Friday, August 8, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 161



কাছে_কিবা দূরে পর্ব-১৭+১৮

0

#কাছে_কিবা দূরে
#পর্ব-১৭
শুভ্র কক্সবাজার থেকে আসার পর তানিকে এড়িয়ে চলছে। খুব সূক্ষ্মভাবে খেয়াল করলে সেটা চোখে পড়ে। বাড়ির সবাই হঠাৎ ওদের ফিরে আসায় অবাক হলো। কিন্তু শুভ্র একদম স্বাভাবিক রইলো। জার্নি করে এসে দুটো দিন প্রায় ঘুমিয়ে ই কাটালো। হাতে গোনা কয়েকটা কথা হলো এই দুদিনে। এক বার খাবার সময় তানিকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল, ডালের বাটি দিতে। আর ঘুমাতে যাবার সময় বলেছিল, বেড লাইট টা অফ করে দিতে৷ তানি খেয়াল করলো, শুভ্র স্বাভাবিকের তুলনায় কথা বলা কমিয়ে দিয়েছে। একবার ওর মনে হলো যে হয়তো কোনো কারনে আপসেট হয়ে আছে তাই কথা কম বলছে। আবার মনে হলো হয়তো ওর কোনো আচরনে কষ্ট পেয়েছে। দিন চারেক পর তানি এক রাতে ঘুমাতে যাবার সময় বলল,

“শুনছেন?”
শুভ্র তানির দিকে পিঠ দিয়ে ঘামাচ্ছিল। সেভাবেই বলল, হ্যাঁ বলো।

“একটু আমার দিকে ফিরুন না!”

শুভ্র উঠে বসে লাইট টা জ্বালিয়ে দিয়ে বলল, এখন বলো।

তানিও উঠে বসলো। মুখোমুখি হয়ে বসা দুজনেই। তানি আদুরে গলায় বলল, আপনি কী কোনো কারনে আমার উপর রেগে আছেন?

শুভ্র’র উত্তর দিতে এক সেকেন্ড সময় ও লাগলো না। বলল, না।

“তাহলে কী কোনো কারনে আপসেট? ”

“হ্যাঁ। ”

“আমাকে কী বলা যায়, কী কারনে আপনি আপসেট।”

“না বলা যায় না।”
শুভ্র কাটাকাটা গলায় জবাব দিলো।

তানির খুব খারাপ লাগলো। এতটা রুক্ষভাবে যে শুভ্র কথা বলতে পারে সেটা ওর ধারনায় ছিলো না। চোখে পানিও এসে গেল। এতো অল্পে আগে তানির চোখে পানি আসতো না, কিন্তু আজকাল অল্পেই চোখে পানি এসে যাচ্ছে।

তানি আস্তে করে বলল, ইটস ওকে।

“উঁহু ইটস নট ওকে। তুমি কী তোমার সব কথা আমাকে বলো বা বলেছ! তাহলে আমাকে কেন সব কথা বলতে হবে? ”

তানি বিস্মিত গলায় বলল, মানে?

শুভ্র হঠাৎই নরম হয়ে গেল। বলল, না কিছু না। স্যরি একটু বেশী ই মিসবিহাভ করে ফেলছি। এক্সট্রেমলি স্যরি।

কথাগুলো বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই শুভ্র শুয়ে পড়লো। তানি কিছু বুঝতে না পেরে খানিক সময় বসে থেকে তারপর শুয়ে পড়লো। সেই রাতে তানি দু’চোখের পাতা এক করতে পারে নি। সকাল হতেই যখন রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের পানি চাপালো তখন মাহফুজা বুঝে গেল যে তানি সারারাত ঘুমোয় নি। বারবার জিজ্ঞেস করলো, যে কিছু হয়েছে কি না। তানি প্লাস্টিকের হাসি মুখে ঝুলিয়ে বলল, কিছু হয় নি। মাহফুজা সরল মনে বিশ্বাস করে নিলো।

মাহফুজা সরে যেতেই তানি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কি যে হয়েছে তা তো আমি ই জানি না।

******
কাজের বাহানা দিয়ে কক্সবাজার থেকে ফিরলেও তেমন কোনো কাজ শুভ্র’কে করতে দেখা যায় নি। ভার্সিটি অফ আছে তাই বাইরেও খুব একটা যায় না। বাসায় থেকে বই পড়ছে, মুভি দেখছে, ইন্টারনেট ব্রাউজ করছে। ব্যাপার টা তানির চোখে পড়লেও ও কিছু জিজ্ঞেস করলো না। সেদিন রাতের ঝাঝালো কথাগুলো কানের কাছে এখনো বেজে চলছে।

অভ্র খেয়াল করলো শুভ্র আর তানির ভিতরে কিছু একটা চলছে। দেখা গেল, সবাই মিলে একসাথে আড্ডা দিচ্ছে। শুভ্র’ও হেসে হেসে গল্প করছে। কিন্তু যেই তানি সেখানে উপস্থিত হয় শুভ্র উঠে চলে যায়। ব্যাপার টা একবার দু’বার হলে কাকতালীয় বলে মানা যেত। কিন্তু বার বার হওয়ায় অভ্র তানিকে জিজ্ঞেস করলো,

“ভাবী বলোতো ঘটনাটা কী?”

“কোন ঘটনা?”

“তোমার আর ভাইয়ার মধ্যে কোনো ঝগড়াঝাটি চলছে? তোমরা ফিরে এলে ভাইয়ার আর্জেন্ট কাজ আছে তাই। কিন্তু ভাইয়া তো বিন্দাস খাচ্ছে ঘুমাচ্ছে।”

তানির সেদিন রাতে শুভ্র’র বলা কথাগুলো মনে পরে গেল। অভ্র’কে সব বলে নিজেই কেঁদে ফেলল।

অভ্র অবাক গলায় বলল, ভাইয়া মিসবিহাভ করছে! সত্যি?

তানি নাক টেনে বলল, আমি মিথ্যে বলি না।

অভ্র ভীষণ অবাক হলো। বলল, আচ্ছা কক্সবাজারে কী এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে যে কারনে ভাইয়া রেগে থাকতে পারে?

“না।”

“একটু মনে করে দেখো”।

তানি একটু ভেবে শুভ্র’র বন্ধুর সাথে দেখা হবার ঘটনা খুলে বলল।

সব শুনে অভ্র বলল, ভাইয়ার সেই বন্ধুকে তুমি চেননা কিন্তু সে তোমাকে চেনে তাই তো?

“হ্যাঁ “।

“আচ্ছা সে কী তোমার আগের হাজবেন্ডের পরিচিত কেউ হতে পারে?”
কথাটা জিজ্ঞেস করার সময় অভ্র কিছুটা বিব্রতবোধ করলো।

তানি রীতিমতো ধাক্কা খেল। শুকনো গলায় বলল, হতে পারে।

অভ্র চিন্তিত গলায় বলল, হতে পারে না ভাবী। আমার মনে হয় তাই ই হয়েছে। হয়তো এমন কিছু বলেছে যেটা ভাইয়া মেনে নিতে পারে নি।

“কিন্তু সেটা আমাকে ক্লিয়ার করে বলবে তো!”

“আচ্ছা আমি জিজ্ঞেস করে দেখি ভাইয়া কী বলে।”

“আচ্ছা”।

****
অভ্র শুভ্র’কে সরাসরি জিজ্ঞেস করলে শুভ্র খুব মেজাজ দেখালো। সব ব্যাপারে অভ্র’র ইন্টারফেয়ার নিয়ে এক দফা রাগ ও দেখালো। কিন্তু অভ্র দমে গেল না। বারবার জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে স্পষ্ট করে বলতে। শুভ্র এক পর্যায়ে রেগে গিয়ে টেবিলে রাখা গ্লাস সেট ভেঙে ফেলল। শব্দ পেয়ে মাহফুজা, তানি, আনিকা সবাই ই ছুটে এলো।

মাহফুজা অবাক গলায় বলল, এসব কী হচ্ছে?

শুভ্র তখনও রাগে ফুসছে। চোখ, মুখ রাগে লাল হয়ে গেছে। গমগমে গলায় বলল, নাথিং সিরিয়াস।

“সিরিয়াস কিছু না হলে এভাবে ভাঙচুর কেন করছিস সব? ”

শুভ্র জবাব দিলো না। মাহফুজা অভ্র’র দিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়েছে বল তো?

অভ্র নির্লিপ্ত গলায় বলল, মা ভাইয়া কয়েকদিন ধরে ভাবীর সাথে স্বাভাবিক আচরণ করছে না? কিছু একটা গন্ডগোল আছে সেটা জানার চেষ্টা করছি।

শুভ্র রক্তচক্ষু নিয়ে তানির দিকে তাকালো। বলল, আমি তোমার সাথে কী অস্বাভাবিক আচরণ করেছি?

তানি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। কিছু বলার খুঁজে পেল না। অভ্র ঠান্ডা গলায় বলল,

“ভাইয়া মাথা ঠান্ডা করো তো প্লিজ। ”

শুভ্র আচমকাই অভ্র’র নাক বরাবর একটা ঘুষি মেরে বলল, এতো বেশী বুঝিস কেন সবসময়?

তানি আর আনিকা ছুটে গিয়ে অভ্র’কে ধরলো। শুভ্র রাগে কাঁপছে অনবরত। মাহফুজা ছেলের এই রাগের সাথে পরিচিত। সহজে রাগে না ঠিকই, কিন্তু রেগে গেলে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে ফেলে।

মাহফুজা শীতল গলায় ডাকলো, শুভ্র!

শুভ্র মাথা নিচু করে রাখলো।

“কী হয়েছে? ”

অভ্র নাক চেপে ধরে বলল, মা কক্সবাজার ভাইয়ার এক বন্ধুর সাথে তার দেখা হয়েছে। সে নাকি ভাবীর পূর্বপরিচিত। তার সাথে দেখা হবার পর থেকেই ভাইয়া ভাবীকে এড়িয়ে চলছে।

তানি মাথানিচু করে কাঁদতে লাগলো।

মাহফুজা জিজ্ঞেস করলো, কী বলেছে তানির নামে?

শুভ্র তানির দিকে এক পলক তাকালো। সেই দৃষ্টি দেখে তানির অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো।

শুভ্র তীর্যক হেসে বলল, আমার বউ তার আগের হাজবেন্ডের সাথে সুখী ছিলো না তাই প্রেগন্যান্ট অবস্থায় বয়ফ্রেন্ডের সাথে বেরিয়ে এসে বাচ্চা এবোর্শন করিয়েছে। সেটা বলেছে। বিয়ের এতো মাস পর জানলাম যে আমার বউ চরিত্রহীনা।

তানির জগৎ টা দুলে উঠলো। পরে যেতে গেলে অভ্র ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিলো।

মাহফুজা আগের মতো ই স্বাভাবিক। বলল, ব্যাস এইটুকুই?

“হ্যাঁ। ”

“আর তাতেই তুই জানোয়ারের মতো আচরণ শুরু করলি?”

“সেটা কী স্বাভাবিক না?”

মাহফুজা উত্তর দিলেন না। সশব্দে শুভ্র’র গালে একটা চড় মেরে বলল, রাস্তার লোকের কথায় বিশ্বাস করে নিজের বউয়ের সাথে অসভ্যতা করার জন্য এই থাপ্পড় টা দিলাম।

শুভ্র মাথানিচু করে ফেলল।

মাহফুজা রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, একটা ব্যাপার পুরোটা না জেনেই একজনের ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দিয়ে ফেললি? কেন সত্যি জানতে আমাকে বা ওকে জিজ্ঞেস করতে পারলি না?

শুভ্র চুপ করে রইলো।

মাহফুজা শান্ত গলায় বলল, যদি নিজের অনাগত সন্তান আর নিজের ভালোর জন্য সহপাঠী বন্ধুর সহায়তায় বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসে তানি চরিত্রহীনা হয় তাহলে তোর বাবাকে ভালোবেসে পালিয়ে বিয়ে করে যে তোকে জন্ম দিয়েছে সেও চরিত্রহীনা।

চলবে……

#কাছে_কিবা_দূরে
#পর্ব-১৮
মাহফুজা নিজেকে শান্ত করতে কিছু সময় নিলেন। বললেন,
“ঠিক কী কী বলেছে তোর বন্ধু সব টা বলবি। ”

শুভ্র তানির দিকে এক পলক তাকালো। মাহফুজা বলল,
“উঁহু। তানি এখানেই থাকবে। ওর সব টা শোনার দরকার আছে।

শুভ্র গলার শ্লেষ্মা পরিষ্কার করে বলতে শুরু করলো।

ঘটনা হলো, শুভ্র’র যে বন্ধু সে ছিলো তানির প্রাক্তন স্বামীর দুঃসম্পর্কের আত্মীয়। তার ভাষ্যমতে, তানির প্রাক্তন স্বামী ছিলো পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। বড় তিনজন বোন ও আছে। অবস্থাপন্ন ফ্যামিলি দেখে তারা তানির বিয়ে দেন এবং পরবর্তীতে তারা বুঝতে পারেন যে মেয়ে মোটেও সংসারী টাইপ না। সংসার, স্বামী কারও প্রতিই কোনো মন নেই। এরমধ্যে তানি প্রেগন্যান্ট হলো। বাচ্চা নেয়ার পর পর ই নাকি তারা টের পেল তানির এ্যাফেয়ার আছে। সেটা ফ্যামিলির সবাই জেনে যাওয়ায় এক রাতে তানি ননদ দের মেরে বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে শোনা যায় এবোর্শন করিয়ে স্বামীকে নাকি ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছে।

সব শুনে মাহফুজা বলল, ব্যাস! এইটুকুই?

শুভ্র কোনো কথা বলল না। তানি নিজেও কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। এতো বড় ধাক্কা খেয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল যেন। শুভ্র’র সব কথা শুনতেও পেল না। তানি উঠে দাঁড়ালো। মাহফুজা বলল, তানি এখানে বস চুপচাপ। আমার কথা এখনো শেষ হয় নি। তানি শুকনো গলায় বলল, আমার শরীর ভালো লাগছে না মা। আমি একটু শোব। আর ওনাকে সত্যিই আমার বলার কিছু নাই। যার কাছে আমার কোনো গুরুত্ব ই নেই। তাকে আর নতুন করে কী বলার থাকতে পারে।

মাহফুজা আরও কিছু বলতে গেলে অভ্র বাধা দিলো। বলল, মা ভাবী একটু বিশ্রাম করুক। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে অনেক টায়ার্ড।

আনিকা তানিকে নিজের ঘরে নিয়ে গেল। ঘরে গিয়ে তানি বিছানায় শুয়ে থাকলো।

মাহফুজা শান্ত গলায় বলল, বিয়ের আগে আমি যখন বলেছিলাম তানির সাথে কথা বল, খোঁজ খবর নে। তখন বলেছিলি মা তোমার উপর ভরসা আছে। তা আজ তো মনে হচ্ছে আমার কিংবা তানির চেয়ে বন্ধুর কথায় তোর বেশী ভরসা।

“মা আমার বন্ধুটা অনেক দিনের পরিচিত। ও যে মিথ্যে বলবে না সেটা আমার বিশ্বাস ছিলো “।

“কিন্তু মা যে মিথ্যা বলতে পারে এ ব্যাপারেও নিশ্চয়ই বিশ্বাস ছিলো?”

শুভ্র অস্ফুটস্বরে বলল, মা!

মাহফুজা হাত দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলল, আগে আমাকে শেষ করতে দে।

তানির বাবা পাত্রের ভালো চাকরি আর পরিবার দেখে বিয়ে দিয়েছিলেন। একবারও বুঝতে পারেন নি যে তার বিশ বছরের মেয়ে সংসারের মারপ্যাঁচ শিখে ওঠে নি। শুধু তানি কেন! ওই বয়সী কোনো মেয়েরাই শিখে আসে না। আমার বিয়ে যখন হয়েছে তখন আমি কলেজে পড়ি। ঠিকঠাক এক কাপ চা’ও বানাতে পারি না। হাত কেটে, পুড়িয়ে সংসারের রান্নাবান্না, কাজ শিখেছি। কিন্তু তানির কাছ থেকে ওর আগের স্বামী আর তার পরিবার সবকিছু একবারে চেয়েছেন। একটা বিশ বছরের মেয়ে তার পক্ষে কী প্রথমেই সব কাজ পারা সম্ভব? তাছাড়া তানি ওর মায়ের আদরের মেয়ে। পৃথিবীর কোনো মায়েরাই তাদের মেয়েকে রান্নাঘরে ঢুকিয়ে কাজ শেখায় না। মায়েদের মন মেয়ের জন্য সব সময় উতলা থাকে। তুই তোর বোন কে জিজ্ঞেস করতো চুলা জ্বালিয়ে এক কাপ চা বানাতে পারে কি না!

ঘরের মধ্যে সবাই চুপচাপ মাহফুজার কথা শুনছে। একটু থেমে মাহফুজা আবারও বলল,
বিয়ের দুইমাসের মাথায় তানির গায়ে প্রথমে হাত তুলল স্বামী। দোষ হলো, বন্ধুদের জন্য তানি রান্না করেছিল। সেই রান্না মুখরোচক না হওয়ার কারনে কষে থাপ্পড় মেরে বলেছিল, আজকের এই থাপ্পড় তোকে সারাজীবনের জন্য ভালো রান্না করা শিখিয়ে দেবে।

শাশুড়ী ছাড়াও তিন ননদ ছিলো যাদের একজন ঘরে আর বাকী দুজন ওই একই বিল্ডিং এ থাকতো। এরা গায়ে হাত দিতো না ঠিক ই। কিন্তু এরা কথা দিয়েই মেরে দিতো। কথায় কথায় বাপের বাড়ির দূর্বলতার খোটা, কাজ না জানার খোটা এসব প্রতিদিন ভাত খাওয়ার মতো করেই শুনতে হতো।

আরেকটা কথা মিস হয়ে গেছে। তানিকে বিয়ে করার কারণ মূলত এটাই ছিলো যে ছোট ঘরের মেয়ে ঘরে আনলে পায়ের তলায় পিষে মারতে সুবিধা হবে। এরা ছেলের জন্য বউ না, বাসার পার্মানেন্ট কাজের লোক এনেছিল। কনসিভ করার পর শুরু হলো এদের আরেক ঝামেলা। ছেলে এতো তাড়াতাড়ি বাচ্চা চায় না। তার বন্ধুদের এখনো বাচ্চা হয় নি। বাচ্চার বাপ হওয়া মানে তার কাছে বুড়ো হয়ে যাওয়া। অথচ তার মা, বোনদের বাচ্চা লাগবে। এই নিয়ে ঝামেলার কোনো শেষ নেই। শেষমেস তারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিলো যে বাচ্চা হয়ে গেলে বোনেদের মধ্যে একজন আছে যার বাচ্চা নেই, সে নিয়ে নেবে। অর্থাৎ বাইরের মানুষ কে জানতে দিবে না যে তানি প্রেগন্যান্ট ছিলো। ঠিক সেকারনে এক প্রকার গৃহবন্দি করে রাখা হতো তানিকে। অল্প বয়সী মেয়েটা তখন একটু সাহস করে ওই কয়েদখানা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছিল। ওদের ব্যাচের একটা গ্রুপ ছিলো যাদের খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিলো। তাদের একজনের ফোন নম্বরে ফোন করে সব টা বললে সে মানবতার খাতিরে ঝুঁকি নিয়ে পুলিশের সাহায্যে তানিকে উদ্ধার করেছিল। শেষ পর্যন্ত পুলিশের সাহায্যে ও রাজশাহী পৌছেছিল। কিন্তু কপাল খারাপ থাকায় সেই বাস জার্নিতেই মিসক্যারেজ হয়ে যায়।

এরপরে তানি একটা ভয়ংকর কাজ করেছিল। সুস্থ হয়ে পুরো পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল মা, খালার সহযোগিতায়। সেই মামলায় তাদের অনেক ভোগান্তিও হয়েছে শুনেছি। তা তোমার বন্ধু বুঝি সেটুকু বলে নি?

শুভ্র লজ্জায় মাথানত করে রাখলো। তানির কাছে মাফ চাওয়ার ও মুখ নেই।

মাহফুজা এক নিঃশ্বাসে অনেক কথা বলে ফেলায় গলা শুকিয়ে গেছে। এক গ্লাস পানি ঢক ঢক করে খেয়ে ফেলল। বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“অবন্তী তো সবাইকে বলতো আমি খারাপ। আমি ওর উপর টর্চার করি। সেগুলো কী সত্যি ছিলো? অবন্তীর কথা অনুযায়ী আমিও তো খারাপ মানুষ। আমাকে মা বলতে তোর ঘেন্না হওয়া উচিত। ”

শুভ্র কাতর গলায় বলল, মা আমি ভুল করে ফেলেছি।

মাহফুজা থামিয়ে দিয়ে বলল, না বাবা ভুল আমার হইছে। তোমার জন্য অবন্তীর মতো মেয়েরাই ঠিক, তানি বেমানান।

অভ্র সাফাই গেয়ে বলল, মা ভাইয়া ভুল করে ফেলেছে। দেখো যে বলেছে সে কিন্তু ভাইয়ার বন্ধু ছিলো।

“আর আমি মা। ও যতটা তানিকে অপমান করেছে ততটা অপমান আমাকেও করেছে।”

শুভ্র’র কিছু বলার মতো মুখ নেই। মাথানিচু করে থাকা। ইশ! তানি বিয়ের আগে দেখা করতে চেয়ে এই কথাগুলোই হয়তো বলতে চেয়েছিল। আর ও তখন বারন করে দিয়েছিল যে ও কিছু শুনতে চায় না। আর সেই ও কী না আজ এরকম একটা বিশ্রী কাজ করলো। তানির পা ধরে ক্ষমা চাইলেও হয়তো কম হয়ে যাবে।

অভ্র’র যতটা খারাপ তানির জন্য লাগছে, তারচেয়ে বেশী লাগছে শুভ্র’র জন্য। আর কেউ না জানুক ও জানে যে, আজকের এই অবিশ্বাস করার ঘটনার পিছনে যে ওর অতীতের কোনো ঘটনার মিল আছে।

মাহফুজা চলে যেতেই আনিকা শুভ্র’র একটা হাত ধরে বলল, ভাইয়া ঘরে চলো। তোমার হাত কেটে গেছে অনেকখানি।

অভ্র খেয়াল করলো যে দেয়ালে ঘুষি দেয়ার সময় যে লেগে গিয়েছিল সেখান থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। এতক্ষন সেটা কেউ খেয়াল করে নি।

অভ্র উঠে এসে ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বলল, ভাইয়া ওঠো।
আনিকাকে ইশারায় ফার্স্ট এইড বক্সের কথা বলল।

শুভ্র উদ্ভ্রান্তের মতো তাকিয়ে রইলো কিছু সময়। বলল, তানির কাছে ক্ষমা চাওয়ার যে কোনো মুখ রইলো না। এখন আমি কী করব?

চলবে…..

সাবিকুন নাহার নিপা

কাছে_কিবা_দূরে পর্ব-১৫+১৬

0

#কাছে_কিবা_দূরে
#পর্ব-১৫
হানিমুন ট্রিপের কথা শুনে শুভ্র’র কোনো ভাবান্তর হলো না। ব্রেকফাস্টের টেবিলে যখন অভ্র বলল, তখন নির্লিপ্ত গলায় বলল, ও তোরা এই করেছিস লুকিয়ে লুকিয়ে।

অভ্র বোকার মতো হেসে বলল, হ্যাঁ সারপ্রাইজ কেমন দিলাম বস!

শুভ্র পরোটা আর ডিম মুখে পুরে বলল, তা কোথায় যাচ্ছি আমরা?

আনিকা উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, কক্সবাজার। কী ভালো একটা রিসোর্ট বুক করা হয়েছে তোমাদের জন্য।

সবার উৎসাহে একরাশ পানি ঢেলে দিয়ে শুভ্র বলল, কক্সবাজার! ইয়াক! ধূলোর শহর ছেড়ে যাব বালির শহরে! কেন আমরা কী হানিমুনে গিয়ে বালি মাখামাখি করে শুয়ে থাকব নাকি?

অভ্র’র মুখ টা ছোট হয়ে গেল। তানি এতক্ষণ চুপচাপ মাথানিচু করে খাচ্ছিলো। বিস্মিত চোখে শুভ্র’র দিকে তাকালো। মাহফুজা রান্নাঘরে রান্না করছিলো। ঠিক তখনই আনিকা চিৎকার করে বলল, ভাইয়ায়ায়া তুমি একটা আস্ত খবিশ।

শুভ্র নির্লিপ্ত গলায় বলল, আমি আরও ভেবেছিলাম অফ টাইমে ভালো কোথাও একমাত্র বউটা’কে নিয়ে ঘুরতে যাব। তোরা’ই তো সব পন্ড করে দিলি।

অভ্র কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, অকৃতজ্ঞ, বেইমান।

তানি অবাক গলায় বলল, আপনি এমন কেন! ভাইয়া, আনিকা আর ইরা কতো কষ্ট করে প্ল্যান করলো। ”

শুভ্র সিরিয়াস গলায় বলল, আচ্ছা তানি বলোতো, তুমি আসলে কোন দলের? বরের হয়ে তো কখনো একটা কথাও বলো না। সবসময় দেখি বজ্জাত দেবর, ননদের ন্যাওটা হয়ে থাকো। অথচ তুমি যখন রেগে গিয়ে টমেটো হয়ে যাও তখন আমিই বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করি।

তানি লজ্জায় মাথানিচু করে ফেলল। কী অসভ্য লোক! কোনো রাখডাক নেই। যা মুখে আসছে তাই বলে যাচ্ছে। ছোট ভাই বোনেরা সামনে সে খেয়াল নেই।

অভ্র বলল, ঠিক আছে আমরা তাহলে সব ক্যান্সেল করে দেই। কী বলিস আনু?

আনিকা বলল, হ্যাঁ ঠিক ই বলেছ।

তানি রুক্ষ গলায় বলল, কেন? উনি না গেলে আমি একা যাব। প্রয়োজনে তোমরা আমার সাথে যাবে।

শুভ্র মিনমিনে গলায় বলল, আরে তোমরা সবাই মিলে এতো হাইপার কেন হচ্ছো? আমি তো যাব না বলি নি।

অভ্র বলল, না না। বালির শহরে তোমাকে আর বালি মাখাতে পাঠাচ্ছি না।

শুভ্র হাসতে হাসতে বলল, আরে আমি তো মজা করছিলাম। কেন এতো সিরিয়াস হচ্ছিস তোরা? তাছাড়া তানি কী একা একা হানিমুন করবে নাকি? বর ছাড়া কী আর হানিমুন হয়?

তানি রেগে গিয়ে বলল, আপনি চূড়ান্ত অসভ্য এক লোক।

শুভ্র হেসে বলল, আরে বউয়ের সাথে অসভ্যতা করা ফরজ।

আনিকা কপট রাগ দেখিয়ে বলল, ভাইয়া আমি কিন্তু এখনো ছোট।

শুভ্র চোখ কপালে তুলে বলল, ওমা তাই? আগে তো জানতাম না। আমি তো জানতাম যে লিপস্টিক, নেইলপলিস ঠিকঠাক লাগাতে পারে তাকে বিয়ে দেয়া যায়। তাহলে তুই ছোট কিসের!

মাহফুজা রান্নাঘরে বসে টের পেলেন ডাইনিং টেবিলে রীতিমতো মাছের বাজার বসে গেছে। বুঝলেন যে তার ছেলে মেয়েরা আবারও ঝগড়া শুরু করেছে। কাজ সেড়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, তোরা খাওয়া বাদ দিয়ে এমন ঝগড়া কেন করছিস?

অভ্র আর আনিকা শুভ্র’র বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ করলো। সব শুনে মাহফুজা শুভ্র’কে বলল, তোর এসব ধানাইপানাই কিন্তু চলছে না, ক’টা দিন তানিকে নিয়ে ঘুরে আয়। মেয়েটা সারাদিন একা একা থাকে।

শুভ্র ভ্রু উঁচিয়ে বলল, আচ্ছা! আমাকে তাহলে তোমার পুত্রবধূর বডিগার্ড হয়ে যেতে হবে?

মাহফুজা হেসে বলল, হ্যাঁ হবে।

“ওহ আচ্ছা! আমি এখন পর তাই তো?”

অভ্র বলল, হ্যাঁ। তাছাড়া আমাদের ভাবীকে আমরা তো আর একা পাঠাতে পারি না, তাই তোমাকে পাঠাচ্ছি পাহারাদার হিসেবে।

শুভ্র দুঃখী হবার ভান করে বলল, আগে জানতাম মেয়েরা বিয়ের পর বাপ, মায়ের কাছে পর হয়ে যায়। এখন দেখলাম ঘরে বউ এলে ছেলেরাও মা, ভাই, বোনের কাছে পর হয়।

শুভ্র’র কথার ধরন শুনে সবাই ই হাসলো। শুধু তানি হাসলো না। গম্ভীর হয়ে রইলো।

******
তানি ঘরে ফিরে গোছগাছ শুরু করলো। ট্রলিতে কেবল নিজের কাপড়, চোপর ই নিচ্ছে। শুভ্র ঘরে ঢুকে সেটা দেখতে পেয়ে বলল, কী স্বার্থপর তুমি? নিজের জামাকাপড় গোছাচ্ছো, আর আমি কী বানের জলে ভেসে এসেছি! আমি পাহারাদার, ভুলে যেও না।

তানি পিছনে ফিরে কোমড়ে হাত দিয়ে বলল, আপনি এতো অসভ্য অসভ্য কথা বলছিলেন কেন?

শুভ্র আকাশ থেকে পড়লো যেন। বলল, যাহ বাবা! বউয়ের সাথে অসভ্যতা করব না তো কার সাথে করব?

“ছিঃ! শেইমলেস কোথাকার।”

শুভ্র জামা, প্যান্ট ভাজ করতে করতে নির্লিপ্ত গলায় বলল, আমি দুটো পঁচা কথা বলে অসভ্য হয়ে গেলাম! আর কেউ কেউ যে রাতে আমার ঘুমের সুযোগ নিয়ে জড়িয়ে ধরে সেটাকে কী বলা যায়!

তানির চোখ দুটো বড় হয়ে গেল। শুভ্র তার মানে জেনে গেছে কাল রাতের ব্যাপার টা!

তানি শুকনো ঢোক গিলে বলল, মানে?

শুভ্র বলল, মানে হলো কিছু কিছু ভদ্রমহিলা আছে যারা স্বামী ঘুমিয়ে গেলে তার চুল হাতাহাতি করে, হাতের আঙুলের ভাজে আঙুল রাখে। একটু কায়দা করে জড়িয়ে ধরে। আর বেচারা স্বামী ভালো ছেলের মতো ঘুমিয়ে থাকে।

তানি রাগে ফুসতে ফুসতে বলল, হুহ! ভালো ছেলে। কতো ভালো জানা হয়ে গেছে।

“কী কী জানলে?”

তানি রাগে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেলে শুভ্র শব্দ করে হেসে ফেলল।

*******
সন্ধ্যেবেলা তানি আর শুভ্র’কে স্টেশনে এগিয়ে দিতে অভ্র আর ইরাও এলো। ইরা তানিকে নিয়ে একটু সামনে সামনে হাটছিলো আর শুভ্র, অভ্র পিছনে হাটছিলো।

অভ্র গলা খাদে নামিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ভাইয়া একটা সত্যি কথা বলবে?

শুভ্র স্বভাবসুলভ রসিকতা করে বলল, না বলব না। কারণ আমি সবসময় মিথ্যা বলে অভ্যস্ত।

“ভাইয়া সিরিয়াস কথা বলছি কিন্তু “।

“তাহলে ঢং না করে তাড়াতাড়ি বল। দিন দিন এতো ঢঙ্গী হচ্ছিস কেন? মেয়েদের সাথে থাকতে থাকতে বুঝি?

“মেয়েদের সাথে কই থাকি? ইরা, আনু আর ভাবী ছাড়া আর কোনো মেয়ে নেই আমার লাইফে। ”

শুভ্র বলল, মূল টপিক ভুলে যাচ্ছিস কিন্তু।

অভ্র বলল, ওহ হ্যাঁ! ভাইয়া সত্যি করে বলোতো তুমি কী ভাবীর প্রেমে পড়েছ?”

“অবশ্যই পড়েছি। ”

শুভ্র’র সহজ সরল স্বীকারোক্তি অভ্র’র হজম হলো না। বলল,
“ভাইয়া মজা না প্লিজ। সিরিয়াসলি বলো।”

“হ্যাঁ সিরিয়াসলি ই বলছি তো।”

“তা কবে প্রেমে পড়লে?”

“বিয়ের পর পর ই। চোখের সামনে এতো সুন্দর একটা বউ। তাও নিজের আপন বউ থাকলে যেকেউ প্রেমে পড়বে। আমিও পড়েছি। ”

অভ্র হাসলো। সেই হাসিটা মেকি হাসি না। প্রানবন্ত হাসি।

শুভ্র বলল, এতো হাসির কারণ?

“শুনে খুব খুশি হয়েছি তাই। ”

“এতো খুশি কেন হচ্ছিস?”

“শোনো ভাইয়া এবার সুযোগ বুঝে ভাবীকে প্রেমের কথাটা বলে দাও”।

শুভ্র কিছু একটা ভেবে বলল, আচ্ছা।

অভ্র খুশিতে পাগল হয়ে গেল। বলল, থ্যাংক ইউ ভাইয়া, থ্যাংক ইউ সো মাচ।

শুভ্র হাসলো। মিষ্টি হাসি। যে হাসি দেখলে তানির আত্মা কেঁপে ওঠে। চোখে পানি এসে যায়। খুশির পানি।

অভ্র আর ইরাকে বিদায় জানিয়ে দুজন ট্রেনে উঠলো। ট্রেন একটু একটু করে চলতে শুরু করলো। ইরা চাপা গলায় বলল, এই দেখো দুজন কে কত্তো সুন্দর লাগছে।

অভ্র উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, জানো ভাইয়াও আজ কনফেস করেছে। বলেছে ভাবীকে ভালোবাসে।

ইরা বিস্ময়ে চোখ বড় করে ফেলল। ট্রেনের গতি বেড়ে চলছে। শুভ্র, তানিকে দেখা যাচ্ছে না আর। ক্রমে ক্রমে মিলিয়ে যাচ্ছে।

ইরার বিস্ময় কেটে গেলে চিৎকার করে বলল, সত্যি!

“হ্যাঁ। ”

“ইশ আমার আজ এতো খুশি লাগছে!”

“আমারও। ”

“আমার তো খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে।”
অভ্র আঁতকে উঠে বলল, এই না না প্লিজ প্লিজ। এটা পাবলিক প্লেস।

ইরা খিলখিল করে হাসলো।

রিকশায় উঠে ইরা বাদাম চিবুতে চিবুতে বলল, আজ আমি তোমার উপর খুব খুব খুব খুশি।

অভ্র মৃদু হাসলো। ইরা অভ্র’র একটা হাত ধরে বলল, আমার সাধ্য থাকলে আমি তারা ভরা একটা আকাশ দিতাম তোমাকে।

অভ্র বলল, উঁহু। আমার নীল আকাশ পছন্দ। নীল আকাশ না পেলেও চলবে তবে এই দুষ্টমিষ্টি মেয়েটাকে নীল শাড়ি পরা অবস্থায় প্রতিটি মিঠা সন্ধ্যায় চাই ই চাই।

চলবে…..

#কাছে_কিবা_দূরে
#পর্ব-১৬
যে রিসোর্টে শুভ্র, তানি এসেছে সেখানের জানালা খুললেই সমুদ্র দেখা যায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে শুভ্র জানালা খুলে মুগ্ধ চোখে কমলা রঙা আকাশ, আর সমুদ্রের ঢেউ দেখে। দুটো সকাল দেখার সৌভাগ্য হয়েছে কেবল। প্রতিটি সকালে ই চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলেছে, একটা জীবন কেন মানুষ পায়! আর সে জীবন টা কেন এতো ছোট। আরেকটু দীর্ঘ হলে কতো ভালো হতো৷

কক্সবাজার আসার দিন টা দুজন মিলে ঘুমিয়েই কাটিয়েছে। জার্নি করার সময় শুভ্র’র ঘুম হয় না। তানি পুরো সময়টা ঘুমিয়ে কাটিয়েছে আর শুভ্র কাটিয়েছে তানিকে দেখে। সারারাত তানিকে দেখতে দেখতে শুভ্র একটা কথা উপলব্ধি করতে পারলো। অভ্র কে যে ও বলেছে তানির প্রেমে পরেছে সেটা আসলে সত্যি না। শুভ্র তানিকে ভালোবেসে ফেলেছে। তানির রাগ করা, ঠোঁট টিপে হাসা, কপাল কুচকে ঘুমানো, কথায় কথায় লজ্জা পাওয়া সব টাই ও ভালোবেসে ফেলেছে। শুভ্র তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল যে তানিকে ভালোবাসার কথা জানাবে। জীবন খুব ই ছোট। এক একটা দিন চলে যাওয়া মানে জীবন থেকে এক একটা মুহুর্ত শেষ হয়ে যাওয়া৷ তাই আর লুকোচুরি না, তানিকে বলে দেবে যে তানি আমি তোমার ড্রেনওয়ালা হতে চাই। প্রথম জীবনে সেই ড্রেনওয়ালা অল্প সময়ের জন্য তোমার হাত ধরেছিল কিন্তু আমি সারাজীবন তোমার হাত ধরতে চাই।

কক্সবাজার আসার পর একটা গোটা দিন শুভ্র তানির সাথে কাটিয়েছে। সমুদ্রের জলে গা ভিজিয়েছে, খালি পায়ে হাত ধরে হাটাহাটি করেছে। রাতে দুজন মিলে জ্যোৎস্না বিলাস ও করেছে। এই সময়ে দুজনেই সবকিছু ভুলে নিজেদের মতো সময় কাটিয়েছে। বাড়ি থেকেও ফোন করে কেউ তেমন একটা বিরক্ত করে নি। মাঝরাত পর্যন্ত দুজন মিলে গল্প করে শেষরাতে ঘুমিয়ে গেছে। আর বিছানার ইন্ডিয়া, পাকিস্তানের বর্ডারও আস্তে আস্তে উঠে যেতে শুরু করেছে।

*****
তানির ঘুম ভাঙলো একটু দেরীতে। উঠে দেখলো শুভ্র ঘরে নেই। ভাবলো একা একা বোর লাগছে বলে হয়তো হাটতে বেরিয়েছে। এই সুযোগে তানি চটপট একটু সেজে নিলো। এখানে আসার সময় ব্যাগে শুধু শাড়িই নিয়ে এসেছে। বাড়িতে সালোয়ার কামিজ পরলেও এখানে শাড়ি পরবে। তানি এতোদিনে বুঝে গেছে যে শুভ্র শাড়ি খুব পছন্দ করে। তাই একেক দিন একেক রঙের শাড়ি পরে নিজেকে একটু সাজিয়ে নেয়।

তানি আজ নীল রঙের শাড়ি পরেছে। শাড়ির সাথে গোলাপি ব্লাউজ। এই ব্লাউজে শাড়ির রঙ টা আরও ফুটে উঠেছে। দুহাত ভর্তি নীল চুড়ি, কানে নীল সাদা পাথরের ছোট দুল আর কপালে ছোট টিপ পরেছে। শুধু লিপস্টিক দেয়া বাকী ছিলো তখন ই শুভ্র ঘরে এসে হাজির। তানিকে দেখে অপলক তাকিয়ে রইলো কিছু সময়। তানি অপ্রস্তুত হয়ে মাথানিচু করে ফেলল। স্বাভাবিক হবার জন্য জিজ্ঞেস করলো,

“কোথায় গেছিলেন?”

শুভ্র’র ঘোর ভাঙলো। বলল, এই তো একটু হাটতে বেরিয়েছিলাম। ”

তানি খেয়াল করলো শুভ্র’র হাতে একটা শপিং ব্যাগ। কিছু একটা যে ওর জন্য এনেছে সেটা বুঝতে পারলো। শুভ্র ব্যাগ টা ট্রলির ভিতর রাখলো। তানি মিটিমিটি হাসলো। শুভ্র আজ প্রপোজ করে ফেলবে নাকি! না শুভ্র স্পষ্টভাষী মানুষ, সে নিশ্চয়ই সিনেমাটিক ভাবে প্রপোজ করবে না। সরাসরি ই হয়তো বলে ফেলবে তানি আমি তোমাকে ভালোবাসি।

হঠাৎ ই তানি শব্দ করে হেসে ফেলল। শুভ্র বলল, কী হলো হাসছ কেন?

তানি বলল, না এমনিই।

“এমনি এমনি কেউ হাসে?”

“হ্যাঁ হাসে।”

“আচ্ছা হাসা শেষ হলে চলো। এমনিতেই পেটে ইঁদুর দৌড় শুরু করছে। ”

তানি মৃদু হেসে বেরিয়ে গেল।

খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে দুজন যখন ঘুরতে গেল তখন ই শুভ্র’র এক কলেজ ফ্রেন্ডের সাথে দেখা হয়ে গেল। শুভ্র’র সাথে কুশল বিনিময় শেষে যখন তানির দিকে চোখ পড়লো তখন প্রশ্ন করলো,

“উনি কে?”

“তোর ভাবী। কয়েক মাস আগে বিয়ে করেছি”।

শুভ্র’র বন্ধু বিচিত্র চোখে তানিকে দেখতে লাগলো। তানির অস্বস্তি হলো ঠিক ই কিন্তু এড়িয়ে যেতে পারলো না। বন্ধুর দৃষ্টি শুভ্র’র নজরে এলো। কৌতুহলী গলায় বলল, তুই কী তানিকে আগে থেকেই চিনিস?

লোকটা বিস্মিত গলায় বলল, ওনার নাম সত্যিই তানি?

এই প্রশ্নটায় তানিও বিব্রত বোধ করলো। এই ভদ্রলোক কে তানির চেনা পরিচিত মনে হচ্ছে না কোনোভাবেই। কোথাও কখনো দেখেছে কী না মনে করতে পারলো না।

শুভ্র বলল, মানে কী?

ভদ্রলোক হেসে বলল, না আসলে ভাবীকে কেমন চেনা চেনা মনে হলো। মনে হচ্ছে এর আগেও দেখেছি।

পরিবেশ কিছুটা হালকা হলেও শুভ্র’র মনের শঙ্কা কাটলো না। বন্ধুর মুখের অভিব্যক্তি যে অন্যকিছু বলছিল সেটা বুঝতে পেরেছে। কিন্তু তানিকে এই ব্যাপারে প্রশ্ন করলো না। তানি নিজে থেকেই বলল,

“আমি আসলে ঠিক মনে করতে পারছি না যে ওনাকে কোথাও দেখেছিলাম কি না! ”

শুভ্র ব্যাপার টা উড়িয়ে দিয়ে বলল, আরে ব্যাপার না। হতে পারে তোমাদের কখনো দেখা হয়েছিল কিন্তু তোমার মনে নেই, ওর হয়তো সেজন্য পরিচিত লাগছে।

“হু।”

কিছুক্ষণ বাইরে কাটিয়ে দুপুরের খাবার খেয়ে রিসোর্টে ফিরে এলো। তানির বাইরে ভালো লাগছিল না তাই শুভ্র’ও জোর করলো না। তানি ঘরে এসে ঘুমিয়ে পড়লো। সেই ঘুম ভাঙলো শেষ বেলায়। দেখতে পেল শুভ্র ঘরে নেই, ভেবে নিলো হয়তো বাইরে হাটতে গেছে। তানি ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় কিছু সময় বসে রইলো কিন্তু শুভ্র’র কোনো খবর নেই। ফোন করেও পেল না। তানির মনে অজানা একটা ভয় জন্ম নিলো। এই ভয়টা অমূলক সেটা তানি জানে। তবুও অস্থিরতা বেড়ে চলছে। এই অস্থিরতা দূর হলো শুভ্র’কে কে দেখার পর। শুভ্র হন্তদন্ত হয়ে এসে বলল, তানি জলদি করে সব গুছিয়ে নাও আমরা এখন চট্টগ্রামের উদ্দেশ্য রওনা হচ্ছি।

তানি বোকার মতো তাকিয়ে রইলো। শুভ্র অপেক্ষা না করে নিজেই রুমে গিয়ে জিনিসপত্র গোছাতে শুরু করলো।
তানি জিজ্ঞেস করলো, আমরা চট্টগ্রাম কেন যাচ্ছি?

শুভ্র গোছাতে গোছাতে উত্তর দিলো,

“কারণ আমরা এখন ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা দেব”।

তানি ভয়ার্ত গলায় বলল, বাড়িতে কিছু হয়নি তো? আমি তো বিকেলে ফোন করে শুনলাম সবাই ভালো আছে”।

“বাড়ির সবাই ঠিক আছে কিন্তু আমার জরুরী কাজ পরে গেছে।”

তানি আর কিছু বলল না। অনিচ্ছাসত্ত্বেও সব গুছিয়ে নিয়ে রওনা হয়ে গেল।

বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত তানি কোনো কথা বলল না। শুভ্র’ও আগ বাড়িয়ে কিছু বলল না। বাসে ওঠার আগে হালকা কিছু খাবারও দুজনে নিঃশব্দে শেষ করলো। চট্টগ্রামে পৌছাতে ওদের সময় লাগলো চার ঘন্টার মতো। এই পুরো সময় টায় শুভ্র কোনো কথা বলল না। তানিও চুপচাপ রইলো। ওর মন টা খারাপ হয়ে গেল। ঠিকঠাক ভাবে ঘুরতেও পারে নি তার আগেই এমন চলে যেতে হচ্ছে। নিশ্চয়ই শুভ্র’র জরুরী কোনো কাজ পড়ে গেছে নাহলে এতো তাড়াহুড়ো কেন করবে!

চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসার জার্নিতে শুভ্র ঘুমিয়ে কাটালো। তানি অবাক হলো কারন ও যতদূর জানে তাতে শুভ্র বাস, ট্রেনে ঘুমায় না। অথচ এখন ঘুমুচ্ছে। রাতের খাবার খাওয়ার সময় তানি ওকে ওষুধ খেতে দেখেছিল। সেটা যে ঘুমের ওষুধ ছিলো তা বুঝতে তানির অনেক সময় লেগেছে।

কক্সবাজার থেকে যে মিথ্যে কাজের বাহানায় শুভ্র ঢাকায় ফিরেছে সেটা তানি টের পেল তিন, চারদিন পর। এই তিন চারদিনে চোখে পড়ার মতো তেমন জরুরী কোনো কাজ শুভ্রকে ও করতে দেখে নি।

চলবে…..

সাবিকুন নাহার নিপা

কাছে_কিবা_দূরে পর্ব-১৩+১৪

0

#কাছে_কিবা_দূরে
#পর্ব-১৩
কথা ছিলো শুভ্র কাউকে তানির প্রেমের গল্প টা বলবে না। কিন্তু অভ্র, আনিকা বাড়ি ফিরতেই শুভ্র সব বলে দিলো। বলার ভঙ্গিটাও বেশ নাটুকে ছিলো। বিকেলে সবাই পিয়াজু, আর ছোলা মাখানো খাচ্ছিলো তখন তানি ছিলো রান্নাঘরে। সবার জন্য চা করছিলো। মাহফুজা তখন বাড়িতে নেই। দুঃসম্পর্কের আত্মীয় অসুস্থ, তাই তাকে দেখতে গিয়েছিল। সুযোগ পেয়ে ইরাও আজ এসেছে। শুভ্র সিরিয়াস গলায় বলল, লেডিস এন্ড জেন্টেলম্যান আজ তোমাদের একটা দুঃখের গল্প বলবো। কিন্তু দেখা গেল দুঃখের গল্প শুনতে কেউ ই তেমন আগ্রহী না। শুভ্র বলল, দুঃখের গল্পটা তানিকে নিয়ে।
সবাই নড়েচড়ে বসলো। অভ্র সিরিয়াস গলায় বলল, কী হইছে ভাইয়া?

শুভ্র আগের মতো ই সিরিয়াস গলায় বলল, আজ তানির একটা সিক্রেট জানতে পেরেছি।

ইরা বলল, সিক্রেট? তাহলে সেটা আমাদের কেন বলছ?

“বলছি কারন তোমরা পুরো ঘটনা শুনে তানিকে যদি হেল্প করতে পারো।”

সবাই ই খুব সিরিয়াস হয়ে গেল। শুভ্র অত্যন্ত সিরিয়াস গলায় হাত নেড়ে নেড়ে তানির প্রেমের গল্প বলতে লাগলো।

তানি চা নিয়ে ফিরলে অভ্র বলল, ভাবী ভাইয়া এসব কী বলছে?

তানি অবাক গলায় বলল, কী বলছে?

“তুমি নাকি এক ড্রেনওয়ালার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছ?”

তানি কটমট চোখে শুভ্র’র দিকে তাকালো। শুভ্র দাঁত বের করে হেসে বলল, তোমার সুবিধার জন্যই ওদের বললাম আর কী।

“কিন্তু আপনি তো কথা দিয়েছিলেন যে কাউকে বলবেন না।”

শুভ্র আমতা আমতা করে বলল, আসলে এমন একটা ব্যাপার। না বলতে পেরে পেটের ভিতর গুরগুর করছিল।

সবাই কে অবাক করে দিয়ে তানি কেঁদে ফেলল৷ বলল, ছিঃ আপনি এতো খারাপ! আগে জানলে জীবনেও বলতাম না আপনাকে।

শুভ্র হকচকিয়ে গেল। অভ্র আর আনিকা মিটিমিটি হাসছে। ইরা চিন্তিত গলায় বলল, এবার কী হবে ভাইয়া?

শুভ্র করুন গলায় বলল, আমি কী একটু বেশী ই বলে ফেললাম?

অভ্র হাই তুলতে তুলতে বলল, এবার যাও তুমি সামলাতে।

শুভ্র বলল, কেন যে তোরা জোর করলি আমাকে।

একসাথে তিনজন ই লাফিয়ে উঠে বলল, এই ভাইয়া একদম মিথ্যা দোষ চাপাবে না। আমরা শুনতে চাই নি, তুমিই জোর করে শুনিয়েছ।

যেহেতু অপরপক্ষের দলভারী তাই শুভ্র আত্মপক্ষ সমর্থন করলো। বলল, এবার রাগ ভাঙাতে হবে? মেয়েদের রাগ ভাঙানোর চেয়ে বিল্ডিং বানানো বেশী সহজ।

অভ্র বলল, ঠিকাছে তুমি বিল্ডিং ভাঙো আমরা আজ আসি।

****
তানি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। ব্যাপার টায় ওর খুব কষ্ট লেগেছে। ও শুভ্র কে একটা কথা বলল আর শুভ্র সেটা নিয়ে সবার সাথে মজা করলো! তাছাড়া শুভ্র কথা দিয়েছিল যে কাউকে বলবে না। কিন্তু সবাই কে বলে দিয়েছে। আশ্চর্য ব্যাপার স্বামী, স্ত্রীর সিক্রেট কথাবার্তা অন্য কাউকে কিভাবে বলে! এতো বড় দামড়া একটা ছেলে অথচ এতো নির্বোধ।

শুভ্র ওই ব্যাপার টা সবাইকে বলে দেয়ায় তানির যতটা কষ্ট লেগেছে। তারচেয়ে বেশী কষ্ট লেগেছে তানিকে ভুলে যাওয়ায়। তানি এখনও ওকে মনে রেখেছে আর ও কী না ভুলে গেল! আর যাবেই না কেন! ওর লাইফে তো তখন অবন্তী ছিলো। অবন্তীর জন্য যে হ্যাংলামি করেছে তাতে করে অন্য মেয়েকে মনে রাখবে কী করে!

তানি সিদ্ধান্ত নিলো শুভ্র’র সাথে দুদিন কথা বলবে না। যত ই সরি বলুক তানি কথা বলবে না। এবার একদম উচিত শিক্ষা দেবে৷

*****
ইরা বলল, আচ্ছা ভাইয়া আর ভাবীর প্রেম টা কতদূর এগিয়েছে?

অভ্র বলল, কী জানি!

আনিকা বলল, বেশীদূর এগোয় নি আপু৷ ভাবী এখনো ভাইয়াকে আপনি করে বলে।

ইরা বলল, আসলেই তো! ব্যাপার টা খেয়াল করিনি।

অভ্র বিরক্তির সুরে বলল, যেমন দেবা তেমনি তার দেবী৷ দুটো ই আনরোমান্টিক। তোরা মাঝেমধ্যে ঘুরতে যাবি, সিনেমা দেখবি, তা না করে ঘরের মধ্যে চিপকে থেকে বস্তাপঁচা প্রেমের গল্প বলে। তাও যদি ঘরের মধ্যে থেকে কোনো কাজের কাজ করতি।

ইরা চিমটি কেটে বলল, কী সব বলছ আনু আছে তো আমাদের সাথে।

আনিকা ঠোঁট টিপে বলল, ইরা আপু সমস্যা নেই। আর দু’মাস পর আমার আঠারো হয়ে যাবে।

ইরা আনিকার মাথায় চাপড়ে দিয়ে বলল, চুপ। তুই কান বন্ধ করে থাক।

আনিকা চুপ করে থাকলো না। বলল, আচ্ছা ভাইয়া আর ভাবীকে হানিমুনে পাঠালে কেমন হয়?

অভ্র’র চোখ দুটো জ্বলে উঠলো। ইরা চিৎকার করতে গিয়েও থেমে গেল। আনিকা মিটিমিটি হাসছে যেন সে এভারেস্ট জয় করে ফেলছে।

******
তানি রুমের দরজা যে সেই বন্ধ করেছে আর খোলে নি। শুভ্র দরজায় ধাক্কা দিয়ে অনেকবার সরি বলেছে কিন্তু তানি দরজা খোলে নি। রাতের রান্নাও করে নি। ঘরের দরজা বন্ধ করায় শুভ্র ঘরেও যেতে পারে নি। কিছু সময় স্টাডিতে ছিলো। বই পড়ায়ও মন দিতে পারে নি। শেষমেস বের হয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল তানির জন্য কিছু একটা বানাবে। যেভাবেই হোক আজ বিল্ডিং মানে তানির রাগ ভাঙাবে।

আনিকা আজ অভ্র’র পকেট থেকে অনেকগুলো টাকা খসিয়েছে। বার্গার খেয়েছে, কিছু নেইলপলিশ কিনেছে। এতো ভালো বুদ্ধি দিয়েছে সে তুলনায় এসব কম ই। ও ভেবে নিয়েছে ভাইয়া আর ভাবীর প্রেম হয়ে গেলে তাদের কাছ থেকেও ট্রিট নিবে।

বাড়ি ফিরে দেখলো শুভ্র রান্নাঘরে রীতিমতো যুদ্ধ করছে। অভ্র বলল,
“কী করছ?”

শুভ্র বলল, তোরা দুই মীর জাফর আমার সাথে কথা বলবি না।

আনিকা বলল, তুমি নিজের দোষে ফেঁসেছ। আমাদের দোষ কই?

শুভ্র ছুড়ি উঁচিয়ে অভ্রর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, এই ব্যটা মীর জাফর যদি না বলে দিতো তাহলে এতো কেস খেতে হতো না।

অভ্র বলল, আচ্ছা শোনো আমি একটা আইডিয়া দিতে পারি। দেখবে তাতে ভাবীর রাগ একদম গলে যাবে।

“কী?”

তানির খুব খিদে পেয়েছে এখন৷ কিন্তু রাগ করে আছে, এই অবস্থায় খেতে গেলে রাগ টা থাকবে না। শুভ্র দুই তিনবার ডেকে গেলেও এখন আর কোনো খবর নেই। তানির মেজাজ আরও খারাপ হলো। এই হলো রাগ ভাঙানোর নমুনা। খেতে পর্যন্ত ডাকছে না। নিজে নিশ্চয়ই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে গেছে।

অভ্র তানিকে ডাকছে। বলল, ভাবী দরজা খোলো, আমরা না খেয়ে বসে আছি।

তানির এবার রাগের সাথে সাথে দুঃখ ও হলো। দেবর, ননদ, শাশুড়ী সবাই এতো ভালো! অথচ বর টা হলো কী না একটা গোয়ার টাইপ। তানি দরজা খুলল৷ আনিকা এসে জড়িয়ে ধরে বলল, ভাবী ভাইয়া আজ তোমার জন্য রান্না করেছে। চলো খেতে চলো৷

তানি এক নজর শুভ্র’কে দেখে বলল, না আমি খাব না।

অভ্র বলল, তুমি না খেলে আমাদের ও ফর্মালিটি দেখিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে। কিন্তু আমরা তো না খেয়ে থাকতে পারি না ভাবী।

শুভ্র বলল, তানি তোমাকে এক লক্ষ বার সরি। আর কোনোদিন ওই ড্রেনওয়ালার নাম মুখে আনবো না। চলো এবার খেতে চলো। নাহলে তোমার শাশুড়ী আমার গর্দান টা নিয়ে নেবে।

তানি মুখ ফিরিয়ে রইলো। শুভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, অভ্র, আনু তোরা টেবিলে গিয়ে একটু চোখ বন্ধ করে বস তো।

দুজনেই টেবিলে গিয়ে চোখ বন্ধ করে বসলো। শুভ্র এসে তানিকে কোলে তুলে নিলো। তানি হকচকিয়ে গেল। বড়, বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলো শুভ্র’র দিকে। শুভ্র হাসছে, হাসার সময় চোখ ও হাসছে। তানি মনে মনে বলল, কবে আপনাকে একটু ছুঁয়ে দিতে পারব!

চলবে….

সাবিকুন নাহার নিপা

#কাছে_কিবা_দূরে
#পর্ব-১৪
টেবিলে খেতে বসে তানি একটাও কথা বলে নি। লজ্জায় মাথানিচু করে ছিলো। কোনোরকম নাকেমুখে খাবার গুজে দ্রুত প্রস্থান করলো। তানি যেতেই অভ্র আর আনিকা শব্দ করে হেসে ফেলল। শুভ্র’র লজ্জা শরমের কোনো বালাই নেই। সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে খেয়ে যাচ্ছে। আনিকা পিঞ্চ করে বলল, ভাইয়া কতো রোমান্টিক দেখেছ?
অভ্র চোখ কপালে তুলে বলল, মোটেও না, এইসব আমার বুদ্ধি। ভাইয়ার কম্ম নয়।

শুভ্র খেতে খেতে বলল, হ্যাঁ বস তোমার তো অনেক এক্সপেরিয়েন্স আছে।

“আমার এক্সপেরিয়েন্স কীভাবে থাকবে? আমার তো আর বউ নেই। ”

“পাতানো বউ আছে তো।”

আনিকা লাফ দিয়ে উঠে বলল, জানো বড় ভাইয়া, ছোট ভাইয়া তো বিয়ের প্ল্যান করছে।

অভ্র আনিকার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, তুই ঠিক কার দলে বলবি?

আনিকা দাঁত বের করে বলল, আমি তোমাদের কারোর দলেই না। আমি শুধু ভাবীর দলে।

শুভ্র বলল, প্রতি মাসে আমাদের পকেট হাতিয়ে, এখন বলছিস তুই কী না ভাবীর দলে! বুঝলি অভ্র, ঘরে এর মতো একটা মীর জাফর থাকলে আর কিছু লাগে না। দেখবি যেকোনো সময় সৈন্য সামন্ত এনে পলাশীর যুদ্ধ শুরু করে দিবে। একে দিয়ে এক ফোঁটা বিশ্বাস ও নেই৷

অভ্র সায় দিয়ে বলল, একদম ঠিক বলেছ।

আনিকা অভ্র’র হাতে চিমটি কেটে ফিসফিস করে বলল, এরকম করলে আমি কিন্তু আর কোনো বুদ্ধি দেব না।

শুভ্র স্পষ্ট শুনতে না পেয়ে বলল, ঘষেটি বেগম কী বলছে রে?

অভ্র বোকার মতো হাসতে হাসতে বলল, না মানে বলছে যে ভাইয়া আর ভাবীর প্রেম তো জমে পুরো আইসক্রিম হয়ে গেছে।

শুভ্র হাসলো শুধু কিছু বলল না।

খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে শুভ্র যখন ঘরে গেল তখন তানি পাশ ফিরে শুয়ে পড়েছে। শুভ্র ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলো তানি ঘুমোয় নি, কিন্তু ঘুমের ভান করে আছে। শুভ্র বুঝতে দিলো না যে ও তানির ভান ধরে ফেলেছে। লাইট অফ করে মোবাইল নিয়ে বসলো। ইমেইল চেক করতে করতে আড়চোখে তানিকে দেখতে লাগলো। তানি আগের মতো ই চোখ বুঝে শুয়ে আছে।

তানি লজ্জায় চোখ বন্ধ করে আছে। ভেবেছিল শুভ্র’র উপরে রেগে থেকে শোধ নেবে। টানা এক সপ্তাহ কোনো কথা বলবে না। কিন্তু শুভ্র কী করলো! একদম বেহায়ার মতো কোলে তুলে নিলো! তাও আবার ছোট ভাই, বোনদের সামনে। ইশ! একটুও লজ্জা, শরম নেই। শুভ্র যখন ওকে কোলে তুলে নিলো তখন ওর কয়েক সেকেন্ডের জন্য মাথা খারাপ হয়ে গেল। লাজ লজ্জা ভুলে ও তখন গলা জড়িয়ে ধরলো। ছিঃ ছিঃ কী লজ্জার ব্যাপার! ইশ লজ্জায় এক্ষুনি তানির মাটির নিচে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে। শুভ্র না’হয় বেহায়া, তাই বলে ও এরকম বেহায়া হয়ে গেল কীভাবে! ছিঃ ছিঃ।

তানি হঠাৎ হাতের উপর শীতল কিছুর স্পর্শ অনুভব করলো। কিছু সময় বাদে বুঝতে পারলো যে ওটা শুভ্র’র হাত। শীতকাল প্রায় চলে গেছে। এখন বসন্তকাল। দিনের বেলায় ভ্যাপসা গরম আর রাতে হালকা শীত। শেষ রাতে শীত একটু বেশী ই লাগে৷ এই ঘরে মাহফুজা পাতলা কম্বল একটা’ই দিয়েছে। বড় কম্বল বলে একটা দিয়েছে। লজ্জায় তানি আরেকটা কম্বল চাইতে পারে নি। এক কম্বলে দুজন থাকতে গিয়ে কখনো কখনো কাছাকাছি চলে আসে। আজ তাই শুভ্র’র স্পর্শ পেয়ে তানি ভাবলো শুভ্র ঘুমের ঘোরে হাত রেখেছে। তানির ভালো লাগলো। হাত টা’কে আলতো করে চেপে ধরলো। শুভ্র’র কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। আরেকটু নিশ্চিত হবার জন্য তানি পাশ ফিরে শুভ্র’র মুখোমুখি হলো। মোবাইলে টর্চ জ্বালালো। টর্চের আলোটা সাহস করে শুভ্র’র চোখের উপর ফেলল। যদি জেগে থাকে কিংবা জেগে থাকার ভান করে তবে চোখের উপর আলো পড়লে কপাল কুচকে যাবে। সেসব কিছুই হলো না। শুভ্র একদম স্বাভাবিক রইলো। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়তে লাগলো। তানি এইবার নিশ্চিত হলো যে শুভ্র গভীর ঘুমে মগ্ন। তানির এখন একটু শয়তানি করতে ইচ্ছে করছে। করবে কী করবে না এই নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। শেষমেস সিদ্ধান্ত নিলো যে করবে। তাছাড়া বর টা যেহেতু ওর তাহলে একটু বেহায়া হয়ে ঢং তো করাই যায়।

তানি শুভ্র’র কপালের চুলগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে দিলো। সরিয়ে দিয়েও ক্ষ্যান্ত হলো না। চুলে বিলি কাটতে লাগলো। এতো নরম সিল্কি চুল! এই চুলে সারাদিন বিলি কেটে গেলেও কোনো ক্লান্তি আসবে না।
এরপর শুভ্র’র হাতের আঙুলের ভাজে নিজের আঙুল গুজে দিলো। একা একা লজ্জা পেয়ে নিজেই হাসলো। এতো টা দুঃসাহস শুভ্র জেগে থাকলে জীবনেও পারতো না। এভাবে কিছু সময় কেটে গেল। হঠাৎই আচমকা শুভ্র হাত বাড়িয়ে তানিকে কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো। তানির নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম। শরীরে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেল যেন। তানি কেঁপে কেঁপে উঠছে, সেই সাথে এক অদ্ভুত ভালোলাগার অনুভূতি হচ্ছে। চোখ বন্ধ করে তানি দু’হাতে শুভ্র’কে জড়িয়ে ধরলো।

তানি যখনই শুভ্র’কে জড়িয়ে ধরেছে তখন ই শুভ্র চোখ খুলল। মটকা মেরে এতক্ষণ যে ঘুমানোর অভিনয় করে গেছে সেটা তানি ঘূনাক্ষরেও টের পায় নি। পাবে কী করে! শুভ্র কী চিজ সেটা কী এখনো ও জানে নাকি!

*****
প্রতিদিন ই তানির ঘুম ভাঙে দেরিতে। কিন্তু আজ শুভ্র এখনো জাগে নি। ঘুম ভাঙতেই তানি নিজেকে আবিষ্কার করলো শুভ্র’র বুকের উপর। গত রাতের কথা মনে পরে গেল। লজ্জা, আর ভালোলাগার মিশ্র অনুভূতি তৈরী হলো। উঠে বসে শুভ্র দিকে তাকালো৷ কী নিঃষ্পাপ লাগছে! কে বলবে যে এই ছেলে জেগে থাকলে সবাই কে উলটা পালটা কথা বলে জ্বালিয়ে মারে। তানি শুভ্র’র চুলে আবারও হাত বুলিয়ে দিলো আর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, এখন থেকে প্রতিদিন শুভ্র’র আগে ঘুম থেকে উঠে ওর মুখ দেখে দিন শুরু করবে।

মাহফুজা ফিরে এসেছে সকালেই। ফিরে আসার পর পর ই অভ্র আর আনিকার কাছে হানিমুন প্ল্যান সম্পর্কে শুনেছে এবং তার ও এই ব্যাপারে সায় আছে। সত্যিই তো বিয়ের পর ওরা একান্তে সময় কাটানোর সুযোগ ও পায় নি। ছেলে মেয়েদের মাথায় যে ব্যাপার টা এসেছে এই ব্যাপার টা তার মাথায় কেন এলো না। এবং সিদ্ধান্ত নিলো অতি শিগগিরই শুভ্র’র সাথে কথা বলবে।

তানি রান্নাঘরে রান্না করছিলো। মাহফুজা গিয়ে বলল, আমাকে কিছু একটা করতে দে। সব কাজ তো তুই ই করছিস।

তানি মৃদু হেসে বলল, তুমি একটা দিন ছুটি পেয়েছ বিশ্রাম করো।

মাহফুজা হেসে বলল, তুই তো দিন দিন আমার অভ্যাস খারাপ করে দিচ্ছিস।

তানি শাশুড়ীর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে আবারও কাজে মন দিলো।

মাহফুজার মন টা খুশিতে ভরে উঠলো। এই মেয়েটা এতো লক্ষী! শুভ্র’র জন্য একদম ঠিকঠাক। তার খাটি সোনা চিনতে একটুও অসুবিধা হয় নি৷ এই মেয়েটা সংসারে আসার পর থেকে সংসার যেন একদম কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। মাহফুজা বলল, তোদের বিয়ের তো অনেক দিন হয়ে গেল। কোথাও ঘুরতে টুরতে তো যাওয়া হলো না।

তানি কিছু না বলে শুধু হাসলো।

“শুভ্র’কে বলি কোথাও তোকে নিয়ে ঘুরে আসুক। তোর যেতে আপত্তি নেই তো”?

তানি মাথা নেড়ে না বলল। মাহফুজা বলল, কোথায় যেতে চাস বল তো?

তানি মাথানিচু করে বলল, ওনার যেখানে ইচ্ছে সেখানেই যাব।

মাহফুজা হাসলো। বলল, আচ্ছা তাহলে তোর ওনার সাথে কথা বলি।

তানি লজ্জা পেয়ে হাসলো। মাহফুজার চোখ আনন্দে চকচক করে উঠলো। এতোদিনে তার ছেলের জীবন টা গুছিয়ে আসতে শুরু করেছে। সব কৃতিত্ব এই মেয়েটার।

*****
শুভ্র’র ইউনিভার্সিটিতে সেমিস্টার ফাইনাল চলছে। এরপর ব্রেক পাবে। সেই ব্রেকে দুজন কে ঘুরতে পাঠানোর প্ল্যান করেছে অভ্র, আনিকা আর ইরা। অভ্র ঘোষণা দিয়েছে হানিমুন ট্রিপের সব খরচ সে দেবে। এটাই হবে তানিকে দেয়া তার পক্ষ থেকে বিয়ের উপহার। কিন্তু হিসেব নিকেশ করে দেখলো ওর সেভিংস যা আছে তাতে সব টা ঠিকঠাক হবে না। ভালো রিসোর্ট বুক করতে হবে। হানিমুনে গিয়ে তো আর সস্তা রিসোর্টে থাকা যায় না। ইরা অনলাইনে সব খোঁজ খবর নিচ্ছে। আপাতত সবাই মিলে ঠিক করেছে দুজন কে কক্সবাজার পাঠাবে। যে রিসোর্ট পছন্দ করেছে সেখানের কস্ট টা একটু বেশী হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া আর কোনোটা’ই ইরার পছন্দ হচ্ছে না। অভ্র চিন্তিত গলায় বলল, খরচ টা তো একটু বেশি মনে হচ্ছে।

ইরা বলল, হোক বেশী। আমার জমানো টাকা আছে আমি সেটা দেব।
সেই শুনে আনিকাও তার সিন্ধুক খুলে বসলো। শেষমেস তিনজন মিলে হানিমুন ট্রিপের সব বন্দোবস্ত করে ফেলল। কিন্তু শুভ্র’কে কিছু জানতে দিলো না। তানি একটু একটু জানলেও পুরোটা জানেনা।

শুভ্র আজ খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছে। তানি শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিল। অভ্র তানিকে ম্যাসেজ দিলো, ভাবী একটু বাইরে এসো।

তানি তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এলো। ভেবেছে এতো রাতে ডেকেছে নিশ্চয়ই জরুরী কিছু বলবে। অভ্র’কে পেল রান্নাঘরে। রাত জেগে ফোনে কথা বলতে বলতে মাঝেমধ্যে তার খিদে পেয়ে যায় তাই নুডলস কিংবা পাস্তা বানিয়ে খায়। আজও নুডলসের যোগাড় করছে। তানি ব্যস্ত গলায় বলল,
“কী হয়েছে ভাইয়া?”

অভ্র হেসে বলল, কিছু হয় নি ভাবী। দেখলাম তোমার ঘরের লাইট জ্বলছে তাই ভাবলাম তোমার সাথে একটু গল্প করি।

তানি স্মিত হেসে বলল, তুমি সরো আমি বানিয়ে দেই।

অভ্র সরে গিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বলল, আচ্ছা ভাবী একটা কথা জিজ্ঞেস করি?

“হ্যাঁ। ”

“সত্যি বলবে কিন্তু। ”

“আচ্ছা। ”

“তুমি কী ভাইয়াকে ভালোবাসো?”

তানি বিস্মিত চোখে অভ্র’র দিকে তাকিয়ে সাথে সাথে চোখ নামিয়ে ফেলল। মিথ্যে বলা ওর পক্ষে সম্ভব না। তাই চুপ করে থাকলো।

অভ্র বলল, নীরবতা সম্মতি ভেবে নেব?

তানি লজ্জা পেয়ে বলল, জানিনা।

অভ্র হাসলো। বলল, আচ্ছা ঠিক আছে জানতে হবে না। তবে একটা কথা শোনো, তুমি আর ভাইয়া যে ঘুরতে যাচ্ছ এই সময় টা ভালোভাবে কাটাবে। মোটেও রাগারাগি করবে না।

তানি কপট রাগ দেখিয়ে বলল, আমার অতো রাগ নেই।

অভ্র ব্যাঙ্গাত্মক সুরে বলল, রাগ নেই তাতেই নাকের ডগা সবসময় লাল থাকে। রাগ থাকলে না জানি কী হতো!

“আচ্ছা! আর তোমার ভাইয়া যে আমাকে লেগপুলিং করে! ”

অভ্র অনুরোধের সুরে বলল, আর যাই করো দয়া করে ঝগড়াঝাটি করবে না প্লিজ। পারলে এবার ভালোবাসার কথাটা বলে দিও।

তানি চোখ কপালে তুলে বলল, আমি বলব?

“হ্যাঁ। তাতে সমস্যা কী?”

“প্রেম ভালোবাসার কথা মেয়েরা আগে বলে না।”

“মেয়েরা বলে না ঠিক আছে, কিন্তু বউয়েরা বলতে পারে। ভাবী প্লিজ প্লিজ আমাদের এতো কষ্টে জল ঢেলে সব ঘেটে ঘ’ করে দিও না। একটু দয়া করো। কথা দিচ্ছি প্রথম ছেলে, মেয়ের নাম তোমাদের নামে রাখব।”

তানি হেসে ফেলল। বলল, তুমিও তোমার ভাইয়ের চেয়ে কম না। বরং একটু বেশী ই।

চলবে…..

সাবিকুন নাহার নিপা

কাছে_কিবা_দূরে পর্ব-১২

0

#কাছে_কিবা_দূরে
#পর্ব-১২
হঠাৎ লাইট জ্বলে ওঠায় তানি চমকে উঠলো। চোখ বন্ধ করে ফেলল৷ শুভ্র তানির দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে হেসে ফেলল। হাসির শব্দ শুনে তানি চোখ খুলল। দুজনের মাঝখানে এক হাত পরিমাণ দূরত্ব এখন৷ তানির বুকের ভিতর দ্রিম দ্রিম শব্দ হচ্ছে, শুকনো ঢোক গিলল একটা। শুভ্র এতো কাছে কেন এসেছে! বিয়ের একুশ দিন হতে চলল, শুভ্র কী তবে তানির উপর অধিকার ফলাতে এসেছে!
তানির হৃদস্পন্দন বেড়ে চলছে। হৃৎপিন্ডে রক্ত চলাচল ও দ্রুত গতিতে বেড়ে গেছে, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।

শুভ্র এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তানির দিকে। ওর খুব মজা লাগছে তানির এভাবে ভয় পাওয়া দেখে। ইচ্ছে করে আরেকটু এগিয়ে গিয়ে তানির গালে ঠান্ডা হাত টা রাখলো। তানি কেঁপে উঠল। শুভ্র সাথে সাথে হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, তোমাকে পরীক্ষা করে দেখছিলাম।

তানি উঠে বসতে বসতে বলল, পরীক্ষা মানে?

“মানে রাগী, ভীতু, লাজুক তানিকে তো দেখে ফেলেছি। ভয় পেলে তানিকে কেমন লাগে সেটা দেখছিলাম আর কী!”

কথাটা শেষ করেই শুভ্র লাইট অফ করে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। তানি তখনও বোকার মতো বসে রইলো।
কিছু সময় বাদে খেয়াল করলো শুভ্র ঘুমিয়ে গেছে। তানির তখন খুব লজ্জা লাগলো। ইশ! ও কতকিছু ভেবে ফেলেছে। ছিঃ ছিঃ শুভ্রকে নিয়ে এতো খারাপ ভাবতে পারলো কী করে!
অবশ্য শুভ্র যে দুষ্ট সেটা বুঝতে পেরেছে আজ রিকশায় বসে। সারারাস্তা ইচ্ছে করে হাত ধরে রেখে তারপর কী ভাব টা’ই না নিলো।

তানি এতোদিনে বুঝে গেল, বয়স বাড়লে কী হবে। পেটে পেটে দুষ্ট বুদ্ধির অভাব নেই। পুরো পেট ভর্তি ই দুষ্ট বুদ্ধি। ব্যাপার টা ভেবে তানি নিঃশব্দে হাসলো।

******
শুভ্র তানির নতুন বিবাহিত জীবন এভাবেই খুনসুটিতে কাটতে লাগলো। স্বামী, স্ত্রীর সহজাত সম্পর্ক দুজনের মধ্যে না হলেও বেশ ভালো বন্ধুত্ব হয়েছে। তানির ভালো ভালো রান্না খেয়ে শুভ্র’র অভ্যাস ও খারাপ হয়ে যাচ্ছে। একদিন অফিস থেকে ফিরে বলল, তানি তোমার রান্না খেতে খেতে বাজে অভ্যাস হয়ে যাচ্ছে। রেস্টুরেন্টের খাবার এখন খুব বিস্বাদ লাগছে। তানি লজ্জা পেলেও খুব খুশি হলো। আজকাল ওর নিজের ও রান্না করতে খুব ভালো লাগে।

শুভ্র যতক্ষন বাড়িতে থাকে ততক্ষণ ওর শুধু শুভ্র’র কাছাকাছি থাকতে ইচ্ছে করে৷ কিন্তু শুভ্র বাসায় ফিরেও ল্যাপটপ কিংবা, বইয়ে মুখ গুজে থাকে। আর শুক্রবার তো সারাদিন পরে পরে ঘুমায় তাই তানির সময় কাটে শাশুড়ী, ননদ, দেবর এদের সাথে। তবে মঙ্গলবার দিন টা তানির জন্য খুব শুভ। এই দিনে অনেক টা সময় শুভ্র কে কাছে পায়৷ বাড়িতে কেউ থাকে না বলে সংকোচ ও কম হয়। তানি খেয়াল করেছে শুভ্র মঙ্গলবার ওকে বেশ সময় দেয়। বাইরে ঘুরতে নিয়ে যায়, কিংবা ছাদে কফি খেতে খেতে গল্প বলে। তাই তানি মঙ্গলবার দিন টা’কে নাম দিয়েছে মঙ্গলবার বিলাস। মনে মনে খুব আক্ষেপ ও যে কেন সপ্তাহে আরেকটা মঙ্গলবার থাকলো না।

এক মঙ্গলবার শুভ্র এসে তানিকে বলল,
“এই তানি আজ তুমি বসে থাকো। আমি রান্না করি। ”

তানি চোখ কপালে তুলে বলল,
“আপনি কেন রান্না করবেন? ”

শুভ্র হেসে বলল, আরে ভয় পেয়ো না। তোমার মতো ভালো না পারলেও আমি রান্না পারি। বিদেশে নিজেই রান্না করতাম।

তানির ভরসা হলো না। বলল,

“থাক আমিই রান্না করে ফেলি।”

“আরে তুমি দেখো আমি কিভাবে রান্না করি।”

সত্যি সত্যি আটঘাট বেঁধে শুভ্র রান্না করতে নামলো। তানি অবাক হয়ে দেখলো কী সুন্দর অভিজ্ঞ হাতে শুভ্র একটার পর একটা কাজ করে যাচ্ছে। তানিকে কিচ্ছু করতে দিচ্ছে না। চুপচাপ বসে থাকতে বলেছে।

তানি মনোযোগ দিয়ে রান্না দেখছে। শুভ্র চুলায় সবজি চাপিয়ে তানিকে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কী কফি খাবে?

“না।”

“খেতে চাইলে বলো। আমি নিজের জন্য বানাবো। ”

“তাহলে খাব।”

শুভ্র তানির চোখের দিকে তাকিয়ে হাসলো।

ঝটপট কফি বানিয়ে তানির হাতে দিতে দিতে শুভ্র বলল,
“দেখো তো কেমন হয়েছে?”

তানি চুমুক দিয়ে স্মিত হেসে বলল, খুব ভালো হয়েছে। আপনি তো দারুণ কফি বানাতে পারেন।

শুভ্র বিশ্বজয়ী হাসি দিয়ে বলল, মাই প্লেজার।

তানি অবশ্য মিথ্যে বলল। কফি খেতে আহামরি কিছু লাগে নি। তাছাড়া ওর কফি পছন্দ ও না। ও চা প্রেমি। কিন্তু শুভ্র’কে সেটা ইচ্ছে করেই বলে নি। মানুষ টা এত কষ্ট করে বানিয়েছে!

শুভ্র কফি খাওয়ার ফাঁকে তরকারি টা দেখতে দেখতে বলল, আচ্ছা তানি তুমি এতো কম কথা বলো কেন আমার সাথে? ”

তানি বিস্মিত গলায় বলল, কই?

শুভ্র আড়চোখে তাকিয়ে বলল, আমি দেখেছি। অভ্র, আনিকার সাথে হেসে হেসে গল্প করো। আর আমার সাথে কথা বলতে এলে হ্যাঁ, না এসবে চালিয়ে দাও। আর আমি কথা বলতে বলতে মুখ ব্যথা করে ফেলি।

তানি মুখে কিছু বলল না। মনে মনে বলল, আমার যে আপনার কথা’ই শুনতে বেশী ভালো লাগে।

শুভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এই যে আমি বক বক করছি আর তুমি মাথা নুইয়ে শুনে যাচ্ছ। ব্যাপার টা কী বলোতো? তোমার বর পছন্দ হয় নি?

তানি আঁতকে উঠে বলল, না না খুব পছন্দ হয়েছে।
মুখ ফসকে কথাটা বলে নিজেই হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলো। শুভ্র সেটা দেখে শব্দ করে হেসে ফেলল। তানি লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলল। শুভ্র বলল,
“আরে লজ্জা পাচ্ছ কেন? আমারও তো বউ পছন্দ হয়েছে। শুধু বউয়ের রাগ টা একটু বেশী এই যা। ”

তানি বলল, মোটেও না।

“হ্যাঁ সেটা টের পেয়েছি”।

“আসলে আমার আপনার কথা শুনতে বেশী ভালো লাগে তাই নিজে কম বলি”।

শুভ্র গভীর চোখে তানির দিকে তাকালো। সেই তাকানো স্থায়ী হলো না। তরকারি তে মনোযোগ দিতে দিতে বলল, কিন্তু আমারও মাঝে মাঝে যে তোমার কথা শুনতে ইচ্ছে করে।

“তাহলে এবার থেকে বলব”।

“এবার থেকে না। এক্ষুনি বলো। ”

তানি অবাক গলায় বলল, কী বলব?

শুভ্র এক সেকেন্ড ভেবে বলল, তোমার প্রেমের গল্প বলো।

“আমার তো প্রেম হয় নি। বাবার পছন্দে বিয়ে হয়েছিল। ”

“উঁহু। বিয়ের গল্প শুনবো না। প্রেমের গল্প। প্রেম হয় নি ঠিক আছে কিন্তু কারোর না কারোর প্রেমে তো পড়েছ সেটার গল্প বলবে।”

তানি বলল, বলব কিন্তু একটা শর্ত আছে।

“কী শর্ত?”

“আপনাকেও আপনার প্রেমের গল্প শুনাতে হবে”।

শুভ্র অতিসন্তঃর্পনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ওকে। তার আগে রান্না শেষ করে নেই। প্রেমের গল্প মনোযোগ দিয়ে শুনতে হয়।

শুভ্র’র বলার ভঙ্গি দেখে তানি হেসে ফেলল৷

রান্না শেষ করে শুভ্র এক কাপ চা তানির জন্য, আর নিজের জন্য কফি নিয়ে বারান্দায় এলো।

তানি চায়ের কাপ হাতে নিতে নিতে বলল, আমার জন্য কফি আনলেন না কেন?

শুভ্র নির্বিকার গলায় বলল, কফি খেয়ে মুখ কুচকে ফেললে তোমাকে দেখতে ভালো লাগে না তাই।

তানি লজ্জা পেল সেই সাথে খুশিও হলো। শুভ্র তার মানে ওকে মনোযোগ দিয়ে দেখেছে।

শুভ্র বলল, তানি ডোন্ট বি লেট। তাড়াতাড়ি শুরু করো।

“উঁহু আপনি আগে বলুন”।

“তোমার আগে বলার কথা ছিলো। ”

“উঁহু আপনি আগে।”

শুভ্র শাসিয়ে বলল, চিটিং করলে কিন্তু ঘ্যাচাং করে মাথাটা কেটে ফেলব।

“আচ্ছা”।

শুভ্র বলতে শুরু করলো,

আমার আর অবন্তীর দেখা হয়েছিল টিএসসিতে। এক বন্ধুর বার্থডে ট্রিটে। অবন্তীকে আমার খুব ভালো লেগেছিল কিন্তু অবন্তী আমাকে পছন্দ করলো না কারণ আমার নাক নাকি বোচা।

“কিন্তু আপনার নাক তো বোচা না। ”

“তখন ছিলো। ঘুষি মেরে মেরে ঠিক করেছি।”

“এ্যা?”

“তুমি গল্প শুনবে?”

“হ্যাঁ হ্যাঁ বলুন”

“অবন্তী আমাকে পছন্দ করলো না কিন্তু আমার যেহেতু পছন্দ হয়েছিল তাই বন্ধুর কাছ থেকে ওর নাম্বার নিয়েছিলাম। তখন গ্রামীন ফোনের রাত ১২ টার পর কলরেট ফ্রী ছিলো। মায়ের ফোন থেকে অবন্তী কে ফোন করলাম। তখন আমার নিজের ফোন নেই। মূলত তখনও মাম্মাস বয়। অবন্তীর নিজের ফোন না। ফোনটা ওর বোনের। তার হাজবেন্ড আবার দেশের বাইরে থাকে। আমি ফোন দিলেই বিজি। হঠাৎ একদিন পেয়ে গেলাম। অবন্তী কে চাইলে প্রথমে রাজি হলো না কিন্তু আমি এমন ভাবে বলেছিলাম যে পরে দিতে বাধ্য হলো।

“কিভাবে বলেছিলেন? ”

“মানে ব্যাপার টা একটু লজ্জার। ”

“বলুন প্লিজ। ”

“না মানে বয়স কম তো, রিকোয়েস্ট করার পরও শুনছিলো না তাই এক পর্যায়ে কেঁদে ফেললাম”।

তানি বজ্রকন্ঠে বলল, তারপর?

“অবন্তী ফোন কানে ধরে যখন শুনলো আমি তখন বিস্মিত হলো। ”

“তারপর? ”

“তারপরের ঘটনা ভয়াবহ। অবন্তী আমাকে অকথ্য ভাষায় গালি দিলো। ”

“কী গালি দিয়েছিল?”

শুভ্র কপট রাগ দেখালো। তানি বলল, তারপর?

“গালি শুনতেও আমার কাছে বেশ লাগলো। সেদিন গালি শুনে অন্যান্য দিনের চেয়ে ভালো ঘুম হলো। এরপর সেই বন্ধুটিকে নিয়ে অবন্তীর বাড়ির সামনে হাজির হলাম। উদেশ্য অবন্তী কে এক নজর দেখা।

“ছিঃ আপনি এতো ছ্যাচড়া ছিলেন? ”

“প্রথম প্রেম সবাই কেই বেহায়া, ছ্যাচড়া বানিয়ে দেয়। তারপর অবন্তী রাগারাগি চেঁচামেচি করলেও আমি পিছু ছাড়লাম না। লেগেই থাকলাম, এক পর্যায়ে অবন্তী সায় দিলো। সেই থেকেই আমাদের সম্পর্ক। তারপর… বিয়েশাদি.. ঝগড়াঝাটি।

“আর বলতে হবে না।”

শুভ্র’র মুখের ধরন পাল্টে গেছে৷ তানি বলল,

“আচ্ছা আমার টা শুনুন। ”

“হ্যাঁ হ্যাঁ বলো।”

“আমি জীবনে একজনের ই প্রেমে পরেছিলাম। ”

“আচ্ছা!”

“তখন আমি কেবল এসএসসি পরীক্ষা শেষ করে ঢাকায় এসেছি খালার বাসায়। এক বৃষ্টিতে তার সাথে প্রথম দেখা।

“কিভাবে দেখা?”

“আমি তখন শহুরে জীবন যাপনে অভ্যস্ত নই। বৃষ্টি হলে যে নালা খুলে দেয় সেটা জানতাম না। খালার বাসার সামনের রাস্তা পানিতে ডুবে গেছে। সেই পানিতে হাটতে গিয়ে বেখায়েলে ড্রেনে পড়ে গেলাম। একটা ছেলে কোথা থেকে যেন এসে আমার হাত ধরে তুলল।

“কোথা থেকে এসেছিল?”

“জানিনা”।

“সাথে কী ঘোড়া ছিলো? আর পোশাক কী রাজাদের ছিলো ”

তানি চোখ পাকিয়ে তাকালো।

শুভ্র বলল, তারপর?

“তারপর ছেলেটা আমাকে এগিয়ে দিয়ে চলে গেল। আমি অনেক খুঁজেও আর তাকে পাই নি। তার নাম, ঠিকানা কিছু জানি না। তবুও মনের ভিতরে গেথে রইলো। শ্রাবণের প্রবল বৃষ্টি এলেই তাকে আমার মনে পরে। ”

“এটা আবার কেমন প্রেম?”

“জানিনা৷ তার হয়তো আমাকে মনে নেই কিন্তু আমি তাকে বৃষ্টি হলেই মনে করি।”

“আহারে বেচারা নাম, ধাম কিছু না বলেই তোমার হৃদয় হরন করে নিয়ে গেল?

তানি ভেবেছিল শুভ্র’র কিছু একটা মনে পরবে। কিন্তু শুভ্র’র কিছু মনে নেই দেখে হতাশ হলো।

শুভ্র সিরিয়াস গলায় বলল, আমার মনে হয় ছেলেটাকে একটু খুঁজলেই পেয়ে যেতে। সিটি কর্পোরেশনের লোকেদের সাথে যোগাযোগ করলেও পাওয়া যাওয়ার কথা।”

“মানে?”

“মানে যারা ময়লা পরিষ্কার করে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। যে ছেলে ড্রেন থেকে তোমাকে তুলেছে সহজে তার তো ড্রেন পরিস্কারের কাজের সাথে যুক্ত থাকার কথা। ”

তানি খিলখিল করে হাসতে লাগলো। এই ব্যটা যখন জানবে যে সে নিজেই সেই ছেলে। তখন কপাল চাপড়াবে।

চলবে….

কাছে_কিবা_দূরে পর্ব-১১

0

#কাছে_কিবা_দূরে
#পর্ব-১১
বাড়িতে ফিরেই অভ্র’র তোপের মুখে পড়লো দুজন। অভ্র খোঁচা দিয়ে বলল, বাব্বাহ! কোথাকার জল কোথায় গিয়ে গড়াচ্ছে!
শুভ্র বুঝতে না পেরে বলল, মানে?

অভ্র সোফায় আধশোয়া হয়ে শুয়েছিল। উঠে বসতে বসতে বলল, মানে হলো খিচুড়ি, মাংস ভুনা, ঘুরতে যাওয়া আরও কতো কী! আর আমরা এসবের কোনো কিছুই ভাগে পাচ্ছি না।

শুভ্র বলল, আচ্ছা তাই বুঝি! আর তোরা যে রাস্তায় রাস্তায় হাওয়া খেয়ে বেড়াস তার বেলায়?

আনিকা মাঝখানে বলে উঠলো, এই বড় ভাইয়া তুমি তো জানো না কী হইছে, ছোট ভাইয়া একটা হিরের নাকফুল কিনেছে। নিশ্চয়ই ইরা আপুকে দিবে।

শুভ্র ভ্রু উঁচিয়ে অভ্রর দিকে তাকালো। অভ্র চোখ পাকিয়ে আনিকাকে এমন ভাবে দেখলো যে এক্ষুনি খেয়ে ফেলবে। তানি মিটিমিটি হাসছিল আর দেখছিল। শুভ্র অভ্র কে উদ্দেশ্য করে বলল, আচ্ছা এবার কী বলবি?

অভ্র আমতা আমতা করে বলল, কী বলব মানে? আমি আবার কী বলব!

“আমরা তো ডুবে ডুবে জল খাই আর তুমি তো জুস খাও তাই না?”

অভ্র হাতজোড় করে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, ভাইয়া প্লিইইইজ! মা শুনতে পেলে কান ছিড়ে ফেলবে।

“তাহলে তো আরও বলব। সারাদিন আমার পিছনে লেগে থাকিস।”

অভ্র তানির দিকে তাকিয়ে বলল, ভাবী প্লিজ তুমি অন্তত আমার হয়ে দুয়েকটা কথা বলো। তানি হাসলো কিছু বলল না।

শুভ্র বলল, ও আর কী বলবে? ও তো আমার ই দলের।

অভ্র অভিযোগের সুরে তানিকে বলল, ভাবী এটা কিন্তু আনফেয়ার।

তানি বলল, সত্যিই তো। এটা কেমন কথা হলো! ও ওর গার্লফ্রেন্ড কে একটা গিফট দিয়েছে সেটার জন্য ওকে এভাবে কেন হেনস্তা করা হচ্ছে শুনি?

শুভ্র চোখ কপালে তুলে বলল, এরমধ্যে দল পাল্টে ফেললে?

“মোটেও না। আমি আগেই ভাইয়ার দলে ছিলাম। ”

আনিকা বলল, ভাবী ছোট ভাইয়ার দল করে কোনো লাভ নেই। ও একটা জোচ্চর ।

অভ্র আনিকার মাথায় চাটি মেরে বলল, যা ভাগ। বাড়াবাড়ি করলে তোর বিয়েতে কোনো কাজ করবো না।

আনিকা ভেংচি কেটে বলল, ইশ! উনি কাজ না করলে যেন আমার বিয়ে আটকে থাকবে।

শুভ্র হাসতে হাসতে বলল, আনু তোর বিয়ে তো অনেক পরের ব্যাপার। আমরা যদি দলে না থাকি তাহলে ওর বিয়ে হবে কি না জিজ্ঞেস কর?

অভ্র বলল, হুহ! আমার সাথে ভাবী আছে আর কাউকে দরকার নেই৷

শুভ্র আড়চোখে তানিকে দেখে বলল, আচ্ছা তা তোমার ভাবী যখন ইরার মা’র তোপের সামনে পড়বে তখন যেন আবার চোখের পানি আর নাকের সর্দি এক করে না ফেলে।

তানি কপট রাগ দেখিয়ে বলল, মোটেও আমি ভীতু না। আর আপনি ভাইয়া কে আর লেগপুলিং করবেন না।

শুভ্র বিস্মিত হবার ভান করে বলল, তুমি আমাকে বড় বড় চোখ দেখাচ্ছ! আজ আমি তোমাকে রিকশায় চড়ালাম, ফুচকা, আইসক্রিম খাওয়ালাম সব এর মধ্যে ভুলে গেছ! ছিঃ ছিঃ তানি। শেইম অন ইউ।

অভ্র লাফিয়ে উঠে বলল, ওয়াও! কী রোমান্টিক! আমরা কাবাবে হাড্ডি হবো বলে আমাদের জানায় ও নি।

তানি লজ্জা পেল।

শুভ্র বলল, রোমান্টিক না ছাই! আমার খেয়েদেয়ে আমার সঙ্গেই বাটপারি।

তানি অগ্নিমূর্তি ধারণ করে বলল, ছিঃ ছিঃ খাইয়ে দাইয়ে আবার খোটাও দিচ্ছেন।

শুভ্র সেকথার পাত্তা দিলো না৷ বলল, যাদের পক্ষ করছ এরপর থেকে তাদের সাথে ঘুরতে যেও।

ঝগড়াঝাটি বন্ধ হলো মাহফুজার কারনে। মাহফুজা এসে বলল, কিরে তোরা সারাক্ষণ ঝগড়াঝাটি করিস।

তারপর তানির দিকে তাকিয়ে বলল, ভালো হয়েছে ঘুরতে গিয়েছিলি। সারাদিন তো একা একা ই থাকিস।

শুভ্র হাই তুলতে তুলতে বলল, আমি নিয়ে গিয়েছিলাম মা৷ ক্রেডিট আমাকে দাও৷

“হ্যাঁ এরপর থেকে ওকে একটু ঘুরতে টুরতে নিয়ে যাস। মেয়েটা একা একা থাকে বাসায়”।

অভ্র শয়তানি হাসি দিয়ে বলল, হ্যাঁ ভাইয়া তো মঙ্গলবার ফ্রী ই থাকে। তাই না?

শুভ্র বলল, হ্যাঁ মাঝেমধ্যে একটু আধটু যদি ভালো মন্দ রেঁধে খাওয়ায় তাহলে নিয়ে যেতেই পারি।

তানি লজ্জা পেয়ে মাথানিচু করে ফেললেও বাকীরা সবাই হাসতে লাগলো। আনিকা বলল, ভাবী খিচুড়ি টা খুব ভালো ছিলো কিন্তু।

অভ্র ও তাল মিলিয়ে বলল, হ্যাঁ একদম ঝাক্কাস। ৷

******

রাতে ঘুমাতে যাবার সময় শুভ্র বলল,
“তানি একটা ব্যাপার ভেবে দেখলাম। তুমি সারাদিন বাসায় একা থাকো। নিশ্চয়ই বোরড হও! এই ব্যাপার টা তো আগে ভেবেই দেখিনি।”

তানি মৃদু হেসে বলল, আমার তো তেমন খারাপ লাগে না৷ রান্না করি, টিভি দেখি, বই পড়ি সময় কেটে যায়৷

“সেটা এখন কেটে যায়৷ প্রথম প্রথম সব ই মিষ্টি মধুর লাগে৷ তেতো হতে শুরু করে কিছুদিন গেলে৷ ”

“আরে না আমার অভ্যাস আছে। ছোট থেকেই আমার বাসায় থাকতে ভালো লাগতো”।

শুভ্র গম্ভীর হয়ে কিছু একটা ভাবলো তারপর বলল,

“একটা কথা বলব তানি?”

“হ্যাঁ বলুন”।

“মায়ের কাছে শুনেছি তুমি ঢাকা এসেছিলে একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে৷ তার মানে চাকরি করার মন মানসিকতা আছে। তুমি চাইলে চাকরি করতে পারো। আমার দিক থেকে আই মিন আমাদের দিক থেকে কোনো প্রবলেম নেই৷

তানি ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলল৷ তানির একাডেমি রেজাল্ট আহামরি না৷ রাজশাহী ইউনিভার্সিটি তে রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করলেও রেজাল্টের বেহাল অবস্থা। অবশ্য এরজন্য তানি দায়ী না, দায়ী তানির পরিবার৷ চাকরি টা দরকার ছিলো নিজের জন্য। বাবার সংসারে থাকা, খাওয়া বাবদ ওকে টাকা দিতে হতো। ব্যাপার টা এমন না যে বাবা, মা চাইতো কিন্তু সংসারের গলগ্রহ হতে চায় নি তানি। এইজন্য টিউশন পড়িয়ে নিজের হাত খরচ সহ অন্যান্য খরচ যোগাড় করতো৷

শুভ্র ডেকে বলল, কী ভাবছ?

“আসলে তখন চাকরির দরকার ছিলো? ”

“এখন নেই বলছ”?

“না মানে..

“লিসেন তানি, আমার মনে হয় প্রতিটি মানুষের নিজের পা’য়ে দাঁড়ানো উচিত। তুমি অন্যকিছু মিন কোরো না, আমি তোমাকে ফোর্সও করছি না। তবুও ভেবে দেখো কিন্তু।”

তানি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললেও মনে মনে বলল, চাকরি করলে কী আর আপনার সঙ্গে মঙ্গলবার বিলাস করতে পারব! নাকি কাজের ছুতোয় আপনাকে মন ভরে দেখতে পারবো!

বিছানায় শুয়ে শুভ্র জিজ্ঞেস করলো,

“তানি ঘুমিয়েছ?”

“না। বলুন”

“একটা কথা বলোতো।”

“আজ রিকশায় বসে কাঁদছিলে কেন”?

তানি জবাব দিলো না৷

তানিকে চুপ থাকতে দেখে শুভ্র বলল, অনধিকার চর্চা করে ফেললাম বুঝি?

তানি বলল, না না৷ আসলে ওই সময় হঠাৎ কী হয়েছিল জানিনা। ”

“কারও কথা কী মনে পড়েছিল? ”

তানি অস্ফুটস্বরে বলল, হু।

“ওহ আমি ভাবলাম কী না কী৷ বাব্বা ভয় পেয়ে গেছিলাম। ”

“আপনি ভয় কেন পেয়েছিলেন?”

শুভ্র বলল, না মানে রিকশায় একটু ভুল করে তোমার হাত ধরেছিলাম। আসলে ভুলটা ইচ্ছাকৃত না। তোমার হাত টা নরম ছিলো তাই হয়তো ভুলটা হয়েছিল৷ ভেবেছি তুমি হয়তো রাগ করেছ।

তানি লজ্জায় লাল হয়ে গেল। লাইট বন্ধ থাকায় শুভ্র সেটা দেখতে পারলো না।

শুভ্র’র আবারও একটু শয়তানি করতে ইচ্ছে করলো৷ তানির লজ্জারাঙা মুখ টা দেখতে ইচ্ছে করলো। নিজের ইচ্ছেটাকে প্রাধান্য দিয়ে হাত বাড়িয়ে টেবিল ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দিলো।

চলবে…..

সাবিকুন নাহার নিপা

কাছে_কিবা_দূরে পর্ব-১০

0

#কাছে_কিবা_দূরে
#পর্ব-১০
শুভ্র স্পষ্ট টের পেলো যে হাতের মুঠোয় রাখা তানির হাত টা অনবরত কাঁপছে। মুচকি হেসে হাত টা’কে শক্ত করে ধরে রাখলো। এমন ভাব করলো যেন হাত ধরে রাখার ব্যাপার টা ওর মাথাতেই নেই। শুভ্র এর পরের অংশটুকু দেখতে চায়। তানি ঠিক কীভাবে ওকে হাত ছেড়ে দেয়ার কথা বলে!

তানির শরীরের কাঁপন বাড়ছে। চোখের কোনে পানি ও জমতে শুরু করেছে। সে একই স্পর্শ। কতো বছর পর! কিছু সময় বাদে তানি খেয়াল করলো শুভ্র হাত ধরে রেখেই কথা চালিয়ে যাচ্ছে। হাত ছাড়ার কথা হয়তো মনে নেই। তানি আকাশের দিকে তাকালো, মনে মনে বলল, হে আল্লাহ রিকশায় যতক্ষণ আছে ততক্ষণ যেন এমন ভাবেই হাত টা ধরে রাখে। প্লিজ প্লিজ।

শুভ্র খেয়াল করলো তানির কাঁপাকাঁপি কমেছে। স্বাভাবিক ভাবেই কথার জবাব দিচ্ছে। তবুও আরেকটু শয়তানি করতে ইচ্ছে করলো। শয়তানি করে হাত টা ধরেই রাখলো। আগের মতো ই এমন ভাব করলো যেন মাথায় ই নেই তানির হাত ধরে আছে।

রিকশা থেকে নামার সময় শুভ্র অবাক গলায় বলল, একি আমি তোমার হাত ধরেছিলাম এতক্ষন? ইশ আমার তো খেয়াল ই ছিলো না!
তানি মাথানিচু করে ফেলল। মাথা নিচু করায় দেখতে পেল না যে শুভ্র মিটিমিটি হাসছিলো।

শুভ্র তানিকে নিয়ে এসেছে রবিন্দ্রো সরোবরে। রিকশা জিগাতলা পর্যন্ত এসেছে। বাকী পথ দুজন মিলে হেটে যাবে বলে রিকশা ছেড়ে দিয়েছে।

লেকের পাশ ঘেঁষে দুজন হাটছে। তখন শেষ বিকেল। কন্যা কুমারী আলোয় দুজন ব্যস্ত শহরের রাস্তায় হাটছে আর গল্প করছে। শুভ্র গল্প বলছে আর তানি মুগ্ধ হয়ে শুনছে। এতো ভালো কেন লাগে সেটা ও জানেনা। শুধু জানে এই মানুষ টা পাশে থাকলে, কথা বললে, এমনকি কথা না বলে যদি ল্যাপটপে মুখ গুজে বসে থাকে তাহলেও ওর খুব ভালো লাগে। এতো টা ভালো লাগে যে সময় জ্ঞান ও ভুলে যায়।

বিকেলে দুজন মিলে অনেক ঘুরলো, ফুচকা খেলো। ফুচকা খেয়ে নাক, মুখ লাল করে শীতের মধ্যে আইসক্রিম ও খেল। সন্ধ্যারও অনেক পরে দুজনে আবারও রিকশায় উঠে বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। তানি এবার আর এক কোনে বসে নি। শুভ্র’র গায়ের সাথে গা মিশিয়ে বসেছে। রিকশায় যেতে যেতে তানি ভেবে রাখলো আজকের দিন টা ও ডায়েরিতে লিখে রাখবে। প্রতিবছর এই দিন টা’কে স্মরণীয় দিন হিসেবে পালন করবে। জীবন খুব ছোট কিন্তু প্রাপ্তি, আনন্দগুলো খুব দামী। আজকের দিন টা তানি সবসময় মনে রাখবে। নাতি নাতনিদের কাছে গল্প করবে। গালে পান গুজে হাতের আঙুলের ডগায় চুন নিয়ে জিবে দিতে দিতে বলবে, তোদের নানুভাই’র সাথে আজকের দিনে ডেটে গেছিলাম। তানির নাতি বা নাতনি তখন বলবে, বিয়ের এতো দিন পর ডেট! কী ব্যকডেটেড ছিলে তোমরা!
তানি তখন পান খাওয়া দাঁত বের করে হেসে বলবে, এইসব তোমরা বুঝবা না। পাশাপাশি রিকশায় বসা, হাত ধরা, এইসব অনুভূতি ব্যকডেটেড না হইলে পাওয়া যায় না।

ঢাকা শহরের অসহ্য যানজটে শুভ্র যখন বিরক্ত হয়ে বসেছিল তখন ই টের পেল তানি কাঁদছে। শুভ্র ভরকে গেল। জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে তানি?
তানি জবাব দিলো না। কান্নাভেজা চোখেই শুভ্র’র দিকে তাকালো। এই প্রথম এতো কাছাকাছি এসে দুজনের চোখে চোখ রাখা! শুভ্র কেবল তাকিয়েই রইলো গভীর চোখ দু’টির দিকে। কী সুন্দর চোখ! কাজল টা লেপ্টে গেছে বলেই বোধহয় এতো সুন্দর লাগছে। শুভ্র মনে মনে বলল, যদি কোনোদিন তোমার সাথে প্রেম হয় তবে যখনই কাজল চোখে দিবে ইচ্ছে করেই একটুখানি কাঁদাবো। তুমি কষ্ট পেলেও অনেকখানি স্বার্থপর হয়ে দু’চোখের তৃষ্ণা মেটাবো।

রাতের শহর, ঝমকালো আলো, মৃদুমন্দ বাতাস আর বড় বড় বিলবোর্ডগুলো এই সময়টুকুর সাক্ষী হয়ে রইলো। ভালোলাগা আর মুগ্ধতার সময়টুকু।

********

“আচ্ছা আমাদের বিয়ে টা কবে হবে?”

অভ্র চা’য়ে চুমুক দিলো। সন্ধ্যাবেলা পাড়ার মোড়ের এলাচি চা না খেলে অভ্র’র রাতে ঘুম হয় না। প্রায় প্রতিদিন ই ইরা কে নিয়ে হাটতে হাটতে এই চা খায়। ওয়ান টাইম কাপে চা নিয়ে দুজন হাটে আর একটু একটু করে চুমুক দেয়।

অভ্র বলল, বুঝতে পারছি না।

ইরা গলা চড়িয়ে বলল, বুঝতে পারছি না মানে?

“আরে পাবলিক প্লেসে এতো জোরে কেউ কথা বলে?”

“ইরা দাঁতে দাঁত চেপে বলল, হোয়াট ডু ইউ মিন? বুঝতে পারছি না মানে কী?

অভ্র ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোমার মা তো আমাকে একদম পছন্দ ই করে না?

ইরা একটু নরম হলো। বলল, তো? বিয়ে তো মা করবে না, আমি করব।

অভ্র দাঁত বের করে বলল, তোমাকে বিয়ে করতে তো আমার কোনো আপত্তি নেই । চাইলে এক্ষুনি বিয়ে করতে পারি।

“আচ্ছা! সত্যি? ”

“তিন হাজার সত্যি। ”

ইরা একটু ভেবে বলল, আজ তো কাজী অফিস খোলা পাবো না। আমরা তাহলে কাল বিয়ে করি।

অভ্র চুপসে গেল। মিনমিনে গলায় বলল, এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে? না মানে এইভাবে বিয়ে! তুমি শাড়ি পরবে, হাতে মেহেদী দিয়ে আমার নাম লিখবে, কবুল বলার সময় অল্প অল্প লজ্জা পাবে, সেসব কিছুই হবে না?

ইরা খিলখিল করে হাসতে লাগলো। হাসি থামিয়ে বলল, তোমার মুখ টা দেখার মতো হয়েছিল।

অভ্রও হাসলো।

ইরা সিরিয়াস হয়ে বলল, সত্যি বলছি আমার এখন বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে, তাছাড়া চাকরি করার প্যারা নেয়ার কোনো ইচ্ছে আমার নেই। আমি তো বিয়ে করব, সংসার করব, অনেক গুলো বাবুর মা হব।

অভ্র শুকনো কাশি দিয়ে বলল, কয়টা বাবুর মা হবা?

“মিনিমাম চারটা।”

অভ্র এবার জোরে জোরে কাশতে শুরু করলো। বলল, মাত্র?

“শোনো, এটাই আমার ড্রিম। ঘরভর্তি পিলপিল করে বাচ্চা হাটবে দেখতে কতো ভালো লাগবে!

“চারটা বাচ্চা কী আর পিলপিল করবে?”

“কেন? তানি ভাবী আছে না! আমাদের দুজনের কম করে হলেও আটটা বাচ্চা থাকবে”

অভ্র কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, জনসংখ্যা উর্ধ্বগতির জন্য আমরা জেলে গেলেই তো হয়! বেচারা ভাইয়া ভাবীকে নেয়ার কী দরকার?”

“তুমি কিন্তু আমার কথা সিরিয়াসলি নিচ্ছো না। প্লিজ তাড়াতাড়ি বিয়ে করো। যে চাকরি করছ তাতেই আমাদের চলে যাবে”।

অভ্র হেসে বলল, আচ্ছা আমি শিগগিরই ভাইয়াকে বলব।

ফিরতি পথে অভ্র ইরাকে বলল, এই জানো আজ ভাইয়া আর ভাবী ডেটে গেছে। ফার্স্ট ডেট।

ইরা লাফিয়ে উঠে বলল, ওয়াও! কী রোমান্টিক!

“হ্যাঁ ওদের এভাবেই একটু একটু করে প্রেম টা হয়ে যাক”।

ইরা বলল, তানি ভাবীকে আমার খুব খুব খুব পছন্দ হইছে। শুভ্র ভাইয়ার সাথে ভাবী ই পারফেক্ট। আগের ওই ডাইনিটা’কে দেখলেই মনে হতো মানুষখেকো রাক্ষসী। আস্ত খবিশ।

অভ্র হাসলো। ইরা মন খারাপ করে বলল, ইশ কেন যে তোমার সাথে প্রেম করতে গেলাম! নাহলে আমাদেরও বিয়ের পর একটা মিষ্টি প্রেম হতো।

“তাহলে চলো ব্রেক আপ করে ফেলি”

ইরা মুখ ভেংচি দিয়ে বলল, কবুল না বলে কোনো ব্রেক আপ হবে না হুহ!

ইরা গেট থেকে যখন ঢুকবে তখন অভ্র ইরাকে ডাকলো। হাতে একটা বক্স দিয়ে বলল, এটা তোমার।

ইরা কৌতূহল নিয়ে বক্স টা খুলতে খুলতে জিজ্ঞেস করলো, কী আছে এতে?

অভ্র কিছু বলল না। ইরা বক্স খুলে একটা আর্তচিৎকার করলো। অভ্র বলল, এই আস্তে আস্তে লোকে শুনলে আমায় ধোলাই দেবে।

ইরার খুশী খুশী গলায় বলল, এই জানো আমার না তোমাকে খুব জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে।

“নেক্সট টাইম দেখা হলে যেন মনে থাকে। সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করব”।

“হু হু।”

“এবার যাও”

“এই শোনো, তুমি চোখ বন্ধ করে একটু কল্পনা করে নিও যে আমি তোমায় জড়িয়ে ধরেছি কেমন!

অভ্র হাসতে হাসতে বলল, আচ্ছা আচ্ছা আচ্ছা।

চলবে…..

সাবিকুন নাহার নিপা

কাছে_কিবা_দূরে পর্ব-০৯

0

#কাছে_কিবা_দূরে
#পর্ব-৯
রাজশাহীতে দুটো দিন কাটিয়ে আবারও ঢাকা ফিরলো দুজন। শুভ্র ঢাকা ফিরেই ব্যস্ত হয়ে গেল। সকালে যায় বিকেলে ফিরে আসে। খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে বাকী সময় টা ল্যাপটপে মুখ গুজে কাটায়। এই রুটিনেই সারা সপ্তাহ চলে যায়। শুধু শুক্রবার দিন টা ব্যতিক্রম। শুক্রবার অভ্র’ ও বাসায় থাকে। আনিকাও পড়াশোনা বাদ দিয়ে ভাই’দের সাথে গল্প করতে আসে। মাহফুজা বিভিন্ন ধরনের খাবার বানায়, সেগুলো খেতে খেতে সবাই আড্ডা দেয়, সিনেমা দেখে, হৈ হুল্লোড় করে। তানির খুব ভালো লাগে শুক্রবার। বিয়ের পর মোট তিনটা শুক্রবার পেয়েছে তানি। বৃহস্পতিবার রাত টা তানির কাছে ঈদের আগের রাতের মতো লাগে। শুক্রবার সারাদিন এমনকি সন্ধ্যার পর ও একটা উৎসব উৎসব আমেজ থাকে। তানি শাশুড়ীর সাথে কথা বলে জেনেছে যে এই নিয়ম তৈরী করেছে মাহফুজা। সাফ সাফ বলে দিয়েছে সারা সপ্তাহ যেমন তেমন শুক্রবার দিনটা আমাদের সবার। তানির ব্যাপার টা খুব পছন্দ হলো। এরকম একটা পরিবার কে না চায়! বাড়িতে ভাই, বোন, ভাবী, মা, বাবা এদের সাথে থাকলেও তানিকে থাকতে হতো একা একা। কারণ তানিদের বাড়িতে এসব মিলেমিশে থাকার রেওয়াজ ছিলো না। সবাই ই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকতো। এমনকি তিনবেলার খাবারেও কোনো শৃংখলা মানা হতো না। যার যখন ক্ষিদে পেত খেয়ে নিতো। কিন্তু শ্বশুর বাড়ি মানে শুভ্রদের বাড়ি এসে তানি বুঝেছে পরিবার কী হয়! রাতে খাবার খেতে খেতে গল্প করা, সন্ধ্যা বেলা কারও ফিরতে দেরি হলে তার জন্য অপেক্ষা করে চা দেরি করে খাওয়া। আরেকটা ব্যাপার যেটা তানিকে চমৎকৃত করেছে সেটা হলো বয়সের লম্বা গ্যাপ থাকলেও সবার বন্ধুসুলভ আচরণ।

তানি নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে অল্প সময়েই। মাহফুজা ১০ টায় স্কুলে চলে যায়, আনিকা যায় কোচিং-এ। অভ্র, শুভ্র যে যার মতো অফিসে গেলে পুরো বাড়িতে তানি একা’ই থাকে। নিজের মতো ঘর সাজায়, রান্না করে, বই পড়ে, ব্যালকনি তে দাঁড়িয়ে বস্তির মানুষের ব্যস্ত জীবন কে দেখে। এইসব কিছুর পর দিনশেষে যখন বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে তখন মনে হয় জীবন টা খুব একটা মন্দ নয়! অবশ্য যার সাথে শুভ্র পরিবার আছে তার জীবন মন্দ হতেই পারে না।

আজ মঙ্গলবার। শুক্রবার ছাড়াও এই দিন টা শুভ্র বাসায় থাকে। ইউনিভার্সিটিতেও যায় না, আবার অন্য কাজেও যায় না। বাসায় থাকলেও অন্যান্য দিনের মতো সকালে ঘুম থেকে উঠে খেয়েদেয়ে স্টাডি রুমে চলে যায়। এই বাসায় ছোট একটা রুমে বইয়ে ঠাসা আছে। তানি সেখান থেকে রবিন্দ্রগুচ্ছ, বঙ্কিমসমগ্র নিয়ে পড়ে। এছাড়াও ইকোনোমিক্স, স্ট্যাটাটিক্সের গাব্দা গাব্দা বই আছে যেগুলো শুভ্র একরকম গিলে খায়।

তানি দুপুরের রান্না বসিয়েছে। বাসায় শুভ্র ছাড়া আর কেউ নেই। যেদিন ই এমন হয় সেদিন ই তানির অন্যরকম একটা অনুভূতি হয়। কেমন একটা চাপা আনন্দ বুকের ভিতর। শুভ্র সারাদিন হয়তো চশমা চোখে বইয়ের পাতায় মগ্ন হয়ে থাকবে তবুও মানুষটা কাছে আছে সেটাই বা কম কিসে! এই হাটার শব্দ পাওয়া যাবে, ড্রয়ার খোলার শব্দ, শাওয়ারের শব্দ। তানি কান খাড়া করে থাকে। দিন টা চলে যায় এইসবের মধ্যেই।

তানি আজ রান্না করবে ইলিশ মাছের ডিম, দই মাংস আর ফুলকপির ঝোল। সবগুলো আইটেম ই শুভ্র’র পছন্দের। শাশুড়ীর কাছ থেকে কৌশলে জেনে নিয়েছে। খুব আয়োজন করে রান্না করছে। শুভ্র খেতে খুব ভালোবাসে সেটা এতোদিনে বুঝে গেছে। দই মাংসে আগে থেকে মসলা মাখিয়ে রাখছিলো তখন ই শুভ্র রান্নাঘরের দরজায় এসে বলল, তানি কী করছ?

আচমকা ডাকায় তানি একটু কেঁপে উঠল। শুভ্র ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে বলল,
“ভয় পেয়ে গিয়েছিলে?”

তানি ভয় পেলেও সেটা স্বীকার করলো না। বলল, না না ভয় কেন পাব? আমি তো জানি ই আপনি বাসায় আছেন।

শুভ্র নিঃশব্দে হাসলো। যখনই এভাবে হাসে তখনই তানি মুগ্ধ হয়ে মনে মনে বলে, কী সুন্দর! কী সুন্দর!

শুভ্র হাতের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কী করছিলে?

“মাংসে মসলা মাখাচ্ছিলাম। ”

শুভ্র কিছু একটা ভেবে বলল, তুমি খিচুড়ি রাঁধতে পারো?

তানি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ পারি।

শুভ্র এক চোখ ছোট করে অনুনয়ের সুরে বলল, তাহলে প্লিজ খিচুড়ি রেঁধে ফেলো না! আমার খুব খেতে ইচ্ছে করছে।

তানি হেসে বলল, আচ্ছা।

শুভ্র খুশি খুশি গলায় বলল, থ্যাংক ইউ মাই ডিয়ার বেটার হাফ।

তানি লজ্জাও পেল আবার ভালোও লাগলো। কী সুন্দর করে বলল!

****
তানি ভুনা খিচুড়ি আর ঝাল মাংস রেঁধে টেবিলে যখন রাখলো তখন প্রায় দুটো বাজে। তাড়াহুড়ো করে সব রান্না শেষ করেছে। শুভ্র চোখ বন্ধ করে ঘ্রাণ নিয়ে বলল, দেখেই বোঝা যাচ্ছে রান্না দারুন হয়েছে।

তানি বলল, আপনি খেতে বসুন।

“তুমি খাবে না?”

“আমি পরে খাব। ”

“পরে কেন? আসো একসাথে খাই। ”

তানি ইতস্তত করে বলল, এতক্ষণ রান্নাঘরে ছিলাম। গোসল না করে খেতে পারব না।

“তাহলে শাওয়ার নিয়ে আসো। আমি অপেক্ষা করছি।”

তানি বলল, আপনার তো খেতে দেরি হবে?

শুভ্র বলল, আসলে এতো সুন্দর দেখতে খাবার গুলোর জন্য অপেক্ষা করা সত্যিই কষ্টের। কিন্তু তোমার জন্য এইটুকু করাই যায়।

তানি হেসে ফেলল। তড়িঘড়ি করে ছুটে চলল, শাওয়ার নিতে।

শাওয়ার নিতে তানির সময় লাগলো নয় মিনিট। অন্যান্য দিন যেটা চল্লিশ মিনিটেও হয় না। এতো তাড়াতাড়ি আসতে দেখে শুভ্র বলল, আরে বাহ! এতো তাড়াতাড়ি! আমিতো ভেবেছিলাম এই ফাঁকে একটু ঘুমিয়ে নেব।

তানি হাসলো। খেতে বসে শুভ্র গাপুসগুপুস করে খেতে লাগলো। তানি খাচ্ছে অল্প করে। কিন্তু নিজে যতটা খাচ্ছে তারচেয়ে বেশী শুভ্র’র খাওয়া দেখছে। শুভ্র খেতে খেতে বলল, তানি আমি অতি শিগগিরই তোমাকে একটা বেস্ট শেফের সার্টিফিকেট দেয়ার ব্যবস্থা করব”।

তানি অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ধ্যাৎ।

“উঁহু সত্যি বলছি। এতো ভালো খিচুড়ি আমি শেষ খেয়েছিলাম খুলনার এক রেস্তোরাঁয়। পরের বার যখন খিচুড়ির টানে আবারও গেলাম তখন খেতে ভালো লাগে নি।

“আপনি একটু বাড়িয়ে বলছেন। ”

“উঁহু। এক ফোটাও বাড়িয়ে বলছি না। ”

তানি আর কিছু বলল না। শুভ্র’র কাছে প্রশংসা পেয়ে খুব খুশি হলো।

শুভ্র আবারও বলল, তানি তুমি তেহারি রাঁধতে জানো?

“জানি। ”

শুভ্র চমৎকৃত গলায় বলল, তুমি তো দেখছি চমৎকার মেয়ে! এতো ভালো যার রান্নার হাত সে এখনো এখানে কী করছে! তোমার তো ফাইভ স্টার হোটেলে থাকার কথা!

তানি হেসে ফেলল। বলল, আপনি পারেন ও সত্যি।

“একদিন তেহারি করে খাইয়ো তো! আর পায়েস? পায়েস রাঁধতে জানো? ”

তানি নিচু গলায় বলল, জানি।

“ওয়াও!”

তানি অতিসন্তঃর্পনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই সব রান্না শিখেছিল আরিফের জন্য। শিখেছিল না বলে বলা উচিত শিখতে বাধ্য হয়েছিল। আরিফের স্বভাব ই ছিলো বন্ধু, বান্ধবদের সাথে সপ্তাহে একদিন খাওয়া দাওয়া। সেই ফরমায়েশ মতো রান্না শিখতে গিয়ে সব শিখে নিয়েছিল। আজ সেটা কাজে লাগলো!

শুভ্র বলল, তানি তোমার ফেভারিট আইটেম কী?

“মোরগপোলাও”

“পুরান ঢাকায় খুব ভালো একটা মোরগ পোলাও পাওয়া যায়। তোমাকে একদিন নিয়ে যাব”।

তানি স্মিত হেসে বলল, কবে নিয়ে যাবেন?

শুভ্র তানির চোখের দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। তানি লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে নিলো।

বিকেলে তানি একটু শুয়েছিল। শুভ্র এসে বলল, চলো তানি আমরা একটু ঘুরে আসি।

তানির মনে হলো ও ভুল শুনছে। বিয়ের পর এ’কদিনে মাহফুজা অনেক বার বললেও শুভ্র গা, গুই করে এড়িয়ে গেছে। আজ নিজে থেকেই বলছে দেখে তানির বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো। শুভ্র তানিকে অবাক হতে দেখে বলল, তাহলে তুমি যাবে না?

তানি ঝড়ের বেগে উঠে দাঁড়ালো।

রিকশায় বসে শুভ্র বলল, এই তানি তুমি ওভাবে বসেছ কেন? পড়ে টড়ে দাঁত, মুখ ভাঙতে।

তানি সংকোচে এগিয়ে বসতে পারলো না। লজ্জায় আরও আড়ষ্ট হয়ে গেল। শুভ্র হাল ছেড়ে দিয়ে তানির হাত ধরে কাছাকাছি নিয়ে আসলো। হাতটা ধরে রেখেই বলল, তোমার মধ্যে আশির দশকের শাবানা, ববিতাদের স্বভাব রয়ে গেছে। ভেরি ব্যাড!

তানি কিচ্ছু শুনলো না। বিয়ের পর এই প্রথম শুভ্র’র এতো কাছাকাছি এলো। এতো কাছে যে নিঃশ্বাসের শব্দ পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে। ভালো লাগার আবেশে তানি থরথর করে কাঁপছে।

শুভ্র দেখলো তানির ধরে রাখা হাত টা অনবরত কাঁপছে।

চলবে…..

সাবিকুন নাহার নিপা

কাছে কিবা দূরে পর্ব-০৮

0

#কাছে কিবা দূরে
#পর্ব-৮
শুভ্র বারান্দায় পায়চারি করছিল। অভ্র অনেকক্ষন হলো গেছে কিন্তু এখনো ফেরার নাম নেই। এই দুইদিনে শুভ্র একটা ব্যাপার স্পষ্ট বুঝেছে, সেটা হলো তানির অনেক বেশী রাগ। অবশ্য সেটা স্বাভাবিক। মেয়েদের রাগ একটু বেশী ই থাকে। রাগ যেমন বেশী থাকে, সহনশক্তিও তেমন বেশী থাকে। তানির সহনশক্তি কেমন সেটা শুভ্র জানে না, কিন্তু রাগ টা টের পেয়েছে। নাকের ডগায় রাগ!
রাগলে মুখ একদম লাল হয়ে যায়। শুভ্র আপনমনেই হেসে ফেলল। অভ্র এসে দেখলো শুভ্র মিটিমিটি হাসছে। অভ্র জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে ভাইয়া?

“কিছু না। বল ওদিকের কি খবর? ”

অভ্র মিথ্যা বলল। বলল, ভাবী তো হেব্বি রেগে আছে দেখলাম। ব্যগপত্র গুছিয়েছে, এক মাস নাকি বাপের বাড়িতে থাকবে।”

শুভ্র অবাক গলায় বলল, মানে?

“মানে একা একা বাপের বাড়ি যেতে হবে বলে ভাবী খুব রেগে গেছে। উঁহু ঠিক রাগ না। সে অপমানিত বোধ করেছে। তাই এবার বাপের বাড়ি গেলে একমাসেও আসবে না। ”

শুভ্র ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভাবলো। তারপর বলল, গিয়ে থাকলে থাকবে! সেটা আলাদা কথা। কিন্তু অপমানিত বোধ করেছে কেন? আমি স্ট্রেইট কথা বলতে পছন্দ করি তাই যা বলার বলেছি। তাতে অপমান কেন হবে”

অভ্র দেখলো পরিস্থিতি বিগড়ে যাচ্ছে। শুভ্র সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছে। সিরিয়াস হয়ে গেলে সমস্যা। অভ্র বলল,
“না মানে তোমার যেমন এটা দ্বিতীয় বিয়ে তেমন ভাবীর ও তো দ্বিতীয় বিয়ে। সে যদি বিয়ের পরে একা বাপের বাড়ি যায় সেটা খারাপ দেখা যায়”

শুভ্র কপাল কুচকে ফেলল। বলল, আমার কাজ আছে সেজন্য যেতে পারব না। নাহলে তো আমি ঠিক ই যেতাম।

“হ্যাঁ মানলাম। কিন্তু রিচুয়ালস বলেও তো একটা ব্যাপার আছে বস। আমরা কিন্তু ভাবীকে সাদামাটা ভাবে ওইবাড়ি থেকে এনেছিলাম। এখন যদি একা যায় তাহলে তো লোকে কথা শোনাবেই।”

শুভ্র’র কপালে চিন্তার ভাজ পড়লো। বলল, এটা তো আগে ভেবে দেখিনি।

“হ্যাঁ এইজন্য তো বলছি কাজ বাদ দিয়ে শ্বশুর বাড়ি যাও”।

“কিন্তু তানি যে রেগে আছে?”

অভ্র হাসি চেপে বলল, রাগ ভাঙাও। দেখ সরি, টরি বললে হয় কী না!

শুভ্র কিছু একটা ভাবলো। তারপর বলল, তুই কিছু একটা কর না?

“আমি কেন করব! তাছাড়া আমি বললে রাগ আরও বাড়তে পারে। তারচেয়ে তুমি ম্যানেজ করো। ”

শুভ্র আর কিছু বলল না। চলে গেল। শুভ্র যেতেই অভ্র শব্দ করে হেসে ফেলল। আড়াল থেকে আনিকা এসে উচ্ছ্বসিত গলায় বলল, উফ ছোট ভাইয়া তোমার যা বুদ্ধি!

অভ্র হাসি থামিয়ে বলল, আস্তে আস্তে ভাইয়া চলে আসতে পারে। ”

আনিকা গলা খাদে নামিয়ে বলল, এরপর কী হবে?

“মান অভিমান ভাঙার পর্ব চলবে। বুঝলি আনিকা এই দুজন হলো উত্তর মেরু আর দক্ষিণ মেরু। আমাদের কাজ হলো এই দুই মেরু কে একত্রিত করা। যেন তারা বিকর্ষিত না হয়ে আকর্ষিত হয়। ”

আনিকা উত্তেজিত গলায় বলল, উফ! আমার তো খুব এক্সাইটেড লাগছে! আফটার ম্যারেজ প্রেম। হাউ রোমান্টিক!

*****
শুভ্র অনেক চেষ্টা করেও তানির সাথে দেখা করতে পারে নি। দুপুরে খেয়েদেয়ে তানি গেল পার্লারে সাজতে। সাজগোজ শেষ হলে সেখান থেকে চলে যাবে কমিউনিটি সেন্টারে। দুপুরে খাবার সময় একসাথেই খেতে বসেছিল সবাই। তানি আড়চোখে একবার তাকিয়েছে শুভ্র’র দিকে। অভ্র স্পষ্ট বলে দিয়েছে কিছুতেই নমনীয় হওয়া যাবে না। বিড়াল প্রথমেই মারতে হয়। এখন যদি ও নমনীয় হয় তবে শুভ্র ওকে পেয়ে বসবে। যতক্ষণ পর্যন্ত শুভ্র স্যরি না বলবে ততক্ষণ পর্যন্ত গাম্ভীর্য বজায় রাখতে হবে। কোনো ভাবেই বুঝতে দেয়া চলবে না যে রাগ পানি হয়ে গেছে। তানি প্রানপনে চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। কথা বলতে না পেরে ভিতরে ভিতরে উতলা হয়ে যাচ্ছে।

খাবার টেবিলে তানির সঙ্গে যে কথা বলবে সেই সুযোগ ইরার জন্য হলো না। ইরা হড়বড় করে হাত নেড়ে নেড়ে কথা বলেই যাচ্ছে। শুভ্র বিরক্ত হয়ে অভ্রকে ম্যাসেজ দিলো, “ওই প্যারাওয়ালি কে থামতে বল। এতো কথা বলছে ওর কী মুখ ব্যথা করছে না?

অভ্র ম্যাসেজ দেখে হাসতে গিয়েও হাসলো না। হাসি চেপে রেখেছে। শুভ্র কে অস্থির হতে দেখে খুব ভালো লাগছে।

শুভ্র বিরক্ত হয়ে উঠে গেল। মাহফুজা শুভ্র কে দেখে বলল, একটু আমার সঙ্গে আয় তো ।

শুভ্র ঘরে যেতেই বলল, আমি আগেই বলেছিলাম যে বিয়ের জন্য কম করে হলেও পনের দিন ছুটি নেবে। যেহেতু এরেঞ্জ ম্যারেজ সেহেতু দুজন দুজন কে জানতে, শুনতেও অনেক সময় লাগবে। কিন্তু এখন বলছ তোমার কাজ আছে?

শুভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলল। শুধু একটা কথায় এভাবে ফাঁসতে হবে সেটা আগে বোঝে নি। মনে মনে তানির চৌদ্দ গুষ্টির পিন্ডি চটকালো কয়েকবার। হাতজোড় করে অনুনয় করে শুভ্র বলল, মা জননী আমি অত্যধিক ভুল করিয়াছি আপনার পুত্রবধূর সহিত খারাপ আচরণ করিয়া। এরজন্য মার্জনা করুন।

মাহফুজা গম্ভীর গলায় বলল, নাটক বন্ধ কর। আর তানির সাথে আর কখনো খারাপ ব্যবহার করবি না। ফের যদি শুনি…..

শুভ্র কানে ধরে বলল, ক্ষমা করুন এই বান্দাকে।

****
রাতের ট্রেনে শুভ্র আর তানি রাজশাহীর উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে। তানির মেজাজ খারাপ। মেজাজ খারাপের কারণ হলো শুভ্র। আজ পার্লারে অনেক সুন্দর করে সেজেগুজে যখন শুভ্র’র সামনে এলো তখন শুভ্র বলল, এটা কী পরেছ তানি? বিয়েতে কেউ সবুজ রঙ পরে?

তানি জলপাই রঙের বেনারশী না পেয়ে সবুজ কিনেছিল। অথচ শুভ্র মুখ, চোখ কুচকে ফেলল সেটা দেখে। তানির কান্না পেল। যার জন্য এতো সাজগোজ সে’ই যদি এইভাবে বলে তাহলে কেমন লাগে।

রিসিপশনে শুভ্র’র কিছু মেয়ে বন্ধু এলো। তাদের তানির একদম ই পছন্দ হলো না। মেয়েগুলো স্মার্ট, স্টাইলিশ হলেও তানির কাছে তাদের মনে হলো চাড়াল, বেহায়া। ওর হাত নিশপিশ করছিল। মেয়েগুলো এতো বেহায়া যে শুভ্র যেখানে যায়, তারাও সেখানে যায়। তানির ইচ্ছে করলো শুভ্র’কে কালিজুলি মাখিয়ে দিতে। তাহলে আর বেহায়া মেয়েগুলো আর ওর দিকে তাকাবে না।

এরপরের ঘটনা আরও মেজাজ খারাপ হওয়ার মতো। শুভ্র’র কলিগ রা শুভ্র’কে জোর করলো তানির সাথে ছবি তুলতে। শুভ্র তখন বলল, তানিকে নাকি সবুজ শাড়িতে গাছের মতো লাগছে। পাশে দাঁড়ালে মনে হবে গাছের পাশে দাঁড়িয়েছে। রাগে, দুঃখে তানির চোখে পানি এসে গেল। সিদ্ধান্ত নিলো বাসায় ফিরে সবুজ যা যা আছে সব পুড়িয়ে ফেলবে। বাসায় গিয়ে সময় পায় নি তাই ব্যাগে করে সব নিয়ে যাচ্ছে।

ঝিকঝিক শব্দে ট্রেন চলছে। জানালা বন্ধ থাকার পরও হিমবাতাস গায়ে লাগছে একটু একটু। তানি বসে আছে জানালার পাশে। শুভ্র আজও ম্যাগাজিন পড়ছে। আসার সময় প্ল্যাটফর্ম থেকে হন্তদন্ত হয়ে ম্যাগাজিন টা কিনে এনেছে। ম্যাগাজিন নিয়ে ফেরার পর বিশ্বজয়ী হাসি দিয়ে বলল, কভার পেজে ক্যাটরিনার ছবি ছিলো। এমন ভাবে ছবিটা দেয়া যেন মনে হচ্ছিলো আমাকে ডাকছে। তাই ছুটে গেলাম।

তানির ইচ্ছে করলো ট্রেনে না উঠে একদিক চলে যেতে। বিয়ে করা নতুন বউয়ের দিকে ফিরেও তাকায় না! উনি যাচ্ছে ক্যাটরিনার কাছে। কপাল খারাপ থাকলেই এমন বর কপালে জোটে।

শুভ্র তানিকে ডেকে বলল, তানি কিছু খাবে?

তানি চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, না। আপনি ম্যাগাজিন পড়ুন। ম্যাগাজিন না পড়লে ক্যাটরিনার কষ্ট হবে।

শুভ্র মৃদু হেসে বলল, তুমি কী বাই এনি চান্স ক্যাট কে হিংসে করছ? না মানে তোমাকে সময় দিচ্ছি না কিন্তু ম্যাগাজিন পড়ছি।

তানি জবাব না দিয়ে অন্যদিকে তাকালো। শুভ্র নিশ্চুপে হাসলো। বলল, আসলে তুমি রেগে ছিলে তাই আর তোমাকে ডিস্টার্ব করিনি। কিন্তু অনেক টেনশন করেছি। যেভাবে দাঁতে দাঁত চেপে আছ তাতে দাঁত ভাঙার সম্ভাবনা প্রবল।

তানি চুপ করে থাকলো। শুভ্র দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আচ্ছা ঠিক আছে এখন বলোতো তোমার রাগ ভাঙাতে আমি কি করতে পারি?

তানি এক নজর দেখলো। শুভ্র’কে দেখে খুব সিরিয়াস মনে হচ্ছে।

শুভ্র বলল, আমি কী কানে ধরব? নাকি নাকে খত দেব?

তানি কথা বলল না।

“নাকি সারা রাস্তা দাঁড়িয়ে যাব? ”

তানি এক নজর শুভ্র’কে দেখে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করলো। ”

“তাহলে কী ট্রেন থেকে লাফ দেব?”

তানির এবার খুব হাসি পেল। হাসি চেপে রাখার চেষ্টা করেও পারছে না। শুভ্র গম্ভীর গলায় বলল, ব্যাস তানি! অনেক হয়েছে। এখানও যদি রাগ না কমাও তাহলে এক লক্ষ জীবানুওয়ালা ট্রেনের টয়লেটের পানি খেয়ে ফেলব।

তানি শব্দ করে হাসতে শুরু করলো। মাঝরাতে অনেকেই ঘুমিয়ে। হাসির শব্দে ঘাড় ঘুরিয়ে অনেকেই সদ্য বিয়ে হওয়া দুষ্ট, মিষ্টি দম্পতি কে দেখছে।

চলবে…..

সাবিকুন নাহার নিপা

কাছে_কিবা_দূরে পর্ব-০৭

0

#কাছে_কিবা_দূরে
#পর্ব-৭
সারারাত এপাশ ওপাশ করে শেষ রাতে ঘুমিয়েছিল তানি। বেশীক্ষন ঘুমাতে পারে নি। ভোর থাকতেই উঠে পড়েছে। শুভ্র তখনও ঘুমিয়ে। রাতে অনেকক্ষন ল্যাপটপ নিয়ে পড়ে থাকার পর ঘুমিয়েছে। তানি ঘুম থেকে উঠে ব্যলকনিতে গেল। শহরটা কেবল ব্যস্ত হতে শুরু করছে। তিনতলার ব্যলকনি থেকে নিচের বস্তি স্পষ্ট দেখা যায়। তানি রেলিঙে চোখ রেখে দেখছে কিভাবে বস্তির বউয়েরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে স্বামীদের খাবার বানিয়ে দিচ্ছে। এক রান্নাঘরে সবার ই আগে রান্না করার তাড়া। এই নিয়ে কয়েকজন একচোট ঝগড়াও করে নিলো। ব্যাপার টা কী মিষ্টি লাগছে তানির! রোজ সকালে উঠে স্বামীর জন্য ঝটপট খাবার তৈরী করা, টিফিন ক্যারিয়ারে খাবার দেয়া, গেট পর্যন্ত এগিয়ে দেয়া এই ব্যাপারগুলোর মধ্যে একটা স্নিগ্ধতা আছে, ভালোবাসা আছে। তানি দীর্ঘশ্বাস ফেলে এগিয়ে যায় আনিকার ঘরের দিকে। আনিকা গুনগুন করে পড়ছে। আনিকার ঘরের দরজায় হাত রাখতেই আনিকা মিষ্টি করে হেসে বলল, গুড মর্নিং ভাবী।

“শুভ সকাল। তুমি রোজ সকালে উঠে এমন পড়াশোনা করো?”

“হ্যাঁ। সামনে পরীক্ষা তো তাই। আমি আবার পড়ে মনে রাখতে পারি না। যত পরীক্ষা এগিয়ে আসে তত সব গুলিয়ে যায়। ”

তানি নিঃশব্দে হাসলো। আনিকা বই বন্ধ করে তানির দিকে তাকিয়ে বলল, আজ তো তোমাদের বাড়ি থেকে লোকজন আসবে।

“হ্যাঁ “।

“তুমি কী চলে যাবে তাদের সাথে? ”

তানি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, মনে হয় না।

“কেন?”

“তোমার ভাইয়া যেতে পারবে না। আর বিয়ের পর স্বামী ছাড়া গেলে আমার অনেক কথা শুনতে হবে। ”

আনিকা অবাক গলায় বলল, ভাইয়া কেন যাবে না?

“জানিনা। হয়তো তার যেতে ইচ্ছে করছে না। মনের বিরুদ্ধে গিয়ে আর কত ই বা করবে! ”

আনিকা বুঝলো তানির মন খারাপ তাই আর কথা বাড়ালো না। প্রসঙ্গ পাল্টে সাজগোজের আলাপ শুরু করলো।

ব্রেকফাস্টের টেবিলে তানি আর শুভ্র’র দেখা হলো। শুভ্র খেতে খেতে গল্প করছিলো। তানি যে গম্ভীর হয়ে খাবার নাড়াচাড়া করছিলো সেটা খেয়াল করে নি। মাহফুজা দেখতে পেয়ে বলল, কোনো সমস্যা তানি?

“না মা। আসলে খেতে ইচ্ছে করছে না”।

“তাহলে অন্যকিছু খাবি?”

“না মা আমি এখন যাই। একটু মাথা ব্যথাও করছে। ”

মাহফুজা আর আটকালেন না। চলে যাওয়ার পর বলল, মেয়েটা হয়তো মানিয়ে নিতে পারছে না। প্রথম বারের ভয়ানক অভিজ্ঞতা থেকে এখনো বের হতে পারে নি বোধহয়।

কিন্তু শুভ্র ঠিক ই বুঝলো তানির ম্যুড অফের কারণ। শুভ্র অভ্রকে বলল, খাওয়া শেষে একটু আমার সাথে যাবি, একটা কথা আছে।

*******

আনিকা মুখ কালো করে বলল, মা ভাবীর মন খারাপ কেন তা আমি জানি।

মাহফুজা অবাক হয়ে বলল, কেন?

“ভাইয়া নাকি বলেছে যে তাদের বাড়িতে যেতে পারবে না। আর ভাইয়া না গেলে ভাবীও যেতে পারবে না সেজন্য। ”

“শুভ্র যাবে না কেন? বিয়ের পর প্রথমবার তো স্বামী, স্ত্রী একসাথেই যায়।”

“জানিনা”।

মাহফুজার কপালে চিন্তার ভাজ পড়লো। শুভ্র’কে বিয়ে করানোর উদ্দেশ্য ছিলো একটা নরমাল লাইফে ফিরিয়ে আনা। ছেলেটা হাসছে, মজা করছে ঠিক ই তবুও ভিতরে ভিতরে যে কষ্ট পাচ্ছে সেটা আর কেউ না জানলেও সে জানে। এইজন্যই চেয়েছে একটা ভালো লক্ষীমন্ত মেয়ের সাথে বিয়ে দিতে। মুখে কিছু না বললেও বিয়ে নিয়ে শুভ্র’র ও যে আতংক আছে সেটা মাহফুজা ভালো করেই জানে। তানিকে দেখার পর মনে হয়েছে এই মেয়েটা বউ হলে শুভ্র একটা নতুন জীবন পাবে। মেয়েটার মুখে যে মায়া আছে সেই মায়ায় ঠিক ই আটকে ফেলবে।

তানির সাথে মাহফুজার দেখা হয়েছিল রাস্তায়। একটা চাকরির ইন্টারভিউ দিতে ঢাকা এসেছিল তানি। সেদিন মাহফুজা বিজয় স্মরনী থেকে রাস্তা পাড় হয়ে ওপারে আসছিলো গাড়ি ধরবে বলে। ফুট ওভার ব্রিজ পাড় হতে গিয়ে মাথা ঘুরে পড়ে গেল। জ্ঞান ফেরার পর দেখলো একটা অচেনা মেয়ে ব্যস্ত হয়ে কাগজ দিয়ে বাতাস করে যাচ্ছে। তানি সেদিন মাহফুজার জন্য চাকরির ইন্টারভিউ টা দিতে পারে নি। প্রথম দেখায় মেয়েটা’কে এতো ভালো লেগেছে যে ফোন নম্বর চেয়ে রেখেছিল। তারপর আস্তে আস্তে বিয়ের কথাবার্তা হলো। শুভ্র’ও রাজী হলো। মাহফুজা ভেবেছিল শুভ্র রাজী হবে না। কিন্তু শুভ্র মায়ের পছন্দ, ইচ্ছে দুটো ই মেনে নিলো।

মাহফুজা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বিয়ে হয়েছে মাত্র ক’টা দিন। এখনও পর্যন্ত দুজন দুজন কে ঠিকঠাক চিনলো ই না। দুজনের ই সময় দরকার। সময় নিশ্চয়ই সব ঠিক করে দেবে।

******

“ভাবী আসবো?”

তানি হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলো। শাড়ি ঠিকঠাক করে বলল, আসুন।

অভ্র ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল, এটা কিন্তু আনফেয়ার ভাবী। আমি যেহেতু তুমি বলছি, তোমাকেও তুমি করে বলতে হবে।

তানি স্মিত হেসে বলল, আচ্ছা তুমি বলব কিন্তু আমি ভাইয়া বলে ডাকব তোমাকে।

অভ্র খুশি খুশি গলায় বলল, বাহ! আমিও তবে একটা বোন পেয়ে গেলাম।

তানি হাসলো।

অভ্র গম্ভীর হয়ে বলল, ভাবী তোমার সাথে কিছু কথা আছে।

“হ্যাঁ বলো”।

“ভাবী কথাটা ভাইয়া সংক্রান্ত “।

তানি শুকনো ঢোক গিলল। কী বলবে শুভ্র’র ব্যাপারে? ভয়ংকর কিছু বলবে না তো! এমন কিছু না বলুক যেটা তানিকে ভেঙেচুরে গুড়িয়ে দিক।

তানি কাঁপা গলায় বলল, কী হয়েছে?

অভ্র হেসে ফেলল। বলল, ভাবী তুমি প্লিজ নরমাল হও। সিরিয়াস হওয়ার মতো কিছু না।

তানির তবুও ভয় লাগলো। অভ্র লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল, ভাবী ব্যাপার টা ভাইয়ার পাস্ট নিয়ে। বিয়ের আগে তোমাকে শুধু জানানো হয়েছিল ভাইয়ার আগের বউ রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে তাই তো?

তানি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। অভ্র বলল,

“কিন্তু আরও কিছু ব্যপার আছে যেগুলো জানানো হয় নি। জানানো হলে হয়তো তোমাদের বিয়েটাই হতো না, এই ভয়ে মা জানায় নি।
ব্যাপার টা হলো, ভাইয়া যে মেয়েটাকে বিয়ে করেছিল তার নাম ছিলো অবন্তী। অবন্তী ভাইয়ার ক্লাসমেট। বিয়ের আগে হাসিখুশি একটা কাপল ছিলো ভাইয়া আর অবন্তী। ক্যাম্পাসে পারফেক্ট কাপল হিসেবে খুব বিখ্যাত ও ছিলো। অবন্তীকে কোনো এক বিচিত্র কারনে মা পছন্দ করতেন না। মুখে কিছু না বললেও ব্যাপার টা বোঝা যেত। অবশ্য পছন্দ না করার মতো অনেক কারণ ও ছিলো। ভাইয়া ইউনিভার্সিটির টপ স্টুডেন্ট ছিলো। পাশ করে বেড়োলেই ইউনিভার্সিটির টিচার হয়ে যাবে। এক কথায় ব্রাইট ফিউচার ছিলো।

অভ্র একটু থামলো। তানি বলল,

“তারর?”

“কিন্তু অবন্তী ছিলো মিডিয়াম টাইপ স্টুডেন্ট। ভাগ্যগুনে হয়তো চান্স পেয়েছিল ভার্সিটিতে। কিংবা আগে পড়াশুনায় ভালো ছিলো, ভার্সিটিতে এসে বিগড়েছে। যার লাইফে কোনো এমবিশন ছিলনা। মধ্যবিত্ত ফ্যামিলিতে বিলং করতো বলে তার স্বপ্ন ছিলো লাক্সারিয়াস লাইফ লিড করবে। কিন্তু নিজে কিছু করবে এরকম কোনো ব্যাপার ছিলো না। অর্থাৎ হাজবেন্ডের টাকায় সব হবে।

“তারপর “?

“মায়ের অবন্তীকে অপছন্দের কারণ ছিলো অবন্তী কিছুটা উগ্র টাইপ ছিলো। আল্ট্রা মর্ডান এটাও দোষ অবশ্য ছিলো। আর সেই খরচ টা মেইনটেইন করতো ভাইয়া। টিউশনি করে যা পেত তার পুরোটা’ই দিয়ে দিতো। মা চাইতো না ভাইয়া টিউশনি করুক, বরং সেই সময় টা ভাইয়া পড়ায় মন দিক সেটা চাইতো। এই নিয়ে মায়ের সাথে ভাইয়ার ঝামেলা হলেও ভাইয়া চুপচাপ ছিলো।

আরেকটা দোষ ছিলো অবন্তীর সেটা হলো ঝগড়া করে বাসায় এসে ভাইয়া কে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করা। মেজাজ বিগড়ে গেলে যেমন রাগারাগি করে বিল্ডিং এর লোকজন জড়ো করতো তেমন রাগ কমলে এসে কান্নাকাটি করতো। এমন কি ভাইয়ার পা ধরে কান্নাকাটি করতো। আর ভাইয়া ভুলে গিয়ে ক্ষমা করতো। এরপর হঠাৎই বিয়ের জন্য চাপ দিতে লাগলো। মা তো রাজি না, ভাইয়া কিভাবে কী সামলাবে কুল, কিনারা পায় না। হঠাৎই সুইসাইড করার চেষ্টা করলো অবন্তী। ভাইয়ার হাতে বিয়ে ছাড়া আর কোনো অপশন রইলো না। বিয়ে করে বাসায় নিয়ে এলো।

“তারপর কী হয়েছিল? মা মেনে নিয়েছিল?”

“হ্যাঁ। বিয়ে যেহেতু হয়েছে না মেনে তো উপায় নেই। ভাইয়া তখনও স্টুডেন্ট। ফাইনাল পরীক্ষা সামনে। মা সহজ ভাবেই অবন্তীকে মেনে নিলো। কিন্তু অবন্তীর মধ্যে টিপিক্যাল বউদের স্বভাব রয়ে গেল।

এরপর শুরু হলো ভাইয়ার জীবনের ভয়ংকর অধ্যায়। অবন্তী ভাইয়াকে নিয়ে ওভার পজেসিভ। তার কথা ছিলো, ভাইয়ার ধ্যান, জ্ঞান সব জুড়ে কেবল সে ই থাকুক। আমরা কেউ থাকতে পারব না । এমনকি মা’ও না। আনিকা, কিংবা আমার সাথে হেসে কথা বললে ভাইয়ার উপর শুরু হতো মেন্টাল টর্চার। মা প্রথম প্রথম ছেড়ে দিলেও পরে যখন প্রতিবাদ করতে শুরু করেছিল তখন মা’কেও অবন্তী তুই তোকারি করে অশ্রাব্য গালাগালি করতো।

“আর তোমার ভাইয়া কিছু বলতো না? ”

“ভাইয়া খুব বোঝাতো। কিন্তু সে কিছু বুঝবে না। উল্টো ভাইয়াকে গালাগালি দিয়ে, ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করে দুনিয়াসুদ্ধ লোক এক করতো।

“কী সাংঘাতিক”?

অভ্র হেসে বলল, আরে ভাবী বাড়িওয়ালা পর্যন্ত সহ্য করতে না পেরে আমাদের উইদাউট নোটিশে বাড়ি ছাড়তে বলেছিল।”

“এরকম ও মেয়ে হয়?”

“হয়। এরপর কী হলো শোনো, ভাইয়া রেজাল্ট খারাপ করলো। খারাপ করলো মানে টপ টেনে থাকতে পারলো না। এখন শুরু হলো ঘরের মধ্যে মহা প্রলয়। অবন্তী সুইসাইড করবে।

“মেয়ে তো মনে হচ্ছে সাইকো ছিলো। ”

“উঁহু ওগুলো ওর স্বভাব ছিলো। অতিরিক্ত লোভে বুদ্ধিজ্ঞান লোপ পায়। এরপর ভাইয়ার প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি তে চাকরি হলো। এখন শুরু হলো আলাদা বাসায় উঠবে। আলাদা সংসার না হলে সে থাকবে না। বাধ্য হয়ে মা নিজেই ভাইয়াকে সেটা করতে বলল।

ভাইয়াকে ছাড়া থাকতে হবে, কষ্ট পেলেও মানসিক শান্তি পেয়েছিলাম। কিন্তু ভাইয়া ভালো ছিলো না। নিজে কিছু না বললেও আমরা বুঝতাম। আমাদের সাথে দেখা করতে এসে ফিরে যাবার সময় তার মন ভার থাকতো। এভাবেই চলে যাচ্ছিলো সব। অবন্তী এরমধ্যে এক্সিডেন্ট করলো। ও যদি মারা না যেত তাহলে ভাইয়া মারা যেত শিওর। অবন্তী নিজেই মেরে ফেলতো রাগের মাথায়। অনেকবার রেগে গিয়ে ভাইয়ার মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে।
অবন্তী মরে যাবার পর ভাইয়ার মানসিক অবস্থা খুব খারাপ হলো। কারও সাথে কথা বলত না, কোথাও যেত না, একলা একলা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাতো। মা কান্নাকাটি করে, বুঝিয়ে সুঝিয়ে নরমাল লাইফে ফিরিয়ে এনেছে। এখন বলো এই অবস্থায় কী ভাইয়ার পক্ষে তোমাকে মেনে নেওয়া এতো তাড়াতাড়ি সম্ভব?

তানি কেঁদে ফেলল। আহারে! মানুষ টা কতো কষ্ট পেয়েছে আর ও কী না তাকে নিয়ে……

অভ্র বলল, আরে তুমি কাঁদছ কেন? কেঁদোনা প্লিজ।

“আমি ওনাকে ভুল বুঝেছি।”

অভ্র স্মিত হেসে বলল, এখন তো ঠিক বুঝলে। এবার ভাইয়ার উপর রেগে থেকো না।

তানি তবুও কাঁদতে লাগলো।

অভ্র বলল, ভাবী ভাইয়ার হৃদয়ের মরুভূমিতে যে করে হোক গোলাপ কিন্তু তোমাকেই ফোটাতে হবে।

তানি অবাক হয়ে তাকালো।

অভ্র ব্যস্ত গলায় বলল, হয়েছে হয়েছে এবার তোমাকে পার্লারে সাজতে যেতে হবে”

“ওনাকে কী স্যরি বলব”?

অভ্র ঠোঁট টিপে হেসে বলল, তোমার কিছু বলার দরকার নাই। দেখোনা তোমার উনি কিভাবে তোমার রাগ ভাঙায়।

তানি লজ্জা পেল। অভ্র হাসতে হাসতে বলল, একটা মজার ব্যাপার শোনো, আমি অবন্তী কে কখনো ভাবী ডাকি নি। তোমাকেই কিন্তু ডাকলাম। ভাইয়ার দ্বিতীয় বউ হলেও আমার কিন্তু প্রথম ভাবী।

তানিও অভ্র’র সাথে হেসে ফেলল।

চলবে…..

সাবিকুন নাহার নিপা

কাছে_কিবা_দূরে পর্ব-০৬

0

#কাছে_কিবা_দূরে
পর্ব-৬
পরদিন বিকেলে তানিকে নিয়ে শপিংয়ে যাওয়া হলো। ঘরে পরার জামা কাপড় ছাড়াও বিয়ের জন্য যা যা কেনা হয়েছিল সব ই আবার নতুন করে কিনতে হবে। অভ্র, ইরা, আনিকা, মাহফুজা গিয়েছিল তানিকে নিয়ে। শাড়ি কেনার সময় তানি বেছে বেছে জলপাই রঙের দুটো শাড়ী কিনেছে। বেনারশী কেনার সময় হলো বিপত্তি। তানি তখনও খুঁজলো জলপাই রঙ। মাহফুজা গলা নামিয়ে বলল, কাল তো তোর বউভাত আছে তানি। লাল, গোলাপি কিছু নিলে ভালো হতো না?
তানি আর কোনো উচ্চবাচ্য করলো না। সিঁদুর রঙা লাল বেনারশী সানন্দে নিলো। অভ্র খোঁচা দিয়ে বলল, ভাবী ভাইয়ার পছন্দের রঙ তো নেভি ব্লু। জলপাই রঙ তো না। তানি লজ্জা পেল, সেই সাথে আফসোস ও হলো কেন নীল রঙের কিছু কিনলো না।

কেনাকাটা শেষ করে রেস্টুরেন্টে সবাই মিলে বার্গার আর কোল্ড কফি খেল। ইরা আর অভ্র পুরো সময় মাতিয়ে রাখলেও তানির শুভ্র’র কথা মনে করলো। শুভ্র থাকলে এখন হয়তো সিরিয়াস ভঙ্গিতে মজার কিছু একটা বলে সবাইকে হাসাতো। তানি যে একটু পর পর উদাস হচ্ছিলো সেটা অভ্র খেয়াল করলো। বলল, তাড়াতাড়ি বাসায় যেতে হবে ভাইয়া একা আছে।

আনিকা অবাক গলায় বলল, ভাইয়া একা আছে তো কী হইছে? ভাইয়া কী কচি খোকা?

অভ্র লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, নতুন নতুন বিয়ের পর পুরুষ মানুষ বউয়ের কাছে কচি ই থাকে।

তানি হকচকিয়ে গেল। মাহফুজা কপট রাগ দেখিয়ে বলল, আচ্ছা! তা তুই ক’টা বিয়ে করেছিস যে এসব জানিস!
ইরাও চোখ রাঙানি দিয়ে বলল, বিয়ের আগেই দেখি এসব ব্যাপারে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে বসে আছ!

অভ্র আমতা আমতা করে বলল, আরে এসব তো আশেপাশের মানুষজন কে দেখে শিখেছি।

পুরো সন্ধ্যাটা খুনসুটিতেই কেটে গেল তানির। বাসায় ফিরেও শুভ্র’র সাথে খুব একটা কথা হলো না। ল্যাপটপে মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিলো শুভ্র। তানি রাতের খাওয়া শেষ করে ঘরে এলে শুভ্র বলল, তানি লাইট অফ করতে পারো। আমার কোনো সমস্যা হবে না।

তানি বলল, না থাক। আমার অসুবিধা হচ্ছে না।

“আরে না। তুমি শুয়ে পড়ো। সকালে তাড়াতাড়ি উঠতে হবে তোমার “।

“আপনি ঘুমাবেন না?”

“আমার দেরি হবে। কিছু কাজ আছে সেগুলো শেষ করতে হবে।”

তানি ইতস্তত করে বলল, মা বলেছে কাল আমাদের রাজশাহী যেতে হবে।

শুভ্র স্ক্রিনে চোখ রেখেই বলল, যাওয়া কী খুব জরুরী?

“এটা নাকি নিয়ম। বউভাতের পর যেতে হয়। ”

“কিন্তু আমি তো যেতে পারব না তানি। আমার কাজ আছে।”

“কিন্তু নিয়ম ভাঙা উচিত হবে?”

“সেরকম হলে তুমি তোমার বাড়ির লোকজনের সাথে চলে যেও। যে ক’দিন থাকতে ইচ্ছে হয় থেকো। এরপর অভ্র গিয়ে নাহয় তোমাকে নিয়ে আসবে”।

তানির চোয়াল শক্ত হলো। ঠান্ডা স্বভাবের মানুষের এই এক দোষ। এরা অল্পেই রেগে যায়। রাগতে যেমন সময় লাগে না, রাগ কমতেও সময় লাগে না। তানির খুব রাগ হলো। এটা কেমন কথা বলল শুভ্র! বিয়ের পর বউভাতে বউ কখনো একা যায়! এতে লোকজন নানান কথা বলে। শুভ্র কী সেসব জানে না! জানবে না কেন! এর আগেও তো এমন অভিজ্ঞতা তার ছিলো।

তানি কাঠ কাঠ গলায় বলল, বিয়ের পর হাজবেন্ড ওয়াইফ একসাথে প্রথমবার যেতে হয়। এইটুকু তো আপনার জানার ই কথা তাই না?

শুভ্র তীক্ষ্ণ চোখে তানির দিকে তাকালো। আধ মিনিট সময় ধরে তানিকে দেখলো। এরপর ল্যাপটপ রেখে উঠে এসে তানির মুখোমুখি বসে বলল, হ্যাঁ জানি। আনফরচুনেটলি বিয়ের অভিজ্ঞতা আরও একবার হয়েছিল।

তানি এখন ঠিক নিজের মধ্যে নেই। তাই বুঝতে পারছে না যে শুভ্র’র বলা কথাগুলো অন্যান্য সময়ের মতো না। তানি বলল, তাহলে?

“তাহলে কী সেটার ব্যখ্যা তো একবার দিলাম। আমার ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আছে তাই যেতে পারব না”।

তানি স্থির চোখে কিছু সময় দেখে হঠাৎই কেঁদে ফেলল। ঘটনার আকস্মিকতায় শুভ্র হতভম্ব হয়ে গেল। বলল,

“আরে তানি কাঁদছ কেন!”

তানি জবাব দিলো না। শুভ্র বারবার জিজ্ঞেস করলো। এক পর্যায়ে বিরক্ত হয়ে শুভ্র বলল, তানি তোমার কান্না শেষ হলে আমার কিছু বলার আছে।

তানি চোখ মুছে ফেলল। এতক্ষনে খেয়াল হলো যে একটু বেশী ই রিয়েক্ট করে ফেলেছে। আমতা আমতা করে বলল, আসলে……

শুভ্র থামিয়ে দিয়ে বলল, তানি তোমার কিছু ব্যাপার জেনে রাখা ভালো। ব্যাপার টা এতো তাড়াতাড়ি বলা উচিত হবে না ভেবে বলা হয় নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না বললে আমাদের দুজনের জন্য ই ঝামেলা।

“কী?”

“তোমার আর আমার বিয়েটা হুট করে ঠিক হয়েছে। আমার কাছে ব্যাপার টা খুব তাড়াতাড়ি হয়েছে। বিয়ের আগে যে মেন্টাল প্রিপারেশন দরকার সেরকম কোনো প্রিপারেশন আমার ছিলো না।

“আসলে আমি একটু বেশী রিয়েক্ট করে ফেলেছি। আই এ্যাম স্যরি।

“আমার কথা এখনো শেষ হয় নি তানি”।

তানি মাথানিচু করে ফেলল। শুভ্র বলল,

“তানি শোনো, তোমাকে আমি বিয়ে করেছি মায়ের পছন্দে। মায়ের পছন্দের উপর ভরসা আছে বলেই বিয়ের আগে তোমার ছবি ছাড়া আর কিছুতে আমি ইন্টারেস্ট দেখাই নি। বিয়ে নিয়ে আমার আর কোনো স্বপ্ন বা, ইচ্ছে এসব কিছুই ছিলো না। মা চেয়েছে আবার বিয়ে হোক তাই করেছি। দ্যাটস ইট। তোমার শুনতে খারাপ লাগলেও আজ কিছু কথা শুনতে হবে। আমি অবন্তীকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। বিয়ের আগে যে অবন্তীকে আমি ভালোবেসেছি সেই অবন্তীর এক পার্সেন্ট ও বিয়ের পর পাই নি। হ্যাঁ সে পাল্টে গিয়েছিল। ছোট ছোট ব্যাপার নিয়ে মেন্টালি টর্চার, ঝগড়াঝাটি এসবে লাইফ দূর্বিষহ হয়ে গেলেও অবন্তীকে ভালোবাসা বন্ধ হয় নি। বরং পাগলের মতো ভালোবাসতাম যেন সেই ভালোবাসা দেখে অবন্তী নিজেকে শুধরে নেয়। কিন্তু নিয়তিতে লেখা ছিলো অন্যকিছু।

শুভ্র কিছু সময় থেমে থেকে আবারও বলল, অবন্তী নেই অনেক দিন হলো। তবুও আমার দ্বিতীয়বার বিয়ে, সংসার এসবে ভীষণ ভয় হয়। একটা নরমাল জীবন চাই আমার। যেখানে কাউকে কৈফিয়ত দিতে হবে না, ঝগড়াঝাটি, পেইন কিছু থাকবে না।
তুমি কী বুঝতে পারছ আমি কী বলতে চাইছি?

তানি শুকনো গলায় বলল, বুঝেছি।

“আমার কাছ থেকে এক্ষুনি সব এক্সেপক্ট কোরো না তানি। আমার কিছু সময় প্রয়োজন।

তানি মাথা নাড়লো। শুভ্র আবারও বলল,

“তুমি পড়াশোনা করতে চাও বলছিলে। আমি তোমাকে সব রকম হেল্প করব। দেখবে সময় কেটে যাবে। তাছাড়া দুজন, দুজন কে জানার মতো সময় ও পাবো।

তানি কিছু বলল না।

“তানি তোমার হয়তো মন খারাপ হচ্ছে। কিন্তু আমার অবস্থাটাও বুঝতে হবে তোমায়। আমি ঘর পোড়া গরু তাই সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পাই।

তানি স্বাভাবিক গলায় বলল, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনার যা ভালো মনে হয় করবেন। আমি আপনার উপর কিছু চাপিয়ে দেব না।

শুভ্র স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ঠোঁট প্রশস্ত করে বলল, থ্যাংকস তানি। আমার মন বলছে তুমি আমার খুব ভালো বন্ধু হবে।

তানি একটু হাসার চেষ্টা করলো। সে’রাতে তানির দু’চোখে এক ফোটা ঘুম ও আসে নি। বারবার শুভ্র’র বলা কথাগুলো ভেবেছে। আসলে শুভ্র’র দোষ নেই, দোষ ওর ই। শুভ্র’র দুটো ভালো কথায় ওর এতো টা ভাবা উচিত হয় নি। শুভ্র নিশ্চয়ই সবার সাথেই অমন। নিজের উপর লজ্জা লাগছে। কেন যে এতো টা হ্যাংলাপনা করতে গেল! তানি অতি সন্তঃর্পনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বিয়ের পর পর ই শুভ্র’র প্রতি ওর মায়া জন্মে গেছে এই কথাটা শুভ্র’কে ও কিভাবে বুঝাবে! হ্যাঁ বিয়ে হয়েছে কেবল চার, পাঁচদিন। কিন্তু এই অল্প সময়ে এক অদৃশ্য মায়ার জালে আটকে গেছে তানি। কেন এমন হলো সেটা ও জানে না। শুভ্র’কে দেখলেই অবচেতন মন শুধু জানান দেয়, ওই মানুষ টা তোর তানি।
তানি মন শান্ত করার চেষ্টা করে। চোখ বন্ধ করে বলে, না সে আমার না। সে আমার হতে চায় না।

চলবে…..

সাবিকুন নাহার নিপা