শূন্যলতা পর্ব-০৮

0
96

#শূন্যলতা
#গুঞ্জন_চৈতি
পর্ব-৮

মধ্যরাতে জ্ঞান ফিরলো গুটির। শক্তপোক্ত মানিক এবার অসহায় বোধ করতে লাগলো। গুটির কতশত প্রশ্নের সম্মুখীন তাকে হতে হবে। সামলাতে পারবে তো? নড়েচড়ে বসলো মানিক। কিন্তু মনের ভাবনা বাস্তব হলো না। গুটির জ্ঞান ফেরার পর না করলো কোন প্রশ্ন, না হলো উতলা। আলগোছে উঠে বসলো চুপচাপ। মানিক শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“খারাপ লাগছে?”
গুটি উত্তর না দিয়ে বলে উঠলো,
“ওনাকে ধরে নিয়ে গেল আর উনি কোন প্রশ্ন করলেন না, আপনাকে চুপ করিয়ে দিলেন, পুলিশও বেশি কিছু বলল না। উনি আগে থেকেই জানতেন এসব হবে, তাই-না?”
মানিক জবাব দিলো না। গুটি মাথায় হাত চেপে বসে রইলো। পুনরায় প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হলো না তবে উত্তর সাজাতে ইচ্ছে করলো। মনে মনে ভাবতে ইচ্ছে করলো কি হতে চলেছে তার সাথে? কি যেন ভাবতে ভাবতে হটাৎ মানিককে বলে উঠলো,
“ভুল পথের ফুল হয়ে ফোঁটার চেয়ে ঠিক পথের ঝরা পাপড়ি হয়ে পায়ের ধুলো মেখে অনাদরে পড়ে থাকা ঢের ভালো। সঠিক মানুষ না জুটলেও সঠিক পায়ের ধুলো অন্তত জোটে কপালে।”
মানিক অনেক কিছু বলতে গিয়েও বলল না। ভরসার চাহনিতে মুচকি হেসে চলে গেল নিজ কক্ষে। গুটি বসে রইলো ভোরের অপেক্ষায়।

পরের দিন সকাল হতে না হতেই গুটি মানিকের সঙ্গে থানায় যাওয়ার জেদ ধরলো। মানিকের একটাই কথা, সরণের বারণ আছে। সকাল থেকে দুপুর অব্দি গুটি জেদ দেখিয়ে বসে রইলো গো ধরে। থানায় গিয়ে বিস্তারিত জানতে চায় আর কথা বলতে চায় সরণের সাথে। বিশ্বাস, অবিশ্বাস আর অনিশ্চিয়তায় ক্লান্ত সে। কিন্তু মানিককে কোনভাবে টলাতে পারলো না। দুপুরে মানিক কোন এক বিশেষ প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে গেলে গুটি একটুখানি খবরের আশায় টিভির সামনে বসলো। খবরের চ্যানেল ঘেটে যা জানতে পারলো তাতে খেই হারালো গুটি। চিন্তায় কুল-কিনারাহীন। ছাত্রনেতা সরণ তালুকদার বাবার খুনের দায়ে আটক! খবরটা গুটিকে ছন্নছাড়া করে তুললো। বীরেন তালুকদার মরে থাকলে খুনী তো সে নিজে, সরণ কি করে খুনী হতে পারে? নানান আশংকা আর চিন্তা মিলিয়ে বুকের বাঁপাশ ভারী হতে লাগলো। মস্তিষ্ক হয়ে উঠলো ভীতসন্ত্রস্ত। প্রতিটা খবরের চ্যানেলে কমবেশি একই খবর ঘুরিয়ে ফিরিয়ে চলছে। সরণের অতীত নিয়ে চলছে টানাহেঁচড়া। গুটি অধৈর্য্যে হয়ে নিজে নিজেই থানার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। আগের দিনের সেই কালো বোরকাটা পড়ে নিয়েছে বেরোনোর আগে। এদিকে মানিক বাসায় ফিরে গুটিকে না পেয়ে দিশেহারা। চলন্ত টিভিতে খবরের চ্যানেল দেখে বুঝে নিল গুটি কতটা জেনেছে। বুঝতে পারলো থানার দিকেই গেছে। গাড়ি নিয়ে বের হলো থানার উদ্দেশ্যে।

