শূন্যলতা পর্ব-০৫

0
117

#শূন্যলতা
#গুঞ্জন_চৈতি
পর্ব-৫

“সুন্দর কন্ঠ শুনে মানুষ বাপের নাম ভুলে যায়, জানা ছিল না। যাইহোক, মনে পড়লে জানাবেন, ওকে? এটুকু বলে কল কেটেছিলেন তিনি। কিছুক্ষণ রাগে গজগজ করে আমি কল করলে তিনবারের বেলায় রিসিভ করে কি বলেছিলেন জানেন? বলেছিলেন, বাপের নাম মনে পড়েছে তাহলে? তাও আবার এতো জলদিই। শার্প ব্রেইন আপনার। কিন্তু মাফ করবেন, আপনার বাপের নাম দিয়ে আমার কাজ নেই। আমার যাকে প্রয়োজন সে আপনি নন তা বুঝেছি। রঙ নাম্বারে কল যাওয়ার জন্য সরি। আর হ্যাঁ, ফ্রীতে মেয়ে মানুষের নাম্বার পেয়েছেন বলে ঠুসঠাস কল করবেন না। ইভটিজিং আর ব্ল্যাকমেইল এর মামলা ঠুকে দেব। রাখছি। খবরদার যদি একটা কল আসে!”
“চুপ করেন! চুপ! অসহ্য লাগতাছে আমার। আমার চারপাশের প্রত্যেকটা মানুষ ধোঁকাবাজ। প্রত্যেকটা মানুষ। প্রথমে বীরেন মেম্বার, তারপর বাবা, তারপর যুথি আর তারপর আপনি। আমার শেষ ভরসা কিনা আপনি আছিলেন! ভাবতেও গা গুলাইতেছে আমার। চুপ চুপ চুপ!”
দু’হাতে মাথা চেপে ধরে চিৎকার করে উঠলো গুটি। সব বিষের মতো লাগছে। এখন মনে হচ্ছে জলে ডুবে মরে কেন গেল না? এর থেকে তো মরণ ভাল ছিল।
“পরিচয় দিইনি বলে আমি ধোঁকাবাজ নই গুটি। আর শেষ ভরসা মানে?”
“চুপ করতে কইছি না আমি? চুপ।”
“আমি কখনো কোন মিথ্যা তো বলিনি। প্রথমদিনের পর আপনি কখনো আমার পরিচয় জানতে চাননি গুটি। আমার ঠিকানাটাও আমি নিজে দিয়েছিলাম…”
“আপনের সাথে আমার আর একটা কথাও নাই। একটাও না। হয় নিজে বাইর হন হাসপাতাল থিকা, নয় আমি বাইর হইয়া যাই।”
“গুটি…”
“চুপ।”
সরণ চলে গেল গুটির সামনে থেকে। গুটি কাঁদতে কাঁদতে বেড থেকে নেমে দাঁড়াতেই মৃদু চিৎকার করে বসে পড়লো মেঝেতে৷ দুম করে দৌড়ের ওপরে পা রাখায় আঘাত লেগেছে ক্ষতস্থানে। সাপে কাটার ক্ষতর পাশে কাঁটাযুক্ত লতার আঁচড় আর শক্ত কিছুর আঘাতও আছে। সেই আঘাতে সেলাই পড়েছে চারটে।
সরণ সাথে সাথেই ছুটে এলো ভেতরে। গুটিকে ধরতে গেলে গুটি না করলো। হুমকি দিল। শুনলো না সরণ। পাঁজা কোলে তুলে বেডে শুইয়ে দিয়ে বলল,
“নিজে থেকে পরিচয় দিই নি বলে ধোঁকাবাজ বলেছেন, এখন কোলে তুলেছি বলে মেয়েবাজ বলবেন না যেন। কিংবা চরিত্রহীন। তাহলে আমিও বলব, আমার কোলে উঠবেন বলেই অসুস্থ পা নিয়ে নামার নাম করে মেঝেতে পড়েছেন। আপনি পড়ে না থাকলে আমি কোলে নিতাম না নিশ্চয়ই?”
“জানের মায়া করেন সরণ তালুকদার। খুব খারাপ মাইয়ার পাল্লায় পড়ছেন। বাপ খুন হইতে হইতে বাঁইচা গেছে, মেম্বার তো চিতায় উঠে উঠে ভাব। চিতায় না উঠলেও ছেঁচা কিন্তু ঠিকি জায়গামতো খাইছে।”
“এই ডায়লগটা দারুণ দিয়েছেন তবে আগেরটা বেশি জোশ ছিলো। আবার বলুন না একটু। কি যেন ছিল? উমমম, বাপের যেডা ছেঁচা গেছে, আপনের হেইডা কাটা না যায়। ক্ল্যাপ ক্ল্যাপ!”
বলেই হুহু করে হেসে উঠলো সরণ। ভীষণ নাটকীয় ভঙ্গিতে শেষ বাক্যটুকু বলেছে। গুটির রাগ কেন যেন নিভে যাচ্ছে। জ্বলে উঠছে অন্যকিছু। এটাকেও হয়তো রাগই বলে, তবে অন্যরকমের। অতীতের কিছু মুহুর্ত মনে পড়তেই গা জ্বলুনি দিয়ে উঠলো দ্বিগুণ। মনে হলো যেন গায়ে কেউ আগুন দিয়েছে। দাঁত কিড়মিড়িয়ে ধীর আওয়াজে বলল,
“ঠান্ডা মাথায় কই, আমার সামনে থিকা যান।”
“যাবো। গিভ মি অনলি টেন মিনিটস। দশ মিনিট আমাকে কথা বলার সুযোগ দিলে যা বলবেন সব শুনবো।”
“কি আত্মবিশ্বাস! দশ মিনিট পট্টি পড়াইলেই আমার রাগ ধুইয়া জল হবো?”
“দশটা মিনিট দিয়ে তো দেখুন।”
“আচ্ছা দিমু। কিন্তু কবে আর কহন তা আমার সিদ্ধান্ত। এহন সরেন আমার চেখের সামনে থিকা।”

সরণ চলে গেল বাইরে। দিনটা পার হলো। পার হলো রাতও। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত দশ মিনিট আর পেল না সরণ। জোরপূর্বক কিছু বলতে গেলে গুটি অস্বাভাবিক বেপরোয়া হয়ে উঠে বিধায় সরণ পারছে না গুটিকে মানাতে। পরেরদিনটার সারাদিন পার করলো গুটি হাসপাতালে বসে। যেখানে ভোরে ঢাকা যাওয়ার কথা সেখানে সন্ধ্যা অব্দি সরণ কথা বলারই সুযোগ পেল না। রাতে দুঃসাহস দেখিয়ে সরণ একটি কান্ড করে বসলো। একজন নার্সকে হাত করে কড়া ডোজের ঘুমের ইনজেকশন দেওয়ালো গুটিকে। অতঃপর ঘুমের মধ্যে গুটি পৌঁছে গেল ঢাকায়। রাতটা গুটির পার হলো সরণের কোলে মাথা রেখে গাড়ির মৃদু ঝাঁকুনিতে। গুটি তা জানতেও পারলো না বুঝতেও পারলো না। সকালে যখন চোখ খুললো, চারদিকে তখন হাসপাতালের রংচটা দেয়ালের পরিবর্তে রঙিন দেয়াল আর দেয়াল জুড়ে দু’জনের স্থিরচিত্র দেখতে পেল। একটা ছোট বাচ্চাকে নিয়ে নাজেহাল মায়ের নানান মুহুর্তের স্মৃতি। চারদিকে তাকিয়ে যখন টের পেল সে আর হাসপাতালে নেই, ঘুমের রেষ তখন বহুদূরে। রাগে কাঁপতে লাগল গুটি। হুড়মুড়িয়ে বিছানা থেকে নামতে গেলে গতকালের ঘটনা পুনরাবৃত্তি ঘটলো। পরে গেল মেঝেতে। সেলাইয়ের জায়গাটায় যেন মোচড় দিয়ে কামড়ে ধরেছে। ধপাস করে ওঠা শব্দ শুনে ওমনি ছুটে এলো সরণ। চোখমুখ দেখে বোঝাই যাচ্ছে সদ্য ঘুম ভাঙা আতংকিত আদল। গুটিকে পা ধরে ঠোঁট কামড়ে ধরে বসে থাকতে দেখে সামনে এসে দাঁড়িয়ে কপাল চেপে ধরে বিড়বিড়িয়ে বলল,
“আবার কোলে নেব? কাল কাটার হুমকি দিয়েছে, আজ না কেটেই দেয়!”
গুটি স্পষ্ট শুনলো কথাখানা। রাগের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে দিলো না। নিরুত্তেজ থেকে নিজে নিজেই বিছানা ধরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলো। সরণ ধরতে এলে ভাল পায়ের হাঁটু গেঁড়ে দিল সরণের দু’পায়ের মাঝখানে। সরণ “আউউউউ” বলে চিল্লিয়ে উঠলো দু-হাত চেপে ধরে। গুটি হিসহিসিয়ে বলল,
“মাফ করবেন, কাঁচি, বটি, রাম দা কিচ্ছু সাথে নাই। থাকলে ছেঁচা দিতাম না। পরেরবার অবশ্যই লগে বটি, কাঁচি কিছু একটা রাখার চেষ্টা করমু।”
সরণ খুব কষ্টের মাঝেও গাল ফুলিয়ে হেসে উঠলো। বিছানায় এসে বসলো আরও দ্বিগুণ কষ্টে। গুটির রণমুর্তি তার এই হাল করবে জানলে একশো গজ দূরে থেকে আজকের দিন পার করতো। ধারণা ছিল গুটি মুখে চেঁচামেচি না করে রাগ দেখাবে অন্যভাবে, কেন যে সাবধান হলো না! মান সম্মান পানি পানি হয়ে গেল।
গুটি দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আপনের সাহস দেখলাম, এহন ধৈর্য দেখমু।”
“যা দেখতে চান সব দেখাবো, সব। শুধু আমার ভবিষ্যতের দিকে পা বাড়াবেন না।”
গুটি ভয়ংকরভাবে তাকালো সরণের দিকে। সরণ মুখ লুকিয়ে বলল,
“না বলে ঢাকা আনার জন্য সরি।”
গুটি চারদিকে চেয়ে বলল,
“ওইটা কি বাথরুম?”
“হুম, আমি নিয়ে যাই?”
“সুস্থ আছেন? আরেকবার ছুইতে আইলে আর থাকপেন না। দূরে থাকেন আমার থিকা।”
গুটি দেয়াল ধরে ধরে এক পায়ে ভর দিয়ে বাথরুমে চলে গেলে সরণ শুয়ে পড়লো বিছানায়। শুয়েই হেসে দিলো। আগে যখন কথা বলতো, তখন টের পেতো মেয়েটার তেজ। মনে মনে ডাকতোও তেজস্বিনী বলে। কিজানি আর কি কি হবে সামনে।

গুটি মিনিট পাঁচেক পর বাথরুম থেকে বেরিয়ে বিছানায় এসে বসলো। সরণ সোজা হয়ে বসলে গুটি কঠোর গলায় বলল,
“দশ মিনিট সময় দিলাম। কন কি কইবেন।”
সরণ থতমত খেলো। আমতা আমতা করে বলল,
“এভাবে হুট করে।”
“তাইলে পুরোহিত ডাইকা আনেন। পঞ্জিকা দেইহা সময় দিই।”
সরণ দুষ্টু হেসে বলল,
“সে ঠিক সময় আনা হবে। এখন আগে ব্রেকফাস্ট করুন, ওষুধ আছে আপনার। তারপর ঠান্ডা মাথায় কথা বলবো।”

খাওয়া দাওয়া শেষ করে সরণ গুটিকে ওষুধ দিতে গেলে গুটি প্রেসক্রিপশন চেয়ে নিজে ওষুধ খেয়ে নিল। তারপর বলল,
“এহন কন কি কইবেন।”
সরণ এবার বলল,
“তিনদিন ভার্সিটি যাইনি, ওদিকে একটু ঝামেলা হয়েছে। আমাকে এক্ষুনি একটু বেরোতে হবে।”
“আমি এতো বড় বাসায় একলা থাকতে পারমু না।”
“মিস করবেন আমাকে?”
গুটি বড় বড় চোখ করে তাকালে সরণ কথা ঘুরিয়ে বলল,
“ঘন্টা দুয়েক লাগবে। একটু এডজাস্ট করে নিন প্লিজ। আমি ল্যাপটপে মুভি দিয়ে যাচ্ছি, সময় কেটে যাবে। আর আসার সময় আপনার জন্য ফোন কিনে আনবো। আপাতত আমারটা রাখুন।”

গুটির পাশে ফোন রেখে পুনরায় বলল,
“ডায়েলে মানিকের নম্বর আছে, কোন প্রয়োজন হলে ফোন করবেন। ও আমার সাথেই থাকবে।”

গুটি কি বলবে ভেবে পেল না। সরণ যেতে যেতে দরজায় দাঁড়িয়ে বলল,
“প্রয়োজন ছাড়াও কল করতে পারেন। আমি কিছু মনে করবো না।”
গুটির চিবুক শক্ত হতে হতে সরণ কেটে পড়লো। গুটি কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে হাতে তুলে নিলো মোবাইল। কোন লক দেওয়া নেই। হয়তো ছিল, তাকে দেবে বলেই লক তুলে ফেলেছে। আঙ্গুল ঠেলে ফোনে ঢুকে সবার আগে ঢুকলো মেসেজ বক্সে। পরপর কিছু সিম কোম্পানির মেসেজের নিচে চাপা পড়া অবস্থায় পেল দু’জনে পুরোনো কথোপকথন। নম্বর সেভ দেখাচ্ছে তেজস্বিনী নামে। নামটা একটু থামালো তাকে। কিছুক্ষণ থমকে থেকে ভেতরে ঢুকলো। তার তরফের মেসেজ খুব অল্প এবং ছোট ছোট। সরণের পাঠানো মেসেজগুলো ইয়া বড় বড়। একটা মেসেজে চোখ আঁটকে গেল গুটির।

“কখনো ভেঙে পড়বেন না গুটি। ভাঙা বস্তু জোরা দিলে চিহ্ন থেকে যায়, দাগ মেটে না। মানুষের ক্ষেত্রেও তাই। একবার ভেঙে পড়ে যেই দাগ মানুষ কুড়িয়ে নেয়, সেই দাগ আজীবন বাধ্য করে বারংবার ভেঙে পড়তে। শক্ত হয়ে দাঁড়ানোর অনুপ্রেরণার বদলে উপহাস জোটে আজীবন। আর এই উপহাস বাইরে থেকে নয়, ভেতর থেকে আসে। কোনদিন মেটে না ব্যার্থতার চিহ্ন। ভেঙে পড়েছেন তো মরেছেন। ভুলেও ভেঙে পড়বেন না। মৃত্যুর আগ অব্দি নিজেকে সব থেকে সুখী মানুষটা ভাবুন। একটা হাত না থাকলে ভাবুন, ভাগ্যিস আরেকটা হাত আছে। কারও তো দু’টো হাতই অক্ষম। যা নেই তা নিয়ে দুঃখী না হয়ে যা আছে তা নিয়ে সুখী হোন। অতীতের একটা অপ্রাপ্তি নিয়ে হতাশ না হয়ে দশটা প্রাপ্তি নিয়ে খুশি হোন। আমি হলফ করে বলতে পারি, মানুষ অতীত হাতড়ে দশদিনের দশটি ঘটনা কিংবা প্রাপ্তি খুঁজলে, তার একটা হবে আফসোসের আর নয়টাই হবে সুখানুভূতির। নিরপেক্ষ মনে খুঁজে তো দেখুন।”

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে