই। এই পৃথিবীতে এমন নিঃস্বার্থ ভালোবাসার অভ্যাস কেই-বা কাটাতে চায়?

করবীর মন আতঙ্কিত হলো। এসব ভাবনা যে বড়োই হাস্যকর! বিন্দুর মতন পাগলাটে মেয়ের ভালোবাসা যে ছেলেটার জন্য, সে ছেলেটাকে করবী কখনোই ভালোবাসবে না। কখনোই না। করবীর নিজের ভাবনায় নিজেই মন খারাপ করল। আশেপাশে কাউকে খুঁজে না পেয়ে খাঁচায় থাকা বাণীর দিকে এগিয়ে গেল। অবুঝ প্রাণীটিকে প্রশ্ন ছুঁড়ল,
” বাণী, আমাদের ভালোবাসার প্রতি এতো লোভ জন্মায় কেন? কেন ভালোবাসা পেলে আমরা পাথর হয়ে থাকতে পারি না? মানুষ কী তবে ভালোবাসাতে আটকে যায়? মায়ার টান এতটা?”

করবীর মন খারাপ বাড়ে। আজ ভীষণ ভাবে সে অনুভব করে মা না থাকার যন্ত্রণা। আজ মা থাকলে সংশয় পরিষ্কার করা যেত। মা নিশ্চয় তার মন বুঝতো? মা নিশ্চয় বলতে পারতো, মায়া কাটে কীভাবে? কেন তার মা নেই? এত অভাবের মাঝে মা না থাকার মতন বড়ো অভাবটা সৃষ্টিকর্তা না দিলেও তো পারতেন। পারতেন না-কি?

নীরব সন্ধ্যা কেটে রাত নামল। ভাবনা তখনো টইটুম্বুর। আর সেই ভাবনার সুতো ছিঁড়তে ভেসে এলো হীরণের চিৎকার। ভয়ঙ্কর ভাবে লোকটা করবীকে ডাকছে। তবে কী ছেলেটা জেনে গেল, তার নিশি জাগরণে কারণ হারাতে চলছে?

#চলবে…..

#বুকপকেটের_বিরহিণী
১৭ এর বর্ধিতাংশ
কলমে: মম সাহা

শান্ত পরিবেশ মুহূর্তেই অশান্ত হৈচৈ-এ আবদ্ধ হয়ে গেল। করবী তাজ্জব বনে তাকিয়ে রইল উদ্ভ্রান্ত হীরণের দিকে। ছেলেটা আজ নিজের মাঝে নেই যেন! চোখ-মুখ লাল টকটকে। কেমন দুলছে শরীর। অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছেও। করবী পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করতে বলল,
“চিৎকার করবেন না এমন করে। আপনার জন্য আমি আবার মানুষের কাছে খারাপ হতে পারব না।”

“চিৎকার করবোই। একশবার করব। রুবী, তুমি আমারে ছাইড়া যাওয়ার দুঃসাহস কেন দেখাইলা? আমার দোষ কী বলো। বলো। ”

হীরণের গলা আরেকটু উঁচুতে ওঠল। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বিন্দু কাঁপছে ভয়ে। তাকে জাপ্টে ধরে কাঁপছে হুতুমও। হীরণের এমন ভয়ঙ্কর রূপ যে বড়োই অপরিচিত তাদের কাছে। করবীর মন ভীত হচ্ছে। মানুষ জড়ো হয়ে গেলে সমস্যা হবে। শেষ মুহূর্তে আবারও মানুষের কালি ছোড়াছুড়ি সে নিতে পারবে না।

“কথা বলছো না কেন? তুমি এই এলাকা ছেড়ে যাচ্ছ আর আমাকে জানাওনি! তুমি কী ভেবেছ আমি জানব না? ভালোবাসছি অনেক তাই তোমার এমন আচরণ? এত অবহেলা? ভালোবাসার বিনিময়েই কী এমন আঘাত প্রাপ্য আমি?”

করবী নিজেকে ধাতস্থ করল। শীতল কণ্ঠে বলল, “এখানে তো চিরজীবন আমি থাকতে পারব না, একদিন না একদিন যেতেই হতো।”

“তোমাকে দেখে আমার চোখের তৃষ্ণা মিটে। তুমি তা জানো। এবং সেজন্যই এই পদক্ষেপ তাই না?”

