Saturday, August 2, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 153



আজকে আমার মন ভালো নাই পর্ব-৬+৭

0

আজকে আমার মন ভালো নাই।
নাহিদা সানজিদ

৬.
মারওয়া ভেবেচিন্তে একটা সিদ্ধান্ত নিলো। এভাবে চলা যায় না। একটা ছেলে দিনের পর দিন তার পিছু করছে এটা দুজনের জন্যই অসম্মানের। আজ আরিব এক কোণায় দাঁড়িয়ে। মনে হচ্ছে দূর থেকে অনুসরণের সন্ধি আঁটছে। আঙ্গুল দিয়ে ইশারায় ডেকে বলল, “চল, তোর সঙ্গে আমার কথা আছে।”
আরিব ভ্যাবাচ্যাকা খেলো। মারওয়া বিপদজনক মেয়ে। কখন কী করে বসে ঠিক নেই। হয়ত দেখা গেলো মাঝরাস্তায় চিৎকার সবাইকে ডেকে ইভটিজিং এর মামলায় ফাঁসিয়ে দিলো। আবার, ওকে না করতেও মন টানছে না। প্রেমিক হবার নানাবিধ বিপদ আছে। সে ভয়ে ভয়ে গেলো। ওরা গেলো স্কুলের সামনের একটা ছোটখাটো কফিশপে। এখানে ছেলে মেয়ে একসাথে বসা যায় না যদি না বৈধ সম্পর্ক থাকে। স্কুল-কলেজকে প্রেম পরিণয় মুক্ত রাখার অভিপ্রায়েই এই নিয়ম। মারওয়া ওকে নোটখাতা বের করে দিয়ে বলল, “তুই যা, আমি আসছি।”

এরপর দুটো ঠান্ডা কোল্ড ড্রিংকসের বোতল নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো। আরেকটা খাতায় হাবিজাবি লিখতে শুরু করে বলল, “আমি কী বলছি শুন?”
আরিব আগ্রহী চোখে তাকালো, “হ্যাঁ বল।”
“তুই আমার সঙ্গে হুদাই হেঁটে কী মজা পাস?”
আরিব কাঁচুমাচু করলো, “বলা যাবে না।”
“তুই যদি আমাকে নূন্যতম সম্মান করে থাকিস, আর এসব করিস না।”
“তাহলে কী করব?”
মারওয়া অবাক হয়ে বলল, “কী করবি মানে? তোর কোনো কাজ নেই? পড়াশোনা নেই?”
“সেসব তো অন্যসময়ও করা যাবে।”
মারওয়ার ইচ্ছা করছে এসব খাতাটাতা ওর মাথায় ছুঁড়ে উঠে চলে যেতে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “তুই বুঝতে পারছিস না, এগুলো হলো শয়তানি ওসওয়াসা। প্রেম মানুষকে অন্ধ করে দেয়। তোর মনে হচ্ছে, তুই দেখতে পাচ্ছিস, আসলে তা না। তুই এখন অন্ধ।”
“আমি অন্ধ?”, আরিব অবাক হলো।
“হ্যাঁ, শয়তান তোকে ফুসলাচ্ছে। আমার সঙ্গে যদি তোর প্রেম হয়, দেখবি কিছুদিন পর আর ভালোলাগে না। আমি অনেক কেস দেখেছি। শয়তানকে তো জিততে দেওয়া যায় না। আমাকে ভুলে যা।”
“কেস দেখেছিস মানে? তুই কী উকিল?”
এ মুহুর্তে এ ছেলের মাথা ফাটিয়ে দিতে পারলে ভালো লাগতো।

“আচ্ছা, অনেকের তো বিয়ের ক-বছর পর বউকেও ভালো লাগে না। সেটা তাহলে কী?” আরিব আরেকবার কৌতূহলী হয়ে উঠলো।
”সেটা বিয়ের পরের শয়তান। এটা প্রি-ওয়েডিং শয়তান। জীবনের প্রতি পদে পদে শয়তান, তোর তো ব্যাপারটা বুঝতে হবে, নাকি? অন্ধ চোখটা ভালো করে মেলে দেখ, তোর বউ তোকে তুই-তুকারি করছে এটা কী তোর ভালো লাগবে বল?”
আরিব বোঝার চেষ্টা করলো না, কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, “সেদিন একজন মাওলানা একটা উক্তি দেখলাম কোথায় যেন, তোর ভাইয়ের নামে নাম — Love is the sea where intellect drowns (ভালোবাসা হলো এমন একটি সমুদ্র যেখানে বুদ্ধিমত্তা লোপ পায়।)।”
মারওয়া বিরক্ত গলায় বলল, “একজন মাওলানার কথা তোর ভুলভাল কাজে লাগালে তো হবে না। যত্রতত্র ময়লা ফেলার মতো প্রেমে পড়ে বসে থাকলে তো সমস্যা।”

ওদের যুক্তিতর্কের শেষ নেই। মারওয়া বুঝতে পারলো সে ভয়ংকর একটা পাপ করেছে এই ছেলেকে বোঝাতে চেয়ে। মাথার গরম আর সূর্যের গরমে টিকতে পারলো না বেশিক্ষণ, আঙ্গুল উঁচিয়ে শাসালো, “আমি আজকেই আব্বাকে বলব, আমাকে যেন কালকের মধ্যে বিয়া দেয়। তখন আমি দেখব, তুই অন্যের বউয়ের পেছনে কীভাবে ঘুরিস।”
ওর ধারণা ছিলো, এতটুকু ছেলেকে কোনো পরিবার বিয়ে দিতে উৎসাহিত তো হবেই না বরং ঘর ছাড়া করবে। একটা শিক্ষা হবে। কিন্তু ওর ধারণা ওকেই একটা শিক্ষা দিয়ে গেলো।

***
আরিব পরিবারের একমাত্র ছেলে। সঙ্গে আছে কয়েক বছরের ছোট একটা বোন। বাবা প্রবাসী। মা গৃহিণী। নানীও তাদের সঙ্গেই থাকেন। বাসায় গিয়ে সে সবার প্রথমে ধরলো, নানীকে। নানী ছাড়া জীবনে আসলেই তেমন গতি নেই। বাজার থেকে মাত্র আনা পান আর সুপারির পুঁটলিটা রেখে নানীর গা ঘেঁষে বসলো। নতুন কোনো আবদার পাড়ার পূর্বাভাস। আবহাওয়া অফিসের মতো মানুষের আবহাওয়া বোঝারও কিছু লক্ষ্মণ আছে। চট করে কাজের কথা বলবে না। একটু রঙঢঙ করবে। শুরু হলো আরিবের রঙঢঙ পর্ব,
“নানী, দেখি কন তো, আমার জন্ম হইছে যে কতবছর?”
নানী পান পাতায় তর্জনী দিয়ে চুন ছোঁয়ালেন,
“এইতো, সেদিনই না জন্ম হইলো তোর? ইন্দুরের বাচ্চার মতো এক বিঘত শরীল।”
উনি হাত দিয়ে মেপে দেখালেন। আরিব কিছুক্ষণ থম মেরে বসে রইলো। তারপর অনুভূতিহীন গলায় বলল, “নানী, সেদিন না। আঠারো বছর হয়ে গেছে। এমন ভাবে কইলেন যেন আমার বয়স এখন কয়েকমাস।”
নানী সন্দিহান গলায় শুধালেন, “তো কি হইসে?”
আরিব আহ্লাদী হবার চেষ্টা করলো। পা টিপে দিতে দিতে বলল, “আচ্ছা নানী, আপনার বিয়ে কত বছর বয়সে হয়েছিলো?”
“এই হইবো দশ এগারো।”
এবার জায়গামতোন কথোপকথন পৌঁছেছে। ভ্রু উঁচিয়ে বলল, “এইতো। আপনাদের সময় তো ভালো ছিলো। যায় দিন ভালো আসে দিন খারাপ। বিয়ে শাদী একটা হওয়া দরকার, তাই না? ধরেন, প্রেম পিরিতি করলাম, গুনাহ্ হইলো আপনাদের। বিরাট সমস্যা।”
“বিয়া কইরা বউরে খাওয়াবি কী?”
“কেন আমার বউ কী ডাইনি নাকি? আচ্ছা, আজ থেকে আমি অর্ধেক প্লেট ভাত খাবো।”
নাতির ধান্ধা বুঝতে অভিজ্ঞ নানীর বেশি সময় লাগলো না। পান চিবুতে চিবুতে সন্ধানী চোখে বললেন, “মাইয়াটা কে?”
আরিব মাথা নিচু করে মিটিমিটি হাসতে লাগলো।

***
সকাল সকাল বাড়ি বয়ে আসা এই বৃদ্ধার মতলব বুঝতে পারছে না মারওয়া। এসে ঘুরে ঘুরে পুরো বাড়ি দেখছেন। যেন পরীক্ষার খাতা। তাকে মার্কিং করতে দেওয়া হয়েছে। এরপর চশমা খানিকটা উপরে তুলে সন্দিহান চোখে বললেন, “তোমার নাম মারওয়া?”
মারওয়া দুপাশে মাথা নাড়ালো না সূচক, “না তো। আমার নাম সখিনা। এই বাড়িত কাম করি।”
কথায় বিশুদ্ধ গ্রাম্য টান। বৃদ্ধা সরল মনে বিশ্বাস করে নিলেন। এক হাতে সরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন। মারওয়া অভিজ্ঞ গোয়েন্দার মতো রহস্যের গন্ধ শুঁকলো। কী হতে পারে?

কিছুক্ষণ পরপরই বেরিয়ে এলো আসল কাহিনী। ভদ্রমহিলা বিবাহের প্রস্তাব দিতে এসেছেন মারওয়ার জন্য। এ বাড়িতে তার বড় একটা বোন আছে এ খবর তিনি জানতেন না। কানিজ চোখমুখ অন্ধকার করে বললেন, “আমার বড় মেয়ে এখনও অবিবাহিতা। তাকে ফেলে ছোটজনকে বিয়ে কেন দেব? তাছাড়া ও এখনও ছোট। এসব বিষয়ে ভাবছি না।”
ভদ্রমহিলা একবার মারওয়াকে দেখতে চাইলেন। হঠাৎ অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে সামনে পড়ে গেলো সাফা। সে বিব্রত হলো অপরিচিত একজন নারীর সূক্ষ্ম দৃষ্টি দেখে। যেন সে কোনো ধাতব বস্তু, জহুরি চোখ দিয়ে হীরা, স্বর্ণ, তামা আলাদা করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন।

তিনি বেফাঁস কিছু বলে ফেলার আগেই কানিজ সতর্ক গলায় পরিচয় করিয়ে দিলেন, “এ আমার বড় মেয়ে, সাফা। মা, সালাম দাও নানুকে?”
সাফা সালাম করলো। কী সুন্দর মিষ্টি একটা মেয়ে! তিনি বড় মেয়েটাকেই বেশ পছন্দ করে ফেললেন। নাতির পছন্দের উপর ভরসা হলো না। তবুও দেখতে চাচ্ছেন এক নজর। মারওয়া ঘরে ঢুকলো চিৎকার করতে করতে,
— “আম্মা তুমি মেজোকে বের করে দিলা কেন? ও ছোট মানুষ। এতকিছু বোঝে? একটু না হয় ঘরই ময়লা করলো। তোমার সবকিছুতেই বাড়াবাড়ি।”
সঙ্গে সঙ্গে নানী এবং না হওয়া নাতবউ চোখ মেলালো, মারওয়ার হাতে তার মেজো বিড়াল। দ্বিতীয় দেখায় মেয়েটাকে ধুরন্ধর ব্যতীত কিছু মনে হলো না। কত বড় মিথ্যাবাদী!
মারওয়া হাত জোড় করে আমতা আমতা করলো, “আরে আমার নাম সখিনাই। দাদী ডাকে, জিজ্ঞেস করেন? আর আম্মা? তিনি আমাকে মেয়ে কম কামের বেটি বেশি মনে করেন, না আম্মা?”
সে পিটপিট করে চোখের পাতা ফেলে মাকে বোঝানোর চেষ্টা করলো। কানিজ গরম চোখে তাকিয়ে আছেন, বৃদ্ধা বিস্ময়ে নির্বাক।

চলবে ~

আজকে আমার মন ভালো নাই।
নাহিদা সানজিদ।

৭.
“আচ্ছা, অর্পা? তুমি কখনো কাউকে ভালোবাসো নি? প্রেম করো নি?”

কোনো স্বামী স্ত্রীদেরকে এ কথা জিজ্ঞেস করে না। করলেও করে বিয়ের আগে। নিশ্চিত হবার জন্য। যদি পাছে আবার বিয়ের দিন গহনাসহ পালিয়ে যায়? অথবা, কোনো ছেলের সঙ্গে গভীর কোনো সম্পর্ক থাকলো যাতে করে স্ত্রী হবার মর্যাদা হারিয়ে ফেলেছে। রুমির এমন কোনো ব্যাপার নেই। তবুও সে প্রশ্নটা করলো কৌতুহলে। মনে হলো বুকের ভেতর একটা মৌমাছি কামড়ে ধরে আছে। অর্পা যদি বলে “হ্যাঁ” তবে সে হুল ফুটিয়ে ফেলবে বুকের মধ্যিখানে। অর্পা হেসে ফেললো, “কেন? ভাবছেন, আমারটা জানতে পারলে সমান সমান। আপনাকে আর ক্ষেপাতে পারবো না?”
রুমি মাথা নাড়ালো দুদিকে। বলল, “না, এমনি। মানুষের গল্প শুনতে ভালোই লাগে।”

অর্পা দুটো গ্লাসে ওয়ানটাইম কফির প্যাকেট ছিলে দিলো। চিনি পানি দিয়ে কিছুক্ষণ নেড়ে গরম দুধ ঢাললো তাতে। হালকা ধোঁয়া উপরে ভেসে যাচ্ছে। চমৎকার ঘ্রাণ। এক কাপ রুমির দিকে এগিয়ে দিয়ে ব্যালকনির চেয়ারটায় বসলো। ধীরে সুস্থে চুমুক দিয়ে বলল, “কখনো কাউকে ভালো লাগেনি তা বলবো না। আমরা তো মানুষ, অনেক ভুলও করে ফেলি। তবে আমার ভালোলাগাকে কখনো সিরিয়েসলি নেইনি। আমি সবসময় ভাবতাম, যদি প্রেম করি, শেষপর্যন্ত বিয়ে না হয়, একটা বিপদে পড়ে যাবো। না স্বামীর হক রক্ষা করলাম, না প্রেমিককে দেওয়া ভালোবাসার কোনো মূল্য। টোটালি ইউজলেস। আমার প্রিয় সাবজেক্ট অর্থনীতি তো। ওভাবে ভাবতে ভাবতে অভ্যাস হয়ে গেছে। একবার একটা ছেলে খুব পাগলামি করলো। একদিন কোথা থেকে নম্বর জোগাড় করে ম্যাসেজ দিয়ে ফেললো। আমি রিপ্লাই করলাম, এতকিছু ভাবিনি। সে এমন ভাবে কথা বলতে লাগলো যেন আমি কোনো দেবী, প্রতিমা। এত মর্যাদা হজম হলো না। পরদিনই ব্ল্যাকলিস্টে ফেলে ভাবলাম, আমার দ্বারা এসব হচ্ছে না। আমি জনে জনে ঘোষণা করে দিলাম, আমি ওয়াইফ ম্যাটেরিয়াল। বিয়ে করব।”

শেষের কথাটি বলে সে বাঁধভাঙা হাসিতে মত্ত হলো। অন্ধকারে তার মুখ স্পষ্ট নয়। রুমি ভ্রু নাচিয়ে বলল, “হাসছো কেন? এখন তোমার কী মনে হচ্ছে।”
অর্পা ঠোঁট ওল্টালো, “কিছু মনে হচ্ছে না। সবই স্বাভাবিক। আমি কাউকে জীবন মরণ এক করে দিয়ে ভালোবাসায় বিশ্বাসী না। এসব আমার পছন্দ না।”
রুমি মেয়েটার সঙ্গে কথা বলে আর অবাক হয়, “এত হিসাব নিকাশ করে ভালোবাসা যায় নাকি?”
“হিসাব নিকাশ করিনি, এগুলো থিউরি। যেমন ধরুন, বই? আপনি হুমায়ুন আহমেদের কঠিন ভক্ত, তাই না?”

রুমি একবার তার হুমায়ুন সংগ্রহের দিকে তাকালো। ঘরের একপাশ দখল করে আছে কেবল হিমু এবং মিসির আলী। সে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। অর্পা গরাদের ফাঁকে চাঁদ দেখছে। কয়েকদিন যাবত চাঁদ তার সর্বোচ্চ জোছনা ঢেলে দেবার চেষ্টা করছেন। অদ্ভুত ভালো লাগে তখন। মনে হতে থাকে, এখন নিরুদ্দেশ বেরিয়ে যেতে পারলে ভালো লাগতো। অর্পা ইচ্ছার কথা বলে না, মুখে বলে অন্যকথা, “প্রথমবার আমি হুমায়ুন আহমেদের বই পড়লাম ক্লাস নাইনে। অপেক্ষা। পড়া শেষ করে যে বন্ধু থেকে ধার করে এনেছিলাম, তাকে বললাম, এত বিচ্ছিরি বই নিয়ে হৈচৈ এর কী আছে?”

রুমি আশ্চর্য হলো। বইটা অতটাও বিচ্ছিরি নয়, বরংচ একেবারেই নয়। সে কেবল শুধালো, “তুমি তো বই পড়ো না।”
অর্পা বরাবরের মতোই হেসে মাথা নাড়ালো। রুমি এতদিনে একটা ব্যাপার খেয়াল করেছে। অর্পা কথায় কথায় হাসে। হাসির কথা নয়, এমন কথাতেও হেসে হেসে কাত হয়। অথচ মাঝেমাঝে এত গম্ভীর আর অদ্ভুত কথা বলে যেন এ মেয়েকে বোঝার মতো কোনো জ্ঞানী বর্তমান পৃথিবীতে নেই। সে বলল, “হ্যাঁ। খুবই কম। যে কটা পড়েছি, সময় কাটছিলো না বলে, দায়ে পড়ে। তাও আবার ফিকশন। ফিকশনের মধ্যেও বাছবিচার করেছি, সহজ লেখা আর হ্যাপি এন্ডিং বই। স্যাড এন্ডিং বই আমি কখনো পড়তাম না। যত ভালোই হোক। অপেক্ষা ছিলো প্রথম বই, তাই বুঝতে পারিনি।”
“কী বলো? স্যাড এন্ডিং পড়লে সমস্যা কী? কেঁদে ফেলো তাই?”
অর্পা এবার শব্দ করেই হেসে ফেললো। অনেকক্ষণ। রুমি ধৈর্য ধরে দেখতে লাগলো। বউয়ের জন্য এতটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে পারবে না?

অর্পা বহুকষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, “ঠিক তা না। স্যাড এন্ডিং পড়লে আমার লেখকের উপর রাগ হয়। মনে হয় ইচ্ছা করে আমার অনুভূতি নিয়ে খেলেছেন তিনি। আগে তো আমি ধরেই নিতাম, স্যাড এন্ডিং দেওয়া হয় মার্কেটিং এর জন্য। সবাই পড়ে বলবে, কান্না পেয়েছে। তারপর অন্যরা হুড়মুড়িয়ে পড়বে, কী এমন আছে তা দেখার জন্য। মূলত মনে হতো, লেখকই এখানে ভিলেন। খুব খারাপ একজন মানুষ।”
এবার রুমিই হাসলো। এভাবে কখনো ভাবা হয়নি। সে কফি শেষ করে কাপটা টেবিলে রাখলো, “স্যাড এন্ডিং-ও একটা উপভোগের বিষয়। আমার তো মনে হয়, বেশিরভাগ সুন্দর বই-ই স্যাড এন্ডিং।”
অর্পা শরীরের ভার দেয়ালের উপর ছেড়ে দিলো। হুহু করে ঠান্ডা বাতাস বইছে। বারান্দাটা আরেকটু বড় হলেই সে এখানে একটা দোলনা বিছাতো। বড়সড়। যেন রুমিরও জায়গা হয়। আর এই দ্বিপাক্ষিক বিপরীত সব চিন্তাভাবনার আলাপ আলোচনা আরো দীর্ঘ হতে পারে।

সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রথমবারের মতো রুমির নাম সম্বোধন করলো, “ইব্রাহীম সাহেব! অন্যের কাল্পনিক দুঃখ যাপনের মতো সময় নেই। ব্যক্তিজীবনে কত দুঃখ নিয়ে আমাদের বসবাস! কত বাস্তব দুঃখের ভান্ডার, একেকটা কষ্টের সমুদ্র আমাদের ঘিরে আছে! উপন্যাসে ডুবে থাকলে তাদের আর অনুভব করার সময় থাকে না।”
রুমি দ্বিমত পোষণ করলো, “মাঝেমাঝে উপন্যাস আমাদের ভালোবাসতেও শেখায়। তবে তোমার কথাও ফেলে দেবার মতোন না। অন্যরকম করে ভাবো তুমি। খুব অবাক হয়েছি।”

অর্পা তা প্রশংসা হিসেবে নিলো না। সে রুমিকে একটা কথা বলেনি। সে জীবনে কখনো কাঁচের চুড়ি পরেনি। সেই কবে! ষোড়শী জীবনে, প্রথম প্রেমে পড়ার ঋতুতেই সে প্রতিজ্ঞা করলো, তার প্রথম কাঁচের চুড়ি নেবে বিয়ের পর। এমন কি সে কোনো কাজে ছেলেদের ব্যবহার করা বন্ধ করে দিলো। রক্তের সম্পর্ক নেই, শুধুমাত্র মেয়ে হবার দরুন উপকৃত হবার বাসনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেললো। মেয়েরা যখন নরম সুরে ছেলেদের দিয়ে বিভিন্ন কাজ করিয়ে নিতো, সে হয়ে গেলো একেবারে আলাদা এক পৃথিবী।

এমনটা সে কেন করেছে আজও জানা নেই। তার অভিধানে ছিলো, “আমি মেয়ে হিসেবে যে সম্মান বিপরীত পক্ষ থেকে আশা করি, আমি ঠিক তেমন করেই প্রতিটি সম্মানযোগ্য ছেলেদের সম্মান করে যাবো। তাদেরকে কোনো কাজে ব্যবহার করব না, খুব বেশি প্রয়োজন হলে সাহায্য চাইবো।”
অর্পার মনে মনে এমন আস্ত এক সংবিধান আছে যা সে কখনো কাউকে বলে না। রুমিকেও বলবে না, যদি না সে তার তেমন কোনো বন্ধু হতে পারে। সে চায়, রুমি তাকে ভাগ্যবতীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করুক, তারপর নিজেও জানুক সে কতোটা ভাগ্যবান।

**
“উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে” বলে বাংলায় একটা কথা আছে। সেই বুধোটা হতে যাচ্ছে সাফা। কানিজ দুশ্চিন্তায় শেষ হয়ে যাচ্ছেন। লোকে এখন বড় মেয়েকে ফেলে ছোট মেয়েকে দেখতে আসছে। এরচেয়ে অসম্মানজনক বিষয় আর কী হতে পারে? বড়মেয়েটার মনের খেয়াল রাখতে হবে না? এই মনের খেয়াল রাখার অজুহাতে নিয়ে সাফার বিয়ে নিয়ে আগ্রহী হলেন। একসাথে দুইবোনকে ঘরে রাখাটা পাপ সমতূল্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। লোকে, একজনকে দেখতে এসে অন্যজনকে পছন্দ করে চলে যাবে, বোনে বোনে সম্পর্ক নষ্ট হবে। তিনি দ্রুত বিষয়টি স্বামী এবং শ্বাশুড়ির সঙ্গে আলোচনা করলেন। সাফা এর কিছু সম্পর্কে অবগত নয়।

মারওয়া এক পায়ের ওপর আরেক পা তুলে ক্রমাগত নাচিয়ে যাচ্ছে। ওর হাতে সুজি। কি যেন একমনে ভেবে যাচ্ছে। সাফা এগিয়ে এলো ধীর পায়ে। যেন একটু জোরে হাঁটলেই জমিন ব্যথা পাবে। ওর পাশে বসলো নিঃশব্দে, “আরিব ভাইকে না করে দিবি?”
মারওয়া ভ্রু কুঁচকে তাকালো, “তোর ধারণা, ওকে বিয়ের করার জন্য আমি দোপাট্টা সামনে ফেলে বসে আছি? আসলেই বলব কবুল?”
“আব্বু আম্মু যদি জোর করে?”, সাফা উদ্বিগ্ন হলো।
মারওয়া হাই তুলে বলল, “কুরবানীর গরু পাইসে নাকি? মেয়ের সম্মতি ছাড়া যে বিবাহ হয় না, সে ফতোয়া স্মরণ করায় দিবো।”
তার পরপরই কুটিল চোখে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল, “সবচে বড় কথা, বড় মেয়ের আগে তো ছোট মেয়ের বিয়ে হয় না।“
সাফার মুখ মুহুর্তে অমাবস্যার রূপ ধারণ করলো। নকল কবিরাজের ভবিষ্যৎ বাণী পেয়ে তার বুকের ঢিপঢিপ বাড়তে লাগলো। চোখ ছলছল করে উঠলো। মারওয়া সহানুভূতি প্রদর্শনের নিয়ম ভুলে হেসে হেসে খাওয়া শেষ করলো।

এদিকে আরিবের নানী অনিচ্ছা স্বত্তেও মারওয়ার জন্য বিয়ের কথা বললেন। তারা কোনোভাবেই রাজি হলো না। কেবলমাত্র নাতির মনের অবস্থা বুঝে পরপর চারবার বিভিন্ন অজুহাতে তাদের বাড়িতে বিষয়টি উত্থাপন করলেন। মারওয়ার মা প্রতিবারই যত্ন করে ‘না’ করছেন। শেষে না পেরে কারণ হিসেবে দেখালেন, “বেকার ছেলের কাছে মেয়ে কেন দেব?”
অর্পা পাশেই ছিলো। সে কিছুই বললো না। জগতের নানা নিয়ম আমরা নিজেদের বেলায় পাল্টে ফেলতে পছন্দ করি। সে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে দেখলো না।
বৃদ্ধা সমঝোতায় আসতে চাইলেন, “আচ্ছা আংটি পড়ানো থাক। ও কিছু একটা করলে তখন আমরা মেয়ে উঠিয়ে নেব।”
কানিজ বিব্রত মুখে সময় চাইলেন। অর্পা পাশেই ছিলো খেয়াল করেননি। কানিজ নিজেকে যুক্তি দিলেন, “আমার ছেলে তো রাস্তায় চড়ে বেড়ানো ছিলো না। ভদ্র ঘরের ভালো ছেলে।”
তবুও মনে খচখচানিটা থেকেই যায়। অর্পা কী তাহলে উপার্জন করা কোনো পুরুষের স্বচ্ছল ঘরণী হতে পারতো না? কি জানি! আমরা নিজেদের লাভের বেলায় হিসেবী না হলেও ক্ষতির বেলায় পাই পাই করে হিসেব বুঝে নেই। খোদা তা’লা তো এমনি এমনি আমাদের অকৃতজ্ঞ বলেননি।

চলবে ~

আজকে আমার মন ভালো নাই পর্ব-০৫

0

আজকে আমার মন ভালো নাই
নাহিদা সানজিদ

৫.
সাফার দাদী আজ আবার নতুন করে তার বিয়ের দিনের গল্প বলবেন। প্রতিবার গল্প থেকে একটা করে নতুন তথ্য উদঘাটন করা যায়। এবারের বলার উদ্দেশ্য হলো, অর্পা। দাদী-শ্বাশুরির বিয়ের গল্প না জেনে এতদিন আছে, সে এক বিস্ময়। মারওয়া বিরস মুখে বসে আছে। একই গল্প আর কতবার শুনতে ইচ্ছা করে?
কিন্তু অর্পা বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনতে লাগলো। দাদীর মাথায় তেল ডলে দিচ্ছে সাফা,
“তারপর কী হলো শুনো, বউ। বিয়ে হলো, কিন্তু শ্বাশুড়ি আর দেখতে পারে না। শুধু কামের খুঁত ধরে। চিনি কম, লবন বেশি। সকালবেলা এক গামলা পানিভাত। এবার ভর্তা বাঁটো। পাতা কুড়াও, ওগুলো দিয়ে রান্না। লাকড়ি ধরতে দিতো না।”

অর্পা সহানুভূতির স্বরে বলল, “এসব করে কী পেতো?”
রুমি এলো একটা আপেল হাতে। কামড় বসিয়ে দিয়ে বলল, “এসব হলো মেয়েলি সালতানাতের মতো। উনার শ্বাশুড়ি উনার সঙ্গে যা করেছেন, উনিও শ্বাশুড়ি হয়ে তাই করবেন এরকম নিয়তের ফসল। আমাদের ছেলেদের মধ্যে এত প্যাঁচ নাই।”
“তুই বলতে চাস আমি তোর মায়েদের উপর অত্যাচার করেছি? এই দিলি আমার ভালোবাসার মূল্য? তুই আমার বড় নাতি। কত তোর নষ্ট কাঁথা ধুয়েছি, মাথায় রাখিনি উকুনের ভয়ে, মাটিতে রাখিনি পিঁপড়ার ভয়ে।” দাদীর প্রায় কান্না করে দেবার দশা।

গৃহযুদ্ধ নামার সন্ধিক্ষণ। রুমি দ্রুত স্বীকারোক্তি দিয়ে বলল, “কী বলো দাদী। আমি তো আগের যুগের কথা বলেছি। তোমার মতো ভালো শ্বাশুড়ি হয় নাকি? আমি হলে তো একটা অ্যাওয়ার্ড রাখতাম, লাখে একজন এমন শ্বাশুড়ি ভাগ্য করে পায়।”
দাদীকে দেখে মনে হলো তিনি সন্তুষ্ট। ফিসফিস করে বললেন, “তবুও তোর মায়ের কাছে আমি খারাপ। আমার মনে প্যাঁচ। আমি বেশি কথা বলি।”
আরেকদফা হৃদয়বিদারক কাহিনী শোনার আগেই রুমির ডাক পড়লো। মাকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলো সে। ঝামেলায় পড়ে গেলো অর্পা। শ্বাশুড়ির পক্ষ নেবে নাকি আপাতত দাদী শ্বাশুড়িকে স্বান্তনা দেবে এ নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেলো।

**
— “রুমি? বাবা। তোর নতুন বউ। একটু ঘুরে টুরে আসবি। এসব কী আমার শিখিয়ে দিতে হবে? আমরাও তো একসময় নতুন বউ ছিলাম। ঘুরতে ইচ্ছা করতো পারতাম না, এখন সব আছে, কিন্তু ইচ্ছা আর করে না। সময় নষ্ট করিস না। যা কোথাও নিয়ে বউটাকে ঘুরিয়ে আন।”
কানিজ ছেলেকে চুপিচুপি সাংসারিক উপদেশ দিলেন। বড় ছেলেটা নেহাৎ বোকা, মনে হয় বুদ্ধি সুদ্ধি তেমন ওর মাথায় নেই। সব কী আর বলে বলে করানো যায়?

রুমি ভাবছে ওর কাছে তেমন পয়সা কড়ি নেই। আজকাল রিকশা ভাড়া দিতে গেলেও মনে হয় কিডনি একটা বিক্রি করে আসি। সে অস্বস্তি নিয়ে বলল, “কোথায় যাবো? আমার কাছে তো টাকা নেই।”
মা কত কি ভেবে বসে আছেন। এদিকে অর্পা? মুখ থেকে সুন্দর একটা কথাও বের হয় না, যেন সে পরপুরুষের সামনে বসে আছে। কুরআনের আয়াত পালন করছে, “তোমরা পরপুরুষের সঙ্গে মিষ্টি সুরে কথা বোলো না।”
মা ওর পিঠে আলতো হাতে চড় দিয়ে বললেন, “তোকে কী লন্ডন নিয়ে যেতে বলছি নাকি? আশেপাশে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবি। যখন টাকা হবে তখন দূরে কোথাও যাবি। স্বামীর সঙ্গে লন্ডনে যাওয়া যা, বাড়ির পাশের পুকুর দেখতে যাওয়াও তা।”
রুমি শেষবাক্যটার মর্মার্থ উদ্ধার করতে পারলো না।

অর্পাকে গিয়ে বলল, “যাও, রেডি হও। তোমার কী কেনাকাটা আছে, সব করে আসি।”
অর্পার স্মৃতিতে কোনো কেনাকাটার কথা মাথায় আসছে না। কিছু লাগবে বলে তো সে জানায়নি। তবুও স্বামীর আদেশ অমান্য করতে নেই। সে তৈরি হলো। যাওয়ার সময় শ্বাশুড়িকে পা ধরে সালাম করতে নিলো ভদ্রতাবশত। তিনি থামিয়ে দিয়ে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বললেন, “আল্লাহ ছাড়া কারো সামনে মাথা নত করতে নেই মা।”

***
রুমি বের হয়ে একটা সিএনজি ভাড়া করলো। রিকশা ভাড়া বেশি চাইবে। ওর কাছে আছে ভার্সিটি থেকে আসার সময় টিউশন ফি পাওয়া কিছু টাকা। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির জামানায় এই পরিমাণটা খুব স্বল্প। বিলাসিতায় ব্যয় করা যাবে না। সে বলল,
— “কোথায় যেতে চাও? আমাদের এদিকে আসলে ঘোরার জায়গা কম। নদীর পাড়ে যেতে পারো। রেস্টুরেন্টে বসতে পারো। নয়ত বইয়ের দোকানে ঘুরতে পারো।”
অর্পা বাইরে তাকিয়ে বলল, “বইয়ের দোকানে যাবো।”
রুমি চমকিত হলো, “তুমি বই পড়ো?”
“না। আমি কখনো বইয়ের দোকানেই যাইনি।”
সঙ্গে সঙ্গে চমকের পারদ ঋণাত্মক হয়ে হতাশায় পরিণত হলো, “তাহলে কেন যাবে?”
“কখনো যাইনি, তাই।” অর্পার সহজ উত্তর।

ওরা কয়েকটা বইয়ের দোকান ঘুরলো। এবার বইমেলায় প্রকাশিত নতুন একটা বই এসেছে। তানভীর ফুয়াদ রুমির ”শায়েরীনামা”। লেখকের গল্পটা খুব মর্মান্তিক। অর্পা অনলাইনে দেখেছিলো। সঙ্গে আরেকটা বই নিলো, জাভেদ হুসেনের অনুবাদ, “মাওলানা রুমির কবিতা”। এখন একসঙ্গে তিনজন রুমি আছে ওর সাথে। বেশ মজার একটা ব্যাপার। রুমি ভ্রু উঁচিয়ে কেবল দেখলো, কিছুই বললো না। রুমি টাকা পে করার আগেই অর্পা হাজারখানেক টাকার একটা নোট এগিয়ে দিলো দোকানিকে। রুমি অবাক হলো, “তুমি টাকা কোথায় পেলে?”
অর্পা ঠোঁট টিপে হাসলো।
“আসার সময় সবাইকে সালাম করেছিলাম, সালামি পেয়েছি। জীবনের প্রথম হালাল ডেটের আয়।”
রুমি না হেসে পারলো না। কী অদ্ভুত কথা!

এরপর ওরা নদীর পাড়েই চলে গেলো। অর্পা কিছুক্ষণ হাঁটার পর ভাবুক গলায় বলল, “আচ্ছা, বুঝলাম না। সবাই এই পানি দেখতে এত টাকা খরচ করে কেন আসে? পানি ঢেউ দিচ্ছে, এটা এত দেখার কী আছে?”
রুমি হতভম্ব হয়ে গেলো। আজ পর্যন্ত কাউকে সে একথা বলতে শুনেনি। ও ভালো করে জানে, এখন সে কিছু বললেই অর্পা পাল্টা জবাব দেবে যা হবে প্রথমটার চেয়ে জটিল এবং অদ্ভুত-তর। দেখা গেলো, ওকে ফেলে রাগ করে বাসায় চলে যেতে ইচ্ছা করলো।

নিজেকে সামলে নিয়ে একটা টেবিল ভাড়া করলো। উপরে কাপড়ের ছাতা ঝুলছে। নদী থেকে বয়ে আসা হাওয়ায় তা উড়ে যাবার জোগাড়। কিছু খাবার অর্ডার করে রুমি কৌতুহলী গলায় বলল, “তুমি বই না পড়লে কিনলে কেন?”
“একজনকে দেবার জন্য কিনেছি। গিফট।”
অর্পা নদীর দিকে তাকিয়ে কি যেন ভাবছে। রুমি একটু এগিয়ে এসে নরম গলায় বলল, “কিছু মনে না করলে বলা যাবে কার জন্য?”
“একটা ছেলের জন্য।”
আবার মেজাজ গরম করে দিচ্ছে মেয়েটা। গম্ভীর হয়ে গেলো সে,
“ছেলেটা কে?”
অর্পা ঠোঁট উল্টালো, সচেতন গলায় জানালো,
”আছে একজন। নীরাকে নিয়ে প্রতিদিন ডায়েরী লেখে আরকি।”
রুমি কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো। এই মেয়ে কী সত্যি সত্যি তার বউ? কীভাবে সম্ভব? অর্পা ঠোঁট টিপে হাসছে।

চলবে ~

আজকে আমার মন ভালো নাই পর্ব-০৪

0

আজকে আমার মন ভালো নাই।
নাহিদা সানজিদ

৪.
“হিমুর হাতে কয়েকটি নীল পদ্ম” পড়ে রুমির আরেক দফা মেজাজ খারাপ হলো। সারা জীবন টো টো করে ঘুরে বেড়ানো মায়া বর্জন করা হিমু সাহেবও প্রেমে পড়ে যাবেন যাবেন ভাব। আরেকটু হলেই চোখ থেকে দুফোঁটা চোখের জল পড়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা ছিলো। পড়ে শেষ করে বইটা টেবিলে ছুঁড়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলো চুপচাপ।
আমাদের সবার কাছে নাকি জন্মলগ্ন থেকে কিছু নীলপদ্ম দেওয়া হয়। সম্ভবত পাঁচটি। এই নীলপদ্মগুলো ভালোবাসার মানুষকে দিতে হয়। আর কেউ যদি তার সবটুকু পদ্মফুল কাউকে দিয়ে দেয়, তার নিজের বলতে কিছুই থাকে না। কাউকে আর ভালোবাসা যায় না।

উপন্যাসটির মূলভাবের সঙ্গে দ্বন্দ্ব করতে ইচ্ছা করছে না। থেকে থেকে আকাশে গুড়ুম গুড়ুম ডাক হচ্ছে। বৃষ্টি আসার সম্ভাবনা। আচ্ছা, নীরাকে কী সে সব পদ্মফুল দিয়ে ফেলেছিলো? অর্পার জন্য অবশিষ্ট কী নেই? এমন কোনো নিয়ম নেই যাতে সব পদ্ম ফেরত এনে সঠিক মানুষকে দিয়ে দেওয়া যায়? আমরা সবসময় ভুলভাল মানুষকে পদ্ম বিলিয়ে বসি। অথচ উচিত ছিলো পদ্ম জমিয়ে রাখা। চট করে যাকে তাকে পদ্ম বিলিয়ে দেওয়া ভালো কিছু অবশ্যই নয়।

নীরার স্মৃতি দিনদিন আবছা হয়ে যাচ্ছে। শেষ দেখা হয়েছিলো দু বছর আগে। এখন কেমন আছে কে জানে। জানার আগ্রহ অবশ্য হচ্ছে না। কিন্তু অর্পা ভীষণ বিরক্ত করছে। বিচ্ছিরি স্মৃতি মানুষকে বারবার মনে করিয়ে দেবার মতো নৃশংসতা আর নেই। আচ্ছা, অর্পা কী ভাবছে নীরার সঙ্গে ওর গভীর কোনো সম্পর্ক ছিল? মেয়েরা হয়ত একটু আগ বাড়িয়ে ভাবতে পছন্দ করে। ওর ছুটি বেশিদিন নেই। ক’দিন বাদেই চিরচেনা ঘর ছেড়ে ওর হলের দিকে ছুটতে হবে। ইঞ্জিনিয়ারিং নামক প্রেশার কুকারে মাথা দিয়ে জীবন বাটনা বাটায় বাটার মতো করে পিষে ফেলতে হবে। অর্পাকে কী তখন আর পাওয়া যাবে? মেয়েটা এত বোকা!

মাওলানা রুমির একটা উক্তি কোথায় যেন পড়েছিলো,
“Life is a balance of holding on and letting go”।
(জীবন হলো ধরে রাখা আর যেতে দেওয়ার মধ্যকার একটি ভারসাম্য।)
যেতে দিয়েছিলো নীরাকে, এখন কী ধরে রাখার সময় না?

**
সাফা-মারওয়ার টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট বেরিয়েছিলো। সাফা হাঁটুতে মুখ গুজে বসে আছে। হিচকি উঠাতে উঠাতে বলল, “ভোররাতের স্বপ্ন সত্যি হয়। দেখলি?”
মারওয়া প্রথমে ভয় পেয়েছিলো। ভেবেছিলো, সে একাই ফেল করেছে। পরে সবার খবর শুনে ওর মন চাঙ্গা হয়ে উঠলো। একসাথে সবাই ডাব্বা মারলে তেমন গায়ে লাগে না। ওদের পাশ করিয়ে না দিলে ফাইনালে কেউই বসতে পারবে না। স্কুলের লস। ওদের কী?
সে পান চিবুতে চিবুতে বলল, “কানের সামনে ভ্যান ভ্যান করিস না। এক বছরের ছোট তোর, তবুও তোর সঙ্গে পড়ছি। বাবাকে বলব, ব্রেইনে ধরছে না। প্রিম্যাচিউর ব্রেইন।”

সাফা উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “তাহলে আমি কী বলব?”
মারওয়া দুই পাটির দাঁত দেখিয়ে রহস্যময় ভঙ্গিতে হাসলো, “বলবি, বাবা পড়াশোনা আমার জন্য নয়। ইয়া আবি, পড়াশোনা নামক অলীক বস্তু আমার মাথায় ঢুকছে না। আপনি আমাকে বিবাহ দিয়ে দিন। তুই বলতে না পারলে আমি বলব।”
সাফা রাগ রাগ চোখে চেয়ে রইলো, ”আমার সঙ্গে ফাজলামো করবি না। সবসময় ফাজলামো ভালো লাগে না।”
মারওয়া অবাক হয়ে বলল, “ফাজলামো কখন করেছি? তুই অঙ্ক পারিস না, ইংরেজি বলতে তোতলাস। বিজ্ঞান তোর মাথায় ঢোকে না। ইতিহাস তোর মনে থাকে না। তুই শুধু শুধু ঢং দেখিয়ে পড়বি কেন?”
এরকম নিষ্ঠুর সত্য কেবল এ বাড়ির ছোট মেয়েটির পক্ষেই বলা সম্ভব। সাফার চোখে পানি এসে গেলো।

রাতে বাবা খাবারের পর দুজনকে ডাকলেন। মারওয়া নয়ছয় করে বুঝিয়ে ছাড়লো। বলল, “সবাই-তো ফেল করেছে। আমরা একা না। দোষটা আসলে স্যারের। উনি প্রশ্নে কিছু একটা গড়বড় করেছেন। আমরা বাচ্চামানুষ, এতকিছু কী মাথায় ঢোকে?”
মা জহুরি চোখে তাকালেন, “যে নিজেকে বাচ্চা দাবি করে, সে বাচ্চা না।”
মা বাবার সঙ্গে সে তেমন তর্ক করে না। চুপ থাকলো। এবার সাফার জবাবদিহির পালা। সে কিছু না বলে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। বাবা প্রশ্রয় দিতে চাইলেও মা শক্ত নজরে তাকিয়ে বললেন, “শুধু ম্যাট্রিকটা দেখবো। যদি উল্টাপাল্টা দেখি, বিয়ে শাদীর জন্য তৈরি হয়ে যেও।”
সাফার কান্নার গতি বাড়লো। সে কিছুতেই বিয়ে করবে না। মারওয়া স্বান্তনার সুরে বলল, “থাক, বেশিরভাগ মেয়েরই অমতে বিয়ে হয়। অমতে বিয়ের সাকসেস রেট বেশি, আমার পরিসংখ্যান বলছে। নামাজ পড়ে পড়ে একটা ভালো জামাই চাইবি, সূরা ফুরকানের ৭৪ নম্বর আয়াত পড়বি। বিবাহ নবীর সুন্নত, ক্ষেত্রবিশেষে ফরজ।”
পুরো রাত ধরে মারওয়ার লাগামহীন জবান চলতে লাগলো। বেশ কয়েকটি গল্প শুনালো যাদের অমতে বিয়ে হয়েছিলো কিন্তু এখন সুখে আছে। যেন ওকে দ্বায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বোনকে বিয়ের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করার।

***
সকাল সকাল ধবধবে সাদা মাঝারি আকারের একটি বিড়াল অর্পার শাড়ির আঁচল ধরে দুষ্টুমি করছে। যেন এটা একটা খেলার যন্ত্র। অর্পা প্রথমে ভয় পেলেও এরপর সহজ হয়ে গেলো। দুই পাহাড়ি নামের বোনদের আজ খোঁজখবর নেই। রাতে বকা খেয়ে সোজা হয়ে গিয়েছে মনে হচ্ছে। চিৎকার চেঁচামেচি নেই কোনো। অন্যদিনগুলোতে, “আম্মা, আমার হিজাব কই? পিন কই? বই কই? খাতা কই? কলম কই?” বলে বলে কান ঝাঁঝরা করে ফেলে। কানিজও বকতে থাকেন অবিরত। এই অত্যাচারের জন্য ঘরে কারো অ্যালার্মের প্রয়োজন পড়ে না। তবে অর্পার সঙ্গে তারা আগ বাড়িয়ে কথা বলেনি আর। অর্পা ভাবলো, এভাবে চলে না। একটু আধটু বন্ধু্ত্ব বোধহয় থাকা দরকার।

রুমি ফজর পড়ে আবার ঘুমাচ্ছে। মনে হচ্ছে চিন্তিত কিছু নিয়ে। চিন্তার গ্রাস থেকে বাঁচতে সারাদিন ঘুমাচ্ছে। অর্পা কাঁটামুকুটের গাছটা সাবধানে শেকড়সহ টেনে ওঠালো। একটা টবে মাটি ভর্তি করে ব্যালকনিতে এনে রাখলো। গাছের পুনর্বাসন শেষ করে পানি ছিটিয়ে দিলো। বিভিন্ন আর্টিকেল পড়ে গাছটা সম্পর্কে জানলো। এ নামের কোনো গাছ আছে সে এটাই জানতো না।

অর্পা মনে মনে দোয়া করলো গাছটা যেন বাঁচে। সবার হাতে নাকি গাছ ভালো জন্মায় না। কিছু কিছু মানুষ আছেন যাদের হাতে সবকিছুই হয়। যেমন, রুমির দাদী। যাই রোপণ করবেন ফলন দেয়। ব্যাপারটা জেনেছে ওর শ্বাশুড়ি মায়ের কাছ থেকে। অর্পা ভাবলো, ঠিকঠাক মতো ভালো না বাসলে বৃক্ষও হয়ত বাঁচে না। ছোটবেলা থেকে ওর মধ্যে স্বভাবজাত বিশেষ কোনো বৃক্ষপ্রেম ছিলো না। এজন্যই ভয়টা করছে। ওর শ্বাশুড়িকে হঠাৎ একটা প্রশ্ন করতে মন চাইলো, “আচ্ছা মা, ধরুন আমি গাছটাকে ভালোবেসে যত্ন করছি যে আমাকে দিয়েছে তার কথা ভেবে। তাহলে কী বাঁচবে?”
নিয়তে গড়বড় হলে গাছটা মরে যাবে এই ভয়েই সে কাটিয়ে দিলো পরবর্তী এক মাস।

চলবে ~
(কপি করা নিষেধ।)

আজকে আমার মন ভালো নাই পর্ব-০৩

0

আজকে আমার মন ভালো নাই।
নাহিদা সানজিদ

৩.
বাসর রাতে বউদের নাকি কিছু উপহার দিতে হয়। নতুন জামানার নিয়ম। আগের জামানায় সম্ভবত মোহরানা পরিশোধ করা হতো। এখন আর তা করা হয় না। দেনমোহর হলো একটি সৌজন্য লিপি। লেখার জন্য লেখে। কখনো বিয়ে ভেঙে যাবার জোগাড় হলে ঝগড়া করার টপিক পাওয়া যায়। ছেলে বলবে, “লোভী, কাবিন ব্যবসায়ী”। মেয়ে বলবে, “তুই একটা ছোটলোক।”
রুমি সেসব পর্যন্ত গেলো না। তার দেনমোহর দশহাজার এক টাকা। অনেক কষ্টে সে ভাংতি এক টাকাটা খুঁজে পেলো। আজকাল কেউ এক টাকা রাখেনা। কিন্তু প্রথম প্রতিশ্রুতিতে গড়িমসি করা সুপুরুষের লক্ষ্মণ নয়।

সঙ্গে কিনলো একটা একটা কাঁটামুকুটের গাছ। ইংরেজিতে যাকে বলা হয়, A Crown of Thorns। গাছটা সচরাচর এ বাজারে দেখা যায় না। এক বন্ধু থেকে জোরাজুরি করে কিনে নিলো। এ টাকাগুলো জমিয়েছিলো সে একটা ল্যাপটপ কিনবে বলে। এখন মনে হচ্ছে, ল্যাপটপ কেনার আগে বউয়ের পাওনা পরিশোধ করা বেশি জরুরি। আচ্ছা, অর্পা কী গাছটা পেয়ে হতাশ হবে?
এই যদি হঠাৎ, নারীমহলে বাসররাতে কী পেয়েছো বলে কথার আসর জমে, তখন কারো হীরার আংটি, প্লাটিনামের নাকফুল, স্বর্নের বালা বাহারি উত্তরের মাঝে অর্পা কী বলতে পারবে? সে পেয়েছিলো, একটি কাঁটামুকুট গাছ। দেখতে সুন্দর অথচ কী বিষধর! চাইলেই ছুঁয়ে ফেলা যায় না, সাবধানে ধরতে হয়?

রুমি তেমন কিছু ভাবলো না আর। বাসায় ফিরে দেখলো, ভয়াবহ একটা কান্ড ঘটেছে। অর্পা তার ডায়েরী পড়ে ফেলেছে। কোনো এক কুখ্যাত সালে নীরাকে নিয়ে লেখা প্রেমকাব্য, রচনা। খুব বেশি কিছু লেখা নেই তাতে। দু এক পাতার গল্প। সে ইতিহাস রোমন্থন না হয় আরেকদিন করা যাবে।
শেষে সুনীলের কবিতা জুড়ে দেওয়া :

“এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে কোনো পাপ করতে পারি ?
শেষ বিকেলের সেই ঝুল বারান্দায়
তার মুখে পড়েছিল দুর্দান্ত সাহসী এক আলো
যেন এক টেলিগ্রাম, মুহূর্তে উন্মুক্ত করে
নীরার সুষমা
চোখে ও ভুরুতে মেশা হাসি, নাকি অভ্রবিন্দু ?
তখন সে যুবতীকে খুকি বলে ডাকতে ইচ্ছে হয়–
আমি ডান হাত তুলি, পুরুষ পাঞ্জার দিকে
মনে মনে বলি,
যোগ্য হও, যোগ্য হয়ে ওঠো–
ছুঁয়ে দিই নীরার চিবুক
এই হাত ছুঁয়েছে নীরার মুখ
আমি কি এ হাতে আর কোনোদিন
পাপ করতে পারি ?
এই ওষ্ঠ বলেছে নীরাকে , ভালোবাসি–
এই ওষ্ঠে আর কোনো মিথ্যে কি মানায়?”

সে ঘরে ঢোকামাত্রই চমকে উঠলো। চমকালো না অর্পা। সে মনোযোগ দিয়ে একের পর এক পাতা উল্টে যাচ্ছে যেন প্রিয় কোনো উপন্যাস। কারো দিকে মনোযোগ দেবার ফুরসত পর্যন্ত নেই। মুহুর্তেই রুমির মনে জন্ম নেওয়া সকল অনুভূতির অকালমৃত্যু হলো। বিয়ে হয়েছে বলে কী প্রাইভেসি থাকবে না? নিজের কোনো নিজস্ব অনুভূতি? হাতের কাঁটামুকুটের গাছটা শব্দ করে টেবিলে রাখলো সে। অর্পা শান্ত চোখে তাকালো। রুমি গম্ভীর গলায় বলল,
— “আপনি আমার ডায়েরীতে হাত দিলেন কেন?”
অর্পা ভীষণ সাধারণ সুরে বলল, “তাহলে কে দেবে? নীরা?”
রুমি ঢোক গিললো, কিছু বললো না।
কিন্তু অর্পার কথারা হারতে ভুলে গেলো,
— “বাহ্! নীরার মুখও ধরা হয়েছে?”
সঙ্গে আরো একটা বাক্য যোগ করলো যা লিখে ফেললে কলমেরও গুনাহ্ হবে বলে ওর ধারণা। আঁৎকে উঠে ওর পানে একবার চাইলো। কী বিশ্রী কথা বলছে মেয়েটা! অথচ কালকে এই মেয়েটাকেই পৃথিবীর সবচেয়ে সহজ সরল মেয়ে বলে মনে হচ্ছিলো। এজন্য নারী ছলনায় সে দ্বিতীয়বার জড়াতে চায়নি। দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
— “এখানে ওষ্ঠে কথা বলার কথা বলা হয়েছে। ইউ হ্যাভ অ্যা ডার্টি মাইন্ড.!”
অর্পা অবাক হওয়ার চেষ্টা করলো, “আই হ্যাভ অ্যা ডার্টি মাইন্ড? ইউ হ্যাভ দ্য পিউরেস্ট সৌল অ্যাজ ওয়াটার, হুঁ?”
রুমি বুঝতে পারছে না অর্পা সব বাড়িয়ে বাড়িয়ে বলছে কেন? এই সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায় কী? বিয়ের পরদিনই এতসব হতে হলো?

**
রুমির মা কোনো এক মহিলা মক্তবে নতুন করে শুদ্ধ কুরআন পাঠের নিয়ম কানুন শেখা শুরু করেছেন। যাকে দেখছেন, তাকেই ডেকে বলছেন, “দেখি আলিফ বা তা বল?”
এই গ্যাড়াকলে প্রথমে পড়লো রুমির বাবা। স্বামীর বাহু টিপে দিতে দিতে আদুরে গলায় বললেন,
— “দেখি আলিফ বা তা বলুন তো?”
আব্দুর রহমান সাহেব বলতে লাগলেন অনর্গল। কানিজ দ্রুত থামিয়ে বললেন, “ছা হবে না। ث উচ্চারণ করতে হবে আলতো করে। জিব্বা উপরের পাটির দাঁতের আগায় লাগিয়ে। সা….”
এরপর ز(যা) উচ্চারণের সময় বললেন, “যাহ্! যাহ্!”
রুমির বাবা ভয় পেলেন স্ত্রী তুই তোকারি শুরু করলেন কি না ভেবে। পরে বুঝলেন, উচ্চারণ শেখাচ্ছে। এমনভাবে তাড়িয়ে দিয়ে ‘যাহ্’ ‘যাহ্’ বলতে হবে যেন ঝিঁঝি পোকার আওয়াজ হয়। তিনি ধীর গতিতে বললেন,
— “একটু সময় নিয়ে ভালোমতো শেখো, তারপর শেখাও।”
স্ত্রীগণ যে কোনোকিছু শেখেন না, কেবল শেখান — এই অভিজ্ঞতা তিনি ভুলতে বসেছিলেন। তাই আপাতত তার পুনঃপাঠ সেশন চলবে।

***
— “তুই এভাবে নেড়িকুত্তার মতো আমার পেছন পেছন আসিস কেন?”
আরিব চোখ বড় বড় করে বলল, “তুই আমাকে নেড়িকুত্তা বলছিস?”
মারওয়ার ভাবভঙ্গি একেবারে স্বাভাবিক, “তুই ছাড়া তো আর কোনো কুত্তা চোখে পড়ছে না।”
আরিবকে আশাহত করে দিয়ে মারওয়া দ্রুত পায়ে স্কুলের দিকে এগিয়ে গেলো। সেভেন এইট থেকে এই ছেলে তার পেছন পেছন ঘুরছে। যেন বর্ডিগার্ডের দ্বায়িত্ব নিয়েছে। পাহাড়া দেয় রাস্তায় নিজের স্বজাতি কুকুর আবার আক্রমণ করে বসে কি না।
— “আমি তোর বয়সে বড়, এটা জানিস?”
— “তো কী করব? বয়সে বড় হলেই হয় না, চরিত্র হাঁটুর নিচে।”
— “তুই এভাবে বলতে পারলি! আমি চরিত্রহীনের মতো কী করলাম? আর তুই আমাকে তুই তোকারি করবি না।”
মারওয়া চোখ মুখ কুঁচকে ভেংচি কাটলো,
— “ওরে রে, তুই তোকারি করব না। আপনি আজ্ঞে করব? তোর বয়স কত?”
আরিব ঢোক গিলে বলল, “কেন? আঠারো।”
মারওয়া আঙ্গুল উঁচিয়ে ভাষণ দেওয়ার মতো করে বলল, “এই তো, এখনও প্রি-ম্যাচিউর বেবি। এই বয়সে পড়াশোনা করতে হয় বৎস, কুকুরিপনা করতে হয় না। কোনো বয়সেই করতে হয় না। তুই তো গোটা পুরুষজাতির মান ইজ্জত ডুবিয়ে দিচ্ছিস!”

আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সে দৌড়ে স্কুলের ফটক পেরিয়ে চলে গেলো। আজ ওদের টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট। সাফা ক্লাসে বসে সবার পানির বোতল শেষ করছে, আর কাঁদো কাঁদো গলায় বলছে, “প্লিজ দে। আমি কল থেকে পুরিয়ে আনবো আবার।”
ভোররাতে সে স্বপ্ন দেখলো গণিতে ফেল করেছে। টেস্টে ফেল করলে তো ফাইনালে বসা যাবে না। কী অপমানজনক একটা ব্যাপার হবে!

মারওয়া এলো হেলেদুলে। ও প্রথম ক্লাস করেনি। বাংলা ম্যাডাম এসেই ধমক দিলেন,
— “এই মেয়ে? স্ট্যান্ড আপ!”
মারওয়া নির্ভয়ে দাঁড়ালো। ম্যাম বললেন,
— “দূর থেকে দেখলাম তুমি এখন এসেছ। এখন বলো, এটা কী স্কুলে আসার সময়? কী এমন কাজ করছিলে যে তোমার চল্লিশ মিনিট লেট হলো?”
মারওয়া চোখেমুখে কৃত্রিম আবেগ নিয়ে এলো জাদুবলে, “ম্যাম, আমার সেজো বিড়ালের খুব অসুখ। পরপর চারটা বেড়াল হাসপাতালে ভর্তি। দেখে এলাম। কী বলব ম্যাডাম! এত দুশ্চিন্তা হয়, রাতে ঘুমাতে পারি না।”

ক্লাসের সবাই খিলখিল করে হেসে ফেলল। ওর বিদ্যালয়ে একটা সুন্দর নাম আছে। ক্যাট’স মাদার, বিড়ালের জননী। ম্যাডাম ডাস্টার দিয়ে টেবিলে পরপর দুটো বাড়ি দিয়ে বললেন, “এই একদম চুপ!”
এরপর একপলক ওর পানে চেয়ে বললেন, “আর কিছু?”
মারওয়া হেসে মাথা নাড়লো উপরনিচ। বলল, “আমার সাত নম্বর বিড়ালের মেয়ের বাচ্চা হয়েছে ম্যাম। আমি নানী হয়েছি, আপনি বড় নানী।”
“গেট আউট! গেট আ-উ-ট।”
শেষবার বললেন ধীর গতিতে স্পষ্ট উচ্চারণে। বোঝা যাচ্ছে অবস্থা সঙ্গিন। মারওয়া বিনাবাক্য ব্যয় করে বেরুলো। দুজন মিলে বের হলে মজা হতো। একা একা কী করবে ভেবে খারাপ লাগছে। আজকাল সত্য কথার ভাত নেই। ওর পকেটেও একটা বেড়ালছানা আছে। বোরকার পকেট বড় হওয়ায় সাথে করে নিয়ে এসেছে। বসে বসে ওর সঙ্গে নিজমনে কথা চালাচালি করতে লাগলো।

ক্লাস শেষে সবাই বিড়ালটা নিয়ে হুড়োহুড়ি শুরু করলো। কোলে নেওয়ার আবদারে মারওয়া বিরস মুখে কেবল চেয়ে রইলো। এরপরই ওর প্রিয় বান্ধবী বিড়ালটা উপহার হিসেবে চাইলো। ‘না’ করা যায় না। আবার বাচ্চাটা ওর সঙ্গে থাকবে না ভাবতেই বুক খালি হয়ে যাচ্ছে। কী করবে এখনও কিছু ঠিক করেনি। স্কুল থেকে পালিয়ে যাওয়ার সময় দেখলো কিছু ছেলে শরবত বিলি করছে। প্রথম দেখায় ভেবেছিলো বিক্রি হচ্ছে। আরিব ওর পেছনে এসে দাঁড়ালো, “খাবি? কিনে দেই?”
মারওয়া মুখ নিচু করে থুতু দিয়ে একটু সরে দাঁড়ালো, “তোর এত মনে চাইলে তুই খা। পুরা এলাকাবাসীকে বিলা। আমার সঙ্গে ঢং দেখাতে আসিস না।”
রাগ করে হাঁটতে শুরু করে ডলিকে বলে গেলো, “যা। বিড়ালটা তোর।”
যাওয়ার পথেই ওর রাগ কমে গেলো। সে বিড়ালটার জন্য হুহু করে কাঁদতে লাগলো। আরিব বিস্মিত হবার মাত্রা ছাড়িয়ে ফেলেছে, “একটা বিলাইয়ের জন্য এত কান্না? আর আমি তো মানুষ। এত খারাপ লাগছে তো দিলি কেন?”

****
“অর্পা, তুমি কী কষ্ট করে মশারিটা টাঙিয়ে দিতে পারো?
”না, নীরা আছে না?”
”খুব ক্ষুধা লেগেছে। একটা ডিম ভেজে দিতে পারো?”
“নীরাকে বলেন।”
“একটু সরো।”
“নীরাকে বলেন।”
“লাইট টা অফ করো।”
“নীরাকে বলেন।”

রুমি অতিষ্ঠ হয়ে বললল, “নীরা এবার অফ যাও।”
অর্পা নাটকীয়ভাবে মুখ হা করে চেয়ে রইলো।
— “বাহ্ নীরা.? আমি নীরা?”
রুমি আমতা আমতা করতে শুরু করলো,
— “তোমার দোষ! সারাক্ষণ কী নীরা নীরা ক্যাচাল শুরু করেছে, ভুলে মুখে চলে এসেছে।”
অর্পা অনেক কিছু বুঝে ফেলার ভান করে বলল,
“মানুষের মনে যা মুখেও তো তাই হবে। সবই বুঝি।”
“মেয়েমানুষ একটু বেশি বেশি বুঝে, এটাই সমস্যা।”
“নীরা মনে হয় একটু কম বুঝতো।”
রুমির একবার ইচ্ছা করলো দেয়ালে মাথা ঠুকতে ঠুকতে মরে যেতে। একবার বিষয়টাতো বুঝতে চাইবে। না, সে কিছু শুনতেই রাজি না। কেবল ফরফর করে বলতে রাজি। নীরা নীরা করে জপ করতে রাজি।

”যতবার নীরা নীরা করছো ততবার ‘আস্তাগফিরুল্লাহ – সুবহানাল্লাহ’ পড়লেও সওয়াব পেতে।”
“নীরাকে নিয়ে ডায়েরী না লিখে কোনো কাজ করতে, তাহলে এতদিন ফকির থাকতে না।”
রুমি বিরক্ত হয়ে “হিমুর হাতে কয়েকটি নীল পদ্ম” পড়তে শুরু করলো। ওর হিমু হওয়ার শপথ ভঙ্গ করাটাই অভিশাপ ছিলো। সে এবার হিমু হয়ে যাবে। বিবাহিত ব্যাচেলর হিমু।

চলবে ~

আজকে আমার মন ভালো নাই পর্ব-০২

0

আজকে আমার মন ভালো নাই
নাহিদা সানজিদ

২.
রুমির বিয়ের দিন বাসর ঘরে এসেই লজ্জাজনক একটা ব্যাপার ঘটলো। বিয়ে বাড়িতে হঠাৎ ভারী ভোজের দরুন বেচারার পেটের অবস্থা নাজেহাল হয়ে উঠলো। বারবার ওয়াশরুমে আসা যাওয়া করতে করতে একেবারে সেখানেই ঘর করে নিলো। লজ্জায় আর বের হওয়ার নাম নিলো না। বাসরঘরে বসে আছে তার সদ্য বিবাহিতা স্ত্রী। নাম অর্পা। এত সুন্দর নাম সে অনেকদিন শোনেনি। তবুও তার মুখ থেকে শোনেনি, বিয়েতে কাজী সাহেব যখন কনের নাম উল্লেখ করেছিলেন তখন শুনেছিলো। অর্পা মাঝে একবার শুধু আড়ষ্ট গলায় বলেছে, “আপনার কী খুব খারাপ লাগছে?”
রুমি কিছু বলতে পারলো না। চুপচাপ থাকতে থাকতে তার এই দশা হয়েছে। অপরিচিত মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে বুক কেঁপে ওঠে। বারবার মনে হয় উল্টাপাল্টা উত্তর হয়ে যাচ্ছে। আবার ভেবেচিন্তে বলতে গেলে অনেক দেরী হয়ে যায়। পরিবেশ অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। ভাবতে ভাবতে আর বলা হলো না। প্রকৃতি আবার নিয়ম ভঙ্গ করে ডাক দিলো তাকে।

অর্পা অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর স্বামীকে ফিরতে না দেখে ওঠার চেষ্টা করলো। ভারী শাড়ি নিয়ে ওর হাঁটতে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। কোমড়ে কালসিটে দাগ পড়ে গেছে। শাড়ির কুচিগুলোও এলোমেলো। বিছানার টি-টেবিলে এক গ্লাস দুধ ঢেকে রাখা। খাওয়া হবে কি না জানা নেই। আধ পুরোনো একটা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে অর্পা গহনাগুলো খুলতে লাগলো। সেজেগুজে কারো সামনে যেতে তার কেমন যেন আড়ষ্টতা কাজ করে। ঘরের সামনে লাগোয়া বেসিনে কড়া লাল লিপস্টিক ধুয়ে সে দুই পাহাড়ি নামের বোনদের খুঁজতে বেরুলো। মারওয়া দরজা ধরে উচ্চ আওয়াজে কথা কাটাকাটি করছে। তাদের খুঁজে পেতে তাই বেগ পোহাতে হলো না। অর্পা হালকা স্বরে তার নাম ধরে ডাকলো,
— “মারওয়া!”
মারওয়া ঘাড় ঘুরিয়ে এক পলক দেখলো। চাপা স্বরে বোনকে বলল, “কী ম্যানারলেস মেয়েটা! স্বামী ফেলে এদিকে চলে এসেছে। বাসর ঘর থেকে কেউ বেরোয়?”
দূর থেকে তার কুটিল শব্দমালা অর্পা শুনতে পেলো না। সাফা চোখ গরম করে বলল, “তুই তো মনে হয় বাসর ঘরের ম্যানার্সের উপর পিএইচডি নিয়ে এসেছিস। বই লিখবি বলে ভাবছিস, ‘বাসর ঘরের আদব’, তাই না?”
মারওয়া তার স্বভাবসুলভ ঠোঁট বাঁকালো। নতুন ভাবির জন্য তাদের ঘর থেকে একটা ড্রেসিং টেবিল সরিয়ে বাবা ভাইয়ের ঘরে সেট করেছেন। কী সাংঘাতিক ব্যাপার! আসতে না আসতেই সবকিছুতে ভাগ!

অর্পা এগিয়ে এসে বলল, “উনার মনে হচ্ছে শরীর খারাপ। ওয়াশরুম থেকে বের হচ্ছেন না। তোমাদের কাছে ঔষধ হবে? কিছু মনে করো না, তুমি করে বলছি।”
নিচের ঠোঁট জিভ দিয়ে ভেজালো অস্বস্তিতে। এই অচেনা পরিবেশে অচেনা মানুষের সঙ্গে মেপে মেপে কথা বলতে বলতেই বোধহয় জীবন কাবার হবে। মনে মনে প্রতিটি বাক্য সাজিয়ে বলার চেষ্টা করছে সে। কখন কী ভুল ধরে ফেলে!
সাফা উদ্বিগ্ন চোখে তাকাতেই মারওয়া ফিক করে হেসে ফেললো। অন্য দিকে তাকিয়ে বলল, “এটা ওর আজন্ম রোগ। একটু ওলট পালট নিয়ম হলেই মহাশয়ের বাথরুম প্রেম বেড়ে যায়। এবার যত তাড়াতাড়ি মানিয়ে নেওয়া যায়!”

নববধূ হিসেবে তার বিরক্ত হবার কথা। কিন্তু সে হলো না। মারওয়ার কথায়ও কিছু মনে করলো না। কিছু কিছু মেয়ে ধরেই নেয় ভাইয়ের বউরা অমানুষ কিসিমের হয়। এদের মাথায় ওঠাতে নেই। মাথায় ওঠালে নাকি সংসার চিবিয়ে খায়। অর্পা সাফাকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আমাকে ঔষধের কৌটা দিতে পারবে? আমি খুঁজে নিচ্ছি ঔষধ।”
কৌটা হাতে নিজের ঘরে ফিরে গেলো অর্পা। শান্ত চোখের চাহুনি, মার্জিত বলার ভঙ্গিতে সাফা মুগ্ধ চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো। তারপর একটা বালিশ নিয়ে মারওয়ার দিকে ছুঁড়ে মারলো।
— “তোর মতো অসভ্য মেয়ে আমি আর দেখিনি। বয়সে তোর কত বড়! এরকম ঢং দেখালি কেন?”
মারওয়া বালিশ হাতে ভেঙিয়ে বলল, “তোমাকে তুমি করে বলছি, কিছু মনে করো না।”

**
আজ আকাশে চাঁদ নেই। ঠান্ডা মৃদু মৃদু হাওয়া প্রবাহমান। রুমির ঘরের সঙ্গে আছে লাগোয়া একটি ছোট্ট বারান্দা। এর আয়তন এতটাই সংকীর্ণ যে দুজন একসঙ্গে দাঁড়ানো যায় না। বড়জোর গুটিশুটি মেরে বসা যাবে, কিন্তু আরামদায়ক হবে না। অর্পা ঘরের ভেতরে থাকা বাথরুমের দরজা বাইরে থেকে আটকে শাড়ি পালটে ফেললো। গাঢ় নীল রঙের একটা শাড়ি। সোনালী রঙা ব্লাউজ আর শাড়ির পাড়। অর্পা চেয়েছিলো এই শাড়ি পরেই সে বিয়ে করবে। কিন্তু সবার চাওয়া পাওয়ার উপর প্রাধান্য পেলো না সে ইচ্ছা। ব্যালকনির গরাদ বেয়ে বেপরোয়া ভাবে বেয়ে উঠছে মানিপ্ল্যান্টের ডগা। একটা পাতা চোখ মেলবে মেলবে ভাব। বেকার মানুষের ঘরে মানিপ্ল্যান্ট থাকার পেছনে অন্ধ কুসংস্কারও থাকতে পারে।

অর্পা মাঝেমাঝে অবাক হয়। তার মামা কী করে একজন বেকার পুরুষের হাতে মেয়ে তুলে দেবার সাহস করলেন? অর্পার বড় ভাই যখন তেড়ে এসে বলল, “এই শালার পুতের ঘরে বিয়ে দেবো না। খচ্চর লোকেরা জুতা পর্যন্ত পাঠায়নি কনের সাজের সঙ্গে। কী ছোটলোক! আজকাল কে বেকারের ঘরে বিয়া দেয়!”
মামা দার্শনিকের মতো ভাবুক গলায় বললেন, “একটা বেকার ছেলে ঠিক কতদিন পর্যন্ত বেকার থাকবে! কিছু না কিছু তো করবেই। বউয়ের দ্বায়িত্ব পরিবার তুলে দিলে আরো আগে করবে। এটা তো আর পালিয়ে বিয়ে না যে দায় দ্বায়িত্ব নাই। আমরা তো মাথার উপরে আছি। পরিবর্তন আমাদেরই করতে হবে, সমাজটা উচ্ছন্নে যাচ্ছেরে বেটা।”
অর্পার ভাই বিরক্তিতে মুখ বিকৃত করে ফেলল, ”সমাজ সংস্কার করার জন্য আপনি আমার বইনরেই পাইলেন?”
মামা উত্তর করেন না। বাবা চাকরি হারিয়েছেন বছর কয়েক হচ্ছে। বিয়েটা মামার খরচে হচ্ছে, বাবা কিছু বলার সাহস খুঁজে পাননা। অর্পা না করে না আর।

বেশ অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পর রুমি বের হলো। ওর মনটা তেতো হয়ে আছে। সদ্য বিয়ে করা বউয়ের সামনে তার সম্মান বলতে বোধহয় কিছু থাকলো না। অর্পা পেছন ফিরে তাকালো। বাতাসের তীব্রতা ধীরে ধীরে বাড়ছে। অর্পা ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বলল, “আসসালামু আলাইকুম।”
রুমি চোখ তুলেও তাকালো না। একমনে পায়ের দিকে তাকিয়ে জবাব নিলো অস্বস্তির সুরে। অর্পার হঠাৎ হাসি পেয়ে যাচ্ছে, সে মাথার ঘোমটাটা আরো একটু টেনে যথাসম্ভব লাজুক গলায় বলল, “পা ধরে সালাম করতে হবে?”
রুমি আৎকে উঠে “না, না” পা লুকানোর চেষ্টা করলো। অর্পা হাসি আটকে রাখতে পারলো না। মুখে আঁচল চেপে হাসতে লাগলো অনবরত। ওর শরীর হাসির ভারে কাঁপছে। রুমি তাকাতে চেয়েও তাকালো না। ওর কেমন যেন লজ্জা লজ্জা করছে। কৈশর থেকে নারীসঙ্গ পরিহার করতে করতে এক ধরনের বৈরাগ্য হানা দিয়েছে মনে। অর্পা ওকে পানি আর ঔষধ এগিয়ে দিয়ে বলল, “আমি কিছু মনে করিনি। বিয়েটা অনেক লম্বা একটা জার্নি। যদি ইমেজ বজায় রাখতে যাই, তাহলে বিয়ে করা উচিত না। আমি চেয়ারে, সোফায়, গাড়ির সিটে পা নিচে রাখতে পারি না। দুপায়ে আসন দিয়ে বসে থাকি। মাংসের তারকারি খেতে গেলে চোখ নাক দিয়ে অনবরত পানি পড়ে। মুখ হা করে ঘুমাই। চোখ হালকা খোলা থাকে। আম্মা বলে, কাউয়া ঘুম। এগুলোতে ইমেজ কীভাবে ধরে রাখবো বলেন?
মানুষ হিসেবে একেবারে নরমাল বিষয়।”
রুমি “কাউয়া ঘুম” এর নাম শুনে হেসে ফেললো। সেই সঙ্গে অর্পার কথা শুনে মুগ্ধও হলো।

কথা বাড়ার আগেই দরজা জানালা শব্দ করে বন্ধ হয়ে গেলো। ঝড় শুরু হচ্ছে। বহুদিন একটানা গরমের পর একটু স্বস্তির বৃষ্টি। অর্পা একহাতে দরজা টেনে ধরে চোখ বন্ধ করে বাতাসের ঘ্রাণ নিচ্ছে। ওর খোপাটা নেই। চুল খোলা। বিয়ের সময় করে দেওয়া মাথার অগ্রভাগের দুপাশে চিকন করে দেওয়া খেঁজুর বেণী। বিয়ের সাজটাও হালকা ছিলো। এখন আরো হালকা হয়ে দারুণ দেখাচ্ছে। পরনের নীল শাড়িতে ওকে বেহেশতী হুরের মতো লাগছে। রুমি কখনো হুর দেখেনি, তাই উপমাটা বেমানান। হাতের এলোমেলো সংখ্যার চুড়ির তাল বৃষ্টির সুরের সঙ্গে মিশে অন্যরকম সঙ্গীত সৃষ্টি করছে। রুমির হঠাৎ সৈয়দ মুজতবা আলীর লেখা “শবনম” এর কথা মনে পড়ছে।
“আমার বিরহে তুমি অভ্যস্ত হয়ে যেওনা!”
আর লতিফুল ইসলাম শিবলীর লেখা “আসমান”।
“তুমি আমার আসমান!”

***
রুমিদের বাড়িটা দোতলা। বাড়ির সামনে পেছনে পর্যাপ্ত উঠান। পেছনে নানা রকম গাছে সুশোভিত বাগান। এক মুহুর্তের জন্য জমিদার বাড়ি বলে ভ্রম হয়। নিচতলায় ভাড়া থাকে মানুষ। এ জায়গাটা গ্রাম শহরের মাঝামাঝি। মানুষের মাঝেও আধুনিকতা, গ্রামীণ জীবনাচার সমান সমান ভাবে বিদ্যমান। এ যেমন চিন্তাভাবনায় যথেষ্ট আধুনিক হওয়া স্বত্তেও রুমির দাদী রুমির দরজায় কান পেতে আছেন। কান পেতে ঠিক কী শোনার চেষ্টায় আছেন তাও এক রহস্য বই কি। মারওয়া এই রহস্য উদ্ধার করতে এগিয়ে এসে নিজের কানটাও পাতলো। কিছু শোনা যাচ্ছে না। দাদীকে ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় “কী?” জিজ্ঞেস করলো। দাদীও ভ্রু নাচালেন।

এ বাড়িতে সকলে ফজরের সঙ্গে ওঠে। রুমির দাদাজান মৃত্যুর আগ পর্যন্ত এ নিয়ম করে গেছেন। একবার তো রুমিকে ঘুমন্ত অবস্থায় বিছানা থেকে ফেলে দিলেন ঘুম ভাঙছিলো না বলে। মেয়েদের ক্ষেত্রে কিছুটা ছাড় জোটে। সাফা হঠাৎ হাভাতের মতো উঠে বসলো। স্বপ্নে দেখলো, অঙ্কের স্যার ধমকে ধমকে বলছেন, “বোর্ডে আয়, অঙ্কটা করে দেখা দেখি।”
সাফা বুকে থুতু দিয়ে খানিকটা ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করলো। বাবা বলেছিলো দুঃস্বপ্ন দেখলে ”আউজুবিল্লাহ” পড়ে থুতু দিয়ে পাশ ফিরে ঘুমাতে হয়।
এটা কী কোনো দুঃস্বপ্ন ছিলো? দুঃস্বপ্নই তো!
মারওয়াকে ঘটনা খুলে বলতেই বিকট আওয়াজে হাসতে শুরু করলো। মেয়েরা নাকি ভাবে, বোন থাকলে সুখ দুঃখের গল্প করা যায়। কতজনকে হাহুতাশ করতে দেখেছে! এ কোন পিশাচ জাতের প্রাণী যে হেসে হেসে সমবেদনা জানায়?

সে রাতের প্রচন্ড ঝড়ে ওদের বাড়ির গেটের উপর লাগানো দুটো মাটির বিমানের একটি খালে পড়ে গেলো। বাবা শখ করে লাগিয়েছিলেন এ দুটি। মাঝখানে মাটির ছাউনি দিয়ে ছোট্ট ঘর। ঘরটা অবশ্য কবরস্হানের মতো দেখাচ্ছে। আগে বের হলেই মারওয়াকে উত্যক্ত করতে কিছু ছেলে বলতো, “কীরে তোর দাদার কবর নাকি?”
মারওয়া জুতা হাতে নিয়ে পেছন পেছন ছুটে যেতো। সেদিনগুলোর মতো আজও ধ্বংসাবশেষের উপর নিষ্ঠুর হাতির মতো পা ফেলে পাড়ার দুষ্ট ছেলেরা হেঁকে হেঁকে সংবাদ পড়তে লাগলো, “রুমির প্রাইভেট জেট বিমানটি নববধূসহ বাংলাদেশের উপর দিয়ে আসার কালে দূর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয়েছে। আমরা তাদের আত্মার মাগফিরত কামনা করি।”

চলবে ~

আজকে আমার মন ভালো নাই পর্ব-০১

0

আজকে আমার মন ভালো নাই।
নাহিদা সানজিদ ।

১.
“আমাদের বাসার মানুষদের অদ্ভুত এক ব্যামো আছে। যেমন ধরুন, কেউ চাচ্ছে না বিয়ে করতে, তাকে জোর করে ধরে হলেও কবুল বলিয়ে নেওয়া ফরজ হয়ে দাঁড়াবে। আবার, কেউ বিয়ে করার জন্য মরিয়া, তাকে সবক দেওয়া হবে সাওম পালন করার। অর্থ্যাৎ বিবাহ করা ইলম অর্জনের পথে বাধা। তাহার এখন কোনোমতেই বিবাহ হওয়া যাইবে না।

পরিবারের এই ব্যামোর শিকার হতে চলেছে আমার বড় ভাই। বাবা শখ করে নাম রেখেছিলেন রুমি। কোথায় নাকি এ নামে একজন বিখ্যাত কবি টবি ছিলেন। আমার অত জানাশোনা নেই। বেচারা বিয়ের দুঃখে কেঁদে ফেললো। কিছুতেই সে বিবাহ করবে না। আমি ওর পিঠে হাত বুলিয়ে বললাম, ‘মেয়েদের মতোন কাঁদছিস কেন? মনে হচ্ছে তোকে নদীর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে কেটেকুটে। আশ্চর্য!’

এত বড় ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলে, অথচ কেঁদে একাকার। তাকে কিছুতেই স্বান্তনা দিয়ে মানানো গেলো না। টেবিলে মাথা ফেলে দুঃখভরা চোখে চেয়ে রইলো শূন্যে। একটু ঢঙ করুক। কদিন পর দেখবো, বউয়ের আঁচল তলায় মুখ লুকিয়ে হাঁটছে। ভাতের মতো উতলে ওঠা প্রেমে ঘরে টেকা যাবে না ছ-সাত মাস। এসব আমার খুব ভালো করে জানা আছে। বাঙালি ঘরের ছোট মেয়ে তো। অনেক কিছুই আন্দাজ করতে পারি। যদিও আমার বয়স খানিকটা কম, তবুও বাবা বলেন, আমার মাথা ভালো। বাকি দুটোর মতো গর্ধভ গোছের নই।

এই ঘটনাটা লিখে রাখার একটা কারণ আছে। আমার গর্ধভ বড় ভাইজান যখন বউয়ের প্রেমে হাবুডুবু খাওয়া শুরু করবেন, তখন আমি চট করে লেখাটা হেঁকে হেঁকে পড়তে শুরু করব। রসিয়ে রসিয়ে বর্ণনা করব, আমার হবু ভাবীর বর তাকে বিয়ে করতে কতটা অনিচ্ছুক ছিলেন। আর আমার ব্যামো মাথার পরিবার তাদের সিদ্ধান্তে কতটুকু সঠিক। মোটামুটি ঘরে একটি লঙ্কাকাণ্ড বাঁধলে এই পরিশ্রমটুকু সার্থক হবে। সংসারে ননদের ভূমিকা পালন না করলে কী হয়?”

মারওয়া লেখা শেষ করে কালো রঙা ডায়েরীটায় চাবি ঘোরালো। ওর বাবা আব্দুর রহমান সাহেব তার তেরোতম জন্মদিনে ঠিক আনা ফ্রাঙ্কের বাবার মতো একটি লক ডায়েরী উপহার দেন। মারওয়াদের ঘরে কখনো কারো জন্মদিন পালন করা হয় না। তেরোতম জন্মদিনে এই আকস্মিক চমকে মারওয়া অবাক না হয়ে পারেনি। আব্দুর রহমান সাহেব মানুষ হিসেবে শৌখিন। নরম গলায় বললেন, “মা, তোমার মতো বয়সে আনার লেখা ডায়েরীটা এখন বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। ডায়েরীতে তুমি তোমার সুখের স্মৃতিগুলো লিখে রেখো, যেন দুঃখের সময় তা তোমার সঙ্গী হয়। কখনো মন্দ স্মৃতি লিখো না, দুঃখচারণ কোরো না। দুঃখচারণের জন্য আকাশ আছে। আকাশের মালিককে দুখের গল্প বলবে। মনে থাকবে?”

মারওয়া তার ডায়েরীর নামকরণ করলো। ডায়েরিটির নাম “আজকে আমার মন ভালো নাই”। অবশ্য সে এ নামে কখনো ডাকে না। দেওয়ার জন্য দেওয়া। বাবার কথা ও ফেলতে পারে না। অনিচ্ছা স্বত্তেও টুকটাক লেখে। আজ তেমনি একটা দিন। ওর যখন খুব মন খারাপ থাকবে, তখন মাঝেমাঝে ডায়েরীটা পড়বে। আর মনে মনে ভাববে, ও আগে কতই না পাগলাটে ছিলো!
ভাইয়া বলে, বড় হলে মানুষ এত স্বতঃস্ফূর্ত থাকতে পারে না। দুনিয়ার বোঝা চেপে গেলে কৈশোরের উৎফুল্লতা মিঁইয়ে যায়। মারওয়ার যদিও তা মনে হয় না। শুধু মনে হয় রুমি তার নামের মান রাখছে। কথায় কথায় নাটুকে কথা বলে নিজেকে কবির সঙ্গে অযাচিত তুলনা করার চেষ্টা। মারওয়া তার বড় দুজন ভাই-বোনের বোকামিতে চরম বিরক্ত হতে শুরু করেছে। এ জগতে সব বড় ছেলেরা গাধা আর বড় মেয়েরা গাধী হয় বলেই ওর ধারণা।

**
সাফার দাদী পান চিবুতে চিবুতে অসংখ্য বার এ জীবনে বলে যাওয়া গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টি পুনরায় রোমন্থন করছেন। তিনি প্রায়শই তার জীবনের প্রথম প্রেমের গল্পটি বলে বেজায় আনন্দ পান। দাদাজানের সঙ্গে তার পরিচয়ের ঘটনাটি। তারা একই এলাকার ছেলে মেয়ে ছিলেন। ছোটবেলা থেকে একটু আধটু ছেলেমানুষী মনোমালিন্য নিয়ে বড় হওয়া। তিনি পড়তেন বাল্যশিক্ষা বই। তখন তাদের টাক মাথার উস্তাদে আজম বেশ কায়দা করে সুরে সুরে পড়াতেন, “My Head অর্থ আমার মাথা।”
এর পরপরই কোনো কাজে তিনি বাহিরে গেলেও শিক্ষার্থীরা বাতলে দেওয়া সবকটি সুরে সুরে চিৎকার করে পড়ত। পড়ার শব্দে মন জুড়িয়ে যেতো পথচারীদের। ঠিক তখনি তার দাদীর মাথায় টোকা দিয়ে দাদাজান বলতেন, “কীসব ভুলভাল বকছিস? বল, My head অর্থ মাষ্টরের মাথা। মাষ্টর কী বলল শুনিস নি? বলেছেন, মাই হেড অর্থ তার নিজের মাথা।”
তার দাদীজান ছিলেন অত্যন্ত সুদর্শনা রমণী। হালকা বাদামি রঙা চোখের মনি ছিলো তার। গায়ের রঙ ফকফকে ফর্সা। এ ধরনের মেয়েরা যে কিছুটা বোকা কিসিমের হয় তা তো জানা কথা। তিনি চোখ বন্ধ করে দাদাজানের কথা শুনে বেশ কয়েকবারই শাস্তির স্বীকার হয়েছেন। দাদাজান যে কিশোর বয়সে দুরন্ত ছিলেন তা বুঝতে পারলো সাফা। সাফার গায়ের রঙও ঠিক তার দাদীর মতন। লোকে বলে, যৌবনে ঠিক তার মতো দেখতেই ছিলেন তার দাদী নূরজাহান।

তার দাদী ঘটনা বলে যেতেই থাকলেন। তার কথা বলা ভীষণ পছন্দের। প্রায় মেয়েরই এটি পছন্দের কাজ। কিন্তু সাফা তার উল্টো। সে শুনতে বেশ পছন্দ করে। ভেবেচিন্তে গুছিয়ে অল্প কথা বলা তার ভালো লাগে। দাদীর ঘটনাটি শুনতে তার মন্দ লাগছে না। তার দাদীজান বেশ রসিক মানুষ। পড়াশোনা তার ওই বাল্যশিক্ষাতেই আটকে ছিলো। দস্তখত দেবার মতো যোগ্যতায় পৌঁছানোর আগেই ঘরের সৎ মায়ের রোষানলে পড়ে তা ক্ষান্ত দিতে হয়। বুড়ো বয়সে অনেক চেষ্টার পরও কাঁপা কাঁপা হাতে তা আর আয়ত্ব করতে সক্ষম হননি। তাই বলে তাকে ছোট করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। চার ছেলের মধ্যে সবাই বর্তমানে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করে ভালো অবস্থানেই আছে। সাফা দাদীর গায়ে হেলান দিয়ে ভাবলো, তার দাদীজানকে রত্নগর্ভা পদক দেওয়া উচিত। তার দাদীর বিয়ের ঘটনায় সে এবার মনোযোগী হলো। বেশ প্রেমময় একটি ঘটনা।

তার দাদীজান বেড়ার ঘরে শুয়েছিলেন। আকাশে তখন পূর্ণ চাঁদ জ্বলজ্বল করছে। বেড়ার ফাঁকে ফাঁকে হালকা আলো ঢুকে পড়েছে তাদের ঘরে। বড় হবার পর বাড়ির ছেলেদের সঙ্গে স্বভাবতই একটু দূরত্ব তৈরি হয়। দাদাজানের সঙ্গে তখন আর কথাবার্তা নেই। বেড়ার দরজা খুলে দাদীজান ভরা চাঁদের আলোয় খেয়াল করলেন একজন সুঠাম দেহের পুরুষ দূরত্বে দাঁড়িয়ে। দাদাজান কী লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছিলেন নাকি?

সাফা আশ্চর্য হলো। এ রহস্য কেবল দাদাজানই বলতে পারবেন। কিন্তু এ কথা জিজ্ঞেস করার সাহস এ বংশে কারোর নেই। সাফা ধারণা করলো, মাতৃহারা এই রূপসী নারীর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন দাদাজান। তাইতো তড়িঘড়ি করে মায়ের অমতে জোর করে বিয়ে করে নেওয়া। দাদীর গল্প শেষ। বিয়ের দিনের অনেক গল্প বললেও তিনি প্রেম পরিণয়ের গল্প শেষ পর্যন্ত আর বললেন না। দাদীর মতে, ছেলের পছন্দ হওয়াটুকু পর্যন্তই প্রেম। এরপর ডিশমিশ। সে মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করতে পারলো না, হুট করে একজন অপরিচিত পুরুষের সঙ্গে বিয়ে নামক বন্ধনের মাধ্যমে তিনি কী করে এত সহজ সরল ভাবে মিশে গেলেন?

ব্যাপারটা ওর কাছে অদ্ভুত লাগে। মানব সম্পর্ক সাফার কাছে জটিল একটি সমীকরণ। এর মধ্যে আরো জটিল নর-নারীর মন সংযোগ জাতীয় বিষয়গুলো। সাফা কিছু না বলে এসব ভাবতে ভাবতে তার দাদীর চুলে বিনুনি গেঁথে গেলো। মারওয়া সকালে কিছু নয়নতারা ফুল এনে রেখেছিলো পাশের টেবিলে। সেগুলো একটা একটা করে বিনুনির ভাঁজে বসিয়ে দিলো। তার দাদীর কুচকে যাওয়া দেহ সৌষ্ঠব দেখে যে কেউ আন্দাজ করতে পারবে, এ নারী তার যৌবনের প্রথম প্রহরে চোখ ধাঁধানো সুন্দরী ছিলেন। সাফা মনে মনে নিজেকে শুধরে নিলো, “সৌন্দর্য মানুষের মানসিকতায়। ব্যবহারে। ভালোবাসায়।”

***
সাফা-মারওয়া দুইবোন। এ নামে আরব দেশে দুটো পাহাড় আছে বলে ওদের জানানো হয়েছে। কুরআনে, পাহাড়কে পেরেকের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে যা পৃথিবীতে প্রোথিত করা হয়েছে সুনিপুণভাবে। সাফার মা নাক কুঁচকে জানিয়েছিলেন : ”পাহাড়ের নামে নাম? কেমন অদ্ভুত না?”
বাবা কিছুটা উদাসীন গোছের মানুষ। লোকে বলে, সাহিত্যানুরাগী কিংবা ধার্মিক লোকেরা একটুখানি দুনিয়াবিমুখ আর চিন্তাশীল হন। তারা আম মানুষের মতো করে ভাবেন না। তিনি কোন ভাগে পড়ছেন সে নিয়ে মতবিরোধ আছে। উত্তরটাও নাটকীয় : “তুমি সুনির্মল বসুর কবিতা পড়োনি? সেখানে কী বলা আছে?
পাহাড় শেখায় তাহার সমান, হই যেন ভাই মৌন-মহান।
মেয়েরা উদার হবে, মহান হবে। তাদের চরিত্রে হাজেরা আলাইহাস সালামের পদধূলি পড়বে, এটুকু তোমার মাথায় ধরে না?”

আর কি? আক্বিকা দিয়ে নাম রাখা হয়ে গেলো। ওদিকে ভাইয়ের নাম তো মিলিয়ে রাখাই হলো ইব্রাহীম। সঙ্গে এঁটে দিলেন প্রিয় কবির নাম, রুমি। উল্লেখ্য, পরপর দুটো তার মেয়ে হবে এবং তাদের নাম সাফা-মারওয়া হবে এসব বাবার পূর্ব পরিকল্পনার অংশ, সবটা খোদা তা’লার কুদরতই বটে। এত নামের ভীড়ে বাড়ির নামকরণের জায়গাটা ফাঁকাই থাকলো। মারওয়া প্রথম তার দশ বছর বয়সে পা দিয়েই বাড়িটির নাম দিলো : “শান্তি নেই”৷ দুদণ্ড শান্তি দেবার জন্য সে জীবনানন্দের বনলতা হতে না পারলেও “শান্তি নেই” বাসভবনে অশান্তি উৎপাদনের মূল হোতা হিসেবে রইলো। নামকরণের পটভূমি তার কাছ থেকে এখনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

যাহোক, আজকে একটা বিশেষ দিন। রুমির আজ বলিদান হচ্ছে। তার চিরকুমার থাকার শপথকে কুরবান করে দিয়ে বাবা আবদুর রহমান সাহেব সত্যি সত্যি বিয়ে করিয়ে দিলেন। এলাকার মানুষ প্রথমবারের মতো নিজের বিয়েতে একজন পুরুষের কাঁদো কাঁদো চেহারা দেখছে। মারওয়া ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বললো, “ভাইয়া, একটুপর বউয়ের সঙ্গে দেখা করতে দিবে। তখন উনাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদিস, কষ্ট কমবে।”
ওর এত সুন্দর পরামর্শ রুমি কানেই নিলো না। চোখ লাল করে বসে রইলো। মারওয়া সাফার কানে কানে বললো : “মেয়েটা ‘কবুল’ বলতে গিয়ে কাঁদলো না কেন? আশ্চর্য! দিনদিন মেয়েগুলো বেহায়ার চূড়ান্ত হচ্ছে, তুই কী সেটা ধরতে পারছিস সাফা?”
সাফাকে সে কখনোই ‘আপা’ বলে ডাকে না। মা মেরে ধরেও শেখাতে পারেননি। ওর এত বিশ্লেষণধর্মী আলোচনায় সাফাও কান দিলো না।

মেয়ের বাড়িতে বিদায়ের সময় ঘনিয়ে এলো। সাফার মা আর দাদী আসেননি রেওয়াজ মেনে। তারা সম্ভবত দরজায় বালিশ ফেলে দিয়ে অপেক্ষা করছেন নববধূর জন্য। এখানে অবাক হওয়ার কোনো বিষয় নেই, আক্কল জ্ঞানের উপস্থিতি পরীক্ষা চলবে। বালিশ হাতে উঠিয়ে এরপর প্রবেশ করা বুদ্ধিমতীর লক্ষন। কন্যা বিদায়ে রুমির সদ্য বিয়ে করা বউ দুনিয়া উজার করে কাঁদতে শুরু করলো। মারওয়া বিরক্ত হলো। সাফাকে ফিসফিসিয়ে বললো, “এতো কাঁদার কী আছে? সামান্য এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি যাবে, এতেই কান্নাকাটি? আমার বিয়েতে আমি কচুও কাঁদবো না। দেখি কে কী বলে!”
সাফা শান্ত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো : “তোর এই কুটিল ননদ সাজার অ্যাক্টিংটা বন্ধ করবি কবে?”

এদিকে রুমির আবেগ বদলে গেলো। একটা মেয়ে তার সঙ্গে যেতে চাচ্ছে না, জোর করে নেবার মানে হয়? সে সরল কন্ঠে বললো, “বাবা উনি যেহেতু যেতে চাচ্ছেন না, থাকুক। অন্য একদিন নিয়ে যাবো।”
পাশ থেকে মেয়ের বাবা চোখ বড় বড় করে তাকালেন। কন্যাদানের দুঃখ ভুলে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে গাড়িতে উঠিয়ে দিলেন। এমন আধপাগল ঘরে আত্মীয়তা হয়েছে, আগে টের পাননি। লোক হাসানোর আগে আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে হলো। রুমি মাথা নিচু করে বসলো পাশে। বউয়ের নামটা অব্দি তার জানা নেই। মাথা নিচু করে বললো : ”আমার পাশে বসতে আপনার অসুবিধা হচ্ছে না তো? তাহলে উঠে যাই।”

মারওয়া ভেঙিয়ে ওই কথাটার পুনরাবৃত্তি করলো। সঙ্গে যোগ করলো : “কেন রে? সমস্যা হলে তোকে বিয়ে করবে কেন? এখন বউয়ের পাশে বসতে লজ্জা করছে না? বিয়ে হলো, ওমনি প্রেম দরদ মোহব্বত সব একসাথে উপচে পড়ছে। আমার ডায়েরীর কথাটা অক্ষরে অক্ষরে ফলবে, সেটা জানতাম। এত তাড়াতাড়ি ফলবে, তাতো জানতাম না!”
রুমি অবাক হয়ে বললো : “ডায়েরীর কী কথা?”
মারওয়া আর কথা বাড়ালো না। ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দিয়ে প্রতিপক্ষকে সতর্ক করবার কোনো অর্থ নেই। ওর নিজে ব্যতীত সকলকেই বুদ্ধি প্রতিবন্ধী মনে হয়। সূক্ষ্ম অহংবোধও আছে এ নিয়ে। ভিন্ন ভিন্ন জীবনের গতি আর গাড়ির গতি একই দিকে ছুটছে, বাড়িটির নাম “শান্তি নেই।”

চলবে ~

বুকপকেটের বিরহিণী পর্ব-৪০ এবং শেষ পর্ব

0

#বুকপকেটের_বিরহিণী
অন্তিম পর্ব:

(৪৮)

বহুদিন পর আসমানে জোছনা উঁকি দিয়েছে। পাতার ফাঁকফোকর গলিয়ে এক মুঠো জোছনা মাটিতে হামাগুড়ি দিচ্ছে। শীতকালে সচারাচর এমন মুক্তমনা জোছনা দেখা যায় না। কুয়াশায় ঢেকে থাকে আসমান, জমিন সব।
বিদিশার গাড়ি জোছনা গলিয়ে বাড়িতে ঢুকেছে কেবল। সারা বাড়িময় লাল-নীল বাতি জ্বলছে। রাত গভীর হলেও তেমন বুঝার জো নেই রঙিন বাতির দাপটে। গাড়ির শব্দ পেতেই জামাল ভূঁইয়া গেইটের দিকটায় এলেন। সুন্দর, নিখুঁত একটি হাসি তার ঠোঁট জুড়ে ঝুলছে। বিদিশা হু হু করে কাঁপতে কাঁপতে গাড়ি থেকে বের হলো। সামান্য শাড়ি এমন শীতে তাকে নাজেহাল করে দিবে সেটাই তো স্বাভাবিক! জামাল ভূঁইয়া মেয়ের কাছে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলেন। ব্যস্ত কণ্ঠে বললেন, ‘কেমন হলো অনুষ্ঠান? কবিতা দর্শকদের মন ছুঁয়েছে তো? যা শীত! ঠান্ডায় গলা বসে যায়নি?’

বিদিশা বাবার উৎসুক নয়নের দিকে তাকিয়ে হাসল। আলতো হাতে জড়িয়ে ধরল বাবাকে। মৃদু স্বরে বলল, ‘ভালো হয়েছে, বাবা।’

জামাল ভূঁইয়া নিজের গায়ে জড়িয়ে রাখা সাদা রঙের শালটা খুলে অভিজ্ঞ হাতে মেয়ের শরীরে জড়িয়ে দিলেন। বাবার বুকের সবটুকু মায়া দিয়ে মেয়েকে আগলে নিলেন বুকে। হাসি-হাসি মুখ করে বললেন, ‘এবার ঘরে চলো।’

বিদিশা ঘাড় ঘুরিয়ে বাড়িতে ঢুকতেই দেখে তার মা মুখ ফুলিয়ে বসে আছে সোফায়। মেয়েকে দেখে তার মুখ-চোখ আরও অন্ধকার হলো। চাপা স্বরে বলল, ‘কাল যে তোমার বিয়ে তা মনে আছে?’

‘তুমি এ অব্দি আঠারোটা কল দিয়ে সেটা এমন ভাবে মনে করিয়ে রেখেছ যে চাইলেই ভুলতে পারব না।’

মেয়ের হেঁয়ালি পছন্দ হলো না মায়ের। তার চোখে-মুখে অসন্তুষ্টি খেলে গেল, ‘তুমি নাকি অনুষ্ঠান থেকে ও বাড়িতে গিয়েছিলে?’

মায়ের ও বাড়ি কথাটার ইঙ্গিত বুঝেও বিদিশা অবুঝের মতন ভান করে বলল, ‘কোন বাড়ি?’

‘তোমার প্রাক্তন শ্বশুর বাড়ি।’
বেশ বিরক্তি নিয়েই বলল কথাটা। বিদিশা অকপটে স্বীকার করল, ‘গিয়েছিলাম।’

‘তোমার বিয়ে আগামীকাল। যদি এ কথাটা জানতে পারে কেউ, কেমন হবে?’

‘কেমন হবে? কোথাও যাওয়া কী পাপ?’

‘ও বাড়িতে তোমাকে যেতে না করেছিলাম।’

‘সে তো তুমি সাত বছর আগে ও বাড়ি থেকে আমাকে বের হয়ে আসতেও না করেছিলে, মা। কিছু কী আটকে আছে তোমার বারণে?’

কথা বলার যুক্তিতে যেন ঝিমিয়ে গেল মায়ের অন্তর। মেয়ে যে মুখের উপর এমন কথা বলবে তা ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি সে। অবস্থা বেগতিক দেখে জামাল ভূঁইয়া নিজের স্ত্রীকে ধমকালেন, ‘যাও তো তুমি। ঘরে যাও। মেয়েটাকে এসব কেন বলছ?’

‘আমি কী ওর খারাপ চাই? সাহেল যদি ওর এই পুরোনো শ্বশুর বাড়িতে যাওয়ার কথা জানতে পারে কতটা কষ্ট পাবে বলো তো?’

বিদিশা নির্লিপ্ত স্বরে বলল, ‘সাহেল আমার সাথেই ছিল এতক্ষণ। ওর সাথেই গিয়েছিলাম ওবাড়ি। আর যাই হোক সাহেল অমানুষ না। অমন বৃদ্ধ একটা মানুষের অসুবিধা শুনেও একমাত্র আমার প্রাক্তন শাশুড়ি বলে ও যাবে না তা কী কখনো সম্ভব? সাহেল তো মানুষ, মা। ভালো মানুষ।’

কথাটুকু শেষ করেই নিজের রুমে চলে যায় বিদিশা। মায়ের মন কোমল হয়ে আসে। যতই হোক, সে যে মা। সন্তান একবার যেই আগুনে পুড়েছে, সে-তো সন্তানকে আবার সেই আগুনে ঠেলে দিতে পারে না। গত সাত বছর আগেই যেই সম্পর্কের ইতি টানা হয়েছিল হাতে-কলমে সেই সম্পর্ক আজও জিইয়ে রেখে কী লাভ? মেয়েটা এখন কত শক্ত শক্ত কথা বলল? অথচ আজও নিজের প্রাক্তন শাশুড়ির বিপদ শুনলে ছুটে যায়। ঐ একা নারীটির খোঁজখবর নেয়। কিন্তু এতে তার মন সায় দেয় না। এতবছর পর নিজের ননাসের ছেলের সাথে বিয়ের আয়োজন হয়েছে। যদি বিপদ হয় কোনো?

রাত বাড়ে পাল্লা দিয়ে। সাথে বিদিশার ফোনের নোটিফিকেশনের পাল্লা ভারি হয়। এই মাঝ রাতে গোসল সেরে এসে বারান্দায় দাঁড়ায়। ফোনের স্ক্রিন অন করতেই দেখে ফেসবুকে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার গাঁয়ের হলুদের ছবি। সাথে কনফেশন,

❝এই যে বিদিশার নেশা, শেষমেশ ও পথে থাকা পুরোনোর কাছেই বাঁধা পড়লেন। পৃথিবীতে এমন অলৌকিক ঘটনাও ঘটে? যে যাকে ভালোবাসে, সে তাকে পেয়ে গেলে কত সুন্দর ইতিহাসই না হয়! বিদিশার নেশা, ঠিক কতখানি প্রার্থনা করেছিলাম বলে এত গুলো বছর পরেও আপনাকে পেলাম ভাবতে পারছেন?

ইতি
ও পথে থাকা পুরোনো।❞

কনফেশনটা দেখে আপনমনে হাসে বিদিশা। সাহেল ভাই যে তাকে পছন্দ করে সেটা সে বুঝতে পারত। কিন্তু তার মন কোনো এক মাহেন্দ্রক্ষণে গিয়ে একজন মানুষে যে আটকে গিয়েছিল তা আর ফেরানো সম্ভব হয়নি। যখন ফিরলো তখন বড্ডো দেরি হয়ে গিয়েছে। তার সংসার জীবনের তিন বছর কেটে গিয়েছিল। তবুও সাহেল ভাই হাল ছাড়েননি। ঠাঁই দাঁড়িয়ে ছিল নিজের অনুভূতিতে। তাই তো সংসার করবে না বলেও আবার এত বছর পর সংসার করার লোভ হলো। একবার তো অ-ভালোবাসা পুরুষকে ভালোবেসে দেখেছে, এবার নাহয় যে ভালোবাসতে জানে তাকে একবার ভালোবাসলো।

বাহিরের বাতাসের সাথে নরম কুয়াশা এসে ছুঁয়ে যায় বিদিশার শরীর। ফোনের স্ক্রিন ঘাটতে ঘাটতে আঙুল থেমে যায় একটি প্রোফাইলে। সাদা শার্টে আজও মানুষটাকে বড়ো সুন্দর লাগে! সব ঠিক থাকলে এই মানুষটার সাথেই তো তার কত যুগের সংসার হতো। অথচ……

এই যে অথচ বলার পর আরও কত কথা না বলা থেকে যায় প্রত্যেকের জীবনে। যে কথা বলা হয় না আর। কেবল জীবনের এক কোণায় একটি আফসোস ধুঁকে ধুঁকে বাঁচে। ধূলো পড়ে যায় আফসোসে, তবুও মুছে না। ওরকম একটি মানুষকে বুকপকেটে রেখেই জীবনের গল্পরা বদলায়। পথ ধরে অন্য সুখের ঠিকানায়।

(৪৯)

সিলেট শহরেও শীত গুরুতর। চাঁদ দেখার জো নেই। কুয়াশায় ঢেকে গিয়েছে নরম চাঁদ। চিকন ফ্রেমের চশমাটা চোখে দিয়ে খুব মনোযোগ নিয়ে একটি পুরোনো কাগজ বের করলেন একজন নারী। যার চুলে পাঁক ধরেছে, চোখে পড়েছে ছানি।
পুরোনো কাগজটা বের করেই কতক্ষণ বুকে চেপে রাখলেন। নোনা জলে ভেসে গেল তার চোখ। তারপর হারিকেনের আলো কিছুটা বাড়িয়ে দিয়ে কাগজটা খুললেন। এই পুরোনো কাগজটা তার মেয়ের লিখা প্রথম এবং শেষ চিঠি যে! তাই কত যত্ন করেই না দু’হাতের আজলে রাখলেন। মুখস্থ চিঠিটা আবার নতুন করে পড়লেন,

“মা,
প্রিয় বলব না অপ্রিয় বুঝতে না পেরে কোনো সম্বোধন দিলাম না। কিন্তু আমার বড়ো সাধ ছিল বুকে, একবার মা বলে ডাকার। সেই সাধ পূরণ করলাম চিঠিতে মা লিখে। বাঁচব আর কিছু ঘন্টা, সাধ পূরণ না করে যেতে মন চায় না যে! মা, আমি তোমার মেয়ে। যাকে তুমি ফেলে গিয়েছিলে হিংস্র বাস্তবতার মুখে, আমি সে-ই মেয়ে, মা। আমি চিঠি লিখছি জেল থেকে। আজ ভোর সাড়ে চারটায় আমার ফাঁ সি। তাই আমার শেষ ইচ্ছে উনারা পূরণ করবে বিধায় আমি তোমাকে চিঠি লিখছি। শুরুতে তো তুমি ছিলে, শেষেও না-হয় থাকলে। জানো, লোকে ভাববে আমার মৃত্যু হয়েছে ফাঁ সিতে, মোটা রশিটা গলায় দৈত্যর মতন চেপে ধরবে তারপর আমার প্রাণপাখি এই দেহ ছেড়ে চলে যাবে। অথচ এটা যে বাহ্যিক মৃত্যু। আমি তো মরে গিয়েছিলাম সেদিনই, যেদিন তুমি আমাকে এই নষ্ট জীবন উপহার দিয়ে চলে গিয়েছিলে নিজের সুখের খোঁজে।
জানো মা, আব্বু তোমাকে কী ভীষণ ভালোবাসতো! কখনো ভুল করেও তোমার নামে একটা খারাপ কথা বলেনি। আমাকে লুকিয়ে তোমায় চিঠি লিখতো। আমি তো তখন জানতামই না তুমি বেঁচে আছো। আর এতটাই সুখে আছো যতটা সুখে থাকলে আমাকে আর আব্বুকে ছুঁড়ে ফেলা যায়। তুমি বেঁচে আছো সেটা জানলাম আব্বুর মৃত্যুর আগে। তার ঘর খুঁজে চিঠি পেলাম যখন তখন জানলাম। আব্বু কতটুকু ভালোবাসলে তোমাকে শেষবার দেখার আশায় চোখ বন্ধ করেনি একবার ভাবো? ভাগ্যিস! আমি চিঠি পেয়েছিলাম, জেনেছিলাম তোমার ঠিকানা। নাহয় তো আব্বুটা তোমাকে দেখার ইচ্ছে বুকে নিয়েই চিরবিদায় নিতো। আচ্ছা মা, যেদিন শেষবারের মতন আব্বুকে হসপিটালে দেখতে গেলে সেদিন তোমার বুক কেঁপেছিল কী? যেই মানুষটা তোমাকে এত ভালোবাসার পরেও ছেড়ে গিয়েছিলে সেই মানুষটা তোমাকে শেষ অবধি মনে রেখেছিল বলে অবাক হওনি? হয়েছিলে নিশ্চয়।
জানো মা, আমি তোমাকে ঘৃণা করি। আমার আব্বু যেই মানুষটার ছবি তার বুকপকেটে যত্ন করে রেখে দিয়েছিল সেই মানুষটার বিশ্বাসঘাতকতা যে আমি মানতে পারিনি। কিন্তু তবুও, মায়ের ভালোবাসা পাওয়ার লোভ যে অন্তরে ছিল। ঘৃণা করতে গিয়েও যে কোথাও একটা তোমাকে ভীষণ ভালোবাসি সেটা অস্বীকার করি কীভাবে?
সে যাই হোক। আজ মাঝ রাতের পরই আমার ফাঁ সি। এরপর এই সুন্দর পৃথিবীটা দেখা হবে না। এই ভোর, এই ভালোবাসার পৃথিবীটাকে আর দেখব না ভাবলেই আমার কান্না পাচ্ছে মা। ভুল কেইসে এত বড়ো দন্ড পেলাম! কী আর করব? ভাগ্যে যে ছিল। বিধাতা কিছু কিছু মানুষকে এমন দুঃখে মোড়ানো ভাগ্য দিয়েই যে পাঠান। এই ভাগ্য অস্বীকার করি কেমন করে? তবে আমার কাছের মানুষ গুলো ভালো আছে এতটুকুই আমার শান্তি। জানো মা, বাবা যেমন তোমাকে ভালোবাসতো, আমাকেও তেমন একজন ভালোবাসে। আমি যতই মানা করি সে শুনে না। বোকা ছেলে! এমন মায়া মায়া ভালোবাসা পেলে মরতে ইচ্ছে করে বলো? কষ্ট হয় যে বড়ো! তবুও মরতে হয়। কাল ভোরে যখন আমার দেহটা প্রাণশূন্য হয়ে পড়ে থাকবে তখন কে নিবে সেই দেহের দায়ভার? আমার মৃত দেহ দেখার মতন এই গোটা দুনিয়ায় কেন কেউ নেই মা? এত খারাপ ভাগ্য কারো হয়? বেলির গন্ধে বাগিচা ভরে যাবে, আমার সদ্য কবরে হাউমাউ করে কেউ কাঁদবে না। কাঁদার মতন একটা মানুষ পৃথিবীতে নেই বলে আমার নিজের জন্য ভীষণ মায়া হচ্ছে। আহারে! এই আমিটা কতই না নিঃস্ব! কতই না দুঃখ পেয় যাচ্ছি মা। আমার যেতে ইচ্ছে করে না। মাগো, এত সাধের জনম, দুঃখে দুঃখেই বিসর্জন দিলাম। মা, মা গো, আমার জন্য দু’ফোটা কাঁদবে কী মা? আমার ফাঁসি ভোর সাড়ে চারটায়। আবারও বলছি, ভোর সাড়ে চারটায়। সেই সময়টায় আমার জন্য দু’ফোটা চোখের জল ফেলো কেমন? গোটা এক আস্ত আমিটা মরে যাব অথচ কেউ কাঁদবে না তা মানতেই পারছি না। তুমি নাহয় কাঁদলে। এই বেনামি মৃ ত দেহটা তবুও শান্তি পাবে। তার বিদায়ে কেউ অন্তত কেঁদেছে ভেবে। ভালো থেকো, মা। পায়ে হেঁটে একদিন দুঃখ দূর করতে চাওয়া আমার জন্য দোয়া করো। আজ ভোরে আমি দুঃখ নিয়েই চলে যাব বহুদূর। বিদায় মা।

ইতি
আশাবরীর বোন রক্তকরবী।”

সাহেবা কেঁদে উঠলেন হাউমাউ করে। তিন বছর আগে তিনি যখন চিঠিটা পেলেন তখন অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছিল। বাড়ি, শহর বদলানোর কারণে চিঠিটা এসে পৌঁছায় বড়ো অসময়ে। তবুও সন্তানের খোঁজে যান তিনি। কিন্তু খোঁজ পাননি কোনো। যেই সন্তানের কথা সারাজীবনে একটিবারও ভাবেননি, সেই সন্তানের জন্য গত তিনটে বছর কেঁদেকেটে, আহাজারি করে কাটাচ্ছেন। মেয়েটার নামে মামলা হওয়ার চার বছরের মাথায় ফাঁসির নির্দেশ আসে। কেইসের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য, প্রমাণের ঘাটতি থাকায় তার মেয়েটা আজ নেই। এই পৃথিবী তার নিয়মেই চলছে অথচ এই যে প্রগাঢ় দুঃখ গুলো! তা মোছার কী সাধ্য আছে কারো?

(৫০)

এই শীতেও বিন্দু গুনে গুনে ছয়বার গোসল করেছে। তা-ও মধ্যরাতে। মাঝে মাঝেই মেয়েটা এমন পাগলামো করে। কী করবে, না করবে বুঝে পায় না। বেশিরভাগ শীত এলেই মেয়েটার মাথা বিগড়ে যায়। মানুষকে চিনতে পারে না, পাগলামো করে।
হুতুম অতিষ্ঠ হয়ে বিন্দুর উপর রাগ দেখাচ্ছে। কিন্তু শান্ত রইল হীরণ। নরম হাতে বিন্দুর মাথা মুছিয়ে দিল সে। ফ্রিজ থেকে নামিয়ে খাবার গরম করে আনল। খাইয়েও দিল। হুতুম নীরবে সবটাই দেখল। হীরণ যখন বিন্দুকে ঘুম পাড়িয়ে ঘর থেকে বের হতে নিবে হুতুম তখন পিছু ডাকল। নরম স্বরে শুধাল,
‘তোমার রাগ লাগে না, মাস্তান?’

হীরণ মুচকি হাসি দিয়ে বলল, ‘কেন?’
“এই যে বিন্দুবালা যে এমন করে!’

‘বিন্দু তো অসুস্থ। সুস্থ যখন থাকে তখন তো এমন করে না।’

‘বিন্দুবালা কী একেবারে ঠিক হইবো না?’

‘হবে। ধৈর্য রাখো। আমাদের বিন্দু একেবারে ঠিক হয়ে যাবে। তুমি যাও, ঘুমাও।’

হুতুম ঘাড় নেড়ে ঘুমুতে চলে যায়। হীরণ তপ্ত শ্বাস ফেলে ঘরের বাহিরে এসে পুব দিকের বাগানটায় গিয়ে বসে। মৃদু বাতাসে তার শীত শীত ভাব গাঢ় হয়। তার সামনেই একটি পুরোনো কবর থেকে কী যেন এক অপরিচিত ফুলের সুবাস ভেসে আসে। হীরণ এক ধ্যানে সেদিকেই তাকিয়ে থাকে। বিড়বিড় করে বলে,
‘রুবী, আজও তোমার শরীর থেকে কত সুন্দর ঘ্রাণ আসছে দেখো! তবুও তুমি বোকার মতন বলো তোমাকে যেন না ভালোবাসি। এমন ফুলের মতন মানুষকে ভালো না বেসে থাকা যায়? যায় না। সেই তুমি রাগ করো আর যা-ই করো আমি তোমাকেই ভালোবাসবো। তোমার অন্যায় আবদার পূরণ করতে বিন্দুবালাকে পৃথিবীর সকল দুঃখ থেকে তো লুকিয়ে ফেলেছি ঠিকই কিন্তু তোমার মতন করে ভালোবাসতে পারিনি। পারবও না। আচ্ছা রুবী, তুমি বিন্দুকে যেমন ভালোবাসলে তার এক ভাগও কেন আমায় বাসলে না? তা-ও তো আমি নিজেকে একটা বুঝ দিতে পারতাম। এমনকি তোমার মৃত দেহের দায়িত্বটুকুও আমায় দিতে নারাজ ছিলে। কেন এত পাষাণ তুমি আমার বেলা? বেশি ভালোবেসেছিলাম বলেই কী এমন শাস্তি? তবুও আমি ভালোবাসব। করো তুমি অভিমান।’

কথা বলতে বলতে অজান্তেই হীরণের চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু। সে ফিসফিস করে বলল,
‘রুবী শুনছো, ভালোবাসি।’

কে জানি? রুবী শুনল কি-না? রুবী দেখল কি-না এই প্রেম। রুবী জানল কিনা তার কবরে রোজ নিয়ম করে একজন কান্না করার মতন মানুষ পৃথিবীতে অবশিষ্ট রয়ে গিয়েছে আজও!
খুব দূরে কুয়াশা ঠেলে একটি পরিচিত পাখি ডাকল বিরহী স্বরে। কে ওটা? বাণী না?

পরিশিষ্ট:
________

বিন্দুর মানসিক অবস্থা বিগড়ে যাওয়ায় মামলা কঠিন থেকে কঠিনতম হয়। আদালতে প্রমাণ হয় করবী টাকার লোভে খু ন করে বিশিষ্ট শিল্পপতিকে। টাকার ক্ষমতার কাছে ফিকে হয়ে যায় সব সত্য। কোনো সঠিক তথ্য প্রমাণ না থাকায় হীরণ চেয়েও করবীকে মুক্তি করাতে পারেনি। তবে করবীর কথা অনুযায়ী বিন্দুকে আড়াল করতে পেরেছিল এই সমাজের চোখ থেকে। শহর ছেড়ে খুব দূরে এক পাহাড়ি অঞ্চলে বিন্দুকে লুকিয়ে রাখে। সেখানেই বিন্দুর চিকিৎসা চলে। তবে সেই চিকিৎসা আজও চলছে। বিন্দুর স্মৃতিতে করবী খুব কম সময়ই আসে। আর যখন আসে তখন বিন্দু উন্মাদ হয়ে যায়। তাই কেউ তাকে করবীর কথা মনে করায় না।
আর তিমির? তিমির হলো সেই চরিত্র যারা আমাদের জীবনের কোনো কিছুতেই থাকে না। কেবল ঝড়ের বেগে এসে জীবনটায় আরও এক আনা দুঃখ বাড়িয়ে দিয়ে যায়।
তবে তিমিরদেরও বুকের ভেতর একজন আস্ত বিরহিণী লুকায়িত থাকে যাদের তারা এক সময় ভালোবেসেছিল। থাকে হীরণদের বুকের ভেতরও। পৃথিবীতে ভালোবাসতে পারা বেশিরভাগ মানুষের বুকের ভেতরই বিরহিণীরা থেকে যায়। শীতের নরম কুয়াশা, গ্রীষ্মের তাপদহন কিংবা শরতের মেঘের পরিবর্তন ঘটে তবে বুকপকেটে থাকা বিরহিণীদের ঘটে না পরিবর্তন। চিরজীবন তারা চির কাঙ্ক্ষিত মানুষ হয়ে অপূর্ণতায় থেকে যায়। যেমন করে বিদিশার বুকেও রয়ে গেছে একজন!

[সমাপ্ত]

বুকপকেটের বিরহিণী পর্ব-৩৮+৩৯

0

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ৩৮ (অর্ধেক অংশ)
কলমে: মম সাহা

(৪৫)

ধর্ষণ শব্দটা কতটা ভয়াবহ তা বিন্দু উপলব্ধি করল ধীরে ধীরে। বিশিষ্ট শিল্পপতি আশরাফুল ইসলাম যেদিন খু ন হলেন ঠিক তার পরেরদিন থেকে পুরো শহর জুড়ে খবর ছড়াতে শুরু করল। খু নের অন্তরালে থাকা ঘটনা খুড়তে খুড়তে বেরিয়ে এলো বিন্দুর নাম। বাতাসের বেগে ছড়াতে লাগল খবর। যদিও আশরাফুল ইসলামের টাকা ছিল তাই প্রথমেই ধরে ধর্ষণের নাম উঠেনি। উঠেছে— বিন্দু নামের এক কারখানার নিম্নবর্গের শ্রমিকের সাথে আশরাফুল ইসলামের অন্তরঙ্গ মুহূর্তের কথা। সেই খবর জানতে পেরেই আশরাফুল ইসলামকে খু ন করেছে বিন্দুর বড়ো বোন রক্তকরবী।
খবরটি মিথ্যে। কিন্তু প্রথম অবস্থায় এই খবরটিই হলো অন্যতম সত্য। ধর্ষণের মতন এমন ঘৃণিত কাজ তো ধনী শ্রেণীর মানুষ করতেই পারে না।

বিন্দু এ শহরের নোংরা খবর সম্পর্কে জানত না। সে তখন ছিল ঘরবন্দী। নিজের সাথে নিজের একটা নির্মম যু দ্ধ চলছিল তার। যতই ভুলে যেতে চাচ্ছিল বিদঘুটে রাতটির কথা, ততই মনে পড়ে যাচ্ছিল। চোখের সামনে নিজের নগ্ন দেহ, অন্তরঙ্গ মুহূর্ত, ঘাড় থেকে মাথা আলাদা হওয়ার দৃশ্যটা তার চোখের পাতায় সিনেমার মতন আটঘাট বেঁধে যেন বসে পড়েছিল। তবুও নিজের সাথে নিজের অদম্য যু দ্ধ শেষে সে সাহস সঞ্চয় করল। হুতুমটার খিদে পেয়েছে, আব্বুকেও তো খাওয়াতে হবে অথচ চাল, ডাল নেই ঘরে। তাই অবশেষে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে। মাথায় ওড়না প্যাঁচিয়ে হুতুমের হাতটা শক্ত করে ধরে ঘর ছেড়ে বের হলো। আজ দু’দিন পর বোধহয় সে সূর্য দেখল। এই দু’দিনে সে ঘর ছেড়ে বের হয়নি আর না হীরণ ভাইকে ঘরে আসতে দিয়েছে। বিন্দু ঠিক করল আজ যেহেতু সাহস করে বের হয়েছে তাহলে আপার সাথেও দেখা করে যাবে। দু’দিন হলো আপাকে দেখে না। সে কতটাই না নির্দয়! যেই আপা তার জন্য আজ এমন পরিস্থিতিতে পড়েছে সেই আপার সাথে যোগাযোগটুকুও করছে না। কতটুকু স্বার্থপর হলে এমন করে মানুষ? অথচ আপা তো তার বিপদ শুনে ঝাঁপিয়ে পড়তে একবারও দ্বিধা করেনি। হাহ্! আপার মতন হতে যে তার সাত জনমও যথেষ্ট নয়।

সবে সিঁড়ি দিয়ে নেমে বিল্ডিং থেকে বের হয়েছে তন্মধ্যেই বিল্ডিং এর নিচ তালার ভাড়াটিয়া খালা ডাকল তাকে, ‘বিন্দু নি? হুন হুন। দাঁড়া।’

বিন্দু স্বাভাবিক ভাবেই দাঁড়াল। উৎসুক নয়নে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী খালা? কন।’

খালা গদোগদো হেসে এগিয়ে এলেন। বিন্দুকে মাথা থেকে পা অব্দি পরখ করে বললেন, ‘তোরে কত টেকা দিছিল, বিন্দু?’

খালার প্রশ্ন বোধগম্য হলো না বিন্দুর। কপাল কুঁচকে বলল, ‘কীয়ের টেকা, খালা?’

‘ঐ যে কারখানার অপিছারের লগে যে থাকতি মাঝে মইধ্যে। কত দিতো?’

বিন্দুর যেন মাথা ঘুরে উঠল এমন কথা শুনে। সে কারখানার অফিসারের সাথে কখন থেকেছে? তাকে তো জোর করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাছাড়া খালা এই খবরই বা কীভাবে জানল?
‘কী কন, খালা? পা গ ল হইছেন?’

‘পা গ ল হমু ক্যা? তোর খবর দেহি পুরা এলাকা জানে। কছ না কত দিতো তোরে। এর লাইগ্যাই তো কই, এই চাকরি কইরা তুই এত টেকা কেমনে পাছ।’

বিন্দুর ঘিনে শরীর কাঁপতে লাগল। চোখ মুখে জল টলমল করল। মুখ দিয়ে আর কথাও বের হচ্ছে না যেন। রাগে, ক্ষোভে সে হুতুমকে টানতে টানতে চলে গেল। পেছন থেকে খালা বেশ কয়েকবার ডাকলেও সাড়া দেয়নি সে।

রাস্তায় বের হওয়ার পর বিন্দুর ধারণা কর্পূরের মতন উড়ে গেল। সে ভেবেছিল কেবল খালা নিচু মনের মানুষ তাই এমন কথা বলেছে। কিন্তু গোটা পৃথিবীর সবাই-ই যে এমন মনের সেটা তার ছোটো ধারণাতে আসেনি। সকলের বাঁকা চোখ যেন কাঁটার মতন গাঁয়ে বিঁধছিল। যারা জানত না ঘটনা তারাও কানাকানিতে জেনে গেল। পুরো মহল্লার গল্পের টপিক হয়ে গেল সে মুহূর্তেই।

মুদি দোকানের মধ্য বয়স্ক লোকটাও বিন্দুর দিকে কেমন করে যেন বার বার তাকাচ্ছিল। সেই দৃষ্টি বিষের চেয়েও বিষাক্ত ছিল। বিন্দুর যেন আর সহ্য হলো না এইসব। সে চেঁচিয়ে উঠলো। খ্যাঁকখ্যাঁক করে উঠল দোকানদারের সাথে,
‘কী দেহেন এত? আমার কী রূপ বাইয়া পড়তাছে? দেহার মতন কী হইছে আমার? অসইব্য লোক।’

খ্যাপে গেলেন দোকানদার। তেড়ে এলেন দ্বিগুণ ক্ষোভে, ‘আমারে অসইব্য কছ! মা* একটা। তুই মাইনষের বিছানতে যাছ আর আমারে কছ অসইব্য?’

এত বিশ্রী গালির পরেও ঠিক থাকতে পারল না বিন্দু। শরীরে আচমকা ঝাঁকুনি দিয়ে সে কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল। হুতুমটা হাউমাউ করে চিৎকার জুড়ে দিল। জড়ো হলো লোক সমাগম। বিন্দুটার কোনো হুঁশ নেই। চুপটি হয়ে মাটিতে মিশে আছে।

(৪৬)

করবীর বিকেলের আকাশ দেখা হয় না কতদিন। কতদিন বাহিরের হাওয়া মন-প্রাণ জুড়িয়ে আলিঙ্গন করে না তাকে! এই একধারে বন্দী জীবনে হাঁপিয়ে উঠেছে যেন সে। এই অপরিচিত জীবনে মানিয়ে নিতে কী ভীষণ কষ্ট হচ্ছে! বিন্দুটাও বা কেমন আছে?

‘ভালো আছো, আপু?’
পরিচিত মেয়েলি কণ্ঠে করবীর ধ্যান ভেঙে গেল। তড়িৎ বেগে সে তাকাল শিঁকের বাহিরে। বিদিশা ভাবিকে দেখে তার বুকে মৃদু কম্পন হলো। যাক, পরিচিত কারো দেখা তো পেলো অবশেষে! কেউ একজন তো এলো তাকে দেখতে। করবী দৌড়ে গেল সেখানে। একবারে কাছাকাছি দাঁড়াল। ঠোঁট কামড়ে কোনো মতে কান্না গিলে বলল, ‘ভালো আছি, ভাবি। তুমি ভালো আছো তো? কেমন কাটছে জীবন?’

বিদিশা অনবরত কথা বলতে থাকা করবীর দিকে তাকিয়ে রইল অনেকক্ষণ। মেয়েটা ভালো আছে বললেও চোখ-মুখ বলে দিচ্ছে মেয়েটা ঠিক কতটুকু ভালো আছে।

‘মন খারাপ করো না, আপু।’
করবী হাসল ভাবির কথায়। পানসে চোখে তাকাল জেলের আধখসা দেয়ালটার দিকে। এই দেয়াল যেন তার জীবনের গল্প বলছে। এই তো তার জীবন। কোনোমতে রঙচটা হয়ে ধ্বংসাবশেষ নিয়ে বেঁচে আছে। করবী হাসি বজায় রেখে বলল, ‘মন খারাপ করব কেন?’

বিদিশা উত্তর দিল কিছুটা রয়েসয়ে, ‘ভাইয়া না হুট করে কোথায় যেন চলে গিয়েছে। বাড়ির সবাইকে বলেছে যেন উনাকে না খোঁজা হয়।’
প্রথম অবস্থায় করবী বুঝতে পারল না কার কথা বলছে বিদিশা। তাই জিজ্ঞেস করল, ‘কোন ভাইয়া?’
‘তিমির ভাইয়া।

করবীর মুখটা যেন রঙ বদল করল। বাঁকা চোখে তাকাল বিদিশার দিকে। কিছু যেন বলতে চাইল কিন্তু বলা হলো না আর। বুক চিরে বেরিয়ে আসা দীর্ঘশ্বাস গুলোকে আবার বুকের ভেতর চেপে ধরল। বিদিশা খুব তীক্ষ্ণ চোখে সবটাই পরখ করল। তার ভীষণ মায়াও লাগল করবীর জন্য। দুঃখিনীর কপালেই বিধাতা দুঃখ লিখেন যে কেন!

#চলবে

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ৩৮ এর বাকি অংশ
কলমে: মম সাহা

(৪৬)

বৃষ্টি হচ্ছে আজ। বৃষ্টির শব্দ বাহির ছাড়িয়ে ঘরে এসে নৃত্য করছে। অসময়ের বৃষ্টির ছাঁট এসে হসপিটালের করিডোরে পড়ছে। বিন্দু ঘুমিয়ে আছে অচৈতন্য হয়ে। তার পাশেই বসা হীরণ। হীরণের কোলে হুতুম বসে আছে। মাথা ঠেকিয়ে রেখেছে হীরণের বুকে। চুপটি করে বসে আঝে বাচ্চাটা। কোনো কথা বলছে না। হয়তো আকষ্মিক এতকিছু বুঝতে পারেনি। হীরণের মাথা চিন্তায় ফেঁটে যাচ্ছে। বিন্দুকে যে অবস্থায় রাস্তায় দেখেছিল, একটুর জন্য তার প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। মেয়েটার জ্ঞান নেই, পাশে বসে ছোটো হুতুমটা কাঁদছে। কী এক অরাজকতার সৃষ্টি যেন! ভাগ্যিস ঐ মুহূর্তে ওদের গলিতে গিয়েছিল।
নাহয় মেয়েটা কতক্ষণ অমন ভাবে পড়ে থাকত কে জানে?

হীরণের এতশত ভাবনার মাঝে ফোনটা বেজে উঠল সশব্দে। পকেট থেকে সাবধানে সে মুঠোফোনটি বের করতেই দেখল স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করে জ্বলছে তার বাবার নামটি। সহজে তাকে কল করার পাত্র বাবা নন। তবে আজ কেন? হীরণ প্রথম কলটি রিসিভ করল না। দেখতে দেখতেই কেটে গেল তাই। পরবর্তীতে আবারও সেকেন্ড পেরুতেই কল এলো। বাবার এত জরুরী তলবে তার ভ্রু দু’টি কুঞ্চিত হয়ে এলো। এত ঘন ঘন কল দেওয়ার কারণ কোনোমতে খুঁজে না পেয়ে অতঃপর সে কল রিসিভ করল। কল রিসিভ করতে তার বাবার বাজখাঁই গলা ভেসে এলো,
‘ইতর ছেলে। এতক্ষণ লাগে কল ধরতে? কই তুই? তাড়াতাড়ি বাসায় আয়।’

বাবার এই ক্রোধ ভরা কণ্ঠ হীরণের কাছে নতুন নয়। সে যথেষ্ট স্বাভাবিক থেকেই বলল, ‘বাসায় কী?’

‘অ স ভ্য ছেলে। কাদের সাথে মিশেছিস তুই? ঐ বস্তির মানুষদের সাথে তাই না? যাদের আমি পায়ের নখের যোগ্যও ভাবি না তাদের সাথে কেইসে তোর নামও জড়িয়ে পড়েছে। আমি জানতামই না উকিল মামুন সাহেব না বললে। তুই আবার তার কাছে গিয়েছিস কেইস নিয়ে। কত বড়ো সাহস তোর।’

হীরণ মাথা যথেষ্ট ঠান্ডা রেখেই বলল, ‘উকিলের কাছে তো মানুষ কেইস নিয়েই যায় বিয়ের কার্ড নিয়ে না। এখানে তো অন্যায়ের কিছু দেখছি না।’

‘তুই আবার মুখে মুখে তর্ক করিস? একটা অ ভ দ্র, অস ভ্য হয়েছিস। এতদিন পথে পথে মা স্তা নি করতিস কিছু বলিনি। তাই বলি এসব কেইসে ফাঁসবি? আমার মানইজ্জত কিচ্ছু নেই। তার উপর যে মেয়ে এসব ঘটনা ঘটিয়েছে তার সাথে নাকি তোকে দেখা যাচ্ছে আজকাল? অমন একটা চরিত্রহীনার সাথে তোর কী এত?’

ধৈর্য্যের বাঁধ আর ধরে রাখতে পারল না হীরণ। চেঁচিয়ে উঠল সাথে সাথে, ‘খবরদার এসব বললে আপনার জিহ্বা টেনে ছিঁড়ে ফেলব। যার সম্পর্কে বলছেন তাকে চিনেন আপনি? জানেন তাকে? আমি ভুলে যাব আপনি আমার বাপ হন।’

হীরণের এই অপ্রত্যাশিত হুমকি বাবা বোধহয় আশা করেননি। তার উপর সন্তানের হাতে মার খাওয়ার হুমকি কোনো বাবা-মাই আশা করেন না হয়তো। তাই ভদ্রলোকও আকস্মিক চুপ হয়ে গেলেন। তাজ্জব হয়ে গেলেন যেন। অস্ফুটস্বরে কেবল বললেন,
‘বাবার গায়ে হাত তোলার হুমকি দিচ্ছো! এত অধঃপতন হয়েছে তোমার?’

ব্যস্! এতটুকু বলেই ফোনটা কেটে দিলেন। হীরণও বুঝতে পারল হটকারিতায় সে ভুল কথা বলে ফেলেছে। যতই হোক বাবাকে এসব বলা শোভনীয় নয়। সৃষ্টিকর্তার দরবারে এই পাপ যে বড়ো ঘৃণিত। কিন্তু তখন বিন্দুর নামে এমন কথা শুনে সে যে নিজেকে সামলাতে পারেনি। তারই বা দোষ কী? এত ঝামেলার মাঝে মাথা ঠিক থাকে? একদিকে তার রুবী জেলে, অন্যদিকে সহজ-সরল মেয়েটার জীবন-মরণ সংশয়, সে যাবে কোথায়? তার উপর রুবীর নামে যেই কেইস উঠেছে তা থেকে নিস্তার পাওয়া অসম্ভব। ভাবতে ভাবতেই হীরণে বুক ভারি হয়ে আসে। তপ্ত শ্বাস ফেলে তাকাতেই দেখে হুতুম তাকিয়ে আছে তার দিকে ড্যাবড্যাব করে। চোখ দুটিতে জলে টলমল করছে। হীরণকে নিজের দিকে তাকাতে দেখে ব্যাকুল স্বরে বলে, ‘মাস্তান, এমন কইরা চিল্লাইও না বিন্দুবালা ডরাইবো যে!’

বাচ্চাটার নিখাঁদ আকুতিতে মন নরম হয়ে যায় তার। মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, ‘সরি, সোনা।’

‘মাস্তান, বিন্দুবালারে না সবাই কেমন কথা হুনাইছে। বকাও দিছে। বিন্দুবালারে সবাই বকে ক্যান? বিন্দুবালা কী করছে? আমাগো বিন্দুবালা তো অনেক ভালা। তুমি কইয়া দিও সবাইরে, আমাগো বিন্দুবালা কহনো কিচ্ছু করে নাই। অরে যেন কেউ না বকে। বিন্দুবালার মা যে মইরা গেছে। বিন্দুবালা কানলে অর চোখে পানি মুছবো কে?’

ছোটো হুতুমের এমন গভীর কথায় হীরণের বুকে উত্তাল ঢেউ উঠে। তারও কাঁদতে ইচ্ছে হয় বুক খুলে। কিন্তু সবাই কাঁদলে স্বান্তনা দিবে কে?

দু’জনের কথোপকথনের মাঝে কেবিনে প্রবেশ করে ডাক্তার সামিনা কায়সার। চিকন ফ্রেমের চশমা পরা চল্লিশোর্ধ্ব সামিনা কায়সারকে দেখে হীরণ দাঁড়িয়ে যায়। হুতুম তখনো তার কোলে। ডাক্তার এসে ঘুমন্ত বিন্দুর কিছু পরীক্ষা করেন। এরপর সহজ গলায় বলেন, ‘রোগী ট্রমাটিক। মেন্টালি হেলথ প্রচন্ড খারাপ। কী হন আপনি?’

উত্তর দিতে গিয়ে গলায় বাঁধে হীরণের। কতক্ষণ চুপ করে থাকে। তারপর ধীর স্বরে বলে, ‘বন্ধু।’

সামিনা কায়সার অভিজ্ঞ চোখে একবার হীরণকে পরখ করে মাথা দুলায়। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলে, ‘রোগীর সাথে যা হয়েছে সেটা অনেক খারাপ। আর রোগী সেসব মানতে পারেনি। তাই তার প্যানিক অ্যাটাক হয়েছে আজ। তার জ্ঞান ফেরার পর যেমন উদ্ভ্রান্ত দেখলাম মনে হচ্ছে তার মেন্টালি অসুস্থ হতে খুব বেশি সময় লাগবে না। এই পরিবেশে থাকলে কিছুদিনের মাঝেই সে পাগল হয়ে যাবে।’

ডাক্তারের কথায় হীরণসহ হুতুমও আঁতকে উঠে। সহাস্যে হীরণের গলা জড়িয়ে ধরে বাচ্চাটা। কেঁদে ফেলে সাথে সাথে। হীরণ নিজেও গতি হারিয়ে ফেলে। কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। সামিনা কায়সার আলগোছে হুতুমের পিঠে মায়ায় দু একবার হাত বুলিয়ে হীরণের উদ্দেশ্যে বলে,
‘উনার সামনে যতই সেসব নিয়ে কথা হবে উনি ততই ভারসাম্য হারিয়ে ফেলবে। একটা সময় পর দেখা যাবে সব হাতের বাহিরে। এবার আপনি ভেবে দেখুন বাকিটা।’

ভেবে দেখুন বললেও হীরণ ভাবতে পারে না। এই কেইসে বিন্দু সবচেয়ে প্রয়োজনীয় মানুষ। তাে উপর এটা যেই ঘটনা, এই পরিবেশ বার বারই বিন্দুকে এইসব কথা শুনতেই হবে। তাহলে? কীভাবে কী করবে সে? এসব আটকানোর সাধ্য কী তার আছে?

_

প্রবল বৃষ্টি দেখে বিদিশা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। বারান্দার শিঁক গলিয়ে ডান হাতটা বাহির করে রেখেছে। টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটায় ভিজে যাচ্ছে সেই হাতটা। তার উপর উন্মাদ করা শীতল বাতাস তার শরীরে শক্ত-পোক্ত আলিঙ্গন করে যাচ্ছে। তার দৃষ্টি, মন খারাপ করা আকাশের দিকে। গুড়ুম গুড়ুম ডাকছে সেই আকাশটি। এই শহরে তখন বৃষ্টি বড়ো বিলাসিতার বস্তু।
ফোনো টুং করে শব্দ হতেই বাম হাতে থাকা ফোনটি চোখের সামনে ধরল। দেখল তার শাশুড়ির মিসড কল দেখাচ্ছে। বিদিশা ফোনটা সরিয়ে রাখতে নিলেই আবার কল বেজে উঠে। কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে তাসনীম বেগমের কোমল কণ্ঠ ভেসে এলো, নিভু নিভু স্বরে বললেন,
‘বউমা, ফিরে আসবে কী?’

খুব দূরে কোথাও বজ্রপাত হলো। আজ আর বিদিশা ভয়ে কাঁপল না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল ঠাঁই। একটি নামহীন হাসি ঠোঁট জুড়ে হামাগুড়ি দিল। সে জানত এই ফোনকলটা যে আসবে। আসাটাই শিরোধার্য যে! ভদ্রমহিলা আবার একা হয়ে গিয়েছেন যে! বড়োছেলে গতকাল দেশ ছেড়েছেন আর ছোটো ছেলে গা ঢাকা দিয়ে কোথায় গিয়েছেন কে জানে? রক্তের ধারা যে এটাই। সমস্যা দেখলেই গা ঢাকা দেওয়া।
এত বড়ো পৃথিবীর, এত বড়ো শহরটায় ভদ্রমহিলা যে একা। তার ভরা সংসার করার স্বপ্ন বুকে নিয়ে একা ঘরে দিন কাটাচ্ছেন। এই চরম বিষাদ মুহূর্তে সেই বৃদ্ধ নারীটির যে পরম শুভাকাঙ্ক্ষী এই বিদিশাই। এই সত্য যে চির নির্মল। এ সত্য অস্বীকার করার জো নেই। অস্বীকার করার ক্ষমতা নেই কারো। ঐ বৃদ্ধা কয়েকদিনের মায়ার বশে যে-ই বিদিশাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছেন সেই বিদিশাই যে বৃদ্ধার একমাত্র সম্বল সেই কথা যে ঐ সৃষ্টিকর্তা জানেন। তাই তো দিনশেষে আবার এই গন্তব্যেই থামিয়েছেন ভদ্রমহিলার সকল সমাপ্তি।

বিদিশা ভাবুক হলো। তার এখন কী করা উচিত? অকৃতজ্ঞ শাশুড়ির প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে এই চরম একাকীত্বে মানুষটাকে ফিরিয়ে দিয়ে পৈচাশিক আনন্দ করা উচিত? ভদ্রমহিলার ছেলে বিদিশার এতগুলো বছরের অপেক্ষাকে ধূলোয় উড়িয়ে দিয়েছে বলে সে শাস্তিস্বরূপ এই নারীটিকে দূরছাই করে তাড়িয়ে দেওয়া উচিত? নাকি বিনা স্বার্থে ডুবতে থাকা মানুষের একমাত্র ভরসার কূলের মতন এই মহিলার শেষ সম্বলটুকু হওয়া উচিত?
কোনটা করলে সমাজ মানবে? আর কোনটা করলেই বা মন মানবে?
প্রতিশোধ নাকি প্রেম? কোনটা হলে অন্তরাত্মা চরম সন্তুষ্টি নিয়ে চোখ বুজবে?

#চলবে

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ৩৯

(৪৭)

এই শহরে বৃষ্টির আবহাওয়া চলছে। দিন নেই রাত নেই, ঝপঝপিয়ে আকাশ কালো করে বৃষ্টি হচ্ছে। কখনো মৃদু গর্জনে আকাশ ডাকছে কখনো বা তুমুল গর্জনে ফেটে পড়ছে। কখনো আবার ঝকঝকে সোনালি রোদ্দুর হাসছে।
আজকের দিনটি সোনালি রোদ্দুর হাসার দিন। ঝকঝকে এক সূর্য উঠেছে চকচকে হাসি নিয়ে। বুক ফুলিয়ে সেই সূর্য দাঁড়িয়ে আছে ঠিক আকাশের মাঝ বরাবর। গরমও পড়েছে অতিরিক্ত। বিন্দুর শরীরে অবনতি এতটাই বাজে পর্যায়ে হয়েছে যে বিন্দুর কোনো বোধ নেই। হুট করেই কাউকে চিনতে পারছে না। আবার চিনতে পারলেও কথা বলছে না। কখনো বা রেগে যাচ্ছে হুটহাট। দু’দিন আগেও হুতুমের মাথা ফাটিয়ে ফেলেছে। তা-ও নিচ তালার এক মহিলার প্রশ্নের বাণে অতিষ্ঠ হয়ে ছুটে এসে এটা ওটা ছুঁড়তে গিয়ে দুর্ঘটনাবশত হুতুমের গায়ে পড়ে যায়। এবং মাথাটা ফেটে যায়। র ক্তা র ক্তি কাণ্ড! হীরণ এসে দেখে তো আহম্মক বনে যায়। বিন্দুর আব্বুও এসব দেখে দেখে গুরুতর অসুস্থ হয়ে যাচ্ছিলেন। তাই অবশেষে একটি স্বাস্থ্য কেয়ার কমপ্লেক্সে হীরণ বিন্দুর আব্বুকে পাঠিয়ে দেয়। বিন্দুর যে অবস্থা, কাউকে ওর সামনে রাখা নিরাপদ না। দেখা যায় হুট করেই কী না কী করে বসবে!

বিন্দুর অবস্থা অবনতি হচ্ছিল বিধায় আবারও সামিনা কায়সারের কাছে নিয়ে যায় হীরণ। কিন্তু ডাক্তারের এক কথা। এই পরিবেশে থাকলে বিন্দুর মানসিক অবস্থা খারাপ বৈ ভালো হবে না। এদিকে করবীর কেইস কোর্টে উঠে গিয়েছে। প্রথমদিন তো বিন্দুকে পেশ করা যায়নি। বিন্দুর অবস্থার জন্য কেইস একবিন্দু আগায়নি। তার উপর কোনো উকিল পাওয়া যায়নি। অবশ্য উকিল ঠিক করার চেয়ে বিন্দুকে নিয়েই বেশি ছুটতে হয়েছে হীরণের। একা মানুষ কোনদিকেই বা যাবে?

আজকে ঝলমলে সূর্যের মতন বিন্দুরও মন মেজাজে খানিকটা উন্নতি দেখা গেল। হীরণ বাসায় এসে দেখল বিন্দু ভাত রান্না করেছে। হুতুমকে নিজের হাতে গোসল করিয়ে সুন্দর জামাকাপড় পরিয়েছে। বিন্দুর এমন আকাশ-পাতাল পরিবর্তনে হীরণ যেন বেজায় চমকে যায়। বোকা স্বরে বলল, ‘বিন্দু! তুই ঠিক হয়ে গিয়েছিস?’

বিন্দু তখন চুল আঁচড়াচ্ছিল। হুট করে হীরণের কণ্ঠ পেতেই বুকে থুতু দিল। ভয় পেয়েছে বেশ। হীরণ এগিয়ে এলো। ব্যস্ত স্বরে শুধাল, ‘ভয়ে পেয়েছিস?’

বিন্দু কিছু বলল না। কেবল আবদার করল, ‘আইজ আপার কাছে যামু, হীরণ ভাই। ম্যালাদিন হইছে আপারে দেহি না।’

এই সব কথাই হীরণের কাছে অবাস্তব লাগছে। বিন্দুর মানসিক অবস্থা গুরুতর খারাপ। তার মাঝে হুট করে এই আবদার যেন বড়ো সমস্যার সৃষ্টি করছে। কিন্তু তবুও হীরণ দ্বিমত পোষণ করল না। কেবল বলল, ‘নিজেকে ঠিক রাখতে পারবি তো?’

বিন্দুর হাত থেমে যায় এমন প্রশ্নে। ঘাড় ঘুরায় যন্ত্রের মতন। বেশ খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে, ‘আমি কতটা পাষাণ তাই না বলো?’

হীরণ দু’কদম এগিয়ে আসে। বিন্দুর মাথায় হাত দিতে গিয়েও দেয় না। যদি বিন্দু ভয় পায় আবার! কেবল স্বান্তনার কণ্ঠে বলে, ‘কে বলেছে তুই পাষাণ?’

‘আমি নিজেই জানি, হীরণ ভাই। আপা আমার লাইগ্যা কত যন্ত্রণা ভোগ করতাছে অথচ আমি কিচ্ছুই করতে পারতাছি না। খালি দিন দিন পাগলের মতন কইরা তোমাগোরে জ্বালাইতাছি। হীরণ ভাই, হেইদিন আপারে আইতে কওয়া আমার অন্যায় ছিল। আপারে আইতে না কইলে এত সমস্যা হইতো না। আপা আমার লাইগ্যাই এমন ফাইস্যা গেলো।’

‘ভাগ্য ছিল, বিন্দু।’

‘হীরণ ভাই, আমার ভাইগ্যেই ক্যান এমন থাহে? আমার মতন অসুন্দর, বিদঘুটেই ক্যান আমার ভাইগ্যটারে হইতে হইলো?’

হীরণ চোখ রাঙায়। এমন কথা বলতে নিষেধ করে। বিন্দুকে উত্তেজিত দেখা যায়। কেমন যেন লাগে। তবুও করবীকে দেখার বায়না পূরণ করার জন্য তাকে নিয়ে ছুটে পুলিশ স্টেশন।

থানায় বেজায় কোলাহল। খু নির আসামীর সাথে দেখা করতে হলে বড়ো অফিসারের নির্দেশ লাগে। হীরণ সেটাও জোগাড় করে আনে। তারপর হুতুম, বিন্দুরে নিয়ে ঢুকে থানায়। করবীর চোখ-মুখ ভেঙে এসেছে। অযত্নের ছাপ পড়েছে মেয়েটার মুখে। যেই সুন্দর রক্তকরবী একসময় যুবকদের বুকের উত্তাল ঢেউ ছিল, সেই সৌন্দর্যতা আজ ফুরিয়ে আসার পথে প্রায়। ফর্মা চামড়ায় কত দাগ পড়ে গিয়েছে এতগুলো দিনে। চোখের নিচে কালচে গাঢ় রেখা। কিন্তু এতদিন পর বিন্দুকে দেখে সেই ক্লান্ত চোখ জোড়া যেন হেসে উঠল। ছুটে এসে লোহার বড়ো বড়ো শিক গলিয়ে ছুঁয়ে দেয় বিন্দুর মুখমন্ডল। হুতুমের মুখমন্ডল। এই আনন্দ যেন বহু যুগ পর তার জীবনে এসেছে হামাগুড়ি দিয়ে। আপন মানুষের মুখ যেন এই জীবনে বড়ো মূল্যবান জিনিস।

কেঁদে দিল বিন্দু। আপার কারগারের বাহিরে থাকা দুই হাতে চেপে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল সে। কাঁদতে কাঁদতে তার চিরপরিচিত বিলাপও যুক্ত করল,
‘আপা, আমারে মাফ কইরো আপা। তোমারে এত দুঃখ দেওয়ার মতন অপরাধ আমি করছি, আপা। আমারে মাফ কইরো।’

করবীও কাঁদল। বিন্দুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘কাঁদছিস কেন বো কা? তুই আমাকে কোথায় দুঃখ দিলি? বরং তুই ছিলিস বলে আমি নিজেকে সুখী দাবী করতে পারি। এমন বো কা কথা কেউ বলে?’

বিন্দু মানতে চায় না আপার সেই স্বান্তনা। হাউমাউ করে চিৎকার করতে করতে বলে, ‘আমারে ক্ষমা কইরো, আপা। আমার এক ভুলে তোমার জীবনডা শেষ। আপা আমার উপর অভিমান রাইখো না। আর কেউ না জানলেও তুমি তো জানো তোমারে আমি কতখানি ভালোবাসি? আমার উপর অভিমান কইরো না গো।’

তাদের এই কান্নাতেই লোক জড়ো হয়ে যায়। হীরণও মুখ চেপে কান্না সংবরণের চেষ্টা করে। তাদের জীবনটা যে এমন হওয়ার কথা ছিল না। এটা এলোমেলো, এতটা নষ্ট হওয়ার কথা ছিল না। তবে কেন এমনটা হলো? রুবীর কপালে কেন দুঃখ নামল স্রোতের মতন? বিন্দুই বা কেন এত কষ্ট পেল?

ভীড়ের মাঝে একজন কনস্টেবল বলে উঠল, ‘আরে এটা সেই মেয়েটা না যার সাথে আশরাফুল ইসলাম খারাপ কাজ করছিলো? এর জন্যই তো পরে খু ন হয়। নাকি?’

বিন্দুর কান্না হঠাৎ থেমে যায়। মাথা চাড়া দিয়ে উঠে সেই দৃশ্য। মুহূর্তেই নরম বিন্দুর রঙ পাল্টে ধারণ করে এক পাগলাটে বিন্দুর রূপ। খ্যাক করে উঠে সে, ‘কে, কে বলল? হ্যাঁ? কে?’

সকলের চোখের সামনেই বিন্দুর অগাধ পরিবর্তন ঘটে। অতি উত্তেজনায় মেয়েটা কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। করবীর কাছে সবটাই নতুন। তাজ্জব বনে হীরণের দিকে তাকাতেই বিন্দুর আসল অসুস্থতার কথা হীরণ বিশ্লেষণ সহকারে জানায়। থম মেরে যায় করবী। ব্যাকুল নয়নে তাকিয়ে থাকে কেবল। তারপর কী যেন ভাবে। টানা টানা চোখে তাকিয়ে কঠিন স্বরে বলে, ‘একটা কথা রাখবে, মাস্তান?’

হীরণ চমকায়। করবীর কণ্ঠস্বর অন্যরকম। অপরিচিত।

করবী আবার বলে, ‘রাখবে?’

‘কী?’

খুব আড়ালে করবী একটি অন্যায় আবদার করে বসে। করবী স্বার্থপর হয় আপন মানুষদের জন্য। হীরণ কথা রাখতে চায় না। কিন্তু করবী অটুট। নিজেকে বড়ো অসহায় লাগে হীরণের। এই ক্ষণটা পৃথিবীর বুক থেকে মুছে ফেলতে ইচ্ছে হয় তার। কিন্তু পারে না। তারপর……
জীবনের গতিপথ বদলে যায় অদৃশ্য এক সম্পর্কের বাঁধনে। সবসময় কী রক্তের সম্পর্কই সব? মোটেও না। আত্মার সাথে আত্মার সম্পর্ক যে বড়ো তা রক্তকরবীরা না থাকলে পৃথিবী জানতো? জানতো না।

#চলবে

বুকপকেটের বিরহিণী পর্ব-৩৬+৩৭

0

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ৩৬ (নতুন মোড়)
কলমে: মম সাহা

(৪৪)

একটি শুনশান রাতের রাস্তা। যে রাস্তায় জোছনা পড়ছে না। রাস্তার উপর আকাশটা হাসছে না। মন ভার তার। ভীষণ শক্ত-পোক্ত রকমের মন ভার। আকাশের গম্ভীর্যতা দেখে আঁচ করা যাচ্ছে বৃষ্টি আসবে। বেশ ভালো রকমের বৃষ্টি। প্রায় একটু বাদে বাদে ভয়ঙ্কর শব্দে ডেকে উঠছে আকাশ।
ঘেমে-নেয়ে একাকার করবীর শরীর। সে দাঁড়িয়ে আছে বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়িটার সামনে। অপরিচিত বাড়ি। কেবল বিন্দুর বলা অস্পষ্ট ঠিকানাটা ধারণা করেই এখানে আসা। বাড়ির গেইটে দু’জন দারোয়ান আছে। ঝিমুচ্ছে একজন। আরকজন বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বসা। ভেতর থেকে লোহার মস্ত বড়ো গেইটটা তালা দেওয়া।
করবী গেইটের সামনে গিয়ে সজাগ থাকা দারোয়ানটাকে ডাকল। যিনি যন্ত্রের মতন বসে আছেন এক ধারে।

‘চাচা, গেইটটা খুলুন না।’
যান্ত্রিক চোখেই সেই দারোয়ান তাকাল করবীর দিকে। তারপর বড়ো বড়ো পা ফলে তিন লাফেই যেন গেইটের সামনে চলে এলো।
‘কাকে চাই?’

করবী কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে বলল, ‘কাকা, এটা কী আশরাফুল ইসলামের বাড়ি?’
যন্ত্রের মতন রোবট মানুষটা হয়তো করবীর কথায় বেশ বিরক্ত হলেন। কিছুটা বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, ‘না জেনেই এত রাতে আসছেন কেন?’

শুদ্ধ ভাষায় কড়া কণ্ঠে বিরক্ত প্রকাশ করলেন উনি।
করবী মিনতি করল, ‘চাচা, বড়ো বিপদে পড়েই এসেছি। সাহায্য করুন। গেইট টা খুলুন। আমার বোন বাড়ির ভেতরে।’

এবার ভদ্রলোক কিছুটা ভ্রু কুঁচকালেন, ‘আপনার বোন?’
‘হ্যাঁ, আমার বোন। চকমো গার্মেন্টস কোম্পানির সাধারণ কর্মী। তাকে নাকি এখানে…’
‘না, না, এখানে তেমন কেউ নেই। আপনি যান তো। রাত-বিরেতে বিরক্ত করবেন না।’

ভদ্রলোকের উচ্চবাচ্যে জেগে গেলেন ঝিমুনি কাটতে থাকা দ্বিতীয় জন। তিনি হাঁক ছেড়ে বললেন, ‘কে এসেছে রে, জামশেদ?’
‘তেমন কেউ না। আপনি ঘুমান।’
জামশেদ নামক লোকটার কথায় আশ্বাসিত হয়ে আবার ঘুমে তলিয়ে গেলেন দ্বিতীয়জন।
করবীর হৃদপিণ্ড কাঁপছে। হাত জোর করে সে মিনতি করল, ‘খুলেন দয়া করে। আমার বোনটা ছোটো। ওর অতটুকু বয়স। ওর পরিবারে কেউ নেই হাল ধরার। বৃদ্ধ বাবা আর ছোটো একটা মেয়ে ছাড়া। ওর কিছু হয়ে গেলে মেয়েটা বাঁচবে না। জামশেদ চাচা খুলেন। চাচা দোহাই লাগে আপনার।’

জামশেদ চাচার চোখে-মুখে উদ্বিগ্নতা দেখা গেল না লেশমাত্র। মুখ-চোখ শক্ত করে বললেন, ‘যান তো এখান থেকে। শুধু শুধু বিরক্ত করে লোক সজাগ করছেন।’

করবী লোহার গেইটের ভেতর দিয়ে হাত ঢুকিয়ে পা জড়িয়ে ধরল লোকটার। চোখ দিয়ে তার অনর্গল অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। কণ্ঠে করুণ মায়া, ‘চাচা, আপনি আমাদের বাবার মতন। আপনার সন্তান বিপদে পড়লে কী এমন নির্দয় হতে পারতেন। আপনার পা ধরলাম চাচা। আমার বিন্দুটার কিছু হয়ে গেলে আমি কী করব! আমার যে ও ছাড়া কেউ নেই। চাচা আপনার দোহাই লাগে চাচা। আপনি দরজাটা খুলেন। আপনার কাছে মিনতি করছি।’

কী জানি! করবীর এমন অসহায়ত্বে যেন ভদ্রলোকের কিছুটা মন গলে গেলো। আশেপাশে চোরের মতন তাকিয়ে সাবধানী কণ্ঠে বলল, ‘খুললেও তুমি একা কিছু করতে পারবে না। চলে যাও। লাভ নেই। কোনো ক্ষমতাই এই বাড়ির মালিকের কিচ্ছু করতে পারবে না।’

ফিসফিস করে কথাটা বলেই ভদ্রলোক সিগারেট বের করে চলে গেলেন ডান দিকে। অসাবধানতা বশত চাবির গোছাটা ফেলে গেলেন একদম করবীর হাতের কাছটায়। প্রত্যক্ষ দৃষ্টিতে যেন মনে হবে অনিচ্ছায় পড়েছে কিন্তু পরোক্ষভাবে দেখলে পুরো ঘটনাটা ঘটল সম্মতিতে।
চাবির গোছাটা পেতেই করবী উন্মাদের মতন গেইট খোলার চেষ্টা করল। দু একবার ব্যর্থও হলো। অতঃপর খুলতে পারল সেই তালা। গেইটটা খুলেই করবী দৌড়ে গেল বাড়িটায়। ভেতর থেকে লক করা দরজা। অনবরত কলিংবেলটা বাজাতে লাগল সে। ব্যাগে ফোনটা বাজছে। বোধহয় হীরণ কল দিয়েছে। সে তো হীরণকে বলল পুলিশ নিয়ে আসতে। হয়তো চলে এসেছে ওরা। কিন্তু এখন ফোন ধরার সময় নেই।

বার বার কলিংবেল বাজানোর পর ভেতর থেকে গলা পাওয়া গেল। মধ্যবয়স্ক পুরুষালি কণ্ঠ,
‘পি চা শের বাচ্চা গুলা শান্তি দিল না। রা স্কে ল একেকটা।’

গমগমে স্বরে কতগুলো গালি দিতে দিতেই দরজা খুললেন আশরাফুল ইসলাম। মোটাসোটা, লম্বা-চওড়া দেহী একজন মাঝবয়সী লোক। করবীকে দেখে তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন।
করবী বলল, ‘বিন্দু কোথায়?’

‘কে? কে রে তুই? এত রাতে আমার বাড়িতে কীভাবে? জামশেদ, জামশেদ… হাবিবুর অ্যাই হাবিবুর… বা** কোথায় তোরা। কাকে ঢুকাইছিস বাড়িতে।’

ভদ্রলোকের জড়িয়ে আসছে গলার স্বর। সেই চিৎকারে ছুটে এলেন জামশেদ ও হাবিবুর নামের দু’জনেই। এসেই বিরাট সালাম দিলেন।
‘শালারা, এই মাইয়া এখানে ঢুকল কীভাবে? কী করছিলি তোরা?’

অবস্থা বেগতিক হওয়ার আগেই করবী আশরাফুল ইসলামকে ধাক্কা দিয়ে বাড়ির ভেতরটায় ঢুকে গেল। আলিশান বাড়ি। সাদা ধবধবে টাইলস বসানো। রাজকীয় হাবভাব। করবীর অত দেখার সময় কই? সে তো সর্বস্ব দিয়ে হাঁক পাড়া আরম্ভ করল,
‘বিন্দু, এই বিন্দু, কোথায় তুই? আপা আসছে। বিন্দুরে..।’

ততক্ষণে আশরাফুল ইসলাম, জামশেদ, হাবিবুর তিনজনেই ঢুকে গেলেন বাড়ির ভেতরে। আশরাফুলের ইশারায় করবীর চুলের মুঠি টেনে ধরলেন হাবিবুর নামের বয়স্ক লোকটা। করবী প্রথম টানে বেশ ব্যথা পেলেও কনুই দিয়ে চাপা ভাঙা, আধবুড়ো লোকটার পেটে আঘাত করল।
এমন শক্ত আঘাত কাবু করে ফেলল লোকটাকে। আশরাফুল জামশেদকে হুকুম করল করবীকে ধরার জন্য। কিন্তু হেলদোল নেই সেই লোকের ভেতরে। দাঁড়িয়ে রইলেন তিনি খাম্বার মতন। এতে আশরাফুল অশ্রাব্য ভাষায় কিছু গালিও দিলেন।
বিন্দু ছুটে এলো দু’তালার একটি রুম থেকে। জামাটা উল্টো গায়ে দেওয়া। সেলোয়ারের বাম পায়ের খানিকটা ছিঁড়ে গিয়েছে। এসেই জড়িয়ে ধরল করবীকে। হাউমাউ করে সে কী কান্না! মদ্যপ অবস্থায় থাকা আশরাফুল ঢুলতে ঢুলতে এগিয়ে গেলেন। করবী লোকটাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করল। প্রথম ধাক্কায় কিছুটা নড়লেও দ্বিতীয় ধাক্কায় কিছুই হলো না। আতঙ্কিত বিন্দুটা হাউমাউ করে চিৎকার করছে। আতঙ্কে, ভয়ে মুখটা ছোটো হয়ে আসছে মেয়েটার। পেছাতে পেছাতে তারা রান্নাঘরে গিয়ে থামল। এত বড়ো বাড়ি অথচ কেউ নেই। থাকবেই বা কীভাবে? এটা যে উনার আলাদা বাড়ি। পরিবার থাকে আরেকটি বাড়িতে।

জামশাদ নেই এখানে। হয়তো পালিয়েছেন। হাবিবুর মাটিতে পড়ে আছেন আগের মতন। কোনো সাড়াশব্দ নেই।
দানবীয় শক্তিতে করবীর বা-হাতের কব্জি টেনে ধরলেন আশরাফুল। জড়িয়ে আসা গলার স্বরে বলেন, ‘এত তেজ! এত নাটকের কী ছিল? তোর বোন তো কাল সকালেই চলে যেত বাসায়। পাঠিয়ে দিতাম আজ রাতটুকু মজা করে। এরপর বেতনও বাড়তো, সুযোগসুবিধাও বাড়তো। শুধু শুধু এত হাঙ্গামার দরকার ছিল না।’

লোকটার কথায় ঘৃণায় ভোরে যাচ্ছিল অন্তরটা। কিন্তু কোনোমতেই উনার শক্তির কাছে পারছিল না করবী। হীরণও এলো তখনি। ছুটতে ছুটতেই ঢুকেছে বোধহয় বাড়িটাতে। হাঁপাচ্ছে সে। করবী ও বিন্দুর এ অবস্থা দেখে তার আত্মা যেন গলায় আটকে গেছে। দ্রুতই সে রান্নাঘরে ছুটে গেল। আশরাফুল ইসলামের উদোম শরীরে কয়েকটা কিল-ঘুষি দিল।
হাতাহাতি লেগে গেল মুহূর্তেই। করবী চিৎকার করে বলল,
‘পুলিশ কোথায়? পুলিশ আনোনি? জানাওনি?’

হীরণরা তখন হাতাহাতিতে ব্যস্ত। এক পর্যায়ে এসে লোকটা হীরণের বুকে একটা লাথি লাগিয়ে দিল। দানবের মতন শক্তি তার। লাথির চোটে হীরণ ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ল। ভদ্রলোক আরেকটি দানবীয় লাথি দেওয়ার আগেই তার ঘাড়টা মাথা থেকে আলাদা হয়ে গেল। ছিটকে গিয়ে পড়ল কাঠের চেয়ারটির পাশে। তরতাজা ভদ্রলোকের মাথা বিহীন উদোম দেহটি তুমুল শব্দে পড়ে গেল ফ্লোরে। র ক্তে ভেসে গেল ফ্লোর। কী বিভৎস সেই দৃশ্য! হীরণের মতন নির্ভয় পুরুষ অব্দি চোখ বন্ধ করে ফেলল।

#চলবে….

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ৩৭

কলমে: মম সাহা

আজ গরম পড়েছে ভীষণ। পুলিশ স্টেশনে ভিড়ও বড়ো বেশি। কেমন হাউকাউ চারপাশে! মনে হচ্ছে যেন মাছের বাজার। থানার বড়ো সাহেব কয়েকবার জোরে জোরে ধমকে উঠেছিল। ধমকের পর সবটা শুনশান নিরবই থাকে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার যেমনটা তেমন হয়ে যায়।
করবী দাঁড়িয়ে আছে লোহার শিকের ভেতরের বদ্ধ ঘরটায়। হীরণ বসে আছে বড়ো সাহেবের সামনে। অনবরত ঘামছে ছেলেটা। কেমন উদ্ভ্রান্ত, দিশেহারা লাগছে তাকে। থানার বড়ো অফিসার রশিদ সাহেব পা দোলাতে দোলাতে বললেন, ‘কী ব্যাপার? এভাবে বসে আছেন কেন? বাড়ি যান। নয়তো খুনের সময় প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন বিধায় আপনাকেও জেলে ভরা হবে।’

রাশিদ সাহেবের কথাতেও ভয় পেতে দেখা গেল না হীরণের ভেতর। বরং সে বেজায় চিন্তিত হলো। পাংশুটে মুখে বলল, ‘আপনাদের তো আমি রাতেই ইনফর্ম করে গেলাম। উঠি-বসি? বলার সাথে সাথেই চলে যাওয়া যায়? আপনারা কী ভাবেন পুলিশদের? স্প্রাইটার ম্যান? নাকি জিন, পরী? উড়াল দিয়ে চলে যেতে পারার ক্ষমতা আছে আমাদের।’

রশিদ সাহেব যতটুকু জোরে চেঁচালেন তার চেয়ে অধিক জোরে থানার কাঠের চেয়ারটায় লাথি দিল হীরণ। রাগে কাঁপছে ছেলেটার শরীর। করবী ভেতর থেকেই ডাকল। নিষেধ করল রাগারাগি না করার জন্য। কিন্তু শুনল না হীরণ। টেবিলে জোরে শব্দ করে ঘুষি দিল।
‘খু ন হওয়ার সাথে সাথে চলে এসে ছিলেন কীভাবে? তখন কী স্প্রাইডার ম্যান হয়ে গিয়ে ছিলেন নাকি জিন, পরি?’

রশিদ সাহেবের ভালো লাগল না হীরণের অতি সাহস। ক্ষুব্ধ হলেন তিনি। উঠে গিয়ে কলার চেপে ধরল তৎক্ষণাৎ। দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, ‘থানাতে এসে গুণ্ডামি? দিবো লকআপে ভরে?’

করবী ভেতর থেকেই আকুতিভরা কণ্ঠে বলল, ‘স্যার, স্যার ওকে ছেড়ে দেন। ওর মাথাটা গরম হয়ে আছে সেজন্য ভুল করে ফেলছে। আমি ক্ষমা চাচ্ছি ভুলের জন্য।’

রশিদ সাহেব করবীর দিকে একবার তাকালেন। তখনই একজন কনস্টেবল এসে ছাড়িয়ে নিলেন দু’জনকে। স্যারকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করে টেনে হীরণকে বের করে আনলেন থানার বাহিরে। হীরণ রাগে ফুঁসছে অনবরত। কনস্টেবল সালাহউদ্দিন হীরণকে বড়ো স্যারের সামনে থেকে কিছুটা আড়ালে নিয়ে গিয়েই দাঁড় করালেন। নম্র কণ্ঠে বললেন, ‘এসব করবেন না। আপনাদের ঝামেলা বাড়বে বৈ কমবে না। এসব করে ঝামেলা বাড়াচ্ছেন।’

হীরণ ক্ষুব্ধ স্বরে বলল, ‘শা লা, মাদার** দলেরা। ইচ্ছে করে এটা করেছে। কাল আমি যখন বলে ছিলাম তখন আমার সাথে গেলেই আজ এত কিছু হতো না।’

‘আপনার সাথে যায়নি কারণ আছে। আশরাফুল ইসলামের অনুমতি বিহীন তার বাংলোতে কেউ যাবে না। সে যে-ই হোক। এত বড়ো একজন শিল্পপতি তিনি, তার এতটুকু পাউয়ার তো চলছেই আইনের বাজারে।’

সালাহউদ্দিনের কথায় আকাশ থেকে যেন পড়ল হীরণ। কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে বলল, ‘কী!’

‘হ্যাঁ, আমি ঠিক বলেছি। এসব শিল্পপতিদের ক্ষমতা। আপনার, আমার মতন সাধারণ জনতা কিছুই করতে পারবে না এখানে। তাই তো আপনি সাহায্য চাওয়া স্বত্বেও সঠিক সময় আইনের লোক গিয়ে পৌঁছায়নি।’

রাজনীতির এই বিদঘুটে গল্প শুনে হতভম্ব হয়ে গেল হীরণ। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলল, ‘তাহলে! এখন কী করব আমরা?’

‘কেইস কোর্টে উঠবে। উকিল ঠিক করা আরম্ভ করুন। যদিও জানি আশরাফুল ইসলাম মরে গেলেও তার বিরুদ্ধে কোনো উকিলও আসবে না। সবারই জানের ভয় আছে। বরং দেখা গেল যারা খু নীকে সাহায্য করবে তাদেরসহ জেলে ভরা হবে নানান কেইসে। এমন কত হলো! ভোগান্তি পোহাতে গিয়ে একটা সময় পর মানুষ আত্মহত্যাও করে। তাছাড়া যার সাথে ঐ লোক খারাপ কাজ করেছে তার ভোগান্তি হবে সবচেয়ে বেশি। মিডিয়ার মানুষ অতিষ্ঠ করে দিবে তার জীবনটা। ন্যায় বিচার তো পাবেনই না উল্টো সব হারাবেন। আমি তো আপনাদের আসামীকেও এসব বললাম। দেখতে দেখতে অভ্যস্ত তো।’

হীরণ পাথর মূর্তির মতন বসে রইল নিরুত্তর হয়ে। এই কোন গোলকধাঁধায় ফেঁসে গেল তারা! তবে কী আর সবটা আগের মতন হবে না?
ভাবনার মাঝেই ফোন বেজে উঠল হীরণের। রিসিভ করতেই বাচ্চার কণ্ঠস্বর পেলো। এক সেকেন্ডেই বুঝল বাচ্চাটি হুতুম। কাঁদছে মেয়েটা। কাঁদতে কাঁদতে অনবরত বলছে,
‘মাস্তান তুমি কই? বাসায় আহো। বিন্দুবালা জানি কেমন করতাছে। আমার বিন্দুবালা মনেহয় পাগল হইয়া গেছে। মাস্তান, কই তুমি!’

বিন্দুর কথা শুনতেই তড়িৎ বেগে সে উঠে দাঁড়াল। হুতুমকে স্বান্তনা দিয়ে বলল, ‘চিন্তা করো না, হুতুম। বিন্দুবালার কিচ্ছু হয়নি। আমি আসতেছি। তুমি বিন্দুবালাকে জড়িয়ে ধরে রাখো। কিচ্ছু হয়নি।’
.

(৪৫)

আকাশে মেঘ করেছে খানিক। বৃষ্টি হবে কি হবে না তা আকাশ দেখে বুঝা যাচ্ছে না। খোলা আকাশের নিচে বসে আছে বিন্দু। ছাঁদের একদম কোণায়। চুল ভেজা। গোসল সেরে এসেছে। চোখ-মুখ শুকনো। দৃষ্টি পাথর।
হীরণ এসে ছাঁদে দাঁড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ। মিনিট পাঁচ হবেই। বিন্দুর হুঁশ নেই সেদিকে। এ-ই দুনিয়ার কোনো কিছুর প্রতিই বোধহয় তার ধ্যান নেই। সে এখন অন্য এক জগতে আছে। যেই জগত ভীষণ দুঃখী। হীরণ নিঃশব্দে গিয়ে বিন্দুর পাশে বসল। এক হাত দূরত্ব রেখে। মৃদু কণ্ঠে বলল, ‘কিরে? ভূতের মতন বসে আছিস যে! ধরল নাকি ভূতে?’

অন্য সময় হীরণের এক কথার বিপরীতে বিন্দু বলে দশ কথা। আজ তা করল না। এমন ভাবে ঠাঁই বসে রইল যেন সে শুনলোই না কথা। বিন্দুর নড়চড় না দেখে হীরণ আরও একটা অপ্রাসঙ্গিক কথা বলল, ‘এমন চকচকে লাল রঙের জামা পরেছিস কেন? কেমন দেখা যাচ্ছে। তুই কী এসব রঙ বাদে ভালো রঙ চোখে দেখতে পাস না?’

প্রায় প্রতিবারই বিন্দুর জামা নিয়ে একটা মন্তব্য করা হীরণের চির-পরিচিত অভ্যাস। আর সেই মন্তব্যের বিপরীতে ইনিয়েবিনিয়ে নিজেকে অসম্ভব সুন্দরী দাবী করা বিন্দুর পছন্দের কাজ। অথচ আজ তেমন কিছুই হলো না। বরং বিন্দু বিরস কণ্ঠে বলল, ‘আমারে তো কুনু রঙেই ভাল্লাগবো না, হীরণ ভাই। আমি যে অসুন্দর। কালা, বিচ্ছিরি দেখতে।’

এমন মায়া মায়া গোপন অভিযোগে হীরণের বুকের ভেতর থাকা অদৃশ্য হৃদপিণ্ডটা যেন ছ্যাঁত করে উঠল। ধমকালো সে, ‘কী বলছিস? একটা চ ড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিব। তুই অসুন্দর কে বলল? একদম এগুলা বলবি না।’

‘তোমারও কী সত্যি কথা হুনতে বুক কাঁপে, হীরণ ভাই? সবার মতন তুমিও কী সত্যি হুনতে পারো না? ডরাও?’

‘আমি সত্যি শুনতে পারি তবে এমন তাচ্ছিল্য করা কথা শুনতে পারি না। তুই এসব বলবি না।’

হীরণের নিষেধাজ্ঞায় হাসল বিন্দু। দূর গগণে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বলল,
‘হীরণ ভাই, আমি তাচ্ছিল্য করি নাই গো। আমার ভাইগ্যডাই এমন। আমি যেই হানে থাহি সেইহানের সব চুরমার কইরা ফালায়। আম্মা কইতো অপয়া। হয়তো রাগের বশেই কইতো। কিন্তু জানো? আম্মা ঠিকই কইতো। দেখলা না আপার ভাইগ্যডা। আমার লাইগ্যা আপারে জেলে যাইতে হইলো। আল্লাহ্ জানে আপার ভাইগ্যে কী আছে। আমি যে কিয়ের লাইগ্যা আপারে কল দিলাম! না দিলেই তো পারতাম। আমার লগে যা হওয়ার তো হইয়াই গেছিলো। আমার তো আপারে ডাকা উচিত হয় নাই। আমি একটা বার আপার কথা না ভাইবাই এত বড়ো বিপদে আপারে ডাইক্যা আনলাম। আপা হইলো কহনো এমন করতো না। বিপদ যেই হানে থাহে, আমার আপা আমারে হেই দিক থেইক্যা একশ হাত দূরে রাহে। আমি কেমনে পারলাম এইডা করতে! হীরণ ভাই, আপা আবার আমাগো কাছে আইবো তো?’

কথা শেষ করেই কান্না জুড়ে দিল বিন্দু। গা কাঁপিয়ে, হাউমাউ করে কাঁদছে মেয়েটা। ঠিক এ সময়ে নিজেকে বড়ো অসহায় লাগল হীরণের। কাকে রেখে কার কাছেই-বা যাবে সে? বিন্দুর কান্না থামানোর জন্য ডান বাহুতে হাত রাখল সে। সেই স্পর্শে কেঁপে উঠল বিন্দু। ছিটকে স্বরে গেল দূরে। ভীত, আতঙ্কিত এবং ব্যথাতুর স্বরে বলল,
‘ধইরো না, হীরণ ভাই। তুমি ধরলেও আমার ঐ লোকটার কথা মনে পইড়া যায়। তোমারে যে আমি ভালোবাসি। তোমার পবিত্র ছোঁয়ায় জা নো য়া রের আভাস পাইলে আমার যে খারাপ লাগে। আর এইহানে বড়ো ব্যথাও পাইছি।’

হীরণের মুখ চুপসে আসে। নরম কণ্ঠে বলে, ‘ব্যথা পেয়েছিস এখানে?’

‘ব্যথা না, হীরণ ভাই। কামড়াইছে বেডা। কুত্তা যেমন কামড়ায় এর চেয়েও খারাপ ভাবে। আমার পুরাডা শইল জ্বইল্যা যাইতাছে। তুমি একটু দূরে গিয়া বও তো। আমার পুরুষ মানুষ দেখলেই বুকটা কাঁপতেছে। ভয় করতাছে। ঘরে আমার পঙ্গু, নীরব আব্বা শুইয়া আছে বইলা আমার ঘরে যাইতোও ডর করতাছে। আমার হুতুম নিচে গেছে। অরে একটু আইন্যা দিবা, হীরণ ভাই? অর লগে যদি এমন হয়…. না, না। আমি জানি কী কইতাছি হীরণ ভাই। আমি কী পাগল হইয়া যাইতাছি?’

কথা বলতে বলতেই উত্তেজিত হয়ে গেল বিন্দু। কেমন উদ্ভ্রান্তের মতন এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। নিজের চুল টানতে লাগল। কপাল বারি দিতে লাগল ছাঁদের রেলিংয়ে।
হীরণ শক্ত হাতে মেয়েটাকে চেপে ধরতেই চিৎকার-চেঁচামেচি বাড়িয়ে দিল মেয়েটা। কেমন হিংস্র সাথে ভীত কণ্ঠে বলতে লাগল,
‘আমারে ছাইড়া দেও, হীরণ ভাই। আমার তোমারেও ডর লাগতাছে। আর আমার শইলড্যা নষ্ট হইয়া গেছে। আমারে ছাড়ো। তুমি ময়লা হইয়া যাইবা। তোমারো বিপদ হইবো আপার মতন। ঐ দেখো হীরণ ভাই ঐ বেডার কাটা মা থাটা ঐখানে পইড়া আছে। কেমন কইরা চাইয়া আছে বেডায়। দেহো।’

উত্তেজিত ভঙ্গিতে বিন্দু ছাঁদের কোণা দেখিয়ে দিচ্ছে। অথচ সেখানে কিচ্ছু নেই। হীরণ আতঙ্কিত হয়ে গেল। হুতুম তবে এজন্যই হীরণকে কল দিয়ে অমনটা বলেছিল? বাচ্চাটা কী ভয় পেয়েছে? কোথায় গিয়েছে হুতুমটা?

#চলবে

বুকপকেটের বিরহিণী পর্ব-৩৪+৩৫

0

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ৩৪
কলমে: মম সাহা

(৪৩)

উত্তপ্ত রোদ উঠেছে অন্তরীক্ষে। রোদের বোধহয় আজ ভীষণ রাগ মনে। তাই তো সেই অসীম তেজে জনজীবন এমন করে পুড়ছে।
বিদিশার হাতে এক কাপ চা। মাটির ছোটো কাপটি। বসে আছে একটি পার্কের কাঠের বেঞ্চিতে। মাথার উপর কৃষ্ণচূড়ার গাছে থরে থরে ফুটেছে লাল টুকটুকে কৃষ্ণচূড়া। প্রথম সাক্ষাতে ফুলগুলোকে মনে হচ্ছে নতুন বউ। যে বেনারসি পরে বসে আছে লাজুক মাথা নিচু করে। সেই ফুল গুলোর দিকে তাকিয়ে থেকে উষ্ণ চুমুক দিল কাপটিতে। গরমে কপালে জমেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। এই মধ্য বিকেলেও এমন ভ্যাপসা গরম যে কোথা থেকে আসছে কে জানে! চা-টাকে উপভোগ্য করার জন্য কাঁধের ব্যাগটা থেকে ফোন বের করল মেয়েটা। উদ্দেশ্য— একটি গল্প পড়তে পড়তে চা-টা উপভোগ করবে। তার আগেই নেট অন করতেই নোটিফিকেশনে ভোরে গেল ফোনের স্ক্রিন। এত এত মেনশনের নোটিফিকেশনে যেন আহাম্মক বনে গেল সে। নোটিফিকেশনে ক্লিক করে ফেসবুকে ঢুকতেই চোখের সামনে একটা ছোটো কনফেশন এলো। তার ছবিসহ কনফেশন। ছবিটা গত বুধবারের। যেদিন ভার্সিটিতে গাছের নিচে বসে সে কপাল কুঁচকে একটি বই পড়ছিল। কেমন সহজ, সুন্দর উঠেছে ছবিটি! নিজের ছবি দেখে নিজেই এক প্রকার মুগ্ধ হলো মেয়েটা। সেই মুগ্ধতার রেশ ধরেই কয়েক লাইনের কনফেশনটার দিকে তাকালো। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ছিল—
❝পৃথিবীতে কত সুন্দর, কত আকর্ষণীয় কিংবা কত মূল্যবান জিনিসই আছে! যার হিসেব নেই। আছে সাতটা আশ্চর্যের নাম খোদাই করা। অথচ গুণী মানুষ যদি কখনো আপনাকে দেখতো তাহলে নির্দ্বিধায় ঘোষণা দিতো- পৃথিবীতে সুন্দর, আকর্ষণীয়, মূল্যবান এবং আশ্চর্যজনক জিনিস কেবল একটাই আছে। তা হলো- বিদিশার নেশা।
এই যে বিদিশার নেশা শুনছেন, কপাল কুঁচকানো আপনাকে আমার ভীষণ মায়া মায়া লাগে।

ইতি
ও পথে থাকা পুরানো❞

ব্যস্! এতটুকু একটা কনফেশনে হুলুস্থুল পড়ে গিয়েছে। এটা নতুন নয়। গত দুই-আড়াই বছর যাবত এমন ছোটোখাটো কনফেশন তার নামে আসছে। ভার্সিটির কনফেশন পেইজ থেকেই আসে। তবে বেশি নয়। মাঝে মাঝে দু একটা। এবং কনফেশনের ভাষায় এমন প্রেম মেশানো থাকে যে মাত্রাতিরিক্ত এটা নিয়ে মাতামাতি শুরু হয়ে যায়। ক’দিন চর্চায় থাকে কনফেশনটা। ভাগ্যিস তার কোনো বন্ধু নেই! নয়তো উঠতে বসতে লজ্জা দিত। তবে ক্লাসমেট গুলো টুকটাক বলে। টুকটাক লজ্জাও দেয়। প্রথম প্রথম বিদিশা কড়াকড়ি জবাব দিত। জানাতো, সে বিবাহিত। তবুও কোনো হেলদোল দেখা যায়নি বিপরীত পাশের ব্যক্তির দিকে। বরং একদিন বিদিশার এমন কড়াকড়ি জবাবের বিরুদ্ধে কনফেশন দিয়ে বলল
“আমি তো প্রেমের প্রস্তাব দিইনি। কিংবা আলটিমেটাম জারি করিনি যে, বিদিশার নেশাকে আমারই হতে হবে! তবে কেন এত কাঠিন্যতা? কেন এত রাগ? মুগ্ধতা প্রকাশে যে ক্ষতি নেই। চাওয়া পাওয়া না রেখে মুগ্ধতা জানাচ্ছি তবুও কেন আসামীর মতন অনাদর করছেন?”…. এরপর থেকে আর বাড়াবাড়ি করে না বিদিশা। কনফেশনে কোনো রকমের রেসপন্স করে না। দেখে, পড়ে তারপর শেষ। ক্লাসমেটরা কয়েকবার ঠাট্টা করেও বলেছিল, এমন কনফেশন পেলে তারা নাকি জীবনও দিয়ে দিত। অথচ বিদিশা সামান্য রিয়েক্টও দেয় না। সেসব কথা মেয়েটা ধরেনি কোনো কালেই। তার কাছে মনে হয়েছে কনফেশন দেওয়া ব্যক্তির বাড়াবাড়ি রকমের ফাজলামো করার বাতিক আছে। তাই কখনো সে কোনো রকমের আগ্রহ দেখায়নি সেদিকে।

কনফেশনে বার কয়েক চোখ বুলালো সে। তিন-চারবার পড়লো। ক্যাম্পাসের কোনো জুনিয়র এই ফাজলামোটা করছে বলে তার মনে হলো। উত্তর না দিয়ে সে ফেসবুক থেকে বেরিয়ে গেলো। ফোনের স্ক্রিন বন্ধ করে ব্যাগের ভেতর রেখে দিল। চা উপভোগ করতে গিয়ে চা হয়ে গেল ঠাণ্ডা। মনে মনে তার ভীষণ রাগও হলো সেজন্য।

করবী তার বাসাটা ছেড়ে দিয়েছে। কাউকে না বলেই ছেড়েছে। বাসা ছাড়ার দু’মাস আগ থেকে জানাতে হয় বিধায় সে আজ জানিয়ে দিয়েছে বাড়িওয়ালাকে। এবং ভীষণ আকুতি মিনতি করে বলেছে এ খবর যেন গোপন থাকে। এই শহরের প্রতি করবীর আর কোনো চাওয়া পাওয়া নেই। শহর পুরোনো হয়ে গিয়েছে। এই পরিচিত হাওয়া-বাতাসে আজকাল তার শ্বাস নিতে ইচ্ছে করে না। তার বড়ো নতুনের লোভ জেগেছে মনে। নতুন করে বাঁচার, নতুন করে স্বপ্ন দেখার লোভ। এই পুরোনো শহরে তার আর মন টিকছে না। সব ছেড়ে ছুঁড়ে কোনো এক পাহাড় কিংবা সমুদ্রের শহরে সে চলে যাবে। তার একা পৃথিবীতে নতুন যে কাছের মানুষদের ঘ্রাণ ছড়িয়েছে, সেই ঘ্রাণ ধামাচাপা দিয়ে সে আবার একা হতে চায়। একা থাকার এই নেশা তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে।
বাড়িওয়ালার বাসা থেকে বেরিয়েই সে নিচে নামল। বাজারে যেতে হবে একটু। ঘরে কিছু নেই। টুকটাক কেনাকাটা করবে। রোদ মাথায় নিয়ে বাড়ি থেকে বেরুতেই তার দেখা হলো পরিচিত মানুষটার সাথে। বেশ অনেকটা দিন পরই এই দেখা। গরমে লাল হয়ে আছে মানুষটার মুখ। করবী আজ কোনো সংকোচ করেনি, কোনো সংশয় করেনি মানুষটার দিকে এগিয়ে যেতে। মানুষটার কাছে গিয়ে বিনা বাঁধায় বলল,
‘এখানে যে! কোনো দরকারে নাকি?’

তিমিরের মুখ-চোখ শুকনো। মনমরা মেজাজ লাগছে। শান্ত, নিবিড় কণ্ঠে জবাব দিল, ‘তোমার কাছেই এসে ছিলাম।’
‘বাসায় যাবেন? চলুন তাহলে।’
‘কোথাও যাচ্ছিলে?’
‘হ্যাঁ, বাজারে।’
‘তাহলে চলো, হাঁটতে হাঁটতেই বলি।’— তিমিরকে বেশ গম্ভীরই দেখাল। হয়তো মন খারাপ প্রচন্ড।
করবী সম্মতি দিয়েই হাঁটা শুরু করল।

‘তোমায় একটা কথা বলব?’— কথাটি জিজ্ঞেস করেই উত্তরের আশায় থামল তিমির। করবীও থামলো সাথে সাথে। শুধাল,
‘কী কথা?’

‘এই যে আমি আরেক জনকে ভালোবাসতাম, এটা তুমি জানো?’

করবী জানে তবুও ভনিতা করে বলল, ‘না তো! কখনো বলেননি তো! নাকি বলেছিলেন? আমার ঠিক মনে নেই।’

করবীর ভনিতা বুঝতে পারল তিমির। বুঝতে পারারও কথা। করবী বুঝিয়েই ভনিতাটা করেছে।
‘না আমি বলিনি কখনো।’
‘তাহলে? না বললে জানব কীভাবে?’
‘কেন আমার ভাবি বলেনি? কিংবা আমাদের বাসার আশেপাশের কেউ বলেনি?’

করবী ভ্রু নাচালো এহেন কথায়, ‘কেন? কেন? আশেপাশের কেউ বলবে কেন? তারাও কী জানে নাকি? এত ফেমাস প্রেম কাহিনি?’

তিমির ফুস করে শ্বাস ফেলল। করবী জেনেই যে ইচ্ছেকৃত এসব বলছে তা আর বুঝতে বাকি রইল না তার। সে ক্লান্ত স্বরে বলল, ‘ফেমাস নয়, বলো ভয়ঙ্কর। ভালোবাসা না পেয়ে যেই পাগলামি করেছি তার কথা সবাই জানে। আমি সত্যিই ওরে ভালোবাসতাম। এখন হয়তো আর বাসি না। বাসলে তোমাকে মনের ভেতর আনতে পারতাম না।’

করবী তিমিরের এমন স্বীকারোক্তিতে ভ্যাবাচেকা খেলো। চুপ করে গেল তাই। তিমির করবীকে চুপ করতে দেখেই ওর হাতটা টেনে ধরল। মিনতি করে বলল,
‘রক্তকরবী, আমি তোমাকে বলতে কেবল তোমাকেই ভালোবাসি। অন্য কেউ হিসেবে নয়। তুমি হিসেবেই। ও চলে যাওয়ার পর আমি পাগল হয়ে গেছিলাম। তুমি চলে গেলে আমি হয়তো মরেই যাব। প্লিজ তুমি আমার একটা কথা রাখো।’

তিমিরের আকুতি মিনতিতে হতভম্ব হয়ে গেল করবী। রাস্তায় তখন বেজায় মানুষ। করবী অস্বস্তি নিয়ে বলল, ‘কী করছেন? আশেপাশে কত মানুষ। সবাই দেখছে।’

‘করবী, আমায় তুমি বিয়ে করবে, প্লিজ! আমাকে বাঁচিয়ে নেও।’

এ যেন তীব্র বজ্রপাত ঘটালো রৌদ্র তপ্ত দিনে। করবী টেনে সরিয়ে নিলে হাতটা, ‘কী বলছেন! আপনি ভালোবাসেন সেজন্য আমাকে বিয়ে করতে হবে? আমি তো ভালো না-ও বাসতে পারি!’

তিমির হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল। কেমন উন্মাদ, উদ্ভ্রান্ত দেখাল তাকে। সে হাত জোর করে বলল,
‘জানি তুমি ভালো না-ও বাসতে পারো তবুও আমার হয়ে যাও না। এমন কতই তো হয়, একজন আরেকজনকে ভালো না বেসেও যুগের পর যুগ সংসার করে যাচ্ছে! যেমন ধরো অ্যারেঞ্জ ম্যারেজে তো ভালোবাসা-বাসির সুযোগ থাকে না, তবুও তো তাদের সংসার কেটে যায় যুগের পর যুগ। তুমি নাহয় তেমনটা ধরে নাও। কখনো না কখনো তো কারো সাথে তোমার জীবন জড়াবে তবে আমার সাথে নয় কেন? আমাকে বাঁচিয়ে নেও না করবী!’

এই আকুতি করবীকে দিশেহারা করে দিল। পালিয়ে যেতে চাইল সে পরিস্থিতি থেকে। তিমির চিৎকার করে ডাকল, ‘করবী, আমি সত্যিই মরে যাব এবার। একটা মানুষ তোমাকে পেলে বেঁচে যেত এই আফসোস সবসময় বয়ে বেড়াতে হবে তোমাকে। মিলিয়ে নিও। আমার বাঁচার সাধ ছিল অনেক। বাঁচতে দিলে না! এত নিষ্ঠুর হলে!’

#চলবে

#বুকপকেটের_বিরহিণী
পর্ব: ৩৫
কলমে: মম সাহা

❝কৃষ্ণচূড়ার লালে যেই মুগ্ধতা ঝরে, সেই মুগ্ধতার চেয়েও শতসহস্র কোটি বেশি মুগ্ধতা অঙ্গে ধারণ করার ক্ষমতা যে নারীটির আছে সে হলো- বিদিশার নেশা। তার চোখে সভ্যতার সাতসমুদ্র যেন টলমল করে। উষ্ণ গরমে তার ঠোঁটে থাকা উষ্ণ চা-কে আমার বড়ো হিংসে হয়। কখনো আমাদের নিবিড় কাছাকাছি আসার গল্প হলে আমি আপনাকে একটি বড়ো গোপন কথা বলব। কেমন করে গুনে গুনে এতগুলো বছর তাকিয়ে ছিলাম তৃষ্ণার্ত হয়ে তা-ও জানাবো।’

ইতি
ও পথে থাকা পুরোনো❞

আরও একটি কনফেশনে উথাল-পাতাল হলো নিউজফিড। এবারের ছবিটি পার্কের। অন্যমনস্ক হয়ে চায়ের কাপে চুমুক দেওয়ার দৃশ্য। তাকে মনে হচ্ছে উনিশ শতকের কোনো চিত্রনায়িকা। টানা টানা চোখ মুখ। উদাস, উন্মনা ভাব! প্রথম অবস্থায় নিজের ছবিটি দেখে দারুণ রকমের মুগ্ধ হলো সে। এই কনফেশন দেওয়া লোকটির যে অসাধারণ ছবি তোলার প্রতিভা রয়েছো তা তার একেকটি নিখুঁত ছবিই প্রমাণ দিচ্ছে।
কত-শত কমেন্টের ভিড়ে তার চোখ নিতান্তই অমনোযোগী হয়ে বার কয়েক ঘুরে বেড়ালো ফোনের স্ক্রিনে। কনফেশনের পাতায়। একটা মানুষের মুগ্ধতা কতদিনের হতে পারে? পাঁচ মাস? দশ মাস? বড়োজোর একবছর। তাই বলে আড়াই-তিনবছর ধরে একটা মানুষ কেবল কনফেশনই দিয়ে যাবে? এত গুরুতর ভালো লাগা? নাকি নেহাৎ ফাজলামো?
ভাবনার মাঝেই ফোনে কল বেজে উঠল বিদিশার। স্ক্রিনে অপরিচিত নাম্বার দেখে রয়েসয়ে কল রিসিভ করতেই অপর পাশ থেকে ভাসা ভাসা পুরুষ কণ্ঠ শোনা গেল,
‘বিদিশা বলছিস?’
কণ্ঠটি স্বল্প পরিচিত হওয়ায় বিদিশা সম্মতি দিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, কে?’
‘আমি, শাহেদ। চিনতে পেরেছিস? নাকি আত্মীয় স্বজনদের ভুলে টুলে বসে আছিস?’

বিদিশা চিনতে পেরেছে নাম শুনেই। শাহেদ তার ফুপাতো ভাই। বড়ো ফুপির ছেলে।
‘হ্যাঁ, চিনেছি।’
‘কী বলিস! চিনে গেলি এত দ্রুত? যেভাবে শ্বশুর বাড়িতে খুঁটি গেড়ে বসে ছিলিস, ভেবেছিলাম তো আমাদের মনে রাখার কোনো প্রয়োজনীয়তা তুই বোধ করিস না।’

শাহেদ এমনই। সবসময় ঠাস ঠাস কথা বলে। বিদিশা কোনোরূপ তর্ক না করেই বলল, ‘মেয়েদের তো জীবনটা কাটাতেই হয় শ্বশুর বাড়িতে। খুঁটি গেড়ে না বসলে হবে?’

‘লাভ কী হলো? সেই তো খুঁটি ছেড়ে চলে আসতেই হলো!’ পরম হেলাতেই যেন কথাটা বলল শাহেদ। যেই তাচ্ছিল্য পছন্দ হলো না বিদিশার।
‘কোনো দরকার ছিল আপনার?’
‘কেন? দরকার ছাড়া কল দিতে পারি না? নাকি শিডিউল করে এখন থেকে কল দিতে হবে তোকে?’
“না, তার জন্য নয়। গত কয়েক বছরের কখনোই তো কল দেননি, তাই বললাম।’
‘দিবো কীভাবে? আত্মীয় স্বজন ছেড়ে দিয়ে যেমন করে সংসার করছিলিস! আমাদের সাথে কথা বলার সময়ই বা কই ছিলো তোর!’
কথাটির বিপরীতে আর কী বলবে বুঝে আসল না বিদিশার। তাই চুপচাপ রইল।

অপরপাশ তাকে চুপ থাকতে দেখে ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বলল, ‘তব্দা খেয়ে গেলি মনে হয়? আচ্ছা যাই হোক, মামিকে দে। কথা আছে। মামি কল ধরছে না।’

‘দিচ্ছি..’ বলেই যেই না কান থেকে ফোন নামাতে নিবে সেই মুহূর্তে শাহেদ নরম কণ্ঠে বলল,
‘আমার কথায় রাগ করেছিস?’

বিদিশা কোমল স্বরে বলল, ‘আরে না।’
‘করিসনি কেন? কর রাগ। তুই রাগ করলেই কী আর না করলেই কী! যা মামিকে ফোনটা দে।’

শাহেদের এমন কথায় না চাইতেও হেসে দিল বিদিশা। হাসতে-হাসতে বলল, ‘একটুও বদলাননি।’
‘বদলানোর কথা ছিল বুঝি? তুই বদলে গিয়েছিস বলে আমাকেও বদলাতে হবে?’
‘আমি বদলে গিয়েছি? কই?’
‘এই যে কাছের তুমি সম্বোধন করা আত্মীয়দের দূরের বানিয়ে আপনি ডাকছিস, এটা কী বদলানো নয়?’

শাহেদের কথায় জিবে কামড় দিল বিদিশা। সে যে শাহেদকে তুমি করে বলত তা তার ঘুণাক্ষরেও মনে ছিল না। থাকবেও বা কীভাবে? যোগাযোগ না হতে হতে, সম্পর্ক গুলো এতটা দূরের হয়েছে কবে টেরই পেল না। অথচ যে-ই সংসারের জন্য এতকিছু শেষমেশ সেই সংসারটা রইল না।

_

বিছানায় সুবাস হীন বাতাস এসে গা ছুঁয়ে যাচ্ছে। বেনামি জোছনাটা এসে করবীর অঙ্গ চুইয়ে পড়ছে। চোখে-মুখে মেয়েটার ঘুম নেই। ঘুম থাকারও না। দুপুরে যেমন ঘটনা ঘটলো তার সাথে, তারপর ঘুম আসার কথাও না। রাস্তার মানুষ যেমন চোখ করে করে তাকিয়ে ছিল তার দিকে! বাড়িওয়ালী চাচী ফোন দিয়ে সেই সম্পর্কে কয়েকটা কথাও বলেছেন।
সে তিমিরকে তখনের মতন বুঝিয়ে বাড়িতে পাঠিয়েছিল। কিন্তু এখন কী করবে? কী করার? তিমিরকে বিয়ে করাটা সঠিক সিদ্ধান্ত হবে? জীবনের কোনো মোড়ে গিয়ে কী মনে হবে তার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল?
নিজেকে বড়ো অসহায় লাগল তার। চারপাশের এই খা খা শূন্যতায় বুক কাঁপল ভীষণ। বাবাটার বেঁচে থাকা উচিত ছিল। বাবা থাকলে আজ নিশ্চয় করবীকে বুঝাতে পারত কোনটা সঠিক হবে কিংবা কোনটা ভুল!

করবী বিছানা ছেড়ে উঠে বসল। ঘরের সাথে লাগোয়া ব্যালকনিতে আলো জ্বালালো। পড়ার টেবিল থেকে বাবার ডায়েরিটা নিয়ে বসল বারান্দার ফ্লোরে। এর আগে কখনো পড়া হয়নি এই অনুভূতি ধরে রাখা ডায়েরিটার ভেতর কী লিখা আছে সেটা। বাবা ডায়েরি লিখতে ভালোবাসত। শৌখিন মানুষ ছিল ভীষণ! ভালোবাসা তার কাছে এক অনন্য শৌখিনতা ছিল বোধহয়।

ডায়েরির পৃষ্ঠা উল্টাতেই ভেসে উঠলো তারিখ,

০৩-০৬-১৯৮৭
পড়ার মোড়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম। একটি মেয়ে, টিয়া রঙের ফতুয়া পরনে। চুল গুলো ছোটো ছোটো করে কেটে ঘাড় অব্দি করে রেখেছে। মেয়েটি এসে আবুল চাচার দোকানে বসে চা খেলো। আড্ডার সকলে তো তার দিকেই তাকিয়ে রইলাম। বন্ধু আজিজ টিটকারি মেরে বলল- টিয়াপাখি। বন্ধু রিয়াজ শিস বাজালো। মেয়েটি বোধহয় ওদের আচরণে বিরক্ত হলো। কেমন করে যেন তখন তাকিয়ে ছিল আমাদের দিকে!

করবী অবাক হলো। এত পুরোনো দিনের ডায়েরি! আজ ২০২৪ অথচ আব্বু যখন ডায়েরিটা লিখেছিল তখস ১৯৮৭ সবে!

উৎসাহ নিয়ে পরের পৃষ্ঠা গুলো উলটাতে শুরু করল করবী—

১০-০৬-১৯৮৭
সাত দিন পর আবার দেখা আজিজের দেওয়া ‘টিয়াপাখি’ নামের মেয়েটার সাথে। মেয়েটা থাকে রায়বাহাদুর রোডে। শৌখিন আর বিলাসবহুল পরিবারের মেয়ে। আজ সব খোঁজ বের করলাম। মেয়েটার নাম রঙ্গিণী জাহ্নবী। বাবা-মায়ের তৃতীয় সন্তান। তার বড়ো দু’টো ভাই আছে।

১৯-০৬-১৯৮৭
আজ জাহ্নবীর সাথে প্রথম কথা হলো। মেয়েটা বেশ প্রাচুর্যে খামখেয়ালিতে অভ্যস্ত। ব্যবহার সহজ-সরল। এবং ভালো। মিশুকও। সুন্দর করে কথা বলে। কে দেখলো, কী করল তা ভাবে না এতকিছু। আমাকে দেখেই কত সোজা ভাবে বলল আমি নাকি দেখতে সুপুরুষ।

করবী ডায়েরির পৃষ্ঠা উলটাতে উলটাতে আরও কত কী পড়ল! তার মায়ের পুরো নামটাও বোধহয় আজ জানলো।

ডায়েরির পাতা পড়তে পড়তে গিয়ে থামল ১৯৯২ তে। লেখা-

০৮-০৯-১৯৯২
সাহেবারর সাথে এত বছরের প্রেম অথচ আজ সব বোধহয় শেষ। কী বেধড়ক মারটাই না মারল ওর ভাইরা আমাকে। আমার মা তো কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়েছে। আমার ভাইরা আমাকে বুঝিয়েছে যেন আর সাহেবার কাছে না যাই। আর ছোটো জন তো কতক্ষণ হম্বিতম্বি করল। সাহেবার ভাইদের দেখে নিবে জানাল। আমাকে মারছে দেখে সাহেবার সে কী রাগ! চিৎকার! কেঁদেছেও বোধহয়। মায়া হলো ওর জন্য।

০১-০১-১৯৯৩
আমি আর সাহেবা আজ পালিয়ে বিয়ে করেছি। এখন মধ্যরাত। আমার ছেলেমানুষ সাহেবা ঘুমিয়ে আছে। বড়ো ক্লান্ত কি-না! মেয়েটার মাথায় কী যে চাপলো? হুট করে বলছে, সাহেব বিয়ে করব। হুট করে বিয়ে করা যায়? মেয়েটা তো বুঝবেই না। তাই বিয়ে করে ফেলেছি। আমার জীবনে সাহেবা ছাড়া আর কীই-বা আছে? তাই ওর আবদারটুকু রাখলাম।

এরপর ডায়েরির পাতায় কথা যেতেই থাকে। সংসারের গল্প, বিবাহিত খুনসুটির গল্প, আর গল্প সাহেবার প্রতি মুগ্ধতার। করবী যেন হারিয়ে গেল বাবা-মায়ের অদেখা সংসারে। কী সুখেরই না সংসার!
কিন্তু এই সুখ হুট করে এক পাতাতে গিয়ে বড়ো ফ্যাকাশে লাগল। করবীর কপাল কুঁচকে এল,

তারিখ: ০৮-০৩-১৯৯৪
আজকাল রূপকথার সংসারে যেন কীসের ছায়া পড়েছে! আমার অনেক ভালোবাসা সাহেবা কেমন খিটখিটে মেজাজের হয়ে যাচ্ছে। আমার পরিবারের কারো সাথে একটুও বনিবনা হচ্ছে না তার। কথায় কথায় ঝগড়া করছে। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। সাহেবার কী মন খারাপ? এই সাহেবাকে বড়ো অপরিচিত লাগে আমার। কাউকে বলতেও পারি না। সাহেবা কেন বুঝে না তাকে আমি ভীষণ ভালোবাসি?

১৫-০৫-১৯৯৪

আজ বেশি কিছু বলব না। কেবল বলব, আমার পরিবারে অতিথি আসবে। আমার ছেলেমানুষি করার সাহেবা মা হবে।

২৬-১২-১৯৯৪
সাহেবাকে এত বুঝিয়েও সংসারে ফেরাতে পারছি না। যেই মন তার বাহিরে গিয়েছে সেই মন কী আদৌ ফিরবে সংসারে? আমি তো সাহেবার এমন বড়ো অন্যায় ক্ষমা করেও আমার আসন্ন সন্তানদের সাথে নিয়ে সুখে থাকতে চাচ্ছি তবে সাহেবা নিষ্ঠুর হচ্ছে কেন?

করবী বুঝল, বাবার সুখী সুখী সংসার বোধহয় সেখানেই থেমে গিয়েছিল। কেমন লেখা গুলোতে এক রাশ অভিমান, অভিযোগ জড়ানো!

পৃষ্ঠা উল্টে গেলে সেই কাঙ্খিত দিনে,
০৮-০৩-১৯৯৫
আজ আমার ঘরে দুই রাজকুমারী এসেছে। আমার দু’টি আত্মা। ওদের নাম……

করবী বাকিটা পড়তে পারল না তার আগেই তার অনবরত বাজতে থাকা ফোনের রিং এ সে বিরক্ত হলো। এবং মনে মনে এক অপ্রত্যাশিত কথা জানতে পেরে বিস্মিতও হলো।
করবী ডায়েরিটা রেখে ফোনটা তুলল। কিছুদিন আগেই নতুন ফোনটা কিনেছিল। অপরিচিত নাম্বার দেখে কিছুটা ভেবেচিন্তে ফোন রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে একটা মেয়েলি কান্না ভেসে এলো। করবী বুঝতে না পেরে বলল, ‘কে?’

হাউমাউ করে কেঁদে উঠল সেই কণ্ঠ, ‘আপা, আমি। আমি বিন্দু। আপা আমার সব শেষ আপা। হুতুমরে তুমি দেইখ্যা রাইখো। আমার সব শেষ।’

আঁতকে উঠল করবী, ‘কাঁদছিস কেন, বিন্দু? কোথায় তুই?’
‘আপা, আমি নষ্ট হইয়া গেছি। তোমরা ভালা থাইকো, আপা। হুতুমরে দেইখো।’

#চলবে