মোকলেস আলীর গভীর রাতে আগমনের কারন জানা গেল, একটা কাজে ঢাকা এসেছেন। দিন কয়েক থাকতে হবে। সচিবালয়ে তার কাজ আছে। তাই রোজিনা আন্টির ঘরেই থাকবেন।
বড় মামা বিষয়টা পছন্দ করলেন না। ঘরের মধ্যে বাইরের মানুষ, তাও একজন বয়স্ক পুরুষ, তিনি সোজাসাপটা বললেন, এরকম কোনো কথা ছিল না৷ বাড়িতে মেয়ে যুবতী আছে, আম্মারও পর্দা নষ্ট হবে। মোকলেস আলী যেন বাইরে থাকে।
মোকলেস আলী বললেন, ভাই সাহেব, এইটা কেমন কথা বলতেছেন?
আমি আমার বউয়ের ঘরে থাকব না তো কোথায় থাকব!
বড় মামা বললেন, সেটা আমার দেখার বিষয় না৷
তবে সাবলেট আন্টি চিন্তিত হলেন না৷ বরং খুশি হলেন।
এতই খুশি হলেন যে রাতে মশলা পিশতে বসে গেলেন, স্বামীর জন্য রান্না করবেন।
রাত দুটোর সময় আমাদের রুমের দরজায় কেউ কড়া নাড়ল। ঘুম চোখে দরজা খুলে দেখি, সাবলেট আন্টি। হাসিমুখে আমাদের খেতে ডাকতে এসেছেন।
সেঁজুতি আপা উঠল না। সে এত রাতে সেহেরি খানা খাবে না৷ আমাকে যেতে হলো৷
গিয়ে দেখি ছবিও বসা। বাসার ছেলেমেয়েদেরকে সাবলেট আন্টি ডেকে নিয়েছেন।
মোকলেস আলী অত্যন্ত বেশি কথা বলেন।
বুঝলা বউ, কালা বিলাইডা ছাও দিছে পাঁচটা। এক্কেরে ধবধবা!
রাত দুপুরে তার বাড়ির কুত্তা বিড়ালের গল্প শুনে সাবলেট আন্টি হেসে গড়িয়ে পড়ছেন। আমরাও হাসার চেষ্টা করছি, তবে হাসি পাচ্ছে না।
মোকলেস আলীর যাওয়ার কোনো লক্ষন দেখা গেল না। সে আস্তানা গাড়ল ধলু মামার ঘরে। সারাক্ষণ বাইরে থাকে। রাতে ফিরে ওখানে ঘুমায়।
ছবির জায়গা হলো আবুল হাসান সাহেবের ঘরে।
ছবিও অবশ্য বাসায় থাকে না। সকালে উঠে চলে যায় টিউশনিতে। সেখান থেকে ফিরে ফার্মগেট যায়। সারাদিন থাকে, রাত নয়টার পরে বাসায় আসে। অল্প কিছু খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। আমার সাথে তার দেখাই হয় না।
বাড়িতে অনেক মানুষ এখন। সাবলেট আন্টি আর মোকলেস আলী বাদে বাকিরা সবাই একত্রে খায়।
সাবলেট আন্টির দিনে অফিস থাকে। মোকলেস আলী দিনে বাসায় থাকে না।
একদিন দুপুরে মোকলেস আলী বাসায় ফিরে এলেন। তখন দুপুরের খাবার সময়। তিনি খুব স্বাভাবিক ভাবে সবার সাথে খেতে বসে বললেন, দেখি একটা প্লেট দেন। বেজায় খুদা লাগছে, যেন দীর্ঘদিন সে এ বাড়ির বাসিন্দা।
এখানেই তার খাওয়ার কথা!
বড়মামা জিজ্ঞেস করলেন, আপনি এখানে খাবেন?
হুম, ভাইজান যে কি বলেন! ভুখ লাগছে খাবো না? আমার বউ থাকলে তো চিন্তা লাগত না, সে তো চাকরিজীবী! এখন দুপুরের সময় আমি কই খাব!
খুবই অকাট্য যুক্তি। তাকে প্লেট দেওয়া হলো। খেতে বসে মোকলেস আলী, সেঁজুতি আপাকে বললেন, দেখু একটা কাঁচা মরিচ দাও তো!
মোকলেস আলীর এই উপদ্রব একদিনে কমল না। সেদিন শুরু হয়ে প্রতিদিন দুপুরেই সে বাসায় ফিরে। বাড়ির সামনে বালতিতে জল ভরে গোসল করে খেতে বসে। খাওয়ার পরে ধলু মামার ঘরে ভাত ঘুম দেয় নাক টেনে।
বড়মামা ঠিক করলেন, রোজিনা আন্টিকে বাসা ছেড়ে দিতে বলবেন।
রোজিনা আন্টিকে বড়মামা ঘর ছেড়ে দেওয়ার কথা বললেন। রোজিনা আন্টি তাকে মিন মিন করে বললেন, মোকলো আলী যে ব্যবসা করতেন, সেইটায় ধরা খেয়েছেন। এখন হাতে কোনো টাকা পয়সা নেই! কোথায় যাবে মানুষটা!
মাস ঘুরে এলো৷ ছবি একদিন আমার হাতে একটা খাম দিয়ে বলল, এইখানে দুই হাজার টাকা আছে।
টাকা?
হুম৷ টিউশনির বেতন পাইছি।
তো আমাকে দিচ্ছ কেন?
বাজার সদাইয়ে কাজে লাগান আপা। আমি একটা বাড়তি মানুষ আছি। থাকছি, খাচ্ছি।
খাম ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, টাকা দিতে হবে না। ভর্তি পরীক্ষার সময় অনেক খরচ। নিজের কাছে রেখে দাও।
ছবি তর্ক না করে ফেরত নিয়ে নিলো।
চলবে
শানজানা আলম
নিঝুমপুর -৮
সাবলেট আন্টি বা মোকলেস আলী কেউই ঘর ছাড়ার লক্ষ্মণ দেখালো না। তারা ভালোই আছে, মোকলেস আগে সারাদিন বাইরে থাকত, এখন বাড়ির ভেতরেই থাকে। সকালে রাতে বউয়ের সাথে বসে খেলেও দুপুরে আমাদের সাথে খায়।
তবে মোকলেস আলী বেশ কাজের লোক বলে মনে হলো। ছাদের কিনারে পাকুর গাছ বড় হয়েছিল। সে একদিন লুঙ্গি কাছা দিয়ে পাকুর গাছ কেটে ফেলল।
শুধু কাটলই না, শেকড় বাকড় উপরে ফেলে দিলো।
ছাদের বড় ট্যাংকিটা দীর্ঘদিন অকেজো হয়ে পড়েছিল। মোকলেস আলী সেই ট্যাংকি ধুয়ে ফেলল, একটা পুরোনো মোটর পড়েছিল ধলু মামার বিছানার নিচে, সেটা সাড়াই করে পানি তোলার ব্যবস্থা করল। এখন দিন রাত চব্বিশ ঘন্টা পানি থাকে। পানি তোলার কোনো চিন্তা থাকে না। ধলু মামা নিশ্চিন্ত থাকেন।
বাড়ির পাশে দেয়ালের সাথের প্যাসেজে ময়লা জমে ছিল, সেটাও পরিস্কার করে ফেলল একদিন।
সামনের উঠানের এক কোণে কিছু ইট ছিল, সেগুলো ভেঙে খোয়া করে প্যাসেজে দিয়ে একটা রাস্তার মত করে ফেলল বাড়ির পেছনদিকে যাওয়ার জন্য।
মনেই হলো না, সে এই বাড়িতে সাবলেট থাকে। মনে হলো, এই বাড়ির কেয়ার টেকার আসলে ধলুমামা না, মোকলেস আলী। মোকলেস আলীকে দায়িত্ব দিয়ে ধলুমামা নিজের ছেলের বাড়িতে বেড়িয়ে এলেন দিন সাতেক।
এক সকালে একটা বড়গাড়ি করে একজন ভদ্রলোক এলেন আমাদের বাড়িতে। তিনি এসে সেঁজুতি আপুকে খুজলেন।
সেঁজুতি আপু আসার আগেই বড় মামার সাথে তার কথা বলতে হলো। তিনি জানালেন, তাকে সেঁজুতি আপার মা পাঠিয়েছে। আপাকে এক নজর দেখতে চান, তিনি খুবই অসুস্থ। সেঁজুতি আপুর মা, আমাদের বড়মামী শুনেছিলাম ঢাকায়ই থাকে।
ভদ্রলোক আপাকে কয়েকবার বলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলেন। বড় মামাও বললেন, তুমি ইচ্ছা করলে যাইতে পারো, তোমার খুশি। আমি বাঁধা দিতেছি না। আমি ভেবেছিলাম সেঁজুতি আপা যাবে, তবে আপা রাজী হলো না। অপরিচিত কোনো জায়গায় সে যাবে না।
ছবি এসেছে প্রায় দুই মাস হয়ে গেছে। তার মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার ডেট দিয়েছে। তবে তাকে পড়াশোনা করতে দেখি না খুব একটা। দুই মাসে সে বেশ চালু হয়েছে। একদিন দুটো শার্ট আরেকটা প্যান্ট কিনে এনে আমাকে দেখিয়েছে। জুতাও কিনেছে দেখলাম। আগে একটা বোকা বোকা চেহারা ছিল, সেলুন থেকে চুল দাঁড়ি সব সাইজ করে চেহারা ভালো করে ফেলেছে।
কোচিং-এর ভাইয়া তাকে একটা ফোন দিয়েছে, যখন তখন কাজে লাগলে যেন যোগাযোগ করতে পারে।
এখন আমাদের বাড়িতে সে শুধু ঘুমাতেই আসে। বেশিরভাগ দিন রাতে খায়ও না।
আমাকে একদিন বলল, আপা আমার পরীক্ষা শুক্রবার। নয়টার মধ্যে হলে ঢোকা লাগবে।
আমি বলল, ভালো তো, যাও পরীক্ষা দিয়ে এসো।
-আপনি যাবেন আমার সাথে?
-পরীক্ষা কোথায়?
-সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে।
-ওহ কাছেই তো!
-হুম।
-বাড়িতে জানিয়েছ?
-কাকে জানাব?
-তোমার আব্বা?
-সে বেশি পড়াশোনা জানা লোক না, এইসব বুঝবে না।
না জানাই ভালো।
-ওহ আচ্ছা।
-তোমার মা?
ছবি কোনো উত্তর দিলো না।
শুক্রবারে আমি গেলাম ছবির সাথে। কত কত মানুষ যে পরীক্ষা দিতে এসেছে, তার কোনো হিসেব নাই।
দেখছ৷ কত মানুষ!
হুম!
তোমার প্রিপারেশন কেমন?
বেশি ভালো না।
আচ্ছা সমস্যা নাই। এরপরে ঢাকা ভার্সিটির ফর্ম তুলো।
আচ্ছা।
ছবি পরীক্ষা দিতে ঢুকল। আমি বসে থাকলাম রাস্তার পাশে পরীক্ষা শেষ না হওয়া অবধি।
নিচে নেমে এলাম চিলেকোঠা থেকে, অর্ধেক সিঁড়িতে এসে ডাকলাম, সেজুআপা, নিচে ডাকছে। আমার ডাকে ওরা হয়তো ছিটকে আলাদা হয়ে গেল! দৃশ্যটা কল্পনায় ভেসে উঠলো চোখের সামনে।
আপাকে ডেকে আমি নিচে নেমে গেলাম। সিঁড়ির নিচে দাঁড়িয়ে দেখলাম, আপা ঠোঁট মুছতে মুুছতে নিচে নামছে।
আবুল হাসান নামের ভদ্রলোকের বয়স পঁয়ত্রিশ থেকে চল্লিশ হতে পারে। বেশিও হতে পারে। সেঁজুতি আপার বয়স কুড়ি কিংবা একুশ!
তার সাথে কিভাবে আলাপ, সেটা জানতে ইচ্ছে করছে।
সত্যি বলতে আবুল হাসানকে আমার খারাপ লাগে নি। মোটাফ্রেমের চশমায় বেশ ভালো লাগে দেখতে।
রাতে বিছানায় শুয়ে জিজ্ঞেস করলাম, আপা, আবুল হাসান সাহেবকে আগে থেকে চেনো?
সেঁজুতি আপা না তাকিয়ে বলল, আড়ি পাতা আর উঁকি দেওয়ায় তুই প্রাইজ পাবি নিঝু!
এটা তো উত্তর হলো না।
আমি উত্তর দিব না।
আমি সবাইকে বলে দিই যদি?
বল! কিন্তু কি বলবি?
এই যে তোমরা, একাকী ঘরে……
সেঁজুতি আপা হেসে বলল, বল গিয়ে। ভালোই হয় তাহলে।
বলো না, কাহিনীটা জানতে ইচ্ছে করছে।
পরে বলব। এখন না৷
কথা এগুতে পারল না৷
কয়েক দিন কেটে গেল। আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেলাম নতুন বাসিন্দাসহ। একদিন কলেজ থেকে ফিরে দেখি ডাইনিংয়ে দুজন অপরিচিত মানুষ ভাত খাচ্ছে। একজন বেশ বয়স্ক, আরেকজন ইয়াং ছেলে, আমাদের বয়সের আশেপাশেই হবে। ময়না খালা খেতে দিচ্ছে।
মায়ের কাছে জানতে পারলাম, একজনের নাম ছবি, আমাদের বয়সের ছেলেটা। ঢাকায় এসেছে কোচিং করতে। ময়না খালার সতীনের ছেলে।
আর বয়স্ক লোকটি ময়না খালার স্বামী। ছেলেকে কোথায় রাখবে এই চিন্তা করে ময়না খালার কাছে নিয়ে এসেছে। ময়না খালাও তো সম্পর্কে মা ই হয়। ছবি ভালো থাকবে।
ময়না খালা গজ গজ করতে করতে বলেছে, এর মায়ের জন্য আমি সংসার হারা হইছি, এরে আমি রাখতে পারব না।
ময়না খালার স্বামী মনে হলো এই কথা শুনলেন না। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, শলা আছে? দাঁতের ফাঁকে মাংস ঢুইক্কা রইছে!
আমি একটা টুথপিক দিলাম।
তিনি দাঁত খুচতে খুচতে গেলেন ধলু মামার ঘরে।
সন্ধ্যায় তিনি বের হলে আসপাশ ঘুরে দেখতে। আর ফিরলেন না। জানা গেল তিনি লঞ্চে উঠে চলে গেছেন ছবিকে রেখে। ছবি বেচারা মুখ শুকনো করে সিঁড়িতে বসে রইল।
রাতে আমি ডাকলাম, খেতে এসো।
আপনি কি পড়েন?
হ্যা পড়ি।
কোন ক্লাশে?
কলেজে পড়ি, তোমার থেকে ক্লাশে ছোট। কিন্তু আমাকে নিঝু আপা ডাকবে।
নিঝু আপা, আমাকে লঞ্চঘাট থেকে লঞ্চে তুলে দিতে পারেন? আমি ঢাকায় কিচ্ছু চিনি না।
না। আমাকে আব্বা কোনো টাকা পয়সা দিয়ে যায় নি।
আমি কিভাবে কোচিং করব!
আচ্ছা, আপাতত খেতে এসো।
ছবির জায়গা হলো ধলুমামার ঘরে। এরকম অদ্ভুত সব মানুষের ভীড় বাড়ছে নিঝুমপুরে।
চলবে
নিঝুমপুর -৬
ছবি একটু চুপচাপ। ময়না খালা তো খুবই বিরক্ত। সে ছবিকে দেখতেই পারে না। খুবই রুড ভাবে কথা বলে।
বেচারা মরমে মরে যাচ্ছে। কেউ তাকে সদরঘাটে দিয়ে আসছে না। ময়না খালা সতীনের ছেলে, তোর মা আমার সংসার ভাঙছে, এসব বলে গালাগাল করে। আমার মা আর নানী বু কিছু বলে না, হিসেবের সংসারে চাল বেশি লাগছে, তাদের মুখ কালো থাকে। ধলু মামা তাকে মাঝে মাঝে বলে, সারাদিন ঘরের মধ্যে কি করো, বাইরে যাইয়া বসো।
ছবি চুপচাপ বসে থাকে বাড়ির সামনে স্বর্নচাঁপা গাছটার নিচে। মাঝে মাঝে বই নিয়ে পড়াশোনাও করতে দেখা যায় তাকে।
সেঁজুতি আপার এসব নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। তাকে আবুল হাসানের সাথে খুব একটা দেখা যায় না।
সে তার মতন আছে।
আমি ছবিকে একদিন বললাম, চলো তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাই।
ছবি ভয়ে ভয়ে জিগ্যেস করল, কোথায় আপা?
আমাদের কোচিংয়ের ভাইয়াকে তোমার কথা বলেছিলাম। উনি বলেছে, ওনার বন্ধু আছে, ফার্মগেটে মেডিকেল কোচিং করায়। তোমাকে নিয়ে সেখানে নিয়ে যাবে।
আমার তো টাকা পয়সা নাই।
সমস্যা নাই, সেটার একটা ব্যবস্থা করে দিবে ভাইয়া।
আমাদের ম্যাথ করায় এজাজ ভাইয়া। ওনাকে ছবির কথা বলায় উনি বলল, ছবিকে নিয়ে আসতে।
এজাজ ভাইয়ার সাথে আমরা সূচনা কমিউনিটি সেন্টারের সামনে থেকে লেগুনায় চেপে ফার্মগেটে গেলাম। একটা গলির মধ্যে অন্ধকার ধরনের একটা বাড়ি। সেখানে নিচতলার একটা ঘরে কিছু ছাত্র পড়াশোনা করছে।
ছবি বেশ দেরি করে ফেলেছে। তাই সবুজ ভাইয়া ছবিকে কিছু কোশ্চেন পেপার দিয়ে সলভ করতে বললেন।
ছবি ইতস্তত করে সলভ করতে শুরু করল। আমার বোর লাগছিল, মোটামুটি ধাচের ছাত্রী আমি, পড়াশোনা করতে হয়, তাই করি আর কি! টাইন্যা টুইন্যা পাশ করলেই খুশী, এত পড়ার কথা আমার ভালো লাগছিল না। ছবিকে রেখে যেতেও পারছিলাম না৷
প্রায় ঘন্টাখানেক পরে ছবির কোশ্চেন সলভ করা দেখে সবুজ ভাই বললেন, ছবিকে পড়াবেন। কোনো টাকা পয়সা লাগবে না, তবে তার কিছু কাজ টাজ করে দিতে হবে। তার একটু উপকারও হবে আর ছবির পড়াশোনাও হবে।
ছবি পারবে তো?- এজাজ ভাই জিগ্যেস করলেন!
ছবি ঘাড় নাড়ল, পারবে।
আবারও লেগুনায় চেপে ফিরে এলাম।
ফেরার পথে ছবিকে বললাম, তুমি একা একা যেতে পারবে?
ছবি আবারো ঘাড় নাড়ল, পারবে।
ঠিক আছে। ভাড়া টাড়া আছে সাথে?
ছয়শ টাকা আছে।
ছবিকে একটা টিউশন জোগাড় করে দিলে ও চলতে পারবে। তাই একটা কাগজে লিখে বাসার রোডে কামাল স্টোরে লাগিয়ে দিয়ে এলাম আমার ফোন নম্বর দিয়ে। এখানে অনেক মানুষ আসে। ছবির একটা টিউশনি জোগাড় হয়ে যাবে।
আশ্চর্য বিষয় হচ্ছে, দুইদিনের মধ্যে ফোন চলে এলো।
ছবি একটা টিউশনি পেয়ে গেল। ক্লাশ থ্রি এর একটা ছেলেকে পড়াতে হবে, সাড়ে তিন হাজার টাকা দিবে।
ছবিকে মোটামুটি গুছিয়ে দিয়ে ভালো লাগছে।
একদিন মাঝরাতে গেটে ঠক ঠক আওয়াজ হলো।
ধলু মামা জানতে চাইল, কে এসেছে এতরাতে!
ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো, আমি মোকলেস আলি। রোজিনা বেগমের স্বামী। আপনেদের সাবলেট রোজিনা।
রাতে খাবার সময় বড় মামা আমাদের জানালেন, ছোট মিয়া একটু সমস্যায় আছে, আপাতত সে আর টাকা দিতে পারবে না। এখন যেহেতু নিঝুম সেঁজুতি দুজনেই পড়াশোনা করছে, ওদের পড়ার খরচের জন্য হলেও আমাদের একটা উপায় বের করতে হবে।
সেঁজুতি আপা বলে উঠল, আমরা একটা রেস্টুরেন্ট করতে পারি। ভাতের হোটেল।
বড়মামা কটমট করে তাকালেন। সেঁজুতি আপা চুপ করে গেলেন।
বড় মামা বললেন, রান্না ঘরের পাশে একটা রুম আছে, এই রুমটা সাবলেট দিলে কিছু টাকা আসবে। ছাদের পাশের চিলেকোঠাও ভাড়া দেওয়া যেতে পারে।
ধলু মামা বললেন, আমারে যে বেতন দেয়, ওইটা তো ধরাই হয় না, ওইটা নিয়ে কাজ চালান আপাতত। বাড়িতে নতুন মানুষ ঢোকান লাগবে না। দুই দুইটা যুবতী মাইয়া বাড়িতে। আপনেদের সাথে এক হাড়িতে খাই এত বছর, কোনোদিন তো কিছু দেই নাই!
এটা ভুল কথা, ধলু মামা প্রায়ই বাজার করে আনে। কারন আমাদের ছোটোমামার ডলারে আমাদের বাড়িভাড়া, পড়াশোনা, নানীবুর ওষুধ, জামা কাপড়, বাজার এত কিছু পোষানো সম্ভব হয় না।
ধলু মামা নিজেই কাঁচা বাজার করে দেয়, ইলিশ মাছ কিনে আনে। আমরা কিছু মনে করি না৷ রিক্সাভাড়া লাগলেও ধলুমামার কাছ থেকে দশ বিশ টাকা নিয়ে যাই, আমি, সেজু আপা দুজনেই।
না না, ওইটা তোমার বৃদ্ধ বয়সের সম্বল, ওইটায় হাত দিবা না৷ আমাদের মেয়েদের নিয়ে কোনো ভয় নাই।
বলেই মামা বিব্রতবোধ করলেন। মনে হয় মায়ের অপকর্মের কথা মনে পড়ে গেল।
ঠিক আছে, মিস্ত্রি লাগাই তাইলে? গতমাসের ভাড়া তো জমা দেওয়া হয় নাই এখনো।
লাগিয়ে দেন, রুমটা একটু ঝাড়ামোছা করে চুনকাম করলেই সুন্দর হয়ে যাবে। চিলেকোঠার ঘরে যে থাকবে, তার টয়লেট ওয়াশরুম হবে নিচে। সেখানে থাকবে ব্যাচেলর।
এটা একটা সমস্যা। স্টোভে রান্না করতে পারবে।
আর ঘরের মধ্যে একজন মহিলাকে রাখা যেতে পারে।
পরের দিনই ধলু মামা মিস্ত্রি ডেকে কাজে লাগিয়ে দিলেন। রান্নাঘরের পাশের রুম থেকে কয়েক বস্তা মালামাল বের হলো। আমাদের সব পুরোনো কাপড়, বইখাতা, খেলনা। এগুলো ভাঙারীর দোকানে বিক্রি করে সাতশ পঁচিশ টাকা পাওয়া গেল। রুমটা ফাঁকা করার পরে দেখা গেল বেশ ভালো লাগছে, চুন করার পরে তো চেহারাই বদলে গেল। সারাবাড়ি থেকে কাঁচা চুনের গন্ধ আসতে লাগল।
আমাদের লোহা লক্করের গেটে ঝুলানো হলো টুলেট। একরুম এবং চিলেকোঠা ভাড়া দেওয়া হইবে।
ছোটো পরিবার/ব্যাচেলর।
আমার ধারনা হয়েছিল কেউ আসবে না, কিন্তু দুদিন পরে একজন এসে গেটে নক করল। চিলেকোঠার ঘরটা দেখতে চায়।
ধলুমামা তাকে চিলেকোঠার ঘরটা দেখালো। ভাড়া হবে তিন হাজার টাকা। দুই মাসের অগ্রীম টাকা দিতে হবে।
লোকটি রাজী হলো, তবে টয়লেট নিচে শুনে তার আগ্রহ শূন্য হয়ে গেল।
চিলেকোঠার ঘরে কোনো সাবলেটই উঠতে চাইল না। আমাদের রান্নাঘরের পাশে এক মহিলা উঠলেন, কোন একটা এনজিওতে ছোটখাটো চাকরি করেন, ঢাকায় একাই থাকেন, পরিবার থাকে গ্রামে।
চার হাজার টাকায় রুমটা ভাড়া হয়ে গেল।
এক ছুটির দিনে উনি উঠে পড়লেন। ওনার নাম রোজিনা। বয়সটা ঠিক বোঝা গেল না৷ চল্লিশের কমই হবে।
আমরা ভেবেছিলাম চিলেকোঠা ভাড়া হবে না। সেঁজুতি আপা অবশ্য খুশি হয়েছিল, কারন তাহলে সে তার খাতা বই নিয়ে চিলেকোঠায় উঠে যাবে।
তবে মাসের পাঁচ তারিখে এক ভদ্রলোক এসে বললেন, তিনি চিলেকোঠায় উঠতে চান। সম্ভব হলে আজই।
ওনার নাম হাসান। আবুল হাসান।
বাথরুম নিচে বলে তার সমস্যা নেই, তবে তাকে খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে পারলে ভালো হয়। এজন্য সে পে করতে প্রস্তুত। ধলুমামা তিন বেলা খাবার আর পানিসহ তার ভাড়া ধার্য করলেন ছয় হাজার টাকার।
হাসান নামের ভদ্রলোক খুশি মনেই উঠে পড়লেন চিলেকোঠায়।
নিঝুমপুরে আরো দুজন বাসিন্দা বাড়ল।
চলবে
শানজানা আলম
নিঝুমপুর -৪
নতুন বাসিন্দা আসায় আমাদের জীবনধারায় তেমন পরিবর্তন হলো না। ধলুমামা বাজার করেন আগের মত। ময়না খালা কাটাকুটি সেরে গোসল করে চুল আঁচরে নেয়। মা আর নানীবু রান্না ঘরে রান্না বান্না করেন। নানী বু সবার সাথে খিট খিট করেন।
সাবলেট আন্টি রাত দুপুরে কিচেনে রান্না করেন। তখন ধরাম ধরাম, টকাস টকাস শব্দ হয়। মনে হয় মশলা পিষেন। মা একদিন বললেন, আপনার দরকার হলে, মশলা আমাদের ফ্রিজে থেকে নিয়েন, রোজ রাতে বাটনা বাটা লাগবে না।
কিন্তু এতেও কোনো কাজ হলো না। আবুল হাসান সাহেব বেশ ভালো মানুষ। একটু উদাসীন ধরনের মনে হয়। বেশ বইপত্র নিয়ে এসেছেন, পড়াশোনা করেন, ল্যাপটপে মনে হয় লেখালেখিও করেন! উনি একটা পত্রিকায় ফিচার লেখক হিসেবে কাজ করেন সম্ভবত।
সেঁজুতি আপা একদিন বলল এটা। ওনার নাকি সুন্দর সুন্দর কবিতা আছে।
তুমি কিভাবে জানলে?
ওনার ফেসবুক প্রোফাইল খুঁজে বের করেছি।
কেন? কী দরকার ছিল?
সেঁজুতি আপা রহস্য করে বলল, দরকার ছিল না, আবার ছিল।
ওহ আচ্ছা।
তুই একটা কাজ কর, হাসান সাহেবকে এক কাপ কফি দিয়ে আয় তো নিঝু!
কফি! আমি কেন তাকে কফি দিতে যাব!
একা থাকে, পরিবারের সবাই দূরে, তাই দিবি।।
নাহ, আমার এত গরজ নাই বাবা, তুমি যাও।
সেঁজুতি আপা উঠে সত্যিই তিন কাপ কফি বানালো, তারপর দুটো কাপে নিয়ে বলল, ছাদে চল।
কেন?
কফি খাবি তাই।
তুমি তিনকাপ কফি দুটো কাপে নিলে কেন?
এমনিই। আয় ছাদে আয়।
আমরা ছাদে গেলাম। আবুল হাসান সাহেব নিজের ঘরে চেয়ার টেবিলে বসে কিছু লিখছিলেন।
সেঁজুতি আপা দরজা নক করে বলল, আসব?
ওহ তোমরা, এসো।।
কফি খাবেন তো, কফি নিয়ে এসেছি।
হ্যা সিওর, কফিতে আমার আপত্তি নেই। ভাবছিলাম একটা স্টোভ বা সিলিন্ডার নিয়ে নিব, কিন্তু সময় পাচ্ছি না।
সেঁজুতি আপা সেলফ থেকে একটা কাপে ওনাকে কফি ঢেলে দিলো, যেন আপা জানে, এখানে একটা কাপ আছে।
চল নিঝু, আমরা সিঁড়ি ঘরে বসি।
আহা চলে যাচ্ছ তোমরা?
আপা বলল, হুম।
নিচ থেকে আমাকে মা ডাকল, নিঝুউউ, আমি কফি না খেয়ে নেমে আসছিলাম। হঠাৎ মনে হলো, আবুল হাসান সাহেব অপরিচিত কেউ না। আপা ওনাকে এ বাড়িতে এনেছে। কতটুকু নিচে নেমে আবার উপরে চলে এলাম আড়ি পাততে।
দরজা চাপানোই ছিল। আমি উঁকি দিয়ে দেখলাম, হাসান সাহেব আর সেঁজুতি আপা দুজন দুজনকে চুমু খাচ্ছে!
আমাদের এই বাড়িটার নাম “চৌধুরী নিবাস”। খুবই কমন নাম, বাংলাদেশে যত চৌধুরী আছে, তাদের কমপক্ষে ষাটভাগ মানুষের বাড়ির নাম “চৌধুরী নিবাস”। তবে আমরা চৌধুরী নই। চৌধুরী ছিলেন যিনি বাড়িটা করেছিলেন, তিনি। তার নাম ছিল চৌধুরী এমাজউদ্দীন। এরশাদ সরকারের আমলে তিনি বিশিষ্ট শিল্পীপতি এবং গুরুত্বপূর্ণ আমলা ছিলেন। এই বাড়িটা তিনিই করেছেন। তিনিও এই বাড়িতেই থাকেন, তবে ঘরে না। বাড়ির কম্পাউন্ডের এক পাশেই তার কবর।
তার পরিবারের লোকজন দেশের বাইরে থাকে।
বাড়িটার অবস্থান আদাবর চার নম্বর রোডের একদম মুখেই। বেশ অনেকটা জায়গায় উঁচু প্রাচীর করা, লোহার গেট দেওয়া বাড়ি। পুরো গেট আমি কখনো খুলতে দেখিনি। একটা পকেটগেটে তালা দেওয়া থাকে, আমরা সেটাই ব্যবহার করি৷
গেট থেকে ঢুকে ছোট আঙিনায় কিছু গাছ লাগানো। একটা আমগাছ, একটা কামরাঙা গাছ আর দুটো কাঠাল গাছ। একটা স্বর্নচাপা গাছ বেশ বড় হয়ে উঠেছে। নারকেল আছে গোটা চারেক। এই গাছগুলো উঠানের মত আঙিনায় রোদ পড়তে দেয় না। বাড়ির সামনেটাও ছায়ায় ঢেকে থাকে।
তবে ছাদে অনেক রোদ পড়ে। আমরা এই বাড়ির ভাড়াটে। নিচতলা দোতলা মিলে আমাদের পরিবারের বেশ কিছু মানুষ এখানে থাকে।
যেমন বড়মামা। ওনার নাম তবারক হোসেন।
বড় মামা আমাদের বাড়ির মুরব্বি। তার কথায়ই এবাড়ির সব কিছু চলে। তার কথা বজ্র কঠিন এবং কোনো নড়চড় হয় না। বড় মামার একটাই মেয়ে, সেঁজুতি আপা, উনি বেশ সুন্দরী তবে আমার মামী নেই। কেন নেই সেটা আরেক গল্প, অন্য কখনো বলব।
নানীবু, নানীবুর বয়স আশির কাছাকাছি। সব কাজ করতে পারে, কিন্তু সারাদিন বাড়ির সবার ভুল ধরে বেড়ানো তার একমাত্র পছন্দের কাজ।
আমার মা আর আমি, আমার নাম নিঝুম, আমার মা তাসলিমা বেগম। মায়ের একমাত্র মেয়ে আমি। জ্ঞান হবার পর থেকে দেখছি আমি এই বাড়িতে, নানীবুর সংসারে। একটু বড় হয়ে জেনেছি, আমার মা এক বখাটে ছেলের সাথে পালিয়ে গিয়েছিল, যে আমাকে মায়ের গর্ভে রেখে পালিয়ে গেছে, আর ফিরে আসে নি। এইকথা অবশ্য বলা নিষেধ। তবে সবাই জানে।
আমি কেন্দ্রীয় কলেজে ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি।
আমার ছোটোমামা থাকে আমেরিকায়। সেখানে তার একটা বিশাল বাড়ি আছে। ফেসবুক ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইলে সুন্দর সুন্দর ছবি আপলোড করেন। আমেরিকান মামীর সুন্দর সুন্দর ফর্সা আমাদের মামাতো ভাইবোন। এই পরিবারের ইনকাম মূলত ছোট মামার পাঠানো ডলার। তবে ডলার বলতে যে অনেক টাকার ছবি ভেসে আসে, সেরকম কিছু না। কয়েকমাস পর পর ছোটমামাকে টাকার জন্য ফোন করতে হয়। মামা তখন বিরক্ত হয়ে কিছু টাকা পাঠিয়ে দেন।
এবং কেন কোনো আয়ের উৎস করা হচ্ছে না, এটা নিয়ে চেঁচামেচি করেন।
আমাদের সাথে আরো দুইজন মানুষ থাকে। তারা আমাদের কোনো আত্মীয় স্বজন নয়। একজন হলেন বাকের মিয়া, এই বাড়ির কেয়ার টেকার। আমরা তাকে ধলু মামা ডাকি। সে এই বাড়ির বহু পুরাতন বাসিন্দা, তার জন্যই একটা রুম আর কিচেন, বাথরুম করা হয়েছিল নিচতলায় গ্যারেজের পাশে। সেখানেই সে থাকে, বিপত্নীক, এক ছেলে নারায়ণগঞ্জে থাকে।
এখন আর এই বাড়ির দেখাশোনা করার কিছু নেই, তবুও ধলু মামা থাকে। আমাদের সাথেই খায়। বাড়িওয়ালার ছেলে মাসে মাসে তাকে বেতন পাঠিয়ে দেয়।
আরেকজন ময়না খালা। মূলত সে গৃহপরিচারিকা। তবে তার স্ট্যাটাস আমাদের সবার চাইতে ভালো। সে খুব সুন্দর করে গুছিয়ে শাড়ি পরে, চুল আচরায়। তরকারি কোটাকুটি করা ছাড়া তাকে অন্য কোনো কাজ করতে দেখা যায় না। বরিশালের পাঁচমিশালি শুদ্ধ বাংলায় সে কথা বলে। তার বিয়ে হয়েছিল কিন্তু স্বামী তাকে ছেড়ে দিয়ে আরেকটা বিয়ে করেছে। সে ইগো প্রবলেমের কারনে আর সে ঘরে ফেরত যায় নি।
মোটামুটি এই হলো আমাদের বাড়ির লোকজন। এই বাড়ির নাম চৌধুরী নিবাস হলেও, আমি এর একটা গোপন নাম দিয়েছি।
এই নামটা আমি অন্য কাউকে বলি নি।
সেই নামটা এখন বলছি, আমি এই বাড়ির নাম দিয়েছি
“নিঝুমপুর”।
চলবে
নিঝুমপুর- ২
একটা বিষয় খেয়াল করেছেন, এই নিঝুমপুরের বাসিন্দা সবাই একা। কারো কোনো সঙ্গী বা সঙ্গিনী নেই। তবে সবাই যে দুঃখী, তা নয়। সবাই একত্রে ভালো আছে। এই যে আমাদের ধলু মামা, উনি একাই রান্না করে খেতেন এক সময়ে। একদিন নানীবু দেখলেন, উনি নাকি ঢেড়স সিদ্ধ পাতে নিয়ে ভাত খেতে বসেছে।
আমার নানীবু বললেন, তুমি একলা একলা কোন ছাতা রান্না করো, আমাগো লগে দুইটা ডাইল ভাত খাও। পরের বেলায় ধলু মামা আমাদের সাথে খেতে এলো। এখন সে যে আমাদের আপন কেউ নয়, সেটা আমরা ভুলেই গেছি। ময়না খালার সাথে তার খুবই খাতির। দুজনে সুখ দুঃখের আলাপ করে ছাদে বসে। নানীবু একবার কথা পেরেছিলেন, ময়নাকে বিয়ে দিবা নি, ধলুর লগে!
বড়মামা কঠিন দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়েছেন নানীবুর দিকে। কথা আর আগায় নি। ধলু মামাকে দেখলে চট করে বোঝা যায় না, উনি কেয়ারটেকার গোছের কেউ। সব সময় ধোঁয়া জামাকাপড় পরে ফিটফাট হয়ে চলাফেরা করেন।
আমার বড় মামা খুবই বদমেজাজী ছিলেন। তখন তারা বরিশালের মেহেন্দিগন্জে থাকতেন। সেজুআপা তখন বেশ ছোটো৷ একবার কোনো কারনে তিনি রেগে গিয়ে পানির গ্লাস ছুড়ে মেরেছিলেন। বড়মামীর কপাল কেটে গিয়েছিল। বড় মামীর বাবা খবর পেয়ে এসে মেয়েকে নিয়ে চলে গেলেন তবে সেঁজুতি আপাকে নিলেন না। তার আদরের মেয়েকে এতদিন এইসব অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে ভেবে তিনি লজ্জিত। মাসখানেকের মধ্যে মামার কাছে তালাকের নোটিশ চলে এলো। শুনেছি মামীর আবার বিয়ে হয়েছে। ঢাকায়ই কোথাও থাকে।
তবে এই বিষয়েও কথা বলা নিষিদ্ধ।
আমাদের এই বাড়ির নাম হওয়া উচিত নিষিদ্ধ বাড়ি। সব কিছুই নিষিদ্ধ। জোরে কথা বলা নিষিদ্ধ, কোনো বিষয়ে প্রশ্ন করা নিষিদ্ধ।
সেঁজুতি আপা ইডেনে পড়ে বোটানিতে। তার একটা বড় সময় কলেজেই কেটে যায়। আমাদের অবশ্য বেশি ক্লাশ হয় না। সারাবছরই কলেজে কোনো না কোনো পরীক্ষার সিট পড়ে থাকে। দুটো কোচিং করিয়ে পড়াশোনা টিকিয়ে রাখা হচ্ছে আমার।
কোচিং থেকে বাসায় ফিরে দেখলাম মামার ঘরে বেশ গম্ভীর মিটিং চলছে। বিষয়টা জটিল মনে হলো। আড়ি পেতে শোনার চেষ্টা করলাম।
নানী বু চি চি করে কাঁদছেন আর বলছেন, কুলাঙ্গার পেটে ধরছি আমি!
আমার মা বলল, এইভাবে বইলো না মা, এতদিন তো দিছে, এখন মনে হয় আসলেই সমস্যা!
মামা কিছু বলছেন না।
যা বুঝলাম, ছোটো মামার কাছে টাকা চাওয়া হয়েছিল। মামা এবারে বলে দিয়েছেন, আর টাকা পয়সা দিতে পারবেন না। এবারে যেন নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরা করে নেওয়া হয়।
বিষয়টা চিন্তার। বড় মামা টুকটাক ব্যবসার চিন্তা করেছিলেন, তবে তার সাথে কারো বনিবনা হয় না।
এই বাসার ভাড়া আট হাজার টাকা, দীর্ঘ আঠারো বছরে এই বাসা ভাড়া মাত্র একবার বেড়েছে বছর দুই আগে। আগে সাত হাজার ছিল, দুই বছর ধরে আট হাজার দেওয়া হচ্ছে।
এই টাকা অবশ্য বাড়িওয়ালার খুব একটা কাজে লাগে এমন নয়, তবে বাড়িটার পানির ট্যাংকি পরিস্কার করাতে হয়, পেছনের ঝোপঝাড় পরিস্কার করাতে হয়, পুরো বাড়ির বাইরের বাতিগুলোর কারেন্ট বিল আসে সেটা দিতে হয়।এইসব খাতেই টাকা পয়সা লাগে।
সব চাইতে বড় বিষয়, আমাদের বাসার বাজারখরচ চলে ছোটো মামার টাকায়।
ঘরে গিয়ে দেখলাম সেঁজুতি আপা ফিরেছে।
মনোযোগ দিয়ে একটা আর্ট পেপারে পাতার ছবি আঁকছে৷
আমাকে দেখে মুখ তুলে বলল, নিঝু, শুনেছিস ঘটনা?
আমি বললাম, কোন ঘটনা?
কেন, আড়ি পাতিস নি? তোর তো আড়িপাতা স্বভাব আছে।
আমি বললাম, মামা টাকা পাঠাবে না, সেটা?
হুম।
শুনলাম।
তোকে তো চিন্তিত মনে হচ্ছে না!
চিন্তা করলে তো টাকা চলে আসবে না। তোমাকেও তো চিন্তিত মনে হচ্ছে না।
আমি চিন্তিত না তাই চিন্তিত মনে হচ্ছে না। আমি ঠিক করেছি, অনলাইনে একটা পেজ ওপেন করব। জামাকাপড় বেচব, খাবার দাবার বেচব। পড়ার খরচ উঠে যাবে।
আমাকে পার্টনার করে নিও। আমি তোমার জামাকাপড় প্যাকেট করে দেব।
সেঁজুতি আপা হি হি করে হেসে উঠলেন। আমিও হাসলাম।আমাদের দুই বোনের হাসি শুনে ময়না খালা উঁকি দিলেন। নিচ থেকে বড়মামা জিজ্ঞেস করলেন৷ এত জোরে হাসে কে?
#কাছে_কিবা_দূরে
#পর্ব-২৫/শেষ পর্ব
সারারাত তানি নির্ঘুম কাটালো। কেমন যেন এক অদ্ভুত অস্থিরতায় সারারাত ছটফট করলো। কখন সকাল হবে আর কখন ছুটে যাবে। ভোরের আলো একটু ফুটতেই তানি অভ্রকে ফোন করলো। যতক্ষণ পর্যন্ত অভ্র ট্রেনে না উঠলো ততক্ষণ পর্যন্ত একটানা ফোন করে গেল।
সারাদিন তানি অস্থিরতার মধ্যে কাটালো। একটু পর পর সময় দেখতে লাগলো। শুভ্র’কে এর মধ্যে ফোনও করেছে কয়েকবার কিন্তু কোনো রেসপন্স নেই। ভিতরে ভিতরে তানি আরও বেশী অস্থির হতে লাগলো। তানির মা টের পেলেন মেয়ের মনের মধ্যে কিছু একটা চলছে। চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“তোর কী হইছে মা?”
তানি একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, কিছু হয় নি তো মা।
“তাহলে এমন করতেছিস ক্যান? জামাইর সাথে কোনো কিছু নিয়ে ঝগড়া হইছে?”
তানি বলল, না না মা সেরকম কিছু না।
“তাইলে কী হইছে।”
তানি আমতা আমতা করে বলল, আসলে মা আমি আজ ঢাকা চলে যাব।
তানির মা অবাক গলায় বলল, কার সাথে যাবি? তুই না বলছিলি কয়টা দিন থাকবি?
“হ্যাঁ কিন্তু যাওয়া দরকার। আবার পরে আসব। অভ্র আমাকে নিতে আসবে।”
তাসলিমা খাতুন মেয়ের মতিগতি কিছুই বুঝলেন না। শুভ্র ঢাকায় থাকবে না তাই ভেবেছিল তানি বেশকিছুদিন থাকবে কিন্তু এখন ফেরার জন্য কেন পাগল হয়ে যাচ্ছে।
****
রাজশাহী ফিরে আবারও ফিরতি গাড়ি ধরতে হলো অভ্র’কে। তানির ফেরা নিয়ে তাসলিমা ছাড়া আর কেউ কিছু বলে নি। অভ্র গাড়িতে উঠে বলল,
“তোমার না গাড়িতে বমির সমস্যা হয়?”
“আজ দুটো ওষুধ খেয়ে নিয়েছি কোনো সমস্যা হবে না।”
“ভাবী তুমি কী একটু বেশী ব্যস্ত হচ্ছ না! এভাবে হানা দিলে ভাইয়া যদি রেগে যায়? ”
তানি বলল, রাগবে কেন? আমি তো তার গার্লফ্রেন্ড না যে কাজের জায়গায় গেলে রাগ হবে! বউরা কাজের জায়গায় যেতেই পারে।
অভ্র হেসে ফেলল। বলল, তোমাদের দুই রোমিও জুলিয়েটের চক্করে আমি ভাজা ভাজা হয়ে গেলাম।
তানি স্মিত হেসে বলল, আচ্ছা সময় আসলে সব পুষিয়ে দেব। তোমার বিয়ের শেরওয়ানির খরচ আমার। এবার খুশি তো?
অভ্র শব্দ করে হাসলো। তানিও তাল মিলিয়ে হাসলো।
অভ্র বলল, ভাইয়ার সাথে থেকে তুমিও অনেক স্মার্ট হয়ে গেছ।
তানিও মাথানিচু করে শুভ্র’র স্টাইলে বলল, মাই প্লেজার।
অভ্র আবারও হো হো করে হাসলো। সেই হাসির শব্দ শুনে কয়েকজন যাত্রী ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের দিকে তাকালো। অভ্র হাসি থামিয়ে বলল,
“ভাবী ইউ আর এ বেস্ট সিস্টার ইন ল ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। ”
তানির খুব আনন্দ লাগছে। এই আনন্দ কে বলে ঈদ ঈদ আনন্দ। ঈদের আগের রাতে সকাল হবার অপেক্ষায় যে আনন্দ অনুভূত হয় সেই আনন্দ। তানি মনে মনে শুভ্র’র অবাক হওয়া মুখ টা দেখতে পেল। হয়তো প্রথমে বিশ্বাস করতে না পেরে চোখ কচলে তাকাবে। তানির খুব মজা লাগলো যে শুভ্র’কে বোকা বানাতে পারবে।
নানানরকম জল্পনা, কল্পনায় জার্নিটুকু কাটালো তানি। বাস থেকে নেমে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেল। আনিকা আর ইরা দৌড়ে এসে তানিকে জড়িয়ে ধরলো। তানির তখনও হতভম্ব ভাব কাটে নি। শুভ্র দাঁড়িয়ে আছে, মিটিমিটি হাসছে। তানি অভ্র’র দিকে তাকাতে অভ্র বলল, ভাবী আই এম এ বেস্ট ব্রাদার ইন ল ইন দ্যা ওয়ার্ল্ড।
*****
তানি কপট রাগ দেখিয়ে বলল, আপনি আমার সাথে মিথ্যে কথা বলেছেন?
শুভ্র হেসে বলল, হ্যাঁ।
“কেন?”
“তোমার গুনধর দেওর আর তার ক্রাইম পার্টনার বলতে বলেছে তাই।”
তানি অভ্র’র দিলে তাকালো। অভ্র বলল, ভাইয়া এটা কিন্তু আনফেয়ার হয়ে যাচ্ছে।
তারপর তানির দিকে তাকিয়ে বলল, ভাবী আমি সব টা বলছি শোনো, এসব আসলে ভাইয়ার প্ল্যান। কাল এসে আমাদের বলল যেন আমরা মিথ্যে বলি।
শুভ্র হাই তুলে বলল, তোমাকে না জ্বালালে আমার একটুও ভালো লাগে না তো। তাই আর কী!
তানি আরও কিছু বলতে গেলে অভ্র থামিয়ে দিয়ে বলল, ভাবী থামো প্লিজ। এটা পাব্লিক প্লেস তো।
রাত আটটার দিকে সবাই মিলে কমলাপুরের দিকে এলো। তানি অনেকক্ষন গম্ভীর হয়ে থাকলেও একসময় না পেরে ইরাকে বলল,
“কমলাপুরে কেন যাচ্ছি?”
ইরা ফিসফিস করে বলল, হানিমুনে যাচ্ছ তোমরা।
তানি অবাক গলায় বলল, মানে কী?
ইরা মিষ্টি করে হাসলো তানির দিকে তাকিয়ে।
তানি বলল, এই শয়তান লোকটার সাথে আমি কোথাও যাব না। বিশ্ববাটপার একটা। আমাকে কতগুলো মিথ্যে বলল।
“আসলে তোমার জন্য সারপ্রাইজ প্ল্যান করছে তো এইজন্য। তুমি প্লিজ আর ম্যুড অফ করে থেকো না প্লিজ।”
আনিকা বলল, ভাবী আমাদের জন্য যাও প্লিজ।
তানির রাগ উবে গেল। এতো ভালো লাগছে ব্যাপার টা। সারপ্রাইজ দিতে মিথ্যে বললেও এখন ওর কাছে ভালোই লাগছে। তাই আর কিছু বলল না।
রেস্টুরেন্টে সবাই যখন একসাথে খেতে বসলো তখন শুভ্র তানির পাশে বসলো। নিচু গলায় বলল,
“শুনলাম তুমি নাকি স্বামীশোকে পাগল হয়ে গেছ?”
তানি কটমট চোখে কিছু সময় তাকিয়ে দাঁত বের করে বলল, হ্যাঁ। কপাল খারাপ বলে সারাজীবন একটা ড্রেনওয়ালাকে নিয়ে থাকতে হবে তো তাই পাগল হয়েছি।
শুভ্র ঠোঁট টিপে হেসে বলল, আজ তো বৃষ্টি আছে, রাস্তায় পানিও হয়তো আছে। একটা নর্দমা খুঁজে বের করব নাকি?
“প্লিজ করুন। তারপর আমি সেখানে আপনাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেব। ”
অভ্র বলল, ভাইয়া তোমাদের এসব ঝগড়াঝাটি দেখে আমার আবারও ভয় করছে।
আনিকা বলল, আমারও।
ইরা শুভ্র’কে শাসিয়ে বলল, ভাইয়া তুমি কিন্তু ভাবীকে খুব জালাচ্ছ। ভাবীর কিন্তু কোনো দোষ নেই।
শুভ্র বলল, আমরা ঝগড়াঝাটি করছি তাতে তোদের কী রে?
অভ্র বলল, আগেরবার ঝগড়া করে আমাদের কতগুলো টাকা নষ্ট করেছ।
তানি সায় দিয়ে বলল, ঠিক ই তো। ছোট ভাই বোনদের টাকায় বউকে নিয়ে ঘুরতে যায় একটুও লজ্জা নেই! আবার বড় বড় কথা!
শুভ্র হাই তুলতে তুলতে বলল, ওকে ফাইন। এই প্যারার বিয়ের সব পার্লার খরচ আমার।
ইরা লাজুক গলায় বলল, ঠিক আছে।
আনিকা বলল, ভাইয়া আমারও কন্ট্রিবিউশান ছিলো?
শুভ্র আনিকার গাল ধরে বলল, তোকে আবার আলাদা করে কী দেব? তোর বিয়েতে তো এমনিই যৌতুক দিতে হবে। যৌতুক ছাড়া তোকে কে বিয়ে করবে শুনি?
অভ্র বলল, হ্যাঁ ঠিক ই তো। এক কাপ চা পর্যন্ত বানাতে পারিস না, তোর আবার বিয়ে কিসের।
আনিকা মুখ ফুলিয়ে রইলো। বাকীরা সবাই হেসে ফেলল।
ট্রেনে ওঠার আগে মাহফুজা তানিকে ফোন করলো। বলল,
“রাগ, মান অভিমান যাই থাকুক সব মিটিয়ে আসিস। তোদের ছোট, খাট ঝগড়া দেখতে ভালো লাগে। বড় ঝগড়া হলে টেনশন হয়। তুই বাড়ি ছেড়ে যাওয়ায় কতো টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম জানিস? ”
তানি নতমুখে বলল, আই এ্যম স্যরি মা।
“উঁহু স্যরি বলতে হবে না। একটা কথা মনে রাখবি, সংসার শুধু ক’টা হাড়ি, পাতিল আর আসবাব পত্র দিয়ে ঘর সাজানো নয়। সংসার মানে দুজনের বোঝাপড়া, সমঝোতা আর অনেকখানি বিশ্বাস আর ভরসা। একজন যখন রেগে থাকে, অন্যজন কে তখন নমনীয় হতে হয়। দুই পক্ষ একসাথে রেগে গেলে জটিলতা বাড়ে। তাছাড়া রাগ কিংবা ঝগড়ার সময় মানুষ যা বলে সেগুলো সবসময় মনের কথা হয় না। তাই সবসময় সেসব ধরতে হয় না।
“বুঝেছি মা। আমি অনেক কিছুই জানি না। সব আস্তে আস্তে আপনার কাছ থেকে শিখে নেব। ”
মাহফুজা হেসে বলল, আচ্ছা যা তোর সময় নষ্ট করছি। আর শোন, আমাদের খুব একটা ফোন করার দরকার নেই।
তানি লজ্জা পেয়ে হাসলো।
****
ট্রেন ছাড়ার আগে অভ্র বলল, ভাবী তোমার বর কিন্তু আমাকেও ম্যাসেঞ্জারে ব্লক দিয়ে রেখেছে।
“কেন?”
“কারণ আমি বলেছিলাম যে, ভাবী রাগ করে গেছে যাক তাতে সমস্যা কী। এতো রাগ ভাঙানোর কী দরকার। ”
তানি হেসে ফেলল। অভ্র’ও হাসল। শুভ্র কাছে নেই, আনিকা আর ইরাকে নিয়ে চকলেট কিনতে গেছে।
ট্রেন ছাড়তেই তানি জিজ্ঞেস করলো,
“আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
শুভ্র তানির দিকে তাকিয়ে বলল, কোথায় আবার! এখন বর্ষাকাল, তাই ড্রেন খুঁজতে যাচ্ছি। হিস্ট্রি রিপিট করতে হবে। তাছাড়া তোমারও তো শখ হয়েছে।
তানি হেসে ফেলল। শুভ্র’ও হাসলো।
তানি বলল, আচ্ছা আপনার আর আমার যখন ফার্স্ট দেখা হয়েছিল তখন আপনি আমায় ভালো করে দেখেছিলেন?
“হ্যাঁ অবশ্যই। তুমি চোখের পানি আর নাকের পানি এক করে ফেলেছিলে। ”
তানি শুভ্র’র কাঁধে আলতো করে মারলো।
পরিশিষ্টঃ ওরা যেদিন শ্রীমঙ্গল পৌছালো সেদিন থেকে শুরু হলো বৃষ্টি। শ্রাবণের এই বৃষ্টিতে মান, অভিমান সব ধুয়ে মুছে গেল। বৃষ্টির রিনিঝিনি শব্দ শুনতে শুনতে ছেলেমেয়ে, নাতি নাতনিদের নাম ঠিক করে ফেলল। কোন স্কুল কোন কলেজে পড়বে সেগুলোও ঠিক করা হলো। এভাবেই চলতে থাকুক ওদের জীবনের ভালোবাসা আর খুনশুটির গল্পটা।
#কাছে_কিবা_দূরে
#পর্ব-২৪
তানি কিছু সময় ডায়েরি বন্ধ করে কাঁদলো। সিদ্ধান্ত নিলো আর পড়বে না। পড়ার দরকার ও নেই। ওর যা জানার জানা হয়ে গেছে। এতো বড় যন্ত্রণা বুকের ভিতর নিয়ে শুভ্র কিভাবে দিনের পর দিন হাসিখুশি ভাবে কাটিয়েছে! তানি নিজেই এইটুকু পড়ে সহ্য করতে পারছে না। তাহলে শুভ্র কিভাবে সহ্য করেছে। পড়বে না ভাবলেও নিজের কৌতূহল দমন করতে পারলো না। আবারও ডায়েরি খুলে পড়তে শুরু করলো।
অবন্তীর কাছ থেকে ধোকা খাওয়ার পর নিজের মন কে বারবার প্রশ্ন করলাম কেন আমার সাথে এসব হলো? কী দোষ ছিলো আমার? আমার ভালোবাসায় তো কোন কমতি ছিলো না। একসময় উত্তর নিজেই খুঁজে বের করলাম। অবন্তীকে ভালোবেসে আমি নিজের মা’কে কষ্ট দিয়েছি। মায়ের সাথে হওয়া অন্যায় কিংবা বেয়াদবি দেখেও কখনো অবন্তী কে কিছু বলিনি। কিছু বললে অবন্তী ঝগড়াঝাটি করবে, রাগারাগি করবে ভেবে চুপ থেকেছি বারবার। এক পর্যায়ে মা, ভাই বোন কে ছেড়ে আলাদা হয়ে গেছি। আমি আপনজনদের সাথে অনেক টা স্বার্থপর হয়েছিলাম বলেই অবন্তী আমাকে ঠকিয়েছিল। ভেবেছিলাম এ জীবনে আর বিয়েশাদি, সংসার করব না। কাজ, পরিবার এসবে ব্যস্ত থেকে জীবন টা কাটিয়ে দেব। কিন্তু মা তা হতে দিলেন না। একদিন এসে বললেন, তোর জন্য তোর মতো ই একটা ভালো মেয়েকে খুঁজে পেয়েছি। আমি মায়ের উপর ভরসা করলাম। একবার তো নিজের পছন্দ বহাল রেখে সবাইকে ভুগিয়েছি, তাই চাইলাম না আর তোমাকে দেখতে। দেখার পর মনে হলো মা আমার জন্য ঠিক মেয়েকেই পছন্দ করে এনেছে।
তানি আমি প্রথম তোমার প্রেমে কবে পড়েছিলাম জানো?
যেদিন তুমি রান্নাঘরে ঘামে ভিজে আমাদের সবার পছন্দের আইটেম রান্না করেছিলে।
এরপর আরেকটু প্রেমে পড়েছি সেদিন, যেদিন তুমি আনিকার জ্বর হয়েছিল বলে সারারাত জেগে ছিলে।
ইরার জন্য আলাদা করে পায়েশ, পিঠে রেখে দিতে যখন তখনও তোমার প্রেমে পড়েছিলাম একটু।
অভ্র’র সাথে রাত জেগে হেসে হেসে যখন গল্প করো তখন আমি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম আর ভাবতাম কেন এই মেয়েটার সঙ্গে আমার জীবন টা আগে জুড়ে গেল না!
চোখের পানিতে ডায়েরির পাতাগুলো ভিজে গেল। তানি ব্যকুল হয়ে কাঁদছে। এই প্রথম তানি খুশিতে এতো কাঁদছে। চোখ মুছে তানি আবার পড়তে শুরু করলো।
তানি আমি অবন্তীর প্রেমে পড়েছিলাম ওর রুপ দেখে। তোমাকে এক বিন্দুও মিথ্যে বলব না। অবন্তী আগেও এমন রাগী, বদমেজাজী ছিলো। তবুও আমি সেটা প্রশ্রয় দিয়েছিলাম। কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে আমি সেই ভুল করতে চাই নি। আমি তোমাকে চিনতে, জানতে চেয়েছি। নিজেকে জানাতে চেয়েছি। তোমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিতে অনেক সময় অনেক কিছু করেছিও কিন্তু বিশ্বাস করো ওই কথাগুলো বলতে চাইনি। আমার মনে হয়েছিল মানুষ হিসেবে আমি ভালো নই বলেই আমার সাথে বারবার এমন হয়। ভুল মানুষের সাথে দেখা হয়। কিন্তু যখন সত্যিটা জানলাম তখন ভিতরে ভিতরে কতো যে ছটফট করেছি তা তোমাকে বোঝানো সম্ভব নয়। তুমি যখন জ্বরে কাতর হয়ে বিছানায় শুয়েছিলে, আমি তখন দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে মনে মনে শতবার বলতাম তানি শিগগিরই সুস্থ হয়ে যাও। সুস্থ হয়ে আমাকে মারো, রাগারাগি করো কিন্তু আমার জীবন থেকে দূরে সরে যেও না। একটা রাত যেখানে তোমাকে ছাড়া থাকা সম্ভব না সেখানে সারাজীবন কিভাবে থাকব! তুমি দূরে চলে গেলে আমি হয়তো মরেও যেতে পারি।
তানি আমার জীবন টা এই ক’দিনে তুমিময় হয়ে গেছে। তোমাকে ছাড়া কিছুই ভালো লাগে না। খাওয়ার সময় গ্লাসে তুমি পানি না ঢেলে দিলে ভালো লাগে না। ঘুমানোর সময় গা ঘেষে না ঘুমালে কেমন যেন অশান্তি লাগে। রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে তোমার এলোমেলো চুল, চোখ বন্ধ করে কপাল কুচকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হওয়া মুখ না দেখলেও ভালো লাগে না।
আমার না জেনে, না বুঝে করা ভুলের জন্য যেটুকু শাস্তি তুমি দিতে চাও তা আমি মাথা পেতে নিতে রাজি আছি, কিন্তু তোমাকে কোনোভাবে হারাতে রাজি নই। তানি আমি একবার জীবনে সবকিছু হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছি, দ্বিতীয় বার আর আমাকে এভাবে নিঃস্ব করে দিও না প্লিজ। যদি মুখ ফিরিয়ে থাকতে চাও, কিংবা দূরে থাকতে চাও তাহলে থেকো। তবুও চোখের সামনে তো থাকবে। দিনশেষে আর শুরুতে যেটুকু চোখের দেখা দেখতে পাব তাতেই আমার তৃষ্ণা মিটে যাবে।
তানি ডায়েরির পাতাগুলো যখন পড়া শেষ করলো তখন সন্ধ্যে নেমে গেছে। আকাশে তখন বিকেলের আলো নেই। রাত নামার পায়তারা করছে। কিছু সময় বেলকনিতে বিমূঢ় হয়ে বসে থেকে শুভ্র’কে ফোন করলো। শুভ্র’র ফোন বন্ধ। আরও বারদুয়েক চেষ্টা করেও বন্ধ পেয়ে শেষমেস অভ্র’কে ফোন করলো৷ দু’বার রিং বাজতেই অভ্র ফোন ধরলো। বলল,
“হ্যালো ভাবী?”
তানি কান্নার দমকে কথা বলতে পারছে না। অভ্র ব্যস্ত হয়ে বলল,
“কী হয়েছে ভাবী?”
“তোমার ভাইয়াকে একটু ফোন টা ধরতে বলবে?”
“ভাইয়া তো কিছুক্ষন আগে বেরিয়ে গেছে। ”
তানি আরও জোরে শব্দ করে কাঁদতে শুরু করলো। অভ্র’র খুব খারাপ লাগলো। বলল,
“প্লিজ ভাবী কেঁদো না। কী হয়েছে আমাকে বলো”?
“তোমার ভাইয়াকে আমার এক্ষুনি লাগবে”।
অভ্র’র মুখের হাসি টা চওড়া হলো। বলল,
“ভাইয়া একুশ দিনের জন্য গেছে ভাবী। একুশ দিনের আগে তো তাকে পাওয়া যাবে না।”
তানি কাঁদতে কাঁদতে বলল, আমাকে নিয়ে চলো প্লিজ। ওনাকে না দেখতে পেলে আমি মরে যাব৷ কেন যে মরতে এখানে থেকে গেলাম!”
অভ্র বলল, ভাবী প্লিজ শান্ত হও। এভাবে অস্থির হইয়ো না।
তানি কোনো কথাই শুনছে না। অভ্র শেষমেস উপায় না পেয়ে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে আমি কাল রাজশাহী এসে তোমাকে নিয়ে ভাইয়ার কাছে যাব। এবার একটু শান্ত হও প্লিজ।
তানি কিছু সময়ের জন্য শান্ত হলো। অভ্র ফোন রাখতেই মাহফুজা চিন্তিত গলায় বলল, তানি কাঁদছিল কেন?
অভ্র হেসে ফেলল। বলল, ভাইয়াকে না দেখতে পেলে মরে যাবে তাই।
অভ্র হেসে ফেলল। খবর পেয়ে আনিকাও ছুটে এলো। বলল, ভাইয়া জানিস আমার না খুশিতে বারবার চোখে পানি এসে যাচ্ছে। অভ্র হাসলো। উত্তেজনায় ওর মুখ দিয়ে কথাই বের হচ্ছে না। আশ্চর্য তো! ওর ও তো আনিকার মতো চোখে পানি এসে যাচ্ছে।
*****
তানি ম্যাসেঞ্জারে শুভ্র’কে আনব্লক করে অনেকগুলো ম্যাসেজ পাঠালো। অপেক্ষা করেও শুভ্র’র রিপ্লাই না পেয়ে শেষমেস মেইলে লিখলো,
এই যে শুনুন, আপনি কী জানেন আপনি আমার দেখা পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ। এতো এতো কথা ডায়েরি তে লিখেছেন! অথচ এগুলো কিন্তু মুখে বললেই পারতেন। কেন আমি কী হিল্লিদিল্লি থাকি! চোখের সামনে ই তো দিনরাত ঘুরঘুর করতাম।
আচ্ছা শুনুন, আমিও অনেক কিছু জমিয়ে রেখেছিলাম যে আপনাকে বলব। কিন্তু আপনি যেহেতু মুখে কিছু আমাকে বলেন নি তাই আমিও বলব না। বরং লিখেই পাঠাই।
এই যে আমি আপনার সাথে কারণে অকারণে রেগে যেতাম। এমন কিন্তু আগে ছিলাম না। রাগা তো বহুদূর কারও মুখের উপর কিছু বলতেই পারতাম না। কিন্তু আপনার সাথে রাগতে পারি, একশ টা খারাপ কথাও শোনাতে পারি। কেন পারি বলেন তো! বলবেন কী করে! আপনি তো বিশ্ব গাধা! আপনি কী আর এসব বুঝবেন।
আপনাকে প্রথম দেখার পর তেমন কিছু ভাবার সুযোগ পাই নি। কিন্তু পরে যখন সেন্সে এলাম তখন মনে হলো ইশ মানুষ টা’র সাথে আর একটা বার আমার দেখা হতো! উপরওয়ালা আমার অনেক কিছু হারানো জীবনে একটা জিনিস ফিরিয়ে দিয়েছে। সেটি হলেন আপনি। শুনুন ড্রেনওয়ালা আপনি সেদিন আমায় হাত ধরে টেনি উঠিয়েছেন ঠিক ই কিন্তু যাওয়ার সময় আমার ছোট্ট মন টা চুরি করে নিয়ে গেছেন। কতো বড় চোর আপনি! ছিঃ! এরজন্য অবশ্যই আপনার শাস্তি হবে, কঠিন শাস্তি।
আপনি জানেন কতগুলো বৃষ্টির দিন আমি আপনাকে নিয়ে ভেবেছি, আর আপনি কী না আমায় নিয়ে হাসাহাসি করেছেন! এরজন্য শাস্তি স্বরুপ আর কখনো আমার হাতের খিচুড়ি আর মাংস ভুনা খেতে পারবেন না।
আর শুনুন, আপনাকে কে বলল যে আমি আপনার জীবন থেকে যাব? ইশ! এতো সহজ সবকিছু! ফের যদি ড্রেনে পড়ে যাই তখন কে তুলবে আমায়? আরেকজন ড্রেনওয়ালা যদি ছুটে না আসে! তখন কী হবে!
তবে আপনাকে আমি কোনোদিনও ক্ষমা করব না বুঝলেন। কারণ আপনি খুব খুব খুব খারাপ একজন লোক। কক্সবাজারে থাকাকালীন সময়ে জলপাই রঙের শাড়ি কিনে ব্যগে ভরে রেখেছেন। আবার ঢাকা অবধি নিয়ে এসে আলমারি ভরে রেখেছেন। কেন শাড়ি টা আমাকে দিলে কী হতো! অন্যান্য সময় তো ঠিকই বেহায়াপনা দেখান আর কাজের সময় ভং ধরে থাকেন? বলতে পারতেন না, তানি একটু ভালো করে সাজুগুজু করো তো, তোমায় নিয়ে সারা শহর ঘুরে বেড়াবো!
এবার কিছু ভালো কথা শুনুন। আপনি যেমন প্রতিদিন একটু একটু করে আমার প্রেমে পড়েছেন তেমন আমিও প্রতিদিন একটু একটু করে আপনার প্রেমে পড়েছি। দ্বিতীয় দর্শনে আপনি যখন বললেন, তানি আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে তখনই তো সর্বনাশ যা হওয়ার হয়ে গেল।
রিকশায় ঘুরতে যেয়ে যখন হাত ধরে বসেছিলেন তখন আরেকবার নতুন করে প্রেমে পড়েছিলাম। সোডিয়াম লাইটের আলোয় যখন গভীর চোখে তাকিয়ে ছিলেন তখনও একবার প্রেমে পড়েছি।
তবে ভালোবেসেছি কখন জানেন? যেদিন আপনি বলেছিলেন, তানি শরীর ছুঁয়ে দেবার আগে আমি তোমার মন ছুঁতে চাই। আমার জীবনের সবচেয়ে শোনা ভালো দুটো কথার মধ্যে এটি একটা। আরেকটা যেটা আপনি আপনার ডায়েরির শেষ পাতায় লিখে রেখেছেন।
আর কোনোদিন অবন্তীর নাম মুখেও আনবেন না। মুখভরা অবন্তী নাম টা’র চেয়ে তানি নাম টা অনেক বেশী সুন্দর। এরপর থেকে তানি তানি করবেন।
তানি পুরো লেখাটা সেন্ট করে দিলো। এখন খুব শান্তি শান্তি লাগছে। ঘরের সবাই বারবার ডাকতে এসেছিল খেতে যাবার জন্য। কিন্তু তানি যায় নি৷ এখন ক্ষিধে টের পাচ্ছে। খেতে যাবার আগে আরও একবার ডায়েরির শেষ পাতাটা ওল্টালো। যেখানে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা, তানি আমি কোনো সাধুপুরুষ না, তাই নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। তবে তুমি কিন্তু আমার মন ছুঁয়েই অনেক টা তৃষ্ণা মিটিয়ে দিয়েছ।
“আসলে ঢাকা ফিরে গিয়ে আমাকে ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পে যেতে হবে।
তানির এবার একটু মন খারাপ হলো। কিছু না বলে চলে গেল। এতো মন খারাপ লাগছে। কতগুলো দিন শুভ্র কাছে থাকবে না।
শেষ পর্যন্ত তানি শুভ্র’র সাথে গেল না। মাহফুজা ফোন করে যেতে বললেও তানি কয়েকটা দিন থাকার জন্য অনুরোধ করলো। যাবার সময় শুভ্র বলল,
“ভালো থেকো তানি।”
তানি কোনো কথাই বলল না। মুখ ভার করে বসে রইলো। শুভ্র কিছু সময় অপেক্ষা করলো তানির মুখ থেকে কিছু শোনার জন্য। কিন্তু তানি কোনো উত্তর ই দিলো না। শুভ্র তানির মুখোমুখি বসে বলল,
“তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিলো তানি। কিন্তু তুমি তো পণ করে বসে আছ যে আমার কোনো কথাই শুনবে না। তাই আমি সেই কথাগুলো লিখে রেখেছি। পড়তে তো নিশ্চয়ই আপত্তি নেই? আমি চাই সেই লেখাগুলো পড়ে তারপর তোমার যা ভালো খারাপ বলার আছে সেগুলো শুনতে।
কথাটা বলে একটা লাল মলাটের ডায়েরি তানির পাশে রেখে চলে গেল।
শুভ্র চলে যাওয়ার পর তানি অনেকক্ষন কাঁদলো অভিমানে। ডায়েরি ছুঁয়েও দেখলো না। অনেক বেলা পর্যন্ত না খেয়ে ঘুমালো।
ঘুম থেকে উঠে দেখলো বাসায় কেউ নেই। এক আত্মীয়ের বাড়িতে সবাই দল বেঁধে বেড়াতে গেছে। একা বাড়িতে তানির একা একা কিছুই ভালো লাগছিল না তাই ডায়েরি পড়তে শুরু করলো।
ডায়েরি টা পুরোনো হলেও লেখাগুলো নতুন। ডেট দেখে বুঝলো লেখাগুলো ওর অসুস্থ থাকার সময়ের।
ডায়েরির প্রথম পাতার লেখাঃ
তানি এই ডায়েরি টা কয়েকবছর আগে আনিকা দিয়েছিল আমার জন্মদিনে। ডায়েরি লেখার অভ্যাস নেই বলে কখনো লেখা হয় নি। কক্সবাজার যাওয়ার আগে হঠাৎ চোখে পড়ায় ভাবলাম তোমাকে নিয়ে কিছু একটা লিখব কিন্তু তোমাকে পড়তে দেব না। যখন আমরা বুড়ো হয়ে যাব কিংবা আমি তোমার আগে মরে যাব তখন তুমি এই ডায়েরি হাতে পেয়ে পড়তে শুরু করবে। ডায়েরির লেখা পড়ে আনন্দে চোখ ভিজিয়ে ফেলবে কিন্তু সেই দৃশ্যটা সামনাসামনি দেখব না। কিন্তু পরিস্থিতি এখন অন্যরকম বলেই ডায়েরি তে এখন অন্যকিছু লিখতে হচ্ছে।
প্রথম পাতার এইটুকু লেখা পড়েই তানির চোখ ভিজে উঠলো।
দ্বিতীয় পাতা থেকে একটানা অনেকখানি লিখেছে শুভ্র।
তানি তুমি কয়েকদিন ধরে আমার পাশে নেই। বিছানার একটা অংশ ফাঁকা। আমার রাতে একফোটাও ঘুম হয় না। বুক টা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। এইটুকুতেই এতো কষ্ট! তাহলে তুমি যদি আমাকে ছেড়ে চলে যাও তাহলে তো মনে হয় মরেই যাব।
তানি আমাদের প্রথম দেখার কথা মনে আছে? ওই যে তোমাকে ড্রেন থেকে হাত ধরে তুলেছিলাম? তুমি অনবরত কাঁদছিলে আর আমি তোমাকে বোঝাচ্ছিলাম। কী অদ্ভুত না! জীবনে আমি কোনোদিন ও ভাবিনি যে তোমার সাথে আমার দ্বিতীয় বার দেখা হবে। তোমাদের বাড়িতে তোমাকে যখন প্রথম বার দেখলাম তখন আমি ধাক্কা খেলাম। আরে এ তো সেই মেয়েটা! তোমার চোখেও তখন বিস্ময়ভাব প্রবল। আমি তখন ই বুঝেছি যে তুমি আমাকে চিনতে পেরেছ। আমি ব্যাপার টা চেপে গেলাম। আশ্চর্য ব্যাপার হলো আমার মনে কেমন একটা চাপা আনন্দ হলো, অথচ আমি কিন্তু তোমার প্রেমে পড়িনি প্রথম দর্শনে। তবুও এতো আনন্দ হলো যেন পুরোনো ভালোবাসা ফিরে পেয়েছি।
তুমি যেমন বৃষ্টির দিনে আমার কথা ভাবতে তেমন আমিও ভাবতাম। কিন্তু আমাদের ভাবনার মধ্যে পার্থক্য ছিলো। যেমন ধরো বৃষ্টি হচ্ছে তখন কাছে অভ্র থাকলে ওকে বলতাম জানিস একবার একটা মেয়ে এমন বৃষ্টিতে ড্রেনে পড়ে ব্যাঙের মতো বসেছিল। তারপর দুজনে মিলে হাসতে হাসতে লুটোপুটি খেতাম। এরকম অনেকবার হয়েছে। ভাবনার পার্থক্য হলেও মিল ছিলো, এটা কী শুধুই কাকতালীয়! আমি জানি না।
আমার খুব ভালো লেগেছিল যখন শুনলাম তুমিও আমায় নিয়ে ভাবতে। কতটুকু ভালো লেগেছিল সেটা তোমাকে বোঝাতে পারব না। তবে তারচেয়েও বেশী ভালো লেগেছিল যে আমি তোমার জীবনের প্রথম প্রেম সেটা শুনে। তুমি আমার জীবনে দ্বিতীয় নারী ছিলে। পুরুষ মানুষ প্রথম প্রেমিকা কিংবা স্ত্রীর সাথে যেমন থাকে, কিংবা অনুভূতি যেমন হয় দ্বিতীয়বার তেমন হয় না। তোমার ক্ষেত্রেও তেমন হয়েছে। এই যে আমি তোমাকে এতো লেগপুলিং করি, বিরক্ত করি, এটা কোনোদিন ই অবন্তীর সাথে করি নি। অবন্তীর সাথে কথা বলতে হতো মেপে মেপে। অবন্তীর রাগের ধাত ছিলো। সেটা তোমার মতো নাকি ফোলানো রাগ না, ভয়ংকর রাগ। রেগে গেলে মানুষ থেকে পশু হয়ে যেত। সেজন্য আমি অবন্তী কে ভয় পেতাম। তোমার সাথে এই ক’মাসে যতগুলো সুন্দর মুহূর্ত তৈরী হয়েছে অবন্তীর সাথে তেমন কোনো সুন্দর মুহূর্ত আমার মনে পড়ে না। আমাদের একসাথে আয়োজন করে, কিংবা হুটহাট রিকশায় চড়ার ও সুযোগ হয় নি, অবন্তীর রিকশায় চড়া পছন্দ না বলে।
তোমার আর অবন্তীর স্বভাবের যেমন পার্থক্য ছিলো তেমনি আমারও আচরণে ভিন্নতা ছিলো। তোমার সাথে কথা বলতে গিয়ে আমার কখনো মনে হয় নি যে এটা বলা যাবে না, তানি রেগে যাবে। বরং তোমাকে রাগাতেই বেশী ভালো লাগে আমার।
এবার কিছু অন্য কথা বলি, কক্সবাজারে যখন বন্ধুটি আমাকে তোমার ব্যাপারে বলল, তখন মুহুর্তের মধ্যে আমি যেন অন্য মানুষ হয়ে গেলাম। কেন হলাম তা জানি না, সত্য মিথ্যা কোনো বাছ বিচার না করেই বারবার মনে হতে লাগলো আমি কী আবারও ঠকে গেলাম! কেন বার বার আমি এভাবে ঠকে যাই! তাহলে আমি কী মানুষ হিসেবে সত্যিই খারাপ।
অবন্তীর সাথে আমার প্রায় আড়াই বছরের সংসার ছিলো। সংসার টা আমার ই ছিলো কেবল। অবন্তীর ছিলো না। এই আড়াই বছরে আমার একবারও মনে হয় নি যে অবন্তী আমাকে ঠকাচ্ছে। আমাকে পরিবার থেকে দূরে রাখা, মেন্টাল টর্চার, রোজ রোজ অশান্তি। পর্যাপ্ত পকেট মানি না পেলে আক্রমণ এসব করলেও কখনো মনে হয় নি অবন্তী অসৎ ছিলো। বন্ধুদের সাথে আউটিং এ যাবার কথা বলে অবন্তী যে বেরিয়ে গিয়েছিল তখনও মনে হয় নি যে অবন্তী কোনো ছেলের সাথে ঘুরতে গিয়েছিল।
এক্সিডেন্টের পর অবন্তীকে হসপিটালে আনার পর ডাক্তার রা বলল, মেয়েটার হাজবেন্ড স্পট ডেড। অথচ আমি তখন অক্ষত শরীরে হসপিটালের করিডোরে বসে আছি। জীবন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়া স্ত্রীর কথা না ভেবে এই একটা কথাই আমাকে বারবার ভাবালো। তাহলে আমি অবন্তীর কে!
অবন্তী যে হোটেলে উঠেছিল সেখানে অন্য এক ছেলেকে স্বামী পরিচয় দিয়ে উঠেছিল। এক্সিডেন্টের খবর তারাই অবন্তীর বাড়িতে জানিয়েছিল।
#কাছে_কিবা_দূরে
#পর্ব-২২
(১৮+ কন্টেন্ট)
শ্বশুর বাড়ি এসে শুভ্র’র জ্বর হলো। অসময়ের বৃষ্টিতে ভিজে বেশ ভালোমতোই জ্বর বাধিয়েছে। তানি ঘুম থেকে জেগে দেখলো শুভ্র কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে। এমনিতে ও ঘুমায় পা সোজা করে, হাত একটা কপালে রেখে। তানি কী যেন ভেবে শুভ্র’র কপালে হাত রাখলো। হাত রেখেই চমকে উঠলো। জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে অথচ সে দিব্যি ঘুমিয়ে আছে। তানি বিছানা থেকে নেমে পাতলা কম্বল বের করে গায়ে দিয়ে দিলো। দ্রুত হাত মুখ ধুয়ে নামাজ পড়ে জল পট্টি দেয়ার ব্যবস্থা করলো। আকাশ মেঘলা বলে ভোরের আলো ফুটতে সময় লাগছে। শুভ্র কপালে শীতল স্পর্শ পেয়ে চোখ খুলে তাকানোর চেষ্টা করলো। আবছা আলোয় তানির উদ্বিগ্ন মুখ দেখতে পাচ্ছে। শুভ্র হাত বাড়িয়ে তানির একটা হাত ধরলো, কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারলো না। গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
শুভ্র’র ঘুম ভেঙেছে অনেক বেলায়। ঘুম ভাঙার পর দেখলো মাথার চুল ভেজা। শরীর টা’ও বেশ ঝরঝরে লাগছে। তাসলিমা বেগম ঘরে ঢুকলেন৷ বললেন,
“এখন কেমন লাগছে শরীর বাবা?”
শুভ্র একটু হাসার চেষ্টা করলো। বলল, ভালো লাগছে।
“তানির কাছে শুনলাম তোমার অনেক জ্বর। তানির বাবা তো ডাক্তার আনতে গেছেন।”
শুভ্র ব্যস্ত গলায় বলল, আরে আন্টি সামান্য ঠান্ডা জ্বরে ডাক্তার আনতে হবে না। প্যারাসিটামল খেলের সেরে যাবে।
সেই সময় তানি ঘরে ঢুকলো। বলল,
“জ্বর অনেক কষ্টে নামানো হয়েছে। ডাক্তার ডাকলে তো আর মহাভারত অশুদ্ধ হচ্ছে না।”
শুভ্র তানির দিকে তাকালো। তানির মুখ থমথমে। খাবারের প্লেট নিয়ে এসেছে। তানির মা কাজের বাহানায় ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। তানি সরাসরি শুভ্র’র দিকে তাকাচ্ছে না। অন্যদিকে তাকিয়েই বলল,
“আপনি কী একা একা ওয়াশরুম পর্যন্ত যেতে পারবেন? ”
“হ্যাঁ পারব।”
শুভ্র উঠে গেল। বেসিনে গিয়ে কল ছেড়ে চোখে, মুখে পানির ঝাপটা দিলো। মাথায় একটা সূক্ষ্ম যন্ত্রণাবোধ হচ্ছে। ওর অসুখ, বিসুখ কম হয়। কিন্তু যখন হয় তখন অনেকদিন ভুগতে হয়। এই মুহূর্তে মারাত্মক অসুখে পড়লে ব্যাপার টা বিশ্রী হয়ে যায়। একটা জায়গায় এসে এভাবে সবাইকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেললে ব্যাপার টা খারাপ দেখায়। শুভ্র হাত, মুখ ধুয়ে বিছানায় এসে বসলো। শীত শীত লাগতে শুরু করছে। আবারও জ্বর বাড়ছে সম্ভবত। শুভ্র খাবারের প্লেট নিয়ে পরোটা একটু ছিড়ে মুখে দিলো। খেতে বিস্বাদ লাগছে। তবুও জোর করে খাওয়ার চেষ্টা করলো।
তানি আড়চোখে দেখছে শুভ্র খাবার মুখে দিয়ে চোখ মুখ কুচকে ফেলছে। জ্বর বাড়ছে কি না সেটাও বুঝতে পারছে না। তানি জিজ্ঞেস করলো,
“আপনার শরীর এখন কেমন লাগছে? ”
শুভ্র বলল, এই তো ভালো।
“খেতে খারাপ লাগছে।”
“খেতে ইচ্ছে করছে না।”
“তাহলে রেখে দিন। জোর করে খেতে হবে না। আমি আপনি জন্য কফি নিয়ে আসছি।”
“আচ্ছা।”
তানির কফি নিয়ে ঘরে আসতে সময় লাগলো দুই মিনিট। তানির মা কফি বানিয়ে রেখেছিল। ঘরে ফিরতেই দেখলো শুভ্র বমি করছে। তানি মগ টা রেখে শুভ্র’কে ধরতে গেল। শুভ্র দূরে সরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলো কিন্তু লাভ হলো না। তানির গায়েই বমি করে দিলো। শুভ্র অসহায় চোখে তানির দিকে তাকিয়ে রইলো। তানি খেয়াল করে বলল, কোনো ব্যাপার না। আপনি ইচ্ছে করে তো করেন নি।
*****
শুভ্র’র জ্বর বেড়েছে। জ্বরে সারারাত ছটফট করে। এই সময়টা’তে তানি একটু ঘুমায় না। কখনো জল পট্টি দিয়ে দেয়, কখনো মাথায় ম্যাসাজ করে দেয়। অসহ্য মাথা ব্যথায় তানি যখন ম্যাসাজ করে দেয় তখন শুভ্র আরামে চোখ বন্ধ করে রাখে। তানি অনেক সময় ধরে ম্যাসাজ করার ফলে হাত ব্যথা হয়ে গেলে শুভ্র’র ঘুম ভেঙে যায়। তানি একটুও বিরক্ত হয় না, এক মুহুর্তের জন্যেও শুভ্র’কে রেখে কোথাও যায় না। যদিও বা যায় তাহলে শুভ্র’র অস্থিরতা বেড়ে যায়।
শুভ্র’র জ্বর হওয়ার খবর শুনে অভ্র খুশি হলো। এই ধাক্কায় অন্তত দুজনের মান অভিমান ভাঙুক। প্রেম টা’ও হয়ে যাক। মাহফুজা টেনশন করছে খুব। প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন করছে। তানির বাবা, মা আশ্বস্ত করেছে যেন চিন্তা না করে তবুও মাহফুজার টেনশন হয়। মা’য়ের টেনশন দেখে অভ্র বলল, তুমি এতো টেনশন কইরো না তো মা। ভাবী আছে সে সব সামলে নেবে। তবুও মাহফুজার টেনশন দূর হয় না। ভালোয় ভালোয় ছেলে মেয়ে দুটোর ঘরে আসার অপেক্ষায় থাকে।
***
শুভ্র ঘুমিয়ে আছে। তানির একটা হাত হাতের আঙুলে গুজে রেখে। তানি মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। চুলের মাঝে আঙুল ঘোরাতে তানির একটুও খারাপ লাগছে না। বরং ভালো লাগছে। তানি মনে মনে বলল, আপনি সুস্থ হয়ে গেলে আমি আপনার সঙ্গে ঢাকা চলে যাব। আপনার বিকল্প ব্যবস্থা নেয়ার কোনো দরকার নেই। অনেক হয়েছে কানামাছি খেলা। এই আপনাকে কথা দিচ্ছি আর কোনোদিন ঝগড়া করব না।
শুভ্র গভীর ঘুমে মগ্ন। তানি বুড়ো আঙুল দিয়ে শুভ্র’র ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। যতবার শুভ্র’র কাছাকাছি এসেছে ততবারই ইচ্ছে হয়েছে ছুঁয়ে দিতে। কিন্তু লজ্জা আর সংকোচে পারে নি। শুভ্র যে শয়তান টের পেলে সেটা নিয়ে লেগ পুলিং করতে থাকবে সবসময়। মুখে কোনো কিছু আটকায় না, দেখা গেল চা খেতে খেতে সেই গল্প সবাইকে শোনালো। ব্যাপার টা ভেবে তানি হেসে ফেলল।
তানি নিচু হয়ে শুভ্র’র ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। বুকের ভিতর দ্রিম দ্রিম আওয়াজ শুরু হয়েছে। এইটুকুতে তানির তৃষ্ণা মেটে নি। আরও একটু দুঃসাহস করে অনেক টা সময় নিয়ে চুমু খেল। শুভ্র চোখ খুলে তাকালো। হঠাৎ জেগে যাওয়ায় তানি ভয় পেয়ে চলে যেতে গেলে শুভ্র দু’হাতে জাপ্টে ধরে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো। এই আদর তানির ফিরিয়ে দেবার সাধ্য নেই, তাই হতভম্ব ভাব কেটে গেলে নিজেও সাড়া দিতে শুরু করলো।
বিয়ের পাঁচমাস পর দুজন দুজনের গাঢ় সান্নিধ্যে এলো। এক কদম তানি এগিয়েছিল বলেই শুভ্র এতোটা সাহস করতে পেরেছিল। সম্পর্ক এমনই হওয়া উচিত। দু’তরফের একজন এগিয়ে গেলে অন্যজন কেও এগিয়ে আসতে হয়। শুভ্র’র প্রতিটি ছোঁয়ায় তানি ভালোবাসার স্পর্শ পেয়েছিল। তানির চোখের কোনে পানি এসে গেল। শুভ্র’র কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলেছিল, আমাকে আজ একটু বেশী করে ভালোবাসুন, যেন এই সুখেই মরন হয়। শুভ্র কিছু সময় গভীর চোখে তানির দিকে তাকিয়ে থেকে কপালের এক পাশে চুমু খেয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
তানির ঘুম ভাঙলো বেলা করে। শুভ্র পাশে নেই। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলো সাড়ে আট টা বেজে গেছে। তানির খুব লজ্জা লাগলো গতরাতের ঘটনা ভেবে। ইশ কী বেহায়ার মতন আচরণ করেছে কাল! এবার কীভাবে শুভ্র’র সামনে দাঁড়াবে!
শুভ্র ওয়াশরুম থেকে বেরিয়েছে। তানি শব্দ পেয়েই চোখ বন্ধ করে ফেলল। শুভ্র সেটা দেখেও ফেলল। বিছানায় এক পাশে বসে শুভ্র তানির দিকে কিছুসময় তাকিয়ে থেকে দীর্ঘশ্বস ফেলে বলল,
“তানি তোমার এক্টিং খুব খারাপ হচ্ছে। চোখের পাতা কাঁপছে। ”
লজ্জায় তানির মরে যেতে ইচ্ছে করলো। পৃথিবীর সবচেয়ে অসভ্য, বেহায়া, খারাপ মানুষটা ওর স্বামী হতে গেল!
শুভ্র আবারও বলল, তানি আমাকে আজ ঢাকা ফিরতে হবে। জ্বর টর যখন কমে গেছে তখন এবার ফিরে যাওয়া যাক। চুমু খেয়ে তো আর পেট ভরবে না। তাই চাকরিতে ফিরতে হবে। তুমি তাহলে কয়েকটা দিন বেড়াও কেমন! আমার জন্য তোমার বেড়ানোটা মাটি হলো।
#কাছে কিবা দূরে
#পর্ব-২১
শুভ্র বাস স্ট্যান্ড গিয়ে যখন পৌছালো তখন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি শুরু হয়েছে৷ কাউন্টারে বসে অপেক্ষা করলো বাস আসা অবধি। বুকের ভিতর কেমন যেন অদ্ভুত এক ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। এই ব্যথা কী কারনে হচ্ছে সেটা শুভ্র জানে, কিন্তু ওর জানায় তো কোনো লাভ নেই। যার জানার দরকার সে তো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। কোনোকিছু শুনতেই নারাজ। শুভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শরীরে ক্লান্তিরা ভর করেছে। আজ সারাদিনে কম ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হয় নি। এই মেয়েটার কেন যে এতো জেদ! একটু বুঝদার হলে লাইফ টা কতো ইজি হতো!
বাস এসে গেছে। অনিচ্ছাস্বত্তেও কাউন্টার ছেড়ে বাসে উঠে বসলো। বাস ছাড়তেই লম্বা ঘুম দিবে, তাহলে যদি শরীর টা একটু ঝরঝরে লাগে। বাসে উঠে বসতেই ঝুপ করে বৃষ্টি শুরু হলো। সাধারণত বৃষ্টি এলে মানুষের মন ভালো হয় কিংবা বিরক্ত হয়। কিন্তু শুভ্র’র মন খারাপ হয়ে গেল। এতোটা মন খারাপ হলো যে চোখে পানি এসে গেল।
ব্যলকনিতে দাঁড়িয়ে তানি ব্যাকুল হয়ে কাঁদছে। রাতে কোনোরকম ক’টা খেয়ে সেই যে ব্যলকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে আর ভিতরে যায় নি। বৃষ্টি শুরু হতেই চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়তে শুরু করেছে। হঠাৎ কিছু না বলে চলে আসায় বাড়িতে একটা গুঞ্জন শুরু হয়েছে। একমাত্র তানির মা ছাড়া আর কেউই ব্যাপার টা’য় খুশি হয় নি। খাওয়ার সময় সাবিনা খোঁচা মেরে বলেছে, ক’দিনের জন্য এসেছ নাকি একেবারে চলে এসেছ তানি?
তানি খাওয়া বন্ধ করে স্থির চোখে ভাবীর দিকে তাকিয়ে রইলো। সাবিনা বলল, না মানে তোমার সংসারে তো সবসময় ই ঝামেলা হয় তাই জিজ্ঞেস করলাম।
তানির মা পরিস্থিতি সামলাতে বলেছে, এসেছে ভালো করেছে। অসুখ, বিসুখ গেছে এবার ক’টা দিন আমার কাছে থাকুক।
সাবিনা থামার মতো মেয়ে না। ঝাঝালো গলায় বলল,
“আম্মা একটা সত্যি কথা বলেন তো? আমরা কী শ্বশুর, শাশুড়ী, ননদ দের নিয়ে সংসার করছি না! এই যে আপনার ঘরে আরও দুটি দামড়ি মেয়ে শুয়ে বসে খায় সেটা কী সহ্য করছি না! তাহলে আপনার মেয়ের এতো সমস্যা কিসের!
তানির মা বড্ড অসহায় হয়ে পড়েন।এই দজ্জাল টাইপের মেয়ের সাথে সে পারে না। তাই চুপ করে থাকা ছাড়া আর উপায় নেই। কিন্তু তানি চুপচাপ থাকে না। কঠিন গলায় বলল, ক’টা দিন থাকতে এসেছি বলে তোমার এতো জ্বলছে কেন ভাবী! নাকি এবার আসার সময় হাতে করে শপিং ব্যাগ আনিনি বলে খুব কষ্ট পাচ্ছ?
সাবিনা এতে আরও তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো। তানির বাবাকে ডেকে তুলে বলল, খোঁজ নিয়ে দেখুন আপনার মেয়ে আবারও বিয়ে ভাঙতে চলেছে কি না! এই মেয়ে সংসার করার না। বাপ, ভাইয়ের ঘাড়ে বসে খাবে।
তানি চুপ করে থাকলো না। একসময় অনেক চুপ করে থেকেছে কিন্তু এখন আর পারলো না। সাবিনার কথার পিঠে নিজেও অনেকগুলো তিক্ত কথা শুনিয়ে এসেছে।
তানি বুঝতে পারলো এখানেও ওর বেশীদিন থাকা ঠিক হবে না। কিন্তু ও বাড়িতেও ফিরে যাওয়া সম্ভব না। শুভ্র যা করেছে সেটা ক্ষমার অযোগ্য। এরপর আর শুভ্র’র সঙ্গে থাকা সম্ভব না।
গভীর ভাবনার ছেদ ঘটলো অভ্র’র ফোনকল পেয়ে। তানি চোখ মুছে ফোন ধরে বলল,
“হ্যালো।”
“ভাবী তোমাদের খবর কী?”
“আমার খবর বলতে পারব। আমি এখন বাড়িতে আছি।”
“আর ভাইয়া?”
“জানিনা।”
অভ্র চিন্তিত গলায় বলল, ভাবী ভাইয়াকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। ভাইয়া রওনা হয়েছে কি না সেটাও জানতে পারছি না।
তানিরও এবার খুব টেনশন হলো। নরম গলায় বলল, আমাদের বাড়ি থেকে তো দশটার একটু পর ই বেরিয়ে গিয়েছিল।
“তারপর আর তোমাদের কথা হয় নি? ”
তানি কিছু সময় থেমে রইলো। তারপর বলল, না হয় নি।
অভ্র কোমল গলায় ডাকলো, ভাবী!
“জি।”
“ভাইয়াকে কী সেকেন্ড চান্স দেয়া যায় না? ”
তানি সেকথার জবাব দিলো না। কী ই বা জবাব দেবে! তানির মা জিজ্ঞেস করেছিল, কী নিয়ে ঝগড়া করেছিস?
তানি উত্তর দিতে পারে নি। আর তাছাড়া উত্তর ই বা কী দেবে! এই ছোট কারনে তানি ঘর ভাঙতে চাইছে সেটা তো লোকে শুনলে হাসাহাসি করবে। অবশ্য তানির কাছে কারণ টা মোটেও ছোট না। চরিত্রের উপর আঙুল তোলা মোটেও তুচ্ছ ব্যাপার না।
অভ্র বলল, ভাবী শুনছ?
“হ্যাঁ শুনছি। ”
“ভাবী উই অল আর মিস ইউ এন্ড লাভ ইউ।”
তানির ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো। বলল, আমিও।
“ভাবী ভাইয়াও তোমাকে খুব ভালোবাসে।”
তানি চুপ করে থাকলো। অভ্র বলল, ভাবী ভাইয়া এখন যা করছে তোমার জন্য সেগুলো কিন্তু তার পার্সোনালিটির সাথে যায় না। তবুও কিন্তু….
“এখন রাখছি।”
শেষ কথাটা বলতে গিয়ে তানির গলা ভারী হয়ে এলো।
*******
রাত একটার দিকে ভিজতে ভিজতে শুভ্র এসে তানিদের বাড়িতে হাজির হলো। ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলে দেখলো, শুভ্র কাকভেজা হয়ে ফিরেছে। শীতে থরথর করে কাঁপছে। তানির বাবা এগিয়ে গিয়ে বললেন, বাবা তুমি?
শুভ্র লজ্জিত ভঙ্গিতে বলল, বাস মিস করে ফেলেছি আঙ্কেল।
তানি বুঝতে পারলো যে শুভ্র মিথ্যে কথা বলছে। অভ্র’র কাছে শুনেছে বাস ছাড়ার সময় ছিলো সাড়ে এগারোটা। অথচ বাড়ি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল সাড়ে দশটার দিকে। বাসা থেকে বাস স্ট্যান্ড যেতে সময় লাগে সর্বোচ্চ দশ মিনিট। তাই বাস মিস করার কোনো প্রশ্ন ই আসে না।
শুভ্র জামাকাপড় ছেড়ে ঘরে ঢুকতেই তানি বলল,
“বাস মিস করার ব্যাপার টা মিথ্যে ছিলো না?”
শুভ্র নির্লিপ্ত গলায় বলল, হ্যাঁ।
“এতো বড় ডাহামিথ্যে টা কী কারনে বললেন?”
“কারণ শ্বশুরবাড়ির আদর আপ্যায়ন না নিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিলো না তাই।”
তানি কঠিন গলায় বলল, একটা কথা মন দিয়ে শুনুন।
শুভ্র বিছানায় শুয়ে পড়লো। একটা হাত দু’চোখের উপর রেখে বলল, এখন মন দিয়ে শোনার সময় নেই। আমি খুব ই ক্লান্ত।
“আপনি যদি ভেবে থাকেন যে আমাকে আপনার সাথে নিয়ে যাবেন, মানে সে উদ্দেশ্য যদি ফিরে এসে থাকেন তাহলে ভুল করছেন। কারণ আমি কোনো অবস্থায় ই আপনার সাথে ফিরে যাব না।
শুভ্র উঠে বসে হাত ধরে তানিকে টেনে কাছাকাছি নিলো। তানির সব কথা বন্ধ হয়ে গেল শুভ্র’র কাছাকাছি এসে। শুভ্র তানির কানে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলো। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল, ডিসিশন চেঞ্জ করে ফেলেছি। তোমাকে এখানেই রেখে যাব। যেতে চাইলে যাবে, না চাইলে না। আমি তো এমনিই ফিরে আসলাম।
তানি আর কিছু বলল না। শুভ্র সটান হয়ে শুয়ে পড়লো। একটু আগে তানিকে সবচেয়ে বড় মিথ্যেটা বলেছে। ও তানির জন্যেই ফিরে এসেছে। বাসে বসে হঠাৎই মনে হলো ঢাকা গেলে ও দমবন্ধ হয়ে মারা যাবে। এই চারটে দিন কোনোভাবেই তানিকে ছেড়ে থাকা সম্ভব না। তাই ফিরে এসেছে।
বিছানায় শুয়ে তানি নীরবে চোখের পানি ফেলছে। এই লোক টা বিশ্বের এক নম্বরের মিথ্যুক। ও যে তানির জন্য ফিরে এসেছে সেটা তানি ঘরে ঢুকে চোখ দেখেই বুঝে গেছে। চোখ দুটো’ও লাল ছিলো, হয়তো বৃষ্টিতে ভিজে এই দশা হয়েছে। এতো বড় একটা বুড়ো মানুষ সে কী না এমন পাগলামি করছে! তানির চোখের জলে বালিশ ভিজে যাচ্ছে। কেন এতো কান্না পাচ্ছে! একটু আগেও ম্যাসেজে লিখে পাঠিয়েছিল, গো টু হেল। আর এখন সেই মানুষ টা এভাবে ফিরে আসায় এতো আনন্দ কেন হচ্ছে! এসবের কোনো মানে হয়! এই বেহায়া মন কে কীভাবে নিয়ন্ত্রন করবে তানি!
#কাছে_কিবা_দূরে
#পর্ব-১৯
কয়েক দিন ধরে তানি খুব অসুস্থ। হঠাৎই টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হয়ে ক’টা দিন হাসপাতালেও কাটিয়ে এসেছে। বাসায় ফেরার পরও প্রায় বেহুশ, কিছু খেতেও পারছে না। মাঝেমধ্যে একটু চোখ মেলে চাইলে মাহফুজা জোর করে কিছু একটা খাইয়ে দেয়। তানিও যন্ত্রের মতো চোখ, নাক বুঝে খাবার গিলে আবারও বিছানায় পড়ে থাকে। মাহফুজা দুদিন স্কুল কামাই করলেও তৃতীয় দিনে আর সম্ভব হলো না। স্কুলে ফার্স্ট টার্ম এক্সাম শুরু হয়েছে তাই বাধ্য হয়ে স্কুলে যেতে হচ্ছে। তবে ভরসার কথা হলো কাজ কর্ম ছেড়ে ইরা এসে তানির দেখভাল করছে। আনিকারও ইউনিভার্সিটির এডমিশন কোচিং শুরু হয়েছে। তাই তাকেও ছুটতে হচ্ছে কোচিং এ। ইরার মা সালমা সুলতানাও এসে মাঝেমধ্যে দেখে যায়। তানিকে তার ও ভীষণ পছন্দ। তাই ইরার অনেক টা সময় থাকা নিয়ে তার কোনো আপত্তি নেই।
শুভ্র এই সময়টা’তে তানির আশেপাশে কেবল তখনই ঘুরঘুর করে, যখন তানি ঘুমিয়ে থাকে। জেগে থাকা অবস্থায় ওর সাহস হয় না তানির মুখোমুখি হবার। তাই তানি যখন ই চোখ মেলে তাকায় শুভ্র তখনই পালিয়ে যায়। এই ক’দিনে শুভ্র এক ফোটাও ঘুমাতে পারে নি। সারারাত বিছানায় এপাশ, ওপাশ করে কাটিয়েছে। ভিতরের যন্ত্রনা না পারছে কাউকে বলতে, আর না পারছে সইতে। একেকবার ইচ্ছে হয় কিছুক্ষন চিৎকার করে কাঁদতে, কিন্তু তাও পারছে না।
অভ্র বলেছে, ভাইয়া ভাবী সুস্থ হলে আমরা তাকে বুঝিয়ে সব টা বলব। তুমি এতো ভেবো না। কিন্তু শুভ্র ভরসা করতে পারে নি। শুভ্র যে ভরসা করতে পারে নি, সেটা অভ্র’ও বুঝেছে। শুভ্র’র চোখের নিচে কালি জমেছে, শেভ না করার কারনে খোঁচা খোঁচা দাড়ি বড় হয়ে গেছে। রাতে ঘুম না হওয়ার কারনে চোখও রক্তবর্ণ আকার ধারণ করেছে। মাহফুজা প্রথম কয়েকটা দিন ছেলের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকলেও তারপর আর পারে নি। মমতার কাছে হেরে গেলেও শুভ্র’কে ক্ষমা করতে পারে নি।
যা যা ঘটেছে তার জন্য মাহফুজা নিজেও অনেক কষ্ট পেয়েছে। শুভ্র অনেকবার ক্ষমা চাইলেও ক্ষমা করতে পারে নি। এর আগে শুভ্র অবন্তীর ভুল, বেহায়াপনা প্রশ্রয় দিয়েছে অথচ এতো ভালো মেয়েটার ব্যাপারে যাচাই না করেই এরকম একটা কথা কিভাবে বলল এটা ভেবেই মাহফুজার রাগ হয়। ছেলের সাথে কথা বলা কমিয়ে দিয়েছে। প্রয়োজন ছাড়া কথাও বলছে না। কিন্তু পরে দেখলো যে শুভ্র নিজেই ঠিক নেই তখন আর রাগ ধরে রাখতে পারে নি। মনে মনে আল্লাহ কে বলেছে, হে আল্লাহ এই অবুঝ ছেলেমেয়ে দুটো’কে তুমি বুঝ দিও৷
*****
গত কয়েকদিনে শুভ্র, তানির চক্করে অভ্র’র ও ভালো ঘুম হয় নি। নিজের ভাইয়ের নির্বুদ্ধিতায় হতভম্ব হয়েছে। শুভ্র’র মতো এতো বুদ্ধিমান মানুষ এরকম একটা কাজ করলো! অন্তত ওকে যদি বলতো তবে পরিস্থিতি এতো বিগড়ে যেত না। অভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সবাই শুভ্র’কে ভুল বুঝলেও ও তা পারেনি। বরং ওর শুভ্র’র জন্যই মায়া বেশী হয়। খেতে বসে এক রাতে দেখলো শুভ্র ডালের বদলে ভাতের প্লেটে পানি ঢেলে নিয়ে খেতে শুরু করেছে। ঠিকঠাক ঘুমায় ও না। প্রায় রাতেই ওর কাছে সিগারেট নিতে আসে, কিছুক্ষণ বসে থেকে সিগারেট ছাড়াই চলে যায়। এসব দেখতে অভ্র’র ভালো লাগে না। ইচ্ছে হয় কিছু একটা করে দুজনের সব দুঃখ, কষ্ট মুছে দিতে।
চেয়ারে হেলান দিয়ে এসব ভাবছিলো তখনই ইরা ফোন করলো। অভ্র ফোন ধরে বলল,
“হ্যালো! ভাবী ঠিক আছে তো।”
ইরা চাপা গলায় বলল, হ্যাঁ ঠিক আছে। ঘুমাচ্ছে, জ্বর নেই।
“তাহলে এই সময় ফোন করলে যে?”
“তোমাকে একটা কথা জানানোর জন্য। ”
“কী?”
“ভাইয়া প্রায় ই দরজার সামনে ঘুরঘুর করে। মাঝেমধ্যে ভিতরে এসে একটু বসে। ভাবীর নড়াচড়া টের পেলে উঠে চলে যায়। ভাইয়া’কে এভাবে দেখতে ভালো লাগছে না। ”
অভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ওর নিজের কী ভালো লাগছে এসব দেখতে।
ইরা আবারও বলল, তবুও ভাবীর দিক টা’ও আমাদের চিন্তা করতে হবে। ভাবীও তো বিনাদোষে কষ্ট পেল।
“হু।”
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলো। ইরা আবারও বলল, আমার কী মনে হয় জানো?
“কী মনে হয়?”
“ভাইয়া ভাবীকে পাগলের মতো ভালোবেসে ফেলেছে। ”
অভ্র কিছু বলল না। সেটা ও নিজেও জানে। কিন্তু জানলে লাভ কী! তানি কী সেটা আর বিশ্বাস করবে! তানি তো বলবে যে, ভালোবাসার এই নমুনা।
ফোনের ওপাশ থেকে কোনো আওয়াজ না পেয়ে ইরা বলল, আচ্ছা রাখছি। তুমি এতো ভেবো না, সব ঠিক হয়ে যাবে।
“তাই যেন হয়। ”
ফোন রেখে আবারও চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিলো অভ্র। মনে মনে ভাবলো, তানি সুস্থ হলে ওকে হাতজোড় করে বলবে, ভাবী তোমাদের কারও অতীত ই মসৃন ছিলো না, হ্যাঁ ভাইয়ার দোষ ও আছে তবুও তাকে বড় কোনো শাস্তি দিতে গিয়ে নিজেও সেই শাস্তির ভাগিদার হইয়ো না।
*****
দুপুরবেলা শুভ্র তানির খোঁজ নিতে গেল। তানি ঘুমিয়ে আছে। ইরা পাশে বসে গান শুনছিলো। শুভ্র’কে দেখে বলল,
“কিছু বলবে ভাইয়া? ”
শুভ্র আমতা আমতা করে বলল, না মানে ও কিছু খেয়েছে কী না!
ইরা বলল, না। ভাবীকে কয়েকবার ডেকেছি কিন্তু সাড়াশব্দ নেই।
শুভ্র চিন্তিত গলায় বলল, অনেক টা সময় হয়ে গেছে। এখন তো ওর ঔষধ খাওয়ার সময় হয়ে গেছে। তুই ওকে ডেকে দে।
শুভ্র’র কথামতো ইরা তানিকে ডেকে তুলল৷ তানি চোখে খুলে তাকাতেই শুভ্র’কে দেখতে পেল। শুভ্র চট করে সরে গেল। ইরা তানিকে বালিশ উঁচু করে হেলান দিয়ে খাওয়াতে লাগলো। তানি চিকেন স্যুপ গিলছে আর বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। দেখার চেষ্টা করছে শুভ্র আছে কী না। ইরা বুঝতে পেরে বলল, ভাবী ভাইয়াকে ডেকে দেব?
তানি ফ্যাসফ্যাসে গলায় বলল, না।
খাওয়ার পর্ব শেষ করে তানি আবারও শুয়ে পড়লো। ইরা রান্নাঘরে খুটখাট করছে সে শব্দ শুনতে পাচ্ছে। তানির চোখে পানি এসে গেল। শেষকালে এসে এমন নিষ্ঠুর মানুষ কে জানপ্রান উজাড় করে ভালোবাসতে গেল! অসুস্থ হয়ে এতোদিন বিছানায় পড়ে ছিলো অথচ দেখতে এসেছে কেবল আজ ই। প্রতিদিন ই তানি ভাবতো চোখ খুলে হয়তো শুভ্র’কে দেখতে পাবে। পাশে থেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দেবে। যা কিছুই হোক, বউ তো! তাছাড়া ভুল যখন করেছে ক্ষমা চাইবে তো অন্তত। সেইটুকু ভদ্রতাটুকু নেই। অথচ বিয়ের পর কতো ভদ্রতা দেখালো। তানি সিদ্ধান্ত নিয়েছে সুস্থ হয়েই সোজা বাপের বাড়ি চলে যাবে। তাছাড়া ও এসব কী ভাবছে! শুভ্র’র কাছেই বা কেন এতোকিছু আশা করছে! যে ছেলে পরের কথায় নিজের বউকে ক্যারেক্টারলেস বলেছে সে চূড়ান্ত অসভ্য একটা ছেলে।
ক্ষমা করার প্রশ্ন ই আসে না। একটু হাটাচলা করতে পারলেই এই বাড়ি ছেড়ে যাবে। দুইবেলা আধপেটা খেয়ে, ভাইয়ের বউয়ের খোঁচা সহ্য করে থাকবে তবুও চরিত্রহীনা তকমা গায়ে লাগিয়ে এ বাড়িতে থাকবে না।
একটা চূড়ান্ত অসভ্য লোককে ভালোবাসার জন্য তানি হাপুস নয়নে কাঁদতে লাগলো।
দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে সেই অসভ্য লোকটার’ও তখন তানির কান্না দেখে চোখ ছলছল করে উঠলো।
চলবে……
#কাছে_কিবা_দূরে
#পর্ব-২০
তানির অবস্থা আগের থেকে অনেক টা ভালোর দিকে। শরীর কিছুটা দূর্বল আছে তবে চলাফেরা করতে পারে অনেক টা রোগাও হয়ে গেছে। সুস্থ হবার পর শুভ্র তানিকে আগের মতো দেখার সুযোগ পাচ্ছে না। তানি এখন আনিকার সাথে ওর ঘরেই থাকছে। সারাদিন ঘর থেকে বের হয় না বললেই চলে। শুভ্র অপেক্ষা করে অন্তত খাওয়ার সময় তানিকে দেখতে পাবে। কিন্তু ও টেবিলে খেতেই আসে না। নিজের ঘরে বসে নাকি খায়। শুভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে। কিভাবে যে মান অভিমান পর্ব চুকিয়ে স্বাভাবিক করবে তানিকে সেটাই ভেবে পায় না। প্রথম প্রথম লজ্জায় তানির সামনে যাওয়ার সাহস করতে পারে নি। এখন যখন সাহস করে তানির কাছে যাচ্ছে, তখন তানি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। লাগাতার দরজায় কড়া নেড়েও দরজা খোলাতে পারে নি। এমন জেদি মেয়ে! শুভ্র সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে করেই হোক তানির সাথে কথা বলবে। চুপচাপ থেকে ব্যাপার টা জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে।
অপেক্ষা করলো মঙ্গলবারের। সেদিন বাসায় কেউ থাকবে না, কিভাবে দরজা আটকে বসে থাকে সেটা শুভ্র’ও দেখবে।
*****
তানি এখন অনেকটা সুস্থ ঠিক ই কিন্তু এই অবস্থায় বাড়ি যাবার মতো সাহস করতে পারছে না। প্রায় ই মাথা ঘুরে, একটু বেশী হাটাচলা করলে শরীর খারাপ করতে শুরু করবে। যদি এই অবস্থায় বেরিয়ে যায় আর পথে অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকে তাহলে দেখার কেউ থাকবে না। তাই এই বোকামি করার মানে হয় না কোনো।
তানি সারাদিন ঘরে, শুয়ে বসে কাটায়। বই পড়তেও আজকাল ভালো লাগছে না। ইরা নীলক্ষেত থেকে কতগুলো বই এনে দিয়েছে সেগুলো তেমন ই পড়ে আছে, ছুঁয়েও দেখে নি তানি। বই খুললেই মাথা ঘোরাতে শুরু করে।
কিছু ভালো লাগছিলো না বলে তানি ফেসবুকে ঢু মারলো। ওয়াইফাই অন করতেই ম্যাসেঞ্জারের টুংটাং আওয়াজ শুরু হতে লাগলো। শুভ্র অনেকগুলো ম্যাসেজ পাঠিয়েছে। তানি ম্যাসেজ না খুলেই শুভ্র’কে ব্লক করে দিয়ে ওয়াইফাই অফ করে ম্যাসেঞ্জার থেকে বেরিয়ে এলো। এতো আদিখ্যেতা সহ্য হচ্ছে না ওর। প্রায় ই চোরের মতো ঘুরঘুর করে, দরজার সামনে এসে নাম ধরে ডাকে। এতোসব নাটক অন্য কোথাও গিয়ে দেখাক, তানি এসব নাটক দেখে মোটেও গলবে না।
★★
রাগে শুভ্র’র শরীর কিড়মিড় করছে। এতো বাড়াবাড়ি! ম্যাসেঞ্জারে ব্লক দিয়ে দিলো! শুভ্র’র হাত মুষ্টিবদ্ধ, একটু পর পর দরজায় ঘুষি দিচ্ছে। কি করবে বুঝতে পারছে না। বুদ্ধিজ্ঞান লোপ পেয়ে গেছে যেন৷ শুভ্র মোবাইল হাতে নিয়ে তানিকে পর পর ফোন দিতে লাগলো। তানি যতই কেটে দেয়, শুভ্র তত আরও ফোন দিতে থাকে। এক পর্যায়ে তানি বিরক্ত হয়ে ফোন বন্ধ করে দিলো। শুভ্র ফোন বন্ধ পেয়ে অভ্র’কে ফোন করলো। অভ্র ফোন ধরতেই গমগমে গলায় বলল,
“অভ্র শোন, বাড়াবাড়ির কিন্তু একটা লিমিট আছে।”
ইরা অবিশ্বাস্য গলায় বলল, এই সামান্য বিষয়ে এতো ঝগড়াঝাটি?
অভ্র বলল, তোমার আমার কাছে সামান্য বিষয়, কিন্তু ভাইয়ার কাছে সিরিয়াস। সে তার বউয়ের প্রেমে পড়ে নিজেকে রোমিও আর বউকে জুলিয়েট ভাবছে। এখন জুলিয়েট তাকে ইগ্নোর করার কারনে ওয়ার্ল্ড ওয়ার শুরু হবে।
ইরা বিস্মিত গলায় বলল, ওহ মাই গুডনেস!
“তুমি তাড়াতাড়ি যাও। আমিও আসছি। ”
ফোন রেখে ইরা পড়িমরি করে ছুটলো শুভ্র’দের বাড়ির দিকে।
★★
শুভ্র’কে দরজা ভাঙতে হয় নি। দরজায় দুরুম দুরুম শব্দ হতেই তানি দরজা খুলেছিল। শুভ্র’র চোখ, মুখ তখন রাগে লাল হয়ে আছে। তানি দেখে ভরকে গেলেও অতিদ্রুত নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“আপনার সমস্যা কী? এভাবে দরজা ধাক্কাধাক্কি করছেন কেন?”
শুভ্র বজ্রকন্ঠে বলল, ধাক্কাধাক্কি না। আমি দরজা ভেঙে ফেলতে এসেছিলাম।
অতি দুঃখেও তানির খুব হাসি পেল। সিনেমায় দেখেছে নায়ক দরজা ভাঙে তাই দেখে নিজের ও শখ হয়েছে। তানি মিটিমিটি হাসলো। তানিকে হাসতে দেখে শুভ্র’র আরও বেশী রাগ হলো। গমগমে গলায় বলল,
“তুমি আমাকে ব্লক কেন দিয়েছ? ফোন কেন কেটে দিয়েছ?”
“আমার আপনার সাথে কোনো কথা নেই তাই। ”
তানি নির্লিপ্ত গলায় বলল।
শুভ্র তানির বাহু চেপে ধরে বলল, অবশ্যই তুমি আমার সাথে কথা বলবে এবং আমার সব কথা মন দিয়ে শুনবে।
তানি নিজেকে শুভ্র’র হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, আপনার কথা শোনার এবং আপনাকে কিছু বলার রুচি আমার একদম ই নেই।
শুভ্র যেন একটু দমে গেল। বলল,
“ওকে ফাইন। তুমি তাহলে কী চাচ্ছ? ”
তানি এরকম প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিলো না। তবুও সাথে সাথে বলল,
“আমি আমার বাড়ি যেতে চাই।”
শুভ্র শীতল গলায় বলল,
“এটাই তোমার শেষ কথা”?
তানি বলল, হ্যাঁ।
“বেশ এক ঘন্টার মধ্যে সব গুছিয়ে নাও। আমি তোমাকে রেখে আসব”।
তানি ঝোকের মাথায় বলে ফেললেও এখন ওর খুব খারাপ লাগছে। মাহফুজা বাড়ি নেই। এভাবে না বলে যাওয়া কী ঠিক হবে!
তানি বলল, আগে মা আসুক তারপর দেখা যাবে। তাছাড়া আপনার সাথে পাশাপাশি বসে যাওয়ার ও কোনো ইচ্ছে আমার নেই।
শুভ্র শীতল চোখে তাকালো। বলল,
“তুমি এক ঘন্টার মধ্যে সব গুছিয়ে রেডি থাকবে। আর একটা কথাও যদি বলো তাহলে তোমার এক ঠ্যাং ভেঙে ঘরে বসিয়ে রাখব। বাপের বাড়ি যাওয়ার শখ মিটে যাবে। ”
★★
অভ্র, ইরা বাসায় এসে দেখলো সব ঠান্ডা। শুভ্র বসে বসে কফি খাচ্ছে। সব ঠান্ডা দেখে তানিকে জিজ্ঞেস করলো, ঘটনা কী! শুভ্র’কে ঘাটানোর সাহস হলো না।
তানির কাছে সব টা শুনে অভ্র’র খুব মজা লাগলো। ইরা ফিসফিস করে বলল, ভাইয়া তো বেশ রোমান্টিক।
মাহফুজা ফিরে এসে সব টা শুনে হতাশ গলায় বলল, এসব কী হচ্ছে? কোনো ভদ্রলোকের বাড়ির মানুষজন এসব করে?
অভ্র চোখ টিপে চুপ থাকতে বলল।
তানি একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে মাহফুজার দিকে আসতেই শুভ্র হাত ধরে সরিয়ে দিয়ে বলল, আমার সাথে কথা বলার রুচি না থাকলে, আমার মা, ভাই, বোনদের সাথেও কথা বলার প্রয়োজন নেই।
তানি অগ্নিদৃষ্টিতে তাকালো। শুভ্র সেই দৃষ্টি উপেক্ষা করে তানির হাত ধরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
মাহফুজা অভ্র’র দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আমাকে কী একটু বলবি কী হচ্ছে এসব?
★★
তানি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদে চলছে। শুভ্র চোখ বন্ধ করে সিটে হেলান দিয়ে আছে। তানি যে কেঁদে যাচ্ছে সেদিকে কোনো খেয়াল নেই। এদিকে তানির খুব কষ্ট হচ্ছে শাশুড়ী, দেবর, ননদের জন্য।
রাজশাহী পৌছুতে পৌছুতে ওদের রাত সাড়ে ন’টা বাজলো। শুভ্র কিছুতেই থাকবে না। দুজন যে ঝগড়া করে এসেছে সেটা সবাই বুঝতে পেরেছে মুখ দেখে। শুভ্র সবার সাথে কথা বলেছে চোখ, মুখ শক্ত করে। অন্যদিকে তানি ভালো করে কারও সাথে কথাই বলে নি। বোনেদের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিয়েছে। শুভ্র ফেরার পথে তানির সাথে দেখা করতে চাইলেও তানি সামনে আসলো না।
শুভ্র অপেক্ষা না করে চলে এলো। নিচে নেমে তানির নাম্বারে ম্যাসেজ করলো, এরপর তুমি কী চাও?
কিছুক্ষণ পর তানি রিপ্লাই দিলো, ডিভোর্স পেপার পাঠাবেন আমি সাইন করে দেব।
মিনিট দুয়েকের মধ্যে শুভ্র লিখলো, ঠিক চারদিন পর তোমাকে নিতে আসব। ভালোয় ভালোয় না এলে অবশ্যই বিকল্প ব্যবস্থা নেব। আর ডিভোর্স? সেটা তো কোনোদিন ই পাবে না। দেখি তুমি কী করো।