“চিরজীবন আমি আপনার চোখের তৃষ্ণা মেটানোর দায়ভার হয়ে তো থাকব না।”

“কেন রুবী তুমি এত কঠিন হচ্ছো? কেন? আমাকে একটু দয়া করা যায় না? আমি কী এতই খারাপ? আমাকে ভালো না বাসো অন্তত আমার থেকে ভালোবাসার সুযোগটুকু কেড়ে নিও না।”

হীরণের নিঃসংকোচ প্রেম নিবেদনে ভ্যাবাচেকা খেলো করবী। অসহায় চোখে তাকাল বিন্দুর দিকে। মেয়েটার চোখে জল। করবী আজ মাথা ঠাণ্ডা রাখল। রাগ করল না। চিৎকার করল না। বরং হীরণের কাছে এগিয়ে গেল দু’কদম। এই প্রথম সকল সংশয়, অস্বস্তি, বাঁধা-ব্যবধান ভেঙে করবী হাত রাখল হীরণের হাতের বাহুতে। শীতলের থেকেও শীতল কণ্ঠে বলল,
“তোমার জীবন আমার জন্য থেমে থাকবে না, হুতুমের মাস্তান। বরং আমি নামক অস্বচ্ছ আদল স্মৃতি থেকে মুছে ফেললেই দেখবে তোমার জন্য একটি মেয়ে আনমনে সন্ধ্যা কাটায়। তোমার কষ্টে কেউ কাঁদে। তোমার খুশিতে কেউ হাসে। এত বড়ো জীবন আমাদের, কাউকে একপাক্ষিক ভালোবেসে কাটানো যে সহজ নয় এবং সম্ভবও নয়। জীবনকে সুন্দর করতে কারো নিখাঁদ ভালোবাসা প্রয়োজন। আর আমি জানি, তোমার জন্য কেউ হাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাহলে তুমি কেন বোকা হচ্ছো? ভালোবাসা যদি ভিক্ষার দান হতো, তবে আমি অনায়াসে তা দিতে রাজি ছিলাম কিন্তু তা যে সম্ভব নয়। আমাকে ছাড়াও তোমার পৃথিবী অনেক বড়ো। একবার সে পৃথিবী দেখো, মাস্তান। দেখবে তোমার এই আকুতি হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে।”

সকল দেয়াল ছিন্ন করে বখাটে ছেলেটির প্রতি করবীর এমন কোমলতা যেন ছিল বহু সাধনার এক পশলা বৃষ্টির ন্যায়। এবং সে বৃষ্টি শীতল করে দিল সব। অশান্ত পরিবেশ, অশান্ত ছেলেটিকেও। হীরণ থেমে গেলে, চুপ হয়ে গেল তার চিৎকার-চেঁচামেচি, সকল অভিযোগ। করবী এবার ছুটে চলে গেল বিল্ডিং এর ভেতর। হীরণ দাঁড়িয়ে রইল করুণ হাসি নিয়ে। আকাশের দিকে তাকিয়ে সবচেয়ে ঝলমল করা তারাটার উদ্দেশ্যে বলল,
“আম্মা, রুবী বড়ো চালাক। দেখলে? ও জানে আমার রাগ পানি কীভাবে হয়! ও সব জানে, আম্মা, সব জানে। কেবল এতটুকুই জানল না, যতটুকু জানলে ওর ভালোবাসা আমি হতাম। আম্মা, মায়ের পর আমরা যে নারীরে ভালোবাসি, সে-ই নারী কতটা সৌভাগ্যবতী তাই না বলো? তবুও আমার রুবী বুঝল না। কেমন অনায়াসে সে এমন সৌভাগ্য ঠেলে দিল অবলীলায়! দেখলে আম্মা, আমার রুবী কত্তো বোকা! কত্ত বোকা!”

চিরজীবনের জন্য নিশ্চুপ হয়ে থাকা মায়ের দিকে ব্যাথার বাণ ছুঁড়ে মেরে হু হা করে হেসে উঠল হীরণ। বিন্দু কেবল ফ্যালফ্যাল করে দেখল। কেবল একা বিন্দু নয় অন্ধকার বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা বোকা রুবীটাও দেখল, কাঁদল। দু’হাতে মোনাজাত করল, তাকে অসম্ভব ভালোবাসা ছেলেটা ভালো থাকুক। ভুলে থাকুক।

মাঝ রাতে তুমুল বর্ষণ হলো। ভিজে একাকার হলো হীরণ। সে নড়ল না। এই একটা রাত-ই তো তার রুবীর নিঃশ্বাসের আশেপাশে থেকে কাটাবে। তারপর তো রুবী অনেক দূর, বহুদূরে চলে যাবে। চাতক পাখির ন্যায় জেগে রইল বিন্দুও। ভয়ে ঘেঁষতে পারেনি হীরণের কাছে তবে দুঃখের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। যে মানুষটা বিন্দুর মতন মেয়ের মেলা ঘুরার ইচ্ছে পূরণ করেছে সে মানুষটার দুঃখে দূরের সঙ্গী হবে না সে! এতটা পাষাণ যে বিন্দু নয়। শূন্য রাস্তা দেখল, কত কাতরতায় ভিজছে দু’জন মানব-মানবী। হীরণের মনের কোথাও ছিল হয়তো রুবী তার মাথায় ছাতা ধরতে আসবে কিন্তু সে ভুল। তার বোকা রুবী ছাতা হয়নি, না সঙ্গী হয়েছে। হীরণের গলা ভেঙে গিয়েছে টানা ভিজতে-ভিজতে। সেই ভাঙা গলায় অনেকক্ষণ পর বিন্দুর উদ্দেশ্যে বলল,
“তুই ভিজছিস কেন?”

“তুমি ভিজছো বলে।” বিন্দুর সহজ-সরল উক্তিতে হাসল ছেলেটা,
“আমি না-হয় প্রেম হারানোর শোকে ভিজছি। তোর কী দুঃখ?”

“তোমার দুঃখই তো আমার দুঃখ, হীরণ ভাই।”

হীরণ থমকে গেল। সহজ-সরল বিন্দুর দিকে তাকিয়ে রইল বহুক্ষণ। তার এই শূন্য জীবনে কেউ তো এমন করে তার দুঃখে দুঃখী হলো না! তবে এই মেয়েটা কেন এমন? তবে কী খুব গোপনে তার জন্য ছাতা ধরার মানুষ পৃথিবীতে অবশিষ্ট আছে?

এই ভালোবাসায় অবুঝ দু’টো ছেলেমেয়ের দিকে তাকিয়ে হাসল করবী। ভিজে একাকার তার দেহ। যে আজ বহুদিন যাবত ভিজছে নিঃসঙ্গ। ভেঙে টুকরো টুকরো হওয়া হীরণেরও শেষবেলার সঙ্গী আছে। কেবল সঙ্গীহীন রয়ে গেল করবী। এই বিশাল পৃথিবীতে মেয়েটার কেউ নেই। কেউ না। অথচ কেউ জানলোও না সেই ছোটোবেলা থেকে একটি মেয়ে যুদ্ধ করতে করতে আজ ক্লান্ত। জানবেই বা কীভাবে? করবী যে চিৎকার করতে জানেনা, কাঁদতে জানেনা। তাই মানুষ তার কষ্ট মাপতেও জানেনা।

#চলবে

বুকপকেটের বিরহিণী পর্ব-১৫

0

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পঞ্চদশ পর্ব:

কলমে: মম সাহা

(২৩)

সকাল হতেই চুলায় চায়ের পাত্র উঠেছে। তিমিরদের আবার চা-ছাড়া সকাল ভালো কাটে না। ড্রয়িং রুমে টিভির শব্দ শোনা যাচ্ছে। বিদিশাই টিভি অন করে রেখেছে। এটা ওর প্রাত্যাহিক অভ্যাস। যখন ওর কাজ করার সময় আশেপাশে কেউ না থাকবে, তখনই ও টিভি অন করে রাখে। এতে ওর মনেহয় যে ওর সাথে কেউ কথা বলছে। ও একা নয়। আজ আবার কাজের আন্টিও আসেননি। তাই ও আরও একা হয়ে গিয়েছে। তার উপর তার শাশুড়ির বাতের ব্যাথা বেড়েছে। সেজন্য ভদ্রমহিলা আর বিছানা থেকে নড়তে পারছেন না। তন্মধ্যেই ওদের বাড়িতে থাকা ল্যান্ডফোনটি বেজে উঠল। সচারাচর ল্যান্ড ফেনে তেমন কেউ কল দেয় না। আধুনিকায়নের যুগে যেখানে স্মার্ট ফোন ব্যবহার হয় হাতে-হাতে সেখানে ল্যান্ড ফোনেরই-বা কী প্রয়োজন পরে! ফোনটা কেবল ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্যই রাখা। কেমন নবাবিয়ানা প্রকাশ পায়!
বিদিশা টিভির শব্দে প্রথম বার শুনতে পেল না। কিন্তু দ্বিতীয় বার ঠিক শুনল। দ্রুত ছুটে গিয়ে রিসিভ করল ফোনটা। তখনই অপর পাশ থেকে ভেসে এলো মেয়েলি মৃদু কণ্ঠ,
“হ্যালো…..”

মেয়েলি কণ্ঠটি বড়ো পরিচিত ঠেকল বিদিশার কাছে। কিন্তু ঠিক ঠাহর করতে পারল না কার কণ্ঠ। তাই সে শুধাল, “কে?”

জবাব এলো, “ভাবি বলছেন?”

বিদিশা এবার চমকালো। মেয়েলি কণ্ঠের অধিকারীনি তাহলে তাকে চেনে! বিদিশা কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে বলল, “হ্যাঁ?”

“ভালো আছেন, ভাবি?”

“এই তো ভালো। কে বলছিলেন ঠিক চিনলাম না!”

“আমি আশাবরী। তিমিরের…. ”

বাকি কথাটুকু সম্পূর্ণ হতে দিল না বিদিশা। মুখ-চোখ শক্ত করে বলল, “আপনি ভাইয়ার কেউ না। এ নাম্বারে কেন কল দিয়েছেন?”

বিদিশার হুট করে কণ্ঠ বদলে হয়তো অপরপক্ষ কিঞ্চিৎ বিস্মিত হলো। কিছুক্ষণ মৌন থেকে বলল,
“কেউ না তা তো জানি। আসলে কল দিয়েছিলাম ভিন্ন কারণে। সেদিন কলেজে গিয়েছিলাম আমার ইন্টারের মার্কশীট, সার্টিফিকেট গুলো আনতে। কাগজ গুলো দরকার। কিন্তু কতৃপক্ষ হেয়ালি করছেন। আমার খুব দরকার সেগুলো। ভেবে ছিলাম তিমির তো পুরোনো স্টুডেন্ট। তা-ও আবার সেই ভার্সিটির। তিমির একটু ব্যবস্থা করে দিলে কাগজ গুলো দ্রুত পেতাম।”

“ভাইয়া এখন এ-শহরে থাকেন না। তাছাড়া আপনারাও তো এ-শহর ছেড়ে ছিলেন! আবার এলেন কেন?”

“ভয় পাবেন না। শহর ছেড়েছি আবার শহরে ফিরে এসেছি বলে ভাববেন না মানুষদের কাছেও ফিরে আসব। শহর আমাকে ভুলেনি। তার স্মৃতিতে আজও আমি ভীষণ সতেজ। তাই তার কাছে আসতে হয়েছে। মানুষের মনের ক্ষেত্রে তো তা-না। মানুষের চোখের আড়াল হলেই মনের আড়াল করে ফেলে। তাই ফিরে আসার চান্স নেই। তাছাড়া সংসারে আমার শিকড় বহুদূর চলে গেছে। সেটা ছিন্ন করে আসা সম্ভব না।”

“কিন্তু আপনার বাতাসও এ শহরে বইলে কিছু মানুষের বেঁচে থাকা দায় হয়ে যাবে। বুঝেন না এটা?”

“ভাবি, যদিও আপনি আমাকে দোষীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন, কিন্তু দুনিয়া জানে আমি শেষবেলা অব্দি যু দ্ধ করেছি। কারো বেঁচে থাকা দায় করার কোনো ইচ্ছে আমার কখনো ছিল না। যাই হোক, রাখছি তবে।”

“আর কখনো কল দিবেন না।”

“চিন্তা করবেন না। দিবো না। আমি কারো জীবনের কাঁটা হতে চাইনি। ফুল হয়েই থাকতে চেয়েছিলাম, ভাবি।”

কথাটি শেষ করে বিনা অপেক্ষায় মেয়েটি ফোন কাটল। বিদিশা দাঁড়িয়ে রইল স্থির। সে আশাবরীকে এভাবে বলতে চায়নি। মেয়েটাকে সে কখনোই সামনে থেকে দেখেনি। ছবি দেখেছে অনেকবার। আর দু একবার মেয়েটার গান শুনেছিল তিমিরের ফোনে। সে আসার আগেই আশাবরীর চাপ্টার এই পরিবারের থেকে মুছে গিয়েছিল। তাই নতুন করে আর পরিচয় হওয়া হয়নি।

নিজের স্থির ভাব কোনোমতে ধামাচাপা দিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে তেল গরম করল সে। শাশুড়ির পায়ে মালিশ করার জন্য। তেল গরম করেই শাশুড়ির ঘরে প্রবেশ করল সে। ভদ্রমহিলা তখন চোখের উপর হাত দিয়ে শুয়ে আছেন। ঘুমিয়ে গিয়েছে কি-না বুঝার উপায় নেই। বিদিশা শব্দ বিহীন মাটিতে গিয়ে বসল। হাত রাখল শাশুড়ির পায়ে৷ ঠিক তখনই তড়াক করে ওঠে বসল তাসনীম বেগম। কণ্ঠস্বর তার গম্ভীর,
“কে কল করেছিল?”

বিদিশা ভড়কালো না মোটেও। বরং নরম কণ্ঠে বলল, “আশাবরী।”

“তুমি তক্ষুনি কয়টা কড়া কথা কেন বললে না ওকে?”

শাশুড়ির তেজীয়ান কণ্ঠের বিপরীতে হাসল মেয়েটা। বলল,
“কতটুকু কড়া কথা বলব, মা? যতটুকু কড়া কথা বললে মানুষ একজন মানুষকে ছাড়ার ক্ষমতা রাখে, ততটুকু কড়া কথা আপনি তাকে বহুবছর আগেই তো বলে ফেলে ছিলেন।”

তাসনীম বেগম তার পুত্রবধূর এহেন শীতল অথচ তীক্ষ্ণ কথায় হতভম্ব হলেন,
“তুমিও কী আমাকে দোষ দিচ্ছ?”

বিদিশা জবাব দিল না। স্থির দৃষ্টি তার শাশুড়ির পায়ের দিকে। নরম হাতে সেখানে অবিরাম মালিশ করে যাচ্ছে। তাসনীম বেগম তখনও প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।
বেশখানিকটা সময় পর বিদিশা উত্তর দিল,
“আপনি সন্তানের ভালোই চেয়ে ছিলেন আমি জানি, মা। কিন্তু কী লাভ হলো সে ভালো চেয়ে? বড়ো ছেলে তো রাগ করে দেশের বাহিরেই চলে গেল। ছোটোজন যা-ও আপনার কাছে রইল তাও যোজন যোজন দূরের হয়ে। শেষ পর্যন্ত সবার ভালো করতে গিয়ে কেমন নিষ্ঠুর করে দিলেন সম্পর্ক গুলো! সেই আফসোস থাকেই, মা।”

বিদিশার কথা শেষ হতেই তাসনীম বেগম মেয়েটার হাতটা টেনে ধরলেন। আফসোস করে বললেন,
“আর কার সাথে কী অন্যায় করেছি আমি জানিনা। তবে তোমার সাথে আমি অন্যায় করেছি। আমাকে ক্ষমা করো।”

বিদিশা আর কথা বলল না। তাকিয়ে রইল খুব দূরে নির্নিমেষ। সেই গ্রাম, সেই নতুন প্রেমে পড়ার ক্ষণ ভেসে উঠে স্মৃতির পাতায়। যা আজ নিছক গল্প। দৃষ্টিরা তার মৃত।

(২৪)

