Friday, August 8, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 163



কাঁটাকম্পাস পর্ব-৪২+৪৩

0

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৪২

#আরশিয়া_জান্নাত

৪২

রুমাইসা ক্যাফেতে খাবার অর্ডার করে টোকেন নিয়ে এসে বসলো। ফোনে গেইম প্লে করে খাবারের অপেক্ষা করার মতো বিরক্তিকর কাজটা এভয়েড করতেই এই কারসাজি। এই ক্যাফের বার্গার তার অনেক পছন্দ বলেই সে নিয়মিত এখানে আসে, এখানে ফুড রেডি হতে বেশ সময় লাগে, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে এখানে আরাম হলেও একা এলে একটুও ভালো লাগেনা। অবশ্য এখন একা না এসেও উপায় কী, আরওয়া এখন সংসারী মেয়ে। বিয়ের পর খুব কমই তারা একসঙ্গে অফটাইমে বের হয়। রুমাইসা তাই নিজেকে নিজেই সময় দেয়। একা একাই বেরিয়ে পড়ে, পিজ্জা খায়, মুভি দেখে। মাঝেমধ্যে বেরিয়ে পড়ে শহরের সুন্দর সুন্দর জায়গাগুলো দেখতে।

“এক্সকিউজ মি?”

রুমাইসা ফোন থেকে দৃষ্টি না সরিয়েই বললো, “বলুন”

“কি গেইম খেলছেন?”

“COC”

“টাউনহল কত?”

“12”

“বাহ! তবে এখনো এটা কেউ খেলে নাকি?”

“ওয়েট এ মিনিট”

রুমাইসা দারুণ একটা ভিলেজ পেয়ে, তাই সৈন্য সামন্ত নিয়ে এট্যাক করলো সেই ভিলেজে। স্ট্রং স্পেল ফেলে এয়ার ডিফেন্স আধমরা করে আর্চার আর উইজার্ড দিয়ে একপাশ ঘিরে ড্রাগন ছেড়ে দিলো। জায়ন্ট দিয়ে ডিফেন্সগুলো ভেঙে গুড়িয়ে দিলো মুহুর্তেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো গ্রামটা তছনছ হয়ে থ্রি স্টার ক্লেইম করে রুমাইসা সামনে তাকালো, সাম্য ভেবেছিল ওকে দেখে রুমাইসা চমকাবে। কিন্তু তার ভাবনা গুড়ে বালি। রুমাইসা বলল, “আপনার জব কি চলে গেছে নাকি? কাজকর্ম ফেলে আমাকে ফলো করছেন কেন?”

সাম্য ওর টোকেনটা দেখে বলল, “আপনার ফুড রেডি হয়ে গেছে।”

রুমাইসা উঠে গিয়ে নিজের ফুড রিসিভ করলো। এসে দেখে ওর টেবিলের উপর একটা লাল গোলাপ আর কার্ড রেখে সাম্য চলে গেছে। রুমাইসা বার্গারে বিগ বাইট দিয়ে বলল, “গোবলিন একটা! আসবে দেখবে তারপর ফুল রেখে চোরের মতো পালিয়ে যাবে,, যত্তসব ন্যাকা!”

জহির সাহেব চা মুখে দিয়ে বললেন,”আমাকে তুমি তিতা করলার মতো ভালোবাসো মানছি, তাই বলে চায়ে বেশি লিকার দিয়ে সেই তেতো ছড়িয়ে দিতে হবে! এক কণা চিনিও বোধ হয় দাও নি এতে?”

রোকেয়া উনার সামনে বসতে বসতে বললেন, ওসব আমায় বলে লাভ নেই, বড় রাজকুমারী রান্নাঘরে পা রেখেছেন। এখন এসব টুকটাক ঘটনা তো ঘটবেই!”

কুহু চিনির বাটি নিয়ে এসে বলল,”মেঝ আব্বু চা খেয়ো না। চিনি দিতে একদম ভুলে গেছি। দাঁড়াও চিনি গুলে দেই”

জহির সাহেব বললেন, “তুই কী এখন সবার ঘরে গিয়ে গিয়ে এমন চিনি দিয়ে আসছিস?”

“হু! চিনির পট সবার আগে রেখেছি অথচ এটা দিতেই ভুলে গেছি। কী একটা অবস্থা! আচ্ছা যাই ভাইয়ারটায় চিনি দিয়ে আসি।”

বলেই কুহু যেমন দ্রুত এসেছিল তেমনি দ্রুত চলে গেল। জহির সাহেব বললেন,” শাস্তিটা সহজ ভেবেছিলাম, কিন্তু ওকে দেখে মনে হচ্ছে এটা ওর জন্য কঠিন ই হবে!”

“বড়ভাবি তো অনেক খুশি হয়েছেন। রান্নাবান্নায় ওর একটুও আগ্রহ নেই। এখন যদি কিছু শিখে আর কী!”

“আজ দুপুরে কী ও রান্না করবে? তোমরা না থাকো শেফ কেউও নেই?”

“হুম ও রান্না করবে। আর শেফ থাকলে আর লাভ কী? ওকে সাহায্য করতে লাকি থাকবে তাও শর্ত হলো রান্নায় কিছু বলে দিবেনা। ও নিজের বুদ্ধিতে করবে।”

“এটা ঠিক হলো না। না দেখিয়ে না শিখিয়ে এরকম ছেড়ে দিলে হয় নাকি? তোমরা সুযোগে আমার মেয়েটাকে খাটিয়ে মারার পায়তারা করছো।”

“তাও ওর ভাগ্য ভালো বাপের বাড়িতেই এই ফীল পাচ্ছে। পরের বাড়ির রান্নাঘর যদি জীবনের প্রথম হতো অবস্থা আরো খারাপ হতো।”

“তাও ঠিক!”

নাহিয়ান টাই বাঁধতে বাঁধতে বলল,”আমি তোর ভবিষ্যৎ নিয়ে রীতিমতো শঙ্কিত। এমন ছেলে চুজ করেছিস যে খেতে ভালোবাসে, অথচ নিজে সামান্য চা টা ও করতে পারিসনা। তোদের সংসারে অন্যকিছু নিয়ে ঝগড়া হবে কী রান্নার জন্যই না গৃহযুদ্ধ লেগে যায়!”

কুহু টেবিলের উপর চায়ের কাপ রেখে বললো, “বিয়ের সময় যৌতুক হিসেবে একটা শেফ দিয়ে দিস। তাহলেই হলো!”

“যৌতুক দেওয়া এবং নেওয়া সমান অপরাধ। সো এসব মিথ্যে আশায় বাসা বাঁধিস না, সময় থাকতে থাকতে নিজেই শিখে নে।”

“শোন ভাইয়া এটা ডিজিট্যাল যুগ, ইউটিউবে রান্নাল টিউটেরিয়ালের অভাব নেই। মানুষ এখন ঘরে বসেই কত রকম রান্না শিখে ফেলছে। এ আর কঠিন কী? এতো তাড়াহুড়ার কিছু নেই!”

“এসব ভেবে ভেবে ২৫ এ পা দিলি! এখনো তোর শেখার বয়স হলো‌না? তোর চেয়ে ছোট আরওয়া এখন দিব্যি সংসার করছে, রান্নার হাত ও চমৎকার আর তুই!”

“তুলনা দিস না, তুলনা ভালো লাগেনা।”

“সত্যি সবসময় তিতাই লাগে। যাক যার যার বুঝ দাঁড়ি কাটি রাখে মোচ।”

আরওয়া আয়নায় পেছনে ল্যাপটপে বিজি থাকা জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে চুল আচড়াচ্ছে। জাওয়াদ বলল, “এরকম হা করে চেয়ে না থেকে কি বলবে বলে ফেলো।”

আরওয়া ওর দিকে ফিরে বলল,”আমি হা করে চেয়ে আছি?”

“হা করো‌নি, তবে এক ধ্যানে তাকিয়ে তো আছ নাকি!”

“আমার বরের দিকে আমি তাকাবো না তো কে তাকাবে? যদিও সে তার ল্যাপটপ ব্যতীত কিছুই চোখে দেখে না…”

জাওয়াদ ল্যাপটপ রেখে উঠে কফি মেকার অন করলো। আরওয়ার সামনে গিয়ে বসে বলল, ” আমার কাজকে এতো হিংসা করো তুমি? ”

“অবশ্যই করি। সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত অফিস করে এসেও যদি ল্যাপটপেই মুখ গুজে রাখেন হিংসা করা কী অস্বাভাবিক হবে? আপনার উচিত বাসায় যতক্ষণ থাকেন আমার দিকে তাকিয়ে থাকা।”

জাওয়াদ ওর চুলের ভাজে হাত গলিয়ে বললো,”তোমার শ্যাম্পুর ঘ্রাণটা তো খুব সুন্দর!”

“দেখেছেন কাজ থেকে মন সরলেই বৌয়ের কত কী নজরে আসে?”

“তোমার নাকটা আরেকটু উঁচু হলে সুন্দর লাগতো, এখন খানিকটা বোঁচা লাগে।”

“মোটেই না। আমার নাক ঠিক ই আছে।”

“আয়নায় ভালো মতো দেখো বুঝতে পারবা। এই তোমার মাথায় উকুন ও আছে দেখছি! আয়হায় তাই তো বলি আমার মাথায় কি চুলকায়। তোমার থেকে আমার মাথাতেও উকুন চলে এলো নাকি?”

“যার চুল আছে, তার উকুন থাকবেই। এতে এতো নাক ছিটকানোর কী আছে? উকুন হলো চুলের শোভা বুঝলেন!”

“বলছে তোমারে!”

“আপনি যান তো কাজ করেন,,”

“ওমা কেন? তুমি না বললে তোমাকে দেখতে? এখন কাজ করবো কেন?”

“দেখতে বলেছিলাম দোষ ধরতে না।”

জাওয়াদ হাসি আটকে বলল,” মনোযোগ দিয়ে তাকালে যা চোখে পড়ে তা বলা কী অন্যায়?”

আরওয়া চুলে ক্লিপ আটকে বললো, “ন্যায় অন্যায় দিয়ে আমার কাজ কী? আপনি যান তো আপনার কাজ করুন।”

জাওয়াদ ওর নাক টেনে বলল, “রোজ এভাবে নাক টানবে বুঝছো!”

আরওয়া নাক ফুলিয়ে বলল,”আপনি একটা তেলাপোকা! অসহ্য অসহ্য অসহ্য।”

জাওয়াদ ওর হাত ধরে কাছে টেনে বলল,”এই অসহ্যকর লোকটাকেই পুরো জীবন সহ্য করতে হবে তোমার। কী দুঃখ!”

আরওয়া ওর হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলল,”হাত ছাড়ুন, আমি বাইরে যাবো।”

“আমি একবার হাত ছাড়লে কিন্তু ২য় বার ধরি না।”

আরওয়া ওর চোখের দিকে চেয়ে রইলো। জাওয়াদ ওর কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল, “এভাবে চেয়ো না মেয়ে, তোমার অগ্নিদৃষ্টিতে আমি ভষ্ম হয়ে যাবো…”

আরওয়া ওর হাতে জোরে কামড় দিয়ে বলল,” আপনাকে আমি একটুও ভালোবাসি না। এক বিন্দু ও না…”

জাওয়াদ হেসে বলল, “Thanks for another love bite. Now I can return it…”

বলেই সে আরওয়ার গলায় গভীর চুমু খেলো। সেই চুমুতে আরওয়া ব্যথা অনুভব করলেও কোনো শব্দ করলো‌না। বরং দুহাতে জাওয়াদের পিঠ খামচে ধরে গাঢ় গলায় বলল, “Love me like you do….”

সানজিদা বেগম নিজের ঘরে বসে কি যেন ভাবছিলেন, ইশরাক দরজায় নক করে বলল, “মা আসবো?”

“আসো”

“কি করছিলে? একা বসে আছ যে?”

“এমনিই বসে আছি। কিছু বলবে?”

ইশরাক মায়ের পায়ের কাছে বসে বলল, “তোমার কী মন খারাপ?”

“নারে বাবা, মন খারাপ হবে কেন? ও বাড়ি থেকে ফোন এসেছিল, উনারা আসতে চাইছেন আমাদের সাথে কথাবার্তা বলতে।”

“বাবা কী বললেন?”

“বলেছে যেন আসে।”

“তুমি সেজন্য রাগ করেছ?”

“নাহ! আমি কেন রাগ করবো? উনার ছেলের বিয়ে উনি যার সাথে ইচ্ছে করাক। আমি বলার কে? তাছাড়া তুমি তো কুহুকে পছন্দ করো,মিয়াবিবি রাজী তো কেয়া করেগা কাজী?”

“মা, কুহুকে তুমি একবার সুযোগ দিয়ে দেখো, দেখবা তোমার ভুল ভেঙে যাবে। ওর কর্মকান্ড একটু অন্যরকম হলেও মনের দিক থেকে ও খারাপ না।”

“দেখ বাবা, তোর জীবন তুই কার সঙ্গে কাটাবি সেটা তোর ব্যাপার। সুখে থাকলে আমরা দেখে সুখ পাবো, অসুখী হলে কষ্ট পাবো এইটুকুই! এখন আমরা যদি তোর মতের বাইরে কিছু করি আজীবন দোষারোপ করে যাবি, তোর মনে হবে আমরা তোকে তোর পছন্দের মানুষ দেই নি। অনেক ভেবেচিন্তে দেখলাম কিছু মানুষ নিজের বুদ্ধিতে ফকির হলেও আনন্দ পায়। তবুও পরের বুদ্ধিতে চলতে চায় না। তুই তাদের দলে। আমার আর কিছু বলার নেই।”

ইশরাক মায়ের রুম থেকে নিরাশ হয়েই বের হলো। ওর মা পুরো ব্যাপারটা ওর উপর ছেড়ে দিয়ে মাইন্ডগেইম শুরু করেছেন সেটা বুঝতে তার বাকী রইলো না। ইশরাক নিজের ঘরে গিয়ে কুহুকে কল দিলো। পরে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মনে পড়লো কুহুদের বাসায় সবাই এই সময়ে ডিনার করে। ওর সঙ্গে মিট করা দরকার।

চলবে,,

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৪৩

#আরশিয়া_জান্নাত

“আমি বুঝতে পারছি না আমার কী করা উচিত। সবকিছু ঠিকঠাক হয়েও সব বেঠিক হয়ে গেছে। মা এখন সবটা আমার উপর ছেড়ে দিয়ে আমার মানসিক চাপ আরো বাড়িয়ে দিলেন। আমি
এখন কী করবো?”

কুহু লেকে ঢিল ছুঁড়ে বলল,”উনাকে কনভিন্স করা ছেড়ে দাও। তোমাদের যখন মনে হচ্ছে আমি ভুল অপশন দ্যান লিভ মি।”

“তুমি আমার সিচুয়েশন বুঝতেছ না, উল্টো রাগ করতেছো!”

“আমি রাগ করে বলছি না। প্র্যাক্টিক্যালি বলছি। দেখো আমাদের এখনো অফিশিয়ালি কিছু হয়নি, তাই এখানে তোমার কোনো দায়বদ্ধতা নেই। কিন্তু বিয়ে বা আংটিবদলের পর কিছু ঘটলে কৈফিয়ত দিতে হবে। ধরো তুমি তোমার মায়ের এগেইনস্টে গিয়ে আমাকে বিয়ে করলে, তারপর কী হবে? বিয়ে করার পর পান থেকে চুন খসলেই তোমার মনে হবে তোমার মায়ের ধারণাই ঠিক ছিল। আর তোমার মা ও শুরু থেকেই আমার প্রতি নেগেটিভ ধারণা নিয়ে থাকবেন। আমাকে চাইলেও মন থেকে এক্সেপ্ট করতে পারবেন না।”

“তুমি ওভারথিংক করছো কুহু!”

“ওভার থিংক বলো আর যাই বলো আমি আমার ফিউচার গেস করতে পারছি। তোমার আর প্রেশার নিতে হবে না। তুমি এমনিতেও আমার প্রতি আগ্রহী ছিলেনা। আমিই জোর করে তোমার লাইফে এন্ট্রি করেছিলাম। সো প্যারা নাই চিল। একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করে নাও‌। আমি আর তোমাকে বিয়ের জন্য বিরক্ত করবোনা।”

“কুহু লিসেন টু মি। আমাকে কিছু বলার সুযোগ দাও,,,”

কুহু উঠে বললো, “ইশরাক! তুমি যদি সত্যিই আমাকে ভালোবাসতে কনফিডেন্ট থাকতে আমাকে নিয়ে। সবটা তোমার উপর ছেড়ে দেওয়াতে দ্বিধায় পড়তে না, বরং আমাকে শক্ত হাতে ধরে দেখিয়ে দিতে আমি ভুল‌ নই। অথবা
তোমার মনের কোথাও না কোথাও আমাকে হারানোর ভয় থাকতো। কিন্তু তোমার চোখে আমি সেটা দেখছি না, বরং দেখছি আমাকে চুজ করতে তুমি ভয় পাচ্ছ! যাক যা হয় ভালোর জন্যই হয়। গুড বায়!”

কুহু পেছনে না ফিরেই এগিয়ে গেল। দুচোখ বেয়ে পানি পড়লেও মোছার জন্য হাত তুললো না পাছে যদি ইশরাক বুঝে ফেলে! কুহু গাড়িতে বসে বললো,”চাচা গাজীপুর চলেন। রানি আন্টির বাসায় যাবো।”

ইশরাক রেস্টুরেন্টে গিয়ে এক্সট্রিম স্পাইসি নাগা অর্ডার দিলো। দুইটা বাইট দিতেই ঝালে তার জিভ জ্বলে উঠে, তবুও সে থামে না। চোখমুখ লাল করে দুইটা লেগপিস সাবাড় করে। ওয়েটার তাকে মিল্কশেক অফার করলেও ও নেয় না। বরং টিস্যু দিয়ে অনবরত চোখ নাক মুছতে থাকে। চোখের পানি নাকি দুঃখ কমায়, তবে ওর কমছে না কেন?

সাবা মন খারাপ করে বলল,”আমার ই দোষ‌ হয়েছে। সেদিন তোমাকে যদি না আটকাতাম, তাহলে আজকে কুহুর এই অবস্থা হতো না।”

পাপিয়া ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,” মন খারাপ করো না ভাবি। আপু আপুর ভুলের শাস্তি পেয়েছে। ও সবসময় সবকিছু লাইটলি নেয় বলেই এই অবস্থা। তুমি কেন নিজেকে দোষ দিচ্ছ। অন্যের বিয়েতে বাগড়া দিতো বলেই নিজের বিয়েতে ভেজালে পড়ছে।”

“পাপিয়া শত হলেও ও আমাদের বোন। ওর সাথে এমন ঘটনা ঘটুক আমরা কেউই চাইবোনা। আচ্ছাআমি কী একবার কথা বলবো আন্টির সাথে? মিসআন্ডার্স্ট্যান্ডিং টা দূর করা উচিত।”

“সেদিন দাদা সাহেব গিয়েছিল, আন্টি নাকি সামনেই আসেননি। আমার মনে হয় আন্টি শুরু থেকেই এই বিয়েতে রাজি ছিলেন না, এখন একটা বাহানা পেয়ে বেঁকে বসেছেন।”

” এভাবে বলো না, কার মনে কী আছে আমরা জানি না। অনুমান করা ঠিক না।”

“এখন কী মনে হয়, এই বিয়ে আর হবে?”

“দুই পক্ষের অবস্থা দেখে তো মনে হচ্ছে আশা‌ নেই!”

“ভাইয়া কী বলে?”

“সে বলে, ‘হচ্ছে না যখন বাদ দাও। অযথা জোরাজুরি করে লাভ কী?’ এরকম বললে হয় বলো? ওরা দুজনকে দুজন ভালোবাসে, সামান্য কারণে বিচ্ছেদ হয়ে যাবে!”

পাপিয়া শ্বাস ফেলে বলল,”কী আর করার?”

আরওয়া হাসিহাসি মুখ করে জাওয়াদের সামনে দাঁড়ালো। জাওয়াদ শার্টের টাই বাঁধতে বাঁধতে বলল, “কী ব্যাপার সকাল সকাল এতো খুশি কেন?”

আরওয়া ওর সামনে বসে বললো, “আজকে আব্বুরা আসবেন। মাত্রই ফোন করে বললেন। আজ আর আমি ভার্সিটি যাবো‌না।”

“ওহ আচ্ছা সেজন্য এতো খুশি!”

“হুম, দাদী বললেন আপনি আজ দুপুরে লাঞ্চটা যেন বাসায় করেন”

“চেষ্টা করবো আসার।”

আরওয়া আলমিরা খুলে বললো, “কোন শাড়িটা পড়ি বলুন তো?”

“যেটা ক্যারি করতে সহজ হবে সেটা পড়ো।”

“রেড পড়বো?”

“নাহ!”

“এশ?”

“নাহ”

“তাহলে সী গ্রিন টা পড়ি?”

“নাহ!”

“পার্পেল?”

“নাহ”

“তাহলে আপনিই বলে দিন না কোনটা পড়বো।”

“পড়ো না যেটা আরামদায়ক!”

আরওয়া কোমরে দু’হাত রেখে ভ্রু কুঁচকে বলল, “যেটাই বলছি না বলছেন, আবার সিলেক্ট ও করে দিচ্ছেন না। সমস্যা কী আপনার?”

জাওয়াদ চুলে ব্রাশ করে বলল,”আমি তোমার ভালোর জন্যই বলেছি, আসলেই লোকের ভালো করতে নেই। গ্রাম বাংলায় একটা প্রবাদ আছে না, “খাইতে কইলে মাইরতে উডে” এটাই সত্যি!”

আরওয়া বলল,”আমি আকাশী ছাড়া যেই কালার ই বলবো আপনি না বলে যাবেন, এটা আমার বোঝা হয়ে গেছে!”

জাওয়াদ ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে চিবুক রেখে বললো, “এটা বোঝো যখন অন্য কালার বলো কেন হুম?”

“তাই বলে অন্য কোনোটা পড়বো না?”

জাওয়াদ ওর কানের কাছে নাক ঘষে ফিসফিস করে বলল,”ডার্ক কালারে তোমাকে বেশি আকর্ষণীয় লাগে। তাই বলি লাইট কিছু পড়ো।”

আরওয়া আহ্লাদি গলায় বলল, “আপনি ও না কি যে বলেন!”

জাওয়াদ লেভেন্ডার কালারের একটা শাড়ি নিয়ে বললো,”এটা পড়ো। এই কালারটাও অনেক সুন্দর!”

“আচ্ছা।”

আরওয়ার বাবা-মা ও দাদী একটু আগে জাওয়াদদের বাড়ি এসেছে। তাদের পেয়ে বাড়ির সবাই আতিথেয়তায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আরওয়া তো খুশিতে একবার কিচেনে যাচ্ছে তো একবার ড্রইং রুমে আসছে। শ্বশুড়বাড়িতে বাবারবাড়ির লোক আসলে স্বভাবতই মেয়েদের মন আনন্দে ভরে যায়। আরওয়াও তার ব্যতিক্রম নয়। তার ছোটাছুটি দেখে রোকেয়া বললেন, “আরেহ তুই এতো ব্যস্ত হচ্ছিস কেন? আমরা সবাই আছি তো, তুই যা উনাদের সঙ্গে গল্প কর।”

শিরিন বললো,” আপা ও করুক সমস্যা নেই। মেয়েকে এমন সংসারী দেখে আমাদের ভালো লাগছে। ওর রান্না আপনাদের পছন্দ হয় তো?”

পাপিয়া বলল,” আমার ভাবীদের রান্না অনেক মজা। ওটা নিয়ে কারো কমপ্লেইনকরার স্কোপ নেই। এক ভাবী বাঙালী রান্নায় এক্সপারৃট তো আরেক ভাবী চাইনিজে। বলতে পারেন আমরা একদম লাকি ফ্যামিলি মেম্বার!”

ওর কথা শুনে কোহিনূর বললো,” একদম ঠিক কথা।”

করিমুন্নেসা নাতনিকে পাশে বসিয়ে আদর করে বললেন, “তোর লাই কদিন‌ ধরি আর যে ফরান ফরের। তোর বায়েরে কইলাম মাইয়াগারে কদিনের লাই লই আয়। হেতে সময়ই পায় না। আইজ এক্কেরে ধরি বান্ধি লই আইছি।”

আরওয়া দাদীর গলা জড়িয়ে বলল, ” দেখো দাদীজান উনি এই আংটিটা দিয়েছে। সুন্দর না?”

“তোর আইশ মিটছে তাইলে। হেতে তোরে আংটি পড়াইছে!”

“হুম। জানো আমরা সেন্টমার্টিনে অনেক মজা করেছি। সাগরপাড় অনেক সুন্দর। ঐখানে কত সুন্দর সুন্দর পাথর! আমার ফিরতেই মন চাইছিল না।”

করিমুন্নেসা নাতনীর চোখেমুখে আনন্দ দেখে মনে মনে বললেন “আল্লাহ তোরে এমনই সুখী রাখুক।”

আমিন সাহেব বললেন, “ভাইসাহেব আমরা একটা বিশেষ কারণে আজকে এসেছি। আসলে কয়েকদিন পর আয়েশার ফুফাতো বোনের বিয়ে। আপা আপনাদের সবাইকে নিমন্ত্রণ করেছেন। আম্মা বলছিলেন আপনাদের মত থাকলে হলুদের আগের দিন আমরা সবাই একসঙ্গে দৌলতপুর যাবো।”

জহির সাহেব বললেন, “এটা তো অনেক ভালো সংবাদ। অনেক বছর হয়েছে গ্রামের বাড়িতে বিয়ের অনুষ্ঠান দেখি না।আমি অবশ্যই আপনাদের সঙ্গে যাবো।”

পাপিয়া বলল,” আমিও যাবো। আমি কখনোই দেখিনি।”

রোকেয়া বললেন,” আব্বা অনুমতি দিলে আমরা সবাই নিশ্চয়ই যাবো।”

করিমুন্নেসা বললেন,” গ্রামের বাড়ি বলে ভয় পাইও না। ওদের বাড়িঘর সব শহরের মতোই। থাকা খাওয়ায় কোনো অসুবিধা হবেনা।”

আরওয়া বললো,” আমার তো ভেবেই আনন্দ হচ্ছে, সবাই একসঙ্গে বিয়েতে যাবো অনেক মজা হবে।”

“দোস্ত একটা কথা বল তো, ভাইয়ার পিএ মানুষটা কেমন?”

“সাম্য ভাইয়ার কথা বলছিস? উনি অনেক ভালো ফ্যামিলি ম্যান, উনার বাবা মারা যাওয়ার পর উনিই সংসারের হাল ধরেছেন। শুনেছি লাইফে অনেক স্ট্রাগল করে এই অবধি এসেছেন, তোর ভাইয়ার তো বলতে গেলে উনি ডান হাত!”

“ওহ আচ্ছা! তা উনার গফ আছে বা এক্স?”

“মনে হয় না। কেন বল তো?”

“ক্যারেক্টার কেমন মনে হয়?”

“যতটুকু দেখলাম খারাপ না।”

“তুই আর‌ দেখলি কই, অফিসে ভালো ইমেজ ধরে রাখলেই কী মানুষ ভালো হয়ে যায়? এমনো তো হতে পারে উনি মেয়েবাজ ছেলে, সুন্দরী মেয়ে দেখলে লাইন মারার ট্রায় করে, ফলো করে সবসময়। ফুল চিরকুট লিখে রেখে যায়। বলদা বলদা লুক নিয়ে মেয়ে পটানোর ট্রায় করে!”

আরওয়া হেসে বলল, “এটা খারাপ নাকি? বিয়ের বয়স হয়েছে যখন মেয়ে দেখবে না? সিঙ্গেল লাইফ লিড করবে নাকী? এখনই তো মেয়ে পটানোর উপযুক্ত সময়”

“হোয়াট ইফ একটা মেয়ে না, অনেক মেয়ে হয়।”

“টোপ ফেলে রাখছে আর কি যেই টোপ গিলবে তাকেই বিয়ে করবে।”

রুমাইসা কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, “ওহ আচ্ছা!”

আরওয়া ওর দিকে তাকিয়ে বলল, “সাম্য ভাইয়া যদি তোকে প্রপোজ করে রিজেক্ট করিস না। সে সত্যিই দারুণ মানুষ। তোকে হ্যাপি রাখবে।”

ওর কথা শুনে রুমাইসার নাকেমুখে উঠে কাশতে লাগলো। আরওয়া ওর পিঠ চাপড়ে বললো,” বি কেয়ারফুল দোস্ত।”

চলবে,

কাঁটাকম্পাস পর্ব-৪০+৪১

0

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৪০

#আরশিয়া_জান্নাত

৪০

কক্সবাজার পৌছানোর পর জাওয়াদ আর আরওয়ার আরেকদফা ঝগড়া লেগেছে। জাওয়াদ বলছে, সেন্টমার্টিন যাবে, আরওয়া বলছে, না আজকে এখানেই থাকতে হবে। দুজনের কেউই কাউকে ছাড় দিতে ইচ্ছুক না। আরওয়া এখানে সারপ্রাইজ প্ল্যান করেছে তাই সেন্টমার্টিন যাওয়ার প্রশ্নই উঠেনা, একইভাবে জাওয়াদ সেন্টমার্টিনে প্ল্যান করেছে এখানে থাকার প্রশ্নই উঠেনা।
তাদের এই ঝগড়া চরম মাত্রায় পৌঁছানোর আগেই সাম্য উপস্থিত হলো। আরওয়া তাকে দেখেই বলল, “সাম্য ভাইয়া আপনার বসকে বলে দিন সবকিছু উনার মর্জিমতো হবেনা। আমি যা বলছি তা মানতে হবে”

জাওয়াদ বলল,”বললেই হলো? ওর মর্জিমতোই তো সব হয়েছে। যখন আসতে বলেছি তখন আসেনি। পরে এসে কীভাবে বলছে আমার মর্জিমতো সব হয়!”

“আগে হোক বা পরে আমি উনার কথামতোই তো চলি তাই না? একটা দিন আমার কথায় চললে কী হয়?”

“এমন দিনে চাইবে কেন যেদিন রাজী হওয়া কঠিন?”

“আমি এতো কথা শুনতে চাই না। আমরা আজকে এখানেই থাকবো।”

“সবসময় জিদ ভালো লাগেনা, বলেছি না আজ ওখানে থাকবো।”

সাম্য ওদের তর্ক থামিয়ে বলল,”আমি জানতাম আপনাদের এই প্রবলেম টা হবে। তাই আমি সে অনুযায়ী টাইম সেট করে রেখেছি। ম্যাম লাঞ্চটা আপনারা এখানে করুন আর ডিনার ওখানে করবেন। প্লিজ একটু কো-অপারেট করুন।”

আরওয়া আর কথা বাড়ালো না, রুমে গিয়ে তৈরী হতে শুরু করলো।

জাওয়াদ সাম্যর দিকে তাকিয়ে বলল,” তুমি আমাকে বলো নি কেন আরওয়া এখানে প্ল্যান করছে?”

“ম্যাম আপনাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল, আমি বললে কীভাবে হবে!”

“হাহ! ডেস্টিনেশন এক জায়গায় মেলালেই তো হতো। তুমি দুই জায়গায় দুটো রাখলে কেন?”

“আপনারা দুজনেই দুই জায়গা সিলেক্ট করেছেন, আবার বলেছেন সিক্রেট রাখতে। আমি আর কী করব?”

জাওয়াদ ঠোঁট গোল করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,” ও যদি ভাবে আমি ভুলে গেছি, ওরটা দেখে মনে পড়েছে তাই পরে আমি এরেঞ্জ করেছি? আমি লাস্ট হয়ে গেলাম না?”

“ম্যাম তেমনটা ভাববেন না। আপনি নিশ্চিত থাকুন। স্যার আপনার জন্য কিছু অর্ডার করবো?”

“হুম অরেঞ্জ জুস অর্ডার করো।”

আরওয়া রেডি হয়ে ফোন চেক করে দেখলো অনেকেই তাদের উইশ করেছে। একটা মেয়ে এসে দরজায় নক করে বলল,” ম্যাম আপনার কি কোনো সাহায্য লাগবে?”

আরওয়া মাথা নেড়ে বললো,”ধন্যবাদ। আমার হয়ে গেছে।”

“ওকে ম্যাম!”

আরওয়া রুম থেকে বেরিয়ে সাম্যকে কল দিয়ে বলল,” ভাইয়া সব এরেঞ্জ করেছেন তো? গিফট যেটা আনতে বলেছিলাম ওটা এনেছিলেন?”

“ইয়েস ম্যাম। চিন্তা করবেন না, আপনি তৈরী হয়ে চলে আসুন সব আপনার কথামতোই হয়েছে।”

সাম্য জাওয়াদকে বলল, “স্যার ম্যাম আসছেন…”

জাওয়াদ পেছন ফিরে তাকায়, আরওয়ার পড়নে জাওয়াদের ফেভারিট স্কাই ব্লু কালারের শাড়ি, চুলগুলো খুব সুন্দর করে সেট করা, কানে গলায় ম্যাচিং করা অর্নামেন্টস। জাওয়াদ জাগতিক সব ভুলে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে আরওয়ার দিকে।

“কেমন লাগছে আমাকে?”

“ভালো”

“শুধুই ভালো?”

“নাহ, অনেক ভালো!”

আরওয়া মুচকি হেসে বলল,”হ্যাপি এনিভার্সেরি ডিয়ার জামাই!”

“১বছর হয়ে গেল নাকি? আহ তোমাকে সহ্য করার ৩৬৫ দিন!!”

“৩৬৬ দিন মনে নেই লিপ ইয়ার ছিল..”

“ওহ হ্যাঁ হ্যাঁ!”

সাম্য ফুলের তোড়া এগিয়ে বলল, “আপনাদের দুজনকে বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা।”

“থ্যাংক ইউ ভাইয়া।”

“ইনজয় ইউর লাঞ্চ”

আরওয়া হাসিমুখে জাওয়াদের দিকে তাকালো, জাওয়াদ আর ও একসঙ্গে কেক কেটে একে অপরকে খাইয়ে দিলো‌। সময়টা তাদের স্মৃতির বাক্সে সুন্দর মূহূর্ত হিসেবে জমা পড়েছে বলা বাহুল্য।

পাপিয়া ফলমূল নিয়ে রিজভীদের বাসায় উপস্থিত হয়েছে। তাকে দেখে রিজভীর মা সানজিদা আহমেদ আপ্লুত গলায় বললেন,” আরেহ পাপিয়া যে। কেমন আছ মা? ”

“আস্সালামু আলাইকুম আন্টি। ভালো আছি, আপনি ভালো তো?”

“ওয়ালাইকুমুস্সালাম। আলহামদুলিল্লাহ! তোমাদের তো দেখাই যায় না, কতদিন পর এলে বলো তো?”

“আসলে আন্টি ব্যস্ত থাকি তো, আসাই হয় না। গতকাল রিজভী বলল আপনি অসুস্থ তাই দেখতে চলে এলাম।”

“ভালো করেছ মা,আমি অনেক খুশি হয়েছি। দাঁড়িয়ে কেন বসো না।”

“আপনার শরীর এখন কেমন? ডাক্তার কী বলল?”

“ডাক্তাররা কত কথাই বলে। ওদের কথায় চলতে গেলে মরার আগেঈ মরে যেতে হবে।”

“এটি কি বলেন‌ আন্টি। উনারা তো ভালোর জন্যই বলে।”

“ভালো‌ না ছাই। চিনি খাওয়া যাবেনা, তেল মশলা খাওয়া যাবেনা, এই খাওয়া যাবে না ঐ খাওয়া যাবেনা। সব যদি নিষেধ করে তো খাবো টা কী?আমাদের বাপ দাদারা শেষ বয়স অবদি ইচ্ছেমতোন খেয়েদেয়ে গেছেন। তাদের এতো রোগবালাই ছিল না। যখন যা ইচ্ছে করেছে পেট ভরে খেয়েছে। কোনো আফসোস রেখে যায়নি। আর আমরা এতো বেছে বেছে জীবনযাপন করেও ৫০ পেরোতে পারিনা। শরীরটা রোগের আস্তানা হয়ে যায়।”

“তখনের সাথে এখনের তুলনা দিলে চলে আন্টি? উনারা সবকিছু ফ্রেশ পেয়েছিলেন, পরিবেশ ও এতো দূষণ ছিল না। এখন তো সবকিছুতেই ভেজাল। পানি যে খাচ্ছেন ওটাও ১০০% নিরাপদ কি না সন্দেহ থেকেই যায়”

“ঠিক বলেছ। আমি ভাবি আগামী প্রজন্মের না জানি আরো কত রোগবালাই হবে! দেখো অবস্থা তোমাকে খালি মুখে বসিয়ে রেখেছি। রোকসানা এই রোকসানা আমার মেয়ের জন্য নাস্তাপানির ব্যবস্থা কর।”

“আন্টি ব্যস্ত হবেন না। আমি সময় নিয়ে এসেছি। আজ সারাদিন আপনার সঙ্গেই থাকবো।”

সানজিদা আহমেদ খুশি হয়ে বললেন,”তাহলে তো অনেক ভালো। অনেকদিন পর কাউকে পেলাম সুখ দুখের গল্প করতে।”

কোহিনূর বেগম খাটের একপাশে বসে কেঁদেই যাচ্ছেন। এতোদিন পর সাবা কনসিভ করেছিল, তাও সব শেষ হয়ে গেল। ওদিকে কুহুর বিয়ে ঠিকঠাক হবার কথা হয়েও ঝুলে আছে। তার ছেলেমেয়ের সাথেই কেন সব অঘটন ঘটে? আল্লাহ তাদের কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছেন তিনিই ভালো জানেন!

রোকেয়া জা-কে সান্ত্বনা দিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু কিছুতেই তিনি শান্ত হচ্ছেন না। কান্নার বেগ যেন আরো বেড়েই যাচ্ছে। রোকেয়া বললেন, “ভাবি আপনি এতো ভেঙে পড়লে চলে? ছেলেমেয়ে দুটো আরো ভেঙে পড়বে, ওদের দিকে চেয়ে হলেও শক্ত হোন।”

“আর কত শক্ত থাকবো বল? আমার ছেলেটার ওয়ারিস কি আসবেনা? তোর ভাসুর তো এবার কোনোরকম গেছে, পরের বার এসেও যদি দেখে বৌমার কোল খালি কী ভাবছিস চুপ করে বসে থাকবে? কতদিন তাকে দমিয়ে রাখবে? কুহুর সাথের সবাই বাচ্চা মা হয়ে গেছে। আর ওর এখনো বিয়েই হলোনা। আত্মীয়স্বজনরা পেছনে কত কথা বলে কানে আসেনা বুঝি! আমার ছেলেমেয়ে দুটোই সবার সমালোচনার মূল বিষয়। আমি মা হয়ে কত সহ্য করবো বল?”

“আল্লাহর উপর ভরসা রাখো ভাবি। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে। আর মানুষের কাজ ই হচ্ছে অন্যের সংসার নিয়ে চর্চা করা। ওসব কানে তুলতে আছে? তুমি অতো ভেবো না তো।”

“কুহুর জন্য তোর পাপিয়ার ও বিয়ে হচ্ছেনা।বয়স তো থেমে থাকছে না। তুই এক কাজ করিস বোন পাপিয়ার জন্য ছেলে দেখা শুরু কর। আমর বদ মেয়ের আশায় আশায় ওকেও অন্যের সমালোচনার পাত্রী বানাইস না। কি সুন্দর সব ঠিকঠাক করা ছিল, ওরা এসে ওকে আংটি পড়িয়ে যাবে। জা*নো*য়ার টা কি করছে আল্লাহই ভালো জানে, সব শেষ। ওরে আমার নিজের মেয়ে বলতেও অসহ্য লাগে।”

“ছোট মানুষ বুঝতে পারেনাই। এতো রেগে থাকিও না।”

“ছোট না ছাই। ওর বয়সের মেয়েরা পুরো সংসার সামলিয়ে ৫জনের সাথে ভাত খায়। আর ও! ওর কথা ভাবতে গেলেও আমার প্রেশার বেড়ে যায়। এই মেয়েকে কোনদিন আমি কি করে বসি…”

কুহু পার্কের বেঞ্চিতে চুপচাপ বসে আছে। ইশরাক ওর দিকে চেয়ে নিরবতা ভাঙলো। স্বাভাবিক গলায় বলল,”মূর্তির মতো বসে আছ কেন? কী বলতে ডেকেছ বলো?”