একজন সিএনজি চালকের সাহায্যে থানা অব্দি পৌঁছোলো গুটি। থানার ভেতরে ঢুকলো ভয়ে ভয়ে। ঢুকতে গিয়ে নিজের বাবাকে চার-পাঁচজন লোকের সাথে বের হতে দেখে চমকে গেল। নিজেকে আড়াল করে এক কোনে গিয়ে দাঁড়ালো। তার বাবা এখানে কেন? যাদের সাথে বের হলো তাদের মধ্যে একজনকে চিনেও ফেলল তৎক্ষনাৎ। গতকাল ড্রয়িংরুমে অনেকের ভীড়ে একজন ছিলো এই লোকটা। আরও কিছুটা ভেতরে যেতে উদ্যত হলে পেছন থেকে হাতে টান পড়লো। মানিক চলে এসেছে। গুটিকে দেখতে পেয়েই আলগোছে হাতে ধরে বাইরের দিকে নিয়ে যেতে যেতে বলল,
“চুপচাপ চলো গুটিদি। সরণ খুব রেগে যাবে।”
গুটি এক ঝটকায় হাত ছাড়িয়ে থানার ভেতরে চলে গেল বড় বড় পা ফেলে। মানিক থানার ভেতরে দাঁড়িয়ে পারলো না জোর করে কিছু বলতে, আর না পারলো জোর করে কিছু করতে। পিছু পিছু ছুটে গিয়ে শুধু বলল,
“ওকে কুল, আমি দেখা করিয়ে দিচ্ছি। তুমি কোন স্টেপ নিও না আর মুখও খুলবে না।”
গুটি নিজেও বুঝতে পারছিলো না কি করবে। তাই মানিকের কথামতো পিছু নিলো। মানিক একজন পুলিশ অফিসারের সঙ্গে কথা বলে অনায়াসে কথা বলার ব্যাবস্থা করে দিলো। গুটি খুব একটা কড়াকড়ি টের পেল না থানার পরিবেশে। মনে হলো যেন থানায় আসা আর এসে একজন খুনের অভিযুক্তের সঙ্গে দেখা করা যেন ভাতমাছ।

গুটি সরণের মুখোমুখি হয়ে কিছু বলতে অব্দি পারলো না, সরণ ধমকে উঠলো গুটির পেছনে দাঁড়ানো মানিককে। হন্তদন্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ওই জানোয়ারটা মাত্র বের হলো, গুটিকে দেখেনি তো?”
মানিক মাথা নেড়ে না করলে গুটির দিকে সরণ তাকালো। চোখ দুটো শুধু দেখা যাচ্ছে। ভেজা চোখে চিন্তার স্যাঁতসেঁতে আদোল। তবুও মনকাড়া। ভেজা চোখ জোড়ায় দৃষ্টি কায়েম রেখেই মানিককে বলল,
“ঘুষখোড়টার ছুঁক ছুঁক স্বভাব আছে। ওটাকে একটু সাইডে নিয়ে যা।”
মানিক চলে গেলে গুটিকে হাতের ইশারায় কাছে এসে দাঁড়াতে বলল সরণ। গুটি এলো না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। সরণ মুচকি মুচকি হেসে বলল,
“একটা গোপন কথা, কেউ শুনে ফেললে মুশকিল। প্লিজ, কাম ক্লোজ।”
গুটি চোখ মুছতে মুছতে কাছে এসে দাঁড়ালে সরণ বলল,
“গতকাল বিয়ে হয়েছে আমাদের, হিসেব অনুযায়ী আজ ফুলসজ্জা। ভাইয়ের সঙ্গে বাসায় গিয়ে বউ সাজুন, আমি আসছি।”
গুটির হাত-পা নিশপিশ করে উঠলো রাগে। এদিকে কি দিয়ে কথা শুরু করবে বুঝেও উঠতে পারছে না। তারওপর সরণের দুষ্টু চাহনিতে দুষ্টু কথা। মিশ্র অনুভূতি গুটির। সরণ এবার সিরিয়াস মুখভঙ্গিতে বলল,
“বাসায় যান, আমি চলে আসবো। আমার জন্য দুশ্চিন্তা করে করে ধকল নেবেন না গুটি, রাতে এমনিতেও বেশ ধকল যাবে।”
এটুকু বলে গাল ফুলিয়ে মিচকে একটা হাসি দিল সরণ। গুটি হতবিহ্বল সরণের এমন পরিস্থিতিতে এমন আচরণ আর কথা শুনে। গুটির মুখভঙ্গি যখন দৃঢ় হলো সরণ তখন বুঝলো গুটি প্রশ্নের বান ভাঙতে প্রস্তুত। ওমনি ব্যাঘাত ঘটাতে বলে উঠলো,
“বাসায় যান, আমি আপনার সব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তবেই আপনাকে আপনার থেকে চেয়ে নেবো। যান গুটি। প্লিজ। এখানে কোন প্রশ্ন করবেন না।”
এতটুকু বলেই সরণ মানিককে ডাক দিলো। গুটি সরণকে ভর্ৎসনা করে বলল,
“থানার চৌদ্দ শিকের পেছনে বসে ফুলসজ্জার আলাপ! কি সোজা না?”
“বউ চাইলে বাকি আলাপ বিছানায় সারবো। আই হ্যাভ নো প্রবলেম।”
“বাবা এখানে কেন এসেছিল?”
“বাসায় যান গুটি।”
এপর্যায়ে সরণের মুখভঙ্গি হলো কঠিন। কন্ঠ দৃঢ়। ততক্ষণে মানিকও চলে এসেছে।
“বাসায় যান। সব প্রশ্নের উত্তর সময়মতো পাবেন। মানিক নিয়ে যা ওনাকে।”
গুটির ভীষণ ইচ্ছে করলো জেদ দেখাতে। কিন্তু কোথাও একটা আটকালো। তারওপর পায়ে ভীষণ ব্যাথাও করছে। হাজারটা প্রশ্নের জবাব না নিয়ে শেষমেশ চলে গেল সরণের সামনে থেকে। তবে যেতে-যেতে কানে এলো মানিককে বলা সরণের কথা,
“বাসায় গিয়ে একটা পেইন কিলার দিস ওনাকে। আর সেলাইটা চেক দিস।”

গুটি বাসায় এসে অবাক। ড্রয়িংরুম ভর্তি ফুলের গোডাউন। মানিক থতমত মুখে ফুলগুলো গুটির রুমে নিয়ে বলল,
“আপাতত ওই রুমে যাও, এই রুমে এখন কাজ আছে।”
গুটি যখন একলা বেরিয়ে গিয়েছিল থানায় যাবে বলে, মানিক তখন ফুল কিনতেই গিয়েছিল। এসে গুটিকে না পেয়ে ফুলগুলো ড্রয়িংরুমে ফেলেই তড়িঘড়ি বেরিয়েছিল গুটিকে খুঁজতে।
গুটি বিরক্ত ছিল। এবার লজ্জাও পেল। আবার মাথাভর্তি চিন্তা। চুপচাপ চলে গেল পাশের রুমে।

রাত যখন এগারোটা ছুঁই ছুঁই, গুটি তখন ঘুমে বিভোর। চিন্তারাজ্য থেকে কখন ঘুমের রাজ্যে চলে গেছে, গুটি তা নিজেও জানে না। ঘুমের মাঝে আচমকা টের পেল কারও বাহুডোরে আবদ্ধ হওয়ার মৃদু অনুভূতি। তাকিয়ে বুঝে উঠতে যতটা সময় নিলো, ততক্ষণে সে হাওয়ায় ভাসছে। অর্থাৎ সরণের পাঁজাকোলে তখন আঁটসাঁট সেঁটে আছে। ঘুমের রেষ কাটিয়ে চিৎকার করতে করতেও চুপ করে গেল গুটি। অপ্রস্তুত হয়ে চারদিকে তাকিয়ে মানিকের খোঁজ করলো। এদিকে বুকের বাঁপাশ ধুপধাপ লাফাচ্ছে। সরণ গুটির মনোভাব বুঝে ফিসফিস করে বলল,
“আপনার ভাইকে বাসা থেকে বের করা হয়েছে৷ সে এখন সামনের এপার্টমেন্টে আছে।”
গুটির সময় জ্ঞান আপাতত নেই। রাত ঠিক কটা বাজে জানে না। তবুও ধরেই নিল এখন মধ্যরাত। বলল,
“এই মধ্যরাতে থানা থেকে পালিয়েই এসেছেন নিশ্চয়ই?”
সরণ বন্ধ রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,
“চাপার জোরটা হাতে ট্রান্সফার করুন তো৷ দরজাটা ধাক্কা মারুন।”
গুটি খুব জোরে ধাক্কা মারলো দরজা। দরজা খুললে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইলো সামনে। কাঁচা ফুলের গন্ধটা চট করেই নাকে এসে ধাক্কা দিলো। তেজ কিছুটা কমে এলো গুটির। সরণ রুমে ঢুকে গুটিকে বিছানায় বসিয়ে ওয়ারড্রব থেকে দু’টো প্যাকেট বের করে দিয়ে বলল,
“ঝটপট রেডি হোন তো। বউ সাজবেন।”
রাগে ফেটে পড়লো গুটি। দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,
“আমারে কি পাগল মনে হয়? পাগল? ফুলসজ্জার রঙ লাগছে মনে, হ্যাঁ?”
