Tuesday, August 5, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 157



শূন্যলতা পর্ব-০২

0

#শূন্যলতা
#গুঞ্জন_চৈতি
পর্ব-২

গুটি পথ বদল করে এক ডুবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করলো বামদিকে এগোনোর। একবার মাথা তুলে শ্বাস নিয়ে দ্বিতীয় ডুব দিতেই টের পেল কেউ টেনে ধরেছে তাকে। পিলে চমকে উঠলো গুটির। তাহলে কি সব চেষ্টা বৃথা গেল? ধরা পরে গেল সে?
গুটি অনুভব করলো তাকে টেনে ধরা মানুষটা খিঁচে ধরে উপরে টেনে তুললো তাকে। জলের উপর মাথা তুলতেই গুটি অচেনা আগন্তুককে দেখল। অন্ধকারে চেহারা স্পষ্ট না হলেও পুরুষ অবয়ব ভয়ঙ্কর রকমের ভীতি দিলো মনে। আর আগন্তুক ছেলেটি দেখল একটি নারী অবয়ব। তবে কি যেন হলো, ছেলেটি মুহুর্তের মধ্যে গুটিকে টেনে পুনরায় জলের নিচে নিয়ে গেল। বিস্ময়ে হাত-পা নেড়ে সাঁতার কাটতে ভুলে গেল গুটি। ভেবেছিল হয়তো চিৎকার করে লোক জানাবে নিজের জয় প্রকাশ করে। কিন্তু উল্টো হাত টেনে ধরে সাঁতরে যাচ্ছে সামনের দিকে। এদিকে সাঁতরালে তো কোন কুল কিনারা পাওয়া যাবে না, উল্টো কিছুদূর গেলেই নদী। লোকসমাগম বেশি না হলে আর লোকজনের হইহট্টগোল বেশি না হলে নিশ্চিত দু’জনের ধপ করে মাথা তোলার শব্দে তাদের খোঁজ পেয়ে যেত গ্রামের লোক। কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে এগোনোর পর গুটি অনুভব করলো ছেলেটির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাঁতরাতে পারছে না আর। ছেলেটির আগেই তার দম খাটো হয়ে আসছে। বারবার হাত টেনে উঠতে হচ্ছে জলের উপর শ্বাস নিতে। আমাবস্যা গেল গতকাল, ঘুটঘুটে অন্ধকারে দিক চেনা মুশকিল। বেশ কিছুদূর গিয়ে সাবধানে মাথা তুলে দেখল লোকজন থেকে বেশ খানিকটা সরে এসেছে দু’জন। তবে ওদিকে এখন ভীড় বেড়ে গিয়েছে চার গুণ। হইহট্টগোল আর গ্রামের মানুষের ভীড়ে টইটম্বুর পুরো রাস্তা যেন ভাসমান এক নৌকা। গুটি আর বেশি দেখতে পারলো না। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে। পা ব্যাথায় ভার হয়ে উঠছে ক্রমে। হাতে টান পড়ায় পুনরায় তলিয়ে গেল জলে। বিল যেখানে নদীর সঙ্গে মিশেছে সেখানটা পার হয়ে নদীর স্রোতে গা ভাসাতেই গুটির ভয় বেড়ে গেল। এদিকে হাত-পা ভেঙে আসছে। অবশ হয়ে আসছে শরীর। এরমধ্যেই ছেলেটি গুটিকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিল নিজের সাথে। নদীর স্রোতে আলাদা হয়ে গেলে এই অন্ধকার হাতড়ে পুনরায় এক হওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই একসাথে থাকতে হলে জাপ্টে ধরেই ভাসতে হবে। গুটি জলে ডুবে অস্বস্তিতে ডোবা ভুলে যায়নি। ছেলেটির জাপ্টে ধরে থাকা তাকে আকাশ সমান অস্বস্তি আর অসহায় অনুভূতি দিচ্ছে। সাথে দিচ্ছে ভয়। এদিকে হাত-পা নেড়ে এগোনোর অক্লান্ত প্রয়াস করতে হচ্ছে না আর, তবে নদীর স্রোত অনুযায়ী নির্দিষ্ট গতিতে আর নির্দিষ্ট দিকে ভাসতে হচ্ছে এবং ভেসে থাকার চেষ্টা করতে হচ্ছে। সামনে কি হতে চলেছে জানে না গুটি, তবে ছেলেটি কে এবং তাকে কোন প্রশ্ন ছাড়াই কেন বাঁচালো তা ভাবার ফুসরত যেন পেয়ে গেল শরীর অস্বাভাবিকভাবে নিভে আসার মাঝামাঝিতেও। ছেলেটি এবার প্রথম বার কথা বলল। গুটিকে বলল,
“শুধু স্রোতে ভাসলে হবে না, স্রোতের বিপরীতে যাওয়ার চেষ্টা করতে হবে আমাদের। স্রোত কম না হলেও খুব বেশিও না। আমরা চেষ্টা করলেই পাড়ে উঠতে পারবো। স্রোত ঠেলে বামদিকে যাওয়ার চেষ্টা করবো, সহযোগিতা করো আমাকে।”
গুটির কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্টে বলে উঠলো,
“আমি পা নাড়াতে পারছি না আর। আর পারছি না।”
এতোক্ষণ সাপে কাটার কথা মস্তিষ্কের বাইরে ছিল গুটির। এবার মনে পড়তেই আতঙ্কে নীল হয়ে উঠলো। ছেলেটি গুটির অস্বাভাবিকভাবে নেতিয়ে পড়া খেয়াল করে উঠতে পারলো না। সে পাড়ে যাওয়া নিয়ে চিন্তিত। চেষ্টা করছে স্রোত ঠেলে সাঁতরাতে। কোনমতে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে পায়ে?”
গুটি কোনমতে সাপের কথা বলতে বলতেই জ্ঞান হারালো। ভারসাম্য হারিয়ে হাত ছুটে গেল ছেলেটির থেকে। আকস্মিকতায় ছেলেটি বিস্মিত। চমকে তৎক্ষনাৎ ডুব দিলো। খুঁজতে লাগলো অচেনা নারী অবয়বকে। স্রোতে স্থির থাকা অসম্ভব। ভাসতে ভাসতেই প্রাণপণে খোঁজার চেষ্টা চালিয়ে গেল। কিন্তু এই স্রোতে একবার হাত ছাড়লে খুঁজে পাওয়া কি এতোই সহজ? রাগে দুঃখে চুল টেনে ধরে অদ্ভুত শব্দ করে রাগের বহিঃপ্রকাশ করলো সরণ। স্রোতের বিপরীতে সাঁতার কেটে কিছুক্ষণের মধ্যেই পাড়ে উঠে গেল। পাগলের মতে এদিক সেদিক পায়চারি করতে করতে এক পর্যায়ে ডেকে উঠলো,
“শুনছেন?”
এভাবে বেশ কয়েকবার ডেকে অতঃপর হতাশ হয়ে বসে পড়লো মাটিতে। চারপাশে নজর বুলিয়ে অনেকটা দূরে একটা দোকান নজরে এলো। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। সাথে ফোন বা ওয়ালেট কিচ্ছু নেই। আরও কয়েক মুহুর্ত এদিক সেদিক নজর বুলিয়ে শেষমেশ হাঁটা দিল দোকানটার দিকে। এক পা দুই পা করে প্রতিটা পদক্ষেপ যেন পিছু পিছু কেউ টানতো লাগল। মেয়েটির সাথে কি হলো? আদৌ বাঁচতে পারবে? বিষধর সাপে কামড়ালে যত জলদি সম্ভব চিকিৎসা প্রয়োজন। এন্টি ভেনম নিতে হবে। বিষধর সাপে যদি নাও কামড়ায়, ভয়েও হার্ট অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। সাপে কাটা হাজারও রোগী এমনও আছে, যারা বিষহীন সাপের কামড়েও শুধুমাত্র প্যানিক আ্যটাকের কারণে হৃদযন্ত্রের কার্যক্ষমতা বন্ধ হয়ে মারা৷ যায়। এমনিতেই মেয়েটার পরিস্থিতি ভীষণ ভয়ানক, তারওপর সাপের কামড়। মেয়েটার সাথে তার বাবা কি করেছে তাও তো জানে না। কোন ক্ষতি করেনি তো? সরণ অপরাধবোধ আর দুশ্চিন্তায় চিৎকার করে শুন্যে পা তুলে লাথি মারলো। অনেকটা পথ আসতেই টের পেলো দোকানদার দোকান বন্ধ করছে। সঙ্গে সঙ্গে দৌড় লাগালো। ছুটে গিয়ে দোকানদারকে ধরে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
“চাচা, মোবাইল হবে? একটা জরুরি কল করবো। জাস্ট একটা কল।”
বৃদ্ধ ছোট্ট একটা বাটন ফোন এগিয়ে দিয়ে বলল,
“টাহা নাই বাজান। তয়, কর্জ করবার পারো। বিশ টাহা ভরছিলাম, কর্জের টাহা কাইট্টা নিছে। আবার করন যাইবো।”
সরণ নিজের বন্ধু মানিককে পরপর দু’টো মিসড কল দিলো। মিসড কল দেওয়ার মতো কয়েক পয়সা ছিলো একাউন্টে। বৃদ্ধ জিজ্ঞেস করলো,
“কাপুর চুপুর ভিজা তোমার, কোন বিপদে পড়ছো বাজান? আমারে কইবার পারো।”
এরমধ্যেই মানিক কল ব্যাক করলে সরণ তাড়াহুড়ো করে বলল,
“নো থ্যাংকস চাচা। ফোনটা দিয়েই অনেক বড় উপকার করেছেন।”
বলতে বলতেই কল রিসিভ করে অধৈর্য গলায় বলে উঠলো,
“বাইক নিয়ে এক্ষুনি বড় রাস্তায় আয়। ব্রিজের এপার আসবি। ব্রিজ পার হয়ে কিছুদূর এগোলে সিঙ্গেল একটা দোকান আছে না? সেখানে আছি আমি। জলদি আয়। আর হ্যাঁ, কেউ আমার কথা জিজ্ঞেস করলে বলবি খুঁজে পাচ্ছিস না।”
দশ মিনিটের মধ্যে মানিক চলে এলো বাইক নিয়ে। সবার আগে নিজের ফোন চেয়ে নিল সরণ। কিছু একটা ভাবল সময় নিয়ে। অতঃপর কন্টাক্ট লিস্ট ঘেঁটে কাউকে কল করলো। ওপাশ থেকে রিসিভ হলে বলল,
“স্থানীয় গভার্মেন্ট হসপিটালে এন্টি ভেনম এভেইলআবল কিনা এক্ষুনি খোঁজ নিয়ে আমায় জানান। যদি এখানে এভেইলআবল না হয় তাহলে কোথায় হবে সেটাও খোঁজ নিন ইমিডিয়েটলি।”
কল কেটে আরও কয়েকজনকে কল করলো। মানিককে বলল ব্রিজের সামনে বাইক দাঁড় করাতে। একেকজনকে একেক দায়িত্ব দিয়ে অতঃপর নিজে গেল ব্রিজের নিচে। সাথে গেল মানিকও। নামতে নামতে সংক্ষেপে অচেনা মানবীর হারিয়ে যাওয়ার গল্প শোনালো সরণ। নিচে নেমে দ্রুত ফ্ল্যাশ অন করে মাছের জন্য পাতা ফাঁদ বাঁশের চাইয়ের ওপাশে নেমে গেল। যদি মেয়েটা স্রোতে ভেসে চলে আসে তাহলে এখানে এসেই ঠেকবে। কপাল ভাল থাকলে এখানেই পেয়ে যেতে পারে। কিন্তু যদি পেয়েও যায়, মেয়েটা বেঁচে আছে তো?

এক বুক আশা নিয়ে সরণ নামলেও উঠে এলো হতাশা নিয়ে। পেলো না অচেনা মানবীর হদিস। মানিক ভরসা দিলো৷ সরণ উঠে এসে মাথায় হাত চেপে বসে পড়লো পাড়ে। মানিককে বলে উঠলো,
“বীরেন তালুকদার কি বেঁচে আছে?”

“এখনও বেঁচে আছে, তবে অবস্থা ক্রিটিকেল। হসপিটালাইজড করা হয়েছে, তবে বাঁচবে বলে মনে হয়না। আঘাত কিন্তু খুবই গুরুতর।”

“মেয়েটা একলা ওই লোকের এই হাল করলো কিভাবে? আমার মাথায় আসছে না। আর মেয়েটা…”
বলতে বলতেই উঠে দাঁড়ালো সরণ। উদ্ভ্রান্তের ন্যায় ছটফট করতে করতে বাইকে উঠে বসলো। এরমধ্যেই কল এলো ফোনে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে শোনা গেল কাঙ্ক্ষিত শব্দ।

“ভাই যে লোকেশন বলছেন সেই লোকেশন থেকে একটু দূরে একটা মাইয়া পাইছি। পাড়ে অজ্ঞান অবস্থায় পইরা ছিল। এলাকার পোলা সিফাত ছিল লগে, ওয় বলতাছে মাইয়ারে ও চিনে। নাম নাকি গুটি।”

সরণ চমকে উঠলো তৎক্ষনাৎ। গুটি? গুটি ছিল ওটা?

(চলবে)

শূন্যলতা পর্ব-০১

0

#শূন্যলতা
#গুঞ্জন_চৈতি
#সূচনা_পর্ব

“একটা মানুষ কতডা নোংরা মস্তিষ্কের হইলে নিজের মাইয়ার বয়েসি কাউরে বিয়ার প্রস্তাব দেয়, তাও আবার অন্ধকারে পথ আটকাইয়া। পথ ছাড়ো মেম্বার কাকা, নইলে তোমার নামে অভিযোগ নিয়া আমি থানায় যামু। অনেক সহ্য করছি, আর না।”

“কি কইলা? অভিযোগ করবা? থানায় রোজ চা খাইতে যাই আমি। পুলিশ নিয়া আমার চলাফেরা। কিছু মালপানি দিলে পুলিশ নিজে তোমারে আমার বাড়ি তমেত দিয়া যাইবো। আমারে দেহাও পুলিশের ভয়? তাও আবার একলা এই অন্ধকারে?”

“আচ্ছা পাঠাইয়েন পুলিশ, এহন যাইতে দেন পথ ছাড়েন আমার তাড়া আছে।”

“রাইত বাজে প্রায় নয়টা, গেরামের অর্ধেক মানুষ ঘুমে বিভররর… এই সময় তোমারে যদি উঠাইয়াও নিয়া যাই, কাকপক্ষীতেও টের পাইবো না। ডাইনে বিল, বায়েও বিল, সামনে পিছে লম্বা পথ। যাবা কোথায় সুন্দরী?”

“কথাডা নিজের মাথায় খেলে না? ডাইনে বিল, বায়েও বিল। যদি আমি ধরি মেম্বার, বিয়ার সাধ সারাজীবনের জন্য ঘুচাইয়া দিমু। আমারে চিনতে এহনও বাকি আছে তোমার।”

“চিনি আবার না….আহ্হারে। বুকে লাগেরে গুটি, বুকে লাগে। এতো তেজ তর, কবে যে মুড়াইয়া খামু তরে। আর পারতাছিনা। কন্টোল অয় না আর। শেষবারের মতো জিগাই, ভালয় ভালয় গলায় মালা পড়াবি না কেরামতি দেহান লাগবো? বুঝিস গুটি, তোরে যদি সসম্মানে না পাই, অসম্মান ছাড়া কিচ্ছু চোক্ষে দেখপি না।”

“কন্ট্রোল হয়না না? জন্তু-জানোয়ার, বিশেষ কইরা রাস্তার কুত্তা আউট অফ কন্ট্রোল হইলে কেমনে কন্ট্রোল করে জানা আছে তো?”

বীরেন মেম্বার এপর্যায়ে রেগে গুটির হাত চেপে ধরে হিসহিসিয়ে বলল,
“জানোয়ার না আমি? আমি কুত্তা? আয় দেহাই জানোয়ারগিরি কারে কয়। এই বিলের মধ্যে কোন হালার পুত তরে বাঁচায় আমি দেহুম। দুই মাস পা দোয়াইছি তর আর তর বাপের। আইজ দেহামু বীরেন মেম্বার কি জিনিস।”

দু’জনের মাঝে কয়েক মুহুর্ত ধস্তাধস্তি হলো। কামিসে হাতে পেঁচিয় সালোয়ারে হাত দিতেই গুটি পেছনে তাকিয়ে হটাৎ চিল্লিয়ে বলে উঠলো,
“সরণদা আপনের বাপে…”

বীরেন মেম্বার ছেলের নাম শুনে হকচকিয়ে পিছু ফিরলে লাথি মারলো গুটি। অপ্রস্তুত বীরেন মুখ থুবড়ে পড়লে সেই ফাঁকে ব্যাগ হাতড়ে কিছু বের করলো গুটি। এতো রাতে একা একা বের যখন হয়েছে, খালি হাতে বেরোনোর মেয়ে তো গুটি নয়। মরিচ গোলানো জল ভর্তি কৌটা বের করে ছুঁড়ে মারলো তার চোখেমুখে। বীরেন মেম্বার দু’হাতে চোখমুখ আঁকড়ে ধরে চিৎকার শুরু করলে রাস্তার পাশ থেকে আস্ত এক ইট তুলে মারলো পুরুষাঙ্গ বরাবর। বীরেন মেম্বারের দম যেন যায় যায়। এক হাতে পুরুষাঙ্গ চেপে ধরে আরেক হাতে গুটির চুলের মুঠি চেপে ধরলে এবার গুটি বীরেন মেম্বারের হাত খামচে ধরে লাথি মারলো পুরুষাঙ্গেই। এবার আর টিকতে পারলো না বীরেন মেম্বার। দু’হাতে চেপে ধরলো দু’পায়ের মাঝখানটা। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেও চিৎকার যেন গলা দিয়ে তার বেরোচ্ছে না। গুটি রাগে জ্ঞানশূন্য। মাটিতে লুটানো বীরেন মেম্বারের অন্ডকোষ বরাবর অনবরত লাথি মারতে লাগল। বীরেন মেম্বারের নড়চড়ের শক্তিও লোপ পেল খুব শীগ্রই। চোখ দু’টো যেন বেরিয়ে আসবে। দম যেন ফুরিয়ে প্রায় শুন্য। রক্তে সাদা পায়জামা লাল হয়ে উঠলেও গুটির তৃষ্ণা মিটলো না। দু’টো মাস যাবত জীবনটাকে অতিষ্ঠ করে তুলেছে এই লোকটা। উঠতে বসতে নোংরা কথা শুনতে শুনতে জন্তু জানোয়ারের থেকেও নীচ মনে হয় এই লোকটাকে। বীরেন মেম্বার জ্ঞান হারিয়েছে টের পেলে উঠে দাঁড়ালো গুটি। সত্যিই জ্ঞান হারালো না প্রাণ, তা পরখ করলো না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে থুতু মারলো বুকের উপর। ব্যাগ থেকে বাকি মরিচ গুলানো জল বের করে ঢেলে দিল দু’পায়ের মাঝখানে। লোকটার জ্ঞান থাকলে নিশ্চয়ই লাফিয়ে উঠতো চিৎকার করে? গুটি তখন যদি জিজ্ঞেস করতে পারতো, কেমন লাগছে মেম্বার? বুকের ভেতরটা নাজানি কত শান্তি পেত! উত্তেজনায় হাত-পা কাঁপলেও দৃষ্টি দ্বিধাহীন, অটল। অনুশোচনার রেষ মাত্র নেই। মাঝারি মাটির রাস্তা, এপাশ ওপাশ দু’পাশেই থৈথৈ জল। মাঝখানে লম্বা মাটির পথখানা বড় রাস্তা থেকে গ্রামের ভেতর অব্দি চলমান। অন্তত বিশ মিনিট হাঁটলে এ রাস্তা ফুরোয়। বর্তমানে বিলের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে সে। একপাশে নামলো চোখেমুখে জল দিয়ে পা ধুয়ে নিতে। জলদি এখান থেকে পালাতে হবে। কেউ চলে আসলে কেলেঙ্কারি ঘটে যাবে। তবে ভাবতে দেরি হলেও কেলেঙ্কারি ঘটতে দেরি হলো না, ঘটেই গেল। হটাৎ টের পেল বড় রাস্তা থেকে ভ্যান আসছে এদিকে। ভ্যানের সামনে ছোট্ট টিমটিমানো লাইট যেন চিৎকার করে বিপদের আগাম বার্তা দিচ্ছে। পিলে চমকে উঠলো গুটির। বাবার মুখটা ভেসে উঠলো চোখের সামনে। সাথে সাথে জলে ঝাপ দিয়ে নিজেকে মিলিয়ে নিল শাপলা পাতার ভীড়ে। হাত-পা সাঁতারে সচল হলেও হৃদযন্ত্র ভয়ে অচল প্রায়। মাথা তুলে যখন দেখল, ভ্যান বেশ কিছুটা কাছে চলে এসেছে বীরেন মেম্বারের। তখন সাঁতারের গতি কমালো গুটি। এমনিতেও শেওলা-ছাতা, শাপলা আর লতাপাতা ঠেলে দ্রুত সে এগোতে পারছে না। জলের ভেতর কারও উপস্থিতি যেন বিন্দু পরিমান টের না পায় তার প্রচেষ্টায় একেক ডুবে প্রাণপন চেষ্টা করছে সর্বোচ্চ দূরে যেতে। কিন্তু এতো বড় বিল পার হয়ে ওপার তো সে একশো ডুবেও যেতে পারবে না। এভাবে সাঁতরাতে থাকলে অন্তত দেড় দুই ঘন্টা সময় লাগবে পারে পৌঁছাতে। গা ছমছমে পরিবেশ। মনে হচ্ছে জলের নিচ থেকে এক্ষুনি কেউ পা টেনে ধরবে। কোথাও কোথাও জলের উচ্চতা কম হওয়ায় সে দাঁড়াতে তো পারছে, কিন্তু যে করেই হোক বিল সাঁতরে ওপার না পৌঁছাতে পারলে ধরা সে পরবেই। এতোক্ষণে ভ্যানচালক চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে। আন্দাজবশত বিলের আশেপাশে টর্চ ধরে ধরে দেখছে কারও উপস্থিতি টের পাওয়া যায় কিনা। তাজা রক্ত বলে দিচ্ছে ঘটনা খুববেশি আগের নয়। ফোনে কারও সাথে কথাও বলছে। গুটি টর্চের আলো অনুসরণ করে একটু পরপর ডুব দিতে গেলে পরে গেল বিপদে। পায়ে কিছু একটা পেঁচিয়ে ধরেছে। হাত দিয়ে ছাড়াতে গিয়ে টের পেল লতার সাথে সাপও ছিল। পায়ে অনুভব হলো সাপের বিষদাঁতের অস্তিত্ব। টের পেতেই শরীর যেন অবশ হয়ে এলো গুটির। সাপটা কি বিষধর ছিল? সেকি তাহলে মরে যাবে? যেই বিল সাঁতরে বড় হলো, সেই বিলেই মিইয়ে যাবে সে? সাপের কামড়ে ভয়ের তাড়নায় অসাবধানতার বশে হুট করে মাথা তোলায় জলে শব্দ করে উঠলো। তৎক্ষনাৎ এপাশে জলের ভেতর কারও উপস্থিতি টের পেয়ে গেল ভ্যানচালক। ততক্ষণে আরও দু’টো ভ্যান প্রায় এসে পড়েছে। তৎক্ষনাৎ সে চিৎকার করে কাউকে বলে উঠলো,
“জলে কেউ আছে, তোমরা তাড়াতাড়ি আহো। আমি টর্চ দিয়া দেখতাছি তুমি হগ্গলরে নিয়া আহো এহনি। আমি গেলাম জলে।”

ফোন রেখে ভ্যানচালক জলে ঝাপ দিলো। গুটি বেপরোয়া হয়ে উঠলো ভয়ে। আফসোসে মরে যেতে ইচ্ছে করছে। রাস্তার ওপাশের বিলে ঝাপ দিলে কিছুক্ষণের মধ্যে পারে পৌঁছে যেত। আর পারে পৌঁছাতে পারলে পালাতে বেগ পেতে হতো না। এপাশের বিল বিশাল বড়। সাঁতরে পার হওয়া বড্ড কঠিন। প্রাণপনে এগোতে লাগল গুটি। শাপলার হাতছানি আর বিভিন্ন লতার ভীড়ে ঠেলে সাঁতরাতে লাগল সামনে। পিছু ফিরে ভ্যানচালককে দ্রুত গতিতে এগিয়ে আসতে দেখে ভয়ে প্রায় অসার গুটি। টের পেল এরমধ্যেই আরও একজন জলে ঝাপ দিয়েছে।
এদিকে বিলে এখন একজন কিংবা দু’জন নয়, বেশ কয়েকজন নেমে পড়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে মোটরসাইকেল এসে পড়লো কয়েকটা। বিলের পাড়ে একে একে জড়ো হতে লাগলো পুরো গ্রাম। মুখে মুখে রটতে লাগল দুর্ঘটনার খবর। গুটি জলের এ প্রান্ত হতে ও প্রান্ত একবার চোখ বুলিয়ে ঠিক করলো পারের দিকে যেতে লাগলে জলদি ধরা পরে যাবে তাই তাকে পূর্ব দিকে যেতে হবে। অন্ধকারে এতো বড় বিলের পুরোটা জুড়ে টর্চ মেরে কেউ দেখতে পারবে না। বাঁচতে হলে বিলের মধ্যেই গা ঢাকা দিতে হবে। পারে যাওয়া বিপদজনক। তবে সামনে না এগিয়ে বামদিকে মোর নেওয়াও বেশ বিপদজনকও বটে। যে কারও হাতে চলে আসতে পারে। তবুও চেষ্টা তাকে করতেই হবে। ওদিকে শেওলা-ছাতাও বেশি। গুটি পথ বদল করে এক ডুবে সর্বোচ্চ চেষ্টা করলো বামদিকে এগোনোর। একবার মাথা তুলে শ্বাস নিয়ে দ্বিতীয় ডুব দিতেই টের পেল কেউ টেনে ধরেছে তাকে। পিলে চমকে উঠলো গুটির। তাহলে কি সব চেষ্টা বৃথা গেল? ধরা পরে গেল সে?

চলবে।

প্রিয় প্রাণ পর্ব-৪৮ এবং শেষ পর্ব

0

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪৮

ঝিরিঝিরি শব্দ তুলে গগন চিড়ে পানির ফোঁটা ঝরছে। সেই দিকে উদাস তাকিয়ে তোঁষা। প্রাণ একবার উঁকি দিলো। তার মা বারান্দায় বসে আছে। আজ ভীষণ ক্ষেপেছে বাবা’র উপর। এখনও আসে নি বাবা। হাতটা মুঠ করে পা টিপে টিপে মায়ের কাছে এলো প্রাণ। জামার কোণায় টান লাগতেই তোঁষা তাকালো। ওর ছোট্ট সোনাটা দাঁড়িয়ে। মুখটা কেমন আদুরে আদুরে। প্রাণ হাতের মুঠোটা মায়ের সামনে এনে বললো,

— এতা নাও আম্মমু। প্লান বাব্বাকে বতে দিবে।

তোঁষা ছেলের মুঠোয় থাকা চকলেটটা নিলো। প্যাকেট খুলে মুখেও দিলো। প্রাণ মায়ের কোমড় ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তোঁষা ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। রাগী গলায় বললো,

— তোর বাবা আসলে আজ কথা বলবি না। মনে থাকবে?

প্রাণ চুপ করে রইলো। বাবা তার অনেক ভালোবাসার। তার সাথে কথা না বলে কিভাবে থাকবে প্রাণ? মায়ের মন রাখতেও মিথ্যা টা বলতে পারলো না। তোঁষা বুঝে সেটা। একটু হেসে বললো,

— প্রিয়ম আসবে আজ।

কিছুটা লাফিয়ে উঠলো প্রাণ। প্রিয়’কে তার অনেক ভালোলাগে। আজ দুই দিন পর আবার আসবে প্রিয়। বলতে না বলতেই কলিং বেল বাজলো। দরজা খুলতেই তুষার, তথ্য প্রিয়মকে নিয়ে ঢুকলো। মামা’র কোলে উঠেই আগে প্রিয়ম’কে ছুঁয়ে দিলো প্রাণ। তথ্য ওর গাল টেনে দিয়ে বললো,

— এই তো আমার মেয়ের জামাই।

তুষার চোখ রাঙালো। তথ্য’র এই বায়না বড়ই অদ্ভুত। বাচ্চারা বড় হলে কত কিছুই তো হতে পারে। তখন যদি তাদের মত বদলায়? এখন থেকে ই কি এসব ভেবে রাখা উচিত? তোঁষা আর আরহামে’র কাহিনি না আবার পুনরাবৃত্তি ঘটে? ভয় হয় তুষারের।
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বোনের দিকে তাকালো তুষার। আটমাস চলছে তোঁষার। এখন এমন একা রাখাটা অনেক রিস্কি হয়ে যায় কিন্তু পরিস্থিতির কবলে পরে এই রিস্কি কাজটাই করতে হচ্ছে।

ওদের সময়টা কাটলো বেশ। আরহাম ফিরলো রাত নয়টার দিকে। বেচারা ভিজে চপচপা অবস্থা। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। সাথে প্রচুর বাতাস। তোঁষা মুখ, গাল ফুলিয়ে টম বানিয়ে রাখলো। কোন মতেই কথা বললো না। আজ কি কথা ছিলো না আরহাম ওকে সময় দিবে? ছিলো তো কিন্তু আরহাম তা রাখে নি৷ সে এসেছে মাত্র। বাবা’কে দেখেই প্রাণ উৎফুল্ল হয়ে এগিয়ে এলো। ভেজা শরীরে ছেলেকে কোলে তুললো না আরহাম। একেবারে চেঞ্জ করে তবেই নিলো। তুষার চোখে চোখে জানালো তার বোন রেগে আছে। আরহাম চোখে হাসলো। সে জানে কিভাবে মানাতে হয়।
.
গগের তখন বিরাজমান মেঘমালা। বৃষ্টি থেমেছে মাত্র ই। তোঁষা’কে নিয়ে হসপিটালে মাত্র ঢুকলো তুষার,আরহাম৷ তথ্য’কে রেখে এসেছে বাচ্চাদের সাথে। তোঁষার মৃদু ব্যাথা হচ্ছিলো তাই ওরা এসেছে কিন্তু এখন ডক্টর জানাচ্ছে ভিন্ন কথা। এখনই নাকি সি সেকশন করাতে হবে। দ্বিতীয় বার বাবা হচ্ছে আরহাম অথচ ঠান্ডার মধ্যে দরদর করে ঘামছে ও। তোঁষা এবার সাহসের পরিচয় দিলো। নিজেই জানালো,

— চা খাব প্রাণ। গরম কিছু খাওয়া দরকার।

আরহাম পারলো না। কিছুতেই উঠতে পারলো না। তুষার চা নিয়ে এলো। আধ ঘন্টা পর ওটিতে নেয়া হবে। শেখ বাড়ীতে জানানো হয়েছে। আদনানের বউ ও অন্তঃসত্ত্বা। তাই ওদের বাসায় রেখে বাকি তিনজন ছুটে এলো৷ তাদের আসতে আসতে তোঁষা’কে ঢুকানো হলো ওটিতে।
হাসতে হাসতে আরহামে’র হাতে চুমু খেয়ে তোঁষা জানালো,

— একটা তুঁষ এনে দিব তোমায়। নিবে?

— নিব।

উত্তর টা দিয়ে মিষ্টি চুম্বন করলো আরহাম। ঝাপসা চোখে দেখলো লাল বাতিটা।

সকলের চিন্তায় ভাটা ফেলে আরহাম কন্যা হাজির হলো ধরণীর বুকে। তার বাবা-মায়ের চোখের পানির ফোঁটার মতো তারও ঝরছে অনবরত পানি। সবার আগে আরহাম ই তাকে কোলে তুললো। কপালে চুমু খেয়ে বললো,

— আমার ছোট্ট তুঁষ।

বাবুটা পলক ঝাপটে দেখলো তার বাবা’কে। আরহাম তোঁষা’র কাছে গিয়ে ওর ঘুমন্ত মুখে হাত বুলালো। তোঁষা চোখ মেলতেই আরহাম বললো,

— এত সুখ কোথায় রাখি প্রাণ?

— বুকে রেখে দাও।

_________________

— প্রাণেশা?

মাথা তুলে এক পলক দেখলো প্রাণেশা। প্রিয়মকে দেখেই মুখ ঘুরিয়ে নিলো৷ এখন মোটেও কথা শুনতে চায় না ও। প্রিয়ম এগিয়ে এসে কিছুক্ষণ ওর গায়ের চাদরটা টানলো। লাভ হলো না। প্রাণেশা উঠবে না। মাঝে শুধু বললো,

— জ্বালিও না ভাবিপু। যাও। ভাইয়ার কাছে যাও। তাকে ভালোবাসো একটু।

— দুষ্ট। উঠ। তোর ভাইকে ডাকব?

— ভাইকে কে বলো প্রাণ উঠবে না।

প্রাণেশা এখন উঠবে না তা বুঝলো প্রিয়ম৷ কথা না বাড়িয়ে তাই রুমে চলে গেলো। রুমে ওদের সদ্য তিনদিনের ছেলেটা বাবা’র কোলে রাখা। প্রিয়ম এগিয়ে আসতেই প্রাণ বললো,

— উঠে নি প্রাণো?

— নাহ।

— ডেকেছিলি ঠিক মতো?

— হু।

কথা বলে প্রিয়ম বিছানায় পা তুলে বসলো। প্রাণ ছেলেকে ওর পাশে শুয়িয়ে দিয়ে বললো,

— খাবে ও।

প্রিয়ম ঢোক গিললো। প্রাণের দিকে তাকাতেই ও বললো,

— এভাবে কি দেখিস? খাবে ও। খাওয়া। আমি বাবা’কে দেখে আসি।

প্রিয়ম মাথা নাড়লো। প্রাণ যেতেই দীর্ঘ শ্বাস ফেললো।
.
বিছানায় শোয়া আরহাম। প্রাণ যেতেই আরহাম চোখ মেললো তবে খুবই অল্প। ভ্রু কুচকে গেলো প্রাণে’র। এভাবে কেন বাবা চোখ মেললো? কিছু মনে করে তারাতাড়ি বাবা’র বুকে হাত রাখতেই চমকালো। চিৎকার করে ডাকলো,

— প্রিয়! প্রিয়!

অতঃপর আবার বাবা’কে বুকে তুলে নিয়ে বলতে লাগলো,

— বাবা? বাবা? তোমার কি খারাপ লাগছে?

প্রিয়ম দৌড়ে এলো। অবস্থা বুঝে কাঁদো কাঁদো চোহারা হয়ে এলো ওর। প্রাণেশা ও ছুটে এসেছে ভাইয়ের চিৎকারে। আরহাম গুঙিয়ে গুঙিয়ে কিছু বলছে তা বুঝতে পারলো না কেউ অথচ প্রাণ স্পষ্ট বুঝছে তার বাবা বলছে সে এখন তার প্রাণের কাছে যেতে যায়। আর একা থাকতে চায় না৷ চোখ দুটো বুজে দুই হাতে বাবা’কে বুকে চেপে রাখলো প্রাণ৷ পরপর চোখ বুজে ফেললো আরহাম৷ প্রাণের মনে হলো ওর বুকে কিছুর চাপা পরলো৷ শ্বাস নিতে বড্ড কষ্ট হচ্ছে।
.
আন্ধকার বলে, ভাই তুমি বড় কালো,
আলো বলে, ভাই তাই তো তুমি আলো।
অন্ধকার আছে বলেই আলোর এত মূল্য। নিশুতি রাত আছে বলেই মানুষ স্বপ্ন বুনে ভোরের আলোর। বেঁচে থাকার তাগিদ আছে বলেই তো স্বপ্ন দেখে দিন রাতে। একসময় সবটা ফুড়ায়। প্রাণে’র আয়ু ফুরায়,আগমন ঘটে নতুন প্রাণে’র।

বছর গুটি আগে তোঁষা চলে গিয়েছিলো। সেই শোকেই মূর্ছা যায় আরহাম। দিন দিন যখন তার অবস্থার অবনতি হচ্ছিলো তখন থেকেই প্রাণ যেন শোকে শোকে থাকা শুরু করলো। “বাবা” তার জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। যাকে সে সবটা উজার করে ভালোবাসতো। ভালো বাসে।

তোঁষা, আরহামে’র সংসার ছিলো প্রাণোচ্ছল। ভালোবাসাময়। গুটি বছর আরহাম বহু কষ্টে রইলো তার প্রাণ ছাড়া। অবশেষে সময় ঘনালো। আরহাম বিদায় নিলো। ধরণীর বুকে রয়ে গেলো তার দুটো প্রাণ। প্রাণ আর প্রাণেশা। তোঁষা আর আরহামে’র প্রেমময় দুটি অংশ।

পরিশিষ্ঠঃ

আরহাম নেই আজ চল্লিশতম দিন। মসজিদে দোয়া পড়ানো হয়েছে। প্রাণ রোজকার ন্যায় আজও বাবা’র কবরে গিয়েছিলো সকালে। অভিমানি চোখে মা’কে দেখেছে। বাবা সবসময় মা’কে বেশি ভালোবাসত। প্রাণ দেখাতে এতে সে অনেক রাগ করে অথচ মা’কে সেও ততটাই ভালোবাসত। তার মা ছিলো নরম,তুলতুলে এক পুতুল। ছোট্ট খাট্ট এক প্রেমময় নারী।

বাসায় ফিরতেই প্রাণ খেয়াল করলো আজ অনেক মানুষ এসেছে বাসায়। তুষার’কে দেখেও না দেখার ভান ধরলো প্রাণ। পা বাড়ালো রুমের দিকে তখনই হঠাৎ কিছুতে তার নজর আটকালো। প্রিয়মের পরণে আজ শাড়ী। সাদার মধ্যে একটা সুতির শাড়ী পরেছে। প্রেগ্ন্যাসির কারণে কিছুটা গোলগাল দেখা যাচ্ছে ওকে। ওর মধ্য শাড়ীতে আজ বড়ই ভিন্ন লাগলো। প্রাণ মুগ্ধ হলো। চেয়ে রইলো নেশাক্ত নয়নে। হুট করে ই তার অন্তরে জাগ্রত প্রেম ছিটকে গেলো। প্রিয়মের কোমড় থেকে শাড়ী কিছুটা সরেছে। সেদিকে তাকিয়ে আছে আসিম। আদনানের ছেলে সে। এখনও বিয়ে করে নি। মনে মনে ভয়ংকর এক গালি উচ্চারণ করলো প্রাণ। অতঃপর ধুপধাপ পা বাড়ালো রুমে। চিৎকার করে ডাকলো,

— প্রিয়! প্রিয়!

ডাক পরতে দেড়ী দৌড়ে আসতে প্রিয়মের দেড়ী হলো না। প্রাণের চোখ মুখ দেখে ভয় ও পেলো কিছুটা। প্রাণ কাউচে বসা মাথা নিচু করে। ওভাবে থেকেই বললো,

— দরজা লক কর।

কাঁপা কাঁপা হাতে তাই করলো প্রিয়ম। তবে নড়লো না। ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো। প্রাণ এবার মাথা তুললো। ওর নজর দেখেই কেঁদে উঠলো প্রিয়মের মনটা। আঙুলের ইশারায় কাছে ডাকতেই গুটি গুটি পা ফেলে প্রিয়ম এগিয়ে এলো। বসা অবস্থায় ই নিজের হাতটা বাড়ালো প্রাণ। ছুঁয়ে দিলো প্রিয়মের নরম কোমড়টা। টেনে আনলো নিজের কাছে। অতি আদুরে ভঙিতে হাত নাড়ালো। প্রিয়ম শিউরে উঠলো। গা মুচড়ালো। নড়তে পারলো না। আকস্মিক ব্যাথাতে আর্তনাদ শুনা গেলো। প্রাণ থামলো না। বড়ই বেসামাল ভঙিতে সে তার হাতের ব্যাবহার করলো সে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো প্রিয়ম। র*ক্ত বের না হলেও ব্যাথায় ম’রে যাওয়া বাকি তার। টলমলে পা তার আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। ভেঙে বসে পরলো ফ্লোরে।
প্রাণ ও বসলো। কাছে টেনে নিলো তার প্রিয়কে। পেটে আরেকটু আঙুল ডাবিয়ে প্রশ্ন করলো,

— আর কাউকে দেখাবি পেট?

নাক টানতে লাগলো প্রিয়। কাঁদলেই তার নাক দিয়ে পানি পরে। প্রাণ উল্টো হাতে ওর নাকের পানি মুছে দিলো। পুণরায় প্রশ্ন করলো। প্রিয়ম অল্প স্বরে বললো,

— না।

— মনে থাকবে?

— হু।

— সত্যি?

— হু।

পেট থেকে হাত সরালো প্রাণ। ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠছে প্রিয়ম। সিজারিয়ান পেট তার। ব্যাথাটা আর সহ্য হলো না। প্রিয়’র পাঞ্জাবীটা খামচে ধরে পা দাপড়ে কাঁদতে লাগলো। প্রাণের বুকটা ছটফট শুরু করলো। দেখতে পারলো না তার প্রেয়সীর ব্যাথা। দুই হাতে প্রিয়মের মুখটা ধরে বলতে লাগলো,

— প্রিয়? প্রিয়? আমি সরি। সরি তো। কাঁদিস না। শুন, আমার কথা শুন, প্রিয় আমার কাঁদে না।

ব্যাথায় কাতরাতে কাতরাতে একসময় চুপ করে গেলো প্রিয়। প্রাণের বুকে লেপ্টে রইলো। চুলের ভাজে আদুরে হাত বুলিয়ে যাচ্ছে প্রাণ। শান্ত ভাবে বলছে,

— আসিফ তোর পেটের দিকে তাকিয়ে ছিলো প্রিয়। আমরা আমাদের ফ্ল্যাটে চলে যাব। এখানে থাকার দরকার নেই।

প্রিয় কথা বললো না। তার কথা বলতে ইচ্ছে করছে না আপাতত। বেশ খানিক পর মাথা তুললো ও প্রাণের বুক থেকে। নিজেকে ঠিক করে রুম থেকে বেরুলো। হাতে ইনসুলিন নিয়ে আসতেই প্রাণ পাঞ্জাবি গুটিয়ে দিলো। পেটে পুশ করে দিলো প্রিয়। জন্মগত ভাবেই ডায়াবেটিস পেসেন্ট প্রাণ। মায়ের থেকে জেনেটিক ভাবেই এটা পেয়েছে সে। বংশ পরম্পরায় পেয়েছে আরো কিছু ডিসঅর্ডার।
প্রিয় এক পলক ঘুমন্ত ছেলেকে দেখে উঠে যেতে নিলেই প্রাণ ওর হাত ধরলো। চোখে চোখে তাদের কথা হলো। প্রিয় হাত ছাড়াতে নিয়ে বললো,

— অনেক দেড়ী হলো। তোমার খেতে লেট হচ্ছে। মাথা ঘুরাবে একটু পর।

— শোন না।

— বলো শুনছি।

— আমাকে ছেড়ে চলে যাবি তুই?

প্রিয় প্রাণের কোলে বসলো। দুই হাতে গলা জড়িয়ে ধরে বললো,

— প্রিয় তার প্রাণ ছাড়া কিভাবে বাঁচবে?

প্রাণ হসলো। দুই হাতে তার প্রিয়’র গাল ধরে চুমু খেলো কপালে। প্রিয় জানে প্রাণ ডিসঅর্ডারের কারণেই এতটা সেনসেটিভ আচরণ করে কিন্তু পরক্ষণেই ঠিক হয়ে যায়। ট্রিটমেন্ট নিজ থেকেই নিচ্ছে প্রাণ। প্রিয় অপেক্ষায়। একদিন তার প্রাণ ঠিক হবে। এই অসুস্থ ভালোবাসা থাকবে না। থাকবে শুধু প্রেমময় প্রিয় আর তার প্রাণ।

#সমাপ্ত…..

প্রিয়_প্রাণ পর্ব-৪৬+৪৭

0

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪৬

ছেলে আর বউ নিয়ে নিজের ফ্ল্যাটে এসেছে আরহাম। কোন ভাবেই চাচির সামনে থাকার বা ওর স্ত্রী, সন্তান কে রাখার ইচ্ছে আর অবশিষ্ট নেই। থাকবার কথা ও না। তোঁষা এমনিতেও ওর মা’কে সহ্য করতে পারে না। কোন ভাবেই মা’কে দেখতে চায় না। এবার যখন ওরা আসলো তখন শুধু ছলছল চোখে তাকিয়ে ছিলো ওর মা। তোঁষা ফিরেও তাকায় নি। আরহামে’র হাতটা শক্ত করে ধরে হেটে বেরিয়ে এসেছে।
পরনে থাকা বোরকা খুলে তোঁষা মুখে দিয়ে বেরিয়ে এলো। আরহাম তখন ছেলের প্যান্ট খুলে নরম প্যান্ট পরাচ্ছে। তোঁষা এক পলক দেখে কিচেনে গেলো। আরহাম রুম থেকেই ডাক দিলো,

— তুঁষ?

তোঁষা জবাব দিলো না। আরহাম পুণরায় ডাকলো,

— প্রাণ?

— উউউ বাব্বাহ।

চমকে তাকালো আরহাম। শুয়ে থাকা প্রাণ তার পা বাবা’র বুকে তুলে দিয়ে ডাকের উত্তর দিলো। আরহাম হেসে ছেলের পায়ে চুমু খেয়ে বললো,

— আপনার আম্মু’কে ডাকি বাবা। সে তো আমার প্রাণে’র টুকরো। এক টুকরো আপনি, এক টুকরো আপনার মা।

ছোট্ট প্রাণ বাবা’র দিকে হাত বাড়ালো। সে কোলে উঠতে চায়। তার শুয়ে থাকতে মোটেও ভালো লাগছে না।

তোঁষা’র কাছে গিয়ে ই কিছুটা গম্ভীর কণ্ঠে আরহাম বললো,

— ডাকছি না? জবাব দিস না কেন?

— কাজ করছি না? ডাকো কেন?

ভ্রু কুঁচকায় আরহাম। এই রোগ নতুন। প্রশ্নের উত্তরে তোঁষা প্রশ্ন ই করবে। আরহাম প্রাণের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে কিচেনে ঢুকে বললো,

— কি করছিস?

— দেখো।

আরহাম তাকালো। বক্সের খাবারগুলো গরম করছে তোঁষা। জোর করে আরহামে’র মা রাতের খাবার সাথে দিয়ে দিয়েছে। তোঁষা চুপচাপ খারাপ গরম করার মাঝেই ছেলের অস্পষ্ট কথা শুনতে পেলো,

— আআমমম্মু বব্বাহ আম।

তোঁষা ভাষা বুঝলো ছেলের আম বলতে সে খেতে চাচ্ছে তবে আপাতত তোঁষা খাওয়াতে চাইছে না৷ তোঁষা রেগে আছে অথচ যার সাথে রাগ তার কোন হেলদুল নেই। রাগে কান্না পেয়ে গেলো এই মুহূর্তে। আরহাম মুখে ও ও শব্দ করে ছেলেকে হাতে তুলে নাচাতে নাচাতে তোঁষাকে বললো,

— প্রাণে’র ক্ষুধা লেগেছে। রুমে চল। আমি দেখছি বাকিটা।

তোঁষা একপ্রকার ছোঁ মে’রে ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে যেতে যেতে বললো,

— সারাক্ষণ মহিলাদের কাজ ই করে যাও। আর কিছু করার দরকার নেই।

আরহাম চামচ নাড়তে নাড়তে বললো,

— কি বললি? তুঁষ? এই….

তোঁষা চলে গিয়েছে। আরহাম কথা না বলে গুনগুন করতে করতে বাকি কাজ করে রুমে এলো। এখনও তার মুখে গুনগুন শব্দ। তোঁষা’র মুখের সামনে এসে ফুঁ দিতেই তোঁষা বিরক্ত হয়ে বললো,

— সরো।

— ঘুমাচ্ছিস?

— যাও এখান থেকে।

— কি হয়েছে বল না প্রাণ।

— কিছুই হয় নি। ওহ্ আহ্ ছাড়ো। ব্যাথা পাচ্ছি। আরহাম ভাই!

আরহাম তারাতাড়ি নিডলটা তোঁষা’র পেট থেকে বের করে নিলো। এক ফোঁটা থেকেও কম র*ক্ত বেরিয়ে এসেছে পেট থেকে। কথার মাঝেই ইনসুলিনটা পুশ করে দিচ্ছিলো আরহাম। র*ক্ত দেখে নিজেই অবাক হলো। দক্ষ হাতে পুশ করেছে সে। তাহলে কি হলো? আরহাম জানে নিডলে মাঝেমধ্যে ই সমস্যা থাকে যার জন্য র*ক্ত বেরিয়ে যায়। তোঁষা’র ব্যাথাকাতুর শব্দ যেন আরহামে’র হৃদপিণ্ডেই সুচের হুল ফুটালো। তোঁষা’র বুকে থাকা প্রাণ পিটপিট করে তাকালো। মায়ের করা শব্দে তার ঘুম ভেঙে গিয়েছে।
আরহাম তোঁষা’র পেটে আঙুল ছুঁয়ে র*ক্তটুকু মুছে নিলো। তার চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে যাচ্ছে। এই লাল, রক্তলাল চোখ তোঁষা আজ নতুন দেখে নি। দুরুদুরু করছে ওর বুকটা। আরহাম মুচড়ে ধরেছে হাতে থাকা নিডলটা। যেই না উঠে যাবে ওমনিই তোঁষা বলে উঠলো,

— প্রাণ’কে কোলে নাও।

আরহাম কথা না বলে দ্রুত পায়ে চলে যেতে নিলেই তোঁষা কিছুটা জোড়েই বললো,

— ওকে নাও বলছি নাহলে কিন্তু ছুঁড়ে ফেলে দিব৷ বুকে ব্যাথা করছে আমার। সরাও!

দরজার বাইরে পা রাখা হলো না। আরহাম ভীতু চোখে তাকিয়ে দ্রুত ছেলেকে কোলে তুলে নিলো। তার লাল চোখটাতে এখন ভয় দেখা গেলো। যদি তোঁষা ফেলে দিতো।
প্রাণ ঘুমাবে। তাই বাবা’র বুকে মুখ গুজে দিয়ে উম উম শব্দ করছে। আরহাম ওকে নিয়ে বারান্দায় গেলো। চাঁদের আলোয় ওর ছোট্ট প্রাণটাকে উজ্জ্বল দেখাচ্ছে যেন দ্যুতি ছড়াচ্ছে এই প্রাণটা। আরহাম ছেলের কপালে, গালে, চিবুকে চুমু খেয়ে বললো,

— বাবা তোমার জন্য সব ছেড়ে দিবে আব্বু। তুমি ভালো থাকো। তোমার আম্মু ভালো থাকুক। বাবা নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করছি। মেডিসিন নিচ্ছি। বাবা নিজেকে বদলে নিব প্রাণ। সত্যি বলছি।

দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে তোঁষা শুনলো সবটা। তখন যদি এমন না করত তাহলে হয়তো আরহাম সেই নিডল দিয়ে নিজেকেই আঘাত করত। তোঁষা কোন ভাবে আঘাত পেলেই সেটা নিজের উপর ফলায় আরহাম৷ তার মতে তোঁষার দুঃখ অনুভব করতে পারে সে এর মাধ্যমে।

রুমে ঘুমন্ত ছেলেকে রেখে তোঁষাকে হুট করে পাজা কোলে তুললো আরহাম। ভরকে গেলেও নিজেকে সামাল দিলো তোঁষা। আরহাম হেসে ফেললো। তোঁষা ওর গলা জড়িয়ে ধরে বললো,

— খেতে নিয়ে চলো।

— ভিন্ন কিছু খেতে মন চাইছে।

— কি?

— তোকে।

— লুচু।

— জামাই লাগি তোর।

— আরহাম ভাই লাগো আমার।

— পাঁজি হচ্ছিস প্রাণ।

— আমার আরো কিছু প্রাণ চাই।

— একটাকে ই সামলাতে পারিস না।

তোঁষা চুপ করে গেলো। আরহাম ওর কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,

— কথা বলিস না কেন?

— আর কতদিন এমন চলবে?

— কেমন?

— আমার স্বাভাবিক সংসার চাই।

— এটা কি স্বাভাবিক না?

— না।

— কি চাই?

— তুমি কাজে যাবে। আমি সংসার সামলাব। প্রাণ’কে সামলাবো। সন্ধ্যায় তুমি এক জংলী ফুল হাতে বাড়ী ফিরবে আমি দরজায় পিঠ লাগিয়ে অপেক্ষা করব। তুমি যখন ফুলটা আমার চুলে গুজে প্রাণ’কে কোলে তুলবে তখন আমি দুইজনকে ঝাড়ব। হসপিটালে যাও। প্লিজ।

— ঐ পেশায় কিভাবে যাই যার কুব্যবহার করেছে আমি।

— দোষ কারো একার নয়।

— দায় এড়াতে পারছি না।

— আমার কসম লাগে।

— মাইর খাবি তুঁষ। এসব শিরক কেন করিস?

— বলো যাবে।

— মন মানে না৷

— আমার জন্য। প্রাণের জন্য।

— যাব।

— সত্যি?

— হু।

তোঁষাকে কোলে নিয়েই আরহাম খাবার টেবিলে গেলো। আজ তোঁষা নিজ হাতে খাওয়ালো ওকে। আরহাম খেতে খেতেই ভাবলো এবার আর নয়। সে সুস্থ, স্বাভাবিক সংসার দিবে তোঁষাকে। ওদের সন্তান বড় হবে স্বাভাবিক ভাবে। কোন ত্রুটিতে নয়।

#চলবে…..

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪৭

— বাবা? বাবা?

বুজে থাকা চোখ দুটো খুলে তাকালো আরহাম। কাঁপা কাঁপা হাত বাড়িয়ে দিলো ছেলের দিকে। প্রাণ বাবা’র পাশে বসে হাত ধরে তাতে চুমু খেলো। উচ্ছাসিত কণ্ঠে বললো,

— আমি বাবা হয়ে গেলাম বাবা।

আরহাম চোখ বুজে নিলো। চোখের কার্ণিশ বেয়ে পরলো জলধারা। প্রাণ সযত্নে তা মুছে দিলো। বাবা’র কপালে চুমু খেয়ে বললো,

— ছেলে হয়েছে বাবা। কি নাম রাখব? তুমি রেখে দিও তো।

আরহাম মুখ খুলে কিছু বলতে চাইলো তবে পারলো না। বাবা’র না বলা কথা প্রাণ বুঝে। তাই ঝটপট করে বলে উঠলো,

— প্রিয় ঠিক আছে বাবা। মাত্র হসপিটালে দেখে এলাম। ঘুমাচ্ছে।

আরহাম চোখ ঝাপটালো। সেদিকে লক্ষ্য করে প্রাণ এবার বললো,

— আম্মুকে বলতে যাচ্ছি এখনই। শুনে অনেক খুশি হবে।

আরহাম পুণরায় চোখ বুজে নিলো। প্রাণ বাবা’র মাথায় হাত বুলালো। ও জানে বাবা ও এখন মায়ের কাছে যেতে চাইছে কিন্তু প্রাণ কিছুতেই এখন বাবা’কে ছাড়বে না। তার বাবা’কে চাই। খুব করে চাই। এই বাবা তার ভীষণ প্রিয়। ভালোবাসার একজন। বাবা’র ঘুমন্ত মুখে তাকিয়ে রইলো প্রাণ৷ অতঃপর উঠে দাঁড়ালো। নিজের বলিষ্ঠ দেহটা আজ ক্লান্ত মনে হলো। গতরাতে প্রিয়মে’র পেইন উঠেছিলো। এরপর ওকে নিয়ে ছুটেছিলো হসপিটালে। হসপিটালে গিয়ে ও শান্তি নেই। ফিমেইল ডক্টর অত রাতে এভেইএবল ছিলো না৷ ম’রে গেলেও মেইল দিয়ে ডেলিভারি করাবে না প্রাণ। তুষার তো মেয়ের কষ্ট দেখে এক পায়ে রাজি হয়ে গিয়েছিলো। তার মেয়েকে সে মেইল ডক্টর দিয়েই ডেলিভারি করাবে। প্রাণের যে তখন কি ভয়ংকর রাগ লাগলো। মন চাইলো ধ্বংস করে দিতে সব। নিজেকে সামলে দাঁত চেপে শুধু ত্যাড়া ভাবে বলেছিলো,

— আমার বউ আমার সিদ্ধান্ত চাচ্চু।

তুষার ও দমবার পাত্র নয়। তার মেয়ে ম’রে ম’রে অবস্থা। একপ্রকার নীরব যুদ্ধ লেগে গেলো যেন। প্রিয়ম বাবা’র হাতটা চেপে ধরে বহু কষ্টে শুধু বলার চেষ্টা করলো,

— আমি মেইল ডক্টর দিয়ে করাব না আব্বু।

ব্যাস তুষার আর কথা বলে নি। নার্সরা সামাল দিতে দিতে ডক্টর হাজির হয়ে যায়। তুষার থেকে প্রিয়মের হাত ছাড়িয়ে প্রাণ ওটিতে চলে যায়। ছলছল চোখে তুষার তাকিয়ে রয়। তার ছোট্ট পরীটা কি না মা হচ্ছে। সময় গুলো কতই না তারাহুরো করলো চলে যাওয়ার জন্য।

_________________

অতীত~

কলিং বেল বাজতেই তোঁষা দরজা খুললো। আরহাম ভেজা শার্ট গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। গরমে চপচপা অবস্থা। তোঁষা হাসিমুখে ওকে ভেতরে ঢুকতে দিলো। পেছন থেকে দৌড়ে প্রাণ এসে এক ঝাপ দিলো বাবা’র কোলে। তোতলানো গলায় বললো,

— বাব্বাহ বাব্বাহ মজা তাও।

আরহাম ছেলের কপালে পরা চুলগুলো গুছিয়ে দিতে দিতে তোঁষা’কে বললো,

— দরজা লক করে দে তুঁষ।

বলেই ছেলেকে নিয়ে সোফায় বসে পরে। বাবা’র কোলে বসেই প্রাণ বাবা’র পকেট হাতালো এক এক করে। না কিছু নেই। ওয়ালেট আর ফোন পেয়েছে শুধু। শেষে হাত দিলো হ্যান্ড ব্যাগে। সোনালী মোরকে প্যাচালো ছোট্ট এক বক্স। তিনটা ফেরিও রোচার এটাতে। কুট্টি কুট্টু দাঁত বের করে হাসলো প্রাণ। বাবা’র বুকে মিশে গালে চুমু দিয়ে বললো,

— প্লান লাব বাব্বাহ।

— নিজের নামটা ও এখন পারে না।

তোঁষার কথায় প্রাণ তাকালো মায়ের দিকে। অতঃপর হাতে থাকা বক্সটা দেখালো হাসিমুখে। তোঁষা হাতের গ্লাসটা আরহামকে দিয়ে বললো,

— তোমার ছেলের এমনিতেই ইঁদুর দাঁত। চকলেট খেয়ে দাঁতে ক্যাবেটি হোক একদম ভালো হবে।

আরহাম জুসে চুমুক বসাতেই প্রাণ মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,

— আমমমু বাব্বাহ’কে বতো তেন?

— বতি মতি তোর কি? সারাক্ষণ ত ত ত ত! এই ত ছাড়া আর কি পারিস?

— প্লান লাব না আমমমু। আমমু পঁতা।

বলেই বাবা’র বুকে মুখ দিয়ে রাখলো। মায়ের সাথে রাগ হয়েছে তার। সে কি করলো? মা কেন বকলো? আরহাম এতক্ষণ মা-ছেলের নোকঝোক দেখছিলো। এই পর্যায়ে সে মুখ খুললো,

— কি শান্তি পাস সারাটাক্ষন ওর পিছু লেগে?

— ওহহো। হ্যাঁ। এটাই শুনা বাকি ছিলো? আমি ওর পিছু লাগি? হ্যাঁ, বলবেই তো। আমি তো অশিক্ষিত। গন্ড মুর্খ। চালিয়ে যাও। তোঁষা এখন খারাপ। এসো আবার আমার কাছে তখন মজা দেখাব।

বলেই কিচেনে চলে গেল তোঁষা। প্রাণ ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মা বাবা’কে বকেছে। তার কান্না পায় কেউ তার বাবা’কে কিছু বললে। এদের কান্ডে আরহাম হাসছে। তোঁষা রেগে গেলেই ছেলে কাঁদে আর এটা হয় সর্বক্ষণ। কারণ তোঁষা রোজই রেগে যায়। প্রাণ’কে বুকে নিয়েই আরহাম উঠে দাঁড়ালো। পা বাড়ালো রুমের দিকে। ছেলেকে বিছানায় বসিয়ে ফুলা ফুলা গালে আদর দিতেই সে থামলো। আরহাম ওকে ফ্লোরে নামিয়ে দুটো খেলনা ও নামিয়ে ও দিলো। ছেলেকে বুঝিয়ে বলে গেলো,

— এখানেই খেলবে বাবা’র প্রাণ। ঠিক আছে?

— আত্তা।

আরহাম ঝটফট একটা টাওয়াল আর টাউজার নিয়ে ওয়াশরুম ঢুকে পরলো। এতক্ষণে তোঁষা দুইবার রুমে এসে গিয়েছে। ছেলেকে দেখে আবার চলে যায়। প্রাণ মা’কে এই দফায় দেখে ফেললো। তোঁষা চলে যেতে নিলেই উঠে দাঁড়িয়ে ডাকলো,

— আমম্মু।

তোঁষা পিছু ঘুরে মুখ ভেঙিয়ে নিজেও বললো,

— আমম্মু।

প্রাণের ছোট খাটো ঠোঁট দুটো তখন কাঁপছে। মা তাকে ভেঙাচ্ছে। কিন্তু কেন? প্রাণ তো দোষ করে নি। নাক টানতে টানতে মাথা নিচু করে আস্তে ধীরে মায়ের কাছে হাঁটু জড়িয়ে ধরলো। তোঁষা চোখ দুটো ছোট ছোট করে বললো,

— কি চাই?

— আম্মমু কোলে।

— কেন বাবা’র কোলে যা। আমার আদর তো সব তোর এখন। আমার কোলে কি? আমি শুধু প্রিয়ম’কে কোলে নিব।

এইবার মায়ের কোলে গাছের মতো বাইতে শুরু করলো প্রাণ। না পেরে তোঁষা ই ওকে কোলে তুললো। প্রাণ মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে গালে দুটো চুমু দিয়ে বললো,

— পিও আতে না কেন? প্লান লাব পিও।

— হ্যাঁ হ্যাঁ। তিন বছরের ছেলে আবার লাব পিও। এই বয়সেই বউ বউ করিস আর তো দিন পরেই আছে। মায়ের কোলে কি তাহলে? যা নাম।

দাঁত বের করে হাসতে হাসতে মায়ের কাঁধে মুখ লুকালো প্রাণ। সে তিন জন কেই লাব করে। তার মা,বাবা আর প্রিয়’কে।

আরহাম গোসল করে বের হওয়া মাত্র ই মুখ ঝামটা মে’রে চলে গেল তোঁষা। আরহাম ঠোঁট টিপে হাসলো একটু। কাঁধে থাকা টাওয়াল নিয়েই বউয়ের পিছনে গেলো ও। তোঁষা টেবিলে খাবার সব এনে রেখেছে। আরহাম টেবিলে বসতেই প্রাণ বাবা’র কোলে উঠলো। সারাদিন তার কাজ ই এটা৷ কোলে কোলে থাকা। জোকের মতো মায়ের বুকে নাহয় বাবার বুকে লেগে থাকবে।
তোঁষা মুখ কালো করেই খেতে বসেছে। আরহাম প্রথমে ছেলের মুখে ছোট্ট ছোট্ট লোকমা তুলে দিলো। প্রাণ ও কম না। সে নিজেও মায়ের প্লেট থেকে হাত দিয়ে নিয়ে বাবা’র মুখে দিচ্ছে।
নীরবতার চাদরে ঘেরা পরিবেশে শুধু প্রাণের কিছু ভাঙা ভাঙা কথাই শুনা গেলো।
.
প্রাণ ঘুমালো মিনিট পাঁচ হবে। আরহাম এবার বারান্দায় গেলো। তোঁষা দূর আকাশপানে তাকিয়ে। পিছন থেকে আরহাম ডাকলেও হয়তো শুনলো না। পাশে দাঁড়াতেই ধ্যান ভাঙলো ওর। আরহাম ওর হাতে হাত রেখে কিছুক্ষণ চুপ রইলো। জীবনে কতগুলো রাত তাদের চলে গেল। গুনে রেখেছে আরহাম। সামনেও গুনে রাখবে। তোঁষা হঠাৎ ফুপিয়ে উঠতেই আরহাম কিছুটা জোরেই হেসে ওকে জড়িয়ে ধরে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

— ছেলের সাথে মা হিংসে করে। এ কথা জনগন শুনলে কি এক অবস্থা হবে বল তো?

— আমাকে কেন আদর করো না?

— করি না?

— একটুও না।

— তাহলে তোর পেটে আবার আবার বাবু ঢুকলো কিভাবে?

তোঁষা বড় বড় চোখ করে তাকালো। আরহাম জানলো কিভাবে? তোঁষা নিজেই তো জানে না শিওর হয়ে। আরহাম তোঁষার এহেন চাহনি দেখে এবার একদম কাছে টেনে নিলো। গালের পানি মুছে দিতে দিতে বললো,

— তোকে তোর থেকে হাজার গুন বেশি আমি জানি প্রাণ।

— কিন্তু…

আরহাম তোঁষাকে চুপ করে দিলো। নরম আদর দিয়ে জানালো,

— ফুল এনেছি তো।

তোঁষার ডান হাতের কবজিতে বেলী’র মালা পেঁচিয়ে দিতে দিতে আরহাম বললো,

— সারাদিন কি করলি?

— কি করলাম? সংসার করলাম তোমার।

— সংসারের স্বাদ মিটেছে?

— ইহকালে মিটবে না।

আরহাম তোঁষা’র হাতে চুমু খেলো। হাঁটু ভেঙে ওর সামনে বসে পেটটা জড়িয়ে ধরে বললো,

— এবার একটা মা আসবে আমার।

— যদি বাবা আসে?

— মন বলে মা আসছে।

— শুধু তোমাকেই বলে?

— হ্যাঁ।

আরহাম উঠে দাঁড়ালো। চাঁদটা আজ জ্বলজ্বল করছে। তোঁষা আহ্লাদী হয়ে আরহামে’র গলা জড়িয়ে ধরলো। আরহাম ওকে পাজা কোলে তুলে রুমে নিতে নিতে বললো,

— এমন আরো বহু বছর তোর সাথ চাই প্রাণ। তোর হাত দুটো ধরে বুড়ো হতে চাই।

— মনজুর।

— প্রমিস।

— পাক্কা প্রমিস।

বিছানায় শুয়ে সবার আগে ছেলের কপালে আদর দিলো তোঁষা। আরহাম গিয়েছে কিচেনে। প্রাণ রাতে ঘুমের মাঝেই ফিডার খায় একটু। তোঁষা’র ছোঁয়া পেতেই প্রাণ গুটালো মায়ের কাছে। তোঁষা হাসলো। ইচ্ছে করেই মা ছেলে সারাদিন ঝগড়া করে। একা একা তোঁষা আর কি ই বা করবে?
ফিডার হাতে মা-ছেলেকে দেখে আরহাম মুগ্ধ হলো। এই তো সাইডে একটু ফাঁকা থাকে। সেখানটার দখলদার ও হাজির হচ্ছে অতি শিঘ্রই।

#চলবে……

প্রিয়_প্রাণ পর্ব-৪৪+৪৫

0

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪৪

বউ, বাচ্চা নিয়ে আরহাম হাজির শেখ বাড়ীতে। কাল আদনানে’র গায়ে হলুদ। শেখ বাড়ী তাই সেজেছে উজ্জ্বল লাল, নীল বাতি’তে। রংবেরঙের বাহার দেখে ছয় মাসের প্রাণ খুবই উচ্ছাসিত। তার মুখের হাসি আর হাত, পা নাড়ানো দেখেই বুঝা যাচ্ছে কতটা প্রাণবন্ত আপাতত সে। আরহাম থেকে একে একে সবাই কোলে নিলো ওকে। তোঁষা আরহামে’র পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। প্রাণ’কে এক পর্যায়ে যেই না ওর মা কোলে নিলো ওমনিই ফুঁসে উঠলো তোঁষা। আরহাম’কে ছেড়ে একপ্রকার ছিনিয়ে নিলো প্রাণ’কে ওর মায়ের কোল থেকে। রাগে কাঁপতে কাঁপতে দাঁত চেপে বললো,

— আমার বাবু ধরবে না।

মূহুর্তের ব্যাবধানে সবাই থমকে গেলো। হঠাৎ করে তোঁষা টেনে নেয়াতে প্রাণ ও ভয় পেয়ে কান্না জুড়ে জোরে। এতে যেন তোঁষা তেঁতেঁ উঠলো আরো। ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বললো,

— কেন কাঁদছিস? জানিস না এই মহিলা ভালো না? তোর মা’কে অনেক মে’রেছে। তোকেও মা’রবে।

ছোট্ট প্রাণ বুঝলো না মায়ের কথা। সে কেঁদে অস্থির হয়ে যাচ্ছে। আরহাম দ্রততার সাথে এগিয়ে এসে কোনমতে ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে তোঁষা’কে টেনে রুমে নিয়ে গেলো। পেছনে অশ্রু চোখে তাকিয়ে রইলো তোঁষা’র মা। তুষার ধীর পায়ে মায়ের কাছে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো। এক কাঁধে হাত রাখতেই তিনি বলে উঠলেন,

— ও কি আমায় মাফ করবে না?

— ওকে করেছিলে?

চমকে ছেলের চোখে তাকালেন উনি। তুষার মৃদু হাসলো। ধরফর করে উঠলো ওর মায়ের বুক। তুষার তাকে নিয়ে বসালো সোফায়। ওর মা ছলছল চোখ করে তাকিয়ে বললো,

— আমার ভুলের কি মাফ নেই?

— ভুল? সেটা পাপ ছিলো আম্মু। তুমি, আব্বু আর চাচ্চু মিলে করেছিলে সেই পাপ। আমার ছোট্ট পুতুলটাকে কতটা আঘাত দিয়েছিলে আম্মু। সত্যি টা আজও আরহাম’কে জানাই নি আমি। ও ডাক্তারি ছেড়ে দিয়েছে আম্মু। ভাবছে নিজের জ্ঞান এর অপব্যবহার করেছে ও অথচ সত্যি টা তো এখানে অর্ধ। সম্পূর্ণ সত্যি জানলে তোঁষা কেন কেউ তোমাকে মাফ করবে না।

হু হু করে কেঁদে উঠলো তোঁষা’র মা। রাগের বশে নিজের মেয়ের সবচেয়ে বড় ক্ষতিটাই তার হাতে হয়েছে। তুষার মা’কে ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। তথ্য রুমে একা। ওকে খাওয়াতে হবে এখন।
.
রুমে ঢুকেই দরজা লক করেছে আরহাম। না জানি তোঁষা কখন বের হয়ে কোন আকাম করে। এদিকে প্রাণ কেঁদেই যাচ্ছে। থামাথামির নাম নেই। আরহাম ভয়ে তোঁষা’কে বলতেও পারছে না একটু খাওয়াতে। ছেলেটা ফিডার মুখেই তুলছে না আজ। তোঁষা পা ছড়িয়ে বসা বিছানায়। রাগে লাল হওয়া মুখটা আপাতত কিছুটা স্থির। এক হাত তোঁষা’র পেটে। আরহাম সেদিকে খেয়াল করার সুযোগ পেলো না। প্রাণে’র মাত্রারিক্ত কান্না যখন কিছুতেই থামলো না তখন তোঁষা বিরক্ত হয়ে বললো,

— ও কাঁদছে না? দাও আমাকে। খাবে এখন। এটাও বুঝো না আবার বলো তোমার ছেলে!

আরহাম যেন দৌড়ে ছেলে নিয়ে হাজির হলো। তোঁষা তখনও বিরক্ত কিন্তু ছেলেকে দিয়ে আরহাম যখন ওকে শুয়িয়ে দিলো তখন শান্ত স্বরে তোঁষা বললো,

— তুমি শুবে না?

আরহাম নিঃশব্দে শুয়ে পরলো। এখনও শরীর কাঁপছে প্রাণ’টার কিন্তু কান্না নেই। সে আরামের সহিত মায়ের বুকে চোখ বুজে আছে।

_____________________

হলুদের অনুষ্ঠান জোরেসোরে শুরু হলো। চারদিকে চকচকে তকতকে একটা রমরমা ভাব৷ তোঁষা’কে তথ্য ধরে হলুদ একটা শাড়ী পরিয়ে সুন্দর করে সাজাতে বসালো। নিজেও এই ভারী শরীরে শাড়ী পেঁচালো তথ্য। তুষারের এই নিয়ে রাগারাগি’র অন্ত নেই। যদি বউটা শাড়ীতে পেঁচিয়ে পরে যায় তখন? যদি এই সুন্দর মুখটা দেখে নজর লেগে যায় তখন? কতশত ভাবনা তুষারের। এসব কি তথ্য বুঝে? মোটেও বুঝে না৷ হাতে দুধ নিয়ে গোমড়া মুখে তা তথ্য’কে দিলো তুষার। তথ্য ও পাত্তা দিলো না৷ নিজের মতো খেয়ে গ্লাসটা সাইডে রেখে তোঁষা’কে বললো,

— রুমে যেতে পারবে? আরহাম ভাই রুমে।

— পারব আপি।

হাসিমুখে উত্তর দিলো তোঁষা। তবুও তুষার বোনের হাতটা ধরে গালে আরেক হাত দিয়ে বললো,

— অনেক সুন্দর লাগছে পুতুল।

তোঁষা হাসলো। তুষার বোনকে হাত ধরে তার রুমে দিয়ে পা বাড়ালো নিজের রুমে। বউটাকে বুঝাতে হবে। এত সুন্দর হয়ে চলাফেরা করা যাবে না পাছে নজর লাগছে?

তোঁষা রুমে ঢুকতেই ওকে দেখে থমকে গেলো আরহামে’র হাত। ছেলেকে ডায়াপার পড়াচ্ছিলো ও। আজ বহুমাস পর তোঁষাকে এভাবে শাড়ী পরা দেখলো। নেশাময় চোখে তাকিয়ে রইলো আরহাম৷ ছোট্ট প্রাণ ও টুকুর টুকুর করে মা’কে দেখে যাচ্ছে। আরহামে’র চোখে আজ ভিন্ন কিছু দেখা গেলো৷ কি দেখা গেলো বুঝা গেলো না। ছেলেটার টলমলে চোখ শুধু জানান দিলো সে কৃতজ্ঞ। সে ব্যাথিত। সে অনুতপ্ত নিজের বিষাক্ত ভালোবাসা নিয়ে।
তোঁষা বিড়াল পায়ে এগিয়ে এলো। আস্তে করে হাত রাখলো আরহামে’র পিঠে। আরহাম হুট করে তোঁষার কোমড় জড়িয়ে ধরে। পেটে মুখ গুজে কেঁদে ফেলে ফুপিয়ে।
তোঁষা ওর প্রাণের চুলের ভাজে আঙুল চালনা করলো। ডাকলো মৃদু শব্দে,

— এই আরহাম ভাই?

ঝট করে সরে গেলো আরহাম। এই ডাকটা ওর কলিজাটা এফার ওফার করে দিলো মুহুর্তে। ছোট্ট প্রাণটাও উউ আআ করে তার কথা বলতে চাইলো। তোঁষা একটু ঝুঁকে আরহামে’র কপালে চুমু খেলো। ফিসফিস করে বললো,

— আজ রাতে ভালোবাসব তোমাকে।

কথাটা বলেই ছেলেকে ডায়াপার পরালো তোঁষা।
.
বেশ সুন্দর ভাবে হলুদের অনুষ্ঠান সম্পূর্ণ হলো। তোঁষা একদম স্বাভাবিক ছিলো কিন্তু কোন ভাবেই আদনান’কে হলুদ ছোঁয়াতে চাইলো না। আরহাম আর তুষার বাদে অন্য কোন পুরুষের সামনেই তোঁষা থাকতে বিরক্ত তা আরহাম স্পর্শ দেখতে পেয়েছিলো।

প্রাণ ঘুমিয়েছে ঘন্টা খানিক হলো। আজ অনেক আনন্দ করেছে সে বুঝা গিয়েছে। ক্লান্ত হয়ে ঘুমাচ্ছে সে। ইদানীং আবার বায়না ও বেড়েছে। মা’কে ছাড়া চলে না৷ তোঁষা’র কাছ থেকে ওকে নিয়ে ছোট্ট দোলনাতে রাখলো আরহাম৷

আরহাম এক লাফে বিছানায় উঠলো। তোঁষা কপাল কুঁচকে বললো,

— কিহ?

— প্রাণ ঘুমিয়ে গিয়েছে।

— হু। মাত্র ই ঘুমালো।

— তুই না বলেছিলি রাতে ভালোবাসবি?

বলেই বাঁকা হাসলো আরহাম৷ তোঁষা হাই তুলে বললো,

— ঘুম পাচ্ছে।

— শোন না।

— ঘুমাব।

— এই প্রাণ?

— প্রাণ ঘুম।

এবারে আরহাম ধৈর্য হারা হলো। হামলে পড়লো কিছুটা তোঁষার উপর। তোঁষা ভরকে গিয়ে যেই না চিৎকার করবে ওমনিই ওকে থামিয়ে দিলো আরহাম। ছেলে উঠলে এখন সব যাবে। আমও যাবে ছালা ও যাবে। তোঁষা দুষ্ট হাসলো। আরহাম টেবিল ল্যাম্পটা অফ করে বললো,

— এখন ঘুমিয়ে দেখা।

— দেখাবই তো।

— দেখা?

— কি দেখাব?

— তাও ঠিক সবই দেখা আমার।

তোঁষা কামড়ে ধরলো আরহাম’কে। থামিয়ে দিলো অসভ্য কথা। দুজন ভালোবাসা দেয়া শুরু করলো দুজনকে। একে একে হারালো দুজন ভালোবাসার মানুষ তাদের সুখের রাজ্যে।
.
বেশ সুন্দর ভাবেই কাটলো আদনানের বিয়ে। নতুন বউ’কে রুমে দিয়ে মাত্র ই সবাই যার যার রুমে গেলো তখনই গগন বিদারী চিৎকার করে উঠে তথ্য। এক সময়ের আর্মি ম্যান তুষার ছোট্ট বাচ্চার মতো আচরণ শুরু করলো। তোঁষা’কে নিজের মায়ের কাছে রেখে আরহাম সহ বাসর ছেড়ে আদনান ছুটলো হাসপাতালে।

সকলকে চিন্তামুক্ত করে ছোট্ট একটা পরি এলো তথ্য তুষারের ঘরে। তুষার নিজের মেয়েকে কোলে নিবে না৷ কিছুতেই না। তার শক্ত হাতে নাকি মেয়ে ব্যাথা পাবে অগত্যা তথ্য ক্লান্ত দেহেই রেগে বললো,

— আমার মেয়ে আমাকে দাও। কোনদিন যাতে আমার মেয়ে ধরতে না আসে এই লোক।

তড়িৎ বেগে মেয়েকে কোলে তুললো তুষার। ওর আচরণে হাসির রোল পরলো হসপিটালের কক্ষতে।

#চলবে…..

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪৫

প্রাণ কিছুটা হামাগুড়ি দিয়ে ঘুমন্ত প্রিয়মের কাছে এলো। ছয়মাসের প্রিয়ম হাত পা ছড়িয়ে ঘুমে কাতুর। প্রাণ দেখলো ওকে। প্রিয়মের লালা গোলাপি গালটাতে ছোট্ট একটা মশা বসা। প্রাণ টুকুর টুকুর করে দেখলো ওটা৷ একটু পরই প্রিয়ম কেঁদে উঠলো উহু উহু করে। এরমানে মশাটা কামড় দিয়েছে। ছোট্ট প্রাণ বুঝলো না সেটা। সে শুধু বুঝলো তার প্রিয় কাঁদছে। উবুর হয়ে পরলো ও প্রিয়মের উপর। গালে লাল দাগটাতে মুখ লাগিয়ে আদর করে দিতে চাইলো। মুখে শব্দ করে ডাকতে লাগলো,

— বাব্বাহ।

বারান্দায় ছিলো আরহাম। ছেলের শব্দ পেতেই দ্রত ছুটে এলো রুমে। এসেই দেখলো একদিকে প্রিয়ম কাঁদছে অন্যদিকে কাঁদছে প্রাণ। সবার আগে ছেলেকেই কোলে তুললো আরহাম। ওকে নিয়ে বসলো প্রিয়মের কাছে। ছোট্ট পরিটার বুকে অলতো চাপর দিতেই সে ঘুমালো সে ঘুমালো কিন্তু থামলো না প্রাণ। বাবার কোলেই ঠেস দিয়ে দাঁড়াতে চাইলো ও। আরহাম ওকে থামাতে আদর করতে করতে বললো,

— কি বাবা? এই যে আমি। কেন কাঁদে বাবা’র প্রাণ?

প্রাণ নড়তে নড়তে হাত বাড়িয়ে ঘুমন্ত প্রিয়ম’কে দেখালো। আরহাম দেখলো তবে বুঝলো না। সে ছেলের ফুলা গালদুটোতে থাকা পানি মুছে দিতে দিতে উঠে দাঁড়াতে নিলেই প্রাণ তেড়াবেড়া শুরু করলো। ও যাবে না। আরহাম ছাড়লো। বুঝার চেষ্টা করলো। ওমনিই দেখলো প্রিয়মের গালটায় লাল দাগ দেখা যাচ্ছে। বুঝাই যাচ্ছে মশা কামড়েছে। ছোট্ট প্রাণ তার প্রিয়মের গালে পুণরায় ঠোঁট ছুঁয়ে আদর করতে গিয়ে লালা লাগিয়ে দিলো। আরহাম ফিক করে হাসির শব্দ শুনেই দরজায় তাকালো। তোঁষা দাঁড়িয়ে হাসছে। আরহাম না বুঝে জিজ্ঞেস করলো,

— হাসছিস কেন?

— হাসা বারণ নাকি?

— ইদানীং প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করিস।

তোঁষা ভেতরে ঢুকে আলমারি খুলে কাপড় বের করতে করতে বললো,

— প্রাণের কাপড় খুলো। গোসল করাবে না?

— হু।

বলেই আরহাম ছেলেকে টেনে নিলো নিজের কাছে। প্রিয়মের গালের লালাটুকু মুছে দিলো নিজ হাতে। প্রাণ তখনও সোজা দাঁড়িয়ে নেই। ছোট্ট ছোট্ট নড়বড়ে তার পা জোড়া এখনও দাঁড়াতে সক্ষম হয় নি। টলমলে ছেলেকে এই দফায় কোলে তুললো তোঁষা। প্রাণ এতে খুশি হলো বেশ তা তার মুখটা দেখেই বুঝা গেলো। কেমন কেমন চোখ করে তাকিয়ে হাসে। মায়ের মতো তার ফুলা ফুলা গালদুটো তখন বেশ দেখায়। মুখে অস্পষ্ট উচ্চারণে শুনা গেলো,

— আআমামমমা।

— হ্যাঁ বাবা, কি বলবে মা’কে?

— মাহ্।

তোঁষা ওর ন্যাংটু ছেলেকে নিয়ে যেতে নিলেই আরহাম বললো,

— হাসলি কেন তখন বললি না?

তোঁষা মুখ ঘুরিয়ে তাকিয়ে বললো,

— ইতিহাস পুণরাবৃত্তি হবে।

— মানে?

— তোমার ছেলে প্রিয়’কে হাতছাড়া করবে না দেখিও।

বলেই দুষ্ট হাসলো তোঁষা। আবারও বললো,

— বাপকা বেটা হবে।

এবার আরহাম ও হেসে ফেললো। এক বছরের ছেলে ওর কিন্তু তার প্রিয়মের প্রতি যথেষ্ট ভালোবাসা আছে। দেখা যায় সেটা। বুঝা যায়। এদের ভবিষ্যৎ কি হবে তা জানা নেই কিন্তু তথ্য প্রায় সময় বলে প্রিয়’র জন্য প্রাণ’কে জামাই হিসেবে পছন্দ তার।

হঠাৎ প্রিয়ম জেগে উঠাতে তোঁষা আরহামে’র হাতে ছেলেকে দিয়ে প্রিয়মকে কোলে তুলে নিলো। ওর কান্নার শব্দে এবার তথ্য ই এলো। তোঁষা তথ্য’কে দেখেই বললো,

— আমার মেয়ে তার মা’কে খুঁজছে।

তথ্য মেয়েকে কোলে তুলতে তুলতে বললো,

— শাশুড়ী থাকতে মা’কে কি দরকার ওর?

তোঁষা হেসে ফেললো শব্দ করে। তথ্য মেয়েকে নিয়ে রুমে চলে যেতেই শুনতে পেলো ঝাপঝাপির শব্দ। পানি পেলেই প্রাণ পা*গল হয়ে যায়। এর সাথে আবার যোগ দেয় আরহাম৷ তোঁষা গিয়ে দেখলো অলরেডি দুই বাপ বেটা ভিজে চপচপা। নেংটু প্রাণ বোলে বসে হাত পা ঝাপিয়ে তার মা’কে ডাকছে। আরহাম ও তোঁষা’কে দেখে বললো,

— তুঁষ এখানে আয়।

তোঁষা ভেতরে ঢুকলো। প্রাণ মা’কে দেখে উচ্ছাসিত হলো। ঝপাৎ ঝপাৎ শব্দ তুললো পানিতে।

____________________

— এখন কেঁদে কি হবে আম্মু? কিসের জন্য কাঁদছো?

— আমার তোঁষা…..

— তোমার তোঁষা? তোঁষা শুধু আরহামে’র। আর কারো না৷ ওকে জানে মে’রে দিলেও তো পারতে। কি দরকার ছিলো বাঁচিয়ে রাখার? এখন কে ধুঁকে ধুঁকে ম’রছে? তুমি? আমি? কেউ না৷ শুধু ম’রছে পুতুল। আর ওর সাথে জড়িত দুটো প্রাণ।

— আমি ইচ্ছে করে….

— না করেছিলাম।

— ওর ভালোর জন্য ই….

— তোমাদের স্বার্থের জন্য।

— তুষার?

— কি বলবে? বলো দোষ নেই তোমার? পুতুলের এই অবস্থার জন্য তুমি দায়ী না? বলো আম্মু?

মুখে হাত চেপে কেঁদে উঠলেন তোঁষা’র মা। তোঁষা’কে যবে থেকে আরহাম থেকে সরাতে মা’র দেয়া শুরু করলো তখনই একদিন রাগে তোঁষা’র মাথায় হাতে থাকা স্টিলের জগ দিয়ে আঘাত করে বসেন। মাথা চেপে ফ্লোরে বসে পরে তোঁষা। এতক্ষণ ধরে করা হাউমাউ তার কান্না থেমে যায় নিমিষেই। ঝাপসা চোখে তাকায় মায়ের দিকে। তখনও রাগী চোখে তাকিয়ে সে। তোষার হা করা মুখটা থেকে লালা গড়িয়ে মুখ লেপ্টে গেলো। টাইটুম্বুর চোখে তখন হতভম্ব ভাব।
ওর মায়ের রাগী মুখটাতেও ভয় জন্মেছিলো যখন প্রায় পাঁচ মিনিট বসে থাকা তোঁষা হেলে পরে ফ্লোরে।
সেদিন বাসায় কেউ ছিলো না। টের পায় নি কেউ৷ তুহিন জানলে হয়তো আদরের স্ত্রী’কে ভয়ংকর শাস্তি দিতেন। তোঁষার মা ওকে ডাক্তার দেখান। মাথায় দুটো সিলি দিয়ে বাসায় ও আনা হয়। তোঁষার সাথে তখন এমনিতেও বাবা-চাচা কথা বলে না। রাতে গা কাঁপিয়ে যখন জ্বর এলো তখন চাচি এসে ছিলো ওর কাছে। তার কাছেই সত্যি টা বলেছিলো তোঁষা।
সেই থেকে মাথা ব্যাথা সহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা যায় তোঁষার মাঝে। যার জন্য খেয়েছে ছাড়া ছাড়া ঔষধ। সবটার ইফেক্ট পরে সোজা ওর মস্তিষ্কে। তুষার একথা জেনেছে বছর খানিক আগে। তাই সে আরহামকে সোজা কখনো দোষ দেয় নি।
আরহাম এখনও জানে না তোঁষার অবস্থা। ধীরে ধীরে ঠিক হচ্ছে তোঁষা অথচ তুষারের ভয় হয়৷ ভীষণ ভয় হয়। হারানোর ভয়। একটা পা*গল করা প্রেমিককে নিয়ে ভয়। এক মাসুম প্রাণের জন্য ভয়।

তুষার ওর মা’কে ছেড়ে রুম ত্যাগ করতেই আরহামে’র মুখোমুখি হলো। বুকে যেন এক ধাক্কা খেলো সজোরে। আরহামের প্রতিক্রিয়া কি হবে তা জানা ছিলো না ওর। তবে এই তিক্ত সত্যি জেনেও আরহাম কিছু বললো না। শুধু তুষারকে জড়িয়ে ধরলো। তুষার টের পেলো আরহাম কাঁপছে। আরহাম ওভাবে থেকেই বললো,

— ওর আমাকে ভালোবাসাটাই ভুল ছিলো ভাই। ওকে এত কেন মা’রতো? তাদের কি মায়া জাগত না এই মায়াবী মুখটা দেখে?

#চলবে…..

প্রিয়_প্রাণ পর্ব-৪২+৪৩

0

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪২

এলোমেলো দিনগুলো তাদের এবার বেশ ভালোই কাটলো। তথ্য’কে নিয়ে তুষার বের হলো আজ ঘুরতে। তাও কি না রিকশায়। প্রেম জিনিস টা কিন্তু অদ্ভুত। এটা বদলায় পরিবেশ ভেদে। এই যেমন সকালে নিজের বদ্ধদারে থাকা সিগ্ধতায় ঘেরা প্রেয়সী এক রুপে তার প্রেমিক’কে ঘায়েল করে তেমনই আবার রাতের উষ্ণতায় তাদের প্রেম ছড়ায় ভিন্ন সুবাস। মাখোমাখো প্রেমাতুর ক্লান্ত বিকেলে বাদাম হাতে প্রেমটা আবার একটু ভিন্ন। ঠিক তেমনই দুপুরে রোদে পুড়ে প্রেমিকার জন্য করা অপেক্ষাটা’র স্বাদ আরেকটু ভিন্ন। লং ড্রাইভে রাত বিলাস হোক বা হোক তিন চাকায় চালিত রিক্সা। প্রেমটা কিন্তু ভিন্ন অনুভূতি জাগাবে মনে। হাতে হাত ধরে পিচ ঢালা রাস্তায় যখন প্রেমিকা নগ্ন পাটে হাটবে তার পাশে পুরুষটা যখন আর মর্দানি ভুলে প্রিয় নারীর জুতা হাতে আরেকপাশ হতে তার হাতটা ধরে হাটে সেটার মিষ্টতা কিন্তু আবার একদমই আলাদা।

এই যে এখন তথ্য আর তুষার পাশাপাশি রিক্সায় চড়ে বসেছে সাথে তাদের ক্ষুদ্র সোনা অথচ ক্ষুদ্রটাকে এখনও হাতে পাওয়া হয় নি কিন্তু সে তো আছে। তার অস্তিত্বের জানান ই বা কম কিসে? তুষারের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে তার এক বাহু বুকে জড়িয়ে বসে আছে তথ্য। তুষার যত্নসহকারে তথ্য’কে আগলে বসেছে। বেছে বেছে এক বৃদ্ধ’র রিক্সায় উঠেছে ও। বৃদ্ধ মানুষ হেলিকপ্টার চালাবে না। সে চালাবে রিক্সা নাহলে যেই বেগে চালায় মনে হয় এখনই উড়িয়ে দিলো বুঝি।
ধীর গতিতে চলমান রিক্সাটাতে এক সুখী দম্পত্তি’র সুখের ছড়াছড়ি দেখে চোখ মুদে আসে। তাদের প্রেমময় ঘনঘটা সিন্ধতার চাদরে মুড়িয়ে রাখে এই জুগলকে।
আচমকা একটা উঁচু জায়গা পেরুতেই তুষার চকিত ভাবে তথ্য’কে আগলে নিলো। মৃদু গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠলো,

— চাচা ধীরে চালান।

মোটামুটি বৃদ্ধ লোকটা পান খাওয়া দাঁত বের করে হাসলেন। জানালেন,

— চিন্তা নাই বাপ। আমি দেইখাই চলামু৷ নতুন আব্বা হইবা? ভয় পাইয়ো না। যত্ন নিও। ছাওয়াল ভালো হইলেই হইলো।

তুষার কথা বাড়ালো না। তবে তথ্য অল্প হেসে বললো,

— দোয়া করবেন চাচা।

বৃদ্ধ মাথা নাড়িয়ে রিক্সায় টুংটাং শব্দ তুলে এগিয়ে গেলো। তুষার গম্ভীর মুখে তখনও বসা৷ কি হলো কে জানে?

তাদের রিক্সা থামলো প্রকৃতির আঁচলে ঢাকা এক জায়গায়৷ তথ্য’কে অতি সাবধানে ধরে নামালো তুষার। তুষার রিক্সা ওয়ালে পঞ্চাশ টাকার ভাড়া দিলো দুইশত টাকা’র এক নোট। বৃদ্ধ খুশি হয়ে কিছুক্ষণ দোয়া করে রাস্তা মাপলো। তুষারের হেলদুল নেই অথচ দোয়া পেয়ে তথ্য বহুত খুশি। তার চেহারা দেখেই সেটা স্পষ্ট।
তথ্য’র হাত ধরে দুইজন সামনে বাড়লো। গোল বাঁধাই করা জায়গাটায় বসলো দু’জন। তথ্য তুষারের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করলো,

— কি হলো?

— কই?

— কই মানে?

— কিছু না।

— এটা কেমন কথা? হুট করে কি হলো?

তথ্য’র কণ্ঠে বিরক্তি। তুষার ওর পানে তাকালো। তথ্য’র দিকে সোজা তাকিয়ে বললো,

— আমার একশটা বাচ্চা হলেও এতটাই কনসার্ন থাকব।

হা করে তাকিয়ে রইলো তথ্য। রিক্সা ওয়ালার সামান্য কথাতে এতটা রিএক্ট? মনে হচ্ছে কোন এক নিব্বা বসা তথ্য’র সামনে? এই লোক কি না এত বড় অফিসার ছিলো? তথ্য’র হা করা মুখ দেখে তুষার বললো,

— কি?

— একশত টা বাচ্চা?

— হ্যাঁ। তাতে কি?

— এত বাচ্চা কে পয়দা করবে?

তুষার এবার দুষ্ট হাসলো। ওর কানে মুখ নিয়ে বললো,

— তুুমি আর আমি।

________________

আরহাম একবার ভাবলো পুণরায় হসপিটালে জয়েন করবে কিন্তু বিবেকের তাড়নায় তা পারছে না৷ নিজের চিকিৎসা শিক্ষার ভুল ব্যাবহার করেছে সে নিজের সবচাইতে প্রিয় জনের উপর। এই ভুলটা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে প্রতিনিয়ত। চাইলেও এই ভুল আজীবন সুধরাবে না। চোখের সামনে থাকা এহেন তোঁষাটা তার নিকট বড্ড কষ্টদায়ক। কিন্তু এভাবে বসে বসে থাকবেই বা কয়দিন? ডক্টর প্রফেশনটা তার এমনিতেও কখনো ততটা পছন্দের ছিলো না। ছাড়তেও মন সায় দেয় না।

দুধে বলক আসতেই তা নামিয়ে রাখলো আরহাম। আগে বাবু’র জন্য কিছুটা আলাদা করে রেখে দুই কাপ চা বানালো। তোঁষা’র আবার বিকেল হতেই চা লাগবে। চা হাতে রুমে ঢুকলো আরহাম। তোঁষা হাত পা মেলে বারান্দায়। রুমে’র ছোট্ট দোলনাটাতে হাত পা নাড়ছে বাবু’টা। আরহাম এসেই উঁকি দিয়ে হাসি মুখে ডাকলো,

— বাবা? এই যে আব্বু। আমার কলিজার টুকরো কি করছে?

মুখে হাত পুরে “আআআ আর পাপাপা” শব্দ করলো বাবুটা। সে তার বাবা’কে ভালো করেই চিনে। বাবা যে তাকে এতটা ভালোবাসে, আদর করে তা জানা ওর। তাই তো দুই হাত বাড়িয়ে দিলো বাবা’র দিকে। বলতে চাইলো কোলে নাও। আরহাম হেসে আগে বারান্দায় ট্রে টা রেখে এসে ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতে করতে বারান্দায় গেলো। তোঁষা চুপচাপ বসে আকাশপানে তাকিয়ে। আরহাম এসে পাশের বাবু’কে রাখলো একদম নিজের কাছে। পুরোটা বারান্দার ফ্লোরে আর্টিফিশিয়াল ঘাস লাগানো। তারমধ্য এখন আরহাম বাচ্চার জন্য রেখেছে ছোট নরম একটা তোশক। বাচ্চাটা একবার তাকালো মায়ের দিকে। হাত পা ছুঁড়ে জানান দিলো সে খুশি। তোঁষা বেশ কিছু সময় তাকিয়ে থেকে চোখ ফিরিয়ে নিতেই আরহাম তোঁষা’র পাশ ঘেঁষে বসলো। তোঁষা তবুও চুপ। আরহাম চা বাড়িয়ে দিতেই ও হাত বাড়িয়ে নিলো। এক চুমুক দিতেই আরহাম তা নিয়ে নিলো ওর হাত থেকে। তোঁষা’র কাপে চুমুক বসিয়ে নিজেরটা দিলো ওকে। তোঁষা তবুও কথা বললো না। এবার ফোঁস করে শ্বাস ছাড়লো আরহাম৷ তোঁষা’র পেছন থেকে কোমড়ের দিকে হাত রেখে বসা অবস্থায় ই আরেকটু কাছে টেনে নিলো। তোঁষা’র কাঁধের কাছে নাক নিয়ে লম্বা শ্বাস টেনে বললো,

— মুখ ফুলিয়ে আছিস কেন তুঁষ?

— কথা বলব না।

— এখন কে বললো কথা?

— আর বলব না।

— কেন?

— এটাও বলব না।

— দোষ টা শুনি।

— আমাকে আদর করো না।

— কিহ! তোকে আদর করি না তো কাকে করি?

— এটাকে।

আঙুল দিয়ে দেখালো তোঁষা। আরহামে’র খারাপ লাগলো। নিজের সন্তানকে এভাবে বলে কেউ? পরপর মনে পরলো বাস্তবতা। তোঁষা’র কাঁধে মাথা রেখে আরহাম বললো,

— তোকে যে কতটা ভালোবাসি তা কিভাবে বুঝাই বল তো।

— জানি না।

আরহাম ওকে নিজের দিকে ঘুরালো। তোঁষা’র দুই গালে হাত দিয়ে ধরে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,

— আমার প্রাণ, তোকে আমি আমার নিজের সবটুকু দিয়ে ভালোবাসি। ছোট্ট প্রাণ তো তোর আর আমার ই অংশ। আমাদের ভালোবাসা।

তোঁষা চুপ করে আরহামে’র বুকে মাথা রাখলো। আরহাম ওর চুল নেড়ে দিয়ে বললো,

— ওকে কোলে নিবি?

— না।

— কেন?

— যদি পরে যায়?

— পরবে না। আমি আছি না?

বলেই ছোট্ট প্রাণটাকে তুলে দিলো তোঁষা’র হাতে। তোঁষা’র কোলে উঠে বাবুটা টুকটুক করে মা’কে দেখতে লাগলো। তোঁষা একদম বুকে মিশিয়ে নিয়ে বসেছে যদি পরে যায়? বাবুটা ঠিক বাবা’র মতোই লোভী মনে হলো। তাই তো মায়ের কোলে এসেই বুকে মুখ ঘঁষে নিজের ক্ষুধা জানান দিলো।

#চলবে……

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪৩

বাতাসে রুমের পর্দাগুলো দুলে দুলে যাচ্ছে। যেন জোয়ারে মাঝে উত্তাল নদীতে পাল তুলে আছড়ে পরা এক নৌকা। বাতাসের দাপট ঠিক আজ কতটা তা বাইশ তলার উপর থেকে ভালোই টের পাওয়া যাচ্ছে। তোঁষা’র অল্পসল্প শীত লাগাতে আলমারি খুলে একটা পাতলা চাদরে নিজেকে পেঁচিয়ে নিলো। আরহাম রুমে নেই। জরুরি কিছু কথা বলতে রুমের বাইরে গিয়েছে কারণ রুমে কথা বললে ওদের ছোট্ট সোনা উঠে যাবে। তোঁষা তাকালো বাবুটার দিকে। আফ্রাহাম শেখ প্রাণ গুটিয়ে ঘুমাচ্ছে। ভারী এই নামটা মোটেও মানায় না বাবুটাকে। তাই শেষমেষ কিভাবে জানি প্রাণ নামটা ও জুড়ে গেলো ওর নামের সাথে। গোলাপি ছোট্ট ঠোঁটদুটো যখন নড়াচড়া শুরু করলো তখন কিছুটা মায়া হলো তোঁষা’র। ঘুমের মাঝেই বাচ্চাটা মুখে শব্দ করছে। এগিয়ে গিয়ে তোঁষা দাঁড়ালো ওর কাছে। এক দৃষ্টিতে দেখতে দেখতে আচমকা হাত বাড়ালো ওর দিকে।

আরহাম অনেকক্ষণ যাবৎ কথা বললো আদনানে’র সাথে। ওদের বিয়ের দিনগুলো শেখ বাড়ীতে থাকার অনুরোধ করলো। আরহাম নিজেও চাইছে কিন্তু তোঁষাটা মানবে কি না কে জানে? প্রাণ ও এখন অনেক ছোট। বাবা-মা ছাড়া এই পর্যন্ত তেমন কারো কাছে থাকে নি। তথ্য আর তুষারের কাছে যা একটু থেকেছে এই যা।
একটু ভেবে আরহাম জানালো,

— আচ্ছা তোকে পরে জানাচ্ছি। তুঁষ দেখি রাজি হয় কি না।

— তোমার সব কথাতেই ও রাজি থাকবে ভাই। বলেই দেখো।

ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে আরহাম বললো,

— ভয়টা অন্য কোথাও।

— কেউ কিছু বলবে না ভাই। এসো তুমি। আমরা সবাই অপেক্ষায় থাকব।

— রাখি।

— আচ্ছা।

কথা শেষ হওয়া নাগাদ আরহাম চোখ ডললো। এদিক ওদিক ঘাড় কাত করে আলস্য ভেঙে পা বাড়ালো রুমে। কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে তোঁষা। আরহাম একবার ডাকলো,

— তুঁষ ঘুমে?

তোঁষা উত্তর করলো না। আরহাম ওয়াশরুম থেকে হাত মুখ ধুঁয়ে টাওয়াল দিয়ে মুছতে মুছতে বেরুলো। একপলক তাকালো ছেলের দোলনার দিকে। এগিয়ে গিয়ে দেখতেই চমকালো। ভরকালো। তড়িৎ হাতে বালিশ সরালো। না নেই। ওর ছোট্ট প্রাণ’টা এখানে নেই। ধ্বক করে উঠে আরহামে’র বুক। স্পষ্ট খেয়াল আছে এখানেই রেখে গিয়েছিলো ছেলেকে। ছয় মাসের ছেলে যাবে কোথায়? তোঁষা’কে ডাকতে লাগলো আরহাম,

— তুঁষ? এই তুঁষ। উঠ। প্রাণ কোথায়?

তোঁষা উঠলো না দেখে ভয়ে আরহাম তোঁষা’র মুখ করে কাঁথাটা সরিয়ে বললো,

— প্রাণ কোথায়?

— আমি কি জানি?

— তোঁষা!! কি করেছিস ওকে? বল! আমি রেখে যাই নি দোলনায়? কোথায় আমার ছেলে?

আরহামে’র ধমক খেয়ে তোঁষা মুখ কালো করে ফেললো। আস্তে করে বুক থেকে কাঁথাটা সরিয়ে দেখালো প্রাণ’কে। মায়ের বুকে ঘাপটি মে’রে ঘুমাচ্ছে সে। আরহামে’র কলিজায় পানি এলো যেন। মাত্র ই ওর কলিজা ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো।
আরহাম তোঁষা’র বুকে থাকা ছেলেকে চুমু খেলো। অপরাধীর মতো তাকালো তোঁষা’র দিকে। তোঁষা কালো মুখেই বললো,

— নাও তোমার ছেলেকে।

— থাকুক।

— না।

— ঘুমাচ্ছে। দেখ।

— নাও ওকে।

— ঘুমাক তোর কাছে।

— নাও নাহয় এখনই ছুঁড়ে ফেলে দিব।

কথাটা শক্ত গলায় বলতেই আরহাম দ্রুত ছেলেকে কোলে তুলে নিলো। অল্প কেঁদে উঠলো প্রাণ। আরহাম পিঠ চাপড়ে কান্না থামিয়ে তোঁষা’র পাশেই শুয়িয়ে দিলো। নিজে বসলো পাশে। তোঁষা পুণরায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে বিরবির করলো,

— এমনিতে বলে আমাদের বাবু এখন বলে নিজের বাবু। তুঁষ আর কখনো কোলে নিবে না৷ আমার কোলে দিলে একদম ফেলে দিব৷ শয়তান৷

আরহাম সবটা শুনলো। তোঁষা’র অভিযোগ আর অভিমান শুনে খারাপ লাগা থেকে বেশি ভালো লাগলো। এরমানে তোঁষা ভাবে আফ্রাহাম ওদের সন্তান। তোঁষা ও তাহলে আফ্রাহামে’র প্রতি ভালোবাসা অনুভব করে। আরহামে’র চোখ ভরে উঠলো। বুক জুড়ে খেলে গেলো উত্থান পাত্থাল ঢেউ। ঠোঁটে দেখা মিললো এক সুখের হাসির ঝলকানি।

অতি সন্তপর্ণে ছেলেকে বুকের একপাশে নিয়ে তোঁষা’কে টেনে নিলো নিজের কাছে। তোঁষা আসবে না। ছুঁড়াছুঁড়ি করতে লাগলো ও। আরহাম ধীরে ওর হাত চেপে ফিসফিস করে বললো,

— বাবু উঠে যাবে।

— তাতে আমার কি?

— তোর ছেলে।

— তোমার।

— কার পেটে ছিলো?

— আমার।

— বাবু কার পেটে থাকে?

— মায়ের।

— তাহলে ওর মা কে?

— আমি।

নিজের কথায় নিজেই ফেঁসে গেলো তোঁষা। আরহাম হাসছে। তোঁষা চোখ রাঙিয়ে তাকালো ওর দিকে। একপাশে ঘুমন্ত প্রাণে’র মিষ্টি দানা। অপরপাশটা খালি। তোঁষা’র চোখ রাঙানো মিলিয়ে গেলো আরহামে’র হাসির সামনে। এত সুন্দর কেন হাসে আরহাম ভাই? তোঁষা’র নরম মনটা যে রাগ পুষে রাখা শিখে নি। টলমলে চোখে আরহামে’র বুকে মাথা রাখলো ও। একসাথে তিনজনকে ঢেকে নিলো আরহাম৷ তোঁষা এক হাত রাখলো ওদের ছোট্ট প্রাণে’র উপর। ছেলের পিঠ’টা একদম নরম। তুলতুলে। তোঁষা হাসলো। ওর হাসিতে হাসলো আরহাম।
তোঁষা’র মাথায় হাত দিয়ে আরহাম ডাকলো,

— প্রাণ?

— হু।

— একটা কথা রাখবি?

— কি?

— ভালোবাসি তোকে।

— জানি তো।

— বল তাহলে কথাটা রাখবি?

— আচ্ছা।

— শেখ বাড়ীতে যেতে হবে সোনা৷

— ঐ মহিলাকে দেখতে মন চায় না আমার।

— চাচি’কে এভাবে বলিস না তুঁষ। মা হয়….

বাকিটা বলার আগেই তোঁষা চেঁচালো,

— সে আমার মা না।

তোঁষা’র কণ্ঠে অল্প কাঁপলো ঘুমন্ত প্রাণ৷ ঠোঁট কাঁপিয়ে সে বাবা’র বুকে নড়েচড়ে উঠলো। তোঁষা কি মনে করে ছেলেকে টেনে নিলো নিজের কাছে। টলমল চোখে মা’কে দেখে তার কান্না বাড়লো বৈ কমলো না। তোঁষা ওর বুকে আদর করে বললো,

— থাম নাহলে মা’রব।

আরহাম তাকে তাকে রইলো যদি সত্যি ই মে’রে বসে? তবে না এমনটা হলো না। তোঁষা খাওয়ালো তার ছেলেকে। একটা সুন্দর সংসারের সূচনা দেখতে পেলো আরহাম। নিজ হাতে ধ্বংস করা ধ্বংসস্তূপ থেকে এখন বেঁচে যাওয়া রাখ টোকাচ্ছে আরহাম৷ বলা তো যায় না যদি সুখের দেখা মিলে?

#চলবে……

প্রিয়_প্রাণ পর্ব-৪০+৪১

0

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪০

আরহামে’র মেজাজটা আজ একটু খারাপ হয়ে আছে। এই দুইদিন ধরে তোঁষা ভীষণ জ্বালাচ্ছে। এর কোন ধরাবাঁধা কারণ নেই। শুধু শুধু ই এটা ওটা নিয়ে জ্বালাচ্ছে। রাতে ঘুমে ঢলবে অথচ ঘুমাবে না। ওর চোখে ঘুম নেই মানে আরহামে’র চোখেও ঘুম নেই। ঘুমহীনা চোখে মুখে আরহামের শরীর ম্যাচম্যাচ করছে। এরমধ্যে তোঁষার আজগুবি কিছু বায়না ওকে আরো জ্বালিয়ে তুলছে।

— প্রাণ?

তোঁষার ডাকে আরহাম তাকালো। গায়ে ভেজা টিশার্ট টা লেপ্টে। গরমে কিচেনে তোঁষার ফরমায়েশ করা মাটন রান্না করতেই এই দশা। এর সাথে খাবে ছিদরুটি। আরহামে’র হাত এই রুটি বানাতে ভীষণ কাঁচা। পরপর রেসিপি দেখলেও সে বানাতে পারলো না। হচ্ছে ই না। শেষ মেষ না পেরে রুটিই বানালো। তোঁষার ফ্যাট খাওয়া নিষিদ্ধ অথচ মেয়েটা এখন ভাজাপোড়া খাচ্ছে ঠেসেঠুসে। সাথে দুই একটা আরহামে’র মুখেও ঠেসে দিবে। আজ সকালে ও বায়না ধরেছিলো আলু পরটা খাবে। ঘুমে ঢুলুঢুলু আরহাম ভাবলো কয়টা ই বা খাবে? দুটো বানাতে বানাতেই চুলা থেকেই শেষ করে দিলো তোঁষা। এতেও পেট ভরে নি তার। আরহাম কতো বললো একটু ফল খেতে। কে শুনে কার কথা? অন্য রুমে গিয়ে বালিশে মুখ গুজে বসে ছিলো তোঁষা। না পেরে আরো দুটো বানিয়ে তোঁষার সামনে দিতেই তোঁষা হাসি হাসি মুখে খেয়ে নিলো।
সারাটা দিন জ্বালিয়ে মে’রে এখন ডাকা হচ্ছে। আরহাম গায়ের ভেজা শার্ট’টা খুলে ওয়াশরুমে ছুঁড়ে দিয়ে বললো,

— গোসল করবি আয়।

— ডাকলাম না?

তপ্ত শ্বাস ফেলে আরহাম এগিয়ে এলো। তোঁষার চুলের বেণী খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করলো,

— কি?

— আমাকে ভালোবাসো না তুুমি।

— সত্যি ই তো।

— কি সত্যি?

— যেটা তুই বললি?

— তাহলে কাকে ভালেবাসো? তোমার বাবু’কে?

— বাসিই তো।

নাকের পাটা সহসা ফুলে উঠলো তোঁষা’র। চোখ দুটো গরম করে তাকিয়ে বললো,

— তাহলে তোমার বাচ্চা তোমার পেটে নাও।

— এখন তো নেয়া যাবে না। কিছুদিন পরই আমি নিব।

— আবার আমাকে ব্যাথা দিক তোমার বাবু তখন আমি ও ওকে ব্যাথা দিব।

আরহাম তোয়াক্কা করলো না। তোঁষা’কে ধরে নিলো গোসল করাতে। ভিজতে ভিজতে মাত্র করা রাগটা ভুলে বসলো তোঁষা। এখন প্রচুর উৎফুল্ল মননে পানি দিয়ে আরহামকে ভেজাচ্ছে সে। গোসল করতে করতে তোঁষা’র মন একদম চাঙ্গা হয়ে গেলো।
নিজের ভেজা চুলের পানি আরহামে’র মুখে ঝেড়ে দিয়ে বললো,

— আজ ও কি আসবে ঐ আপুটা?

— না।

— কেন?

— গতকাল ই তো এলো।

— আজও আসবে।

— আচ্ছা দেখা যাবে। এদিক আয়।

তোঁষা এলো না। ভেজা পায়ে বারান্দায় হাটা দিতে গিয়েই পা পিছলে পরতে নিলো৷ আরহাম ভয় পেয়ে দৌড়ে এসে টেনে কোনমতে দেয়ালে ভর দিয়ে দাঁড়ালো। বুকটা ফুলে উঠছে ওর। শব্দ করছে ধুকপুক করে। মাত্র ই তুঁষটা পড়ে যেতো তখন কি হতো? কথাটা ভাবতেই আরহামে’র বুকের উঠানামা বৃদ্ধি পেলো। তোঁষার এসবে হেলদুল নেই। ও আরহামে’র বুকের লোমগুলোতে নিজের গাল ঘষে আদর দিচ্ছে।
এই মুহুর্তে রাগ হলো আরহামে’র। চাইলো ধমকে দিতে। কিন্তু করলো না। নিয়ন্ত্রণ করলো নিজেকে।
তোঁষা’কে ধরে আস্তে করে বসিয়ে নিজে বসলো ওর পাশে।
তোঁষা পা নাচাতে নাচাতে বললো,

— খাব না এখন?

দীর্ঘ শ্বাস ফেলে আরহাম বললো,

— কথা শুন আমার প্রাণ।

— বলো।

— আর কখনো এভাবে দৌড়াদৌড়ি করবি না। তোর পেটে একটা বাবু আছে তুঁষ। ছোট্ট একটা প্রাণ৷ তুই দৌড়ে যদি এখন পরে যেতি তখন তোর সাথে এই ছোট্ট প্রাণটা ও তো ব্যাথা পেতো। বল পেতো না?

তোঁষা মাথা নাড়লো। আরহাম পেটে হাত বুলিয়ে দিলো। দীর্ঘ শ্বাস ছাড়া কিছুই করার নেই। তোঁষা ভুলে যাবে এই কথা। উঠে খাবার নিয়ে এসে যেই না রুমে ঢুকবে ওমনিই শুনতে পেলো তোঁষা বেশ জোরে জোরে ধমকাচ্ছে কাউকে। ভ্রু কুচকে রুমে ঢুকা মাত্র আরহাম হেসে ফেললো। পেট থেকে কাপড় সরিয়ে আঙুল তুলে রিতীমত শাসাচ্ছে তোঁষা। বাবু ওকে কিক মে’রেছে। কেন মা’রলো? এটাই অভিযোগ। তোঁষা কি করেছে? এখন যদি তোঁষা মা’রে তখন কি হবে?
এসব বলে বলে তোঁষা ধমকাচ্ছে৷ শেষে শুধু বললো,

— এখন মাফ করলাম। আর মা’রবি না তাহলে আমিও মা’রব।

কথাটা বলা মাত্র আবারও জোরে নিজের অস্তিত্বের জানান দিলো। আরহাম কিছু বুঝে উঠার আগেই তোঁষা হাত মুঠ করে পেটে এক আঘাত করলো। আঘাত করা মাত্র নিজেই ব্যাথায় কেঁদে উঠলো। পরপর আরেকবার আঘাত করার আগেই আরহাম দৌড়ে এসে তোঁষার গালে পরপর দুটো চড় বসিয়ে দিলো। আচমকা এমন হওয়াতে দুইজনই অবাক। বাকরুদ্ধ। তোঁষা ভীতু ভীতু চোখে তাকালো আর আরহাম তাকালো অনুতপ্তের চোখে। তোঁষা’র পেটে এক হাত বুলিয়ে দিয়ে আরেকহাত রাখলো ওর গালে। এমন না সে জোরে চড় মে’রেছে কিন্তু তোঁষার অভিমান জমা হলো। জমে একদম টাইটুম্বুর হলো তার চোখ। কথা বললো না তোঁষা। আরহাম কতবার সরি বললো লাভ হলো না। অভিমানীর অভিমান ভাঙানোর কাজটা মোটেও সহজ হলো না৷
.
বিকেল নাগাদ তথ্য আর তুষার হাজির হলো আরহামে’র ফ্ল্যাটে। তোঁষা তখন আরহামে’র বুকে ঘুম। তুষারের হাতে আরহাম একস্ট্রা চাবি দিয়ে রাখাতে ওদের ঢুকতে সমস্যা হলো না। তথ্য এসেই সোফায় গা এলিয়ে দিলো। বাইরে প্রচুর গরম। তুষার ফ্রিজ হাতালেও ঠান্ডা পানি পেলো না৷ আরহাম রাখে না৷ তোঁষা’র খাওয়া নিষেধ এমন কিছুই আরহাম খায় না৷
তুষার বরফের কয়েক টুকরো নিয়ে তা গ্লাসে পানি নিয়ে তাতে দিয়ে তথ্য’র জন্য আনলো। তথ্য মুচকি হেসে পুরোটা পানি শেষ করলো। এরপর উঠে হাটা দিলো কিচেনে। তুষার মানা করলো না৷ করেও লাভ নেই। তথ্য শুনবে না। এসেই ও রান্না করে এখানে। আরহাম তোঁষা’র কাহিনী শুনামাত্র তথ্য’র মনে আরহামে’র প্রতি সম্মান ভালোবাসা জন্ম নিয়েছে। ভাই বোন না থাকায় তাকে বসিয়েছে ভাইয়ের আসনে।
তুষার ও সাহায্য করলো তথ্য’কে। ওদের রান্না প্রায় শেষ তখন কিচেনে এলো আরহাম৷ এসেই তুষারকে জড়িয়ে ধরে বললো,

— কেমন আছো ভাই?

— ভালো। একটা খুশির খবর আছে?

— তুমি বাবা হচ্ছো এর থেকেও খুশির?

তুষার হাসলো। জানালো,

— আদনানে’র বিয়ে ঠিক হয়েছে।

— বাহ৷ ভালো তো।

— যাবি না?

— না ভাই। তুঁষের সমস্যা হবে।

— আমরা আছি তো।

— আচ্ছা দেখা যাবে।

ঘুম থেকে উঠে তোঁষা তথ্য’কে দেখে খুশি হলো। তথ্য’কে আপু বলে ডাকে ও। তথ্য ও নিজের বোনের মতো আদর করাতে তোঁষা’র হয়তো তথ্য’র প্রতি টানটা বেশি।
রাত প্রায় আটটার দিকে ওরা বেরিয়ে গেলো। তুষারের বাহুতে মাথা এলিয়ে তথ্য ঢাকা শহরের ব্যাস্ত রাস্তা দেখে যাচ্ছে। তুষারের শক্ত হাতের মুঠোয় ওর হাতটা। তুষার সামনের দিকে তাকিয়ে বললো,

— কিছু খাবে?

— খাব তো।

— কি খাবে?

তথ্য ঠোঁট কামড়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,

— আপনাকে।

তুষার চোখ পাকিয়ে তাকালো। চোখের ইশারায় বুঝালো সামনে রিক্সাওয়ালা। তথ্য সেই দৃষ্টি দেখেও হেসে ফেললো। তুষার আর কথা বাড়ালো না। আজকাল তথ্য’টা বেহায়া হয়ে যাচ্ছে। কেমন বেহায়া বেহায়া চোখ করে তাকিয়ে থাকে।

________________

তোঁষা হেলান দিয়ে খাটে শুয়ে ছিলো। পাশে আরহাম। হঠাৎ তোঁষা মুখ চোখ খিচিয়ে নিলো। প্রথমে আরহাম খেয়াল না করলেও পরে দেখলো যখন তোঁষা শুয়ে পরলো অথচ মুখে শব্দ করলো না। আস্তে ধীরে খিঁচুনি বাড়লো। আরহাম ব্যাস্ত হলো। ভয় পেলো। তোঁষার গালে হাত দিয়ে ঝাকিয়ে ডাকলো,

— তুঁষ? এই তুঁষ? ব্যাথা হচ্ছে?

আরহাম খেয়াল করলো ওর পেটে। কাপড়টা উঠাতেই খেয়াল করলো পেটে’র চামড়ায় স্পষ্ট পায়ের ছাপ। বাবুটা আজ বেশ ছটফট করছে। এই ব্যাথায় ছটফট করছে তোঁষা অথচ কাঁদছে না। আরহাম তোঁষার পেটে হাত বুলাতে বুলাতে বারকয়েক ডাকলো। তোঁষা উত্তর না দিয়ে খিঁচে রাখলো নিজের নাক, মুখ। আরহাম তখন ভয় পেয়ে গেলো,

— এই তুঁষ কাঁদ। কাঁদ না। কিছু বলব না আমি। সত্যি বলছি। কাঁদ তুই।

তোঁষা কাঁদলো না। তার জমাট হওয়া অভিমান ভুলে নি সে। আরহাম খেয়াল করলো বাচ্চাটা আজ বেশি পা ছুড়াছুড়িঁ করছে। এত এত আঘাত পেয়ে হঠাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেললো তোঁষা। আরহাম এতে যেন আরো বেশি ভয় পেয়ে গেলো। ভোঁতা অনুভূতি হলো ওর। তোঁষা আজ এত মাস পর কোন বিষয় মনে রাখতে পেরেছে এতে খুশি হবে নাকি এই দশায় কষ্ট পাবে তা ভেবে পেলো না ও।

#চলবে…..

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪১

হসপিটালে আরহাম তোঁষা’কে নিয়ে এসেছিলো মান্থলি চেকআপে’র জন্য কিন্তু এখানেই তোঁষা’র কিছুটা পেইন উঠে গেলো। ডক্টর জানিয়ে দিলো বেবি আজরাতেই ডেলিভারি করা হবে। আরহামে’র যেন মাথা ঘুরে উঠলো। আট মাস পঁচিশ দিনে যেই ভয় আরহাম পেলো না সেই ভয় ও পাচ্ছে এখন। কাঁধে কারো হাত টের পেতে মাথা তুললো আরহাম। এতক্ষণ মুখ দুই হাতে ঢেকে বসে ছিলো। ডক্টর আদিত্য তুষার’কে জানাতেই তথ্য আর তুষার হাজির এখানে। ওদের আসার পর পর ই শেখ বাড়ীর সকলে একে একে উপস্থিত হলো। তোঁষার মা আরহামে’র সামনে আসতে মাথা নিচু করে রাখলো আরহাম। কেন জানি চাচি’র সাথে চোখ মিলাতে পারে না। দোষ কার এটা বলা যায় না। পরিস্থিতি’র কবলে পরে সবাই দোষী আবার বলা যায় সবাই সময় আর হাল অনুযায়ী আচরণ করেছে। কেউ তাহলে দোষী না।
তোঁষা’র মা ধীরে ধীরে আরহামে’র বুকে মাথা রেখে ওকে জড়িয়ে ধরলো। ওনার নীরব কান্নায় আরহামে’র ভেতর দুমড়ে মুচড়ে গেলো। শান্ত ভাবে চাচি’কে জড়িয়ে ধরলো ও কিন্তু কথা বলতে পারলো না। হাজার চেষ্টা করে ও না।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল। আরহাম তোঁষা’র মাথায় সুন্দর করে হাত চালিয়ে আদর করে দিচ্ছে। তোঁষা তখনও অল্প স্বরে কাঁদছে। পাশেই তথ্য নানা কথা বলে বুঝাচ্ছে তোঁষা’কে। ও শুনছে বলে মনে হলো না। বারবার আরহামে’র হাতটা খামচে ধরে রাখছে। ঢোক গিলে গিলে বারবার যেন ব্যাথা কমানোর চেষ্টা করলো। একটু পরই তোঁষা’কে নিয়ে যাওয়া হবে। তুষার এসে তথ্য’কে পাশের সোফায় বসালো। হাতের প্যাকেট খুলে কাটা ফল আর কিছু শুকনো বাদাম ওর হাতে দিয়ে বললো,

— ফিনিস করো।

বলেই উঠে আরহামে’র পাশে বসলো। ও জানে আরহাম’কে বললেও এখন খাবে না তাই নিজেই পর মুখের সামনে খাবার তুলে দিয়ে বললো,

— কোন কথা শুনতে চাইছি না আপাতত।

আরহাম মাথা নামিয়ে মুখ খুলে খেয়ে নিলো। কোন এক সময়ে গর্জন করা আরহামে’র এহেন ভেজারুপ আচরণ সত্যি ই বিরল। কে জানতো পরিস্থিতি তাদের এহেন কাঠগোড়ায় দাঁড় করাবে?

সন্ধ্যার পর তোঁষাকে ওটিতে নেয়া হলে বাঁধলো বিপত্তি। আরহাম ছাড়া ও এখানে থাকবে না। এমন ভাবে নড়াচড়া শুরু করলো যে বাচ্চা’র অবস্থান উল্টে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলো। অগত্যা আরহামকে’ও বিশেষ পোশাক পরিয়ে ভেতরে নেয়া হলো। এক পাশে বসে তোঁষার হাতটা শক্ত করে ধরলো ও। তোঁষা’র যখন এনেস্থিসিয়া’র প্রভাবে নিভু নিভু চোখ তখনও সে মৃদুস্বরে বলে গেলো,

— প্রাণ যেও না আর। আমি ভয় পাই৷ কাছে থাকো। হাত ছেড়ো না। তোমার বাবু আজ ও ব্যাথা দিচ্ছে কিন্তু থামছে না। ও অনেক পঁচা একটা বাবু প্রাণ। আমি ওকে কখনো আদর করব না। পঁচা বাবু

আরহামে’র লাল হওয়া চোখ জোড়া দিয়ে তখন অনবরত পানি পরছে। ওর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে করা কান্না’র দরুন বারবার ভাঙাচুরা দেহটা কেঁপে উঠছে।

বাইরে সকলে উত্তেজিত হয়ে বসে আছে। তোঁষার মা আর চাচি দুইজন কেঁদে অস্থির। তথ্য তাদের সামাল দিচ্ছে। তুরাগ শেখ ও এক জায়গায় মাথা নিচু করে বসা। তথ্য’র চোখটা ওটির দরজায়। বলিষ্ঠ এক সাবেক আর্মি ম্যান দাঁড়িয়ে সেখানে। নিজেকে যতটাই শক্ত দেখাক না কেন তথ্য জানে তুষার ভেতরে ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে আছে। বোন’কে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসা দেয়া তুষার নিশ্চিত এই মুহুর্তে শান্ত নেই।
.
দীর্ঘ এক ঘন্টা পঁচিশ মিনিট বাইশ সেকেন্ড পর পৃথিবীর বুকে ছোট্ট এক প্রাণ পদার্পণ করলো। নিজের হাজিরি জাহির করতে সে কেঁদে উঠলো শব্দ করে। বাবা’র চোখে মুখের আতঙ্ক ভাবটা ঘুচিয়ে হাসি ফুটালো সেই প্রাণ। আশ্চর্য হয়ে আরহাম তাকিয়ে রইলো সেই ছোট্ট একটা প্রাণের দিকে। সবার আগে তার হাতেই তুলে দেয়া হলো। ভীতু চোখে তাকিয়ে হাসি মুখে হাত বাড়িয়ে ছোট্ট প্রাণ’কে কোলে তুলে নিলো আরহাম। ছোট্ট প্রানটা বুঝি বুঝলো বাবা’র অস্তিত্ব। একদম চুপ করে রইলো সে। আরহাম অপলক তাকিয়ে রইলো সেদিকে। লাল ঠোঁট, গোল গোল চোখ, ঘন পাঁপড়ি’তে ঘেরা এক ফুটফুটে নরম বদনে’র প্রাণ। এ কিনা ছিলো আরহামে’র তুঁষে’র পেটে? ভাবা যায়? আরহাম তো ভাবতে পারে না৷ কিছুতেই না। পাগল পাগল লাগে নিজেকে।
অশ্রু চোখে আরহাম চুমু খেলো তার অস্তিত্ব’কে। ছোট্ট প্রাণটা বুঝি হাসলো। হামি তুলে একটা হাত মুখে পুরে দিলো।

নার্স এসে ওকে নিতে নিলেই আরহাম বাঁধ সাধলো। ও দিবে না। মন ভরে নি দেখে দেখে। এই রুপের সাগরে ডুবে থাকা রত্ন আজ উঠে এসেছে। একে দেখলেই কি মন ভরে নাকি?
নার্স বুঝানোর পর আরহাম ছাড়লো। তাকালো ওর তুঁষে’র দিকে। এখন ঘুম ওর তুঁষ। এগিয়ে এসে সকলের সম্মুখেই আরহাম তোঁষা’র ঠোঁটে চুমু খেয়ে কানে ফিসফিস করে বললো,

— এই ছোট্ট প্রাণ তোর ছোট্ট পেটে কিভাবে ছিলো প্রাণ? একদম তোর মতো নরম। তারাতাড়ি উঠে যা তুঁষ। আমরা ওকে একসাথে দেখব আবার। পালব। ভালোবাসব। তুই, আমি আর ছোট্ট একটা প্রাণ।

তোঁষা’কে নিয়ে যাওয়া হলো কেবিনে শিফট করতে। বাইরে থাকা শেখ বাড়ীর সকলে উল্লাসে মেতে উঠলো। তোঁষা’র ছেলে হয়েছে শুনেই সকলে খুশি। তুষার ও খুশি তবে সে খুব করে চাইছিলো আরহামে’র একটা মেয়ে হোক। বাবা’রা মেয়েদের অনেক নিকটের হয়। হয়তো আরহাম তাহলে বুঝতো নিজের করা ভুলগুলো। যদিও ভুল বুঝার বা স্বীকার করার মতো আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।

________________

শেখ বাড়ীতে দুই দিন থেকে আরহাম বউ, বাচ্চা সহ নিজের ফ্লাটে ফেরত এলো। কারণ একমাত্র তোঁষা। কিছুতেই ওখানে থাকবে না। ওর ভালো লাগে না। অগত্যা তথ্য সহ তুষার ও এখানে এলো। আরহাম না করেছে বারকয়েক। তথ্য নিজেও প্রেগন্যান্ট। এই অবস্থায় তোঁষা সহ আবার বাচ্চা সালাম দেয়া ও ঝামেলা একা আরহামে’র হাতে।
এরমধ্যে মহাঝামেলা হচ্ছে তোঁষা’র মুড সুইং। প্রেগন্যান্সি চলাকালীন এই মেয়ের এত মুড সুইং হয় নি যা পোস্ট প্রেগন্যান্সিতে হচ্ছে। আরহাম তাই না পেরে রাজি হয়েছে। তথ্য’কে অবশ্য রান্নাঘরে যাওয়া থেকে নিষেধ করা হয়েছে। এই দিক সালাম দিতে আরহাম ই যথেষ্ট। এর মধ্যে আদনান হুটহাট করে হাজির হয় বাসার খাবার নিয়ে। নিয়ম করে দুপুর রাত শেখ বাড়ী থেকেই খাবার পাঠানো হচ্ছে। এদের না করলেও উপায় নেই।
আগামী মাসেই আদনানে’র বিয়ে। আরহাম তোঁষা’র ছোট্ট প্রাণটার এখন ছয়মাস বয়স।
এতে সকলেই খুশি। খালি শেখ বাড়ীর আঙিনায় এবার ফুলের সমাহার দেখা দিলো দিলো ভাব। তোঁষা’টা ফিরার অপেক্ষায় দিন প্রহর গুনছে সকলে। এক সাথে বাড়ীর দুটো ফুল বাড়ী ছাড়া এই শোক কি আদৌ ভুলা যায়?

নিশুতি রাতে কান্নার শব্দে তোঁষা’র ঘুম ভেঙে গেলো। আরহাম ছোট্ট প্রাণ’কে নিয়ে এদিক ওদিক পায়চারি করে যাচ্ছে। কিছুতেই থামছে না ও। তোঁষা বিরক্ত হয়ে গলা উঁচিয়ে দিলো এক ধমক। বাচ্চাটা সাথে সাথে থেমে গেলো। আরহাম নিজেও চমকে গেলো। বুকে থাকা প্রাণ’টাকে আরেকটু বুকে চেপে ধরে তোঁষা’র দিকে তাকাতেই দেখলো রাগে ফুঁসছে ও। আরহাম কিছু বলার আগেই বললো,

— ওকে ওর মায়ের কাছে দিয়ে এসো।

— কে ওর মা?

তোঁষা ভাবলো। আসলেই কে ওর মা? সবাই বলে তোঁষা ওর মা। কথাটা মনে পরতেই মন খারাপ হয়ে গেল ওর। এই বাবু’র জন্য আরহাম ওকে ততটা ভালোবাসে না। রাতে তো তোঁষা বুকে ঘুমায় অথচ এখন থাকে এই বাবুটা।
আরহাম তোঁষা’র দিকে তাকিয়ে অসহায় চোখে। সব ঠিক থাকলেও তোঁষা রেগে যায় খাওয়াতে গেলে। কিছুতেই খাওয়াবে না। এখনও ফিডার খেতে চাইছে না ছোট্ট প্রাণ’টা। এতটুকুন বাচ্চাকে এমনিতেও ফিডার দেয়া উচিত না৷ না পেরে আরহাম ফিডার দিয়েছে।

হঠাৎ যেমন তোঁষা’র ঘুম ভেঙেছিলো তেমন ই হঠাৎ ই আবার ঘুমিয়ে গেলো। মানে এতক্ষণ ঘুমেই ছিলো। দীর্ঘ শ্বাস ছাড়লো আরহাম। তাকালো বুকে থাকা প্রাণটার দিকে। সে তার ঠোঁট কাঁপিয়ে টলমল চোখে তাকিয়ে বাবা’র দিকে। বুক কামড়ে উঠে আরহামে’র। ছেলের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলে,

— আর কাঁদে না বাবা’র প্রাণ। মা উঠলে বকবে না আমার প্রাণ’কে। আমার বাবা খাবে এখন। এখনই মা খাওয়াবে। কাঁদবি না কিন্তু।

বাবুটাও চোরা চোখে বাবা’কে দেখলো। কাঁদলো না ও। হয়তো ও জানে মা জেগে গেলে খেতে দিবে না৷ তাই চুপচাপ বাবা’র কথা মেনে নিলো।
আরহাম অতি সন্তপর্ণে ছেলেকে তোঁষা’র কাছে নিয়ে খাওয়ালো। ঘুমন্ত তোঁষা টের পেলো না। টের পেলে নিশ্চিত রেগে যেতো। ভাবতেই হাসলো আরহাম।

#চলবে……

প্রিয় প্রাণ পর্ব-৩৮+৩৯

0

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৩৮

একই সাথে দুটো বড় বড় খবর এবার যেন আরহামে’র সত্তা পর্যন্ত নাড়িয়ে দিলো। তোঁষা’র দিকে তাকানোর মুখটা পর্যন্ত ওর নেই। শেখ বাড়ীতো রীতিমতো কান্নার রোল পরে গেলো। তোঁষাকে নিয়ে আরহাম সোজা ওর ফ্লাটে চলে এসেছে তখন। পিছুপিছু তুষার ও এলো। তবে তোঁষার সামনে যায় নি। রুমের থেকে প্রায় ঘন্টা খানিক পর বেরুলো আরহাম। তুষার ড্রয়িং রুমে মাথা নিচু করে বসে আছে। আরহাম এগিয়ে এসে ধপ করে তুষারের পাশে বসে পরলো। মাথা নিচু করে বললো,

— আমি আমার ওয়াদা রাখতে পারলাম না ভাই। তুঁষ’কে ঐ অবস্থায়….

তুষার সহসা থামিয়ে দিলো আরহাম’কে। নিজের হাতের রিপোর্টগুলো দিলো আরহামে’র হাতে। ভ্রু কুঁচকে তা হাতে নিলো আরহাম। পাতা গুলো উল্টে হঠাৎ চোখ আটকে গেলো “পজেটিফ” লিখা জায়গাটায়। শূন্য চোখে মাথা তুলে তাকালো তুষারের দিকে অতঃপর আবার সেই লিখাটার দিকে। তুষার আরহামে’র পিঠে হাত রাখতেই চমকে উঠলো ও। চোখে ওকে তুষার চাইলো ভরসা দিতে কিন্তু পারলো না। উঠে দৌড়ে রুমে চলে গেলো এদিকে আরেকটা রিপোর্ট পরে রইলো ফ্লোরে। এক ধ্যানে ঐ রিপোর্টটার দিকে তাকিয়ে রইলো তুষার। তোঁষাকে বাঁচানোর চেষ্টায় ব্যার্থ এক ভাই ঠাই বসে রইলো। নড়লো না। শক্তি পেলো না।

আরহাম তোঁষা’র উপর এক প্রাকার ঝাপিয়ে পরলো। সারা মুখে চুমু খেতে খেতে আবেগী গলায় ডাকলো,

— এই প্রাণ? আমার প্রাণের টুকরো। আমার তুঁষ। জানিস কি হলো? আমি আবার বাবা হব। উঠ। আর কত ঘুমাবি? এই তুঁষ? উঠ না।

ঢুলুমুলু তোঁষা নড়েচড়ে শুয়ে পরলো আবার। আরহাম ওর পেটটা উন্মুক্ত করে নজর দিলো সেখানে। উঁচু হওয়া একটা থলথলে পেট। তুঁষটা অনেকটাই গুলুমুলু হয়েছে আগের থেকে। আগে যতটা ছিলো তার থেকেও অনেকটা বেশি মোটা হয়েছে। তাই বোধহয় বুঝা যায় নি। আরহাম নাক, মুখ ডুবিয়ে দিলো তলপেটে। একে একে দিতে শুরু করলো ওর ভালোবাসা। বুনে ফেললো এক ঝুড়ি স্বপ্ন। ভুলে গেলো বাস্তবতা।
আদৌ তার বুনন কতটা ভুল। তার তুঁষ কি স্বাভাবিক যে স্বপ্নগুলো স্বাভাবিক হবে?
.
আরহামে’র সেই স্বপ্ন স্বপ্ন ই রয়ে গেলো বোঁধহয়। ডক্টর সোজা বলে দিলো তোঁষার বর্তমান শরীর বেবি ক্যারী করার ক্ষমতা রাখে না। এটা আরহাম জানে। তাই তো পাগল হয়ে ছুটে এসেছে তোঁষাকে নিয়ে। নিজের সবটুকু বিসর্জন দিয়ে আরহাম বলে উঠলো,

— এবোর্শন। এবোর্শন করব আমরা। ও..ওকে আজই এবোর্শন করুন। আমার শুধু তুঁষ’কে চাই আর কিছু না।

ডক্টর আদিত্য’র মায়া হলো খুব। আরহামের আগাগোড়া তার জানা। কোন এক সময় কাছের বন্ধু ছিলো তারা। আজ আরহামকে দেখলেই তার দীর্ঘশ্বাস বেরুয়। চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে আরহামে’র পাশে বসলো ডক্টর আদিত্য। ওর হাতে হাত রেখে বললো,

— এবোর্শন সম্ভব না আরহাম। তুই নিজেও ডক্টর। বুঝিস এসব। চার মাসের বেবিটাকে কিভাবে মা’রব? আর তোঁষার বডি এখন এসব নিতে পারবে না। এটা সম্ভব না।

আরহাম অসহায় চোখে তাকালো। তুষারের দিকে তাকিয়ে শুধু বললো,

— ভাই আমার পাপ কি এতই বেশি? এর প্রায়শ্চিত্ত আমি আর কতদিন করব?

তুষার কথা বললো না। ডক্টর আদিত্য আরহামে’র কাঁধে হাত দিয়ে বললো,

— ওর চিকিৎসা চালিয়ে যা। দেখ কি হয় সামনে। সবটা ছেড়ে দে উপর ওয়ালার কাছে। আমি দোয়া করি আরহাম। তুই সুখী হ।

আরহাম কথা বললো না। মানুষের মন ম’রে গেলে যেমন হয় আরহাম’কে তেমনই দেখালো। ছেলেটা আস্তে ধীরে হেটে তোঁষার কেবিনে চলে গেল। ঠোঁট দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে তোঁষার মাথার কাছে গিয়ে বসলো।
ইলেকট্রিক শক দেয়ার ফলে কিছুটা প্রভাব পরেছে বেবির উপর। আরহামে’র নিজেকে অসহায় লাগলো। বড্ড অসহায়। আজ তার মনে হচ্ছে সে ম’রে যাক শুধু তার তুঁষ আর ছোট্ট প্রাণটা সুখে থাকুক।

____________________

রজনীর পর রজনী একা কাটিয়ে তথ্য এখন একাকীত্ব’কে ভয় পায় না৷ ঢাকা এসেছে আজ দুই দিন। ছুটিতে আসার কোন ইচ্ছেই ছিলো না। বাবা’র জোরাজোরিতে বাধ্য হলো আসতে। খেতে বসেছে এমন সময় কলিং বেলটা বেজে উঠলো। তথ্য’র মা উঠে গিয়ে দরজা খুলতেই কেউ একজন ওনাকে সালাম দিলো। তথ্য’র হৃদপিণ্ড থেমে গেলো মুহুর্তের জন্য। কার কণ্ঠ শুনলো এটা? ভাবলো একবার হয়তো এটা ওর ভ্রম কিন্তু না। ভ্রম না এটা। ওর মা তুষারের হাতটা ধরে তুষারকে খাবারের টেবিলে বসিয়ে দিলো। তুষার ওর বাবা’কেও সালাম দিলো। তিনজন এতটাই হেসেখেলে কথা বলছে যেন তারা অতি পরিচিত। তথ্য সবে খেয়লা করলো টেবিলে জামাই আদরের খাবার সাজানো। ঢোক গিললো তথ্য। তুষারের চেহারাটা এমন কেন? এমন ভাঙা চাপা ওর তুষারের না। এই বিষন্ন মুখ ওর তুষারের না। একটা শক্তপোক্ত মানুষের হঠাৎ এহেন দশা কেন?
আজ কতটা মাস পর দেখছে তুষারকে? তুষার ওর দিকে তাকালো না। তথ্য’র মা ওকেও খেতে তাগাদা দিলো। খেয়ে দেয়ে তথ্য নিজের রুমে চলে আসলো। তুষার শশুর শাশুড়ী’কে সময় দিচ্ছে।

রাত একটা নাগাদ তুষার তথ্য’র রুমে ঢুকলো। না অনুমতি, না নক। সোজা ঢুকে জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তথ্য’কে জড়িয়ে ধরলো নিজের সাথে। কেঁপে উঠলো তথ্য। আজ কত মাস পর ছোঁয়াটা পেলো? আপন পুরুষটার আরো তীব্রকর ছোঁয়া পেতে চাইলো তথ্য। ঘুরে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে জানান দিলো নিজের আবদার।
তুষার এতমাস পর অন্তত তথ্য’র মন ভাঙতে চাইলো না। মেনে নিলো সবটুকু আবদার। দিয়ে দিলো নিজের দেহ, মনে জমিয়ে রাখা সবটুকু ভালোবাসা। সুখের সাগরে ভাসলো দুটি দেহ৷ একটি প্রাণ। দীর্ঘ থেকেও দীর্ঘ রজনী পার হলো। প্রেমময়। ভালোবাসাময় এক রজনী।
তথ্য’র জীবনের অপেক্ষা শেষ হলো। শেষ রাতে তথ্য মাথা রাখলো তুষারের উন্মুক্ত বুকে। বিরবির করে বললো,

— অপেক্ষা যদি এত সুখ বয়ে নিয়ে আসে তাহলে আমি রাজি অপেক্ষা করতে। আজ সকল অপেক্ষা সার্থক তুষার। সব সার্থক।

তুষার তথ্য’র কপালে চুমু খেলো। চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

— বেকার জামাই’কে পেয়ে নিজেকে স্বার্থক বলছো?

তথ্য আলতো কিল মা’রলো তুষারের বাহুতে।

— ভুলেও আমার জামাই’কে বেকার বলবেন না।

— অফিশিয়ালি ছেড়ে দিয়েছি।

— আমিও দিব।

— মে’রে ফেলব বোকামি করলে।

— আমি সংসার করতে চাই তুষার। আপনার ছানাপোনার মা হতে চাই। হোক না ছোট্ট একটা সংসার। শুধু সুখ থাকলেই হলো। আপনি ছোট্ট একটা কাজ করবেন আর আমি কোমড়ে শাড়ী গুজে সংসার করব।

— তোমার মতো স্বাধীনচেতা মেয়ের মুখে এসব মানায়?

— এতসব জানি না আমি। প্লিজ তুষার। আমি আপনার কাছে আর কিছুই চাইলাম না শুধু এতটুকু চাই। দিবেন না?

তুষার শব্দ করে তথ্য’ট ঠোঁটে চুমু খেলো। জানান দিলো তার সম্মতি। একে একে জানালো এতমাসের ঘটনা। তথ্য দেখা করতে চাইলো তোঁষার সাথে। তুষার ওকে জড়িয়ে ধরে বললো,

— নিব। নিব ওর কাছে।

#চলবে…

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৩৯

আকাশ জুড়ে হেসে খেলে উড়ে যাচ্ছে এক গুচ্ছ মেঘ। ধূসর নয় বরং সাদা ঘন ফুলা ফুলা মেঘরাশি দৌড়ে বেড়াচ্ছে আকাশময়। রোদের ঝলকে মানুষ কমই বের হচ্ছে। এই তীব্রতা সহ্য করার মতো নয়। আরহামে’র রুমে’র বারান্দায় প্রচুর রোদ আসার কথা থাকলেও ততটা আসছে না। মূলত আসার সুযোগ পাচ্ছে না। তোঁষা যেদিন বারান্দা থেকে লাফিয়ে পড়তে চেয়েছিলো তার কিছুদিন পরই নেট দিয়ে ঘেরাও করে দিয়েছিলো আরহাম। সারা বারান্দাময় এখন সবুজের ছড়াছড়ি। তোঁষা কখনোই গাছপালার সখ করে না। তাই তার পছন্দ অপছন্দ বলে কিছু নেই। আরহাম নিজের ইচ্ছে মতো অসংখ্য ছোট ছোট চারা লাগিয়েছে এখানে। সুন্দর সুন্দর গ্রীষ্মকালীন ফুল ফুটেছে এখানে। দুপুর হতেই তারা নেতিয়ে যায়। আবার সন্ধ্যা হতেই গোলাপি রঙের সকাল সন্ধ্যা ফুলগুলো ঘ্রাণে বারান্দা মাতিয়ে রাখে। দরজা খোলা থাকলে সেই ঘ্রাণ রুমে ও পাওয়া যায়। তোঁষার আবার এটা পছন্দ অথচ এই গাছ আরহাম কিনে আনে নি। কোন চারার সাথে হয়তো এসেছে। বলে না আসল থেকে মানুষ সুদ বেশি ভালোবাসে এখানেও তেমনটাই। তোঁষার ভালোলাগে এই সন্ধ্যা মালতি ফুল। নাক ডুবিয়ে সে ঘ্রাণ শুকে সে।

সন্ধ্যা নামবে নামবে বলে। এখনও আকাশে লালিমার দেখা মিললো না। বিকেলের দিকে রোদটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাওয়া ধরে। তোঁষা’র কথা রাখতে আরহাম বারান্দায় নিয়ে এসে ফ্লোরে করা আর্টিফিশিয়াল ঘাসের উপর অতি সাবধানে বসিয়ে দিলো ওকে। পিছনে দুইটা কুশন দিয়ে বললো,

— ঠিক আছে?

— হু।

তোঁষা হু বললেও আরহাম পুণরায় চেক করলো। নিজে আবার একটা কুশন তোঁষার পিঠে দিয়ে একটা দিলো ওর মেলে রাখা পায়ের নিচে। তোঁষা মিষ্টি করে হাসলো। ওর এই গোল মুখটাতে চাঁদমুখো হাসির ফালি ঝরাঝরা সুখের ছিটে দিলো আরহামে’র বক্ষপিঞ্জরে। ঠিক যেন তপতপে দুপুরে এক ফালি ভেজা মেঘের বর্ষণ। লোভাতুর আরহাম লোভ সামলাতে ব্যার্থ। এগিয়ে এসে তোঁষা’র গালে চুমু খেলো সময় নিয়ে। গাল গাল লাগিয়ে ঘষা দিতেই তোঁষা “উফ” শব্দ করলো। আরহাম সরে এসে হাত রাখলো তোঁষার সাতমাসের পেটে। আদুরে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,

— ব্যাথা লাগছে এখানে?

— উহু। গালে।

বলেই নিজের গালে হাত ঘষলো তোঁষা। আরহাম বোকা বোকা চোখে তাকালো ওর তুঁষে’র দিকে। নিজের অল্প বড় হওয়া দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললো,

— দাড়ি বড় রাখব ভাবলাম৷ আর কাটব না। সুন্দর লাগবে না? কি বলিস প্রাণ?

— তুমি তো সুন্দর ই।

আরহাম হাসলো। তোঁষার কাছে ঝুঁকে আবারও শুনতে চাইলো সে আসলেই সুন্দর কি না। তোঁষা আরহামে’র গালে হাত রেখে বললো,

— এই যে তুমি সুন্দর। অনেক সুন্দর। আমার প্রাণ, অনেক সুন্দর তুমি।

আরহামে’র ভালো লাগে ওর প্রাণের করা প্রশংসা। আরহাম নিজেও জানে সে এখন পূর্বের ন্যায় সুন্দর নয়। পেটানো শরীরটা আগের মতো নেই। চোখদুটো গর্তে ঢুকে কেমন কালো দেখায়। নির্ঘুম রাত্রী তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায় কিন্তু আফসোস নেই এ নিয়ে। তোঁষাটার চোখে সুন্দর থাকলেই তো হলো।
আরহাম উঠতে উঠতে বললো,

— একটুও নড়বি না। আমি আসছি এখনই।

তোঁষা মাথা নাড়লো। আরহাম এলো মিনিট পাঁচ পর। তোঁষাকে এখন খাওয়াতে হবে। এই সময় ক্ষুধা লাগে ওর। আরহাম এসে খাবার রেখে তোঁষার দিকে তাকাতেই আঁতকে উঠল। দ্রততার সাথে ওর গালে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— ক…কি হয়েছে? তুঁষ তাকা। বল কি হলো? কেন কাঁদিস? বাবু কিক করেছে? কথা বল। প্রাণ।

তোঁষা চোখের ইশারায় নিজের পা দেখালো। বুড়ো আঙুলে একটা বড় জাতের পিঁপড়ে। কামড়ে ধরে র’ক্ত বের করে ফেলেছে। মূলত এটা পিঁপড়া না। ভিন্ন জাতের কিছু৷ নিশ্চিত কোন গাছে ছিলো। আরহাম হাত দিয়ে ফেলে চেপে ধরে সে আঙুল। ব্যাথায় মুখ কুঁচকে রইলো তোঁষা। পানি দিলেও জ্বলা কমলো না। উঠে গিয়ে তারাতাড়ি একটু পেয়াজ কেটে সেখানে ডললো আরহাম। মুখে দুই একবার “জ্বলে জ্বলে” বলে চুপসে গেলো তোঁষা। আরহাম শান্ত হলো। তোঁষার ভেজা গাল মুছে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো,

— পায়ে ছিলো ফেলিস নি কেন?

— তুমি না বললে, নড়বি না এখান থেকে?

কথাটা বলে নাক টানে তোঁষা। আরহাম কিছু বললো না। তোঁষা’র রিকোভারি হচ্ছে। বলা যায় অনেক দ্রুত ই হচ্ছে কিন্তু এখনও পুরোপুরি সুস্থ হতে পারে নি। সবটা বুঝে উঠতে এখনও সময় লাগে মেয়েটার। মাঝেমধ্যে ঠিক আগের মতো জেদ ধরে। সব কথা মনে রাখতে না পারলেও কিছু কিছু বিষয়ে যখন জেদ ধরে, রেগে যায় তখন বুকে প্রশান্তি পায় আরহাম। ওর মা বাদে সবার সাথে ই টুকটাক কথা বলে। শুধু রাগী দৃষ্টিতে দেখে মা’কে যেন কোন একটা চাপা রাগ কাজ করছে ওর মাঝে। হাজার কাঁদে ওর মা তোঁষা মানে না৷ জানা নেই কারো এর কারণ।
শেখ বাড়ীতে নিতে চাইলে আরহাম মানা করে নি কিন্তু তোঁষা এখান ছাড়া রাতে থাকে না। কেঁদে অস্থির হয়ে উঠে ঠিক যেমন বিয়ের আগে সাফোকেশন হতো তা এখনও হয় কিন্তু জায়গা ভেদে।
এতে অবশ্য সবাই খুশি। প্রেগ্ন্যাসির কারণে জটিলতা যতটা হওয়ার কথা ততটা হচ্ছে না। মাঝে মধ্যে বাবুর কিক খেয়ে তোঁষা ভ্যাঁ ভ্যাঁ কাঁদলেও পরে ভুলে যায়। আরহাম তাকে সাহায্য করছে। আমৃত্যু করবে।

তোঁষার মুখে শেষ খাবারটুকু দিয়ে আরহাম উঠতে নিলে তোঁষা ওর হাত টেনে ধরে বললো,

— তুমি খাবে না?

— দুপুরে খেলাম না?

— তাহলে আমি কেন খেলাম?

— তোর ভেতরে যে বাবু?

— আমার ভেতরে?

— হু।

— কিভাবে গেলো?

আরহাম এই দফায় ফিক করে হেসে ফেললো। ওর হাসিতে তোঁষা ও হাসলো তবে কারণ ছাড়া। তার হাসতে কারণ লাগে না। আরহাম নামক প্রাণটা হাসলেই তোঁষা হাসতে পারে।

_______________

তথ্য’র চাওয়া সেই ছোট্ট সুখের সংসারটা গুছাতে বড্ড ব্যাস্ত ও। রিজাইন নিয়ে এই পর্যন্ত কয় দফা যে ঝগরা হলো হিসেব নেই। তুষার কিছুতেই রাজি নয় আর এদিকে তথ্য রাজি না কাজ করতে। যদি তুষারও থাকতো তাহলে নাহয় তথ্য কোয়াটারে থাকতো। সংসার করত। কিন্তু এখন এই মেয়ে কিছুর বিনিময়ে ই রাজি না। ওর এই নাদানিপনাতেে ওর মা-বাবা ওকে ফুল সাপোর্ট দিচ্ছে এটা দেখে রীতিমতো অবাক তুষার।
তথ্য’র বাবা নিজেও অবসরপ্রাপ্ত অফিসার। ওর মা গৃহিণী হলেও উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত। এদের মুখে মানায় এসব?
তাদের একই কথা, একটামাত্র মেয়ে। নিজের সখ পূরণ করেছে এখন তার যদি স্বাদ হয় সংসার করার তারা বাঁধা দিবেন না৷
তথ্য’কে বুঝাতে বুঝাতে অনেকটা সময় গেলেও যখন তথ্য মানলো না তখন তুষার তীক্ষ্ণ গলায় বলেছিলো,

— এই রংচং তোমার কতদিন থাকে আমি দেখব তথ্য। যখন আমার সংসারে তোমার অবহেলা দেখব তখন দেখাব এই তুষার কি করতে পারে। সারাজীবন পরে আছে সংসার করার জন্য। এখন ক্যারিয়ার এ ফোকাস করো। আমার কাছাকাছি ই থাকতে হবে এমন তো কোন কথা নেই। দূরে থেকে কি বিগত এক বছরে ভালোবাসা কমে গিয়েছিলো? যায় নি তো। তাহলে? এখন এসব কেন? চুপচাপ কথা শুনো নয়তো বউ ধরে পিটানোর অভিযোগ শুনবে আমার নামে দুইদিন পর। চাকরি যাওয়ার টেনশন নেই সেটা এমনিতেও নেই।

তথ্য এই দফায় এগিয়ে এসে তুষারের বুকে নিজের দুই হাত রাখলো। একটু ঝুঁকে মাথাটা ও সেখানেই রাখলো। তপ্ত শ্বাস ফেলে তুষারও জড়িয়ে ধরলো ওকে। তথ্য তুষারের পিঠটাতে হাত বুলাতে বুলাতে মনের কথা জানান দিলো,

— আপনি বললেন সারাজীবন পরে আছে সংসার করার জন্য। আমি তো দেখি না তুষার। কোথায় সময়? সময় কি হাতের মুঠোয় আটকানো যায়? যায় না তো। এই দেখুন আপনার বয়স। আমার বয়স। এই বয়সে আমার দুটো করে বাচ্চা স্কুলে থাকার কথা আর আপনার বাচ্চাকাচ্চা কলেজে থাকার কথা। নাকি ভুল বললাম? পুতুলের কত বছরের বড় আপনি জানি না আমি?
আমাকে কেন বাধ্য করছেন কাজের জন্য? বললাম না কিচ্ছু চাই না। শুধু আপনাকে চাই। মলিন শাড়ীতেও আমি সুখ খুঁজে নিব তুষার। সুযোগ দিয়েই দেখুন। তথ্য নিরাশ করবে না।

তথ্য’র কথাতে দীর্ঘ শ্বাস ফেলা ছাড়া কিছুই করার ছিলো না তুষারের। মেনে নিয়েছিলো সবটা। কিন্তু তথ্য বিশ্বাস করতে পারে নি তুষারকে। এই লোকের কোন ঠিকঠিকানা নেই। রিজাইন লেটার পাঠিয়েছে আজ চারমাস। এরমধ্যে ও বারকয়েক তথ্য’কে যেতে হয়েছে। ভ্যালিড রিজন দেখাতে হয়েছে। এখানে সবচাইতে বড় চাল তো তথ্য চেলেছে তুষারের বিরুদ্ধে।

— তথ্য!!

হঠাৎ তুষারের ডাকে অল্প কেঁপে উঠলো তথ্য। শাশুড়ী’র কাছে বসে ছিলো এতক্ষণ। তোঁষার চিন্তায় চিন্তায় খাওয়া নাওয়া ছেড়েছেন উনি। শাসন ভালো। অবশ্য ই ভালো কিন্তু অতিরিক্ত শাসন একজন সন্তানকে তার মা-বাবা ঠিক কতটা দূর করতে পারে তা তোঁষাকে না দেখলে বুঝা যায় না। তথ্য উঠলো না। ঠাই বসে রইলো। তুষার ডাকলো আরো দুই বার। ওর মা তথ্য’র মাথায় হাত দিয়ে বললেন,

— আম্মু তুষার ডাকছে। যাও।

— পরে যাই?

— আমি ঠিক আছি আম্মু। যাও। হয়তো কিছু লাগবে।

আড়ষ্টতার সাথে উঠে পা টিপেটিপে রুমের দিকে হাটা দিলো তথ্য। তুষার গরম চোখ করে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। হাতে তার পিলের পাতা। ঢোক গিললো তথ্য। তুষার কোনমতেই এখন বাচ্চাকাচ্চা চাইছে না। তথ্য’কে বলেছিলো সাবধান থাকতে। তারা প্ল্যান করবে কিন্তু ঐ যে তথ্য বিশ্বাস করে উঠতে পারে নি তুষারকে। না জানি কখন তথ্য’কে ফেলে চলে যায়। যেই লোক এক রাতের বউ রেখে চলে যায় তাকে কতটা বিশ্বাস করবে তথ্য?

ধাম করে দরজাটা লাগতেই তথ্য কেঁপে উঠলো। তুষার পিলের পাতা ওর চোখের সামনে তুলে গম্ভীর কণ্ঠে কিছুটা ঝাড়ি দিয়ে বললো,

— পাতা খালি না কেন?

— এটা তো নতুন পাতা।

— এক থাপ্পড়ে মুখ ভেঙে ফেলব তথ্য। ইয়ার্কি করা হচ্ছে? বেয়াদব মেয়ে! কথা শুনো না তুমি?? বেশি বার বেড়েছে তোমার। আমাকে শিখাও তুমি! নতুন পাতা এটা? গতমাসে তিনপাতা এনেছি। কোথায় একপাতা ও তো শেষ হয় নি। ছুঁয়েও দেখোনি।

তথ্য তড়িৎ বেগে মাথা তুললো। ও তো লুকিয়ে রেখেছিলো। তুষার ওর চাহনি দেখে আরো তেঁতেঁ উঠে বললো,

— ড্রয়ারে পিল ফেলে রাখতে তুমি। কি ভেবেছো আমি টের পাব না। আজ ড্রয়ার না হাতালে তো আমি জানতাম ই না৷ চোখের সামনে থেকে যাও তথ্য। জাস্ট গেইট আউট।

বলেই মাথা চেপে খাটে উবুড় হয়ে শুয়ে পরলো তুষার। প্রচন্ড মাথা ব্যাথা করছে ওর। তথ্য দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বিছানায় উঠে তুষারের চুলে হাত রাখলো। সময় নিয়ে টেনেটুনে দিলো। অতঃপর আরো টেনে নিজের কাছে নিয়ে কপাল চেপে দিলো। এই লোক ভালো হলো না। হবেও না। এখন তথ্য’র পেটের কাছে টিটিংটিটিং করছে। তথ্য’র হাসি পেলেও এই মুহুর্তে হাসা বারণ। তার বর মহাশয় কিছু পরখ করছে। করুক। দেখুক কি পায়। তুষার জহুরি চোখে পেট দেখেদুখে বলদের মতো প্রশ্ন করলো,

— বাবু কি আছে?

— কি জানি।

হাসি চেপে উত্তর দিলো তথ্য।

— বুঝো না?

— আপনি বুঝেন না?

— আমার পেটে যে বুঝব?

— তো আমার একার ঠ্যাকা যে বুঝব?

— মানে?

— বাবু তো দু’জনের হবে তাই না? তাহলে আপনার ও তো ফিল হওয়ার কথা।

— মে’রে তক্তা বানাবো তোমাকে। দিনদিন ইতর হচ্ছো। টেস্ট করেছিলে?

— বেকার বরে’র টাকাপয়সা থাকলেই না টেস্ট করব।

— খোঁটা দিচ্ছো।

— দিলাম। তাতে কি?

— সত্যি বলো না।

— বললাম না৷ বেকার পর কিট এনে দিলেই টেস্ট করব।

তুষার প্রায় ঝড়ের বেগে উঠে গায়ে টিশার্ট জড়িয়ে বেরিয়ে গেলো। হাতে তিনতিনটা কিট নিয়ে ফিরলো সে। তথ্য জিজ্ঞেস করতেই ও বললো,

— একদম শিওর হতে হবে। তিন কম্পানির তিনটা।

তথ্য তিনটাই হাতে নিলো। ওয়াশরুম ঢুকে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। পাঁচ মিনিটে সাতবার ডাক পরলো তুষারের। মুচকি হেসে বেরুলো তথ্য। তিনটা কিটই দিলো তুষারের হাতে।
তুষার কিট হাতে ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে ই রইলো। তথ্য মুচকি হেসে জড়িয়ে ধরলো ওকে। হাসতে হাসতে ই বললো,

— নতুন প্রাণের খবর শুনে তথ্য’র প্রাণ পাগল হয়ে গেলো।

#চলবে…..

প্রিয়_প্রাণ পর্ব-৩৬+৩৭

0

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৩৬

ছোট্ট একটা কেক হাতে দাঁড়িয়ে আরহাম। কেকটা নিজ হাতে বানালো মাত্র। রাত বারোটা বাজতে মিনিট পাঁচ বাকি। আজ তার আর তার তুঁষে’র দ্বিতীয় বিবাহ বার্ষিক। ঘুমন্ত তোঁষাকে টেনেটুনে তুললো আরহাম। ঢুলুঢুলু তোঁষা ফোলা ফোলা চোখে তাকালো। এলোমেলো তার চুলগুলো আরহাম আঙুল চালিয়ে গোছালো। তোঁষার সামনে কেকটা এনে কানে চুমু খেয়ে ফিসফিস করে জানালো,

— হ্যাপি অ্যানিভারসিরি প্রাণ।

তোঁষা বুঝলো না তবে হাসলো। তার কানে সুড়সুড়ি লাগছে। আরহামে’র কোলে উঠে বসলো আরাম করে। মৃদু হাসে আরহাম। তোঁষাকে আদর করে কাঁধে রাখা নিজের মাথাটা। অতঃপর দুজন একসাথে কেকটা কাটলো। তোঁষাকে খায়িয়ে দেয়াতে মজা পেলো ও। আরহামকে এখন দিবে না। একা একা আধ পাউন্ডের কেকটা খেয়ে ঢেকুর তুললো। আরহাম কিচ্ছু বললো না। তোঁষার মাথায় চুমু খেয়ে আবদারের স্বরে বললো,

— আজ ঘুমাস না আর প্রাণ।

তোঁষা হামি তুললো। আরহাম ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,

— প্লিজ না প্রাণ। আজ ঘুমাস না। আজই তো শেষ। তোকে দেখি। আমাকে দেখ। এই আরহাম তো তোর সব শেষ করে দিলো। আরহাম নিজেও শেষ প্রাণ। তোর ধ্বংসাবশেষটাই নাহয় দেখে যাই আমি। আমাকে আজ রাত টা দে।

তোঁষা বুঝলো না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। একটু পরই কি মনে করে গলা জড়িয়ে ধরলো।
আরহাম তোঁষা সহ উঠে দাঁড়ালো। আলমারি খুলে বের হলো গোলাপি এক প্রিন্সেস গাউন। তোঁষার পছন্দের চরিত্রের ডিজনিল্যান্ড এর এক পোশাকের মতো। নিজ হাতে তোঁষাকে সেটাতে সাজালো আরহাম। কাঁধ সমান চুলগুলো ছেড়ে আঁচড়ে দিলো। ফুটফুটে গোলাপি রঙে রাঙালো তোঁষার ওষ্ঠাধর।
ঠিক যেন প্রিন্সেস। তোঁষা বেজায় খুশি হলো। ঘুরে ঘুরে আরহামকে দেখালো সে। আরহাম ঢোক গিললো। সামনে কি হবে তা জানা নেই তার। আজ রাতটা বাদে তার জীবনে আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। কিচ্ছু না।

যদিও গত ছয়মাস আগেই কথা ছিলো তুষার তোঁষাকে এসাইলেমে পাঠাবে কিন্তু ওর পা ধরে অনুরোধ করে আরহাম রেখেছে এখানে। নিজের সব মেধা খাটিয়ে চিকিৎসা করছে। ফলাফল কতটুকু পেলো জানা নেই। তবে তুষার সকালে নিয়ে যাবে তোঁষাকে।
আজ তাদের দ্বিতীয় বিবাহ বার্ষিকিতে আরহাম মোটেও মন খারাপ রাখবে না। সে দেখবে তার তুঁষ’কে। ভালোবাসবে তার প্রিন্সেসকে।

একদিকে ফুটফুটে তোঁষা অন্য দিকে আগুনপোড়া আরহাম৷ হাত বাড়িয়ে আরহাম তোঁষাকে নিজের কাছে নিলো। খুব ধীরে ধীরে তারা দুজন দুলছে। একসময় তোঁষা আরহামে’র বুকে মিশলো। আরহাম থামলো না। সে তার প্রিন্সেস নিয়ে বোল ডান্সে ব্যাস্ত। আচমকা হাত পৌঁছালো তোঁষার পিছনে চেইনে। এক টানে তা খুলে দিলো আরহাম। হাত চালনা করলো পিঠময়। তোঁষা আরামে “উম” শব্দ করে ও থেমে গেল। সময় পেরুলো। আরহাম ও থামলো। লাগিয়ে দিলো চেইনটা। তোঁষা মুখ তুললো গলা থেকে। আরহামে’র দিকে তাকিয়ে রইলো নেশালো চোখে। আজ পরাজিত আরহাম। সব দিক দিয়ে। সমাধি দিতে দেড়ী হলো না তার।
.
সকাল নয়টার কথা থাকলেও তুষার এলো এগারোটায়। তার নিজের ও মন চায় না তোঁষাকে আরহাম থেকে সরাতে কিন্তু আর কত? দুটো বছর জীবন থেকে গায়াব হয়ে গেলো। এখন তো সবাই সবার মতে জীবনে এগিয়ে যাচ্ছে তাহলে কেন তার পুতুল আর আরহাম সেই বছর দুই আগে আটকে থাকবে? তোঁষার সুস্থতা ছাড়া আপাতত তুষার কিছুই ভাবছে না।
দরজায় নক হওয়ার প্রায় দশ মিনিট পর খুললো আরহাম। তুষার তো একবার ভাবলো হয়তো আরহাম খুলবে না কিন্তু না সে খুলেছে। ভেতরে ঢুকার পরই দেখলো টেবিল ভর্তি নাস্তা। তোঁষা এটা ওটা নাড়ছে। আরহাম ধীর কন্ঠে বললো,

— আজ একসাথে খাব ভাই।

— পুতুল..

— ওকে বুঝিয়েছি। কিছু বলবে না তোমাকে।

তুষার আস্তে ধীরে তোঁষা থেকে একটু দূরে বসলো। আরহাম জুস এনে টেবিলে রেখে তোঁষার প্লেটে খাবার তুললো। তোঁষা সব কিছুই দুই হাতে ধরছে। আরহাম ওর মুখে মুরগির মাংসের টুকরো দিতেই তোঁষা একটু চুষে তা আরহামে’র মুখের সামনে ধরলো। অনায়াসে তা খেয়ে নিলো আরহাম। তুষার হা হয়ে তাকিয়ে রইলো। এ কোন আরহাম? সেই আরহাম যে কারো জুঠা তো দূর কারো ছুঁয়া খাবারটা ও খেতো না?
অথচ তোঁষার মুখের লালায় ভরা খাবার গিলে নিলো? আচ্ছা ভালোবাসা ঠিক কেমন হয়? এমন হয় যেমনটা তুষার চোখে দেখছে?

তুষারকে খেতে না দেখে আরহাম তোঁষা’র মুখে খাবার দিয়ে বললো,

— ভাই তোমার কি অসুবিধা হচ্ছে? অন্য পাশে বসে খাবে? সোফায় দেই?

তুষার অবশ্য সরলো না কিন্তু খেতেও পারলো না। এমনটা না তার ঘৃণা লাগছে। হয়তো অন্য কেউ হলে এখানে খেতেই পারতো না।

তোঁষা’কে খাওয়ানো হতেই তুষার বললো,

— ওনারা নিচে অপেক্ষা করছে।

আরহাম মাথা নিচু করে তোঁষাকে বুকে নিয়ে বসে রইলো। তুষার সময় দিলো। আরহাম ছাড়লো না। অগত্যা তুষার তাদের উপরে আসতে বললেই তিনজন নার্স এলো। তোঁষা বড়বড় চোখে তাদের দেখতেই একজন খুব সাবধানে তোঁষার হাতে ইনজেকশন পুশ করলো। তোঁষাকে যখন আরহাম থেকে সারাতে চাইলো তখনও ঢুলুমুলু তোঁষা বলছে,

— প্রাণ। আমাকে ছাড়ো কেন? ধরো।

একসময় মেয়েটা জ্ঞান হারালো। আরহাম ঠাই বসা। তোঁষা’কে ছাড়াতে গেলেই তুষার দেখলো তোঁষার হাতের মুঠোয় আরামে’র শার্টের কোণা যা ছাড়িয়ে দিলো তুষার। তার বুক ফেঁটে কান্না আসছে। কিন্তু করার কিছু নেই।
তোঁষাকে নিয়ে যাওয়ার দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে রইলো আরহাম৷ তুষার ওর হাত ধরতেই দাঁড়া থেকে ছিটকে ফ্লোরে পরলো ও।

#চলবে…..

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৩৭

“সুখ” জিনিসটা কারো সহ্য হয় তো কারো হয় না। ভাগ্যে আরহাম তোঁষার সুখ জিনিসটা বোধহয় একদমই সইলো না। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ তারা আলাদা। আরহামের শিয়রের কাছে বসা ওর মা। ভদ্র মহিলা বারবার চোখ মুছে যাচ্ছেন। একটু দূরে গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছেন তুরাগ। উপরে উপরে নিজেকে যতটা ই কঠর দেখাক না কেন ভেতরে ভেতরে তার করা হাহাকার কেবলমাত্র সেই টের পায়। তার প্রথম সন্তান আরহাম। তার প্রথম বাবা অনুভূতির জন্ম দিয়েছে এই আরহাম। এই ছেলেটাকে সে ভালোবাসে। শুধু মাত্র পরিবারের যাতে ভাঙন না ধরে তাই কোনদিন সে তোঁষা আরহামে’র বিয়ের পক্ষে ছিলো না। তুহিন কোনদিন চায় নি আরহামে’র সাথে তার ছোট পুতুলকে বিয়ে দিতে। আরহামে’র হুটহাট রাগ উঠা। নিজের জিনিস একদম নিজের করে রাখা এসব কে ই বা পছন্দ করবে? কোন বাবা ই চাইবে না আরহামে’র মতো ছেলের সাথে নিজের সন্তানের বিয়ে হোক। তুহিন ও চায় নি। তুরাগ পরিবার ভাঙার ভয়ে ছেলেকে কত অপমান করে দূর দূর করে দিয়েছিলো। তার সেই বুকের ধন আজ বিছানায় পরে আছে। ছেলের খোলা বুকে তাকিয়ে তার বুকটা ছেঁত করে উঠে। অসংখ্য আঘাতের চিহ্ন তাতে। কামড়ের দাগগুলো যেন একদম তাজা। তুরাগের বুকে চাপ অনুভব হলো। মন চায় ছেলেকে বুকে চেপে ধরে রাখতে অথচ সে অপারগ। কোন এক অদৃশ্য দেয়াল দাঁড়িয়ে বাবা ছেলের মাঝে।
আজ তিনদিন ছেলেটা হাসপাতালে ভর্তি। ডক্টর এখনও বললো না কি হয়েছে। তুষারের কাছে শুধু শুনলো আরহাম সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে।
কোন বাবা মায়ের কাছে ছেলের সুইসাইডের কথাটা মানুষ যতটা সহজে বলে জিনিসটা কি আসলেই এত সহজ?

তোঁষাকে দেখে সোজা হসপিটালে ফিরলো তুষার। ওর লাল হওয়া চোখ দেখেই ওর মা দৌড়ে এসে ছেলের বুকে মাথা রেখে জড়িয়ে ধরলো। অস্থির কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

— তুষার তোঁষা, তোঁষা ঠিক আছে?

তুষার দুই হাতে মা’কে জড়িয়ে রাখলো। একটু সময় নিয়ে ধুকপুক করা বুকে বললো,

— মা পুতুল….

— হ্যাঁ বল। পুতুল কি?

— ও ও ভালো নেই মা। ও ভালো নেই। শুধু কাঁদে। ওর মুখে ওর প্রাণ বাদে কোন শব্দ নেই। আরহাম ছাড়া ও বাঁচবে না মা৷ ও ম’রে যাবে। ওখানে সত্যি ই ম’রে যাবে। বাঁচবে না। আজ আমাকে দেখেই দৌড়ে এসে পা জড়িয়ে ধরলো। বিশ্বাস করো মা, মনে হলো আমার কলিজাটা ফেটে যাচ্ছে। এতদিন আমাকে ও কত আঘাত করলো সেই আঘাতে আমি এত কষ্ট পাই নি যত কষ্ট আজ ওর এই দশাতে পেলাম। ওখানে রাখব না মা৷ ওখানে আমার পুতুল ম’রে যাবে।

এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলো তুষার। ওর মায়ের মনটা ও কেমন আনচান করে উঠলো। তুষার মাকে নিয়েই আরহামে’র কাছে গেলো। তখনই আদনান এলো। পরিবারের সকলেই উপস্থিত এখানে। অপেক্ষা আরহামে’র জ্ঞান ফিরার।
আদনান তুষারকে দেখেই বললো,

— ভাই ডক্টর আসছে। কথা বলে এসেছি।

তুষার শুধু মাথা নাড়লো। কথা বলার শক্তি পেলো না আর।

রাত আটটা নাগাদ চোখ মেলে আরহাম৷ বুঝতে সময় লাগলো নিজের অবস্থান৷ আশেপাশে একে একে সকলকে দেখলেও দেখলো না ওর প্রাণকে। কিছু একটা মনে পরতেই ফট করে উঠে বসলো ওমনিই আদনান ধরলো ভাইকে। ওর মা আরহামকে সজাগ দেখেই ছেলের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে অঝোরে কেঁদে উঠলেন। আরহাম একহাতে জড়িয়ে ধরে অস্থির হয়ে বললো,

— তুঁষ? ভাই তুঁষ?

তুষার এগিয়ে এসে কিছু বলার আগেই আরহাম বললো,

— আমাকে নিয়ে চলো ওর কাছে। শুধু দেখব। একবার দেখব। কথা দিচ্ছি। দূর থেকে দেখব। আমার মন কেমন লাগছে। ও ও ভালো নেই ভাই।

ছেলের পাগলামি দেখে তুরাগ এগিয়ে এসে হঠাৎ জড়িয়ে ধরলো আরহামকে। মুহুর্তে থমকে গেলো আরহাম৷ আজ ঠিক কতটা বছর পর এক ভরসার বুক পেলো সে। দুই হাতে সেই বাবা নামক মানুষটার পিঠ ঝাপটে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠলো আরহাম।
পরিবেশটা মুহুর্তে ই ভারী হলো। তুরাগের চোখ গলিয়ে পানি পরলো। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে শুধু ধরা গলায় বললো,

— তোর তুঁষ তোরই থাকবে বাবা। নিয়ে যাবে ওর কাছে।

আরহাম কান্নার চোটে কথা বলতে পারলো না৷ আজ ঠিক কত বছর পর সে বাবা নামক ভালোবাসা পেয়েছে তা জানা নেই তার।

_____________

গায়ে কোনমতে এক শার্ট জড়িয়ে তুষার আর আদনানে’র সাহায্য গাড়িতে উঠলো আরহাম। অস্থির হয়ে একবার নিজেই বললো,

— আমি চালাই গাড়ি।

তুষার ওকে শান্ত স্বরে মানা করলো। আরহামে’র হাসফাস লাগছে। একদমই সহ্য হচ্ছে না এই পথঘাট যা পেরুতে এত সময় লাগে।

হাটু পর্যন্ত এক ফ্যাকাশে আকাশী রঙের ঢোলা জামা পরা তোঁষার। তিনজন তাকে চেপে ধরে আছে বেডের সাথে। শরীর মুচড়ে মুচড়ে উঠতে চাইছে তোঁষা। চিৎকার করে কাঁদছে গলা ফাটিয়ে। ওর কণ্ঠনালী ভেদ করে শুধু এক শব্দ ই বেরুচ্ছে “প্রাণ”। ভালোবাসা জিনিসটা বড় অদ্ভুত। এটা যেমন তোমাকে সুখের চাদরে মুড়িয়ে রাখবে তেমনই ছুঁড়ে মা’রবে অতলে যেখানে হারালেও তুলার কেউ নেই।

একসময় তোঁষার চিৎকার বন্ধ করে দেয়া হলো। তার মুখের ভেতর গুজে দেয়া হলো রুমাল। হাত পা ছটফটিয়ে উঠলো আরহামে’র প্রাণে’র। যাকে আরহাম তুলা তুলা করে বুকে পুরে রাখলো সেই তোঁষাকে যখন ইলেক্ট্রিক শক দেয়া হলো তখন তার সারা শরীর কাঁপিয়ে হাত পা ছুড়লো মেয়েটা। লাভ হলো না। কেউ দয়া দেখালো না তোঁষাকে। চোখ গড়িয়ে পানি পরলো। বড় বড় চোখ করে তোঁষা খুঁজলো। পেলো না কাঙ্খিত ব্যাক্তিকে। নেই তোঁষার প্রাণ। কোথাও নেই।

এসাইলেমে ঢুকা মাত্র আরহাম যেন আরো অস্থির হলো। ভুলে গেলো তুষারকে দেয়া ওয়াদা।
তুষার ওকে নিয়ে ডক্টরের ওখানে যাওয়া মাত্র জানা গেলো তোঁষাকে শক দেয়া হচ্ছে। আরহাম নেতানো শরীরটা যেন এটা শোনামাত্র শিউড়ে উঠে। সেলের দিকে দৌড়ে যেতেই হা করে তাকিয়ে রইলো আরহাম৷
চিৎকার করে ঢুকতে নিলো ভেতরে। তুষার চেয়েও আটকাতে পারলো না। সোজা ভেতরে ঢুকে একেএকে সব তোঁষা থেকে খুলে দিলো। তোঁষা শরীর ছেড়ে দিলো। আরহাম গর্জে উঠে তোঁষার নামে মুখে অজস্র চুমু খেতে খেতে ডাকলো,

— প্রাণ। আমার প্রাণ। এই যে আমি। কলিজা আমার তাকা না। একটু তাকা। আমাকে মাফ কর তোঁষা৷ আমাকে মাফ কর।

জ্ঞানহীন তোঁষা হয়তো জ্ঞানে থাকলে অবাক হতো আরহামে’র মুখে ” তোঁষা” ডাক শুনলে। আরহাম সোজা কোলে তুলে নিলো ওকে।
কারো দিকে না তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো সেখান থেকে। শুধু এক পলক লাল চোখে তাকালো উপস্থিত ডক্টরের দিকে। ওর নজরে কেঁপে উঠলেন তিনি।
এদিকে তোঁষার সদ্য রিপোর্ট হাতে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তুষার। মাত্র ই ওর হাতে দেয়া হয়েছে এটা। জানা নেই তুষারের। কি বয়ে আনবে এই রিপোর্ট তোঁষা আরহামে’র জীবনে।

#চলবে…

প্রিয় প্রাণ পর্ব-৩৪+৩৫

0

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৩৪

চিঠি। এই জিনিসটা পুণরায় এলো তথ্য’র কাছে। তথ্য এখন কুমিল্লায় আছে। বেশি দিন নয়। এই তো সপ্তাহ তিন চার হবে। গুনে গুনে বললে তিন সপ্তাহ চার দিন। চিঠি এসেছে এখানকার ঠিকানায়। ক্লান্ত তথ্য রুমে ঢুকা মাত্র রিক্তা নামের মেয়েটা দিয়ে গেলো। চৌদ্দ বছর বয়সী এক মেয়ে। এখানকার ই কেয়ার টেকার এর মেয়ে। এই কয়েকদিনেই তথ্য’র ভালো লাগলো মেয়েটাকে। সারাক্ষণ “আপা ম্যাডাম” ডাকে। তথ্য কতবার বললো, এটা কেমন ডাক। না রিক্তা শুনবেই না। ও এই নামেই ডাকবে। ওর নাকি তথ্য’কে আপা আপা লাগে। কিন্তু শুধু আপা ডাকতে নাকি মন টানে না তাই এই অদ্ভুত ডাকের আবিষ্কার করলো ও।
তথ্য চিঠিটা খুলতেই সবার আগে অবাক হলো। অফিশিয়াল কিছু ডকুমেন্টস এর কপি পাঠানো এখানে। বি*স্ফোরিত নয়নে তথ্য তাকিয়েই রইলো। এগুলো তুষারের কাগজ। তুষার ই এই কপি পাঠিয়েছে। কাঁপা কাঁপা হাতে তথ্য চিঠিটা খুলতেই গোটা গোটা অক্ষরগুলো চোখে ভেসে উঠলো,

আমার প্রাণ,
কষ্ট পেলে? এই তুষার তোমাকে সারাটা জীবন কষ্ট ই দিয়ে গেলো। জানতাম তুমি বিশ্বাস করবে না তাই অফিশিয়াল কাগজের কপি পাঠিয়ে দিলাম। শিঘ্রই সামনাসামনি দেখা হবে। আমি আসব। অপেক্ষা করবে নাকি এই শূন্য তুষারকে আর কাছে টানবে না?

ব্যাস এতটুকু ই। এতটুকু লেখা পড়ে বসে রইলো তথ্য। ঠিক কতক্ষণ যে বসে রইলো খেয়াল নেই। রিক্তা’র ডাকে হুশে ফিরলো ও। রিক্ত জহুরি চোখে তাকিয়ে বললো,

— আপা ম্যাডাম কি হইলো? কথা কও না ক্যান?

— হ..হু। ওহ না। কিছু না। কিছু বলবি?

— কি বলুম? খাওন আইনা দাঁড়ায়া আছি। খায়া নাও। ঠান্ডা হইয়া গেলো তো।

রিক্তা চলে গেল। খাবারটা ঠিকই ঠান্ডা হয়ে গেলো কিন্তু তথ্য তা মুখে তুলতে পারলো না৷ এই অগোছালো সব কি আদৌ কোনদিন গোছালো হবে?

_________________

তোঁষা ইদানীং মানুষ সহ্য করতে পারে না। সেদিনের পর থেকে তুষার অনেকবার ই এলো এখানে। তোঁষা ভাইকে চিনতে পারে নি। আরহাম চেয়েও তখন নিজে অসুস্থ থাকার কারণে তোঁষার কোন ট্রিটমেন্ট শুরু করতে পারে নি৷ আজও তুষার ড্রয়িং রুমে বসা। আরহামে’র পা ঠিক হয়েছে অনেকটাই। ক্রেচ ছাড়াই খুড়িয়ে হাটতে পারছে। তোঁষা এখনও রুমের বাইরে আসে না। হাজার দরজা খোলা থাকলেও না। সে বেরুবে না। আরহাম ছাড়া কাউকে দেখলেই হাতের কাছে যা পাচ্ছে ছুঁড়ে মা’রছে। তুষার শুধু বোনকে দেখে যাচ্ছে। কিছু বলা বা করার মতো তার হাতে আছে বলে মনে হচ্ছে না। তবুও আজ একপ্রকার বুকে পাথর রেখে আরহামকে বললো,

— ওকে আস্যাইলেমে পাঠা আরু।

— কি বলো? মাথা ঠিক আছে!

অনেকটাই রেগে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো আরহাম। তুষার ও দমলো না। ওর পুতুল ওকে চিনে না এই শোক কোথায় রাখবে তুষার? এতটা অসহায় শেষ কবে লেগেছিলো নিজেকে? জানা নেই। তোঁষার এই অবস্থা কোন ভাবেই মানতে পারছে না ও। তুষার দারাজ গলায় বললো,

— আমার মাথা বিগড়াস না আরহাম৷ মাইর একটা ও নিচে…..

— আমার প্রাণ থাকতে ওকে ছাড়ব না।

— ছাড়তে বলি নি তোকে। ওকে ট্রিটমেন্ট করাতে হবে। আমার পুতুলকে মে-রে ফেলবি তুই।

হঠাৎ আরহামে’র কিছু হলো। উঠে টেবিল থেকে ফল কাটার ছুড়িটা নিয়ে তুষারের হাতে দিয়ে বললো,

— এটা দিয়ে আমাকে মা’রো এরপর তোঁষাকে নিয়ে চলে যাও।

তুষার আরহামে’র বুকে ধাক্কা মা’রতেই হঠাৎ একটা ফ্লাওয়ার বাস ওর বাহুতে লাগলো। ভালোই ব্যাথা লাগলো। দরজার ফাঁক দিয়ে ফোঁস ফোঁস করা তোঁষার লাল মুখটা দেখা যাচ্ছে। আরহাম তুষারের বাহু ধরে বিচলিত হলো। তোঁষা ভেতর থেকেই আরহামকে ডাকতে লাগালো। বারবার বলছে,

— প্রাণ চলে এসো। ওটা খারাপ লোক। তোমাকে মে’রেছে। ওকে আমি মে’রে দিব। চলে এসো।

তুষার হয়তো আজকের মতো অবাক কোনকালে হয় নি। আরহাম থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে শক্তপোক্ত মানুষটা চলে গেল। আরহাম হাজার পিছু ডাকলেও শুনলো না। দাঁড়ালো না একপল।
.
রাত গভীর নয়। এই তো বারোটা। তোঁষার গা কাঁপানো জ্বর। আরহামের বুকে মুখ দিয়ে গুনগুন শব্দে কাঁদছে সে। এদিকে অস্থির আরহাম। তোঁষাকে অনেক জোর করে উঠালো।

— প্রাণ উঠ একটাবার। একটু পানি ঢালব।

— শীত লাগে তো।

— কথা শুনবি না? একটু উঠ।

অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে ওকে নিয়ে ওয়াশরুম ঢুকে আরহাম। বহু কষ্টে গোসল করাতেই তোঁষার কাপুনি বেড়ে গেলো। রুমে এনে জ্বরের মেডিসিন দিয়ে মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে ঘুমালো তোঁষা।
আরহামে’র মাত্র ই বুঝি চোখটা লাগবে লাগবে ভাব। এমন সময় পেট মোচড়ে কান্না জুড়ে দিলো তোঁষা। শুধু ই বুঝি কান্না? ওর কান্নায় আরহামে’র ঘুম তো ছুটলোই সাথে লাইট জ্বালিয়ে তোঁষার দিকে তাকিয়ে নিজেই ঘেমে উঠলো। তোঁষা ফ্রক পরে থাকায় ওর ফর্সা পায়ে লাল তরল যেন রক্তজবার ন্যায় দেখালো। আরহামে’র গা গুলিয়ে উঠলো হঠাৎ করে। মনে হচ্ছে নিজেই বমি করে দিবে।

#চলবে…..

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৩৫

“ভুল” দুই অক্ষর বিশিষ্ট এই কাজটা মানুষ ই করে। বলা হয়, “মানুষ মাত্র ই ভুল”। সুতরাং ভুল পশুপাখি দ্বারা নয় বরং মানুষের দ্বারা হওয়াটাই স্বাভাবিক। সেই ভুলের ধরণ ও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। একজন সুস্থ মানুষের করা কাজটা চক্ষু দৃষ্টিতে ভুল হলেও একজন অসুস্থ মানুষের করা কাজটা কি আদোও ভুল বলা চলে? একটা অসুস্থ মস্তিষ্ক কি বুঝে তার কাজটা ভুল না সঠিক। আদোতেও ঠিক বা কতটা বেঠিক? কতটা জঘন্য অথবা ঠিক কতটা মারাত্মক? না সে বুঝে না। বুঝার কথা ও না। কিন্তু আরহামে’র অসুস্থ মস্তিষ্ক যেন থমকে গিয়েছে। যেন নিজের করা সবটা কাজ করায় গন্ডায় তার চোখের পাতায় ভেসে বেড়াচ্ছে। আরহাম খুব করে চাইছে অতীত টাকে হাতড়ে নিতে। মুঠোয় পুরে গোছগাছ করে দিতে অথচ তা সম্ভব না। কোনদিন ও না।

সামনেই তোঁষা বসা ওর। কাঁধ সমান চুলগুলোতে একটু আগেই দুটো বেনুনী করলো আরহাম। শেখ বাড়ীতে ওকে যে পুতুল ডাকে ডাকটা একদম স্বার্থক। তোঁষাটা একদম পুতুল পুতুল দেখতে। চিনির দলা আরহামে’র। নরম ভেজা তুলতুলে এক বস্তা তুলা। এই সুন্দর নরম তোঁষাটা আজ আগের মতো নেই। তার মানুষিক অবস্থা বিগড়ে গিয়েছে। এই তো তার আজকাল ক্ষুধা আর আরহাম বাদে কিছুই লাগে না। কিছুই চাই না। আরহাম কোন একদিন চেয়েছিলো তার তুঁষ শুধু তাকে মনে রাখবে। শুধু তার হয়ে থাকবে। আজ তোঁষা’র দশা তা ই আছে অথচ আরহাম মানতে পারছে না। কোন ভাবেই না। তার এখন আগের তোঁষাটাকে চাই। সেই ফুড়ফুড়ে ঝলমল করা তুঁষটা তার কোথায় হারালো? অন্ধকারে গহীনে ডুবে আজ একা আরহাম। কুল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

“অভিশাপ” জিনিসটা খুবই ভয়ংকর। হয়তো তোঁষার মা সেদিন মন থেকে অভিশাপ দেয় নি। হয়তো তোঁষার ভুল ছিলো না৷ হয়তো আরহামের দোষটা ও ছিলো না। কিন্তু অভিশাপ টা তো লেগে গেলো। এত বিশ্রী ভাবে লাগলো যে আরহাম নিঃস্ব হয়ে গেল। জীবনটা একদম উলোট পালোট করে রেখে গেলো। আরহাম তো চাইছিলো একটা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসবে। তোঁষা’র ট্রিটমেন্ট করে সবটা গুছাবে কিন্তু এই প্রকৃতি কিসের যে প্রতিশোধ নিলো আরহাম থেকে আরহামের বুঝে আসে না। অভিশাপ টা তোঁষার লাগলো নাকি আরহামের তা ও বুঝে আসে না।
তোঁষা কি আদৌ বুঝে ওর সাথে কি হলো? কে এলো আর কে গেলো?

এলোমেলো আরহাম গত এক মাস আগের সেই ভয়ানক রাতে ডুবলো। বিভৎস সেই রাতে সে তার জীবনের দিক হারালো।

সেদিন তোঁষার র*ক্ত দেখা মাত্র চমকায় আরহাম। তোঁষা যখন কান্নার প্রকোপে জ্ঞান হারালো তখন পা*গলের মতো ছুটলো আরহাম ওকে নিয়ে।
তীব্র জ্বর আর সেই জ্বরের মেডিসিনে আরহাম নিজের অস্তিত্ব হারা হলো। হায়! সেই কষ্ট আজও আরহাম কাউকে দেখাতে পারলো না। পা*গলের মতো লাজ লজ্জা ত্যাগ করে যখন রাতের আধারে হসপিটাল জুড়ে আরহাম চিৎকার জুড়ে দিয়ে কাঁদলো তখন আশেপাশের মানুষ তাকিয়ে রইলো। কেউ কি বুঝলো তার শোক? উহু কখনো বুঝলো না। বুঝবে না।
বাবা নামক এক সত্তা আরহামে’র বুকে তীব্র ভাবে হানা দিলো। আরহামে’র ছোট্ট এক অস্তিত্ব নিজের অস্তিত্বের জানান দিলো বিদায় নিয়ে। আরহাম না ম’রে গেলে ভালো হতো তা থেকে? এই খবর শুনে এখন কিভাবে বেঁচে আছে জানা নেই ওর। বুকে বারবার তার ঝড় উঠে। বাবা নামক ঝড়। মন চায় তখন নিজেকে খু’ন করতে। এই বুক ঝাঁঝড়া করে দিতে।
অথচ হসপিটালে তিনদিন থেকেও তোঁষার অনুভূতি কিছুই না। তার সামনে আরহাম পা’গলের মতো যখন কাঁদে তখন তোঁষা হুটহাট কাঁদে। তার মধ্যে অনুভূতি এখন আর অবশিষ্ট কিছুই বাকি নেই।

তুষার সহ পুরো পরিবার ছুটে এলেও তোঁষা কাউকে চিনতে পারলো না। ওর মা তোঁষার হাত দুটো ধরে চোখের পানি ছেড়ে মাফ চাইলো। বারবার বললেন,

— তোঁষা। মা আমি তোকে অভিশাপ দেই নি। বিশ্বাস কর দেই নি৷ মন থেকে একটা কথা ও বলি নি। মা’কে বিশ্বাস কর সোনা৷ আমাকে মাফ কর তোঁষা। আমার পাখি। তোঁষা কথা বল না৷ মায়ের দিকে তাকা।

তোঁষা চিৎকার করে কান্না জুড়ে দেয়াতে ওর মা ছেড়ে দেয় ওকে। তুষার আরহামকে ধরে জোর করে তোঁষার কাছে নিয়ে আসে। আরহাম বলার বা করার মতো কিছু খুঁজে না পেলেও তোঁষা তার শেষ আশ্রয় খুঁজে তার প্রাণের মাঝে।

আরহাম এর বিশ দিন পরই তোঁষাকে নিয়ে শেখ বাড়ীতে যায়। তোঁষার ট্রিটমেন্টের জন্য এটা জরুরি। একা রেখে কিছুই করা যাবে না৷ কিন্তু পরিস্থিতি সেদিন একদম ই বদলে গেলো। দরজা মেলে তোঁষাকে দেখে ওর মা জড়িয়ে ধরতেই তোঁষা তাকে কামড়ে ধরে আরহামের পিছনে লুকালো। আরহাম হাজার বুঝালেও কাজ হয় নি। তোঁষা আরহামে’র কাছে লেপ্টে বারবার একই কথা বলছিলো,

— এখানে অনেক আলো প্রাণ৷ আমাদের বাসায় চলো।

দীর্ঘ দেড় বছর সেই রুমে থাকা তোঁষা কিছুতেই এই প্রকৃতির আলো সহ্য করতে পারলো না।
আরহাম ব্যার্থ হলো সেদিন আবারও। ফিরে এলো। এমন হাজার ও চেষ্টা চললো অথচ লাভ হচ্ছে না।

আজ তুষার আসবে। তোঁষাকে এসাইলেমে পাঠাবে। এছাড়া পথ তাদের সামনে নেই। আরহাম এতদিন জোর করে না বললেও এখন পথ খোলা নেই কোনো। কি করবে? কাকে বুঝাবে? কিন্তু শেষ একটা কাজ আজ আরহাম করবেই। যে করেই হোক সে তার তুঁষকে ভালো রাখবে। সুখে রাখবে। হোক না সেই সুখটা আরহাম ভাই নামক এক কলঙ্কিত পুরুষ ছাড়া।

দরজায় বেল বাজতেই আরহাম উঠে দাঁড়ালো। পিটপিট করে তাকালো তোঁষা। আরহামে’র সাথে পিছু পিছু সেও গেলো। মাঝে মধ্যে তুষার আসে। তোঁষার সহ্য হয় না। এটা ওটা ছুঁড়ে মা’রে তখন তুষার কথা না বলে চলে যায়। আজও তোঁষা হাতে একটা খাতা নিলো। এটাতেই এতক্ষণ আঁকিবুঁকি করছিলো ও। দরজা থেকে উঁকি দিলো দেখতে।
আরহাম দরজা খুলেই দেখলো আদনান দাঁড়িয়ে।
আরহাম তারাতাড়ি দরজা লাগিয়ে ওকে বসিয়েই রুমে চলে গেল। তোঁষা তখনও আগত মানুষটার মুখ দেখে নি। আরহাম তোঁষাকে নিয়ে কোনমতে বিছানায় বসালো। তোঁষার গালে হাত রেখে কপালে চুমু খেয়ে বললো,

— প্রাণ কথা শুনবি?

— শুনব।

মিষ্টি করে হাসলো তোঁষা৷ বুক কাঁপলো আরহামের। এই হাসিটা তো তার জন্য। অন্য কারো জন্য না৷ এই হাসি কোথায় পাবে আরহাম?
বুকে পাথর রেখে তোঁষাকে নিয়ে শুয়ে পরলো ও। মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে কত গল্প করলো। তাদের নাম না জানা এক পৃথিবীর গল্প যেখানে বাস করে তোঁষা আর তার প্রাণ।
তোঁষা চোখ বুজতেই খুব ধীরে উঠে গেলো আরহাম। দরজা খুলে আদনানের সামনে দাঁড়িয়ে বললো,

— চল।

আদনান ভেতরে এলো আরহামে’র সাথে৷ ঘুমন্ত তোঁষা’র দিকে তাকিয়ে রইলো। আগের তোঁষা আর এই তোঁষার ফারাক দিন রাত। আরহাম আদনানের দুটো হাত ধরে কাকুতি করে বলে উঠলো,

— এভাবে তাকাস কেন? তুই কি ভাবছিস ও আগের মতো সুন্দর না? মোটা হয়ে গিয়েছে? তোর কাছে গেলেই ঠিক হয়ে যাবে। বিশ্বাস কর আমাকে। তোর কি ওকে এখন পছন্দ হচ্ছে না? এই তুই না ওকে ভালোবাসতি? শুধু কি ওর সৌন্দর্যকে ভালোবাসতি তাহলে!

আদনান কথা বলার খেই হারালো। আরহাম নিজেকে শান্ত করে আদনানের হাত ধরে কিছু কথা বলে রুমের বাইরে গেলো। এক মিনিট। দুই মিনিট যেতেই অস্থির আরহাম দৌড়ে এলো দরজার কাছে। ভেতরে কিছু ভাঙার শব্দ হলো। দরজা ধাক্কাতে থাকে আরহাম। দুই হাতে আঘাত করতে করতে ডাকে,

— এই আদনান? দরজা খোল। কি করছিস ওকে? ওকে ধরলে হাত কেটে নিব তোর আমি। দরজা খোল।

তোঁষার চেঁচামেচি শুনে আরহাম ঘামতে লাগলো। হঠাৎ দরজা খুলতেই হুরমুর করে ভেতরে ঢুকে চমকালো আরহাম৷ আদনানের মাথা ফেটে র*ক্ত পরছে। সামনেই কাঁচের ভাঙা গ্লাস। তোঁষা আরহামকে জড়িয়ে ধরলো। ফুঁপিয়ে কাঁদছে ও।

আরহাম কিছু বলার আগেই আদনান বললো,

— আমি ওকে ধরি নি ভাই। ও নিজেই উঠে আমাকে দেখে গ্লাস ছুঁড়ে মা’রলো। ও তোমাকে ততটা চিনে যতটা তুমি ও নিজেকে চিনো না। চেহারা এক কেন শুধু, হাজার আরহাম থেকে তুঁষ তার প্রাণ খুঁজে নিবে। যেই পা*গল ভালোবাসা চিনে তার সুস্থতা দিয়ে কি হবে?

আরহাম কথা বললো না৷ ও শুধু চেয়েছিলো ওর তুঁষ ভালো থাকুক। আরহামকে ছেড়ে আদনানের সাথে থাকলে হয়তো ভালো থাকত কিন্তু তা তো হলো না। তোঁষা ওকে গভীর থেকেও গভীর ভাবে চিনে। তাহলে কি তুষার এসাইলেমেই পাঠাবে ওর তুঁষ’কে?

#চলবে….