Thursday, July 31, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 150



তোমার জন্য সিন্ধুর নীল পর্ব-৩৩

0

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_৩৩
#সারিকা_হোসাইন®

★★★★
সেনাকুঞ্জ,ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট

সূর্য দিগন্তে হারিয়ে গোধূলির রূপ ধারণ করেছে।উত্তরীয় হাওয়ায় সেনাকুঞ্জের সারিবদ্ধ সাইকাসের চিরল পাতা গুলো হেলেদুলে নড়ছে থেকে থেকে।
একটু অন্ধকার ছড়াতেই কনভেনশন সেন্টার সহ আশে পাশে জ্বলে উঠলো হরেক রঙের মরিচ বাতি।
কনভেনশন সেন্টার এর ভেতরে বড় বড় ঝাড়বাতি দিনের আলোর মতো দ্যুতি ছড়াচ্ছে।
সকল আত্মীয়স্বজন, বড় বড় আর্মি অফিসার এবং নব্য নির্বাচিত মন্ত্রীকে দাওয়াত করা হয়েছে এই স্বর্ণালী সন্ধ্যায়।

ছোট ছোট বাচ্চা গুলো এদিক সেদিক ছুটাছুটি করে গুছানো চেয়ার টেবিল গুলো বার বার এলোমেলো করে ফেলছে।

মুহিত বর বেশে তৈরি হয়ে চলে এসেছে অনেক আগেই।

স্বর্গের সাজ ই নাকি এখনো কমপ্লিট হয়নি তাই সে পৌঁছায় নি।

মুহিত আজ পড়েছে ডার্ক নেভি ব্লু রঙের “ক্লাস A” সিরেমনিয়াল ইউনিফর্ম।যার সাথে পরিধান করেছে এযাবৎ কালে তার অর্জিত সকল ব্যাজেস,মেডেল এবং বিভিন্ন ডেকোরাম জিনিস।
হাতে নেভি ফোর্স এর ব্ল্যাক ফিতার ঘড়ি।পায়ে কালো শো, মাথায় নিজের রেঙ্ক অনুযায়ী মিলিটারি পিকড ক্যাপ।

মুহিতের কলিগস,সৌম্য আদ্রিয়ান পড়েছে সেইম ড্রেস শুধু তারা হাতে পড়েছে সাদা হাত মোজা।
মুহিত পায়চারি করছে আর ভাবছে কখন স্বর্গ বধূবেশে তার সামনে এসে দাঁড়াবে আর মুহিত দুই চক্ষু ভরে সেই সৌন্দর্য সুধা উপভোগ করবে!

মুহিত বাইরে বেরিয়ে একটি বিশালাকার কৃষ্ণচূড়া ফুল গাছের নিচে এসে দাঁড়ালো।
মিনিট পাঁচেক পরেই স্বর্গের দামি গাড়িটি সেনাকুঞ্জের গেটের সামনে দেখা গেলো।
গাড়িটি ভেতরে ঢুকতেই মুহিতকে সামনে দেখে ড্রাইভার গাড়ি থামালো।
মুহিত দরজা খুলে হাত বাড়িয়ে দিলো স্বর্গের পানে।
স্বর্গ মুহিতের বাড়িয়ে দেয়া হাত শক্ত করে ধরে বেরিয়ে এলো গাড়ি থেকে।
নববধূর সাজে সজ্জিত স্বর্গকে দেখে মুখের ভাষা হারালো মুহিত।

মোটেও তার প্রিয়তমা কে কোনো সাধারণ মানবী ঠেকছে না।
প্রত্যেক প্রেমিক পুরুষের কাছে তার স্ত্রী হুর তুল্য।
বিয়ের সাজে মেয়েদের যেই সৌন্দর্য ফুটে উঠে সেই সৌন্দর্য আর কখনোই চোখে পড়েনা।
অন্যরকম এক মাধুর্য ভেসে উঠে সর্বাঙ্গে।

স্বর্গ মুহিতের কথা অনুযায়ী গায়ে জড়িয়েছে ধবধবে সাদা জামদানি যার জমিন,পাড় আর আঁচল সোনালী জরি সুতায় কাজ করা।সেই পাড়ের সাথে মিলিয়ে পড়েছে ব্রাইডাল ওড়না।সাথে ম্যাচিং বড় সিতা হার,চকার,কানের দুল ,টিকলি।
মুখে খুবই হালকা মেকআপের ছোয়া।চোখে সুরমা রঙা আইশ্যাডো পেলেটের নিখুঁত ছোয়া,গাঢ় মোটা করে দেয়া হয়েছে কালো কাজল।ঠোঁটে ন্যুড কালার এর লিপস্টিক।চুলগুলো সুন্দর করে খোঁপা করে তাতে দেয়া হয়েছে বেলিফুলের গাজরা।

মুহিত মুগ্ধ নয়নে স্বর্গকে খুটিয়ে দেখে বলো উঠলো

“খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে স্বর্গ।একদম স্বর্গের হুরদের মতো।
যদিও আমি হুর দেখিনি।কিন্তু পবিত্র কোরআনে তাদের বর্ননা রয়েছে।সেই বর্ননা অনুযায়ী তোমাকে হুর ই লাগছে”

স্বর্গ অমায়িক হাসলো।
মুহিত আদুরে স্বরে বলে উঠলো
“চলো সবাই অপেক্ষা করছে।
মুহিতের হাত ধরে স্বর্গ সিরামিক ইটের গাঁথুনি করা নিখুঁত রাস্তা দিয়ে এগিয়ে চললো কনভেনশন সেন্টার এর দিকে।

স্বর্গ আর মুহিত কে দেখে সকলেই দাঁড়িয়ে গেলো।
মুহিতের সহযোগী রা তাদের প্রত্যেকের হাতে থাকা তলোয়ার দিয়ে হবু নব দম্পতি কে সম্মান জানানোর উদ্দেশ্যে টানেল বানালো।
সেই টানেল এর ভেতর দিয়ে ধীর গতিতে মুহিতের কুনুই জড়িয়ে হেটে চললো স্বর্গ ।

টানেল পার হতেই মিসেস তারিন আর তনুজা স্বর্গকে ধরে স্টেজে তুলে সোফায় বসিয়ে দিলেন।
নাফিজ মাহমুদ মুহিত কে নিয়ে স্টেজে উঠলেন।
একটু পর কাজী এলো।

নাফিজ মাহমুদ মুহিত আর মিসেস তারিনকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো
“মেয়ে বিয়ে হয়ে স্বামী সংসারে চলে যাচ্ছে,আমার খারাপ লাগার কথা,আদরের মেয়ের বিদায়ে কান্না পাবার কথা”
কিন্তু তোমরা বিশ্বাস করো আমার একটুও খারাপ বা কষ্ট কিছুই লাগছে না।

“আমার চাইতেও মুহিত ওর ভালো খেয়াল রাখবে এটা আমার বিশ্বাস বলতে বলতেই কেঁদে ফেললেন নাফিজ মাহমুদ।

তনুজা আচলের সহিত নিজের চোখের জ্বল মুছে বলে উঠলো আমার মেয়েটাকে আপনাদের হাতে তুলে দিচ্ছি,ওর ভুল ত্রুটি গুলো নামিরা ভেবে ক্ষমা করে দিবেন।

সুখ, স্বর্গের সামনে এসে হাটু মুড়ে বসে স্বর্গের কোলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
স্বর্গ সুখের মাথায় হাত বুলিয়ে নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে ভেজা কন্ঠে বলে উঠলো
“আমি শশুর বাড়ী থেকে প্রতিদিন এসে এসে তোর সাথে মারামারি ঝগড়া সব করবো ।তুই শুধু দেখিস।

“চোখের জল মুছে সুখ বলে উঠলো
“আমি তোর ঝগড়া আর মার খাবার জন্য অপেক্ষা করবো আপুই।

মিসেস তারিন তনুজা আর নাফিজ কে শান্ত করে বললেন তোরা এভাবে কাঁদলে মেয়েটাও খুব কাঁদবে।
স্বর্গ যদি তোদের সাথেই থাকতে চায় থাকবে,দরকার পড়লে মুহিত মাঝে মাঝে এসে দেখা করে যাবে।

আর আমি কি আমার আম্মার কোনো অযত্ন অবহেলা করতে পারবো রে পাগল!

মুহিত বলে উঠলো
“স্যার আপনি কোনো চিন্তা করবেন না,আপনার মেয়েকে আমার সম্পর্কে কখনো কোনো অভিযোগ দেয়ার সুযোগ ও আমি দেবোনা।
আমি তাকে নিজের থেকেও বেশি যত্নে রাখবো।
ওয়াদা রইলো আপনার কাছে আমার।
মিসেস তারিন তাড়া দেখিয়ে বলে উঠলেন―

“চল বিয়েটা পড়িয়ে চার হাত এক করে দেই।সময় যে চলে যাচ্ছে।।গেস্ট দের খাবার খাইয়ে বিদেয় করতে হবে।
এখনো অনেক কাজ বাকী পড়ে আছে।”

সকলেই চোখের জল মুছে মুহিত কে আর স্বর্গকে বিয়ে পড়ানোর আসরে নিয়ে গেলো।

একটি সুন্দর কার্পেট বিছানো যার চারপাশে তাজা ফুলের বেড়া।সুগন্ধি ফুলের গন্ধে ম ম করছে চারিপাশ।
স্বর্গের পাশে বসে গেলো তার বান্ধবী রা আর মুহিতের পাশে তার সকল সহকর্মী, সৌম্য,মেজর আদ্রিয়ান।

মাঝখানে দেয়া হলো সাদা কার্টেন এর দেয়াল।

কাজী সকল পেপার্স রেডি করে মুহিতের দিকে এগিয়ে দিলো।
মুহিত বিসমিল্লাহ বলে ঘস ঘস করে সই করে বলে উঠলো
“আলহামদুলিল্লাহ কবুল”

মুহিতের সহকর্মীরা হাত তালি দিয়ে সমস্বরে বলে উঠলো
“আলহামদুলিল্লাহ।
এবার স্বর্গের পানে এগিয়ে দেয়া হলো খাতা কলম।

কলম হাতে নিতেই স্বর্গের চোখ বেয়ে অঝোরে বর্ষণ হতে লাগলো।
আজ থেকে সে অন্যের অধীনে চলে যাবে।বাবার বাড়িতে এর পর থেকে সে মেহমান হিসেবে গণ্য হবে।
মেয়ে থেকে মেহমান হওয়া একটি মেয়ের জন্য কতোটা কষ্টের তা কেবল সেই মেয়েটি ই জানে।
যদিও স্বামী হিসেবে মুহিতের জুড়ি মেলা ভার।

পিউ স্বর্গকে পিঠে হাত বুলিয়ে রিল্যাক্স করে বললো
“দেরি হয়ে যাচ্ছে
প্লিজ সই টা করে দে।
কাঁপা কাঁপা হাতে স্বর্গ সই করে ভেজা রিনরিনে কন্ঠে জবাব দিলো

“আলহামদুলিল্লাহ, কবুল।

সমস্বরে সবাই আনন্দ উল্লাস এ চিৎকার করে উঠলো।
তুলে দেয়া হলো সামনের কার্টেন।
স্বর্গের হাতে চুমু খেয়ে হাত ধরে টেনে দাঁড় করালো মুহিত।

নব্য তরুণ আর্মি অফিসার রা বিভিন্ন নাচ গান করছে।মেয়েরাও সাথে পাল্লা দিয়ে অংশগ্রহণ করছে।
কোনো ঝামেলা ছাড়াই আনন্দ বেদনা মিলিয়ে শেষ হয়ে গেলো মুহিত আর স্বর্গের বিয়ের অনুষ্ঠান।

মুহিত আর স্বর্গকে গাড়িতে তুলে দেবার সময় নাফিজ মাহমুদ মুহিতের হাত জড়িয়ে বাচ্চাদের মতো কেঁদে উঠলেন।

“মুহিত তুমি দেখেছো আমি কিভাবে ওদের বড় করেছি,আমার মেয়েটা দিনে দিনে বড্ড অবুঝ হয়ে যাচ্ছে।আমি তোমাকে অনুরোধ করে বলছি কখনো ওকে বকা দিয়ে কিছু বলো না।ওর মনটা খুব নরম।
তুমি একটু বুঝিয়ে বললেই ও বুঝে যাবে।
তনুজা স্বর্গকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠলেন।
আজ থেকে ঘুম ভাঙলেই তিনি আর তার মেয়েকে দেখতে পাবেন না।
খাবার টেবিলের চেয়ার টা ফাঁকা পরে থাকবে।
কেউ আর বলবে না মাম্মা তাড়াতাড়ি খাবার দাও দেরি হয়ে যাচ্ছে।

স্বর্গ তনুজা আর সুখ কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে যাচ্ছে।
সকলের কান্না দেখে মুহিতের ও চোখে পানি চলে আসলো।
মেজর আদ্রিয়ান আর সৌম্য নাফিজ মাহমুদ কে বুঝিয়ে শান্ত করলেন।
নামিরা আর পিউ তনুজা কে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
মিসেস তারিন সুখ কে বলল
“আব্বা তুমি চলো ফুপির সাথে,স্বর্গের ভালো লাগবে।
সুখ চোখের জল মুছে মিসেস তারিনের গাড়িতে গিয়ে উঠলো।

প্রথমে গাড়িতে করে বড় বড় আর্মি অফিসার রা বেরিয়ে গেলো।
এর পর মিসেস তারিনের গাড়ি বেরিয়ে গেলো।
মুহিত আর স্বর্গের গাড়ি স্টার্ট দিলো সৌম্য।

মেজর আদ্রিয়ান নাফিজ মাহমুদ আর তনুজাকে সেনা নিবাস পৌঁছে দিবে বলে গাড়িতে উঠতে বললো।

ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে গেলো সেনাকুঞ্জ।

――――
ঘড়িতে রাত বারোটা বেজে ছিঁচল্লিশ মিনিট।
স্বর্গ তার গহনা খুলে একে একে শাড়ির পিন খুলছে।
খুট করে খুলে গেলো দরজা।
মুহিত কক্ষে প্রবেশ করলো।

মুহিত স্বর্গের কানের কাছে গিয়ে মাদকতা মিশ্রিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো

“আমি হেল্প করবো?”

স্বর্গ মুখ টিপে হেসে লাজুক ভঙ্গিতে বললো
“লাগবে না তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো।”

মুহিত ড্রেস চেঞ্জ করে টাওয়েল নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো।

স্বর্গ কোনো মতে শাড়ি চেঞ্জ করে একটা টিশার্ট আর লোজ প্লাজু প্যান্ট পরে নিজের ব্যাগ খুললো।

এক এক করে নিজের সকল জিনিস বের করে কাবার্ড খুললো।
খুলেই শব্দ করে হেসে উঠলো।

কাবার্ড এর একটা সাইড এর পুরোটা খালি
সেখানে বড় বড় করে মোটা কাগজে লিখা
“এখানে আমার বউয়ের জিনিস থাকবে।”

স্বর্গ বলে উঠলো” পাগল একটা”.

বলে আস্তে আস্তে সব গোছালো।
মিনিট পনেরো পরেই মুহিত বেরিয়ে এলো।
স্বর্গ মুহিতের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিললো

মুহিত হাটু সমান সাদা একটি টাওয়েল পরেই বের হয়ে গিয়েছে।
তার ধবধবে ফর্সা শরীরে পানির ফোটা গুলো চকচকে হিরের মতো লাগছে।কপালে লেপ্টে আছে কিছু চুল যাদের আগায় শিশিরের মতো বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে।
হাত দিয়ে চুলগুলো এলোমেলো করে দিতে খুব ইচ্ছে করছে স্বর্গের।

ভাবনার মাঝে কখন যে মুহিত তার একদম কাছে চলে এসেছে সে টেরই পায়নি।
মুহিত নেশাক্ত কন্ঠে ডেকে উঠলো
“স্বর্গ!”

স্বর্গের ধ্যান ভাঙতেই মুহিত চুমু খেতে মুখ বাড়িয়ে দিলো স্বর্গের ঠোঁটের দিকে।
স্বর্গ মুহিত কে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে হাতে থাকা মেরুন রঙের সুতি শাড়ি আর টাওয়েল নিয়ে ওয়াশরুমে দৌড়ে পালালো।

মুহিত চিল্লিয়ে বলে উঠলো
“একটু পরে এই বন্ধ ঘরে আমার কাছেই আসতে হবে।কোথাও পালাতে পারবে না সুন্দরী।
বলেই হু হা হা করে ভিলেনের মতো হেসে উঠলো।

মেকআপ ক্লিন করে,সেটিং স্প্রে করা চুলের জট ছাড়িয়ে ভালো ভাবে শাওয়ার নিয়ে আধ ঘন্টা পর ওয়াশরুম থেকে বের হলো।

ইতোমধ্যে নামিরা একটা ট্রেতে করে কিছু ফলমূল আর গ্লাসে করে দুধ দিয়ে গিয়েছে।সাথে দুটো জায়নামাজ।

স্বর্গ বের হতেই মুহিত বললো ওযু করে এসো আমি অপেক্ষা করছি নামাজ আদায় করতে হবে।

বাধ্য মেয়ের মতো স্বর্গ ওযু করে এসে মুহিতের পিছে দাঁড়ালো।

দুই রাকাত সালাত আদায় করে নিজেদের দাম্পত্য জীবন যাতে ঝামেলা মুক্ত,সুখের হয়, সেই দোয়া করলো।
মুহিত রাব্বুল আলামিনের দরবারে হাত তুলে বললো
“মৃত্যুর দিন পর্যন্ত যেনো স্বর্গ তার থেকে কোনো আঘাত না পায়,মুহিত কে নিয়ে স্বর্গ যাতে কোনো অভিযোগ অনুযোগ না করতে পারে।

দুজনেই নামাজ শেষ করে উঠে দাঁড়ালো।

দেয়ালে থাকা সুইচবোর্ড হাতড়ে কক্ষের বাতি নিভিয়ে দিলো স্বর্গ।

আকাশে আজ পূর্ণ থালার মতো চাঁদটি ঝকঝকে আলো ছড়াচ্ছে।
মুহিতের দক্ষিণ পাশের জানালার ফাক গলিয়ে সেই চাঁদের আলো ঘরময় হুটোপুটি খাচ্ছে।

সেই চাঁদের আলোতে স্বর্গকে অত্যাধিক মোহনীয় লাগছে মুহিতের কাছে।
পেছন থেকে মুহিত স্বর্গকে জড়িয়ে ধরলো।
কেঁপে উঠলো স্বর্গ।
পিঠের ভেজা চুল সরিয়ে ঘাড়ে চুমু খেয়ে পকেট থেকে একটি ডায়মন্ড এর পেনডেন্ট বের করে স্বর্গের গলায় পরিয়ে দিলো।

“আমার পক্ষ থেকে এই পবিত্র রাতে তোমার জন্য ছোট একটি উপহার।
“এর আগের বার কিছুই দিতে পারিনি তোমাকে,তার জন্য তোমার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী”

স্বর্গ নিজেকে মুহিতের দিকে ঘুরিয়ে মুহিতের গলা জড়িয়ে বলে উঠলো
“আমার সোনা দানা হিরে কিছুই চাইনা।আমি শুধু তোমাকে সবসময় ,সব ভাবে ,প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে আমার পাশে চাই।

“বলো থাকবে??”

মুহিত স্বর্গের কপালে চুমু খেয়ে বলে উঠলো
“থাকবো”
স্বর্গ শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মুহিত কে।
মুহিত তার শক্তিশালী দুই বাহুর সাহায্যে এমন ভাবে চেপে ধরলো স্বর্গকে তার মনে হচ্ছে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে রাখতে পারলে শান্তি পাওয়া যেতো।

আবেশে,শান্তিতে চোখ বন্ধ করে ফেললো স্বর্গ।মুহিতের বুকের ধারকান স্বর্গকে মাতাল করে দিচ্ছে।
ধীরে ধীরে বাড়তে থাকলো হৃদযন্ত্রের গতি।
নেশাক্ত চোখে স্বর্গের পানে তাকালো মুহিত।

স্বর্গ মুহিতের পানে দৃষ্টি দিয়ে পড়ে ফেললো মুহিতের চোখের ভাষা।

মুহিত তার ওষ্ঠদ্বয় চেপে ধরলো স্বর্গের তিরতির করে কাঁপা ঠোঁটে।

স্বর্গ পরম ভালোবাসায় বদ্ধ উন্মাদের ন্যায় আকড়ে ধরলো মুহিতের ঠোঁট।
স্বর্গকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে গায়ের শার্ট এক টানে খুলে ফেললো মুহিত।

চাঁদের আবছা আলোতে হাতের নরম আঙ্গুলি দিয়ে মুহিতের কান থেকে গাল পর্যন্ত স্লাইড করলো স্বর্গ।
সহসাই স্বর্গের মেদহীন পেটে মুখ ডুবালো মুহিত।

শিউরে উঠলো স্বর্গ।
হাতের বিচরণ হলো অবাধ্য থেকে অবাধ্যতর

দুনিয়াবি সকল চিন্তাভাবনা ভুলে দুজন মানব মানবী হারিয়ে গেলো ভালোবাসার পবিত্র সুধা আস্বাদনে।

#চলবে।

তোমার জন্য সিন্ধুর নীল পর্ব-৩১+৩২

0

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_৩১
#সারিকা_হোসাইন

*********
সময় বহমান,নদীর স্রোত যেমন ধীরে ধীরে বয়ে চলে ঠিক সেভাবেই সময় চলে যায় সকলের অলক্ষে।বিভিন্ন ব্যাস্ততায় মানুষ তা ঠাহর করতে পারেনা।যে সময় একবার চলে যায় তাকে আর কখনো ফিরিয়ে আনা যায় না শুধু থেকে যায় আফসোস।

ঠিক সেভাবেই প্রত্যেকের জীবন থেকে হারিয়ে গিয়েছে দীর্ঘ একটি বছর।
এই এক বছরে মুহিত তার জীবনের সকল ঝামেলা উৎপাটন করতে সক্ষম হয়েছে।শুধু তাই নয় তার বাবার তৈরি পুরাতন বাসটাকে সু সজ্জিত করে দিয়েছে নতুন রূপ।

স্বর্গ এখন একজন মিলিটারি ফিজিসিয়ান ক্যাপ্টেন,নিজের দায়িত্ব কর্তব্যে এক চুল গাফিলতি তার পছন্দ নয়।

নামিরার ছেলেটা এখন সাড়ে চৌদ্দ মাসে পা দিয়েছে।আধো আধো বুলিতে নানান ধরনের শব্দ আওড়ায় সে আর থপ থপ করে ঘুরে বেড়ায় সারা বাড়ি।

সোহাগ তার পূর্বের ভার্সিটিতে আবার ইংলিশ প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেছে।

ধরতে গেলে মিসেস তারিনের পরিবার অনেকাংশেই সুখী সমৃদ্ধি পরিবার।
সব কিছুই আছে মিসেস তারিনের সংসারে শুধু নেই আদরের ছোট পুত্র মুকিত আর ভালোবাসার মানুষ টা।

――――――
মিসেস তারিন ,মুহিত,সোহাগ আর নামিরা বসে আছে নাফিজ মাহমুদ এর ড্রয়িং রুমে।
একটু আগে বিভিন্ন নাস্তার পসরা সাজিয়ে দিয়ে গিয়েছেন বাড়ির হেল্পিং হ্যান্ড ফতেমা।
মুহিত চোরের মতো গোপনে গোপনে খুঁজে চলেছে তার মনের রাজ্যের রাজকুমারী কে।কিন্তু কোথাও তাকে দেখা যাচ্ছে না।
মুহিতের ধৈর্য্যের বাঁধ যেনো ভেঙে যাচ্ছে,বুক ধুকপুক করছে।
দীর্ঘ ছয়মাস ধরে সে তার প্রিয়তমা কে দেখতে পারছে না।

মুহিত,সৌম্য আর আদ্রিয়ান নিজেদের পদমর্যাদা বাড়াতে কঙ্গো তে গিয়েছিলো ছয়মাসের একটা মিশনে ।
সেখানে মুহিতের কাজ ছিলো বিভিন্ন ডিভাইস এর উপর।সারাক্ষন স্ক্রিনে নজর রাখতে হতো।
যার জন্য মুহিত বাসার কারো সাথেই খুব একটা যোগাযোগ রাখতে পারেনি।
মাঝে মাঝে দুই তিন মিনিটের জন্য কথা বলার সুযোগ পেতো।আর নেটওয়ার্ক এর অবস্থা এতো বাজে, ভিডিও কলে কথা বলার সৌভাগ্য হয়নি কারো সাথেই মুহিতের।

এজন্য মিশন থেকে ফিরেই পরিবার নিয়ে এসেছে নাফিজ মাহমুদ এর বাড়িতে।
আজই সে আংটি পরিয়ে রাখবে এবং মিশনের সকল কাজ অফিসিয়াল সাবমিট করে এক সপ্তাহের মধ্যে স্বর্গকে নিজের ঘরে তুলবে।

স্বর্গ অবশ্য জানেনা আজ মুহিত আসবে,তনুজাও জানতেন না হুট করে মুহিত তার ফ্যামিলি নিয়ে চলে আসবে।

মুহিত কিছুক্ষন উশখুশ করে নামিরাকে চিমটি কাটলো।
নামিরা চোখ গরম করে মুহিতের দিকে তাকাতেই অসহায় এর মত ফেস করে মুহিত বলে উঠলো
―মামী কে জিজ্ঞেস কর না আমার বউটা কোথায়?

নামিরা কটমট করে বললো এতো নির্লজ্জ কেনো তুই?বিয়েটা আগে হতে দে, পরে না হয় সারাক্ষন বউ বউ করিস।

মুহিত দাঁত পিষে বললো

“যেটা করতে বলেছি সেটা কর না হলে তোর ছেলের কান মলে দিব আমি।”

ছেলের কান মলার কথা শুনতেই ছেলের দিকে তাকালো নামিরা,দেখতে পেলো মুহিত অলরেডি তার ছেলে ‘শুদ্ধর ” কান ধরে আছে।

বাসায় গিয়ে তোকে দেখছি বলেই নামিরা ইতস্তত করে বলে উঠলো
―মামী স্বর্গকে কোথাও দেখছি না,

তনুজা স্মিত হেসে বললেন

“আসলে তোমরা আসবে এটা স্বর্গ জানতো না,ও সিএমএইচ এ গেছ। ইমারজেন্সি কল করেছে ওখান থেকে”

মিসেস তারিন বলে উঠলো

“আসলে আজ শুক্রবার এজন্য আমরা ভেবেছি ও হয়তো বাসাতেই আছে!তাই সারপ্রাইজ দিতে এলাম!

“সারপ্রাইজ দিতে এসে নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেলাম ”
মিনমিন করে বলে উঠলো মুহিত।

একটু পর হন্তদন্ত হয়ে নাফিজ মাহমুদ বাসায় ফিরে মিসেস তারিনের সাথে কুশল বিনিময় করে মুহিত কে নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে গেলেন।

“তা বাবা মুহিত ওখানে কি অনেক পরিশ্রম হয়েছিল নাকি?একদম শুকিয়ে কালো হয়ে গেছো!”

“”আসলে স্যার প্রচুর ঘুম কামাই করতে হয়েছে,দিনে রাতে মিলিয়ে আমি সাড়ে তিন ঘণ্টার মতো সময় পেয়েছি ঘুমানোর জন্য।”

“আর তাছাড়া পার্সোনাল কিছু দুশ্চিন্তা ও ছিলো।এজন্য নিজের ঠিকঠাক যত্ন নিতে পারিনি”

হঠাৎই নাফিজ মাহমুদ তনুজাকে ডেকে স্বর্গ কোথায় জানতে চাইলেন।

“বাপী আমি এখানে”
ক্লান্ত স্বরে জবাব দিলো স্বর্গ।

স্বর্গের আকস্মিক জবাবে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো মুহিত।বুকে তার তোলপাড় শুরু হয়েছে।শূন্য বুক খাঁখাঁ করছে।হৃদয়ের অলিন্দ বারবার আন্দোলন করে যাচ্ছে স্বর্গকে জড়িয়ে ধরার জন্য।

ড্রয়িং রুমে মুহিতকে দেখে থমকে দাঁড়ালো স্বর্গ।
শ্বাস রোধ হয়ে আসছে এমন অনুভূতি হচ্ছে থেকে থেকে।বুকের ছাতিতে কে যেনো জোরে জোরে হাতুড়ি পেটাচ্ছে শুধু।

এতোগুলো দিন মুহিতকে না দেখে কিভাবে থেকেছে স্বর্গ এই কথা সে ছাড়া আর কেউ জানে না।
মাঝে মাঝে ইচ্ছে হয়েছে পাখি হয়ে মুহিতের কাছে চলে যেতে।কিন্তু তা কি আর সম্ভব?

মুহিতের বুকে হামলে পরে শান্তির শ্বাস নিতে ইচ্ছে করছে স্বর্গের।কিন্তু বাবা আর ফুপির সামনে সম্মান বিসর্জন দিবে কিভাবে?

“ফুপি তুমি বসো আমি ফ্রেস হয়ে আসছি”
বলেই এক প্রকার দৌড়ে নিজের কক্ষে চলে আসলো স্বর্গ।

এই মুহিত টা তাকে ভীষন ভাবে কাবু করেছে তার প্রতি ।ভালোবাসা হীন এক দন্ড তার সামনে দাঁড়ানো যায়না।সারাক্ষন মাথায় চুমু,হাগ,কামড় দেয়া এসব ঘুরে বেড়ায়।
“এ কেমন অসভ্য ইচ্ছে??

মুহিত তার বুকের তোলপাড়ের কারনে বসে থাকতে পারছি না।”

“এখনই স্বর্গের কাছে যাওয়া চাই”

হঠাৎই দাঁড়িয়ে গেলো মুহিত,অনুরোধের স্বরে নাফিজ মাহমুদ কে উদ্দেশ্য করে বললো
“স্যার আমি কি একবার একান্তে ওর সাথে কথা বলতে পারি”?

প্রাণ খুলে হেসে উঠলেন নাফিজ মাহমুদ।মুহিত কে তিনি ছোটবেলা থেকে দেখে আসছেন।যেমন ভদ্র তেমন শান্তশিষ্ট ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন একটি ছেলে ।ঠিক যেনো বাপের কার্বন কপি।
চোখ বন্ধ করে এই ছেলেকে বিশ্বাস করা যায়।
আর যাই হোক কারো কোনো ক্ষতি এই ছেলের দ্বারা সম্ভব নয়।

মাথা ঝাকিয়ে নাফিজ মাহমুদ বলে উঠলেন
“হপ ব্যাটা,এটা আবার অনুমতি নেবার কি আছে?তোমার ই তো হবু বউ,যাও কথা বলে এসো।আমরা অপেক্ষা করছি”

মুহিত দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে স্বর্গের কক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

স্বর্গ ঝটপট শাওয়ার নিয়ে কোনো রকমে এলোমেলো করে একটা বেগুনি রঙের জামদানি পরে টাওয়েল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো।

মুহিত আস্তে করে দরজায় নক করলো।
স্বর্গ ভেবেছে তনুজা এসেছে বোধ হয় তাই গলার আওয়াজ উঁচু করে বলে উঠলো
“দরজা খোলাই আছে ,ভেতরে এসো”

মুহিত দুই হাতের ধাক্কায় সপাটে দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে দরজা ভিড়িয়ে দিলো।

আয়নার দিকে তাকিয়ে চুল মুছতে মুছতে হঠাৎ ই আয়নার প্রতিবিম্বে মুহিতের অবয়ব দেখে ঈষৎ কেঁপে উঠে স্বর্গ।

মুহিত দ্রুত পায়ে পেছন থেকে কোমর জাপ্টে ধরে থুতনি গুঁজে দেয় স্বর্গের কাঁধে।

আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলে স্বর্গ।হাত থেকে পরে গেলো ভেজা টাওয়েল।
শক্ত পুরুষালী হাতের সহায়তায় স্বর্গকে নিজের দিকে ফেরালো মুহিত।

এলোমেলো শাড়ি,ভেজা চুল, স্নিগ্ধ মুখ সব মিলিয়ে মুহিত কে বেসামাল করে দিচ্ছে।ধবধবে সাদা অঙ্গে বেগুনি পাতলা জামদানি টি জলজল করছে।
মুহিতের মনে হচ্ছে এই শাড়িটি স্বর্গের জন্যই আলাদাভাবে তৈরি মরা হয়েছে।

স্বর্গের এহেন আগুন ঝরা রূপে ঝলসে গেলো মুহিত।মাথা ফাঁকা হয়ে গেলো তার।
এসেছিলো অনেক কথাই বলতে,কিন্তু এখন কিছুই মনে নেই তার।

নিজের একান্ত ব্যাক্তিগত মানুষের এমন রূপ কোনো প্রেমিক পুরুষ সহ্য করতে পারবে?

মনের সাথে মুহিতের কিছুক্ষণ নীরব যুদ্ধ চললো।এর পর করে ফেললো এক পাগলামি।

শাড়ির ফাক গলিয়ে স্বর্গের মেদহীন তলপেট মুচড়ে ধরলো মুহিত,

স্বর্গ নিজেকে সামলাতে না পেরে খামচে ধরলো মুহিতের চুল।

নেশাতুর চোখে স্বর্গের পানে তাকিয়ে স্বর্গের লাল ঠোঁট দুটো দুই আঙুলের সহিত টেনে টিপে ধরলো।

হঠাৎই দরজায় করাঘাত এর আওয়াজ পাওয়া গেলো।
স্বর্গ ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো মুহিত পাশে থাকা চেয়ারে ঝিম মেরে বসে গেলো।

রুমে প্রবেশ করে উৎসুক হয়ে নামিরা জানতে চাইলো
“কি করছিস তুই?স্বর্গ কোথায়?
আর এই শীতের মধ্যে এভাবে এতো ঘামছিস কেনো ?

মুহিত আমতা আমতা করে কিছু বলার আগেই ঠিকঠাক ভাবে নিজেকে পরিপাটি করে বেরিয়ে এলো স্বর্গ।

নামিরা স্বর্গের হাত ধরে টেনে নিয়ে বললো
“এসো সবাই অপেক্ষা করছে”

নামিরা চলে যেতেই কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে চোখ বন্ধ করে ফুঁস করে নিশ্বাস নিলো মুহিত।এরপর নিজেকে স্বাভাবিক করে বাইরে বেরিয়ে এলো।

ড্রয়িংরুমে সকলেই বসে আছেন,গল্প গুজব করছেন।একটু পর মুহিত এসে সেই আড্ডায় সামিল হলো।
সকলের মাঝে হঠাৎই মিসেস তারিন বলে উঠলো

“আমি যদি আজকে আমার আম্মাকে আংটি পরিয়ে যাই কারো কোনো আপত্তি আছে?”

নাফিজ আর তনুজা মুখ চাওয়া চাওয়ি করে বলে উঠলেন
“কি বলিস আপা আপত্তি কেনো থাকবে?”

মিসেস তারিন খুশি মুখে আবার বলে উঠলেন

“”আজকে আম্মাকে আংটি প্রিয় যাবো,আগামী সপ্তাহে বিয়ের ডেট ফেলতে চাচ্ছি”

“তোরা কি তোদের মেয়েকে আগামী সপ্তাহে আমার ঘরে দিবি নাকি আরো কিছুদিন তোদের কাছে রাখতে চাস?”

মায়ের মুখের এমন কথায় ধক করে উঠলো মুহিতের বুক।কি পরিয়ে নিয়ে এলো আর এই মহিলা বলছে কি?
“এখন যদি মামা মশাই বলে ফেলে আরো কয়েকদিন যাক?

“তাহলে তো কচু গাছের সাথে ফাঁস নেয়া ছাড়া কোনো উপায় থাকবেনা মুহিতের।
বিয়ে করা বউকে কাছে পাওয়া যাচ্ছে না সময় মতো এর চাইতে বড় কষ্ট আর কি আছে এই নশ্বর দুনিয়াতে??””

“মুহিত মনে মনে আল্লাহ মাবুদ জপতে থাকলো।

একটু পর নাফিজ মাহমুদ বলে উঠলো মেয়েকে কাছে রাখার কিছুই নেই আপা, তোর বাসা আমার বাসা থেকে দশ মিনিটের রাস্তা।চাইলেই যখন তখন মেয়েকে দেখতে পাবো,আর মেয়েতো অন্য কারো ঘরে যাচ্ছে না।
নিজের ফুপুর কাছে যাচ্ছে।

“”যেখানে তুই আছিস,মুহিত নামিরা আছে সেখানে আমার চিন্তা করা বা দুঃখ পাবার কিছুই নেই।

মুহিতের ও বিয়ের বয়স হয়ে গেছে অনেক আগেই,আর ওদের বিয়েটাও অনেক দিন ই হলো ঠিক হয়েছে।

আমার মনে হয় এখন বিয়েটা হয়ে যাওয়াই ভালো
“কি বলো তনুজা??

তনুজা মধুর হাসি ঝুলিয়ে বলে উঠলো

“আপনার ভাই ঠিকই বলেছে আপা, আগামী সপ্তাহেই আমরা বিয়ের তারিখ ফেলতে চাই।

আলহামদুলিল্লাহ বলে হ্যান্ড ব্যাগ থেকে একটি বক্স বের করলেন মিসেস তারিন।

স্বর্গকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো
“আম্মা আমার পাশে এসে বসো তো দেখি”

স্বর্গ লাজুক ভঙ্গিতে মাথা নিচু করে মিসেস তারিনের পাশে বসলেন।

একটি ডায়মন্ড এর আংটি মুহিতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন
“এটা তোমার পাপা ভালোবেসে আমাকে দিয়েছিলো, ব্যাবহার করলে নষ্ট হবে ভেবে আমি কোনদিন হাতে তুলিনি এই আংটি।

মানুষটা আজ নেই,দুদিন পরে আমিও থাকবো না,
“তোমার পাপা বেঁচে থাকলে হয়তো আরো সুন্দর সুন্দর জিনিস তোমার বউয়ের জন্য খুশি হয়ে কিনতো।
মানুষটা কতো সৌখিন ছিলো এটা তোমাদের কারোর ই অজানা নয়।

কিন্তু আল্লাহ তাকে নিয়ে গিয়েছে।মনকে সবর দেয়া ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই।

তোমার পাপার পক্ষ থেকে বাড়ির প্রথম ছেলের বউ হিসেবে স্বর্গের জন্য এই ছোট উপহার।

পরে তুমি তোমার মন মতো যা খুশি কিনে দিও।
বলেই মুহিতের দিকে আংটি টি বাড়িয়ে দিলেন।

সকলের চোখ ভিজে উঠলো মিসেস তারিনের আক্ষেপে।

মুহিত বারবার পলক ঝাপটে অশ্রু লুকিয়ে মায়ের হাত থেকে আংটি নিয়ে স্বর্গের হাতে পরিয়ে দিলো।

মিসেস তারিন মুহিত আর স্বর্গের মাথায় হাত বুলালেন।
স্বর্গের নরম হাত তুলে নিয়ে অনামিকা আঙুলে চুমু খেয়ে বললেন
“আম্মা আংটি সুন্দর মানিয়েছে তোমার সুন্দর হতে।
বিয়ের যা যা কেনাকাটা দুজন মিলে করে নিও,ফুপি আর ডিস্টার্ব করবো না।

স্বর্গ আহ্লাদী হয়ে মিসেস তারিনের হাত জড়িয়ে ধরে বললো
আংটি অনেক পছন্দ হয়েছে আমার,এটা আর জীবনেও ফেরত পাবে না তুমি।আর তোমার পছন্দ অনেক সুন্দর।
আমার বিয়ের সব কেনাকাটা তুমি আমার সাথে গিয়ে কিনবে।
বলেই মিসেস তারিনের কাঁধে মাথা রেখে চোখ বুঝলো স্বর্গ।

মিসেস তারিন স্বর্গের গালে মমতার হাত বুলালেন।

নাফিজ মাহমুদ ক্যালেন্ডার দেখে সকলের উদ্দেশ্যে বললেন
আগামী শুক্রবার বিয়ে।সকলেই প্রস্তুতি নাও।কেনাকাটা তে লেগে যাও।
আমি উঠলাম আজ আমার অনেক কাজ আছে।একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা।

#চলবে।

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_৩২
#সারিকা_হোসাইন

★★★
ডিসেম্বর মাস,ঢাকায় একটু একটু শীত পড়তে শুরু করেছে।শীতের আমেজ চার পাশে পরিলক্ষিত।সন্ধ্যা নামতেই হালকা ধোয়ার মতো কুয়াশা জাল বিছিয়ে দিচ্ছে সর্বত্র।
আজ স্বর্গের গায়ে হলুদ।বিয়ে নিয়ে প্রতিটা মেয়ের অনেক কল্পনা জল্পনা থাকে।স্বর্গ ও তার ব্যাতিক্রম নয়।গায়ে হলুদ থেকে শুরু করে রিশিপশন পর্যন্ত সব কিছু মন মতো হওয়া চাই।

নাফিজ মাহমুদ এর বাড়ী আত্মীয় স্বজনে গিজগিজ করছে।বড় বড় আর্মি অফিসারের ছোট ছোট বাচ্চাগুলো ঘরময় দৌড়ো দৌড়ি করে এই সন্ধাটাকে আরো চাঞ্চল্যকর করে তুলেছে।

ছোট বড় প্রত্যেকে আজ কাজে ব্যাস্ত।কেউবা ফল ডেকোরেশন করছে,কেউবা পায়েস এর থাল সাজাচ্ছে কেউবা আবার গার্ডেন এর পাশে হলুদের স্টেজ সাজাতে ব্যাস্ত।

আজকের এই মধুমাখা হলুদ সন্ধ্যায় স্বর্গ গায়ে জড়িয়েছে কাঁচা হলুদ রঙের জামদানি সাথে গোলাপি রঙের জারবেরা আর জুঁই ফুলের অধফোটা কুঁড়ির তৈরি গহনা।
মুখমন্ডলে হালকা মেকআপের টাচ,তরতরে সোজা সিল্কি বাদামি চুলগুলো আজ সে কার্ল করেছে।ঠোঁটে গ্লোসি হালকা গোলাপি রঙের লিপস্টিক।

পার্লার থেকে হেনা আর্টিস্ট এসে দুপুরেই খুব সুন্দর করে মেহেদী পরিয়ে দিয়ে গেছে
মুহিত পই পই করে বলেছে দুই হাতের তালুতেই ডিজাইনের ভীড়ে তার নামের অক্ষর থাকা চাই ই চাই।
স্বর্গ হেনা আর্টিস্ট কে বার বার বলে দিয়েছে ডিজাইনের প্রত্যেকটা ফাঁকা জায়গায় যেনো সে “M” লিখে দেয়।

স্বর্গের এহেন পাগলামি কাণ্ডে হেনা আর্টিস্ট ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা।

পিউ এসে স্বর্গকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে,কোথাও কোনো সাজে ভুল আছে কি না।
নাহ সেরকম কিছুই দৃষ্টিগত হলো না।

“তোকে আজ রূপকথার রাজকুমারী দের মতো লাগছে ”
বলেই চোখের নিচে থেকে কাজল এনে স্বর্গের গ্রীবাদেশে লাগিয়ে দিলো পিউ।

“আজ মেজর মুহিত তোকে দেখে জ্ঞান হারাবে”
বলেই কুনুই দিয়ে স্বর্গের হাতে গুঁতো দিলো পিউ।

আচানক কোথায় থেকে যেনো সুখ এসে ঢুকে পড়লো স্বর্গের কক্ষে।
কোমরে হাত দিয়ে বিজ্ঞের ন্যায় ঠোঁট ফুলিয়ে কিছু ভাবলো।
এর পর গমগমে কণ্ঠে বলে উঠলো
একটা সত্যি কথা বলবো?

পিউ মনে মনে ভাবছে এখনই লাগবে দুটোর ঝগড়া আর সেই ঝগড়ায় নষ্ট হবে সাজ।

কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সুখ বলে উঠলো
“তোকে আজ অনেক সুন্দর লাগছে”

“আচ্ছা থাক আমি চলি বলেই দরজার কাছে এসে দাড়ালো সুখ।
স্বর্গের পানে দৃষ্টি বুলিয়ে হো হো করে হেসে উঠলো এর পর চিল্লিয়ে বলে উঠলো
“তোকে আস্ত একটা ডাইনি লাগছে,পিশাচিনি।জিজু দেখলে নির্ঘাত হার্ট এট্যাক করবে”
বলতেই পায়ের স্যান্ডেল ছুড়ে মারলো স্বর্গ।

হাসতে হাসতে সুখ দৌড়ে পালালো।

নাফিজ মাহমুদ এর বাংলোর সামনের গার্ডেন এর পাশে বিশাল এক খোলা জায়গা।সেখানেই সুন্দর করে গায়ে হলুদের স্টেজ সাজানো হয়েছে।
হলুদ গোলাপ আর সাদা রজনী গন্ধ্যার মিশ্রনে তৈরি হয়েছে স্টেজ টি।রাখা হয়েছে সোফা আর সেন্টার টেবিল।
বিভিন্ন ধরনের সুসজ্জিত খাবারের পসরা সাজানো হয়েছে সেই টেবিলে।

একটু পর নামিরা আর সোহাগ এলো বিশাল বড়ো এক আকর্ষণীয় কেক নিয়ে।

নামিরা আজকে হলুদ লেহেঙ্গা আর জলপাই রঙের ওড়না পড়েছে সাথে হালকা মেকআপ।

সোহাগ মুগ্ধ নয়নে দেখে যাচ্ছে নামিরাকে।
এই দীর্ঘ সাড়ে সাত বছর সোহাগ নামিরাকে কখনো সাজতে দেখেনি।হয়তো সাজার মতো কোনো অবস্থাই তৈরি হয়নি এই কয়েক বছরে।

“কে বলবে এই মেয়ের একটা দেড় বছরের বাচ্চা আছে?.”

নামিরার সৌন্দর্য সোহাগের মনে হিংসের সৃষ্টি করে।
আবার মনে মনে নিজেকে বুঝ দেয়
“এই অতীব সুন্দরী রমণীটি তাকে পাগলের মতো ভালোবাসে এবং তার সন্তানের মা ।
এসব ভাবনা ভাবতেই সোহাগের বুকে হিমশীতল বাতাস প্রবাহিত হয়।

“কি দেখছো এমন ছ্যাবলার মতো?
“কখন থেকে ডেকে যাচ্ছি সারা দিচ্ছনা শুধু দেখেই যাচ্ছ!

নামিরার তেজ পূর্ন স্বরে ধ্যান ভাঙলো সোহাগের।নিজেকে ধাতস্থ করে মিনমিন করে বলে উঠলো
“তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে নামিরা।
বলেই তড়িঘড়ি করে অন্যকাজে লেগে গেলো।

সকল কাজ কমপ্লিট, এখনই স্বর্গকে স্টেজে আনা হবে।মৃদু শব্দে হলুদের গান বাজছে,ছোট ছোট বাচ্চারা বক্সের সামনে বিভিন্ন ভঙ্গিতে নেচে যাচ্ছে।
লাল রঙের সামিয়ানা যা গোল্ডেন জরি সুতায় কারুকাজ খচিত ।সেই সামিয়ানার চারকোনা ধরেছে চারজন মেয়ে।
স্বর্গ আগে আগে যাচ্চে পিছনে তার বান্ধবীরা গানের তালে তালে নেচে চলছে।
নাচতে নাচতে তারা স্বর্গকে এনে স্টেজে পাতা সোফায় বসালো।
এবার হলুদ ছোয়ানোর পালা।

প্রথমে মিসেস তারিন একটু হলুদ ছুইয়ে মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করলেন।এরপর তনুজা,নাফিজ মাহমুদ হলুদ ছুঁইয়ে কপালে চুমু দিয়ে সোফায় এসে বসলেন।
ধীরে ধীরে নামিরা,পিউ,সুখ সবাই হলুদ ছোয়ালো।

হঠাৎই ক্যাপ্টেন সৌম্য এসে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলে উঠলো
“হ্যালো,চেক ,ওয়ান,টু,থ্রি।

“এবার আপনাদের সামনে একটা ধামাকা হতে যাচ্ছে,সেই ধামাকা না আগে কেউ দেখেছে না শুনেছে।”

এবার মেজর আদ্রিয়ান মাইক্রোফোন কেড়ে নিয়ে সৌম্যের গলাগলি ধরে বলে উঠলেন,
সবাই ধামাকা দেখার জন্য রেডি?

সকলেই সমস্বরে বলে উঠলো
“ইয়েস”

প্রত্যেকের সমর্থন পাবার সাথে সাথেই নিভে গেলো সকল লাইটস।জলে উঠলো ফোকাস লাইট।

একটি উঁচু টুলে গিটার হাতে একটি ছেলে বসে আছে।
অন্ধকারে তার মুখ অস্পষ্ট।

কিন্তু স্বর্গের একমুহূর্ত সময়ও লাগলো না ঠাহর করতে মানুষটা কে?

“মানুষটা তার একান্ত ব্যাক্তিগত সম্পত্তি।

ধীরে ধীরে স্পষ্ট হলো মুহিতের পুরা অবয়ব।
মুহিত পড়েছে সাদা পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা সাথে স্বর্গের শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে কাঁচা হলুদ কুটি।হাতে ব্রাউন ফিতার নেভিফোর্স ঘড়ি।

স্বর্গ মোহনীয় দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে মুহিত কে।
স্বর্গের কাছে মনে হচ্ছে মুহিত পরিবীর সবচেয়ে স্নিগ্ধ আর শুদ্ধতম পুরুষ।
যেই পুরুষকে কেউ ছুঁয়ে দেখেনি, যেই পুরুষের প্রীতিময় সান্নিধ্য একমাত্র স্বর্গ ছাড়া কেউ পায়নি।
নিজেকে পৃথিবীর সবচাইতে ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে তার নিজের কাছে।

গিটারের টুংটাং শব্দে ধ্যান ভাঙলো স্বর্গের।

নামিরা দুই হাতের সহিত ঢেকে ফেললো তার মুখ।

কোনোভাবেই নামিরা তার কান্না চেপে রাখতে পারছে না।

“এটাই তো সেই আগের মুহিত,যেই মুহিত দীর্ঘ সাড়ে সাত বছর ধরে হারিয়ে গিয়েছিলো।”

“এটাই তার আদরের সেই চঞ্চল হাসিখুশি ভাই”

মিসেস তারিন চশমা খুলে চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া জ্বল নীরবে মুছে নিলেন।
তনুজা মিসেস তারিন কে জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত বুলালেন।

“মুহিত গুনে গুনে আট বছর পর গিটার হাতে ধরলো”

মুহিতের গিটারের সুরের সাথে বেজে উঠলো মিউজিশিয়ান দের সফট মিউজিক।
মুহিত গাইতে শুরু করলো

“তোমার জন্য সিন্ধুর নীল
“আরো হবে সপ্নীল।
উদাস দুপুরে রাগ বসন্তে গাইবে সোনালী চিল
তোমার যতো ভুল সব
নিমিষেই হবে ফুল।
তবু ভালোবাসি শুধু তোমায়
নিশিদিন সারা বেলা,,,,,,
তোমার জন্য সিন্ধুর নীল আরো হবে স্বপ্নীল।

মুহিত গান শেষ করতেই সকলের করতালিতে মুখরিত হলো চারপাশ।
গিটার ছেড়ে মুহিত এগিয়ে আসলো স্বর্গের কাছে।
হলুদের বাটি থেকে হলুদ নিয়ে নিজের গালে মেখে সেই গাল ছোয়ালো স্বর্গের গালে,নাকে।

সকলেই হাত তালি দিয়ে বলে উঠলো আমরা মুহিত আর স্বর্গের ডান্স পারফর্ম দেখতে চাই।
নিমিষেই সকলে এক যোগে বলা শুরু করলো
“মুহিত,স্বর্গ।”মুহিত -স্বর্গ”

মুহিত মাথা নিচু করে এক হাত বুকে রেখে আরেক হাত বাড়িয়ে দিলো স্বর্গের পানে।

স্বর্গ মুহিতের আহ্বানে সায় দিয়ে আলতো করে চেপে ধরলো মুহিতের হাত।
উঠে দাঁড়ালো স্বর্গ।
ফাঁকা করা হলো স্টেজ।

বক্সে বেজে উঠলো সিলেক্টেড গান।

প্রথমে ছেলেদের দল উঠে গেলো স্টেজে।

সালামে ইস্ক সালামে ইস্ক গানে নাচবে সবাই।

গানের মিউউজিক এর তালে তালে নেচে উঠলো
মুহিত সৌম্য আর আদ্রিয়ান এর দল।
এক ঝাঁক তরুণ আর্মি অফিসার নিখুঁত ভাবে নেচে যাচ্ছে
সবাই হাত তালি দিয়ে উৎসাহ প্রদান করছে আর নাচছে।

মেয়েরাও উঠে গেলো স্টেজে।
কেউ কারো থেকে কম যাচ্ছে না।

পারফরম্যান্স শেষ হতেই সকলেই করতালিতে তাদের প্রশংসা জানালো।

সকল আচার অনুষ্ঠান মেনে আনন্দ ফুর্তিতে শেষ হলো গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান।

――――
রাত প্রায় একটার কাছাকাছি।
স্বর্গ নিজ রুমে এসে শাড়ি গহনা খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

হঠাৎ করেই কক্ষে মুহিত প্রবেশ করে দুম করে দরজা আটকে দিলো।

স্বর্গ উঠে দাঁড়াতেই মুহিত শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো স্বর্গকে।

“অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছি বউ।
“এমন ঘায়েল করা রূপ দিয়ে মেরে ফেলতে চাও নাকি আমাকে?

“এই দেখো বুকের এই জায়গাটায় চিনচিনে ব্যাথা হচ্ছে বলে আঙ্গুলি দিয়ে নির্দেশ করলো।

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে স্বর্গ জিজ্ঞেস করলো
“তার জন্য কি করতে আমাকে ফটাফট বলে কেটে পড়ো।
আমার ঘুম পেয়েছে।
কালকে বিয়ে অনেক ধকল যাবে।

ঠোঁটে একটা মিষ্টি দিয়ে দাও চলে যাচ্ছি বউ।

কন্ঠে সিরিয়াস ভাব এনে বলে উঠলো মুহিত―

“আমাকেও ঘুমুতে হবে বউ কাল থেকে তো আর ঘুমানো যাবে না।

স্বর্গ টুপ করে চুমু খেয়ে সরে দাঁড়ালো।
“হয়েছে দিয়েছি যাও এখন!

মুহিত আহত স্বরে জিজ্ঞেস করলো

“এটা কি দিলি বউ?

“কি আবার? চুমুই তো চাইলে”

“আমি কি ফকির ?চুমু ভিক্ষে চাইতে এসেছি?

ভালো করে দেহ!

“মেজর মুহিত কালকে মজা বোঝাবো তোমাকে তুমি এখন ভাগো এখান থেকে।
বলে বেলকনিতে টেনে এনে পাইপ নির্দেশ করে বলে উঠলো নেমে যাও।

অসহায় মুহিতকে বারান্দায় ফেলে মুখ টিপে হেসে বেলকনির দরজা আটকে দিলো স্বর্গ।

মুহিত সহসাই মেসেজ পাঠালো স্বর্গের ফোনে

“আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়া?
কালকে এর শোধ তুলবো
রেডি থাকবেন মিসেস ওয়াসিফ।

#চলবে

তোমার জন্য সিন্ধুর নীল পর্ব-২৯+৩০

0

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_২৯
#সারিকা_হোসাইন

রাত বারোটা বাজতে আর দু মিনিট বাকী।তৈরি হচ্ছে সৌম্য আর আদ্রিয়ান।মুহিত আগেই চলে গিয়েছে সেই জায়গায়।চারপাশে খুজ লাগানো ভীষন জরুরী।
এতোটা রাত হবার পরেও চারিপাশে অন্ধকার রাতের পরিবর্তে আলোর রোশনাইয়ে ঝা চকচক করছে সব কিছু।
কালো শার্ট,কালো প্যান্ট কালো বুটস আর কালো ক্যাপে নিজেদের আবৃত করেছে আজকে তিন জন যুবক।
মুহিতের পাঠানো লোকেশন গুগল ম্যাপ এ সার্চ দিয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে এলো সৌম্য আর আদ্রিয়ান।

মুহিত বারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।বারের ফ্রন্ট এরিয়াতে তেমন লোক সমাগম নেই।সন্ধ্যার দিকে এই জায়গাটা লোকে লোকারণ্য হয়ে থাকে।ব্লুটুথ ডিভাইসে ক্লিক করে সৌম্য আর আদ্রিয়ান এর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো
―অল ওকে।

মুহিত ধীরে ধীরে ভেতরে প্রবেশ করলো।চার পাশে মানুষ নেশায় বুদ হয়ে পড়ে আছে।কিছু মানুষ ফ্লোরে চিৎ হয়ে পড়ে আছে।হুশ নেই বললেই চলে।
মুহিত কোনো রকমে তাদের পাশ কাটিয়ে কটেজের রাস্তা ধরলো।
সামনেই টহল রত সিকিউরিটি দেখে একটি বড় পিলারের পেছনে লুকিয়ে পড়লো মুহিত।সিকিউরিটি সরে যেতেই হনহন করে হাঁটা ধরলো মুহিত।
কাঙ্ক্ষিত রুমের সামনে এসেই কোমরে গুঁজে রাখা রিভলবার বের করে পজিশন নিলো।
এরপর দরজা তে নক করলো।দরজা কেউ খুলছে না এদিকে বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করার মতো সময় মুহিতের কাছে নেই।সপাটে লাথি দিতেই খুলে গেলো দরজা।কক্ষে প্রবেশ করলো মুহিত।
ঘুটঘুটে অন্ধকার কক্ষ,কিছুই দেখা যাচ্ছে না।ফোনের ফ্লাশ জ্বালিয়ে সুইচ বোর্ড খুঁজে লাইট জ্বালাতেই চোখ চড়ক গাছ।

কক্ষ পুরো খালি।ছোট একটা কক্ষ যার একপাশে একটা বেড পাতা আর কর্নারে দুটো সোফা বসানো।আর কিছুই নেই।
লাইটস নিভিয়ে ধীরে ধীরে মুহিত কক্ষ ত্যাগ করে বেরিয়ে এলো।
এর পর সৌম্য আর আদ্রিয়ান কে নিয়ে চলে গেলো ফোর জিরো ফোর এর সামনে।
তিনজনেই বন্দুক তাক করে অতর্কিত ভাবে ঢুকে পড়লো কক্ষে।
সেটাও খালি।
কারোর ই বোধগম্য হলো না ঘটনা টা।
রুমের বাইরে এসে মুহিত দৌড়ে সেই ফুলদানির কাছে গিয়ে দেখতে পেলো ক্যামেরাটা সেখানে নেই।
ক্যামেরার পরিবর্তে সেখানে একটা চিরকুট রাখা হয়েছে।

দ্রুত চিরকুট পকেটে ঢুকিয়ে বার থেকে বেরিয়ে এলো ওরা তিনজন।

বার থেকে একটু নিরাপদ জায়গায় বসে চিরকুট টি পকেট থেকে বের করলো মুহিত।
গোটা গোটা অক্ষরে লিখা
―এতো সহজেই ধরে ফেলবি ভেবেছিলি?
দিলাম তো ডজ।কেমন লাগলো মেজর?
আমি জানতাম আমার নিমকহারাম ছেলে তোকে সব বলে দিবে।
আর তুই ও ঈগলের মতো চলে আসবি শিকার খুঁজতে।
এরকম হাইড এন্ড সিক আর ভালো লাগছে না।
চল সামনা সামনি বসে তোর সাথে কথা বলি।
নিম্নলিখিত ঠিকানায় কাল বিকেল পাঁচটায় চলে আয়।
আর হ্যা নিজের সাঙ্গপাঙ্গ দের রেখে আসবি।
জানিস ই তো ক্যাপ্টেন সৌম্যের বউ টা এতিম!

রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো মুহিতের।চিঠিটা একে একে প্রত্যেকে উল্টে পাল্টে পড়লো।
সৌম্য আর আদ্রিয়ান এর এক জেদ তারা মুহিত কে একা ছাড়বে না।

কিছুক্ষন মৌন রইলো মুহিত।এরপর তিনজন মিলে এক দুর্দান্ত ফন্দি আটলো।
ক্রুর হাসলো মুহিত ।
অপেক্ষা আগামী দিনের সূর্য ওঠার।

――――
আশরাফ চৌধুরী একটি আরাম কেদারায় পায়ের উপর পা তুলে ভ্যাপ এর ধোয়া ফুকছেন আর রাগে ফুঁসছেন।
ওই মেজর এখান পর্যন্ত চলে এসেছে এতো দ্রুত?
তার এখানের খবর আহিয়ান ছাড়া কেউ জানবার কথা নয়।তার মানে জানোয়ারটা এতদিন ভং ধরে ছিলো?আহমেদ কসাই এর নাকের ডগায় বসে এতো নিখুঁত অভিনয় করে গেলো যে সে ধরতেই পারলো না?
কতোবার মন চেয়েছে হাজতের ভেতরই ঝুলিয়ে দিতে।কেন যে দিলো না তখন ভাবতেই ছুড়ে মারলো ভ্যাপারের পাইপ খানা।

কোথাও গিয়ে দুদন্ড শান্তিতে থাকা যাচ্ছে না,কি মুসিবত।
কাল দেখিয়ে দেবো মেজর কে আমার সাথে লাগতে আসার ফল।বাপ ভাইয়ের পরিণতি দেখেও যার শিক্ষা হয়নি তাকে আর কিভাবে শিক্ষা দেবে আশরাফ চৌধুরী?

ভাবনা ফেলে দুই হাতের সহায়তায় জোরে তালি দিতেই বাধ্য দাসের ন্যায় আটজন ছেলে সারি বদ্ধ ভাবে আশরাফ চৌধুরীর দুই পাশে দাঁড়ালো।

মুহিতের বর্ননা দিয়ে আশরাফ চৌধুরী ছেলে গুলোকে উদ্দেশ্য করে থাই ভাষায় বলে উঠলো
―দেখা মাত্র হাত পা ভেঙে মাটির সাথে মিশিয়ে দেবে।
ছেলেগুলো দুই হাত বুকে ভাঁজ করে মাথা নিচু করে এক যোগে বলে উঠলো
-ওকে।

চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন আশরাফ চৌধুরী।কাল তার অনেক কাজ।ওই মেজর কে একটা চূড়ান্ত সত্য জানানো বাকি আছে এখনো।ওই সত্যের ধাক্কাটা আগে দিয়ে একদম কাবু করে ফেলবে।বলেই কিটকিটিয়ে হেসে উঠলো এবং হনহন করে কক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে গেলো।

*****
আজ সেই অপেক্ষাকৃত দিন।
ঘড়ির ঘন্টা কাটা চারের ঘরে ঠেকতেই ঢং ঢং করে আওয়াজ তুলে জানান দিলো এখন চারটা বাজে।
মুহিত দ্রুত তৈরি হয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে এলো।
এখান থেকে গুগল ম্যাপ লোকেশন আধা ঘন্টার রাস্তা দেখাচ্ছে।

মুহিত কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর একটা বাইক রাইড বুক করে ড্রাইভার কে লোকেশন সেন্ড করলো।

একক ভাবে প্রভাবশালী কোনো পরিবহনের প্রচলন না থাকায় এবং রাস্তায় বহু ক্যাটাগরির যানবাহনের জন্য জ্যামে পরিপূর্ণ এই শহর।
মুহিত ঘড়িতে বার বার শুধু সময় দেখে যাচ্ছে আর বিরক্তিতে মুখে চ সূচক শব্দ করছে।
দীর্ঘ পঞ্চান্ন মিনিটের যাত্রা শেষ করে মুহিত এখন উপস্থিত হয়েছে ফুকেট ফাইট ক্লাব এর সামনে।
জায়গাটা মেইন শহর থেকে একটু দূরে জনমানব সংখ্যা খুবই কম এমন একটি জায়গায়।

নিজেকে স্বাভাবিক করে মুহিত ভেতরে ঢোকার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।
দরজা তে নক করতেই একটি ছোট বাচ্চা ছেলে দরজা খুলে দিয়ে মাথা নিচু করে স্বাগত জানালো।
কাঠের বড় পাল্লার দরজা পার হতেই ছেলেটি হাতের ইশারায় বাম পাশের রাস্তা নির্দেশ করলো।
মুহিত ছেলেটির দেখানো পথে চারপাশে চোখ বুলিয়ে হাটতে লাগলো।

জায়গা টা বাহির থেকে দেখলে বোঝার কোনো উপায় নেই যে ,ভিতরে বিশাল খোলা জায়গা আছে।
ক্লাবের ভিতরে ফাইটিং এর সকল জিনসে পরিপূর্ণ।
মুহিত মনে মনে ভাবছে এমন জায়গায় তাকে ডাকার কি কারন থাকতে পারে আশরাফ চৌধুরীর?

চলতে চলতে একটি বড় দরজা দেখতে পেলো মুহিত।কিছুক্ষন ভেবে হাতের মুঠের সাহায্যে ঠক ঠক শব্দ করলো।
নিমিষেই দুই পাশ থেকে দুজন ব্যাক্তি দরজার পাল্লা সরিয়ে মুহিত কে ভেতরে ঢুকতে দিলো।

মুহিত ভেতরে প্রবেশ করতেই আশরাফ চৌধুরী খুশিতে গদ গদ হয়ে বললো
― এসো মেজর এসো।
―স্বাগতম তোমাকে আমার মেহমান খানায়।

আশরাফ চৌধুরীর এতো সমাদর মুহিতের কাছে ভালো ঠেকছে না।
কথায় বলে অতি ভক্তি চোরের লক্ষণ।

মুহিত চুপ করে সব কিছু পর্যবেক্ষণ করে যাচ্ছে শুধু।
নীরবতা ভেঙে আবারো আশরাফ চৌধুরী বলে উঠলো
―তোমার জন্য কোথাও তো শান্তিতে টেকা যাচ্ছে না মেজর।নিজেও শান্তিতে থাকছো না অন্যকেউ দিচ্ছ না।
―তারচেয়ে বরং চলো আজকে তোমাকে শান্ত করে দেই।
বলেই হাত তালি দিয়ে উঠলো আশরাফ চৌধুরী।

মুহূর্তেই ছেলেগুলো দৌড়ে আশরাফ চৌধুরীর সামনে এসে দাড়ালো ।
একটি ছেলেকে উদ্দেশ্য করে আশরাফ চৌধুরী বলে উঠলো
―ড্যানিয়েল চেক হিম!

ড্যানিয়েল নামের ছেলেটি দৌড়ে এসে মুহিত কে পা থেকে মাথা পর্যন্ত সার্চ করে কিছুই পেলো না।
ছেলেটি ফিরে যেতেই বাঁকা হাসলো মুহিত।

মুহিতের ভাবভঙ্গি কিছুই আশরাফ চৌধুরীর ভালো লাগছে না।
যতো দ্রুত এই মেজরের থেকে নিস্তার পাওয়া যায় ততোই মঙ্গল।
আশরাফ চৌধুরী মুহিতের দিকে এগিয়ে এসে গলা খাকরি দিয়ে বলে উঠলো
―তা মেজর বাপ ভাইয়ের লাশ গুলো জানাজা করে দাফন করতে পেরেছিলে?

লাশ দাফনের কথা শুনেই মুহিত মুষড়ে উঠলো।অজানা নীল ব্যাথায় সর্বাঙ্গ দুর্বল হলো।বুকে তোলপাড় শুরু হলো।

মুহিত কোথাও খুঁজে পায়নি তার বাবা আর মাসুম ভাইয়ের লাশ।
কতো মর্গ কতো জায়গায় তল্লাশি চালিয়েছে।
লাভের ফল বরাবরই শূন্যের কোঠায় ছিলো।

মুহিতের নীরবতা দেখে আশরাফ চৌধুরী বলে উঠলো
―চলো মেজর একটা ম্যাজিক দেখাই তোমাকে।

বলতেই দুটো ছেলে ধরাধরি করে একটা কফিন আনলো।
মুহিতের সামনে কফিনটা রাখার নির্দেশ দিলেন আশরাফ চৌধুরী।

ছেলে গুলো কফিন রেখে সোজা হয়ে মুহিতের পেছনে বুকে হাত ভাঁজ করে দাঁড়ালো।
আশরাফ চৌধুরী হাটু ভাঁজ করে বসে কফিনের ঢাকনা খোলতে তৎপর হলেন।

মুহিত যেনো কিছু বলার ভাষাই খুঁজে পাচ্ছে না।
এতোগুলো বছর পর আশরাফ চৌধুরী লাশ দাফনের কথা বলে এভাবে কেনো ব্যাথিত করবে মুহিত কে?

একজন সন্তানের কাছে পিতার লাশ দাফনের কার্য সম্পন্ন করতে না পারার যে কষ্ট বা ব্যার্থতা।এটা কি আশরাফ চৌধুরী বুঝবে?

নিমিষেই খুট করে খুলে গেলো কফিনের দরজা।ধ্যান ভাঙলো মুহিতের।
কফিনের দিকে দৃষ্টি দিতেই হাটু গেড়ে বসে গেলো মুহিত।

লাশটি আর কারো নয় তার বাবা আদনান ওয়াসিফ এর লাশ।

লাশটি দেখেই আশরাফ চৌধুরী হুহু করে হেসে উঠলো।

মুহিত কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো
―দেখ মেজর তোর বাপ কে কতো যত্ন করে রেখে দিয়েছি আমি।অনেক ভুগিয়েছিলো আমাকে।যখন কোনো কারণ খুঁজে না ই রাগ
করার জন্য!তখন তোর বাবার লাশ টা বের করে দেখি।
খুব রাগ হয় তখন জানিস?
তখন রাগের চোটে মনে চায় সব জ্বালিয়ে দেই।

তোর ভাইয়ের লাশ ও আছে রে মেজর ।
ওটাও রেখেছি।ফেলতে পারিনি,মায়া লেগেছে ছেলেটার জন্য বলেই ছেলে দুটোকে নির্দেশ দিলো ছোট কফিনটা নিয়ে আসতে।
ছেলে দুটো কফিন নিয়ে এসে মুহিতের সামনে রাখতেই মুহিত কফিন খোলার জন্য উন্মাদ হয়ে গেলো।
মুহিতের এমন অস্বাভাবিক আচরণে আশরাফ চৌধুরী হেসে কুটিকুটি হচ্ছে।
তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে এমন হাস্যকর দৃশ্য পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আর হয় না।

মুকিতের কফিনটা মুহূর্তেই খুলে ফেললো মুহিত।

একপাশে বাবার আরেক পাশে প্রানপ্রিয় আদরের ভাইয়ের মেডিসিন মিশ্রিত ফ্যাকাশে লাশ দেখে মুহিতের বুকে ব্যাথা শুরু হলো।
টপটপ করে শুধু মুহিতের চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে।মুহিত মুখে কিছুই বলতে পারছে না।

লাশ গুলোর মেডিসিনের ঝাঁঝালো গন্ধে প্রত্যেকে নাকে রুমাল গুজলো।
মুহিত সেভাবেই ঠাঁয় বসে রয়েছে।
কিছুক্ষন বাদে আশরাফ চৌধুরী হুংকার দিলেন কফিন দুটো নিয়ে যেতে।
ছেলে গুলো কফিন নিয়ে যেতেই আশরাফ চৌধুরী ড্যানিয়েল নামের ছেলেটিকে বললেন
―কিল হিম।

আশরাফ চৌধুরীর নির্দেশ পাওয়া মাত্র ছেলেগুলো মুহিত কে ঘিরে ফেললো চার পাশ থেকে।
মুহিত মাটির দিকে দৃষ্টি দিয়ে এক ধ্যানে বসে রয়েছে।
ছেলে গুলোর মধ্য থেকে “তায়ও” নামের ছেলেটি মুহিত কে শার্টের কলারে ধরে টেনে দাঁড় করালো।
মুহিতের আজকে নিজেকে ভারসাম্য হীন মানুষ বলে মনে হচ্ছে,যার পায়ে বল নেই,মনে জোড় নেই,মাথা বুদ্ধিশুণ্য।

মুহিতের মা এই লাশ গুলো দেখে আবার জীবন্মৃত হয়ে যাবে?
আবার এই বেদনায় ভরা অতীতের পুনরাবৃত্তি হবে?

মুহিতের ভাবনার মাঝেই মুহিতের মুখ বরাবর একটা পাঞ্চ মেরে দিলো বডিবিল্ডার দের মতো দেখতে একটি ছেলে।

টাল সামলাতে না পেরে পরে গেলো মুহিত।সে এখনো নির্বিকার।ঠোঁট ফেটে রক্ত ঝরছে সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই।জড়বস্তু লাগছে তার নিজের কাছেই।

হঠাৎ ই মুকিতের স্বপ্নে বলা কথা গুলো মনে পড়লো মুহিতের।
―ভাইয়া তুমি কাপুরুষ, পাপা তোমাকে তার যোগ্য পুত্র ভেবে অনেক দায়িত্ব দিয়ে এসেছিলো।
তুমি কিছুই পালন করো নি।তুমি চলে যাও আমাদের দরজার সামনে থেকে।পাপা কোনোদিন আর তোমার সাথে কথা বলবে না।
চলে যাও,চলে যাও ভাইয়া,চলে যাও।

চোখ খুলে উঠে দাঁড়ালো মুহিত।
সে এখান থেকে জ্যান্ত ফিরবে সাথে বাপ ভাইয়ের লাশ নিয়েই ফিরবে।
পিছন মুড়ে সব গুলো ছেলেকে দেখে নিলো মুহিত।

প্রত্যেক টা ছেলের শরীরের গঠন,উচ্চতা,গায়ের রঙ এক।শুধু চেহারা আলাদা।এরা সবাই যে ভালো ফাইট জানে তা তাদের শরীর আর আশেপাশের ইকুইপমেন্ট দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

ছেলে গুলো খালি গা,সবার পরনে কালো প্যান্ট আর বুটস।
ধবধবে ফর্সা শরীরে মাসেল গুলো চকচক করছে।
মুহিত এদের সাথে শক্তিতে পারবে কিনা জানেনা।
কিন্তু মনোবল হারাবে না সে।পারতে তাকে হবেই।

নিজের গায়ের শার্ট খুলে ছুড়ে মারলো মুহিত।
শার্টের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো মুহিতের মাসেল যুক্ত জিম করা শক্ত বডি।
ঘাড় ঘুরিয়ে কটকট শব্দে হাড়ের গিট ফুটিয়ে নিজেকে রিল্যাক্স করলো মুহিত।

ছেলেগুলো কারাতে পোজে ঘিরে দাঁড়িয়ে গেলো মুহিতের চার পাশে।
বাঁকা হাসলো মুহিত।
মুহিত নিজেও একজন কারাতে ব্ল্যাক বেল্ট পাওয়া চ্যাম্পিয়ন।কিন্তু ভাবে কিছুই প্রকাশ করলো না।
আস্তে ধীরে কোমরে হাত দিয়ে খুলে ফেললো বেল্ট এর বকলেস এর পিন।
ছেলে গুলো এগিয়ে আসতেই সহসাই বেল্ট খুলে হাতে পেঁচিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বাড়ি দিতে লাগলো।
ছেলে গুলো সামান্য আহত হয়ে ছিটকে পড়ে গেলো।
আহত বাঘের ন্যায় ফুসফুস করতে করতে ছেলে গুলো উঠে দাঁড়ালো।একটা ছেলে দৌড়ে এসে মুহিতের পেট বরাবর পাঞ্চ মারার ট্রাই করলো।
মুহিত তার বুদ্ধি আর শক্তির সাহায্যে ছেলেটির পাঞ্চ ব্লক করে নিজের হাটু দিয়ে ছেলেটিকে তলপেট বরাবর আঘাত করলো।এর পর কুনুই দিয়ে বুকে আঘাত করতেই মাটিতে লুটিয়ে পড়লো ছেলেটা।

দৌড়ে এলো আরো দুটো ছেলে।পেছন থেকে দুজনেই মুহিত কে ঝাপটে ধরলো।
মুহিত কুনুই এর সহায়তায় তাদের দুজনকেই বুকের খাঁচা বরাবর আঘাত করলো ছেলে গুলো ছিটকে না পড়ে মুহিত কে আরো ভালো করে চেপে ধরলো।
মুহিত তার সমস্ত শক্তি দিয়ে হাত ঝাড়া দিয়ে ফেলে দিলো ছেলে দুটো কে।
এর পর দৌড়ে একটা ওয়ালের অর্ধেক পর্যন্ত উঠে ঝাঁপিয়ে পড়লো ছেলে গুলোর উপর।
দুই পাশ থেকে দুটো ছেলের হাত মুচড়ে ধরে উল্টিয়ে ভেঙে দিলো মুহিত।

হঠাৎ ই একটা ছেলে চাইনিজ চপার আর কুড়াল নিয়ে আক্রমন করতে এলো।
হঠাৎই সৌম্য আর আদ্রিয়ান দৌড়ে এসে প্রটেক্ট করলো মুহিত কে।
শুরু হলো ফাইট।
কেউ কারো থেকে কম যাচ্ছে না।
দুই পাশের মানুষেরই রক্ত ঝরে যাচ্ছে সমানে।
বিভিন্ন মিলিটারি কায়দায় ,শক্তি বলে আর বুদ্ধির জোড়ে সব গুলো ছেলেকে কাবু করে ফেললো তারা তিন জনে।

হঠাৎ ই পেছন থেকে একটা চাইনিজ চপার ছুড়ে মারলো মুহিতের দিকে।সৌম্য চিৎকার করতেই মুহিত সাইড হয়ে সরে যায়।
ধারালো সেই চপার মুহিতের সামনের দেয়ালে লেগে অর্ধেক ঢুকে গেলো।
এবার মুহিতের মাথায় খুন চেপে গেলো।
রক্ত চক্ষু নিয়ে হাত মুষ্টি বদ্ধ করে এগিয়ে গেলো চপার এর দিকে।

শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে টেনে বের করলো চপার টা।
এরপর সেটা নিয়ে দৌড়ে আশরাফ চৌধুরীর দিকে এগুতে থাকলো।
আশরাফ চৌধুরী যেনো নড়ার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললো এই মুহূর্তে।
মুহিত দৌড়ে এসে সেই চপার দিয়ে কোপ বসিয়ে দিলো আশরাফ চৌধুরীর বুক বরাবর।
বুকের দিকে তাকিয়ে চোখ বড় বড় করে ফেললেন আশরাফ চৌধুরী।
গল গল করে রক্ত বেরিয়ে যাচ্ছে সমানে।
একের পর এক এলোপাতাড়ি কুপিয়ে যাচ্ছে মুহিত।
এক সময় আশরাফ চৌধুরী লুটিয়ে পড়লো মাটিতে।
হাটু মুড়ে বসে আশরাফ চৌধুরীর চুল টেনে বসালো মুহিত।
এর পর দাঁতে দাঁত পিষে বলে উঠলো
তুই মোটেও কোপানোর উস্তাদ নস।এক্সপার্ট হলে আমাকে মারতে সক্ষম হতি।বলেই তাচ্ছিল্য পূর্ণ হেসে উঠলো মুহিত।
― আর শোন, তোর ছেলেই তোর মৃত্যুর কাল হলো রে আহমেদ।আমি চির কৃতজ্ঞ তোর ছেলের কাছে।এজন্য তাকে আমি জেল থেকে পালাতে সাহায্য করেছি।
এবার তুই শান্তিতে মর বলেই গলা বরাবর চালিয়ে দিলো চপার টা।
আশরাফ চৌধুরী চোখ বড় করে হা করে শেষ নিঃশ্বাস নিলেন।

মুহিত দৌড়ে চলে গেলো কফিন দুটোর কাছে।
মেজর আদ্রিয়ান আর সৌম্যকে ধরতে বললো তার বাবার কফিন
আর নিজে কাঁধে তুলে নিলো আদরের ছোট ভাইয়ের ছোট কফিন টি।।

ফাইটিং ক্লাব থেকে বেরিয়ে গেলো মুহিতরা,পরে রইলো মৃত আশরাফ চৌধুরীর ক্ষতবিক্ষত লাশ।যা এই অজানা শহরে ধরার কেউ নেই,কবর ,জানাজা এসব করার ও কেউ নেই।

মেজর আদ্রিয়ান আর্মি হেডকোয়ার্টার এ মুহিতের বাবা আর ভাইয়ের লাশের কথা জানালেন।
ওখান থেকেই লাশ নেবার সমস্ত কিছু রেডি করে দিবেন।
থাইল্যান্ডের কর্পস প্রিজারভেটিং ফ্রিজে কফিন দুটো রেখে চলে এলো মুহিত।

হোটেলে এসে লম্বা শাওয়ার নিয়ে বেরিয়ে ফোন হাতে তুললো মুহিত।
ডায়াল করলো নির্দিষ্ট নম্বরে।
রিং হতেই ফোন তুললো ওপাশের ব্যাক্তি

―সোহাগ ভাই !

#চলবে

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_৩০
#সারিকা_হোসাইন

এক লহমায় কেটে গিয়েছে পনেরটি দিন।সোহাগ নামিরা দের নিয়ে দেশে ফিরে এসেছে।
মিসেস তারিন কোনোভাবেই আর নাফিজ মাহমুদ এর বাংলো তে থাকতে রাজি নন।তিনি তার ছেলে মেয়েদের নিয়ে তার স্বামীর পুরাতন বাড়িটা তে বাকী যে কদিন বাঁচবেন সে কদিন কাটাতে চান।
পুরাতন যেই ক্ষত দীর্ঘ সাড়ে ছয় বছরে কিছুটা সেরে উঠেছে মুহিতের ফোন কল পাবার পর থেকে পুরোনো সেই ক্ষত থেকে চুয়ে চুয়ে যেনো গড়িয়ে পড়ছে লাল টকটকে রক্তের ধারা।

বাংলাদেশ আর্মি হেডকোয়ার্টার মুহিতের বাবা আর ভাইয়ের লাশ বাংলাদেশে আনার সকল ব্যাবস্থা করে দিয়েছে।
আগামীকাল ভোরের ফ্লাইটে তারা বাংলাদেশে পৌঁছুবে।

নামিরা থেকে থেকে শুধু কেঁদেই যাচ্ছে।নামিরার কোলের আড়াই মাসের বাচ্চাটা থেকে থেকে করুন সুরে কেঁদে উঠছে।হয়তো মায়ের কান্না অবুঝ শিশুটিও সহ্য করতে পারছে না।
স্বর্গ বাচ্চাটাকে নামিরার কোল থেকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।একদিকে ভ্যাপসা গরম তার মধ্যে কান্নাকাটি।বাচ্চাটা একদম নেতিয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু এতকিছুর ভিড়ে মিসেস তারিন নির্বিকার।দীর্ঘ বছরের শোক সইতে সইতে পাথরে পরিণত হয়েছেন।
তনুজার কাছে এই মুহূর্তে তারিন কে রোবট মনে হচ্ছে।অবশ্য জন্ত্র মানবী বলাই চলে।
যার হৃদ ক্রিয়া চালানোর জন্য একটা আস্ত মেশিন বুকের ভেতর বসানো হয়েছে সে কি আর নরম দিলের মানুষ আছেন?

কিছু লোক লাগিয়ে বাড়ির পাশের জঙ্গল গুলো পরিস্কার করানো হচ্ছে।কাজের লোকেরা বাড়ি ঘর ধুয়ে মুছে সাফ করছেন।মনে হচ্ছে বিশেষ কোনো অতিথি এই বাড়িতে আসবেন।তার জন্য এতো এতো আয়োজন।

――――――
শুক্রবার,১২ ই আগস্ট
আজকের আবহাওয়া টা মনোরম।আকাশে তীক্ষ্ণ রোদের তেজ নেই।ধরনীতে স্বর্গের হাওয়া বিরাজ করছে সর্বত্র।বাতাসে মিষ্টি একটা গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে যেনো সারাক্ষন।এতো এতো কাজ কর্ম করেও কেউ হাপাচ্ছে না।

মুহিত বিমানে উঠার আগে ফোন করে জানিয়েছে যে,তারা আসছে।
মুহিতের দাদা বাড়ির কিছু নিকট আত্মীয় বাসায় ভিড় করেছে।কেউ কেউ কোরআন তেলাওয়াত, তসবিহ পাঠে ব্যাস্ত।
নামিরার কান্না যেনো শেষ ই হচ্ছে না।
যেই ব্যাথা নতুন অতিথি পেয়ে ভুলতে বসেছিলো সেই ব্যাথা আবার কিভাবে ফিরে এলো?
―ওরে আল্লাহ তুমি কেনো এতো নিষ্ঠুর হলে আমাদের প্রতি?

সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়াতেই পু পু সাইরেন এর আওয়াজ পাওয়া গেলো।
আদনান ওয়াসিফ এর বিশাল তিন তলা বাড়ির খোলা প্রাঙ্গণে প্রথমে একটি পুলিশের গাড়ি প্রবেশ করলো।এর পর দুটো আর্মি জিপ।এরপর মুহিত দের এম্বুলেন্স।
পিছে পিছে এলো মন্ত্রী মহোদয় এর গাড়ি।
নিমিষেই মানুষে গিজগিজ করে উঠলো আদনান ওয়াসিফ এর পরিত্যক্ত খালি বাড়িটি।
কান্নার আওয়াজ বাড়ালো নামিরা।বাইরে বের হবার জন্য পাগল হয়ে গেছে সে।স্বর্গ আর তনুজা কেঁদে চলেছে নামিরাকে জড়িয়ে।
সোহাগ ছোট বাচ্চাটা কে নিয়ে পায়চারি করছে আর চোখের জল মুছছে।
অপরাধীর ন্যায় মুহিত ঘরে প্রবেশ করলো।
তার সারা শরীর ছোট ছোট জখমে ভর্তি ।মুহিতের রোগা মলিন চেহারা দেখে স্বর্গের বুক ধক করে উঠলো।
কিন্তু পরিস্থিতি এখন অন্য ধাঁচের।
মুহিতের কাছে এখন গিয়ে এসব নিয়ে কথা বলার প্রশ্নই আসে না।

মুহিত ড্রয়িং রুমে এসে জোরে ডেকে উঠলো
―মা!
মিসেস তারিন আজ নিজেকে সজ্জিত করেছেন।
গায়ে জড়িয়েছেন ধবধবে সাদা শাড়ি।মধ্যে খানে সিঁথি করে শক্ত করে হাত খোঁপা করে বেঁধে নিলেন।চোখের চশমাটা ঠিক করে মাথায় কাপড় দিয়ে দূতলার আদনান ওয়াসিফ এর ঘর থেকে ধীরপায়ে বেরিয়ে এলেন।

মুহিত তার মায়ের এমন নির্বিকার রূপ দেখে প্রচন্ড ভয় পেয়ে গেলো।তার মা কি পাগল হয়ে গেলো অধিক শোকে?
মা কি আবার হারিয়ে যাবে তাদের জীবন থেকে?

নামিরা সহসাই এসে ঝাপটে ধরলো মুহিত কে।কেঁদে ভাসালো মুহিতের বুক।

নাফিজ মাহমুদ নিজেই কাউকে শান্তনা দেবার অবস্থায় নেই।নিমিষেই পুরো বাড়িটি শোকের মাতমে ছেয়ে গেলো।

মুহিত আজ তার শক্ত খোলস থেকে বেরিয়ে বোনের সাথে মিলে কাঁদছে।ছোট বাচ্চার মতো কাঁদছে মুহিত।
মুহিতের কান্না দেখে স্বর্গ নিজেকে সামলাতে পারছে না।
মেজর আদ্রিয়ান আর সৌম্য এসে মুহিত কে শান্ত করার অনেক চেষ্টা করলো।

মিসেস তারিন এসে মুহিতের সামনে দাঁড়ালেন।
মুহিত অসহায় ভাবে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো
―পাপাকে নিয়ে এসেছি মাম্মা!

মিসেস তারিন আজ একটুও কাঁদলেন না।মুহিত কে কঠিন সুরে আদেশ দিলেন
―যাও তোমার পাপার লাশ গাড়ি থেকে বের করে আনো।তাকে ধোঁয়ানোর ব্যাবস্থা করো।দ্রুত জানাজা যে দিতে হবে মুহিত।

মায়ের আদেশ পেয়ে মুহিত দৌড়ে ফ্রিজিং কারের নিকট আসে।
লাশ গাড়ি থেকে নামানোর আগে পুলিশ আর রিপোর্টার এসে মুহিত কে বিভিন্ন জেরা শুরু করে।

আর্মি জেনারেল এটা দেখে রেগে গিয়ে পুলিশকে ধমকে উঠেন।
পুলিশ সরতেই তিনি আরো কয়েকজন সোলজার ডেকে কফিন গুলো নামাতে আদেশ দেন।

বিশাল বড় ড্রয়িং রুমের ফাঁকা জায়গায় পরপর দুটো খয়েরি রঙের কফিন সাজিয়ে রাখা হয়েছে।
মুহিতের মা আদেশ দিলেন কফিনের ঢাকনা খুলতে।

আদ্রিয়ান আর সৌম্য ঢাকনা খুলতেই নামিরা একবার বাবার কাছে একবার মুকিতের কাছে গিয়ে পাগলের মতো বিলাপ করতে শুরু করে।

মুকিতের ফ্যাকাশে মায়াবী মুখখানা প্রত্যেকটি মানুষের হৃদয় কে মুষড়ে দিলো।কেউ কেউ কষ্টে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।
মুকিতের কফিনের কাছে গিয়ে মিসেস তারিন হাটু ভেঙে বসে পড়লেন।

নরম সুরে ডেকে উঠলেন
―মুকিত!মানিক আমার,এই দেখ মাম্মা বসে আছি,চোখ খুলবি না?

কিন্তু হায় আদরের মুকিত।সে তো চোখ খুলে না।
এবার মিসেস তারিন আদনান ওয়াসিফ এর কফিনের কাছে এলেন।
―আদনান,এই আদনান উঠবে না?
কথা বলবে না আমার সাথে?
অনেক দিন তোমার সাথে মন খুলে কথা হয়না।
আমাকে নিঃস করে দিয়ে বাবা ছেলে কী সুন্দর ঘুমাচ্ছ নাহ?

নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিলেন মিসেস তারিন।হাউমাউ করে কাঁদার ক্ষমতাও হারিয়েছেন বহু আগেই।
একটু কাঁদলেই বুকে অসহনীয় ব্যাথা অনুভূত হয়।দম আটকে আসে।

মুহিত এসে তার মা কে জড়িয়ে ধরলো।সোহাগ কারো কাছে বাচ্চাটা গছিয়ে দিয়ে কফিনের কাছে এসে বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো।
যেই মানুষটা তাকে এতো বড় করলো,বিপদ থেকে উদ্ধার করলো।অথচ সোহাগ সেই মানুষটির কোনো উপকারেই আসলো না।
এর চাইতে নির্মম কিছু কি ধরনীতে আর কিছু আছে?

নিজেকে স্বাভাবিক করে নাফিজ মাহমুদ কে ডাকলেন মিসেস তারিন।
―তোর দোলাভাই এর গোসল এর ব্যাবস্থা কর।

যেহেতু লাশ গুলো দীর্ঘদিন প্রিজারভেটিং করা ছিলো তাই দীর্ঘ সময় এগুলো এভাবে না ফেলে রাখাই ভালো।
রোগ জীবাণু বা ভাইরাস ছড়াতে পারে যখন তখন।

নাফিজ মাহমুদের হুকুমে কয়েকজন লোক এসে গোসলের কাজ শুরু করে দিলো।
একে একে আদনান ওয়াসিফ আর মুকিতের গোসল শেষে তাদের সাদা কাফনের কাপড় পরিয়ে খাটিয়ায় তোলা হলো।

তাদের জানাজা পড়তে দলে দলে মানুষ আসতে শুরু করলো।
আদনান ওয়াসিফ এর সহকর্মীরা এলেন।
হাজার লোকের সমাগমে শেষ হলো জানাজা।

মিসেস তারিন কবর কোথায় হবে সেটা আগেই দেখিয়ে দিয়েছিলেন।
জানাজা শেষে দ্রুত তাদের দাফনের ব্যাবস্থা করা হলো।
সমস্ত কাজ শেষ করতে করতে দুপুর গড়িয়ে রাত নামলো।

কিছু পুলিশ আর আর্মির বড় বড় অফিসাররা ভিড় করেছে মুহিতের বাসায়।
তাদের একটাই প্রশ্ন লাশ ওখানে কিভাবে গেলো?

মুহিত মেঝেতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বসে আছে।বাবা আর ভাইয়ের করুন চেহারা মনে পড়তেই চোখ থেকে খসে পড়লো মোটা মোটা দু ফোটা জল।
প্রশ্নবিদ্ধ নজরে প্রত্যেকে মুহিতের দিকে তাকিয়ে আছে।

নীরবতা ভেঙে মুহিত বলতে শুরু করলো
―যখন সবাই জানাজানি হতে শুরু করে যে নির্বাহী অফিসার আর তার ছেলেকে কেউ খুন করে দিয়েছে,ঠিক সেই মুহূর্তই পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বদলে গিয়েছিলো।রিপোর্টের কোথাও লিখা ছিলো না যে পাপা আর মুকিত কে কুপিয়ে ,শ্বাসরোধ করে মারা হয়েছে।
পাপা আর মুকিতের লাশ সরিয়ে ফেলা হয়েছিলো আর আমাদের বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিলো।

মুহূর্তেই খবরের কাগজে আর সংবাদ শিরোনামে হেডলাইন বের হয় যে সৎ নির্বাহী অফিসার আদনান ওয়াসিফ আর তার পরিবার আগুনে পুড়ে মারা গিয়েছে।তাদের দেহাবশেষ কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
আমি আর মামা অনেক মর্গ অনেক হসপিটাল তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি।কিন্তু কেউ সেই লাশের হদিস দিতে পারেনি।

আর্মি জেনারেল প্রশ্ন করলেন
―কোথায় তোমার সেই মামা মুহিত?
মুহিত আঙ্গুলি দিয়ে নাফিজ মাহমুদ এর দিকে নির্দেশ করলো।
সকলেই মুহিতের আঙ্গুল বরাবর তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলো।

এক যোগে সবাই প্রশ্ন করলেন
―মেজর জেনারেল নাফিজ মাহমুদ তোমার মামা?

মুহিত মাথা নিচু করে জবাব দিলো জি স্যার।

তুমি একথা কেনো এতোদিন আমাদের বলো নি মুহিত? অবাকের স্বরে জানতে চাইলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল।

―আমি চাইনি আমার বাবা আর আর ভাইয়ের মতো মামাও হারিয়ে যাক।আশরাফ চৌধুরী পাপা কে বলেছিলো আমাদের যে হেল্প করবে তাকেই মেরে ফেলবে।

মুহিত কিছু স্থির চিত্র আর পেনড্রাইভ বের করে নিয়ে আসলো তার কক্ষ থেকে।

সেগুলো পুলিশের ডিআইজির হাতে তুলে দিয়ে মুহিত আহত সুরে বললো এখানে আশরাফ চৌধুরীর বিভিন্ন খারাপ কাজের সামিল হওয়া কিছু পুলিশ অফিসার এর তথ্য আছে।যারা মোটা অংকের ঘুষ খায় আর অপরাধ করে বেড়ায়।এখানে তাদের সকল বায়োডাটা আর কি কি অপরাধ করে তার সকল বিবরণ রয়েছে।পাপা নিজে এদের শাস্তি দিতে চেয়েছিলেন।
কিন্তু উনাকেই চিরতরে শেষ করে দেয়া হয়েছে।
আমি চাই আপনারা সকল প্রমাণের ভিত্তিতে তাদের এরেস্ট করুন।দেশকে কলুষিত মুক্ত করুন।

এর পর মুহিত আবার বলতে শুরু করলো―

মা যে বেঁচে ছিলো এটা আশরাফ চৌধুরী জানতেন না।
তিনি কৌশল খাটিয়ে লাশ গুলো থাইল্যান্ড নিয়ে যান।
সেখানে এগুলো এতোগুলো বছর প্রিজারভেটিং করা ছিলো।
উনি কেন এতদিন পর্যন্ত লাশ গুলো রেখেছিলেন তা আমার কাছে অজানা।
হয়তো পাপার মৃত্যুতে দেশে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিলো এজন্য তিনি নিজে বাঁচার জন্য লাশ পাচার করে গুম করে ছিলেন।

আশরাফ চৌধুরী এখন কোথায় আছেন?
জিজ্ঞেস করলেন এক পুলিশ অফিসার।

মুহিত সাবলীল কন্ঠে উত্তর দিলো
বন্দুক যুদ্ধে নিহত হয়েছেন তিনি।
আর্মি অফিসার রা পুলিশ গুলোকে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
নাফিজ মাহমুদ বোনকে বিভিন্ন শান্তনা দিলেন।স্বর্গ এখনো ফুপিয়েই যাচ্ছে।
নামিরা জ্ঞান হারিয়ে পরে রয়েছে।
ইতোমধ্যে বাড়ি খালি হতে শুরু করেছে।ধীরে ধীরে আত্মীয় স্বজন ফিরে যাচ্ছে নিজ নিজ আবাসস্থলে।

মুহিত কে উদ্দেশ্য করে মিসেস তারিন বলে উঠলেন
―তুমি আমার মনের এতদিনের দাউদাউ করে জ্বলা আগুন নিভিয়ে দিয়েছো মুহিত।
তোমার বাবা সত্যি ই আমাদের জন্য তার অবর্তমানে একজন যোগ্য গার্ডিয়ান রেখে গিয়েছে।
এভাবেই আমাদের আগলে রেখো মুহিত ।
বলেই মুহিতের গালে মমতার হাত ছোয়ালেন মিসেস তারিন।

মায়ের আদুরে হাতের পরশে চোখ বন্ধ করে ফেললো মুহিত।টুপ করে গড়িয়ে পড়লো উষ্ণ দুফোটা জল।

মুহিতের আজকে সত্যি ই পিতার যোগ্য পুত্র মনে হচ্ছে।
মুহিত পেরেছে তার বাবা,ভাইয়ের লাশের জানাজা করে কবর দিতে এবং অপরাধীদের শাস্তি দিতে।
তার বাবা ভাইকে বেওয়ারিশ লাশ হতে হয়নি।

************-***********
সমস্ত ঝুট ঝামেলায় পেরিয়ে গেছে একটি মাস।

ধীরে ধীরে ক্ষত গুলো শুকিয়ে যাচ্ছে।
নিজের স্বামী সন্তানের কবরের দিকে তাকিয়েই শান্তিতে বুক ভরে নিঃশাস নেন মিসেস তারিন।
তিনি তার পাশেই পুত্র স্বামীর উপস্থিতি অনুধাবন করতে পারেন।
সবাই ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনযাপন এ অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে।
আশরাফ চৌধুরী নামক মানুষের অস্তিত্ব ও ভুলতে বসেছে সবাই।

কেটে গিয়েছে আরো পনেরো দিন।
আজ সৌম্য আর পিউ এর রিশিপশন এর অনুষ্ঠান।
পিউ একটি লাল খয়েরি রঙের ভারী লেহেঙ্গা পড়েছে,সাথে ভারী ভারী ম্যাচিং করা পাথরের গহনা,ভারী মেকআপ।
সৌম্যের কাছে পিউকে অপ্সরা লাগছে।
বহু কষ্টে বেচারা নিজেকে ধরে রেখেছে।না হলে মন বার বার বলছে
―যা ব্যাটা জড়িয়ে ধরে চুমু খা।ঐটা তোর ই বউ।

সৌম্যের রিশিপশন এর আয়োজন করা হয়েছে সেনাকুঞ্জে।বড় বড় সকল আর্মি অফিসার এসেছেন নিমন্ত্রণ খেতে।

সৌম্য অলরেডি কোয়ার্টার এর জন্য আবেদন করেছে।আজকে আপাতত ভাড়া বাসায় উঠবে।বাসাটা অবশ্য পিউ এর পছন্দতেই নিয়েছে সৌম্য।
বিশাল ড্রয়িং রুম আর খোলা বারান্দা পিউ এর খুব পছন্দ।পিউ এর সকল চাওয়া পাওয়া অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে সৌম্য।

বিশাল জাকজমক ভাবে শেষ হয়ে গেলো সৌম্য আর পিউ এর বিয়ের অনুষ্ঠান।

মুহিত কে টেনে কমিউনিটি সেন্টার এর একটি চিপায় নিয়ে এসেছে স্বর্গ।
মুহিতের গলা জড়িয়ে ধরে আদুরে স্বরে জানতে চাইলো
―আমাদের টা কবে হবে?

মুহিত স্বর্গের ঠোঁটে চুমু দিয়ে আদর মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলো আরেকটু গুছিয়ে নেই সবকিছু?
স্বর্গ মন খারাপ করে দৃষ্টি অবনত করে সম্মতি জানালো।

স্বর্গের মুখের দিকে তাকিয়ে মুহিত মনে মনে অনেক কষ্টে পেলো।ভাষায় প্রকাশ না করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো
―বাসায় চলো।

#চলবে।

তোমার জন্য সিন্ধুর নীল পর্ব-২৭+২৮

0

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_২৭
#সারিকা_হোসাইন

~~~~~~

তাহলে ধরেই ফেললে আমাকে মেজর মুহিত ওয়াসিফ?

কথাটা বলে আয়েশ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো আহিয়ান।
এর পর চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ মৌন রইলো।
এরপর দুই হাত ভাঁজ করে টেবিলের উপর রেখে তাতে থুতনির ভর দিয়ে মুহিত কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো―

আমি যে পাগল নই এটা কিভাবে তুমি প্রমান করবে মেজর মুহির ওয়াসিফ?

―আমি তোমাকে প্রমান করতে আসিনি।
এসেছি বাম্পার এক অফার নিয়ে। সাবলীল উত্তর মুহিতের।

ভ্রু কুঁচকে মুহিতের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো আহিয়ান।
কি এমন অফার নিয়ে হাজির হয়েছে সে?

গলা খাকরি দিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠলো মুহিত
তোমাকে জেল থেকে বের হবার সকল ব্যাবস্থা আমি নিজে করে দেবো আহিয়ান।বিনিময়ে আশরাফ চৌধুরী কে আমার হাতে তুলে দেবে তুমি!তার সাথে বহু হিসেব নিকেশ বাকী পরে আছে আমার।

তুমি আমাকে কেনো পালাতে সাহায্য করবে?আমিও তো তোমার ক্ষতি করতে চেয়েছি।
―তোমার সাথে আমার সেরকম কোনো শত্রুতা নেই প্লাস তোমাকে ভালো হবার একটা চান্স দিলাম।আর তুমি যেই ভুলটা করেছিলে সেটা ভালোবেসে পাগলামি করেছিলে।
আর কোথাও না কোথাও তোমার জন্য আমার মনে একটা সফট কর্ণার রয়েছে।
কারন পিতৃহীন থেকে মাতৃহীন হয়ে দুনিয়াতে বেঁচে থাকা সবচাইতে কষ্টের।হয়তো তোমার মা বেঁচে থাকলে আজকে তোমার লাইফের মোড় অন্য কোথাও ঘুরে যেতো।

মায়ের কথা শুনতেই আহিয়ান এর চোখে জ্বালা করতে শুরু করলো।
দেখতে কতো মিষ্টি ছিলো তার মা।মায়ের পুরাতন স্মৃতি তে নিমিষেই ডুবে গেলো আহিয়ান।

আহিয়ান এর সকল দুস্টুমি মেনে আহিয়ানের পিছে পিছে সারা বাড়িময় ঘুরে বেড়াতো মিসেস অহনা।আহিয়ান ছিলো চঞ্চল প্রকৃতির দুষ্ট ছেলে।বহুবার ঘরের দামি জিনিস ভেঙে ফেলেছে,মা কে ইচ্ছে করে ব্যাথা দিয়েছে,খাবার নিয়ে ঝামেলা করেছে।কোনো দিনও মিসেস অহনা আহিয়ান কে একটা মার তো দূরে থাক ধমক পর্যন্ত দেন নি।সারা রাত মাথায় বিলি কেটে গল্প শোনাতো।মায়ের বুকের ওম বহুদিন ধরে পায়না আহিয়ান।

বাবার সকল কুকীর্তি থেকে সবসময় বুকের মাঝে আগলে দূরে দূরে রেখেছেন।
কিন্তু আহিয়ান?
সে তো পারেনি তার মা কে আগলে রাখতে।রাক্ষস টা ঠিক তার মাকে কব্জা করে খেয়ে ফেলেছে।আহিয়ান লুকিয়ে লুকিয়ে শুধু দেখেছে,কিন্তু কারো কাছে আজ পর্যন্ত প্রকাশ টুকু করতে পারেনি।

আচ্ছা আহিয়ানের এই কুকর্মের জন্য তার মা কি ওপারে অনেক কষ্ট পাচ্ছে?

মুহিতের গমগমে কন্ঠে আহিয়ানের ধ্যান ছুটলো।

―তোমাকে আমার প্রয়োজন আহিয়ান!
আমার কথায় রাজি হয়ে যাও আহিয়ান।
ধরে নিতে পারো
―এ গোল্ডেন অপুরচুনিটি ফর ইয়ু।
কিছুক্ষন ভেবে আহিয়ান বলে উঠলো―

আমি তো দাগী আসামিতে পরিণত হয়েছি, যতো সহজে তুমি আমাকে পালাতে হেল্প করবে ভাবছো বিষয় টা আসলে অতোটা সহজ নয়।

মুহিত ভাবলেশহীন ভাবে উত্তর দিলো সেটা নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।
তুমি কি জেল থেকে বের হতে চাও নাকি আজীবন এখানেই পঁচে মরতে চাও সেটা তোমার ব্যাপার।
মনে হচ্ছে তুমি এখানেই কমফোর্ট ফিল করছো।থাকো তাহলে আমি উঠি।আমার শিকার আমি নিজেই ঠিক খুঁজে নেবো বলেই কলার ঝেড়ে উঠে দাঁড়ালো মুহিত।

আহিয়ান তোষামোদ এর সুরে বললো
আরে মেজর এতো অল্পতেই রেগে গেলে কিভাবে হবে?
ভাবার সময় টাতো দিবে!
তুমি পাপার সাথে ঐরকম কিছুই করছে চাচ্ছ যা মোশতাকের সাথে করেছো তাইনা?
বলেই চোখ টিপলো আহিয়ান।

মুহিতের ভাবের কোনো পরিবর্তন ঘটলো না।
আহিয়ান আবার বলে উঠলো
তোমার দম আছে বলতে হবে মেজর।
আম প্রাউড অফ ইউ।
―আম রিয়েলি প্রাউড অফ ইউ বলেই হাত তালি দিলো আহিয়ান।

আমি অবশ্যই তোমাকে হেল্প করবো,সে শুধু তোমার বাপ ভাইয়ের খুনি নয়,আমার সহজ সরল অবলা মায়ের খুনিও ওই কসাই টা বলেই রক্তচক্ষু নিয়ে মুহিতের দিকে তাকিয়ে হাত পাঞ্চ করে মুহিতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো
ডিল?
মুহিত আহিয়ানের পাঞ্চে হিট করে বললো
ডিল!

――――
নিস্তব্ধ কক্ষের মাঝে হঠাৎই ঘড়ির টিকটিক শব্দে লাফিয়ে ধড়ফড় করে উঠে বসলেন তন্দ্রাচ্ছন্ন আশরাফ চৌধুরী।বসে থাকতে থাকতে কখন যে দুই চোখ লেগে গিয়েছিলো বুঝতেই পারেন নি তিনি।
কতো দিন ধরে এভাবে বসে বসে সময় পার করছেন তার হিসেব অক্ষরে অক্ষরে করে রেখেছেন তিনি।ওই মেজর কে এর থেকেও জাহান্নাম আজাব ভোগ করাবেন তিনি।

পরিবেশ শুনশান,কোনো মানুষের আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না।মাঝে মাঝে দূর রাস্তা থেকে বড় বড় ট্রাকের শব্দ ভেসে আসছে।আর দুই একটা নেড়ি কুকুরের মৃদু শব্দে ঘেউ ঘেউ শব্দ শোনা যাচ্ছে।
হাঁটুতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালেন আশরাফ চৌধুরী।পা টিপে টিপে বের হলেন তার গোপন কুঠুরি থেকে।
তিন তলায় নিজের শয়ন কক্ষ পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারলেই অর্ধেক কাজ কমপ্লিট হয়ে যাবে।শুধু অপেক্ষা আলমারি থেকে গোপন ফোনটা বের করার।

অন্ধকার হাতড়ে সিঁড়ির রেলিং বেয়ে বেয়ে দূতলা পর্যন্ত উঠলেন।হঠাৎই সিঁড়ি ঘরের কর্নারে থাকা শোপিস রেকের সাথে বেঁধে রেক সমেত পড়ে গেলেন।
নিমিষেই ঝনঝন শব্দে আলোড়িত হয়ে গেলো নির্জন বাসটা।

ভয়ে সিঁড়ির চিপায় উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লেন আশরাফ চৌধুরী।মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি এখন হার্ট এট্যাক এসে যাবে।
বুকের ব্যাথায় দম বের হবার উপক্রম হলো তার।
কিছুক্ষন ওভাবেই শুয়ে থেকে নিজেকে স্বাভাবিক করে মেজর মুহিতের গুষ্টির পিন্ডি চটকে উঠে দাঁড়ালেন।
আবার রেলিং ধরে ধরে ধীর পায়ে হাঁটা ধরলেন।
এবার সুযোগ পেলে চামড়া তুলে নেবেন তিনি ওই মেজরের।

হাতড়ে হাতড়ে নিজের কক্ষের সামনে এসে দেখলেন দরজা খোলা।
খোলা দরজা দেখে অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকালেন।পরে মুহূর্তেই মনে পড়লো মানুষ সুযোগ বুঝে তার বাড়িতে চুরির অভিযান ও চালায় মানুষ।আমাকে তো খুঁজতে আসে না,আসে কোথা থেকে কি চুরি করা যাবে সেটা দেখতে।
দামি দামি সব নিয়ে যাচ্ছে এক এক করে।যেনো দান বাক্স খুলে বসেছি।
তাচ্ছিল্য হাসলেন আশরাফ চৌধুরী।
সালা সবাই চোর দোষ খালি আমার একার।
সকল ভাবনা ফেলে আলমারির দিকে এগিয়ে গেলেন।যতো যাই হোকনা কেনো অতো সহজে তিনি ওই হাঁটুর বয়সী মেজরের হাতে ধরা দিবেন না।

বিনা শব্দে রুমে প্রবেশ করে আলমারি খুলে বের করলেন নিজের গোপন ফোন।
সুইচ অন করে ডায়াল করলেন কাঙ্খিত নম্বর।
একবার রিং হয়ে কেটে গেলো।
রাগে ঠোঁট কামড়ে চোখ উল্টালেন আশরাফ চৌধুরী।
বিশ্রী গালাগাল দিয়ে আবার ফোন কানে তুললেন।
রিং হতে হতে কেটে যাবে এমন মুহূর্তে ফোনটি রিসিভ করলো ওপাশের ব্যাক্তি।
খুশিতে ঠোঁট গলিয়ে বেরিয়ে এলো দুপাটি চকচকে দাঁত।
―সোয়াদদী (হ্যালো)
―নি আহমেদ (আমি আহমেদ)
―ছুঁওয়াই ডুওয়াই (আমাকে সাহায্য করো)

ওপাশের ব্যাক্তির কথায় প্রশস্ত হলো আশরাফ চৌধুরীর হাসি।আরো কিছু কথা বলে ফোন কেটে দিয়ে আবার গুপ্ত কুঠুরির উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো।

রাত টা কোনো ভাবে কাটলেই হলো।মেজর মুহিত তুই আমার ছায়ার ও কোনো খুঁজ পাবি না।বলেই হো হো করে হেসে উঠলো।

*******
―তুমি কি বলছো মুহিত এসব?
তোমার মাথা ঠিক আছে?
এই কাজ আমি কিভাবে করবো?

―স্যার আমি আজ পর্যন্ত আপনার কাছে কোনো দিন সাহায্য চাইনি।প্লিজ স্যার আমাকে এই হেল্প টুকু করুন।

ছেলেটা দাগী আসামি মুহিত তোমাকে এটা বুঝতে হবে!

কেউ যদি তার ভুল বুঝতে পেরে ভালো পথে ফিরে আসতে চায় তাহলে তাকে সেই সুযোগ দেয়া উচিত স্যার।

যেখানে সৃষ্টিকর্তা আমাদের এতো এতো ভুল ক্ষমা করে তওবা করে তার কাছে ফিরে আসার সুযোগ দেয়,সেখানে আমরা তো নগন্য মানুষ স্যার।

মুহিত সবই বুঝতে পারছি তোমার কথা।কিন্তু কেউ যদি জানতে পারে আর্মি জেনারেল স্বয়ং এর সাথে জড়িত আছে আমার উপর কেমন ঝড় ঝাপটা আসবে তুমি বুঝতে পারছো?

স্যার আপনি সেসব কিছুই ভাববেন না।আমার টিম নিয়ে ঠিক আমি সব হ্যান্ডেল করবো।আপনি শুধু পুলিশ সুপার কে ম্যানেজ করবেন।
প্লিজ স্যার।

আর্মি জেনারেল মুহিতের পিঠ চাপড়ে মাথা নিচু করে প্রস্থান নিলেন।
মুহিত প্রশস্ত হেসে বলে উঠলো
থ্যাঙ্ক ইউ স্যার।

―――――
আজকে আহিয়ানের শুনানি।তার মেন্টাল হেলথ পরীক্ষা নিরীক্ষা করে আদালতে নেয়া হবে।তারিখের পর তারিখ বেড়েই যাচ্ছে কিন্তু আহিয়ানের সুস্থ হবার কোনো নাম নেই।
ডাক্তাররাও সমস্যাটা কোথায় সেটা ধরতে পারছেন না।

ক্রিমিনাল ভ্যানে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে আহিয়ান কে তোলা হলো।সাথে দুটো কনস্টেবল।
গাড়ি ছুটে চলেছে হসপিটাল এর দিকে।
সামনে পুলিশের ডিউটিরত এস আই এর গাড়ি মাঝখানে আহিয়ানের গাড়ি,পিছনে মটর সাইকেল এ দুজন কালো পোশাকে আবৃত কারী ব্যাক্তি।

গাড়ি চলতে চলতে হঠাৎ ই নির্জন একটি রাস্তায় এসে ব্রেক কষলো।
সামনে কেউ তুমুল মারামারি লাগিয়েছে রাস্তা বন্ধ করে।
দুই পাশ থেকেই রাস্তা বন্ধ করেছে ছেলে গুলো।
কি নিয়ে তাদের মারামারি এটাই কেউ বুঝতে পারছে না।
এস আই কনস্টেবল দুটোকে নির্দেশ দিলেন গাড়ি থেকে নামতে।

ছেলে গুলো নিজেদের গাড়ি গুলো রাস্তায় এমন ভাবে পার্কিং করেছে কোনো পাশ থেকেই অন্য গাড়ি গুলো ঢুকতে পারছে না।।

কনস্টেবল নামতেই কালো পোশাকের লোক গুলো পুলিশ ভ্যান এর সাটার এর হ্যাজবল খুলে সুনিপুণ কৌশলে আহিয়ান কে বের করে তাদের বাইকে বসালো।
উল্টো দিকের ফাঁকা রাস্তা দিয়ে বাইক জোরে টান দিয়ে ধুলো উড়িয়ে নিমিষেই হারিয়ে গেল অজানা গন্তব্যে।

কিছুক্ষণ বাদে মারামারি থামিয়ে কনস্টেবল দুটো পুলিশ ভ্যানে এসেই চোখ বড় বড় করে ফেললো।
এটা কিভাবে সম্ভব।
তারা তো আহিয়ান কে হ্যান্ডকাফ সমেত গাড়ির সিটের সাথে শিকল দিয়ে তালা দিয়ে গেছিলো।
নিমিষেই খবর পৌঁছে গেলো উপর মহল পর্যন্ত।
এস আই দৌড়ে এসে পড়ে থাকা হ্যান্ডকাফ দেখে বলে উঠলেন
―ওহ শীট।

শো কজ কি করবেন সেটা ভেবেই ঘাম ছুটে গেলো প্রত্যেকের।

মানুষ তো অবশ্যই প্রশাসনের অক্ষমতার দিকে আঙ্গুল তুলবে।
বিষয়টা শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো হয়ে গেলো।
দ্রুত মর্গ থেকে এক্সিডেন্ট এ মারা যাওয়া চেহারা বিকৃত বেনামি একটি লাশ নিয়ে মিডিয়া ডেকে পুলিশ সুপার জানিয়ে দিলেন

আদালতে নেবার পথে গাড়ি থেকে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করে আহিয়ান।
একদিকে পুলিশের ধাওয়া অন্যদিকে ব্যাস্ত রাস্তা ।
হঠাৎই সিলিন্ডার ভর্তি একটা ট্রাক এসে আহিয়ান কে পিষে দেয়।
সাথে সাথেই স্পট ডেট হয়ে যায় আহিয়ানের।

কু কথা বাতাসে ছড়ায় বেশি।
ঠিক তেমন ভাবেই নিমিষের মধ্যেই আহিয়ানের এক্সিডেন্ট করে মৃত্যুর খবর পুরো শহর ছড়িয়ে গেলো।
কেউ কেউ খুব খুশি হলো আবার কেউ কেউ দুঃখ পেলো।

――――
পেরিয়ে গেছে দুটো দিন।আহিয়ানের সেই জাহাজে আহিয়ান কে তুলে দিতে এসেছে মুহিত আর মেজর আদ্রিয়ান।
মুহিত কে জড়িয়ে ধরে আহিয়ান বলে উঠলো
―যেই উপহার তুমি আমাকে দিয়েছো মেজর এর এহসান একদিন ঠিক চুকাবো ব্রো।
বলেই চোখ মুছে দ্রুত জাহাজে উঠে গেলো।
মুহূর্তেই ভো ভো শব্দ করে কালো ধোঁয়া উড়িয়ে পতেঙ্গা বন্দরের ছোট ছোট ঢেউ চিড়ে ধীরে ধীরে চলতে লাগলো ডেড সৌল।
এর পর স্পিড বাড়তে থাকলো।ধীরে তা মিলিয়ে গেলো সমুদ্রের ঘোর অন্ধকারে।

আহিয়ান যাবার আগে মুহিত কে অনেক ক্লু দিয়ে গেছে।সেই হিসেবেই মুহিত তার পরবর্তী কাজ শুরু করবে।

রাতটা কোনো ভাবে কাটাবে তারা এখানে।সকালে নোভোএয়ারে তাদের ডমেস্টিক ফ্লাইট আছে।

★★★
চট্রগ্রাম শাহ আমানত বিমান বন্দর এ এসে পৌঁছালো মুহিত আর আদ্রিয়ান।
ইমারজেন্সি টিকিট কাটা আছে তাদের।
বিমানবন্দরে ঢুকতেই এক বিদেশি পর্যটক এর সাথে ধাক্কা খায় আহিয়ান।পর্যটক তার আপন ভাষায় কিছু কথা বলে উঠে।
আহিয়ান ইংরেজিতে প্রশ্ন করলে দৌড়ে আসে পর্যটকের গাইড।
সরি স্যার,সে থাইল্যান্ডের নাগরিক।এখানে ঘুরতে এসেছে।তারা ইংরেজি বলতে পারেনা।
মুহিত আর আদ্রিয়ান ভদ্রতাসূচক আরো কিছু আলাপ করে ডমেস্টিটিক এরিয়াতে এসে নিজেদের টিকিটের সব কিছু ঠিক করে বিমানে উঠে বসে।

মুহিতের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে কেনো ওই বিল্ডিং এ বার বার গিয়েও টাইলস গুলো চেক করে দেখলো না।কেনো তার মাথায় এই বুদ্ধি আগে এলো না।
বিমান ছাড়বে সেই অনাউন্স বেজে উঠলো।
সিট বেল্ট বেঁধে একটা ম্যাগাজিন হাতে নিলো মুহিত।
অল্প সময়ের জার্নি।
একটু পরেই প্লেন ল্যান্ড করবে।
এয়ারপোর্ট থেকে বের হতেই সে আদ্রিয়ান কে নিয়ে চৌধুরী ম্যানশন এ যাবে।

*****
সকল ঝামেলা পেরিয়ে এক ঘন্টার একটু বেশি সময় লাগলো মুহিত আর আদ্রিয়ান এর এয়ারপোর্ট থেকে বের হতে।
ঢাকা বিমানবন্দরের পার্কিং এরিয়াতে আসতেই সৌম্যের দেখা পাওয়া গেলো।গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে।
তাদেরকে দেখেই গাড়ি স্টার্ট দিলো।
গাড়িতে উঠে বসতেই মুহিত বলে উঠলো আশরাফ চৌধুরীর বাড়িতে চলো ক্যাপ্টেন।

রাস্তায় জ্যাম ঠেলে আসতে আসতে চল্লিশ মিনিট সময় লাগলো চৌধুরী ম্যানশনে পৌঁছাতে।
গাড়ি থেকে নেমেই দৌড়ে ভেতরে প্রবেশ করলো তিনজনে।
গ্রাউন্ড ফ্লোরে দক্ষিণ পাশের প্রত্যেকটি টাইলসে হাত দিয়ে বাড়ি দিতে দিতে এক জায়গায় গিয়ে ফাঁপা মনে হলো।
পাশেই একটা টাইলস এ ছোট হ্যান্ডেল এর মতো দেখা গেলো।
সেটা ধরে টান দিতেই কূপের মুখের মতো গর্ত দেখা গেলো সাথে স্টিলের মই যা নিচের ওয়ালের সাথে ফিটিং করা।
মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে ধীরে ধীরে নেমে পড়লো তিন জনই।

ভেতরে ঢুকতেই তাদের চোখ ছানাবড়া।
ঝকঝকে পরিপাটি গুছানো কক্ষ।দেখেই বোঝা যাচ্ছে এখানে কেউ অবস্থান করছে নিয়মিত।
প্যাকেট জাত খাবারের খোসা ছড়িয়ে আছে সর্বত্র।
তন্ন তন্ন করে সারা কক্ষ খুঁজেও আশরাফ চৌধুরী কে পাওয়া গেলো না।
দৌড়ে উপরে উঠলো তিন জনেই।
চার তলা থেকে চারটি মিনি রেকর্ডার ডিভাইস বের করে আনলো মুহিত।
সেগুলোর মেমরি খুলে প্রত্যেকেই নিজেদের ফোনে লাগালো।

প্রথম টা থেকে কোনো সাউন্ড পাওয়া গেলো না।দ্বিতীয় টা থেকে ঝনঝন শব্দে তারা সজাগ হলো।
আর কোনো শব্দ নেই সেটাতে।

তৃতীয় টা থেকে অনেকক্ষন বাদে অদ্ভুত কিছু ভাষা শুনতে পাওয়া গেলো।
ভ্রু কুঁচকে এলো প্রত্যেকের।
আদ্রিয়ান বলে উঠলো
কমরেড ভাষা গুলো খুব পরিচিত লাগছে।
মাথায় জোর দিতেই মনে পড়লো কোথায় শুনেছে সেই ভাষা।

সেই থাইল্যান্ডের পর্যটকের কাছে।

রেকর্ডেড কথা গুলো গুগল ট্রান্সলেট করে অর্থ বুঝতেই মুহিতের হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো।
সজোরে দেয়ালে এক ঘুষি বসিয়ে দিলো।

মুহূর্তেই বাঁকা হাসলো মুহিত।
চলুন মেজর আদ্রিয়ান থাইল্যান্ড যাওয়া যাক।

#চলবে।

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_২৮
#সারিকা_হোসাইন

ব্যাঙ্কক,ফুকেট

থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাঙ্কক এর ফুকেটের সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়নি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।কিন্ত এই ফুকেট দিনের বেলায় যতোটা সুন্দর মোহনীয় রাতের বেলায় ততোটাই ভয়ংকর।একটু এদিক সেদিক হলেই ঘটে যেতে পারে দুর্ঘটনা।
চুরি,ডাকাতি,স্মাগলিং,সে*ক্স ক্লাব,ক্যাসিনো সবকিছু গড়ে উঠেছে ফুকেট এর বাংলা রোডে।এই রোডে সন্ধ্যার পর যে কোনো ক্রাইম ঘটার চান্স থাকে আশি শতাংশের উপরে।বিদেশী পর্যটকদের জন্য বাংলা রোড কে রাতের বেলা রেড এরিয়া হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।

টানা সাড়ে তিন ঘন্টা জার্নি করে ব্যাঙ্কক সুবর্ণ ভূমি এয়ারপোর্ট এসে পৌঁছেছে আদ্রিয়ান,সৌম্য আর মুহিত।

ইকোনোমিক টিকিটের ব্যাবস্থা না থাকায় বিজনেস ক্লাসে আসার জন্য একেকজন কে গুনতে হয়েছে সত্তর হাজার টাকা।
তাদের কে ওয়েলকাম করার জন্য প্ল্যাকার্ড হাতে দাঁড়িয়ে আছেন তাদের গাইড থাই আব্বাস।
লোকটির বয়স চল্লিশের কাছাকাছি।থাইল্যান্ড সম্পর্কে এতোই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন যে, নামের সাথে যুক্ত হয়ে গেছে” থাই”

আব্বাসের সহায়তায় তারা তাদের লাগেজ নিয়ে ফুকেট এর পশ একটি হোটেল নভোটেল ফুকেট সিটি তে উঠে।
মূলত তারা এসেছে এক ঢিলে দুই পাখি মারতে।রথ দেখা কলা বেঁচা যাকে বলে।
এর মাঝে সুন্দরী মেয়েদের দিয়ে বডি ম্যাসাজ করাতে পারলে মন্দ হয় না!

হোটেলে ঢুকে ফ্রি ওয়াইফাই কানেক্ট হতে না হতেই সৌম্য আর মুহিতের ফোনে ভিডিও কলের নোটিফিকেশন আসতে শুরু করলো।
বিভিন্ন ধরনের মেসেজ দিয়ে ভরিয়ে ফেলেছে পিউ আর স্বর্গ।
একটাই সতর্ক বাণী
―সাদা রঙের মেয়ে মানুষ থেকে একশত হাত দূরে।

মেজর আদ্রিয়ান বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে হো হো করে হাসতে লাগলো।কারন সে স্বাধীন।তাকে বলার মতো কেউ নেই।
তার মতে
― সিঙ্গেল লাইফ ইজ বেস্ট।
―মিঙেল হলেই যতো প্যারা।

মুহিত আর সৌম্যকে উদ্দেশ্য করে চোখ টিপে আদ্রিয়ান বলে উঠলো
―আমি বডি ম্যাসাজ ও নিবো, নাইট ক্লাবেও যাবো,আর বিচেও হাফপ্যান্ট পরে শুয়ে থাকবো।
বলেই মাথার পিছে দুই হাত ভাঁজ করে দিয়ে পায়ের উপর পা তুলে শুয়ে থাকলো।

আদ্রিয়ান এর কথা শুনে মুহিত আর সৌম্য চোখ চাওয়া চাওয়ি করলো।কারন তারা অসহায়।তারা বউয়ের বন্দী কারাগারে।

মুহূর্তেই মুহিতের ফোন ভো ভো শব্দে কেঁপে উঠলো।
স্ক্রিনে দৃষ্টি ফেলতেই নিজের আদুরে বউয়ের নম্বর দেখে ঠোঁটের হাসি মিইয়ে গেলো।
এখনই শুরু হবে একশ একটা প্রশ্নের জবাব উত্তর।

হলোও তাই।মুহিত ফোন তুলে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে স্বর্গ
বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলো সাথে একশত বার শাশালো যাতে ছোট পোশাক পরিহিত মেয়েদের দিকে চোখ না দেয় মুহিত।
তাহলে স্বর্গ মুহিতের চোখ উপরে ফেলবে।

মুহিত শুধু আচ্ছা,আচ্ছা বলে বাধ্য বাচ্চার ন্যায় ফোন কেটে দিলো।

স্বর্গ ফোন কাটার সাথে সাথেই পিউ ফোন করলো সৌম্যের ফোনে।
ঐ একই হুমকি ধামকি।
―শালার আসামি ধরতে এসেও শান্তি নেই দেখা যাচ্ছে বলে বালিশ দিয়ে মাথা চেপে ধরলো সৌম্য।
কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে দুপুরের খাবার খেতে হোটেলের রুফটপ রেস্টুরেন্টে গেলো তারা।
এটাই প্রথম থাইল্যান্ড ভ্রমন তাদের।এখানকার খাওয়াদাওয়া, কৃষ্টি,কালচার কিছুই জানে না তারা।আর কতো রকম দেশে যে তাদের ভ্রমন করতে হবে সেটাও তারা জানেনা।

মেনু কার্ড নিয়ে খাবারের নাম দেখতে থাকলো।
সৌম্য তো ভয়েই শেষ যদি পর্ক দিয়ে রান্না করে দেয়?
ভাবতেই চোখ মুখ কুঁচকে জিভ বের করে আস্তাগফিরুল্লাহ বলে উঠলো।
সৌম্যের এমন অবস্থা দেখে মুহিত জিজ্ঞেস করলো
―উজবুকের মতো আচরণ করছো কেনো ক্যাপ্টেন?
সৌম্যের উত্তর না শুনেই ওয়াইটার ডাকলো মুহিত।
মুহিত সবাইকে বোঝালো কোনটা কি খাবার আর তারা কোনটা খাবে?
সকলের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মুহিত ওর্ডার দিলো থাই স্টীম বোট,সৌম্য ভাত প্রিয় মানুষ সে ওর্ডার দিলো খাও ক্লুখ ক্রবি আর আদ্রিয়ান ওর্ডার দিলো চিকেন সাতায়।
গুগল ঘেঁটে খাবার সম্পর্কে আইডিয়া নিয়ে নিয়েছে তারা।এবার টেস্ট করার পালা।

কিছুক্ষণ পরেই তাদের অর্ডারকৃত খাবার চলে এলো।
সৌম্য ভয়ে ভয়ে খাবার মুখে তুললো।খাবার খেয়ে সে তার মন্তব্য ব্যাক্ত করলো।
―এতো কঠিন নামের কি দরকার ছিলো?চিংড়ি ভর্তা দিয়ে ভাত মাখানো বললেই তো সহজ হতো।

―বেশি কথা না বলে খাও ক্যাপ্টেন বলেই ফুটন্ত ভেজিটেবল আর চিকেন স্টক এ পাতলা স্লাইস করে কাটা মুরগির মাংস চুবালো মুহিত।

সৌম্য খেতে খেতে প্রশ্ন করলো
মেজর আপনি এখানে কোথায় খুঁজে পাবেন আপনার কাঙ্ক্ষিত আশরাফ চৌধুরী কে?
―সন্ধ্যে নামলেই দেখতে পাবে বলেই চপ স্টিক দিয়ে ডুবানো মাংস টা তুলে মুখে পুড়লো মুহিত।
খাবার সময় বেশি কথা মুহিতের পছন্দ নয়।এজন্য সৌম্য আর ঘাটালো না বেশি।

――――
পায়ের উপর পা তুলে বসে আছেন আশরাফ চৌধুরী।পেছনে দুজন মেয়ে গরম তেল মালিসের মাধ্যমে তাকে ম্যাসাজ দিয়ে যাচ্ছে।মেয়ে গুলোকে কক্ষে নিয়ে শুয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে আশরাফ চৌধুরীর।কিন্তু মুখে কিছুই প্রকাশ করলেন না।
মুহিতের কথা মনে পড়তেই বিদঘুটে হেসে উঠলেন।
তার হাসিতে মেয়ে গুলো ম্যাসাজ বন্ধ করে দূরে সরে দাঁড়ালো।

―আর কিভাবে আমায় খুঁজে পাবি মেজর?
অনেক দৌড় করিয়েছিস আমাকে।এবার তোকে কি করি আমি তুই শুধু দেখ।
লাশ ধরে কাঁদার জন্য ও কোনো মানুষ পাবি না বলেই হাতে থাকা বিয়ারের ক্যান ছুড়ে মারলেন ।

মুহিত যদি কোনোভাবে এখানেও চলে আসে তবে জ্যান্ত পুতে দেবেন থাইল্যান্ডের মাটিতে।
বাংলাদেশের চাইতেও আশরাফ চৌধুরীর জন্য নির্ভরযোগ্য স্থান থাইল্যান্ড।
এখান থেকেই তার ব্যাবসা জীবনের হাতে খড়ি।
ঘুরতে আসা কতো নারী পর্যটক কে অপহরণ করে পতিতালয়ে দিয়ে দিয়েছে আশরাফ চৌধুরী তার কোনো ইয়াত্তা নেই।
বিনিময়ে হাতিয়েছে লক্ষ লক্ষ টাকা।
ধীরে ধীরে পোক্ত আবাস গড়েছেন এখানে।
ছেলেটার জন্য এতোদিন দেশে ফিরে গিয়েছিলেন।
কিন্তু হারামিটা তার সব শেষ করে দিলো।

হঠাৎই আশরাফ চৌধুরীর কক্ষে আট জন্য থাই ছেলে প্রবেশ করলো।প্রত্যেকের উচ্চতা ছয় ফিট।সাথে মাসেল যুক্ত বডি।প্রত্যেকেই কারাতে স্পেশাল।
এবার আর শুকনো মাটিতে বসে থাকবেন না আশরাফ চৌধুরী।ওই লাফাঙ্গা মেজর কে একদম ভরসা নেই।যখন তখন তাকে পাকড়াও করতে চলে আসবে।
সেই জন্যই তো এতো আয়োজন।
গেট কিপার খলিল,মোশতাক আহমেদ এর মৃত্যু কিভাবে হয়েছে তা একটু হলেও আঁচ করতে পেরেছেন আশরাফ চৌধুরী।
পুলিশকে ঘোল খাওয়ানো গেলেও তাকে ভুলানো এতো সহজ নয়।
মাথার চুল বাতাসে পাকেনি তার।

এবার মুহিত কে হাতের কাছে পেলে এই ছেলে গুলোকে দিয়ে টাইট দেয়াবেন আর তিনি বসে বসে উপভোগ করবেন আর হাত তালি দিবেন।
মুহিতের চাটনী বানানো হচ্ছে ভাবতেই খুশিতে চোখ বন্ধ হয়ে এলো আশরাফ চৌধুরীর।

―――――
পৃথিবীতে মানুষের কাছ থেকে কঠিন কোনো সত্য বের করার প্রধান উপায় হচ্ছে ইমোশনাল ব্ল্যাক মিল।
মুহিত এটাই ট্রাই করেছে আহিয়ান এর উপর।
মুহিত জানতো আহিয়ানের মা নেই।তাই বলে তার মা কে আশরাফ চৌধুরী খুন করে দিয়েছে এটা মুহিত স্বপ্নেও ভাবেনি।

সহধর্মিণী হয় আত্মার আত্মা,সব চেয়ে কাছের বন্ধু,ভালো থাকার মেডিসিন।যাকে একটু রুষ্ট স্বরে কথা বললে কীয়তক্ষন বাদে নিজেরই বুকে কষ্ট অনুভূত হয়।
তাকেই কিভাবে কেউ হত্যা করতে পারে?
কতোটা জঘন্য এই আশরাফ চৌধুরী?
ভেবে উত্তর খুজে পায়না মুহিত।

ধীরে ধীরে থাইল্যান্ডের আকাশের সূর্য দিগন্তে হারাচ্ছে।সময়টা এখন গোধূলী।একটু পরেই নেমে আসবে অন্ধকার।কিন্তু বাঙলা রোড সেজে উঠবে ঝকঝকে আলোতে,চলবে দেহ ব্যাবসায়ী দের হাঁকডাক।সাথে ক্যাসিনো,বিভিন্ন ড্রাগস এর আসর আর ডাকাতি ছিনতাই।
মুহিত তৈরি হয়ে নিচ্ছে দ্রুত।
আদ্রিয়ান আর সৌম্য অসময়ে ঘুমুচ্ছে।
মুহিত আজ যাবে আহিয়ানের কথা অনুযায়ী লন্ডন বার নামক জায়গাটি তে।
আহিয়ান আশরাফ চৌধুরী সম্পর্কে সকল তথ্য হাতে কলমে মুহিতের কাছে দিয়ে গিয়েছে।
কোথায় কোথায় পাপের সাম্রাজ্য গড়েছে আশরাফ চৌধুরী সব এখন মুহিতের নখদর্পণে।
মুহিতের হাত থেকে এবার কোনো ভাবেই নিস্তার পাবেনা আশরাফ চৌধুরী।
মুহিত আজকেই এট্যাক করবে না।আজকে সে ওই জায়গায় নাম মাত্র খুঁজ লাগাতে যাবে।

কালো জিন্স প্যান্টের সাথে হাফ হাতার লোজ একটি হোয়াইট টি শার্ট পড়লো মুহিত।মুখে কালো মাস্ক লাগাতেই তাকে দেখে সে কোন দেশের মানুষ তা বোঝার উপায় থাকলো না।

মাথায় একটা ক্যাপ পরে নিলো।পায়ে কালো বুটস।
ঠিকানা অনুযায়ী গুগল ম্যাপে পনেরো মিনিটের রাস্তা দেখাচ্ছে।
ম্যাপের রাস্তা ধরে হাটতে হাটতে মুহিত বিশ মিনিট পর পৌঁছে গেলো সেখানে। মুহিতকে ছোট ছোট পোশাক ধারী মেয়ে গুলো ম্যাসাজ ম্যাসাজ করে ডাকছে আর চোখ দিয়ে বিভিন্ন ইশারা করছে।
মাঝে মাঝে টেনে ধরার চেষ্টা করছে।
মুহিতের আর বোঝার অপেক্ষা থাকলো না যে,কিসের জন্য মেয়েগুলো ডেকে যাচ্ছে।
হাটতে হাটতে মুহিত এসে দাড়ালো একটি বার এর সামনে।যার সাইনবোর্ড এ লাইটিং এ জ্বলজ্বল করছে” লন্ডন বার ফুকেট লেখাটি।”
মুহিত কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে আশেপাশের ভাবভঙ্গি বোঝার চেষ্টা করলো।এরপর বারের ভেতরে প্রবেশের জন্য পা চালালো।

বারটি তে আসতেই কোকেন এর গন্ধে পেট গুলিয়ে উঠলো মুহিতের।
বহু কষ্টে নিজেকে স্বাভাবিক করে বারের ভেতর ঢুকে গেলো।

বারের ভেতর প্রবেশ করতে মুহিতের মনে হলো সে জাহান্নামে এসে পৌঁছেছে।চার পাশে মানুষ নেশায় বুদ হয়ে আছে।ছোট ছোট কক্ষ গুলো থেকে ভেসে আসছে মেয়েদের শীৎকার আর বিশ্রী হাসির আওয়াজ।ইয়ং ছেলে গুলো সমানে নাক দিয়ে হেরোইন টেনে চলেছে।
মুহিত সবকিছু পর্যবেক্ষণ করতেই দেখতে পেলো দুটো ছেলে তাকে ঘুরে ঘুরে দেখছে শুধু।
মুহিত তাদের কিছুই বুঝতে না দিয়ে একটা উঁচু বার স্টুল এ গিয়ে বসলো।
কি ওর্ডার করবে সেটাই বুঝতে পারছে না।এদিকে ছেলে গুলো মুহিতকে বার বার নজরে রাখছে।
মুহিত এতটুকু বুঝতে পেরেছে যে,মুহিতের চালচলন ওদের কাছে ভালো ঠেকছে না বলেই ওরা মুহিতকে নজরে রেখে বোঝার চেষ্টা করছে।

মুহিত একটা ককটেল শট ওর্ডার দিলো যা বিভিন্ন সফট ড্রিংকস এর মিশ্রনে তৈরি।
জুস সার্ভ করতেই মুহিত জুসটা হাতে নিয়ে প্রথম চুমুক দিতেই ছেলে দুটো দুপাশ থেকে এসে মুহিতের পাশে বসে গেলো।
এমন ভাবে মুহিত কে চেপে বসেছে যেনো মুহিত পালিয়ে যাচ্ছে।

হঠাৎই মুহিত টের পেলো তার পেটের কাছে শক্ত কিছু ধরেছে ডান পাশে থাকা ছেলেটি।
ছেলেটির মুখের দিকে তাকাতেই অস্পষ্ট ইংরেজি তে বলে উঠলো
―হেই দোন্ত মুভ।
―গিভ আস এভরিথিং ইউ হ্যাভ ,

ফিচেল হাসলো মুহিত।এমনিতেই একজন সারাক্ষন হয়রানি করে যাচ্ছে তার মধ্যে আবার এই দুজন।
মুহূর্তেই রাগে কান গরম হয়ে গেলো মুহিতের ।
রক্ত চক্ষু করে ডান পাশের ছেলেটির দিকে তাকিয়ে গর্জে উঠলো
―মুভ ইউও গান নাও এট ডিজ মোমেন্ট।
―আদার ওয়াইজ আ উইল কিল ইউ ব্লাডি বিচ।
মুহিতের ধমকে কেঁপে উঠলো ছেলে গুলো,সাথে আশেপাশের মানুষ তাদের তাকিয়ে দেখতে লাগলো।

ছেলেটি আরো শক্ত করে বন্দুক চেপে ধরলো মুহিতের পেটে।
তারা এতটুকু বুঝে গেছে ছেলেটা অন্য দেশের।আর এখানে কোনো ওকারেন্স ঘটালে কেউ বাঁচাতে আসবে না তাকে।
আর একা একটা মানুষ দুজনের সাথে পারবে নাকি?

ছেলেটির ত্যাড়ামো দেখে মুহিতের পায়ের রক্ত মাথায় উঠলো।জুসের গ্লাস টা টেবিলে রেখে খপ করে ডান পাশের ছেলের হাতের কব্জি ধরে ফেলল এবং ছেলেটির হাত মুচড়ে ভেঙে বন্দুক ওই ছেলের পেটেই তাক করলো।
এরপর গমগমে কন্ঠে বলে উঠলো
―আম বেটার এট গানস শুটিং দ্যান ইউ।
―নাউ মুভ ফ্রম হেয়ার।
আচানক আক্রমণে ছেলে দুটো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো, আর ডান পাশের ছেলেটি হাতের ব্যাথায় রীতিমতো চিৎকার শুরু করেছে।

এর পর মুহিত তার কোমরে গুঁজে রাখা 500 S&w magnam রিভলবার টি বের করে ছেলেদের দিকে তাক করে বলে উঠলো
―মাই রিভলবার ইজ মোর পাওয়ারফুল দ্যান ইয়ু।
ছেলে দুটি ভয়ে ভয়ে দ্রুত সরে গেলো।

মুহিত নির্বিকার ভাবে আবারো বসে রইলো।অপেক্ষা বার খালি হবার।
বার কি আর কখনো খালি হবে?
লোক সমাগম কমতে থাকার অপেক্ষা করতে লাগলো মুহিত।
দীর্ঘ অপেক্ষার পর মুহিত বারের পেছনের কক্ষে যাবার রাস্তা ফাঁকা পেলো।আশেপাশে নেশায় কাতর লোকজন।
সুযোগ বুঝে মুহিত কাঙ্খিত কক্ষের দিকে হাঁটা দিলো।

নির্দিষ্ট গন্তব্যে এসে মুহিত খুঁজতে লাগলো কক্ষের নম্বর।কারণ ছোট ছোট কটেজে টাইপের অনেক গুলো রুম আছে এখানে।

রুম নম্বর ফোর জিরো ফোর।
বন্ধ রুম অবশ্যই ভেতর থেকে আটকানো ।এই রুমে যে আশরাফ চৌধুরী আছে তারই বা নিশ্চয়তা কি?
কিছুক্ষন পায়চারি করলো মুহিত।
এরপর করিডোরে রাখা একটি বড় ফুলদানির ভেতরে পকেট থেকে বের করে মিনি ক্যামেরা সেট করে দ্রুত বের হয়ে এলো।

দৌড়ে বের হতেই মুহিত দুজন সিকিউরিটির সাথে ধাক্কা খেলো
তারা এই এরিয়াতে মুহিতকে দেখে অবাকের স্বরে জিজ্ঞেস করলো
―হোয়াটস ইউর রুম নম্বর?
―শো মি ইউর কার্ড।

মুহিত কি করবে ভাবতে লাগলো।আচমকাই নেশাক্ত মানুষের মতো হেলেদুলে অস্পট করে বলে উঠলো
―আম লুকিং ফ—-র আ ওয়াশরুম হেয়ার।
লোক গুলো মুহিতের কথা বিশ্বাস করলো কারন প্রায়ই নেশায় বুদ হয়ে মানুষ এই রেস্ট্রিক্ট্রেড এরিয়াতে ঢুকে পড়ে।
সিকিউরিটি মুহিত কে আর না ঘাটিয়ে ওয়াশরুম যাবার রাস্তা দেখিয়ে দিলো।
মুহিত তাদের থ্যাঙ্কস জানিয়ে দ্রুত সরে আসলো ওই জায়গা থেকে।

বারের বাইরে বেরিয়ে মুহিত আশেপাশে দৃষ্টি বোলালো।
সন্দেহ জনক কিছুই চোখে পড়লো না।এর পর সাবধানে হোটেলের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো মুহিত।

―――――
ঘরে বসে থেকে ভালো লাগছে না আশরাফ চৌধুরীর।নিজের প্রিয় হুইস্কিও নেই সেই কক্ষে।
উশখুশ করে উঠে দাঁড়ালেন আশরাফ চৌধুরী।দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন বারের অভিমুখে।

*****
রুমে আসতেই সৌম্য আর আদ্রিয়ান চেপে ধরলো মুহিতকে।তাদের না জানিয়ে কোথায় গিয়েছিলো সে?
এখানে একা একা রিস্ক নেয়া ঠিক হবে না।কারন আগের বার আশরাফ চৌধুরী মুহিতকে বড় ধরনের ক্ষতি পৌঁছিয়ে ছিলো।
সকল কে থামিয়ে মুহিত বলে উঠলো
―জাল ফেলে এলাম যাতে সময় করে মাছ টা তুলে নিতে পারি।
এর পর হাতের ফোন বের করে ক্যামেরার অপশন ঠিক করতে স্ক্রিনে প্রদর্শিত হলো কটেজের করিডোর।

তিন জনেই স্ক্রিনের উপর হামলে পড়লো।
কীয়তক্ষন বাদেই দেখা গেলো অতিকাঙ্খিত সেই ব্যাক্তিকে।
চকচকে হলো সৌম্য আর আদ্রিয়ান এর চোখ।
কপাল কুচকালো মুহিত।
―ইটজ নট ফোর জিরো ফোর?
ইটজ ফোর জিরো জিরো!

#চলবে।

তোমার জন্য সিন্ধুর নীল পর্ব-২৫+২৬

0

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_২৫
#সারিকা_হোসাইন

গ্রীষ্মের এই তাপদাহ আর কোনো মতেই সহ্য করা যাচ্ছে না।জনজীবন বিতৃষ্ণায় ভুগছে।এই অতিরিক্ত গরম কেও ছাপিয়ে আরো সবকিছু উত্তপ্ত করেছে মন্ত্রী মোশতাক আহমেদ এর আকস্মিক মৃত্যু।

ব্রিফ মিটিং এ পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি বক্তৃতা দিয়ে যাচ্ছেন সেগুলোই বিভিন্ন চ্যানেল এ টেলিকাস্ট করা হচ্ছে ঘুরে ফিরে।

পুলিশের বক্তৃতা অনুযায়ী চেক আউট এর টাইম পার হবার পরেও মন্ত্রী মোশতাক আহমেদ চেক আউট এর জন্য রিশিপশন এ না এলে তাকে ইন্টার কমে কল করা হয়।

দীর্ঘ সময় কল করেও তাকে পাওয়া যায়নি।

শেষে হোটেলের ম্যানেজার আর একজন এমপ্লয়ী তার কক্ষের সামনে এসে দরজায় ক্রমাগত নক করতে থাকেন।

দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হবার পরও দরজা না খুললে তাদের মনে সন্দেহ তৈরি হয়।

তাদের কাছে থাকা কপি ডোর লক কার্ড পাঞ্চ করে রুমে ঢুকে তাকে না পাওয়া গেলে ওয়াশরুমের দরজা খোলা দেখে তারা সেখানে সন্ধান চালায়।
এমপ্লয়ী বাথটাবে তাকে খুঁজে পায়।কিন্তু তাকে ডাকাডাকি করলে কোনো সাড়া পাওয়া যায়না।

হোটেল কতৃপক্ষ দ্রুত নিকটস্থ থানায় ফোন করে সব জানালে পুলিশ সেখানে উপস্থিত হন।

তার লাশ মেডিকেল এ আনা হলে ডিউটিরত চিকিৎসক বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষার পর জানান তিনি হার্ট এট্যাক এ মারা গেছেন।

আপাতত আমাদের কাউকেই সন্দেহ হচ্ছে না কারন মন্ত্রী মহোদয় এর সাথে কারো কোনো শত্রুতা কখনো পরিলক্ষিত হয়নি।

মোশতাক আহমেদ এর মৃত্যুতে বিরোধী দলীয় মন্ত্রী সারা শহরে মিষ্টি বিতরণ করলেন।একজন মানুষের মৃত্যু নিমিষেই আনন্দ উৎসবে পরিণত হলো।
এসবে মুহিতের কিছু যায় আসছে না।সে হন্যে হয়ে আশরাফ চৌধুরীর খুঁজ চালিয়ে যাচ্ছে।
মুহিত দুই আঙুলের সহিত কপাল স্লাইড করতে করতে চোখ বন্ধ করে ভাবছে
―কোথায় লুকিয়েছে আশরাফ চৌধুরী?

মুহিতের ভাবনার মাঝেই কর্কশ স্বরে বেজে উঠলো রিডিং টেবিলের উপর থাকা মোবাইল টা।
স্ক্রিনে সৌম্যের নম্বর দেখে দ্রুত রিসিভ করে ফোন কানে তুললো
―হ্যা ক্যাপ্টেন বলো
―স্যার আগামী নয় তারিখ দুপুর দুটো পঁয়তাল্লিশ মিনিটে আহিয়ান এর সাথে আপনার ভিজিটিং আওয়ার।
সৌম্যের কথা কর্ণকুহরে আসতেই ঠোঁটের হাসি প্রশস্ত হলো মুহিতের।

――――
পুব আকাশে গোলাকার রবি ধীরে ধীরে রক্তিম আভা ছড়াচ্ছে সাথে মৃদুমন্দ হাওয়া বইছে।চারপাশে পাখিদের কিচিরমিচির শোনা যাচ্ছে।কিছু সোলজার কোয়ার্টার এর মাঠের ঘাস গুলো পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে।মানুষের সাড়া শব্দ নেই বললেই চলে।স্নিগ্ধ মনোরম লাগছে সবকিছু।

ফজরের নামাজ পড়ে স্বর্গ তার বেলকনিতে পাতানো দোলনায় বসে সকালের এই সৌন্দর্য উপভোগ করছে।বিভিন্ন ঝামেলায় এতোদিন সকাল সকাল উঠা হয়নি।
আজ থেকে তার হসপিটালে ডিউটি শুরু হয়েছে এজন্য উঠে গেছে ভোর বেলা।এখন থেকে প্রতিদিন এই রুটিন ই চলবে।

ধীরে ধীরে কিছুক্ষণ আগের রক্তিম সূর্য সোনালী রঙের তেজী কিরণ ছড়াচ্ছে।বাতাস ও কোথায় যেনো মিলিয়ে গেলো।এখন আর সকাল মনে হচ্ছে না।মনে হচ্ছে দুপুর।
স্বর্গ বার বার ঘড়িতে সময় দেখে নিচ্ছে।সাতটা বাজলেই মুহিতকে সে কল করবে।
অপেক্ষার সময় যেনো কাটতেই চায় না।ঘড়ির কাটা যেনো নড়ছেই না।
ছয়টা ঊনষাট বাজতেই এভারেস্ট জয়ের হাসি দিলো স্বর্গ।

ইয়েস বলে ফোন হাতে নিয়ে মুহিতের নম্বর ডায়াল করে ফোন কানে তুললো।
এই বজ্জাত পুরুষের ঘুমু ঘুমু কন্ঠ টা মারাত্মক লাগে শুনতে।মন চায় গলা কেটে ফেলতে।এতো সুন্দর হতে হবে কেনো তার কন্ঠ?

প্রথম রিং হতেই ফোন তুলে ফেললো মুহিত।
ঘুম ঘুম কন্ঠে বলে উঠলো
―গুড মর্নিং জান।
স্বর্গ যেনো কোরবান হয়ে গেলো।এতো আদর লাগিয়ে কে কথা বলতে পারে?
মুহিত ছাড়া কেউ তাকে এতো সুন্দর করে আদর করে কথা বলতে পারবে না।
মুহিতের নেশাক্ত কন্ঠ শুনে আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেললো স্বর্গ।
এখন মুহিত পাশে থাকলে টিপে মেরে ফেলতো সে মুহিত কে।
এর পর মুহিত আবারো বলে উঠলো
―ঘুম থেকে উঠলেই কাছে পেতে ইচ্ছে করে তোমাকে,যেমন এখন তোমাকে খুব চুমু খেতে ইচ্ছে করছে।
মুহিতের সাথে সায় জানিয়ে স্বর্গ ও তার মনের ভাব ব্যাক্ত করলো
―আমারো তোমাকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে থাকতে ইচ্ছে করছে।
কিন্তু তুমি আমাকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেছো।
নেক্সট বার এলে উচিত শিক্ষা দেব।
দিল খোলা হাসি দিলো মুহিত।এর পর আদুরে কন্ঠে বললো
―আচ্ছা দিও যতো খুশি ততো শিক্ষা,আমি সকল শিক্ষা গ্রহন করতে প্রস্তুত।বিনিময়ে তোমাকে আদর করতে পারলেই হবে।

মুহিতের এমন ঠোঁট কাটা কথায় লজ্জায় গোলাপি আভা ছড়ালো স্বর্গের দুই গালে।
হঠাৎ ই স্বর্গ মেকি রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো―
তুমি না ক্যাপ্টেন তুলিকা ফার্নাজ এর সাথে হাত ধরে হিহি করেছিলে?

স্মিত হাসলো মুহিত।স্বর্গকে উদ্দেশ্য করে হাসতে হাসতে বললো
―এই প্রশ্ন টা এই পর্যন্ত তুমি চারশত সাতাত্তর বার করেছো।আর কতোবার করলে আমি ক্ষমা পাবো তোমার কাছে বলতে পারো?

আর দেখা করতে যাবার উপর আমার কোনো দোষ নেই সব দোষ আমার শশুরের।

মুহিতের হাসি দেখে স্বর্গের হঠাৎ ই রাগ উঠে গেলো সাথে নিজের বাপের উপর ও চটে গেলো।
ক্যাপ্টেন তুলিকার চুল ছিড়তে পারলে শান্তি লাগতো মনে।
কতবড় সাহস মুহিতের গায়ে হাত দেয়।
রাগের চোটে মুহিতের মুখের উপর ফোন কেটে দিয়ে সুইচড অফ করে দিলো।
হনহন করে রুমে এসে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে হসপিটাল যাবার জন্য পা বাড়ালো।

স্বর্গের এমন রাগের মাহাত্ম বুঝলো না মুহিত।ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো।নিজের ভুলটা কোথায় হয়েছে সেটাই ভাবতে লাগলো।

তনুজা আর নাফিজ মাহমুদ সকালের ব্রেকফাস্ট সাড়ছেন, পিউকে ডেকে এসেছেন,পিউ পরে খাবে।
হঠাৎ কোনো দিকে না তাকিয়ে স্বর্গকে সদর দরজার দিকে যেতে দেখে ডেকে উঠেন তনুজা
―সে কী না খেয়ে কোথায় যাচ্ছিস?
―স্বর্গ গর্জে উঠা কন্ঠে বলে উঠলো
―খাবার খাওয়ার মতো কোনো অবস্থা রেখেছো তোমরা?

মেয়ের হঠাৎ এমন রেগে যাবার কোনো কারণ দেখতে পেলেন না তনুজা।
নাফিজ মাহমুদ আদুরে স্বরে মেয়েকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন কি হয়েছে মা?
এবার রাগ ঢালার মানুষ পেলো স্বর্গ।
এতদিন পর সে জানতে পেরেছে ক্যাপ্টেন তুলিকার সাথে মুহিত কে বিয়ে দেয়ার ঘটক তার বাবা নিজেই।
দাঁত কটমট করে স্বর্গ বলে উঠলো
―এমন ভান ধরছো যেনো কিছুই জানোনা?
―ক্যাপ্টেন তুলিকার সাথে মেজর মুহিত কে দেখা করার ব্যাবস্থা কেনো করে ছিলে?

মেয়ের এহেন গাধার মতো প্রশ্নে বেক্কল হয়ে গেলেন নাফিজ মাহমুদ।তবুও স্বাভাবিক স্বরে বললেন
―মুহিত কে বিয়ে দিতে হবে না?
মেজর মুহিত কি তোমাকে ঘটক রেখেছে বাপী?
নাফিজ মাহমুদ মেয়েকে অবাকের সুরে জিজ্ঞেস করলেন
তুমি এতো রেগে যাচ্ছ কেনো?

“”তখন তো আপা তোমাকে দিয়ে মুহিতের বিয়ের কথা বলেনি””
আর মেয়েটা যথেষ্ট ভালো এজন্য দেখা করিয়েছি।যদিও মুহিত যেতে চায়নি।

স্বর্গ দাঁতে দাঁত চেপে বললো
“”তোমার ঐ যথেষ্ট ভালো মেয়ে কি করেছে জানো?
–বার বার মুহিতের হাতে হাত রাখার চেষ্টা করছিলো, আর হাসতে হাসতে ঢলে পড়ছিলো।

পুরাতন বিষয় নিয়ে তুই কেনো পরে আছিস মা?উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলেন তনুজা।
―ঐ মেয়ের কথা মনে পড়লেই হিংসে হয় আমার,শরীরে আগুন জ্বলে,সহ্য করতে পারিনা আমি বুঝতে পেরেছো?
বলেই গটগট করে বেরিয়ে গেলো স্বর্গ।

নাফিজ মাহমুদ মেয়ের যাবার পানে তাকিয়ে তনুজাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো
―এটা কার মেয়ে?এমন হিংসুটে মেয়ে কোথা থেকে এনেছো তনু?
তনুজা নাফিজের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে বলে উঠে
―কথাটা আবার বলো,তার পর তোমাকে দেখে নিচ্ছি।

সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে সবকিছু দেখছিলো পিউ।
আজকে তার মা,বাবার সম্পর্ক ঠিক থাকলে এমন খুনসুটিময় একটি পরিবার তার ও হতো।
কিন্তু নির্মম নিয়তি কতো নিষ্ঠুর ভাবেই না তাকে নিঃস্বঙ্গ করে দিয়েছে!

চোখের জল আড়াল করে সকলের অগোচরে উপরে উঠতে নিলেই নাফিজ মাহমুদ ডেকে উঠলো
―পিউ!

–এদিকে একটু আয় তো রে বাবা।

নিজেকে স্বভাবিক করে অবনত মস্তকে নীচে নেমে এলো পিউ।

নাফিজ মাহমুদ এর পাশের চেয়ার টেনে পিউকে বসতে বললেন নাফিজ মাহমুদ।

পিউ বসতেই নাফিজ মাহমুদ আদুরে কন্ঠে বলে উঠলো
―ক্যাপ্টেন সৌম্য তার ফ্যামিলি নিয়ে তোকে আংটি পড়াতে আসতে চাইছে।
আসতে বলবো?

কথাটি শোনা মাত্রই হুহু করে কেঁদে উঠলো পিউ।
যেই দায়িত্ব নিজের বাবার পালন করার কথা সেটা পালন করতে চাচ্ছে বান্ধবীর বাবা!
এর চাইতে কষ্টের কি ধরনীতে দ্বিতীয় কিছু আছে?

তনুজা উঠে এসে পিউ এর পাশে দাঁড়ালেন।
পিউ এর মাথা তার পেটের কাছে জড়িয়ে ধরে আদর করে হাত বুলালেন।
তনুজা বলে উঠলেন
―আমাদের সেভাবে আপন ভাবতে পারছিস না বাবা?
―স্বর্গ আর তুই সমান সমান আমাদের কাছে।ছোট থেকে তোকে দেখে আসছি।
তুই ভাবিস না আমরা যেমন তেমন করে তোকে সৌম্যের হাতে তুলে দেবো।
মনে কর আমি ই তোর মা।মায়ের কাছে যেভাবে সব শেয়ার করে সন্তান রা ,তুই ও সেভাবে সব শেয়ার করবি আমাকে।
―ক্যাপ্টেন সৌম্য আসবে বাবা?
তনুজার আদুরে মমতায় আশার আলো পেলো পিউ।

পিউ উপর নিচ মাথা ঝাঁকালো তনুজার প্রশ্নে।

হ্যা বোধক উত্তর পেয়ে নাফিজ,তনুজা দুজনের মুখেই খুশির ঝিলিক দেখা গেলো।

★★★★
চৌধুরী ম্যানশন এর চার তলা বিশিষ্ট বাড়িটা আশরাফ চৌধুরী এমন ভাবে ডিজাইন করেছেন যে কারো দেখলে মাথা ঘুরে যাবে।
যেমন বাইরের নান্দনিক সৌন্দর্য তেমনি ভেতরে।।
শুধু তাই নয়,রয়েছে একটি গুপ্ত কুঠুরি ও।যার সন্ধান আশরাফ চৌধুরী ছাড়া কেউ জানেনা।
জানতো আরেকজন যিনি বাড়ির ডিজাইন করেছেন।
কিন্তু আশরাফ চৌধুরী তাকেও দুনিয়া থেকে খালাস করে দিয়েছেন।
আশরাফ চৌধুরীর রহস্য কেউ জানতে পারবে না কোনোদিন বলেই হা হা করে হেসে উঠলেন আশরাফ চৌধুরী।
হঠাৎই হাসি থামিয়ে রাগে ফুঁস করে উঠলেন।
না পারছেন ঠিক মতো খাবার খেতে না পারছেন ফোন খুলে কারো সাথে যোগাযোগ করতে।
ফোন খুললেই নেটওয়ার্ক ট্র্যাক করে কুকুর গুলো খুঁজে বের করে ফেলবে তাকে।
যেভাবেই হোক তিন তলায় নিজের কক্ষের আলমারি থেকে গোপন ফোন টা বের করে আনতে হবে।
একবার এই বাড়ি থেকে বের হয়ে জাহাজে উঠতে পারলেই তার একটা লোম ও কেউ বাঁকা করতে পারবে না।
আর বাকী রইলো মেজর মুহিত!
ওর বংশ নির্বংশ করে দেবে এবার সুযোগ বুঝে আশরাফ চৌধুরী।

আজ পর্যন্ত কখনো তাকে এই গুপ্ত কুঠুরিতে অবস্থান করতে হয়নি।
সামান্য একটা মেজরের ভয়ে সে এখানে লুকিয়েছে!
এর জন্য কঠিন মূল্য যোগাতে হবে ওই হারামজাদা মেজর কে।

এদিকে ছেলেটা কি আসলেই উন্মাদ হয়েছে নাকি ভান ধরে আছে সেটাও বুঝা যাচ্ছে না।
শুয়োর টাকে জেলের ভেতর ই যদি শেষ করে দেয়া যেতো!
আপাতত শান্তিতে ঘুমানো যেতো।
ছেলের মুখ খোলার চিন্তায় কুঠুরিতে এসেও আরামে ঘুমানো যাচ্ছে না।

――――――

নাফিজ মাহমুদের ড্রয়িং রুমে বসে আছে মুহিত।আজ তার ছুটির দিন,স্বর্গ ও বাসাতেই আছে।এতো ভোর বেলায় মুহিত কে এই বাসায় দেখে অবাক হলেন তনুজা।মুখে কিছুই বললেন না।ঘুম ঘুম চোখে হাই তুলতে তুলতে বেরিয়ে এলেন নাফিজ মাহমুদ।ভেবেছিলেন ছুটির দিনে একটু আরামে লম্বা সময় ধরে ঘুমাবেন,কিন্তু তনুজার ডাকাডাকি তে তা আর হলো না।
মুহিত কে চিন্তিত মুখে বসে থাকতে দেখে নিমিষেই ঘুম ছুটে গেলো তার।
কিছু হয়েছে কি না ভাবতেই ভয়ে এক প্রকার দৌড়েই নামলেন।মুহিতের পাশে বসতে বসতে উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলেন কোনো সমস্যা হয়েছে মুহিত?
অসহায় এর ন্যায় মুহিত বলে উঠলো―
―বিশাল বড় সমস্যা হয়ে গেছে স্যার।

সমস্যার কথা শুনে ভয় পেয়ে গেলেন নাফিজ মাহমুদ।চিন্তিত হয়ে জানতে চাইলেন কি সমস্যা মুহিত?
―আপনার মেয়ে দুদিন ধরে ফোন তুলছে না স্যার।

“তোমরা ঝগড়া করেছো? জিজ্ঞেস করলেন নাফিজ মাহমুদ।
অসহায় বদনে মুহিত বলে উঠলো
― না স্যার।

নাফিজ আগ্রহ সহকারে জানতে চাইলো
―দোষটা কার?
মুহিত সাবলীল ভাবে উত্তর দিলো
―আপনার!

ঘটনা আন্দাজ করতে সময় লাগলো না নাফিজ মাহমুদ এর।
অপরাধীর ন্যায় জিজ্ঞেস করলো
এখন কি করবে?
―আজ যেহেতু অফ ডে আছে দেখি একটু হাওয়া খাইয়ে নিয়ে আসি,যদি মন গলে।
নাফিজ মাহমুদ তনুজাকে ইশারা করলেন মেয়েকে ডাকতে।

দরজার ফাঁক দিয়ে চোরের মতো মুহিত কে দেখে যাচ্ছে স্বর্গ।সকালে নামাজ পড়ে বেলকনিতে দাঁড়াতেই মুহিতের জিপ দেখতে পেয়েছে সে।মুহিতকে কিভাবে চুম্বকের মতো টানতে হয় সেই বুদ্ধি ভালোই আছে স্বর্গের।

সিঁড়ি দিয়ে তনুজাকে উঠতে দেখে ঘুমের ভান ধরে বিছানায় পরে রইলো স্বর্গ।
তনুজা এসে ডাক দিতেই চোখ খুলে এতো সকালে ডাকার কারন জিজ্ঞেস করলো স্বর্গ।
―মুহিত এসেছে শিগ্গির আয়।
―তুমি যাও,আসছি বলে তনুজাকে তাড়িয়ে দিলো স্বর্গ।
নিজের নাইট ড্রেস চেঞ্জ করে একটা নরমাল লং শার্টের সাথে ডেনিমের লোজ প্লাজো পরে গলায় ওড়না ঝুলিয়ে,চুল গুলো এক পাশে সিঁথি করে কাঁধের দুই পাশে ফেলে পরিপাটি হয়ে বেরিয়ে এলো স্বর্গ।
ড্রয়িং রুমে এসে মুহিতের আকর্ষণীয় হটনেস দেখে মনের ভেতর প্রজাপতি উঠতে থাকলো তার।
এস কালার সফট ডেনিম শার্টের সাথে ব্ল্যাক জিন্স পড়েছে।হাতে কালো ফিতার ব্র্যান্ডেড ঘড়ি,মনে হচ্ছে গোসল করেছে।একদম স্নিগ্ধ লাগছে তাকে।এখনই একটা চুমু মুহিতের অবশ্যই প্রাপ্য।
সময় বুঝে মুহিতকে দিয়ে দেবে স্বর্গ মনে মনে ভাবলো।

নাফিজ মাহমুদের ধমকে হঠাৎই ধ্যান ভেঙে চমকে উঠলো স্বর্গ।
―এটা কেমন বেয়াদবি করছো মুহিতের সাথে?
একজন ডাক্তার হয়ে এসব আচরণ তোমার মানাচ্ছে?
ছেলেটাকে হয়রানি করছো কেনো?
ছুটির দিনে না ঘুমিয়ে তোমার রাগ ভাঙাতে এসেছে!সব সময় সব কিছুতে জেদ করছো ইদানিং।
দিনে দিনে ফাজিল হয়ে যাচ্ছ বেশি আদরে?
একটা ব্যাক্তিত্ববান ছেলে তোমার জন্য ব্যাক্তিত্ব হারা হচ্ছে।
বয়স কতো তোমার?

সকাল সকাল বাবার মুখে ধমক খেয়ে চোখের কোনে জল জমা হলো স্বর্গের।
বহু কষ্টে চেষ্টা করলো আটকে রাখতে।
তবুও টুপ করে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে।
মুহিত পড়লো মহা ফ্যাসাদে।এখন তো মনে হচ্ছে হ্যাঙ আউটে ও যাওয়া হবে না।
নাফিজ মাহমুদ কে সামলিয়ে মুহিত স্বর্গ কে বললো
―এসো আমার সাথে,প্লিজ কেঁদোনা।
মুহিত ভেবেছিলো স্বর্গ তার উপর মুখ ঝামটা দিয়ে চলে যাবে,কিন্তু মুহিত কে ভুল প্রমাণ করে গাড়িতে উঠে বসলো।

গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দ্রুত কোয়ার্টার থেকে বেরিয়ে গেলো মুহিত।
আজ সারাদিন স্বর্গকে সময় দেবে সে।স্বর্গ যা যা করতে চায় তাই তাই করবে।

একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে ব্রেক কষলো মুহিত।স্বর্গ না খেয়েই বাসা থেকে বেরিয়েছে।তাকে আগে ব্রেকফাস্ট করাতে হবে,তারপর ঘুরতে যাওয়া।

―নামো।
বলে গাড়ির দরজা খুলে দিলো মুহিত।
কোনো টু শব্দ না করে বাধ্য মেয়ের ন্যায় নেমে দাঁড়ালো স্বর্গ।

স্বর্গের হাত ধরে রেস্টুরেন্টের ভেতর প্রবেশ করলো মুহিত।
একটা ওয়াইটার ডেকে স্বর্গের পছন্দের চিকেন স্যুপ আর গার্লিক নান ওর্ডার দিলো।সাথে ভেজিটেবল স্যালাড।

ওয়েটার চলে যেতেই স্বর্গের হাত ধরে ফেললো মুহিত।
আদুরে নরম স্বরে বললো
―তুলিকা ফার্নাজ এর সাথে দেখা করার জন্য আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত।প্লিজ তুমি এভাবে আমার থেকে দূরে থেকো না,বুকের এখানে খুব কষ্ট হয় বাবু।

―তুমি বোঝোনা?

আমি আর কোনোদিন কোনো মেয়ের দিকে তাকাবো না,ইভেন তুমি না বললে হাসবো ও না।
হ্যাপি?

স্বর্গ মাথা নিচু করে চুপ হয়ে বসে রইলো।

মুহিত স্বর্গের থুতনি ধরে মুখ উপরে তুলে আহ্লাদী হয়ে বললো
―আজকে সারাদিন আমি তোমার কাছে আছি,যেভাবে চাইবে সেভাবেই আজকে পাবে আমাকে।
মনে করো আমি তোমার ভালোবাসায় কেনা বাধ্যগত দাস,আমি তোমার সকল হুকুম পালন করতে আজকে প্রস্তুত।

কথাটা জাদুর মতো কাজ করলো স্বর্গের উপর।
নিমিষেই মন খারাপের কালো মেঘ সরিয়ে বলে উঠলো
―সত্যি?
মুহিত প্রশস্ত হেসে বললো
―তিন সত্যি!

#চলবে।

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_২৬
#সারিকা_হোসাইন®

★★★★
মেঘলা আকাশ সাথে শিরশিরে বাতাস,সব মিলিয়ে যেনো ঘুরতে যাবার উপযুক্ত সময় এটা।
মানুষ সামাজিক জীব,সমাজে বেঁচে থাকার অদম্য লড়াই করতে গিয়ে মানুষ পরিণত হয়েছে যন্ত্র চালিত রোবটে।
টাকার পিছে,একটু সুখে থাকার আশায়,ভালো খাবারের জন্য মানুষ তার সকল চাওয়া পাওয়া ইচ্ছে, অনিচ্ছা সব কিছু যেনো মাটিচাপা দিয়ে দিয়েছে।সকল দায়িত্ব পূরণ করতে গিয়ে নিজের জন্য সময় বের করাই যেনো দুষ্কর।

যান্ত্রিক এই জীবন কে ছুটি দিয়ে মুহিত আর স্বর্গ একটু ভালো ভাবে নিজেদের জন্য সময় কাটাতে এসেছে ফ্যান্টাসি কিংডম এ।
আজ তারা তাদের সকল ক্লান্তি ভুলে,ডিউটি ভুলে,কারো অর্ডার এর তোয়াক্কা না করে বাঁধাহীন একটি দিন উপভোগ করবে।

বড় হবার সাথে সাথে মানুষ শৈশবের সবকিছু ভুলে যায়,বা শৈশবের জিনিস গুলো করতে গেলে অনেকে নাক ছিটকিয়ে বলবে ―বুড়ো বয়সে ঢং!
কিন্তু যেই আনন্দঘন শৈশব একবার হারিয়ে গিয়েছে তা কি আর ফিরে পাওয়া যাবে কোনো দিন?

স্বর্গের আজ বাচ্চা হতে ইচ্ছে হয়েছে।আজকের দিন সে তার ছোটবেলায় যেভাবে হেসে খেলে কাটিয়েছে সেভাবে কাটাবে।সাথী হিসেবে মুহিত রয়েছে।

প্রথমে তারা দুটো টিকিট নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলো।
টিকিটের সাথে যেই রাইড গুলো আছে তারা প্রথমে ওগুলো ট্রাই করবে।
প্রথমে মুহিত ডিসাইড করলো তারা রোলার কোস্টার এ উঠবে।
স্বর্গকে যতোটা উচ্ছসিত দেখা গিয়েছিলো প্রথমে, রোলার কোস্টার এর নাম শুনেই মুখ চুপসে গেলো তার।
কিন্তু মুহিত খুব এক্সাইটেড।স্বর্গকে বগল দাবা করে মুহিত ছুটলো রোলার কোস্টার এর দিকে।
একদম সামনের সিটে বসে পড়লো মুহিত।
স্বর্গ নিজেকে মুহিতের সামনে দুর্বল প্রমান করতে নারাজ।নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে কিন্তু হাত পা কাঁপছে।
কিছুক্ষন পর ব্যারিকেড হ্যান্ডেল গায়ের সাথে সেটে গেলো।
স্বর্গ বুঝতে পারলো এখন এটা চালু হবে।
সাথে সাথেই মুহিত কে খামচে ধরলো।
হোহো করে হেসে কুটিকুটি হলো মুহিত।
স্বর্গকে জিজ্ঞেস করলো
“”ভয় লাগছে মনা?””
স্বর্গ কিছু উত্তর করার আগেই ছুটে চললো রোলার কোস্টার,ধীরে ধীরে স্পিড বাড়তে থাকলো।
স্বর্গ প্রথমে যেই ভয়টা পেয়েছিলো নিমিষেই সেটা আনন্দে পরিণত হলো।
খুশিতে চিল্লাতে চিল্লাতে চোখ দিয়ে পানি বের করে ফেললো সে।

এর পর বড় যেই নৌকা স্যান্টা মারিয়া আছে ঐটাতে উঠলো।
এবারো মুহিত একদম লাস্টের মাথায় গিয়ে বসবে।
তার মতে যতো উপরে উঠে দোল খাওয়া যাবে ততো মজা।
স্বর্গ এবার কিছুতেই উপরে উঠবে না।
মুহিত টেনে হিচড়ে জোর করে স্বর্গকে নিয়ে বসিয়ে দিলো একদম লাস্ট মাথায়।
শুরু হলো দোল।
স্বর্গ ভয়ে চোখ বন্ধ করে হ্যান্ডেল চেপে ধরে খিচে বসে রইলো।
তার মনে হচ্ছে সে হাওয়ায় ভাসছে।তার পায়ের নীচে সব ফাঁকা।পেটের ভেতর থেকে সব বেরিয়ে যাচ্ছে।
পুরো সময় সে চোখ বন্ধ করেই কাটালো।
এর পর বাম্পার কার খেলায় স্বর্গ মুহিত কে চোখ ইশারায় বুঝিয়ে দিলো
―দেখে নেবো তোকে।
মুহিত ফিচেল হাসলো।
শুরু হলো দুজনের টক্কর,স্বর্গ মুহিত কে বিভিন্ন এঙ্গেল থেকে এসে মেরে দিচ্ছে ।বিজয়ীর হাসি স্বর্গের চোখে মুখে।
মুহিত ইচ্ছে করেই স্বর্গকে জিতিয়ে দিয়ে মনে মনে হাসলো আর বললো
―বাচ্চাটা আমার।

একে একে সব গুলো রাইড শেষ করে বেরিয়ে আসে তারা।
হাসতে হাসতে গাল ব্যাথা হয়ে গেছে স্বর্গের।
মুহিত আদুরে স্বরে জিজ্ঞেস করে
―ম্যাডাম আপনার নেক্সট প্ল্যান কি ?
এক বাক্যে স্বর্গ পেটে হাত দিয়ে বলে উঠলো
―খাবো।
খুব খিদে পেয়েছে।
দুজনেই জিপে উঠে বসলো,মুহিত গাড়ি হাকালো ভালো রেস্টুরেন্টের দিকে ।
আধঘণ্টা বাদে তারা রেস্টুরেন্টে পৌঁছে গেলো।
রেস্টুরেন্টে ঢুকে ওয়েটার ডেকে ইচ্ছে মতো অর্ডার দিলো স্বর্গ।
ওর্ডার দিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো ফ্রেস হতে।
মিনিট পাঁচেক পরে ফিরে এসে খাবার এখনো দেয়নি কেনো ?
সেটা নিয়ে মুহিত কে খুঁচিয়ে যাচ্ছে।

মুহিত ভাবছে অন্য কথা!
―এই ছোট পেটে এতো খাবারের জায়গা হবে কি করে?
তবুও মুখে কিছুই বললো না,পরে দেখা যাবে রেগে মেগে খাবারই খাবে না।
অযথা ঝামেলার দরকার কি বাবা?
শুধু মাথা ঝাকিয়ে আসবে, আসবে, বলে অপেক্ষা করতে বললো।

কিছুক্ষন পর তিন জন ছেলে ধীরে ধীরে খাবার গুলো নিয়ে টেবিলে পরিবেশন শুরু করলো।
খাবার রেখে চলে যেতেই স্বর্গ দুই হাতে দুটো স্পুন নিয়ে উচ্ছসিত হয়ে মুহিতের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো
―লেটস ডিগ ইট!

একের পর এক খাবার মুহূর্তেই সাবাড় করে দিচ্ছে স্বর্গ।
মুহিতের মনে হচ্ছে খাবার গুলো বোধ হয় বেশি স্বাদ।
নিজেও টেস্ট করে দেখলো।
উহু আহামরি কিছুই না।
মুহিত যেনো আজ অন্য আরেক স্বর্গ কে দেখছে।
যেই মেয়ে এতো ডায়েট মেইনটেইন করতে করতে শুকিয়ে শুঁটকি মাছ হয়ে আছে,সেই মেয়ের ডায়েট ফায়েট আজ কোথায় তল্পিতল্পা গুটিয়ে পালালো?

মুহিত ভেবেছিলো অর্ধেকের বেশি খাবার নষ্ট হবে,কিন্তু মুহিতকে ভুল প্রমাণ করে স্বর্গ সব খেয়ে ফেলেছে।
মুহিত একটা ড্রিংকস এর বোতলে স্ট্র ঢুকিয়ে স্বর্গের পানে এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো
―আরো কিছু খাবে সোনা?
স্বর্গ মাথা নেড়ে অর্ডার দেয়ার ভঙ্গিতে বললো
―নো, এখন শপিংয়ে যাবো।

রেস্টুরেন্টের বিল মিটিয়ে মুহিত আবার গাড়ি হাকালো।গন্তব্য স্বর্গের পরিচিত শপিংমল।
কেনাকাটা শেষ করতে করতে রাত আটটা বেজে গেলো।এদিকে নাফিজ মাহমুদ সমানে ফোন দিয়ে যাচ্ছে তারা কোথায়?
সৌম্যের বাবা মা এসেছে।
স্বর্গকে নিয়ে দ্রুত জিপে বসলো মুহিত।গাড়ি স্টার্ট দিয়ে স্পিড বাড়িয়ে দিলো।
রাত সাড়ে নয়টার মধ্যে পৌঁছে গেলো নাফিজ মাহমুদ এর বাংলো তে।

শপিং ব্যাগ গুলো দুই হাতে জাপ্টে ধরে বহু কষ্টে হেলেদুলে উপরে উঠে গেলো স্বর্গ।
মুহিত সৌম্যের বাবা মায়ের সাথে কুশল বিনিময় করে ফ্রেস হতে গেলো।

সৌম্যের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইল মধুপুরের এক প্রত্যন্ত গ্রামে।সেখান থেকে আসতে তাদের একটু দেরি হয়ে গেছে।ঠিক সময়ে গাড়ি ধরতে না পারায় দুপুরে পৌঁছনোর কথা থাকলেও সন্ধে গড়িয়ে গেছে।
সৌম্যের বড় একটা বোন আছে,তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে।
সৌম্যের বাবা মা দুজনেই খুবই সাধাসিধে আর মিশুক প্রকৃতির।
পিউকে তারা খুবই পছন্দ করেছে।
সৌম্য আর পিউ চাইলে তারা আজকেই আংটি পড়িয়ে আকদ করে রাখবে।।

সৌম্যের বাবা মায়ের আরো কয়েকদিন পরে আসার কথা ছিলো।পিউ এর কথা চিন্তা করে সৌম্য আজই তাদের ফোন করে নিয়ে এসেছে।
মুহিত সৌম্যকে ডেকে জিজ্ঞেস করলো কি করতে চায় সে?
সৌম্য সাবলীল ভাবে উত্তর দিলো
―স্যার আমি আজকেই আকদ করাতে চাই,আগামী সপ্তাহে ওকে তুলে নেবো।পিউ ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েছে।ওর এখন আমাকে বিশেষ প্রয়োজন।মুখে না বললেও আমি বুঝতে পারি।
বলেই মাথা নিচু করলো সৌম্য।

মুহিত সৌম্যের কাঁধ চাপড়ে ড্রয়িং রুমে এসে বসলো।
পকেট থেকে ফোন বের করে মেজর আদ্রিয়ান এর নম্বর ডায়াল করলো।
―কাজী নিয়ে আসুন মেজর আদ্রিয়ান।
সকলের মুখে হাসি ফুটলো,পিউ নার্ভাস হয়ে গেলো।

পিউকে গোসল করিয়ে বিছানায় বসালো স্বর্গ।
এরপর মুহিতের শপিং করে দেয়া ব্যাগ হাতড়ে একটা মেরুন রঙের সোনালী পাড়ের জামদানি শাড়ি বের করলো।
সাথে কিছু নতুন সিম্পল গহনা।
পিউকে দেখিয়ে বললো এগুলো তোর জন্য এনেছি।
পছন্দ হয়েছে?

পিউ নীরবে অশ্রু বিসর্জন দিলো।স্বর্গ পিউকে জড়িয়ে ধরে বললো
―কিচ্ছু হয়নি,মনে কর আমি তোর বোন।মাম্মা,বাপী তোর ও মাম্মা বাপী।
এখান থেকেই তোর বিয়ে হবে,বিয়ের পর তোর নাইয়র ও এখানেই করবি।
কি করবি তো?
শাসিয়ে জিজ্ঞেস করলো স্বর্গ।
পিউ চোখের জল মুছে মুচকি হেসে মাথা ঝাঁকালো
সে অবশ্যই আসবে!

খুবই সিম্পল ভাবে, ঘরোয়া পরিবেশে আংটি বদল আর আকদ হয়ে গেলো।
আগামী সপ্তাহে সেনা কুঞ্জে বড় অনুষ্ঠান করে সৌম্য পিউকে ঘরে তুলবে।
বিয়ে নিয়ে পিউ এর অনেক ফ্যান্টাসি ছিলো।
সৌম্য সব অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে।
বাবা মা পাশে নেই তো কি হয়েছে?সৌম্য তো মরে যায়নি।এখনো অক্ষত অবস্থায় পিউ এর সামনে শ্বাস নিচ্ছে।

যদিও বিয়ের পর কিছু ঝামেলা আছে,সৌম্য এখনো ব্যাচেলর অফিসার্স কোয়ার্টার এ থাকে,বিয়ের পর কোয়ার্টার এর জন্য আবেদন করলে সেটাও সাবমিট হতে একটু সময় লাগবে।
তবুও সৌম্য সব ভেবে রেখেছে।
বাইরে বাসা নেবে সৌম্য দরকার পড়লে।তবুও পিউকে একা ছাড়বে না।
রাত বারোটা নাগাদ সকল কাজ শেষ করে সৌম্য আর মুহিত চলে যায় তাদের কোয়ার্টার এ,সৌম্যের বাবা মা থেকে যায়।
তারা ভোরে গ্রামে ফিরে যাবে।
তিন কুলে তেমন নিকট আত্মীয় না থাকায় কাউকে বিয়েতে নিমন্ত্রণ করার ও ভেজাল নেই।
অনুষ্ঠানের আগের দিন তারা চলে আসবে বড় মেয়েকে নিয়ে।

――――
রাত একটা বেজে দশ মিনিট।কোনোভাবেই মুহিতের ঘুম আসছে না।কাল দুপুরে আহিয়ান এর সাথে ভিজিটিং আছে।
দুইয়ে দুইয়ে চার কিছুতেই যেনো মিলছে না।
আশরাফ চৌধুরী গেলো টা কোথায়?

সহসাই লাফ দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো মুহিত।
সেনা নিবাস থেকে আশরাফ চৌধুরীর বাসা বিশ মিনিটের রাস্তা।
দুস্টু বুদ্ধি খেলে গেলো মুহিতের মাথায়।

কালো একটা শার্ট পরে মাথায় নরমাল ক্যাপ পরে মুখে মাস্ক লাগিয়ে চোরের মতো পা টিপে অন্ধকার হাতড়ে বেরিয়ে এলো গেটের কাছে।
আসতেই নাইট গার্ড কে গেটের কাছে আসতে দেখে একটা ঝাউ গাছের পিছনে লুকিয়ে গেলো।
লোকটি সরতেই দ্রুত গতিতে গেট বেয়ে লাফিয়ে রাস্তায় চলে এলো।
নাইট গার্ড শব্দ পেয়ে দৌড়ে গেটের কাছে এসে কিছুই দেখতে পেলো না।

প্রথমে ধীরে পরে জোরে হেটে একসময় দৌড়াতে শুরু করলো মুহিত।
দৌড়াতে দৌড়াতে চৌধুরী ম্যানশন এর সামনে এসে হাঁটুতে হাত দিয়ে হাপাতে লাগলো।
কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে রেস্ট নিয়ে ছোট টর্চ বের করে আবার গেট টপকে ভেতরে ঢুকলো মুহিত।
কোমরে রাখা রিভলবার হাতে পজিশন করে ধরে ধীরে ধীরে আগাতে থাকলো।
মানুষজন ধাক্কাধাক্কি করে,ঢিল ছুড়ে বাড়ির অবস্থা ঝকরমকর করে ফেলেছে।
মেইন গেটের লক পর্যন্ত নষ্ট করে ফেলেছে।
মুহিত বিনা শব্দে প্রত্যেকটি তলায় ঘুরে ঘুরে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করলো।সন্দেহ জনক কিছুই পেলো না।তবুও হাল ছাড়ার পাত্র সে নয়।

সুযোগ বুঝে প্রত্যেক টি তলায় একটি করে স্পাই মিনি ভয়েস রেকর্ডার সেট করে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।
মুহিত শতভাগ নিশ্চিত আশরাফ চৌধুরী বাড়িতেই কোথাও লুকিয়ে রয়েছে।

হাটতে হাটতে ফেরার পথে নাফিজ মাহমুদ এর বাংলো দেখে সুপ্ত ইচ্ছে জেগে উঠলো মুহিতের মনে।
রাত তিনটে বাজে তবুও তার পা এই রাস্তা থেকে সরছে না।
ফোন বের করে স্বর্গের নম্বরে কল করতেই রিসিভ করলো স্বর্গ।
ঘুম ঘুম কন্ঠে বললো
হ্যালো মুহু!
মুহিত যেনো এই রোমাঞ্চকর কন্ঠ শুনে আরো পাগল হয়ে গেলো।
নিজেকে সামলে বলে উঠলো
―পাঁচিল টপকে যদি তোমাদের দরজার সামনে যাই আমাকে তোমার সাথে ঘুমুতে দেবে?
মুহিতের কথায় নিমিষেই স্বর্গের ঘুম ছুটে গেলো।

“”ছেলে বলে কি!”

দ্রুত বেলকনির দরজা খুলে আশেপাশে তাকিয়ে বললো
―কোথায় তুমি?তোমাকে তো দেখছি না।
মুহিত ফিসফিস করে বলে উঠলো
―আলোতে দাঁড়িয়ে দাঁত ক্যালাবো যাতে চোর মনে করে গার্ড ধরে ফেলে?
স্বর্গ আঙ্গুল কামড়ে ভাবতে লাগলো কি করবে।
পিউ আজ গেস্ট রুমে ঘুমিয়েছে। সৌম্যের বাবা মা ও নীচে ঘুমুচ্ছে।

মুহিত কে মেইন গেট দিয়ে আসার সময় হঠাৎ কেউ যদি দেখে ফেলে?

মুহিত আবার বলে উঠলো
“”কি ব্যাপার কথা বলছো না কেনো?
― ফিরে যাবো?
তড়িঘড়ি করে স্বর্গ বলে উঠলো
এমা, না না,যেও না।
– শুনো,আমার রুমের পিছনের বেলকনি দিয়ে উঠতে পারবে?
পাইপ বেয়ে কিন্তু উঠতে হবে!
মুহিত সিচুয়েশন বুঝলো,তবুও মনের সাথে যুদ্ধ করে জয়ী হবে কার সাধ্য?

ফোন কেটে সুযোগ বুঝে পাঁচিল টপকে স্বর্গের পিছনের বেলকনির দিকে অগ্রসর হলো।দুটো বেলকনি ই খোলা,গ্রিল হীন।আকাশের চাঁদ হাতে পেলো মুহিত।
লম্বা মানুষ চাইলেই অসাধ্য সাধন করতে পারে।
একটু পাইপ বেয়ে উঠতেই প্রথম বেলকনিতে উঠতে পারলো।
এর পর কোমড় সমান ইটের গাঁথুনি তে পাড়া দিয়ে স্বর্গের বেলকনিতে উঠে পড়লো।এদিকে হাত ছিলে গেলো সামান্য।সেসব গায়ে মাখলো না মুহিত।

বেলকনির দরজা আটকে স্বর্গ মুহিতকে বিছানায় বসতে দিলো।এর পর পানির বোতল এগিয়ে দিলো।
ঢকঢক করে পুরো বোতলের পানি সাবাড় করলো মুহিত।
হঠাৎ ই ভ্রু কুঁচকে সন্দিহান চোখে জিজ্ঞেস করলো স্বর্গ
―এমন ভুত সেজে কোথায় গিয়েছিলে?
কেনো আমাকে দেখে খুশি হওনি?পাল্টা প্রশ্ন করলো মুহিত।
আচ্ছা তাহলে চলে যাই বলেই উঠে দাঁড়ালো।
কুনুই বরাবর টেনে ধরলো স্বর্গ
―কখন বললাম খুশি হইনি?
ঘুম পাচ্ছে শুয়ে পড়লাম বলেই মুহিত বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে গেলো।
স্বর্গ বেয়াক্কেল এর মতো দাঁড়িয়ে জিগ্যেস করল
―এহ?তুমি ঘুমুতে এসেছো এখানে?
―গায়ের শার্ট খুলতে খুলতে মুহিত রসিয়ে রসিয়ে বললো
―অনেক কিছুই করতে এসেছি।শুয়ে পড়ো বেশি কথা না বলে।

লাইট অফ করে নীল রঙা ডিম লাইট জ্বালিয়ে দুরুদুরু বুক নিয়ে মুহিতের পাশে শুয়ে পড়লো স্বর্গ।
হঠাৎ ই শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মুহিত স্বর্গ কে।

এর পর ফিসফিস করে স্বর্গের কানের কাছে মুখ এনে বললো
―আগামী মাসেই বিয়ে করে তুলে নিয়ে যাবো তোমাকে,এভাবে আর থাকা যাচ্ছে না।
মুহিতের গরম নিঃশ্বাসে শিহরণ বয়ে গেলো স্বর্গের সারা শরীরে।
শক্ত করে মুহিত কে জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেললো।
স্বর্গের চোখে মুখে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলো মুহিত।
মুহিতের চুল খামচে ধরলো স্বর্গ।
নিজেকে আর কন্ট্রোলে রাখা গেলো না।
নিমিষেই উন্মাদনায় দুজন দুজনের মাঝে হারিয়ে গেলো।

★★★★
আজ নয় তারিখ,কাঙ্ক্ষিত সেই সময় একটু পরেই ঘনিয়ে আসবে।
সৌম্যকে না নিয়ে সিভিল ড্রেসে নিজের কালো রঙের কে টি এম বাইক স্টার্ট দিলো মুহিত।মাথায় কালো হ্যালমেট লাগিয়ে ছুটে চললো হাজতে।
নির্দিষ্ট সময়ের এক ঘন্টা আগে এসে দাঁড়িয়ে আছে মুহিত।আজ তার অনেক কাজ।
সকল কাজের দ্রুত সমাধা না করলে সমস্যা ধীরে ধীরে বাড়তেই থাকবে।
একদিকে মা বোন,অন্যদিকে বউ।
সবাই চুম্বকের মতো টানছে কিন্তু কারো কাছেই যাওয়া যাচ্ছে না।
আশরাফ চৌধুরী কে নির্মূল করে তবেই ধুমধাম করে স্বর্গ কে ঘরে তুলবে মুহিত।
শত্রু বাঁচিয়ে রেখে আনন্দ উল্লাস করতে মন সায় দিচ্ছেনা এবার।
এদিকে অপেক্ষা করতেও কষ্ট হচ্ছে।
অপেক্ষার সময় সবচেয়ে দীর্ঘ।

হঠাৎই এলার্ম বেজে উঠলো ফোনে।ধ্যান ছুটে গেলো মুহিতের।
দুটো বেজে চল্লিশ মিনিট।আর মাত্র পাঁচ মিনিট পরেই শুরু হবে দর কষাকষি।
কতদিন চালাতে হবে আর এই তামাশা?
ভিজিটিং রুমে বসে পায়ের উপর পা তুললো মুহিত।
চোখ বন্ধ করে গুনলো
―ওয়ান,টু,থ্রি!
আহিয়ান এসেছে।
আহিয়ান কে দেখেই মুখের হাসি প্রশস্ত হলো মুহিতের।

মুহিতকে দেখেই আবোল তাবোল বলতে শুরু করলো আহিয়ান।
মুহিত চোখ দিয়ে ইশারা করতেই কারারক্ষী বাইরে চলে গেলো।

সোজা হয়ে বসলো মুহিত।
এক ভ্রু বাঁকা করে ফিচেল হেসে আহিয়ান কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো
―নিজের ফর্মে এসো আহিয়ান।
―ইউ আর আন এবল টু ডজ মুহিত ওয়াসিফস আইজ!

#চলবে।

তোমার জন্য সিন্ধুর নীল পর্ব-২৩+২৪

0

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_২৩
#সারিকা_হোসাইন

~~~~~~
পূর্ণিমার ঝকঝকে থালার মতো রুপালি চাঁদ শেষ হয়ে গেছে আরো কয়েক দিন আগে ।ঘন কালো অমাবস্যার নিশুতি গ্রাস করেছে পুরো ধরণী।আকাশে চাঁদ এখনো দৃশ্যমান হয়নি।বাইরের পরিবেশ উত্তপ্ত,গুমোট।হঠাৎ ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেলো।
চাঁদহীন আকাশ আর আলো হীন ধরণী সব মিলিয়ে ঘুটঘুটে চারপাশ।মাঝে মাঝে ঝিঁঝিঁ পোকার কর্কশ ডাক শোনা যাচ্ছে।

এই অন্ধকার নিশুতিতে সাগরিকা নিবাসের পাঁচিল টপকে উঠে গেলো দুজন তাগড়া যুবক।পাঁচিল টপকানোর কৌশলে মনে হচ্ছে তারা এই কাজ আরো আগেও বহু বার খুব সুনিপুণ ভাবে করেছে।

কোমরে গুঁজে রাখা রিভলবার টাকে দুই হাতে পজিশন করে ধরে ধীরে ধীরে সামনে আগাতে থাকলো।
আশেপাশে ভালো ভাবে যুবক দুটো খেয়াল করে দেখলো কেউ আছে কি না।
নাহ কেউ দেখছেনা।ভেতরে প্রবেশের এটাই উপযুক্ত সময়।
দূতলা বাসাটির নিচ তলায় কিচেন।সেই কিচেনের জানালার একটা পাল্লা খোলা দেখা যাচ্ছে।
যুবক দুটির চোখ চকচক করে উঠলো।
পরিবেশ আর সুযোগ সব মিলিয়ে যেনো সোনায় সোহাগা।

*****
ইজি চেয়ারে বসে দোল খাচ্ছেন নাসের হায়দার।জীবনের সব সুখ যেনো হাওয়ায় মিলিয়ে যেতে চাইছে তার।হঠাৎই আশরাফ চৌধুরী গিরগিটির ন্যায় রং বদল করে ফেলছে।মেজর মুহিত ও ফিরে এসে সব প্ল্যানিং প্রোগ্রাম পন্ড করে দিচ্ছে।
এদিকে মেয়েটাও অনেক তথ্য হাতিয়ে নিয়েছে।
মায়ের মতো তাকেও চিরতরে শেষ করে দেয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে মনে হচ্ছে।

নাহ আর ভালো লাগছে না।সব কিছু পানসে লাগছে ।পানসে সময় কে একটু স্বাদ যুক্ত করতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন তিনি।
পছন্দের হুইস্কির বোতল থেকে ঢেলে নিলেন এক প্যাগ হুইস্কি সাথে দিলেন কয়েক টুকরো বরফ।

চোখ বন্ধ করে প্রথম চুমুক দিতেই গলায় তিতকুটে ঝাঁঝালো স্বাদ অনুভূত হলো।
হুইস্কি গ্লাস হাতে ধীরে ধীরে বারান্দায় পাতা সোফা টাতে বসলেন ।
এখান থেকে বকুল ফুলের গাছটা ভালো দেখা যায়।
কিন্তু ইলেক্ট্রিসিটি হীন পরিবেশ অন্ধকার কবরের মতো মনে হয়।
বকুল গাছ সম্পূর্ণ না দেখা গেলেও হালকা বাতাসে দোল খাওয়া পাতার খচ খচ শব্দ শোনা যাচ্ছে।
বিশ টি বছর ধরে এই বকুল গাছ দেখেই জীবন পার হয়ে গেলো।

নাহ হুইস্কি তে ভালো নেশা হচ্ছে না আজ।

পুরোনো অতীতের ক্ষত গুলো তাজা হয়ে উঠে নেশা কাটিয়ে দিচ্ছে।
★★★

সালটি ১৯৯৫।
ঘর আলো করে চাঁদের মতো একটি পুত্র সন্তান এসেছিলো নাসের আর সাগরিকার ঘরে।নাসের তখন সাধারণ একজন লেফটেন্যান্ট।
খুবই সামান্য বেতন ছিলো তার।
সেই অল্প বেতনে নাসের আর সাগরিকার চললেও সন্তান আসার পর হিমশিম খেতে হতো তাদের।
সাগরিকার বুকের দুধ খুবই কম ছিলো, শিশুটি সারাদিন কাঁদতে থাকতো করুন সুরে।
সামান্য বেতনে বাসা ভাড়া,বাজার খরচ ,সব চালাতে হতো।এর পর যুক্ত হলো বাচ্চার দুধ।
এতো অভাব অনটনের মধ্যেও সাগরিকা ছিলো হাসি খুশি।ছেলেটার বয়স যখন দুই তখন কঠিন এক ব্যধিতে আক্রান্ত হলো সে।
চিকিৎসা করেও কোনো ভালো হবার লক্ষণ দেখা যাচ্ছিলো না।এক দিকে অনাহারে জীবন যাপন,তার মধ্যে বাচ্চা নিয়ে যুদ্ধ,নির্ঘুম রাত্রি যাপন,হঠাৎই সম্পর্কে বিতৃষ্ণা এসে গেলো দুজনের।
ছেলেটা একদিন খুবই অসুস্থ হয়ে পড়লো।এদিকে মাসের শেষ প্রায়।হাতে কোনো টাকাই নেই।
ছেলেটা এক নাগাড়ে কেঁদেই যাচ্ছে।।
কাঁদতে কাঁদতে হঠাৎই খিঁচুনি উঠে ছেলেটা কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই মৃত্যু কোলে ঢলে পড়লো।
সাগরিকা একটুও কাঁদলো না সেদিন।
শুধু আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

―টাকা হীন পুরুষের একটা নেড়ি কুত্তার সমান দাম ও নেই।
এক দিকে পুত্র শোক অন্যদিকে সাগরিকার এহেন অপবাদ।
সব মিলিয়ে মাথা ঘুরে উঠলো।পৃথিবীর সমচেয়ে অসহায় মনে হলো নিজেকে।

ধীরে ধীরে পুত্র শোক কাটিয়ে উঠলাম ঠিকই কিন্তু দুজন দুই মেরুর মানুষ হয়ে একই ছাদের নিচে বসবাস করতে লাগলাম।

হঠাৎই একদিন দিনাজপুর বর্ডার এলাকায় ট্রান্সফার হলো আমার।
চুরাই পথে বিভিন্ন জিনিস আসে,ওখানে গিয়ে জানতে পারলাম এসব দেখেও না দেখার ভান করলে শুধু টাকা আর টাকাই আসে।
এমন কথায় চোখ চক চক করে উঠলো আমার।।

এমন পরিস্থিতিতে পরিচয় হলো আহমেদ কসাই এর সাথে।
বিশাল ব্যাবসা তার।মানুষ পাচারের ব্যাবসা।
লোকটি আমাকে আশার আলো দেখালো,বিনিময়ে আমার সাহায্য প্রার্থনা করলো।
আমিও রাজি হয়ে গেলাম,টাকার লোভ কে হাতছাড়া করবে?

আমি নিজেই গাড়ি করে মানুষ বর্ডার পার করে দিলাম।
এক বছরের ব্যাবধানে লাখপতি হয়ে গেলাম।
ঢাকায় জমিও কিনে ফেললাম।
খুশি হয়ে সাগরিকা কে গড়ে দিলাম দূতলা একটি বাড়ি।

আহমদ কসাই নিমিষেই নাম ধাম বদলে বিশিষ্ট সমাজ সেবী আশরাফ চৌধুরী হয়ে গেলো।আর আমি হলাম তার বিষ্যভাজন ব্যাক্তি।
এমন কোনো কাজ নেই যেখানে আমি তাকে সাহায্য করিনি।

পিউ পেটে এলো।সাগরিকা খুশিতে পাগল হয়ে গেলো।
টাকা সন্তান দুটোই এক সাথে।সুখ যেনো সত্যি ই ধরা দিলো এবার।

আমি ঢাকায় শিফট হলাম আবার।পিউ এর বয়স তখন চার।
একদিন আমার আর আশরাফ চৌধুরীর সকল কথা শুনে ফেললো সাগরিকা।
শুনেই আমাকে ঘৃণা করতে লাগলো,সংসারে অশান্তি শুরু করে দিলো।।

আমার নামে ক্যান্টনমেন্ট এ বিচার দেবে সেই ভয় দেখাতে লাগলো।

আমার এতদিনের গড়া সুখ,টাকা এই নির্বোধ মহিলা এক নিমিষেই শেষ করে দিতে চাইলো।
যখন টাকা ছিলোনা তখনো কথা শুনাতো,যখন টাকা দিয়ে ভরিয়ে দিলাম তখন আবার টাকা প্রাপ্তির উৎস খুঁজতে লাগলো।

মেয়েদের মন কে বুঝতে পারবে যে,তাদের কখন কি চাই?

টাকার নেশা ততোদিতনে আমাকে বদ্ধ উন্মাদ করে দিয়েছিলো।
সাগরিকা বিভিন্ন ভয় ভীতি দেখিয়ে চুপ করিয়ে নজরদারি তে রাখলাম।

সাগরিকা এক রাতে পিউকে কোলে নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলো।
আমার সন্তান নিয়ে আমার বাসা থেকে পালিয়ে যাচ্ছে আমার নামে আর্মি হেড কোয়ার্টার এ বিচার দিতে।
রক্ত গরম হলো মুহূর্তেই।
পিউকে ছো মেরে নিয়ে বন্দি করে দিলাম স্টোর রুমে।কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটা কখন ঘুমিয়ে গেছে কে জানে?

রাগ সংবরন করতে না পেরে প্যান্টের বেল্ট খুলে সাগরিকার গলায় চেপে ধরলাম,
―হারামজাদী বিচার দিবি আমার নামে?
―তোর কথার জন্যই তো হারাম পথে টাকা কামাতে গেলাম।
―তুই ই তো আমাকে রাস্তার কুকুরের সাথে তুলনা করেছিলি।
তোকে রাজপ্রাসাদ গড়ে দিলাম তবুও এখন মনে ধরছে না তোর?

জিভ বেরিয়ে এলো সাগরিকার, অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে।অনেক কিছু বলতে চাইলো, কিন্তু পারলো না।

সেসবে আমার কিচ্ছু যায় আসে না।
ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে নিস্তেজ হলো সাগরিকা।
নাক দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়লো।
নিমিষেই রাগ পানি হলো আমার কিন্তু সাগরিকা আর নেই।
কোথায় লুকাবো এই লাশ?
সাগরিকার তিন কুলে কেউ নেই যে খুজ করতে আসবে।
কিন্তু মেয়েটি তো মাকে খুঁজবে।
কোদাল নিয়ে চলে গেলাম বাড়ির পাশের খালি জায়গা টায়।গভীর গর্ত করে পুতে দিলাম ভালোবাসার সাগরিকা কে।লাগিয়ে দিলাম বকুল ফুলের চারা।

স্মৃতি চারণ করতে করতে পুরো বোতল সাবাড় করে ফেললো নাসের হায়দার।এবার তার প্রচুর ঘুম পাচ্ছে।
ইজি চেয়ারে বসেই মুহূর্তেই তলিয়ে গেলো ঘুমের রাজ্যে।

******
বহু কসরতের পর জানালার গ্রিল খুলতে সক্ষম হলো যুবক দুটো।
রান্না ঘরের জানালা দিয়ে ঢুকে গেলো বাসার ভেতর।
অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে খুঁজতে লাগলো পিউ এর কক্ষ।
দূতলা বাড়ি টিতে মোট বারোটি রুম রয়েছে।
কোনটাতে আছে পিউ?
অন্ধকারে ছোট টর্চ জ্বালিয়ে খুঁজেও সারা বাড়িতে পিউ এর কোনো খুজ পাওয়া গেলো না।
নিস্তব্ধ পরিবেশে হঠাৎই ফুঁপিয়ে কান্নার আওয়াজ পাওয়া গেলো।
চকিত হলো যুবকদ্বয়ের কান।
কান খাড়া করে শব্দ অনুসন্ধান করে এগুতে এগুতে একটি তালাবদ্ধ দরজার সামনে এসে হাজির হলো তারা।
আরেকটু সজাগ হতেই বুঝতে পারলো এই রুম থেকেই কান্নার আওয়াজ আসছে।
দ্রুত ব্যাকপ্যাক থেকে লক কাটার টুলস বের করে শক্ত পেশির শক্তিতে কেটে ফেললো লক।
সহকারী কে পাহাড়ায় রেখে ঢিপঢিপ করা বুক নিয়ে ঢুকে পড়লো কক্ষের ভেতর।
টর্চের আলো ফেলতেই ভয়ে কেঁপে উঠলো পিউ।
নিজের অতিপরিচিত প্রানপ্রিয় পুরুষকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলো ।
দৌড়ে এসে গলা জাপ্টে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলো।
ভালোবাসার মানুষের এমন করুন পরিস্থিতি সহ্য হলো না প্রেমিক পুরুষের।
গড়িয়ে পড়লো দু ফোটা জল।
পিউ কান্না থামিয়ে শার্টের কলার ধরে বলে উঠলো
―আমাকে এখান থেকে নিয়ে চলো সৌম্য।বাবা আমাকেও আমার মায়ের মতো মেরে ফেলবে।

উপর নিচ মাথা ঝাঁকালো সৌম্য।
অবশ্যই সে আজ সাথে করে নিয়ে যাবে তার ভালোবাসাকে।

হাত ধরে প্রস্থান করতে নিলেই দাঁড়িয়ে গেলো পিউ।
“”এক মিনিট সৌম্য।
দৌড়ে চলে গেলো নিজের কক্ষে।লুকিয়ে রাখা ফোন আর রেকর্ডার ডিভাইস নিয়ে কীয়তক্ষন বাদেই ফিরে এলো।

ধীরে ধীরে পা ফেলে তারা চলে এলো রান্না ঘরে।
মেজর আদ্রিয়ান লাফিয়ে নেমে গেলো বাইরে।
সৌম্য পিউ কে কোলে তুলে বাইরে বের করে দিলো।
মেজর আদ্রিয়ান ধরে ফেললো পিউ কে।
সৌম্য ঝাঁপিয়ে পড়লো এরপর।
খুব সাবধানে গেট ক্রস করে গাড়িতে এসে বসলো।
মেজর আদ্রিয়ান গাড়ি স্টার্ট দিয়ে চলতে লাগলো।

――――――
সকাল হতেই দরজায় ধুপধাপ বাড়ির আওয়াজে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটলো নাসের হায়দার এর।
আবারো ঘুমের চেষ্টা চালালো সে।কিন্তু চিৎকার চেঁচামেচি তে ব্যার্থ হলো।
রাগে মুখে খারাপ গালি উচ্চারণ করে দরজা খুলতেই আর্মি স্পেশাল ফোর্সের পুলিশ দেখে অবাক হয়ে জানতে চাইলো
আপনারা?
“”কি চাই আমার কাছে??
দুটো সোলজার গাড়ির ভেতর থেকে শাবল ,করাত আর কোদাল নিয়ে এলো।
এসব যন্ত্রপাতি দেখে চোখ কপালে উঠলো নাসের হায়দার এর।
বিশ বছর ধরে যত্ন করা বকুল ফুলের গাছটি নিমিষেই কেটে ফেললো নবাগত দুজন সোলজার।
কোদাল দিয়ে কুপিয়ে শাবলের সাহচর্যে উপরে ফেললো গাছের মূল।
আরো কিছুখন খনন করতেই বেরিয়ে এলো একটি এলোমেলো কঙ্কাল।
সকলের চক্ষু চড়ক গাছে পরিণত হলো।
পুলিশ অফিসার নির্দেশ দিলেন
“”এরেস্ট হিম।
দুজন সিপাহী হ্যান্ডকাফ পরিয়ে দিলো নাসের হায়দার এর হাতে।
টেনে হিচড়ে নিয়ে যাওয়া হলো তাকে গাড়ির কাছে।

–—–/—–
কোর্ট -মার্শাল বসানো হয়েছে নাসের হায়দার এর জন্য।
বিচারক হিসেবে রয়েছেন আর্মি জেনারেল,এবং বিচার বিভাগ এর একজন বিচারক,সামরিক প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত দুজন উকিল ।

নাসের হায়দার কে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে টেবিলে বসানো হলো।সামনে তার কোর্ট রুমের জন্য বরাদ্দকৃত মাইক্রোফোন।

পিউকে ডাকা হলো।

শুরু হলো বিচার কার্য।

একের পর এক পাল্টাপাল্টি প্রশ্ন চলছে।

পিউ তার হাতে থাকা সমস্ত প্রমান আর্মি জেনারেল এর কাছে পেশ করলো।
সকল প্রমানাদির ভিত্তিতে এবং নিজের স্ত্রীকে খুনের দায়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হলো নাসের হায়দার কে আর আশরাফ চৌধুরী কে দ্রুত গ্রেফতার এর নির্দেশ দেয়া হলো।

মেয়ের দিকে তাকিয়ে স্মিত প্রাণহীন হাসলেন নাসের হায়দার।ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলো পিউ।
পুলিশ নাসের হায়দার কে নিয়ে যেতে উদ্দত হতেই আসামি পক্ষের উকিল পিউকে জিজ্ঞেস করলেন
―আপনি কি আপনার বাবার উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চান?
উকিলের কথা শুনে পিউ ধীর পায়ে নাসের হায়দার এর সামনে এলো।
সে অনেক কিছুই বলতে চায় বাবা নামের এই অমানুষ টাকে।
কিন্তু বলতে ইচ্ছে করছে না এই মুহূর্তে।

কিছুক্ষন মৌন রইলো পিউ,এর পর মাথা উঁচু করে নাসের হায়দার এর চোখে চোখ রেখে বলে উঠলো
―পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ বাবা তুমি,তোমাকে আমি ঘৃণা করি।দূর হয়ে যাও আমার সামনে থেকে।

নাসের হায়দার এর চোখে নীল বেদনার জল দেখা গেলো।
নিজের মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে কলিজা মোচড়ে উঠলো তার ।
কিছুই বলতে পারলেন না পিউ কে।
কেউ বুঝি গলা টিপে ধরে আছে।
বহু কষ্টে গলার স্বর স্বাভাবিক করে শুধু বলে উঠলো
―কোনো বাবাই পৃথিবীতে খারাপ হয়ে জন্ম নেয়না রে মা।
পরিস্থিতি বাবাদেরকে খারাপ করে দেয়।
শুধু খারাপ নয়,জঘন্য থেকে জঘন্যতম।

কথাটি বলে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা করলেন না নাসের হায়দার।
পুলিশের আগে আগে চলে গেলেন কারাগারের দিকে।

হাটু মুড়ে মেঝেতে বসে পড়লো পিউ।সৃষ্টিকর্তা তার জন্য কি একটুও বাবা মায়ের আদর রাখতে পারলো না?
দুজন কেই দুই ভাবে কেড়ে নিতে হলো?
পিউএর কান্নায় সৌম্যের চোখেও জল এসে গেলো।
আর্মি জেনারেল পিউকে উদ্দেশ্য করে শান্তনার বাণী দিয়ে প্রস্থান করলেন।
স্বর্গ এসে জড়িয়ে ধরলো পিউ কে।
কোনোমতে শান্ত করে স্বর্গ পিউকে তার সাথে নিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিলো।

*******
সকল পরিস্থিতি যেনো আশরাফ চৌধুরীর প্রতিকূলে।শালা নাসের হায়দার তাকে চূড়ান্ত ফাঁসানো ফাঁসিয়েছে।
এদিকে মন্ত্রী মোশতাক আহমেদ ফোন তুলছে না।
ব্যাটা নির্ঘাত মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করে বেড়াচ্ছে।
এদিকে আমি শুলে চড়ে আছি আর ঐদিকে উনি মস্তি করে ঘুরছে।
আরো বার চারেক মোস্তাক আহমেদ এর নম্বর ডায়াল করে রাগে ফোন ছুড়ে মারলেন আশরাফ চৌধুরী।

মেজর মুহিত কে টুকরো টুকরো করে কুত্তা দিয়ে খাওয়াতে পারলে মনে একটু শান্তি পাওয়া যেতো।রাগে মাথার চুল ছিড়তে ইচ্ছে করছে আশরাফ চৌধুরীর।

আশরাফ চৌধুরীর বাড়ির চারপাশ ঘিরে ফেলেছে জনগণ।ক্রমাগত ঢিল ছুড়ে জানালার কাচ ভাঙছেন ক্রুদ্ধ জনতা।
আইনের বিচারের আগে তারাই বিচার করবেন এই জানোয়ারের।
তাদের বোকা বানিয়ে তাদের নাকের ডগায় বসে এসব কুৎসিত অপকর্মের শোধ আজকেই তুলবেন তারা।কিছু মানুষ গেট টপকে ভেতরে ঢুকে গেলো।
সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও তাকে কোথাও পাওয়া গেলোনা আশরাফ চৌধুরী কে।

আরো কিছু ভাঙচুর করে চলে গেলেন তারা।কিছু মানুষ সুযোগ পেতেই ঘর থেকে দামি জিনিস নিতেও ভুললেন না।

আশরাফ চৌধুরী তার গোপন কামরায় ঘাপটি মেরে বসে আছেন।মানুষের সকল কথাই তিনি শুনতে পাচ্ছেন।
কেউ কেউ নাখাস ভাষায় গালিগালাজ ও করে যাচ্ছেন।
আশরাফ চৌধুরী মনে মনে ভাবলেন
পরিস্থিতি খালি একবার স্বাভাবিক হোক।সবকটা কে চামড়া তুলে লবন মরিচ লাগাবো।

#চলবে।

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব২৪
#সারিকা_হোসাইন

******
টিকটিক শব্দ তুলে আকস্মিক নীরবতা ভেঙে ঘড়ির কাটা জানান দিলো এখন রাত বারোটা।জানালার ফাক গলিয়ে মৃদু চাঁদের আলো স্বর্গের কক্ষের মেঝেতে হুটোপুটি করছে।থেকে থেকে দমকা বাতাসে সাদা ফিনফিনে পর্দা গুলো উড়ুউড়ি করছে।চারপাশ নিস্তব্ধ, নিগূঢ়।
পিউ কিছুক্ষণ আগেই কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গিয়েছে।
এসির পাওয়ার কমিয়ে একটা কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লো স্বর্গ।

ত্রিশ মিনিট যুদ্ধ করেও চোখে ঘুম আনতে পারলো না সে।ইদানিং মুহিতের বুকে না শুলে ঘুম ই আসতে চায়না তার ।মুহিত নামক অস্তিত্ব তার সকল অভ্যাস বদ অভ্যাসে পরিণত করেছে দিনে দিনে।

আরো কিছুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে উঠে বসলো স্বর্গ।
পিউকে ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে শব্দ না করে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালো।এর পর পা টিপে টিপে দরজার দিকে এগুতে লাগলো।
আস্তে করে দরজা খুলে রুমের বাইরে এসে বাহির থেকে দরজা চাপিয়ে দিলো।

এদিকে নিজের প্রয়োজনীয় সকল কাজ গুছিয়ে ব্যাগ গুছাচ্ছে মুহিত।সকালে সে তার নিজের কোয়ার্টার এ ফিরে যাবে।এখানে থেকে কাজ করতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে তার।নাফিজ মাহমুদ বা স্বর্গ কারো কাছেই এমন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে চায়না মুহিত যার উত্তর তার জানা নেই।

নিজের বাসা থেকে যেই কাজ যতো কমফোর্টলি করা যায় অন্যের বাসায় সেটা ততোটাই আনইজি।
মায়ের জন্য মুহিত এতোদিন এখানে পরে ছিলো।নামিরা ফিরে এলে মুহিত সবাইকে নিয়ে তার বাবার পুরাতন বাড়িটাতে উঠবে।আবার একসাথে হেসে খেলে বাঁচবে তারা।

এবার যে পথের কাটা হয়ে দাঁড়াবে তাকেই মূল সমেত উপড়ে ফেলবে মুহিত।
যেই গ্লানি এই ছয় বছর টেনেছে তারা প্রত্যেকে ,তার আর পুনরাবৃত্তি হতে দেবেনা সে কিছুতেই।

দরজার সামনে কারো হাঁটার শব্দে সজাগ হলো মুহিত,
মৃদু শব্দে নক হতেই ঠোঁটে ফুটলো প্রাপ্তির হাসি।
দরজার ওপাশে কে আছে বুঝতে ন্যানো সেকেন্ড সময় ও লাগলো না তার।
সহসাই রুমের লাইট নিভিয়ে খুট করে দরজা খুলে হেচকা টানে কোলে তুলে ফেললো স্বর্গকে।
আদুরে বিড়ালের ন্যায় মুহিতের গলা জড়িয়ে ধরে থুতনিতে মুখ গুজলো স্বর্গ।
এর পর মুহিতের গলায় নাক ডুবিয়ে লম্বা এক নিঃশ্বাস নিলো।
মুহিতের গায়ের গন্ধে আপনা আপনি চোখ বন্ধ হয়ে এলো তার।এখন ভালো ঘুম হবে।

স্বর্গকে বিছানায় এনে বসিয়ে দিলো মুহিত।তার চলে যাওয়ার কথা এখনো বলেনি স্বর্গকে।
কিভাবে কথাটা শুরু করবে সেটাও জানেনা।
মুহিত জানে, চলে যাবার কথা শোনা মাত্রই মেয়েটা কষ্ট পেয়ে কেঁদে দিবে।কিন্তু মুহিতের যেতেই হবে।
আরো দুটো পথের কাঁটা এখনো তুলতে বাকী আছে যে।।

নীরবতা ভেঙে আদুরে কন্ঠে বলে উঠলো মুহিত
―তুমি না বলেছিলে আজকে আসবে না?পিউ এর সাথে ঘুমুবে?

ঠোঁট উল্টালো স্বর্গ।এই মানুষটার সামনে আসলে তার যতো ধরনের বাচ্ছামো আছে সব করতে ইচ্ছে করে।

মুহিতের শার্টের বাটনে আঙ্গুল খুটতে খুটতে বললো
―তোমাকে ছাড়া ঘুম আসছিলো না।
জানো এক ঘন্টা ধরে এভাবে চোখ বন্ধ করে রেখেছি আমি
বলেই হাত দিয়ে চোখ টিপে ধরে মুহিতকে দেখালো ।

মেয়েটির এমন কিউট ফেস দেখে ঠোঁট কামড়ে হেসে উঠলো মুহিত।।
স্বর্গকে উদ্দেশ্য করে মুহিত বললো
―চলো আমি ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি।ভোর হবার আগেই চলে যাবে কেমন?
বড় বড় চোখ মেলে দুই ঠোঁট ফুলিয়ে স্বর্গ জবাব দিলো
―হু।
ডিম লাইট জ্বালিয়ে এসির পাওয়ার কমিয়ে কাঁথা জড়িয়ে স্বর্গকে বুকে টেনে শুয়ে পড়লো মুহিত।
এই মুহূর্তে যেনো তুলতুলে শরীরের এই উত্তাপ টাই প্রয়োজন ছিলো মুহিতের।
মুহিতের পেশীবহুল হাতের নীচে গুটিসুটি মেরে মুহিতের বুকে চুপ করে শুয়ে শুয়ে এক শয়তানি ফন্দি আটলো স্বর্গ।

হঠাৎই মুহিতের বাইসেপ পেশিতে কামড়ে ধরলো স্বর্গ।
অকস্মাৎ আক্রমণে ককিয়ে উঠলো মুহিত।
সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে কামড়ে ধরেছে স্বর্গ।
ইদানিং নাকি মুহিত কে দেখলেই তার দাঁত কিড়মিড় করে কামড়ানোর জন্য।
দাঁত পিষে সবটা সহ্য করলো মুহিত।একদিকে মামাতো বোন,আবার প্রেমিকা তারমধ্যে বউ।এমন বাম্পার অফার পেতে প্ল্পহলে একটু কষ্ট তো সহ্য করতেই হবে।

কিছুক্ষণ বাদে মুখ সরিয়ে মুহিতের বুকে ঘাপটি মেরে রইলো স্বর্গ।
মুহিত নরম কন্ঠে জানতে চাইলো
–মাংস খাওয়া শেষ মনা?

স্বর্গ আস্তে করে বললো
―হুম।
স্বর্গকে একটু লজ্জা দিতে মুহিত আহ্লাদী স্বরে বলে উঠলো
―আমি তো সহ্য করে নিলাম।
এখন আমি যদি খেতে শুরু করি তুমি সহ্য করতে পারবে তো বউ?

মুহিতের মধুমাখা স্বরে তনুমন জ্বলে উঠলো স্বর্গের।লোকটা দিনে দিনে বদের হাড্ডিতে পরিণত হচ্ছে।
কিন্তু যতো যাই হোক আজকে সে মুহিতের কাছে কিছুতেই ধরা দিবেনা।

হঠাৎই কথা ঘুরাতে বলে উঠলো বিলি কেটে দাও ঘুম পেয়েছে।

স্বর্গের ঘুম ঘুম কন্ঠে বেসামাল হতে ইচ্ছে কাছে মুহিতের।
কিন্তু নিজেকে কন্ট্রোল করে স্বর্গকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে অন্য হাতে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।

মুহিতের মনে হলো তার চলে যাবার ব্যাপারে স্বর্গকে এখন বলা টাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
কিছুক্ষণ ইতস্তত করে মুহিত বলে উঠলো
―একটা কথা ছিলো।
“”হু বলো শুনছি
―আমি কাল ফিরে যাচ্ছি আমার কোয়ার্টার এ।
কথাটা শোনামাত্র লাফ দিয়ে বসে গেলো স্বর্গ।
অবাক হয়ে জানতে চাইলো
―চলে যাচ্ছ মানে?

স্বর্গের ডেসপারেট ভাব দেখে মুহিত স্বর্গকে কাছে টেনে নিজের কোলে বসালো।
এরপর নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললো
―কিছু কাজ আছে,ওগুলো দ্রুত শেষ করে তোমাকে একবারে আমার কাছে নিয়ে যাবো।
মনে করো, সেই কাজ গুলোই দ্রুত শেষ করতে যাচ্ছি।

মুহিত চলে যাবে ভাবতেই মন ভার হলো স্বর্গের।যেহেতু মুহিত বলেছে তার কাজ আছে সেহেতু স্বর্গ কোনো ভাবেই বাধা দিবেনা মুহিত কে।আর মুহিত যেহেতু নিজে থেকে বলেনি কি কাজে যাচ্ছে তাই স্বর্গ ও আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করে মুহিত কে বিব্রত করলো না।

ভেজা কন্ঠে মুহিত কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে অনুরোধ করে বললো
―যেখানেই যাও আমার মুহিত কে অক্ষত অবস্থায় আমার কাছে ফেরত দিবে।
প্রমিস?
স্বর্গের কপালে অনেক গুলো চুমু খেয়ে মুহিত বললো
“”প্রমিস।

―――――
পেরিয়ে গেছে দুটো দিন আশরাফ চৌধুরী কে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।রিপোর্টার, জনগণ, ছোট বড় ইউটিউবার সবাই মিলে ভিড় করে আছে আশরাফ চৌধুরীর বাড়ির সামনে।
একটা জলজ্যান্ত মানুষ গায়েব হয়ে গেলো নিমিষেই ,কেউ ই টের পেলো না?

যতো ধরনের যানবাহন আছে প্রত্যেকটা জায়গায় খুঁজ নেয়া হলো।আশরাফ চৌধুরীর ছবি দিয়ে বিজ্ঞাপন দেয়া হলো
―ধরিয়ে দিন।
মুহিতের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো,
গেলো কোথায়?

হঠাৎই মুহিত সৌম্যকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো
―ক্যাপ্টেন চলো আহিয়ান কে দেখে আসি।
বলেই বাঁকা হাসলো মুহিত।

*******
ঢাকার নামিদামি একটি হোটেলের বিলাসবহুল কক্ষে দুটো মেয়েকে নিয়ে ফুর্তিতে মেতেছে মন্ত্রী মোশতাক আহমেদ।
ফুর্তির সময় ফোন কলে ডিস্টার্ব করা একদম পছন্দ নয় তার।
তার মতে যে ব্যাক্তি প্রতিদিন নতুন দেহের স্বাদ না পেয়েছে তার জীবন বৃথা।
মনের মধ্যে আফসোস নিয়ে মরার কোনো সাধ নেই তার।যতদিন বাঁচবে ফুর্তি করেই বাঁচবে।
ক্ষমতা বড়ই ভয়ঙ্কর জিনিস।ক্ষমতা থাকলে টাকা থাকে আর টাকা থাকলে বাঘের চোখ ও কেনা যায়।
না হলে তার মতো এক বুড়ো চুষা আমের কাছে কচি হট মেয়ে গুলো শয্যাসঙ্গী হতে কেনো আসবে?
নিজের ক্ষমতার দাপটে নিজেই হো হো করে হেসে উঠলো।

দুটো মেয়ে বয়স বিশ কি বাইশ,খুবই ছোট ছোট পোশাকে মোশতাক আহমেদ এর গায়ে পরে ঢলাঢলি করছে আর মোশতাক আবেশে চোখ বন্ধ করে সুরা পানে ব্যাস্ত।
হঠাৎই খুট করে খুলে গেলো দরজা।
ঘরে প্রবেশ করলো তিনজন উঁচু,চওড়া,কালো কাপড় পরিহিত আগন্তুক।
হঠাৎ রুমের মধ্যে কারো আগমনে মেয়ে গুলো দৌড়ে বিছানার সাদা চাদরে নিজেকে আবৃত করলো।
হঠাৎ ই একজন কালো কাপড় পরিহিত লোক মেয়ে গুলোর উদ্দেশ্যে গর্জে উঠে বললো
―গেট আউট।
ভয়ে মেয়ে গুলো দ্রুত প্রস্থান করলো।
রুমে হঠাৎ কারো আগমনে ভড়কে গেলো মোশতাক আহমেদ।মুহূর্তেই নিজেকে ধাতস্থ করে বালিশের নিচে রাখা রিভলবার বের করে যুবক গুলোর দিকে তাক করলো।

রিভলবার ধরার স্টাইল দেখেই যুবক গুলো বুঝে গেলো এই লোক কোনোদিন একটা গুলি তো দূরে থাক ট্রিগার ই চাপে নি।

বন্দুক তাক করে মোশতাক বলতে থাকলো
―মুখের কাপড় খোল শুয়োরের বাচ্চা রা দেখি বুকের কতো পাটা।
বলা মাত্রই মুখের কাপড় খুললো তারা।
তাদের চেহারা দেখেই মোশতাক বলে উঠলো
―তুই বেঁচে আছিস?
হাসলো মুহিত,তাচ্ছিল্য ভরা কন্ঠে বলে উঠলো
“”তুই কিসের মন্ত্রী?
এতো এতো ঘটনা হয়ে যাচ্ছে আমাকে ঘিরে তুই কিছুই জানিস না?
মোশতাক মুহিতের কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারলো না।

হঠাৎই মেজর আদ্রিয়ান জোরে এক ঘুষি বসিয়ে দিলো মোশতাক এর পেটে।
ঘুষি খেয়ে পেটের সব হাওয়া গালে জমা হলো,গাল ফুলিয়ে
“ওপ” শব্দ করে বসে পড়লো মোশতাক।হাত থেকে ছিটকে পড়লো ভারী রিভলবার।
ইন্টার কমে ফোন করার চেষ্টা করলো সে,সৌম্যের জন্য সেটাও পারলো না।

মুহিত গমগমে কন্ঠে সৌম্যকে আদেশ দিলো ওকে বাথটাবে শুইয়ে বেঁধে ফেলো।

দুজন সেনা সদস্যের শক্তির সাথে টিকতে পারলো না মোশতাক।তাকে চ্যাঙ্গদোলা করে তুলে নিয়ে বাথরুমের দিকে অগ্রসর হলো মেজর আদ্রিয়ান আর সৌম্য।

মোশতাক মুখের ঠাট বজায় রেখে বিভিন্ন হুমকি ধামকি দিতে থাকলো।
―তোদের সবকটার চাকরি খেয়ে ফেলবো দেখিস,কার সাথে পাঙ্গা নিয়েছিস?

―বেঁচে থাকলে তবেই তো চাকরি খাবি বলে উঠলো আদ্রিয়ান।
সেনাসদস্য দের এমন হেঁয়ালি কথা শুনে রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারালো মোশতাক।
বাথটাবের পাশে থাকা কাঁচের বডি ওয়াশ এর বোতল দিয়ে মুহিতের মাথায় বাড়ি বসিয়ে দিলো।
হাত দিয়ে নিজেকে প্রটেক্ট করতে গিয়ে হাতের কব্জি থেকে উপর পর্যন্ত কেটে রক্ত বেরিয়ে গেলো মুহিতের।
রাগে চক্ষু লাল হয়ে গেলো মুহিতের।
ভাঙা টুকরো কুড়িয়ে মোশতাকের চোখ বরাবর বিধিয়ে দিতে উদ্দত হতেই চোখ খিচে বন্ধ করে ফেললো মোশতাক।

এইটুকু সাহস নিয়ে আমায় বাড়ি মেরেছিস?বলেই হা হা করে হাসলো মুহিত।
মোশতাক এর গায়ে আগুন ধরে যাচ্ছে মুহিতের হাসিতে।
নিজেকে নিজেই মনেমন গালাগাল দিয়ে যাচ্ছে সিকিউরিটি ছাড়া কেনো এসেছে সেটা ভেবে।
সিকিউরিটি সাথে থাকলে মুহিতের তেরোটা বাজিয়ে ছেড়ে দিতো আজকে সে।
সামান্য মেজর হয়ে তাকে বাথ টাবের সাথে বেঁধে ফেলে ?

হঠাৎই স্কচটেপ আটকে দেয় মোশতাকের মুখে মুহিত।এবার মোশতাকের ভয় করতে শুরু করে।
কি করতে চাইছে এই মেজর?

মুহিত আগ্নেয়গিরির লাভার ন্যায় রক্ত চক্ষু নিয়ে মোশতাকের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলে
―তুই ই সেদিন আমার মা কে বাথটাবে চুবিয়ে দিয়েছিলি নাহ?

কুকর্মের সকল স্মৃতি হাতড়ে মনে পড়ে যায় মোশতাকের ছয় বছর আগের সেই ঘটনা।
আশরাফ চৌধুরীর কথা মতো আদনান ওয়াসিফ এর বাড়িতে তারা হানা দেয়।
ড্রয়িংরুমে বসে ছিলো আদনান ওয়াসিফ আর তার ছোট বাচ্চা ছেলেটা।
তাদের কে হত্যার সময় দূতলা থেকে আদনান ওয়াসিফের স্ত্রী দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে আর চিৎকার চেঁচামেচি করতে থাকে।
সকলেই যখন বাপ ছেলেকে নিয়ে পড়ে আছে তখন মোশতাক দৌড়ে গিয়ে খাবলে ধরে মিসেস তারিনের হাত।
সপাটে গালে চড় মেরে সিঁড়িতে ফেলে দেয় তাকে।
এর পর চুলের মুঠি ধরে টেনে হিঁচড়ে দুতলায় নিয়ে গিয়ে কি করবে ভাবতে থাকে।
হঠাৎই ওয়াশরুমের খোলা দরজা তার নজরে পড়ে।তৎক্ষণাৎ এক শয়তানি বুদ্ধি চাপে তার মাথায়। ওয়াশরুমে নিয়ে গিয়ে শাড়ীর আঁচল দিয়ে শক্ত করে মিসেস তারিনের দুই হাত বেঁধে ফেলে।

মহিলা অনেক কাকুতি মিনতি করছিলো তার বাচ্চাটার জন্য।
কিন্তু মোশতাকের শক্তির সাথে কুলিয়ে উঠতে পারছিলো না।
মহিলার আর্তনাদে মোশতাকের কান ধরে গেলো।
পকেট থেকে টেপ বের করে মুখে লাগিয়ে দিয়ে বাথ টাবে ধাক্কা মারে।
সিরামিকের শূন্য বাথ টাবে চিৎ হয়ে পড়তেই মাথা ফেটে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন মিসেস তারিন।
মোশতাক দ্রুততার সহিত বাথ টাবের কল চালু দিয়ে বেরিয়ে চলে আসে।

মোশতাকের ধ্যান ভাঙে পানি পড়ার শব্দে।
ভয়ে চোখ বড় হয়ে যায় মোশতাকের।মুখে উম উম করে অনেক কিছু বলার চেষ্টা করে যাচ্ছে সে ।হাত পা এমন ভাবে বাধা হয়েছে, ডাঙ্গায় তোলা মাছের মতো মোশতাক শুধু উল্টা পাল্টা করে যাচ্ছে কিন্তু দাঁড়াতে পারছে না।
টাকা, ক্ষমতা,কিছুই যেনো আজ তার কাজে আসছে না।

মুহিত বেদনা জড়িত কন্ঠে বলতে থাকে
―তোরা আমাদের পুরো পরিবার শেষ করে দিয়েছিস।আমার মাকে জিন্দা লাশ বানিয়ে রেখেছিস।ঠিক সময়ে আমরা না এলে মা ও হয়তো বাবা আর ছোট ভাইয়ের মতো হারিয়ে যেতো।তোদের জন্য আমার বোনটা ছয় বছর ধরে বাংলাদেশে আসতে পারেনা।

হিসেব না চুকে কিভাবে তোকে ছাড়বো বল?

মিনিট দশেক বাদেই স্বচ্ছ পানিতে পরিপূর্ণ হলো বাথটাব।মুহিত বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে মোশতাকের বুকে পাড়া দিয়ে ধরলো।তলিয়ে গেলো মোশতাক।
মিনিট দুয়েক বাদে ছেড়ে দিলো,ভেসে উঠে যেনো বেঁচে ফিরলো মোশতাক।
এমন কঠিন দম বন্ধকর মৃত্যু কে চাইবে?
মনে মনে ভাবলো মোশতাক বেঁচে ফিরলে সকল খারাপ কাজ বাদ দিয়ে ভালো হয়ে যাবে।
কিন্তু এই মেজর কি সেই সুযোগ তাকে দিবে?
মোশতাক কে দ্বিতীয় বার পানিতে ডুবানোর আগে মুহিত তেজী কন্ঠে বলে উঠলো
―তোকে আমি মেরে ফেলবো রে মন্ত্রী।
তুই তোর এই ক্ষমতার জেরে কতো মানুসের ক্ষতি করেছিস তুই নিজেও জানিস না।তোর লালসা মিটাতে ভার্সিটির মেয়েদের পর্যন্ত ছাড় দিস নি তুই। তুই দেশের ভবিষ্যৎ কি গড়বি?তুই আরো ভবিষ্যত নষ্ট করছিস।

কতোজন কে পাচার করেছিস আশরাফ এর সাথে মিলে?
ক্রুদ্ধ হয়ে জানতে চাইলো আদ্রিয়ান।

তুই বেঁচে থাকলেই বরং দেশ ও দেশের মানুষের ক্ষতি।
তার চেয়ে তুই মরে যা।কারন তুই সমাজের জঞ্জাল।
আর জঞ্জাল সাফ করাই আমাদের দায়িত্ব বলে উঠলো সৌম্য।

মুহিত দুই হাত দিয়ে বাথটাব ভর্তি পানিতে চুবিয়ে চেপে ধরলো মোশতাক কে।তড়পাতে থাকলো মোশতাক।মুহিতের মাথায় যেনো খুন চেপে গিয়েছে।মোশতাক এর প্রাণবায়ুর বিনিময়ে ই যেনো মুহিতের শান্তি মিলবে।

ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে চোখ বড় হয়ে গেলো মোশতাকের।তার শেষ নিঃশ্বাসের সাথে পানি ভুরকি কাটলো।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ভেসে উঠলো পানির উপরে।

শেষ হয়ে গেলো তাদের আরেকটি গোপন মিশন।

দ্রুততার সাথে হাত পায়ের বাধন খুলে দিয়ে,মুখের টেপ তুলে বাথরুম পরিষ্কার করে সব কিছু ঠিকঠাক করে নিথর মোশতাক কে ফেলে চলে গেলো তারা।
এবার আশরাফ চৌধুরীর পালা।
কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি দিবে তাকে মুহিত।

#চলবে।

তোমার জন্য সিন্ধুর নীল পর্ব-২১+২২

0

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_২১
#সারিকা_হোসাইন

দেয়ালে থাকা এসিটা এই তীব্র তাপদাহের মধ্যেও ফুরফুরে ঠান্ডা হাওয়া দিয়ে যাচ্ছে যার কারনে বাইরের আগ্নেয়গিরির লাভার মতো উত্তাপ গায়ে লাগছে না।জানালার দামি ভারী পর্দা গুলো মাঝে মাঝে বাতাসে দোলে উঠছে।চারপাশে ফিনাইলের উটকো গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে পুরো কেবিন জুড়ে।

সকল পরীক্ষা নিরীক্ষার পর স্ট্রেচারে করে এনে মুহিত কে কেবিনে শিফট করা হলো।চাইলেই মুহিত বাসায় যেতে পারবে।কিন্তু মুহিত ই যেতে চাচ্ছে না।

একজন নার্স সহ একজন এসিস্ট্যান্ট ডক্টর নিয়ে কেবিনে প্রবেশ করলেন প্রফেসর সারোয়ার জাহান।হাতে মুহিতের সকল রিপোর্টস।

মুহিত কে উদ্দেশ্য করে প্রফেসর বলতে শুরু করলেন

―মেজর মুহিত ভয়ের কিছুই নেই,আপনাকে যেই গুলি টি করা হয়েছিলো তা খুব কম রেঞ্জের হওয়ার কারনে পিঠ ভেদ করে বেরিয়ে গেছে।আল্লাহ সহায় জন্য আপনি বেঁচে গেছেন।গুলি ভেতরে থাকলে এতোদিনে ইনফেকশন হয়ে আপনি মারা যেতেন।আর হাতে পায়ের যেই হাড় গুলো ভেঙেছে তা অনেকটাই রিকভার করেছে।
আমি জানিনা কে এগুলো ঠিক পজিশনে বসিয়েছে?
তবে যিনি বসিয়েছেন তার হাতে জাদু আছে বলতে হবে।
এরকম ফ্রাকচার আর ভাঙা হাড় জোড়া লাগতে অনেক সময়ের ব্যাপার।
আপাতত ব্রেচ পরিয়ে কয়েকদিন গলায় স্লিং ঝুলালেই আপনার হাত ঠিক হয়ে যাবে।
প্রফেসর সারোয়ার জাহান এর কথা শেষ হতে না হতেই ঝড়ের বেগে দৌড়ে কেবিনে প্রবেশ করলো স্বর্গ।

স্বর্গকে দেখে প্রফেসর অবাকের স্বরে জিজ্ঞেস করলো
―আরে স্বর্গ মামনি তুমি এই সময়ে ?
স্যার মেজর মুহিত ইজ মাই উডবি!
ওর ড্রেসিং গুলো আমি করাতে চাই।

প্রফেসর হাসি মুখে বললেন
―সিউর,হুয়াই নট?

মুহিত স্বর্গের এহেন স্বাভাবিক আচরণ দেখে নবম আশ্চর্যে উপনীত হলো।সে ভেবেছিলো কোথায় স্বর্গ তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদবে,অভিযোগ, অনুযোগ জানাবে।কিন্তু মেয়ে দেখি পুরো স্টিল হয়ে বসে আছে।
ফিরে এসে ভুল করলো নাকি মুহিত?

নাকি ঝড়ের পূর্বাভাস?

খালি গায়ে বেডে বসে আছে মুহিত।স্বর্গ ভালোভাবে হাত ধুয়ে ষ্টেরাইল গ্লাভস পরে নিলো।এর পর একজন নার্স এসে ট্রলিতে করে ষ্টেরালাইজড যন্ত্রপাতি ব্যান্ডেজ, রিবোন গজ, আরটারি ফরসেপ্স, টুথ ফরসেপ্স, সিজোর, পোভিসেপ, হেক্সিসল, স্পিরিট, দিয়ে গেলো।
বড় রিবন গজ পভিসেপে চুবিয়ে মুহিতের দিকে করুন চোখে তাকিয়ে ক্ষততে ঢুকিয়ে দিলো।সাথেই সাথেই মুহিত চিৎকার করে উঠলো।
স্বর্গ নির্বিকার কঠিন হয়ে তার কাজ চালালো।

মুহিতের এই মুহূর্তে স্বর্গকে কঠিন হৃদয়ের মানবী মনে হচ্ছে।মুহিতের আর্তনাদে নার্স আর সহকারী ডক্টর শিউরে উঠলো।

স্বর্গ মুহিত কে উদ্দেশ্য করে স্বাভাবিক কন্ঠে বলে উঠলো―

―মেজর মুহিত প্লিজ দাঁত চেপে সহ্য করুন,আমি এভাবে ড্রেসিং না করলে ভেতরের ময়লা পরিষ্কার হবে না।যতো জোরে প্রেস করবো ততো গজ টা ময়লা চুষে নেবে।
প্লিজ আরেকটু সহ্য করুন।

টুথ ফোর্সেপ্স দিয়ে প্রথম রিবন গজ বের করে আনলো স্বর্গ।মুহিত যেনো দ্বিতীয়বার বেঁচে ফিরলো।এর পর আবার একটি মেডিকেটেড গজ রেডি করলো স্বর্গ।
ক্ষততে দেবার আগেই মুহিত স্বর্গের হাত চেপে ধরলো।

স্বর্গ চোখের ইশারায় নার্স আর এসিস্ট্যান্ট ডক্টর কে চলে যেতে বললো।
তারা চলে যেতেই স্বর্গ মুখের মাস্ক খুলে মুহিতের ঠোঁটে উষ্ণ চুমু দিয়ে বলে উঠলো
―এটাই শেষ আর কষ্ট দিবোনা।

গজ ঢুকিয়ে চিপে চিপে ক্লিনিং প্রসেস চালাতেই মুহিত বহু কষ্টে গলায় স্বর এনে বলে উঠলো
―অনেক কষ্ট হচ্ছে বউ।

মরে যাচ্ছি।

একটু তো রহম করো প্লিজ।

মুহিতের আর্তনাদে স্বর্গের বুক ভেঙে কান্না পেলো।
কিন্তু সে একজন ডাক্তার।কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডাক্তার দের হতে হয় কঠোর মনের অধিকারী।
নিজ নিজ অবস্থানে থেকে পরিস্থিতি যতোই খারাপ হোক দায়িত্ব পালন করতেই হবে।

―আরেকটু সহ্য করো প্লিজ মুহিত।

মুহিত দাঁত চেপে বসে থাকলো ।
বিশ মিনিট পর স্বর্গের ড্রেসিং শেষ হলে মেডিসিন দিয়ে গজ দিয়ে মুহিতের বুক পিঠ পেঁচিয়ে দিলো।

নার্স কে ডাকতেই তারা এসে মুহিত কে পিঠের নিচে বালিশ দিয়ে আধ শোয়া করে দিলো।

হাতে পায়ে প্লাস্টার করে ব্ৰেচ পরিয়ে বেডে শুইয়ে দেয়া হলো মুহিত কে।
শরীরের জখম গুলো অনেকটাই শুকিয়ে গিয়েছে।

মুহিতকে কেবিনে রেখে স্বর্গ বাইরে চলে আসলো চেঞ্জ করতে।
ডাস্টবিনে গ্লাভস গুলো ফেলে বেসিনের সামনে দাঁড়ালো হাত ধুতে।
নিমিষেই মন আকাশে কালো মেঘের আনাগোনা হলো।
টুপটুপ করে অবিরত গড়িয়ে পড়লো কপোল বেয়ে।
মুহিতের এমন অবস্থা সহ্য করতে অনেক কষ্ট হয়েছে তার।তবুও হিংস্রের ন্যায় মুহিতকে কষ্ট দিয়েই গেছে সে।
মুহিতকে এতোটা অসহায় আর কখনো লাগেনি।
মুহিত তার কাছে বেচে ফিরেছে এই অনেক।স্বর্গের মাথায় স্বাভাবিক জ্ঞান থাকতে মুহিতকে কোনো দিন কষ্ট পেতে দিবেনা আর।
দরকার পড়লে বুকের ভেতর আগলে রাখবে সে ।

চোখে মুখে পানির ছিটা দিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো স্বর্গ।

সুখ আর তনুজা মুহিতের প্রিয় ইলিশ পোলাও নিয়ে কেবিনের সামনে বসে আছে।
স্বর্গের কঠিন নির্দেশ
কেউ দুই মিনিটের বেশি ওর রুমে থাকতে পারবে না।
প্রথমে সুখ গেলো।

―হ্যালো ব্রো
তুমি আমার বোনকে এতো কষ্ট দিলে এটার জন্য বিশেষ শাস্তির ব্যাবস্থা আছে তোমার জন্য।
তুমি সুস্থ হলে আমি তোমার বিষয় টা হ্যান্ডেল করবো।

তোমার বোন যদি আমাকে পানিশমেন্ট দিতে দেয় তাহলে আমি ঘাড় পেতে নিবো সালা বাবু।

বলেই ফিচেল হাসলো মুহিত।
সুখ আরো কিছু কথা বলে বেরিয়ে গেলো।

তনুজা নীরবে কেঁদেই যাচ্ছে মুহিতের পাশে বসে।মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে উঠলেন
আমার মেয়েটা তোমাকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছে বাবা।
এতোদিন আমরা কেমন জীবন কাটিয়েছি আল্লাহ ছাড়া কেউ জানে না।
দ্রুত সুস্থ হলেই তোমাদের চার হাত এক করে দেব।
সময় করে তোমার মাকে একটা কল করো।।
উনি চিন্তায় ভেঙে পড়েছেন তোমাকে ফোনে না পেয়ে।
মুহিত ঘাড় কাত করে বাধ্য ছেলের মতো সায় জানালো।

তনুজা চলে যেতেই টিফিন ক্যারিয়ার সমেত কেবিনে প্রবেশ করলো স্বর্গ।
প্লেটে খাবার গুলো ঢেলে ইলিশ মাছের কাঁটা বেছে মুহিতের সামনে লোকমা তুললো।

এই হৃদয়হীনা একটু আগে তাকে চরম কষ্ট দিয়েছে। মুহিত কিছুতেই খাবেনা তার হাতের খাবার।
মুখ ঘুরিয়ে বসে থাকলো মুহিত।

স্বর্গের কাছে মুহিতের মতিগতি সুবিধার ঠেকলো না।যেখানে তার অভিমান করার কথা সেখানে সে ভাব ধরে বসে আছে?

মুহিতের দুই চোয়ালে হাত দিয়ে চেপে ধরে পোলাও পুড়ে দিলো।
মুহিতকে উদ্দেশ্য করে স্বর্গ তেজি কন্ঠে বলে উঠলো
―ঢং কম করে করো।খাবার পুরোটা খেয়ে মেডিসিন খেতে হবে।ঢং করলে তোমার ই লস।
বলেই আরেক লোকমা ঠুসে দিলো।
খাবার চিবুতে চিবুতে মুহিত বলে উঠলো

― জল্লাদি একটা।

―――――
মিসেস তনুজার ল্যান্ড লাইনে সমান তালে রিং বেজে যাচ্ছে।তনুজা দৌড়ে এসে ফোন কানে তুলতেই মিসেস তারিনের আওয়াজ পাওয়া গেলো

কি গো তনু কি খবর তোমাদের?
―জি আপা ভালো রেখেছে উপর ওয়ালা।
নামিরা আর বাবু কেমন আছে?

মিসেস তারিন প্রাণহীন উত্তর দিলেন।মুহিতের জন্য কদিন ধরে মনটা খচ খচ করছে।আজ প্রায় এক মাসের বেশি হয়ে গেলো ছেলেটার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই।ইদানিং ঘুমালেই বিভিন্ন আজেবাজে স্বপ্ন এসে হানা দেয়।
মনের সন্দেহের ভিত্তিতে তনুজা কে মিসেস তারিন বলেই ফেললো

―আমার ছেলেটা বেঁচে আছে তো তনু?

মিসেস তারিনের এহেন প্রশ্নে চমকে উঠলো তনুজা।
নিজেকে ধাতস্থ করে বলে উঠলেন
ছি ছি এসব কি বলেন আপা?

মুহিত আজ ফোন করেছিলো আপনাকে ফোন করার কথা বলেছে আপনার ভাই।
আজ কালকের ভেতরই মুহিতের ফোন পাবেন ইনশাআল্লাহ।

আরো কিছু কথা বলে লাইন কেটে ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিলেন তনুজা।
এই প্রশ্ন টা মিসেস তারিন যদি আরো আগে করতো তাহলে তনুজা কিভাবে সামলাতেন সব কিছু?

―――――
ক্যাপ্টেন সৌম্য আর নাফিজ মাহমুদ দাঁড়িয়ে আছে মুহিতের সামনে।নিজের ভাগ্নের এমন সূচনীয় অবস্থা সহ্য না করতে পেরে কেঁদে দিলেন নাফিজ মাহমুদ।এতো সুন্দর ছেলেটা ব্যান্ডেজ এর চোটে মমিতে পরিণত হয়েছে।এসব কি মানা যায়?

সৌম্য হঠাৎ ই মুহিতের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লো
―স্যার আমার পরবর্তী কাজ কি?

―প্রেস কনফারেন্স এর আয়োজন করো ক্যাপ্টেন সৌম্য শাহরিয়ার।
বলেই বাঁকা হাসি হাসলো মুহিত।

*******
ছেলেটাকে দেখে আসার পর থেকে কিছুই ভালো লাগছে না আশরাফ চৌধুরীর।সবকিছু একঘেয়ে লাগছে।একটু দেশ বিদেশের খবর দেখা দরকার।টিভি অন করে নিউজের চ্যানেল চাপতে চাপতে এক জায়গায় এসে থমকে যান আশরাফ চৌধুরী।দৃষ্টি বিস্ফারিত হয়ে যায় তার।এ কিভাবে সম্ভব?নিমিষেই মাথা ঘুরে উঠলো তার।

সাংবাদিক রা একের পর এক প্রশ্ন করে যাচ্ছে মুহিত কে আর সেগুলোই বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এ টেলিকাস্ট করা হচ্ছে।

―মেজর মুহিত কে বা কারা আপনাকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিলো?
আপনি কি তাদের চেহারা দেখতে পেয়েছিলেন?

―না আমি তার চেহারা দেখতে পাইনি, আমাকে পিছন থেকে শ্যুট করা হয়েছে।লোকটি কালো পোশাকে আবৃত ছিলো।

সাংবাদিক আবার প্রশ্ন ছুঁড়লো

―এই ছোট ছেলেটির সাথে আপনার কিভাবে পরিচয়?আমরা শুনেছি সে একজন ট্রাক ড্রাইভার।

পাশে থাকা ছেলেটি লাইট ক্যামেরা দেখে ভয়ে গুটিসুটি মেরে মুহিতের কাছ ঘেষে রইলো।মুহিত মুখের ভাব স্বাভাবিক রেখে বলে উঠলো

আসলে ছেলেটি ওখানকার স্থানীয়।আমি ওর সাহায্য নিয়ে পাহাড়ে উঠেছি।আমাকে যখন কেউ গুলি করে ও তা দেখে ফেলে এজন্য আগন্তুক এই ছেলেটিকেও গুলি করে দেয়।

মেজর মুহিতের এসব বানোয়াট ইন্টারভিউ দেখে আশরাফ চৌধুরীর মাথা ঘুরে যাচ্ছে।

এতোটা স্বভাভিক কিভাবে রয়েছে এই মেজর?আহমেদ কসাই এর হাত থেকে আজ পর্যন্ত কেউ বেঁচে ফিরতে পারেনি।তাহলে এরা কিভাবে পারলো?

আর সত্য না বলে এসব বলে কি করতে চাইছে সে?আশরাফ চৌধুরী নিজেই মুখ খুলে তাকে চেহারা দেখিয়েছে।

দাবার চাল কি নিমিষেই উল্টে যাবে?

――――
আমার মেয়ে হয়ে আমার ই ঘরের খবর তুই ওই আর্মি ক্যাপ্টেন এর কাছে পৌঁছে দিস?কি ভেবেছিস,আমি এতোই বোকা?আমার পিঠ পিছে চাকু বসাবি আমি কিচ্ছুটি টের পাবো না?

তোর মা ও এই একই ধৃষ্টতা দেখিয়েছিলো।
কি করেছি তার সাথে জানিস?

বলেই নাসের হায়দার পিউ এর চুলের মুঠি ধরে জানালার পাশে এনে দাঁড় করালো।

এর পর আঙ্গুলি নির্দেশ করে বললো ঐ যে বকুল গাছ টা দেখছিস ঐখানে পুতে দিয়েছি তোর মাকে।
বাবার মুখে এমন নৃশংস কথা শুনে কেঁপে উঠলো পিউ।

তার মা তাহলে অন্য মানুষের সাথে পালিয়ে যায়নি?
তার বাবা তার মাকে মেরে ফেলেছে?
মায়ের পুরোনো স্মৃতি মনে করে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো পিউ।
রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে নাসের হায়দার এর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো

―আমাকেও পুতে দাও বাবা
নাহলে আমি কাল সাপ হয়ে ছোবল মারবো তোমাকে।

মেয়ের এমন সাহস দেখে রাগে বোধ শক্তি হারিয়ে ফেললো নাসের হায়দার।
গায়ের সমস্ত শক্তি খাটিয়ে পিউকে এক থাপ্পড় কষিয়ে দিলো।
থাপ্পড়ের তাল সামলাতে না পেরে পিউ ডাইনিং টেবিলের চেয়ার এর সাথে বাড়ি খেয়ে পড়ে গেলো মেঝেতে।
কপালের কোনা কেটে গড়িয়ে পড়লো রক্ত।

পিউ আবার বলে উঠলো
আমাকে মেরে ফেলা বাবা,না হলে তুমি আমার হাতে খুন হবে।

নাসের হায়দার বাজ পাখির মতো পিউকে থাবা মেরে ধরে টেনে হিচড়ে তার গোপন কক্ষে নিয়ে ধাক্কা মেরে বিছানায় ফেলে দিলো।

তুই এখানেই বন্দী থাকবি হারামজাদী।
বলেই বাইরে থেকে দরজা লক করে চলে গেলো।

হাটু মুড়ে বসে হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠলো পিউ।
পৃথিবীতে এমন খারাপ বাবাও আছে?

মায়ের হাসি মাখা মুখটা মনে পড়তেই বুকে চিনচিনে ব্যাথার অনুভূতি হলো তার।

――――
মুহিত সোহাগের নম্বরে কল করেছে
ওপাশ থেকে সোহাগ হ্যালো বলতেই মুহিত সোহাগের সাথে কুশল বিনিময় করলো।
এর পর সোহাগ স্টোর রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলতে শুরু করলো

―মুহিত তুমি বেঁচে আছো?
টিভিতে তোমার নিউজ দেখে আমি বাসায় সকল লাইন কেটে দিয়েছি যাতে নামিরা বা মা কেউ এই বিষয়ে না জানতে পারে।
মামা কে অনেক বার ফোন করে তোমার খবর জেনেছি।কোনো ভাবেই নাকি তোমাকে উদ্ধার করা যায়নি।
তাহলে কিভাবে বেঁচে ফিরলে?

মুহিত স্মিত হাসলো।সোহাগ কে উদ্দেশ্য করে নরম কন্ঠে বললো
―সময় করে সব বলবো সোহাগ ভাই।আগে প্রয়োজনীয় কিছু কথা বলে নেই।

মা বড্ড অবুজঝ।মাকে আপনার একটু আগলে রাখতে হবে সোহাগ ভাই।
প্রথমে মা কে বলবেন আমি ছয় মাসের জন্য মিশনে এসেছি।আমি ফিরলে মা বাংলাদেশে আসবে ।
যেভাবেই হোক সোহাগ ভাই মাকে ছয় মাস আপনি ধরে বেঁধে রেখে দিবেন।
এখানে আমার কিছু জরুরি কাজ পেন্ডিং আছে।ওগুলো কমপ্লিট করেই আমি আপনাদের সবাইকে দেশে ফিরিয়ে আনবো।
আমরা আবার একসাথে হাসি খুশি ভাবে বাঁচবো সোহাগ ভাই।

******
সৌম্য বসে আছে মুহিতের সামনে।মুহিত তাকে ইন্সট্রাকশন দিচ্ছে কিভাবে কখন কি করতে হবে।

―খলিল কে একটু ধরে আনার ব্যাবস্থা করো সৌম্য
জামাই আদর টা খলিল কে দিয়েই শুরু করবো।

কোথায় ধরে আনবো স্যার?

আহা ক্যাপ্টেন দুধের বাচ্চার মতো সব বুঝিয়ে দিতে হয় তোমাকে।

―যেখানে গেলে ওকে চারশত চল্লিশ ভোল্টে শক দেয়া যাবে সেখানে।

চোখ বড় হলো সৌম্যের, ঠোঁট প্রশস্ত হলো মুহিতের।

#চলবে।

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_২২
#সারিকা_হোসাইন®

মুশুলধারে ধরনীতে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ভারী বর্ষনের দল।থেকে থেকে বিকট শব্দে বড় বড় বাজ পড়ছে।ভারী বর্ষনের কারনে কোনো মানুষ জন ঘর থেকে বাহির হয়নি আজ।বৃষ্টি আর বজ্রপাত দুটো মিলিয়ে মনে হচ্ছে যেনো সাক্ষাৎ যমদূত ধরনীতে তান্ডব চালাচ্ছে।

ভাঙা একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে লোহার চেয়ারে শক্ত করে মুড়িয়ে বাধা হয়েছে গেট কিপার খলিল কে।খলিলের মুখ স্কচ টেপ দিয়ে আটকানো।
আগাগোড়া কালো কাপড়ে মোড়ানো এক দানবের মতো ব্যাক্তি দাঁড়িয়ে আছে খলিলের সামনে।বজ্রপাতের ঝলকানি তে তার অবয়ব বোঝা যাচ্ছে কিন্তু চেহারা স্পষ্ট নয়।
সবেই হুশ ফিরেছে খলিলের।হুশ ফিরেই নিজের এহেন দুর্দশা আর সামনে দাঁড়ানো আগন্তুক কে দেখে রূহ কেঁপে উঠলো খলিলের।

হঠাৎই ছটফট করতে লাগলো খলিল।কিন্তু হাত পা শক্ত করে বাধা।এক বিন্দু নড়ার শক্তি নেই।মুখে অনেক কথাই বলতে চাইলো।সেটাও পারলো না।
খলিলের ছটফটানি দেখে হা হা করে হেসে উঠলো যুবক।

পাশেই বিকট শব্দে বাজ পড়লো।কেঁপে উঠলো খলিল।আজ কি তার জীবনের লীলা খেলা সাঙ্গ হতে যাচ্ছে তবে?

ভয়ের আতংক খলিলের চোখে স্পষ্ট।এটাই চেয়েছিলো মুহিত।
তার কলিজার টুকরা ভাইকে এই নির্দয় খলিল গলা টিপে হত্যা করেছে।
শুধু তাই নয় মুখে স্কচ টেপ লাগিয়ে কথা বলার,চিল্লানোর সুযোগ টা পর্যন্ত দেয়নি।

যেই মুকিত কে বাড়ির কোনো সদস্য ফুলের টোকা পর্যন্ত দেয়নি,সেই মুকিত কে এই জানোয়ার চিপে চিপে মেরেছে।

কতোটা কষ্ট পেয়েছে মুকিত?
মুকিতের করুন চেহারা মনে পড়তেই আগ্নেয়গিরির মতো জ্বলে উঠলো মুহিত।

মুখের কাপড় সরিয়ে টর্চ জ্বালিয়ে হাটু মুড়ে খলিলের সামনে বসলো।

মুহিতের চেহারা দেখেই খলিলের অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো।

মুহিতের পাশেই দুটো ব্যাটারি আর কিছু ক্লিপ যুক্ত তার রয়েছে।

খলিলের উদ্দেশ্যে মুহিত বলে উঠলো
―ভয় করছে খলিল চাচা?

খলিল মাথা দিয়ে ইশারায় বুঝালো সে ভয় পাচ্ছে।
মুহিত হাসতে হাসতে বললো
“”ভয় পাওয়ানোর জন্যই তো এতো আয়োজন খলিল চাচা।
আপনি ভয় না পেলে তো আমার সব কষ্ট বৃথা।

কথা বলতে বলতে মুহিত ক্লিপ গুলো ব্যাটারি তে লাগিয়ে নিলো।এর পর খলিলের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো
―এগুলো দিয়ে আপনাকে ইলেকট্রিক শক দেবো খলিল চাচা।সেই শক খেয়ে আপনি তড়পাবেন আর আমি মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় উপভোগ করবো।

কেমন মজা হবে তাই না?

মুহিতের এসব কথায় পিপাসায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো খলিলের।
মুহিত উঠে দাঁড়ালো,এক টানে খুলে ফেললো খলিলের মুখের টেপ।

খলিল হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।
আমাকে কেনো ধরে এনেছেন স্যার?আমার অপরাধ কি?

খলিলের প্রশ্ন শুনে চোয়াল শক্ত হয়ে এলো মুহিতের ।
কতো বড় সাহস,আমাকে প্রশ্ন করা হচ্ছে?

পায়ের ভারী বুট দিয়ে পিষে ধরলো খলিলের পা,
ব্যাথায় গগন বিদারী চিৎকার করে উঠলো খলিল।
মুহিত হাসতে হাসতে বললো

―জোরে জোরে চিৎকার কর খলিল।
আমার মাসুম ভাইকে তো তুই চিৎকার করতে দিস নি।
কিন্তু আমি তোকে সেই সুযোগ দিলাম।
তুই যতো চিৎকার করবি আমি ততো শান্তি পাবো।

তোর জন্য আজকে ছয় বছর ধরে আমি ভাইয়া ডাক শুনি না।

দোকানে কতো ভালো ভালো খেলনা,চকলেট ,জামা কাপড় দেখি,কিন্তু কিনতে পারিনা।কারন যাকে এগুলো কিনে দেবো সেই ই নেই।তুই তাকে শেষ করে দিয়েছিস।

বুকের এই খান টাতে কতো কষ্ট হয় জানিস?

তুই এটা কিভাবে করেছিস খলিল?

ওর নিষ্পাপ চোখের জ্বলে কি তোর মন একটুও গলেনি?
তুলার মতো ধবধবে সুন্দর গলায় কিভাবে তোর ওই কুৎসিত হাত দিয়েছিস খলিল?

দুই হাতের সাহায্যে মুহিত খলিল কে ইঙ্গিত দিয়ে বুঝালো
―এতোটুক বয়স থেকে কোলে পিঠে করে আগলে রেখেছি ওকে আমরা।কোনো দিন আহ শব্দ টুকু করতে দেইনি।

আর তুই তাকেই এতো কষ্ট দিয়ে মারলি?
চোখের জল মুছে মুহিত খলিল কে প্রশ্ন করলো
―তুই কিভাবে মরবি ডিসাইড কর।
চারশত চল্লিশ ভোল্টের শক খেয়ে মরবি নাকি শ্বাসরোধ হয়ে মরবি?

খলিল ভয়ে কেঁদে কেঁদে মিথ্যে বলে বাঁচার আকুতি জানিয়ে যাচ্ছে শুধু।
খলিলের এসব মিথ্যে নাটকে রাগ ধরে গেলো মুহিতের সারা শরীরে।

বৈদ্যুতিক তারের দুটো মাথা লাগিয়ে দিলো লোহার চেয়ারের সাথে লাগানো কটকা তে।
দোলে উঠলো খলিল।তার সারা শরীর ঝাকুনি দিয়ে উঠছে শুধু।
শক দেয়া বন্ধ করে মুহিত আবার খলিলের উদ্দেশ্যে বললো
“”কেমন লাগলো?””
“”আবার দেবো?””

খলিল ভারসাম্য হীনের মতো শুধু তাকিয়ে দেখছে সব কিছু,মুখে কিছুই বলতে পারছে না।সে চোখের সামনে সাক্ষাৎ যমদূত দেখতে পাচ্ছে।

মুহিত আবার শক দিলো।

খলিলের শরীর আবার ঝাঁকুনি দিয়ে উঠলো।এই বয়সে এতো শক নিতে পারলো না খলিল,নিমিষেই মুখ দিয়ে লালা ছুটে গেলো তার,মিনিট পাঁচেক পরেই মৃত্যু কে আলিঙ্গন করে নিলো খলিল।

খলিলের নিস্তেজ হয়ে যাওয়া দেহের দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি হাসলো মুহিত।
দুই হাতের আঙ্গুল এর সাহায্যে চোখে জমা জল মুছে
ক্যাপ্টেন সৌম্য বলে হুংকার দিয়ে উঠলো মুহিত।

বাধ্য ভৃত্যের ন্যায় দৌড়ে এলো সৌম্য।
গমগমে কন্ঠে মুহিত বলে উঠলো

―ভোর হবার আগে জায়গা ক্লিয়ার করে আগের মতো করে রাখবে।
যেনো ঘটনা কিছুই ঘটেনি।

সৌম্য কন্ঠ খাদে ফেলে মাথা নিচু করে জিজ্ঞেস করলো
―স্যার লাশ কি করবো?

মুহিত কিছুক্ষণ মৌন থেকে স্বাভাবিক কন্ঠে উত্তর দিলো
―রাস্তার পাশে যেই বড় ইলেকট্রিক খাম্বা রয়েছে সেখানে সব ব্যাবস্থা করা আছে।জাস্ট শুইয়ে দিয়ে আসবে।

সকালে যে কেউ ভাববে বজ্রপাতে পরে মারা গেছে।
বলে এলবো ক্রাচে ভর দিয়ে প্রস্থান নিলো মুহিত।

―――――――

রাত এগারোটা বেজে পয়ত্রিশ মিনিট,বজ্রপাত কমে গিয়ে ঝুপঝুপ করে মোটা মোটা বৃষ্টির ফোটা পড়ছে শুধু।
নিজের ঘর টাকে মন মতো গুছিয়ে নিলো স্বর্গ।
সকালেই মুহিত ফিরে আসবে হসপিটাল থেকে।
মুহিতের কথা মনে পড়তেই লজ্জায় রাঙা হলো স্বর্গের ধবধবে সাদা গাল।

নিজেকে কিভাবে উপস্থাপন করবে সে মুহিতের সামনে?

আয়নায় নিজেকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে স্বর্গ।
নিজের মনের সাথে যুদ্ধ করে অভিনয় অনেক হয়েছে,নিজেকে শক্ত প্রমান করতে গিয়ে বহু কষ্টে গিলে ফেলেছে সকল কান্না,অভিযোগ, অনুযোগ।

হসপিটালে ও সে মুহিতের সামনে বাকি দশ জন ডাক্তারের মতো থেকেছে।
আর কতোদিন চলবে নিজের সাথে নিজের এই কানামাছি?
মুহিতকে একান্তে পেলে নিজেকে এভাবেই ধরে রাখতে পারবে তো সে?

ভাবনার সুতো ছিড়লো হঠাৎ দরজায় নকের আওয়াজে।

এই টাইমে কেউ আশার কথা নয়।
বাপী জরুরী কাজে চিটাগাং গিয়েছে,মাম্মা তো ঘড়ির কাটা দশের ঘরে যেতেই ঘুমে কাত।
আর সুখ?
সেও তো মিলিটারি একাডেমী তে ফিরে গেছে বিকেলে।
তাহলে কে এলো?
এতো সিকিউরিটি, ক্যামেরা ফাঁকি দিয়ে চোর ও তো আসতে পারবে না।
তবুও ভয় হলো স্বর্গের মনে।

ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেও ভয় পায়।
এক পা দু পা করে এগিয়ে দরজা অল্প খুলতেই অতি পরিচিত পুরুষালী গন্ধ ভুরভুর করে নাসারন্ধ্রে বাড়ি খেলো।

নিমিষেই বুক ধক করে উঠলো,মন ভারী হলো,চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো জ্বল।
দরজা ঠেলে কক্ষে প্রবেশ করলো মুহিত।

বহু কষ্টে শক্তি সঞ্চয় করে দরজা আটকে দিলো স্বর্গ।
এলো মেলো পায়ে মুহিতের সামনে এসে দাড়ালো।
মুহিতের চোখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎই ঝাপটে ধরলো মুহিত কে।

বাইরের বর্ষনের সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে থাকলো স্বর্গের অক্ষি বর্ষণ।বেহায়া মন আর নেত্র কোনোটাকেই আয়ত্তে আনা গেলো না অবশেষে।

গলার স্লিং খুলে বুকের সাথে মিশিয়ে ফেললো স্বর্গকে মুহিত।

কাঁদতে কাঁদতে হিচকি উঠে গেলো স্বর্গের।

শুরু হলো নানান অভিযোগ অনুযোগ।

―তুমি আমাকে ধোকা দিয়েছো মুহিত,
অন্ধের মতো শুধু নিজের পথেই হেঁটেছো অথচ তোমার সাথে যে আরেক জনের জীবন জুড়েছে সেটা ভেবে দেখোনি।
আমি কক্ষনো তোমাকে ক্ষমা করবো না।

তুমি আমার কথা একবারো কেনো ভাবলে না?
যদি তুমি ফিরে না আসতে আর ?
আমি কোথায় যেতাম কি করতাম?
তুমি এতো বড় অন্যায় কিভাবে করলে আমার সাথে?

এই কয়েকটা দিন আমার কাছে কয়েক হাজার বছরের মতো ঠেকেছে।আমার বুকে অনেক কষ্ট হয়েছে মুহিত!
প্রতি মুহূর্তে আমার নিজেকে শেষ করে দেবার ইচ্ছে জেগেছে।
তুমি কখনো বুঝতেই পারলে না আমি তোমাকে কতোটা ভালোবাসি!

অসহায় এর মতো কাঁদতে কাঁদতে স্বর্গ হাটু মুড়ে মুহিতের পা জড়িয়ে ধরে বসে পড়লো।

প্লিজ মুহিত আমাকে ছেড়ে আর কখনো কোথাও যেওনা।
আমি বাঁচতে পারবো না,মরে যাবো।সহ্য করতে পারিনা আমি।
বুকের এইখানে অনেক ব্যাথা করে।দম বন্ধ লাগে।

স্বর্গের এমন কান্না দেখে মুহিতের নেত্র বেয়ে ফোটায় ফোটায় টুপটুপ করে গড়িয়ে পড়লো জল।
সত্যি ই তো,সে তো স্বার্থপর এর মতো কাজ করেছে।
মুহিত যদি আর না ফিরতো কোনোদিন?
ফুলের মতো পবিত্র মেয়েটা সারাটা জীবন বিধবার তকমা গায়ে জড়িয়ে বেঁচে থাকতো।
প্রতিশোধ পরায়নতা তাকে এতো অন্ধ কিভাবে করলো?

মুহিত ওয়াসিফ যে তার পিতার আদর্শে আদর্শায়িত ,তার মতো বিচক্ষণ মানুষের দ্বারা এতবড় ভুল কিভাবে হলো?

বহু কষ্টে উপুড় হয়ে টেনে তুললো স্বর্গকে।
বুকের সাথে মিশিয়ে কপালে,চোখে,মুখে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলো।
আবার বুকে চেপে ধরলো।
স্বর্গের মাথায় চুমু খেয়ে আহত কন্ঠে বলে উঠলো
―সরি বউ,অনেক বড় অন্যায় করে ফেলেছি।
এই দেখো আমি কান ধরেছি।
জীবনেও আর কখনো এমন ভুল হবেনা।

ফুঁপিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে স্বর্গ।
স্বর্গের এহেন কান্না মুহিতের বুকের শেলের মতো বিধছে।
কন্ঠে সকল দরদ ঢেলে স্বর্গের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো

―ক্ষমা করে দে না জান!

―তুই ক্ষমা না করলে আমি নিজেকে কঠিন শাস্তি দিবো।

সাথে সাথেই স্বর্গ তার কোমল হাতের তালু দিয়ে ছাপিয়ে ধরলো মুহিতের হাত।
অসহায় নেত্রে তাকিয়ে থাকলো মুহিতের মুখের পানে।
স্বর্গের তুলতুলে নরম হাতের পিঠে,তালুতে চুমু খেলো মুহিত।

রজনীগন্ধার স্টিকের মতো লম্বা আঙ্গুল গুলো তে আস্তে করে কামড়ে ধরলো।
শিউরে উঠলো স্বর্গ।
গলা জড়িয়ে ধরলো মুহিতের।
জানালার গ্রিল গলিয়ে বৃষ্টির ঝাপটা এসে সামান্য ভিজিয়ে দিলো দুজন কে।
বেসামাল হলো মুহিত।
স্বর্গের চোখের গড়িয়ে পড়া জ্বল শুষে নিলো ঠোঁট দিয়ে।
উত্তাল হলো বুকের মাঝে জমানো ভালোবাসা।
দুজনে ডুব দিলো ভালোবাসার সুধা আস্বাদনে।

―――――
বিমর্ষ মনে নিজের বরাদ্দকৃত রুমে বসে আছে সৌম্য।আজ দুদিন ধরে না পিউ ফোন তুলছে না দেখা করছে।
চারপাশে এতো সহিংসতা যা মনের ভীতি বাড়িয়েই দেয় শুধু।
যেই পিউ এক মিনিট ও সৌম্যের সাথে কথা না বললে পাগল হয়ে যায়,সেই পিউ আজ দুদিন ধরে ফোন অফ করে রেখেছে।
বুকের ভেতর জলোচ্ছাস বয়ে যাচ্ছে সৌম্যের।
সারাক্ষন মন টা কু ডেকে চলেছে।
নিজের কার্য সাধন করতে গিয়ে নিজের প্রাণ প্রিয়ার ক্ষতি করে ফেললো না তো?

নাসের হায়দার সাংঘাতিক একজন মানুষ।টাকা পয়সাই তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
নিশ্চয় কিছু জানতে পেরে পিউকে কিছু করে দিয়েছে।
নাহ আর এক মুহূর্ত দেরি করা যাবেনা।
মেজর মুহিত কে সব কিছু জানাতে হবে।

চিন্তিত মুখে গায়ে ইউনিফর্ম জড়িয়ে ডিউটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলো ক্যাপ্টেন সৌম্য শাহরিয়ার।

―――――
দুদিন পর খলিলের লাশ পাওয়া গিয়েছে বড় রাস্তার মোড়ের বৈদ্যুতিক খাম্বার নীচে।বজ্রপাতে মারা গিয়েছে সে।মাথার চুল গুলো সহ পুড়ে গেছে।বিশ্রী রকম কালো হয়ে গিয়েছে তার লাশ।
আজকে বাদ জোহর তার জানাজা।
নিমিষেই কোয়ার্টারের প্রত্যেকটা মানুষের কানে পৌঁছে গেলো এই খবর।
ক্রুর হাসলো মুহিত।
নেক্সট নাসের হায়দার এর পালা।
তাকে মুহিত শাস্তি দিবেনা।
তার শাস্তির ব্যাবস্থা ভিন্ন।
তাকে দেশদ্রোহীতার শাস্তি দেয়ার ব্যাবস্থা করবে মুহিত নিজে।
আজীবন জেলে পচে মরবে সে।
মনে মনে এসব ভাবতেই কফি খেতে খেতে আনমনে হেসে উঠলো মুহিত।
পাশেই নাফিজ আর স্বর্গ ব্রেকফাস্ট করছিলো।
মুহিতের আচমকা এমন হাসি তাদের সুবিধার ঠেকলো না।তবুও কেউ কিছুই প্রশ্ন করলো না মুহিত কে।
হঠাৎ ই মুহিতের ফোন ভো ভো আওয়াজ তুলে ভাইব্রেট হতে লাগলো।
ক্যাপ্টেন সৌম্যের কল দেখে দ্রুত তা রিসিভ করে কানে তুললো।
ওপাশ থেকে সৌম্যের আহত আওয়াজ ভেসে উঠলো
―স্যার আজ তিন দিন ধরে পিউ এর কোনো খুঁজ পাচ্ছিনা।
যা বুঝার বুঝে গেলো মুহিত।

দুদিন রেস্ট নিয়ে নাসের হায়দার এর বন্দোবস্ত করতে চেয়েছিলো।কিন্তু এখন তো মনে হচ্ছে আজকে রাতেই একশনে নামতে হবে।
সৌম্য কে আস্বস্ত করে ফোন কেটে দিলো মুহিত।

―――――
ক্রিমিনাল ভিজিটিং রুমে বসে আছে স্বর্গ আর মুহিত।আহিয়ান কে দেখার জন্য এসেছে তারা।মুহিত যখন শুনেছে আহিয়ান এর মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে তখন থেকেই দেখা করার চেষ্টা করেছে,কিন্তু সময় স্বল্পতার জন্য পারেনি।

কিছুক্ষন পর দুজন কারারক্ষী আহিয়ান কে ধরে আনলো।
আহিয়ানের এমন সূচনীয় অবস্থা দেখে কোথাও একটু মন খারাপ হলো মুহিতের।
মুহিতকে দেখে আহিয়ান যেনো আকাশের চাঁদ হাতে পেলো।দৌড়ে এসে মুহিত কে জাপ্টে ধরলো।
মেজর মুহিত ওয়াসিফ,আমি জানতাম তুমি আসবে।তোমাকে আমি আগেই দেখে নিয়েছি।
পাপার বিনাশ তোমার হাতে ই হবে তাইনা বলো?
এতো স্মার্ট একটা ছেলে কেমন হয়ে গেছে নিমিষেই।মুহিতের মনে হঠাৎই এক দয়া এলো।
সব কিছু স্বাভাবিক থাকলে আহিয়ান কে আরেকটা চান্স দেবে মুহিত।সে জন্য তার যা যা করতে হয় সব করবে।

স্বর্গের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক মানুষের মতো করে বলে উঠলো
―স্বর্গ তুমি মলিন হয়ে গেছো, তোমাকে এমন ভালো লাগেনা।
তুমি সবসময় প্রাণবন্ত থাকবে ঠিক আছে?

ভিজিটিং আওয়ার শেষ হতেই মুহিত ,স্বর্গ উঠে দাঁড়ালো।
কারারক্ষী আহিয়ান কে বগল দাবা করে ধরে নিয়ে যেতে উদ্দত হলো।
হঠাৎই আহিয়ান ডেকে উঠলো
―স্বর্গ!
পিছন ফিরে তাকালো স্বর্গ।
মৃদু হেসে আহিয়ান বলে উঠলো
―আমি তোমাকে সত্যি ই আমার করে পেতে ছিলাম।
কিন্তু প্রাপ্তির উপায় টা ছিলো অপরাধের।

#চলবে।

তোমার জন্য সিন্ধুর নীল পর্ব-১৯+২০

0

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_১৯
#সারিকা_হোসাইন

নির্ঝর আবাসিক
চারপাশে সবুজ গাছ আর ফুলের সমারোহ,সাথে একটি বড় লেক।চারপাশের নারিকেল গাছের চিরল পাতা গুলো হালকা বাতাসে থেকে থেকে দোলে উঠছে।পাখির কিচিরমিচির এ পুরো জায়গাটা অসাধারন লাগে।

এই অমায়িক পরিবেশে থমথমে মুখে দাঁড়িয়ে আছে পিউ আর সৌম্য।
পিউএর চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ছে জল।সে আর কখনো স্বর্গকে মুখ দেখাতে পারবে না।
পিউ কান্না থামিয়ে শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো―
তোমাকে সব জানানোর পর ও মেজর মুহিত কে কেনো জানালে না সৌম্য?

পিউ এর এহেন অভিযোগ এর আঙ্গুল উঠানো দেখে অবাকের চরম সীমায় পৌঁছে গেলো সৌম্য।
এই মেয়ে এখনো তাকে চিনতে পারেনি?
এতো বড় অপবাদের আঙ্গুল তুলে ফেললো?

তবুও কন্ঠে স্বাভাবিকতা বজায় রেখে বললো
―তোমার কি মনে হয় পিউ?
“”মেজর সম্পর্কে এতো বড় একটা কথা গোপনে চেপে যাবো আমি ?
আমি রেকর্ড সমেত মেজর কে সব বলেছি।
উনি আমাকে কি বলেছে জানো?

প্রশ্নবিদ্ধ নজরে সৌম্যের পানে চাইলো পিউ।সে জানতে চায় কি বলেছে মেজর?

মেজর মুহিত বলেছে এসব কথা যেনো আমি কাউকে না বলি,শুধু তাই নয় ডিপার্টমেন্ট কেও জানাতে নিষেধ করেছে
উনি সকল প্রমান এক সাথে জোগাড় করে লড়াই করতে চেয়েছিলো।
ভাগ্য সহায় না হলে আমাদের কি কিছু করার থাকে পিউ?

থেকে থেকে সৌম্যের চোখ লালচে বর্ন ধারণ করছে, টলটলে অশ্রু জমা হচ্ছে মনিতে।কন্ঠ রোধ হয়ে আসছে।
কিন্তু ছেলে মানুষ চাইলেই কি যখন তখন কাঁদতে পারে?

পিউ তোমার কাছে আমার অনুরোধ তুমি রিস্ক নিয়ে আর কিছু করতে যেও না।তোমার বাবা তোমাকে জিম্মি করতে এক মিনিট ও সময় নেবেনা।প্লিজ এখানেই স্টপ যাও।

******
ফোনের গ্যালারি থেকে নিজেদের আনন্দঘন মুহূর্তের ছবি স্ক্রল করে করে দেখছে স্বর্গ।টুপটুপ করে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে কপোল বেয়ে।মুহিত নেই এটা ভাবতেই তার বুকে ব্যাথা হচ্ছে।আজকাল কান্না করতে গেলেও কষ্ট হয় অনেক।নিঃশাস বন্ধ হয়ে আসে।নিজেকে অপয়া মনে হয়।
―আমার সংস্পর্শে এসেই তোমার ক্ষতি হয়ে গেলো মুহিত!
দুজনের কতো প্ল্যানিং ছিলো, এখনো কতোটা পথ হাটতে বাকী।এভাবে চলে গেলে আমি কিভাবে বাঁচবো?
হঠাতই চিল্লাচিলি শুরু করে দিলো স্বর্গ
―তুমি ধোঁকাবাজ মুহিত, ইউ চিট
―আই উইল নেভার ফরগিভ ইউ
বেড সাইড টেবিলের উপর থাকা ফুলদানি ছুড়ে মারলো ড্রেসিং টেবিলের আয়নায়।
মুহূর্তেই পুরো রুম ঝনঝন শব্দে আলোড়িত হয়ে গেলো।
বাইরে থেকে তনুজা আর সুখ দরজা কড়া নেড়ে যাচ্ছে,কিন্তু স্বর্গ দরজা খোলে না।

মেয়ের এমন দুরবস্থা মা হয়ে সহ্য করতে পারছেন না তনুজা।এমন কঠিন পরিস্থিতিতে কোনো দিন তার পড়তে হবে এটা তিনি দুঃস্বপ্নেও ভাবেন নি।

সুখ দরজার বাইরে থেকে বলে উঠলো
―প্লিজ আপু শান্ত হয়ে যা,ভাইয়া ঠিক ফিরে আসবে,মাম্মা অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে,,প্লিজ হুঁশে আয়।

তনুজা কাঁদতে কাঁদতে স্বর্গকে উদ্দেশ্য করে বললো
―মাম্মা যেখান থেকে পারি মুহিত কে এনে দেব তবুও এমন করিস না বাবা!
হঠাৎ ই শান্ত হলো স্বর্গ।স্বাভাবিক গলায় মাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো
―কিচ্ছু হয়নি মাম্মা আমি ঠিক আছি।
চলে যাও দরজার সামনে থেকে।

――――――
ট্রাক ড্রাইভার ছেলেটিকে আদ্রিয়ান ঢাকায় এনে সিএমএইচ এ ভর্তি করেছে ,ছেলেটিকে তাদের প্রয়োজন।ভয়ে ঘাবড়ে আছে ছেলেটি।একটু স্বাভাবিক হলেই জবানবন্দি নেয়ার কাজ শুরু হবে।
ছেলেটির মা আর ছোট ছোট ভাই বোনকেও ঢাকা এনে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা হয়েছে।
এই মুহূর্তে ছেলেটির স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা সবার কাছে বেশি ইম্পরট্যান্ট।
আর্মি দেখলেই ভয়ে কেঁদে উঠছে ছেলেটি, আর বলছে সে কিছুই জানেনা।
বিভিন্ন কায়দা করে তাকে ট্রমা থেকে বের করতে হবে।
কিভাবে ছেলের মুখ থেকে কথা বের করতে হবে তা মেজর আদ্রিয়ান এর খুব ভালো করে জানা আছে।
অপেক্ষা শুধু উপযুক্ত সময়ের।

******

জুন মাস শেষ হয়ে জুলাই এ পড়েছে।এক লহমায় কেটে গেছে পঁচিশ টি দিন।অসহায় দরিদ্র পরিবারটি অচেনা লোকটিকে নিয়ে ভীষন বিপদে পড়েছে।।কবে লোকটির জ্ঞান ফিরবে ,কবে তার আসল পরিচয় জানা যাবে?

প্রতিদিনের মতো সেদিনও তারা খুব সকালে অন্ধকার না কাটতেই দেবতার পূজা দেবার জন্য সুরমা নদীর তীরে গিয়েছিলো।
নদীর তীরে তারা রহস্য জনক কিছু দেখতে পেয়ে দৌড়ে এগিয়ে যায়।
কাছে যেতেই গৃহ কত্রী দেখতে পায় একটি যুবক নদীর তীরের কাঠের গুড়ির সাথে আটকে আছে।হয়তো স্রোতে ভেসে এসেছে।পরনের কাপড় ছেড়া।
প্রথমে তারা ভেবেছিলো মৃত কোনো লাশ হয়তো ভেসে এসেছে।কিন্তু নাকের কাছে আঙ্গুল ছোয়াতেই কর্তা চমকে উঠে।
এখনো শ্বাস চলছে।
স্বামী স্ত্রী দুজনে মিলে টেনে হিচড়ে শুকনো পাড়ে তোলার চেষ্টা করে।
লোকটির অত্যাধিক উচ্চতা,আর ওজনের ভারে দুজনেরই বেগ পোহাতে হয়।
যুবক টিকে উল্টে পাল্টে দেখতেই তাদের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দেয়।
―বুকে ক্ষত, একটা হাত আর পা ভেঙে ভাঁজ হয়ে আছে,গালের চামড়া ছিলে গেছে,পিঠে বুকে অসংখ্য জখম।

স্বামী স্ত্রী দুজনেই দুজনের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে নিজেদের ঘরে নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

কোনো মতে টেনে হিঁচড়ে বাড়িতে এনে ভেজা পোশাক পাল্টে নিজেদের পোশাক পরাতে চায়।
কিন্তু তাদের পোশাক কোনোভাবেই ছেলেটির দেহে ঢুকানো গেলো না।
যুবকটির গড়ন তাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ।শুধু একটা লুঙ্গি পরিয়ে কাঁথা দিয়ে শরীর ঢেকে দিয়ে চলে গেলো বৈদ্য খুঁজতে।

তাদের কাছে মনে হয় ডাক্তার এর ওষুধ থেকে বৈদ্যর জরিবুটি তে বেশি কাজ হয়।
আর ডাক্তার এর কাছে নিতে গেলেও ঝামেলা অনেক।এখান থেকে উপজিলা হাসপাতাল অনেক দূর।যানবাহন এর ও তেমন ভালো ব্যাবস্থা নেই।পাহাড় আর কাঁচা রাস্তার কাদামাটি পার হয়ে তার পর যেতে হবে উপজেলায়।
লোকটির এহেন অবস্থায় তাকে নিয়ে উপজেলায় যাওয়াও দুষ্কর।আপাতত সুস্থ হলে পরে ভেবে দেখা যাবে কি হয় না হয়!

বৈদ্য এসে লোকটি কে দেখে চিন্তিত হয়ে পড়লেন―
ধারালো কিছু দিয়ে তার বুকে আঘাত করা হয়েছে যা বুক ভেদ করে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে গেছে।হাত পা এমন ভাবে ভেঙেছে জরিবুটি তে কাজ হবে কিনা সে জানেনা,কিন্তু গালের,বুকের পিঠের জখম ঠিক করতে পারবে তিনি।
অসহায় পরিবার টি তবুও বৈদ্য কে সাময়িক চিকিৎসা চালাতে অনুরোধ জানান।

বৈদ্য জরিবুটি লাগিয়ে চলে গেছে সেই কবেই লোকটির জ্ঞান তবুও ফিরছে না।
পল্লীর আরো জাত গোষ্ঠীকেও এব্যাপারে বলা যাচ্ছে না।তারা বলবে অজাতের মানুষ ঘরে কেনো জায়গা দিয়েছি?
তখন আমাদের সমাজ থেকে বিতাড়িত করবে।
যতটা গোপনে পারা যায় লোকটিকে সুস্থ করে বিদেয় করতে হবে।

ছোট মেয়েটা প্রতিদিন আগন্তুক লোকটির দিকে তাকিয়ে থাকে।তার কাছে লোকটিকে দেবতাই মনে হচ্ছে।মানুষ হলে তো ঘুম ভাঙতো এতোদিনে।মেয়েটির অনেক প্রশ্ন জমা আছে এই দেবতার কাছে সাথে নানান স্বপ্ন পূরণের বাহানা।দেবতা জেগে উঠলেই প্রথমে এক বস্তা চাল দিতে বলবে,যাতে তারা প্রতিদিন তিন বেলা পেট ভরে ভাত খেতে পারে।
সেজন্য সারাক্ষন মেয়েটা তার শিয়রে বসে থাকে।

――――――
তুমি এভাবে কাপুরুষের মতো পালিয়ে এসেছো ভাইয়া?তুমি তো ভীতু!তুমি আমাদের সবাইকে কষ্ট দিয়েছো।বাবা আর তোমার সাথে কোনোদিন কথা বলবে না।তুমি দুর্বল,তুমি তো বিবেক কাজে লাগিয়ে কাজ করোনি,তুমি নির্বোধ।চলে যাও আমাদের বাড়ির দরজা থেকে ,বেরিয়ে যাও।তুমি কাপুরুষ।

হঠাৎই আগন্তুক অস্থিরতা শুরু করলো,তার কপাল কুঞ্চিত হলো,ঠোঁট নড়ে উঠলো কিন্তু কিছু বলছে তা বোঝা যাচ্ছে না।হঠাৎই বড় বড় করে চোখ মেলে চাইলো দেবতা সম্বোধন করা লোকটি।

বাচ্চা মেয়েটা খুশিতে হাততালি দিতে শুরু করলো।হঠাৎই বাচ্চা মেয়েটা মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটিয়ে তার বাবা মায়ের উদ্দেশ্যে চিল্লিয়ে বলতে শুরু করলো―
――স্যান ইউ ইসঙ্গী(দেবতা জেগে গেছে)
লাফাতে লাফাতে হাত তালি দিতে দিতে একই কথা বার বার বলছে মেয়েটা।
মেয়েটির কথা শুনে তার বাবা মা দৌড়ে আসে ,এসে দেখতে পায় লোকটি অবাক নয়নে তাকিয়ে আছে।মেয়েটির বাবা মা এসে তাদের প্রথা অনুযায়ী আগন্তুক এর পায়ে লুটিয়ে পড়ে হাত ছোয়ায়।
আগন্তুক ভড়কে যায়,পা সরিয়ে ফেলতে চায়,কিন্তু ব্যাথায় পারে না।
আগন্তুক হাত ইশারায় লোকটিকে কাছে ডেকে কিছু বলে উঠে।ঠোঁট নাড়ানো দেখা যাচ্ছে কিন্তু কথা বোঝা যাচ্ছে না।
লোকটি বুঝতে পেরে যায় হয়তো সে কোথায় আছে তা জানতে চাচ্ছে।

লোকটি তাদের নিজস্ব ভাষায় কথা বলতে শুরু করলে যুবক বহু কষ্টে শক্তি সঞ্চয় করে তার হাত দিয়ে লোকটির গায়ের জামা টেনে ধরে।এবং আবার ঠোঁট নাড়ায়।
লোকটি কথা শোনার জন্য ঠোঁটের কাছে কান আনলে যুবক শুধায়
―আমি কোথায়?
এবার লোকটি বুঝতে পেরে যায় আগন্তুক এর কথা
তখন সে বলতে শুরু করে―
বাবু তোহকে থ হামরা ছুরমার কিনেরত পাইহেচি,
তোর কায়া থ ঘায়ে ভৈরে ছিবে(তোমার শরীর ক্ষততে ভরা ছিলো)
লোকটি আরো কিছু বলতে চাইলো কিন্তু হাতের ইশারায় যুবক থামিয়ে দিলো।

যুবকটি মনে মনে ভাবলো
সে কোথায় আছে এটা পরে দেখা যাবে, আগে নিজেকে সুস্থ করা দরকার,হাত পায়ের অবস্থা বেগতিক, বুকের ক্ষততে ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে,
যুবক আর কিছুই ভাবতে পারলো না পেট গুলিয়ে উঠলো,বমির উদ্রেক হচ্ছে।অস্থির হয়ে উঠলো যুবক।
যুবকের অস্থিরতা দেখে দৌড়ে চলে গেলো বাড়ির কর্তী, একটু পরেই ফিরে এলো হাতে একটি গ্লাস সমেত।
মধু,আর পাহাড়ি উদ্ভিদের রসের সমন্বয়ে তৈরি করা পানীয় বাড়িয়ে দিলো যুবকের উদ্দেশ্যে।
কর্তা লোকটি যুবকটিকে ধরে পিঠের পিছনে দুটো বালিশ দিয়ে আধশোয়া করে বসিয়ে দিলো।
ব্যাথায় চোখ মুখ কুঁচকে এলো তার কিন্তু মুখে শব্দ করার শক্তি অবশিষ্ট রইলো না।
বাচ্চা মেয়ে টি পানীয় টি খাইয়ে দিতে উদ্দত হলো
ওহিদু―(খেয়ে নে)
যুবক এক নিঃশ্বাসে পুরো পানি টুকু খেয়ে ফেললো, অমৃতের মতো স্বাদ ঠেকলো তার কাছে।
পানীয় টি পান করার পর সকল অস্বস্তি এক নিমিষেই গায়েব হয়ে গেলো।
শরীরে শক্তি ফিরিয়ে আনতে হলে প্রথমে দরকার ভালো খাবার।কিন্তু এদের অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে দরিদ্র সীমার নীচে এদের বসবাস।নিজেরাই হয়তো ভালো ভাবে খেতে পায়না,তাকে খাওয়াবে কোথা থেকে?
একটু পর ছোট মেয়েটি হাতে করে খাবারের একটি প্লেট নিয়ে এলো
খাবারের চেহারা দেখেই যুবকের পেট গুলিয়ে উঠলো,কিন্তু বেঁচে থাকতে হলে এটাই তাকে খেতে হবে।
উঠে বসতে চাইলো সে,শরীর সায় দিলো না,আবারো চেষ্টা করলো একটু নড়তে সক্ষম হলো,তিন বারের চেষ্টায় বসতে সক্ষম হলো।মনোবল বাড়াতে হবে,এই ব্যাথায় ভেঙে পড়ল হবে না।
আপনজন দের চেহারা মনের কোঠায় ভাসতেই চোখের মণিতে জলে টলমলে হলো।পলক ফেলে জল গুলোকে লুকিয়ে ফেললো।

নিজের হাতে খাবার খেতে চেষ্টা করে ব্যার্থ হলো,ছোট মেয়েটির সহায়তায় পুরো খেতে না পারলেও অল্প খেলো।

পেরিয়ে গেছে আরো এক সপ্তাহ।হাত পা নাড়ানো গেলেও তাতে ব্যাথা প্রচুর।জরিবুটি কি হাড্ডি জোড়া লাগাতে পারে,?
বুকের ক্ষত ড্রেসিং না করলে ইনফেকশন হবে মাস্ট।এখান থেকে আমাকে কোনো শহরে যেতে হবে।
তার আগে হাঁটার ক্ষমতা অর্জন করতে হবে।
বাঁশ ধরে ধরে ভালোই হাঁটা যায়,তাই বলে কি পঁচিশ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দেয়া সম্ভব??
তবুও যেতে হবে,একটা কচ্ছপ যদি খরগোশের সাথে রেসে জিততে পারে তাহলে সে কেনো পারবে না?
এতো এতো অর্জিত মেডেল, এক্সারসাইজ,মিশন ,প্রতিকূল পরিবেশে যুদ্ধ,ট্রেনিং তাহলে তো বৃথা হয়ে যাবে সব।

উপজাতি লোকটিকে কোনো মতে বুঝিয়ে উদ্ভট পোশাক গায়ে চেপেই,কালো একটি চাদরের সহিত সারা শরীর,মুখ ঢেকে শক্ত বাঁশে ভর দিয়ে চলতে লাগলো সে।

উপজাতি লোকটির নাম মারুং।
মারুং যুবকের হাঁটার ভাবভঙ্গি দেখে বুঝে ফেললেন এই ছেলে কোনো সাধারণ মানুষ নয়।

বিশ্রাম নিয়ে নিয়ে তিন ঘন্টা হাঁটার পর তারা একটি গরুর গাড়ি দেখতে পায় সামনে।দুজনের চোখ ই চকচকে হয়ে উঠে।
গাড়িয়াল কে অনুরোধ করে মারুং তাদের উপজেলার রাস্তায় নামিয়ে দিতে।
গাড়িয়াল লোকটি পাশের যুবকের শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে রাজি হয়।
মুখের হাসি প্রশস্ত হয় মারুং এর।

★★★★★
চৌকষ মেজরকে কেউ অনায়াসে গায়েব করে দিলো এটা কেউ টের ও পেলো না?
ডিপার্টমেন্ট এটা কিছুতেই মানতে পারছে না ।আর্মি হেডকোয়ার্টার এ মিটিং বসেছে এই বিষয়ে।

অফিসিয়াল ভাবে তারা মেজর মুহিত কে মৃত ঘোষণা করে তার প্রাপ্ত জিনিসের প্রতি সম্মান জানিয়ে মেডেল সহ তার পরিবার কে প্রদান করবে।এজন্য মেজর মুহিতের মাকে প্রয়োজন।
আর্মি জেনারেল বক্তব্য দিচ্ছেন এমন সময় ক্যাপ্টেন সৌম্যের ফোনে একটি ফোন এলো।
সৌম্য গুরুত্ব না দিয়ে বক্তব্য শুনতে মনোযোগ দিলো।
আবারো কেঁপে উঠলো সৌম্যের ফোন
ফোন বের করে আননোন নম্বর দেখে ভ্রু কুঁচকে উঠলো সৌম্যের।

হল রুম ছেড়ে বাইরে এসে ফোন কানে তুলতেই
ওপাশ থেকে ভাঙা ভাঙা গলার গমগমে আওয়াজ এলো আওয়াজ এলো
―ইটজ ইউর মেজর স্পিকিং ক্যাপ্টেন সৌম্য।

শরীরের লোম দাঁড়িয়ে গেলো সৌম্যের,চোখের কোনে জমা হলো খুশির জল।

আর্মি জিপ স্টার্ট দিয়ে দ্রুত ছুটে চললো
গন্তব্য অজানা শহর।

#চলবে ।

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_২০
#সারিকা_হোসাইন

◆◆◆
ধরনীতে সূর্যের তেজ দেখে মনে হচ্ছে যেনো হাশরের মাঠে দাঁড়িয়ে আছে সবাই।এতো সূর্যের তেজ?রোদের তাপে মাটি শুকিয়ে সাদা রং ধারণ করেছে।পাড়া দিলেই মনে হয় গরম তাওয়া।

ক্রিমিনাল ভিজিটিং রুমে বসে আছেন আশরাফ চৌধুরী,মাথার উপর ক্যাচক্যাচ শব্দ তুলে বৈদ্যুতিক পাখা আস্তে আস্তে ঘুরে যাচ্ছে।শরীর ঠান্ডা হবার বদলে মনে হচ্ছে আরো উত্তপ্ত ছাদের গরম হাওয়া গায়ে মাখিয়ে দিচ্ছে।গায়ের সাদা পাঞ্জাবি ভিজে জবজবে হয়ে গেলো নিমিষেই।
বহু কষ্টে রাগ সংবরন করে বসে আছেন,আহিয়ান কে পুলিশ আনতে গেছে।
হঠাতই ঝনঝন শব্দে সম্বিৎ ফিরে এলো আশরাফ চৌধুরীর।
এ কাকে নিয়ে এসেছে পুলিশ?

যেই ছেলে দামি ব্র্যান্ডেড পোশাক বাদে অন্য কোনো পোশাক গায়ে জড়ায় নি তার গায়ে কয়েদির ময়লা পোশাক?চুল দাঁড়ির একি হাল?এসির পাওয়ার কমিয়ে কম্বল মুড়িয়ে ঘুমানো ছেলে এমন গরমে ঘুমায় কিভাবে?
গলায় শিকল হাতে পায়ে বেড়ি?
হঠাতই পিতৃ হৃদয় বেদনায় মুষড়ে উঠলো।যতোই পাষান হৃদয়ের মানুষ হোক,বাবা তো হয়।
ছেলে আজ উন্মাদ হয়ে কয়েদি জীবন গুজরান করছে।সুস্থ হওয়া মাত্রই ফাঁসির হুকুম হবে।কি থেকে কি করে দিলো শালা মেজর মুহিত।

আশরাফ চৌধুরী কে দেখা মাত্রই এক দলা থু থু ছুড়ে দিলো আহিয়ান।
এর পর হঠাৎই উত্তেজিত হয়ে গেলো।তেড়ে মারতে আসলো আশরাফ চৌধুরী কে। দুজন কনস্টেবল কোনো রকমে কব্জা করে ফেললো আহিয়ান কে।
এর পর খিক খিক করে হেসে উঠলো আহিয়ান।
আশরাফ চৌধুরী কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো

―পাপা মেজর মুহিত ওয়াসিফ তুমাকে পিষে ফেলবে।পালিয়ে যাও পাপা।আমি তাকে দেখে ফেলেছি ,সে আসছে।তোমাকে পিস পিস করে কেটে লবন ভরে দেবে ।
বাঁচতে চাইলে পালাও।

যেই ছেলের জন্য কিছুক্ষণ আগে মন জমিনে দুঃখ হানা দিয়েছিলো সেই ছেলের এহেন কথায় রাগে বিতৃষ্ণা এসে গেলো আশরাফ চৌধুরীর।
কেমন নিমকহারাম জন্ম দিয়েছে ভাবতেই নিজের প্রতি রাগ হলো।

একদিকে অসহনীয় গরম তার মধ্যে ছেলের বাতুলতা মাথায় রক্ত ছলকে উঠলো তার।
মনে মনে শয়তানি হাসলো আশরাফ চৌধুরী।
তোর মেজর এর কঙ্কাল এর খুজ ও কেউ পাবেনা হারামজাদা ছেলে।
গহীন অরণ্যে সমাধি দিয়ে এসেছি ওই দুই টাকার লাফাঙ্গা মেজর কে।
মনের ভাবনা মনে রেখে বুকের ব্যাথার ভান ধরে বাইরে বেরিয়ে আসলেন আশরাফ চৌধুরী।

――――――
দীর্ঘ সাত ঘন্টা জার্নি করে তাহির পুর উপজেলায় এসে পৌঁছেছে সৌম্য।মেজর মুহিত এখানেই স্থানীয় হেলথ ক্লিনিকে আছেন।
মুহিত যখন কল করে সৌম্য কে এখানে আসার কথা বলেছে,সৌম্যের মনে হয়েছে তার দুটো পাখা থাকলে ভালো হতো,উড়ে উড়ে দ্রুত চলে যাওয়া যেতো।
লোকাল মানুষের কাছে জিজ্ঞাসা করে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে পৌঁছে গেলো সৌম্য।
স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ঢুকে মুহিতকে পাগলের মতো খুঁজতে লাগলো সে।অবশেষে পেয়ে গেলো তার মেজর কে।মনে যেনো প্রশান্তির হাওয়া বয়ে গেলো।

দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো সৌম্য।ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলো মুহিত।ভয়ে ছেড়ে দিয়ে সৌম্য বলে উঠলো
―সরি স্যার সরি।আবেগ সামলাতে পারিনি।
ভাঙা কন্ঠে মুহিত ফ্যাসফ্যাসে কন্ঠে বলে উঠলো
―সুস্থ হয়ে পানিশমেন্ট দেবো তোমাকে ক্যাপ্টেন।

সৌম্যের চোখের জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো।
―জি স্যার,আমি সকল পানিশমেন্ট এর জন্য প্রস্তুত।
একটু পর ডিউটি ডক্টর এলো।
মুহিত কে উদ্দেশ্য করে মাধুর্যহীন কন্ঠে বলে উঠলো এই রোগীর গার্ডিয়ান কে আছে?

সৌম্য তড়িঘড়ি করে ডিউটি ডক্টর এর কাছে গিয়ে জানালো
―আমি।
এমন জীর্ণ রোগীর গার্ডিয়ান একজন আর্মি অফিসার?
কন্ঠ নরম হয়ে এলো ডিউটি অফিসার এর।
সৌম্য তার ভাবাবেগ বুঝতে পেরে আগ বাড়িয়ে বলে উঠলো
―নো কুয়েশ্চেন প্লিজ!ইটজ আওয়ার সিক্রেট ম্যাটার।

ডক্টর ঢোক গিলে মুহিতের দিকে অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি দিয়ে সৌম্যের দিকে তাকিয়ে বললো
দেখুন উনার পা,হাত দুটোই মারাত্মক ভাবে ভেঙে গেছে,আমি জানিনা উনি কিভাবে এতোদিন এগুলো নিয়ে বসে ছিলো?
দ্রুত বড় হসপিটাল এ উনাকে এডমিট করতে হবে,আর বুকে একটা ক্ষত দেখা যাচ্ছে।বুকের ক্ষত টা গভীর।আমাদের এখানে এসবের চিকিৎসা নেই।বুঝতেই পারছেন!বলে হাত কচলালো ডিউটি ডক্টর।

যা বুঝার সৌম্য বুঝে গেলো।ডিউটি ডক্টর কে থামিয়ে দিয়ে মুহিতের কাছে আসলো।স্যার আমাদের যেতে হবে।আপনি কি যেতে পারবেন আমার সাথে?

―না পারলেও আমাকে যেতে হবে সৌম্য।একজনের কাছে আমি খুব অপরাধী হয়ে গেছি।সে অপরাধ মার্জনা না করলে আমি শান্তি পাবো না।যতো দ্রুত তার কাছে যাবো ততো দ্রুত ক্ষমা পাবো।

–তোমাকে যেটা আনতে বলেছিলাম এনেছো?
―জি স্যার,বলেই গাড়ির বক্স থেকে একটা ব্যাগ নিয়ে আসলো সৌম্য।
মুহিতের হাতে দিয়ে বললো
― নিন স্যার।

মুহিত মারুং আর সৌম্যকে নিয়ে স্বাস্থ্য কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে জিপের কাছে আসলো।
মুহিত মারুং কে উদ্দেশ্য করে বললো
―আপনারা আমার জন্য যা করেছেন তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার ভাষা নেই আমার।আমি মন উজাড় করে কিছু দিতে চাই আপনাকে।
মারুং এর হাত টেনে হাতে থাকা ব্যাগটি মারুং এর হাতে দিলো মুহিত।
মারুং প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে চাইলো মুহিতের পানে।মারুং এর চোখের ভাষা মুহূর্তেই বুঝে গেলো মুহিত।

মৃদু হাসলো মুহিত।
এখানে পাঁচ লাখ টাকা আছে।আপনি জীবিকা নির্বাহের জন্য কিছু করে টাকাটা ব্যায় করলে মনে শান্তি পাবো আমি।
আজকে আমি চলে যাচ্ছি।
কিন্তু অতিশীঘ্রই আমি আবার ফিরে আসবো।ডিকো কে আমার তরফ থেকে ভালোবাসা জানাবেন।
ডিকোর প্রতি আমার কিছু কর্তব্য আছে।সুস্থ হয়ে এসে আমি অবশ্যই সেগুলো পালন করবো।
আপনি নিজেও জানেন না আপনি কাকে বাঁচিয়েছেন।
এর প্রতিদান না দিয়ে কিভাবে যাবো বলুন?

মারুং এর চোখে জল এসে গেলো।সে এটা বুঝে গেছে লোকটি বড় কোনো সাহেব।মারুং সেভাবে কিছুই করতে পারেনি তার জন্য।

যতটুকু করেছে তার বিনিময়ে দেবতা তার জন্য এতোবড় পুরস্কার রেখেছে সে ভাবতেই পারেনি।
কাঁদতে কাঁদতে মারুং মুহিত কে হাত জোড় করে ধন্যবাদ জানালো।
সৌম্যের কাছ থেকে আরো কিছু খুচরো টাকা নিয়ে মারুং এর হাতে দিয়ে বললো
―আপনার মেয়ে ফল খেতে আর নতুন জামা পড়তে ভালোবাসে।
মারুং এর মুখে হাসি ফুটে উঠলো।মারুং কে আবারো কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করে সৌম্যের সহযোগিতায় জিপে উঠে বসলো মুহিত।
সহসাই জিপ স্টার্ট দিয়ে বাতাসের গতিতে চালাতে লাগলো সৌম্য।
যতদূর তাদের দেখা গেলো মারুং ততক্ষণ তাকিয়ে তাদের দেখলো।

গাড়ি চলছে আপন মনে।সৌম্য কোনোভাবেই নিজের ভেতরের কৌতুহল দমিয়ে রাখতে পারছে না।মেজর চোখ বন্ধ করে আছে বলে কিছু জিজ্ঞেস করতে ও পারছে না।
মুহিত এর কন্ঠে নীরবতা ভাঙলো।
চোখ বুঝেই মুহিত সৌম্যকে বলে উঠলো
―তুমি যে এখানে এসেছো কেউ জানে?

সৌম্য গলা খাকরি দিয়ে বললো
―না স্যার,আপনার কথা মতো শুধু নাফিজ স্যার কে বলে জিপ নিয়ে এসেছি।

“”তোমাকে অনেক দায়িত্ব পালন করতে হবে এখন থেকে ক্যাপ্টেন।””

―জী স্যার আমি যেকোনো দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত।আপনি আমাকে আলাদিনের জীন ভাবতে পারেন।

সৌম্যের এমন ডেডিকেশনের জন্যই মুহিত তাকে এতো পছন্দ করে।

আমার বউকে তোমার নম্বর থেকে কল করো।
নিমিষেই কড়া ব্রেক কষলো সৌম্য।
ঝাঁকি খেয়ে ব্যাথায় আউচ্ করে উঠলো মুহিত।
বউ মানে?

না বলে ব্রেক কষার জন্য পানিশমেন্ট পাবে ক্যাপ্টেন।

স্যার যা খুশি দিয়েন আগে সব খুলে বলুন।

আমি তোমার ম্যাডাম কে বিয়ে করে ফেলেছি গোপনে।
অবাক নয়নে প্রশ্ন করলো সৌম্য
কেনো স্যার?
―আমি যতদূর জানি আপনাদের দুই পরিবার ই রাজি ছিলো।

সৌম্যকে এতোটা অবাক হতে দেখে স্মিত প্রাণহীন হাসলো মুহিত।
এর পর বলতে শুরু করলো―

ছিলো সৌম্য,কিন্তু একই ছাদের নিচে একই বাড়িতে আগুন আর মোম এক সাথে থাকতে পারে?
তোমার ম্যাডাম ভালোবাসার দাবি নিয়ে যখন তখন আমার কাছে ছুটে আসতো।
তাকে বারবার ফিরিয়ে দিতে আমার অনেক কষ্ট হতো,আবার পাপ বোধ ও হতো।।
আর তোমার ম্যাডামের অভিমানের পাল্লা ভারী হতো।
মেয়েটা বড্ড অবুজ সৌম্য।

মা অস্ট্রেলিয়া গিয়েছে তুমি জানো।
যাবার আগে মা আমাকে কি বলে গিয়েছে জানো?

না স্যার জানিনা,সৌম্যের সাবলীল উত্তর।
গাড়ি স্টার্ট দাও বলছি।
সৌম্য গাড়ি স্টার্ট দিলো,গাড়ি রানিং হতেই মুহিত বলতে লাগলো―

মা আমাকে অনুরোধ করে বলেছে উনাকে যেনো একা ফিরিয়ে না আনা হয়।উনি তার মেয়ে নাতি,জামাই সবাইকে নিয়ে ফিরতে চায়।

পাপা কেনো ওদের দূরে পাঠিয়ে ছিলো আমার নতিজা দেখেই বুঝতে পারছো।

―জী স্যার।

―আমি চেয়েছিলাম আশরাফ চৌধুরীর সকল প্রমান জোগাড় করে আইনের আশ্রয় নিতে।
কিন্তু এর পরের ঘটনা তুমি জানো।বিষয়টা অতোটা সহজ নয়।আরো কতোদিন অপেক্ষা করতে হবে তাও জানিনা।

ঘরে আগুন সুন্দরী প্রেমিকা রেখে কোনো পুরুষ সাধু থাকতে পারবে ক্যাপ্টেন?

―না স্যার পারবে না!

এজন্যই বিয়ে করেছি আমরা।যাতে কোনো পাপবোধ না হয়,আর অপেক্ষার প্রহর গুনতে না হয়।

কিন্তু বিয়ে করেও কোনো ফায়দা হলো না।তোমার ম্যাডাম মারাত্মক কষ্ট টাই পেলো আমার থেকে।
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে গাড়ির সিটে হেলান দিলো মুহিত।

কিছুক্ষন মৌন থেকে আবার বলতে শুরু করলো

আমার সিলেট আসার খবর কে উনাকে দিয়েছে জানো?

―কে স্যার?

গেট কিপার খলিল।

খলিলের নাম শুনে কপালের চামড়ায় চিন্তার ভাঁজ পড়লো সৌম্যের।

সৌম্যকে কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে মুহিত আবার বলে উঠলো

পাপাকে আর মুকিত কে যেদিন হত্যা করা হয় সেদিন ও খলিল সাথে ছিলো।
খলিল ই মুকিতের শ্বাস রোধ করেছিলো।

চোখের কোনে জমা জল আঙ্গুল দিয়ে মুছে মুহিত আফসোস এর সুরে বললো

সবচেয়ে কষ্টের বিষয় কি জানো সৌম্য?

এই খলিল কে চিহ্নিত করতে আমার ছয় বছর লেগে গেলো।
যেদিন আমি সিলেট আসি,কোয়ার্টার এর গেট ক্রস করতেই লুকিং গ্লাসে আমি ওর ক্রুরতা মিশ্রিত হাসি দেখেই সব বুঝে গেছিলাম।

এখন করতে চাচ্ছেন স্যার?

সব গুলোকে কেটে লবন মরিচ লাগাবো।আইন আমার দেখা শেষ।এবার তুমি আমার আইন দেখবে সৌম্য।

মুহিতের আগ্নেয়গিরির মতো লালচে চোখ দেখে ভয়ে কেঁপে উঠলো সৌম্য।

এখন কোথায় যাবো স্যার?
গলার সমস্ত আওয়াজ দিয়ে মুহিত বলে উঠলো

ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট সৌম্য।

মুহিতের তেজে লোমকূপ পর্যন্ত ফুলে উঠলো সৌম্যের।দ্রুত গাড়ি হাকালো ক্যান্টনমেন্ট এর উদ্দেশ্যে।

******
বিছানায় মৃতের ন্যায় পড়ে আছে স্বর্গ।এই দুনিয়া সম্পর্কে তার কোনো ধ্যান জ্ঞান নেই।নিজের জীবনের হিসেব কিছুই মিলছে না যেনো তার।কি থেকে কি হয়ে গেলো নিমিষেই।
মুহিতের সকল স্মৃতি তাকে প্রতিনিয়ত কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।মাঝে মাঝে সিলিং এর ফ্যান স্বর্গ কে খুব টানছে।
কিন্তু তার মতো একজন ডাক্তার এর এসব শোভা পায়না।যার দায়িত্ব একজন মানুসের জীবন বাঁচানো সে কিভাবে নিজের জীবন ই নিয়ে নেবে?

হঠাৎই রুমে তনুজা আর সুখ প্রবেশ করলো।তারাও নেতিয়ে পড়েছে এই কদিনে।সুখ যে ভাবে ছুটি কাটাচ্ছে,মেজর জেনারেল এর ছেলে না হলে তাকে এতদিন মিলিটারি একাডেমি থেকে বহিষ্কার করা হতো।
পরিবারের মানুষ এর পাশে আগে থাকতে হবে পরে পড়াশোনা ।এটা ভেবেই সুখ যায়নি আর।

বোনকে শান্তনা দিতে সুখ অনেক কিছু বোঝালো।
কদিনেই স্বর্গের চোখের নিচে কালি পরে গেছে।চেহারার জৌলুষ মলিনতায় চাপা পড়ে আছে।
মেয়ের এহেন অবস্থা কি কোনো মা সহ্য করতে পারে?

তনুজা করে যাচ্ছে।পরীর বাচ্চার মতো মেয়ে তার,কেমন জীর্ণ শীর্ন হয়ে আছে।
মেয়েকে খাবার খাওয়ার জন্য অনেক ক্ষণ চাপাচাপি করলেন ।লাভের ফল শূন্যে।
মা হয়ে তিনিও মুখে খাবার তুলতে পারছেন না।
স্বর্গকে আরো কিছু কথা বলে কান্না মুছতে মুছতে বেরিয়ে গেলেন তনুজা।

মায়ের পিছে পিছে সুখ বেরিয়ে দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে স্বর্গকে একা থাকতে দিয়ে চলে গেলো।

হঠাৎই স্বর্গের ফোন ভাইব্রেশন হলো।কে ফোন করেছে দেখার প্রয়োজন মনে করলো না সে।
যেখানেই নিজের প্রাণেশ্বর ই তাকে আর কোনো দিন ফোন করবে না।সেখানে অন্যের ফোন ধরে শান্তনা বাণী শোনার কোনো ইচ্ছে নেই স্বর্গের।
দ্বিতীয় বার ও ফোন আসলো।তাকিয়েও দেখলো না স্বর্গ।
তৃতীয় বারের কলে রাগে বিবেক বোধ হারিয়ে ফেললো।
ভাবলো ফোন ধরেই জন্মের গালি দিবে।
ফোনে ক্যাপ্টেন সৌম্যের নম্বর দেখে রাগ পানি করে ফেললো স্বর্গ।
ভ্রু কুঁচকে ফোন রিসিভ করে
নরম ভেজা কন্ঠে বলে উঠলো
―হ্যালো?
ওপাশ থেকে কোনো সাড়া আসলো না।
আবার হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো
―আমার হাতের স্লিং টা তুমি ই লাগিয়ে দাওনা বউ।

কেঁপে উঠলো স্বর্গ।বেহায়া নেত্র চাপিয়ে বর্ষণ শুরু হলো।স্বাস যেনো বন্ধ হয়ে আসছে।শরীর থরথর করে কাঁপছে।

ফোন কেটে চোখের জল মুছে তড়িঘড়ি করে নিজের এপ্রোন খুঁজে বের করে গায়ে জড়ালো স্বর্গ।
তনুজা কে চিল্লিয়ে ডেকে উঠলো।
মাম্মা,মাম্মা

মেয়ের ডাকে অন্তর শুকিয়ে এলো তনুজার,আবার নতুন কোন তান্ডব আসতে চলেছে?

,সুখ কে নিয়ে দৌড়ে ড্রয়িং রুমে এলেন তনুজা।
মেয়ের কান্না দেখে আরো ভয় পেয়ে গেলেন তিনি।

স্বর্গ কান্নার চোটে কথাই বলতে পারছে না।
তবুও ভাঙা ভাঙা শব্দে বলে উঠলো
―মুহিতের পছন্দের ইলিশ পোলাও করে সুখকে দিয়ে সিএমএইচ এ পাঠিয়ে দিও।
আমি যাচ্ছি ওখানে,মুহিত আমার কাছে চিকিৎসার আবদার করেছে।

#চলবে

তোমার জন্য সিন্ধুর নীল পর্ব-১৮

0

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_১৮
#সারিকা_হোসাইন

ঘড়িতে সকাল দশটা বেজে পঁচিশ মিনিট
মেজর আদ্রিয়ান কে নিয়ে মৌলভীবাজার বাস স্ট্যান্ড এ বসে আছে মুহিত।তারা তাদের আর্মি জিপটি রিসোর্ট এ রেখে শ্রীমঙ্গল এর লোকাল গাড়িতে করে এখানে এসেছে।

এখানে বৃষ্টির কোনো সময়,অসময় নেই।যখন খুশি তখন ই যেনো ঝুপঝুপ করে ধরনীতে ঝরে পড়তে হবে।
বৃষ্টির কারণে মুহিতরা তাদের কাজে আগাতে পারছে না।
আজকের দিনটা তাদের জন্য সোনার ডিম পাড়া হাঁসের মতো।

মুহিত গোপন সূত্রে খবর পেয়েছে আজকে ড্রাগ সাপ্লাই হবে।
শকুনের মতো দৃষ্টি তাক করে আছে মুহিত আর আদ্রিয়ান।

হঠাৎই তারা একটি খালি ট্রাক দেখতে পায় যা বর্ডার এর দিকে যাচ্ছে,মুহিত আর আদ্রিয়ান দৌড়ে চলন্ত ট্রাকটিতে ঝাঁপিয়ে উঠে পড়ে।
ট্রাকের স্পিড কম থাকায় কোনো প্রকার ঝুঁকি স্পর্শ করেনি তাদের। বৃষ্টিতে ভিজে দুজনের অবস্থাই যবুথুবু।

বর্ডারে আসার আগেই ট্রাক ড্রাইভার তাদের উদ্যেশ্যে বিড়ি ফুকতে ফুকতে কেটকেটে কন্ঠে বলে উঠে
―নামুইন,এই গাড়ি বর্ডার জাইতোনা।

ড্রাইভার এর কথায় আধার নেমে আসে মুহিত আর আদ্রিয়ান এর মুখে।তারা দ্রুত নেমে পড়ে ট্রাক ড্রাইভার কে ধন্যবাদ জানায়।

ড্রাইভার তাদের নামিয়ে দিয়ে অন্য পথ ধরে।

যতটুকু পথ আছে দৌড়ে গেলে ত্রিশ মিনিটের মতো সময় লাগবে।

মেজর অদ্রিয়ানের দিকে তাকিয়ে মুহিত চোখ টিপ দিয়ে ফিচেল হেসে বলে উঠে―
তো একটা রেস হয়ে যাক মেজর আদ্রিয়ান আভিয়াজ!বলেই একটা ভ্রু উঁচু করে গুনতে লাগলো―

―রেডি,স্টেডি, গো

দুজন মেজর সমান তালে গাছ,মানুষ ,পাহাড় ছাপিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে,কিন্তু কেউ তাদের আসল পরিচয় জানে না।জানতে চায় ও না।আদিবাসী দের মেজর এর পরিচয় দিয়েই বা কি কাজ?

দৌড়াতে দৌড়াতে দুজনেই তাদের লক্ষে এসে উপস্থিত হয়,এর পর হাঁটুতে ভর দিয়ে হাপাতে হাপাতে মেজর আদ্রিয়ান ভেজা ঘাসের উপর শুয়ে পড়ে।আশেপাশে কোনো মানুষ পরিলক্ষিত হচ্ছে না।যতদূর চোখ যায় বড় বড় গাছ ঝোপঝাড় আর কাঁটা তারের বেড়া।

চারপাশে আরেকবার ভালো করে চোখ বুলিয়ে নিয়ে
সুযোগ বুঝে ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে যায় মুহিত আর আদ্রিয়ান।যেভাবেই হোক,ড্রাগস ভর্তি ট্রাকে তাদের উঠে যেতে হবে,এবং সেই ড্রাইভার কে কব্জা করে বর্ডার গার্ডের ক্যাম্প পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারলেই কাজ অর্ধেক হয়ে যাবে।

তিন ঘন্টা ধরে ওঁৎ পেতে বসে আছে মেজর আদ্রিয়ান আর মুহিত,এখনো সন্দেহ জনক কিছুই চোখে পড়ছে না।
ঝোপের ভেতর মশার কামড়ে অতিষ্ঠ মেজর আদ্রিয়ান।তার কাছে মনে হচ্ছে সে এই মুহূর্তে উগান্ডা বর্ডার পাহারা দিচ্ছে।

দিনের আলো ফুরিয়ে সন্ধ্যা নেমে আসছে,বিশ্রী শব্দে বন্য পশু গুলো ডেকে যাচ্ছে।দুজন মানুষ অজানা পরিবেশে ঝোপের মধ্যে স্যাতস্যাতে মাটিতে বসে আছে,সাপ খোপ ও তো কামড়াতে পারে !

মেজর আদ্রিয়ান ভয়ে চুপসে আছে।মুহিত নির্বিকার।

জঙ্গল পুরোটাই যখন ঘন কালো অন্ধকারে ছেয়ে গেলো তখন ই একটি ট্রাক কোথা থেকে যেনো কাটা তারের বেড়ার কাছে এলো।
মুহিতরা সেদিন দুই পাশে বেড়ার তার কাটা দেখেই বুঝতে পেরেছে কাজ এই পথেই হয়।শুধু তাই নয় সেখানে একটি গোপন সুড়ঙ্গ ও তারা আবিস্কার করেছে যা দিনের বেলায় লতাপাতা দিয়ে ঢাকা থাকে।

হ্যারিকেন হাতে একে একে বেরিয়ে এলো পঁচিশ জন ব্যাক্তি,তাদের প্রত্যেকের মাথায় একটি করে বস্তা,ছোট ট্রাকটিতে বস্তা গুলো লোড করে প্রত্যেকেই জঙ্গলে হারিয়ে গেলো।

ট্রাক ড্রাইভার টি বারো কি চৌদ্দ বছরের একটা ছেলে।
এতো ছোট ছেলে এই কাজে জড়িত ভাবতেই মুহিতের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো।

ট্রাক স্টার্ট দেয়ার সাথে সাথেই মুহিত আর মেজর আদ্রিয়ান ট্রাকে কৌশলে উঠে পড়লো,ট্রেনিং এর সময় এই কৌশল সবার আগে তাদের রপ্ত করতে হয়েছে।শুধু তাই নয় আর্মিদের বড় বড় চলতি গাড়িতে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠা নামা তাদের নিত্য দিনের অভ্যেস।

,জঙ্গল পার হতেই দুজনেই তাদের কোমরে গুঁজে রাখা রিভলবার বের করলো,
এখনই ছেলেটাকে বাগে আনতে হবে এবং ট্রাকটির ব্যাবস্থা করতে হবে।

ভাবতে ভাবতে আদ্রিয়ান সামনে থাকা একটি শাল গাছে ফাঁকা গুলি ছুড়লো,ছেলেটি ভয়ে ট্রাকটি স্লো করতেই মুহিত নেমে ট্রাকের দরজা খুলে ছেলেটিকে বন্দুক তাক করে।
মুহিত অবাকের চরম পর্যায়ে পৌঁছে যায় যখন সে ছেলেটির কাছেও বিদেশি একটি রিভলবার দেখতে পায়।

আদ্রিয়ান ও আরেক পাশের দরজা খুলে ট্রাকে উঠে বসে,দুইজন দুইপাশে থেকে গান পয়েন্ট করে ছেলেটিকে তাদের কথা মতো গাড়ি চালাতে বলে।

হঠাৎই ছেলেটি সিলেটি ভাষায় উঠে―

―আমারে ধইরা কোনো লাভ ঐতো না,স্যার
“”আমার থেইকা কোনো তথ্য বাইর করতে পারতাইন না।
―আমার থেকে তথ্য বাইর করার আগেই তারায় আমারে গুলি করে মাইরা লাইবো।

ছেলেটির মুখে মৃত্যুর কথা নির্বিকার স্বাভাবিক ভাবে বলার ধরন দেখে মুহিত আদ্রিয়ান দুজনেই অবাকের চরম পর্যায়ে চলে যায়।

এই টুকু ছেলে জীবনের ভয় করছে না ,কিসের ভয় তার তাহলে?

মুহিত কৌতূহল দমে রাখতে পারলো না,ছেলেটিকে প্রশ্ন করে ফেললো
―কেনো তুমি এই ঝুঁকিপূর্ণ জীবন বেছে নিয়েছো?

আমার মা,বইন আর ভাইয়ের লেইগা, ছেলেটির সোজাসাপ্টা উত্তর।
মুহিত ছেলেটিকে নির্দেশ দিলো গাড়ি বর্ডার গার্ড দের ক্যাম্পের রাস্তায় ঘুরাও।
ছেলেটি ভয়হীন কন্ঠে বলে উঠলো
―ঐহানে গেলেও লাভ হয়তো না,হেইনের বড় বাবু ও সব জানে,আপ্নেই বিপদে পরবাইন।

মেজর আদ্রিয়ান আর মুহিত দুজন দুজনের চোখ চাওয়া চাওয়ি করলো।
এসব অফিসার দের কিসের লোভ সেটাই মুহিত অনুধাবন করতে পারছে না।
ছেলেটির কথায় যুক্তি আছে,নাহলে এতো বছর ধরে এসব হচ্ছে কেউ কি কোনো ও দিন টের পায়নি?
মুহিত ছেলেটিকে আশ্বাস দেয় সে যদি মুহিত কে স্মাগলার সম্পর্কে সকল তথ্য দেয় তবে মুহিত তার পরিবার ও তাকে একটা ভালো লাইফ লিড করার ব্যাবস্থা করে দেবে।

ছেলেটিকে মুহিতের নম্বর আর ভিজিটিং কার্ড দিয়ে আর ছেলের কিছু কথা রেকর্ড করে নেমে আসে গাড়ি থেকে।
মুহিত শতভাগ নিশ্চিত ছেলেটি তাকে অবশ্যই ফোন করবে।
কারো চোখের ভাষা পড়তে মুহিত ওয়াসিফ কখনো ভুল করেনা।

******
সারাদিন মুহিতের কোনো দেখা সাক্ষাৎ পায়নি স্বর্গ।সেই যে মেডিসিন এনে দিয়ে বেরিয়ে গেলো, এর পর না হোটেলে ফিরলো না তাকে ফোনে পাওয়া গেলো।
স্বর্গ জানে মুহিত এখানে তার একান্ত ব্যাক্তিগত কাজে এসেছে।তবুও তার কাছে মনে হলো মুহিত তাকে অবহেলা করছে,প্রায়রোটি কম দিচ্ছে।
এসব উল্টাপাল্টা ভেবে মন আকাশে কালো মেঘ জমলো সাথে অক্ষি কোনে জমলো জল।

রাত দুইটার দিকে মুহিত ক্লান্ত শরীরে হোটেলে ফিরে আসলো, তার উচিত স্বর্গকে একটু সময় দেয়া,দুজনে কিছু ভালো টাইম স্পেন্ড করা।কিন্তু বাবা ভাইয়ের খুনির শাস্তি না দেয়া পর্যন্ত কিভাবে নিশ্চিন্তে সুখের সময় পার করবে মুহিত?

স্বর্গ টের পেয়েছি মুহিত এসেছে তবুও অভিমানে চোখ টিপে কাত হয়ে ঘুমের ভান ধরে পরে রইলো।
মুহিত ফ্রেস হয়ে এসে স্বর্গকে না ডেকে আস্তে করে পাশে শুয়ে পড়লো।
মুহিতের এমন আচরণে অভিমানের পাল্লা আরো ভারী হলো।স্বর্গ মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলো কাল ভোরেই মুহিতকে ফেলে সে ঢাকা চলে যাবে।

―――――――
মিসেস তারিন কে দীর্ঘ ছয় বছর পর কাছে পেয়ে নামিরার যেনো কান্নাই থামছে না।সোহাগ তাকে থামানোর চেষ্টা করে বার বার ব্যার্থ হচ্ছে।এই সময়ে তার এতো স্ট্রেস নেয়া ঠিক হবে না।

মিসেস তারিন নিজেকে অনেকটাই সামলে নিয়েছেন।মন দুর্বল থাকলে অল্প কারণেও কষ্ট পাওয়া যায়,আর যদি মনকে একবার শক্ত করা যায় তখন শত বিষাদ ও আর কষ্ট মনে হয় না।

নামিরাকে শান্তনা দিয়ে চুপ করালেন মিসেস তারিন।
নামিরাকে যেই সম্ভাব্য ডেলিভারি ডেট দেয়া হয়েছে সেটা আগামী কাল।
মিসেস তারিন নামিরা আর সোহাগ কে অভয় দিচ্ছেন আর ব্যাগপত্র গুছাচ্ছেন।কখন হসপিটাল এ দৌড়াতে হবে কেউ জানেনা।

মিসেস তারিন হেল্পিং হ্যান্ড কে ঘর কিভাবে গুছাতে হবে কি দিয়ে মুছতে হবে সব বুঝিয়ে দিলেন।

ব্যাগ গুছাতে গুছাতে হঠাৎই হাতের ধাক্কা লেগে বেড সাইড টেবিলের উপর থেকে ফুলদানি টা মোজাইক করা ফ্লোরে পরে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে গেলো।
চমকে উঠলো নামিরা,
মিসেস তারিনের মন কু ডেকে উঠলো।
মেয়েটার ডেলিভারি ভালোয় ভালোয় হবে তো?

★★★★★
সকাল বেলা মুহিতের ঘুম ভাঙলো ফোনের ভাইব্রেট শব্দে,একটা আননোন নম্বর থেকে কল এসেছে।
বিরক্তি তে চোখ মুখ কুঁচকে এলো।
এখনো ঘুমের রেশ রয়ে গেছে কে ফোন করলো এই সাত সকালে?

বিরক্তি তে ফোন রিসিভ করে কানে তুলতেই ওপাশ থেকে সালাম দিয়ে বলে উঠলো
―সালাম সাহেব,আমি রাশেদ।

ট্রাক ড্রাইভার ছেলেটি তাকে কল করেছে ভাবতেই সব ঘুম উধাও হলো,লাফিয়ে উঠে বসে দ্রুত ফ্রেস হতে ওয়াশরুমে চলে গেলো মুহিত।
স্বর্গ সব টের পেয়েও ঘাপটি মেরে রইলো।
মিনিট দশেক পরে মুহিত রেডি হয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো।

স্বর্গের জানার কৌতূহল হলো এতো ভোরে মুহিত যাচ্ছে কোথায়?

মুহিত কে ফলো করতে সেও হাত মুখ না ধুয়ে স্লিপিং ওয়ার এর সাথে চোখে কালো সানগ্লাস,আর মাস্ক পরে নিলো।
মনে মনে বললো―
ফলো হিম।

আর্মি জিপ নিয়ে মুহিত একটা রাস্তা ধরেছে।
মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে স্বর্গ একটা ট্যাক্সি নিয়েছে হোটেলের সামনে থেকে।
একটা চা বাগানের সামনে এসে মুহিত জিপ রেখে নেমে গেলো, স্বর্গ ও গাড়ি থামিয়ে ভাড়া মিটিয়ে নেমে গেলো।
তিনটা রাস্তা তিন দিকে গিয়েছে,চারপাশে আঁকাবাঁকা টিলা ,ঘন চা বাগান আর পাহাড়,
মুহিত কোন রাস্তায় গেছে স্বর্গ গুলিয়ে ফেললো।
তবুও মনে সাহস সঞ্চয় করে অপু,দশ, বিশ খেলে মাঝখানের রাস্তা দিয়ে পথ ধরলো।

*****
মুহিতকে রাশেদ দেখা করতে বলেছে এই পাহাড়ে,গুরুত্বপূর্ণ কথা সারবে তাই।তাড়াহুড়ো তে মেজর আদ্রিয়ান কে বলতে ভুলে গেছে মুহিত,অবশ্য টেক্সট করে লোকেশন পাঠিয়ে দিয়েছে,এসে যাবে তারাও।
কিছুক্ষণ হাটতেই কাঙ্ক্ষিত পাহাড়ের সন্ধান পায় মুহিত,জায়গাটা শহর থেকে পঁচিশ কিলোমিটার দূরে।বেশি মানুষের আনাগোনা নেই।কারন চা বাগান টা চা কালেক্ট করার অবস্হায় নেই।

অনেক খুজাখুজির পর রাশেদের সন্ধান পাওয়া গেলো,
ছেলেটি যতটা উচ্ছাস নিয়ে মুহিত কে ফোন করেছিলো ততোটাই বিরস লাগছে এখন তাকে।

ছেলেটি মুহিত কে নিয়ে বিভিন্ন কথার ছলে পাহাড়ের উপর উঠার রাস্তা ধরলো।
মুহিত ও কিছু বাছবিচার না করে মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় তাকে অনুসরণ করতে লাগলো।

হাটতে হাটতে হাঁপিয়ে উঠলো মুহিত,পাহাড়টি ভূমি থেকে প্রায় সাত থেকে আটশত মিটার উঁচু হবে।
আশরাফ চৌধরী সম্পর্কে বিভিন্ন কথা শুনতে শুনতে অনেকটাই উপরে উঠে গেছে তারা।
হঠাৎ মুহিতের মনে সন্দেহ দানা বাধে।আর উপরে উঠতে চায়না মুহিত।
প্রতিশোধ পরায়নতা এতোটা অন্ধ করে ফেলেছে তাকে?

একটা অচেনা,অজানা ,জায়গা,তারমধ্যে অপরিচিতের সাথে এতটা পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে গেছে?

হঠাৎ ই স্বর্গের স্বপ্নের কথা মনে পড়তেই বুক ছ্যাত করে উঠলো মুহিতের।

হঠাৎ আকাশে কালো মেঘ আর গুড়গুড় শব্দ শোনা গেলো।
বিদ্যুৎ চমকানোর আওয়াজে ভীত হলো মুহিত।কিন্তু বাইরে প্রকাশ করলো না।

হঠাৎ ছেলেটি কান্না জড়িত কন্ঠে বলে উঠলো―
“”সাহেব আমারে মাফ করবায়ন, আমি আমার পরিবার বাঁচানের লেইগা আপনেরে মৃত্যু মুখে ঠেইলা দিলাম।
বলেই ছেলেটি চোখের জল মুছে পাহাড়ের উপরে তাকালো।
পাহাড় এর চূড়া থেকে একজন কালো কাপড় পরিহিত লোক দেখা যাচ্ছে যার চোখ মুখ সব ঢাকা।
মুহিত অবস্থা বেগতিক দেখে পাহাড় থেকে দৌড়ে নামতে চাইলো কিন্তু লোকটি মুহিতের বুকে গুলি করে দিলো।।

বুকে হাত দিয়ে হাটু মুড়ে বসে পড়লো মুহিত,তার চোখ দিয়ে জল ঝড়ছে,গলগল করে বের হওয়া তাজা রক্ত ভিজিয়ে দিলো মুহিতের শার্ট,হাটু,পাহাড়ের মাটি।
হঠাৎই মাথার উপর আকাশে একটি চিল চক্রাকারে ঘুরতে লাগলো আর ভয়ঙ্কর সুরে ডাকতে শুরু করলো।
মুহিতের স্বাস রোধ হয়ে আসছে,দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে।

হায় নিষ্ঠুর নিয়তি,জীবনে কোনো সুখ ই আমার জন্য লিখলে না?
স্বর্গের কান্না ভেজা চেহারা চোখের সামনে ভেসে উঠলো মুহিতের।মেয়েটি জানতেও পারলো না তার স্বামী পৃথিবী থেকে বিদায় নিচ্ছে।
নরম মনের পাগল মেয়েটা কিভাবে সহ্য করবে নিজের সদ্য বিয়ে করা স্বামীর অকাল মৃত্যু?

আর মা!
মা কি বাঁচবে আমার মৃত্যুর খবর শুনে?
এমন কঠিন জীবন দিয়ে কেনো তাদের সৃষ্টি কর্তা এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছে?
তারা সৎ,নিষ্ঠাবান এটাই কি তাদের অপরাধ?

শরীর আর সায় দিচ্ছে না,চোখ ভরে ঘুম আসছে।
লোকটি বিদঘুটে শব্দে হাসছে,হাসতে হাসতে মুহিতের কাছে এসে শার্টের কলারে ধরে দাঁড় করালো।
লুটিয়ে পড়তে চাইছে মুহিত,কিন্তু লোকটির এক হাতেই বহুত শক্তি।
মুহিতের মতো আশি কেজি একজন মানুষকে সামান্য কলারে ধরে দাঁড় করিয়ে রেখেছে সে।
লোকটি হাসি থামিয়ে দাঁত পিষে বলে উঠলো
―কোথায় গেলো তোর বাহাদুরি মেজর মুহিত ওয়াসিফ?
আমি যদি আগেই জানতাম তোর বাপের আরো একজন ছেলে আছে ,তাহলে তোর ছোট ভাইয়ের মতো তোকেও পাতাল থেকে খুঁজে হলেও অস্তিত্ব মিটিয়ে দিতাম।

আজ তোকে দেখাবো আমার সাথে লড়ার পরিণাম,যেমন তোর বাপকে দেখিয়েছিলাম।
―আরেহ, তোর বাপকে পিস পিস করে কুপিয়েছি আমি।
কি ভেবেছিস তুই?
সিলেট এসে আমার নামে প্রমান জোগাড় করে জেল খাটাবি আমাকে?
আমার চোখ ফাঁকি দেয়া এতই সোজা?
কি পারলি?
ঠিক ধরে ফেললাম তোকে।
অনেক চেষ্টা করেছি তোকে বাগে আনতে,আজ সফল হলাম বলেই রাগে খড়খড়ে কন্ঠে বলে উঠলো―
“”বন্দুকের গুলির চাইতে কোপানোর হাত ভালো আমার!
কেনো জানিস?
এক কালে কসাই ছিলাম আমি!

― কসাই।
আহমেদ কসাই।
গরু আর মানুষ দুটোই খুব ভালো কাটতাম।

বন্দুকের হাত নয় আমার,চাকু,চাপাতি, চপার এসব ভালো চলে বুঝেছিস??
মরবি ই যখন মরার আগে আমার চেহারা টা দেখে মর।
বলেই মুখের কাপড় সরালো।

আশরাফ চৌধুরীর এমন ভালো মানুষির আড়ালে হিংস্র রূপ মুহিতের চোখে জলের সমাগম করলো।মুখ দিয়ে কিছুই প্রকাশ করতে পারলো না।তার বাবাকে দেয়া প্রতিশ্রুতি সে রাখতে পারলো না।
―গুড বাই মেজর!
―ওপারে ভালো থাকিস,বহুত দৌড় করিয়েছিস আমাকে তুই

বলেই পাহাড় থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো মুহিত কে।

এমন মৃত্যু দিলাম তোকে তোর বাপ ভাইয়ের মতো জানাজাও পেলিনা।জঙ্গলের পশুর খাদ্যে পরিণত হ শালা চুতিয়া বলেই হাসি থামিয়ে চোখ মুখে রাগ এনে ফুঁসতে থাকলেন।

আর ট্রাকড্রাইভার কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো―
তুই আমার কোনো কাজের ই নস,যখন তখন মুখ খুলে দিবি সুযোগ পেলে,তোকে আর ভরসা করা যাচ্ছে না।

তুই ও মেজর এর সাথে ওপারে যা।
ছেলেটি ভয়ে পাহাড় থেকে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইলে আশরাফ চৌধুরী তার শীর্ন দেহ খানা ধরে ফেলে এক থাবায়।
গুলি ছুড়ে দেয় ছেলেটির পেটে।
ছেলেটি লুটিয়ে পড়ে আশরাফ চৌধুরীর পায়ে ঝাপটে ধরে।আশরাফ চৌধুরী ছেলেটির হাত পিষে দিয়ে চলে যায়।
ছেলেটি মাটিতে শুয়ে কাতরাতে থাকে।

―――――――
মেজর আদ্রিয়ান আপনি এখানে?
হঠাৎ ই গহীন পাহাড়ে নিজের নাম শুনে চমকে উঠে আদ্রিয়ান, পাশেই একটি মেয়ে স্লিপিং ড্রেস আর বড় কালো চশমা,মাস্কের সহিত মুখ ঢেকে দাঁড়িয়ে আছে।বিদঘুটে লাগলো আদ্রিয়ান এর কাছে।
স্বর্গ মাস্ক খুলে নিজের পরিচয় দিতে ই চিনে ফেললো আদ্রিয়ান।
বিনয়ের সহিত বললো
―জি ম্যাম মেজর আমাকে এখানে আসতে বলেছে,যদিও একটু লেট করে ফেলেছি।
চলুন যাওয়া যাক বলে পায়ের গতি বাড়ালো আদ্রিয়ান।

কাঙ্ক্ষিত পাহাড়ের নিকট এসে স্বর্গ কে উদ্দেশ্য করে আদ্রিয়ান বলে উঠলো
―ম্যাম আমি উপরে উঠবো আমার কাজ আছে আপনি অপেক্ষা করুন।
পাহাড় টির দিকে তাকাতেই স্বর্গের স্বপ্নের সেই পরিচিত পাহাড়ের মতো মনে হলো।
হঠাৎই বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো স্বর্গের।ভয়ে বমি বমি ভাব হচ্ছে তার।
আদ্রিয়ান কে ফেলেই সে পাহাড়ে উঠতে লাগলো।
ভেতর থেকে কেমন একটা অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে থেকে থেকে।

চল্লিশ মিনিট ওঠার পর স্বর্গ হাঁপিয়ে উঠলো।কতো উঁচু পাহাড়?আর মুহিত কোথায়?

মেজর আদ্রিয়ান ফোন চেক করে দেখলেন নেটওয়ার্ক নেই।জোরে জোরে ডাকতে শুরু করলেন
―মেজর মুহিত!
―মেজর মুহিত?

স্বর্গ এবার কেঁদে ফেললো।তার স্বপ্ন কি অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে সত্যি হতে যাচ্ছে তবে?
ভেতর থেকে শক্তি সঞ্চয় করে
ছোট ছোট গাছ ধরে ধরে আবার পাহাড়ের চূড়ার দিকে উঠতে শুরু করলো।
আরো বিশ মিনিট হাঁটার পর চোখের সামনে রক্তাক্ত অবস্থায় একটি ছেলেকে গোঙাতে দেখে চিৎকার করে উঠলো স্বর্গ।
মেজর আদ্রিয়ান দৌড়ে ছেলেটির কাছে গিয়ে আঁতকে উঠলো।

মেজর আদ্রিয়ান সমানে ছেলেটিকে ঝাকাচ্ছে আর প্রশ্ন করে যাচ্ছে মুহিত কোথায়?সেই তো মুহিত কে কল করে এখানে আসতে বলেছে।তাহলে এরকম অবস্থা কেনো তার?

ছেলেটির প্রতি স্বর্গের কোনো এটেনশন নেই।
সে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে ডেকে যাচ্ছে
মুহিত,মুহিত!

দিকবিদিক শূন্য হয়ে গেলো স্বর্গ।

ছেলেটি বহুত কষ্টে হাত ইশারা দিয়ে কিছু বোঝানোর চেষ্টা করলো।
স্বর্গ যা বোঝার তা বুঝে নিলো।অনেক উঁচু এই পাহাড়ের যেই সাইড টা ছেলেটি নির্দেশ করেছে সেখানে একটি খাল ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
স্বর্গ পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে বলে উঠলো
―প্লিজ মেজর আদ্রিয়ান আর্মি রেসকিউ টিম কে কল করুন।কেউ মুহিত কে নিচে ফেলে দিয়েছে
বলেই মাটিতে হাটু মুড়ে বসে কাঁদতে লাগলো।

একদিকে এই আহত ছেলেটি অন্যদিকে স্বর্গ।কাকে রেখে কাকে ধরবে আদ্রিয়ান?
এই মুহূর্তে তার নিজেকে পৃথিবীর সবচাইতে অসহায় ব্যাক্তি মনে হচ্ছে।
মেজর মুহিতের চিন্তায় তার কান্না এসে যাচ্ছে।
তার মধ্যে এই রক্তাক্ত ছেলেটির গোঙানি।
অনেক প্রতিকূল পরিবেশে যুদ্ধ করে মিশন শেষ করে দেশে ফিরেছে আদ্রিয়ান।কখনো এমন ফিল হয়নি।তবে আজ কেনো এত ভেঙে পড়ছে সে?
নাহ তাকে শক্ত হতে হবে।নিজের ডিউটি তাকে শতভাগ পালন করতে হবে।
নিজেকে স্বাভাবিক করে,ছেলেটির ক্ষত ভালো করে লক্ষ করলো আদ্রিয়ান।কোনো আনাড়ি হাতের গান শট মনে হচ্ছে।ছেলেটি সাময়িক জ্ঞান হারালেও প্রাণে বাঁচানো যাবে।

আদ্রিয়ান স্বর্গের উদ্দেশ্যে বললো
―ম্যাম নিজেকে শক্ত রাখুন,ছেলেটিকে বাঁচানো আমার ডিউটি।আমি ওকে নীচে নিয়ে যাচ্ছি,আর এখানে নেটওয়ার্ক নেই।
রেসকিউ টিম কে কল করতে হলে নীচে নামতে হবে।

প্লিজ আমার সাথে নীচে নেমে আসুন।

ছেলেটিকে এক ঝটকায় কাঁধে তুলে ফেললো আদ্রিয়ান,এখানে দ্রুততার সাথে কিছুই করা যাবেনা।যা করার সাবধানে করতে হবে।
একটু অসতর্ক হলেই নির্ঘাত পরপার।

ছেলেটিকে নিয়ে ধীরে ধীরে পাহাড়ের গাছ ধরে ধরে নামতে লাগলো আদ্রিয়ান।

দেড় ঘন্টা পর নিচে নেমে এলো তারা ততক্ষনে ছেলেটি জ্ঞান হারিয়েছে।
অদ্রিয়ানের জিপের কাছে আসা মাত্র ফোনে নেটওয়ার্ক এলো।
সাথে সাথে আদ্রিয়ান ডায়ালপ্যাড থেকে নম্বর ডায়াল করে দ্রুত কল লাগালো

―হ্যালো রেসকিউ টিম?
―ইটজ মেজর আদ্রিয়ান আভিয়াজ–

#চলবে।

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#বোনাস_পর্ব
#সারিকা_হোসাইন
মুষলধারে বৃষ্টি পরেই যাচ্ছে থামার নাম নেই,আকাশ কালো মেঘে ঢেকে আছে মাঝে মাঝে বাজ পড়ছে বিকট শব্দে।এরূপ বৈরী আবহাওয়া তে পাহাড় টাকে ভুতুড়ে মনে হচ্ছে।আর্মিদের বুটের চাপে পাহাড়ি লালচে মাটি গলে গলে যাচ্ছে।

আর্মির রেসকিউ টিম দুটো হেলিকপ্টার দিয়ে সমানে পুরো পাহাড় চক্কর কেটে যাচ্ছে।প্রায় দুশো সোলজার পুরো পাহাড় তল্লাশি চালিয়েও কিছুই পেলো না।

কয়েকজন সোলজার মিলে খালের পাশে যাবার জন্য জন্য প্রস্তুতি নিলো।
আদ্রিয়ান নাফিজ মাহমুদ কে ফোন করে সব কিছু জানালে তিনি হেলিকপ্টার সহযোগে দ্রুত এসে পড়েন।
মেয়ের এহেন বিধস্ত অবস্থা দেখে গোপনে চোখের জল মুছে ফেলেন নাফিজ মাহমুদ।

স্বর্গের অবস্থা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নেই।কাঁদতে কাঁদতে তার চোখের জল শুকিয়ে গিয়েছে।ফ্যালফ্যাল চোখে বিবর্ণ মুখে সবকিছু দেখে যাচ্ছে শুধু।
দুটো ক্যাপ্টেন মেয়ে তাকে সামলে রেখেছে।

ঘন্টা খানেক পর দুজন সোলজার কাঁদাযুক্ত পায়ের একটা জুতা আর ভাঙা স্মার্ট ওয়াচ নিয়ে ফিরে আসলেন।

এগুলো যে মুহিতের চিনতে এক সেকেন্ড ও সময় লাগলোনা স্বর্গের।
সোলজার এর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে জুতা আর ঘড়ি বুকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো।
কাঁদতে কাঁদতে এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।

নাফিজ মাহমুদ মেয়েকে কিভাবে সামলাবেন আর বোনকে কি জবাব দিবেন এটা ভেবেই তার বুকে ব্যাথা শুরু হচ্ছে থেকে থেকে।

মেজর অদ্রিয়ান একটি জিপার ব্যাগে ভরে ফেললো মুহিতের জিনিস গুলো।
সারা দিনের তল্লাশি চালিয়ে রিক্ত হাতে ফিরে চললো রেসকিউ টিম।
নিকটস্থ আর্মি ক্যাম্পে স্বর্গকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হলো।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসায় আজকের মতো আপাতত তল্লাশি শেষ করতে হলো,কাল সকালে আবার চেষ্টা চালাতে হবে।

―――――-;
নামিরার লেবার পেইন উঠেছে সকাল থেকে,তাকে হসপিটাল এ আনা হয়েছে।ওটি রুমে নার্স আর ডক্টর নামিরার পাশে রয়েছে।

সোহাগ থেকে থেকে শুধু ঘেমে অস্থির হয়ে যাচ্ছে,বেসিনে বার বার চোখ মুখ ধুয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে।
মিসেস তারিন তসবিহ পড়ছেন,
আধ ঘন্টা পরেই বাচ্চার কান্নার আওয়াজ পাওয়া গেলো।
সোহাগ যেনো আরো উন্মাদ হয়ে গেলো
তার একটাই চিন্তা
―নামিরা ঠিক আছে তো?

কিছু সময় পর একটা নীল টাওয়েল এ মুড়িয়ে বাচ্চা টিকে নিয়ে একজন নার্স সমেত ডক্টর বেরিয়ে এলেন।
সোহাগ কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন
―কংগ্রাচুলেশন্স মি,সোহাগ।
―ইটজ এ বয়।
ইউর ওয়াইফ ইজ আউট অফ ড্যাঞ্জার, ইউ ক্যান ভিজিট হার।

বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে নীরবে কেঁদে উঠলো সোহাগ।
মুকিতের মুখের আদল তার ছেলের চেহারায়।
সোহাগ বাচ্চার কপালে চুমু খেয়ে মিসেস তারিনের কাছে দিতে দিতে বলে উঠলো
―মা নিন আপনার ছোট মুকিত।
নাতির চোখে মুখে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলেন মিসেস তারিন,
চোখে তার খুশির অশ্রু কনা।
মুহিত কে খবর জানাতে নামিরার পাশে বাচ্চাকে শুইয়ে দিয়ে সোহাগের ফোন থেকে কল করলেন মুহিত এর নম্বরে।
পর পর দুবার ডায়াল করেও ব্যার্থ হলেন মিসেস তারিন।
ভাবলেন হয়তো ব্যাস্ত আছে।
এর পর নাফিজ মাহমুদের নম্বর ডায়াল করলেন ফোন তুললেন না তিনি।
চিন্তিত হয়ে বাসার ল্যান্ড লাইনে ফোন দিলেন।
সমানে রিং বেজে যাচ্ছে তনুজা ফোন তুলছেন না।
নিজের মেয়ের কপাল কি তবে খারাপ হলো এতোটা?
তার মেয়েটা কিভাবে নিজেকে গুছাবে?
স্বর্গ তো জানে মুহিত তার হবু বর,এই দাগ কিভাবে যাবে স্বর্গের মন থেকে।
তনুজার কান্না যেনো আর বাঁধ মানছে না।
টেলিফোনের কর্কশ রিং আবার বেজে উঠলো।
নিজেকে স্বাভাবিক করে ফোন কানে তুললেন তনুজা।
ভারী স্বরে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে তারিনের উৎকণ্ঠা মিশ্রিত আওয়াজ পাওয়া গেলো।
―তোমরা কেউ ফোন ধরছো না কেনো তনুজা?
তনুজা স্বাভাবিক হবার চেষ্টা করে আমতা আমতা করতে লাগলেন।
এর পর বললেন রান্না করছিলাম আপা।
মিসেস তারিন সকল কুশলাদি বিনিময় করার পর জানালেন

― নামিরার ছেলে বেবি হয়েছে
―মুহিত এলে যেনো তাকে কল করে।

―আচ্ছা আপা বলবো।আল্লাহ হাফেজ।
তনুজা ফোন কেটে দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন।

কিভাবে বাঁচবে তারিন নিজের অন্ধেরজষ্ঠী টাকেও যদি হারিয়ে ফেলেন?
সুখ কোনোভাবে তার মাকে শান্ত করে বিছানায় শুইয়ে দিলো।

******
দ্বিতীয়বারের মতো অভিযান চলছে কালা পাহাড় নামক স্থান টিতে।
মেজর আদ্রিয়ান,সিলেট ক্যাম্প এর মেজর তুষার জাওয়াদ দাঁড়িয়ে আছে স্পেশাল ফোর্সের দুটো মাল্টিপারপাস ক্যানাইনস (কুকুর)এলেক্স আর জাস্টিন কে নিয়ে।
মুহিতের ব্যাবহার করা কাপড় শুকিয়ে তাদের দৌড়াতে দেয়া হলো।
কুকুর দুটো দৌড়ে পাহাড়ের পাশে খালটিতে চলে গেলো।
সেখানে গিয়ে ঘেউঘেউ করতে লাগলো উপরের দিকে তাকিয়ে।

মেজর আদ্রিয়ান কুকুরের দৃষ্টি বরাবর দৃষ্টি তাক করে একটি বড় গাছ দেখতে পেলো।কুকুর দুটো পাহাড় বেয়ে গাছের দিকে চলে যেতে চাচ্ছে।
মেজর তুষার এলেক্স কে নিয়ে সেই গাছের কাছে গেলে কুকুর বার বার গাছে উঠার জন্য গাছ খামচে চলছে।
দুজন সোলজার এর মধ্য থেকে একজন সোলজার গাছে উঠে গেলো।
সেখানে কি আছে জিজ্ঞেস করলো আদ্রিয়ান।
সোলজার জবাব দিলো রক্ত আর শার্টের ছেড়া টুকরো স্যার।

এবার ও খালি হাতে ফিরলেন দুই মেজর।
তারা শার্টের টুকরো এনে একটি জিপার ব্যাগে রাখতে রাখতে নাফিজ মাহমুদ এর উদ্দেশ্যে বলেন
―স্যার মেজর মুহিত কমপক্ষে দুশো মিটার উপর থেকে পড়েছে,আমরা ওখানে তন্নতন্ন করে খুঁজেও কিছু পাইনি।
পাশের যেই খালটা আছে সেটা প্রচুর খরস্রোতা।
আমার মন বলছে মেজর প্রথমে গাছের উপর পড়েছে সেখানে বাড়ি খেয়ে খালটিতে পড়েছে।
গাছে উপর পড়ার কারণে তার শার্টের হাতার কিছু টুকরো কাপড় আর রক্ত গাছের ডালে পাওয়া গিয়েছে আর খালটিতে পরে থাকলেও তাকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
কারন পানির স্রোত তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে।

মেজর অদ্রিয়ানের সকল বক্তব্য শুনে মাথার ক্যাপ খুলে বগলে রাখলেন নাফিজ মাফমুদ।
মনে তার একটাই চিন্তা তার মেয়েটাও তার বোনের মতো সারা জীবন নিজেকে অপয়া দোষী সাব্যস্ত করে বেঁচে থাকবে!
আবার সেই একই অতীতের পুনরাবৃত্তি?
কোন পাপের শাস্তি এটা?

দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখের কোনে জমা জল মুছে আর্মি ক্যাম্পে ফিরে এলেন নাফিজ মাহমুদ।
স্বর্গকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে যাবেন।
আর সিলেটের আর্মি ক্যান্টনমেন্ট এর জেনারেল এর সাথে কথা বলে মুহিতের ছবি দিয়ে নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তি দিতে আর বিভিন্ন ক্যাম্প এর আর্মিদের বলে দিতে তারা যেনো মুহিতের খুজ পাওয়া মাত্র তাদের জানায়।

―――――.
স্বর্গ কোনো ভাবেই মুহিত কে না নিয়ে যাবে না এখান থেকে।তার বিশ্বাস মুহিত এখানেই কোথাও আছে কিন্তু আর্মি দের গাফিলতির জন্য তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।
স্বর্গের জেদ চূড়ান্ত মাত্রা ছাড়িয়ে গেলো।
নাফিজ মাহমুদ বুঝতে পারলেন মেয়ে মানসিক সমস্যার শিকার হচ্ছে।
জোর করে হেলিকপ্টার এ তুলে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হলেন তারা।

********
কেটে গিয়েছে সতেরো টি দিন।কোনো ভাবেই মুহিতের খবর পাওয়া যায়নি।বিভিন্ন টিভি চ্যানেল এ মুহিতের নিখোঁজ সংবাদ ই যেনো প্রধান হেডলাইন।
নামিরা ,তারিন নাফিজের কাছে ফোন করে পাগল হয়ে যাচ্ছে মুহিত কেনো ফোন ধরছে না।

নাফিজ বুকে পাথর বেঁধে চূড়ান্ত এক মিথ্যে বলে দিলেন তারিন কে
―আপা মুহিত কে হঠাৎই মিশনে যেতে হয়েছে।
ও ভালো আছে।তুমি তো জানো আফ্রিকা কেমন দুর্গম জায়গা।
ওখানে জঙ্গলে কি আর নেটওয়ার্ক আছে ?
ছয় মাস পরেই ফিরে আসবে,ওখানে আর্মি ক্যাম্প এর সাথে আমাদের যোগাযোগ আছে।মুহিত ভালো আছে।
তাকে নামিরার বাবুর কথা বলা হয়েছে, অনেক খুশি হয়েছে মুহিত।

ফোন কেটে বিছানায় ছুড়ে মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন নাফিজ মাহমুদ।
―――――
একটি ছোট বাচ্চা মেয়ে যার বয়স পাঁচ কি ছয়, গায়ের রঙ তাম্র বর্ণের,কোঁকড়া চুল গুলো খোপার মতো করে বাধা,ছোট ছোট চোখ,বোঁচা নাক,পরনে কাজিম পিন পোশাক ।
মেয়েটির নাম ডিকো।
সে খুব মনোযোগ এর সহিত অবচেতন একটি আগন্তুক কে দেখে যাচ্ছে।আগন্তুক আজ পনেরো দিন ধরে তাদের বাড়িতে আছে,

আচ্ছা উনি কখনো ঘুম থেকে উঠেনা কেনো?

বাচ্চা মেয়েটির মনে অনেক ধরনের প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।

লোকটির চেহারা তাদের মতো নয়,অনেক ফর্সা,কি সুন্দর দেখতে!

দেবতাদের মতো,আর কতো লম্বা!
―গায়ে ক্ষতের কোনো অভাব নেই তবুও যেনো চেহারায় রাজ্যের মায়া।

আচ্ছা তার গালে থুতনিতে চুল কেনো গজিয়েছে?
তার বাবা দাদার তো নেই।
লোকটিকে তার মা বাবা নদীর পাড় থেকে তুলে এনেছে।
আচ্ছা লোকটি কি দেবতা উবলাই নাংথউ?
দেবতা বলেই কি বাবা মা উনাকে এতো যত্ন করে?

#চলবে

তোমার জন্য সিন্ধুর নীল পর্ব-১৬+১৭

0

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_১৬
#সারিকা_হোসাইন

সৌম্যের সামনে অবনত মস্তকে বসে আছে পিউ।তার চোখ থেকে অনবরত টুপটাপ করে গড়িয়ে পড়ছে জল।সৌম্য নির্বাক হয়ে বসে আছে।তাকে শান্তনা দেবার মতো কোনো ভাষা তার জানা নেই।

শুধু কোমল কন্ঠে বলে উঠলো
―পিউ এভাবে কাঁদলে তো বুকে কষ্ট হয় সোনা!

কান্নার বেগ আরো হুহু করে বাড়ে পিউ এর।
একটি পেন ড্রাইভ নিয়ে সৌম্যের কাছে এসেছে পিউ।
সিক্ত নয়নে অপরাধীর ন্যায় কাঁপা হাতে পেনড্রাইভ টি তুলে দিলো সৌম্যের হাতে।

সৌম্যের কথামতো সে তার বাবার পিছনে স্পাই এর মতো লেগেছিলো এ কয়দিন।
ফিঙ্গার প্রিন্ট পাউডার কালেক্ট করে এর সাহায্যে ফোনের লক খুলতেও সক্ষম হয়েছিলো পিউ।

এরপর সে গোপন কল রেকর্ডার এপ্স চালু করে দেয় নাসের হায়দার এর ফোনে।
ওখানে সকল ধরনের কথা রেকর্ড হতো।
পিউ সৌম্যের দরকারি রেকর্ড গুলো প্রতিদিন রাতে তার বাবা নেশায় বুদ হয়ে মাতাল হলে কালেক্ট করে নিজের পেন ড্রাইভে রেখে দিতো।

আজ ও তার ব্যাতিক্রম হয়নি।
―কিন্তু এই রেকর্ড টা শুনে তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে।

“”মেজর মুহিত ওয়াসিফ কে শেষ করে দেবার প্ল্যানিং করছে তার বাবা!””

স্বর্গ কখনো যদি জানে তার বাবা তার ভালোবাসার মানুষের হত্যাকারীদের একজন।
তখন স্বর্গ কে কিভাবে মুখ দেখাবে পিউ?

নিজের বাবার প্রতি ঘেন্নায় বমি এসে যাচ্ছে পিউ এর।এতোদিন কার কাছে থেকেছে সে?

এখন পিউ বুঝতে পারছে তার মা কেনো তাদের ছেড়ে পালিয়ে গেছিলো।
অযথাই মায়ের প্রতি এতোগুলো বছর ঘেন্না পোষন করেছে।
আসল কালপ্রিট তো ওই নাসের হায়দার।

পিউ সহসাই সৌম্যের হাত চেপে ধরলো,
কান্না জড়িত কন্ঠে বলে উঠলো আমাকে তোমার কাছে নিয়ে চলো সৌম্য।
ওই রাক্ষসপুরী তে আমি আর যাবো না।
―আমাকে তোমার কাছে নিয়ে চলো।

“”ওখানে প্রতিমুহূর্তে আমার দম বন্ধ লাগে,আমার কিচ্ছু ভালো লাগেনা।সব কিছু চরম অসহ্য মনে হয়।

―প্লিজ আমার উপর একটু দয়া করো সৌম্য।

বলেই কান্নায় ভেঙে পড়লো পিউ।

সৌম্য পিউকে শান্ত করার জন্য তৎপর হলো।বিভিন্ন কথা বলে পিউকে শান্ত করার চেষ্টা চালালো।কিন্তু কিছুতেই পিউ থামছে না।

সৌম্য পড়লো আরেক বিপাকে।

একজন সেনা সদস্য হিসেবে তার বিয়ের বয়স হতে আরো মাস ছয়েক বাকী।
বাড়িতেও এখনো পিউ এর কথা বলা হয়নি।
গ্রামের সাধারণ কৃষক পরিবারের ছেলে সৌম্য।
পিউ কি পারবে নিজেকে গ্রামীন পরিবেশে মানিয়ে নিতে?

তবুও পিউকে শান্তনা দিতে সৌম্য আদুরে স্বরে বলে উঠলো এভাবে কেঁদোনা প্লিজ।
―কান্না করছো তুমি,কষ্ট পাচ্ছি আমি।
আমি প্রমিজ করছি যতো দ্রুত পারি তোমাকে আমার কাছে আনার ব্যাবস্থা করবো।
প্লিজ লক্ষিটি আর এভাবে কেঁদে আমার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ করো না।
বলেই পিউ এর মাথা তার বুকে চেপে ধরলো।

******
মিসেস তারিন স্বর্গকে চেয়েছে মুহিতের জন্য,তনুজার মুখে যেনো আর খুশি ধরেনা।
ছেলে হিসেবে মুহিতকে লুফে নিতে কে না চাইবে?
সৌন্দর্যে,ব্যাক্তিত্বে,যোগ্যতায় লাখে একটা মিলে এমন ছেলে।

নাফিজ কে যখন তারিন বলেছে তোর মেয়েকে দিবি আমাকে?

নাফিজ খুশিতে হাসতে হাসতে এক বাক্যে বলেছে আপা তুই এখনই নিয়ে নে তোর ভাতিজি কে!

মিসেস তারিন ভেবেছিলেন এমন ভাঙাচোরা পরিবারে নাফিজ হয়তো মেয়ে দিতে অস্বীকৃতি জানাবে বা মুখে সরাসরি না বললেও আকার ইঙ্গিত দিয়ে বুঝাবে।

এজন্য কিছুটা ভয় আর কিছুটা সংকোচ রেখেই তিনি আবদার টা করেছিলেন।

নাফিজ এতো দ্রুত রাজি হয়ে যাবে এটা তারিনের কল্পনার বাইরে ছিলো।

সেদিন রাতে পানি পিপাসায় ঘুম ভেঙে যায় মিসেস তারিনের।উনার কক্ষের জারে কোনো পানি ছিলো না।
দরজা খুলে যেই বাইরে বের হবেন তখন ই দেখতে পান মুহিত দৌড়ে স্বর্গের রুম থেকে বেরিয়ে আসছে।

মুহিত কে কিছু টের পেতে না দিয়ে পানি না খেয়েই দরজা লাগিয়ে দেন মিসেস তারিন।

ছেলে কেনো ওই রুমে গিয়েছে মায়ের বুঝতে এক সেকেন্ড সময় ও লাগলো না।

স্বর্গ যখন জ্ঞান হারিয়ে বিছানায় পরে ছিলো মুহিত কে মারাত্মক রকমের অস্থির দেখেই তিনি বুঝেছিলেন ছেলে ভালোবেসে ফেলেছে।

মা ছেলে মিলে জীবনে অনেক খুশি তারা হারিয়ে ফেলেছে।
গাধার মতো বাবার অর্পিত দায়িত্বের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে ছেলেটা।

মা হিসেবে কখনো কিছুই দিতে পারেননি তিনি মুহিত কে!
―,যা মুহিতের সকল গ্লানি মুছে দিতে পারে।

ভাইয়ের কাছে ভিক্ষা চেয়ে হলেও স্বর্গ কে মুহিতের কাছে এনে দেবেন এমন প্রতিজ্ঞাই তিনি মনে মনে করে ছিলেন।

কিন্তু তারা মুহিত কে এভাবে গ্রহণ করে ফেলবে উনি ভাবতেই পারেন নি।

মরার আগে ছেলেটাকে একটু গুছিয়ে দিয়ে যেতে পারলেই শান্তিতে শ্বাস ত্যাগ করা যাবে।
আমি থাকি বা না থাকি ছেলেটা তার ভালোবাসার মানুষের সাথে তো থাকবে?
মুহিতের বাবার অসমাপ্ত দায়িত্ব পালন করে দিয়ে যেতে পারলে মানুষটার আত্মা টা তো শান্তি পাবে।
মনে মনে ছেলে মেয়ে স্বামীর অতীত স্মৃতি মনে করে আনমনে অশ্রু বিসর্জন দিলেন তিনি।

ভেতরে থাকা দীর্ঘশ্বাস টাকে লুকিয়ে চোখে জমে থাকা জল মুছে ফেললেন সংগোপনে।
আজ মুকিত টা বেঁচে থাকলে কতো বড়ো হতো?
মুকিতের জন্যও একটা লাল টুকটুকে বউ আনতে হতো!
নামিরার ছোট বেবীটাকে দেখে কেমন রিয়াকশন হতো মুকিতের?

আহ, এসব ভাবলে বুকে ব্যাথা হয়,কষ্ট হয় প্রচুর।আমার ছোট বাচ্চাটা।
―আমার মুকিত !
আর পারলেন না এসব ভাবনা ভাবতে মিসেস তারিন।
হৃদযন্ত্র টা সায় দেয়না আর এসব ভাবলে।নিষ্ঠুরের মতো পীড়া দিতে থাকে।

★★★★

তনুজা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্বর্গের দিকে।
মেয়ের ঠোঁট কিভাবে এতখানি কেটে গেলো সেটাই তার বোধগম্য হচ্ছে না।
এদিকে জ্বরটাও কমছে না।মেয়েটার খালি বিপদের উপর বিপদ যাচ্ছে।
তনুজা একবার শুনেছিলেন গ্রাম্য মহিলাদের কাছে
―বিয়ের আগে যেসব কুমারী মেয়ের অসুখ বিসুখ,বিপদ আপদ লেগেই থাকে,তাদের যদি দ্রুত বিয়ে দেয়া হয় তাহলে সমস্ত বিপদ কেটে যায়।
উনি জানেন এসমস্তই কুসংস্কার।
কিন্তু মায়ের মন বলেও তো কথা।

তাই তিনি মনে মনে ভাবলেন যতো দ্রুত পারা যায় মেয়েকে মুহিতের গলায় ঝুলিয়ে দেবেন

মনের চিন্তা সরিয়ে স্বর্গের উদ্দেশ্যে বলে ফেললেন তনুজা
― ঠোঁটে ব্যথা কিভাবে পেলিরে বাবা?

―মায়ের কোলে মাথা রেখে গুটিসুটি মেরে শুয়ে ছিলো স্বর্গ।

মায়ের এহেন প্রশ্নে ভড়কে না গিয়ে সুন্দর ভাবে বলে দিলো

–―রাতে জ্বরের ঘোরে ওয়াশ রুমে যেতে নিয়েছি অমনি ওয়ালে বাড়ি খেয়েছি মা।

―চিন্তা করো না,ওয়েন্টমেন্ট লাগালেই ভালো হয়ে যাবে।

বলেই মুখ টিপে হেসে উঠতে চাইলো কিন্তু ঠোঁটের ঘায়ে টান লাগায় আউচ্ শব্দ করে উঠলো।

★★★★

জুন মাস বছরের সবচেয়ে উত্তপ্ততম মাস।আকাশে ঝকঝকে আকাশি মেঘের ভেলা সাথে আগুনসম সূর্যের তেজ।
কোনো ফাঁকফোকর গলিয়ে ধরনীতে বাতাসের আগমন হয় না।
ঘরের বাইরে বের হলেই মনে হয় যেনো গায়ে ফোস্কা পড়ে গেলো।
একটু রোদে দাঁড়ালেই পিপাসায় গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যায়।

মুহিতের জলপাই রঙা আর্মি জিপটা নিয়ে মুহিত নাফিজ মাহমুদের বাংলোর সামনে অপেক্ষা করছে।আজ মিসেস তারিনের অস্ট্রেলিয়া যাবার ফ্লাইট।
আরো বিশ মিনিট আগে মুহিত মা কে তাড়া দিয়ে গাড়িতে উঠে বসে আছে।অথচ তার মায়ের কোনো খবর নেই।গরমে আর সূর্যের তাপে মুহিতের মাথাও গরম হয়ে যাচ্ছে।

মেয়ে মানুষের এই এক দোষ।
কথার পর্বই শেষ হতে চায় না তাদের ।সময় নিয়ে একদম তাদের কোনো মাথা ব্যাথা নেই।
হাতে থাকা স্মার্ট ওয়াচ টা বার বার টাচ করে করে সময় দেখে নিচ্ছে মুহিত।বিরক্তিতে মুখ দিয়ে ” চ” সূচক শব্দ করে জিপ থেকে নেমে দাঁড়ালো।
তার জানার অনেক আগ্রহ জাগলো এতো সময় কি করছে উনি ভেতরে।

_________

মিসেস তারিন খুশি খুশি মুখ নিয়ে তনুজার হাতে ধরে বিদায় নিচ্ছেন,তনুজা কেঁদে ভাসাচ্ছেন।
নাফিজ মাহমুদ বিরক্ত মুখে তাকিয়ে আছেন সহধর্মিনী তনুজার পানে।
অযথা কান্নার মানেই বুঝতে পারছেন না তিনি।
সকাল থেকে এই মহিলা কে ফ্যাচ ফ্যাচ করে কান্না করতে দেখছেন তিনি।
তনুজা কোমল মনের মানুষ,সবাইকে একদম হৃদয়ের মধ্যে খানে বসিয়ে রাখে।
তাই বলে এতো কান্না করতে হবে?
মনের বিরক্তি আর ধরে রাখতে পারলেন না মুখ দিয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠলেন―
―আপা কি সারা জীবনের জন্য যাচ্ছে নাকি তনুজা?
যাচ্ছে তো মাস তিনেক এর জন্য।আর তার মেয়ের কাছে যাচ্ছেন।
অস্থানে তো যাচ্ছে না।
তুমি কান্না বন্ধ করো, না হলে আমি কিন্তু রেগে যাচ্ছি।

মিসেস তারিন তনুজার চোখের জল মুছে দিয়ে বললেন
―এতো কোমল কেনো তুমি তনু?
―আপা কিছুদিন পরই তো ফিরে আসবো।মনে কষ্ট নিও না।

চোখের জল মুছে তনুজা মিসেস তারিন কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন―
নিজের যত্ন নিবেন আপা, একদম খাবারে অনীহা করবেন না।
ওখানে নামিরা তো বাবুকে নিয়েই ব্যাস্ত হয়ে যাবে।আপনাকে আপনার নিজের ই সবকিছু খেয়াল করে চলতে হবে।

মিসেস তারিন স্বর্গের কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে থুতনি ধরে বললেন
―ফিরে এসেই তোমাকে আম্মা বানিয়ে আমাদের ঘরে নিয়ে যাবো।
আজেবাজে চিন্তা একদম করবেনা আম্মা।
এসে যেনো দেখি খেয়েদেয়ে একদম গুলুমুলু হয়ে গেছো।
ঠিক আছে?

স্বর্গের মনে হয় মিসেস তারিন কে আল্লাহ মুখে মধু দিয়ে পাঠিয়েছেন এই দুনিয়ায়।
না হলে একটা মানুষের কন্ঠ ,কথা বলার ধরন এতো মিষ্টি হয় কি করে?

মুহিত দরজায় দাঁড়িয়ে সবকিছু পর্যবেক্ষণ করছিলো।এর পর রুমে প্রবেশ করে মাকে শুধালো――
―মেয়ের কাছে যাবার ইচ্ছে নেই?
―দেখো কটা বাজে?
তোমার ফ্লাইটের টাইম হয়ে যাচ্ছে,দ্রুত বের হও।
ভাবছো পনেরো মিনিটের রাস্তা এজন্য ঢিলেমি করছো?
ইমিগ্রেশনে তোমার কাজ আছে মা-
তাড়াতাড়ি চলো বলেই মুহিত নাফিজ মাহমুদ কে নিয়ে বেরিয়ে গেলো।

******
শুনশান একটি জঙ্গল,কোনো মানুষের আনাগোনা নেই।মাঝে মাঝে পাখিদের কিচিরমিচির ডাক শোনা যাচ্ছে।চারপাশে বিশাল উঁচু উঁচু পাহাড়।
মুহিত আর স্বর্গ হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটি পাহাড়ের চূড়ায় এসে পৌঁছালো।

হঠাৎ ই পাহাড়ের চূড়া থেকে মুহিত কে কেউ ধাক্কা দিয়ে খাদে ফেলে দিলো।

,স্বর্গ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে কিন্তু নড়ার শক্তি পাচ্ছে না।মনে হচ্ছে কেউ তাকে চেপে ধরে আছে।

গলা দিয়ে আওয়াজ ও বের হচ্ছে না।

মুহিত কে ধাক্কা দিয়ে খাদে ফেলে লোকটি ভয়ংকর ভাবে হো হো শব্দ তুলে হেসে যাচ্ছে।

স্বর্গ কোনো কথাও বলতে পারছে না,কারো কাছে সাহায্য ও চাইতে পারছে না।
শুধু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে।
অনেক কষ্টে গলায় শক্তি সঞ্চয় করে স্বর্গ চিল্লিয়ে উঠলো

“”মুহিত!

নিমিষেই ঘুম ছুটে গেলো স্বর্গের, সে এখনো কাঁদছে।শরীর ঘামে ভিজে একাকার।
এসির পাওয়ার উনিশ।
তবুও গরমে পিপাসায় তার গলা শুকিয়ে মরুভূমির ন্যায় হয়ে উঠলো।

ভয়ে বুক দুরু দুরু করে কাঁপছে।ঘড়িতে সময় দেখে নিলো দেড়টা বাজে।

কোনো কিছু চিন্তা না করেই মুহিতের রুমের উদ্দেশ্যে হাঁটা দিলো।

――――――
মুহিত ল্যাপটপে নিজের যাবতীয় কাজকর্ম গুছিয়ে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো।
ভোর হতেই তাকে সিলেট যেতে হবে।সেখানে তিন দিনের জন্য থাকতে হবে।
মুহিতের সাথে মেজর আদ্রিয়ান আভিয়াজ ,ও দুজন ক্যাপ্টেন যাবে।
সৌম্য যেতে পারবেনা।
সে ছুটিতে আছে।

তাদের কাছে গোপন সূত্রে খবর এসেছে সিলেট বর্ডার থেকে পাথরের গাড়িতে করে বিভিন্ন ড্রাগস বাইরের দেশ থেকে ঢাকায় সাপ্লাই দেয়া হচ্ছে।
মুহিত জানে এটি কার কাজ।
এজন্য প্রমান জোগাড় করতে নিজেই যাবে সে।
যেভাবেই হোক,যে কোনো প্রকারে আশরাফ চৌধুরী সম্পর্কে সকল তথ্যই মুহিত বের করে আনবে।
তাকে যদি পাতালেও যেতে হয় ,সেখানেও সে যেতে প্রস্তুত।

সব কিছু গুছিয়ে কেবলই মুহিত গায়ের টিশার্ট টা খুলে হ্যাঙ্গারে ঝুলাবে।
এমন সময়ে স্বর্গ এসে পিছন থেকে মুহিত কে ঝাপটে ধরে ফুঁপিয়ে উঠে।
এতো রাতে স্বর্গের উদ্ভ্রান্তের ন্যায় কান্নায় ভয় পেয়ে যায় মুহিত।

মামা মামী কেউ বাড়িতে নেই,হঠাৎ মামীর বাবা অসুস্থ হয়ে যাওয়াতে রাতে তারা উনাকে দেখতে গিয়েছেন,সকালে ফিরবে।
স্বর্গ অসুস্থ বলে তাকে রেখে গিয়েছে।

এখন যদি স্বর্গের অসুস্থতা বাড়ে, মুহিত একা কিভাবে সামলাবে?

সমস্ত চিন্তা বাদ দিয়ে স্বর্গকে সামনে এনে বিছানায় বসালো মুহিত।

বিচলিত হয়ে জানতে চাইলো
পেট ব্যাথা হচ্ছে বাবু?
কোথায় কষ্ট হচ্ছে আমাকে বলো!
এক্ষুনি সব ঠিক করে দিচ্ছি
প্লিজ জান এভাবে কেঁদোনা সহ্য করতে কষ্ট হয়।

মুহিতের আদর যুক্ত কথায় কিছুটা ফুপানো কমলো স্বর্গের।
মুহিত স্বর্গের চোখের জ্বল মুছিয়ে দিয়ে হাটু মুড়ে ফ্লোরে বসে স্বর্গ কে জড়িয়ে ধরে পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে জানতে চাইলো

কি হয়েছে পাখী?হসপিটাল নিয়ে যাবো?অনেক খারাপ লাগছে?

স্বর্গ মুহিতের ঘাড়ে থুতনি রেখে ফুপাতে ফুপাতে বললো
―আমি তোমাকে নিয়ে বাজে স্বপ্ন দেখেছি!

“”কেউ তোমাকে ধাক্কা দিয়ে পাহাড় থেকে ফেলে দিয়েছে।””
“জানো আমি না তোমাকে কোথাও আর খুঁজে পাইনি!”
বলেই মুহিত কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে জোরে কেঁদে উঠলো স্বর্গ।

“”জানো আমার কতো কষ্ট হচ্ছিলো?””

তোমাকে হারালে আমি কিভাবে বাঁচবো মুহিত?

স্বর্গের স্বপ্নের কথা শুনে মুহিত স্বাভাবিক হলো,স্বর্গকে নিয়ে যেই ভয় পাচ্ছিলো সেটা কেটে গেলো।
স্বর্গকে ছাড়িয়ে,ফ্লোর থেকে উঠে স্বর্গের পাশে বিছানায় বসলো।

স্বর্গের একটা হাত মুহিতের কোলে রেখে আরেকটা হাত বুকে জড়িয়ে মুহিত বলে উঠলো―

“”তুমি বাজে স্বপ্ন দেখেছো।
অসুস্থ হলে মানুষ এমন ভিত্তিহীন স্বপ্ন দেখে।

―এই দেখো আমি সুস্থ সবল ভাবে তোমার সামনে বসে আছি।
তোমার কাছ থেকে আমাকে দূরে সরায় কার সাধ্যি?

কেউ কিছু করতে এলে তুমি তাকে ক্রসফায়ার করে দিও আমি অনুমতি দিলাম
বলেই মুহিত স্বর্গের জড়িয়ে রাখা হাতে চুমু খেলো।

আমার কিচ্ছু হবে না লক্ষীটি।
আমি যেখানেই যাই, যাই করি না কেনো!
সমুদ্রের নিচেও যদি যাই তোমার জন্য ফিরে আসবো!

“”হ্যাপি??

স্বর্গ মুহিতের চোখের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ভেঙে বললো
―তিন সত্যি বলো!

স্বর্গের কিউট ফেস টি দেখে মুহিত হেসে ফেললো এবং পর পর তিনবার ঠোঁটে চুমু একে বললো
―এক সত্যি, দুই সত্যি, তিন সত্যি।

স্বর্গ বাচ্চাদের মতো করে বলে উঠলো আমি তোমার সাথে ঘুমাবো,আমার ভয় লাগছে।

মুহিত কিছুক্ষন মৌন রইলো
এর পর স্বর্গকে বুকে টেনে নিয়ে বললো
একজন ছেলে আর একজন মেয়ে বিয়ের আগে এক বিছানায় ঘুমুলে দুর্ঘটনা হয়ে যাবে রে পাগলী।

আমি চাইনা আমার জন্য তোমার কোনোক্ষতি হোক।

স্বর্গের চুলে বিলি কাটতে কাটতে মুহিত বললো
―কি বলেছি বুঝতে পেরেছেন ম্যাডাম?

নাহ বুঝিনি।

স্বর্গ নাছোড়বান্দা।
সে এই রুমেই ঘুমাবে।

অগত্যা না পারতে মুহিত রাজি হলো।
মুহিত নিজের কাঁথা বালিশ নিয়ে ফ্লোরে বিছানা করতে নিলেই সেখানে স্বর্গ বাধা প্রদান করে বলে উঠলো
―তোমার বুকে ঘুমুতে চাই মুহিত,তোমার বিছানায় নয়।

বাঁকা হাসলো মুহিত।মেয়েটা তাকে ভালোই কাবু করতে জানে।
এমন জীবন সঙ্গী হলেই তো বিবাহিত জীবন মধুর হবে।

মুহিত স্বর্গের দিকে তাকিয়ে বললো
তোমার সাথে শোবো কিন্তু শর্ত আছে
উৎসুক হয়ে জানতে চাইলো স্বর্গ
“”কি শর্ত?

রুমের লাইট অন থাকবে ঠিক আছে??

বাধ্য মেয়ের মতো স্বর্গ রাজি হলো।

ঘড়ির কাটা তিনটের ঘরে।
হঠাৎই গুড়গুড় শব্দে মেঘ ডেকে ঝুম বরাবর বৃষ্টি শুরু হলো।
পরিবেশ নিস্তব্ধ, কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই।
এই দূতলা বাড়িটিতে প্রাপ্ত বয়স্ক দুজন নর- নারী ছাড়া আর কোনো প্রাণী নেই।

মানব মানবী কারোর চোখের পাতাতেই ঘুম ধরা দিচ্ছে না।
দুজন দুজনের হৃদ স্পন্দন শুনতে পাচ্ছে।

মুহিত অস্থির হয়ে যাচ্ছে বার বার।
ভেতর থেকে নিজের পুরুষ সত্ত্বা বার বার নিজের পুরুষত্ব জাহির করতে চাইছে।
মুহিত তাকে শিকল পরিয়ে বেঁধে রেখেছে।

অষ্ঠেপিষ্টে স্বর্গ দখল করেছে মুহিতের বুক,পা,হাত।

মুহিতের মাথা খালি খালি লাগছে,ভো ভো শব্দ হচ্ছে।মনে হচ্ছে গায়ে কেউ কেরোসিন ঢেলে দিয়েছে।
স্বর্গের লজ্জা জনক চোখের চাউনি, বার বার ঠোঁট কামড়ে ধরা,এলোমেলো চুল,ওয়েস্টার্ন স্লিপিং ড্রেস।
সবকিছু মুহিত কে কন্ট্রোল লেস করে দিচ্ছে।

হঠাৎই মুহিত স্বর্গকে নীচে ফেলে স্বর্গের উপরে উঠে গেলো।

স্লিপিং শার্ট এর কলার সরিয়ে স্বর্গের কাঁধে কামড়ে ধরলো।
স্বর্গ ব্যাথায় ককিয়ে উঠলো।
হুঁশে ফিরলো মুহিত, কামড়ের জায়গা থেকে মুখ সরিয়ে দেখতে পেলো ক্ষত থেকে ব্লাড বের হচ্ছে।
স্বর্গের চোখে টলমলে জল।
নিজেকে অপরাধী মনে হলো মুহিতের।

কিভাবে পারলো নিজের কলিজায় কামড় বসাতে?
রাগের চোটে ওয়ালে জোড়ছে ঘুষি বসিয়ে দিলো।

কেনো সে নিজের কন্ট্রোল ধরে রাখতে পারছে না?

কয়েকটা ঘুষি মারতেই হাত ফেটে বেরিয়ে এলো রক্ত।

স্বর্গ দৌড়ে এসে মুহিত কে জড়িয়ে ধরলো।

প্লিজ থামো!

আমার ব্যাথা লাগেনি।

―নিজেকে কষ্ট দিও না প্লিজ

চলো হাতে ব্যান্ডেজ করবে বলে মুহিতকে ছেড়ে দিয়ে নিজের রুমে দৌড়ে চলে গেলো ফার্স্ট এইড বক্স আনতে।
অল্প সময়ের মধ্যেই ফিরে এসে মুহিতকে টেনে নিয়ে বিছানায় বসালো।
স্যাভলন আর তুলার সহিত রক্ত পরিস্কার এর কাজ চালালো।
মুহিত নির্বিকার,
ওয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে সাদা ব্যান্ডেজ হাতে মোড়াতে লাগলো স্বর্গ।
মুহিত গমগমে কন্ঠে বলে উঠলো

―কাল আমাকে বিয়ে করবি জান??
#চলবে।

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#পর্ব_১৭
#সারিকা_হোসাইন

[১৮+ এলার্ট,নিজ দায়িত্বে পড়বেন,বাজে কমেন্টস করবেন না]

●●●
ঘড়ির কাটা টিকটিক করে জানান দিলো এখন সকাল ন’টা।কিছুক্ষণ আগেই তনুজা আর নাফিজ মাহমুদ বাসায় ফিরেছেন।বাবাকে কাছে পেয়েই আবদারের ঝুলি খুলেছে স্বর্গ।

―বাপী ,মেজর মুহিতের সাথে আমিও সিলেট ঘুরতে যেতে চাই। বলেই নাফিজ মাহমুদের উত্তর শোনার প্রতীক্ষায় তাকিয়ে রইলো স্বর্গ।

―নাফিজ মাহমুদ স্বর্গকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে,
মুহিত সেখানে ঘুরতে যাচ্ছে না, সে যাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ কাজে।

সেখানে স্বর্গকে নিয়ে গেলে তার কাজে ঝামেলা হবে,মুহিত বিরক্তও হতে পারে।

কিন্তু স্বর্গ যাবেই।স্বর্গ না যেতে পারলে মুহিত ও যেতে পারবে না।

এতবড় মেয়ের বাচ্চাদের মতো জেদ দেখে মনেমনে খুব বিরক্ত হলেন নাফিজ মাহমুদ।

এবার তনুজা মেয়ের পক্ষ নিয়ে বলে উঠলো―

তুমি তো দেখতেই পাচ্ছ মেয়েটা দীর্ঘদিন ধরে ঘর বন্দী হয়ে আছে।মুহিত যেহেতু যাচ্ছে মেয়েটাকেও নিয়ে যাক না।
শুধু তো সাথে করে নিয়েই যাবে,ওকে তো আর কোলে নিয়ে ঘুরতে হবে না তাইনা?

আল্লাহ তো আমার মেয়েকে জ্ঞান বুদ্ধি সব দিয়েছেন, মুহিতের কাজে ডিস্টার্ব হবে এমন কিছু সে কেনো করবে?

ঘরে বসে সারাক্ষন বোরিং হবার চাইতে একটু হাওয়া বদল করে আসুক না।

নাফিজ মাহমুদ সবই বুঝলেন,তনুজার কথাও ফেলে দেবার নয়।মেয়েটা সারাক্ষন অসহায় এর মতো শুয়ে বসে দিন কাটাচ্ছে।

কিন্তু মুহিতের যেই ব্যাক্তিত্ব,নাফিজ মাহমুদ কিভাবে এই আবদার করবেন সেটাই ভেবে পাচ্ছেন না।

হঠাৎই দূতলার সিঁড়ি বেয়ে মুহিতকে নামতে দেখা গেলো।

ধবধবে ফর্সা গায়ে নেভি ব্লু শার্ট জড়িয়েছে সাথে পড়েছে লাইট কালারের জিন্স।পায়ে সাদা স্নিকার্স।চোখে কালো রোদ চশমা।

ছেলেটা এতটাই সুন্দর,দেখলেই ফুরফুর করে মন থেকে ভালোবাসা চলে আসে।
মুহিতের এমন রূপ দেখে মনে শিহরণ জেগে গেলো স্বর্গের।পুরুষটি আজকে থেকে তার একান্ত ব্যাক্তিগত হবে।এতো সুখ কোথায় রাখবে স্বর্গ?
সুখের ঠেলায় কি সে আজ মরে যাবে?

মুহিত নীচে নেমে মামা মামীকে উদ্দেশ্য করে বললো
―আমি সিলেটে যাচ্ছি,ফিরবো তিন চার দিন পর।

তনুজা কিছুটা ইতস্তত করে মুহিতকে বলেই ফেললো
―বাবা মুহিত, স্বর্গ যদি তোমার সাথে যায় তোমার কোনো আপত্তি আছে?
না মানে ও অনেক দিন ধরে ঘরে বসে আছে,মনটাও ভালো নেই।একটু হাওয়া বদল হলে প্রকৃতি দেখলে যদি মনটা ভালো হয় এই আর কি?

মামী আসলে――

মুহিত কে থামিয়ে দিয়ে নাফিজ মাহমুদ বলে উঠলেন
―ও তোমাকে বিরক্ত করবে না।ও শুধু তোমার সাথে যাবে,ওখানে আমার এক ফ্রেন্ড আছে আমি তাকে বলে দেব স্বর্গের ঘুরাঘুরির সকল ব্যাবস্থা আমার বন্ধু করে দেবে।

মুহিত মনে মনে বিপাকে পড়ে গেলো।
“”আরেহ বন্ধুর বাসায় গেলে বিয়ে হবে কিভাবে??

“এ আবার কোনো মুসিবত হাজির হতে চাচ্ছে!

স্বর্গ মাঝে দিয়ে বলে উঠলো
আমি মেজর মুহিতের সাথেই ঘুরবো,কোনো বন্ধু ফন্ধুর বাসায় যাবোনা।

এবার মুহিত কাউকে কিছু না বলতে দিয়ে নিজেই আগ বাড়িয়ে বলে ফেললো
না স্যার কোনো সমস্যা নেই,আমি উনাকে নিয়ে যেতে পারবো,বলেই স্বর্গের উদ্দেশ্যে তাগাদা দিলো
―স্বর্গ আপনি দ্রুত রেডি হোন, একটু পরেই মেজর আদ্রিয়ান গাড়ি নিয়ে আসবে।

মনে মনে মুহিত দোয়া পড়তে লাগলো
হুহ বাবা বেঁচে গেছি,এখনই তো ভালো সাজার নাটক ছুটে যাচ্ছিলো।

বিয়ের আগেই কি শশুরের কাছে আবদার করা যায় নাকি যে,
“”আপনার মেয়েকে আমার সাথে দূরে ঘুরতে যেতে দিন??

মিনিট দশেকের মধ্যেই স্বর্গ নীচে নেমে এলো।

তার পরনে মেরুন রঙের একটি জামদানি শাড়ি,সাথে ম্যাচিং গহনা,কানের দুল।বাদামি চুল গুলো খোঁপা করা,ঠোঁটে লিপস্টিক,চোখে কাজল, মুখে হালকা প্রসাধনী।
এমন রূপে নিজের প্রানপ্রিয় উর্বশীকে দেখে হার্টবিট মিস করলো মুহিত।
কেউ দেখার আগেই চোখ সরিয়ে, মামা আসছি ,বলে আগে আগে বেরিয়ে গেলো।।

বুকের বাম পাশে চাপড়াতে চাপড়াতে মুহিত মনে মনে বললো
―এই মেয়ে তোকে খু*ন করে ছাড়বে মুহিত।রূপের আগুনে তোকে ঝলসে দেবে।
এমন আগুন সুন্দরী নিয়ে রাস্তায় গাড়ি কিভাবে চালাবে মুহিত?
যদি মুহিত হার্ট এট্যাক করে?

হঠাৎই স্বর্গের গলার আওয়াজ পাওয়া গেলো―

কেমন অভিনয় করেছি মুহিত সোনা?

মুহিত হেসে হেসে বললো
―খুব ভালো হয়েছে,খুব খুশি হয়েছি, দশে দশ।সিলেট গিয়ে পুরুস্কৃত করবো দাঁড়াও।

মুহিত যে তাকে লেগপুল করছে সেটা ভালোই বুঝতে পারলো স্বর্গ।

এজন্য দ্রিম করে মুহিতের পিঠে বসিয়ে দিলো এক ঘা।

পিঠ হাতাতে হাতাতে মুহিত বলে উঠলো গুন্ডি একটা।

সব কিছুর শোধ সিলেট গিয়ে তুলবো।মনে মনে বাঁকা হাসলো মুহিত।

এরই মাঝে জিপ নিয়ে হাজির হলো মেজর আদ্রিয়ান।
মুহিত দুটো জিপের ব্যাবস্থা করেছে।।
একটাতে সে আর স্বর্গ যাবে অন্যটায় মেজর আদ্রিয়ান আর ক্যাপ্টেন রা যাবে।

ব্যাগপত্র গাড়িতে ভরে সবাই যার যার মতো গাড়িতে চেপে বসলো।গন্তব্য সিলেট,মৌলুভীবাজার,শ্রীমঙ্গল।

――――――――

হাসপাতাল থেকে রিলিজ নিয়ে বাসায় ফিরে এসেছেন আশরাফ চৌধুরী।মিথ্যে অভিনয় করে কতোদিন বসে বসে টাকা ঢালবেন সেখানে?
তার মধ্যে কোনো কাজ ই সেখান থেকে করা যাচ্ছিলো না।

নিজের ছেলের দুরবস্থার কথা চিন্তা করে তেতে উঠলেন আশরাফ চৌধুরী।মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন
“”যার জন্য তার ছেলের এহেন দশা,তাকে জীবনের চরম শিক্ষাটাই দিবেন।
ভাবতেই কানে ফোন তুললেন

কি রে ফকিরের বাচ্চা দারোয়ান খলিল,ওই চুতিয়া মেজরের খবর বল।

ওপাশ থেকে খলিল নিজের এমন অপমানে কষ্ট পেলো।কিন্তু এটা তার সাময়িক কষ্ট।যখন টাকার চেক হাতে আসে এসব কষ্ট সেই চেকের সামনে ফিকে হয়ে যায়।

খলিল অপমান গায়ে না মেখে গদগদ হয়ে বললো
একটু আগে সিলেটের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে।
বিদঘুটে হাসলো আশরাফ চৌধুরী।
আজকেই তবে মেজরের খেল খতম হতে যাচ্ছে ?হুম?

মুহূর্তেই হাসি রাগে রূপান্তরিত হলো।
মদের গ্লাস হাতে তুলে চুমুক দিতে নিয়ে ছুড়ে ফেললেন মেঝেতে।
এই মেজরের জন্য তার অনেক কাজ আটকে রয়েছে।
যেখানে পুলিশ পর্যন্ত তাকে সমীহ করে চলে সেখানে এই দুটাকার মেজর তাকে পদে পদে নাজেহাল করে ছাড়ছে।
এই মেজরের জন্য তার যতো টাকা লস হয়েছে সব মেজরের চামড়া তুলে উসুল করবেন মনে মনে এই ভাবনা ভেবে ফেললেন আশরাফ চৌধুরী।

★★★

কাজী অফিসে বসে আছে স্বর্গ আর মুহিত।কিছুক্ষণ পরেই তারা একটি পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হবে।এর পর দুজন দুজনের সকল দূরত্ব ঘুচিয়ে ফেলবে।কেউ আঙ্গুল তুলতে পারবে না তাদের প্রতি।কোনো পাপবোধ থাকবে না।
থাকবে শুধু ভালোবাসা আর ভালোবাসা।

কিছুক্ষণ পর কাজী সমস্ত পেপার রেডি করে দুজনের উদ্দেশ্যে পান খেতে খেতে নির্দেশ দিলেন――

“”এখানে সই করুন।””

স্বর্গের যেনো আর তর সইছে না।মুহিতের ব্যাপারে সে সবসময়ই ডেসপারেট।এই মুহূর্ত থেকে মুহিত তার ব্যাক্তিগত মানুষ হবে,নিজের স্বামী,সেই সুযোগ কিভাবে হাতছাড়া করবে স্বর্গ?

কাজীর হাত থেকে পেপার টেনে নিয়ে ঘষঘস করে এক সেকেন্ডে সই করে মুহিতের দিকে এগিয়ে দিলো।
স্বর্গের এমন খসখস করে সই করতে দেখে কাজীর নাকে মুখে পানের রস উঠে গেলো।পানি খেয়েও তার কাশি কমলো না।চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে এলো।

বাঁকা হেসে মুহিত সই করে কাজীকে সব বুঝিয়ে দিয়ে স্বর্গের হাত ধরে বেরিয়ে এলো।

মনে মনে কাজী স্বর্গকে বেশরম খেতাবে ভূষিত করলো।

*********

এখানে তিন দিনের জন্য এসেছে মুহিত।স্বর্গ যদি আরো থাকতে চায় তবে মুহিত এক দিন ছুটি বাড়াতে পারবে।
এখানে প্রতিটা সেকেন্ড খুব গুরুত্বপূর্ণ।যেই কাজে মুহিত এসেছে সেটা করেই তাকে ব্যাক করতে হবে।
এখন স্বর্গকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে মুহিত কাজে বের হবে।কখন ফিরবে সে জানেনা।

বাকি দুই ক্যাপ্টেন মেজর আদ্রিয়ান কে নিয়ে জঙ্গল কটেজে উঠেছে,মুহিত নিউলি ম্যারেড প্লাস স্বর্গের কম্ফোর্টের জন্য সে গ্র্যান্ড সুলতান এ উঠেছে।
হোটেলে ঢুকতেই তাদের ওয়েলকাম ড্রিংকস দিয়ে ওয়েলকাম করা হলো।

এই হোটেল টা বড় রিসোর্ট এর মতো, ভেতরে সকল ব্যাবস্থাই আছে।সুইমিংপুল,গল্ফ খেলার মাঠ,কিডস জোন,জিম সেন্টার, বাহারি ফুলের গাছ,বিশাল বড় বড় নারিকেল গাছ সাথে পাহাড় কেটে সিঁড়ি করা রাস্তা।
সবকিছু এক নিমিষেই স্বর্গকে মুগ্ধ করে ফেললো।
কিন্তু লম্বা জার্নির জন্য স্বর্গ কে মুহিত জোর করে ধরে রুমে নিয়ে গেলো।
ধবধবে সাদা বিছানায় গোলাপের পাপড়ি ছিটানো,আর মাঝখানে গোলাপের পাপড়ি দিয়ে একটা লাভ বানানো,লাল গোলাপের স্টিক রাখা ফ্লাওয়ার ভ্যাসে।
আলফাব্যাটস বেলুন দিয়ে লিখা লাভ ইউ স্বর্গ।
সব কিছুই স্বর্গের মন ছুঁয়ে গেলো।
ভালো লাগায়, ভালোবাসায় মুহিত কে জড়িয়ে ধরলো স্বর্গ।
মুহিত স্বর্গের মাথায় হাত বুলিয়ে দ্রুত ফ্রেস হতে তাড়া দিলো।

স্বর্গ ফ্রেস হয়ে এলে মুহিত ও ফ্রেস হতে চলে যায়,ফিরে আসে মিনিট দশেক পর।এসেই পোশাক পাল্টে স্বর্গকে বিশ্রাম নিতে বলে বেরিয়ে যায়।
মিনিট দুয়েক পরেই আবার রুমে ব্যাক এসে সতর্কতা বাণী দিয়ে যায় স্বর্গকে।
―বাবু আমি সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবো,তুমি ঘুমানোর ট্রাই করো, একা একা বাইরে যেও না, কিছু লাগলে ইন্টারকমে কল করবে রিশিপশন থেকে হেল্প করবে।বলে স্বর্গের কপালে চুমু খেয়ে বেরিয়ে যায়।

জিপ নিয়ে মেজর আদ্রিয়ান কে সঙ্গে নিয়ে মৌলভীবাজার বর্ডার এ পৌঁছুলো মুহিত।এখান থেকেই তাকে গুপ্তধন খুঁজে বের করতে হবে।চারপাশে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে।বড় বড় গাছপালার জন্য জায়গাটা আরো ঘুটঘুটে লাগছে।মাঝে মাঝে দুই একটা বন্য পশু পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে।

মেজর আদ্রিয়ান আর মুহিত টর্চ জেলে দুজন দুই পাশে কিছু একটা খুঁজতে লাগলো।
মিনিট দশেক খোঁজাখুঁজি করার পর কাঙ্খিত জিনিস পেয়ে দুজনের মুখের হাসি ই প্রশস্ত হলো।
বাকী কাজ কাল দেখা যাবে।
তাড়া দেখিয়ে মুহিত হাসকি কন্ঠে বলে উঠলো――

―তো মেজর আদ্রিয়ান হোটেলে ফেরা যাক?
―সিউর মেজর মুহিত ওয়াসিফ
লেটস গো।

●●●●
আজকের রাত টা মুহিত আর স্বর্গের জন্য একটা স্পেশাল রাত হতে যাচ্ছে।
মুহিতকে স্বর্গ নিজের সব দিক থেকে হ্যাপি করে দেবে আজ।
ইন্টারকমে কল করে স্বর্গ রুমটাকে সাজানোর প্ল্যানিং করলো।সাথে নিজেকেও মুহিতের জন্য তৈরি করলো।

****
প্রচুর গাছপালা, পাহাড়,আর মেঘালয় পর্বতের প্রভাবে প্রায় ই বৃষ্টি হয় মৌলভীবাজারে।
আজকের আবহাওয়া টা খুব সুন্দর।
মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে সাথে ঠান্ডা বাতাস।

স্বর্গ পুরো রুমটা মোমবাতির আলোতে সাজিয়েছে,সাথে মুহিতের প্রিয় ফুল লাল গোলাপ আর রজনী গন্ধা।

আজ স্বর্গ নিজের মন মতো সেজেছে।তার রূপে মুহিত কে আজ ডুবে মরতে হবে।কেনো অন্য মেয়ের সাথে সেদিন কফিশপে বসেছিলো তার শোধ তুলবে আজ।

স্বর্গ কালো রঙের একটা পাতলা জর্জেট শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে স্লিভলেস ব্লাউজ পরে নিলো,সাথে ম্যাচিং করে ডায়মন্ড এর সেট পরলো।স্ট্রেইট চুলগুলো কার্লি করে ছেড়ে দিলো কাঁধের দুই পাশে।ঠোঁটে লাল রঙের লিপস্টিক, চোখের ঘন পাপড়িতে মাসকারা,মোটা করে কাজল দিয়ে ব্লাশন দিয়ে সাজ কমপ্লিট করলো।
মেদহীন কোমরে গোল্ডেন কালারের বেলি চেইন পরে নিলো।

একটু আগে মুহিত কল করেছিলো, বলেছে দশ মিনিটের মধ্যে ফিরবে।
সব কিছু গুছিয়ে রাখতেই দরজায় নকের শব্দ হলো।
দরজায় নকের শব্দে স্বর্গের বুক ধাকধাক করছে,নিশ্বাস ভারী হয়ে আসছে।তার মানে মুহিত এসেছে।
দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো স্বর্গ।
পুরো রুম অন্ধকার করে রেখেছে স্বর্গ,মুহিত স্মিত হাসলো।
তার মানে বউ স্পেশাল কিছু রেখেছে।
স্বর্গকে আসছি বলে ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে মুহিত ফ্রেস হতে চলে যায়।
স্বর্গ দিশলাই এর সাহায্যে ক্যান্ডেল গুলো জ্বালিয়ে দেয়।সুগন্ধি যুক্ত মোমবাতি তে আগুন দিতেই পুরো কক্ষ জুড়ে মন পাগল করা সুন্দর গন্ধ ভেসে বেড়াতে লাগলো।
মিনিট দশেক পর শাওয়ার নিয়ে বের হলো মুহিত।

গায়ে সাদা শার্ট আর লোজ সাদা প্যান্ট পরে বেরিয়ে এলো মুহিত।
সামনের চুল গুলো কপালে দুই এক গাছি করে পড়ে রয়েছে।
গলার নীচে থুতনিতে মুক্তার মতো বিন্দু বিন্দু পানি জমে আছে,মোমের আলোতে স্বর্গের কাছে সেগুলোকে হীরে মনে হচ্ছে।

――――
মুহিতের দিকে নেশাক্ত নজরে মুহিতের সামনে এসে দাঁড়ায় স্বর্গ।
নিজের প্রেয়সীর এমন আগুন ঝরা রূপে দিশা হারালো মুহিত।
হারিয়ে ফেললো মুখের ভাষা।

স্বর্গ মুহিতের গলা জড়িয়ে ধরে ঠোঁটে গাঢ় চুম্বন একে দিলো।
সম্বিৎ ফিরে পেলো মুহিত।
সহসাই স্বর্গের কোমর চেপে ধরলো শক্ত করে।
দখল নিলো স্বর্গের ঠোঁট।
মুহিতের সাথে তাল মিলিয়ে চললো স্বর্গ।
কাঁধ থেকে হাত চলে আসলো মুহিতের শার্টের বাটনে।
এক এক করে সব গুলো বোতাম খুলে ফেললো স্বর্গ।
মুহিত শার্ট খুলে ছুড়ে মারলো মেঝেতে।
বৃষ্টির বেগ আরো বেড়ে চললো সাথে উত্তাল হলো দুজন মানব মানবী।
স্বর্গকে এক ঝটকায় কোলে তুলে ফেললো মুহিত,শুইয়ে দিলো নরম ফুলের বিছানায়।ঝাঁপিয়ে পড়লো মুহিত স্বর্গের উপরে।
আজ কোনো বাধা নেই,কোনো পাপবোধ নেই।
আজ তারা পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ,স্বামী স্ত্রী।

স্বর্গের গলার ভাঁজে মুখ গুঁজে দিলো মুহিত,ছোট ছোট চুম্বনে ভরিয়ে দিলো গলা।
মুহিতের উষ্ণ স্পর্শে কেঁপে উঠছে স্বর্গ।

নিজের কন্ট্রোল হারালো মুহিত,হাতের বিচরণ হলো অবাধ্য।
স্বর্গের বক্ষে মুখ গুঁজে দিলো মুহিত,আস্তে আস্তে চলে এলো নাভীরন্দ্রের কাছে।উত্তপ্ত চুমু দিলো মেদহীন কোমরে।সাথে পেটে, কাঁধে,বক্ষে,পিঠে অসংখ্য লাভ বাইটস।

স্বর্গ নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারলো না।চরম আকুতি নিয়ে মাদকতার সুরে মুহিতকে আহবান জানালো স্বর্গকে সুখে ভাসাতে।

মুহিত বাধ্য দাসের ন্যায় আজ্ঞা পালনে সায় দিলো।
প্রথমবারের চেষ্টায় ককিয়ে উঠলো স্বর্গ,মুহিত স্বর্গের দিকে আহত দৃষ্টি দিয়ে সরে আসতে চাইলো।

জড়িয়ে ধরলো স্বর্গ।

ভেসে গেলো সুখের রাজ্যে,স্বর্গের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লো জল।সেই জল শুষে নিলো মুহিত।
আদিম খেলায় মত্ত হলো দুজন নর–নারী।

~~~~~~
ভোরের আলো ফুটতেই ঘুম ভেঙে গেলো মুহিতের।নিজের বাহুডোরে স্বর্গের নিষ্পাপ মুখমন্ডল দেখে মনে সুখের হাওয়া দোলা দিলো।
স্বর্গের নগ্ন পিঠ দেখে আঁতকে উঠলো মুহিত। সারা পিঠে লালচে জখমের দাগ। ,নিজের অজান্তেই কষ্ট দিয়ে ফেলেছে স্বর্গকে।মুহিতের বুক থেকে সরিয়ে স্বর্গকে বালিশে শুইয়ে দিয়ে শাওয়ার নিতে চলে গেলো মুহিত।

পানির ছোয়া লাগা মাত্রই সারা শরীর জলে উঠলো মুহিতের।
কষ্টের বদলে সুখ অনুভূতি হলো মুহিতের।
প্রশস্ত হাসলো মুহিত।
মেয়েটা তাকে যেই সুখ গত রাতে দিয়েছে এই সুখ কি মুহিত তার এই ত্রিশ বছরের জীবনে কোনো দিন পেয়েছে?

মুহিত শাওয়ার নিয়ে এসে স্বর্গকে ডেকে তুললো,গোসল করে দ্রুত রেডি হতে বললো স্বর্গকে,আজ ঘুরতে নিয়ে যাবে।
কিন্তু স্বর্গ চোখ মেলে তাকাতেই পারছেনা।
এক রাতেই কেমন চেহারা মলিন হয়ে গেছে।মুহিতের অনেক মায়া হলো স্বর্গের জন্য।
স্বর্গ বহু কষ্টে উঠতে নিলে ব্যাথায় আবার শুয়ে পড়ে।

বিচলিত হয়ে মুহিত স্বর্গের গায়ের ব্ল্যাঙকেট টান দিতেই মুখে আধার নেমে আসে।পুরো শরীর লালচে জখমে ভরে আছে।

স্বর্গকে জড়িয়ে ধরে সরি বললো মুহিত।
এক্ষুনি মেডিসিন এনে দিচ্ছি জান, খেলেই ব্যাথা কমে যাবে।
স্বর্গের কপালে চুমু দিয়ে মুহিত আবার স্বর্গকে শুইয়ে দিলো।

রুমের অবস্থা এমন হয়ে আছে যেনো ঝড়,টর্নেডো,সাইক্লোন, সব কিছু এই রুমের উপর দিয়েই বয়ে গেছে।

মুহিত সব কিছু গুছিয়ে বাইরে চলে আসলো মেডিসিন কিনতে।
সাথে মেজর আদ্রিয়ান কে ফোন দিয়ে বললো ―

―চলুন মেজর আদ্রিয়ান শিকার ধরা যাক তবে।
বলেই বাঁকা হাসলো মুহিত।

#চলবে।