Wednesday, August 6, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 158



প্রিয় প্রাণ পর্ব-৩২+৩৩

0

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৩২

বিছানায় মাথা ঠেকিয়ে শুয়ে আছে আরহাম। এই তো গত একমাস ধরে তার শরীর খারাপ করছে। মাত্রারিক্ত দূর্বল মনে হয় নিজেকে। এক দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে রইলো ও। মেঘলা আকাশটার নিচে তার নিজের জীবনটাকে বড্ড অগোছালো মনে হলো। পরক্ষণেই মনে হয় না। এই অগোছালো জীবন যেটাতে তার তুঁষ আছে সেটাই সুন্দর। একটু হাত বাড়িয়ে টেবিল থেকে প্রোটিন শেইকটা হাতে তুলে ছিপি খুলে গটগট করে কয়েক ঢোক গিললো। ইদানীং শরীরচর্চা করা হচ্ছে না। নিজের যত্ন নিতে ইচ্ছে হয় না। তোঁষাটা কেমন কেমন করে। সারাক্ষণ লেগে লেগে থাকে। এই যে এখনও আরহামে’র বুকে শুয়ে আছে। আজ কিছুতেই ও বিছানায় শুবে না। বিছানা নাকি শক্ত। তাই আরহামে’র বুকে চরে শুয়ে আছে। আরহামের যদিও বুকে এখন ব্যাথা হচ্ছে তবুও সে তোঁষা’কে সরাবে না। থাকুক তার প্রাণ তার বুকে। এই বুক থেকে সরলেই উল্টো আরহামে’র কষ্ট হয়। সেদিনের কথা ভাবতেই আজ ও ওর বুক কেঁপে উঠে ভয়াবহ ভাবে।

ঐ দিন তোঁষা যখন পাগলামি শুরু করলো তখন লাফ দেয়ার আগেই জ্ঞান হারালো তোঁষা। উঁচু জায়গাটা থেকে পরলো কার্ণিশের কোণায়। আরহাম দৌড়ে গিয়ে তোঁষা’কে বুকে জড়িয়ে ধরে। একটুর জন্য। শুধু মাত্র একটুর জন্য তোঁষা বেঁচে গিয়েছিলো। তবে মাথায় আঘাত লেগেছিলো একটু বেশি। ড্রেসিং করে ব্লিডিং থামালেও তোঁষা’র আচরণে ভিন্ন পরিবর্তন লক্ষ করা গিয়েছিলো সেই সপ্তাহ থেকে। আরহাম বাদে কাউকেই চায় নি তোঁষা। তুহিনের নাম ও মুখে তুলে না।

ও কি চাচ্ছে আরহাম ঠাহর করতে পারছে না। সারাক্ষণ তার আরহামকেই লাগবে। ওকে ঘুম পারিয়ে বাসা থেকে যেতে হয়। ভয় তো আরহাম সেদিন পেলো যেদিন সিসি ক্যামেরায় দেখলো ঘুম থেকে উঠেই বাচ্চাদের মতো হাউমাউ করে তোঁষা কাঁদছে। কাঁদতে কাঁদতে তার মুখে শুধু একটাই ডাক “প্রাণ”। তার প্রাণ’কে ডাকতে ডাকতে সে কেঁদে অস্থির। সব ফেলে ঘন্টায় মধ্যে ছুটে এলো আরহাম। রুমের লক খুলে তোঁষা’কে বুকে জড়িয়ে যখন মাথায় হাত বুলালো তার কত পর গিয়ে থামলো ওর তুঁষ। শাস্তি সরুপ সে ক্ষত বিক্ষত করে দিলো আরহামে’র বুকে।
ধারালো দাঁতে তোঁষা ইদানীং খুবই বাজে ব্যবহার করছে। আরহামে’র বুকে এখন প্রায়সময় ব্যাথা হচ্ছে। সেদিন কামড়ে যে ধরলো ছাড়তেই চাইলো না। ব্যাথার চোট সামলাতে না পেরে চোখ দিয়ে পানি পরে যখন তোঁষা’র মুখে পরলো তখন গিয়ে ছাড়লো পাঁজিটা। কাচুমাচু মুখে হাসি ফুটিয়ে কি সুন্দর করে বললো,

— চুমু দিলেই ঠিক হয়ে যাবে।

অথচ আরহামে’র অবস্থা বেগতিক হয়ে গিয়েছিলো। বুকে হাজার বরফ ঘঁষেও কাজ হলো না। সেদিন রাতে যখন তোঁষা বুকে ঘুমাতে চাইলো তখন আরহাম ব্যাথায় মুখ খিঁচে যে চোখের পানি ছাড়লো তা কি তোঁষা দেখেছিলো? দেখলে ও কি তোঁষা’র অনুভূতি প্রবণতা জাগ্রত ছিলো? সে কি বুঝে তার প্রাণের কষ্ট?

তোঁষা নড়চড় করতেই আরহাম ধীরে ধীরে তোঁষা’কে বুকে আরেকটু চেপে ধরে কোলে তুললো। এভাবে কতক্ষণ থাকবে? ওকে নিয়ে বিছানায় শুলেও শান্তি মিললো না। তোঁষা আরহাম’কে আঁকড়ে ধরে বুকে মাথা রেখে ঘুমালো। ব্যাথা লাগলেও আরহাম সরালো না বরং কপালে গাঢ় চুমু খেলো।

____________________

তুষারের সাথে বরাবর বসা আরহাম। বড় ভাই’কে সে যথেষ্ট সমীহ করে তাই তো মাথাটা নীচু করে রাখা আরহামে’র। তুষার আরহামে’র হাতের উপর এক হাত রাখতেই চমকে তাকালো আরহাম। ওর চমকানিতে মৃদু হাসলো তুষার। সেই ভঙ্গি বজায় রেখেই প্রশ্ন করলো,

— তোর মন কি বলে আরু? কাজটা ঠিক করেছিস?

“আরু” এই ডাকটা আজ বহু বছর পর ডাকলো তুষার ওকে। বয়সে তুষার থেকে অনেকটাই ছোট ও। ছোট বেলায় এই তুষার নামক বড় ভাইটার পিঠে চড়ে অনেক ঘুরা হয়েছে। ভালোবেসে ওকে আরু ডাকতো তুষার পরে কি যেন একটা হলো। আরহাম ধীরে ধীরে একদম গুটিয়ে যেতে থাকলো।
এই মুহুর্তে মন চাইলো তুষারের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে জড়িয়ে ধরে রাখতে। মন খুলে দুটো কথা বলতে। একটু কাঁদতে। অভিযোগ জানাতে। কিন্তু কোনটাই সম্ভব হলো না। ঐ যে দূরত্ব। সেটা আজ আরহাম’কে দূর করে রাখলো। গাঢ় কণ্ঠে তুষার আবার জিজ্ঞেস করলো,

— বল?

— না।

— স্বীকার করছিস কাজটা ঠিক হয় নি?

— উপায় ছিলো না ভাই।

— আমি বিয়েটা হতে দিতাম তোর মনে হয়?

— কিছু ঘন্টা আগে আমি তুঁষ’কে তুলে নিয়েছিলাম। একটু দেড়ী হলে বিয়েটা দিয়ে দিতে তোমরা। তখন?

— হতে দিতাম না আমি।

— বাঁধা দিতে তো শুনলাম না।

দীর্ঘ শ্বাস ফেললো তুষার। কাকে কি বুঝাবে? তবুও আরহামে’র দিকে তাকিয়ে বললো,

— পুতুল’কে কি করেছিস বল তো সত্যি করে।

— কি করেছি?

— ও এমন কেন ছিলো ঐদিন আরু? সত্যি টা বল।

আরহাম মাথাটা সহসা নীচু করে নিলো। তুষার উত্তরের অপেক্ষায়। খুবই নিচু গলায় আরহাম বললো,

— যারা আমাকে আমার প্রাণ থেকে দূর করতে চেয়েছিলো তাদের ভুলাতে চেয়েছি।

— কিহ!!

সহসা ধমকে উঠলো তুষার। আরহাম মাথা তুললো না। উঠে এসে কাঁধ চেপে ধরলো আরহামে’র। আরহাম মাথা তুলতেই তুষার ধমকে উঠলো,

— কি বললি? কি করেছিস? আরহাম!! কথা বল!

— মেমরি লস করার ট্রিটমেন্ট করেছিলাম কিন্তু পুরো সেশন শেষ করতে পারি নি তার আগেই তুঁষের আচরণ অন্য রকম হয়ে যাচ্ছিলো। সাইড ইফেক্ট কি না বুঝতে পারছি না….

বাকিটা বলার আগেই সজোরে চড় মা’রলো তুষার।আরহাম প্রতিক্রিয়া দেখালো না যেন এটার ই অপেক্ষায় ছিলো। তুষার পরপর এবার দুটো ঘুষি মা’রলো আরহামের গালে। চেয়ার থেকে ছিটকে ফ্লোরে পরলো আরহাম। ওর কলার ধরে টেনে তুলে তুষার নিজের শক্ত হাতের আঘাত করলো আরহাম’কে।
তুষার আঘাত দিতে দিতে হঠাৎ থেমে গেলো যখন আরহাম শব্দ করে কেঁদে উঠলো। হতভম্ব হয়ে গেল তুষার। এভাবে কবে কেঁদেছে আরহাম? আদৌ কখনো কেঁদেছে এভাবে? আরহামে’র ঠোঁটের কোণটা কেটে র*ক্ত গড়িয়ে চিবুক ছুঁয়ে গেলো। সেই মুখে এই সুপুরুষটার কান্না বড্ড বেমানান। কোন পুরুষ মানুষ এই আঘাতে এভাবে কাঁদে? অন্তত আরহামের এই প্রতিক্রিয়া ভাবে নি তুষার।
হাঁটু ভেঙে আরহামে’র কাছে বসে নিজের কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরলো তুষার। ঠিক এক অসহায় বাচ্চার মতো আরহাম কাঁদলো। কেন কাঁদলো? কিসের জন্য কাঁদলো বুঝলো না তুষার।
আরহামে’র শার্টের বোতাম কয়েকটা ছিড়ে যাওয়াতে তুষার ওর বুকটা খেয়াল করলো। আরহাম’কে বুক থেকে তুলে বাকি বোতামগুলো খুলতেই থমকে গেলো। ভাইয়ের বুক হাত দিয়ে আতঙ্কিত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,

— আরহাম? এই তোর বুকে এগুলো?

— তুঁষ করেছে ভাই। দেখো।

বলে পুরোটা বুক দেখালো ভাইকে। তুষার কথার খেই হারিয়ে ফেললো। এই ক্ষত বিক্ষত বুকে ও নিজেও মাত্র আঘাত করলো। তবে কি তীব্র থেকেও তীব্র ব্যাথায় কাঁদলো আরহাম?

আরহাম নিজ থেকে পুণরায় ভাইয়ের বুকে এলো। জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কাঁদছে সে। মাঝে শুধু বললো,

— আমাকে অনেক ব্যাথা দিয়েছে ও কিন্তু আমি তবুও ওকে ভালোবাসি। অনেক ভালোবাসি ভাই। ওকে ছিনিয়ে নিও না।

— নিব না। কিন্তু…

— কি?

তুষার আরহামে’র মাথায় হাত রাখলো। এই চাচাতো ভাইটা ও ওর অনেক প্রিয়। আরহাম অসহায় ভাবে তাকিয়ে ওর দিকে। তুষার আরহামে’র দিকে তাকিয়ে বললো,

— আমাকে একটাবার জানালে আজ এমন হতো না।

আরহাম মাথাটা নামিয়ে নিয়ে শুধু বললো,

— ওকে যখন আঘাত করতো চাচি তখন কেন থামাতে না ভাই?

— ছিলাম না তখন।

— আমি ওকে শুধু নিজের কাছে রাখতে চাই।

— তুই ওকে মে’রে ফেলবি আরু।

ফট করে চোখ তুলে তাকালো আরহাম। লাল হওয়া চোখে তুষার’কে দেখতে নিলেই তুষার বললো,

— কি মা’রবি আমাকে? চোখ নামা।

আরহাম সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে নিলো। তুষার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

— তোঁষা অসুস্থ আরহাম।

চোখ তুলে প্রশ্ন করে আরহাম,

— মানে?

— তুই যখন বিদেশে গেলি এর বছর কয়েক পর তোঁষার আচরণে আমি কিছুটা সন্দেহ পোষণ করি। এক জায়গায় টিকতে পারত না। ফাঁপর লাগতো। ওর নাকি দম বন্ধ হয়ে আসতো। একবার চট্টগ্রামে যখন পাগলামি করলো তখন শিওর হলাম। আদনান ও জানে এ বিষয়ে। পরে আমি ডক্টর দেখালাম ওকে। আমার বন্ধু। রিত্ত’কে চিনিস না? ও ছিলো। কিন্তু সত্যি অন্য কিছু ছিলো আরহাম। জেনেটিক ভাবে শুধু তুই একা না আমাদের বংশে তোঁষার ও কিছু সমস্যা আছে। তুই যেমন সেনসেটিভ তেমনিই তোঁষা। ভালোবাসা কি যেই মেয়ে বুঝতো ও না সেই মেয়ে শুধু তুই তুই করে পাগল হয়ে ছিলো। ওর রাগ, জেদ, হাত তুলা কোনটাই স্বাভাবিক ছিলো না। মাঝখানে ওর পাগলামি অনেক তীব্র হলো একবার। আম্মু বুঝে নি ততটা। ইচ্ছে মতো মে’রেছিলো আমার পুতুলটাকে। জানিস আমার পুতুলটার কপাল ফেটে গিয়েছিলো। এতে তোঁষা বিগড়ে গেলো আরো। আমি রিত্ত’র সাথে বলা বলে ওকে ডক্টর দেখালাম পরে সবটা জানতে পারি।

আরহাম হা করে শুনলো সবটা। ওর মাথা নিমিষেই যেন লন্ডভন্ড হয়ে গেল। ও তোঁষা’কে তাহলে যেই ট্রিটমেন্ট দিলো সেটা রিএক্ট কি এজন্যই এমন হলো? তোঁষা’র ইন্টারনালি ক্ষতি হলো না তো? তুষার ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

— এবার বল তোঁষার মেমোরি লস করার ট্রিটমেন্ট কতটা হার্ম করলো ওকে আরহাম। আমার পুতুলটাকে কি করলি তুই?

আরহাম কথা বললো না। হয়তো বা বলতে চাইলো কিন্তু পারলো না। আস্তে করে উঠলো সেখান থেকে। হাঁটতে হাঁটতে শার্টের বোতাম লাগালো কয়েকটা। বিরবির করতে করতে বললো,

— আমার তুঁষ ঠিক হয়ে যাবে। আমি ওকে কেন মা’রব? ভালোবাসাকে কেউ মা’রে?

তুষার থামালো না আরহামকে। নিজেও বেরিয়ে এলো সেখান থেকে।
.
আরহাম একা একাই হাঁটছে রাস্তায়। ওর গাড়ি গ্যারেজে। মনে শুধু একটাই ভাবনা তুঁষটার ক্ষতি হলো কতটা? এজন্য ই কি এমন করে? আরহাম নাকি ওকে মা’রবে। এটা কি সম্ভব? এলোমেলো পায়ে হাঁটছে আরহাম৷ কখন যে মেইন রোডে উঠলো খেয়াল হলো না। হঠাৎ এক গাড়ি এসে ধাক্কা মারতেই রাস্তার মধ্যে ছিটকে পরলো আরহাম। উঠে দাঁড়াতে চাইলেও পারলো না। দূর্বল শরীরটা চোখ বুজে নিলো সেই ব্যাস্ততম রাস্তায়।

তোঁষা’র প্রাণ পরে রইলো অবহেলায় রাস্তার মাঝে। অপর দিকে ঘুম ভাঙলো তোঁষা’র। এদিক ওদিক খুঁজে ও যখন তোঁষা’কে পেলো না তখনই মেয়েটা চিৎকার শুরু করলো অথচ এখন কেউ আে না। আসবে না তাকে থামাতে। আদৌ কি তার প্রাণ আসবে আর কখনো তোঁষা’কে থামাতে?

#চলবে…….

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৩৩

খুবই ধীর গতিতে চোখের ভেজা পাপড়িগুলো নড়াচড়া শুরু করলো। লাল হওয়া ঠোঁট দুটো কিঞ্চিৎ নড়লো বুঝি। জ্ঞান ফিরার সময় টুকু কিছুই মনে করতে পারলো না আরহাম। তবে হঠাৎ নিজের হাতটা শক্ত এক হাতের মুঠোয় আবিষ্কার করলো। মাথাটা কাত করে সেদিকে তাকাতেই দেখা মিললো তুষারের। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে আদনান। আরহামে’র চোখ খোলা মাত্রই চেঁচিয়ে উঠলো কিছুটা আদনান,

— ভাই? ভাই চোখ খুলেছে।

তুষার চোখ বুজে ছিলো। আদনানে’র কথায় তাকাতেই দেখলো আরহাম তাকিয়েছে। ভেজা চোখে দেখে যাচ্ছে দুই ভাইকে। আরহামে’র মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ তখন কতটা কার্যকর জানা নেই অথচ তার মুখ দিয়ে নাম বের হলো,

–তুঁষ।

কথাটা এতই ধীরে ছিলো কেউ বুঝলো না। তুষার দাঁড়িয়ে আরহামে’র মাথায় হাত বুলিয়ে ধীরে ডাকলো,

— আরু।

আরহাম উত্তর করতে পারলো না। তুষার সময় দিলো। আদনান ডক্টরকে ডেকে আনতেই উনি চেক করলেন। জানালেন এখন ঠিক আছেন আরহাম কিন্তু পায়ে ফ্যাকচার হয়েছে। ঠিক কবে হাঁটতে পারবে বলা যাচ্ছে না। হয়তো মাস খানিক সময় লাগবে। হাটাচলা এখন একদম নিষিদ্ধ আরহামে’র জন্য। বেড রেস্ট মাস্ট। ডক্টর যাওয়ার ও প্রায় আধ ঘন্টা পর সম্পূর্ণ হুঁশে ফিরলো। এদিক ওদিক তাকিয়েই দেখলো একজন নার্স কিছু মেডিসিন গুছাচ্ছে আর কাউচটাতে আদনান মাথা এলিয়ে শুয়ে আছে। উঠে বসার চেষ্টা করলো আরহাম। নার্স ওকে উঠতে দেখেই এগিয়ে এসে বললো,

— স্যার প্লিজ নড়বেন না। আপনার পায়ে ফ্যাকচার হয়েছে। হাটতে পারবেন না এখন।

— ভাই? ভাই কোথায়?

— তুষার স্যার? উনি মাত্র ই বাইরে গেলেন?

— আমি কখন থেকে এখানে?

— গত দুই দিন ধরে স্যার। আপনার অ্যাকসিডেন্ট এর পর আজ ই জ্ঞান ফিরলো।

মাথায় বাজ পরলো যেন আরহামে’র। দুই দিন! তাহলে ওর তুঁষ? পাগলের মতো উঠতে নিলেই পরে যেতে নিলো। ততক্ষণে আদনান এসে ধরেছে ভাইকে। শান্ত স্বরে বলছে,

— ভাই, এমন করো না। হাটতে পারবে না তুমি।

— ছাড়!

— কথা শুনো।

— ছাড় বলছি!!

আরহামে’র ধমকে ছেড়ে দিলো আদনান তবুও ভাইকে শান্ত করতে চাইলো। এদিকে আরহাম তোঁষা’র চিন্তায় পাগলপ্রায় অবস্থা। এদিক ওদিক তাকিয়ে ক্র্যাচ দেখলো দুটো। আদনান জানে ভাইকে থামানো যাবে না তাই দুটো এগিয়ে দিতেই আরহাম সেটাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। যেটাতে ভর দিয়ে উঠে হাটা ই কষ্টসাধ্য সেটাতে ভর দিয়ে দৌড়ে যেতে নিতেই মুখ থুবড়ে পরলো আরহাম। নার্স ঘাবড়ে গেলো সাথে সাথে। আদনান দৌড়ে এসে ভাইকে ধরলো। আরহামে’র মুখে একটাই কথা,

— আমার তুঁষ।

বহু কষ্টে আরহামকে নিয়ে গাড়িতে তুলতেই আরহাম ঝাঁঝালো গলায় বললো,

— গাড়ি থেকে বের হ।

— ভাই শুনো। আমি তোমাকে দিয়ে আসি। কোথায় যাবে?

— বের হ আমার গাড়ি থেকে!

পুণরায় ধমাকালো আরহাম। গাড়িটা গ্যারেজ থেকে তুষার ই আনিয়েছিলো। অগত্যা মেডিসিনের প্যাকেটটা আরহামে’র কাছে দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে গেল আদনান। আদনান নামতেই শোঁ শোঁ আওয়াজে চলে গেল আরহামে’র গাড়িটা। আদনান সেদিকটায় তাকিয়ে ই রইলো।

গতকাল তুষারের ফোনে ফোন আসে একটা। হসপিটাল থেকেই ছিলো সেটা। তখনই জানা যায় আরহামে’র খবর। রাস্তা থেকে মানুষ ধরে হসপিটালে নিয়েছিলো। ফোনে চার্জ না থাকায় পরিচিত কাউকে পায় নি। গতকাল ফোন অন হতেই সর্বশেষ নাম্বার পায় তুষারের তাই সেটাতেই কল করা হয়। তুষারের সাথেই ছিলো আদনান তাই দুই ভাই ছুটে আসে। জেনারেল ওয়ার্ড থেকে কেবিনে শিফট করে।

কাঁধে কারো হাত পেতেই আদনান তাকালো। তুষার দাঁড়িয়ে। আদনান দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,

— ভাই চলে গিয়েছে।
_______________________

এলোমেলো গাড়ি চালিয়ে আরহাম ফিরলো। দারোয়ান এগিয়ে এসে সাহায্য করলো নামতে। কোনমতে লিফট এ উঠে বাইশ তলায় গেলো ও। লক খুলে প্রবেশ করেই ডাকতে লাগলো,

— তুঁষ? প্রাণ আমার, কোথায় তুই?

বলতে বলতে রুমের লক খুলে ভেতরে এলো। লাইট অন করা কিন্তু তোঁষা নেই। আশেপাশে কোথাও নেই। ধুকপুক করা বুকে ভেতরে এসে ওয়াশরুমের খোলা দরজায় তাকাতেই অন্তরআত্না কেঁপে উঠলো। তোঁষা ফ্লোরে পরে আছে। দিকবিদিকশুন্য হয়ে পরলো আরহাম। ওয়াশরুমের ফ্লোরে গিয়ে বসে কোলে তুলে নিলো তোঁষা’র মাথাটা।

— তুঁষ? এই প্রাণ। চোখ খুল না? কি হয়েছে তোর? চোখ খুল না? ভয় পাই তো। এই যে এসেছি আমি। উঠ না। কষ্ট হচ্ছে আমার প্রাণ।

তোঁষা উঠলো না। আরহাম নিজেই হাটতে পারে না কিভাবে তুলবে এখন তোঁষা’কে। ট্যাবটা ছেড়ে পানি নিয়ে তোঁষার মুখে চোখে ছিটালো। টেনে যতটা পারলো বুকে তুললো। তোঁষা চোখ খুললো অনেক পর। আরহাম’কে দেখেই জড়িয়ে ধরে কাঁদলো। অভিযোগ করলো রোজকার ন্যায়। জানালো সে ভয় পেয়েছে। জ্ঞান ফিরলেও যথেষ্ট দূর্বল দেখালো তোঁষা’কে। আরহাম চাইলেও কোলে তুলতে পারলো না। মানিয়ে তোঁষা’কে বললো,

— একটু দাঁড়া।

তোঁষা দাঁড়ানোর পর বহু কষ্টে দেয়াল ধরে দাঁড়ালো আরহাম। ভর দিয়ে কোনমতে গিয়ে বসলো বিছানায়। তোঁষাকে বলে বলে ইনসুলিন আনালো।
মূলত না খাওয়ার কারণেই হয়তো তখন মাথা ঘুরেছে।
তাকিয়ে দেখলো জগের ভেতর রুটি ভিজিয়ে রাখা কিছুটা। হয়তো তোঁষা খেয়েছে। আরহামে’র বুকটা চিনচিন করা শুরু করলো। তুঁষটা কি না খাওয়া ছিলো?
তোঁষা ইনসুলিন এনে আরহামে’র হাতে দিলো। আরহাম কোনমতে তোঁষা’র বাহুতে পুশ করলো। তোঁষা এসে সোজা আরহামে’র পাশ ঘেঁষে বসে পরলো। মুখটা ফুলিয়ে রেখে বললো,

— খাব।

আরহাম ওকে রেখেই ক্রেচে ভর দিয়ে কিচেনে গেলো। কোনমতে ব্রেডে কেচআপ লাগিয়ে ভেতরে সালাদের পুর দিয়ে নিয়ে নিয়ে এলো। তোঁষা’র সামনে রেখে ওকে খেতে বলতেই নাক মুখ কুঁচকালো তোঁষা। খাবে না ও এটা। আরহাম আহত চোখে তাকিয়ে রইলো। তবুও জোর করতেই তোঁষা হাতে তুলে ছুঁড়ে মা’রে ফ্লোরে। মুহুর্তে ই তা ছড়িয়ে গেলো। আরহাম কিচ্ছুটি বললো না। ফোন হাতে তুলে খাবার অর্ডার দিলো।
কাছাকাছি হওয়াতে খুব দ্রুত ই খাবার এলো। তোঁষা’র সামনে খাবার রেখে ফ্লোর থেকে কুড়িয়ে ব্রেডটা খেয়ে নিলো আরহাম। পায়ের ব্যাথায় টিকা যাচ্ছে না। মেডিসিন নিতেই হবে।
যেই খুঁতখুঁত স্বভাবের আরহাম কোনদিন রাস্তা ঘাটে খায় না সেই আরহাম আজ ফ্লোরে তোঁষা’র ছুঁড়ে ফেলা খাবারটা অনায়াসে খেয়ে নিলো।
তোঁষা আপনমনে খাচ্ছে বিছানায় বসে। আরহাম মেডিসিন খেয়ে তোঁষা’কে নিয়ে বিছানায় শুয়ে পরলো। তোঁষা ঘুমাবে না। আরহাম ক্লান্ত ভাবে শুধু বললো,

— অনেক কষ্ট হচ্ছে প্রাণ। একটু ঘুমাতে দে।

— আদর করো।

— এখন না।

— না এখনই করো।

— পাগলামি করে না প্রাণ।

তোঁষা কথা না বলে আরহামে’র বুকে উঠে গেলো। হয়তো আজ এই প্রথম তোঁষা’কে না চাইতেও সাড়া দিলো না আরহাম। তার শরীরে কুলাচ্ছে না। কিছুতেই না।
.
কান্নার শব্দে হঠাৎ ই ঘুম ভাঙলো আরহামে’র। টেনে চোখ খুলে তাকালো কোনমতে। ঘন্টা খানিক হলো ঘুমালো। কান্নার উৎস খুঁজে তাকালো এদিক ওদিক। আলমারির পাশে ফাঁকা জায়গাটায় বসে কাঁদছে তোঁষা। আরহাম উঠতে চাইলেও পারলো না। কোনমতে আধশোয়া হয়ে বসে ডাকলো তোঁষাকে। তোঁষা সাড়া দিলো না। দেখে মনে হলো হয়তো পরে গিয়ে এভাবে বেকায়দায় বসে আছে। একদম ছোট ছোট চুলে মনে হলো এক বাচ্চা মেয়ে কাঁদছে। আরহাম পুণরায় ডাকলো,

— তুঁষ? প্রাণ উঠে আয়। কোথায় ব্যাথা পেয়েছিস? আয় আমার কাছে।

— তুঁষ উঠবে না। তুঁষ ব্যাথা পেয়েছে। কোলে তুলে নাও।

আরহাম কত করে বললো কিন্তু তোঁষা উঠলো না। অগত্যা শরীরটা ঠেলে বিছানার কিণারায় আনলো ও। ওর ক্রেচ দুটো দরজায় পাশে পরে আছে। নিশ্চিত তোঁষা ফেলে রেখেছে ওখানে।
না পেরে এবার শরীরের উপরিভাগ ছেড়ে দিলো আরহাম। ওমনিই শরীরটা ওর ছিটকে পরলো ফ্লোরে। ব্যাথায় মুখ কুঁচকালো আরহাম। পায়ে একদমই বোঁধ পাচ্ছে না৷ কোনমতে শরীরটা টেনে সেচড়ে নিলো তোঁষা’র কাছে। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে হাঁপিয়ে যাওয়া কণ্ঠে বললো,

— আয়।

তোঁষা এবারেও মানলো না। আরহাম হাত বাড়িয়ে তোঁষার হাতটা টেনে আনলো নিজের কাছে। তোঁষা এবার আরহামে’র কোলের উপরে ধপ করে বসলো। বসেই গলাটা জড়িয়ে ধরে মুখ গুজে দিলো কাঁধে। এভাবে তোঁষা পায়ে বসাতে ব্যাথায় জর্জরিত আরহামে’র মুখটা লাল হয়ে গেলো। দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে তোঁষা’কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো শব্দ করে।

#চলবে….

প্রিয় প্রাণ পর্ব-৩০+৩১

0

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৩০

তুহিন দুনিয়া ত্যাগ করেছেন আজ চারদিন। চারদিনের দিন নাকি সকলের মন পাথর হয়ে যায়। শোক ধীরে ধীরে কমতে থাকে। একসময় রয়ে যায় শুধু ই স্মৃতি। শেখ বাড়ীর কেউ ই হয়তো ভালো নেই। তুষার মা’কে সামলাতেই হিমশিম খাচ্ছে। খাওয়া নাওয়া ত্যাগ করে বসে থাকেন তিনি। তুষার মুখে তুলে দিবে খাবে নয়তো না ই। এদিকে তোঁষা’র খবর নেয়া হচ্ছে না। ঐ দিকে তথ্য। কোনদিকে কি সামাল দিবে তুষার তাই ভেবে পাচ্ছে না। আদনান দরজায় নক করতেই তুষার তাকালো। ইশারায় আসতে বলতেই আদনান নিঃশব্দে প্রবেশ করে। বড় ভাইয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেই তুষার বললো,

— বস।

— চাচি খেয়েছে ভাই?

— হু। একটু ভাত খেলো। মসজিদে যাব একটুপর। নামাজের পর মাদ্রাসায়।

— গোছানো আছে সব ভাইয়া। কবরস্থানে যাবে?

— সকালে গিয়েছিলাম।

— ওহ।

একসময় চুপ করে গেলো আদনান। তুষার তা লক্ষ্য করে বললো,

— কিছু বলবি?

— তুঁষ কোথায় আছে ভাইয়া? জানো?

তুষার গহীন দৃষ্টিপাত করতেই আদনান নিজেকে সামলে বললো,

— ঐ দিন তো এলো তাই….

— তাই রোজ রোজা আনবে আরহাম?

— এমনটা না।

— তাহলে কেমনটা?

— রেগে যাচ্ছো?

— না।

— আমার দিকটা….

— তোর কোন দিকই আমি ভাবতে চাই না আদনান। আর না ই কোনদিন চাইব ভাবতে। হাজার বার সবাইকে বলেছি দু’জনকে একসাথে থাকতে দিতে। তাদের সুখ বৈ কিছুই হতো না। আরহাম পা*গল না এটা কে না জানে? সামান্য একটা সমস্যা’কে ঘিরে তাদের সাথে প্রতারণা করা হলো। এখন যখন নিজেরা সুখ খুঁজতে বাড়ী ছাড়লো তাতেই সব দোষ ওদের? এটা ও আমাকে মানতে হবে? আর হ্যাঁ, এতসবে নিজেকে নিঃদোষ ভাবার চেষ্টা করিস না। আপন ভাইয়ের ভালোবাসার দিকে নজর দিয়েছিলি তুই। এ থেকে গর্হিত কাজ আর কি ই বা হতে পারে?

মাথা নিচু করে সবটা শুনলো আদনান। সে মানে তার দোষ আছে। বরং একটু বেশিই আছে।
তুষার উঠে বের হতেই আদনান ও বেরুলো। তখনই চোখ খুললো ওর মা। তার চোখ গড়িয়ে পানি পরছে।
ভুল মানুষ একসময় বুঝে কিন্তু আফসোস তখন সঠিকটাকে গ্রহণ করার ক্ষমতা কারো হাতে থাকে না।

________________

— বারান্দার থাই খুলে দাও।

তোঁষা থাই ধরে দাঁড়িয়ে থেকে কথাটা বললো। আরহাম সাইড টেবিলে খাবার রাখতে রাখতে ডাকলো,

— খেতে আয় প্রাণ।

— এটা খুলো।

— কেউ নেই ওখানে।

— আছে আমি দেখেছি৷ বাবা এসেছিলো মাত্র।

— কেউ আসে নি প্রাণ। এদিক আয়। খাবি।

— খুলে দাও না।

এবার বড়ই কাতর শুনালো তোঁষা’র কণ্ঠ। না পেরে আরহাম এগিয়ে এলো ওর দিকে। তোঁষা’র হাতটা ধরে চোখে চোখ রেখে বললো,

— ওখানে চাচ্চু নেই।

— চাচ্চু নেই। বাবা আছে।

আরহাম তোঁষা’র কাঁধ সমান গোল করা চুলগুলো কানে গুজে দিতেই তোঁষা ঘাড় কাত করে মুখ কুঁচকালো। আরহাম তোঁষা’র গালে হাত রাখলো। অতঃপর কপালে চুমু খেয়ে বললো,

— চাচ্চু নেই প্রাণ।

— জানি তো।

— তাহলে জেদ করছিস কেন? খেতে আয়।

— বাবা আছে।

আরহাম দীর্ঘ শ্বাস টানলো। বিগত দুই দিন তোঁষা ছিলো একদম নির্বাক। চুপচাপ। ঠিক অতি শোকে পাথর। কিন্তু গত দুই দিন ধরে সে এমন করছে। আরহাম তাকে এখন ইনসুলিন বাদে কিছুই দিচ্ছে না৷ অথচ তোঁষা’র আচরণ তার স্টাডি অনুযায়ী সম্পূর্ণ ভিন্ন। ও বারবার বলছে তুহিন’কে দেখছে। সে ডাকছে ওকে। হাত বাড়িয়ে ডাকে। দুই হাত মেলে দিয়ে ডাকে। তোঁষা’র তখন মন চায় দৌড়ে বাবা’র বুকে চলে যেতে কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না তা আরহামে’র জন্য। আরহাম তাকে যেতে দেয় না৷ গতকাল রাতে যখন তোঁষা তাদের সুখের মুহুর্তে হঠাৎ “বাবা” বলে চিৎকার করে উঠলো তখন ভয় পেয়েছিলো আরহাম। তোঁষা নিজ থেকেই তাকে ডাকলো। আরহাম যখন পাগল হয়ে উঠলো তখনই তোঁষা পাগলামি শুরু করলো। কতটা কষ্টে তোঁষা’কে আর নিজেকে সামাল দিলো আরহাম।

দীর্ঘ এক দম নিলো আরহাম৷ বারান্দার থাই খুলে তোঁষা’র হাত ধরে গেলো সেখানে। আশেপাশে কিছু খুঁজার ন্যায় তাকালো তোঁষা। আরহাম পরখ করলো ওকে। তোঁষা না পেয়ে এবার ডাকলো,

— বাবা? বাবা? বেরিয়ে এসো। এই যে আমি। এতক্ষণ না ডাকলে? এখন কোথায়? প্রাণ ও এসেছে। বাবা?

তুহিন আসে না। আসবে না। তোঁষা’র মুখটা ধীরে ধীরে লাল হতে শুরু করলো। আরহামে’র দিকে তাকাতেই আরহাম খেয়াল করলো তোঁষা’র রাগী মুখটা৷ ধরে রাখা হাতটা ঝাড়া দিয়ে তোঁষা রুমে এসে খাটে উবুড় হয়ে শুয়ে পরলো। আরহাম ও থাই লক করে এলো। তোঁষা’র পিঠে হাত রাখতেই তোঁষা আরহামে’র বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আরহাম ওর তুঁষকে আগলে ধরে মাথায় হাত দিয়ে বুঝাতে চাইলো,

— প্রাণ আমার, প্লিজ কাঁদিস না৷ চাচ্চু নেই এখানে।

— আছে।

— কথা শুন তুঁষ।

— তুঁষ শুনবে না তোমার কথা।

বলেই আরহামে’র বুকে কামড়ে ধরে তোঁষা। হঠাৎ আক্রমণে আরহাম ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে। তবে তোঁষা ছাড়লো না। নিজের জেদে সে তার দাঁতের প্রয়োগ করছে আরহামে’র বুকে। আরহাম আর সহ্য করতে না পরে ছাড়াতে চাইলো এবার। পারলো না। একদম চুটার মতো লেগে আছে তোঁষা। মুখে নোনতা স্বাদ পেতেই তোঁষা এবার আরো জোরে যখন দাঁত বসালো তখনই আরহাম মৃদু স্বরে চেঁচালো,

— আহহ! ছাড় তুঁষ।

একপ্রকার জোর করে ওকে সরালো আরহাম। সরে উল্টো ঘুরে বসে রইলো তোঁষা। তার মুখে আরহামে’র র’ক্ত। বুকে হাত চেপে বড় বড় শ্বাস ফেলতে ফেলতে বিছানায় শুয়ে পরলো আরহাম। বুকে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে তার। গায়ের টিশার্ট’টা টেনে ছুঁড়ে মারে নিচে। অনকটা দাঁত বসেছে ওখানে। টিস্যু দিয়ে র*ক্ত মুছে যেই না উঠবে তখনই ওর উপর হামলে পড়ে তোঁষা। আরহাম দূর্বলভাবে ছাড়াতে ছাড়াতে বললো,

— এখন না। ছাড়।

— উউউউহু। এখনই।

কথাটা বলেই আরহামে’র বুকের ক্ষত’তে চুমু খায় তোঁষা। বুকে উঠে নিজেকে উৎসর্গ করতে চায় আরহামে’র মাঝে। হঠাৎ পরিবর্তনের কিছুই বুঝলো না আরহাম৷ তোঁষা’র এমন আচরণের কারণ তার অজানা৷ চারদিন যাবৎ ইনজেকশন অফ রেখেছে আরহাম৷ তোঁষা’র বাকি কাউকে মনেও পরে না। শুধু তার বাবা’কে দেখছে। প্রাণ’কে দেখছে। এটাই করে যাচ্ছে। আবার হুটহাট আরহামে’র মাঝে বিলীন হচ্ছে।
তোঁষা’র অনিয়ন্ত্রিত স্পর্শে এবার আরহাম ও নিয়ন্ত্রণ হারালো। তবুও শেষবার তোঁষা’কে সরাতে চাইলো কিন্তু সম্ভব হলো না৷ তোঁষা পুরোপুরি ভাবে আরহামকে নিজ আয়ত্ত্বে এনেছে। এই কাজটা অতি সুক্ষ্ম ভাবে করতে জানে সে।

#চলবে…..
#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৩১

বিরসতায় ঘিরা দিনটাতে সুইমিং পুলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তথ্য। এটাকে অবশ্য পুল বলা যায় না। বিড়াট বড় এক অগভীর পানির পুকুর। মূলত এদিকটাতে আজ ট্রেনিং চলছে। তথ্য তাদের গাইড হিসেবে নিয়জিত এখানে। মনমরা হয়ে তথ্য আপাতত এদিকটাতে বসে আছে। সূর্য এখনও ডুবে নি। ডুববে ডুববে একটা ভাব। তথ্য’র মনে হয় ওর জীবনের সূর্যটা ডুবে গিয়েছে। ডুবলো তো ডুবলো এখনও উদয় হলো না। কোথায় যে হারালো? দীর্ঘ শ্বাস ফেলার কিছুই নেই ওর।
এদিক ওদিক হাঁটতে হাঁটতে আশেপাশে তাকালো তথ্য। ওর দিকেই একজন হেঁটে আসছে। তথ্য তাকে চিনে। ওর সিনিয়র অফিসার। এই ব্যাক্তি তথ্য’কে অনেক সাহায্য করেছে তুষার’কে পেতে। ওনাকে আসতে দেখেই তথ্য পদচারণ থামালো। সম্মুখের ব্যাক্তিটি ওর সামনে দাঁড়াতেই তথ্য স্যালুট করলো। বরাবর দাঁড়িয়ে অফিসার অল্প হেসে তথ্য’কে ভিন্ন ভাবে সম্মোধন করলো আজ,

— মিসেস.তুষার, কি খবর?

তথ্য লজ্জা পেলো কিছুটা। কি এক অবস্থা করেই না তুষার পাগলটা ওকে বিয়ে করলো। পুরোই হুলুস্থুল এক কান্ড। মান ইজ্জত বাকি রইলো না কিছু। তথ্য’কে লজ্জা পেতে দেখে অফিসার এবার অল্প শব্দ করে হাসলেন। তার হাতে থাকা কাগজটা তথ্য’কে দিয়ে শুধু বললেন,

— হি ইজ ফাইন। ডোন্ট ওয়ারী।

তথ্য প্রশ্নবোধক চাহনি দিলো। অফিসার ইশারায় কাগজটাকে দেখিয়ে চলে গেলেন। দ্রুত পায়ে রুমে ছুটলো তথ্য। দরজা লাগিয়ে বসলো একদম মেঝেতে। তুষারের চিঠি। এই ডিজিটাল জুগে এই চিঠি’র মানে তথ্য খুঁজে পেলো না। দুরুদুরু বুকে কাগটা খুলতেই মতির দানার মতো ঝরঝরা লিখাগুলো নজর কাটলো তার।

প্রিয় প্রাণ,

প্রাণ বলেই সম্মোধন করলাম তোমাকে তথ্য। তুমি আমার প্রাণের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমার প্রাণের টুকরো। আমার প্রিয় প্রাণ, তোমাকে একা ফেলে এসেছি বলে রেগে আছো? টেনশন হচ্ছে? ভাবছো না তো যে তুষার ছেড়ে চলে গেলো? ছয়মাস তো আর কম নয়। বুঝি আমি। জানি। কিন্তু কি করব বলো? তুমি তো সাধারণ কোন পুরুষ’কে ভালোবাসো নি তথ্য। বেসেছো ঝামেলায় পরিপূর্ণ এক দায়িত্ববান সন্তানকে। এমন এক কঠোর পুরুষ’কে যে নতুন বিবাহিত এক রাতের আদরের বউ’কে রেখে চলে আসে। আমি এতটাই কঠোর তথ্য। ঠিক এতটাই কঠোর যতটা কঠোর হলে সোহাগে পরিপূর্ণ আমার ঘ্রাণে মত্তে থাকা নতুন বউটাকে রেখে চলে এলাম। জানো আমি এতটাই কঠোর।
কিন্তু কি জানি হলো বুঝলে। আমি ভেঙে গেলাম। প্রথম ভাঙলাম যখন বাবা ছেড়ে চলে গেল। বাবা আর ফিরবে না তথ্য। সে ছাইচাপা কষ্ট নিয়ে চলে গেল পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে অথচ ত্যাগ করতে পারলো না তার পুতুলের মায়া।
দ্বিতীয় বার আমি আবার ভাঙলাম তথ্য। আমার পুতুল। আমার পুতুলটা যাকে আমি আমার সন্তানের মতো ভালোবাসি সে নিজের মধ্যে নেই। কেমন যে হয়ে গেলো আমি বুঝাতে পারলাম না। বিশ্বাস করো তথ্য, আমার বুকের পাজরের হাড়টা বুঝি মোচকে গেলো। কেমন জানি দম বন্ধ দম বন্ধ লাগে। তথ্য ওকে এমন ভাবে দেখতে যে আমার কি কষ্ট হলো আমি বুঝাতে পারলাম না।

জানো তথ্য আমাকে কাঁদানো এত সহজ না। অথচ আমি প্রচন্ড দূর্বল হয়ে যাচ্ছি। তুমি কাছে থাকলে তোমার বুকটাতে মুখ গুজে কেঁদে বুক হালকা করতাম।
প্রাণ আমার, আমি ফিরব। তুমি মন খারাপ করো না। করেও লাভ হবে না। তুমি তো নিষ্ঠুর এক পুরুষ’কে বিয়ে করেছো।

ভালো থেকো বলতে পারলাম না। জানি না, কতটা ভালো থাকতে পারবে।

ইতি,
তোমার অপ্রিয় প্রাণ।

চিঠিটা পড়া মাত্র ঝরঝরে কেঁদে উঠলো তথ্য। কাগজটা বুকে জড়িয়ে কেঁদে উঠলো শব্দ করে। কোথায় যাবে ও এখন? কোথায় পাবে ওর পুরুষটাকে? তুষারে’র এই কষ্ট কিভাবে লাঘব করবে ও?

___________________

বিছানায় কোণায় গুটিয়ে বসে আছে তোঁষা। দরজা বন্ধ ওদের রুমের। আরহাম বাসায় ফিরে নি এখনও। ভয়ে ভয়ে তোঁষা বারদুই ডাকলো আরহাম’কে। আরহামে’র সাড়াশব্দ না পেয়ে ভয়টা বেশি বাড়লো। ও দেখেছে ওর বাবা এসেছিলো। দরজা ঠকঠক করার শব্দ হলো প্রথমে। তোঁষা যখনই বললো, কে। তখনই তুহিন উত্তর করলো। এর মানে ওর বাবা এসেছে। তোঁষা’কে ডেকেছে। একটু পর ই বারান্দায় দাঁড়িয়ে ডেকেছে তোঁষা’কে। আরহাম’কে বললে আরহাম কিছুতেই বিশ্বাস করে না। তোঁষা’র কান্না পায় তখন।
হঠাৎ ই তোঁষা দরজার দিকে তাকাতেই দেখলো তুহিন দাঁড়িয়ে। বালিশে মুখ লুকিয়ে ফেললো তোঁষা ততক্ষণে। একটু পর ধীরে ধীরে এক চোখ বের করে দেখলো না যায় নি ওর বাবা। এখনও দাঁড়িয়ে। তার মুখটাতে হাসি নেই। কেমন দুঃখ দুঃখ মুখটা। ধীরে ধীরে পুরো বালিশটা ই সরালো তোঁষা। তুহিন ডাকে ডাকলো,

— পুতুল?

— বাবা।

— হ্যাঁ বাবা। এদিকে আয় আম্মু।

— ভয় হয়।

— বাবা’কে ভয় হচ্ছে? কেন পুতুল? আমার পুতুল তার আব্বু’কে ভয় পায়?

— তুমি তো চলে যাও বাবা।

— যাব না?

— উহু।

— তাহলে কি করব মা?

— থেকে যাও।

— জায়গা নেই তো। কোথায় থাকব?

— আমার কাছে থেকে যাও। অন্তত আরহাম ভাই আসা পর্যন্ত। উনি বিশ্বাস করে না।

— তুই করিস?

— কি?

— বিশ্বাস।

— তোমাকে?

— হ্যাঁ।

— সত্যি?

— তিন সত্যি বাবা।

— তাহলে যাবি বাবা’র সাথে?

— কোথায়?

— মাত্রই না বললি বিশ্বাস করিস।

— আমি চলে গেলে আরহাম ভাই কাঁদবে বাবা।

— আমি ও কাঁদি পুতুল। কাঁদতে কাঁদতে আমার বুকে ব্যাথা উঠে যায়। বাবা’র সাথে চলবি না আম্মু?

— চলব তো।

— রাতে বারান্দায় আসবি। বাবা অপেক্ষা করব।

— আরহাম ভাই আসা পর্যন্ত থাকো না বাবা।

— রাতে আবার আসব মা।

তোঁষা ঘাড় নাড়লো। তুহিনের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো তোঁষা। এদিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আরহাম। দশ মিনিট হবে সে বাসায় ফিরলো। রুমে ঢুকেই দেখলো তোঁষা কথা বলছে। প্রথমে আরহাম না বুঝলেও পরে বুঝলো তুহিনের সাথেই কথা বলছে। আরহাম যে ওর সামনে দাঁড়িয়ে দশটা মিনিট যাবৎ তা খেয়াল ই হয় নি ওর। তবে কি তোঁষা’র হ্যালুসিনেশন হচ্ছে? এর প্রখরতা কি কতই বেশি যে দিনদাহারে তোঁষা কল্পনা করছে? আরহাম এসব বিষয়ে যথেষ্ট পটু। তার জানা আছে এর ট্রিটমেন্ট তবে তোঁষা রেসপন্স করে না ওর কথা অনুযায়ী। এটাই হলো সমস্যা।

— বাবা এসেছিলো প্রাণ।

তোঁষা’র কথায় ধ্যান ভাঙলো আরহামে’র। তোতাপাখির ন্যায় তোঁষা বলে গেলো তার বাবা এসেছিলো। কি কি কথা হলো। আরহাম শুনলো সবটা। তবে এখন আর তোঁষা’র ভুল ভাঙাতে চাইলো না। প্রচন্ড মাথা ধরেছে আজ।
.
— তুই কি খাবি না?

— আগে বাবা’র কাছে যেতে দাও।

— রাগাস না আমায় তুঁষ।

— তুঁষ খাবে না। আগে বাবার কাছে যাবে।

এমনিতেই মাথা ধরে আছে আজ। তারমধ্য তোঁষা’র জেদ ধরে খাবার না খাওয়াতে রাগ হলো আজ আরহামের। এতদিক সামাল দিতে দিতে সে হয়রান। তবুও ধৈর্য ধরে তোঁষা’র হাত টেনে ধরে বসাতে নিলেই তা ঝারা দিয়ে ফেলে দিলো তোঁষা। আরহাম এবার রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বললো,

— খেতে বস।

— খাব না।

— বস বলছি।

— না।

তোঁষা’র জেদ এবার কাজে লাগলো না। হাতের প্লেটটা সজোরে টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়ালো আরহাম। তোঁষা’র হাত টেনে ধরে দিলো এক ধমক। এই প্রথম। হ্যাঁ এই প্রথম আরহামে’র ধমকে কেঁপে উঠলো তোঁষা। আরহাম ওর বাহু চেপে ধরে জোরে ধমকে বললো,

— বল খাবি! খাবি বল!

তোঁষা বড় বড় চোখ করে দেখে যাচ্ছে আরহাম’কে। আরহাম তোঁষা’র জবাব না পেয়ে এবার দ্বিগুণ জোরে ধমকে উঠলো,

— বল খাবি!

— ব…বল খাবি। বল খাবি……

ভয়ে ভীতু তোঁষা বুঝ হারা হলো। বারবার এটাই বলে যাচ্ছে । আরহাম আস্তে করে ওর হাতটা ছেড়ে দিলো। তোঁষা’র মানুষিক অবস্থা ঠিক কতটা খারাপ হচ্ছে তার অনুমান করা যাচ্ছে। আরহাম ঝট করে ওকে বুকে চেপে ধরলো। তোঁষা তখনও বিরবির করছে,

— বল খাবি।

আরহাম বেশ সময় নিয়ে চেষ্টা করলো তোঁষাকে খাওয়াতে। তবে তোঁষা আজ খাবেই না। অগত্যা বারান্দার লক খুলে আরহাম। তোঁষা এদিক ওদিক ওর বাবা’কে খুঁজছে। আরহাম ওকে পাশে বসিয়ে বললো,

— এখন নিয়ে আসি। খাবি।

— বাবা আসবে বলেছিলো।

আরহাম কথা না বলে উঠে গেলো প্লেট আনতে। রুমে ঢুকা মাত্র আরহাম শুনতে পেলো তোঁষা’র গলা,

— প্রাণ!!

ঘুরে তাকানো মাত্র ই দেখলো তোঁষা রেলিং ধরে নীচে তাকিয়ে ডাকছে,

— বাবা বাবা উপরে এসো। বাবা??

— প্রাণ পরে যাবি। তুঁষ। তুঁষ!

আরহাম ডাকতে ডাকতে দ্রুত পায়ে আসতে নিলেই তোঁষা বলতে লাগলো,

— বাবা’র কাছে যাব। বাবা ডাকে আমাকে।

বলেই উঁচু জায়গাটাতে উঠে লাফিয়ে পড়ে বাবা’র কাছে যেতে চাইলো তোঁষা।
মুহুর্তেই ধপ করে একটা শব্দ হলো। এই বাইশ তলার উপরে মুহুর্তেই নিস্তব্ধতায় মুড়ে গেলো। ধপ করে বসে পরলো আরহাম। গলা দিয়ে শুধু বেরুলো একটাই শব্দ,

— তুঁষ।

#চলবে……

প্রিয়_প্রাণ পর্ব-২৮+২৯

0

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২৮

সময়টা পড়ন্ত এক বিকেল। বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে আরহাম। তোঁষা’র সামনে কিছুতেই ফোন বের করে না ও। আপাতত ওকে রুমে রেখে বাইরে এসেছে ও। তোঁষা বিছানায় বসে আছে গোল হয়ে। ওর সামনেই খাবার রাখা। একবার খাবারে হাত বাড়ালেও আবার তা গুটিয়ে নিচ্ছে। এবার আর অপেক্ষা করলো না তোঁষা। ক্ষুধা লেগেছে ওর। হাত বাড়িয়ে নিয়ে মুখে দিলো। খেতে খেতে কিছুটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো বিছানায়। কাঁপা হাতে তোঁষা যতটুকু পারছে মুখে পুরে নিচ্ছে। দুপুরে খাওয়া হয় নি। ঘুমোচ্ছিলো ও। এখন উঠতেই তার প্রাণ খেতে দিয়েছে তাকে। হঠাৎ দরজায় শব্দ হতেই তোঁষা মুখ তুলে তাকালো। দণ্ডায়মান ব্যাক্তিকে দেখে তাকিয়ে রইলো কৃয়ংকাল। আরহাম ও ভেতরে ঢুকে তোঁষা’কে খাবার ছড়াতে দেখে এগিয়ে এসে বলতে লাগলো,

— আমি ই তো খায়িয়ে দিতাম প্রাণ। তুই কেন….

কথা বলা সহসা থেমে গেলো। তোঁষা’র দৃষ্টি অনুসরণ করে সম্মুখে তাকায় আরহাম। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে তুহিন। তোঁষা বেশ কিছু সময় তাকিয়ে রয়ে বলে উঠলো,

— বাবা।

তুহিন দরজা ধরে বসে পরলো। আরহাম হতবাক। হতবিহ্বল। কোথা থেকে এলো চাচ্চু? কিভাবে পেলো? কখন এলো? কিছু মাথায় এলো না ওর। তোঁষা হাসি হাসি মুখ করে মুঠোয় থাকা খাবার টুকু বাবা’কে দেখিয়ে বললো,

— বাবা খাবে।

বলেই উঠতে নিলো বিছানা থেকে। উঠে যেতে নিলেই দুই পা এগিয়ে এসে ধপ করে পরে গেলো। পড়েই হু হু করে কেঁদে উঠলো। ফ্লোরে ছড়িয়ে পরলো হাতে থাকা ভাতটুকু। আরহাম তারাতাড়ি তোঁষা’কে ধরে বুকে নিলো। ব্যগ্র হয়ে বলতে লাগলো,

— তুঁষ? কিছু হয় নি প্রাণ। তাকা আমার দিকে। এই যে আমি।

তোঁষা ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আরহামে’র বাহু জড়িয়ে রইলো। আরহাম বেশ ভয় পেয়ে তাকালো তুহিনের দিকে। তুহিন এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে জ্ঞান হারালো। এবার আরহাম তোঁষা’কে ছেড়ে দৌড়ে গেলো তুহিনের কাছে। মাথাটা কোলে তুলে গালে হাত দিয়ে ডাকতে লাগলো,

— চাচ্চু? চাচ্চু উঠো। কি হয়েছে? কথা বলো।

তুহিন কথা বলে না। আরহাম কাঁধে তুলে নিলো তাকে। পাশের রুমে নিতে নিতে কানে এলো তোঁষা’র কান্না। সমানতালে কেঁদে কেঁদে আরহাম’কে ডেকে যাচ্ছে সে। আরহাম তাকে ফ্লোরে বসিয়ে রেখেই এসেছে।
.
তুহিন চোখ খুলে তাকালো মিনিট ত্রিশ পর। আরহাম ওর ব্লা’ড প্রেশার চেইক হাই। এই বয়সে এটা খুবই রিক্স হয়ে যাচ্ছে। আরহাম’কে চোখের সামনে দেখেই কেঁদে ফেললেন তিনি। আরহাম ওনার একটা হাত ধরলো শক্ত করে। এই মানুষ গুলো এক সময় তাকে অনেক পীড়াদায়ক যন্ত্রণা দিয়েছে। জেনেটিক সমস্যা’কে পাগলের অপবাদ দিয়েছে। দূরে ঠেলেছে। অবশেষে প্রতারণা করেছে।
চাইতেই আরহাম তুহিন’কে কিছু বলতে পারলো না৷ মানুষটার বয়স হয়েছে। আজ অবশ্য অতিরিক্ত দূর্বল দেখাচ্ছে তাকে। আরহাম ওনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

— কেঁদো না চাচ্চু।

— আমার পুতুল….

— আছে। পাশের রুমে।

— ও..ও এমন করছিলো কেন? ওকে কি করেছিস আব্বু?

আরহাম এই প্রশ্নটা এরিয়ে গিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো,

— এখানে কিভাবে এলে চাচ্চু?

তুহিন চোরা চোখে আশেপাশে তাকালো। আরহাম গভীর ভাবে তাকে দেখে যাচ্ছে। মানুষের চোখের ভাষা খুব ভালোই পড়তে পারে সে।

তুষা’র ঢাকা এসেছে আরহামে’র খোঁজ পেয়ে। এসেই জোড়ালো ভাবে খুঁজাখুঁজি চলছিলো। তুষার যখন আজ দুপুরে ফোনে কারো সাথে কথা বলছিলো তখনই তুহিন তা শুনে ফেলে। এক মুহুর্ত দেড়ী না করে এসে পরে এখানে। যদিও আসাটা অত সহজ ছিলো না। তুষার আরহামে’র ফ্ল্যাটের লকের চাবি ও ডুপলিকেট বানিয়েছিলো। তুহিন লুকিয়ে সেটা নিয়ে এসেছে।

— কথা বলো?

আরহামে’র এমন শান্ত বাণীতে চমকালো। ঢোক গিলার চেষ্টা করলেও যখন পারলো না তখন পাশ থেকে পানি নিয়ে খাওয়ালো আরহাম। তুহিন একটা শ্বাস ফেলে বললো,

— পুতুল?

— বললাম তো আছে।

— এখানে এনে দাও না আব্বু।

— সবাই জানে আমরা এখানে?

— না না। আমি জানি। তুষার জানে আর কেউ না।

–ভাইয়া জানে তুমি এখানে?

— লুকিয়ে এসেছি।

— প্রতারক, জালিম হওয়ার পাশাপাশি চুরিতে ও পারদর্শী তোমরা।

— কথা শু…

— শুহ।

— পুতুলকে দেখব।

— কি দেখবে?

এই পর্যায়ে খেই হারিয়ে ফেললো তুহিন। তার কলিজার টুকরো মেয়েকে সে দেখবে এটা ও কি বলতে হবে? তবে কি আরহাম দেখতে দিবে না?

আরহাম অতটাও নিষ্ঠুরতম আচরণ করলো না। দেখা করালো। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো। তোঁষা চিনতে পারলো না তুহিন’কে। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে আরহামে’র বুকে মুখ লুকালো। আহত চোখে তাকিয়ে রইলো তুহিন। কথা বলার ভাষা হারালো আগে। তার মেয়ে তাকে চিনতে পারছে না কিন্তু কেন?
আরহাম নাকের পাটা ফুলিয়ে তোঁষার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে তুহিন’কে উদ্দেশ্য করে বললো,

— যেভাবে এসেছো সেভাবেই চলে যাও চাচ্চু।

তুহিন থাকতে চাইলেও থাকলো না। মন মানলো না। পেছন থেকে ই তোঁষা’র ছোট্ট চুলে হাত বুলিয়ে এক পা করে পিছু হটলো। একসময় বেরিয়ে এলো।
আরহাম ক্ষুদ্র শ্বাস ফেললো। মুখ বিকৃত হলো। তোঁষা তার বুকে কামড়াচ্ছে।
.
রাত বারোটা। হঠাৎ আরহামে’র ফোনটা বেজে উঠলো। পাশেই কাঁথার নিচে গুটিয়ে তোঁষা ঘুমাচ্ছে আরহামে’র নগ্ন বুকে। শীতলায় ঘেরা পরিবেশটাতে ফোনের শব্দ বিরক্ত করলো আরহামকে। তখন তোঁষা’র জন্য ফোনটা লুকানো হয় নি। আরহাম উঠতে নিলেই নিজেকে তোঁষা’র মাঝে আটকা পেলো। ওর নড়াচড়াতেও তোঁষা ও নড়লো। অতি যত্নে ওর মাথায় আদর করলো আরহাম। ফোনটা খুঁজে বের করলো ফ্লোরে থাকা প্যান্টের পকেট থেকে।
রিসিভ করেই থম ধরে গেলো আরহাম। তাকালো তোঁষা’র পানে। এক হাতে চুল টেনে ধরে আরহাম। অপর পাশ থেকে এখনও বলে যাচ্ছে,

— স্যার স্যার আছেন? ম্যামের বাবা ইন্তেকাল করেছেন। এখন হসপিটালেই আছেন। বাসায় নেয়া হবে। স্যার শুনছেন?

টুট টুট শব্দ হলো। আরহাম তোঁষা’কেই দেখে যাচ্ছে। ওকে কিভাবে বলবে এই সত্যি? কেমন প্রতিক্রিয়া হবে তোঁষা’র?

#চলবে….

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২৯

আলগোছে তোঁষা’র মাথাটা নিজের কাঁধ থেকে সরালো আরহাম। গাড়ির কাঁচে শেড থাকায় বাহির হতে কিছুই দেখা যাচ্ছে না ভেতরে অথচ ভেতর থেকে সবটা দেখছে আরহাম। শেখ বাড়ীর সদর দরজা খোলা। নামীদামী হওয়াতে অনেক মানুষের আনাগোনা। আরহাম গাড়িটা রেখেছে একদম সাইডে। তোঁষা’র মুখের মাস্ক’টা একটু ঠিক করে দিয়ে ওকে নিয়ে গাড়ি থেকে নামলো আরহাম। তোঁষা’র চোখমুখ স্বাভাবিক। রাতে শেষ হওয়ার পথে। আরহাম নিজের সাথে এক প্রকার যুদ্ধ করে তোঁষা’কে নিয়ে এসেছে এখানে। তোঁষা আরহামে’র হাত ধরে বললো,

— এখানে এলাম?

— হু।

— ভেতরে যাব?

— যাব।

তোঁষা কথা বললো না। মাথা ঝিমঝিম করছে তার। আরহাম ভাই এখানে কেন আনলো ওকে তা বুঝে উঠতে পারছে না। আরহাম ওর হাত ধরে বাড়ীতে প্রবেশ করলো। ওমনিই কান্নার শব্দ কানে এলো। কিছু একটা ধাক্কা খেলো তোঁষা’র বুকে। ওর মায়ের গলায় কান্না শুনা যাচ্ছে। তোঁষা চোখ বন্ধ করে মনে করার চেষ্টা করলো। হ্যাঁ। এটাই তো মায়ের গলার শব্দ। পরক্ষণেই মনে হচ্ছে না। এটা মায়ের গলা না। তোঁষা’র ঠিকঠাক মনে পরছে না। আরহামে’র বাহুটা শক্ত করে ধরে জিজ্ঞেস করলো,

— কে কাঁদে?

–ভেতরে চল।

আরেকটু সামনে এসে তোঁষা’কে ছেড়ে দিলো আরহাম। দেখার পালা তোঁষা আদৌ চিনতে পারছে কি না। হুটহাট ওর ভুলে যাওয়ার সমস্যা টা সাময়িক হয়। তোঁষা’কে এই মুহুর্তে কেউ খেয়াল করলো না।
মাঝখানে রাখা তুহিনের দেহটা। এই বয়সে মৃত্যুটা অতটাও অস্বাভাবিক না। তবে তুহিনের মৃত্যু’টা অস্বাভাবিক বটে। ভালো মানুষটা বাসায় ফিরেই স্ট্রোক করে বসলো। হাসপাতালে নিতে নিতে দুনিয়া ত্যাগ করে ফেললো। এতদিনের তার চিন্তা, মেয়ের শোক সবটার অবসান ঘটলো। স্বামী’র লা’শের খাট ধরে অঝোরে কেঁদে যাচ্ছে তোঁষা’র মা। পাশেই তুষা’র। মাথা নিচু করে সেও মায়ের পাশে বসা। এক হাতে মায়ের রুগ্ন দেহটাকে নিজের বুকে আগলে রেখেছে সে।
একে একে সবার দিকে নজর বুলালো তোঁষা। চাচা কাঁদছেন। চাচি ওর মায়ের পাশে বসা। একবার মনে হলো আরহাম ভাই দাঁড়িয়ে। কিন্তু না ওটা আদনান ভাই৷ তোঁষা আশেপাশের মানুষদের ও দেখে নিলো। অতঃপর তাকালো আরহামে’র দিকে। কোন ভাবান্তর ছাড়া তোঁষা’র ঐ চোখজোড়ায় কিছু একটা দেখলো আরহাম যা ওর বুকে আঘাত হানলো।
সেই নজরে টিকতে পারলো না আরহাম। সহসা দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিলো। তোঁষা অবুঝের ন্যায় বাবা’র খাটের পাশে বসলো হাঁটু মুড়ে। অল্প ঢোক গিলে হাত বাড়ালো বাবা’র দিকে। বন্ধ চোখে, মুখে হাত বুলালো অতি যত্নে। বাবার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে ডেকে উঠলো,

— বাবা?

যেই ছোট্ট একটা ডাকের বিনিময়ে তুহিন তিনবার উত্তর করতো আজ সেই কাঙ্খিত বাবা ডাকের বিনিময়ে কোন জবাব এলো না। তুহিন শুনলো না সেই অতি মায়াময় ডাকটা তার অতি সখের শেষ বয়সে জীবনে আসা মেয়ে থেকে। যাকে প্রায় বছর খানিক সময় ধরে খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত হয়ে তুহিন দুনিয়া ত্যাগ করলো সেই পুতুল আজ তার সন্নিকটে। অতি কাছে। সে ডাকছে তার বাবা’কে অথচ তুহিন কি না অপারগ। সে শুনতেই পেলো না তার পুতুলের ডাক। যেই পুতুল গতকাল তাকে খনিকের জন্য চিনতে পারলো না সেই পুতুল আজ কত সুন্দর হেটে এলো বাবা’র নিকট। ভালোবাসার কাছে হেরে গেলো স্বার্থপর এই বাবা’র ভালোবাসা। তুহিন স্বার্থপরের মতো সবটা করলো। তার প্রথম স্বার্থ ছিলো তোঁষা। তার পুতুল’কে সে এতটাই ভালোবাসতো যে আরহামে’র সামান্যতম দোষটা মানতে পারলো না। নিজের পুতুলের মধ্যেই সে নিজের ভালো থাকা খুঁজে নিয়েছিলো অথচ ভুলেই বসেছিলো তার পুতুল ভালো থাকতো আরহামে’র কাছে। আজও শুধু মাত্র সে তার পুতুলের নজরে অচেনার শোক সইতে না পেরে দুনিয়া ত্যাগ করলো। সত্যি ই কি তবে তুহিন স্বার্থপর?

তুষার খেয়াল করলো তোঁষা’কে। বোরকা পড়া, মুখ ঢাকা থাকলেও তুষারে’র তার পুতুলকে চিনতে বিলম্ব হয় নি। বাবা পুতুলের কাছে গিয়েছিলো এটা জেনেছে তুষার। শেষ সময়ে বাবা তাকে ভাঙা গলায় জানিয়েছিলো, পুতুল তাকে চিনে নি। কেন, কিভাবে এসবের উত্তর জানা নেই তুষারের। মা’কে বুকের মধ্যে নিয়ে তোঁষা’র মাথায় হাত রাখলো তুষার। তোঁষা তাকালো ভাইয়ের দিকে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়েই রইলো। তুষারের বুকটা মোচড় উঠলো। তার পুতুলটা এমন অনুভূতিহীন ভাবে তাকিয়ে আছে কেন?
তুষার ডাকলো,

— পুতুল?

— বাবা কথা বলে না কেন? আমার সাথে রেগে?

হঠাৎ তোঁষা’র গলা শুনতেই কয়েক জড়ো চোখ তাকালো ওর পানে। ওর মা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো পাশে বসা তোঁষা’কে দেখে। আচমকা এক থাপ্পড় পরলো ওর গালে। পরপর দুই তিনটা আরো পরলো। চিৎকার করে ওর মা বলতে লাগলো,

— তুই মে’রেছিস! তুই মে’রেছিস আমার স্বামী’কে। তোর কোনদিন ভালো হবে না তোঁষা। আমি আমার আল্লাহর কাছে বিচার দিলাম। যেভাবে আমার সব সুখ তুই ধ্বংস করলি সেভাবেই তোর সুখ ধ্বংস হবে। যেই সুখের জন্য এতগুলো প্রাণ আজ প্রাণহীন তোর সেই সুখ অচিরেই ধ্বংস হবে। এক সদ্য বিধবা নারীর অভিশাপ তোকে তোঁষা। আমার অভিশাপে ধ্বংস হবি তুই।

উপস্থিত সকলে হায় হায় করে উঠলো। এ কেমন অভিশাপ? কোন মা এভাবে অভিশাপ দেয়? পাশ থেকে চাচি মুখ চেপে ধরলো ওর মায়ের। আরহাম তোঁষা’র গালে থাপ্পড় পড়তেই এসে তোঁষা’কে নিজের কাছে নিয়েছে। তোঁষা কোনরূপ বাক্য উচ্চারণ করলো না। তুষার বোনকে আরহাম থেকে ছাড়িয়ে নিজের বুকে নিলো৷ কপালে চুমু খেয়ে গালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,

— সোনা আমার। পুতুল, ব্যাথা পেয়েছিস? মা ইচ্ছে করে এসব করে নি। ভাইয়ের জান, তাকা আমার দিকে। তোর এই অবস্থা কেন? কথা বল পুতুল। তাকা আমার দিকে।

তোঁষা তাকালো তবে কথা বললো না৷ কথা বলার শক্তি পেলো না ও। ভাইয়ের বুকে মিশে রইলো কিছুক্ষণ। এরপর নিজেই সরে এসে বাবা’র গালে হাত বুলালো। উঠে দাঁড়িয়ে সোজা আরহামে’র কাছে এসে বাহু জড়িয়ে ধরে মিনমিন করে বললো,

— বাসায় চলো প্রাণ।

তোঁষা’র অস্বাভাবিক আচরণে ভয় পেলো আরহাম। এই সময় এতটা শান্ত কেন ওর তুঁষ? কোনমতে আরহাম বললো,

— আজ থাকি প্রাণ আমরা……

— উহু। চলো বাসায় যাব।

কথাটা বলেই আরহামে’র বুকে মুখ লুকালো।

#চলবে…..

প্রিয়_প্রাণ পর্ব-২৬+২৭

0

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২৬

হাত চুয়ে চুয়ে র*ক্ত গড়িয়ে পরছে তোঁষা’র। সুন্দর মুখটাতে সাজ লেপ্টে একাকার। আরহামে’র পা জোড়া রুমে এসেই থমকে গেলো। তোঁষা’র বা হাতে সিরিঞ্জের নিডলটা ঢুকে আছে সেখান থেকেই র*ক্ত পড়ছে। শাড়ীটা না কত সুন্দর করে পরলো অথচ এখন আঁচলটা ও জায়গা মতো নেই। কেন নেই? কি হয়েছে তা বুঝে না আরহাম। শুধু ধপ করে বসে পরে ফ্লোরে। তোঁষা’র চোখের পাপড়িগুলো নড়ছে অল্পসল্প। পাতলা লাল রঙে রঙ্গিন ঠোঁট’টা কাঁপছে অনবরত। মনে হচ্ছে কিছু বলছে। হাঁটুতে ভর দিয়েই এগিয়ে এলো আরহাম। তাকালো ওর তুঁষে’র পানে। একহাত রাখলো তোঁষা’র গালে। তোঁষা এলিয়ে দিলো নিজের মুখটা। সম্পূর্ণ ভর এখন আরহামে’র হাতের তালুতে। এক হাতে খুবই ধীরে তোঁষা’র হাতে গাঁথা সুই’টা টেনে নিলো। এখনও কিছুটা লিকুয়িড বাকি এটাতে। টান দিয়ে বের করতেই র’ক্ত গড়ালো আবারও। আরহাম খুব অল্প স্বরে ডাকলো,

— তুঁষ?

— হুউ।

মৃদু শব্দে উত্তর করে তোঁষা। বুক ফুলিয়ে শ্বাস টানলো আরহাম। ক্লান্ত অবশান্ত চোখ দুটো দেখেই যাচ্ছে তোঁষা’কে। বারবার আরহামে’র ভেতরটা চিৎকার করে বলছে, “কেন এইসব?”

তোঁষা’কে বুকে টেনে নিলো আরহাম। সামনে তিনটা এম্পুল খালি দেখে যা বুঝার বুঝলো। ভয়ে এবার তোঁষা’কে বুকে জড়িয়ে শক্ত করে ধরে কেঁদে ফেললো আরহাম। তোঁষা ম’রার মতো পরে রইলো আরহামে’র বুকে। আরহাম গুমড়ে কাঁদতে কাঁদতেই অভিযোগ জানায়,

— তুই না সাজলি? তুই না কেক বানালি? কোথায় সব? এই তুঁষ, কথা বল! এসব কি করলি তুই প্রাণ? তুই এটা কি করলি? এভাবে…..

কথা বের হলো না আরহামে’র গলা দিয়ে। শব্দ করে কেঁদে যাচ্ছে ও। খেয়াল রইলো না তোঁষা’র দিকে। তোঁষা’র নেতানো শরীরটা নিজের বুকে নিয়ে বহু কষ্টে আরহাম উঠে। বিছানায় যত্ন করে রাখে। ড্রয়ার খুলে তুলা দিয়ে তোঁষা’র হাতটা পরিষ্কার করে। একটু ঢোক গিলে তোঁষা’র আঁচলটা বুকে টেনে দিলো। দুই হাতে তোঁষা’র মুখটা ধরে কপালে দীর্ঘ সময় নিয়ে ঠোঁট ছোঁয়ালো আরহাম৷ ধীরে ধীরে নামলো নাকে অতঃপর ঠোঁটে। আলতো আদর দিতে দিতে বুকে নামলো আরহাম। মাথা রাখলো তোঁষা’র বক্ষে। ছোট্ট শিশুর ন্যায় জায়গা করে নিলো তোঁষা’র বুকে।
আরহামে’র কম্পিত শরীরটা মিশে গেলো ওর তোঁষা’র সাথে। ঠিক অবুঝের ন্যায় সে কাঁদলো তার তোঁষা’র বুকে।
অবহেলায় ফ্রিজে পরে রইলো অপরিপক্ক হাতে বানানো চকলেট কেকটা।
__________________

এত রাতে বেজায় মেজাজ খারাপ হলো তুষা’রের। ওর হাতে তথ্য’র রিজাইন লেটার। যদিও এটা সরাসরি দায়িত্বরত অফিসারের নিকট পাঠানো হয় তবে তথ্য’র এই লেটার পাওয়া মাত্র পাঠানো হয়েছে তুষা’রের কাছে। তুষারের দায়িত্ব না এসব হ্যান্ডেল করা। তবুও না চাইতে ডাক পাঠালো তথ্য’কে। এদিকে ঘন্টা পার হয়ে গেলেও তথ্য’র আসার নাম নেই। বিরক্তিতে দুই আঙুল কপালে ঘঁষলো তুষার। এমনিতেই তোঁষা নিয়ে চিন্তায় আছে ও। বাসা খোঁজ খবর নেয়া হচ্ছে না। আদনানে’র সাথে কথা হলো কিছুক্ষণ আগে। মায়ের শরীর খারাপ যাচ্ছে। বাবা বৃদ্ধ বয়সে এসে অতি আদরের মেয়েকে হারিয়ে পাগল প্রায় অবস্থা। এদিকে তুষা’র ডিউটি করে বোনের খবর যোগাতে ব্যাস্ত অথচ নতুন করে নাটক শুরু করেছে তথ্য। আজ একে উচিত শিক্ষা দিয়েই ছাড়বে তুষার৷ এই মেয়ের সাহসের তারিফ করতে হয়।

উঠে দাঁড়িয়ে গটগট পায়ে বাইরে এলো তুষার৷ হাটা দিলো তথ্য’র রুমের দিকে। এই প্রথম নক না করেই তুষার ঢুকে পরলো। ঢুকতেই কিছুটা অবাক হয়ে গেল। রুম জুড়ে কাপড় ছড়িয়ে তা লাগেজ ভরছে তথ্য সেই সাথে সমান তালে কেঁদে যাচ্ছে। এই প্রথম বুঝি এই মেয়েকে কাঁদতে দেখলো ও। সবসময় যথেষ্ট সাহসীকতার পরিচয় দিয়েছে তথ্য। যথেষ্ট স্ট্রং একজন অফিসার অথচ এই মেয়ে এখন ছেঁকা খেয়ে ব্যাকা টাইপ কান্না করছে। তুষার গলা খেঁকানি দিতেই তথ্য তাকালো। তুষারকে দেখে চমকালো না বরং লাগেজের চেইন লাগানো। হাতে ফোন তুলে সোজা বাবা’কে কল লাগিয়ে একদমে বলে উঠলো,

— ঐ পাইলট’কে বিয়ে করব৷ সকালেই বাসায় পৌঁছে যাব বাবা।

তথ্য’র হাত থেকে ফোনটা টেনে নিয়ে কল কাটলো তুষার। ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বললো,

— এসব কি?

বলেই লেটারটা ছুঁড়ে মারলো তথ্য’র সামনে। তথ্য সেটা উঠিয়ে শান্ত স্বরে বললো,

— রিজাইন লেটার।

— ফর হোয়াট?

— আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু কন্টিনিউ।

— তার জন্য যথেষ্ট কারণ সহ রিজাইন লেটার দরকার। এই ফালতু লেটার কোন সাহসে পাঠাও? মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে?

— প্রাথমিক ভাবে পাঠিয়েছি স্যার। এন্ড খুব শিঘ্রই বিয়ের জন্য ছুটি নিব অতঃপর পারমানেন্ট বিরতি।

— তথ্য।

— বলুন।

চোখে চোখ রেখে বললো তথ্য। কিছুটা অবাক হয় তুষার। এই পর্যায়ে কিছুটা কাতর শুনালো তুষা’রের গলা,

— সময় দাও কিছুটা।

— পাইলট এন্ড আর্মি ভালো মানাবে। এটাই তো বলেছিলেন স্যার।

— সময় দেয়া যাবে না?

— আর কত?

— আর কিছুটা।

— বিয়ে করবেন আমাকে?

……………

— বিয়ের নাম শুনতেই শেষ? এখন নিন সময়? আপনি কোনদিন কাউকে ভালোবাসতে পারবেন না তুষার। কোনদিন আমাকে বিয়ে ও করতে পারবেন না। জাস্ট এমনিই এতদিন আমাকে ঘুরালেন আপনার পিছনে। ওহ সরি আপনি ঘুরান নি বরং আমি ঘুরেছি। আপনাকে বিরক্ত করার জন্য আমি দুঃখীত স্যার। আপনাকে আর জ্বালাবে না তথ্য। থাকবেই না এখানে। আপনি বিয়ে করুন কার্নেল তাহেরের মেয়েকে। এই জন্যই আমাকে পাত্তা দেন না? আগে বললেই হতো……

তথ্য’কে কথা সম্পূর্ণ করতে দেয়া হলো না। তুষার তাকে আটকে দিলো। তথ্য’র দম বন্ধ হওয়ার জোগাড় হলো। শ্বাস আটকে এলো। হাত পা ছুড়লেও লাভ হলো না। দুই হাত পিছন দিকে মুচড়ে ধরা তুষার নিজের বা হাত দিয়ে। ডান হাতটা তথ্য’র চুলের ভাজে। শক্ত করে তথ্য’র চুল খামচে ধরা তুষার। এই প্রথম নিজের এতটা সন্নিকটে কোন পুরুষের অস্তিত্ব কাঁপিয়ে তুললো তথ্য’কে। হাল ছেড়ে দিলো সে। তথ্য’র মনে হচ্ছে ওর শরীরটা ভাসছে বাতাসে। কখন যে তুষার ওকে উঁচু করলো টের ই পেলো না ও।
দীর্ঘ পাঁচ মিনিট পর ছাড়া পেলো তথ্য। সাথে সাথেই জোরে শ্বাস টানতে চাইলো। লাভ হলো না এতে তুষার পুণরায় একই কাজে মত্ত হলো।

দুই মিনিট যেতেই ছাড়লো তুষার। তথ্য’র অবস্থা যেন বেগতিক। তুষার তথ্য’র কাঁধের দিকে নিজের মুখ ঘঁষে ঠোঁট মুছে নিলো। তথ্য’র মুখের সামনে মুখ নিয়ে বললো,

— পাঁচ মিনিট টিকতে পারো না সারাজীবন কিভাবে টিকবে?

তথ্য শ্বাস টানার কারণে কথা বলতে পারলো না। তুষার পুণরায় বললো,

— দশ মিনিট পানির নিচে কিভাবে ছিলে ট্রেনিং এর সময়? এখন তো দুই মিনিট ও ঠিকঠাক ভাবে পারলে না কিছু।

তথ্য হঠাৎ কেঁদে উঠলো। দুই হাতে তুষা’রের গলা জড়িয়ে ধরে ধরতেই তুষার আলগা হাতে তথ্য’কে জড়িয়ে ধরলো। কানে চুমু খেয়ে বললো,

— এখন করবে বিয়ে?

— করব।

#চলবে…..

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২৭

সময় গুলো খুবই দ্রুততার সাথে অতিক্রম করে চলে গেল। দেখতে দেখতে চোখের পলকে কিভাবে যেন সাতটা মাস অতিক্রম হলো। কেউ টের পেলো না আবার কেউ বা কারা টের পেলো অতি গভীর ভাবে। নিগূঢ়তার সাথে। কারো জীবন ছন্নছাড়া হলো তো কেউ হারালো জীবনের লক্ষণ। কেউ বা গা ভাসালো স্রোতের সাথে। কেউ আছড়ে পরলো তাল মিলাতে না পেরে।

কপালে জমা ঘাম টুকু হাত দিয়ে মুছলো তথ্য। ক্লান্ত লাগছে আজ। সোজা হেটে সামনে গিয়ে ঠান্ডা পানি পান করলো কিছুটা। সস্তি শরীর পেলেও মন পেলো না। মন টা আদৌ কি আছে তার সাথে? নিজেকে প্রশ্ন করেও উত্তর পেলো না তথ্য। তুষার, খারাপ লোকটা যাওয়ার সময় তার মন সহ সবটা নিয়ে গিয়েছে। রেখে গিয়েছে শূন্য এই দেহটাকে। যেটা টেনে বেড়াচ্ছে তথ্য একা। একা থাকলেই মনে হয় এই বুঝি তুষার এলো। অপেক্ষাটা দীর্ঘ হচ্ছে। তথ্য শ্বাস ফেললো ক্ষুদ্র একটা। সকল মন খারাপ তো তখনই মিটে যায় যখন সেদিন রাতের কথা ভাবে তথ্য। তুষার’কে ক্ষেপাতে গিয়ে নিজেই আহত নিহত হয়েছিলো তথ্য। তথ্য’কে নিয়ে ঐ দিন ই বিয়ে করলো। ঐ অচেনা রাজশাহী শহরে দুটো আর্মির বিয়ে হলো। সাক্ষী রইলো চারজন বড় আর্মি অফিসার আর মেহমান হলো ট্রেনিং এ থাকা জুনিয়র সকলে। কি এক আজব কান্ড ই না ঘটলো। কর্নেল তাহেরের আচরণ ছিলো সবচেয়ে অবাক করা। তুষারের কান্ডে তার উচিত ছিলো রেগে যাওয়া অথচ তিনি রাগ করলেন না বরং নিজে দাঁড়িয়ে থেকে বিয়ে পড়ালেন।
জুনিয়র গুলো আবার এক পায়ে দাঁড়িয়ে বিশ মিনিটের ব্যাবধানে তাদের বাসর সাজালো। কিভাবে? কখন? জানা নেই তথ্য’র। কিচ্ছু জানা নেই। ভিডিও কলে তার বাবা মা দেখেছে তাদের বিয়ে।
সেদিনের রাতটা ছিলো স্বপ্নের। তুষারের মতো এত বড় একজন পুরুষ’কে বাগে আনতে পেরে তথ্য’র খুশি যখন বাঁধভাঙা তখনই তুষার রুমে ঢুকে সর্বপ্রথম যা বললো তা ছিলো তার তোঁষা নিয়ে। তার পরিবার নিয়ে। তুষার মনে কিছু রাখে নি বরং তথ্য’কে সবটা জানায়। এটাও জানায় তার জীবনে তোঁষা’র গুরুত্ব ঠিক কতটুকু। তথ্য আগেই জানতো। তবে বোনের প্রতি ভাইয়ের এহেন ভালোবাসা আর পিতা সুলভ আচরন দেখে মুগ্ধ বৈ কিছু হলো না।
তুষার’কে হতাশ করে নি তথ্য। বরং সেদিন রাতটাকে তারা রাঙিয়েছিলো নিজ রঙ তুলির আচড়ে। তথ্য সেখানে ছিলো এক অবলা ক্যানভাস। আর সেই ক্যানভাস জুড়ে তুষা’র এঁকেছে। মন প্রাণ উজার করে প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষটা আচড় কেটেছে নিজের তুলির। রাঙিয়েছে তথ্য’কে নিজ রঙে। পূর্ণতা পেয়েছে তাদের ভালোবাসা।
এত এত সুখানুভূতিতে লুটোপুটি খাওয়া ক্লান্ত তথ্য সময় পেলো না অনুভূতিগুলো গোছাতে। তার আগেই এক কল এলো। তুষার ভোর রাতে শুধু তথ্য’র কপালে গভীর চুমু খেয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। মানুষটা সেই যে গেলো এখনও এলো না।

ভালেবেসে নিজের প্রাণে’র অপেক্ষা করতে জানে তথ্য। যেখানেই যাক না কেন সে প্রাণে’র টানে ফিরে আসবেই।

___________________

আরহাম দাঁড়িয়ে আছে বিছানা বরাবর। বিছানায় এলেমেলো তোঁষা ঘুমোচ্ছে। সেদিন যখন আরহাম পাগল প্রায় অবস্থা তখন তোঁষা ছিলো জ্ঞানহীন। টানা তিনদিন পর সম্পূর্ণ হুসে ফিরে তোঁষা। তবে মাঝখানে যতবার সে চোখ খুলেছিলো ততবার আতঙ্কিত চোখে দেখেছিলো আরহাম’কে। সেই দৃষ্টি আজও ভুলতে পারে না আরহাম। বিগত সাতটা মাস ধরে সেই দৃষ্টিগুলো ভুলতে পারছে না ও। তোঁষা আরহাম’কে চিনতে পারে নি। কেন পারে নি এর উত্তর জানা নেই। আরহাম যখন কাছে এসে ধরতে চাইলো তখন ই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠে তোঁষা। ভরকে যায় আরহাম। কিছুতেই তোঁষা ওকে চিনলো না। এক সময় তড়পাতে তড়পাতে জ্ঞান হারালো। টানা দুই দিন এমন করে তৃতীয় দিন থেকে তোঁষা কিছুটা স্বাভাবিক হয়। প্রায় সপ্তাহ খানিক পর তার মনে পরে সেদিন সে কেক বানিয়েছিলো। এক সপ্তাহ পর তোঁষা আরহামে’র কেক কাটলো। আরহাম আতঙ্কে আতঙ্কে কেক কেটেছে। সে নিজেই তোঁষা’কে দেখে টানা এক সপ্তাহ ঘোরের মাঝে ছিলো।

তবে এরপর থেকে মেডিসিনগুলোর এফেক্ট উল্টো পরলো। চারমাস চলা কালীন সময় থেকে তোঁষা ধীরে ধীরে ভুলতে শুরু করলো। আরহাম তো এটাই চেয়েছিলো। ও চেয়েছিলো ওর তোঁষা সব ভুলে যাক। ভুলে যাক প্রতারকদের। ধোঁকাবাজদের। শেখ বাড়ীর সকলকে। আরহামে’র চাওড়া ধীরে ধীরে পূরণের পথে ছিলো। তোঁষা ভাবশালীন ভাবে থাকা শুরু করলো। সারাদিন একা একা থেকে এর এফেক্ট পরলো ভিন্ন ভাবে। কিছুটা উগ্র আচরণের দেখা মিললো সারে চার মাসের সময়। বিয়ের তাদের বছর পূর্তি হলো। আরহামের স্বপ্ন গুলো পূরণের পথে অথচ আরহাম খুশি থাকতে পারছে না। কোথায় যেন খটকা বেঁধেই যাচ্ছে তার। তোঁষা ধীরে ধীরে সকলকে ভুলতে চলেছে। দিনের আলো ভুলতে চলেছে। এই একটা ফ্ল্যাট জুড়েই তার আনাগোনা। বারান্দায় যেতে দেয় না আরহাম এখন। এর অবশ্য কারণ রয়েছে।
গতমাসে তোঁষা পালাতে চেয়েছিলো। ভাবা যায়? আরহাম থেকে পালাতে চায়? ডোজ কেটে যেতেই তোঁষা মেইন দরজা খুলে ফেলেছিলো। ভাগ্যিস আরহাম ঐদিন তারাতাড়ি বাড়ী ফিরলো নাহলে কি হতো? হারিয়ে যেতো না আরহামে’র তোঁষা। তখন কি করত আরহাম? রাগান্বিত আরহাম সেদিন থেকে বাসা বন্দী না বরং রুম বন্দী করে তোঁষা’কে। তোঁষা প্রথম প্রথম কাঁদলেও গত দুই দিন ধরে কাঁদছে না। আরহাম এতেও খুশি হতে পারলো না। পারছে না। হাজার চেয়েও ও খুশি হতে পারছে না। এর কারণ জানা নেই ওর। ও তো এটাই চেয়েছিলো ওর তুঁষ ওর থাকুক। আরহামে’র বুকে ওর প্রাণ থাকছে। যেভাবে চেয়েছিলো ঠিক সেভাবে তবে আরহাম এখনও সন্তুষ্ট নয়। তার বুকে যেন এখন ছটফটানি বেড়েছে। তুঁষটা আগের মতো নেই? কেন নেই? আগের মতো কেন আদর করে না আরহামকে? কেন সে আরহামে’র সাথে আগের মতো কথা বলে না? সেবার টানা একদিন কথা ছাড়া ছিলো। কি ভয়টাই না পেলো আরহাম। পরদিন যখন কথা বললো তখন ই না আটকে রাখা শ্বাস ছাড়লো।
.
চুলগুলো নিয়ে বিপত্তি বেঁধেছে ইদানীং। আরহাম গোছাতে পারে না। তাই আজ সিদ্ধান্ত নিয়েছে তোঁষা’র এই হাঁটু সমান চুলগুলো ছোট করে দিবে। তোঁষা নিজেই কেমন কেমন করে চুল নিয়ে। ঘুমন্ত তোঁষা’কে সযত্নে বুকে তুললো আরহাম। তোঁষা বেভুর ঘুম। খানিকক্ষণ আগে তাকে ইনজেকশন পুশ করা হয়েছে। আরহাম এক হাতে ফোন তুলে কল দিতেই দরজা ঠেলে এক মেয়ে ঢুকলো। মেয়েটা যে কতটা ভীতু হয়ে আছে তা তার চোখ দেখেই বুঝা যাচ্ছে। আরহাম ইশারা করতেই মেয়েটা তোঁষা’র হাঁটু সমান চুলগুলো কেটে দিলো। মনে হলো কেউ আরহামে’র বুকে চালান করলো কেঁচি’টা। মেয়েটার ও আফসোস হলো। কত সুন্দর বড় বড় চুল। এভাবে কেউ কাটে? একদম ঘাড়ের ওপর সমান গোল করে কাটা হলো।
আরহাম এমনটাই বলেছিলো। মেয়েটা যেতেই স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো আরহাম। তার বুকে যন্ত্রণা হচ্ছে। অসম্ভব এক যন্ত্রণা।
এই চুলগুলো তো ওর ভীষণ প্রিয়। ছোট্ট থেকেই তুঁষটার ইয়া বড় বড় চুল ছিলো। চোখ মুখ যখন ঢেকে যেতো তখন চাচি চাপ ব্যান্ড পরিয়ে রাখতো। একটু চুল কাটালেই সেই কি কান্নাটাই না করতো। একবার তো আরহাম পিঠে করে বাজার ঘুরালো পরেই না শান্ত হলো।

তোঁষা’কে রেখে কিচেনে গেলো আরহাম৷ কিছু বানাবে এখন৷ তুঁষটা ঘন্টা যেতেই উঠে যাবে।
হঠাৎ তীব্র কান্নার শব্দে ভরকে যায় আরহাম। দৌড়ে আসে রুমে। ফ্লোরে বসেই চুল খামচে ধরে কেঁদে যাচ্ছে তোঁষা। আরহামের চোখের পাপড়িগুলো নড়লো। ভীত হলো কিছুটা। তোঁষা’র পাশে বসে ভীত স্বরে ই ডাকলো,

— তুঁ…তুঁষ? প্রাণ আমার কথাটা শু….

— আমার চুল? আমার চুল কেন কাটলেন? কেন কাটলেন? বলুন কেন কাটলেন? কেন?

বলেই গলা ফাটিয়ে কাঁদতে লাগলো তোঁষা৷ আরহাম কাছে আসতে নিলেই তোঁষা হাত পা দাপড়ে শুরু করলো। ওর একেকটা চিৎকার আরহামে’র হৃদয় যেন এফার ওফার করে দিচ্ছে। তোঁষা দুই হাতে বারান্দায় থাইতে থাপ্পড় মা’রতে মা’রতে ডাকলো লাগলো,

— আম্মু!!!! আম্মু তুমি কোথায়? আব্বু আমাকে নিয়ে যাও। আমি এখানে থাকব না৷ আমাকে নিয়ে যাও। ভাইয়া!!!!

কতক্ষণ দেয়ালে দুই হাত দিয়ে আঘাত করলো তোঁষা। পরণে থাকা ঢোকা টিশার্ট’টা কাঁধ বেয়ে পরে গেলো। আরহাম এক পা করে করে পিছু হটলো। বিরবির করে বলতে লাগলো,

— এটা তুই ঠিক করলি না তুঁষ। আমাকে ছেড়ে চলে যাবি? কোথায় যাবি? আমি দিব যেতে? আমার প্রাণ না তুই? তোর প্রাণ’কে রেখে কোথায় যাবি? আ…আমার কাছে থাকবি তুই।

কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে গেল তোঁষা। নাক মুখ ফুলে লাল হয়ে গেলো। হঠাৎ ওর শ্বাস কষ্ট শুরু হতেই হাসফাস করতে লাগে ও। বদ্ধ জায়গায় থাকতে পারে না চঞ্চল এই হরিণী অথচ আজ এক মাস এই রুম থেকে বের হওয়ার অনুমতি ও তার নেই। আচমকা আরহামের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে কেউ। এতক্ষণ যাবৎ ধ্যানে থাকা আরহাম হুশ ফিরে পেলো। তোঁষা ওর কাঁতরাতে কাঁতরাতে বললো,

— আ…আরহাম ভাই, শ্…শ্বাস নিতে পারি না। প..পারি ন..না তো….

আরহাম তড়িৎ বেগে তোঁষাকে বুকে শক্ত করে চাপলো। লাভ হলো না। সাফোকেশনে তোঁষা ছটফট করেই যাচ্ছে। তবুও আরহাম ওকে রুম থেকে বের করলো না। কিছুতেই বের করবে না। যদি আবারও পালায় তুঁষ? পাশ থেকে তোঁষাকে কিছু দিতেই তোঁষা শান্ত হয়ে গেলো। চোখ বুজলো খানিক বাদে।
শান্ত তোঁষাকে কোলে তুলে বারান্দায় গেলো আরহাম। আস্তে করে বসে পরলো। বাইশ তলার উপর থেকে অপরুপ সুন্দর দেখায় প্রকৃতি। রাতের এই দৃশ্য টুকু একটু বেশিই সুন্দর।
আর তার প্রাণে’র কপালে চুমু খায়। টুপ করে এক ফোটা পানি পরলো তোঁষা’র চোখে। অল্প কাঁপলো তোঁষা। ঘুমের মাঝেই বললো,

— প্রাণ যাবে না তুুমি। কাঁদব আমি। বলো যাবে না।

আরহাম আরেকটু বুকে চেপে ধরে তোঁষা’র দেহটা। ঘুমন্ত তোঁষা’র ঠোঁটে চুমু খেয়ে বলে,

— কোথাও যাব না প্রাণ।

— প্রমিস।

— প্রমিস।

#চলবে…..

প্রিয় প্রাণ পর্ব-২৪+২৫

0

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২৪

তোঁষা’র মাথাটা কোলে তুলে আরহাম শান্ত হয়ে বসে আছে। বাইরে থেকে ঝাপ্টা একটা বাতাসে শীতলতা অনুভব করলো আরহাম। ঝাপ্সা চোখে তাকালো তোঁষা’র পানে। একটু আগের করা তোঁষা’র ছটফটানি এখনও ওর চোখে ভেসে বেড়াচ্ছে। আরহাম জানে তোঁষা’কে দেয়া মেডিসিনগুলো রিএক্ট করবে। সাইড ইফেক্ট আছে তাই বলে এমন কোন কিছু যে আজ হবে তা আরহামে’র জানার বাইরে। ব্রেইন কন্ট্রোল করা আরহাম জানে। পটুত্ব যতটা দরকার তার অনেকটাই আরহামে’র আয়ত্ত্বে। দেশের বাইরে চিকিৎসা শিক্ষা উন্নত বেশ। সেখানে যদি প্রশ্ন আসে সাইকোলজি নিয়ে তাহলে উন্নয়নের শীর্ষে রয়েছে কিছু রাষ্ট্র। আরহাম যথেষ্ট মেধাসম্পন্ন ছেলে। যেমন ভাবে তার একদিক দিয়ে মানুষিক কিছু সমস্যা রয়েছে ঠিক তেমন ভাবেই তার মেধা তুখোড় এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। ইন্জিনিয়ারিং পড়া ছেড়ে হুট করে মেডিক্যাল সেক্টরে যাওয়াটা কারো জন্যই সহজ বিষয় নয় কিন্তু সেখানেও নিজের মেধার পরিচয় দিয়ে নিজেকে বিস্তর ভাবে প্রামাণ করেছে আরহাম। বাবা’র নজরে সে তোঁষা’র জন্য নিজেকে পারফেক্ট করতে চেয়েছিলো। করেছেও। তারা যদি একটা বার মেনে নিতো তাহলে হয়তো আজ আরহামে’র এতটা কঠোর হতে হতো না। তোঁষা’কে এতটা কষ্টদায়ক ভাবে ট্রিট করতে হতো না।

তখন যখন আরহাম ফিরে তাকালো তখন বিছানা থেকে নিচে পড়েছে তোঁষা। ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে নিজের মাথা নিজেই দেয়ালে বারি মে’রেছে। আরহাম’কে ধরার বা কিছু করার সুযোগ সে দেয়নি। মুহুর্তটা ভুলতে পারছে না আরহাম। বহু কষ্টে ইনজেক্ট করেছে তোঁষা’কে। এরপর এইতো মাত্র ঘুমালো। কপালটা ফুলে আছে। ডান সাইডে খুবই আলতো হাত বুলালো আরহাম। সাইড থেকে মলমটা নিয়ে খুবই যত্ন করে লাগিয়ে দিলো কপালে। কিছুটা চুল তোঁষা’র মুখে চোখে আসছে দেখে আরহাম চুলগুলো একত্রে করার চেষ্টা করছে। বেশ হিমশিম খেতে হলো আরহাম’কে। এত বড় চুলগুলো কিছুতেই আয়ত্ত্বে রাখা যায় না। তুঁষ’টা নিজেও ঝামেলায় পরে যায় চুল নিয়ে।

দৃষ্টি নিবদ্ধ তোঁষা’র মুখে। ফুলা ফুলা গাল দুটো আরহামে’র অনেক প্রিয়। যখন তুঁষ’টা জেদ ধরে বা রাগ করে তখন লাল একটা আভা ছড়ায় এখানে। লজ্জা তেমন একটা পায় না ওর তুঁষ। তাই আরহাম বুঝতে পারলো না তার তোঁষা’র মুখটা লজ্জায় রাঙা হয়? জানা নেই।
মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আরহাম ভাবনায় পরলো। ডোজটা সে নিজেই বাড়িয়েছে তোঁষা’র। আরেকটু স্টাডি করা দরকার এটা নিয়ে। তোঁষা’র এতটা মাথা ব্যাথা কেন উঠলো? চিন্তায় আরহামে’র কপালে ভাজ পড়লো। এমন হওয়াটা আজ স্বাভাবিক ঠেকল না ওর নিকট।

_________________

রাফি’কে ডেকে পাঠালো তুষা’র। রাফি শুকনো ঢোক গিলে দরজায় নক করলো। তুষা’র গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

— কাম।

— স্যার!

— কাম হেয়ার রাফি।

— সরি স্যার।

— আই সেইড ইউ টু কাম।

তুষা’রের কথা শুনা মাত্র রাফি’র ঘাম ছুটে গেলো। স্যার তাকে কেন ডেকেছে তা জানা নেই রাফি’র। ভয়ে ভয়ে আগেই সরি বলে কেটে পরতে চাইলো কিন্তু তুষারের মুখভঙ্গি দেখে কিছুই ঠাওর করতে পারলো না। তুষার বেশ স্বাভাবিকভাবেই বললো,

— বসো।

সামনের চেয়ারটা ইশারায় দেখাতেই রাফি জড়সড় হয়ে সেখানে বসলো। তুষা’র আরাম করে বসে আছে। বেশ ঠান্ডা গলায় সে বলে উঠলো,

— এখানে কেন এসেছো?

ডেকে এনে জিজ্ঞেস করছে কেন এসেছো? রাফি শুকনো গলায় বললো,

— আপনি ডেকেছেন তাই।

— আই আস্কড হোয়াই ডিড ইউ জয়েন্ড বাংলাদেশ আর্মি?

— ইটস মাই লাভ ফর মাই কান্ট্রি স্যার।

— ভুল। কোথায় দেশ প্রেম? আমি তো রাজশাহী শহর জুড়ে তোমার নারী প্রেম দেখছি।

তুষার প্রচুর চতুর মানুষ। মুখের ভাষায় মা’রতে হয় কিভাবে তা জানা আছে তার। যা বুঝার তা সে বুঝে গেলো ততক্ষণে। বেশ তারাহুরোয় বলে উঠলো,

— স্যার আই কেন এক্সপ্লেইন।

— প্রয়োজন নেই তার। ইউ মে গো।

রাফি মাথা নিচু করে চলে গেল। যাওয়ার আগে আরেকবার সরি বলতেও ভুললো না সে।

রাফি যেতেই তুষারের ফোনটা বেজে উঠে। তারাতাড়ি ফোন তুললো তুষার। ব্যাস্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

— কোন ইনফরমেশন?

অপর পাশ থেকে কিছু বললো যা শুনে ভ্রু কুঁচকায় তুষা’র। কিছুক্ষণ কথা বলে ফোনটা রাখলো বা পাশের টেবিলে। তোঁষা’টাকে খুঁজতে খুঁজতে এই মাস খানিক সময়ে হাঁপিয়ে উঠছে তুষার। অতি গোপনে আরহামে’র খোঁজ চালাচ্ছে সে। আপাতত এতটুকু শিওর আরহাম ঢাকাতেই আছে। এই পর্যন্ত দুই বার তাকে দেখা গিয়েছে তবে কেউ ই নিশ্চিত না যেহেতু আরহামে’র মুখ ঢাকা থাকে। মাক্সের দরুন চেহারা বুঝা না গেলেও কিছুটা টের পাওয়া যায়। ম্যাসেজে পাঠানো ছবিটা দেখে থমকে গেলো তুষার। হ্যাঁ এটাই আরহাম। এরমানে আরহাম তোঁষা’কেও ঢাকাতেই রেখেছে। মাথা কাজ করছে না তুষা’রের। আরহাম নিজেকে হাজার কন্ট্রোলে রাখুক না কেন দিন শেষে সে বদ্ধ পাগল হয়ে যায়। তখন কাউকে পরোয়া করে না। কতবার এর সাক্ষী স্বয়ং তুষার ছিলো। যে নিজেকে আঘাত করতে দ্বিতীয়বার ভাবে না সে তোঁষা’কে হাজার ভালোবাসা দিক দিনশেষে সেই ভালোবাসাটা ও তো উন্মাদনায় ভরপুর থাকবে। সেই প্রণয়ের ফুলকিতে ঝলসে না যায় তুষা’রের নরম বোনটা। ছোট সেই প্রাণটা।

__________________

— ক্ষুধা লেগেছে।

— হু? হ্যাঁ। খাবি তো প্রাণ। ইনসুলিন টা আগে দিয়ে নেই।

— সাথে ওটা ও দিও নাহলে আমার মাথা ভালো লাগে না।

ঢোক গিললো আরহাম। শুষ্ক গলায় জিজ্ঞেস করলো,

— ওটা মানে?

— জানি না। কিছু একটা। তুমি দাও তো। সেটাই। ওটা না দিলে আমার মাথা ভার ভার লাগে। দেয়ার পর ভালোলাগে।

— আমি কিছু দেই না তুঁষ। শুধু তোর ভালোর জন্য..

— উম। খাব এখন।

— হ্..হ্যাঁ প্রাণ যাচ্ছি এখনই।

সবে মাত্র ঘুম ভেঙেছে তোঁষার। রাত এখন আড়াইটা। আরহাম ইনসুলিন পুশ করে বিশ মিনিট পরই খাবার হাতে ঢুকলো। তোঁষা’র আচরণ স্বাভাবিক। তবে খেতে খেতে জানালো তার মাথা ব্যাথা করছে। আরহাম ব্যাস্ত হতেই তোঁষা পুণরায় বললো,

— কপালে করছে ব্যাথা।

— চলে যাবে প্রাণ। হা কর।

বড় করে মুখ খুললো তোঁষা। আজকের তোঁষা’র খাওয়াটা স্বাভাবিক ঠেকলো না আরহামে’র নিকট। এমন করে ও ওর তুঁষ খায় না। খেতে খেতে কয়েকবার গালে জমিয়ে রেখেছে। আরহাম ওকে পানি খায়িয়ে যেই না নিজে খাবে ওমনিই দেখলো খাবারে আজ লবন হয় নি। হয়নি বলতে হয়তো দেয়া ই হয় নি। তাহলে তোঁষা কেন বুঝলো না?
স্বাদকুড়িতে তো সমস্যা হওয়ার কথা না। তাহলে?

খাওয়া শেষ করে আরহাম তোঁষা’র কাছে এসে ওর কপালে হাত রাখলো। অল্প গরম শরীরটা। আজ তোঁষা’র সপ্তাহিক ইনজেকশন দেয়ার কথা। তবে দিবে কি না আরহাম বুঝতে পারছে না। ওটা দিলেই তো হাতপা ছুঁড়ে কাঁদে তোঁষা। ব্যাথা জনক ইনজেকশনটা। আকাশগুড়ুম ভাবতে ভাবতে তোঁষাই বলে উঠলো,

— আজ রাতে সুই দিবে না?

চমকালো আরহাম। বেশি তো না। এই তো টানা তিন সপ্তাহ ধরে দিচ্ছে তাহলে তোঁষা কিভাবে বুঝলো? আরহাম কিছু বলার আগেই বিছানার মাঝখানে বসে গলগল করে বমি করে দিলো তোঁষা।

#চলবে……

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২৫

তোঁষা’কে বমি করতে দেখেই চমকায় আরহাম। অস্থির হয়ে ওকে চেপে ধরে। মুহুর্তেই নিজের শরীর সহ বিছানা মেখেঝুকে ফেলে তোঁষা। একদিকে যেমন বমি করছে অন্যদিকে কান্না করছে। আরহাম কিছুটা বেকায়দায় পড়ে। তবুও তোঁষা’কে বুকে নিয়ে পুরোটা বমি করায়। বমি করার সময় তা আটকে রাখতে নেই বা মুখে চেপে রাখতে নেই। এই বমি আটকে রেখে ওয়াসরুমে যেতে যেতে কিছুদিন আগে এক বাচ্চা মা’রা গেলো।
তোঁষা’র বমি থেমে যেতেই ও আরহামে’র বুকের দিকে মুখ মুছলো। আরহাম নিজের দিকে তাকালো। আশ্চর্য একটা বারের মতো ওর নাক কুঁচকালো না। তোঁষা’র পিঠে এতক্ষণ বুলানো হাতটা এবার মাথায় বুলিয়ে বললো,

— আরো বমি করবি?

— উহু।

— আয়।

বলেই টেনেটুনে তোঁষা’কে কোলে তুললো। তোঁষা শরীর ছেড়ে আছে। আরহাম কোনমতে ওকে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে। পরপর পরণে থাকা কাপড়ে লেপ্টে যাওয়া সব পানি দিয়ে ধুয়ে এরপর তোঁষা’কে গোসল করতে সাহায্য করলো। নিজের গায়ে থাকা টিশার্ট’টা খুলে পাশে রেখে তোঁষা’কে নিয়ে বের হলো। তোঁষা’কে পাশে থাকা কাউচে বসিয়ে কিছুটা দৌড়ে ওর পোশাক বের করে আরহাম। তোঁষা’র সামনে দিতেই তোঁষা মুখ ঘুরিয়ে বললো,

— পড়ব না এখন।

— কেন?

অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো আরহাম।

— ঘুমাব।

তোঁষা’র সরল জবাব। আরহাম জোর করেই তোঁষা’কে পড়াতে চাইলো। তোঁষা ও পরবে না। বাথরোবটা গায়ে জড়িয়েই বসা থেকে কাউচে শুয়ে পরলো ও। আরহাম হার মানলো তবে ওকে অবাক করে ওকে কাছে টানলো তোঁষা। হতবুদ্ধ হয়ে গেলো আরহাম। তোঁষা’কে পরিষ্কার করালেও আরহাম পরিষ্কার হতে পারে নি। তারমাধ্যে বিছানা নষ্ট হয়ে আছে। আরহাম বাঁধা দিতে চাইলেও পারছে না। তোঁষা ওকে আঁকড়ে ধরেছে। আরহাম অসহায়ত্ব বোধ করলো। তোঁষা’কে ফেরানোর সাধ্য ওর নেই। না কোনদিন ছিলো। এদিকে তোঁষা ও ছাড়ার নাম নিচ্ছে। আরহাম ফাঁকা ঢোক গিলে তপ্ত শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলালো। অসহায় গলায় বললো,

— ত..তুঁষ এখন না।

— এখনই।

— প্রাণ আমার আমি নোংরা হয়ে আছি।

— কিছু হবে না।

— বুঝার চেষ্টা কর। সব পরিষ্কার করতে হবে।

— আগে আমি।

— হ্যাঁ আগে তুই। একটু সময় দে। আধ ঘন্টা লাগবে।

— উহু। আগে আমি।

তোঁষা থামলো না। আরহাম উশখুশ করতে লাগলো। এভাবে সম্ভব না। অলরেডি টকটক গন্ধে রুম ভরে যাচ্ছে। তোঁষা’র আঁকড়ে ধরা হাতটা ছাড়িয়ে দীর্ঘসময় ওকে চুম্বন করে আরহাম। এতে তোঁষা ছাড়লো তো না ই উল্টো আহ্লাদী হয়ে উঠলো। আরহাম পরলো বিপাকে। এবার জোর করেই তোঁষা’কে ছাড়ালো ও। উঠে বসতে নিলেই রেগে গেলো তোঁষা। আরহামে’র হাত খামচে ধরে তাকালো ওর পানে। জোরে জোরে শ্বাস টানতে টানতে বলতে লাগলো,

— ডেকেছি না আমি? কেন আসো না?

আরহাম অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তুঁষটা ও এমন না। হাতের খামচিটা তীব্র হতেই “আহ” শব্দ করে আরহাম। তোঁষা’র গালে হাত দিয়ে বললো,

— একটু সময় দে।

— না।

— প্রাণ…..

— যাহ।

আরহাম বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলো। তোঁষা’র আচরণ বুঝতে পারছে না ও৷ তোঁষা’কে ধরতে নিলেই ও ঝাড়া দিয়ে বললো,

— ধরবেন না।

বলেই উল্টো হয়ে শুয়ে পরলো। কি যে বিরবির করছে বুঝে না আরহাম। আপাতত সে ঘর গোছাতে ব্যাস্ত হলো। বিছানার চাদর থেকে নিয়ে বাকিসব ধুঁয়ে শুকাতে দেয় আরহাম। নতুন একটা বেড শিট বিছিয়ে স্যাভলন দিয়ে ফ্লোরটাও মুছলো যদিও এর দরকার ছিলো না তবে খুঁতখুঁত স্বভাবটা এখনও যায় নি ওর। একপলক তোঁষার পানে তাকাতেই দেখলো ও শুয়ে শুয়ে ফুঁসছে। এরমানে ঘুমায় নি? আরহাম তো ভাবলো হয়তো ঘুমিয়ে গিয়েছে। কিছু না বলে নিজের একটা শর্ট প্যান্ট নিয়ে গোসল করতে চলে গেল আরহাম। প্রায় বিশ মিনিট পর গোসল শেষ করে বের হয় আরহাম।
খালি বুকে বিন্দু বিন্দু তার পানির ছিটা। হাত দিয়ে চুলগুলো ঝাড়া দিয়ে তোঁষা’র পানে তাকালো। কাউচের বাইরে তোঁষা’র চুলগুলো। এগিয়ে এসে নিজের টাওয়াল দিয়ে ই তোঁষা’র চুলগুলো মুছে দিলো। তোঁষা কথা বললো না। আরহাম এবার ডাকলো,

— তুঁষ?

তোঁষা কথা বললো না। বলবে না সে কথা। কেন বলবে? রাগ হয়েছে তার। আরহাম বুঝে। অল্প হেসে ফ্লোরে বসে পা মুড়ে। তোঁষা’র পিঠে হাত রাখতেই তোঁষা মুখ তুলে তাকায়। আরহাম ব্যাস্ত হলো। হাত রাখলো ওর প্রাণে’র গালে। ব্যাস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— ব্যাথা হচ্ছে? খারাপ লাগছে তুঁষ? কথা বল। কেন কাঁদছিস?

— কথা নেই আপনার সাথে। ভালোবাসেন না আপনি আমাকে।

— কে বলেছে? তোকে না বলেছি এসব কথা না বলতে। আমার কাছে আয়।

বলেই কোলে তুলে বিছানায় নিলো তোঁষা’কে। যেই না আরহাম ওর কাছে এলো ওমনিই তোঁষা তাকে ফিরিয়ে দিলো। আরহাম অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— কি হয়েছে?

— ভালো লাগছে না। কিছু দাও তো আমাকে।

— ক..কি দিব?

— কিছু দাও। ভালো লাগছে না। মাথা কেমন করছে।

এবার ঘাবড়ে যায় আরহাম। তোঁষা ধীরে ধীরে উত্তেজিত হওয়ার আগেই আরহাম ইনজেকশন নিয়ে আসলো। তোঁষা নিজেই হাত বের করে দিয়ে বললো,

— তারাতাড়ি দিন। আমার ভালো লাগছে না। মাথা কেমন করছে।

আরহাম দ্রুত হাতে পুশ করলো। গুঙিয়ে কেঁদে যাচ্ছে তোঁষা তবে বেশিক্ষণ না। মিনিট দুই যেতেই তীব্র ব্যাথায় শব্দ করে কাঁদে তোঁষা। আরহাম বহু কষ্টে বুকে ঝাপ্টে ধরে লাভ হয় না। হাত পা দাপিয়ে মিনিট পাঁচ কাঁদলো তোঁষা। অতঃপর শান্ত। একদম ঠান্ডা। আরহামে’র বুকের মাঝে শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেলো আরহামে’র প্রাণ।
তোঁষা’র ব্যাথায় জর্জরিত মুখটাতে চুমু খায় আরহাম। গলায় মুখ গুজে শুয়ে পরে ওকে নিয়ে। অভিযোগ জানায় কানে কানে,

— এমন কেন হচ্ছে প্রাণ? এমন তো হওয়ার কথা না। তুই আজ বমি কেন করলি? কষ্ট হচ্ছে অনেক? তোর আরহাম ভাই তোকে কষ্ট দিবে না। বিশ্বাস কর আর কষ্ট দিবে না। আর কিছুটা দিন। ধীরে ধীরে সবটা ভুলে যাবি তুই। শেখ বাড়ীর কাউকে মনে থাকবে না তোর। তুই জুড়ে আমি থাকব প্রাণ। শুধু আমি। তোর শরীরে যারা এত আঘাত দিয়েছে। কষ্ট দিয়েছে। ধোঁকা দিয়েছে। এদের সকল থেকে তোকে দূরে রাখব আমি। ভিসায় ঝামেলা হচ্ছে। ওটা মিটে গেলেই আমরা দেশ ছেড়ে দিব। সব ছেড়ে তুই আর আমি সংসার করব। আমি তোকে আমার সবটা দিয়ে ভালোবাসি প্রাণ। আমৃত্যু এই আরহাম তোকে ভালোবেসে যাবে। আমি পা*গল না। বিশ্বাস কর আমি পা*গল না৷ আম্মু বলেছে আমি আমি পা*গল না। অথচ দেখ আম্মু আর তুই বাদে সবাই পা*গল ভাবে আমাকে। আমি চিকিৎসা নিয়েছিলাম প্রাণ। তোর জন্য সবটা করেছি। কিন্তু তোকে যে কারো জন্য ছাড়তে পারব না। আমার আরো কিছু ট্রিটমেন্ট সেশন বাকি। তোকে নিয়ে গিয়ে বাকিগুলো করব। কিন্তু আমি আবারও বলছি আমি পা*গল না প্রাণ।
তুই শুধু আমাকে মনে রাখ। ধোঁকা দেয়া সকল মানুষদের ভুলে যা। আমি তোকে অনেক আদর করব। প্রচণ্ড ভালোবাসা দিব।

ঘুমন্ত তোঁষা’র কানে কানে সব বললো আরহাম অথচ আরহাম জানলোই না অনিশ্চিত তাদের ভবিষ্যতের কথা। কিছু না বলা সত্য। কিছু না জানা তিক্ততা।

______________

— স্যার!

কর্নেল তাহের হাসলেন তুষারকে দেখে। ইশারায় বসতে বললেই তুষার বসলো সটান হয়ে। যতক্ষণ না স্যার কিছু বলছে ততক্ষণ তুষার ও কিছু বলতে পারছে না। অবশেষে প্রস্তাব দিলো কর্নেল তাহের,

— ইউ নো তুষার সোজা কথা বলতে পছন্দ করি আমি।

— ইয়েস স্যার।

— আমি তোমাকে আজ অনেক বছর ধরে চিনি। তোমার স্বভাব চরিত্র আমার জানা। আমার মেয়ের জন্য তোমাকে চাইছি। আমি চাই তাকে তোমার হাতে তুলে দিতে।

এতটুকু বলেই থামলেন তিনি। মুখ চিকচিক করছে তার। তুষার কোনদিন তাকে ফেরাবে না এটা জানেন তিনি। তথ্য কিছু কাজে এইদিকে এসেছিলো। এসেই এমন কথা শুনে ওর মাথা ঘুরে উঠলো। এইজন্য ই কি তুষার তাকে পাত্তা দেয় না। যেখানে এতবড় ঘরের প্রস্তাব পেয়েছে সেখানে তথ্য’র মতো কাউকে কেন ই বা গ্রহণ করবে তুষার? কথাটা ভাবতেই গলা ধরে আসলো ওর। চোখটা ঝাপটালো বার কয়েক। কান্না করা এতটাও সহজ না তথ্য’র জন্য। খুব কমই কাঁদে সে। অথচ আজ তথ্য’র চোখে পানি। শক্ত স্বাভাবের তথ্য শুধু মাত্র এই তুষারের জন্য কি ই না করলো। কত বেহায়াপনা করলো। তুষার বুঝি এজন্যই তথ্য’কে কোনদিন দেখেও দেখে নি। বিয়ের কথা শুনেও কোন প্রতিক্রিয়া দেখায় নি।

কোনমতে কান্না চেপে বেরিয়ে এলো তথ্য। এসেই টেবিল থেকে কাগজ তুলে রিজাইন লেটার লিখে ফেললো। কোনকিছু না ভেবে তা পাঠিয়ে দিলো দায়িত্বরত অফিসারের নিকট।
থাকবে না এখানে তথ্য। কিছুতেই না।

_________________

তোঁষা’কে আজ সকাল থেকে বেশ ফুরফুরা দেখালো। আরহাম তাতে সস্তি পেলো। ভোরে তোঁষা নিজে ধরা দিলো আরহাম’কে। সকল ক্লান্তি, চিন্তা অবসাদ যেন তাতেই কেটে গেলো। ক্ষুদ্র শ্বাস ফেলে আরহাম। আজ আসার সময় তোঁষা হাসিমুখে বিদায় জানিয়েছে তাকে। আরহাম অল্প চিন্তায় পরলেও তোঁষা যখন গলায় ঝুলে তাকে মিষ্টি আদর করলো তখন আরহাম চিন্তামুক্ত হয়ে বেরুলো।

আজ রাতে আরহামে’র জন্মদিন। দিন গুণে গুণে রাখার অভ্যাস তোঁষা’র। তার আরহাম ভাই এর জন্মদিন ও সে গুনেগুনে হিসেব রাখে। আরহাম যেতেই সোজা রান্না ঘরে ঢুকে ও। ফ্রিজ ঘেটেঘুটে ময়দা, ডিম বের করলো। কেক বানাতে পারে না ও। তবুও চাচি’কে যতটুকু দেখেছে তা মনে করেই কাজ আগালো তোঁষা। সকাল থেকে দুপুর অতঃপর বিকেল। আজ সারাটাদিন লাগিয়ে এসব করেছে তোঁষা। আরহাম সবটা ফোনে দেখলো। মনে জোয়ার এলো যেন ওর। তোঁষা’র ভালোবাসা নিখুঁত। তার থেকেই নিখুঁত খোদ তোঁষা।

আজ আরহামে’র ফিরতে লেট হলো কিছুটা। তোঁষা তখন সুন্দর করে একটা শাড়ী পরেছে। সেজেছে হালকা করে। লম্বা চুলগুলো ছেড়ে দিলো পিঠ জুড়ে। লাল রঙা ঠোঁটটা বেশ আকর্ষণীয় দেখালো। নিজেকে দেখে হাসলো তোঁষা। লজ্জা পেলো সামান্য। মিনমিন করে বললো,

— দেয়ার মতো গিফট তো নেই। আমিটাকেই আপনাকে দিয়ে দিব প্রাণ।

অতঃপর অপেক্ষা। তোঁষা আধঘন্টা যাবৎ অপেক্ষা করার পর চিন চিন ব্যাথা অনুভব করলো মাথায়।

গাড়িতেও একবার লাস্যময়ী তোঁষা’কে দেখেছে আরহাম। নিজেকে বহু কষ্টে সামাল দিয়ে ড্রাইভিং এ মনোযোগ দিলো ও।

তোঁষা’র মাথা ব্যাথা চিনচিন থেকে ধীরে ধীরে তীব্র হচ্ছে। তোঁষা দুই হাতে মাথা চেপে ধরলো। মুখে ব্যাথাকাতুর শব্দ করে ডেকে উঠলো মা, বাবাকে। চোখের সামনে সবই যেন ঝাপ্সা হয়ে আসছে ক্রমশ। আর সহ্য করতে পারে না তোঁষা। উঠে দৌড়ে যায় আলমারির ড্রয়ারের কাছে। টান দিতেই তা খুলে গেলো। হয়তো আরহাম আজ লক করতে ভুলে গিয়েছে।

তিন চারটা অ্যাম্পুল রাখা সেখানে। তোঁষা বড় সিরিঞ্জ নিলো একটা। মাথা ব্যাথায় জান যায় যায় অবস্থা। তিনটা অ্যাম্পুল হাতে তুলে তোঁষা আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। ধপ করে আলমারি ঘেঁষে বসলো পরলো। শাড়ীর আঁচলটা অবলীলায় পরে গেলো। তোঁষা সহ্য করতে না পেরে এক সিরিঞ্জ লিকুইড স্যাম্পল নিজের হাতে পুশ করলো। ব্যাথা কমে নি ওর। পরপর আরেক সিরিঞ্জ ভরে জোরে গেঁথে দিলো বাহুতে। শরীর কাঁপছে ওর। ঠিক যেন কোন নেশাগ্রস্ত মানুষ নেশা পেলো। তীব্র বাসনায় দিশেহারা হলো ও।
তৃতীয়টাও বাদ গেলো না। তবে সেটা শরীরে গাঁথলেও অর্ধেকের বেশি পুশ করতে পারলো না তোঁষা। শরীর ছেড়ে দিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে রইলো ও।
আরহামে’র জন্য করা সাজটা নিমিষেই লেপ্টে গেলো। এদিকে তীব্র আকাঙ্খা আর হাত ভর্তি ফুল নিয়ে রুমে ঢুকলো আরহাম। হাসি মুখে ডেকে যাচ্ছে,

— তুঁষ? তুঁষ? কোথায় তুই প্রাণ?

#চলবে……

প্রিয় প্রাণ পর্ব-২২+২৩

0

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২২

আরহামে’র আজ সত্যি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছিলো তাই কিছুটা সময় ব্যাস্ততায় কেটেছে তার ফলাফলস্বরূপ ফোন হাতে তোলার সময় পায় নি। নাহলে সে তার তুঁষে’র মিনিটের খবর ও রাখার চেষ্টা করে। ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখলো একটা বাজে। মিটিং সবে শেষ হলো। আরহাম ফোনটা হাতে তুলে প্রথমের সিসিটিভি ফুটেজ অন করে। নিশ্চিত তুঁষ’টা গাল ফুলিয়ে বসে আছে। ভাবতেই মৃদু হাসে আরহাম যা মুহুর্তেই পরিবর্তীত হয়ে আতঙ্কিত রুপ ধারণ করলো। বিগত তিন ঘন্টায় তোঁষা’র করা আচরণ কোনমতে দেখে যেই না ভিডিও টানলো ওমনি আরহাম পাগল হয়ে গেলো। অসম্ভব ভাবে বুকে উঠানামা করছে তার। বিরবির করে চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে স্ক্রিনে। অতঃপর পাগলের মতো দৌঁড়ে ছুটলো আরহাম।
কোনমতে গাড়িতে উঠেই স্টেরিং এ হাত রাখে ও। চোখে এখনও আটকে আছে তোঁষা। প্রচন্ড বেগে হাত কাঁপছে আরহামে’র। বিরবির করে বারংবার বলে যাচ্ছে,

— ত….তুঁষ, আমার তুঁ…ষ। তুই ক…কি করলি?

জোরে জোরে শ্বাস টানে আরহাম। কোনমতে স্টেরিং ঘুরালো। একসময় দিকবিদিক হারিয়ে ড্রাইভিং করলো। আগে পিছে কিছু না দেখে আরহাম শুধু গাড়ি চালালো। গাড়িটা বাসার সামনে পৌঁছাতেই দৌড়ে নেমে গেলো লিফটের কাছে। বাইশতলায় যাবে সে অথচ লিফট এটা এগারোতে আটকে। বা সাইডের লিফটেও ভিড়। পা চলছে না আরহামে’র। কোনমতে সে দৌড়ে লাগালো সিঁড়ি দিয়ে। বাইশ তলা! ঠিক বাইশ তলা সে দৌড়ে উঠতে উঠতে আর কিছু যেন মনে পরে না। দরজায় হাত থাপড়া দিয়ে ডাকতে লাগে,

— তুঁষ!! এই দরজা খোল! দরজা খোল প্রাণ। এই যে আমি। তুঁষ?

দরজা খুললো না কেউ। আরহামের মস্তিষ্ক হঠাৎ কিছুটা সজাগ হলো। তুঁষ কিভাবে দরজা খুলবে? চাবি কোথায়? নিজের বুক পকেটে হাতরায় ও। নাহ। নেই চাবি। কার্ড ও নেই। প্যান্টের পকেটে হাত দিতেই মিললো কাঙ্ক্ষিত জিনিস। হাত কাঁপার দরুন বারকয়েক চেষ্টা করে দরজা খুলে ও। অতঃপর এক দৌড়ে রুমের সামনে এসে ছিটকিনি খুলে দিলো। সম্মুখে তাকিয়ে হাঁটু ভেঙে বসে পরলো আরহাম। মাথায় হাত দিয়ে আস্তে করে বললো,

— কি করলি এটা তুঁষ?

সারা রুম জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে তোঁষা’র বইগুলো। কোনটাই অক্ষত নেই। তোঁষা’র জেদ, রাগ সব তারা সহ্য করেছে। আরহাম এবার উঠে দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে তোঁষা’র কাছে বসলো। হেলে পড়া তোঁষা’র দেহটা নিজের কম্পমান দেহের ভাজে তুলে নিতেই নজর গেলো তোঁষা’র বা হাতে। চুয়ে চুয়ে র*ক্ত বের হচ্ছে সেখান থেকে। আরহাম শব্দ করে না। ঘার কাত করে দেখে তোঁষা’র র*ক্ত। সাদা চামড়া ভেদ করে ঝরা র*ক্ত। সাদার মাঝে লাল। বেশ মানালো আরহামে’র নজরে। পাশ থেকে তোঁষা’র ওরনা তুলে র*ক্তাক্ত হাতটা পেঁচিয়ে ধরে বুকে চেপে ধরে তোঁষা’র দেহটাকে। কানে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে অভিযোগ জানায় অভিমানে টাইটুম্বুর কণ্ঠে,

— এটা কেন করলি প্রাণ? কি করলি এটা?
তুই আমার প্রাণের হেফাজত কেন করতে পারিস না?

ক্রমে ঠান্ডা হচ্ছে তোঁষা’র পাখিসম দেখটা অথচ হেলদোল নেই আরহামে’র। সে তার প্রাণ’কে বুকে নিয়ে বসে আছে। মাঝেমধ্যে কথা বলছে। অভিযোগ জানাচ্ছে নিজ স্বরে। সময় কাটলো। প্রায় সাত আট মিনিট। হঠাৎ ই পকেটে কিছু ভাইব্রেট হলো। আরহাম চোখ বড় বড় করে তাকালো। প্রচন্ড জোরে যেন ধাক্কা খেলো। নিজের বুকে তাকাতে নিজেই আঁতকে উঠল যেন। অগোছালো, নিঃস্প্রাণ তোঁষা তার বুকে। কখন, কিভাবে আরহাম যেন ভুলেই গেলো। সে ঠিক কতক্ষণ এভাবে তোঁষা’কে নিয়ে বসে ছিলো? না ভাবতে পারলো না ওর মস্তিষ্ক। বুক থেকে তোঁষা’র মুখটা সরিয়ে অস্থির হয়ে চিৎকার করে আরহাম,

— তুঁষ? এই তুঁষ? কি হয়েছে আমার প্রাণে’র? প্রাণ? তুই এভাবে কেন? উঠ!! উঠ না তুঁষ।

তোঁষা উঠে না। আরহাম উত্তেজিত হলো বহুগুণে। গুনগুন করে তার কান্নার শব্দ ও এলো। তোঁষা’কে বুকে তুলে একসময় শব্দ করে কেঁদে ফেললো সে,

— আ….আমার তুঁষ। আমার প্রাণ, তু…ই কি চলে গেলি? কথা…কথা বল না তুঁষ? এ…এই….

নিঃস্তব্ধতার ঘিরা ফ্লাট’টাতে পুরুষটার কান্না বিকট শুনালো। আরহামে’র মস্তিষ্ক তার সাথ দিচ্ছে না ঠিকঠাক। তোঁষা’র বা হাতটা চেপে ধরে সে উঠে দাঁড়ালো। টলমলে পায়ে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে।
________________

তুহিন পানির গ্লাসটা নিতে গিয়ে ভেঙে ফেললো। গলা শুকিয়ে গিয়েছে আজ বেশি। দৌড়ে রুমে ঢুকেন তোঁষা’র মা। স্বামী’কে বসে হাশফাশ করতে দেখে আতঙ্কিত হয়ে তারাতাড়ি সামনে আসেন। তুহিন কাঁপা গলায় পানি চাইতেই তারাতাড়ি স্বামী’কে ধরে পানি পান করান তিনি। তুহিনের কপাল জুড়ে বিন্দু বিন্দু ঘাম। ওরনা’র কোণা দিয়ে তা মুছে দিলো তোঁষা’র মা। অল্প বিস্তর কুঁচকানো চামড়ার হাতটা নিজের হাতের মাঝে নিতেই তুহিন দম ছাড়লেন। স্ত্রী’র মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন কিয়ংকাল। মায়াময় এক নারী অবয়ব। ছোট্ট সেই কিশোরী বউটা তার কবে যে এতটা বড় হলো? তুহিন উত্তর পান না। নিজের একটা হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলেন স্ত্রী’র গাল। আজও বড্ড নরম। অস্থির কণ্ঠে তোঁষা’র মা জিজ্ঞেস করলো,

— বেশি খারাপ লাগছে?

তুহিনের চোখে পানির ছলকানির দেখা মিললো। মানুষটা কাঁদে কেন? আর কত কাঁদবে? কেন ভাবে না তাদের কোন মেয়ে নেই? এটা কি আদৌ ভাবা যায়? এত সখের একটা শেষ বয়সের নাড়ী ঝাড়া সন্তান। কিভাবে ভুলবে? তুহিন ভাঙা গলায় বললো,

— পুতুলটা’র পরিক্ষা গেলো। সকাল থেকে কেন্দ্রের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভাবলাম আসবে। এলো না। দেখ.. আমাকে দেখ। কত ক্লান্ত আমি। পুতুল কি ওর বাবা’কে ভুলে গেলো? আমি না অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম। একে একে কত মানুষ এলো আবার চলেও গেলো কিন্তু আমার পুতুলটা এলো না। আচ্ছা ও কি ম’রে গেলো? মে’রে ফেলেনি তো? এতদিন তো কোথাও থাকতে পারে না। দেখ না কেমন ছটফট করে। কোথায় যে আছে পুতুলটা?

তোঁষা’র মা শক্ত করে স্বামী’র হাতটা ধরে। তুহিন নিজেই আবার বললো,

— ম’রে নি বোধহয়। আমার বিশ্বাস আরহাম লা’শ আনবে শেখ বাড়ীতে। বলো? আনবে না? নাকি লা*শটাও দেখাবে না আমাকে?

বলেই হু হু করে কেঁদে ফেললেন তিনি। তোঁষা’র মা শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নেন স্বামী’কে। চোখ উপচে পানি ঝড়ছে তারও।
দরজায় বাইরে দাঁড়িয়ে চোখ মুছেন তুরাগ। পাশেই তার স্ত্রী আর আদনান। সত্যি ই পুতুলটা বেঁচে নেই।
আজ তুহিন রাস্তায় পরে ছিলো। তুরাগ কল পেতেই ছুঁটে যান। কেন্দ্রের বাইরে গরমে জ্ঞান হারায় তুহিন। এক বাবা’র তৃষ্ণার্ত চোখ তার মেয়ের অপেক্ষায়। শেষ বয়সে পাওয়া এক অমূল্য রতন তার পুতুল। কোথায় যে হারালো?

_______________

সুবহে সাদিক সেরে সূর্য উঁকি দিলো ধরণীর বুকে। এক ধ্যানে তোঁষা’কে দেখছে আরহাম। ডান হাতে স্যালাইন চলছে ওর। হাতের উপরের চামড়া কেটে ফেলেছে তুঁষ’টা। বড্ড জেদী কি না? পরিক্ষা’র জন্য এমন করলো? কে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আরহাম না এই পরিক্ষা?

তোঁষা চোখ খুললো দুপুর দিকে। চোখ খুলে প্রথমেই নজরে এলো আরহামে’র মুখটা। প্রতিক্রিয়া দেখালে না তোঁষা। তার মস্তিষ্ক তখনো ধরতে পারে নি। ঝাপসা চোখে দেখে যাচ্ছে তোঁষা। মনে পরে না কিছু। আরহাম হাত রাখলো তোঁষা’র মাথায়। আস্তে করে ডাকলো,

— তুঁষ?

— কে?

— আমি।

— আমি?

— চোখ বন্ধ কর তুঁষ।

তোঁষা চোখ বুজলো। মিনিটের ব্যাবধানে চোখ খুলে দেখলো। হ্যাঁ এবার চিনলো তোঁষা৷ আরহাম ওর সামনে। কথা বললো না তোঁষা। চুপচাপ দেখে গেলো আরহাম’কে। আরহাম ঢোক গিলে তোঁষা’র হাতটা ধরে। কপালে চুমু খেয়ে আদুরে ভাবে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে। অভিমান ভর্তি গলায় বললো,

— এমনটা কেন করলি প্রাণ?

#চলবে…..

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২৩

সকাল সকাল মর্নিং ওয়াকে বেরুলো তুষার। রাজশাহী যতটা গরম মনে হলো তার নিকট ঠিক ততটাও না। রাত থেকে ভোর পর্যন্ত বেশ ঠান্ডা লাগলো তার। এই যে এখন রানে যাচ্ছে তাতে কিছুটা র*ক্ত উষ্ণ হচ্ছে। এক রান দিয়ে থামলো না তুষার পরপর চার পাঁচটা রান দিলো একসাথে। সাথে থাকা বাকিরা সাথ ছেড়েছে সেই কখন অথচ তুষার তার দেহ ঝাঁকিয়ে দৌড়ে চলছে। কর্ণেল তাহের তার রান শেষ করে দেখে যাচ্ছে তুষা’রকে। কেন জানি তার বেশ লাগে ছেলেটাকে। গম্ভীর, স্বল্পভাষী এক পুরুষ। সুপুরুষের সকল লক্ষণ বিদ্যমান অথচ দোষে দোষী সে এক জায়গায় ই। বিয়ে করছে না। বিয়ে করলে এতদিনে মেয়ে ছেলে তার চু চু করতো অথচ এই ছেলে গোঁ ধরে বসে আছে। এবার তিনি ভাবলেন তার মেয়ের জন্য বলবে তুষার’কে। ফেরাতে পারবে না তুষার। তার কোনকথা না শুনে এমন হয়নি কখনো এবারেও তা হবে না এটা বিশ্বাস তার।

রান শেষ হতেই পানির বোতলটা হাতে তুললো তুষার। দুই ঢোক গিলতেই নজর গেলো পাশে। তথ্য জুনিয়র একজনের সাথে হেসে খেলে কথা বলছে। সচরাচর এই দৃশ্য চোখে পরবার নয়৷ তবে আজ যথেষ্ট সুযোগ নিয়ে কথা বলছে তথ্য। তুষার ততটা ঘাটলো না। হেটে নিজ গন্তব্যে চলে গেল সে দায়সারাভাবে। এদিকে তথ্য তখনও কথা বলে যাচ্ছে। হঠাৎ কেউ ডাক পাঠাতেই মুচকি হেসে চলে গেল ও। আশেপাশের অনেকেই কিছুটা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। তুষার বাদে এই প্রথম হয়তো কাজের বাইরে কারো সাথে এতটা কথা বললো তথ্য। ভাববার বিষয় এটা। গভীর ভাবনার বিষয়।

_______________

তোঁষা মুখ ফিরিয়ে পাশে তাকাতেই আরহামের চেহারাটা নজরে এলো। এক দৃষ্টিতে সেদিকেই তাকিয়ে রইলো ও। সকাল থেকে কোন কথা বলা হয় নি এই পর্যন্ত। আরহাম চেষ্টা করে নি এমন না। করেছে তবে তোঁষা চোখ বন্ধ করে রেখেছিলো। এমনটা তোঁষা অনুভব করে নি বা শুনেছে কারো নাক টেনে কান্না’র শব্দ। শুনেছে। তবে না শুনার ভান ধরে পরে ছিলো বিছানায়। আরহাম যখন খাবার আনলো তখন চুপচাপ নিজ হাতে খেয়ে নিয়ে পুণরায় চোখ বুজে রইলো। আরহাম ডাকলেও উত্তর দেয় নি তোঁষা। হাতের দিকে তাকালো তোঁষা। স্যালাইন খোলা হয়েছে একটু আগে। আরহাম এবার তোঁষা’র কাছ ঘেঁষলো। তোঁষা একপলক দেখলেও কথা বললো না। যেই না আরহাম ওর হাতটা ধরলো ওমনি তা ঝামটা মে’রে ফেললো তোঁষা। আহত চোখে তাকালো আরহাম। ঢোক গিলে পুণরায় হাতটা ধরার চেষ্টা করলো। তোঁষা সুযোগ দিলো না বরং উঠে যেতে নিলো। আরহাম আটকে ধরলো নিজের সাথে। অসম্ভব ভাবে বুক কাঁপছে তার৷ তুঁষ’টা কথা বলছে না কতঘন্টা ধরে। মন যে আর মানছে না। শ্রবণ অঙ্গ দুটি পিপাসিত হয়ে আছে প্রাণে’র মুখ নিঃসৃত বাক্য শুনতে অথচ সে কথা বলছে না। কম্পমান স্বরেই আরহাম বললো,

— কথা বল না তুঁষ।

তোঁষা কথা বললো না বরং নিজেকে ছাড়াতে চাইলো। আরহাম ছাড়তে না চাইলেই সজোরে কামড় পরলো বুকের বা পাশে। “উফ” শব্দ করে ছাড়লো আরহাম। নিজের দিকে না তাকিয়ে তোঁষা’র পানে তাকায় ও। আকুল আবেদন জানায়,

— দয়াকর আমার উপর। কথা বল না তুঁষ।

— বাসায় দিয়ে আসুন আমাকে।

— ত…তুই…

— বলেছি বাসায় যাব। আমার প্রশ্নের উত্তর আপনি দিবেন না আরহাম ভাই। তাই বাসায় চলুন। ওখানে কথা হবে। কেন করলেন এমনটা?

শেষে চিৎকার করে উঠলো তোঁষা। নাকের পাটা ফুলে উঠলো আরহামে’র। তোঁষা পুণরায় চিৎকার করে জানতে চাইলো,

— কেন কেন? আমিই কেন? পরিক্ষা কেন দিতে দিলি না? বাসায় দিয়ে আসবি। এখনই দিয়ে আসবি। ধোঁকা!! আমাকে ধোঁকা দিলো? দিলো না পরিক্ষা দিতে।

চিৎকার গুলো কান্নায় রুপ ধারণ করলো। অল্প কাঁপলো আরহাম। তুঁষটা এভাবে কেন কাঁদে? আর “তুই”? এভাবে তো কখনো সম্বোধন করে নি আরহাম’কে। তাহলে আজ কেন?
আরহাম এগিয়ে এলো তোঁষা’র কাছে। ওর বা হাতটা আলতো করে ধরতে চাইলো তবে আজ হঠাৎ যেন তেঁতে উঠে তোঁষা। হাত পা ছুঁড়ে যখন কান্নায় ভেঙে পরলো তখন আরহাম এক দৃষ্টিতে দেখে গেলো। একা একাই আস্তে আস্তে বলতে লাগলো,

— এমন করিস না তুঁষ। ব্যাথা পাবি তুই। পরে কাঁদবি আবার। জেদ করে এত কেউ? আমার কাছে আয়। এদিকে আয়। তুঁষ? কথা শুন আমার।

তোঁষা’র কানে ও গেলো না কথাগুলো। রাগে মাথা ছিড়ে যাওয়ার উপক্রম ওর। এদিকে আরহাম ঘাড় কাত করে ওকে দেখে যাচ্ছে। অনেকদিন পর এভাবে কাঁদতে দেখলো তোঁষা’কে। একবার হাসলো আরহাম। কান্না করে কত সুন্দর ভাবে। ঘাড় দুলিয়ে দুলিয়ে হাসলো কিছুক্ষণ। তোঁষা ভীতু চোখে তাকালো ওর দিকে। অস্বাভাবিক লাগলো আরহাম’কে ওর নিকট। এমন করে কেন হাসছে? বিছানা থেকে নামতে চাইলেই আরহাম এক টানে নিজের বুকে নিলো তোঁষা’কে। হাসি নেই এখন মুখে। তোঁষা নিজেকে ছাড়াতে চাইলেই হঠাৎ নজর গেলো আরহামে’র হাতে। বড়সড় একটা ধাক্কা যেন ও এখানেই খেলো। তোঁষা’র মনে হচ্ছে ওর শরীর কাঁপছে। ঝাপসা চোখে তাকিয়ে রইলো সেখানটায়। ডান হাতটা বাড়াতে ও সঙ্কোচ লাগলো যেন। আরহামে’র হাতটা বুকে চেপে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো ও। আরহাম এবার তোঁষা’কে ছাড়লো।
ওকে নিয়েই শুয়ে পরলো বিছানায়। আদর করে দিলো ওর তুঁষ’কে। ওর প্রাণ’কে। কত কাঁদে প্রাণটা ওর।
.
তোঁষা কাঁদছে। বরাবর মুখ করে শুয়ে আছে আরহাম। ওর বাহুর মাঝেই ওর প্রাণের ক্রন্দন সহ্য হয় না ওর। একহাত গালে ছুঁয়ে দিয়ে আরহাম তপ্ত গলায় বললো,

— আর কাঁদিস না প্রাণ।

— আমার কষ্ট হচ্ছে আরহাম ভাই। আপনি কেন এমন করলেন? উত্তর দিন আমাকে। আম্মু আমাকে বলতো আপনি আমাকে মে’রে ফেলবেন। আজ আমার মনে হচ্ছে আমার ভেতর কিছু একটা ম’রে গেলো। কে মা’রলো? আপনি।

তড়িঘড়ি করে তোঁষা’কে শক্ত করে বুকে চেপে ধরে বললো,

— তোকে মা’রার আগে আমার নিজের প্রাণ নিয়ে নিব আমি তুঁষ। ভুল ভাবিস না আমাকে।

— হাতে এসব কেন করেছেন বলুন? কিসের পাগলামি এসব?

আরহাম তোঁষা’র কানে চুমু খেলো৷ তোঁষা দমলো না। তার উত্তর চাই। আরহাম কেন নিজের হাতে এভাবে কেটেছে। কাটাছিটা গুলো পুরো তাজা। এসবের কারণ কি? তোঁষা ভেবে কুল পাচ্ছে না। যতই ভাবছে ততই আতলে হারাচ্ছে যেন। আরহাম ওর গলায় দিকে আগাতে নিলেই তোঁষা আটকালো৷ শক্ত গলায় বলে উঠলো,

— উত্তর দিন আমার। হাত কেন কেটেছেন এভাবে? আর কেনই বা আজ এমন করলেন? হয় উত্তর দিবেন নাহয় আজ আমি……

আরহাম বলতে দিলো না ওর তুঁষ’কে। আলতো চুমু দিলো ঠোঁটে। গরম শ্বাস পরলো তোঁষা’র চোখেমুখে। ঘন পল্লবগুলো কাঁপলো বুঝি। আরহাম কথা গুছালো। তোঁষা’কে গলাতে আগে আদর লাগিয়ে কথা বলতে হবে। মাইন্ড গেইম কে ভালো পারবে আরহাম থেকে। যেখানে পুরো তুঁষ’টাকে ওর চেনা সেখানে ওকে ম্যানুপুলেট করা সহজ বটে।
আরহাম তোঁষা’র কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,

— তোর হাতে যেমন ব্যাথা, আমার হাতেও তেমন ব্যাথা। তুই কষ্টে তো আমিও কষ্টে। তুই সুখী তো আমিও সুখী। তোর দেহ থেকে যদি র*ক্ত ঝড়ে তাহলে আমার দেহ থেকে ও ঝরবে।

ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে তোঁষা। ডান হাতে আরহামে’র গলা জড়িয়ে ধরা হাতটা ধরে বলে,

— আমার হাতে তো একটা কাটা। আপনি কেন এভাবে কেটেছেন? অনেক র*ক্ত বের হয়েছে না?

— উহু। একটু কষ্ট হয় নি এটাতে যতটা কষ্ট হয়েছিলো বাইশ তলা দৌড়ে উঠতে। যতটা কষ্ট হয়েছিলো তোকে ঐ অবস্থায় দেখে। যতটা কষ্ট হয়েছিলো তুই যখন আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইলি। যতটা কষ্ট হয়েছিলো তুই যখন কথা বললি না। যতটা কষ্ট হয়েছিলো তুই যখন তোকে ছুঁতে দিলি না। আরো হচ্ছে কষ্ট। এখনও হচ্ছে। কারণ তুই আমাকে বিশ্বাস করে উঠতে পারছিস না।

তোঁষা কথা বললো না। আরহাম ওর কপালে চুমু খেয়ে একটু ঝুঁকে বললো,

— আজ যদি তোকে নিয়ে বের হতাম কোনদিন ফেরত পেতাম না তুঁষ। তোর বাপ-চাচারা সব কেন্দ্রের আশেপাশে ছিলো। আমি একা কিভাবে তোকে নিয়ে ফিরতাম। তারা দিত না তোকে। আমার প্রাণ, তোকে পাওয়ার জন্য আজ স্বার্থপর হয়ে গেলাম৷ তুই কি এই স্বার্থপরকে ছেড়ে যাবি? আমি তো যেতে দিব না। আমার প্রাণ’কে পেতে আমি পাগলের খেতাম পেয়েছি। আমি নাহয় তোকে পেতে পাগল ই রইলাম।

তোঁষা তাকিয়ে রইলো আরহামে’র দিকে। ঠিকঠাক ভাবে বুঝে উঠতে পারে না আরহাম’কে। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলো ওর গাল। মনমরা কণ্ঠে বললো,

— তারা তোমাকেও ভালোবাসে।

— বাসে না।

— সত্যি বলছি। চাচ্চু’কে কাঁদতে দেখেছি তোমার জন্য। একা ছাদে কাঁদে। কেউ দেখে না।

— ওসব ভুল দেখেছিস। তারা সবাই শুধু ছিনিয়ে নিতে চায় তোকে আমার থেকে। ধোঁকা দিয়েছে আমাকে। আদনানের সাথে তোকে বিয়ে দিতে চেয়েছিলো। আমি ভুলি নি তুঁষ। ভুলব না কোনদিন।

— ভুলতে পারছি না।

— আমি ভুলিয়ে দিব সব। আমার হয়ে থেকে যা না প্রাণ। প্লিজ। তোকে ছাড়া আমি আরহাম কিভাবে বাঁচব?

তোঁষা ঝট করে আরহামে’র বুকে ঢুকলো। টিশার্ট’টা খাঁমচে ধরে গুনগুন করে বললো,

— মাফ করে দিন৷ রাগ করে বলেছি। কোথাও যাবে না তোঁষা। এখানেই থাকবে তার প্রাণে’র বুকে। আমি আপনাকে অনেক ভালোবাসি আরহাম ভাই। আপনার দেয়া কষ্টগুলো তাই সহ্য হয় না।

— বল শুধু আমার থাকবি?

— থাকব।

আরহামে’র কপাল কুঁচকে এলো কিছুটা। তোঁষা’র মুখ থেকে লালা গড়িয়ে পরছে সাথে কেমন কেমন ঢোক গিলছে। ডান হাতটা দিয়ে খামচে ধরা হাতটা তীব্র হলো। আরহাম অস্থির হয়ে ডাকলো,

— তুঁষ? এই কি হয়েছে? কথা বল।

বিছানায় কাতরায় তোঁষা। মুখটা তুলে আরহামে’র গলার কাছে গুজে কেঁদে উঠলো শব্দ করে। কোনমতে বুঝা গেলো ওর মাথা ব্যাথা করছে। আরহাম ভয় পেয়ে যায় সাথে সাথে। এমনটা হওয়ার কথা তবে এত তারাতাড়ি না। পরক্ষণেই মনে হয় আজ তোঁষা’কে ইনজেক্ট করা হয় নি। উঠতে নিবে এমন সময় ই সেজোরে নিজের ব্যাথা কমাতে কামড়ে ধরে তোঁষা আরহামে’র ঘাড়ে। ঠোঁট কামড়ে ধরলো আরহাম৷ মুখটা ব্যাথায় যেন নীল হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। তোঁষা’কে ছাড়াতে ছাড়াতে বলতে লাগলো অস্থির হয়ে আসা গলায়,

— ব্যাথা কমিয়ে দিব তুঁষ। এখনই কমিয়ে দিব। একটু ছাড়। এখনই কমে যাবে।

— আ…ম্মু আমার ম…মাথা ব্যাথা করে। আ…আরহাম ভা..আই। আমার মাথা….

কাতরাতে কাতরাতে এতটুকুই বললো তোঁষা।তোঁষা’কে ছাড়িয়ে উঠে যেতে যেতেই ধাম করে একটা শব্দ হলো। পিছু ঘুরতে ঘুরতেই আরহামের চোখ বড় বড় হয়ে এলো। এসব কি হচ্ছে? কেন হচ্ছে?

#চলবে……

]

প্রিয় প্রাণ পর্ব-২০+২১

0

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২০

তোঁষা আরহামে’র বুকেই কেঁদে যাচ্ছে। কেন আরহাম ম’রার কথা বললো? আরহাম নিজেও বুঝে নি তোঁষা এতটা অস্থির হবে। বুকে প্রশান্তি অনুভব করে আরহাম। ওর তুঁষের ভালোবাসা কতটা গাঢ় তা আরহামে’র জানা। তোঁষা’র মাথাটা বুক থেকে সরাতে চাইলেই কান্নার বেগ বাড়লো। আরহাম থাকতে দিলো বুকে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে কোমল স্বরে বললো,

— কাঁদে না তুঁষ।

তোঁষা শুনলো না। সে কেঁদেই যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতেই বললো,

— কেন বললেন ম’রে যাবেন? কার জন্য আমি এত কষ্ট সহ্য করলাম। আমাকে আপনি ভালোবাসেন না। একটুও না।

শেষের কথাটা শুনতেই আরহামে’র বুকে জ্বালা ধরলো যেন। ও নাকি ওর তুঁষ’কে ভালোবাসে না? এটা কি ইহকালে সম্ভব?
তোঁষা’র দেহটাকে শক্ত করে নিজের মাঝে জড়িয়ে ধরে আরহাম। কানে আলতো চুমু খেয়ে জানায়,

— এই পৃথিবীতে আমার অস্তিত্ব যতটা সত্যি ঠিক ততটা সত্যি আমার ভালোবাসা তুঁষ। আমার ভালোবাসায় প্রশ্ন তুলিস না প্রাণ।

— আর বলবে?

— উহু।
___________________

সবে মাত্র টিম মেম্বারদের সাথে মিটিং শেষ করলো তুষা’র। আফ্রিকা’তে এই সপ্তাহেই ফোর্স পাঠানো হবে। দায়িত্ব অনেকটা তুষা’রের উপর পরাতে কিছুটা ব্যাস্ত সময় পার করছে ও। আপাতত ফ্রী নেই সে। তথ্য গত দুই দিন ধরে যদিও বারকয়েক এসেছিলো তবে তুষারের সময় হয় নি তার সাথে কথা বলার। গতকাল কর্নেল তাহের এসেছিলেন৷ তার সাথে কথা বলতে বলতে রাত দুটো বাজলো। তুষার বিরক্ত ছিলো বটে। আর্মি ম্যানরা সবাই যথেষ্ট সময়নিষ্ঠ সেখানে কর্নেল তাহের পুরোট উলটো। রাত দিনের কোন খেয়াল থাকে না তার। হৈ চৈ লাগিয়ে রাখেন ফোর্সের। দেখলে বুঝা দায় যে এই মধ্যবয়স্ক পুরুষটার বয়স বায়ান্ন। তারমাধ্যে তুষারের সাথে যেন ভাব তার জমে দই। তুষার আবার অতটা আড্ডা প্রেমী মানুষ না। এরমধ্যে এখনে থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করতে ও। আজ রাতে তার ব্যাঘাত ঘটলো। বিরক্তি ধরে গিয়েছে তুষা’রের। রাতের খাবার এখন কপালে জুটে নি। নিশ্চিত এতক্ষণে ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে।
টেন্ট ছেড়ে নিজের কামরায় যেতেই গরম ইলিশের ঘ্রাণ পায় তুষার। সরিষা ইলিশ? আনমনেই ভাবলো তুষার। এই আধ রাতে গরম ইলিশ তাও কি না সরিষার কোথা থেকে আসবে?
তুষার অতশত পাত্তা না দিয়ে ওয়াসরুমে চলে গেল। ফ্রেশ হওয়া দরকার।

এদিকে কিচেনে তথ্য তুষা’রের খাবার গরম করে সার্ভ করেছে টেবিলে। আজ কথা বলেই যাবে। বাবা আজ ধমকেছে তথ্য’কে। বিয়ে করিয়েই দম নিবেন তিনি। বাবা হিসেবে নিজের জায়গায় সে ঠিক তা জানে তথ্য কিন্তু অনিশ্চিত তুষার আর ভবিষ্যৎ নিয়ে কি ই বা জানাবে বাবা’কে?

তুষা’র টেবিলের সামনে অন্যমনস্ক তথ্য’কে দেখে চমকালো না। এই মেয়ের ঠিক ঠিকানা নেই। একদিন ধমক দেয়া দরকার। ভাবলো তুষার। তবে কেমন ভাবে ধমকটা সেটা ভাবতে পারলো না। গরম ভাত আর ইলিশ তাকে টানছে। সেই টানের মায়ায় পড়ে তথ্য’কে অগ্রাহ্য করে সোজা টেবিলে খেতে বসে ও। মুখে বড় বড় দুটো লোকমা পুরে একপলক তথ্য’কে দেখলো। মেয়েটা নির্বাক হয়ে তাকিয়ে ওর দিকে। কিছু কি বলতে চায় তাহলে? এতটা শান্ত থাকার মেয়ে আবার তথ্য না। তবুও তুষার আগে খাওয়া শেষ করলো। অতঃপর হাত মুছতে মুছতে জিজ্ঞেস করলো,

— কিছু কি বলবে?

— জ্বি।

চোখে চোখ রেখে বললো তথ্য। সোজা হয়ে দাঁড়ালো তুষার। এত গম্ভীর মুখে কেন মেয়েটা?

— বলো? আচ্ছা আগে বসো। কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছো। আর হ্যাঁ খাবার গরম করার জন্য ধন্যবাদ তোমাকে তবে এসব আর করতে যেও না তথ্য অভ্যাস নষ্ট হয় আমার।

কথা বলতে বলতে তুষার সোফায় বসে। তথ্য ও এগিয়ে এলো তবে বসলো না বরং সম্মুখে দাঁড়িয়ে জানালো,

— বাবা ছেলে দেখেছে?

ভ্রু কুঁচকায় তুষার। ছেলে দেখেছে মানে? ওর বাবা ছেলে দেখুক বা মেয়ে দেখুক তাতে তুষারের কি? তবুও প্রশ্ন করলো,

— ছেলে দেখেছে বলতে?

— বিয়ের জন্য।

— হোয়াট!!!

আচমকা তুষা’রের চিৎকারে ছিটলে সরলো তথ্য। তুষার হতভম্ব মুখে দাঁড়িয়ে রইলো। তথ্য ভাবলো তাহলে কি তুষা’রের মন গললো? সে ও কি ভালোবাসে তথ্য’কে? বাসেই তো নাহলে এভাবে রিএক্ট কেন করলো?
তবে এই ভাবনা বেশিক্ষণ টিকলো না তুষা’রের প্রশ্নে,

— তোমার বাবা ছেলে বিয়ে করবে?

— কিহ!!!

তথ্য ও এবার চিৎকার করে উঠলো। এত মাথামোটা কবে থেকে হলো তুষার? তথ্য চওড়া গলায় জানালো,

— পাগল হলেন? কি সব বলেন?

তুষার হেসে ফেললো ফিক করে। সোফাতে গা এলিয়ে দিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললো,

— ছেলে কি করে?

— পাইটল।

— হু বেশ মানাবে। পাইলটের বউ আর্মি৷ নট ব্যাড তথ্য। গো এহেইড।

তথ্য টলমলে চোখে তাকিয়ে রইলো। এতটা নির্বিকার কেন তুষার?

__________________

— আমার কলেজ ড্রেস কবে আনবেন?

আরহাম তোঁষা’র ইনসুলিনটা পেটের চামড়ায় পুশ করে উঠে দাঁড়ালে তোঁষা প্রশ্নটা আবার করলো। শ্বাস ফেলে আরহাম জানালো,

— আজ এনে দিব।

— কাল সকালে পরিক্ষা শুরু অথচ এখনও ড্রেস আনছেন না কেন? কবে থেকে বলছি আরহাম ভাই?

আরহাম তোঁষা’কে টেনে নিলো নিজের কাছে। ফোলা ফোলা গাল দুটো নিজের আজলায় নিয়ে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,

— আর কত আরহাম ভাই ডাকবি? কাজিন থেকে প্রেমিক হলাম। বর হলাম এরপর তো….

তোঁষা ডান হাত চেপে ধরে আরহামে’র ঠোঁটে। মুহুর্তে লজ্জায় রাঙা হলো ওর মুখটা। আরহাম হাসলো। লজ্জায় পড়া তুঁষটা তার পছন্দের।
.
খাওয়া শেষ হতে যেই না তোঁষা বই হাত তুলবে ওমনি আরহাম তোঁষা’র কাঁধে মাথা রাখলো। শুধু মাথা রেখেই ক্ষ্যান্ত হলো না তোঁষা’র চুলগুলো নিজের মতো নাড়াচাড়া করতে ব্যাস্ত হলো। তোঁষা অসহায় চোখ করে তাকায়। এমন করলে ওর সুরসুরি লাগে পড়বে কিভাবে? রিভাইস দেয়া তো বাকি। চাইলেও তোঁষা আটকাতে পারলো না আরহাম’কে। নিজের প্রাণ’কে কিভাবে আটকাবে তার প্রেম জাহির করা থেকে?
দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলো তোঁষা অথচ পারলো না। হার মানলো আরহামে’র কাছে। তার প্রেমের কাছে। নিজের অবাধ্য অনুভূতির কাছে। এসময় পুরোটা হারালো তোঁষা।
তার প্রেমিক পুরুষ তাকে মাতিয়ে নিলো নিজের মাঝে। বইটা অবহেলার রইলো বিছানার কিণারে যেটা বা হাতে নিচে ফেললো আরহাম।
অবহেলায় তা স্থান নিলো ফ্লোরে আর তোঁষা স্থান পেলো তার প্রাণে’র মাঝে অথচ মেয়েটার আগামী কাল সকালে এইচএসসি পরীক্ষা।

#চলবে…

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২১

তুষার থেকে কোন রুপ প্রতিক্রিয়া না পেয়ে মনঃক্ষুণ্ন হলেও তা প্রকাশ করতে চাইলো না তথ্য। তুষা’কে কোনদিন বলা হয় নি নিজের অনুভূতির কথা। ভালোবাসা বা পছন্দের কথা। তাই বলে কি তুষার বুঝে না? পুরুষ কি আর এতটা মাথামোটা হয়? এই যে তথ্য ওর পিছু পিছু ঘুরে বেড়ায়। এদিক ওদিক যেদিক ই যাক তথ্য ও চলে আসে। এসব সে কেন করে? ভালোবাসে বলেই তো। তাহলে তুষার নামক পুরুষটা এতটা নির্বিকার কেন? তথ্য জানে তুষা’র পরিবার নিয়ে আপাতত টেনসড তাই বলে কি তথ্য’কে একটুও আগলে রাখা যাচ্ছে না। একটা বার মুখে বলুক তাহলেই তো তথ্য বাবা’কে নয় ছয়ে দশ বুঝ দিতে পারে। তথ্য হাটতে হাটতে পাশের টেন্ট গুলোতে তাকালো। একটা টেন্ট এ লাইট অন দেখে পা বাড়ালো সেখানে। এতরাতে কারো জেগে থাকার কথা না। এরা সবাই ই সাধারণ সৈনিক পদে আছে।
তথ্য টেন্টে’র বাইরে থেকে নক করতেই রাফি নামক ছেলেটা বের হলো। ছোট ছোট জিরো সাইজ চুল করা, মোটামুটি হ্যাংলা একটা ছেলে অথচ লম্বা যেন তার আকাশ ছুঁয়ে দিবে এমন ভাব। তথ্য’কে দেখেই সে স্বাভাব বশত স্যালুট করলো। তথ্য সালামের উত্তর করেই বললো,

— এত রাতে জেগে আছো যে? ফজরের পর ট্রেনিং না? তখন ভুল হলে কর্নেল তাহের কিন্তু রেগে যাবেন।

রাফি শুকনো মুখে জানালো,

— সরি ম্যাম।

— ইটস ফাইন রাফি। গো।

রাফি দাঁড়িয়ে রইলো তথ্য না যাওয়া পর্যন্ত। তথ্য এক পা ঘুরেও ফিরে তাকালো। রাফি’র দিকে তাকিয়ে বললো,

— এনি প্রবলেম রাফি?

— নো ম্যাম।

— শিওর?

— ইয়েস ম্যাম।

— একটা কাজ করতে পারবে?

— ইয়েস ম্যাম।

তথ্য রহস্য হাসলো। ও জানে রাফি’র কোন একটা সমস্যা আছে। তথ্য এখন একটা সাধারণ ডিল করবে। এক রাফিকে হেল্প করবে বিনিময়ে নিজের কাজ করিয়ে নিবে।

__________________

তোঁষা আজ কিছুতেই ঘুমাচ্ছে না। আরহাম সেই কখন থেকে চেষ্টা করছে ওকে ঘুম পাড়াতে অথচ ওর নাকি ঘুম আসছে না। এত বলেও কাজ হচ্ছে না তবে আরহাম বিরক্ত হচ্ছে না। মোটেও না। ওর ভালেবাসে ওর তুঁষে’র এই ছোট ছোট জেদগুলো। তোঁষা’র অল্প ভেজা চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আরহাম বললো,

— একটু ঘুমা?

— টেনশনে ঘুম আসে না তো। জানেন না আপনি?

আরহাম জানে। তবে আজ যে তোঁষা’কে ঘুমাতেই হবে। লাস্ট তোঁষা’র পিএসসি পরিক্ষা তে আরহাম পাশে ছিলো বোর্ড পরিক্ষার মধ্যে। সেবায় কত কি ই না করলো আরহাম। সারাটা বাড়ী জাগিয়ে রেখেছিলো এই তুঁষ। মনে করলো আরহাম সেদিনকার কথাগুলো,

জেএসসি পরীক্ষা বলে টেনশনে তোঁষা কেঁদেছে একঘন্টা। সন্ধ্যা হতেই থেমে থেমে কাঁদছে। এই মেয়ে কষ্টে দুঃখে কাঁদে না সহজে। ও কাঁদে রাগে, জেদ করে অথবা টেনশনে। তুহিন মেয়েকে কোলে করে বিকেলে হেটে এলো। বাসায় রেখে আবার একটু বাইরে গিয়েছিলো এরমধ্যেই তুরাগ হাত ভর্তি জিনিস আনলো ভাতিজী’র জন্য। তোঁষা একটু ঘেটেঘুটে রেখে দিলো। বই হাতে নিয়েও বেশিক্ষণ রাখে না। সব পারে। কত রিভাইস দিবে। তুঁষা’র বোনকে আগলে কতকিছু বুঝালো। যখন বুঝালো তখন তোঁষা শান্ত অথচ এরপর ই ওর মাথা খারাপ হয়ে যায়। আদনান সন্ধ্যা হতেই তোঁষা’র পছন্দের খাবার নিয়ে বাসায় ঢুকে। দুই প্লেট ফুচকা এনেছে সে। টাকা পয়সা ছিলো না ততটা। তোঁষা নাক টেনে টেনে সবটা খেলো কিন্তু এরপর ও যখন কান্না থামে না তখন ওর মা রেগে গেলো। এগিয়ে আসতে নিলেই ওর চাচি কোলে তুলে নিজের কাছে নিয়ে গেলো। চাচির কাছেই রাগে ফুঁসেছে তোঁষা৷
এদিকে আরহাম বাড়ী ফিরে রাত নয়টার দিকে। হাতে দুটো ব্যাগ।
তোঁষাকে তখন রাতের খাবার খাওয়াতে চেষ্টা করছিলো ওর চাচি অথচ তোঁষা খাবে না। আদনান, তুরাগ ও কত চেষ্টা করলো লাভ হলো না।
আরহাম’কে দেখতেই তোঁষা দৌড়ে ওর কাছে আসে। হাঁটু ভেঙে ওর সামনে বসে আরহাম। গোল ফ্রক পরা তুঁষ’টা কেঁদে মুখ লাল করে আছে। আরহাম হাতের ব্যাগগুলো তোঁষা’কে দিয়ে বললো,

— কাঁধে আসবি?

— হু।

বলেই ব্যাগ হাতে আরহামে’র কাঁধে উঠে সে। কোথায় গেলো কান্না? কোথায় গেলো জেদ? দিব্যি নেচে কুঁদে আরহামে’র কাঁধে চড়ে বাড়ির চক্কর দিলো। ক্লান্ত আরহাম ওকে নিয়ে সোফায় বসতেই ব্যাগ হাতড়ে সব বের করে তোঁষা। পছন্দের পেন্সিল বক্স সহ স্কেল, রাবার, ব্যাগ সব বেগুনি রঙের। এটাই চেয়েছিলো তোঁষা তবে বাবা আনে নি। সে গোলাপি এনেছিলো বেগুনি পায় নি বলে।
খুশিতে চাচির হাতে খেয়েছিলো তোঁষা।

তুরাগ যখন খাবার টেবিলে আরহাম’কে জিজ্ঞেস করলো,

— এত টাকা কোথায় পেয়েছো?

— মার্কেটে দশ বস্তা টেনে দিয়েছি। পাঁচশত টাকা দিয়েছে।

সবার মুখ হা হয়ে যায় আরহামে’র কথায়। মাসে পকেট মানি দেয়া হয় দুই ছেলেকে। হয়তো শেষ করে ফেলেছে তাই বলে বাবা’র কাছে না চেয়ে তার ছেলে কি না বোঁঝা টানলো? পকেট মানি ও বেশিদিন টিকে না ওর। এটা ওটা এনে মা অথবা তোঁষা’কে দিবে।
ওর মা তারাতাড়ি ছেলের হাত দেখলেন। ফর্সা হাতের তালু দুটো লাল টুকটুকে হয়ে আছে। ছলছল চোখে দেখেন তিনি ছেলেকে। আরহাম তত কথা না বলে তোঁষা’র কাছে যায়। সেদিন সারাটা রাত তোঁষা’র কাছে বসে পড়া রিভাইস করালো আরহাম অথচ পিঠ, হাত ব্যাথায় জর্জরিত। দশ তলায় ভারী ভারী বস্তা গুলো উঠানো কি মুখের কথা?

সারারাত তোঁষা’কে নিয়ে থেকে একেবারে ওর কেন্দ্রে পৌঁছে দিয়ে বাসায় আসবে আরহাম অথচ তোঁষা হাসিমুখে ঢুকার আগে বলে গেলো,

— আরহাম ভাই পরিক্ষা শেষ হলে একসাথে রসমালাই খাব।

— ডায়াবেটিস বেড়ে যাবে না?

— একদিন।

আরহাম কথা বলে না। অল্প হেসে সম্মতি জানায়। এত ভীরে বসার জায়গা নেই। তুহিনের তখনও বয়স কিছুটা। চাচা’কে বসার জায়গা করে দিয়ে দাঁড়িয়ে রয় আরহাম। দীর্ঘ তিন টা ঘন্টা দাঁড়িয়ে ই রইলো। ঠিক ততক্ষণে দাঁড়িয়ে যতক্ষণ না হাস্যজ্জ্বল মুখে দুই ঝুটি করা তুঁষ’টা দৌড়ে এসে বললো,”গোল্ডেন না আরহাম ভাই ডায়মন্ড আনব এবার”।
.
ভোরের পাখিরা উঠলো সবে তবে আরহামের বুকে থাকা পাখি’কা সজাগ চোখে তাকিয়ে তার দিকে। আরহাম ঘুমিয়ে কিছুক্ষণ আগে। তোঁষা আরহাম থেকে সরে উঠে নামাজে দাঁড়ায়। একটু পর আরহাম ও উঠে যায়।
তোঁষা উৎফুল্ল হয়ে বই হাতে বসে আছে। আরহাম এক পলক ওর দিকে থেকে কিচেনে চলে যায়। চুলায় দুধ বসিয়ে চুপচাপ নাস্তা বানায়। নিঃস্তব্ধতার চাদরে ঘেরা আজ পুরোটা ফ্ল্যাট। গুনগুনিয়ে শুধু তোঁষা’র পড়ার শব্দ।
আরহাম চুপচাপ এসে তোঁষা’কে ইনসুলিন পুশ করে দিলো। একটু পর খাবার ও খাওয়ালো তবে কথা হলো না। তোঁষা ঘড়ি দেখে আবার কলেজ ড্রেসটা ও পড়লো। চুলগুলোতে একটা বেণী করে পুরো রেডি হয়ে পুণরায় বই খুললো।
আরহাম শার্ট ইন করে কোর্ট পড়ে হাত ঘড়ি পড়ছে। তোঁষা পড়ার ফাঁকেই বললো,

— আরহাম ভাই?

— হু।

— আপনি কি ওখানেই থাকবেন নাকি চলে যাবেন?

— দেখ তো ঘড়ি’টা। পড়িয়ে দে।

তোঁষা বই রেখে ঘড়ি পড়াতে পড়াতে বললো,

— ভয় হচ্ছে একটু।

আরহাম কথা বাড়ালো না। তোঁষা ঘড়ি’টা ঠিক মতো পড়িয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আরহামে’র বুক বরাবর ওর মাথাটা। আস্তে করে মাথাটা আরহামে’র বুকের বা পাশে রাখতেই দুই হাতে সাথে সাথে জড়িয়ে নিলো আরহাম। সেকেন্ডের ব্যাবধানে বাঁধনটা শক্ত হলো। তোঁষা’র মাথায় থুতনি রেখে আরহাম খুবই ক্ষীণ গলায় বললো,

— আমি আছি তো। ভয় কেন লাগে?

তোঁষা’র অশান্ত মনটা শান্ত হলো নিমিষেই। নাক, মুখ রাখলো আরহামে’র বুকে। সাদা শার্টে মুখটা ঘঁষতে ঘঁষতে বললো,

— এটা বলতে এতক্ষণ কেন লাগলো? কেমন জানি লাগছিলো।

আরহাম তোঁষা’র ঘাড়ে হাত রাখতেই তোঁষা মুখ তুললো। সন্তপর্ণে চুমু খেল আরহাম তোঁষা’র কপালে। তোঁষা হাসছে। ভালোলাগে তার এই আদরটুকু। নিজেও আদর দিয়ে বললো,

— আজ পরিক্ষা শেষ হলে ঘুরব হ্যাঁ? আর বাসায় কি ফোন দিবেন একটু। কথা বলতাম আমি। না হলে শুধু বাবা’কে। আচ্ছা আচ্ছা বাবা’কে দিতে হবে না ভাই’কে দিন। ভাইয়ের সাথে কথা বলব। আচ্ছা বাবা’কে দিলে কি হবে? বাবা’কে ও বলি একবার।

একসাথে আবদারের ঝুঁড়ি খুললো তোঁষা। চোখ, মুখ লেপ্টে তার আশার প্রদীপ। এই প্রদীপের আলোয় সময়কাল জানা নেই আরহামে’র। না ই তোঁষা’র। খুব ধীরে তোঁষা থেকে নিজেকে ছাড়ায় আরহাম। ওকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বললো,

— আজ একটা মিটিং আছে তুঁষ। গুরুত্বপূর্ণ বুঝলি?

— বুঝলাম।

— আজ তারাতাড়ি পৌঁছাতে হবে আমাকে।

— আমাকে দিয়ে চলে যাবেন।

— আমার ওয়ালেট টা দে তো।

আরহামে’র খাপছাড়া আচরণ বুঝতে অক্ষম তোঁষা। ওয়ালেট দিতেই আরহাম তোঁষা’র কপালে চুমু খেয়ে বললো,

— একটু বস আসছি আমি।

বলেই তোঁষা’কে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে আরহাম চলে গেল। দরজাটা বাইরে দিয়ে লক করে দিতে নিলেই তোঁষা উঠে দৌড়ে এসে দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে ডাকলো,

— আরহাম ভাই? আরহাম ভাই?

— হ্যাঁ তুঁষ আছি আমি। যাচ্ছি এখন।

— রুমের দরজা কেন লক করলে? খোলো। আমার ও লেট হবে।

— আমি আসব তুঁষ। অপেক্ষা কর।

— কতক্ষণ?

— বেশিক্ষণ না।
.
আরহামে’র সেই “বেশিক্ষণ না” কথাটা আজ ফললো না। তোঁষা অপেক্ষা করলো। দশটায় পরিক্ষা শুরু। এখন বাজে ঠিক নয়টা আটান্ন। দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে ফ্লোরে বসে আছে তোঁষা। আশার আলো ওর এখনও জ্বলছে টিমটিম করে। আরহাম ভাই বলেছে আসবে। তাহলে অবশ্যই আসবে। কোথায় যে গেলো? বললো তো গুরুত্বপূর্ণ মিটিং আছে। তোঁষা’কে নামিয়ে গেলেই তো হতো তাহলে তো তোঁষা এতটা টেনশন করতো না। বুকটা সমান তালে ধুকপুক করে যাচ্ছে ওর। তোঁষা’র অপেক্ষার পালা শেষ হয় না অথচ ঘড়িটা থমকে নেই সে আপন গতিতে চলে যাচ্ছে। তোঁষা এখনও ভাবছে আরহাম ভাই আসবে। এসেই অস্থির হয়ে বলবে, “তুঁষ জলদি আয় প্রাণ, লেট হচ্ছে”।
হলো না সেটা। দেখতে দেখতে দুই মিনিট পার হলো খুব শিঘ্রই। তোঁষা ঢোক গিললো একটা। দরজার পানে তাকালো একবার। না কেউ এলো না। ঘাড় কাত করে তোঁষা তাকিয়ে রইলো অপলক। ঠোঁট দুটো একসাথে আটকে আছে ওর। শুকনো ঠোঁটদুটো তিরতির করে কাঁপে তোঁষা’র। চোখ দিয়ে এক ফোঁটা পানি পরলো টুপ করে। বুকের ভেতর চললো দামামা অথচ তোঁষা কিছু করছে না। দরজায় পিপাসিত চোখ এখনও কি তবে আরহামে’র অপেক্ষায়?

সময় থামলো না। দেখতে দেখতে পার হলো পাক্কা তিন ঘন্টা। এরমানে পরিক্ষা শেষ। হ্যাঁ শেষ পরিক্ষা। তোঁষা বড় বড় চোখ দিয়ে দরজা দেখছে এবার। আস্তে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে দরজার কাছে গিয়ে ডাকে,

— আরহাম ভাই?

উত্তর আসে না। নেই ওর আরহাম ভাই। বারান্দার দরজাটাও লক করা। খুলতে পারে নি তোঁষা। পারলেও কি হবে এই বাইশ তলার উপর থেকে?
ঘন ঘন নাক টানে তোঁষা। পুরো শরীর কাঁপছে ওর। একসময় চিৎকার করে আরহাম’কে ডাকলো সে। পাগলের মতো নিজের বইটা ছিঁড়ে ফেললো। একে একে সব বই ছুঁড়ে ফেললো আলমারি থেকে। এতেও ক্ষান্ত না তোঁষা। বইয়ের পাতা গুলোতে হামলে পড়ে ওর সকল রাগ। সমান তালে ফুঁপানোর শব্দ শুনা গেলো অথচ শুনলো না কেউ।পাগল প্রায় তোঁষা’র মস্তিষ্ক তখন কাজ করে না। চিৎকার করে ফ্লোরে পা দাপড়ে কেঁদে ফেললো সে।ক্ষণে ক্ষণে কাঁপে তার দেহ। পরণের ক্রস বেল্ট’টা টেনে খুলে ছুঁড়ে দিলো। একসময় পাগল হয়ে ড্রয়ার খুলে কিছু খুঁজলো। কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি পেতেই তোঁষা বা হাত বরাবর তার খুবই সুক্ষ্ম ব্যাবহার করে দিলো। মুহুর্তেই খিঁচে যায় তোঁষা। ভীতু চোখে তাকায় আশেপাশে। ভীতর থেকে শরীর খিঁচছে তার।একসময় দেয়ালে হেলে পরে আরহামে’র প্রাণ।
আচ্ছা আরহাম কি জানে তার প্রাণে’র নাশ সে নিজেই ডেকেছে?

#চলবে…

প্রিয়_প্রাণ পর্ব-১৮+১৯

0

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৮

রাত এখন ততটাও গভীর নয় তবে ঘুমন্ত পুরিতে পরিণত হয়েছে রাজশাহী শহর। যেদিকটায় ক্যাম্প সাজানো সেদিকটা’কে শহর বলা চলে না। নিতান্তই বাস্তব এক জঙ্গল এটা। তথ্য একদফা ভাবলো এসব জঙ্গলেই কেন বেশিরভাগ ক্যাম্প গাঁথা হয়?
কি হয় শহরের দিকে থাকতে দিলে? একা মনে কথাগুলো ভাবতে ভাবতে সামনে পা বাড়ালো তথ্য। নিজেকেই নিজে সান্ত্বনা দিতে বললো,

— শহরে কি এত জায়গা আছে যে ট্রেইন করবে এত এত ষাঁড়গুলো’কে?

— ষাঁড়’কে একবার ডেকেই দেখো টুকটুকি তোমার পিছু পিছু জাহান্নামে চলে আসব।

হঠাৎ চিকন গলায় উক্ত বাক্য শুনেই ভ্রু কুঁচকায় তথ্য। পিছনে ঘুরতেই দেখলো চ্যাংড়া দুই চারটা ছেলে দাঁড়িয়ে। এক দেখায় তথ্য চিনে ফেললো এগুলো সব গাঁজাখোড়। চোখের চাহনি আর শরীরে’র ঢুলনি তাই প্রমাণ করছে। যে কিনা দুই ছটাক শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে সে কিনা তথ্য’র মতো মেয়ে’কে তাকে টুকটুকি? আশ্চর্য! ডাকবি শালা ডাক তাই বলে টুকটুকি কেমন শব্দ? কেমন মনে হয় কেউ বুঝি ওকে টিকটিকি ডাকলো। ভাবতেই তথ্য’র গা গিজগিজ করে উঠলো।
নতুন কালে যখন ট্রেনিং এ গেলো তখন সিনিয়র আপা’রা ওকে টিকটিকি’র সাথে বাথরুমে আটকে দিয়েছিলো। সেগুলো কি আদৌ টিকটিকি ছিলো? ইয়া বড় বড় একেকটার সাইজ৷ ওখানকার স্থানীয় লেকগুলো কিছু একটা নামে ডাকতো সেগুলো’কে। তথ্য’র মনে হয়েছিলো সেগুলো ছোট্ট বেলায় দেখা নাভিসাপ। ঐ সাপ দেখলেই সবাই প্যান্ট উপরে টেনে নাভি ঢেকে রাখতো। ধারণা ছিলো ঐ সাপ নাভি দেখলেই নাড়িতে কামড় দিবে।
সেদিন বাথরুমে কি ভয়টাই না পেলো তথ্য। আহা আজও মনে পরলে গা কেঁপে উঠে কেমন। চিৎকার করে ডাকলেও কেউ দরজা খুলে নি।
তবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে পরদিন তথ্য ঐ বড় টিকটিকি হাতে নিয়ে এক সিনিয়র আপা’র গায়ে ছুঁড়ে দিয়েছিলো। সবাই অবাক হয়েছিলো সেদিন। একরাতে কি না এই মেয়ে’র টিকটিকির ভয় কেটে গেলো? তবে আসল রহস্য আজও কেউ জানে না। সেটা তথ্য’র রহস্য। একান্তই নিজের।

— কি টুকটুকি, কি ভাবো? আমার কাছে আসো। আমার লাল টুকটুকি…..

সজোরে এক থাপ্পড় মার*তেই চ্যাংড়া ছেলেটা ছিটকে পড়লো সাইডে’র ঝোঁপে। তথ্য চোখ রাঙিয়ে ধমকালো,

— আরকবার টিকটিক ডেকে দেখ শালা। তোর চাপার দাঁত খুলে ফেলব আমি।

সেই যে ছেলেটা ঝোঁপে পরলো আর উঠার শক্তি পেলো না। ওখানেই কাত। তথ্য অবাক হলো। এক থাপ্পড়েই এমন। এতো এমন হলো যেখানেই রাত ওখানেই কাত। হাউ রিডিকুলাস।
বাকি তিনটা ছেলে কটমট করে তাকিয়ে বললো,

— তোর তো ত্যাঁজ অনেক ছেমড়ি। তোরে তো আজ….

ব্যাস মাথা গেলো খারাপ হয়ে তথ্য’র। দুই হাত দুই পা এর সঠিক ব্যাবহার করতেই তিনটা ছেলেও নড়বড়ে হয়ে গেল। তথ্য হাত ঝাড়তে ঝাড়তে সামনে পা বাড়ালো। মাত্র ঘটা ঘটনাটায় বিরক্ত হলো বটে। মেয়ে হয়ে শান্তি নেই। এই যে ও আর্মি গার্ল তবুও কি না এই সব এংড়া চ্যাংড়া ওকে টিজ করে। এই ছিলো কপালে? পুড়া কপাল। ঐ এক তুষা’রের প্রেমে পড়ে জীবনটাই ফাঁতা ফাঁতা। ব্যাটা পাত্তা দেয় না।

শুকনো পাতায় পা ফেলার ন্যায় শব্দ কানে বাজতেই তথ্য পিছু ঘুরলো। তুঁষা’র দাঁড়িয়ে হাতে কফির মগ নিয়ে। তথ্য এগিয়ে এলো ওর দিকে। পিছু উঁকি দিয়ে বললো,

— একাই এসেছো?

— হু।

— কফি খাচ্ছো?

তুষা’র কথা না বলে হাতে থাকা খালি মগটা দেখিয়ে বললো,

— শেষ।

তথ্য সামনে যেতে যেতে বলতে লাগলো,

— যাবেন আমার সাথে?

— কোথায়?

— প্রেম নগরীতে।

তুষা’র হেসে ফেললো। বললো,

— তোমার মতো মেয়ের সাথে প্রেম হবে না। মাত্র ই গু*ন্ডামী করলে।

তথ্য চোখ বড় বড় করে তাকালো। আশ্চর্য হওয়া কণ্ঠে বলে উঠলো,

— গু*ন্ডামী?

— মাত্র ই কে মা*রলো ছেলেগুলোকে?

— আমাকে টিকটিকি ডেকেছে।

— টুকটুকি হবে।

— হ্যাঁ হ্যাঁ। বোত সাউন্ডস সেইম।

— এখনও ভয় কাটলো না টিকটিকি’র।

তথ্য চাপা হাসলো। ঐ দিন বড্ড সাহস জুগিয়ে টিকটিকি হাতে তুলেছিলো ও যাতে সিনিয়র আপা’রা আর তাকে ভয় না দেখায়। বুদ্ধিটা যদিও ছিলো তুষা’রের। তথ্য যখন নালিশ জানাতে যায় তখনই তুঁষা’র তাকে এহেন বুদ্ধি দেয়।
হঠাৎ ঝোঁপে’র মাঝে শব্দ হলো। তথ্য তাকাতেই দেখা মিললো সেই সাপে’র। সাথে সাথেই নিজের অজান্তে তথ্য’র হাত চলে গেল পেটে। পরণে থাকা টাউজারটা টেনে তুলতেই হো হো শব্দে মুখরিত হলো চারপাশ। তুঁষা’র বহু কষ্টে হাসতে হাসতে বললো,

— এখনও তুমি প্যান্ট টানো সাপ দেখলে? নাও প্লিজ ডোন্ট সে নাভিসাপ তোমার নাভি দেখলে কামড়ে দিবে।

লজ্জা পেলো তথ্য। ছোট বেলার এই অভ্যাস’টা ত্যাগ করা যাচ্ছে না। গুইসাপ দেখলেই এমন ভয় লাগে।

______________________

— বই এনে দিবেন আজ।

— দিব।

— দিব মানে? আগেও বলেছেন দিবেন। কোই দিলেন?

বলেই ফুলা গাল দুটো আরেকটু ফুলালো তোঁষা। আরহাম হাতের ব্যাগটা গোছাতো গোছাতে বললো,

— আগে আমাকে পড়ে শেষ কর।

তোঁষা এবার টলমলে চোখে তাকালো। আরহাম তাকাতেই হকচকিয়ে গেল। এই তুঁষ’টাকে বশে আনা বহুত কঠিন কাজ। গভীর তাপস্যা’র বিষয়। এগিয়ে এসে তোঁষা’র গাল ছুঁয়ে দিতেই তোঁষা মাথা নামায়। প্রচুর জেদী এই মেয়েটা চাইলেও রাগ দেখাতে পারে না আরহামে’র কাছে। আরহাম হাত বাড়িয়ে তোঁষা’কে নিজের কাছে টানতে নিলেই তোঁষা উঠে গেলো। আরহামে’র সামনে দিয়ে হেটে রুম থেকে বাইরেও চলে গেলো।
দীর্ঘ দৃষ্টিতে এতটুকুই দেখলো আরহাম। এতক্ষণ দুটো বালিশ এক করে তার উপর উঠে বসে ছিলো তোঁষা। ছোট থেকেই এই বদঅভ্যেস। এতবছর ওকে এভাবে বসতে দেখলেই মা বকতো কিন্তু আরহাম বকে না। উল্টো নিজে বালিশ দিয়ে উঁচু করে দিবে। নিজের তুঁষে’র কোন আবদার বাকি রাখবে না আরহাম। তবে এই পড়াশোনার ব্যাপার’টা ভালো লাগছে ওর কাছে। বিগত কয়েকদিন ধরে তোঁষা বই বই করে পাগল করে দিচ্ছে ওকে। ঠোঁট কামড়ে কিছু ভাবলো ততক্ষণাৎ।

তোঁষা’র কাছে যেতেই তোঁষা মুখ ঘুরিয়ে নিলো। হাসলো আরহাম। লম্বা চুলের গোছা ধরতেই তোঁষা ছাড়িয়ে নিলো তা। উঠে যেতে নিলেই এবার আটকালো আরহাম। তোঁষা’কে ধরে রাখে নিজের সাথে। তোঁষা মোচড়ালো। ছাড়াতে চাইলো। লাভ হলো না। আরহাম ওকে কোলে নিয়েই খাটে বসে। তোঁষা’র কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে নরম হয়ে আরহাম বললো,

— আজ এনে দিব সত্যি।

— তিন সত্যি?

— তিন সত্যি।

— যদি না আনো?

— তাহলে সব শাস্তি মেনে নিব।

তোঁষা ঠোঁট উল্টে বললো,

— আমি তো আপনাকে শাস্তি দিতে পারি না।

আরহাম হাসলো শব্দহীন। কন্ঠে তপ্ততা এনে বললো,

— যখন তুই এভাবে রেগে যাস আমার সাথে। কথা বলিস না তখন আমার বুকের ভেতর মনে হয় কেউ পাথর দিয়ে আঘাত করছে। এর থেকে বড় শাস্তি আর কি দিবি?

তোঁষা ঝট করে ঘুরে জড়িয়ে ধরে আরহাম’কে। অপরাধী’র স্বরে বলে,

— আ’ম সরি।
.

আরহাম আজ তার কথা রেখেছে। মোটা মোটা বইগুলো সব টেনে এনে বড্ড ক্লান্ত সে। তোঁষা দৌড়ে আগে ঠান্ডা পানি এনে দিলো ওকে। আরহামে’র ভালো লাগলো তোঁষা’র এতটুকু আদর। আরহাম’কে পানি দিয়েই তোঁষা বইগুলো খুলে বসলো। নতুন কাগজের ঘ্রাণে মনে হলো তোঁষা বুঝি নতুন ইন্টারে ভর্তি হয়েছে অথচ এই বছরই তার পরিক্ষা। তোঁষা বইগুলো হাতাতে হাতাতে বলতে লাগলো,

— আগের বইগুলো দাগানো ছিলো। সমস্যা নেই আমি শেষ করে ফেলব। পরিক্ষা’র পর তো এডমিশন কোচিং এ ভর্তি হতে হবে। তাই না? শুনুন আমি কিন্তু বুয়েট এ পড়ব। আপনার পকেট খালি হয়ে যাবে। তখন কিন্তু কিছু বলতে পারবে না।

আরহাম মনোযোগ দিয়ে শুনলো। তবে প্রতিত্তোরে কিছু বললো না। তোঁষা নিজের মতো বইগুলো নেড়েচেড়ে দেখলো কিছুক্ষণ। উঠে দাঁড়াতেই আরহাম বললো,

— আমার টাওয়াল দে তো তুঁষ। শাওয়ার নিব।

তোঁষা একপল তাকায় পরপরই আলমারি থেকে টাওয়াল বের করে দেয়। আরহাম কিছু না বলে ওয়াশরুমে চলে যায়। তোঁষা’র মনে হলো এই প্রথম আরহাম ভাই ওকে এভাবে আদেশ ভাঙ্গিতে কিছু বলেছে। ততটা না ভেবে নিজের বইগুলো রাখার যথাযথ জায়গা খুঁজতে ব্যাস্ত হয় তোঁষা। এদিক ওদিক তাকাতেই যেন হতাশা ভর করে ওর মাঝে। পড়ার টেবিল নেই রুমটাতে। অগত্যা আলমারি খুলে আরহামে’র আর ওর কাপড়ের মাঝে বই গুছিয়ে রাখে ও। বোটানি’টা নিজের কাছেই রাখলো। বায়ো মাথায় থাকে না তোঁষা’র। মুখস্থ বিদ্যা বড়ই খারাপ ওর। একদম যা তা অবস্থা। অন্য ফিজিক্স হোক বা হায়ার ম্যাথ তোঁষা বরাবরই ভালো একজন ছাত্রী।
বইটা নিয়ে বিছানায় গোল হয়ে বসে তোঁষা। প্রথম অধ্যায়টা জটিল মনে হতেই তোঁষা তৃতীয় অধ্যায় খুললো। কোষ বিভাজন কিছুটা সহজ তবে ঝামেলা বাঁধে এগুলোর ধাপগুলো মনে রাখতে। বিরক্ত তোঁষা হার মানে না। বিরবির করে পড়ে যায়।

আজ প্রায় ঘন্টা খানিক লাগিয়ে আরহাম গোসল শেষ করে। টাওয়াল পেঁচিয়ে অর্ধভেজা শরীরে বেরিয়ে এসেই নজরে পরে তোঁষা বিরক্ত মুখখানা। ভ্রু কুঁচকায় আরহাম পরক্ষণেই দেখে তোঁষা’র হাতে বায়োলজি। যার বর ডক্টর সেই বউ কি না বায়ো মনে রাখতে পারে না। আফসোসের বিষয় এটা। আরহাম গলা ঝেড়ে ডাকে,

— তুঁষ?

— উ।

— এদিকে আয়।

তোঁষা একবাক্যে উঠে এলো। আরহাম ওকে টেনে নিলো নিজের কাছে। ওর ভেজা বুকে তোঁষা হাত রেখেই বললো,

— ভেজা কেন আপনি? টাওয়াল কোথায়?

আরহাম ইশারায় দেখালো। তোঁষা লাল হওয়া মুখে বললো,

— ওটা পেঁচানো’র আগেই শরীর মুছা উচিত ছিলো।

— এখন মুছে দে।

— নিজে মুছো।

— বউ আছে না আমার?

— কোথায় তোমার বউ?

তোঁষা’র নাকে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়ে আরহাম জানালো,

— এই তো।

তোঁষা সরে গিয়ে শুকনো টাওয়াল এনে মুছে দিলো আরহামে’র পেটানো শরীর। সবটা সময় আরহাম দেখলো ওর তুঁষ’কে।

খাওয়া দাওয়া শেষ হতেই তোঁষা বই হাতে নিলো তখনই ওর কোলে মাথা রাখলো আরহাম। আবদার জানালো,

— টিপে দে।

তোঁষা দম ফেলে হাত রাখলো আরহামে’র চওড়া কপালে। তুলতুলে হাত দিয়ে টিপতে লাগলো কপাল। আরহাম দ্বিতীয় আবদার ছুঁড়লো,

— চুল টেনে দে।

ঘন চুলের ভাজে হাত ডুবালো তোঁষা। টানতে টানতে কখন যে মেয়েটা ঘুমালো টের পেলো না। এদিকে তোঁষা ঘুমাতেই আরহাম ঘড়ি দেখলো। রাত ততটা নয়। দুই ঘন্টা পর তোঁষা’কে ডাকবে খেতে। এরপর আর পড়ার সুযোগ হবে না তোঁষা’র। ভাইব্রেট শব্দ হতে আরহাম বালিশের নীচ থেকে ফোনটা বের করলো। তোঁষা’র আশেপাশে ফোন রাখে না ও।

#চলবে……

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৯

ফ্লোরে বইগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে অবহেলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে যেন। কয়েকটা’র আবার পাতা নড়ছে কৃত্রিম পাখা’র বাতাসে। তোঁষা এক দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে সেই পাতার নড়চড়। নজর যেন টলতে চাইছে না। টলমলে লাল চোখদুটো ছিটকে পানি বের হওয়ার পালা এখন অথচ কি আশ্চর্য তোঁষা’র চোখে পানি নেই। কিছু সময় গড়াতেই তোঁষা দুই এক পা করে এগিয়ে এলো। ঝুঁকে হাতে তুলে নিলো ফিজিক্স প্রথম পত্র বইটা। বইটা’র দুটো পৃষ্ঠা ছিঁড়ে গিয়েছে। তোঁষা সেটা নিয়েই বসে পরলো ফ্লোরে। দুই হাত দিয়ে ঘোচানো পৃষ্ঠাগুলো সোজা করার চেষ্টা চালালো। লাল চক্ষুদ্বয় আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। স্বেচ্ছায় টপটপ করে ঝড়তে লাগলো। একে একে বইগুলো নিজের কাছে নিয়ে গোছগাছ করার চেষ্টা করছে তোঁষা তবে সবটা নীরবে শুধু মাঝে মধ্যে নাক টানার শব্দ শুনা যাচ্ছে আর একটু পর পর চোখ ডলছে বাহুতে।

আরহামের ঘুম ভাঙলো মাত্রই। বিকেলে তোঁষা’র সাথে এই রুমে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো। চোখ বন্ধ অথচ ভ্রু কুঁচকে গেলো ওর আশেপাশে তোঁষা’র উপস্থিতি টের পাচ্ছে না বলে। চোখ খুলে ঢুলুঢুলু উঠে বসে আরহাম। এদিক ওদিক তাকালেও তোঁষা’কে দেখা গেলো না। বিছানা থেকে নেমে চপ্পল পায়ে এগিয়ে যায় আরহাম। নিজেদের বেডরুমে’র সামনে যেতেই থমকে গেলো আরহাম। ঘুমের রেশ না কাটা চেহারাটায় ভীত একটা আলোড়নের দেখা মিললো। গলাটা হঠাৎ ই যেন পিপাসিত অনুভব করছে। শুকনো ঢোক গিলে আরহাম। এদিক ওদিক নজর ঘোরায় একবার।
তোঁষা নিজের বইগুলো একত্রে করছে। আরহাম ভেবেছিলো এসব গুছিয়ে নিবে তবে তোঁষা’র কাছে যেতেই কখন জানি ঘুমিয়ে গেলো। সুন্দর পুরুষ’টার ওষ্ঠাধর হঠাৎ ই কাঁপছে যেন। তোঁষা’কে কি বলবে এখন? তোঁষা যদি প্রশ্ন করে? আচমকাই যেন আজ ভয় পাচ্ছে আরহাম। এত তারাতাড়ি তোঁষা’কে আয়ত্ত্বে আনা যাবে না।
ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরে এগিয়ে এসে আরহাম হাত লাগালো তোঁষা’র বইতে। তোঁষা শব্দ করলো না। নিজের মতো বইগুলো সব একত্রে করে ফ্লোরেই সাইড করে রাখলো।
তোঁষা যেই না উঠে যাবে ওমনিই ওর হাত টেনে নিলো আরহাম। তোঁষা মাথা নিচু করে বসে রইলো। সামনা সামনি দুজন বসে অথচ রা করছে না কেউ।
একটা ফাঁকা ঢোক গিলে আরহাম ক্ষুদ্র থেকেও ক্ষুদ্র শ্বাস ফেললো অতি গোপনে। এক হাতে যদিও তোঁষা’র ধরা তবুও সে আরেকহাত দিয়ে তোঁষা’র হাতটা মুঠোয় পুরে নিলো। কৈফিয়ত দেয়ার মতো বলতে চাইলেও কিছুটা অস্থিরতা কাজ করলো আরহামে’র মাঝে,

— তঁ…তুঁষ, আমি তখন টিশার্ট.. হ্যাঁ টিশার্ট খুঁজছিলাম। বইগুলো ছড়ানো ছিলো আলমারি’তে। শুন… শুন তাকা আমার দিকে। এদিকে আয়! তুঁষ, প্রাণ আমার, মাথা তুল। হ্যাঁ তাকা আমার দিকে।
তো টিশার্ট না পেয়ে যখন খুঁজছিলাম তখন এলোমেলো থাকায় বই কয়েকটা পরে যায়। আমার কথা বুঝছিস তুই? আমি বুঝাতে চাইছি…

— বইগুলো ছড়ালো কিভাবে?

আরহামে’র কথার মাঝেই প্রশ্ন করলো তোঁষা। আরহাম সত্যিটা স্বীকার করলো,

— রা…রাগ উঠেছিলো আমার। সত্যি বলছি আমিই গুছাতাম কিন্তু তোর কাছে যেতেই ঘুমিয়ে গেলাম। বিশ্বাস কর না প্রাণ। মিথ্যা বলছি না।

কথাগুলো বলার সময় অসম্ভব ভাবে ধ্বক ধ্বক করে যাচ্ছে আরহামে’র বুক। তোঁষা’র মনোভাব ঠিক ঠাওর করা যাচ্ছে না। আরহাম ব্যাস্ত হলো। তোঁষা’র মুখটা ধরলো আজলায় তুলে। চোখ চোখ রাখতেই তোঁষা’র চোখে দেখা মিললো এক অসহায় চোখের। তোঁষা শান্ত স্বরে জানালো,

— ফিজিক্স বইয়ের দুটো পাতা ছিঁড়ে গিয়েছে।

— আমি আঠা লাগিয়ে দিব।

একদম সাথে সাথেই বলে উঠলো আরহাম। তোঁষা কথা বাড়ালো না শুধু পলকহীন ভাবে পর্যবেক্ষণ করলো আরহাম’কে। আরহাম উঠে দাঁড়িয়ে তোঁষা’কেও তুললো। ব্যাগ থেকে একটা কাগজ বের করে তোঁষা’র হাতে দিতেই তোঁষা মুখ তুলে তাকায়। এডমিট কার্ড সাথে পিন করা রেজিস্ট্রেশন কার্ড। গত পনেরো দিন ধরে আরহামে’র কাছে তোঁষা বলেই যাচ্ছিলো এডমিট তোলার জন্য কিন্তু আরহাম পাত্তা দেয় নি। আজ নিয়ে আসাতে তোঁষা’র খুশি লাগছে তবে সে প্রকাশ করতে পারছে না। শুধু মুখ তুলে আরহামে’র পানে তাকাতেই চোখ গলিয়ে পানি পরে। আরহাম হাত বাড়িয়ে তা মুছে দিলো। তোঁষা’র মাথাটা বুকে চেপে ধরে বললো,

— মাফ করে দে প্রাণ।

— দিলাম।

_________________

ঘোর আমানিশা’য় আছন্ন চারিপাশ। বুনো কোন কিছু একটা ডেকে যাচ্ছে তীক্ষ্ণস্বরে। ঝিঁঝি পোকা’র শব্দ এমন না। নাম না জানা প্রাণী’টাকে দেখার বড্ড ইচ্ছে জাগ্রত হলো তথ্য’র মনে। টেবিলে এতক্ষণ কিছু কাজ করে মাত্রই মায়ের সাথে কথা বলছিলো ও। সেই পুরানো প্যাঁচাল ভালো লাগলো না তথ্য’র। বিয়ে বিয়ে করে মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। ফোনটা মাত্র ই কেটেছিলো তথ্য। ইচ্ছে ছিলো বাইরে বের হবে অথচ তখনই পুণরায় ফোনটা বেজে উঠে। ছোট একটা শ্বাস ফেলে ফোন তুললো তথ্য। অপর পাশ থেকে পুরুষনালী এক কণ্ঠস্বর শুনে মুহুর্তেই নিজের ভেতর থাকা গোছালো শব্দগুচ্ছ’কে অগোছালো করে দিলো। তথ্য’কে কথা বলতে না শুনেই পুণরায় ওর বাবা বললেন,

— আছো? তথ্য কথা শুনছো তুমি।

— জ্বি আব্বু।

— তো কি সিদ্ধান্ত নিয়েছো?

— এখনও কিছু ভাবি নি এ বিষয়ে।

— তোমাকে ভাবার জন্য যথেষ্ট সময় দেয়া হয়েছে তথ্য। লাইফে যা চেয়েছো দিয়েছি এজ এ ফাদার। তোমার মা না করা সত্বেও তোমাকে আর্মিতে দিয়েছি। এখন যখন বিয়ের জন্য সময় চেয়েছো তা ও দিলাম। প্রায় তিন বছর। কি দেই নি?

— জ্বি আব্বু।

— তোমার নিজের পছন্দ থাকলে ও ফ্রী ভাবে বলার অধিকার দেয়া হয়েছিলো অথচ ইউ মিসড ইট তথ্য। নাও আই ওয়ান্ট ইউ টু কাম ব্যাক হোম এন্ড গেট ম্যারিড তথ্য।

— আ..

— নো মোর ওয়ার্ড তথ্য। আমি মেজর’ ইসহাক’কে কল দিচ্ছি।

বলেই বাবা কল কেটে দেন। তথ্য টলমল হওয়া চোখ মেলে নিজেকে দেখলো আয়নায়। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে একদম গভীর ভাবে পর্যবেক্ষণ করলো নিজেকে। সে কি সুন্দর নয়? চুলগুলো কাঁধ সমান, একটু কি লম্বা হওয়া উচিত ছিলো নাকি খাড়া নাকটা বোঁচা হওয়া উচিত ছিলো। চেহারার উজ্জ্বলতা যতটুকু কম দেখায় তা পুরোটায় রোদের কারণে। তাহলে কেন তুষা’র তাকে পছন্দ করছে না?
বাবা যে কিছুতেই আর দমবার পাত্র নয় তা জানা আছে তথ্য’র। বাবা’কে সবসময় ইউনিফর্ম এ দেখে তথ্য’র সখ জেগেছিলো সেই ছোট্ট বেলায় যে সেও আর্মি হবে। হয়তো বাবার মতো অতবড় পদ নয় তার তবুও তথ্য চেষ্টা করছে। এরমধ্যে কিভাবে যে মনটা তুষা’র নামক পাষাণ্ড’তে আটকে গেলো ভেবে পায় না তথ্য। বাসায় চাইলেও কিছু বলা যাচ্ছে না তুষা’র সম্পর্কে। দেখা গেলো তথ্য’র বাসায় রাজি এদিকে রুঠে হুয়ে মেহবুব সেজে বসে থাকত তুষা’র। বড়ই অপমানের বিষয়। মেয়ে রাজি বিয়েতে এক ঠ্যাং তুলে অথচ ছেলে দুই ঠ্যাং তুলে দায়সারা ভাব দেখায়।
কোথায় যাবে এখন তথ্য? ভাবতেই অসহায় লাগলো ওর নিজেকে। জোরে শ্বাস টেনে নিজেকে শান্ত করে তথ্য। ভাবলো আগামী কাল কথা বলবে তুষারে’র সাথে। সে কি আদৌ তথ্য’কে পছন্দ করে কি না। যদিও তুষা’র কোনদিন তাকে বলে নি সে পছন্দ করে।

টুং শব্দ শুনতেই তথ্য ফোনটা হাতে তুললো। হাসোজ্জ্বল একজন পুরুষের ছবি। ড্রেস কোর্ড পাইলটদের। ফাঁকা ঢোক গিললো তথ্য। বাবা কি এবার তাহলে কোমড় বেঁধে নামলো তথ্য’র বিয়ে দিতে?

_______________

তোঁষা সারাদিন পড়ে পড়ে সব শেষ করছে। আরহাম যতক্ষণ বাসায় থাকে ততক্ষণ তোঁষা বই ধরার সুযোগ পায় না তাই তো একা একা থাকাকালীন সময়টাকে কাজে লাগায়। আজ আরহাম বাসায় ই আছে। বাইরে যায় নি একবারও। তোঁষা আরহামে’র গালে হাত রাখলো। হালকা গরম গালটা। খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলাতে বেশ ভালো লাগলো তোঁষা’র। আরহাম ঘুমের মাঝেই যেন শান্তি পাচ্ছে, মুখভঙ্গি দেখে বুঝলো তোঁষা। মুখ এগিয়ে নিয়ে চুমু খেলো ওর কপালে। কপালটাও গরম তবে অল্প। তাহলে কি অসুস্থ তোঁষা’র আরহাম ভাই?
কথাটা ভাবতেই তোঁষা’র খারাপ লাগলো। আরহামে’র হাতটা নিজের দুই হাতের মুঠোয় পুরে চুমু খেলো আঙুলে আঙুলে। ঘুমের মাঝেই নড়লো আরহাম। তোঁষা চোরের মতো চুপ করে সরে গেলো। আরহাম ভাই’কে বুঝতে দেয়া যাবে না তোঁষা এখন রেগে নেই। প্রিয় পুরুষের তখনকার মলিন চেহারা দেখেই তোঁষা’র সকল রাগ, অভিমান পালিয়েছে।
উঠে কিচেনে এলো তোঁষা। ভাবলো নিজে আজ কিছু আরহামে’র জন্য বানাবে। আরহামে’র জন্য কি বানাবে ভাবতে ভাবতে তোঁষা ফ্রীজ ঘুটে সব এলোমেলো করলো। সবজি বাদে ভালো কিছু নেই তাতে। তোঁষা খেয়াল করলো আরহাম ওকে সবজি খাওয়ায় অনেক যা বাসায় কারো সাধ্য ছিলো না। বাসার কথা ভাবতেই মন খারাপ হয় তোঁষা’র। কতগুলো গাজর বের করে গ্রিন্ড করা শুরু করে। হালুয়া বানাবে আজ আরহাম ভাই এর জন্য। যদিও তোঁষা রান্নাবান্না পারে না কিন্তু আরহামে’র জন্য টুকটাক সে শিখেছে চাচি থেকে। গাজরের হালুয়া পছন্দ ওর আরহাম ভাই এর। অথচ তোঁষা’র একটুও পছন্দ না এই হালুয়া কিন্তু এখন তোঁষা শিখে গিয়েছে এটা খাওয়া।
আরহাম যখন দেশের বাইরে গেলো তখন ই তো চাচি থেকে টুকটাক রান্না শিখে একা একাই খেতো তোঁষা। ভালোবাসা মানুষ’কে ঠিক যতটা অসহায় করে তুলে তোঁষা’র অসহায়ত্ব ছিলো তার বহুগুণ।
অপছন্দের খাবার গুলো কতটাই না স্বাচ্ছন্দ্যে পছন্দের তালিকায় তুলেছে ও।
ঘি দিতেই কিছুটা অসাবধানতার জন্য তোঁষা’র হাতে ছিঁটে পরে। ট্যাবের নিচে হাত ধরে পরপরই মনোযোগী হয় হালুয়াতে।

আরহামে’র চোখ খুললো মাত্র। শরীর আজ ম্যাচম্যাচ করছে ওর। টুংটাং শব্দ কানে আসতেই ভ্রু কুঁচকায় আপনাআপনি। উঠে হাঁটা দিলো শব্দের উৎসের দিকে। তোঁষা’কে রান্না করে দেখেই যেন চোয়াল ফাঁক হলো আরহামে’র। এই তুঁষ রান্না শিখলো কবে? হালুয়ার ঘ্রাণটা যেন একদম নাসারন্ধ্র বারি খাচ্ছে। আরহাম ধীর পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো তোঁষা’র পিছনে। পেছন থেকেই তোঁষা’র হাতের উপর হাত দিয়ে খুন্তিটা ধরে। চমকায় না তোঁষা। ওর প্রাণে’র অস্তিত্ব ও টের পেয়েছে আরো আগে তবে প্রতিক্রিয়া দেখায় নি এমনকি এখনো দেখাচ্ছে না। আরহাম তোঁষা’র কাঁধে মুখ ঘঁষে ডাকলো,

— তুঁষ?

…………

তোঁষা’র উত্তর মেলে না দেখে আরহাম ওকে নিজের দিকে ঘুরালো। কপালে চুমু খেয়ে পরপর নরম গাল দুটোতে দাবিয়ে চুমু খেলো। তোঁষা চুপ করে দাঁড়িয়ে। আরহাম ও থামলো না বরং থুতনি এবং চোখে চুমু খেতে খেতে বললো,

— কিচেনে আসতে না করেছিলাম না। কথা কেন শুনিস না?

— কথা শুনেছি। বলেছিলেন আপনি বাসায় না থাকলে এখানে না আসতে।

আরহাম হেসে ফেলে গাল টেনে দিলো তোঁষা’র। তোঁষা ও হেসে দিলো। কপালে হাত দিয়ে বললো,

— মনে হচ্ছে জ্বর।

— তোর উত্তাপে আমি ইদানীং উষ্ণ থাকি প্রাণ।

— পঁচা লোক।

বলে তোঁষা গ্যাস অফ করে। আরহাম নিজেই বাটিতে বেড়ে নিলো। তোঁষা আবদার জানালো,

— চা খাব।

— এখনই বানাচ্ছি।

আরহাম চুলায় পানি বসিয়ে চামচ দিয়ে মুখে হালুয়া পুরে নিলো। নিমিষেই চোখ বন্ধ হয়ে এলো ওর। ঠিক যেন মায়ের হাতের হালুয়া। একই স্বাদ। আরহাম তৃপ্তি সহকারে একবাটি খেয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— কবে শিখলি?

— যখন আমার দেহে প্রাণ ছিলো না।

আরহাম তোঁষা’র মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। আজ মায়ের কথা বেশিই মনে পরছে।
চা নিয়ে দুজন বসেছে বারান্দায়। ফুরফুরে বাতাসে মিশতে মন চায় তোঁষা’র। চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললো,

— আর কতদিন থাকব এখানে?

— কেন? ভালো লাগে না আমার সাথে?

— এটা বলিনি তো।

— এটাই তো বললি।

— বলেছি বাসায় যাব না?

— না।

— কেন?

আরহাম উত্তর করলো না। তোঁষা’কে টেনে নিলো নিজের কাছে। তোঁষা ওর বুকে মুখ গুজতেই আরহাম বললো,

— ওরা ছিনিয়ে নিবে তোকে আমার কাছ থেকে। কিভাবে বাঁচব তোকে ছাড়া প্রাণ। তুই চাস আমি ম’রে যাই? বল চাস? কথা বল প্রাণ।

কথাগুলো বলতে বলতেই ওর নজর গেলো তোঁষা’র লাল হওয়া হাতে।

#চলবে……

প্রিয়_প্রাণ পর্ব-১৬+১৭

0

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৬

জ্বর ছেড়ে ছিলো তোঁষা’র গতরাতে। সেই যে সন্ধ্যা রাতে জ্বর উঠলো কমার নাম গন্ধ নেই। সারাটা রাত আরহাম জেগেই ছিলো। ঘুমাবে কিভাবে তার তুঁষ’টা যে জ্বরে হুশহীন। শেষ রাতে তোঁষা’র জ্বর ছাড়তেই ঘেমে-নেয়ে উঠে তোঁষা। আরহাম যেন সস্তি’র শ্বাস ফেলে। মেডিসিনগুলো কাজ করতে বেশ সময় নিয়েছে। আরহাম তোঁষা’র মুখপানে তাকালো। সবেই সূর্য উঠা শুরু করেছে হয় তো পরক্ষণেই মনে হচ্ছে, না সূর্য এখন উঠবে না। ফজরের আজান হলো সবে। আরহাম তোঁষা’র ঘামে ভেজা শরীরটা নিজের বুক থেকে সরিয়ে পাশে বালিশটাতে রাখলো অতি যত্নে। তুঁষ’টা অসুস্থ হলেই কেমন করে জানি কাঁদে। আরহামে’র বুকে কম্পন ধরে সেই কান্না শুনে। সহ্য হয় না। অসুস্থ এক কান্না। ঘুমের মাঝেই কাঁদে। তোঁষা কি জানে সেই কান্না কারো হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ করতে সক্ষম?

ধীর পায়ে বিছানা ছাড়ে আরহাম। বুকের দিক ভেজা তার৷ টিশার্ট টা একটানে খুলে তা দুই হাতের মাঝে ভাজ করে ওয়াশরুমে’র ঝুড়ি’তে রাখলো। নতুন একটা টিশার্ট গায়ে গলিয়ে দিয়ে উত্তম রুপে ওযু করে নিলো।
একপলক তোঁষা’কে দেখে নিতেও ভুল হলো না তার।
.
টুংটাং শব্দ করে আরহাম রান্নাঘরে কাজ করছে। ওর তুঁষরাণী’র আবদার অথবা হুকুম যেটাই হোক তা হলো সে সকাল সকাল ঝাল খাবে অথচ আরহাম জানে এই তু্ঁষ ঝাল খেলেই কুপোতকাত হয়ে যায়। আরহাম যথেষ্ট মাথা খাটিয়ে রান্না বসিয়েছে। তোঁষা খেতে চেয়েছে খিচুড়ি, আরহাম বানাচ্ছে ওটস খিচুড়ি। এটা হেলদি ফুড। তোঁষা’র খাবারের দিকটা উলোট পালোট হলেই যত সমস্যা দেখা যায়। রান্নার মাঝে আরহাম একবার ডাকলো,

— তুঁষ?

— কিইইই।

আরহাম থতমত খেলো। এত উচ্চ গলায় কেন উত্তর এলো। পা বাড়াতে নিলেই পানির শব্দ এলো। তোঁষা কি গোসল করছে তাহলে? এই সকালে? গ্যাসটা কমিয়ে আরহাম দ্রুত রুমে ঢুকলো। যা ভেবেছিলো তাই। তোঁষা ওয়াশরুমে। আরহাম ঠক ঠক শব্দ করে দরজায়,

— তুঁষ? তুঁষ?

— কি?

— কি মানে কি? কি করছিস তুই?

— গোসল করছি তো।

— এই দরজা খোল তুই। তুঁষ দরজা খোল। বেরিয়ে আয়।

— এমন করো কেন?

“তুমি” ডাক? আরহাম জানে এই আদুরে কথায় আরহাম’কে গলাতেই এই মেয়ে “তুমি” শব্দটা ব্যবহার করছে। একটু দমে গিয়ে আরহাম পুণরায় বললো,

— এক মিনিটে বের হ তুঁষ নাহয় দরজা খুল।

অগত্যা এক মিনিটেই তোঁষা দরজা খুললো। কালো একটা টাওয়াল পেঁচিয়ে ভেজা শরীরে দাঁড়িয়ে আছে তোঁষা। ফর্সা নাদুসনুদুস তোঁষা’র পরণে কালো এই টাওয়াল বড়ই আকর্ষণীয় দেখালো। আরহাম নজর ভরে দেখেও নিলো। দেখতে মানা নেই। কেন থাকবে? তুঁষ’টা কার? তারই তো।
আরহামে’র মুখের সামনে ঠান্ডা এক হাঁচি দিয়ে পাশ কাটিয়ে রুমে ঢুকে তোঁষা। আরহাম ফিরে তাকালো। তোঁষা’টা তার একদম ভিন্ন। এই যে এমন এক ভেজা মুহুর্তে যে কোন মেয়ে লজ্জা পাবে, নিজেকে লুকাতে চাইবে, লালিমা’র দেখা মিলবে ফর্সা গালে সেখানে তুঁষ তার ভিন্ন। গাল তারও লাল তবে ঠান্ডা’র জন্য। তোঁষা মাথার টাওয়াল খুলে চুল মুছতে মুছতে অভিযোগ জানায়,

— এত ডাকছিলেন কেন? গোসল করছিলাম না?

— এই সকাল সকাল কে বলেছে গোসল করতে তোকে? বলেছি আমি? বল বলেছি?

— ঘেমে ছিলাম তো।

— থাকতি। আমি মুছিয়ে দিতাম না গরম পানি দিয়ে? এখন হাঁচি আসছে কার…..

দ্বিতীয় দফায় আরহামে’র মুখে হাঁচি পরলো। তোঁষা নাক টেনে বললো,

— ঠিকমতো গোসল হলো না।

তোঁষা’র হাতে থাকা টাওয়ালে মুখ মুছলো আরহাম। ভালোভাবে তোঁষা’র চুলমুছে দিতে দিতে বললো,

— এমন আর করবি না ঠিক আছে?

— হু।

— তোর জন্য খিচুড়ি করেছি প্রাণ। বস এখানে ইনসুলিন নিয়ে আসি।

আরহাম যেতেই তোঁষা নিজের চুলগুলো একপাশে কাঁধে রাখলো। এতো গোঁছা আর বড় চুল সামলানোটা বড্ড কঠিন।

আলমারি খুলে তোঁষা নিজের পোশাক বের করছে তখনই কানে এলো আরহামে’র কণ্ঠে,

— তুঁষ!!

চমকে উঠে তোঁষা’র ছোট্ট শরীরটা। আরহাম দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে তোঁষা’কে ঘুরিয়ে দিলো। অসংখ্য কালো কালো ছোপ দাগ পিঠে। কালসিটে দাগগুলো দেখেই বুঝা যাচ্ছে কিছুটা মাস খানিক পুরাতন কিছুটা বা কয়েক সপ্তাহ আগের। লম্বা লম্বা কালো দাগগুলো স্কেল অথবা বেত দিয়ে মে’রেছে। আরহাম ভেজা চোখে তাকিয়ে রইলো। তোঁষা’র ধবধবে ফর্সা পিঠে এরূপ দাগ বড্ড বেমানান। একদমই মানা যায় না। আরহাম নিজের হাত বাড়ালো। ধীর হাতে ছুঁয়ে দিলো তার তুঁষে’র আঘাতপ্রাপ্ত নরম পিঠ’টা। তোঁষা’র শরীর শিউরে উঠে তাতে। তোঁষা’র নাকের পাটা ফুলে উঠলো ততক্ষণে। ঘুরে দাঁড়িয়ে আরহামে’র হাতটা ধরতেই হঠাৎ যেন হুসে এলো। তোঁষা’কে ঘুরিয়ে ওর পিঠের দিকে অস্থির গলায় জিজ্ঞেস করলো,

— তুঁষ?? এই তুঁষ, তোর পিঠে… প্রাণ আমার, তোর পিঠে কি…. এই তোকে মে’রেছে না? আমাকে কেন বলিস নি?

দুই হাতে অস্থির আরহাম’কে জড়িয়ে ধরে তোঁষা। ওকে শান্ত করতে বলে,

— কিচ্ছু হয় নি। সত্যি বলছি।

— অনেক ব্যাথা পেয়েছিস প্রাণ? তোকে এত কষ্ট দিলো? আমার জন্য?

— কষ্ট নেই এখন। আপনি এমন করছেন কেন?

আরহাম’কে আজ প্রথম এমন দশায় দেখলো তোঁষা। কেমন অস্থির হয়ে দম আটকে আটকে শ্বাস ফেলছে। চোখ দুটো লাল হয়ে আছে। রাগ নাকি অসহায়ত্ব? বুঝে এলো না তোঁষা’র। শক্ত করে জড়িয়ে রাখলো তোঁষা। আরহাম শান্ত হতে চাইলো। সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও তেমন একটা সুবিধা করতে পারলো না ও কিন্তু তোঁষা’র কাছে অস্বাভাবিক হওয়া যাবে না। কিছুতেই না। খুব সুক্ষ্ম ভাবে নিজেকে সামাল দিলো আরহাম। তোঁষা’কে নিজেও জড়িয়ে ধরতেই তোঁষা জিজ্ঞেস করলো মৃদু শব্দে,

— ঠিক আছেন?

— হু।

তোঁষা অতঃপর আর কিছু জিজ্ঞেস করলো না। আরহাম নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করলো,

— কে মে’রেছে?

…………

তোঁষা’র জাবাব এলো না। আরহাম নিজেই বললো,

— চাচি?

উত্তরে তোঁষা হাতের বন্ধনী দৃঢ় করলো। আরহাম ওর মাথায় চুমু খেয়ে আস্তে করে নিজের থেকে ছাড়ালো। তোঁষা’র পিঠ এখন আরহামে’র সম্মুখে। একদম সামনে। আরহামে’র চোখ টাইটুম্বুর অথচ লাল। খুব ধীরে সে মুখ নামিয়ে চুমু খেলো কালসিটে দাগে। তোঁষা’র এখন মনে হচ্ছে তার ব্যাথা নেই আর। সবটা তো উসুল সেই কবেই হলো যবে সে আরহাম ভাই’কে পেলো। আরহাম পুণরায় চুমু খেয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— এখনও ব্যাথা প্রাণ?

— উহু।

_________________

তুষা’র আজ যাচ্ছে রাজশাহী। তাদের কোন একটা মিটিং আছে সেখানে। কিছু সৈন্য পাঠানো হচ্ছে আফ্রিকায়। সেটার জন্যই মূলত এই মিটিং। চট্টগ্রাম থেকে রাজশাহী পথটা কম না৷ এই মিটিং এ সব সিনিয়র অফিসার’রা ই যাচ্ছে। কোন জুনিয়র নেই।
তথ্য এদিক ওদিক তাকালো একবার। মাত্রই দেখলো অফিসার রিদ নিজের রুমে ঢুকেছে। নিজের কথা মনে গুছিয়ে তথ্য দরজায় নক করতেই ভেতর থেকে শুনা গেলো,

— কাম ইন।

তথ্য ঢুকেই সজোরে বা পা মাটিতে আঘাত করে সটান দেহে স্যালুট করলো। রিদ সালামের জবাব নিয়ে বললো,

— ইজ এনি থিং রং মিস.তথ্য?

— নো স্যার।

— দ্যান?

তথ্য কিছু বলার আগেই অফিসার রিদ পুণরায় বললো,

— বসুন আগে।

তথ্য বসতেই অফিসার রিদ বললো,

— এবার বলুন।

— স্যার আই থিং….

তথ্য’কে সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই রিদ বললো,

— ইউ থিংক?

— স্যার আসলে…

— ক্যাম্পে যেতে চাইছেন রাজশাহী।

তথ্য চোরা হাসলো। রিদ এবার শব্দ করে হেসে বললো,

— কারণ?

তথ্য’কে এবারও উত্তর দিতে দিলো না রিদ। নিজেই বললো,

— কারণ যেটাই বলেন না কেন মেইন রিজন তো অফিসার তুষার শেখ।

তথ্য এবার লাজুক হাসলো যা অদ্ভুত দেখায়। অদ্ভুত সুন্দর। আর্মির গেটাপে থাকা মেয়েদের ফর্মাল ড্রেসে মুখে লাজুক হাসি বড়ই অদ্ভুত। এই সৌন্দর্য বর্ননা করা মুশকিল।

তথ্য বেরিয়ে এক দৌড়ে চলে গেল তুষা’রের কটেজে। এখন বানিয়ে ছানিয়ে কাহিনি করবে ও একটা। এই কাহিনী করে করেই তো তুষারের পিছু নেয় বারংবার।

________________

তোঁষা আজ পাংশুটে মুখে বসে আছে বারান্দায়। সামনে ওর পরিক্ষা। বই-খাতা নেই কিছুই। ভাবলো আজ আরহাম এলেই তাকে বলবে বই খাতা এনে দিতে নাহলে পরিক্ষায় লাড্ডা শিওর। আরো কিছু লাগবে তোঁষা’র। ভাইয়ের সাথে কথা বলতে হবে। বাবা’কে দেখতে হবে। মায়ের সাথে তোঁষা’র রাগ তবে মায়ের কথা ওর মনে পরে। চাচি’র কথা মনে পরছে। চাচি না থাকলে তোঁষা শেষ মুহুর্তে হয়তো ম’রে যেতো।
ওর ভাবনার মাঝেই আরহামে’র আগমন হলো। তোঁষা’র মুখে হাসি ফুটে উঠলো। বারান্দা থেকে দৌড়ে দরজা অবদি গিয়েই আরহাম’কে জড়িয়ে ধরে তোঁষা ওমনিই ওকে পাঁজা কোলে তুলে আরহাম। তোঁষা হাসি মুখে গলা জড়িয়ে ধরে কিছু আবদার করে যাচ্ছে। আরহাম আদৌ শুনছে কি না জানা নেই। তবে সে এক ধ্যানে তোঁষা’কে দেখে যাচ্ছে। বিছানায় তোষা’কে রাখতেই তোঁষা উঠে বসতে চাইলো তবে বাঁধা দিলো আরহাম। তোঁষা’কে বিছানায় রেখেই সাইড টেবিলে কিছু খুটুর খুটুর করে যাচ্ছে ও। এদিকে তোঁষাও প্রশ্নের ঝুড়ি খুললো,

— কি করছেন আরহাম ভাই?

— তেমন কিছু না প্রাণ।

— ভাইয়ার সাথে কথা বলব আজ।

–একটু কাজ আছে প্রাণ। অপেক্ষা কর।

তোঁষা দেখলো আরহামে’র হাতে একটা সিরিঞ্জ ভর্তি। কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই আরহাম ওকে উল্টো করে শুয়ে দিলো। তোঁষা ইনজেকশন ভয় পায় না তবে বড্ড কৌতুহলী সে। তাই জিজ্ঞেস করলো,

— এটা কিসের?

আরহাম উত্তর না দিয়ে বললো,

— ব্যাথা দিব না প্রাণ। দেখি দিতে দে।

বলেই তোঁষা’র পরণে থাকা পোশাক তুললো আরহাম। দৃশ্যমান হলো কোমড়ের দিক। ঠিক মেরুদণ্ড বরাবর পুশ করে আরহাম। মিনিট খানিক কি গেলো? না মিনিট গেলো না তবে গগন বিদারি চিৎকার করে উঠলো তোঁষা। ছটফট করতে করতে বলতে লাগলো,

— ক..কি দিচ্ছো? কি দিচ্ছো? ব্যাথা পাচ্ছি। জ্ব…জ্বলছে আমার। ছাড়ো। ছাড়ো আমাকে৷ আরহাম ভাই অনেক জ্বলছে।

আরহাম ছাড়লো না। পুরোটা পুশ করে তোঁষা’কে ঝাপ্টে ধরে ও। তোঁষা’র অবস্থা তখন খারাপ। ও ছটফট করে কেঁদে যাচ্ছে,

— আম্মু…. আম্মু….জ্বলছে আমার। আব্বু। ছাড়ো আমাকে। ছাড়ো। জ্বলছে।

— ব্যাথা নেই। ব্যাথা নেই প্রাণ। তোকে যে ব্যাথা দিয়েছে তার থেকে তোকে মুক্তি দিব আমি প্রাণ। একটু ধৈর্য ধর।

কাঁপা কাঁপা গলায় বলে গেলো আরহাম। বহু কষ্টে তোঁষা’কে চেপে রেখেছে সে। হাই ডোজটা সহ্য করতে পারলো না তোঁষা’র দেহ। একসময় কয়েকটা ঝাঁকি দিয়ে থেমে গেলো ওর ছটফট করা দেহটা।

আরহাম নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো তোঁষা’র জ্ঞানহীন দেহটাকে। মুখে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে অসহায় গলায় বললো,

— তোর সব ব্যাথা আমি মুছে দিব প্রাণ৷ একটা বার তুই আমার হ, পুরো দুনিয়া আমি পর করে দিব।

#চলবে…..

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৭

রাজশাহী ট্রিপে তথ্য’কে দেখে বিন্দুমাত্র চমকালো না তুষা’র। না ই তেমন কোন আগ্রহ দেখালো। ও চমকাতো যদি তথ্য এখানে না থাকত। ডিউটি পড়ুক আর না পড়ুক এই মেয়ে ওর পিছু নিবেই। এই যে চাইলেই এখন ক্যাম্পে থেকে নিজের কাজ করতে পারত অথচ সে এসেছে রাজশাহী। এই মেয়ে ক্লান্ত হয় না। পরক্ষণেই তুষা’রের মনে হলো আর্মিদের আবার ক্লান্তি?

বাইরে ঝলমলে সূর্যের প্রখর রোদ আজ। রাজশাহী শহরটা কি তবে গরম? চট্টগ্রামে যথেষ্ট ঠান্ডা লাগে তুষারের। সেই ঠাণ্ডাটা অবশ্য আরামদায়ক। শরীরে সহনীয়। যদিও এখন শরীর মন কিছুই তার ভালো থাকে না। পরিস্থিতি থেকে পালানো কি এতই সহজ? মোটেও সেটা সহজ না৷ তোঁষা ওর বোন হলেও বয়সের বিরাট বড় ফারাকের কারণে তাকে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসে তুষা’র। এই যে পালিয়ে এলো পরিস্থিতি থেকে। পরিবারের উপর রাগ করে শান্তি কি মিলছে? উহু মোটেও না৷ কোন শান্তি নেই এখানে। আগের মতো রুচি জাগে না কিছুতেই। কানে বারংবার বাজে এই বুঝি পুতুল’টা ভাই বলে ডেকে উঠলো।
আরহামের হয়তো সমস্যা আছে তবে তাদের দূরে রাখাটা কতটা যুক্তিযত হলো? এখন কেমন আছে ওর পুতুলটা। গোপনে এখানে এসে খোঁজ চালাচ্ছে তুষা’র যা বাসায় থাকাকালীন করা সম্ভব ছিলো না। এখান থেকে তোঁষা’র খোঁজ চালাচ্ছে ও। আরহাম যথেষ্ট মান্য করে তুষা’রকে। তুষার বুঝাবে আরহাম’কে। ও জানে আরহাম ভালোবাসে তবে সেই ভালোবাসাটা অসুস্থ। হয়তো পৃথিবীর শুদ্ধতম ভালোবাসা তবে বি*ষা*ক্ত বাঁধনে ঘেরা।

ঠকঠক শব্দে ঘাড় ঘুরালো তুঁষা’র। তথ্য দাঁড়িয়ে। তুষা’রের লাল মুখটা দেখেই তথ্য’র হাসিখুশি মুখটায় আঁধার নেমে এলো। তুষারের হাসি পেলো। সে হাসলো ও। মনের মধ্যে থাকা বিধ্বস্ততা সে দেখাতে চায় না কাউকে। সবাই উপরটা ই দেখুক। ভেতরটা নিজের থাকুক। একদম একান্ত নিজের।
তবে তা হলো না। তথ্য মিথ্যা হাসি চিনে ফেললো। ঘাড় নামিয়ে ফেলে ধীরি শব্দে ডাকলো,

— তুঁষা’র?

তুষা’রের হাসি মিলে গেলো মুহুর্তেই। এদিক ওদিক তাকিয়ে কথা বলার জন্য কিছু খুঁজলো। তথ্য ওর আচরণে অবাক হয় কিছুটা। শক্তপোক্ত একজন মানুষ কিভাবে এতটা ভেঙে পরলো? তথ্য জানে তুষা’রের জন্য তোঁষা কি। আগে যখন আলাপ হতো তখন পাঁচ লাইন কথায় তার তিনবার পুতুল’কে মনে হতো। কতটা ভালোবাসে তাও জানে তথ্য। এগিয়ে এসে সাহস জুগিয়ে তুষা’রের হাত ধরলো ও। তুষা’র হয়তো এমনি সময় রেগে যেতো তবে আজ রাগলো না। তার ভীষণ ভাবে মনে হলো একজন দরকার তার হাতটা ধরার জন্য। একজন মানুষ প্রয়োজন মনটাকে তার সম্মুখে মেলে ধরার জন্য। সেই কেউ টা তথ্য হলে মন্দ কি? তুষার দৃষ্টিপাত করলো তথ্য’র দিকে। সুন্দর এক রমণী দাঁড়িয়ে তার সম্মুখে যার চোখে, মুখে লেপ্টে থাকা ভয়। তুষা’রের জন্য ই সেটা। হাত বাড়িয়ে এই প্রথম তথ্য’র গাল স্পর্শ করে তুষা’র। শিউরে উঠে তথ্য। আতঙ্কিত গলায় ডাকে,

— তুষা’র?

— হু।

— তু…তুমি।

— তথ্য?

____________________________

তোঁষা সেই যে ঘুমালো এখনও উঠে নি। আরহাম ল্যাপটপে আঙুল চালনা করলেও ফাঁকে ফাঁকে তোঁষা’কে দেখে যাচ্ছে। আজ বাসা থেকেই দুটো কেস হ্যান্ডেল করছে ও। এখন তোঁষা উঠবে না জানা সত্বেও কেন জানি তোঁষা’কে একা ছাড়তে মন চাইলো না। ঘুমন্ত নিষ্পাপ একখানা মুখ। কেমন ফুলাফুলা দেখতে গালগুলো। মনে হয় আকাশের মেঘ যেন এগুলো। কাজের ফাঁকে এক ধ্যানে তোঁষা’কে দেখলো আরহাম। মন ভরে না তার। কিছুতেই না। মন চায় শুধু দেখেই যাক।
হাতের কাজটুকু শেষ করে আড়মোড়া ভেঙে উঠে আরহাম। বিছানায় বসে হাত রাখে তোঁষা’র কপালে। মেডিসিন এর এফেক্টে অল্প জ্বর চলে এসেছে। উঠলে নিশ্চিত শরীর ও ব্যাথা থাকবে। তখন আরহাম নিজে মলম লাগিয়ে দিবে। যদিও উচিত না তাও ভাবলো একটা পেইন কিলার খায়িয়ে দিবে। তুঁষটা’কে কষ্টে রাখা যাবে না। ঠিক যতটা না দিলেই নয় ততটুকু ব্যাথা তোঁষা’কে সহ্য করতেই হবে। আরহাম কিছুতেই তাকে নিজের থেকে আলাদা করার ফাঁকফোকর রাখবে না কারো জন্য।
গতকাল যখন তোঁষা’র পিঠে ওর মায়ের দেয়া আঘাতগুলো দেখলো তখন আরহামে’র অনুভূতি দি মুখী ছিলো। প্রথমত তার রাগে শরীর কাঁপছিলো। মন চাইছিলো নিজ হাতে একটা প্রাণ কেড়ে নিতে। যে ওর তুঁষে’র নরম দেহে আঘাত হানলো তার দেহ’টাকে ছিন্ন করে দিতে কিন্তু ওর দ্বিতীয় অনুভূতিটা ছিলো ভিন্ন। ভালোবাসা পূর্ণ এক আদুরে অনুভূতি। তোঁষা’টা তাকে ভুলে নি, ছাড়ে নি এতটা বাজে আঘাত পাওয়ার পরেও।
তাই তো আরহাম এতদিন যেই কাজ ধীরে ধীরে করছিলো তা গতকাল ডোজ বাড়িয়ে দিলো। তোঁষা’কে সে নিজের করে রাখবে। তোঁষা’র চিন্তা, ভাবনা সবটা হবে তাকে জুড়ে।

কথাগুলো ভাবতেই আরহাম ঝুঁকে চুমু খেলো তোঁষা’র মুখে। আজ ঘুমের মধ্যে শব্দ করছে তোঁষা। প্রথম ডোজটা শরীরে সইতে সময় নিচ্ছে। আস্তে ধীরে সহ্য হয়ে যাবে। তখন এত কষ্ট হবে না নিশ্চিত। আস্তে করে কাঁথার নিচে ঢুকে আরহাম। তুলে নিলো তার প্রাণ’কে। বুকে শান্তি লাগে তার। কেমন একটা ভালোলাগা কাজ করে। মন চায় বুকটা খুঁড়ে এখানে দাফন করে রাখুক তার প্রাণ’টাকে।
.
টলতে টলতে ওয়াশরুম থেকে বের হলো। ঘুমের রেশ যেন এখনও কাটতে চাইছে না। কাউচে ধপ করে বসে মাথা এলিয়ে দিলো তোঁষা। একটু ঘুম দরকার আবারও তবে সেটা আপাতত সম্ভব হলো না। আরহাম এসে টেনে তুললো ওকে। তোঁষা টেনেটুনে চোখ খুলতেই দেখা মিললো আরহামে’র। হাত বাড়িয়ে দেয় তোঁষা ওর প্রাণে’র পানে। আরহাম তোঁষা’র হাত ধরে নিজের কাছে টেনে নিতে নিতে বললো,

— তুঁষ? খাবি এখন প্রাণ।

— ঘুম পায় তো।

বলেই গলা জড়িয়ে ধরে আরহামে’র। আরহাম ঠোঁট কামড়ে কিছু ভাবলো। ডোজ বেশি ছিলো সেটা ও জানে তাই বলে তোঁষা’র এতটা ঘুম পাওয়ার তো কথা না। অল্প বিস্তর চিন্তা দেখা দিলো আরহামে’র চেহারায়। তোঁষা ততক্ষণে ওর বুকে হেলান দিয়ে চোখ বুজে নিলো। আরহাম ওকে নিয়ে পা বাড়ালো বাইরে। তোঁষা’র হাতে এক মগ ভর্তি ধোঁয়া উড়া কফি দিয়ে বললো,

— শেষ কর।

— ঘুমাই?

— না।

— খাব না এটা।

— আমি বানিয়েছি তোর জন্য।

তোঁষা মুখ বানালো। আরহামে’র কিছুই সে ফিরিয়ে দিতে পারে না। টেনে চোখ খুলে একপলক দেখে বললো,

— তোমারটা খাব।

আরহাম বিনাবাক্যে মেনে নিলো ওর প্রাণে’র আবদার। নিজের মগে ঠোঁট গোল করে ফুঁ দিয়ে ধরলো তোঁষা’র ঠোঁটে। তোঁষা এক চুমুক দিয়ে ঘাড় দুলালো। ভালো লেগেছে ওর। বাকিটুকু পুরোটা খেলো ও আরহামে’র। আরহাম খাওয়ালো নিজ হাতে। তোঁষা’র ছোট ছোট চুমুক বসিয়ে কফি শেষ সময় লাগলো বটে। ততক্ষণে ওর হাতের কফি ঠান্ডা হয়ে শরবত। তোঁষা জিহ্বা দিয়ে নিজের ঠোঁটের আশপাশে চেটে বললো,

— আপনার টা তো শেষ।

— হু।

— তাহলে আমারটা খাও।

উচ্ছাসিত গলায় বলে নিজের মগের কফিটা নিজ হাতে খাওয়াতে উদ্ধত হয় তোঁষা। সব সময় গরম ধোঁয়া উড়া কফি খাওয়া আরহাম আজ তৃপ্তি সহকারে চুমুক বসালো ঠান্ডা কফিতে। তার প্রাণে’র হাতের সবকিছুই তার নিকট প্রিয়। এই প্রাণ’টা ই তার প্রিয়।
.
–দুধ ভালো লাগে না আরহাম ভাই।

কথাটা বলেই কাঁথার নিচে মুখ লুকালো তোঁষা। আরহাম একবার গ্লাসটা দেখলো। কিছু মেডিসিন মেশানো এটাতে। তোঁষা’কে খাওয়াতেই হবে। এই মেডিসিন কোর্স কম্পিলিট করতেই হবে। গ্যাপ দেয়া যাবে না।
আরহাম গ্লাসটা সাইডে রেখে কাঁথা সরাতে চাইলো। তোঁষা ছাড়বে না। জোর করেই ঠ্যাটামি করে পরে রইলো। আরহাম কাঁথা টেনে পুরোটা সরিয়ে দিতেই তোঁষা’র দিকে তাকালো। আরহামে’রই ছাই রঙা টিশার্ট’টা ওর পরণে। তোঁষা’র গলায় হাত ছুঁয়ে দিলো আরহাম। কেঁপে উঠল ওর কণ্ঠনালী। চোখ মেলতেই আরহাম বললো,

— খেয়ে নে না তুঁষ।

কি অসহায় আবদার অথচ একটু আগেও মিউ মিউ করে তোঁষা’র কাছে সমর্পণ করেছিলো এই আরহাম ভাই।
তোঁষা অর্ধ চোখ খুলে বললো,

— আগে প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।

— কর।

— গতকাল কিসের ইনজেকশন ছিলো ওটা? অনেক জ্বলেছিলো। ব্যাথাও ছিলো। এখনও আছে।

আরহাম তোঁষা’র নরম হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নেয়। এক হাত ওর চুলের ভাজে গলিয়ে দিয়ে শান্ত স্বরে উত্তর করে,

— তোর কষ্ট লাঘবের দায়িত্ব আমার না প্রাণ? সেটাই পূরণ করছি।

— কষ্ট তো বেশি পেয়েছি। ওটা দেয়াতেই ঘুম পায় আমার।

— ঘুমালে ব্যাথা কমে যাবে। উঠ দুধ শেষ কর।

তোঁষা উঠলো। আরহামে’র কানের কাছে কিছু সময় ঘ্যানঘ্যান করে দুধটুকু শেষ করে ও। তোঁষা বায়না ধরে,

— চলুন না বারান্দায় যাই।

— এখন?

— হু।

তোঁষা’কে বিছানা ছাড়তে হলো না। আরহাম কোলে তুলে হাটা দিলো বড় বারান্দায়। কাপল গোল দোলনাটাতে এই বাইশ তলার উপর থেকে বসে চন্দ্র বিলাস ভিন্ন এক অনুভূতির জোয়ারে ভাসালো দু’জনকে। একসময় তোঁষা নিজেকে দিলো ওর সবচাইতে ভরসার মানুষটার বুকে।
আরহাম এক ধ্যানে তোঁষা’কে দেখে ওর শরীরটা নিজের মাঝে আটকে ধরলো। ফিসফিস করে জানালো,

— তোর অতীত থাকবে না কোন প্রাণ। সব ভুলিয়ে দিব আমি। সব মুছে দিব। অতীতহীনা তুই আমার। তোর বর্তমান হব আমি। ভবিষ্যৎ ও আমি।

#চলবে….

[ এটা একটা কাল্পনিক গল্প।]

প্রিয় প্রাণ পর্ব-১৪+১৫

0

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৪

ঠান্ডা রুমে’র মাঝে এতক্ষণ যাবৎ উত্তাপ ছড়িয়ে এখন শীতলতায় ঘিরে আছে এক প্রেম যুগল। তোঁষা’র মাথায় হাত বুলাচ্ছে আরহাম। মাত্র ঘুমালো বলে তুঁষ’টা। এতক্ষণ ঘুমাতে পারে নি সে। ছটফট করেছে শুধু। আরহাম যে মেডিসিন দিবে তারও সুযোগ হয় নি। তোঁষা’র অবস্থান এখন আরহামে’র উপর। আরহামে’র গলায় মুখ গুজে গরম নিঃশ্বাস ফেলছে সে। আরহাম ভেবে কুল পায় না ঐ দিনের হওয়া সেই তুঁষ’টা কি পাগলামো’টাই না করলো। সেই পাগলামো’তে যখন আরহাম ও পাগল হলো তখন ই যেন কাহিল হলো তুঁষ’টা। আরহাম তখন থেকে বুকে তুলে রেখেছে তাকে। কতক্ষণ তো শুধু কাঁদলো। আরহাম উঠতে চাইলেই সেই কান্নার শব্দ যেন বেড়ে যায় অগত্যা এখনও উঠতে পারলো না ও।
তোঁষা’র চুলে হাত বুলাতে বুলাতে বারকয়েক সময় পরপর চুমুও খাচ্ছে আরহাম তার মাথায়। বুকে এখনও কেমন ধ্রীম ধ্রীম শব্দ হচ্ছে। কিছুক্ষণ আগের মুহুর্তগুলো ভাবতেই গলা শুকিয়ে যায় আরহামে’র। কেমন চোখ ভিজে উঠে। দেশের বাইরে কমতো ছটফট করে নি ও। দেহের ব্যাথা মানুষ দেখে কিন্তু মনের ব্যাথা? এটা কেউ দেখে না। দেখলেও বুঝতে চেষ্টা করে না। শেখ বাড়ীর প্রতিটা সদস্য জানতো আরহাম কতটা অসহায় হয়ে পরে ছিলো সেই ভিনদেশে অথচ কারো মনে মায়াটুকু হয় নি তাই এখন আরহাম ও মায়া দেখাবে না। এতকষ্টে’র পর পাওয়া তুঁষ’কে কোথাও হারাতে দিবে না ও।
কথাগুলো ভাবতেই নিজের সাথে তোঁষা’র নরম দেহটা আরো গভীর ভাবে জড়িয়ে নেয় আরহাম। মনে পরে যখন তোঁষা’কে ছেড়ে গিয়েছিলো সে হাসিমুখে অথচ সম্পূর্ণ’টা ছিলো শেখ বাড়ীর সদস্যসে’র পরিকল্পনা।

~তুরাগ বেশ ভালোই বুঝে যান ছেলে তার এত সহজে মানবে না। যথেষ্ট মেধাবী আরহাম৷ পাবলিকে চান্স তো আর এমনি এমনি পেলো না। তুরাগ ছোট ভাই তুহিন’কে ডেকে খুব মাথা খাটিয়ে এক পরিকল্পনা করলো। আরহাম’কে না জানিয়ে তার জন্য ভিসা এপ্লাই করে দেশের বাইরে। এতসবে তোঁষা শুধু জানলো আরহাম ভাই বাইরে পড়তে যাবে কিন্তু তুরাগ এখানে বড় একটা চাল করেছিলো।
আরহামে’কে নিজের রুমে ডেকে ঐ দিন বেশ নরম গলায় বললো,

— দেখো আরহাম আমার প্রথম সন্তান তুমি।

— কি বলতে চাও আব্বু?

আরহাম জানে বাবা এত সহজ মানুষ না৷ তুরাগ ও জানে ছেলে তার এত বোকা না। তাই তো নরম হয়ে বলেছিলেন,

— দেখ আরহাম তোমাকে যেমন ভালোবাসি তেমনই পুতুল’কেও সবাই ভালোবাসে। ওর কোন ক্ষতি হোক কেউ চাই না।

— কে করবে ক্ষতি? আমি?

আরহামে’র কন্ঠে রাগের আভাস। তুরাগ ছেলে’কে পাশে টেনে বসান। আরহামে’র হাত ধরে বলেন,

— বাবা আমার, তোমার সমস্যা’র কথা তুমি জানো। আমার ছোট ভাই’টার একটা মাত্র মেয়ে। আমারও কোন মেয়ে নেই। বংশের একমাত্র মেয়ে পুতুল। কোন বাবা কি চাইবে নিজের মেয়ে’কে অসুস্থ কোন ছেলের সাথে বিয়ে দিতে? হাজার থাকুক ভালোবাসা।

— ওকে কেন ক্ষতি করব আমি? ভালোবাসি তুঁষ’কে। ও ওতো ভালোবাসে আমাকে। ওকে কারো কাছে ঘেঁষতে দিব না আব্বু। শুধু একটা বার ওকে আমাকে দিয়েই দেখো। কাউকে অভিযোগ করার সুযোগ দিব না।

— সুযোগ টা যদি আগে দেই?

আরহাম তাকালো। তুরাগ ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,

— তোমার ট্রিটমেন্ট এর জন্য দেশের বাইরে পাঠাতে চাইছি আরহাম। সম্পূর্ণ সুস্থ হও আগে। ততদিনে তোঁষা’কে আগলে রাখব। ওয়াদা করছি।

আরহাম তখন তোঁষা পেতে মরিয়া। তাই তো নিজের শখে’র সাবজেক্ট ইন্জিনিয়ারিং ছেড়ে দেশের বাইরে যেতে রাজি হয়ে গেলো ততক্ষণাৎ। সবাই জানল আসল ঘটনা অথচ তোঁষা’কে জানালো হলো আরহাম যাচ্ছে পড়াশোনা’র জন্য। অর্ধ সত্য জানা তোঁষা তাতেই কেঁদে অস্থির। তাকে কোন ভাবে জানানো হয় নি আরহাম’কে দূরে পাঠানোর আসল কারণ। এতসবে একমাত্র বিরোধীতা করলো তুষা’র। কারণ একটাই। ও জানে বাপ-চাচাদের আসল উদ্দেশ্য। তোঁষা’র সাথে কখনো তারা আরহাম’কে মিলতে দিবে না। জেনেটিক ভাবে আরহাম অসুস্থ। এখানে সুস্থ হওয়াটা একটু কঠিন। বাপ-চাচা অতকিছু বুঝতে চাইলো না। তাদের ধারণা আরহাম থেকে তোঁষা দূরে থাকলেই ভুলে যাবে। একসময় তোঁষা’কে বিয়ে দিয়ে দিবে। তাহলেই শেষ। তুষা’র সোজা বাবা’র রুমে ঢুকেই তীক্ষ্ণ স্বরে বললো,

— কি করতে চাইছো তোমরা?

তুহিন কিছু বলার আগেই তুরাগ বললো,

— আমার ছেলে আমি চিনি তুষা’র। এ বিষয়ে কথা বলতে চাইছি না।

তুষা’র কথা মানলো না। জোর করেই বাবা’কে উদ্দেশ্য করে বললো,

— তোমাদের উদ্দেশ্য আমার জানা আছে আব্বু। আরহাম’কে দূর করতে চাইছো? ভাবছো আরহাম একাই পাগল পুতুলের জন্য? নিজেরা কি দেখছো না পুতুল নিজে কতটা পাগল? কারো কথা শুনে না আরহাম ছাড়া। ওর জেদ আরহাম ছাড়া কেউ ভাঙাতে পারে না। দু’জনকে বিয়ে করিয়ে রাখ। এ বাড়ীতেই থাকুক একসাথে। অন্তত চোখের সামনে থাকবে।

— হ্যাঁ এরপর ঐ পাগল আমার মেয়ে’কে মে’রে ফেলুক!

কিছুটা খলবলিয়ে কথাটা বললেন তুহিন। তুষা’র পরবর্তীতে অনেক চেষ্টা করেও বাসায় কাউকে মানাতে পারে নি। একবার চাইলো আরহাম’কেই জানিয়ে দিবে বাবা-চাচা’র আসল উদ্দেশ্য কিন্তু মায়ের দেয়া কসম তাকে বাঁধা দিলো সেটা করতে। সেদিন রাগে বাসা ছেড়ে চলে যায় তুষা’র। তার হাতে করার জন্য কিছুই ছিলো না। কাকে বুঝাবে তোঁষা’র সাথে আরহাম আর আরহামে’র সাথে তোঁষা ই ভালো থাকবে। এদের আলাদা করতে গেলেই হয় ভেঙে যাবে নয় একদম গুড়িয়ে দিবে।

এই তো অতঃপর একদিন আরহাম চলে গেলো। সেদিন দুটো নারী’র কান্নায় শুধু মুখরিত হলো শেখ বাড়ী। তোঁষা’কে সামলাতে অবশেষে আরহাম’কেই লাগলো। যদিও বাসার সবাই চেয়েছিলো তোঁষা স্কুলে থাকাকালীন আরহাম’কে পাঠিয়ে দিবে কিন্তু সেটা সম্ভব হয় নি। তোঁষা ঐ দিন স্কুল পালিয়ে বাসায় ফিরেছিলো। কেন জানি ওর মন বলছিলো ওর প্রাণ চলে যাচ্ছে। বহুদূরে। সেদিন সেই প্রাণে’র টানেই তো প্রাণের প্রাণেস্বরী ছুটে এলো।
আরহাম তোঁষা’কে ধরে রুমে নিয়ে দরজা লাগাতেই সবাই কিছুটা ভরকে যায়। কি করবে আরহাম?
আরহাম তেমন কিছু করলো না। শুধু তোঁষা’র হাত ধরে পাশে বসে শান্ত স্বরে বলেছিলো,

— আমার প্রাণ না তুই তুঁষ? তুই কাঁদলে এই প্রাণহীন দেহ নিয়ে কিভাবে যাব?

ব্যাস তোঁষা শান্ত হয়ে যায়। উল্টো সেদিন নিজে আরহাম’কে বলেছিলো,

— আমার প্রাণ যাতে তারাতাড়ি ফিরে আসে।

— প্রাণ কি প্রাণে’র জন্য নিজের খেয়াল রাখবে?

— রাখবে?

— ওয়াদা দে।

— দিলাম।

— যাব?

— আচ্ছা।

— সত্যি?

— তিনসত্যি।

— কাঁদবি?

— হু।

— তুঁষ?

— কাঁদব না।

অতঃপর আরহাম তোঁষা’র মাথায় হাত রেখে রুম থেকে বেরুলো। গাড়িতে উঠার আগে আদনানকে জড়িয়ে ধরে আরহামে’র দুটো আবদার,

— মা আর তুঁষ’টাকে দেখে রাখিস। শুন রাতে আম্মুর কাছে এসে ঘন্টা খানিক থাকবি। তোকে দেখলে আমার কথা কম মনে পরবে।

আদনানে’র চোখ ভিজে উঠে। ভাই’কে সে ভালোবাসে। দুই ভাইয়ের ভালোবাসার কমতি কখনো ছিলো না।
আরহামে’র গাড়িটা ছাড়তেই একই সাথে সস্তি আর হতাশার শ্বাস ফেললো সকলে। আচ্ছা তুরাগে’র ভেজা চোখটা কি কেউ দেখলো না? একজন বাবা’র কষ্ট’টা সবসময় ই অদৃশ্য থাকে। আড়ালে। আবডালে।
তোঁষা বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপলক দেখে সেই যাওয়া। ওর চোখদুটো কেন জানি আর কাঁদে না। মনে হয় আরহাম যায় নি। কখন জানি এসে বলে,
“তুঁষ ইনসুলিন নিয়েছিস? মিষ্টি খেতে মন চায়?”

কিন্তু বছরের পর বছর আরহামে’র দেখা পায় না তোঁষা। অপেক্ষা কাটে। যখনই তোঁষা জানতে পারে তাকে আর আরহাম’কে ধোঁয়াসায় রাখা হ’য়েছে তখনই সে প্রতিবাদ করে।মিনতি করে। লাভ হয় না।
তোঁষা’কে আরহামে’র সত্যিটাও জানানো হয় কিন্তু ততদিনে তার কি সেই বিশ্বাসটা বহাল ছিলো শেখ বাড়ীর সদস্যের উপর?

#চলবে….

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৪(বর্ধিতাংশ)
[পর্বটা একটু রোম্যান্টিক]

সবে মাত্র চোখ খুললো তোঁষা। আরহাম হয়তো মাত্রই ক্লান্ত দেহে চোখ বুজলো। মৃদুমন্দ ব্যাথা’য় চোখ বুজলো পুণরায়। কন্ঠ ভেদ করে বেরিয়ে এলো ব্যাথাকাতুর শব্দ। আরহামে’র চোখটা নড়লো বোধহয়। যথেষ্ট কানখাড়া পুরুষ সে। তবে আজ তার ক্লান্ত চোখদ্বয় খুললো না। তোঁষা উঠতে চাইলো। নিজের দেহটা’কে টেনে সরালো আরহামে’র উপর থেকে। আচ্ছা আরহাম ভাই কি এতক্ষণ ব্যাথা পায় নি? আস্ত একটা তোঁষা ছিলো তার উপর। তোঁষা আপাতত উঠতে চাইলো। আরহামে’র থেকে নিজেকে সরাতেই বেশ বেগ পেতে হলো তাকে। যেই না শরীর থেকে কাঁথা’টা সরালে ওমনিই লজ্জায় মাথা নত হয়ে এলো তোঁষা’র। অক্ষিপটে ভেসে উঠে রাতের তাদের একান্ত ব্যাক্তিগত মুহুর্তগুলো যা ছিলো তোঁষা’র কাছে আদরের। ভালোবাসা’র। এই নতুন ভাবে পাওয়া আদরে’র ছাপ ছড়িয়ে তোঁষা’র সর্বাঙ্গে। নিজের পরণে থাকা আরহামে’র শার্ট’টার দিকে তাকিয়ে রয় তোঁষা। মাথাটা কাত করে ঘ্রাণ নিতে চায়। পুরাতন অভ্যাস বলে কথা। অথচ বোকা তোঁষা ভুলেই গিয়েছে যেখানে আস্ত আরহাম ভাই তার এত নিকটে, যার ঘ্রাণে এখন মাতোয়ারা এখন খোদ তোঁষা সেখানে আরহাম ভাই এর এই শার্টের ঘ্রাণ নিছক তুচ্ছ বৈ কিছুই না। তোঁষা কথাগুলো মনে করে নিজের হাসলো। ফোলা ফোলা গাল দুটো রক্তিম হয়ে উঠলো মুহুর্তেই। শরীরে’র সকল পীরা ভুলে তোঁষা পা রাখলো নীচে। ওমনিই যেন ওর সারা শরীর চিরিক করে উঠলো। মুখে এবার একটু জোরেই শব্দ করে ব্যাথাটা প্রকাশ হলো যেন৷ আরহামে’র সজাগ কান তা শুনলো। নিজেকে একা আবিষ্কার করেই তার ঘুমন্ত মস্তিষ্ক জাগ্রত হলো নিমিষেই। তুঁষ’টা কাছে নেই। চোখ খুলে কিছু বুঝে উঠার আগেই ধপ করে শব্দ হলো। অর্ধ জাগ্রত মস্তিষ্ক’টা এবার পুরোটা জেগে উঠলো। তড়িৎ বেগে বিছানা ছাড়তেই এলোমেলো তোঁষা’কে ফ্লোরে আবিষ্কার করে আরহাম। আরহাম আতঙ্কগ্রস্থ ডেকে উঠলো,

— তুঁষ!

তোঁষা মুখ নাড়লো। বলতে চাইলো কিছু তবে সম্ভব হলো না। আরহাম তাড়াতাড়ি তোঁষা’র মাথাটা কোলে তুলে নিয়ে আতঙ্কিত ভাবেই ডাকতে লাগলো,

— তু..তুঁষ? এই তুঁষ? পরে গেলি কিভাবে প্রাণ? উঠ। উঠ না। তাকা আমার দিকে।

তোঁষা’র চোখ বেয়ে শুধু পানি পরলো। মুখ ফুটে কিছু বলার সুযোগ তার হলো না। চাইলেও বলতে পারলো না। আরহাম অস্থির হয়ে উঠলো যেন। বাড়লো তার উন্মাদনা। তোঁষা’র মুখ দিয়ে লালা জাতীয় কিছু গড়িয়ে পরতেই আরহাম হুস হারিয়ে ফেললো। সহজ বিষয়’টা তার কাছে জটিল হয়ে এলো। সাধারণ ভাবেই স্যালিভারী গ্লান্ড থেকে স্যালিভা ক্ষরণ হয়ে থাকে। যা বেশি হলে মুখ থেকে গড়িয়ে বের হয়। অর্ধ চেতন তোঁষা’র ও তাই হলো। আরহাম পাজা কোলে তুলে ওকে বিছানায় রাখতেই পুরোপুরি জ্ঞান হারালো তোঁষা।
একা এক বাড়ীতে তোঁষা’কে নিয়ে এহেন অবস্থায় বড্ড অসহায় হলো আরহাম। চোখে মুখে পানি’র ছিটে দিয়ে ডাকতে লাগলো ব্যাকুল কন্ঠে,

— তুঁষ… এই তুঁষ? একটা বার তাকা না প্রাণ। আমার ভয় লাগছে তুঁষ। প্লিজ তাকা না।

অনবরত তোঁষা’র গালে আলতো চাপড় মে’রে আরহাম ডাকতে লাগলো। তোঁষা’র ঠোঁটদ্বয় যখন ফ্যাকাসে হলো তখনই আরহামের টনক নড়লো। পাশ থেকে ছোট যন্ত্রটা নিয়ে তোঁষা’র ডায়াবেটিস চেক করতেই চোখ চড়কগাছ। ডায়াবেটিস নীল হয়ে আছে। আরহামে’র হঠাৎ ই মনে পরলো গতরাত আর সকাল তোঁষা’কে ইনসুলিন পুশ করা হয় নি। ভয়ংকর কিছুর টের পেতেই আরহাম এক দৌড়ে ফ্রিজ থেকে ইনসুলিন এনে পুশ করে দিলো। তোঁষা’র লেগে থাকা দুই দাঁতের মাঝে নিজের অনামিকা আঙুল ঢুকিয়ে দাঁতের পাটি আলাদা করতে চাইলো। প্রচুর বেগ পেতে হলো আরহাম’কে এই কাজ করতে। অতঃপর যখন তোঁষা’র চোখের পাতা কিছুটা নড়লো তখন আরহাম ধীর কন্ঠে তাকে ডাকতে লাগলো,

— তুঁষ উঠবি না। প্রাণ আমার তাকা এদিকে।

তোঁষা কি পারে তার প্রাণে’র ডাক উপেক্ষা করতে? উহু। মোটেও না। তাই তো ঠেলেঠুলে চোখ মেলার চেষ্টা করলো। বদ্ধ চোখদ্বয় খুলতেই গড়াতে লাগলো অশ্রু কণা। আরহাম বুঝি আটকে রাখা শ্বাসটুকু ছাড়লো? হ্যাঁ। ছাড়লোই তো। জোড়ালো গলায় ঢোক গিললো একটা। ভয় পেয়েছে সে। তোঁষা আরহাম’কে দেখেই ফিকড়ে কেঁদে ফেলে। তার চোখ মুখের মলিনতা আরহামে’র কায়া নাড়াতে সক্ষম। কেন কাঁদে তার তুঁষ? ব্যাথা পাচ্ছে বলে? ব্যাথার কারণটা তো আরহাম নিজেই। তোঁষা’র উপর অল্প ঝুঁকে আরহাম। গালে হাত রেখে পানিটুকু মুছে দিতে দিতে বলে,

— অনেক কষ্ট হচ্ছে?

— হু।

আরহাম ধীরে তোঁষা’র নরম দেহটা নিজের মাঝে তুলে নিলো। তোঁষা শরীর ছেড়ে দিলো আরহামে’র উপর। ওকে কোলে তুলেই আরহাম ওয়াসরুমে হাটা দিলো। ওকে ফ্রেশ করাতে গিয়ে শুনা গেলো আরেকজন কান্নার আওয়াজ। নরম কোমল তুষকন্যা’র কান্নায় ভারী হলো চারপাশ। বাতাসে যেন মিলিয়ে সুদূর প্রসারিত হচ্ছে। যার সাক্ষী হচ্ছে এই সকালের মলিন বাতাস।

আরহাম যথেষ্ট সাবধানে তোঁষা’কে কোলে নিয়ে বের হয়। তোঁষা এখন একদম চুপ। নাক, মুখ ফুলিয়ে কেঁদেকেটে অস্থির তোঁষা এখন লজ্জায় লাল হয়ে আছে। কে জানতো এত সুখ লিখা ছিলো এত বছরের কষ্টে’র পর?
আরহাম চটজলদি পা বাড়ালো রুমে’র বাইরে। তোঁষাটা’কে খাওয়াতে হবে। খুব জলদি করে যতটুকু পারলো বানালো আরহাম৷ এর মধ্যে দুই চারবার “তুঁষ তুঁষ” করে ডাকও দিলো তবে সাড়া এলো না। যেহেতু কান্নার শব্দ ও আসে নি তাই ঝটপট হাতের কাজ শেষ করে রুমে পা বাড়ায়।

রুমে ঢুকা মাত্র নজরে এলো উবুড় হয়ে শুয়ে থাকা তোঁষা’র দিকে। সুদর্শন মুখটাতে হাসির দেখা মিললো। বলিষ্ঠ দেহটা টেনেটুনে এগিয়ে এলো আরহাম। হাতের ট্রে’টা সাইডে রেখে তোঁষা’র পাশে বসে মাথায় হাত রাখতেই ইটের ন্যায় শক্ত হয়ে গেলো তোঁষা। আরহামে’র চাপা হাসিটা এবার ছিটকে বের হলো বুঝি। শব্দ হলো সেই হাসির। তোঁষা’র লজ্জা বাড়লো এবার হুরমুর করে। পাশ হাতড়ে বালিশ নিতে চাইলেও পারলো না। আরহাম ওর হাত আটকে দিয়েছে। তোঁষা ছাড়াতে চাইলেই আরহাম দুষ্ট কন্ঠে বললো,

— রাতভর এত কষ্ট করে কার লজ্জা ভাঙালাম?

এই কথার দরুন কি হলো? তোঁষা মূর্ছা গেলো লজ্জায়। আবারও কান্না পাচ্ছে ওর তবে লজ্জায়। আরহাম ওকে সোজা করে উঠালো। তোঁষা মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। আরহাম হাসতে হাসতেই বললো,

— তুঁষরাণী’র কি হয়েছে হু? গতরাতে সে আমাকে পাগল বানালো, এখন নিজেই লজ্জায়…..

তোঁষা হুট করেই আরহামে’র বুকে আছড়ে পড়লো। আরহাম বুঝলো। লজ্জা না দিয়ে এবার ওকে জোর করেই খাওয়ালো। তবে বেশি খেতে পারলো না তোঁষা। বমি পাচ্ছে তার। আরহাম আজ জোর করে নি।
তোঁষা’কে খায়িয়ে হাতে ইনসুলিন নিয়ে আসতেই ভ্রু কুঁচকায় তোঁষা। দূর্বল কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

— খাওয়ার পর?

— হ্যাঁ। দিতে হবে প্রাণ।

তোঁষা বিশ্বাস করে তার আরহাম ভাই’কে। তাই তো দ্বিতীয় প্রশ্ন করলো না। আরহাম ওকে ইনজেকশন’টা পুশ করেই বুকে নিয়ে হেলান দিয়ে বসলো। তোঁষা তখনও চুপচাপ। একসময় মেয়েটা ঘুমালো বটে। আরহাম ঘাড়কাত করে দেখে তার প্রাণ’কে। মৃদু শব্দে জানায়,

“প্রাণ আমার, তোকে আজীবন আমার প্রাণকুঠুরিতে আটকে রাখব। তোর দিনও আমি, রাতও আমি। তোর ধ্যান ও আমি,জ্ঞান ও আমি। তোর শুরু ও আমি, তোর শেষটা ও আমিই হব।”

#চলবে…….

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৫

মাত্র হট সাওয়ার শেষ করে অর্ধ অনাবৃত্ত দেহে বের হলো তুষা’র। কাঁধে টাওয়াল ঝুলিয়ে চুলগুলো যথাসম্ভব হাত দিয়ে ঝেড়ে অবশিষ্ট পানিটুকু ও ফেলে দেয়ার চেষ্টা। ফর্সা লোমশ সুন্দর এক চওড়া বুক। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলে মন্দ হবে কি? না মোটেও মন্দ হবে না কিন্তু মন্দ কাজ করা থেকে আপাতত নিজেকে সংযত করে তথ্য। এসব বেহায়া আচরণ কি আদৌ তাকে মানায়? উহু। মানায় না৷ তবে এই সুপুরুষ’কে দেখা মাত্র সে নিজের মতো থাকলে তো। সে তো তুষা’রকে দেখলেই উলোটপালোট হয়ে যায়। এখনও যে বসে আছে মনে হচ্ছে এই বুঝি কিছু একটা বলে বা করে ফেললো। নিজের কাঁধ সমান চুলগুলো ঠেলে পিছনে দিয়ে যথাসম্ভব ভদ্র ও শান্ত হওয়ার চেষ্টা করলো তথ্য। আর্মি ম্যান নিশ্চিত অগোছালো কিছু পছন্দ করে না? ঠোঁট উল্টে কিছু একটা ভেবে পরক্ষণেই মেরুদণ্ড সোজা করে বসলো ও।

তুষা’র আচমকা বসার ঘরে তথ্য’কে দেখে চমকালো কিছুটা। নিজেকে খালিগায়ে আবিষ্কার করে যথাসম্ভব দ্রুত হাতে টিশার্ট তুলে গায়ে জড়িয়ে টেনেটুনে ঠিক করলো। তথ্য যেন লাল টমেটো ততক্ষণে। গলা ঝেড়ে তুষা’র কিছুটা অসন্তুষ্ট দৃষ্টি ফেলে বললো,

— মিস.তথ্য, কোন কাজে এসেছেন?

তথ্য’র গলা যেন শুকিয়ে এলো। পানি খাবার জন্য বড্ড তৃষ্ণার্ত সে। অথচ এই মেয়ে কি না জুনিয়রদের ধমকে ধামকে রাখে? শখের পুরুষের কাছে নিজেকে শক্ত রাখা দায়। তথ্য তা হাড়েহাড়ে টের পেলো। কোনমতে কন্ঠে শব্দ তুলে বললো,

— এমনিতেই কথা বলতে এলাম। অসুবিধায় ফেললাম?

— তা ফেলেছেন মিস.তথ্য।

তথ্য’র মুখটা ছোট হয়ে এলো তবে উঠে চলে যাওয়ার মতো কোন লক্ষণ দেখা গেলো না তারমধ্যে। ভালোবাসা মানুষ’কে বেহায়া করে তুলে তার জলজ্যান্ত প্রমাণ তথ্য। তুষার দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,

— কফি?

— খাওয়া যায়।

চটপট উত্তর এলো তথ্য থেকে। এই দফায় হেসে ফেললো তুষা’র। কিচেনে গিয়ে গরম পানি বসাতে বসাতে তথ্য’কে জিজ্ঞেস করলো,

— কোন স্পেশাল কাজ ছিলো?

— না। কেন? আসতে পারি না?

— পারো তবে হুটহাট? আই ফিল অকওয়ার্ড।

–অকওয়ার্ড?

— আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই তথ্য। আমাদের মাঝে তেমন কোন সম্পর্ক নেই যার জের ধরে তুমি এসেছো বা মাঝেমধ্যে আসছো।

তথ্য কথা বললো না। নিশ্চিত আবার কিছু হয়েছে তাই তুষা’রের কথাগুলো ততটা গায়ে মাখলো না৷ একসময় তুষা’র কফি হাতে হাজির হলো।
গরম ধোঁয়া উড়া কফি’তে কফিতে চুমুক বসিয়েই তথ্য’র মনে হলো এই কফির জন্য হলেও তার তুষা’রকে বিয়ে করা উচিত। পরক্ষণেই একগাল হেসে ফেললো নিজের ভাবনার উপর। তুষার দীর্ঘ পলক ফেলে দেখলো সেই হাসি। এমন তো না তার পৌরুষ মন তথ্য’কে অপছন্দ করে তবে নিজের জরাজীর্ণ জীবনে কোথায় ই বা ঠাই দিবে সে তথ্য’কে?

_____________________

আজ দুপুরের পর বের হয়েছিলো আরহাম। মাত্র চারজন রুগী কাউন্সিল করেই আজ বাসায় ফিরলো সে। তোঁষা’টা অসুস্থ। ওকে আজ একা রেখে বেরুতে মন মানেনি আরহামে’র কিন্তু আজকের চারটা কেস তার আন্ডারে ছিলো। যাওয়াটা ছিলো জরুরী নাহলে আরহাম বুঝি যেতো? রাস্তায় জ্যাম দেখে বিরক্ত হলো আরহাম। পেশাটা আজ ভিন্ন হলে এতটা ঝামেলা হতো না। অন্যান্য ডাক্তার’টা যেখানে ঘন্টায় দশ পনেরোটা রুগী দেখে সেখানে সাইকিয়াট্রিস্টদের একজন রুগীকেই ঘন্টার পর ঘন্টা সময় দিতে হয়। আজ তো তাও সময় কম লাগলো কারণ রিকভারি প্যাসেন্ট ছিলো দু’জন।
তাচ্ছিল্য হাসলো আরহাম। শেখ বাড়ীর সকলের নজরে পাগল আরহাম কি পাগলের ডাক্তার? বিষয়টা চিন্তার বটে।
আরহাম নজর ঘুরালো। কাঁচে টোকা পরেছে। তেরো চৌদ্দ বছরের এক কিশোরী দাঁড়িয়ে। পরণে ময়লা কিন্তু সাদা একটা ফ্রক। খসখসে চেহারাটা মলিনতায় ঘেরা অথচ দারুণ এক হাসি লেপ্টে তার ঠোঁটে। হাতে একগুচ্ছ গোলাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে সে।

আরহাম চিন্তায় পড়লো। বছর কয়েক আগের কথা। তোঁষা’টা তখন কিশোরী। তুঁষ’টার জন্মগত ভাবেই বিভিন্ন রোগ বয়ে এনেছে। বাদবাকি জ্বর, ঠান্ডা তার জীবনে বোনাস। এই তো সেই কিশোরী তোঁষা এক গরমের দিনে পাতলা একটা ফ্রক পড়ে ছাদে বসে ছিলো। সবার নজরে তোঁষা ছোট হলেও বাইরের লোকজন তা মারাতো না। কিশোরী তোঁষা’র সেই সৌন্দর্য ফুটে উঠছিলো ঝলমল করে যা ছিলো চোখে পড়ার মত।
রাতে ছাদে উঠেছিলো তোঁষা বাতাস খেতে। ভয়ডরে ভরপুর তোঁষা জানতো তার আরহাম ভাই ছাদে পড়ছে তাই তো একা ছাদে উঠার সাহস করলো।
তবে বিপত্তি ঘটলো অন্যভাবে। তোঁষা জানতো না ঐ দিন ছাদে আরহাম আর আদনান বাদেও অন্য কেউ উপস্থিত ছিলো। তাই তো যখন টাঙ্কির উপর বসতে নিলো তখনই একজন ছেলে বলে উঠলো,

— কি পিচ্চি তুলে দিব?

তোঁষা হকচকিয়ে যাওয়ার দরুন পড়ে গেলো টাঙ্কি থেকে। ব্যাথা সে পায়নি ততটা তবে লজ্জা পেয়েছিলো। গলা ফাটিয়ে সে কি কান্না। আরহাম তোঁষা’র কন্ঠ শুনে আসতে আসতে তোঁষা কান্ড ঘটিয়ে ফেললো। আরহাম এসেই দেখলো তোঁষা কাঁদছে ছাদের মেঝেতে অন্যদিকে অরুন কপাল চেপে হতবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। অরুনের কপাল বেয়ে চিকন ধারায় র*ক্ত গড়াচ্ছে। তবে আরহাম অরুনে’র দিকে বিশেষ খেয়াল করলো না। ও ব্যাস্তপায়ে তোঁষা’কে টেনে তুলতে তুলতে জিজ্ঞেস করলো,

— কি রে তুঁষ, ব্যাথা পেলি? পড়লি কিভাবে? উঠ।

তোঁষা আরহামে’র টিশার্ট খামচে ধরে উঠে দাঁড়ালো। ফুপাতে ফুপাতে নিজের বয়ে যাওয়া নাকটা মুছে নিলো আরহামে’র বাহুতে। আরহাম সেসবে পাত্তা দেয় না অথচ তার রয়েছে ওসিডি রোগ। সুচিবাই মানুষ’টা একদম ভিন্ন তার তুঁষে’র ক্ষেত্রে।
আদনান এসে অরুণ’কে ধরলো। তোঁষা’কে আরহাম নীচে নিয়ে যেতেই আদনান অরুন’কে ঘটনা জিজ্ঞেস করলো। অরুন কি বলবে ভেবে পেলো না। ঘটনাটা যতটা হুট করে হলো তাতে তার বলার কিছুই নেই। আদনান কিছু আবার জিজ্ঞেস করার পূর্বেই কোথা থেকে আরহাম এসে অরুণে’র উপর হামলে পড়ে।
তোঁষা থেকে ঘটনা যা শুনা গেলো তার সারমর্ম হলো, তোঁষা টাঙ্কিতে উঠতে নিলেই অরুণে’র কন্ঠ শুনে ভয়ে পরে যায়। অরুণ তাকে তুলতে গিয়ে পিঠে হাত রাখতেই তোঁষা পাশ থেকে ইটের টুকরো ছুঁড়ে মা’রে ওকে।
অরুণ মাথা নামিয়ে নিলো। ঘটনা মিথ্যা নয় আবার পুরোপুরি সত্যি ও নয়। হয়তো পিঠে অরুণ হাতটা রেখেছিলো তবে নিয়ত খারাপ ছিলো না।

— ভাই ফুল নিবেন না? একটা নেন না।

হঠাৎ আকুতি ভরা কন্ঠ শুনে আরহামে’র ধ্যান ভাঙে। অল্পবিস্তর হেসে মেয়েটার মাথায় হাত রেখে বললো,

— কত দিব?

— পঞ্চাশ টাকা পিস। ফেব্রুয়ারিতে দাম একটু বেশিই গোলাপের তবে আপনি ভালা মানুষ তাই দশটাকা কম দিয়েন।

এবার শব্দ করে হেসে ফেললো আরহাম। কচকচা একটা হাজার টাকার নোট মেয়েটাকে দিয়ে অবশিষ্ট সবগুলো গোলাপ নিয়ে বললো,

— গোলাপের কখনো মূল্য হয় না। এই যে ফুটন্ত এক গোলাপ তুমি। মূল্যহীন এক রত্ন।

মেয়েটা অর্ধবির্ধ বুঝে হাসলো। আরহাম গাড়ি ছাড়লো।

বাসায় পৌঁছেই সব অন্ধকার পেলো আরহাম। তোঁষা কি তাহলে উঠে নি? উত্তর জানা আরহামে’র। তবুও ডাকলো,

— তুঁষ?

উত্তর এলো না। পা চালিয়ে বেড রুমে যেতেই চোখ আটকালো ঘুমন্ত তোঁষা’র পানে। মাথা কাত করে ঘুমুচ্ছে সে। আরহাম এগিয়ে এসে ওর মুখে নিজের হাতটা রাখতেই চমকালো। কাঁথা সরিয়ে গলা, হাত-পা ধরতেই দেখলো অসম্ভব গরম শরীর। জ্বর এলো অথচ আরহাম কি না জানলো না? এতক্ষণ তো ভেবেছিলো ঘুমাচ্ছে কিন্তু…। চিন্তিত আরহাম তোঁষা’র মুখের উপর ঝুঁকলো। গালে আলতো হাত বুলিয়ে দিয়ে ডাকলো,

— তুঁষ?

— হু।

— খারাপ লাগছে?

— উহু।

— একটু উঠ।

— উহু।

— প্লিজ না প্রাণ।

তোঁষা উঠবে না। আরহাম নিজেই বালতি ভর্তি পানি এনে পানি ঢাললো ওর মাথায়। আধ ঘন্টা খানিক যেতেই তোঁষা কথা বললো,

— আর না।

— আরেকটু দেই?

— উহু।

আরহাম উঠলো। তোঁষা’র লম্বা, ঘন চুলগুলো সযত্নে টাওয়াল পেঁচিয়ে ভেজা টাওয়াল এনে যতটুকু পারলো মুছে দিলো। তোঁষা চোখ বন্ধ করেই ডাকলো,

— আরহাম ভাই?

আরহাম তখন অতি যত্নে তার তুঁষে’র পায়ের পাতা মুছে দিচ্ছে। ডাকের জবাবে বললো,

— বল প্রাণ।

— আব্বু-আম্মু’র কথা মনে পরছে আর ভাই’কে। চাচ্চু-চাচি’কেও।

আরহামে’র নরম মুখটা নিমিষেই শক্ত হলো। তোঁষা একাএকাই কিছু বিরবির করতে করতে চুপ করে গেলো। আরহাম উঠে সব গুছিয়ে নিজেও ফ্রেশ হয়ে এসে তোঁষা’র পানে তাকিয়ে গোলাপ গুলোর দিকে তাকালো। হাত বাড়িয়ে একটা ছুঁয়ে দিতেই অতি সুক্ষ্ম এক কাটা বিধলো ওর আঙুলে। সঙ্গে সঙ্গে র*ক্ত আসতেই আরহাম হাসলো। ঝুঁকে বৃদ্ধাঙ্গুলী’টা দিয়ে তোঁষা’র ওষ্ঠ ছুঁয়ে দিতেই তা আরহামে’র র*ক্তে রঞ্জিত হলো। বিগলিত হাসে আরহাম। শুনা যায় তার চাপা কন্ঠস্বর,

— প্রাণ আমার, এই গোলাপে’র ভালোবাসা পেতে যেমন কাটার আঘাত পেতে হয় তবুও কেউ গোলাপ’কে ত্যাগ করে না তেমনই আরহামে’র ভালোবাসা পেতে তোকে আমার কাছেই থাকতে হবে। এরমাঝে আর কেউ থাকবে না। কেউ না। শুধু আমি আর আমার প্রাণ।

#চলবে….