করবী নিজের হাতে হুতুমকে গোসল করিয়ে দিয়েছে আজ। নতুন একটা ফ্রক পরিয়েছে। বাচ্চাটা এতেই ভীষণ খুশি। সবুজ রঙের ফ্রকটা পরে ছুটে বেড়াচ্ছে এখানে সেখানে। খেলার ছলে ভুলে গিয়েছে প্রিয় মানুষ হারানোর শোক।
কিন্তু বিন্দু বাচ্চা নয়, তাই নতুন ফ্রক কিংবা কোনো বাহানায় মেয়েটার শোক ভুলানো সম্ভব হচ্ছে না। কেমন উদাস থাকে অতটুকুন মেয়েটার মন! ঝলমল করে হাসে না, হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে না তার উপর। তবে শোকও দেখায় না আড়ম্বরপূর্ণ ভাবে। কেঁদেকেটে বালিশও ভেজায় না। কেবল চুপ করে থাকে। আজ করবী ভেবেছে শপিং করতে যাবে। বিন্দুর শাড়ি পছন্দ কিন্তু কখনো মেয়েটা কোনো শাড়ি পরেনি। তাই করবী ওর জন্য শাড়ি আনবে। একদিন আমেনা খালাই বলে ছিলেন, বিন্দুর শাড়ির প্রতি আলাদা আগ্রহ। আর বিন্দুও একদিন বলেছিল সে শাড়ি পরবে, হীরণ ভাই পাঞ্জাবি পরবে এবং দু’জন ঘুরতে যাবে। হয়তো এই একটা উপায়ে মেয়েটাকে খুশি করা যাবে!

যেমন ভাবনা, তেমর কাজ। করবী তার ঘরের মোটামুটি রকমের আলনাটা বিক্রি করে দিল। কাঠের আলনা, কেনার সময় কিনেছিল সাড়ে এগারো হাজার টাকা দিয়ে কিন্তু বিক্রি করল মাত্র তেইশো সত্তর টাকায়। করবীর হাত ফাঁকা। তেমন টাকা নেই। তাই শাড়ি কেনার টাকাটা জুগালো বড়ো মায়া ত্যাগ করে। আলনাটা তার ভীষণ পছন্দের ছিল কি-না! একটা পছন্দ ত্যাগ করে আরেকটা পছন্দের কাজ করবে। তাতে আফসোস কিসের? বিন্দু তার শখের মানুষ। মেয়েটার সুখের জন্য সে সব করবে।

বিন্দু এবং করবী মিলে বড়ো রাস্তায় গেলো। শপিংমল থেকে একটা শাড়ি কিনল, তার সাথে মিলিয়ে পাঞ্জাবিও কিনলো। শপিং করে বের হওয়ার সময়ই পেছন থেকে তার ডাক ভেসে এলো,
“করবী না?”

করবী পেছন ফিরে তাকাল। এক দেখায় চিনতে পারল না মুখটা। কিছুক্ষণ ভেবে অতঃপর বলল,
“চিনলাম না যে!”

বোরকা পরিহিতা নারীটি তখন এগিয়ে এলো করবীর দিকে। হাসি-হাসি কণ্ঠে বলল,
“আশাবরী, চিনেছ?”

করবী কতক্ষণ ভাবল। তারপর হুট করে মনে পড়তেই হাসল খানিক,
“আশা! ভালো আছেন? আপনাদের ছোট্টো করবী ভালো আছে?”

আশাবরী হাসল। জবাব দিল, “ছোটো করবী বড়ো হয়েছে। ভালো আছে।”

তারপর আরও টুকটাক কথা আদান-প্রদান হলো তাদের ভেতর৷ আদান-প্রদান হলো বাড়ির ঠিকানা এবং নাম্বারও। করবী প্রস্থান নিল বিদায় জানিয়ে। আশা তাকিয়ে রইল সে প্রস্থানের দিকে। সে মনে-মনে কত খুঁজেছিল মেয়েটাকে! অবশেষে পেল!

অপরদিকে করবী বের হয়েই হীরণকে কল দিল, গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“আমার জন্য একটা কাজ করে পারবেন?”

“একবার বলে দেখো, জান দিয়ে দিব।”

হীরণের কথার বিপরীতে তাচ্ছিল্য হাসল করবী,
“যার জন্য জান দিতে পারবেন তারই মানহানি করতে একবারও ভাবেননি। যাই হোক, আমি চাই আমার জন্য আপনি আরেকবার ভালোবাসুন অন্য কাউকে। যে আপনাকে আপনার চেয়েও ভালোবাসে।”

করবীর উত্তরে নীরব হয়ে গেল হীরণ। এরপর হতাশ স্বরে বলল,
“জান দিয়ে দিব বলাতে সত্যি সত্যিই যে জান কেড়ে নিতে চাইবে ভাবিনি। তোমারে রেখে অন্য কাউকে ভালোবাসা আমার কাছে প্রাণ বিসর্জন দেওয়ার মতনই নিষ্ঠুর। বিসর্জনের ব্যাথা আমি সইতে পারব না, রুবী।”

#চলবে…….