Saturday, August 2, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 152



তোমার জন্য সিন্ধুর নীল পর্ব-০৩

0

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#তৃতীয়াংশ
#সারিকা_হোসাইন

দেখুন মেজর মুহিত আপনার মায়ের হার্টে পেসমেকার মেশিন বসাতে হবে,আপনার মা অনেক দিন ধরেই এখানে ভর্তি রয়েছে আমি দীর্ঘদিন উনার চিকিৎসা সেবা দিয়ে আসছি উনার সমস্ত কন্ডিশন আমার নখদর্পণে।উনার হার্টের স্বাভাবিক কার্যক্রম বলুন বা স্পন্দন তৈরি করাই বলুন উনার হার্টের যেই কন্ডিশন এখন আপনি অনুমতি দিলেই আমি মেশিন বসানোর জন্য অপারেশন করার ব্যাবস্থা নিবো।

-মেশিন বসালে কি আমার মা পুরোপুরি সুস্থ হবে ডক্টর?

মুহিতের কথা শুনে চুপ করে দৃষ্টি নত করে ফুঁস করে নিঃশাস নিলেন প্রফেসর সারোয়ার জাহান।

―দেখুন মেজর , হায়াৎ মউত উপরে যিনি আছেন তার হাতে,আমি আপনাকে একশ পার্সেন্ট গ্যারান্টি দিতে পারবো না তবে আমার বিশ্বাস আপনার মা সুস্থ হবে ।
কথাটি বলে মুহিতের হাতের উপর হাত রাখলেন প্রফেসর।

―আর দেরি করবেন না মেজর,দেরি করলে অবস্থা শুধু খারাপ ই হতে থাকবে।যতো দ্রুত সিদ্ধান্ত নিবেন ততো উনার জন্য ভালো।

চোখ বন্ধ করে কিছু একটা ভাবলো মুহিত,পরক্ষণেই গমগমে কন্ঠে বলে উঠলো―
–আপনি অপারেশন এর সবকিছু রেডি করুন

―কিন্তু মেজর একটা প্রবলেম আছে, এই বলে একটা পেপার এগিয়ে দিলেন প্রফেসর মুহিতের দিকে।

―কী এটা?

―মেজর মুহিত এখানে আপনাকে বন্ড সই দিতে হবে।

কথাটি শোনা মাত্র মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো মুহিতের।জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মুহিত প্রফেসর এর দিকে তাকালো।

―আসলে অপারেশনের একটু জটিলতা রয়েছে।ভাগ্য খারাপ হলে ওটি টেবিলেই উনি মারা যেতে পারেন।কিন্তু আমরা আমাদের চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখবো না মেজর।

প্রফেসর এর কথা শুনে চোখের মধ্যে জ্বালা শুরু হলো মুহিতের,এখন কি ভারী বর্ষণ হবে চোখের দুকূল ছাপিয়ে?এমনটা কি হবার কথা ছিলো?

―আজ থেকে ছয় বছর আগের ভাবনায় ডুব দিলো মুহিত।
শীত বিদায় নিবে নিবে ভাব কিন্তু রাতে হালকা শীতের আমেজ রয়েছে এবং দিনে চকচকে সোনালী রোদ।আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভাসছে।মুহিত তখন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট।তার পোস্টিং ছিলো কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট এ।মুহিত সকালের জগিং শেষ করে শাওয়ার নিয়ে ডাইনিং হলের উদ্দেশ্যে পা বাড়িয়েছে মাত্র।হঠাৎই মুহিতের হাতে থাকা মুঠোফোনে ভাইব্রেশন শুরু হয় ।স্ক্রিনে দৃষ্টি ফেলে “পাপা” নামটি দেখে হাসি ফোটে মুহিতের ঠোঁটে।

~হ্যালো!
–কেমন আছো মুহিত?
―ভালো আছি পাপা’তোমরা সবাই কেমন আছো?

―আমরা অনেক ভালো আছি,একটা খুশির খবর আছে তোমার জন্য মুহিত।

-জী পাপা বলো

―নামিরার বিয়ে ঠিক করেছি,জানি সবকিছুই অনেক দ্রুত হয়েছে তোমাকে জানানোর সময় হয়নি।
পাত্র নামিরার বেশ পছন্দ হয়েছে ।বাকী কথা বাসায় এলে বলবো।আজই তুমি ঢাকায় ব্যাক করবে, রাতে এনগেজমেন্ট।

―বোনের বিয়ের কথা শুনে মুহিত প্রথমে অনেক খুশি হয় কিন্তু পরে ভাবতে থাকে সবকিছু এতো দ্রুত হয়ে যাচ্ছে?

মুহিত জানে তার বাবা একজন বিচক্ষণ মানুষ সে ভুল সিদ্ধান্ত নিবেনা অবশ্যই।কারন একজন বিচক্ষণ ম্যাজিস্ট্রেট আর যাই করুক যার তার হাতে কখনো মেয়ে তুলে দিবে না।
মুহিত আরো কিছু কথা বলে ফোন কেটে দেয়।

নিজ কক্ষে ব্যাগ গুছাচ্ছে মুহিত,একমাত্র বোনের বিয়ে বলে কথা
পনেরো দিনের ছুটি নিয়ে মুহিত ঢাকার উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করে।

―এখন বিকেল পাঁচটা,মুহিত দাঁড়িয়ে আছে তার বাড়ির মেইন ডোর এর সামনে,কলিং বেল টিপে অপেক্ষা করছে।খুট করে খোলে গেলো দরজা ,দীর্ঘ ছয়মাস পর মুহিত বাসায় এসেছে।মুহিত কে দেখে ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো দশ বছরের এক বালক।
চিৎকার করে বলে উঠলো―
―আ,,,,,,, ভাইয়া!

আদরের ছোট ভাইকে জড়িয়ে কোলে তুলে ফেললো মুহিত।নামিরা আর মুহিতের চাইতে বয়সে অনেক ছোট এই পুঁচকো মুকিত।যেমন বাড়ির ছোট সদস্য তেমনি কিউট একটা বাচ্চা।এজন্যই তো সকলের চোখের মধ্যমণি।
হুট করে এলে জানালে না কেনো?
তোকে সারপ্রাইজ দিলাম,পাপা জানতো মাও জানতো তোকে কেউ জানায়নি আমি নিষেধ করেছি তাই।
– এই বলে কোল থেকে মুকিত কে নামিয়ে সোফায় ফেলে দিলো মুহিত।ফেলেই সুড়সুড়ি দেয়া শুরু করলো,মুকিত হেসে কুটিকুটি।

-তাদের দুই ভাইয়ের খুনসুটি হাসাহাসি করার শব্দে রান্না ঘর থেকে দৌঁড়ে এলেন মিসেস তারিন রহমান আর নামিরা।
নামিরা এসেই মুহিতের কান টেনে ধরলো,এই ছয় মাসে একবারো আসতে মন চায়নি তোর?

―আহ আপু লাগছে,মা লাগছে ছাড়তে বলো!

―না ছাড়বো না, লাগার জন্যই দিয়েছি।
―আচ্ছা সরি, মাফ করে দে আপু নেক্সট বার থেকে প্রতি মাসে মাসে আসবো।

মুকিত নামিরা কে অনুনয়ের সুরে বললো ছেড়ে দাও না আপুনি ভাইয়ার কানে ব্যাথা লাগছে।

―ভাইয়ের উকিল হয়েছিস?

-মুকিত মাথা উপর নিচ করে হ্যা বুঝালো!

– আচ্ছা, যাহ ছেড়ে দিলাম।
ছেলেমেয়েদের এমন কীর্তি দেখে হেসে ফেললেন মিসেস তারিন,
~তোদের নিয়ে আর পারি না।যা মুহিত ফ্রেস হয়ে খেয়ে নে, কাজ আছে অনেক।

এই পুটু এই ব্যাগে যা যা আছে সব তোর যাহ নিয়ে নে সব।
মুকিত যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেলো,এজন্যই তো ভাইকে তার এতো ভালোবাসতে ইচ্ছে করে।

এবার নামিরার পিছু নিলো মুহিত,তুই প্রেম করেছিস নাহ?

নামিরা হাত উঁচিয়ে বলে -মারবো এক ঠাটিয়ে!

আচ্ছা বুঝেছি লজ্জা পেতে হবে না শুধু বল বর কে ?পটাপট নাম বলে ফেল!

তুই চিনিস!

আমি চিনি?

নামিরা লজ্জায় মাথা নিচু করে মুখ টিপে হেসে ফেলে

-সোহাগ ভাই?

নামিরার দিকে দৃষ্টি ফেলে নামিরার রক্তিম গাল আর ওড়নার কোণা আঙুলে প্যাচানো দেখে মুহিত বুঝে ফেলে হি ইজ রাইট।

সিউর সোহাগ ভাই?

নামিরা মাথা দুলিয়ে হ্যা সূচক উত্তর দেয়।

কিভাবে পটালি ওই হাবলু টাকে?

নামিরা চোখ রাঙিয়ে বলে উঠে মার খাবি মুহিত

-মুহিত খুব ভালো করে সোহাগ নামের ছেলেটিকে চিনে।মুহিতের বাবার বাল্যকালের এক বন্ধুর ছেলে এই সোহাগ।ছেলেটি গ্রামে থাকতো।একদিন মুহিতের বাবা আদনান ওয়াসিফ অনেক রাত্রে একটি ছেলেকে এনে কঠিন গলায় সবাইকে ডেকে বলেছিলো আজ থেকে এই ছেলে আমার ছেলেদের মতো।সেও এবাড়ির সদস্য এখন থেকে।

―ও আমার বন্ধু হামিদের ছেলে।ওর বাবা দুদিন আগে এই দুনিয়া ত্যাগ করেছে।ইহজগতে ওর কেউ নেই।তোমরা কেউ কখনো ওর সাথে কোনো প্রকার খারাপ আচরণ বা অশোভনীয় কিছু করবে না।তাহলে আমি অনেক কষ্ট পাবো।আজকে আমি এই এতিমের গার্ডিয়ান হলাম,ভবিষ্যতে আমার অবর্তমানে এই ছেলের দোয়ায় আল্লাহ চাইলে অন্যকেউ তোমাদের ও গার্ডিয়ান হবে।

সোহাগ তখন ইন্টারমিডিয়েট এক্সাম দিয়েছে কেবল।এই অবস্থায় কোথায় যাবে কার কাছে যাবে কিছুই ঠাহর করতে পারছিলো না।এমন সময় ফেরেস্তার মতো সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলো আদনান ওয়াসিফ।

-মিসেস তারিন সোহাগ কে কাছে টেনে বলেছিলো আমাকে আম্মা ডাকতে পারবি?

-সোহাগ সেদিন মিসেস তারিন কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিয়েছিলো।

সোহাগ পড়াশোনায় অনেক ব্রিলিয়ান্ট ছিলো, নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি নামিরা আর মুহিত কেও অংক ইংরেজি পড়াতো অবসর সময়ে। নামিরার এসএসসি পরীক্ষার সকল নোটস নিজ হাতে তৈরি করে দিয়েছিলো সোহাগ । যেদিন ইন্টারমিডিয়েট এক্সাম এ সোহাগ জিপিএ ফাইভ পেলো,সেদিন মিসেস তারিন আর আদনান ওয়াসিফ এর খুশি দেখে কে।

নিজের সন্তানের মতো সকল সুযোগ সুবিধা দিয়েছিলেন সোহাগ কে।পড়িয়েছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে।নিজের যোগ্যতা বলে সোহাগ নামকরা এক কলেজের ইংরেজী বিষয়ের প্রফেসর হিসেবে নিয়োগ পায়।
মুহিত আগেই বুঝেছিলো সোহাগের জন্য নামিরার মনে কোথাও কিছু আছে,কিন্তু এটা যে প্রেম ভালোবাসা পর্যন্ত গড়াবে তা ভাবতে পারেনি মুহিত ।
―কারন সোহাগ ছিলো খুবই সাধাসিধে, ঘরকোনো টাইপ ছেলে।তিন তলার চিলেকোঠার ঘরটাতে সারাক্ষন পড়াশোনা করে কাটাতো খাওয়াদাওয়ার সময় ছাড়া।

মায়ের ডাকে ধ্যান ফিরলো মুহিতের,

―খেতে আয় আর কিছু কাজ আছে হাতে হাতে করে দে।
কাজ গুলো বুঝিয়ে দিয়ে চলে গেলেন মিসেস তারিন।

চারপাশে আলো ঝলমল করছে।কিছু কাছের আত্মীয় এসেছে।বাচ্চাদের হাসা হাসিতে মুখরিত চারিপাশ।বাড়িতে যেনো চাঁদের হাট বসেছে।নামিরার আকদ হবে আজ।

মুহিত কর্ম ব্যাস্তায় তার বাবার খবর নেয়ার সময় ই পায়নি,তবুও তার মায়ের কাছে জানতে চেয়েছে,

-মা পাপা কে দেখছি না কোথাও

-আছে কোথাও কাজে ব্যাস্ত হয়তো,আকদের সময় দেখতে পাবি বলেই অন্যদিকে চলে গেলেন পার্লারের মেয়েরা এলো নাকি সেটা দেখতে

ঘরের এক কোণে বসে জীবনের হিসেব কষছেন আদনান ওয়াসিফ
উনার জীবদ্দশায় কোনো দিন এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হন নি তিনি।নিজের এতো বছরের অর্জন করা সততা, সম্মান খুইয়ে দিবেন ,নাকি পালিয়ে যাবেন,নাকি জীবন দিয়ে হলেও সব আগলে রাখবেন কোনো সিদ্ধান্তেই উপনীত হতে পারছেন না তিনি।দিনে রাতে এতো পরিমান হুমকিজনক ফোন কল আর নেয়া যাচ্ছে না।কি করতে পারি এখন আমি?

পরিত্যক্ত একটি বিল্ডিংয়ের আধ ভাঙা একটি কক্ষে গোপন বৈঠক বসিয়েছেন কয়েকজন গণ্যমান্য ব্যাক্তি।তারা সবাই সমাজের উজ্জ্বল ব্যাক্তিবর্গ।তাদের ভালমানুষির আড়ালের মুখোস জনগন জানেনা।জানানোর দরকার ই বা কি?তারা কি দেশের মানুষের মুখের ভাত কেড়ে নিয়েছে?

নিজের স্বার্থ নিয়ে ভাবা কি ভুল কিছু নাকি?

টাকার প্রতি লোভ কার না আছে?

―সামান্য একজন নির্বাহী অফিসার এর কাছে এভাবে জিম্মি না হয়ে এতো ভয় না পেয়ে ভয় কে জয় করলে কেমন হয় লেফটেন্যান্ট?

―ভনিতা না করে খুলে বলুন কি করতে চাচ্ছেন আহমেদ খান?

আহমেদ খান এর উত্তর শোনার আশায় বাকি সদস্যরা গভীর আগ্রহ নিয়ে তার মুখপানে দৃষ্টি দিলেন।

―যদি ঐ নির্বাহী অফিসার ই আর না থাকে তাহলে কেমন হবে ?

কথাটি সকলের মনে ধরে গেলো।

-এইজন্যই বলি আহমেদ ,তুমি আসলেই একটা পাক্কা খিলাড়ি বলেই হাত তালি দিলেন নব্য হওয়া মন্ত্রী মোশতাক চৌধুরী।

আহমেদ খান হুইস্কির গ্লাস তিন আঙ্গুল দিয়ে ধরে তাতে বরফ ঢেলে নাড়তে নাড়তে ঢেউ খেলানো হুইস্কির দিকে তাকিয়েই আবারো বলে উঠলো-

-আমি তো জানি সেনাবাহিনীর লোকেরা হয় সৎ,ন্যায়নিষ্ঠবান।
তো তুমি কিভাবে এমন জোচ্চোর হলে লেফটেন্যান্ট?

গ্লাসে হুইস্কি ঢালতে ঢালতে বিদঘুটে শব্দে হো হো করে হেসে উঠলেন লেফটেন্যান্ট।

একজন লেফটেন্যান্ট কে সরকার বেতন কতো দেয় জানো?

পাশে থাকা মোশতাক জানতে চাইলেন কতো?

―মাত্র ঊনত্রিশ হাজার টাকা

কিন্তু আমার পেট টা দেখেছো?

পেটের দিকে আঙ্গুল তাক করে লেফটেন্যান্ট সকলের উদ্দেশ্যে বললেন আমার পেট চায় কোটি কোটি টাকা।এখন এই কোটি টাকার খিদে এই সামান্য খড়কুটো দিয়ে কিভাবে চলবে আহমেদ?

পাশে থাকা খলিল বলে উঠলো আমার বেতনের কথা আর নাই বা বললাম সাহেব।সামান্য একজন দ্বার প্রহরী তো সেই হিসেবে কিছুই পাইনা।আপনাদের পায়ের ধুলো লাগিয়ে যদি একটু খেয়ে পড়ে বাঁচতে পারি এটাই আমার জন্য অনেক কিছু।

তাহলে ঐ কথাই রইলো,
উড়িয়ে দাও লেফটেন্যান্ট নির্বাহী অফিসার কে।
পথের সামনের কাঁটা যতো দ্রুত সরাবে ততো পথ ভালো ভাবে হাটতে পারবে বুঝতে পেরেছো?

আর মন্ত্রী শুনো,
―হারামি যেহেতু হয়েছো তাহলে সরকার কে কিভাবে কি বুঝাতে হবে আশা করি সব আয়ত্ত করবে।লেফটেন্যান্ট যেনো না ফাঁসে।ফাঁসলে নরম গদিতে কিন্তু বসতে পারবে না কথাটা মাথায় ঢুকিয়ে নিও ভালো ভাবে,বলেই হুইস্কি গ্লাসে ঠোঁট লাগিয়ে এক সিপ টান দিলো।

রাত নয়টা বেজে পঁচিশ মিনিট
নামিরা আর সোহাগ কে পাশাপাশি বসানো হয়েছে,আংটি বদল করানোর জন্য।অনুষ্ঠানটা ঘরোয়াভাবে হচ্ছে।নামিরাকে পুতুলের মতো লাগছে আজকে মুহিতের কাছে।
যেহেতু সামনে বিয়ের অনুষ্ঠান ধুমধাম করে হবে তাই আজকে এতো বেশি আয়োজন করা হয়নি।
আংটি বদল করার জন্য দুটো আংটি মিসেস তারিন একটি ফুলের ডালিতে করে নিয়ে এলেন এনে সামনের পাতানো টেবিলে রাখলেন।
এতোদিন পর মুহিত ভালোভাবে সোহাগের দিকে খেয়াল করে দেখলো নামিরার জন্য সোহাগের চোখে গভীর ভালোবাসা ভালোলাগার হাতছানি।সোহাগকে কেমন যেনো পরিপূর্ণ আর উচ্ছসিত লাগছে।আংটি বদল করার জন্য সোহাগ আংটি তুলে নিয়ে নামিরার হাত টেনে নিলো।

খুবই সন্তর্পনে আংটি পরিয়ে দিলো যেনো নামিরার আঙ্গুল ও টের না পায়।

বিষয়টা খুবই ভালো লাগলো মুহিতের।যাক তার বোন পারফেক্ট কাউকে পেয়েছে ,আর যাই হোক মুহিত বুঝে গেছে এই ছেলের থেকে কখনো নামিরা কষ্ট কি জিনিস তা উপলব্ধি করতে পারবে না।

আংটি বদল করার খুশিতে সকলে হাত তালি দিয়ে হবু কপোত কপোতি কে কংগ্রাচুলেশন্স জানালো।
এতো এতো খুশির মধ্যে মুহিতের নজর গেলো তার বাবার দিকে
ভদ্রলোকের বিধ্বস্ত চেহারা মুহিতের মনে ভয়ের স্তুপ জমালো।

কী এমন ভাবছে উনি?উনি কি অসুস্থ?নামিরার বিয়েতে কি উনি খুশি নন?আপুর জেদের কাছে হার মেনে কি বিয়ে হচ্ছে উনার অমতে নাকি অন্য কোনো ঘটনা লুকিয়ে আছে?

সকল ভাবনাকে দূরে ঠেলে সমস্ত প্রশ্নের উত্তর জানতে বাবার কাছে দ্রুত এসে দাড়ালো মুহিত

―পাপা কিছু না লুকিয়ে সত্যি করে বলো কি হয়েছে?
#চলবে।

তোমার জন্য সিন্ধুর নীল পর্ব-০২

0

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#দ্বিতীয় পর্ব
#সারিকা_হোসাইন
হাতে গ্লাভস পরে নিলো স্বর্গ আর পিউ,মুহিত কে উপুড় করে শোয়ানো হয়েছে।ইনজেকশন এ মেডিসিন লোড করার জন্য পিউ কে নির্দেশ দিলো স্বর্গ।
লজ্জায় ইতস্ততায় মুহিত বালিশে মুখ গুজে চোখ বন্ধ করে ফেললো ।সাথে সাথেই মনের ক্যানভাসে ভেসে উঠলো গ্রে কালারের কুর্তির সাথে জিন্স প্লাজু পরিহিত চাঁদের মতো হলুদ ফর্সা বর্ণের পিচ্চি একটা পরী।যার ঝলমলে ডিপ ব্রাউন রঙের স্ট্রেট চুল গুলো কাঁধ পর্যন্ত স্টাইল করে কাটা,ধবধবে সাদা মুখটিতে প্রসাধনীর কোনো ছোয়া নেই তবুও যেনো অপ্সরা।গোলাপি ঠোঁটে লিপবাম কৃত্তিম আলোর ঝলকে চকচক করছে সাথে ঠোঁটের নিচের কুচকুচে কালো তিলটা যা মনের ভেতর নিষিদ্ধ ইচ্ছের জাগ্রত করে।বড় বড় চোখের ঘন পাপড়ির ঝাপ্টানি বুকে হাতুড়ি পেটাচ্ছে।

-মেজর উঠে পড়ুন ইনজেকশন পুশ করা হয়ে গেছে,মেয়েলি মিষ্টি কন্ঠে ভাবনার ভাঙন হলো।
এতো দ্রুত শেষ হয়ে গেলো?
এতো দ্রুত নয় পাক্কা দশ মিনিট লেগেছে বলেই হেসে ফেললো স্বর্গ
লজ্জায় দ্রুত প্যান্ট ঠিক করে বেরিয়ে এলো মুহিত,এমন ভাবেই এই মেয়ের ভাবনায় ডুবেছে যে এতো মোটা সুইয়ের ঘা ও টের পায়নি?

হুহ সর্বনাশী একটা~

ক্যাপ্টেন সৌম্য!বলেই ডেকে উঠলো মুহিত
আলাদিনের দৈত্যের মতো নিমিষেই হাজির হলো সৌম্য।

ছেলেটা বেশ কাজের।একসাথে অনেক কাজ করেছে মুহিত আর সৌম্য।যেমন চৌকষ তেমনি ব্যাক্তিত্ববান।দেড় বছর ধরে ছেলেটি মুহিতের সাথে বিভিন্ন প্ল্যানে সামিল হয়েছে।মানুষকে হাসাতে এবং নিজে হাসতে ভালোবাসে ছেলেটি।মুহিতের ও ইচ্ছে করে সৌম্যের মতো হতে কিন্তু বিভিন্ন কারনে নিজের খোলস থেকে বেরুতে পারেনা মুহিত।

সৌম্য সুযোগ পেলেই তাকে হাসায়।এজন্য সে সৌম্যের কাছে অনেক ঋণী।মুহিতের মরুভূমি ন্যায় জীবনে সৌম্য এক পশলা বৃষ্টির মতো।এজন্যই তো মুহিত ধীরে ধীরে নিজের ছোট ভাইয়ের স্থান দিয়েছে সৌম্যকে।

ক্যাপ্টেন তুমি কি ডাক্তারনী কে দেখেছো?
সৌম্য গদগদ হয়ে হয়ে মাথা নিচু করে দুই হাত বুকে ভাঁজ করে বললো –
-জী স্যার ডাক্তারনী ভয়ংকর সুন্দরী।

ভয়ংকর সুন্দরী নয় বলো ভয়ংকর বেয়াদব।
বলেই ফিচেল হেসে কালো রোদ চশমাটা নায়কীয় স্টাইলে চোখে লাগিয়ে এক হাত পকেটে ঢুকিয়ে শিস বাজিয়ে প্রস্থান নিলো।

মেজরের এমন উদ্ভট আচরণ দেখে বেক্কল বনে গেলো সৌম্য।
রাত বারোটা বেজে পনেরো মিনিট ,রহস্যময় ব্যাক্তির কাছে হঠাৎ ই একটা ফোন কল আসলো-

-হ্যালো খলিল ভূঁইয়া তারপর বলো ওখানকার খবর কি?
সাহেব ওই মেজর কোনো এক মিশনের প্রস্তুতি নিচ্ছে কিন্তু কি মিশন সেটা বুঝতে পারছি না।

সেটা বুঝার জন্যই তো তোমার মতো লোক কে রাখা হয়েছে কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে তুমি পুরাই একটা অপদার্থ।
রাগ চেপে খলিল বলে উঠলো ক্যান্টনমেন্ট এর ভেতর থেকে খবর কি সহজেই বের করা যায় সাহেব?

টাকা ছিটাও খলিল,
ভাত ছিটালে কাকের অভাব হবে না আশা করি বুঝতে পেরেছো।রাখছি এখন এসব অকাজের প্যাচাল ভালো লাগছে না বলেই খট করে লাইন কেটে দিলো ওপাশের ব্যাক্তিটি।

-শালা গিরগিটি বলেই রাগে বাটন ফোন টি সজোরে আছাড় মারলো খলিল।

পাখির কিচিরমিচির শব্দে ঘুমের রেশ হালকা হয়ে গেলো স্বর্গের।আজ তার অফ ডে ইচ্ছে মতো ঘুমাবে এই নিয়তে এসির পাওয়ার কমিয়ে কম্বল মুড়ি দিয়েছে কিন্তু ভোরের আলো ফুটতেই ঘুম হালকা হয়ে গেলো।এলার্ম টি এখনো যেহেতু বাজেনি আরেকটু চোখ বন্ধ করে রাখলে ক্ষতি কি?

মুহূর্তেই বেড সাইড টেবিলের উপর থাকা মোবাইল নামক যন্ত্রটি কর্কশ সুরে বেজে উঠলো।চোখ মুখ খিচে কম্বলের নীচে ঢুকে গেলো স্বর্গ।কোনো মতে হাতড়ে মোবাইল টা সাইলেন্ট করে ফেলে রাখলো।চোখ বুঝে ঘুমের সামান্য চেষ্টা চালালো সে।

অকস্মাৎ দরজায় ধাম ধাম বাড়ির শব্দে আর চিল্লানির শব্দে স্বর্গের রাগ সপ্তম আসমানে পৌঁছে গেলো ।ব্ল্যাঙকেট সরিয়ে দরজা খুলে কাউকে না দেখতে পেয়ে রাগ এর পারদ আরো মাত্রা ছাড়িয়ে গেলো।
দরজায় কে এসেছিলো বুঝতে বেশি বেগ পেতে হয়নি চৌকষ ডাক্তারের।আজ এর একটা বিহিত করতেই হবে এবং ডিস্টার্ব দাতাকে কিভাবে পানিশমেন্ট দিবে সেটাও ভেবে ফেললো।

-পা টিপে টিপে স্বর্গ সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো,লিভিং রুমে এসে দেখতে পেলো কেউ একজন পায়ের উপর পা তুলে পত্রিকা পড়ছে সামনে জুস আর হালকা নাস্তা।স্বর্গ জানে এটা তার ছোট ভাই যদিও ওতো ছোট নয় মাত্র দুই বছরের ছোট বড়।কিন্তু তাদের লড়াই মারামারি তিন চার বছরের বাচ্চা কেন টম জেরিকেও হার মানাবে।

~ঐতো পত্রিকার উপর দিয়ে “সুখের” চুল গুলো দেখা যাচ্ছে,খপ করে ধরতে পারলেই বাগে আনা যাবে।যেই ভাবা সেই কাজ ধূর্ত বাজ পাখির মতো ধরে ফেললো চুলের মুঠি যদিও ছোট চুল ধরতে বেগ পেতে হচ্ছে তবুও ছাড়া যাবেনা।ঘুম নষ্ট করার শাস্তি ওকে পেতেই হবে ভেবেই চুল ধরে আরেক হাত দিয়ে গলা টিপে ঝাকাতে ঝাকাতে বলে উঠলো সুখের বাচ্চা হারামি,কুত্তা তোকে আমি মেরেই ফেলবো আজ!

অকস্মাৎ আক্রমণে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো যুবক।

ড্রয়িং রুমের চিৎকারে মিসেস তনুজা মাহমুদ খুন্তি হাতেই দৌড়ে আসলেন,নাফিজ মাহমুদ সবেই চুলে অর্ধেক কালো রঙের কালি টা লাগিয়েছেন বাকিটা আর লাগাতে পারলেন না বাটি সমেত দৌড়ে আসলেন।স্বর্গের ভাই সুখ পিছন থেকে জুসের গ্লাসে এক সিপি চুমুক দিয়ে বলে উঠলো আপুই আমি তো এখানে,

-পিছন ফিরে সুখকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে স্বর্গ নিজের আলুথালু চুল গুলো এক হাত দিয়ে চোখের সামনে থেকে সরিয়ে সামনে থাকা পুরুষটির দিকে নজর দিলো।

ধবধবে ফর্সা পুরুষটির ওভাল শেপের ক্লিন সেভ করা চকচকে মুখমণ্ডল।সেই মুখে রাজ্যের মায়া ভরা,তীক্ষ্ণ চোখ যেন স্বচ্ছ সমুদ্র,খাড়া নাক,নৌকার মতো বাঁকা ভ্রু জোড়া,আর্মি কাটিং হেয়ার টা তাকে একটু বেশিই মানাচ্ছে যেনো ,তার জিম করা পেশীবহুল শরীরের সামনে স্বর্গ নিতান্ত এক পিঁপড়ে।এক হাত দিয়ে চুলের মুঠি এখনো ধরে আছে বেখেয়ালে হাত সরাতেই ভুলে গেছে।

ওপর দিকের পুরুষটির ক্ষেত্রে ঘটনা ঘটেছে অন্য।স্বর্গের পরনে স্লিপিং শার্ট ,ট্রাউজার ,আলুথালু চুল,মুখে জমে থাকা তেলে চকচক করা গাল নাক ,কাঁপা কাঁপা গোলাপি শুষ্ক ঠোঁট জোড়া এবং এতোটা কাছাকাছি প্রথম কোনো মেয়ের হওয়া,সব মিলিয়ে মনের ভেতর নিষিদ্ধ ইচ্ছেকে বার বার মাথা চাড়িয়ে জাগ্রত করে দিচ্ছে।

নাহ আর পারা যাচ্ছে না।

এটা তুই কি করলি মা!মেজর কে মেরে দিলি?বেচারা আমার কাছে কাজে এসেছে আর এভাবে অপমান করে দিলি?

বাপকে তো পাত্তা দিসই না অন্তত বাইরের মানুষকে তো দে।

বাপির মুখে এমন নাটকীয় কথা শুনে স্বর্গ আহাম্মক হয়ে গেলো,এই লোক আর্মির জেনারেল না হয়ে নাটকে সিনেমায় ভাড়ামি করলে বেশি জনপ্রিয় হতো ।

মুহিতের চুলের মুঠি ছেড়ে আমতা আমতা করে মাথা নিচু করে বিনীত সুরে বলে উঠলো স্বর্গ-

-স- সরি মেজর আ-আ-মি আমার ভাইকে ভেবে আপনাকে ধরে ফেলেছি ইন্টেনশনালি করি নি।মাফ করবেন,বলেই এলোমেলো পায়ে প্রস্থান নিলো।

মুহিত তার বুকের হার্টবিট এর ধুকপুকুনিতে কথার খেই হারিয়ে ফেললো।
তনুজা কোমল সুরে জানতে চাইলো –
বাবা লাগেনি তো তুমার?
না আন্টি এসব ছোটখাটো মার আমার কাছে গায়ে তুলা পড়ার মতো,আপনি আপনার কাজ করুন প্লিজ আমি ঠিক আছি।

দেখেছো বলেছিলাম না মেয়েটা ডাকাত?

স্যার বাকি রঙটা চুলে লাগিয়ে আসুন জোকার লাগছে

মুহিতের এমন কথা শুনে বোকার মতো হাসি দিয়ে আবার ওয়াশ রুমে ঢুকে গেলো নাফিজ মাহমুদ।

মুহিত জানে বাবা হিসেবে নাফিজ মাহমুদ দশে দশ।কাজের সূত্রে নাফিজ মাহমুদ এর সাথে অনেক মেলামেশা করার সুযোগ পেয়েছে মুহিত।ভদ্রলোক যেমন হাসিখুশি তেমনি কঠোর।তিনি কাজ আর ফ্যামিলি কখনো এক জায়গায় রাখেন না।মুহিতকে নাফিজ মাহমুদ বারবার একটা কথা বলেছেন –

আমার ফ্যামিলি আমাকে নিয়ে কখনো কোনো অভিযোগ করতে পারবেনা মুহিত।আমি কখনো ওদের প্রতি কঠোরতা দেখাইনি।যখন যতটুকু ওদের ভালো রাখতে প্রয়োজন হয়েছে আমি সেভাবেই দিয়েছি।আমার ছেলে মেয়েদের কাছে আমি বেস্ট বাবা ,আমার স্ত্রী তনুজার কাছে আমি শ্রেষ্ঠ হাজব্যান্ড।এর চাইতে বড় অর্জন আর কি হতে পারে মুহিত?

মুহিত মন থেকে এই ভদ্রলোককে অনেক শ্রদ্ধা করে।নাফিজ মাহমুদ কর্মক্ষেত্রে যতোটা কঠোর কর্মক্ষেত্রের বাইরে ততটাই নমনীয়।নাফিজ মাহমুদের মাঝে মুহিত নিজের বাবার প্রতিচ্ছবি খুঁজে পায়।

হঠাৎই পিছন থেকে সুখ কাশি দেয়ার ভান করলো-এহেম,এহেম
হাই ব্রো ,”আম সাফওয়ান মাহমুদ সুখ”,স্বর্গের গুনে গুনে দুই বছরের ছোট একমাত্র আদরের ভাই।
খুব জ্বালাই তো এজন্য মাঝে মাঝে বাগে পেলেই রামধুলানী দেয়।আবার মাঝে মাঝে লুকিয়ে পড়ি তখন বাপি ওর খামচি খায়।এই ধরুন আজকের ব্যাপারটাই,

-একটু আগে ইচ্ছে করেই ওর আরামের ঘুম টা ভাঙলাম তার বদলে আপনি কেলানি খেলেন,কিন্তু আপনাকে কেলানি খাওয়ানোর ইচ্ছে আমার ছিলো না।জাস্ট ওর ছুটির দিন টা স্পয়েল করতে চাইলাম এন্ড আম সাকসেস বলেই কলার ঝাঁকালো বাইশ বছরের ক্যাডেট পড়ুয়া যুবক টি।

এই মুহূর্তে মুহিতের এই বাড়ির প্রত্যেক সদস্যকে পাগল মনে হচ্ছে সাথে নিজেকেও।কিন্তু ফিউচার শ্বশুরবাড়ি বলে কথা কাউকে পাগল বলা যাবে না।চুপচাপ জুসের গ্লাসটা হাতে নিয়ে ছোট করে একটি চুমুক বসালো এবং মনে মনে ভাবলো পাগল হয়ে যদি সুখের লহমায় দিন গুজরান করা যায় ক্ষতি কোথায়?

~বিশ মিনিট পর জেনারেল নাফিজ মাহমুদ তার স্টাডি রুমে মুহিত কে ডাকলেন।মুহিত কিছু কাগজ আর নকশা নিয়ে পৌঁছে গেলো সিঁড়ি বেয়ে দুতলার কর্নারের কাঙ্খিত সেই রুমে।শুরু হলো গোপন বৈঠক।

হেই !

-আপনি ক্যাপ্টেন সৌম্য না?আকস্মিক মেয়েলি কন্ঠ শুনে পিছন ফিরতেই সামনে দাঁড়ানো সুন্দরী এক মেয়েকে দেখে বিষম খেলো সৌম্য।
জী আমি ক্যাপ্টেন সৌম্য শাহরিয়ার,আপনাকে তো চিনলাম না।

আপনার ব্রেনে জং ধরেছে ক্যাপ্টেন দুদিন আগেই আমাদের দেখা হয়েছিলো বুশরা জাহিন স্বর্গের চেম্বারে।

মাথা চুলকে ওহ মনে পড়েছে বলে ভদ্রতাসূচক হাসি বিনিময় করলো সৌম্য।আরো বললো সেদিন দেখা হলেও কথা হয়নি।এজন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।

এমা ,না না কোনো প্রবলেম নেই।

আপনার নামটা জানা হলো না,যদিও আপনি আমার নাম ইতোমধ্যেই জেনে গেছেন।

-মেহেনাজ পিউ।আমি স্বর্গের স্কুল জীবনের ফ্রেন্ড।
সুন্দর নাম ঠিক আপনার মতো।
ফ্লার্টিং করছেন?

সৌম্য জিভ কামড়ে কান ধরে কিউট করে তওবা বলে বলে উঠলো একদম না ম্যাডাম।

পিউএর কি হলো কে জানে সৌম্যের এমন রূপ দেখে মনে তার ঠান্ডা বাতাস বয়ে গেলো।

সকাল দশটা বেজে পাঁচ মিনিট-
সেনাসদস্য দের প্রশিক্ষণ অনুশীলন চলছে,মুহিত দাঁড়িয়ে তা পর্যবেক্ষণ করছে আর ভাবছে ভেতরের খবর বাইরে কে পাচার করছে?নিজেদের ব্যাক্তিগত তথ্য কিভাবে আংশিক হলেও ফাঁস হচ্ছে?আরো বেশি সতর্ক হতে হবে কোনো ভাবেই এবারের প্ল্যান ভেস্তে দেয়া যাবেনা।যেই বোয়াল আমি দুই বছর ধরে খুঁজে চলেছি তাকে এবার আমার জালে আটকাতেই হবে।

~কি ব্যাপার মুহিত তোমাকে অন্যমনস্ক লাগছে?
হঠাৎ পিছন থেকে এমন ভরাট কন্ঠ শুনে চমকে উঠে মুহিত,ভাবনা কাটিয়ে পিছন ফিরে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজ মোর্শেদ কে দেখে তৎক্ষণাৎ স্যালুট জানায়।

-কিছুনা স্যার হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়েছে,দীর্ঘদিন তিনি হসপিটালে ভর্তি,সুস্থতার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না তাই একটু চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম।এমন আর হবেনা,সরি স্যার।

-ডোন্ট ওয়ারি মাই বয় সব ঠিক হয়ে যাবে কাজে মন দাও আর তোমার মিশনের কি খবর কোনো খুঁজ পেলে?

নিয়াজ মোর্শেদ কে কেমন জানি সুবিধার মনে হয়না মুহিতের,তাই মুহিত সব কথা চেপে গিয়ে নানান তালবাহানা লাগিয়ে এক গল্প বলে ফেললো-

~না স্যার কোনো কিছু করেও আহমেদ খান এর নাগাল পাচ্ছি না,আপনি টেনশন করবেন না আমি ঠিক খুঁজে বের করবো কথাটি বলে আর একমুহূর্ত দেরি না করে চোখে কালো রোদ চশমাটা পরে লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটা ধরলো মুহিত।গন্তব্যে সিএমএইচ,একবার মাকে দেখে ডক্টরের সাথে কথা বলতে হবে।
#চলবে।

তোমার জন্য সিন্ধুর নীল পর্ব-০১

0

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#সূচনা পর্ব
#সারিকা_হোসাইন

মেজর আপনাকে প্যান্ট খুলতে হবে!কথাটি শুনা মাত্র চকিত গতিতে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সামনে দাঁড়ানো লেডি ডিউটি ডাক্তার এর মুখের দিকে তাকালো মেজর মুহিত ওয়াসিফ।ভ্রু কুঁচকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি প্রয়োগ করে বুঝার চেষ্টা করছে ডাক্তারের মুখভাব।কিন্তু মেয়েটি মাস্ক পরিহিত।যার জন্য বেশ সুবিধা করতে পারলো না মুহিত।নেইম প্লেটের দিকে দৃষ্টি পাত করে মনে মনে নাম টা আওড়ালো বুশরা জাহিন স্বর্গ।

-মিস অর মিসেস স্বর্গ ,আপনার কথাটা ঠিক বুঝতে পারলাম না,আপনি জানেন আপনি কাকে কি বলছেন?
-জি মেজর আমি জেনে বুঝেই কথাটি বলেছি,আপনাকে প্যান্ট খুলতে হবে।আমি আপনাকে ভেন্ট্রো গ্লুটিয়াল পেশিতে ইনজেকশন টি পুশ করবো।এটা আপনি হাতে নিতে পারবেন না।উপর থেকে ওর্ডার আছে।কথাটি নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলে ইনজেকশন এ মেডিসিন ঢুকানোর প্রস্তুতি নিলো ‘স্বর্গ’

এতক্ষন পাশেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাদের কথোপকথন শুনছিলো ক্যাপ্টেন ‘সৌম্য শাহরিয়ার’তার ভাবতেই পিলে চমকে উঠছে যেই মেজর এর এক ধমকে তাদের পুরো টিম থরথর করে কাপে তার সামনে একটি পুচকে মেয়ে মেজর কে নির্দ্বিধায় প্যান্ট খুলে ফেলতে বলছে?মেয়েটির সাহসের তারিফ না করে পারছে না সৌম্য।কীয়তক্ষন বাদেই সকল ভাবনাকে দূরে ঠেলে সৌম্য মনে মনে এক দুস্টু ভাবনা ভেবে ফেললো।
আজকে কি আমি মেজরের পাছু দেখতে পাবো?এত বড় সৌভাগ্য আমার?মনে মনে কথাটি ভেবেই শব্দ করে হেসে উঠলো ক্যাপ্টেন সৌম্য।
হঠাৎ হাসির শব্দ শুনে রাগে চিরবিড়িয়ে উঠলো মুহিতের শিরা উপশিরা।।এক দিকে এই ব্রেনলেস ডক্টরের অসংলগ্ন কথা অন্য দিকে সৌম্যের এমন বিদঘুটে হাসিতে বিতৃষ্ণায় হাত মুষ্টি বদ্ধ হয়ে এলো। মুহূর্তেই মুহিত রক্ত হিম করা দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো সৌম্যের পানে।মুহিতের দৃষ্টির সাথে সৌম্যের দৃষ্টি মিলে যাওয়ার সাথে সাথেই ভয়ে যেকটা দাঁত সৌম্য বের করেছিলো দ্রুত মুখ বন্ধ করে তা ঢেকে ফেললো।মনে মনে সে আল্লাহর নাম ডাকছে মেজরের পাছু কি দেখবো নিজের পাছুর ছাল থাকলেই এনাফ।রক্ষা করো মাবুদ।
আবারো রিনরিনে কন্ঠে ডক্টর বলে উঠলো শুয়ে পড়ুন মেজর!
মুহিত এবার নিজেকে শান্ত রেখে কন্ঠে খানিক গাম্ভীর্য ঢেলে বলে উঠলো -আপনি কার সাথে কথা বলছেন জানেন?
জি,আমি মেজর মুহিত ওয়াসিফ এর সাথে কথা বলছি,যাকে দেখলে পুরো ডিপার্টমেন্ট ভয় পায় কিন্তু আমি পাচ্ছিনা।
মেয়েটির সাহস দেখে অবাকের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গেলো মুহিত।মনে মনে মেয়েকে পাক্কা বেয়াদব উপাধি দিলো।
আমি এখন ইনজেকশন নিবো না মিস স্বর্গ।
না নিলে আপনি যেতে পারেন ,আমাকে যেমন অর্ডার করা হয়েছে আমাকে তো সেভাবেই কাজ করতে হবে তাই না?
মেয়েটির কথার ধরনে শরীরে যেনো আগুনের ফুলকি পড়লো মেজর মুহিতের ।
আমি উপর মহলে কথা বলতে যাচ্ছি,ইনজেকশন পোস্টপন্ড করলাম আর আপনার মতো বেয়াদব মহিলাকেও দেখে নিচ্ছি জাস্ট ওয়াচ এন্ড ওয়াইট বলে মুহিত দুই আঙ্গুল দুই চোখের সামনে তুলে ইশারায় বুঝালো।
আমাকে আপনি কিছুই করতে পারবেন না মেজর মুহিত।কারন এই ইনজেকশন না নিলে আপনি যেই মিশনের স্বপ্ন দেখছেন সেটা পূরণ করতে পারবেন না আর যার কাছে আমার নামে বিচার শালিস দিবেন উনি আমার গুণধর বাবা।আশা করছি কোনোটিতেই বিশেষ লাভ করতে পারবেন না।আর আমাকে মহিলা ভেবে ভুল করবেন না বয়স মাত্র চব্বিশ।কথাটি বলে মুখের মাস্ক টা খুলে ফেললো স্বর্গ।
রাগের চোটে নাকের ডগা লাল হয়ে এলো মেজর মুহিতের।সে উপরে তাকিয়ে ডিউটি ডাক্তার এর চেহারা দেখার প্রয়োজন মনে করলো না।কিন্তু ক্যাপ্টেন সৌম্য এই সুযোগ মিস করার পাত্র নয়।সুন্দরী মেয়েদের প্রতি তার একটা আলাদা দায়িত্ব আছে আর সেই দায়িত্ব টা হচ্ছে তাদের চোখ মুখ খুটিয়ে খুটিয়ে দেখা আর কোথায় কোন সৌন্দর্যের খুঁত রয়েছে তা বের করা।
কিন্তু ক্যাপ্টেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছেনা।অনেক ক্ষণ চেষ্টা করেও যখন কোনো খুঁত ধরতে না পারলো তখন দুই হাত দিয়ে দুই চোখ কচলে আবার ডিউটি ডাক্তার এর দিকে দৃষ্টি দিলো।
ইনজেকশন না নিলে অন্যজনকে নেয়ার জায়গা করে দিন।দরজার বাহিরে লম্বা সিরিয়াল আছে।আশা করি বুঝতে পেরেছেন মেজর মুহিত।
মুহিত মেয়েটির খোঁচা মারা অপমান সইতে না পেরে- ক্যাপ্টেন সৌম্য বলে হুংকার ছেড়ে রুম থেকে বেরিয়ে এলো।
গায়ের এপ্রোন ঠিক করে চুল গুলো ইলাস্টিকের সহিত বেঁধে নেক্সট বলে হাক ছাড়লো স্বর্গ।
রুমে এসে গায়ের ইউনিফর্ম খুলে বিছানায় সজোরে আছাড় মারলো মুহিত।সৌম্য মনে মনে জিকির করেই যাচ্ছে কারন পূর্বের ন্যায় মেজর আজকেও রেগে আছেন আর তাকে নির্ঘাত কঠিন পানিশমেন্ট দিবেন।পূর্বের পানিশমেন্ট এর কথা মনে পড়তেই পেটে মোচড় দিলো সৌম্যের।
সৌম্য চলে গেলো সেই ভয়ংকর স্মৃতিচারণ করতে-
গত বছর গ্রীষ্মকালে তাদের টিম একটি গ্রামের জঙ্গলে ক্যাম্প গেড়েছিলো।রাতে গোলাগুলির মহড়া হতো দিতে মাটি গর্ত করে বাংকার বানাতে হতো।যেমন গরম তেমন পরিশ্রমে মেজরের অনুপস্থিতে সৌম্য এক সোলজার কে নিয়ে কাজে ফাঁকি দিয়ে ক্যাম্পের বাইরে চলে আসে শুধু তাই নয় হাঁটতে হাঁটতে তারা লোকালয়ে পৌঁছে যায়।হাটতে হাটতে নির্জন একটি বাড়িতে একটি আমগাছে পাকা পাকা টসটসে আম ঝুলতে দেখে লোভ সামলাতে পারেনি সৌম্য।সে আম ছিড়তে উদ্দত হতেই সোলজার তাকে নিষেধ করে যে ,
-স্যার মেজর জানলে রক্ষে থাকবে না চলুন ফিরে যাই।কারন মেজর আগেই নিষেধ করেছে লোকালয়ে কারো সাহায্য না নিতে এমনকি কারো জিনিসে হাত না দিতে।রেপুটেশন খারাপ হবে স্যার।
সৌম্য বুক উঁচু করে বহুত বড়াই বুকে চাপড়ে বলেছিলো তুমার মেজর কিচ্ছুটি টের পাবেনা।এর পর তারা আম ছিড়ে খেতেই কোথা থেকে যেনো একটি বুড়ি এসে লাঠি নিয়ে তাদের দৌড়ানি দিয়েছিলো সৌম্য আম নিয়েই ভো দৌড়।ভেবেছিলো বুড়ি আর কি করতে পারবে?কিন্তু বুড়ি ছিলো ধানী লঙ্কা।দৌড়েই ক্ষান্ত হয়নি সোজা ক্যাম্পে এসে বিচার দিয়ে গেছে।সেদিন মুহিত তাকে এই তেল ঝড়ানো গরমে দুশো পুশ আপ করিয়েছে সাথে এক পায়ে তিন ঘন্টা দাঁড় করিয়ে রেখেছে,এমনি এমনি দাঁড় করায়নি।হাতে ছয়টি ইট উঁচু করে ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছিলো।সেদিনের সেই শাস্তিতে রাতে হাড় কাঁপিয়ে জ্বর এসেছিলো সৌম্যের।সেই জ্বরে সৌম্য টানা একুশ দিন কিছু খেতে পারেনি।আর শরীর ব্যাথার কথা না বললেই নয়,মনে পড়লে এখনো ব্যাথা করে।

সৌম্যের ভাবনার ছেদন হলো মুহিতের দাঁত পিষানো ধমকে,
কেনো হেসেছিলে ক্যাপ্টেন?
এমন আকস্মিক প্রশ্নে গলা শুকিয়ে উঠলো সৌম্যের, কি উত্তর দিবে তা ভাবতে লাগলো।এরই মধ্যে আবারো গমগমে কন্ঠে বলে উঠলো মুহিত –
তুমাকে শাস্তি পেতে হবে সৌম্য।
শাস্তির কথা মনে পড়তেই সৌম্যের মুখ পাংশুবর্ণ ধারণ করলো।কাঁদো কাঁদো মুখে মেজরের দিকে অসহায় দৃষ্টিপাত করেও কোনো সুবিধা করতে পারলো না বেচারা ক্যাপ্টেন।
যাও সৌম্য শাস্তির জন্য রেডি হও!
কিসের শাস্তি চলছে এখানে মেজর মুহিত ওয়াসিফ?
হঠাৎ ই রুমে মেজর জেনারেল নাফিজ মাহমুদ এর প্রবেশ যেনো অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে দিলো মুহিত আর সৌম্য কে।
দুজনেই ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে স্যালুট ঠুকলো।
মুহিত জিজ্ঞেস করলো স্যার আপনি এখানে?
আসতে হলো মেজর ,আসতে হলো।আমার মেয়েকে কথা শুনিয়ে ইনজেকশন নিবে না বলে নাকি বের হয়ে এসেছো?
মুহিত হা হয়ে গেলো তার মানে ইতিমধ্যে বিচার চলে গিয়েছে?যেখানে বিচার দেবার কথা মুহিতের কারন সে অপমানিত হয়েছে সেখানে কিনা ওই মেয়েই তাকে শায়েস্তা করতে বিচার দিয়েছে?দুঃখে হাসি এসে গেলো মুহিতের।অবজ্ঞা জনক হাসি।
স্যার একটা সত্য কথা বলি?
-বলো’
আপনার মেয়ে একটা পাক্কা শয়তানের হাড্ডি আর বেয়াদব,কাউকে সম্মান করতে তো জানেই না উল্টো কিভাবে অপমান করতে হবে সেটা ভালোভাবে রপ্ত করেছে।
ক্যাপ্টেন সৌম্য জানে মুহিত ঠোঁট কাটা তাই বলে মেজর জেনারেল এর সামনে তারই মেয়ের নামে এমন ভয়ানক ব্যাখ্যা শুনে মাথা ভনভন করে ঘুরে উঠলো সৌম্য শাহরিয়ার এর।
ঠিক বলেছো মেজর মুহিত মেয়েটা একদম মায়ের মতো হয়েছে ঘরেও সম্মান পাইনা এখানেও পাইনা।
নাফিজ মাহমুদের উক্তিতে চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে এলো সৌম্যের।মেজর জেনারেল মা মেয়ের অত্যাচারে নিগৃহীত?
এজন্যই তাহলে আমাদের উপর স্টীম রোলার চালায় ব্যাটা হারামি।
তা বাবা মুহিত আমার মেয়েকে তুমি অপমান করেছো নাকি আমার মেয়ে তুমাকে করেছে যদি বলতে খুব উপকার হতো আরকি?কথাটি বলে উত্তরের প্রত্যাশায় মুহিতের দিকে দৃষ্টি বুলালেন।
-আপনার মেয়ে আমাকে অপমান করে রুম থেকে বের করে দিয়েছে স্যার!
খুক খুক করে কেশে ফেললেন মেজর জেনারেল নাফিজ মাহমুদ।যেই মেজরের ভয়ে তিনিও মাঝে মাঝে তটস্থ থাকেন সেই মেজর তার মেয়ের কাছে পাত্তা পায়নি?
মুহিতের কাঁধে হাত চাপড়ে বলে উঠলেন নাফিজ মাহমুদ-
থাক বাবা মনে কষ্ট নিওনা যেখানে তুমাদের স্যার ই প্রতিনিয়ত অপমানিত হচ্ছে সেখানে একদিন অপমানিত হয়ে মন খারাপের কিছুই নেই।বিকেলে গিয়ে ইনজেকশন টা দিয়ে এসো যেই জায়গায় আমার মেয়ে দিতে চায় সেই জায়গাতেই ঠিকাছে?
না হলে ইনজেকশন টা আমাকেই পুশ করবে বলেছে।
আর তুমার যেই মিশন নিয়ে এতো স্বপ্ন সেই মিশনে যেতে হলে তুমাকে প্রচুর ফিট থাকতে হবে আশা করি সব বুঝতে পেরেছো?বাচ্চাদের মতো জেদ করোনা।
নিজের স্বপ্নের মিশনের কথা মনে পড়তেই মুহিতের স্বর খাদে নেমে এলো,
-জি স্যার আমি দেখছি কি করা যায় বলেই আবার স্যালুট ঠুকে নাফিজ মাহমুদ কে বিদায় জানালো।
ক্যাপ্টেন সৌম্য তুমাকে মাফ করে দিলাম যাও আজকে শাস্তি দেয়ার মোড নেই বলেই ওয়াশ রুমে ঢুকে গেলো মুহিত।
ক্যাপ্টেন সৌম্য যেনো গভীর সমুদ্রে তলিয়ে গিয়ে বেঁচে ফিরলো।এক মুহুর্ত কাল বিলম্ব না করে এক প্রকার দৌঁড়েই পালালো সে।
মিনিট বিশেক হট একটা শাওয়ার নিয়ে রুমে এসে মুহিত তার গোপন ফোন টি বের করলো।ফোনটা অন করতেই একটা মেসেজ টুং করে উঠলো-
আহমেদ খান ইজ হেয়ার,সি ইউ ইন আফগানিস্তান
মেসেজ টি দেখে মুহূর্তেই মুখে হাসি ফুটে উঠলো মুহিতের,চোখ গুলো হয়ে উঠলো চকচকে,খুব দ্রুতই তাহলে মিশন শুরু হতে যাচ্ছে!
তাহলে তো আর দেরি করা যাবেনা।
ওকে গেট রেডি ফর ইনজেকশন বলে রেডি হয়ে ক্যাপ্টেন সৌম্যকে নিয়ে রওনা হলো ডক্টরের চেম্বারে।
ডিউটি শেষ করে এপ্রোন খুলে সব কিছু গুছিয়ে নিলো স্বর্গ।আজ অনেক ধকল গেছে।সুযোগ পেয়ে অবশ্য ক্লোজ ফ্রেন্ড মেহেনাজ পিউ কে ডেকেছে দুজনে এক সঙ্গে বুফে খাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।দুজনে যেই বের হবে অমনি মেজর মুহিত ক্যাপ্টেন সৌম্য কে নিয়ে হাজির।
আসতে পারি?
স্বর্গ স্মিত হেসে প্রশ্ন করলো এসেছেন তাহলে?
আসতে হলো,কোনো সমস্যা?
নাহ সমস্যা না শুয়ে পড়ুন!প্যান্ট খুলুন
বলেই মুখ টিপে হেসে ফেললো স্বর্গ।
এবার আগে ভাগেই ভয়ের চোটে রুম ত্যাগ করলো সৌম্য।
মুহিতের লজ্জা এবং ব্যাক্তিত্বের এমন ফালুদা হওয়াতে সে ইতস্তত করতে লাগলো।তা বুঝতে পেরে চিকন সুমিষ্ট কন্ঠে স্বর্গ বলে উঠলো-
লজ্জার কিছু নেই মেজর,ও ডক্টর পিউ ও আমাকে হেল্প করবে কারন একটু এদিক সেদিক হলেই প্রচুর ব্লিডিং হবে,সো ডোন্ট প্যানিক ওকে?
এতোক্ষন ডাক্তারের চেহারা না দেখলেও নরম কন্ঠ টা শুনে মেজর মুহিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো স্বর্গের দিকে এবং আপনা আপনি ই মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো মাশাআল্লাহ।
#চলবে?

প্রেমযাত্রা পর্ব-০২ এবং শেষ পর্ব

0

#প্রেমযাত্রা
#লাবিবা_আল_তাসফি

২.
ঝকঝকে আকাশটা হঠাৎ করেই ভিষণ বিষণ্ণ হয়ে পড়েছে। জৌলুষতা কমে কেমন মলিনতায় ছেয়ে পড়েছে। খানিক বাদেই ঝর ঝর করে অশ্রু ঝরাবে। নিরুর বৃষ্টি পছন্দ। তবে এই মুহূর্তে নয়। অগোছালো চুল আর হাতে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হাঁটতে ভিষণ বেগ পেতে হচ্ছে তাকে। তার উপর রাস্তা চেনা নেই। এই মুহূর্তে দেবদূত হয়ে হাজির হলো তার প্রতিবেশী সিটের মালিক। স্বভাব সুলভ নাক উঁচু করে বললো,

‘ঠিকানা বলুন গাড়িতে তুলে দিচ্ছি।’

নিরু লক্ষ্মী মেয়ের মতো ঠিকানা জানালো। ঠিকানা শুনতেই সে ভ্রু বাঁকিয়ে তাকায়। পরক্ষণে রাশভারী গলায় বলে,

‘আমাকে ফলো করুন।’

অচেনা একটা মানুষকে ভরসা করতে নিরুর ভিষণ ভয় হচ্ছিলো। তবুও কেন যেন তার মন বলছিলো একটু ভরসা করেই দেখি!
সেবার অনাকাঙ্খিত ভাবে নিরুর পুরো যাত্রাই সাদাফের সাথে কাটলো। নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতেই তাদের পথ আলাদা হলো। নিরু বিনয়ের সহিত তাকে ধন্যবাদ জানালেও মানুষটা তার নাক উঁচু স্বভাবের জন্য কোনো প্রতি উত্তরে করলো না। এই প্রথমবারের মতো এমন অপমান নিরু মেনে নিলো। তার দয়ার মন এত উপকার করার জন্য এই সামান্য অন্যায় ক্ষমা করতে তার হ্রদয় দ্বিতীয়বার ভাবেনি। তবে বাড়িতে পৌঁছাবার পুরোটা পথ নিরু আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছে এই ছোট্ট পৃথিবীতে লোকটার সাথে যেন তার আর দেখা না হয়। নিরুর এই প্রার্থনা উপরওয়ালা কবুল করলোনা বোধহয়। মামাবাড়িতে পৌঁছে সারাদিনের ধকল কাটাতে ছোট একটা ঘুম দিয়ে উঠে যখন রাতের খাবার খেতে খাবার ঘরে যায় তখনি তার চোখ আকাশে। মামাতো ভাই কাফির পাশেই বসে সাদাফ। কালো রঙের পোলো টিশার্ট জড়ানো গায়ে। চুলগুলো এখনো ভেজা। কিছুক্ষণ পূর্বেই শাওয়ার নিয়েছে বোধহয়। পাশেই মামি দাঁড়িয়ে তার প্লেটে খাবার বেড়ে দিচ্ছে। নিরুর পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চাইলো। অযথাই এই লোকের সামনে পড়ে ঝামেলা না বাড়ানো শ্রেয়। কিন্তু তার কপাল যে মোটেই অমন ভালো নয়। দু পা আগাতেই পেছন থেকে মামি ডেকে উঠলো।

‘ওদিকে কোই যাস? খাইতে বস আয়। সারাদিন ধকল গ্যাছে। খাওয়া শ্যাষে লম্বা ঘুম দিবি, শরীর ফুরফুরা হইবে। আয় আয় খাবার দিতাসি।’

নিরু বোকা হেসে খাবার টেবিলের দিকে অগ্রসর হলো। আড়চোখে একবার সাদাফকে দেখে নিলো। নিরুর দিকেই তাকিয়ে আছে। তার চোখ ভিষণ শান্ত। নিরুকে সামান্য তম বিষ্ময় ভর করেনি তার। যেন নিরুর এখানে থাকাটাই স্বাভাবিক। নিরু টেবিলে বসতেই সাদাফ পুনরায় কাফির সাথে কথায় মগ্ন হলো। কিন্তু নিরু অস্থিরতার শিকার হলো। এই একই টেবিলে বসে খাওয়াটা তার পক্ষে অসম্ভব বলে মনে হলো। কাজেই সে প্লেট হাতে সাবধানে উঠে যেতে নিলো। এবারো সে ধরা খেলো। কাফি কপালে ভাঁজ ফেলে বলে উঠলো,

‘তুই আবার কই যাস? খাবার শেষ কর। ফুপু শুনলে তোর মাথার চুল সব তুলে ফেলবে। বাঁচতে চাইলে নো নাটক, ঝটপট খাবার শেষ কর।’

নিরু থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে। কি একটা জঘন্য অবস্থা! এই লোকের সামনেই এসব বলা লাগলো? নিরুর চোখে পানি জমতে শুরু করেছে। এই অপমান সে কিভাবে হজম করবে। আড় চোখে তাকালে দেখা গেলো সাদাফ মাথা‌ নিচু করে খাবারে মনযোগ দিয়েছে। তা দেখে নিরু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঝটপট পায়ে তার থাকার ঘরে চলে যায়। এই মুখ নিয়ে সে আর কখনোই সাদাফের সামনে যেতে পারবে না। সম্মানের কানাকড়িও নেই তার সাদাফের কাছে।
রাত প্রায় বারোটা। বাড়ির সকল বাতি নেভানো। সকলে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। নিরুর বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। তার দুই পাশে দুই মামাতো বোন শুয়েছে। বিছানা শেয়ার করার অভ্যাস না থাকায় তাকে এই সমস্যা ভোগ করতে হচ্ছে। নিরু ফোনে সময় দেখে বিছানা ছেড়ে নেমে আসে। গায়ে ওড়না জড়িয়ে পা টিপে টিপে শিড়ি ঘরে আসতেই শক্ত কিছুর সাথে সজোরে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায়। পায়ে ব্যাথা পেয়ে মৃদু আর্তনাদ করে উঠলেই পুরুষালি গলা ব্যস্থ হয়ে বলে ওঠে,

‘কে নিরু? ব্যাথা পেয়েছেন?’

নিরু মৃদু গলায় জবাব দেয়,

‘হুম।’

‘আমার হাত ধরে উঠতে চেষ্টা করুন।’

সাদাফ হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। এই অন্ধকারে সাদাফের অন্ধকার অবয়ব স্পষ্ট ভাবে বোঝা যাচ্ছে। নিরু সাদাফের হাত ধরে উঠে দাঁড়ায়। সাদাফ চাপা গলায় বলে,

‘বেশি লেগেছে? হাঁটতে পারবেন।’

‘হুম পারবো।’

‘এত রাতে এখানে করছেন?’

‘হাঁটছিলাম।’

‘এই অন্ধকারে? নাকি আপনি অন্য জগতের প্রাণি যা রাতে ঘুরে বেড়ায়। সুদর্শন পুরুষ দেখলে ছলনা করে বশে নিয়ে রক্ত খেয়ে নেয়। এমন কিছু কি?’

‘আমি রক্ত খাই না।’

‘বুঝলাম! আপনি একটু ভিন্ন ধর্মী। তবে আমাকে কেন বশ করতে চাইছেন?’

‘আজব! আমি আপনাকে বশ কেন করবো?’

‘সেটা তো আপনি জানেন।’

‘আপনি অদ্ভূত!’

সাদাফ হাসে। ফোনের ফ্লাস অন করে সিঁড়ির দিকে তাক করে বলে,

‘আমি ছাদে যাচ্ছিলাম। এর মাঝে আপনি উড়ে এসে পড়লেন। এসেছেন যখন দুকাপ কড়া করে চা করে নিয়ে ছাদে আসুন। অন্যথায় এন্ট্রি মানা।’

নিরুর জবাবের অপেক্ষা করলো না। দু তিন সিঁড়ি বাদে বাদে লাফিয়ে ছাদেয়ে উঠে গেলো। নিরুর মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে থাকলো খানিকক্ষণ। এই লোককে দেখলেই তার নিজের সম্মানহানির কথা মনে পড়ে। আর ভাগ্য কিনা বারবার তাকে এই লোকের সামনে এনে হাজির করে।

এরপর থেকে রোজ তিন চারবার করে সাদাফের সাথে তার দেখা হতো তার। খুব কম সময় কথা হতো। প্রতিবার সাদাফ নিজ থেকে কথা শুরু করতো। বরিশালে সাদাফ ছিলো মাত্র চারদিন। কিন্তু এই চারদিনেই যেন গুরুজনদের প্রিয় পাত্র হয়ে উঠেছিলো। নিরুর মা হলো সাদাফের অন্যতম ভক্ত। যখন সে জানতে পারলো সাদাফ ঢাকায় নিরুর হলের কাছেই থাকে তখন খুব করে আবদার করে বললো,

‘বাবা তুমি আমার মেয়ে নিরুটাকে একটু দেখে রেখো। মেয়েটা দূরে থাকে একা। বুকের ভেতরটা সবসময় ফাঁকা হয়ে থাকে। তুমি কাছেই আছো শুনে এখন থেকে একটু স্বস্তি পাবো।’

সাদাফ তার কথা রেখেছে। সপ্তাহে একদিন সে নিরুর সাথে যোগাযোগ করে। নিরুর কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা জানতে চায়। মানুষটা ভিষণ দায়িত্বশীল। নিজের দায়িত্ব থেকে কখনো পিছিয়ে যায় না। নয়তো কেন সে অচেনা এক মেয়ের এত যত্ন নিবে?
……

নিরু বিছানা থেকে উঠে জানালার পর্দা সরিয়ে দেয়। জানালার পাশে মস্ত এক মেহগনি গাছ। এই গাছটার একটা ডাল নিরের জানালা ঘেঁষে। ডালটায় প্রায়শই একটা নাম না জানা পাখি এসে বসে। মিষ্টি গলায় ডাকে। আজ আসেনি। নিরু ব্যস্ত পায়ে ফ্রেশ হতে যায়। বারোটায় ক্লাস আছে। এই ভরদুপুরে ক্লাস করার ব্যাপারটা নিরুর ভিষণ অপছন্দ। এত এত সুন্দর সময় থাকতে ভরদুপুরেই কেন?

আজকের বিকেলটা সুন্দর। মিষ্টি উজ্জ্বল আকাশ। মৃদু মৃদু বাতাস বইছে। নিরু তার আর সাদাফের সম্পর্কটা নিয়ে ভিষণ ভাবুক হয়ে আছে। তাদের মধ্যে প্রণয়ের সম্পর্ক নেই। তবুও কোথাও যেন একটা অধিকার বোধ আছে। এই যেমন সাদাফ তাকে ম্যাসেজ করে জানিয়েছে নীল রঙের শাড়ি পড়তে। চুল সুন্দর করে খোঁপা করতে। যে কেউ কি এমন আবদার করতে পারে? করলেও বা নিরু কেন শুনবে? কিন্তু প্রশ্নটা যখন সাদাফকে নিয়ে নিরু তখন ভিষণ বাধ্য মেয়ে।
সাদাফের বর্ণনা মতোই সেজেছে নিরু। চুল সুন্দর করে খোঁপা বেঁধেছে। হাতে নীল রঙের কাঁচের চুড়ি পড়েছে। চোখে মোটা কাজল। আর কপালে নীল টিপ। ঠোঁটে রঙ ছোঁয়ানো মানা। এভাবেই তাকে বেশ লাগে।
নিরু হলের গেট থেকে বের হতেই সাদাফকে দেখতে পেলো। রিকশার উপর বসে আছে। তার পড়নে হলুদ পাঞ্জাবী। চুল ব্যাকব্রাশ করা। হাতে এক গুচ্ছ সাদা গোলাপ। নিরুর বুকটা কেমন করে ওঠে। সাদাফ কখনোই ফুল হাতে দেখা করেনা। তবে আজ কেন?

‘উঠে আসেন ম্যাডাম। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করিয়েছেন।’

‘দুঃখিত।’

‘এভাবে তো ক্ষমা করা যাচ্ছে না। তবে অন্যভাবে যেতে পারে।’

নিরু পিটপিট করে তাকায়। ছোট করে বলে,

‘কিভাবে?’

‘আজ একটু বেশি সময় দিতে পারবে?’

কেমন করুন শোনালো কথাটা। নিরু জবাব দিতে পারলো না। গলা আটকে আছে তার। সাদাফ হয়তো বুঝলো। মুচকি হেসে হাত বাড়িয়ে দিলো,

‘উঠে এসো।’

রিকশা চলছে আপন গতিতে, গন্তব্যহীন ভাবে। সাদাফ মনোযোগ সহকারে গোলাপের কাটা ভাঙছে। নিরু বারবার সেদিকে লক্ষ্য করছে। তার মন ছটফট করছে। গোলাপ গুলো তার জন্য তো? এখনো দিচ্ছে না কেন তবে? তার ভাবনার মাঝেই অনুভব হলো তার খোঁপায় খুব যত্ন নিয়ে সাদাফ ফুল গুঁজে দিচ্ছে। নিঃশ্বাস আটকে এলো। শক্ত হয়ে বসে রইলো সে। নিজের ভেতরের অস্থিরতা সে কিছুতেই সাদাফকে বুঝতে দিবে না।

‘নিরু?’

‘হুম।’

‘আন্টি আমাকে তোমায় দেখে রাখার দায়িত্ব দিয়েছিলো। আমি কি সেটা পালন করতে পেরেছি?’

নিরু পাশ ফিরে তাকায়। সাদাফ তার দিকেই তাকিয়ে। নিরু বুঝতে পারেনা হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন।

‘পেরেছি কি?’

নিরু মাথা নাড়ায়। সাদাফ বলে,

‘মুখে বলো।’

‘হুম।’

‘গুড। তাহলে আমি যদি পুরোপুরি ভাবে তোমার দায়িত্ব নিতে চাই তাতে কোনো আপত্তি আছে? আমার মনে হয় আমি আমার দায়িত্ব বুঝে নিতে পারবো। তোমার কি মনে হয়? পারবো?’

বোকা নিরু সাদাফের কথার অর্থ বুঝলো না। তবে সাদাফ দায়িত্বশীল তাই সে নির্দ্বিধায় বলে উঠলো,

‘হুম পারবেন।’

সাদাফ মুচকি হাসে। বলে,

‘ তবে নিজেকে প্রস্তুত করো।’

‘কেন?’

‘আমার কাঁধে ভর করতে।’

‘কেন? আমার পায়ে তো সমস্যা নেই!’

সাদাফ হো হো করে হেসে ওঠে। নিরুর মাথায় টোকা দিয়ে বলে,

‘বুদ্ধু মেয়ে। নো প্রব্লেম আমার এমনটাই পছন্দ।’

নিরু পাশ ফিরে হাসে। মাঝে মাঝে বোকা সাজতে মানা নেই। নিজেকে গোপন করতে ওটাই একমাত্র উপায়।

সমাপ্ত

প্রেমযাত্রা পর্ব-০১

0

#প্রেমযাত্রা
#লাবিবা_আল_তাসফি

১.
সময়টা নভেম্বর মাসের বাইশ তারিখ। অল্প স্বল্প শীত পড়েছে। নিরু গলা অবদি কম্বল টেনে ফ্যান চালিয়ে ঘুমিয়ে আছে। এভাবে ঘুমাতে তার বেশ লাগে। হলের এই রুমটাতে সে একাই থাকে। যদিও এখানে তিনজনের থাকার ব্যাবস্থা আছে। তার দুজন রুমমেট ও আছে। কিন্তু তারা কিছুদিন হলো গ্রামে গেছে। তাই সে তার মর্জি মতো চলতে পারছে। তার রুমমেট দুজন সিনিয়র। সারাক্ষণ হুকুম চালায়। রাত দুপুরে চা খাওয়ার আবদার করে। নিরুকে না চাইতেও খাটের তলায় লুকিয়ে রাখা হিটার বের করে চা করে দিতে হয়। চিনি, চা পাতা দুটোই তার। সাথে দুটো বিস্কুট ও দিতে হয়। নিরু চাইলেও কিছু বলতে পারে না। যদি হল সুপারকে হিটারের কথা বলে দেয়!
রুমে পার্সোনাল চুল্লি রাখা হলের নিয়মে অবৈধ। নিরু সেই অবৈধ কাজটাই করছে। এজন্য তাকে মুখ বুজে সবটা সহ্য করতে হয়। ব্যাপারটা যে এখানেই শেষ এমন নয়। এই তো নবীন বরণ অনুষ্ঠানের দিন নিরুর অতি প্রিয় নীল রঙের শাড়িটা তাকে দিয়ে দিতে হয়েছে। সিনিয়র মেয়ে দুজনের মধ্যে মিতু নামের মেয়েটা রূপবতী। ফকফকা ফর্সা গায়ের রঙ। গায়ে টোকা পড়লেই রক্ত বেরিয়ে যাবে ধরনের সুন্দর। তার নজর পড়লো শাড়িটার উপর। লাজ লজ্জা ছেড়ে এসে বললো,

‘শাড়িটাতো ভিষণ সুন্দর নিরু। কিন্তু এই রঙটা তোমায় মানাবে না। তোমার গায়ের রঙ তো চাপা! নীল রঙ টকটকে ফর্সা মেয়েদের জন্য। আমার মতো।’

উত্তরে নিরু ছোট করে বলেছিল,

‘আচ্ছা।’

‘কি আচ্ছা? তুমি এক কাজ করো, শাড়িটা আমায় দিয়ে দাও। আমি তোমায় দাম দিয়ে দিব।’

‘না না আপু। আমি শাড়ি বিক্রি করবো না।’

‘আরে মেয়ে ঐ টাকায় তুমি তোমার গায়ে মানাবে এমন একটা শাড়ি কিনে নিও। লজ্জা পেতে হবে না।’

শাড়িটা নিয়ো নিলো মিতু। নিরু চেয়েও কিছু বলতে পারলো না। কেবল বিরবির করে বললো,

‘আমি সত্যিই বিক্রি করতে চাই না!’

নবীন বরণ শেষ হয়েছে মাস পাঁচেক হলো। এখনো সে টাকা নিরু হাতে পায়নি। লোকলজ্জার ভয়ে চাইতেও পারেনি। তবে নিরু ঠিক করেছে এবার গ্রাম থেকে তারা ফিরলে মিতুর কাছে সে টাকা চাইবে। কিছু ক্ষেত্রে লজ্জা না থাকা ভালো।
.
.
নিরুর আনন্দের ঘুমের বেড়াজাল ভাঙলো সহসা বেজে ওঠা ফোনের শব্দে। স্বাদের ঘুম ভাঙায় মহা বিরক্ত হলো সে। আজকাল মোবাইল নামক যন্ত্রটার প্রতি প্রচন্ড বিতৃষ্ণা জেগেছে তার। কোনোরকম শরীর টেনে তুলে কল রিসিভ করে কানে চেপে ধরতেই ওপাশ থেকে রাশভারী গলায় কেউ শুধালো,

‘এত দেরী কেন?’

নিরু তখনো ঘুমে ঢুলছে। উক্ত কথা তার মস্তিষ্ক নিতে পারল না তৎক্ষণাৎ। আর না পারলো এমন রাশভারী গলার মালিককে চিনতে। কপাল বরাবর ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করলো,

‘কে আপনি?’

প্রশ্নটা অহেতুক।‌ সেভ করা নম্বরটিতে জ্বলজ্বল করছে কলদাতা ব্যক্তির নাম। কিন্তু নিরু ঘুমের বশে তা দেখতে পায়নি। অপর ব্যক্তি ফোনের ওপাশ থেকে শান্ত গলায় বললো,

‘নম্বরটা তাহলে এখনো সেভ করোনি?’

নিরুর ঘুমের হ্রেস কিছুটা লঘু হয়েছে। মস্তিষ্ক সচল হতেই সে কান থেকে ফোন নামিয়ে চোখের সামনে ধরলো। ফোনের স্ক্রিনে জ্বলজ্বল করছে ‘চৌধুরি সাহেব’ নামটি। নিরু তৎক্ষণাৎ জিভ কাটে। ফোন কানে চেপে ছোট করে বলে,

‘দুঃখিত। আসলে..’

‘ঘুমাচ্ছিলে?’

‘হুম।’

‘বিরক্ত করলাম?’

‘তা কেন?’

ওপাশের লোকটা খানিক হাসলো। শুধালো,

‘বিকেল হলে দেখা করো? আমি তোমার হলের সামনে আসবো।’

কথাটা বলেই লাইন কেটে দিল। নিরু উত্তর দিতে পাররো না। প্রততিবার দেখা করার কথা উঠলে এমনটাই করে লোকটা। নিরুর মুখ থেকে ‘না’ শোনার মতো খারাপ জিনিস সে শুনতে চায়না। যদিও আজ নিরু না করতো না।

_____________

সাদাফের সাথে নিরুর দেখা হয়েছিল বরিশাল যাবার পথে। বাসে তাদের সিট পাশাপাশি ছিল। দুর্বল ভাগ্য নিয়ে জন্মানো নিরুর ভাগ্যে সেবার জানালার পাশের সিট ছিলো না। সাদাফের ছিল জানালার পাশের ছিট। লোকটা গম্ভীর ধাঁচের। নিরু বাসে উঠে তার পাশে বসার পর একবার ও ঘার ফিরিয়ে তাকায়নি। পুরোটা সময় জানালা থেকে বাহিরে তাকিয়ে ছিল।
নিরুর বাস যাত্রায় বমি করার অভ্যাস আছে। বাসে ওঠার আগে সে বমির ওষুধ খেয়ে উঠেছে। তবুও কেমন পেট মুচড়ে উঠছে। হাত দিয়ে নাক মুখ চেপে স্থির হয়ে বসে আছে সে। এতক্ষণে তার পাশে থাকা রোবট মানুষটা কথা বলে উঠে।

‘খারাপ লাগছে আপনার?’

নিরু কেবল মাথা উপর নিচ করে উত্তর জানালো। সাদাফ ভদ্রলোকের মতো জানালার সিটটা নিরুকে দিয়ে দিলো। জানালার গ্লাস টেনে সরিয়ে দিতেই নিরু বড় করে শ্বাস ছাড়লো। বাহির থেকে আসা ফুরফুরে বাতাসে শ্বাস নিতেই সব খারাপ লাগা নিমিষেই হারিয়ে গেলো। নিরু পাশ ফিরে সাহেদকে দেখলো। লোকটার হাইট মিডিয়াম হবে। গায়ের রঙ কালো বলা চলে না। একটু উজ্জ্বল। মুখ জুড়ে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। শক্ত চোয়াল। পোশাক আসাকে তাকে ভদ্র পরিবারের বলেই মনে হলো। কানে হেডফোন গুঁজে চোখ বন্ধ করে রেখেছে। নিরু একবার ধন্যবাদ দিতে চাইলো। কিন্তু কিভাবে? কানে যে লোকটা হেডফোন গুঁজে রেখেছে। নিরু তবুও নরম গলায় ডাকলো,

‘এই যে! শুনছেন?’

নিরু ভেবে নিয়েছিল লোকটা শুনতে পাবে না। কিন্তু সে শুনতে পেলো। চোখ মেলে তাকালো সরাসরি নিরুর চোখে। কি প্রকট সে চাহনি! নিরু তাকিয়ে থাকতে পারলো না। চোখ সরিয়ে আবারো তাকালো। লোকটা তার দিকে সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়লো,

‘কিছু বলবেন?’

কাটকাট প্রশ্ন। কথার ধরনেরই বোঝা যাচ্ছে মানুষটা খুব একটা কথা বলে না। যতটুকু বলে সেটাও খুব কাটকাট। নিরু অপ্রস্তুত হেসে বললো,

‘ধন্যবাদ।’

‘কেন?’

‘এই সিটটার জন্য।’

‘এরপর থেকে নিজের সমস্যা গুলো মুখ খুলে বলবেন। অহেতুক কথা না বলে প্রয়োজনের কথা গুলো বলতে শিখুন।’

ঠান্ডা ভাবে করা অপমান নিরুর হজম হলো না। তবুও গলা চেপে হজম করে নিলো। এভাবে মানুষ তাকে মুখের উপর বাচাল বলার পরও সে কিছু বলতে পারলো না দেখে ভেতরটা কেমন হাঁসফাঁস করছে। এটা তার একটা রোগ। কেউ কিছু বললে সে উত্তর না দিয়ে থাকতে পারেনা। যতক্ষণে সে উত্তর দিবে না ততক্ষন সে অন্য কাজে মন দিতে পারবে না। মাথার ভেতর ঐ একটা ব্যাপার ঘুরঘুর করে বেড়াবে। নিরু তার অতি পরিচিত স্বভাব বদলাতে পারলো না। পাশে বসে থাকা অতিব ভদ্রলোককে ছোট করে ডাকল,

‘এই যে! শুনুন?’

সাদাফ তার পাশে বসা মেয়েটার এমন ঘ্যানঘ্যান স্বভাবে অতিষ্ঠ প্রায়। এই জায়গায় কোনো ছেলে হলে এতক্ষণে এক ধমকে চুপ করিয়ে দিত সে। কিন্তু মেয়ে হওয়ায় যত বিপত্তি। ধমক দিলেই দেখাগেল কেঁদে কেটে একাকার করলো। তখন আরো এক বাজে অবস্থা ক্রিয়েট হবে। এসব ভেবেই সে ছোট করে শ্বাস ফেলল। পাশে ফিরে ভ্রু উঁচু করতেই মেয়েটা বেশ কনফিডেন্স নিয়ে বললো,

‘দেখুন আমি একদম বাঁচাল নই। এটা মিসআন্ডারষ্টান্ডিং ছিলো।’

সাদাফ ছোট করে জবাব দিলো,

‘আচ্ছা।’

নিরু এমন জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারলো না। তার ভেতরটা হাঁসফাঁস করছে। লোকটা সত্যিই কি বুঝেছে!
পুরোটা যাত্রায় লোকটার সাথে তার আর কথা হলো না। নিলু একবার ভেবেছিল ডেকে শুনবে সে কোথায় যাচ্ছে। কিন্তু পরক্ষণে নিজ সিদ্ধান্ত বাতিল করেছে। এমন নাক উঁচু স্বভাবের মানুষের সাথে কম কথা বলা শ্রেয়। জানালা থেকে বাহিরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কিছু একটা আবিষ্কার করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে এক পর্যায়ে ঘুমকে আবিষ্কার করলো। ঘুম ভাঙলো যখন তখন বেলা পড়ে গেছে। যাত্রিরা সকলে নেমে গেছে প্রায়। তার দিকে অদ্ভূত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার প্রতিবেশী সিটের মালিক। নাক কুঁচকে বললো,

‘আপনি কি ঘুমানোর জন্য এতটা পথ পাড়ি দিলেন?’

নিরুর কিছুটি অস্বস্তি বোধ হয়। এভাবে অচেনা কারো সামনে ভুষভুষ করে ঘুমানোটা অবশ্যই গর্ব করার মতো কিছু না। তার উপর জন্মসুত্রে পেয়ে যাওয়া নাক ডাকা ব্যপারটা যদি ঘটে থাকে তবে এ মুহূর্তে তার উঠে দাঁড়ানোর থেকে জানালা থেকে বাহিরে ঝাঁপ দেওয়া শ্রেয়।

‘আপনি কি এখানেই থাকতে চাচ্ছেন? তবে আমি চললাম। ফাঁকা বাসে একা একটা মেয়েকে ফেলে রেখে যাওয়াটা অপরাধ বোধ হচ্ছিলো তবে এবার আর যেতে অসুবিধা নেই। চললাম মিস।’

কথা শেষ হতে কালো রঙের ব্যাগটা কাঁধে চাপিয়ে সত্যিই পা বাড়ালো বাহিরে। এতক্ষণ থমকে থাকা নিরু নড়েচড়ে ওঠে। নিজের ব্যাগ হাতে নিয়ে দ্রুত বাস থেকে নামে। সাদাফ ততক্ষণে বড় বড় পা ফেলে অনেকটা দূরে এগিয়ে গেছে।

চলবে……

(বি.দ্র: ইহা একটি ছোট গল্প। ভালোবাসা আপনাদের)

আজকে আমার মন ভালো নাই পর্ব-১৬ এবং শেষ পর্ব

0

আজকে আমার মন ভালো নাই।।
নাহিদা সানজিদ।।
১৬.
তুমি হিম কুয়াশায়, দিন ধোঁয়াশায় বর্ষা মুখোর ক্ষণে,
এসো ফুল হয়ে দুল, দোল দুলোনি,
তুমুল রতি রনে।

সকাল থেকে ফোনের প্লেলিস্টে এই গানটা বাজছে। বাজনা ছাড়া লোকটার গলায় গানটা বেশ ভালো লাগছে। খালি গলায় এ যুগে এত সুন্দর কেউ গাইতে পারে সাফার জানা ছিলো না। আজ সাফার বিয়ে। সেও গুনগুন করে গানটা গাওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে। এরমধ্যে জহির একবার কল করেছে, মা এসে ফোনটা দিয়ে গেছেন। হামলে পড়ে ফোনটা ধরলো ওর কিছু বান্ধবী। তারা মূলত দুষ্টুমি করতে চেয়েছিল। দুষ্ট গলায় বলল,
— “হ্যালো।“
সঙ্গে সঙ্গে ফোনটা কেটে গেলো। ওরা বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো। এর কিছুক্ষণ পর আবার কল এলো, ধরলো সাফা, “হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম?”
— “ওয়ালাইকুমুস সালাম। আমরা আপনার জিনিসপত্র এখনই পাঠিয়ে দিতে চাচ্ছি। নামাজ পড়ে যেতে যেতে তো দেরী হবে। আপনাদের সাজতে তো একটু সময় লাগে।”
সাফা বলল, “আচ্ছা।”
এরপর কৌতুহলী গলায় জিজ্ঞেস করল, “তখন ফোন কাটলেন কেন?”
জহির স্বাভাবিকভাবেই বলল, “এমনি। কল করেছি আপনাকে। আরেকজনের সাথে কথা কেন বলব?”
সাফা হেসে ফেললো। ভাবী মনোযোগ দিয়ে মেহেদী দিয়ে দিচ্ছেন। একটু পরপর রান্নাঘরেও উঁকি দিয়ে আসছেন। রূমীও ব্যস্ত মেহমান তদারকি করতে। কাকে সশরীরে দাওয়াত করা হয়নি বলে গাল ফুলিয়ে বসে আছেন, তার হেস্তনেস্ত করতে।

মারওয়া হেঁটে বেড়াচ্ছে খোলা চুলে। মাঝে মাঝে প্রেতাত্মা বলে ভ্রম হয়। দুনিয়াবি কোনো বিষয়ে আপাতত তার কোনোরূপ আগ্রহ নেই। অর্পা সবাইকে মেকআপের লেসন দিচ্ছে, “এখনকার অধিকাংশ মেয়েদের মেকআপ করার নিয়ম জানা নেই। ওরা মনে করে সাদা আটা ময়দার একটা চামড়া উপরে বসিয়ে দিলেই হয়। মেকআপ করতে হয় ত্বকের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে। তোমার গায়ের রঙ ব্রাউন হতে পারে। তুমি তার সঙ্গে মিলিয়ে শেড ব্যবহার করবে। এই জোর করে চেহারা বদলে ফেলাটা আমার রীতিমতো রেসিজম লাগে, বুঝলে?”
সাফাকে ঘরোয়াভাবে সাজানো হলো। লাল জামদানি শাড়ি, জর্জেটের ওড়না মাথার উপর টানা। মনে হচ্ছে ছোট্ট একটা পরী বসে আছে। রূমী এসে দেখে বলল, “অর্পা, মনে হচ্ছে আমরা পুতুল বিয়ে খেলছি। পিচ্চি বরবউ খেলার কনে।”
হাসতে গিয়েও ওর মন খারাপ হয়ে গেলো।

কানিজ আজ ব্যস্ততম মানুষদের একজন। আব্দুর রহমান সাহেব ব্যস্ত হবার ভান করছেন ঠিকই, কিন্তু তিনি আদতে ব্যস্ত নন। সবার সঙ্গে হাত মিলিয়ে জোরপূর্বক একটা হাসি দিচ্ছেন। বরপক্ষ এলো খুব তাড়াতাড়িই। বর সাহেবও খুব বেশি দেরি করলেন। এক পাল ছেলেপেলে বাড়ির ফটক আগলে দাঁড়িয়ে থাকলো। লাখ টাকার নিচে নাকি ভেতরে যেতে দেবে না। বেশ কিছুক্ষণ গাল বাজানোর পর তারা পাঁচ হাজারে মানলো। বরের সঙ্গের বন্ধুরা ক্রমাগত গান গেয়ে চলেছে,
“আঙ্গো দিগের হেতি,
রাইনতো জানে ইছা মাছ আর হাইন্না কচুর লতি…”
নোয়াখালীর গান। একদল আবার টেবিলের উপর হাত দিয়ে তালি বাজাচ্ছে। অন্দরমহলের নারীদের হাসির শব্দও শোনা যাচ্ছে। কথা কি হচ্ছে না হচ্ছে তাতেই সকলে একসাথে হেসে উঠছে জোরে।

প্রিয়া গম্ভীর মুখে বসে। ওর সঙ্গে মিন্টুর একটু আগেই তুমুল ঝগড়া হয়েছে। মেয়েরা বেশ আগ্রহের সঙ্গে তাদের প্রেমের গল্প শুনতে চাইছে। প্রিয়া রাগ রাগ গলায় বলল, “সবসময় ছেলেরা কেন বিয়ে করতে আসে? এবার থেকে উচিত মেয়েদের গিয়ে বিয়ে করা। এত অসমতা মানা যায়?”
মিন্টু তাকে কলে বলছে, “ওরে বাবা! আর?”
সে ইদানীং ভদ্র। অযথা তর্ক করে না। প্রিয়া ফুঁসে উঠলো, “জামাই খাওয়া বলে যে রাক্ষসের খাবারের আয়োজন। মেয়েদের জন্য শ্বশুরবাড়িতে কী হয়?”
“হয় না? বউভাত।” মিন্টুর সরল উত্তর।
“সে তো একদিন।”
মিন্টু শ্বান্তনার সুরে বলল, “আচ্ছা,যাও। তোমাকে এবার নিয়ে উঠানখাসি জবাই দেব।”
প্রিশা মেনে গেলো। কিন্তু পরে খেয়াল হলো উঠানখাসি কী জিনিস! পুরো ঘরে কেউ জবাব দিতে পারলো না।

মারওয়া গম্ভীর মুখে চেয়ে আছে। অবাক হবার ভং ধরে বলল, “কী রে! তুই এমন হে হে করে হাসছিস! দুই মিনিট পর বাবার বাড়ি ছেড়ে যাবি, এখনি এত হাহা হিহি। ব্যাপারটা কী? তোর ওই লোক বান মেরেছে নাকি তো বুঝতে পারছি না।”
সাফা আয়নায় বারবার তার মুখ দেখছে। কেমন অন্যরকম লাগছে। দাদী তার দীর্ঘদিনের বিবাহিত জীবন থেকে কিছু উপদেশ দেবার চেষ্টা করছেন। মাঝেমাঝে এমন সব কথা বলছেন কানে কানে, যে তার কান লাল হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মাঝে হঠাৎ হুজুর এসে কবুল শুনতে চাইলেন। সাফা মারওয়ার হাত শক্ত করে ধরে রাখলো। মারওয়ার বুক ধুকপুক করছে। তবুও সে ধমক দিয়ে বলল, “কবুল বলার আছে বলবি, পরে ফাঁকে দিয়ে আরেকজন এসে কবুল বলে দিলো। তুই তো আবার কালামানিককে ছাড়া বাঁচবি না।”
সুষ্ঠুভাবে বিয়ে সম্পন্ন হলো। বর কনেকে একসাথে বসিয়ে আয়না ধরা হলো সামনে, ছোট ছোট বাচ্চারা পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। ওরা আয়নায় চোখে চোখ মেলাতে লজ্জা পাচ্ছে। এত মানুষ সামনে দাঁড়িয়ে!

মারওয়া একটা রুবা কানে কানে কি যেন বলল। রুবা হাত নাড়িয়ে সকলের সামনে গিয়ে বলল, “Stop guys. এই আয়নাটা সম্ভবত মঙ্গলগ্রহ। কারণ এতে দুটো চাঁদ দেখা যাচ্ছে।”
সবাই হেসে উঠলো “ওওওও” শব্দ করে।
জহিরের সঙ্গের ওরা বসার ঘরে বসে গানটা গেয়েই যাচ্ছে। সাফা ফিসফিস করে বলল, “গানের লাইনগুলোর মানে কী?”
জহির মাথা নিচু করে হাসলো।
“প্রমিত ভাষার মতো নোয়াখালীর ভাষায়ও তিনটা সর্বনাম আছে। হেতি , হেতনে, হিজ্জা। হেতনে বলা হয় অনেক সম্মান করে। হেতি বলা হয় সে’ অর্থে। হিজ্জা বলা হয় তুই অর্থে। ওরা আপনার কথা বলছে, মানে আমাদের দিকের সে, অর্থাৎ ওদের ভাবী বা আমার বউ। রাঁধতে জানে ছোট চিংড়ী মাছ আর পানিকচুর লতি। কিছুটা এরকম। প্রশংসা করে আরকি।”
সাফা ভ্রু উঁচিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো, “আর উঠানখাসি মানে?”
“কুকুর।”

মিন্টু আপাতত নয় নম্বর বিপদ সংকেতের আওতায়। রূমী ওকে লুকিয়ে রেখেছে। মিন্টু মাঝেমাঝে ওকে ফোন করে আবহাওয়ার সংবাদ জানতে চাইছে। প্রিয়া কোমড়ে হাত দিয়ে বলছে, “তোকে কুত্তা খাওয়াবো, কুকুর না তোরই কিমা বানাবো।”
“স্বামীর সঙ্গে এভাবে কথা বলা ঠিক? কোরান হাদীস পড়ো, বউ।”
“শুধু নিজের ফায়দার বেলায় কোরান হাদীসের কথা মনে আসে?”

**
শ্বশুরবাড়ি ছিমছাম। কাঁদতে কাঁদতে গাড়িতে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো সে। অর্পাও তার কান্না দেখে কেঁদে ফেলল। রূমীকে তো দেখাই যায়নি। মারওয়াকেও না। নতুন জায়গায় এসে ওর সব অপরিচিত লাগছে। শ্বশুরালয়ে এসে প্রথম পড়লো শ্বাশুড়ির সামনে, “হায় আল্লাহ! মেয়েটার কী অবস্থা। দেখি সর সর।”
জহিরকে সরিয়ে দিয়ে সাফার গহনা খুলে দিলেন তিনি। সুতি একটা শাড়িও পরিয়ে দিলেন। এরপর বিছানা করে দিয়ে বললেন, “ঘুমাও, মা। কেউ আসবে না এখানে।”
সাফাকে পুতুল বউয়ের মতো ঘুম পাড়িয়ে তিনি বাইরে এলেন। এসে অবাক হয়ে দেখলেন ছেলে সেজেগুজে ঠায় বসে আছে। অসহায় গলায় বলছে, “আম্মা, আমার বউ কই?”
— “বউ কই মানে? বউ ঘুমাচ্ছে। ছোট্ট একটা মেয়ে। তোকে ভয় পাবে।”
জহির অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকালো, “আম্মা, আমি তোমার ছেলে। উনি আমার বউ।”
— “উনি উনি করছিস কেন? তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে মেয়েটা বুড়া মহিলা।”
জহির কিছু বললো না। লজিং হিসেবে ছোটবেলায় তাদের বাড়িতে এক হুজুর ছিলেন। তিনি স্ত্রীকে আপনি করে বলতেন। কিশোর মনে কি যে গেঁথে গিয়েছিলো তখন। ওয়াদা করে ফেলেছিলো আপনি করে বলবে ভবিষ্যৎ স্ত্রীকে।

সাফা সত্যিই ঘুমিয়ে গেছে। ওর মতো বোকা মেয়ে এই পৃথিবীতে আছে কিনা সন্দেহ। জহির মন খারাপ করে বারান্দায় বসে রইলো। মস্ত বড় থালার মতো চাঁদ। এত ভালো লাগছে দেখতে। ধ্যাত! ঘরে চাঁদ রেখেও পরের চাঁদ দেখতে হচ্ছে। বিরক্তিকর। অন্ধকারে হাঁটার শব্দ হচ্ছে। সাফা চোখ কচলে কিছুক্ষণ থম মেরে দাঁড়িয়ে রইল, “আমার বিয়ে হয়ে গেছে?”
জহির কি বলবে ভেবে পেলো না। সাফা গরাদে হাত রেখে অবাক গলায় বলল, “আরে! কী সুন্দর চাঁদ! চলেন আমরা বাইরে যাই?”
রাত একটায় বাইরে! তবুও সদ্য বিবাহিত রমণীর নাকের উপর জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা নাকফুলের দিকে চেয়ে মানা করে গেলো না। ওরা সত্যিই বেরুলো। ঠান্ডা ঝিরিঝিরি হাওয়া বইছে। সাফা হাঁটছে নেচে নেচে। ওর চুড়িগুলো টুংটাং করে বাজছে। সে গুনগুন করছে সকাল থেকে শোনা সেই গান, “তুমি ফজর হলে আলতো করে ভেঙে দিও ঘুম…”
জহির ওর হাত মুঠোয় টেনে নিয়ে বলল, “এভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে হাঁটলে যাওয়ার সময় খোঁড়া বউ নিয়ে যেতে হবে। এরপর না আমাকে বলবে বালিকা বউ নিয়ে কোন দুঃসাহসে আমি বের হলাম। আমাকে তো অপহরণের মামলা দেওয়া উচিত।”
সাফা হেসে উঠলো।

সে নিবিষ্ট মনে কি যেন ভাবছে। জহির বলল, “কী ভাবছেন?”
ও খেয়ালই করলো না ওকে আপনি করে বলা হচ্ছে। সে ভাবুক গলায় বলল, “আমরা যখন তিনজন একসাথে ঘুমাতাম? ভাবী, আমি, মারওয়া? তখন ভাবী আমাকে বলেছিলো, কেউ যদি কারো ভালোটুকু জানে, তাহলে সে তার প্রেমে পড়ার সম্ভাবনা প্রবল। আবার কেউ যদি কারো শুধু খারাপ টুকু দেখে, তাহলে মনে হয়ে এর চেয়ে জঘন্য মানুষ এ পৃথিবীতে নেই! আর আমাদের ভালো খারাপ মিলিয়ে যারা আমাদের সাথে থাকে, তারাই কেবল আপন মানুষ। ভালোবাসার মানুষ হতে পারে।”
জহির মাথা নাড়িয়ে বলল, “সুন্দরই বলেছেন তিনি। বেশ থটফুল।”
সাফা হঠাৎ জহিরের চোখে চোখ রাখলো। জহিরের বুক ধ্বক করে উঠলো। কী সুন্দর চোখ! শুভ্র ভেজা হাসনাহেনার মতো পবিত্র যার দৃষ্টি! তার মিষ্টি কন্ঠ গানের মতো বাজে, “আমি চাই আপনিও আমার তেমন কোনো আপন মানুষ হয়ে যান।”
জহির মনে মনে কেবল ভাবতে লাগলো, কোন সে পূন্য আমি করেছি যে জন্য আল্লাহ এমন কাউকে মিলিয়ে দিলেন!

***
“আজ আমি আমার শেষ ডায়েরীর শেষ দিনলিপিটি লিখছি। মাঝে কতকি ঘটে গেলো! কিছু টুকে রাখা হয়েছে, কিছু হয়নি। কিছু কিছু বিষয় এত সংক্ষিপ্ত করে লিখেছি, এখন পৃষ্ঠা উল্টে মনে করার চেষ্টা করলে বোধ হয় ব্যর্থ হবো। এ ডায়েরী আমার বৃষ্টি সমান চঞ্চলতার নিরব স্বাক্ষী। আমাকে আমার হয়ে বড় হতে দেওয়া সবচে ভালো সঙ্গী। কিন্তু এক ডায়েরী আর কত দিন? অষ্টাদশে পা দেওয়া আমার এই পাঁচ বছরের পুরোনো ডায়েরীটা অবশেষে আয়ুর শেষপর্যায়ে পৌঁছুলো।

আরিব এসেছে। সে গল্পের গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তি নয়। তবুও জোর করে ঢুকতে চাওয়ায় তাকে নিয়ে অনিচ্ছা স্বত্তেও লিখতে হয়। আরিবকে যদি আমি এখন বিয়ে করে ফেলি, তখন একটি জটিল সমস্যায় পড়ে যাবো। সবাই মনে করবে, আমাদের বহুবছরের প্রেম ছিলো। লোকমুখে এতটুকু গল্প যখন রঙচঙ মাখিয়ে উপন্যাস রূপে আমার ছেলেমেয়ে শুনবে, তখন তাদের কাছে দেখানোর মতো মুখ আমি খুঁজে পাবো না। আরিবের সঙ্গে কোনোকালেই আমার কোনো প্রেম ছিল না। তবুও জোর করে এই অপবাদ স্বেচ্ছায় তুলে নেওয়া কী ঠিক হবে?

আবার না করে দিলেও আমি বিপদে পড়ে যাব। সবাই আঙ্গুল আমার দিকে তাক করে বসে থাকবে। একটা মেয়ের জন্য যখন একটা ছেলে উপার্জনক্ষম হয়ে আসে, পরিবারকে মানিয়ে নেয়, তখন স্বভাবতই সে ছেলের প্রতি সকলের একটা মায়া কাজ করে। ছেলেদের ভালোবাসার মূল প্রকাশ সম্ভবত দ্বায়িত্ববোধে। যাহোক, আমি সে নিয়ে একেবারেই কৌতুহলী নই।

আমি আরিবকে একটা প্রশ্ন করব বলে ঠিক করেছি। ঠিক প্রশ্ন নয়, উদ্দীপক। প্রশ্নটা করবে সে। তার প্রশ্নটা যদি আমার মনমতো হয়, তবে আমি এসবকিছু না ভেবেই বিয়েটা করব। আর মনমতো না হলে যতদিন মনমতো উত্তর কারো থেকে না পাচ্ছি, ততদিন বিয়েই করব না।”

আরিব এলো উপরে। ছেলেটা খুব খুশি। চোখে মুখে বাড়তি আনন্দ উপচে পড়ছে। এখন বর্ষাকাল। হুটহাট বৃষ্টি ঝরে। আকাশে মেঘের ভয়ংকর গর্জন। মারওয়া মন খারাপ করে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে। ও অভিনয় করবে বলে ভেবেছিলো। কিন্তু এখন সত্যি সত্যি মন খারাপ লাগছে। আরিব উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “কী হয়েছে?”
— “আজকে আমার মন ভালো নাই। আপনি কী অন্য কোনোদিন আসতে পারেন? তখন কথা বলব।”
আরিব মাথা দুলিয়ে চলে যাবে বলেই ভাবছিলো। হঠাৎ একবার পেছন ফিরে বলল, “কেন মন খারাপ জানতে পারি?”
মারওয়া না করলো। জানতে পারবে না। অনেকদিন পর হঠাৎ ‘তুই’ করে বলতে ওর ভালো লাগছে না। আরিব মাথা হেলিয়ে সিঁড়ির কয়েক ধাপ পার করে আবার ফিরে এলো। বলল, “খুব বেশি মন খারাপ হলে সবচেয়ে প্রিয় কাজটি করা যেতে পারে। আমি সবসময় ঘুরে বেড়াই পছন্দের জায়গাগুলোতে। পরে মনে হয়, আরে! আমার তো মন খারাপ ছিলো।”
অবান্তর একটি পরামর্শ মনে হলো মারওয়ার। সে বিরক্তি চ শব্দ করে বলল, “আপনি যান তো। মেয়েদের মন খারাপ আর মুডসুয়িং এত পাত্তা দিতে হয় না।”
আরিব চলে গেলো। সারাদিন সে ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে লাগলো। রাত দশটায় সে মারওয়ার নাম্বারে একটা ম্যাসেজ করলো, “তোমার কথাটা নিয়ে আমি সারাদিন ভেবেছি। একটা কথায় তুমি নিজেই নিজেকে ছোট করলে। তোমার প্রশ্নের উত্তর আমি পেয়েছি।”

“প্রশ্ন এবং উত্তরটা আমি গোপন করেই রাখছি। ডায়েরীতে যাপিত জীবনের সব গল্প লিখে রাখতে নেই। দূর্বলতা বাড়ে। আমাদের প্রতিটি স্মৃতি লিখে রাখবার জন্য যে কেরামান কাতেবীন ভর করে আছে কাঁধে। একপাক্ষিক বিবৃতি দিয়ে এই ডায়েরীটি এখান সমাপ্ত হলো। আরিবের সঙ্গে আমার বিয়েটা হয়েছিলো। ভাববেন না, টাকা হয়েছে বলেই বিয়েটা করেছি। সৌদি আরবে যে এখন স্বর্ণের খনি পাওয়া যায় না, তা সবাই জানে। আমি বিয়ে করেছি উত্তরের দায়ে। বেচারাকে কথা দিয়েছিলাম উত্তর ঠিকঠাক পেলে আমি রাজি হব। ওর আমার “আপনি আজ্ঞে” করা হজম হচ্ছে না। এজন্য তুই তুকারি শুরু করেছি আবার। এবার বিশ্বাস হয়েছে।”

কোনো শ্রাবণের দিনে মারওয়ার দাদী মারা গেলেন। বুকের ভেতর উপচে উঠা কান্না নিয়ে সে ছাদে দাঁড়িয়ে রইলো। আরিব ওর পাশে দাঁড়ালো বিনা বাক্য ব্যয়ে। কোনো অযাচিত স্বান্তনা ছুঁড়তে গেলো না। মারওয়াকে সে প্রথমবারের মতো কাঁদতে দেখলো। আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে রাখা ছাড়া সে কিছুই করতে পারলো না। মারওয়ার মনে পড়ে গেলো সেদিনের বৃষ্টিবিলাসের স্বপ্নটার কথা। খোদা তা’লা আমাদের জীবনে কিছু দেন আর কিছু কেড়ে নেন। তকদীরের মতো সুস্পষ্ট সত্য আমরা মানতে পারি না। তবুও পেছন ফিরে তাকালে মনে হয়, “আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য। আমরা তাঁর কাছ থেকে এসেছি, আর তাঁর নিকটই আমার প্রত্যাবর্তন।”
বাতাসে মন খারাপের ঘ্রাণ। আজকে আমার মন ভালো নাই, আজকে আমার মন ভালো নাই, খবরের নিঃশব্দ বিজ্ঞপ্তি শহর জুড়ে। গল্পটি এখানে সমাপ্ত করা ছাড়া উপায় নেই। মারওয়া ডায়েরীর শেষ পাতায় দাগ টেনে লিখলো, “And the story of my sweet sixteen ends here…”।

পরিশিষ্ট :
বিশ্ব গাধা দিবসে অর্পা তার স্বামীকে মেনশন দিয়ে লিখলো, “কিছু মনে করবেন না। কেন জানি আপনার কথাই স্মরণে আসলো প্রথমে।”
এক ঝাঁক হাহা পড়েছে। রূমী দেখলো, কিছু বললো না। এমনিতেই কালভাদ্রে ফেসবুকে আসে, তাও অর্পার জ্বালায় শান্তি নেই। সে নাকি বিয়ে করেছে কেবল পোস্টে মেনশন দেওয়ার জন্য। বিয়ের আগে মেনশন দেওয়ার মানুষের অভাববোধ হতো।

সাফা নতুন নতুন নোয়াখালীর ভাষার শেখার চেষ্টা করছে। ঘোমটা টেনে লাজুক পায়ে হেঁটে এসে সে জহিরের কানে কানে বলল, “আঁই আন্নেরে বালোবাসি। এক্কেরে জান জান হরান দি। হাছা কইর।”
জহির অদ্ভুত স্বরের এই কথা শুনে হাসতে হাসতে কাত হচ্ছে। এই ছেলের হাসি এত সুন্দর!

অনেকদিন পর মারওয়া তার ডিএক্টিভেট প্রোফাইলটা ওপেন করলো। “Marو Rahman updated her profile picture” শিরোনামের পোস্টটি ছাড়া বর্তমানে কোনো পোস্ট মজুদ নেই। তার কাছে ফেসবুকে অলস অলস লাগে। এত রোবোটিক জীবন তার পছন্দ না। সে মূলত ফেসবুকে এসেছে রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস বদলাতে। অকারণেই তার এই ইচ্ছাটা করছে। সে গট ম্যারিড স্ট্যাটাস দিয়ে ক্যাপশনে লিখলো : “যার কাছ থেকে শয়তানি ওসওয়াসা ভেবে পালাতাম, এখন সওয়াবের আশায় তার পা টিপে দিতে হয়।”

আরিব সেখানে মন্তব্য করেছে, “কখন পা টিপে দিয়েছিস? কত বড় অপবাদ পাবলিক প্লেসে!”
মারওয়া প্রতুত্তরে লিখলো, “টাইপিং মিস্টেক হয়েছে। ওটা পা’ এর জায়গায় গলা’ হবে।”

সমাপ্ত।

আজকে আমার মন ভালো নাই পর্ব-১৪+১৫

0

আজকে আমার মন ভালো নাই।।
নাহিদা সানজিদ।।

১৪.
প্রিয় অর্পা,
তোমাকে আজ একটা সত্য কথা বলে ফেলি। প্রিয় মানুষকে ধোঁয়াশায় রাখা কষ্টের। গোপন কথা মনে চেপে না রেখে ফরফর করে বলে দেবার জন্যই আমরা হন্য হয়ে নিজের মানুষ খুঁজে ফিরি। সেখানে এত বড় একটা ঘটনা কীভাবে চেপে রাখি? আমার দমবন্ধ লাগতে শুরু করেছে। ধরতে পারো অপরাধের বিবৃতি। একপাক্ষিক মনে করে কিছুটা সন্দেহ কোরো।

বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন একটা মেয়েকে আমি প্রচন্ডরকম ভালোবেসে ফেলি। মেয়েটা ছিলো ক্লাসের অন্যতম সুন্দরীদের একজন। সুতরাং কেন ভালোবাসলাম জিজ্ঞেস করে লজ্জা দেবেনা আশা করি। কিন্তু সমস্যা ছিলো তখন আমার বয়স ঊনিশ। চাকরিবাকরি নেই। আম্মা গালি-গালাজ করে বিয়ের পোকা বের করে দিলেন। আমার বাবা মেয়েটার হাত চাইতে গিয়েছিলেন তাদের দুয়ারে, বেকার ছেলের কাছে নাকি মেয়ে দেওয়া হয় না। আধুনিক যুগের নিয়ম। মেয়েটার সেবছরই বিয়ে হয়ে গেলো।

আমি অভিমানে বইয়ের সঙ্গে ঘর সংসার শুরু করলাম। আমার সহজ সরল সঙ্গী হলো হুমায়ুন আহমেদের একটি বিখ্যাত চরিত্র হিমু। হিমু-রূপা নিয়ে অনেক রোমান্টিসিজম এ যুগে প্রচলিত হলেও, আদতে হিমু ছিলো একা। আমার মধ্যে বৈরাগ্য চলে আসলো হিমুতে ডুবে থাকার কারণে। ঠিক করলাম, আমিও মহাপুরুষ হতে চাই। কিন্তু আমি হলদে পাঞ্জাবি পরে হাঁটবো না শহরের এমাথা থেকে ওমাথা। আমি হতে চেয়েছি ঘরকুনো। সাদা পাঞ্জাবি পড়ি শুভ্রতার প্রতীক হিসেবে, সবুজও পড়ি মাঝেমাঝে। আমার এই মহাপুরুষ হবার যাত্রা বেশিদিন টিকলো না। হিমুর বাবা হিমুকে মহাপুরুষ বানাতে চেয়েছিলেন, আমার বাবা নয়। আমার বাবা চেয়েছেন, আমি হই পৃথিবীর সহজ সরল ছেলে হই যে জগতের কুটিলতা নিয়ে তেমন ভাবে না। যার মন হবে শিমুল তুলার মতো নরম, অল্প দিনেই ভালোবেসে ফেলবে বাবার ঠিক করা পুত্রবধূকে। আমার ধারণা বাবা আমাকে খুব ভালোমতোই চেনেন। তার ষড়যন্ত্র সফল হয়েছে।

চিঠি আর বেশি বড় করলাম না। এই আধুনিক যুগে চিঠি দেওয়ায় আদিম গন্ধ ভাসে। আমি বিশ্বাস করি ভালোবাসা ঐশ্বরিক একটি বিষয়। আদম আলাইহিস সালাম একা বোধ করছিলেন বলে হাওয়া আলাইহাস সালামকে সৃষ্টি করা হয় তার বুকের পাঁজর থেকে। এর চেয়ে চমৎকার উদহারন এ মুহুর্তে মাথায় আসছে না। ইঞ্জিনিয়ারিং আমার জীবন শুকনো তক্তার মতো বানিয়ে ফেলেছে, আমি প্রায়ই ভাবি মরে যাই, তাই ভালো। এত জঞ্জাল আর সহ্য হয় না।

তখন আমি তোমার মুখ মনে করার চেষ্টা করি। তুমি আমার ভালো সময়ে বিরক্ত করতে থাকো, আর খারাপ সময়ে বলো, “ইব্রাহীম সাহেব, জীবনে কত কত বড় বড় ব্যাপার সামনে পড়ে আছে। আপনি ছোট্ট একটা ইঞ্জিনিয়ারিং এর ডিগ্রী নিয়ে মাথাব্যথা তুলে ফেলছেন? আপনি বরং এসব ছেড়ে চলে আসুন, আমরা কৃষিকাজ শুরু করি। এরচেয়ে চমৎকার জীবন আর হয় না। মানুষ কামলা বলে ডাকবে, ব্যাপারটা মাথায় রাখবেন। তাতে কী? ইঞ্জিনিয়ারদেরও আজকাল লোকে ‘ভাতে মরা’ বলে ডাকে।”
তোমার একই সঙ্গে কুযুক্তি এবং সুযুক্তির প্রেমে আমি আবারও পড়বো, সব ছেড়েছুড়ে চলে আসতে চাইবো।

হঠাৎ আমার খুব চিঠি লিখতে ইচ্ছা করেছে। তুমি কবে যেন একবার বলেছিলে, মন খারাপ হলে তুমি মন দিয়ে চিঠি লিখতে ভালোবাসো। আজকে আমার মন ভালো নেই একেবারেই। তোমাকে চিঠি লেখার ছাড়া মন ভালো করার আর কী উপায় হতে পারে? আরো হাজার হাজার উপায় থাকলেও আমি তোমাকেই লিখব, পরম নির্ভরতায় দিয়ে দিচ্ছি আমার সকল মন খারাপ বহনের ভার। স্বামী হিসেবে আমি মন্দই, তুমি সত্যি বলেছিলে।

শেষে একটা প্রশ্ন জুড়ে দিচ্ছি, পৃথিবীতে আমার প্রতিনিয়ত কত মানুষের সঙ্গে দেখা হচ্ছে, গল্প জমছে টুকরো টুকরো, বাড়ছে আমার আত্মজীবনীর দৈর্ঘ্য। তবুও আমার কাছে কেবল তোমার এবং আমার গল্পটুকুই গুরুত্বপূর্ণ কেন? অল্প কটা স্মৃতি নকশীকাঁথায় পুরোনো গৃহবধূদের মতো ফুটিয়ে রাখতে চাইছি বারংবার, যেন এইটুকুর জন্যই আমি আমার সারাটি জীবন অপেক্ষা করে ছিলাম। চিঠি বড় করব না করব না বলেও এত বড় হয়ে গেলো, স্বামী হিসেবে আমি কী মিথ্যেবাদীও?

ইতি,
তোমার মন্দ স্বামী।

**
আজ হঠাৎ একজন ম্যাম অর্পাকে দাঁড় করিয়ে বললেন, “চাকরি বাকরি করার কী কিছু ইচ্ছা আছে? নাকি স্বামীর ঘাড়ে বসে বসে খাওয়ার স্বপ্ন দেখছো?”
এভাবে বলার কারণ আছে। এবারের সিজিপিএ থ্রি পর্যন্ত আসেনি। পরপর ভালো রেজাল্ট করার কিছু নেতিবাচক দিক আছে। এটা তার মধ্যে একটা। লোকে ভেবে বসেই থাকে, সে কখনো খারাপ করতে পারবে না।
নতুন ফোন কেনার টাকা নেই। হয়ত রুমিও তাগিদ অনুভব করে না কথা বলার। কেমন যেন শীতল সম্পর্ক যাচ্ছে তাদের। অজান্তেই ভারী মন খারাপ হতে শুরু করলো। ক্যান্টিনের চেয়ার টেবিলে বসে তিন টাকায় কেনা একটা নীল রঙা কাগজে চিঠি লিখতে শুরু করলো। অনেকক্ষণ ভেবেও কোনো সম্বোধন খুঁজে পেলো না। শেষে সম্বোধন ছাড়াই লিখলো –

“আজকে আমার একটি অহেতুক কারণে মন খারাপ। আমি বেশিক্ষণ মন খারাপ করে থাকতে পারি না। মন খারাপ টানা জমিয়ে রাখতে নেই। বাতাসে উড়িয়ে দিতে হয়। আমি তাই একটা চিঠি লিখছি। আমার চিঠি লেখার মানুষের খুব অভাব, একান্ত নিরুপায় হয়ে আপনাকে লিখলাম। আবার অন্যকিছু ভাববেন না। আপনি স্বামী হিসেবে অত্যন্ত মন্দ প্রকৃতির মানুষ, আপনার অভাববোধ করার তো প্রশ্নই আসে না। যাইহোক, কাজের কথায় আসি। ইদানীং আমার মনে হচ্ছে,

আমাদের সবকিছু কেমন যেন বাধা ধরা নিয়মই। কেউ বলে, ধর্ম নারীদের আটকে রেখেছে। কিন্তু, আমার প্রশ্ন হলো, তারা নিজেরা কী আটকে রাখেনি? আমার স্বামী যদি আমার পূর্ণ দেখভাল করে, আমার যদি একটা ব্যস্ত সংসার থাকে, আমি কেন নিজের ওপর ডাবল চাপ নিয়ে কাজ করতে যাবো? ইটস টোটালি মাই চয়েস। হু আর ইউ টু জাজ মি? অর্থনীতি এত এত মতবাদ, একেকজনের একেক মত, তার আবার সমালোচনা। তার মানে কী? তারা কেউই পুরোপুরি সঠিক নয়। আসলে, আমার মনে হয় ভুল ভ্রান্তি ছাড়া মানুষ হতেই পারে না। আমরা কেউই নিজেদের চিন্তা ভাবনার একশ পার্সেন্ট ভরসা দিতে পারিনা, এক্সেপশন ইজ অনলি আওয়ার ক্রিয়েটর,আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা, যদি আমরা বিশ্বাসী শিবিরের কেউ হয়ে থাকি। আপনারও মনে হয় একজন গৃহিণী মা কিংবা স্ত্রী ঘরে কেবল বসেই থাকে? তাহলে টাকা খরচ করে বুয়া কেন রাখা হয়? মায়ার একটা দরদাম করুন তো দেখি! বলে দিন, এত এত দামে যত্ন পাওয়া যায়, ভালোবাসা পাওয়া যায়। যে ভালোবাসা দাম দিয়ে কেনা, সে কী আদোও ভালোবাসা?

পুঁজিবাদ অর্থনীতি পড়তে গিয়ে ক্লাস নাইনেই আমার অর্থনীতির প্রতি একটা বিরূপ ধারণা চলে এসেছিলো। আমাদের খাতায় দাগাতে হতো, মায়ের কাজ একটি অ-অর্থনৈতিক কাজ, বাজারমূল্য নেই। একটাবার ভেবেছেন? যদি মায়েরা বাসায় না থাকতো, স্কুল থেকে ফিরে এত এত গল্প আমি কাকে শোনাতাম? আমার ছোট্ট মনের অনর্থক বলে যাওয়া অনর্গল সব আকথা-কুকথা। পৃথিবীতে সবকিছু মানুষের চিন্তায় মাপলে আমরা নিজেদের অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলবো। জগতে সবকিছু নিক্তি দিয়ে হিসাব কষতে নেই।

এই যেমন ধরুন, আমি আর আপনি? আপনি আমায় বিয়ে না করলেও পারতেন। একটা বড় অঙ্কের আয় হয়। একা একাই আয়েশে ঘুরতে পারতেন। বউ বাচ্চার ভার নিতে হতো না। জমাতে পারতেন। তবুও আমি থেকে আমরা হলাম। চোখ বন্ধ করে ধর্মীয় বিধান পালন। বিশ্বাস করছি আরশে আজিমে থাকা কাউকে। আমরা সারাদিন কথা বলছি না। একে অপরের উপর বিরক্ত থাকি। মাঝেমাঝে মনে হয়, এত খারাপ মানুষ আমি আমার জীবনে দেখিনি। তবুও ভাবছি, আমার কেউ একজন আছে। তিন অক্ষরের একটা শব্দ “কবুল” বলে ফেলার পরপর জীবন উল্টেপাল্টে যাচ্ছে, তবুও মায়া হচ্ছে না। মনে হচ্ছে, যা হচ্ছে ভালো।

এই যে অর্থনীতির হিসাব নিকাশের বাইরে গিয়ে আমরা একে অপরকে নিয়ে ভাবছি, এর চেয়ে প্রশান্তির বিষয় সম্ভবত পৃথিবীতে নেই।
“আমি আপনাকে ভালোবাসি” বলাটা কী খুব গুরুত্বপূর্ণ? নিরবতার আবেদন, মনে মনে কথোপকথনের স্নিগ্ধতা, প্রকাশ করলে থাকে না বলেই আমার ধারণা।

শীঘ্রই বাসায় আসবেন। আমাকে কখনো ভুল করেও “নীরা” বলে ডাকবেন না। আমি অর্পা। পৃথিবীর সবচেয়ে অসুন্দর একজন রমণী। আমার চোখের পানে চেয়ে নির্দ্বিধায় মিথ্যা বলা যায়।
ইতি,
ভুলবশত, আপনার বউ।

প্রথমটুকুতে ম্যাডামের উপর রাগগুলো ঝেড়েছে সে। শেষটুকুতে তার রাগের মোড় ঘুরে অন্যদিকে চলে এসেছে। কোনদিকে সে ঠিক জানেনা। বলতে ইচ্ছা হয়েছে, তাই বলেছে। রিভিশন দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না। তখন আবার ইচ্ছা করবে, চিঠি কুটিকুটি করে ডাস্টবিনে ফেলে দিতে।

চিঠি পোস্ট করে এসে হেলেদুলে সড়ক ধরে হাঁটতে লাগলো। কয়েকবার সে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো। এমনও তো হতে পারে রুমি তার পাশাপাশি হাঁটছে, বিনা নোটিশে চলে এলো। অর্পা আবদার করলো রিকশায় ঘোরার। লোকাল বইয়ের দোকানগুলো দেখে দামদামি করে কয়েকটি বই নিলো। আইসক্রিম খেতে খেতে বাসায় ফিরলো, সবার জন্য নিলো শ খানেক টাকার ঝালমুড়ি। মানুষ কল্পনায় সুন্দর করে বাঁচে। ভাবতে মন্দ লাগে না। বিবাহিত জীবনের কতদিন পেরিয়ে গেলো দিনক্ষণ গুনে রাখা হয়নি। আমাদের একসাথে কতকিছু করা বাকি —র তালিকা অপ্রতিরোধ্য হারে বাড়ছে বই কমছে না।

সে ভাবছে একটা লিস্ট করে ফেলবে, “কোন কোন জায়গায় মা আমাকে বিয়ের পর যেতে বলেছিলেন” শিরোনামে।
রুমিকে পড়ে শোনাবে। মারওয়া টিপিক্যাল ননদের নকল করে বলবে, “যা ঘুরেছেন বিয়ের আগে। ধেই ধেই করে মুখ উঠিয়ে ঘুরতে চলে যাওয়া, এ বাড়ির নিয়ম কানুনে নেই।”
অর্পা হেসে বলবে, “তাহলে আমাকে এবার নিয়ম সংশোধন করতে দাও। সবাই মিলে ধেইধেই করে যাবো, তোমাকে বিয়ে দিয়ে তোমার স্বামীকে সহ নিয়ে যাবো।”
মারওয়া ঠোঁট বাঁকাবে তার চিরায়ত নিয়ম মেনেই, বিবাহের মতো মরণ ফাঁদে সে জড়াতে চায় না।

চলবে ~

আজকে আমার মন ভালো নাই।।
নাহিদা সানজিদ।।

১৫.
“কীইইই! ৩৪ বার রিজেক্ট! তুই বলতি, একেবারে হাফ সেঞ্চুরি শেষ করে আসুন। এরপর দেখা যাবে।”

সাফা-মারওয়া ব্যাগপত্র গুছিয়ে অর্পার ঘরে শিফট করেছে। তাদের কিছু জরুরি বিষয়ে শলাপরামর্শ করা দরকার। আর এজন্য একজন বিবাহিত রমণী উত্তম সমাধান। সাফা কিছু কিছু ঘটনা বললো আর কিছু এড়িয়ে গেলো সন্তর্পণে। মারওয়ার কথা শুনে অর্পা হেসে ফেললো। সে সাফার মাথায় তেল দিয়ে দিচ্ছে। সিঁথি কাটতে কাটতে বলল, “আমার মনে হচ্ছিলো ছেলেটা খুব সাদাসিধা, কিন্তু বোকা না।”
মারওয়া ভ্রু কুঁচকে চেয়ে রইলো। সাফার দাদী ছেলে একদমই পছন্দ করেননি। তিনি প্রথমবারেই বলে বসলেন,
“না না। ছেলে কালো হইলে সমস্যা। নাতিপুতিও কালাছালা হবে। আমার নাতিনের কী ছেলের আকাল নাকি?”

বিয়েকে পবিত্র জিনিস বলা হলেও আদতে তা যে কদর্য ব্যাপার দ্বারা পরিপূর্ণ সাফার বুঝতে খানিকটা সময় লাগলো। কেউ যে কাউকে ভালো লাগলেই চট করে বিয়ে করে ফেলতে পারে না তা কখনো তার মাথায় আসেনি। পারিবারিক মহলে দুই পক্ষের সমস্ত খুঁত মেলে ধরে দর কষাকষিতে বিয়ের পবিত্রতা কোথায় মিঁইয়ে যায় মানুষ বুঝতেই পারে না। যতবারই জহিরের প্রসঙ্গ উঠছে, ততবারই স্মরণ করিয়ে দেওয়া হচ্ছে তার গায়ের রঙ। সাফার খুব খারাপ লাগছে লোকটার জন্য।

কেউ কী নিজেকে নিজে তৈরি করেছে? আর কোথাকার কে সাদাকে সুন্দর আর কালোকে অসুন্দরের মানদণ্ড হিসেবে সেট করলো? তার মানদণ্ডই বা কেন সকলকে মেনে চলতে হবে? শরীরে কেবল মেলানিনের উপস্হিতি অনুপস্থিতি দুটো মানুষকে এভাবে কেন আলাদা করে দেয়?
অর্পা সাফার বিমর্ষ মুখ খেয়াল করে মারওয়াকে ইশারায় বললো যেন কিছু না বলে আর। এখন বর্ষাকাল চলছে। যখন তখন বৃষ্টি। সাফা কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে গেল। কি যেন ভাবছে একমনে। মারওয়া পড়ছে। দিনদিন পড়াশোনার প্রতি সিরিয়াস হচ্ছে সে। অর্পা সাফার কাঁথার ভেতর ঢুকে গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো এক হাতে, “সাফা.?”
“হুম?”
“তোমার কী ছেলেটাকে খুব পছন্দ?”
সাফা কিছু বলল না। অর্পা আবার বলল, “তোমার যদি ওকে খুব বেশি ভালো লাগে, তাহলে আমি বাবা-মার সঙ্গে কথা বলব। ছেলে ভালো হলে তো কোনো ঝামেলাই নেই। আমরা খোঁজখবর নিয়ে দেখব।”

**
রূমীদের অনার্স প্রায় শেষের দিকে। আজকে একটা বিশেষ দিন। জুমা বার। মিন্টু আজকে বিয়ে করতে যাচ্ছে তার সেই কথায় কথায় বিচ্ছেদ করে ফেলা প্রেমিকাকে। একজন পুরুষবাদী ও একজন কট্টর নারীবাদীর সংসার কেমন হবে তাই দেখার বিষয়। রূমী অবশ্য কোর্ট ম্যারেজের পক্ষপাতী না। বাবা-মাকে মানিয়ে দিতে বলায় মিন্টু তাকে গালি দিয়েছে। মিন্টুর প্রেমিকার যে জায়গায় বিয়ে হচ্ছিলো সে ছেলে মদ্যপ, অতি বড়লোকের উগ্র ছেলে। আপাতত তাই তার মদ্যপের চেয়ে সিগারেটখোর জামাই বেশি শ্রেয় মনে হচ্ছে। মিন্টুর প্রেমিকার নাম প্রিয়া। আপাতত প্রিয়া আর সে একটা রেঁস্তোরায় বসে আছে।

রূমী বারবার ফোন দিয়ে বিরক্ত করছে,
“হ্যালো বন্ধু! বিয়ে শাদী কইরো না। নারী একটা আজাব। তুমি তো জানো মিয়া।”
মিন্টুর কাছে টাকা কম। সে ফিসফিস করে বলল, “এই শালা! কয়ডা টাকা বিকাশে দে। আর্জেন্ট।”
রূমী হেসে ফেলল, কিন্তু বুঝতে দিলো না, “না মামা। কিয়া কও এডি? বেডি মানুষেরে খাওয়ানোর জন্য টাকা দিমু?”
মিন্টু নিজের কথা বলার স্বাধীনতা রদ করছে, প্রিয়া গালিগালাজ করা একেবারেই পছন্দ করে না। রাগ করে পরে বিয়ে না করলে সমস্যা।

ওর ফোনটা আবার বেজে উঠেছে। রূমী। দাঁতে দাঁত চেপে সে ফোন রিসিভ করলো। রূমী গম্ভীর গলায় বলছে, “মামা ফ্যামেলি প্ল্যানিং কিন্তু বুঝে শুনে করতে হইবো। বাচ্চা হবে জোড়ায় জোড়ায়। নয়ত ভাগ বাটোয়ারায় অসুবিধা হবে। একটা তুই পালবি, আরেকটা ভাবী। সমান সমান কন্ট্রিবিউশান। আবার, একটা ছেলে একটা মেয়ে হলে সমস্যা। মেয়েটা ভাবীরে দেওয়ার চেষ্টা করবি। মেয়েদের কসমেটিকসের যে দাম! ফাঁইসা যাবি। আর পোলা তোর মতো হইলে তো মাশাল্লাহ! একটা গেঞ্জি দিয়ে বছর কাবার।”
মিন্টু চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “তুই ফোন রাখবি?”
রূমী সরল কন্ঠে বলল, “এজন্য বলে মানুষের উপকার করতে নাই। শোন! বিল তুই অর্ধেক দিবি। বেডিদের খাওয়াইয়া দুই পয়সার দাম নেই, কয়দিন পরে দেখবি বলব, এই লোককে বিয়ে করাই আমার ভুল হয়েছে।”
ভাইব্রেট হয়ে ফোন কেটে গেলো আরেক দফা। রূমী পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছে। মিন্টু ফোন সাইলেন্ট করে ফেলেছে।

রূমী এসেছিলো চা খেতে। একটা ফুলের দোকানে ওর চোখ আটকে গেলো। বালতিতে রাখা তাজা গোলাপ। পথশিশুরা হয়ত রাস্তায় বিক্রি করতে বেরোবে। বেলী ফুলের মালা ঝুলছে একপাশে। আচ্ছা, অর্পা কী ফুল পছন্দ করে? ঠিক তখুনি ফোনটা বাজলো। বাবা কল করেছেন, “তুই কোথায়?”
— “এইতো আছি, কেন?”
— “যেখানে আছিস দাঁড়া। আমরা আসতেছি।”
— “আমরা মানে?”
বাবা ফোন কাটলেন। রূমী বিভ্রান্ত মুখে দাঁড়িয়ে রইলো। বাবা আসছেন, সঙ্গে একটা মেয়ে। অর্পা! রূমী কিছুক্ষণ অবাক হয়ে চেয়ে রইল। অর্পা ওর চোখের সামনে হাত নাড়ছে। হাসিখুশি কন্ঠে বলে, “কী হলো?”
রূমীর বাবা ছেলের কাঁধে চাপড় দিয়ে বললেন, “বউকে দেখে রাখিস। কাজে যাচ্ছি। মেয়েটা জোর করে চলে এলো।”
রূমীর বিশ্বাস করতে অনেকটা সময় লাগলো, এরপর বলল, “তুমি কী মনে করে এলে?”
অর্পা আবার হেসে ফেললো। একটা মানুষ এত কী করে হাসতে পারে? অর্পা হাসি চেপে স্বাভাবিক হওয়ার ভান করলো, “এমনি। বউকে দেখতে আসছেন না। ভাবলাম, নিয়ম উল্টে ফেলি। আজকাল সমান অধিকারের যুগ।”

রূমী এতক্ষণ চেয়ে থাকা বেলীর মালার একটা ব্যবস্হা করতে পারলো। দুটো মালা কিনলো সে। আর পাঁচটা গোলাপ। একটা মালা অর্পার হাতে পেঁচিয়ে দিতে লাগলো,“ভালো সময়ে এসেছো। চলো এক জায়গায় নিয়ে যাবো তোমাকে। ফ্রি-তে একটা সিনেমা দেখে চলে আসবে। হালাল সিনেমা।“
এসময়ই মিন্টু কল দিয়ে জানালো, ও মালা আনতে ভুলে গেছে। বিয়ের পর মালাবদলের জন্য তার এক্ষুনি দুটো মালা দরকার। নিয়ে যেন কাজী অফিসে চলে আসে। রূমী সম্মতি না জানিয়ে কুটিল গলায় বলল, “দুটো মালা কেন নিতে হবে? তোরটা তুই নিবি। বউয়ের টা বউ। সমান সমান অধিকার। নারীর সঙ্গে তোর এত দ্রুত হেরে গেলে কীভাবে হবে? সারাজীবন পড়ে আছে সামনে।”
মিন্টু তাকে গালি দিয়ে ফোন রাখলো। রূমী হাসি চেপে আবারও দুটো মালা কিনলো। অর্পার হাতে দিয়ে বলল, “চলো, বিয়ে খাবো।”
অর্পাও হাসছে, “এটা কী সেই মন্তুবাবা?”
রূমী মাথা নাড়ালো।

***
ওদের বিয়েটা হলো একেবারে সাদামাটা। প্রিয়া একটা জামদানি শাড়ি পরে এসেছে। মিন্টুর গায়ে রূমীর সাদা পাঞ্জাবি। বিয়ে শুরু হবার আগে রূমী ওর কানে ফিসফিসিয়ে বলল, “দেখিস, যত টাকা কাবিন, ততটাকা যৌতুক। নো ঠগবাজি। ফট করে দেখবি একদিন নারী নির্যাতনের মামলা খেয়ে বসে আছিস।”
অর্পা ওকে টেনে দূরে সরিয়ে আনলো। বিয়ের আগেই অলক্ষুণে কথা বলতে নেই। যা হয়েছে হয়েছে। নবদম্পতিকে তারা শুভেচ্ছা জানালো। স্বাক্ষীও হলো। আসার আগে রুম সাজিয়ে এসেছিলো অর্পা। ওদের বন্ধুদের ভাড়া করা একটা ব্যাচেলর বাসা। আজকের জন্য খালি করা হয়েছে।

প্রিয়া সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় মিন্টু হাত বাড়িয়ে দিলো। শাড়ি পড়ে ওর হাঁটতে অসুবিধা হচ্ছে। হিল জুতায় ফোসকা পড়ে যাচ্ছে। মিন্টু ধমকে বলল, “এসব জুতা পড়ারই বা কী দরকার?”
ফুটপাত থেকে একটা নরমাল জুতা নেওয়া হলো। অর্পা ওদের একা ছেড়ে দেওয়ার জন্য তাগাদা দিচ্ছে। মিন্টুর গানের গলা ভালো। ভরাট কন্ঠস্বর। সে খালি গলায় গাইলো,

“Well, I found a girl,beautiful and sweet.
Oh, I never knew you were the someone,
Waiting for me…
Cause, We were just kids when we fall in love,
Not knowing it was,
I’ll not give you up this time…”

রূমী যাওয়ার আগে ওকে আরেকবার কানে কানে বলে গেল, “ভাবীর জুতা ভাবী কিনবে। হুদাই টাকাডা খরচ করলি। যাইহোক সময়মতো টাকাটা দিয়ে দিস। মেয়ে হলে মাফ করে দিতাম।”
চোখ টিপে চলে এলো। অর্পা ওকে টেনে নিয়ে গিয়ে কৃত্রিম রাগ নিয়ে বলল, “মেয়ে হলে মাফ করে দিতাম মানে?”
রূমী ঠোঁটে আঙুল চেপে ধরলো, ”নো কমেন্টস। চলো বউ, ঘুরে আসি অজানাতে।”
বলে ওর কাঁধে হাত রাখলো। অর্পা কাঁধ থেকে হাত ঝাড়িয়ে রাগ করে বলল, “সব পুরুষ মানুষই এক। আমার আগেই বোঝা উচিত ছিলো।”

বলে সে একা একা হাঁটতে লাগলো। এই জায়গায় তার প্রথম আসা। তার আসলে তেমন রাগ লাগছে না। এমনিই মনে হচ্ছে, অনেকদিন রাগারাগি হয় না। ঝগড়াঝাঁটি করি কিছুক্ষণ। অদ্ভুত ক্রেভিংস। রূমী ওকে মানানোর চেষ্টা করছে। শ খানেকবার “সরি” ও বলা শেষ। অর্পা হাসি চেপে রাখছে কষ্ট করে। আজকের দিনটা অনেক প্রতিক্ষার ছিলো তার।

***
আজকের আবহাওয়ার সংবাদ বলছে, দিনটা রৌদ্রজ্জ্বল থাকবে। It’s a sunny day! রূমী নোটিফিকেশন কেটে একটা রিকশা ডাকলো। ভাড়া নিয়ে দরদামের ক্যাঁচালে গেল না। একদিন আগেও তার মন প্রচন্ড খারাপ ছিল। সব ছেড়ে ছুঁড়ে চলে যেতে মন চাইছিলো প্রিয়তমার শহরে। প্রিয়তমা আজ নিজেই এসে হাজির। অর্পার হাত ধরে ওঠালো। জীবনটা নদীর মতো টলমল নিঃশব্দে চলে যাচ্ছে। অর্পার রাগ ভাঙানোর মতো বড় বড় বোঝা প্রতিদিন বইতে হয় না। ও মাঝেমাঝে এও ভুলে যায় কি নিয়ে রাগ করেছিলো। এটা কিনব, ওটা কিনে দেন বলে মাথা খায়, কিন্তু দোকানের সামনে গিয়ে তাও ভুলে যায়। অর্পা এখন বলছে,
— “প্রেমের মতো আনরিয়েলিস্টিক ব্যাপার আর নেই, বুঝলেন?”
রূমী মাথা নাড়িয়ে বলল, “না, আপনিই বুঝিয়ে দিন, অর্পা ম্যাডাম।”
অর্পা হেসে ফেললো রিমঝিম বৃষ্টির মতো। ও হাসতে শুরু করলে অনেকটা সময় ধরে হাসতে থাকে। চোখে পানি এসে যায়। এত ভালো লাগে!

অর্পা হাসি থামায় খুব কষ্টে, “না। এ যেমন ধরুন, প্রিয়া আপু আজকে কী সুন্দর সেজেগুজে এসেছেন! বিয়ে করলেন! কদিন পর এই শাড়ির রঙ মলিন হবে। কাজের চাপে গুছিয়ে পরার মতো শখ তিনি করতে যাবেন না। তখনই চোখ থেকে প্রেমের চশমা খুলে যায় সবার। এতদিনের পরিপাটির প্রেমিকা চটচটে মুখ নিয়ে দরজা খুললে মেজাজ বিগড়ে যাবে। ছেলেদের কী বিশ্বাস আছে?”
রূমী ভ্রু কুঁচকে তাকালো। রাগ করেছে নাকি বোঝা যাচ্ছে না।
—- “তোমার সমস্যাটা কী বলো? আরেকজনের সংসারের মাথাব্যথা নিয়ে নিজের সংসারে অশান্তি করছো!”
অর্পা মাথা দুদিকে নাড়িয়ে মুখ টিপে হাসলো। এরপর রূমীর এক হাত জড়িয়ে ওর কাঁধে মাথা এলিয়ে দিলো, বলল,
—- “আচ্ছা বাদ দেন। সবাই সুখে থাকুক।”

অর্পার হাতে পোড়া দাগ। রঙচটা চুড়ির ফাঁক গলে সে দাগ উঁকি দিচ্ছে অস্পষ্টভাবে। রূমী ওর হাতটা মেলে ধরলো, “কী হয়েছে এখানে?”
অর্পা চোখ টিপলো, “স্বামী সেবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। দাগ না থাকলে তো বিশ্বাস করতেন না। হাত ফাত পুড়িয়ে পুরুষজাতির জন্য জীবন কুরবান করে দিচ্ছি। এদিকে এদের আরো এক হালি বউ চাই।”
রূমী কান ধরে নাটকীয় গলায় বলল, “আমার অন্যায় হয়েছে।”

ঠিক তখুনি ঝমঝম করে বৃষ্টি নামলো। রূমী হুড তুলতে চাইলেও অর্পা দিলো না। সে মাথা এলিয়ে বৃষ্টির শব্দ শুনতে লাগলো। রূমী শান্ত হয়ে বসে থাকলো সারাটি দুপুর। ওরা কোথায় যাচ্ছে ঠিক নেই। অর্পাকে একবার ক্যাম্পাস ঘুরিয়ে দেখালে ভালো হয়। কিন্তু একি! এই মেয়ে ঘুমিয়ে আছে নিরালায়। খুব ভোরে রওনা দেয়ায় হয়ত ঘুমাতে পারেনি ঠিকঠাক। কেমন ভেজা ভেজা ভালোলাগার আবেশে জড়িয়ে আছে সব! সে ভাড়া মিটিয়ে বলল, “মামা, আমরা কিছুক্ষণ বসি?”
মামা রাজি হলেন।

অর্পার যখন ঘুম ভাঙলো, তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ওরা নেমে গেলো পিচ ঢালা রাস্তায়। বর্ষাকাল এখন। মাঝের কয়েকটা গাছে মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছে কদমফুল। রূমী ওকে প্রতিটি ভবন ঘুরিয়ে দেখালো। ফ্রেশ হবার জন্য নিয়ে গেলো মেয়েদের হলে। ওদের সঙ্গেরই একটা মেয়ে বেশ আগ্রহ করে ভেতরে নিয়ে গেলো অর্পাকে। মেয়েটা বাকপটু। কয়েকটা মেয়ে ঘুরেফিরে দেখছে, কিছুক্ষণ পরই রূমীর বউ দেখতে কেমন তা নিয়ে বসবে সমালোচনার আসর।

****
“আপনিও আমাদের সঙ্গে চলুন? সাফার জন্য তো ছেলে দেখছে। আমার মনে হচ্ছে খুব তাড়াতাড়িই বিয়েটা হয়ে যাবে। ছেলে ভালোই।”
রূমী মাথা নাড়িয়ে বলল, “না, শুক্রবার যাব। আমার অ্যাসাইনমেন্ট জমা দেওয়া বাকি।”
অর্পা আর কিছু বলল না। বাবা এসে গেছেন। একটু পর ট্রেন ছেড়ে যাবে স্টেশন। রূমী কাছের দোকান থেকে ওকে কিছু খাবার কিনে দিলো। অর্পা ট্রেনে পা দিয়ে পেছন ফিরে বলল, “এবার তাহলে যাই। হ্যাঁ?”
রূমী হেসে ফেলল, “না। বলতে হয়, আসি।”
অর্পাও হেসে ফেললো। মায়া মায়া চোখগুলো মেলে শান্ত গলায় বলল, “আপনি চলে যান। ট্রেন তো এখনই ছেড়ে দেবে।”
রূমী তবুও দাঁড়িয়ে থাকলো। ওর বুক ট্রেনের শব্দের মতো ধুকপুক করে কাঁপছে। খরা বয়ে যাওয়া জীবনে অর্পা এক পশলা বৃষ্টির মতো কিছুক্ষণ ছুঁয়ে চলে যাচ্ছে। বিয়ের পরও যেন মাগরিব বাদ তার ঘরে ফেরার দায় শতভাগ।

ট্রেন ধীর গতিতে চলতে শুরু করেছে। রূমীর মনে হলো ওর হৃদয় থেকে কি যেন আলাদা করে ফেলা হলো। সে প্রাণপনে দৌঁড়াতে লাগলো ট্রেনের সঙ্গে। অর্পা ওকে জানালা দিয়ে না করছে। সম্ভবত ওর চোখে পানি। গতির জন্য বোঝা যায় না। অর্পা সবসময় নিজেকে অদ্ভুত সাজানোর চেষ্টা করলেও রূমী জানে অর্পার মন আদতে শরতের কাশফুলের মতো নরম। অর্পা কাঁদে লুকিয়ে। ওকে কে যেন বলেছে, কান্না দূর্বলতা প্রকাশ করে। তাই সে শক্ত মূর্তির মতো আজব এক চাদরে ঢেকে রাখে রোজ। রূমী এই চাদর উপড়ে ফেললো কি করে জানেনা। মাঝেমাঝে মানুষকে আমরা জেনে ফেলি অবচেতনে। হৃদয়ে হৃদয়ে টেলিফোনে কথা বলার কোনো সিস্টেম থাকতে পারে।

ট্রেনটা ছেড়ে চলে যায় সময়ের মতো। তাদের মানুষের মতো পিছুটান, আবেগ কিচ্ছু নেই। রূমী সে জায়গায় হাঁটু মুড়ে বসে রইলো সারাটি সন্ধ্যা। বিয়ে করা বউয়ের জন্য এত পাগলামি করছে জানলে মিন্টু ওকে ক্ষেপাবে। বিনা শর্তে পাশে থেকে যাওয়া মানুষের দাম কী আর ও বুঝবে?

চলবে ~

আজকে আমার মন ভালো নাই পর্ব-১২+১৩

0

আজকে আমার মন ভালো নাই।
নাহিদা সানজিদ।

১২.
“তোর বউয়ের গহনা বেচে দিলেই তো পারিস। ওগুলো তো তোরই।”

রূমী ভ্রু কুঁচকে তাকালো। সেদিন মিহীকা রূমীর ভীতু চেহারা দেখে খিলখিল করে হেসে উঠেছিলো। তারপর হাসি চেপে বলেছিলো, “মজা করেছি, স্যার। বাসায় সবাই আছে। আপনাকে একটা পরীক্ষা করলাম। সাইকোলজি বলে, মেয়েরা তাদের জীবনে থাকা পুরুষদের ব্যাপারা নিশ্চিন্ত থাকতে চায়। এজন্য সম্ভবত মেয়েরা একটু বেশি সন্দেহপ্রবন হয়।”

রূমী প্রথমবারের মতো ধমকালো ওকে, “এসব ভুলভাল সাইকোলজি কে শেখাচ্ছে আপনাকে? আমি অনেক রাগ করেছি।”

মিহীকা আবারও হেসে উঠলো। সেদিনের মতো পড়িয়ে বেরিয়ে এসেছিলো সে। হাত-পায়ের কাঁপন স্পষ্ট অনুভব করতে পারছিলো। কত কিছুই না হয়ে যেতে পারতো চোখের পলকে! আল্লাহ বাঁচালেন।

ইদানীং তার আর এসব ঝামেলা ভালো লাগে না। একটা পিসি নিয়ে নিলে নিজের মতো কিছু করতে পারতো। এসব দ্বারে দ্বারে টিউশনি করে অপদস্ত হতে হতো না। মিন্টুকে ঝামেলার কথা বলতে না বলতেই তার শয়তানি সমাধান হাজির।

— “কোন গহনা?”
— “তোর বউরে বাপের বাড়ি থেকে কিছু দেয় নাই? মাইয়ারে সাজায় টাজায় দেয় স্বর্ন দিয়ে। ওগুলা আরকি।”
— “আমার বউকে গহনা আমি কিনে দিব। ওর বাবা কেন দিবে?”
মিন্টু অনুচিত উচ্চারণের একটা গালি দিয়ে বলল, “আবার বালের ঢঙ শুরু হইছে। দ্যাখ, এগুলা বইয়ে মানায়। বক্তৃতা দিলে বাহবা পাইবি মাইয়াগো থেকে, বাস্তবে এসবের কাম নাই। অহন লবি, এরপর টাকা পয়সা হলে আবার কিনে দিবি।”

রূমীকে মাথা নাড়িয়ে বলল, “আমি ফেরত দিতে পারব তার নিশ্চয়তা কী? আম্মার গহনা বেচে আব্বা একটা বিজনেসে দিয়েছিলো। সব টাকা খোয়া। আর স্বর্ণের এখন যা দাম! আমি এত রিস্ক নিতে পারবো না। আর এটা কেমন যেন! স্বর্ন তো বাবা-মায়ের কাছ থেকে পেয়েছে, ওর জন্য স্মৃতি, আমি কীভাবে নেই? আমার গায়ে লাগবে। আর যদি আমার বাড়ি থেকে দেওয়া হয়, তাহলে তো উপহার ফিরিয়ে নেবার মতো জঘন্য কাজ হবে!”

মিন্টু বিরক্ত হয়ে গেলো। এই ছেলের নীতিবাক্য তার আর ভালো লাগে না। সবকিছুতে তার একহাত লম্বা ভাষণ নিয়ে আসতে হবে। সে ফ্যাকাশে রঙা একটা কাঁথা গায়ে টেনে দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলো, “তাইলে আমার কাছে ক্যাচক্যাচ করস ক্যান? তোর আল্লার কাছে চা, যা। আল্লাহ তরে আকাশ থেইকা পয়সার বৃষ্টি দিব। শালা, আবাল একটা। বউ যখন ফট কইরা পল্টি নিয়া কইব, তর মতো ফাতরা জামাই জীবনেও দেহি নাই, তখন কান্দিস না। গালে একটা চটকনা লাগামু।”

রূমী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ওর গালিগালাজ শুনে এখন আর মারামারি করতে ইচ্ছা করে না। ওর কথায় একটু খারাপি আছে, মনটা ভালো। বাজে পরিবেশে বড় হওয়ায় একটু রগচটা গোছের হয়ে গেছে। রূমীর মাঝেমাঝে অনেক প্রশ্ন জাগে। কেউ যদি ভালোর সংস্পর্শে বড় হয়ে ভালো হয়, তাতে তার অবদান সামান্য থাকে। কেউ যদি আঁধারের দুনিয়ায় বড় হয়ে আপাতদৃষ্টিতে মন্দ মানুষ হয়েই বড় হয়, তবে তার অপরাধ আর কতটুকু? আমরা ভালোর মুখোশ ধরে কেন তাদের দূরে রেখে দেই?

রূমীকে অনেকবার অনেকে বলেছে রুম বদলে ফেলতে। কিন্তু ওর মায়া লাগে। মিন্টু সেই ছেলে, যে একদিন এক মাদকসেবক সিনিয়রের কাছ থেকে তাকে বাঁচিয়ে নিয়েছিলো বন্ধুত্বের খাতিরে। তাই তার মন বারবার বিভ্রান্ত হয়, একজন মানুষ কী সম্পূর্ণ ভালো হতে পারে?
কেউ কী তার সমস্তটা জীবন কলঙ্কহীন রাখতে পারে?
তবুও কেন আর ভালো খারাপের তকমা দিয়ে বেরাই আজীবন!

**
অর্পার ফোন হঠাৎ করে বালতিতে পড়ে গেছে। স্পট ডেথ। অনেক আগের মোবাইল। বাবা, বড় আপার হাত হয়ে তার কাছে এসেছিলো। তবুও এই পুরোনো বস্তুটার প্রতি তার মায়া পড়ে গেছে। সে সুন্দর করে তার সমাধি করলো আপন স্মৃতির সংগ্রহে। পুরোনো জিনিস ফেলে দেওয়ার ধাঁত তার নেই। বরং প্রতিটি জিনিস সযতনে আগলে রাখা তার স্বভাব। এ যেমন রূমীর বই, তার উপহার দেওয়া গাছ? কি যে দুশ্চিন্তা হচ্ছিলো গাছটাকে নিয়ে! নতুন কোনো পাতার দেখা না পেয়ে তার মনে হচ্ছিলো, এই বাচ্চাটা অঙ্কুরেই ঝরে পড়বে মৃত্যুর কোলে, ঠিক তাদের যুগল জীবনের মানবীয় প্রেমের মতো।

ক্যান্টিনে খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে টাকা জমিয়ে একটা টব কিনলো মাঝারি ধরনের। গাছের পুনর্বাসন দিলো আবারও। এবার রেখে আসলো উঠানে। ভয় লাগছিলো, কোনো দুষ্ট ছেলে এসে যদি ভেঙে ফেলে? প্রতিদিন একবার করে দেখতে যেতো এমন করে যেন মায়ের কোল থেকে একটা ছোট্ট শিশুকে দূরের কোনো মাদরাসায় দিয়ে দেওয়া হয়েছে। অদ্ভুত এই বস্তুগত সংসার নিয়ে তার দিন চলে যাচ্ছে। আজ প্রথম গাছটায় ফুল এসেছে। ছবি তোলার জন্য ফোন নেই। নয়ত রূমীকে পাঠানো যেতো। রূমী মারওয়ার সঙ্গে কথা বলছে কলে। ইনিয়ে বিনিয়ে সম্ভবত স্ত্রীর কথা জানতে চাইছে। কিন্তু মারওয়ার সঙ্গে কী এসব ছুতো করা সম্ভব? কাট কাট গলায় জবাব দিচ্ছে সে। আগ বাড়িয়ে একটুকিছুই বলছে না। অর্পাও ইচ্ছা করে সামনে গেল না।

বিকেলে ওদের একটা গোপনীয় সাক্ষাৎকার আছে। সাফার জন্য ছেলে দেখতে যাবে তারা তিনজন। গুরুজন হিসেবে বাড়ির বড় বউই যাচ্ছে। পেছন পেছন শ্বশুরমশাই যাবেন ঠিকই, কিন্তু দেখা দেবেন না। মেয়েদের চোখে এমন অনেককিছুই ধরা পড়ে যা পুরুষ মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব না। ষষ্ঠ ইন্দ্রীয়ের গুনগান তো পুরোনো কথাই। তারা তিনজন প্রস্তুতি নিচ্ছে। সাফা ঠিক প্রস্তুতি নিচ্ছে না, জোর করে নেওয়ানো হচ্ছে। সে চোখমুখ লাল করে ফেলেছে। ফর্সা হওয়ায় চোখে লাগছে বেশ।

দাদী ওর পিঠে হাত বুলিয়ে বলছেন, “আমার জাদুসোনা, যাইয়া একবার পোলাডার চেহারাছবি দেখবি। কালা না ধলা দেখতে হইব না? ভালা লাগলে তো লাগছে, না লাগলে বাদ। একজন দেখতে চাইলে কী না করন যায়? লক্ষ্মী না আমার বইন?”
সাফা মনে মনে এবার কিছুটা সাহস পেলো। গিয়ে ছেলেটার ভুল ধরার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিলো, বাহ্যিক সাজসজ্জা তার সামান্যই। বলা যায়, করেইনি।

***
“ছেলেটাকে দেখলাম। আমার পনেরো ষোলো বছরের এই নাতিদীর্ঘ জীবনে এরচেয়ে বিচ্ছিরি ছেলে আর দেখিনি! এত কুচকুচে কালো কারো গায়ের রঙ হতে পারে, ধারণাই ছিলো না। অথচ ভাবী দেখে বলল, “আরে! এ তো দেখছি হুমায়ুনের নায়ক মুহিব!”
আমার একবার বমি করে দিতে ইচ্ছা করলো, এ? নায়ক? ভাবী বেশ উৎসাহী গলায় ভাইয়ার একটা বইয়ের গল্প বলতে লাগলেন।

ছেলেটার নাম মুহিব। গায়ের রঙ এত কালো যে অন্ধকারেও দেখা যায় না। শুধু দাঁতগুলো মজবুত, টেকসই, ফর্সা। কী আশ্চর্য! বিবরণ খাপেখাপ মিলে যাচ্ছে! তার মানে কী এটা একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে? লেখক তার জীবনে একবার এই ঘটনা দেখে লিখে ফেললেন এসব ছাঁইপাশ পিরিতের কাহিনী, আর আমি দেখে লিখতে যাচ্ছি আরেকবার? কী ভয়ানক ব্যাপার? এই লোক কী তাহলে আমার দুলাভাই হতে চলেছে? অন্ধকারে যাকে ঠাওর করা যাবে না!

ভাবী আমার কথা শুনে বললেন, “সাদা মানুষের তো আলাদা কোনো আলো নেই অন্ধকারে দেখতে পাওয়ার। আছে?”
এসব ঢঙের কথা আমি শুনতে পারি না। বিয়ে হবে না, ক্যানসেল। কিন্তু আমার ধারণা, সাফা খুব শিগগিরি এই লোকের কালোজাদুতে কবজা হবে, ঠিক আমার নীরিহ ভাইটির মতো। এই মহামারীর জালকে আমি স্পষ্ট চিনতে পারি, আমার সেটুকু জ্ঞান আছে। সাফা হেঁটে আসছে লাজুক পায়ে, তার ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি, ইয়া আল্লাহ! লা ইলাহা ইল্লা আংতা সুবহানাকা ইন্নী কুনতি মিনাজ জোয়ালিমীন! এই ডায়েরীতে তোমার কাছে লিখিত দোয়া চাচ্ছি, এই অনিষ্ট থেকে রক্ষা কর।”

****
মারওয়ার দ্রুত ডায়েরি বন্ধ করে ক্ষ্যাপা গলায় বলল, “এতক্ষণে আসার সময় হয়েছে? কি পিরিতির আলাপ করলি শুনি?”

সাফা বিব্রত বোধ করলো। লোকটার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত কথাগুলো কী ফাঁস করে দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে? নাকি অনুমতি নেবে আবার ফিরে গিয়ে? জিজ্ঞেস করবে, “আচ্ছা, আমি কী আমার বোনকে আমাদের সব কথাগুলো বলতে পারি? এটা কী কথার আমানতের খেয়ানত হবে?”

কিন্তু তার লজ্জা করছে। লোকটা এত ভালো! প্রথম দেখায় লোকটাকে দেখে ভড়কে গেছিলো বটে। তবে চেহারাসুরতের নম্রতা তার সেই ভাবনাকে মেরে ফেলতে বাধ্য করেছিলো। গায়ের রঙ কবে থেকে আবার চিন্তায় ফেলে দেওয়ার বিষয় হয়ে দাঁড়ালো? লোকটি তাকে শুরুতেই সালাম দিলো, এরপর বলল, “এর আগে ৩৪ বার রিজেকশন খেয়েছি, এবার ৩৫ নম্বর সাক্ষাৎ।”
লোকটার কথায় তার ভেতর একটা হাহাকার জেগে উঠলো। আহারে! সে সরল গলায় শুধালো, “কেন?”
লোকটা অজ্ঞতা প্রকাশ করলো, “কি জানি! হয়ত এই গায়ের রঙ?”
সাফা মাথা নাড়ালো, “উহুম। এমনও তো হতে পারে আপনার স্বভাব চরিত্র ভালো মনে হয়নি?”
তার অবলীলায় মুখের উপর বলা থেকে লোকটা বোধহয় কিছুক্ষণ থমকালো। এরপর মাথা নিচু করলো, “আমার ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট তো আর আমি দিতে পারি না। আপনি আমার এলাকায়, বন্ধু-বান্ধবদের থেকে জেনে নিতে পারেন। তাছাড়া, আপনার মনে হয় এই চেহারায় আমি ক্যারেক্টারলেস কিছু করার সু্যোগ পেয়েছি?”
— “তার মানে কী? সুযোগ পেলে করতেন? সুযোগ না পেয়ে ভালো মানুষ হয়েছেন?”
লোকটা থতমত খেয়ে বলল, “এভাবে তো ভেবে দেখিনি।”
সাফা হাসলো, “আপনার চেহারায় তো কোনো সমস্যা দেখছি না। আপনার নাক অনেক সরু। আপনি জানেন? আমিও রিজেকশন খেয়েছিলাম, নাক বোচা বলে।”
বলে সে নাকে হাত দিলো। জহির হেসে ফেলল, “আপনাকেও কেউ রিজেক্ট করতে পেরেছে! এত তাড়াতাড়ি বিয়েই বা করছেন কেন? আমি ভাবিনি, আপনি এত ছোট!”

সাফা এমনভাবে গল্প করতে শুরু করলো যেন শত সহস্র বছর ধরে তার বন্ধুত্ব এই লোকটির সাথে। কখন যে সময় ফুরিয়ে এলো! মানুষটা যাওয়ার সময় বলে গেল, তার মায়ের পর প্রথম কোনো মেয়ে তার সঙ্গে এত সুন্দর করে কথা বলেছে। ছোটবেলায় অবশ্য আরেকজন বলেছিলো, মেয়েটির নাম টিনা। তখন তো আর রঙের ভেদাভেদ বুঝতো না। সাথে সে ধরেই নিলো, তার বিয়েটা এখানেও হচ্ছে না। মেয়ের মনে হালকা একটু জায়গা করে নিতে পারলেও , বাবা-মায়েরা রাজি হবেন না। এমন কত অনুভূতি চাপা পড়ে যায় বাস্তবতার ফাঁদে! সব কী আর পার্মানেন্ট হয়? কিছু জিনিস দলছুটো হয়ে স্মৃতিতে আজীবন জায়গা করে রাখে।

মারওয়া এসব গল্প কিছুতেই ওর পেট থেকে বের করাতে পারলো না। বিরক্ত হয়ে বলল, “এই কালাচানের চিন্তা বাদদে। লোকটাকে দেখলেই আমার গা জ্বালা করছে। ইইই..”
সাফা খুব কষ্ট পেলো। রাগে লালা হয়ে গেলো সে, “বিয়ে হলে আমার সাথে হবে, তোর গা জ্বালা দিয়ে আমি কী করব? তোর গা জ্বালাই থাকা উচিত, শালী আর দুলাভাই একশ হাত দূরত্বে থাকবে, এটা নিয়ম।”
মারওয়ার বিস্ময়ের পারদ ছাড়িয়ে যাচ্ছে। আজ থেকে ও ডায়েরি লেখাই ছেড়ে দেবে। আর ভাগ্যলিখন লিখে সে বাবার দেয়া ডায়েরিটার পৃষ্ঠা নষ্ট করতে চায় না। বরংচ গণকের কাজ শুরু করা যায়, হাত দেখে দেখে পয়সা কড়ি নেবে। একটা অনলাইন পেজ খুলে ফেলবে আপডেটের জন্য। প্রথম রিভিউ দেবে তার ভাই-বোন। আশ্বাস দিয়ে বলবে, “ও যা বলে, হান্ড্রেড পার্সেন্ট মিলে যায়। আমরা তার প্রমাণ। আপনারাও ট্রাই করতে পারেন, আশা করি ধোঁকা খাবেন না। ট্রাস্টেড পেজ।”

চলবে ~

আজকে আমার মন ভালো নাই।।
নাহিদা সানজিদ।।

১৩.
আরিব বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে, বাবার সঙ্গে। ঘুরে বেড়াচ্ছে নিজের মতো। মন চাইলে চলে যাচ্ছে এদিক ওদিক। কিন্তু কোথাও মন বসে না। মনের সঙ্গে মস্তিষ্কের দ্বন্দ্ব চলছে। ছোটবোন আরিবাকে বলেছে মারওয়ার বাড়ির খোঁজখবর রাখতে, যেন ফট করে আবার তাকে কেউ দেখতে না চলে আসে। বাঙালি ঘরের তো আবার ব্যারামের অভাব নেই। হঠাৎ শোনা যাবে, দেখতে এসে বিয়ে হয়ে গেছে। আরিবা অবশ্য বলেছে,
—“এত কী দরকার? তোর জন্য আরো ভালো মেয়ে দেখছি। মারওয়া একটা মেয়ে হলো?”
আরিব ধমকে বলেছে, “তুই চুপ থাক।”
বাবা হজ্বের নিয়ত করেছেন। খুব শীঘ্রই বের হবেন মদিনার উদ্দেশ্যে। ওর প্রথমে যাবার ইচ্ছা ছিলো না, কিন্তু কি মনে করে সাথে চলল। হুটহাট সিদ্ধান্তে তেমন কিছু গোছানোর সুযোগ পেলো না। একটা ট্রাভেল ব্যাগ নিয়েই চড়ে বসলো উড়োজাহাজে। সাদাত হোসাইনের একটা কবিতার লাইন মনে পড়ছে,

“তোমার জন্য যতটা পথ হেঁটেছি,
ততটা পথ হাঁটলে আমি পৌঁছে যেতে পারতাম জেরুজালেম, আমার প্রিয়তম শহর।”

লাইনটা ওর মনে দাগ কেটে গেলো। তার প্রিয় শহর কোনটি? বাবাকে জিজ্ঞেস করায় বললেন, “মদিনা”।
সে তার হাঁটার উদ্দেশ্য বদল করার জন্য হাঁসফাঁস করে উঠলো। মারওয়া যদি তাকে পছন্দ না করে, তাকে কী জোর করা আদোও সম্ভব? কখনো নয়। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আধঘুমে ডুবলো।

ইহরামের কাপড় বাঁধার সময় সে খানিকটা মায়ায় পড়ে গেল সাদা কাপড়ের। কাফনের রঙ। মৃত্যু! এ মুহুর্তে মৃত্যু হলে কী হবে তার? এই ছোট্ট জীবনটা কী অবলীলায় খাপছাড়া করে কাটিয়ে দিচ্ছে সে! মরে যাবে এমন করে যেন পৃথিবীর বুকে সে কোনোদিন ছিলোই না।
মারওয়ার বাবা মির্জা গালিবের কবিতার বেশ বড় রকমের একজন ভক্ত। একদিন চা খেতে গিয়ে দেখা। তিনি বললেন, “আরিব। আমরা আমাদের জীবনে কী চাই সেটা নির্ধারণ করা জরুরি। একটা ফাইনাল ডেসটিনেশন। এটার পরে ওটা চাই, এরকম খাই খাই ধরনের মনোভাব নিয়ে তুমি কক্ষনো সুখী হতে পারবে না। বুঝলে? মির্জা গালিব এ নিয়ে একটা হৃদস্পর্শী লেখা লিখেছিলেন, তুমি জানো?

পৃথিবীতে পোশাক বিহীন এসেছিলে হে গালিব!
একটি কাফনের জন্য এতো লম্বা সফর করলে!”

বাবার সঙ্গে গলায় গলায় বন্ধুত্ব রেখে তারই অগোচরে তার মেয়ের পেছন পেছন ঘোরার মতো দুমুখো বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো যেন সে। দ্রুত মন পাল্টাতে লাগলো অন্য কোনো বিষয়ে। মন খারাপের অতল গহ্বরে তলিয়ে যাবার আগে।

মদিনা শহরটা আসলেই মায়ার শহর। বহুদিন পর সে প্রাণখোলা সজীব নামাজের ছায়া দেখলো। দেখলো তাড়াহুড়ো করে আসা মুসল্লি। রাতের খোলা আকাশ। মিটিমিটি তারা। মসজিদের মেঝেতে সে শুয়ে থাকলো কিছুক্ষণ সিজদাবনত হয়ে। মাথা ওঠাতে ইচ্ছা করছে না। ওর খুব কান্না পাচ্ছে। সে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। মুখ গুজা অবস্থায় কেউ দেখার নেই। সে মনে মনে বলতে লাগলো, “আল্লাহ, তুমি জানো। আল্লাহ, তুমি জানো।”

ওর শরীর কাঁপছে। সে উঠে বসলো। ঝিরিঝিরি হাওয়ার সঙ্গে শুরু হলো মৃদু বৃষ্টি। সে চুপচাপ বসে রইলো। আরবীয় এক তরুণ সুপুরুষ তাকে খেজুর সাধলো। সঙ্গে এক বোতল পানি। সে হাসিমুখ করে নিলো। কোথায় যেন শুনেছিলো, উপহারে কখনো না করতে নেই। নবিজী সা: নাকি এ নিয়ম মেনে চলতেন, তিঁনি দানের জিনিস নিতেন না। নিতেন ভালোবেসে দেওয়া উপহার। সে মাথা উঁচু করে আকাশের দিকে চেয়ে রইলো নিশ্চিন্তে। ছেলেটা বসার অনুমতি চাচ্ছে। বসার পর সে অস্পষ্ট ইংরেজিতে বলল,
“Are you sad, brother? I’m not fluent in English. Gonna study in abroad next month. Wanna have a try with you..”।

বলেই হাসলো। লালচে ফর্সা গায়ের রঙ। গালে হালকা দাঁড়ি। আরিবও হাসলো। বসার ভঙ্গিতে শালীনতা এনে বলল, “I’m not fluent too! Even I’m a college drop out student.”

ছেলেটা গল্প জমাতে চাইলো। ওর চোখেমুখে শিশুসুলভ উচ্ছলতা। নাম ইব্রাহীম। ইব্রাহীম নামের সব ছেলেরাই কী এমন সুন্দর আর সাদাসিধা হয়? আরিবের প্রশ্ন জাগে। রূমী ভাইয়ের নামও তো ইব্রাহীম রূমী।
আরিব বৃষ্টিভেজা মেঝেতে গা এলিয়ে দিলো। এখন বৃষ্টি নেই।
সে জিজ্ঞেস করলো, “ইব্রাহীম? এই মসজিদ কী শুধু পূন্যবান ব্যক্তিদের জন্য? আল্লাহ যদি শুধু ভালো মানুষ বেছে নেন, আমরা কোথায় যাবো বলতে পারো?”

ইব্রাহীম তার সরল দীপ্তিময় চোখ মেলে তাকালো পেছন ফিরে, “না তো। তুমি কী শোনোনি? আল্লাহ তাওবাকারীদের বেশি ভালোবাসেন। তওবা কারা করে বলোতো? সমস্যা তো আমাদের মাঝে। আমরাই কখনো আল্লাহকে বেছে নেই না।”

আরিবের বুকে ধ্বক করে উঠলো। সহজ সরল একটা কথা। তবুও তার ভেবে দেখতে ইচ্ছা করছে না। অনুশোচনা করতে গেলে তার পাগল পাগল লাগে। তার ইব্রাহীমকে আরেকটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে, “ইব্রাহীম, মানুষ কেন স্রষ্টায় বিশ্বাস করে না বলতে পারো?”
বিশ্বাসীদের দূরবস্হা তাকে প্রশ্নটি করার সাহস দিলো না।

**
মারওয়া এসএসসির জন্য জোরদার পড়াশোনা করছে। তার ঘরের মানুষ বিয়ে করে চুলোয় যাক, তার কী? সে করবে পড়াশোনা, ব্যারিস্টারি পেশায় যাওয়া যায়। মন্দ হয় না। সমস্যা হলো, যুক্তিতর্ক করতে গিয়ে আবার ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বসলে কী হবে? উল্টোপাল্টা যুক্তি শুনে হয়ত ভরা কোর্টে উকিলের মুখে পানি ছুঁড়ে মারলো?
আচ্ছা, পরে দেখা যাবে। সে মনোযোগ দিয়ে পড়তে শুরু করলো। ইংরেজির একটা প্রেজেন্টেশন করছে, “There is 6 members in my family. I’m blessed with one sister, one sister in law, one brothers as well. They are a big foool…”
বলে একটা টান দিলো। ভালো লাগছে না। একবার জীববিজ্ঞান বই খুলে “আস্তাগফিরুল্লাহ” বলে বই বন্ধ করে দিলো। এত পাপের কাজ তার দ্বারা হবে না। আরেকবার ধরলো পদার্থবিজ্ঞান, বিকৃত মুখে বন্ধ করে দিয়ে নিজেকে নিজে বলল, “এর চেয়ে অপদার্থ থাকাই ভালো ছিলো।”
এরপর ধরলো বাংলা। বহিপীরের গল্পটা পড়ার পরই “আউজুবিল্লাহ” পড়লো। বইয়ের ভেতর দিয়ে তাহেরাকে বলল, “বুড়া হোক, মরা হোক, জামাই তো? ছিহ্ ছিহ্। ভাইগা যাওয়ার আগে ডিভোর্স দিবি না? ইদ্দতেরও তো ব্যাপার স্যাপার আছে। হাশেম, লুইচ্চা ব্যাডা।”

অর্পার ওর অতি পড়ুয়া ভাবভঙ্গি দেখে এক গ্লাস দুধ এনেছিলো, “কাকে বকছো এমন করে?”
মারওয়া মাথা নাড়িয়ে দুঃখ প্রকাশ করলো। বাংলাদেশের শিক্ষাখাতে কত বড় রকমের অযোগ্য ব্যক্তিরা বসে আছে তা বিশ্লেষণের চেষ্টা করলো। সাথে সন্দিহান কন্ঠে বলল, “ওই ঢঙ্গী কোথায়? পড়াশোনা কী ছেড়ে দিয়েছে? ফুল টাইম গৃহবধূ? নারীজাতির এ কী অবনতি! রোকেয়া তার সারাজীবন এ নারীজাতি চেয়েছিলো? একটা কাইল্লা ছেলের প্রেমে পড়ে যে জীবন জগত ভুলে যায়!”

অর্পা হেসে ফেললো। ভ্রু উঁচিয়ে খানিকটা গম্ভীর হয়ে গেল, “মারওয়া, তুমি কী জানো? পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর এবং একই সাথে সবচেয়ে কুৎসিত বিষয় হলো মানুষের কথা বলা। ‘সে মুখ খারাপ হলেও মন ভালো’ এই সে নামক মানুষেরা খুব কষ্টে থাকে। তারা পাহাড়সম কোনো উপকার এহসান আমাদের উপর করে ফেললেও তার একটা বাজে কথা মস্তিষ্ক থেকে সবকিছু ডিলেট করে দিতে সক্ষম। মানুষের ধর্ম এমনই। বিপরীতে কারো চরম দুঃসময়ে তুমি কেবল কিছু শব্দ বল, বুদ্ধি বিবেচনাবোধ খাটিয়ে, সে তোমাকে তার সারাটি জীবন মনে রাখবে। তুমি যদি তোমার কথার নিয়ন্ত্রণ নিতে পারো, বাকি সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ নেওয়া ব্যাপার না। এর এটা কিন্তু অনেক চ্যালেঞ্জিং একটা কাজও বটে। আল্লাহ আমাদের কথা বলার নিয়ামত দিয়েছেন বলেই যে আমরা একে যা তা বলে ব্যয় করব, এটা কী কোনো যুক্তি হলো? তুমিই বলো।”

মারওয়া ভ্রুক্ষেপহীন ভাবে চেয়ার ঘুরিয়ে বসলো। এমন ভাব করলো যেন কিছু শোনেইনি। সে এবার ধরলো ইসলাম শিক্ষা বই। পড়তে শুরু করলো সূরা ইনশিরা। বারবার পড়লো, যেন মুখস্হ হয়ে যায়। অর্পা ওর কাঁধে হাত রেখে কি যেন নিরব আশ্বাস দিয়ে গেলো। এরপর চলে গেলো।

***
দুদিন বাদে রূমী মিহীকার মাকে ‘না’ করে দিলো। আর পড়াবে না। বলল, বিয়ে করেছে রিসেন্টলি। কোনো কাজে ঢুকে যাবে।
জীবনের এত জটিলতা তার ভালো লাগে না। রিক্ত শূন্য হাতে রাস্তায় নেমে সে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল, “আল্লাহ, আমি তোমার ভয়ে ভুলের আশঙ্কায় ফিরে এলাম। আমাকে এর চেয়ে উত্তম কোনো ব্যবস্হা করে দাও, প্লিজ!”

মারওয়াকে সেদিন জিজ্ঞেস করেছিল, “অর্পার ফোন কোথায়?”
সে ভীষণ হেয়ালি, “তা আমি কী জানি? তোর ধারণা, আমি তোর বউয়ের পিছে পিছে ঘুরি? তার সব খবর জানার দায় আছে আমার?”
রূমী আশ্চর্য হলো, “অর্পাকে ফোনটা দে।”
সে দুই হাঁটু একসাথ করে বসে শক্ত গলায় বলল, “পারব না। তোর বউ গাছ-পালার সেবা করছে। আমি তো শুনেছি, সে বৃক্ষকে সন্তান হিসেবে গ্রহণ করেছে। বইকে গ্রহণ করেছে সৎ মেয়ের মতো। সুযোগ পেলেই দেখি জ্ঞানার্জনে ডুবে যাচ্ছে।”
মারওয়ার সঙ্গে তর্ক করতে করতে রাত পোহায়।

মিন্টু এসে চোখ টিপল একদফা, “মাম্মা তুই তো ফেল এবারও। ওই শালায় বলসে, আমগো দুইটারে নাকি পাশ হইতে দিবো না।”
তারপর মাথা বাড়িয়ে ফিসফিস করে বলল, “চল, শালাকে মা*র্ডার কইরা ফালাই। নয়ত তোর আদুভাই হওয়া ছাড়া উপায় নাই।”
রূমীর হতাশা শুধু বাড়ে। সিজিপিএ নেমে এসেছে তিনের নিচে সে কবেই। কোর্স টিচারের সঙ্গে তাদের ব্যক্তিগত কোনো শত্রুতা নেই। একবার তিনি ক্লাসে মুসলমানদের রোজা রাখার ভুল ব্যাখ্যা দিচ্ছিলেন। বলছিলেন, হাসান হোসাইন কারবালায় পানির অভাবে মারা যান বলেই মুসলমানরা স্মৃতি রক্ষার্থে রোজা রাখে। ক্লাসের কেউ কেউ বলছিলো, “এটা ডায়েটের জন্য”। আবার কেউ বলেছিল, “গরিবদের অনাহারের কষ্ট বোঝার জন্য।”

রূমী দাঁড়িয়ে শান্ত ভাষায়ই জানালো, “স্যার, মুসলমানরা নবিজী সা: এর জীবিত থাকা অবস্থা থেকেই রোজা রাখে। নবিজী নিজেও রেখেছেন নিয়মিত। এটা স্মৃতি রক্ষার্থে না। মূলত ইবাদতের একটা অংশ। এর অনেক উপকারিতা থাকতে পারে, কিন্তু আমরা এসব ভেবে রাখি না। শুধুমাত্র আল্লাহকে ভয় করে, তাঁর আদেশ পালন করি আমরা।”

তিনি তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসলেন, “পড়াশোনা করিয়ে এসব ধর্মান্ধ উৎপাদন হচ্ছে দেখি? এই তোমার রেজাল্ট কী?”
তখন রেজাল্ট ভালোই ছিল। এরপর শুরু হলো অবনতি। সেই কোর্সে আর পাশ করা হয় না। ইউনিভার্সিটিতেও যে লোকে ফেল করতে পারে, তা অনেকের অজানা। কতদিনে পাশ করে বেরোতে পারবে কে জানে! অর্পার নাম্বারে অসংখ্য কল আর ম্যাসেজের পর সে শেষবারের মতো একটি ম্যাসেজ লিখলো,

“Orpa, I’m feeling so down now-a-days. Can we talk for a while? How are you? I’m not that well. University life is totally a piece of hell, you know? What have I done?” (অর্পা, আমার কিছুদিন ধরে খুব খারাপ লাগছে। আমরা কী কিছুক্ষণ কথা বলতে পারি? কেমন আছ তুমি? আমি তেমন ভালো নেই। জানো? ভার্সিটি লাইফ ঠিক জাহান্নামের মতো। আমি কী করেছি?)

অর্পার ফোন যে বন্ধ.!
চলবে ~

আজকে আমার মন ভালো নাই পর্ব-১০+১১

0

আজকে আমার মন ভালো নাই।
নাহিদা সানজিদ

১০.
রূমী পৌঁছালো ১১ টায়। কিছু খাওয়া যাবে না, অথচ খুব ক্ষুধা পেয়েছে। প্রতিদিনের বাজেট একশ টাকা। সকালে খেলে আরো বাড়ে। সুতরাং, সচেতন ভাবেই সকালের খাবার বেশিরভাগ সময় মূলতবি রাখা হয়। কখনো চায়ের কাপে লেক্সাস বিস্কিটের ঝড় তোলা হয়, কিন্তু সবসময় নয়। ব্যাগ খুলেই প্রথমে পেলো হটপট। অর্পার কাজ হতে পারে, আবার মাও হতে পারেন। তবে মা লুকোছাপা করেন না। হটপটের ভেতরে খিচুড়ি। সকালে রুটি খেয়েছিলো যতদূর মনে পড়ে, অর্পার কাজই হবে। রূমী আনমনেই হাসলো। হটপটটা পাশে রেখে জামা কাপড় বদলে নিলো।

কিছুক্ষণ পর এলো ওর রুমমেট মিন্টু। কীভাবে যেন ভার্সিটিতে এসে তার নাম বদলে ‘মন্তুবাবা’য় রূপান্তরিত হয়েছে। মন্তুবাবা দাঁত মুখ খিঁচে কাকে যেন বিশ্রী করে গালিগালাজ করছেন, “শালারপুত, তুই আসবি না এটা আগে বললি না কেন? সাড়ে সাতটা বাজে ঘাস কাটতে উঠসি আমি?”
কাকে বলছে সে আর রূমী ভাবতে চাইলো না। মিন্টু বারবার কাকে যেন কল দিচ্ছে। ওর আবার একটা প্রেমিকাও আছে যার যার দুদিন পরপরই বিয়ে লাগে। হবে, হচ্ছে, হয়েই গেল — এভাবে চলছে রোজ। ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, বিসিএস ক্যাডারদের লম্বা লাইন তার পেছনে, এর মাঝে মিন্টু চুনোপুঁটি। তবুও কীভাবে যে প্রেমটা টিকে আছে! প্রতিদিনই একবার করে তাদের বিচ্ছেদ হয়। আর প্রতিবার ধৈর্য্য ধরে সে বিচ্ছেদের পটভূমি, উৎপত্তি, কারণ, ফলাফল শুনতে হয় রূমীকে। আবার সমাধানও দিতে হয়।

একবার রূমী বিরক্ত হয়ে বলেছিলো, “বিয়ে করে ফেল। এত কাইজ্জাকাটি দেখতে আর ভালো লাগে না।”
মিন্টুর প্রেমিকা রাজি নয়, মিন্টু নিজেও নয়। তাই বলে বিচ্ছেদেও সুখী হতে পারছে না। দুইদিন পর ওর একলা একলা লাগে, রূমীর কাঁধে হাত রেখে বলল, “ভালোবাসি, দোস্ত। ভুলব কেমনে?”
এ কোন জাতের ভালোবাসা তার জানা নেই।

এখন সে হেঁকে হেঁকে কী যেন বলছে,
— “এই যা ব্রেকআপ! ব্রেকআপ! এই পৃথিবীর আখেরি মাইয়া হইলেও তোর দিকে আমি ফিরেও তাকাবো না। এই রূমী? তুই স্বাক্ষী। খোদার কসম, ওরে যদি আমি আর ফোন দিসি।”
ফোন রাখার পর রূমী বলল, “কসম ভাঙলে কাফফারা দিতে হয়।”
মিন্টু কিছু বললো না। রাগে তার শরীর কাঁপছে, রূমী ওর পাশে বসলো, নরম গলায় বলল, “আমি বিয়ে করে ফেলেছি বন্ধু।”

মিন্টু অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকালো। জীবনটা হিন্দি সিরিয়াল হলে ব্যাকগ্রাউন্ডে দু একটা বজ্রপাত হতে পারতো। নানান নাটকীয়তার পর ঠিক হলো আজকে তাকে খাওয়াতে হবে কোনো শানদার রেস্তোরাঁয়। সাথে সে আরেকটা কাজ করলো, জনে জনে দেখা হলেই বলতে শুরু করলো, “রূমী শালা তো কাম সাইরা ফালাইছে। শালার পুতে বিয়া করসে, আমারেও কয় নাই। চিন্তা করতে পারছোস? সবগুলা নিমকি শয়তান। এজন্যই কয়, ভার্সিটিতে বন্ধু হয় না। সব কালসাপ।”

রূমী মাঝে একবার অর্পাকে কল দিয়ে জানাতে চাইলো পৌঁছাবার খবর। কিন্তু মিন্টুই দিলো না। আলফা মেইলরা কখনো নারীর কাছে নত হয় না। রূমী নিষ্পাপ গলায় জিজ্ঞেস করলো, “আলফা মেইল মানে?”
মিন্টু খাওয়ার মাঝে প্রশ্ন করায় বিরক্ত হয়, “আলফা মেইল মানে শক্তিশালী মেইল। শালারপুত তো আবার ফেসবুকও চালাস না।”
রূমী এবার একটু রাগ হলো, “তুই সারাক্ষণ শালারপুত শালারপুত করছিস কেন? গালি দেওয়া আমার একদম পছন্দ না।”
— “গালি কখন দিলাম? শালার পুত্র। নরমাল একটা শব্দ। এটা কী গালি? কুত্তার বাচ্চা। মানে কী? কুকুর একটা বিশ্বস্ত প্রাণী। বিশ্বস্ত প্রানীর বাচ্চাও বিশ্বস্ত প্রাণী। এগুলো গালি নারে পাগলা, এগুলো ভালোবাসা।”
রূমী এবার স্বাভাবিক হলো। তার চেহারায় জন্মগত এক ধরনের সরলতা আছে। সে তরল কন্ঠে বলল, “বুঝেছি, ******।”
মিন্টু চোখ বড় বড় করলো, মারমুখো হয়ে বলল, “তুই আমাকে গালি দিলি? রূমী? কীভাবে পারলি?”
“গালি কখন দিয়েছি? ভালোবাসা প্রকাশ করলাম দোস্ত।”

**
অর্পা বোরকা হালকা উপুড় করে সাবধানে পা চালিয়ে কলেজে গেলো। ফার্স্ট ডে অ্যাট কলেজ আফটার ম্যারেজ। সবাই উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে। অর্পা ছাতাটা বন্ধ করে ক্লাসে গেলো। নয়না কিছু বলবে বলে ভাবছে। বিবাহ পরবর্তী সময়ে এমন নানা জনের না আগ্রহের বিষয় থাকে। অর্পা চুপচাপ বসে থাকলো। স্যার এসে কীসব ভাষণ দিলেন মাথার উপর দিয়ে গেল। রূমী পৌঁছানোর পর মাকে ফোন দিয়েছে, অর্পাকে দেয়নি। সারাদিন সে একটা ফোনের জন্য অপেক্ষা করেছিলো। রাতে দিয়ে দেখলো ফোন বন্ধ। অর্পার এত রাগ হলো! সে বিষয়টা ভুলে যাবার চেষ্টা চালালো। ক্লাসে মনোযোগ আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালালো। কদিন বাদে ইনকোর্স। পড়াশোনা কিছুই হয়নি।

কে যেন বলেছিলো, স্বামী, সংসার, সন্তান এসব খানিকটা স্বার্থান্বেষী জিনিস। প্রয়োজন ফুরালে নারীকে অস্বীকার করে ফেলতে দুই মিনিটও ভাবে না। অর্পার হঠাৎ একথা কেন মনে হলো, বুঝতে পারলো না। সে মাথা থেকে সকল দুশ্চিন্তা দূর করার চেষ্টা করলো। দুটো ক্লাস শেষে আবার ফেরার বাস ধরতে হলো। বাসা থেকে বেশ খানিকটা দূরেই। যাত্রাপথে সে বাইরেই চেয়ে রইলো পুরোটুকু সময়। সে ভাবতে লাগলো, বিয়ের আগের জীবন আর পরের জীবনে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। সবাই যার যার নিজস্ব ভবিষ্যত নিয়ে ব্যস্ত, দিনশেষে সেই একাকী জীবন। ঘরে ফেরার তাড়া নেই। কারো আলাদা পরোয়া নেই। খেলে খাও, না খেলে না খাও। কারো পরোখ করার সময় পর্যন্ত নেই। তবুও আমরা কী ভীষণ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে থাকি কেউ একজন আসুক। সৃষ্টি থেকে সৃষ্টির এ দূরত্ব বোধহয় খোদা তা’লা নিজের জন্যই রেখেছেন। যেন তার ফিরে আসে একটু তাঁর ঘরে।

অর্পা মোবাইল ফোন অন করে কুরআন তিলাওয়াত শুনতে লাগলো,

“হে প্রশান্ত আত্মা।
তুমি ফিরে আসো তোমার রবের প্রতি সন্তুষ্টচিত্তে, সন্তোষভাজন হয়ে।
অতঃপর আমার বান্দাদের মধ্যে সামিল হয়ে যাও,
আর প্রবেশ করো আমার সৃজিত জান্নাতে।”

আকাশ মেঘলা। বাতাস কারো বাধা নিয়ম মানছে না। উড়ছে বেখেয়ালে ওড়নার ফাঁক গলে উঁকি দেয়া এক গাছি চুল, গগন হেঁকে নামছে বৃষ্টি। বর্ষা অর্পার চোখেও। কাঁদতে কাঁদতে তার হিচকি উঠে গেলো। সবাই ফিরে তাকাতেই সে নিজেকে ধাতস্হ করার চেষ্টা করলো। সে নিজেকে এতকাল শক্তিশালী নারী বলেই জানতো, কী এমন হলো তার? যে এত অল্পতেই তার কান্না পেয়ে যাচ্ছে।

***
রূমীকে মিন্টু প্রতিনিয়ত আলফা মেলের বৈশিষ্ট্য পড়াচ্ছে। তার মতে, আলফা মেল হলে মেয়েদের ভুলেও পাত্তা দেওয়া যাবে না। একটা শক্ত ইমেজ বজায় রাখতে হবে। ওদের কথায় কান দেওয়া যাবে না। কারণ, মেয়েরা আবেগী। ওদের পরামর্শ শুনলে কলসি গলায় বেঁধে পুকুরে ঝাঁপ দেওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না। রূমী পরিশ্রান্ত গলায় বলল, “তাই বলে নিজের বউকেও ফোন দেব না? এটা কেমন কথা? আমার কোনো আলফা মেল হবার দরকার নেই। সর।”

মিন্টু মাথা নাড়িয়ে জোর গলায় নিষেধ করলো।
— “তুই বুঝতে পারছিস না বন্ধু। একেকটা সুপ্ত ফেমিনিস্ট। কাবিন ব্যবসায়ী। কাবিন ধরবে ১ কুটি, অথচ আমরা যৌতুক নিতে পারব না। এটা কেমন কথা?”

রূমীর মন বিতৃষ্ণায় ছেয়ে গেলো, “না আমার বউ কাবিন ব্যবসায়ী, না আমি কোনো যৌতুকের মতো ঘৃন্য জিনিস আশা করি। আমাদের শান্তিতে থাকতে দে। তোর ফেমিনিস্ট গালফ্রেন্ড আর তোর আলফা মেল ব্যক্তিত্ব নিয়ে আরামে সংসার কর। প্লিজ আমাদের ছেড়ে দে!”

মিন্টু শাহাদাত আঙ্গুল উঁচিয়ে বলল, “একদিন ঠিক আমাকে মনে পড়বে। শালা সিম্প কোথাকার। বউয়ের কাছে মারা খাইলে এরপর এই বন্ধুর কথা ঠিকই মনে পড়বে।”
হঠাৎ এর মাথায় কী ভূত চড়ে গেলো রূমীর মাথায় ধরছে না। মাথা প্রচন্ড ব্যথা করছে, তর্ক করার আর শক্তি নেই। সে আর কল করার সময় শক্তি কোনোটাই পেলো না। ঘুমিয়ে গেলো। মিন্টুও ঘুমাতে গেছে। রুমমেট এত সহজে বিয়ে করে এখন সারারাত প্রেমালাপ করবে এসব সহ্য করার মতো ধৈর্য্য তার নেই। ভুংভাং কথা বলে অন্যের সংসারে আগুন ধরানোর মতো কাজ করে এখন তার নিজেকে সাক্ষাৎ শয়তান বলে মনে হচ্ছে। কোন ওয়াজে যেন শুনেছিলো, স্বামী-স্ত্রীর মাঝে দ্বন্দ্ব লাগাতেই শয়তান বেশি শক্তি খরচ করে।

পরদিন ক্যাম্পাসে নতুন কলরব উঠলো। এক সিনিয়র আপু রূমীকে নিয়ে ক্রাশ অ্যান্ড কনফেশনে চিঠি দিয়েছেন। চিঠিটা মারাত্মক। ছেলেরা আফসোস করে বলছে, “সিঙ্গেল হয়ে কোনো জুনিয়র আজ অব্দি চিঠি দিলো না, শেষে কি না বিবাহিতরা পাচ্ছে?”
রূমী জানলো বিকেলের দিকে। মিন্টু তাকে ছবি দেখালো। ও বসে বসে একমনে পড়ছে, চোখে চশমা। বোঝাই যাচ্ছে দূর থেকে চুপিসারে তোলা। টিউশনে দেরী হবে ভেবে সে বেরিয়ে গেলো।

অর্পা রাতে রূমীর আইডি সার্চ করতে গিয়েই কনফেশনটা পড়লো। আইডি ঘুরে দেখলো, রূমীর আইডিতে এখনও রিলেশনশিপ স্ট্যাটাস আপডেট হয়নি। খুব সুন্দর করে লেখা ‘সিঙ্গেল’। অর্পা ভাবলো, সে বুঝি এ ছোট্ট খবরটি কাউকে জানাতে চায় না। মেয়েদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা কমে যাবে বলে! রূমীর আইডিতে তেমন কিছু নেই। বেশ কদিন পরপর সে কিছু সুন্দর কাব্যিকধর্মী লেখা লেখে। তিনবছরের পুরোনো আইডিতে বড়জোর দশ বারোটা লেখা পাওয়া যাবে। অর্পা নিজের আইডিটা ডিএকটিভ করে ফেললো। সে শান্ত চোখে রূমীর রেখে যাওয়া বইয়ের স্তূপে তাকিয়ে আছে। উপরের তাকটায় দৃষ্টি আকর্ষণ করছে হুমায়ুন আহমেদের একটা বই, “দীঘির জলে কার ছায়া গো”। সে নিজের মন নিয়ন্ত্রণের দ্বায়িত্ব নিলো সঙ্গোপনে। এই লং ডিসট্যান্স সম্পর্কের পরিণতি নিয়ে আপাতত ভাবতে ইচ্ছা করছে না।

চলবে ~

আজকে আমার মন ভালো নাই।
নাহিদা সানজিদ।

১১.
“বৃষ্টিভেজা রাতে, আমি তোমায় নিয়ে যাবো,
যতগুলো কথা হয়নি বলা তোমাকেই বলে দেব,
হুম, হুম, হুম…….”

এই ‘হুম’ এর অর্থ হলো মন্তুবাবা লিরিক্স ভুলে গেছে। এখন সে তার নিজস্ব লিরিক্স নিয়ে আসবে। কয়েকদিন ধরে থেকে থেকে বৃষ্টি হচ্ছে। রূমী কয়েকবার অর্পাকে ফোন করার চেষ্টা করলো। ওর নাম্বার বন্ধ বলছে। মাকে জিজ্ঞেস করায় বললেন, কলেজে গেছে। সে অনেকদিন পর নিজের আইডিতে লগ ইন করলো। লাইভ ইভেন্টে শেয়ার করলো, “আলহামদুলিল্লাহ্, আল্লাহুম্মা বারিকলানা…. ”। কিন্তু অর্পাকে মেনশন করলো না। তার এমনিতেই দেখিয়ে বেড়ানো জিনিসটা পছন্দ নয়। নিজের সবকিছু আজীবন গোপন রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো।

মিন্টুর সঙ্গে আরেক দফা তর্ক হয়েছে। ও নাকি নানা আর্টিকেল ঘাঁটাঘাঁটি করে জেনেছে মেয়েরা মূল্য দেওয়া পুরুষমানুষকে পাত্তা দেয় না। মূলত নারীজাতি নিয়ে অনেক বড় রিসার্চ করে ফেলেছে। রূমী ক্লান্ত গলায় বলল, “নারীজাতি নিয়ে এত রিসার্চের সময় আমার নাই। আমি আমার নারীরে কীভাবে চালাবো সেই চিন্তায় আছি ভাই। ওকে কিছু হাতখরচ তো প্রতিমাসে দিতে হবে। টিউশন একটায় তো পোষাবে না। ও কী এখন আমার আব্বার কাছে হাত পাতবে?”
ওর কন্ঠ করুণ শোনায়। মিন্টু হাতে তালি বাজিয়ে বলল, “দেখলি? কী বললাম আমি? এই এখন টাকা না দিয়ে দেখ। কয়দিন টিকে? মেয়েরা আসলে টাকা ছাড়া কিছু যে বোঝেনা, এবার বুঝবি।”

রূমী বুঝলো প্রাক্তনের কথা ভেবে এই ছেলে হতাশার নিম্নস্তরে পৌঁছে যাচ্ছে। সে খানিকটা হেসে ওর কাঁধে হাত রাখলো, “তোর জীবনে কখনো একজন ভালো নারীর ছোঁয়া লাগেনি বলে এই না যে সব নারীই খারাপ,একরকম। শুধু তোর মায়ের কথা ভাব, এই যথেষ্ট। নারী আর পুরুষ কখনো প্রতিপক্ষ ছিলো না, পরস্পর সহযোগী ছিলো। প্রতিযোগিতা না। শুধু শুধু মানসিক শান্তিটা নষ্ট করিস না। আল্লাহর কাছে দুআ কর যেন ভালো কারো দেখা পাস জীবনে। এসব ঝগড়াঝাঁটি ফেসবুকেই মানায়, এজন্য ফেসবুক ছেড়েছি। সব গার্বেজের আড্ডাখানা।”

মিন্টুর জবাবের অপেক্ষা না করে ওকে বেরুতে হলো। উদ্ভাসের খাতা কাটার জন্য একটা ল্যাপটপের দরকার ছিলো। টাকাটা খরচ করে ফেলেছে। এখন নিয়মিত তাকে অফিসে যেতে হয়। একটা কোচিং এ ক্লাসও নিচ্ছে। এখন আবার টিউশন। মাস শেষে অর্পার হাতে কটা টাকা দিতে পারলেই স্বস্তি। এই মেয়েটা আবার কী ধরে বসে আছে কে জানে! এক টুকরো অবসর তার নেই, অর্পা কী বুঝে নেবে না এটুকু?

**
ছাদের মেঝেতে টপ টপ করে বৃষ্টির ফোঁটা ঝরছে। একেকটি ফোঁট পানিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে খানিকক্ষণের জন্য নকশা কাটে। খুব দ্রুতই আবার মিলিয়ে যায়। মারওয়া মনোযোগ দিয়ে দেখছে। ওর হাতে তরমুজ। বৃষ্টিভেজা তরমুজে কিছু সময় বাদে একেকটা কামড় বসাচ্ছে। ওর মতিগতি ঠাওর করা যাচ্ছে না। সাফা আর অর্পা খোঁজ করতে করতে চলে এলো এদিকে। তাকে থেকে হঠাৎ ওদেরও উদ্ভট এই ইচ্ছা জাগ্রত হলো। বাসায় মা একটা নতুন কাজের মেয়ে এনেছেন। ঠিক কাজের মেয়ে নয়, মেয়েটা সৎ মায়ের নিকট থেকে নির্যাতিত হচ্ছিলো। এজন্য কানিজ সাথে করে নিয়ে এসেছেন। মেয়েটা পড়তে চাইলে পড়বে, টুকটাক দেখভাল করবে বাড়ির, এই।

মেয়েটার বয়স কম। নিতান্ত বালিকা বলা চলে। মেয়েটার নাম দিলরুবা। অর্পার মনে হতে লাগলো, এত সুন্দর নাম সে বহুদিন শুনেনি। সে আদুরে গলায় ডেকে উঠলো, “রুবা। এই রুবা?”
রুবা চিলেকোঠায় উঁকি দিলো। অর্পা চমৎকার ভঙ্গিতে হেসে বলল, “আমাদের দুটো তরমুজের পিস এনে পারো? চাইলে নিজের জন্যও নিতে পারো। অসুবিধা নেই।”
রুবাও বিনিময়ে হাসলো। “ভাবী” এবং “আপামণি” দুটো সম্বোধনের মধ্য থেকে সে শেষেরটিই বেছে নিয়েছে। সরু চঞ্চল পায়ে দৌড়ে সে নিয়ে এলো তিন তিনটা কাটা তরমুজের অংশ। সবার ভাগেরটুকু বুঝিয়ে দিয়ে সে উন্মাদ পাগল কিসিমের আপাটিকে অনুসরণ করতে লাগলো।

অর্পা আর সাফাও মারওয়ার পাশাপাশি হাঁটতে লাগলো। মারওয়াকে কিছুটা বিচলিত দেখাচ্ছে। মাঝেমাঝে আকাশের দিকে তাকাচ্ছে। অর্পা উদ্বিগ্ন হলো, “তোমার কী হয়েছে মারওয়া?”
মারওয়া মলিন করে হাসলো, এত করুণ দেখালো! সাফার মনে মনে কান্না উতলে উঠলো। সে চোখভর্তি অশ্রু আটকে মারওয়ার দিকে চেয়ে আছে। যমজ বোন বলেই হয়ত মনের একটা অংশ কেমন করে জোড়া লেগে গেছে ছোট থেকে।

মারওয়া মাথা নিচু করে বলতে চাইলো, “আজকে আমার মন ভালো নেই, ভাবী। মনে হচ্ছে, কাউকে যদি বলতে পারতাম, আজকে আমার অনেক মন খারাপ। কেউ জিজ্ঞেস করতো না কারণ। শুধু পাশে বসে থাকতো। আমাকে দিতো মাথা রাখার জন্য কাঁধ। আমি ভীষণ নিশ্চিন্তে মাথা রাখতাম, ঝরঝর করে কেঁদেও ফেলতাম হয়ত। সে আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকতো, কিন্তু কিছু বলতো না। অকারণ, অহেতুক, অর্থহীন স্বান্তনাও দিতো না। শুধু পাশে থাকতো।”
কিন্তু ও মুখে কিছুই বললো না। এই আবেগ তার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে বেমানান। সে ভ্রু কুঁচকে বলল, “গোপনসূত্রে একটা খবর পেয়েছি, সেটা নিয়েই ভাবছি।”
সাফা স্বাভাবিক হলো, “কী খবর?”
— “তোর তো এক কালামানিকের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হচ্ছে। শুনেছি ছেলে কুচকুচে কালো। দাঁত ছাড়া কিছুই দেখা যায় না। অন্ধকারে সমস্যায় পড়ে যাবি। সেটার সলিউশন খুঁজছি। এখনও বিয়ে করিনি তো, তাই ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারছি না।”
সাফা এই সত্য অগ্রাহ্য করলো আলগোছে। মারওয়ার দুষ্টুমির বাতিক ভেবে নিলো।

অর্পা প্রসঙ্গ বদলালো, “সাফা আমাকে আরিবের সব গল্প বলেছে। আমি ভাবতেই পারছি না, তুমি ওকে না করেছ! এত সুন্দর করে কীভাবে ভাবো বলোতো? অন্য কোনো মেয়ে হলে মজা নিতো কয়েকদিন। গিফট টিফট নিতো। শেষপর্যন্ত বিয়ে করতো না। কত দেখেছি! আমার খুব খারাপ লাগতো, জানো?”
মারওয়া বড়দের মতো মুখ বিরস করে ফেললো, “এসব প্রেম পিরিতির গল্প আমার সঙ্গে করবেন না। আমি আন্ডার এইটিন। এইসব কিছু বুঝি না।”
অর্পা আর সাফা এমন ভাবে হেসে উঠলো যেন কোনো কৌতুক। ওরা ভুবন কাঁপিয়ে হাসছে। মারওয়া ওদের কাছ থেকে একটু সরে গিয়ে আলাদা হাঁটতে লাগলো।

অর্পা হেঁটে আবার ওর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো, “আচ্ছা, ধরো, আরিব এলো অনেক বছর পর। ক্যারিয়ার বানিয়ে। আবার তোমাকেই চাইলো। তখন কী তুমি ওকে বিয়ে করবে?”
মারওয়া বিরক্ত হলো। ধমকে বলল, “বিয়েই করব না। ভাইয়া নিয়ত করেছিলো, নারী জাতির ছলনায় পড়বে না। আমি নিয়ত করলাম, পুরুষজাতির ছলনায় পড়ব না। ডিসিশন ফাইনাল, মামলা ডিশমিশ।”
সাফা বিভ্রান্তি নিয়ে বলল, “কিন্তু এর পরপরই তো ভাইয়ার বিয়ে হয়ে গেছে।”
মারওয়ার বিরক্তির পারদ সীমা ছাড়ালো। তাতে এক ধরনের নাটকীয়তা বিদ্যমান। সে সাফার কানে ফিসফিসিয়ে বলল, “তাতেই তো এত ভালো বউ পেলো। নিয়তের ফল। আমি দেখেছি, যাদেরই জোর করে বিয়ে হয়, তাদের সংসার সুখের হয়।”
অর্পা ভ্রু নাচিয়ে জানার আগ্রহ প্রকাশ করলো। সাফা আরো বিভ্রান্ত হলো, “এটা যে মুনাফেকি ধরনের নিয়ত, আল্লাহ জেনে যাবেন না?”

মারওয়া জবাব দেবার জরুরত অনুভব করলো না। ও এমুহূর্তে ছাদের পাকা করা সিটে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। বৃষ্টিবিলাস। অর্পা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মারওয়ার মাঝের এই অদ্ভুতুড়ে ব্যাপারটা কেউ ধরতে পারে না। অনেকের ধারণা, সে মানসিকভাবে কিছুটা বিপর্যস্ত। বেশি দরকার না হলে তাই কেউ ঘাঁটায় না। কিন্তু অর্পার মনে হচ্ছে, মারওয়া সবকিছুই ইচ্ছে করেই করে। জেনেবুঝে। পাগল মানুষদের নিয়ে কারো মাথাব্যথা থাকে না, নিজেকে এই মানবারণ্যে থেকেও একলা করে রাখার অভিনব উপায়।

***
রূমী যেতে যেতে অনেকটুকু ভিজে গেলো। মিহীকা দরজা খুলে দিয়েছে। মেয়েটাকে ও তিন বছর যাবত পড়াচ্ছে। তখন ছিলো অষ্টম শ্রেণীতে। এখন কলেজ প্রথম বর্ষের ছাত্রী। সে মাথা নিচু করে প্রবেশ করলো। হাত দিয়ে ঝেঁড়ে মাথা মুছে নেওয়ার প্রচেষ্টা চালালো বৃথা। মিহীকা একটা তোয়ালে এনে দিলো। রূমী নিতে নিতে খেয়াল করলো, তার ছাত্রী টকটকে লাল রঙের লিপস্টিক লেপেছে ঠোঁটে। রঙ কড়া লাল হওয়ায় চোখে পড়েছে দ্রুত। রূমী মনোযোগ হটানোর চেষ্টা করলো। পড়াতে পড়াতে হঠাৎ মিহীকা বলে উঠলো, ”স্যার, আপনি কী জানেন? আপনার চুল বড় হলে অনেক ভালো লাগবে। আপনার মাঝে এক ধরনের হিমু হিমু ব্যাপার আছে। অবশ্য হিমু চশমা পড়তো কিনা জানিনা। শুভ্র পড়তো।”

রূমীর স্বভাবের সঙ্গে রূঢ়তা ব্যাপারটা ঠিক যায় না। তবুও সে গম্ভীর হবার চেষ্টা করলো, “মিহীকা, আপনি ডেসিমেলের অঙ্কটায় মনোযোগ দিন। কলেজে প্রথম বর্ষে অনেকে আইসিটিতে ফেল করে, জানেন? আমার এক বন্ধু, অনেক মেধাবী ছিলো। কিন্তু প্রথম সেমিস্টারে কেমেস্ট্রিতে ফেল করলো। কেমন পড়তে হবে বুঝতে পারছেন?”
রূমীর আরেকটি অভ্যাস। সে তার নারী ছাত্রীদের ‘আপনি’ করে বলে। হোক সে ক্লাস ওয়ানের ছাত্রী, তবুও এমন করে বলবে যেন তার গুরুজন। মিহীকা হেসে বললো, “আপনি করেননি,স্যার?”

রূমী খেয়াল করলো আজকে মিহীকা চুলও বাঁধে নি। অঙ্ক করার সময় বারবার তার মুখ ঢেকে ফেলছে। মায়েদের এই বয়সী মেয়েদের উপর নজরদারি করা দরকার, রূমী কি করবে ভেবে পেলো না। ছোট্ট একটা মেয়ে, এখন তার একটু একটু করে পৃথিবী চেনার বয়স। একটা ভুল পদক্ষেপ তাকে কতটা হয়রান করে দেবে তার মায়ের এতটুকু বোধ থাকা উচিত।

মিহীকা অঙ্কের মাঝে বিরতি নিয়ে বলল, “স্যার, আপনি জানেন? হিমুর কোন বিষয়টা আমার ভালো লাগেনি?”
সে উত্তরের অপেক্ষা না করে অনর্গল বলতে থাকে, “সে হলুদ পাঞ্জাবি পরে। কী বিচ্ছিরি দেখতে! আপনি নীল পাঞ্জাবি পরবেন। আপনাকে অনেক সুন্দর দেখায়। তখন মনে হতে থাকে, এই অসভ্য জগতে আপনার চেয়ে ভালো মানুষ আর একটিও নেই।”
রূমী এবার বিরক্ত হলো। বলল, “তোমার আম্মু কোথায়?”

মিহীকা খিলখিল করে হেসে উঠলো। সে কলম রেখে স্মৃতিচারণ করতে বসলো, “জানেন স্যার? আপনাকে প্রথম যখন রেখেছিলো, আমি খুব বিরক্ত হয়েছিলাম। সারাক্ষণ ভাবতাম, কী করে আপনাকে বাদ দেওয়ানো যায়। পুরুষ মানুষ একদম আমার সহ্য হতো না। কেন হতো না, সেটাও এক ইতিহাস। একদিন আমার মা নানীর অসুস্থতায় আমাকে একা রেখে চলে গেলেন। বাবাও দেশের বাইরে। আমি একা একা ঘরে বসে আছি। আপনি আসায় ভয় করতে লাগলো। মনে হলো, বাসায় তো কেউ নেই। তবুও সাহস করে দরজা খুললাম। আপনি খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় পড়ালেন। প্রতিদিনের মতো আমাকে খুকি ভেবে মজার মজার গল্প বলে হাসালেন। একবারের জন্যও খেয়াল করলেন না, আমার বাসাটা নিস্তব্ধ হয়ে আছে। এরপর চলে গেলেন। সেদিনটা আমি আমার সারাজীবনে কখনো ভুলতে পারব না। এই সাধারণ ব্যাপারটার জন্যই আপনাকে আমার আজন্ম ভালো লেগে গেলো, স্যার।”

রূমীর খুব অস্বস্তি লেগে উঠলো। সে কিছু ভেবে ওঠার আগে মিহীকা মৃদু হাসির মিশেলে বলতে লাগলো, “আজকের দিনটাও অন্যরকম, স্যার। কেন জানেন?”
রূমীর মনে হচ্ছে এই ঘর থেকে এক্ষুনি তার বেরিয়ে পড়া উচিত। মিহীকা তার নিজের প্রশ্নের সমাধান নিজেই দিলো, “আজকেও কেউ বাসায় নেই, স্যার।”
এর চেয়ে ভয়ানক কোনো পরিস্থিতি তার জীবনে সম্ভবত কখনও আসেনি।

চলবে ~

আজকে আমার মন ভালো নাই পর্ব-৮+৯

0

আজকে আমার মন ভালো নাই।
নাহিদা সানজিদ।

৮.
সেদিন বৈশাখের চরম তাপমাত্রাকে ভেদ করে বিনা নোটিশে কালবৈশাখী আরম্ভ হলো। আকাশে সিঁদুর রাঙা মেঘের আনাগোনা। থেকে থেকে বাতাস ছুঁয়ে দিচ্ছে প্রবলভাবে। অর্পা দৌড়ে বাড়ির দরজায় দাঁড়ালো। বৃষ্টি এলে সে ঘরে বসে থাকতে পারে না। এক অদৃশ্য সম্মোহন তাকে বৃষ্টির কাছাকাছি নিয়ে আসে। চলমান বারিধারায় সে তার সকল দুঃখ উজাড় করে দিলো। সে এক বৃষ্টি থেকে আরেক বৃষ্টির আগ পর্যন্ত সকল দুঃখ যাতনা একটি খামে পুরে রাখে, মনের খামে। আর বৃষ্টি এলেই তাকে পৌঁছে দেয়। বৃষ্টি যেন তার ডাকপিয়ন।

পৃথিবীতে চার ধরনের বৃষ্টি আছে। এর মধ্যে বাংলাদেশে এর দুটো সম্ভবত দেখা যায়। এটা কোন প্রকারের বৃষ্টি অর্পা অনেক ভেবেও মনে করতে পারলো না। কোথায় যেন পড়েছিলো! অর্পা দরজা আগলেই কেবল দাঁড়িয়ে থাকলো। ভিজলো না। বৃষ্টি তার নিজ নিয়ম মেনে এক ছটাক দিলো, তবুও না দেবার মতোই। এই একটু বৃষ্টিতেই অর্পার গায়ে জ্বর চলে এলো। অথচ, সে নিজেকে সহনশীল শক্তপোক্ত নারী বলেই জানতো। সারা দুপুর একা একা সে ক্রমাগত হাঁচি দিতে থাকলো। রূমী বাইরে গেছে ট্রেনের টিকেট কাটতে। কালকে ওর যাবার পালা। বিকেলের দিকে এসেই ও অবাক হয়ে গেল, “এতটুকু সময়ের মধ্যে অসুখ বাঁধিয়ে ফেলেছো? সারাদিন তো বড় বড় কথা বলতে থাকো, যেন আমার নানী-শ্বাশুড়ি।“

একটা থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মেপে সে রান্নাঘরে গেলো, লবঙ্গ, এলাচ, দারুচিনির লাল চা করতে। হলে ওঠার আগে তাকে বেশ কয়েকদিন আলাদা বাসায় থাকতে হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে সিট পাওয়া যেত না তখন। এখনও সম্ভবত যায় না। বন্ধুরা মিলে কীভাবে কীভাবে যেন অনেক রান্নাই শিখে ফেললো। এটা সে গোপন রেখেছে। কে যেন বলেছিলো, পুরুষ মানুষের রান্না জানার দক্ষতা গোপন রাখাই ভালো। নয়ত ঘরের নারীসমাজ কথায় কথায় ভং ধরবে, বলবে, “তোমার রান্না অনেক মজা, আজ একটু রাঁধো, শরীরটা ভালো লাগছে না।”।
এটাও কোনো বড় ভাইয়ের দেওয়া উপদেশই হবে।

কিছুক্ষণ পরেই মা আসলেন, সন্দিগ্ধ চোখ। রূমী হাত খানিকটা উঁচু করে আত্মসমর্পণ করার ভঙ্গিতে বলল, “আম্মা, প্লিজ বইলো না, জীবনে তো আমাদের কিছু করে খাওয়ালি না। ওরকম সিচুয়েশন হলে খাওয়াতাম।”
কানিজ মুখ বাঁকালেন প্রথমে, এরপর হেসে ফেললেন, “বলতেই যাচ্ছিলাম, এখন সর। কত করে খাওয়াস দেখি তো।”
রুমীকে সরিয়ে চা বানানোর দ্বায়িত্ব নিলেন।
রূমী সমঝোতায় আসতে চাইলো, “মা, তোমার তো মেয়েরা আছে, সবাই আছে। অর্পার এখানে কে আছে বলো? আমিও তো কাল চলে যাব।”
কানিজ ভ্রু উঁচিয়ে অনেক কিছু বুঝে ফেলার ভাব করলেন, “ওওও। আমরা বুঝি অর্পার কেউ না।”
রুমী কিছু বললো না। কি বলা উচিত আদো বুঝতে পারছে না। কানিজ সতর্ক গলায় বললেন, “শুন আব্বু। অর্পা মনে হয় একটু রাগ, তোকে মনে হয় বলেছে। আমি আরিবের নানীকে কীভাবে না করব বুঝতে পারছিলাম না, তাই বলে দিয়েছি বেকার। এতকিছু ভেবে বলিনি, ওকে একটু বুঝিয়ে বলিস।”

রূমীকে অর্পা কিছু বলেনি। বলার মতো মেয়ে সে নয়। তবুও মায়ের কথা শুনে ভালো লাগছে। সে মাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, “আম্মা, তুমি জানো, তুমি কত ভালো? আমাদের জীবনে ভুলচুক বড় কোনো বিষয় না। সবচে সুন্দর বিষয়টা হলো এই ভুলটা মেনে নেওয়া, স্বীকার করে ফেলা, অনুশোচনা করা আর মাফ চেয়ে নেয়া। আর এই জিনিসটা আমি তোমার থেকে শিখেছি!”
কানিজ কোনো জবাব দিলেন না। চায়ের কাপ হাতে দিয়ে হাসলেন, “যা, বউয়ের সেবা কর গিয়ে। জীবনে তো মায়ের সেবার কথা মুখেও আনতে দেখিনি..”

**
প্রতিবেশী এক মহিলা বউ দেখতে এসেছেন। রুমী বউ কেমন পেলো, সেটাই তার মূল কৌতুহল। অর্পা এলো এলোমেলো পা ফেলে। নাকের ডগা লাল হয়ে আছে,উদভ্রান্তের মতো দৃষ্টি। সে মৃদু স্বরে সালাম করলো। ভদ্রমহিলা সালামের জবাব নিলেন। উনার মুখে অসন্তোষ প্রকাশ পাচ্ছে। বউ মনে হচ্ছে পছন্দ হয়নি। রূমী পাশে এসে দাঁড়ালো, বলল, “তুমি ঘরে গিয়ে শুয়ে থাকো, পরে একদিন কথা বলে নিও।”
অর্পা ভেতরে চলে গেলো। কানিজ কিছু মিষ্টি আর টুকটাক নাস্তা হাতে এলেন।
ভদ্রমহিলা ফিসফিস করে বললেন, “রুমী হিসেবে বউ মনে হচ্ছে একটু উজ্জ্বল কম। কী বলেন আপা?”
কানিজ কী বলবেন বুঝতে পারছেন না, “আপা, বউ স্বভাব চরিত্র দেখে এনেছি। তাছাড়া ও যথেষ্ট উজ্জ্বল। আজ অসুখ তো, তাই কালো দেখাচ্ছে হয়ত।”

রূমী মেয়েলি আলাপে থাকলো না। তার বউ কী ফেয়ার অ্যান্ড লাভলীর অ্যাড করবে নাকি যে তার উজ্জ্বল তকতকে ফর্সা মুখ থাকতে হবে। নারী হয়ে নারীকে বিশ্লেষণ করা, কেমন যেন লাগে তার কাছে। কোনো পুরুষ এই মন্তব্য করলে তাও ভালো দেখাতো। বুঝতো, তার আকর্ষণের বিষয়াদি আছে। একজন নারীর অন্য একজন পুরুষের ফর্সা বউ নিয়ে এত মাথাব্যথা কেন থাকবে? কদিন আগে সাফাকে এক বাড়ি থেকে দেখতে এলো। রুমী নিজের বোনকে এতদিন অসম্ভব রূপবতী বলেই জানতো। কিন্তু ছেলের মা আবিষ্কার করে ফেললেন, সাফার নাক বোচা, চাকমাদের মতো। এদিকে ছেলে মেয়েকে পছন্দ করে বসে আছে। রূমীকে ডেকে বলল, “ভাই, বিয়ে করলে আপনার বোনকেই করব।”
রূমী দীর্ঘশ্বাস ফেললো, এত মূল্যবান জীবন নারীকে চিনতে পার করে দেওয়ার মানেই হয় না। জীবনে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে।

রূমী যাবার পেছনেই মারওয়া এসে হাজির। হেঁটে হেঁটে পপকর্ণ খাচ্ছিলো, হঠাৎ ভদ্রমহিলার মাথা হাতড়ে একটা সাদা চুল নিয়ে এলো, মুখে হাত দিয়ে কৃত্রিম বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, “আল্লাহ! আন্টি! আপনার চুল পেকে গেছে!”
ভদ্রমহিলা হকচকিয়ে গেলেন, বিব্রত মুখে বললেন, “তো কী হয়েছে?”
মারওয়া মাথা নাড়িয়ে মর্মাহত চেহারায় বলল, “এই আরকি, সাদা জিনিসও সবসময় ভালো না। এই দেখেন, আমার গায়ের রঙ ফকফকা ফর্সা। তবুও কেউ বিয়ে করতে চায় না। ছেলে বিশ্বাসই করতে চায় না, আমি সিঙ্গেল। মনে করে, এত সুন্দরী মেয়ের বয়ফ্রেন্ড নাই, এরচেয়ে মিথ্যা আর কী হতে পারে? আম্মা, তো এটা নিয়ে চিন্তায় আছে, না আম্মা?”
কানিজ রাগ রাগ চোখে চেয়ে থাকলেন। মারওয়া পাত্তা দিলো বলে মনে হলো না,সে দারুণ ভাবে হরহর করে মিথ্যা বলার গুণ নিয়ে জন্মেছে, “চিন্তা করেছি কালকে থেকে নো সানস্ক্রিন ক্যাম্পেইন শুরু করব। রোদের তাপে চেহারা কালো ছালো বানিয়ে ফেলব। জীবনে বিয়ে একটা তো দরকার। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এই যে কিছু মহিলা, বিয়ের পরেরদিন বউকে রিভিউ করে। রিভিউতে ফেল মারব। ভাবীও এই ট্রিকস ফলো করে ফেল মারলো, দেখলেন না?”

ভদ্রমহিলা আগামাথা বুঝতে পারছেন না। এই মেয়ের কী মাথা খারাপ? মারওয়া মাথা নাড়িয়ে নিজেকে আরেকবার সঠিক প্রমাণের চেষ্টা করলো, “সারাজীবন ফেল করেছি পরীক্ষায়। ফেলটুস মেয়েদের জীবনে একটা সহজ সরল সমাধান হলো বিয়ে, বিয়েতেও যদি ফেল মারি, তাহলে তো জীবন অন্ধকার।”
বলতে বলতে সে ভদ্রমহিলার মাথা দ্বিতীয়বারের মতো হাতড়ে দুটো উকুন নিয়ে এলো, একটার রঙ ফ্যাকাশে, আরেকটার রঙ কুচকুচে কালো। উনার হাতের ভাঁজ খুলে তালুতে উকুন দুটো রেখে বলল, “আন্টি বলেন তো, এই উকুনটা সাদা কেন?”
“কেন?”, উনি ভয়ে ভয়েই জিজ্ঞেস করলেন। উনার ধারণা, মারওয়ার কোনো মানসিক সমস্যা আছে।
মারওয়া উত্তর করলো, “কারণ এটার রক্তশূন্যতা।”
বলে সে চলে গেলো। ভদ্রমহিলা কানিজকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপা, মেয়েকে ডাক্তার দেখান না? লক্ষ্মণ তো ভালো না।”

***
রূমী ঘরে ফিরে দেখলো সবাই একসঙ্গে হাসাহাসি করছে কি নিয়ে। অর্পা নেই কেবল। সে আগ্রহ নিয়ে শুধালো, “ব্যাপার কী?”
মারওয়া হাই তুলল আলস ভঙ্গিতে। বলল, “কোনো ব্যাপার নাই। তোর কালা বউ নিয়ে কথা হচ্ছে।”
— “আমার বউ কালো, তোকে কে বলল?”
— “আমাদের চোখ আছে না?”
রূমী সিরিয়াস হবার ভং ধরে বলল, “তোমাদের চর্মচক্ষু আছে। মনের চোখ নেই। অবশ্য তোদের চর্মচক্ষুতেও সমস্যা হয়েছে বলে আমার ধারণা। টাকা পয়সা হলে ডাক্তার দেখিয়ে দেব।”
মারওয়া এগিয়ে এলো গোপনীয় কিছু বলবার উদ্দেশ্যে, মাথা বাড়িয়ে রূমীর কানের কাছে নিয়ে বলল, “সুন্দরী বউ রেখে চলে যাচ্ছিস, চিন্তা হচ্ছে না? পাহারা দিতে বলবি না? বলার আগে অ্যাডভান্স করে তারপর বল। ভেবে দেখব।”
রূমী ভ্রুক্ষেপহীন, “একটু আগে না বললি, আমার বউ কালো। পাহারা দিতে হবে কেন?”
সাফা হেসে মারওয়ার পক্ষ নিলো, “ধর, কেউ তোর মতো মনের চোখ দিয়ে দেখলো। বিপদ না?”
মারওয়া সাফার হাতে হাত রাখলো শব্দ করে, “এই না হলে আমার বোন?”
রূমী হেসে ফেলল।

ওদের সঙ্গে তর্ক শেষে ঘরে গিয়ে দেখলো অর্পা গভীর ঘুমে। অর্পার গায়ে একটা কাঁথা টেনে দিয়ে ওর পাশে বসে থাকলো। কালকে থেকে দুজন আবার দুই পৃথিবীর বাসিন্দা হয়ে যাবে। অপরিচিত এক জেলায় গড়তে হবে তার একাকী সংসার। সেটাকে ঠিক সংসার বলা যায় না। একটা কথা ইদানীং খুব জনপ্রিয়, “একবার ঘর ছেড়ে বের হলে আর কখনো ঘরে ফেরা হয় না। মাথার উপর কংক্রিটের ছাদ থাকে, কিন্তু কোনো ঘর থাকে না।”
অর্পা এপাশ ওপাশ করলো কিছুক্ষণ। হঠাৎ চোখ মেলে বলল, “আপনি? ঘুমাননি? এখন কয়টা বাজে?”
— “ওঠো, ন’টা। চলো, ভাত খাব।”
অর্পা উঠে বসলো, খুব সাধারণ ভাবে প্রশ্ন করলো, “আপনি কী কাল চলে যাবেন?”

রূমীর “হ্যাঁ” বলতে খুব কষ্ট লাগলো। পৃথিবীতে কিছু কথা উচ্চারণ করা কঠিন, লেখা কঠিন, ভাবাও কঠিন। তবুও সাহস করে তার মুখোমুখি হতে হয়। রূমী কিছুই বললো না। ও ব্যাগ গুছাতে শুরু করলো। তেমন কিছু নেবার নেই। দুটো শার্ট, পাঞ্জাবি আর একটা ফর্মাল স্যুট। অর্পা বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো তাকে। রূমী আচানক চোখে চোখ পড়তেই বলল, “কী দেখছো?”
— “ভাবছি।”
— “কি?”
অর্পা কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, “ভাবছি, আমার জায়গায় যদি নীরা বা অন্য কোনো মেয়ে থাকতো, আপনি এভাবেই সেবা করতেন?”
রূমীর ভুল ভাঙলো। স্বামী বিদায়ে দুঃখ করার মতো মেয়ে অর্পা না। রূমীর ধারণা, অর্পা নীরাকে নিয়ে যতটুকু সিরিয়াস তাকে নিয়ে তার একভাগও না। সে আজ একটা উপসংহার টানলো নীরা মামলায়। ডায়েরীর পৃষ্ঠা দুটো ছিঁড়ে দুমড়েমুচড়ে ফেলে দিলো। হাত জোড় করে বলল, “একটু শান্তি দাও! আর জীবনে ডায়েরী লিখব না। আমার ঢের শিক্ষা হয়েছে।”
অর্পার কপালের ভাঁজ ঠিক হলো না। দ্বিগুন সিরিয়াস হয়ে বলল, “কাকে নিয়ে লিখবেন না বলছেন? নীরাকে নিয়ে? এখন কী অন্য কাউকে নিয়ে লিখবেন বলে ভাবছেন? কী সর্বনাশ! হিমুর সব রূপ ধারণ করতে শুরু করেছেন, এই নীরা, এই মারিয়া, এই রূপা।”

অর্পার মজা এবার ব্যর্থ হলো। রূমী রাগ করে বেরিয়ে গেলো। ওর বাড়াবাড়ি আর ভালো লাগছে না। আজকের দিনটা সে সুন্দর করে কাটাতে চেয়েছিলো। অথচ কী হলো? অর্পার কী মন বলে কিছু নেই? একটা মানুষ এত কঠিন হৃদয়ের কী করে হতে পারে? অর্পা তাকে মানাতে চাইলেও তার মন সায় দিলো না। সে ঠিক করলো, কাল ভোরে উঠেই সে বেরিয়ে যাবে। অর্পাকে জাগাবে না। থাকুক সে, আর তার শান্তিপূর্ণ একলা জীবন। ফোনও করবে না গিয়ে, নিশ্চয়ই অর্পার এতেও কিছু যায় আসবে না।

ভেবে ভেবে রূমীর মন কেবল বিষাদে তলিয়ে যেতে থাকলো। সে আবার বিয়ের প্রথমদিন থেকে ভাবতে শুরু করলো, অবাক হয়ে আবিষ্কার করলো, তার আর অর্পার কোনো গল্প নেই।
গল্প শুরু হবার আগে নীরা নামটি রেড লাইটের মতো নিষেধের দাগ টেনে বসে আছে। তবুও, কেন এত এত মন খারাপের ভার? মনের সঙ্গে যোগসূত্র নেই, এমন জিনিস নিয়ে কী আমরা মন খারাপ করি?

চলবে ~

আজকে আমার মন ভালো নাই।
নাহিদা সানজিদ।

৯.
অর্পা একটা আয়না এগিয়ে দিলো। চারকোণা ফ্রেম, সরু বক্সটা খুললেই একটা পরিস্কার আয়না চোখে পড়ে। আরেক পাশে একটা ছোট্ট চিরুনী। রুমী আয়নায় চোখ রাখলো। আয়নায় অর্পার হাসিমুখ। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দুটি চোখ। কাজল দেয়া। রূমী তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ সেই বিশ্বাসের আয়নায়। সে এই আয়নায় কখনো দাগ পড়তে দেবে না। বিশ্বাসের আয়নায় দাগ পড়লে তা আর ঠিক হয় না। অমন অসহ্য যন্ত্রণা কখনো তার জীবনে না আসুক।

ফজরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে রূমীর ঘুম ভাঙলো। ভোরবেলার স্বপ্ন! রূমী কিছুক্ষণ আলগোছে শুয়ে রইলো। এপাশ ওপাশ করলো। অর্পা ঘরে নেই। এত সকালে কি করছে আল্লাহ মাবুদ জানে! রূমী চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসলো। অনিচ্ছাস্বত্তেও যেতে হবে। মাঝেমাঝে ওর মনে হয়, ঘরে বসে একটা কৃষিকাজ শুরু করলেও হতো। লোকাল কোনো ন্যাশনাল কলেজে ভর্তি হয়ে যেতো। অর্পার সঙ্গে আসতো, যেতো। সহজ সরল একটা জীবন। ইদানীং ওর মাথা সারাদিন ‘অর্পা’ ‘অর্পা’ করছে। সে মাথা ঝাঁকালো এমন ভাবে যেন ঝাঁকালেই অর্পার চিন্তা উধাও হবে।

হ্যাঙ্গার থেকে একটা সাদা পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে সে বেরুলো। ফজরে মসজিদে মানুষ তেমন হয় না। হাতে গোনা কয়েকজন। সামনের কাতারে অনায়াসে জায়গা পেয়ে গেলো। ইমাম সাহেব খুব সুন্দর একটা তিলাওয়াত করছেন, সূরা দ্বুহা। আয়াতগুলোর বঙ্গানুবাদ প্রাণ সঞ্চার করে,

“আপনার রব আপনাকে পরিত্যাগ করেননি,
আপনার প্রতি অসন্তুষ্টও হননি।”
“নিশ্চয়ই কষ্টের সাথে স্বস্তি আছে।”

নামাজের পর সে কিছুক্ষণ বসে রইলো ঠান্ডা মেঝেতে। ওর কিছুই ভালো লাগছে না। মন কেমন যেন অশান্ত লাগছে। কি করবে বুঝতে পারছে না। সে চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে রইলো সেথায়। ভার্সিটিতে গেলে প্রায়ই নামাজের রুটিন এলোমেলো হয়ে যায়। রাত জেগে অ্যাসাইনমেন্ট করলে পরেরদিন আর হুঁশ থাকে না। কী এক দূর্বিষহ জীবন লাগে তখন! হঠাৎ মনে হলো কয়েকদিন শ্বাস ফেললো নিশ্চিন্তে। আল্লাহর ঘরে এসে খানিকটা বিলিয়ে দিলো যাপিত জীবনের সকল পেরেশানি।

তাকের ওপর থেকে একটা কুরআন এনে সে পড়তে শুরু করলো বাক্বারাহ থেকে। আবার কখন না কখন হাতের নাগালে আসে! অথবা এমন আকস্মিক মৃত্যু এলো আর এই ঘরের মালিকের সঙ্গে দেখা করার প্রস্তুতি থাকলো না। সব ভুলে সে এক মনে পড়তে থাকলো। কখন সুবহে সাদিকের নরম স্পর্শ বদলে সূর্যের আলো হানা দিলো খেয়াল হলো না। সে বন্ধ করে দুআ করতে শুরু করলো নিয়মতান্ত্রিক, মায়ের জন্য, বাবার জন্য, বোনেদের জন্য, দাদীর জন্য, প্রয়াত বাসিন্দাদের জন্য, আজকে সে নিয়মের মাঝে ঢুকে গেলো আরেকজন। অর্পা।
আমার মালিক অর্পাকে তাঁর চাদরে জড়িয়ে নিক, সেও ভালো থাকুক।

**
“উপন্যাস পড়ার কিছু অপকারিতা আছে। আমার ধারণা অপকারিতাই বেশি। যেমন ধরুন, উপন্যাসে নায়ক-নায়িকা দুজনের মনের কথা প্রকাশ পাচ্ছে, আপনি জানতে পারছেন, সহজেই হিসেব করতে পারছেন ভালোবাসার পরিমাণ। কিন্তু বাস্তবে আমরা তেমনটা পারি না। আমরা কেবল নিজেদের টুকুই জানি। অন্যদেরটা জানার সুযোগ হয় না। এই যেমন ধরুন, আমার ভাই। ছেলে হিসেবে বোকা না সহজ সরল আমি জানিনা। এ যুগে এসে কাউকে এত ভ্যাবলা হতে দেখিনি।

সে আমায় এসে আজ বলছে, ‘মারু, বোন। তুই আমার বোন হলেও ভাইয়ের চেয়ে কম যাস না। তোর সাহসকে আমি সমীহ করি। নারী সবসময় নরম থাকলে লোকে সুযোগ নেয়। তুই অর্পাকে দেখে রাখিস, ও তো এ জায়গায় নতুন। কোনো সমস্যা হলে তো তোরা ছাড়া আর কেউ নেই। ওর খোঁজখবর রাখিস।’

খাওয়ার টেবিলে গিয়ে দেখি আরেক ঢং শুরু হয়েছে। কোনো কথা বলছে না। ভাবী এত কষ্ট করে নাস্তা বানালো, সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে খেয়ে চলেছে। নাটক! এত নাটক দেখে আর পারি না। জামাই বউয়ের নাটক দেখার জন্য আমাদের রাখা হয়েছে, দর্শক। বিয়ে সংসার এসব জিনিস আমার মাথায় ধরে না। কদিন আগেও বিয়ে করবে না বলে মরে যাচ্ছিলো। এখন দরদ দেখাতে এসেছে! এসব নাটক হবে আমি আগে থেকেই জানতাম। ভাগ্যিশ নিজের পার্সোনাল ডায়েরীতে লিখছি, নয়ত এসব ডিরেক্টর, ফিরেক্টর, লেখক-ফেখকের দিন আরো আগেই শেষ হতো। ওদের বউরা ভাতে মরবে বলে কাউকে জানাইনি। সমশের হয়ে কী যে এক বিপদে আছি!”

মারওয়া খাওয়ার টেবিল থেকে ফিরে কিছুক্ষণ মেজাজ খারাপ করে বসে থাকলো। ডায়েরি লেখার পর সে একমনে অন্যকিছু ভাবতে বসলো। আরিব হম্বিতম্বি করে গেছে। ও নাকি দুমাসের মধ্যেই কিছু করে দেখাবে। কানিজ কী করে তাকে বেকার বলবেন তখন দেখবে। মারওয়ার ইচ্ছা করছিলো ভেংচি কেটে আসে। তবুও নিজেকে সংযত করেছে। সে ভেবেচিন্তে আরিবকে একটা চিরকুট লিখলো, ঠান্ডা মাথায়। জীবন থেকে আরিব নামক অধ্যায়টি দ্রুত বন্ধ করা দরকার, পথ অনেক দূর!

***
সকাল সকাল হুলুস্থুল পড়ে গেছে। বাড়ির ছেলে চলে যাবে। অর্পা ভোরেই শ্বাশুড়িকে সাহায্য করতে এসেছিলো। রূমীকে কি বলে “সরি” জানাবে সে ভেবে পেলো না। রূমী নাশতা খেলো নিরবে। একটা শব্দও বাড়তি বললো না। অর্পাও কিছু বলার মতো খুঁজে পেলো না। ও শুধু দুচোখ মেলে দেখতেই থাকলো। মনে মনে মনে অনেককিছু সাজিয়েও বলতে পারলো না কিছুই ঠিকঠাক। অর্পা ভাবলো, “থাকুক। আমাকে না বলে কীভাবে যায় দেখব”।

রূমী শেষপর্যন্ত অর্পার সঙ্গে কথা বললো না। শুধু যাবার আগে বলল, “যাই”। অর্পা সংশোধন করে দিলো, “বলতে হয়, আসি। যাই বলা ভালো না। আম্মা বলে।”
রূমী কিছু বললো না। ওর বাবা রিকশা দাঁড় করিয়েছেন। এক্ষুনি যেতে হবে। দাদী, মা সবাই দরজা আগলে দাঁড়িয়ে আছেন। মা বরাবরের মতো আঁচল মুখে চেপে রেখেছেন। চোখে পানি টলমল করছে। প্রতিবার নিয়ম করে কাঁদার অর্থ রূমী খুঁজে পায় না। মায়ের ভালোবাসার অর্থ খুঁজতেও নেই। সে সবার থেকে বিদায় নিয়ে বেরুলো।

হঠাৎ অর্পা খালি পায়ে ছুটে গেলো। পেছন থেকে ডাকলো না। মেয়েরা কিছু কুসংস্কার না চাইতেও মানে। পাশে গিয়ে বলল, “দাঁড়ান!”
সত্যি সত্যি একটা আয়না এগিয়ে দিলো সে। সবুজরঙের ফ্রেম। অন্যপাশে সেঁটে রাখা ছোট্ট একটা চিরুনী। কিন্তু বাস্তবে অর্পার চোখে কাজল নেই। আয়নায় পড়ছে ওর আলুথালু প্রতিবিম্ব। অগোছালো করে খোঁপা করে রাখা চুল। অপর্যাপ্ত ঘুমের দরুন দেবে যাওয়া ক্লান্ত চোখ। রূমী অবাক হয়ে চেয়ে রইলো।

হর্ণের শব্দে তাড়া দিলেন বাবা। ওকে উঠে বসতে হলো। এত আপনজনের মাঝে কি বা বলতে পারতো ও? হঠাৎ পরিচিত গন্ডি পেরিয়ে চলে এলো দৃষ্টিসীমানার বাইরে। আয়নাটা মুখের সামনে ধরে সে অর্পাকে দেখতে চাইলো, বারবার ঘুরে ফিরে কেবল নিজের প্রতিচ্ছবি ভেসে আসলো। কী আশ্চর্য! একটু আগের চিত্রটাকে কী ধারণ করে রাখা যেতো না? এই আয়নার আর মহত্ত্বটা রইলো কই?

****
আরিব হাতে হাতে চিঠি পেয়ে বেশ আগ্রহ ভরে খুলে দেখলো। আদতে তা কয়েক লাইনের চিরকুট। মারওয়া তার চেনা খোলস ভেঙে অন্য কন্ঠে লিখেছে। আরিবের মন ভেঙে গেলো। এত সুন্দর করে মানুষকে ‘না’ বলতে পারার ক্ষমতা নিয়ে জন্মেছে মেয়েটা! আহারে! এই এক জীবনে বোধহয় আমার তাকে পাওয়া হলো না। আমার রুবি রায় নাকি বেলা বোস? আরিব কয়েকবার পড়লো। মারওয়া লিখেছে,

“আরিব শুন! আমি যা করেছি ভালো করিনি, তুইও কোনো পূন্যের কাজ করিস নি।

— Arib, do you really know, what love is?

সেদিন তুই আমাকে মাওলানা রূমীর একটা উক্তি বললি, মনে আছে?
আমি আমার প্রশ্নের জবাবটা উনার উক্তি দিয়েই দিচ্ছি,

Love is when Allah says to you,
‘I have created everything for you..’
And you say,
‘I have left everything for you…’

তুই আমাকে ছেড়ে দে। আর কখনো আসিস না, তোকে কেউ অসম্মান করবে না কখনো। একজন মানুষের জীবনে অনেক কিছু করার থাকে, মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। তোর স্বপ্ন কেন একজন নারীর কাছে আটকে থাকবে? জীবনে একদিন অনেক বড় হয়ে যখন ভাববি, তখন এটা হাস্যকর অতীত ছাড়া কিছু মনে হবে না।”

বারবার পড়তে পড়তে আরিবের চিরকুটটা বেশ ভালোমতন মুখস্হ হয়ে গেলো। এমন হলো, সে দিনে একবার করে পড়ে। কিন্তু সেই পরিচিত রাস্তায় তার দেখা আর মেলে না। রাস্তার পরিচিত কুকুরগুলো তাকে মনে করলেও সে জানে দুনিয়া উল্টে গেলেও সে পাহাড়ের নামে নাম মেয়েটি তাকে কখনো স্মরণ করবে না। ওর ভিসা হয়, পাসপোর্ট হয়, বাবাই করে দেন। সে আর না করে না। হঠাৎ একটা উর্দু লেখার অনুবাদ করে,

এ কী ভালোবাসা? নাকি মৃত্যুর ফেরেশতা?
যেই পেলো, তাকেই মেরে ফেললো!

ফেসবুকের শেষ স্ট্যাটাসটি দিয়েই সে পাড়ি জমালো বিদেশের বুকে। আর কবে দেশ তাকে ডাকবে, সে হদিস তার জানা নেই। আপাতত অচেনা জগতে থিতু হবার দায় বইতে হবে দীর্ঘদিন। এর ফাঁকে যদি সব ভুলে যাওয়া যায়!

চলবে ~