কুহু সাথে সাথে জবাব দিলো না, আরো কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললো, “দেখো আমি অনেক ভেবে দেখেছি, আমার জন্য অনেক সমস্যা হয়ে গেছে। আমি বিয়েটা ভাঙার জন্য সেদিন ঐরকম আচারণ করেছিলাম এটা আন্টি কিছুতেই মানতে চাইছেনা। আমার মনে হয় বিয়েতে মত না দেওয়ার পেছনে এটাই শুধু কারণ নয়। আমি মানছি আমার ভুল‌ ছিল, তবে তুমিও একটু ভেবে বলো এই ভুল কি এতোটাই বড় ছিল যে উনি একদমই মত দিতে চাইছেন না? এখানে অন্য কারণ ও আছে।”

“তুমি বলতে চাইছো আমার মায়ের তোমার সাথে শত্রুতা আছে? উনি এই বিয়ে না দিতেই বাহানা করছেন?”

“তুমি হাইপার হয়োনা প্লিজ। লজিক্যালি ভাবো। আমি সেদিন অতোটাও ডিপ কিছু করিনি যা দেখে কেউ ৩৬০° এঙ্গেলে উল্টে যাবে। যে কেউ যদি ভালোভাবে ভেবে দেখে সহজেই বুঝতে পারবে আমি ইচ্ছাকৃত ভাবে এমন করেছি। মানুষ যত খারাপ হোক গেস্ট আসলে খারাপ আচারণ করে না। হোক সেটা সামনে বা পেছনে। সেখানে আমি বলতে গেলে ড্রইং রুমের পেছনেই তেমন করেছিলাম। এইটুকু অবজার্ভ করলেও তো বোঝার কথা সবটা প্রি-প্ল্যানড ছিল!”

ইশরাক কুহুর যুক্তি ফেলতে পারলো না। সতিই কী এখানে অন্য কোনো রিজন আছে নাকি ওর ওভারথিংক?

চলবে..

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৪১

#আরশিয়া_জান্নাত

৪১

সমুদ্র মহান আল্লাহর একটা রহস্যময় সৃষ্টি। এই বিশাল জলরাশিতে কত বৈচিত্রময় সৌন্দর্যই না লুকিয়ে আছে। মাথার উপরে নীল আকাশ, সাগরের ঢেউ, অদূরেই উড়তে থাকা গাংচিলের ঝাঁক। সব মিলিয়ে সেন্টমার্টিন যাওয়ার পথটা অপার্থিব সৌন্দর্যের অভিজ্ঞতা দেয়। আরওয়া জাহাজের রেলিং ধরে প্রকৃতির অপরূপ মহিমা উপভোগ করছে। বাতাসে তার শাড়ির আঁচল উড়ছে, চুলগুলো এলোমেলো হবার আগেই সে ক্লিপ বেঁধে ফেলেছিল। নয়তো এই উথাল পাতাল বাতাসে মাথাটা কাকের বাসা হতে সময় লাগতো না! জাওয়াদ সাম্যর সাথে কথা বলে আরওয়ার পাশে এসে দাঁড়ায়। সূর্য প্রায় পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। পড়ন্ত বিকেলের রক্তিম আভা যখন পানিতে ছড়িয়ে পড়ে মনে হয় এটা আমাদের চিরচেনা জগত নয়, এ এক অন্য জগত। দূর দূরান্ত অবধি কেবল পানি আর পানি।

“কেমন লাগছে?”

“অসম্ভব সুন্দর! আমি আগে কখনো সেন্টমার্টিন যাই নি। তাই খুব এক্সাইটেড লাগছে!”

“আশা করি ওখানে গেলে আরো বেশি ভালো লাগবে। রাতে সেন্টমার্টিনের সৌন্দর্য অনেকগুণ বেড়ে যায়!”

“ফ্র্যাঙ্কলি স্পিকিং আমার তো এই জাহাজ থেকে নামতেই ইচ্ছে করছে না। আমি ভেবেছিলাম পানিতে অনেক ভয় লাগবে,,,”

“আমার প্ল্যান ছিল এখানে সময় কাটানোর কিন্তু এখানকার বর্তমান অবস্থা শুনে রিস্ক নিতে চাইছি না। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার আসবো কেমন?”

“আচ্ছা!”

“আরওয়া শোনো?”

“হুম?”

“পৃথিবীটা খুব সুন্দর তাই না?”

“হ্যাঁ। অনেক অনেক সুন্দর!”

“জানো পুরনো একটা বিশ্বাস আছে, সাগরের মাঝে নাকি মিথ্যে বলতে নেই।”

“বললে কী হয়?”

“বললে ঐ মিথ্যার জন্য অন্যরাও শাস্তি পায়, ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে। এরকম কিছু আর কি!”

“ওহ! এখন বোধহয় তেমন হয় না। মানুষ তো এখন অনেক মিথ্যেবাদী হয়ে গেছে,,,”

“হুম হয়তো। দাদী বলেন শেষ জামানায় আল্লাহ সুতা ছেড়ে দিয়েছেন। মানুষ কত সীমালঙ্ঘন করতে পারে তা দেখার জন্য। তাই তো পাপ হারে আযাব আসছেনা। যাই হোক কথাটা শুরু করেছিলাম যেজন্য সেটাই বলা হলো‌না।”

আরওয়া ওর দিকে তাকিয়ে বললো,” বলুন কি বলবেন?”

জাওয়াদ ওর দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো।চোখেমুখে অন্যরকম উজ্জ্বলতা দৃশ্যমান। আরওয়া ওর হাবভাব দেখে মনে মনে ভাবলো আজ বুঝি জনাব মনের কথা মুখে প্রকাশ করবে!
জাওয়াদ ওর হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,”আরওয়া তুমি ভীষণ মায়াবী মেয়ে। সবসময় এমন প্রাণোচ্ছল আর হাসিখুশি থেকো।”

“হাহ! আপনি আমার ধারণার বাইরের মানুষ।আমি চাইলেও আপনাকে নিয়ে সঠিক গেস করতে পারবোনা।”

“এই কথা কেন বললে?”

“এমনিই বলেছি। আচ্ছা আমি কি আপনাকে বলেছি আপনি আমার কয় নাম্বার ভালোবাসা?”

জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকে বললো, “এখানেও নাম্বারিং আছে?”

“অবশ্যই। জীবন ছোট হলেও ঘটনাবহুল। এই ঘটনাবহুল জীবনে কত কী ঘটে !!”

“আচ্ছা! তা আমার পূর্বেও আরো অনেকে ছিল না কি?”

“সবমিলিয়ে দেখলাম আপনি অনেক দেরীতে এসেছেন।”

জাওয়াদের চেহারার রং বদলে গেল যেন। সে হালকা হেসে বলল, ” ঐসব রাখো। শুনতে চাইছি না আপাতত।”

আরওয়া ওর কাছে ঘেষে দাঁড়ালো। বাহু আঁকড়ে বললো, “আপনি এতো কিউট কেন বলুন তো? আমার তো ইচ্ছে করে আপনাকে কোথাও লুকিয়ে রাখি!”

“কিউট বলে লাভ কী? তোমার মনে তো আরো অনেকে আছে। কোন একটা স্যারও তো ছিল না?!”

আরওয়া জিভ কেটে মাথা নেড়ে বলল, “উহু উহু ভুল বুঝছেন। ঐ স্যার আমাকে লাইক করতো আমি না। আমি তো আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলাম বিয়ের পর বরের সাথে প্রেম করবো। সেই হবে আমার ফার্স্ট লাভ। অন্য কাউকে চান্স দেওয়ার ফুরসত কই! বিশ্বাস না হলে রুমাইসা কিংবা দাদীজানকে জিজ্ঞাসা করবেন। ওরা সবাই জানে আমি কত জামাইপাগল ছিলাম।”

জাওয়াদ ওর কথা শুনে হাসতে লাগলো। “বিয়ের আগেই কেউ জামাই পাগল হয়?”

“আলবাৎ হয়। ভবিষ্যৎ জীবনসঙ্গীকে কেন্দ্র করে কল্পনা করা কঠিন‌ নাকি?”

“তাই না!”

“হুম।”

আরওয়া গোলাপ ফুলের পাপড়ি ছিড়ে হার্টশেইপ বানালো, তার মাঝে আচড় কেটে লিখলো A+J। জাওয়াদ ওর বাচ্চামো দেখে মুচকি হাসলো। আরওয়া ওকে ডেকে বললো, “এ বছর ডাবল সেলিব্রেশন হচ্ছে। ব্যাপারটা মজাদার!”

জাওয়াদ ওকে টেনে তুলে বলল, ” বাচ্চাদের মতো বালি নিয়ে খেলা শুরু করে দিলে! দিনে কী করবা?””

আরওয়া হাত ঝেড়ে বলল,” দিনেই দেখবেন।”

সে দেখবো সমস্যা নেই। এখন চলো।”

রেড কার্পেট এর উপর জাওয়াদ ও আরওয়া একসঙ্গে হেঁটে যাচ্ছে। চারদিকে ফুল ও লাইট দিয়ে খুব সুন্দর ডেকোরেশন করা। জাওয়াদ চেয়ার টেনে আরওয়াকে বসিয়ে নিজে অপর চেয়ারে বসলো। একজন‌ এসে জাওয়াদকে ফুল ও গিফট দিয়ে যেতেই জাওয়াদ সেসব আরওয়াকে দিয়ে বললো, “তোমার সাথে শুরু হওয়া এই পথচলা দীর্ঘ হোক। হ্যাপি এনিভার্সেরি ডিয়ার!”

“থ্যাঙ্ক ইউ। আপনার উইশ পূরণ হোক।”

জাওয়াদ পকেট থেকে রিং বের করে বলল,”তোমার আফসোস ছিল আমাদের বিয়ের সময় আমি কেন তোমায় রিং পড়াই নি। আজ সেই আফসোস দূর করার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা করছি। উইল ইউ গিভ মি ইউর হ্যান্ড?”

আরওয়া আনন্দচিত্তে হাত বাড়িয়ে দিলো। জাওয়াদ ওর হাতের অনামিকায় রিং পড়িয়ে চুমু খেলো।

“আপনাকে অনেক ধন্যবাদ এতো সুন্দর মুহূর্ত উপহার দেওয়ার জন্য।”

জাওয়াদ ওর প্লেটে খাবার তুলে দিয়ে বলল, “ইটস মাই প্লেজার।”

খাওয়া শেষে তারা বীচে বসে সাগরের অপার সৌন্দর্য উপভোগ করতে লাগলো। জাওয়াদের বুকে মাথা রেখে সেই মুহূর্তে আরওয়ার মনে হলো সে এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়ে….

জোবায়ের সাহেব ড্রইং রুমে বসে আছেন। তার আদেশে পরিবারের অন্য সদস্যরাও সমাবেত হয়েছেন সেখানে। কুহু জানে এই জরুরী বৈঠক তাকে কেন্দ্র করেই বসেছে। তাই সে মনে মনে দোয়া দুরূদ পড়ে যাচ্ছে। জোবায়ের সাহেব থমথমে গলায় বললেন, ” কুহু একটা সত্যি কথা বলো। বিয়ে নিয়ে তোমার মতামত কী? তোমার কি পছন্দের কেউ আছে? কিংবা অন্য কোনো কারণ আছে যার কারণে তুমি বিয়ে করতে আগ্রহী নও? থাকলে দ্রুত কনফেস করো।”

কুহু নতমুখে বসে রইলো। জোবায়ের সাহেব ওর দিকে তাকিয়ে নিঃশ্বাস ফেললেন। পুনরায় বললেন,”তুমি যদি বিয়ে করতে আগ্রহী না হও বলে দাও। আমরা অযথা মানসম্মান খোয়াতে পাত্রপক্ষ আনতে ইচ্ছুক নই। তুমি তোমার মনমর্জিমতো আচারণ করে তাদের হটানোর চেয়ে শ্রেয় আমরা তোমার বদলে পাপিয়ার বিয়ের ব্যাপারে মনোযোগ দেই। দয়া করে এখন অন্তত মুখে কুলুপ এটে রেখো না। তুমি সেদিন কি করেছ আমি জানি না, তবে এইটুকু বুঝেছি যা করেছ মোটেই ভালো করো নি। খন্দকার বাড়ির মেয়েদের নাম খারাপ করে কী লাভ হলো বলবে? তুমি এ বাড়ির বড় মেয়ে হয়ে যদি এমন আচারণ করো অন্যদের অবস্থা কী হবে বুঝতে পারছো?”

কোহিনূর বেগম বিনয়ী গলায় বললেন,”আব্বা ওকে মাফ করে দিন। ঝোকের বশে ভুল করে ফেলেছে। আর করবে না…”

জোবায়ের সাহেব রুক্ষ গলায় বললেন,”বৌ মা ওর হয়ে তুমি জবাব দিবেনা। তোমাকেও প্রশ্ন করা হবে। ধৈর্য ধরে বসো। আমি সবাইকে অযথা ডাকিনি। এখানে আজ সবাইকেই প্রশ্ন করা হবে। শেষ অবদি অপেক্ষা করো। একে অন্যের জবাব দেওয়ার চেষ্টা করবেনা।”

আরওয়া জাওয়াদকে ফিসফিস করে বলল,”আপনাদের এখানে জরুরী বৈঠক এতো সিরিয়াসলি হয়! কেমন গা ছমছমে অবস্থা!”

জাওয়াদ বললো,”ভয় পেয়ো না শেষের সমাধানটা এতোটাও ভীতিকর হয় না।”

“কী ব্যাপার জবাব দিচ্ছো না কেন?”

কুহু বলল, “দাদা সাহেব আমার ভুল হয়ে গেছে। আমি না বুঝেই ওরকম আচারণ করে ফেলেছি। সত্যি বলতে তখন এই প্রপোজাল টা আমার ভালো লাগেনি। কিন্তু পরে ভালো লেগেছে। আপনি কী অনুগ্রহ করে এখানেই কথা ফাইনাল করবেন?”

ওর কথা শুনে কোহিনূরের হিচকি উঠে গেল। রোকেয়া তাকে পানি এগিয়ে দিলেন। জোবায়ের সাহেব ওর দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,”তোমার মা কী তোমাকে ছেলে সম্পর্কে কিছু বলে নি? ওদের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড বা বায়োডাটা ও ছবি কি তুমি দেখো নি? তখন কী দেখে অপছন্দ হয়েছিল আর তারা আসার পর কি দেখে পছন্দ হয়ে গেল সব ডিটেইলসে বলো।”

কুহু নাহিয়ানের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো। নাহিয়ান বোনের অবস্থা দেখে মিটমিটিয়ে হাসছে। কুহুর মনে হলো নাহিয়ান ওর ভাই না। ও নিশ্চয়ই কুড়িয়ে পাওয়া সন্তান। তাই তো বোনের এমন বিপদের দিনে ভাই হয়ে শত্রুর মতো হাসছে।

সালমা বেগম বললেন, “থাক না এসব কথা। কাগজপত্রে দেখা আর বাস্তবে দেখায় পার্থক্য আছে না? শুরুতে হয়তো মনে ধরেনাই। পরে ভালো লাগছে। এখন নাতনি যখন সরাসরি বলছেই ওর এই বিয়েতে মত আছে আপনি এইদিকেই ফোকাস দেন না।”

“এটা তো হাতের মোয়া না? ছেলের মা এই বিয়েতে মত দেয়নাই। তার একটাই কথা এমন মেয়েকে তিনি ছেলের বৌ করবেন‌না। বুঝতেছ তুমি ঘটনা কত গভীরে ঘটেছে। এ বাড়িতে আসার আগ অবদি যারা বিয়ের ডেট ফাইনাল করার কথা বলছিল এখানে পা রাখতেই সব চেইঞ্জ। এখন কোন মুখে ও বলতেছে এই বিয়েতে ও রাজি!”

নাহিয়ান বললো,” দাদা সাহেব হাইপার হবেন না। দেখুন ইশরাকের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, ও কুহুকে পছন্দ করেছে এবং এই বিয়েতে আগ্রহী। এখন কুহুও বলছে ওর অমত নেই। আমার মনে হয় এখানে যে ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে তা মিটমাট করলেই উভয়পক্ষের ভালো হয়। একটা ছোট ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিয়ে ভেঙে দেওয়া ঠিক হবে না। প্রয়োজনে আমি আন্টির সঙ্গে কথা বলবো। আশা করি উনি আমাদের নিরাশ করবেন‌না।”

“বড় বৌমা তুমি কী বলো?”

“আব্বা ভুল যখন আমরা করেছি খেসারত তো আমাদেরই দিতে হবে। তবে আপনার মাথা নত হয় এমন কোনো কাজ করতে আমি ইচ্ছুক নই। আপনি যা ভালো বুঝবেন তাই করা হোক।”

“সেটা দেখা যাবে। আপাতত কুহুর শাস্তির কথা বলি। ও যে অন্যায় করেছে ওর উপযুক্ত শাস্তি পাওয়া আবশ্যক। আশা করি এ নিয়ে কারো দ্বিরুক্তি থাকবে না।”

কুহু মাথা নেড়ে বললো,”আপনি যে শাস্তি দিবেন আমি মেনে নিবো।

“বেশ! তুমি আগামী ৭দিন সংসারের যাবতীয় সব কাজ করবে। অর্থাৎ তোমার মা চাচীরা যা করে তুমি সেসব করবা। যদি এই সাতদিনের মধ্যে একদিনও হেরফের হয় তবে পুনরায় ১ম দিন থেকে কাউন্ট করা হবে।”

কুহু মনে মনে বলল, “এ আর কঠিন কী? এটা তো খুব সোজা!” তাই সে সম্মতি জানিয়ে বলল, “জ্বি আচ্ছা।”

সাবা তার বাবার বাসায় গেছে আজ ৮দিন হতে চলল। ওর মানসিক অবস্থা বিবেচনা করে সেখানে পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু অবস্থার পরিবর্তন ঘটেনি। দিনরাত মেয়েটা এককোণে বসে আলট্রার ছবিটা বুকে জড়িয়ে
কান্নাকাটি করে। তার মা-বাবা মেয়ের এমন অবস্থা দেখে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পায় না। তারা নাহিয়ানকে ফোন করে সবটা বলে। নাহিয়ান কি করবে বুঝে পায় না। মেয়েটা এমনিতেই এই দিকে দূর্বল। তার উপর এবার সন্তান হারানোর বেদনা জুড়ে বসেছে। ওকে সামলানো কতটা কঠিন বলা বাহুল্য। নাহিয়ান বসে বসে ভাবতে থাকে, সেদিনের এতো সুন্দর স্বপ্নটা সত্যি হয়েও কেন হলো না? হঠাৎ তার দৃষ্টি যায় টেবিলের উপর থাকা কাগজের দিকে। এতিমখানার ফান্ডে ডোনেশন করার বিজ্ঞাপনটা দেখে গভীর ভাবনায় পড়ে যায়। “আচ্ছা স্বপ্নটার ইঙ্গিত এইদিকে ছিল না তো?”

চলবে…

কাঁটাকম্পাস পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯

0

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৩৭

#আরশিয়া_জান্নাত

“ভাবি শুনো একটা জরুরী কথা আছে।”

“হাতে অনেক কাজ পাপিয়া, পরে শুনি?”

“ভাবি এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। না শুনলে সব কাজ অকাজ হয়ে যাবে!”

পাপিয়ার কথা শুনে সাবা থেমে গেল। জিজ্ঞাসু গলায় বললো, “কি হয়েছে?”

“এখানে না রুমে চলো বলছি।”

পাপিয়া ঘরে ঢুকেই দরজা আটকে বললো,”ভাবি কুহু আপুর মাথায় ভুত চেপেছে। ও এই বিয়ে ভাঙার জন্য কি একটা প্ল্যান করেছে আল্লাহই ভালো জানে। আমার খুব টেনশন লাগছে। দাদাসাহেব রাগলে কি হবে বুঝতে পারছ!”

সাবা হেসে বলল,” ওর যা মন চায় করতে দাও, শেষে পস্তানো টা আমাদের না ওরই হবে।”

“তুমি এভাবে বলছো?”

“শোনো পাপিয়া, কুহুর কিছু বদ অভ্যাস আছে। ওর সেটা শোধরানো উচিত। এমনি এমনি তো কিছু ঠিক হয়না, বিপদে পড়লেই ঠিক হয়।”

পাপিয়া হা হুতাশ করে বলল,”ভাবি তুমি টিপিক্যাল ননদ-ভাবির মধ্যকার সংঘর্ষের মতো কথা বলছো! তোমার থেকে এটা আশা করিনি।”

সাবা চেয়ারে বসে বলল,” ওকে আমি পাত্রের বায়োডাটা দিয়েছি, বলেছি চেক করে দেখতে। কিন্তু ও এসব থোরাই পাত্তা দেয়। সবসময় অবহেলা করা কি ঠিক তুমিই বলো?”

“না কিন্তু বায়োডাটায় কি আছে?আপু তো সবসময় ফেলে দেয় এটা নতুন কী?”

“গুণীজন কহেন, “যেখানে দেখিবে ছাই উড়াইয়া দেখো তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন।”

পাপিয়া কিছুক্ষণ ভেবে বললো,”ভাবি ডোন্ট সে পাত্র সেই ভোজনরসিক- ইশরাক ভাইয়া?”

সাবা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিয়ে বলল,”ইয়েস মাই ডিয়ার ননদী। তোমার ভাইয়া এই প্রোপজাল টা দাদাসাহেবের কাছে রেখেছিল। দাদাসাহেব ও সব দিক বিবেচনা রাজী হয়েছেন।”

“ইয়া আল্লাহ! এখন আপু যদি ব্ল্যান্ডার করে কি হবে বুঝতে পারছো? আমি এখুনি আপুকে গিয়ে বলছি দাঁড়াও।”

সাবা ওকে আঁটকে বললো, “উহু কিছু বলবেনা। দেখি না ওর দৌড় কতদূর অবদি যায়। অনেকদিন এন্টারটেইন হচ্ছিনা।”

পাপিয়া হেসে বললো,” ইশরাক ভাইয়াকে অন্তত এলার্ট করা উচিত না? আমার সত্যিই আপুকে ভয় লাগে, মনে নেই কুলসুম খালামণির বিয়েতে কি কেলেঙ্কারি করেছিল। সেদিন যদি নানাভাই সবটা সমলে না নিতেন বিয়ের আসর থেকে বরযাত্রী চলে যেত।”

“এখানেও আমরা সবাই আছি তো। ডোন্ট ওয়ারি।”

জাওয়াদ অফিস থেকে ফিরে হোটেল রুমে বসে আছে। লাস্টবার বিজনেস ট্রিপে আরওয়া সঙ্গী হয়েছিল। তাই এবার একা আসায় একটু বেশিই মিস করছে মেয়েটাকে। আরওয়ার প্রাণোচ্ছলতা, অল্পতেই হেসে গড়িয়ে পড়া, সবকিছুই যেন চোখের সামনে ভাসছে। জাওয়াদ রকিং চেয়ারে দুলে দুলে ভাবছে, এতোক্ষণে নিশ্চয়ই ও বাড়িতে গেস্টরা চলে এসেছে। ওখানে হৈ হৈ রৈ রৈ অবস্থা। আর সে এখানে একা বসে আছে। কাল সকালে আবার সাইট ভিজিটিং এ যেতে হবে।
রাগ করে আসলে মানুষের পরিবার কত ফোন করে, রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করে। আর ওর এমন নসীব ও রাগ করলে ভাঙাবে কি কেউ ছায়াও মারায় না। এমন ভাব যেন রাগ ও করে নি, অন্য সবাই করেছে। আরওয়াও সেইম কাজটাই করলো। ওর মান ভাঙানোর বদলে সাম্যকে কল করে খবর নিচ্ছে। কেন ওকে কল করলে কি গায়ে ফোস্কা পড়ে যেত? নাকি ও ওকে চিটাগং থেকে মি*সা* ইল পাঠিয়ে হামলা করতো?
আজ সবাই একত্রিত হবে সেখানে, অথচ ওর অনুপস্থিতি কারোই চোখে পড়বেনা। অবশ্য পড়বেই বা কেন সে কি ও বাড়ির গুরুত্বপূর্ণ কেউ নাকি! ও তো জাস্ট একটা কামলা, যে যন্ত্রের মতো সকাল ৯থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত কামলা খাটবে। দিনশেষে আবার আনকালচার খেতাব পাবে!
এসবকিছু ভাবতেই মনটা কেমন তেতো হয়ে উঠে তার। কফি মেকার থেকে কফি নিয়ে বেলকনীতে গিয়ে দাঁড়ায়। আকাশের দিকে চেয়ে বলে, “গত বছর আর এ বছরের মধ্যে পার্থক্য কি? তখনো এমন মন খারাপ ছিল, এখনো মন খারাপ। অথচ লোকে বলে বিয়ের পর সব স্বপ্নের মতো বদলে যায়….”

পাত্রপক্ষের সামনে যাওয়ার আগে কুহু তাদের কাজের মেয়ে লাকিকে বাজখাই গলায় বকা দিয়ে বলল,”এসবের মানে কি লাকি? এতো সস্তা কাপড় পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস কেন? তুই কি জানিস না খন্দকার বাড়ির কাজের লোকেরাও নামিদামী পোশাক পড়ে! ইউ ইডিয়ট মানসম্মান সব নষ্ট করার ষড়যন্ত্র করছিস না? ছিঃ কি বিচ্ছরি দেখাচ্ছে তোকে!”

লাকি অপ্রস্তুতভঙ্গিতে কুহুর দিকে তাকিয়ে রইল। কুহু নিজের শাড়ি সামলে বললো, “আমার চেইঞ্জ করা কাপড়গুলো দ্রুত সরিয়ে ফেলবি। আমি যেন এখান থেকে ফিরে আমার রুমে ২য় বার সেসব না দেখি।”

“বড় আপা আপনি দুপুরে যে জামা পড়ছেন ঐটা ফেলে দিতাম? ঐটা না কয়দিন আগেই কত দাম দিয়ে কিনলেন?”

কুহু ভ্রু কুঁচকে বলল,”সো হোয়াট? একটা ড্রেস আমি দুবার রিপিট করা পছন্দ করি না। তাছাড়া টাকার হিসাব কুহু খন্দকার কখনোই করেনা।
যা তো কথা বাড়াস না। যত্তসব থার্ড ক্লাস পিপল।”

লাকি দ্রুত সরে গেল। কুহু আড় চোখে তাকিয়ে দেখলো মধ্যবয়স্ক ভদ্রমহিলা একটু দূরে দাঁড়িয়ে সবটা শুনেছেন এবং দেখেছেন। সে বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে মনে মনে বলল, “আশা করি অর্ধেক কাজ হয়ে গেছে। বাকিটা পাত্রের সঙ্গে কথা বলার সময় করবো।”

ইশরাকের মা শাহিনা মাহবুব মলিন মুখে এসে সোফায় বসলেন। তার ছোট মেয়ে নিসা মায়ের এমন মুখ দেখে বললো,”মা কিছু হয়েছে? তোমায় এমন দেখাচ্ছে কেন?”

শাহিনা মাথা নেড়ে বলল, “নাহ আমি ঠিক আছি। তোর ভাই এসেছে?”

“নাহ, আসছে হয়তো।”

“ওহ আচ্ছা।”

কুহুকে আনার পর যখন পরিচয় করানো হলো কুহু তাকিয়ে দেখলো সেই ভদ্রমহিলা পাত্রের মা। ওর মনটা খুশিতে নেচে উঠলো। যাক নিশানা একদম জায়গামতো বসেছে।

সাধারণ কথাবার্তার মাঝেই ইশরাক ও তার বন্ধুরা প্রবেশ করে। কুহু ওকে দেখে ভীষণ চমকে যায়। তবে কি ইশরাকের বন্ধুর সাথেই ওর বিয়ের কথা চলছে! এই বলদ নিশ্চয়ই নাচতে নাচতে নিজের এক্স আর বন্ধুর বিয়ের খাওয়া খাবে, আর বলবে মামা এখানে কাবাবের শর্ট, রোস্ট আরেক পিস দেন তো, কাচ্চিটায় লবণ কম হইছে! যত্তসব।

কিন্তু তার ভাবনা যে সম্পূর্ণ ভুল তার প্রমাণ মিলল নাহিয়ানের কথায়। কুহু চোখ বড়বড় করে চেয়ে রইলো নাহিয়ানের দিকে। একদিকে আনন্দ হচ্ছে ইশরাকের সাথে ওর বিয়ে হবে, আবার নিজের কৃতকর্মের জন্য ভয় লাগছে তার মা না আবার তাকে অহংকারী মেয়ে ভেবে বিয়ে ভেঙে দেয়!

সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে আরওয়া যখন নিজের ঘরে গেল ল্যাপটপে মগ্ন মানুষটাকে না দেখতে পেয়ে মনটা কেমন যেন হয়ে গেল। একটু আগেও হাসিখুশি ভাব থাকলেও এই মুহূর্তে সব ম্লান হয়ে গেছে বলা বাহুল্য।

আরওয়া শাড়ি পাল্টে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে ফেসবুকে লগিন করলো। রাত প্রায় ১২টা বাজে। তার চোখে ঘুম নেই। মানুষটা ওখানে কি অবস্থায় আছে কে জানে। এখনো কি রাগ করে আছে? আরওয়াকে নিশ্চয়ই মনে মনে অনেক বকা দিচ্ছে,না? আরওয়া ফোনটা একপাশে রেখে সিলিং এ তাকায়। মনে মনে ভাবতে থাকে কত কথা, কত স্মৃতি! হঠাৎ ফোনে নোটিফিকেশন আসতেই সে চেক করে দেখে এক বছর আগের মেমোরিজ এসেছে, রুমাইসা ওকে ট্যাগ করে ছবি আপলোড করেছে তার মেমোরিজ, ইমেজ ওপেন হতেই দেখে তার হলুদের ছবি আপলোড করা হয়েছিল। আরওয়া এক ঝটকায় শোয়া থেকে উঠে বসে। ফোনের স্ক্রিন চেক করে দেখে তাদের হলুদের ছিল, তার মানে ১দিন বাদে ওদের ম্যারেজ এনিভার্সেরি! ইয়া আল্লাহ! এটাতোতার মাথাতেই ছিল না।
তাদের ১ম এনিভার্সেরিতে জাওয়াদ ওর পাশে থাকবে না?
আরওয়া বেশকিছুক্ষণ ভেবে বলে, “তবে কি এজন্যই অসময়ে কক্সবাজার যাওয়ার প্ল্যান করেছিলেন তিনি? উনার মাথায় ছিল নাকি নেহাতই কাকতালীয় ব্যাপার?”

পরদিন হসপিটালে যাওয়ার পর নাহিয়ানের কেবিনে তারিন এসে বলল, “ডক্টর সাহেব কোন আউটলেটে মিষ্টি অর্ডার করবো বলুন?”

নাহিয়ান ফাইল চেক করতে করতে বলল, বিয়ে কনফার্ম হোক আগে মিষ্টি অর্ডার করতে হবে না সরাসরিই হাতে পাবি।”

তারিন ওর হাত থেকে ফাইল নিয়ে বলল,” আরেহ গাধা আমি কি বিয়ের ব্যাপারে বলেছি? অন্যের ফাইল না ঘেটে নে নিজের মিসেসের ফাইল দেখ।”

নাহিয়ান বিস্মিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো সাবার রিপোর্টের দিকে। “সত্যিই কি সে আসতে চলেছে?”

চলবে,,,

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৩৮

#আরশিয়া_জান্নাত

“মা তুমি ভুল বুঝতেছ। কুহু ইচ্ছে করেই হয়তো এমন বিহেভ করেছে। ও মোটেও তেমন মেয়ে না ট্রাস্ট মি!”

” ও কেমন মেয়ে দেখা হয়েছে আমার। ও সামনে এক পেছনে আরেক। আমি নিজে দেখেছি সবার আড়ালে কেমন আচারণ করেছে।তুই ওর প্রেমে অন্ধ হয়ে গেছিস তাই দেখতে পাচ্ছিস না। দেখ বাবা বিয়েটা ছেলেখেলা না। অনেক ভেবেচিন্তে জীবনসঙ্গী চুজ করতে হয়।এখানে আমার মন মানতেছে না…”

ইশরাক মায়ের হাত ধরে বললো,” মা তোমার কি মনে হয় তোমার ছেলে এতোটাই কাঁচা? ৩২ বছরের জীবনে মানুষ চেনার একটু জ্ঞান ও কি আমার হয়নি? আমি কি এই পর্যন্ত কোনো মেয়ের কথা তোমাকে বলেছি?”

শাহিনা মাথা নেড়ে বলল,” আব্বুরে তোর চোখে এখন ভালোবাসার পট্টি বাঁধা, তুই এখন আমার কথা বুঝবি না। তোর যা ইচ্ছে কর তবে এই বিয়েতে আমি মন থেকে মত দিচ্ছি না। গরীবের নম্র ভদ্র মেয়ে ধনীর অহংকারী মেয়ের চেয়ে হাজারগুণ ভালো।”

ইশরাক হতাশ হয়ে মায়ের যাওয়ার পানে চেয়ে রইলো। আর মনে মনে বলল,”তুমি কেন ঐসব করতে গেলে কুহু! আমাদের বাড়া ভাতে ছাই না ফেললে কি তোমার হতো না?”

আরওয়া দাদীকে ফোন করে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে লাগলো। করিমুন্নেসা নাতনিকে স্বাভাবিক হতে সময় দিলেন, কান্নার বেগ কমে আসতেই তিনি নরম গলায় বললেন, “ও বু কি হইছে?”

“দাদীজান আমার কিছু ভালো লাগছেনা। আমি উনাকে কষ্ট দিয়েছি দাদীজান, উনি আমার উপর রেগে আছেন হয়তো।”

“ঘটনা কী হুনি আগে?”

আরওয়া পুরো ঘটনা দাদীকে খুলে বলল। করিমুন্নেসা সবটা শুনে বললেন, “আই তো ইয়ানে তোর দোষ দেহিয়ের না। পাঁচজন লই সংসার কইরতে গেলে কতদিক বিবেচনা কইরতে অয় হেতে না বুইজলে কি করন আছে? হেতের ভাবসাব হুনি তো মনে কর হেতে বিবাহবার্ষিকী পালন কইরবার লাই বুলি তোরে সাথে নিতে চাইছিল।”

“হুম উনি অনেক প্ল্যান করেছিল, আমিই গাধা বুঝিনাই।”

“মন বেজার করিচ্চা, দাদীর কথা হুন। তুই এক কাম কর তুই চিটাং যা গই। হেতের সামনে যাই খাড়াইলেই দেইখবি সব গোস্সা ফানি হই গেছে। যাওনের সময় হেতের লাই কিছু কিনি লইস ক্যান? আর কান্দিচ্চা, তোর হোড়িরে কই চিটাং যাওয়ার ব্যবস্থা কর।”

“আমি একা এতো দূর কীভাবে যাবো?”

“আই গাড়ি ফাডাইয়ের, সালাউদ্দীন তোরে দি আইবো।”

আরওয়া চোখ মুছে বলল,” আল্লাহ তোমারে অনেক দিন বাঁচাই রাখুক। তুমি আছ বলেই আমার সমস্যার সমাধান সহজেই হয়ে যায়।”

করিমুন্নেসা হেসে বললেন,”মসিবতে অধৈর্য হবি না, মাথা ঠান্ডা করি আরে ভাইববি। দেখবি আমনেই সমাধান মাথায় আই যাইবো।”

“হু”

আরওয়া শাশুড়ির থেকে অনুমতি নিতে গেলে রোকেয়া শুরুতে না করতে চাইলেও ওর চোখমুখ দেখে রাজী হয়ে গেলেন। আরওয়া শাশুড়ির অনুমতি পেয়ে দ্রুত ব্যাগপত্র গোছাতে শুরু করলো।

পাপিয়া অফিস থেকে ফিরে নিজের রুমে শুয়ে পড়লো। আজ তার শরীর একদম ভালো নেই। তাই সে চোখবন্ধ করে এক কাত হয়ে শুয়ে আছে। রোকেয়া মেয়ের জন্য ফলের জুস এনে তার শিয়রে বসলেন। মাথায় আলতো হাতে বিলি কেটে বললেন, “শরীর খারাপ লাগছে?”

“আমি ঠিক আছি আম্মু। চিন্তা করোনা।”

“আরওয়া আজকে চিটাগং গেছে। বুঝিনা ওদের কি হলো। ছেলেটা রাগ করে চলে গেছে, এখন বউ গেছে রাগ ভাঙ্গাতে। ওদের এসব ঝগড়াঝাটি কবে যে শেষ হবে!”

পাপিয়া চোখ না খুলেই বললো,”যে সম্পর্কে ঝগড়া বেশি ঐটাতে ভালোবাসাও বেশি। ওদের সম্পর্ক এভাবেই গড়ে উঠেছে, দেখবে এটা লাস্টিং করবে অনেকদিন।”

“কিন্তু উল্টোটা হয় যদি! বেশি ঝগড়া করলে মনে তিক্ততা আসে, একে অপরের প্রতি ঘৃণা জন্মায়। ওতেই আমার ভয়।”

পাপিয়া উঠে বসলো। মায়ের গালে হাত রেখে বলল, “সব ঝগড়ায় যেমন ভালোবাসা বাড়েনা, তেমনি সব ঝগড়ায় ক্ষোভ ও জন্মায় না‌।ওদের এই টকঝাল রাগ অভিমান ওদের সম্পর্ককে মজবুত করবে, চিড় ধরাবেনা ইনশাআল্লাহ!”

পাপিয়া মনে মনে বলল, “আমার সঙ্গে রিজভীর কত ঝগড়া হয়েছিল, কিন্তু ব্যাড এফেক্ট তো পড়েনি। বরং বন্ধুত্ব মজবুত হয়েছে। আশা করি ভাইয়া ভাবিরও তেমনি হবে।”

রোকেয়া চলে যাওয়ার পর পাপিয়া উঠে ডেস্কে বসলো। ফটো এলবাম বের করে দেখতে লাগলো পুরনো মানুষগুলোকে। যাদের অনেকেই বেঁচে আছেন আবার অনেকে কবরবাসী হয়েছেন। পাপিয়া সবার ছবি দেখছে আর ছবির পেছনে কাহিনী স্মরণ করছে। সেই ছবিগুলোর মধ্যে একটি ছবি আছে যেটায় তার কোলে ছিল তাদের অতিপ্রিয় বিড়াল সিম্বা। পাপিয়া ছবিটা স্পর্শ করতেই চোখ ভরে আসে। সিম্বাকে হারানোর স্মৃতি মানসপটে কড়া আঘাত হানে, পুরনো ক্ষত যেন তাজা হয়ে উঠে মুহূর্তেই। ওরা থাকেনা ওদের আদুরে স্মৃতিগুলো থেকে যায় আমৃত্যু কষ্টের বোঝা বইতে। পাপিয়া দ্রুত এলবাম বন্ধ করে টেবিলে মাথা রেখে কাঁদতে থাকে। কেন সব প্রিয়রা তাড়াতাড়ি হারিয়ে যায়?

জাওয়াদ অফিস শেষ করে শহরের অলিতে গলিতে হাঁটতে লাগলো। সাম্য গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করতে চাইলেও তাকে থাকতে দিলো না। এই সময়টা সে একা উপভোগ করতে চায়। আকাশে চতুর্দশী চাঁদ বেশ আলো ছড়াচ্ছে। জাওয়াদ রোড সাইডের বেঞ্চিতে বসে আকাশের দিকে চেয়ে থাকে। ওর কাজ আজ শেষ হয়ে গেছে। সে চাইলেই এখন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে পারে। কিন্তু সে যাবেনা। সে এখানে ইচ্ছে করে আরো দু’দিন থাকবে তারপর ফিরবে। এতে অবশ্য কারোই অসুবিধা হবে না। আরওয়ার ও না,যদি অসুবিধা হতো এ কয়দিনে একবার হলেও কল দিতো, কবে ফিরবে খোঁজ নিতো। খোঁজ নিচ্ছেনা তাও বলা যাচ্ছেনা, সাম্যকে নিয়মিত কল দিচ্ছে খোঁজ নিচ্ছে। শুধু ওর ফোনেই কল আসতে যত সমস্যা। জাওয়াদ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত প্রায় ১১টা বেজে গেছে, নাহ এখন হোটেলে ফেরা উচিত। সিএনজি ঠিক করে সে ফোন চেক করলো। নাহ কোনো কল বা মেসেজ আসেনি। জাওয়াদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইরের দিকে তাকায়।

“স্যার আপনি এসেছেন। আমি তো টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম…”

“এতো টেনশনের কী আছে? আমি কি এই প্রথম একা বেরিয়েছি নাকি?”

“নাহ স্যার সেটা বলিনি আসলে…”

“এক্সপ্লেইনেশন চাচ্ছি না। আমি আজ ডিনার করবোনা। তুমি ডিনার করে ফেলো। আমাকে কাল সকালে আর্লি ডাকবে না। আমি লেট করে উঠবো।”

লিফটের দরজা বন্ধ হতেই সাম্য বলল,” আজ এমনিতেও আমার সঙ্গে ডিনার করতে পারতেন না স্যার! আই হোপ এখন আপনার মুডটা ঠিক হবে”

রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই জাওয়াদের মনে হয় রুমটা খালি না। এখানে কারো উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছে। জাওয়াদ সতর্কভাবে ভেতরে ঢুকতে লাগলো। রুমে সব স্বাভাবিক দেখালেও ওয়াশরুমে শাওয়ারের শব্দে ওর আত্মা উড়ে যায়। এতো রাতে ওর ঘরে কে শাওয়ার নিচ্ছে! কেউ ভুল করে ঢুকে যায় নি তো? কিংবা অশরীরি কিছু….. জাওয়াদ আয়াতুল কুরসী আর সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত পড়ে গায়ে ফুঁ দিলো। সাথে সাথে পানির শব্দ বন্ধ হয়ে যায়। ব্যাপারটা ভুতূড়েই ঠেকে! সে চুপচাপ সোফায় গা এলিয়ে বলে, “যাক মানুষ না থাকুক অন্যকিছু হলেও আছে! আ’ম নট এলোন।”

দরজা খোলার শব্দ কানে আসতেই সে সামনে তাকায়,একটা মৃদু সুবাস ছড়িয়ে পড়েছে পুরো ঘর জুড়ে। জাওয়াদ উঠে এগিয়ে যায় ওয়াশরুমের ওদিকে। সত্যিই কি কোনো জ্বীনের সাক্ষাৎ মিলবে আজ! আরওয়াকে দেখে জাওয়াদ ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো। মনে মনে ভাবতে লাগলো জ্বীনটা কী তাহলে আরওয়ার বেশে এলো? ও আল্লাহ!

আরওয়া আয়নার সামনে বসে টাওয়ালে চুল মুছতে মুছতে বলল, “এমন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকার কী আছে? আমাকে কী এখন বেশিই সুন্দর লাগছে নাকি?”

জাওয়াদ নিজের চুলে হাত চালিয়ে ঠিক করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। টাই খুলে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে কাভার্ড থেকে টিশার্ট নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।

নাহিয়ান ডিউটি শেষে বাসায় ফিরেই নিজের ঘরে গেল। সাবাকে সরাসরি খুশির সংবাদ দিতেই এতোক্ষণ সে কিছুই জানায়নি। এত বড় গুড নিউজ ফোনে বললে ওর রিয়েকশন দেখা হবেনা। তাই সে দ্রুত নিজের ঘরে গেল। কিন্তু রুমে ঢুকতেই দেখে সাবা ফ্লোরে হাঁটুতে মাথা গুজে বসে আছে। নাহিয়ান ওর কাছে গিয়ে প্রফুল্ল গলায় বলে, “তোমার ধারণা ঠিক ছিল পাখি। সে আসতে চলেছে, সত্যিই আসতে চলেছে দেখো….”

সাবা মাথা তুলে চায় নাহিয়ানের দিকে, ওর অশ্রুসিক্ত নয়ন দেখে নাহিয়ান বিচলিত হয়ে বলে, “কি হয়েছে সাবা কাঁদছো কেন? শরীর খারাপ লাগছে? পেট ব্যথা করছে?”

সাবা ওর বুকে মাথা রেখে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল, অস্পষ্ট গলায় বলল,” ও নেই নাহিয়ান। ও নেই…..”

চলবে…

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৩৯

#আরশিয়া_জান্নাত

জাওয়াদ ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে আরওয়া খাবার পরিবেশন করছে। দৃশ্যটা খুব সাধারণ হলেও তার ভালো লাগছে। আরওয়া তাকে দেখে বলল, “খেতে আসুন। দুইদিনেই চেহারার যে হাল করেছেন মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে আপনার কেউ নেই।”

জাওয়াদ চেয়ারে বসে বলল,”হঠাৎ চিটাগং এলে কেন?”

আরওয়া ওর সামনে প্লেট দিয়ে বলল, “আপনাকে দেখার জন্য।”

জাওয়াদ অবজ্ঞাসূচক হাসি দিয়ে বলল,”নাইস জোক্স”

“থ্যাঙ্ক ইউ।”

“কোল্ড ওয়্যার রাখো। সোজাসাপ্টা জবাব দাও। তুমি তো দায়িত্বব্রতী নারী! সংসার নিয়ে এতো বিজি যে আমি এখানে আসার পর আমায় একবারও কল করে নি, সে হঠাৎ উদয় হলো কেন? তার দায়িত্ব কর্তব্য সব শেষ?”

আরওয়া ওর পিঞ্চ হজম করে বলল, “মানুষের চাওয়া পাওয়া যদি সময়ের সাথে বদলায় আমার কি কিছু বলার থাকে?”

“মানে?”

“মানে খুব সোজা। তবে এই মুহূর্তে আমি সেসব ডিসকাস করে কথা বাড়াতে চাইছি না। আমি লং জার্নি করে এসেছি, ভীষণ ক্ষুধার্ত এবং ক্লান্ত। দয়া করে এসব তুলে রাখুন।”

জাওয়াদ কি মনে করে ওর কপালে হাত দিয়ে টেম্পারেচর বোঝার চেষ্টা করলো। তারপর ওর হাত টেনে নিজের কাছে এনে চেক করলো। আরওয়া ওর কার্যকলাপ দেখে বলল, “কিছু করি নি আমি। এতো চেক করার কী আছে?”

“কে চেক করছে, আমি তো এমনিই ধরে দেখছি তুমি মানুষ কি না।”

“কোকোনাট একটা!”

জাওয়াদ চুপচাপ খাওয়ায় মন দিলো। আরওয়া ওর দিকে চেয়ে নিজেও খেতে শুরু করলো।

নাহিয়ান সাবাকে বুকে নিয়ে শুয়ে আছে। মেয়েটা দীর্ঘক্ষণ কেঁদেকেটে ঘুমিয়ে পড়েছে। নাহিয়ান এতোক্ষণ পাথর হয়ে থাকলেও এখন দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে। কেন সবসময় এমন হয়। স্বপ্ন পূরণ হতে গিয়েও হয় না। আলট্রাসনোগ্রাফীতে দেখা ঐ ছোট্ট প্রাণটা কেন এসেও এলো না? কেন সবসময় ওদের সাথে এমন হচ্ছে? আশার আলো ফুটিয়েও কেন আধার নেমে আসে? নাহিয়ান আলতো হাতে সাবাকে সরিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। এখন ওর কান্নার বেগে সাবার না ঘুম ভাঙে!

ছাদে বসে আকাশের দিকে ঝাপসা চোখে চেয়ে বলে, “তুমি কেন এমন করছো? তুমি তো রাহমানুর রাহিম। আমাদের বেলা কেন রহমত দিচ্ছ না? একটা সন্তান ই তো চাইছি তোমার কাছে। দয়া করে এই অধমকে সেটা দিচ্ছো না কেন?”

নাহিয়ানের কান্নার তোপ বাড়তে থাকে। সে নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করেও বিশেষ লাভ হয় না।

রিজভী বলেছিল আজ সে কল করবে, তাই পাপিয়া ফোন হাতে বসে আছে। আজকাল রিজভীর সাথে কালেভাদ্রে কথা হয়। লং ডিস্টেন্সে থাকায় টাইমিং ম্যাচ হয় না। দেখা যায় রিজভী যখন অবসরে থাকে পাপিয়া তখন মহাব্যস্ত। আবার পাপিয়া যখন ফ্রি রিজভী তখন বিজি। এভাবেই দুই প্রান্তের মানুষ একে অপরের নাগাল পাচ্ছে না। সময়ের এই টানাপোড়েনে কীবোর্ডের কয়েকটা শব্দ বার্তারূপে পৌঁছে দুজনের মেলবন্ধন টিকিয়ে রেখেছে বলা বাহুল্য। রিজভী লাইনে আসতেই পাপিয়া নড়েচড়ে বসে। আয়নায় নিজেকে আরেকবার দেখে আশা রাখে রিজভী বুঝি ভিডিও কলে আসতে চাইবে। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণ করে রিজভী অডিও কল দেয়। পাপিয়া কল রিসিভ করতেই সেই চিরচেনা গলার স্বর শুনতে পায়। ঝরঝরে গলায় রিজভী বলে,” পাপিতা, কেমন আছিস?”

“ভালো আছি। তুই?”

“আছি বেশ! তারপর বল তোর কী খবর? বাসার সবাই ভালো আছে?”

“হুম সবাই ভালো। তোদের বাসার সবাই ভালো তো?”

“সবাই ভালোই তবে মা একটু অসুস্থ।”

“কী হয়েছে আন্টির?”

“বয়স হলে রোগের অভাব আছে? আমার দাদী বলতো, “জয়কালে ক্ষয় নাই, বয়সকালে দাওয়াই নাই।” উনার সাথেও তেমনি ঘটছে। ”

“বুঝেছি।”

“তোর বোনের বিয়ে কনফার্ম হয়েছে?”

“না এখনো হয় নি।”

“কেন? তুই না বললি ওর পছন্দের ছেলের সাথেই কথাবার্তা চলছে? এখন সমস্যা কী?”

“আপু নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরেছে।এখন ইশরাক ভাইয়ার আম্মু মত দিচ্ছেন না।”

“তোর বোন একটা চিজ বটে! এতো নাটক সে করতে জানে। মাঝখানে তোর যত ঝামেলা।”

“আমার ঝামেলা কেন?”

“তো কার ঝামেলা? ওর বিয়ে না হলে তোর হবে? তাও ভাগ্য বুঝলি তোর ভাইয়েরা বিয়ে করে ফেলেছে। নয়তো সব কয়টা চিরকুমার থেকে যেতো।”

“হুম তাও ঠিক।”

“আংকেল আন্টি কী বলে? তোর বিয়ে নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে না?”

“প্রপোজাল তো আসেই, তবে আপুকে বাদ দিয়ে আমারটা কীভাবে দেখবে! তাই আগাচ্ছে না।”

“বুঝেছি। তোর অফিসে কোনো কলিগ নেই? আই মিন যার সঙ্গে রিলেশনে যেতে পারিস। একটা ব্যাকাপ রাখলি আর কি!”

পাপিয়া ওয়েট টিস্যু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বলল,”রিলেশন করা প্যারা লাগে আমার কাছে। সিঙ্গেল আছি ভালো আছি। বিয়ে ভাগ্যে থাকলে হবে নাহলে নাই। ওসব নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছি না। আমার কথা বাদ দে, তোর কথা বল তুই কার অপেক্ষায় আছিস? তোর তো কোনো সিরিয়াল নেই, ওখানে ভালো জব করছিস। দেশী না হোক বিদেশী কাউকে চুজ করে সংসার পাতলেই পারিস!”

রিজভী হেসে বলল,” বিয়ে করার হলে দেশীই করবো। বিদেশীর প্রতি আমার ইন্টারেস্ট নেই।”

“তাই নাকি?”

“হ্যাঁ। তুই কি করছিস? ফ্রন্ট ক্যামেরা অন করা যাবে?”

পাপিয়া মনে মনে বলল,”মেকাপ মোছার পর তোর চেহারা দেখতে মন চাইলো?”

রিজভী ভিডিও কল দিলে পাপিয়া এক্সেপ্ট করলো। রিজভী ওকে দেখেই বললো,” আরেহ তুই তো অনেক সুন্দর হয়ে গেছিস। তোর রূপের রহস্য কী?”

পাপিয়া ওর মিথ্যে প্রশংসা গায়ে মাখলো‌না। স্ক্রিনে তাকিয়ে রিজভীকে মন দিয়ে দেখলো। চোখেমুখে সেই দুষ্টুমি মাখা ভাবটা আর নেই, বরং ম্যাচিওরিটি এসেছে মনে হলো। নাকী অনেকদিন বাদে দেখছে বলে এমন মনে হচ্ছে? আগের চেয়ে একটু হেলদী হয়েছে না? সুন্দরই লাগছে। হতাশার ছাপ মুছে একটু প্রানবন্ত হয়েছে এটাই স্বস্তির।

রিজভী তুড়ি বাজিয়ে বললো,” কি রে কোথায় হারালি? কথার উত্তর দিচ্ছিস না যে?”

“অনেক দিন বাদে তোকে দেখছি! দেশে আসবি না?”

“সবেই তো এলাম, আরো কয়েক বছর যাক তারপর আসবো।”

“তুই গেছিস যে ৭মাস চলে না?”

“হুম।”

“অথচ মনে হচ্ছে ৭বছর হয়ে গেছে!”

“হেহেহে,,,তুই দেখি আম্মুর মত কথা বলোস। সেদিন আম্মুও বলতেছিল, কবে ফিরবো। কী একটা অবস্থা!”

“ছেলে দেশের বাইরে গেলে মায়েদের মন নরম হয়ে যায়। তুই চাইলে দেশেই ভালো কিছু করতে পারতি, ওখানে যাওয়ার দরকার ছিল‌ না।”

“সেটা ঠিক, তবে আমি চাইছিলাম না দেশে থাকতে। মাঝেমধ্যে চেনা গন্ডি টপকে অচেনা জায়গায় বসতি গড়তে হয়। এতে শরীর ও মন দুটোই ভালো থাকে।”

“তুই সামিয়াকে ভুলতে ওখানে গেছিস তাই না?”

রিজভী মাথা চুলকে বলল,” মোটিভ এটাই ছিল, তবে এখানে এসে অন্য একটা রিয়েলাইজেশন হয়েছে। মে বি দেশে থাকলে সেটা আসতো না। তাই আমি মনে করি চলে এসে ভালো করেছি।”

পাপিয়া হেসে বললো,”আমি মন থেকে চাই তুই মুভ অন করে একটা হ্যাপি লাইফ লিড কর।”

“আই নো! পাপিয়া শোন?”

“হুম?”

“মানুষ কি আবার প্রেমে পড়তে পারে? আই মিন লং টাইমের রিলেশন ভাঙার পর সে যদি আবার প্রেমে পড়ে এটা কী খারাপ?”

“আমার সেটা মনে হয় না।”

“তুই হয়তো আমার দিক বিবেচনা করে ফ্রেন্ডলী আনসার দিচ্ছিস। সত্যিটা ভিন্ন!”

পাপিয়া হেসে বলল,”ফ্রেন্ডের কথা খুব কম মানুষই সত্যি বলে মেনে নেয়!”

“সাম্য ভাইয়া, এখান থেকে কক্সবাজার কত দূর?”

“ম্যাম,আমাদের লোকেশন থেকে কক্সবাজার যেতে এক দেড় ঘন্টা লাগতে পারে।”

“কাছেই তাহলে। আচ্ছা ওখানে থাকার ব্যবস্থা কেমন? আপনি কি এখন কোনো রুম বুক করতে পারবেন?”

“অবশ্যই পারবো। আপনি কোনো চিন্তা করবেন না। আমি সব ব্যবস্থা করছি।”

“ধন্যবাদ ভাইয়া।”

সাম্য চলে যেতেই জাওয়াদের আগমন ঘটলো। ডাইনিং এর চেয়ারে বসে বললো,”সাম্যর সাথে এতো হেসে হেসে কী কথা বলছিলে?”

“আপনাকে কেন বলবো?”

“না বললে নাই, হু কেয়ার্স!”

“হু কেয়ার্স দেখাই যাচ্ছে! এনিওয়ে আপনার অফিশিয়াল কাজ তো গতকালই শেষ হয়ে গেছে না? আজ তো আপনি ফ্রি বলতে গেলে?”

“পিএ আমার নাকি তোমার? সাম্য সব ইনফরমেশন পাচার করছে না! ওকে আমি…”

আরওয়া ব্রেডে বাটার মাখতে মাখতে বলল,” সবসময় নিরীহ মানুষের উপর রাগ দেখাবেন না। অর্ধাঙ্গিনী মানে বুঝেন? আপনার সবকিছুতে আমার অধিকার অন্যদের চেয়ে বেশি। এটা ভুললে চলবে না।”

“তোমার কাছে আমি বাদে সবাই নিরীহ!”

“মোটেই না, আপনি ওদের সবার চেয়ে বেশি নিরীহ! সহজ ভাষায় যে নিজের মনের ইচ্ছা প্রকাশ করতে পারে না তার প্রতি আমার সহানুভূতি আরো বেশি আসে!”

“আমি কি কঠিন ভাষায় বলেছিলাম?”

“নাহ!”

“তাহলে?”

“তাহলে কিছু না।”

“অবশ্যই অনেক কিছু, আমার ইচ্ছা অনিচ্ছার দাম তোমার কাছে নেই। এখন সেটা সহজ ভাষায় বলি বা কঠিন ভাষায়!”

“রিয়েলি?”

“অফকোর্স! ”

“যা হবার হয়েছে, বাড়ির বউ হবার দায়িত্ব পালন করে এসেছি। এখন স্ত্রী হবার দায়িত্ব পালন করবো। দয়া করে মুখ ভার করে না রেখে হাসিমুখে থাকুন।”

জাওয়াদ ফোন বের করে সাম্যকে টেক্সট করলো, “Restart the plan”

সাম্য মেসেজ পেয়ে মুচকি হাসলো। তার ধারণাই ঠিক ছিল, ভাগ্যিস গতকালই সে সব এরেঞ্জমেন্ট করে ফেলেছে!

“হ্যালো শুনুন আমি যেভাবে বলেছি সবটা সেভাবেই করবেন। কোনো কিছু যাতে নড়চড় না হয়। আর কেকটা অবশ্যই স্ট্রবেরি ফ্লেভারের হবে…..”

চলবে,,,

কাঁটাকম্পাস পর্ব-৩৪+৩৫+৩৬

0

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৩৪

#আরশিয়া_জান্নাত

পাপিয়া তাদের ক্যাম্পাসের ক্যাফেটেরিয়ায় একা বসে আছে। এখানে বসে তারা কত মজার সময় কাটিয়েছে, বন্ধুদের সাথে হাসি আড্ডায় অনেকটা সময় এখানে কেটে যেত। অথচ এখন এখানে আসাই হয় না। এমবিএ করার পর সবাই যার যার ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছে। হিয়া তো চাঁদপুরে শ্বশুরবাড়িতে সেই যে গেল আর আসেনি। রিজভীও ইউকে। অন্যদের সাথেও বিশেষ যোগাযোগ নেই। পাপিয়া সবাইকে মিস করলে এখানে চলে আসে। বসে পুরনো স্মৃতি আওড়ায়। এখানে চারদিকে তাদেরই অতীতের প্রতিচ্ছবি ঘুরে বেড়ায়। মুখগুলো ভিন্ন হলেও চিত্রগুলো ভিন্ন হয় না। সময় কত দ্রুত চলে যায়, এই তো সেদিন প্রথম এই ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছিল। তারপর ৫ বছর যেন চোখের পলকেই শেষ হয়ে গেছে। জবে জয়েন করার ও এক বছর হতে চলল। সবকিছু কত দ্রুতই না হচ্ছে!

পাপিয়া কফিতে শেষ চুমুক দিয়ে উঠার জন্য প্রস্তুত হতেই পাশের টেবিল থেকে ভেসে, “দোস্ত তুই না আমার পরাণের দোস্ত। বিশ্বাস কর আমি আগামী মাসে পকেটমানি পাওয়া মাত্রই ফেরত দিয়ে দিমু, মানসম্মান বাঁচা…”

“তুই সবসময় এমন করোস। এই পঙ্গপালদেরকে না খাওয়ালে তোর ইজ্জত যায় কেন? যত্তসব।”

পাপিয়ার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে। “রিজভী! কই রে তুই? তোকে অনেক মিস করি….”

কুহু পার্কের বেঞ্চিতে বসে আইসক্রিম খাচ্ছে, ওর পাশেই ইশরাক বসা। আপাতত সে নিজের আইসক্রিম খাওয়া বাদ দিয়ে কুহুর দিকে তাকিয়ে আছে। কুহু ওর দিকে না তাকিয়েই বলল, “এমন হাবলুর মতো চেয়ে থেকো না। যে টেম্পারেচর তোমার আইসক্রিম গলে পড়বে।”

ইশরাক নড়েচড়ে বলল, “তুমি এমন গা হিম করা নিউজ বলে চুপচাপ আইসক্রিম খাচ্ছ কিভাবে!”

“লোহাকে লোহা কাটে জানো? তেমনি ঠাণ্ডা ঠাণ্ডাকে কাটে। সিম্পল!”

“লজিক আছে।”

“তোমরা বাসায় আসবে কবে?”

“আপু ঢাকায় আসলেই।”

“আপু ঢাকায় আসবে কবে?”

“বলেছে তো এই মাসে আসবে। দেখি।”

কুহু ওর দিকে ক্রুর দৃষ্টি দিয়ে বলল,”শোনো আমার যদি অন্য অন্য কোথাও বিয়ে ফিক্সড হয়ে যায়, ভেবো না আমি কেঁদেকেটে বালিশ ভেজাবো। সরাসরি তোমায় খু*ন করে ফেলব মাথায় রেখো।”

কুহুর কথা শুনে ইশরাক কাশতে কাশতে বললো, “এখানে আমার অপরাধ কি? আমাকে খু*ন করবে কেন?”

“তোমার অপরাধ নেই বলছো? আমি সেই কবে তোমাকে বলেছিলাম বাসায় আসো। কথাবার্তা আগাও, কিন্তু না তোমার আরো সময় চাই। তোমার সময় হতে হতে আমার চুল সব সাদা হয়ে যাবে, তবুও তোমার সময় হবেনা।”

“তোমার দাদাসাহেব সত্যিই ছেলে ঠিক করেছেন? তুমি মজা করছো না তো?”

“আমার চেহারা দেখে কি সেটা মনে হচ্ছে?”

ইশরাক মাথা নেড়ে বলল,” না। তবে তোমার চেহারা সবসময়ই সিরিয়াস থাকে। তাই বুঝতে পারছি না ঘটনা সত্যি কি না।”

কুহু উঠে বলল, “বিশ্বাস না করলে নাই। তুমি থাকো আমি যাচ্ছি।”

ইশরাক আইসক্রিম শেষ করে পটটা ডাস্টবিনে ফেলল। হাসিমুখে কুহুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, “বায়োডাটা না পড়ে ফেলে রাখার অভ্যাস তোমার যাবে না,পাগলী একটা!”

নাহিয়ান হসপিটাল থেকে ফিরে রুমে আসতেই দেখে সাবা ওয়াশরুমের দেয়ালে চোখ বুজে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে দ্রুতপদে তার কাছে গিয়ে বলল,” এই সাবা কি হয়েছে তোমার চেহারা এমন লাগছে কেন?”

সাবা উত্তর দেওয়ার আগে আবার বমির বেগ আসে। নাহিয়ান তার মাথা ধরে রাখে পরম যত্নে। যা গরম পড়ছে নিশ্চয়ই পেটে খাবার সহ্য হচ্ছেনা, তাই সব উগড়ে দিচ্ছে। বেশ কিছুক্ষণ পর তাকে ফ্রেশ করিয়ে বিছানায় বসিয়ে ইন্টারকমে কল করে শরবত আনতে বলল।

“তোমার হঠাৎ এতো শরীর খারাপ হলো কিভাবে? সকালেও তো সুস্থ দেখে গেলাম, কি খেয়েছ এর মাঝে?”

“তেমন কিছু খাই নি। এমনি বমি বমি ভাব পাচ্ছিল।”

“আচ্ছা, তুমি রেস্ট করো। আমি ফ্রেশ হয়ে‌ নি”

“নাহিয়ান শোনো?”

“হুম?”

” আমার ২টা সাইকেল মিস গেছে।”

“তোমার তো রেগুলার হয় না।”

“হ্যাঁ কিন্তু আমার মন বলছে…”

নাহিয়ান ওর দীপ্তচোখে চেয়ে ম্লান হাসলো। এটা তার জন্য আজ নতুন ঘটনা নয়। প্রায়ই সাবা এরকম আশা বুনে, ৩য় মাসে আশাহত হয়।
সে ওর মাথায় পরম স্নেহে হাত রেখে বলল, “তোমার ধারণা সত্যি হোক!”

সাবা হেসে সম্মতি দিলো।

রুমাইসা ফুচকা গালে তুলে বলল, “রাজীব স্যার বিয়ে করছে শুনছোস?”

“কবে? শুনিনাই তো!”

“গত শুক্রবার হয়তো। ইনস্টাতে ছবি আপ করলো দেখলাম। বেচারা তোকে কত পছন্দ করতো। তুই তো পাত্তাই দিলি না।”

“ধুরর! স্যার-ছাত্রীর বিয়ে আমার কাছে লেইম লাগে। আমার মতে অবিবাহিত কম বয়সীদের ভার্সিটিতে টিচার হিসেবে অ্যাপয়েন্ট করা উচিত না। আমি সরকার হলে এই নিয়ম জারি করতাম।”

“এটা তোর ভুল ভাবনা। কোনো মেয়ের বাবা বেকার ছেলের কাছে মেয়ে বিয়ে দেয়?এমনিতেই দেশে বেকারত্বের হার যেই এর মধ্যে তোর নিয়ম জারি হলে শেষ।”

“এভাবে তো ভেবে দেখি নি! তবে দোস্ত যাই বলোস না কেন, পড়ানোর সময় স্যার যদি তোকে ছাত্রী কম প্রেমিকা বেশি ভাবে তাহলে স্টুডেন্ট হিসেবে ক্ষতি বৈ লাভ হবেনা। উনার ব্যক্তিত্ব উন্নত করা প্রয়োজন ছিল। শিক্ষকতা খুব শ্রদ্ধেয় পেশা বুঝলি!”

“সবাই এতো নীতিকথা মানলে প্রেম হবে কিভাবে? হেহে””

আরওয়া ওর হাসিতে যোগ দিলো। রুমাইসা হাসি থামিয়ে বলল, “তোর জামাইটা শান্তি দিলো না। চলে আসছে তোরে নিতে!”

আরওয়া পেছন ফিরে দেখে জাওয়াদের গাড়ি এসেছে। তবে জাওয়াদ এর বদলে সাম্য গাড়ি থেকে ওর কাছে এসে বলল, “ম্যাম স্যার একটা জরুরি কাজে আটকা পড়েছে বলে আমাকে পাঠালেন। আপনি কি এখন উঠবেন নাকি আরো কিছুক্ষণ সময় লাগবে?”

রুমাইসা ভ্রু কুঁচকে ফুচকা গালে তুলল। সাম্য এক নজর ওর দিকে চেয়ে বলল, “আমি নাহয় অপেক্ষা করছি আপনি খাওয়া শেষ করুন।”

“সাম্য ভাইয়া আপনিও জয়েন করুন? এখানের ফুচকা অনেক টেস্টি। নাহয় মিন্ট লেমন জুস খাবেন?”

“না না ম্যাম ঠিক আছে, থ্যাঙ্কস।”

রুমাইসা ওর দিকে তাকিয়ে বলল,” তোর রোবট বরের পিএ ও রোবট বুঝলি। এসব খাবার তারা খেতে পারবে না।”

খোঁচাটা হজম করে সাম্য ভদ্রতাসূচক হাসি দিলো। আরওয়া বলল, “ভাইয়া, আপনি ওকে ভুল প্রমাণ করে দিন তো, বসুন প্লিজ। মামা আরেক প্লেট ফুচকা দিন তো।”

সাম্য সানগ্লাস না খুলেই বসে পড়লো সামনের চেয়ারে। আর মন দিয়ে দেখতে লাগলো পিঞ্চ কাটা রমণীকে।

রুমাইসা স্ট্রতে ঠোঁট চেপে চুমক দিয়ে বলল, “সানগ্লাস চোখে রেখে মেয়ে দেখা ওল্ড ট্রিক্স। নতুন কিছু ট্রায় করুন।”

সাম্য থতমত খেয়ে সানগ্লাস খুলে বলল,”আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন।”

আরওয়া রুমাইসাকে কনুই দিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলল, “এমন করছিস কেন? ভাইয়া এমনিতেই আনইজি ফিল করছে।”

“ওকে ফাইন কিছু বলছি না আর। এই মুখে কুলুপ আটলাম।”

সাম্য চুপচাপ খাওয়ায় মন দিলো। এই মুহূর্তে কিছু বলা মানেই ব্ল্যান্ডার হয়ে যাবে। তার চেয়ে মানে মানে কেটে পড়া ভালো। তবে এ কথা বলতেই হয় মেয়েটার চেহারাটা ভীষণ মায়াবী! তাকিয়ে থাকতেও আরাম লাগে টাইপ। ধুরর কি সব ভাবছে সে। ছি ছি ছি…

অফিস থেকে ফিরে জাওয়াদ বলল, “আরওয়া ৫মিনিট সময় দিচ্ছি আর্লি রেডি হও।”

আরওয়া পড়ার টেবিল থেকে উঠে বলল,” কি হয়েছে এতো তাড়াহুড়া কেন? কোথায় যাবেন?”

“এতো কথা বলার সময় নেই তো। হারি আপ!”

আরওয়া কাভার্ড থেকে ড্রেস বের করে চটজলদি চেইঞ্জ করে তৈরি হয়ে নিলো। জাওয়াদ ওকে দেখে বললো, “শাড়ি পড়লে ভালো হতো, থাক এটাতেও খারাপ লাগছে না। চলো।”

আরওয়া গাড়িতে বসে বলল, “এখন তো বলুন কোথায় যাচ্ছি?”

“আমার এক ফ্রেন্ড এর বিয়ে আজকে। আমি একদম ভুলে গেছি। যদি এটেন্ড না করি আমাকে ও মেরেই ফেলবে। তোমাকে নিয়ে গেলে বলতে পারবো বউ মেকাপ করতে টাইম লেগেছে তাই লেট হলো!”

আরওয়া চোখ সরু করে বললো,”আপনি এতো শেয়ানা! বউ এর নাম দিয়ে নিজের দোষ লুকাবেন?”

“ট্রাস্ট মি ও যদি ডেঞ্জারাস না হতো এই পন্থা অবলম্বন করতাম না। ও নাহয় সত্যি সত্যিই বিয়ের আসর থেকে উঠে এসে আমাকে মারবে।”

“হেহেহে আপনার এমন বন্ধুও আছে? অবিশ্বাস্য!!”

“স্কুল লাইফের ফ্রেন্ড তো হিসাব নিকাশ করে হয় না। ওরা সবসময় অবিশ্বাস্য লেভেলের হয়।”

“রাইট! কিন্তু আমি যে বেশি সিম্পল হয়ে এসেছি। বিয়েতে কেউ এমন যায়?”

“সবাই তো হেভি মেকাপে যাবে, সেখানে তুমি সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস হবা! মিস্টার ফারাজ খন্দকার জাওয়াদের ওয়াইফ বলে কথা, যেভাবেই যাও না কেন ট্রেন্ড হয়ে যাবে!”

“ইশ কি কনফিডেন্ট!!”

“ওভারএক্টিং হয়ে গেল?”

আরওয়া হেসে বলল, “মাঝেমধ্যে একটু আধটু বাড়িয়ে বলাই যায়। ব্যাপার না।”

স্টেজে যাওয়ার পর অয়ন জাওয়াদকে জড়িয়ে ধরে বললো, “এখানের রেড কার্পেট তোলার সময় আসতি, এতো তাড়াতাড়ি আসলি কিভাবে?”

“ঢাকায় যে জ্যাম জানিস তো।”

“বাহানা দিস না আমি সিওর তুই ভুলে গেছিলি, স্কুলে আসার আগের মতো ৫মিনিটে রেডি হয়ে এসেছিস তাই না!”

“আরেহ না কি যে বলোস? এখন কি আগের দিন আছে।”

“যাক এসেছিস এতেই আমি অনেক খুশি।”

ছবি তোলার পর ওরা ফুড সেকশনে গেল। জাওয়াদ চেয়ারে হেলান দিয়ে শ্বাস ফেলে বলল, “সেই বাঁচা বেঁচেছি! ভাগ্যিস সাম্য মনে করিয়ে দিয়েছে।‌”

“হুম সেটাই। এই খুশিতে সাম্য ভাইয়াকে গিফট দিবেন।”

“এখানে দোষ ও কিন্তু ওর। ও আমার পিএ হয়ে এতো কেয়ারলেস হলো কেন? আমার সব ইভেন্ট ওর মুখস্থ থাকার কথা! আজকাল কি হয়েছে কে জানে, কেমন এবসেন্ট মাইন্ডে থাকে। আগে তো এমন ছিল না।”

“হয়তো গফের সাথে ঝগড়া চলছে তাই এমন করছে।”

“সাম্যর গফ আছে নাকি!”

“নেই?”

“আই ডোন্ট নো!”

“আহারে বেচারা! এমন এক বসের আন্ডারে জব করে লাভ এফেয়ারে জড়ানোর সময় টুকু পায় না। সো স্যাড!”

জাওয়াদ চোখ ছোটছোট করে বলল, “আমি কি ওকে ধরে রেখেছি? আমার ফল্ট কোথায়?”

“আমি কি বলেছি আপনি দোষী? আপনি তো‌ নির্দোষ। কথাটা বলার সময় আমার বিবেকে কাজ করে নাই আবেগে কাজ করেছে…”

বলেই আরওয়া হাসতে লাগলো। জাওয়াদ ওর হাসি দেখে বলল, “স্ট্রেইঞ্জ! এখানে হাসির কি আছে?”

“হাসতে কারণ লাগে নাকি? আরওয়া এমনিতেই হেহে হিহি করে।”

জাওয়াদ মনে মনে বলল, “সো কিউট!”

চলবে…

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৩৫

#আরশিয়া_জান্নাত

“আমি বুঝি না তোমরা সবসময় এমন কেন করো? ছেলেপক্ষ আসতে চাইলেই সবাই লাফিয়ে উঠো, যেন পারলে প্রথম সাক্ষাতেই কাবিন ফাইনাল!”

কোহিনূর বেগম বোতাম এর শেষ ফোঁড় দিয়ে বললেন, “তোর কথামতো চলতে গেলে তুই তো বুড়ি হবিই সাথে ছোটবোনটাকেও বুড়ি বানাবি। পাপিয়ার জন্য আসা প্রপোজাল গুলোও দেখা যাচ্ছেনা তোর জন্য। তোর মেজ চাচারা নেহাতই ভালো মানুষ বলে এখনো চুপচাপ আছেন। অন্য কেউ হলে…”

“আম্মু বিয়ের সিকোয়েন্স বলে কিছু নাই। যার যখন ইচ্ছে সে তখন বিয়ে করে ফেলবে। বড় ছোট এসব মানা ঠিক না। ওর জন্য ভালো প্রপোজাল আসলে ওকে দিয়ে দাও। আমার অপেক্ষা করার কি আছে!”

“আমরা জয়েন্ট ফ‌্যামিলিতে থাকি, চাচাতো ভাইবোনের মধ্যে আপন ভাইবোনের মতোই সিরিয়াল হয়। তোরা পড়াশোনা করতে চেয়েছিস পড়িয়েছি। তুই গ্র্যাজুয়েট হলি, এমএসসি করলি তারপরো তোকে কিছু বলেছি? প্রেশার দিয়েছি? আর কত স্পেস দিবো তুই ই বল?”

“তুমি জানো কোরিয়ান মেয়েরা….”

“খবরদার কুহু ঐ ভিনদেশী দের তুলনা টানবি না। ওদের কালচার আমাদের চেয়ে ভিন্ন।‌এটা তোকে মানতেই হবে।”

কুহু বিরক্তস্বরে বললো,” আমি আগেই বলেছিলাম আমাকে বাইরের দেশে এপ্লাই করতে দাও। তোমাদের এইসব আমার ভাল্লাগেনা। ধুরর।”

কুহু চলে যেতেই কোহিনূর ভেংচি কেটে বললো,” দেখবো তো এবার কিভাবে বিয়ে না করে থাকিস। বজ্জত মাইয়া, সারাক্ষণ তোর বই না হয় সিরিজ দেখা ছুটাচ্ছি!”

সাবার অবস্থা এবার সত্যিই বিশেষ সুবিধার না। যাই খাচ্ছে বমি করে উগড়ে দিচ্ছে। তার মনে হয় খাবার সব বিস্বাদ, একটুও টেস্ট নেই। সাবা ক্ষুধা নিবারণের জন্য নাকমুখ কুঁচকে কোনোমতে দু’টো মুখে দিলেই দ্বিগুণ হারে বেরিয়ে গিয়ে তাকে কাহিল বানায়। কোহিনূর রীতিমতো ওর জন্য টেনশনে পড়ে গেছে। ওদিকে নাহিয়ান ক্যাম্পিং এর জন্য ঢাকার বাইরে গেছে। ওর অবস্থা বেগতিক দেখে নাহিয়ানের হসপিটালেই নিয়ে গেলেন তিনি। বেশকিছু টেস্ট করিয়ে সাবাকে নিয়ে বাসায় ফিরলেন। সালমা তাকে দেখে বললেন,”বড় বৌ, কি বললো ডাক্তার?”

“তারিন ছিল না আম্মা। ও ফোনে কিছু টেস্ট করাতে বলছে ঐগুলো করিয়ে আসছি। রিপোর্ট আসলে বলা যাবে। চিন্তা করবেন না।”

“মেয়েটার মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছেনা। এত দূর্বল হয়ে গেছে। বললেই কি আর চিন্তা না করে থাকা যায়? আচ্ছা তুমি যাও রেস্ট নাও।”

আরওয়া ছাদে বসে হাওয়া খাচ্ছে। তার সঙ্গে পাপিয়াও আছে‌। পাপিয়া বললো,”নতুন ভাবি আমার কি মনে হয় জানো? এবার আমরা সত্যিই ফুপী হবো।”

“কি বলো আপু? ভাবির অবস্থা দেখে সবাই যেখানে টেনশনে আছে তুমি ভাবছো ফুপী হবা!”

“ভাবির শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটছে মানছি, তবে লক্ষণ কিন্তু এইদিকেই পয়েন্ট করছে। যদি এটা সত্যি হয় ওদের আর কোনো অপূর্ণতা থাকবেনা।”

“আল্লাহ তোমার ধারণা সত্যি প্রমাণ করুক।”

পাপিয়ার ফোনে জরুরি কল আসায় সে ওখান থেকে সরে নীচে চলে আসে। আরওয়া চোখ মেলে চায় দিগন্ত বিস্তৃত আকাশের দিকে। দূরদূরান্তে বড় বড় দালানকোঠা ব্যতিত কিছুই চোখে পড়েনা। যান্ত্রিক এই শহরে সবাই ছুটছে তো ছুটছেই। কোথাও অবসর নেই, এক মুঠো ফুরসত নেই নিরবতা অবলম্বন করার। আরওয়াই বুঝি একমাত্র বেকার মানুষ। ফোনে জাওয়াদের নাম্বারটা ভেসে উঠতেই আরওয়ার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠে, আনন্দের ঝলক ছড়িয়ে পড়ে বদনে। মোলায়েম কন্ঠে বলে উঠে,”আস্সালামু আলাইকুম।”

“ওয়ালাইকুমুস্সালাম। কোথায় আছেন ম্যাম? রুমে দেখছি না যে!”

“ছাদে আছি। দাঁড়ান আসছি..”

“নাহ আসতে হবেনা বসুন,আমিই আসছি।”

“আচ্ছা!”

আরওয়া টেবিলে থাকা গ্লাসে আইস কিউব দিয়ে তাতে তরমুজের জুস ঢালল। জাওয়াদ ছাদে এসে চেয়ারে বসল। আরওয়া তার দিকে গ্লাস এগিয়ে বলল, “আপনি দিনদিন এমন গ্লো করছেন কেন? আপনার রূপের রহস্য কী?”

জাওয়াদ হেসে বলল, “তুমি কী উল্টোটা শুনতে চাইছো?”

“উল্টোটা শুনতে চাইবো কেন? আমার যেটা মনে হলো সেটাই বললাম। বউয়ের ভালোবাসা পেয়ে পেয়ে আপনি আরো সুন্দর হয়ে যাচ্ছেন। এটা কি ভুল বললাম? বিশ্বাস না হলে আয়নায় দেখুন।”

“হুম এটা ঠিক! আমার মিসেস আমাকে প্রচুর ভালোবাসে, আজকাল অনেকেই এটা কানাঘুষা করে শুনি।”

“তাই না?”

“হুম। এই শোনো, কক্সবাজার যাবে? ওখান থেকে সেন্ট মার্টিন ও ঘুরে আসবো। কি বলো?”

“যেতে পারলে মন্দ হয় না। কিন্তু এখন কি যাওয়া ঠিক হবে?”

“কেন এখন কি হয়েছে আবার?”

“বাসায় কত ইভেন্ট আছে। আপুকে দেখতে আসবে, সাবা ভাবির শরীরও ভালো নেই। দাদাসাহেবের হাবভাব দেখে তো মনে হচ্ছে কুহু আপু্র বিয়ে প্রায় কনফার্ম। এখন এমন প্ল্যান করা কি ঠিক হবে?”

“এতোকিছু ভাবতে গেলে কখনোই বের হতে পারবানা। একটার পর একটা লেগেই থাকবে।”

“রেগে যাচ্ছেন কেন? আমাদের সবকিছু বুঝেশুনে প্ল্যান করা উচিত না?”

জাওয়াদ উঠে বলল, “এজ ইউর উইশ! বলে রাখছি যেসবকে তুমি বড় কিছু ভাবছো ওসব আমার কর্মক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলেনা। এমন নয় আমি চিটাগং না গিয়ে থাকবো। আমাকে কাজটাই আগে দেখতে হয়, এটাই আমার উপর ধার্য করা থাকে। আমি তোমাকে জাস্ট সেই সফরের সঙ্গী করতে চেয়েছি,তুমি যেতে না চাইলে ইটস ওকে!”

“আপনি আমাকে ভুল বুঝছেন। এখন আমি কক্সবাজার যাবো শুনলে অন্যরা কি ভাববে বলুন তো? আমি এ বাড়ির বউ, আমার কিছু দায়িত্ব আছেনা?”

জাওয়াদ নিজের চুলে হাত চালিয়ে বলল, “আমি জোর করছি না। তোমার যা ইচ্ছা করো।”

ফোন বের করে সাম্যকে কল করে বলল,”দুটো টিকিট ক্যানসেল করো। আমি একাই যাবো। জাস্ট টাইমে প্রেজেন্ট থাকবে।”

“স্যার কক্সবাজার রুম বুক করলাম যে ওটাও কি ক্যানসেল করে দিবো?”

“সেটাও বলে দিতে হবে? কাজে যাচ্ছি যখন কাজই করবো, কক্সবাজার আনন্দভ্রমণ করতে যাবে কেন? তোমার ইচ্ছে হলে তুমি যাবে আর সাগরের পানিতে তা ধিন ধিন করে নাচবে। যত্তসব!”

সাম্য মুখ কালো করে বলল,”স্যরি স্যার। আমার আরো বুঝদার হওয়া উচিত ছিল।”

জাওয়াদ ফোন রেখে ছাদ থেকে নেমে গেল। আরওয়া ওর দিকে চেয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মনে মনে বলল,”পাগলে ক্ষেপছে রে। আজ তোর‌ নিস্তার নাই।”

নিজের ঘরের দিকে এগুতেই রোকেয়া দৌড়ে এসে বলল, “আরওয়া কি হয়েছে রে ফারাজ এতো রেগে আছে কেন?”

“তিনি কি করলেন আবার?”

“আমাকে এসে বলতেছে সিরিয়াল দেখে দেখে আমার মাথা একদম গেছে। আমি নাকি তোকে আদর্শ বউ বানানোর প্রতিযোগীতায় নাম লিখিয়েছি। তোকে সবার মন জয় করার জন্য প্রেশার দিচ্ছি। আরো কত কি বলে গেল আমাকে। আমি আগামাথা কিছুই বুঝলাম না। এই বাপবেটার সবকিছু আমার সিরিয়ালে এসেই কেন থামে? আজিব!”

“ওহো আম্মু, রিল্যাক্স! জানো তো উনি কেমন। মন খারাপ করো না তো।”

“মন খারাপ করি কি আর সাধে? ব্যাগপত্র গুছিয়ে কোথায় চলে যাচ্ছে কে জানে। তুই গিয়ে ওকে থামা তো মা। আমি আর পারি না এদের নিয়ে।”

আরওয়া কাচুমাচু গলায় বলল,”আম্মু আমি এখন রুমে গেলে আমাকে যদি কাঁচা খেয়ে ফেলে! যেমন হাইপার হয়ে গেছে আমার তো ভয় লাগতেছে।”

“ঘটনা কী খুলে বল তো?”

“উনি মেবি চিটাগং যাবেন কাজে। আমাকে জিজ্ঞাসা করছিল কক্সবাজার যাবো কি না। আমি বললাম বাসায় তো অনেক ইভেন্ট আছে, এখন যাওয়া পসিবল না। ব্যস অমনি ক্ষেপেছে।”

রোকেয়া মাথা নেড়ে বলল, “পুরুষমানুষ এসব বুঝবেনা। শ্বশুড়বাড়িতে আমাদের কে যে কতদিক বিবেচনা করে পা ফেলতে হয় এটা বোঝার ক্ষমতা ওদের নেই। ছেলেটা এমন একরোখা যে কিছু বলাও যায় না। আচ্ছা তুই দাঁড়া আমি আম্মাকে বলে দেখি উনি কি বলেন। ”

আরওয়া হু বলে দোয়া ইউনুস পড়ে নিজের রুমে গেল। জাওয়াদ নিজের লাগেজ গুছিয়ে একপাশে দাঁড় করিয়ে ল্যাপটপ ব্যাগে রাখছে। কোথায় ভেবেছিল তাদের ম্যারেজ এনিভার্সেরিতে জাহাজে করে সেন্টমার্টিন যাবে, আরওয়ার সাথে দারুণ কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করবে, বারবিকিউ পার্টিসহ আরও কত কি করবে। সব পরিকল্পনা ধূলিসাৎ হয়ে গেল। মেয়েটার মাথাতেই যেন নেই দু’দিন পর তাদের বিয়ের ১বছর পূর্ণ হবে। অথচ ও যদি ভুলে যেত কত মেজাজ ই না দেখাতো। মেয়েমানুষের মন বোঝা পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন কাজ।

“এই শুনছেন?”

“আমি কালা না, কি বলবে বলে ফেলো।”

“আপনি এমন গলায় কথা বললে আমার মন খারাপ হয়, পেট মোচড়ায়। দেখুন কেমন ঘুটঘুট শব্দ তুলছে!”

“এসব কথা ছাড়ো প্লিজ। আমি এখন এসব শুনতে ইচ্ছুক নই।”

আরওয়া ওর গা ঘেসে একপাশে দাঁড়িয়ে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,”এতো রাগ করে না সোনা। আপনি আমার ১০টা না ৫টা না একটমাত্র স্বামী। আপনি এমন রাগ করলে মানায় হুম?”

জাওয়াদ ওর হাত ছাড়িয়ে বলল, “ন্যাকামো করো না আরওয়া। আমার হাতে সময় নেই। তুমি থাকো তোমার পারিবারিক কার্যকলাপ নিয়ে। আমি তো নিষেধ করছি না। এখন অযথা এসব নাটকের প্রয়োজনীয়তা দেখছি না।”

আরওয়া ওকে জড়িয়ে ধরে বুকে নাক ঘষে বলল, “ভালোবাসি তো।”

“তোহ আমি কি করবো?”

“ভালোবাসির প্রত্যুত্তরে ভালোবাসি বলতে হয়।”

“এসব ফাউ কথা।”

আরওয়া ওর বুকে চিবুক রেখে মাথা উঁচিয়ে বলল, “এই?”

“হুম।”

“শান্ত হবেন না?”

“আমাকে অশান্ত ভাবার মতো কিছু করেছি?”

আরওয়া জবাব দিলো না। চুপচাপ জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো। জাওয়াদ ওকে আগলে নিলো না বলে অভিমানে চোখ ভরে আসলো। খানিকবাদে বুকের মাঝে ভেজা অনুভব করলেও জাওয়াদ কোনো শব্দ করলো না। যাওয়ার আগে শুধু বলল, ” স্বামী দিয়েই স্বামীর পরিবার আসে। তাদেরকে প্রায়োরটি লিস্টের শুরুতে রেখে স্বামীকে নীচে রাখলে শেষে দুটোই হারাবে,,”

এইটুকু যথেষ্ট ছিল তার মনের আকাশে গাঢ় আধার নামার…

নাহিয়ান ক্যাম্পের তাবুতে বসে কেটলী থেকে গরম চা ঢাললো। শরীর প্রায় ছেড়ে আসছে একটু রেস্ট না নিলে আর হচ্ছে না। পকেট হাতড়ে ফোন বের করে সাবাকে কল দিয়ে চায়ে চুমুক দিলো। ৪বার রিং পড়তেই অপরপাশের মানুষটা ফোন রিসিভ করলো। তার গলার স্বরে মহান আল্লাহ কি রহমত ঢেলে দিয়েছেন তিনিই ভালো জানেন, শুনলেই মনপ্রাণ জুড়িয়ে আসে।

“কেমন আছ এখন? শরীর ঠিক আছে?”

“আমার জন্য চিন্তা করো না, আমি ঠিক আছি। তোমার ক্যাম্পিং কেমন যাচ্ছে?”

“ভালোই তবে জান বেরিয়ে যাচ্ছে এখানে। এত গরম!”

“এসিতে থেকে থেকে অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে। সাধারণ তাপমাত্রাও অনেক বেশি মনে হয়। তার উপর তুমি যেখানে আছ ওখানে গরম আরো বেশি। একটু কেয়ারফুল থেকো।”

“হুম। শোনো তারিন কল করেছিল, ও তোমাকে দেখতে পারেনি বলে সরি বলছিল। কাল তোমাকে হসপিটাল যেতে হবেনা। ও রিপোর্টগুলো নিয়ে বাসায় যাবে বলেছে। তুমি আপাতত পানিজাতীয় খাবার কন্টিনিউ করো কেমন?”

“আচ্ছা।”

“আর হ্যাঁ পেঁপে এভয়েড করবে। আমি রিস্ক নিতে চাইছি না…”

সাবা মুচকি হেসে বললো,”আমাকে না বলো অথচ তুমি নিজেও আশা রাখছো!”

“আমরা আশাতেই বাসা বাঁধি পাখি। ওটাই আমাদের বেঁচে থাকার প্রেরণা। আচ্ছা রাখছি, পরে কথা হবে। নিজের খেয়াল রেখো কেমন?”

“তুমিও নিজের খেয়াল রেখো। আর গরম বেশি লাগলে একটু গা মুছে নিও। আরাম লাগবে।”

“আচ্ছা। বায়”

“বায়”

চলবে,,,

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৩৬

#আরশিয়া_জান্নাত

আরওয়া বেলকনীর এককোণে হাঁটুতে মাথা রেখে বসে আছে। জাওয়াদ নিষ্ঠুর পুরুষ এ তো তার জানা কথা। তবুও কেন তার বলা বাক্যে বুকটা ভেঙে যায়? অসহনীয় যন্ত্রণায় চোখের পানি বাঁধা মানেনা। আরওয়া উঠে ওয়াশরুমে যায় চোখেমুখে পানি ঝাপটা দিয়ে বেরিয়ে আসে। রোকেয়া শাশুড়ির সঙ্গে শলাপরামর্শ করে বলেন, “আরওয়া কালকে তো কুহুকে দেখতে আসবে, তাই ফারাজের ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারছি না। তোরা পরে একসময় নাহয় গিয়ে বেরিয়ে আসিস।”

“চিন্তার কিছু নেই আম্মু, উনি চলে গেছেন।”

রোকেয়া ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “মন খারাপ করিস না, সব ঠিক হয়ে যাবে।”

জাওয়াদের গাড়ি চলছে আপনগতিতে। সে শেষ মুহূর্তেও আশা করেছিল আরওয়া ওর সঙ্গে আসবে। কিন্তু ওর ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। জাওয়াদ নিজের বুকের মাঝখানটায় হাত দিয়ে দেখলো ভেজা অংশটা এখনো সম্পূর্ণ শুকায়নি। সে জানলা গলিয়ে বাইরের দিকে তাকালো। আর ভাবতে লাগলো আরওয়া কেমন ফুঁপিয়ে কান্না করছিল। ভাবতেই বুকটা কেমন ভার হয়ে আসে। সে কেন যে মেয়েটাকে এতো কষ্ট দিয়ে ফেলে। আসবার সময় যা বলে এসেছে এতে নিশ্চয়ই ও আরো কয়েক দফা কান্নাকাটি করবে। ধুরর ভালো লাগেনা।
তানভীরের কলে তার ধ্যান ভাঙ্গে। সে রিসিভ করে ফোন কানে তুলতেই তানভীর বলে,”কি রে কেমন আছিস?”

“আলহামদুলিল্লাহ, তুই কেমন আছিস?”

“আছি ভালো। কোথায় আছিস?”

“চিটাগং যাচ্ছি, অন দ্য ওয়ে। কেন?”

“ওহ! ভেবেছিলাম আড্ডা দিবো তোর সাথে। তা আর হলো না।”

“পরে আসিস সময় করে।”

“হুম। আচ্ছা শোন আমাদের ভার্সিটিতে রিইউনিয়ন প্রোগ্রাম হবে। তুই যাবি? অনেকেই আসবে শুনলাম। কত বছর পর সবাই একত্রিত হবো, তুই না বলিস না!”

“ডেট ফিক্সড হয়েছে?”

“খুব সম্ভবত এই মাসেই হবে। ডেট ফিক্সড হলে তোকে জানাবো। অবশ্যই থাকবি।”

“ওকে।”

“আচ্ছা রাখি তাহলে ঢাকায় ফিরলে নক দিস”

“ওকে, বায়”

“বায়”

নাহিয়ান আজ সকালে ঢাকায় ফিরেছে। এসেই কোহিনূর বেগমকে বললো, “আম্মু চটজলদি কিছু খাইয়ে দাও আমি এখন ঘুমাবো, কখন উঠি ঠিক নেই। আমি ভীষণ টায়ার্ড!”

“তুই ফ্রেশ হয়ে নে আমি তোর ঘরেই খাবার পাঠিয়ে দিচ্ছি। তবে যত ঘুম ঘুমানোর ঘুমিয়ে নে, বিকালে পাত্রপক্ষ আসার সময় কিন্তু উপস্থিত চাই।”

“ঐটা তো থাকবোই। শাকচুন্নিকে বিদায় করার টেনশন আমারো আছে। ঐটা তোমায় ভাবতে হবেনা।”

কুহু আপেল কাটতে কাটতে বলল,”তোর ঐ সুখ এতো সহজে আসতে দিবো ভাবছিস? আমি তোর ঘাড়ে কাঁঠাল ভেঙে না খাওয়া অবদি নড়ছি না।”

“তো এখন কি করছিস?”

“বাপের টা খাচ্ছি, তোর না!”

“কথার কি ছিরি দেখো। আমি যেন এ সংসারে কোনো টাকাপয়সা দেই না। দেখলে আম্মু কেমন নাফরমানী কথা!”

“ওর কথা বাদ দে, ও কত কথাই বলে। তুই যা তো ঘরে যা।”

কুহু বললো,”আম্মু তুমি যতোই বলো তোমার ছেলে এখান থেকে নড়বেনা। ওর বউকে ছাড়ো দেখবে সুরসুর করে চলে গেছে।”

নাহিয়ান ওর মাথায় গাট্টি মেরে বললো, “এতক্ষণে ভালো কথা বললি। হ্যাঁ আম্মু আমার বউ কে দিয়ে দাও আমি চলে যাই।”

“ভাইয়া! ভালো কথা বললে কেউ এতো জোরে মারে। তুই এতো খারাপ!”

কোহিনূর বিরক্তস্বরে বলল,”বৌমা যাও তো ওর সাথে। নয়তো এখানে ওরা রণক্ষেত্র বানিয়ে ছাড়বে। ক’টা দিন শান্তিতেই ছিলাম।”

নাহিয়ান নায়ক জসীমের মতো ইমোশনাল লুক এনে বললো,”আম্মু এটা তুমি বলতে পারলে? আমাকে তুমি অশান্তির কারণ বললে। হে আল্লাহ! এই দিন ও দেখতে হলো আমার? এ পরিবারে আমায় কেউ ভালোবাসেনা…..”

সাবা ওকে টেনে বের করে বলল,”চলো তো তুমি, অযথা আর চিৎকার চেঁচামেচি করোনা।”

নাহিয়ান রুমে এসেই সাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল,”আহ! কত্তদিন পর বৌটাকে বুকে পেলাম গো। শান্তি!”

সাবা ওর হাতে চুমু খেয়ে বললো,” অনেক কষ্ট হয়েছে ওখানে না? তোমাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে।”

নাহিয়ান ওর গালে হাত রেখে বলল,”এ কয়দিনে এ কি হাল হলো তোমার? শরীর এতো খারাপ কেন?”

“চিন্তা করো না। এখন ঠিক আছি।”

“সাবা, আমার কাছে তোমার সুস্থতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তুমি সুস্থ থাকো, আমার পাশে থাকো ওতেই আমি শান্তি। অন্য কোনোকিছু আমি চাই না।”

“এরকম বলিও না। এরকম বললে যদি যে আসবে ভাবছি সে চলে যায়?”

নাহিয়ান ওর কথা শুনে বলল,” তোমার কীসব ভাবনা! যে আসার সে আসবেই আমার কথায় কি আসে যায়?”

“আমি তেমন ভাবিনা। আমাদের নিয়তের উপর অনেককিছু ডিপেন্ড করে। যাই হোক তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি বিছানা ঠিক করে দিচ্ছি, খেয়েই ঘুম দিও।”

নাহিয়ান মাথা নেড়ে ফ্রেশ হতে চলে গেল।

জোবায়ের সাহেব একটা আংটির বক্স বের করে বললেন,”দেখো তো পছন্দ হয় কি না?”

সালমা আংটিটা হাতে নিয়ে পরোখ করে বললেন,”সুন্দর তো অনেক! কার জন্য নিলেন?”

জোবায়ের সাহেবের চোখেমুখে আনন্দের ঝলক, দেখা গেল। তিনি প্রসন্নস্বরে বললেন,
“গড়াতে দিয়েছিলাম নাতজামাইয়ের জন্য। আজকে হয়তো পড়ানোর লোক পেয়ে যাবো।”

“আমি জানি আপনি ভালোটাই আনবেন। তবে আমার অনুরোধ ওদের পছন্দ না হওয়া পর্যন্ত কিছু বলবেন না। ওরা সবাই আপনাকে ভয় পায়, সম্মান করে। ওদের মতামত রাখার জায়গা দিবেন।”

জোবায়ের স্ত্রীর দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালেন। তার চেহারার ভাবভঙ্গি বদলে গেছে মুহূর্তেই। তিনি ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, “সব সময় তোমার এটা বলতে হয় সালমা? আমার নিয়ম কি তুমি জানো না? আমি বলেছি না মেয়েদের বেলা আমি জোর করি না। তবুও কেন তোমার প্রতিবার এই কথা বলা লাগে? তোমার কি মনে হয় এটা বললে নিজেকে খুব মহান দেখায়?”

সালমা নির্লিপ্ত গলায় বললেন,” আপনাকে মনে করিয়ে দেওয়া স্ত্রী হিসেবে আমার দায়িত্ব। আমি চাইনা আপনি অহংকারবশত কখনো ভুল করে বসেন। শয়তান কখন কাকে কিভাবে ভুল পথে নিয়ে যায় কেউ বলতে পারেনা। নিজেকে সবসময় সঠিক ভাবা ঠিক না, আমাদের জ্ঞানের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে। এটা ভুলে গেলে চলবে না।”

জোবায়ের সাহেব শান্তশিষ্ট স্বভাবের স্ত্রীর কথার জবাব খুঁজে পেলেন না, তাই নিরবে প্রস্থান করলেন।

পাপিয়া সালাদের প্লেট নিয়ে কুহুর ঘরে ঢুকলো। আশা করেছিল আজকেও দেখবে কুহু বই পড়ছে। কিন্তু না তার ধারণা ভুল করে দিয়ে কুহু মেকাপ করতে বসে গেছে। পাপিয়া বলল,” তোকে কেউ সম্পূর্ণ চিনে বললেও ভুল হবে। প্রতিবার তুই সেটা প্রমাণ করবি!”

“ঘটনা সেটা না। গতবার মেকাপ না করার পেছনে রিজন ছিল যেন পছন্দ না করে। কিন্তু ঐ ট্রিক্স কাজে লাগেনাই। তাই এবার মেকাপ করে সেকেন্ড এক্সপেরিমেন্ট করবো। দেখি আজকেও পছন্দ করে কি না!”

পাপিয়া হেসে বললো,” ও তুই যত ট্রিক্স ই এপ্লাই করিস না কেন, তোকে সবাই পছন্দ করবেই।”

“এতো কনফিডেন্স?”

“হুম। আমাদের দেশে বিয়ের ক্ষেত্রে উভয়পক্ষের কিছু কমন ফ্যাক্ট আছে। মেয়েপক্ষ চায় একটা স্টাবলিশড সিম্পল ফ্যামিলিতে মেয়ে বিয়ে দিতে। ছেলের ইনকাম এর পাশাপাশি তার পারিবারিক ইনকাম ও মাথায় রাখা হয়। অনেকে ভাবে মেয়ের বেলা বুঝি এটা দেখে না। ঘটনা কিন্তু ঠিক না। হ্যাঁ মেয়েদের সৌন্দর্য মূখ্য তবে পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড ও গৌণ নয়। সেদিক দিয়ে বিচার করলে তোকে রিজেক্ট করার প্রশ্নই আসে না।”

কুহু মেকাপ করা বন্ধ করে দিয়ে পাপিয়ার দিকে তাকালো। রুক্ষ গলায় বলল, “তাহলে শুধু আমাকে কেন তোকেও কেউ রিজেক্ট করবে না। তুই কথাটা এভাবে বলছিস কেন? আমি যদি খন্দকার পরিবারের না হতাম আমাকে কি কেউ পছন্দ করতো না?”

“আমি সেটা বুঝাই নি আপু। আমি বলতে চাইছি যে মাপকাঠিটা সমাজে অবধারিত করা আছে তাতে তুই উপরেই আছিস। এখন তুই মেকাপ কর বা না কর ডাজন্ট ম্যাটার!”

কুহু বায়োডাটার খাম টা বাস্কেটে ফেলে বলল,” তাহলে একটা গেইম প্লে করি চল। আমি এমন সব আচারণ করবো যেন ওরা আমায় পছন্দ না করে। তারপর বোঝা যাবে ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড ম্যাটার করে কি না?”

“এসব করার কোনো দরকার নেই। দাদাসাহেব এই প্রপোজালটা নিয়ে খুব আগ্রহী। অযথা ভেজাল করিস না…”

তবে কুহু এসব কানে তুলল বলে মনে হচ্ছে না।

আরওয়া ফোন নিয়ে দ্বিধায় আছে। একবার চাইছে কল করে খোঁজখবর নিতে পরক্ষণেই মনে হচ্ছে ও কেন কল দিবে? উনিও তো দিচ্ছেনা। বহু ভেবে সাম্যকে কল করাই বেটার মনে হলো। যেই ভাবা সেই কাজ, কল করলো সাম্যর নাম্বারে, বেশ কয়েকবার রিং হবার পর কর রিসিব হতেই সে বলল,

“হ্যালো সাম্য ভাইয়া? আপনারা ঠিক মতো পৌঁছেছিলেন তো?

“আপনার সাম্য ভাইয়া ঠিকঠাক পৌঁছেছে। আর কিছু?”

জাওয়াদের গলা শুনে আরওয়া ভীষণ ভড়কে গেল, শক্ত গলায় বলল,”উনার ফোন আপনার কাছে কেন? বস হয়েছেন বলে কি উনার মিনিমাম প্রাইভেসী নেই!”

“আমার পিএ কে আমি কীভাবে ট্রিট করবো তা তোমার থেকে জানতে চাইছি না। অন ডিউটিতে ওকে কল করে ডিস্টার্ব করছো কেন?”

“আমি ডিস্টার্ব করছি না। খোঁজখবর নিতে কল করেছি।”

“সাম্য কি দৈনিক প্রথম আলোর রিপোর্টার? নাকি খবর ফেরি করে বেড়ায়?”

“সেটা আপনার না জানলেও চলবে। ভাইয়াকে ফোন‌ দিন আমার কথা আছে উনার সঙ্গে।”

জাওয়াদ দাঁতে দাঁত চেপে সাম্যর দিকে ফোন বাড়িয়ে দিলো। সাম্য ওর চেহারা দেখে ভয়ে ভয়ে ফোনটা কানে তুলতেই আরওয়া বলল,” ভাইয়া আপনারা ঠিকমতো পৌঁছেছেন বুঝেছি। ওখানে ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া করবেন আর আপনার বসকে দেখেশুনে রাখবেন। শীত তো শেষ ফাগুনের আগুন তো লেগেছে চারদিকে, উনার মেজাজের আগুন মিলে যেন তাপদাহ না হয় সেই দায়িত্ব আপনার। রাখছি। আল্লাহ হাফিজ। ”

জাওয়াদ বিড়বিড় করে বললো,” ফাগুন এসেছে মাথায় আছে, অথচ ফাগুনেই যে বিয়ে হয়েছিল মাথায় নেই। গাবেট একটা! আমাকে ফোন‌ না করে আমার পিএ কে ফোন করা। সব হিসাব রেখো আরওয়া। সবকিছু শোধ নেওয়া হবে!”

চলবে…

কাঁটাকম্পাস পর্ব-৩২+৩৩

0

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৩২

#আরশিয়া_জান্নাত

৩২

জাওয়াদ কখনোই ঈদে শপিং এ যায় না। ওর মা-বোন ই বলতে গেলে ওর যাবতীয় সবকিছু কেনাকাটা করে কিংবা সাম্য সবটা হ্যান্ডেল করে। এবার ঈদেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। অফিস শেষে জাওয়াদ সাম্যকে শপিং মলের দিকে গাড়ি নিতে বলায় সাম্য তাই অবাকই হলো বটে। সাম্যর জানামতে ও বাড়ির সবার কেনাকাটা প্রায় শেষ। তবে শপিং এ কেন যেতে চাইছে কে জানে!

জাওয়াদ গাড়ি থেকে নেমে মলে ঢুকলো। চারদিকে মানুষ গিজগিজ করছে। সবার হাতেই শপিং ব্যাগ, সাথে পরিবার পরিজন। কারো কারো চেহারায় ক্লান্তির রেশ। জাওয়াদ ঘুরে ঘুরে চারদিক দেখে একটা দোকানে ঢুকলো। শাড়ির দোকান দেখে সাম্যর গেস করতে অসুবিধা হলোনা জাওয়াদ কেন এখানে এসেছে। বেশ কিছু শাড়ি দেখার পর তার মাথা নষ্ট হয়ে গেল। কোন শাড়িটা বেশি সুন্দর কে জানে, সবগুলোই তো একই লাগছে! জাওয়াদ নেড়েচেড়ে দেখেই যাচ্ছে, শপের স্টাফরা আচল মেলে মেলে সব দেখাচ্ছে। ২৫টা শাড়ি দেখার পর জাওয়াদ বলল, “হয়েছে এবার থামুন। আর দেখাতে হবে না।”

“স্যার একটাও পছন্দ হয় নি?”

জাওয়াদ কপাল চুলকে বললো,” সব কয়টা প্যাক করে দিন।”

সাম্য বললো,” স্যার একটা দোকান থেকে নেওয়ার কি আছে? আরো কয়েকটা দোকান ঘুরে দেখি? ভালো কালেকশন থাকতে পারে।”

“ওরা সবাই এরকম পড়ে পড়ে দেখাবে? দরকার নেই তাহলে, ইটস লুকিং সো উইয়ার্ড! এরচেয়ে এক দোকান থেকে সব নিয়ে যাই এটাই শর্টকার্ট।”

“ওকে স্যার”

“শোনো এখান থেকে ১২টা শাড়ি সেপারেট করো। দাদীদের জন্য ২টা সিলেক্ট করো। আর বাকি ১০টা অন্য সদস্যদের জন্য। বাকি সবগুলো আরওয়ার জন্য।”

সাম্য হেসে বলল, “আপনি চেইঞ্জ হয়ে গেছেন স্যার! পজিটিভ চেইঞ্জ।”

ওদেরকে প্যাক করতে বলে জাওয়াদ দোকানের বাইরে এসে দাঁড়ালো। একটা ড্রেস এর উপর তার চোখ আটকেছে। এই ড্রেসটায় আরওয়াকে দারুণ মানাবে বলেই মনে হচ্ছে। সে আর ২য়বার ভাবলো না। ড্রেসটাও নিয়ে নিলো। গাড়িতে বসে জাওয়াদ ভাবতে লাগলো আরওয়া নিশ্চয়ই অনেক খুশি হবে। ওর হাসিমুখ কল্পনা করতেও আরাম লাগছে। তবে এটা বলতেই হবে শপিং করা খুব কঠিন হাহ!

নাহিয়ান নিজের কেবিনে থাকা সোফায় শুয়ে ঘুমাচ্ছে। এইটুকু জায়গায় ওর বিশেষ সুবিধা না হলেও অভ্যাস হয়ে গেছে। রাত ১টায় একটা ওটি আছে। কতক্ষণ লাগবে হিসাব নেই। তাই একটু ঘুমিয়ে নেওয়াই উত্তম। এই স্বল্প পরিসরের ঘুমের মধ্যে নাহিয়ান খুব সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখলো। সে একটি বাগানে নরম ঘাসের উপর হেঁটে যাচ্ছে। চারদিকে নানারকম ফুলের সৌরভ, মৃদু বাতাস। স্বপ্নটা এতো জীবন্ত যে ও পায়ের তলায় ঘাসের স্পর্শও অনুভব করতে পারছে। সে খানিকটা এগোতেই খেয়াল করলো এই বাগানের ফুল গাছে ফুলের বদলে ছোট শিশুরা ফুটে আছে। সবাই দেখতে ভীষণ সুন্দর আর মায়াবী। নাহিয়ান কাছে গিয়ে দেখে ওরা চোখ বুঝে ঘুমিয়ে আছে। নাহিয়ান বলে, “আমাকে একটা ফুল দেবে? আমি সাবাকে দিবো। ও বাচ্চার জন্য খুব মন খারাপ করে। এখান থেকে একটা বাচ্চা দাও প্লিজ। বিনিময়ে যা চাইবে দিবো….”

ওখানকার এক মালি উত্তরে বলল, “এখানে ফুল শুধু দেখতে পারবেন ছিড়তে পারবেন না। ছিড়লে ওরা মরে যাবে।”

নাহিয়ান মন খারাপ করে ওদের দিকে তাকিয়ে বলল,” নাহ ওরা বেঁচে থাকুক। আমি ছিড়বো না।”

তখনই একটা ফুল নিজে নিজেই ঝরে পড়ে। নাহিয়ান আর্তনাদ করে বলল, “আল্লাহ এখন কি এটা মরে যাবে? এতো সুন্দর বাচ্চাটা মরে যাবে!”

মালি হেসে বলল, “নাহ। এটা আপনার জন্যই ঝরেছে। ওকে নিয়ে যান। অনেক যত্ন করে রাখবেন, সবাই এই রত্নের মালিক হয় না। সন্তান পাওয়া অনেক সৌভাগ্যের। সবাই সন্তান পায় না। যারা পায় তারা ঠিকঠাক যত্ন করতে পারেনা। আশা করি আপনি তাদের মত হবেন না।”

নাহিয়ান খুশিতে কেঁদে ফেলল, বাচ্চাটাকে যত্নে কোলে তুলে বলল, ” আমি অন্যদের মতো হবোনা। আমার সাবা ওকে খুব যত্নে রাখবে, খুব আদরে রাখবে। আমি জানি ও পৃথিবীর বেস্ট মা হবে।”

বলেই অঝরে কাঁদতে লাগলো। নাহিয়ানের মনপ্রাণ আনন্দে ভরপুর হয়ে গেছে। সে দ্রুত সাবার কাছে যেতে চাইছে, বলতে চাইছে দেখো আমি কি এনেছি তোমার জন্য!!
ঘুম ভাঙার পর নাহিয়ান বহুক্ষণ চুপচাপ বসেছিল, স্বপ্নটা যদি সত্যি হতো কত ভালোইনা হতো?

ইশরাক মেন্যু চেক করে বলল, “এখানের লেমন গার্লিক বাটার চিকেন অনেক জোস। টেস্ট করবেন?”

“আপনি যখন বলছেন তার মানে সত্যিই মজা। টেস্ট করাই যায়।”

“নাহ কুহু এরকম ব্লাইন্ড হলে চলবে না। আপনার উচিত চোখ কান খোলা রেখে যাচাই করা‌। অন্ধ বিশ্বাস মানুষকে অন্ধ বানিয়ে দেয়।”

কুহু মৃদু হেসে বলল,”আচ্ছা!”

খাবার অর্ডার করে ইশরাক বললো, “সরাসরিই কথা বলি, দেখুন আমি জানি আপনি লাস্ট ছয়/সাত মাস আমার সম্পর্কে অনেক ইনফরমেশনই কালেক্ট করেছেন। এন্ড আপনি আকারে ইঙ্গিতে নিজের আগ্রহের কথাও বলেছেন।”

“হ্যাঁ। শুরুতেই বলে দেই আমি এখন প্রেম করার বয়সে নেই। আপনি রাজী হলে সরাসরি বিয়ের ব্যাপারেই রাজী হতে হবে।”

ইশরাক খুকখুক করে কেশে উঠলো। কুহু ওকে পানি এগিয়ে দিলো। ইশরাক পানি পান করে নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,”আপনি এমন বোল্ড হবেন আশা করি নি। যাই হোক, আমি চাইছিলাম কিছুদিন দেখি, কথাবার্তা বলি তারপর একটা সিদ্ধান্ত নিলাম।”

কুহু পেছনে হেলান দিয়ে বসে বলল,”It’s been 7months. আপনি এতো লেট লতিফ হলে তো সমস্যা। বেসিক জানাশোনা তো হয়েছেই। বাকিটা বিয়ের পর জানলেও হবে। আপনি হ্যাঁ বললে আমি বাসায় জানাবো।”

“বেশি তাড়াহুড়ো হয়ে গেল না?”

“মোটেই না। ওটা আপনার ফল্ট। খাওয়ার ফাঁকে যদি একটুও তাকাতেন এতোদিনে জানাশোনা হয়ে যেত। এনিওয়ে রোজার ঈদ বাপের এখানে করবো,তবে কুরবানি টা আপনার ওখানেই করতে চাইছি।”

ইশরাক কুহুর দিকে হা করে চেয়ে রইলো। কুহু হেসে বললো,”আমার চেহারা অনেক সুন্দর তাই না? হাসলে ডিম্পল ও পড়ে দেখুন..”

আরওয়া জাওয়াদের দিকে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে বললো, “আপনি এতো শাড়ি এনেছেন আমার জন্য সিরিয়াসলি! আমি শাড়ি পড়ি?”

জাওয়াদ শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলল, ” পড়ো না তো কি হয়েছে এখন থেকে পড়বে।”

“আপনার শপিং করার থাকলে আমাকে বলতেন আমিও যেতাম। একই ডিজাইনের ২/৩ কালার আনলেন কিভাবে! দোকানদার আপনাকে বোকা পেয়ে সব গছিয়ে দিয়েছে।”

“তুমি আচ্ছা মেয়ে তো! তোমার হাজবেন্ড তোমার জন্য শপিং করেছে কোথায় তুমি খুশি হবে তা না, শুধু দোষ খুঁজে যাচ্ছ!”

আরওয়া জোরে শ্বাস নিয়ে ছাড়ল। নিজের মাথায় হালকা চাপড় মেরে বললো, “রিল্যাক্স আরওয়া রিল্যাক্স। এই যন্ত্রমানব তোর জন্য এনেছে এটাই অনেক। কুল….”

“এই তুমি কি বিড়বিড় করছো?”

“কিছু না। থ্যাংকস ডিয়ার হাবি, এতো ভারী ভারী শাড়ি কিনে আনার জন্য। আপনার পছন্দ লা জওয়াব!”

জাওয়াদ তৃপ্তির হাসি দিয়ে বলল,” এই তো গুড গার্ল।”

আরওয়া ওর গা ঘেষে দাঁড়িয়ে বলল, ” আপনি আপনার ব্যস্ততা একপাশে রেখে আমার জন্য সময় বের করেছেন এতেই আমি অনেক হ্যাপি।”

জাওয়াদ গাল বাড়িয়ে বললো, “রিওয়ার্ড দাও?”

আরওয়া ওর গালে চুমু এঁকে দিতেই জাওয়াদের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো।

“আরওয়া শোনো?”

“হুম?”

“তুমি কি টায়ার্ড?”

“নাহ কেন?”

জাওয়াদ নিজের আঙুলের ভাঁজে আরওয়ার আঙুল গলিয়ে গাঢ় গলায় বলল, “I wanna feel you deeply…”

লজ্জায় আরওয়ার মুখ লাল হয়ে গেল। চিবুক নামিয়ে মাথা নেড়ে সম্মতি দিতেই জাওয়াদ তাকে কোলে তুলে বলল, “তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আরওয়া। আমার জীবনে থেকে যাওয়ার জন্য!”

আরওয়া ওর গাল ছুঁয়ে বললো, “প্রতিবার এটা বলতে হয় আপনার? এটা না বললে কি চলে না?”

“কৃতজ্ঞতা প্রকাশে কিপ্টামী করা ঠিক না। আমি জানি আমি তোমার সঙ্গে যা করেছি তা অন্যায় ছিল। ঐ একটা বিশেষ রাত নষ্টের খেসারত হয়তো আজীবনেও পরিশোধ হবেনা।”

আরওয়া ওর ঘাড় টেনে একদম কাছে এনে বলল,”আমি অতীত বা ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে ইচ্ছুক না। আমি বর্তমানে বাঁচি। মনপ্রাণ উজাড় করে বাঁচি। আপনিও সেটা করুন না?”

জাওয়াদ ওর কপালে গভীর চুমু খেয়ে বলল, “আই উইল ট্রায় মায় বেস্ট!”

ভালোবাসার উষ্ণ ছোঁয়ায় দুটো প্রাণ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেল। চারদিকে যেন আনন্দের বর্ষণ বইছে। প্রেমোত্তাপে তনু ঘেমেনেয়ে একাকার করে উঠলেও কেউই কারো সান্নিধ্য ছাড়তে চাইছে না, গভীর থেকে গভীরতর স্পর্শে একে অপরকে পাগল বানানোর প্রতিযোগীতায় যেন নেমেছে তারা।

কতটা সময় পেরিয়েছে কে জানে। আরওয়া চাদর মুড়িয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। জাওয়াদ ওর চুলগুলো একপাশে সরিয়ে পিঠে মাথা রেখে বলল, “আরওয়া উঠো শাওয়ার নিয়ে নাও। একটু পরেই সাইরেন বাজবে।”

আরওয়া ঘুম জড়ানো গলায় বললো, “আরেকটু ঘুমাই না। আজ সাহরী করবোনা। পানি খেয়ে রোজা রেখে ফেলবো।”

জাওয়াদ উঠে বললো, ” উঠো বলছি।‌ দিন অনেক লম্বা। পরে তোমারই কষ্ট হবে। উঠো না প্লিজ!”

আরওয়া কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,” আপনাকে একদম ভাল্লাগেনা। হুহ!”

জাওয়াদ ওর গাল টেনে বললো, “ভালো না লাগতেই এতো পাগলামী করলে ভালো লাগলে কি করতে হুম?”

আরওয়া বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে বলল, “আপনি এমন ঠোঁটকাটা কেন? উফফ একটুও লজ্জা নেই আপনার।”

“কেউ হুঁশ হারালে দোষ নেই। আমি মুখে বললেই দোষ।”

আরওয়া ওর মুখ চেপে বলল,” থামুন তো। আমি উঠে গেছি। আর বলতে হবেনা।”

জাওয়াদ হাসতে লাগলো।

ইউকে আসার পর রিজভী পাপিয়াকে সবচেয়ে বেশি মিস করে। যেখানেই কোনো ফ্রেন্ডস গ্রুপ দেখে ওর পাপিয়ার কথাই মনে পড়ে। মেয়েটা একটু বোকা হলেও অনেক কিউট। অনেক কেয়ারিং ও বটে। ওর দুঃসময়ে এই পৃথিবীতে আর কেউ থাকুক না থাকুক বাবা-মায়ের পর যদি কেউ থাকে সেটা অবশ্যই পাপিয়া। সামিয়ার সঙ্গে ওর দীর্ঘদিন সম্পর্ক থাকলেও মেয়েটা ওকে ততোটা কেয়ার করেনি বা ওর মনের কথা ততোটা জানেনি যতোটা পাপিয়া জেনেছে কিংবা প্রয়োজন ছাড়া টাইম স্পেন্ড করেছে।
ওর সাথে রিলেশনে যাওয়ার আগে অনেকেই ভাবতো পাপিয়াই বুঝি ওর গফ হবে। ফিউচারে তারা কাপল হবে এমন বাজিও কম ধরা হয়নি গ্রুপে।
হলে অবশ্য মন্দ হতো না। কিন্তু সত্যি বলতে রিজভী কখনো চায়নি এতো সুন্দর একটা ফ্রেন্ডশীপ ভিন্ন নামে রূপান্তরিত হোক। বন্ধুত্ব থেকে প্রেমে গড়ানো সম্পর্কে শেষ পর্যন্ত কিছুই যদি না থাকে, কেবল প্রেমিকা না বন্ধুও হারায়। তাই রিজভী সবসময় একটা লাইন এঁকে রেখেছিল।

দূর দেশে এসে ওর মনেপ্রাণে একটাই রিয়েলাইজেশন এসেছে- পাপিয়া কে চুজ না করা ওর জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল ছিল। তবে এবার সে আর ভুল করবে না। পাপিয়ার সঙ্গেই বাকিটা জীবন কাটাবে। কিন্তু এটা বললে পাপিয়া যদি ওকে ভুল বুঝে? কিংবা এই ভেবে বসে গফ পালানোতে ঠেকায় পড়ে ওকে চাইছে? এটা সাময়িক মোহ!
তবে সে নিজেকে মুখ দেখাতে পারবে?
রিজভী মনের সঙ্গে লড়াই করতে করতে হাঁপিয়ে উঠে। নাহ আপাতত শান্ত থাকাই শ্রেয়। আরো ক’টা দিন যাক তারপর নাহয় কিছু একটা ভাবা যাবে।

কালকে ঈদ। তাই বাড়ির সব মেয়েরা মেহেদি পড়তে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। মেহেদী আর্টিস্টরা এক এক করে সবাইকে মেহেদী লাগাচ্ছে, আর হাসি আড্ডায় চারদিকে হৈ হৈ রব। কোহিনূর আর রোকেয়া শেফদের কি কি আইটেম করা হবে তার লিস্ট করে দিয়ে মেহেদী উৎসবে যোগ দিলো। মিডিয়াম ভলিউমে বাজতে লাগলো সেই বিখ্যাত গান,
“ও মন রমজানের ঐ রোজা শেষে এলো খুশীর ঈদ….”

চলবে….

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৩৩

#আরশিয়া_জান্নাত

নাহিয়ান বিরিয়ানি খেতে খেতে বসার ঘরে ঢুকলো। সাবার পাশে বসে বলল,”আহারে বেচারি দু’হাত ভর্তি মেহেদি দিয়ে বসে আছে। এখন চাইলেও এতো মজার বিরিয়ানি খেতে পারবে না।”

সাবা বলল, “তোমার খাওয়া তুমি খাওনা। আমি কি বলেছি আমি এখন খাবো?”

“রাত প্রায় ১২টা বাজে। এখন না খেলে কখন খাবে?”

“এক রাত না খেলে কিছু হয় না।”

“এখন না ৫মিনিটে রং হয়। তোমার মেহেদী দেখি শুকালোই না।”

“অর্গানিক মেহেদী দিয়েছি সারারাত রাখলে অনেক রং হবে।”

“তোমার হাতে এমনিতেও রং বেশি হবে। যাই হোক দেখি হা করো, আমি আবার এতো নির্দয় নই বৌকে উপোস ফেলে একা একা খাবো।”

কুহু বলল, ” তুই যে ডাইনিং ছেড়ে কেন এখানে খেতে এসেছিস এ আমরা সবাই আগে থেকেই জানি। এতো নাটক করার কি দরকার বুঝি না।”

“ও তুই বুঝবিও না শাকচুন্নি। সারাক্ষণ তো নাক উঁচু করে ঘুরিস কোথায় কার ব্যাপারে নাক গলানো যায় সেই খোঁজে।”

কুহু বলল, “আমার নাক খাড়া বলে তোর সবসময়ই বেশি জ্বলে!! হিংসুক একটা।”

“ইসসস, যেই না নাক তার!”

সাবা গালের খাবার শেষ করে বললো,” এই তুমি থামবে? কেন রাগাচ্ছ ওকে?”

“তুমিই বলো আমি কি ওকে কিছু বলেছিলাম? ও নিজেই তো আমাদের কথার মাঝে ঢুকলো। হে আল্লাহ এই জাদরেল মেয়ের এটাই যেন এ বাড়িতে শেষ ঈদ হয়। আগামী বছর ও যেন শ্বশুরবাড়ি থাকে। আমিন”’

কুহু ডোন্ট কেয়ার মুডে বললো, “আগামী বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করছিস কেন? বল যে কোরবানীর আগেই যেন চলে যাই। শাওয়াল মাসে হলে তো আরো জোস।”

নাহিয়ান ভ্রু নাচিয়ে বললো, ” কোন হাবলারে ফাঁদে ফেললি?”

“তোরে বলবো কেন? তুই তো পারলে আমার বাড়া ভাতে ছাই দিবি তোরে কিছুতেই বলবোনা।”

“তলে তলে এতো দূর? দাঁড়া আমি এখনি মাকে বলছি।”

“যা বল গিয়ে, হু কেয়ার্স?”

“দেখেছ সাবা, আমি ওর বড় ভাই অথচ আমাকে একটুও দাম দিচ্ছে না। আরেহ আমার মত ছাড়া তুই পার পাবি ভাবছিস? আমি না বললে কেউ রাজি হবে?”

“এহহ আসছে বড় টোটো কোম্পানীর ম্যানেজার। তার মত ছাড়া আমার বিয়ে হবে না উউউ”

“ভেংচি কেটে লাভ নেই কোকিলা বেহেন। আমার কাছেই তোরে আসতে হবে দেখিস।”

সাবাকে খাবার খাইয়ে দিয়ে নাহিয়ান চলে গেলে পাপিয়া বলল, “আপু তুই ভাইয়াকে রাগিয়ে কি ঠিক করলি? সত্যি সত্যিই যদি ভাইয়া বেঁকে বসে?”

কুহু হেসে বলল,” আমার মিষ্টি ভাবি আছে না?সে ই সব মিটমাট করে দিবে, কি বলো ভাবি?”

সাবা মুচকি হেসে সমর্থন জানিয়ে বলল, “তা সে রাজী হলো?”

“মনে তো হচ্ছে রাজীই, মুখে স্বীকার করা বাকী।”

পাপিয়া চারদিকে তাকিয়ে বলল, “নতুন ভাবি কোথায় গেল এখানেই না ছিল?”

কুহু– “হয়তো নিজের ঘরে গেছে।”

“দেখলাম ও না কেমন হলো তার ডিজাইনটা!”

সাবা বললো,” আবার আসবে হয়তো, নয়তো সকালে দেখিও।”

কুহু– “ঘুম এসে গেছে বোধ হয়, সে তো আবার রাত জাগতে পারে না।”

“হুম তাই হবে।”

সালমা বেগম সবার জন্য বড় বাটিতে করে বিরিয়ানি এনে বললেন, “সবাই লাইন ধরে বস। আমি খাইয়ে দিচ্ছি।”

কুহু পাপিয়া ও তাদের অন্য কাজিনরা দৌড়ে দাদীর কাছে গেল, প্রতিবছর এমনি হয়। চাঁদরাতে মেহেদী পড়ার পর দাদী তাদের মুখে তুলে খাইয়ে দেন। এতোক্ষণ সবাই তার অপেক্ষাতেই ছিল।

আরওয়া দু’হাত মেলে দেয়ালে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। বিছানায় শোয়া এই মুহূর্তে রিস্কি। ওর যে ঘুম পরে হাতের মেহেদী সব বিছানার চাদরেই রয়ে যাবে, হাতে আর থাকবে না। জাওয়াদ রুমে এসে তাকে এমন অবস্থায় দেখে ফোন বের করে ছবি তুললো। তখনই দরজায় একজন এসে নক করে বলল, ” স্যার আরওয়া ম্যাম ডিনার করেন নি। তাই উনার জন্য খাবার পাঠিয়েছেন।”

“আচ্ছা আমাকে দাও।”

জাওয়াদ খাবার নিয়ে টেবিলের উপর রেখে ফ্রেশ হতে চলে গেল।

“আরওয়া এই আরওয়া উঠো,,এভাবে বসে বসে কেউ ঘুমায়? দেখি উঠে বিছানায় ঘুমাও”

আরওয়া হাত দিয়ে চোখ কচলাতে নিলে জাওয়াদ তাকে থামিয়ে বলে,” এই হাতে মেহেদী তো। কি করছো?”

“উপস স্যরি। আপনি কখন এসেছেন? এতো তাড়াতাড়ি সকাল হয়ে গেছে নাকি?”

“নাহ। সকাল হয় নি। দেখি উঠো কুলি করে খাবার খেয়ে নাও।”

“খাবো না এখন, ঘুমাবো।”

“তুমি এমন কেন আরওয়া? জানো ১১টার পর জেগে থাকতে পারোনা, আগে আগে খেয়ে নিবা না?”

“আপনি আমাকে বকা দিচ্ছেন কেন? চাঁদরাতে কেউ বকা দেয়? সবাই আনন্দ করছিল, তাই খাওয়ার কথা ভুলে গেছি। তাছাড়া অনেক নাস্তা খেয়েছি তো বেশি খিদে নেই।”

জাওয়াদ প্লেট হাতে নিয়ে বলল, “আর কোনো কথা শুনতে চাইছি না। আমি খাইয়ে দিচ্ছি চুপচাপ খেয়ে ঘুমাবে। কোনো বাহানা শুনতে চাইছি না।”

জাওয়াদের গুরুগম্ভীর গলা শুনে আরওয়ার চোখ থেকে ঘুম চলে গেল। সে গুডগার্লের মতো চেয়ারে বসে জাওয়াদের হাতে খেতে লাগলো। জাওয়াদ গাম্ভির্যতা ধরে রেখে পুরো খাবার শেষ করেই দম নিলো।

ঈদের নামায পড়তে বাড়ির সব ছেলেরা ঈদগাহে গেছে। এদিকে বাড়ির অন্য সদস্যরা গোসল সেড়ে নতুন জামা পড়ে সেজেগুজে একদম তৈরি। নামায শেষে ফিরলেই সালামি আদায়ের ধুম পড়বে। তারপর সবাই বেরিয়ে যাবে চেনাজানা সকলের বাসায় বেড়াতে।
জোবায়ের সাহেব নামাজ শেষে সবাইকে নিয়ে পারিবারিক কবরস্থানে গিয়ে কবর জিয়ারত করলেন। তারপর বাড়ি ফিরে সোফায় বসতেই এক এক করে সবাই তার কদমবুসি করলো। তিনিও হাসিমুখে সবাইকে সালামি দিয়ে ঈদের শুভেচ্ছা জানালেন।

আরওয়া রুমে এসে বলল, “এই শুনুন?”

“হুম বলো?”

“আপনি আমাকে সালামি দিবেন না?”

জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকে বলল, “এতোজন থেকে সালামি পেয়েও হলো না?”

“হুহ! আপনি এতো কিপ্টে কেন? সবাই কত সুন্দর করে তাদের ওয়াইফকে সালামি দেয়। এমনকি দাদাসাহেব ও দাদীকে দিলেন। আর আপনি কেমন ভ্রু কুঁচকে আছেন যেন আপনার হৃদপিন্ড চেয়েছি!”

“সালাম না করে সালামি চাইলে এমনি তো হবে। তুমি যদি সালাম করে বলতে জনাব আমার সালামি? তবে কি না দিয়ে থাকতাম?”

আরওয়া মাথায় ঘোমটা দিয়ে বললো, “আস্সালামু আলাইকুম জনাব। ঈদ মোবারক।”

“ওয়ালাইকুমুস্সালাম। ঈদ মোবারক। এবার কোলাকুলি করো?”

“কোলাকুলিও করতে হবে!”

“অবশ্যই।”

“হুহ আপনার যত রুলস!”

জাওয়াদ ওকে জড়িয়ে বললো,”আল্লাহ তোমায় শত সন্তানের জননী করুক।”

“এই এই এটা কি হলো? এটা কেমন দোয়া?”

“এটা সবচেয়ে দামি দোয়া বুঝলে। এখন ৩টা সন্তান পাওয়াও কঠিন হয়ে যায় সেখানে তুমি শত সন্তানের জননী হবে। সো ব্লেসিং! তোমার তো খুশি হওয়া উচিত!”

“আপনি পাগল? এতো বাচ্চা হলে আমি বাঁচবো?!”

“আচ্ছা যাও ৫০ জন হোক।”

“নাহ!!”

“২৫?”

“উহু”

“সর্বনিম্ন ১২ তো হবেই। আর কমানো যাবে না।”

“আল্লাহ! এমন একটা ভালো দিনে আপনি এমন দোয়া করছেন? কবুল হয়ে যায় যদি?”

জাওয়াদ ওর কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,” কবুল হলে আমি এতিমখানায় কাচ্চি বিরিয়ানি খাওয়াবো।”

“থাক থাক আমাকে সালামি দিতে হবে না। আপনি এমনিই থাকুন, এমন দোয়াও করে দিতে হবে না…আমি ঠিক আছি।”

জাওয়াদ ওর কথায় হাসতে লাগলো। আরওয়া নাক ফুলিয়ে বলল,” আপনি খুব চালাক!”

জাওয়াদ পকেট থেকে খাম বের করে বললো, “বেগম, এই নিন আপনার সালামি!”

আরওয়ার ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। হাত বাড়িয়ে খামটা নিতে গেলে জাওয়াদ ওর হাত ধরে বলল,”বাহ খুব সুন্দর রং হয়েছে তো!”

আরওয়া বলল,” আমি তো জানতাম ই আমার হাতের মেহেদিতে সবসময় রং ভালো হয়। দাদীজান বলতো আমার বর আমাকে অনেক ভালোবাসবে।”

“তাহলে স্বীকার করলে তোমার বর তোমাকে বেশি ভালোবাসে?”

“কি জানি, মুখে তো একবারও বলেনি। মনে মনে বাসে কি না সে ই ভালো জানে!”

“সবসময় মুখে বলাটাই কি মুখ্য? তোমার মন কি বলে?”

আরওয়া ওর গলা জড়িয়ে চুলে হাত গলিয়ে বললো, “আমার মনে বলে সে আমাকে একটুও ভালোবাসে না।”

জাওয়াদ ওর কোমড় খামচে কাছে টেনে বললো, “ঠিকই বলে। তোমাকে সে একটুও ভালোবাসেনা। এক কণাও না।”

আরওয়া চোখ বন্ধ করে ব্যথা হজম করে বলল, “আপনার ভালোবাসা সবসময় ব্যথাময় হয়। কখনো বুকের মাঝখানে ব্যথা দেয় তো কখনো শরীরে..মজার ব্যাপার হলো আমি এই ব্যথাতুর অনুভূতিতেই আপনার তীব্র ভালোবাসা খুঁজে পাই। মুখে আপনি যাই বলুন না কেন আই ডোন্ট কেয়ার!”

জাওয়াদ ওর কথা শুনে এক মুহূর্তও বিলম্ব করলো না। তীব্র আবেগে পাপড়ির ন্যায় কোমল অধরে নিজের পুরুষালি অধর মিশিয়ে প্রেয়সীর অমৃত সুধা পান করতে লাগলো। এই সময়টা না ফুরাক, এই অকৃত্রিম অনুভূতি কখনোই অম্লান না হোক…..

চলবে,,,

কাঁটাকম্পাস পর্ব-৩০+৩১

0

#কাঁটাকম্পাস #পর্ব৩০

#আরশিয়া_জান্নাত

পাপিয়া বিভিন্ন কোম্পানিতে সিভি জমা দিয়েছিল। সেই সুবাদে কাল তার একটা ইন্টারভিউ আছে। তারই প্রিপারেশন নিতে বইপত্র নিয়ে বসেছে। দরজায় টোকার শব্দ শুনে সে পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে তার ছোট ভাই জাহিদ দাঁড়িয়ে আছে।

“ভেতরে আয়।”

“আপু কি করছিস?”

“কাল ইন্টারভিউ আছে, তার জন্য টুকটাক পড়ছি। কিছু বলবি?”

“হ্যাঁ। আচ্ছা বলতো পৃথিবী আহ্নিক গতি যদি সামহাও কমে যায় তাহলে কি সময়ের উপর কোনো প্রভাব পড়বে?”

“হ্যাঁ পড়ে তো। আহ্নিক গতি কমলে দিনের দৈর্ঘ্য বাড়বে। অর্থাৎ সময় ধীরে যাবে”

“তার মানে যদি আহ্নিক গতি বাড়ে তাহলে সময় দ্রুত যাবে?”

“হুম।”

“আপু আমি দুইটা আর্টিকেল পড়েছি। একটায় দেখলাম চীনের থ্রি গর্জেস বাঁধের জন্য পৃথিবীর আহ্নিক গতি কিছুটা কমে গেছে। আবার আরেক জায়গায় পড়লাম পৃথিবীর আহ্নিক গতি বেড়ে গেছে, এখন পৃথিবী নিজ অক্ষে ঘুরতে ২৪ ঘন্টা লাগছে না। কোনটা সত্যি?!”

“দুটোই সত্যি। সময় দ্রুত যাচ্ছে তবে পরিমাণটা এখন পর্যন্ত খুব সামান্য। চীনের বাঁধ গতি কমানোতে প্রভাব ফেলছে এটাও সত্যি। তবে আজকে এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা করতে পারবোনা। ”

“তোরা সবাই খুব বিজি থাকিস। আমার একদম ভালো লাগেনা!”

“তোর স্কুল বন্ধ নাকি? পড়ালেখা নাই?”

“পড়াশোনা করতে গিয়ে ই তো এসব মাথায় এলো। আচ্ছা আপু ধর এই পৃথিবীতে টিকে থাকার আর কোনো উপায় রইলো না। সবাই দলে দলে মঙ্গল গ্রহে চলে যাচ্ছে। তুই কি করবি?”

“কি করবো আর সবার সাথে আমিও চলে যাবো।”

“কিন্তু আমি যাবো না।”

“কেন? তুই এখানে সার্ভাইব করতে পারবি নাকি!”

জাহিদ হেসে বলল,”ভেরি সিম্পল আপু সবাই যদি অন্য গ্রহে চলে যায় এই গ্রহ একদম ঠিক হয়ে যাবে। হ্যাঁ শুরুতে অনেক সমস্যা হবে তবে
কয়েক মাসের মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে। দূষণ করার মানুষ ই যখন থাকবেনা তখন আর ধ্বংস করবে কে? চারদিকে নতুন গাছপালা গজাবে, ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস সব নষ্ট হয়ে যাবে, গাছপালা বৃদ্ধির ফলে গ্লোবাল ওয়ার্মিং ও ঠিক হয়ে যাবে। আমার তো মনে হয় কয়েক বছরও লাগবেনা সব ঠিকঠাক হতে। তাই সবাই চলে গেলেও আমি থেকে যাবো।”

পাপিয়া ওর কথা শুনে বিস্মিত হয়ে গেল। ওর চিন্তাভাবনা এই ছোট্ট বয়সেই এমন আলাদা। সামনে কি করবে কে জানে! হয়তো ভবিষ্যতে নাসার বিজ্ঞানী বা গবেষক হয়ে গেল; বলা যায় না!!

গাছ থেকে ডাব পাড়া মাত্র সাথে সাথেই দা দিয়ে কেটে আরওয়াকে দিলো মফিজ ।

“আম্মিজান খেয়ে দেখেন, এই গাছের ডাব খুবই মিষ্টি। এমন মিষ্টি পানি কোথাও আর পাবেন না”

পলি একটা গ্লাস এনে ডাবটা উপুড় করে পানিটা নিয়ে আরওয়াকে দিলো। আরওয়া প্রথম চুমুক দিয়েই বললো, “উমম অনেক ইয়ামি। চাচা আমি কি আরেকটা পেতে পারি?”

“এটা বলতে হয় আম্মীজান। এই খানে যতগুলি দেখছেন সব তো আপনাদের জন্যই। যত ইচ্ছে খান। আমি আরো কাটতেছি দাঁড়ান।”

আরওয়া খুশি মনেই ডাবের পানি খেতে খেতে জাওয়াদের কাছে গেল। জাওয়াদ ছাদে বসে ল্যাপটপে কাজ করছে।

“এই ডাবের পানি খাবেন? অনেক মিষ্টি আর ঠান্ডা। মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায় টাইপ।”

বলেই সে আরেক চুমুক খেল। জাওয়াদ কাজ রেখে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো। আরওয়া বুঝলো জাওয়াদেরও খেতে ইচ্ছে করছে। সে তার গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “নিন খান। আরো কয়েক গ্লাস আছে। আপনি বললে নিয়ে আসবো।”

জাওয়াদ ল্যাপটপ একপাশে রেখে আরওয়াকে বললো, “এদিকে এসো।”

“কেন?”

“আসতে বলেছি আসবে। এতো প্রশ্ন কেন?”

আরওয়া ওর পাশে বসে বলল, “আপনি ডাব খাবেন না? আমি পুরোটা খেয়ে ফেলি?”

“খাও”

“আমি খেয়েছি বলে এখান থেকে খাবেন না যে? আলাদা গ্লাসে আনবো?”

জাওয়াদ অন্যদিকে চেয়ে বাঁকা হাসলো, আরওয়া সেই হাসির অর্থ বুঝবার আগেই সে তার ঠোঁটজোড়া দখল করে নিলো।

কিছুক্ষণ পর আরওয়া সরে গিয়ে নিজের ঠোঁট চেপে বললো, “এটা কি হলো? এরকম হুটহাট কেউ চুমু খায়?”

“তো কি বলেকয়ে খায় নাকি? তাছাড়া তুমি বারবার বলছিলে খাওয়ার জন্য….”

“আমি ডাবের পানি খেতে বলেছিলাম আমাকে না।”

“ঐ একটা হলেই হলো।”

“আপনি খুব…..”

“রোমান্টিক তাই না?”

” নাহ। বেশরম”

“ভেবে বলছো তো?”

” এখানে ভাবার কি আছে? ঠিকই তো বলেছি।”

“রোমান্টিক এর খাঁটি বাংলা এটাই গো। এখন তুমি যাই বলো আমি গায়ে মাখছি না। বউয়ের কাছে সভ্য লাজুক হয়ে থাকলে প্রেম ভালোবাসা আর হয়না বুঝলে!”

আরওয়া ভেংচি কেটে ওখান থেকে চলে গেল। জাওয়াদ হেসে মনে মনে বলল, “বউকে চুমু খেলে সত্যিই স্ট্রেস কমে যায়!”

দেখতে দেখতে বছর ঘুরে রোজার মাস চলে এসেছে। সবাই মিলে সাহরি আর ইফতার করার মাঝে এক অন্যরকম আনন্দ। প্রতিবছর রমজান মাসে খন্দকারদের পক্ষ থেকে ইফতারের আয়োজন বেশ বড় করে করা হয়। এ সময় নির্দিষ্ট স্থানে পথচারী, মুসাফির সহ যেকোনো শ্রেণির রোজাদারের জন্য ইফতারের ব্যবস্থা করা তাদের রেওয়াজে পরিণত হয়েছে। প্রতিদিন নিম্নে দু’শো লোক সেখানে তৃপ্তি ভরে ইফতার করে। নিয়ম মাফিক বাড়ির ছেলেরা একেকদিন একেকজন গিয়ে সব তদারকি করে সেখানেই ইফতার করে।
আজ নাহিয়ানের পালা আসায় সাবা বললো, “শুনছো আমি বলি কি আজকের ইফতারটা আমি তৈরি করবো। রোজাদারদের ইফতার করালে তো অনেক সোয়াব হয় তাই না? আল্লাহ যদি এই উছিলায় আমায় সন্তান দান করেন….”

“ওখানে অনেক মানুষ হয়, এই গরমে তুমি এতো রান্না কিভাবে করবে?”

“আমি একটা আইটেম হলেও করি প্লিজ নাহিয়ান মানা করো না।”

“সাবা আমি বুঝতে পারি তোমার মনের অবস্থা। কিন্তু…”

“আমি একা করবো না তো। শেফরা তো আছেন ই।”

“তোমার যা ইচ্ছে করে করো।”

“আজকে আমি একটা এতিমখানার অনেকগুলো বাচ্চাকে ওখানে আসতে বলেছি। তুমি ওদের পেট ভরে ইফতার করাবে।”

“আচ্ছা!”

“থ্যাংক ইউ!”

নাহিয়ান হেসে বললো,” তুমি অনেক কিউট সাবা। তোমাকে এমনি এমনি এতো ভালোবাসি না আমি!”

সাবা উত্তরে কেবল হাসলো।

আরওয়া ফ্লোরে শুয়ে একটু পর পর ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। উহু এতো গরম গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। কখন ইফতারের সময় হবে। জাওয়াদ অফিস থেকে ফিরে আরওয়াকে এমন দেখে বলল, “বেশি কষ্ট হচ্ছে?”

“নাহ, প্রথম দিকে একটু কষ্ট হয়ই। ধীরে ধীরে আবার অভ্যাস হয়ে যাবে।”

জাওয়াদ শার্ট পাল্টে বলল, “বাইরে যা গরম সে অনুযায়ী কষ্ট কম ই লাগছে। রোজাদারদের উপর আল্লাহর বিশেষ রহমত থাকে এই গরমে সেটা আবারো টের পেলাম।”

“হুম ঠিক বলেছেন।”

জাওয়াদ আরওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,” উঠে এসো। বিছানায় শুয়ে রেস্ট নাও। আসরের নামাজ পড়েছ?”

“হুম। না আর রেস্ট নিবো না। আমি এখন কোরআন পড়বো। পাপিয়া আপু আমার চেয়ে এক পারা এগিয়ে গেছে। তাড়াতাড়ি ব্যালেন্স করতে হবে..”

“তোমাদের কম্পিটিশন হচ্ছে নাকি?”

“হুম, দাদীজান বলেছেন সবাইকে ২৬ রোজার মধ্যে খতম দিতে।”

“ওহ, কিন্তু তাড়াহুড়ো করে পড়া ঠিক না। কোরআন অর্থ বুঝে ধীরে সুস্থে পড়তে হয়।”

“ওরকম পড়তে গেলে শেষ হবেনা তো।”

“আচ্ছা পড়ো তবে সময় পেলে অর্থ বুঝে পড়বে কেমন?”

“হুম আচ্ছা।”

জাওয়াদ ওর কপালে চুমু দিয়ে মৃদু হাসলো।

ইফতারের পর কুহু ইশরাকের ফোনে কল দিলো। বরাবরের মতোই সে প্রথমবারে রিসিভ করলো না। ৭ম বার ডায়াল করার পর রিসিভ করে বিরক্ত গলায় বললো,” কেউ যখন কল রিসিভ করে না বুঝতে হয় সে বিজি আছে। একটানা এতোবার কল করা লাগে?”

কুহুর ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। সে প্রফুল্ল গলায় বলল, “জানেন তো রিসিভ না করে পারবেন না, তবে প্রথমবারে রিসিভ করলেই হয়। আপনিও বিরক্ত হলেন না আমারো কষ্ট করা লাগলো না।”

“কেন ফোন করেছেন তা বলুন?”

“কোথায় আছেন এখন?”

“অফিসেই কেন?”

“ছুটির পর দেখা হবে তাহলে। আমি আপনার অফিসের সামনে আসছি।”

ফোন রেখে ইশরাক তার কলিগ শাহানার কাছে গেল। ক্রুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “তুই আমাকে শান্তি দিলি না শানু! কি দরকার ছিল ওকে আমার সব ডিটেইলস দেওয়ার? ”

শাহানা কম্পিউটারে টাইপ করতে করতে বলল,” মেয়েটা দেখতে শুনতে খারাপ না। তাছাড়া সে তোমার প্রতি খুব আগ্রহী। আমার মনে হয় এবার তোমার বিয়েটা করে ফেলা উচিত। বয়স তো কম হচ্ছেনা,,,”

“তাই বলে সম্পূর্ণ অচেনা একটা মেয়েকে বিশ্বাস করবো?”

“কেউই জন্ম থেকে চেনা হয় না। তুমি তো ওকে চেনানোর সুযোগ ই দিচ্ছ না। তোমার লাইফের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পার্ট হচ্ছে খাওয়া। আর ও তোমার খাওয়া দেখেই পছন্দ করেছে। এটা তো তোমার জন্য প্লাস পয়েন্ট। তাও এমন করো কেন বুঝি না!”

“বেশি কৌতুহলী মানুষ আমার ভয় লাগে। এদের আগ্রহ আসতেও সময় লাগেনা যেতেও সময় লাগেনা।”

“কুহু কে আমার সেরকম লাগছেনা। ও বেশ ম্যাচিওর মেয়ে। ওরা ষোড়শীর মতো আবেগে প্রেমে পড়েনা। যখন পড়ে বুঝতে হবে সত্যিই মনে ধরেছে। তুমি এটলিস্ট সুযোগ দিয়ে দেখতে পারো…”

ইশরাক মাথা চুলকে ভাবতে লাগলো, “দিবে নাকি একটা সুযোগ?”

চলবে…

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৩১

#আরশিয়া_জান্নাত

৩১

জোবায়ের সাহেব ইজি চেয়ারে বসে কি নিয়ে যেন গভীর চিন্তা করছেন। তার বড় মেয়ে সাবিহা দরজায় নক করে বলল,”আব্বা আসবো?”

“হ্যাঁ আয়।”

“আব্বা আপনার কি বেশি টায়ার্ড লাগছে? শুয়ে রেস্ট নিন। ইফতারের এখনো দেরি আছে তো।”

“সমস্যা নেই। আসরের পর শুয়ে থাকা ভালো না,স্বাস্থ্য নষ্ট হয়। কিছু বলবি?”

“আসলে আব্বা আপনার জামাই একটা পাত্র দেখেছে। ছেলে দেখতে শুনতে খারাপ না।ওদের পরিবারও ঠিকঠাক আছে। উনার ইচ্ছে ঈদের পরপরই মাইশার বিয়েটা সেরে ফেলার। আপনি কি বলেন?”

“ছেলের খোঁজখবর নাও ভালোমতো। তারপর বিয়ের চিন্তা। বিয়েতে তড়িগড়ি করা ভালো না। সারাজীবন যে সম্পর্ক বয়ে বেড়াতে হবে তার বুনিয়াদ মজবুত হওয়া চাই।”

“আমি কিছু বললে উনি বলেন আমরা বেশি বুঝি বলেই ঘরে ২টা উপযুক্ত মেয়ে এখনো ফেলে রেখেছি। বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারছি না। আব্বা কুহুর বিয়ের ব্যাপারে আপনারা সিরিয়াস হচ্ছেন না কেন? ওর পরে তো পাপিয়াও আছে। বয়স তো থেমে থাকছেনা কারো। ”

জোবায়ের সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, “তুমি মাইশার বিষয়ে আর কিছু বলবেনা। ওর মেয়েকে ও যেখানে মন চায় বিয়ে দিক। ওর বুঝ ওর কাছেই থাক। যে স্ত্রীকে সামান্য কথায়ও বাপের বাড়ি নিয়ে খোঁটা দেয় তার সঙ্গে তর্ক করা অহেতুক। আমি তোমাকে শুরুতেই বলেছিলাম এই ছেলে তোমার জন্য ভালো হবেনা….”

সাবিহার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেল। সাবিহার অবনত মুখ দেখে জোবায়ের সাহেবের ভাবান্তর হলো না। তিনি ফের বললেন,” আমি আমার জীবনে শিক্ষা একবারই নিই। বারবার এক ভুল করা মানুষ আমি নই। আমার বাড়ির ছেলেমেয়েদের বিয়ে আমি অনেক ভেবেচিন্তে দেওয়ার চেষ্টা করেছি। ভাগ্যের লেখা বদলানো যায় না। যা হবার তা হবেই। ইয়াকুব (আঃ) যেমন তার পুত্রদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “যদিও আমি তোমাদের যে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলেছি, তা ভাগ্যলিপি খণ্ডন করতে পারবে না। কেননা আল্লাহ তাআলা কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে তা রোধ করার ক্ষমতা কারো নেই।”
আমিও তার মতোই সতর্কতা অবলম্বন করছি মাত্র।”

সাবিহা মাথা নেড়ে বাবার কথায় সমর্থন জানিয়ে বললেন,” আব্বা আপনি একবার খোঁজখবর নিয়ে দেখবেন? ও তো আপনারও নাতনী। ওর উপর আপনারও অধিকার আছে তাই না?”

“দাদার মতো নানার দাম নেই সাবু। যদি থাকতো তোমার স্বামী কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে আমাকে অবশ্যই জানাতো। সরাসরি বিয়ের দাওয়াত দেওয়ার অপেক্ষা করতো না। তুমি মেয়ের মা বলেই ভালোমন্দের চিন্তা করে আমাকে জানালে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এখানে আমার মতামতের মূল্য হবেনা। তাই আমি বলবো তুমিও এই বিষয়ে আর মাতামাতি করো না।”

“কিন্তু আব্বা..”

“আর কোনো কিন্তু না। আল্লাহর কাছে দোয়া করো যা হবে ভালোর জন্যই হবে।”

সাবিহা নিরবে প্রস্থান করলো। সালমা মেয়ের চোখে পানি দেখে ভেতরে এসে বললো,” কি ব্যাপার সাবুর কি হইছে? ও কান্না করতে করতে গেল কেন?”

“মেয়েটা বয়সেই বড় হয়েছে বুঝলে সালমা, স্বভাব বৈশিষ্ট্যে এখনো সেই ছোট্ট খুকী রয়ে গেছে। অথচ জীবনের চরম সিদ্ধান্তের বেলা এই ছোট্ট খুকিটাই কি দুঃসাহসিকতাই না দেখিয়েছল!!”

“আপনি এখনো এ কথা নিয়ে ওর উপর রাগ?”

“নাহ রাগ হবো কেন? কুমারি আর বিধবা মেয়েকে তাদের সিদ্ধান্তের বাইরে বিয়ে দেওয়া যায় না। ওর পথ ও ধরেছে আমি রাগ করার কে?”

“আপনি এ বাড়ির ছেলেদের বেলা এই ছাড় দেন না, মেয়েদের বেলাই দেন। এটা কি ঠিক?”

“হাহাহা তুমি সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে পিছু হটো না। ঠিকই খোঁচা টা জায়গা মতো বসিয়ে দিলে..”

“ভুল বললাম?”

“না ভুল বলোনি। তবে একটা কথা কি জানো সালমা সংসারে মেয়েরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বলে না, সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। কথাটা একদম সত্যি। তাই পরের ঘরের মেয়ে আনার সময় আমি কোনো ছাড় দিতে চাই না। হয়তো মেয়েদের বেলাও এটা করতাম যদি না হাদিসে নিষিদ্ধ থাকতো। নয়তো আমার এত আদরের বড় মেয়ে সাবুকে এমন ছেলের কাছে বিয়ে দিতাম!”

“বড় জামাই আবার কিছু করছে? ও কি এই জীবনে ঠিক হবেনা?”

“কিছু মানুষ কখনোই বদলায় না।”

“ওকে পাঁচ রকম করেও মন পাইলাম না। মেয়েকে সুখী করতে কত কি করেছি। যখন যা চেয়েছে দিয়েছি। তাও ও বাড়িতে আমার মেয়ে একটু সম্মান পায়নি। ওর নসীবই খারাপ আসলে…”

“ওসব বাদ দাও। এখন ওসব শুনতে ইচ্ছে করছেনা।”

সালমা আর কিছু বললোনা, কিন্তু চোখ দিয়ে পানি ঠিকই পড়তে লাগলো।

জাওয়াদের মনমেজাজ একদম খারাপ হয়ে আছে। আজকের মিটিংটা ওর জীবনের সবচেয়ে জঘন্য মিটিং ছিল।‌ টেন্ডার টা হাতের নাগালে এসে একটুর জন্য ফসকে গেল। ভাবতেই গা’টা জ্বলুনি দিয়ে উঠছে। বিক্ষিপ্ত মেজাজ নিয়েই সে নিজেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে এসেছে রফিক বা সাম্যর অপেক্ষা করেনি। রাগটা আরো বাড়িয়ে দিতেই বুঝি রাস্তায় এতো লম্বা জ্যাম বেঁধেছে। ইফতারটা না আজ রাস্তাতেই করা লাগে! কথা ছিল মিটিং সাকসেসফুল হলে ওখানেই সবার সঙ্গে ইফতার করবে। কিন্তু সেটা আর হলো না। এখন মাঝরাস্তায় গাড়িতে বসে থাকা ছাড়া আর উপায় নেই।

আরওয়া সাবার পাশে বসে বললো, “ভাবি আজকে ভাইয়াও বাসায় ইফতার করবে না?”

“নাহ”

“আজকে বাসায় এতো গেস্ট অথচ ঘরের ছেলেরাই নেই।”

” ভাইয়াকে মিস করছো বুঝি?”

“তা করছি একটু,,,”

“চিন্তা করোনা সন্ধ্যায় চলে আসবে।”

রোকেয়া হন্তদন্ত হয়ে কিচেনে ঢুকে বলল, “রাহেলা দুলাইভাইয়ের জন্য রুহাফজার মিল্ক শেক করেছিস?”

“হুম মেঝ ভাবি করছি তো।”

“গোলাপজল দিছোস?”

“আইত্তেরি ভুইলাই গেছি। খাড়ান এখনি দিতাছি।”

“সাবা কাবাব বানানো শেষ?”

“হুম সেই কখন..”

“আরওয়া তুই কি বানিয়েছিস দেখি?”

“আমি সবচেয়ে কঠিন আইটেম করেছি আম্মু। তবে আমি সিওর খাওয়ার পর সবাই বলবা সেই হইছে!”

“কি আইটেম শুনি?”

আরওয়া স্বগর্বে বলল, “আমি ক্যারামেল পুডিং বানিয়েছি।”

সাবা আর রাহেলা ওর কথা শুনে ঠোঁট চেপে হাসতে লাগলো‌। রোকেয়া ওর দিকে তাকিয়ে বলল,”আমার বৌমা টা কি কঠিন রেসিপিই না তৈরি করেছে! তোরা কেউ পারবি এতো কঠিন রান্না করতে?”

সাবা হেসে মাথা নাড়ালো। আরওয়া বললো, “আম্মু দেখো এটা বানানো এতোটাও কঠিন না, ক্যারামেল টা ঠিকঠাক করতে পারলেই সব সহজ…”

“হয়েছে বাবা আমি বুঝেছি এই কঠিন রান্না করার জন্য তোকে অনেক ধন্যবাদ। এখন চল সবাই, ইফতারের সময় হয়ে আসছে।”

সবাই ডাইনিং এ ইফতার সামনে নিয়ে মোনাজাত ধরেছে। এই মুহূর্তে রোজাদার যা দোয়া করে আল্লাহ তায়ালা সেটা পূরণ করেন। তাই সবাই এই সময়টায় নিজেদের মনের যত ইচ্ছে আছে সব এই সময়টায় মোনাজাতে চেয়ে থাকে। সাবার অবশ্য একটাই চাওয়া ওর কোল আলো করে একটা সন্তান আসুক। তার এই মোনাজাতে কুহু, কোহিনূর সহ পরিবারের অনেক সদস্যই অংশীদার হয়। সবার চাওয়া এই একটা পয়েন্টে এসে ঠিকই মিলে যায়। জোবায়ের সাহেব নিজের পুরো পরিবারের দিকে চেয়ে মুচকি হাসেন। আর মনে মনে বলেন, “ওদের সবাইকে মাফ করে দাও আল্লাহ। ওরা যেন মিলেমিশে সুখে শান্তিতে বাস করে।”

জাওয়াদ বাসায় ফিরেছে প্রায় ২ ঘন্টা পর। রাস্তায় পানি আর বিস্কিট দিয়ে রোজা ভেঙেছে। কথায় বলে যেদিন খারাপ হয় সবদিকেই হয়। বাসায় ঢুকে সবাইকে হাসি ঠাট্টা করতে দেখে ওর মন আরো ক্ষিপ্ত হয়। এদের এতো হেহে হিহি আসে কোত্থেকে কে জানে!
ওকে এরকম গম্ভীর মুখে কথা না বলে চলে যাওয়াটা সবার চোখেই পড়ে। রোকেয়া কি একটা আন্দাজ করে আরওয়াকে বলে, “আরওয়া ওর জন্য খাবার আর শরবত নিয়ে যা তো মা।”

আরওয়া শাশুড়ির কথামতো সেসব নিয়ে রুমে যায়। রুমে ঢুকে দেখে জাওয়াদ চুপচাপ বসে আছে। আরওয়া হাসিমুখে খাবারগুলো টেবিলে রেখে বলল,”ফ্রেশ হয়ে খাবার গুলো খেয়ে নিন?”

জাওয়াদ কোনো উত্তর দিলো না। আরওয়া ওর পাশে বসে বললো, “মুড অফ কেন? কিছু হয়েছে?”

“এতো কথা বলো কেন? চুপ করে থাকা যায় না?”

জাওয়াদের ধমক শুনে আরওয়া চুপ হয়ে গেল। জাওয়াদ উঠে ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নিলো। মাথায় পানি ঢেলে উযু করে মাগরিবের নামাযের কাযা পড়লো। আরওয়া এককোণে দাঁড়িয়ে সব দেখছে। অন্য সময় এভাবে বকা দিলো ও হয়তো এতোক্ষণে কেঁদেকেটে এক করে ফেলতো। কিন্তু আজ সেটা করছে না। এখন রুম থেকে সরে গেলে যদি জাওয়াদ আর না খায়, তাই আর নড়ছেও না। জাওয়াদ নামায শেষ‌ করে উঠে আরওয়ার দিকে তাকালো। আরওয়া ওর শান্ত চাহনী দেখে সাহস করে কাছে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো। পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, “এতো রাগ করে না জনাব শান্ত হয়ে যান তো।”

জাওয়াদ নিরবে তার আলিঙ্গন অনুভব করতে লাগলো। ধীরে ধীরে সব অশান্তি যেন প্রশমিত হয়ে যাচ্ছে।

“ইফতার করেন নি তাই না? দেখি চলুন আগে খেয়ে নিবেন।”

জাওয়াদ ওর চিবুক তুলে বলল, “এগুলো কিভাবে পারো বলো তো? কোথায় শিখেছ এই ফর্মূলাগুলো?”

“কোথায় যেন পড়েছিলাম “One hug can fix everything.” সেটাই এপ্লাই করলাম।”

“ভেরি স্মার্ট!”

আরওয়া তাকে টেনে চেয়ারে বসিয়ে বললো, “আই নো। নিন শুরু করুন।”

জাওয়াদ হেসে খেতে শুরু করলো। আরওয়াও তার রাজ্যের গল্প খুলে বসলো। সাপোর্টিভ জীবনসঙ্গী সাথে থাকা মন্দ না, বরং শান্তির ই বটে!

রিজভীর কল দেখে পাপিয়া হাতের কাজ রেখে ফোন নিয়ে বসলো।

“হেই পাপিতা কি খবর? কেমন আছিস?”

“ভালো তুই?”

“ভালো। বাসায় সবাই ভালো তো?”

“হুম সবাই ভালো। তোর কথা বল। ওখানে সব ঠিকঠাক তো?”

” হ্যাঁ ঠিকঠাক ই তবে সাহরী আর ইফতারে খুব মন খারাপ লাগে। সবাইকে মিস করি অনেক।”

“স্বাভাবিক। এখানে কেউ নেই বললেও অনেকে আছে। উৎসবমুখোর পরিবেশ আছে। ওখানে তোর একা লাগবে স্বাভাবিক।”

“আমি ভুল করেছি রে,বিয়ে করে বৌ সাথে করে আসা উচিত ছিল। আমার এক ফ্রেন্ড স্পাউজ নিয়ে এসেছে। ওর রান্না খাওয়ার প্যারা নাই‌ আর এলোন ও কম লাগে। আমিই ভেজালে পড়ছি।”

“তুই তো বিয়েই করবি না বলছিলি। এখন উল্টা সুর কেন?”

“এখনো মত বদলায় নি পরিস্থিতির স্বীকার। তোকে নিয়ে আসা উচিত ছিল রে। তোর রান্নার হাত যদিও বেশি সুবিধার না বাট আমার চেয়ে বেটার এটা সত্যি।”

“এহহ শখ কত!”

“শপিং করলি?”

” হুম। তুই?”

“নাহ। করার দরকার পড়বেনা। আসবার সময় যা এনেছি সব পড়া হয়নি। নতুন আছে। ”

“তাও ঠিক।”

“আচ্ছা শোন।”

“বল?”

“আমার এখানে একটা ফ্রেন্ড হয়েছে। ব্রিটিশ ছেলে বাট মুসলিম। ওর ইচ্ছে বাংলাদেশী মেয়ে বিয়ে করার। তোর জন্য দেখবো নাকি?”

“বিদেশী ছেলের প্রতি আমার ইন্টারেস্ট নাই।”

“কুহুর জন্য?”

“আপু এখন বিদেশী খোঁজেনা রে। একটা পেটুক ছেলের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে।”

“বলিস কি রে চিকনাচাকনা কোরিয়ান পোলা বাদ দিয়ে সরাসরি ভোজনরসিক! দেখেছিস আমার কথা ফলেছে..”

“সম্পূর্ণ ফলেনাই। ঐ ভাইয়া ভোজনরসিক হলেও গোপাল ভাড়ের মতো না দেখতে। লম্বা চওড়া সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। আপু তো এই ছেলেকে বাদে কাউকেই বিয়ে করবেনা বলে পণ নিয়েছে।”

“তো সমস্যা কোথায় সবাই রাজী হয়ে যা।”

“সমস্যা হলো ছেলেই তো রাজী হয়নি এখনো!”

” কি বলোস! কুহুকে রিজেক্ট করে এমন ছেলেও আছে?”

” আপু তো বলে ইশরাক ভাইয়া ফুড থেকে চোখ সরালে তো আপুকে দেখতো! হেহেহে….”

“হাহাহা। খুব দারুণ জিনিস মিস করছি রে। আমি ঢাকায় থাকলে সিওর তার সঙ্গে মিট করতাম‌”

“যদি ওদের ঠিকঠাক হয় মনে হয়না বাসায় কেউ আপত্তি করবে।”

“তোদের হিটলারের ভরসা নাই। সে কখন বেঁকে বসে।”

“বসবেনা। কুহু আপু পাক্কা খেলোয়াড় বুঝলি। সব ইনফরমেশন কালেক্ট করেছে। বলতে গেলে ও একদম কোমরে গামছা বেঁধে নেমেছে। জাস্ট ইশরাক ভাইয়ের হ্যাঁ বলার অপেক্ষা!”

“তুই এমন বড় বোন পেয়েও চালাক হতে পারলি না!”

“আমি বোকা না! যা আছি এনাফ ফর মি”

“ঘোড়ার ডিম! এই বুদ্ধি নিয়ে সংসার করতে পারবি না। না না ভুল হয়েছে। বোকা মেয়েরা বউ হিসেবে জোস। এদেরকে ইচ্ছামতো নাচানো যায়।”

পাপিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল, “তুই আসলেই বদ।”

রিজভী হেহে করে হাসতে লাগলো।

চলবে….

কাঁটাকম্পাস পর্ব-২৮+২৯

0

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব২৮

#আরশিয়া_জান্নাত

২৮

আমিন সাহেব মেয়ের পছন্দের ফ্লেভারের কেক নিয়ে বাসায় ফিরে দেখলেন আরওয়া বসার ঘরে ভ্রু কুঁচকে জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে আছে। বাবাকে দেখে আরওয়ার মুখ স্বাভাবিক হয়ে উঠলো। আমিন সাহেব মেয়েকে এক হাতে জড়িয়ে বললেন, “জন্মদিনের অনেক অনেক শুভেচ্ছা মামণি।”

“থ্যাঙ্ক ইউ আব্বু।”

“গিফট পছন্দ হয়েছে!”

“অনেক!”

“যাক শান্তি। দেখ এবার কেকটা পছন্দ হয় কি না।”
আরওয়া কেকের বক্স নিয়ে চলে যেতেই তিনি বললেন,”বুঝলে বাবা আমার মেয়ের মনমতো জিনিস খুঁজে পাওয়া অনেক কঠিন। অনেক ভেবেচিন্তে ডিসাইড করতে হয়। তা দাঁড়িয়ে কেন বসো না?”

জাওয়াদ ভদ্রতাসূচক হাসি দিয়ে সোফায় বসে বললো, “আপনি ভালো আছেন তো?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। তোমাদের বাসায় সবাই কেমন আছেন?”

“জ্বি আলহামদুলিল্লাহ।”

“আচ্ছা তুমি বসো আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। যা গরম পড়ছে এবার! ”

আরওয়া ফিরে বললো, “আপনি আমার প্রশ্নের জবাব দেন নি এখনো!”

“কি জবাব দিবো?”

“আপনার তো রাতে আসার কথা ছিল এখন এলেন কেন?”

“আমার শ্বশুড়বাড়িতে আমি যখন ইচ্ছা তখন আসবো। তোমাকে জবাবদিহি করতে হবে কেন?”

“অবশ্যই করতে হবে। আমার জন্যই এটা আপনার শ্বশুড়বাড়ি হয়েছে। আমাকে উত্তর দিবেন না তো কাকে দিবেন?”

“ঝগড়া করো না তো। আমি এমনিতেই খুব টায়ার্ড। ফ্রেশ হবো, রুমে এসো।”

আরওয়া লেবুর শরবত নিয়ে রুমে গেল। জাওয়াদ ততক্ষণে ফ্রেশ হয়ে টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছতে লাগলো। আরওয়া ওর দিকে শরবত এগিয়ে দিলে জাওয়াদ সেটা নিয়ে বলল, “তুমি সারাক্ষণ এতো কথা বলো, নিজের বার্থডের কথা একবারও বলোনি কেন? সকালবেলা গাল ফুলিয়ে না রেখে যদি বলে দিতে বেশি সমস্যা হতো? প্রথম বছর জানতে শুনতে সময় লাগেনা বলো?”

“আমার বায়োডাটা দেখার সময় আপনি খেয়াল করেন নি আমি জানবো কিভাবে? মানুষ তার পছন্দের মানুষের ছোটখাটো বিষয়ও নজরে রাখে। আর আপনি তো চোখের সামনে থাকা জিনিস ও দেখতে পান না।”

“তুমি খুব ঝগড়ুটে আরওয়া!”

“হ্যাঁ এখন সব দোষ আরওয়ার। আপনি তো একদম ভালো মানুষ।”

“অবশ্যই এখানে আমার কোনো ফল্ট নেই। এমন না আমাদের বিয়ে হয়েছে বছর খানেক হয়ে গেছে, আর আমি প্রতিবছর ভুলে যাই। তাছাড়া তোমার বোঝা উচিত আমি তোমার উপর শুরুতে ইন্টারেস্টেড ছিলাম না, না আমি এই বিয়েটা নিয়ে সিরিয়াস ছিলাম। তো তোমার বায়োডাটা দেখার সময় জাস্ট এডুকেশন সেক্টরটাই মন দিয়ে দেখেছি। এখন যদি সেটাকে কেন্দ্র করে ঝগড়া করতে থাকো তবে সেটা সম্পূর্ণ তোমার ইমম্যাচিওরিটি। আমার এখানে কিছু বলার নেই!”

“হ্যাঁ সেটাই, আমারই ইমম্যাচিওরিটি।”

জাওয়াদ গ্লাসটা টেবিলে রেখে ওর সামনে দাঁড়ালো, দু’হাত কাঁধে রেখে নরম গলায় বলল, “আমি চেষ্টা করবো এসব ছোটখাটো ব্যাপার মনে রাখার। তুমি আর রেগে থেকো না প্লিজ।”

আরওয়া তার কথায় শান্ত হয়ে বলল, ” আমার গিফট কোথায়?”

জাওয়াদ নিজের দিকে ইশারা করে বললো, “জলজ্যান্ত গিফট দাঁড়িয়ে আছে এটা কি যথেষ্ট নয়?”

আরওয়া ভেংচি কেটে বলল, “ঢং!”

“ঢং হবে কেন! ফারাজ খন্দকার জাওয়াদকে গিফট হিসেবে পাওয়া চাট্টিখানি কথা না ম্যাম!”

আরওয়া ওর গলা জড়িয়ে বলল, “তাই নাহ?”

“বিশ্বাস হয় না?”

“অবশ্যই হয়।”

জাওয়াদ মুচকি হেসে ওর কপালে চুমু খেলো। তারপর আরওয়াকে আয়নার সামনে ঘুরিয়ে পকেট থেকে ডায়মন্ডের পেন্ডেন্টযুক্ত চেইনটা বের করে গলায় পড়িয়ে দিলো। কাঁধে চিবুক রেখে বলল, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ! আল্লাহ তোমাকে অনেক সুখী করুক। পছন্দ হয়েছে?”

“হুম অনেক সুন্দর হয়েছে। থ্যাঙ্কস!”

” শুকনো থ্যাঙ্কসে কাজ হবে না।”

“আজকে ডিনারে অনেক আইটেম করা হয়েছে, বিনিময়ে ওসব খেয়ে যাবেন। কেমন?”

জাওয়াদ ভ্রু উঁচিয়ে বলল, “ঐটা তো কিছু না আনলেও খেতে পারতাম। দিস ইজ নট ফেয়ার আরওয়া!”

“আমি জাতিসংঘের সচিব না, ফেয়ার আনফেয়ার দিয়ে আমার কাজ নেই।”

“আচ্ছা মেয়ে তো তুমি। আমাকে সবসময় বলতে আনরোমান্টিক ক্ষ্যাত! নিজে কি হুম? বরকে স্বেচ্ছায় আদর করেছ কোনোদিন?”

“করিনি?”

“নাহ, একবারও না। বিশ্বাস না হলে নিজেই ভেবে দেখো।”

আরওয়া সত্যি সত্যিই ভাবতে লাগলো কখনোই কি ও কিছু করেনি!!

পাপিয়ার আজ মন ভীষণ খারাপ। ক্যাম্পাসে আসার পর থেকে একা একা ঘুরছে। হিয়াকে ছাড়া ক্লাস করতে একটুও ভালো লাগছে না। এমন না ওর আর কোনো ফ্রেন্ড নেই। তবে হিয়ার সাথেই তার সখ্যতা বেশি। কেন যে ওর বিয়ে হয়ে গেল, সাথে সাথে চলেও গেল চাঁদপুরে। ফাইনাল পরীক্ষার সময় শুধু আসবে হয় তো। পাপিয়া অসহায়ের মতো এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলো। রিজভী ওর মাথায় টোকা দিয়ে বলল,” কিরে এমন অসহায় নারীর মতো মুখ করে ঘুরে বেড়াচ্ছিস কেন? জামাই মরে গেছে নাকি?”

“সবসময় অলুক্ষণে কথা বলিস না তো। জামাই আসলোই না এখনো তুই কি না তাকে মেরেই ফেলছিস?”

“বাব্বাহ জামাইয়ের জন্য এতো দরদ ?”

“অবশ্যই। জামাইয়ের জন্য দরদ হবে না তো কি তোর জন্য হবে! পুরো পৃথিবীতে একটা মাত্র জামাই হবে আমার তার ভ্যালু বেশি হবেনা?”

“তোর কথা শুনে আমি পুরা কেন্দে দিয়েছি!”

“নাটক করিস না রিজভী। এমনিই মেজাজ খারাপ লাগতেছে।”

“কি হইছে? তোর সাথেরটার বিয়ে হয়ে গেছে বলে দুঃখে আছস?”

“হুম…”

“আহারে। তো তুই ও বিয়ে করে ফেল। বসে আছিস কেন?”

“করবো তো আগে কুহু আপুর বিয়ে হোক। তারপর আমার সিরিয়াল।”

“তোর কুহু আপুর কাহিনী বুঝি না। এ বিয়ে করে না ক্যান?”

“আপু মনমতো ছেলে পায় না। উনার কোরিয়ান ছেলে পছন্দ।”

” এখন সব মেয়ের ই ওদের পছন্দ। তাই বলে কি সবাই ঐদেশে চলে গেছে নাকি? দেখবি তোর বোন এমন ছেলেরে বিয়ে করবে যে কোরিয়ার উল্টা ভার্সন। গোপাল ভাড়ের উত্তরসূরী টাইপ বাঙালি পুরুষ!!”

“আমার সেটা মনে হয় না। কত ভালো ভালো ছেলে দেখছে পাত্তাই দেয়নাই।”

“তাহলে তো ১০০% নিশ্চিত থাক। যারা বেশি বাছে তাদের কপালে পছন্দের বিপরীত জুটে।”

“তুই খুব নেতিবাচক। মানুষ জীবনসঙ্গী রুচি অনুযায়ী খু্ঁজতেই পারে। এটাকে খারাপ ভাবিস কেন? সারাজীবন যার সঙ্গে জীবন কাটাবে তাকে যদি পছন্দই না হয় চলে?”

“আমি বলছি না বাছাই করা খারাপ। তবে অতিরিক্ত করলে শেষটা ভালো হয় না। যাই হোক সেতিরে নিয়ে ঝগড়া করতে চাইছি না। চল ক্যাফেতে যাই, গরমে জান যাচ্ছেগা আমার।”

“হ্যাঁ আমি পাগল তো তোর সাথে ক্যাফেতে যাবো আর তুই সামিয়ার বিলটাও আমার কাধে তুলে দিবি….. বলেই পাপিয়া জিভ কাটলো।

রিজভীর হাসিমুখ মুহূর্তেই বদলে গেল, দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “সামিয়া!”

পাপিয়া প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললো, “তোর ইউকে যাওয়া কনফার্ম হলো?”

“মোটামুটি কনফার্ম। বাবা ভেজাল না করলে এ বছরই হয়তো চলে যাবো ইনশাআল্লাহ!”

“তোরা সবাই চলে যা, ঢাকায় আমার আর কেউ থাকিস না।”

“তোর হাবিগুষ্টি সব ঢাকাতেই আছে। এমন ভং ধরিস যেন একা পড়ে থাকবি!”

“ফ্রেন্ড তো হাতে গণা কয়েকজন ই। তার মধ্যে বেস্ট দুজন ই চলে যাচ্ছিস!”

“ধুরর পাগলী রুলায়েগা কেয়া?”

“নাহ তুই থাকতে থাকতেই বিয়ে করে ফেলতে হবে। নয়তো সত্যিই আমি একা থেকে থেকে বেঁকা হয়ে যাবো।”

“করে ফেল। সামনে বর্ষা আসছে। এসময় বিয়ে করা আরাম!”

“তুই হালা বাক্কা শেয়ানা। সব ঋতুতেই বেনিফিট খুঁজে পাস। গরমে ভালো, বর্ষায় ভালো, শীতে ভালো। সবটাতেই তোর ভালো লাগে!”

“যা সত্যি তাই তো বলি। বিয়ে সব ঋতুতেই জোশ। আমার কি দোষ?”

“হ তোর জন্য! তুই ও করে ফেল। ”

“আমি আর বিয়ে করবো না রে। চিরকুমার থেকে যাবো।”

“ধুরর, ভুল মানুষের জন্য এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া বোকামী। এসব অহেতুক চিন্তা মাথায় আনিস না।”

রিজভী ম্লান হাসলো, জবাব দিলো না।

রোকেয়া বিছানায় এমন জোরে ঝাট দিচ্ছে যেন এই বিছানার তোশকের সাথে তার জন্মের শত্রুতা। জহির সাহেব পেপার এর ফাঁক দিয়ে স্ত্রীর মতিগতি বোঝার চেষ্টা করছেন। এখন উঠে দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও সমস্যা, তাই চুপচাপ পেপার পড়ার ভান করেই বসে রইলো। রোকেয়া নিজেই তার সামনে এসে বললেন, “তোমার কাছে পেপার পড়াই সবচেয়ে জরুরি তাই না? বড় ভাইজানকে দেখেছ? কয়দিনের জন্য দেশে ফিরেন, তাও বড় ভাবিকে নিয়ে কত জায়গায় যায়। শপিং করে আনন্দ করে। উনি এমনিতে সবার সামনে খিটখিট করলেও বৌকে ঠিকই ভালোবাসে। ছোট ভাই ও তার বৌকে কত কি কিনে দেয়, প্রতি মাসে ২/৩ বার বাচ্চাদের‌ নিয়ে কতখানে যায়। আর তুমি একই ছাদের নীচে থেকেও একটা দিন আমায় বেড়াতে নিলে না। কিছু বললে বলো বুড়ো হয়ে গেছি। ওদের দেখো একজন তোমার বড় আরেকজন তোমার ছোট। দুই ক্যাটাগরিই দেখিয়ে গেল শখ আহ্লাদের বয়স থাকে না…”

জহির সাহেব কি উত্তর দিবেন বুঝতে পারলেন না। মাথা নাড়িয়ে বললেন, “তোমার কথা একদম ২৪ ক্যারেট খাঁটি। এখানে কোনো খাঁদ নেই। আমিই মিডেলে হয়ে ভেজালে পড়েছি। না বড় ভাই হতে পারলাম না ছোট।”

“সেন্টিমেন্টার এট্যাক করতে এসোনা খবরদার। আমি বলেই তোমার সংসার করছি, অন্য কোনো…..”

“অন্য কোনো মেয়ে হলে কবেই চলে যেত। তোমার এসব গোয়ার্তুমি সহ্য করে এতো বছর সংসার করতো না। আমারই পোড়া কপাল। কত ভালো ভালো সমন্ধ এসেছিল। সেসব বাদ দিয়ে কেন যে তোমাকে দেখে মাত্রই পছন্দ করতে গেলাম। সবই নিয়তি। কথায় বলে না “হায়রে কপাল মন্দ চোখ থাকিতে অন্ধ!” চোখের কথা শোনাই কাল হলো।”

“আমাকে শেষ করতে না দিয়ে তুমি এসব বললে কেন?”

” দেখো তুমি এমনিতেই এতক্ষণ বিছানা ঝেড়ে হয়রান হয়ে গেছ। এখন আবার চেচিয়ে এতো কথা বলতে কষ্ট হবে ভেবে আমিই বলে দিলাম। যত যাই হোক তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী না? তোমার কষ্ট কমানো আমার ফরজ না?”

“মন ভোলানো কথাতেই আছ।”

” ঐটাই যে সম্পদ জনাবা। নয়তো এতো সুন্দরী রমণীকে ঘরনী করে রাখার সাধ্য আমার মতো অধমের ছিল?”

রোকেয়ার রাগ যে পড়ে গেছে তার চেহারা দেখেই বোঝা গেল। তবুও শক্ত গলায় বললো, অতো কথা জানিনা, “আজ আমায় নিয়ে বের না হলে খবর আছে।”

“যথা আজ্ঞা মহারানী”

চলবে,,,,

#কাঁটাকম্পাস #পর্ব২৯

#আরশিয়া_জান্নাত

২৯

ক্লাস শেষে আরওয়া রুমাইসার সাথে গল্প করতে করতে গেইটে এসে দেখে জাওয়াদ গাড়ির সামনে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার পড়নে সি গ্রিণ কালার ফর্মাল শার্ট বরাবরের মতো ইন করা, চুলগুলো বেশ সুন্দর করে গোছানো, রোমশ হাতে এশ কালার ওয়াচটা স্বগর্ভে বসে আছে‌। চোখে সানগ্লাস থাকায় দৃষ্টি বোঝা গেল না। আরওয়া দূর থেকে তাকে দেখে মুগ্ধ হলো। মনে মনে বলল, “আল্লাহুম্মা বারিকলাহু। মাশাআল্লাহ আমার বরটা দেখতে এতো দারুণ! কোনো ডাইনির বদনজর না লাগুক।”

রুমাইসা ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে বলল, “ভাই তুই এমনভাবে তোর জামাইয়ের দিকে তাকাই আছস যেন আজকে প্রথম দেখলি! ”

“দোস্ত তুই বিয়ে করলে বুঝবি, জামাইয়ের দিকে তাকাই থাকতেও শান্তি।”

“আমি তোরেই এমন দেখছি। আচ্ছা তুই যা, আমি লাইব্রেরিতে যাবো। আল্লাহ হাফিজ।”

“আল্লাহ হাফিজ”

আরওয়া জাওয়াদের দিকে তাকিয়েই মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে গেল। আজ সকালেও তো একসঙ্গে বেরিয়েছে কই তখন তো এতো চোখে পড়েনি, নাকি এমন রৌদ্রজ্জ্বল দিনে দূর থেকে দেখায় বেশি আকর্ষণীয় লাগছে?

আরওয়ার চাহনি দেখে জাওয়াদের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো। সে এগিয়ে ওর কাছে যেতেই আরওয়া কিসব বিড়বিড় করে ওর গায়ে ফুঁ দিয়ে বললো, ‘আমার সাথে থাকা ক্বারিন জ্বিনের ও নজর না লাগুক।”

“আই নো আমি দেখতে অনেক হ্যান্ডসাম, তাই বলে এমন চোখ দিয়ে স্ক্যান করবে! লজ্জা নেই মেয়ে?”

” অন্য কাউকে না নিজের একান্ত ব্যক্তিগত পুরুষকে দেখছি; লজ্জার কি আছে?”

“কথায় তোমায় হারাতে পারবো না। গাড়িতে উঠো।”

গাড়ির দরজা খুলে আরওয়াকে বসালো। তারপর নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে বলল, “লাঞ্চ করেছিলে ঠিকমতো?”

“হুম। আপনি?”

“হ্যাঁ”

আরওয়া রাস্তার দিকে তাকিয়ে বললো,”কোথায় যাচ্ছি?”

“যাচ্ছি যেকোনো একটা জায়গায়..”

“বেড়াতে নিচ্ছেন? সিরিয়াসলি?”

“এমনভাবে বলছো যেন আমি কখনো বেড়াতে নিই না?”

“না তা নয়, তবে সচরাচর নেন না তো তাই প্রতিবারই প্রথমবারের মতো এক্সাইটমেন্ট কাজ করে।”

“আচ্ছা!”

মেইন শহর পেরিয়ে অনেকটা দূরেই গাড়ি চলছে। আরওয়া বহুক্ষণ জেগে থাকলেও একটা সময় সিটে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। জাওয়াদ ওর ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে মুচকি হাসলো। কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছানোর পর মৃদুস্বরে আরওয়াকে ডেকে তুলতেই আরওয়া বললো, “আমরা এখন কোথায়?”

বেরিয়ে এসো। দেখো কোথায় এসেছি।

আরওয়া বের হয়ে দেখলো চারদিকে সবুজ সমারোহ। আরওয়ার চোখ জুড়িয়ে গেল এমন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অবলোকন করে। জাওয়াদ গাড়ির চাবিটা গার্ডকে দিয়ে আরওয়ার হাত ধরে ভেতরে প্রবেশ করলো। বাহারি গাছপালায় ঘেরা সাদা রঙের একতলা একটা বাড়ি। বাড়িতে প্রবেশ করার আগে ঘাট বাঁধানো বিশাল দিঘী। আরওয়া চারদিক দেখে দেখে এগোতে লাগলো। বাড়ির ভেতর থেকে একজন মধ্যবয়স্কা নারী বেরিয়ে এসে বললেন, “বাবা তুই আসছোস? পথে কোনো অসুবিধা হয় নি তো?”

“আস্সালামু আলাইকুম ফুফু। কেমন আছেন?”

“ওয়ালাইকুমুস্সালাম। ভালো আছি বাবা। এটা তোর বউ? মাশাআল্লাহ অনেক সুন্দর।”

আরওয়া তাকে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময় করল। তিনি তাদের ভেতরে নিয়ে বললেন, “তোমরা হাতমুখ ধুয়ে নাও। আমি তোমাদের নাস্তাপানির আয়োজন করি।”

আরওয়া কৌতুহলীগলায় বলল, “উনি কে? আর আমরা এখানে এসেছি কেন?”

“উনি ফাতেমা ফুফু। দাদাসাহেবের ভাতিজী। উনার ছেলেমেয়ে সবাই বলতে গেলে ফরেনে থাকে। উনি একাই এখানে থাকেন। যদিও অনেকবার বলা হয়েছিল উনার বড় মেয়ের ওখানে থাকতে কিন্তু ফুফু এই বাড়ির মায়া ছাড়তে পারেন না। তাই আমরা সুযোগ পেলেই উনাকে এসে দেখে যাই।”

“ওহ আচ্ছা। অবশ্য যে সুন্দর জায়গা আমি হলে আমিও কোথাও যেতাম না।”

“তাই?”

“হুম”

“আচ্ছা তুমি ফ্রেশ হয়ে নাও আমি একটু আসছি।”

“কোথায় যাচ্ছেন?”

“দেখে আসতে সব ঠিকঠাক আছে কি না।”

“আচ্ছা”

জাওয়াদ চলে যাওয়ার পর আরওয়া হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে নিলো। ফাতেমা বাহারি পদের নাস্তা টেবিলে সাজিয়ে বললেন, “বৌ এদিকে আসো।”

“ইয়া আল্লাহ! ফুপী আপনি এতো আয়োজন করতে গেলেন কেন?”

“শোনো মেয়ের কথা! বেশি কিছু আর করতে পারলাম কই। শরীরে যখন বল ছিল আরো কত কি করতাম। এখন তো আগের মতো কিছুই করতে পারিনা, মলি,পলি সাহায্য করায় যা একটু করেছি। কই রে তোরা এদিকে আয়। দেখে যা তোদের ভাবিকে।”

দুটো কিশোরী মেয়ে লাজুক ভঙ্গিতে আরওয়ার সামনে এসে দাঁড়ালো। ফাতেমা বললেন,” বুঝলে বৌ এই বুড়ো বয়সে ওরাই আমার লাঠি। দুটো বোন মিলে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে রাখে। তোমাকে দেখে লজ্জা পাচ্ছে বলে চুপ করে আছে। একটু থাকলে বুঝবে কি করে ওরা।”

আরওয়া ওদের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে কুশল বিনিময় করলো। জাওয়াদ এসে বলল, ” ফুফু তুমি আমাদের জানালে না কেন উত্তর পাশের দেয়ালটায় মেরামত করানো লাগবে? আর এখানে চোর এসেছিল সেটাও তো বলোনি? আমি এখানে সিসি ক্যামেরা সেট করানোর ব্যবস্থা করছি। সিকিউরিটি তে আরো দুজন লোক রাখছি।”

“তুই অযথাই এতো উত্তেজিত হচ্ছিস। আমার পরে এখানে আর কেউ এসে থাকবেনা। এতো কিছু ঠিক করে লাভ কি?”

“এটা কেমন কথা! তুমি তো আছ, তোমার নিরাপত্তা নিয়ে ভাববো না?”

“ওসব রাখ, দেখি খেতে বস।”

জাওয়াদ চেয়ারে বসে বলল, “কি রে তোরা আজ এত চুপচাপ? ওকে দেখে ভদ্র হয়ে গেলি? আরেহ ও তোদেরই দলের লোক।”

পলি বলল– “ভাইয়া নতুন ভাবির সামনে এমন বলিও না।”

“আচ্ছা যা কিছু বলছি না। শুধু এবার বাদড়ামী না করলেই হলো। আয় তোরাও বস। ফুফু বসো না”

সবাই একসঙ্গে খেতে খেতে গল্প করতে লাগলো।

কুহু লাইব্রেরী থেকে বের হয়ে বাসার দিকে যাচ্ছিল। রোডসাইডের ফুডকার্টে নজর যেতেই দেখে সেদিনের ঐ লোকটা গরম গরম লুচি আর চিকেন চাপ খাচ্ছে। কুহু হাত নাড়িয়ে খানিকটা জোরেই বলল, “হেই ভল্লা!”

লোকটা ফিরেও তাকালো না অন্যদের সঙ্গে গল্প করতে করতে খেতে লাগল। কুহু সামনে এসে বলল, “কি ব্যাপার ভল্লা সাহেব কতবার ডাকছি রেসপন্স করছেন না কেন?”

সে ভ্রু উঁচিয়ে বললো,”স্যরি? আপনাকে ঠিক চিনলাম না?”

“আরেহ ঐ যে ঐদিন রেস্টুরেন্টে দেখা হয়েছিল, আপনি বিগ সাইজের বার্গার খাচ্ছিলেন মনে নেই?”

“কি জানি ভাই, আমি তো কতখানেই খেতে যাই। কয়টা মনে রাখবো।”

“আচ্ছা মনে না রাখেন আপনিই বলুন আপনার সঙ্গে আলাপ না হলে কি আমি আপনার নাম জানতাম?”

তার পাশে থাকা একটা ছেলে বললো, “কি নাম বললেন শুনি?”

“কেন ভল্লা!”

“ভল্লা?”

বলেই সবাই হেহে করে হেসে উঠলো। “এটা আবার কেমন নাম?”

“কেন উনিই তো বললেন অবশ্য আমারও মনে হয়েছিল এটা কেমন নাম! পরে ভাবলাম বাবা মায়ের ইচ্ছের তো অভাব নেই। শখ করে কত আজগুবি নাম ই না তারা রাখেন। যেমন আমারটাই দেখেন কোকিল ডাকা দিনে হয়েছি বলে আমার নাম রেখে দিলো কুহু। আবার আমাদের এক স্যারের নাম ফকির, এক ম্যামের নাম পেয়ারা! এরকমই হয়তো উনাকে ছোটবেলায় ভল্লা কামড়েছে তাই উনার নাম ভল্লা।”

তার কথা শুনে উপস্থিত সবাই বেশ মজা পেলো। কিন্তু ভল্লা ছদ্মনামের লোকটার বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।

একটা মেয়ে কোনোমতে হাসি চেপে বলল, ” তোমার লজিক বুঝলাম আপু। কিন্তু ওর নাম ভল্লা না। ওর নাম হলো ইশরাক। তুমি ওকে এই ফানি নামে আর ডেকো না।”

“নাইস নেইম! থ্যাঙ্কস আপু। আপনারা কি আশেপাশে কোথাও জব করেন নাকি?”

“হ্যাঁ এই যে সামনের বিল্ডিংটা দেখছো ওখানেই আমরা জব করি। ব্রেকে এসেছি নাস্তা খেতে। তুমিও জয়েন করো?”

“না আপু ঠিক আছে।”

কুহু ইশরাক থেকে এমন বলাটা আশা করছিল কিন্তু সে তাকে নিরাশ করলো। কুহু বলল, ” এটা কি খেতে খুব মজা? আমি এতো কথা বললাম আপনার মনোযোগই সরলো না?”

ইশরাক বলল, “অচেনা কারো সঙ্গে কথা বলার চেয়ে তেল মশলার কম্বিনেশন পারফেক্ট হলো কি না তা যাচাই করা বেশি ভালো।”

“আপনি ফুড ব্লগ করেন নাকি? চ্যানেলের নাম কি?”

“আমি ফুড লাভার ফুড ব্লগার নই।”

“ভেরি ইন্টারেস্টিং। মামা আমাকেও সেইম প্ল্যাটার দিন তো। আমিও খেয়ে দেখি কেমন মজা।”

অন্যরা একে অপরের দিকে চোখের ইশারায় হাসতে লাগলো।

“এই শোনো”

“হুম বলো?”

“তুমি আজান দিতে পারো?”

“কেন?”

“বলো‌না। আজান পুরো টা মুখস্ত আছে?”

“হুম পারি তো।”

“শোনাও তো…”

নাহিয়ান কাজ রেখে সাবার দিকে ফিরে বলল,” হঠাৎ আজান এর কথা আসছে কেন কি হয়েছে?”

“আমি একটা পাকিস্তানি ড্রামায় দেখেছি ওদের যখন বেবি হলো নায়ক তার বাচ্চার কানের কাছে আজান দিচ্ছিল। দৃশ্যটা এতো সুন্দর আর মনোরম। আমার চোখে পানি চলে এসেছে। এই শোনো আমাদের যখন বাবু হবে তুমি ওকে কোলে তুলে প্রথমেই ওর কানের কাছে আজান দিবে কেমন?”

নাহিয়ান ওর দিকে স্নেহার্দ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,”এটা তোয়ার বলে দিতে হবে পাখি? আমি অবশ্যই সেটা করবো।”

সাবা উঠে ওর কোলে বসে গলা জড়িয়ে বলল, “আমাদের কবে বাচ্চা হবে নাহিয়ান? কবে আমরা ছোট্ট ঐটুকুন পুতুলকে বুকে নিবো? আদরে আহ্লাদে প্রাণ জুড়াবো? আল্লাহকে বলো না তাড়াতাড়ি আমার কোল যেন আলো করে দেয়…..”

সাবার চোখ দিয়ে নিরবেই পানি ঝরতে থাকে। নাহিয়ান ওকে বুকে চেপে বলে,” এতো অধৈর্য হয়োনা। আল্লাহ নিশ্চয়ই তোমাকে সন্তানের জননী করবে। ইনশাআল্লাহ!”

চলবে

কাঁটাকম্পাস পর্ব-২৬+২৭

0

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব২৬

#আরশিয়া_জান্নাত

সাবা সবার জন্য বিকালের নাস্তা বানাচ্ছে, তাকে আরওয়া ও রাহেলা সাহায্য করছে। নাহিয়ানের আজ নাইট শিফটে ডিউটি। তাই সে এখন বাসায় নিজের রুমে বসে টুকটাক স্টাডি করছে। সাবা মূলত তার আবদার রাখতেই এই সময়ে রান্নাঘরে ঢুকেছে।

সালমা বাইরের ঘরে বসে আপনমনে যিকির করছেন। এমন সময় কোহিনুর বললেন, “আম্মা আপনার সঙ্গে একটা জরুরী কথা বলার ছিল।”

“কি কথা বড় বৌ?”

“আম্মা এখানে না, আপনার ঘরে চলেন।”

সালমা উঠে নিজের ঘরের দিকে গেলেন। কোহিনুর দরজা আটকে ধীর গলায় বলল, “আম্মা আপনার বড় ছেলে কি শুরু করেছে জানেন?”

“না বললে জানবো কিভাবে? কি করছে?”

“উনি নাহিয়ানের জন্য মেয়ে দেখছেন। লোকও ঠিক করেছেন পাত্রী দেখতে….”

“এটা কি কথা! ওর বউ থাকতে আবার বিয়ে কেন?”

“ওদের বাচ্চা হচ্ছেনা বলে উনি এসব পাগলামী শুরু করেছেন। আম্মা আপনিই বলেন নাহিয়ান যদি এসব শুনে ও কি শান্ত থাকবে? আমার তো কিছুই মাথায় ঢুকছেনা আমি কি করবো?”

সালমা বিরক্তস্বরে বললেন, “মেয়ের বিয়ের চিন্তা বাদ দিয়ে বিবাহিত ছেলেরে আবার বিয়ে করানোর ফন্দি আটতেছে। ওদের বিয়ে হইছে কয় বছর হইছে! মানুষের বিয়ের ১০/১৫ বছর পর ও বাচ্চা হয়। আল্লাহ চাইলে ৮০ বছরেও ছেলের বাপ হওয়া যায়। আমাদের নবী ইব্রাহীম (আ), যাকারিয়া (আ) শেষ বয়সে ছেলের বাবা হয় নাই? এত অধের্য হবার কি আছে?”

কোহিনুর মাথা নেড়ে শাশুড়ির কথায় সম্মতি জানালেন। সালমা বললেন, “আমার ছেলে বিদেশ থাকতে থাকতে মন পাথর হয়ে গেছে। তুমি এ নিয়ে চিন্তা করো না। আমি ওরে বুঝাই বলবো ঘরে অযথা অশান্তি করার কোনো দরকার নাই।”

“কিন্তু আম্মা উনি যদি না শুনতে চায়?”

“ও শুনবে না ওর ঘাড় শুনবে।”

নাহিয়ান ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বসার ঘরে গেল।সাবাকে না দেখে বুঝলো মহারাণী এখনো কিচেনেই আছেন।

“বলি আর কত ক্ষণ লাগবে আপনার? এতো সময় তো বিয়ে বাড়ির বাবুর্চির ও লাগেনা…”

“এই তো হয়ে গেছে আর একটু…”

নাহিয়ান বসার ঘরে বসে টিভি অন করলো। কুহু আর পাপিয়া গল্প করতে করতে সেখানে উপস্থিত হতেই নাহিয়ান বলল, “কি রে গাট্টবাট্টু কি খবর তোদের?”

কুহু বললো, “ভাইয়া গাট্টুবাট্টু ছেলেদের নাম। আমরা ছেলে না!”

“উপমাগত তো মিল আছে ওতেই চলবে।”

পাপিয়া বলল, “ভাইয়া তোমাদের হসপিটালে আমার একটা ফ্রেন্ড যাবে। ওকে একটু দেখিও তো।”

“দেখলাম সমস্যা কি! শুধু ভিজিট ঠিকঠাক দিলেই চলবে।”

কুহু– “ছোটবেলায় তো ঠিকই কম্পোজিশন লিখতি ফ্রিতে চিকিৎসা করবি। বড় হয়ে ভিজিট নিয়ে চিন্তা করিস কেন?”

নাহিয়ান–“ছোটবেলায় আমরা কত কথাই বলি। সব কি পালন করি?”

পাপিয়া– “ভাইরে ভাই তুই এতো হিসাবি? এমনভাবে বলছিস যেন ও তোকে ভিজিট না দিয়ে ফ্রিতে চেকাপ করাতে যাবে। যা আমি ওকে বলে দিবো যেন এক টাকাও কম না দেয়।”

নাহিয়ান– ” এই তো এবার গিয়ে বোনের মতো কথা বললি। দেখ ভাই আমি গরীব সরিব মানুষ, রুগি দেখে যে ক’টা টাকা পাই তা দিয়েই তো কোনোরকম সংসার চালাই। আমার সাধ থাকলেও সাধ্য নাই।”

কুহু— “হইছে আর গলা শুকাইস না ভাই। দিনদিন হাড়কিপ্টে হয়ে যাচ্ছিস!”

সাবা ট্রে হাতে প্রবেশ করে বললো, “কে হাড়কিপ্টে হয়ে গেছে?”

কুহু–“কে আবার আমাদের ডাক্তার সাহেব।”

নাহিয়ান–” দেখেছ বউ আমাকে একা পেয়ে তোমার এই জংলি ননদ দু’টো কিসব অপবাদ দিচ্ছে?”

কুহু–“জানো ভাবি তোমার বর এতো হিসাবী হয়েছে রুগি দেখার আগে ভিজিটের চিন্তা করে।”

সাবা– “কি আর করবে তেমন রুগী আসেনা তো তার চেম্বারে। ভাগ্যক্রমে যে কয়টা আসে তাদের থেকে বেশি করে আদায় করতে চায়।”

নাহিয়ান মুখ ভোতা করে বললো, “এটা কি হলো? তুমি আমার পক্ষ না নিয়ে উল্টো ওদের সাথে দল পাকালে? এই দিন দেখার জন্য আমি তোমাকে এত ভালোবেসেছি? এ ধরণী দ্বিধা হও আমি ঢুকে যাই…..”

কুহু আর পাপিয়া হেহে করে হাসতে লাগলো। সাবা বললো, “তুমি নাট্যকলায় ভর্তি হলে আরো বেশি ভালো হতো। এতো অভিনয় পারো। দেখি নাও খেয়ে দেখো সব ঠিকঠাক হয়েছে কিনা।”

” নাহ এতো অপমান শেষে আমার গলা দিয়ে আর খাবার নামবে না। তোমরাই খাও।”

সাবা ওর সামনে নাস্তার প্লেট ধরে দাঁড়ালো। নাহিয়ান ভয়ে ভয়ে প্লেটটা হাতে নিয়ে বললো, “আমি নেহাতই অবলা প্রাণি বলে তোমরা সবাই আমায় চেপে বসো। এ ঠিক না; এ ঘোরতর অন্যায়।”

কুহু– “বল যে ভাবির রান্না খাওয়া মিস করতে চাস না। অথচ ভান করছিস বাধ্য হয়ে নিলি।”

নাহিয়ান ওর ঝুটি টেনে বলল, ” তুই বেশি পেকে গেছিস। তোরে যে কেন এখনো বিদায় করতে পারলাম না!!”

“ভাইয়া তুই সবসময় এমন করিস। জানিস ঝুটি টান দিলে পুরো চুলটাই এলোমেলো হয়ে যায়?”

“আমি জানবো কিভাবে আমি কি ঝুটি বাধি নাকি? ডাস্টবিন থেকে কুড়িয়ে আনা মেয়ের কত ঢং; দেখো!”

“তোকে ডাস্টবিন থেকে এনেছে আমাকে না।”

“আমি আগে হয়েছি তুই না। আমার এখনো মনে আছে তোকে যখন এনেছিল তোর গা থেকে ময়লার গন্ধ আসছিল। কতদিন আমি তোকে কোলে তুলিনি গন্ধের কারণে। আমার তো মনে হয় এখনো তোর থেকে সেই স্মেলটা বেরোয়…”

দাদাসাহেব সেখানে আসার আগ অবদি তাদের এই ঝগড়া চলতে থাকলো।

আরওয়া জাওয়াদের জন্য খাবার নিয়ে নিজেদের রুমে ঢুকে দেখে জাওয়াদ ফ্লোরে শুয়ে আছে। ওকে এমন অবস্থায় দেখে সে দ্রুত ওর কাছে গিয়ে বললো, ‘এই আপনার কি হয়েছে মেঝেতে শুয়ে আছেন কেন? আপনি ঠিক আছেন?”

জাওয়াদ ওকে টেনে বুকের মাঝে নিয়ে বললো, “এতোক্ষণ কোথায় ছিলে? তোমার বরটা যে ঘরে একা বসে আছে মাথায় নেই?”

আরওয়া উঠার চেষ্টা করে বললো, “আপনি তো কাজ করছিলেন, ল্যাপটপে ঢুকলে আপনার হুশ থাকে?”

“এই মেয়ে এতো নড়চড় করছো কেন? চুপটি করে শুয়ে থাকো তো।”

“আপনি বিছানায় না শুয়ে নীচে শুয়ে আছেন কেন তা বলুন আগে?”

“আমার এলোন লাগলে আমি ফ্লোরে শুয়ে থাকি। এটা আমার ছোটবেলার অভ্যাস!”

আরওয়া ভ্রু কুঁচকে বললো, “এ কেমন অদ্ভুত অভ্যাস! আর একা লাগছিল কেন? আমরা সবাই তো আছিই?”

জাওয়াদ দু’হাত প্রসারিত করে বললো, “একা মানেই একলা বসে থাকা বোঝায় না। কোলাহলে মানুষ আরো বেশি একা হয়। সেটা তুমি বুঝবেনা।”

আরওয়া উঠে হাঁটু উঁচু করে বসলো, হাঁটুতে চিবুক রেখে বললো, “এখানে অন্যদের চেয়ে আপনি একটু আলাদা।”

জাওয়াদ উঠে আরওয়ার গা ঘেঁষে বসে বলল, “তোমার কাকে পছন্দ? অন্যদের নাকি আমাকে?”

আরওয়া হেসে বললো, “বিপরীত চার্জে আকর্ষণ বেশি থাকে। আমি যেহেতু ওদের মতোই তাই আমার আপনাকে অধিক পছন্দ;”

জাওয়াদ ওর কথা শুনে মুচকি হাসলো।

“আরওয়া জানো?”

“হুম?”

“হয়তো আমি ক্রমান্বয়ে তোমার প্রেমে পড়ছি…”

“আহারে! আপনার প্রেমিকার কি হবে তাহলে?”

“সেটাই তো ভাবছি! আমায় খু*ন না করে
ফেলে!!”

আরওয়া ওর কাধে মাথা এলিয়ে হাসতে লাগলো। জাওয়াদ বললো, “আমার মাঝেমাঝে কি মনে হয় জানো?”

“কি মনে হয়?”

“তোমার মাথার স্ক্রুটা আর খুঁজে পাবোনা।”

“সমস্যা নেই আপনার থেকে দু’টো ধার নিয়ে লাগিয়ে নিবো।”

“তাহলে আমার কি হবে?”

“বোকা হয়ে যাবেন। শুনেন নি প্রেমে পড়লে বুদ্ধিমান রা বোকা আর বোকারা বুদ্ধিমান হয়ে যায়! আপনার সেই দশা হবে আর কি। হেহেহে”

জাওয়াদ নিজের মাথা চুলকে বললো, ” তবে কি আমি সত্যিই বোকা হয়ে যাচ্ছি?!”

চলবে,,,

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব২৭

#আরশিয়া_জান্নাত

২৭

কুহু বই পড়া বাদ দিয়ে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো। শরৎচন্দ্রের “গৃহদাহ” উপন্যাসটা অর্ধেক পড়ে মাথাটা টগবগ করছে। সে এখন বাইরে না গেলে কিছুতেই হবে না। পার্স আর ফোন হাতে নিয়ে সে ঐ অবস্থাতেই বেরিয়ে পড়লো। সময় তখন রাত প্রায় সাড়ে আটটা। ঢাকা শহরে এটা তেমন রাত না বললেই চলে। কুহু গাড়ি থেকে নেমে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকলো। পছন্দসই খাবার অর্ডার করে টোকেন নিয়ে একদম মাঝখানের টেবিলটায় গিয়ে বসলো। মাঝখানে বসা যদিও ওর পছন্দ না। তবে এই মুহূর্তে অধিক কোলাহোল ই পারবে ওর মনোযোগ বিচ্যুত করতে। চারদিকে সবাই যার যার মতো গল্প করে যাচ্ছে, কুহু সেসব গল্পের অংশবিশেষ ভালোই মন দিয়ে শুনছে। হঠাৎ একটু দূরে একজনকে দেখে তার চোখ আটকে যায়। সে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সেই মানুষটার দিকে। মাঝারি গড়নের হেলদি একটা ছেলে। বেশ তৃপ্তির সাথে বিগ বাইট দিয়ে ফাইভ লেয়ারের বার্গার খাচ্ছে। কেউ খাওয়ার সময় তাকিয়ে থাকা ঠিক না কিন্তু কুহুর দৃশ্যটা দেখতে দারুণ লাগছে। তার ফুড রেডি হতেই সে কাউন্টার থেকে খাবার নিয়ে নিজের সিটে না বসে ঐ ছেলের সামনে গিয়ে বলল, “ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড আমি কি এখানে বসতে পারি?”

ছেলেটা মুখের খাবার শেষ করে বললো,”স্যরি? এখানে তো আরো অনেক সিট খালি আছে।আপনার এখানে বসতে হবে কেন?

কুহু অনুরোধের স্বরে বলল, “প্লিজ মানা করবেন না। আমি ভেবেছিলাম একা একা ফুড ইনজয় করবো। কিন্তু এখানে সবাইকে ফ্রেন্ডস ফ্যামিলির সঙ্গে দেখে নিজেকে অরফান লাগছে। আপনিই একমাত্র একা আছেন তাই ভাবলাম এখানেই বসি!”

বলেই সে উত্তরের আশা না করেই বসে গেল অপজিট চেয়ারে।

ছেলেটা একটু ভড়কে গেলই যেন। মনে মনে বিরক্ত ও হলো বোধহয়। কুহু ফিশ ফিঙ্গার খেতে খেতে বললো, “আপনি থেমে গেলেন কেন? খাওয়া শুরু করুন। বাই দ্য ওয়ে আমি রোদেলা আপনি?”

“ভল্লা।”

“ভল্লা?”

“হ্যাঁ। কেন নামটা সুন্দর না?”

“এই নামটা এই প্রথম শুনেছি তো তাই আর কি! আচ্ছা আপনি কি ডিস্টার্ব ফীল করছেন? এমন নাকমুখ কুঁচকে আছেন যে!”

“নাহ তেমন নয়। এমন এক্সপেরিয়েন্স আগে হয় নি তো তাই হয়তো এমন দেখাচ্ছে।”

বলেই সে হাতের ইশারায় ওয়েটার কে ডেকে বললো বাকিটা প্যাক করে দিতে। কুহু বুঝতে পারলো সে তার উপস্থিতি পছন্দ করেনি। হয়তো সে আয়েশ করে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে প্রতিটা কণা উপভোগ করতে চাচ্ছিল। কুহু উড়ে এসে বাগড়া দিয়েছে। কুহু ওয়েটার কে বলল, “ভাইয়া প্যাক করতে হবে না। আপনি যেতে পারেন।” তারপর সামনে তাকিয়ে বললো,” স্যরি ফর ডিস্টার্বিং। ইনজয় ইউর ফুড।”

বলেই উঠে চলে গেল। ভল্লা নামক লোকটা সেটা বিশেষ গায়ে মাখলো না। বরং খুশিমনেই খাওয়ায় মনোনিবেশ করলো। কুহু দূরের টেবিলে বসে ব্যাক ক্যামেরায় সেটা ভিডিও করতে লাগলো। ফোনের দিকে তাকিয়ে হেসে নিজের খাবার খেতে লাগলো। “খাওয়ার সময় কাউকে দেখতে এতো কিউট লাগে! ওয়েএএ ইচ্ছে তো করছে ফুলকো লুচির মতো গাল দুটো টেনে দিতে…..”

আরওয়া ভার্সিটির জন্য তৈরি হয়ে বইপত্র গুছিয়ে নিচ্ছিল তখন জাওয়াদ ওর সামনে দাঁড়িয়ে বললো,” এই টাইটা বেঁধে দাও তো।”

আরওয়া ত্যাড়া গলায় বললো, “কে যেন বলেছিল “আমার কাজ আমি নিজে করতে পছন্দ করি।” ??”

“সবকিছু মুখস্ত করে রেখেছ নাকি?”

“অফকোর্স! এতো সহজে ভুলবো নাকি? আমার জীবনের প্রথম বাসর বরবাদ করেছেন, প্রথম চুমু বরবাদ করেছেন। আপনার কথা ভোলা এতো সোজা?”

জাওয়াদ ওকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো, ” মাথা ভর্তি আমায় নিয়ে ঘুরলে পড়া রাখবে কোথায়?”

“পড়া পড়ার জায়গায় স্বামী স্বামীর জায়গায়। মেয়েদের স্মৃতিশক্তি এসব ক্ষেত্রে খুব প্রখর হয় বুঝলেন? সো বি কেয়ারফুল!”

জাওয়াদ আলতো হাতে ওর চুল সরিয়ে কাধে নাক ঘষে আদুরে গলায় বললো, “সকাল সকাল মেজাজ এতো গরম হয়ে আছে কেন? আমি কি কিছু করেছি?”

আরওয়ার রাগ নিভে আসতে চাইলেও সে নাক ফুলিয়ে বললো, ” আমি আপনাকে ভুল নাম দিয়েছিলাম। আপনি রোবট না। রোবট রা সব মনে রাখে।”

জাওয়াদ মাথা চুলকে বললো,”আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। খুলে বলবা তো কি হয়েছে? না বললে বুঝবো কি ভাবে?”

“নতুন করে আর কি হবে। যা দূর্ঘটনা হবার তা তো ৬ মাস আগেই হয়েছে। আমিই বলদি, এক্সপেক্টেশন রেখে বসে আছি।”

বলেই হনহন করে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।জাওয়াদ বোকার মতো চেয়ে রইলো, ঘটনা কি হলো। একটু টাই বাধতে বলায় এতো কথা শুনিয়ে দিলো মেয়েটা!

গাড়িতে বসেও আরওয়া কোনো কথা বললো না। জাওয়াদ এটা সেটা জিজ্ঞাসা করলেও বিশেষ উত্তর দিলো না। অফিসে বসে জাওয়াদ ভাবতে লাগলো কাল সে কি কি করেছে, কোন আচারণে আরওয়া এমন রেগে আছে সম্ভাব্য কারণসমূহ চিহ্নিত করতে। কিন্তু না বহু ভেবেও তেমন কিছু উদ্ধার করতে পারলো না। বিরক্ত হয়ে নিজের কপাল নিজেরই চাপড়াতে ইচ্ছে করছে।

সাম্য তার অস্বাভাবিক অবস্থা পরোখ করে বলল, ” স্যার আপনি ঠিক আছেন? আপনাকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। কোনো সমস্যা?”

জাওয়াদ কপাল ঘষে বললো, “আচ্ছা সাম্য মেয়েদের সম্পর্কে তোমার আইডিয়া কেমন? আই মিন তাদের হাবভাব বুঝতে পারো?”

সাম্য ঘাড় নেড়ে বললো, “এত বছর একসঙ্গে থেকে আমার ছোটবোনের মনমেজাজ ই বুঝতে পারলাম না স্যার। অন্যদের টা আর কি বুঝবো। ওদের ফিচারটাই খুব ক্রিটিক্যাল; এক আল্লাহ ছাড়া কেউ বুঝবেনা।”

“একদম ঠিক বলেছ”

জাওয়াদ মনে মনে রিপিট করতে লাগল আরওয়া ওকে বলেছে রোবটরা সব মনে রাখে, আবার বলল সে এক্সপেক্টেশন রেখেছিল। নাহ সব ক’টা কথা আগপিছ করেও বিশেষ কিনারা করা যাচ্ছে না।

রিজভী ক্যান্টিনে বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। ওদের মধ্যে একজন টেবিল চাপড়ে গান গাইছে, আরেকজন তার সাথে গলা মেলাচ্ছে। কিছুদিন পরেই তারা মাস্টার্স শেষ করে বেরিয়ে যাবে। রিজভীর বাবা অবশ্য ঠিক করে রেখেছেন ছেলেকে তার বিজনেসে নিবেন। কিন্তু রিজভীর মাথায় অন্য প্ল্যান। সে অলরেডি কাগজপত্র ঠিকঠাক করে ফেলেছে, মাস্টার্স দিয়েই ফরেন চলে যাবে। সামিয়ার স্মৃতি ভুলতে হলে তাকে চেনা গন্ডি পেরিয়ে অনেক দূরে যেতে হবে।

পাপিয়া নোটস তুলতে তুলতে বলল, “যাক ফাইনালি তোর বিয়ের দাওয়াত মিললো। এবার খুশিমনে স্বামি সংসার নিয়ে বিজি থাকবি।”

হিয়া বলল,”আব্বু চাচ্ছিল আমি জব করি। এতোবছর খরচা করে পড়াশোনা করিয়েছে। কিছুটা হলেও ফিন্যান্সিয়াল সাপোর্ট আশা করেছিল বোধহয়।”

“জব করতে চাইলে বিয়ের পর ও তো করতে পারবি। সবসময় তো ভালো প্রপোজাল আসেনা। ”

“পারবো না রে। উনি বলেছেন জব করা উনার পছন্দ না। তাদের সংসারে কোনো কিছুর অভাব নেই। উনারা এমন মেয়ে চায় যে মন দিয়ে সংসারটা আগলে রাখবে। এমনটা সরাসরিই বলেছিল।”

“এটা খারাপ না কিন্তু। তবে তোদের পারিবারিক অবস্থা অনুযায়ী আঙ্কেলের অবর্তমানে তুইই বলতে গেলে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তোর বাকি দুই ভাইবোন তো এখনো মাধ্যমিক পেরোলো না। আঙ্কেলের এক্সপেক্টেশন কে দোষ দিতে পারি না।”

“দোষ আমিও দেই না। আমি জানি মধ্যবিত্তদের সীমাবদ্ধতা অনেক। আমার জায়গায় যদি ছেলে হতো আব্বুর মাথার উপর থেকে বোঝা কিছুটা হলেও কমতো। তিনি হয়তো ছেলে মেয়ের মাঝে তফাতটা মানতে চান নি। আশা রেখেছিলেন এখনের যুগে এসে অন্তত তার মেয়ে এমন ছেলে বিয়ে করতে চাইবেনা যে জব করা এলাউ করবেনা।”

“মন খারাপ করিস না। মানুষ ১০০% পায় না। এখানে উনাদের অন্য ডিমান্ড নেই, বিয়ের সকল খরচাও তারা বহন করছে। বলতে গেলে তোর জন্য পারফেক্ট প্রপোজাল। তুই সবসময় টেনশন করতি বিয়ের খরচা দিতে গিয়ে আঙ্কেলের না সমস্যা হোক। আল্লাহ তোর মনের আশা পূরণ করেছে। আমার দাদী বলেন রিজিক এর ব্যবস্থা আল্লাহ আগেই করে রাখেন। আমরা অযথাই টেনশন করি। দেখা গেল তোর ইনকাম বাদেও তোদের সংসার ভালোই কাটবে। তোর ভাই-বোন, মা-বাবার রিজিক অনুযায়ী বরকত আসবেই।”

“জানি না। নিজেকে কেমন স্বার্থপর লাগছে। আমাদের বাসার সবাই অবশ্য এই বিয়ে নিয়ে খুব খুশি। দেখি আল্লাহ ভাগ্যে কি রেখেছেন।”

“যা হবে ভালোই হবে। চিন্তা করিস না।”

“তোর নোট তোলা শেষ? আমাকে আবার শপিং এ যেতে হবে। উনারা আজকে বিয়ের শপিং করবেন বললো।”

“এই তো আরেকটু..”

হিয়া আনমনে মাথার উপরের জারুল গাছটায় চেয়ে রইলো।

ভার্সিটি থেকে বাসায় না ফিরে আরওয়া নিজেদের বাসায় গেল। তাকে দেখে করিমুন্নেসা আপ্লুত স্বরে বললো, ” সকাল থেইকা তোর লাই বই রইছি। কতক্ষণছ আইবি আর আই তোর ফচন্দের ছড়া ফিডা খাওয়ামু।”

আরওয়া দাদীর পাশ ঘেষে দু’হাতে গলা জড়িয়ে বসে রইলো। করিমুন্নেসা নাতনির মন খারাপ টের পেয়ে বললেন, “কি হইছে বু এন বেজার হই আছত ক্যান? হেতের লগে আবার কাইজ্জা কইরছত ক্যান?”

“দাদীজান, উনি আমাকে উইশ করেনাই। হয়তো জানেও না আজকে আমার বার্থডে। মানুষ এত কেয়ারলেস হয় বলো?”

“হেতে কি তোর স্কুল কলেজের মাস্টর নি? তোর জন্মনিবন্ধন কার্ড লই বই আছে? এরে হুন, তোগো নোয়া বিয়া হইছে, এহনো ভালামতো একজন আরেকজন রে জানোস নাই, চিনোস নাই। হেতে দেখগই জানেও না তোর জন্মদিন কবে। ইগিন লই মন খারাপ করিচ্চা। যে জানেনা তারে জানাইতে হয়, তার উপর গোস্সা করা মানায় না বুবু!”

“মানুষ যাকে ভালোবাসে তার পছন্দ অপছন্দ, বিশেষ দিন এসব মনে রাখেনা? বা জানার চেষ্টা করে না? উনি কেন এমন দাদীজান? উনি আমাকে ভালোবাসেনা কেন? আমি কি ভালোবাসার যোগ্য না?”

করিমুন্নেসা তার পিঠে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,” ধৈর্য ধর বোইন, ধীরে ধীরে সব ঠিক হইবো। দেইখবি একদিন হেতে তোর লাই এমুন বেদিশা হইবো তুই কূল পাইতি নো।”

“তুমি সবসময় পজেটিভ কথা বলো। জীবনে এতো ভালোও ঘটেনা। আর এই বদলোকের বেলা তো না ই….”

“হাছা নি? হেতে বুঝি পরিবর্তন হয় নো?”

“হয়েছে তো, একটুখানি!”

শিরিন বাটিতে করে পিঠা এনে বললো, “আম্মা নেন আপনার নাতনিকে পিঠা খাওয়ান।”

করিমুন্নেসা চামচ কেটে আরওয়াকে পিঠা খাইয়ে দিতে দিতে বলল, “বৌমা তোমার মেয়ের জামাইরে কল দাও। বলো আজ রাতে আমাদের সাথে খাবে।”

“আচ্ছা”

আরওয়া গাল ফুলিয়ে বললো,” আমার জন্য তৈরি করা মজার খাবারগুলোতে ঐ লোকে ভাগ বসাবে? তুমি তাকে আসতে বলতেছ কেন?”

শিরিন চোখ গরম করে বলল, “এসব কি কথা আয়েশা? ঐ লোক আবার কি? নিজের স্বামীকে কেউ এভাবে সম্বোধন করে?”

“তো কি বলবো আমার পরাণের সোয়ামি? হুহ তোমরা আমায় ধরেবেঁধে একটা রোবটের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছ। নেহাতই সে দেখতে ভালো বলে চুপচাপ মেনে নিয়েছি। নয়তো কবেই চলে আসতাম!”

” আজকের দিনে এমন গাল ফুলিয়ে না রেখে তোর রুমে যা। তোর জন্য কি গিফট রাখা আছে দেখে আয়।”

“আব্বু কখন আসবে আম্মু?”

“চলে আসবে একটু পরেই। আমাদেরকে বলে গেছে তোকে যেন বলি রেডি হয়ে থাকতে। আসবার সময় কেক আনবে।”

“চকলেট কেক আনতে বলেছ তো?”

“ঐটা মিস যাবে?”

আরওয়া মুহূর্তেই খুশি হয়ে গেল। আনন্দিত গলায় বললো, ” দাদীজান তুমি বসো আমি তৈরি হয়ে আসি।”

বলেই সে নিজের রুমের দিকে গেল। শিরিন বলল, “আম্মা জামাইকে কি বলবো আজকে যে ওর জন্মদিন?”

“তুমি না বলে বরং শোয়েব রে বলো ও যেন ওর দুলাভাইরে বলে গিফট নিয়ে আসতে।”

“কিছু মনে করে যদি?”

“না বললে যে বোমা রেডি হবে তার সামনে এটা কিছু না। বরং দেখবা তারই বড় উপকার হবে।”

“আচ্ছা তাহলে আগে আসার কথা বলি। পরে শোয়েবকে দিয়ে কল করাবো।”

“হুম তাই করো।”

চলবে..

কাঁটাকম্পাস পর্ব-২৫

0

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব২৫

#আরশিয়া_জান্নাত

আরওয়াকে দেখে পাপিয়া প্রফুল্ল চিত্তে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলল, “নতুন ভাবি তোমরা এসে গেছ! তোমাদের অনেক মিস করেছি জানো!”

“আমি তোমাদের কে ৩গুণ বেশি মিস করেছি। একা থাকা কি কঠিন কাজ বাপরে! ”

লাগেজগুলো ভেতরে পাঠিয়ে সাম্য দাঁড়ালো। জাওয়াদ গাড়ি থেকে নেমে বললো, “কাল অফিসে এসো না।”

সাম্য ওর কথায় বিবর্ণ হয়ে গেলো,ভীত স্বরে বলল, “স্যার তবে কি আমার চাকরি গেল?”

জাওয়াদ ওর শার্টের পকেটে একটা খাম রেখে বললো,”এতো কথা না বলে যা বলছি তাই করো।”
বলেই সে বাড়ির ভেতরে চলে গেল।

সাম্য মনখারাপ করে গেইটের দিকে এগোতে লাগলো। পকেটে থাকা খাম টা খুলে দেখে একটা চেক। ওর বুঝতে বাকি রইলো না চাকরিটা গেছে।
তখনই ওর ফোনে একটা মেসেজ আসে,

“তুমি আমার খুব বিশ্বস্ত একজন মানুষ। তোমাকে বাদ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা এখন আপাতত দেখছি না। এ ক’দিন অনেক প্রেশার গেছে, কিছু দিন রেস্ট করো।”

সাম্যর খুশিতে চোখে পানি চলে এসেছে। বুকের উপর থেকে অনেক বড় একটা পাথর সরে গেছে যেন।

আরওয়া রুমে না গিয়ে পাপিয়ার সাথে গল্প জুড়ে বসেছে। বাড়ির অন্যরাও ওর গল্প বেশ আগ্রহ নিয়ে শুনছে। জাওয়াদ ফ্রেশ হয়ে বিছানায় শুয়ে আছে। আর একটু পরপর দরজার দিকে তাকাচ্ছে। আচ্ছা মেয়ে তো, আসার পর ঐ যে বসার ঘরে আসর পেতে বসেছে উঠার কোনো নামগন্ধ নেই। আর সবাইও কেমন কেউ ওকে ফ্রেশ হবার কথাও বলছে না; স্ট্রেইঞ্জ!

রোকেয়া হালকা খাবার নিয়ে জাওয়াদের ঘরে এলো। টেবিলের উপর ট্রে রেখে বললো, “কি রে মুখটা এমন পেঁচার মতো করে রেখেছিস কেন?”

“কই না তো!”

“আমাকে কি তোর অন্ধ মনে হয়? কি হয়েছে তোর আবার কোন গন্ডগোল পাকিয়েছিস বল?”

“আমি আবার কি করলাম, একা ঘরে বসে আছে চুপচাপ থাকবো না তো কি একা একা হেহে হিহি করে হাসবো? চুপ থাকলে সবার মুখই পেঁচার মতো লাগে।”

রোকেয়া বিছানার একপাশে বসে বললেন, “টায়ার্ড লাগছে বেশি? ঘুমাবি কিছুক্ষণ?”

“নাহ আমি ঠিক আছি।”

“আরওয়ার সাথে ঝগড়া করেছিস আবার?”

“নাহ তো! আমি কারো সঙ্গে ঝগড়া করি?”

“তোরা বাপ ছেলে ঝগড়া করিস না তো। তোরা জাস্ট আগুনটা জ্বালিয়ে দিয়ে বসে থাকিস। বাকি যা হবার এমনিতেই হয়ে যায়…”

“আমার কথা বিশ্বাস না হলে ওকে ডাকো, সরাসরি জিজ্ঞাসা করো। তাহলেই তো আর এতো কষ্ট করে আন্দাজ করতে হচ্ছেনা।”

রোকেয়া মাথা নেড়ে বললেন, “আসলেই ওকে ডাকা উচিত, তোর পেটে বোমা ফেললেও আসল কথা বেরোবে না।”

রোকেয়া ব্যতিব্যস্ত হয়ে দোতলার করিডর থেকে আরওয়াকে ডাকতে লাগলেন। আরওয়া শাশুড়ির ডাক শুনে দৌড়ে উপরে গেল। রোকেয়া তার হাত ধরে রুমে নিয়ে বললো, “সত্যি করে বল তো ফারাজ তোর সাথে আবার ঝগড়া করেছে কি না? ”

আরওয়া বিস্মিত গলায় বললো,”কই না তো। কেন কি হয়েছে?”

“কি আর হবে মুখটাকে বাংলার পাঁচের মতো করে শুয়ে শুয়ে দুঃখবিলাস করছে। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল এই পৃথিবীতে ওর মতো দুঃখী আর কেউ নেই!”

জাওয়াদ বিরক্তস্বরে বললো, “আম্মু, তুমি তিলকে তাল বানাচ্ছ কেন? চেহারা দেখে মনের খবর জাজ করা যায় নাকি?”

রোকেয়া বললো,”আমার গর্ভে তুই হয়েছিস নাকি তোর গর্ভে আমি? তোর হাবভাব আমার ভালোই চেনা আছে।”

জহির সাহেবের ডাক শুনে রোকেয়া আর কথা বাড়ালোনা। ” কোথাও গিয়ে যে দু দন্ড বসবো সে ফুরসত নেই। হাঁকডাক চলতেই থাকে ফারাজ খাবারগুলো খেয়ে নিস কিন্তু…” বলতে বলতে তিনি দ্রুতপদে বেরিয়ে গেলেন।

আরওয়া খাটের প্রস্থে গা এলিয়ে বললো, “কি ব্যাপার কি শুনছি এসব হুম?”

জাওয়াদ উঠে টেবিল থেকে ফলের জুসটা নিয়ে বললো, জার্নি করে আসলে ভালোভাবে হাতমুখ অন্তত ধুতে হয়। তুমি তো সেসব ভুলে গল্পে মজেছ!”

আরওয়া একপাশে কাত হয়ে হাতের উপর মাথা রেখে দুষ্টুমি মাখা হাসি দিয়ে বললো,” এই তাহলে জনাবের মুড অফের কারণ? ইশ! এতো চোখে হারান আমাকে, কি লজ্জা কি লজ্জা!”

“আমার বয়েই গেছে তোমাকে চোখে হারাতে।”

আরওয়া উঠে এসে বললো, “ইয়া আল্লাহ আপনার নাকে কি হয়েছে?”

জাওয়াদ নাকে হাত দিয়ে বলল, “কই কি হয়েছে?”

“মিথ্যে বলতেই আপনার নাক ১ইঞ্চি লম্বা হয়ে গেছে! বিশ্বাস না হলে আয়নায় তাকিয়ে দেখুন।”

বলেই আরওয়া হেহে করে হাসতে লাগলো। জাওয়াদ ওর হাসি দেখে বললো, “এই দাঁড়াও তোমার দাঁতে ওটা কি লেগে আছে? সবুজ শাক নাকি?”

আরওয়া ইই করে দাঁত দেখিয়ে বললো, “দেখুন অনেকগুলো লেগে আছে।”

জাওয়াদ তাকে জব্দ করতে না পেরে হতাশ হলো। আরওয়া হেসে বললো, “Well try My dear hubby. কিন্তু আমার হায়া একটু কম। এটা ভুললে চলবে না।”

হিয়া বাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, “জীবনটা আর ভাল্লাগেনা রে। ঘুরেফিরে ঐ একই রুটিন। সো বোরিং!”

“নতুন কি লাগবে তোর? বাচ্চা সামলাতে চাস নাকি বর?”

“দুটোই সামলানোর বয়স চলতেছে, একটা বললে কি হবে?”

পাপিয়া ওর জমানো বাদাম থেকে দুটো মুখে তুলে বলল, ” বিয়ে করে ফেল। অনেক দিন বিয়ের দাওয়াত খাই না।”

“মিথ্যুক কয়দিন আগে না ভাইয়ের বিয়ে খাইলি?”

“ভাইয়ের টা আর বান্ধবির টা কি এক?”

“ছেলে দেখ আমার জন্য। পড়াশোনা নিপাতে যাক। আমি নাচতে নাচতে সংসার করবো, আর শাড়ি গয়নার বায়না ধরবো। আহা আহা কি সুখ!”

“কত স্বপ্ন তোর ওহো ওহো! শাড়ি গয়না লাগলে এখনি তো নিতে পারোস। এর জন্য বিয়ে করা লাগে?”

” দেখ ব্রো, দুনিয়ার সবাই মিলেও যদি শাড়ি গয়না দেয় মন ভরবে না। জামাই একটা দিলে যে আনন্দ টা আসবে তার সামনে অন্যদের টা কিছুই না। আমি তো ঠিক করে রেখেছি সে যখনই নতুন শাড়ি দিবে আমি সাথে সাথে সেটা পড়ে তার সামনে ঘুরঘুর করবো। আর সে বলদার মতো ড্যাব ড্যাব করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে।”

পাপিয়া ওর কথা শুনে বলল, “তোর এতো পজেটিভ চিন্তা আসে কেমনে ভাই!”

“যাদের লাইফে পজেটিভ কিছু থাকেনা তারা হয় প্রচুর হোপলেস হয় নাহয় প্রচুর হোপফুল হয়। আমি হোপফুল!”

পাপিয়া ওর কাধে হাত রেখে সান্ত্বনার স্বরে বললো, “আল্লাহ তোর মনের ইচ্ছা পূরণ করুক! দেখবি অনেক সুখী হবি তুই।”

হিয়া হেসে বললো, ” সুখী তো হবোই। এখন হোক সেটা এই দুনিয়ায় নাহয় ঐ দুনিয়ায়….”

রিজভী পাপিয়ার মাথায় টোকা দিয়ে বললো,” তুই এখানে বসে আছিস, “আমি তোকে আরও কই কই খুঁজছি!”

“পৃথিবীতে মোবাইল বলে একটা ডিভাইস আছে। ঐটা ইউজ করা যেত না?”

“ওহ আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম মোবাইল নামে একটা ডিভাইস আছে!”

“তোর আসলেই মাথাটা খুব স্লো চলে। হরলিক্স খাবি রোজ বুঝলি।”

“হরলিক্সের কোনো পুষ্টিগুণ নাই। ঐটা ফাউ বিজ্ঞাপন ছিল। যাই হোক কেন খুঁজছিলাম ওটা বলতেই ভুলে যাচ্ছি তোর কথার মারপ্যাঁচে।”

“বল কি বলবি?”

রিজভী একটা ছোট প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলল, “তোর থেকে অনেক টাকা ধার নিছি। নে সব শোধ করলাম।”

“আরেহ বাহ এবার এক দানেই সব দিলি?”

রিজভী ম্লান হেসে বললো,”এখন তো আর খরচা নেই! তাই একবারেই দিতে পেরেছি।”

হিয়া বলল, “আল্লাহ তোকে সুবুদ্ধি দান করুক। এবার যেন সঠিক মানুষ চিনতে পারিস।”

পাপিয়াও ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।

নূর মোহাম্মদ ছাদে দাঁড়িয়ে তার স্ত্রীকে বললেন, “আবেগ দিয়ে কাজ করার বয়স এখন আর নেই।আমাদের একটাই ছেলে ওর থেকেই তো আমার পরিবার আগাবে। ওর যদি সন্তান না হয় কিভাবে চলবে? সমস্যা সাবার ওর তো না। ও কেন নিজের ভবিষ্যৎ নষ্ট করবে? আমাদের আর্থিক অবস্থা ভালো, নাহিয়ানের ইনকাম ও ভালো। ও চাইলেই আরেকটা বিয়ে করতে পারে। ইনসাফ করযে পারলে ২স্ত্রী রাখতে তো নিষেধাজ্ঞা নাই। ছেলেকে বোঝাও ও যেন আরেকটা বিয়ে করতে প্রস্তুত হয়”

কোহিনূর স্বামীর কথায় প্রতিবাদ করার সাহস পেলেন না। এমনিতেই কিছুদিন আগে অনেক ছোট হয়েছেন। এখন যদি আবার সেটা টেনে অপমান করে তাই ভয়ে সে নিরবই থাকলো। তাছাড়া সে ভালো করেই জানে নাহিয়ান জীবনেও এসবে মত দিবে না।

চলবে…

কাঁটাকম্পাস পর্ব-২২+২৩+২৪

0

#কাঁটাকম্পাস #পর্ব২২

#আরশিয়া_জান্নাত

২২

আরওয়া লাগেজ থেকে নিজের পছন্দমতো একটা শাড়ি বের করে পড়ে নিলো। তারপর বেশ মন দিয়ে মেকাপ করে ,চুল আঁচড়ে, ম্যাচিং গয়না পড়লো। সাজগোজ শেষে জাওয়াদের সামনে দাঁড়িয়ে বললো, “কেমন লাগছে? সব ঠিকঠাক তো?”

“হুম, ভালোই!”

“ভালোমতো দেখে বলুন, কোনো খামতি আছে কি না?”

জাওয়াদ একবার তাকিয়ে বললো, “ঠিকই তো আছে!”

“সিওর?”

এবার জাওয়াদ একটূ নড়েচড়ে বসলো, নাহ মেয়েটা যখন এভাবে বলছে তার মানে ঘাপলা আছে! সে মনোযোগ দিয়ে আরওয়ার দিকে তাকালো। সাদা রঙের শিফন শাড়িতে নীল অপরাজিতা ফুল ছাপা। কানে গলায় ম্যাচ করা নীল পাথরের গয়না। সাজ বলতে চোখে টানা করে আই লাইনার দেওয়া,আর ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, চুলগুলো খোঁপা করে রাখা।
পর্যবেক্ষণ শেষে জাওয়াদের মনে হলো এই কস্টিউমের সাথে খোলা চুলেই বেশি মানাতো।

“দেখা শেষ? পেলেন কিছু?”

জাওয়াদ দ্বিধাগ্রস্ত গলায় বললো, “মেয়েদের সাজগোজের ব্যাপারে আমার ধারণা কম। তবে আপাতত মনে হচ্ছে তোমার চুল খোলা রাখলেই ভালো লাগবে!”

“তাই? বেশ তো খোঁপাটা খুলে দিন?”

“আমি?”

“হুম। পারবেন না?”

“পারবো,,”

আরওয়া তার দিকে পিঠ করে সামনে দাঁড়ালো। জাওয়াদ ওর খোঁপা খুলে দিয়ে চুলগুলো সারা পিঠময় ছড়িয়ে দিলো। আরওয়া মিষ্টি হেসে বলল, “ধন্যবাদ, নিন এখন আমার বেশকিছু ছবি তুলুন। অবশ্যই যেন ব্যাকগ্রাউন্ড পুরোটা আসে।”

“তুমি জাস্ট ছবি তুলতে এতো আয়োজন করলে?!”

“অবশ্যই! হানিমুনে এসেছি যে ডেমো রাখতে হবে না? এসব ডেকোরেশন তো আর বারবার হয় না! দেখি কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি ছবি তুলুন। সুন্দর করে তুলবেন, এঙ্গেল যেন ঠিকঠাক হয়।”

জাওয়াদ আরওয়ার ফোন নিয়ে বেশকিছু ছবি তুললো, আরওয়াও হাসিমুখে নানারকম পোজ দিয়ে যাচ্ছে।

“সিঙ্গেল অনেক তুলেছি, এবার আসুন কাপল ফটো তুলি। সেলফি নিন। একদম সুখী দম্পতির মতো ভান করবেন ওকে?”

আরওয়া ওর ক্লোজ হয়ে কাপলের মতো দাঁড়ালো, জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকে বললো, “এসব করা কি খুব দরকার?”

“ওহো এতো কথা বলেন না আপনি! দিন আমিই সেলফি তুলছি, ভ্রু সোজা করুন হাসিহাসি মুখ করে ফোনের দিকে তাকান। প্লিজ ……”

আরওয়া ক্লিক করেই যাচ্ছে, হঠাৎ জাওয়াদ বাঁকা হেসে আরওয়ার গালে চুমু খেলো। আরওয়া চোখ বড় বড় করে জাওয়াদের দিকে তাকিয়ে বললো,” এটা কি হলো? আপনি আমায় চুমু দিলেন কেন?”

“বা রে! তুমি একাই হানিমুনের ফিল নিবা? আমি নিবো না?”

আরওয়া ফোন রেখে তার চোখে চোখ রেখে বলল, “আমি কি আপনাকে একবারও বারণ করেছি?”

“বারণ করো নি বলছো?”

“অবশ্যই করি নি,,, ইনফ্যাক্ট সবসময় এগিয়ে এসেছি। যেমন আজ এলাম!”

জাওয়াদ ওর কপালে আঙ্গুল ছুঁইয়ে বললো, “তোমাকে এখন ভীষণ সুন্দর লাগছে!”

আরওয়া জাওয়াদের গলা জড়িয়ে আদুরে গলায় বললো, “সত্যি বলছেন?”

“হুম…তবে সমস্যা একটাই সমস্যা, সাদা রঙটা কেমন জানি ভুতুড়ে লাগে। মনে হচ্ছে তুমি পুরোনো কটেজে সাদা শাড়ি পড়ে ঘুরে বেড়ানো অতৃপ্ত আত্মা! ভাগ্যিস সবুজ পাতায় নীল অপরাজিতা টা আছে….”

“আপনি আমায় পেত্নি বোঝালেন?”

“আমি কিন্তু নাম বলি নি। তুমি নিজেই বললে।”

আরওয়া রেগে ক্ষুব্ধ হয়ে বললো,”ধুরর আপনার থেকে ভালো কিছু আশা করাই ভুল…”

বলেই সে সরে যেতে নিলো। জাওয়াদ হেঁচকা টানে তাকে বুকের মাঝে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো, “রাগ মানুষ কে ধ্বংস করে। তোমার মতো মোমের পুতুল হলে তো কথাই নেই। সেই তাপে পুড়িয়ে নিঃশেষ করে ফেলে!”

আরওয়া ওর বাহুবন্ধন থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করতে লাগলো। দৃঢ় গলায় বললো, “আপনি একটা বদ লোক, নিজেই আগুন লাগাবেন আবার নিজেই নীতিবাক্য বলতে আসবেন, ছাড়ুন আমাকে।”

জাওয়াদ হেসে বললো,”যে আগুন জ্বালায় সে ই আগুন নেভাতে পারে ম্যাম! তার থেকে দূরে সরলে হবে?”

“ঢং করবেন না বলে দিচ্ছি। আপনি সবসময় এমন করেন, মেজাজ খারাপ না করলে আপনার শান্তি হয় না। ”

রাগের চোটে আরওয়ার চোখে পানি চলে এসেছে। এটা কেমন অসহ্যকর ব্যাপার! দুঃখ পেলে চোখের পানি কন্ট্রোল করা গেলেও রাগের বেলা যায়না। চোখ যেন শত্রুতামি করে অঝোর ধারায় পড়তেই থাকে বিব্রত করতে। আরওয়া চাইছে না জাওয়াদ ওর কান্না দেখুক। নিজেকে ছিঁচকাদুনে প্রমাণ করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ওর নেই।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে টের পেতেই জাওয়াদ দ্রুত ওর ঠোঁট জোড়া দখলে নিলো। লেলিহান আগুনে বরফ শীতল পানি পড়ার মতোই আরওয়ার রাগ ক্ষোভ দপ করে নিভে গেল। সে পরম আবেশে চোখ বন্ধ করে অপার্থিব অনুভুতির জোয়ারে হারিয়ে গেল মুহুর্তেই। বাঘিনী কে বশে আনার উপায় জাওয়াদ সাহেব ভালোই রপ্ত করেছেন!

বেশকিছু সময় অতিবাহিত হবার পর জাওয়াদ ধীরে ধীরে তাকে ছেড়ে দিলো। আরওয়া সাথে সাথে ওর শার্টের কলার আঁকড়ে ধরলো। ওর আবেদনময়ী দৃষ্টির ভাষা বুঝতে জাওয়াদের সময় লাগলো‌না। তবুও বাজিয়ে দেখতে বলল, ” কি?”

আরওয়া কাতরস্বরে বললো,”আমার ভালো লাগছে না। একদম ভালো লাগছেনা। আমি বোধহয় মরে যাবো….”

জাওয়াদ ওকে কোলে তুলে বললো, “কেন ভালো লাগছে না শুনি?”

“আপনি আমাকে ভালোবাসেন না কেন? কি হয় একটু ভালো বাসলে?”

জাওয়াদ তাকে বিছানায় শুইয়ে বললো,”তুমি একা ক্ষতবিক্ষত হও না আরওয়া, আমাকেও ক্ষতবিক্ষত করো। তোমাকে ভালোবাসলে আমার কি হবে বুঝতে পারছো?”

আরওয়া উঠে ওর শার্টের বোতাম খুলে বুকের মাঝখানে পয়েন্ট করে বললো, ” এই পাথরের বুকটায় আরওয়ার নামে ফুল ফুটুক। এই মনের সবটা জুড়ে কেবল আরওয়া থাকুক।”

জাওয়াদ মুঠোভর্তি গোলাপের পাপড়ি নিয়ে আরওয়ার মাথার উপর ধীরে ধীরে ফেলতে লাগলো। নরম পাপড়ির ছোঁয়ায় সে চোখ বুজে ফেলল, জাওয়াদ ওর মুখ আজলায় ভরে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, “আমাকে বড্ড জ্বালাও তুমি! আমি ততোটাও পাথুরে নই যতোটা তুমি ভাবছো। এখন যা হবে তার দায়ভার সম্পূর্ণ তোমার,আমাকে কিন্তু পরে দোষারোপ করতে পারবে না…..”

“আপনাকে আমি দোষারোপ করবো কেন? আমি আপনার জন্য হালাল। আমার উপর আপনার পূর্ণ হক আছে। আপনার আহ্বানে সাড়া না দেওয়া বরং আমার জন্য পাপ হবে।”

“অনুমতি দিচ্ছো তাহলে?”

আরওয়া নিজের হাত দিয়ে ওর চোখ ঢেকে বললো, “আপনি এভাবে তাকাবেন না, আমার লজ্জা লাগছে। ”

জোবায়ের সাহেব পত্রিকার হেডলাইনগুলোয় চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে। একটু পরেই তিনি অফিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবেন। সালমা বেগম স্বামীর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র হাতের কাছে এগিয়ে রেখে বললেন, “কুহুর জন্য একটা সমন্ধ আসছে,ওর বড় মামা আনলো। আপনি অনুমতি দিলে উনাদের আসতে বলবো।”

“বায়োডাটা কই দেখি?”

সালমা বেগম তৈরিই ছিলেন, দ্রুত বায়োডাটা এগিয়ে দিলেন। জোবায়ের সাহেব মনোযোগ দিয়ে সবটা দেখলেন। তারপর বললেন, “আসতে বলো, দেখাসাক্ষাৎ করে দেখি। আল্লাহর হুকুম থাকলে হবে নাহয় হবেনা।”

সালমা হাসিমুখে বললেন, “হ্যাঁ সেটাই।”

জাওয়াদের বুকের মাঝে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছে আরওয়া। নির্ঘুম রাত্রিযাপনে দুজনেই ক্লান্ত পরিশ্রান্ত। স্বর্গীয় সুখানুভূতিতে দেহমন তৃপ্ত হলেও চোখের পাতা এক হচ্ছে না কারোই। জাওয়াদ আলতোভাবে আরওয়ার চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে আর সে মন দিয়ে
তার হৃদস্পন্দন শুনছে।

“ঘুমোবেন না?”

“এখন ঘুমালে মিটিং টা মিস হয়ে যাবে। তুমি বরং ঘুমাও।”

আরওয়া ওর বুকে নাক ঘষে বলল, “আজ না গেলে হয় না?”

“সেটাই ভাবছিলাম। কোনোভাবে পোস্টপন করা যায় কি না…”

“সাম্য ভাইয়া কে বলে দিন, এতো চিন্তা ভাবনার কি আছে?”

জাওয়াদ ওর কপালে চুমু খেয়ে বলল, ” দাদাসাহেবের কাজ ফেলে রাখতে সাহস হয় না।”

আরওয়া উঠে বসলো। দু’ হাতে চুলে ক্লিপ আটকে বললো, ” আমি সাম্য ভাইয়া কে নক করে বলছি, মিটিং টা বিকেলের দিকে করতে। আপনি এখন নিশ্চিন্তে ঘুমান।”

জাওয়াদ মুচকি হেসে বলল, “ঘড়ি দেখেছ? এখনো ভোর হয় নি। ওকে এখন নক করার মানে বোঝো? বোকা মেয়ে একটা!”

আরওয়া ঘড়ির দিকে তাকিয়ে জিভ কেটে বললো, “আসলেই তো! আমার কাছে তো মনে হয়েছে অনেক লম্বা সময় পার হয়ে গেছে। কিন্তু সময় তো খুব স্লো!!”

“তাই না?”

আরওয়া তার হাতটা টেনে নিজের গালে ছুঁইয়ে বলল, ” আই উইশ আপনার সঙ্গে কাটানো মুহূর্তগুলো এমনিভাবে অনেক লম্বা হোক।”

পাপিয়া পাত্রের ছবি দেখে বলল, “আপু উনি তো দেখতে সেই! তোর পছন্দ হয়েছে? দুলাভাই হিসেবে আমার তো বেশ পছন্দ হয়েছে!”

কুহু বইপত্র গোছাতে গোছাতে বলল, “বেশি পছন্দ হলে বলে দে তোর জন্য দেখতে বলি।”

“তুই কেমন রে আপু! আমি কি বলেছি আমার জন্য পছন্দ হয়েছে?”

“তোর তো বফ নেই, পছন্দ করিস এমন ছেলেও নাই। আমি তোকে সাজেস্ট করতেই পারি। এমন কত ঘটনা আছে বড় বোনকে দেখতে এসে ছোটবোনকে পছন্দ করে। আগে থেকে মেন্টালি প্রিপেয়ার থাকা ভালো।”

পাপিয়া বিরক্তস্বরে বললো, “তোকে কিছু বলাই ভুল আমার।”

“পাপ্পি! যদি এমন হয় আমি বিয়ের দিন পালিয়ে গেছি। মানসম্মান রক্ষা করতে দাদাসাহেব তোকে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিলো। তুই তখন কি করবি?”

“এই আপু তুই পালিয়ে যাওয়ার প্ল্যান করছিস না তো! খবরদার ওটা করিস না। আমি বলির পাঠা হতে পারবো না…”

“মন্দ কি ছেলে তো তোর ভালো ই লেগেছে?”

“নাহ একটুও ভালো লাগেনি। আর শোন দেখতে আসলেই বিয়ে হয় না। তোর পছন্দের কেউ থাকলে বড় ভাইয়াকে বল। ভাইয়া ঠিকই ব্যবস্থা নিবে। অযথা এডভেঞ্চারিং কিছু করার চিন্তা করিস না।”

“তুই খুব ভীতু রে পাপ্পি। এইটুকু তেই তোর হালুয়া টাইট হয়ে গেছে! সত্যি করে বল তো তুই আসলেই সিঙ্গেল? এমন ভয় তো মিঙ্গেল রা পায়, তুই পাচ্ছিস কেন? কারো সঙ্গে কমিটেড আছিস?”

“আরেহ না! তেমন নয়।”

“আমার তো মনে হচ্ছে না!!”

পাপিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো, “নিজেরটা আমার উপর চাপাইস না। তোর মনে শয়তানি চলতেছে বলে সবাইকে তেমন ভাবিস না।”

কুহু ওর কথা শুনে হেহে করে হাসতে লাগলো

চলবে,,,

#কাঁটাকম্পাস #পর্ব২৩

#আরশিয়া_জান্নাত

“বলছিলাম কি স্যার সত্যিই আপনি দেশে ফিরে আমাকে বের করে দিবেন?”

জাওয়াদ ফোনের দিকে চেয়ে থেকে ই বললো,” তোমার সঙ্গে রসিকতা করার মতো রিলেশন নিশ্চয়ই আমার নয়!”

“স্যার প্লিজ এমন করবেন না, আপনি তো জানেন আমি কত লয়্যাল এমপ্লয়। আমার এতো দিনের ডেডিকেশন দেখে একটু হলেও কনসিডার করুন প্লিজ!”

জাওয়াদ ওর দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো। সাম্য সাথে সাথে চুপ হয়ে গেল। জাওয়াদের এই নিরব চাহনি সে প্রচুর ভয় পায়। মনে মনে ভাবতে থাকে কোথায় কোথায় সিভি জমা দিলে দ্রুত চাকরি মিলবে। ওকে অবাক করে দিয়ে জাওয়াদ বলল, “তোমাকে একটা সুযোগ দিচ্ছি, যদি কাজটা করে আমাকে স্যাটিসফাইড করতে পারো তবে…”

“আই উইল ট্রায় মাই বেস্ট, আপনি বলে তো দেখুন।”

” আরওয়ার জন্য একটা ভালো ডিনারের আয়োজন করো।”

“আপনি বলতে চাইছেন আপনাদের জন্য? আপনি একদম চিন্তা করবেন না। আমি এই শহরের বেস্ট শেফদের হায়ার করবো। আজকে রাতের ডিনারটা ম্যাম কোনোদিন ভুলবেন না।”

“গুড লাক!”

আরওয়া রেজোর্টের ডাইনিং স্পেসে বসে কফি পান করছে। সামনের টেবিলে থাকা একটি বাচ্চা মেয়ে একটু পরপর ওর দিকে তাকায় আবার চোখাচোখি হতেই চোখ সরিয়ে ফেলে।
আরওয়া ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করছে। ওর ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে ভড়কে দিতে। কিন্তু সেটা করবার আগেই জাওয়াদ সেখানে উপস্থিত হলো। জাওয়াদ নিজের জন্য কফি অর্ডার করে কোচে হেলান দিয়ে বসলো।

“আপনার কাজ শেষ হতে আর কতদিন লাগবে?”

“এই তো আর ২/৩ দিন। কেন? ভালো লাগছেনা এখানে?”

“নাহ এমনিই জিজ্ঞাসা করলাম।”

“আচ্ছা!”

কফি পান শেষে জাওয়াদ বলল, “আরওয়া মিউজিয়াম পছন্দ করো?”

“করবো না কেন? যাবেন নাকি?”

“হুম। চলো যাই?”

“বেশ তো চলুন।”

টোকিও ন্যাশনাল মিউজিয়াম জাপানের প্রাচীন সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নিদর্শন হয়ে আছে। জাপানিজরা তাদের অতীতের বিভিন্ন মিথ মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে এবং তাদের বর্তমান জীবনেও সেটার প্রভাব লক্ষণীয়। তাদের আচার অনুষ্ঠানগুলো সেটারই প্রমাণ দেয়। আধুনিক সভ্যতার সাথে অতীতের সভ্যতার মেলবন্ধনে জাপান হয়ে উঠেছে অনন্য। মিউজিয়াম পরিদর্শন করে জাওয়াদের কাছে এমনটাই মনে হলো। সেখান থেকে বেরিয়ে ওরা হালকা স্ন্যাক্স করলো। সাম্যর টেক্সট পেয়ে আরওয়াকে নিয়ে লোক্যাল ট্রান্সপোর্টে করেই নির্দিষ্ট রেস্টুরেন্টের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতেই আরওয়া বলল, “আমরা কোথায় যাচ্ছি? গাড়িতে না উঠে বাসে উঠলেন যে?”

“গাড়িতে বোর লাগছিল তাই ভাবলাম লোক্যালে চড়ে দেখি!”

“ওহ আচ্ছা!”

“এই আরওয়া তুমি তো ডোরেমন পছন্দ করো তাই না?”

“আপনি কিভাবে জানলেন?!”

“তোমার রুমে ডোরেমনের ছবিযুক্ত অনেককিছুই দেখেছিলাম, তাই গেস করলাম আর কি!”

“হ্যাঁ আমি ডোরেমন অনেক পছন্দ করি। আই উইশ আমার একটা ডোরেমন থাকতো। যা চাইতাম তাই ওর পকেট থেকে বের করে দিতো!কি মজা হতো তাই না!”

“ওর কোন গ্যাজেটটা তোমার সবচেয়ে পছন্দ?”

“টাইম মেশিন! আমার কাছে টাইম মেশিন থাকলে সুযোগ পেলেই আমি অতীতে গিয়ে ঘুরে আসতাম। কত্ত মজা হতো!”

জাওয়াদ হেসে বললো, “তুমি আসলেই বাচ্চা! তা ডোরেমনের শহরে এসেছ ওদের বাসা দেখবে না?”

“ওদের বাসা সত্যিঈ আছে?”

“ট্যুরিস্টদের জন্য ওরকম করে তৈরি করা হয়েছে শুনেছিলাম। খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে। তুমি চাইলে কাল ওখানে যাবো কেমন?”

“ওয়াও! আমি খুব এক্সাইটেড। সত্যি সত্যি ওদের বাসা দেখবো ভাবতেই আনন্দ লাগছে।”

রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করতেই তাদের ফুল দিয়ে স্বাগত জানানো হলো। আরওয়া অবাক হয়ে বলল, “এখানে কোনো অনুষ্ঠানে চলছে নাকি? হঠাৎ এতো ফুল দিলো যে?”

“তোমাকে বোধহয় উনাদের পছন্দ হয়েছে। তাই ফুল দিয়ে বরণ করলো।”

“এহহ! মজা করছেন আমার সঙ্গে!”

জাওয়াদ হাত বাড়িয়ে বললো, “চলো ভেতরে যাই?”

আরওয়া খুশিমনেই ওর বাহু জড়িয়ে ভেতরে ঢুকলো। বাহারি ফুলে বেশ সুন্দর করে সাজানো হয়েছে রেস্টুরেন্ট টি, লন্ঠনের আলোয় চারদিকটা ভীষণ মায়াময় লাগছে। আরওয়া ঘুরে ঘুরে সবকিছু দেখতে লাগলো। এতো সুন্দর একটা রেস্টুরেন্টে একটা মানুষ ও নেই ভেবে খানিকটা অবাক ই হলো বটে। আফসোসের স্বরে বললো, “আপনি কি না জেনেই এই রেস্টুরেন্টে এলেন? এখানে বোধহয় খাবার বিশেষ সুবিধার না। দেখুন না এতো সুন্দর পরিবেশ অথচ একটা কাস্টমার ও নেই!”

জাওয়াদ ওর কথা শুনে বললো, “আসলেই তো ভুল চুজিং ছিল। চলো বেরিয়ে যাই?”

“নাহ! এটা সুন্দর। খাবার খেয়ে দেখি আগে এমনো হতে পারে খাবার খারাপ না!”

“না জেনেই ভরসা করা কি ঠিক হবে?”

“সবকিছু তো আগে থেকে জানা থাকেনা। দাদীজান বলেন, ধাক্কা না খেলে কেউ পাক্কা হয় না।”

“এখানে তোমার ধাক্কা খাওয়ার প্রয়োজন তো দেখছি না। অপশন অনেক আছে।”

আরওয়া ওর পেছনের দেয়ালটা পয়েন্ট করে বললো, “ঐ দেখুন…”

জাওয়াদ পেছনে ফিরে দেখলো খুব সুন্দর কার্ডে তাদের নাম লেখা।

“এটা আপনিই বুকিং করেছেন তাই না? অথচ এমন ভান করছেন যেন কিছুই জানেন না।”

জাওয়াদ উত্তরে কেবল হাসলো।

বেশ কয়েকজন শেফ নিয়ে ওখানকার ম্যানেজার উপস্থিত হলেন। জানালেন উনারাই আজ তাদের জন্য ডিনার প্রস্তুত করছে। তারপরই ওয়েটার এসে এক এক করে বিভিন্ন খাবার সাজিয়ে দিয়ে গেল। জাওয়াদ চেয়ার টেনে তাকে বসিয়ে নিজেও অপর চেয়ারে বসলো। মৃদু সুরে বাজতে লাগলো জাপানের ঐতিহ্যবাহী গান। সময়টা দারুণ উপভোগ্য হয়ে উঠলো।

একটু পরেই কুহুকে দেখতে পাত্রপক্ষ আসবে। ওদের জন্য সোনারগাঁও হোটেল থেকে খাবার এসেছে, বাসায় ও বেশকিছু আইটেম করা হয়েছে। কোহিনুর এই সমন্ধটা নিয়ে ভীষণ এক্সাইটেড। তার মতে কুহুর জন্য এর চেয়ে ভালো পাত্র হয় না। তার ভাইয়ের পক্ষ থেকে এসেছে বলেই এই বাড়তি আনন্দ কি না সেটা আপাতত বোঝা যাচ্ছে না। তবে এখানে বিয়ে হলে উনার ভাইয়ের ইমেজ সুন্দর হবে এমনটাই ধারণা তার।

পাপিয়া কুহুর রুমে বসে আছে। অন্য কোনো ওকেশনে কুহু ঘন্টা তিনেক আগে থেকেই সাজতে বসে গেলেও আজ তার হোলদোল নেই। সে আপনমনে হুমায়ূন আহমেদের “কুহক” বইটা পড়ছে।

“আপু তুই রেডি হবি না?”

“গল্পের ক্লাইমেক্সে আছি ডিস্টার্ব করিস না তো!”

“তুই এই সময়ে বই নিয়ে বসলি কেন? উঠ না। বড় আম্মু আমাকে বললো তোর হলো কি না দেখতে, উনারা আসার সময় হয়ে গেছে..”

কুহুর কোনো ভাবান্তর হলো না। সে বইয়ের ভেতরেই ডুবে রইলো। পাপিয়া বিরক্ত হয়ে ওর‌ রুম থেকে বেরিয়ে গেল। নিজের রুমে গিয়ে বসতেই ফোনে রিজভীর কল আসে।

“হ্যাঁ রিজভী বল..”

“আজ ভার্সিটি এলি না কেন?”

“বাসায় গেস্ট আসবে তাই যাই নি।”

“তুই কি এখনো ছোট খুকী আছিস? ছোটবেলায় গেস্ট আসলে আমরা স্কুল‌ কামাই দিতাম আর তুই বড় হয়েও সেই ধারা অব্যাহত রাখছিস!”

“বড় হলে দায়িত্ব আরো বাড়ে ওসব তুই বুঝবি না।”

“তোদের বাসায় কামলা খাটার মতো কিছু তো নাই। তোদের বাসায় গেস্ট আসা মানেই অর্ধেক খাবার আসবে বাইরে থেকে আর অর্ধেক হবে তোদের বিখ্যাত শেফ দিয়ে! তারপরও যে ভাবে বললি যেন তুই সব করছিস!”

“এতো প্যাচাল পাড়ছিস কেন, আমাদের পরিবারে প্রথম মেয়েকে দেখতে আসছে বলে কথা। ছোট আব্বুরাও সকালে চলে এসেছেন। একটু পরেই ফুফুরাও আসবে হয় তো।”

“বাবারে এলাহী কান্ড!”

“হুহ তোদের ওখানে যেন হয় না?”

“ভাই আমাদের এতো ক্যাচাল নাই, আপুকে দেখতে আসছিল আর রেস্টুরেন্ট বুক করেছিল। যা করার ওরাই করেছে। আমরা জাস্ট আলাপ আলোচনা করেছি। এটাই সিম্পল ওয়ে।এখনো কেউ বাসায় এনে এতো প্যারা নেয়?”

“কিছু করার নেই, আমাদের এখানে এমনি হয়।”

“আচ্ছা কাল তাহলে আসিস। রাখছি।”

“ওকে বায়”

“ঐ পাপিতা দাঁড়া দাঁড়া…

“কি বল?”

“তুই আবার ওদের সামনে যাইস না..”

পাপিয়া বিরক্ত গলায় বললো, “তুই এখনো আগের দিনে আছিস যে একজনকে দেখতে এসে আরেকজনকে পছন্দ করে ফেলবে?”

“দেখ মামা যুগ বদলাইলেও খাসিলত বদলায় নাই। আমরা সবাই বেটার অপশন খুঁজি। যদিও কুহু আপু দেখতে তোর চেয়ে বেটার। কিন্তু কিছু আবাল আছে বুঝলি, যাদের চোখে তুইই আটকাবি।”

“বলছে তোরে।”

“আমার কথা অবহেলা করিস না। পরে পস্তাবি। বিয়ে কনফার্ম না হওয়া অবদি ঐদিকে পা মারাইস না…”

পাপিয়া ফোন রেখে দিলো। রিজভীর মাথায় আসলেই সমস্যা আছে। অথবা ওর চোখ নাই। কুহু আপুর গায়ের রং থেকে শুরু করে সবকিছুই বেস্ট। তাকে ফেলে ওর দিকে কেউ নজর দিবে এ ভাবাও বোকামি। যদিও সে দেখতে কোনো অংশে কম না। তবে কুহুর তুলনায় কমই!

জাওয়াদ ল্যাপটপে কিসব টাইপ করায় বিজি। আরওয়া তার সামনে অযথাই ঘুরঘুর করছে। নাহ এরকম চুপচাপ থাকা তার পক্ষে আর সম্ভব না। সে জাওয়াদের সামনে দাঁড়িয়ে বললো, “আপনার এই প্রেমিকাটা কে কিছুক্ষণের জন্য ছাড়বেন?”

“জরুরী কাজ করছি আরওয়া। ডিস্টার্ব করো না।”

“সারাদিন তো কাজই চলে আপনার। রাখুন না এটা, আমি বোর হচ্ছি।”

“ওয়েট আর অল্প।”

আরওয়া বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। বেকার জীবনযাপন করার চেয়ে কঠিন কাজ এই মুহূর্তে আর কিছুই মনে হচ্ছে না। জাওয়াদ ল্যাপটপ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আরওয়ার দিকে তাকালো। আরওয়া মনমরা হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। জাওয়াদ উঠে তার পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো, দু’হাতে কোমর জড়িয়ে বললো,” মন খারাপ করলে?”

“নাহ মন খুশি করেছি!”

“এটা আবার কেমন কথা?”

“এটা হলো আরওয়া কথা।”

“নাইস!”

“হুহ! উঠে এলেন কেন যান না যান ঐ রাক্ষসীকে কোলে নিয়ে বসে থাকেন। ও ই আপনার সবচেয়ে প্রিয়।”

“তুমি এতো হিংসুটে আরওয়া? ওটা জাস্ট একটা ডিভাইস…”

“সে যাই হোক আমার চেয়ে ওর প্রায়োরিটি ই বেশি এ আমি জানি তো।”

“ভুল জানো না। এটা সত্যিই।”

আরওয়া নাক ফুলিয়ে ওর হাত সরিয়ে বললো, “জানি তো আমি। ঘটাও করে বলতে হবে না। যন্ত্রমানবের কাছে যন্ত্রই সব হয়। আমিই অযথা রক্তে মাংসে গড়া মানুষ আপনার জীবনে উড়ে এসে জুড়ে বসেছি।”

জাওয়াদ ওর নাক টেনে বললো, “রেগে গেলেই তোমার নাকটা এমন ফুলে উঠে না দেখতে একদম….”

“বলবেন না আমি শুনতে ইচ্ছুক না।”

“আরেহ শুনবা তো আগে।”

“আমি জানি আপনি এমন কিছুর সঙ্গে তুলনা করবেন যা শুনে আমার মেজাজ আরো বেশি খারাপ হবে!”

“তুমি দেখছি আমাকে ভালোই চিনেছ! কিন্তু না বললে তো হবেনা আমার। তুমি যখন রেগে নাক ফুলাও তোমাকে একদম ফণা তোলা সাপের মতোই লাগে।”

আরওয়া বিবর্ণমুখে ওর দিকে তাকিয়ে বললো,‌”শেষে কি না ফণা তোলা সাপ! মানুষ তার ওয়াইফকে কত সুন্দর উপমা দেয় আর আপনি!”

“যখন যেটা মিলে সেটা বলবো না? আমি তো তখন রীতিমতো ভয়ে থাকি কখন আবার সেদিনের মতো ছোবল মারো।”

“মেজাজ খারাপ করলে শাস্তি তো পাবেনই।”

জাওয়াদ বাকা হেসে বলল,”মেজাজ খারাপ হলে যে শাস্তি দেয়, মেজাজ ভালো হলে সে নিরব থাকে কেন? এটা তো অন্যায়!”

“মানে?”

“মানে কাল তো তুমি খুব আনন্দিত ছিলে, রিওয়ার্ড তো পেলাম না! এটলিস্ট একটা চুমু তো ডিসার্ব করি নাকি?”

আরওয়া হা করে ওর দিকে চেয়ে রইলো রুষ্ট গলায় বলল, “আপনি তো ভালো ই লুচু, আগে তো বুঝি নি!”

জাওয়াদ ডোন্ট কেয়ার মুডে বলল, “বউয়ের সামনে সভ্য থাকলে প্রজন্ম আগায় না। লুচু হতেই হয়।”

“এহহ! এতো দিন তো ঠিকই রোবট ছিলেন। অনুভূতি এলো কবে?”

“অনুভূতি ছিলো না মানছি তবে রোবট নই। রোবট হলে তোমায় হুটহাট চুমু খেতাম না, এইটুকু বোঝা উচিত ছিল!”

“হুহ সবকটা তো রাগের বশেই ছিল আপনার।”

জাওয়াদ ওর মাথায় টোকা দিয়ে বলল, “বড় হও সোনা! তুমি এখনো অনেক পিচ্চি!”

আরওয়া নিজের মাথা ঘষে বলল, “আমি মোটেও পিচ্চি না….”

চলবে…

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব২৪

#আরশিয়া_জান্নাত

২৪

বেশ সাদামাটা অবস্থায় কুহু পাত্রপক্ষের সামনে যায়। এতে অবশ্য তাদের সুবিধা ই হয়েছে। মেকাপের কৃত্রিম আস্তরণে আসল চেহারা বোঝার উপায় থাকেনা। কুহু দেখতে চমৎকার মেয়ে! এমনিতে ওর গায়ের রং ফর্সা না তবে বেশ পরিষ্কার। সে নিজের ত্বকের যত্নে একটুও ছাড় দেয় না। ও খাবার খেতে ভুলে যেতে পারে কিন্তু স্কিনকেয়ার করতে কখনোই ভুলে না। ৫ফুট ৪ইঞ্চি হাইটের ছিমছাম গড়নের বাঙালি মেয়ে, পিঠ অবদি ঝলমলে বাদামি রঙের চুল। এটা অবশ্য কৃত্রিম উপায়ে করা। তাকে দেখে বাইরের গেস্ট রা অবাক না হলেও বাসার সবাই বেশ অবাকই হলেন বটে! সে যাই হোক উনাদের কুহুকে পছন্দ না করার কোনো কারণ থাকে না। এক প্রকার পাকা কথা দিয়ে ই উনারা বিদায় নেন। কিন্তু জোবায়ের সাহেবের গম্ভীর চেহেরা দেখে বাড়ির কেউই আনন্দ প্রকাশের সাহস পায় না। তিনি থমথমে গলায় বললেন, “বড় বৌমা, তোমার ভাইকে বলবে নেক্সটবার যেন দেখেশুনে সম্বন্ধ আনে। এখানে বিয়ে দেওয়ার চিন্তা ও মাথায় এনো না।”

তার ঐটুকু কথাই যথেষ্ট হয়ে যায় কোহিনুরের নাকের পানি চোখের পানি এক করতে। সবাই বুঝে নিলেন এখানে আর আশা নেই।
জোবায়ের সাহেব নিজের ঘরে যেতেই সালমাও তার পিছু পিছু আসেন। ধীর গলায় বললেন, “কি হয়েছে হঠাৎ আপনি একদম না করে দিলেন?”

জোবায়ের সাহেব ইজিচেয়ারে বসে বললেন, “বাহ্যিকভাবে কোনো কিছু যাচাই করো না। তুমি ছেলের চায়ের কাপ ধরা দেখেছ? ও মাদকসেবী এ আমি হলফ করে বলতে পারি। বিশ্বাস না হলে তোমার বড় ছেলেকে বলো খোঁজ নিতে। আমি বেঁচে থাকতে এই ছেলের সঙ্গে আমার নাতনিকে বিয়ে দিবো না। ছেলে গরীব হলেও চলে কিন্তু মাদকাসক্ত আর চরিত্রহীন হলে চলে না।”

সালমা আর কোনো কথা বললেন না চুপচাপ বেরিয়ে গেলেন। কথাটা হাওয়ার গতিতে পুরো বাড়ি ছড়িয়ে গেল নাহিয়ানের বাবা নূর মোহাম্মদ রেগে অস্থির হয়ে উঠলেন সমন্ধির উপর। সাথে সাথে লোক লাগানো হলো ছেলের যাবতীয় খবরাখবর বের করতে। যদি এটা সত্যি হয় তবে কি ঘটবে বলা বাহুল্য!!

কিছু ক্ষণ আগেও যে বাড়িতে উৎসবের আমেজ ছিল এখন সেটা গোরস্থানে পরিণত হয়েছে। পাপিয়া মন খারাপ করে কুহুর ঘরে গেল। উদাস গলায় বলল, “যদি দাদাসাহেব এর ধারণা সত্যি হয় বড় মামাদের সাথে আর কোনো সম্পর্ক রাখতে দিবেনা বড় আব্বু! কি হবে তখন বুঝতে পারছিস আপু?”

“ভুল করলে ভুলের শাস্তি তো পেতেই হবে। এমনিতেই উনাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বিশেষ সুবিধার না। আম্মু এই সুযোগে নিজের ভাইয়ের একটা ভালো ইমেজ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। মামার উচিত ছিল ভালোমতো খোঁজখবর নিয়ে আগানো।”

“মানুষের ভেতর কি আছে তা কি বাইরে থেকে বলা যায় আপু? হয়তো মামা ভেবেছিলেন ছেলে ভালো ফার্মে জব করে, শিক্ষিত ও ধনী পরিবারে। আর কি চাই?! এখন ছেলের ভেতরের খবর কে জানবে?”

কুহু মোবাইল রেখে পাপিয়ার দিকে তাকালো। সিরিয়াস গলায় বলল, “পাপ্পি তুই এখনো অপরিপক্ক। বাইরের মানুষের হিসাবনিকাশ বুঝিস না। মানছি বাইরে থেকে মানুষ কে চেনা যায় না। তবে একতরফা অতো প্রশংসা করার কি দরকার ছিল? উনি যে পরিমাণ ভালো ভালো কথা বলে সময় নষ্ট করেছে ঐ সময়টায় লোক দিয়ে খোঁজখবর নিতে পারতেন না?
এখনের যুগে কারো ভেতরের খবর বের করতে গোয়েন্দা লাগে? বাড়ির সামনের চায়ের দোকানে বসলেই অর্ধেক খবর পাওয়া যায় বুঝলি!”

“বড় আম্মু কান্নাকাটি করছে। তুই গিয়ে উনাকে সান্ত্বনা দিবি?”

কুহু হাই তুলে বলল,” ওটার জন্য বাড়িতে অনেক লোক আছে। তুই গিয়ে রাহেলা খালাকে বলিস আমার জন্য ফ্রুট সালাদ টা নিয়ে আসতে। আমি কিন্তু আজ রাতে ভাত খাবো। বলবি ভালো আইটেম গুলো যেন রাখে আমার জন্য।”

পাপিয়া মনে মনে বলল, “তুই আসলেই অদ্ভুত রে! এমন পরিস্থিতিতে ও কত স্বাভাবিক আছিস!”

আরওয়া শাওয়ার নিয়ে সাবার দেওয়া নাইটিটা পড়লো। বেচারি যখন এতো শখ করে দিয়েছে না পড়াটা অন্যায় হবে। চুলে টাওয়েল জড়িয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বেশ আয়েশ করে ড্রেসিং টেবিলের সামনের চেয়ারে বসে মুখে ক্রিম দিয়ে, হাতেপায়ে লোশন মাখলো। আজকের হাইকিং টা দারুণ ছিল। এতোক্ষণ খুব টায়ার্ড লাগলেও শাওয়ার নেওয়ার পর শান্তি লাগছে। ফেরার সময় দুজনেই ডিনার করে আসায় আপাতত বিশেষ খিদে নেই। এখন জাওয়াদ ফিরলেই আরাম করে ঘুম দিবে। জাওয়াদ যে কোথায় গেল কে জানে। একটু আসছি বলে যে বেরিয়েছে আধা ঘন্টা হয়ে গেল ফেরার নাম নেই। আরওয়া নিজের ফোন বের করে জাওয়াদকে কল করলো দু তিনবার রিং পড়তেই দরজা খোলার শব্দ এলো। আরওয়া ফোন কানে রেখেই পেছনে ফিরলো। জাওয়াদকে দেখে বললো, ” এই আপনার ২মিনিটে আসা?”

জাওয়াদ হাতে থাকা প্যাকেটগুলো রেখে বললো, “আর্লি ডিনার করে তো চলে এসেছি। রাতে যদি তোমার ক্ষুধা পায়? তাই হালকা কিছু নিয়ে এসেছি।”

আরওয়া ওর গলা জড়িয়ে আদুরে গলায় বললো,”ওওও সো কেয়ারিং জামাই!!!”

” তাই নাকি!”

“হুম অবশ্যই।”

“আচ্ছা তুমি বসো আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।”

“ওকে”

আরওয়া প্যাকেট থেকে খাবারগুলো বের করে টেবিলের উপর রাখলো। টাওয়েল সরিয়ে চুলগুলো মুছে বেলকনিতে সেটা মেলে দিয়ে আসলো। জাওয়াদ বের হয়ে হঠাৎ ওর দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো। টিপ্পনী কেটে বললো, “সকালের কথায় কাজ হয়েছে দেখছি। রিওয়ার্ড দিতে একদম তৈরি হয়ে বসে আছ,এমেজিং! এই না হলে আরওয়া!”

আরওয়া জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে ভ্রু উঁচিয়ে বলল, “মানে?”

জাওয়াদ ওর দিকে কদম এগিয়ে বললো, “সত্যিই বোঝো না নাকি বুঝেও না বোঝার ভান ধরো হুম? ”

আরওয়া পেছাতে পেছাতে বললো,”আপনি বাংলা সিনেমার গুন্ডাদের মতো এগিয়ে আসছেন কেন?”

জাওয়াদ থমকে বললো, “আমি বাংলা সিনেমার গুন্ডা?”

“ভাবভঙ্গি তো ওটাই। পুরাই মিশা সওদাগরের মতো।”

জাওয়াদ ভোঁতা মুখে বললো, “সিরিয়াসলি আরওয়া? আমাকে তোমার মিশা সওদাগর মনে হলো?”

“যখন যেটা মিলে সেটা বলবো না?”

জাওয়াদ আরওয়ার পিঞ্চটা বুঝতে পেরে বললো, তুমি এতো মিন! কথাটা ব্যাক না করে হজম করলে না।”

“আরওয়া ঋণ রাখেনা। যা পায় তা শোধ করেই দম ফেলে।”

জাওয়াদ আর কথা বাড়ালো না। জেগে উঠা অনুভূতি একপাশে সরিয়ে বেলকনিতে চলে গেল। আরওয়া হঠাৎ কি মনে করে বেলকনিতে গিয়ে জাওয়াদকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরলো, পিঠে গাল ঠেকিয়ে বললো, ” রাগ করলেন”

“নাহ।”

“করেছেন, আপনার গলা শুনেই বোঝা যাচ্ছে।”

জাওয়াদ ওর দিকে ফিরে বললো, ” আমার রাগ করাটা অহেতুক জানি। আমি মজা করে বলেছিলাম তুমি সেটা ফেরত দিয়েছ। এটা স্বাভাবিক হয়তো। কিন্তু আমাকে প্রতিপক্ষ ভেবো না আরওয়া। আমার ভয় লাগে এটা!”

“ওভারথিংক করবেন না জনাব। সহজভাবে নিতে‌ শিখুন এটা স্বাভাবিক মনে হবে। আমি জানি আপনার এই ফোবিয়া ওভারকাম করা সহজ না, আমরা চেষ্টা তো করতে পারি তাই না? খুঁত ধরা বা বৈশিষ্ট্য মিলিয়ে ফেলার প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেই দেখবেন সব ঠিকঠাক।”

“চেষ্টা করবো…”

“আমি ও চেষ্টা করবো আপনাকে রিভেঞ্জ টাইপ রিপ্লাই না করতে।”

জাওয়াদ মুচকি হেসে বলল, “আমাকে বোঝার জন্য ধন্যবাদ আরওয়া! আমি সত্যিই কৃতজ্ঞ।”

আরওয়া দু হাত মেলে বলল, “কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার সুযোগ দিচ্ছি, আমায় ভালোবেসে পুষিয়ে দিন!”

জাওয়াদ ওকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বলল, “কত ভালোবাসা চাই তোমার শুনি?”

“যতোটা ভালোবাসলে অন্য কাউকে ভালোবাসার মতো জায়গা অবশিষ্ট থাকবেনা, ততোটা ভালোবাসুন।”

জাওয়াদ আলগোছে তাকে কোলে তুলে বলল,”ভায়োলেট কালার তোমার জন্য নিষিদ্ধ করা হলো। এই কালারটা জাস্ট আমার সামনে পড়বে। মনে থাকবে?”

“কেন এই কালারে আমাকে মানাচ্ছে না?”

জাওয়াদ ওর কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,”মাথা নষ্ট করার মতো মানিয়েছে, আজ না আমি বেপরোয়া হয়ে যাই!!”

আরওয়া ওর টিশার্ট খামচে বললো, “উহু আজ নয় আজ নয়। আমি খুব টায়ার্ড।”

জাওয়াদ তার গলার ভাঁজে নাক ডুবিয়ে নেশাতুর গলায় বলল, “এই মেয়ে মাত্রই না বললে অনেক ভালোবাসা চাই? এখন মত বদলালে তো হবে না।”
বলেই পরম যত্নে সহস্র আদরে ভরিয়ে দিতে লাগলো। জাওয়াদের প্রেমের বর্ষণে ভিজে একাকার হতে লাগলো আরওয়া।


কাল সকালে ওরা বাংলাদেশে ফিরে যাবে। তাই
মিস্টার ইয়োশি আজ তাদের বাড়িতে জাওয়াদদের নিমন্ত্রণ করেছে। সাম্য তাদের জন্য বেশকিছু ফলমূল ও উপহার সামগ্রী কিনে গাড়িতে রেখেছে। জাওয়াদের মন জয় করতে এমন কিছু বাকি নেই যা সে করছেনা। এতে যদি অন্তত তার চাকরি টা বাঁচে! সাম্যর খুব পছন্দের শহর টোকিও। এখানে ঘুরছে ফিরছে ঠিকই কিন্তু মনটা অশান্তি তে আছে। আজ যদি এই টেনশন না থাকতো সেও মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াতে পারতো। তবে এইটুকু স্বস্তির ছোটবোনের পছন্দসই শপিং সে করতে পেরেছে।

চলবে,,