“বউ সেজে খাটের ঠিক মাঝখানটায় বসবেন। মাথায় ঘোমটাটা মাস্ট। আর ওই কাঁচা ফুলের গয়নাগুলোও। আমি ঘোমটাটা তুলবো, আপনি হাসবেন। অল্প করে। এই এইটুকুনি। তারপর আমি আপনার কপালে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়াবো। গতকালের মতো মাঝখানে কোন হাত থাকবে না। চুমুটা ছোঁবে, আপনাকে আর আমাকে একত্রে। তারপর আপনাকে বুকের ঠিক মাঝখানটায় জড়িয়ে নিয়ে আরাম করে সব বলবো। যদি শুনতে চান আরকি। নয়তো গেলাম আমি শুতে।”
হাই তুলতে তুলতে সরণ বিছানার বালিশ ঠিক করতে লাগল। গুটি আশ্চর্যজনক চাহনিতে চেয়ে আছে। লজ্জা আর রাগে কান্না পাচ্ছে গুটির। মাথায় জেদও চাপছে। ইচ্ছে করছে লোকটার হাত-পা বেঁধে গলায় চা কু ধরে বলতে,
“সব বলবি না দেবো ভবলীলা সাঙ্গ করে?”
গুটি দারুণ জেদ দেখিয়ে বলল,
“আমি এসব কিচ্ছু করবো না। ভাল চানতো এমনিই বলুন, নয়তো আমি…..”
“নয়তো আমি?”
গুটির দু-হাত আচমকা পিছু মুড়িয়ে বলল সরণ। অপ্রস্তুতভাবে গুটি বন্দী হতেই রাগ বেড়ে তার আকাশচুম্বী। পা দিয়ে সরণের পায়ে আঘাত করে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো। ব্যার্থ হলে নখ বসালো সরণের হাতে। সরণ তাতে আরও জাপ্টে ধরে বলল,
“বউ সাজতে হবে না, ঘোমটাও দিতে হবে না, ফুলের গয়নাও দিলাম বাদ, একটু হাসতে তো পারেন, নাকি? হাসতে হাসতে বুকে চলে আসুন, বাকিটুকু স্যাক্রিফাইস করে নিচ্ছি।”
গুটি আচমকা হাত নাড়তে গিয়ে চিৎকার করে উঠলো। সরণ চিন্তিত হয়ে হাত ছেড়ে কি হয়েছে তা জিজ্ঞেস করতেই সরণকে বিছানায় ফেলে দিল গুটি। সরণের দু’হাত চেপে ধরতেও সময় নিল না। কুটিল হেসে দাঁতে দাঁত চেপে গুটি বলল,
“পন্থাটা পুরোনো, একটু ফিল্মি, কিন্তু কার্যকরী।”
সরণ নড়লো চরলো না, প্রতিক্রিয়াও শুন্য। দু’জনের মাঝের কয়েক ইঞ্চি দুরত্ব ঘুচিয়ে শুধু একটা মাত্র কাজ করলো, মাথা উঁচিয়ে শব্দ করে চুমু খেলো গুটির ঠোঁটে। গুটি এক মুহুর্ত থমকে থেকে উঠতে গেলে টান দিয়ে ফেলে দিল বুকের উপর। অতঃপর হলো সেই, যা চেয়েছিল সরণ। বুকের সঙ্গে জাপ্টে ধরে আরাম করে মিইয়ে গেল নরম বিছানায়। একটু বেশি মিইয়ে গেল গুটি। ভেতরের অবস্থা তার ভীষণ নড়বড়ে। পেটের ভেতর মোচড়াচ্ছে। পুরো শরীরে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হচ্ছে অনবরত। আর সরণ? সে অনুভূতি কুড়াতে বন্ধ চোখে শ্বাস গুনছে যেন।

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে