Saturday, August 2, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 151



তোমার জন্য সিন্ধুর নীল পর্ব-১৪+১৫

0

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_১৪
#সারিকা_হোসাইন

সকাল সাতটা বেজে পনেরো মিনিট।

আকাশে কালো মেঘের ঘনঘটা পরিলক্ষিত হচ্ছে।যেকোনো মুহূর্তে ধরনীতে বরষার জল আছড়ে পড়বে ঝুমঝুম শব্দে।থেকে থেকেই শো শো শব্দে বাতাস বইছে।বাতাসের প্রকোপে গাছপালা গুলো হেলে দুলে ঢলে পড়ছে।সাথে আকাশে সোনালী আলোর ঝিলিক দেখা যাচ্ছে।দেখেই বোঝা যাচ্ছে বৃষ্টির সাথে সাথে বজ্রপাতও হবে।

সাদা টি শার্ট আর সাদা ট্রাউজার সাথে স্পোর্টস শো পরে কোয়ার্টার এর মাঠে দৌড়াচ্ছে মেজর মুহিত ওয়াসিফ।দৌড়ের গতিতে তার হাতের পায়ের রগ গুলো ফুলে উঠেছে।এই ঠান্ডা আবহাওয়ার মধ্যেও তার শরীর ঘামে ভিজে একাকার।কপাল,চিপ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে মোটা মোটা ঘাম।

মুহিত থামতে ভুলে গেছে,আনমনে দৌড়ে চক্কর কেটে যাচ্ছে পুরো মাঠ।

এতদিন মুহিত মরীচিকার পিছে দৌড়ে বেড়িয়েছে।এতোগুলো বছর অযথা নষ্ট হয়েছে।
আহিয়ানের মুখ থেকে তার বাবা ভাইয়ের খুনির নাম শোনার পর থেকে বুকের ভেতরে যেনো পাথর চেপে বসেছে।

এতদিন ধরে সেই খুনি তার আশেপাশে ঘুরে বেড়িয়েছে অথচ সে কতো দেশ বিদেশে তাকে খুঁজে চলেছে।

যার কথা আহিয়ান বলেছে তাকে সাক্ষী, প্রমান ,ব্যাতিত কিভাবে আটক করবে মুহিত?
ফাঁসির দড়ি গলায় নিয়ে কেউ অন্ততঃ নিজের বাবা সম্পর্কে এমন মিথ্যে বলবেনা।
যখন আহিয়ান মুহিতকে বলেছিলো মুহিতের বাবা আর ভাইয়ের খুনি তার বাবা স্বয়ং আশরাফ চৌধুরী যিনিই কিনা ছদ্দবেশে আহমেদ খান!

তখনই মুহিতের পুরো দুনিয়া দুলে উঠছে,

মানুষটি চমৎকার অমায়িক,।

সমাজ,মানুষ ,দেশ নিয়েই যেনো তার সকল চিন্তা।
মুহিত নিজেও বিভিন্ন কাজে তার সান্নিধ্যে এসেছে।
কখনো মুহিতের মনে হয়নি লোকটি একজন নরঘাতক।

আহিয়ান যখন তার বাবার অপকর্মের কথা গুলো মুহিতকে বলছিলো, তখন মুহিত তার চোখে চিকচিক করা মুক্তোর ন্যায় জ্বল দেখতে পেয়েছে।

আহিয়ান কথা গুলো মুহিতকে বলার পর অনুরোধ করে মুহিতের হাত চেপে ধরে বলেছে
―মেজর আমাকে আজই ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিন।কয়েদের প্রত্যেকটা মিনিট আমার কাছে সর্প দংশনের মতো মনে হচ্ছে,

―আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে মেজর।

―প্লিজ আমাকে আজকেই ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিন।প্লিজ

একই কথা বার বার বলতে বলতে হাসতে হাসতে লাফানো শুরু করে আহিয়ান।

দ্রুত দুজন পুলিশ এসে তাকে ধরে নিয়ে যায়,এর পর মুহিত কাউকে কিছু না বলে সিক্ত নয়নে দ্রুত গতিতে বেরিয়ে আসে জেল থেকে।

আশরাফ চৌধুরী সম্পর্কে তথ্য জোগাড় করার পথ এতোটাও সুগম হবে না।
আশরাফ চৌধুরীর দিকে আঙ্গুল তোলার আগে মুহিতকেই সমাজের মানুষ আঙ্গুল তুলে বসে থাকবে।

―কিভাবে হবে বাবা ভাইয়ের হত্যার খুনির শাস্তি?

নাহ মুহিত আর ভাবতে পারছে না।এক ঘন্টা ধরে দৌড়ানোর ফলে তার বুকে প্রচুর ব্যাথা অনুভূত হয়।
দৌড়ের গতি কমিয়ে দাঁড়িয়ে যায়।
মাঠের নরম ঘাসে শরীর এলিয়ে দিয়ে চিত হয়ে শুয়ে পড়ে।

এই পৃথিবী,এই সময়,এই জীবন সবকিছুই তার কাছে বিষাক্ত লাগছে।

হাতে থাকা স্মার্ট ওয়াচ এর স্ক্রিনে টাচ করে সময় টা দেখে নিলো মুহিত।আজ আর অন্য কোনো এক্সারসাইজ করার প্রয়োজন নেই।
অলরেডি সে আটশত আশি ক্যালোরি লস করেছে শুধু দৌড়ে।

একটু আগে যেই আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে গেছিলো তা এখন সূর্যের তেজে পরিপূর্ণ।
কথায় আছে
যতো গর্জে ততো বর্ষে না।
আসলেই তাই।

নিজের বরাদ্দকৃত রুমে এসে টাওয়েল নিয়ে মুহিত ওয়াশ রুমে চলে গেলো।
লম্বা একটা শাওয়ার নেবার পর বেরিয়ে এলো মুহিত।
এখন ভালো লাগছে।

ব্রেকফাস্ট করার জন্য ডাইনিং টেবিলে গিয়ে সবাইকে গুড মর্নিং জানালো।

টেবিলে সবাইকে দেখলেও স্বর্গকে না দেখে মনে চিন্তার উদ্রেক হলো।তবুও কিছু প্রকাশ করলো না।

মুহিত প্লেটে একটি পরোটা আর ভাজি নিয়ে নিলো।
পরোটা ছিড়ে মুখে পুড়তে পুড়তে মিসেস তারিন কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো

―মা ,সোহাগ ভাই ফোন করেছিলো।
নামিরার যখন তখন লেবার পেইন উঠতে পারে।ভাইয়া একা ভয় পাচ্ছে।তোমাকে নামিরার পাশে থাকতে বলছে।
তুমি কি যাবে??

মিসেস তারিন কিছু ক্ষণ মৌন রইলেন।এর মধ্যেই নাফিজ মাহমুদ বলে উঠলেন
―আপা যাও না!
মেয়েটা একা একা আছে,তোমার ও শরীর টা এখন অনেক ভালো।ঘুরে এসো ভালো লাগবে।

তনুজা চুপচাপ সবার কথা শুনে বলে উঠলো
―আহা এভাবে কেনো বলছো তোমরা?
আপার সিদ্বান্ত আপাকেই নিতে দাও।

মিসেস তারিন লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস নিলেন।
মুহিতকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন―

এখানে আছি মনে হচ্ছে তোমার বাবার কাছাকাছি আছি,তার গন্ধ আমার নাকে লাগে।মনে হয় সে আমার সাথে আছে।
নামিরা আমার মেয়ে তার প্রতি আমার কর্তব্য অবশ্য পালনীয়।

আমি অবশ্যই যাবো।

তবে মুহিত তোমার কাছে আমার একান্ত অনুরোধ থাকবে তোমার সকল সমস্যার সমাধান করে ঘরে একটা বউ আনো।

সোহাগ নামিরাকে দেশে আনার ব্যাবস্থা করো।

তোমার বাবা কেনো তাদের দূরে সরিয়ে রেখেছিলো তা আমার কাছে সেদিন ই স্পষ্টমান ছিলো।তবুও সব জেনে বুঝে আমি চুপ ছিলাম।

কারন কোনোদিন তোমার বাবার কথার উপর আমার গলার আওয়াজ তুলিনি আমি।কখনো আমি তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করিনি ,যার উত্তর দিতে গিয়ে তিনি মাথা অবনত করবেন।

মানুষটা নেই,তার স্মৃতি নিয়ে আমি কোনোরকম বেঁচে আছি।আমি তোমাদের এক সাথে সুখে দেখে হাসি মুখে মরতে চাই।
যে কটা দিন বাঁচবো তুমি,নামিরা,তোমার বউ,সোহাগ কে নিয়ে বাঁচতে চাই।

মাম্মা তো বেশি কিছু আবদার করিনি রে বাবা!
মিসেস তারিন আবার বলে উঠলেন―

আমি যেতে চাই আমার মেয়ের কাছে।

―কিন্তু ফেরার সময় আমাকে একা ফিরিয়ে এনো না।আমি ওদের সাথে নিয়ে ফিরতে চাই।

বলেই মুহিতের দিকে অসহায়ের মতো তাকিয়ে রইলেন মিসেস তারিন।

সবার চোখের কোনেই জমা হলো জল।কারোর ই আর পেট ভরে খাওয়া হলো না।
মুহিত মিসেস তারিনের হাতের উপর হাত রেখে আশ্বস্ত করলো।

★★★★

স্বর্গ ঘরে দরজা আটকে বসে আছে।আজ কয়েকদিন ধরেই সে মুহিতের সাথে কথা বলে না।মুহিত অনেক বার সুযোগ পেতে ই কথা বলার চেষ্টা করেছে।কিন্তু স্বর্গ পাত্তা দেয়নি।

কেনো দেবে,??
প্রেমিকা হিসেবে সে কি বেশি কিছু আবদার করেছে,?

একটু আদর করে কথা বললে কি এমন ক্ষতি হয়?একটু বেশি ভালোবাসলে কি খুব লস হয়ে যায়?

স্বর্গ যথেষ্ট ম্যাচিউর একটা মেয়ে।সে জানে তার মতো মেডিকেল অফিসার এর এসব মানায় না।

তবুও ভালোবাসার ব্যাপারে সে ইমম্যাচিউর হয়েই থাকতে চায়।মুহিত কে এসব ব্যাপারে এক বিন্দু ছাড় ও দেবেনা।

মুহিত তাকে আদর কেনো করবে না?

নানী দাদির মতো সারাক্ষন আপনি আপনি করে বেড়ায়।
ব্যাটা খাটাশ।

নাহ আর ভাত ও খাবোনা,কথাও বলবো না।

এরই মাঝে তনুজা এসে দরজায় নক করে স্বর্গ বলে ডাকে উঠলো।

অনেক ক্ষণ ডাকার পর দরজা খুললো স্বর্গ।

ঝাঁঝালো কন্ঠে তনুজার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো
―কি চাই?
ব্রেকফাস্ট করবি না?

না করবো না,খিদে নেই,চলে যাও।
বলেই তনুজাকে ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে আবার দরজা বন্ধ করে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো।

————–

ক্যাপ্টেন সৌম্য চোরের মতো দাঁড়িয়ে আছে মুহিতের সামনে।কিভাবে কথা শুরু করবে সেটাই গুছিয়ে উঠতে পারছে না।

একজন মেজরের ব্যাক্তিগত বিষয়ে একজন ক্যাপ্টেন হয়ে কিভাবে কথা বলবে সেটা ভেবেই কুলকিনারা পাচ্ছে না সৌম্য।

তবুও বলতে হচ্ছে,!

এক দিকে প্রেমিকার চাপ,অন্য দিকে ডাক্তার সাহেবা।

সৌম্যের কাচুমাচু দেখে মুহিত কপাল কুঁচকে ভরাট কন্ঠে জিজ্ঞেস করে উঠলো কি ব্যাপার ক্যাপ্টেন?
এমন চোরের মতো ভান ধরে আছো কেনো?

পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঘটনা খুলে না বললে বিদেয় হও।

কাজ আছে আমার বলেই ঘস ঘস করে কলম দিয়ে লিখতে শুরু করলো মুহিত।

জিভ দিয়ে শুষ্ক ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নিলো সৌম্য।এর পর মিনমিন করে বলে উঠলো―

স্যার বিষয় টা খুব সেনসেটিভ,বললেও শাস্তি পাবো না বললেও শাস্তি পাবো।
অনেকটা শাঁখের করাতের মতো।

মুহিত এবার সোজা হয়ে বসে বলে উঠলো

―নাটকবাজি করা ছাড়া আর কিছু জানোনা ক্যাপ্টেন?

জী স্যার জানি !

সেটাই এখন বলবো।

বলেই সৌম্য মুহিতের সামনের চেয়ার টেনে নিয়ে বসে পড়লো।
টেবিলের উপর থেকে পানির বোতল নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে গলাটা ভিজিয়ে নিলো।

স্যার আমার হালুয়া টাইট করার চিন্তা বাদ দেন,আপনার চিন্তা করেন।আপনার তো সামনে ভীষন বিপদ!

মেজর জেনারেল এর মেয়ে,মানে ডাক্তারনী বলেই মুহিতের চোখের পানে চাইলো সৌম্য।

মুহিতের প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি দেখে সৌম্য বুঝে নিলো মেজর পুরো ঘটনা শুনতে চাচ্ছে।

সৌম্য এবার নিজেকে মেলে ধরে আয়েশ করে বলতে শুরু করলো
―স্যার মেয়েটা বোধ হয় আপনাকে ভালোবাসে।
সে একটু কেয়ার চাচ্ছে আপনার থেকে।বিষয় টা ঠিক কেয়ার না!উম কিভাবে যে বলি?
অন্যপাশে মুখ ফিরিয়ে মিনমিন করে বলে ফেললো―

“”আদর বলতে পারেন!””

কথাটা শোনা মাত্র খুকখুক করে কেশে উঠলো মুহিত।

সৌম্য পানি এগিয়ে দিয়ে বললো লজ্জার কিছুই নেই স্যার,পানিটা খেয়ে নিন।

সৌম্য লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে মুহিত কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো―
বয়সে আপনার থেকে ছোট হলেও প্রেমের অভিজ্ঞতায় বড়।
আমার কথা মাথায় রাখবেন।
আজ আমি গেলাম।

ম্যাডাম কে একটু কেয়ার মানে ঐটা আরকি দিয়েন।

বলেই রাজাদের যেমন সৈন্যরা কুর্নিশ করে ঐভাবে সৌম্য প্রস্থান নিলো।

সৌম্য যাওয়া মাত্র মুহিতের ফর্সা গালে লজ্জার আভা ছড়িয়ে পড়লো।
লাজুকতায় আপনা আপনি ই হাসি চলে আসছে তার।
এমন সময় মুহিতের ক্যাবিনে প্রবেশ করলেন নাফিজ মাহমুদ।

নাফিজ মাহমুদ কে হঠাৎ তার কক্ষে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেলো মুহিত।
স্যালুট দিতেও ভুলে গেলো।
নাফিজ মাহমুদ সেসব গায়ে মাখলেন না।গদগদ হয়ে মুহিতের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন―

তোমার মা অস্ট্রেলিয়া যাবার আগেই তোমার হবু বউকে যদি তাকে দেখিয়ে দেই কেমন হবে মুহিত?

মামার এমন ভিত্তিহীন কথায় চিন্তিত হয়ে মুহিত জিজ্ঞেস করলো ―কিসের বউ স্যার?
নাফিজ মাহমুদ খুশিতে গদগদ হয়ে জিজ্ঞেস করলো
―ক্যাপ্টেন তুলিকা ফার্নাজ কে তোমার কেমন লাগে?

মুহিত ভাষা হারিয়ে ফেললো মুখের।

এরা বাপ মেয়ে তাকে পেয়েছে কি?
যখন যার যেভাবে খুশি অত্যাচার চালাচ্ছে।
এ আবার কোনো নতুন মুসিবত হাজির করতে চাইছে?

স্বর্গ জানলে তো মুহিতকে সরাসরি ক্রসফায়ার দিবে।

নাফিজ হাসি মাখা কন্ঠে বলে উঠলো কি ভাবছো মুহিত?

স্যার আমি ক্যাপ্টেন তুলিকা কে সেই ভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখিনি।মিনমিন করে জবাব দিলো মুহিত।

দেখোনি কি হয়েছে ?একটু পরেই দেখার ব্যাবস্থা করে দিচ্ছি,।
বলেই ফোন টিপে হ্যালো বলে মুহিতের কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন ।

মুহিত অসহায় এর মতো বসে রইলো ।মাথায় কিছুই ঢুকছে না তার।

**********

পিউ কে নিয়ে একটা কফিশপে যাবার জন্য তৈরি হচ্ছে স্বর্গ।
কফিশপ টা নতুন খোলেছে।ফেসবুকে বেশ হাইপ উঠেছে ।
এখানে ছবি তোলার কর্নার রয়েছে।আর তাদের রুফটপ টা নাকি অনেক সুন্দর।
স্বর্গ আর পিউ ঠিক করেছে আজ তারা শাড়ি পরবে আর সুন্দর সুন্দর ছবি তুলবে।

পিউ পড়বে গোল্ডেন কালার এর জর্জেট শাড়ি আর স্বর্গ পরবে ব্ল্যাক।

আয়নার সামনে বসে আছে স্বর্গ,শাড়ি পরেছে সে,ম্যাচিং অর্নামেন্টস পরেছে তার সাথে।বাদামি চুল গুলো কাঁধের দুই পাশে ছেড়ে দিলো এক পাশে সিঁথি করে।ঠোঁটে লাগালো টকটকে লাল লিপস্টিক।
চোখে ভালো ভাবে মাসকারা লাগিয়ে নিলো।
মুখে ব্লাশনের টাচ আপ দিলেই সাজ কমপ্লিট।

হাতে চুরি পড়তে পড়তে পিউ কে কল দিলো স্বর্গ।
পিউ উত্তর দিলো রাস্তায় গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে।

তনুজার কাছে বলে বেরিয়ে গেলো স্বর্গ।

কাঙ্খিত রেস্টুরেন্টের দুতলায় এসে উপস্থিত হলো পিউ আর স্বর্গ।

খাবার ওর্ডার করে বসে গল্প করছে তারা দুজন।
হঠাৎই স্বর্গের চোখ যায় কর্নারে থাকা টেবিলে।
সেখানে দেখতে পায় মুহিত একটি মেয়ের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে।
আর মেয়েটি ঠাট্রার ছলে বারবার মুহিতের গায়ে হালকা করে ছুঁয়ে দিচ্ছে।

এসব দৃশ্য দেখে স্থির থাকতে পারলো না স্বর্গ।মাথা ঘুরে উঠলো তার।
চোখের কোনে জমা হলো জ্বল।এক সময় তা বর্ষনের রূপ নিলো।
দম বন্ধ হয়ে হাঁসফাঁস লাগছে।এখানে থাকলে মরে যাবে সে।মুহিতের পাশে অন্য মেয়েকে দেখে কষ্টে বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে তার।
চেয়ার ছেড়ে উঠে বাইরে বের হতে চাইলো।
শরীর সায় দিলো না।
লুটিয়ে পড়লো রেস্টুরেন্ট এর মেঝেতে।

#চলবে।

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_১৫
#সারিকা_হোসাইন
[১৮+এলার্ট,যারা সহ্য করতে পারবেন তারাই পড়বেন,সম্পূর্ণ মুক্ত মনাদের জন্য]
●●●
চিন্তিত মুখে স্বর্গের বেডের চারপাশে কেউ বসে আছে কেউবা দাঁড়িয়ে আছে।হঠাৎ অজ্ঞান হবার কারন কেউ খুঁজে পাচ্ছে না।নাফিজ মাহমুদ হাত মুঠি করে ঠোঁটে ছুঁইয়ে বসে বসে ভাবছেন―

মেয়ে সেজে গুঁজে খুশি মনে রেস্টুরেন্টে গেলো সেখানে কি এমন দেখলো যে জ্ঞান হারালো?
তিনি তো মেয়ের সুরক্ষার জন্য বাইরে দুটো সোলজার কেও রেখে ছিলেন।
পিউ মেয়েটাও তো মুখ খুলছে না।

জ্ঞান হারানোর পিছনের ঘটনা কি??


মুহিত থেকে থেকে ঘেমে উঠছে শুধু।মুখ দিয়ে কিছুই প্রকাশ করতে পারছেনা।ভেতরে নানান ধরনের ভয়ানক চিন্তায় বমি বমি ভাব হচ্ছে তার।আর কেউ না জানলেও মুহিত তো জানে স্বর্গ কেনো জ্ঞান হারিয়েছে।

তনুজা মেয়েকে হাতে পায়ে তেল মালিশ করেই যাচ্ছেন।মিসেস তারিন স্বর্গের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন আর দোয়া দুরূদ পড়ছেন।

নিমিষেই খুট করে খুলে গেলো দরজা।একজন নার্স কে সাথে নিয়ে কিছু মেডিসিন সমেত হন্তদন্ত হয়ে রুমে প্রবেশ করলো পিউ।

স্টেথোস্কোপ কানে দিয়ে কিছুক্ষণ নিরীক্ষণ চালালো। এরপর প্রেসার মাপতে মাপতে বললো―

―আংকেল ভয়ের কিছুই নেই,অতিরিক্ত টেনশন থেকে প্রেসার ফল করে প্যানিক এট্যাক এসেছে।এমনিতেই ও এখনো দুর্বল এজন্য সামান্য টেন্সড হতেই আর নিউরন কাজ করেনি।

এক্ষুনি জ্ঞান ফিরবে।

বলেই হাতে থাকা একটি নল স্বর্গের নাক বরাবর ঢুকিয়ে দিলো।
দক্ষ হাতের কৌশলে নিমিষেই জ্ঞান ফিরলো স্বর্গের।

জ্ঞান ফিরেই পিউকে উদ্দেশ্য করে ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে বলে উঠলো স্বর্গ―――

― গুঁতো টা আস্তে দিলে কি খুব ক্ষতি হতো তোর?
“”দেখ চোখ দিয়ে পানি এসে গেছে।””
বলে চোখের কোনা থেকে অশ্রু বিন্দু এনে দেখালো।

পিউ কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নাফিজ মাহমুদ হুমড়ি খেয়ে পড়লেন মেয়ের উপর।

সে কোনো জ্ঞান হারিয়েছে, কি দেখে ভয় পেয়েছে?

যে তার মেয়েকে প্যানিক এট্যাক দিয়েছে তাকে খুঁজে পেলে শুলে চড়াবেন বলে মেয়েকে প্রতিশ্রুতি দিলেন।

দাঁত দিয়ে নখ কামড়াতে কামড়াতে মনে মনে মুহিত বললো―

নিজেকে আগে শুলে চড়তে হবে !

তনুজা কিছু বলতে নিবে তার আগেই দুর্বল কন্ঠে স্বর্গ বলে উঠে
―অনেক রাত হয়েছে সবাই ঘুমুতে যাও, আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।

পিউ ও সকল কে উদ্দেশ্য করে বললো আপনারা ওকে একটু স্পেস দিন প্লিজ।
রাতে ফ্রেস ঘুম হলে সকালেই সুস্থ হয়ে যাবে ।

বলেই কিছু মেডিসিন এর লিস্ট দিয়ে গেলো তনুজার হাতে।
আন্টি টাইমলি মেডিসিন গুলো ওকে দেবেন।

পিউ তনুজার উদ্দেশ্যে আরো বললো

আন্টি স্বর্গ এখনো একটু দুর্বল আছে ।আপনারা খেয়াল রাখবেন কোনো বিষয় নিয়ে ডিপ্রেসড বা মারাত্মক লেভেলের টেনশন যাতে না করে।

কদিন আগেই ও কতবড় মিজারেবল লাইফ থেকে ব্যাক করেছে এ কথা আমরা সকলেই জানি।

আমি চলে যাচ্ছি,আংকেল চিন্তা না করে আপনারাও শুয়ে পড়ুন ।

বলেই নার্সকে নিয়ে বেরিয়ে এলো পিউ।

মেয়েকে ঠিকঠাক ভাবে শুইয়ে দিয়ে এসির পাওয়ার বিশ করে একটি কাঁথা স্বর্গের গায়ে জড়িয়ে মিসেস তারিন কে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন তনুজা মাহমুদ।

নাফিজ মাহমুদ মুহিত কে ইশারা দিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

–———–

ঘড়ির ঘন্টা,মিনিট,সেকেন্ডের কাটা দুইয়ের ঘরে পৌঁছানো মাত্র ঢং ঢং করে বেজে উঠলো।চারপাশ নিস্তব্ধ, শুনশান।গুড় গুড় করে মেঘ ডাকছে আর টুপটাপ শব্দে বৃষ্টি হচ্ছে।জানালার পর্দা ভেদ করে বৃষ্টির ছিটা ঘরে এসে পড়ছে।

প্রত্যেকে হয়তো বেঘোরে ঘুমুচ্ছে।কিন্তু মুহিতের চোখে কোনো ঘুম নেই।

মুহিত উঠে দাঁড়িয়ে জানালা বন্ধ করে দিলো।
স্বর্গের জন্য মুহিতের কষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছে।স্বর্গ যদি মুহিত কে নারী সংঘটিত কারনে ভুল বুঝে , মুহিত কখনোই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না।
মুহিতের মনে স্বর্গ ব্যাতিত অন্য কারো জন্য কোনো ফিলিংস তো দূরের কথা কোনো মেয়ের ভাবনাই নেই।

মুহিত জানে মুহিতের কাছে স্বর্গ কতখানি।

আহিয়ান যখন স্বর্গ কে অপহরণ করেছিলো, মুহিতের মনে হয়েছে আহিয়ান তার জান নিয়ে পালিয়েছে।
প্রতিটা সেকেন্ড মুহিতের শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় কেটেছে ।

চাপা স্বভাবের জন্য মুহিত স্বর্গ কে তার অব্যক্ত অনুভূতি গুলোও কখনো বলতে পারেনি।

―অথচ স্বর্গ তার সকল অনুভূতি কি সুন্দর সাবলীল ভাবে মুহিতকে জানিয়েছিলো।

রাশিয়ান পোর্টের কথা মনে পড়তেইএকটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ফেললো মুহিত।

মুহিত নাফিজ মাহমুদের কাছে পাত্রী দেখতে যাবেনা বলে দু তিন বার মানা করার পর ও নাফিজ মাহমুদ আর লেফটেন্যান্ট জেনারেল মাহতিম কিবরিয়া জোর করে তাকে পাঠিয়েছে।

শুধু তাই নয় রেস্টুরেন্টের টেবিল পর্যন্ত তার মামাই রিজার্ভ করে ক্যপ্টেন তুলিকা ফার্নাজ কে ইনভাইট করেছে।
এখন মুহিত যদি না যায় মেয়েটার সামনে তার মামা ছোট হবে।

মুহিত সিদ্ধান্ত নেয় যে,
― দেখা করে মেয়েকে বুঝিয়ে বলে সব কিছু হ্যান্ডেল করবে।

কিন্তু মেয়েটার গায়ে পড়ার স্বভাবের জন্য সব ভেস্তে গেলো।

মুহিত বারবার সাইড কেটে থাকার চেষ্টা করেছে।
কিন্তু বজ্জাত মেয়েটার মুখের হাসি ই যেনো শেষ হচ্ছে না।
অযথাই গায়ে হাত দেয়ার বাহানা করছিলো।

মুহিত অবশ্য মনে মনে ভেবে রেখেছিলো একজন ক্যপ্টেন হয়ে মেজরের সাথে এমন অভদ্রতামি করার জন্য কৌশলে পানিশমেন্ট দিবে এই মেয়েকে।

মুহিত যদি জানতো স্বর্গ এতোটা কষ্ট পাবে তাহলে মুহিত মামার কথা কখনোই মানতো না।
দরকার হলে বেয়াদবি করে হলেও ত্যাড়ামো করতো।

বাইরে বৃষ্টির দাপট বেড়েই চলছে সাথে মুহিতের মনের সাথে যুদ্ধ।

মুহিত সকাল হবার অপেক্ষা করতে পারছে না।
এখনই স্বর্গের ভুল ভাঙানো চাই।

যেই ভাবনা সেই কাজ।
আস্তে করে দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে আসে মুহিত।গন্তব্য স্বর্গের রুম।

ফোনের টর্চ জেলে আস্তে আস্তে মুহিত স্বর্গের রুমের সামনে এসে দাড়ালো।
আঙ্গুল দিয়ে সামান্য ধাক্কা দিতেই দরজা খোলে গেলো অল্প ।

মুহিত পা টিপে টিপে স্বর্গের কক্ষে প্রবেশ করলো।মনে দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়ে স্বর্গের বেডের কাছে এসে দাড়ালো।

ডিম লাইটের মৃদু আলোয় স্বর্গের কোমল মুখ খানি দেখে অন্তর ধক করে উঠলো মুহিতের।
মেয়েটাকে দেখলেই মুহিতের কামড়ে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে।

এইযে এখনই ইচ্ছে করছে নিষিদ্ধ ইচ্ছে গুলোর বহিঃপ্রকাশ করতে।
মেয়েটি এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে,তার স্লিপিং ট্রাউজার এর একটা পা হাটু সমান উঠে আছে যার জন্য লোমহীন ধবধবে সাদা পা দৃষ্টিগ্রাহ্য হচ্ছে।
টি শার্ট টা উপরে উঠে নাভীরন্ধ্র পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে।
এসব দৃশ্য দেখে কি কোনো প্রেমিক পুরুষ স্বাভাবিক থাকতে পারবে?

স্বর্গের ঘুমের ঘোরে ঠোঁট উল্টানো দেখে বুকে কাঁপন ধরলো মুহিতের।

নিমিষেই মুহিতের শরীর গরম হয়ে উঠলো।

মুহিত চায়না তার পবিত্র ভালোবাসা অপবিত্রে রূপান্তর করতে।
স্বর্গের গায়ে কলঙ্কের কালো কালি মুহিত সহ্য করতে পারবে না।এজন্য নিজের গাম্ভীর্য পূর্ণ ভাব বজায় রেখে চলার চেষ্টা করে মুহিত সর্বত্রই।

মুহিত চায় তার দিক থেকে যেনো স্বর্গের কোনো ক্ষতি না হয়।

কিন্তু মুহিতের এমন কাঠিন্য ভাব যে এই কোমলমতি মেয়ের হৃদয়ে এতোটা কষ্টের কারন হবে এটা মুহিত স্বপ্নেও ভাবেনি।

জানলে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিতো স্বর্গের পুরো কায়া।

সকল ভাবনাকে দূরে ফেলে দ্বিধা ভুলে স্বর্গ কে ফিসফিসিয়ে ডেকে উঠলো মুহিত।
―স্বর্গ
―এই স্বর্গ!

যখন স্বর্গ রেসপন্স করলো না তখন মুহিত গায়ে হাত দিলো।হাত দিতেই চমকে উঠলো মুহিত।

―আরেহ ! জ্বরে তো সারা শরীর পুড়ে যাচ্ছে!

সাথে সাথেই মুহিত বিচলিত হয়ে গেলো।এতো রাতে মামা মামীকে ডাকবে নাকি ডাকবে না সেই চিন্তায় অস্থির হয়ে গেলো।

ডাকার পর তারা যদি প্রশ্ন করে
―এতো রাতে আমার অসুস্থ মেয়ের রুমে তুমি কি করছো?

―তখন কী জবাব দেবে মুহিত?

ভাবতে ভাবতে মুহিত নিজের রুম থেকে ছোট টাওয়েল নিয়ে এলো।
ছোট একটি বোলে করে পানি নিয়ে এলো।
এরপর সেগুলো কে বেড সাইড টেবিলে রেখে স্বর্গের পাশে বসলো।

টাওয়েল পানিতে চুবিয়ে,নিংড়ে স্বর্গের মাথায় জল পট্টি দিয়ে দিলো মুহিত।

জ্বরের ঘোরে স্বর্গ বলে উঠলো―
“”আপনি খুব খারাপ মেজর,খুব খারাপ
―আপনি আমাকে একটুও আদর করেন না, সব সময় অহংকারী ভাব ধরে থাকেন।
অথচ বাইরের মানুষের সাথে হেসে হেসে কথা বলেন।

―আপনাকে আমি কঠিন শাস্তি দিবো মেজর ,কঠিন শাস্তি।
বলেই পাশ ফিরে মুহিতের কোমর জড়িয়ে ধরলো।

স্বর্গের এহেন স্পর্শে ভেতরে তোলপাড় শুরু হলো মুহিতের।
জ্বলপট্টি দিতেও হাত কাঁপছে তার।

কোন বিপদের মুখে এসে পড়লাম এই রাতের বেলা?

হঠাৎ ই বাইরে জোরে বজ্রপাত হলো।স্বর্গ চমকে উঠে মুহিতের কোমর আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।

হঠাৎ ই মুহিতের খেয়াল হলো এসি চলছে সাথে বাইরের ওয়েদার ঠান্ডা কিন্তু স্বর্গের গায়ে কাঁথা নেই।

শীতে স্বর্গের শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো
স্বর্গ মুহিতের কোমর জড়িয়ে বিড়াল ছানার মতো গুটিয়ে রইলো।

কোনো মতে স্বর্গ কে ছাড়িয়ে মুহিত ভালোভাবে বালিশে শুইয়ে দিলো।
পিঠের নীচে থেকে কাঁথা টান দিতেই স্বর্গের ঘুম ভেঙে গেলো।

নিজের আশেপাশে পুরুষালী অতি পরিচিত গন্ধ পেতেই চোখে জল জমলো।
এই কঠিন হৃদয়ের পুরুষ তাকে আজ অনেক কষ্ট দিয়েছে।কোনো ভাবেই তাকে ক্ষমা করবেনা স্বর্গ।

মুহিত বুঝতে পারলো স্বর্গ জেগে গেছে তাই স্বর্গ যাতে তাকে ভুল না বুঝে তাই জন্য কোমল কন্ঠে বলে উঠলো――

―আপনাকে সরি বলতে এসেছিলাম স্বর্গ।

এসে দেখি আপনার সাংঘাতিক জ্বর এসেছে।
তাই জ্বলপট্টি দিয়ে দিচ্ছিলাম।

প্লিজ আমাকে ভুল বুঝবেন না।

মুহিতের মুখে আপনি সম্বোধন শুনে আর নিজেকে এমন রিজার্ভ রেখে কথা বলার জন্য স্বর্গের প্রচুর কান্না পেলো।

ইদানিং তার হুটহাট কান্না পায়।

একজন চব্বিশ বছরের মেয়ের এমন নিব্বীদের মতো আচরণ শোভা পায়না।

কিন্তু মুহিতের কথা মনে পড়লেই স্বর্গের এমন অবস্থা হয়।

মুহিতের ভালোবাসা পাবার আকুলতা তাকে ষোলো বছরে এনে নামিয়েছে।

বহু কষ্টে গলার স্বর স্বাভাবিক রেখে স্বর্গ মুহিত কে উদ্দেশ্য করে বললো――

―আপনি চলে যান এখান থেকে মেজর মুহিত।
আর আমার সেবা করার জন্য ধন্যবাদ।

বলেই পাশ ফিরে নাকে মুখে কাঁথা টেনে ঘাপটি মেরে রইলো স্বর্গ।

মুহিত অপরাধীর ন্যায় চুপ করে দাঁড়িয়েই রইলো।স্বর্গের ভুল না ভাঙিয়ে সে এখান থেকে এক কদম ও নড়বে না।

হঠাৎই ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ পেলো মুহিত।

মেয়েটির কান্নার আওয়াজে হৃদয়ে ছেদন হলো মুহিতের।কান্না যুক্ত প্রতিটি নিঃশাস মুহিতের হৃদয়ে চিনচিনে ব্যাথার সৃষ্টি করলো।
হাতের টাওয়েল কে ছুড়ে ফেলে এক টানে সরিয়ে ফেললো স্বর্গের গায়ের কাঁথা।

হেঁচকা টানে স্বর্গকে তার দিকে ঘুরিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।

ফুপানোর ফলে স্বর্গের ঠোঁট বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে।

মুহিতের নিজেকে বেসামাল মনে হলো।

নিজেকে কন্ট্রোল করা দায় হলো।

মুহিতকে বেসামাল করার সকল দায় স্বর্গের উপর চাপিয়ে এক অবাধ্য জিনিসের অনুমতি চাইলো মুহিত।

―আমি কি তোমার ঠোঁটের দখল নিতে পারি জান?

মুহিতের এমন আদুরে মাদকতা মাখানো স্বরে মুহিত থেকে প্রাপ্ত সকল কষ্ট ভুলে গেলো স্বর্গ।

অশ্রুসিক্ত বড় বড় পাপড়ি যুক্ত নয়নে মুহিতের চোখের পানে দৃষ্টি দিলো।
মুহিতের সিন্ধুর নীল জলের মতো স্বচ্ছ চোখে মাতাল হলো স্বর্গ।

বশীভূত মন্ত্রের ন্যায় সায় জানিয়ে নিজেই খামচে ধরলো মুহিতের টিশার্ট এর কলার।
মুহিতের ফোলা ফোলা লালচে ঠোঁটে ছুঁইয়ে দিলো নিজের ঠোঁট।

মুহিত কে আর পায় কে?

পাগলের মতো চুম্বন করতে থাকলো তার শ্রেয়সী কে।
এক পর্যায়ে মুহিত কন্ট্রোললেস হয়ে গেলো।

সব কিছু ভুলে নিজের বোধ শক্তি হারিয়ে মুহিত স্বর্গের কমলার কোয়ার ন্যায় ঠোঁটে কামড় বসিয়ে দিলো।

ব্যাথায় স্বর্গ মুহিতের পিঠে খামচে ধরলো। হারিয়ে যেতে চাইলো অন্য জগতে।
এর পর স্বর্গ এক অন্যায় আবদার করে বসলো মুহিতের কাছে।

নেশাতুর কন্ঠে ভাঙা ভাঙা শব্দে বলে উঠলো―

―প্লিজ কিল মি জান।
বলেই নেশা যুক্ত চাহনি নিক্ষেপ করলো মুহিতের পানে।

হাতের বিচরণ অবাধ্য হবার আগেই হুঁশে ফিরলো মুহিত।জোর করে স্বর্গ কে ছাড়িয়ে এক দৌড়ে নিজের রুমে ফিরে আসলো।
আবেগে পরে এমন ভুল কিভাবে করতে যাচ্ছিলো সে,?

পাগল পাগল লাগছে সব কিছু।

নিজেকে ঠান্ডা করতে শাওয়ার নিতে চলে গেলো মুহিত।

যেই আগুন শরীর মননে জ্বলছে তা কি ঠান্ডা পানিতে নিভবে?

★★★>>>

ঢাকার নামিদামি একটি হসপিটাল এর স্পেশাল কেবিনে পিছনে হাত দিয়ে সমানে পায়চারি করছেন আশরাফ চৌধুরী।
ভেবেছিলেন ছেলের ফা*সিঁ হয়ে গেলে ভং ছেড়ে দুদিন কাদাকাটির নাটক করে ভালো হয়ে যাবেন।
কিন্তু খবর এসেছে ছেলে উন্মাদ হয়ে গেছে।সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত ফাঁ*সি কার্যকর হবে না।
রাগে ক্ষোভে চক্ষু রক্তবর্ণ ধারণ করলো ভদ্রলোকের।

যাদের জন্য তার এই অবস্থা হয়েছে তাকে তো একবার চরম শিক্ষা দিতে হয়।

টেবিলের উপর থেকে ফোন দিয়ে দ্রুত গতিতে কল লাগালেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল নাসের হায়দার কে।

ওপাশ থেকে হ্যালো বলতেই গর্জে উঠলেন আশরাফ চৌধুরী।
রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে নাসের হায়দার এর উদ্দেশ্যে চিল্লিয়ে উঠলেন―
―টাকা দিয়ে তোমাকে চাকর বানানো হয়েছে বা*ল ফালানোর জন্য?
এমন বিশ্রী ভাষা শুনে নাসের হায়দার এর রাগে পায়ের রক্ত মাথায় ছলকে উঠলো।তবুও সুর নত রেখে হেতু জিজ্ঞেস করলো।

ওই মেজর এর সকল আপডেট আজ সন্ধ্যার মধ্যে চাই।আর পারলে আমার ছেলেকে জেলের ভেতর লটকে দেবার ব্যাবস্থা করো।
বলেই ফোন কেটে আছাড় মারলেন বেডের উপর।

****
মুহিতের মায়ের অস্ট্রেলিয়া যাবার সকল ব্যাবস্থা হয়ে গিয়েছে।আগামী বৃহস্পতিবার তার ফ্লাইট।
যাবার আগে তার রুমে তনুজা আর নাফিজ মাহমুদ কে ডাকলেন।
নাফিজ মাহমুদ বোনের ব্যাপারে খুব যত্নশীল ।বোনের প্রতি তার ভালোবাসা অগাধ।

বোনের রুমে এসে চেয়ার টেনে বসতে বসতে প্রশ্ন করলেন
―কেনো ডেকেছিস আপা?
মিসেস তারিন কিছুটা দ্বিধান্বিত হয়ে মনে সাহস সঞ্চয় করে অনুরোধের স্বরে নাফিজ কে বললেন―

তোর মেয়েটা আমাকে দিবি?
আমার মুহিতের জন্য?

#চলবে।

তোমার জন্য সিন্ধুর নীল পর্ব-১২+১৩

0

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_১২
#সারিকা_হোসাইন

চারপাশে লাইটস ক্যামেরার ঝলকানি,সাধারণ মানুষের চাইতে যেনো রিপোর্টাস এর সংখ্যাই বেশি।
আহিয়ান কে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে বুলেট প্রুফ জ্যাকেট পরিয়ে শেল্টার এর সাথে ঢাকা এয়ার পোর্ট থেকে আর্মিদের স্পেশাল গাড়িতে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে।

কিন্তু চারপাশে ক্রুদ্ধ জনতা।

কেউ পাথর ছুঁড়ে মারছে,কেউ স্যান্ডেল ছুড়ে মারছে কেউবা আবার ডিম।

টিভিতে নিজের ছেলের এমন দুর্দশা দেখে টিভি বরাবর রিমোট ছুড়ে মারলেন আশরাফ চৌধুরী।রিমোটের আঘাতে নিমিষেই ডিসপ্লে নষ্ট হয়ে গেলো বিদেশ থেকে আনা ব্র্যান্ডেড টিভি টার।

তার তিলেতিলে গড়া সম্মান,ভালমানুষির মুখোস,প্রতিপত্তি,এই জানোয়ার নিমিষেই নষ্ট করে দিলো।স্কাউনড্রেল টা কে আগেই খুন করে দিলে আজকে আর এই দিন দেখতে হতো না।

মানুষের সামনে সম্মান হানী, ছেলে সম্পর্কে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নের জবাব এসব এড়াতে মিথ্যে নাটকের ভান ধরা ছাড়া আর কিচ্ছু করার নেই।বজ্জাত রিপোর্টার দের কথা না বললেই নয়।

প্রথম প্রশ্নই করে বসবে
―আপনার ছেলে এতো অপকর্ম করেছে ,আপনি একজন বাবা হিসেবে কিছুই জানেন না?
শুধু কি তাই?
মিথ্যে গুজব জুড়ে দিয়ে বিভিন্ন হেডলাইন বানিয়ে খবর প্রচার করবে।
শেষে দেখা যাবে কেঁচু খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে গেছে।

―――――――
নিউজ পোর্টাল গুলো তে সাংবাদিক রা একে একে বিভিন্ন খবর বিভিন্ন ভাবে বলে যাচ্ছে_

বিশিষ্ট সমাজ সেবী আশরাফ চৌধুরীর একমাত্র ছেলে আহিয়ান চৌধুরী আহির ধুর্ততার সহিত মেজের জেনারেল নাফিজ মাহমুদ এর মেয়েকে রাশিয়াতে পাচার করে দেবার জন্য অপহরণ করেছে।
টানা পঁয়তাল্লিশ দিনের আর্মি অভিযানে রাশিয়ান আর্মির সহায়তায় সি,এম,এইচ এর এই নব্য মেডিকেল অফিসার কে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।

মুহিতের রেকর্ড করা রাশিয়ান ছেলে গুলোর জবানবন্দি গুলো কে মিডিয়া আরো রসিয়ে রসিয়ে প্রচার করলো।
আরো বললো―
ছেলের এহেন কুকীর্তি সহ্য করতে না পেরে বাবা আশরাফ চৌধুরী হার্ট এট্যাক করে ঢাকার একটি স্বনামধন্য হাসপাতালে আই সি ইউ তে ভর্তি আছেন।
অবস্থা আশংকাজনক।

********
বিভিন্ন জবানবন্দি, মেডিকেল টেস্ট করার পর স্বর্গকে বাসায় আনা হয়েছে।
মেয়েকে জড়িয়ে ধরে তনুজা আকুল হয়ে কেঁদে কেঁদে মেয়ের চোখে মুখে চুমু খাচ্ছেন।
মুহিত কে জড়িয়ে ধরে নাফিজ শুধু পিঠ হাতিয়েই যাচ্ছেন।

মুহিত আজ তার প্রাণ তার হাতে ফিরিয়ে দিয়েছে।এই বিনিময়ে মুহিত যা চাইবে নিজের জীবন বাজি রেখে হলেও মামা হিসেবে নাফিজ মাহমুদ মুহিতকে সেটাই দিবে দেবে।

মিসেস তারিন অবুঝের মতো শুধু চেয়েই রইলেন।কিছুই তার বোধগম্য হলো না।

সুখ দৌড়ে এসে স্বর্গকে জড়িয়ে ধরলো।
কাঁদতে কাঁদতে বলতে শুরু করলো
―মাফ করে দে আপু।আর কখনো তোর পিছনে লাগবো না।গুড বয় হয়ে লেখাপড়া করবো আর তোকে দেখেশুনে রাখবো।

পরিবারের মানুষের এহেন সূচনীয় অবস্থা দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো স্বর্গ।

বাবা মা,ভাইকে ছাড়া সেও অনেক কষ্ট পেয়েছে অজানা,অচেনা পরিস্থিতি তে।

সে আবার নতুন জীবন পেয়েছে মুহিতের জন্য।
স্বর্গ মনে মনে নিজের সমস্তটা মুহিতের জন্য উৎসর্গ করলো।

________
পিউকে চমকে দিতে সৌম্য নিজেই এসেছে পিউ এর ক্যাবিনে।

পিউ কোনো এক ভাবনায় ডুবে রয়েছে।

সৌম্য গলা খাকরি দিলো

―পিউ আনমনে জিজ্ঞেস করলো কি সমস্যা ?খুলে বলুন।

―সমস্যা তো অনেক ম্যাডাম।আপনি কয়টার মেডিসিন প্রেসক্রাইব করবেন?

পরিচিত কন্ঠস্বর কানে পৌঁছুতেই বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো পিউ।

সামনে দাঁড়ানো নিজের একান্ত ব্যাক্তিগত পুরুষ টিকে দেখে চেয়ার রেখে দৌড়ে সৌম্যের বুকে আছড়ে পড়লো।
এতো দিনের জমিয়ে রাখা কষ্ট বাঁধ ভাঙা অশ্রুতে ধুয়ে মুছে গেলো।

সৌম্যকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে জানালো নানান অভিযোগ
―আপনি খুব খারাপ ক্যাপ্টেন, খুব খারাপ।
আপনি আমাকে এতগুলো দিন অনেক কষ্ট দিয়েছেন।

―একটা ফোন কল ও কি আমার প্রাপ্য ছিলো না?

আদুরে কন্ঠে সৌম্য বলে উঠলো―

―আপনি বড্ডো নরম মনের মানুষ পিউ,এতো নরম হলে কিভাবে চলবে?মানুষ তো আপনাকে সহজেই ভেঙে দিয়ে চলে যাবে।

―পিউ সৌম্যকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে,পিউ এর মনে হচ্ছে ছেড়ে দিলেই সৌম্য আবার পালিয়ে যাবে।

পিউকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে সৌম্য বলে উঠলো―
“”আপনি জানেন না দূরত্ব ভালোবাসা বাড়ায়??

―না আমি জানিনা,জানতেও চাইনা।
পিউয়ের সাবলীল উত্তর।
মুচকি হেসে পিউএর কপালে গাঢ় চুমুর পরশ আঁকে সৌম্য।

*****—-

যতো দুপুর গড়াচ্ছে সূর্যের তেজ হুহু করে বাড়ছে,বাইরে এক দন্ড টেকা যাচ্ছে না।সূর্যের উত্তাপে মাটি সহ মরুভূমির বালুর মতো উত্তপ্ত হয়ে আছে।কোনো ফাঁকফোকর গলিয়েও ধরনীতে কোনো হাওয়া বইছে না।পাখপাখালী পর্যন্ত গাছের পাতার চিপায় ঘাপটি মেরে বসে আছে।মাঝে মাঝে দু একটা কাকের কা কা ডাক শোনা যাচ্ছে।

একদিকে প্রচুর গরমের ভেতর জার্নি করে এসেছে তন্মধ্যে
খাবারের অনিয়ম, ভয়ভীতি,অনুপযোগী পরিবেশ,সব মিলিয়ে স্বর্গের অবস্থা নাজুক।

বাসায় এসেই সে হড়হড় করে বমি করে দিলো।

মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে বার বার।

তনুজা ধরে ধরে দূতলায় স্বর্গের বেড রুমে স্বর্গকে এনে শুইয়ে দিলেন।

আর নিজে চলে গেলেন স্যুপ বানাতে।

শরীরে শক্তি পাচ্ছে না স্বর্গ।

এই মুহূর্তে ভিটামিন স্যালাইন পুশ করা জরুরি।
নিজের ফোন ওয়ালেট,ব্যাগ সব কিছু হারিয়ে গেছে স্বর্গের।

আহিয়ানের দুধর্ষতার কথা মনে পড়তেই শরীর শিউরে উঠলো স্বর্গের।

হঠাতই স্বর্গের শয়ন কক্ষের দরজা খুট করে খুলে গেলো।
রুমে প্রবেশ করলো মুহিত।

মুহিত কে দেখে বুকের ধুকপুকুনি বেড়ে গেলো স্বর্গের।মনে হচ্ছে এখনই লাভ এট্যাক এসে যাবে।

মুহিতের আর্মি ইউনিফর্মের আকর্ষণীয় রূপে স্বর্গ ভুলে গেলো চোখের পলক ফেলতে।

উফ,কে বলেছে এই ব্যাটাকে এতো সুন্দর হতে?

এই ব্যাটা রাস্তায় চলাফেরা করে কিভাবে?

মেয়েরা কি তাকে নজর দিয়ে গিলে খায় না??

শোয়া থেকে উঠে বসতে চাইলো স্বর্গ,কিন্তু শরীর সায় দিলোনা।
বসা মাত্র মাথা ঘুরে উঠলো।
আউচ্ বলে মৃদু শব্দ করে আবার ধপ করে শুয়ে পড়লো স্বর্গ।

মুহিত বিচলিত হলো।দৌড়ে স্বর্গের কাছে এসে দুটো বালিশ উঁচু করে দুই বাহু ধরে স্বর্গকে শুইয়ে দিলো।

মুহিত এতটাই স্বর্গের কাছে চলে এলো যে,
দুজন দুজনের হার্টবিট শুনতে পাচ্ছে।

মুহূর্তেই চোখাচোখি হলো দুজনের।এতটা কাছে তার প্রেয়সী।বুকের ভেতর অবাধ্য ইচ্ছে আন্দোলন করে বাইরে বেরিয়ে আসতে চাইছে।
নিজেকে কন্ট্রোল করা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে ।
নিজেকে ভয়াবহ শাসিয়ে সরে আসতে চাইলো মুহিত।

অমনি খপ করে শার্টের কলার ধরে ফেললো স্বর্গ।
―প্লিজ নড়বেন না মেজর।আপনার হৃদ স্পদন শুনতে আমার ভালো লাগছে।
―আপনি আমার কাছে থাকলে আমার ভালো লাগে।নিজেকে সেইফ মনে হয়।
বলতে বলতে স্বর্গ মুহিতের গালে আঙুল ছুঁইয়ে ছুঁইয়ে ঠোঁটের কাছে আনলো।
দুই আঙুলের সহায়তায় মুহিতের টকটকে লাল ঠোঁটে টিপে ধরলো স্বর্গ।
আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেললো মুহিত।

কন্ঠ খাদে ফেলে বলে উঠলো
―নিজেকে কন্ট্রোললেস লাগছে স্বর্গ।আমি অনেক ক্ষণ ধরে সব কিছু আয়ত্তে আনার চেষ্টা করছি।প্লিজ আমাকে সীমানা পার হতে বাধ্য করবেন না।
―আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবেন মেজর?
স্বর্গের আকুল নিবেদন।

কিভাবে মানা করবে নিজের মোহিনীর এমন আবদার?

মুহিত পারলো না স্বর্গের আকুতি ফিরিয়ে দিতে।দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে চেপে ধরলো বুকের সাথে।স্বর্গও মুহিত কে এমন ভাবে ঝাপটে ধরলো যেনো কেউ চাইলেও আর তাদের আলাদা করতে না পারে।
মুহিতের মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে স্বর্গ কে সে যদি বুকের ভেতর পুরে ফেলতো পারতো তাহলে বুকের ভেতর যেই উত্তাল দাবানলের সৃষ্টি হয়েছে সেটা নিভে যেতো।

―আপনাকে ভালোবাসি মুহিত।আপনি ই আমার ভালো থাকার একমাত্র ঔষধ।
আপনি কাছে আসার পর থেকে আমার সকল ক্লান্তি,খারাপ লাগা,উধাও হয়ে গেছে।
আপনি কি সব সময় এভাবে আমার পাশে থাকবেন মেজর?

দুই হাতের তালুতে স্বর্গের মুখের আদল ধরে নাকে ছোট করে একটি চুমু দিয়ে মুহিত আদুরে স্বরে বলে উঠলো―

যেভাবে চাইবেন সে ভাবেই আমি আপনার পাশে থাকবো স্বর্গ।

#চলবে।

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_১৩
#সারিকা_হোসাইন

সমস্ত সাক্ষ প্রমাণের ভিত্তিতে আদালত আহিয়ান কে ফা*সি*র আদেশ ধার্য করলো।
আশরাফ চৌধুরীর কাছে পুলিশ মারফত খবর পাঠানো হলো
সে যেনো একবার হলেও তার পুত্রকে দেখতে আসেন।
হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে নাকি সুরে কেঁদে খবর পাঠালেন―
–যেই ছেলে তার দেশ ও দেশের মানুষের ক্ষতি পৌঁছায় সে আর যাই হোক আশরাফ চৌধুরীর ছেলে হতে পারে না।

আমার এই জীবব্দশায় জেনে বুঝে কোনো দিন কোনো একটা পিঁপড়ে পর্যন্ত মারিনি,আর আমার ছেলে কি না —!

বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন আশরাফ চৌধুরী।

যেসব মেয়ে গুলোকে আহিয়ান পাচার করেছে এবং নির্মম ভাবে হ*ত্যা করেছে তাদের পরিবারের কাছে সংবাদ মাধ্যমে মিডিয়ার সামনে ক্ষমা চাইলেন।

আদালত যাতে দ্রুত তার ফাঁসি দিয়ে দেয় এটা নিয়েও তিনি কঠোর মতবাদ জানালেন।

যেই ছেলে বাবার আদর্শে মানুষ হতে পারেনি,যেই ছেলে অপকর্মে লিপ্ত হয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষতি করে বেড়াচ্ছে ,সেই ছেলের বেঁচে থাকার হক নেই।

আশরাফ চৌধুরীর কান্নায় সারা দেশের সাধারণ জনগণের চোখেও জল এসে গেলো।
এই না হলো আদর্শ বাবা।

এমন বাবা ঘরে ঘরে হওয়া উচিত।সবাই আশরাফ চৌধুরী কে তালি সমেত বাহবা জানালো।

*******
জেলে বসে বসে আহিয়ান জীবনের হিসেব কষছে।
তার বয়স যখন ছয় বছর তখন সে তার মাকে তার বাবার হাতে খু*ন হতে নিজ চোখে দেখেছে।
শুধু তাই নয় ,এই বিষয়ে আহিয়ান যদি কাউকে কিছু জানিয়ে দেয় তাহলে তাকেও মায়ের মতো গলা টিপে চিরজীবনের মতো চুপ করিয়ে দেবে বলে হুমকি দিয়েছে।
মাতৃ ভালোবাসা হীন আহিয়ান বড় হয়েছে হেল্পিং হ্যান্ডের হাতে।বাবা আশরাফ চৌধুরী প্রতিদিন নিত্য নতুন মেয়ে নিয়ে এসে বাসায় ফুর্তি করে বেড়াতো।

বাবার শয়ন কক্ষে অন্য একটি মেয়ের যৌন শীৎকার আহিয়ান কে প্রচুর কষ্ট দিতো।প্রথম প্রথম সে দুই কান চেপে ধরে কান্না করতো।মাঝে মাঝে আলমারির ভেতরে লুকিয়ে পড়তো।

আশরাফ চৌধুরী প্রায় ই নেশায় বুদ হয়ে আহিয়ান কে প্যান্টের বেল্ট দিয়ে পেটাতো।

বাবার হাত থেকে রক্ষা পেতে আহিয়ান তার বাবাকে প্রতিশ্রুতি দেয় উনি যেভাবে চাইবেন আহিয়ান সেই ভাবেই নিজেকে প্রকাশমান করবে।

তবে আজ কেনো তার বাবার তার প্রতি এতো ঘৃণা?
এটা কি ঘৃণা নাকি নিজেকে বাঁচানোর নতুন নাটক?

আহিয়ানের এই একত্রিশ বছরের জীবনে সে কখনো দেখেনি আশরাফ চৌধুরী কে সামান্যতম বুকে ব্যাথা অনুভব করতে।

তবে এক রাতের ব্যাবধানেই হার্ট এট্যাক এসে গেলো?

আশরাফ চৌধুরীর সাজানো নাটক বুঝতে পেরে কষ্টে বুক ফেটে কান্না এলো আহিয়ানের।

সে তো বলেনি টাকার বড়াই দেখিয়ে তাকে এখান থেকে মুক্ত করতে!

সে শুধু চেয়েছে তার বাবা তার শেষ সময়ে এসে তাকে একবার হলেও দেখে যাক।
মমতা মাখা হাতটা মাথায় রেখে দুটো ভালো ভালো কথা বলে শান্তনা দিয়ে যাক।

গড়িয়ে পড়া জ্বল আঙুলের সাহায্যে মুছে টুকা দিয়ে দূরে ছুড়ে ফেললো আহিয়ান।

এর পর উঠে দাঁড়ালো,পাশে থাকা কারা রক্ষীকে কাছে ডাকলো।

কেটকেটে কন্ঠে কারা রক্ষী বলে উঠলো―

“”কী চাই””
আহিয়ান বাঁকা হেসে বললো―

“মেজর মুহিত ওয়াসিফ”

******

পুষ্টিকর খাবার,ইনজেকশন, ভিটামিন স্যালাইন আর বেড রেস্টের প্রভাবে কয়েক দিনেই অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে স্বর্গ।

ঘরে বসে থাকতে তার একদম ভালো লাগছে না।
বাইরে যাবার জন্য মন হাঁসফাঁস করছে।

সুখ চলে গেছে গত কাল,নাফিজ মাহমুদ দুপুরে খেয়ে ভাত ঘুম দিয়েছেন।উঠবেন সেই সন্ধ্যায়।

কোয়ার্টার এর মাঠ টাতে হেটে বেড়াতে পারলে ভালো লাগতো।

বিকেলে ছোট ছোট বাচ্চারা কেউ সাইকেল চালায়,কেউ দৌড়াদৌড়ি করে,কেউ ব্যাট মিন্টন খেলে কেউবা আবার বসে বসে আড্ডা দেয়।
প্রত্যেকটা অফিসারের বাংলোর সামনে সুসজ্জিত ফুলের বাগান।দেখলেই মন ভরে যায়।সাথে কচি নরম ঘাস।

মাঝে মাঝে স্বর্গের মনে হয় সে যদি গরু হতো তাহলে মাঠের সব ঘাস এক দিনেই সাবাড় করে ফেলতো।বিশেষ করে জেনারেল এর বাংলোর সামনের ঘাস গুলো।

মনের সকল ভাবনাকে একপাশে সরিয়ে স্বর্গ তার কক্ষ পরিত্যাগ করে ড্রয়িং রুমে নেমে আসলো।

সেখানে কাউকে পরিলক্ষিত হলো না।

সোফায় ধপ করে বসে পড়লো স্বর্গ।আজকের বিকাল টা তার কাছে সাংঘাতিক অলস মনে হচ্ছে।

সোফায় হেলান দিয়ে দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে হঠাৎ মুহিতের কথা মনে পড়লো তার।
মুহিতের আজ অফ ডে।

ওকেই তো নিয়ে যাওয়া যাবে।

ভাবনা টা মাথায় আসতেই ইয়েস বলে তুড়ি মারলো স্বর্গ।
যেই ভাবনা সেই কাজ।পা টিপে টিপে স্বর্গ মুহিতের কক্ষের দিকে অগ্রসর হলো।

মুহিতের দরজার সামনে এসে দুরু দুরু বুকে ঠকঠক শব্দ করলো স্বর্গ।

বিছানায় বসে ল্যাপটপে কিছু ব্যাক্তিগত কাজ সারছিলো মুহিত।
হঠাৎ দরজায় নকের শব্দে কাজে ব্যাঘাত ঘটলো।

এই টাইম টাতে মামা মামী দুজনেই ঘুমায়।আর মা তো কখনো ই আসেনা।মুহিত ই কাজের ফাঁকে গিয়ে মায়ের সাথে সময় কাটায়।তাহলে কে আসলো?
কাজ বাদ দিয়ে ল্যাপটপ অফ করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো মুহিত।

খুট করে দরজা খুলে স্বর্গ কে নিজের রুমের দরজার সামনে দেখে ঠান্ডা সমীরণ বয়ে গেলো মুহিতের প্রাণে।

না চাইতেও ঠোঁটে ফোটে উঠলো প্রশস্ত হাসি।

স্বর্গ আজ মেরুন রঙের একটি কুর্তি পড়েছে সাথে ম্যাচিং করা প্লাজও,গলায় ঝুলানো স্কার্ফ।ঘাড় সমান বাদামি চুল গুলো দুই পাশে ছাড়া।মুখে কোনো প্রসাধনীর ছোয়া নেই তবুও তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে মোহনীয় মনে হয় মুহিতের।

স্যালাইনের প্রভাবে মুখটা গুলুমুলু লাগছে।

মুহিতের মনে হলো মেয়েটাকে একটা টুপ করে চুমু খেয়ে ফেললে মন্দ হয় না ।
কিন্তু চাইলেই কি মেজর জেনারেল এর মেয়েকে যখন তখন চুমু খাওয়া যাবে নাকি?

মন কে বহুত হুমকি ধামকি দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক করলো মুহিত।
মুখে হাসি বজায় রেখে বলে উঠলো―

―আরে স্বর্গ আপনি?
“ভেতরে আসুন।””

মুহিতের মুখে আপনি সম্বোধন শুনে রাগের মিটার ছয়শত ফারেনহাইট হলো সামনে দাঁড়ানো মানবীর ।

তৎক্ষণাৎ পিছন ফিরে হাঁটা দিলো সে।

সাথে সাথে ই মুহিত বেক্কল বনে গেলো।

নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলো ―

“”কী হলো মেয়েটার হঠাৎ””

মুহিত আবার বলে উঠলো―

“”কি প্রবলেম হয়েছে স্বর্গ আমাকে খুলে বলুন।ভেতরে আসবেন না?

স্বর্গ মুখে কাঠিন্য বজায় রেখে বলে উঠলো―

“”না যাবোনা””!

“”তখন মুড ভালো ছিলো এজন্য এসেছিলাম,এখন মুড খারাপ হয়ে গেছে তাই চলে যাচ্ছি।

“”দরজায় নক করে আপনার বিশেষ সময় নষ্ট করার জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত, মাফ করবেন।

বলেই দুই হাত জোড় করে চলে যেতে উদ্দত হলো।

মুহিত জানে মেয়েদের মুড সুইং হয়।নিজের বোন কে দিয়েই জলজ্যান্ত প্রমান মুহিত।

তাই বলে সেকেন্ডের ব্যাবধানেই??

স্বর্গকে মুহিত অনেক দিন ধরেই দেখে আসছে।সেকেন্ডের মাঝেই এমন আমূল পরিবর্তন কখনোই চোখে পড়েনি।মেয়েটি যথেষ্ট ম্যাচিউর।

―তাহলে??

“”মুহিত কি কোনো অন্যায় করে ফেলেছে?

“”নিজের অজান্তেই কি স্বর্গের কোমল মনে আঘাত দিয়ে ফেলেছে?

ভাবনা থেকে বের হতেই মুহিত দেখতে পেলো স্বর্গ তার রুমের ত্রিসীমানায় নেই।
মুহিত মাথায় হাত দিয়ে চার পাশে উঁকিঝুঁকি মেরে চিল্লিয়ে উঠলো

―আরেহ পাখী গেলো কোথায়?

★★★
সৌম্য মিশন থেকে ফেরার পর থেকেই পিউ আর সৌম্যের ভ্যালেন্টাইন চলছে প্রতিদিন।লাভ বার্ড এর মতো সুযোগ পেলেই দুজন দুজনকে ছাড়া থাকতে পারছে না।

ডিউটি টাইম শেষ হতেই সৌম্য পিউকে নিয়ে ঘুরে বেড়ায়,নিজেদের মতো করে সময় কাটায়।

দুজনের বন্ডিং ও খুব ভালো।তারা দুজন দুজনের প্রতি যথেষ্ট লয়াল।
তাদের সম্পর্ক এখন মধুপুর্ন।
“”আপনি”” নামক সম্বন্ধ কে টাটা বাই বাই জানিয়ে “”তুমি””তে চলে এসেছে।

ক্যান্টনমেন্ট এর ভেতরে নির্ঝর আবাসিক এর লেকের পাড় দিয়ে হাত ধরে হেটে বেড়াচ্ছে সৌম্য আর পিউ।
হঠাতই পিউয়ের ফোনের কর্কশ রিংটোন এ প্রেমে ব্যঘাত ঘটলো তাদের।
ঝটপট ফোন বের করে স্বর্গের মায়ের নম্বর দেখতেই ভ্রু কুঁচকে এলো পিউ এর।
স্বর্গ তার ক্লোজ ফ্রেন্ড হলেও স্বর্গের মায়ের সাথে খুব কম কথাই হয়েছে তার।
চিন্তিত হয়ে ফোন রিসিভ করে সালাম দিতেই ওপাশ থেকে স্বর্গের আওয়াজ পাওয়া গেলো।

পিউ কুশল বিনিময়ের জন্য প্রশ্ন করার আগেই স্বর্গ ঝনঝনানি কন্ঠে বলে উঠলো―
ওই হাব্লু মেজরের বডিগার্ড তোকে কি বলে সম্বোধন করে রে?

পিউ বুঝলো কোনো ঝামেলা নির্ঘাত হয়েছে।না হলে সৌম্য তাকে কি বলে সম্বোধন করে এসব সে কেনো জানতে চাইবে?

তাই স্বর্গ কে না ঘাঁটিয়ে সিধে ভাবে বলে দিলো–
তুমি বলে ডাকে।

তোকে আদর করে কি বলে ডাকে?

উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলো স্বর্গ।

মাঝে মাঝে বাবু,জান, পাখি,টুকটুকি কখন কি বলে সেটা কথার মোডের উপর ডিপেন্ড করে “”
কেনো?
হঠাৎ এই প্রশ্ন কেনো?

স্বর্গ ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে উঠলো তোর ওই মেজরের বডিগার্ড কে বলবি―
প্রতিদিন যেনো ওই রসকস হীন করল্লা মেজরের এক ঘন্টা করে লাভ ক্লাস নেয়।
না হলে এতদিন মেজর একা পানিশমেন্ট দিয়েছে,এবার থেকে বাপিকে বলে বাপীকে দিয়েও ওর হালুয়া টাইট করাবো।

বলেই খট করে কল কেটে দিলো স্বর্গ

স্বর্গের এহেন রণমূর্তি দেখে ভড়কে গেলো পিউ।
পিউএর মুখের দিকে তাকিয়ে সৌম্য বলে উঠলো ―

কি হয়েছে বাবু?

ঠোঁট উল্টে পিউ বললো –
স্বর্গ তোমাকে পানিশমেন্ট দিবে।

সৌম্য বড় বড় চোখ করে জিজ্ঞেস করে―

“”সে কী?আমি কি করলাম আবার?

―তুমি কিছুই করোনি,করেছে মেজর।

সৌম্য অবাকের সহিত প্রশ্ন করলো

“”কী করেছে মেজর??

সেটা তো আমিও জানতে চাই,বলেই বিজ্ঞের ন্যায় ভান ধরলো পিউ।

◆◆◆
নামিরা এখন নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা।পেট টা অনেকটাই ফুলে উঠেছে।রাতে ঘুমাতে অসুবিধা হয় তার,সোহাগ খেয়াল করেছে রাতের বেশির ভাগ সময় ই ওয়াশ রুমে কাটায় মেয়েটা।
খাবার দাবার এও চরম অনীহা এসেছে।

ডক্টর বলেছে এই টাইমটাতে প্রচুর সেইফলি চলাফেরা করতে হবে।
সোহাগ ভার্সিটি থেকে ছুটি নিয়েছে সে জন্য।

দিন যতো যাচ্ছে সোহাগ ততো ভয়ে সিটিয়ে যাচ্ছে,একা এই অচেনা দেশে সে কিভাবে সামলাবে নামিরা আর ছোট বাচ্চাকে?

সোহাগ মনে মনে ভাবলো নামিরার মাকে যদি এখানে আনা যায় তাহলে নামিরাও ভালো থাকবে,মা ও ভালো থাকবে।

অনেক ভেবে চিন্তে সোহাগ মুহিতের নম্বর ডায়াল করলো।

চারিদিকে ভ্যাপসা গরমে দম ফেলতেও যেনো কষ্ট হচ্ছে
সূর্যের উত্তাপ যেনো আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে ধরনীতে।এসির ঠান্ডা হাওয়ায় শরীর যেমন দ্রুত হীম হয় তেমনি বাইরে বের হলে যেনো গায়ে আগুন ধরে যায়।একটু বৃষ্টির শীতলতা উপভোগ করতে পারলে মন্দ হতো না।

মুহিত আজ অনেক ব্যাস্ত।অফিসিয়াল কাজে এক দন্ড রেস্ট নেবার ফুসরত মিলছে না।রোদের মধ্যে দৌড়াদৌড়ির কারনে ঘেমে নিয়ে একাকার অবস্থা।
এর মধ্যে জেল সুপার জরুরি তলব করেছে।

মুহিতের সাথে জেল সুপার এর কি কাজ?

সেটাই ভেবে চলেছে মুহিত।

ভাবনার সুতো ছিড়লো রিংটোন এর শব্দে।স্ক্রিনে সোহাগের নম্বর দেখে বুক কেঁপে উঠলো মুহিতের।
জরুরি দরকার ছাড়া সোহাগ কখনোই মুহিত কে কল করে না।

ফোন কানে তুলে হ্যালো বলতেই সোহাগের উচ্ছসিত কন্ঠ শোনা গেলো।
মুহিত কিছুটা শান্ত হয়ে কুশল বিনিময় পর্ব শেষ করলে।

সোহাগ ইতস্তত করে বলে উঠলো
―মুহিত নামিরার যেকোনো সময় লেবার পেইন উঠতে পারে,আমি একা এখানে সাহসে কুলাতে পারছি না।

“”তুমি জানো নামিরার মুখ থেকে একটু “আহ” মূলক শব্দ আমার হৃদয়ে কতোটা ব্যাথার সৃষ্টি করে।

লেবার পেইনে নামিরা এই বিদেশ বিভুঁইয়ে কাতরাবে এটা আমি সহ্য করতে পারবো না।
আর তা ছাড়া নামিরার একটা সাহস দেবার মানুষ প্রয়োজন।

জানি একটা অন্যায় আবদার করতে যাচ্ছি।তবুও নামিরার ব্যাপারে আমাকে একটু নয় অনেকটাই স্বার্থপর বলতে পারো।

সোহাগ অপরাধীর ন্যায় কন্ঠ খাদে ফেলে বললো

―””যদি কিছু মনে না করো মা কে একটু পাঠাবে?

মা তো অনেকটাই সুস্থ এখন।

,বলেই নীরব শ্রোতা হয়ে মুহিতের উত্তরের প্রতীক্ষায় রইলো সোহাগ।

স্মিত হেসে মুহিত উত্তর করলো

এতো ইতঃস্ততার কি আছে সোহাগ ভাই?

আমি মা কে বলে আপনাকে সব কিছু জানাবো।আপনি চিন্তা করবেন না ।
আরো বিভিন্ন কথা বলে সোহাগ কে ভরসা দিয়ে লাইন কেটে দিলো মুহিত।

――――――――――

মুহিত চিন্তিত মনে বসে অপেক্ষা করছে ক্রিমিনাল ভিজিটিং রুমে।

তার বোধগম্য ই হচ্ছে না আহিয়ান কেনো তার সাথে কথা বলতে চাইছে?
মুহিত তো সব কিছু সাবমিট করে দিয়ে ঝামেলা চুকিয়ে ফেলেছে।
তবে আজ কেনো আহিয়ান তাকে জরুরি তলব করেছে?

ঝনঝন শব্দে ধ্যান ভাঙলো মুহিতের।
হাতে হ্যান্ডকাফ, পায়ে বেড়ি দিয়ে মুহিতের সামনে বসানো হলো আহিয়ান কে।
দুদিন আগেই যেই ছেলেটার চেহারা জৌলুসে পরিপূর্ণ ছিলো আজ সেটা অনেকটাই মলিন।
কেমন যেনো কয়েক দিনের ব্যাবধানেই অনেকটা শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে ছেলেটা।
ক্লিন শেইভের চকচকে গাল গুলো খোঁচা খোঁচা দাঁড়িতে ভরে গেছে।
চোখের নিচে জমেছে কালি।

মুহিতের মনে হঠাৎ মায়ার উদ্রেক হলো।তবুও মুখে গাম্ভীর্য ভাব বজায় রেখে তাকে ডাকার হেতু জানতে চাইলো।

আহিয়ান বিষাদ পূর্ণ হাসি দিয়ে মুহিতের উদ্দেশ্যে বললো―
“”মেজর মুহিত আমাদের চোখের সামনে যা দেখি,যা ঘটে আমরা তাকেই সত্যি ভেবে নেই।

”’কিন্তু সত্যের পিছনেও সত্য থাকে।
আমরা সেটাকে যাচাই করিনা।

মুহিতের কপালে সূক্ষ্ণ ভাঁজ দৃশ্যায়মান হলো।
গমগমে কন্ঠে বলে উঠলো―
―হেঁয়ালি না করে যা বলতে চান তাই বলুন,সময় খুব কম আমার হাতে।

তাচ্ছিল্য পূর্ণ হেসে আহিয়ান বললো―
―””বাপ ভাইয়ের খুনি কে?

তা জানতে ইচ্ছে করে না মেজর মুহিত ওয়াসিফ??

#চলবে

তোমার জন্য সিন্ধুর নীল পর্ব-১১ এবং বোনাস পর্ব

0

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_১১
#সারিকা_হোসাইন

―তোমাকে কেনো এখানে তুলে এনেছি জানো?

প্রশ্নটি করে আহিয়ান স্বর্গের পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো।

স্বর্গের কোনো ভাবান্তর না দেখে মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে বলে উঠলো আহিয়ান

―আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই স্বর্গ।

কথাটি শোনা মাত্র স্বর্গের রাগের পারদ তরতর করে মাত্রা ছাড়ালো কিন্তু মুখে কিছুই প্রকাশ করলো না।

আহিয়ান আয়েশ করে স্বর্গের পাশে বসে আবার বলতে শুরু করলো

―আমি তোমাকে প্রথম দেখেছিলাম আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজের (এ এফ এম সি) বেলকনিতে।

মুখে লাজুকতার ভাব নিয়ে আহিয়ান স্বর্গের পানে চাইলো

―তুমি দূতলার একটি বেলকনিতে কিছু মেয়ের সাথে হেসে হেসে কথা বলছিলে।আমি ওইদিন বাবার সাথে সেখানে উপস্থিত হয়েছিলাম কিছু কাজে।

কিন্তু তোমাকে দেখার পর আমি কিছুতেই সেই কাজে আর মনোযোগ দিতে পারিনি। তোমার হাসি মাখা মুখটাই শুধু আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে।

তোমার বড় বড় চোখের পাপড়ি ঝাপ্টানি আমার হৃদয় কে করেছে উত্তাল।সেদিন ই আমি তোমার মাঝে আমার সর্বনাশ দেখেছি মিস স্বর্গ।

তুমি তো জানো,
চাইলেই যেই কেউ ক্যান্টনমেন্ট এর ভেতরে প্রবেশ করতে পারে না।

“কিন্তু আমি বিভিন্ন অফিসার এর সহযোগিতা নিয়ে ঠিক তোমাকে দেখে গিয়েছি।”

“তোমাকে দেখার লোভ আমার এজন্মে শেষ হবে না স্বর্গ।”

―”চাইলে আমার সামনে এসে এসব বলতে পারতেন আপনি!এমন কাপুরুষের মতোন তুলে এনেছেন কেনো?
ঝাঁঝালো স্বরে বলে উঠলো স্বর্গ।”

আহিয়ান মাথা নিচু করে ফুস করে নিঃশ্বাস নিলো ।তারপর একটু থেমে আবার বললো

―কাপুরুষ ই বলতে পারো।

“আসলে প্রেম নিবেদন,ভালোবাসার গপ্পো বলে মেয়ে পটানো এসব আমার ধাঁচে নেই।”

“আমি শুধু জানি যেটা আমার চোখে পড়েছে সেটা আমার লাগবে এবং সেটা শুধু আমারই।”

তোমার জন্য ওই দু টাকার মেজর মুহিতের চোখে আমি মুগ্ধতা দেখেছি।কতো বড় সাহস তার ,
―আমার সামনে থেকে তোমাকে উঠিয়ে নিয়ে যায়

বলেই রাগ সংবরন করতে না পেরে পাশে থাকা আয়নায় ঘুষি মারে আহিয়ান।
পেশীবহুল হাতের ঘুষিতে ঝনঝন শব্দে ভেঙে যায় দেয়ালে থাকা আয়না।

স্বর্গ চমকে উঠে কিন্তু একদম ভড়কায় না।

আহিয়ান এর হাত কেটে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত ঝরছে।

একজন ডক্টর হিসেবে স্বর্গের খারাপ লাগা স্বাভাবিক।কিন্তু তার লাগছে না।

এই লোকের কারনে তার বাবা,মা,ভাই সবাই অবশ্যই সাফার করছে।
আর মুহিত?
সে কী আমাকে খুঁজবে?নাকি অন্য কোনো কাজে ব্যস্ত হয়ে যাবে?

★★★
পোর্ট মাস্টার এর কাছে ডেড সৌল এর নাম শুনে মুহিত আর সৌম্যের চোখ চকচক করে উঠে।তার মানে তারা সঠিক জায়গাতেই এসেছে।
পরক্ষনেই তাদের আশার প্রদীপ নিভে যায় যখন পোর্ট মাস্টার জানায় আগামী তিন মাসের মধ্যে এই জাহাজ এই ঘাটে নোঙর ফেলবে না।
বলেই শিডিউল বইটি মেজর নিকোলাস এর হাতে দিলো বৃদ্ধ ।

নিকোলাস আর ভলতেয়ার সব গুলো কাগজ উল্টে পাল্টে দেখে মুহিত কে ইংলিশে সব বুঝিয়ে দিলো।

মুহিতের মনে আগ্নেয়গিরির হুতাশন জ্বলে উঠলো।যেই আশা বুকে বেঁধে এখানে এসেছে তবে কি তা পূরণ না করে ব্যার্থ হয়ে ফিরে যেতে হবে?

কেনো মুহিত সব জেনেও স্বর্গের জন্য নাফিজ মাহমুদ কে বলে তখন থেকেই দেহ রক্ষীর ব্যবস্থা করলো না।

মুহিত রাগে,কষ্টে নিজের উপর অভিমান করে জমে থাকা বরফের স্তুপে অনবরত পাঞ্চ করতে থাকলো।

সৌম্য দৌড়ে গিয়ে মুহিত কে কোনো ভাবে ম্যানেজ করলো।বিধস্ত মুহিত শরীরের ভার ছেড়ে দিলো সৌম্যের উপর।

আর কি কি হারালে নিয়তি তাকে ক্ষমা করবে?

প্রবীণ আরো কিছু কাগজ ঘেটে আরেকটি পোর্ট সম্পর্কে ওদের জানালো।
―ইউ ক্যান চেক দ্যাট পোর্ট
বলে একটা কাগজ নিকোলাস এর হাতে দিলেন।

বৃদ্ধ কে থ্যাঙ্কস জানিয়ে তারা দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করলো।

●●●
পেরিয়ে গেছে বারো দিন।এখনো স্বর্গের কোনো পাত্তা পাওয়া যায়নি।সমস্ত নিউজ পোর্টাল এ ঘুরছে বড় বড় হেডলাইন
―মেজর জেনারেল নাফিজ মাহমুদ এর কন্যাকে অপহরণ করা হয়েছে।
কোনো প্রমাণ ছাড়া আহিয়ান এর ছবিও কেউ পোস্ট করতে পারছে না।

দুইদিন ধরে নাফিজ মাহমুদ মুহিতের সাথে যোগাযোগ করেও ব্যার্থ হচ্ছেন।মুহিতকে লাইনে পাওয়া যাচ্ছে না।চিন্তায় মাথা টনটনে ব্যাথা করছে।
কি থেকে কি হয়ে গেলো এক নিমিষেই !
হায় মাবুদ সহায় হও!

তনুজা ঠেলে ঠেলে কোনোমতে নিজেকে চালাচ্ছেন।তার বিশ্বাস একদিন না একদিন হয় ভালো খবর আসবে না হয় মন্দ।

যখন নাফিজ মাহমুদ বিদেশে মিশনে যেতেন তনুজা কে বুঝাতেন―
” আমি আর না ফিরলে বুঝবে আমি ওপারে চলে গিয়েছি”।

“তোমাকে শক্ত হতে হবে তনুজা।তুমি একজন দেশ রক্ষকের স্ত্রী।তোমার মন দুর্বল হলে কিভাবে চলবে তনুজা?”

প্রথম প্রথম তনুজা অনেক ভয়ে ভয়ে থাকতো

নাফিজ ফিরবে তো?

কিন্তু ধীরে ধীরে তনুজা সেই ভয়কে জয় করে মন কে কঠিন করতে পেরেছে।

তবে আজ কেনো সেই কঠিন মনে আবার ভয় এসে হানা দিচ্ছে?
মাতৃ হৃদয় বলেই কি এমন?

আর ভাবতে পারেনা তনুজা।

স্বর্গের নিষ্পাপ মুখটা মনে পড়তেই কপোল বেয়ে ভারী বর্ষণ নেমে আসে।

সুখের দুস্টুমি কমে গিয়েছে।সেও গুটিয়ে রয়েছে,অনলাইনে বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা চালাচ্ছে কিভাবে তার বোন কে উদ্ধার করতে পারবে?

সুখ মনে মনে প্রমিস করেছে আপু ফিরলে আর কখনো অকারনে জ্বালাবো না।
খেপাবো ও না।ভালো ছেলে হয়ে বোনের কেয়ার করবো।

মিসেস তারিন এখনো কিছুই জানেন না।তাকে জানতে দেয়া হয় না।অসুস্থ মানুষ ঘর থেকে বেশি বের ও হন না।এজন্য তিনি এখনো নিশ্চিন্তে একটু আরামে আছেন।

***
পোর্ট মাস্টারের কথা অনুযায়ী সমস্ত খোঁজ খবর নিয়ে তারা এখন উপস্থিত হয়েছে ―

নভোরোসিয়স্ক বন্দরে।

এই বন্দরটি বরফ মুক্ত হওয়ায় বেশিরভাগ জাহাজ এখানে অবতরণ করে।বন্দরটি আকারে বিশাল বড়।
শত শত জাহাজের ভীড়ে কোথায় পাবে সেই ডেড সৌল??

রাশিয়ান আর্মিদের অত্যন্ত সমীহ করে চলে এই দেশের জনগণ।চাইলেই তারা ক্ষমতার ব্যাবহার করে যা খুশি তাই করতে পারে।

পোর্টে আর্মি জিপ দেখেই কিছু পোর্ট অথরিটি দৌড়ে কাছে আসলো এবং অত্যন্ত সম্মানের সহিত জানতে চাইলো
কি প্রয়োজন?

নিকোলাস মুহিতের ট্যাব নিয়ে জাহাজের ছবি বের করে সবাইকে দেখিয়ে সবিস্তারে কাহিনী খুলে বললো।

পোর্ট মাস্টার সকল জাহাজের সিডিউল চেক করে একটি ঘাট দেখিয়ে নির্দেশ করলেন যে―
আগামী মাসের নয় তারিখে জাহাজটি এখানে নোঙর করবে।
মুহিতের নিভে যাওয়া আশার প্রদীপ দপ করে জ্বলে উঠলো।

গ্রাউন্ড ফোর্সের জেনালের এর সাথে কথা বলে নৌবাহিনীর জাহাজের সাথে কথা বললেই কাজ অর্ধেক কমপ্লিট।

এরই মাঝে সন্দেহ জনক দুটি ছেলেকে পাওয়া গেলো,হঠাৎই তারা পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছিলো।
টহল রত দুজন সোলজার দক্ষতার সহিত ছেলে দুটো কে ধরে ফেললো এবং গাড়িতে করে আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে এলো।

ছেলে দুটোকে হাতে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে আটকে রাখা হলো।
সকাল হলে তাদের বিষয়ে খোঁজ লাগিয়ে একশন নিবে।

~~~স্বর্গ চতুরতার সহিত বিদেশি মেয়েটাকে বোকা বানিয়ে আহিয়ান সম্পর্কে অনেক তথ্য হাতিয়ে নিয়েছে।

স্বর্গ মেয়েটিকে বলেছে আমি আহিয়ানের হবু স্ত্রী।তুমি যদি তার কি পছন্দ কি অপছন্দ তার দুর্বলতা কিসে?এসব না জানাও আমাকে তাহলে আহিয়ানের কাছে তোমার নামে উল্টা পাল্টা বলে সমুদ্রের তল দেশে সলিল সমাধি দিয়ে দেব।

সুন্দরী মেয়ে দের সঙ্গ আহিয়ানের মারাত্মক পছন্দ।এই একটি বিষয়েই সে দুর্বল।সাথে নেশাপানি।
এই কুলকিনারা হীন সমুদ্র থেকে কোনো প্রকার চতুরতা করেও স্বর্গ ফিরতে পারবে না।যোগাযোগ এর ও কোনো মাধ্যম নেই।যা আছে তা হচ্ছে ওয়াকিটকি।

নিজের এমন দুর্ভাগ্য দেখে আনমনে ঠোঁট কামড়ে কেঁদে উঠলো স্বর্গ।

◆◆
আশরাফ চৌধুরী এই নিয়ে ছাপ্পান্ন বার তার ছেলের নম্বরে কল করেছেন।বরাবরই সংযোগ বিচ্ছিন্ন।রাগে বিতৃষ্ণায় মুখে বাজে গালি এসে গেলো তার।
মনে মনে এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন তিনি।
তার এই ছেলের জন্য যদি নিজের ধীরে ধীরে গড়া সম্রাজ্যের সামান্য টুকু ফাটল ধরে তাহলে তিনি তার ছেলেকে জ্যন্ত পুতে ফেলবেন।

****
থেমে নেই পিউ।নিজের ডাক্তারি ডিউটি পালনের পাশাপাশি সে তার বাবাকে বেশ ভালো নজরদারি তে রেখেছে।এমন ভাবে সকল কাজ করে বেড়াচ্ছে পিউ যেনো তার বাবা কিচ্ছুটি টের না পায়।

নাসের হায়দার এর বড্ড কু অভ্যাস হচ্ছে মদ খেতে খেতে মাতাল হয়ে ধ্যান জ্ঞান হারানো।
সেই সুযোগ টাই লুফে নিলো পিউ।
ঘড়িতে সময় রাত বারোটা বেজে ত্রিশ মিনিট।
নাসের হায়দার নেশায় চূর হয়ে এলোমেলো ভাবে বিছানায় পরে রয়েছেন।
পা টিপে টিপে পিউ নাসের হায়দার এর শয়নকক্ষে প্রবেশ করলো।সন্তপর্নে আশেপাশে তাকিয়ে তার বাবার ফোনের অনুসন্ধান চালাচ্ছে।
হঠাৎই ফ্লোরে পায়ের ধাক্কা লেগে খালি হয়ে যাওয়া মদের বোতল গড়গড় শব্দ তুললো।
ভয়ে পিউ আলমারির সাথে সেটে রইলো।
কীয়তক্ষন অপেক্ষা করার পর ও যখন নাসের হায়দার এর কোনো সাড়া শব্দ পেলো না তখন পিউ পা টিপে টিপে বিছানার কাছে আসলো।

ঐতো উনার পিঠের নিচেই ফোনটা দেখা যাচ্ছে।যেকোনো প্রকারে ফোনটা পিউয়ের হাতে চাই।
নিজের কথা চিন্তা না করেই পিউ ফোনের দিকে হাত বাড়ালো,নাসের হায়দার কে কিচ্ছুটি টের না পেতে দিয়ে বের করে আনলো মোবাইল ফোন।
আনন্দে পিউ এর ঠোঁটে সূক্ষ্ণ হাসি ফুটে উঠলো।

বিপত্তি বাধলো লক খুলতে গিয়ে।ফিঙ্গার নয় কোড প্রেস করে লক খুলতে হবে।
জানা অজানা সকল নম্বর দিয়ে ট্রাই করে ব্যার্থ হলো পিউ।
হাল ছেড়ে দিলে চলবে না।যেভাবেই হোক কোড জানতে হবে।

মাথায় খেলে গেলো দারুন বুদ্ধি।
“কালই একবার ল্যাবে যেতে হবে।প্রধান কাজ হচ্ছে ফিঙ্গার প্রিন্ট পাউডার কালেক্ট করা।

মোবাইলটা পূর্বের জায়গায় রেখে ধীরে ধীরে প্রস্থান নিলো পিউ।

■■
কেটে গিয়েছে চুয়াল্লিশ টি দিন।কারো চোখে ঘুম নেই।কবে জাহাজ কিনারায় ভিড়বে,কবে উদ্ধার হবে স্বর্গ?

স্বর্গকে ওই দিনের পর আহিয়ান একটা আচড় ও লাগতে দেয়নি।যখন স্বর্গের উপর রাগ হয়েছে সে নিজেকে নিজে আঘাত করেছে।

আহিয়ান স্বর্গকে বোঝাতে চায় যে,
“সে অমানুষ হলেও তার ভালোবাসা নিখাদ।”

মুহিত কে টেক্কা দিয়ে স্বর্গকে দূর দেশে নিয়ে এসেছে এর চাইতে বড় প্রাপ্তি আর কি হতে পারে?

এখানে কোনো আর্মি পুলিশ কিছুই করতে পারবে না তাকে।কে দিবে তার নামে প্রশাসনের কাছে বিচার?

কেউ কি ঘূর্ণাক্ষরে টের পেয়েছে সে কোথায় যাবে বা যাচ্ছে?
রাশিয়া পৌঁছেই স্বর্গকে যেভাবেই হোক বিয়ে করে ফেলতে হবে।মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ওকে আমার সাথেই থাকতে হবে।
আমি না পেলে কেউ ওকে পাবে না।

দরকার হলে স্বর্গকে টুকরো টুকরো করে সমুদ্রে ফেলে দিবে আহিয়ান।

যেই জিনিস আহিয়ান চৌধুরী চুজ করেছে সেই জিনিসে আর কারো অধিকার নেই।

স্বয়ং নাফিজ মাহমুদ এর ও না।

――――――――――
পোর্ট মাস্টারের দেয়া ডেট শেষ হয়ে গিয়েছে আরো দুদিন আগে।মুহিত দের ফিরে যাবার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
মুহিত কোনো কাকুতি মিনতি করেও কিছু করতে পারেনি।

যাবার আগে শেষ বারের মতো মুহিত আজকে আবার পোর্টে এসেছে।আজকে সাথে সৌম্য আসেনি।সৌম্য ফিরে যাবার সমস্ত কিছু রেডি করছে।
হঠাৎ ই জাহাজ কিনারায় ভিড়ার শব্দ পেলো।
বিশাল বড় পোর্ট ,এক সাথে অনেক গুলো জাহাজ তীরে ভিড়ছে।যাত্রী,মালামাল, খদ্দের এর ভিড় সব মিলিয়ে এক গোলক ধাঁধার মধ্যে পড়ে গেলো মুহিত।
জেটি ঘাট নিমিষেই লোকে লোকারণ্য হয়ে গেলো।

স্বর্গের চারপাশে আহিয়ান কয়েকজন রুশ মেয়ে নিয়োজিত করে দিলো।আর কঠিন হুঁশিয়ারি জারি করলো।
পোর্টে স্বর্গ কোনোরূপ ঝামেলা করলে ওকে শেষ করবে তো করবেই সাথে নিজের বাবা ,মা ,ভাইকেও তার দাম চুকাতে হবে।

ভয়ে ,ঘৃণায় স্বর্গ নিষ্প্রাণ হয়ে রইলো।

এতো এতো ভিড়ের মাঝে হঠাৎই মুহিতের বুকের বাঁ পাশ টা ধক ধক করে উঠলো।
এমনটা মুহিতের আগেও হয়েছে,যখন স্বর্গ তার আশেপাশে থেকেছে।তবে আজ কেনো এমন পরিস্থিতিতে ধারকান বেড়ে যাচ্ছে?

আনমনে মেয়ে গুলোর ভিড়ে হাঁটছে স্বর্গ।নিজেকে সে সপে দিবে আহিয়ান এর কাছে।এই বিদেশ বিভুঁইয়ে কেউ তাকে রক্ষা করতে আসবে না।নিজেকে কোরবান দিয়ে যদি বাবা,মা,ভাইকে বাঁচিয়ে রাখা যায় ক্ষতি কি?

চোখের জ্বল মুছে সামনের তাকিয়ে হাঁটা ধরলো স্বর্গ।
হঠাৎই পরিচিত পারফিউম এর ঘ্রাণ নাকে এসে লাগলো স্বর্গের।

মুহিতের কথা মনে পড়তেই দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো মোটা মোটা অশ্রু দানা।
“আপনাকে আমার ভালোবাসার কথাটা জানানো হলো না মেজর।”আমি আপনাকে ভালোবাসি মেজর মুহিত ওয়াসিফ।ভালোবাসি।

আহিয়ান চোখ মুখ ঢেকে দ্রুত বেগে পোর্ট থেকে বেরিয়ে গেলো।পোর্ট অথরিটির সাথে কিছু কাজ আছে,সেগুলো কমপ্লিট করে দ্রুত বের হতে হবে এখান থেকে।

যাবার আগে মেয়ে গুলোকে নির্দেশ দিয়ে গেলো কোথায় কিভাবে স্বর্গ কে পৌঁছাতে হবে।

শীতের তীব্রতায় মুহিত নিজেকে এমন ভাবে ঢেকে রেখেছে শুধু চোখ দুটো ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

মুহিত দিকবিদিক শূন্য হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।কোনো ভাবেই হৃদপিন্ডের লাফানো থামছে না।বুকে সূক্ষ্ণ ব্যাথার আলোড়ন সৃষ্টি করেছে এই স্পন্দন।

এতো এতো মানুষের ভিড়ে হঠাৎ ই স্বর্গের চোখ যায় ডিপ ব্রাউন ট্রেঞ্চ কোট পরিহিত এক যুবকের দিকে।
চেহারা দৃশ্যমান নয়।গ্রে কালারের মাফলারে সে মুখ গলা ঢেকে রেখেছে শুধু চোখ গুলো বের করা।
পরনে হালকা ব্রাউন সোয়েটার,ব্ল্যাক জিন্স আর বুটস।

এই চোখের দৃষ্টি স্বর্গের বহু চেনা।সমুদ্রের স্বচ্ছ নীল জল রাশির মতো অক্ষিদ্বয় এর মালিক তার মনের অনেক কাছে বাস করে।এই চোখের গভীরে সে তো কবেই ডুবে মরেছে।শুধু চোখের মালিক কে জানানো হয়নি ।

পরক্ষণেই সে মনকে বুঝ দেয়
―সে এখানে কিভাবে আসবে?”

“সবই তোর মনের ভ্রান্ত ধারণা স্বর্গ।

“তাকে পাবার লোভ আর করিস না।”

অবাধ্য মনের নিষেধ অমান্য করে ―

মরীচিকার পিছনে পিপাসার্ত বেদুইন যেভাবে ছোটে সেই ভাবে স্বর্গের ও ওই যুবক টির কাছে যাবার জন্য অন্তর পিপাসার্ত হয়ে উঠলো।

মেয়ে গুলোর চোখ ফাঁকি দিয়ে যুবকটির কাছ ঘেষে দাঁড়ালো এবং হাত চেপে ধরলো স্বর্গ।

আকস্মিক কারো হাতের স্পর্শ পেতেই চমকে উঠে মুহিত।

সামনে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অবাধ্য নোনা জ্বলের ধারা।

#চলবে

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#বোনাস_পর্ব
#সারিকা_হোসাইন

■■
এবাক্যান, রাশিয়া

ঘড়িতে সময় রাত এগারোটা বেজে ত্রিশ মিনিট, যা বাংলাদেশের সময় অনুযায়ী তিন ঘন্টা পিছিয়ে।

চারপাশে পাকা গম ক্ষেতের বিস্তার, গমের শীষের উপর কুয়াশার আস্তরণ মাকড়শার জালের মতোন মনে হচ্ছে।উত্তরীয় শৈত প্রবাহ হাত পা জমিয়ে দেবার জন্য যথেষ্ট।তাপমাত্রা সাত ডিগ্রি সেলসিয়াস। কুয়াশায় আকাশের চাঁদটা ঝাপসা হয়ে মৃদু আলো ছড়াচ্ছে।

হাওয়ার দাপটে গম ক্ষেতের উইন্ডমিল গুলো ক্যাচ ক্যাচ শব্দ তুলে ঘূর্ণায়মান হচ্ছে।চারপাশ নিস্তব্ধ, শুনশান।মাঝে মাঝে এবাক্যান নদীর তীর থেকে বাইসনের হাড় হিম করা হুংকার ভেসে আসছে।

গম ক্ষেতের জমি থেকে সামান্য উঁচু ভূমিতে ছোট একটি দূতলা বিশিষ্ট কাঠের বাড়ি দেখা যাচ্ছে,সেখানে জ্বলছে মৃদু হলুদ আলো যুক্ত লাইট।বাড়িটির পাহারায় রয়েছে রাইফেল হাতে সাতজন তাগড়া জোয়ান ছেলে।প্রত্যেকের উচ্চতা গুনে গুনে ছয় ফিট সাথে জিম করা মাসেল যুক্ত বডি।

এদের একেক জনের ঘুষির ওজন কমপক্ষে আড়াইশ থেকে তিনশত পাউন্ড হবে।এদের সামনে কোনো সাধারণ মানুষ শক্তিতে টিকতে পারবে না।

বাড়িটির চারপাশ ঘিরে ফেলেছে রাশিয়ান গ্রাউন্ড ফোর্স।সকলের হাতে একটি করে “একে ফোরটি সেভেন” রাইফেল রয়েছে যা বাড়িটির দিকে তাক করা। শুধু অপেক্ষা মেজরের সিগন্যাল এর।

বিয়ার ক্রলিং করে সৌম্য মুহিতের নিকট এগিয়ে এলো।

–”স্যার পজিশন নেয়া হয়ে গেছে,আপনি সিগন্যাল দিলেই শ্যুট করবো।

মুহিত হাতের সাহায্যে ইশারা দিয়ে সৌম্য কে পজিশন হোল্ড করতে বললো।

বাড়িটির চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে পঞ্চাশ জন আর্মি।তাদের লিডার মেজর নিকোলাস।
প্রত্যেকের কানে একটি করে ব্লুটুথ ডিভাইস।

মুহিতের কাছ থেকে সিগন্যাল পেলেই সরাসরি এট্যাক করবে।

কিন্তু মুহিত এখনো কেনো সিগন্যাল দিচ্ছে না ?

“এম কে ফোর” রাইফেলটি কে রাইফেল স্ট্যান্ড এর উপর রেখে সিক্স এক্স স্কোপ টিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ভিতরের অবস্থা দেখে নিলো মুহিত।

এই রাইফেলটি মুহিত খুব ভালো চালাতে পারে।এক সাথে ত্রিশ টি গুলি লোড করা যায়,এবং একটানা শ্যুট করা যায়।

শ্যুটিং রেঞ্জ ও যথেষ্ট ভালো।

মুহিত এখন যেই পজিশনে আছে ,শত্রু পক্ষ তার থেকে পাঁচশত পঁচাত্তর মিটার দূরে।
এই রাইফেলের সহায়তায় সে ছয়শত মিটার রেঞ্জের ভেতর গুলি ছুড়তে পারবে।
প্রথম শ্যুটেই টার্গেট বরাবর পৌঁছানোর রেকর্ড আছে মুহিতের।এজন্য একবার সে সেরা গোলন্দাজ এর পুরস্কার ও পেয়েছিলো।

জীবনে খুব কম টার্গেট ই মিস হয়েছে মুহিতের হাত দিয়ে।

তবে আজ কেনো মনে এতো ভয়,এতো অনিশ্চয়তা নিজের উপর?

মানুষটি তার একান্ত ব্যাক্তিগত বলেই কি মনে এতো দ্বিধা,এতো ভয়?

―――――――
বাংলাদেশ সময় অনুযায়ী ঘড়িতে বরাবর একটা বেজে উঠলো।
আর্মি জেনারেল এর ক্যাবিনে বসে আছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল, নাফিজ মাহমুদ,মেজর আদ্রিয়ান আহিয়াজ,দুজন ক্যাপ্টেন,দুজন লেফটেন্যান্ট।

মুহিত সকালে তাদের ইনফর্ম করেছে স্বর্গ কে রাশিয়া তে আনা হয়েছে,এবং কোথায় রাখা হয়েছে মুহিত তা জানে।আজ রাতেই মুহিত অপারেশন চালাবে।
প্রত্যেকে অধীর আগ্রহে বসে আছে কখন এই মিশন শেষ হবে।

মুহিত কে ওর্ডার দেয়া হয়েছে আহিয়ান কে কোনো প্রকার ক্ষতি পৌঁছানো ছাড়া দেশে ফিরিয়ে আনা।কিন্তু মিশন চলাকালে গুলি লাগলে সেটা ভিন্ন কথা।

মুহিত কি আর্মি জেনারেল এর আদেশ পালন করবে এবার?

নামাজে বসে আল্লাহর দরবারে মোনাজাতে অঝোর ধারায় কাঁদছেন তনুজা।

―ইয়া রাব্বুল আলামীন আমি তো কখনো আমার নিজের জন্য তোমার কাছে কিছু চাইনি।
নিজের স্বামী সন্তানের মঙ্গলের জন্য দোয়া চাওয়া কি অন্যায়?

―সন্তানের জন্য নাকি তোমার দরবারে দোয়া সমূহ দ্রুত কবুল হয়।আমি এক অসহায় মা আমার সন্তানের সুরক্ষার জন্য দোয়া ভিক্ষা চাচ্ছি।

“আমার বাচ্চা টাকে সহি সালামতে কোনো চোট পৌঁছানো ছাড়া আমার বুকে ফিরিয়ে দাও।”

গভীর রাত কিন্তু স্বর্গের চোখে কোনো ঘুম নেই।
স্বর্গ ঠিকই ছিলো, স্বর্গের মন মিথ্যে বলে নি।পেয়েছে সে এই অপরিচিত দেশে তার চেনা পরিচিত একান্ত ব্যাক্তিগত পুরুষটির স্পর্শ।

―কিন্তু সেই স্পর্শ এক মিনিট ও স্থায়ী হয় নি।
মুহিতের চোখে স্বর্গ দেখেছে তার জন্য কাতরতা।

স্বর্গ যখন অচেনা যুবক মনে করেও মুহিত ভেবে হাত চেপে ধরেছে এই আশায় যে,
―আল্লাহ আমার জীবনে যদি কোনো দিন আমি একটা হলেও ভালো কাজ করে থাকি,সেই কাজের উসিলায় এই ছেলেটিকে ই মেজর মুহিত বানিয়ে দাও।
মৃত্যুর আগে হলেও আমি একবার তাকে আমার হৃদয়ে তার জন্য জমানো অভিব্যক্তি গুলো প্রকাশ করতে চাই।

অচেনা যুবক ভেবেও স্বর্গ সেই ছেলেটির হাত চেপে ধরে বলেছিলো
―আমি জানিনা আপনি কে?তবে আপনাকে আমার বহু জনমের চেনা পরিচিত কাউকে মনে হচ্ছে।আপনার চোখ আমি অনন্ত কাল ধরে চিনি। আপনার শরীরের এই ঘ্রাণ আমার রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে।

জানিনা আমাদের আর কখনো দেখা হবে কি না।আমি আর কখনো আপনাকে পাবো না মেজর।আহিয়ান আমাকে আপনার থেকে আলাদা করে দেবার জন্যই এখানে তুলে এনেছে।
বলেই ফুঁপিয়ে উঠলো স্বর্গ।

কান্না মিশ্রিত কন্ঠে আবার বলে উঠলো_

―””মেজর মুহিত আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি।””
―এই হৃদয়ে শুধু আপনারই বসবাস।

আমার হৃদপিণ্ডের প্রতিটি
স্পন্দন আপনার নামে উৎস্বর্গ করলাম মেজর।

কথা গুলো শুনে মুহিতের হৃদয়ে যেনো রক্তক্ষরণ শুরু হলো।এভাবে সে স্বর্গের দেখা পাবে ভাবতেও পারেনি।

এ কদিনে মেয়েটা শুকিয়ে পুতুলের ন্যায় হয়ে গিয়েছে ,উজ্জ্বল হালুদাভ মুখের অবয়ব পাংশুবর্ণ ধারণ করেছে।মলিনতায় ঢেকে গেছে সকল চাঞ্চল্যতা।

এ কোন স্বর্গকে দেখছে মুহিত?
স্বর্গের এহেন দুর্দশা নিজ চোখে দেখতে পেয়ে মুহিতের চোখ থেকে আপনা আপনি গড়িয়ে পড়লো অশ্রু কনা।

সে স্বর্গকে বুকে জড়িয়ে ধরার আগেই মেয়ে গুলো স্বর্গের কোমরের কাছে পিস্তল চেপে ভিড়ের ভেতর ঠেলে নিয়ে চলে যায়।

মেয়েগুলোকে কোনো গ্যাঙ এর সদস্য মনে হয়েছে মুহিতের।
প্রত্যেকের হাতে একটি করে ট্যাটু ছিলো, সেইম ডিজাইনের।

ট্যাটু গুলো মুহিত আগেও একবার দেখেছে।

কিন্তু কোথায় দেখেছে এখন মনে করার সময় নয়।

স্বর্গ করুণ চেহারায় যতক্ষন পর্যন্ত মুহিত কে দেখা গিয়েছে ততক্ষণ দেখে নিয়েছে প্রাণ ভরে।

এতো কাছে পেয়েও মুহিত স্বর্গকে হারিয়ে ফেললো ভাবতেই ভেতর থেকে চিৎকার করে কান্না আসলো।
ছেলে মানুষের যখন তখন কান্না করাও বেমানান।
কান্না গুলো মুহিত নিমিষেই গিলে ফেললো।

ক্রোধে মুহিতের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো।ঘাড়ের রগ গুলো ফুলে উঠলো।চোখ দুটো আগ্নেয়গিরির লাভার মতো লাল বর্ণ ধারণ করলো।

দ্রুত দৌড়ে মেয়ে গুলোকে ফলো করার চেষ্টা করলো।কিন্তু আর খুঁজে পেলো না।

মুহিত দিকবিদিক শূন্য হয়ে জিপের কাছে এসে জিপ স্টার্ট দিয়ে সোজা ক্যম্পে পৌঁছে গেলো।
সেখানে গিয়ে দেখতে পেলো ধরে আনা ছেলে গুলো সম্পর্কে কোনো খারাপ রেকর্ড পাওয়া যায়নি বলে তাদের ছেড়ে দেয়া হচ্ছে।
ছেলে গুলো বন্দরের মানুষের মাল বহন করে জীবিকা নির্বাহ করে।

ছেলে গুলো ক্যাম্প ক্রস করবে এমন সময় মুহিতের নজর যায় পাশে থাকা ছেলেটির হাতের দিকে।তার হাতেও ঐ মেয়ে গুলোর মতো সেইম ট্যাটু।

ট্যাটুর রহস্য বুঝতে ন্যানো সেকেন্ড সময় ও লাগলো না চৌকষ বুদ্ধিদীপ্ত মেজরের।

কোমরে গুঁজে রাখা রিভলবার টি দ্রুত বের করে ছেলেটির হাটু বরাবর তাক করে শ্যুট করে দিলো।

অতর্কিত হামলায় পাশে থাকা ছেলেটি হুড়মুড়িয়ে কেঁদে উঠলো।

গুলি আর চিৎকার এর শব্দে নিকোলাস দৌড়ে এসে কারন জিজ্ঞেস করলে মুহিত সব খুলে বলে তাকে।

সাথে সাথেই ছেলে দুটোকে আবার বন্দী করে নেয় আর্মি ফোর্স।

তাদের উপর রিমান্ড জারি করা হয়।

টর্চার সেলের ভেতর ঢুকিয়ে নানান পাশবিক নির্যাতন করা হলো ছেলে দুটো কে।
এক দিকে গুলি খেয়ে পায়ে জান চলে যাবার মতো ব্যথা,অন্যদিকে এমন টর্চার ,
সহ্য করতে না পেরে হড়বড় করে সব বলে দিলো ছেলে দুটো।

◆◆
আহিয়ান চৌধুরী আহির,রাশিয়াতে গড়ে তুলেছে পাপের সাম্রাজ্য।সুন্দরী মেয়েদের ধরে এনে চড়া দামে বিক্রি করে দেয় রাশিয়ান পতিতালয়ে।স্বদেশী মেয়েদের চাইতে বাহিরের মেয়েদের প্রতি ইন্টারেস্টেড এ দেশের মানুষ।যৌন কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের অমানুষিক নির্যাতন করা হয় মেয়ে গুলোকে।

ব্যাথায় কাতর হয়ে মেয়ে গুলো যখন হাউমাউ করে গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদে নেশায় বুদ হওয়া অমানুষ গুলো সেগুলো তৃপ্তির সাথে উপভোগ করে।

এটাই এক ধরনের আনন্দ তাদের কাছে।

এই পর্যন্ত আহিয়ান দুই হাজারের ও বেশি এমন মেয়ে এই দেশে নিয়ে এসেছে।ছেলে গুলো বিভিন্ন নিরাপত্তার সাথে কোনো ঝামেলা ছাড়াই আর্মি, পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে মালবাহী কার্গো তে করে বিভিন্ন শহরে পৌঁছে দেয়।

শুধু তারাই নয়,বড় বড় পোর্ট অফিসার পর্যন্ত আহিয়ানের সাথে যুক্ত।এজন্য দীর্ঘদিন ধরে সে কোনো আইনি ঝামেলা ছাড়াই নির্দ্বিধায় ,বাধাহীন ভাবে কাজ গুলো করে যাচ্ছে।

ছেলে দুটো আরো বললো―

“”নিজের একান্ত মনোরঞ্জন করার জন্য কোনো মেয়ে তুলে আনলে তাদের নিয়ে যায় তার এবাক্যান এর আস্তানায়।””

সারা রাত ফুর্তি করে মেয়ে গুলোকে হয় বিক্রি করে দেয় না হলে জ্যান্ত পুতে ফেলে।

ওই ফার্ম হাউজে তার একটি এলপাইন ড্যাসবার্ষক কুকুর আছে।
দীর্ঘদিন ভোগ করার পর যেই মেয়ে গুলোর প্রতি তার ঘেন্না ধরে যায়,তাদের হত্যা করে ওই কুকুরের খাবারে পরিণত করে।

আহিয়ান সম্পর্কে ছেলেদুটোর মুখে এমন লোমহর্ষক বর্ননা শুনে বুকের ভেতর মুচড়ে উঠে মুহিতের।সে আর এক মুহূর্তের জন্যেও দেরি করতে চায় না।
ছেলে দুটোর থেকে ঠিকানা নিয়ে নিকোলাস চলে যায় জেনারেল এর কাছে।
মিশন স্টার্ট করার জন্য আর্মড ফোর্স দরকার।,অস্র ,গোলাবারুদ, ম্যাগাজিন,এসবের ও প্রয়োজন রয়েছে।অফিসি সকল পেপারে জেনারেল সাইন করলে মিশনে যাবার অনুমতি পাবে।

বাংলাদেশে কল করে মুহিত নাফিজ মাহমুদ কে সব কিছু জানায়।এখানকার ডিপার্টমেন্ট রাশিয়ান আর্মড ডিপার্টমেন্ট এর কাছে অনুরোধ করে সকল ধরনের হেল্প করতে।

অবশেষে হাসি মুখে নিকোলাস সাইন করা পেপার নিয়ে মুহিত কে বলে আমরা আজ রাতেই অপারেশন স্টার্ট করতে পারবো।

________
মুহিত হাতের ইশারায় সকল কে মিশন স্টার্ট করার সিগন্যাল দিলো।
নিকোলাস ব্লুটুথের মাধ্যমে সকল কে ” ওকে” জানিয়ে দিলো এবং হাতের সাইন দিয়ে বুঝালো
“কভার দ্যা এরিয়া””

প্রথম শ্যুট টা মুহিত দ্বার রক্ষী ছেলেটাকে করলো।
হঠাৎ গুলির শব্দ শুনে ভয়ে বিছানার এক কোনো জড়সড় হয়ে বসে রইলো স্বর্গ।
দ্বিতীয় শ্যুট করার আগেই ওপাশ থেকে ও পাল্টা হামলা এলো।
এরপর শুরু হলো পাল্টা পাল্টি হামলা।
ওপাশের আক্রমণে দুটো সোলজার গুরুতর আহত হলো।

মুহিত গুলি লোড করে আবার রাইফেল তাক করলো।
মিনিটের ব্যাবধানে দুটো ছেলেকে আহত করলো মুহিত।
হাতে গুলি করে দিয়েছে তাদের।বেঁচে থাকবে ঠিকই,কিন্তু গুলি চালাতে পারবে না।
বাকী রইলো আর চার জন।
রাশিয়ান আর্মির রণ দক্ষতার কাছে টিকতে পারলো না ছেলে গুলো।

কাঠের বাড়িটির পিছনের সাইডে চলে গেলো সৌম্য।ভেতরের পরিস্থিতি কি চলছে তা বোঝা দরকার।

আহিয়ান কেবলই ড্রিংকস করার জন্য নিজের ফেভারিট ব্র্যান্ডের বোতল এর ছিপি খুলেছে।এরই মধ্যে এমন গোলাগুলি তার সহ্য হলো না।মুখে বিশ্রী গালি উচ্চারণ করে রিভলবার নিয়ে সে ও বেরিয়ে গেলো।

যেই গম গাছ গুলো ঘন্টা খানেক আগেও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে ছিলো সেগুলো এখন মাটির সাথে মিশে আছে আর্মিদের বুটের চাপে।

সৌম্য মুহিত কে ঘরের ভেতরে ঢুকে যাবার জন্য ইশারা করলো।
বুকে আর কুনুইয়ে ভর দিয়ে ক্রলিং করে মুহিত কাঠের বাড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
বাইরের প্রতিরক্ষার জন্য নিকোলাস আর ভলতেয়ার রয়েছে।

সামনের দরজা দিয়ে প্রবেশ করা যাবেনা।যেকোনো সময় বিপদ হতে পারে।

ঘরটির পিছনের দিকে একটি জানালা আর বেলকনি আছে তাতে বেয়ে বেয়ে উঠে দু তলায় উঠে যেতে হবে।ভেতরে আহিয়ান আর দুটো মেয়ে ছাড়া আর কেউ নেই।
বাকি সবাই বাহিরে আহিয়ান কে প্রটেক্ট করার জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে।

হঠাৎই আহিয়ানের চোখ যায় রুমের পিছনের জানালা বরাবর বেলকনির দিকে।
মানুষটি কে বুঝতে এক মিনিট ও সময় লাগলো না আহিয়ানের।

রাগে বোধশক্তি হারালো আহিয়ান।
মুহিতকে মেরে ফেলার জন্য বন্দুক তাক করলো আহিয়ান

―মরার জন্য শেষ পর্যন্ত রাশিয়া পর্যন্ত চলে এলি মেজর?

আহিয়ানের মুখে বাংলায় মেজর সম্বোধন শুনে দিকবিদিক হারিয়ে দৌড়ে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত রুম থেকে বেরিয়ে এলো স্বর্গ।

মুহিত ধীর পায়ে আহিয়ানের দিকে এগিয়ে আসছে,তার হাতেও আহিয়ানের দিকে তাক করা রাইফেল।
হঠাতই আহিয়ান বিবেক হারিয়ে ট্রিগার চেপে ধরলো।
স্বর্গ আহিয়ান কে বাঁধা দিতে দৌড়ে আহিয়ানের কাছে উপস্থিত হলো।
কিন্তু ভাগ্য আহিয়ানের সহায় হলো না।রিভলবার থেকে কোনো গুলি বের হলো না।কারন গুলি শেষ হয়ে গিয়েছে।
আহিয়ান দ্বিতীয়বার ট্রাই করেও ব্যার্থ হলো।

এবার আহিয়ান পাশে থাকা মদের বোতল টাকে দেয়ালের সাথে বাড়ি দিয়ে ভেঙে সেই ভাঙা অংশ স্বর্গের গলায় ছুঁইয়ে বললো―

” খবর দার মেজর এক পা আগালে তোর প্রেয়সী বাঁচবেনা।””

―হাত উপরে তোল, রাইফেল ফেলে দে ভালোয় ভালোয় মেজর মুহিত।””

সৌম্য উপরে এসে স্বর্গের এহেন অবস্থা দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যায়।

আহিয়ান আবারো কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠে―
―বন্দুক নীচে নামা শালা দু টাকার ক্যাপ্টেন।

ব্লুটুথ ডিভাইসের মাধ্যমে নিকোলাস আর ভলতেয়ার সব শুনতে পাচ্ছিলো কিন্তু কিছুই বুঝে উঠতে না পেরে বেলকনির দিকে অগ্রসর হয়।

সৌম্য টের পেয়ে বলে উঠে ―”ফ্রিজ।””

এর পর হ্যান্ড সাইনের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেয় যে, ভেতরে “এনিমি”।

নিকোলাস কৌশলে আহিয়ানের অবস্থান বুঝে ধীরে ধীরে সরে গিয়ে দূরে গিয়ে পজিশন নেয়।

এদিকে মুহিত স্বর্গকে ছেড়ে দেবার জন্য আহিয়ান কে অনুরোধ করে যাচ্ছে।

―আহিয়ান চৌধুরী ভালোয় ভালোয় আত্মসমর্পণ করুন।হাতে আইন তুলে নেবেন না।আমরা আপনাকে সুস্থ ভাবে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাবো।আপনাকে ধরে নেয়ার জন্য আমাদের কাছে ওর্ডার আছে।

মেজর জেনারেল এর মেয়েকে ছেড়ে দিন।

আহিয়ান আরো জোরে স্বর্গের গলায় ভাঙা বোতল চেপে ধরছে।তাকে নিতে হলে এই মেয়ের লাশ ক্রস করে তার কাছে আসতে হবে।

হঠাৎই ব্যাথায় স্বর্গ ককিয়ে উঠলো।

আহিয়ান বোতল এতোটাই জোরে চেপে ধরেছে যে তার গলার ভেতরে তা বিধে রক্ত বের হচ্ছে।

সৌম্য আহিয়ান কে বিভিন্ন ভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেও কোনো ফল পেলো না।

হঠাৎ ই আহিয়ান দেখতে পেলো তার বুকে অনেক গুলো গান টার্গেট লাইট।

এবার সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো সে মরলে স্বর্গ কে নিয়েই মরবে।

যেই জিনিস আহিয়ানের হাতে এসেছে সেই জিনিস কেউ ফিরিয়ে নিতে পারবে না।

আহিয়ানের ভান্ডার শুধু প্রাপ্তিতে পরিপূর্ণ থাকবে।

মুহিত স্বর্গকে চোখের ইশারায় আহিয়ানের হাতে কামড় বসাতে বললো―
চোখের ইশারা পেতেই স্বর্গ আহিয়ানের হাতে কামড় বসিয়ে দেয়।

রাগে হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে স্বর্গের চুলের মুঠি ধরে গালে কষিয়ে এক চড় মেরে দেয় আহিয়ান।

টাল সামলাতে না পেরে স্বর্গ মুহিতের উপর পড়ে যেতে নিলে মুহিত তাকে এক হাতের সাথে আগলে নেয় অন্য হাত দিয়ে গান পয়েন্ট করে।

হঠাৎই দুটো ছেলে রুমের ভেতর প্রবেশ করে মুহিত আর সৌম্যকে বন্দুক তাক করে।

বাইরে থেকে অনবরত গুলি ছুড়তে থাকে নিকোলাস এর টিম।

হঠাৎই পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হয়ে যায়।

মুহিত হেচকা টানে স্বর্গকে কোলে তুলে নেয়।

স্বর্গ দুই হাতে মুহিতের গলা জড়িয়ে ধরে,দুই পা দিয়ে কোমড় জড়িয়ে মুহিতের বুকের সাথে লেপ্টে রইলো ছোট বাচ্চাদের মতো।

হঠাৎই মুহিত উৎফুল্ল কন্ঠে বলে উঠলো―

―স্বর্গ যা কিছুই হয়ে যাক আমাকে এভাবেই ধরে থাকবেন।নড়বেন না।

ঠিক আছে?

স্বর্গ বিড়াল ছানার মতো গুটিয়ে রইলো মুহিতের কাঁধে মাথা রেখে।

মুহিত এবার দুই হাতে রাইফেল ধরে সৌম্যকে ওর্ডার দিলো
― ক্যাপ্টেন ,কভার মি।

ছেলে দুটো কে নিকোলাস আর ভলতেয়ার গুলি করে ঝাঁঝরা করে দিলো।
অসহায় এর মতো পরে রইলো আহিয়ান একা।

সিঁড়ি বেয়ে সতর্কতার সহিত বন্দুক তাক করতে করতে নীচে নেমে এলো মুহিত।

ব্লুটুথ ডিভাইসের মাধ্যমে নিকোলাস কে জানালো―
―মিশন সাকসেস।

―এরেস্ট হিম।
#চলবে।

তোমার জন্য সিন্ধুর নীল পর্ব-১০

0

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_১০
#সারিকা_হোসাইন

একজন দেশদ্রোহীর শাস্তি কী হয় জানেন তো পিউ?

―আমাকে এই কথা কেনো বলছেন ক্যাপ্টেন সৌম্য?
বিচলিত কন্ঠে জানতে চাইলো পিউ।

–আপনাকে বলার পিছনে অবশ্যই কারন আছে পিউ।কন্ঠে গাম্ভীর্য এনে জবাব দিলো ক্যাপ্টেন সৌম্য শাহরিয়ার।
এরপর বলতে শুরু করলো
―――――

মেজর মুহিতের কথা অনুযায়ী আমি দীর্ঘদিন ধরে আপনার বাবা লেফটেন্যান্ট জেনারেল নাসের হায়দার কে ফলো করে আসছি।

শুধু তাই নয় উনার সকল বিষয়ে খোঁজ খবর ও নিয়েছি।

ক্যান্টনমেন্ট এর ভেতরের সকল গোপন খবর উনি এবং আরেকজন অফিসার বাইরে প্রকাশ করেন টাকার বিনিময়ে।

অবশ্যই যার তার কাছে নয়।এমন কারো কাছে যে দেশের কোনো কল্যাণ চায় না।যিনি নিজের আখের গোছাতে ব্যাস্ত।

একজন সেনা সদস্য হিসেবে আমাদের শপথ বাক্য কি হয় জানেন?

―শান্তিতে আমরা,সমরে আমরা।আমার উপর ন্যাস্ত সকল দায়িত্ব আমি সততা ও বিশ্বস্ততার সহিত পালন করবো।আমার জীবন বিপন্ন করে হলেও জল ,স্থল,আকাশ যেখানেই যাবার আদেশ দেয়া হবে আমি সেখানেই যেতে প্রস্তুত।কারন আমরা দেশের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছি।

সেখানে একজন সেনা সদস্যের বড় অফিসার এমন শপথ বাক্য পাঠ করেও কিভাবে তার খেলাপ করতে পারে পিউ?

―পিউ জানে ক্যাপ্টেন সৌম্য আজেবাজে কথা বলার মানুষ নয়।
এ পর্যন্ত সৌম্যের কোনো কথার হেরফের হয়নি।এক কথার মানুষ সৌম্য।
নিজের বাবা সম্পর্কে কথা গুলো যেমন অবিশ্বাসের,তেমনি ক্যাপ্টেন সৌম্যের কথাও ফেলে দেবার নয়।

সৌম্য ভরাট কন্ঠে আবার বলে উঠলো―

―পিউ আপনার কাছে আমার অনুরোধ থাকবে আমার অবর্তমানে আপনার বাবার গতিবিধি লক্ষ রাখবেন।

―আমি রাশিয়া যাচ্ছি ,কবে ফিরবো জানিনা।আদৌ বেঁচে ফিরবো কিনা সেটাও জানিনা।
―আমি চাই আমার অনুপস্থিতিতে আপনি আমার দায়িত্ব টা পালন করবেন পিউ।
বলেই সৌম্য পিউএর হাত চেপে ধরলো।

পিউ নির্বাক হয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে সৌম্যের পানে নীরব দৃষ্টি দিলো।মুখে কিছুই উচ্চারণ করতে পারলো না।

***

মেজর জেনারেল নাফিজের সামনে বসে আছে মুহিত।

নীরবতা ভেঙে মুহিত গাম্ভীর্য পূর্ন কন্ঠে বলে উঠলো

―স্যার তিন দিনের টানা প্রচেষ্টায় সকল বিবরণের ভিত্তিতে আমি জানতে পেরেছি ঐটা আহিয়ান চৌধুরীর ই জাহাজ ছিলো।সে ঐ জাহাজের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে রাশিয়াতে নারী,শিশু পাচারের কাজ করে থাকে।

শুধু তাই নয় , অবৈধ অস্ত্র সরবরাহ সহ যতো ধরনের ইললীগেল কাজ আছে সব সে ঐ জাহাজের মাধ্যমে সমুদ্র পথে হাসিল করে

বলেই তার ট্যাব থেকে এক এক করে কিছু ছবি নাফিজ মাহমুদ কে দেখালো।
―ধীর স্বরে মুহিত আবার বলে উঠলো,
ছবি গুলো আমি বিভিন্ন দেশের স্পাই এর মাধ্যমে পেয়েছি।

ছবি গুলো দেখে নাফিজ মাহমুদ অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলো।

কন্ঠ খাদে ফেলে উত্তেজিত হয়ে নাফিজ মাহমুদ জানতে চাইলেন

―তুমি এতো কিছু জেনেও চুপ করে কেনো আছো মুহিত?ডিপার্টমেন্ট কে কেনো কিছু জানতে দিচ্ছ না?

―স্যার ডিপার্টমেন্ট জানলে বিভিন্ন তামাশা করে ওকে ধরে আনবে, বিচার হবে,রায় হবে জেল ।

কিন্তু সে ক্ষমতার দাপট খাটিয়ে আবার বেরিয়ে যাবে।

―এমনটি আমি হতে দিবো না এবার।আমি ওকে সরাসরি ক্রসফায়ার করবো।সে আমার বহুত পুরোনো শিকার।পূর্বের অনেক হিসেব নিকেশ আছে তার সাথে আমার।

কাতর কন্ঠে নাফিজ মাহমুদ বলে উঠলেন―

―জাহাজে রাশিয়া পৌঁছুতে কমপক্ষে এক মাস সময় তো লাগবেই, এই সময়ের মধ্যে ও যদি আমার মেয়ের কোনো ক্ষতি করে দেয়,?

―কিছুই করবে না স্যার।খুজ নিয়ে জেনেছি সে স্বর্গকে এক বছর ধরে ফলো করে যাচ্ছে।স্বর্গ কে টাকা দাবি বা পাচারের স্বার্থে সে অপহরণ করেনি এটা আমি নিশ্চিত।
কিন্তু কোন উদ্দেশ্য নিয়ে করেছে সেটাও ধোঁয়াশাতে রয়ে গিয়েছে।

মুহিত আবার ও গমগমে কন্ঠে বলে উঠলো―

―চাইলে সে বিমানে করে স্বর্গ কে বিদেশ নিতে পারতো।কিন্তু পাসপোর্ট এর ঝামেলা,এয়ারপোর্ট পুলিশের হয়রানি এসব এড়াতে সমুদ্র পথ বেছে নিয়েছে।আর যেহেতু জাহাজ টি তার নিজের এখানেও ঝামেলা কম।পোর্ট অথরিটি ওর সাথে অবৈধ কাজে জড়িত আছে।।।

মুহিত বুকের উপর দুই হাত ভাঁজ করে অভিজ্ঞের ন্যায় বলে উঠলো―

―আপনি চিন্তা করবেন না স্যার।স্বর্গ মিলিটারি ট্রেনিং ভালো মার্কস নিয়ে কমপ্লিট করেছে।এটা শুধু আমি নই আপনিও ভালো করে জানেন।

চাইলেই যে কেউ যখন তখন ওর ক্ষতি করতে পারবে না।ও নিজেকে সেফ রাখতে পারবে।

আমি জেনারেল কে বলেছি দ্রুত আমাকে রাশিয়া পাঠাতে।আহিয়ান পৌঁছানোর আগে আমাদের গিয়ে সব পজিশন ক্লিয়ার করতে হবে সেখানে

―গত বছর মঙ্গোলিয়াতে যেই মিশনে গিয়ে ছিলাম সেই মিশনে রাশিয়ার কিছু আর্মড ফোর্স ছিলো।সেখানকার মেজর নিকোলাস আর ক্যাপ্টেন ভলতেয়ার এর সাথে আমাদের টিমের খুব ভালো সখ্যতা গড়ে উঠেছে।
ওই মিশনে আমরা ওদের অনেক হেল্প করেছিলাম।তারা বলেছিলো কোনো দিন কোনো কিছুর প্রয়োজনে রাশিয়া এলে সেই সাহায্যের বিনিময় দেবে।

সেই হেল্প নেয়ার এটাই মোক্ষম সময়!

আমি মেইল করে সব জানিয়েছি তাদের।আমাকে যে কোনো হেল্প করতে তারা প্রস্তুত।

মুহিত নরম সুরে নাফিজ মাহমুদ কে বললো–

―আমার মাকে শুধু সামলে রাখবেন স্যার।আমি যদি আর না ফিরি,আমার মাকে আপনি সময় সুযোগ বুঝে নামিরার কাছে পাঠিয়ে দেবেন।

আপনার কাছে আমার শেষ অনুরোধ থাকলো স্যার।

একদিকে প্রাণ প্রিয় মেয়ের চিন্তা অন্যদিকে মুহিতের চিন্তায় মুখের ভাষা হারালেন মেজর জেনারেল নাফিজ মাহমুদ।মুহিত কে শান্তনা দেবার কোনো ভাষা খুঁজে পেলেন না তিনি।

শুধু পিঠে চাপড় দিয়ে স্থান ত্যাগ করলেন।

■■
বন্দি রুমে সময় কতো হয়েছে কিছুই ঠাহর করতে পারছে না স্বর্গ।আদৌ এখান থেকে মুক্তি মিলবে নাকি এখানেই পঁচে মরতে হবে?
কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাকে?কি প্রয়োজনে ?
কিছুই সে জানেনা।

দমে যাবার পাত্রী নয় স্বর্গ।যেকোনো প্রকারে তাকে শক্ত থাকতে হবে।নিজেকে এতো দ্রুত ধরাশায়ী করা যাবে না

নিজেকে শক্ত সামর্থ্য রাখতে হলে প্রথমে প্রয়োজন খাবার।
যেই ভাবনা সেই কাজ।

নিজেকে বন্দী দেখতে পেয়ে স্বর্গ স্বাভাবিক থাকতে পারেনি।তার মধ্যে সাজানো ফল দেখে মাথা আরো গরম হয়ে গিয়েছিলো।এজন্য সব কিছু ছুড়ে ফেলেছে।

রুমের কোনায় উকি ঝুঁকি করে বেডের নিচ থেকে থেতলে যাওয়া একটা আপেল বের করে আনলো স্বর্গ।

যেই কামড় বসাতে যাবে অমনি দরজা খোলার শব্দ পাওয়া যায়।ব্ল্যাঙকেট এর তলায় আপেল লুকিয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান ধরে পরে রইলো স্বর্গ।

―ম্যাম প্লিজ টেইক ইউর ফুড
মেয়েলি স্বর শুনে অবাক হয়ে দ্রুত চোখ খুলে স্বর্গ।
খাবার ট্রলি সমেত একজন বিদেশি মেয়েকে দেখতে পায়।শারীরিক গড়ন,পোশাক,আর প্রসাধনীর জন্য সঠিক বয়স অনুমান করা যাচ্ছে না।
তবুও স্বর্গের মনে হলো মেয়েটি আঠাশ কি ত্রিশ বছরের মহিলা।
স্বর্গ চোখ টিপে পরে রইলো।

মেয়েটি আবারো নরম সুরে বলে উঠলো―
― ম্যাম প্লিজ টেইক ইউর ফুড।
―ইফ ইউ ডোন্ট টেইক ইউর ফুড,স্যার উইল কিল মি।

এবার নড়েচড়ে উঠলো স্বর্গ।
বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো এবং মেয়েটির উদ্দেশ্যে বলে উঠলো

―আই উইল টেইক ইট,বাট ইউ হ্যাভ টু টেস্ট ডিজ ফুড ফার্স্ট।

কথাটি বলে স্বর্গ মেয়েটির দিকে নির্লিপ্ত ভাবে তাকিয়ে রইলো।

মেয়েটি একটু ইতস্তত করে একটা কাটা চামচ আর নাইফ হাতে নিলো।স্টেক এর এক কোণা থেকে একটু কেটে মুখে পুড়লো।এর পর সেগুলো ওয়াশ করে নতুন চামচ আর নাইফ আনতে চলে গেলো।

স্বর্গ মনে মনে স্থির করলো এই মেয়েটির সাথে সখ্যতা গড়ে প্রয়োজনীয় তথ্য হাসিল করবে।

■■মাঝে পেরিয়ে গেছে আরো চার দিন।মুহিত আর ক্যাপ্টেন সৌম্য দুবাই এয়ার পোর্ট এ বসে পরবর্তী বিমান ছাড়ার অপেক্ষা করছে।

খুব ছোট ছোট পোশাক পরিহিত আমেরিকান এক মেয়ে পায়ের উপর পা তুলে মুহিতের সামনে বসে পড়লো।মুহিত সেটা দেখেও না দেখার ভান করলো।
মেয়েটি মুহিতের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য বারবার বিভিন্ন ইঙ্গিত করেই যাচ্ছে।
মুহিত ব্ল্যাক কালার এর জ্যাকেট,ব্ল্যাক জিন্স,সাথে ম্যাচিং বুটস পড়েছে।
মুহিতের সৌন্দর্যে মেয়েটি চোখ সরাতে পারছে না।
হঠাৎই মেয়েটি রিনরিনে কন্ঠে বলে উঠলো―

―হেই আম ভেরোনিকা,ভেরোনিকা স্টুয়ার্ট।
,―ইউ আর ঠু মাচ হট।
―উইল ইউ স্পেন্ড এ নাইট উইথ মি?

বলে মুহিতের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো।

মুহিত অন্যদিকে ঘুরে উত্তর দিলো
―সরি আম নট ইন্টারেস্টেড।
মেয়েটি তবুও নির্লজ্জের মতো এটা সেটা হেসে হেসে বলে মুহিতের উপর ঢলে পড়তে চাইছে।

সৌম্য দাঁত চেপে কোনো মতে বসে রইলো।তাদের মাথায় এখন কিভাবে স্বর্গ কে রেসকিউ করে মিশন টা সাকসেস করা যাবে সেই চিন্তা।

সৌম্যের কাছে এই মেয়েটাকে এখন উটকো ঝামেলা মনে হচ্ছে।
মুহিত খেয়াল করলো হঠাৎই মেয়েটি ব্যাগের চেইন খুলে কিছু বের করার চেষ্টা করছে আর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মুহিতের দিকে তাকিয়ে আছে।

সচেতন হলো মুহিত।আশেপাশের কাউকে বিশ্বাস নেই।যখন তখন দাবার চাল উল্টে যেতে পারে।

মেয়েটি ব্যাগ থেকে কিছু বের করার আগেই মুহিত তার কোমরে থাকা সেলফ ডিফেন্সের লাইসেন্স করা রিভলবার মেয়েটির মাথা বরাবর পয়েন্ট করে।

মেয়েটি ভয়ে চোখ বড় বড় করে ফেলে।

ব্যাগ থেকে মেয়েটিকে হাত বের করতে বলে মুহিত।
মেয়েটি বিচলিত হয়ে ভয়ে ভয়ে একটি ভিজিটিং কার্ড বের করে আনে।

মুহিতের এমন কাণ্ডে এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি পুলিশ দৌড়ে এসে মুহিত কে হ্যান্ডস আপ করতে বলে।

সৌম্য গোপনে তাদের আইডেন্টি কার্ড দেখিয়ে দিলে পুলিশ তাদের সরি বলে এবং সমস্ত ঘটনা জানার পর মেয়েটিকে ধমকে তাড়িয়ে দেয়।

প্লেন ছাড়ার সময় হয়েছে।মুহিত আর সৌম্য বিজনেস ক্লাস এ তাদের সিটে বসে রয়েছে।
ব্যাগ থেকে ট্যাব বের করে সৌম্য আর মুহিত নিজেদের কাজের ছক একে ফেললো।
এবার পালা রাশিয়া পৌঁছানোর।

সময় রাত এগারোটা বেজে পনেরো মিনিট।
আশরাফ চৌধুরী নিজের পছন্দের পুরোনো দিনের গান ইজি চেয়ারে বসে বসে শুনছেন আর ঝিমুচ্ছেন।
এমন সময় বিকট শব্দে ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো।বিরক্তি তে মুখে খারাপ গালি এনে বললেন―
―কোন চুতিয়া এতো রাতে কল করে বিরক্ত করছে তাকে দেখে নেবে।
নাসের হায়দার হারামজাদা এতো রাতে কেনো ফোন করেছে কৌতূহলী হয়ে ফোন কানে তুলে বললেন
―কি বে শালা নিজের ঘুম নেই বলে অন্যকে ও ঘুমুতে দিবি না।

নাসের হায়দার ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো

―আরে রাখো তোমার ঘুম।তোমার ছেলে যে মেজর জেনারেল এর মেয়েকে অপহরণ করে ডুব দিয়েছে সেই খবর রাখো?

পুরো ডিপার্টমেন্ট হাত ধুয়ে পরেছে তোমার ছেলেকে ক্রসফায়ার করতে।

কোথায় আছে তোমার ছেলে?

তাকে সাবধান হয়ে যেতে বলো।না হলে কিন্তু এবার আর রক্ষে নেই।
আর এই খবরের জন্য আমার একাউন্ট এ দুলাখ পাঠিয়ে দিও বলেই খেঁক খেঁক করে হেসে লাইন কেটে দিলো নাসের হায়দার।

―এতো রাতে এভাবে হাসছো কেনো বাবা?

হঠাৎ মেয়ের ডাকে চমকে উঠলেন নাসের হায়দার।তোতলাতে তোতলাতে বললেন
―ক ক কই হেসেছি?
―আর এতো রাতে না ঘুমিয়ে বাবার রুমে জাসুসি করতে এসেছো?

জাসুসি নয় দেখতে এলাম এতো রাতে কাকে ফোন করে এতো খুশি হচ্ছ?
আমি কি তোমার খুব লস করে ফেললাম বাবা?

এতো রাতে বাবার সাথে মশকরা করতে এসেছো বেয়াদব মেয়ে?যাও নিজের রুমে যাও বলে ধমকে পিউ কে ঘর থেকে বের করে দিলেন নাসের হায়দার।

নিজের বুকে নিজেই থুথু লাগিয়ে বলে উঠলেন
―হুহ আরেকটু হলে এখনই ধরা পরে যেতাম।মেয়েটা হয়েছে মায়ের মতো বজ্জাত।মা কে তো বিদেয় করতে পেরেছি।কিন্তু নিজের মেয়েকে কোথায় জলাঞ্জলি দেবো??

―নিজের রুমে শুয়ে বালিশে মুখ গুজে ফুঁপিয়ে কাঁদছে পিউ।
সৌম্য ঠিকই বলেছে।তার বাবাই খবর আদান প্রদান করে।তার বাবা সত্যি ই একজন দেশদ্রোহি।একথা ডিপার্টমেন্ট জানলে কি হবে??

সহসাই উঠে বসে পিউ।যা হয় হউক।
চোখের জল হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে আপন মনে বলে ওঠে―

―ক্যাপ্টেন সৌম্য ,আপনার দেয়া সকল দায়িত্ব আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করবো
প্রমিস।

মস্কো এয়ারপোর্ট এ মুহিত আর সৌম্য অপেক্ষা করছে কাঙ্খিত গন্তব্যে যাবার জন্য।এখানে তাদের অনেক কাজ।অপরিচিত জায়গায় পরিচিত শত্রু।বিষয় টা খুব ইন্টারেস্টিং হলেও প্রচুর কাঠখড় পোড়াতে হবে তাদের।

আর্মি ক্যাম্প থেকে তাদের জেটি ঘাটে যেতে হবে এবং কিছু ইনফরমেশন কালেক্ট করতে হবে।
স্যাম নামের যে স্পাই আছে তার কাছ থেকে ঐ জাহাজ সম্পর্কিত আরো অনেক তথ্য জানতে হবে।
ছেলেটি সুইজারল্যান্ডের নাগরিক কিন্তু টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন দেশে স্পাই এর কাজ করে।টাকার কাছে জীবন বাজি রাখতে হাসি মুখে রাজি স্যাম স্মিথ।

যেসব মানুষ যেদিকে টাকা দেখে সেই দিকেই ঢলে পড়ে মুহিত তাদের দু চোখে দেখতে পারে না।কিন্তু কাজের সূত্রে এদের ভীড়েই হাটতে হয় মুহিত কে।

সকল ভাবনার অবসান ঘটলো যখন আর্মি জিপটি ক্যাম্পে এসে ব্রেক কষলো।
নিকোলাস আর ভলতেয়ার দৌড়ে এলো মুহিত আর সৌম্যের সাথে কুশল বিনিময় করতে।

দিনের আলো ফুরিয়ে রাতের আধার চারপাশ গ্রাস করেছে।
ঘুমিয়ে পড়েছে ঝিঁঝিঁ পোকারাও।
দুচোখের পাতায় ঘুম নেই নাফিজ দম্পতির।

দিনে তারা সকলের সামনে ভালো থাকার অভিনয় চালিয়ে যাচ্ছে,কিন্তু রাত হলে সকল ভয় এসে মনের মাঝে হানা দিচ্ছে।
আদৌ বেঁচে আছে তো মেয়েটা?

বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন তনুজা।নাফিজ বুকে জড়িয়ে তাকে শান্ত করার বৃথা চেষ্টা চালালেন।

■■সিডনি,অস্ট্রেলিয়া
নামিরা অনেকটাই সুস্থ এখন।যেদিন থেকে নিজের মা কে একটু সুস্থ হতে দেখেছে সেদিন থেকেই সে স্বাভাবিক আচরণ করছে।এখন আর অযথা কাঁদে না।
কিন্তু মনের মাঝে ছোট নিষ্পাপ ভাইটার মৃত্যু শোক তোলপাড় করে।
মুকিতের কথা আর বাবার কথা চিন্তা করে নামিরা মাঝে মাঝে ই অনেক অসুস্থ হয়ে পড়ে।

কিন্তু যেদিন আল্ট্রাসাউন্ড করে নিজের বেবির মুখের আদল মুকিতের মতো দেখেছে সেদিন থেকে সে ধরে নিয়েছে মুকিত আসবে তার ঘরে।
এভাবে কান্না করে দুর্বল হওয়া যাবে না।

কিন্তু নামিরা প্রায় ই সোহাগের কাছে বায়না ধরে দেশে যাবার জন্য।
সোহাগ নামিরা কে কথা দিয়েছে আর কিছুদিন গেলে মিসেস তারিন একটু স্বাভাবিক হলে সোহাগই তাকে অস্ট্রেলিয়া নিয়ে আসবে।

তখন মা মেয়ে যতো খুশি এক সাথে থেকো।এখন আপাতত বাচ্চার দিকে মন দাও।

ছোট বাচ্চাটা যখন পেটের ভেতর নড়ে উঠে নামিরা তখন খুশিতে সোহাগ কে জড়িয়ে ধরে কতো অভিযোগ জানায়।

―জানো তোমার ছেলে আমাকে এখানে লাথি দিয়েছে,
ওখানে ঘুষি মেরেছে আরো কতো কী।

সোহাগ জানে ঘরে ছোট ছোট হাত পা নিয়ে যখন বাচ্চা ঘরময় ঘুরে বেড়াবে তখন নামিরা সব দুঃখ কষ্ট ভুলে যাবে।

কিন্তু সোহাগ?

সে কি পারবে তার পিতৃতুল্য লোকের শোক কাটাতে?

যেই লোক তার বিপদে আশ্রয় দিলো,মানুষের মতো মানুষ করলো তারই বিপদের খবর সোহাগ জানতেও পারলো না সাহায্য তো দূর কি বাত।

আর মুকিত?

মুকিতের মর্মান্তিক মৃত্যু বর্ননা মনে পড়তেই চোখের কোনে জল জমা হলো সোহাগের।

◆◆
রাশিয়া,মুরমানস্ক ,টোরগোভী পোর্ট

সবচেয়ে শীতল তম দেশ হবার কারনে মুহিত আর সৌম্যের একটু কষ্ট হচ্ছে।তবুও নিজেদের যথাসম্ভব লং কোর্টের সাহায্যে উষ্ণ রেখে তারা এই পোর্টে এসে অপেক্ষা করছে।
সমুদ্র থেকে আসা ভারী হাওয়া বুকে কাঁপন তুলছে।

সন্ধ্যার সূর্য আকাশে হেলে পরে আধারে বিলীন হচ্ছে।এমন সময় রাশিয়ান ভাষায় হ্যালো বলে উঠলেন পোর্ট মাস্টার।
লোকটির বয়স পঞ্চাশ কি পঞ্চান্ন।লম্বা ছয় ফিটের কাছাকাছি।
মুখে মায়াবী হাসি ঝুলিয়ে জানতে চাইলেন তারা কি চায়?

জাহাজটির ছবি দেখানো মাত্র বৃদ্ধ মাস্টার জাহাজ টি চিনে ফেলে এবং অবাকের সাথে জিজ্ঞেস করে
ডেড সৌল??

#চলবে।

তোমার জন্য সিন্ধুর নীল পর্ব-০৯

0

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_৯
#সারিকা_হোসাইন

সাবধান তনুজা ,
যাবার আগে বারবার হুঁশিয়ারি দিয়ে গেলাম, আপা যাতে এসব বিষয়ে কিছুই না জানে।আপার কন্ডিশন তোমার অজানা নয়।
তোমাকে আপার সামনে শক্ত থাকতে হবে,যদিও মা হিসেবে এটা তোমার জন্য অনেক কষ্টের,আতংকের।কিন্তু পরিস্থিতিই এমন হয়ে গেছে এখন।

আপা যদি এবারও শকড হয় তাহলে অবস্থা কতো ভয়াবহ হবে আন্দাজ ও করতে পারবে না।

তাই অনুরোধ করছি আপা স্বর্গের বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করলে বলবে জরুরি মিশনে ঢাকার বাইরে গেছে।আর বলবে চিন্তার কোনো কারণ নেই মুহিত সাথে আছে।

বলে মাথায় আর্মি ক্যাপ পরে গটগট পায়ে বেরিয়ে গেলেন নাফিজ মাহমুদ।

নরম তুলতুলে বিছানায় এলোমেলো হয়ে পরে রয়েছে স্বর্গ।এই দুনিয়াতে কি হচ্ছে সে বিষয়ে তার ধারণা নেই।বিভোর ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমিয়েছে সে রূপকথার রাজকুমারী দের মতো।যেই ঘুম রাজকুমার না এলে ভাঙবে না।

কিন্তু কোথায় আছে সেই রাজকুমার?সে কি পৃথ্বীরাজ এর ঘোড়া নিয়ে স্বর্গকে উদ্ধার করতে আসবে এই রাক্ষসপুরী থেকে?

―――――――――

ক্যাপ্টেন সৌম্য কিছু কি খুজ লাগাতে পারলে?কাতর কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো মুহিত।

―স্যার লোকেশন চিটাগাং হাইওয়ে নির্দেশ করছে।

মুহিতের কপালে চিন্তার সূক্ষ্ণ ভাঁজ পরে।

***
সারা শহর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও আর্মি স্পেশাল পুলিশ ইউনিট নাফিজ সাহেবের মেয়ের কোনো হদিস পেলো না।

আর্মি হেড কোয়ার্টার এ বোর্ড মিটিং বসানো হলো।

,কোনো মুক্তিপণ দাবির উদ্দেশ্যে মেজর জেনারেল এর মেয়েকে কেউ কিডন্যাপ করলে, উদ্ধার অভিযান চালানোর সময় ,কিডন্যাপ কারীকে সরাসরি শ্যুট করার ওর্ডার দিলেন আর্মি জেনারেল বেনজামিন রিয়াজি।

মুহিত তার স্পেশাল ভাইপার স্কোয়াড্রন টিম নিয়ে হেলিকপ্টার এ করে চিটাগাং এর দিকে ছুটলো।
সাথে আরো দুটো হেলিকপ্টার তাদের কে অনুসরণ করে ছুটতে লাগলো।

দীর্ঘ পাঁচ ঘন্টার জার্নি শেষ করে ক্যাম্পিং কারটি নিজের এক সহযোগীর কাছে হস্তান্তর করে নির্দেশ দিলো জাহাজে গাড়িটি ঢুকিয়ে ,জাহাজ ছাড়ার ব্যাবস্থা করো কুইকলি।
ঘুটঘুটে রাতের আধারে নিজের প্রাইভেট শিপ ―ডেড সৌল―এ স্বর্গ কে শুইয়ে দিলো আগন্তুক।।।আশেপাশের কেউ এবিষয়ে কোনো খবর রাখলো না।

এবার আর কেউ তাদের নাগাল পাবেনা।মেজর মুহিত কে আচ্ছা জব্দ করা গেলো ভেবেই হো হো করে হেসে উঠলো।

■■
সমস্ত শহরের সিসি টিভি ফুটেজ চেক করে এক অদ্ভুত ধরনের গাড়ির সন্ধান পেলো পুলিশ ইউনিট,যা বিদেশে এভেইলেবল,কিন্তু বাংলাদেশে নয়।গাড়িটির স্পিড অন্যান্য গাড়ির চেয়ে দ্বিগুন।সন্দেহের জাল বুনলো তাদের মনে।আরো বেশি সন্দেহ পোক্ত হলো যখন দেখা গেলো প্রত্যেকটি ট্রাফিক সিগনাল সেই গাড়ি চালক ব্রেক করেছে।গাড়িটি চিটাগাং এর দিকে যাচ্ছে।গাড়ির নম্বর প্লেট ও বাংলাদেশের নয়।
দ্রুত পুলিশ ফোর্স হেলিকপ্টার নিয়ে চিটাগাং এর উদ্দেশ্যে যাত্রা করলো।

চিটাগাং বন্দরে এসে হেলিকপ্টার থেকে রশি ফেললো মুহিত,একে একে দড়ি বেয়ে নেমে এলো মুহিত,সৌম্য,মেজর আদ্রিয়ান আহিয়াজ,লেফটেন্যান্ট মিরাজ কায়সার।
দ্রুত ঝাঁপিয়ে পড়লো বন্দরের নরম বালুতে।আশেপাশে তাকিয়ে গান পয়েন্ট করলো তারা।কিন্তু সন্দেহ জনক কিছুই দেখা গেলো না।

হঠাৎ ই মুহিত সমুদ্রের দিকে খেয়াল করে দেখতে পেলো একটি জাহাজ ভো ভো শব্দে সমুদ্রের আধারে মিলিয়ে গেলো।
মুহিতের পায়ের রক্ত মাথায় ছলকে উঠলো।আরো দৃঢ় প্রতিজ্ঞবদ্ধ হলো এর শেষ দেখে ছাড়বে মুহিত।

মেজর জেনারেল নাফিজ মাহমুদ বার বার কপাল স্লাইড করছেন দুই আঙুলের সহিত।মেয়েটার এই চব্বিশ বছরের জীবদ্দশায় কখনো একা ছাড়েন নি তিনি।এতো বড় মেডিকেলে পড়া মেয়েকে ও হাতে ধরে কলেজের সামনে রেখে এসেছেন তিনি।

সেই মেয়ে আজ কার না কার হাতে পরেছে!স্বর্গের ভয়ার্ত চেহারা মনে করে নাফিজ মাহমুদ বুকে তীক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভব করলেন।

স্বর্গকে কিডন্যাপ কে করতে পারে তা মুহিত নাফিজ মাহমুদ কে জানিয়েছে, শুধু তাই নয় ছেলেটি কি পরিমাণ দুধর্ষ সেটার প্রমান নাফিজ নিজেই।ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এর মেয়ের বিয়ের দিন ই মুহিত নাফিজ সাহেবকে সব খুলে বলেছে।
সাবধান হবার আগেই যে এমন ঘটনা ঘটে যাবে তা ঘূর্ণাক্ষরে টের পাননি নাফিজ মাহমুদ।

বাসায় সুখ আর তনুজা নিজেদের যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখার নাটক চালিয়ে যাচ্ছে।কিন্তু একজন মা আর ভাই কি পারবে দীর্ঘ সময় ধরে এই নাটক চালাতে?

কি ব্যপার তনুজা তোমাকে এমন লাগছে কেনো কিছু হয়েছে?
আর মুহিতের কন্ঠ শুনেছিলাম,দেখা না করেই কোথায় গেলো?

―আসলে আপা ঢাকার বাইরে একটা জরুরি মিশনে ওদের দ্রুত চলে যেতে হয়েছে,আপনার ভাই ফোন করে জানিয়েছেন ছোট একটা মিশন।চিন্তার কিছুই নেই।

―অনেক রাত হয়েছে আপা, শুয়ে পড়ুন।বেশি রাত জাগা আপনার জন্য ভালো নয়।
বলেই কাজের বাহানা দিয়ে চলে গেলেন তনুজা।
***
মুহিত অনেক আগে থেকেই আহিয়ান এর সকল খুজ খবর রাখতো কিছু গুপ্তচর এর মাধ্যমে।কোথায় যায়,কি করে ,কোথায় কার সঙ্গে ওঠাবসা এভরিথিং।
চাইলেই মুহিত সকল খবর জানতে পারবে।কিন্তু সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
এই অপেক্ষা তো মুহিতের কাছে এক শতাব্দীর সমান হবে।

মুহিত উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠে―

―মেজর আদ্রিয়ান সমুদ্রে টহল দেয়া নৌবাহিনীর জাহাজ এফ টি থার্টি তে কল করুন এবং সবিস্তারে সব খুলে বলুন।

ইতোমধ্যে পুলিশের হেলিকপ্টার চিটাগাং বন্দরে পৌঁছে গেছে।তারা হেলিকপ্টার এর মাধ্যমে লাইটিং পয়েন্ট করে নির্দিষ্ট সমুদ্র সীমানার উপরে চক্রাকারে ঘুরে সব কিছু পর্যবেক্ষণ করলো।কোথাও কিছুর হদিস পেলো না।

◆◆নড়েচড়ে উঠলো স্বর্গ।মাথা ঝিমঝিম করছে।চোখ খুলতে গিয়েও খুলতে পারছে না।হাত পা নাড়াতেই প্রচুর দুর্বল লাগছে।বহু কষ্টে আঁখি পল্লব মেলে চারপাশের সবকিছু ঠাহর করতে লাগলো।

কিয়ৎক্ষন বাদে বুঝতে পারলো সে একটি রুমে শুয়ে ছিলো।শরীরে শক্তি সঞ্চয় করে ধীরে ধীরে এগিয়ে চললো দরজার পানে।কোনো ভাবেই খুলতে পারলো না।শক্তিতেও আর কুলালো না।ক্ষীণ সুরে চিল্লাচিল্লি শুরু করে দিলো স্বর্গ

―কেউ আছেন?দরজা টা খুলুন প্লিজ
―আমাকে কোথায় আটকে রেখেছেন?
―আমি বাড়ি যাবো,আমার বাবা মা চিন্তা করছে আমার জন্য
প্লিজ দরজা টা খোলে দিন।বলেই দরজায় হেলান দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো স্বর্গ।

এর পর দৌড়ে উঠে গিয়ে নিজের মোবাইল,ব্যাগ সবকিছু সারা রুম তন্ন তন্ন করে খুজলো।কোথাও তার ব্যাক্তিগত জিনিস গুলোর সন্ধান পেলো না।
এবার সে বুঝতে পেরে গেলো কেউ তাকে কিডন্যাপ করেছে সিউর।তৎক্ষণাৎ মনে পড়লো মার্কেটে যাবার পথে একটা গাড়ি তার ট্যাক্সি কে ফলো করেছে।ড্রাইভার বারবার তাকে বলেছিলো একথা।

স্বর্গ আমলে নেয়নি।যদি তখন ট্যাক্সি ঘুরিয়ে বাসায় ফিরে যেতো তাহলে আজ এই দুরবস্থা হতো না।

কান্নার বেগ বেড়ে চললো স্বর্গের।

পাশে থাকা বেড সাইড ধবধবে টেবিলটার উপর কিছু ফল আর একটা চাকু রাখা।চাকুটা প্যান্টের ভাঁজে লুকিয়ে ফেললো স্বর্গ।

এরপর রুমে যা কিছু আছে সব ভাঙচুর শুরু করে দিলো।
সারা রুম ঝনঝন শব্দে আলোড়িত হলো নিমিষেই।
কারো দৌড়ে আসার শব্দ পেতেই দরজার পিছনে লুকিয়ে পড়লো স্বর্গ।

হাতে চাকুটা খুব সতর্কতার সহিত ধরে অপেক্ষা করতে লাগলো।স্বর্গ সেলফ প্রটেক্ট জানে।সে গান পয়েন্ট থেকে শুরু করে বিপদে পড়লে কিভাবে নিজেকে রেসকিউ করতে হবে এসব ট্রেনিং খুব ভালো মার্কসের সহিত অর্জন করেছে।
খট করে খুলে গেলো দরজা।

সুযোগ বুঝে পিছন থেকে দৌঁড়ে লোকটির গলা বাহু দিয়ে চেপে ধরে এমন ভাবে তাকে আঘাত করলো যে, লোকটি মরবে না কিন্তু আর উঠেও দাঁড়াতে পারবে না।

হঠাতই পিছন থেকে গমগমে কন্ঠে কেউ বলে উঠলো―

ওয়েল ডান বেইব,ওয়েল ডান।

বলেই হাততালি দেয়া শুরু করলো।

―এমন পার্টনার ই আমি পছন্দ করি।যারা বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁদে,আমার পায়ে পরে,তাদের উপর একদম ঘেন্না জমে গেছে।

―কিন্তু তোমাকে এমন রূপে দেখে তনু,মন দুটোই চাঙ্গা হলো।

বলেই স্বর্গ কে পেছন থেকে হাত মুড়িয়ে বেঁধে ফেললো।

লোকটির চেহারা দেখে স্বর্গ মুখের ভাষা হারিয়ে ফেললো।হ্যা এটা ওই বিয়ের দিনের অসভ্য লোকটা!

―এই লোক তাকে কেনো ধরে এনেছে?তার সাথে কি কাজ?

আপনার বকবকানি শুনতে একদম ভালো লাগছে না আহিয়ান চৌধুরী।ভালোই ভালোই আমাকে ছেড়ে দিন!
―যেতে পারলে যাও।বলে দরজা নির্দেশ করলো আহিয়ান।

স্বর্গ দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এলোপাতাড়ি ভাবে বাহিরে যাবার রাস্তা খুঁজতে লাগলো।
স্বর্গের এমন পাগলামি দেখে কিটকিটিয়ে হেসে ই যাচ্ছে আহিয়ান।
তার এহেন রূপ স্বর্গের শরীরে জ্বালা ধরালো।

এতো সুন্দর চেহারার পিছনে এতো ঘৃণিত রূপ?
ভেবেই এক দলা থুথু ফেললো স্বর্গ।
এই সিঁড়ি সেই সিঁড়ি করে অনেক সময় দৌড়ানোর পর স্বর্গ একটু আলোর ঝলকানি দেখতে পেলো।সেই আলো অনুসরণ করে বাইরে এসে যা দেখলো তাতে তার মাথা ঘুরে যাবার উপক্রম।
নিমিষেই ঝাপসা হলো চোখ।বড় বড় চোখ দুটো থেকে নীরবে ঝরতে লাগলো বড় বড় অশ্রু ফোটা।

সে কোনো বাড়ি বা কোনো জায়গায় নয়।সে একটি জাহাজে গভীর সমুদ্রের মধ্যে।

―কি পথ খুঁজে পেলে না?
―আমাকে কেনো ধরে এনেছেন জবাব দিন।
কন্ঠে ধার নিয়ে জিজ্ঞেস করলো স্বর্গ।

―ব্যাক্তিগত শয্যা সঙ্গী বানাবো সেই জন্য
আহিয়ানের নির্লিপ্ত উত্তর।

―আপনার লজ্জা করলো না অপরিচিত একটি মেয়েকে তুলে আনতে এভাবে?

―লজ্জা কেনো করবে?পছন্দ হয়েছিলো, নিজের কাছে রাখলাম।জানোনা পছন্দের জিনিস ফেলে রাখতে নেই।না হলে অন্য কেউ লুফে নিতো।

আহিয়ান চৌধুরীর প্রাণ থাকতে তার পছন্দের জিনিসে কেউ হাত দিতে পারবে না বলেই কন্ঠে কাঠিন্য এনে বললো

―যাও রুমে যাও অনেক নাটক সহ্য করেছি তোমার।

না যাবোনা,না গেলে কি করবেন আপনি?

বলেই জাহাজের রেলিং এর কাছে চলে গেলো স্বর্গ।

―আপনি আমার কাছে এলেই আমি পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়বো।

বাজ পাখির মতো ধূর্ত আহিয়ান সহসাই স্বর্গের নিকট এসে দুই গালে সজোড়ে থাপ্পড় মারে।
থাপ্পড়ের প্রবণতা এতোটাই ছিলো যে, ছিটকে পরে যায় স্বর্গ।তার দুই গালেই হাতের আঙ্গুল এর ছাপ বসে যায় এবং ঠোঁটের কোণা থেকে রক্ত বেরিয়ে যায়।

এই চব্বিশ বছরের জীবনে তার বাবাও কোনোদিন তাকে একটা ধমক পর্যন্ত দেয়নি,আর এই অপিরিচিত লোকটি তাকে রক্তাক্ত করে দিলো।
ভেবেই বাঁধ না মানা অশ্রু ভিড় করলো নেত্র কোলে।

★★★
কেটে গিয়েছে বাহাত্তর ঘন্টা।কোনো খবরই কেউ জোগাড় করতে পারছেনা।টানা তিন দিন ধরে পুরো টিম খাওয়া দাওয়া বাদ দিয়ে নাফিজ মাহমুদ এর মেয়ের খুঁজ চালিয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎই মুহিতের গোপন ফোনে একটি মেসেজ আসে।
―হেই ব্রো, ইটজ স্যাম স্মিথ।
ইউর ডিজায়ারড শিপ ইজ হেয়ার।

দ্রুত মুহিত দৌড়ে জেনারেলের রুমে চলে যায়।
―স্যার ইমিডিয়েটলি আমাদের রাশিয়া যাবার ব্যাবস্থা করুন।আমার সাথে ক্যাপ্টেন সৌম্য যাবে।আর ওখান থেকে রাশিয়ান আর্মি মেজর নিকোলাস ও ক্যাপ্টেন ভলতেয়ার থাকবে।

আরেকটা কথা স্যার ডিপার্টমেন্ট এর কেউ যাতে না জানে।আপনি তো জানেন ই কেউ আমাদের সব খবর বাইরে পাস করে দেয়।আমি চাইনা এই অপারেশনে কোনো স্পইলিং হোক।

জেনারেল মুহিতকে ভরসা দিলেন।ডোন্ট ওয়ারি মাই বয়।আমি সব ব্যাবস্থা করে দেব।

―আর রাশিয়ান আর্মড ফোর্স এর গ্রাউন্ড ফোর্স এর জেনারেল এর সাথে কথা বলে সব ব্যাবস্থা করে দেব।যাতে ওখানে তোমাদের কোনো প্রবলেম না হয়।
তুমি এখান থেকে কাকে নিতে চাও?

স্যার ক্যাপ্টেন সৌম্য ,আর আমি যাবো।
#চলবে।

তোমার জন্য সিন্ধুর নীল পর্ব-০৮

0

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_৮
#সারিকা_হোসাইন

―আমাদের এতোই পর ভাবলেন আপা?
আপনার দুঃসময়ে আমাদের সাথে নিলেন না?,কষ্ট গুলো ভাগাভাগি করে নিলে ব্যাথা কম অনুভূত হয় এটা কেনো বুঝলেন না আপা?

তনুজা তারিন কে হাত জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে আরো নানান অভিযোগ জানালেন
জানেন আপা আপনার ছেলেটা একটা পাষান!

―চার বছর ধরে এখানে আছে অথচ,কোনোদিন ও পরিচয় দেয়নি সে নাফিজের ভাগ্নে।
আর আপনি?
―আপনি কিভাবে আপনার ভাইকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ করালেন যাতে কোনোদিনও আপনি না বলা পর্যন্ত আপনাদের পরিচয় আমাদের না জানায়?
পৃথিবীতে কেউ অশুভ, অপয়া,অভিশপ্ত নয় আপা।বড় কথা আমরা সবাই মানুষ।আল্লাহ মানুষের ভাগ্য তার জন্মের ও বহু আগে লিখে রেখেছেন।
―আপনি কারো সংস্পর্শে গেলেই তার অকল্যাণ হবে এসব ভুল ধারনা আপা।

আপনার কোনো কথাই আর শুনবো না আমি।
―,আপনি আমার সাথে চলুন।
বলেই তারিনের ব্যাগপত্র গোছাতে উদ্দত হলো তনুজা।

কাঁপা কাঁপা হাতে মিসেস তারিন তনুজার হাত আকড়ে ধরে,তনুজার চোখের অশ্রু মুছিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন―

নাফিজ কখনো ভুল করতে পারেনা।

―আমার ভাইকে আমি চিনি,আমি জানতাম ও সমঝদার কাউকেই জীবন সঙ্গী করবে যে ওকে দেখেই ওর মন পড়ে ফেলবে।আজ অনেক আত্ম তৃপ্তি পেলাম তোমাকে দেখে তনুজা।

―নাফিজের মুখে তোমার অনেক প্রশংসা শুনেছি।তোমাকে দেখার লোভ আমার বহু আগে থেকেই।আমার মনের ভ্রান্ত ধারণার জন্য আর সাহস পাইনি।
―মাফ করবে আমাকে।
আমি অবশ্যই যাবো তোমার সাথে তনুজা,আর মুহিত কে বকে দেবো কেনো ও পরিচয় গোপন করেছে তার জন্য।

দরজায় দাঁড়িয়ে নাফিজ মাহমুদ সব কিছু শুনছিলেন।নিজের বোনকে কতো বছর পর এমন সাবলীল কথা বলতে শুনলেন ?
হিসেব করে গুনে গুনে বের করলেন নাফিজ মাহমুদ।
চোখের অশ্রু মুছে তারিনের বেডের কাছে এগিয়ে গেলেন।

―আপা তুই তেতত্রিশ বছর তিন মাস ছয়দিন পর আবার আমার আগের আপার মতো করে কথা বললি।আমি খুশিতে কথা বলতে পারছি না আপা।

আমার এতো খুশি কেনো লাগছে আপা?
বলেই হাটু মুড়ে তারিনের বেডের পাশে বসে অঝোরে কাঁদলেন নাফিজ মাহমুদ।

মুহিতের চোখ ঝাপসা হয়ে গেলো।তার মা আবার আগের মতো কথা বলছে।মা আবার হাঁটবে, চলবে,মুহিতের কান টানবে।
―।সুখ কি সত্যিই আবার ধরা দিতে চাচ্ছে?

এই আবেগ ঘন মুহূর্তে স্বর্গ একটু বেশি ই আবেগী হয়ে গেলো।ভুলে গেলো সে একজন আর্মি ডক্টর।
ভে ভে করে সকলের সাথে তাল মিলিয়ে কেঁদে উঠলো।

―তুমি খুব খারাপ ফুপি! খুব খারাপ!

তুমি তোমার সাথে সাথে সবাইকেই অনেক কষ্ট দিয়েছো,তোমাকে শাস্তি পেতে হবে ফুপি।

মিসেস তারিন স্বর্গের গালে,মুখে,কপালে চুমু খেয়ে স্মিত হেসে ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে বলে উঠলো―

কি শাস্তি দিবে তুমি আমাকে আম্মা?যা শাস্তি দিবে আমি মাথা পেতে নেবো।

সুখ কেও খবর দেয়া হয়েছিলো।সে মাত্রই এসে শাস্তির কথাটাই শুনলো প্রথমে।অমনি ভরা কেবিনে ফুরফুরে মেজাজে বলে উঠলো

―তোমার ছেলের সাথে ওকে বিয়ে দিয়ে দাও ফুপি,তোমার আর তোমার ছেলের যাবজ্জীবন শাস্তি ভোগ করা হয়ে যাবে।

তনুজা ছেলের দিকে চোখ গরম করে তাকালেন।
―ফাজিল কোথাকার সব জায়গায় একই আচরণ।কোথায় কি বলতে হবে শিখেনি।

মুহিত আর স্বর্গ লজ্জায় কোথায় পালালে কেউ খুঁজে পাবে না আর কোনোদিন মনে মনে যেই জায়গা খুঁজছে আর সুখের চৌদ্দ গুষ্টির শ্রাদ্ধ করে ফেলছে।

এমন সময় কেবিনে একজন নার্স আর প্রফেসর সারোয়ার জাহান প্রবেশ করলেন।
―অনেক দিন পর আপনাদের সবাইকে খুশি দেখে ভালো লাগছে নাফিজ সাহেব।
আপনারা সবাই চেষ্টা করলেই উনার জীবন আগের মতো সুন্দর স্বাভাবিক হবে।

কি কি করতে হবে সব আমি প্রেসক্রিপশন এ লিখে দিয়েছি।আপনাদের চেষ্টার যাতে কোনো ত্রুটি না থাকে আর দুই মাস পর পর আমার ফলোআপ এ নিয়ে আসবেন।
আজকে উনাকে আপনারা নিয়ে যেতে পারবেন।

―আর মেজর মুহিত আপনার মায়ের সঙ্গে সব সময় থাকবে এমন একজন মানুষ লাগবে।যার সাথে সে কমফোর্টলি সব শেয়ার করতে পারবে।হাসবে,কাঁদবে ,সারাদিন কথা বলবে এভরিথিং।

―আশা করি বুঝতে পেরেছেন আমি কার কথা বলছি?
বলে চোখ টিপলেন মেজর মুহিতের উদ্দেশ্য এই প্রবীণ প্রফেসর।

দেয়ালে টানানো বৃহতকার ঘড়ির ঘন্টা,মিনিট ,সেকেন্ড এর কাটা বারোটার ঘরে পৌঁছানো মাত্র ঢং ঢং করে বিকট আওয়াজ তুললো।নিস্তব্ধ নিশীতে শব্দটা বড়ই ভয়ংকর শোনাচ্ছে।

জড় বস্তু হলেও প্রযুক্তির ছোয়ায় তার মধ্যে কৃত্তিম প্রাণের সঞ্চালন হয়েছে।

সৃষ্টি কর্তা মানুষকে জ্ঞান বুদ্ধি দিয়েছে। সেই বুদ্ধি কেউ ভালো কাজে ব্যাবহার করছে কেউ খারাপ কাজে।
কিছু মানুষ চেষ্টা করে পৃথিবীতে কিভাবে কিভাবে উন্নয়ন মূলক কাজ করা যাবে?কিছু মানুষের প্রচেষ্টা আবার ভিন্ন।তাদের কাজ ই হচ্ছে ভালোকাজ ভেস্তে দিয়ে খারাপ কিছু করা।
তেমন ধাঁচের মানুষের মধ্যে রয়েছে আশরাফ চৌধুরী।
ইজি চেয়ারে বসে বসে নিজের জীবনের ছক আঁকছেন ষাট বছর বয়সের এই প্রবীণ।

তার নিজের অনুধাবন তাকে বলছে সে একজন নিকৃষ্ট খারাপ মানুষ,অথচ তার বাহিরের সত্তা তাকে এসব খারাপ কাজ থেকে ফিরতে বাধা দেয়।সবই টাকার খেলা।এই নশ্বর দুনিয়াতে টাকা না থাকলে সম্মান,ক্ষমতা,প্রাচুর্য কোথা থেকে আসবে?

এই জন্যই তো নিজের একমাত্র সন্তানকে ও গড়েছেন নিজের আদলে।কেউ তো আর চিরস্থায়ী নয় এই ভুবনে।সে মারা গেলে তার অস্তিত্ব কে টিকিয়ে রাখবে?ওই পারে কে কোন হালে রয়েছে সেই খবর কেউ রাখবে না।তাই আমোদ, ফুর্তি,সুখ ভোগ ,অপকর্ম এই দুনিয়াতে একটু করলে ক্ষতি কি?

কেউ তো আর জানছে না আমি এসব করে বেড়াচ্ছি।দিনে সমাজসেবা চলছে পুরোদমে আর রাতে?
বলেই খেক খেক করে হেসে উঠল আশরাফ চৌধুরী।
―দিনে আমি বিশিষ্ট সমাজ সেবক,গরিবের বন্ধু, নির্লোভ,সাধারণ জীবন যাপন কারী আশরাফ চৌধুরী।আর রাতে?আবার বিদঘুটে হাসি হেসে ওয়াইনের গ্লাস তিন আঙ্গুলএর সহিত ধরে চলে গেলেন আয়নার সামনে।।
ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে নকল চুল আর গোঁফ লাগিয়ে হো হো করে হেসে উঠলেন,,
―তোমাকে কেউ কোনো দিন খুঁজে বের করতে পারবে না আহমেদ খান কেউ না।
বলেই রাগে ওয়াইনের গ্লাস ফ্লোরে ছুড়ে মারলেন।
টাইলসের সংস্পর্শে এসে খান খান হয়ে চুরমার হয়ে গেলো ছোট গ্লাসটি।
রাগ যেনো তার সপ্তম আকাশ ছুলো
দাঁতের সাথে দাঁত পিষে চোখ বড় বড় করে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে উঠলো―
―আমার পিছনে লাগার ফল হাড়ে হাড়ে টের পাইয়ে ছেড়ে দেবো মেজর,যেমন দিয়েছিলাম ওই ম্যাজিস্ট্রেট কে।
পুরো ফ্যামিলি শেষ করে দিয়েছি এক তুড়িতে।তুমি তো সেদিনের ছোকরা।

আজ স্বর্গের অফ ডে।ডিউটি আর বাসা ডিউটি আর বাসা করতে করতে শরীর জং ধরে গেছে যেনো।এজন্য সে ঠিক করেছে আজকে বাইরে ঘুরতে যাবে।
ঘুরে বেড়ানোর জন্য হোক বা মন ভালো করার জন্য হোক স্বর্গ মনে করে শপিংয়ের চাইতে ভালো উপায় আর কিছুই হতে পারে না।

তনুজা কে নিয়ে আগে সব জায়গায় যেতো স্বর্গ,ফুপি আছে বলে মা একটু ব্যাস্ত।তাই নিজেই রেডি হতে হতে পিউ কে কল করলো।
পিউ জানিয়েছে ক্যাপ্টেন সৌম্যের সাথে আজকে তার ডেট আছে সে যেতে পারবে না।অগত্যা মন খারাপ না করে নিজেই চলে গেলো শপিং করতে।

বাইরে বের হয়ে অদ্ভুত এক শখ জাগলো তার মনে।সে আজ কোনো শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্র্যান্ডেড দোকান থেকে কিছু কিনবে না।সাধারণ মানুষের মতো নিউমার্কেট থেকে দামাদামি করে কেনাকাটা করবে।যেহেতু অনেক দিন পর সে বাইরে এসেছে,তাই সে তার নিজের মতো করে সময় কাটাবে।
যেই ভাবনা সেই কাজ,গাড়ি না নিয়ে সে চলে গেলো রাস্তায়।টেক্সি ক্যাব নিয়ে যাত্রা শুরু করলো
গন্তব্য নিউ মার্কেট।

বোকা স্বর্গ বুঝতেই পারলো না সে কতো বড় বোকামি করে ফেললো।এক জোড়া বাজ পাখির মতো তীক্ষ্ণ চোখ তাকে অনুসরণ করে চললো মুখে ক্রুর হাসি নিয়ে।

গাড়ি থেকে নেমে তনুজা কে স্বর্গ কল করে জানায় সে নিউমার্কেট এসেছে,সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরবে।মেয়ের উপর ভরসা আছে তনুজার,তাই সে অতোটা ঘটালো না।যেই মেয়ে শ্যুটিং, সেলফ প্রটেকটিং জানে তাকে নিয়ে আবার দুশ্চিন্তা কিসের,?

আস্তে আস্তে ভিড়ের মাঝে ঢুকতে থাকলো স্বর্গ,পিছনের ব্যাক্তি আর দু কদম এগুলোই ধরে ফেলতে পারবে স্বর্গকে।কিন্তু না এটা উপযুক্ত সময় নয়।
আরেকটু ভিড় প্রয়োজন।
যেই ভাবা সেই কাজ,রুমালে ক্লরোফার্ম স্প্রে করে স্বর্গ যেই ভিড়ের ভেতর ঢুকে গেলো অমনি নাকে রুমাল চেপে ধরলো।
ছিমছাম গড়নের হালকা পাতলা স্বর্গ নেতিয়ে পড়লো আগন্তুকের বাহুতে।কায়দা করে বুকে জড়িয়ে সন্তপর্নে ভিড় থেকে বেরিয়ে নিজের ব্র্যান্ডেড মার্সিডিজ গাড়িতে তুলে ফেললো।

―বিজয় এবার তার।

রেস্টুরেন্টে বসে আছে পিউ আর সৌম্য।এই রেস্টুরেন্টের পুরো রুফটপ রিজার্ভ করেছে সৌম্য।দুজন ছেলে মেয়ে বসে থাকবে কেউ ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে দেখবে এটা সৌম্যের পছন্দ নয়।আর সে পিউ কে কোনো প্রকার অস্বস্তিতে ফেলতে চায় না।

―মৃদু শব্দে সফট মিউজিক বাজছে সাথে রয়েছে রঙবেরঙের লাইটিং ব্যাবস্থা।মৃদুমন্দ বাতাস,সব মিলিয়ে রোমাঞ্চকর এক অনুভূতি।

প্রেম ভালোবাসার ক্ষেত্রে যে শুধু লাভ ইউ, বা আপনাকে আমি পছন্দ করি ভালোবাসি এসব বললেই ভালোবাসা হয় সেই ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করেছে এই জুটি।

দেখা সাক্ষাতে কখন যে দুজন দুজনার জন্য আকুল করা টান অনুভব করেছে কেউ জানেনা।শুধু জানে তারা ভালোবেসেছে।

বুক পকেটে হাত দিয়ে সৌম্য একটি বক্স বের করে আনে,সেটা পিউ এর হাতে দিয়ে বলে_
―আমার পক্ষ থেকে অতি ছোট একটা গিফট আপনার জন্য পিউনাজ।।
পিউ আবেশে লজ্জায় হাত বাড়িয়ে সেই বক্স গ্রহণ করে।

―খুলে দেখুন পিউনাজ কি আছে এতে।
―পিউ পাগল করা হাসি উপহার দিয়ে বক্স খুলে একটি ডায়মন্ড এর পেনডেন্ট দেখতে পায়।খুশিতে ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করে বলে উঠে―
―অনেক সুন্দর এটা, পছন্দ হয়েছে খুব।

পিউয়ের খুশি মাখা মুখ সৌম্যের বুকে হাতুড়ি পেটায়।কে বলেছে এই মেয়েকে এতো সুন্দর হতে?এতো দিল মে চাক্কু লাগানো হাসি।
সৌম্য তুই নির্ঘাত মরে যাবি দেখিস।

পিউ সৌম্যের মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে সৌম্যের হুশ ফিরায়।
―কি দেখছেন এমন করে?
―আপনাকে পিউনাজ !

সৌম্যের সাবলীল উত্তর।

পিউয়ের দিকে তাকিয়ে সৌম্য অনুরোধের সুরে বলে ওঠে―

―আমি কি পেনডেন্ট টা আপনার গলায় পরিয়ে দিতে পারি পিউনাজ?

―পিউ চোখ বন্ধ করে সৌম্যের হাতে বক্স টা তুলে দেয়।

আজকের সন্ধ্যা টা সৌম্যের কাছে মোহনীয় লাগছে।প্রেম ভালোবাসা মনে হয় এমনি।

সবকিছু নতুন আর মোহনীয় লাগে।

সৌম্য পিউএর হাত থেকে পেনডেন্ট টা নিয়ে পিউ এর পিঠের ঝলমলে চুল গুলো সরায়।পিউএর চুলের মাতাল করা ঘ্রানে সৌম্যের বুকে উত্তাল ঢেউয়ের প্রবাহ হয়।

সৌম্যের ছোয়ায় পিউ কেঁপে উঠে।এ কেমন শিহরণ জাগানো অনুভূতি?

সৌম্যের মতো ড্যাসিং, স্মার্ট,লম্বা,মোহনীয় পুরুষ পেয়ে পিউ এর কাছে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে।এই সুদর্শন পুরুষটি একান্তই তাঁর।

সৌম্যের উষ্ণ নিঃশাস আছড়ে পড়ছে পিউ এর পিঠে।পিউ আর সহ্য করতে পারলো না।সামনে ফিরে সৌম্যকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেললো।

ঘড়িতে সময় রাত আটটা বেজে চল্লিশ মিনিট।
এতোক্ষণ তনুজা স্বাভাবিক থাকলেও এখন আর থাকতে পারছে না। না মেয়েটা বাসায় ফিরছে না ফোনে পাওয়া যাচ্ছে

এর মধ্যে হঠাৎ কলিং বেল এর আওয়াজ হলো।তনুজা দৌড়ে দরজা খুলতে গেলেন।ভেবেছেন স্বর্গ এসেছে কিন্তু দরজা খুলে মুহিত কে দেখতে পেলেন।
ভদ্রতাসূচক হেসে ভেতরে প্রবেশ করতে বললেন মুহিত কে।

মামীর এমন রূপ দেখে বুদ্ধিমান মুহিত বুঝে ফেললো কিছু হয়েছে।

তনুজা ভাবছে নাফিজ মাহমুদ বাসায় এলে কি জবাব দেবেন তিনি?
চিন্তায় তার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো।

মুহিত বিনীত সুরে জানতে চাইলো

―কিছু হয়েছে মামী?
তনুজা বাচ্চাদের মতো কেঁদে উঠলো
মুহিত ঘাবড়ে গিয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে মামী খুলে বলুন!

স্বর্গ―
কী হয়েছে স্বর্গের?
―স্বর্গ বাসা থেকে শপিং এ যাবার জন্য সেই চারটার সময় বের হয়েছে এখন নটা বাজতে চললো মেয়েটা ফিরছে না ফোনেও পাওয়া যাচ্ছেনা।

কথাটা শ্রবণ ইন্দ্রিয় তে পৌঁছানো মাত্র মুহিতের পুরো পৃথিবী অন্ধকার হয়ে গেলো।
তবুও নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললো হয়তো এখনই এসে পড়বে।

―না বাবা ও বলেছে সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে ফিরবে।আর ও সন্ধ্যার পর কখনো বাইরে থাকেনা।

উদ্বিগ্নের সহিত মুহিত জানতে চাইলো কোথায় গিয়েছে শপিং এ?

তনুজা কেঁদে উত্তর করলো ―নিউমার্কেট।

আহিয়ানের কথা মনে পড়তেই বুকটা ধক করে উঠলো মুহিতের।

―আমি দেখছি চিন্তা করবেন না মামী বলে দৌড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।

জিপে উঠে বসে সৌম্যকে কল করলো।

সৌম্যের কাছে ব্যাক্তিগত বিষয় এক পাশে ,ডিউটি আরেক পাশে।

কেবলই দুজনে ডিনার ডিগ করতে স্টার্ট করেছে।

হঠাৎই ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো।

তড়িৎ গতি তে তা রিসিভ করে বলে উঠে
―জি স্যার।
ওপাশ থেকে কি বললো তা পিউ শুনতে পেলো না,সৌম্য আবার বলে উঠলো জি স্যার।

পিউ দ্রুত খাবার শেষ করুন আমাদের যেতে হবে।

পিউ কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সৌম্য বলে উঠলো স্বর্গ ম্যাম কে পাওয়া যাচ্ছে না।আমি মেজর এর সাথে বের হবো।

―আপনার বাসার ঠিকানা বলুন দ্রুত।
পিউয়ের বাসা রেস্টুরেন্ট থেকে বেশি দূরে নয়,সৌম্য যাবার পথেই ওকে নামিয়ে দিতে পারবে।দেরি না করে দুজনেই দ্রুত বিল মিটিয়ে বেরিয়ে যায়।

পিউকে নামিয়ে দিয়ে সৌম্য মুহিত কে কল করে,
―স্যার আমি অপেক্ষা করছি আপনি আসুন।
―ক্যাপ্টেন একটা নম্বর দিচ্ছি ট্র্যাক করার চেষ্টা করবে কোথায় আছে?

এসব কূটকাচালি বিষয়ে সৌম্য খুব এক্সপার্ট,কিন্তু ডিপার্টমেন্ট সৌম্যের এই গুণ জানেনা।জানলে নির্ঘাত এই ভাইপার স্কোয়ার্ডন থেকে সাইবার সিকিউরিটি তে ঢুকিয়ে দেবে!

নাফিজ মাহমুদ ডিপার্টমেন্ট এ জানিয়ে দিলেন কেউ তার মেয়েকে অপহরণ করেছে।ডিপার্টমেন্ট থেকে পুলিশ ইউনিট মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়লো সারা সারা শহর।

মুহিত মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এটা যদি আহিয়ানই হয় সে ডিরেক্ট শ্যুট করে দিবে।কিছুতেই মুহিতের বুনা জাল থেকে বের হতে দেবেনা আহিয়ান কে এবার।

#চলবে।

তোমার জন্য সিন্ধুর নীল পর্ব-০৭

0

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_৭
#সারিকা_হোসাইন

কিছুক্ষন আগেই ঝড়ের তান্ডব শেষ হয়েছে।চারপাশে ঝিঝি পোকা ঝিঝি শব্দের রব তুলেছে।পরিবেশ শান্ত স্নিগ্ধ।শুনশান চারপাশ কারো কোনো আওয়াজ নেই।ঘুমিয়ে গেছে হয়তো পাখপাখালী ও।শুধু ঘুম নেই মুহিতের চোখে।
জীবনের হিসেব কিছুতেই যেনো মিলছে না।কি থেকে কি হয়ে গেলো নিমিষেই!

চোখ বন্ধ করলেই মুকিতের বড় বড় চোখের দুস্টু দুস্টু চাহনি ,ভুবন ভোলানো হাসি,ছোট ছোট হাত পা,ভাইয়া ভাইয়া করে ডেকে অস্থির করে ফেলা সব এসে হানা দেয় আখি পল্লবে।

সেদিন মুহিত কুমিল্লায় ফিরে যেতে চায়নি।

আদনান সাহেব কে দেখেই মুহিত বুঝে গেছিলো কিছু একটা হয়েছে,এজন্য মুহিত আংটি বদল শেষ হতেই আদনান ওয়াসিফ এর কাছে যায়―

―পাপা কোনো কিছু না লুকিয়ে সত্যি করে বলো কি হয়েছে?তোমাকে এমন বিধ্বস্ত অসহায় কেনো লাগছে?
আদনান সাহেব মুহিতের পানে দৃষ্টি ফেলে বললেন
―আমার রুমে এসো মুহিত কথা আছে।

মুহিত আদনান সাহেব কে অনুসরণ করে দূতলার দক্ষিণ পাশের রুমটাতে চলে যায়।সেই রুমের বেলকনি সাইজে বিশাল বড়,বেলকনির এক কোনে চেয়ার টেবিল পাতানো।
মিসেস তারিন গাছ ,ফুল প্রিয় মানুষ।বিভিন্ন ইনডোর প্লান্ট আর ফুলের গাছ দিয়ে বেলকনি সজ্জিত করেছেন ।পাশেই একটা ইজি চেয়ার পাতা।
আদনান ওয়াসিফ এলোমেলো পায়ে হেটে ইজি চেয়ারে বসে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করলেন।
বড় করে শ্বাস নিয়ে মুহিতের উদ্দেশ্যে বলেন-

―শুনো মুহিত,সবসময় মাথায় রাখবে তুমি সৎ,সত্যবাদী, আদর্শ একজন নির্বাহী অফিসার এর সন্তান।টাকার লোভে বা ক্ষমতার লোভে পরে কখনো কোথাও দালালি করতে যাবে না।

―এসব কেনো বলছো পাপা?

―বলছি অবশ্যই এর পিছনে কারন আছে।
তোমাকে এই সংসারের হাল ধরতে হবে মুহিত।আমার অবর্তমানে তুমি হবে মুকিত,নামিরা আর তারিনের গার্ডিয়ান।বাবা হিসেবে তোমাকে অনুরোধ নয় ওর্ডার দিচ্ছি আমি।

আমার ছেলে,মেয়ে আর তারিন কে কখনো কোনো দুঃখ দিতে পারবে না তুমি।তোমাকে হতে হবে শক্ত,ধৈর্যশীল।মনোবল হারালে চলবে না।

কি বলেছি তুমি কি বুঝতে পেরেছো?
―আদনান সাহেব চোখ খুলে হেলান ছেড়ে উঠে বসলেন।মুহিতের পানে দৃষ্টি দিগে আবার বলতে লাগলেন-

―আমার সমস্ত দায়িত্ব আমি তোমার উপর অর্পণ করলাম,কখনো দায়িত্বের অমর্যাদা করবেনা।
নামিরার বিয়ে শেষ হতেই কুমিল্লায় ফিরে যাবে তুমি,এখানে যাই হয়ে যাকনা কেনো এই বাসায় আসবেনা।

নামিরা আর সোহাগের জন্য তোমার নাফিজ মামা সকল ব্যাবস্থা করে রেখেছেন।আমি চাই তুমি শুধু আমার না হওয়া দায়িত্ব গুলো পালন করবে বাধ্য অফিসার এর মতো।আমাকে কোনো প্রকার প্রশ্ন করবে না।

মুহিত আদনান সাহেবের এমন কাঠিন্যতা দেখে অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলো সেদিন।
―যেই বাবা কখনো চোখ গরম করে পর্যন্ত তাকায়নি সেই বাবা আজ এতো কঠিন স্বরে কথা বলছে?

আদনান সাহেব আবারো বলতে শুরু করলেন―
তোমার মা নরম মনের মানুষ,এমনিতেই তার মন দুঃখ কষ্টে ভরপুর।কোনো আঘাত সহ্য করতে পারেনা।কখনো তাকে আঘাত দিবেনা।আমি থাকি বা না থাকি তাকে ছোট বাচ্চার মতো সামলে রাখবে।
―পরশু নামিরার বিয়ে,বিয়ে শেষ হওয়া মাত্রই ব্যাগপত্র গুছিয়ে চলে যাবে।
অনেক রাত হয়েছে শুয়ে পরো।
বলেই চেয়ার থেকে উঠে শয়ন কক্ষে চলে গেলেন আদনান সাহেব।

মুহিত দুইয়ে দুইয়ে চার মেলাতে পারছে না।একজন ম্যাজিস্ট্রেট কে টেক্কা দিতে পারে এমন মানুষের সংখ্যা খুবই কম।
কোনো ঝামেলা হয়েছে এটা নিশ্চিত।

কিন্তু ঝামেলা টা কি এমন যে, কেউ কারো জান নিয়ে নিবে?

সেদিন রাতে মুহিতের ঘুম এলো না।খুব ভোরে বিছানা ছাড়লো মুহিত।

নামিরার বিয়ের তেমন কোনো আয়োজন ও নেই।মুহিত সারাদিন ভেবে চিন্তেও কোনো সুরাহা করতে পারলো না তার বাবার এসব বলার পিছনের ঘটনার।
নামিরার বিয়ে শেষ হতেই মুহিত চলে যেতে ব্যাগ পত্র গোছালো।তারিন ,মুকিত,নামিরা জোর জবরদস্তি করেও মুহিতের মুখ থেকে কিছু বের করতে পারলো না।

তারিন নামিরা কান্না করে দিলো একপ্রকার।
তারিন বলে উঠলো―

―তুই না বললি পনেরো দিনের ছুটিতে এসেছিস তাহলে এখনই কেনো চলে যাচ্ছিস আরো তো বারো দিন বাকী।

নামিরা নাক টেনে টেনে বললো―

সোহাগ কে মানতে পারছিস না দুলাভাই হিসেবে?

মুকিত তো মুহিতের ব্যাগ ই ছাড়ছে না।মুহিত যদি ছুটি থাকতেই ফিরে যায় তাহলে মুকিতের লা*শে*র উপর দিয়ে যেতে হবে।

একদিকে বাবার আদেশ অন্যদিকে পরিবারের আকুতি।সব মিলিয়ে মুহিত মহা ফ্যাসাদে পরলো যেনো।
অবশেষে কাজের বাহানা,মিশনের বাহানা দিয়ে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে কুমিল্লায় ফিরে আসে মুহিত।

যেদিন বাবা ভাই কে হারালো সেদিন মুহিত একদম কাঁদেনি।কেনো জানি কান্না আসেনি।দুর্বল মনের মুহিত এক রাত্রের ব্যাবধানে পাষান এ পরিণত হলো।

প্রানপ্রিয় ভাইয়ের শোক হৃদয়ে পাথরের স্তুপ বসালো।হায়রে অভাগী মা! জীবন তোকে কোনো শান্তি ই দিলো না।

এতোদিন বাবা হারানোর শোক ,মিথ্যে অপবাদ নিয়ে কাটিয়েছিস আর এখন সাথে যুক্ত হলো ভালোবাসার স্বামী আর প্রানপ্রিয় পুত্র হারানোর শোক!

মুহিতের বাবা আর মুকিতের পোস্টমর্টেম রিপোর্ট নিমিষেই বদলে গেলো।পুলিশ মিথ্যে সাক্ষী দিলো।রাতের আধারে কে বা কারা মুহিতদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলো।
সংবাদ পত্রে নিউজ হলো সৎ ম্যাজিস্ট্রেট আদনান ওয়াসিফ পরিবার সমেত আগুনে পুড়ে মা*রা গিয়েছেন।

মুহিত তখনো মিডিয়ার সামনে এসে হু হা করলো না।
মুহিত ততক্ষনে বুঝে গিয়েছিলো প্রতিপক্ষ প্রশাসনের বাম হাত।এদের কে ধরতে হলে আত্নগোপন করাই শ্রেয়।
এখনই সামনে আসলে তাকেও শেষ করে দিতে কার্পণ্য করবে না।

কিন্তু মুহিত তা কখনো হতেই দিবেনা।তার সুখের পরিবারকে যারা এক নিমিষেই ছারখার করেছে,একদিন অবশ্যই মুহিত তার চূড়ান্ত হিসেব কষবে।

ওপাশের কেউ জানলোই না,নির্বাহী অফিসার এখানে একজন বারুদ রেখে গিয়েছে যা সময় সুযোগ বুঝে আপন শক্তিতে জ্বলে উঠবে এবং তাদের ও জ্বালাবে।

রাতের আধারে পুড়ে যাওয়া নিজের ভবনে এসেছিলো মুহিত,আদনান ওয়াসিফ এর নিজস্ব লকার ছিলো, সেটার লক মুহিত জানতো।
টর্চ জেলে কাঙ্খিত লকারের নিকট এসে কোড প্রেস করতেই লকার খুলে গেলো।
বেরিয়ে এলো বাদামি মলাটের ডায়েরি,একটা পেনড্রাইভ, কিছু স্থির চিত্র।
সোনার হরিণ পাওয়ার মতো চকচক করে উঠলো মুহিতের চোখ।

একজন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট এর দৌড় আর কতোই বা?
এখনই প্রতিপক্ষ কে জব্দ করা মোক্ষম সময় নয়।সুযোগ বুঝে চাল ফেলতে হবে।

অধ্যবসায় আর কঠিন পরিশ্রমে নিজের তীক্ষ্ণ বুদ্ধির জেরে খুব দ্রুত লেফটেন্যান্ট থেকে ক্যাপ্টেন।ক্যাপ্টেন থেকে মেজরে পরিণত হলো মুহিত।

নিজের মামার পাওয়ার কাজে লাগিয়ে ঢাকায় এসে স্থান পোক্ত করলো।বড় বড় অফিসারদের হাত করতে যা যা দরকার তাই করে তাদের খুশি করে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এর চোখের মধ্যমনি পর্যন্ত হয়ে গেলো মুহিত।

মামার পরিচয় জানলে মানুষ তাকে আর তার মামাকে অন্য চোখে দেখবে।তখন মুহিতের কঠিন পরিশ্রম তাদের চোখে পড়বে না।মুহিতের কষ্টে অর্জিত ফল চলে যাবে মামার ক্রেডিটে শুধু তাই নয় মামাও বিপদে পড়বে,ডিপার্টমেন্ট মামাকে হেনস্থা করবে।

এমনটি বুদ্ধিদীপ্ত মুহিত কখনোই হতে দেবেনা।শক্ত মনের অধিকারী মুহিত ভুলে গেলো মেজর জেনারেল তার মামা।

নাফিজ মাহমুদ আর দুটো মেজরের মতো তার ও স্যার।সবাই তাকে স্যার ডাকতে পারলে সেও পারবে।
নামিরার সাথে খুব কম যোগাযোগ করে,নামিরার কান্নাকাটি তে বুকের বাঁ পাশে সূক্ষ্ণ ব্যাথা অনুভূতি হয় যা মুহিত হতে দিতে চায়না।

সোহাগের সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ আছে তার।সোহাগ ভালো রাখবে তার বোনকে বা এখনো রাখছে,সেই নিশ্চয়তায় শান্তিতে শ্বাস নেয় মুহিত।।

মাকে আগলে রেখেছে মুহিত ছোট নবজাতকের ন্যায়।যে মা উঠেনা, খায়না,কথা বলে না।যার শুধু শ্বাসটাই চলে।

সকল ভাবনা ভাবতে ভাবতে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়লো মুহিতের চোখের কার্নিশ বেয়ে।বাবাকে দেয়া কথা মুহিত রাখতে পারছেনা।দিনে দিনে মনোবল হারিয়ে যাচ্ছে।
মনটাকে শক্ত করা দরকার।
★★
রাত তিনটে বেজে সাতাশ মিনিট■
চারশত নব্বই বারের মতো আজকেও বাবার লিখা বাদামি মলাটের ডায়েরিটা মুহিত খুলে বসেছে।মনোবল শক্ত করতে ম্যাজিকের মতো কাজ করে তার বাবার লেখা গুলো।যতোবার মুহিত মনোবল হারাতে বসেছে ততবারই তার বাবার এই ডায়েরি তাকে সাহস জুগিয়েছে।

মুহিত প্রথম পৃষ্ঠা বের করলো,তাতে টানা টানা অক্ষরে হাতের লিখা―

―আমার ছাব্বিশ বছরের চাকরির জীবনে আমি কখনো অসুদুপায় অবলম্বন করিনি।কখনো আমি আমার পেশার উপর কলঙ্কের কালি লাগতে দেইনি।আমার সন্তানরা কখনো আমার জন্য মানুষের সামনে মাথা নত করবে না।তারা মাথা উঁচু করে বাঁচবে।আমার স্ত্রীর কাছে আমি যেমন আদর্শ স্বামী হয়ে আছি মৃত্যুর পর ও এমনটাই থাকতে চাই।

পরের পৃষ্ঠা উল্টালো মুহিত।

সাল ২০১৮ সতেরো মে।

আমার আদরের পুত্র মুহিত সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হয়েছে।ছেলে দেশের জন্য নিজেকে নিয়োজিত করেছে এর থেকে সুখের আর কি হতে পারে?আমি জানি মুহিত আমার সকল স্বপ্ন পূরণ করবে।আমার প্রানপ্রিয় মুহিত বাবার সকল দোয়া আর ভালোবাসা তোমার জন্য।।

◆◆জুন তিন
ভেবেছিলাম নামিরাকে বিয়ে দিয়ে চিন্তামুক্ত হবো,কিন্তু ভাগ্য সহায় হবে কি?
আমি কুচক্রী কিছু লোকের খারাপ পরিকল্পনার মধ্যে ঢুকে গেছি।আমার জন্য তাদের গোপন তথ্য ফাঁস হবার উপক্রম হয়েছে।আমাকে হুমকি দেয়া হয়েছে আমাকে সহ আমার স্ত্রী সন্তান কে তারা পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেবে।
আমি যদি সাক্ষী না দেই তাহলে সবাই ভালোভাবে বেঁচে থাকবে।

কিন্তু আমিও একজন বাবা,যাদেরকে এভাবে পাচার করে দেয়া হচ্ছে তাদের ও পরিবার আছে,মা,বাবা আছে।নামিরা মুহিত,মুকিতের জন্য আমার যেমন চিন্তায় জান বেরিয়ে যায়,তাদেরও তেমন ই হচ্ছে।

আমাকে যদি আমার জান কোরবান দিতে হয় দিবো তবুও কোনো বাবা মায়ের বুক খালি হতে দিবো না।

■■
জুন সাত―
মনের সাথে যুদ্ধ করে বহু ভেবেচিন্তে দেখেলাম,আমি কোনোভাবেই আমার চরিত্রে দাগ লাগাতে পারবো না।আমি নিজের জীবন বিসর্জন দেব সেই ভাবনা ভেবে ফেলেছি।কাল আমার আদরের একমাত্র মেয়ে নামিরা মেহজাবিন এর বিয়ে।আমার অনেক আনন্দিত হবার কথা।কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে।আমার স্ত্রী সন্তান, কে শেষ রক্ষা করতে পারবো তো?


জুন পনেরো―
―মুহিত আমাকে কথা দিয়েছে ও সব সামলে নেবে।মুহিতের প্রতি আমার আস্থা শতভাগ।মুহিতকে পারতেই হবে।আমি কখনো কারো উপর অবিচার,জুলুম করিনি।আল্লাহ ই আমার সন্তানদের জন্য যথেষ্ট।তিনি অবশ্যই আমার স্ত্রী সন্তানকে রক্ষা করবেন।

মুহিত তুমি যদি কখনো এই ডায়েরি পাও ভেবে নিবে বাবার পক্ষ থেকে তোমার মনোবল বৃদ্ধির মেডিসিন এটা।পাপার সকল দোয়া আর গভীর হৃদয়ের ভালোবাসা তোমার জন্য।

তোমাকে নিয়ে আমার অনেক স্বপ্ন ছিলো, হয়তো কিছুই পূরণ হবে না।যখন তুমি এই লিখা গুলো পড়ছো পাপা হয়তো তখন তোমার থেকে অনেক দূরে।
তোমার জন্য আমার না হওয়া কিছু কাজ ফেলে যাচ্ছি।যদি বড় কোনো অফিসার হও তাহলে বদলা নিও,আর যদি ভীতু কাপুরুষ হও তবে জেনে নেবে তোমার বাবাকে কেউ সততার জন্য খু*ন করেছে।
নিজেকে ঐভাবেই গড়ে তুলবে মুহিত যেভাবে গড়লে পাপার মৃ*ত্যু*র প্রতিশোধ নিতে পারবে।

কখনো অন্যের নৌকায় পা দিয়ে চলার চেষ্টা করবেনা।কোনো সাহায্য প্রয়োজন পড়লে তোমার মামা নাফিজের কাছে চাইবে।নাফিজ আমাকে কথা দিয়েছে তোমাদের দেখে রাখবে।কিন্তু অনুরোধ থাকবে কারো কাছ থেকে সাহায্য নিতে গিয়ে তাকেই আবার বিপদে ফেলবে না।

তোমাকে অনেক বড় হতে হবে মুহিত,বড় অফিসার হবে।দেশের জন্য,দেশের মানুষের জন্য কাজ করবে,নিজের শ্রম আর মেধা খাটিয়ে সবসময় সবকিছু অর্জন করবে।সততার পুরষ্কার কতো বড় হয় জানোতো?

মুহিত নরম মনের মানুষ গুলো এই দুনিয়ায় সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায়,যাকে মানুষ নরম পায় তার পিছনেই লেগে থাকে।একটা কথা জানোতো?
―শক্তের ভক্ত,নরমের যম!

এমন ভাবেই বিকশিত করবে নিজেকে যেনো ভক্তিটাই তোমার ঝোলাতে উঠে,আর অন্যের জন্য নিজে যমে পরিণত হও।

পাপা অনেক কথা বলে ফেলছি,হাতে সময় খুবই কম।কিছু দায়িত্ব আছে ওগুলো কমপ্লিট করতে হবে।আমার আদর্শে বেঁচে থেকো মুহিত।
শুধু মনে আফসোস তোমাদের পুরোপুরি গুছিয়ে দিয়ে যেতে পারলাম না এমন অভাগা পিতা আমি”

ভালো থেকো আদরের মুহিত।

■ডায়েরি টাতে আর কিছুই লেখা নেই।বাকী সব সাদা পাতা।

ফজরের আজান হচ্ছে চারপাশে।অশ্রু সিক্ত নয়নে মুহিত ডায়েরি টা বন্ধ করে লকারে আবার পুরে রাখলো।
হাত মুখ ধুয়ে ওযু করে মুহিত নামাজে দাঁড়ালো।

তনুজা সকাল সকাল সব কাজ রেডি করছে দ্রুত।আজ সে নিজেই যাবে মুহিতের মা কে এবাড়িতে আনতে।প্রফেসর ফোন করে জানিয়েছেন মিসেস তারিন এর জ্ঞান ফিরেছে।উনাকে একা একা রাখার চাইতে বেশি মানুষের মধ্যে হাসিখুশি রাখলে উনার জন্য ভালো হবে।
স্বর্গকে নিয়ে মিসেস তনুজা বেরিয়ে গেলেন নাফিজ মাহমুদের বাংলো থেকে।

স্বর্গ আর তার মা দাঁড়িয়ে আছে কাঙ্ক্ষিত কেবিনের দরজার সামনে।দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে মুহিত কে দেখা গেলো মায়ের সাথে টুকটাক কথা বলছে আর হাসছে।
মুহিত কে হাসলে এতো সুন্দর লাগে?ভেবেই স্বর্গের মনে আনন্দের সৃষ্টি হলো।
এইতো মুহিত আজকে মন থেকে হাসছে।

হঠাৎ তনুজাকে দেখে দাঁড়িয়ে যায় মুহিত।সালাম দিয়ে প্রশ্ন করে ―
―ম্যাডাম আপনি এখানে?

―তনুজা হুহু করে আঁচলে মুখ গুজে কেঁদে উঠেন।
থাবড়িয়ে গালের খাল তুলে ফেলবো ফাজিল ছেলে
―আমি তোর ম্যাডাম নই, আমি তোর মামী।

#চলবে

তোমার জন্য সিন্ধুর নীল পর্ব-০৬

0

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_৬
#সারিকা_হোসাইন

●●
ঘড়িতে সময় রাত দশ টা বেজে পঁচিশ মিনিট।বাইরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে সেই সাথে জোরে শো শো শব্দে বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে,আকাশ কালো মেঘে ঢেকে গেছে।একটু আগে যেই চাঁদটা আলো ছড়াচ্ছিলো সেই চাঁদকে এখন এই মেঘ গুলো গ্রাস করে ফেলেছে পুরোদমে।যে কোনো মুহূর্তে ঝড় আসবে এমন অবস্থা।

আজ দ্বিতীয় বারের মতো স্বর্গ নাফিজ মাহমুদের স্টাডি রুমে উপস্থিত হয়েছে সাথে রয়েছে তনুজা মাহমুদ।

■■দুপুরে

পিউ এর কথা শুনে মুহিতের মায়ের কেবিন তল্লাশি চালাতে গিয়ে কাঙ্খিত রুমের সামনে দাঁড়িয়ে আছে স্বর্গ।
দরজা ঠেলে যেই ভিতরে ঢুকবে অমনি পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে পায়ের তলার মাটি সরে যায় স্বর্গের।

―আপা চোখ খুলো, আর কতোদিন এভাবে মরার মতো পরে থাকবে আপা?আমরা কেউ ভালো নেই আপা, মুহিত উপরে শক্ত থাকলেও ভিতরে চুরমার হয়ে গেছে,সে তোমাকে আকড়ে ধরে কোনো মতে বেঁচে থাকতে চাইছে তুমি ই যদি এমন করো মুহিত কি করে বাঁচবে আপা?
নামিরা আর সোহাগ ভালো আছে আপা, আমি কিচ্ছু হতে দেইনি ওদের।

―জানো আপা তুমি নানী হবে,নামিরার ঘরে ছোট্র মুকিত আসবে ,

চোখ খুলো না আপা!ও আপা।
বলে কান্নায় ভেঙে পড়লেন নাফিজ মাহমুদ।
বাবার মুখে মুহিতের মাকে আপা সম্বোধনে অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেলো স্বর্গ।

সে জানতো তার একজন বড় ফুপি আছে,সেই ফুপি যে মুহিতের মা সেটা সে কল্পনাও করতে পারেনি।
ফ্যামিলি এলবামে নাফিজ মাহমুদ এর সাথে একজন কিশোরীকে দেখে যেদিন স্বর্গ প্রথম জিজ্ঞেস করেছিলো

― উনি কে বাপী?
―উনি তুমার ফুপি কিন্তু সে হারিয়ে গেছে
সাত বছরের অবুঝ স্বর্গ তখন কি এতোকিছু বুঝতো নাকি?

এতো বছর পর সেই ফুপির সন্ধান এভাবে পাবে ভাবতেও পারেনি স্বর্গ।
দরজা ঠেলে রুমের ভেতরে প্রবেশ করলো স্বর্গ,
সন্তপর্নে নাফিজ মাহমুদ এর পিঠে হাত রেখে ডেকে উঠলো ―
―বাপী!
পিছন ফিরে স্বর্গকে রুমে দেখে হতবাক হয়ে যান নাফিজ মাহমুদ

★বর্তমান
স্বর্গ বাসায় এসে তনুজাকে সব জানালে তনুজা কান্নায় ভেঙে পড়েন।এতদিনের সংসার জীবনে তার মনে হচ্ছে নাফিজ মাহমুদ জীবনে প্রথম আজ তার মন ভেঙেছে।তার বোন এমন অবস্থায় পরে রয়েছে একথা তনুজা জানলে কি এমন ক্ষতি হতো,মুহিত তো বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাজে এবাড়িতে অনেক বার এসেছে তখন কোনো বলেনি সে যে,মুহিত তার আপন ভাগ্নে?

আর মুহিত?
মুহিত ও তো বলতে পারতো যে নাফিজ তার মামা!মুহিত কেনো সব চেপে গিয়েছে?
―শুধু বাসায় ই নয় বাইরেও কেনো মুহিত স্যার সম্বোধন করে অপরিচিতের ন্যায় থাকে?

প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে নাফিজ মাহমুদ এর দিকে তাকিয়ে আছে স্বর্গ এবং মিসেস তনুজা।

দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে মাথা নিচু করে বসে আছেন নাফিজ মাহমুদ।হঠাৎই মুখ তুলে স্বর্গ আর তনুজার পানে চাইলেন নাফিজ মাহমুদ।পাশে থাকা কর্নার টেবিল থেকে পানির গ্লাস তুলে নিয়ে এক দমে ঢকঢক করে গিলে ফেললেন সবটুকু।এর পর বলতে শুরু করলেন―

~আপা আর আমি গুনে গুনে পাঁচ বছরের ছোট বড় ছিলাম,আপা ছিলো আমাদের বংশের প্রথম কন্যা সন্তান।আপাকে আব্বা অনেক স্নেহ করতেন।আপাই যেনো আব্বার জীবনের সকল আশা ভরসা ছিলো।আমাদের গ্রামে সুন্দরী বলতে আপাই ছিলেন সবার শীর্ষে।

আপাকে নিয়ে আব্বার অনেক স্বপ্ন ছিলো, যেখানে পরিবারে ছেলেরা বেশি আদর পায় সেখানে আপাকে সবাই বেশি আদর করতো।আপা ছিলো হলুদ ফর্সা এজন্য অবশ্য এলাকার মহিলারা আপাকে হলুদ পাখি বলে ডাকতো।

আপা লেখা পড়াতেও ছিলো অত্যন্ত মেধাবী, আব্বার স্বপ্ন আপা জীবনে অনেক বড় কিছু হবে।আব্বা আপাকে ঢাকায় পাঠালেন পড়াশোনার জন্য।আমিও ঢাকায় থাকতাম।আপা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেলো আব্বা সারা গ্রামে সাত টা গরু জবাই দিয়ে লোক খাওয়ালেন।

আমি ইন্টার পাশ করে কমিশন্ড অফিসার হিসেবে আবেদন করেছি কেবল।হঠাৎ চিঠি মারফত আব্বা আমাকে গ্রামে যেতে বললেন,আপাকেও বললেন।
আমি আর আপা রাতের ট্রেন ধরে গ্রামে ফিরলাম।গিয়ে দেখি আব্বা তার বন্ধুর ছেলের সাথে আপার বিয়ের কথা বলছেন।ছেলে বিয়ের পর আপাকে বিদেশ নিয়ে চলে যাবে ওখানেই তার ব্যাবসা।ছেলে দেখতেও মাশাআল্লাহ।সবাই খুশি।
কিন্তু আমি আপার দিকে তাকিয়ে দেখি আপার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।
আমি রাতে সবাই ঘুমানোর পর আপার রুমে গেলাম
―আপা শুয়ে পড়েছিস?
আপার সাড়াশব্দ না পেয়ে রুমে ঢুকে দেখি বালিশে মুখ গুজে আপা কাঁদছে।কারন জানতে চাইলে আপা যা বলে তা শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে।

―কি বলছিস তুই এসব আপা?
―হ্যা নাফিজ আমি পালিয়ে বিয়ে করে ফেলেছি,বাবা জানলে অনেক কষ্ট পাবেরে বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন আপা।

আপা তার তিন বছরের সিনিয়র এক ছেলেকে বিয়ে করেছেন।
আপার কান্নায় আমার কষ্ট হচ্ছিলো, কিন্তু আব্বার মান সম্মান খোয়ানোর ভয়ে আমি সেই কষ্টও প্রকাশ করতে পারছিলাম না।

যেই ছেলেকে আপা বিয়ে করেছেন ছেলে প্রচুর মেধাবী ছিলো কিন্তু তখন সে ছিলো বেকার।আপাই তাকে চাপ দিয়েছিলো পালিয়ে বিয়ে করার।চাকরি পেলে তিনি যেনো আব্বার কাছে আপাকে চায়।
কিন্তু আব্বা এতো দ্রুত আপাকে তার পছন্দের ছেলের সাথে বিয়ে দিতে চাইবে এটা আপা স্বপ্নেও ভাবেনি।
আপা ভেবেছিলো আপার কোনো আবদার আব্বা আজ পর্যন্ত ফেলেনি,আপা যাকে ভালোবাসে তার কথা যেকোনো ভাবে আব্বাকে বলে আপা রাজি করাতে পারবে।

কিন্তু আপার সমস্ত ধারণাকে ভুল প্রমাণিত করে আব্বা রুমে প্রবেশ করে আপার উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন

―তোমার ব্যাগপত্র গুছিয়ে এবাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও তারিন।
আব্বার আকস্মিক আগমনে আমি আপা দুজনেই চমকে উঠে দিশাহীন হয়ে যাই।
আপা আব্বার পায়ে ধরে অনেক ক্ষমা চেয়ে কাকুতি মিনতি করে কাঁদলেন
কিন্তু আব্বার কঠিন ইস্পাতের মতো মন গললোনা।

আব্বা মাধুর্যহীন কণ্ঠে আরো বলেন,
―আমি আজ থেকে জানবো আমার মেয়ে মৃত,
কোনোদিন এবাড়ির ত্রি সীমানায় ঘেঁষতে পারবে না তুমি।আমার সকল স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি থেকেও তুমি বঞ্চিত।

আব্বাকে এমন কঠিন অবস্থায় আমরা সেই দিন ই প্রথম দেখেছিলাম।আম্মা গত হয়েছিলেন আপা যখন ক্লাস নাইনে পড়ে তখন।ক্যানসার নামক ব্যাধি আম্মার সবকিছু গ্রাস করে ফেলেছিলো।আপার পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ ছিলো না সেদিন।

আপাকে বের হয়ে যেতে বলে আব্বা ঘরে খিল দিলেন।
আমি ভোর রাত্রের দিকে আপাকে নিয়ে ঢাকায় রওনা দিলাম,আপাকে হলে পৌঁছে দিয়ে আবার বাড়ি ফিরলাম।আব্বার হাতে পায়ে ধরে হলেও যেনো আব্বাকে নরম করতে পারি।

―তুমি যদি তোমার বোনের হয়ে এখানে দালালি করতে এসে থাকো তাহলে তুমাকে ও সবকিছু থেকে বঞ্চিত করা হবে।
আব্বার হুমকিতে আমি ভয় পেয়ে গেলাম,চাকরি নেই,বয়স ও কম মাত্র আঠারো,আব্বা সবকিছু থেকে সত্যি ই মুখ ফিরিয়ে নিলে কোথায় যাবো?
আর্মিতে চান্স পেলাম ,সবকিছু ভালোই চলছিলো।আপার সাথে আমার যোগাযোগ অব্যাহত ছিলো।কিন্তু গ্রামে গেলে কথা বলতে পারতাম না।
আমি যখন সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট তখন আপা একদিন ক্যান্টনমেন্ট এ এলেন কিছু ফল আর মিষ্টি নিয়ে।সেদিন আমি আপাকে অনেক খুশি দেখে ছিলাম
―তুই মামা হতে চলেছিস আর তোর দুলাভাই এখন একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।কথাটা বলতেই আপা কেঁদে দিলেন,খুব কাঁদলেন।আমিও কাঁদতে দিলাম,কাঁদলে মন হালকা হয়।

আপাকে আশ্বস্ত করলাম যেই ভাবেই হোক আব্বাকে রাজি করাবো যাতে আপাকে মেনে নেয়।

শীতের শেষে দুই মাসের ছুটি নিয়ে গ্রামে গেলাম,গিয়ে ব্যাগ পত্র রেখেই আব্বার পায়ে পরে গেলাম
―আপনি নানা হবেন আব্বা,আপাকে ওই নিষ্পাপ বাচ্চার উছিলায় মাফ করে দেন।
সেদিনও আব্বা আমাকে ভুল প্রমাণ করে উঠে গেলেন।

খুজ নিয়ে জেনেছিলাম আব্বার বন্ধু আপাকে কেন্দ্র করে আব্বাকে অনেক অপমান আর নোংরা কথা শুনিয়ে ছিলেন।আমার নরম আব্বা এক নিমিষেই পাথরে পরিণত হলো।

আপার কোল আলো করে নামিরা এলো,নামিরা দেখতে ঠিক হুবুহু আপার কার্বন কপি।
আমি মনে আবার আশার আলো জ্বালালাম।এবার হয়তো আব্বা মানবে।

আপা, দুলাভাই আর দেড় মাসের ছোট নামিরাকে নিয়ে রওনা হলাম মিহিপুর গ্রামে।এবার আমি একশ ভাগ নিশ্চিত আব্বা নামিরাকে দেখে ফিরাতে পারবেন না।

হাসি মুখে গাড়ি থেকে নেমে ভ্যানে করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলাম,বাড়ির কাছে আসতেই দেখি মানুষের জটলা।মনটা কু ডাক ডেকে উঠলো।অজানা ভয়ে কলিজায় মোচড় দিলো।
ছোট নামিরা হঠাৎই কেঁদে উঠলো।কোনো ভাবেই আপা সেই কান্না থামাতে পারছে না।
জটলা ভেদ করে গিয়ে দেখি আব্বা ইহজগতের মায়া ত্যাগ করেছে।মোবাইলের বহু ব্যাবহার না থাকায় কেউ আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি আব্বা গত হবার খবর ও দিতে পারেনি।বাড়িতে আব্বার দেখাশোনা কারী আলীম জানায় সকালে আব্বাকে নামাজের জন্য ডাকতে আসলে আব্বার সাড়া শব্দ না পেয়ে বাড়ির আরো মানুষের সহযোগীতায় আলীম দরজা ভেঙে আব্বাকে মৃত অবস্থায় উদ্ধার করে।

সেদিন আপার কান্না দেখে কে? গ্রামের মানুষ আপাকে যা নয় তাই বলে অপমান করলেন।এমনকি আব্বার মৃত্যুর দায় ও আপার উপর চাপিয়ে দিলেন।সেদিন আপা আর নিজেকে ক্ষমা করতে পারলেন না। আব্বার দাফন কাজ শেষ হতেই সেই যে আপা ঢাকা ফিরলেন আর কোনো দিন কোনো আত্মীয়ের সাথে যোগাযোগ কিংবা গ্রামে পর্যন্ত বেড়াতে এলেন না।

তনুজাকে যখন বিয়ে করি খুব আশা নিয়ে আপাকে আনতে গেলাম।আপা খুশি হলেন আমার বিয়ের কথা শুনে,কিন্তু কোনো ভাবেই এলেন না।আপা ততোদিনে নিজেকে অপয়া,খুনি হিসেবে বরণ করে নিয়েছিলেন।
আপার কিছু গহনা আমাকে দিয়ে বললেন এগুলো তোর বউয়ের জন্য আমার পক্ষ থেকে উপহার।মুহিত তখন আপার পেটে।
সেদিন মন খারাপ করে চলে এলাম,মুহিত,মুকিত দুনিয়ায় এলো আর আপা নিজেকে আস্তে আস্তে আড়ালে নিয়ে গেলো, আপা আর আমার সাথে বেশি যোগাযোগ করতেন না।মাঝে মাঝে সুখ স্বর্গের খবর নিতেন।কিন্তু দুলাভাইয়ের সাথে আমার সকল যোগাযোগ অব্যাহত ছিলো।লোকটি খুবই সৎ আর ভালো মানুষ
ছিলেন।

একদিন আপা খুব খুশি আর উচ্ছসিত হয়ে ফোন করলেন যে,মুহিত মিলিটারি একাডেমিতে চান্স পেয়েছে,সেদিন আপার খুশি দেখে কে?
তখন টুকটাক কথা বলা শুরু করলো আবার,ছেলে মেয়েদের সাফল্যে হয়তো আপা পূর্বের কষ্ট গুলো একটু ভুলতে বসেছিলেন।

কিন্তু তনুজার সাথে কথা বলতে বললেই আপা এটা সেটা বলে ফোন রেখে দিতেন।আর বলতেন উনার কথা কাউকে না বলতে।উনার ইচ্ছে ছিলো সব কিছু ঠিকঠাক থাকলে একদিন হুট করে আমার বাসায় এসে সবাইকে চমকে দিবেন।

আপা একদিন হুট করে ফোন করে বললেন তোর দুলাভাই কেমন মন মরা হয়ে থাকে তোর সাথে যেহেতু অনেক ফ্রি ,জিজ্ঞেস করে দেখিস তো কি হয়েছে উনার?

সময় করে আপার বাড়িতে গেলাম,দুলাভাইকে চেপে ধরতেই দুলাভাই হুহু করে কেঁদে দিলেন।আমি হতবাক হয়ে গেলাম
দুলাভাই একজন শক্ত মনের মানুষ উনি এভাবে কেন কাঁদবে?

―নাফিজ আমার লাইফ হেল হয়ে যাচ্ছে ওই আহমেদ খান আর আসলাম চৌধুরীর জন্য।
সবিস্তারে ঘটনা জানতে চাইলে দুলাভাই যা বললেন তাতে গায়ের লোমকূপ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে গেলো।

―কোনো এক অজ্ঞাত ব্যাক্তির কল পেয়ে আমি আশরাফ চৌধুরীর পণ্যবাহী কার্গো রাস্তায় আটকাই, সাথে আরো পুলিশ অফিসার ছিলো।
গাড়ির ড্রাইভার পুলিশের সামনেই আমাকে বন্দুক তাক করেছে,পুলিশ সাময়িক ভাবে তাদের আটক করে , আমি গাড়ির তালা খুলি।খুলে শুধু বাইশ তেইশ বছরের কিশোরীকে অজ্ঞান অবস্থায় পাই।এই নিয়ে কিছু বলতে যাবো―

হঠাৎই ডিউটি অফিসার এর ফোনে কল আসে,তার সাথে কি কথা হয়েছে আমি জানিনা।জি স্যার বলে সে কল কেটে ড্রাইভার গুলো কে ছেড়ে দেয় এমনকি মেয়ে গুলোকে পর্যন্ত উদ্ধার করে না।

আমি অনেক চেষ্টা করেছি,আদালতে কেস ফাইল ও করেছি,সামনের মাসে কোর্টে যেতে হবে সাক্ষী দিতে।যেই পুলিশ অফিসার ওখানে উপস্থিত ছিলো তাকে এক রাতের ব্যাবধানে অন্য থানায় ট্রান্সফার করা হয়েছে।সে সাক্ষী দিতেও অনাগ্রহী।

আমাকে কেউ একজন দিনে রাতে ফোনে কেস না তুললে খু*ন করে দেবে সেই হুমকি দিয়েই যাচ্ছে।এই অবস্থায় কি করতে পারি?

―আপনি চাইলে আমি হেল্প করবো,আমার টিম মেম্বার নিয়ে তদন্ত করে অপরাধী কে শাস্তি দেব।আপনি ভয় পাবেন না দুলাভাই।

দুলাভাই কে আশ্বস্ত করে সেদিন আপাকে কিছু না বলেই বেরিয়ে এলাম।
এক সপ্তাহ পর দুলাভাই জানালেন নামিরার বিয়ে,আংটি বদল হবে আমাকে যেতে।কিন্তু ওইদিন আর্মি হেড কোয়ার্টার এ মিটিং থাকায় আমি যেতে পারিনি।

দুলাভাই দুদিন পর আবার আমাকে যেতে বললেন,গিয়ে দেখি মুহিত বাড়িতে।মুহিত ,নামিরা,মুকিত শুরু থেকেই জানতো আমি তাদের মামা।কিন্তু তোমাদের চিনতো না।কারন ওদের সাথে তোমাদের কখনো দেখাই হয়নি।শুধু জানতো ওদের ছোট মামাতো ভাই বোন আছে।অনেক দিন পর আমার দেখা পেয়ে তিন ভাই বোন আমার উপর আনন্দে হামলে পড়লো,কিন্তু দুলাভাই কেন ডেকেছে সেই চিন্তায় ওদের ভালোবাসা বিনিময় না করেই দুলাভাই এর রুমে গেলাম।

দুলাভাই আমার হাত ধরে অনুরোধ করে বললেন
– শুনেছি তনুজার ভাইয়েরা অস্ট্রেলিয়া তে থাকে,আমার মেয়ে আর মেয়ের জামাই এর একটা ব্যাবস্থা করে দাও নাফিজ।ওরা আমার মেয়ে ,মেয়ের জামাইকেও পেলে মেরে ফেলবে।ওরা বলেছে কাউকে বাঁচতে দেবেনা।
ভাবলাম দুলাভাই অযথাই হয়তো ভয় পাচ্ছে।মানুষ মানুষকে মে*রে ফেলবে এতো সহজ কথা নাকি?

দুলাভাই এর মিনতিতে তনুজার বড় ভাই সাঈম এর সহযোগিতায় সোহাগের সকল কাগজ পত্র সিডনি সেন্ট্রাল ইউনিভার্সিটি তে পাঠালাম,সাঈম ও ওই ভার্সিটির ম্যাথম্যাটিক্স লেকচারার।
সাইমের কঠিন চেষ্টায় সপ্তাহের ব্যাবধানেই সোহাগের জব হলো ওই ভার্সিটিতে।
যেই বিয়ে ধুমধামের সহিত হবার কথা ছিলো ,দুলাভাই তা দ্রুত ঘরোয়া ভাবে শেষ করলেন।
কাউকে নিমন্ত্রণ করলেন না।আমারও আর পরিবার নিয়ে যাওয়া হলো না।

এর মধ্যে দুলাভাই এর ফোনে হুমকি জনক কলে ভরে গিয়েছে।

মুহিত কে দুলাভাই কিছুই জানালেন না, আমাকেও কঠিন নিষেধ দিলেন।আপা তো আব্বার জন্য আগেই নিজেকে অপয়া,অলক্ষী অপবাদ দিয়ে বসে আছেন,
আপা যাতে আর কোনো চিন্তা মাথায় না নেন সেজন্য দুলাভাই আপার কাছেও সব চেপে গেলেন।

চৌকষ মুহিত কিছুটা হয়তো আঁচ করতে পেরেছিলো।

এজন্য দুলাভাই মুহিতকেও দ্রুত ক্যান্টনমেন্ট এ পাঠিয়ে দেন।

সোহাগের ভিসা হলো,টিকিট এলো,দুলাভাই আমার সহায়তায় আর্মি জিপ দিয়ে ওদের এয়ারপোর্ট পাঠালেন।নিজেও গেলেন না আপাকেও যেতে দিলেন না।মুকিত অনেক কাঁদলো ,হাত পা ছুড়ে ছুড়ে কাঁদলো নামিরার সাথে এয়ারপোর্ট যাবে বলে।তবুও সেদিন দুলাভাই আদরের মুকিতের আবদার রাখতে পারেন নি।

অসহায় নামিরা জানতেও পারেনি সেদিন কেনো এতো দ্রুত তাদের দেশ ছাড়া করা হচ্ছে।

মুকিত কে তোমরা দেখোনি, এতো খানি সুন্দর একটা বাচ্চা ,আপার ওখানে গেলেই মামা,মামা করে পাগল করে ফেলতো বলেই নাফিজ মাহমুদ কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

তনুজা নাফিজ মাহমুদ এর পাশে বসে তাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন।

স্বর্গের পুরো পৃথিবী যেনো দুলে উঠলো।তার মনে হচ্ছে তার পায়ের তলায় মাটি নেই,সে শূন্যে ভাসছে।

কান্না মুছে নাফিজ মাহমুদ আবার বলতে শুরু করলেন

যেদিন কোর্টে দুলাভাই এর স্বাক্ষী হবে তার আগের দিন দুলাভাই আমাকে ফোন করলেন।তিনি আপাকে নিয়ে আমার বাসায় আসছেন।আপা আর মুকিত আমার বাসায় থাকবে।কখন রওনা হবেন সেটাও আমাকে জানালেন।

আমি দ্রুত ডিউটি শেষ করে রাত আটটা নাগাদ দুলাভাই কে ফোন করলাম,দুলাভাই ফোন তুললেন না।আপাকে কল দিলাম আপাও তুললো না।ভয়ে বুকে কাঁপন ধরলো আমার।
ইউনিফর্ম না পাল্টেই দুজন সোলজার নিয়ে আপার বাসার উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়লাম।

যেতে যেতে আপার বাসা পর্যন্ত গেলাম,যেই বাসার বাইরে পর্যন্ত বাতি জ্বালানো থাকে প্রতিদিন, সেই বাসাটা আজকে ভুতের বাড়ি লাগছে,এদিকে মুহিত বারবার আমাকে কল করে যাচ্ছে আমি তুলতে পারছি না।

সোলজার দুটোকে নিয়ে টর্চ জ্বালিয়ে আপার বাসার গেট পার হলাম,আঙিনায় এসে দেখি মেইন দরজা খোলা,ভয়ে আমি দৌড়ে রুমে ঢুকতে নিলে পিচ্ছিল কিছুর সাথে স্লিপ খেয়ে পরে যাই।
কেউ ইচ্ছে করেই বৈদ্যুতিক লাইন কেটে দিয়েছিলো যার জন্য হাজার বার সুইচ টিপেও বাতি জ্বালানো যাচ্ছিলো না।

টর্চের আলো ফেলে আমি দেখি দুলাভাই কে কে যেনো মনের ঝাল মিটিয়ে কু*পি*য়ে*ছে।সারা ফ্লোর লাল র*ক্তে ভেসে গিয়েছে।

আর মুকিত !
মুকিতের মুখে সাদা স্কচটেপ মারা ছিলো, ওকে শ্বাসরুদ্ধ করে হ*ত্যা করা হয়েছে।ধবধবে সাদা ফর্সা মুকিত কুচকুচে কালো হয়ে সোফার চিপায় বিলীন হয়ে পরে আছে।

আমি এসব দেখে দিশেহারা হয়ে যখন আপাকে খুঁজি,আপা কোথাও ছিলেন না।আমার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়।

আমি পুলিশে কল করি,দেড় ঘন্টা পার হলেও পুলিশ আসে না।ততক্ষনে মুহিত আর্মি জিপ নিয়ে কুমিল্লা থেকে ঢাকা আসে।
এসেই দৌড়ে রুমে আসে।আর মুকিত মুকিত করে চিল্লিয়ে উঠে।

আমাকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে মুহিত।

দুই ঘন্টা পর পুলিশ এসে বাসার কারেন্ট এর লাইন ঠিক করে। আপাকে আমরা বাথরুমে বাথ টাবের ভেতর পাই।ঠান্ডা পানিতে হাত পা বেধে,মুখে টেপ লাগিয়ে ডুবিয়ে রাখা হয়েছিলো আপাকে।আপার শরীর ততক্ষনে ফ্যাকাশে বর্ন ধারণ করেছে।
আপাকে দ্রুত হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয় ।

মুকিত আর দুলাভাইয়ের লা*শ পুলিশ নিয়ে যায় পোস্ট মর্টেম করতে।

মুহিতের কাছে জানতে পারি মুহিত আর মুকিত ভিডিও কলে কথা বলছিলো ।দুলাভাই আর মুকিত বসে আপার জন্য অপেক্ষা করছিলো।আপা জীবনে প্রথম আমার বাসায় আসবে বলে মনের মতো করে রেডি হচ্ছিলেন।হঠাৎই কারেন্ট চলে যাওয়ায় লাইন কেটে যায়।মুহিত আবার অডিও কল করে -সেটা মুকিত কেবলই রিসিভ করেছে

―হ্যালো বলার আগেই কয়েকজন কালো কাপড় পরিহিত এবং চোখ মুখ ঢাকা আগন্তুক বাসায় প্রবেশ করে।বাসার কেউ তাদের চেহারা দেখতে পায়নি।

দুলাভাই চকিতেই প্রশ্ন করে
―কে ওখানে?

ভরাট কন্ঠে কেউ বিদঘুটে হাসতে হাসতে উত্তর দিলো
–পুরোনো লেনদেন পরিশোধ করতে এলাম আদনান সাহেব।কতো করে বললাম সাক্ষী দিলে প্রাণবায়ু বাঁচবে না।শুনলে না তো?এবার তাহলে চড়া দাম চুকাও বলেই এলোপাতাড়ি কো*পা*নো শুরু করে।

মুকিত পাপা বলে চিল্লিয়ে কাঁদতে থাকে মুহিত পুরোটাই ফোনে শুনেছে।

মুহিত পাগলের মতো লাইনে থেকে শুধু প্রশ্ন করেই যাচ্ছে মুকিত ,মুকিত?
―কি হয়েছে ওখানে?কে পাপাকে মারছে?

―ভাইয়া পাপাকে কেউ মে*রে ফেলছে।আমার ভয় লাগছে বাঁচাও ভাইয়া।ভাইয়া!ভাইয়া!পাপা!

এরপর মুকিতের উম উম করা আওয়াজ পাওয়া গিয়েছে আর কোনো শব্দ পাওয়া যায়নি।আর লাইনটা কেটে গিয়েছে।মুহিত বারবার ফোন করে লাইন বন্ধ পেয়েছে।

মুহিত দ্রুত দৌড়ে তার ডিউটি অফিসারের কাছে সব ঘটনা খুলে বলে জিপ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।কিন্তু শেষ রক্ষা করতে পারেনি।পারেনি দুলাভাই আর মুকিত কে বাঁচাতে।

এরপর আপাকে চিকিৎসা করে প্রাণে বাঁচানো গেলেও স্বাভাবিক জীবনে আর ফেরানো যায় নি।

আপা হুঁশে ফিরলে শুধু মুকিত মুকিত করে কেঁদে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।এভাবেই চলছে আপার ছয় বছর ধরে জীবন যুদ্ধ।আর মুহিতের কাঠিন্যতার ভান।যেই মুহিত আগে হাসি দুস্টুমিতে হট্রগোল করে সারা বাড়ি মাতাতে সেই মুহিত এখন সময়ের ব্যাবধানে পরিস্থিতির চাপে হয়ে গেছে নিশ্চুপ,গম্ভীর,রাগী।

মুহিত কে ঢাকা ট্রান্সফার করাতে আমার বহুত কাট খড় পোড়াতে হয়েছে।মুহিত দুলাভাই এর ডেইলি রাইটিং ডায়েরি এর সন্ধান পায়।সেখানে দুলাভাইয়ের হাতের লিখা ছিলো আমার পরিচিত বা রক্তের যাকে পাবে তাকেই শেষ করে দেবে।
সেই ভয় থেকে মুহিত সব কিছু চেপে গেছে,আর মুহিত চায়না ডিপার্টমেন্ট আমার দিকে আঙ্গুল তুলুক যে―
মামা মেজর জেনারেল বলে ভাগিনা সুযোগ লুটছে।

―মুহিত যখন আমাকে মামা না বলে ,স্যার বলে ,আপনি বলে সম্বোধন করে তখন এই বুকে কেমন চিনচিনে ব্যাথা হয় তনুজা আমি তোমাকে বলে বুঝাতে পারবো না

#চলবে।

তোমার জন্য সিন্ধুর নীল পর্ব-০৫

0

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_৫
#সারিকা_হোসাইন

―হেই মিস নাম না জানা অপ্সরা তুমি এখানে?আর তোমায় আমি কোথায় কোথায় খুঁজে চলেছি।

অপরিচিত কন্ঠে তুমি সম্বোধন শুনে ভ্রু কুঁচকে ফোন টেপা বাদ দিয়ে উপরে মুখ তুলে তাকালো স্বর্গ।
সেই অসভ্য ছেলেটা আবার এখানে?
উফ আর বাঁচা গেলো না।

―কি বিড়বিড় করছো এমন করে?

―আপনি কি আমার আত্মীয়?আমাকে চেনেন?আমি কি আপনাকে চিনি?

এক বাক্যে কতোগুলো প্রশ্ন করে দম ফেললো স্বর্গ।

-আরেহ রিল্যাক্স এতো হাইপার কেনো হচ্ছো ?

―হাইপার তো করছেন আপনি আমাকে।চেনেন না জানেন না একটা মেয়েকে সারাক্ষন দৃষ্টিতে দৃষ্টিতে রাখছেন আবার তুমি তুমি করছেন।একটা মেয়ের জন্য এটা কতোটা আনকম্ফোর্টেবল এটা আপনি বুঝেন?

―ওহ এই কথা? আচ্ছা’ পরিচিত হয়ে নিচ্ছি

―হ্যালো আম আহিয়ান চৌধুরী আহির, ওনার অফ চৌধুরী গ্রুপস এন্ড কোং কোম্পানির মালিকের এক মাত্র ছেলে।যাকে সবাই এক নামে চেনে কিন্তু তুমি ,ওপস সরি আপনি চেনেন না।
বলে স্বর্গের দিকে হাত বাড়ালো আহিয়ান।

হেই আম মেজর মুহিত ওয়াসিফ ,নাইস টু মিট ইউ।
আকস্মিক ভরাট গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠ আর হাত চেপে ধরায় আহাম্মক হয়ে গেলো আহিয়ান।

―আমি তো আপনার সাথে পরিচিত হতে চাইনি মেজর মুহিত ওয়াসিফ?

―আপনি যার দিকে হাত বাড়িয়েছেন আমি তার পার্সোনাল বডিগার্ড, উনার বাবা মানে মেজর জেনারেল নাফিজ মাহমুদ আমাকে নির্দেশ দিয়েছে একটা ফুল ও যাতে উনাকে স্পর্শ করতে না পারে তাহলে আমি একটা আস্ত মানুষের হাতের স্পর্শ কিভাবে পেতে দেই মিস্টার আহিয়ান?

―তাচ্ছিল্য ভরা হাসি দিয়ে আহিয়ান বলে উঠলো
―হাহ, হাসালেন মেজর হাসালেন, যখন আপনার স্যার জানবে হাত টা আমার ছিলো ,উনি নিজেই উনার মেয়ের হাত আমার হাতের সাথে স্পর্শ করিয়ে দিবেন।

― মুহিত ফিচেল হেসে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো
―তাহলে আপনি সেই স্বপ্ন দেখতে থাকুন আহিয়ান সাহেব।

এতোক্ষন চুপচাপ সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিলো স্বর্গ,হঠাৎ সে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো আমি মাম্মার কাছে যাবো মেজর।

―সিউর হুয়াই নট ?বলে সামনের দিকে হাত ইশারায় নির্দেশ করলো মুহিত।

আমাদের আবার দেখা হবে আহিয়ান চৌধুরী,আসি ।
বলে দুই আঙুল দিয়ে সালামের মতো করলো মুহিত।

মুহিত দের যাবার পানে তাকিয়ে কিটকিটিয়ে হেসে উঠে আহিয়ান।

―দেখা তো করতেই হবে মেজর,মুখের সামনে থেকে খাবার তুলে নিয়ে গেলে,দেখা না হলে এমন দুঃসাহসিকতার দাম কিভাবে দেবে?

―আপনি মিথ্যে বললেন কেনো মেজর?আপনি কি আমার বডিগার্ড?

―শুধু বডিগার্ড নয় মিস স্বর্গ আপনার সব কিছুর গার্ড আমি।
এই বলে একটা শপিং ব্যাগ এগিয়ে দিলো মুহিত।

―এখানে আপনি যেই টাইপের কাপড় পড়েন সব আছে,চেঞ্জ করে নিন আমি আপনাদের খাওয়াদাওয়া শেষ হলে বাসায় পৌঁছে দেব।স্যার এখান থেকে একটা মিটিংয়ে চলে যাবেন,উনার সাথে আপনাদের দেখা হবে না।সো প্লিজ একটু হারি করে সব কিছু করবেন ।

শপিং ব্যাগ হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে দাঁড়িয়ে আছে স্বর্গ এক অদ্ভুত ভালো লাগায় ছেয়ে যাচ্ছে তনু মন।পড়াশোনার তাগিদে বহু ছেলে ফ্রেন্ডস,ক্লাসমেটস এর সংস্পর্শে আসা হয়েছে কিন্তু কখনো মনে এমন ভালোলাগার ফিল হয়নি।তবে কেনো মেজর মুহিত কাছে এলে শরীর শিরশির করে,বুকে ধুকপুকুনি হয়?কি নাম এই অনুভূতির?

নিমিষেই সকল ভাবনা বন্ধ করে ঝটপট পোশাক পাল্টে নিলো স্বর্গ।ফ্লোরাল প্রিন্টের অফ হোয়াইট লং স্কার্ট,সাথে ম্যাচিং শার্ট আর স্কার্ফ।চয়েস আছে বলতে হবে মেজরের বলে মুচকি হাসলো স্বর্গ।

মুহিত কপালে বার বার আঙ্গুল স্লাইড করছে,আহিয়ান কে সে ভুলতে পারছে না কোনো ভাবেই।মুহিত খুব ভালো করেই আহিয়ান কে চেনে।নিজের রূপের জ্বালে ,টাকা পয়সা অভিজাত্যের লোভ দেখিয়ে ভালোবাসার নাটক করে মেয়েদের ফাঁসিয়ে বাইরে পাচার করে দেয়াই তার কাজ।কিন্তু সমাজে তার বাবা আর তার মতো সম্মানিত ব্যাক্তি দ্বিতীয়টি নেই।

গোপন সূত্রে শুধু এসব খবর পাওয়াই গিয়েছে কিন্তু পোক্ত প্রমাণের অভাবে কেউ আহিয়ান এর দিকে আঙ্গুল তুলতে পারেনি।তার বাবার নাম ডাকে প্রশাসন পর্যন্ত ভয়ে কাপে।সেখানে মুহিত সামান্য একজন মেজর হয়ে প্রমান ব্যাতিত কিভাবে তাকে জব্দ করবে?

এই নরঘাতক স্বর্গের মতো নিষ্পাপ একটি মেয়ের দিকে হাত বাড়িয়েছে, মুহিত কিভাবে সামাল দিবে সবকিছু?নাহ আর ভাবতে পারছে না মুহিত,অস্থির লাগছে।যেভাবেই হোক নাফিজ মাহমুদ কে সব জানাতে হবে,চুপ থাকা যাবে না।

খুব বেশি কি দেরি হয়ে গেলো মেজর?

স্বর্গের ডাকে হুশ ফিরলো মুহিতের।
পিছন ফিরে নিজের পছন্দের মানুষের সাজসজ্জা হীন স্নিগ্ধ মুখ দেখে নিজের মনকে শান্ত করলো মুহিত।মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো এমন অপরূপ সৌন্দর্য্যের দর্শন করানোর জন্য।

―আপনাকে সদ্য প্রস্ফুটিত ভোরের শিশির মিশ্রিত বেলি ফুলের মতো লাগছে স্বর্গ।

লজ্জায় মাথা নিচু করে দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরলো স্বর্গ।

―চলুন দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে মুহিত সামনে পা বাড়ালো।

কোয়ার্টারের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মুহিতের জলপাই রঙা মিলিটারি জিপ।গেট কিপার খলিলকে আশেপাশে কোথাও দেখা যাচ্ছে না।এতো রাতে দুজন মেয়ে মানুষকে গাড়িতে বসিয়ে অপেক্ষা করাতে রাগে মাথার শিরা ফেটে যাচ্ছে মুহিতের।

সুখ বিয়ের ভেন্যু থেকেই মিলিটারি একাডেমিতে ফিরে গিয়েছে,জরুরি দরকারে।
বার দশেক কল করার পর কোথা থেকে যেনো খলিলের আগমন ঘটলো।
―ইদানিং এই খলিল কে ব্যাপক সন্দেহ হয় মুহিতের।একটু নজরদারিতে রাখতে হবে ব্যাটাকে।

তনুজা মাহমুদের সামনে কোনো সিনক্রিয়েট করতে চাইলো না মুহিত।

তাই কোনো প্রশ্ন না করে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলে গেলো মেজর জেনারেল এর বাংলো তে।

তাদের কে বাসায় নামিয়ে আবারো গাড়ি হাকালো মুহিত।
গন্তব্য গোপন আস্তানা।

কানে ব্লুটুথ ইয়ার প্যাড লাগিয়ে নিলো মুহিত,ডায়াল প্যাড থেকে কল করলো সৌম্য কে
~হ্যালো ক্যাপ্টেন কি খবর ওখানের?

―স্যার কেলানি খেয়েও কিছু বলছে না

―ঠিক আছে আধ ঘন্টার মধ্যে আসছি আমি।বলে লাইন কেটে দিলো।

শহর থেকে একটু দূরে পরিত্যক্ত একটি বিল্ডিং।দিনের বেলাতেও ভুতের ভয়ে এই গলি কেউ মাড়ায় না।মানুষের ভ্রান্ত ধারণা এখানে ভুত প্রেত রয়েছে।যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর মানুষ নাকি সাধারণ মানুষ কে এখানে ধরে ধরে এনে নৃশংস ভাবে হত্যা করতো। আশেপাশের মানুষ নাকি এখনো তাদের চিৎকার চেঁচামেচি করার আওয়াজ পায়।এসব ভ্রান্ত ধারণাকে পথে ঠেলে সেই বাড়িটাকেই নিজেদের গোপন আস্তানা বা মুখোশ পরা জানোয়ারদের জন্য টর্চার সেল বানিয়েছে মুহিত।

উহু শুধু মুহিত বললে ভুল হবে।কিছু সৎ আর্মি অফিসাররা মিলে।যারা ক্ষমতার দাপটে অন্যায় করেও প্রশাসন কে ঘুষ দিয়ে বুক ফুলিয়ে হাওয়া খেয়ে অপকর্ম করে বেড়ায় তাদের জন্য কিছু অফিসার মিলে গোপনে এই সেল বানিয়েছে।সরকার বা আইন ছেড়ে দিলেও গোপনে তারা তাদের প্রাপ্য শাস্তি দিয়ে দেয়।

অজ্ঞাত এক ব্যাক্তিকে চেয়ারে বসিয়ে শক্ত দড়ির সাহায্যে হাত পা মুড়ে বাধা হয়েছে।মুখে স্কচটেপ।সৌম্য যে তাকে তথ্য বের করতে বেদম প্রহার করেছে তা তার দেহ জুড়ে প্রকাশিত।
লোকটির সামনে হাটু মুড়ে বসলো মুহিত

―পানি দাও সৌম্য।

সৌম্য স্টীলের একটি মগে করে পানি এনে মুহিতের হাতে দিলো,মুহিত পানি নিয়ে সাথে সাথেই ছুড়ে মারলো অজ্ঞাত ব্যাক্তির মুখে।লোকটি নড়ে উঠলো এবং অল্প কিছুক্ষনের মধ্যেই হুঁশে ফিরলো।

এক টানে মুখের টেপ খুলে ফেললো মুহিত।
সাথে সাথেই লোকটি ব্যাথায় ককিয়ে চিল্লিয়ে কান্না জুড়ে দিলো

―আমাকে ছেড়ে দিন স্যার আমাকে ছেড়ে দিন।আমি কিচ্ছু করি নি,আমি কিচ্ছু জানিনা।

–এখনো তো আমি তোকে কোনো প্রশ্নই করিনি এতোই তাড়া তোর বলে হাত পায়ের দড়ি গুলো চাকু দিয়ে কেটে দিলো মুহিত।

ধমকের সুরে মুহিত হুংকার করলো ― উঠে দাঁড়া.
লোকটি ভয়ে ভয়ে দাঁড়াতে নিলে পায়ের ব্যাথায় ফ্লোরে ধপ করে বসে পরে।

কেমন ডোজ দিয়েছো ক্যাপ্টেন দাঁড়াতেই পারছে না?

―সৌম্য কাচুমাচু করে বললো হকি স্টিক টা ভেঙে গেছে স্যার।

সৌম্য কে পিঠ চাপড়ে সাবাস জানালো মুহিত।
এরপর চোখ গরম করে রক্ত চক্ষু নিয়ে দাঁত পিষিয়ে বলে উঠলো

―আমাকে কেনো ফলো করেছিস সেদিন রাতে?

–আমি কিচ্ছু জানিনা স্যার,আমাকে শুধু বলা হয়েছে আপনার ছবি দেখিয়ে ফলো করতে।আপনার প্রতিনিয়ত চলাফেরার আপডেট জানাতে।
―কিন্তু কে বা কারা আমি কিচ্ছু জানিনা স্যার আমি তাদের চেহারা দেখিনি বলে হাটু মুড়ে মুহিতের পায়ের কাছে বসে কান্না জুড়লো লোকটি।
ঘরে আমার অসুস্থ স্ত্রী,
―যিনি আপনার ছবি দেখিয়েছে সে বলেছে আমি আপনার তথ্য জোগাড় করে তাদের দিতে পারলে আমাকে অনেক টাকা দিবে।আমি টাকার লোভে এমন করেছি স্যার।আমাকে মারবেন না।আমাকে মারলে আমার স্ত্রী বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে।

লোকটির মুখে এসব আকুতি ভরা কথা শুনে মুকিতের অসহায় মায়াবী মুখ টা মনে পড়ে গেলো মুহিতের।মুকিত ও কি এভাবে আকুতি করেছিলো।নাহ মুহিত আর কিছু মনে করতে চায়না।এসব ঘটনা মনে রেখে কতোদিন আর এভাবে জিন্দা লাশ হয়ে বেঁচে থাকবে,?

পাশে থাকা ভাঙা একটি বেঞ্চে জোরসে লাথি মেরে সৌম্যকে ডেকে বলে―
ওকে ছেড়ে দাও আর নজরদারি তে রাখো।

আর তোকে কেনো ছেড়ে দিলাম জানিস?
তুই এখন আমার কাছে আলাদিনের দৈত্য।তোকে দিয়ে আমি আমার বাকি না হওয়া কাজ উদ্ধার করবো -বলে ঝড়ের গতিতে ধপাধপ পা ফেলে বেরিয়ে আসে মুহিত।

ক্যান্টিনে বসে লাঞ্চ সাড়ছে পিউ আর স্বর্গ। কাটা চামচ দিয়ে চাউমিন প্যাচাতে প্যাচাতে পিউ স্বর্গকে জিজ্ঞেস করলো ক্যাপ্টেন সৌম্য কে চিনিস?
―ঐযে লম্বা ফর্সা হ্যাঙলা মেজরের বডিগার্ড টা?
―এভাবে বলিস না দোস্ত
―তাহলে কিভাবে বলবো?আচ্ছা যা ভালো ভাবে বলছি
মেজর মুহিতের সাথে সারাক্ষন চিপকে থাকে যেই ক্যাপ্টেন সে?
পিউ মিনমিন করে বলে উঠে” হ্যা”

স্বর্গ কৌতূহলী হয়ে জানতে চায় ওই ক্যাপ্টেন এর সাথে তোর কি কাজ?

―আই থিংক আই এম ইন লাভ উইথ হিম!বলে মাথা নিচু করে ফেললো পিউ।

সফট ড্রিংকস টা কেবলই এক চুমুক দিয়েছে স্বর্গ,পিউয়ের কথা তা নাকে মুখে বিষমের উদ্রেক করলো।

সাট সাট বলে পিউ স্বর্গের পিঠে হালকা চাপড় দিলো।
স্বর্গ নিজেকে স্বাভাবিক করে রিল্যাক্স হয়ে জিজ্ঞেস করলো― কবে থেকে?

―পিউ দাঁত কেলিয়ে বললো যেদিন প্রথম তোর চেম্বারে দেখেছি সেদিন থেকেই।

তলে তলে এসব চলছে তাহলে ?এই জন্যই সময় পেলেই সিএমএইচ এ আসা?

ঠিক এজন্য না আবার এজন্যই বলতে পারিস।আরেকটা কথা তোকে বলতে ভুলে গেছি,বলে চাউমিন চিবুতে চিবুতে বললো পিউ

―তুই কি জানিস মেজর মুহিতের মা যে এই হসপিটাল এ দীর্ঘদিন ধরে ভর্তি?রিসেন্টলি উনার হার্টে সার্জারি হয়েছে,আইসিইউতে আছে,যদিও কন্ডিশন ক্রিটিক্যাল কিন্তু প্রফেসর বলেছে রিকভার করবে।

―তুই এতো খবর কিভাবে জানিস? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো স্বর্গ।
আরো একটা কথা জানি,কিন্তু সত্যতা কতোখানি সেটা বলতে পারবো না
―কি কথা?
―চার পাশে সন্তপর্নে চোখ বুলিয়ে পিউ ফিসফিস করে বলে উঠলো
―মেজর এর পুরো ফ্যামিলি কে কেউ খু*ন করে দিয়েছে!

কথাটি শোনা মাত্র স্বর্গের হাতে থাকা কাটা চামচ ফ্লোরে পরে ঝনঝন শব্দে আলোড়ন সৃষ্টি করলো
চোখের কোনে জমা হলো জল।
―যিনি সারাক্ষন এমন গম্ভীর হয়ে থাকেন,শক্ত মনের খোলস পরে থাকেন,যাকে দেখলেই মনে হয় অহংকারী একটা লোক, তার মনে এমন দগদগে ঘা ?
কারো উপরের আবরণ দেখে কি ভেতরের স্বত্বার খবর অনুধাবন করা যায়?

স্বর্গ কাঁপা কাঁপা কন্ঠে পিউকে জিজ্ঞেস করলো
―মেজর মুহিতের মায়ের কেবিন নম্বর কতো?
―পিউ উত্তর দিলো
―রুম নম্বর চার শত চল্লিশ!

#চলবে।

তোমার জন্য সিন্ধুর নীল পর্ব-০৪

0

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#চতুর্থাংশ
#সারিকা_হোসাইন

মেজর মুহিত!আপনি এখানে?

পিছন থেকে সুমিষ্ট মেয়েলি সুরটি কার হতে পারে তা ভাবতে ন্যানো সেকেন্ড সময় ও লাগলো না মুহিতের।
পিছন ফিরে মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে উঠলো―

-জী ডাক্তার সাহেবা, আমি এখানে আপনার সামনে।চাইলে আমার চুল টেনে গলা টিপে ধরতে পারেন।

লজ্জায় চোখ নামিয়ে নিলো স্বর্গ,

লজ্জায় অবনত মুখশ্রী দেখে মুহিতের নিজেকে নেশাখোর মনে হচ্ছে।কি আছে এই মায়াবী চেহারায়?

আমি আপনাকে কিন্তু অলরেডি সরি বলেছি মেজর,তা নাটক না করে এখানে কেনো এসেছেন জানতে পারি?

একটা কাজ ছিলো,

~তো কাজটি কি শেষ?

মুহিত মাথা ঝাকিয়ে নরম সুরে বললো আপাতত শেষ।

_তা মিস গুন্ডি সরি স্বর্গ আপনার ইউনিফর্ম কোথায়?

―ডিউটি আওয়ার শেষ বাড়ি যাবো।

―চলুন একসাথে যাওয়া যাক বলে মুহিত সামনের দিকে সম্মানের সহিত হাত ইশারা দিলো।

―দাঁড়ান একমিনিট মেজর!
যাবো আর আসবো বলেই ফুরুৎ করে দৌড় লাগালো স্বর্গ।

স্বর্গের পরনে জিন্স কালারের রোমপার্স সাথে হাফ হাতা হোয়াইট টিশার্ট,পায়ে স্নিকার্স,সাথে পনিটেইল স্টাইলে বাধা চুল,চোখে সামান্য কাজল ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপিস্টিক মুহিতের বুকে কাঁপন ধরালো।

স্বর্গ যাওয়ার পর মুহিত দুই হাত দিয়ে বুক চেপে ধরে ওয়েটিং চেয়ারে বসে পড়লো আর বলে উঠলো হৃদয় হরিণী একটা।

মিনিট পাঁচেক পরেই ফিরে এলো স্বর্গ।
―কি ব্যাপার মেজর আপনাকে এমন বিধস্ত লাগছে কেনো বুকে ব্যাথা হচ্ছে?স্বর্গ দুই হাতে দুটো ঠান্ডা জুসের কাপ নিয়ে মুহিতের দিকে ভ্রু কুঁচকে উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

স্বর্গের কথা শ্রবণ ইন্দ্রিয় তে প্রবেশ করা মাত্র ধুম করে দাঁড়িয়ে পড়লো মুহিত।

―না মিস স্বর্গ। আসলে ,কেউ আমাকে খুন করতে চাচ্ছে।

স্বর্গ ভয় পেয়ে জিজ্ঞেস করলো ফিসফিসিয়ে―

-কে খুন করতে চাইছে মেজর?আপনি তাকে চিনতে পেরেছেন?ডিপার্টমেন্ট জানে?

―চিনতে পেরেছি,কিন্তু আমি খুন হতে চাই মিস স্বর্গ।তাই ডিপার্টমেন্ট কে জানাইনি।

এবার স্বর্গ বুঝতে পারলো মুহিত তার সাথে মজা নিচ্ছে,তাই সে মুখ ফুলিয়ে বললো

―আমাকে বোকা বানালেন মেজর মুহিত ওয়াসিফ?
এর শোধ আমি তুলবো।বলে জুসের কাপ এগিয়ে বলে উঠলো নিন ঠান্ডা জুস পান করুন বাইরে অনেক গরম।

-জুস হাতে নিতে নিতে মুহিত স্বর্গের দিকে তাকিয়ে বলে বসলো
―আমি চাই আপনি আমার উপর শোধ তুলুন মিস স্বর্গ কথাটি বলে স্বর্গের চোখে চোখ রাখলো।
কতোক্ষণ তাদের দৃষ্টি বিনিময় হলো কে জানে ধ্যান ভাঙলো ক্যাপ্টেন সৌম্যের ডাকে।

―স্যার জিপ নিয়ে এসেছি হেড কোয়ার্টার এ যেতে হবে বোর্ড মিটিং আছে।
সৌম্যের উপস্থিতিতে ইতঃস্ততায়
দুজনেই দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে কাচুমাচু করে কেউ কাউকে বিদায় না জানিয়ে দ্রুত প্রস্থান নিলো।


হুইস্কির বোতল থেকে কেবলই নিজের পছন্দ মতো এক প্যাগ গ্লাসে ঢেলেছে লেফটেন্যান্ট কর্নেল নাসের হায়দার,চুমুক দেয়ার আগেই টেবিলে রাখা ফোনটি কাঁপতে শুরু করলো।
অসময়ে যখন তখন ফোন আসা নাসের এর পছন্দ নয়।বিরক্তিতে চোখ উপরের দিকে উল্টিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে ফোনটি হাতে নিলো।স্ক্রিনে জানা পরিচিত রাঘব বোয়ালের নম্বর দেখে মুখের সমস্ত দাঁত বের হয়ে এলো খুশিতে।

~হ্যালো―

―ওদিকের খবর কি লেফটেন্যান্ট?
গোপন সূত্রে জানতে পেরেছি কোনো এক মেজর আমার খুব নজরদারি করছে।মেজর কে একটু ঘোল খাওয়ালে কেমন হয় বলোতো?

―তোমার যা ভালো মনে হয় আহমেদ,কিন্তু তুমি কি তার নাগাল এতো সহজে পাবে ?মেজর কিন্তু সাধারণ কোনো মেজর নয়।যেমন চৌকষ তেমন কার্য উদ্ধারকারী। পুরো ডিপার্টমেন্ট তার সাথে আছে। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পর্যন্ত তাকে বেশ সমীহ করে চলে।

― শুনো লেফটেন্যান্ট!
তোমার দায়িত্ব আমাকে খবর সাপ্লাই দেয়া, আমি কিভাবে কি করবো সেটা নিয়ে তুমার না ভাবলেও চলবে।
রাখছি বলেই কল টা কেটে দিলো।

নাসের এর মাঝে মাঝে মনে চায় এক শুটে আহমেদ এর বুক ঝাঁজরা করতে,ব্যাটা নিজেকে মহা পন্ডিত ভাবে। যা খুশি তাই বলে ফেলতে দ্বিধা করে না।শালা খুনি একটা।

কিন্তু টাকার লোভে শত অপমান সহ্য করেও দাঁত কামড়ে পরে আছে নাসের।

বাংলাদেশ আর্মি হেড কোয়াটার্স এ বোর্ড মিটিং বসেছে।আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে আহমেদ খান নামের এক ব্যাক্তি যিনি প্রচুর অর্থ ,কোটি কোটি টাকার হীরা,আর মানুষের বিভিন্ন অর্গান পাচারের কাজ রীতিমতো করে যাচ্ছে।কোনো পুলিশ র‌্যাব,বিডিআর এমনকি আর্মির কয়েকটি ইউনিট মিলেও কিছু করতে পারছে না।কেনো করতে পারছে না?এই ব্যার্থতা আসলে কার এই নিয়ে মিটিং।মিটিংয়ে উপস্থিত রয়েছেন ক্যাপ্টেন সৌম্য শাহরিয়ার, মেজর মুহিত ওয়াসিফ,লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেজবাহ সিরাজী,কর্নেল তাজ মাহমুদ,ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান ফারুকী, মেজর জেনারেল নাফিজ মাহমুদ সহ লেফটেন্যান্ট জেনারেল এবং জেনারেল।

তারা কিছুদিন আগে একটা গোপন খবরের মাধ্যমে জানতে পেরেছে আহমেদ খান কোথায় আছেন বর্তমানে এবং এটাও জেনেছেন ক্যান্টনমেন্ট এর কোনো বড় অফিসার এখানকার সকল খবর আহমেদ খান এর কাছে পৌঁছায়।এজন্য প্রতিবার আটঘাট বেঁধে প্ল্যানিং করলেও লাভের ফলাফল শূন্য।তাই আজকের মিটিংয়ে শুধু তাদের ই ডাকা হয়েছে যারা তাদের ইউনিফর্ম আর নীতির সাথে কখনো বেইমানি করেনি,এবং ভবিষ্যতেও করবে না।যাদের উপর দেশের দায়িত্ব অর্পণের এতো গুলো বছর পরেও অভিযোগের কোনো আঙ্গুল উঠেনি।

কিরে এমন দৌড়ে বাসায় ফিরলি কেনো?আর ফিরেছিস যখন পোশাক না পাল্টে হাতমুখ না ধুয়ে মরার মতো পরে আছিস কেনো?সেই দুপুরে বাসায় এলি এখন বাজে বিকেল পাঁচটা,দুপুরের খাবার ও খেলি না কিছু হয়েছে মা?

মায়ের প্রশ্নে স্বর্গ কি উত্তর দেবে ভেবে না পেয়ে বলে ফেললো হিসু চেপে ছিলো মাম্মা তাই দৌড়ে উপরে চলে এসেছি।

―তাই জন্য ভাত ও খাবিনা?

―ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম এজন্য যাইনি

কিন্তু আমি তো তোর রুম থেকে ঝাপাঝাঁপির শব্দ পাচ্ছিলাম,কি হয়েছে সত্যি বল।

―ধুর কিচ্ছু হয়নি ,যাওতো এখন কথা বলতে ইচ্ছে করছে না।

―তোমার মেয়ে প্রেমে পড়েছে মা!।

ভাইয়ের আকস্মিক এমন বেহায়া কথায় চেতে উঠলো স্বর্গ।

-এখনই তোকে ছাদ থেকে ফেলে দেবো ফাজিল ছেলে!একজন ক্যাডেট অফিসার হয়ে ট্রেনিং কমপ্লিট না করে ঘরে বসে বসে কি করিস তুই? বাপীর নাম ভাঙিয়ে যখন খুশি তখন বাসায় চলে আসিস।বেয়াদব!

স্বর্গ কে খেপিয়ে দিয়ে মায়ের পিছনে লুকালো সুখ,

―তোমার মেয়ে প্রেমে পড়েছে মা !দেখো ওর গাল লাল হয়ে রয়েছে লজ্জায়।

তুমিই বলো ও এমনি এমনি লজ্জা কেনো পাবে?

-মাম্মা তোমার ছেলেকে কিন্তু সত্যিই এখন খু*ন করে ফেলবো আমি ।
বলেই বেড সাইড টেবিল থেকে ফুলদানি হাতে নিলো স্বর্গ।
ভয়ে মিসেস তনুজা আর সুখ আস্তে করে দরজা ভিড়িয়ে চলে গেলো।
পাগল ক্ষেপেছে, ইয়ে আম সাকসেস।
বলে সুখ হাত মুষ্ঠি করে ভিক্টরি সাইন দিলো।

― বিছানায় ধপ করে চার হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে পরলো স্বর্গ।এর পর আবার বসে পরলো।হাটু ভাঁজ করে হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে উঠলো ―
―কে বলেছে তোকে স্বর্গ ,ওই মেজরের দিকে এমন ড্যাব ড্যাব করে তাকাতে?ওই লোক যেই চূড়ান্ত বজ্জাত আর ঠোঁট কাটা
তোকে তো লজ্জায় চুবিয়ে মারবে।

―ধুর আর ভুলেও সামনে পারবোনা ওই সর্বনাশা মেজরের বলেই ওয়াশরুমে ফ্রেস হতে চলে গেলো স্বর্গ।

-তুমি কি কখনো প্রেমে পরেছো ক্যাপ্টেন সৌম্য?
আকাশ থেকে পড়ার ভান করে সৌম্য বলে উঠলো―
প্রেম?আর আমি?

―কী যে বলেন স্যার,ইন্টার পাশ করে লং কোর্সে ক্যাডেট অফিসার হলাম,যেখানে সিটি পাস ছাড়া বাইরেই বের হওয়া যায়না,ট্রেনিং নিলাম লেফটেন্যান্ট হলাম এর পর থেকে তো জীবনের রং ই বদলে গেছে।খালি মিশন ,এক্সাম,মিশন ,এক্সাম।এখন আবার ক্যাপ্টেন হয়ে তো মাঝ দরিয়ায় পড়েছি।বাথরুমে যাবার সময় পর্যন্ত পাচ্ছিনা স্যার।

―আপনার মতো মেজর হয়ে গেলে প্রেম না ডিরেক্ট বিয়ে করে টানা ছয় মাসের জন্য গুম হবো বউ নিয়ে।

―এখন তো সারাক্ষন আপনার সাথে থাকি কোনো লেডি অফিসার,নার্স,ডক্টর ,লেডি সোলজার কেউ আপনার ভয়ে সামনে আসে না।প্রেমটা কিভাবে হবে স্যার?

সৌম্য ঠিকই বলেছে ডিউটি আওয়ারে অহেতুক আলাপচারিতা বা কোনো ক্যাপ্টেন,লেফটেন্যান্ট ,বা সোলজার,কোনো লেডি অফিসার,লেডি সোলজার এর সাথে কথা বলা মুহিত একদম এলাউ করে না।

মুহিত মনে করে তারা দেশ এবং দেশের মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছে।এখানে ডিউটি ফেলে কারো সাথে হাসি ঠাট্রা করে দুই মিনিট কথা বললেই বিরাট লস।তাই পানিশমেন্ট এর ভয়ে মেজরের সামনে এসব করার সুযোগ হয় না।আর ক্যান্টনমেন্ট এর বাহিরে যাওয়া হয় খুবই কম তাও বিশেষ প্রয়োজনে।প্রেমটা তাহলে হবে কিভাবে?

―কেনো স্যার হঠাৎ প্রেমের কথা কেনো বললেন?

সৌম্যের প্রশ্নে গলা খাকরি দিয়ে মিথ্যে কথার ডালা সাজালো মুহিত
―প্রেম করলে এটার অজুহাতে তোমাকে কঠিন পানিশমেন্ট দিতাম আরকি সেজন্য ।
সৌম্য কে নাটক করার সুযোগ না দিয়ে কন্ঠে অর্ডারের সুরে গাম্ভীর্য নিয়ে বলে উঠলো―
চলো সৌম্য তোমার জন্য আজ রাতে কঠিন ডিউটি আছে বলে রওনা দিলো মুহিত।

□■■অস্ট্রেলিয়া, সিডনি
ঘড়ির কাটায় সময় সকাল নয়টা বেজে বিশ মিনিট যা বাংলাদেশের সময় অনুযায়ী ভোর পাঁচটা।নামিরা ছয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা।সোহাগ ভার্সিটিতে যেতে নিলেই নামিরা এমন কান্না জুড়ে দেয়।সোহাগ সিডনি ইউনিভার্সিটির একজন লেকচারার।নামিরার এমন কান্নার জন্য প্রায়শই তার লেট হয়ে যায়।নামিরার কান্নার কারন প্রতিদিন একটাই নিঃসঙ্গতা।সোহাগ জানে নামিরা কেনো কাঁদে এভাবে প্রতিদিন।
কিন্তু সোহাগ নিরুপায়, ক্ষমতা থাকলে সে সব আগের মতো করে ফেলতো, সোহাগ তো সবসময় চেয়েছে নামিরা ফুলের মতো হাসুক,খেলুক।কোনো দুঃখ যেনো নামিরাকে স্পর্শ করতে না পারে।
―তাহলে সোহাগের মনের সব চাওয়া গুলো কেনো এক নিমিষে পাশার গুটির মতো উল্টে গেলো?
আচ্ছা যদি টাইম ট্রাভেল নামের সত্যিই কিছু থাকতো সোহাগ কি আগেভাগেই সকল দুর্ঘটনা এড়িয়ে নামিরা কে স্বাভাবিক সুন্দর একটি জীবন গড়ে দিতে পারতো?

কি হয়েছিলো ছয় বছর আগে?কেনো নিমিষেই সব বিভীষিকাময় হয়ে উঠলো?ঘটনা গুলো না ঘটলে নামিরা সোহাগ,মুহিত,সবার জীবনের মোড় হতো ভিন্ন।এমন হৃদয় বিদারক ঘটনা ঘটে যাওয়ার কি খুব দরকার ছিলো?
–নাহ আর ভাবতে পারছে না সোহাগ,নিজের চোখের জল কোনো রকম সামলে নামিরা কে হেল্পিং হ্যান্ডের কাছে বুঝিয়ে ভার্সিটিতে যাবার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো ।

হাই মিস পিউ!কোন ড্রেস টি নিবেন ডিসাইড করতে পারছেন না?
সৌম্যের অতর্কিত আগমনে চমকে উঠে পিউ।বুকে থুথু লাগিয়ে বলে ওঠে
―আপনি কি ভুত নাকি !ক্যাপ্টেন?

―ওমা ভুত হবো কেন?শপিং এ এসেছি, শপিং করতে করতে দেখলাম আপনি গালে হাত দিয়ে বসে আছেন।আরেকটু এগিয়ে এসে দেখি সামনে ড্রেসের পসরা সাজিয়েছেন।

এতো গুলো ড্রেস একসাথে দেখলে আপনি কখনোই একটি সুন্দর ড্রেস কিনতে পারবেন না মিস পিউনাজ।

সৌম্যের এমন আদুরে ডাকে পিউ আইসক্রিম এর মতো গলে গিয়ে বিড়াল ছানার মতো দুই হাত থুতনির নীচে গুটিয়ে কিউট ফেস বানিয়ে বলে উঠলো

-তাহলে আপনি একটা সিলেক্ট করে দিন ক্যাপেটন।

সৌম্য অভিজ্ঞের ন্যায় দোকানী কে এটা দেখান ওটা দেখান বলে দুটো ড্রেস সিলেক্ট করলো।কাকতলীয় ভাবে দুটো ড্রেস ই পিউ এর পছন্দ হলো,একটি মেরুন রঙের অন্যটি ল্যাভেন্ডার ।

সৌম্য পিউকে উদ্দেশ্য করে আকুতি ভরা কন্ঠে বললো―

―পিউনাজ ড্রেস গুলো আপনাকে সুন্দর মানাবে,কিন্তু অনুরোধ থাকবে এগুলো আপনি কোনো ছেলের সামনে পরবেন না।
কেউ আপনাকে মুগ্ধ হয়ে দেখলে আমার অনেক খারাপ লাগবে বলেই দ্রুত হাঁটা দিলো সৌম্য।

মুচকি হেসে ড্রেস গুলোর বিল মিটিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো পিউ।

ঢাকা সেনা নিবাসের সেনাকুঞ্জের কমিউনিটি সেন্টারটি ফুলে ফুলে সজ্জিত।চার পাশে বিভিন্ন ধরনের লাইটিং,ক্যান্ডেল নিয়ন বাতি সেট করে।আকাশে গুড় গুড় শব্দে ফুটছে বাজি।আজকের সন্ধ্যাটা যেনো মোহনীয় রূপ ধারণ করেছে।বড় বড় সামরিক বাহিনীর অফিসার রা তাদের পরিবার নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন।ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান ফারুকীর মেয়ের বিয়ে বলে কথা।কোনো কিছুর কমতি নেই। সবার সাথে বিয়েতে উপস্থিত হয়েছেন নাফিজ মাহমুদ ও তার পরিবার।

মুহিত আর সৌম্য ড্রেস কোড মিলিয়ে ব্ল্যাক সুটপরেছে,সাথে সাদা শার্ট।হাতে ব্র্যান্ডেড স্মার্ট ওয়াচ,কালো বেল্ট ,কালো শো।চুল গুলো জেল দিয়ে সেট করা।তারা দুজনেই কানে লাগিয়ে নিলো ব্লুটুথ ডিভাইস।তারা আজ বিয়ে খেতে নয় গোয়েন্দাগিরি করতে যাচ্ছে।

সৌম্য ,মুহিত আর একজন নবাগত মেজর দাঁড়িয়ে কাজের ব্যাপারে কথা বলছেন এমন সময় মুহিতের নজর গেলো বেবি পিংক লেহেঙ্গা পরিহিত মেয়েটির পানে।আজকে সে সেজেছে,ড্রেসের সাথে স্টাইল করে চুল বেঁধেছে,ঠোঁটে গাঢ় রঙের লিপস্টিক, কানে ঝুলানো বড় বড় দুল, মাথায় ছোট টিকলি,হাতে রিনঝিন চুরি,আহ এই বুঝি হার্ট এট্যাক এসে যায়।মেয়েটা সত্যিই স্বর্গ।দেখলেই শান্তি লাগে মনে।
উফ ডাক্তারনী বুঝি আমাকে খুন করেই ক্ষান্ত হবে।

কিন্তু পরক্ষণেই মুহিত খেয়াল করলো স্বর্গ ভালোভাবে হাটতে পারছে না,সে কাউকে খুঁজছে এমন মনে হলো মুহিতের।
মুহিত মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় মেজর ফাহিম আর ক্যাপ্টেন সৌম্য কে ফেলে চলে যায় স্বর্গের কাছে।

কিছু হয়েছে স্বর্গ?
মেজরের মুখে নিজের এমন আদুরে নাম শুনে থমকে দাঁড়ালো স্বর্গ।পাশে ফিরে মেজর মুহিত কে দেখে লজ্জায় রক্তিম হলো স্বর্গের দু কান আর গাল।
মিনমিন করে স্বর্গ বললো―

―নাহ মেজর মুহিত, আমি ঠিক আছি, বলে ক্যাবলাকান্তের মতো দাঁত বের করে হে হে করে হেসে উঠলো।
কিন্তু মুহিত ছেড়ে দেবার পাত্র নয় তার জানতেই হবে স্বর্গের কি কোনো প্রবলেম হয়েছে?যদিও এটা অনধিকার চর্চা,তার ব্যাক্তিত্বের সাথে এসব যায়না।তবুও কেন জানি তার নির্লজ্জ্ব হতে ইচ্ছে করছে এই মেয়েটার সামনে।

আপনি নির্ধিদ্বায় বলতে পারেন আমাকে স্বর্গ আমি আমার বেস্ট চেষ্টা করবো ।
স্বর্গ নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বললো

―আসলে মেজর আমি এই ড্রেস টা পরে হাটতেই পারছি না।লেহেঙ্গা টা অনেক ভারী,তার মধ্যে এতো গরম অনেক কষ্ট হচ্ছে আমার বলেই মাথা নিচু করে ফেললো।
তার মধ্যে একটি ছেলে আমাকে এমন ভাবে ফলো করছে আমি তার দৃষ্টির আড়াল হতে এদিক সেদিক ছুটাছুটি করতে করতে কাহিল হয়ে গেছি।
কোনো ছেলে স্বর্গকে ডিস্টার্ব করছে কথাটি শুনতেই চোয়াল শক্ত হয়ে হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো মুহিতের।
― গমগমে রাগ মিশ্রিত ভারী কন্ঠে বলে উঠলো―
-দেখিয়ে দিতে পারবেন কোন ছেলে এমন অসভ্যতামি করার চেষ্টা করছে?
সামনের কপালের বেবি হেয়ার গুলো ঠিক করতে করতে স্বর্গ বললো ―
যেই ছেলেটা ড্রেস কোড ফলো না করে ডিপ ব্রাউন স্যুট পড়েছে সেই ছেলেটা।
মুহিত আর কিছু না বলে সামনের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো

―মিস স্বর্গ আসুন আমার সাথে,বলে মুহিত হল রুমের দিকে হাঁটা দিলো।
স্বর্গ দুই হাতে লেহেঙ্গা উঁচু করে ধরে মুহিতের পিছনে ছুটলো আর মনে মনে তার গুণধর ভাই সুখের পিন্ডি চটকালো।
বেয়াদব একটা,দরকার ছাড়া আঠার মতো চিপকে থাকবে কিন্তু দরকারে হারিকেন জ্বালিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

এখানে বসুন স্বর্গ বলে কর্নারের একটি সোফা স্বর্গকে নির্দেশ করলো মুহিত।
কোথা থেকে যেনো একজন সোলজার কে ডেকে এনে দায়িত্ব দিলো যে,মুহিত ফিরে না আসা পর্যন্ত এক পা ও না নড়তে।সোলজার বাধ্য বাচ্চার মতো সায় জানিয়ে বডি গার্ডের পোজ নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো স্বর্গের পাশে।

মুহিতের এমন অস্থিরতা স্বর্গের মনে হিম শীতল বাতাস প্রবাহিত করলো।
এটা কি ভালোলাগা নাকি মেজর জেনারেল এর মেয়ে বলে দায়িত্ব পালন করা নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলো স্বর্গ।
কিন্তু মন থেকে যা উত্তর এলো তাতে ঠোঁটে সূক্ষ হাসি ফুটে উঠলো স্বর্গের।
#চলবে।