শূন্যলতা পর্ব-১২

0
73

#শূন্যলতা
#গুঞ্জন_চৈতি
পর্ব-১২

গুটির জ্ঞান ফিরেনি এখনও। গুলি লেগেছে হাতে, আর ইটের উপর পড়ে আঘাত লেগেছে মাথায়। তাতে সেলাই পড়েছে তিনটে। আর সরণের হাতে পায়ে আর মাথায় ব্যাণ্ডেজ় পড়েছে বেশ কয়েক জায়গায়। রডের আঘাতে ছেয়ে গেছে পুরো শরীর। কোথাও শুভ্র ব্যাণ্ডেজ় চিঁড়ে উঁকি দিচ্ছে লোহিত রক্ত। আর মনে কড়া নাড়ছে ক্ষোভের প্রলয়। গুটির হাতে গুলি লেগেছিল জিহাদের বন্দুক থেকেই। জিহাদ জ্ঞান হারানোর আগে এলোপাথাড়ি দু’টো গুলি ছুড়েছিল। তার একটা লাগে গুটির হাতে। সরণ ঠিক করে নিয়েছে, জিহাদকে শুধু আইনের শাস্তি নয়, নিজে হাতেও শাস্তি দেবে। তারজন্য যতদূর যেতে হয় সে যাবে। যদি গুলিটা গুটির হাতে না লেগে অন্য কোথাও লাগতো! ভাবতেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো।

“সরণ, তুই তোর কেবিনে গিয়ে রেস্ট নে। গুটিদির জ্ঞান ফিরলে আমি ডেকে দেব।”
সরণের জন্য আলাদা কেবিন নেওয়া হলেও সরণ তাতে এক মুহুর্ত বসেওনি। মানিকের কথা কানে না নিয়ে গুটির পাশ গলিয়ে শুয়ে পড়লো। আলতো করে গুটির শরীরটাকে আগলে নিয়ে বলল,
“আমি চাই ও চোখ খুলে প্রথমে আমাকে দেখুক।”

এমন সময় হসপিটালে উপস্থিত হলো, ফখরুল ইসলাম। সরণ বিচলিত হলো কিনা বোঝা গেল না। ফখরুল ইসলাম সরাসরি কেবিনে ঢুকে এলে সরণ উঠে এগিয়ে এলো। শাসিয়ে বলল,
“খবরদার! এদিকে ভুলেও এগোবেন না। নতুন কোন নোংরা খেলায় মাততে চাইলে ক্যারি অন। আ’ম রেডি ফর এভরি কাইন্ড অফ সিচুয়েশনস।”
“কুল। আমি এখানে জিহাদের চাচা হয়ে আসিনি। এসেছি তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে।”
“হোয়াট?”
“আমরা কি এখানেই কথা বলবো?”
ফখরুল ইসলাম কথাটা মানিককে উদ্দেশ্য করেই বলল। মানিক তা টের পেয়ে বিরবির করে বলল,
“কথা বলার জন্য বাসরঘরের ব্যাবস্থা করবো নাকি।”
সরণ ক্রুদ্ধ স্বরে বলল,
“যা বলার এখানেই বলুন। এখানেই……”
“দেখো, তোমার ঝামেলা জিহাদের সঙ্গে, আমার সঙ্গে নয়। আমি তোমার কোন ক্ষতি করিনি। বরং উপকারই করিছি। জিহাদকে তো একদম অন দ্য স্পটে পুলিশ ধরেছে। ওর বাঁচার চান্স নেই। তুমি ওর বিরুদ্ধে যা খুশি করো, শুধু আমাকে জড়িয়ো না। জিহাদের সঙ্গে আমার নাম জড়িয়ো না। তার বিনিময়ে তোমায় পলিটিকসে পাকাপোক্ত করার দায়িত্ব আমার। তোমার আমাকে প্রয়োজন। আমি তোমার পলিটিকাল লাইফের বিগ সাপোর্ট হতে পারি।”
“আমার না আপনাকে প্রয়োজন আর না আপনার সাপোর্ট। এখান থেকে চলে যান। আপনাকে আমি কোর্টে দেখে নেব।”
“ভুল করছো সরণ। আমি কিন্তু এমন অনেক কিছুই জানি যা তুমি আমাকে বলোনি।”
“হুমকি দিচ্ছেন? আমিও অনেক কিছু জানি যা আপনি না আমাকে বলেছেন আর না দেশের জনগণকে। প্রমাণ হাতে বসে আছি। হাত উপুর করবো নাকি?”
“সরণ! যে খুনের দায়ে জেলের বাতাস লাগালে গায়, সেই খুন যে তোমার বউয়ের হাতে হয়েছে, সেই নিউজ লিক করতে আমার দু’মিনিটও লাগবে না।”
“এক্ষুনি বের না হলে আমার ছেলেপেলে ডাকতে হবে।”
“ভয়ডর নেই কোন? যে বউকে বাঁচাতে খুনের দায় নিজের ঘাড়ে নিলে তাকে যদি ফাঁসিয়ে দিই?”
“আপনি আপনার বিরোধী দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্যকে বীরেন তালুকদারের খুনে ফাঁসিয়ে আমাকে বাঁচিয়েছেন। এখন যদি এই সত্যি তাদের সামনে আসে, আপনি বাঁচবেন তো? ছাড়বে আপনাকে? শেয়াল কুকুরের মতো ছিঁড়ে খাবে না? গুটিকে তো আমি বাঁচিয়ে নেব। কারণ খু ন টা ছিল ওর আত্মরক্ষার একটা পদক্ষেপ।”
ফখরুল ইসলামের চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সরণ বলল,
“কিছু কাজ দেব, যদি হয় ঠিকঠাক, তবে ছেড়ে দেব আপনাকে। কিচ্ছু ফাঁস করবো না।”
“কি কাজ? দেখো…..”
“আপনার মতো আবর্জনার কীট নই আমি। ভালো কাজই দেব। এলাকার কিছু উন্নয়নমূলক কাজ। এখন বিদায় হন। সময়মতো আমি দেখা করে কাজের লিস্ট দিয়ে দেব।”

ফখরুল ইসলাম চলে গেলে সরণ দীর্ঘশ্বাস ফেলে গুটির দিকে ফিরতেই দেখল গুটি চোখ মেলে চেয়ে আছে। মানিক বাইরে চলে গেল দু’জনকে একলা ছেড়ে। সরণ ছুটে গিয়ে গুটির কপালে চুমু খেল। কপালে কপাল ঠেকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কেমন লাগছে এখন? মাথায় ব্যাথা করছে? আর হাতে?”
সরণের প্রশ্নের উত্তর দিল না গুটি। কি যেন ভাবল কিছুক্ষণ। অতঃপর দু’হাতে আঁকড়ে ধরলো সরণের মাথা। হটাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামার মতো হুহু করে কেঁদে উঠলো। কান্নারত অবস্থায় সরণকে আঁকড়ে ধরে বলল,
“এতো লুকোচুরি কেন? কারণ বলতে পারেন? যাকে সব বলা যায় না তাকে ভালোবাসা যায়?”
“ষুহহহহ।”
গুটির ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে চুপ করালো সরণ। বলল,
“এই কথা আমি বেঁচে থাকতে তো দূর, মরে গেলেও বলবে না। আমি তোমাকে কতটা ভালোবাসি তা প্রকাশের কোন উপায় আমার জানা নেই। শুধু এতটুকু বলব, আমার হৃৎস্পন্দন তোমার উপর নির্ভরশীল। তুমি চাইলে সে চলমান, না চাইলে স্থবির।”
“এটা আমার প্রশ্নের উত্তর?”
“এসব জানলে তুমি কষ্ট পেতে, টেনশন করতে…”
“এসব হচ্ছে না? বলতে চাচ্ছেন টেনশন দেননি? কষ্ট দেননি? আমি খুব ভালো আছি? যখন ওরা বলছিল আপনি বেঁচে আছেন কিনা তার ঠিক নেই, তখন আমার কেমন লেগেছিল ধারণা করতে পারেন? এক মুহুর্তের জন্য মনে হয়েছিল আমি হারিয়ে ফেলেছি আপনাকে। মনোবল ফেরাতে নিজের সঙ্গে নিজেকে যুদ্ধ করতে হয়েছে। কোথায় যান, কি করেন, কি হচ্ছে আপনার সাথে কিচ্ছু জানি না আমি। কিচ্ছু জানান না। এভাবে….. ”
গুটির মাথা বুকে চেপে ধরে সরণ তড়িঘড়ি বলল,
“সরি, সরি, সরি….. সরি ফর এভরিথিং। প্লিজ শান্ত হও।”
ক্রমেই অস্থিরতা বাড়তে লাগল গুটির। ফোপাঁতে ফোপাঁতে বলল,
“এই অনুভূতিগুলো কেমন হয় জানেন?”
“আর কখনো কিছু লুকোবো না, প্রমিসসসস।”
“আমার খুনের দায় আপনি কেন নিলেন? আপনার জেল হলে আমি বুঝি খুব সুখে থাকতাম? খুব আনন্দে থাকতাম?”
“আমার কিচ্ছু হতো না। ট্রাস্ট মি, সব জেনে-বুঝেই মাঠে নেমেছিলাম।”
“আমাকে পাগল মনে হয় আপনার? পুলিশ…..”
গুটি থামলো। বলা ভালো, থামতে হলো। সরণের ঠোঁট থামিয়ে দিল তাকে। আলতো চুমু খেয়ে চট করে শুয়েও পড়লো ওর পাশে। বলল,
“কাম ডাউন সুইটহার্ট। কাম ডাউন। আমার কিচ্ছু হয়নি। আর হবেও না। এই আত্মবিশ্বাস ছিল বলেই খুনী হিসেবে নিজের নামটা নিজের লোক দিয়েই পুলিশ অব্দি পৌঁছিয়ে ছিলাম।”
“কী!”
গুটি আৎকে উঠলো। সরণ বুকে হাত দিয়ে অসহায় ভঙ্গিতে বলল,
“এমন লুক দিয়ো না বউ, এখানে লাগে।”
গুটি চোখ মুছে চোখ পাকালো।
সরণ গুটির হাত আঁকড়ে ধরে হাতের উল্টো পিঠে চুমু খেল। ধীরে ধীরে মুখভঙ্গি খানিক ভার হয়ে এলো। গম্ভীর গলায় বলল,
“বীরেন তালুকদার যখন প্রথম প্রথম বিয়ের প্রস্তাব দিতো, তোমার বাবা রাজি হতো না কেন?”
গুটি খানিক অপ্রস্তুত হলো। ওই মানুষটার নাম শুনলে নিজেকে খুনী খুনী লাগে। অপরাধবোধ জাগে না, তবে অস্বস্তি হয়। রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা আর আফসোসের মিশ্র অনুভূতিতে আহত হয় মন মস্তিষ্ক।
“কারণ, তার নেশার খরচ আর সংসার খরচ চালাতাম আমি৷ বিয়ে দিলে ওসব কে সামলাতো?”
নিজেকে সামলে বলল গুটি। সরণ কিঞ্চিৎ ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে উঠলো,
“তাহলে যে মানুষ তোমায় বিয়ে দেবে না বলে বীরেন তালুকদারের সঙ্গে তর্কাতর্কি থেকে হুমকিধামকি অব্দি গিয়েছে, সে কি করে শেষমেশ রাজি হলো? পাগল হয়ে উঠলো তার সাথে তোমার বিয়ে দেওয়ার জন্য।”
“জানি না। তবে বাবার ভাষ্যমতে বীরেন তালুকদারের সাথে বিয়ে হলে নাকি রাজরাণী হতাম আমি। তার তো অনেক টাকা পয়সা।”
“বাজারের বরইতলার সামনে যে ছোটখাটো মার্কেট হচ্ছিল নতুন, সেটা তোমার বাবার নামে হচ্ছিল। জানো সেটা?”
“কী! নাতো। বাবার নামে মার্কেট! অসম্ভব! ওটা তো বীরেন তালুকদারের জায়গা ছিল।”
“ওই মার্কেট আর নগদ এক লক্ষ টাকার বিনিময়ে তোমার বাবাকে বিয়ের জন্য রাজি করিয়েছিল বীরেন তালুকদার। সোজা কথায়, কিনে নিয়েছিল। মার্কেটের লিগ্যাল পেপার আর নগদ টাকা বিয়ের দিন দেওয়ার কথা ছিল।”
“এজন্য বাবা হটাৎ করে এতো বদলে গেল?”
“তোমার বাবাকে তুমি কতটা ভালোবাসো?”
গুটি নিরুত্তর রইলো। সরণ বলল,
“এর আগে একদিন এমনি জিজ্ঞেস করেছিলাম। আন্সার পাইনি। আজ পাবো?”
“ভালোবাসি না, ঘৃণা করি। তবে মন থেকে অভিশাপ দিতে পারি না। ভেতর থেকে আসে না। মনে হয় একদিন সব ঠিক হবে। তার নিজের রক্তই তো আমি। নেশা করে বলে আর পাঁচটা বাবার মতো নয়। এই কথা বলেই নিজেকে শান্তনা দিয়ে আসছি কয়েক বছর হলো।”
সরণ আচমকা বলে উঠলো,
“যদি কখনো জানতে পারো আমি তোমার বাবাকে খু ন করেছি, আমায় আর ভালোবাসবে না?”
আৎকে উঠলো গুটি। স্বাভাবিকের তুলনায় দ্বিগুণ বড় হয়ে গেছে চোখ। এক ঝটকায় সরণের থেকে সরে এসে চোখে চোখ স্থির করে ধীর কন্ঠে বলল,
“ব..বাবা বেঁচে আছে তো?”
সরণের দৃষ্টি গুটির অন্তর আত্মায় কাঁপন ধরালো। সেখানে অকুতোভয় ও দৃঢ়তা দেখতে পাচ্ছে গুটি। সরণ খুব স্বাভাবিক কিন্তু গম্ভীর মুখভঙ্গিতে গুটিকে বুকে টেনে নিল। মাথায় চুমু দিয়ে বলল,
“তুমি সেদিন বাড়ি থেকে পালিয়েছিলে কেন? অসহনীয় দিন তো তোমার কতই গেছে, পালাওনি তো। সেদিন কেন পালালে?”
গুটি শুঁকনো ঢোক গিলে বড় শ্বাস টানলো। মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল,
“আপনাকে খুব ভয় লাগছে। কি করেছেন বাবাকে? বাবা বেঁচে আছে তো?”
সরণের জবাবের অপেক্ষা সইলো না গুটির। পুনরায় অস্থির গলায় বলল,
“সে না মানুষ হিসেবে যোগ্য আর না বাবা হিসেবে। তবুও সে আমার বাবা। এই পৃথিবীতে আমার আপনার আগে এবং পরে ওই বাবা নামক মানুষটা ছাড়া আর কেউ নেই। বাবাকে কি করেছেন?”
সরণ একরোখা কন্ঠে বলল,
“সেদিন কেন পালিয়েছিলে? রাতের অন্ধকারে কেন বেরিয়েছিলে অজানা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে? তোমার বাবার জন্য নয়কি? জোর করে বীরেন তালুকদারের সাথে পরেরদিন বিয়ের তারিখ ঠিক করেছিল না? মন্দিরে বিয়ের কথা ছিল, রাইট? সেজন্য ওইদিন রাতেই আমার ঠিকানা মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলে বিপদ মাথায় নিয়ে। আর তোমার বাবা তোমার পালানোর খবর টের পেয়ে বীরেন তালুকদারকে জানায়। সে পথ আটকায় বিলের মাঝখানে। আর শুরু করে অসভ্যতামি। ঠিক বলছি তো?”
“হ্যা ঠিক বলছেন। আগে বলুন বাবার সাথে কি করেছেন?”

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে