Friday, August 8, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 162



কাছে_কিবা_দূরে পর্ব-০৫

0

#কাছে_কিবা_দূরে
#পর্ব-৫
বিছানায় ঘুমানোর সময় ইন্ডিয়া পাকিস্তানের বর্ডার দেয়া হয় নি শেষ পর্যন্ত। শুভ্র সিরিয়াস গলায় বলল, শোনো তানি আমার কাছে এসব ব্যপার খুব ফিল্মি লাগে। মাঝখানে বর্ডার থাকবে সেটা ক্রস করা যাবে না। ব্লা ব্লা.. এসব সিনেমায় হয়। আমার কাছে মনে হয় বৈবাহিক সম্পর্কে আগে মন ছুঁয়ে তারপর শরীর ছুঁতে হয়। তাই তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। তাছাড়া আমার হাত, পা ছড়িয়ে ঘুমানোর অভ্যাস ও নেই। তোমারও হয়তো নেই। তবুও ইনসিকিউর ফিল করলে মাঝখানে কোলবালিশ রাখতে পারো।

তানি স্মিত হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো। শুভ্র পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়লো। তানিও অনেক দিন পর নিশ্চিন্তে ঘুমালো।

সকালে শুভ্র’র ঘুম ভেঙেছে আগে। তানিকে গভীর ঘুমে মগ্ন দেখে আর জাগায় নি। একা একা খেয়েদেয়েই বেরিয়ে গেছে। তানির ঘুম ভেঙেছে বেলা হবার পর। জেগে উঠে ঘড়িতে সময় দেখে লজ্জা পেল। এতোটা বেলা পর্যন্ত ঘুমিয়েছে! মাহফুজা তানিকে দেখে বলল, ঘুম কেমন হলো?

“জি ভালো।

“আসো খাবে এখন।”

“আপনারা খেয়েছেন”?

মাহফুজা কপট রাগ দেখিয়ে বলল, এই মেয়ে আপনি আপনি করছিস কেন! আমার ছেলেমেয়েরা আমাকে তুমি বলে ডাকে। তুই ও তেমন ডাকবি”।

তানি হেসে বলল, আচ্ছা।

তানি একা খেতে বসলো না। আনিকা, আর মাহফুজাও সাথে বসেছে। তানিকে যত্ন করে প্লেটে খাবার তুলে দিলো মাহফুজা। তানির ভীষণ ভালো লাগলো। ভালো লাগায় চোখে পানিও এসে গেল। এরকম যত্ন করে মা’ও ওকে খাওয়াতো। খেতে খেতে হঠাৎই তানির মন খারাপ হলো। এই বাড়ির মানুষগুলো বড্ড ভালো। এরা সত্যিই কী ভালো! নাকি বিয়ের পর প্রথম প্রথম ভালো থাকার চেষ্টা করছে! তানি সেটা বুঝতেই পারে না। আরিফের সাথে বিয়ে হবার পরও প্রথম প্রথম তার বাড়ির লোকজন কে এরকম ভালো মনে হয়েছিল তানির। কিন্তু যখন খোলস ছেড়ে আসল রুপ বেরিয়ে এলো তখন বুঝতে পারলো যে একেকটা বিষধর সাপ।

মাহফুজা অবাক হয়ে গেল তানিকে দেখে। গাল বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। কাঁধে একটা হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে তানি?

তানি সম্বিত ফিরে পেতেই চোখের পানি মুছে ফেলল। আনিকা বলল, ভাবীর মনে হয় বাড়ির জন্য মন কেমন করছে। তাই না ভাবী?

তানি নিজেকে যথাসম্ভব সামলে নিয়ে স্মিত গলায় বলল, আই এ্যাম স্যরি।

মাহফুজা তানির একটা হাত ধরে বলল, ঝটপট খেয়ে নে। খাবার ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে।

সারাটা দিন আনিকা আর শাশুড়ীর সাথেই কেটে গেল। তানি রান্না করতে চাইলেও মাহফুজা দিলেন না। বললেন, নতুন বিয়ে হয়েছে এখনই রান্নাঘরে যেতে হবে না। তানিও মেনে নিলো। সারাদিন আনিকার সাথে গল্প করলো, টিভি দেখলো।
শুভ্র ফিরলো সন্ধ্যার পর। ফিরেই সোফার উপর সটান হয়ে বসে পড়লো। তানি তখন টিভি দেখছিল। মাহফুজা বাজারে গেছে আর আনিকা কোচিং-এ পড়তে গেছে। তানি শুভ্র’ কে দেখে দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল,
“আপনাকে কী পানি দেব”?

শুভ্র চোখ বন্ধ রেখেই বলল, দাও।

তানি পানি এনে দিতেই শুভ্র বলল, কেমন আছ তুমি তানি?

তানি ইতস্তত করে বলল, ভালো?

“শ্বশুর বাড়ি কেমন লাগছে? ”

“ভালো। ”

“শাশুড়ী “?

“খুব ভালো “।

“ননদ”?

“খুব ভালো “।

“দেবর”?

“খুব ভালো ”

“আর বর”?

তানি এবার কোনো জবাব দিলো না। মাথা নিচু করে ফেলল। শুভ্র কৌতুকে গলায় বলল, তার মানে সব ভালো লাগলেও বর ভালো লাগে নি?

তানি বুকভরে নিঃশ্বাস নিলো। এরপর শুভ্র’র চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তো তেমন বলি নি।

শুভ্র দুঃখিত গলায় বলল, কই সবাইকে তো খুব ভালোর সার্টিফিকেট দিলে আর আমার জন্য শান্তনা পুরস্কার হিসেবে ভালো ও বললে না।

তানি মাথা নিচু করে হাসলো। শুভ্র জবাবের অপেক্ষা করছে। তানি বলল, মোটে তো দুইদিন। এখনও তো আপনাকে বুঝে উঠতে পারিনি।

শুভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, হে আল্লাহ আপনি দেখুন। সবাইকে বুঝে ফেলল আর আমাকে এখন পর্যন্ত বুঝলো না। এইসব শোনাও বাকী ছিলো! এইসব শোনার জন্যই কী সাত আট ঘন্টা এই কাঁধে কুমড়ো সাইজের একটা মাথা বয়ে নিয়ে এসেছিলাম?

তানি খিলখিল করে হাসলো। শুভ্রও তাল মিলিয়ে হাসলো। হাসি থামিয়ে বলল, মজা করছিলাম তানি।

তানি হাসতে হাসতেই বলল, আপনি অভিনয় করলে অনেক নাম করবেন।

শুভ্র কুর্নিশ করার ভঙ্গিতে মাথা নত করে বলল, মাই প্লেজার। এবার বলো বর দেরিতে পৌছানোয় যে মেন্টাল শক পেয়েছিলে সেটা কী কেটে গেছে।

তানি মুখ হাসি হাসি করে হ্যাঁ বলল ঠিকই, কিন্তু মনে মনে বলল, সেটা তো আপনাকে দেখেই কেটে গেছে।

শুভ্র স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে বলল, থ্যাংকস গড। আমি তো খুব ভয়ে ছিলাম। সর্বস্ব হারিয়ে যতটা বিপাকে পড়েছিলাম তার চেয়েও বেশী টেনশন ছিলো তোমাকে নিয়ে। অলমোস্ট সাত, আট ঘন্টার লেট। তুমি যদি কিছু করে বসো! আই মিন সুইসাইড।

তানি ব্যাপার টায় মুগ্ধ হলো। বলল,
“আপনি তো আমাকে দেখেন ও নি। তবুও এতো চিন্তা করছিলেন?”

শুভ্র হেসে বলল, বিয়ে ঠিক হওয়ার পর থেকে ইউ আর মাই রেন্সপন্সিবিলিটি তানি।

শুভ্র আরও কিছু বলতে যাবে তখনই কলিংবেল বেজে উঠলো।

******

দরজার ওপাশে হাসি হাসি মুখ করে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। একটু দূরে আনিকাও আছে। তানি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে মেয়েটা বলল, ভাবী আমি ইরা। তোমাদের প্রতিবেশী।

তানি ইরার নাম টা এর আগেও আনিকার কাছে শুনেছে। ইরার ও বিয়েতে যাবার কথা ছিলো। কিন্তু পথে ওই দূর্ঘটনার কারনে ওরা ফিরে এসেছিল।

শুভ্র ইরার গলা পেয়ে বলল, তানি ওর নাম ইরা। ইরা না ডেকে প্যারাও ডাকতে পারো। ওর প্যারায় পাড়ায় কোনো দোকানদার টিকতে পারে না।

ইরা ততক্ষণে ঘরে ঢুকে গেছে। মারমুখী হয়ে শুভ্র’র দিকে এগিয়ে গেল, আর ঢঙ্গী গলায় বলল, ভাঁইঁয়াঁ।

শুভ্র সরে যেতে যেতে বলল, আমার সাথে বেয়াদবি করলে তোমার বিয়ে আটকে যাবার সম্ভাবনা আছে।

ইরা বলল, ধ্যাৎ আমি বিয়ে করলে তো!

শুভ্র টেনে টেনে বলল, হ্যাঁ বিয়ে করবে না কিন্তু বাচ্চার নামও ঠিক হয়ে আছে। বাচ্চার নাম টা যেন কী?

ইরা লজ্জা পেল। আনিকা তানির পাশে গিয়ে ফিসফিস করে বলল, ইরা আপুর সাথে ছোট ভাইয়ার ইটিসপিটিশ আছে।

তানি চোখ কপালে তুলে বলল, ইটিশপিটিশ! ইশ! এসব কোথায় শিখেছ!

আনিকা হেসে বলল, আমরা মজা করে মাঝেমধ্যে বলি।

তানির খুব ভালো লাগছে এসব খুনসুটি। এই অল্প সময়ে মানুষ গুলো কে এতো ভালো লাগছে। জীবন টা এখন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।

চলবে…..

সাবিকুন নাহার নিপা

কাছে_কিবা_দূরে পর্ব-০৪

0

#কাছে_কিবা_দূরে
#পর্ব-৪
গত রাত টা নির্ঘুম কাটায় ট্রেনে উঠেই তানি ঘুমিয়ে পড়লো। তানি বাসে চড়তে পারে না, বমি হয়। তাই ওরা ট্রেনে করে ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা হয়েছে। তানি ঘুমানোর মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করছে শুভ্র’র কাঁধ টা’কে। শুভ্র সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে একমনে ম্যাগাজিন পড়ছে। ম্যাগাজিন টা কিনেছে প্ল্যাটফর্ম থেকে। সারা পথ কিভাবে সময় কাটাবে এই ভেবে কেনা হয়েছে। অভ্র বসেছে বাম দিকের প্রথম সিটে। শুভ্র আর তানি ডান দিকের সিটে। অভ্র খোঁচা মেরে বলল, ভাইয়া ভাবী তো দেখি ঘুমিয়েই যাচ্ছে।

শুভ্র অন্যমনস্ক হয়ে বলল, হু?

অভ্র মিটিমিটি হেসে বলল, অথচ তুমি সকালে কী ভাব টা’ই না করেছিলে?”

শুভ্র ম্যাগাজিন রেখে অগ্নিদৃষ্টিতে অভ্রর দিকে তাকিয়ে বলল, এইসব অশ্লীল কথাবার্তা কোথায় শিখেছ?

অভ্র হাসি চেপে বলল, যাহ বাবা! আমি কী করলাম!

শুভ্র চোখ গরম করে বলল, ইরার মা’কে বলি যে তার মেয়েকে এখন থেকে যেন একটু দেখেশুনে রাখে। রাত বিরাতে বখাটে ছেলেরা আজকাল খুব ডিস্টার্ব করছে।

“এরমধ্যে ইরা কোত্থেকে এলো?”

শুভ্র দৃষ্টি সরিয়ে ম্যাগাজিনে মনোযোগ দিলো। বেশ খুটিয়ে খুটিয়ে ম্যাগাজিন পড়ছে। ট্রেন ঝিকঝিক শব্দে এগিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্য চলছে। কয়েক মিনিটের জন্য স্টেশনে থামছে, সেই সময় শোনা যায় হকারদের হাকডাক। তানি বেহুশের মতো ঘুমুচ্ছে। শুভ্র এক নজর তানিকে দেখলো। মেয়েটার কতো বয়স হবে! শুনেছিল চব্বিশ, পঁচিশ বছর বয়স। অথচ এই বয়সেই হোচট খেয়ে বসে আছে! শুভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কাকে কী বলছে! তানি যেমন হোচট খেয়েছে, তেমনি ও তো খেয়েছে। অবন্তীকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল ইউনিভার্সিটি তে পড়া অবস্থায় ই। অবন্তী উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছিলো। অবন্তীর বাবা জেদ করলেন ইউনিভার্সিটি তে পড়া অবস্থায় ই মেয়ের বিয়ে দিবেন। পাশ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করলে দেরি হয়ে যাবে। সেদিন দু’চোখে কেবল অন্ধকার ই দেখেছে শুভ্র। বাবা মারা গেছে। মায়ের চাকরি আর বাবার পেনশনের টাকা মিলিয়ে পড়ার খরচসহ বাসা ভাড়া, সংসার চালাতে হয়। এরমধ্যে অবন্তীকে বিয়ে করাটা বোকামি। শুভ্র অবন্তীর বাবার কাছে সময় চেয়েছিলো কিন্তু সে সময় দিতে রাজি ছিলেন না কোনোভাবেই। এদিকে অবন্তীও শুভ্র কে না পেলে আত্মহত্যা করবে। এছাড়াও নানান রকম মানসিক চাপ ছিলো অবন্তীর। উপায়ন্তর না পেয়ে মায়ের অনুমতি ছাড়াই অবন্তী কে বিয়ে করেছিল। মা অসন্তুষ্ট হলেও সেটা প্রকাশ করলেন না। অবন্তীকে নিজের মেয়ের মতো ই মানতেন। কিন্তু অবন্তী ছিলো উচ্চ মধ্যবিত্ত মানসিকতার। সে বিয়ের পর একটা নিজস্ব জীবন চেয়েছিল যেখানে শাশুড়ী, দেবর, কেউ থাকতে পারবে না। বৈবাহিক জীবনের দুটো বছর শুভ্র’র তিক্ততায় কেটেছে। এই তিক্ততা শুধু শুভ্র না, তার ফ্যামিলিকেও ভোগ করতে হয়েছে। অনেক মাশুল ও দিতে হয়েছে। তাই দ্বিতীয়বার বিয়ের জন্য শুভ্র রাজী ছিলো না। কিন্তু মায়ের অনুরোধ ফেলাও সম্ভব হয় নি।

তানি ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছে। কেউ একজন তাকে এক নাগাড়ে ডেকেই যাচ্ছে। কিন্তু তানি লোকটা’কে চিনতে পারছে না। এর আগে দেখেও নি অথচ এমন ভাবে ডাকছে যেন কতো আপন। হঠাৎ মাথায় ধাক্কা লাগায় তানির ঘুম ভেঙে গেল। চোখ কচলে এদিক ওদিক চেয়ে জিজ্ঞেস করলো, এটা কোথায়?

“এটা এ্যাওয়ার্ড ফাংশনের ট্রেন। এক্সপার্ট ঘুম কাতুরে যারা তাদের সেই ফাংশনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে”।

তানি বোকার মতো তাকিয়ে রইলো। অভ্র হেসে ফেলে বলল, ভাবী আপনি কিছু মনে করবেন না। ভাইয়া মজা করেছে। আসলে ভাইয়া গম্ভীর হয়েও পেটে খিল ধরানো কথা বলে! ”

শুভ্র তানিকে বলল, ঘুমকন্যা আপনি কী আমাদের সাথে যাবেন নাকি গিনিস বুকে নাম লেখাতে চলে যাবেন?”

তানি লজ্জায় মাথানিচু করে ফেলল। এতক্ষন ঘুমিয়েছে!

******

শুভ্র’র মায়ের নাম মাহফুজা রহমান। মাহফুজা একটা প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি করেন। স্বামী মারা গেছেন বছর দশেক হবে। এরপর একা হাতে ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন। শুভ্র, অভ্র ছাড়াও তার একটি মেয়ে আছে। যার নাম আনিকা। আনিকা এবার ইন্টারমিডিয়েটে পড়ছে।

তানিকে দেখে আনিকা ছুটে গেল। বলল, ভাবী আমি কিন্তু তোমার একমাত্র ননদ। পরীক্ষা চলছিলো তাই যেতে পারিনি।

মাহফুজা তানিকে হাত ধরে ঘরে আনলেন। বারবার জিজ্ঞেস করলেন পথে কোনো সমস্যা হয়েছে কী না! বিয়েতে দেরি করে পৌছানোর জন্য ক্ষমাও চাইলেন। তানি নত মস্তকে সব টা শুনলো আর নিচু গলায় দুই একটা কথা বলল।

আনিকা তানির পাশে এসে বসে বলল, ইশ! তুমি কতো সুন্দর! ছবি দেখে ভেবেছিলাম সব ক্যামেরার কেরামতি।

অভ্র ফোড়ন কেটে বলল, আরে জানিস না তো, ভাবীকে সালোয়ার কামিজে কতো সুন্দর লাগে।

তানি প্রথমে না বুঝতে পারলেও পরে বুঝলো অভ্র কোন অর্থে কথাটা বলেছে। যখন বুঝতে পারলো তখন তানি লজ্জা পেল। শুভ্র’ও নিশ্চয়ই ব্যাপার টা লক্ষ্য করেছে!

মাহফুজা খাবারের বন্দোবস্ত করতে গেছেন। শুভ্র এসেই ভেতরের ঘরে চলে গেল। আনিকা আর অভ্র দুজনেই তানির সামনে বসে আছে।

আনিকা মন খারাপ করে বলল, ভাবী তুমি কী কথা কম বলো?

তানি ইতস্তত করে বলল, না মানে….

অভ্র বলল, সবাই কী তোর মতো ফাজিল হবে! ভাবী নতুন তো তাই কথা কম বলছে। আর যদি কথা কম বলার অভ্যাস থাকে তো কোনো ব্যাপার ই না। আমরা শিখিয়ে নেব।

তানি মৃদু হাসলো। আনিকাও হেসে ফেলল।

অভ্র বলল, ভাবী তোমাকে কিন্তু আপনি আজ্ঞে করতে পারব না। স্ট্রেইট তুমি।

তানি মৃদু হেসে মাথা নাড়লো।

মাহফুজা এসে বললেন, কী রে তোরা কী মেয়েটা’কে একটু হাত মুখ ধুতেও দিবি না। আসো তানি হাত মুখ ধুয়ে কিছু খেয়ে নিবে।

তানি মাহফুজা কে অনুসরণ করে। তানির চোখে পানি এসে গেছে। এরকম একটা পরিবার ও মনে মনে চেয়ে এসেছে কিন্তু প্রথমবার যেভাবে স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়েছে তাতে আর কোনোদিন বিয়ের স্বপ্নও দেখে নি। অথচ যা চেয়েছে তা পেয়েছে। দেরি হয়েছে ঠিকই, তবুও পেয়েছে তো। তানি চোখ মুছলো। মাহফুজা হেসে বললেন, ধুর বোকা মেয়ে কাঁদছিস কেন? বাড়ির জন্য মন কেমন করছে?

তানি কিছু বলল না। হঠাৎই মন খারাপের পাল্লা ভারী হতে লাগলো। আচমকাই মাহফুজা কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলল। মাহফুজা পিঠে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, পাগল মেয়ে।

শুভ্র’র সাথে তানির আর দেখা হলো না। একসাথে খেতেও বসে নি। নিজের ঘরে ঘুমিয়েছে। তারপর পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছে। সন্ধ্যা বেলা আনিকার কাছে চা চেয়ে খেয়েছে কিন্তু ঘর থেকে বের হয় নি। তানি লজ্জায় ও ঘরে যায় ও নি। আনিকার ঘরেই বিশ্রাম করেছে। সন্ধ্যায় একসাথে সবাই মিলে চা খেয়েছে। বারবার তানি শুভ্র’র ঘরের দিকে তাকাচ্ছিলো। এক একটা জিনিসের জন্য শুভ্র যখন একে ওকে ডাকে তখন তানি কান খাড়া করে থাকে। এইটুকু সময় না দেখতে পেয়ে ভিতরে ভিতরে জ্বলে যাচ্ছে। এর নাম কী ভালোবাসা! তানি তা জানেনা। শুধু জানে আর ওর পক্ষে অপেক্ষা করা সম্ভব না। এখন যদি শুভ্র কে না দেখতে পায় তাহলে ওর দম বন্ধ হয়ে যাবে।

শুভ্র’র সাথে দেখা হলো তানির রাতে৷ শুভ্র পা দুলাতে দুলাতে ম্যাগাজিন পড়ছিল। তানিকে দেখে চমকে উঠে বলল, ও তানি তুমি এই ঘরে ঘুমাবে?

তানি বোকার মতো তাকিয়ে রইলো। শুভ্র বলল, দাঁড়িয়ে আছ কেন! বসো।

তানি জড়োসড়ো হয়ে বিছানায় বসলো। মুখ থমথমে। অপমান আর রাগে ফর্সা মুখ লাল হয়ে গেছে। শুভ্র স্থির চোখে তানিকে দেখতে লাগলো। তারপর শব্দ করে হেসে ফেলল। বলল, রাগলে তো তুমি পুরো টমেটো হয়ে যাও।

তানি একবার তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিলো। শুভ্র হেসে বলল, আসলে কাল রাতে তুমি একটুও ঘুমাও নি। তাই মনে হয়েছে যে তুমি কম্ফোর্টেবল হবে না এক বিছানায় ঘুমাতে। এইজন্য জিজ্ঞেস করলাম।

তানি অবাক ও বিস্মিত হলো। তার মানে কাল যে ও জেগে ছিলো সেটা শুভ্র জানে!

শুভ্র বলল, ঠিক আছে ঠিক আছে তুমি শুয়ে পড়ো। আমি মাঝখানে কাঁটাতাড়ের ব্যবস্থা করছি।

তানি শব্দ করে হেসে ফেলল। শুভ্র চোখ কপালে তুলে বলল, যাক বাবা তুমি হাসতে পারো। আমি ভেবেছি তোমার দুই একটা দাঁত কম আছে বলে ঝিম মেরে থাকো, হাসো না। এখন তো দেখি সব দাঁত ঠিকঠাক ই আছে। একদম মজবুত, টেকসই।

তানি এবার আরও জোরে শব্দ করে হাসতে লাগলো। তাল মিলিয়ে শুভ্র’ও হাসলো কিন্তু তাতে শব্দ হলো না।

চলবে……

সাবিকুন নাহার নিপা

কাছে_কিবা_দূরে পর্ব-০৩

0

#কাছে_কিবা_দূরে
#পর্ব-৩
সারারাত তানির ঘুম হলো না। কিন্তু শুভ্র নিশ্চিন্তে ঘুমালো। তানির এখন আর কোনো ভয় নেই। বিয়ে শব্দটায় যে আতংক ছিলো এখন সেটাও নেই। ওর মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরছে সেটা হলো এই দেখতে সুন্দর সিনেমার নায়কের মতো লোক টা এখন থেকে শুধু ওর। শুভ্র’র সাথে তানির দেখা হয়েছিল অনেক বছর আগে। খালামনির বাসা থেকে যখন বেরিয়েছিল তখন মেঘের ছিটেফোঁটাও ছিলো না। কিন্তু যেই রাস্তায় পা দিলো অমনি শুরু হয়ে গেল বৃষ্টি। কিছুদূর যাওয়ার পর তানি সিদ্ধান্ত নিলো বাসায় ফিরে যাবে। কারন ওর বৃষ্টি সহ্য হয় না। একাই একাই ফিরে আসছিল। রাস্তাঘাটে তখন বৃষ্টির পানি জমে গেছে। তানি বুঝতে না পেরে বেখেয়ালে ড্রেনে পড়ে গেল। পায়ে পা লেগে পড়ে গেল। কোমড় পর্যন্ত ভিজে গেল ড্রেনের নোংরা পানিতে। যে কয়েকজন লোক দেখেছিল তার হাসতে হাসতে লুটোপুটি খাচ্ছিলো কিন্তু কেউ এগিয়ে এলো না। কিন
শুভ্র দৌড়ে এলো। চোখে চশমা, কাঁধে ব্যাগ। ছুটে এসে তানির হাত ধরে বলল, তুমি কী খুব ব্যথা পেয়েছ?
তানি ততক্ষনে কাঁদতে শুরু করেছে। শুভ্র হাত ধরে তুলে বলল, আরে এটা তো এক্সিডেন্ট। তুমি কাঁদছ কেন?

তানি হাপুস নয়নে কেঁদেই চলছে। শুভ্র বলল, তোমার বাসা কোথায়?

তানি হাত উচিয়ে মিনিট দু’য়েকের দূরত্বে একটা বিল্ডিং দেখালো। শুভ্র বলল, যাও চলে যাও। কাছেই তো।

তানি চলে গেল। শুভ্র চলে যেতে বললেও ওর পিছু পিছু এলো। একদম গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে চলে গেল। কিন্তু না নিজের নাম বলল, আর না তানিকে নাম জিজ্ঞেস করলো।

তানি এরপর যে’কদিন ওখানে ছিলো প্রায় প্রতিদিন সে জায়গায় গিয়ে দাঁড়াতো শুভ্র’র খোঁজে। কিন্তু দেখা পায় নি। এরপর রাজশাহী চলে এলো। পরের বার আবার যখন ঢাকা গেল তখন ও মনে মনে চেয়েছে আরেকবার ছেলেটার সাথে দেখা হোক। কিন্তু হয় নি। একসময় তানি ব্যস্ত হয়ে গেল পড়াশোনা নিয়ে। এরপর বিয়েও হলো। তবুও ঝুম বৃষ্টির সময় ছেলেটাকে মনে পড়তো আর বুকের ভিতর টা হু হু করে উঠতো। আজ সেই মানুষ টা তানির এতো কাছে আছে যে ইচ্ছে করলেই ছুয়ে দিতে পারবে। সেই অধিকার টুকুও পেয়ে গেছে কাগজে সই করে।

শুভ্র’র ঘুম ভাঙলো খুব সকালেই। দেখলো তানি রাতে যেমন বসে ছিলো তেমনই বসে আছে। আঁতকে উঠে বলল,

“এই তানি তুমি আবার সারারাত এই ভাবে বসে ছিলে নাকি?”

তানি লজ্জা পেল। আমতা আমতা করে বলল, না মানে….

“ওহ। আমি ভেবেছি তুমি হয়তো ঘুমাও নি। তা কখন উঠলে? ”

“এই তো”।

“আচ্ছা শোনো আমাদের কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে। তুমি তাড়াতাড়ি সব গুছিয়ে তৈরী হয়ে নাও”।

“আচ্ছা”।

তানি চলে যেতেই শুভ্র হাফ ছেড়ে বাঁচলো। ভাগ্যিস মেয়েটা স্বাভাবিক হয়েছে। কাল প্রথম দেখায় যেভাবে রক্তশূন্য মুখ দেখেছে! একে তো বিয়ের আগে ওর সাথে দেখা করে নি, তার উপর দেরি করে আসা! সবটা মিলিয়ে তানি হয়তো খুব আপসেট হয়ে পড়েছিল। হবার ই কথা। এটা তানির দ্বিতীয় বিয়ে। প্রথমবার বিয়ে ভেঙে গেলে মেয়েরা সাধারণত ভয় বেশী পায়। ঘর পোড়া গরু তো সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় হয়। দ্বিতীয় বার যে আবারও তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হবে না সেটার গ্যারান্টি কী! এসব নিয়ে মেন্টাল স্ট্রেস ও বেশী থাকে। সারাপথে যে বিপদ ঘটেছে তাতে নিজেদের নিয়ে ভাবার চেয়ে তানিকে নিয়ে বেশী ভেবেছে শুভ্র। তানি আবার আত্মহত্যা করে ফেলবে না তো! এই ভয়ে আচ্ছন্ন হয়ে গিয়েছিল। যাক ঠিক সময় পৌছে অনেক বড় অপমান থেকে বেঁচেছে। শুভ্র’র মামা চেয়েছিল ফিরে যেতে কিন্তু শুভ্র রাজী হয় নি। যে করেই হোক বিয়ে আজ ই করবে। অচেনা, অজানা একটা মেয়ে অপেক্ষা করে আছে। সেটা বিফলে যেতে দেয়া যায় না।

******
অভ্র শুভ্র কে দেখে চোখ টিপে জিজ্ঞেস করলো, ভাইয়া ঘুম কেমন হয়েছে?

শুভ্র কপট রাগ দেখিয়ে বলল, আমি তোর পাঁচ বছরের বড়। সম্মান দিয়ে কথা বল। বড় ভাইয়ের গোপন ব্যাপার জানতে চাওয়ার জন্য তোর অবশ্যই শাস্তি হবে। কঠিন শাস্তি।

“যাহ বাবা! আমি এতোকিছু জিজ্ঞেস করলাম কখন? তুমিই তো আগ বাড়িয়ে সব বললে। ”

“হু। তানির সাথে তোর দেখা হয়েছে? ঘুম থেকে ওঠার পর আর দেখলাম না?”

অভ্র চোখ কপালে তুলে বলল, এক রাত যেতে না যেতেই ভাবীকে চোখে হারাচ্ছ! এক রাতেই….. ”

“এই কথা গুলো পারলে আপনার ভাবীর সামনে বলুন। দেখি কতো পারেন!

অভ্র হেসে ফেলল। বয়সের ব্যবধান থাকলেও দুই ভাইয়ের সম্পর্ক টা বন্ধুর মতো। শুভ্র সবার সাথেই সহজে মিশে যায়। অভ্র সিরিয়াস গলায় বলল,

“আচ্ছা ভাইয়া একটা সত্যি কথা বলোতো?”

“আমি অকারণে মিথ্যে বলিনা অভ্র”।

“ভাবীকে প্রথম দেখায় তোমার কেমন লেগেছে? ”

শুভ্র মৃদু হেসে বলল, সত্যি বলব?

“হ্যাঁ “।

“লাভ এট ফার্স্ট সাইট হয় নি। তবে চমৎকার লেগেছে উল্টো জামা পরা অবস্থায় দেখে। ”

দুজনেই ফিক করে হেসে ফেলল। অভ্র বলল, সত্যি! তোমাদের নাতি নাতনিরা এই গল্প শুনে খুব মজা পাবে?

শুভ্র কিছু একটা বলতে গিয়েও হেসে ফেলল। তাল মিলিয়ে অভ্রও হাসলো।

*****
বিদায়ের সময় তানি একটুও কাঁদলো না। হাসিমুখে বিদায় নিলো। এই বাড়িতে যে খুব শান্তিতে ছিলো তেমন না। বরং উঠতে, বসতে অনেক খোটা শুনতে হয়েছে তানিকে। কেন সংসার করতে পারলো না! কেন স্বামী, শাশুড়ীর মন জুগিয়ে চলতে শিখলো না। তানি সেসব কথার জবাব দেয় নি। বরং নীরব থেকেছে। এগারো মাসের সংসারে তানিও কম চেষ্টা করে নি মানিয়ে থাকার জন্য। কিন্তু একসময় দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ায় আর পারে নি। ফিরে এসেছিলো। সে অধ্যায় টা তানির জীবনের ভয়াবহ একটা অধ্যায়। মনে পড়লে তানি শিউরে ওঠে এখনো। বাড়ির প্রতিটি মানুষ সেই আঘাতে খোঁচা দিয়ে গেছে এতো দিন। কিন্তু আজ থেকে তানির শুরু হলো নতুন জীবন। এই জীবন কেমন হবে তানি জানে না। কিন্তু মনে মনে স্বস্তি পায় এটা ভেবে যে অন্তত পুরোনো ক্ষতটা তো ভুলতে পারবে।

তাসলিমা মেয়ের জন্য কাঁদছে। শুভ্র কী বলবে বুঝতে পারছে না। তাসলিমা শুভ্র’র একটা হাত ধরে বলল, বাবা আমার মেয়েটারে দেইখ্যা রাইখো।

শুভ্র মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। হঠাৎ ই মন টা খারাপ হয়ে গেল। অবন্তীর মা’ও ঠিক এইভাবে হাত ধরে বলেছিল, অবন্তীকে দেখে রেখো শুভ্র৷ এখন থেকে তুমিই ওর সব। শুভ্র কথা দিয়েছিল। কিন্তু রাখতে পারে নি। অবন্তী মারা গিয়েছিল ওর চোখের সামনে। ভয়াবহ এক্সিডেন্টে মাথা থেতলে গিয়েছিল। ছিয়াত্তর ঘন্টা আইসিউ তে ছিলো। আইসিউ তে নেয়ার আগে শুভ্রই বন্ডে সই করেছিল। কী ভয়ংকর সেই দিনগুলো! শুভ্র আর ভাবতে পারে না। মাথার মধ্যে সূক্ষ্ম যন্ত্রণা শুরু হয়। অবন্তী ওর প্রথম ভালোবাসা ছিলো। সেই কলেজ থেকে দুজন দুজন কে ভালোবাসতো। আজ ও নেই। ওর জায়গায় এখন থেকে তানি থাকবে। কিন্তু তানিকে কী কোনোদিন ভালোবাসতে পারবে! ভালোবাসা বলে আদৌ কিছু হয় কী! যদি হতো ই তবে অবন্তীকে এতো ভালোবাসার পরও কেন ওকে ঠকিয়েছিল!

চলবে….

সাবিকুন নাহার নিপা

কাছে_কিবা_দূরে পর্ব-০২

0

#কাছে_কিবা_দূরে
পর্ব-২
মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যেই বাড়িতে আবারও প্রাণ ফিরে এলো। শুভ্র আর তানির বিয়েটা হয়ে গেছে। বিয়ের আগে খাবার খাওয়ার রেওয়াজ নেই বলে আগে বিয়ে পড়ানো হলো। বিয়েতে তানির সাজগোজ তেমন কিছু ছিলো না। জলপাই রঙের শাড়ী পরেছে, চোখে একটু কাজল আর ঠোঁটে লিপস্টিক। তবুও সেই সাজে অপরুপ দেখালো।

তাসলিমার শরীরের ক্লান্তিভাব ও দূর হয়ে গেল। রান্নাঘরের তদারকি করছে হাসিমুখে। ফরহাদ সাহেব খুশিমনে পান চিবুচ্ছে আর ঘরে পায়চারি করছে। সাবিনা ও দরদী গলায় বলছে, আম্মা তানি তো সারাদিন কিছু খায় নি? ওরে তো কিছু খাওয়ান দরকার। তাসলিমা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বর আসছে না এই টেনশন সবাই করলেও লুকিয়ে চুরিয়ে অনেকেই খেয়ে ফেলেছে। ফরহাদ সাহেব ক্ষিদে সহ্য করতে পারে না, তাই সেও খেয়ে নিয়েছে। খাওয়া হয় নি শুধু তাসলিমা আর তানির। তাসলিমা একটা প্লেটে কিছু খাবার নিয়ে মেয়ের ঘরের দিকে রওনা হলো। মেয়েটা শ্বশুর বাড়ি যাবে, এরপর হুটহাট আসবে বেড়াতে। শেষ খাওয়া টা মায়ের হাতে তৃপ্তি করে খাক।

আজকের দিন টা তানির কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। সকালে উঠেও অন্য দিনের মতো সাদামাটা মনে হয়েছিল। কিন্তু শেষ বিকেল টা! এতো টা চমক ও জীবনে অপেক্ষা করেছিল! তানির হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে বারবার। আচ্ছা শুভ্রর কী ওর সাথে দেখা হওয়ার দিন টার কথা মনে আছে? না থাকার সম্ভাবনা ই বেশী। তানি তখন মাত্র এস এস সি পরীক্ষা শেষ করে ঢাকা বড় খালার বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল। শুভ্ররও তখন বয়স কম। বোধহয় ইউনিভার্সিটি তে পড়তো। জীবনে চলার পথে কত মানুষের সাথেই তো দেখা হয়। কজন কে ই বা মানুষ মনে রাখে! তাছাড়া তানি দেখতে তখন কিছুটা হ্যাংলা, পাতলা বোকা বোকা চেহারার ছিলো। এখন বেশ পরিবর্তন এসেছে। চেহারায় একটা ধার এসেছে। এখন আর রোগাও নেই। কিন্তু শুভ্র আগের মতোই আছে। সেই চশমাওয়ালা চোখ, কথা বলার ধরন, পেটানো শরীর, লালচে ঠোঁট। একটুও বদলায় নি।

তাসলিমা খাবারের প্লেট তানির সামনে রেখে বললেন, নে মা খা একটু। সারাদিন তো কিছু খাস নাই।

তানি স্মিত হেসে বলল, মা তুমিও তো কিছু খাও নি। চলো একসাথে খাই।
তাসলিমার চোখে পানি এসে গেল। এতো লক্ষ্মী মেয়ে তার! তবুও এই বয়সে কতো কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। মেয়ের মুখের দিকে ঠিকঠাক তাকাতেও পারে নি এতোকাল। এখন যেন মেয়েটা শান্তিতে থাকে।

****

শুভ্রর ঘুম পাচ্ছে খুব। গতকাল রাত টা নির্ঘুম কেটেছে, সেই সাথে সারাদিনের ঝামেলা। মনে হয় খাওয়াও বেশী হয়েছে। মাত্র কিছুক্ষণ হলো এই বাড়ির জামাই হয়েছে। এরমধ্যে কী ঘুমাতে চাওয়া টা কী অন্যায় হবে! হওয়ার কথা না। তাছাড়া শুভ্র’র রাখডাক নেই। তানির কাছে খাবারের কথা বলতেও ওর কোনো সংকোচ হয় নি৷ তাই ঘুমের কথাও বলা যায় নির্দিদ্বায়। কিন্তু তানিকে আশেপাশে কোথাও দেখছে না। বসার ঘর থেকে ভেতরে বেশ কয়েকবার উঁকি দেয়ার চেষ্টা করেছে কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত কিছুই দেখতে পারে নি।

শুভ্র’র মোচড়ামুচড়ি দেখে অভ্র ফিসফিস করে বলল, ভাইয়া বিয়ের ফিলিংস কেমন?

“ঘুম ঘুম ভাব হচ্ছে?”

অভ্র হাসি চেপে বলল, এইজন্য এদিক ওদিক তাকিয়ে ভাবীকে খুঁজছো?

“উঁহু তানিকে খুঁজছিলাম”।

“তোমার তানি কিন্তু আমার ভাবী হয়।”

শুভ্র চকিতে বলল, ও হ্যাঁ সেটা ভুলে গিয়েছিলাম। আচ্ছা এইভাবে কতক্ষণ বসে থাকতে হবে?

“অনেকক্ষন। কারন ফুল আনতে গিয়েছে। ফুল আসার পর ঘর সাজানো হবে তারপর।
অভ্র এক চোখ টিপে বলল, আজ তো তোমাদের বাসর রাত৷

শুভ্র ফোস করে নিঃশ্বাস ফেলল। এই মুহুর্তে চোখে ঘুম ছাড়া আর কিছুই দেখছে না। চোখ বন্ধ করলেই কল্পনায় দেখছে একটা নরম বিছানায়, নরম বালিশে মাথা রেখে নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। পাশে আছে একটা তুলতুলে কোলবালিশ।
মাথা থেকে ব্যাপার টা যাচ্ছেই না কোনো ভাবে। অভ্রকে বলল, তুই কী কিছু একটা ব্যবস্থা করবি?

অভ্র আঁতকে উঠে বলল, আমার এতো বুদ্ধি নেই। তাই আই এ্যম স্যরি।

শুভ্র’র ভাগ্য সুপ্রসন্ন ছিল। ফরহাদ সাহেব মেয়ে জামাইয়ের খোঁজ নিতে এসেছেন। শুভ্র দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, ওয়াশরুমে যাওয়ার দরকার।
ফরহাদ সাহেব ব্যতিব্যস্ত তানির ঘরে শুভ্র কে পাঠালেন।

তানি বিছানায় চুপচাপ বসেছিল। দুইপাশে ওর ছোট দুই বোন বসা। হঠাৎই শুভ্র ঘরে ঢুকে বলল, ওয়াশরুম কোন দিকে?
এ বাড়িতে ঘরের সাথে লাগোয়া বাথরুম কেবল এই ঘরটাতে। এই ঘর সাবিনা আর তারিকের। তারিক তানির বড় ভাই।

শুভ্র কে দেখে অ্যানি আর মনি দুজনেই লাফিয়ে উঠলো। শুভ্র স্বাভাবিক গলায় বলল, তোমরা দুজন পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে আমাকে খুব দেখার চেষ্টা করেছিলে কিন্তু সাকসেসফুল হতে পারো নি। এই জন্য নিজে থেকেই বান্দা হাজির।

ঘটনার আকস্মিকতায় তানিসহ বাকী দুজন ও হকচকিয়ে গেল। মনি আমতা আমতা করে বলল, আপা আমরা যাই এখন।

তানির জবাবের অপেক্ষা না করে দুজনেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। শুভ্র বিছানায় বসতে বসতে বলল, তানি কেমন আছ?

তানি চমকে উঠলো। বলল, ভালো আপনি?

“আমিও ভালো। থ্যাংকস তানি। তুমি রাতে খেয়েছ? ”

তানি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল। শুভ্র বলল, তোমার মা’কে ধন্যবাদ জানাবে তানি। আমি এতো ভালো রান্না এর আগে কখনো খাই নি।

“আপনি অভুক্ত অবস্থায় খেয়েছেন তাই এমন মনে হচ্ছে। ”

“বাহ! তুমি তো দেখছি কথা বলতে পারো। আচ্ছা তুমি যে শাড়ী টা পরেছ সেটা কী রঙের?

তানি এই রঙের নাম জানেনা। নিচু গলায় বলল, জলপাই কালার।

“কাঁচা জলপাই?”

তানি করুন চোখে তাকালো। শুভ্র সে দৃষ্টি উপেক্ষা করে বলল,
“তানি তুমি এখন একটা ভয়ংকর কাজ করবে?”

তানি বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো। শুভ্র বলল, তুমি এখন উঠে দরজা আটকে দেবে। ফুল আনা পর্যন্ত আমি ওয়েট করতে পারছি না। এখন না ঘুমালে মরে যাব। এইটুকু ফেভার করো প্লিজ।

তানি শুভ্র’র কথামতো দরজা আটকে দিলো। শুভ্র বিছানায় শুয়ে বলল, থ্যাংকস তানি। এরজন্য তোমাকে পুরস্কৃত করা হবে কিন্তু।

তানি দাঁড়িয়ে রইলো। শুভ্র চোখ বন্ধ করলো। এখন অগ্রহায়ণ মাস। দিনের বেলা তেমন শীত না পড়লেও শেষ রাতে ঝাকিয়ে শীত পরে। তানি ওয়ারড্রব থেকে কম্বল বের করে শুভ্র’র পাশে রাখতেই শুভ্র বলল, তানি তোমার একমাত্র দেবর বাইরে আছে তার একটা ব্যবস্থা করো।

“জি আচ্ছা। আপনি চিন্তা করবেন না”।

“শুভ রাত্রি তানি”

তানি আস্তে করে বলল, গুড নাইট, সুইট ড্রিম।

শুভ্র বলল, তানি সাদামাটা সাজে তোমাকে জলপরীর মতো লাগছিলো। যদিও জলপরী দেখিনি তবুও এটা ছাড়া মাথায় কিছু আসলো না।
তানি মৃদু হাসলো। শুভ্র গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। ভারী নিঃশ্বাস পড়ছে।

তানি ভেবেছিল আজ রাতে শুভ্র কে জিজ্ঞেস করবে, আপনার কী আমাকে মনে আছে? ওই যে আমি একবার ড্রেনে পড়ে গিয়েছিলাম। আপনি আমাকে তুলেছিলেন হাত ধরে। আর যাওয়ার সময় আমার হৃদয় টা চুরি করে নিয়ে গিয়েছিলেন।

চলবে…..

কাছে কিবা দূরে পর্ব-০১

0

#কাছে_কিবা_দূরে
#পর্ব-১
সাবিকুন নাহার নিপা

সে অনেক বছর আগের ঘটনা। তানি সেবার প্রথম বড় হয়ে খালার বাসায় গেল। বড় খালা ঢাকায় থাকে। একদিন কী একটা কাজে একা বাইরে বেরিয়েছিল। কী বৃষ্টি ছিলো সেদিন। তানির তাড়াহুড়ো ছিলো ভীষণ। বেখেয়ালে হাটতে গিয়ে পড়ে গেল ড্রেনে। আশেপাশে অনেক লোক। কেউ কেউ খ্যাক খ্যাক করে হাসলো। কাছাকাছি চায়ের দোকানের লোকটা উঁকি দিয়ে দেখে কাজে মন দিলো। সেই দোকান থেকেই বেরিয়ে এসেছিল সুদর্শন, চমৎকার ছেলেটা। তানির তাকে এখনো মনে আছে। কতো আগের ঘটনা!

****
আজ তানির বিয়ে হবার কথা ছিলো। আড়ম্বরহীন বিয়ে। বরপক্ষের কয়েকজন লোক আসবে, বিয়ে পড়িয়ে খেয়েদেয়ে চলে যাবে। সেইমত সব আয়োজন করা হয়েছিল। তানির বাবা ফরহাদ সাহেব ত্রিশ জন মানুষের খাবারের আয়োজন করেছেন। বেছে বেছে লোক বলেছিলেন। সবাই এলেও বরপক্ষের কেউ আসেনি। তাদের আসার কথা ছিলো সকালে। ঢাকা থেকে আসবেন। বিয়ে হবার পর আবারও ফিরতি গাড়িতে রওনা হবেন। কিন্তু কারও টিকিটিও দেখা যায় নি।
ফরহাদ সাহেব হিসেবি মানুষ। তার জন্য এটা অনেক বড় লোকসান। সবচেয়ে বড় কথা হলো এই ঘটনা আজ নতুন নয়। এর আগেও দু’বার তানির বিয়ে ভেঙেছে। তবুও তিনি আশায় ছিলেন এবারের বিয়েটা হবে। ছেলের মা নিজে এসে তানিকে আংটি পরিয়ে গিয়েছিলেন। এমনকি গতকাল রাতেও কথা হয়েছে কিন্তু আজ ফোনে পর্যন্ত পাচ্ছেন না।
রাগে ফরহাদ সাহেবের মাথা কাজ করছে না। ইচ্ছে হচ্ছে মেয়ের গলা কেটে নদীতে ভাসিয়ে দিতে। মেয়ের কেলেঙ্কারির জন্য এসব হচ্ছে। তানির এটা দ্বিতীয় বিয়ে। এর আগে বিয়ে হয়েছিল কিন্তু টিকতে না পেরে আবার ফিরেও এসেছে। ফরহাদ সাহেব মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন কিন্তু তিনি একবারও ভাবেন নি যে তানির এই একটা ভুল তাদের সকলের ঘুম হারাম করে দেবে। তানি ছাড়াও ফরহাদ সাহেবের আরও দুটি মেয়ে আছে। অ্যানি আর মনি। অ্যানির বিয়েটা আটকে আছে তানির জন্য। এদিকে মনিরও বিয়ের বয়স হতে চলেছে। তাই বিয়েটা দেয়া জরুরী ছিলো। ফরহাদ সাহেব এতোকাল পাত্র খুঁজেছেন বয়স্ক, বৌ মারা গেছে এমন কিন্তু সেসব পাত্রও শেষ পর্যন্ত তানিকে বিয়ে করতে রাজি হয় নি। এর একটা কারণ হলো তানি সুন্দরী। সুন্দরী মেয়ে তার উপর প্রথম বিয়ে ভেঙেছে তাই সকলের ই ধারণা এসব মেয়ে সংসার করার মতো না। আবার আরেকদল ভাবে এসব মেয়েদের জন্ম হয়েছে অ্যাকুরিয়ামে থাকার জন্য, রান্নাঘরের হাতা খুন্তি এদের জন্য নয়। তবুও শেষমেস ভালো পাত্র পাওয়া গেছিলো। পাত্র একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির টিচার। তার বউ মারা গেছে। সম্ভ্রান্ত ফ্যামিলির ছেলে। পাত্রের মা তানিকে দেখেছে রাস্তায়। তিনি মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিল তখন তানি তাকে সাহায্য করেছে। ভদ্রমহিলা নিজে এসে করজোড়ে মেয়েটাকে ছেলের জন্য চেয়েছেন। ফরহাদ সাহেব ও খুশিমনে মেনে নিয়েছেন। এর আগে যেখানে বিয়ে হয়েছিল সেখানকার ছেলেটাও ভালো ছিলো। বয়স অল্প, বুদ্ধিমান, পরিশ্রমী ছেলে কিন্তু তানি সেখানে সংসার করতে পারেনি। তার জন্য তিনি অনেক অপদস্ত হয়েছেন কিন্তু মেয়েকে ফেলতে পারেনি। কারণ তানির মা তার ছেলেমেয়েদের মধ্যে তানিকে স্নেহ করেন বেশী। সেই অপত্য স্নেহের কাছে ফরহাদ সাহেব কেও হার মেনে নিতে হয়েছে।

*****
“আম্মা শুনেন, রোজ রোজ এইসব বিয়ের নাটক করে টাকা পয়সা খুইয়ে কোনো লাভ নাই। ওই মেয়েকে কেউ বিয়ে করবে না”।

তাসলিমা বেগম শুকনো গলায় বলল, তানি কই আছে এখন?

সাবিনা রুক্ষ গলায় বলল, কই আর থাকবে? ছাদে যাইয়া বইসা আছে।

“সাজগোজ ধুইয়া ফালাইছে?”

“হ্যাঁ। খালি খালি দুইটা হাজার টাকা পানিতে গেল। আপনাগো টাকা বেশী হইছে তা বোঝা যাইতেছে”।

তাসলিমা ছেলের বউকে কিছু বললেন না। মেয়েটার কাছে যাওয়া দরকার কিন্তু শরীরে কুলোচ্ছে না। কাল রাত থেকে রান্নাবান্নার যোগাড় যন্ত থেকে দুপুর পর্যন্ত একটানা কাজ করে গেছেন। তার উপর আসর হয়ে গেল কিন্তু বরপক্ষের খবর নেই।
মেয়েটার কপাল টা এতো খারাপ কেন সেটা ভেবেই তাসলিমার রাতে ঘুম হয় না। অথচ তার পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে সবচেয়ে ভালো আর শান্ত শিষ্ট এটি। অথচ তার কপালেই ভোগান্তি লেগে থাকে। প্রথম বার বিয়ে হলো ইউনিভার্সিটি তে পড়া অবস্থায়। সে বিয়ে টিকলো না। আর এখন বিয়ে ঠিক হবার পরও কোনো না কোনো বাহানায় বিয়ে ভেঙে যায়। তাসলিমা উঠে দাঁড়ালো। মেয়ের আজ দুঃখের দিন। এই দিনে তার পাশে থাকা অবশ্যই দরকার। এখন ছাদে গিয়ে মেয়ের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদবেন। তবে যদি মেয়েটা একটু হালকা হয়।

———————— ————————

তানি বসে আছে ছাদের এক কোনে। বাড়িতে এখন এটাই সবচেয়ে নিরিবিলি জায়গা। একটু আগে হিম শীতল পানিতে গোসল করায় শীত শীত লাগছে। তানি হাতের মেহেদীর রঙ খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছে। মেহেদীর রঙ ফুটে ওঠায় তানির খালা বলেছিল, জামাই সোহাগি হবি তুই। অথচ তানির বিয়েটাই আজ হলো না। এই বিয়ে নিয়ে তানির অনেক আশা ছিলো। যে মহিলা তানির শাশুড়ী হবে তাকে ওর খুব পছন্দ হয়েছিল। এই মহিলা মাত্র এক দেখায় ই সবকিছু জেনেশুনে বলেছিল, আমার ছেলের বউ হবি মা? তোরে মাথায় করে রাখব। তানি মুগ্ধ হয়েছে ভদ্রমহিলার কথায়। নিজের মুখে কিছু না বললেও পরিবারের সম্মতিতে আপত্তি করে নি। তবে ইচ্ছে ছিলো হবু বরের সাথে একবার দেখা করে নিজের ব্যাপারে কথা বলবে। কিন্তু ভদ্রলোক দেখা করতে চাইলেন না। মায়ের পছন্দ ই নাকি তার পছন্দ।
তানির মনে হয়েছে ভদ্রলোকের আসলে বিয়েতে মত ছিলো না। মা’কে খুশি করতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু বিয়েটা করবে না সেটা জানিয়ে দেয়া ভালো ছিলো। এতে করে সবার ই সুবিধা হতো । তানি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ওর একটুও কান্না পাচ্ছে না। বিয়ে শব্দটা বরং ওর কাছে একটা আতংক। যে বিবাহিত জীবন একবার দেখে এসেছে তারপর বিয়ে করার ইচ্ছে মরে গেছে।

“এই তানি আপা কই তুই শিগগিরই নিচে আয়। বর আসছে।”

ছোট বোনের কথা শুনে তানির নিঃশ্বাস বন্ধ হবার উপক্রম হলো। কী বলছে! বর আসলো অথচ ও গাড়ির শব্দ পেল না!

তানি হেলেদুলে নিচে নামতে লাগলো। হাত, পা অনবরত কাঁপছে। তাসলিমা মেয়েকে দেখতেই বলল, ক্যান যে সাজগোজ ধুইয়া ফেললি! এখন জামাইর সামনে ক্যামনে যাবি।

সাবিনা চাপা গলায় বলল, আম্মা জামাই তো এখনই তানির সাথে দেখা করতে চায়।

ঘটনার আকস্মিকতায় তানি হকচকিয়ে গেল। সবকিছু এতো তাড়াতাড়ি ঘটছে যে তানির বুদ্ধিসুদ্ধি লোপ পেল। হবু বরের সামনে গেল উল্টো জামা পড়ে। বেখায়েলে যে তখন উল্টো জামা পরেছে সেটা তখন কেউ খেয়াল করে নি।

***
“তানি আমিই আহনাফ শুভ্র। আমার সাথেই আজ আপনার বিয়ে হবে “।

তানি মাথা নাড়লো।

“তানি আপনি কিছু মনে করবেন না। আসলে আমরা পথে একটা বড় দূর্ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি। ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে সব খুইয়েছি তাই কোনোভাবে আপনাদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় নি। আপনি প্লিজ এর জন্য আমাদের ক্ষমা করবেন। ”

তানির কানে কিছুই ঢুকলো না। সে বিস্ময়ে হা হয়ে আছে। এই তো.. এই তো সেই লোক! বৃষ্টির দিন! ম্যানহোলে পড়ে যাওয়া! হাত ধরে ওঠানো! সেই মানুষ টা। আশ্চর্য….!

তানিকে চুপ থাকতে দেখে শুভ্র বলল, তানি আপনি কী ক্ষমা করেছেন? যদি করে থাকেন তাহলে প্লিজ কিছু খাবার ব্যবস্থা করুন। নাহলে অভুক্ত অবস্থায় যাকে সামনে পাব তাকেই খেতে ইচ্ছে করবে।

চলবে…..

কাঁটাকম্পাস পর্ব-৫২ এবং শেষ পর্ব

0

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৫২

#আরশিয়া_জান্নাত

নাহিয়ান তার বাবা-মায়ের রুম থেকে অনেকটা হতাশ হয়ে নিজের রুমের দিকে গেল। তার বাবা নূর মোহাম্মদ এই ব্যাপারটা সহজে মানবেন না এ তাঁর জানাই ছিল। কিন্তু সুযোগে তিনি তার মনের বিষ এতোটা ছড়াবেন নাহিয়ান বুঝতে পারেনি। নাহিয়ানের মনপ্রাণ ভারাক্রান্ত হয়ে উঠে, নিজেকে খুব অসহায় লাগছে বলা বাহুল্য। তবে সে তার সিদ্ধান্তে অটল। আজ এতো বছর পর সাবার চোখেমুখে যে উচ্ছ্বাস সে দেখেছে তা হারানোর কথা সে ভাবতেও চায় না। মাতৃত্ব আসলেই খুব সুন্দর। সাবাকে দেখে মনেই হচ্ছে না তার কোলের শিশুটার তার ঔরসজাত নয়। বরং মনে হচ্ছে এ তাঁর ই সন্তান। নাহিয়ান দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে সাবা ওকে নিয়ে এ কাত হয়ে শুয়ে আছে। এই সাধারণ দৃশ্যটা দেখার জন্য কত সহস্র কাল অপেক্ষা করেছে সে! সাবা ওকে দেখে খুব সতর্কতার সাথে আলগোছে উঠে আসলো। ফিসফিস করে বললো,”শব্দ করোনা, বহুকষ্টে ঘুম পাড়িয়েছি।”

নাহিয়ান পা টিপে টিপে খাটের সামনে গেল, উপুড় হয়ে ঘুমন্ত পরীর দিকে চেয়ে নরম গলায় বললো,”আমার বাবাইটা ঘুমিয়ে পড়েছে!”

সাবা ওর পাশে দাঁড়িয়ে বললো,”ওর নাম কি রাখবে ঠিক করেছ?”

“হুম। ওর নাম হবে লিয়ানা আফরিন সানা!”

“সানা! সাবা নাহিয়ান মিক্সড?”

“হুম তবে অর্থ টাও সুন্দর। এর অর্থ পবিত্র ও আমাদের কাছে ভীষণ পবিত্র!”

আরওয়া ঘুমের মাঝেই একটু পরপর নিজের হাত পা ম্যাসাজ করছে। জাওয়াদ ব্যাপারটা লক্ষ্য করে বুঝলো আজ সারাদিন ছোটাছুটি করার দরুন ওর হাত পা ব্যথা করছে। ল্যাপটপ রেখে সে উঠে সে কিচেনে গেল, কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করে সরিষার তেল আর রসুন গরম করে একটা বাটিতে নিয়ে রুমে এসে দরজা লক করলো। তেলটা হালকা ঠান্ডা করে আরওয়ার পায়ে ম্যাসাজ করে দিতেই আরওয়ার ঘুম ভেঙ্গে গেল।

“আল্লাহ! এ কি করছেন আপনি?”

“কথা না বলে চুপচাপ ঘুমাও তো।”

“এই আপনি আমার পায়ে তেল মালিশ করছেন! দেখি রাখুন আমি নিজে করে নিবো।”

“কেন? আমি করে দিলে সমস্যা কী?”

“আপনি আমার বড় না! আপনি আমার পা ছুঁবেন কেন!”

“উফ অহেতুক কথা রাখো। তুমি আরাম করে ঘুমাও। সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখবে ব্যথা একদম গায়েব হয়ে গেছে।”

আরওয়া জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। জাওয়াদ খুব যত্নের সাথে ওর হাতেপায়ে তেল ঘষে দোয়া পড়ে ফুঁ দিচ্ছে ঠিক দাদীজানের মতো।

“এই শুনুন?”

“হুম বলো?”

“ভালোবাসি!”

“জানি…”

“জানলেই হবেনা, জবাব দিতে হবে।”

“ভালোবাসি কি প্রশ্ন নাকি যে জবাব দিতে হবে?”

“আপনি কখনো আমাকে এটা বলেন না কেন? বললে কী ক্ষতি হয়?”

জাওয়াদ ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,”তোমার বুঝে নিতে কষ্ট হয়?”

“সবসময় বুঝে নিতে পারবোনা, মাঝেমধ্যে মনের কথা মুখে বলতে হয়।”

“আমার সেটা মনে হয় না, মনের কথা মুখে বলে দায়সারা হওয়ার চেয়ে কাজেকর্মে প্রকাশ করে জিইয়ে রাখাই আমার অধিক প্রিয়।”

“আপনি সবকিছু তে ইউনিক,হাহ!”

রিজভী সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর থেকেই মুখ গোমড়া করে বসে আছে। মনমেজাজ এতো খারাপ কেন কে জানে! আজ তার বিয়ে কোথায় সে খুশীতে নাচবে তা না নড়তেও মন চাইছে না। এইরকম হবার রহস্য কী?
রিজভী ফোন হাতে নিয়ে পাপিয়া কে কল দিলো।বেশ কয়েকবার রিং হবার পর ও কল রিসিভ হলোনা, এই মেয়েটা করছে টা কী! এমন ভাব ধরছে যেন বিয়ের সব কাজ ও একা করছে কারো কল ধরার পর্যন্ত সময় নেই! যত্তসব ঢং!
আধা ঘন্টা পর পাপিয়া কল ব্যাক করে ব্যস্ত গলায় বললো,” কি রে কেন কল দিয়েছিলি?”

রিজভী নিরস গলায় বললো,”হবু বরের সাথে দু’টো মিষ্টি কথা বলার ফুরসত তোর নেই দেখছি! আমি বলেই বেঁচে গেলি রে, নয়তো পরের ছেলে জীবনেও এমন ভেজিটেবল মনোভাব দেখানো মেয়েকে বিয়ে করতোনা।”

“তোর কথা শুনলে মনে হয় আমাকে তুই বিয়ে করে বড় মেহেরবানী করছিস। তুই ছাড়া অন্য কেউ আমায় বিয়েই করতো না?”

“আমি সেটা বললাম কখন? দেখ অযথা ঝগড়া বাঁধিয়ে আমার বাসর নষ্ট করার পরিকল্পনা করিস না বলে দিচ্ছি। তোর মান অভিমান ভাঙাতে ভাঙাতে এনার্জি শেষ করতে পারবোনা।”

পাপিয়া বিরক্ত হয়ে বললো,”রিজভী তোর আজাইরা প্যাঁচাল বন্ধ করবি? কাজের কথা থাকলে বল নাহয় রাখছি। আমি তোর মতো হুদা কাজে বসে নেই।”

“কি বললি তুই আমি আজাইরা প্যাঁচাল পাড়ি?হুদাই বসে আছি? তুই জানোস আমার কত কাজ আজকে? কি অমানুষিক পরিশ্রম করতে হবে আমার তোর আইডিয়াও নেই! অবশ্য মেয়েরা এসব বুঝবেনা। যাক তোকে একটা জরুরী কথা বলতে ফোন করেছিলাম। ”

“জ্বি বলে উদ্ধার করেন!”

রিজভী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, “বেশি কাজকর্ম করে টায়ার্ড হইস না। এনার্জেটিক থাকিস কিন্তু!”

পাপিয়া গালি দিয়ে বলল,”তুই ভালো হবি না!”

“ওরেহ তুই গালিও পারোস! ওয়াও! এই ট্যালেন্টটা এতো দিন দেখি নাই আমি। এই আর কী কী জানিস রে? এমন নয়তো আমি তোকে বোকারাণী ভেবে বসে আছি, কিন্তু তুই ভেতরে ভেতরে ঝুনা নারকেল!”

“নিজেকে অতি চালাক ভাবা বন্ধ কর। বোর লাগলে রুমের বাইরে যা কাজে হাত লাগা। অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। তোর চারপাশে শয়তান ঘুরতেছে, বি কেয়ারফুল।”

রিজভী হেহে করে হাসতে লাগলো। হাসতে হাসতে বলল,”দোস্ত আমি তোরে অনেক মিস করবো রে। আমাকে গুড লাক উইশ করবি না? আমি যেন এই পৃথিবীর বেস্ট রোমান্টিক বর হতে পারি!”

পাপিয়া খট করে কল কেটে দিলো। এই ছেলের মাথায় আসলেই সিট আছে! কেন যে সে এই বদকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিলো কে জানে!

বেশ জমকালো আয়োজনের মাধ্যমেই পাপিয়া আর রিজভীর বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলো। ওকে বিদায় দিয়ে সবাই যখন বাসায় ফিরলো রাত প্রায় ১টা বাজে। রোকেয়া আর জহির সাহেব পাশাপাশি বসে আছেন। কন্যা বিদায় দিয়ে তাদের মন বিষাদে ভরে আছে বৈ কি। মেয়েরা কেন যে দু’দিনের অতিথি হয়ে জন্মায়। আদরের মধ্যমণি হয়ে বুকের মাঝে বড় হয়ে উঠে, তারপর সেই বুকে পাথর বেঁধে তাকে পরের ঘরে পাঠিয়ে দিতে হয়। এই চক্রের উৎপত্তি কেন যে ঘটলো? জহির সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,”মনে আছে রোকেয়া পাপিয়া ছোটবেলায় কী বলতো? ও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অভিনয় করতে করতে বলতো, আমাকে যদি বিয়ে দেওয়ার কথা কারো মাথাতেও আসে, এই সংসারে আমি ব্যাপক আগুন লাগিয়ে দিবো! হাহাহা…”

রোকেয়া আর্দ্র চোখে হেসে বললেন,”হ্যাঁ সাপলুডু নাটক টা দেখে দেখে ও তখন এই ডায়লগটা মুখস্থ করেছিল। যাই হতো বলতো ব্যাপক আগুন লাগিয়ে দিবো!”

“আল্লাহ আমার সন্তানদের সুখী করুন, এই কামনাই করি।”

ফুলে ফুলে সাজানো বিছানায় পাপিয়া ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। রিজভী ওর ঘোমটার নীচে উঁকি দিয়ে বললো,”টুকি!”

পাপিয়া ঘোমটা তুলে বললো, “এতোক্ষণ কই ছিলি? ঘুমে আমার চোখ ফেঁটে যাচ্ছে আর জনাব এসে বলে টুকি!”

“ছি ছি পাপিয়া! বরকে কেউ তুই তোকারি করে? কোথায় এসে আমার কদমবুসি করবি, সব বলে বলে শেখাতে হবে দেখছি!”

পাপিয়া আড়মোড়া ভেঙে বললো,”তোর সাথে ফরমালিটি দেখাতে আমার বয়েই গেছে। দেখি সর, আমি চেইঞ্জ করবো।”

“চেইঞ্জ করবি মানে! সুন্দর লাগছে তো,,”

“সুন্দর লাগলে কী করবো? এই ভারী সাজে সারারাত বসে থাকবো?”

“তো থাকবি না? বাসররাত কী জীবনে বারবার আসে নাকি?”

পাপিয়া লাগেজ থেকে কাপড় বের করে বললো, “তোর ইচ্ছে হলে সারারাত শেরওয়ানি আর পাগড়ি পড়ে বসে থাক। মানা করলো কে?”

“এজন্যই বেস্ট ফ্রেন্ড কে বিয়ে করতে নেই। এরা এটকুও দাম দেয় না। অন্য মেয়ে বিয়ে করলে এতোক্ষণে এক রাউন্ড হয়ে যেত…..”

পাপিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল,”সবসময় বোল্ড কথা বললে কাউকে কুল লাগেনা।”

রিজভী ওর হাত ধরে টেনে নিজের কাছে এনে বলল,”আমি শুধু কথায় না কাজেকর্মেও ভীষণ বোল্ড। তোর কী হবে রে এবার?”

পাপিয়া ভেংচি কেটে বললো, “যত্তসব হুমকি ধামকি তোর, এমন ভাব করিস যেন বাঘ না ভাল্লুক!”

রিজভী হেসে তাকে কোলে তুলে বললো,”সে তুই যা ইচ্ছে বলতে পারিস আমি একটুও রাগ করবো না। আজকে রিজভী শুধু ভালোবাসবে, আদর করবে। রাগ করে সময় নষ্ট করবে না….”

পাপিয়া দু’হাতে ওর চোখ ঢেকে বললো,”এমন অদ্ভুত ভাবে তাকানোর মানে কী আজিব!”

“উফফ এটাকে অদ্ভুত তাকানো বলে না বলদি। এটাকে বলে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকানো, প্রেমময় দৃষ্টিতে তাকানো।”

জাওয়াদ আর আরওয়া রেজোর্টের লনে বসা। আরওয়া তার বাহু আঁকড়ে কাঁধে মাথা রেখে সামনের ছোট লেকে হাঁসদের চড়ে বেড়ানো দেখছে। কী সুন্দর তারা চড়ে বেড়াচ্ছে উপর থেকে বোঝা যায় না যে তারা সাঁতার কাটছে।
নিরবতা ভেঙ্গে জাওয়াদ বললো,”বললে না তো হঠাৎ এতো তোড়জোড় করে এখানে আসতে চাইলে কেন?”

“এমনি ইচ্ছে হলো আপনার সঙ্গে সময় কাটানোর তাই।”

“আমার তো সেটা মনে হচ্ছে না। কী চলছে তোমার মনে বলবা?”

আরওয়া ওর গালে চুমু খেয়ে বললো,”আমরা দুজন থেকে ৩জন হতে চলেছি….”

জাওয়াদ স্তব্ধ হয়ে চেয়ে রইলো আরওয়ার দিকে। অবিশ্বাস্য গলায় বলল,” সত্যি বলছো!”

“নাহ মিথ্যে বলছি!”

“আরওয়া! সত্যি আমি বাবা হতে চলেছি? আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না!”

আরওয়া নাক ফুলিয়ে বললো, “অবিশ্বাস হবার কী আছে?আমি অযথা মিথ্যা বলবো কেন হু?”

জাওয়াদ ওকে বুকে জড়িয়ে বললো,”আমি সেটা বলি‌নি পাগলি! আমার এতো আনন্দ হচ্ছে না আমি বলে বোঝাতে পারবোনা…”

আরওয়া ওর বুকের মাঝে মুখ লুকিয়ে হাসতে লাগলো।

🌿🌿🌿🌿🌿🌿🌿🌿🌿🌿🌿

পরিশিষ্ট: সানা হসপিটালের করিডরে বসে একটু পরপর বলছে, বাবাই আমার ভাই কখন আসবে? আর কত অপেক্ষা করবো? নাহিয়ান নিজেও অস্থিরভাবে পায়চারি করছে। অপেক্ষার সময়টা শেষ হবে কখন কে জানে? সে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,”আল্লাহ আল্লাহ করো মামণি, যেন তোমার আম্মু এবং ভাইয়া দুজনেই সুস্থ থাকে। সানা দু’হাতে মোনাজাত তুলে দোয়া করতে লাগলো।

কুহু বকা দিতে দিতে বললো,”তুমি এতো অবিবেচক কীভাবে? বললাম হসপিটালে আছি সবার জন্য হালকা খাবার নিয়ে আসো। আর তুমি কী না কাচ্চি নিয়ে এলে? এখানে টেনশনের মাঝে সবাই কাচ্চি খাবে?”

ইশরাক ঠোঁট চওড়া করে হেসে বললো, “আরেহ বোঝো না কেন কোনো সেলিব্রেশন কী কাচ্চি ছাড়া হয়? একটু পর তুমি নিজেও আমার প্রশংসা করবে দেখে নিও।”

“তোমার তো শুধু বাহানা চাই কাচ্চি খাওয়ার।”

রিজভী হালকা খাবার সঙ্গে করে এনে বললো,”আপু দুলাভাই কিন্তু ঠিকই বলেছে। আজকে এমন খুশির দিন কাচ্চি ছাড়া জমে নাকি?”

পাপিয়া–“একদম ঠিক!”

জাওয়াদ অফিস থেকে সোজা স্কুলে গেল। আরওয়া বারবার করে বলে দিয়েছে ১১:১৫তে স্কুল ছুটি হবে এক মিনিট ও যেন‌ এদিক সেদিক না হয়। জাওয়াদ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল, যাক হাতে এখনো ৪মিনিট সময় আছে সে লেট হয় নি। গেইটের কাছে দাঁড়ানোর কিছু ক্ষণ পরেই ছুটির ঘন্টা বেজে উঠে। গুটিগুটি পায়ে জায়রা চারদিক চেয়ে বাবাকে দেখে হাসলো। দৌড়ে এসে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়তে ই জাওয়াদ ওকে কোলে তুলে আদর করল। জায়রা বাবার ঘড়ির দেখিয়ে বললো,”আজকে তুমি একদম ঠিক সময়ে এসেছ বাবা! আম্মু তোমাকে একটুও বকতে পারবেনা..”

জাওয়াদ হেসে বললো,”হুম প্রিন্সেস। তাড়াতাড়ি বাসায় চলো।”

জায়রা আবদারের ভঙ্গিতে বাবার দিকে তাকাতেই জাওয়াদ আইসক্রিমের গাড়ি দেখে বললো,”উহু আজ নয়। তোমার এমনিতেই সর্দি লেগে আছে আম্মু। সুস্থ হয়ে উঠলে সত্যিই খাওয়াবো..”

“পিংকি প্রমিজ?”

“পিংকি প্রমিজ।”

ঘর ভর্তি মেহমান, এখন আর বাইরের আত্মীয় আসতে হয়না, ঢাকার সবাই এলেই উৎসবমুখর অবস্থা হয়ে যায়। সাবা নাহিয়ানের ছেলে হবার খবর শুনে সবাই সকাল সকাল চলে এসেছে। তাদের খাতিরযত্নে যেন ত্রুটি না হয় সেইদিকে আরওয়ার সতর্ক দৃষ্টি। কোহিনুর বেগম তো একবার বাইরে যাচ্ছেন একবার ভেতরে আসছেন। কখন তার নাতি আসবে কখন তিনি তাদের ঘরে তুলবেন সেই খুশিতে তিনি পাগলপারা। জাওয়াদ জায়রাকে নিয়ে আরওয়ার কাছে যেতেই আরওয়া ওকে রুমে নিয়ে চেইঞ্জ করালো, জাওয়াদ সেই ফাঁকে তাঁকে খাবার খাওয়াতে লাগলো। জায়রা বললো,”আম্মু ছোট্ট ভাইয়া কখন আসবে?আমি তো ভেবেছিলাম এসে দেখবো সবাই চলে এসেছে।”

“একটু পরেই আসবে। তুমি ঠিকমতো সব ব্যাগে রেখেছিলে তো?”

“হুম।”

“গুড। এখন নাস্তা খেয়ে নীচে এসো কেমন? আম্মুর অনেক কাজ বাকি আছে।”

জায়রা বাবার হাতে নাস্তা খেয়ে দাদীর কাছে ছুটলো। আরওয়া ওর জন্য শরবত এনে টেবিলে রাখতেই জাওয়াদ ওর কোমড় জড়িয়ে বললো,”এতো ছুটছো কেন হুম? অন্যরা আছে তো সব দেখার জন্য। স্থির হয়ে বসো তো।”

আরওয়া ওর হাতের উপর হাত রেখে বলল,”বড় ভাবির অবর্তমানে আমাকেই তো সব দেখতে হবে তাই না? আর সত্যি বলতে আমার আনন্দ লাগছে এসব করতে।”

জাওয়াদ ওর কাঁধে চুমু খেয়ে বললো,”আমার আরওয়াটা এখন পুরোদমে গিন্নি বনে গেল বটে!”

আরওয়া ওর গলা জড়িয়ে বললো,”তাই বুঝি!”

“হুম ঠিক তাই…. আচ্ছা তোমাকে কী একটা জরুরী কথা বলেছিলাম?”

“কী কথা?”

“বলিনি এখনো?”

“নাহ তো!”

জাওয়াদ ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,”তোমাকে আমি অনেক ভালবাসি জানো?”

আরওয়ার ঠোঁটে বিশ্ব জয়ের হাসি ফুটে উঠে। অবশেষে জনাব মুখে বললো তবে…..

#সমাপ্ত

কাঁটাকম্পাস পর্ব-৫১

0

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৫১

#আরশিয়া_জান্নাত

“বাচ্চাটা কার? কোত্থেকে এনেছ ওকে?”

“দাদাসাহেব, বাচ্চাটা যার ই হোক এখন থেকে সে আমাদের পরিচয়েই বড় হবে। আমি ওকে এডপ্ট করেছি।”

জোবায়ের সাহেব চেয়ারে বসে বললেন, “তোমার উত্তরাধিকার চাই? তবে ২য় বিয়ে করছো না কেন? আল্লাহর রহমতে তোমার সামর্থ্য আছে ২ স্ত্রীর ভরণপোষণ চালানোর। বাইরের কারো রক্ত না এনে নিজের অংশ পৃথিবীতে আনা অধিক শ্রেয়।”

“আমার পক্ষে সেটা করা সম্ভব না দাদাসাহেব। আমি সাবাকে ছাড়া কাউকে স্ত্রী বানাতে পারবো না।”

“সাবাকে রাখতে চাইছো, রাখো। আমি মানা করবো না। তবে আমার বাড়িতে বাইরের কারো সন্তান থাকবে এটা আমি মেনে নিবো না। এটা কোনো বিড়াল ছানা না যে শখের বশে তুলে এনেছি, লালন পালন করে বড় করবো। এটা মানুষ! মানুষ বড় বেঈমান জাতি। এদের যতোই আদর যত্নে বড় করো না কেন, পর কোনোদিন আপন হয় না।”

“একটা কথা কী জানেন দাদাসাহেব, আমাদের আপনরাও সবসময় আপনের মতো আচারণ করে না। খেয়াল করলে দেখবেন আপনভাইয়ের হাতে ভাই খু*ন হয়, সম্পত্তির জন্য সন্তান পিতাকে হ*ত্যা করে এমন নজিরও তো কম নেই। তাই বলে কী মানুষ সন্তানদের ভালোবাসা কমিয়ে দেয়? নাকি জন্মের পরপরই মে*রে ফেলে?”

“Exeption can’t be example!”

“পর আপন হয় না এটা পুরোপুরি সঠিক না। আসলে আমরা আপনের বেলা চোখে একটা পট্টি বেঁধে রাখি। তাই পিঠে ছোঁড়া ঠুকলেও বলি আপন ই তো! অথচ এই একই কাজ যদি পর কেউ করে তাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা কল্পনায় ও আনি না। আমি এই শিশুটিকে এনেছি আমি ওকে আদর যত্ন করে বড় করে তুলবো। অবশ্যই প্রতিদান আশা করা ছাড়া।”

জোবায়ের সাহেবে হেসে বললেন,”আবেগের বশে ভুল ভাবছো। মানুষ যতোই বলুক পার্থক্য করবে না, কিন্তু পার্থক্য চলেই আসে। আজ নাহয় কাল সাবা যদি কখনো মা হয় তখন এই শিশুকে উটকো ঝামেলাই মনে হবে! কিংবা তোমার ভাইবোনের সন্তানদের তুলনায় ওকে কম কাছের মনে হবে। এই বিভেদ কী ও টের পাবে না ভাবছো? আমি এমন অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়েছি। বেশি দূর কেন তোমার সাবিনা ফুফুকেই জিজ্ঞেস করো গিয়ে তার ভাসুর যে পালক ছেলে এনেছিল তার কী হাল এখন।”

নাহিয়ানকে নিরব দেখে জোবায়ের সাহেব বললেন, “তোমাদের আশা ভরসা সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যায়নি। এসব করে অন্যদের নিশ্চিত হতে দিচ্ছ কেন সাবা কোনোদিন মা হতে পারবেনা?”

“দাদাসাহেব বাচ্চাটার মা ওকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছেন।‌ ওর বাবাকে খবর দেওয়ার পর বলেছে ওকে কোনো এতিমখানায় দিয়ে দিতে। এমন ফুটফুটে নিষ্পাপ শিশুকে আমরা প্রতিপালন করলে কী খুব ক্ষতি হবে? এমনো তো হতে পারে ও আমাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।”

জোবায়ের সাহেব বুঝলেন নাহিয়ান কে বলে কাজ হবেনা। তাই তিনি হাল ছেড়ে বললেন,”তোমার যা ইচ্ছে তাই করো। আমার আর কিছু বলার নেই। তবে একটা কথা মাথায় রেখো আমি আমার নাতনির বিয়েতে কোনো হাঙ্গামা চাই না।”

নাহিয়ান তার ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে এগোলো। সে ভালো করেই জানে দাদাসাহেব মনের দিক থেকে নরম। কিন্তু ভেজাল বাধাবে ওর বাবা!

“নাহিয়ান এই মাথা নিয়ে কেমনে যে এতো বড় ডাক্তার হইছে বুঝি না। বলদ পোলা কোনাই তুই ওগ্গা সুন্দর চাই বয়তালি বিয়া করি পোলামাইয়ার বাপ হবি , হেতে গেছে কোন বেজন্মারে ঘরে তুইলতো। হাগল নি কোনো?”

“ইগ্গো চাচী বেশি মাতিয়েন না, ফরে আর বিয়া খাওন লাইগদো নো, হিচা দি ঠিডি বাইর করি দিবো। হেতে যে বৌ পাগল। বৌয়ের লাই মানুষ খু*ন কইরতেও সময় নিতো‌নো চাইয়েন”

“মাগ্গো মা ঠিকই কইছোস হুক্কি! আর তুন তো লাগে হেতেরে তাবিজ তুমার করি বচকাই রাইখছে। এন্নে এন্নে বাইজ্জা বেডির জামাই এতো বশে থায়ে?”

সাবা কথাগুলো শুনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। মানুষ কারো পেছনে কীভাবে এতো জঘন্য সমালোচনা করতে পারে! সাবার চোখ ভরে আসে নোনাজলে, এইটুকু শুনেই তার সহ্য হচ্ছেনা, এই ভরা বাড়িতে আরো কতজন আছে যারা ওর পেছনে এমন কত আজেবাজে কথা বলছে। ঐসব শুনলে ও আর বাঁচতে পারবে?
সাবা দ্রুত নিজের ঘরে চলে যায়। বাচ্চাটাকে বুকে চেপে অঝোরে কাঁদতে থাকে। “তবে কী ওকে দত্তক নেওয়া ওদের ভুল সিদ্ধান্ত ছিল?”

নূর মোহাম্মদ রাগান্বিত গলায় বললেন,”তুমি না বলেছিলে তোমার ছেলের উত্তরাধিকার চাই না? ওর বৌ নিয়েই ও খুশি? এই তার নমুনা? কার না কার বাচ্চাকে ঘরে তুলে এনেছে! বাপ হওয়ার এতো শখ যখন ওর আমার কথায় ক্ষেপছিল কেন?”

কোহিনুর ভীত গলায় বললেন, “আমি শুনেছি এমন পালক বাচ্চা আনলে হিংসা হিংসিতে বাচ্চা চলে আসে। আমাদের বাড়ির এক……”

“খবরদার বলতেছি আমাকে উল্টাপাল্টা কাহিনী শোনাতে আসবা না। আমার তো মনে হয় তুমিই এসব আজগুবি কথা শুনিয়ে শুনিয়ে ছেলেটার কান ভরেছ।”

পাপিয়ার হলুদের অনুষ্ঠান বলতে গেলে খুবই অশান্তির মধ্য দিয়েই হলো।

জাওয়াদ কফি মগ হাতে লনে আসতে দেখে জোবায়ের সাহেব চুপচাপ বসে আছেন। এই বাগানে তিনি সচরাচর আসেন না। এখানে আসলেই তার মনে পড়ে মেঝ ছেলেটা দারুণ মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও বুয়েটে না পড়ে কৃষিবিজ্ঞানে এডমিশন নিয়েছিল। সেই দিনটার তিক্ততা তিনি এতো বছরেও ভুলতে পারেন নি‌। তার ৫সন্তানের মধ্যে ২টা তার কলিজায় আঘাত করেছে। এক তার বড় মেয়ে আরেক মেঝ ছেলে। অতীত জীবনের স্মৃতিচারণে কেন জানি এই দুই ঘটনাই শেষ পর্যন্ত চলে আসেই। তিনি চাইলেও এই ব্যতিত সমাপ্তি ঘটাতে পারেন না।
জাওয়াদ নিঃশব্দে দাদার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। জোবায়ের সাহেব ওর দিকে এক পলক চেয়ে বললো, “তোমরা ফ্যামিলি প্ল্যানিং করছো না কেন? নাকি ঠিক করে রেখেছে সবাই মিলে বাইরে থেকে দত্তক এনে এনে আমার বংশ বিলুপ্ত করবে?”

জাওয়াদ বেঞ্চিতে বসে বললো,”যদি বিলুপ্ত হবার থাকে তবে শত শত উৎপাদন করেও লাভ হবে না। যা হবার তা হবেই…”

জোবায়ের সাহেব বিস্মিত দৃষ্টিতে জাওয়াদের দিকে তাকালেন। জাওয়াদ তাকে এরকম কিছু বলতে পারে এ যেন তার কল্পনাতীত! জাওয়াদ কফিতে চুমুক দিয়ে বলল,”একটা ছোট্ট প্রাণ, যে এখনো পৃথিবীর হিসাব-নিকাশ বোঝেনা, ওর আচার ব্যবহার কেমন হবে, ও কী ভালো হবে নাকি খারাপ হবে সেটা পর্যন্ত আমরা কেউ জানি না। অথচ আমরা কী সুন্দর হিসাব করে ফেলেছি ও পরের সন্তান মানেই ও খারাপ হবে সিওর! ওর জাত রক্ত নষ্ট এটাও নিশ্চিত। আসলেই কী ব্যাপারটা এমন দাদাসাহেব?”

জোবায়ের সাহেব অপ্রস্তুত গলায় বললেন,”আমি কখন বলেছি ওর জাত রক্ত নষ্ট! ”

“আমি তো বলিনি আপনি বলেছেন, আপনি বলেছেন নাকি?”

“নাহ! আমি কেন এসব অহেতুক কথা বলতে যাবো। আমি বলেছি ওর যা ইচ্ছে হয় করুক। আমার কী?”

“এটা আপনার ৩য় আফসোস হবেনা তো?”

জোবায়ের সাহেব গলা ঠিক করে বললেন, “এ জীবনে আমার কোনো আফসোস নেই। আল্লাহ আমাকে অনেক দিয়েছেন আলহামদুলিল্লাহ।সেসবের শোকর আদায় করেই তো কূল পাই না আফসোস করবো কখন!

“আপনার উপর আমার অনেক রাগ ছিল সেটা আপনার অজানা না। তবে এখন আমি আপনার নিকট কৃতজ্ঞ। থ্যাংক ইউ সো মাচ দাদাসাহেব! হয়তো আপনি সেদিন জোর না করলে আমি কখনোই আরওয়ার মতো মেয়েকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতাম না!”

জোবায়ের সাহেব তার কাঁধে হাত রেখে বললেন,”বলেছিলাম না সুযোগ দিয়ে দেখো, নিরাশ হবে না!”

“সুযোগ পাওয়ার অধিকার সবাই রাখে তাই না?।ওরা যখন চাইছে ওদেরকে সুযোগ দিন না? ঢাল হয়ে দাঁড়ান না ওদের সামনে? আপনি দাঁড়ালে এখানে কেউ আর কথা বলার সাহস পাবে না!”

জোবায়ের সাহেব নিরবে প্রস্থান করলেন।

“আমার একদম ভালো লাগছে না ভাবি! দেখো একটা ছবিও কারো ভালো আসেনি। সবার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে যেন মরা বাড়িতে এসেছে! দিস ইজ নট ফেয়ার!!”

আরওয়া লাগেজে চেইন আটকাতে আটকাতে বললো, “আসলেই ছবিগুলো ভয়ঙ্কর লাগছে! তবে পজিটিভলিও বলতে পারো, আদরের মেয়েকে বিদায় করার ভাবনায় সবাই গ্লুমি হয়ে আছে।”

“আমার ভাগ্যটাই আসলে খারাপ। কুহু আপুর বিয়ের সময় কত মজা হয়েছে। আমরা কত আনন্দ করেছি, হৈ চৈ করেছি। আর আমার বেলা…..ওরা এখনই কেন এসব করতে গেল বলো তো? ক’টা দিন অপেক্ষা করা গেল না?”

কুহু ওর মাথায় গাট্টি মেরে বলল,”নাকি কান্না থামা তো। আমার বিয়ে আমার বিয়ে বলে বলে কেমন ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদছিস ছি!”

“তুই তো বলবিই! নিজের বিয়ে তো এমন হয় নি। পছন্দের ছেলের সাথে নাচতে নাচতে চলে গেছ, হলুদেও কত রং ঢং করে নাচলা। আর আমার বেলা কী করছো?”

“এমন ভাবে বলছিস যেন তোরটা অপছন্দের কারো সাথে হচ্ছে? তুই ও নাচতে নাচতে যা না ধরে রাখছে কে?”

“তুই আমার দুঃখ বুঝবি না, বোনেরা বিয়ের পর এমনিতেই পর হয়ে যায়। আর তুই তো বিয়ের আগে আমার সৎবোন ছিলি!”

কুহু হাই তুলে বললো,”এসব ঝগড়াঝাটি বাদ দে, আমার অনেক ঘুম পাচ্ছে, দেখি সর ঘুমাই।”

“তুই আমার রুমে কেন ঘুমাবি? তোর রুমে যা।”

“আমার রুমে জায়গা নেই। কাদের আন্ডাবাচ্চা সব আমার বিছানায় ঘুমাচ্ছে কে জানে। এখন ওদের মা খুঁজে খুঁজে এনে ওদের তুলবো এতো সময় আমার নাই।”

“দুলাভাই কোথায়?”

“বাসায় চলে গেছে। আমাকেও বলছিল যেতে, পরে ভাবলাম এ বাড়িতে তোর আজ শেষ দিন। দয়া দেখিয়ে থেকেই যাই। আবার কবে না কবে একসাথে ঘুমানোর সুযোগ হয়!”

“আপু দেখো আর কিছু নেওয়া বাকী আছে কি না। তারপর লক করে দিও। তোমাদের আর কিছু লাগবে?”

কুহু বললো,”অনেক খেটেছ গো মনু, যাও এখন গিয়ে ঘুমাও।”

“গুড নাইট!”

“গুড নাইট”

আরওয়া দরজা আটকে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলো। আজকের দিনটা অনেক লম্বা কেটেছে যেন। কত কী ঘটলো সেই সকাল থেকে। এখন বিছানায় গা এলিয়ে ঘুম দিতে পারলেই শান্তি…

চলবে,,,,

কাঁটাকম্পাস পর্ব-৫০

0

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৫০

#আরশিয়া_জান্নাত

পাপিয়া জানালার ধারে বসে আছে। রিজভী সামিয়াকে পাগলের মতো ভালোবাসতো এ তাদের কারোই অজানা নয়। ৪বছরের ভালোবাসা ভুলে যাওয়া এতো সহজ না। এটা সে ভালোভাবেই জানে। তবুও মেয়েদের মন অভিমানী হয়। যার সঙ্গে জীবনের বাকী অংশ একসঙ্গে কাটানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তার চোখে অন্য নারীর জন্য বিষাদ দেখা সহ্য করা কঠিন বৈকি! পাপিয়া যতোই মনকে বুঝ দিক কোথাও না কোথাও ওর ঠিকই মনে হয় ও কেন প্রথম নারী হলো না!

রোকেয়া মেয়েকে আমের আচার দিতে এসে দেখলো পাপিয়া মুখ ভার করে বসে আছে। তার মেয়ে এমন চুপচাপ বসে থাকার মতো না, তবে কি কোনো কারণে মন খারাপ? অবশ্য দু’দিন পর যার বিয়ে তার মনে মেঘ থাকা অস্বাভাবিক না। এতোদিনের চেনা গন্ডি পেরিয়ে নতুন পরিবারে জীবন গুছিয়ে নেওয়া, সবকিছু নতুন করে শুরু করা এতো সহজ না। তাই স্বভাবতই আনন্দের চেয়ে ভয় ভীতি ও দুঃখটাই বেশি অনুভূত হয়। রোকেয়া মেয়ে কাঁধে হাত রেখে বলল, “কিরে এমন মূর্তির মতো বসে আছিস কেন? ধ্যান করছিস নাকি!”

পাপিয়া মায়ের হাত ধরে সামনে বসালো। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলল, “তোমাকে অনেক জ্বালাই তাই না আম্মু!”

“হঠাৎ এইকথা কেন বলছিস? বিয়ের আগে সব হিসাব নিকাশ চুকাবি নাকি?”

“নাহ! তোমাদের কাছে আমি আজীবন ঋণী থাকতে চাই।”

“আচ্ছা থাকিস! নে আচার খা, তোর খালা পাঠিয়েছে তোর‌ জন্য।”

পাপিয়া আয়েশ করে আচার খেতে লাগলো, রোকেয়া মেয়ের দিকে স্নেহার্দ্র দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, “আল্লাহ ওকে সুখী করো!”

নাহিয়ান রাউন্ড শেষ করে কেবিনে এসে দেখে সাবা ওর চেয়ারে বসে আছে। নাহিয়ান হেসে বলে, “কী সৌভাগ্য আমার মিসেস খন্দকার আমার কেবিনে এলেন যে!”

সাবা চেয়ারে দোল খেতে খেতে বললো, “দেখতে এলাম আসলেই ঠিকঠাক চিকিৎসা করছো, নাকি হসপিটালে ফাঁকিবাজি করে দিন কাটাও!”

নাহিয়ান হ্যান্ড সেনিটাইজার দিয়ে হাত ক্লিন করে বললো,” হতে পারি একটু আড্ডাবাজ তাই বলে ফাঁকিবাজ নই ম্যাডাম! চাইলে ডিটেক্টিভ দিয়ে খোঁজ নিতে পারেন।”

“তাই না!”

“জ্বি ঠিক তাই।”

ডক্টর তারিন দরজায় নক করে বললো,”আসতে পারি?”

সাবা হেসে বললো,”আসো আপু। কেমন আছ?”

“ভালো আছি, তুমি ভালো তো? ”

“আলহামদুলিল্লাহ।”

নাহিয়ান চায়ের অর্ডার দিয়ে চেয়ারে বসলো।তারিন অপর চেয়ারে বসে বললো, “জীবন খুব অদ্ভুত গল্পের নাম।”

“তা তো বটেই!”

নাহিয়ান বলল,” হঠাৎ দর্শন নিয়ে বসলি কেন? কিছু হয়েছে আবার?”

তারিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,”আমার ওয়ার্ডে একটা ডেলিভারি পেশেন্ট এসেছে গতকাল। বেচারি একা একাই ভর্তি হয়েছে। ওর সাথে কেউ আসে নি। ফ্যামিলি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেই বললো, ওর বাবা-মা কেউ নেই। মামার বাসায় বড় হয়েছে। পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছে। কিন্তু হাজবেন্ড সুবিধার না।”

“আহারে বেচারি! এমন কঠিন সময় একা সব হ্যান্ডেল করছে।”

“হুম আসলেই। আচ্ছা সাবা শোনো, আমি এখন রাউন্ডে যাবো। এসেই তোমাকে চেকাপ করবো কেমন? অপেক্ষা করতে অসুবিধা হবেনা তো?”

নাহিয়ান বললো,”অসুবিধা অবশ্যই আছে, আগে থেকে এপয়েন্টমেন্ট দিয়েও যদি অপেক্ষা করতে হয় তাহলে লাভ কী হলো? ”

“তুই মাঝখানে ঢুকিস না, এটা আমাদের ভাবি ননদের ব্যাপার”

“আপু তুমি যাও, সমস্যা নেই আমি আছি।”

জাওয়াদ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ফের দরজার দিকে তাকালো। না এখনো তানভির আসছেনা।ও কি আদৌ আসবে নাকি অযথাই বসিয়ে রাখছে কে জানে। জাওয়াদ ৩য় বার কফি অর্ডার করে সিদ্ধান্ত নিলো এই কফি শেষ হলেই ও চলে যাবে। আর অপেক্ষা করবেনা।

“সরি দোস্ত অনেকক্ষণ অপেক্ষা করালাম। প্লিজ রাগ করিস না।”

জাওয়াদ কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, “ইমার্জেন্সি খবর দিয়ে নিজেই লেট করে আসা কেউ তোর থেকে শিখুক! এনিওয়ে কেন ডেকেছিস তাই বল?”

“আমি একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তোকে সেটা শেয়ার করতেই মূলত ডাকা।”

“কী সিদ্ধান্ত?”

তানভির কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,”আমি নিপাকে ডিভোর্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি!”

জাওয়াদ ভাবলেশহীনভাবে জবাব দিলো,”আচ্ছা!”

তানভির ওর দিকে তাকিয়ে বললো,”তোর থেকে রিয়েক্ট আশা করা ঠিক না!”

“তুই নিশ্চয়ই শুধুমাত্র আমার রিয়েকশন দেখতে এমন সিদ্ধান্ত নিস নি! সলিড রিজন আছে বলেই নিয়েছিস।”

“হুম রিজন তো আছেই!”

“তা ফিন্যান্সিয়ালী রেডি তো? আই মিন এন্টিমনি…”

“২০লক্ষ টাকা কাবিন ছিল…”

“মাথা গরম করে ডিসিশন নিস না। সমস্যা আইডেন্টিফাই কর, সল্যুশন আছে কী না দেখ। দুজনে কথা বল সর্ট আউট করার ট্রায় কর। তারপরো যদি মনে হয় হচ্ছে না, দ্যান ডিভোর্স ফাইল করিস। তন্ময় এর কথা মাথায় রাখ, তোরা দুজনে মুভ অন করে যার যার লাইফে সেটেল হলেও বাচ্চাটা একা পড়ে যাবে।”

“ওর জন্যই তো শত সমস্যা এড়িয়েও সংসার করে যাচ্ছি! আমার লাইফ যদি ১টা দিন লিড করতি বুঝতি কী অবস্থায় বেঁচে আছি। ভালো মেয়ে স্ত্রী হিসেবে পাওয়া অনেক বড় গিফট। আমি আসলেই হতভাগা!”

“তোর যদি বেশি কষ্ট হয় তবে বলবো ছেড়ে দে। আমরা সবাই ভালো জীবন ডিজার্ভ করি।”

তানভির চোখের কোণ চেপে বলল,”আম্মা খুব অসুস্থ ছিলেন। অপারেশনের সব টাকা রাহার হাজবেন্ড দিছে। আমাকে বলে নাই কারণ জানে নিপা অশান্তি করবে। আব্বার মতো রাগী লোক ও নিপাকে এড়িয়ে চলে। আমার এই টাকাপয়সার কী ভ্যলু বল তো? যদি নিজের মা-বাপের জন্য ইচ্ছেমতো খরচ করতে পারি না। ছেলে বেঁচে থাকতে মেয়ের জামাই থেকে অপারেশনের টাকা নিতে হয়……”

জাওয়াদ বাইরের দিকে তাকালো। শত শত গাড়ির হেডলাইটের আলোয় রাত টা রাত মনে হয় না। এই শহরে সবাই কত লড়ছে একটা সুখী জীবন পেতে। কিন্তু সবাই কী সুখ পায়? বাড়ি ফিরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারে?

জাওয়াদ বাসায় ফিরে মাত্রই আরওয়াকে জড়িয়ে ধরলো। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে মনে মনে বলল, “রোজ শোকরানার নামাজ আদায় করলেও বোধহয় শোকর আদায় শেষ হবে না আমার!”

“ব্যাপার কী বলুন তো? আজ এসে মাত্রই জড়িয়ে ধররেন! সচরাচর তো এমন করেন না..”

“একটা হেডলাইন দেখলাম স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে থাকলে নাকি হার্ট এট্যাকের ঝুঁকি অনেকটা কমে যায়। এমনিতেই ছেলেদের এই ঝুঁকি অনেক বেশি, তাই সেটা কমানোর ট্রায় করছি!”

“তাহলে বেশি সময় নিয়ে জড়িয়ে রাখুন।”

জাওয়াদ মুচকি হেসে বললো,”পরীক্ষা কেমন হলো আজ?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালোই। আপনার অফিসে সব ঠিকঠাক তো?”

“হুম।”

“আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন আমি নাস্তা পানির ব্যবস্থা করছি।”

“আরওয়া”

“হুম?”

“ব্যাগে কিছু আছে কি না দেখে যেও তো…”

আরওয়া ফিরে ব্যাগের চেইন খুলে দেখে হলুদ গোলাপফুল রাখা। আরওয়া ফুলগুলো ঠিক করে বলল, “কাঁচা ফুল কেউ এভাবে ব্যাগে রাখে? হাতে করে বৌয়ের জন্য কিছু আনতে জনাবের যতো লজ্জা! হুহ!”

“হ্যালো পাপিতা, কোথায় আছিস?”

“বাসায় আর কোথায় থাকবো?”

“নিচে আয় চটজলদি”

“তুই কী আমাদের এখানে? হঠাৎ এই অসময়ে?

“এতো কথা না বলে দ্রুত আয়।”

পাপিয়া ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হলো। যদিও রাত ১০টা তেমন রাত না। তবুও এরকম আসলে কেমন দেখায়! পাপিয়া মনে মনে রিজভীক কিছু গালি দিয়ে নিচে নামলো। ভাগ্যিস ড্রইং এ কেউ নেই এখন। পাপিয়া দরজা খুলে বের হতেই ভুত দেখার মতো চমকে গেল।

হিয়া চিরচেনা ভঙ্গিতে হেসে বললো, “কিরে এমন মূর্তির মতো দাড়িয়ে থাকবি জড়াই ধরবি না?”

পাপিয়া ওকে জড়িয়ে ধরে বললো, “আল্লাহ! হিয়া সত্যিই তুই আসছোস? কিভাবে সম্ভব!!”

রিজভী পাশ থেকে উঁকি দিয়ে বলল,”অসম্ভবকে সম্ভব করা রিজভীর কাজ!”

“এই বাদরটা আজ দুপুরে চাঁদপুর গিয়ে হাজির। কত কী করে তোর ভাইয়াকে রাজী করালো যদি দেখতি! আমার বাসায় একটু পানিও খায় নাই, সাথে করে নিয়ে আসছে সোজা এখানে।”

“তোহ কী করবো বল? তোর জন্য সেতি যেই মরা কান্না জুটাইছে। পরে বিয়ের আগেই না বিধবা হয়ে যাই আমি!”

“ছেলেরা বিধবা হয় না বিপত্নিক হয়!”

“দেখেছিস হিয়া কেমন ও! এই সময়েও ব্যাকরণের ভূল ধরে? কোথায় খুশিতে আমাকে একটু জড়িয়ে ধরে চুমু খাবে তা না…”

পাপিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল,”দিন দিন তুই ঠোঁটকাটা হয়ে যাচ্ছিস! যাই হোক হিয়া তোর সাথে আমার অনেক বড় ঝগড়া আছে। আগে ফ্রেশ হয়ে নে তারপর ঝগড়ার ঝুলি খুলে বসবো।”

“এ কি রে, বান্ধবীকে নিয়ে চলে যাচ্ছিস আমাকে আসতে বলবি না?”

“তুই লাগেজগুলো নিয়ে আয়। হ্যাঁ রে দুলাভাই আসেনাই?”

“আসছে, রিজভী তো পথে থামতেও দিলো না। খালি হাতে কীভাবে আসবে। তাই কিছু কিনতে গেছে।”

পাপিয়া হিয়ার ছেলেকে কোলে নিয়ে দুনিয়ার কথা বলতে বলতে সোফায় গিয়ে বসলো। ওর চোখেমুখে আনন্দের ফোয়ারা বয়ে যাচ্ছে।রিজভী ওর দিকে চেয়ে আড়মোড়া ভেঙে বিড়বিড় করে বলল, “যাক কষ্ট সার্থক হলো!”

পাপিয়ার হলুদের দিন সকালে খন্দকার বাড়িতে একটা বড়সড় ঘটনা ঘটে গেল। নাহিয়ান আর সাবা সদ্য জন্ম নেওয়া একটি নবজাতক শিশুকে কোলে নিয়ে যখন দরজায় দাড়ালো বাড়ির সকলে ভীষণ অবাক বৈ কী
বলা নেই কওয়া নেই হুট করে একজনকে এভাবে নিয়ে আসবে এ সবার কল্পনার অতীত। অতিথিরা সবাই কানাঘুষা শুরু করলেও জোবায়ের সাহেবের ভয়ে আওয়াজ করতে পারলো না। নূর মোহাম্মদ ছেলের এহেন কান্ডে রেগে আগুন। তার সব রাগ গিয়ে সাবার উপরেই কেন্দ্রীভূত হয়। এই মেয়েটাই তার ছেলের মাথা খেয়ে রেখেছে।‌ নয়তো আজ তাকে এই দিন দেখা লাগতো? শক্ত সামর্থ্য ছেলে হয়েও বাবা হবার সুখ থেকে বঞ্চিত সে। শুধুমাত্র ভালোবাসায় অন্ধ হয়েই আরেকটা বিয়ে করছে না। বাবা হয়ে এটা মেনে নেওয়া যায়?
জোবায়ের সাহেব নিরবতা ভেঙে বললেন, “সালমা সাবাকে নিয়ে ভেতরে যাও। আর নাহিয়ান আমার ঘরে আসো।”

কুহু বাচ্চাটাকে কোলে তুলে বলল,”মাশাআল্লাহ কত সুন্দর বাচ্চাটা! ভাবি এতো সুন্দর পরী কোত্থেকে আনলে গো?”

সাবা নিষ্পাপ শিশুটির কপালে চুমু খেয়ে বললো, “আল্লাহ বোধহয় ওকে আমার কোল আলো করতেই পাঠিয়েছেন….”

চলবে…..

কাঁটাকম্পাস পর্ব-৪৭+৪৮+৪৯

0

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৪৭

#আরশিয়া_জান্নাত

৪৭

“আস্সালামু আলাইকুম আন্টি।”

“ওয়ালাইকুমুস্সালাম। কেমন আছ?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি ভালো তো?”

“আলহামদুলিল্লাহ!”

“আপনারা এসেছেন আমি অনেক খুশি হয়েছি। আঙ্কেল আসেননি?”

“হ্যাঁ এসেছে।”

“আচ্ছা আপনারা বসুন আমি আম্মুকে ডেকে আনছি।”

পাপিয়া রিজভীর মা-বোনকে বসিয়ে নিজের মাকে খুঁজতে গেল। যাওয়ার পূর্বে ওয়েটারকে বলে গেল উনাদের খেয়াল রাখতে।

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা প্রায় শেষের পথে, একটু পরেই কনে বিদায় দেওয়া হবে। এই মুহূর্ত প্রতিটা মেয়ের জীবনে যতটা কষ্টের তার চেয়ে অধিক কষ্টের তার বাবা-মায়ের জন্য। কুহু ভেবেছিল তার বিয়ের দিন তার মায়ের চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হবেনা। তিনি ওর বিয়ে নিয়ে গত কয়েকবছর যে পরিমাণ টেনশন করেছেন, আজ সেটা থেকে মুক্ত হয়ে নিশ্চয়ই খুশিতে গদগদ হয়ে মেয়েকে বিদায় করে বলবেন, “উফ আপদ বিদায় হলো!” কিন্তু না কোহিনূর মেয়েকে জড়িয়ে যে মরা কান্না জুড়েছিলেন তাতে উপস্থীত সবারই চোখে পানি আসতে বাধ্য হয়েছিল। মায়েরা যতই মেয়ের বিয়ে নিয়ে কথা শোনাক না কেন, বিয়ের দিন ঠিক হলে তাদেরই বেশি পুড়ে! বাবা-মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কুহু চলেছে জীবনের নতুন এক অধ্যায়ে পাশে তার বহুকাঙ্ক্ষিত শখের পুরুষ। ইশরাক নিরবতা ভেঙে বললো,”কুহু মন খারাপ করো না। তোমার যখন ইচ্ছে হবে ওখানে যেতে পারবে। আমি মানা করবোনা। আর কেঁদো না প্লিজ!”

কুহু চোখের কোণে টিস্যু চেপে বসে রইলো। এতো কান্না কোত্থেকে আসছে কে জানে!

আরওয়া ক্লাসে বসে স্যারের লেকচার নোট করছে। রুমাইসা মনোযোগী ছাত্রীর মতো স্যারের দিকে তাকিয়ে থাকলেও ওর মন এখন এখানে নেই।পেটের ভেতর কথাগুলো ঘুটঘুট করছে, আরওয়াকে না বলা অবধি সে শান্তি পাবেনা। আরওয়া আবার ক্লাসে কথা বলে পছন্দ করেনা। সে তো পারলে স্যারের সব কথা এ টু জেড খাতায় তুলে নিবে। রুমাইসা মনে মনে প্রার্থনা করছে ক্লাসটা দ্রুত শেষ হোক।

ক্লাস থেকে বেরিয়ে আরওয়া বলল,”চেহারা এমন বাংলার পাঁচের মতো করে রেখেছিস কেন?কী হয়েছে?”

“বিয়েতে কী পড়বো বুঝতেছিনা। একবার মনে হচ্ছে কাতান পড়ি, আবার মনে হচ্ছে জামদানি পড়ি, আবার লেহেঙ্গা পড়তেও মন চাইতেছে। আমি অনেক কনফিউজড!”

“এটা নিয়ে টেনশনের কী আছে? হলুদে জামদানি পড়িস, বিয়েতে কাতান রিসিপশনে লেহেঙ্গা! হয়ে গেল তো।”

” ধুরর তুই বুঝতেছোস না। বিয়েতে জামদানি পড়া এখন ট্রেন্ড। তাসনিয়া ফারিন কে দেখোস নাই কী সুন্দর লাগছিল! কুহু আপুকে কাতান শাড়িতে জোস লাগছে, দেখে ঐটা পড়তে মন চাইছে। পরে ইনস্টাতে লেহেঙ্গা দেখে….”

আরওয়া বিরক্ত গলায় বললো, “এখন একদিনে সব ট্রেন্ড ফলো করলে কেমনে হবে?”

“সেটাই তো!”

“সাম্য ভাইয়াকে বলেছিস?”

“নাহ।”

” এক কাজ কর এসব ট্রেন্ড বাদ দে, সাম্য ভাইয়ার কোনটা পছন্দ সেটা জিজ্ঞেস কর, সে অনুযায়ী সিলেক্ট কর। যত বেশি ঘাটবি তত কনফিউজড হয়ে যাবি। এর চেয়ে যার জন্য সাজছিস তার পছন্দকে গুরুত্ব দেয়া শ্রেয়!”

“সেটাই করতে হবে মনে হচ্ছে। তুই লাকি রে, তোকে এসব প্যারায় পড়তে হয়নাই।”

“এমনভাবে বলছিস যেন কয়েক যুগ আগে আমার বিয়ে হয়েছে। তখন এসব ছিল না!”

“সেটা বলিনাই। তবে তুই আমার মতো কনফিউজড তো ছিলি না।”

“হুম এটা ঠিক। এখন পরীক্ষায় ফোকাস কর, পরীকৃষার পর না বিয়ের ডেট ফিক্সড হলো?”

“এটাই বিরক্তিকর। পরীক্ষাটা মাঝখানে না টপকালে হতো না! বিয়ের পর পরীক্ষা হলে কী হতো!”

“আমারে বলোস আমি জামাই পাগল, এদিকে তুই তো বিয়ের আগেই সেটা হয়ে গেলি!”

রুমাইসা বাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, “লোকটাকে দেখলে একটু মায়াই লাগে। কেমন বলদা বলদা লুক নিয়ে তাকাই থাকে। সেজন্য একটু মায়া দেখাই আর কী এমনিতে কিছু না!”

“হইছে আর বুঝ দিতে হবেনা। আমরা খাই সুজি কিছু কিছু বুঝি!”

রোকেয়া বেশ কিছু কাপড় কিনে এনেছেন কাঁথা সেলাইয়ের জন্য। একটু পরেই সাহেরা নামে একজন আসতেই তিনি বললেন, “এখানে আস্তরসহ কাপড় দিচ্ছি, ৫০/৬০টা কাঁথা বানাবে। নকশি করে বানাবে ২০টা বাকিগুলো এমনি সেলাই করলেই হবে।”

“আন্টি আমনেগোর বাড়ির কারো বাচ্চা হইবো নাকি? হঠাৎ এতো খেতা সিলাইতে দিতাছেন?”

“সময় থাকতে থাকতে বানিয়ে নিচ্ছি, কার কখন সুখবর আসে বলা তো যাচ্ছেনা।”

“ওহ আইচ্ছা, বুদ্ধি ভালাই।”

“শোন তোর বোনের হাতের কাজ সুন্দর। ওরে বলিস নকশিগুলো যেন ও করে। যারেই দেই না কেন সবকয়টাই আদরের। তাই কাঁথাগুলো সুন্দর হতেই হবে।”

পাপিয়া মায়ের কান্ড দেখে বললো,”ওরে বাবা এ তো এলাহি কান্ড! তুমি কী সবার বাচ্চার জন্য কাঁথা সেলাই করতে বসছো?”

“এতো চিল্লাইস না। সবাই শুনলে আরেক কাহিনী শুরু হবে।”

পাপিয়া মায়ের কাছে বসে বললো,” সত্যি করে বলো তো আরওয়া ভাবীর সুখবর পাইছো?”

“আরেহ নাহ। এমনিই বানাই রাখতেছি।”

“ওহ। সাহেরা আপা আমার জন্য একটা বড় নকশী কাঁথা বানাবেন।”

“আমনে কাপড় ডা খালি দেন, বাকি সব আমার কাম। এমন সুন্দর ডিজাইন কইরা দিমু সবাই হা কইরা চাইয়া থাকবো।”

পাহাড়ের ঢল বেয়ে নেমে আসা বিশাল ঝর্ণার নীচে জাওয়াদ আর আরওয়া দাঁড়িয়ে আছে। পানি আর বাতাসের শব্দ মিলেমিশে অন্যরকম এক পরিবেশ। চারদিকে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ, গাছগাছালির সোঁতা গন্ধ। আরওয়া উল্লাসিত গলায় বললো,”আমার অনেক ইচ্ছে ছিল এমন ঝর্ণা সরাসরি দেখার। কী সুন্দর এটি!!”

জাওয়াদ মুচকি হেসে বললো,”তোমার পছন্দ হলেই স্বার্থক!”

আরওয়া এক কিনারায় বসে পানি নিয়ে খেলতে লাগলো। জাওয়াদ ওর দিকে মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আরওয়ার উচ্ছাসিত বাচ্চামো দেখতে আজকাল ওল ভালোই লাগে। মেয়েটা কখন যে ওর মনের অনেকটা অংশ দখল করে নিয়েছে কে জানে! জাওয়াদ শুরুতে ভেবেছিল এই বিয়েটা ১মাস ও টিকবে না, ও আরওয়াকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে। তখন আরওয়াকে ওর ইমম্যাচিওর,ইরিটেটিং ক্যারেক্টার মনে তো। ওর অগোছালো স্বভাব, জিনিসপত্র এলোমেলো করার প্রবণতা, ঘুমের মধ্যে অস্থির অঙ্গিভঙ্গি সবই বিরক্তিকর লাগতো। অথচ সময়ের সাথে সাথে সব অভ্যেস হয়ে গেছে। আরওয়াও অনেকটা সংসারী হয়েছে, গুছিয়ে চলা শিখছে। গতিটা ধীর হলেও চেষ্টা করে যাচ্ছে এতেই জাওয়াদ খুশি। ঘুমের মাঝে ছটফট ভাবটা সম্পূর্ণ না কমলেও জাওয়াদের বুকে স্থির হয়ে থাকাটা ওকে স্বস্তি দেয়। আজকাল জাওয়াদের বরং কষ্ট হয় ওর সান্নিধ্য না পেলে। ও নাক ফুলিয়ে রেগে ঝগড়া না করলে মনে হয় দিনটা পূর্ণই হলো না।
আরওয়া ওর দিকে পানির ঝাপটা দিতে ধ্যান ভাঙ্গে তার, আরওয়া ভ্রূ উঁচিয়ে বলল,” কোথায় হারালেন?”

জাওয়াদ মুখ মুছে বলে,” এটা কী হলো? এভাবে কেউ পানি মারে!”

“তো কীভাবে মারে?”

“দাঁড়াও দেখাচ্ছি,,”

জাওয়াদকে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে আরওয়া পেছাতে থাকে। হেসে বলে, “আমার ডেমো চাই না। আমি বুঝে গেছি….”

“এখন বললে তো হবে না। আমি ডেমো তো দিবোই। এমন পেছাচ্ছ কেন?”

“আপনি নিশ্চয়ই ডেঞ্জারাস কিছু করবেন, আপনাকে আমি ভালো মতো চিনি।”

“আরওয়া পিছিও না। স্থির হয়ে দাঁড়াও।”

আরওয়া মাথা নেড়ে না বলতে বলতে পেছালো। এলোমেলো পাথরের কিনারায় ব্যালেন্স করতে ওর কষ্ট হলেও স্থির হলোনা। জাওয়াদ ওকে আকড়ে ধরার জন্য এগোতে চাইলেও ও থামলো না। এক পর্যায়ে জাওয়াদ দাঁড়িয়ে বললো,” আরওয়া থামো,‌আর পিছিও না For God sake!”

আরওয়া খিলখিল করে হেসে বললো,”হুম আমি থেমে যাই আর আপনি ঝট করে ধরে ফেলুন। হবে না সেটা। আমি আর বোকা নেই!”

জাওয়াদ ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আরওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো, আরওয়া পেছাতে পেছাতে অনেকটা দূর চলে গেছে। হঠাৎ পা পিছলে আরওয়া ঝিলে পড়ে গেল। পানিতে হাবুডুবু খেয়ে জাওয়াদকে ডাকতে লাগলো। জাওয়াদ ওর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলেও পা কিছুতেই এগোচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে ওর একেকটা পায়ের ওজন কয়েক মণ হয়ে গেছে, সে কিছুতেই পা নাড়িয়ে এগোতে পারছে না। আরওয়া ওকে প্রাণেপনে চিৎকার করে ডেকেই যাচ্ছে আর বলছে, “আমি সাতার পারি না, আমাকে বাঁচান। জাওয়াদ আমাকে বাঁচান প্লিজ…”

হঠাৎ আরওয়া পেছনে তাকিয়ে দেখে বিশাল আকৃতির কুমির তার দিকে এগিয়ে আসছে। ভয়ে ওর আত্মা উড়ে যায় যেন। ও পানিতে ধাপাধাপি করে কিনারায় পৌঁছানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে‌। কিন্তু পানির স্রোতের সঙ্গে পেরে উঠে না। জাওয়াদ ওর কাছে এগিয়ে আসতে আসতে পুরো পানি রক্তে লাল হয়ে উঠে…

জাওয়াদ ঘুম থেকে উঠে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে। চোখের কিনারা এখনো অশ্রুসিক্ত, ভয়ে তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। কাঁপা হাতে ল্যাম্প অন করে আরওয়াকে দেখে ওর মন শান্ত হলেও দুঃস্বপ্নের প্রভাব দূর হয় না। ও গ্লাস থেকে পানি পান করে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করে। মানসপটে বারবার ভেসে উঠে সেই ভয়ানক দৃশ্য। জাওয়াদ আরওয়া কে তুলে বুকের মাঝে নেয়। গালে কপালে চুমু খেয়ে বলে,”আলহামদুলিল্লাহ তুমি ঠিক আছ, তোমার কিচ্ছু হয় নি। ঐটা দুঃস্বপ্ন ছিল।”

আরওয়া মুখে পানির অস্তিত্ব টের পেয়ে জেগে উঠে, ওর চোখ মুছে দিয়ে ঘুমঘুম গলায় বলে, “কী হয়েছে? আপনি কাঁদছেন কেন? খারাপ স্বপ্ন দেখেছেন?”

জাওয়াদ ওর হাতেরমুঠোয় চুমু দিয়ে বলে,”আরওয়া তুমি কখনো আমার কথা অমান্য করবে না। আমি না বললে ঐ পথে আর এগোবে না প্লিজ। তুমি সাবধানে থাকবে বুঝছো।তোমার লাইফে আমার চেয়ে বেস্ট অনেক ছেলে আসলেও আমার লাইফে তোমার মতো কেউ আসবেনা। আমার কাছে তুমি মূল্যবান। এটা মাথায় রেখো।”

আরওয়া ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো,” খারাপ স্বপ্ন সত্যি হয় না। ঐগুলো আমাদের ভাবনার রিফ্লেক্ট। এতো পাত্তা দেওয়ার কিছু নেই। যা দেখেছেন ভালো দেখেছেন। শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন তো। আমি আছি আপনার পাশে।”

জাওয়াদ শান্ত হলো না। বরং সেই রাতে তার গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো।

পাপিয়া জাহিদের সঙ্গে গল্প করতে করতে বাসায় ফিরছিল। হঠাৎ তাদের গেইটে তাকিয়ে দেখে বেশ কয়েকটা গাড়ি এসেছে। জাহিদ বললো, “বাসায় কোনো মেহমান এলো নাকি?”

“কুহু আপুদের তো আজ আসার কথা না। তাহলে কে এলো?”

“চলো ভেতরে গিয়ে দেখি।”

পাপিয়া বাড়ির ভেতরে ঢুকে ভুত দেখার মতো চমকে যায়। তাদের ড্রইং রুমে রিজভী ও তার পরিবারের সবাই বসে আছে। রিজভী দেশে ফিরলো কবে! কই ওকে তো কিছু বলেনাই।

চলবে…

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৪৮

#আরশিয়া_জান্নাত

“কুহু উঠো। আরেকটু দেরি হলে পরে নিজেই আফসোস করবে।”

কুহু ইশরাকের কথা শুনেছে বলে মনে হলো না। বরং আরো গুটিয়ে আয়েশ করে ঘুমাচ্ছে। ইশরাক ঘড়ির দিকে চেয়ে বললো,” আজকেও উঠতে লেট করবে, তারপর দাদীর কাছে বকা শুনবে।”

ইশরাক আরেকদফা ডেকে ওয়াশরুমে গেল। কুহু ফোনের এলার্ম অফ করে উঠে বসে। ওর দাদী শাশুড়ি ঢাকায় এসেছেন ৩দিন হলো। এই ৩দিন ওকে ফজরের ওয়াক্তে উঠে নামাজ পড়ে নাস্তার আয়োজন করতে হয়। ঘড়ির কাটা ৬টায় পড়লেই তাকে থোকমা ভেজানো ১গ্লাস পানি দিতে হয়। নাস্তায় পাতলা করে ৩টা রুটি আর তরকারি, শেষে মধু দেওয়া রং চা। রুটি পাতলা আর গোল‌ না হলে তিনি ছুঁয়েও দেখেন না।
এসব কাজ এতোদিন ছেলের বৌ করলেও এবার এসেই বলেছেন নাতবৌ যেন সব করে। তাই কুহুকেই সবটা দেখতে হচ্ছে। এই ৩দিনে সে রোজ বকা শুনেছে, কখনো দেরি করে উঠার জন্য তো কখনো রুটির জন্য। বেচারি যতোই চেষ্টা করুক পারফেক্ট দিন শুরুই হচ্ছেনা। ইশরাক উযু করে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে বললো, “তাড়াতাড়ি করো সময় চলে যাচ্ছে।”

কুহু দ্রুত ফ্রেশ হয়ে ইশরাকের পাশে নামাজে দাঁড়ালো। নামাজ শেষে ইশরাক বরাবরের মতো কুহুর হাতের কড়ায় তসবীহ পাঠ করে, তারপর দোয়া পড়ে তার মাথায় ফুঁ দিয়ে বলে, “আল্লাহ তোমার মুশকিল আসান করে দিক!”

কুহু আধখোলা চোখে হেসে ওর দিকে তাকায়। ইশরাক ওর গালে হাত রেখে বলে,”কষ্ট হচ্ছে অনেক তাই না?”

“দাদী চলে যাওয়ার পর আমি কয়দিন টানা ঘুমাবো। এখানে পসিবল না হলে আমাদের বাসায় গিয়ে হলেও ঘুমাবো। আগে থেকে বলে দিচ্ছি!”

“আচ্ছা!”

সাবা আর নাহিয়ান শ্রীমঙ্গল বেড়াতে এসেছে। শহুরে ব্যস্ততা ভুলে ক’টা দিন প্রকৃতির মাঝে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেই এই কারসাজি। পাখির কিচিরমিচির শব্দ, স্নিগ্ধ শীতল বাতাস, মাটির ভেজা গন্ধ। সব মিলিয়ে প্রকৃতির নৈকট্যে এক দারুণ সময় পার করছে এই দম্পতি।

পাপিয়া ঘুম থেকে জেগে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। গতকাল বিকেলের ঘটনা তার কাছে স্বপ্নের মতোই মনে হচ্ছে। কিন্তু অনামিকায় জ্বজ্বল করতে থাকা হীরের আংটিটা জানান দিলো এ স্বপ্ন নয় বরং উজ্জ্বল দিনের মতো সত্যি! রিজভী পারিবারিকভাবে ওকে বিয়ের প্রপোজাল দিয়েছে। গতকাল সবার কথায় বোঝা গেল এই বিয়েটা নিয়ে ইতোমধ্যে দুই পরিবারে কথাবার্তা হয়েছে। কেবল রিজভী ফেরার অপেক্ষা ছিল। পাপিয়া চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলো তার আর রিজভীর কথোপকথন,

“কেমন সারপ্রাইজ দিলাম? চমকে গেছিস অনেক তাই না?”

“এটা সারপ্রাইজ ছিল না শক ছিল। তোর সাথে সেদিনও তো কথা হলো, দেশে আসবি বললি না তো!”

“তোকে বলেছিলাম না ওখানে একা থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে? একজন সঙ্গী থাকলে ভালো হতো। তাই ভাবলাম দেশে যাই কাউকে ধরে আনি।”

“বিয়ে করার জন্য দেশে ফিরলি তাই বল! আমিও তো অবাক বলা নেই কওয়া নেই ভুত হাজির!”

“ভুতেরা বুঝি তোকে বলে কয়ে আসে? তা আসবার আগে কী বলে? পাপিয়া ম্যাম মে আই কাম ইন?”

পাপিয়া কোলের কাছে কুশন নিয়ে বলল,” এরকম বলে না তবে হিন্ট দেয়। মুভিতে দেখিস না কীভাবে লাইট অনঅফ হয়, দরজায় নক করে, কিংবা উপস্থিতি টের দেয়। তারপরই তো প্রকট হয়। হুট করে তোর সময় সরাসরি উদয় হয় না।”

“তাই না! কেমন তুই? আমি এতোদিন পর এলাম কোথায় ভাবলাম জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করবি। বলবি, ও দোস্ত তোরে কত মিস করছি, এতো শুকাই গেলি কেমনে? ঐখানে কী খাওয়া দাওয়া করিস না! তা না করে এমন ভাব নিচ্ছিস যেন আমি আসায় তুই মহাবিরক্ত।”

“তেমন হতে যাবে কেন আজীব!”

“তেমন হলেও আমার লস কী? তোকে বিরক্ত করাই আমার আনন্দের কাজ। যাই হোক আজ এমনি এমনি আড্ডা দিতে আসি নি। একটা সিরিয়াস টপিকে কথা বলতেই এসেছি।”

“হুম বল কী সিরিয়াস কথা?”

“আমার হাতে সময় বেশি নাই। ১০দিনের মধ্যে বিয়ে করে বৌকে সঙ্গে নিয়ে যাবো, সেই উদ্দেশ্যেই এসেছি।”

“১০দিনে মেয়ে খুঁজে বিয়ে করবি? সিরিয়াসলি? এত কম সময়ে মেয়ে পাবি কই?”

“আরে আম্মু সব ঠিক করে রেখেছে। আমি এসেছি জাস্ট কবুল বলে সাইন করতে‌”

কথাটা শুনে পাপিয়ার চেহারার রং বদলে গেল। তবে বিয়ের দাওয়াত দিতেই উনারা সবাই এলেন? পাপিয়া নিজের অভিব্যক্তি লুকিয়ে হাসিমুখে বললো,”ওয়াও কংগ্রেটস। আমি সত্যিই তোর জন্য অনেক খুশি। তুই মুভ অন করতে পেরেছিস এটা আসলেই আমাদের জন্য অনেক ভালো খবর।”

রিজভী পাপিয়ার দিকে চেয়ে বাঁকা হাসলো। ফুরফুরে গলায় বললো,” হুম তুই আমার প্রথম সারির শুভাকাঙ্ক্ষি বলে কথা! তোর তো ভালো লাগবেই। শোন তুই ও বিয়ে করে ফেল। কুহু তো গেল, এবার তুই ও যা, তোর ভাইয়ের বৌদের একটু শান্তি দে।”

“এখন বুঝি অশান্তি দিচ্ছি!”

“অফকোর্স দিচ্ছিস। আবিয়াইত্তা ননদ থাকার প্যারা বুঝিস? বাংলা সিনেমা দেখিস নি? কাল ননদীর অত্যাচারে কত নায়িকা কষ্টের অভিনয় করতো!”

“বলছে তোরে!”

“এটাই চিরন্তন সত্যি, বলে দিতে হয় না। যাই হোক আমার হাতে অনেক ছেলে আছে, দেখবো নাকি তোর জন্য?”

“আমারে নিয়ে তোরে ভাবতে হবেনা। নিজের চরকায় তেল দে।”

“নিজের চরকায় তেল দিতেই তো তোকে বলছি। তুই না আমার বেস্টফ্রেন্ড? তুই আমি কী আলাদা?”

“আমি তোর কোনোকালের বেস্টফ্রেন্ড না। এসব স্বপ্নবিলাস বন্ধ কর।”

রিজভী কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,” নাআআ এ হতে পারে না। বলে দে তুই মিথ্যে বলছিস, বলে দে এই সবই মনগড়া কথা!”

“বাপ্পারাজ সাজিস না তো। অসহ্যকর!”

রিজভী হেহে করে হাসতে লাগলো। বহুক্ষণ পর হাসি থামিয়ে বললো,”পাপিতা আমি একা এই জেলখানার কয়েদি হবোনা রে। তোরে সাথে নিয়েই বিয়ে নামক জেলখানায় ঢুকবো। বাংলাদেশে এখন সীজনটা বিয়ের জন্য পারফেক্ট না হলেও সমস্যা নেই। ইউকে তে পারফেক্ট ই আছে।”

পাপিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো,”তোর কথার আগামাথা আমি কিছুই বুঝতেছি না।”

“মাথামোটা মেয়ে, তোর বুঝতেও হবেনা।চুপচাপ শুধু দেখে যা, না বলার স্পর্ধা দেখাবি না বলে দিচ্ছি।”

আরওয়া এসে বললো, “আপু তোমাদের ডাকছে, নীচে চলো।”

পাপিয়া আরওয়ার সাথে যেতে যেতে বলল,”ভাবি ঘটনা কী হচ্ছে জানো কিছু?”

আরওয়া ওর কাধে হাত রেখে বলল, “এটা বোধহয় বিয়ের বছর গো ননদী, সবার বিয়ে এ বছর ই হবে…”

জাওয়াদের আজকাল অফিস থেকে ফিরতে বেশ রাত হয়। সাইটের বিভিন্ন কাজ সরেজমিন দেখে এসে অফিশিয়াল কাজ চেক করতে করতে দিন পেরিয়ে কখন যে অনেক রাত হয়ে যায় হুশ থাকে না। আরওয়া ১১টা পর্যন্ত বহুকষ্টে জেগে থাকলেও এরপর আর পারেনা। জাওয়াদ পা টিপে টিপে শব্দ না করে রুমে ঢুকে, চেইঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে আসে এমনভাবে যেন আরওয়ার ঘুম না ভাঙ্গে। কিন্তু ঘুমের কুমির আরওয়া তার অস্তিত্ব টের পেতেই উঠে যায়। চোখ কচলে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “রোজ এতো লেট হয় আপনার? এভাবে আর কতদিন চলবে হু?”

জাওয়াদ বিছানার একপাশে বসে বলে,” আর কয়টা দিন, তারপর রিল্যাক্স হয়ে যাবো।”

“আপনি বসুন আমি খাবার গরম করছি।”

“তুমি ঘুমাও, রাহেলা আন্টি আছে তো, উনি দিবেন।”

আরওয়া চুল ঝেড়ে খোপা করে বলে, “আমি থাকতে আমার বরকে অন্য কেউ বেড়ে দিতে হবে না। যখন থাকবো না তখন অন্য হিসাব।”

জাওয়াদের বুকটা ধ্বক করে উঠে ওর কথা শুনে। ও তাকে হেচকা টানে বুকে এনে বলে, ‘যখন থাকবে না মানে? কোথায় যাবে তুমি?”

আরওয়া ওর দিকে তাকিয়ে বলল,”কোথাও যাচ্ছি না, কথার কথা বললাম আর কী। ”

“কথার কথা এতো নেতিবাচক হয় কেন আরওয়া? তুমি যেখানেই যাও না কেন, সাথে আমিও যাবো।”

আরওয়া ওর গলা জড়িয়ে বলল,”কোথাও বুঝি একা ছাড়বেন না?”

“নাহ একদমই না।”

“এ কেমন অধ্যাদেশ জারি করলেন হুম? ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুন্ন করা কি উচিত?”

জাওয়াদ ওর কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,”আমাকে তুমি নিষ্ঠুর, বর্বর অত্যাচারী যাই বলো‌না কেন, আমার বৌকে ছাড়া আমি এক দন্ডও একা থাকবোনা।”

আরওয়া ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,”ওয়েএএ সো সুইট অফ ইউ!”

জাওয়াদ ওকে বুকের মাঝে নিয়ে চাপা নিঃশ্বাস ফেলল, ওর বুকের ভেতর যে ভয় ঢুকেছে তার পরিত্রাণ করা কি সম্ভব? আরওয়াকে ছাড়া জীবন সে কল্পনাও করতে চায় না। জাওয়াদ এই অস্থিরতা দূর করতে কয়েকদিন ধরে গরীব দুঃখীদের দান সদকা বাড়িয়ে দিয়েছে। দানসদকা অযাচিত বিপদ এড়ানোর উত্তম পন্থা। আল্লাহ ওর আরওয়াকে সহীহ সালামত রাখুক, বিপদ আপদ থেকে হেফাজত করুক এটাই তো তার এখন চাওয়া! একজন ঠিকই বলেছে, “ভালোবাসা মানুষের সবচেয়ে বড় দূর্বলতা!!”

চলবে…

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৪৯

#আরশিয়া_জান্নাত

আরওয়া খুব মন দিয়ে হাতে মেহেদী আঁকছে। করিমুন্নেসা নাতনীর দিকে স্নেহার্দ্র দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। আরওয়া বলল, “দাদীজান আমার আজকাল নিজেকে ভীষণ সুখী মনে হয়। তুমি ঠিকই বলেছিলে যে মেয়ের স্বামী তাকে ভালোবাসে সে এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়ে।”

“নিজের সুখ লই বেশি মাতামাতি করিচ্চা। সাপের মুখ লাল মাইনষের মুখ কাল। আল্লাহর কাছে সবসময় দোয়া কইরবি যেন হিংসুক আর শয়তানের বদনজর থেকে তোগোরে হেফাজত করে।”

“আচ্ছা।”

আরওয়ার মা শিরিন এসে বললেন, “দুপুরে কী খাবি? মাছ তরকারী আছে, আর কিছু করবো?”

“নাহ আর কিছু করা লাগবেনা।”

“আম্মা দেখেছেন আয়েশা কত বদলে গেছে!”

করিমুন্নেসা বললেন,” তা তো দেখতেছি। আগে মাছের কথা শুনলে নাক ছিটকাইতো। এখন দেখি চুপচাপ আছে।”

আরওয়া বললো,”উনার মাছের আইটেম অনেক পছন্দ। তাই এখন আমারও মাছ ভালো লাগে। এতো চমকানোর কী আছে?”

শিরিন বললেন,”আচ্ছা জামাই পাগল তো তুই!”

আরওয়া মুখ চওড়া করে হেসে বললো,”দাদীর উপর গেছি তো তাই!”

করিমুন্নেসা নিজের লাঠি দিয়ে ওকে খোঁচা দিয়ে বলল,”এরে তুই বুঝি আর উফর গেছত?”

“অবশ্যই। তুমি যে দাদাজানের জন্য কত পাগল ছিলা জানিনা ভাবছো? আমাকে ছোট দাদী সব বলেছে।”

“হেতির আর কাম কী, আজাইরা কিচ্ছাকাহিনী বানাই কয়।”

“হইছে থাক আর লজ্জা পাইতে হবেনা। জামাইরে ভালোবাসা খারাপ না। এটাই তো স্বাভাবিক। প্রাউড ফিল‌ করবা বুঝছো। আম্মু তুমিও আব্বুকে অনেক ভালোবাসবা, বেশি বেশি প্রকাশ করবা।”

শিরিন মেয়ের কান মলে বললেন, “তোর যত হাবিজাবি কথা। পরীক্ষার চিন্তা নাই? কয়দিন বাদে না ইয়ার ফাইনাল?”

“পড়াশোনা আরওয়ার বা’হাতের খেল। ঐটা কোনো ব্যাপারই না। আচ্ছা আম্মু শুনো বাসায় চ্যাপা শুটকি আছে? ভর্তা খেতে ইচ্ছে করতেছে।”

“নাই, আচ্ছা আমি ব্যবস্থা করতেছি।”

রোকেয়া পাকোড়া আর চা নিয়ে লনে বসলেন। জহির সাহেব গাছে পানি দিতে দিতে বললো,”কী ব্যাপার মহারাণীর মনে হচ্ছে আজ মন খুব ভালো?”

রোকেয়া চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, “মেয়ে দুটোর নাল করতে পেরে শান্তি অনুভব হচ্ছে। আপাতত কয়েক বছর আর কারো বিয়ের চিন্তা নেই।”

“হাহাহা তাই বলো!”

“রিজভীকে তো বলতে গেলে ছোট থেকেই চিনি, ওর পরিবারের সবার সাথে আমাদের সখ্যতা দুইদিনের‌ না। এমন পরিচিত ঘরে মেয়ে দিয়েও শান্তি। কিন্তু…”

“কিন্তু কী?”

“আমার একটা মাত্র মেয়ে। একা বিদেশে পড়ে থাকবে? এখানে থাকলে তো চিন্তা ছিল না। কিন্তু ওখানে….”

“সবাই চায় ওসব উন্নত দেশে সেটেল হতে। এতে খুশি না হয়ে বেজার হচ্ছ কেন?”

“সবাই যদি দেশটাকে ফেলে চলে যায় এ দেশটার কী হবে? মানছি এখানে দূর্নীতির অভাব নেই, তবুও জন্মভূমি তো। মায়া ছাড়া কী সহজ?”

জহির সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,” তিক্ত হলেও সত্যি এদেশে পড়ে থেকে লাভ নাই। যাই হোক দেশের কথা তুলে মুড নষ্ট করতে চাইছি না। দেখি কেমন হলো…”

রোকেয়া তার জন্য কাপে চা ঢেলে বলল,”এই শুনছো ভাবছিলাম কী পাপিয়ার বিয়ের অনুষ্ঠান ঢাকায় না করে মুন্সীগঞ্জ করলে কেমন হয়? ওর জন্ম যেখানে সেখানেই বিয়ের অনুষ্ঠান হলো!”

“আইডিয়া খারাপ না, আব্বাকে বলে দেখতে হবে।”

পাপিয়া আর রিজভী বিয়ের শপিং শেষে রেস্টুরেন্টে বসে আছে। রিজভী খাবার অর্ডার করে বললো,”তুই এতো কিউট ক্যান বল তো? আমি ভেবেছিলাম বিয়ের শপিং করতে আসলে সারাদিন চলে যাবে প্লাস পকেট পুরা ফাঁকা হবে। কিন্তু তুই আমারে ভুল প্রমাণ করলি। এতো শর্টকাটে কোনো মেয়ে শপিং করতে পারে!”

“পছন্দ হয়ে গেছে কিনে ফেলছি, এতো ঘোরাঘুরি করে সময় নষ্ট করার দরকার কী?”

রিজভী হেসে বললো, “তুই একা আসলি কেন, ভাবী বা আপুদের আনলি না?”

“এমনিই আনিনি। কেন আমি একা আসায় তোর ভালো লাগছে না?”

“সেটা বলিনাই, বিয়ের শপিং তো সবাই দলবেধে করে, তাই বললাম আর কি!”

“হিয়া বিয়েতে আসতে পারবেনা বললো, দেখেছিস কেমন হারামি? সেই যে বিয়েতে দেখেছি ওটাই লাস্ট। আর দেখা নেই। বিয়ের পর মানুষ এতো পর হয়ে যায়…”

“জানি তো, তাই তোকেই বৌ করে নিচ্ছি। যাতে তুই পর না হস!”

পাপিয়া ভেংচি কেটে বলল,”বড় উপকার করেছেন!”

হঠাৎ চেনা গলা শুনে রিজভী পেছনে ফিরে তাকায়। সামিয়াকে দেখে রিজভী অবাক না হয়ে পারে না। সামিয়া ঢাকায় ব্যাক করেছিল!
রিজভীর চেহারা মুহূর্তেই বদলে যায়। সামিয়ার সাথে অনাকাঙ্খিত সাক্ষাৎ সে চায় না। সে চুপচাপ পাপিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। পাপিয়া ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ওর হাতের উপর হাত রাখে। নরম গলায় বলে,”তুই চাইলে ওর সঙ্গে কথা বলতে পারিস। আমি কিছু মনে করবো‌না।”

রিজভী চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিয়ে বলে “আমি ঠিক আছি, ডোন্ট ওয়ারি!”

সামিয়া হাসতে হাসতে তার বরের হাত ধরে বেরিয়ে যায়, রিজভীর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠে। হয়তো পুরনো কোনো সুন্দর স্মৃতিচারণ করে অথবা নিজের বোকমীতে, পাপিয়া তাকে প্রশ্ন করে বিব্রত করেনা। ভাঙা মনের পুরুষকে যে ভালোবেসেছে, তার এসব তোয়াক্কা করলে খাটে?

ছাদে কাপড় মেলে দেওয়ার সময় ইশরাক এসে কুহুকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। কুহু হাত সরিয়ে বলে, “ইশ‌ ছাড়ো তো, কখন কে চলে আসে। তুমিও না!”

ইশরাক ওর কাধে চিবুক রেখে বলে, “ধরলে নিজের বৌ কে ধরেছি, কার কী?”

“তাই না?”

“কোনো সন্দেহ আছে?”

“কুহু বাকি কাপড় মেলে বললো, “সন্দেহ থাকবে কেন? ছুটির দিনে তোমার ভালোবাসা বাড়ে এ তো আজ নতুন না! আমি আগেই বলে দিচ্ছি আজ আমি আর রান্নাঘরে যাচ্ছি না। তোমার কিছু খেতে ইচ্ছে হলে ফুড পান্ডায় অর্ডার করবে।”

“ছি কুহু আমায় তুমি এমন ভাবতে পারলে? আমি বুঝি শুধু তোমাকে রান্না করানোর‌ জন্য আদর করি? এমনি করিনা?”

“এমনি করো না কখন বলেছি?”

“বললেই তো! আচ্ছা যাও এখন থেকে আর কোনো কিছু রেঁধে দিতে বলবোনা। যা খেতে মন চাইবে বাইরে থেকে আনিয়ে খাবো।”

কুহু হাই তুলে বললো,”হ্যাঁ বাইরে থেকে আনবে আর পরে মা বলবে ছেলেটা ছুটির দিনে একটু বাসায় থাকে তাও ঘরের বৌ কিছু বানিয়ে দিতে পারেনা।”

“তোমাদের বৌ শাশুড়ির রেষারেষিতে আমি পিষে মরি। যাও আগামী সপ্তাহ থেকে আর বাসাতেই থাকবো না।”

“বাবারে ভল্লা দেখি রাগ ও করতে পারে!”

“ভল্লা ডাকবে না। আমি ভল্লা নই!”

“তুমিই তো নিজের নাম ভল্লা দিয়েছিলে। এখন পছন্দ হচ্ছে না কেন?”

“কোন‌ দুঃখে যে সেটা বলতে গেছিলাম! তুমি আমাকে সবার সামনে এই নামে ডেকে এমন হাল করেছ। অফিসে কয়েকদিন সবাই আমাকে ভল্লা ভাই ডাকছে!”

“হাহাহাহাহা,, বেশ করেছে। ডাকটা তো দারুণ ভল্লাভাই! পাপিয়া আর জাহিদকেও বলবো তোমাকে দুলাভাই না ডেকে যেন ভল্লাভাই ডাকে।”

“ঐ না প্লিজ!”

কুহু চারদিক ঝংকরিত করে হাসতে লাগলো। ইশরাক মাথা চুলকে বললো, “হাসলে তোমায় লাগে আরো ভালো!”

আরওয়া গোসল সেরে এসে দেখে জাওয়াদ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। গতকাল সাম্য আর রুমাইসার হলুদ ফাংশন থেকে ফিরতে প্রায় ভোর হয়ে যায়। সারারাত নির্ঘুম পার করায় জনাব এখন নিচিন্তে ঘুমাচ্ছেন। আরওয়ার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি এলো, সে নিজের ভেজা চুল দিয়ে জাওয়াদের নাকে মুখে সুরসুরি দিতে লাগলো। জাওয়াদ মুখ থেকে চুল সরিয়ে বললো, “আহ আরওয়া লেট মি স্লিপ।”

“অনেক বেলা হয়েছে, উঠুন তো। সারাদিন ঘুমিয়ে পার করবেন নাকি?”

“আজ কোনো কাজ নেই তো। ঘুমালেও সমস্যা কী?”

“অবশ্যই সমস্যা আছে, উঠে দুপুরের খাবার খেয়ে নিন। তারপর আবার ঘুমান, কিছু বলবোনা।”

জাওয়াদ ওকে টেনে পাশে শুইয়ে দিলো। ওর গলায় মুখ গুজে বলল,” ঐসব বাদ দিয়ে তুমিও ঘুমাও।”

আরওয়া ওর চুলে হাত বুলিয়ে বললো, “আচ্ছা বেশ আপনি ঘুমান। আমি বরং যাই।”

জাওয়াদ ওকে শক্ত করে ধরে রাখলো। আরওয়া নড়তে না পেরে বললো,”কী ব্যাপার ছাড়ছেন না কেন?”

জাওয়াদ মাথা উঁচু করে আরওয়ার দিকে তাকালো, গাঢ় গলায় বললো,”এখন তো ছাড়া যাবে না। ঘুম সরে গেছে তোমার সোপের ঘ্রাণে!”

“তাহলে তো ভালোই, উঠে ফ্রেশ হয়ে নিন। একসঙ্গে লাঞ্চ করবো।”

“হাহ! বোকা মেয়ে। এখনো বরের মন বুঝলে না। ”

আরওয়া অবস্থা বেগতিক বুঝে মানে মানে সরে যেতে চাইলো, কিন্তু জাওয়াদ তার চেয়ে বরাবরই দুই কদম এগিয়ে। সে ঠিকই আদরের চাদরে মুড়িয়ে খুব সহজেই আরওয়াকে বশে করে নিলো। আরওয়াও তার প্রিয় পুরুষের গভীর স্পর্শে দ্রুত সায় দেয়। এই মানুষটার সংস্পর্শে থাকার চেয়ে সুখের আর কিছুই যে তার নেই!

চলবে..

কাঁটাকম্পাস পর্ব-৪৪+৪৫+৪৬

0

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৪৪

#আরশিয়া_জান্নাত

“আচ্ছা সাবা একটা কথা বলি, রাগ করবে না তো?”

“কী কথা শুনি আগে?”

“আগে বলো রিয়েক্ট না করে বোঝার চেষ্টা করবে?”

“কী হয়েছে নাহিয়ান? সিরিয়াস কিছু?”

“কিছুটা সিরিয়াস ই বলা যায়।”

“ভণিতা করোনা প্লিজ। বলো ঘটনা কী?”

নাহিয়ান ওর হাতটা মুঠোয় নিয়ে বললো,” দেখো পৃথিবীতে এমন অনেক কাপল আছে যাদের বেবী হয়না। ওরা বিভিন্ন পদ্ধতিতে বেবী‌ নেয় বা এডপ্ট করে,,,”

“তুমি তাহলে আশা ছেড়ে দিচ্ছ নাহিয়ান? আমি বাচ্চা জন্ম দিতে পারবোনা এটা মেনে নিচ্ছ? তাই বিকল্প পথ খুঁজছো?”

নাহিয়ান ব্যতিব্যস্ত হয়ে বললো,”না পাখি আমাকে ভুল বুঝো না। আমি সেটা বুঝাই নি।”

সাবা চোখের পানি মুছে বলল,”শোনো নাহিয়ান, তোমার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। তুমি বাচ্চাদের অনেক পছন্দ করো, তোমার নিজের একটা সন্তান হবে এমন আশা করা অস্বাভাবিক না। আমি তোমার ইচ্ছাপূরণে অক্ষম এটা তুমি রিয়েলাইজ করেছ। আমি বলি কী অযথা বিতর্ক সৃষ্টি করো না, বাবাকে তুমি ভালো করেই চেনো। উনি কখনোই চাইবেনা তার পরিবারে বাইরের কেউ আসুক।”

“সাবা সারোগেসি পদ্ধতিতেও অনেকে বাচ্চা নিচ্ছে। এটায় তো সমস্যা নেই! তোমার আমার অংশ মিলেই ও বেড়ে উঠবে,,,”

“এতো কষ্ট করার কী দরকার নাহিয়ান? তোমার কাছে আরো সহজ উপায় আছে। তুমি বরং আরেকটা বিয়ে করে ফেলো।”

নাহিয়ান বিস্ময়ে ওর হাত ছেড়ে দিলো। ধরা গলায় বললো,” তুমি এটা বলতে পারলে সাবা? আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি সেটা জেনেও এমন কথা বলতে পারলে!”

সাবা কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল, “আমি অনেক ভেবেচিন্তেই কথাটা বলেছি। ভালোবাসা ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই সুন্দর ফেয়ারওয়েল হওয়া ভালো। এতে সম্পর্কের সৌন্দর্য অটুট থাকে।”

নাহিয়ান টেবিলের উপর থাকা পানির জগটা ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। রাগান্বিত গলায় বলল,”আমি তোমাকে বলেছিলাম সাবা আমাকে ছেড়ে যাওয়ার চিন্তা মাথাতেও এনো না। আমার কাছে তোমার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেই। কিন্তু তুমি আমার কথাটা না বুঝে অন্য টপিক নিয়ে এলে।”

সাবা চুপচাপ বসে রইলো। কোনো কথা বললোনা। নাহিয়ান সবকিছু ভেঙেচুড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। ও চলে যেতেই সাবা কান্নায় ভেঙে পড়লো। জীবনটা কেন এতো কঠিন তার? একটা সন্তান দিতে আল্লাহ কেন এতো পরীক্ষা নিচ্ছে?

ভাঙচুরের শব্দ শুনে আরওয়া দৌড়ে সাবার ঘরে এলো। সাবার কাছে গিয়ে বিচলিত গলায় বলল, “ভাবি কি হয়েছে? এসব কীভাবে ভাঙলো!”

সাবা ওকে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠলো। কান্নামাখা কন্ঠে বলল,”আরওয়া মা হওয়া এতো কঠিন কেন বলতে পারো? আমি কেন মা হতে পারছি না…”

আরওয়া ওর পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,”ভাবি এতো অধৈর্য হয়োনা। আল্লাহ উত্তম পরিকল্পনাকারী। উনি নিশ্চয়ই ভালো কিছু ভেবে রেখেছেন। ভরসা রাখো।”

“কিছু ভালো হবেনা, কিছু না। এই পৃথিবীতে সবাই সুখী হয়না….”

আরওয়া সাবাকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো কোনো কথা পেলো না।

ইশরাক আজ ৭দিন ধরে বাসায় খাওয়া দাওয়া করেনা। সকালে অফিস যায় তো রাত করে বাড়ি ফেরে। ওর জন্য খাবার যেভাবে রাখা হয় সেভাভেই পড়ে থাকে, ছুঁয়েও দেখেনা। নিসা ওর মায়ের কাছে গিয়ে বলল,”মা রোজ রোজ এতো খাবার নষ্ট করা ঠিক না। তুমি ভাইয়াকে কিছু বলছো না কেন?”

সানজিদা আহমেদ গাছে পানি দিতে দিতে বললেন,”আজ থেকে আর খাবার রাখিস না, বাইরের খাবার পছন্দ যখন বাইরেই খেয়ে আসুক। খাবার নষ্ট করে পাপের ভাগী হবার ইচ্ছে নাই আমার।”

“তোমার মনে হয় ও বাইরে খাচ্ছে! এমন নয়তো রাগ করে খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে?”

“ও রাগ করে আর যাই করুক খাওয়া বন্ধ করেনা।”

নিসা রেলিং এ হেলান দিয়ে বললো, “মা একটা কথা বলি শোনো, জীবনের ধারাবাহিকতা আটকে রাখা যায় না। মানুষ প্রথমে সন্তান হিসেবে বড় হয়, তারপর স্বামী/স্ত্রীরূপে–বাবা/মা–শ্বশুড়/শাশুড়ি—দাদা/দাদী। এই ধারাবাহিকতা চলতেই থাকে। মা-বাবা জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ এই কথা সত্যি, তবে এই ক্রমবর্ধমান জীবনকে তারা যদি বাধাগ্রস্ত করে কিংবা অধিকার হারানোর ভয়ে আটকে রাখার চেষ্টা করে তবে সন্তানের মনে সম্মানের জায়গাটা আর থাকে না।”

“এসব কথা তুই আমাকে বলছিস কেন? আমি তো বলেছিই যার যেখানে খুশি বিয়ে করুক আমার বলার কিছু নেই।”

“তুমি এভাবে ছেড়ে দিয়ে ব্যাপারটা আরো জটিল করেছ। আচ্ছা মা সত্যি করে বলো তো কুহু আপুর জায়গায় যদি সেইম কাজ সোনিয়া আপু করতো তুমি কী দোষ ধরতে? বিয়েতে অমত দিতে নাকী ভাইঝির দুষ্টমি ভেবে এড়িয়ে যেতে?”

সানজিদা বেগম তেতে উঠে বললেন, “তোর যত কুটনৈতিক চিন্তা। আমার ভাইঝি মোটেও এমন করতো না। ওর মধ্যে পারিবারিক নৈতিক শিক্ষা আছে। ও কখনোই এতো অভদ্র আচারণ করতো না।”

“করতো না মানলাম। তবে কুহু আপুর দিকটাও ভাবো, উনি ভাইয়াকে ভালোবাসে। নিজের ভালোবাসার মানুষের বদলে অন্য কাউকে বিয়ে করতে না চাওয়াটা কী অন্যায়? উনি যদি জানতেন আমরা কে তবে কখনোই কী এইসব করতেন? ”

“তুই কুহুর হয়ে ওকালতি করছিস কেন? ইশরাক তোকে কত টাকা দিয়েছে ওর হয়ে ওকালতি করতে?”

নিসা হেসে বললো,”আমার ভাইয়ের দুঃখ তুমি দেখেও না দেখার ভান করতে পারতেছ। আমি পারতেছি না। ওর চেহারা দেখলে আমি কেন যে কারোরই মায়া লাগবে, টাকাপয়সার বিনিময় আশা না করেই তোমার কাছে অনুরোধ নিয়ে আসবে।”

সানজিদা পানির পট রেখে মেয়ের দিকে তাকালেন, রুক্ষ গলায় বললেন,”আমাকে ভিলেন বানানো বন্ধ কর। তোদের সবার যখন ঐ মেয়ে এতো পছন্দ যা গিয়ে নিয়ে আয়। আমার কোনো আপত্তি নেই।”

নিসা মায়ের গলা জড়িয়ে বললো,” তুমি রেগে থাকিও না মা। একটু নরম হয়ে ভেবে দেখোনা। ভুল তো মানুষ ই করে তাই না? সব ভুলের শাস্তি কি দিতে হয়? কিছু ভুল ক্ষমা করে বড়রা ২য় বার সুযোগ দিলেই তো ছোটরা শোধরাতে পারে। তুমি আজ ভাইয়াকে হাসিমুখে বলবে, কুহুকে তোর পছন্দ তো, যা ওকেই আমি বৌ করে ঘরে তুলবো। তবুও দেবদাসের মতো ঘুরে বেড়ানো বন্ধ কর!”

সানজিদা আহমেদ বেশ সময় নিয়ে মেয়ের কথাগুলি ভাবলেন। “তবে কী একবার সুযোগ দেওয়া উচিত?”

নাহিয়ান কোথায় গেছে কোনো খবর নেই। ফোন সুইচড অফ করে রাখা। হসপিটালে খবর নিয়ে জানা গেল সেখানেও যায় নি‌। চিন্তায় কারো মাথা কাজ করছেনা। কোহিনূর সাবাকে বকা দিতে দিতে বললেন,”কি দরকার ছিল ছেলেটাকে এসব বলার। ও তোমাকে বেশি ভালোবাসে বলে কষ্ট দিতে মজা লাগে তাই না? এখন খুশি তো?”

সালমা বেগম বললেন, “বড় বৌমা রাগের মাথায় উল্টাপাল্টা বকো না, পরে নিজেই কষ্ট পাবা। ছেলেটা কোথায় আছে আগে খোঁজখবর নাও। বিপদে অস্থির হতে নাই।”

“আম্মা আপনি এই অবস্থায় ও আমাকেই চুপ থাকতে বলছেন? সাবাকে আমরা কেউ কখনো কিছু বলেছি? আমরা তো ধৈর্য ধরে আছি, ছেলেটা ওর মনের অবস্থা বুঝে একাকিত্ব দূর করতে হয়তো কথাটা বলেছে। তাই বলে ও বিয়ের কথা তুলবে? ও কী দেখেনি ওর শ্বশুড় এ কথা বলেছিল বলে নাহিয়ান কতদিন ওর বাবার সাথে কথা বলেনি? এখনো ঠিকঠাক কল করে খবর নেয়না। সেখানে ও কীভাবে পারলো এমন করতে?”

“আহ মা তুমি ঘ্যানঘ্যান করা বন্ধ করবে? এমনিতেই সবাই টেনশনে আছি তোমার এসব শুনতেও বিরক্ত লাগছে। এই ভাবি চলো তো এখান থেকে, এখানে বসে বসে এসব শুনে লাভ নেই। ভাইয়াকে খোঁজ করার জন্য লোক গেছে। ইনশাআল্লাহ ভাইয়া চলে আসবে।‌”

কুহু একপ্রকার টেনেই সাবাকে নিয়ে গেল। পাপিয়া আর আরওয়াও তার সঙ্গে গেল।

জোবায়ের সাহেব ইজি চেয়ারে বসে রইলেন।‌ ছেলেটা কখনো এমন‌ করেনা, আজ কোথায় গিয়ে যে বসে আছে কে জানে‌,কোনো বিপদাপদ হলো না তো!

জাওয়াদ গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে গাছগাছালিতে ভরা ১০মিনিটের পথ অতিক্রম করলো। দিঘীর সিঁড়িগোড়ে নাহিয়ানকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তার আন্দাজ সঠিক হয়েছে তাহলে!
মিটিং শেষে নাহিয়ানের খবর শুনে সে আর অফিসে ফেরেনি, গাড়ি ঘুরিয়ে নিজে ড্রাইভ করে আন্দাজে এখানে এসেছে। ছোটবেলায় স্কুল শেষে তারা দুই ভাই প্রায়ই এখানে আসতো, ফুটবল খেলতো, মাঝেসাজে সাতারের প্রতিযোগীতা করতো। জায়গাটা যেন একটুও বদলায় নি। আগের মতোই নিরব ও মনোরম হয়ে আছে।

নাহিয়ান পায়ের শব্দ শুনে বললো, “আমি ভাবি নি তুই আসবি! অবশ্য তুই ছাড়া এই জায়গার খোঁজ আর কেউই জানেনা।”

জাওয়াদ ওর পাশে বসে বলল, “আমিও ভাবিনি এতো জায়গা থাকতে তুই এখানেই আসবি! আন্দাজের উপর ঢিল মেরে দেখি নিশানা সঠিক জায়গায় লেগে গেছে!”

নাহিয়ান দূরে ঢিল মারলো। জাওয়াদ উঠে কিছু নুড়ি পাথর কুড়িয়ে আনলো, নাহিয়ানের পাশে রেখে বললো, “ব্যাঙের মতো ঢিল ছোঁড় দেখি! ছোটবেলায় কত শিখতে চেয়েছি এটা। শিখালি না একবারও!”

“ছোটদের সবকিছু শিখতে নেই!”

“সবসময় এসব বলে লাভ নেই, তোর আমার বয়সের গ্যাপ কোনো গ্যাপই না! তুই ইচ্ছে করে বড় সাজার জন্য আমাকে শিখাস নাই।”

নাহিয়ান ওর কথা শুনে ম্লান হাসলো। দুহাত পিছিয়ে ভর দিয়ে আকাশে তাকিয়ে বলল, “ছোটবেলায় ভাবতাম কখন বড় হবো, সবাই মান্যিগন্যি করবে। বড় হবার কত তাড়া ছিল আমার। অথচ দেখ যখন বড় হয়ে গেছি মনে হচ্ছে কেন যে এতো তাড়াতাড়ি বড় হতে গেলাম!”

জাওয়াদ ভাইয়ের দিকে শান্তদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। নাহিয়ানকে সে আগে কখনো কাঁদতে দেখেনি, হাতে পায়ে ব্যথা পেয়ে র*ক্ত বের হলেও সে শক্ত গলায় বলতো “আরেহ এটা কোনো ব্যথা হলো? খেলতে গেলে কত কিছুই হয়। ছেলেমানুষের শরীর নরম হলে চলে?”

সবসময় যাকে বুঝদার বড়ভাই রূপে দেখে অভ্যস্ত, তাকে দূর্বল ও অসহায় দেখতে জাওয়াদের ভালো লাগছেনা। একদমই ভালো লাগছে না!

চলবে,,

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৪৫

#আরশিয়া_জান্নাত

৪৫

“ওর সামনে খাবার দিয়ে বসে আছো কেন? দেখছো না ওর ডান হাত কেটে গেছে। ওকে খাইয়ে দাও।”

দাদী শাশুড়ির কথা শুনে সাবা নাহিয়ানে প্লেট নিতে হাত বাড়াতেই নাহিয়ান বলল, “মেঝ আম্মু অনেক দিন তোমার হাতে খাওয়া হয়না। আজকে খাওয়াবে?”

“কেন খাওয়াবো না, উঠে আয় আমিই খাইয়ে দিচ্ছি।”

সাবা খাবার নাড়াচাড়া করলেও মুখে তোলার আর জোর পেলো না। বুকের ভেতরের তান্ডব বাইরে প্রকাশ না পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে গেল পুরোটা সময়। পাপিয়া ওর হাতের উপর হাত রেখে ভরসা দিলো সব ঠিক হয়ে যাবে। জাওয়াদ আপন মনে খাবার খেয়ে যাচ্ছে। এখানে একমাত্র সে ই স্বাভাবিকভাবে ডিনার করছে, বাকি সবার দৃষ্টি নাহিয়ান আর সাবার দিকেই নিবদ্ধ। খাওয়া শেষে কুহু নিজের ঘরে না গিয়ে পাপিয়ার ঘরে গেল। ওর বিছানায় লম্বা হয়ে শুয়ে বললো,” আজ আমি তোর রুমে ঘুমালে তোর কি কোনো সমস্যা হবে?”

“তোকে তো আমি প্রায়ই বলি আমার সাথে ঘুমাতে, আমার সমস্যা হবে কেন?”

কুহু ওর কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে বললো, “পাপ্পি লাইফে কখনো জীব মানে প্রাণ আছে এমন কোনো কিছুর প্রতি আসক্ত হবি না। সবসময় জড়বস্তুর প্রতি মায়া জমাবি। আমি আগেই ভালো ছিলাম। আমার সব আসক্তি জড়পদার্থকে কেন্দ্র করে ছিল। তখন আমার কোনো কষ্ট হয় নি, ইজি পিজি লাইফ! যেই মানুষের প্রতি মন বসলো জীবনটা জটিল হয়ে গেছে। তাই বড় বোন হিসেবে তোকে সাজেস্ট করবো Never fall in love with mortal creature!”

পাপিয়া ফোন চার্জে দিয়ে কুহুর পাশে বসলো। নরম গলায় বলল,”জীবনের পথ মসৃণ হয়না। এখানে উত্থান পতন থাকবে। জীবনে হাসি-কান্না, আশা-হতাশা আছে বলেই এটা সুন্দর, একঘেয়ে নয়। আমি জানি আমাদের পরিবারে এখন সময়টা ভালো যাচ্ছে না। তবে আশা রাখছি এটাও স্থায়ী হবেনা।”

” মানুষের জীবনে অনেক অপূর্ণতা থাকে, তবে এরমধ্যে সবচেয়ে বড় অপূর্ণতা হলো একজন বিশেষ মানুষের ভালোবাসা না পাওয়া। কিন্তু তিক্ত হলেও সত্যি যে যেটা পেয়ে যায় ওটাকে আর মূল্যবান মনে করেনা। তখন মনে করে যা পাচ্ছেনা ঐটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল!”

“এটাই প্রেষণা। সন্তুষ্ট হয়ে গেলে মানুষ স্থির হয়ে যেত, মৃত্যু অবধি তার চাহিদা বদলাবে এটাই তো নিয়ম।”

“আচ্ছা পাপ্পি বল তো, বিয়ে টিকে থাকতে বাচ্চাই কি সব? এমনিতে দুটো মানুষ দুজনকে ভালোবেসে জীবন কাটিয়ে দিলে কী সমস্যা? মানছি বাচ্চা থাকা ব্লেসিং, ভবিষ্যৎ উত্তরসূরী রাখতে কে না চায়! কিন্তু এটাই সব না। ভাইয়া ভাবির জন্য আমার ভীষণ কষ্ট হয়। ওরা একে অপরকে কত ভালোবাসে। এইটুকুতেই কেন ওরা সুখী হতে পারেনা…”

“আপু তুই কাঁদছিস!”

কুহু চোখের কোণ চেপে বললো,”আরেহ না চোখে কি জানি পড়ছে!”

পাপিয়া ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,” মন খারাপ করিস না আপু। আল্লাহর কাছে দোয়া কর যেন সব ঠিক হয়ে যায়।”

নাহিয়ান বেলকনীতে দাঁড়িয়ে নিকোটিনের ধোঁয়া উড়াচ্ছে। সাবা রুমে ঢুকে দেখে থাই গ্লাসের ওপারটা ধোয়াময় হয়ে আছে। নাহিয়ান এমনিতে স্মোকার নয়, তবে যখন ওর মনমেজাজ খুব খারাপ থাকে তখন ১প্যাকেট ও পোষায় না।

সাবা বেলকনীর দরজা খুলতেই কেশে উঠল, নাহিয়ান চেঁচিয়ে বললো, “তুমি এখানে কেন এলে, সিগারেটের ধোঁয়াকত ক্ষতিকর জানো না?”

“এটা ক্ষতিকর তুমি তো জানো?তারপরও‌ কেন খাচ্ছ?”

নাহিয়ান উত্তর না দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। সাবা ওর পিঠে মাথা ঠেঁকিয়ে বললো,”আমাকে ক্ষমা করো‌ নাহিয়ান। আমি খুব স্যরি! আমার নিজেকে আজকাল একটুও ভালো লাগেনা। মনে হয় আমি তোমার লাইফে বার্ডেন হয়ে আছি। বিশ্বাস করো তোমাকে কষ্ট দেওয়ার উদ্দেশ্য আমার ছিল‌না। আমি কী করবো বলো, কতক্ষণ বাস্তবতা থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখবো। নিজের অক্ষমতার বোঝা আমাকে ভেতরে ভেতরে নিঃশেষ করে ফেলতেছে। আমি পারতেছি না স্বাভাবিক থাকতে, আমার জন্য তুমি নিজেকে কষ্ট দিও না প্লিজ!”

সাবা হিচকি তুলে কাঁদতে লাগলো। নাহিয়ান পেছন ঘুরে সাবাকে বুকে জড়িয়ে নিলো, মাথায় চুমু খেয়ে বললো,”কেঁদো না পাখি, তুমি জানো আমি তোমার কান্না সহ্য করতে পারিনা। প্লিজ থামো।”

“তুমি এতো ভালো কেন বলতে পারো? আমাকে বেশি ভালোবাসো বলেই আমার মাঝে এতো খুঁত। মা বলতেন শখের হাড়ির মাঝখানে কাঁচা হয়…”

“কেউই নিখুঁত না সাবা! আমি তোমাকে ভালোবাসি, আমার চোখে তুমি এই পৃথিবীর সেরা নারী। তুমি আমাকে ওয়াদা করো আর কোনোদিন আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা মাথায় ও আনবেনা, আর না আমাকে বিয়ে করতে বলবে। আমি তোমার সাথেই আমার জীবনের শেষ‌ নিঃশ্বাস পর্যন্ত বাঁচতে চাই। আমার জন্য তুমি যথেষ্ট। আমার আর কিচ্ছু চাই না।”

সাবা মাথা নেড়ে বললো,”তুমিও কথা দাও আর কোনোদিন এরকম নিখোঁজ হবেনা। আর এই ছাইপাশ ভুলেও ছুঁবে না।”

নাহিয়ান ওকে শক্ত করে ধরে বললো,”কথাদিলাম…”

বেশ কিছুদিন পর,,,

ইশরাক ও তার পরিবারকে দেখে কোহিনূর ভীষণ অবাক ই হলেন বটে। তাদেরকে সাদরে সোফায় বসিয়ে তিনি লাকিকে বললেন, অন্যদের খবর দিতে। কুশল বিনিময় শেষে ইশরাকের বাবা ইমতিয়াজ আহমেদ বললেন, “আপা আজকে আমরা বিশেষ অনুরোধ নিয়ে এসেছি। দয়া করে আমাদের খালি হাতে ফিরিয়ে দিবেন না। কুহু মাকে আমরা আমাদের পুত্রবধূ হিসেবে ঘরে তুলতে চাই।”

কোহিনুর তার শ্বশুড় শাশুড়ির দিকে তাকালেন, জোবায়ের সাহেব ইশারায় সম্মতি দিতেই তিনি বললেন,”এ তো আমাদের জন্য পরম সৌভাগ্যের। আপনারা বসুন আমি মিষ্টির ব্যবস্থা করছি।”

নিসা ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো, “আন্টি ব্যস্ত হবেন না, আমরা মিষ্টি নিয়ে এসেছি। আজ বিয়ের ডেট ফাইনাল না করে আমরা যাবোনা!আঙ্কেল মিষ্টির প্যাকেটগুলো ওখানে রাখুন।”

কোহিনুরের খুশিতে চোখে পানি এসে গেল। অবশেষে সত্যিই কুহুর বিয়ে হবে! এতো আনন্দ হচ্ছে তার!

সানজিদা আহমেদ বিনীত গলায় বললেন, “চাচাজান গতবারের ব্যবহারের জন্য আমি খুব লজ্জিত। অনুগ্রহ করে আমাকে ক্ষমা করবেন। ”

“দেখো মা আমার নাতনির আচারণের পরিপ্রেক্ষিতে তুমি তেমন করেছ, এতে তোমার ভুল নেই। সব মা ই চায় তার ছেলেমেয়ের জীবনে ভালো কেউ আসুক। যা হয়েছে সব ভুলে যাও। পুরনো তিক্ততা ভুলে নতুন সম্পর্কের মিষ্টতা ছড়িয়ে পড়ুক এই কামনাই করি।”

কুহু দোতলায় দাঁড়িয়ে সব দেখছে, ইশরাক মাথা নীচু করে সবার মাঝে বসে আছে। তার ভাবভঙ্গি দেখে কুহু ভেংচি কেটে বললো,”ঢং দেখলে আর বাঁচি না। এমনভাবে গাল লাল করে বসে আছে যেন সে নতুন বৌ, যত্তসব!”

“তুই না কেমন! এমন পরিস্থিতিতে লজ্জা পাওয়া স্বাভাবিক না?”

“আমার সাথে এই ১৪দিন যোগাযোগ রাখেনি, খোঁজখবর নেয়নি। এখন আসছে সরাসরি বিয়ের ডালা নিয়ে। কী ভেবেছে আমি ওকে বিয়ে করতে বসে আছি? তুই লিখে রাখ পাপ্পি ওর সাথে যদি আমার বিয়েও হয় ১৪দিন ধারেকাছেও ঘেষতে দিবোনা। ”

পাপিয়া হাই তুলে বললো,” দেখিস আবার ১৪দিন বলে ১ম রাতেই কনসিভ করে ফেলিস না!”

কুহু ওর দিকে ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,” তোর মুখ এতো পাতলা হলো কীভাবে? বড় বোনকে কী বলোস এগুলো। ছি ছি ছি লাজলজ্জার মাথা খেয়ে ফেললি!”

পাপিয়া হেহে করে হাসতে লাগলো।

আজ কুহুর গায়ে হলুদ। খন্দকার বাড়িত আত্মীয়স্বজনদের সমাগমে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। যদিও অনুষ্ঠান হবে নামকরা কমিউনিটি সেন্টারে, তবে যাবতীয় আচার অনুষ্ঠান বাসায় হওয়াতে ছোট বড় সকলের মাঝেই আনন্দের ফোয়ারা বয়ে যাচ্ছে। ইশরাকদের বাড়ি থেকে হলুদের ডালা আসার পর বড় ভাবি হিসেবে সাবা সেটা নিতে গেলেই মুরব্বিগোচের একজন চেচিয়ে উঠলো, “আয়হায় রে! সাবা এটা তুমি নিতেছ কেন? তুমি নিও না এটা, উফ তোমরা শহরের মেয়েরাও না কেমনজানি। কোনোকিছু বাছবিচার করো না বলেই এতো অমঙ্গল ঘটে। আরওয়া তুমি বরং ডালাটা নাও। এসব বিষয়ে খুব সতর্ক থাকতে হয়।”

কথাটা শুনে সাবার চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। আরওয়া বিরক্ত গলায় বললো, “ইসলামে মঙ্গল অমঙ্গল বলে কিছু নেই। এসব কুসংস্কার কথাবার্তা। এসব অহেতুক কথা বলা বাদ দিন তো।”

“শোনো মেয়ে বড়দের মুখে মুখে তর্ক করতে এসোনা। বিয়ের আচার অনুষ্ঠানে বাজা মহিলাদের ছায়াও পড়তে দিতে নাই। নেহাতই ও কনের ভাবি, তাই বলে সব তো এড়ানো যায়না।”

“আপনার জানায় ভুল আছে। আমাদের উম্মুল মুমেনিনদের মধ্যে অনেকেই নিঃসন্তান ছিলেন, কই তাদেরকে তো কেউ কোনকিছু থেকে সরিয়ে রাখেনাই। তবে আপনি কোন সূত্রে এসব বানোয়াট নিয়ম জারি করছেন? আমাদের কথায় ও কাজে যদি কারো মনে কষ্ট এসে চোখে পানি পড়ে এর পাপ কত হয় জানেন?”

“এই মেয়ের চোয়া আছে! এখনের যুগের মাইয়াগো আর কিছু থাক নো থাক চোয়াডা ঠিকই আছে। যাক বাবা তোগো যা মন চায় কর। আমি আর কিছু বলতাম না। পরে তোরাই পস্তাবি! আমার কী?”

সাবা আরওয়াকে থামিয়ে বললো,” থাক না এসব তর্ক করোনা, মুরুব্বি মানুষ মেহমান হিসেবে এসেছেন। কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তুমিই বরং এসব নাও। সমস্যা নেই”

“নাহ ভাবি এখন তুমি এই ছাড় দিলে চলবে না, আজ একজন বলেছে তার দেখাদেখি কাল আরো কয়েকজন বলবে। অজ্ঞতার চেয়ে খারাপ আর কিছু নেই। ওরা কোথা থেকে কিসব আজগুবি নিয়মকানুন বের করে আমাদের উপর চাপিয়ে দিবে আর আমরা সেসব মেনে চলবো? তুমি ধরো তো এসব। ”

সেই মহিলা মুখ ভার করে চলে গেলেন। সাবা ডালাটা নিয়ে কুহুর রুমে রেখে এককোণে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলো। সমাজের মানুষ এতো খারাপ কেন? তারা কেন বুঝতে চায়না ওদের কথা বুকের ভেতর কী কঠিন ক্ষত সৃষ্টি করে। আজ সাবাকে বাজা বলতেও বাঁধলো না ওদের! এতো তিরস্কার এতো অপমান!

ওদিকে সেই আত্মীয় গিয়ে রসিয়ে রসিয়ে আরওয়ার নামে সবার কাছে বদনাম করতে লাগলো,”মেয়েটার চেহারা যত সুন্দর হোক না কেন ভেতরটা অহঙ্কারে ভরা! নিজেরে নিজে কি একটা মনে করে। আমারে বলে আমি নাকি মূর্খ, কিছুই জানি না। দেখছেন অবস্থা? আমরা ১০জনের লগে খাই বই জীবন পার করি নো তো। হাওয়ায় হাওয়ায় আমাগো চুল সাদা হইছে। দুইদিনের মাইয়া আমারে হাদিসকালাম শিখায়!”

বিয়ে বাড়ির প্রৌঢ়া সমাজে আরওয়া বেয়াদব মেয়ে বলেই দ্রুত প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল।

চলবে…

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৪৬

#আরশিয়া_জান্নাত

৪৬

পাপিয়ার মন একটুও ভালো নেই। কুহুর বিয়ে নিয়ে তার অনেক পরিকল্পনা ছিল, সেসব পূরণও হচ্ছে। কিন্তু বোন আজ চলে যাবে, এটা ভাবতেই মন খারাপ হয়ে আসছে। বাড়িতে এতো কোলাহোল, এতো আনন্দ তার মাঝেও একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস পরিবারের সবার মাঝেই বিরাজমান। পাপিয়া পায়ে বাম মালিশ করতে করতে সেসবই ভাবছে। গতকাল নাচানাচি করে পা একদম গেছে। সকালে মাত্র ২ঘন্টা ঘুম হয়েছে। বাচ্চাদের হাউকাউ এ কোথাও শান্তি পাওয়া যাচ্ছেনা। এ বাড়িতে এখন শুধু জাওয়াদের রুমটাই কোলাহলমুক্ত। ওর আশেপাশে ঘেষার সাহসও কেউ দেখায় না, বলতে গেলে ওকে এড়িয়েই চলে ছোটবড় সবাই। গুরুগম্ভীর চেহারার জন্য হোক বা ওর একদমই কথাবার্তা না বলে এড়িয়ে যাওয়ার জন্যই হোক ওকে বিরক্ত করার কথাও কারো মাথায় আসেনা। এতে অবশ্য জাওয়াদের সুবিধাই হয়েছে, এসব অহেতুক শোরগোল ওর কখনোই পছন্দ না। অন্য কেউ রুমে ঢুকে ব্যক্তিগত জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করবে, বিছানা দখল করে বসে থাকবে এসব কল্পনা করতেও তার বিরক্ত লাগে।
আরওয়া ওর জন্য ব্রেকফাস্ট নিয়ে রুমে প্রবেশ করে বললো,”আম্মু বললো আপনি নাকি মানুষ দেখলে ডাইনিং এ যান না, তাই আমাকে দিয়ে খাবার পাঠালো।”

“সবাই খেয়েছে?”

“খাচ্ছে। আপনি খেয়ে নিন।”

“চলে যাচ্ছ নাকি?”

“কিছু বলবেন?”

“বসো আমার সামনে। আমি যতক্ষণ খাবো চুপচাপ বসে থাকবে।”

আরওয়া গ্লাসে পানি ঢেলে বললো,”একা খেতে ভালো লাগেনা? নীচে আসুন সবাই আছে তো।কত গল্প আর হাসাহাসি করছে।”

জাওয়াদ পরোটায় গোশত নিয়ে আরওয়ার মুখে তুলে বললো,”তোমার সঙ্গ চাইছি, অন্যদের না। আর ওদের আড্ডা মানেই অন্যদের নিয়ে গসিপ করা, কার কি হয়েছে, কে কী করেছে এসব নিয়ে দুনিয়ার বকবক। আমার এসব ভালো লাগেনা।”

“আচ্ছা!”

“আলমিরাতে একটা বক্স আছে নিয়ে আসো তো।”

আরওয়া উঠে বক্স আনলো। জাওয়াদ খেতে খেতে বললো,” কুহুর জন্য নিয়েছি। দেখো তো ওর পছন্দ হবে কী না?”

আরওয়া বক্স খুলে দেখলো খুব সুন্দর সোনার গহনা। ডিজাইনটা অনেক সুন্দর আর ইউনিক। “অনেক সুন্দর হয়েছে। আপু নিশ্চয়ই পছন্দ করবে।”

“আমি সেইম ডিজাইনের ৩টা গড়িয়েছি।”

“৩বোনের জন্য ৩টা তাই তো?”

“হুম। কুহু, পাপিয়া আর ছোট্ট রাইসার জন্য।”

“দারুণ কাজ করেছেন। ব্যাপারটা খুব সুন্দর!”

“ওদের পছন্দ হলেই হলো!”

“নিশ্চয়ই হবে। ভাই আদর করে দিচ্ছে পছন্দ হবেনা কেন? আপনার জন্য চা আনবো নাকি কফি খাবেন?”

“আপাতত কোনোটাই লাগবেনা। আমি এখন বের হবো।”

“কোথায় যাবেন? আপনার না ছুটি?”

“দাদাসাহেব বলেছেন উনার সঙ্গে যেতে, কুহুর বিয়ে উপলক্ষে দুপুরে খাওয়ানোর ব্যবস্থা করেছেন।”

“কই এই বিষয়ে কিছু শুনলাম না তো! কোথায় খাওয়ানোর ব্যবস্থা হচ্ছে?”

“বাসায় সবাই জানেনা। দাদাসাহেব ব্যক্তিগতভাবে সেটা করছেন।”

আরওয়া মুচকি হেসে বলল,”আপনি আর দাদাসাহেব একদম একই রকম। আপনাদের ভেতরটা বাইরে থেকে বোঝা যায় না!”

“সবার বুঝতে হবেনা, আমাদের জীবনসঙ্গীরা আমাদের বুঝলেই চলবে!”

কোহিনূর ব্যস্তগলায় বললেন,”সব জিনিসপত্র নিয়েছিস তো? শোন একদম লেট করবি না। ৮টায় বরযাত্রী আসবে তোরা ৭টার মধ্যে ওখানে উপস্থিত হবি। ওহ আরেকটা কথা কুহুর লাগেজগুলো লক করেছিস তো?”

পাপিয়া বলল,”বড় আম্মু এতো টেনশন করো না, আমরা আছি তো।”

কোহিনূর ওর চিবুক ছুঁয়ে আঙুলের ডগায় চুমু খেয়ে বলল,”তোরা আছিস বলে অনেকটা চিন্তামুক্ত আছি রে মা। আর শোনো আমার ছেলের বৌয়েরা, তোমরাও ভালোমতো সেজে নিবে কিন্তু। লোকে যেন বুঝতে না পারে কোনটা কনে কোনটা কনের ভাবি!”

তিনি চলে যেতেই রোকেয়া ছুটে আসলেন, কুহুকে বললেন, “কুহু ভাত কয়টা খেয়ে নিবি মা?”

“না মেঝ আম্মু এখন কিছু খাবোনা। আমার পেট ভরা আছে।”

“দেখিস কিন্তু অনেকক্ষণ ওখানে বসে থাকতে হবে।”

“সমস্যা নেই সত্যি বলছি!”

“আচ্ছা। ও সাবা তোমাকে নাহিয়ান খুঁজছিল, বের হবার আগে গিয়ে একবার দেখা করে আয় তো।”

ফাইজা বললো,” আমাদের নাহিয়ান ভাইয়া একটুও বদলায় নি। বিয়ের এতো বছর হয়ে গেলো এখনো সেই আগের মতোই বৌকে চোখে হারায়!”

“মাশাআল্লাহ বল। ওদের সম্পর্ক এমনি অটুট থাকুক সেই দোয়া করিস।”

“ইশ আমার নজর লাগেনা! তুমি যেভাবে বলছো যেন আমি নজর দিতে বসে আছি।”

“নজর কি বলে কয়ে লাগে? সুন্দর কিছু দেখলে আল্লাহর প্রশংসা করতে হয়, অথবা বলতে হয় আল্লাহুম্মা বারিকলাহু। এতে শয়তানের বদনজর আর লাগে না।”

ফাইজা বললো,” আচ্ছা আচ্ছা বুঝেছি। মাশাআল্লাহ মাশাআল্লাহ! তোমার ভাই ভাবির সম্পর্কে কারো নজর না লাগুক। হ্যাপি তো!”

কুহু হেসে বললো, “হুম অনেক হ্যাপি!”

সাবা নাহিয়ানের কাছে গিয়ে বললো,” জনাবের কী আজ্ঞা শুনি? হঠাৎ জরুরি তলব ?”

নাহিয়ান ওর কোমর জড়িয়ে কাছে টেনে বললো, “ভিটামিন বৌ এর অভাবে দৃষ্টিশক্তি দূর্বল হয়ে গেছে গো। কিছুই চোখে দেখতে পাচ্ছি না…”

“তুমিও না! কিসব যে বলো।”

“সত্যি কথার ভাত নেই বুঝলে। আমি সত্যি কথা বলি তো তাই আমাকে কেউ দাম দেয় না।”

“তা দাম দিতে কী লাগবে সোনার মোহর নাকি কড়ি?”

“অবুঝ বালিকা! সোনাদানায় কী আর দাম মেটে?”

“তবে কী চাই?”

“উমম হাজার দুয়েক চুমুতে আপাতত কিছুটা মিটবে!”

সাবা ভেংচি কেটে বললো,”এহহ আমার বয়েই গেছে! দেখি এখন ছাড়ো পার্লারে যাওয়ার জন্য সবাই বসে আছে। এমনিতেই সবাই হাসাহাসি করছিল, কী একটা অবস্থা!”

“আমার বৌকে আমি ডেকেছি এতে হাসাহাসির কী আছে? তাছাড়া আমি তো অকারণে ডাকিনি। আমার কারণটা আসলেই গুরুত্বপূর্ণ!”

“হ্যাঁ এখন দেখেছ তো, চোখের দ্যুতি ফিরেছে নিশ্চয়ই, এবার যাই?”

“হুম যাও।”

রুমাইসা কোল্ড ড্রিংকে চুমুক দিয়ে স্টেজের দিকে তাকিয়ে আছে, বধূবেশে কুহুকে অনেক বেশিই ভালো লাগছে। আরওয়া যদিও এতোক্ষণ ওর সাথে বসেছিল, কিন্তু বিয়ে পড়ানোর কার্যক্রম শুরু হতেই ও স্টেজের দিকে চলে গেছে। রুমাইসা বসে বসে ওদের কার্যকলাপ দেখছে। এমন সময় সাম্য গলা খাকারি দিয়ে বলল,”কেমন আছেন মিস রুমাইসা?”

“ভালো। আপনি?”

“জ্বি ভালো। ডিনার করেছেন?”

“নাহ। আরওয়ার সঙ্গে খাবো।”

“আচ্ছা!”

“কিছু বলবেন?”

সাম্য কপালের ঘাম মুছে বললো,” এখানে এসি বোধহয় কভার হচ্ছেনা।”

“এসির পাওয়ার ঠিকই আছে, আপনি নার্ভাস হয়ে যাওয়ায় এমন মনে হচ্ছে। কোল্ড ড্রিংক খাবেন?”

“ধন্যবাদ আমি ঠিক আছি।”

“দাঁড়িয়ে কেন বসুন না!”

সাম্য চেয়ারে বসে বলল,” আপনাকে আজ খুব সুন্দর লাগছে!”

“তাই? থ্যাঙ্কস!”

সাম্য কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, “রুমাইসা আপনার লাভ ম্যারেজ পছন্দ নাকি এরেঞ্জ?”

“লারেঞ্জ।”

“লারেঞ্জ?”

“হুম আধা লাভ আধা এরেঞ্জ!”

“মাই গুডনেস! আপনি তো নতুন শব্দ ক্রিয়েট করে ফেললেন।”

“এটা এখন ট্রেন্ড। দুটো শব্দকে মিক্সড করে একটা বানানো। বাই দ্য ওয়ে আপনার প্ল্যান কী আমাকে প্রপোজ করবেন নাকি বাসায় আসবেন?”

ওর কথা শুনে সাম্যর হিচকি উঠে গেল। রুমাইসা ওয়েটার থেকে পানি নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে বললো,” এতো অল্পতেই ভিমড়ি খেলে চলে? আমি তো এখনো আসল কথাই বলিনি।”

সাম্য কোনোমতে পানি খেয়ে বললো,” আসল কথা বলতে?”

রুমাইসা নিজের চুল ঠিক করে বললো,”ঐ টেবিলে আমার বাবা-মা আপনার পরিবারের সঙ্গে বসে আছেন। তাকিয়ে দেখুন তাদের দৃষ্টি এখানে। আপনি যদি এখন আমাকে কনভিন্স করতে পারেন তবে অফিশিয়ালি একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”

সাম্য তাকিয়ে দেখলো ওর মা বোন হাসিহাসি মুখ করে ওর দিকে চেয়ে আছে ও এতক্ষণ এটা খেয়ালই করে নি!

কাজী সাহেব যখন পরিচয় বর্ণনা করে কবুল বলার কথা বললেন, তখন জাওয়াদ আরওয়ার পাশে দাঁড়িয়ে ধীর গলায় বললো, “আমাদের বিয়ের কথা ভাবছো বুঝি?”

“কীভাবে বুঝলেন?”

“আমিও সেটা ভাবছি তাই বললাম।”

“আপনি নিশ্চয়ই কাঁদো কাঁদো গলায় কবুল বলেছিলেন তাই না?”

“অবুঝ ছেলেরাই হেসে হেসে কবুল বলে! কারাগারে ঢোকার খবর জানলে কখনোই হাসতো না।”

আরওয়া নাক ফুলিয়ে বললো,” আপনি কারাবাসে আছেন বললেন? আমি আপনাকে কোনো পেইন দিয়েছি? আমার নামে এত বড় অপবাদ!”

“তোমার কথা বলি নি তো। তুমি তো গুড গার্ল!”

“ঢং”

জাওয়াদ অন্যদিকে ফিরে হেসে বললো,”এংরি বার্ড একটা!”

চলবে…

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৪৭

#আরশিয়া_জান্নাত

৪৭

“আস্সালামু আলাইকুম আন্টি।”

“ওয়ালাইকুমুস্সালাম। কেমন আছ?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি ভালো তো?”

“আলহামদুলিল্লাহ!”

“আপনারা এসেছেন আমি অনেক খুশি হয়েছি। আঙ্কেল আসেননি?”

“হ্যাঁ এসেছে।”

“আচ্ছা আপনারা বসুন আমি আম্মুকে ডেকে আনছি।”

পাপিয়া রিজভীর মা-বোনকে বসিয়ে নিজের মাকে খুঁজতে গেল। যাওয়ার পূর্বে ওয়েটারকে বলে গেল উনাদের খেয়াল রাখতে।

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা প্রায় শেষের পথে, একটু পরেই কনে বিদায় দেওয়া হবে। এই মুহূর্ত প্রতিটা মেয়ের জীবনে যতটা কষ্টের তার চেয়ে অধিক কষ্টের তার বাবা-মায়ের জন্য। কুহু ভেবেছিল তার বিয়ের দিন তার মায়ের চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হবেনা। তিনি ওর বিয়ে নিয়ে গত কয়েকবছর যে পরিমাণ টেনশন করেছেন, আজ সেটা থেকে মুক্ত হয়ে নিশ্চয়ই খুশিতে গদগদ হয়ে মেয়েকে বিদায় করে বলবেন, “উফ আপদ বিদায় হলো!” কিন্তু না কোহিনূর মেয়েকে জড়িয়ে যে মরা কান্না জুড়েছিলেন তাতে উপস্থীত সবারই চোখে পানি আসতে বাধ্য হয়েছিল। মায়েরা যতই মেয়ের বিয়ে নিয়ে কথা শোনাক না কেন, বিয়ের দিন ঠিক হলে তাদেরই বেশি পুড়ে! বাবা-মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কুহু চলেছে জীবনের নতুন এক অধ্যায়ে পাশে তার বহুকাঙ্ক্ষিত শখের পুরুষ। ইশরাক নিরবতা ভেঙে বললো,”কুহু মন খারাপ করো না। তোমার যখন ইচ্ছে হবে ওখানে যেতে পারবে। আমি মানা করবোনা। আর কেঁদো না প্লিজ!”

কুহু চোখের কোণে টিস্যু চেপে বসে রইলো। এতো কান্না কোত্থেকে আসছে কে জানে!

আরওয়া ক্লাসে বসে স্যারের লেকচার নোট করছে। রুমাইসা মনোযোগী ছাত্রীর মতো স্যারের দিকে তাকিয়ে থাকলেও ওর মন এখন এখানে নেই।পেটের ভেতর কথাগুলো ঘুটঘুট করছে, আরওয়াকে না বলা অবধি সে শান্তি পাবেনা। আরওয়া আবার ক্লাসে কথা বলে পছন্দ করেনা। সে তো পারলে স্যারের সব কথা এ টু জেড খাতায় তুলে নিবে। রুমাইসা মনে মনে প্রার্থনা করছে ক্লাসটা দ্রুত শেষ হোক।

ক্লাস থেকে বেরিয়ে আরওয়া বলল,”চেহারা এমন বাংলার পাঁচের মতো করে রেখেছিস কেন?কী হয়েছে?”

“বিয়েতে কী পড়বো বুঝতেছিনা। একবার মনে হচ্ছে কাতান পড়ি, আবার মনে হচ্ছে জামদানি পড়ি, আবার লেহেঙ্গা পড়তেও মন চাইতেছে। আমি অনেক কনফিউজড!”

“এটা নিয়ে টেনশনের কী আছে? হলুদে জামদানি পড়িস, বিয়েতে কাতান রিসিপশনে লেহেঙ্গা! হয়ে গেল তো।”

” ধুরর তুই বুঝতেছোস না। বিয়েতে জামদানি পড়া এখন ট্রেন্ড। তাসনিয়া ফারিন কে দেখোস নাই কী সুন্দর লাগছিল! কুহু আপুকে কাতান শাড়িতে জোস লাগছে, দেখে ঐটা পড়তে মন চাইছে। পরে ইনস্টাতে লেহেঙ্গা দেখে….”

আরওয়া বিরক্ত গলায় বললো, “এখন একদিনে সব ট্রেন্ড ফলো করলে কেমনে হবে?”

“সেটাই তো!”

“সাম্য ভাইয়াকে বলেছিস?”

“নাহ।”

” এক কাজ কর এসব ট্রেন্ড বাদ দে, সাম্য ভাইয়ার কোনটা পছন্দ সেটা জিজ্ঞেস কর, সে অনুযায়ী সিলেক্ট কর। যত বেশি ঘাটবি তত কনফিউজড হয়ে যাবি। এর চেয়ে যার জন্য সাজছিস তার পছন্দকে গুরুত্ব দেয়া শ্রেয়!”

“সেটাই করতে হবে মনে হচ্ছে। তুই লাকি রে, তোকে এসব প্যারায় পড়তে হয়নাই।”

“এমনভাবে বলছিস যেন কয়েক যুগ আগে আমার বিয়ে হয়েছে। তখন এসব ছিল না!”

“সেটা বলিনাই। তবে তুই আমার মতো কনফিউজড তো ছিলি না।”

“হুম এটা ঠিক। এখন পরীক্ষায় ফোকাস কর, পরীকৃষার পর না বিয়ের ডেট ফিক্সড হলো?”

“এটাই বিরক্তিকর। পরীক্ষাটা মাঝখানে না টপকালে হতো না! বিয়ের পর পরীক্ষা হলে কী হতো!”

“আমারে বলোস আমি জামাই পাগল, এদিকে তুই তো বিয়ের আগেই সেটা হয়ে গেলি!”

রুমাইসা বাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, “লোকটাকে দেখলে একটু মায়াই লাগে। কেমন বলদা বলদা লুক নিয়ে তাকাই থাকে। সেজন্য একটু মায়া দেখাই আর কী এমনিতে কিছু না!”

“হইছে আর বুঝ দিতে হবেনা। আমরা খাই সুজি কিছু কিছু বুঝি!”

রোকেয়া বেশ কিছু কাপড় কিনে এনেছেন কাঁথা সেলাইয়ের জন্য। একটু পরেই সাহেরা নামে একজন আসতেই তিনি বললেন, “এখানে আস্তরসহ কাপড় দিচ্ছি, ৫০/৬০টা কাঁথা বানাবে। নকশি করে বানাবে ২০টা বাকিগুলো এমনি সেলাই করলেই হবে।”

“আন্টি আমনেগোর বাড়ির কারো বাচ্চা হইবো নাকি? হঠাৎ এতো খেতা সিলাইতে দিতাছেন?”

“সময় থাকতে থাকতে বানিয়ে নিচ্ছি, কার কখন সুখবর আসে বলা তো যাচ্ছেনা।”

“ওহ আইচ্ছা, বুদ্ধি ভালাই।”

“শোন তোর বোনের হাতের কাজ সুন্দর। ওরে বলিস নকশিগুলো যেন ও করে। যারেই দেই না কেন সবকয়টাই আদরের। তাই কাঁথাগুলো সুন্দর হতেই হবে।”

পাপিয়া মায়ের কান্ড দেখে বললো,”ওরে বাবা এ তো এলাহি কান্ড! তুমি কী সবার বাচ্চার জন্য কাঁথা সেলাই করতে বসছো?”

“এতো চিল্লাইস না। সবাই শুনলে আরেক কাহিনী শুরু হবে।”

পাপিয়া মায়ের কাছে বসে বললো,” সত্যি করে বলো তো আরওয়া ভাবীর সুখবর পাইছো?”

“আরেহ নাহ। এমনিই বানাই রাখতেছি।”

“ওহ। সাহেরা আপা আমার জন্য একটা বড় নকশী কাঁথা বানাবেন।”

“আমনে কাপড় ডা খালি দেন, বাকি সব আমার কাম। এমন সুন্দর ডিজাইন কইরা দিমু সবাই হা কইরা চাইয়া থাকবো।”

পাহাড়ের ঢল বেয়ে নেমে আসা বিশাল ঝর্ণার নীচে জাওয়াদ আর আরওয়া দাঁড়িয়ে আছে। পানি আর বাতাসের শব্দ মিলেমিশে অন্যরকম এক পরিবেশ। চারদিকে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ, গাছগাছালির সোঁতা গন্ধ। আরওয়া উল্লাসিত গলায় বললো,”আমার অনেক ইচ্ছে ছিল এমন ঝর্ণা সরাসরি দেখার। কী সুন্দর এটি!!”

জাওয়াদ মুচকি হেসে বললো,”তোমার পছন্দ হলেই স্বার্থক!”

আরওয়া এক কিনারায় বসে পানি নিয়ে খেলতে লাগলো। জাওয়াদ ওর দিকে মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আরওয়ার উচ্ছাসিত বাচ্চামো দেখতে আজকাল ওল ভালোই লাগে। মেয়েটা কখন যে ওর মনের অনেকটা অংশ দখল করে নিয়েছে কে জানে! জাওয়াদ শুরুতে ভেবেছিল এই বিয়েটা ১মাস ও টিকবে না, ও আরওয়াকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে। তখন আরওয়াকে ওর ইমম্যাচিওর,ইরিটেটিং ক্যারেক্টার মনে তো। ওর অগোছালো স্বভাব, জিনিসপত্র এলোমেলো করার প্রবণতা, ঘুমের মধ্যে অস্থির অঙ্গিভঙ্গি সবই বিরক্তিকর লাগতো। অথচ সময়ের সাথে সাথে সব অভ্যেস হয়ে গেছে। আরওয়াও অনেকটা সংসারী হয়েছে, গুছিয়ে চলা শিখছে। গতিটা ধীর হলেও চেষ্টা করে যাচ্ছে এতেই জাওয়াদ খুশি। ঘুমের মাঝে ছটফট ভাবটা সম্পূর্ণ না কমলেও জাওয়াদের বুকে স্থির হয়ে থাকাটা ওকে স্বস্তি দেয়। আজকাল জাওয়াদের বরং কষ্ট হয় ওর সান্নিধ্য না পেলে। ও নাক ফুলিয়ে রেগে ঝগড়া না করলে মনে হয় দিনটা পূর্ণই হলো না।
আরওয়া ওর দিকে পানির ঝাপটা দিতে ধ্যান ভাঙ্গে তার, আরওয়া ভ্রূ উঁচিয়ে বলল,” কোথায় হারালেন?”

জাওয়াদ মুখ মুছে বলে,” এটা কী হলো? এভাবে কেউ পানি মারে!”

“তো কীভাবে মারে?”

“দাঁড়াও দেখাচ্ছি,,”

জাওয়াদকে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে আরওয়া পেছাতে থাকে। হেসে বলে, “আমার ডেমো চাই না। আমি বুঝে গেছি….”

“এখন বললে তো হবে না। আমি ডেমো তো দিবোই। এমন পেছাচ্ছ কেন?”

“আপনি নিশ্চয়ই ডেঞ্জারাস কিছু করবেন, আপনাকে আমি ভালো মতো চিনি।”

“আরওয়া পিছিও না। স্থির হয়ে দাঁড়াও।”

আরওয়া মাথা নেড়ে না বলতে বলতে পেছালো। এলোমেলো পাথরের কিনারায় ব্যালেন্স করতে ওর কষ্ট হলেও স্থির হলোনা। জাওয়াদ ওকে আকড়ে ধরার জন্য এগোতে চাইলেও ও থামলো না। এক পর্যায়ে জাওয়াদ দাঁড়িয়ে বললো,” আরওয়া থামো,‌আর পিছিও না For God sake!”

আরওয়া খিলখিল করে হেসে বললো,”হুম আমি থেমে যাই আর আপনি ঝট করে ধরে ফেলুন। হবে না সেটা। আমি আর বোকা নেই!”

জাওয়াদ ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আরওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো, আরওয়া পেছাতে পেছাতে অনেকটা দূর চলে গেছে। হঠাৎ পা পিছলে আরওয়া ঝিলে পড়ে গেল। পানিতে হাবুডুবু খেয়ে জাওয়াদকে ডাকতে লাগলো। জাওয়াদ ওর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলেও পা কিছুতেই এগোচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে ওর একেকটা পায়ের ওজন কয়েক মণ হয়ে গেছে, সে কিছুতেই পা নাড়িয়ে এগোতে পারছে না। আরওয়া ওকে প্রাণেপনে চিৎকার করে ডেকেই যাচ্ছে আর বলছে, “আমি সাতার পারি না, আমাকে বাঁচান। জাওয়াদ আমাকে বাঁচান প্লিজ…”

হঠাৎ আরওয়া পেছনে তাকিয়ে দেখে বিশাল আকৃতির কুমির তার দিকে এগিয়ে আসছে। ভয়ে ওর আত্মা উড়ে যায় যেন। ও পানিতে ধাপাধাপি করে কিনারায় পৌঁছানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে‌। কিন্তু পানির স্রোতের সঙ্গে পেরে উঠে না। জাওয়াদ ওর কাছে এগিয়ে আসতে আসতে পুরো পানি রক্তে লাল হয়ে উঠে…

জাওয়াদ ঘুম থেকে উঠে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে। চোখের কিনারা এখনো অশ্রুসিক্ত, ভয়ে তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। কাঁপা হাতে ল্যাম্প অন করে আরওয়াকে দেখে ওর মন শান্ত হলেও দুঃস্বপ্নের প্রভাব দূর হয় না। ও গ্লাস থেকে পানি পান করে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করে। মানসপটে বারবার ভেসে উঠে সেই ভয়ানক দৃশ্য। জাওয়াদ আরওয়া কে তুলে বুকের মাঝে নেয়। গালে কপালে চুমু খেয়ে বলে,”আলহামদুলিল্লাহ তুমি ঠিক আছ, তোমার কিচ্ছু হয় নি। ঐটা দুঃস্বপ্ন ছিল।”

আরওয়া মুখে পানির অস্তিত্ব টের পেয়ে জেগে উঠে, ওর চোখ মুছে দিয়ে ঘুমঘুম গলায় বলে, “কী হয়েছে? আপনি কাঁদছেন কেন? খারাপ স্বপ্ন দেখেছেন?”

জাওয়াদ ওর হাতেরমুঠোয় চুমু দিয়ে বলে,”আরওয়া তুমি কখনো আমার কথা অমান্য করবে না। আমি না বললে ঐ পথে আর এগোবে না প্লিজ। তুমি সাবধানে থাকবে বুঝছো।তোমার লাইফে আমার চেয়ে বেস্ট অনেক ছেলে আসলেও আমার লাইফে তোমার মতো কেউ আসবেনা। আমার কাছে তুমি মূল্যবান। এটা মাথায় রেখো।”

আরওয়া ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো,” খারাপ স্বপ্ন সত্যি হয় না। ঐগুলো আমাদের ভাবনার রিফ্লেক্ট। এতো পাত্তা দেওয়ার কিছু নেই। যা দেখেছেন ভালো দেখেছেন। শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন তো। আমি আছি আপনার পাশে।”

জাওয়াদ শান্ত হলো না। বরং সেই রাতে তার গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো।

পাপিয়া জাহিদের সঙ্গে গল্প করতে করতে বাসায় ফিরছিল। হঠাৎ তাদের গেইটে তাকিয়ে দেখে বেশ কয়েকটা গাড়ি এসেছে। জাহিদ বললো, “বাসায় কোনো মেহমান এলো নাকি?”

“কুহু আপুদের তো আজ আসার কথা না। তাহলে কে এলো?”

“চলো ভেতরে গিয়ে দেখি।”

পাপিয়া বাড়ির ভেতরে ঢুকে ভুত দেখার মতো চমকে যায়। তাদের ড্রইং রুমে রিজভী ও তার পরিবারের সবাই বসে আছে। রিজভী দেশে ফিরলো কবে! কই ওকে তো কিছু বলেনাই।

চলবে…