Wednesday, July 30, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 149



চড়ুই নীড়ে বসবাস পর্ব-০৯

0

#চড়ুই_নীড়ে_বসবাস
#আলো_রহমান(ফারজানা আলো)
#পর্ব:৯
.
রাত আটটার মতো বেজেছে। খায়রুল সাহেব দোতলার বৈঠকখানায় বসে আছেন। উনার হাতে কাগজ কলম। বিন্তুর বিয়েতে কাকে কাকে দাওয়াত দেওয়া হবে, তার একটা তালিকা করা হচ্ছে। তালিকা ছোট রাখতে গিয়েও রাখা যাচ্ছে না। কাকে বলা হবে, কাকে বাদ দেওয়া হবে, সব মিলিয়ে দারুণ বিভ্রান্তি। শিরিন বাবার পাশে বসে আছে। সে বুঝতে পারছে না এক সপ্তাহে কিভাবে আয়োজন করা সম্ভব হবে। সে এ পর্যন্ত এগারোটা নাম্বারে ফোন করেছে। খায়রুল সাহেব আরও কিছু নাম লিখছেন। শিরিন অস্থির হয়ে বলল,
“বাবা! তাড়াতাড়ি করো। এরপর আরও অনেক কাজ আছে।”
খায়রুল সাহেব লেখা বন্ধ করলেন। মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আবার কি কাজ?”
শিরিন হতাশ ভঙ্গিতে বলল,
“কি কাজ মানে? বিয়েতে, গায়ে হলুদে খাবার কি কি হবে সেটা ঠিক করতে হবে তো। তারপর সেই অনুযায়ী বাজারের লিস্ট বানাতে হবে, বাবা।”
খায়রুল সাহেব হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললেন,
“হ্যাঁ, তাই তো! ভালো কথা মনে করেছিস। রান্নার জন্য বাবুর্চি আনতে হবে। আর কি কি করতে হবে, শিরিন? একটু বল তো।”
“বাড়িঘর সাজাতে হবে, বাবা। সেই আয়োজন আছে। তারপর বিয়ের কেনাকাটাও তো করতে হবে।”
খায়রুল সাহেবের কপালে চিন্তার ভাঁজ পরলো। উনি মৃদু গলায় বললেন,
“একা একা কি করে সব করবো বল তো?”
শিরিন ইতস্তত করে বলল,
“ইয়ে…একা করবে কেন, বাবা? কিছু কাজের দায়িত্ব অমিতকে দিয়ে দাও না। না মানে, তুমি যদি ঠিক মনে করো…। তাছাড়া আমি আর বড় আপা আছি তো সাহায্য করার জন্য।”
খায়রুল সাহেব গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন। তারপর চিন্তিত গলায় বললেন,
“খারাপ বলিস নি। শিরিন, যা তো মা। আমার জন্য এক কাপ চা পাঠিয়ে দে। আর তারপর একটু সায়লাকে ডেকে দে।”
শিরিন ভ্রু কুঁচকে বলল,
“এখন ফুপুকে কেন ডাকবে? অন্তু আর বিন্তু বাইরে গেছে বলে কি তুমি ফুপুকে বকবে? বাবা, ওরা একটু পরেই ফিরে আসবে। তুমি রাগারাগি করো না।”
খায়রুল সাহেব মৃদু হাসলেন। চশমা খুলে হাতে নিয়ে ব্যথিত গলায় বললেন,
“তোর কি ধারণা রে? আমি সবসময় শুধু বকাবকি করি? সায়লার শ্বশুর বাড়ির কাউকে দাওয়াত দিতে হবে কিনা, জানতে হবে তো। যা, মা, তোর ফুপুকে ডেকে দে।”
শিরিন অপরাধীর ভঙ্গিতে বলল,
“সরি, বাবা। চিন্তা করছিলাম বেশি, সেজন্য বলে ফেলেছি। আমি চা পাঠিয়ে দিচ্ছি। ফুপুকেও বলছি।”
শিরিন বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। খায়রুল সাহেব পুনরায় চোখে চশমা পরলেন। দীর্ঘশ্বাস ফেলে কপালে হাত রেখে চোখ বন্ধ করলেন। উনি শিরিনকে বলতে চেয়েছিলেন চা নিয়ে রুনিকে পাঠিয়ে দিতে। বলতে পারেন নি। কোথায় যেন একটা সংকোচ! কিন্তু বড় কন্যার সাথে কিছু কথাবার্তা বলতে উনি ভেতরে ভেতরে ঠিকই ছটফট করছেন। আর পাঁচটা সাধারণ বাবার মতো উনারও ইচ্ছা করছে মেয়ে, জামাই, নাতনি, সবাইকে একসাথে বাড়িতে আনতে। বাড়িতে একটা উৎসব হতে চলেছে। অথচ একমাত্র নাতনি সেখানে নেই। নাতনিকে এ জীবনে কোলে পর্যন্ত নেওয়া হলো না। কোনোকিছুই কি আর স্বাভাবিক হবে না?
দরজায় টোকা পরলো। ঠকঠক শব্দে খায়রুল সাহেবের চিন্তা ভঙ্গ হলো। উনি মাথা তুলে তাকালেন। রুনি এসেছে। তার হাতে এক কাপ চা। খায়রুল সাহেব ভীষণ খুশি হলেন। মুখে হাসি টেনে বললেন,
“আয়, মা। ভেতরে আয়।”
রুনি ভেতরে গেল। টেবিলে চায়ের কাপ রেখে হাসিমুখে বলল,
“কি এত চিন্তা করছো, বাবা?”
খায়রুল সাহেব হেসে উত্তর দিলেন,
“বাড়িতে বিয়ে। চিন্তা কি আর একটা রে, মা?”
“তুমি একটুও বদলাও নি, বাবা। টেনশনের সময় চা খেয়ে সেটা কমাতে চাইছো। কিন্তু এই অসময় চা খাওয়া কি ভালো? বয়স হয়েছে তোমার।”
খায়রুল সাহেব হাসলেন। চায়ে চুমুক দিয়ে মলিন গলায় বললেন,
“ঠিকই বলেছিস। বয়স হয়েছে। এই বয়সে এসে আর মান অভিমানের ধাক্কাটা নিতে পারি না রে, মা। বুড়ো বাপের উপর আর তুই রাগ করে থাকিস না। তোর খারাপ আমি কখনো চাই নি। তুই কি সেটা বিশ্বাস করিস না?”
রুনি মলিন গলায় উত্তর দিলো,
“ভালো খারাপ আপেক্ষিক ব্যাপার, বাবা। তোমাদের যা খারাপ মনে হয়েছিল, সেটা আমার জন্য ভালোও হতে পারতো। আমার তোমার প্রতি অভিযোগ নেই, বাবা। যার সাথে বিয়ে দিয়েছ, সে ভালো মানুষ। আমাকে সম্মান করে। সম্মান করে বলেই এত বছর ধরে তোমাদের সাথে যোগাযোগ না রাখার সিদ্ধান্তকে সে সম্মান করেছে। আমার মেয়ের জন্মের পরে যখন তোমরা হাসপাতালে গেলে তখন আমি তোমাদেরকে মেয়ের মুখ দেখতে দিলাম না। তখনো কিন্তু সে আমার পাশে থেকেছে। কোনো জোরজবরদস্তি করে নি। কিন্তু ওর জায়গায় যদি সেই ছেলেটা থাকতো যাকে আমি পছন্দ করেছিলাম, তাহলে কি হতো জানো? তাহলে সে নিজ দায়িত্বে তোমাদের সাথে আমার মনোমালিন্য মিটিয়ে দিতো। এটাই তফাত, বাবা। দুজনেই ভালো, কিন্তু দু’রকমভাবে।”
খায়রুল সাহেব কথা বললেন না। মেয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন এক দৃষ্টিতে। রুনি হালকা কেশে ভারী হয়ে আসা গলা পরিষ্কার করে নিলো। তারপর স্বাভাবিক গলায় বলল,
“তোমাদের জোর করে বিয়ে দেওয়াতে আমার হয়তো শেষ পর্যন্ত কোনো ক্ষতি হয় নি। এই বিয়ে হয়ে আমি সুখীই হয়েছি। কিন্তু ক্ষতি হয়েছে সেই মানুষটার যাকে আমি পছন্দ করেছিলাম, আশ্বাস দিয়েছিলাম। সে কোনো অপরাধ না করেই কষ্ট পেয়েছে। তোমাদের সিদ্ধান্তের কারণে সে বহুবছর এলোমেলো জীবনযাপন করেছে। আমি তাকে বিয়ে করলে সুখে থাকতাম, এখনো সুখেই আছি। শুধু আমার জীবন থেকে একটা মানুষ হারিয়ে গেছে। তোমরা মেনে নিলে, তাকে হারাতে হতো না। তার জীবনের কয়েকটা বছর অগোছালো কাটতো না। আমারও নতুন মানুষকে মেনে নিতে নিজের সাথে লড়াই করতে হতো না। আজ হয়তো সব শান্ত হয়ে গেছে, যে যার মতো ভালো আছি। কিন্তু একটা সময় যেই ঝড়ের মধ্যে দিয়ে গিয়েছি আমরা, সেটা আমাদের প্রাপ্য ছিল না। এইসবই তোমাদের প্রতি আমার অভিমানের কারণ। আর সবচেয়ে বড় কারণ, সেই সময় আমার সাথে তোমার আর মায়ের করা দুর্ব্যবহার যা আমি এখনো ভুলি নি।”
রুনি থামলো। খায়রুল সাহেব বজ্রাহতের ন্যায় বসে রইলেন। উনার পলক পরছে না। সত্যিই কি এটা এত বড় অপরাধ? রুনি মৃদু গলায় বলল,
“চা খাও, বাবা। ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।”
খায়রুল সাহেব চায়ে চুমুক দিলেন। চা ঠান্ডা হয়ে গেছে। খেতে ভালো লাগছে না। উনি চায়ের কাপ টেবিলে রাখলেন। কিছুটা বিভ্রান্তি নিয়েই বললেন,
“তোর কথা হয়তো বুঝেছি, আবার হয়তো বুঝি নি। কিন্তু তোকে যে কষ্ট দিয়েছি, তা বুঝতে পেরেছি। তুই এবার আমাদের সাথে সম্পর্কটা স্বাভাবিক করে নে, রুনি মা। জামাইকে, আমাদের নাতনিকে এবার এই বাড়িতে নিয়ে আয়। আমি বাবা হয়ে ক্ষমা চাইছি তোর কাছে।”
রুনি তাড়াহুড়ো করে বলল,
“না না, বাবা। ক্ষমা চাইতে হবে না। তুমি শুধু আমার একটা কথা রাখো। রাখবে?”
“কি কথা? বল।”
রুনি বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে শীতল গলায় বলল,
“বিন্তুর এই বিয়েটা দিও না, বাবা। প্লিজ!”
খায়রুল সাহেব হকচকিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলেন। ধীরে ধীরে বিস্ময় নিয়ে বললেন,
“কিসব বলছিস, রুনি? সব ঠিকঠাক হয়ে গেছে। এখন কিভাবে আমি পিছিয়ে আসবো?”
রুনি একইভাবে বলল,
“বুঝতে চেষ্টা করো, বাবা। আমার ভাগ্য ভালো বলতে হয়। আমার স্বামী খুব ভালো মানুষ। কিন্তু এই ছেলেটা! এই ছেলেটা কথায় কথায় বিন্তুকে অপমান করে, ছোট করে কথা বলে। তার বাড়ির লোকের কথা নাহয় বাদই দিলাম। সেও যদি বিন্তুর পাশে না থাকে, তাহলে বিন্তু কি করে এখানে সংসার করবে?”
“সে কি? হাবিবকে তো আমি ভদ্রলোক বলেই জানি। ও যদি বিন্তুকে অপমান করে থাকে তাহলে বিন্তু আমায় এতদিন বলে নি কেন?”
“বলার সুযোগ পায় নি, বাবা। আমি তো বলছি এখন। তুমি বিয়েটা ভেঙে দাও।”
খায়রুল সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“এখন তো আর সম্ভব নয়, রুনি। পাড়া প্রতিবেশীরা জেনে গেছে। আর তাছাড়া এই বিয়ে ভাঙলে বিন্তুকে নিয়ে আমার চিন্তা বাড়বে। তোর মাও ঝামেলা করবে।”
“মাকে আমি সামলাবো।”
খায়রুল সাহেব ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
“পারবি না, রুনি। দুবছর আগে বিন্তুকে নিয়ে বেশ বড় একটা ঝামেলা হয়েছিল। পাড়া প্রতিবেশীর গঞ্জনা থেকে বহু কষ্টে বাঁচিয়েছি। তোর মা সেসব জানে। তখনই তোর মা বিন্তুদের এ বাড়ি থেকে বের করে দিতে চেয়েছিল। আমি সামলেছি অনেক কষ্টে। এখন শর্মিলি চায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিন্তুর বিয়েটা হয়ে যাক। বিয়ে ভাঙলে যদি কোনোভাবে আগের কথাগুলোও প্রকাশ হয়ে যায়? তখন তো বিন্তুর বদনাম হবে। ও বিপদে পরবে।”
রুনি ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কি হয়েছিল দু’বছর আগে?”
“আমি এসব কথা আর তুলতে চাই না। আমি যা করছি তাতেই বিন্তুর ভালো হবে।”
রুনি হতাশ হয়ে উঠে দাঁড়ালো। বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
“বিন্তুকে নিয়ে কি হয়েছিল তা আমি জেনে নেবো, বাবা। কিন্তু তুমি জেনে রাখো যে এই বিয়েটা আমি হতে দেবো না।”
কথা শেষ করে রুনি ক্লান্ত ভঙ্গিতে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে। খায়রুল সাহেব চিন্তিত হয়ে বসে রইলেন। সব জেনেশুনেই হাবিব রাজি হয়েছিল বিয়েতে। সব বললে ভুল হবে, অর্ধেকটা জেনে। কিন্তু এই অর্ধেকটা জেনেই বা আর কোন ছেলে বিন্তুকে বিয়ে করতে চাইবে?
__________________________________________
অন্তুকে তার বান্ধবীর বাসায় পৌঁছে দিয়ে বিন্তু বাইরে বেরিয়ে এসেছে। হাঁটতে হাঁটতে ডাকবাংলোর পাশের চায়ের দোকানটায় এসেছে সে। চায়ের দোকানে এখনো বেশ ভিড়। কতগুলো লোক চা খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছে। সবার কথাবার্তার আওয়াজে ভীষণ হট্টগোল হচ্ছে। বিন্তু কাছে এগিয়ে যেতে পারছে না। সে ভেবেছিল এগিয়ে গিয়ে দোকানদারকে পল্লবের খবর জিজ্ঞেস করবে। পল্লবের ফোন নাম্বার আছে কিনা তাও জানতে চাইবে। কিন্তু এতগুলো পুরুষ মানুষের ভিড়ের মধ্যে গিয়ে সে কি করে কথাটা জিজ্ঞেস করবে? বলা যায় না, এখানে হয়তো তার মামার চেনা কোনো ব্যক্তিও আছে। বিন্তু উপায় খুঁজে পেলো না। কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। লম্বামতো এক যুবক বিন্তুর দিকে এগিয়ে আসছে। যুবকের মুখে হাসি। বিন্তু অস্বস্তি বোধ করছে। এই লোকটা তার দিকে এগিয়ে আসছে কেন? বিন্তু ভেবে পেলো না। লোকটাকে সে চেনে বলে মনে হলো না। বিন্তু আর দাঁড়িয়ে থাকলো না। উল্টো দিকে হাঁটতে শুরু করলো। পিছন থেকে আওয়াজ এলো,
“বিন্তু, দাঁড়ান।”
বিন্তু থম মেরে দাঁড়িয়ে গেল। গলাটা তার পরিচিত। যুবক দৌড়ে তার সামনে এসে দাঁড়ালো। প্রশ্ন করলো,
“আমাকে দেখে চলে যাচ্ছিলেন কেন?”
বিন্তু হাসলো। বলল,
“আপনিই পল্লব সাহেব?”
পল্লব এবার ভ্রু কুঁচকে উত্তর দিলো,
“জ্বি। আপনি আমায় চিনতে পারেন নি?”
বিন্তু এবার শব্দ করে হাসলো। হাসতে হাসতেই বলল,
“গলা শুনে চিনলাম এবারে। চেহারা তো এর আগে স্পষ্ট দেখতে পাই নি।”
পল্লব হাসলো। জানতে চাইলো,
“আপনি এখানে?”
বিন্তু মাথা নাড়িয়ে বলল,
“হ্যাঁ, একটু দূরে আমার বোনের বান্ধবীর বাসা। ওকে সেখানে পৌঁছে দিয়ে একটু হাঁটতে বেরিয়েছি। কিন্তু আপনি? আজ তো বৃষ্টি নেই।”
“বৃষ্টি না হলেও আমি সন্ধ্যার পরে একবার এই চায়ের দোকানে আসি। একপাশে বসে মানুষ দেখি।”
বিন্তু মৃদু হাসলো। কথা বলল না। পল্লব নিজে থেকেই বলল,
“দেখা যখন হয়েই গেছে, চলুন না কোথাও বসি। আপনার হাতে সময় আছে তো?”
বিন্তু মৃদু হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। বলল,
“নদীর পাড়ে বসবেন? আজ আকাশে চাঁদ আছে।”
পল্লব রাজি হলো। সানন্দে বলল,
“চলুন।”
.
বিন্তু আর পল্লব নদীর ধারের ঘাসের উপর মুখোমুখি বসেছে। নদীর জলে হালকা ঢেউ। চাঁদের আলো পরে নদীর পানি রূপার থালার মতো চকচক করছে। চারপাশে ঝিঁ ঝিঁ পোকার শব্দ। মৃদুমন্দ বাতাসে বিন্তুর চুল উড়ছে। সে চোখ বন্ধ করে মুখমণ্ডল ছুঁয়ে যাওয়া হাওয়া উপভোগ করছে। এমন সুন্দর প্রকৃতির অভিজ্ঞতা আগে তার হয় নি। সে অস্ফুটে বলে ফেললো,
“কী অসাধারণ!”
পল্লব মৃদু হাসলো। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,
“চাঁদনী রাত আমার ভীষণ প্রিয়। আমি প্রায়ই এখানে আসি জ্যোৎস্না দেখতে।”
বিন্তু মলিন হাসলো। ক্লান্ত গলায় বলল,
“আমার জীবনে এমন সুন্দর মুহূর্ত আসে না। তবে এক সময় আসতো। নিজের ভুলে সেটা হারিয়েছি।”
পল্লব কৌতুহলী গলায় বলল,
“মানে?”
বিন্তু এ প্রশ্নের উত্তর দিলো না। মলিন গলায় বলল,
“নদীর ধারে বসে এই প্রথমবারের মতো জ্যোৎস্না দেখছি আমি। হয়তো এটাই শেষ বার।”
“শেষবার? কেন?”
বিন্তু মুখে হাসি টানলো। চাঁদের আলোয় তার হাসি রহস্যময় লাগছে। ভারী গলায় সে বলল,
“আমার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে, পল্লব সাহেব। যার সাথে বিয়ে হচ্ছে সে বউকে নিয়ে রাত-বিরাতে জ্যোৎস্না বিলাস করার মানুষ নয়।”
পল্লব বজ্রাহতের ন্যায় বসে রইলো কিছুক্ষণ। তার মনে হলো কেউ তাকে বিষম এক ধাক্কা দিয়েছে। বিন্তুর মুখে তখনো হাসি। পল্লব প্রায় অস্পষ্ট গলায় বলল,
“আপনার বিয়ে ঠিক হয়েছে?”
বিন্তু হঠাৎ হাহা করে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতেই বলল,
“মজার ব্যাপার কি জানেন? এটা আমার প্রথম বিয়ে নয়। দ্বিতীয় বিয়ে।”
পল্লব কিছু বুঝতে পারলো না। পৃথিবী সমান বিস্ময় আর একগুচ্ছ প্রশ্ন মনে নিয়ে সে বিন্তুর দিকে চেয়ে রইলো। বিন্তুর মুখে হাসি। কিন্তু তার চোখ দিয়ে জল গড়াচ্ছে। পরিপূর্ণ জ্যোৎস্নাতলে মেয়েটাকে বড় রহস্যময় লাগছে। ভারী এক নিস্তব্ধতার পরে বিন্তুই মুখ খুললো। গাল বেয়ে নেমে আসা অশ্রু মুছতে মুছতে বলল,
“জীবনে নিজের শখ, নিজের ইচ্ছা পূরণের অনেক সুযোগই আমি পেয়েছিলাম। সুযোগের সদ্ব্যবহারও করেছি অনেক। কিন্তু একবার এর অপব্যবহার করে ফেললাম। আমার মামাকে কষ্ট দিলাম। আমার মায়ের উপর মামার রাগ থাকলেও আমাকে মামা খুব ভালোবাসতেন।”
পল্লব এবারও কথা বলল না। বিন্তু হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলো। তারপর বলল,
“আমার বাবা যতদিন বেঁচে ছিলেন, আমাকে খুব আদর আহ্লাদে রেখেছিলেন। তারপর একদিন হুট করেই বাবা চলে গেলেন। বাবা চলে যাওয়ার পরে আমার মাকে তার স্বামীর বাড়ি ছাড়তে হলো। কারণ সেই বাড়ির কেউই তাকে রাখতে চায় নি আর। তখন আমরা বুঝতে পেরেছিলাম, এতবছরেও মাকে কেউই ঠিক মন থেকে মেনে নিতে পারে নি। বাবা ছিল বলে কেউ কিছু বলতে পারে নি এতদিন। কিন্তু বাবা চলে যেতেই সব প্রকাশ হয়ে পরলো। আমার দাদীজান মায়ের মুখের উপরে বলে দিলেন, যে মেয়ে বাপ ভাইকে লুকিয়ে আমার ছেলের হাত ধরে পালিয়েছে তার এই বাড়িতে কোনো জায়গা হবে না। মাকে চলে যেতে বলা হলো। কিন্তু আমাদের দুই বোনকে মায়ের সাথে যেতে দেওয়া হবে না বলে ঠিক করা হলো। আমাদের ছেড়ে থাকার কথা মা ভাবতে পারলেন না। সেদিন রাতে মা আমাদের নিয়ে পালিয়ে এলেন। পনেরো বছর পরে নিজের বাপের বাড়িতে গিয়ে দাঁড়ালেন। কিন্তু ততদিনে সেখানেও আর মায়ের জায়গা নেই।”
বিন্তু থামলো। পল্লব নিচু আওয়াজে বলল,
“সেদিন আপনাকে যেখানে পৌঁছে দিয়ে এলাম, সেই বাড়িটা আপনার মামাবাড়ি?”
বিন্তু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। বড় করে একবার শ্বাস নিয়ে বলতে শুরু করলো,
“আমার নানাজান মায়ের উপর রাগ করে সব সম্পত্তি মামার নামে লিখে দিয়েছিলেন। যেদিন আমরা এই বাড়িতে এলাম সেদিন আমার নানাজান মারা গিয়েছেন। বাড়িতে ঢুকে দেখি নানাজানের লাশ। মাকে দেখে সবাই যেন আকাশ থেকে পরলো। মা আমার বাবার হাত ধরে পালিয়ে যাবার পরে এই বাড়ির মানসম্মান যতটুকু হারিয়েছিল, পনেরো বছরে তা একটু একটু করে ফিরিয়ে এনেছিলেন নানাজান। মা দুই সন্তানের হাত ধরে এই বাড়ির উঠোনে দাঁড়ানোর পরে আবারও যেন সেসব অসম্মান, অপমান মাথা চাড়া দিলো। আমার মামী ভীষণ ক্ষিপ্ত হলেন। একে তো সদ্য মৃতের বাড়ি। তার উপর আমরা যেন একটা উটকো ঝামেলা। নানাজানের দাফন হলো। আমরা কয়েকদিন অস্পৃশ্যের মতো বাড়িটাতে ঘুরে বেড়ালাম। কেউ আমাদের দেখেও দেখলো না। সপ্তাখানেক পরে মামা আর মামী আমাদের নিয়ে বসলেন। মামা চেয়েছিলেন সম্পত্তির একটা অংশ মাকে ফিরিয়ে দিতে। মামী কিছুতেই তা হতে দিলেন না। শেষে ঠিক হলো, আমরা বাড়ির নিচতলায় থাকবো। কিন্তু তার বদলে আমাদের ভাড়া দিতে হবে। মাকে তাইই মেনে নিতে হলো। যে বাড়িতে আমার মায়ের জন্ম, যে বাড়িতে আমার মায়ের বড় হয়ে ওঠা, সেই বাড়িতেই আমার মা হয়ে গেলেন ভাড়াটে।”
বিন্তুর গলা জড়িয়ে এসেছে। পল্লব স্তব্ধ হয়ে বসে আছে। তার স্থির দৃষ্টি বিন্তুর মুখের দিকে। প্রথমবারের মতো বিন্তুর চোখেমুখে বাস্তবতার রূঢ়তা দেখতে পেলো পল্লব। সে মৃদু গলায় প্রশ্ন করলো,
“আপনার দাদা বা দাদী কেউ আর পরে আপনাদের খোঁজ করলো না?”
“উঁহু, কোনোদিন না।”
পল্লব ব্যথিত হলো। কিছু বলবে না বলবে না করেও বলল। কৌতুহল বড় সংক্রামক। প্রশ্ন করে ফেললো,
“এরপর কি হলো?”
বিন্তু মুচকি হেসে বলল,
“এরপর ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হয়ে এলো। আমরা ওই জীবনে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। বাবার অফিস থেকে প্রতিমাসে কিছু টাকা পান আমার মা। বাবা মাকে নমিনি করেছিলেন। সেটা দিয়েই মাসের খরচ চালান আমার মা। মামা মাঝেমধ্যে সাহায্য করেছেন। টাকাপয়সা নিয়ে টানাটানি থাকলেও আমার দুঃখ ছিল না। মা আমাকে অবাধ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। মামাও খুব ভালোবাসতেন। মামী সবসময় দুর্ব্যবহার করলেও মামার কাছে আমার আবদার করার সুযোগ ছিল। মামার কাছে গিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে এটাসেটা চাইতাম। মামা কখনো না করতেন না। কিন্তু কয়েক বছর পরে আমি এমন একটা ভুল করে ফেললাম যে মামার সামনে কথা বলার মুখ রইলো না আমার। তাই আজও আমি মামাকে বলতে পারি নি যে এই ছেলেটাকে আমার পছন্দ হয় নি। আমি এই বিয়েটা করতে চাই না। বলার উপায় নিজেই রাখি নি।”
পল্লব কৌতুহল নিয়ে বলল,
“কি করেছিলেন আপনি?”
বিন্তু ভেতরের দীর্ঘশ্বাস চাপা দিলো। সামনের নদীর পানিতে দৃষ্টি দিলো। চাঁদের আলো ম্লান হয়ে আসছে। হয়তো মেঘ করছে। একটু সময় নিয়ে সে বলল,
“বর্ণ। সেই কিশোরী বয়স থেকেই ওকে দেখেছি একই পাড়ায় থাকার সুবাদে। কিন্তু কলেজে পড়ার সময়ে বর্ণিলকে আমার ভালো লেগে গেল। ওর সাথে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠলো। ধীরে ধীরে না চাইতেও আমি ওর সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে পরলাম। এখানে বলে রাখা ভালো যে বর্ণিলের মা আমাদের কখনোই পছন্দ করতেন না।”
বিন্তু থামলো। বড় নিঃশ্বাস ফেলে আবার বলল,
“সেই বয়সে যেমন উত্তাল অনুভূতি থাকে, আমারও তাই ছিল। আমি এড়িয়ে যেতে পারলাম না সেই অনুভূতি। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে আমরা কথা বলতাম। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ঘুরতে যেতাম। এভাবেই চলছিল। এরপর আমাদের কলেজ শেষ হলো। বর্ণকে ওর মা বাবা অনার্স করতে দেশের বাইরে পাঠাতে চাইলো। ও রাজি হলো না। কারণটা অবশ্যই আমি। আমাকে ভর্তি হতে হলো এলাকার ডিগ্রী কলেজে। ও আমাকে ছেড়ে যেতে চাইলো না। শেষ পর্যন্ত দেশের বাইরে না গেলেও এই মফস্বল ছেড়ে অন্য শহরে ঠিকই যেতে হলো। কিন্তু ও যাওয়ার আগেই আমরা একটা ভুল সিদ্ধান্ত নিলাম।”
পল্লব থমথমে গলায় বলল,
“লুকিয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত?”
বিন্তু হেসে উঠলো। চাপা গলায় বলল,
“আপনি বুদ্ধিমান।”
পল্লব কথা বলল না। বিন্তু কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। তারপর মাথা নিচু করে বলল,
“তখন বয়স অল্প ছিল। বুঝতে পারি নি। ভেবেছি বিয়ে তো হয়ে গেছে। আর কেউ আলাদা করতে পারবে না আমাদের। কয়েক মাস গোপনে সংসার করেছি। মাকে মিথ্যা বলে বর্ণর কাছে যেতাম। ওর সাথে থাকতাম। যখন ওর বাড়িতে কেউ থাকতো না, ও লুকিয়ে ওর বাড়িতে আমাকে নিয়ে যেতো। আমরা ভেবেছিলাম, বর্ণিল নিজের পায়ে দাঁড়ানোর পরে সবাইকে জানাবো বিয়ের কথা। কিন্তু উল্টোদিকে যে বর্ণর মায়ের এত ঘোরতর আপত্তি, তা ও কখনোই আমাকে জানায় নি। উনাকে যে বর্ণ রাজি করাতে পারবে না, আর উনার রাজি না হওয়াটাই যে শেষ অব্দি বর্ণ মেনে নেবে তাও আমি জানতাম না।”
“উনার মা কবে জানতে পেরেছিলেন?”
বিন্তু উদাসীন হয়ে উত্তর দিলো,
“বছর দুয়েক পরে।”
পল্লব হতভম্ব হয়ে বলল,
“দুই বছর আপনারা গোপন রেখেছিলেন সবটা?”
“জ্বি। দুই বছর যে খুব ভালো ছিলাম, তা নয়। বর্ণ অন্য শহরে যাওয়ার পর থেকেই কেমন যেন বদলে গেল। আগে ও হাজার কাজের মাঝেও আমার জন্য সময় বের করতো। কিন্তু ধীরে ধীরে ওর সময় কমতে লাগলো। আমাকে একটাবার ফোন করার সময়ও হতো না ওর। মাঝেমধ্যে বন্ধুদের আড্ডায় বসে আমাকে বলতো, ব্যস্ত আছি। বিরক্ত করিস না। আমি এসব মেনে নিতে পারতাম না। এসব নিয়ে ঝগড়াঝাটি করতাম। ঝামেলা হতো। ঝগড়ার পরে রাগ করে আমি কথা বন্ধ করে দিতাম। বর্ণর কিচ্ছু যায় আসতো না। ও যেন আরও স্বস্তি পেতো। কিন্তু আমি ভীষণ অস্থির হয়ে পড়তাম। একটা সময় পরে নিজে থেকেই আবার কথা বলতাম। অনুরোধ করতাম যাতে সব স্বাভাবিক করে নেয়। একদিন ওকে বলেছিলাম, আজ রাতে আমার সাথে কথা বল। আমার শরীর ভীষণ খারাপ। তোকে খুব মনে পড়ছে। ও নিষ্ঠুরের মতো বলে দিয়েছিল ও পারবে না। আমার শরীর খারাপ বলে কি ও আমাকে নিয়ে বসে থাকবে? ওর অন্য জরুরি কাজ আছে। আর তাছাড়া ও তো ডাক্তার নয়। পরে ওর এক বন্ধুর থেকে জানতে পেরেছিলাম যে ওর জরুরি কাজটা ছিল একটা কনসার্টে যাওয়া। আমি প্রচন্ড আঘাত পেলাম। আমার মনে হলো, বর্ণর কাছে আমার আর কোনো গুরুত্ব নেই। আমি এক বাড়ি লোকের মধ্যে থেকেও ওর সাথে কথা বলার সুযোগ করে নিতাম। অথচ ও কি করলো? আমি অভিমানে টানা সাতদিন ওর সাথে যোগাযোগ করলাম না। ভেবেছিলাম ও আমার অভিমান ভাঙাতে চাইবে। কিন্তু তেমন কিছু ঘটে নি। বরং অষ্টম দিনে আমিই ওকে ফোন করলাম। জানতে চাইলাম, এই ক’টাদিন একবারও কি আমার সাথে কথা বলতে ওর ইচ্ছা করলো না? ও উত্তর দিয়েছিল, ইচ্ছা করেছে। কিন্তু সময় দরকার ছিল বলে যোগাযোগ করে নি। আমার ওর কথা বিশ্বাস হলো না। কিন্তু তবুও মেনে নিলাম। কারণ আমি ওকে ছাড়া থাকতে পারতাম না। অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল কিনা!”
বিন্তু মুচকি হেসে থেমে গেল। পল্লব ধীরে ধীরে বলল,
“দুটো বছর কি এভাবেই কেটেছে?”
বিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“না, ভালো স্মৃতিও আছে অনেক। কিন্তু অধিকাংশ সময় এভাবেই কেটেছে। এক পর্যায়ে ও বলতে শুরু করলো, আমি নাকি ওকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাই। ওর সব কাজে বাধা দিই। ওকে আমার কথা অনুযায়ী চলতে বলি। ও নিজের মতো কিছু করতে চাইলে আমি তা মানতে পারি না। সেজন্যই নাকি আমাদের মাঝে ঝগড়া বিবাদ হয়। আমার অভিমানটা বুঝতে পারলো না ও। আমাকে সময় না দেওয়াটা ওর ভুল ছিল, সেটাও মানলো না। কিন্তু আমি ওর কথা মেনে নিলাম। কারণ আমার একমাত্র চিন্তা ছিল সম্পর্কটা বাঁচানো। ওর মনমতো চলতে শুরু করলাম ধীরে ধীরে। ঝগড়া করা বন্ধ করে দিলাম, সময় চাইতে তো ভুলেই গেলাম। সপ্তাহে মাত্র দু তিনদিন যোগাযোগ হতো, তাও আবার আমি ফোন করলে তবেই। ওর এসব পরিবর্তন ভেতরে ভেতরে আমাকে তীরের মতো বিঁধতো। কিন্তু তবুও আমি সব মেনে নিলাম। আর আগের বর্ণকে মিস করতে থাকলাম। শেষ যে বছর আমাদের বিয়েটা টিকেছিল সে বছর বর্ণ দশদিনের ছুটি পেলো। বাড়িতে এলো। আমার সাথে সুন্দর কিছু মুহূর্ত কাটালো। আমি ভাবলাম সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। কিন্তু এরপর আমি পরলাম এক ভয়ংকর দোটানায়। বর্ণ চলে যাওয়ার মাসখানেক পরে জানতে পারলাম আমি অন্তঃসত্ত্বা।”
পল্লব বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল। তার শরীরে শীতল একটা স্রোত বয়ে গেল। হতভম্ব হয়ে বিন্তুর দিকে তাকিয়ে রইলো সে। কথা বলতে চেয়েও পারলো না। কেবল অস্ফুটে উচ্চারণ করলো,
“কি?”
বিন্তু স্পষ্ট গলায় বলল,
“ঠিকই বলছি। এসব কথা আমি কখনো কাউকে বলি নি আগে। বলার কথাও নয়। আপনাকেও বলতাম না। কিন্তু আপনিই সেদিন বললেন, মনের ভেতর চাপা দিয়ে রাখা কথাগুলো অচেনা কাউকে বলাটাই নিজেকে হালকা করার সবচেয়ে ভালো উপায়। তাই বলছি। যদিও আপনি এখন আমার অচেনা নন, তা সত্ত্বেও আপনাকেই বলা যায় বলে মনে হয়েছে।”
পল্লব নিজেকে স্বাভাবিক করলো। থমথমে মুখে বলল,
“বলুন। এরপর কি হলো?”
বিন্তু ক্লান্ত গলায় বলতে লাগলো,
“বর্ণকে জানানোর পরে ও প্রথমে খুব রাগারাগি করলো। বলল, আমি নাকি পরিকল্পনা করে ওকে আটকে রাখতে কাজটা করেছি। আমারও রাগ হলো। যা মনে এলো বলে দিলাম। বললাম, বিয়ের পরে সব মেয়েই স্বামীকে আটকে রাখতে চায়। এটা অপরাধ হলে হয়েছে। আমার তাতে আফসোস নেই। এক কথা দুই কথা থেকে একটা বিশ্রী কথা কাটাকাটি হলো। আমি দুশ্চিন্তায় শেষ হয়ে যেতে লাগলাম। ধীরে ধীরে অনিদ্রার রোগী হয়ে গেলাম। রাতের পর রাত কাটাতে লাগলাম বারান্দায় বসে। কয়েকদিন কাটার পরে বর্ণিলের দয়া হলো। ও বাড়িতে এলো। আমাকে নিয়ে ওর মায়ের কাছে গেল। ওর মা সব জানার পরে বর্ণকে কি বলেছিলেন জানি না। কিন্তু আমাকে ভীষণ বাজেভাবে অপমান করলেন। হুমকি দিলেন যেন আমি এই বাচ্চাটাকে না রাখি। আর তারপর যেন তার ছেলেকে তালাক দিয়ে দিই। যদি উনার কথা না শুনি তাহলে আমার পরিবারকে সব জানাবেন। আমি অবাক হয়ে দেখলাম বর্ণ তার মায়ের প্রতিটা কথা মেনে নিচ্ছে।”
“আপনি উনাদের কথা মেনে নিলেন?”
বিন্তু জোরের সাথে বলল,
“প্রশ্নই ওঠে না। আমি রাজি হই নি। পরবর্তীতে ওরা আমার মামা মামীকে ডাকলেন। সব জেনে উনারা আকাশ থেকে পরলেন। মামা চেষ্টা করেছিলেন যাতে সামাজিকভাবে আমাদের সম্পর্কটা স্বীকৃতি পায়। কিন্তু বর্ণর মা রাজি হোন নি। মামা আর মামীকে খুব অপমান করেছিলেন। মামী আমার উপর রাগে ফেটে পরলেন। আমাকে বিদ্রূপ করে বললেন আমি নাকি আমার মায়ের যোগ্য কন্যা হয়ে উঠেছি। তবে একটা কথা আমাকে স্বীকার করতেই হবে। মামী মুখে আমাকে গঞ্জনা দিলেও আমার ভালো চেয়েছিলেন। বারবার বর্ণর মাকে অনুরোধ করেছিলেন আমাদের বিয়েটা মেনে নিতে। উনি মানেন নি। হুমকি দিয়েছিলেন, এক মাসের মধ্যে তালাক না দিলে উনি মামার মান সম্মান মাটিতে মিশিয়ে ছাড়বেন। আমাকে বদনাম করবেন। আমি অন্তঃসত্ত্বা ছিলাম বলে বর্ণিলের দিক থেকে তালাক দেওয়াটা সম্ভব হচ্ছিলো না। মামা মামী চিন্তায় পরলেন। মামী আমার মাকে কিছুই জানতে দিলেন না। আমাকে উনি সেই সময়টায় আগলে রেখেছিলেন।”
বিন্তু থামলো। তার চোখ ভর্তি জল মুছে ফেলে ধীরে ধীরে আবার বলল,
“একদিন হুট করে বর্ণর মা আমাকে ফোন করলেন। খুব আদর করে আমাকে বাড়িতে ডাকলেন। উনার মিষ্টি কথায় ভুলে আমি সেখানে গেলাম। আর সেদিনই করলাম সবচেয়ে বড় ভুল। সেদিন উনি আমাকে কি খাইয়েছিলেন জানি না। কিন্তু খাবারের সাথে নিশ্চয়ই কিছু মেশানো ছিল, হয়তো কোনো ওষুধ। যার ফলে আমি আমার বাচ্চাটাকে হারালাম। নিজেও অসুস্থ হয়ে পরলাম। সেদিন আমার শিরিন আপা না থাকলে আমি হয়তো মরেই যেতাম। এই ঘটনার মাসখানেক পরে আমার কাছে ডিভোর্স নোটিশ এলো। আমি মরিয়া হয়ে বর্ণর কাছে গেলাম। জানতে চাইলাম, সেও কি এই বিচ্ছেদ চায়? তার মায়ের করা অন্যায় নিয়ে সে কি কিচ্ছু বলবে না? ও উত্তর দিয়েছিল, তার মা কিছু করে নি। বাচ্চাটা আমি হারিয়েছি নিজের দোষে। সেজন্যই ও ডিভোর্স চায়। এইদিন, ঠিক এইদিন থেকেই আমি বর্ণকে প্রচন্ড ঘৃণা করতে শুরু করলাম।”
বিন্তু দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করলো। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক কমে এসেছে। চারদিক এখন প্রায় নিস্তব্ধ। টিপটিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। পল্লব ইতস্তত করে প্রশ্ন করলো,
“আপনার মা এখনো কিছু জানেন না?”
“সবটা জানেন না। মামী শুধু বলেছিল, আমি লুকিয়ে বিয়ে করতে গিয়েছিলাম আর মামা আমাকে সেখান থেকে ফিরিয়ে এনেছেন। ছেলেটা কে সে বিষয়ে মা জানেন না। এটুকু জানার পর থেকেই মা আর কখনো আমার সাথে ভালো করে কথা বলেন নি।”
“বর্ণিলের সাথে আর কখনো দেখা বা কথা হয়েছে আপনার?”
বিন্তু তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। বলল,
“বছর দুয়েক পরে বর্ণ বাড়িতে ফিরে আসে। এখন এই এলাকার কলেজেই মাস্টার্স করছে। ওর মা ওকে আর দৃষ্টি সীমার বাইরে যেতে দেয় নি। আর আমি টেনেটুনে ডিগ্রী পাশ করেছি। তারপর বিয়ে করতে চলেছি। কিন্তু আমি সবসময় চেয়েছি আমার বোন পড়ালেখা করুক। তাই যখন আমি জানলাম ওর জন্য টিউশন টিচার প্রয়োজন, তখন খানিকটা নিরুপায় হয়ে বর্ণর কাছে গিয়েছিলাম। ততদিনে যদিও দুই বছর কেটে গেছে, তবুও আমার ভেতরের আঘাত তখনো তাজা। তবুও গিয়ে অনুরোধ করেছিলাম অন্তুকে যেন পড়ায়। শুরুতে রাজি হয় নি। পরে অবশ্য হয়েছে। আমার মা জানেন না বলেই ও রোজ এসে অন্তুকে পড়াচ্ছে।”
“আপনি কি এসবকিছুর জন্যই বিয়েতে মন থেকে রাজি হতে পারছেন না?”
“হ্যাঁ। মনে হচ্ছে, যাকে বিয়ে করছি তাকে ঠকাচ্ছি। যদিও আমার অতীত আমি বর্তমানে আনবো না। তবুও দ্বিধা হয়। আর তাছাড়া যার সাথে আমার বিয়ে হতে চলেছে, তাকে আমার পছন্দ হয় নি।”
পল্লব আর কথা বলল না। বিন্তু আকাশের দিকে তাকালো। মেঘে ঢেকে যাচ্ছে চাঁদ। সেদিকে তাকিয়েই বিন্তু মৃদু গলায় বলল,
“জানেন, পল্লব সাহেব? আমার সম্পর্কে খুব ভয়। যদি আবার বদলে যাওয়া দেখতে হয়? মানুষের হুট করে বদলে যাওয়া বড় ভয়ংকর। এরচেয়ে একা থাকা ভালো।”
পল্লব এবারেও কথা বলল না। বিন্তু উঠে দাঁড়ালো। মুখে হাসি টেনে বলল,
“অনেক রাত হয়ে গেল। আমি আসি। আমার বোনকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে।”
বিন্তু কথা শেষ করে দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতে লাগলো। আধো অন্ধকারে পল্লবের কেমন ঘোর লাগা অনুভূতি হলো। মনে হলো, এতক্ষণ যা হলো সবটাই স্বপ্ন। সে উঠে দাঁড়ালো। বিন্তুর চলে যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তার ইচ্ছা করলো দৌড়ে গিয়ে বিন্তুকে আটকাতে। তারপর বলতে, “আপনি যাবেন না, বিন্তু। আমাকে বিশ্বাস করুন। আমি কখনো বদলে যাব না।” সে দু’পা এগিয়ে গেল। পরক্ষণেই আবার পিছিয়ে এলো। যদি কথা রাখতে না পারে?
.
#চলবে……………

