Thursday, August 7, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 159



প্রিয় প্রাণ পর্ব-১২+১৩

0

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১২

এই তো বেশি আগের কথা না। বছর কতক পূর্বে তোঁষা যখন ক্লাস এইটে পড়ে তখনকার ঘটনা। স্কুলে রোজকার ন্যায় তুহিন ই আনতে যায় ওকে। তোঁষা ও নেচে-কুঁদে বাবা’র হাত ধরে বাসার পথে রওনা হয়। ঘটনা নিত্যদিনেরই কিন্তু তুহিনের একটা ভুল হয় এখানে। বাড়ী’র মোড়ে তোঁষা’কে নামিয়ে সে যায় অফিসে। কোন এক গুরুত্বপূর্ণ মিটিং ছিলো বোধহয়। তোঁষা হেলেদুলে পাশের ফুচকা’র দিকে গেলো আগে। বাসা থেকে কেউ ওকে একা ছাড়ে না। ভয় পায় যদি তোঁষা হারিয়ে যায়? তোঁষা’র আগে বিরক্ত লাগলেও বড় হতে হতে ব্যাপারটা বুঝে ও। বাড়ী’র একটামাত্র ছোট সদস্য তা ও কি না এক মাত্র মেয়ে হওয়ার দরুন সকলের এই উপচে পড়া ভালোবাসা। আজ সুযোগ পেয়ে কাজে লাগায় তোঁষা। দোকানে গিয়েই চটপটে গলায় বললো,

— মামা ঝাল দিয়ে ফুচকা দিন।

দোকানী চেনে তোঁষা’কে। শেখ বাড়ীর কন্যা বলে কথা। তিনি ঝটপট আগে তোঁষা’কে দিতেই পাশে থাকা চার পাঁচজন ছেলের একজন বলে উঠলো,

— কি মামা, আগে আমরা থাকা সত্বেও ললনা’কে আগে দিলা? নট ফেয়ার।

তোঁষা’র কানে কথাটা ঢুকতেই চিরবিড়িয়ে উঠে ওর নিউরনগুলো। তখনও ফুচকায় হাত লাগায় নি৷ অগ্নিদৃষ্টি দিয়ে ছেলেটার দিকে তাকাতেই ছেলেটা মজা নিতে চাইলো,

— কি সুন্দরী, এভাবে তাকাও কেন? বুকে লাগে তো।

কথাটা বলেই বুকে হাত রাখে নিজে। পাশে মটকার উপরে রাখা স্টিলের গ্লাস। তোঁষা ছোঁ মেরে সেটা নিয়ই ছুঁড়ে মা’রে ছেলেটাকে। নিশানা একদম সঠিক কপাল বরাবর। ছেলেটা কপাল চেপে ধরে তোঁষা’র দিকে তাকায়। বাকিরা ঘটনার সূচনায় কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তোঁষা রাগে লাল হয়ে ধমকে উঠে,

— কি রে বল এবার? কে ললনা তোর?

ছেলেটা তেঁড়ে যেই না তোঁষা’র কাছে আসবে তখনই কেউ ওর কলার চেপে ধরে পরপর নাক বরাবর ঘুষি মা’রে। পরপর দুই ধরণের শব্দ শুনা যায় তখন। প্রথমত ছেলেটার ব্যাথাকাতুর শব্দ দ্বিতীয়ত তোঁষা’র উচ্ছাসিত কন্ঠ। উৎফুল্ল তোঁষা বলতে থাকে,

— কিরে এবার বল সুন্দরী।

আরহাম ছেলেটা’কে বলার সুযোগ বুঝি দেয়? পরপর আঘাতে ছেলেটা নীচে পরতেই আরহাম তার বুকে আঘাত করতে করতে বলে,

— বল! বল! বুকে লাগে এবার?

আশেপাশে’র কেউ সাহস সঞ্চার করেও আরহামে’র ধারে কাছে যাওয়ার সাহস করতে পারলো না।
সেই ছেলেকে অবশেষে হসপিটালে ভর্তি রাখা হয় টানা দুই সপ্তাহ। তুরাগ কি বলবে ভেবে পায় না। কারণ ঐ দিন দুপুরে আরহাম তোঁষা’কে নিয়ে খুশি মনে বাসায় ফিরেছিলো। দু’জন’কে দেখে বাসার কেউ ই টের পায় নি এত বড় কান্ড ঘটিয়ে এসেছিলো তারা। দু’জন বেশ হাস্যজ্বল মুখে বাড়ী ফিরে সেদিন।
এমন হাজার ও ঘটনা আরহাম ঘটিয়েছে তোঁষা’কে ঘিরে। শুরুতে শুরুতে ব্যাপারগুলো স্বাভাবিক হলেও পরে আর স্বাভাবিক রইলো না। তোঁষা’কে ঘিরে ছোট্টখাট্ট ব্যাপারগুলোতেও আরহাম রোষপূর্ণ আচরণ করা শুরু করলো। কাউকে পরোয়া করা তখন পছন্দ ছিলো না ওর। বাসায় সবাই যা ই বলুক না কেন আরহাম কারো কথায় কর্ণপাত করে নি। বরং দিন কে দিন তোঁষা’কে ঘিরে তৈরি করেছিলো অদৃশ্য এক দেয়াল যা টপকানো বা ভাঙা কারো দ্বারা সম্ভব ছিলো না। শেখ বাড়ীর সকলে যখন ব্যাপারটা বুঝতে পারে ততদিনে তোঁষা, আরহামে’র সম্পর্ক গড়িয়েছে বহুদূর। হয়তো তারা তাদের অনুভূতি তখন গোছায় নি বা তোঁষা’র বুঝে ততকিছু আসে নি কিন্তু তোঁষা এটা বুঝে গিয়েছিলো তার জীবনের ব্যাপক এক স্থান জুড়ে আরহাম। যার বিরাজমান ব্যাতিত তোঁষা কল্পনা করতে পারে না নিজেকে।

বাসায় সবাই যখন দেখলো তোঁষা’কে নিয়ে আরহাম এর এই ওভার পসেসিভনেস ওদের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াচ্ছে তখন তুরাগ ডেকে পাঠায় আরহাম’কে। নিজের বড় ছেলের প্রতি তার ভালোবাসাটা হয় তো সে ততটা প্রকাশ করতে পারে না তাই বলে এমন তো না ভালোবাসে না। আরহাম আসতেই তুরাগ বলে,

— দিন দিন এই অধপতনের কারণ টা কি আরহাম?

— কিসের কথা বলছো আব্বু? সেমিস্টারে টপ করেছি।

তুরাগ এবার রেগে যান,

— ফাজলামো হচ্ছে? জানিস না কিসের কথা বলছি? তোঁষা’কে ছাড়। ওর সাথে এত কি তোর? চাচাতো বোন লাগে। ব্যাস আর কিছু না।

— কোন বোন না ও আমার। চাচা জাত বোন শুধু।
ভালোবাসা আমার।

— পাগলামি বাদ দাও। ফাজিল ছেলে। তোমার এই পাগলামি মে’রে দিবে ওকে!

— ভালোবাসি আমি।

— ভুল ভালোবাসা এটা।

— তোঁষা’কে আমার চাই ই চাই।

কথাটা বলে নিজের রুমে গিয়ে ভাংচুর করে আরহাম। ওর মা ছুটে যান ছেলের রুমে। লাভ হয় না। দরজা লক করা ভেতর থেকে। তুরাগ সহ তুহিন, তোঁষা’র মা এসেও দরজায় কড়া নাড়েন। আরহামে’র সেদিনের গর্জনগুলো ছিলো রুহ কাঁপানো। ওর একেকটা হুংকারে যেন শেখ বাড়ীর দেয়ালে গুঞ্জন তুলেছিলো। তোঁষা কোচিং থেকে ফিরতেই চিৎকার চেচামেচি শুনে। গলাটা আরহামে’র। শুনতেই দৌড়ে হাজির হয় রুমে’র সামনে। তোঁষা’কে দেখা মাত্র ভয় পান তুহিন। তার ছোট্ট মেয়েটা’র উপর না প্রভাব পড়ে এসবের। সবাই ভেবেছিলো তোঁষা ভয় পাবে কিন্তু না। তোঁষা তেমন প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সে শুধু দরজায় টোকা দিয়ে ডাকলো,

— আরহাম ভাই?

ব্যাস আর কোন গর্জন শুনা যায় না। সবটা নিমিষেই শান্ত হয়ে যায়। তোঁষা পুনরায় আবার বলে,

— দরজা খুলবেন না?

সেকেন্ডর ব্যাবধানে দরজা ও খুলে গেলো। আরহামে’র মা আর চাচি দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকেই চমকে যান। ফ্লোর জুড়ে কাঁচ। আরহামে’র মা আঁতকে উঠেন ছেলে’র হাত দেখে। তোঁষা’র মা তারাতাড়ি হাতটা ড্রেসিং করে দিয়ে বুয়া ডাকেন রুম পরিষ্কার করতে। তোঁষা ভেতরে ঢুকে নি আর। এসব র*ক্ত সহ্য হয় না তার। তাও যদি হয় আরহাম ভাই এর।
তুরাগ, তুহিন বুঝেন আরহাম’কে সামাল দেয়া সহজ হবে না তাই তো সবচেয়ে নিকৃষ্ট পথটা বেছে নেন আরহাম’কে তোঁষা থেকে সরানোর।

__________________

— আজকে পেটে দিব।

আরহাম ভ্রু কুঁচকায়। তোঁষা’র বাহু টেনে দেখতে দেখতে জিজ্ঞেস করে,

— হাতে কিছু হয়ে’ছে?

— হু। ব্যাথা।

আরহাম’কে মুহুর্তেই চিন্তিত দেখালো। তোঁষা মুখে থাকা চোরা হাসিটা দমিয়ে রেখে পরণে থাকা কুর্তি’টা উঁচু করলো অতি সামান্য। এতেই যেন আরহামে’র কিছু হলো। ধবধবে সাদা পেট’টা অল্প চর্বি যুক্ত। ঠিক যতটা না হলেই নয়। আরহাম বাজে ভাবে ফাঁসলো যেন। এই বুঁচি ওকে জ্বালিয়ে মা’রছে। কোন মতে দাঁত চেপে পেটে দুই আঙুল রেখে চামড়া উঁচু করতেই তোঁষা মুচড়ে উঠে। প্রচন্ড স্পর্শকাতুরে কিনা। আরহামে’র নিয়ন্ত্রণ রাখাটা এবার যেন কঠিন হলো বেশ। ধমকের স্বরে বললো,

— একদম সোজা দাঁড়িয়ে থাক তুঁষ।

তোঁষা মানলো। দাঁড়ালো সোজা। আরহাম অতিশীতল হাতে স্পর্শ দিলো তোঁষা’র পেটে। শিউরে উঠে এবার মোচড়া মোচড়ি করার সময় পেলো না তোঁষা। আরহাম দক্ষ হাতে পুশ করেছে। তড়িৎ বেগে তোঁষা’র কাপড় ঠিক করতেই দেখলো তোঁষা মুখ টিপে হাসছে। আরহাম ওরদিকে তাকিয়ে শ্বাস টেনে অসহায় গলায় বললো,

— জ্বালানোটা বেশি হয়ে যাচ্ছে না?

তোঁষা যেন অবুঝ সাজলো। বললো,

— মানে?

— জানিস না?

— না তো।

আরহাম কিছু বলার আগেই তোঁষা আজ তাড়া দিলো,

— যাবেন না? লেট হচ্ছে তো।

আরহাম ভ্রু কুঁচকায়। যেই মেয়ে পারলে ওকে টেনে নিজের কাছে রাখে সারাদিন সে আজ তাড়াচ্ছে?
অবশেষে তোঁষা’র কাছে বাধ্য হয়ে আরহাম চলে যায়। যাওয়ার আগে রোজকার ন্যায় তোঁষা’কে কিছু সীমাবদ্ধতা জানিয়ে যেতেও ভুলে না সে। তোঁষা মাথা নাড়ে শুধু। আরহাম যেতেই নিজের কাছে লেগে গেল তোঁষা। এতটা উৎফুল্ল এর আগে কখনো হয় নি ও। অথচ কাজটা করতে তোঁষা’র ভেতর ভেতর ধ্রীম ধ্রীম শব্দ করেই যাচ্ছে কিন্তু তোঁষা দমবার পাত্রী নয়। একবার যেটা চাই তা চাই ই চাই।

#চলবে…

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৩

রানওয়েতে ট্রেনিং চলছে নতুনদের। উচ্চপদস্থ অফিসার হিসেবে তত্বাবধানে তুঁষা’র এসেছে ভিজিটিং এ। ওকে দেখা মাত্রই অন্যান্য সৈনিক’রা অভ্যর্থনা জানালেন। তুঁষা’র তাদের সাথে বেশ কিছু সময় আলাপ করে লাঞ্চের জন্য সামনের দিকে হাটা দিলো। ওকে দেখা মাত্র ই তথ্য নিজের স্লটে’র কাজ থেকে বিরতি দিয়ে ছুটলো তুঁষা’রের পিছু। ও জানে এত মানুষের সামনে তুঁষা’রকে ডাক দেয়াটা ঠিক হবে না তাই দৌড়ে গিয়ে একদম সটান হয়ে ওর সম্মুখে দাঁড়ায়। তুঁষা’র ভ্রু কুঁচকায়। তথ্য এক পা সজোরে মাটিতে হিট করে স্যালুট জানাতেই অল্প হাসলো তুঁষা’র। বিনিময়ে জানালো,

— লাঞ্চ ব্রেকে কথা বলব।

তথ্য’র মুখে খুশির উজ্জ্বলতা দেখা মিললো। তুঁষা’র কথাটা বলেই পা বাড়ায় সামনে। পিছনে রয়ে যায় তথ্য’র তৃপ্তিময় শ্যামলা মুখটা যা রোদের তপ্ততায় এ রং ধারণ করেছে।
.
লাঞ্চ শেষ হতেই দরজায় নক হলো। তুঁষা’র অনুমতি দিতেই তথ্য দুটো কফি হাতে ভেতরে ঢুকে। হাসি মুখে এককাপ তুঁষা’রের কাছে দিতেই তুঁষা’র অভ্যাসবশত ধন্যবাদ জানায়। তথ্য ও বিনিময়ে হাসি দিয়ে আশেপাশে তাকালো। তুঁষা’র সময় নিয়ে দুই এক বার চুমুক বসিয়ে তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,

— ঐ দিনের ব্যাবহারের জন্য দুঃখীত তথ্য।

— আরে ইটস ওকে স্যার?

— স্যার?

— আপনি না বললেন।

— তখন রেগে ছিলাম।

— এখন?

— নেই।

— আমি কি রাগ নামক এই টেনশন’টার কারণ জানতে পারি তুঁষা’র?

তুঁষা’র ভাবলো। গুমরে ম’রা থেকে শেয়ার করা উত্তম তবে বলার বা অভিযোগ কার বিরুদ্ধে থাকবে তার কথার মাঝে সেখানটাতে আটকে যায় তুঁষা’র। চাইলেও মুখ ফুটে প্রকাশ করতে ব্যার্থ হয় নিজের ভেতরে থাকা জ্বলন্ত আগুনের পিন্ডটা’কে। তুঁষা’রকে চুপ থাকতে দেখে তথ্য বুঝলো কিছু। প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করলো,

— তোঁষা কেমন আছে?

— পুতুল….

আনমনে তুঁষা’র কথা বলতে গিয়ে সামলে নিলো নিজেকে। কফি’র মগে চুমুক দিয়ে বললো,

— দুটো ভালোবাসা একসাথে আছে তথ্য।

______________________

লাল নেটে’র শাড়ীটা গায়ে জড়িয়েছে তোঁষা। কাজটা সহজ ছিলো না তার জন্য। বহু কষ্টে শাড়ী পড়ে এখন বসেছে সাজুগুজু করতে। ড্রেসিং টেবিলে’র ড্রয়ারে যাবতীয় সব রাখা। তোঁষা সাজ বলতে শুধু লাল টকটকা রং’টা ঠোঁটে লাগালো। কোমড় সমান চুলগুলো পিঠময় ছড়িয়ে মাঝ বরাবর সিঁথি করতেই সজল চোখে আয়নাতে নিজে দেখলো। সলজ্জ ভঙ্গিতে নিজেকে দেখে হাসে তোঁষা। আজ আরহাম ভাই’কে পাগল বানিয়ে ছাড়বে ও। মনে মনে দীর্ঘ সংকল্প এটেছে তোঁষা। অপেক্ষা শুধু আরহামে’র।

রাত এখন প্রায় আটটা’র কাছাকাছি। ঘড়ি’র কাটা প্রায় রাত আট’টা ছুঁই ছুঁই। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে তোঁষা’র বুকের ধুকপুকানি। যেটা একদম শিথিল হয়ে এলো যখন দরজা খোলার শব্দ কানে এলো। আরহাম এসেছে। তোঁষা এখন যেন সব উল্টেপাল্টে ফেললো। একবার ভাবলো দৌড়ে ওয়াসরুমে ঢুকে সব খুলে ফেলবে কিন্তু পরক্ষণেই কিছু মনে করে যেই না দরজা লাগাতে যাবে ওমনিই আরহামে’র আগমন ঘটলো।

লাল রঙা শাড়ীতে মোড়ানো এক অপসরী দাঁড়িয়ে আরহামে’র সম্মুখে। যার ওষ্ঠাধর লালে লালে লেপ্টে। কোমড় সমান চুলগুলো হেলেদুলে যেন বাতাসে মিশতে চাইছে। তোঁষা’র এই লাস্যময়ী রুপ দেখে আরহামে’র জানপ্রাণ উড়ে যাওয়ার উপক্রম যেন। কন্ঠনালী রোধ হলো। শ্বাস প্রশ্বাস হলো ধীমি। চক্ষু ভরা তৃষ্ণা নিয়ে আরহাম ভীতু ঢোক গিললো।
প্রাণঘাতী, প্রাণনাশী এই রুপে কাকে বলি দিবে তোঁষা? এই আরহামকে ই তো। ভয় পাওয়াটা নিশ্চিত স্বাভাবিক। তবে আরহামের হঠাৎ কিছু হলো। একটানে তোঁষা’কে রুমে থেকে বের করে দরজা আটকে জোরে শ্বাস টানলো। না আর সহ্য করার ক্ষমতা তার নেই।

এদিকে তোঁষা বাকরুদ্ধ, হতভম্ব। কি হলো হঠাৎ? আরহাম কি তবে তাকে প্রত্যাখ্যান করলো? কিন্তু কেন? বিয়ের প্রথম রাতে আরহাম ই তো বলেছিলো যেদিন তোঁষা নিজেকে সমর্পণ করবে ঐ দিন যাতে এই লাল শাড়ী পড়ে। তবে আজ কেন এই প্রত্যাখ্যান? তোঁষা চোখ জ্বলে উঠে। তিরতির করে কাঁপন ধরে তার ঠোঁটে। একসময় ঠোঁট ভেঙে কেঁদে ফেলে তোঁষা। তার মস্তিষ্ক তাকে বারংবার দংশিত করছে আরহাম থেকে পাওয়া প্রত্যাখ্যানের বিরহে।

#চলবে……

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১৩(বর্ধিতাংশ)

রুমে’র দরজার বাইরে ঠাই দাঁড়িয়ে তোঁষা। ঠিক তেমনটাই যেমনটা আরহাম তাকে বের করার সময় ছিলো। শুধু পরিবর্তন এসেছে তার মুখের। চেহারায় ভাঙা এক অবস্থা। তার কান্নার কারণ দাঁড় করানো গেলো না। সবসময়ে জেদ ও রাগে কান্না করা মেয়ে’টা আজ কাঁদছে আরহামে’র জন্য। আরহাম থেকে ভালোবাসার প্রত্যাখ্যান পাওয়ার জন্য। ফর্সা মুখটা নিমিষেই লাল দেখালো। ঘন্টা দেড় এক হবে তোঁষা দাঁড়িয়ে এখানে। নড়ে নি ও। নড়বেও না। হঠাৎ ই খট করে দরজাটা খুলে গেলো। বেরিয়ে এলো আরহাম। তোঁষা’র মুখের দিকে তাকাতেই চমকালো সে। ভরকালো তোঁষা’র দশা দেখে। দ্রুত ভাবে এসে তোঁষা’র মুখটা নিজের হাতের আজলায় নিতেই ঝামটা মে’রে তা ফেলে দিলো তোঁষা। আরহামে’র বুকটা যেন ছ্যাঁত করে উঠলো। ঠিক যেন জলন্ত আগুনে পানি’র ছিটে দিলো। তবে আরহাম গায়ে মাখলো না। পুণরায় তোঁষা’র মুখ’টা আজলায় তুলে অস্থির কন্ঠে বললো,

— তুঁষ? এই? কি হয়েছে? আমার প্রাণ কাঁদছে কেন?

তোঁষা এবারেও একই কাজের পুনরাবৃত্তি ঘটালো। ঝামটা মে’রে আরহামে’র হাত সরালো নিজের গাল থেকে। এই মুহূর্তে যেন আরহামে’র মাঝে কিছু হলো। তার নিউরনে চিড়বিড় অনুভূতি হচ্ছে। ঘাড় কাত করে দেখে আরহাম। চোখের দুই পাশে লাল দাগ ফুটে উঠে। বহু কষ্টে জিহ্বা পিঁষলো দাঁতের নিচে। নিজেকে মিনিটের মধ্যে ই নিয়ন্ত্রণ করলো এক অনিয়ন্ত্রিত পুরুষ। সবটা আড়ালে রইলো তোঁষা’র। সে দেখে নি। আরহাম’কে পাশ কাটিয়ে সোফায় বসে ফুঁপাচ্ছে। আরহাম পা ফেলে ঝটপট ওর কাছে এলো। হাঁটু ভেঙে বসলো নিচে। তোঁষা’র হাত’টা ধরতেই তোঁষা ছাড়াতে চাইলো। বিশেষ লাভ দেখা গেলো না। আরহাম শক্ত করে ধরেছে। কাতর গলায় জিজ্ঞেস করলো,

— আমার দোষ’টা বল। কেন কাঁদছিস?

তোঁষা কথা বললো না। আরহামে’র ও সহ্য হচ্ছে না এই কান্না। মস্তিষ্কে চাপ প্রয়োগ করতেই তার যেন কিছু মনে পরলো। মুহূর্তেই বুঝলো তোঁষা’র কান্নার কারণ। সাথে সাথে অধর কোন ঠেসে হাসি উপড়ালো তার। হাঁটু উঁচু করে হাত বাড়ালো। ছুঁয়ে দিলো তোঁষা’র গাল। জোর করে চোখ মুছে ফিসফিস করে বললো,

— আজ তোকে সারারাত কাঁদাব প্রাণ।

তোঁষা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো। বুঝে নি এই কথার মানে। আরহাম তোঁষা’র বোকা চাহনি দেখেই বুঝলো তোঁষা বুঝে নি তার কথার গভীরতা। আজ গভীর হবে আরহাম। ঠিক ততটা গভীর যতটা গভীর ছিলো ভালোবাসা। আছে তার প্রাণের প্রতি।

সময় ঘুরলো বলে। ঝট করে তোঁষা’কে পাঁজা কোলে তুলে আরহাম। তোঁষা নামতে চাইলেই আরহাম ওকে কোলে নিয়েই একটা ঘুরান দিয়ে বললো,

— বুঁচি কান্না করার আগে দেখবি তো আদৌ কান্নার মতো কিছু হয়েছে কি না।

— আমাকে কে বের করলো?

— কেউ না।

— মিথ্যা।

— তুমি বের করো নি টেনে?

— কারণ দেখবি না?

তোঁষা এবারেও কিছু বুঝলো না। আরহাম ইশারায় কিছু বললো তাকে। তোঁষা খেয়াল করলো আরহামে’র চুল ভেজা। পরণে থাকা কাপড় ভিন্ন। সুন্দর এক পুরুষ দাঁড়িয়ে যার কোলে তোঁষা। আরহামে’র পরণে সাদা ধবধবে এক শার্ট যা খুবই ফিনফিনে সাথে সাদা প্যান্ট। ভেজা চুলগুলো আজ গোছালো না। বুকের দিকের দুটো বোতাম খোলা থাকার দরুন কিছুটা অংশ ফর্সা বুক দেখা যাচ্ছে। তোঁষা কি চুমু টুমু খাবে সেখানে? ভাবলো। তবে বিশেষ লাভ হলো না। ভাবতেই তার লজ্জায় মরি মরি অবস্থা। আরহাম তোঁষা’কে নিয়ে দরজার কাছে এলো। তোঁষা’র চোখ মুখে ভর্তি প্রশ্ন। আরহাম উত্তর মুখে না দিয়ে করে দেখালো। এক পলিথিন ভর্তি গোলাপের পাপড়ি থেকে দুই হাত ভর্তি করে ছিটালো তোঁষা’র উপর। হঠাৎ এমন ঘন পাপড়িগুলো তোঁষা’কে পুলকিত করতে সক্ষম হলো। উপচে পড়া খুশি ওর মুখে। দুই হাতে মুখ ঢেকে উপভোগ করছে মুহুর্তটাকে। আরহাম এখানেই থামলো না তাজা টকটকে এক বড় গোলাপ হাতে হাঁটু গেড়ে বসলো তোঁষা’র সামনে যা তোঁষা’কে আরো অবাক করে দিয়ে আরহাম বললো,

— আজ আমার হবি প্রাণ?

তোঁষা নিজেও বসে পরলো আরহামে’র হাঁটু’র ভাঁজের উপর। দুই হাতে গলা জড়িয়ে ধরে উচ্চারণ করলো,

— হু।

— কাঁদছিস?

— উহু।

অথচ তোঁষা কাঁদছে। এত বছরের কষ্ট, ক্লেশ যাতনাকে ভুলে আজ তাদের ভালোবাসা কি না পূর্ণ হতে চলছে। কমতো সহ্য করলো না। আজ যখন সব পেতে চলছে তখন কি আর চোখ বাঁধ মানে? উহু। মোটেও মানে না। তোঁষা’র ও মানলো না। আরহামে’র গলা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে শুধু বললো,

— সমর্পণ করলাম আজ।

ব্যাস আর কিছু বলা বা শুনার অপেক্ষা করলো না আরহাম। ওভাবেই কোলে তুললো তোঁষা’কে। তোঁষা তখনও ওর গলা জড়িয়ে। আরহাম পা বাড়ালো তাদের রুমের দিকে। তোঁষা যেন আরেকদফা চমকালো। ওদের রুম সাজানো কাঁচা ফুলে। বিছানায় ছড়ানো গোলাপের পাপড়ি। আরহাম তোঁষা’র অবাক হওয়া মুখটা দেখে হাসি মুখে বললো,

— ফুল ছাড়া কিভাবে বাসর হবে প্রাণ?

— আপনি কিভাবে জানলেন আজ….

তোঁষা’কে অতঃপর আর কথা বলার সুযোগ দিলো না আরহাম। আসার সময় ই আরহাম ফুল এনেছিলো। লজ্জায় নত করা মুখ থাকায় তোঁষা তখন দেখে নি। তবে আরহাম কিভাবে জানলো তা এখনও প্রশ্ন। নিজের প্রাণ’কে নিশ্চিত আরহাম এমন একা ফ্ল্যাটে রেখে যাবে না। না কোন ফোন বা যোগাযোগ মাধ্যম অথচ প্রতি মিনিট আরহাম নজর রাখছে ওর তুঁষে’র উপর। প্রতিটা খনের খবর জানা আরহামে’র। এই যে আজ তোঁষা এসব যা করেছে তা আগেই আরহাম দেখেছে। বুঝেছে। শুধু দেখে নি তোঁষা’র এই লাস্যময়ী রুপটাকে। যা সরাসরি দেখামাত্র থমকে গিয়েছে।
এই ঘন্টা খানিক সময় লাগিয়ে এসব ই করতো। বারান্দায় ছোট্ট করে একটা ক্যান্ডল লাইট করা। আজকের খাবারটাও বাইরে থেকে এনেছে আরহাম।
তবে আপাতত অতসব দেখার বা মনে করার সময় হলো না। দু’জন প্রাপ্তবয়স্ক প্রেমময়ী যুগল ভুলে গেলো তাদের ক্ষুধা’র চাহিদা। তাদের বর্তমান চাহিদা’টা নিজেদের মাঝে। আরহাম তোঁষা’কে বুকে নিয়েই বিছানায় বসলো। এই প্রথমবারের মতো খুবই আলতো হাতে ছুঁয়ে দিলো তোঁষা’কে। তোঁষা বুঝি এতেই নেতিয়ে গেলো। আরহামে’র পুরুষ হাতের স্পর্শ কাঁপিয়ে তুললো তার বদন। মাতাল হলো তোঁষা। মাতাল করলো আরহাম। দেহ জুড়ে যখন তাদের প্রেম বইছে তখনই আরহামে’র প্রথম চুম্বনের আবেশে তোঁষা যেন ঘায়েল হলো। মৃত্যুশয্যা’য় যেতেও যেন রাজি এখন সে। আরহাম নিজেও নিয়ন্ত্রণ হারালো। এত বছরের ভালোবাসা সব ঢেলে দিলো তাদের প্রাণের মাঝে। তোঁষা বোধশক্তি হারালো সাথে হারালো আরহাম। দু’টি প্রাণে’র নাশ ঘটলো বুঝি এই রাতে।
.
আকাশে আজ সুতা’র ন্যায় চাঁদ। এমন লাল চাঁদের দেখা মিলে না সহসা। তবে আজ দেখা মিলছে। নতুন চাঁদে’র এই রুপটা আজ ভয়ংকর সুন্দর। যে কোন প্রেমোদগম বীজ বুননের সর্বোত্তম সময়। তোঁষা আরহামে’র ও তাই হলো। তারা নিজেদের আবিষ্কার করলো নতুন ভাবে। আরহামে’র উন্মাদনায় তোঁষা আজ দিকহারা হলেও তোঁষা’র নরম ছোঁয়ায় আরহাম পাগল হয়েছে। তোঁষা’কে সবটা দিয়ে আজ আরহাম নিজের করলো।
এই লাল চাঁদ’টা সাক্ষী তাদের মিলনের। এ কি সুখ বয়ে আনবে নাকি ধ্বংস তা জানে না কেউ। তবে কেউ কেউ তো বলে লাল রঙা চাঁদ ভয়াবহ দুঃখ বয়ে আনে? তবে কি তোঁষা আরহামে’র জীবনের ধ্বংসের অধ্যায় শুরুর পথে?
________________

সূর্যের দেখা মিলে নি এখনও। এই তো সুবহে সাদিক হতে চলছে। শেখ বাড়ীর সকলেই জাগ্রত। পুরুষ তিনজন নামাজে। আরহামে’র মা রান্না ঘর থেকে বের হয়ে তোঁষা’র মায়ে’র কাছে এলেন। শরীর খারাপ ঐ যে হলো আর ঠিক হওয়ার নাম নেই তার। হবেই না কিভাবে? যার ঘরে’র কন্যা, বুকের মানিক তার কাছে নেই সে মা কিভাবে ঠিক থাকবে? অথচ বছরের পর বছর উনি ঠিক আছে। এই যে যার মাধ্যমে প্রথম মাতৃত্বের স্বাদ পেলো। যে ছেলেটা জন্ম থেকে মায়ের ন্যাওটা সে এখন মা’কে দেখে না। চাইলেও কন্ঠ শুনা যায় না আরহামে’র। স্বামী’কে বললেই আগে বলতো,

— আদনান’কে দেখো। একই তো সুরত।

— বাবা কোনদিন মা হয় না। আমার চৌদ্দটা সন্তানের চেহারা এক হলেও তাদের মধ্যের ভিন্নতা আমি বুঝতাম।

বিনিময়ে তুরাগ কথা বাড়াতো না অথচ দিনে দিনে তিনি আদনান দিয়ে আরহামে’র স্বাদ মিটাচ্ছে।
আঁচলে চোখ মুছে রুমে ঢুকলেন তিনি। তোঁষা’র মা কাত হয়ে শুয়ে আছে। মাথায় হাত রাখতেই চোখ মেললেন। আরহামে’র মা’কে দেখেই ম’রা স্বরে বললেন,

— ভাবি আমার পুতুলটা…

এই কথা ছাড়া ইদানীং বিশেষ কিছু বলতেও পারেননা তিনি। কান্না পায় সারাটাদিন। টেনেটুনে তাকে উঠালো আরহামে’র মা। ধমকের স্বরে বললো,

— উঠ। একা রান্না করতে পারব না আমি। চল সাথে।

ঠেলেঠুলে উঠলেন তিনি। মেয়ের শোকে শোকে সংসার ত্যাগের উপক্রম যেন।
সেদিনের সিদ্ধান্ত’টা কতই না ভুল ছিলো। তারা ভেবেছিলো তোঁষা’কে আদনানে’র সাথে বিয়ে দিলে হয়তো আরহাম লজ্জা পাবে ভাইয়ের বউয়ের দিকে নজর দিতে। আর একবার বাচ্চাকাচ্চা হলে হয়তো ফিরেও তাকাবে না। অথচ এক সকালে আরহাম কল দিয়ে শুধু বলেছিলো,

— তোঁষা’র যদি চৌদ্দ বার ও বিয়ে হয় আর একশত বাচ্চা’র মা ও হয় তখনও আমার ওকেই লাগবে। ওর নেতানো, অন্য পুরুষের ছোঁয়া শরীরটাকেই নিব আমি। ওর লা*শ হলেও নিব আমি। ঐ লা*শ বিয়ে করে সংসার ও করব আমি।

কথাগুলো ভাবতেই যেন গায়ে কাটা দেয় তাদের। তোঁষা’টা কি বেঁচে আছে নাকি মে’রে ফেললো আরহাম?

#চলবে…..

প্রিয় প্রাণ পর্ব-১০+১১

0

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১০

“বর্ডার লাইন পারসোনালিটি ডিজঅর্ডার” অর্থাৎ কোন কিছু বা কাউকে নিয়ে অতিরিক্ত পসেসিভ হওয়া, ইমোশনাল হওয়া, সবসময় তাকে ঘিরে নিজেকে কল্পনা করা। এটা একটা মেন্টাল ডিজঅর্ডার যা বাড়তে থাকলে একসময় মারাত্মক আঁকার ধারণ করে। তখন ঐ নিদিষ্ট জিনিস’টাকে নিজের করে রাখতে সে মরিয়া হয়ে উঠে। হারায় হিতাহিত জ্ঞান। যেকোনো কিছুর বিনিময়ে তার সেই কাঙ্খিত বস্তু চাই ই চাই। তারা ভয় পায় শেয়ার নামক শব্দটা’কে। বিশ্বাস জিনিসটাও কারো’কে করতে পারে না হোক সে যতই আপন। অথচ এরা স্বাভাবিক একজন মানুষের মতোই থাকে। ক্ষেত্র বিশেষে এরা নিজের কাঙ্খিত বস্তু নিয়ে প্রচন্ড সেসসেটিভ হয়ে থাকে। যার ফলে সম্পর্ক গঠনে হয়ে থাকে এরা সবচেয়ে দূর্বল।

আরহাম আক্রান্ত এই রোগে। বাসায় কেউ ই এটা প্রথমে বুঝতো না। আদনান আর আরহাম জমজ ভাই। আরহাম বড় হওয়ার দরুন সবাই হয়তো আগে ওকে ভালোবাসত। সেইম ওর মায়ের ক্ষেত্রে ও। আরহাম ছোট থেকেই নিজের মা’কে নিয়ে প্রচন্ড সেনসিটিভ। কারো সাথে দিবে না মা’কে। স্কুল থেকে আসলেও তার মা’কে চাই সবার আগে।

সেই বহু বছর আগের এক ঘটনা, একদিন আদনান এসে লুকিয়ে আগে মা’কে জড়িয়ে ধরলো। আরহাম পেছনে থাকায় দেখি নি মা’কে। যেই না দেখলো আদনান আজ আগে মা’কে জড়িয়ে ধরেছে তখনই প্রচুর রেগে গেলো। দৌড়ে এসে আদনান’কে টানতে টানতে বলতে লাগলো,

–আম্মু’কে ছাড়। ছাড়।

আদনান মা’কে আরো শক্ত করে জড়িয়ে থাকতেই ওর মা আরেকহাতে আরহাম’কে জড়িয়ে ধরতে চায়। আরহাম তখন রাগে মুখ চোখ লাল করে তাকিয়ে আছে। মা’কে তার একা চাই। শেয়ার করে না।
ওর মা সেদিন হয়তো বুঝেন নি ছেলের মন। আরহাম যখন সারাদিন না খেয়ে থাকলো তখন হাজার চেষ্টা করেও তাকে খাওয়ানো গেলো না। অথচ সবাই হাসলো ওর কান্ডে। বলাবলি করলো,”এই মা পাগল ছেলে বউ পেয়ে না বদলালেই হলো”।

আরহাম বদলালো। ভয়ংকর সেই চেঞ্জ। মা তার প্রিয় না এমন না তবে সে মা’কে শেয়ার করেছে। একজনের সাথে খুব করে শেয়ার করেছে। তার মায়ের বুকে ঘুমাতেও দিয়েছে। একসময় মায়ের থেকেও বেশি আঁকড়ে ধরেছে সেই ছোট্ট প্রাণ’কে। তোঁষা’কে। বরফের মতো তুঁষ’টাকে সে স্থান দিয়েছিলো নিজের বুকে। অনুভূতি তখন সে ততটা বুঝে না কিন্তু নামহীনা এক মায়াজালে আটকেছিলো আরহাম সেই ছোট্ট শিশুটার বদনে, মুখের আদলে, গোলাপি রঙা সেই মুখটায়। ছোট্ট ছোট্ট হাত পায়ে। ছোট্ট নরম তুলতুলে তোঁষাটা’কে কোলে তুললেই যেন রাজ্যের প্রশান্তি হানা দিতো তার বুকে। সেটা যেন ছিলো বেনামী এক অনুভুতি। যা ক্রমে ক্রমে গ্রাস করেছিলো আরহাম’কে। এখনও করছে। আরহামে’র বুকে আজন্ম থেকে যাবে তোঁষা।

__________________

— তুঁষ? উঠবি এখন? নাস্তা রেডি। আমি গোসল করতে যাচ্ছি।

তোঁষা বিড়ালের ন্যায় চোখ বের করে আরহাম’কে দেখলো যে আপাতত আলমারি থেকে কাপড় বের করছে। তখন আর লজ্জায় উঠা হয় নি ওর। এরপর কিভাবে জানি আরেকদফা ঘুমালো। আরহাম পুণরায় ডাকলো না তাকিয়েই,

— প্রাণ উঠবি এখন? আমি কি নাস্তা দিয়ে যাব।

তোঁষা’র কোন উত্তর মিললো না এবারও। আরহাম তপ্ত শ্বাস ফেলে ওয়াসরুমে ঢুকতে নিলেই কোথা থেকে দৌড়ে এসে তোঁষা ঢুকে বললো,

— আগে আমি।

আরহাম তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে বললো,

— আগে আমি।

— না না আমি।

— এতক্ষণ যে ডাকলাম?

— কে ঘুমাতে বলেছিলো?

আরহাম দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। এই বুঁচি’র সাথে তর্ক করে পারা যায়? তোঁষা’র ব্রাশ এগিয়ে ওর হাতে দিতে দিতে আরহাম বললো,

— নে। আমি তাহলে নাস্তা গুছিয়ে আসি।

আরহাম বের হতে নিলেই তোঁষা ওর হাত টেনে ধরে। আরহাম চোখের ইশারায় কি হয়েছে জানতে চাইলেই তোঁষা দাঁত বের করে হাসলো। আলতো করে টান দিলেও আরহাম এগিয়ে এলো। তোঁষা বা হাতে সাওয়ার অন করতেই ঝরঝর করে পানি পরা শুরু করলো ওদের উপর। মুহূর্তেই ভিজে গেলো দুটি দেহ। আরহাম কিন্তু চাইলেই আটকাতে পারত তোঁষা’কে অথচ আটকালো না। করুক না যা করতে চায়। কত বছরের অপেক্ষা। কোনদিন কি কাছাকাছি আসা হয়েছিলো? একটুও না। হয়নি কোনদিন অনুভূতি ব্যাক্ত করা। আরহাম নিজেই এগিয়ে এসে তোঁষা’র গাল স্পর্শ করলো। তোঁষা লজ্জায় রাঙা মুখটা নামিয়ে রেখেছে। পদক্ষেপ সে নিজেই গ্রহণ করে তখন হুস থাকে না কিন্তু কাজ সারার পরই তার মুখের দিক তাকানো যায় না। সামাল দিতে হয় আরহাম’কে অথচ আরহাম নিজেই বড্ড কষ্টে সব সামলে আছে।
.
তোঁষা নিজের মাথায় টাওয়াল পেঁচিয়ে সব নাস্তা টেবিলে রাখলো। তখনই আরহাম কফি হাতে কিচেন থেকে আসে। স্লিভলেস একটা টিশার্ট আপাতত গায়ে। বা হাতের বাহুতে হঠাৎ ই নজর গেলো তোঁষা’র। মুহুর্তেই যেন আঁতকে উঠল ও।
আরহামে’র হাতটা টেনে ধরে উত্তেজিত গলায় জিজ্ঞেস করলো,

— কি হয়েছে এখানে? গতরাতে ও না ঠিক ছিলো। বলুন।

আরহাম ঠোঁট কামড়ে ধরে। ওর একটুও মনে ছিলো না তোঁষা দেখে ফেললে কি উত্তর দিবে। কেন যে আজ স্লিভলেস টিশার্ট পরলো? কথাটা ভাবতেই বিরক্তিতে মুখ তেঁতো হলো ওর। তোঁষা অনবরত প্রশ্ন করেই যাচ্ছে। আরহাম ঝট করে কথা সাজালো,

— তেমন কিছু না তুঁষ। বিষাক্ত কিছু ফুটেছে এদিকে তবে কিছুই হয় নি। হয়তো ইনফেকশন হয়েছে। বিশ্বাস কর এখন ব্যাথা নেই।

আরহাম যাই করুক না কেন তোঁষা’কে মিথ্যা বলে না। অন্তত এই পর্যন্ত মিথ্যার আশ্রয় নেয় নি ও। যেখানে ওর ভালোবাসা সত্য সেখানে মিথ্যা’র কোন প্রয়োজনীয়তা নেই।
তোঁষা’র চিন্তায় বিষন্ন মুখটা তখন ঠিক হয় নি। মুখ কুঁচকে আছে তোঁষা। আরহাম জানে প্রচুর কৌতুহলী মেয়ে তোঁষা। তাই আরহাম খেতে তাড়া দিলো,

— জলদি হা কর তুষ। খেয়ে নে। আজ একটু তারাতাড়ি যাব।

তোঁষা ফট করে উত্তপ্ত শ্বাস ফেলে বললো,

— আমিও চলব না আজ?

আরহামে’র মুখটা শুকিয়ে এলেও তা প্রকাশ করে না। তোঁষা’র মুখে খাবার তুলে দিয়ে নিজেও খেয়ে নিলো।
_______________

শেখ বাড়ীর শোক যেন আজ আরো বাড়লো। তুঁষা’র ক্যাম্পে চলে যাচ্ছে। কাঁধে ব্যাগ তুলে বের হতেই ওর মা দৌড়ে এসে ঝাপ্টে ধরে ছেলেকে। হু হু করে কেঁদে উঠেন সশব্দে। তার কান্নার ফলে বেরিয়ে আসেন তুঁষা’রের চাচি, চাচা। ভ্রু কুঁচকে তুরাগ জিজ্ঞেস করলো,

— কোথায় যাচ্ছো তুঁষা’র?

— ক্যাম্পে।

— না না তুই যাবি না। বাবা আমার যাবি না। মা..মা যেতে দিব না।

— যেতে হবে আম্মু। দেখি ছাড়ো। কেঁদো না।

ওর মা আরো শক্ত করে ধরেন ছেলেকে। ততক্ষণে ধীরে ধীরে তুহিন ও বেরিয়ে এলেন। মন মেজাজ তারও ভালো না। সাথে শরীরটা ও ভালো লাগে না। চিন্তায় চিন্তায় শরীর ভেঙে যাচ্ছে যেন। তবুও দারাজ কন্ঠে বললেন,

— তোমার মা অসুস্থ তুঁষা’র। এখন হুট করে যাওয়ার মানে কি?

তুঁষা’র মা’কে জড়িয়ে ধরে। ঠান্ডা কন্ঠেই উত্তর করে,

— হুট করে? ঐ দিন না জানালাম?

তুরাগ মাঝ দিয়ে বললো,

— আমি তো ভাবলাম ওটা এমনিই বলেছো।

— চাচ্চু এমনিই কিছু আমি বলি না। যদি বছর আগে আমার কথা সবাই শুনতে তাহলে এমন করুন দশায় থাকতে না আজ। অন্তত দুটো নক্ষত্র আজ শেখ বাড়ীতেই থাকতো।

তুরাগ মাথা নাড়ান। কিছু বলেন না। ভুল তাদের দ্বারা হয়েছে। শুধুই কি ভুল? পাপ বলা যায় না এটাকে?

তুঁষা’র মাকে নিয়ে রুমে এসে তার হাত ধরে। মায়ের উত্তপ্ত ললাটে চুমু খেয়ে হাত দুটোতেও চুমু খেয়ে বললো,

— এই হাতে কত আঘাত করছিলে আমার পুতুল’কে আম্মু। মনে পরে?

ফিকড়ে কাঁদে ওর মা। তুঁষা’র মায়ের চোখ মুছে পেছন ফিরে না। বেরিয়ে যায় রুম থেকে। অতঃপর বাসা থেকে। পেছন থেকে চাচি এত ডাকলো কিন্তু দাঁড়ায় না তুঁষা’র। একটা বার পেছন ফিরে না।
তুহিন রুমে ঢুকে তাকায় স্ত্রী’র দিকে। আজও এই নারী’র চোখের পানি দেখতে পারে না সে। এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে তাকে। মাথার এলোমেলো চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে আদর করেন। নিজের হাত দুটো স্বামী’র সামনে দেখিয়ে বলেন,

— এই হাত দিয়ে এত মা’রলাম তোঁষাটা’র তবুও মেয়েটা রইলো না।

তুহিন কিছু বললো না। আসলেই তো তখন যদি তুঁষা’রের কথা শুনতো তবে আজ অন্তত মেয়েটা বুকে থাকতো। চোখের সামনে থাকতো।

#চলবে…….

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১১

উদাস মুখে আকাশ পানে তাকিয়ে তোঁষা। আরহাম ভাই তাকে নেয় নি সাথে। তোঁষা জেদ করতেই অসহায় চাহনি দেয় আরহাম। সেই চাহনি উপেক্ষা করে কিছু বলার সাহস আর হলো না তোঁষা’র। খুশি মনে আরহাম’কে বিদায় দিয়েছে। অনেক জেদ করে অনুমতি নিয়েছে বারান্দায় আসার।
আজও আরহাম তাকে বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে গেলো। তোঁষা অদূরেই আকাশছোঁয়া পাখিদের দেখা পায়। আরহাম গিয়েছে সেই সকালে। এখন বিকেল। তোঁষা’র তো আজ দুপুরে ও করার মতো কিছু ছিলো না। গোসল তো সকালেই করলো।
যদিও আজ তোঁষা প্লান করেছিলো ঘুমিয়ে দিনটা কাটিয়ে দিবে কিন্তু তাও হলো না। শত চেষ্টা’র পরও তা সম্ভব হয়ে উঠলো না। মানুষ তখনই ঘুমাতে পারবে যখন তার শরীর এবং মস্তিষ্ক ক্লান্ত থাকবে। তোঁষা সাকলেও ভালো ঘুমালো। সারাদিন শুয়ে বসেই কাটালো। ঘুম আসবে টা কোথা থেকে? তোঁষা’র মনটা নিমিষেই খারাপ হয়ে যায়। মনে পরে বাসার কথা। মা-বাবা আর তুষা’রের কথা। তুঁষা’র তাকে অনেক ভালোবাসে। মা ও তাকে ভালোবাসত কিন্তু কেন যে এমনটা করলো তা বুঝে আসে না তোঁষা’র। পিঠে এখন ও ব্যাথা অনুভব হয় তার। ঐ দিনের পিঠে দেয়া আঘাতটা খুব জোরে ছিলো। তোঁষা কখনো ভুলবে না সেটা। শরীরে মা’রের কম আঘাত নেই তার। মা তো তাকে নিজের জান বলে দাবি করতো কিন্তু কেউ কি নিজের জান’কে মা’রে? মা’রে না তো। তাহলে কেন মা মা’রলো তোঁষা’কে? তোঁষা’র ভুলটা কি ছিলো? ভালোবাসা কি ভুল ছিলো? ভুল থাকলে কেন তাকে শুরুতেই থামালো না? যখন তোঁষা সম্পূর্ণ ভাবে ভালোবাসার কাছে আয়ত্তহীন হয়ে পরলো তখনই তারা উঠে পরে লাগলো তোঁষা’কে আরহাম থেকে আলাদা করতে।

কথাগুলো ভাবতেই তোঁষা’র চোখ টলমল করে উঠে। এখন তার কোন চিন্তা নেই। আরহামে’র ঘ্রাণ সারাক্ষণ না পাওয়া গেলেও তোঁষা তার ব্যাবস্থা করে নেয় নিজেই। কখনো আরহামে’র গায়ের শার্ট পরে বা কখনো আরহামের দেয়া পারফিউম সারারুমময় ছড়িয়ে। তবুও কেন জানি দিন শেষে তোঁষা’র মন বিষাদে ভরে যাচ্ছে। বাবার কথা মনে পরছে। বাবা তো তোঁষা’র সাথে ঠিকমতো কথাই বলত না শেষদিকে কিন্তু মাঝেমধ্যে যে রাতে রুমে এসে তোঁষা’র মাথায় হাত বুলাতো তখন তোঁষা সব ভুলে যেতো। মন চাইতো ডুকরে কাঁদতে। কয়েকবার তো বাবা টের ও পেতেন যে তোঁষা জাগ্রত। তখন সন্তপর্ণে তোঁষা’র কপালে চুমু খেয়ে চলে যেতেন তিনি। তোঁষা’র মনে পরছে এখন বাবা’র কথা। কতদিন হলো দেখা হচ্ছে না তাকে। ভাই নিশ্চিত এখনও ক্যাম্পে ফিরে নি। তোঁষা’কে খুঁজে চলছে। কিন্তু তারা পাবে না তোঁষা’কে। কখনোই না। তোঁষা লুকিয়ে থাকবে এখানে। ওর আরহাম ভাই’য়ের কাছে।
.
আজ সন্ধ্যা একটু গড়াতেই আরহাম বাড়ী ফিরলো। তোঁষা তখন টিভি দেখতে দেখতে সোফায় ঢলেছে কিছুটা। আরহাম খুব ধীর শব্দে দরজা লক করে পাছে যদি তুঁষা’টা উঠে যায়? তোঁষা’র কাছে এসে গভীর চোখে দেখলো আরহাম। ঠোঁটে যেন হাসি ঝরা শুরু করে তার এই মায়াবী মুখ দেখলে। তোঁষা’র কপালে পড়ে থাকা কিছু এলোমেলো চুল দেখতেই আরহাম হাতে থাকা ব্যাগটা পাশে রেখে হাঁটু ভেঙে বসে তোঁষা’র বরাবর। পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে দেখে তোঁষা’কে। হাত বাড়িয়ে তোঁষা’র মুখে পড়া চুলগুলো সরাতেই তোঁষা চোখ খুললো। আরহাম’কে দেখেই হাসলো অধর এলিয়ে। নিদ্রা মিশ্রিত কন্ঠে ডেকে উঠলো,

— কখন এলেন?

আরহামে’র হৃদপিণ্ডে যেন প্রচুর বেগে জোয়ার বয়ে গেলো। তার তুঁষে’র এই ঘুম জড়ানো কন্ঠ’টা শুনা হয় না আজ অনেকদিন। আরহাম তোঁষা’র চুলগুলো নাড়তে নাড়তে উত্তর করলো,

— মাত্র ই এলাম।

— আমার জন্য কি এনেছেন?

— কি আনব?

দুষ্ট কন্ঠ আরহামে’র। তোঁষা মুখ কুঁচকে উঠতেই আরহাম ওর নাক টেনে বললো,

— বুঁচি একটা, বোঁচা এক নাক নিয়ে সারাক্ষণ মুখ কুঁচকে রাখে।

কথাটা বলেই আরহাম রুমে যায়। তোঁষা অলস ভঙ্গিতে তাকালো পাশের সোফায়। এখন ওর একটুও উঠতে মন চাইছে না। সাপের মতো মোচরাতে মোচরাতে সোফা থেকে নেমে পাশের সোফায় পৌঁছালো। যেই না ব্যাগের চেইন খুলবে ওমনিই আরহামে’র গলা শুনা গেলো,

— তুঁষ! এটা কি ছিলো? এই তুই আজ থেকে এইসব ফালতু কার্টুন দেখবি না। দিন দিন সিনচেন হয়ে যাচ্ছিস।

তোঁষা মুখ ভেঙালো। আরহাম’কে ভেঙিয়ে নকল করে বললো,

— দিন দিন সিনচেন হয়ে যাচ্ছিস।

আরহাম কিছুপল তাকিয়ে রইলো। তোঁষা ব্যাগ হাতড়ে তখন দেখছে ওর জন্য কি কি আছে। কয়েক পদের চকলেট পেতেই তোঁষা মুখে পুরলো আগে টপাটপ। পরে যদি আরহাম ভাই সব খেতে না দেয়?
_____________

— তুঁষ এদিক আয়।

তোঁষা হাতে থাকা গ্লাস রেখে আরহামে’র দিকে যেতেই আরহাম ইনসুলিন পুশ করতে এগিয়ে এলো। তোঁষা ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

— আমি নিয়েছি ইনসুলিন।

— কখন?

— যখন আপনি খাবার গরম করছিলেন।

আরহাম ঠোঁট কামড়ে ধরে। কিছু একটা ভেবে তোঁষা’র হাত টেনে নিজের কাছে আনে। তোঁষা মুখ ভর্তি লজ্জা ভাব নিয়ে মাথা নিচু রাখতেই আরহাম ওর মুখ তুলে। চোখে চোখ রেখে বললো,

— এরপর থেকে আমিই পুশ করে দিব। সকালেও আমি রাতেও আমি। মনে থাকবে?

— আমি একাই দিতে পারি।

— উহু। কোন কথা না।

— আচ্ছা আচ্ছা। ছাড়ুন। আমাকে সুচের খোঁচা দিতে মজা লাগে আপনার। বুঝি আমি।

কথাটা বলেই তোঁষা নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো আরহাম থেকে। ও এগিয়ে যায় টেবিলের দিকে। আরহাম আজ তোঁষা’র পছন্দের বিফ করেছে। নাদুস নুদুস তোঁষা’র ভীষণ পছন্দ খাওয়া দাওয়া করা। আজ মনটা ফুড়ফুড়া এত মজার খাবার দেখে। তোঁষা নিজেই দুই প্লেটে খাবার বাড়তে লাগলো অথচ পিছনে রয়ে গেল আরহামে’র রাগান্বিত মুখশ্রী।
তোঁষা’র কথা ওর ভালো লাগে নি। আরহামে’র কি না ভালো লাগে ওর তুঁষ’কে আঘাত করা? আর ইনসুলিন যে আজ একা নিলো এখন আরহাম কি করবে? ভাবতেই আরহামে’র রাগ হলো। দাঁত দিয়ে দাঁত পিষে আরহাম। লাল হওয়া চোখ দিয়ে আশপাশ দেখে হনহনিয়ে কিচেনে চলে যেতেই তোঁষা’র ডাক পরলো,

— আরহাম ভাই, আসুন না তারাতাড়ি। আমার তো লালা পরে গেলো।
________________

রাত্রি’র অন্ধকারে যখন ঢাকা গোটা শহর তখন কফি হাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে তুঁষা’র। জীবন বড্ড অগোছালো হয়ে গেল তার। তোঁষাটা’র কি অবস্থা? পুতুল’টা যে ছটফট করে। আরহাম কি তবে বেঁধে রাখলো ওকে? এক জায়গায় তো পুতুলটা বেশিক্ষণ থাকতে পারে না। ওর নাকি দম আটকে আসে। বাসা ছাড়া কোথায় থাকতে পারে না। সেবার যখন এসএসসি’র আগে বার্ষিক পিকনিক এ গেলো তখন রাত এগারোটা’র দিকে কল আসে তুঁষা’রের ফোনে। ওরা এসেছিলো চট্টগ্রাম। এদিকে তুঁষা’রের কোয়াটার তখন। ফোন ধরতেই কানে আসে তোঁষা’র কান্নারত গলা,

— ভাই…. ভাই আমাকে নিয়ে যাও। আমার সাফোকেশন হচ্ছে। ভালো লাগছে না।

তুঁষা’র ব্যাস্ত হয়। আর্মি ম্যান ঝটপট জানায় তার পুতুল’কে,

— পুতুল। ভাই’য়ের জান। ভাই আসছি বাচ্চা। একটু ধৈর্য ধর।

— এখনই আসো ভাই। ভালো লাগছে না।

বলেই ডুকরে উঠে তোঁষা। তুঁষা’র একাই বের হয় আঁকাবাঁকা রাস্তা ধরে। তোঁষা’কে নিয়ে আসে নিজের সাথে। সেদিন সারারাত দুই ভাই-বোন চট্টগ্রামের রাস্তা ভ্রমণ করেছিলো। নিকোষ কালো অন্ধকার ভেদ করে হাস্যজ্বল তোঁষা’র মুখটা যেন চিকচিক করছিলো।

পিছনে কারো অস্তিত্ব টের পেতেই তুঁষা’র বাস্তবে ফিরলো। পাশেই তথ্য দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েটা তুঁষা’রের জুনিয়র তবে এত বছর ধরে একসাথে থাকতে থাকতে তাদের মাঝে সম্পর্ক গড়ে উঠেছে কিছুটা। তথ্য নিজের কাঁধ সমান চুলগুলোতে দুটো বেণী করাতে একদম বাচ্চা বাচ্চা এক ভাব ফুটে উঠলো তার চেহারায় অথচ নারীটি’র বয়স তুঁষা’র থেকে বছর দশ কি বারো কম হবে। পার্থক্য ততটাও না আবার কম ও না। তথ্য ধীরে জানতে চাইলো,

— কিছু কি হয়েছে?

— না।

— মনে হচ্ছে…

— লিফ তথ্য।

— তুঁষা…

— আ’ম ইউর স্যার। কল মি স্যার ওকেই নট তু্ঁষা’র।

কথাটা বলেই চলে যায় তুঁষা’র। তথ্য’র সাথে অতটাও ভালো সম্পর্ক তার নেই যে পুতুলের ব্যাপারটা শেয়ার করবে। এদিকে তথ্য মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো। লোকটা তাকে অপমান করে গেলেও কেন জানি ওর খারাপ লাগলো না।
.
তোঁষা ঘুমালো ঘন্টা খানিক আগে। ঘুম কি সে সহজে এলো? আরহাম কত কত কথা বলে, মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়ালো। যখন বুঝলো তোঁষা সম্পূর্ণ ঘুম তখনই আলমারি’র একটা ড্রয়ার খুলে একটা ইনজেকশন রেডি করলো ও। তোঁষা’র কাছে এসে বা হাতটাতে পুশ করতেই তোঁষা “উহ” শব্দ করে। আরহাম তৎক্ষণাত তোঁষা’র পাশে শুতেই তোঁষা ঘুমের মধ্যেই বললো,

— এত উপরে মশা কেন আরহাম ভাই?

আরহাম উত্তর করে না। তোঁষা যখন পুণরায় ঘুমালো তখন আরহাম ওকে বুকে চেপে নিলো। কানে কানে ফিসফিস করে জানালো,

— তোকে আগেই জানিয়ে রাখলাম তুঁষ। পরে বলবি আগে কেন জানাই নি। তুই শুধু আমাকে ভালোবাস। আমাকেই চিন। তোর প্রথম আর শেষ আমিই হই। তোর পাপ আর পূর্ণ্য ও আমিই হই। সব ভুলে যা তুই তুঁষ। শুধু আমার প্রাণ হয়ে থেকে যা।

#চলবে……?

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১১(বর্ধিতাংশ)

অফিসে’র কাজেই ইদানীং বুদ হয়ে থাকছে আদনান। যথাসম্ভব চেষ্টা নিজেকে শান্ত রাখা। কাজে কাজে ব্যাস্ত রাখা। নিজের ভেতরের কষ্ট কাউকে দেখাতে ইচ্ছুক না ও। আদনানে’র নিজের উপর ও মাঝেমধ্যে ঘৃণা জন্মায়৷ মনে হয় যা হয়েছে ঠিক হয়েছে। আদনান এটার ই যোগ্য। এই কষ্ট, দুঃখ, বুকের চিনচিন ব্যাথা আর রাতে ঘুম না আসা সকল কিছুর জন্য দায়ী আদনান নিজেই। কতটাই না ঘৃণিত তার ভালোবাসা। নিজের আপন বড় ভাইয়ের ভালোবাসা’র মানুষ’কে ভালোবাসাটা অবশ্যই পাপ। জেনে শুনে আদনান সেই পাপে পা দিয়েছিলো। ফলাফল সরুপ নিজেই দগ্ধ হচ্ছে তার অনলে। ভালোবাসা’র প্রত্যেকটা স্ফুরণ তাকে জ্বালিয়ে মা’রছে রোজ রোজ। আদনান জানে না কিভাবে মুক্তি মিলবে। আদৌ কি কোনদিন ভুলতে পারবে তোঁষা’কে? ল্যাপটপে চলমান আঙুলগুলো নিমিষেই থেমে যায় আদনানে’র। এক দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে ফকফকা স্ক্রিনটা। কল্পনায় হঠাৎ ই যেন ভেসে উঠে কিছুদিন আগেই ঘটনা যখন হুট করে বাবা-চাচা তার রুমে প্রবেশ করে।

~তুরাগ আর তুহিন আদনানে’র রুমে আসতেই আদনান ভদ্রভাবে জিজ্ঞেস করে,

— কিছু কি বলবে আব্বু?

তুরাগ একবার ছোট ভাই’কে দেখে। তুহিন কিছু না বলে কাউচে বসতেই তুরাগ ও বসেন। ইশারায় ছেলেকে বসতে বলেন। আদনান ভ্রু কুঁচকায়। এমন শান্ত আচরণ বাবা-চাচ্চুর তার হজম হয় না। জিজ্ঞেস করে,

— চাচ্চু কিছু কি হয়েছে? আমার রুমে আসতে হলো যে? আমাকে ডাকলেই পারতে।

গলা খেঁকান তুরাগ। তুহিন ঠান্ডা মাথায় বলেন,

— গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিলো আদনান।

— এভাবে কেন বলছো? বলো কি কথা।

এবার তুরাগ কথা বাড়ালেন না। ছেলের পানে তাকিয়ে কিছুটা আদেশের ভঙ্গিতে বললেন,

— পুতুল’কে বিয়ে দিতে চাইছি।

আদনানে’র বুকে যেন ধাক্কা লাগে একটা। ও জানে এমনটাই হওয়ার কথা। তোঁষা’র সাথে তো আরহামে’র বিয়ে সেই ছোট থেকেই ঠিক করা তাহলে কেন আজ আদনানে’র খারাপ লাগা কাজ করছে? মাথা নিচু করেই আদনান বললো,

— হু। আমার দায়িত্বগুলো বলে দিও। সামলে নিব আমি। ভাই কি আসছে এর মধ্যে?

তুরাগ যেন খলবলিয়ে উঠলেন,

— কোথায় আসবে ঐ পাগল? তুমি বিয়ে করবে পুতুল’কে। আর কোন কথা চাইছি না।

আদনান এক মুহুর্তের জন্য থমকে যায়। মাত্র কি বললো ওর বাবা? পুতুল’কে বিয়ে করবে আদনান? তাহলে আরহাম? সে এসে যদি এমন দেখে তখন কি করবে?
এমনটা না আদনান রাজি নয় বা কিছু। তবে মুহুর্তেই তার মনে হয় এটা মোটেও ঠিক হবে না। নিজের আপন বড় ভাইয়ের ভালোবাসা’কে বিয়ে করা?
তবে বাবা-চাচা’র কথা আর মনের গহীনে থাকা তোঁষা’র জন্য এক অপ্রকাশিত অনুভূতি তাকে জেড়া করলো। আদনান প্রকাশ করে না নিজের অনুভূতি তবে রাজি হয়ে যায়,

— পুতুলে’র জন্য যেটা ভালো হয় তাই করো।

তুরাগ ছেলের কাঁধ চাপড়ে দেন। তুহিন আদনানে’র হাত ধরে বললো,

— বাবা আমার মেয়েটা অবুঝ। তুই তো জানিস ই। ওকে একটু গুছিয়ে নিও। একটু জেদী, মানিয়ে নিও।

আদনান জড়িয়ে ধরে ওর চাচ্চু’কে। ওর মনে যে কতটা আবেগ জমানো ছিলো তা প্রকাশ করতে অক্ষম হয় আদনান। উপচে পড়া সকল অনুভূতি’র জোয়ারে ভুলে বসে কতটা গর্হিত কাজ করতে যাচ্ছে সে। আদৌ কি তোঁষা রাজি কি না তাও একটাবার তার চিন্তায় আসে না।

তোঁষা যেদিন যখন কলেজ থেকে ফিরলো তখন মা তাকে খুব আদর করে আগলে নেন। নিজ হাতে খায়িয়ে দিতে দিতে বলেন,

— তোঁষা, আমরা বড়’রা একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আশা করি তুমি বড়দের সম্মান করো।

তোঁষা খেতে খেতেই উত্তর করে,

— আমিও আশা করব তোমরা নিজেদের সম্মান বজায় রেখে সিদ্ধান্ত নিয়েছো।

মেয়ের কথার ভঙ্গিতে শুনে ওর মা বুঝেন ততটা সহজে তোঁষা রাজি হবে না। না চাইতেও বারংবার তাকে নিজেকে শক্ত খোলসে আবৃত্ত করতে হয়। না চাইতেও তোঁষা’র প্রতি কঠোর থেকেও কঠোর হতে হচ্ছে ইদানীং। তোঁষা’কে খায়িয়ে মুখ মুছে দিয়ে ওর বরাবর বসেন তিনি। ভেজা চুলগুলো ঝেড়ে দিতে দিতে অবলীলায় জানায়,

— তোমার বিয়ে ঠিক করেছি আমরা। তুমি যেমন পছন্দ করো ঠিক তেমনই ছেলে। উচ্চতা,চেহারা সব এক। শুধু পেশা ভিন্ন।

— মানে?

— আদনান।

তোঁষা যেন অগ্নিশর্মা হয়ে যায় মুহুর্তে। চিরবিরিয়ে উঠে ওর মস্তিষ্ক। দাঁড়িয়ে গিয়ে রাগে ফুসতে ফুসতে বলে,

— পাগল হয়েছো? পাগল তোমরা? অসুস্থ মানুষ।

বলেই দৌড়ে থেকে বের হয়ে আদনানে’র কাছে যেতে নিলো তোঁষা। সবাই নাহয় পাগল হয়েছে তাই বলে কি আদনান ভাই ও পাগল হলো? সে কি জানে না তোঁষা আরহাম’কে ভালোবাসে? জানে। সবাই জানে। তবুও এইরকম একটা কুরুচিপূর্ণ প্রস্তাবে সে কিভাবে রাজি হয়? আদনানে’র রুমে এই প্রথম কোন নক না করেই তোঁষা ঢুকে পড়াতে কিছুটা চমকায় আদনান। ওকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই তোঁষা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে,

— নিজের বড় ভাইয়ের হবু বউ’কে বিয়ে করতে চাইতে লজ্জা করলো না আপনার আদনান ভাই? বিবেগে বাঁধলো না একটুও? কতটা জঘন্য আপনি! আমি জানাব আরহাম ভাই’কে।
চেহারা এক হলেই মানুষ এক হয় না৷ চরিত্রহীন লোক আপনি…..

চড় খেয়ে তব্দা খেয়ে রইলো তোঁষা। ওর মা ওর মুখ চেপে ধরে টানতে টানতে নিতে বললো,

— মুখ সামলা তোঁষা। তোর বিয়ে আমি আদনানে’র সাথেই দিব। দেখি কে থামায় আমাকে।

তোঁষা মায়ের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে সোজা বাবা’র কাছে যায়। তুহিন বুঝে মেয়ে’কে। আদরে তোঁষা’কে বুকে টেনে নিতে চাইলেই তোঁষা চিল্লিয়ে উঠে। তুরাগ আর চাচি বের হতেই তোঁষা সবার সামনে হুমকি দিয়ে বলে,

— আমাকে জোর করছো তাই না? আমি ই যদি না থাকি তখন কাকে নিয়ে এসব নিয়ে? আমার লা’শকে দিও বিয়ে।

“লা’শ” শব্দটা কানে বাজে উপস্থিত পাঁচজনের কানে। ওর চাচি দৌড়ে এসে তোঁষা’কে ঝাপ্টে বুকে চেপে ধরেন। তোঁষা’র ভালো লাগে চাচি নামক মানুষ’টাকে। মনে হয় আরহাম ভাই কাছে তার। এই নারী’র নাড়ি নেড়া ধন তার আরহাম ভাই। চাচি ওকে বুঝিয়ে শুনিয়ে নিজের সাথে নিতেই তুরাগ তিরিক্ষি ভাবে আদনান’কে উদ্দেশ্য করে বললেন,

— বিয়ে হওয়ার পরপর ই নাতি নাতনি চাই আমার আদনান। নিশ্চিত আরহাম এতটাও নীচে নামবে না যে নিজের ভাইয়ের সংসার ভেঙে তোঁষা’কে নিয়ে যাবে। বাচ্চা থাকলে সুবিধা হবে। আরহাম তখন কিছু করতে পারবে না।

আদনান শুনলো। বুঝলো। ও জানে কেন ওর সাথে তোঁষা’র বিয়ে দিতে চাইছে সবাই। সবাই ভাবছে আরহাম আর যা ই করুক না কেন নিজের ভাইয়ের বউ এর দিকে নজর দিবে না বা ভাইয়ের ক্ষতি করবে না। সেখানে বাইরের কারো সাথে তোঁষা’র বিয়ে দিলে আরহাম হয়তো খু’ন করতেও পিছু পা হবে না। তাই তো শেখ বাড়ীর সকলে মিলে পরিকল্পনাটা করলো। আদনান সুযোগ নিলো। চাইলো তোঁষা’কে। তবুও যখন ও প্রশ্ন করলো,

— তোঁষা কোনদিন মানিয়ে নিবে না আমাকে। তখন? একটা বাচ্চা, একটা সংসার, একটা বিয়ের কথা হচ্ছে এখানে?

তখনই উত্তর করে তোঁষা’র মা,

— মেয়ে মানুষ। যে পাত্রে ঢালবে তার আকার ই ধারণ করবে। আমার মেয়ে। চিনি আমি। একটু আদর পেলেই গলে যাবে।

আদনান কথা বললো না। তার খুব করে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হলো,”তাহলে কেন পুতুল’টাকে আদর দিয়ে বুঝিয়ে ও আরহাম ভাই থেকে আগলে রাখলেন না?”

#চলবে……

প্রিয় প্রাণ পর্ব-৮+৯

0

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৮

মোট আট ঘন্টা পার করলো তোঁষা একা একা। এরমধ্যে হয়তো ঘন্টা পাঁচ তার কেটেছে ঘুমে। ঘুম ভাঙতেই মনে হলো ওর ক্ষুধা লেগেছে। উঠে ওয়াসরুমে ঢুকে মুখে পানি দিয়ে বের হয়ে যেই না কিচেনে পা বাড়াবে ওমনই মনে পরলো আরহামে’র কথা। তোঁষা’কে কিচেনে যেতে না করেছে একা। ঠোঁট উল্টো করে এদিক ওদিক তাকায় তোঁষা। এটা কেমন কথা, তোষা একা থাকছে এখানে। কিচেনে
যেতে হলে তো তাকে একাই যেতে হবে। তাই না? এখন তোঁষা খাবে কি? দেনামোনা করতে করতে টেবিলে গিয়ে ধপ করে বসে পরলো তোঁষা। ক্ষুধায় মরণ হলেও তোঁষা কিচেনে যাবে না। যেখানে আরহাম ভাই নিষেধ করেছে তোঁষা কখনো সেখানে যায় না। এখনও তাই।
টেবিলের মাঝখানে তাকাতেই তোঁষা’র ভোঁতা মুখটা উজ্জ্বল হয়ে গেল। ফলের ঝুড়ি রাখা সেখানে। তোঁষা খেয়াল করে নি সেটা আগে। মনটা যেন নিমিষেই ভালো হয়ে গেল ওর। হাত বাড়িয়ে দুটো আপেল আর কমলা নিয়ে মুখে টপাটপ চর পাঁচটা আঙুল পুরে রুমে হাটা দিলো। মন চাইলো বারান্দায় যেতে কিন্তু সেটা ও তো করা যাচ্ছে না। মন খারাপ করে সোফায় লম্বা হয়ে শুয়ে পরলো তোঁষা। টিভিটা অন করে চ্যানেল পাল্টালেও কার্টুন বাদে কিছুই পেলো না। তোঁষা’র অবশ্য সমস্যা হলো না। কার্টুন ভালো লাগে ওর।
সেই ভালো লাগাটাও বেশিক্ষণ টিকলো না আজ তোঁষা’র। ছোট থেকে যৌথ পরিবারে থাকা মানুষটা এমন একা কতক্ষণ ই বা থাকবে। বাইরে ও বের হওয়া নিসিদ্ধ তার জন্য। জানালা দিয়ে দূর আকাশ পানে তাকালো তোঁষা। অভিযোগ করলো একা একা অনেক কিছু। খুব কি খারাপ হতো পরিবার যদি তাকে আরহাম’কে মেনে নিতো?
_________________

হঠাৎ দরজা খুলতেই হকচকিয়ে যায় আরহাম। ভেতরে ঢুকা মাত্রই দৌড়ে এসে তোঁষা ঝাঁপিয়েছে তার বুকে। দুই হাতে শক্ত করে ধরার দরুন আরহাম ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো। হাতের ব্যাগটা ঢিল মে’রে কাউচে ছুঁড়ে দুই হাতে জড়িয়ে নিলো তোঁষা’র দেহটা। এক হাতে মাথায় আদর দিতেই তোঁষা’র নাক টানার শব্দ শুনা গেলো। আরহাম শক্ত হলো। দাঁত দিয়ে দাঁত পিষে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা চালালো। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,

— আর যাব না তোকে রেখে।

তোঁষা মুখ তুললো না। একজন মানুষ হয়ে এভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা একা পার করাটা মোটেও সহজ কিছু ছিলো না। একদিন না হয় ঠিক আছে তাই বলে আরহাম রোজ রোজ বের হলে তখন কিভাবে থাকবে তোঁষা?
মুখ তুলে আরহামের দিকে তাকাতেই আরহাম তোঁষা’র গালে হাত দিলো। সযত্নে মুছে দিলো জমা পানিটুকু। তোঁষা এবার আরহামে’র বুকে মুখ গুজে বললো,

— মিসড ইউ।

— মি ঠু প্রাণ।

তোঁষা মুখটা ঘঁষে দিলো আরহামে’র বুকে। হাত ধরে রুমে নিতে নিতে বললো,

— কেমন ছিলো আপনার দিন? আচ্ছা মেয়ে পাগল কয়টা এলো? ও একটা কথা ছিলো তো আমার.. মেয়ে পাগলগুলো কি বয়স্ক থাকে না কি আমার বয়সের?

কথাগুলো সহজ গলায় জিজ্ঞেস করতে করতে আরহামে’র গায়ের কোট’টা খুলে টাই আলগা করে তোঁষা। আরহাম ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে আছে ওর তুঁষে’র মুখটা’র দিকে। তোঁষা উত্তর না পেয়ে আরহামে’র শার্টের বোতামে হাত রেখে চোখ দিলো আরহামে’র মুখে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে পুণরায় জিজ্ঞেস করলো,

— কি বলুন। আর একটা প্রশ্ন আছে। আপনার সাথে কে থাকে? না মানে নার্স নাকি বয়? আপনি চাইলে আমাকে জবটা দিতে পারেন। এই যেমন আপনার কাছে আসা পাগলদের সিরিয়াল দেয়া বা আপনার খাবার দাবার খেয়াল রাখা। কখন কি লাগে আপনার বুঝা যায় না তাই না? আমি আপনার কেবিনেই একপাশে বসে থাকলাম৷ কি বলেন?

এক নাগারে কথাগুলো বলতে বলতে আরহামে’র শার্টের বোতাম গুলো খুলে দিলো তোঁষা। উত্তর না পেয়ে আরহামে’র দিকে তাকাতেই দেখা মিললো অসহায় আরহামে’র চোখ। তার চোখ থেকেও বেশি অসহায় শুনালো আরহামে’র কন্ঠ,

— তোর কি অনেক কষ্ট হয়েছে তুঁষ?

তোঁষা কথা বলে না। মাথা নিচু করে রাখে। আরহাম ওর হাত ধরে নিয়ে বিছানায় বসলো। ও জানে তোঁষা’র কষ্ট। দেখেছে ওর ছটফটানি। এই যে এখন একা থাকতে পারছে না বলে কত বাহানা ধরছে আরহামে’র সাথে যাওয়ার। তোঁষা’কে বিছানায় শুয়িয়ে কপালে চুমু দিয়ে আরহাম বললো,

— অপেক্ষা কর। সাওয়ার নিয়ে আসছি। এরপর একসাথে খাব।

আরহাম আলমারি থেকে নিজের একটা টাউজার নিয়ে ওয়াসরুমে ঢুকে যায়। তোঁষা শোয়া থেকে উঠে বসে। দুই হাতে চোখ ডলে নেমে যায় বিছানা থেকে। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে আসে কিচেনে। আরহাম এখন ক্লান্ত। তোঁষা তার বউ। সেই হিসেবে তোঁষা’র উচিত আরহামে’র খাবার রেডি করা। কিন্তু সমস্যা হলো রান্না। কেউ তো কখনো তাকে রান্না শেখায় নি। তবে কিছুটা শিখেছে আরহামে’র জন্য।
মন খারাপ করে ফ্রিজ খুলতেই প্লাস্টিক দিয়ে মোড়ানো কিছু খাবার পেলো তোঁষা। ঝটপট বের করে ওভেনে দিয়ে প্লেট রাখলো টেবিলে। আরহাম সকালেই রান্না করে সব গুছিয়ে গিয়েছে।

— কি করছিস তুঁষ?

হঠাৎ আওয়াজে ভয় পেয়ে যায় তোঁষা। আরহাম এগিয়ে এসে ভেজা চুলগুলো ঝাড়া দিলো তোঁষা’র মুখের উপর। চোখ বুজে নেয় তোঁষা। আরহামের চুলের পানি তখন ওর নাকে মুখে। নাকে ভেসে আসে কড়া পুরুষীয় ঘ্রাণ। তোঁষা’র ভালো লাগে শুঁকতে। আরহামে’র কন্ঠে ঘোর কাটে তোঁষা’র,

— বলি নি কিচেনে একা না আসতে?

থতমত খেলেও তোঁষা মুখ সামলে উত্তর দিলো,

— সেটা বলেছিলেন একা বাসায় থাকলে। যেহেতু আপনি এখন বাসায় তাই এই কথা প্রযোজ্য হবে না।

আরহাম তীক্ষ্ণ চোখে তোঁষা’কে দেখে নিয়ে কিচেনে হাটা দিলো। তোঁষা প্লেট হাতে টেবিলে বসতে বসতে বললো,

— আরহাম ভাই, কাল আমি রান্না করব হ্যাঁ? জানেন আপনার জন্য আম্মু’র থেকে রান্না শিখেছিলাম….

বাকিটা বলতে গিয়ে ও তোঁষা চুপ হয়ে গেল। বুকে চিনচিনে ব্যথা অনুভব হলো মা’য়ের জন্য। তবে সেই ব্যাথায় পাত্তা দেয় না তোঁষা। আরহাম শেখ বাড়ীর কারো কথা শুনা পছন্দ করে না তাই তোঁষা চুপ করে যায়। আরহাম হাতে ইনসুলিন নিয়ে এগিয়ে এসে তোঁষা’র বাহু টেনে নিলো নিজের কাছে। হাফ হাতা কুর্তি’টার হাতা আরেকটু উপর তুলে সযত্নে পুশ করে দিতেই তোঁষা মুখ কুঁচকে একটু শব্দ করে,

— উফ!

আরহাম ততক্ষণে পুশ করে দিয়েছে। তোঁষা’র মুখে তাকিয়ে ব্যাস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— এই তুঁষ? ব্যাথা পেলি?

তোঁষা মাথা ঝাঁকাতেই আরহাম উলোট পালোট হলো। কপালের শিরা ফুলতে শুরু করেছে কিছুটা। তোঁষা’র পুশ করা জায়গাটায় একটু লাল তরল বের হয়েছে কিন্তু কেন? এমন তো হওয়ার কথা না। আরহাম খেয়াল করলো নিডেলটা বাকা। কেন ও আগে খেয়াল করলো না? কেন ওর তুঁষে’র মুখে ব্যাথাকাতুর শব্দ? তাও আরহামে’র কাছে? আরহাম কি তা মানবে? এটা কি সম্ভব? তোঁষা নিজেই এক আঙুলে বাহু থেকে র*ক্ত মুছে হাত ধুতে যেতে যেতে বললো,

— মনে হচ্ছে নিডেলে সমস্যা।

তোঁষা খেয়াল করে নি আরহামে’র মুখভঙ্গি। পুড়া গন্ধ নাকে আসতেই কিচেনে যায় আরহাম। একসাথে খাওয়া শেষ করে শুয়ে পরে তোঁষা’কে নিয়ে। তোঁষা ঘুমাতেই বিছানা ছাড়ে আরহাম। এগিয়ে যায় অন্ধকারে কিচেনে। ডাস্টবিনে নিডেল ফেলা। তোঁষা ফেলেছে এটা। আরহাম সেটা হাতে তুলে চুপ করে বসলো ফ্লোরে। এক ধ্যানে দেখলো নিডল’টাকে। সোজা না হয়ে কেন বাঁকা এটা? আরহাম ভাবলো।
আরেকটু সময় অতিবাহিত হতেই ঘড়ির কাটায় শব্দ হলো সাথে ভিন্ন এক শব্দ। এই তো রাত বারোটা বাজে এখন। আরহাম কাত হয়ে ফ্লোরে শুয়ে পরলো। বা হাতের বাহু গড়িয়ে তখনও চুয়ে চুয়ে বের হচ্ছে লাল তরল। অগণিত সুচের আঘাত সেই শক্ত পেশি’র বাহুতে। ব্যাথাটা কি ওর তুঁষে’র ব্যাথার সমান হলো? নাকি হলো না? আরো কিছুক্ষণ কি আরহাম খোঁচাবে হাতটা? ভাবতে ভাবতে সুন্দর করে উঠে ফ্লোর পরিষ্কার করে আরহাম অতঃপর একদম শান্ত ভাবে এগিয়ে এসে তোঁষা’র পাশে বসলো। পুশ করা স্থানে ঠোঁট লাগিয়ে ভেজা চুমু খেয়ে ফিসফিস করে আরহাম জানালো,

— সমান সমান তুঁষ। তোর যতটুকু ব্যাথা আমারও ততটুকু ব্যাথা।

#চলবে….

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৯

রোদ্দুরে ঝকমক করছে ধরণী। আমানিশা কেটেছে কিছুক্ষণ আগে। বেভুর ঘুমে থাকা তোঁষা আরহামের টিশার্টের বুকের দিকে খাঁমচে ধরে আছে। আরহামে’র একটা হাত তোঁষা’র মাথায়। বা হাতটা সাইডে ফেলে কাত হয়ে ঘুমাচ্ছে সে। আস্তে ধীরে ঘুম ভাঙে তোঁষা’র। এদিক ওদিক মুচড়ে চোখ খুলে ধীরেসুস্থে। সম্মুখে নজর তাক করতেই দিদার মিলে আরহামে’র। ঘুমের রেশ লাগা মুখটায় দেখা মিলে হাসির। যতটুকু দূরত্ব আছে তোঁষা ঘুচিয়ে দেয় তা। একদম আরহাম’কে ছুঁই ছুঁই করে এগিয়ে আনে নিজের শরীর’টাকে। কাত হয়ে দেখতে থাকে আরহামে’র সুশ্রী সুদর্শন চেহারাটা’কে। সুন্দর আরহাম ভাই তোঁষা’র। ঠিক যেন ঘোর আমাবস্যা’র রাতে পূর্ণিমার চাঁদ। তোঁষা দুই আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দিলো আরহামে’র গালটা। খোঁচা খোঁচা লাগলো আঙুলে। তোঁষা ভাবলো আরহাম’কে বলবে যাতে একটু দাড়ি রাখে। চাপ দাঁড়িতে নিশ্চিত তাকে আরো মানানসই লাগবে।
আরহামে’র চোখের মনি নড়ছে কিছুটা। ঠাহর করতে পেরে তোঁষা চোখ বুজে নিলো কিন্তু চোখ মেললো আরহাম। তোঁষা’কে নিজের এতটা কাছাকাছি দেখে মুহুর্তে চমকালেও সামলে নিলো নিজেকে। ওর দুষ্ট প্রাণ যে সজাগ তা ও জানে আরহাম। না জেনে উপায় আছে? এই যে দুষ্ট পাখিটা ঘুমের ভান ধরেছে বলে এমন শক্ত হয়ে সোজা শুয়ে আছে অথচ তার ঘুম হলো এলোমেলো। শরীর ছেড়ে ঘুমায়। আরহাম নিজেও দুষ্ট কম না। ঠিক তোঁষা’র মতোই তোঁষা’র গালে দুই আঙুল বুলিয়ে দিলো। প্রচন্ড স্পর্শকাতর মেয়ে তোঁষা। আরহাম যখনই ওর গাল থেকে থুঁতনিতে আঙুল চালালো ওমনিই শরীর মুচড়ে মুখে “উমম” উচ্চারণ করলো।
অল্প হেসে আরহাম তোঁষা’র হাত টেনে নিজের কাছে আনতেই তোঁষা তাকালো। তাকালো আরহাম নিজেও। দু’জনের গভীর দৃষ্টি দু’জনে চোখে। তোঁষা সম্মোহীন হয়ে দেখে যাচ্ছে আরহাম’কে আর আরহামের দৃষ্টিতে উত্তাপ।
মনোবিজ্ঞানী’রা বলেন, “একজন প্রাপ্তবয়স্ক নর ও নারী পরস্পরের চোখের দিকে টানা এক মিনিট তাকিয়ে থাকলে হয় তারা পরস্পর’কে খু*ন করতে চাইবে অথবা পরস্পরের সানিধ্য চাইবে”।

তোঁষা’র ক্ষেত্রে বোধহয় সেটাই হলো। হঠাৎ করে আরহামে’র মুখোমুখি মুখ আনতেই আরহাম আটকে দিলো। তোঁষা মানলো না। আরহামে’র বাঁধা উপক্রম করতে নিলেই শক্ত হাতে আরহাম জড়িয়ে ধরে তাকে। জোরে জোরে শ্বাস টানে আরহাম। নিজেকে কি সে সামলাতে পারছে বা পারে? মোটেও পারে না। এই যে গত তিন চারটা দিন ধরে তুঁষটা’কে নিয়ে নিস্তব্ধতায় ঘেরা এই ফ্ল্যাটে থাকে। প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ হিসেবে আরহাম কি দাঁত কামড়ে পরে রইছে না? সে কি নিয়ন্ত্রণ করছে না? হুটহাট তোঁষা’র আলিঙ্গনে বেসামাল কি আরহাম হয় নি? হেয়েছে। একবার না বারবার আরহাম বেকায়দায় পড়েছে অতঃপর নিজেকে সামলেছে।
তোঁষা’র এই ভালোবাসা টাইটুম্বুর থাকে আবেগে। আরহাম চাইছে তোঁষা আগে নিজেকে সামলে উঠুক। এমন ভাবে আচানক কিছু না ঘটুক যাতে তোঁষা’র স্ব্যাস্থে তার প্রভাব পড়ে। এমনিতেই তোঁষা’র শরীর ততটা ভালো থাকে না। অনেকটা সমস্যা নিয়েই সে ভূমিষ্ট হয়েছিলো ধরণীতে।

আরহামের ভাবনার মাঝেই তোঁষা নড়াচড়া শুরু করলো। প্রচন্ড জেদী এই তুঁষ। আরহাম ছাড়া কাউকে মানতে ও চায় না। শক্তপোক্ত আরহামে’র সাথে পেরে উঠবে না জেনেও শক্তি ক্ষয় করে যাচ্ছে। আরহাম শক্ত করে তোঁষা’কে বুকে পিষলো। তোঁষা বুঝি এতটাই বুঝার মেয়ে? ছটফট করে ছুটতে চাইছে সে। নীরব যুদ্ধ চলছে এই ভোর সকালে। এসময় আরহাম “উফ” শব্দ করতেই তোঁষা শান্ত হলো। এ কি যেই সেই শান্ত? একদম ঠান্ডা পানি যাকে বলে। যেন ঘাসের উপর লেপ্টে থাকা তুঁষা’র।
আরহাম গালে হাত ডলতে ডলতে বললো,

— দেখ তো প্রাণ র*ক্ত বের হলো নাকি?

তোঁষা দেখা তো দূর নড়লোই না। আরহাম হেসে ফেললো। কাত হয়ে তোঁষা’র নাক টেনে দিয়ে বললো,

— বুঁচি’র আবার লজ্জা লাগে?

— হু।

— তাহলে কামড় দিলি কেন?

………….

— কি? এখন চুপ কেন? কথা বল।

— তোমার দোষ। কথা বলবে না।

আরহাম অল্প বিস্তৃত ভ্রু কুঁচকে হাসছে। প্রচন্ড আদুরে ভাবে আছে তার তুঁষ। এই “তুমি” ডাকটা বছরে এক দুই বার শুনা যায় তার মুখে। আরহাম মুখ এগিয়ে এনে চুমু খেল তোঁষা’র মাথায়। নিজে উঠতে উঠতে বললো,

— আরেকটু ঘুমা।

___________________

আরহামে’র সাথে তোঁষা’র বিয়ে কেউই দিবে না। তোঁষা’র হাজার পাগলামি কাজে লাগে না। একা ছোট্ট তোঁষা কত লড়বে? কত মা’র খাবে? কতই বা মায়ের বকা, বাবা’র সেই অসন্তুষ্ট দৃষ্টি দেখবে? আরহামে’র সাথে তোঁষা যে লুকিয়ে কথা বলতো তা ধরা খেয়েছিলো আদনানে’র কাছে। পরিক্ষা’র জন্য রাতে পড়ার জন্য জেগে থেকে তুঁষা’রের ফোনটা লুকিয়ে এনে কথা বলে তোঁষা যা আদনান দেখে ফেলে কোনভাবে। তখন তোঁষা’কে কিছু না বলে তোঁষা’র জন্য আনা দুধ’টা নিয়ে ফেরত চলে যায় ও। আদনান সারাটা রাত জেগে ছিলো তোঁষা সজাগ বলে। তুঁষ’টা পড়ছে আদনান কিভাবে ঘুমাবে? সারাদিন কাজ শেষে রাত জাগাটা মোটেও সহজ কিছু না। তবুও আদনান জেগে থাকে তোঁষা’র জন্য। মনের ভেতরে লুকায়িত ভালোবাসা সে কোনদিন প্রকাশ করে নি। করার সুযোগটাও হলো না। সেদিন ই ছিলো তোঁষা আরহামে’র শেষ কথা। এরপর থেকে আর কারো ফোন লুকায় নি তোঁষা। সুযোগ ও হয় নি। মা তাকে সকালে ঘুম থেকে তুলে রাবারের স্কেল দিয়ে পিটিয়েছে। সারারাত জেগে থাকা তোঁষা হঠাৎ হামলায় ঘুমের মধ্যেই চিৎকার করে কেঁদে উঠে। ওর ভয়ানক এই আর্তনাদে ছুটে আসে বাড়ী’র সকলে কিন্তু দরজা লক থাকায় কেউ ঢুকতে পারে না। তোঁষা’র একেকটা আত্মচিৎকারে ভারী হয়ে আসে শেখবাড়ী।

— আম্মু….আম্মু মে’রো না। মে’রো না আম্মু। আম্মু ব্যাথা পাই। আব্বু? আব্বু? ভাইয়া! ভাইয়া ব্যাথা পাচ্ছি।

অপরপাশে পাগল হয়ে যায় তুঁষা’র। শক্ত হাতের থাবা বাসায় দরজায়। শক্ত দেহটা কাঁপছে তখন রাগে। বোনের চিৎকারে। বাঁচাতে না পারার অক্ষমতায়। দরজা যেন ভাঙার উপক্রম তুঁষা’রের,

— মা মা দরজা খুলো। পুতুল’কে ছাড়ো মা। ভালো হবে না মা! ছাড়ো পুতুল’কে। দাও ওকে। মা!!

ওর মা কথা শুনে না। তোঁষা তখনও চিৎকার করে কাঁদছে।
আদনান গিয়েছিলো মর্নিং ওয়াকে। সারারাত ঘুম হয় নি তাই সকালে ও আর ঘুমায় নি সে। বাসায় ফিরে তোঁষা’র চিৎকার শুনে দৌড়ে আসতেই পরিস্থিতি বুঝে যায় ও। দরজা ধাক্কাতে ধাক্কাতে তুঁষা’রকে বলে,

— ভাই ধাক্কা দাও।

এদিকে তুরাগ আর তুহিন ও থেমে নেই। তোঁষা’কে হাজার রাগ দেখালেও তোঁষা’র ঐ দিনের কান্নায় পাষাণ হৃদয় ও বুঝি কাঁদতো। ছোট্ট একটা প্রাণ, ভালোবাসার দায়ে কতটাই না আঘাত পেলো।

তুঁষা’রের মতো আর্মি ম্যান ও যেন হঠাৎ থমকে যায়। তোঁষা’র কান্না বন্ধ তখন। তুহিন দুই পা পিছিয়ে যান। নাজুক তার কলিজার টুকরো’টার কিছু হলো কি? তুরাগ তাড়া দিলেন দরজা ভাঙতে। ততক্ষণে বিলাপ জুড়েছেন তার স্ত্রী।
তুঁষা’র শেষ বারের মতো সজোরে ধাক্কা দেয়ার আগেই খট করে দরজাটা খুলে গেলো। ওর দাদা এই দরজাগুলো জার্মান থেকে আনিয়েছিলেন। প্রচুর মজবুদ ধাঁচের। তুঁষা’র দেখলো ক্লান্ত মা’কে। মধ্যবয়স্ক সুশ্রী নারীটি ক্লান্ত। তুঁষা’রের পুতুল মে’রে ক্লান্ত, ভাঙা শরীর নিয়ে হেলেদুলে বেরিয়ে যান তিনি। তুঁষা’র ঠাই দাঁড়িয়ে রয়। আদনান ততক্ষণে চিৎকার করে ডাকে,

— তুঁষ!

র*ক্তাক্ত জ্ঞান হারা তোঁষা তখন ফ্লোরে পড়া। পরণে থাকা টিশা’র গলার দিকে র*ক্ত। কোথায় কাটলো? কোথায় ফাটলো? তুঁষা’রের মতো আর্মি বুঝে না সেটা। বিচক্ষণতা’র যেন মুহুর্তে ই বিলুপ্তি ঘটলো। তুঁষা’র দৌড়ে এসে তোঁষা’কে ধরে। তুহিন এগিয়ে এলো না। বৃদ্ধ শরীর তার শক্তি পায় না। তুরাগ তাড়া দিলেন হাসপাতালে নিতে। ওর চাচি তোঁষা’র মুখে পানি দিচ্ছে। তুঁষা’র এগিয়ে এসে বোনকে আগলে নিলো। কে বলে পুরুষ বাবা স্বাদ পায় নিজের অস্তিত্বের আসছে এই খবর পাওয়ার পর? তুঁষা’র তো এই পুতুল’টাকে দেখেই পিতৃ স্বাদ পায়। যেন তুঁষা’রের অবিচ্ছেদ্য দেহটা। একই র*ক্তের টান আছে না।
আদনান হতভম্ব হয়ে যায়। চাচি এমন কাজ করবে ও ভাবেনি।
তোঁষা’র দেহটা যেন ভারী লাগে তুঁষা’রের নিকট। বিছানায় শুয়িয়ে দিয়ে ফোন হাতে কল লাগায় পরিচিত ডক্টর’কে। হাসপাতালে নিলে যখন পুলিশ আসবে তখন কাকে দোষারোপ করবে আর্মি ম্যান? মা’কে নাকি ভাগ্য’কে?

তোঁষা’র সেদিনের কম্পমান র*ক্তাক্ত দেহটা ভেসে উঠে চোখের পর্দায়। তিনটা ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরতেই কাকে ডাকলো তোঁষা? ক্লান্ত তার মুখটা শুধু অভিযোগ জানালো,

— ভাইয়া, আব্বু, আম্মু মে’রেছে। আরহাম ভাই আসুক। বলে দিব সব।

ফট করে চোখ খুলে তুহিন। দরদর করে ঘামছে সে। এই তো মাস কয়েক আগের ঘটনাটা আজও স্বপ্নে দেখলো সে। তোঁষাটা কি বেঁচে আছে?
নিজের প্রশ্নে অবাক তুহিন। পাশেই প্রায় অচেতনের মতো ঘুমাচ্ছে তার স্ত্রী। কুঁচকানো চামড়ার হাতটা বাড়িয়ে স্ত্রী’র কাপালে রাখেন তুহিন। জ্বরটা কেন যে থামছেই না।

#চলবে….

[গল্পটা সম্পূর্ণ কাল্পনিক তাই সেভাবেই ভাবুন।]

প্রিয় প্রাণ পর্ব-৬+৭

0

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৬

শেখ বাড়ীর ছোট ছেলে আদনান। শান্ত, ভদ্র এক ছেলে। ইন্জিনিয়ারিং শেষ করে ভালো এক পেশায় নিয়োজিত। লম্বা চওড়া সুন্দর ধাঁচের ছেলেটা। আরহামের মা তাকিয়ে আছেন আদনানে’র দিকে। এগিয়ে এসে একটু মাথায় ও হাত বুলিয়ে দিলেন। আদনান ফিচেল হাসলো। ও জানে এই আদরটা ওর মা ওকে করছে না। এই আদর টুকু হলো ওর বড় ভাই আরহামে’র। চেহারা এক হওয়াতে মা মাঝেমধ্যে ই আরহামের কথা মনে পরলে রাত বিরাতে আদনানে’র রুমে ছুটে আসেন। আদনান বুঝে মায়ের মন। কিছুই করার নেই তার। শুধু আদনান কেন কেউ ই কিছু করতে পারবে না। মায়ের হাতটা জড়িয়ে নিজের বুকে রাখে আদনান। অল্প অন্ধকারে দেখে নেয় মায়ের ক্রন্দনরত চেহারাটা। দুই ভাই এর ই জান তাদের মা। আদনানের মা ভাবে নি ছেলে সজাগ। আদনান মায়ের কোলে মাথাটা তুলে দিতেই হু হু করে কেঁদে উঠেন তিনি। আদনান মা’কে থামায় না। কাঁদতে দেয়। কাঁদুক। কাঁদা ভালো। কাঁদলে মন হাল্কা হয়। আদৌ কোনদিন ওর মায়ের মন হালকা হবে কি না জানা নেই। একজন মায়ের কাছে তার প্রথম সন্তান কি তা সেই মা ছাড়া কেউ জানে না। সৃষ্টিকর্তা’র দেয়া প্রথম নেয়ামত বলে কথা।
ধীরে সুস্থে মায়ের কোল থেকে মাথা তুলে আদনান। হাত বাড়িয়ে মুছে দেয় চোখের পানি। অল্প বিস্তর হেসে শুধায়,

— কেন কাঁদছো মা? ভাই ঠিক আছে।

সচকিত নয়নে তাকান তিনি। আদনান বুঝে মায়ের না করা প্রশ্ন। সেই প্রশ্নের উত্তর সরুপ ওষ্ঠ ছুঁয়ে দেয় তার ললাটে। চোখের পানি বাকিটুকু মুছে দিয়ে বলে,

— জানি না কোথায় আছে কিন্তু এতটুকু বিশ্বাস আছে তার নিজের প্রাণের টুকরো’কে নিয়ে সে খারাপ থাকবে না কখনোই।

দুই হাতে জাপ্টে ধরেন তিনি ছেলেকে। কাঁদতে কাঁদতে ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলেন,

— ও..ওকে এনে দে না আদনান। আমার প্রথম সন্তান ও। আমার কলিজার টুকরো’টাকে দেখি না কতবছর।

আদনানে’র গলা ধরে আসে। কান্না পায় তারও কিন্তু কাঁদে না সে। মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শুধু বলে,

— আরেকজনের কলিজার টুকরো নিয়ে গিয়েছে সে মা।

— ও পুতুলের খারাপ চায় না।

— চাইলেও কোনদিন ভালো করতে পারবে না মা। কবে না জানি তুঁষে’র লা*শ নিয়ে চৌকাঠে আসে।

ওর মা ঝট করে ছেড়ে দেন আদনান’কে। আদনানে’র ঠোঁটে তখন দেখা মিলছে দুর্বোধ্য হাসি। ওর মা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলেন। আদনান মায়ের হাতের তালুতে চুমু খেয়ে বললো,

— যাও মা। ঘুমাও। ভাই ঠিক আছে। যাও।

নির্বোধের ন্যায় উঠে দাঁড়ায় ওর মা। দুই পা ফেলে দরজার দিকে এগিয়ে ও যান। পরবর্তী পা ফেলা হলো না। আদনানে’র দিকে তাকিয়ে বললেন,

— ও কি কখনো ভালো হবে না?

— চিকিৎসক নিজে অসুস্থ হলে তার রোগ সারাবে কে?

ওর মা আর অপেক্ষা করে না। রুম থেকে চলে যান। বালিশে মুখ গুজে দেয় আদনান। বলিষ্ঠ দেহটা কাঁপছে তার ক্ষণে ক্ষণে। কেন সে ভালোবাসা পেলো না? মানুষ তো সুরত দেখে ভালোবাসে। তাহলে তার তুঁষ কেন আটকালো না? আরহাম আর ওর মাঝে চেহারার পার্থক্য টা কোথায়? আদনানে’র মনটা যেন হঠাৎ ই উত্তর দিলো, “ভালোবাসা সুরত দেখে না”।
___________________

নিজের পিঠে ভারী কিছু অণুভব হতেই আরহামের ঘুম কিছুটা ছুটে যায়। তুলতুলে একটা র*ক্তে মাংসে গড়া অস্তিত্ব তার উপর টের পাচ্ছে সে। কোন নড়চড় নেই অস্তিত্বটার মাঝে। আরহাম নিজেই একটু নড়লো। তবুও ওর উপরে থাকা তুলার বস্তাটা নড়লো না। সে ঠাই মে’রে আরহামের পিঠে’র উপর শুয়ে আছে। আরহাম ঘুম জড়ানো কন্ঠে ডাকলো,

— তুঁষ?

ধ্বক করে উঠে তোঁষা’র ছোট্ট বুকটা। এই ডাকটা যেন তার হৃদয় এফারওফার করে দিচ্ছে। আরহাম তোঁষা’র জবাব না পেয়ে পুণরায় বললো,

— কি হয়েছে প্রাণ?

তোঁষা এবারের ও নিশ্চুপ। আরহাম এবার তোঁষা’কে এক হাতে পেঁচিয়ে পল্টি দিয়ে ঘুরলো। অবস্থান পেলো তোঁষা আরহামে’র বুকে। নিজের মুখটা আরহামের মুখের উপর নিয়ে বেজার মুখে বললো,

— বোর হচ্ছি আরহাম ভাই। চলুন না ঘুরতে যাই।

— ঘুরতে যাবি?

— হু।

— কোথায়?

তোঁষা ভাবছে কোথায় যাওয়া যায়। একুল ওকুল ভেবেও গতি যখন পেলো না তখন উৎফু্ল্ল চিত্তে বললো,

— আপনি যেখানে নিবেন সেখানেই যাব।

–যেখানে নিব সেখানেই।

— হ্যাঁ তো। উঠুন না। আমার একা ভালো লাগছে না।

আরহাম নিজের সরু দৃষ্টি ফেলে তোঁষা’কে দেখে যাচ্ছে। এক হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিচ্ছে তোঁষা’র আধ ভেজা চুল। মেয়েটার এই দীর্ঘ কেশ অনেক পছন্দ আরহামে’র। তোঁষা ও অনেক যত্ন করে চুল গুলোর। আরহামের উপর ঝুঁকে থাকাতে কিছু সংখ্যক চুল আরহামের মুখে চলে এলো। তোঁষা হাত দিয়ে তা আরহামে’র মুখ থেকে সরাতে নিলেই আরহাম থামিয়ে দিলো। তোঁষাটা’র চুল থেকেও কেমন একটা ঘ্রাণ আসে। এতবছর দূরে থাকলেও আরহাম ভুলে নি তার তুঁষে’র ঘ্রাণ। যেই ঘ্রাণ আগে লুকিয়ে চুপিয়ে নিতো সেই ঘ্রাণ এখন ও কাছ থেকে পাচ্ছে। এই তুঁষ’টার ঘ্রাণ ও কেমন একটা শীতলতা অনুভব করায় ওর প্রাণে।
তোঁষা পুণরায় তাড়া দিলো,

— এএই আরহাম ভাই?

— উউম।

— আর কতক্ষণ?

— আয় ঘুরাই তোকে।

বলেই আরহাম তোঁষা’কে কোলে তুলে উঠে দাঁড়ালো। তোঁষা হেসে আরহামে’র গলা জড়িয়ে ধরে। আরহাম ওকে নিয়ে পুরোটা ফ্লাট জুড়ে হাটলো। আনাচে কানাচে সব জানালো। প্রায় ঘন্টা খানিক যখন পার হবে তখন শেষ হলো ওদের ঘুরা। আরহাম এখানে খুব সুক্ষ্মভাবে এরিয়ে গিয়েছে তোঁষা’কে ঘুরতে নেয়ার ব্যাপারটা। তোঁষা অতশত খেয়াল করলো না। সে মজা পেয়েছে এভাবে আরহামের কোলে চড়ে ঘুরতে।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতেই আরহাম তোঁষা’কে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসালো। তোঁষাটা’র হাটু সমান চুলগুলো সুন্দর করে আঁচড়ে দিতে দিতে তাকালো তোঁষা’র পানে। মেয়েটা সারাটাক্ষন আরহাম’কে দেখে। কি যে দেখে আল্লাহ মালুম। এই যে আজ দুটো দিন হতে চললো অথচ তোঁষা দেখেই যাচ্ছে আরহাম’কে। আরহাম যে ওকে আরো গভীর ভাবে দেখে তা কি তোঁষা জানে বা টের পায়? পায় না বোধহয়। পেলে নিশ্চিত লজ্জায় ম’রে যেতো।
তোঁষা হঠাৎ ই প্রশ্ন করলো,

— আরহাম ভাই, আপনি কি ডাক্তারি ছেড়ে দিয়েছেন?

— এটা কেন মনে হলো তোর?

— জিজ্ঞেস করলাম?

— কাজ ছেড়ে দিলে বউ খাওয়াব কি দিয়ে?

— দেশে জয়েন করেছেন?

— হু।

তোঁষা কথা বাড়ালো না।
আরহাম এদেশে থেকে ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিলো কিন্তু দুই বছর যেতেই দেশের বাইরে পারি জামায় সে। তোঁষা শুধু জানে ওর আরহাম ভাই ডক্টর হওয়ার সুযোগ পেয়েছে তাই গিয়েছে কিন্তু পুরো শেখ পরিবার জানে আসল ঘটনা। খুব সাবধানে তারা তোঁষা থেকে আড়াল করে রেখেছে এতগুলো বছর। আরহামের সাথে প্রথম প্রথম তোঁষা’কে যোগাযোগ করতে দিলেও পরে তা কমিয়ে দেয়া হয়। আরহাম জিজ্ঞেস করতেই তাকে জানানো হয়, তোঁষা’র পড়াশোনায় প্রভাব পড়বে এত বেশি কথা বললে। আরহাম মেনে নেয়। তার তুঁষ’টাকে পেতে সবটুকু কথা মেনে নেয় পরিবারের। টু শব্দ করে না। কিন্তু চঞ্চল প্রাণ তোঁষা’কে থামাতে পারে নি কেউ। নিজের ফোন না থাকায় রাতে বাবা, ভাইয়ের ফোন লুকিয়ে এনে আরহাম’কে কল দিয়ে কথা বলতো। কখনো প্রেমের আলাপ জমতো না তাদের মাঝে। যা ছিলো বা থাকতো সবটা ছিলো তোঁষা’র বাচ্চামো কথাবার্তা। আরহাম শুনতো। মাঝেমধ্যে হু হা যা বলা তা বলতো। তোঁষা’র তখন উঠতি বয়স। ভালো লাগতো সব কিছু।
শেখ বাড়ীর সবাই ভেবেছিলো সময়ের সাথে সাথে তোঁষা আরহাম’কে ভুলে যাবে কিন্তু না এমন কিছুই হয় নি বরং তোঁষা দিন কে দিন আরো গভীর ভাবে ডুবে থাকতো আরহামে’র ভাবনায়। যেটা কে সবাই তোঁষা’র আবেগ বলে আখ্যা দিয়েছিলো সেটা পরবর্তী’তে রুপ নিয়েছিলো ভালোবাসায়। একসময় পাগলামিতে।

#চলবে……

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৭

শেখ বাড়ীর সকলের চোখে মুখে বিষাদ লুকোচুরি খেলা করছে। বাড়ীটা যেন আস্ত এক ম’রা বাড়ী। বলা যায় গত কয়েক মাস ধরেই এটা ম’রা বাড়ী হয়ে ছিলো তবে এখন যেন মৃতপুরী’তে রুপান্তর হয়েছে। হাজার তোঁষা বিগত মাস কয়েক চুপচাপ থাকতো, হুটহাট সবার সামনে এসে আবদার করতো আরহামে’র জন্য, মাঝেমাঝে তেঁজী রুপ দেখা যেতো ওর। কিন্তু এখন? সবটা নিঃস্তব্ধতার চাদরে মুড়ানো। তাদের পুতুল নেই তাদের কাছে। সবাই জানে সে কোথায়, কার সাথে আছে কিন্তু তাদের হাত বাঁধা। তুহিন আর তুরাগ দুই ভাই গত দুই’টা দিন ধরে কম তো খুঁজলো না। পুলিশ জানিয়েও লাভ হয় নি। তারা জানে হবেও না। আরহাম প্রচন্ড ধুর্ত এক ছেলে। সে কোথায় লুকিয়েছে তা জানা মুশকিল। তবে এটা ভেবে তারা কিছুটা হলেও সস্তি’তে আছে যে আরহাম আর যা ই হোক এখন পর্যন্ত তোঁষা’কে কিছু করে নি। হঠাৎ কলিং বেল বাজতেই তুঁষা’রের মা দরজা খুলেন। পুলিশ অফিসা’র দেখেই স্বামী’কে ডাকতে চলে আসেন ভেতরে। ততক্ষণে আদনান এগিয়ে এসে তাদের ভেতরে আনলো।
বাড়ী’র পুরুষ’রা সকলে সোফায় বসা। তাদের সামনে টেবিলে ল্যাপটপে চলছে একটি ভিডিও যাতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে তোঁষা পার্লার থেকে পালিয়ে নিজে গিয়ে একটা গাড়ীতে চড়ে বসছে। তবে এর আগে আদনান পার্লারে ঢুকেছে। আদনান সেটা দেখেই চমকে উঠে বললো,

— ভাই।

পুলিশ অফিসার নিজেও ব্যাপারটা নিয়ে বিভ্রান্তি’তে ছিলেন৷ তিনি ভেবেছিলেন ওটা আদনান তবে না সেটা ছিলো আরহাম যে আদনান সেজে পার্লারে ঢুকেছিলো। হয়তো তখনই কোনভাবে তোঁষা’র সাথে যোগাযোগ করেছে যার দরুন তোঁষা পালাতে পেরেছে।
সবটা শুনে অফিসার তুরাগে’র দিকে তাকিয়ে বললেন,

— স্যার এখানে কিডন্যাপ এর মতো কিছুই নেই। তোঁষা নিজে পালিয়েছে। সবটা পরিষ্কার। কোন ক্লু এর ভিত্তিতে তোঁষা’র খোঁজ করব?

তুহিন চুপ করে গেলেন আর তুরাগ সে নিজের ছেলের কৃতকর্ম দেখে বাকহারা। তোঁষা’র মা দূর থেকেই মেয়ের পালানোর দৃশ্য দেখে মুখে আঁচল গুজে কাঁদছে। আরহামের মা দুই হাতে নিজের সাথে জাপ্টে ধরেন তাকে। কাঁদতে কাঁদতে তিনি শুধু বললেন,

— ভাবী মেয়েটাকে বিয়ের সকালেও মে’রেছি আমি। ও ভাবী ও কি আর ফিরবে না? আমার বুকটা কেমন করছে ভাবী। আমার পুতুল।

তুঁষা’রের কানে যাচ্ছে মায়ের কান্না। তবে তার চতুর মস্তিষ্ক দেখছে অন্য কিছু। স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকেই সে প্রশ্ন করলো,

— তোঁষা’র নাকে, মুখে র*ক্ত কিসের?

হঠাৎ এহেন প্রশ্নে চমকে তাকান সকলে। হ্যাঁ তাই তো। কেউ কেন খেয়াল করলো না বিষয়টা না। পার্লার থেকে বের হলে কেন তোঁষা’র নাকে, মুখে র*ক্ত আর কেন ই বা এক হাতে পেটের দিকে চেপে রেখেছে? এত এত প্রশ্ন অথচ উত্তর শূন্য।

অফিসার বিদায় হতেই ধপ করে বসে পরে তুহিন। তুরাগে’র মুখে ভাষা নেই ছোট ভাই’কে কিছু বলার বা সান্ত্বনা দেয়ার। আরহাম’কে কিছুতেই সহজে নেয়া যাচ্ছে না। তবে এটাও ঠিক এখন পর্যন্ত সে হয়তো তোঁষা’র গায়ে মশার কামড় ও পরতে দেয় নি তবে সামনে কি হতে পারে তা ভাবতেই যেন গা শিওড়ে উঠছে। আদনান দুই হাতে মাথা চেপে ধরে কিছুক্ষণ বসে থেকে উঠে দ্রুত পায়ে রুমে চলে গেল। এখানে টিকা যাচ্ছে না আর। কিছুতেই না।
তুঁষা’র এতক্ষণ চুপ থাকলেও হঠাৎ বললো,

— এই সপ্তাহে চলে যাচ্ছি চাচ্চু।

তুরাগের দৃষ্টিতে হতভম্বতা। আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

— চলে যাচ্ছো মানে?

— ক্যাম্পে যাচ্ছি।

তুহিন মাথা তুলে ছেলের দিকে অসহায় দৃষ্টি ফেলেন। তুঁষা’র সেটা দেখে নির্লিপ্ত গলায় বললো,

— এভাবে তাকিয়ে লাভ নেই আব্বু। আমি বহু আগেই তোমাকে বলেছিলাম। শুনো নি। এখন ভুগো। আমার কথা শুনলে অন্তত আজ আমার পুতুল আমার বুকে থাকতো।

বলেই হনহনিয়ে রুমে চলে যায় তুঁষা’র। বোনের জন্য তার হৃদয়ে যে ভালোবাসা তা শুধু মাত্র ভাইয়ের না বরং তোঁষাটা’কে নিজের সন্তানের মতো ভালোবাসে তুঁষা’র। না চাইতেও বারবার মনে হয় এই বুঝি মাস গড়াতেই আরহাম তার পুতুল’টার প্রাণহীন দেহ নিয়ে হাজির হয়। ভাবতেই তুঁষা’রের হাত-পা শীতল হয়ে আসে। মনকে বুঝ দেয় এখন পুতুল ভালো আছে। আরহাম যেমন তোঁষা’কে বুকে করে রাখবে ঠিক তেমনই ঐ বুকে তোঁষা’র সমাধি দিতেও পিছু পা হবে না।

________________

পাখির কিচিরমিচির শব্দ শুনা যাচ্ছে তবে দূর থেকে। ফুরফুরে বাতাস তেড়ে আসছে রুমে। আরহাম ঘুম জড়ানো চোখে একবার তাকালো। জানালা লাগানো তবে বারান্দার থাইটা একটু খোলা। তা দিয়ে ই এমন বাতাস আসছে। পাখির শব্দ এই বাইশ তলার উপর ঠিকঠাক শুনা যায় না তবে শীত হওয়াতে কিছুটা টের পাওয়া যাচ্ছে। ঠান্ডা বাতাস তোঁষা’র গায়ে লাগবে ভাবতেই আরহাম তাকালো। আরহামের বাহুর ভেতর ঢুকে বিড়াল ছানার ন্যায় গুটিয়ে তার বুকে মিশে আছে তোঁষা। ঘুম ঘুম মুখটাতে আরহামের হাসি। তৃপ্তিময় এক হাসি। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলো তোঁষা’র ফুলা গালটা। আরহামের চোখটা হঠাৎ জ্বলে উঠলো যেন। বছরের পর বছর কিভাবে পার করেছে তা কেবল আরহাম জানে। এই তোঁষাটা’কে ছাড়া বহু কষ্টে দেশের বাইরে থেকেছিলো সে। মনে বিশ্বাস ছিলো সে সফল হয়ে ফিরার পর তোঁষা’কে পাবে। নিজের করে। কিন্তু না, ধোঁকা খেলো খুব বাজে ভাবে। একজন সফল, ক্ষ্যাতিমান সাইকিয়াট্রিস্ট হওয়ার পরও শেখ বাড়ীর সকলে মিলে কি ধোঁকাটাই না দিতে চাইলো।
চোখ গড়িয়ে এক ফোঁটা পানি পরতেই আরহাম তোঁষা’র মাথায় মুখ দিয়ে রাখলো। তোঁষা আরেকটু জড়িয়ে নিলো নিজেকে আরহামে’র সাথে। সায় পেয়ে আরহামের বন্ধনী দৃঢ় হলো আরো। তোঁষা তখন অল্প ব্যাথা পেলেও কিছু বললো না। হোক না মরণ, বুকটা তার প্রাণে’র হলেই শান্তি।
.
আরহাম’কে তৈরী হতে দেখেই তোঁষা’র মন খারাপ হয়ে এলো। এদিক ওদিক ঘুরঘুর করছে ও। আরহাম আড় চোখে সবটা দেখছে তবে চুপচাপ কাজ করে যাচ্ছে। তোঁষা উৎসুক দৃষ্টি ফেলে এবার আরহামে’র কাছে আসতেই আরহাম টাইটা বাড়িয়ে দিলো ওর দিকে। তোঁষা যদিও টাই বাঁধতে পারে না তবুও এতক্ষণে আরহামে’র মনোযোগ পেয়ে সে টাই’টা হাতে তুলে নিলো। আরহাম থেকে অনেকটা খাটো হওয়ার দরুন তোঁষা নাগাল পাচ্ছে না তাকে। আরহাম দেখলো তোঁষা’র চেষ্টা। পায়ের তালু উঁচু করে সে চেষ্টায় আছে আরহামের টাই বাঁধতে। আরহাম ব্যাপারটা সহজ করলো ওর তুঁষে’র জন্য। দুই হাতে কোমড় জড়িয়ে উঁচু করে নিজের বরাবর করে দিলো। তোঁষা তখনও চেষ্টায়। বেচারী এতশত চেষ্টার পর ও যখন পারলো না তখন মুখটা পেঁচার মতো করে বললো,

— পারি না তো।

— চেষ্টা কর।

— করলাম তো।

— আবার কর।

এবার আরহাম গাইড করলো আর তোঁষা বাঁধলো। পাঁচ মিনিট লাগিয়ে সুন্দর করে তোঁষা কাজটা সম্পূর্ন করেই বিজয়ের হাসি হাসলো। উঁচু হওয়ায় আরহামের গলা জড়িয়ে উচ্ছাসিত গলায় বললো,

— আরহাম ভাই! বেঁধেছি আমি।

— হু। তুই বেঁধেছিস।

এগিয়ে একটু কাছাকাছি হলো আরহাম। তোঁষা ও নিজের মুখটা এগিয়ে নিতেই আরহাম ওর বোঁচা নাকে একটা চুমু খেয়ে বললো,

— আমার বুঁচি।

তোঁষা আবার বিনিময়ে একদম পাকা। নিজেও ঠেসে এক চুমু খেলো আরহামে’র গালে। পরপর নাকে দিয়ে বললো,

— আমার খাঁড়া নাক ওয়ালা শেখ সাহেব।

আরহাম হেসে ফেললো এহেন সম্মোধন শুনে। তোঁষা মুখটা ভোঁতা করে আরহামে’র চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— কখন ফিরবেন?

— ফিরার জন্য তো আগে যেতে হবে।

তোঁষা মুখ গোমড়া করেই রাখলো। আরহাম নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো তোঁষা’র দেহটাকে। কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,

— শিঘ্রই ফিরব প্রাণ।

তোঁষা আরহাম’কে দরজা পর্যন্ত বিদায় দিতে চাইলেও তা সম্ভব হলো না। তোঁষা’কে ভেতরে রেখে বাইরে দিয়ে মেইন ডোর লক করে গিয়েছে আরহাম। বারবার তোঁষা’কে তোতাপাখি’র মতো বলেছে যাতে দরজা না খুলে, বারান্দায় না যায়, রান্না ঘরে না যায় সহ এত কথা। তোঁষা সবটা শুনেছে। তবে এখন আর ভালো লাগছে না ওর। কিছুতেই না। পরপর তিনটা ঘন্টা পার হতেই ওর মন মেজাজ খারাপ হওয়া শুরু করলো। পায়চারি করতে করতে এলো আলমারি’র সামনে। খুলে হাতে নিলো আরহামে’র শার্ট। আলগোছে সেটা নিয়ে বিছানায় যায় তোঁষা। শার্টে নাক ডুবিয়ে চেষ্টা করে ঘ্রাণ নেয়ার। হায়! এতটা মাদকীয় কোন পুরুষের ঘ্রাণ হয় নাকি?

#চলবে…..

[ গল্পটা কাল্পনিক তাই সেভাবেই ভাবুন ]

প্রিয় প্রাণ পর্ব-৪+৫

0

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৪

“বয়স আঠারো হয় নি। এখনই পুরুষ দরকার তোর?”

ঝাঁঝালো বাক্যটা শুনে তোঁষা থমকে যায়। এই কথার ইঙ্গিতটা ঠিক কতটা বাজে তা বুঝতে ওর বেশি মাথা খাটাতে হয় নি। তোঁষা যেন একদম থমকে আছে এহেন বাক্য শুনে। কি বললো এটা মা? তোঁষা’কে চুপ থাকতে দেখে ওর মা এবার ওর বাহু চেপে ধরে বললো,

— কথা বল তোঁষা!

তোঁষা কথা বলবে? কিন্তু কিভাবে? আজ ভাষা গুলো গোছানো যাচ্ছে না কিছুতেই। কোনদিন উচ্চবাক্য ব্যায় করে নি ওর মা। নিজের সতেরো বছরের জীবনে তোঁষা কখনো শুনে নি ওর মায়ের উঁচু গলা। সবসময়ের মিষ্টভাষী ওর মা। ভদ্রমহিলা স্বামী থেকে অনেকটাই ছোট। পার্থক্য না হলেও বছর বিশ তাদের। তুহিন তাকে সবসময় আদরে আদরে রেখেছে। এক মাত্র সন্তান কি না তার প্রিয়তমা নিজের মা-বাবার। হাজার রাগ উঠলেও কোনদিন তুহিন স্ত্রী’র সাথে মন্দ ব্যাবহার করেন নি কিন্তু পরিস্থিতির সাপেক্ষে গতকাল হাত তুলেছিলেন। কতটা অনুতপ্ত সে তা রাতেই টের পেয়েছেন তোঁষা’র মা। তুহিন তাকে ঘন্টার পর ঘন্টা বুকে জড়িয়ে ছিলেন। তার অনেক সখের নারী বলে কথা। তোঁষা’র মা সবটা সময় ধরে ছিলো নির্বাক। তার মুখ থেকে বের হয় নি কোনরূপ বাক্য। তুহিন যেন অস্থির হয়েছিলেন তাতেই।
পনেরো বছরের এক অপরিপক্ক কন্যা এনে দিয়েছেলেন তার মা তাকে। সেই কন্যা থেকে ভালোবেসে, আদর, যত্নে, পেলে পুষে তুহিন ই তো নারী করলো তাকে। কিভাবে যেন একটা ভুলে তুঁষা’র টা এসে পরলো। এতে ক্ষতি বলতে শুধু ছুটে গেল তোঁষা’র মায়ের পড়াশোনা। তুহিন অবশ্য অনেক কষ্টে এইচএসসি টা দেয়ালো বউ দিয়ে। সেই নিয়ে ও তো তার মা কম চিল্লান নি। তুহিন তখন একরোখা জেদ করে তার স্ত্রী’কে পড়াশোনা করিয়েছেন। তুঁষা’র ছিলো প্রচুর চটপটে তাই তো ইচ্ছে থাকলেও আর উপায় হলো না। তারপর? কতগুলো বসন্ত এলো। থাকলো। চলে গেল। যখন পরিপূর্ণ, পরিপক্ক এক রমণী তুহিনের সেই স্ত্রী তখন জন্ম তোঁষা’র। সারাটা বাড়ীতে তখন খুশির ঝলক। এর অবশ্য কারণ ও ছিলো। শেখ বাড়ীতে না হলেও এক যুগের বেশি পর নতুন কেউ আসতে চলেছিলো। তুহিনকে তখন পায় কে? তখনকার ঐ বয়সেই সে যেন পাগল হয়ে যাবে খুশিতে।
যখন খবর পেলো পরী আসবে তখন যেন পাগলামো বাড়লো বহুগুণ। তুঁষা’র তখন যথেষ্ট বুঝদার। ওর মা অবশ্য লজ্জা পাচ্ছিলো। কিন্তু জা, ভাসুর এদের এত এত ভালোবাসা আর তুহিনে’র আদরে সবটা যেন সহজ হয়ে গেলো। শাশুড়ী তখন বেশ বৃদ্ধ। তোঁষা’র জন্মের চারদিন পর ইহকাল ত্যাগ করেন তিনি।

শেখ বাড়ীর সদস্য সংখ্যা তোঁষা’র আগমনে হলো আটজন। তোঁষা’র বড় চাচ্চু তুরাগ শেখ। তার স্ত্রী এবং দুই ছেলে সন্তান আরহাম এবং আদনান। আর এদিকে তুহিন আর তার স্ত্রী দুই সন্তান। একই ছাদের নীচে তাদের বসবাস। প্রাণোচ্ছল পরিবারটাতে সাজানো এক পুতুল হয়ে এসেছিলো তোঁষা। একমাত্র মেয়ে হওয়ার দরুন যে থাকত সকলের চোখের পাতায়।

সেই তোঁষা’কে উপরিউক্ত কথাটি তার মা বলেছে। তোঁষা’র বাহু চেপে দ্বিতীয় বার তিনি বলে উঠেন,

— তোর বিয়ে তো আমিই দিবই তোঁষা। তোর যখন এতই পুরুষ প্রয়োজন সেখানে তোকে বিয়ে না দিয়ে আমি কেন পাপিষ্ঠ হব?

— আরহা….

তোঁষা’র চোয়াল চেপে ধরে ওর মা। শক্ত কন্ঠে বলেন,

— একদম চুপ!! কে আরহাম? হ্যাঁ! কে আরহাম? ওর নাম মুখে আনবি না। তোর বাপ তোর খাটিয়া কাঁধে তুলতে রাজি কিন্তু আরহামের সাথে তোর বিয়ে দিতে না।

তোঁষা বড়বড় চোখ দিয়ে ওর মা’কে দেখে নিলো। এতটা হিংস্রতা ওর মায়ের মাঝে কখনো দেখি নি ও। গালে ব্যাথা পেতেই ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে শুধু বললো,

— আম্মু.. ব্যাথা পাচ্ছি।

ওর মা ঝট করে ছেড়ে দিলেন। অবিশ্বাস্য চোখে দেখলেন তার পুতুলের গালটা। তার দুই হাতের আঙুলগুলো ডেবে আছে গাল জুড়ে। তখনই আদনান রুমের বাইরে থেকে বলে,

— চাচি?

তোঁষা’র মা যেন চোর ধরা পড়ার ন্যায় পালিয়ে গেলো মেয়ের রুম থেকে। দুই হাতে মুখ চেপে কান্না আটকানোর চেষ্টা করলো। গতরাতে স্বামী’র আদর পেয়ে তার সকল অপরাধ ভুলে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন তিনি। তুহিন শেষ আবদার করেছিলো তাকে,

— আমার পুতুলটাকে কিভাবে বাঁচাব প্রাণ? বলো তো?

তোঁষা’র মা শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন স্বামী’কে। আশ্বাস দেন সামলাবেন সবটা। কিন্তু এখন? তার পুতুলের গালে ঐ দাগটা তার হাতের করা। কথাটা ভাবতেই চোখ দিয়ে পানি পরে তার।

আদনান ধীর পায়ে রুমে প্রবেশ করতেই তোঁষা মুখ তুলে তাকায়। টলমলে চোখে অনুরোধ করে,

— আদনান ভাই, আরহাম ভাই’কে বলুন না আমার কথা।

আদনান মুখ চোখ শক্ত করে তাকায়। তোঁষা উঠে বিছানা ছাড়ে। আদনানের কাছে এসে পুণরায় অনুরোধ করে বলে,

— আপনার ফোনটা একটু দিন না আদনান ভাই। আমি শুধু একবার কথা বলব তার সাথে।

— তোর সাথে কথা আছে তুঁষ।

তোঁষা বিরস মুখে তাকায়। এই “তুঁষ” নামে এই দুই জন ব্যাক্তি ই ডাকে তাকে। নাক টানে তোঁষা। ভেজা গলায় বলে,

— সব কথা শুনব আমি। এই যে ওয়াদা করছি। আগে একবার কথা বলিয়ে দিন না।

আদনান তোঁষা’র মুখপানে তাকায়। ফুলা গাল দুটো লাল হয়ে গিয়েছে। মাত্রই চাচি এ কাজ করেছে তা ওর জানা। আদনান হাত বাড়াতেই তোঁষা দুই পা পিছিয়ে যায়। বাড়ানো হাতটা নিমিষেই গুটায় আদনান। গম্ভীর কণ্ঠে শুধু বলে,

— সবার কথা মেনে নে তুঁষ। আরহাম কোনদিন তোর হবে না।

তোঁষা যেন মুহূর্তেই রেগে যায়। নাকের ডগা লাল হয়ে আসে। কম্পমান গলায় অগ্নি চক্ষু দিয়ে তাকিয়ে বলে,

— কেন হবে না? একশত বার হবে। হাজার বার হবে। আরহাম ভাই আমার ই হবে। তোমারা সবাই মিথ্যুক। জঘণ্যতম মিথ্যার আশ্রয় নিয়ে তাকে দূর করেছো।

তোঁষা যেন রাগের মাথায় কাঁপতে থাকে অনবরত। ধৈর্য ধরে আদনান বোঝাতে চেষ্টা করে কিন্তু তোঁষা মানবে না কিছুতেই। অতিরিক্ত উত্তেজিত হয়ে হাতের সামনে থাকা পেপার ওয়েটটা আদনানের দিকে ছুঁড়ে মা’রতেই আদনান ওর হাত চেপে ধরে। ধমকে উঠে বলে,

— পাগল হয়েছিস? কি করছিস? খু*ণ করবি আমাকে?

তোঁষা’র মুখ তখন লাল হয়ে আছে। অস্থির হয়ে নিজেকে ছাড়াতে আদনানের বুকে ধাক্কা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। আদনান হাজার চেষ্টা করেও লাভ হয় না। ততক্ষণে তুঁষা’র ও বোনের চেঁচামেচিতে রুমে আসে। তোঁষা’কে ওমন অবস্থায় দেখে দৌড়ে রুমে এসে বুকে জড়িয়ে লাল চোখ দিয়ে আদনান’কে দেখে। তোঁষা রাগে কষ্টে ফুঁপাতে থাকে ভাইয়ের বুকে। তুঁষা’র ওকে ঠান্ডা করতে মাথায় হাত বুলায়। তোঁষা বাবাসম ভাইয়ের বুকের দিকটা খামচে ধরে ফুঁপাতে ফুঁপাতে বলে,

— তুমি যাবে না ভাই। বলো যাবে না। এরা কেউ ভালো না। কেউ না। আমাকে আরহাম ভাইয়ের কাছে নিয়ে যাও। আমি থাকব না এখানে।

তুঁষা’র বোনকে আগলে রাখে। চোখের ইশারায় আদনান’কে রুম ছাড়তে বলতেই আদনান চলে যায়। তুঁষা’র বোনকে আগলে নিয়ে বিছানায় বসে। চোখ মুছিয়ে দিতেই তোঁষা কাঁদতে কাঁদতে অভিযোগ জানায়,

— আমাকে সবাই মা’রে এখানে ভাইয়া। আমি থাকব না আর। দেখো গালে আম্মু মা’রলো এখন। তোমার সাথে নিয়ে চলো আমাকে।

তুঁষা’র যথেষ্ট সামর্থ্যবান একজন সুপুরুষ। বর্তমানে আর্মিকে আছে ট্রেইনার প্লাস অফিসার হিসেবে। এবার বাসায় আসার কারণটা তার ভিন্ন। তোঁষা’টার জন্যই আসা হলো এবার নাহলে এত তারাতাড়ি ফিরত না ও। বোনের গালে আলতো হাত ছুঁয়ে আদর করে তুঁষা’র। পুরুষনালী ভারী গলাটা বড্ড আদুরে শুনায়,

— বেশি ব্যাথা করছে পুতুল?
.
বড় ভাইয়ের কথা মনে পরতেই তোঁষা’র মনটা খারাপ হয়ে যায়। নজর দেয় ওয়াশরুমের দরজার দিকে। সাওয়ার দিয়ে পানি পড়ার শব্দ হচ্ছে। এরমানে আরহাম তখনও গোসল করছে। তোঁষা মাথায় টাওয়াল পেঁচিয়ে রাখা। মাত্রই গোসল করেছে ও। ওর নিজের ঠান্ডা লাগছে কি না বুঝা যাচ্ছে না তবে আরহাম ভাই বলেছে,”তুঁষ অনেক ঠান্ডা। তারাতাড়ি আয় এদিকে”।
অতঃপর তোঁষা’কে কম্বলের নিচে ঢুকিয়ে ঢেকে ঢুকে নিজে ওয়াসরুমে গিয়েছে। তোঁষা এক পলক এদিক ওদিক তাকালো। গতরাতে এখানে আসা হলেও এখন পর্যন্ত রুমটাই ভালোভাবে দেখা হয় নি ওর। চোখ গোল গোল ঘুরিয়ে দেখে নিলো তোঁষা। সাদা রঙের দেয়াল কিন্তু বেড সাইডের দিকে আর্টিস্টিক ছোঁয়া। সম্মুখেও সুন্দর করে ডেকোরেট করা দেয়াল। প্রয়োজনীয় কাবার্ড সহ এই কাউচ আর একটা ভ্যানিটি। তোঁষা এখনও জানে না এই ফ্লাট বা রুম আরহামের কি না? তবে রুমের রুচিসম্মত আসবাবপত্র দেখে তোঁষা নিশ্চিত এটা ওর আরহাম ভাই এর ই রুম। বাসায় ও তার রুমটা এমন ঝকঝকা ফকফকা থাকতো। তোঁষা দৌড়ে যেয়ে তার নরম গদিতে ঝাঁপিয়ে পড়তো ছোট থাকতে। সবার জন্য আরহামের রুমে অনুমতি ব্যাতিত প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকলেও তোঁষা’র ক্ষেত্রে ছিলো তা সম্পূর্ণ ব্যাতিক্রম।
কাঁচ দেয়া দেয়ালটার দিকে তাকালো তোঁষা। শীতের দিন বিধায় রোদ উঠেছে দেড়ীতে কিন্তু চলে যাচ্ছে তারাতাড়ি। আরহাম গোসল সেড়ে বের হতেই তোঁষা’র নজরে এলো তার আরহাম ভাই’কে। ড্যাবড্যাব করে তাকিয়েই রইলো ও। কোন রোকঠোক নেই ওর দৃষ্টিতে। বেহায়া, বেপরোয়া চোখটা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে যাচ্ছে যতটা দেখা যায়।
সাদা টাওয়াল কাঁধে ঝুঁলিয়ে নাভির নিচে টাউজার পড়ে বের হ’য়েছে আরহাম। তোঁষা নির্লজ্জ হয়ে তাকিয়ে রয়। দেখতে থাকে খুঁটিয়ে। লম্বা চওড়া পেটানো শরীরের পুরুষ আরহাম। চওড়া কাঁধ আর সুদর্শন মুখটা তোঁষা’কে যেন খুব করে টানে। বুকে লেপ্টে থাকা কুচকুচে কালো লোম গুচ্ছ ও যেন বাদ গেলো না। তারা ডাকছে তোঁষা’কে। বারবার বলছে, “দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পর এই বুকে তোঁষা। এই বুকটাতে নাক ডুবিয়ে শ্বাস টেনে নে। কম তো কষ্ট করিস নি”।
তোঁষা শুনে মনের কথা শুনলো৷ কেন শুনবে না? এতটা বছর অন্যর কথা শুনে কি লাভ হলো? ধোঁকা ছাড়া কি পেলো তোঁষা? কিছুই না।
আরহাম মাত্রই তাকালো তোঁষা’র দিকে ওমনিই তোঁষা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে আরহাম’কে। নাক, মুখ ডুবিয়ে দেয় বুকে। টেনে নেয় শ্বাস বুক ভরে।
আরহাম চোখ বুজে। ওর সার্বাঙ্গ যেন শিউরে উঠে প্রবলভাবে। জড়িয়ে নেয় তোঁষা’কে নিজের সাথে। তোঁষা ও চেষ্টা করে যতটুকু ধরা যায়। আরহামের ঠোঁটে হাসির ঝলক দেখা যায়। ওর চাওয়া গুলো পূরণ হচ্ছে একটু একটু করে। তুঁষ’টা ও তার হচ্ছে একটু একটু করে। আরহাম নিজের বাহু বন্ধনে আটকে থাকা রমণীর মুখটা তুলে। তোঁষা ধীমি স্বরে জানায়,

— আপনার শরীরের ঘ্রাণ এত মাতাল মতাল কেন আরহাম ভাই?

#চলবে…..

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৫

তোঁষা পুরো বাড়ীটা ঘুরে ঘুরে দেখছে। আরহাম কিচেন থেকেই একবার গলা উঁচিয়ে বললো এদিক ওদিক না ছুটতে। তোঁষা বুঝি শুনে? নিজের মতো এদিক ওদিক দেখছে ও। বড় একটা ড্রয়িং রুম পুরোটা গোছালো। গতকাল আরহাম ওকে এখানে এনে বেডরুমে আটকে রেখেই কোথায় যেন চলে গিয়েছিলো। তোঁষা’র দেখা হয় নি কিছুই। ওদের বেড রুম ছাড়াও আরো রুম আছে। হঠাৎ তোঁষা চিৎকার করতেই হাতের কাজ ফেলে দৌড়ে বের হয় আরহাম। মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তোঁষা ব্যালকনিতে। আরহাম অস্থির হয়ে ওর হাত টেনে নিজের কাছে এনে প্রশ্ন করে,

— কি হয়েছে তুঁষ? চিৎকার করলি কেন?

তোঁষা’র বিষ্ময় যেন কাটছেই না। আরহাম ওর বাহু ঝাঁকাতেই তোঁষা মুখ ফুটে জিজ্ঞেস করলো,

— আমরা কোথায়?

ঢোক গিললো আরহাম। কিছুতেই তোঁষা’কে বলা যাবে না ওরা কোথায় আছে এখন। তোঁষা পুণরায় জিজ্ঞেস করতেই আরহাম পাল্টা প্রশ্ন করে,

— কি হয়েছে? বল আমাকে।

— আমরা কত তলায় আছি?

— বাইশ।

তোঁষা যেন ধাক্কা খেলো একটা। বাইশ তলার উপরে কি না ওরা? বিস্ফোরিত চোখে আরহামের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

— কার বাসা এটা?

— তোর।

— মানে?

— মানে আমার বউয়ের বাসা এটা।

তোঁষা চমকে তাকাতেই আরহাম ওর বোঁচা নাকটা টেনে বললো,

— আমার বুঁচি’র জন্য এটা। অনেক আগের কেনা।

— আমার তো হাইটে ফোবিয়া তাহলে এত উপরে কেন?

আরহাম একটু চুপ থেকে তোঁষা’র মুখটা দেখে নিলো যা বার্তমানে কৌতুহলে ভরপুর। কিঞ্চিৎ হেসে জানালো,

— তোকে আমার থেকে দূর করতে পুরো শেখ পরিবার লেগেছে প্রাণ। তাদের থেকে তোকে লুকাতেই এতকিছু।

তোঁষা’র প্রাণে জোয়ার বয়ে গেলো নিমিষেই। সেই জোয়ারের পানি মেটালো তার সকল জাগ্রত প্রশ্ন। আরহামের পানে তাকিয়ে চেষ্টা করলো নিজের চক্ষু তৃষ্ণা মেটানোর। এই সুন্দর আরহাম ভাইটা ওর অনেক প্রিয়।
পুড়ে যাওয়ার গন্ধ নাকে ঠেকতেই নিজের বোঁচা নাকটা কুঁচকে ফেলে তোঁষা। আরহাম তখন তাকিয়ে তোঁষা’র দিকে। গভীর দৃষ্টি ফেলে ভেবে যাচ্ছে অনেক কিছু।
তোঁষা নাক কুঁচকে আরহামের বাহুতে ধাক্কা দিয়ে বললো,

— পুড়ে যাচ্ছে তো আপনার ফিশ!

আরহামের টনক নড়ে কিছুটা। ও ইটালিয়ান ফিশ ট্রাই করছিলো। এক হাতে এখনও স্পাচুলা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরণে একটা চেইক ছাপার কিচেন এপ্রোণ। আরহাম ছুঁটে যেতে নিলেই তোঁষা ও পিছু নিলো তার। এতক্ষণ আরহাম তাকে যেতে দেয় নি। গ্যাস অফ করে আরহাম ফ্রাই প্যানটা নামিয়ে পাশে রাখতে রাখতে বললো,

— একটুর জন্য বেঁচে গেলো আমার ফিশ। বুঁচি’র বোঁচা নাক কাজে এসেছে।

কথাটা বলতে বলতে ওভেন থেকে ফ্রাইড রাইস বের করে আরহাম। সে খেয়াল করে নি তোঁষা’র মুখ ফুলানো। আরহাম প্লেট হাতে ঘুরতেই দেখা মিললো তার তুঁষে’র। মাথা নিচু করে কোণ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। আরহাম হরবরালো৷ হকচকালো। প্লেট সাইডে রেখে তোঁষা’র হাত টেনে ধরে বলে উঠলো,

— কি হয়েছে? তুঁষ?

তোঁষা রা করে না। ছোট থেকেই ওর নাকটা নিয়ে সবাই রাগাতো ওকে। শেখ বাড়ীর একমাত্র তোঁষা’র নাকটাই বোঁচা বাকিদের কি সুন্দর খাঁড়া খাঁড়া নাক। সবচেয়ে সুন্দর নাক ওর আরহাম ভাই এর। আরহাম ভ্রু কুচকে কিছুসময় অবলোকন কর। ঠোঁটে ওর চাপা হাসি। ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট চেপে আটকে রেখেছে সে। তোঁষা’র মুখটা হাত দিয়ে তুলে বললো,

— অন্য কেউ বললে তার নাক ফাটিয়ে দিব কিন্তু আমি বলবই। আমার বুঁচি তুই। আমরণ থাকবি।

তোঁষা’র চোখের সামনে ভেসে উঠে বছর কয়েক আগের ঘটনা।

~এই তো ক্লাস সিক্সে পড়ে তখন তোঁষা। সারাদিন ছুটাছুটি ওর র*ক্তে মেশানো যেন। স্কুল থেকে বান্ধবী’র হাত ধরে গেট পর্যন্ত আসতেই দেখা মিলে তুহিনে’র। অন্যদের বাবা থেকে কিছুটা বয়স্ক তুহিন। হওয়াটাই স্বাভাবিক। মধ্যবয়সে দ্বিতীয় বার বাবা হয়েছে বলে কথা। তবে বুঝার কায়দা করা যায় না। বলা হয় “পুরুষ নব্বই তে ও জোয়ান কিন্তু নারী;সে কুড়িতেই বুড়ি”। বাবা’কে দেখেই তোঁষা ফড়িং এর উড়ে চলে আসে। মেয়ে’র কপালের ঘামে লেপ্টে থাকা চুলগুলো কানে গুজে ব্যাগটা নিজের কাঁধে তুলে এক হাতের মুঠোয় পুরে নেয় তোঁষা’র হাত। তোঁষা বুঝি থেমে থাকার মেয়ে? আদরের আহ্লাদী মেয়ে ফুডুং ফুডুং করে এটা ওটা বলেই যাচ্ছে। তুহিন কখনো বিরক্ত হন না বরং ভালো লাগে তার মেয়ের চঞ্চলতা। ঠিক যেন তার কিশোরী সেই স্ত্রী’র কার্বন কপি তোঁষা। বাবা’র হাত টেনে ধরে বায়না ধরে তোঁষা,

— আব্বু আব্বু আইসক্রিম খাব একটা।

তুহিন আবার মেয়ে পাগল বাপ। মেয়ে চাইবে সেটা না দিয়ে সে থাকবে তা কখনো হয়েছে? না কখনোই না। তবুও মুখটা অসহায় করে জানায়,

— পুতুল মা বকবে না বলো? গত সপ্তাহে ঠান্ডা ভালো হলো।

— তুহিন শেখে’র বউ’কে কে জানাবে আব্বু? আমার আব্বু তো জানাবে না এটা শিওর এর মানে কি তুমি জানাবে?

মেয়ে’র গোলগাল ছোট্ট মুখটার পানে তাকিয়ে আর কিছু বলতে পারে না তুহিন। এগিয়ে যায় আইসক্রিম ওয়ালার ভ্যানের দিকে। তোঁষা কোন ফ্লেভার খাবে জিজ্ঞেস করতেই ওর মুখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। একে একে বলতে থাকলো,

— চকলেট, ম্যাংগো, ভ্যানিলা আর স্ট্রবেরি মিক্স করে কর্নেটো তে ভরে দিন। উপর দিয়ে চকলেট সিরাম দিবেন মামা। আর হু হু উমম, কয়েকটা চকো চিপ্স ছিটিয়ে দিয়েন।

বলেই দাঁত কেলিয়ে হাসলো। তুহিন দীর্ঘ শ্বাস ফেললো। এই মেয়ে সুযোগ পেলেই তার অসৎ ব্যবহার করবে। এই যে এখন আইসক্রিম খাবে তাতে তিন জনের টা একাই খেয়ে নিবে সে। বাহানার শেষ নেই। একস্ট্রা টাকা ছাড়া এভাবে কর্ণেটো ফিল ও করা হয় না। তোঁষা’র হাতে আইসক্রিম আসতেই ও খুঁটে খুঁটে আগে চকলেট খাওয়া শুরু করলো। বাবার মুখে দিতেও ভুলে নি।
তুহিনের কাঁধে তখনও তোঁষা’র ব্যাগ। পরিচিত একজনের সাথে দেখা হতেই তোঁষা’কে দাঁড় করিয়ে তিনি একটু সাইডে যান কথা বলতে।
কয় মিনিট হলো? এই তো দশ থেকে পনেরো মিনিট। এর বেশি তো না। তবে তুহিন ফিরতেই তার মনে হলো এখানে কয়েক ঘন্টা পর ফিরেছে সে। তার পুতুলের হাতের আধ খাওয়া আইসক্রিমটা রাস্তায় পড়ে গলে গিয়েছে কিছুটা। গাড়ির সাথে লেগে ফুঁপিয়ে কাঁদছে তোঁষা। না ভুল। তোঁষা মোটেও কাঁদছে না। সে রাগে ফুঁপাচ্ছে। রাগের চোটে তার ডাগর ডাগর আঁখিতে পানি জমেছে। কিন্তু তুহিনের এই ধারণা ও ভুল। তার মেয়ে কাঁদছে নিজের আইসক্রিমের জন্য আর রেগে আছে একটা ছেলের উপর। ছেলেটাকে চেনে তুহিন। তোঁষা থেকে দুই ক্লাস উপরে সে। বর্তামানে ছেলেটার অবস্থান আরহামের নিচে। তার কলার আরহামের হাতের মুঠোয়। তুহিন ছাড়াতে আসতে আসতে শক্ত করে দুটো চড় আরহাম ছেলেটার গালে দিয়ে দিলো। তুহিন দাঁড়িয়ে গেলেন। কি হবে এখন যেয়ে? তবুও পা ঠেলে গিয়ে আরহাম’কে ধমকে উঠে,

— আরহাম! আব্বু ছাড়ো ওকে। কি করছো? কত ছোট তোমার, ওর গায়ে হাত কেন তুলেছো?

— একদম ঠিক হয়েছে। বল এখন বল। এখন বলিস না ক্যান হ্যাঁ?

তুহিন তাকালো মেয়ের দিকে। ভীতুর ডিম তার মেয়ে আরহামের হয়ে কথা বলছে। সাহস অবশ্য সে আরহাম’কে দেখেই পায়। ছেলেটাকে তুলে তুহিন বুঝ দিতে দিতে আরহাম তোঁষা’র জন্য আরেকটা আইসক্রিম নিয়ে নেয়। মাথায় হাত রেখে শুধু বলে,

— আমার বুঁচি’কে একমাত্র আমিই বুঁচি ডাকব।

পরেই আবার বলে,

— এই সপ্তাহে আর মিষ্টি কিছু খাবি না। ডায়াবেটিসের পয়েন্ট বেড়ে যাবে।

তোঁষা জিহ্বা দিয়ে আগে আইসক্রিমটা চেটে নেয়। বলা যায় না এটাও যদি পড়ে যায়?

তুহিন পরে ঘটনা শুনে বাকরুদ্ধ। তোঁষা’কে ঐ ছেলে শুধু বলেছিলো, ” কি বুঁচি আইসক্রিম খাচ্ছো?”
ব্যাস তোঁষা রেগে আইসক্রিম ছুঁড়ে মা’রে ছেলেটার গায়ে। এত রাগ এই মেয়ের! তুহিন মাঝে মধ্যে ভয় পায়। কে সামাল দিবে এই রাগী পুতুল’কে। ঐ রাস্তা দিয়েই আরহাম ভার্সিটি যাচ্ছিলো। রাস্তায় এই ঘটনা দেখেই পরবর্তী ঘটনার সূচনা ঘটায় সে।
.
তোঁষা’র ভাবনায় ছেঁদ পড়ে আরহামের কথায়,

— খায়িয়ে দিব?

তোঁষা মাথা নাড়ায়। আরহাম রাইস সহ ভেজিটেবল নিলেই তোঁষা মুখ কুঁচকে বললো,

— সবজি ভালো লাগে না আরহাম ভাই। ফিশ দিন।

— চুপচাপ হা কর তুঁষ। শরীরের কি হাল তোর? শেখ বাড়ীর লোক কি ফকির হয়ে ছিলো যে সবজি কিনতে পারে নি?

তোঁষা বেজার মুখ করে লোকমাটা মুখে তুললো। আরহাম নিজেও খাচ্ছে। তোঁষা খেতে খেতে বললো,

— আপনি দেশে কবে ফিরেছেন?

আরহাম এক লোকমা ওর মুখে দিয়ে উত্তর করলো,

— একমাস।

তোঁষা চমকে তাকালো। অসহায় কন্ঠে শুধালো,

— আমাকে আগে কেন আপনার কাছে আনলেন না আরহাম ভাই? আপনি কি জানতেন না আপনার তুঁষে’র কষ্ট হচ্ছিলো।

আরহামের হাত থেমে গেল। সে জানতো কিন্তু করার কি ই বা ছিলো। তোঁষা’র মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,

— তোকে তো বাসা থেকে বের হতে দিচ্ছিলো না প্রাণ। কিভাবে কি করতাম। গতকাল তুই পার্লারে যেতে বের হলি। সুযোগ পেলাম। তুলে নিয়ে আসলাম।

— আপনি জানতেন আমার বিয়ে….

— হু।

— কার সাথে..

— চুপ।

— জানেন?

— হু।

তোঁষা চুপ রইলো। আরহাম হাত ধুঁয়ে একটা মলম এনে তোঁষা’র ঘাড়ে লাগিয়ে, হাতের কনুইতেও লাগালো। তোঁষা’র দিকে তাকিয়ে বললো,

— পেটে লাগাতে পারবি?

সময় ব্যায় করে না তোঁষা। পরণের কুর্তি অল্প তুলে দেয়। আরহাম নিঃশব্দে আঁচড় আর কাটা জায়গাগুলোতে মলম লাগায়। দীর্ঘ শ্বাস বেরিয়ে আসে ভেতর থেকে। তোঁষা আরহামের হাতটা ধরে নিজের দুই হাত দিয়ে। নিজের গালে লাগিয়ে বলে,

— আমার সব ছেড়ে আপনার কাছে এসেছি। এই তুঁষ’টা ই আপনার। সংকোচ কোথা থেকে আসে হু?

#চলবে…..

প্রিয় প্রাণ পর্ব-২+৩

0

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ২

উষ্ণীয় আলিঙ্গনে ঘুমের জোড় বাড়লো তোঁষা’র। নাক,মুখ ডুবিয়ে শ্বাস টেনে নিলো সে। শীতের সকালে এহেন আলিঙ্গন তার নিকট নতুন। আরহাম জেগেছে ঘন্টা খানিক আগেই কিন্তু তোঁষা’কে এতটা আদুরে মুহূর্তে পেয়ে আর ছাড়তে পারে নি সে। এই মেয়েটা যে তার প্রাণে’র অনেকটা জুড়ে। এই প্রথম এতটা কাছে পেয়েছে তাকে আরহাম। না চাইতেও তার মনে হানা দেয় বিভিন্ন সংশয়। যদি কেউ ছিনিয়ে নেয় তার প্রাণ’কে? যদি কেউ টের পায়? আদনান কি টের পাবে এই লোকালয়ের বাইরে যে তার ভালোবাসা’কে লুকিয়েছে আরহাম? পরক্ষণেই সকল অযাচিত চিন্তাভাবনা বাদ দেয় আরহাম। কেউ টের পাবে না। কখনোই না। এই বাইশ তলার উপর কে ই বা টের পাবে যে আরহাম লুকিয়ে রেখেছে তার প্রাণ’কে? তবুও যেন আরহামের চিন্তার শেষ নেই। মাঝেমধ্যে ভীষণ রাগ উঠে ওর শুধুমাত্র তোঁষা’র উপর। কে বলেছিল এই মেয়ে’কে আরহাম’কে এতটা পাগল করতে? ছোট থেকেই সে দৌড়ে বেড়ায় আরহামে’র রন্ধ্রে রন্ধ্রে। শিরায় উপশিরায়। ইশ! কতটাই না জ্বালাময় সে অনুভূতি।

পিটপিট করে চোখ খুলার চেষ্টা করে তোঁষা। গালে এখনও টনটনে ব্যাথার উপস্থিতি তার ঘাড় সহ মাথায় ও উঠেছে যেন। অল্প সল্প খোলা চোখে অক্ষিপটে ভেসে উঠে আরহামে’র সুশ্রী মুখমন্ডল। প্রথমে অবাক হলেও ক্ষাণিকের মাঝেই ওর মুখটা হাসি হাসি হয়ে গেলো। লাল হওয়া গাল দুটো তখন গর্তে ঢুকেছে যেন। গালের পেশির মাঝে বড়বড় গর্ত এই রুপসীর রুপ যেন বাড়িয়ে দেয় বহুগুণে। আরহাম আলতো হাতে ছুঁয়ে দেয় ওর গাল। অল্প ব্যাথায় মুখে শব্দ করে তোঁষা,

— আহ!

তোঁষা’র ব্যাথাটা অল্প হলেও আরহাম উত্তেজিত হয়ে উঠে,

— ব্যাথা পেলি? তুঁষ! দেখি গালটা।

তোঁষা নাক, মুখ কুঁচকে উঠে বসে। আরহাম ও সাথে সাথেই এক লাফে উঠে বসতেই তোঁষা বোঁচা নাকটা ফুলিয়ে বললো,

— কিছুই হয় নি। আপনি শুধুই এমন করেন।

আরহাম চাচ্ছে না রাগ করতে। কিছুতেই এখন রাগ করা যাবে না। অন্তত পক্ষে ওর তুঁষে’র সামনে তো না ই। তোঁষা’র বাহুটা ছাড়তেই তোঁষা বিছানা থেকে নামতে যায়। যেই না এক পা এগুবে ওমনিই ধপ করে হুমড়ি খেয়ে পরলো ফ্লোরে। আরহাম তারাতাড়ি বিছানা ছেড়ে তোঁষা’কে ধরতে গেলেই তোঁষা ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠলো। এতটা আহ্লাদী যদিও সে না তবে আরহামের নিকট সে বড্ড আহ্লাদী হয়ে উঠে। আরহাম টেনে তুলে ওকে বিছানায় বসিয়েই ব্যাস্ত হয়ে চোখ মুছে দেয়। তোঁষা’র পড়নের টাউজারটা রাতে গুটিয়ে দিলেও তা এখন ছুটে গিয়েছে ওটাতেই পা বেঝে আছারটা গেলো তোঁষা। বোঁচা নাকটা টানতে টানতে তোঁষা মুখ নাক লাল করে ফেললো। আরহাম ওর পা টা নিজের কোলে তুলে দেখতে দেখতে অস্থির হয়ে শুধালো,

— তুঁষ? ব্যাথা পেলি কোথায়? মোচকেছে? এই কথা বল!

অস্থির হয়ে প্রথমে বললেও পরে কিছুটা রেগে যায় আরহাম। তার এই রাগ যে কিছুতেই আয়ত্তে থাকে না। তোঁষা কিছুটা চমকে যায় হঠাৎ ধমক খেয়ে কিন্তু চমকানো টা বেশিক্ষণ টিকে না। আরহাম স্বাভাবিক করে নেয় নিজেকে। মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করে। গত কাল থেকে আজ পর্যন্ত ওর তুঁষ’টা তো কম আঘাত পাচ্ছে না। তখন না হয় আরহাম কাছে ছিলো না। পাশে ছিলো না কিন্তু এখন? আরহামের এতটা কাছে থেকে কেন ওর তুঁষ আঘাত পাচ্ছে? এটা কোনভাবেই আরহাম মানবে না। মন’কে মানালেও মস্তিষ্ক তার কিছুতেই মানতে চায় না।
হঠাৎ করেই তোঁষা’কে জড়িয়ে ধরে আরহাম। ভ্রু কুঁচকায় তোঁষা। বিছানা থেকেই তো পরলো তাতে এতটা চিন্তিত হওয়ার কি আছে? আরহাম তোঁষা’কে ছেড়ে নিজের মুঠোয় তোঁষা’র নরম হাতটা পুরে নেয়। তোঁষা তাকায় আরহামের চোখের দিকে। বাদামী বর্ণের চোখের মনির দিকে তাকাতেই তোঁষা’র ভ্রু কুচকানো টান টান হয়ে যায়। আরহামের চোখে মুখে চিন্তার ভাজ। মুখভঙ্গি ও আদল বদলেছে। কেন? শুধু মাত্র তোঁষা এই অল্প ব্যাথা পেলো বলে? নরম হয়ে আসে তোঁষা,

— বেশি লাগে নি তো।

আরহাম কিছু বলে না। মাথা নিচু করে কিছু ভাবছে সে। তোঁষা শ্বাস ফেলে ডাকে,

— আরহাম ভাই?

আরহাম কোন কালেই তার তুঁষে’র এই ডাক উপেক্ষা করতে পারে নি। আজও পারলো না। অল্প হাসার চেষ্টা করে বললো,

— আয়।

আরহামের বাড়িয়ে দেয়া হাতে হাত রাখে তোঁষা। পায়ে যে একেবারে ব্যাথা পায় নি তা না। পেয়েছে কিন্তু অল্প। তোঁষা ওয়াসরুমের দরজা লাগাতেই এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজের ফোনটা খুঁজে আরহাম। টেবিলের সাইডে রাখা সেটা। হাতে তুলে দ্রুত গতিতে বৃদ্ধাঙ্গুলি চালিয়ে কিছু টাইপ করলো। অতঃপর ছুঁড়ে মা’রলো তা কাউচে। ঘাড়টা এদিক ওদিক নাড়িয়ে হাত দুটো প্রসারিত করে অলসতা কাটানোর মতো করে আরহাম। লালচে গোলাপি রঙা ঠোঁটে তার বক্র এক হাসি। বড়ই অদ্ভুত সুন্দর সেই পুরুষের পুরো ঠোঁটের হাসিটা। তোঁষা দেখলেই বলত, “আরহাম ভাই, আপনি এভাবে হাসলে আমার কিছু হয়”।
কথাটা ভাবতেই খট করে দরজা খুলে কিছুটা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বের হলো তোঁষা। আরহাম গিয়ে ধরে এনে কাউচে বসিয়েই রুমের বাইরে গেলো। তোঁষা গালে হাত দিয়ে তাকিয়ে রইলো ওর আরহাম ভাই নামক জামাই’টার দিকে। তোঁষা’র প্রাণে’র অস্তিত্ব সম্পূর্ণটা জুড়ে এই আরহাম ভাই। একে পেতেই তো এত সব পাগলামি তোঁষা’র। এই আরহাম ভাই এর টিশার্ট জড়িয়েই তো বুক ভরে শ্বাস টানতো তোঁষা। নিন্দ্রাহীন রজণী কেন কাটাতো? ফোনে লুকিয়ে লুকিয়ে কথা বলে বুকের ভার কমাতো। রাত বিরাতে মনে মনে কান্না করতো তোঁষা। এই আরহাম ভাই’কে পেতে জীবনের সবচেয়ে বড় সাহসীকতার পরিচয় দিয়েছে ও গত কয়েকটি দিন। যার শেষ ছিলো গতকাল। বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এসেছে তোঁষা ওর আরহাম ভাইয়ের কাছে। একজনকে ভালোবেসে নিশ্চিত আরেকজনের সাথে সংসার করাটা সম্ভব ছিলো না তার জন্য? তোঁষা কি বাঁচতো ওর আরহাম ভাই ছাড়া? বাবা’কে কত বললো। যেই বাবা’কে জমে’র মতো ভয় পেত সেই বাবা’র সামনে দাঁড়িয়ে জাহির করেছিলো মনের কথা। তোঁষা ভাবুক হলো,

~বাবা’কে যথেষ্ট ভয় পেয়ে চলে তোঁষা। অথচ বাবা ছাড়া তার চলেও না। সারা বাড়ি টো টো করা ওর একমাত্র কাজ। সকলের আদুরে বাচ্চা কি না। পরিবারের সবচেয়ে কনিষ্ঠ মেয়ে তোঁষা। যাকে বড় চাচা সহ বাকিরা পুতুল নামে ডাকে। যার লাল, ফর্সা দুধের রঙের শরীরটা শীতের দিনে ঠিক তুষের ন্যায় লাগতো। তাই তো ওর আরহাম ভাই ওর নাম রেখেছিলো তুঁষ যা একসময় ঠিকঠাক করে সকলে রাখলো তোঁষা। তোঁষা’র নিকট তুঁষ নামটাই বেশি ভালোবাসার। ওর আরহাম ভাই ডাকে এই নামে। আরো একজন ডাকে তবে তাকে মনে করতে ইচ্ছুক নয় তোঁষা।
আরহাম’কে বিয়ে করার কথা বাবা’র সামনে বলতেই বাবা গম্ভীর কণ্ঠে না করে। তোঁষা তখন বাবা’র সামনে ঐ গতকাল প্রথম সাহস জুগিয়ে বলেছিলো,

— আরহাম ভাই ছাড়া বিয়ে করব না আমি।

ননীর পুতুলের ঠোঁট দিয়ে বের হওয়া কথা শুনেই রেগে যান তুহিন। উঠে এসে সজোরে থাপ্পড় বসান আদরের মেয়ের গালে। যেই গালে সবাই ঠেসে চুমু খেলেই লাল লাল দাগ পরতো সেই গালে ঐ থাপ্পড়টা ছিলো আবিরের ন্যায়। একদম রঙা করে দিয়েছিলো তোঁষা’র গাল। যার দাগ এখনও মিটে নি।
তোঁষা কিন্তু দমে নি। ভীতু মেয়েটা দৌড়ে গিয়ে বড় চাচা তুরাগে’র পা ধরে। অনুরোধ করে জানায়,

— চাচ্চু…চাচ্চু আব্বুকে বোঝাও না। আমি তো আরহাম ভাই’কে ভালোবাসি। তোমরা না বলেছিলে আরহাম ভাই আমার বর হবে তাহলে অন্য কারো সাথে কেন বিয়ে দিচ্ছো?

তুরাগ অপারগ। হাজার হোক তার ছেলে আরহাম। তিনি কখনোই তোঁষা’র বিয়ে দিবেন না আরহামের সাথে। তোঁষা’কে পা থেকে বহু কষ্টে টেনে তুলে চাচি। তোঁষা শুধু কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করে,

— মিথ্যা ওয়াদা কেন দিয়েছিলে? কেন বলেছিলো আরহাম ভাই আমার বর? আরহাম ভাই ফিরবে। নিশ্চিত ফিরবে।

কথাটা শেষ করতে না করতেই তুঁষার ওকে টেনে হিচরে নিয়ে যায় ওখান থেকে। তোঁষা তখন বড় ভাইয়ের কাছে নালিশ জানায়। লাভ হয় না। তুঁষার শুনে না। ওর টান হেচরিতেই তোঁষা আঘাত পায় কিছু জায়গায়।

হঠাৎ হাতে সূচ ফুটতেই মুখে “উফ” শব্দ করে অতীত থেকে বেরিয়ে আসে তোঁষা। আরহাম ততক্ষণে ওকে ইনসুলিন পুশ করেছে। তোঁষা হাসলো। আরহাম ওর মাথায় হাত দিয়ে বললো,

— পয়েন্ট কত যাচ্ছে ইদানীং?

তোঁষা’র হাসি মিলিয়ে গেলো নগদে। জন্মের কয়েক বছর পরই ওর মধ্যে ডায়বেটিস দেখা গিয়েছিলো। ইনসুলিন নিতে নিতে জীবন তেঁতো হয়ে আছে। আরহাম রেগুলার পয়েন্ট চেক রাখে। গত কয়েকমাস রাখা হয় নি। সুযোগ হয় নি বলা যায়। তোঁষা তো ইচ্ছে মতো খেয়েছে। পয়েন্টের হুস কি ছিলো?
ওর মুখের চোরা চোরা ভাবটা দেখেই আরহাম চেক করার জন্য ড্রয়ারে হাত দিলো। পয়েন্ট দেখেই যেন মাথায় হাত। খালি পেটে নয়। মোটেও কম কথা না। আরহাম রেগে তাকাতেই তোঁষা মুখ কালো করে। নীচু কন্ঠে বলে,

— ক্ষুধা লেগেছে আরহাম ভাই।

— কে তোর ভাই??

আরহামের ধমকে কাঁপে তোঁষা। আরহাম হুট করে ওর একবাহু চেপে ধরতেই তোঁষা ব্যাথায় মুখ কুঁচকায়। দাঁত পিষে আরহাম শুধু বললো,

— বলেছিলাম আমার জন্য তোর খেয়াল রাখিস।

— ব্যাথা পাই।

— পা।

— ছাড়ুন।

আরহাম ছাড়লো না বরং চাপ বাড়ালো। তোঁষা শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে ধাক্কা মা’রতেই কদম দুই পেছালো আরহাম। চক্ষু ওর তখনও টকটকে লাল।

#চলবে….?

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৩

তোঁষা যেন একুল ওকুল দুই কুল হারিয়ে বসে আছে। একা একা কতক্ষণ ভালো লাগে? আরহাম সেই যে বেরুলো এখন ও ফিরে নি। যাওয়ার আগে শুধু গোমড়া মুখে তোঁষা’কে খায়িয়ে গিয়েছে। অবশ্য এটা বললেও ভুল হবে। শুধু রুটি আর ডিম ওর সামনে রেখেছে। তোঁষা নিজ হাতেই তো খেলো। ওর খাওয়া দেখা মাত্র হনহনিয়ে পকেটে ফোন আর মানি ব্যাগ ঢুকিয়েই আরহাম কোন প্রকার বাক্য ব্যায় না করে চলে গিয়েছে। তোঁষা এমন রাগের কারণ দাঁড় করাতে পারলো না। কারণ টা কি তোঁষা নিজের যত্ন করে নি এটা নাকি তোঁষা ওকে ধাক্কা মা’রলো ওটা?
ভাবলো তোঁষা, নিজের যত্ন নেয়ার মতো কাজটা কিভাবে করতো ও? গত মাস থেকে টানা দুই দিন ইচ্ছা করে ইনসুলিন নেয় নি। উদ্দেশ্য একটাই। বাবা-চাচ্চু সহ সবাইকে রাজি করানো। কিছুতেই অন্য কাউকে বিয়ে করতে রাজি না ও। ইহকালে তোঁষা’র দেহে প্রাণ থাকতে না। বিষাদে ঘেরা মনটা তেঁতো সময়গুলো মনে করে,

~ এই তো গত মাসে। সবাই’কে বারবার বলেও রাজি করাতে পারে না তোঁষা। বাবা কথা ও বলে না ঠিকঠাক ভাবে ওর সাথে। তোঁষা বেহারায় ন্যায় যাকে পায় তাকেই বলে,

— আরহাম ভাই এর খবর জানো?

ওর এই এক প্রশ্ন যেন তুহিন’কে রাগীয়েছিলো বহুগুণ। দুটো মাত্র সন্তান তার। তুষা’র হওয়ার কত বছর পর এই তোঁষা টার আগমন এই ধরণীর বুকে। ঠিক এক শীতের রাতে তাদের গৃহ আলোকিত করে ভোরের ঊষা হয়ে এসেছিলো তাদের পুতুল। তোঁষা’র মা তো ভরসাই ছেড়ে দিয়েছিলেন আরোকটা সন্তানের। মধ্যবয়সে এসে এই তোঁষা নামক প্রাণে’র আগমন। ঠিক যেন তুঁষে’র রাণী। শেখ বাড়ীর তুঁষে’র পুতুল।
এই পুতুলটার এহেন পাগলামী কে ই বা মেনে নিবে? কেন মেনে নিবে? মানার কি কোন অবকাশ ছিলো বা আছে?

মেয়ের তখনকার পাগলামো দেখে তুহিন রেগে যান ভয়াবহ ভাবে। সেই রাগ থেকেই তেড়ে আসেন তোঁষা’র দিকে। তোঁষা মায়ের পিছু লুকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে,

— আমার ফোন দিতে বলো আম্মু। আরহাম ভাই’কে কল করব।

তোঁষা’র মা নিতান্ত ভদ্রমহিলা। স্বামী’র কাছে তিনি নিজেই প্রচুর আদরের। তুহিন স্ত্রী’কে প্রচুর ভালোবেসে আগলে রাখেন। দুই সন্তান আর এই বউ নিয়েই তো তার ছোট্ট সংসার। যৌথ সংসারে একদম রমরমা ভাব। কিন্তু তোঁষা’র এহেন আচরণ সব যেন উল্টে দিলো। তোঁষা’র শেষোক্ত কথাটা শুনে রাগে তেড়েমেড়ে তুহিন বলে উঠেন,

— তোঁষা বেশি বারাবাড়ি করবে না। আরহামের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলে খুব খারাপ হবে বলে রাখলাম।

তোঁষা ও যেন ফুঁসে উঠলো। তীব্র প্রতিবাদী স্বরে জানালো,

— কেন করব না? তোমরা কথা দিয়ে কথা কেন রাখছো না? আমি আরহাম ভাইকেই বিয়ে করব। ম’রে গেলেও অন্য কাউকে….

কথার মাঝেই চড়ের তীব্র শব্দ কানে আসে তোঁষা’র। চোখ বড়বড় করে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকে বাবা’র পানে। তুহিন নিজেও হতভম্ব তখন। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন ওর মা। রাগ সামলাতে ব্যার্থ হয়ে স্ত্রীর গালে চড় বসিয়ে দিয়েছেন। তুহিন হতভম্ব ভাব কাটালো। ধমকের স্বরে বলার চেষ্টা করলো,

— মেয়ে সামলাও নাহলে এরচেয়ে ও খারাপ কিছু হবে।

তোঁষা কেঁদে ফেললো ততক্ষণাৎ। ওর মায়ের সাথে যে বাবা কখনো উচ্চবাক্য ব্যায় করে নি সে কিভাবে তার গায়ে হাত তুললো? দৌড়ে যেতে যেতে শুধু বললো,

— কেন আশা দিয়েছিলে? এখন কেন এসব? আমার আরহাম ভাই আসবে। তোমার ওয়াদা ভঙ্গকারী হলেও সে না।

দৌড়ে গিয়েও বেশিদূর এগোতে পারলো না তোঁষা। ইনসুলিন না নেয়াতে মাথা ঘুরে পরে যায় রুমের বাইরে। তুঁষা’র বাসায় ছিলো না। বোনকে দরজার সামনে পরে থাকতে দেখেই চিৎকার করে এগিয়ে আসে। বোনের মাথাটা কোলে তুলে একবার মা-বাবা’কে ডাকে তো পরক্ষণেই তোঁষা’র গালে চাপড় মে’রে ডাকতে থাকে,

— পুতুল? এই পুতুল? কি হয়েছে? এই!!

তোঁষা হাত পা ক্রমশ ঠান্ডা হওয়ার পথে। তুঁষা’র বোনকে নিয়ে বিছানায় শোয়াতে শোয়াতেই চাচা,চাচি, বাবা আর আদনান ও হাজির হয়। ওর চাচি কাঁদতে কাঁদতে হিচকি তুলে ফেললো। এই চিনির পুতুলটার এই অবস্থা কেন? আরহাম’কে কোনদিন যখন মেনেই নিবে না তাহলে কেন তাকে বছরের পর বছর ছেলে ছাড়া থাকতে হলো? যেই ছেলের সুখ এই তোঁষা সেই ছেলে কি মানবে এত বড় ধোঁকা?
তুষা’র বুদ্ধিমান। ও বুঝে তোঁষা ইনসুলিন নেয় নি। তাই ঝটপট সুগার চেক করলো। যা ভেবেছিলো তাই। ইনসুলিন পুশ করে সবাই’কে রুম থেকে বের হতে বলে। সবাই বের হলো। চাচি তখনও শিয়রের কাছে বসা। তুষা’র হাটু গেড়ে বসে চাচির কাছে। হাতটা মুঠোয় পুরে শুধু বলে,

— আমার অনেক আদরের বোন চাচি। আরহাম…

— আমার ও অনেক আদরের ছেলে আরহাম তুষার। কিন্তু দেখ বছরের পর বছর সে আমার কাছে নেই। যার জন্য এতকিছু তাকে নিয়েই ছিনিমিনি?

— সব ধ্বংস হয়ে যাবে চাচি।

— সেটা এমনিও হবে ওমনিও।

— তোঁষা’কে একটু বুঝাও।

— অনেক চেষ্টা করেছি।

তুষা’র দীর্ঘ নদীর মাঝে খেই হারা মাঝির মতো লক্ষ্যভ্রষ্ঠ হয়ে রইলো। চাচি উঠে গেলেন তোঁষা’র খাবার আনতে। তুষা’র তাকায় বোনটার মুখের দিকে। অনেকটা পার্থক্য ভাই-বোনের বয়সের। হাঁটুর বয়সী বোন। সময় মতো বিয়ে করলে তুষা’রের হয়তো তোঁষা থেকে বছর সাত আট ছোট্ট মেয়ে থাকত।
তুষা’রের নিকট বাচ্চা বৈ কিছুই না তোঁষা। তার কলিজার টুকরো এই বোন। বাড়ীতে তিনটা ছেলে। একটা মাত্র মেয়ে। সবার চোখের মণি অথচ সময় আর পরিস্থিতি সবটা বিগড়ে দিয়েছে। সবটা।

তুহিনের নজর যায় সোফার কিণারায়। তার স্ত্রী সেখানেই ঠান্ডা হয়ে ঠাই দাঁড়িয়ে আছে। হ্যাঁ ঘন্টা খানিক হবে ওখানেই তো তাকে থাপ্পড়টা মা’রলো তুহিন। স্বামী’র দেয়া বিবাহিত জীবনের প্রথম আঘাতটা কি সে সহ্য করতে পারে নি? হয়তো। তাই তো দিকহারা হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টিতে শুধু শূন্যতা।
তুহিন এগিয়ে যান। আলতো করে হাত রাখেন স্ত্রী’র পিঠে। একসময় ধীরে জড়িয়ে নেন নিজের সাথে। ডান হাতটা বুলিয়ে দেন গালে। ফিসফিস করে শুধু ব্যাথিত গলায় শুনা যায়,

— দোষ খুঁজলাম আমার। অনেক খুঁজলাম। পেলাম না।

তুহিনের চোখ দিয়ে এক ফোটা অনুতাপ ঝড়লো। মনের ঝড় তার মন জানে। অপ্রকাশিত সকল অনুভূতি দগ্ধ করে চলছে তাদের।
.
খট করে শব্দ করে দরজাটা খুলে যায়। তোঁষা মুখ তুলে তাকায়। আরহাম এসেছে। যাওয়ার সময় ওকে রুমে রেখে দরজাটা বাইরে থেকে লাগিয়ে গিয়েছিলো। তোঁষা অশ্রু ভরা চোখে তাকালো। আরহাম ওর দিকে তাকাতেই দৌড়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে তোঁষা তার বুকে। হাত থেকে আরহামের সকল ব্যাগ পরে গেলো ফ্লোরে। দুই হাতে তোঁষা’কে তুলে ধরে নিজের সাথে। তোঁষা কাঁদতে কাঁদতে শুধু বলতে পারলো,

— অনেক কষ্টে আপনাকে পেয়েছি আরহাম ভাই। আপনি কেন চলে গিয়েছিলেন?

আরহাম বিষ্মিত হলেও পরক্ষণেই ঠোঁটের মাঝে খেলে উঠলো রহস্যময় এক হাসি। সন্তপর্ণে চুমু খেলো তোঁষা’র মাথায়। তোঁষা তখনও ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আরহাম’কে প্রথমে শক্ত করে ধরে রাখলেও এখন শরীর ছেড়ে দিয়েছে। আরহাম ওকে নিজের সাথে মিশিয়ে রাখলো। ওভাবেই হেঁটে গেলো বিছানার কাছে। আরহাম ডাকলো ওকে কিন্তু তোঁষা মুখ তুলে না। আরহাম দ্বিতীয় বার ডাকলো,

— তুঁষ?

— হু।

— কেন কাঁদছিস?

— কোথায় ছিলেন আপনি? রেগে কেন চলে গেলেন? আমি ভয় পেয়েছিলাম।

“ভয়” হ্যাঁ এই একটা মাত্র জিনিস ই আছে যা পারে তোঁষা। খুব ভয় পেতে পারে সে অথচ কিছু মাস ধরে সকল ভয় সে বিসর্জন দিয়েছিলো। ভালোবাসার মানুষটার জন্য গলা উঁচিয়ে কথা ও বলেছিলো।
আরহাম অভিযোগ শুনলো মনোযোগ দিয়ে। নিজের সাথে তোঁষা’কে নিয়ে বসলো বিছানায়। নিজের কালো কুচকুচে চাপ দাঁড়ি যুক্ত গালটা লাগিয়ে দিলো তোঁষা’র ফুলা গালটার সাথে। বাকি কাজটা তোঁষা নিজেই করে নিলো। ঘঁষে দিলো নিজের নাক,মুখ আরহামের গালে। টু শব্দ করলো না দু’জনের একজনও। আরহাম অনুভব করলো নিজের ভেজা গালটাকে। তুঁষে’র ফোঁটায় ফোঁটায় যেন সিক্ত তার গাল। তোঁষা আরহামের নাকটাকে ছুঁয়ে দিলো আঙুল দিয়ে। আরহাম তাকাতেই নাক টেনে টেনে বললো,

— আমার নাকটা বোঁচা অথচ আপনারটা কত খাড়া নাক আরহাম ভাই। একদম চাচ্চু’র মতো।

নিজের বাবা’র কথা শুনে হঠাৎ ই চোয়াল শক্ত হয়ে এলো আরহামের। তোঁষা’কে কাছে পেয়েছে চব্বিশ ঘণ্টা ও হয় নি অথচ রাগ উঠেছে কয়েকবার। নিয়ন্ত্রণ করাটা বড্ড কঠিন হয়ে যাচ্ছে আরহামের। বিশ্বাসঘাতকদের শাস্তি হওয়া উচিত। ভয়ংকর শাস্তি। জিহবা চোয়ালের নীচে পিঁষে আরহাম তাকায় তোঁষা’র পানে। ওভাবেই শুধু বলে,

— বিশ্বাসঘাতকদের কথা আর মনে করবি না তুঁষ।

তোঁষা ভরকে যায় কিছুটা পরক্ষণেই বলে উঠলো,

— আপনি এখনও রেগে আছেন?

— কেন মনে হলো রেগে আছি?

— তখন ধাক্কা দেয়াতে অথবা নিজের যত্ন না নেয়াতে।

— আমি কে হই তোর?

সরাসরি উত্তর তোঁষা’র,

— আরহাম ভাই।

— আর?

— আর কি?

— আর কিছু নই?

তোঁষা যেন লজ্জা পেলো মুহূর্তেই। কেন পাবে না আরহাম ভাই গত কাল থেকে ওর স্বামী। ওর একান্ত পুরুষ। তোঁষা’র প্রাণ। কত বছরের সাধের এই মানুষটা তোঁষা’র। সহাস্যে প্রকাশ করে তোঁষা,

— আমার স্বামী আপনি। আমার সবটুকু জীবনের গাঢ় রঙটা আপনি যে রাঙিয়ে দেয় আমাকে প্রতিনিয়ত। আপনি এমন এক অস্তিত্ব আমার যাকে ছাড়া বছরের পর বছর পাড়ি দিয়েছি আমি কিন্তু কখনো ভুলে থাকতে পারি নি। আমার প্রিয় প্রাণ আপনি আরহাম ভাই।

তোঁষা’র সহজ সরল স্বীকারোক্তি। আরহাম প্রলুব্ধ নয়নে তাকিয়ে দেখে নিলো ওর বোকা তুঁষে’র মুখটা। নিজের খসখসে হাতের ঠান্ডা তালুর আজলায় তুলে নিলো তোঁষা’র মুখ। চোখে চোখ রেখে জানালো,

— তোর উপর রাগ করার ক্ষমতা সৃষ্টিকর্তা এই আরহাম শেখ’কে দেয় নি তুঁষ।

— তাহলে…

— তখন রাগ উঠেছে শেখ বাড়ীর সকলের প্রতি। আমার থেকে তোকে দূর করতে লোকগুলো এতটাই বেভুর ছিলো যে তাদের কলিজার টুকরো’র খেয়াল রাখতে পারলো না। তোর ডায়বেটিস এর পয়েন্ট কেন এত বেশি থাকলো তুঁষ? খালি পেটে নয়। বুঝিস কিছু?

— আপনি তো ছিলেন না তাই এমন হয়েছে।

তোঁষা’র চোখ মুখে দুষ্ট হাসি। আরহাম ও চাপা হাসলো। তোঁষা ততক্ষণে আরহাম থেকে সরে দরজার সামনে পড়ে থাকা ব্যাগগুলো তুলে। উৎসুক দৃষ্টি আরহামের দিকে। তোঁষা’র চোখে করা প্রশ্ন বুঝে আরহাম। অল্প হেসে জানায়,

— সব তোর।

তোঁষা’র খুশি আর দেখার কসুর রইলো না। একে একে ব্যাগ খুলে সব বিছানায় ছড়ালো। এত এত সুন্দর সুন্দর সব কি না তোঁষা’র সেখানে দাতা কি না ওর আরহাম ভাই! ভাবা যায়?
লাল নেটের শাড়ীটা হাতে তুলেই হাসোজ্জল চোখে তাকায় তোঁষা। আরহাম আপ্লূত চোখে তাকিয়ে রইলো। কতগুলো বছরের বিচ্ছেদ অতঃপর ই না আজ তারা এক। দুটো দেহ একটি প্রাণ।
তোঁষা হাতের শাড়ীটা উল্টে পাল্টে দেখতে দেখতে আনমনে প্রশ্ন করে,

— এই শাড়ীটা অনেক সুন্দর।

— সুন্দর একটা দিনের জন্যই তার আগমন।

তোঁষা বুঝে না কথার অর্থ। পুণরায় জিজ্ঞেস করতেই আরহাম বলে উঠলো,

— যেদিন আমার প্রাণে মিশতে চাইবি ঐ দিন এটা পড়বি তাহলেই আমি বুঝে নিব আমার প্রাণ ঐদিন আমার মাঝে নিহিত হবে।

কথাটা গভীর হলেও এর মর্মার্থ বুঝে তোঁষা। লজ্জায় গাল দুটো গরম হয়ে যাচ্ছে যেন। আরহাম নিজ থেকে কাছে আসে নি আজ পর্যন্ত। প্রতিটা বার তোঁষা গিয়েছে। এবারও যাবে। গতরাতের শুধু মাত্র তোঁষা’র অনুরোধে ই না আরহাম তার কাছে রইলো ফলে ই না তোঁষা প্রশান্তির ঘুম দিলো। লজ্জায় নেতিয়ে গেলেও তোঁষা মুখ নামালো না বরং এক হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলো আরহাম’কে। ওর প্রিয় পুরুষটার দিকে।

#চলবে….?

[গল্পটা কাল্পনিক। বাস্তবতার সাথে মিল খুঁজবেন তো হতাশ হবেন। ]

প্রিয় প্রাণ পর্ব-০১

0

#প্রিয়_প্রাণ
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ১

বিয়ের সাজে বিধ্বস্ত হয়ে ফ্লোরে শুয়ে আছে তোঁষা। নাক দিয়ে চিকন ধারায় র*ক্ত গড়াতে গড়াতে এতক্ষণে শুকিয়ে জমে আছে। কিছুটা লাল তরল ছুঁয়েছে তার চিবুক। সুন্দর রমণী’র বিয়ের সাজটা ও অনেকটা লেপ্টে। মাথার দোপাট্টা’টা অবহেলায় দরজাটার কাছে পরে আছে। তোশা এতক্ষণ যাবৎ এক কোণায় বসে থাকলেও এখন ঘুমাচ্ছে। ক্লান্ত শরীর তার ঘুম চাইছে। রাত গভীর হতে হতে তার ঘুমটাও গভীর হয় একসময়। ঠান্ডা ফ্লোরটাতে একদম গুটিয়ে শুয়ে আছে ও।
দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই আরহামের নজর আটকালো ঘুমন্ত নতুন বউয়ের দিকে। দরজা আটকে ধীরে ধীরে পা ফেলে এগিয়ে আসতেই চোখ যায় তোঁষা’র ব্লাউজ আর লেহেঙ্গা’র মাঝখানে উন্মুক্ত কোমড়ের দিকে। আঁচড়ের মতো লেগেছে ওখানে। আরহাম ঝুঁকে ওকে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেয় সেখানটায়। ঘুমের ঘোরেই কিছুটা কাঁপে যুবতী। বাঁকা হেসে তাকে সোজা কোলে তুলে বিছানায় রাখতেই আরহামের হাত জড়িয়ে ধরে সে। ঘুম জড়ানো কন্ঠে ডেকে উঠে,

— আরহাম ভাই।

আরহাম মায়াময় দৃষ্টি ফেলে তোষা’র মুখপানে। তোঁষা’র চেহারাটাতে একটা বাচ্চা বাচ্চা ভাব আছে। একটু ঝুঁকে তোঁষা’র গালে নিজের শক্ত হাতটা রাখতেই সেটা নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলে তোঁষা। আরহাম আস্তে করে ওকে বহুতে করে তুলে বুকে জড়ায়। গম্ভীর কণ্ঠে বলে,

— হুস কাঁদে না তুঁষ। আমি আছি তো।

— আ…আমি ভয় পেয়েছিলাম। আপনি কোথায় ছিলেন?

প্রশ্নটা সে করলো তবে চোখদ্বয় তখনও বন্ধ। আরহাম এবার ওর গালে নজর দিলো গভীর ভাবে। ডান গালটাতে আঙুল ডেবেছিলো তাই লাল হয়ে আছে সেখানটাতে। এবার ঝুঁকলো আরহাম। খুব ধীর ভাবে চুমু খেলো সেই ফুলাফুলা গালে। একদম নরম ফোলা তুঁষের ন্যায় ই তুলতুলে তার তোঁষা’র গাল। আরহামের চোয়ালদ্বয় শক্ত হয়ে এলো। ওর তুঁষে’র এই নরম গালে এই লালদাগ? তাও কি না অন্য পুরুষের? আরহাম কি তা মানবে?কোনদিন ই না। ভেতরে জ্বলে গেলেও বাইরে যথাসম্ভব শান্ত রাখলো নিজেকে। ওর তুঁষ না খাওয়া আজ সারাদিন। গতরাতে ও খেয়েছে কি না সন্দেহ। আস্তে করে তোঁষা’কে তুলে বসিয়ে ঠেস দেয়ালো নিজের বুকের কাছে। নরম গালে হাত দিয়ে ডাকলো আদুরে গলায়,

— তুঁষ?

— উম।

— উঠ সোনা। খাবি না?

— উহু।

— একটু জান।

— ঘুমাবো।

— হ্যাঁ। ঘুমাবি তো। আগে খেতে হবে প্রাণ।

বলে আর অপেক্ষা করে না আরহাম। দুই হাতে বুক থেকে সরিয়ে গালে আলতো হাত বুলিয়ে সজাগ করাতে চায়। অথচ তোঁষা’র ঘুম ছুটছে না। কিছুতেই না। অনেক রাত ঘুম হয় না তার। আজ ও ওর প্রাণে’র বুকে আছে। এখন আর দৈহিক ক্ষুধা ওকে বশে আনতে পারবে না। কিছুতেই না। ওর মনের ক্ষুধা শুধু মাত্র ওর প্রাণ ই মিটাতে পারবে তার বুকে রেখে।
তোঁষা থেকে সাড়া না পেয়ে এবার আরহাম নিজেই ওকে জোর করে তুললো। তোলা বলতে ধরে একদম দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। তোঁষা পিটপিট চোখ করে ঢলে পড়তে নিলেই এবার আরহাম ওর বাহু চেপে ধরে। রাগী কন্ঠে ধমকে উঠে কিছুটা,

— একদম নড়বি না তুঁষ। গাল লাল তো হয়ে ই আছে একটা। আরেকটা আমি লাল করে দিব চড়িয়ে।

তোঁষা ফট করে চোখ খুলে। একদম সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে চেয়েও পারলো না। পায়ে কিছু একটা হয়েছে। আরহাম তাকিয়ে দেখলো পা থেকে মাথা পর্যন্ত। বধু সাজে তার তুঁষ যদিও সাজটা তার জন্য নয়। অন্য পুরুষের জন্য এই সাজ অথচ তুঁষ’টা এখন তার। তার প্রাণ। হঠাৎ নজর যায় উন্মুক্ত পেটের দিকে। কোমড়ের দিকে আঁচড় থাকলেও পেটে বেশ ভালোই একটা ক্ষত। আরহাম হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিতে নিলেই তোঁষা হেলে যায় ওর শরীরে। ততক্ষণাৎ করে আগলে নেয় আরহাম৷ ওর তুঁষে’র শরীরটা খারাপ। দূর্বল জান একটা। সোজা কোলে তুলে ওয়াশরুম হাটা দেয় আরহাম৷ নিজের সাথে ধরে দাঁড় করিয়ে নাকের থেকে আসা র*ক্ত মুখে দেয় হাত দিয়ে ডলে। র*ক্ত গুলো শুকিয়ে আঠা হয়ে যাওয়াতে একটু বেশিই ডলতে হলো। সেই সাথে তোঁষা’র পুরো বিয়ের সাজটা ও ধুয়ে দিলো আরহাম৷ কোন চিহ্ন নেই এখন কারো। ওর তুঁষ এখন শুধু মাত্র ওর। তোঁষা’কে পরিস্কার করে আবার কোলে তুলে রুমে এসে ওকে বসালো বিছানার পাশে বড় কাউচটাতে। হাত রাখলো তোঁষা’র গলার কাছে। একে একে খুলে দিলো সকল অলঙ্কার। কানের ভারী দুলটা খুলেই ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠে তোঁষা। আরহাম বিচলিত হলো। আঙুল দিয়ে চেপে ধরে কানের লতি। দুলটা খোলার সাথে সাথেই ওখান থেকে র*ক্ত পড়ছে। তোঁষা কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,

— আরহাম ভাই, ব্যাথা পাচ্ছি।

— এই তো সোনা। হয়ে গিয়েছে।

আঙুলটা সরিয়ে পাশের ড্রয়ার থেকে মেডিসিন বক্স বের করে আরহাম। এনটিসেপটিক মলমটা আঙুলে নিয়ে আস্তে করে লাগিয়ে দেয় ওর কানে। তোঁষা আরহামের এক হাত ধরে আছে। আরহামের দৃষ্টি শান্ত অথচ ভেতরে চলছে তার দামামা। প্রত্যেকটা আঘাতের শোধ না তুলা অবদি এই দুনিয়া ত্যাগ করবে না আরহাম। ওর প্রাণ’কে আঘাত দেয়ার শাস্তি কতটা ভয়ংকর এবং বিশ্রী তা সকলে বুঝিয়েই ছাড়বে ও।
তোঁষা’র হাত ছাড়িয়ে ওর সামনে হাটু গেড়ে বসে আরহাম। তোঁষা’র পড়নে লেহেঙ্গা আর উপরে ব্লাউজ। মধ্যেখানে উন্মুক্ত তার উদরখানি’র বাইরের চামড়া। সাদা চামড়ায় ক্ষত। বড্ড বিশ্রী ব্যাপার ঠেকলো আরহামের নিকট। ওর তুঁষ শুধু নামেই তুঁষ না সে সত্যিই শীতের সকালে পড়া তুঁষে’র ন্যায়। পাক্কা এক সাদা বরফ খন্ড।
আঙুলে মলম নিয়ে তোঁষা’র পেটে ছোঁয়াতেই ব্যাথায় ছটফটিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে যায় তোঁষা। তার জ্বলছে সেখানটায়। আরহাম শান্ত স্বরে বলে,

— চুপচাপ বস তুঁষ। মাথা খারাপ করবি না।

— জ্বলছে।

— একটু সহ্য কর।

কথাটা বলেই উঠে কাউচে বসে আরহাম। নিজের কোলে টেনে বসায় তোঁষা’কে। একহাতে পেছন থেকে ওকে আঁকড়ে ধরে আরেক হাতে পেটের আর কোমড়ের ক্ষত’তে মলম লাগায়। তোঁষা মুখ গুজে আছে আরহামের গলায়। সেখানে মুখ দিয়েই ছটফট করলো কিছুটা। কিছুক্ষণ পরই ওখানে ঠান্ডা অনুভব হয় ওর। আরহাম তখনও একে একহাতে জড়িয়ে অন্য হাত দিয়ে মাথায় হাত বুলাচ্ছে। তোঁষা ঠান্ডা হতেই আস্তে করে ওর মুখটা তুলে। লাল হওয়া গালটাতে মলম লাগিয়ে আলতো করে একটা চুমু খায় সেই গালে। চোখ বুজে নেয় তোঁষা। প্রিয় ছোঁয়া এটা ওর। ওর প্রাণে’র ছোঁয়া। ওর প্রিয় পুরুষটার ছোঁয়া। তোঁষা’র চোখ গলিয়ে পানি পরলো। এই পুরুষটাকে পেতে কম কষ্ট করতে হয় নি তাকে। বহু কষ্টের ফল এই আরহাম ভাই তার। শুধু মাত্র তার তুঁষে’র।

আরহাম ভেজা অনুভব করে গালে। ওর তুঁষ কাঁদে কিন্তু কেন? এখন কেন কাঁদবে? এখন তো সে তার প্রাণে’র কাছে। আরহাম ব্যাস্ত হয়। দুই হাতে তোঁষা’র গাল ধরে অস্থির হয়ে প্রশ্ন করে,

— এই তুঁষ? এই? প্রাণ আমার কেন কাঁদছিস?

— আমি ভয় পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম আর পাব না আপনাকে। আরহাম ভাই? এত দেড়ী কেন করলেন?

কন্ঠ জুড়ে শুধু আকুলতা আর আরহাম’কে না পাওয়ার ভয়। চোখ জুড়ে ভর করে আছে ভীতিকর চাহনি। আরহাম জাপ্টে ধরে ওকে নিজের বুকে। শক্ত থেকেও শক্ত হয় ওর বাঁধন। কম্পমান গলায় রাগ মিশিয়ে কাঁপতে কাঁপতে বলতে থাকে,

— তুই শুধু আমার তুঁষ। আমার প্রাণ তুই। আমি বাদে আর কেউ ই তোকে স্পর্শ করতে পারবে না। কেউ না। আর কাঁদিস না সোনা। তোর প্রাণ এখন তোর কাছে না?

— বাবা মে’রেছে আমাকে। দেখো। গালেরটা বাবা মে’রেছে।

আরহামের শরীরে এবার ভয়ংকর কম্পন হচ্ছে। কিছুতেই যেন থামবে না সেই কাঁপন। তোঁষা ও দুই হাতে তাকে জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলো। এত বড় হুষ্টপুষ্ট পেটানো শরীরটা কিছুতেই নিজের বাহুতে আটকাতে পারলো না ও। তবুও কত চেষ্টা তার আরহাম ভাই’কে বুকে চেপে রাখার। যতটুকু পারা গেলো ততটুকু জাপ্টে রাখলো। আরহামের চোখ দুটো তখন ভয়ংকর দেখাচ্ছে। তার তুঁষ’কে যারা আঘাত করেছে তাদের কাউকে সে ছাড়বে না। তাকে দেয়া ওয়াদা ভঙ্গ করার শাস্তিটা বড্ড কঠিন হবে।

তোঁষা’কে রেখে খাবার নিয়ে আসে আরহাম। তোঁষা নাক টানে। আরহাম পাশ থেকে টিস্যু নিয়ে ওর সর্দি মুছে দিয়ে ভাত মেখে তোঁষা’র মুখে লোমকা দিলো। তোঁষা খেতে গিয়েও মুখে, গালে ব্যাথা পাচ্ছে। বাবা থাপ্পড়টা গতরাতে অনেক জোড়েই দিয়েছিলো।
চতুর্থ লোকমা খেতে খেতে তোঁষা বললো,

— আপনি কেন খাচ্ছেন না? আপনিও খেয়ে নিন।

— আগে তোর হোক।

— একসাথে খেলে ভালোবাসা বাড়ে।

— যতটুকু ভালোবাসা আমার কাছে আছে আগে তো এতটুকু সামাল দে। তারপর তোর না পোষালে বাড়িয়ে নিব ভালোবাসা।

তোঁষা গাল ফুলাতেই নিজের মুখেও ভাত তুলে আরহাম। আরহাম খেয়াল করলো ওর তুঁষে’র ফোলা গালে হাসি। দু’জনের খাওয়া হতেই আরহাম ভেজা হাতে তোঁষা’র মুখটা মুছিয়ে দিয়ে একটা টুস্যু দিয়ে ও মুছিয়ে দেয়। তোঁষা সেই এটো টিস্যু দিয়ে আরহামে’র ঠোঁট মুছে দেয়। পুরু ঠোঁট’টা এলিয়ে হাসে আরহাম। এতেই যেন লজ্জা লাগে তোঁষা’র। কদু’র মতো গাল দুটো ধারণ করে রক্তজবার রং। ইশ! এভাবে কেন হাসে ওর আরহাম ভাই? ম’রে না যাবে তোঁষা? এত সুন্দর বলিষ্ঠ দেহের পেটানো শরীরের পুরুষটা তার আরহাম ভাই। পরক্ষণেই ওর মনটা তীব্র প্রতিবাদ জানায়,”গাঁধা তুঁষ আরহাম ভাইয়ের তুই তোঁষা। সে এখন শুধু মাত্র তোর চাচাতো ভাই আরহাম না বরং তোর বিয়ে করা বর”। মনের গহীনে কথাগুলো ভাবতেই পুণরায় লজ্জা লাগে তোঁষা’র। যুবতী’র স্বপ্নের পুরুষ সে। লম্বা চওড়া সুন্দর ফর্সা ত্বকের অধিকারী এই আরহাম ভাই এখন থেকে তার প্রাণ।

আরহাম দেখে তোঁষা’র নত মুখ। আলতো হাতে ছুঁয়ে দেয় গালটা। তোঁষা নাক টানে। আরহাম ওর হাতটা ধরে বলে,

— কাল সব লজ্জা দেখব তোর। আজ ঘুমাবি প্রাণ।

আরহামের কথায় এবার লাল পাঁকা টমেটো’র ন্যায় গাল দুটো ঝুলে গেলো যেন তোঁষা’র। আরহামের মুখে একটু চিন্তার ভাজ। এই জড়ি দেয়া কাপড়ে কিভাবে ঘুমাবে ওর তুঁষ? কিছুই তো আনা হলো না। আরহাম আলমারি খুলে হাতায় একটু। নাহ। তেমন কিছুই নেই। তোঁষা একপলক দেখে ওর আরহাম ভাই’কে। বুঝার চেষ্টা করে কি খুঁজে তার আরহাম ভাই। আরহাম মনযোগ দিয়ে কিছু খুঁজেই যাচ্ছে। না পেয়ে আবার রাগে ফোঁসফোঁস ও করছে। তোঁষা মিনমিন করে ডাকে,

— আরহাম ভাই?

— বল তুঁষ।

— কি খুঁজেন?

— কিছুনা।

— বলুন না। আমি খুঁজে দেই।

— তুই চিনিস কিছু? চুপ করে বস।

— কি এমন খুঁজেন যে বলেন না? আন্ডারওয়্যার?

আরহাম চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই তোঁষা মুখ নামিয়ে নাক টানলো। আরহাম ততক্ষণে পেয়েছে কিছু। এগিয়ে এসে তার সবচেয়ে ছোট টিশার্ট আর একটা টাউজার তোঁষা’কে দিয়ে বললো,

— আমি রুমের বাইরে দাঁড়াচ্ছি। তুই চেঞ্জ কর।

বলেই আরহাম বের হয়। তোঁষা বড়বড় পোশাকের দিকে তাকিয়ে আবার নিজের ছোট্ট দেহটার দিকে তাকায়। এগুলো দিয়ে তো তোঁষা’কে আলাম দাফন দেয়া যাবে।
ভাবতে ভাবতে হাতে তুলে টিশার্টা। নাকের সামনে নিয়ে বুক ভরে শ্বাস টানে। আরহামের ঘ্রাণ আসে এটা থেকে। ঠোঁটে হাসি দেয়া দেয় ওর। বিপত্তি বাঁধে ওটা পড়তে নিলে। ব্লাউজের হুক,ফিতা সব পেছনে। ওর হাত পৌঁছাচ্ছে না ওখানে কিছুতেই। অনেক চেষ্টা করেও শেষমেশ ব্যার্থ ই হলো।
আরহাম প্রায় মিনিট বিশ পর নক করে ভেতরে ঢুকে তোঁষা’কে আগের অবস্থায় দেখে কিছুটা রেগে যায়। তবে ওর লটকানো মুখ দেখে আর কিছু বলে না। জিজ্ঞেস করে,

— চেঞ্জ করতে বলি নি?

— পারছি না তো?

আরহাম দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। তারই বুঝা উচিত ছিলো। তোঁষা’কে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে যতটুকু পারা যায় সাহায্য করে চেঞ্জ করতে।

আপাতত তোঁষা’র পড়নে কমলা রঙের ঢোলাঢালা এক টিশার্ট আর লম্বা ঢোলা এক টাউজার। আরহাম ওর পায়ের কাছে বসে টাউজারটা পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত গুটিয়ে দিয়ে ওর চুলগুলো আঁচড়ে বেঁধে দেয়। অতঃপর ওকে রেখে নিজেও কাপড় বদলে ফিরে আসে।
তোঁষা’কে নিয়ে শুয়িয়ে দিয়ে যখন আরহাম উঠে যেতে নিলো তখনই ওর হাত টেনে ধরে তোঁষা। মোলায়েম গলায় আরহাম বলে,

— একটু আসছি।

— উহু।

— তুঁষ?

— আচ্ছা ঘুমাব। সত্যি বলছি।

আরহাম মানে। তোঁষা’কে বুকে আগলে নিয়ে মনোযোগী হয় ঘুম পাড়াতে। দুর্বল তোঁষা ও ঘুমিয়ে যায় কিন্তু বুঝে না সদ্য বিবাহিত পুরুষটার বুকে যখন জ্বলছে তুঁষে’র আগুন। ঢোক গিলে আরহাম। সময় দরকার তার। খাওয়ার পরই তোঁষা’কে মেডিসিন দেয়া শুরু করেছে ও। ধীরে ধীরে সবটা ঠিক হবে৷ একদম আরহামের কথামতো হবে। ওয়াদা রাখতে না পারার শাস্তিতা সত্যি ই ভয়াবহ হবে।

#চলবে….?

নিঝুমপুর পর্ব-১৪ এবং শেষ পর্ব

0

নিঝুমপুর -১৪

মা সেন্স হারিয়েছে৷ বড়মামা, মোকলেস আলী মাকে নিয়ে সেন্ট্রাল হাসপাতালে গেল। নানীবুকে নিয়ে গেলাম আমি। মায়ের কি হয়েছে ডাক্তার কিছু বললেন না তবে তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষনে রাখা হলো। সব কিছু এত দ্রুত ঘটে গেল, কেউ কিছু বোঝার আগেই।

বড় মামা আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন।
চিন্তা করিস না নিঝু, সব ঠিক হয়ে যাবে। সকালে মাকে নিয়ে যাব আমরা।

আমি শান্ত স্বরে বললাম, আমি চিন্তা করছি না মামা।

রাত বাড়ছে। নানীবুর শরীর ভালো না, দুর্বল হয়ে পড়েছে। তাকে রেখে আসতে বড় মামা বাড়িতে চলে গেলেন। আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম একাকী। কিছুক্ষণ পরে
আমার ছবি এসে পাশে দাঁড়ালো নিঃশব্দে।

আমি একটু হাসার চেষ্টা করে জিজ্ঞেস করলাম, কখন এসেছ?

-এই তো!

-বসো।

ছবি আমার পাশে বসল।

-কি হয়েছিল জানো?

না।

আজ একটা লোক এসেছিল। সম্ভবত এই লোকের সাথে মা পালিয়ে গিয়েছিলেন!

ও আচ্ছা।

এটাই শেষ কথা না। আরো আছে।

ছবি জানতে চাইল কিনা বুঝতে পারছি না। তবে আমার বলতে ইচ্ছে করছে।

-তুমি ভাবছ, এই লোক আমার বাবা, তাই তো? সেটা ঠিক না। এই লোকটি মাকে নিয়ে গিয়ে একটা ঘরে আটকে রেখেছিল। সেখানে দিনের পর দিন অনেক পুরুষকে পাঠিয়েছে। আমার বাবা কে, সেটা মা জানে না। এই সত্য আমি জেনে যাব, সেটা ভেবে মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সেঁজুতি আপুর মা, মানে আমাদের বড়মামী কে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, মায়ের এসব কথা জানাজানি হওয়ার পরে। এই সব কথাই আমি আর সেঁজুতি আপা দুজনেই জানি।
আশেপাশের লোকজন কানাকানি করত, বড়মামা তাই সবাইকে নিয়ে মেহেন্দীগন্জ থেকে ঢাকায় চলে এসেছিলেন।

ছবি কোন কথা বলল না আর।

-মায়ের কি দোষ বলো তো ছবি ? একটা অমানুষকে বিশ্বাস করেছিল, এটাই?

একজন নার্স এসে ডাকছেন। আইসিইউ নম্বর সাত, কে আছেন, স্যারের সাথে দেখা করুন। পেশেন্টের অবস্থা ভালো না।

-ছবি, এটা মায়ের বেড নম্বর। আমি যাব না। তুমি যাও।

একটা নিঝুমপুর ছেড়ে মা অন্য এক অচিনপুরে চলে যাচ্ছে। ছবি আমার একটা হাত ধরল। আমি কাঁদছি না। কাঁদার মত কিছু হয় নি। আমি কখনো কাঁদব না।

শেষ

শানজানা আলম

নিঝুমপুর পর্ব-১১+১২+১৪

0

নিঝুমপুর -১১

মোকলেস আলীকে আমরা দুইবোন সাবলেট আন্টির ঘটনা জানালাম না। কারন এটা বলার মত কোন ঘটনা না৷ মোকলেস আলীর কাছে একটা ফোন এলো আন্টির অফিস থেকে। সম্ভবত এটা মিথ্যা কথা, ফোন এসেছে থানা থেকে সম্ভবত, মোকলেস আলী গেল সেখানে খুঁজতে।

তবে আন্টিকে আনা গেল না। আবুল হাসান সাহেব মোকলেস আলীর সাথে গেলেন তবে বিশেষ কাজ হলো না। এই দেশে সাধারণ মানুষেট মামলা মোকদ্দমার ঝক্কি হয় সাংঘাতিক। মাদক মামলা থেকে রেহাই পাওয়া খুব একটা সহজ বিষয় না। আন্টিকে কোর্টে চালান করা হয়েছে। সেখান থেকে কারাগারে নিয়ে যাবে। ভালো উকিলের খরচ চালানো মোকলেস আলীর সামর্থ্যের বাইরে।
এসব বিষয় চুপেচাপে বাসায় ঘটতে লাগল আর আমরা ভাব করলাম, আমরা কিছুই জানি না।

এই বিপদের মধ্যে একটা সুখবর হলো, ছবি মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। সে ফোর্থ হয়েছে। ছেলেদের মধ্যে সেকেন্ড। এই খবর বাসায় আসার পরে সব চাইতে খুশি হলো ময়না খালা। সে বার বার বলতে লাগল, পোলাটা মায়ের মত খাইস্টা না, ব্রেন্ট ভালো! একটু পড়ালেকা করল না, সে নাকি মেডিকেলে চান্স পাইলো!

কয়েকটা কোচিং সেন্টার থেকে ছবির খোঁজে বাসায় এলো। ছবি তাদের কাছে কোচিং করেছে, এটা ছবিকে বলতে হবে, তাদের সাথে ছবি তুলতে হবে। ছবির জন্য তারা খাম নিয়ে এসেছে। খামে কি আছে, আমার দেখার ইচ্ছা ছিল, কিন্তু ছবি রাজী হলো না। সে তার কোচিংয়ের ভাইয়া ছাড়া কারো কাছে পড়েছে, এটা বলতে রাজী হলো না।

ছবির এই সাফল্যে বড়মামাও খুশী হলেন। ধলু মামা বাজারে গেল। বাজার থেকে গরুর মাংস নিয়ে এলো।
ব্যপক উৎসাহে বাড়িতে গরুর মাংস আর খিচুড়ি পাক হলো। ছবি লজ্জা পেলো মনে হয়। এক ফাঁকে এসে আমাকে বলে গেল, আপা, আপনি না থাকলে আমি তো কিছুই পারতাম না!

আমি হেসে বললাম, পারতে, তুমি তো সবই পেরেছিলে প্রথম দিন যে ভাইয়া টেস্ট নিলো, আমি তো দেখেছিলাম।

আপনি আমার ছোট না হলে আপনাকে একটা সালাম করতাম!

এই সেরেছে! থাক, এত আদিখ্যেতা দেখাতে এসো না আবার।

সত্যি বলতে ছবি যে আমার চাইতে বড়, এই বিষয়টা আমার মনেই ছিল না। খুবই হাস্যকর বিষয়।

সেঁজুতি আপা আমাকে জিজ্ঞেস করল, তোর সাথে ওর এত ফিসফাস কি? ওকে তো দেখলাম পরীক্ষা দিতেও নিয়ে গেলি!

আমি একটু রহস্য করে হাসলাম শুধু। থাকুক আপা একটু চিন্তায়!

মোকলেস আলীকে চিন্তিত দেখায় না, তবে তার চুল পেকে গেল কয়েকদিনে। একদিন সকালে সে বড় মামার কাছে গিয়ে বলল, সে বাড়ি যেতে চায়। অনেক দিন তো হলো, রোজিনা নাই, ভাড়াও দিতে পারবে না।

বড় মামা তাকে বললেন, ভাড়া দিতে হবে না। সে যেন রোজিনা আন্টিকে না ছাড়িয়ে কোথাও না যায়।

মোকলেস আলী এই বাড়ির সদস্য হয়ে থাকতে শুরু করল।

চলবে

নিঝুমপুর -১২

দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল নিরিবিলি। আবুল হাসান সাহেবের মা একদিন এলেন আর মেয়েকে নিয়ে। সারাদিন থাকলেন আমাদের বাড়িতে। বিকেলে যাওয়ার সময়ে বড় মামাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। খুব আশ্চর্য বিষয় হলো, বড় মামা কোনো উচ্চবাচ্য করলেন না। রাজী হলেন সহজেই। তার পরের শুক্রবারে সেঁজুতি আপার সাথে আবুল হাসান সাহেবের বিয়ে হলো। বিয়ের পরে আপা আর হাসান সাহেব, সরি সাহেব বলছি কেন! ওনাকে এখন দুলাভাই বলতে হবে। দুলাভাই আমার ডাকতে ইচ্ছে করে না। হাসান ভাই বলা যাক বরং! তো যা বলছিলাম, আপা আর হাসান ভাই চলে গেল তাদের ফ্ল্যাটে। আমি, ছবি, ধলু মামা, মোকলেস আলী আমরা গিয়ে আপা আর হাসান সাহেবকে পৌঁছে দিয়ে এলাম।

আপা চলে যাওয়ার পরে আমি কিছুটা একা হয়ে গেলাম। যদিও আপার সাথে আমার অনেক বেশি কথা হতো না, তবু রাত বিরেতে একা থাকতে হতো না।

হাসান সাহেব চলে যাওয়ার পরে ছবি চিলেকোঠায় থাকতে শুরু করল। তার ক্লাশ শুরু হলে হলে চলে যাবে। তার আগ অবধি এখানে থাকবে।

ধলু মামার ছেলে এসেছিল। সে চাচ্ছে মামা তার সাথে গিয়ে থাকুক। এখানে আর কত দিন! কম তো বয়স হয় নি! এবারে আরাম করুক!

ধলু মামা যেতে রাজী হলো। প্রতিমাসে সে এসে দেখে যাবে। আর মোকলেস আলী তো রইলই বাড়ির দেখাশোনা করার জন্য। ধলু মামা চলে গেল ছেলের সাথে।

এখন নিচতলায় থাকে মোকলেস আলী। ধলু মামার কাজগুলো সে করে। চিলেকোঠায় থাকে ছবি।
বাড়িভাড়া থেকে আয় ইনকাম বন্ধ হয়ে গেছে। আমাকে কোচিং ছেড়ে দিতে হলো।

একদিন দুপুরে বাড়িতেই ছিলাম। ছবি সাধারণত দুপুরে থাকে না। কোথা থেকে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল, আপা, কোচিংয়ে যাচ্ছেন না?

না, কেন?

এমনিই, এজাজ ভাইয়ার সাথে দেখা হলো, তার কাছে শুনলাম।

আপাতত আর যাব না৷

আচ্ছা… কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল ছবি।

★★★

মাস কেটে গেল আরেকটা।
একদিন সকালে দেখি যে ভদ্রলোক সেঁজুতি আপাকে খুঁজতে এসেছিলেন, উনি এসেছেন।

তার কাছ থেকে জানতে পারলাম সেঁজুতি আপার মা আমাদের বড় মামী মারা গেছেন। উনি আপার জন্য ছয় লাখ টাকা আর কিছু গয়না রেখে গেছেন। আপা তো নিজের বাসায় আছে এখন। আপাকে পেলেন না।
তাই মামার সাথে কথা বলছেন।
বড় মামা বললেন, সেঁজুতি মায়ের টাকা নেবে কিনা সেটা তার বিষয়, আমি তাকে জানাতে পারি। জোর করতে পারি না।

আপাকে ফোন করা হলো। লাউডস্পিকারে দিয়ে মামা তাকে জানালেন, তোমার মা কিছু টাকা রেখেছেন। তুমি কি নিতে চাও?
আমি মোটামুটি শতভাগ নিশ্চিত আপা টাকা নেবে না।
কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে আপা বলল, সে টাকা নিতে চায়। মায়ের স্মৃতি গয়নাও।

ভদ্রলোক ভালো মানুষ। উনি আপাকে দেখা করে সব বুঝে নিতে বললেন।

সেঁজুতি আপা গেল এবং টাকা গয়না নিয়ে বাড়িতে চলে এলো।

টাকা গুলো বড় মামাকে দিয়ে বলল, আপাতত কয়েক মাস এই টাকায় চলতে পারবে।
আর গয়নাগুলো দিলো আমাকে।

নিঝু, এই গয়না তুই রাখ। তোর তো বিয়ে হবে নাকি!
আমার তো মায়ের সাথে কোন স্মৃতি নেই, স্মৃতিচিহ্ন রেখে কি হবে!

তুমি এজন্য টাকা আর গয়না নিয়েছ?

আপা বলল, হুম। আমি না নিলে অন্য কেউ ভোগ করত! আমাকে দিয়েছে, আমি নিয়েছি! না নিয়ে ইগো দেখানোর কিছু নেই! না চাইতেই আমি স্বামী সংসার সন্তান স্বচ্ছলতা সব পেয়েছি! আমার আর কোন দুঃখ নেই!

আপার গয়না আমি নিলাম! ভালোবাসা ফেরাতে নেই! কিন্তু এই গয়না আমার কাছে অর্থনৈতিকভাবে মূল্যহীন!

রাতে খাবার টেবিলে মামা বড়মামা বললেন, নিঝুম, আবার কোচিং শুরু কর। পরীক্ষার তো বেশি বাকি নেই!

আমি রাজী হলাম। তবে পরীক্ষা দিতে ইচ্ছে করছে না।
তাই আর কোচিংয়ে গেলাম না। কোচিংয়ের সময়টাতে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘোরাঘুরি শুরু করলাম।

চলবে

নিঝুমপুর- ১৩

ছবির মেডিকেলে ভর্তিসহ আনুষঙ্গিক বেশ কিছু টাকা লাগবে। ছবির বাবা তাকে রেখে গেছে তো গেছে, আর একবারো আসে নি। ছবিও বাড়ি যায় নি।
সেখানে টাকা দেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। তবে ছবিকে ভর্তি করে দিলেন বড় মামা। সেঁজুতি আপুর দেওয়া টাকা থেকে ছবি ভর্তি হলো। একসময় তার ক্লাশও শুরু হলো। আমাদের বাড়ি থেকে সে হলে চলে গেল।

আমার পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেল একসময়। ভালো নাই করতে পারি, তবে ফেল করব না। শেষ মুহূর্তে বইখাতা ঘেটে পরীক্ষায় বসলাম। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরে অফুরন্ত অবসর পাওয়া গেল। সারাদিন বাসায়ই থাকি। ভর্তি কোচিং না করে টুকটাক ফ্রিল্যান্সিং শেখার চেষ্টা করছি। পড়াশোনা না করলেও যাতে কিছু করে চলা যায়! তবে ঠিক পারফেক্টলি কোন ইনকাম করতে পারছিলাম না। ছবি কোচিংয়ের ভাইয়াদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে, একগাদা শিট দিয়ে গেছে। খাটের নিচে ঢুকিয়ে রেখেছি।

আমাদের বাড়িওয়ালা ফোন করেছিল। গত কয়েকমাসে কোন ভাড়া জমা হয় নি ব্যাংকে। ধলু মামাও চলে গেছে। তাই আমাদের উপরে বোধহয় আর ভরসা করতে পারছে না। মামার মুখ শুকনো হয়ে গেছে এই ফোন আসার পরে। কাউকে কিছু না বলে একা একা সারাক্ষণ চিন্তা করছেন।

এক সকালে একজন লোক এলো আমাদের বাড়িতে। চেহারার একপাশ ঝলসে গেছে। মনে হয় কেউ এসিড দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। এরকম লোক আমাদের বাড়িতে কারো পরিচিত হতে পারে, ঠিক জানি না।

লোকটি নিচে বসে আছে। সে আসার থেকে বাড়ির পরিবেশ কেমন পাল্টে গেল। বড়মামা লোকটিকে চলে যেতে বলছেন। লোকটি কিছু বিষয় নিয়ে তর্ক করার চেষ্টা করছে। আমি নিচে নামব ভাবছিলাম, কিন্তু রুমের ছিটকিনিটা বাইরে থেকে কেউ বন্ধ করে রেখেছে। জোরে কয়েকবার মাকে ডাকলাম, ময়না খালাকেও ডাকলাম কিন্তু কাজ হলো না। এত ডাকাডাকি না করে ঘুমিয়ে পড়লাম। আজ কোথাও যাব না, সারাদিন ঘুমাব।

আমার ঘুম ভাঙল সন্ধ্যায়। মা এসে বসেছে আমার পাশে।

-নিঝুম, ওঠ।

উঠে বসলাম চোখ ডলে।

-কিছু হয়েছে মা?

মা কিছু বলল না।

-কি বলবে বলো?

-তোর পড়াশোনার খবর কি?

-খবর ভালোই।

-হুম।

-বাড়িওয়ালা ফোন করেছিল। আমাদের বাড়িটা ছেড়ে দিতে হবে। ডেভলপারকে দিয়ে দিবে কয়েকমাস পরে।

-ও আচ্ছা।

-গত কয়েকমাস আমাদের ভাড়াও পায়নি, সেটা অবশ্য দিতে বলে নি।

-হুম।

তবে এটা বলতে মা আসে নি, আরো কিছু বলতে চায়।

-কিছু বলবে মা?

-আজ যে লোকটা এসেছিল, তোর সাথে কথা বলতে চাইলে কথা বলবি না। খুব খারাপ লোক।

-ঠিক আছে মা।

-তুই উঠে ফ্রেশ হয়ে নে, আমি কিছু খেতে দিচ্ছি।

-আচ্ছা।

আমাকে খাবার দেওয়ার কথা বলে মা চলে যেতে যেতে পা ফসকে সিঁড়ি থকে পড়ে গেল। অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিল মনে হয়। আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে গিয়ে দেখি, মা অজ্ঞান হয়ে গেছে। আমি চিৎকার করে মামা আর নানীবুকে ডাকলাম।

……..

চলবে না,
শানজানা আলম

নিঝুমপুর পর্ব-৯+১০

0

নিঝুমপুর -৯

ছবি পরীক্ষা দিয়ে বের হয়ে আমাকে খুঁজে বের করল।
কেমন হলো পরীক্ষা – জিজ্ঞেস করতেই মুচকি হেসে বলল, ভালোই।

ভালোই?- ভালো না?

মনে হয় ভালো হইছে। আমাদের কোচিংয়ের এমসিকিউ গোল্লা ভরতে দেয় না। টিক দিতে হয়। টিকের নিচে আবার কোনটা টিক দিলো, কেন দিলো সেটা এক লাইনে লিখতে হয়। আমার কাজ ছিল স্ক্রিপ্টগুলো চেক করা। এই দেড় দুই মাসে স্ক্রিপ্ট চেক করতে করতে আমার সমস্ত বই মুখস্থ হয়ে গেছে। যা আসছে, সবই পারছি।

বলো কি! তাইলে তো তুমি চান্স পেয়ে যাবে!

চান্স পাওয়া না পাওয়া আসলে কপাল আপা। আপনে আমার জন্য অনেক করছেন। আমি সারা জীবন আপনার কাছে ঋণী থাকব। আজকে বিকালে আমি বাড়ি চলে যাব।

ঢাকা ভার্সিটিতে পরীক্ষা দিতে চাও না!

ছবি কিছু না বলে হাঁটতে শুরু করল।

★★★

শেষ দুপুরের দিকে সেঁজুতি আপা টেনে তুলল। এই নিঝু, ওঠ তো!

কেন আপা?

চল এক জায়গায় যাব।

কোথায়?

আমার বাপের বউকে দেখে আসি।

এভাবে বলছ কেন!

তাহলে কিভাবে বলব?

তাই তো, কিভাবেই বা বলবে, এত ছোট অবস্থায় মেয়েটাকে রেখে চলে গেছেন মামী!

মামী ভর্তি আছে পান্থপথের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। আমরা বাসা থেকে বের হয়ে থানার সামনে হেঁটে গেলাম। আপা সিএনজি খুঁজছিল না। হঠাৎই একটি গাড়ি এসে থামল। আবুল হাসান সাহেব ড্রাইভিং করছেন!
আমি ফিসফিস করে জিগ্যেস করলাম৷ উনি কি ড্রাইভার? নাকি পার্টটাইম উবার চালান?

আরে গাধা৷ গাড়িটা ওর! – আপা হাসল হাসান সাহেবকে দেখে।

আচ্ছা আপা….

পরে জিজ্ঞেস করিস। এখন চল। – আপা থামিয়ে দিলো আমাকে।

আমরা গাড়িতে উঠে বসলাম।

হাসপাতালে আমাদের বেশি সমস্যা পোহাতে হলো না। সেদিনকার লোকটি আপাকে দেখে চিনতে পারলেন এবং আপাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন।

আপা বেশিক্ষণ থাকল না। দশ মিনিটের মধ্যেই বের হয়ে এলো। সেই লোকটি বললেন, আবার এসো মা। তোমার যখন খুশি, মায়ের কাছে এসো।

আপা উত্তর দিলো না। আমরা আবার হাসান সাহেবের গাড়িতে উঠে বসলাম। তবে বাসায় গেলাম না। পান্থপথ থেকে বের হয়ে ভুতের গলির অলিগলির ভেতরে একটা বাড়ির ভেতরে এসে ঢুকলাম।

আপা ডাকল, আয়। এটা আমাদের বাসা।

আমার চমকানোর হয়তো আরো অনেক বাকি ছিল।
লিফটে করে যে ফ্ল্যাটে আমরা গেলাম, সেখানে একজন বয়স্ক মহিলা দরজা খুলে দিলেন। তিন বছরের একটি বাচ্চা মেয়ে দৌড়ে এসে আপাকে জড়িয়ে ধরল, মামাম এসেছে! মামাম!

চলবে

নিঝুমপুর -১০

ছোট বাচ্চাটাকে সেঁজুতি আপা কোলে নিয়ে আদর করল।
আপার কাঁধে হাত রেখে বললাম, বিয়ে করেছ?

নাহ, বিয়ে করব বলেই হাসানকে আগে বাড়িতে নিলাম। ওকে বলেছিলাম, তোমার মত আমি এত সাজানো গোছানো পরিবেশে বড় হই নি। আগে দেখে এসো।

-সেটা তো প্রস্তাব দিলেই জানতে পারতো।

-পুরোটা পারতো না। আমি আরশিয়াকে খুব ভালোবাসি। ওর কাছে চলে আসতে চাই। কিন্তু হাসানের বাচ্চা আছে জানলে আব্বা কী বিয়ে দিতে চাইবেন!

-সহজ বিষয়টা জটিল করে ফেলেছ আপা!

হাসান সাহেব একটু হাসার চেষ্টা করে বললেন, নিঝুম অনেক ম্যাচিউরড। তোমার মত ছেলেমানুষি করে না!

হাসান সাহেব আর আপার বয়সের পার্থক্য ১৪/১৫ বছর হতে পারে। অনেক কিছু জানা হয়ে গেল আজ!

এক ছুটির দিনে আরশিয়াকে নিয়ে চুল কাটাতে পার্লারে গিয়েছিলেন হাসান সাহেব। সেঁজুতি আপা তার কোনো বান্ধবীর সাথে গিয়ে অপেক্ষা করছিল ওয়েটিং রুমে।
আরশিয়া কিছুতেই পার্লারের মেয়েটার সাথে যাবে না। হাসান সাহেব অসহায় বোধ করলেন।
সেঁজুতি আপা বললেন, মায়ের সাথে পাঠাতেন!

হাসান সাহেব ঈষৎ হেসে বললেন, ওর মা নেই!

সেঁজুতি আপা তখন আরশিয়াকে কোলে নিয়ে ভেতরে গেল। ওর চুল কেটে নিয়ে বের হলো যখন, আরশিয়া আর বাবার কোলে যাবে না!

আপাকে যেতে হলো হাসান সাহেবের বাসায়।
আরশিয়া খেয়ে ঘুমিয়ে পড়া অবধি অপেক্ষা করতে হলো। হাসান সাহেব আপাকে পৌঁছে দিয়ে গেলেন সেদিন। মাঝে মাঝেই আপা আরশিয়াকে দেখতে যেত আর এভাবেই দুজনের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি হলো!
আরো জানতে পারলাম আরশিয়ার মা আরশিয়াকে রেখে চলে গেছে নিজের প্রেমিকের সাথে।

বাসায় ফিরলাম হাসান সাহেবের সাথেই। আরো কিছুদিন পরে বাবার কাছে প্রস্তাব দেবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওরা। বাড়িতে শুধু আমিই জানলাম।

রাতে আপাকে বললাম, আপা, আমার মনে হয় তুই হাসান সাহেবকে ভালোবাসিস না। মামী তোকে ফেলে চলে গেছেন আর আরশিয়াকে ফেলে চলে গেছে ওর মা! তুই একটা চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছিস!
বিয়ে করার আগে নিজেকে প্রশ্ন করে নিস!

আপা কিছু বলল না উত্তরে। একটা নিঃশ্বাস ফেলল। হয়তো আমি সত্য না। অথবা আমিই সত্য! কে জানে কোনটা মিথ্যা!

রাত বাড়ছে। মোকলেস আলী আজ রাতেও আমাদের সাথে খেয়েছে৷ সাবলেট আন্টি অফিস ট্যুরে গাজীপুরে গিয়েছে, ফিরতে রাত হবে।
সে আমাদের সাথে বসে খাচ্ছে এটাই এখন স্বাভাবিক বিষয় হয়ে গেছে। মা বা নানীবু তার জন্য তারকারি বাটিতে রেখে দেয়।
ছবির চলে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সে যায় নি। রাত করে ফিরেছে। খাবার টেবিলে তাকে দেখা গেল। ছবি, ধলু মামা, মোকলেস আলী একত্রে খায়৷ খাওয়া শেষে ছবি আবুল হাসান সাহেবের খাবার নিয়ে দিয়ে আসে।

সে রাতে সাবলেট আন্টি বাসায় ফিরল না। মোকলেস আলী গভীররাত অবধি গেটের সামনে চেয়ারে বসে রইল।

সকালে আপা আমাকে ডেকে তুলল।

এই নিঝু ওঠ তো!

কেন আপা?

দেখ এই নিউজটা, এটা সাবলেট আন্টি না?

জাতীয় দৈনিকের ফেসবুক পেজে খবর আপডেট – রাজধানীর একটি আবাসিক হোটেল থেকে মাদক সহ ভ্রাম্যমান দেহব্যবসায়ী আটক!

রোজিনা আন্টির চোখ মুখ ঢাকা হলেও তাকে চিনতে অসুবিধা হচ্ছে না।

চলবে

শানজানা আলম