চড়ুই নীড়ে বসবাস পর্ব-০৮

0

#চড়ুই_নীড়ে_বসবাস
#আলো_রহমান(ফারজানা আলো)
#পর্ব:৮
.
বিন্তু এক কাপ চা হাতে দোতলার বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছে। বহুদিন পরে রুনি বাড়িতে এসেছে বলে বাড়িতে একটা উৎসব উৎসব ভাব এসেছে। বাড়ির সবাই নিজেদের মতো ছোটাছুটি করতে ব্যস্ত। সকাল থেকে বাড়িতে নানা পদের রান্নাবান্না হচ্ছে। খায়রুল সাহেব সকালবেলা নিজে বাজারে গিয়েছেন। বিশাল সাইজের একটা বোয়াল মাছ এনেছেন। উঠোনে বসে মহা উৎসাহে সেই মাছ কাটছে অমিত। তাকে কিছুতেই বাড়ির বাইরের একজন বলে একপাশে সরিয়ে রাখার উপায় নাই। নিজে নিজেই বাড়ির কিছু কাজের দায়িত্ব সে নিয়ে ফেলেছে। সকালবেলা যখন খায়রুল সাহেব বাজারের উদ্দেশ্যে বেরোচ্ছিলেন, তখন সেও সেজেগুজে সাথে বেরিয়ে পরেছে। বাজার থেকে ফিরে বোয়াল মাছ কাটতে বসে পরেছে। বাড়ির কাজের মেয়েটাকে গম্ভীর স্বরে বলেছে, রান্নাবান্নায় মন দাও। মাছ কাটা আমি সামলে নিচ্ছি। বিন্তু অবাক হয়ে সব দেখছে। কেমন নিশ্চিন্তে দিন কাটাচ্ছে মানুষটা! অথচ তার এখন বিষম চিন্তায় থাকার কথা। খায়রুল সাহেব তাকে এক মাস সময় দিয়েছে। এই এক মাসের মধ্যেই তাকে একটা রোজগারের ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই সে শিরিনকে বিয়ে করতে পারবে। তবে কাজ খোঁজা নিয়ে অমিতের কোনো উদ্যোগ এখনো কারোর চোখে পরে নি। একটু আগে বিন্তু অমিতকে জিজ্ঞেস করেছে,
“অমিত ভাই, আপনার কি দুশ্চিন্তা হচ্ছে না?”
অমিত অমায়িক হেসে উত্তর দিয়েছে,
“দুশ্চিন্তা করে জীবনে কখনো কারোর লাভ হয় নি, বিন্তু। হেসেখেলে দিন কাটানোই জীবনের নিয়ম। এই যে তুমি সবসময় মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়াও, এতে তোমার ছাড়া আর কারোর ক্ষতি হচ্ছে না। দুঃখ কিন্তু তোমার চেয়ে আমার বেশি। মা বাবা নেই, মাথার উপরে ছাদ নেই, কাল কি করবো তাও জানি না। তোমার কিন্তু এই সবকিছুই আছে। জীবনে মেনে নেওয়া হলো ভালো থাকার উপায়।”
বিন্তু হকচকিয়ে গিয়েছে। অমিত ভুল বলে নি। অমিতের কথা শোনার পরে সে আজ বহুদিন নিজেকে সুন্দর করে সাজিয়েছে। চোখে কাজল পরেছে। এক কাপ চা বানিয়েছে। মামার কাছে গিয়ে নতুন চশমা চেয়েছে। সে আবিষ্কার করেছে, কাজগুলো যত কঠিন বলে মনে হতো ততটা আসলে নয়।
অন্তু দৌড়ে দোতলায় এলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“আপা, দুলাভাই এসেছে।”
বিন্তু দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কেন?”
“আমি তো জানি না, আপা। একটু পরে নাকি দুলাভাইয়ের বাড়ির লোকও আসবে।”
“আমাকে কেউ কিছু জানায় নি কেন?”
অন্তু ঠোঁট উল্টে বলল,
“বাড়ির কেউই জানতো না। উনারা নাকি একটু আগেই হুট করে ফোন করে বলেছেন বিয়ের দিন তারিখ ঠিক করতে আসবেন। সামনে সপ্তাহেই তোমার বিয়ে, আপা।”
বিন্তু কথা বলল না। অমিতের কথা শুনে সে ঠিক করেছে সে মানিয়ে নেওয়ার একটা চেষ্টা করে দেখবে। অন্তু তার হাত ঝাঁকিয়ে বলল,
“ও আপা! ছাদে যাও। দুলাভাই তোমার জন্য ওখানেই অপেক্ষা করছে।”
বিন্তু ধমক দিয়ে বলল,
“দুলাভাই দুলাভাই করবি না তো। বিরক্ত লাগে।”
বলেই ছাদের দিকে চলে গেল সে। যাওয়ার আগে চায়ের কাপটা অন্তুর হাতে ধরিয়ে দিলো। অন্তু মুখভার করে দাঁড়িয়ে রইলো। কেন যে ও ধমক খেলো, সেটা বুঝতে পারছে না।
হাবিব ছাদের এক পাশের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। বিন্তু ধীরে ধীরে সেদিকে এগিয়ে গেল। ছাদে বেশ রোদ। আজ বৃষ্টি পরছে না। ছাদের একপাশে একটা ছাউনির মতো আছে। হাবিব সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। বিন্তু তাকে ঝাপসা দেখছে। একগুচ্ছ রঙ ছাড়া আর কিছুই সে দেখতে পাচ্ছে না। সে এগিয়ে গিয়ে নিচু গলায় বলল,
“আপনি হঠাৎ?”
হাবিব ঘুরে তাকালো না। দৃষ্টি আকাশের দিকে রেখে উত্তর দিলো,
“কেন? নিষেধ নাকি এখানে আসা?”
“আমি তেমনটা বলি নি।”
“তুমি বড় বেশি বাড়াবাড়ি করো। তাই তোমাকে বেঁধে ফেলতে এসেছি।”
বিন্তু দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আপনি সবসময় এভাবে কেন কথা বলেন? আপনার কথার মধ্যে সবসময় অসম্মান লুকিয়ে থাকে। ব্যাপারটা আমার পছন্দ নয়।”
হাবিব হেসে উঠে বলল,
“সম্মান অসম্মান নিয়ে তুমি কথা বলছো? তোমার কোনো ধারণা আছে এসব নিয়ে? তুমি সেদিন যেভাবে চলে গেলে, সেটা কি আমাকে অপমান করা নয়? তোমার কি মনে হয় না যে তুমি ভুল করেছ?”
বিন্তু বিরক্তি নিয়ে উত্তর দিলো,
“দেখুন, আমি তর্কে জড়াতে চাই না। আমাকে ছাদে কেন ডেকেছেন বলুন।”
হাবিব কোনোরকম সংকোচ ছাড়াই বলে ফেললো,
“একটু পরে আমার বাড়ির লোকেরা আসবে। তুমি তাদের সামনে আমার কাছে ক্ষমা চাইবে।”
বিন্তু থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না সে। তার মনে হচ্ছে সে ক্রমশ একটা খাঁচায় জড়িয়ে পরছে। বিষয়টা নিয়ে কি কারোর সাথে কথা বলা দরকার? কিন্তু কার সাথে? অমিত ভাই? শিরিন আপা? রুনি আপা? নাকি পল্লব? বিন্তু ভেবে পেলো না। পল্লবের কথা মাথায় আসতেই বিন্তুর মনে হলো তাকে নিজের সব গল্প বলতে পারলে হয়তো ভালো লাগতো।
উত্তর না পেয়ে হাবিব ঘুরে তাকালো। ঘুরে তাকিয়েই শব্দ করে হেসে উঠলো সে। বিন্তু ভ্রু কুঁচকে হাবিবের মুখ স্পষ্ট করতে চেষ্টা করলো। হাবিব বিন্তুর দিকে তাকিয়েই হাসছে। বিন্তু অস্ফুটে বলল,
“কি হয়েছে?”
হাবিব হাসি থামাতে পারলো না। বিন্তু হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। হাবিব কোনোমতে হাসি থামিয়ে বলল,
“তোমার চশমা কোথায়? চশমা পরো নি কেন?”
বিন্তু প্রায় অস্পষ্ট গলায় বলল,
“ভেঙে গেছে।”
হাবিব আরেক দফা হেসে উঠে বলল,
“হেসে ফেলার জন্য সরি। কিছু মনে করো না। কিন্তু চশমা ছাড়া তোমাকে একেবারে ভূতের মতো লাগছে।”
বিন্তুর হাতের মুঠো শক্ত হয়ে এলো। ভীষণ রাগে তার চোখ ছলছল করে উঠলো। হাবিব এখনো হাসছে। বিন্তু কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে হাবিবের হাসি দেখলো সে। তারপর হিসহিসিয়ে বলল,
“আমাকে বিয়ে করলে এই ভূতের মতো চেহারা আপনাকে দেখতে হবে, মিস্টার। বউকে তো সবসময় আপনি চশমা পরিয়ে রাখতে পারবেন না।”
কথাটা বলেই বিন্তু দ্রুত পায়ে নিচে নেমে গেল। প্রায় ছুটে গিয়ে সে ঢুকলো তার মায়ের ঘরে।
.
সায়লা ঘরে বসে ফল কাটছেন। একটু পরেই মেয়ের হবু শ্বশুর বাড়ির লোক আসবে। অনেককিছু গোছাতে হবে তাকে। দোতলায় গিয়ে শর্মিলির রান্নাঘর থেকে কয়েকটা জিনিস পাঠাতে হবে। অন্তু উনার কাছে বসে ঘ্যানঘ্যান করছে। আজ তার এক বান্ধবীর জন্মদিন। বিকালে সেখানে দাওয়াত। রাতে খেয়ে তারপর বাসায় ফিরবে। সায়লা অন্তুর কথা কানেই তুলছেন না। এতটুকু মেয়েকে রাতের দাওয়াতে যেতে দেওয়ার প্রশ্নই উঠছে না। উনি মনোযোগ দিয়ে কাঁচের পিরিচে ফল সাজাচ্ছেন। অন্তু মেঝেতে তার মায়ের পায়ের কাছে বসে আছে। সে আবদারের সুরে বলে উঠলো,
“ও মা! যাই, মা? এইতো কাছেই ওদের বাসা। যেতে দাও না, মা!”
সায়লা ধমক দিয়ে বললেন,
“আহ অন্তু! কাজ করতে দিবি না? কেন যন্ত্রণা করছিস?”
অন্তুর মুখ কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। সে মাথা নিচু করে বিরবির করে বলল,
“একদিনই তো যেতে চেয়েছি!”
এই সময় হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলো বিন্তু। হনহন করে এসে অন্তুর পাশে বসে পরলো সে। নাক টানতে টানতে চোখ মুছছে সে। তার চোখমুখ লাল হয়ে আছে। সায়লা মেয়ের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকালেন। বিরক্তি নিয়ে বললেন,
“তোদের দুই বোনের হয়েছেটা কি? জ্বালিয়ে মারলি আমাকে।”
বিন্তু কথা বলল না। সে বুঝতে পারছে যে তার কথা শোনার মতো সময় মায়ের নেই। অন্তু ফিসফিস করে বলল,
“আপা, কি হয়েছে? দুলাভাই তোমাকে বকেছে?”
বিন্তু এবারও কথা বলল না। নতুন একটা চশমা হাতে রুনি এলো। দরজা থেকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
“বিন্তু, তোর নতুন চশমা এনেছি। বাবাকে বলে অমিতকে দিয়ে আনিয়েছি সকালেই। তোকে দেওয়া হয় নি তখন। নে, পরে নে।”
বিন্তু হাত বাড়িয়ে চশমা নিলো। রুনি পাশে বসে বলল,
“এরকম বোকামি কেউ করে? বাড়তি একটা চশমা বাড়িতে রাখতে হয় তো।”
বিন্তু উত্তর দিলো না। নড়লোও না। রুনি বিন্তুর থমথমে মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
“কি হয়েছে, বিন্তু? আমাকে বল।”
বিন্তু এবার কেঁদে উঠলো। রুনির হাত চেপে ধরে বলল,
“বড় আপা, আমি এই বিয়েটা করবো না। ওই লোকটা…”
বিন্তুর কথা শেষ হলো না। তার আগেই সায়লা চেঁচিয়ে উঠে বললেন,
“বিন্তু! এই সময় এসে এসব কি বলছিস তুই?”
রুনি বলে উঠলো,
“আহা! ফুপু, চিৎকার করো না। ওর কিছু বলার আছে। বলতে দাও।”
সে বিন্তুর মাথায় হাত রাখলো। বিন্তু নিচু গলায় বলল,
“ওই লোকটা সবসময় আমাকে অপমান করে, আপা। এই বিয়েটা করলে আমি মরেই যাব!”
বিন্তু কাঁদছে। রুনি জড়িয়ে ধরলো বিন্তুকে। কোমল গলায় বলল,
“আমি আছি, বিন্তু। কাঁদিস না। আমি দেখছি।”
সায়লা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। অন্তু পাশে বসে উশখুশ করছে। সবকিছুর ভিড়ে তার বান্ধবীর বাসায় যাওয়ার কথাটাই শুধু চাপা পড়ে গেল।
____________________________________
হাবিবের বাড়ির লোকজন এসেছে। বাড়ির সকলে মিলেই তাদের আপ্যায়ন করছে। শুধু শর্মিলি এই ঘরে নেই। মাথাব্যথার অজুহাতে তিনি নিজের ঘরে শুয়ে আছেন। রুনি ঘরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে হাবিবকে দেখছে। সে মাথা নিচু করে বসে আছে। দেখে মনে হচ্ছে তার মতো সুশীল পুরুষ আর হয় না। হাবিবের বড় চাচী পান খাচ্ছেন। উনার হাতে একটা টিনের বাক্স। সেখান থেকেই কিছুক্ষণ পর পর পান বের করছেন উনি। হাবিবের বড় চাচা বললেন,
“খায়রুল সাহেব, আপনাদের বংশ দেখেই আমরা রাজি হয়েছিলাম। মেয়ে যে বংশেরই হোক। বড় তো হয়েছে আপনার ঘরে। সেই ভরসাতেই আমরা বিয়েটা দিচ্ছি।”
হাবিবের বড় চাচী সুর মেলালেন। পান চিবাতে চিবাতে বললেন,
“একদম তাই। কিন্তু বংশের ধরা বড় ব্যাপার। পরপর দুই দিন মেয়ে যা কেলেঙ্কারি করলো! আমাদের বাড়ির কোনো মেয়ে এরকমটা ভাবতে পর্যন্ত পারে না। আপনার শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তুলছি না। কিন্তু ওই যে, রক্তের ধারা।”
সায়লা অপমানে মাথা নিচু করলেন। হাবিবের ফুপু বলে উঠলেন,
“আমরা বড় মনের মানুষ। শুধু আমরা বলেই এতকিছুর পরেও বিয়েটা দিচ্ছি৷ অন্যকেউ হলে কবেই বিয়েটা ভেঙে দিতো!”
খায়রুল সাহেব কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। তার আগেই রুনি কঠিন গলায় বলে উঠলো,
“মাফ করবেন! কিন্তু আপনারা বড় মনের মানুষ বলে এই বিয়েটা দিচ্ছেন না।”
সকলে হকচকিয়ে রুনির দিকে তাকালো। হাবিবের বড় চাচা প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে খায়রুল সাহেবের দিকে তাকালেন। খায়রুল সাহেব হাসার চেষ্টা করে বললেন,
“ও আমার বড় মেয়ে।”
পাত্রের বড় চাচা মৃদু হেসে বললেন,
“তা মা, কেন আমরা দিচ্ছি এখানে বিয়ে?”
রুনি হেসে উত্তর দিলো,
“দেখুন, আমি সোজা কথা বলতে পছন্দ করি। সোজাসুজিই বলছি। এই বিয়ে দিচ্ছেন কারণ বিন্তুর বাবা নেই। মামাবাড়িতে বড় হয়েছে। নিজের কথা নিজে মুখ ফুটে বলতে শিখে নি কখনোই। শ্বশুর বাড়ি গিয়েও বিন্তু সেভাবে কোনো মতামত দিতে পারবে না, এটাই স্বাভাবিক। আপনারা এরকম কাউকেই বউ হিসেবে চাইছেন। আর তাছাড়া, আপনাদের ছেলেকে দেখে যথেষ্ট বয়স হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। এতদিনেও তার বিয়ে দিতে পারেন নি। হয়তো কোনো মেয়েই ওকে এতদিন পছন্দ করে নি। এতদিন পরে বিন্তুর সাথে বিয়ের কথাবার্তা এগিয়েছে। কারণ বিন্তুর নিজের পছন্দ বলার সুযোগ নেই। শেষমেশ একটা মেয়ে পেয়েছেন বলে আপনারা এই বিয়েটা ভাঙতে চাইছেন না, সে যতই বিন্তুর কিছু কাজকর্ম আপনাদের অপছন্দ হোক না কেন। ঠিক বলেছি?”
সকলে বজ্রাহতের ন্যায় তাকিয়ে রইলো। কেউ কোনো কথা বলল না। শুধু পাত্রের ফুপু বিরবির করে বললেন,
“আপনার বাড়ির সব মেয়েরাই কি এমন অদ্ভুত গোছের?”
__________________________________
সন্ধ্যা হয়েছে। বিন্তু নিজের ঘরে শুয়ে আছে। বিছানার আরেকপাশে বসে আছে শিরিন আর রুনি। শিরিন রুনির চুলে তেল মাখিয়ে দিচ্ছে। রুনি চোখ বন্ধ করে রেখেছে। বিন্তুর মন ভালো নেই। সামনে সপ্তাহে তার বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে। এখন ছোটখাটো ঘরোয়া অনুষ্ঠান করে বিয়েটা হবে। সামনের শীতে বড় করে অনুষ্ঠান হবে।
শিরিন বোনের মাথায় তেল ঘষতে ঘষতে হতাশ গলায় বলল,
“তোমার এতগুলো কথা শোনার পরেও ওরা বিয়ের দিন ঠিক করে ফেললো! কী আশ্চর্য!”
রুনি ক্লান্ত গলায় বলল,
“বাদ দে, শিরিন। ওদের কথা এখন ভালো লাগছে না। আমি পরে দেখছি।”
শিরিন অন্য কথা পাড়লো। হাসিমুখে বলল,
“আপা, তোমার একটা মেয়ে হয়েছে শুনেছিলাম। ওকে আনলে না কেন?”
রুনি নির্লিপ্তভাবে উত্তর দিলো,
“প্রতিজ্ঞা করেছি মা বাবাকে ওর মুখ দেখাবো না।”
বিন্তু উঠে বসলো। মলিন গলায় বলল,
“এত রাগ! তুমি কি করে পারো, আপা? বাচ্চাটার বুঝি নানা নানির আদর দরকার নেই?”
“না, নেই।”
বিন্তু দমে গেল। শিরিন ভয়ে ভয়ে বলল,
“এভাবে রাগ করে থেকো না, আপা। সব ঠিকঠাক করে নাও।”
রুনি কথা বলল না। অন্তু এই সময় হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকলো। শিরিন সেদিকে তাকিয়ে বলল,
“কিরে? ছোটাছুটি কিসের?”
অন্তু এগিয়ে এলো। রুনির সামনে বসে বলল,
“বড় আপা, আমার একটা সমস্যার সমাধান করে দিতেই হবে। দাও না, বড় আপা!”
রুনি চোখ খুললো। ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তুই একটা পুঁচকে মেয়ে। তোরও সমস্যা হচ্ছে বুঝি?”
অন্তু মলিন গলায় বলল,
“বড় সমস্যা, আপা। আমার বান্ধবীর জন্মদিন। একটু পরেই কেক কাটা হবে। এইতো একটুখানি দূরে। মা যেতে দিচ্ছে না।”
রুনি হেসে বলল,
“ফুপুকে রাজি করাতে হবে?”
অন্তু উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে বলল,
“হু।”
রুনি বিছানা থেকে নামলো। বিন্তুর হাত ধরে বলল,
“ঠিক আছে। তুই রেডি হয়ে নে। বিন্তু তোকে নিয়ে যাবে। ফুপুকে আমি সামলাচ্ছি।”
.
#চলবে…………

চড়ুই নীড়ে বসবাস পর্ব-০৭

0

#চড়ুই_নীড়ে_বসবাস
#আলো_রহমান(ফারজানা আলো)
#পর্ব:৭
.
বিকাল গড়িয়েছে। ঘড়িতে পাঁচটা দশ। ঝিরঝির করে এখনো বৃষ্টি পরছে। বর্ণিল ছাতা মাথায় বিন্তুদের বাড়ি থেকে বেরিয়েছে। আজ সে অন্তুকে প্রতিদিনের চেয়ে বেশ অনেকটা সময় বেশি পড়িয়েছে। কোথাও একটা আশা ছিল বিন্তুকে দেখার। কিন্তু বিন্তু এখনো ফেরে নি। এতক্ষণ বাইরে কি করছে বর্ণিল বুঝতে পারছে না। অবশ্য সময় তো লাগবেই। হবু বরের সাথে বাইরে গেছে বলে কথা। এত জলদি নিশ্চয়ই ফিরবে না। বিন্তুদের বাড়ির সামনে পানি জমেছে। বর্ণিল সাবধানে পা টিপে টিপে কাদা পার হলো। রাস্তার বাঁদিকে একটা সাদা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। এটা কি সেদিনের সেই গাড়িই কিনা বর্ণিল বুঝতে পারছে না। তাকে দেখেই গাড়ি থেকে একজন বয়স্ক ভদ্রলোক নেমে এলেন। ভদ্রলোকের মাথার উপরে কালো রঙের ছাতা। ছাতা তিনি নিজে হাতে ধরেন নি। ছাতা ধরে পিছনে পিছনে আসছে আরেকজন। বর্ণিল তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। এদেশের মানুষের হাতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকাপয়সা এলে তারা আর ছাতাটাও নিজ হাতে ধরতে পারে না। মশা মারতেও কামান আনে। এখানে গরিবের ঘোড়া রোগ হয়, আর বড়লোকের হয় কামান রোগ।
বয়স্ক ভদ্রলোক বর্ণিলের সামনে এসে দাঁড়ালেন। বর্ণিলকে ডেকে কোমল গলায় বললেন,
“বাবা, একটু শুনে যাও।”
বর্ণিল দাঁড়িয়ে পরলো। ভদ্রলোক যথাসম্ভব নিচু আওয়াজে কথা বলছেন। জিজ্ঞেস করলেন,
“তুমি কি এই বাড়ির কেউ?”
বর্ণিল না সূচক মাথা নেড়ে বলল,
“আমি আর এক বাড়ি পরে থাকি।”
“ওহ্! তার মানে খায়রুল সাহেবের প্রতিবেশী?”
“জ্বি। আপনাকে ঠিক চিনলাম না তো।”
ভদ্রলোক মুখ ভোঁতা করে উত্তর দিলেন,
“এবাড়ির সাথে আত্মীয়তা করতে এসেছি। মানে, এই বাড়ির মেয়ের সাথে আমার ভাতিজার বিয়ে ঠিক করেছি।”
উনি কার কথা বলছেন বর্ণিল বুঝতে পারলো না। জানতে চাইলো,
“এবাড়ির মেয়ে? মানে বিন্তুর কথা বলছেন?”
“হ্যাঁ, সেই মেয়েটিই। বড় বিপদে পরেছি এই মেয়েকে পছন্দ করে।”
“বিপদ! কি বিপদ?”
ভদ্রলোকের চোখেমুখে অসন্তুষ্টি। তিনি বিরক্ত গলায় বললেন,
“মেয়েটির আচার আচরণ প্রচন্ড উগ্র। আজ আমার ভাতিজা তাকে নিয়ে বাইরে গিয়েছিল। মেয়েটির এত বড় সাহস! সে আমার ভাতিজাকে অপমান করে চলে গেছে। ছেলেটা মন খারাপ করে বাড়ি ফিরেছে। বেয়াদব মেয়ে!”
বর্ণিল ভ্রু কুঁচকে ফেললো। অপমান করেছে মানে? বিন্তুর মতো একটা শান্তশিষ্ট মেয়ে কাউকে অপমান কেন করতে যাবে? সে বিভ্রান্তি নিয়ে বলল,
“আমার কাছে কি চাইছেন?”
ভদ্রলোক বিরস মুখে বললেন,
“খোঁজ নিতে চাইছি। বিয়েশাদি তো এক কথায় হয় না। প্রতিবেশীদের কাছে মেয়েটার ব্যাপারে খোঁজ নিবো বলে আমি এখানে এসেছি। এমন উগ্র আচরণ তো মেনে নেওয়া যায় না।”
বর্ণিল শীতল গলায় বলল,
“উগ্র মনে হলে বিয়েটা ভেঙে দিন।”
ভদ্রলোক শুকনো গলায় বললেন,
“বিয়ে ভাঙা যাবে না। এই বিয়ের অনেক সুবিধাও আছে। শুধু কিছু বিষয় জানা জরুরি।”
“কি বিষয়?”
ভদ্রলোক বর্ণিলকে একবার ভালো করে দেখে নিলেন। বললেন,
“তুমি তো ইনাদের প্রতিবেশী। দেখে মনে হচ্ছে বিন্তুর কাছাকাছিই তোমার বয়স। মেয়েটার স্বভাব চরিত্র কেমন?”
বর্ণিল বেশ অনাগ্রহ নিয়ে উত্তর দিলো,
“ও ভালো মেয়ে। শান্ত স্বভাব।”
“কোনো ছেলের সাথে কি ওর সম্পর্ক টম্পর্ক ছিল? আজকালকার মেয়ে। জেনে নেওয়া দরকার।”
বর্ণিল বিরক্ত হলো। তবে কথাবার্তায় বিরক্তি প্রকাশ করলো না। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে উত্তর দিলো,
“এতকিছু আমার জানা নেই। যদি আগে কোনো সম্পর্ক থেকেও থাকে সেটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। এখন তো ও এই বিয়েতেই রাজি হয়েছে।”
ভদ্রলোক হেসে উঠে বললেন,
“রাজি সে হয়েছে কিনা তা বোঝার উপায় নেই। বাবা নেই, এতিম মেয়ে। পরগাছার মতো মামাবাড়িতে বড় হয়েছে। ওর নিজের মতামত নেই। থাকাটা গুরুত্বপূর্ণও নয়। যাই হোক, বাবা। তোমাকে ধন্যবাদ।”
ভদ্রলোক বিন্তুদের বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন। বর্ণিল বিচলিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। লোকটার কথাবার্তা ঠিক ভালো লাগলো না তার। কেমন পরিবারে বিয়ে হচ্ছে বিন্তুর? আর বিন্তু অপমান করে চলে গেছে কথাটার মানে কি? বিন্তু তো এখনো বাড়ি ফেরে নি! বর্ণিলের কপালে চিন্তার ভাঁজ পরলো। গেল কোথায় মেয়েটা?
____________________________________________
সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। বৃষ্টি থামলেও আকাশ এখনো মেঘলা। আকাশে মেঘ থাকায় চারদিক অন্ধকার। চায়ের দোকানটায় টিমটিমে একটা আলো জ্বলছে। দোকান থেকে খানিকটা দূরে রাখা একটা বেঞ্চিতে বসেছে বিন্তু আর পল্লব। বিন্তুর হাতে চায়ের কাপ। সে দুই হাতে কাপটা ধরে ধীরে ধীরে ফু দিচ্ছে। বৃষ্টিতে ভেজায় তার ঠান্ডা লাগছে। শাড়ির আঁচল দিয়ে নিজেকে ঢেকে রেখেছে সে। তার পাশে পল্লব দাঁড়িয়ে আছে। বিন্তু তার দিকে না তাকিয়েই বলল,
“পল্লব সাহেব, আপনি হুট করে নিজের গল্পটাই আমাকে বললেন কেন?”
পল্লব চায়ে চুমুক দিয়ে উত্তর দিলো,
“মানুষ আত্মকেন্দ্রিক প্রাণী। দুঃখের সময় সবার আগে সে নিজের দুঃখ নিয়ে ভাবে। সুখের সময়ে ভাবে নিজের আনন্দের কথা। অপরের সুখ দুঃখ নিয়ে মানুষ চিন্তিত নয়। গল্প বলার ক্ষেত্রেও মানুষের আগে নিজের গল্পটাই মনে পড়ে।”
বিন্তু মুচকি হাসলো। আধো অন্ধকারে তার সবকিছু রহস্যময় লাগছে। অচেনা একটা মানুষের সাথে সে পুরো দিন কাটিয়ে দিলো! সেই মানুষটাকে সে ভালো করে দেখেও নি। বিন্তুর চোখে স্পষ্ট হওয়ার জন্য যতটুকু কাছে আসা প্রয়োজন, পল্লব ততটুকু কাছে একবারও আসে নি। সারাদিনে বিন্তুর একবারও বাড়ি যাওয়ার কথা মনেও পড়ে নি। পল্লব প্রশ্ন করলো,
“বনরুটি খাবেন, বিন্তু?”
বিন্তুর ক্ষিদে লেগেছিল। সারাদিনে তার খাওয়া হয় নি। কিন্তু সে সংকোচে সে কথা বলল না। মুখে হাসি টেনে বলল,
“জ্বি না। আমি খাব না।”
“খেয়ে দেখুন। ভালো লাগবে। দাঁড়ান, আমি নিয়ে আসছি।”
পল্লব দোকানের দিকে এগিয়ে গেল। দুটো বনরুটি নিয়ে বিন্তুর পাশে দূরত্ব রেখে বসলো। বিন্তুর দিকে এগিয়ে দিতেই বিন্তু এবার সংকোচ ছাড়াই সেটা নিলো। পল্লব প্রশ্ন করলো,
“আপনি বাড়ি ফিরবেন না?”
বিন্তুর হঠাৎ যেন চেতনা ফিরলো। বাড়ি! হ্যাঁ, ফিরতে হবে। কিন্তু তারপর? কে জানে কী অবস্থা এখন বাড়িতে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অস্পষ্ট গলায় বলল,
“না ফিরলেই ভালো হতো।”
পল্লব বুঝতে পারলো না। জিজ্ঞেস করলো,
“কিছু বললেন?”
বিন্তু মাথা নেড়ে বলল,
“না, কিছু না।”
পল্লব কথা বলল না। বাড়ির কথা মনে পড়তেই বিন্তুর মন খারাপ হয়ে গেছে। অন্ধকার গাঢ় হয়ে এসেছে। বাড়ি ফেরার সময় ঘনিয়ে এসেছে তার। সে আনমনে বলল,
“পল্লব সাহেব, আপনি নিজের গল্পটা আমাকেই কেন বললেন? আপনি তো আমাকে চেনেন না।”
পল্লব মৃদু হেসে উত্তর দিলো,
“মনের ভেতর জমানো দুঃখের গল্প মাঝেমধ্যে কাউকে বলতে হয়। কিন্তু মুশকিল হলো সব দুঃখের কথা সবাইকে বলা যায় না। কিছু দুঃখ থাকে, যেগুলো হয়তো কাছের মানুষরা বুঝতে পারে না। কিংবা কিছু কথা হয়তো কাছের মানুষকে বললে তারা চিন্তায় পরে যায়। সেই সময় কথাগুলো অচেনা কাউকে বলাটা মনের জমানো দুঃখ উগড়ে দেওয়ার একটা কৌশল। মানুষটাও হারিয়ে যাবে, সেই সাথে আপনি যে কাউকে কথাগুলো বলেছেন এই বিষয়টিও হারিয়ে যাবে।”
বিন্তু চমৎকৃত হলো। উৎসাহ নিয়ে বলে ফেললো,
“আপনি কি আমার কথাগুলো শুনবেন?”
পল্লব স্বাভাবিক গলায় বলল,
“নিশ্চয়ই। বলুন”
বিন্তু মাথা নাড়লো। নিচু গলায় বলল,
“আজ নয়। আজ বড় ক্লান্ত লাগছে আমার। আপনি কি আরেকদিন এখানে আসবেন? প্লিজ!”
পল্লবের হঠাৎ মায়া হলো। সে কোমল গলায় বলল,
“হু, আসবো। বলুন কবে?”
বিন্তু হতাশ গলায় বলল,
“কবে? আমি নিজেও তো জানি না।”
তার কথা শেষ হতেই হলুদ হেডলাইট জ্বালিয়ে দোকানের সামনে একটা গাড়ি এসে থামলো। পল্লব উঠে দাঁড়ালো। অস্ফুটে বলল,
“সর্বনাশ!”
বিন্তু বিচলিত হয়ে উঠে দাঁড়ালো। চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করলো,
“কি হলো?”
পল্লব উত্তর দিলো না। গাড়ি থেকে একজন ভদ্রমহিলা নেমে এলেন। উনার পরনে গাঢ় রঙের বোরকা। মাথা কালো চাদরে ঢাকা। মুখ দেখা যাচ্ছে। স্পষ্ট দেখতে না পেলেও বিন্তু বুঝতে পারছে উনি কিছুটা বয়স্কা। উনি সোজা হেঁটে তাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। পল্লব মাথা নিচু করে বলল,
“আম্মা, আপনি কষ্ট করে আসতে গেলেন কেন? খবর দিলে চলে আসতাম।”
বিন্তুর কাছে স্পষ্ট হলো ভদ্রমহিলার পরিচয়। সে কিছুটা পেছনে সরে দাঁড়ালো। ভদ্রমহিলা ভারী গলায় বললেন,
“কিভাবে খবর দেবো? না তোমার সাথে মোবাইল ফোন আছে, আর নাইই তোমার যাওয়ার জায়গার ঠিকঠাক ঠিকানা আছে।”
পল্লব কথা বলল না। ভদ্রমহিলা শুকনো গলায় বললেন,
“খবর দিতেই বা হবে কেন? সারাদিন যাযাবরের মতো বাইরে ঘুরছো। বাড়িতে আমি চিন্তা করি, সেটা ভেবেছ? এই বয়সে আর কত চিন্তা করবো?”
পল্লব মৃদু আওয়াজে বলল,
“ভুল হয়ে গেছে, আম্মা।”
ভদ্রমহিলা এবার বিন্তুর দিকে তাকালেন। বিন্তুকে ভালো করে দেখে নিলেন একবার। তারপর পল্লবকে প্রশ্ন করলেন,
“ও কে?”
পল্লব ইতস্তত করে উত্তর দিলো,
“ওর নাম বিন্তু।”
“তুমি কি ওকে পছন্দ করো? বিয়ে করতে চাও?”
বিন্তু হকচকিয়ে গেল। কি বলছেন উনি এসব! পল্লব বিব্রত বোধ করলো। তাড়াহুড়ো করে বলল,
“না, আম্মা। আপনি যেমন ভাবছেন তেমন কিছু নয়। উনার সাথে আমার আজই পরিচয় হয়েছে। নাম ছাড়া আর কিছুই জানা হয় নি এখনো।”
উনি অবাক হলেন না। যেন ছেলের এমন স্বভাবের সাথে তিনি পরিচিত আছেন। উনি এবার কোমল গলায় বিন্তুকে প্রশ্ন করলেন,
“তুমি থাকো কোথায়, মা?”
বিন্তু কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দিলো,
“জ্বি, বাগানবাড়ি।”
“ঠিক আছে, মা। আমাদের সাথে এসো। তোমাকে পৌঁছে দিয়ে তারপর আমরা বাড়ি যাব।”
বিন্তু উত্তর দিতে পারলো না। ভদ্রমহিলা বিন্তুর দিকে এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরলেন।
_________________________________________
রাত আটটা বেজেছে। শিরিন দোতলা থেকে নেমে বাইরের বসার ঘরে ঢুকলো। অমিত সোফায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে গান শুনছে। এই ঘরে শিরিনের দাদাজানের সময়ের একটা পুরানো টেপ রেকর্ডার আছে। অমিত সেটাতে নজরুল গীতির একটা ক্যাসেট চালিয়েছে। শিরিন দ্রুত পায়ে গিয়ে টেপ রেকর্ডার বন্ধ করে দিলো। অমিত চোখ খুলে বলল,
“একি! বন্ধ করলে কেন?”
শিরিন প্রচন্ড রেগে আছে। সে হিসহিসিয়ে বলল,
“তুমি জানো সকাল থেকে কতকিছু সহ্য করতে হচ্ছে আমাকে? আর তুমি মনের আনন্দে গান শুনছো?”
অমিত ঠান্ডা গলায় বলল,
“রেগে যেয়ো না। তুমিও গান শুনতে পারো চাইলে। এতে চিন্তা কমবে।”
শিরিন চিৎকার করে বলল,
“অমিত! আমি মজা করছি না। সকাল শুরু হয়েছে তোমাকে নিয়ে ঝামেলায়। তারপর ওই লোকটা এসে বিন্তুকে নিয়ে যা তা বলে গেছে। মা বাবা দুজনেই ভীষণ রেগে আছে। তার উপর বিন্তু এখনো বাড়ি ফেরে নি। ফুপু ঘরে বসে কাঁদছে। আর তুমি!”
অমিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“আমি বুঝতে পারছি তুমি খুব চিন্তিত। কিন্তু আমার কি কিছু করার আছে?”
শিরিন চোখ বন্ধ করে বড় করে একবার শ্বাস নিলো। তারপর রুক্ষ গলায় বলল,
“অমিত, আমার বাড়িতে এভাবে হুট করে এসে ঝামেলা বাঁধিয়েছ তুমি। এই অপরাধে আমি তোমাকে বিয়ে করবো না।”
অমিত শান্ত গলায় বলল,
“তুমি না করতে চাইলে করবে না। অসুবিধা কি?”
শিরিনের রাগে গা জ্বলে গেল। এ কেমন ছেলের সাথে প্রেমে জড়িয়েছে সে! রেগে কিছু বলতে যাওয়ার আগেই কলিং বেল বাজলো। সে একবার রাগী চোখে অমিতের দিকে তাকালো। তারপর হনহন করে বেরিয়ে গেল। দরজা খুলে সে বিন্তুকে দেখতে পেলো। শিরিনের যেন প্রাণ ফিরে এলো। সে বিন্তুকে হাত ধরে ভেতরে নিয়ে এলো। আদরের গলায় বলল,
“কোথায় ছিলি, বিন্তু? তুই তো পুরো ভিজে গিয়েছিস। চল, ঘরে চল।”
শিরিন বিন্তুকে নিয়ে ঘরে যেতে পারলো না। উঠানে শর্মিলি আর খায়রুল সাহেব দাঁড়িয়ে আছেন। শর্মিলি হিসহিস করে বললেন,
“নষ্ট মেয়েছেলে! সারাদিন কার সাথে কাটিয়ে এলি?”
শিরিন চাপা গলায় বলল,
“মা! থামো।”
শর্মিলি থামলেন না। চিৎকার করে সায়লাকে ডাকলেন,
“সায়লা, কোথায় গেলে? বেরিয়ে এসো। তোমার গুণবতী মেয়ে আমাদের নাক কেটে ফিরে এসেছে।”
সায়লা প্রায় সাথে সাথেই ছুটে বেরিয়ে এলেন। বিন্তু ভয়ে ভয়ে মায়ের দিকে তাকালো। মায়ের চোখমুখ লাল হয়ে আছে। বোধহয় এতক্ষণ কান্নাকাটি করেছে। বিন্তু অস্ফুটে উচ্চারণ করছিল,
“মা, আ…আমি…. ”
তার কথা শেষ হলো না। সায়লা উর্ধশ্বাসে ছুটে গিয়ে বিন্তুর চুলের মুঠি ধরলেন। বিন্তু যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠলো। সায়লা জ্ঞানশূন্য হয়ে বললেন,
“বেইমান বেহায়া মেয়ে। তোকে আজকে সবার সামনে আমি মারবো। শেষ করে ফেলবো তোকে। আর কত জ্বালাবি আমাকে?”
শিরিনের চোখে পানি এসে গেল। সে অনেক চেষ্টা করেও ফুপুকে আটকাতে পারলো না। শুধু অস্পষ্টভাবে বলতে লাগলো,
“ছেড়ে দাও, ফুপু। ছেড়ে দাও।”
শিরিনের কথা সায়লা শুনলেন না। উনি শুনলেন খায়রুল সাহেবের কথা। খায়রুল সাহেব প্রচন্ড এক ধমক দিয়ে বললেন,
“সায়লা! মেয়েকে ছেড়ে দে।”
সায়লা ছেড়ে দিলেন। তারপর মুখে আঁচল দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে চলে গেলেন উনি। প্রচন্ড অভিমান আর অপমানে বিন্তুর চোখ থেকে পানি পরতে শুরু করেছে। শিরিন তাকে একহাতে ধরে রেখেছে। খায়রুল সাহেব এগিয়ে গেলেন। কঠিন গলায় বললেন,
“এই নিয়ে আমাকে দুইবার অপমানিত হতে হলো তোর জন্য। তুই কি বোধবুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছিস, বিন্তু? হাবিবের বড় চাচা নিজে এসেছিলেন আজ। হাবিব তোকে নিয়ে ভালো কোনো রেঁস্তোরায় খেতে চেয়েছে। এটা কি কোনো অপরাধ? কেন তুই তাকে অপমান করে চলে গিয়েছিস?”
বিন্তু উত্তর দিলো না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। শিরিন অস্থির হয়ে বলল,
“বাবা, এসব কথা পরে হবে। ওকে ঘরে নিয়ে যাই।”
“না, শিরিন। ওকে আগে বলতে হবে কেন ও আমাকে অপমান করলো?”
বিন্তু এবারও উত্তর দিলো না। কিন্তু উত্তর এলো দরজার দিক থেকে। শীতল মেয়েলি গলায় কেউ বলল,
“বেশ করেছে।”
সকলে দরজার দিকে ঘুরে তাকালো। উঠোনের মাথায় শাড়ি পরিহিত এক যুবতী দাঁড়িয়ে আছে। শিরিন আচ্ছন্নের মতো বলে উঠলো,
“বড় আপা!”
শর্মিলি ছুটে গেলেন। মেয়েটির হাতে মুখে চুমু খেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। কেঁদে ফেলেছেন তিনি। হড়বড় করে বলতে লাগলেন,
“রুনি! আমার রুনি! মা, তুই এসেছিস? আমি জানতাম তুই একদিন আসবিই। মা বাবার উপর কি রাগ করে থাকা যায়? মা আমার! কেমন আছিস, মা? এতদিন পরে আমার কথা তোর মনে পড়েছে?”
রুনি নিজেকে মায়ের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিলো। কঠিন গলায় বলল,
“না, মা। তোমার কথা আমার মনে পড়ে নি। আমি এসেছি বিন্তুর বিয়ের খবর শুনে।”
শর্মিলি আহত চোখে তাকিয়ে রইলেন। রুনি উনার হাত সরিয়ে দিয়ে সামনে এগিয়ে এলো। খায়রুল সাহেবের সামনে এসে দাঁড়ালো সে। খায়রুল সাহেবের বুক কাঁপছে। উনি নিজের বড় কন্যার মাথায় হাত রেখে জানতে চাইলেন,
“মা, ভালো আছিস?”
রুনি এ প্রশ্নের উত্তর দিলো না। রুক্ষ গলায় বলল,
“বিন্তু যা করেছে ঠিক করেছে, বাবা। তোমাদের সব কথাই এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনেছি। তোমরা বিয়েটা ঠিক করার আগে একবার জানতে চেয়েছিলে ওর মত আছে কিনা? জিজ্ঞেস করেছিলে এই ছেলেটাকে ওর পছন্দ কিনা? ছেলের বড় চাচা কি না কি বলে গেছে সেই কথায় তোমরা ওকে দোষারোপ করছো! একবার ওর থেকে জানতে চেয়েছ কি ঘটেছিল? মেয়েটা সারাদিন পর বাইরে থেকে এসেছে। জানতে চেয়েছ সারাদিনে ও খেয়েছে কিনা? জিজ্ঞেস করেছ একবারও যে ও ঠিক আছে কিনা? তোমরা সবসময়ের মতো নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত। ছি, বাবা!”
খায়রুল সাহেব বজ্রাহতের ন্যায় দাঁড়িয়ে রইলেন। রুনি বিন্তুর হাত ধরে বলল,
“যা করেছিস ঠিক করেছিস। একদম কাঁদবি না। চল, ঘরে চল।”
রুনি আর কোনোদিকে না তাকিয়ে বিন্তুকে নিয়ে ঘরে চলে গেল। বাকি সবাই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো উঠোনে। গুড়গুড় করে মেঘ ডাকতে শুরু করেছে। মনে হচ্ছে, এক্ষুনি আবার বৃষ্টি পরতে শুরু করবে। বাতাসে ভেজা গন্ধ।
.
#চলবে…………….

চড়ুই নীড়ে বসবাস পর্ব-০৬

0

#চড়ুই_নীড়ে_বসবাস
#আলো_রহমান(ফারজানা আলো)
#পর্ব:৬
.
হাইস্কুলের পাশ থেকে বিন্তু রিকশা নিয়েছে। রিকশা যাচ্ছে পুরানো রাজবাড়ির দিকে। রিকশা চলছে ভীষণ এলোমেলো গতিতে। প্রচন্ড বাতাসে সে ভালো করে চোখ খুলতে পারছে না। তার চুল উড়ে চোখেমুখে পরছে। রিকশাওয়ালা ক্রমাগত কিছু বলে চলেছে। বিন্তু কিছুই ভালো করে শুনতে পাচ্ছে না। সে বিরক্তি নিয়ে বলল,
“হয় রিকশা ধীরে চালান, আর নয়তো মুখ বন্ধ রাখুন।”
রিকশা হুট করে থেমে গেল। প্রচন্ড গতিতে চলমান রিকশা হুট করে ব্রেক কষায় রিকশা প্রায় উল্টে যাচ্ছিলো। শেষ পর্যন্ত রিকশা না উল্টালেও, রিকশা থেকে পরে গেল বিন্তু। রাস্তার ধারে রাখা বালির স্তুপে পরায় গুরুতর জখম হলো না। কিন্তু চশমা ছিটকে গিয়ে পরলো রাস্তার ঠিক মাঝে। চুরমার হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে গেল চশমার কাঁচ। বিন্তু অস্ফুটে বলল,
“আমার চশমা!”
রিকশাওয়ালা মাঝবয়সী লোক। চেহারায় উন্মাদ একটা ভাব, চাল চলনে দারুণ অসভ্য। সে বলে উঠলো,
“গরিবরা কথা কইলেই চুপ করতে কন ক্যান?”
বিন্তু শান্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো। শাড়ি থেকে বালি ঝেড়ে ফেলে দিয়ে ব্যাগটা কুড়িয়ে নিলো। তার পায়ের জুতা জোড়া পরেছে রাস্তার আরেকদিকে। সে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে জুতা পরলো। খেয়াল করলো তার পায়ের চামড়া হালকাভাবে ছিলেছে, সেখানে রক্ত জমে আছে। বিন্তু ধীরে ধীরে এগিয়ে এলো। রিকশাওয়ালার দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,
“আপনি একজন অত্যন্ত অসভ্য এবং বাচাল লোক।”
কথা শেষ করে বিন্তু সামনে এগিয়ে যেতে শুরু করলো। সে এখন আছে রাজবাড়ির পেছনের পুকুরের পাশে। আরেকটু এগিয়ে গেলেই সে তার কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছে যাবে। রিকশাওয়ালা চিৎকার করে উঠলো,
“আমার ভাড়া না দিয়া কই যান?”
বিন্তু সেই কথা কানেও তুললো না। তার ঝাপসা দৃষ্টিতেই সে এগিয়ে চলল সামনের দিকে।
রাজবাড়ির আধভাঙা দালানের চারপাশে ঝাঁ চকচকে অনেক নতুন দালান। সেখান থেকে কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলেই রাজবাড়ির সাথে নদীর বাঁধানো ঘাট। বিন্তু সেখানে গিয়ে বসলো। সে চাইলে কফি শপ থেকে বেরিয়ে নদীর বাঁধ ধরে হেঁটে সোজা এখানে এসে বসতে পারতো। কিন্তু এতটাই রাগ হচ্ছিলো তার যে ঠিকঠাক সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠতে পারছিল না কোথায় যাবে। ফলস্বরূপ হাইস্কুলের সামনে দিয়ে ঘুরে আসতে হলো। বিন্তু দীর্ঘশ্বাস ফেলে নদীর দিকে তাকালো। নদীর জল শান্ত। দূরে কোথায় যেন নৌকার ইঞ্জিনের শব্দ। বিন্তু ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। সে কিছুই ভালো দেখতে পাচ্ছে না। এমনটাও হতে পারে যে নৌকাটা তার থেকে অল্পই দূরে, সে বুঝতে পারছে না। সে চিন্তায় পরলো। নতুন আরেকটা চশমা কিনতে হবে ভাবতেই অস্থির লাগছে। তার এভাবে চলে আসার খবর নিশ্চয়ই বাড়ি অব্দি পৌঁছাবে। এরপর কি আর তার চশমা নিয়ে ভাবার সময় থাকবে কারোর?
“আমি কি এখানে বসতে পারি?”
পুরুষালি কন্ঠে বিন্তু পিছনে ফিরে তাকালো। লম্বামতো একজন ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। বিন্তু তার মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। সে ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কে আপনি?”
উত্তর এলো,
“আমাকে চিনতে পারছেন না? সেদিন বৃষ্টির মধ্যে আপনার সাথে দেখা হয়েছিল। আপনার সাথে ডাকবাংলোর পাশের চায়ের দোকানে চা খেয়েছিলাম।”
বিন্তু চোখ বন্ধ করলো। তার চোখ ব্যথা করছে। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল,
“ওহ্! আপনিই সে ব্যক্তি যে প্রথম দেখায় আমার জীবন গল্প শুনতে চেয়েছিলেন।”
হাসির আওয়াজ এলো। হাসতে হাসতেই ভদ্রলোক বিন্তুর পাশে বসলেন। বিন্তু বিরক্তি নিয়ে বলল,
“হাসছেন কেন?”
“লজ্জিত হয়ে হেসেছি। মানুষ যখন লজ্জায় পরে, তখন সে বিব্রত ভঙ্গি আড়াল করতে হাসে।”
“জেনে উপকৃত হলাম। আমার কাছে কি চান?”
ভদ্রলোক ইতস্তত করে বললেন,
“আপনি বোধহয় রাগ করছেন। আপনার কাছে আমি কিছু চাই না। আমি এখানে কিছুক্ষণ বসবো বলে এসেছিলাম। আমার মন খারাপ থাকলে আমি এখানে আসি। আপনার সাথে দেখা হয়ে গেল তাই কথা বললাম।”
বিন্তু চোখ মেললো। লোকটার দিকে তাকিয়ে তার মুখ দেখার চেষ্টা করলো। উনি বসেছেন বিন্তুর থেকে কম করে হলেও তিন হাত দূরে। বিন্তু স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে না। ভদ্রলোক বললেন,
“সেদিন আপনি আমার উপরে বিরক্ত হয়েছিলেন। আমার ওভাবে আপনার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে জিজ্ঞেস করাটা হয়তো ঠিক হয় নি। আমি ক্ষমা চাইছি।”
বিন্তু হেসে ফেলে বলল,
“আপনি যদি ভেবে থাকেন আজ আমি আপনাকে বলবো তাহলে আপনি ভুল ভাবছেন। আমি এখনো পর্যন্ত আপনার চেহারাও দেখি নি।”
ভদ্রলোক এবার হতভম্ব গলায় বললেন,
“আপনি তো বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন!”
বিন্তু শব্দ করে হেসে উঠলো। হাসির ধাক্কায় কিছুক্ষণ কথা বলতে পারলো না। দেখতে না পেলেও বিন্তু বুঝতে পারছে ভদ্রলোক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে আছেন। বিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“জ্বি, তাকিয়ে থেকে দেখার চেষ্টা করছি। কিন্তু তবুও দেখতে পাচ্ছি না।”
ভদ্রলোক ইতস্তত করলেন। আমতা আমতা করে বললেন,
“ইয়ে….কিছু মনে করবেন না। আপনি কি…আপনি কি অন্ধ?”
বিন্তু আবার হেসে উঠলো। এবারে সে হাসতেই হাসতেই বলল,
“না, আল্লাহর অশেষ রহমতে আমি অন্ধ নই। কিন্তু অর্ধ অন্ধ।”
“মানে?”
“মানে আমার চোখ জোড়া খারাপ। মোটা চশমা ছাড়া আমি দেখতে পাই না।”
ভদ্রলোক হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললেন,
“ওহ্ হ্যাঁ! প্রথমদিন আপনার চোখে চশমা দেখেছিলাম। সেজন্যই আজ আপনাকে একটু অন্যরকম লাগছে। সেদিন কি ঝাপসা চশমার কারণে দেখতে পান নি?”
“জ্বি।”
“আজ চশমা পরেন নি যে?”
বিন্তু উদাসভাবে উত্তর দিলো,
“পরে গিয়েছিলাম। ভেঙে গেছে।”
“ও আচ্ছা।”
ভদ্রলোক চুপ করে গেলেন। বিন্তুও কথা বলল না। দুজনের দৃষ্টিই নদীর জলে। ইঞ্জিন নৌকার চলার শব্দ ক্ষীণভাবে এখনো শোনা যাচ্ছে। হঠাৎই আকাশ চিড়ে বিদ্যুৎ চমকালো। মেঘ গুড় গুড় করার আওয়াজে নীরবতা চটের বস্তার মতো চিড়ে গেল। বিন্তু দুই হাত দিয়ে কান চেপে ধরলো। ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন,
“আপনি ভয় পাচ্ছেন?”
বিন্তু মাথা নাড়িয়ে ছোট্ট করে বলল,
“উঁহু।”
“আপনি আবার আনমনা হয়ে পরেছেন। একটু আগে যখন হাসছিলেন, তখন আপনাকে ভালো দেখাচ্ছিল।”
বিন্তু দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সত্যিই তো! কতদিন পরে সে এভাবে হাসলো! শেষ কবে প্রাণ খুলে হেসেছিল ভুলেই গেছে সে। মুচকি হেসে বলল,
“ধন্যবাদ। আপনি এখানে না এলে আমি হয়তো হাসতাম না।”
ভদ্রলোক মাথা নিচু করে বললেন,
“স্বাগতম।”
বিন্তু স্বাভাবিক গলায় বলল,
“জানেন? আজ আমার ভীষণ মেজাজ খারাপ। মনও খারাপ। এক রিকশাওয়ালার অসভ্যতায় আমার চশমা ভেঙেছে। উনি এত বাজেভাবে চালাচ্ছিলেন যে আমি রিকশা থেকে পরে গেলাম। আর তারপর আমি উনাকে ভাড়া না দিয়েই চলে এসেছি। ভাড়া দিই নি বলে এখন খারাপ লাগছে। দেওয়া উচিত ছিল।”
“খারাপ লাগার কিছু নেই। সে আপনার ক্ষতি করেছে, আপনি তার ক্ষতি করেছেন। সমান সমান।”
বিন্তু বিস্মিত হলো। কত সহজে কথাটা বলে দিলো লোকটা! বিন্তু প্রশ্ন করলো,
“জীবনকে এত সহজভাবে নেওয়া যায়?”
ভদ্রলোক হেসে উত্তর দিলেন,
“উঁহু, সবসময় যায় না। কিন্তু কখনো কখনো নিতে হয়। নইলে জীবন কাটাবেন কি করে?”
বিন্তু উত্তর দিলো না। পাশের থামে হেলান দিয়ে ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে বলল,
“আপনি কি কষ্ট থেকে মুক্তির উপায় জানেন?”
“না, জানি না। তবে কিছুক্ষণ আপনি অন্যের জীবনের গল শুনতে পারেন। মস্তিষ্ক ব্যস্ত থাকবে।”
“আপনি তো লেখক। অনেক গল্প জানেন। একটা শোনান না আমায়!”
“আপনি শুনতে চাইলে শুনাতে পারি।”
“শুনতে চাইছি।”
ভদ্রলোক কোনোরকম ভূমিকা না করেই বলতে শুরু করলেন,
“একটা ছেলে। ক্লাস নাইনে পড়ার সময় এক ভয়াবহ সুন্দরীর প্রেমে পরলো। খুব ছেলেমানুষি প্রেম। বইয়ের ভেতর লুকিয়ে চিরকুট দেওয়া, ক্লাসে বসে চোখাচোখি করা। কলেজে পড়ার সময় বাড়ি থেকে মেয়েটার বিয়ে ঠিক হলো। মেয়েটা বিয়ে করবে না বলে পালিয়ে গেল ছেলেটির বাড়িতে। ছেলের মা বাবা ভীষণ রেগে মেয়েকে তার বাড়িতে ফিরিয়ে দিয়ে আসতে চাইলো। ছেলেটা বিদ্রোহ করলো। ঘোষণা করলো, এই মেয়ের অন্য কোথাও বিয়ে হলে সে বাড়ি ছাড়বে। শেষে তাই ছাড়লো। কিন্তু একা নয়, মেয়েটিকে নিয়েই। তারা সংসার পাতলো। ছেলেটা টুকটাক লেখালেখি করছিল। তাই করতে লাগলো। আর মেয়েটা বাচ্চাদের পড়াতে লাগলো। এভাবে খারাপ চলছিল না। বিয়ের দুই বছর পরে মেয়েটি সন্তানসম্ভবা হলো। খবর পেয়ে মেয়েটির বাবা এলো। দুই বছর পরে তারা বিয়েটা মেনে নিলো। তার বড়লোক বাবা ছেলেটিকে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দিতে চাইলো। ছেলেটা প্রত্যাখ্যান করলো। খান বংশের ছেলে সে। শ্বশুরের তদবিরে চাকরি সে কখনো নিতে পারে? সে লেখালেখিতেই মনোযোগ দিলো। দিন নেই রাত নেই, শুধু লিখতে লাগলো। লিখতে লিখতে স্ত্রী সন্তানের খোঁজ নিতেও ভুলে গেল। একদিন তাদের পুত্র সন্তান এই পৃথিবীতে এলো। সন্তানের জন্ম হলো এক দুরারোগ্য ব্যাধি নিয়ে। চিকিৎসার দরকার পরলো। ছেলেটির শ্বশুর চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে চাইলেন। ছেলেটি ভীষণ অহংকারে তা ফিরিয়ে দিলো। ছেলেটির স্ত্রী তার পায়ে পরে গেল। কিন্তু তবুও ছেলেটি রাজি হলো না। বাচ্চাটির মৃত্যু হলো।”
ভদ্রলোক থামলেন। বিন্তু থমথমে গলায় জানতে চাইলো,
“তারপর?”
ভদ্রলোক একটু সময় নিলেন। চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে রইলেন। নিচু গলায় বললেন,
“সন্তানের মৃত্যুর জন্য ছেলেটিকে দায়ী করলো তার স্ত্রী। কঠিন গলায় বলল, তোমার অহংকারে আমার সন্তান মারা গেছে। তোমার মতো স্বার্থপর একজনকে বিয়ে করে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করেছি। তোমাকে আমি ঘৃণা করি। তারপর মেয়েটি চলে গেল। ছেলেটিকে ছেড়ে ফিরে গেল তার বাবার কাছে। সেদিন না বুঝলেও, আজ ছেলেটি ঠিকই নিজের ভুলগুলো বুঝতে পারে। কিন্তু সময় চলে গেছে। এখন আর সাধন হবে না।”
বিন্তু মলিন গলায় বলল,
“ছেলেটির নাম কি?”
“পল্লব। ছেলেটির নাম পল্লব।”
“আপনিই কি সেই পল্লব?”
ভদ্রলোক হাসলেন। বিন্তুর দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আপনি বুদ্ধিমতী।”
বিন্তুর মন আরও খারাপ হলো। সে পরিবেশটা হালকা করার উদ্দেশ্যে বলল,
“আপনি কেমন লিখতে পারেন জানি না। কিন্তু গল্প বলাতে আপনি খুবই খারাপ।”
পল্লব হাসলেন। বিন্তু প্রশ্ন করলো,
“আপনার স্ত্রী এখন….?”
পল্লব ভেতরের দীর্ঘশ্বাস চেপে উত্তর দিলেন
“ভালো আছে। কয়েক বছর হলো আবার বিয়ে করেছে। খোঁজ নিয়েছি। সুখে আছে।”
“আর আপনি?”
পল্লব হেসে উঠে উত্তর দিলো,
“আমি এক গরিব পুরুষ। বাবার ব্যবসায় হাত দিয়েছিলাম। তারপর তাতে ধ্বস নেমেছে। ব্যবসায় মন্দা। আমার ছোট ভাই ব্যবসাটা আবার দাঁড় করাতে হিমশিম খাচ্ছে। আর আমি নিজের হাতখরচ চালাতে একটা পত্রিকায় বাচ্চাদের ছড়া লিখছি। তাও আমার এক বন্ধু দয়া করে সুযোগ দিয়েছিল বলে। প্রতি সপ্তাহে দশটা ছড়া জমা দিতে হয়। ওরা বেছে বেছে একটা ছাপায়। কাল ছড়া জমা দেওয়ার দিন। আমি এখনো একটা ছড়াও লিখি নি।”
বিন্তু দুঃখিত হলো। ইতস্তত করে বলল,
“উনার বিয়ে করা নিয়ে আপনার কোনো অভিযোগ নেই?”
“অভিযোগ থাকবে কেন? মানুষ অল্প বয়সে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। তাই বলে কি পরবর্তীতে আর জীবনকে সাজিয়ে নেবে না?”
বিন্তু মৃদু হেসে বলল,
“আপনি ভীষণ ভালো।”
“ছিলাম না। এখন হওয়ার চেষ্টা করছি।”
বিন্তু কথা বলল না। সে সামনে তাকালো। যে মানুষ নিজেই দুখী, সে আরেকজনকে সান্ত্বনা দিতে পারে না। বিন্তুও পারলো না। মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। নদীর জলে ঝমঝম করে বৃষ্টি পরছে। বৃষ্টি কি আনন্দদায়ক নাকি কষ্টকর?
___________________________________________
অন্তু মুখ ভোঁতা করে অংক করছে। এই বৃষ্টির মধ্যেও বর্ণিল তাকে পড়াতে এসেছে। সে ভেবেছিল আজ আরাম করে শুয়ে টিভি দেখবে। কিন্তু তা হতে পারলো না। বর্ণিল বেশ কিছুক্ষণ যাবৎ উশখুশ করছে। বিন্তুর খবর জানার জন্য সে ছটফট করছে। কিভাবে জিজ্ঞেস করবে বুঝতে পারছে না। বেশ অনেকটা সময় ইতস্তত করার পরে বর্ণিল মুখ খুললো। হালকা কেশে বলল,
“অন্তু, তোমার মাকে বলে দিয়ো আজ নাস্তা লাগবে না।”
অন্তু অনাগ্রহের সাথে উত্তর দিলো,
“এমনিতেও কেউ আজ আপনাকে নাস্তা দেবে না। বাড়ির অবস্থা ভালো না।”
বর্ণিল ভ্রু কুঁচকে বলল,
“বাড়িতে কি হয়েছে? তোমার আপার বিয়ে নিয়ে কিছু?”
“না। শিরিন আপার বিয়ে নিয়ে।”
“শিরিনের বিয়ে নাকি? কবে?”
“না, বিয়ে নয়। শিরিন আপার প্রেমিক এখানে এসেছে আপাকে বিয়ে করতে।”
বর্ণিল হতভম্ব হয়ে গেল। বিস্ময় নিয়ে বলল,
“বলো কি?”
“ঠিকই বলছি। কাল রাতে ছেলেটা এই বাড়িতে এসে উঠেছে।”
বর্ণিল অবাক হলো। সত্যিই কি ছেলেটা শিরিনকে বিয়ে করবে বলে এসেছে? এত সাহসী প্রেমিকও হয়? শুধু সেইই বুঝি সাহস করে উঠতে পারে নি। বিন্তু ঠিকই বলেছিল। সে একজন অযোগ্য প্রেমিক। প্রেমকে আগলে রাখার যোগ্যতা তার ছিল না। বর্ণিল দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ছেলেটা যে শিরিনের প্রেমিক সেটা তোমাকে কে বলেছে?”
“বলতে হবে কেন? আমি সব বুঝতে পারি।”
বর্ণিল হেসে ফেলে বলল,
“তাই নাকি? আর কি কি বুঝতে পারো তুমি?”
অন্তু হাত থেকে কলম রাখলো। খাতা থেকে চোখ সরিয়ে বর্ণিলের দিকে তাকালো। মুখে হাসি টেনে বলল,
“এখন আমি বুঝতে পারছি যে আপনি আপার খোঁজ জানতে চাইছেন। আপা তার হবু বরের সাথে বাইরে গেছে।”
বর্ণিল হকচকিয়ে গেল। আমতা আমতা করে বলল,
“আ…আমি তোমার আপার খোঁজ কেন চাইবো?”
অন্তু কোনোরকম সংকোচ না করে বলল,
“কারণ আপনি আপাকে পছন্দ করেন।”
বর্ণিল আচ্ছন্নের মতো বলল,
“আমি তোমার আপাকে পছন্দ করি?”
“হ্যাঁ। শুধু পছন্দ না, আপনি আপাকে ভালোবাসেন।”
বর্ণিল কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলো,
“আর….তোমার আপা?”
অন্তু কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,
“আপা আপনাকে ঘৃণা করে।”
বর্ণিল কাঠের মূর্তির মতো বসে রইলো। সামনে বসে থাকা কিশোরীটিকে তার মনে হলো এই পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম মানুষ।
.
#চলবে……….

চড়ুই নীড়ে বসবাস পর্ব-০৫

0

#চড়ুই_নীড়ে_বসবাস
#আলো_রহমান(ফারজানা আলো)
#পর্ব:৫
.
সবকিছু সামলে শিরিন সবেমাত্র নিজের ঘরে গিয়ে বসেছে। ভীষণ ক্লান্তিতে শরীর এলিয়ে পড়েছে তার। বিশাল একটা ঝামেলা সামলানো গেছে ভেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো সে। সময় বুঝে অমিতকে উচিত শিক্ষা দেবে সে। এভাবে ঝামেলা বাঁধানোর কোনো মানে হয়? এমনিতেই বিন্তুর ব্যাপারটা নিয়ে সে চিন্তিত। আপাতত নিজেকে কিছুক্ষণ স্বস্তি দিতে শিরিন একটা ম্যাগাজিন হাতে বিছানায় হেলান দিয়ে বসলো। প্রথম পাতা খুলতেই শর্মিলি তার ঘরে ঢুকলেন। শিরিন ক্লান্ত ভঙ্গিতে বলল,
“আবার কি হলো, মা?”
শর্মিলির মুখ থমথমে। উনি নিঃশব্দে বিছানার এক কোণায় বসলেন। অসম্ভব রকমের ভারী গলায় বললেন,
“শিরিন, মা বাবাকে কষ্ট দিয়ে কিছু করতে নেই।”
শিরিন ভ্রু কুঁচকে ফেললো। কোনো উত্তর না দিয়ে পুনরায় ম্যাগাজিনের পাতায় দৃষ্টি নিবদ্ধ করলো। কিছুক্ষণ নীরবতার পরে শর্মিলি আবার বললেন,
“তোর বড় বোন আমাদের সাথে আর যোগাযোগ রাখে নি। আমাদের কথা মনেও পড়ে না তার। কিন্তু এই আমিই ওকে জন্ম দিয়েছি। আমার হাতে ও মানুষ হয়েছে। ওকে লালন পালন করে কি আমি দোষ করেছি?”
শিরিন নির্লিপ্তভাবে জবাব দিলো,
“দোষ করেছ ওর অমতে ওকে বিয়ে দিয়ে।”
শর্মিলি আহত চোখে তাকালেন। শুকনো গলায় বললেন,
“ওর খারাপ করেছি? ও কি সুখে নেই?”
“সে তো আর তুমি আমি ঠিক করতে পারি না, মা। ওর মনে সুখ আছে কিনা, সেটা ওইই বলতে পারবে। আর সুখ থাকলেও হয়তো ওর অভিমান মেটে নি এখনো। কে জানে!”
“তুই আমার সাথে এত কঠিন করে কথা বলছিস কেন, শিরিন?”
“কঠিন করে কথা বলছি না।”
শর্মিলি শিরিনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। ওর মনোযোগ ম্যাগাজিনের পাতায়। মায়ের দিকে ভুলেও তাকাচ্ছে না। শর্মিলি এবার ব্যথিত গলায় বললেন,
“তোকে তোর বাবা খুব ভালোবাসা দিয়ে বড় করেছে। কোনোকিছুর কমতি রাখে নি। আমিও তোর কোনো কাজে বাধা দিই নি। এর প্রতিদানে কষ্ট পাওনা আমাদের?”
শিরিন স্বাভাবিক গলায় বলল,
“না। বিন্তু আর ফুপুকে কষ্ট দেওয়ার প্রতিদানে কষ্ট পাওনা তোমার।”
শর্মিলি বজ্রাহতের ন্যায় তাকিয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর চিৎকার করে উঠলেন,
“শিরিন!”
“চিৎকার করো না, মা।”
শর্মিলি উঠে দাঁড়ালেন। রাগী গলায় বললেন,
“ঠিক আছে। তোর আদরের ফুপুকে আমি কষ্ট দিয়েছি। আমার সাথে তোকে কথা বলতে হবে না। তুই তোর বাবার সাথে কথা বল। সে তো আর কাউকে কষ্ট দেয় নি।”
শিরিন চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকালো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“তুমি বাবাকে অমিতের বিষয়টা জানিয়ে দিয়েছ?”
“হ্যাঁ, দিয়েছি। চেনা নেই, জানা নেই, একটা ছেলে আমার মেয়েকে বিয়ে করতে আমার বাড়িতে এসে উঠেছে। আর আমি কিছু বলবো না?”
কথা শেষ করে শর্মিলি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। শিরিন বিছানা ছেড়ে নামলো। ক্লান্ত ভঙ্গিতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। বাবার ঘরের সামনে গিয়ে শিরিন থামলো। তার বাবা পায়চারি করছেন। উনাকে দেখে ভীষণ চিন্তিত এবং বিচলিত মনে হচ্ছে। শিরিন দরজায় দাঁড়িয়েই বলল,
“বাবা, চা এনে দেবো?”
খায়রুল সাহেব তাকালেন। গম্ভীর গলায় বললেন,
“ভেতরে আয়।”
শিরিন ভেতরে গেল। খায়রুল সাহেব কিছুটা চেঁচিয়ে বললেন,
“এসব কি হচ্ছে আমার বাড়িতে?”
শিরিন চমকালো। বাবা সরাসরি একটা সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কথা শুরু করেছেন মানে তিনি সত্যিই ভীষণ রেগে আছেন। সে ইতস্তত করে বলল,
“বাবা, মা তোমাকে কতটুকু বলেছে আমি বুঝতে পারছি না।”
খায়রুল সাহেব একইভাবে বললেন,
“আমার বাড়িতে জ্বর নিয়ে একটা ছেলে পরে আছে। অথচ আমাকে কিছুই জানানো হয় নি। কেন?”
শিরিন উত্তর দিলো না। মা জানাতে নিষেধ করেছিল এ কথাটা বলাটাও এখন যুক্তিযুক্ত হবে না। কারণ মা নিজেই সবটা জানিয়ে দিয়েছে। সব অমিতের দোষ। সে অমিতকে ছাড়বে না।
খায়রুল সাহেব বিছানার পাশের আরামকেদারায় বসলেন। হিসহিসিয়ে বললেন,
“ছেলেটাকে ডেকে দে। দেখি তার অসুবিধা কি।”
“জ্বি, বাবা।”
শিরিন ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল। গুটি গুটি পায়ে নিচে নেমে সে অমিতকে সে উপরে পাঠালো। তারপর নিচের বারান্দায় ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে পরলো।

অমিত বেশ সহজভাবে দাঁড়িয়ে আছে। খায়রুল কবির সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকে দেখছেন। ছেলেটির চোখেমুখে প্রশান্তি। জীর্ণ জামাকাপড় আর উষ্কখুষ্ক চুল। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি আর চোখের দৃষ্টি খানিক উদ্ভ্রান্ত। এ বাড়ির মেয়েদের পছন্দ এত অদ্ভুত কেন তিনি ভেবে পেলেন না। শুরুতে সায়লা, তারপর উনার নিজের মেয়েরা। উনি চোখেমুখে গম্ভীর ভাব এনে বললেন,
“কি করা হয়?”
অমিত সাবলীল ভঙ্গিতে উত্তর দিলো,
“মাস্টার্স করেছি দু’বছর হলো। এখন চাকরি খুঁজছি।”
“তুমি শিরিনের সিনিয়র।”
“জ্বি, তিন বছরের।”
“তবে যে শিরিন বলল তুমি ওর বন্ধু?”
অমিত হালকা কেশে বলল,
“ইয়ে…জ্বি। বিতর্ক ক্লাবে পরিচয় হয়েছিল। তারপর একটা বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে বলতে পারেন।”
খায়রুল সাহেব কিছুটা রূঢ় গলায় বললেন,
“এখানে কি মনে করে? মাঝরাতে বান্ধবীর বাড়িতে আসাটা কি কোনো ভদ্রলোকের ছেলের কাজ?”
অমিত ইতস্তত করে বলল,
“আসলে, আমি একটা চিলেকোঠায় ভাড়া থাকতাম। চার মাস ভাড়া দিতে পারি নি বলে কাল হঠাৎ মাঝরাতে বাড়িওয়ালা আমাকে বের করে দিয়েছেন। আমার যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। তাই সাতপাঁচ না ভেবেই আমি এখানে চলে এসেছি। আমি দুঃখিত।”
খায়রুল সাহেবের কঠিন চোখমুখ স্বাভাবিক হয়ে এলো। উনি প্রশ্ন করলেন,
“যাওয়ার জায়গা নেই মানে? তোমার নিজের বাড়িঘর নেই?”
অমিত মাথা নিচু করে বলল,
“জ্বি না। আমি ছোটবেলায় ফুপুর বাড়িতে কাটিয়েছি। তারপর একটা বয়সের পর থেকে হোস্টেলে হোস্টেলে থেকেছি। মা বাবা নেই। আর এমন কোনো বন্ধুবান্ধবও নেই যে আমাকে থাকতে দিতে রাজি হবে। কিছুটা নিরুপায় হয়েই…..”
খায়রুল সাহেব চেয়ারে হেলান দিলেন। চোখ বুজে বললেন,
“ঠিক আছে। তুমি নিচের ঘরে যাও।”
অমিত মাথা নেড়ে “জ্বি আচ্ছা” বলে নিচে নেমে গেল। ভদ্রলোককে খুব একটা কঠিন মানুষ বলে তার মনে হলো না।
_____________________________________
নদীর বাঁধের চারপাশটা শান্ত। নদীর ধারের এই ক্যাফেতে বিন্তু প্রায়ই আসে। কফিতে চুমুক দিতে দিতে উল্টোদিকের ডাক বাংলোর মাঠে বাচ্চাদের ক্রিকেট খেলা দেখে। মাঝে মাঝে আরেকদিকে তাকিয়ে ঠান্ডা নদীর জলে বয়ে চলা ধীরস্থির ঢেউ গোনে। আজ সে এসেছে হাবিব নামক ব্যক্তিটির সঙ্গে। লোকটাকে এই প্রথম যে ভালো করে দেখলো। ভদ্রলোকের বয়স সত্যিই কিছুটা বেশি। কে জানে বিন্তুর সাথে চিন্তাভাবনায় মিল হবে কিনা। বিন্তুই প্রথম কথা বলল।
“জায়গাটা সুন্দর না?”
হাবিব বিরস মুখে উত্তর দিলো,
“আমার ফাইভ স্টার ছাড়া অন্য কোনো জায়গা পছন্দ নয়। নদীর ধার থেকে ধুলো উড়ে আসছে। আমার বিশেষ ভালো লাগছে না।”
বিন্তু হেসে ফেললো। নদীর দিকে তাকিয়ে বলল,
“ধুলো উড়ছে না। সুন্দর হাওয়া আসছে। যাই হোক, আপনি কি ধরণের কফি খেতে পছন্দ করেন?”
হাবিব অনাগ্রহের সঙ্গে জবাব দিলো,
“আমি এরকম একটা দোকানের কফি খেতে চাইছি না।” তোমাকে জায়গা পছন্দ করার দায়িত্ব দিয়ে ভুল করেছি। সেই ভুলের খেসারত হিসেবে এখন এখানে বসে আছি।”
বিন্তুর কপাল কুঁচকে গেল। এই জায়গায় খারাপ কি আছে? তার এখন বিরক্ত লাগছে লোকটাকে। সে তবুও মুখে হাসি টেনে বলল,
“খেয়ে দেখুন। খারাপ লাগবে না। আমি অর্ডার দিয়ে আসছি। আপনার জন্য কোল্ড কফি বলছি।”
বিন্তু উঠে গেল টেবিল থেকে। মিনিট পাঁচেকের ভেতরে ফিরে এলো। চেয়ারে বসতে বসতে বলল,
“এখানকার কফি খারাপ নয়। আপনি খেয়ে দেখুন। এই এলাকার মেয়েকে যখন বিয়ে করছেন, তখন এখানকার খাবারও তো পছন্দ করতে হবে। আর যাকে বিয়ে করছেন, তার পছন্দের জায়গা হলে তো আরও আগে পছন্দ করতে হবে।”
হাবিব ভ্রু কুঁচকে বলল,
“পছন্দ করার কিছু নেই। বিয়ের পরে মেয়েদের পছন্দ অপছন্দ বদলাতে হয়। তোমাকেও বদলাতে হবে, বিন্তু। আমাদের আদব কায়দার সাথে মানিয়ে নিতে হবে।”
বিন্তু দমে গেল। তার পছন্দ অপছন্দের কোনো দাম নেই নাকি? সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“আপনার তাহলে কি পরিকল্পনা ছিল?”
“আমার পরিকল্পনা ছিল তোমাকে নিয়ে কোনো ফাইভ স্টারে গিয়ে লাঞ্চ করা।”
“তাহলে শুরুতেই বললেন না কেন? শুধু শুধু আমাকে পছন্দ করতে বললেন।”
“ভদ্রতা করে বলেছি। তোমার রুচি এত খারাপ, তা তো বুঝি নি। অবশ্য তোমার দোষ নেই। যেভাবে বড় হয়েছ, রুচিও তেমন হয়েছে। তবে এখন বদলাতে হবে।”
বিন্তু এবার রাগী গলায় বলল,
“আপনি কিন্তু আমাকে অপমান করছেন!”
হাবিব হেসে উঠে বলল,
“তুমি দেখি রেগে যাচ্ছ। কথাগুলো সহজভাবে নাও।”
বিন্তু কথা বলল না। তাদের কফি চলে এসেছে। বিন্তু হাতে নিয়ে চুমুক দিলো। সম্পূর্ণ মনোযোগ দেওয়ার চেষ্টা করলো কফির কাপ আর নদীর পানিতে। হাবিব কফিটা খেলো না। বিন্তুর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“সেদিন বৃষ্টির মধ্যে তুমি সারাদিন ছিলে কোথায়?”
বিন্তু সহজভাবে উত্তর দিলো,
“আশেপাশেই হাঁটাহাঁটি করেছি। তারপর বৃষ্টিতে ভিজেছি।”
হাবিব ভ্রু কুঁচকে বলল,
“কেন?”
“কারণ আমার বৃষ্টি পছন্দ। আবহাওয়ার খবরে দেখেছিলাম আজ বৃষ্টি হতে পারে। চাইলে আপনি ভিজতে পারেন। নদীর ধারের ঘাসে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভেজা খুবই রোমাঞ্চকর ব্যাপার।”
হাবিব ব্যাঙ্গাত্মক হেসে বলল,
“টিনেজারদের মতো কথা বলছো কেন? তোমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে, বিন্তু। ম্যাচিউর চিন্তাভাবনা করো। কাদায় পা মাখামাখি করে বৃষ্টিতে ভেজার বয়স কি আর আছে তোমার?”
বিন্তু এবার প্রচন্ড বিরক্ত হলো। চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি চলে যাচ্ছি।”
হাবিবও উঠে দাঁড়ালো। বলল,
“হ্যাঁ, চলো। এখানে আর ভালো লাগছে না।”
বিন্তু কঠিন গলায় বলল,
“আপনি আমার সাথে যাচ্ছেন না।”
হাবিব হকচকিয়ে গিয়ে বলল,
“মানে?”
“মানে, আমি আপনার সাথে যাব না। দুপুরে আপনার সাথে খাবও না। আমি যাব আমার মতো।”
হাবিব হতভম্ব হয়ে বলল,
“কোথায় যাবে?”
“যেখানে আমার ইচ্ছা। আর আপনি আমার সাথে আসার চেষ্টাও করবেন না। নইলে আমি চিৎকার করবো।”
হাবিব অস্ফুটে বলল,
“বিন্তু, দাঁড়াও। আমি কিন্তু বিয়েটা ভেঙে দেবো। তোমার মামার সাথে কথা বলবো।”
বিন্তু শুনলো কিনা বোঝা গেল না। সে বেরিয়ে চলে গেল। হাবিব দাঁড়িয়ে দেখছে বিন্তু হাইস্কুলের পাশের রাস্তাটা ধরে এগিয়ে চলেছে।
.
#চলবে………….

চড়ুই নীড়ে বসবাস পর্ব-০৪

0

#চড়ুই_নীড়ে_বসবাস
#আলো_রহমান(ফারজানা আলো)
#পর্ব:৪
.
মধ্যরাতটা শুরু হয়েছে অন্যভাবে। টিপটিপ বৃষ্টি আর হালকা বাতাসে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমানোর পরিবর্তে বিন্তু বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছে। তার ঘুম আসছে না। বহুক্ষণ এপাশ ওপাশ করে সে বিছানা ছেড়ে উঠে এসেছে। এই মুহূর্তে তার ভয়ংকর একটা ইচ্ছে করছে। ইচ্ছা করছে হুট করে কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে। কিন্তু এই ঘটনা এখনই পুনরাবৃত্তি করা সম্ভব নয়। শিরিন আপাকে বলে দেখা যেতে পারে। তার কাছে সব সমস্যার সমাধান থাকে। বিন্তু একবার ভাবলো শিরিনের ঘরে যাবে। পরক্ষণেই সিদ্ধান্ত বদল করলো। শিরিন আপা হয়তো ঘুমিয়ে পরেছে। অথবা হয়তো প্রেমিকের সাথে ফোনালাপে ব্যস্ত। বিরক্ত করা একেবারেই ঠিক হবে না। কেউ একজন যতই কাছের হোক না কেন, তার ব্যক্তিগত গন্ডিতে ঢুকে পরা উচিত নয়। বিন্তু বারান্দার গ্রিল ঘেঁষে দাঁড়ালো। বাতাসের ধাক্কায় কিছু পানি বারান্দায় এসে পরেছে। বিন্তু পানিটুকু পাশ কাটিয়ে সামনের উঠোনের দিকে তাকালো। কংক্রিটের উঠোনে বারান্দার এক কোণে জ্বলতে থাকা হলুদ আলোটা ছড়িয়ে আছে। টিমটিমে আলোয় উঠোনের বৃষ্টি ফোঁটাগুলো চকচক করছে। চারদিকে মাটির টবে লাগানো পাতাবাহার গাছগুলো মৃদু বাতাসে নাচছে। বিন্তুর এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে গাছ হয়ে জন্মালে ভালো হতো। না থাকতো মন, না থাকতো দুঃখ। সে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
কাঁধে ঠান্ডা হাত পরতেই বিন্তু চমকে পিছনে ফিরলো। দোতলা থেকে শিরিন নেমে এসেছে। তার মুখ থমথমে। বিন্তু হাফ ছেড়ে বলল,
“উফ, আপা! ভয় পাইয়ে দিয়েছ। এভাবে ভূতের মতো কেউ হাঁটাচলা করে? পা ফেলার কোনো আওয়াজ নেই পর্যন্ত!”
শিরিন শুকনো মুখে বলল,
“একটা ঝামেলা হয়ে গেছে, বিন্তু।”
বিন্তু অস্থির হয়ে বলল,
“সে কী! আবার কি হলো?”
শিরিন থমথমে মুখে উত্তর দিলো,
“অমিত আমাদের বড়ির সামনে চলে এসেছে।”
বিন্তু কিছু বুঝতে পারলো না। অস্ফুটে বললো,
“কে?”

অমিতকে বাইরের বসার ঘরে এনে বসানো হয়েছে। ছেলেটাকে বিন্তুর বেশ ভালো লাগছে। প্রেমিকাকে দেখতে বাড়ির সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে। এটা কি কম বড় ব্যাপার? শিরিন রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এসব খামখেয়ালিপনার মানে হয় না। এখন যদি বাড়ির কেউ উঠে পরে তাহলে কী ঝামেলাটাই না হবে!
অমিতের হাতে একটা তোয়ালে দিয়েছে বিন্তু। সে মাথা মুছছে। বিন্তু জিজ্ঞেস করলো,
“পানি খাবেন?”
অমিত মৃদু হেসে বলল,
“পানি লাগবে না। কিন্তু এক কাপ চা খেতে পারি। অনেকক্ষণ ঠান্ডা বাতাসে থেকেছি তো। খুব ঠান্ডা লাগছে।”
বিন্তু বিস্মিত হলো। একটা অল্পবয়সী যুবক লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেমিকাকে দেখতে এসেছে। তাকে বাড়ির ভেতরে আনা হয়েছে চোরের মতো। অথচ এমন অনায়াসে চা চাইলো যেন সে নিমন্ত্রিত কোনো অতিথি। শিরিন কঠিন গলায় বলল,
“এত রাতে এই বাড়িতে চা হবে না।”
বিন্তু উঠে দাঁড়ালো। কোমল গলায় বলল,
“এভাবে বলো না, আপা। আমি নিয়ে আসছি।”
শিরিন বিচলিত হয়ে বলল,
“সাবধানে, বিন্তু! কেউ টের পেয়ে গেলে ঝামেলা হবে।”
বিন্তু মৃদু হেসে মাথা নাড়লো। পা টিপে টিপে রান্নাঘরের দিকে রওনা হলো। শিরিন তাকালো অমিতের দিকে। অমিত হাত পা ছড়িয়ে আরাম করে বসেছে। সে বিরক্ত গলায় বলল,
“এসবের মানে কি? বাড়িতে এমনিতেই হাজার ঝামেলা। বাবা জানতে পারলে আমাকে আস্ত রাখবে না।”
অমিত স্বাভাবিক গলায় উত্তর দিলো,
“আমি দুটো দরকারে এসেছি। প্রথম দরকার, তোমার সাথে দেখা করা। আর দ্বিতীয়, আমার কিছু টাকার প্রয়োজন। তুমি ছাড়া আমাকে ধার দেওয়ার কেউ নেই।”
শিরিন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হতাশ চোখে তাকিয়ে বলল,
“এই যুগে টাকা ধার করতে তিন ঘন্টা বাসে বসে সামনে এসে দাঁড়াতে হয়? তুমি চাইলে আমাকে ফোনে বলতে পারতে। আমি টাকা পাঠিয়ে দিতাম। এটা কোনো দরকারি কারণ হতে পারে না, অমিত। এসব ছেলেমানুষির মানে কি?”
অমিত হাসলো। শিরিনের দিকে তাকিয়ে বলল,
“আমি কেন এসেছি, আমি আসলে জানি না।”
শিরিন ভ্রু কুঁচকে বলল,
“তোমার কান্ডকারখানা আমি এখনো বুঝি না। বিন্তু চা নিয়ে এলে খেয়ে চলে যাবে। যন্ত্রণা!”
অমিত বিনা দ্বিধায় বলল,
“শুধু চা খেয়ে যেতে পারবো না। আমার খুব ক্ষিদে লেগেছে। এক প্লেট গরম ভাত আর ডিম ভাজি খেয়ে তারপর উঠবো।”
শিরিন রাগ করতে গিয়েও পারলো না। মমতার চোখে অমিতের দিকে তাকালো। এই ছেলেটার উপর কেন যে তার এত মায়া, সে বুঝতে পারে না। হয়তো অমিতের কেউ নেই বলেই এত মায়া হয় তার। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো। কোমল গলায় বলল,
“তুমি বসো। আমি ব্যবস্থা করছি।”
শিরিন ভেতরে গেল। অমিত সোফায় গুটিশুটি হয়ে শুয়ে পরলো এবং কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পরলো।
___________________________________________
বিন্তু ঘুমিয়েছিল অনেক রাতে। তার ঘুম ভাঙতে দেরি হয়ে গেল। বেলা এগারোটায় অন্তুর ডাকে সে উঠলো। কোনোমতে চোখ টেনে খুলতেই অন্তু হড়বড় করে বলল,
“দুঃসংবাদ, আপা। দুলাভাই এসেছে তোমাকে নিয়ে বাইরে যাবে বলে। কিন্তু তাকে বসার ঘরে নিয়ে যেতেই এক বিপত্তি। সেখানে এক অচেনা ছেলে শুয়ে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। মা তো ভয়ে কথা বলতে পারছে না।”
ঘুমের রেশ কাটেনি বলে অন্তুর কথাগুলো তার বোধগম্য হলো না। বিন্তু উঠে বসলো। আড়মোড়া ভেঙে জড়ানো গলায় বলল,
“হড়বড় করে কীসব বলছিস? দুলাভাই কে? কার দুলাভাই?”
অন্তু উত্তর দিলো,
“আমার দুলাভাই, আপা। যার সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হচ্ছে।”
বিন্তু দমে গেল। লোকটা এখানে কি চায়? বিরক্তি নিয়ে বলল,
“এসেছে তো আমি কি করবো? আমি উনার সাথে কোথাও যেতে পারবো না। শিরিন আপা কি করছে দেখে আয়। আপার সাথে বাইরে যাব আমি।”
অন্তু বিরস মুখে বলল,
“শিরিন আপা আসতে পারবে না। সে মামীকে সামলাচ্ছে। অচেনা সেই ছেলে নাকি আপার বন্ধু।”
বিন্তু চমকে উঠলো। সর্বনাশ! অমিত নামক ছেলেটি কি তবে রাতে এখানেই থেকে গেছে? বিন্তু বিছানা ছেড়ে নামলো। দৌড়ে মায়ের ঘরে যেতেই সেখানে শিরিন আর তার মামীকে আবিষ্কার করলো। শর্মিলি মুখভার করে আছেন। শিরিন বলছে,
“মা, ও বিপদে পরে এসেছে। ওর খুব জ্বর বলে আমি ওকে চলে যেতে বলতে পারি নি।”
শর্মিলি মুখ ভোঁতা করে বললেন,
“তোকে আমি কোনোকিছুতে না করি না বলে তো তুই যা খুশি করতে পারিস না। বন্ধুবান্ধব কি অন্য কারোর থাকে না? তারা কি এভাবে রাত বিরাতে বাড়িতে এসে উপস্থিত হয়?”
“মা, ওর জ্বর কমলে চলে যাবে। তুমি একটু শান্ত হও।”
শর্মিলি সায়লার দিকে তাকালেন। চাপা গলায় বললেন,
“সায়লা, সারারাত একটা বাইরের লোক বাড়ির ভেতরে। অথচ তুমি আমাকে সকালবেলা জানাচ্ছো?”
সায়লা থতমত খেয়ে বললেন,
“আমি তো বাইরের বসার ঘরে যাই নি, ভাবি। তাই জানতে পারি নি।”
শিরিন মাথা নিচু করে বলল,
“মা, আমি খুব লজ্জিত। তুমি প্লিজ একটু বুঝতে চেষ্টা করো। ও সত্যিই অসুস্থ। তবে হ্যাঁ, এভাবে না বলেকয়ে এসেছে বলে তুমি একশবার রাগ করতে পারো। চলে যেতেও বলতে পারো। আচ্ছা, ঠিক আছে। আমি ওকে বলছি এখনই বেরিয়ে যেতে।”
শিরিন বাইরে যাচ্ছিলো। শর্মিলি গম্ভীর গলায় বললেন,
“থাক। চলে যেতে বলতে হবে না। আজকের দিনটা থাকুক। কিন্তু তোর বাবা যেন জানতে না পারে। ছেলেটাকে বলে দিস যেন ওই ঘর থেকে বাইরে না বেরোয়।”
শিরিন আনন্দিত হলো। ভেতরের উচ্ছ্বাসকে চাপা দিয়ে বলল,
“বলে দেবো, মা। ও ঘর থেকে বেরুবে না।”
শর্মিলি সায়লার দিকে তাকালেন। কড়া গলায় বললেন,
“তোমার মেয়েদের বলে দাও ওই দিকে যেন না যায়। আর হাবিবকে আমি বলছি ভেতরে এসে বসতে। যতসব ঝামেলা আমার ঘাড়ে জুটেছে!”
শর্মিলি বেরিয়ে গেলেন। শিরিন যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো। বিন্তু ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে বলল,
“ব্যাপারটা কি, আপা? তোমার অমিত সাহেব তো দেখছি ডেঞ্জারাস। শ্বশুর বাড়িতে লুকিয়ে লুকিয়ে এসে এভাবে ঘুমিয়ে পরলো?”
শিরিন হাসলো। বিন্তুর হাত চেপে ধরে বলল,
“চুপ কর, বিন্তু। আস্তে কথা বল।”

শর্মিলি বাইরের বসার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলেন। উনার উদ্দেশ্য হাবিবকে ওখান থেকে ভেতরের ঘরে এনে বসানো। কিন্তু ঘরের দরজায় দাঁড়াতেই উনার ভ্রু কুঁচকে গেল। অমিত সোফার উপরে পা তুলে বসেছে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে খুব আগ্রহ নিয়ে হাবিবের সাথে গল্প করছে। সে বলছে,
“হাবিব ভাই, আপনি বুদ্ধিমান মানুষ। আপনি কেন এত ছোট একটা মেয়েকে বিয়ে করছেন বুঝতে পারছি না। আপনি ব্যবসায়ী মানুষ। এই মেয়ে আপনার ব্যবসার কি বুঝবে?”
হাবিব জবাব দিলো,
“বুঝবে না বলেই বিয়ে করছি। ঘরের বউয়ের ব্যবসা বোঝার প্রয়োজন কি?”
অমিত হেসে বলল,
“আপনাকে যতটা ভেবেছিলাম, তার থেকে বেশি বুদ্ধিমান মনে হচ্ছে। এই বাড়িটা আপনার কেমন লাগে?”
“ভালো। তবে বেশ পুরানো বাড়ি। নতুন ফ্ল্যাট করতে পারলে ভালো হতো। আমার পরিচিত একজন কন্ট্রাক্টর আছে। মামার সাথে কথা বলে দেখবো ভাবছি।”
“বলছেনটা কি? বিয়ের আগেই হবু শ্বশুরবাড়ি ভাঙতে চাইছেন? আপনি দেখছি পাকা ব্যবসায়ী।”
“ভুল কিছু তো বলছি না। পুরানো বাড়ি আর কতদিন?”
অমিত চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,
“আমার আবার পুরানো আর্কিটেকচার খুব পছন্দ। আমি এই বাড়ি ভাঙতে দেবো না।”
হাবিব তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
“আপনি এই বাড়ির ব্যাপারে কথা বলার কে?”
অমিত স্পষ্ট গলায় বলল,
“আপনি যা, আমিও তা। আমিও এই বাড়ির হবু জামাই। আমি শিরিনকে শীঘ্রই বিয়ে করতে চলেছি। আপনি বয়সে বড় হলেও সম্পর্কে আপনার চেয়ে বড় হবো আমি।”
হাবিব আশ্চর্য চোখে তাকিয়ে রইলো। দরজা থেকে আরও এক জোড়া চোখ অমিতের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখ শর্মিলির। উনি হতভম্ব হয়ে গেছেন। এই ছেলের নাকি জ্বর! কই? দেখে তো বোঝা যায় না!
.
#চলবে………..

চড়ুই নীড়ে বসবাস পর্ব-০৩

0

#চড়ুই_নীড়ে_বসবাস
#আলো_রহমান(ফারজানা আলো)
#পর্ব:৩
.
সকাল থেকে আকাশ মেঘলা। বৃষ্টি যদিও থেমেছে, তবুও থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। বর্ণিল চিন্তিত হয়ে বিছানায় বসে আছে। সম্ভবত সকাল দশটার মতো বাজে। মেঘের কারণে মনে হচ্ছে সদ্য ভোর হয়েছে। বর্ণিল জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। বিন্তুদের বাড়ির সামনে একটা সাদা রঙের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। সে একদৃষ্টিতে সেদিকেই দেখছে। আজ তার অন্তুকে পড়াতে যাওয়ার কথা ছিল বিকাল তিনটায়। কিন্তু সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঘন্টাখানেকের ভেতরে সেখানে উপস্থিত হবে। ব্যাপারটা যে কী ঘটছে সেটা জানতে সে অস্থির হয়ে আছে। বিন্তুর বিয়ে কি সত্যি সত্যিই হচ্ছে? অবশ্য হলেও আশ্চর্য কি? এই বয়সী মেয়ের বিয়ের তোরজোড় হবে, সেটাই বরং স্বাভাবিক। বর্ণিল দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
দরজা খুলে বর্ণিলের ঘরে প্রবেশ করলেন তার মা, নাজমা। তিনি খুব কঠিন ধরণের মহিলা। একমাত্র ছেলেকে মানুষ করেছেন খুব কড়া শাসনে। অতি আদরে ছেলে নষ্ট হয়ে যাবে, সেই সম্ভাবনাই কোনোভাবে তৈরি করতে চান নি। নাজমা ছেলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। ছেলের বিচলিত মুখ লক্ষ্য করে চিন্তিত হলেন। কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন,
“তোমাকে বিচলিত মনে হচ্ছে, বর্ণ। কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করছো?”
বর্ণিল মায়ের দিকে তাকালো। শান্ত গলায় বলল,
“না।”
“সকাল দশটা বাজে। নয়টায় নাস্তার টেবিলে আসার কথা। আজ এলে না?”
“সবসময় যন্ত্রের মতো চলতে ভালো লাগে না, মা। ক্ষুধা পায় নি, তাই খেতে আসি নি।”
“মানুষের শরীর এক প্রকার যন্ত্রই, বর্ণ। আর তুমি ভালো করেই জানো যে তোমার বাবা এসব অনিয়ম পছন্দ করেন না।”
“মা, সবকিছু বাবার কোর্ট নয়।”
নাজমা কঠিন গলায় বললেন,
“এভাবে কথা বলবে না। চুপচাপ খেতে এসো।”
বর্ণিল উঠে দাঁড়ালো। আলমারি থেকে শার্ট বের করতে করতে বলল,
“আমি আজ খাব না। বেরোচ্ছি।”
“সাত সকালে যাবে কোথায়? আজ তোমার ক্লাস নেই বলেই তো জানি।”
“অন্তুকে পড়াতে যাব, মা।”
নাজমা ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। ছেলেটাকে কি এই মেয়ের হাত থেকে কোনোভাবেই পুরোপুরি বের করে আনা যাবে না? উনি তাড়াহুড়ো করে বললেন,
“না, তুমি এখন যাবে না। বিন্তুকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছে। আমি চাই না এই সময় তুমি সেখানে যাও।”
বর্ণিল শান্ত চোখে মায়ের দিকে তাকালো। দৃঢ় গলায় বলল,
“মা, আমি যাব।”
নাজমা কোনোমতে রাগ চাপা দিয়ে বললেন,
“বর্ণ, আমি তোমাকে অনুমতি দিয়েছিলাম অন্তুকে পড়ানোর। তুমি আমাকে সেটা বন্ধ করতে বাধ্য করো না। আমি ওই বাড়িতে গিয়ে সায়লার সাথে কথা বলি, তেমনটা তুমি নিশ্চয়ই চাও না।”
বর্ণিল হকচকিয়ে গেল। বিরক্তিতে ছেয়ে গেল তার চোখমুখ। হাতের শার্টটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সে চেয়ারে বসলো। নাজমা চোখ বন্ধ করে বড় করে শ্বাস নিলেন। ছেলের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন,
“আমি যা করি, তোমার ভালোর জন্যই করি। মা কখনো সন্তানের খারাপ চায় না।”
“ভালো খারাপ আপেক্ষিক বিষয়, মা। তোমার কাছে যা ভালো, আমার কাছে তা নাও হতে পারে।”
“তুমি এখন রেগে আছ। মাথা ঠান্ডা হলে তারপর এসব নিয়ে কথা বলা যাবে। আপাতত তুমি ঘরেই বসো। আমি খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
নাজমা বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে। বর্ণিল দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিজের জীবনটা আজীবনই কি তার মায়ের সিদ্ধান্তেই চলবে? কে জানে!
________________________________________
পাত্রপক্ষকে নিচের বসার ঘরে বসানো হয়েছে। মোট অতিথি চারজন। পাত্রের বাবা, বড় ভাই, বড় চাচী আর পাত্র নিজে। উনাদের সামনে খায়রুল সাহেব বসে আছেন। পাশে শর্মিলিও আছেন। উনার এই পরিবারটাকে কেমন ছোটলোক বলে মনে হচ্ছে। কথাবার্তা, আচার আচরণ, সবেতেই ছোটলোকি। কিছুক্ষণ আগে মিষ্টি খেতে গিয়ে পাত্রের বড় চাচী বলেছেন, “এসব সস্তার মিষ্টি আমাদের খাওয়ার অভ্যাস নেই। আমরা শহরের সব দামী মিষ্টি আপনাদের জন্য এনেছি। সেখান থেকে আমাদের দিলেও তো পারতেন।” কথা শুনে শর্মিলির গা জ্বলে গেছে। কথাবার্তার এ কী ধরণ! সস্তার মিষ্টি মানে? এই ভদ্রমহিলাকে একেবারেই সহ্য করতে পারছেন না শর্মিলি। পাত্রী দেখতে এসেছে? নাকি খেতে?
পাত্রের বাবা মুখ খুললেন। চোখেমুখে গম্ভীর ভাব এনে বললেন,
“ভাইসাহেব, গতকাল আপনার ভাগ্নি যা করেছে তারপর এখানে আসাটা আমাদের শোভা পায় না। কিন্তু তবুও আমরা এসেছি। কারণ আপনাদের মেয়ের বয়স কম। এই বয়সে ভয় পেয়ে এমন অনেকেই করে ফেলে। আশা করি, এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না।”
খায়রুল সাহেব মাথা নাড়লেন। “নিশ্চয়ই হবে না।”
পাত্রের বড় চাচী বললেন,
“আমাদের ছেলে সোনার টুকরা। এই বয়সেই ব্যবসা বাণিজ্যে ভালো নাম করেছে। টাকা পয়সার অভাব নেই। এলাকায় গিয়ে শুধু হাবিব নামটা উচ্চারণ করা, দেখবেন সবাই সম্মানে মাথা নিচু করে ফেলবে। এত অল্প বয়সে এত মান সম্মান বানিয়েছে, তবুও কিন্তু আমাদের কোনো চাহিদা নাই।”
শর্মিলি মুখে হাসি টেনে বললেন,
“কিছু মনে করবেন না। ছেলের বয়স কিন্তু ভালোই মনে হচ্ছে। কম বলে কিন্তু মনে হচ্ছে না।”
ভদ্রমহিলা দমে গেলেন। শুকনো গলায় বললেন,
“ওর বয়স বেশি নয়।”
সায়লা বসার ঘরে ঢুকলেন। অতিথিদের জন্য নতুন করে নাস্তা আনা হয়েছে। সাথে শিরিন এসেছে। নাস্তা টেবিলে রাখতেই শর্মিলি বলে উঠলেন,
“এই মিষ্টি খেয়ে দেখুন। হুট করে আবার সস্তা বলে ফেলবেন না যেন। এগুলো কিন্তু আপনারাই এনেছেন।”
কথা শেষ করে শর্মিলি ভেতরে চলে গেলেন। এই লোকগুলোকে তার সহ্য হচ্ছে না। শিরিন শরবতের গ্লাসগুলো টেবিলে রাখতেই পাত্রের ভাই আর বড় চাচীর ফিসফিস কানে এলো। উনারা বলাবলি করছেন, “মেয়ে রূপসী শুনেছিলাম। এখন তো দেখছি গায়ের রঙ কালো।”
শিরিন হেসে উঠলো। ভদ্রমহিলার দিকে তাকিয়ে বলল,
“ভয় নেই। এই কালো মেয়েকে আপনারা দেখতে আসেন নি। আমি আমার বোনকে নিয়ে আসছি।”
শিরিন ভেতরে চলে গেল। বিন্তু নিজের ঘরে তৈরি হচ্ছিলো। শিরিনকে দেখতে পেয়েই এগিয়ে গেল। মলিন গলায় বলল,
“শাড়ি পরিয়ে দাও, আপা।”
শিরিন রাগী গলায় বলল,
“রাখ তোর শাড়ি! বিন্তু, তুই এই বিয়েতে না করে দিবি।”
বিন্তু হকচকিয়ে গিয়ে বলল,
“কেন?”
“কারণ এরা মোটেও ভালো মানুষ নয়। এসে থেকে নিজেদের টাকাপয়সা দেখিয়ে চলেছে। অসহ্য!”
বিন্তু হাসলো। “টাকাপয়সা থাকলে তো দেখাবেই, আপা।”
“চুপ কর, বিন্তু। পাত্রকে আমি দেখে এসেছি। কাঠের মূর্তির মতো বসে আছে। একটা যেন জড় পদার্থ। অপদার্থ একটা!”
“ওরা বড়লোক বলেই তো মামা আমার জন্য এই পরিবার পছন্দ করেছেন।”
“তুই বাবাকে না করে দিবি, বিন্তু। ছেলের বয়স মাত্রাতিরিক্ত। এত বয়স্ক একজনকে কেন বিয়ে করবি?”
বিন্তু উত্তর দিলো না। হেসে বলল,
“শাড়ি পরিয়ে দাও, আপা।”
শিরিনের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। রাগী গলায় বলল,
“পারবো না। যা পরে আছিস, তাই পরে যা।”
তারপর হনহন করে ঘর থেকে বেরিয়ে চলে গেল। বসার ঘরের সামনে যেতেই পাত্রের বড় চাচীর কথা কানে এলো। তিনি বিপুল উৎসাহ নিয়ে সায়লাকে বলছেন,
“আপনার মেয়ের কপাল ভালো যে কালকে এরকম একটা কান্ড করার পরেও আমরা তাকে দেখতে আসতে রাজি হয়েছি। সাথে করে হীরার আংটি এনেছি। মেয়ে পছন্দ হলে পরিয়ে দিয়ে যাব। এই দেখুন, আপা। এই আংটি আমাদের ছেলে বিদেশ থেকে এনেছে। এর দাম দেড় লাখ টাকা।”
শিরিনের ভ্রু কুঁচকে গেল। এই মহিলা বড্ড বেশি কথা বলে। এদের সাথে বিন্তু সংসার করবে কি করে?
_______________________________________________
বিন্তু বাইরের টানা বারান্দায় বসে আছে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। বাইরে আবার টিপটিপ করে বৃষ্টি পরছে। বিন্তু আধো অন্ধকারে হাতের আংটির দিকে তাকিয়ে আছে। পাত্রপক্ষ তাকে পছন্দ করেছে। খুব শীঘ্রই বিয়ের দিন ঠিক করবে বলে গেছে। যার সাথে বিয়ে, বিন্তু জানে না সে কেমন মানুষ। তার দিকে একবার তাকিয়েও দেখে নি। দেখতে ইচ্ছা করে নি। তার জীবন তার হাতে নেই। তাকে কেউ কখনো বোঝে নি। তার ভীষণ বিষন্ন লাগছে। বিয়ের আনন্দ বলে যে কিছু আছে, তেমনটা সে অনুভব করতে পারছে না। ইচ্ছে করছে মনের প্রবল দুঃখের গল্পগুলো কাউকে বলতে। কিন্তু কে বুঝবে তার এসব কথা?
দরজায় কড়া নড়লো। বিন্তু উঠে গিয়ে দরজা খুললো। বর্ণিল এসেছে। বিন্তু ভেতরের দীর্ঘশ্বাস চেপে বলল,
“ও, তুই! অন্তু ঘুমিয়ে আছে। আমি ডাকছি।”
বিন্তু চলে যাচ্ছিলো। বর্ণিল ডাকলো,
“দাঁড়া, বিন্তু। শুনে যা।”
বিন্তু ঘুরে দাঁড়ালো। বর্ণিল কাছে এগিয়ে এসে বলল,
“তোর সাথে কথা আছে আমার। খুব জরুরি।”
“শুনছি। বল।”
“তোকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল?”
বিন্তু স্পষ্ট গলায় জবাব দিলো,
“হ্যাঁ। আমাকে পছন্দ করেছে। এই যে, আংটিও পরিয়ে গেছে।”
বিন্তু নিজের বাম হাত তুলে ধরলো। বর্ণিল আংটিটার দিকে অপলক তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলো,
“তুই এই বিয়েতে রাজি?”
বিন্তুর বুকে মোচড় দিলো। সে চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল,
“রাজি না হওয়ার কোনো কারণ আছে?”
বর্ণিল অস্থির হয়ে বলল,
“নেই? তুই ভালোবাসিস না আমাকে?”
বিন্তু থমকে গেল। তার সারা শরীর শিহরিত হয়ে কেঁপে উঠলো। সে শত চেষ্টা করেও কথা বলতে পারলো না। বর্ণিল আবার প্রশ্ন করলো,
“উত্তর দে। তুই পারবি আরেকজনের সাথে সংসার করতে?”
বিন্তু ভেতরের সমস্ত আবেগের সাথে লড়াই করে কাঁপা ঠোঁটে উচ্চারণ করলো,
“পারবো। তোকে আমি ঘৃণা করি। তুই আর কখনো আমার সাথে কথা বলতে চেষ্টা করবি না। কোনোদিনও না।”
কথাগুলো শেষ হতেই বিন্তু ছুটে ঘরে চলে গেল। বর্ণিল স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এত অপমানিত আগে কখনো বোধ হয় নি তার।
.
#চলবে……

চড়ুই নীড়ে বসবাস পর্ব-০২

0

#চড়ুই_নীড়ে_বসবাস
#আলো_রহমান(ফারজানা আলো)
#পর্ব:২
.
বিন্তু যখন বাড়ি ঢুকলো, তখন সন্ধ্যা হয়েছে। সায়লা মাগরিবের নামাজ আদায় করে বিছানায় বসেছেন। হেমন্তের বৃষ্টিতে ঠান্ডা ঠান্ডা ভাব এসেছে। উনি গায়ে একটা চাদর জড়িয়েছেন। অন্তু একটা বই কোলে নিয়ে পাশে বসে গুনগুন করছে। আজ সে সত্যিই পড়ছে। কারণ আজ মায়ের মেজাজ খারাপ। একটু উনিশ বিশ হলেই আপার উপরের রাগটা তার উপরে গিয়ে পরার সমূহ সম্ভাবনা। এই আপার জন্য যে আর কতকিছু তাকে করতে হবে কে জানে! অন্তু দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আজ পাত্রপক্ষ শেষ পর্যন্ত আসে নি। কিন্তু তা নিয়ে বিরাট একটা ঝামেলা হয়েছে। পাত্রের বাবা খায়রুল সাহেবকে অপমান করেছেন। কথা দিয়ে কথা বদল করেছেন বলে তাকে কতগুলো মন্দ কথা শুনিয়েছেন। সেই কারণে সায়লাকে কথা শুনিয়েছেন তার ভাবি। সায়লার সব রাগ এখন বিন্তুর উপরে।
বিন্তু ভয়ে ভয়ে ঘরে ঢুকলো। কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা নিজের ঘরে গেল। অন্তু ফিসফিস করে বলল,
“মা, আপা এসেছে। ডেকে আনবো?”
সায়লা গম্ভীর গলায় বললেন,
“না। ওকে নিজে থেকে আসতে দে।”
অন্তু দমে গেল। সে ভেবেছিল ডেকে আনার নাম করে আপাকে খানিকটা সাবধান করে দিয়ে আসবে। কিন্তু তা হলো কই? মা বোধহয় সব বুঝে ফেলেছে।
সায়লা বানু ধমক দিলেন।
“কিরে? থেমে গেলি কেন? পড়।”
অন্তু অনতিবিলম্বে আবার পড়তে শুরু করলো। বিন্তু মায়ের ঘরে এলো মিনিট দশেক পরে। সে ভেজা শাড়ি বদলেছে। গায়ে ওড়না জড়িয়েছে, মাথায় তোয়ালে পেঁচিয়ে রেখেছে। গুটিগুটি পায়ে সে মায়ের সামনে এসে দাঁড়ালো। ভীত গলায় বলল,
“মা, আমি বুঝতে পেরেছি যে ভুল করেছি।”
সায়লা গম্ভীর গলায় বললেন,
“বস এখানে।”
বিন্তু বসলো। সাথে সাথেই তার বা গালে সপাটে একটা চড় পরলো। চড়ের শব্দে অন্তু চমকে উঠলো। সে তৎক্ষনাৎ একহাতে বিন্তুকে জড়িয়ে ধরে বলল,
“ও মা, আপাকে মেরো না, মা। মা গো!”
বিন্তু মাথা নিচু করে বসে রইলো। তার চোখে পানি এসে গেছে। সায়লা দাঁতে দাঁত চেপে বললেন,
“তোকে জন্ম দিয়ে কি আমি পাপ করেছি? কেন শত্রুতা করছিস তুই আমার সাথে?”
বিন্তু কান্না জড়ানো গলায় বলল,
“মা! আমি কেন শত্রুতা করবো তোমার সাথে? তুমি ছাড়া কে আছে আমার?”
“শত্রুতা নয়? এই আশ্রয় হারালে কোথায় গিয়ে আমি দাঁড়াবো? কেন এই কান্ড ঘটালি? আমার মুখটা একবার মনে পড়ে নি তোর? মনে হলো না একবার যে তোর মাকে অপদস্ত হতে হবে?”
“মা, আমার আর কোনো উপায় ছিল না। আমাকে তুমি মাফ করে দাও।”
সায়লা ভ্রু কুঁচকে ফেললেন। সন্দিহান হয়ে জানতে চাইলেন,
“উপায় ছিল না মানে? তুই কি গোপনে কোনো ঘটনা ঘটিয়েছিস? কি করেছিস তুই?”
বিন্তু প্রায় চিৎকার করে বলল,
“মা! কিসব বলছো? আমি কিছুই ঘটাই নি। আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম কারণ আমি এখন বিয়ে করতে চাই না, মা।”
সায়লা বড় করে শ্বাস নিলেন। নিজেকে সামলে শান্ত গলায় বললেন,
“তোর চাওয়াতে কিছু যায় আসে না, বিন্তু। তোর মামা মামী যা বলবেন, তোকে তাই করতে হবে। আর আজ থেকে তুই বাড়ির বাইরে পা দিবি না।”
“মা, আমি…”
বিন্তুর কথা শেষ হলো না। সায়লা তার আগেই ভীষণ এক ধমক দিলেন।
“একদম চুপ। আমি যা বলবো, তোকে তাই করতে হবে। এখন তুই উপরে যা। তোর মামা মামীর কাছে ক্ষমা চেয়ে আয়।”
বিন্তু নিঃশব্দে উঠে গেল। অন্তু ইতস্তত করে বলল,
“মা, আমিও আপার সাথে যাব?”
সায়লা বানু রাগী চোখে তাকালেন। অন্তু দমে গেল। হাসার চেষ্টা করে বলল,
“এমনি বলেছি, মা। আমি যাচ্ছি না। আমি পড়ছি।”
______________________________________________
দোতলায় উঠতেই বা দিকে রান্নাঘর। তার পাশে প্রশস্ত জায়গা জুড়ে খাবার টেবিল সাজানো। ডানে এক বিশাল বৈঠকখানা। এটা তৈরি হয়েছিল বিন্তুর নানার আমলে। পরবর্তীতে খায়রুল সাহেব বাড়ির অনেককিছু পরিবর্তন করলেও এই বৈঠকখানা একই রেখেছেন। বিন্তু যখন উপরে এলো, তখন শর্মিলি টেবিলে চায়ের কাপ সাজাচ্ছিলেন। বিন্তুকে খেয়াল করলেন না উনি। বিন্তু ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে নিচু গলায় ডাকলো,
“মামী, মামা কই?”
শর্মিলি মাথা তুলে তাকালেন। বিন্তুকে দেখে উনার শরীর জ্বলে গেল। উনি গম্ভীর গলায় বললেন,
“অসভ্য মেয়ে! আমার সামনে আসতে লজ্জা করলো না? কার হাত ধরে পালাতে চেয়েছিলি?”
বিন্তু মাথা নিচু করে জবাব দিলো,
“আমি এরকম কিছু করি নি, মামী।”
“আবার নিজের হয়ে সাফাই দিচ্ছিস? তোর লজ্জা নেই?”
“মামী, আমি বুঝতে পেরেছি আমার ভুল হয়েছে। আমাকে ক্ষমা করো।”
শর্মিলি চিৎকার করে বললেন,
“খবরদার, বিন্তু। আমার সামনে তুই ঢং করবি না। তুই কি ভাবিস তোর এভাবে বাইরে বেরিয়ে যাওয়ার মানে আমি বুঝি না? তুই চাস আমাদের মান সম্মান নষ্ট করতে।”
বিন্তু দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ক্লান্ত গলায় বলল,
“আমি কেন এরকমটা চাইবো?”
“কারণ তুই আমার মেয়েকে হিংসা করিস। তুই এসব করিস যাতে আমি আমার মেয়েটাকে ভালো বাড়িতে বিয়ে দিতে না পারি। তোদের আমি চিনি না?”
“মামী! এসব কি কথা? আমি শিরিন আপাকে হিংসা কেন করবো? আপাকে আমি খুবই ভালোবাসি।”
“চুপ কর, নির্লজ্জ মেয়ে কোথাকার! তোদের মা মেয়ের মনে শুধু হিংসা।”
বিন্তু কথা বলল না। এই ভদ্রমহিলার সাথে কথা বলা মানে যেচে অপমানিত হওয়া। মাঝেমধ্যে তার ইচ্ছা করে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিতে। কিন্তু তার সে উপায় নেই। বিন্তু অসহায় বোধ করে। আজ যদি তার বাবা থাকতো তাহলে কেউ তাকে এভাবে কথা শুনাতে পারতো না। বিন্তুকে চুপ করে থাকতে দেখে শর্মিলির রাগ বাড়লো। তিনি ধমকে উঠে বললেন,
“এভাবে দাঁড়িয়ে থাকবি না। যা তোর মামাকে চা দিয়ে আয়। যত্তসব আপদ।”
বিন্তু চা হাতে নিয়ে বৈঠকখানায় গেল। খায়রুল সাহেব সেখানে বসে টেলিভিশন দেখছেন। টেলিভিশনে সন্ধ্যার সংবাদ চলছে। বিন্তু ভেতরে ঢুকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বলল,
“মামা, চা।”
খায়রুল সাহেব চা নিয়ে বললেন,
“দেখেছিস, বিন্তু? যুদ্ধে ছোট ছোট বাচ্চাদের কী ভয়ানক কষ্ট!”
বিন্তু উত্তর দিলো না। তার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া নিয়ে মামা কিছু বলছে না দেখে অবাকও হলো না। মামা চট করে সিরিয়াস কথা শুরু করেন না। উনি প্রথমে এমন কোনো কথা বলেন, যেটা হয়তো পরিস্থিতির সাথে পুরোপুরি প্রাসঙ্গিক নয়। খায়রুল সাহেব চায়ে চুমুক দিয়ে বললেন,
“কখন ফিরেছিস?”
বিন্তু নিচু গলায় বলল,
“একটু আগে।”
“আজ বেশ ভালো বৃষ্টি হয়েছে। না রে?”
বিন্তু হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। খায়রুল সাহেব হালকা কেশে বললেন,
“আজ এভাবে বেরিয়ে গিয়ে ঠিক করিস নি, বিন্তু। আমাকে ওরা অপমান করেছে। আমি দুঃখ পেয়েছি।”
বিন্তু মাথা নিচু করে বলল,
“আমাকে ক্ষমা করে দাও, মামা। আমি আর কখনো এরকম করবো না। তুমি উনাদের আসতে বলো।”
“ঠিক আছে, বলবো। তুই এখন ঘরে যা।”
বিন্তু বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে নিচে যাচ্ছিলো। তার ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। সে ঘুমাতে চায়। সিঁড়িতে পা দিতেই শর্মিলি ডেকে উঠলেন,
“এই মেয়ে! চলে যাচ্ছিস কেন? আমার সাথে রান্নাঘরে কাজ করবি আয়।”
বিন্তু না করতে পারলো না। সেই উপায় নেই। ঘুরে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে শিরিন বেরিয়ে এলো, খায়রুল সাহেবের ছোট মেয়ে। বিন্তুকে দেখে উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল,
“এসেছিস, বিন্তু? আয়, আমার ঘরে আয়।”
বিন্তু হাসিমুখে বলল,
“ভালো আছ, আপা?”
“আছি। আমার সাথে আমার ঘরে আয়। তারপর কথা বলছি।”
শর্মিলি তাড়াহুড়ো করে বললেন,
“তোর ঘরে যাবে মানে? ওকে আমি ডেকেছি। ও রাতের রান্না করবে আমার সাথে।”
শিরিন হেসে বলল,
“মা, তুমি নিজে একটু কষ্ট করে রান্না করে নাও। ওকে আমি নিয়ে গেলাম।”
কথা শেষ করে বিন্তুকে নিয়ে শিরিন ঘরে চলে গেল। শর্মিলি কিছুই বলল না। তিনি তার এই কন্যাটিকে ভীষণ ভালোবাসেন। মেয়ের কথার উপরে কখনো কিছু বলেন না। বিন্তু হাসলো। ছোটবেলা থেকে মামীর হাত থেকে যে শিরিন আপা তাকে কতবার বাঁচিয়েছি ঠিক নেই। এই বাড়িতে শিরিন আপা না থাকলে তার জীবন আরও বেশি কঠিন হতো। বিছানায় বসে শিরিন বিন্তুর মুখের দিকে ভালো করে তাকালো। বিন্তুর চোখ ভেজা। বাম গাল লাল হয়ে আছে। হয়তো মায়ের হাতে মার খেয়ে এসেছে। শিরিনের মায়া হলো। সে বিন্তুর গায়ে হাত বুলিয়ে কোমল গলায় বলল,
“কখন ফিরেছিস, বিন্তু? সারাদিন বৃষ্টিতে ভিজেছিস। শরীর ঠিক আছে?”
বিন্তু হেসে মাথা নাড়লো।
“আছে।”
“ফুপু খুব রাগ করেছে, না?”
“হ্যাঁ, খুব।”
“আহা! মন খারাপ করিস না। তোর কি হয়েছে আমায় বলবি? এভাবে চলে গেলি কেন?”
“অনেক কথা বলার আছে, আপা। আমি বলবো। কিন্তু এখন নয়।”
“ঠিক আছে, যখন ইচ্ছা হয় বলিস।”
“তুমি তোমার খবর বলো, আপা। কখন এলে?”
“বিকালে এসেছি। ইউনিভার্সিটি বন্ধ। এসে দেখি বাড়িতে হুলস্থূল বেঁধে আছে। এমন কেউ করে? বোকা মেয়ে তুই, বিন্তু।”
বিন্তু উত্তর দিলো না। শিরিন গলা নিচু করে প্রায় ফিসফিস করে বলল,
“আমি একটা ছেলেকে বিয়ে করবো বলে ঠিক করেছি। এবার ছুটি শেষে যখন ক্যাম্পাসে ফিরবো, তখনই বিয়ে করে ফেলবো।”
বিন্তু হকচকিয়ে গিয়ে বলল,
“বিয়ে! কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করবে?”
“হ্যাঁ, করবো। ছেলেটাকে আমি ভালোবাসি। বাবাকে জানালে বাবা মানবেন না। তাই নিজে নিজেই বিয়ে করবো। বড় আপার মতো ভুল আমি করবো না।”
বিন্তুর বিস্ময় কাটে নি। সে আচ্ছন্ন গলায় বলল,
“কেন মানবেন না?”
“কারণ ও এখনো বেকার।”
“তাহলে কিছুদিন অপেক্ষা করো।”
“না, বিন্তু। অপেক্ষা করাটা ভয়ানক। আমি পারবো না। মা যদি আমায় অন্য কোথাও বিয়ে দিয়ে দেয়, তখন কি হবে? আমি কোনো ঝুঁকি নেবো না। একবার বিয়ে হয়ে গেলে তো আর মা আমায় অন্য কোথাও বিয়ে দিতে পারবে না।”
বিন্তু নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
“ছেলেটা তোমার ইউনিভার্সিটিতে পড়ে?”
শিরিন লাজুক হেসে বলল,
“হ্যাঁ। ও খুব ভালো ছেলে।”
“তোমাকে প্রেমপত্র লিখেছিল?”
শিরিন মাথা নেড়ে বলল,
“উঁহু, জীবনেও না। প্রেমপত্র আমি লিখেছিলাম। প্রেম প্রস্তাবও আমি দিয়েছি। তাও আবার এক লাইনের। ও সেই এক লাইনের চিঠির জবাব দিয়েছিল এক শব্দে।”
“এক শব্দে! কিভাবে?”
শিরিন হাসলো। উঠে দাঁড়িয়ে ব্যাগ থেকে একটা ছোট কাগজ বের করলো। বিন্তুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“দেখ।”
বিন্তু কাগজ হাতে নিলো। ভাঁজ খুলতেই একটা মাত্র লাইন চোখে পড়লো। ইংরেজি অক্ষরে নীল কালিতে লেখা একটা লাইন,
” Be my kids’ dad!”
এই লাইনের “my” শব্দটা লাল কালিতে কেটে দিয়ে উপরে লেখা হয়েছে, “our”। বিন্তু বুঝলো, এই শব্দটিই শিরিনের প্রেমিকের উত্তর।
পৃথিবীর সংক্ষিপ্ত এক প্রেমপত্র আর তার সংক্ষিপ্ততম উত্তর দেখে বিন্তু বিস্মিত হলো। শিরিনের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে হেসে গড়িয়ে পরছে।
.
#চলবে…….

চড়ুই নীড়ে বসবাস পর্ব-০১

0

#চড়ুই_নীড়ে_বসবাস
#আলো_রহমান(ফারজানা আলো)
#সূচনা_পর্ব

অন্তু বিরক্তি নিয়ে বলল,
“কাঠুরিয়া সৎ ছিল, এই ব্যাপারে আমরা এত নিশ্চিত কি করে? হতেও তো পারে কাঠুরিয়া বোকা ছিল। এতটাই বোকা ছিল যে সোনার কুড়াল আর রূপার কুড়াল চিনতেই পারে নি।”
বর্ণিল ভ্রু কুঁচকালো। গম্ভীর গলায় বলল,
“গল্পটা তাড়াতাড়ি মুখস্থ করো।”
অন্তু মুখ কুঁচকে মোটা ইংরেজি বইটা নিয়ে পড়তে শুরু করলো। বর্ণিল ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললো। অন্তু মেয়েটার চিন্তাভাবনা জটিল ধরণের। মেয়েটাকে পড়াতে তাকে বেশ ভালোই নাকানিচোবানি খেতে হয়। সবেমাত্র অষ্টম শ্রেণিতে পড়া এক কিশোরীর মাথায় এত জটিল ধরণের ভাবনা আসবে কেন? কিশোরীরা হবে সরল, বোকাসোকা। তাদের যা বুঝানো হবে তাই বুঝবে। একেবারে বিন্তুর মতো। বিন্তু যদিও কিশোরী নয়; যুবতী। বর্ণিল অন্তুর মামার মুখে শুনেছে অন্তু আর বিন্তু গুনে গুনে এগারো বছরের ছোট বড়। তবুও মেয়েটার সারল্য বর্ণিলকে মুগ্ধ করে।
অন্তুর মা নাস্তা নিয়ে এলেন। হাসিমুখে জিজ্ঞেস করলেন,
“অন্তু ঠিকমতো পড়ছে, বাবা?”
বর্ণিল মাথা নেড়ে উত্তর দিলো,
“চেষ্টা করছে।”
অন্তুর মা চলে গেলেন। বর্ণিলের মন খারাপ হলো। নাস্তা দিতে অধিকাংশ সময়ে বিন্তুই আসে। আজ এলো না কেন? বিন্তু গেল কোথায়? ও কি বাড়িতে নেই? অন্তুকে কি জিজ্ঞেস করা যায়? না, থাক। এই মেয়েটাকে ভরসা করা যায় না। অন্তুর মা আবার ফিরে এসে বর্ণিলের সামনে দাঁড়ালেন। বর্ণিল শান্ত চোখে উনার মুখের দিকে তাকালো। অন্তুর মা ইতস্তত করে বললেন,
“ইয়ে…বর্ণিল, বলছিলাম যে এ মাসে তোমার টাকাটা দিতে খানিকটা দেরি হবে বাবা।”
বর্ণিল স্বাভাবিক গলায় বলল,
“অসুবিধা নেই। যখন পারবেন, দেবেন।”
সায়লা বানু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে চলে গেলেন। বর্ণিল দীর্ঘশ্বাস চেপে চায়ের কাপ হাতে নিলো। এই ব্যাপারটিতে সে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। প্রতিমাসেই তার টাকাটা পেতে দেরি হয়। এরকম একটা টিউশনি করানোর মতো ইচ্ছা তার কখনোই ছিল না। সে কাজটা করছে শুধুমাত্র বিন্তুর কথা ভেবে। বিন্তু তাকে খুব অনুরোধ করে বলেছিল যেন ওর ছোট বোন অন্তুকে বর্ণিল পড়ায়। বর্ণিল প্রথমে না বলেছিল। এত নামমাত্র সম্মানীতে পড়ানো এই বাজারে অসম্ভব। ওর মুখ থেকে না শোনার পরে বিন্তুর চোখে পানি এসে গিয়েছিল। খারাপ লাগলেও বর্ণিল সেটাকে গুরুত্ব দেয় নি তখন। কিন্তু দুদিন পরে নিজে থেকেই পড়াতে এসেছে অন্তুকে।
সেই দুদিন বর্ণিল অনেক ভেবেছে। বিন্তুর প্রস্তাব নিয়ে মায়ের সাথেও আলোচনা করেছে। ছোটবেলা থেকেই বিন্তুদের অবস্থা সে দেখে আসছে। সায়লা বানু দুই কন্যাকে নিয়ে ভাইয়ের বাড়িতে থাকেন। শুধু শুধু নয়, ভাড়ায় থাকেন। হ্যাঁ, নিজের ভাইয়ের বাড়িতেও ভাড়া চুকিয়েই থাকতে হয় উনাকে। বরাবর টানাটানির সংসার উনার। বর্ণিলের এখনো মনে আছে, ক্লাস নাইনে টিউশন পড়ার টাকা ছিল না বলে বিন্তু বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি না হয়ে মানবিক বেছে নিয়েছিল। বর্ণিল কারণ জিজ্ঞেস করায় হেসে বলেছিল, “আমার অংক করতে ভালো লাগে না রে।” অথচ বর্ণিল বিলক্ষণ জানতো, বিন্তু মিথ্যা বলছে। ও আজীবন স্বপ্ন দেখেছে রসায়ন নিয়ে পড়াশোনা করার, ঠিক ওর বাবার মতো।
বিন্তু আর অন্তুর বাবা বর্তমান নেই। বিন্তুর বয়স তখন তেরো, আর অন্তুর দুই; ওদের বাবার মৃত্যু তখনই। ওদের বাবার সাথে সায়লা বানু বিয়ে করেছিলেন বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে। তারপর এ বাড়ির কেউ আর যোগাযোগ করে নি তার সাথে। মেয়েকে একবার দেখতে পেলেন না, এই কষ্ট বুকে নিয়ে মারা গেলেন সায়লার মা। টিউশন মাস্টারের সাথে পালিয়েছে বলে রাগ করে সমস্ত সম্পত্তি ছেলের নামে লিখে দিলেন সায়লার বাবা। পনেরো বছর পরে, যখন এ বাড়ির সমস্ত জায়গা থেকে সায়লা প্রায় মুছেই গিয়েছে, ঠিক তখনই এক হেমন্তের ভরসন্ধ্যায় দুই সন্তানকে নিয়ে এই বাড়ির উঠানে এসে দাঁড়ালেন সায়লা। এই বাড়ির উঠোন জুড়ে তখন মানুষের ঢল; আর উঠোনের ঠিক মাঝে বসানো খাটিয়াতে সায়লার বাবার লাশ।
অন্তু বর্ণিলের দিকে একটা খাতা এগিয়ে দিলো। বলল,
“আমি লিখেছি।”
বর্ণিল ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে খাতা হাতে নিলো। এক পাতার একটা ইংরেজি গল্প লিখতে অন্তু ভুল করেছে মোট সাতটা বানান। বর্ণিল বুঝে উঠতে পারে না এই গর্দভ মেয়েটা বিন্তুর বোন কি করে হয়! বর্ণিল বানানগুলো ঠিক করে দিলো। তারপর খাতাটা আবার অন্তুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“যে বানানগুলো ভুল করেছ সেগুলো তিনবার করে লিখে আমাকে দেখাও।”
অন্তু মুখ কুঁচকে বলল,
“এখনই?”
“হ্যাঁ, এই মুহূর্তে।”
অন্তু দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাতা হাতে নিলো। কিছু একটা অজুহাত দাঁড় করানোর চেষ্টা করছিল সে। হঠাৎ বাইরে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ পেয়ে অন্তু দৌড়ে বাইরে চলে গেল। বর্ণিল কিছুমাত্র বলার সুযোগটাও পেলো না। বাইরে থেকে অন্তুর মামার গলা আসছে। সম্ভবত উনি সায়লা বানুর উপরে চিৎকার করছেন। কেন চিৎকার করছেন, তা স্পষ্ট নয়। বর্ণিল উঠে দাঁড়ালো। বাইরে যাওয়া উচিত হবে কিনা বুঝতে পারছে না সে। শত হলেও, সে বাইরের লোক। বাড়ির লোকেদের কথা কাটাকাটির মাঝখানে পরা মোটেই উচিত না। কিন্তু সে করবে কি? একা একা এই ঘরে বসে থাকারও তো মানে নেই। অন্তু যে আজ আর পড়বে না, তা তো ভালো করেই জানে সে।
সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে বর্ণিল দরজার দিকে এগিয়ে গেল। বাইরের চিৎকার চেঁচামেচি স্পষ্ট হলো। অন্তুর মামা, খায়রুল কবির সাহেব হিসহিসিয়ে বলছেন,
“তোর বড় কন্যা একটা অমানুষ তৈরি হয়েছে। এই মেয়েকে আমি আর বাড়িতে ঢুকতে দেবো না। এত বড় সাহস! আজ পাত্রপক্ষ আসবে জেনেও ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল! এত্ত সাহস!”
বর্ণিলের ভুরু কুঁচকে গেল। বিন্তুকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে মানে? আর ও বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথায় গেছে? কতক্ষণ বাড়িতে নেই ও?
সায়লা বানু অপরাধীর মতো বললেন,
“ভাইজান, ও কখন বেরিয়ে গেছে আমি টের পাই নি। কোথায় গেছে তাও জানি না।”
খায়রুল সাহেব ধমকে উঠে বললেন,
“কেমন মা তুই? মেয়ে কখন ঘরে ঢুকছে কখন বাইরে যাচ্ছে কিছুই জানতে পারিস না? সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চলল, অথচ তোর বজ্জাত মেয়ে এখনো লাপাত্তা। বিকালে পাত্রপক্ষ এলে আমি কি জবাব দেবো? আমার মানসম্মান থাকবে তাদের কাছে?”
সায়লা প্রায় কেঁদেই ফেলেছেন। মাথা নিচু করে বললেন,
“ভাইজান, কোনোভাবে কি উনাদের অন্যদিন আসতে বলা যায়?”
খায়রুল সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
“দেখছি।”
কথা শেষ করে তিনি দোতলায় উঠে গেলেন। উনি চলে যেতেই সায়লার সামনে এসে দাঁড়ালেন উনার স্ত্রী, শর্মিলি। উনি শক্ত করে সায়লার হাত চেপে ধরে বললেন,
“তোমাদের তিন মা ছায়ের কি শত্রুতা আমাদের সাথে? সিন্দাবাদের ভূতের মতো ঘাড়ে চেপে বসে আছ। এখন আবার আমাদের অপমান করার জন্য উঠে পরে লেগেছ। কত বড় অকৃতজ্ঞ তোমরা!”
সায়লা বানু কেঁদে ফেলেছেন। নিচু গলায় বললেন,
“ভাইজানকে অপমান করার কথা আমি কখনো ভাবতে পারি না, ভাবি।”
“নাটক করবে না, সায়লা। তোমরা কি পারো আর কি পারো না, আমার ভালোই জানা আছে। তোমার মেয়েদের জন্য তোমার ভাইজান কি না করেছে! হাজার হাজার টাকা তোমাকে ধার দিয়ে রেখেছে। সেগুলো তো চায়ই নি, উল্টো তার উপর তোমার বেহায়া মেয়ের বিয়ের দায়িত্ব নিজে নিয়েছিল। কিন্তু কি করলো তোমার মেয়ে? নিজে একবার পালিয়ে গিয়ে তো আমাদের মুখে চুনকালি দিয়েছ। এখন বাকি আছে তোমার মেয়ে। আরেকবার আমাদের অপদস্ত করতে আটঘাট বেঁধেছে সে।”
সায়লা কথা বলতে পারলেন না। শর্মিলি চাপা গলায় বললেন,
“দু’মাসের বাড়ি ভাড়াও দাও নি। আর তোমাকে কোনো ছাড় দেবো না, সায়লা। কাল সকালে আমি ভাড়ার সমস্ত টাকা গুনে নেবো। মনে থাকে যেন।”
কথা শেষ করে শর্মিলি হনহন করে দোতলায় চলে গেল। সায়লা হুহু করে কেঁদে ফেললেন। বাইরে ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে। এর মধ্যে তার মেয়েটা বাইরে, তা নিয়ে কারোর কোনো চিন্তা নেই। তারা ব্যস্ত নিজেদের মান সম্মান নিয়ে। উপরন্তু এতগুলো কথা তাকে শুনিয়ে গেল। বাড়ি ভাড়ার টাকা নিয়েও খোঁটা দিলো। অথচ এই সেই বাড়ি, যেখানে সে ছোট থেকে বড় হয়েছে। এই বারান্দায় সে পুতুল খেলেছে। উঠানে বসে চুল বেঁধেছে। সায়লার চোখে পানি উপচে পরে। সে কি নিজের মেয়ের খোঁজ রাখে না? সে কি করবে? এত বড় মেয়েকে কি সে বেঁধে রাখবে? বেইমান মেয়ে! মায়ের কষ্ট বুঝলো না।
অন্তু এগিয়ে গিয়ে মায়ের হাত ধরে। মলিন গলায় বলে,
“মা, ঘরে চলো।”
সায়লা বানু মেয়ের হাত ধরে পা বাড়ান। দরজার দিকে ঘুরতেই বর্ণিলকে চোখে পড়ে। ছেলেটা কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। উনি কোনোমতে চোখের পানি আড়াল করে বললেন,
“বর্ণিল বাবা, তুমি আজ বরং বাড়ি চলে যাও। পরশু আবার এসো।”
বর্ণিলের হড়বড় করে অনেক প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে। বিন্তুর কি বিয়ে দিচ্ছেন? কার সাথে বিয়ে দেবেন ওকে? পাত্রের বুঝি অনেক টাকাপয়সা? এখনই কেন ওকে বিয়ে দেবেন? ওকে পড়াশোনা করতে দিন। আরেকটু সময় দিন। বর্ণিল এসব কিছুই বলে না। নিজেকে সামলে নিয়ে ইতস্তত করে বলে,
“ফুপু, আপনি বললে আমি বিন্তুর খোঁজ করতে পারি।”
সায়লা আঁচলে চোখ মুছে বললেন,
“না, বাবা। এই বর্ষা বাদলের দিনে তুমি কেন শুধু শুধু কষ্ট করবে? ও ভেসে যাক, ও মরুক। ওকে খুঁজতে হবে না।”
কথা শেষ করে তিনি প্রায় ছুটে ঘরে চলে গেলেন। অন্তু এগিয়ে এলো বর্ণিলের সামনে। অসহায়ের মতো বলল,
“বর্ণিল ভাইয়া, আপনি মায়ের কথা শুনবেন না৷ আপাকে খুঁজে আনুন। প্লিজ!”
বর্ণিল হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। খোলা দরজা দিয়ে উঠানের দিকে তাকালো। বাইরে বরিষধরা। প্রবল বৃষ্টিতে এ বাড়ির উঠোন ভেসে যাচ্ছে।
_____________________________

লম্বামতো লোকটার সামনে পরতেই বিন্তুর সম্বিত ফিরলো। লোকটার দিকে তাকাতেই বিন্তু প্রথমবারের মতো বুঝতে পারলো মুষলধারে বৃষ্টি নেমেছে। জলের ধারা চারদিক ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। সে প্রায় কাকভেজা, অথচ এতক্ষণ বৃষ্টির প্রতি খেয়ালও হয় নি তার। নিজের প্রতি নিজেই অবাক হলো বিন্তু। এতটা আনমনা হয়েও কি কেউ হাঁটে? তার নামকরণের সময় তার বাবা একটা ভুল করেছে। তার নাম হওয়া উচিত ছিল আনমনা।
সামনে দাঁড়ানো ভদ্রলোক ঘাড়টা সামান্য নিচু করে এনে বলল,
“আপনি এভাবে ভিজছেন কেন? কোনো ছাউনির নিচে গিয়ে দাঁড়ান।”
বিন্তু ভুরু কুঁচকে ফেললো। মাথা উঁচু করে ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকালো। বৃষ্টিতে চশমার কাঁচ ঝাপসা হয়ে গেছে। কাজেই বিন্তু তার মুখ স্পষ্ট দেখতে পেলো না। সে চশমা খুলে হাতে নিলো। ভ্রু কুঁচকে চোখ ছোট ছোট করে লোকটার মুখ স্পষ্ট করার চেষ্টা করলো। চেষ্টা সফল হলো না। লোকটাকে সে আগের চেয়েও বেশি ঝাপসা দেখছে। তার হঠাৎ মন খারাপ হয়ে গেল। তার চোখ এতটা খারাপ?
ভদ্রলোক আবার বলে উঠলো,
“ম্যাডাম, আপনার শাড়িটা একেবারে ভিজে গেছে। আপনি দয়া করে আর ভিজবেন না। কোনো ছাউনির নিচে দাঁড়ান।”
বিন্তু এবার নিজের দিকে দৃষ্টি দিলো। বৃষ্টিতে ভিজে তার শাড়ি শরীরে লেপ্টে গেছে। নিজের উদাসীনতায় নিজের উপরে বিরক্ত হলো সে। শাড়ির আঁচল সামনে টেনে এনে নিজেকে যথাসম্ভব আবৃত করলো। তারপর পা টিপে টিপে রাস্তার ধারের একটা চায়ের দোকানে গিয়ে দাঁড়ালো। লোকটা তার পিছু পিছু গেল। টঙের বেঞ্চিতে আরও অনেকেই বসে আছে। বিন্তুর অস্বস্তি লাগছে এখানে। ভদ্রলোক দু’কাপ চা নিয়ে বিন্তুর সামনে এলেন। একটা কাপ এগিয়ে দিয়ে বললেন,
“চা খাবেন?”
বিন্তু ভ্রু কুঁচকালো। অদ্ভুত মানুষ তো। চা এনে তারপর জানতে চাইছে খাবেন কিনা! বিন্তু হাত বাড়িয়ে চা নিলো। হালকা কেশে বলল,
“চায়ের দাম?”
ভদ্রলোক নির্দ্বিধায় উত্তর দিলেন,
“আমি দিয়েছি। চায়ের দাম ১৫ টাকা। আপনি যদি দামটা ফিরিয়ে দিতে চান, তবে আরেকটা বৃষ্টির দিনে এখানে আসতে পারেন। এই দোকানের মালাই চা খুবই ভালো। আমি বৃষ্টির দিনে এখানে চা খেতে আসি।”
“আমি তবে হেঁটে হেঁটে আপনার পছন্দের দোকানে এসে দাঁড়িয়েছি?”
“জ্বি। কিছু মনে না করলে আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে চাই।”
বিন্তু চায়ে চুমুক দিয়ে বলল,
“চা খাইয়েছেন। এখন নাম ধাম, মোবাইল নম্বর, ধীরে ধীরে এসব জানতে চাইবেন। তাই তো?”
ভদ্রলোক হাসলেন। ভারী দরাজ গলার হাসি। বললেন,
“জ্বি না। আমি জানতে চাইছিলাম এভাবে অন্যমনস্ক হয়ে আপনি রাস্তায় হাঁটছিলেন কেন? আপনি কি কোনো সমস্যায় পরেছেন?”
“সমস্যায় না পরলে কি মানুষ অন্যমনস্ক হতে পারে না?”
“আপনি যতটা হয়েছিলেন, ততটা পারে না। মানুষের ইন্দ্রিয় না চাইতেও কাজ করে, কতকটা স্বয়ংক্রিয়। তখনই কাজ করতে পারে না, যখন মানুষ মাত্রাতিরিক্ত দুশ্চিন্তায় থাকে। আপনাকে দেখে যে কেউই বলে দিতে পারে আপনি চিন্তিত।”
“সমস্যায় পরলে পরেছি। আমার সমস্যা দিয়ে আপনার কি? কয়েক মিনিটের পরিচয়ে কি আমি আপনাকে নিজের সমস্যা বলতে শুরু করবো?”
“না, তা নয়। আসলে আমি একজন লেখক। মানুষের বাস্তব সমস্যাগুলো নিয়ে লেখার চেষ্টা করি। আপনার বলতে আপত্তি না থাকলে কোনো এক বইতে হয়তো আপনাকে নিয়ে লিখতাম।”
বিন্তুর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সে হাত থেকে চায়ের কাপ পাশের বেঞ্চে নামিয়ে রাখলো। তারপর বিরক্ত গলায় বলল,
“এক কাপ চায়ের বিনিময়ে আপনি আমার ব্যক্তিগত জীবন বাজারে বেঁচতে চান? অদ্ভুত লোক তো আপনি!”
“না। আপনি যেভাবে ভাবছেন…”
উনার কথা শেষ হলো না। বিন্তু উনাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
“থামুন আপনি। যত্তসব উটকো ঝামেলা।”
কথা শেষ করে বিন্তু টঙ থেকে রাস্তায় নেমে গেল। বৃষ্টি কিছুটা কমেছে। বিন্তু ভেবেছিল লোকটা তার পিছু পিছু আসবে। তেমনটা হলো না। ভদ্রলোক এলেন না। যেহেতু পিছু করেন নি, সেহেতু তাকে নিতান্তই ভদ্রলোক বলা যায়।
রাস্তায় লোকজন কম। বিকেল পেরিয়েছে কিনা বুঝতে পারছে না বিন্তু। মেঘলা আকাশ দেখে সময় বুঝতে পারা অসম্ভব। তার কি এখন বাড়ি ফেরা উচিত? বিন্তু একটু সামনে এগিয়ে গেল। বামে ঘুরতেই হাইস্কুলের গেটের সামনে বর্ণিলের সাথে দেখা হয়ে গেল। ঝাপসা চশমাতেও বর্ণিলকে চিনতে তার অসুবিধা হলো না। বর্ণিল দ্রুত পায়ে কাদা পেরিয়ে এসে বলল,
“এসব কি, বিন্তু? বাড়িতে অশান্তি পাকিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছিস? বৃষ্টিতে ভিজেছিস কেন? এদিকে ছাতার নিচে আয়।”
বিন্তু গেল না। স্বাভাবিক গলায় বলল,
“তুই এদিকে কি করছিস?”
“তোকে খুঁজতে এসেছি। তোর মা কান্নাকাটি করছে। সকাল থেকে তোর খোঁজ নেই। ফোনটাও ফেলে এসেছিস। বাড়ি চল, বিন্তু।”
বিন্তু শীতল গলায় প্রশ্ন করলো,
“এই বৃষ্টিতে তুই আমায় খুঁজতে এসেছিস, সেই কথা তোর মা জানে?”
বর্ণিল উত্তর দিলো না। বিন্তু নিচু গলায় বলল,
“মামীকে চিন্তায় ফেলা তোর ঠিক না। এমনিতেই আমাকে উনি সহ্য করতে পারেন না। তার উপর আমার জন্য তোকে বর্ষা বাদলা মাথায় ছোটাছুটি করতে দেখলে উনি মেনে নিতে পারবেন না। তুই বাড়ি যা, বর্ণ। আমি একটা রিকশা নিয়ে চলে যাব। তুই চিন্তা করিস না।”
কথা শেষ করে বিন্তু নদীর বাঁধের দিকে এগিয়ে গেল। সেখানে সারি সারি রিকশা দাঁড়ানো। এই বৃষ্টিতে কেউ বাগানবাড়ির দিকে যেতে রাজি হলে হয়।
.
চলবে।

তোমার জন্য সিন্ধুর নীল পর্ব-৩৪ এবং শেষ পর্ব

0

#তোমার_জন্য_সিন্ধুর_নীল
#অন্তিম_পাতা
#সারিকা_হোসাইন

********
চারিদিকে পাখির কিচিরমিচির ডাকে মুখরিত হচ্ছে,পুব আকাশের সূর্য টা লাল বর্ণের আভা ছড়িয়ে আকাশ কে লালিমা লেপন করে দিয়ে জানান দিচ্ছে এখন ভোর হয়েছে।বাইরে মৃদুমন্দ বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে।টুপটুপ করে কুয়াশা পড়ে গাছের পাতা,ঘাসের ডগা গুলো কে ভিজিয়ে দিচ্ছে।

মুহিতের উদোম লোমহীন বুকে শান্তির নিদ্রা যাপন করছে স্বর্গ।
মুহিতের কক্ষের দক্ষিণের জানালা খোলা থাকায় ভোরের শিরশিরে ঠান্ডা বাতাসে শীতে কেঁপে শরীর কাটা দিয়ে উঠলো স্বর্গের।
একটু উমের আশায় বিড়াল ছানার মতো মুহিতের বাহুডোরে লুকালো।

স্বর্গের কাঁপুনিতে মুহিতের ঘুম ছুটে গেলো।চোখ মেলেই স্বর্গের ঘুমন্ত নিষ্পাপ মুখশ্রী দেখে এক অনিন্দ্য সুখ পেলো মুহিত।
সরে যাওয়া পাতলা ব্ল্যাঙকেট জড়িয়ে দিলো স্বর্গের নগ্ন পিঠে।
আরাম পেয়ে মুহিত কে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরলো স্বর্গ।

রাতের সুখময় স্মৃতি মনে পড়তেই নিমিষেই মুহিতের রক্ত গরম হয়ে উঠলো।

স্বর্গের কপালে,গালে ,ঠোঁটে ভালোবাসার পরশ একে নিজের সাথে চেপে ধরলো স্বর্গকে।
ঘুমের মধ্যেই ব্যাথায় ককিয়ে উঠলো স্বর্গ।

হাতের বাধন আলগা করে গত রাতের কথা ভাবলো মুহিত।

বহুদিন পর নিজের শ্রেয়সী কে কাছে পেয়ে একটু বেশি ই কষ্ট দিয়ে ফেলেছে সে।

মুহূর্তেই নিজের প্রতি নিজের রাগ হলো।

“এতো হিংস্র কি করে হতে পারলো সে?”

“মেয়েটা তো আর তার থেকে পালিয়ে যাচ্ছিলো না।”

স্বর্গের আবেদনময়ী রূপ দেখে মুহিত নিজেকে কোনোভাবেই কন্ট্রোল করতে পারেনি।খুব বেশি ই বেসামাল হয়ে গেছিলো সে।

স্বর্গের তুলার মতো নরম শরীর নিমিষেই দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে মুহিত।

মুহিত তো প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলো যে,সে কখনো স্বর্গকে তার তরফ থেকে কোনো কষ্ট পেতে দিবেনা।
তাহলে একরাত্রের ব্যবধানেই কি করে প্রতিজ্ঞা ভাঙলো মুহিত?
হঠাৎই মুহিতের ভাবনার ছেদন হলো স্বর্গের ঘুম ঘুম কন্ঠে
“লাভ ইউ জান”
কথাটি শুনে।

স্মিত হেসে কপালে চুমু খেয়ে মুহিত বলে উঠলো
“লাভ ইউ টু”

স্বর্গের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে মুহিত অপরাধীর ন্যায় বলে উঠলো
“কাল রাত্রের জন্য আম রিয়েলি সরি”
“আমি নিজেকে আয়ত্তে আনতে পারিনি।
“প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও আর কখনো এমন ভুল হবে না”

স্বর্গ মুহিতের নাকে হালকা স্লাইড বুকে আঁকিবুকি করতে করতে আবেশ মেশানো ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বললো
” তুমি যতো বার কন্ট্রোললেস হবে আমি ততো বার তোমাকে কন্ট্রোলে আনতে প্রস্তুত।

মুহিত স্বর্গের কাঁধে মুখ ডুবিয়ে জিজ্ঞেস করলো―
“সত্যি?
স্বর্গ দুই হাতে মুহিতের পিঠ জড়িয়ে বলে উঠলো
―তিন সত্যি।

এরপর নিজেকে সরিয়ে বিছানায় বসে মুহিত স্বর্গকে বললো
“তোমার জন্য দুটো সারপ্রাইজ আছে।কবে দেখতে চাও সেগুলো?

“স্বর্গ দুম করে উঠে বসে জিজ্ঞেস করলো কেমন সারপ্রাইজ??
“গেলেই দেখতে পাবে “হেসে বলে উঠলো মুহিত।

“তাহলেই আজকেই যেতে চাই”

“অনেক লম্বা জার্নি করতে হবে ,পারবে??

“আলবাত পারবো।

“আচ্ছা ঠিক আছে কাল নিয়ে যাবো।

“না আমি আজকেই যেতে চাই”

“আজকে তোমাদের বাড়িতে যেতে হবে ভুলে গেছো পাগলী?

“স্বর্গ মিন মিন করে “হুম” বলে মুহিতের কোমর জড়িয়ে আরেকটু ঘুমানোর চেষ্টা করলো।

―――――
স্বর্গ ,মুহিত,সুখ,নামিরা আর সোহাগ যখন নাফিজ মাহমুদ এর বাংলোতে এসে পৌঁছায় তখন দুপুর বারোটা বাজে।
মিসেস তনুজা আর হেল্পিং হ্যান্ড ফতেমা মিলে স্বর্গ আর মুহিতের পছন্দ সই বিভিন্ন পদ রান্না করছেন।
নাফিজ মাহমুদ জরুরি কাজে বাইরে গিয়েছিলেন।যখন মুহিত জানালো তারা বাসা থেকে বের হচ্ছে তখনই নাফিজ মাহমুদ দ্রুত কাজ সেরে বাসার দিকে রওনা দেন।

এসেই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষন বসে থাকলেন নাফিজ মাহমুদ।
মেয়ে যখন বাড়িতে ছিলো তখন সারাদিন দেখা না হলেও কিছুই অনুভব হতোনা।
কিন্তু মেয়েটা যেই দূরে চলে গিয়েছে তখনই বুকটা খাঁ খাঁ করতে শুরু করেছে।
আসলেই দূরত্ব ভালোবাসার কদর বোঝায়।

স্বর্গ নাফিজ মাহমুদ এর পিঠ হাতড়াতে হাতড়াতে বলে উঠলো
“বাপী আমি কিন্তু এখন কেঁদে দেবো।

অমনি নাফিজ মাহমুদ স্বর্গকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।
“না মামনি কেঁদোনা, তোমার কান্নার সুর শুনে মুহিত ভয় পাবে।

ইচ্ছে করেই বিকৃত শব্দে খিক খিক করে হেসে উঠলো” সুখ।”

পরিবারের সকলের খুনসুটিতে নিমিষেই সকল মন খারাপ দৌড়ে পালালো।

খেতে খেতে ডাইনিং টেবিলে নাফিজ মাহমুদ মুহিতকে জিজ্ঞেস করলেন

“তা কোথায় ঘুরতে যাচ্ছ?

“স্যার এটা সিক্রেট আছে,স্বর্গের জন্য সারপ্রাইজ হিসেবে রেখেছি।

“সেকি বাবা এখনো স্যার স্যার করে যাচ্ছ?
“হয় বাবা বলো না হয় মামা বলো,এরম স্যার স্যার বলে আমাদের দূরে ঠেলে দিও না
অনুযোগের সুরে বলে উঠলো তনুজা।

“নেক্সট টাইম প্র্যাকটিস করে তারপর বলবো ম্যাডাম”
বলেই স্বর্গের দিকে তাকালো মুহিত।

স্বর্গ চোখ গরম করে বলে উঠলো
“এখনই বলতে হবে তোমাকে ,ফুপিকে তো সকালে উঠেই আমি মা বলেছি।
তোমার এতো আজাইরা লজ্জার কারন তো দেখছি না।
মামীর” মী, কেটে দিয়ে মা বলবে আর বাপিকে বাবা বলবে শেষ।

স্যার ,ম্যাডাম ডাকলে আমিও তোমাকে ভাইয়া ডাকবো।

খুক খুক করে কেশে উঠলো মুহিত।
একগ্লাস পানি নিয়ে খেতে খেতে ভাবলো

নিজের প্রানপ্রিয় বউয়ের মুখে ভাইয়া ডাক শোনার মতো হরিবল আর কিছুই হয়না।

স্বর্গকে বিশ্বাস নেই ডেকেও ফেলতে পারে।তার আগেই শুধরে যাই।

ঠিকাছে বলছি
ম্যাডাম সরি মা,বাবা আমি আজকেই স্বর্গকে নিয়ে চলে যেতে চাই।যদি আপনাদের কোনো আপত্তি না থাকে।
অনেক দিন আমাদের কারোর ই ঘুরাঘুরি হয়নি।
আমি যখন মিশনে ছিলাম তখন স্বর্গ ডিউটি আর বাসা করেই সময় কাটিয়েছে।
আর মিশন থেকে এসেই বিয়েটা হয়ে গেলো।

তাই আমি কিছুদিন একান্তে ওর সাথে টাইম স্পেন্ড করতে চাচ্ছি।

নাফিজ মাহমুদ আর তনুজা সম্মতি জানালো।

রাতের খাবার খেয়ে মুহিতরা বেরিয়ে গেলো।
পিছনে ফেলে গেলো তিনজন বিমর্ষ প্রিয়জনকে।

*********
আজ ডিসেম্বর মাসের পনেরো তারিখ।মোটামুটি ভালোই শীত পড়তে শুরু করেছে।দিনে শীতের প্রকোপ এতোটা বোঝা না গেলেও রাতে ঠিকই বোঝা যায়।
ভোর পাঁচটা বাজেতেই কর্কশ স্বরে মুহিতের ফোনের এলার্ম বেজে উঠলো।
স্বর্গ কম্বল দিয়ে চোখ মুখ ঢেকে বিরক্তি প্রকাশ করলো।
সারা রাত ঘুম হোক বা না হোক এই ভোর রাতে শান্তির ঘুম যেনো চোখের পাতায় এসে জেঁকে বসে।

তড়িৎ গতিতে এলার্ম বন্ধ করে উঠে বসলো মুহিত।
আজ স্বর্গকে সারপ্রাইজ দেবার প্রথম দিন।
দ্রুত ফ্রেস হয়ে এসে আদুরে স্বরে ডেকে উঠলো স্বর্গকে।

মুহিত খুব ভালো করেই জানে এই মেয়ে প্রচুর অলস।
ঘুমের আরামের জন্য দেখা যাবে বলে বসেছে”আজকে সারপ্রাইজ লাগবে না,অন্য দিন দিও”

স্বর্গকে হাড়ে হাড়ে চেনে মুহিত।
তাই এক টানে ব্ল্যাঙকেট সরিয়ে দুই হাত টেনে উঠে বসালো স্বর্গকে মুহিত।

স্বর্গ আবার শুয়ে পড়তে চাইলেই মুহিত জগে থাকা পানি অল্প হাতে নিয়ে স্বর্গের চোখে ছিটিয়ে দিলো।

শীতে ঠান্ডা পানির স্পর্শে চোখ মেলে তাকালো স্বর্গ।

ঘুম কাতুরে কন্ঠে বলে উঠলো
“এভাবে আমাকে কষ্ট দিচ্ছ কেনো মুহিত”

মুহিতের বুঝি মায়া হলো স্বর্গের এহেন অভিযোগে।
কিন্তু কিচ্ছু করার নেই।একজনের কাছে সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।তাকে যেতেই হবে।দায়িত্ব কর্তব্য ফেলে এখানে ভাবলেশহীন দিন কাটানোর মানুষ মুহিত নয়।

মুহিত স্বর্গের গালে হাত দিয়ে বলে উঠলো

“তোমার বর একজনের কাছে খুব ঋণী।তার ঋন পরিশোধ না করলে মরেও যে শান্তি পাবোনা !

মুহিতের এমন সিরিয়াস কথা শুনে স্বর্গ দ্রুত ফ্রেস হতে চলে গেলো।
আধা ঘন্টার মধ্যে রেডি হয়ে সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মুহিতের জলপাই রঙা জিপে চেপে বসলো দুজনে।

হালকা আলো ফুটার আগেই হাইওয়ে ধরলো মুহিত আর স্বর্গ।

সকালের বাতাস টা খুব গায়ে লাগছে।হালকা কুয়াশার ধুম্রজাল বেষ্টন করেছে ধরণী।
জিপ থামিয়ে গলার মাফলার দিয়ে নাক কান পেঁচিয়ে নিলো মুহিত সাথে স্বর্গকেও ভালো মতো পেঁচিয়ে দিয়ে আবার জিপ হাকালো।

চারপাশের সুন্দর মনোরম পরিবেশ স্বর্গকে মুগ্ধ, বিমোহিত করছে।গাছের পাতার ফাক গলিয়ে লাল সূর্যটা বেরিয়ে এলো।পাখি গুলো আকাশে উড়ে বেড়াচ্ছে।রাস্তায় দুই একজন মানুষের দেখা মিলছে মাঝে মধ্যে।
কিছু কিছু হোটেল,চায়ের স্টল এ আগুন জ্বালানো হচ্ছে।
ঘন্টা তিনেক পর শহর থেকে একটু দূরে একটি টং দোকানের কাছে ব্রেক কষলো মুহিত।

স্বর্গ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মুহিতের দিকে তাকালো।

মুহিত মুচকি হেসে বললো,”এখনো বহুদূরের পথ বাকী।
নেমে এসো চা খাবো।”

বড় বড় রেস্টুরেন্ট বা কফিশপের চায়ের থেকেও টং দোকানের চায়ের স্বাদ বেস্ট।
অল্প চুমুক আর বড় নিশ্বাস,যেনো আত্মিক প্রশান্তি।

মুহিত কড়া লিকারের দু কাপ দুধ চা চাইলো।
দোকানী দ্রুত চা বানিয়ে মুহিতের হাতে তুলে দিলো।

মুহিত স্বর্গের পানে চা এগিয়ে দিয়ে বলে উঠলো
” সকালের এই ঠান্ডা হাওয়ায় লম্বা একটা শ্বাস নেবে,এরপর চায়ে চোখ বন্ধ করে ছোট চুমুক দেবে।চা টা গিলে শ্বাস ছাড়বে।
দেখবে কতো প্রশান্তি !”

মুহিতের কথা মতো স্বর্গ চা পান করে যেনো এক অনন্য সুধা পান করলো।
মনে হলো চা আর প্রকৃতির মিষ্টি হাওয়া দুটোই পেটে নয় অন্তরে গিয়ে লাগলো।

স্বর্গ উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করলো
“তুমি এটা কিভাবে জানলে??

“পাপা শিখেয়েছিলো,আর আমি শীতকাল আসলে ইচ্ছে করেই গ্রাম সাইডের আর্মি ক্যাম্পিং এ যাবার জন্য নাম লিখাতাম।

প্রকৃতির সাথে থাকলে তুমি কখনো কুটিল হতে পারবে না।
প্রকৃতি তোমাকে তারমতো উদার বানিয়ে দেবে।
বিশ্বাস না হলে জানুয়ারিতে আমার সাথে ক্যাম্পিং এ চলো।

স্বর্গ মাথা নাড়িয়ে সায় জানালো,সে যাবে।

ফাঁকা রাস্তা,এবং মাঝে মাঝে বিরতি দিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ সব মিলিয়ে সাড়ে আট ঘণ্টা সময় লাগলো মুহিতদের কাঙ্খিত জায়গায় পৌঁছুতে।

দেড় বছরে অনেক কিছুই পাল্টে গেছে।পাহাড় কেটে রাস্তাও তৈরি করা হয়েছে।খাসিয়া পল্লীর সবচেয়ে শেষের ঘরটা ডিকো দের।
মুহিত নিমিষেই চিনে ফেললো সেই ঘর।
কিন্তু পাশে আরো দুটো নতুন ঘর হয়েছে।

স্বর্গ অবাক হয়ে সব কিছু পর্যবেক্ষণ করছে।কিছুই তার বোধগম্য হচ্ছে না।

মুহিত গাড়িতে করে এক গাদা জিনিস এনেছে বাচ্চা মেয়েটির জন্য।

গাড়ি থেকে দুজনে মিলে সব নামিয়ে শেষ করতে পারলো না।কিছু জিনিস রেখে নেমে বাড়ির সদর দরজায় টোকা দিলো।
মিনিট পাঁচেক পরেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলো একটি মেয়ে।
এই দেড় বছরে সে অনেক খানি বড় হয়ে গিয়েছে।তার ছোট কোঁকড়ানো চুল গুলোও কাঁধ ছাপিয়ে নেমে এসেছে।

মেয়েটি মুহিতের দিকে তাকিয়েই চোখ বড় বড় করে ফেললো।

চিল্লিয়ে তার মা কে ডেকে উঠলো
“দেবতা আইসেছে”

মেয়েটির চিল্লানোর শব্দে মারুং আর তার স্ত্রী দৌড়ে এসে মুহিতের সামনে দাঁড়ালো।
তাদের রীতি অনুযায়ী মেহমান কে সম্মান জানালো।

প্রথমেই মুহিত ডিকোর হাতে তুলে দিলো লাল টকটকে একটা জামা।
মারুং কে গাড়ি নির্দেশ করে বলে উঠলো
“ওখানে যা কিছু আছে সব ডিকোর”

স্বর্গ এতোক্ষন চুপ থাকলেও সুযোগ পেতেই মুহিতকে জিজ্ঞেস করলো
“এদের কিভাবে চেনো?”

“আজকে তুমি এদের জন্যই আমাকে পেয়েছো স্বর্গ”
বলেই সেই বিভীষিকা ময় ঘটনার বিস্তারিত ঘটনা খুলে বললো মুহিত।

পুনরায় সেই কুৎসিত স্মৃতি মনে পড়তেই চোখের কোনে জল জমা হলো স্বর্গের।

হঠাৎই হাতে কারো স্পর্শ অনুভব করলো স্বর্গ।হাতের দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো ডিকো লাল ফ্রকটি পরে সেজে দাঁড়িয়ে আছে।

মেয়েটিকে গাল টিপে আদর করে দিলো স্বর্গ।
মুহিত মেয়েটিকে কোলে তুলে আদুরে স্বরে বলে উঠলো
“তুই আমার অনেক সেবা করেছিস,এবার তোর সারা জীবনের সেবা করতে পারলে নিজেকে হালকা লাগবে।

মেয়েটি মুহিতের কথার আগা মাথা কিছুই না বুঝে শুধু নীরবে তাকিয়ে রইলো।

মারুং এর থেকে মুহিত জানতে পারে মুহিতের দেয়া টাকাটা দিয়ে তারা একটা পানের বর দিয়েছে।সেখান থেকে ভালোই টাকা আসে।তারা তিনবেলা পেট ভরে খেয়ে পরে ভালোভাবেই বেঁচে আছে।
ডিকো স্কুলে যায়।সরকার থেকে ওদের জন্য একটা স্কুল করা হয়েছে,চিকিৎসা সেবাও ভালো এখন।

মুহিত মারুং কে অনুরোধ করে
“ডিকো যতদূর পড়তে চায় মারুং যেনো বিনা বাধায় তাকে পড়তে দেয়।ডিকোর সকল খরচ মুহিত প্রদান করবে।
এবং সুযোগ পেতেই তাদের সাথে দেখা করতে আসবে।

সারাদিন সময় কাটিয়ে মুহিত আর স্বর্গ বেরিয়ে আসে মারুং দের বাড়ি থেকে।
ডিকো কেঁদে ভাষায়, মারুং আর তার স্ত্রী নীরবে চোখের অশ্রু মুছে।
কে বলেছে রক্তের সম্পর্ক না থাকলে মানুষ আত্মার আত্মীয় হয়না?

বরং রক্তের সম্পর্ক হীন মানুষ ই বেশি আত্মার আত্মীয় হয়।
মারুং আর তার পরিবার জলন্ত প্রমান।

যেতে নাহি দিবো হায়, তবু যেতে দিতে হয়, তবু চলে যায়।
নিজেদের জীবিকার তাগিদে মানুষকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতেই হয়।
ধরে বেঁধেও কেউ রেখে দিতে পারে না।
বিষন্ন মনে মুহিত আর স্বর্গ জিপে চেপে বসে,
স্বর্গ মুহিত চির কৃতজ্ঞ এই ছোট খাসিয়া পরিবারটির কাছে।

মুহিত জিপ হাঁকায়, যতো দূর দৃষ্টি সীমানায় মুহিতের জিপ দেখা যায় ডিকো, মারুং, আর তার স্ত্রী তাকিয়ে থাকে।
স্বর্গ মুহিত ও পিছন ফিরে বারবার তাদের বিদায় জানায়।

――――
মুহিত আর স্বর্গ বসে আছে আছে দুবাই আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে।
সাড়ে পাঁচ ঘন্টার নন স্টপ এমিরেটস ফ্লাইটে তারা এসে পৌঁছেছে।
দুবাই কেনো এসেছে মুহিত স্বর্গ কে নিয়ে তা অজানা স্বর্গের।

মুহিত তারজন্য কি সারপ্রাইজ রেখেছে সেটা দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে স্বর্গ।

একটু পরে একটি লোক হন্তদন্ত করে প্ল্যাকার্ড নিয়ে মেজর মুহিত ওয়াসীফ এর খুজ চালাচ্ছে।
এই ব্যাস্ত এয়ারপোর্ট এ কোথায় খুঁজবে সেই মেজর কে?ভাবতেই দুবাই ছামাদের ঘাম ছুটে গেলো।

মুহিত তার কালো চশমার ভেতর দিয়ে দুবাই ছামাদ কে দেখে ফিচেল হাসলো।
কারন এই ব্যাক্তির চেহারা মুহিত আগেই দেখেছে ফোনে।

মুহিত ব্যাগপত্র নিয়ে স্বর্গের হাত ধরে দুবাই ছামাদের সামনে দাঁড়ালো। গমগমে কন্ঠে ছামাদ কে উদ্দেশ্য করে আরবি ভাষায় বলে উঠলো

“মারহাবান”(হ্যালো)
মাসাউল খাইর”(শুভ সন্ধ্যা)

চমকে উঠলো ছামাদ।এই বহুরূপী দেশে কে তাকে এভাবে শুভ সন্ধ্যা জানাচ্ছে।
মুখের দিকে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলো
“মা আন্ত?

মুহিত মেপে হাসলো।এর পর আরাবিক ভাষায় উত্তর দিলো
“ইসমী মেজর,,,,,

মুহিত কে কথা শেষ করতে না দিয়েই মুহিতের মুখের দিকে তাকিয়ে ছামাদ দিল খোলা হেসে মুহিত কে জড়িয়ে ধরলো।

কোলাকুলি করে বলে উঠলো
আম সরি ব্রো
আম রিয়েলি সরি

মুহিত বলে উঠলো
“দা “আ” হা তাদহাব,(আরে বাদ দাও)

ছামাদ হাতের প্ল্যাকার্ড উল্টিয়ে রাস্তা নির্দেশ করে মুহিত আর স্বর্গের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো
“দায়ানা নাদহাব, (চলো যাওয়া যাক)

এয়ারপোর্ট থেকে মুহিত আর স্বর্গ বেরিয়ে পার্কিং এরিয়াতে আসতেই ছামাদ কালো রঙের রেঞ্জ রোভার গাড়ি নির্দেশ করে তাদের উদ্দেশ্যে দরজা খুলে দিলো।

মুহিত স্বর্গকে নিয়ে গাড়িতে উঠতেই গাড়ি স্টার্ট দিলো ছামাদ।

ত্রিশ কিলোমিটার পথ জার্নি করার পর আবুধাবি শহরের একটি বিশাল বড় এপার্টমেন্ট এর সামনে এসে ছামাদ গাড়ি থামালো।

মুহিতকে প্রচুর উত্তেজিত দেখালো।
স্বর্গের হাত ধরে গাড়ি থেকে নেমে ছামাদ কে ব্যাগ নামানোর নির্দেশ দিলো।
একজন গার্ডের সহায়তায় তাদের লিফট পর্যন্ত নিয়ে ছত্রিশ তলার বাটন প্রেস করা হলো।

লিফটে দাঁড়িয়ে স্বর্গ মুহিত কে খোঁচা মেরে জিজ্ঞেস করলো এতো সম্মান প্রদর্শন করে কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তাদের?

মুহিত স্বর্গকে রিল্যাক্স থাকতে বলে আরাবিক ভাষায় গার্ড এর সাথে কিছু কথা বার্তা সারলো।

স্বর্গের কাছে এই মুহূর্তে মুহিতকে দুবাইয়ের শেখ মনে হচ্ছে।
যে কথায় কথায় আরবি ঝাড়ছে।

কাঙ্খিত ফ্লোরে আসতেই খুলে গেলো লিফটের দরজা।
গার্ড হাতের ইশারায় একটি বিশালাকার কারুকাজ খচিত দরজা নির্দেশ করলো।
সেখানে গিয়ে মুহিত কলিংবেল টিপতেই বেরিয়ে এলো সুদর্শন এক যুবক।
যার পড়নে কান্দুরা, মাথায় কেফায়া,লম্বা লম্বা দাড়ি,যেনো চেহারায় নূর ভাসছে।
স্বর্গ অভিভূত হয়ে লোকটির দিকে তাকিয়ে থাকলো।
লোকটিকে তার বড্ড চেনা পরিচিত লাগছে।
লোকটির সাথে বোরকা পরা পর্দানশীন একজন অল্প বয়সের মেয়েও বেরিয়ে এলো।

মুহিত স্বর্গকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করতেই সকলেই তাদের সমাদর করতে ব্যাস্ত হয়ে পড়লো।
আল্লাহর বিভিন্ন নাম,মদিনার ছবি, বিভিন্ন সূরার ওয়ালম্যাট শোভা পেয়েছে ঘরের প্রত্যেকটি দেয়ালে।

যুবকটি তাদের সামনের সোফায় বসে দৃষ্টি সংযত করে জিজ্ঞেস করলো
“কেমন আছো স্বর্গ”

“স্বর্গের বুক ধক করে উঠলো,আরেহ এটা আহিয়ান।
আহিয়ান এর এতো আমূল পরিবর্তন দেখে খুশিতে বাক হারা হলো স্বর্গ।
মুহিতের সারপ্রাইজ এ সে সত্যি সারপ্রাইজড হয়ে ভাষা হারিয়েছে।

পাশে থাকা মেয়েটিকে নির্দেশ করে দেখিয়ে বললো
“ও আমার স্ত্রী মারীয়ম।”
মাস ছয়েক হয়েছে তারা দাম্পত্য জীবন শুরু করেছে।
বাংলাদেশ থেকে ফিরেই আহিয়ান নিজেকে শুধরে নিয়েছে।
নিজের খারাপ অতীতকে ঘৃণা করে বেছে নিয়েছে রাব্বুল আলামিনের রাস্তা।
আহিয়ান অনেক সুখে আছে তার স্ত্রী কে নিয়ে।
মেয়েটা এখানকার নাগরিক।
আহিয়ান রাশিয়া থেকে চলে এসে এখানে স্থান গেড়েছে।

মুহিতের হাত ধরে আহিয়ান কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলে উঠলো
“আমার এই জীবন তোমার দেয়া।আল্লাহ তোমার উছিলায় আমাকে তওবা করার সুযোগ দিয়েছে মেজর।

“আমার মা প্রতিদিন আমার স্বপ্নে আসে।আমাকে অনেক দোয়া করে,আমার প্রতি সন্তুষ্টি প্রকাশ করে”

“আমি দীর্ঘ ত্রিশ বছর আমার মাকে স্বপ্ন দেখিনি মেজর।”

“এখন রোজ দেখি”
মায়ের সাথে গল্প করি”

“একজন সন্তান হিসেবে এর চাইতে বড় প্রাপ্তি আর কি আছে মুহিত?

আহিয়ান মায়ের জন্য কাঁদে,আল্লাহর ভয়ে কাঁদে।
সে হেদায়াত প্রাপ্ত হয়েছে এই খুশিতে কাঁদে।

আহিয়ানের খুশির কান্নায় ভিজে উঠে মারীয়ম সহ সকলের চোখ।

――――
সময় বহমান,পেরিয়ে গেছে চোখের পলকে দুটো বছর।
হসপিটাল এর ওটি রুমের সামনে সমানে পায়চারি করছে মুহিত,সুখ আর নাফিজ মাহমুদ।নামিরা,তনুজা মিসেস তারিন দোয়া পড়ে যাচ্ছেন সমানে।
স্বর্গের বেবি হবে,প্রেগন্যান্সি সময়ে তার অনেক জটিলতা গিয়েছে।

মুহিত ভয়ে থেকে থেকে অস্থির হয়ে উঠছে শুধু।

নামিরার সাড়ে তিন বছরের ছেলেটা সব কিছু প্রত্যক্ষ করছে।

হঠাৎই ভেসে উঠলো কান্নার আওয়াজ।ভয়ে কেঁদে ফেললো মুহিত ও।
আর কোনোভাবেই নিজেকে সামলাতে পারছেনা মুহিত।
ডক্টর কেনো এখনো বের হচ্ছে না।
চিন্তায় প্রেসার ফল হবার উপক্রম।
একটু পর পিউ দুই হাতে দুটো বাচ্চা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।
পিউকে দেখেই উত্তেজিত হয়ে গেলো মুহিত।
অসহায় চোখে পিউয়ের দিকে তাকাতেই পিউ চোখের ইশারায় ভেতরে যাবার অনুমতি দিলো।
মুহিত দৌড়ে স্বর্গের কাছে চলে গেলো।
লেবার পেইন আর নরমাল ডেলিভারির প্রেসারে একদম নেতিয়ে গিয়েছে মেয়েটা।
স্বর্গের হাত ধরে চুমু খেয়ে ফুঁপিয়ে বাচ্চাদের কেঁদে ফেললো মুহিত।
স্বর্গ কাঁপা কাঁপা হাতে মুহিতের চোখের জল মুছে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।

কিছুক্ষন পর পিউ এসে মুহিতকে বললো
“লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুহিত ওকে কেবিনে শিফট করবো আমি। আপনি বাইরে গেলে ভালো হয়”
মুহিত বুঝতে পেরে মাথা দুলিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলো।
একটি পুত্র আর একটি কন্যা সন্তানের বাবা হয়েছে মুহিত।

মেয়েটা হুবুহু মায়ের চেহারা পেয়েছে।
ছেলেটার দিকে নজর দিতেই কলিজা মুষড়ে উঠলো মুহিতের।
মুকিত ,নামিরার ছেলে আর মুহিতের ছেলে হুবুহু চেহারা।

ছেলেমেয়েদের কোলে নিয়ে চুমু খেলো মুহিত।
বাবা হবার যেই অব্যাক্ত আনন্দ তা কাউকে বলে বোঝানো যাবেনা।

******
আদনান ওয়াসিফ এর বিশাল বাড়ির ড্রয়িং রুমে দৌড়ে হেটে খেলে বেড়াচ্ছে মুহিতের দুই ছেলে মেয়ে “লিও”আর “রেইন”

হঠাৎই খেলতে খেলতে পড়ে গেলো দেড় বছরের মুহিতের মেয়ে রেইন।
মুহিত,স্বর্গ দৌড়ে আসার আগেই শুদ্ধ এসে টেনে তুলে আদর করে চোখ মুছিয়ে বলে উঠলো
“কেঁদোনা তুমি।তুমি কাঁদলে আমার কষ্ট লাগে।
কথাটা শুনেই চুপ করে হাসতে লাগলো রেইন।

বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পাঁচ বছরের শুদ্ধ দৌড়ে নামিরার কাছে গিয়ে আবদার করলো
“মাম্মা আমিও মামার মতো ওকে বিয়ে করবো।রেইন কে আমার অনেক ভালো লাগে।ও অনেক সুন্দর পুতুলের মতো।

সকলেই এই কথা শুনে হাসতে হাসতে ঢলে পড়লো।

মনে মনে মিসেস তারিন ভাবলেন
আজ যদি মুকিত আর মানুষটা বেঁচে থাকতো তাহলে কতো খুশি হতো মুহিত আর নামিরার খুশিতে।
সব খুশিতেই পরিপূর্ণতা থাকে না।কিছু কিছু খুশি অপূর্ণতাই থেকে যায়।বলেই গোপনে সুখের অশ্রু মুছলেন।

―――――― সমাপ্ত ――――――