মেহরাম এখনো তার বাবার বাড়িতেই রয়েছে। শশুড় বাড়িতে কুসুম বেগম আর তার বড়ো ভাই আছেন। রোজ কথা হয় সবার সাথেই। মেহরামের এখন ভর পেটে। আট মাস গড়িয়ে নয়ে পরবে পরবে এমন। একটুও ঠিই ভাবে বসে থাকতে পারে না এক জায়গায়। সারা বাড়ি দিনে কতো বার যে চক্কর দেয় তা হিসেব ছাড়া। ওদিকে তনু অন্য রুম থেকে সকাল বেলা নিজের রুমে চলে গেছে। তবে গিয়ে দেখে আয়ুশ নেই, এতে তনু কিছু টা কপাল কুচকায়। রুমের ভেতরে গেতেই দেখে আয়ুশ বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে, হয়তো ব্যাপার টা অনেক সিরিয়ায়া তাই একটু চিল্লিয়ে কথা বলছে। তনু কিছু না বলে ফ্রেশ হতে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর তনু বের হয়ে পরে। সোজা নিচে চলে যায়। এর মধ্যে আয়ুশের সাথে তার কোন রকম কোন কথা হয় না। আয়ুশ তো ল্যাপটপের মাঝেই ঢুকে বসে আছে। এসেই দেখে কণা টেবিলে বসে খাচ্ছে আর তার শাশুড়ী রান্নাঘরে।
তনু;; মা কিছু লাগবে হেল্প করবো?
লায়লা;; না রে এইতো আমার প্রায় শেষ হয়ে গেছে সব কাজ। তুই আয় টেবিলে আয় খেতে বোস। আর আয়ুশ কই?
তনু;; না মানে মা আসলে ও তো কাজ করছে।
লায়লা;; কাল সারা রাত ঘুমায় নি। আমার কাছে কিছুক্ষণ থেকে আবার কাজ করতে বসেছে। এখন আবার। এই শুরু করলো কি। না খেয়ে না দেয়ে না ঘুমিয়ে কাজ।
তনু;; কণা কি লাগবে কিছু দিবো?
কণা;; না না ভাবি তুমি বোস কিছু লাগবে না।
তনু;; মা তুমিও বোস।
লায়লা;; হ্যাঁ বসি (ওপরে আয়ুশের রুমের দিকে তকিয়ে)
কণা;; ভাবি বলছিলাম কি!!
তনু;; কি?
কণা;; না মানে, মেহরাপুর কাছে গেলে কেমন হয়। মেহরাপুর কথা মনে পরছে।
তনু;; ওমা তাই, আচ্ছা যাবো নি বিকেলের দিকে। (হেসে)
কণা;; সত্যি?
তনু;; হ্যাঁ।
আয়ুশ;; না ছেলে টার হলো কি, কণা একটু গিয়ে দেখ না মা।
কণা;; হ্যাঁ যাচ্ছি।
কণা উঠে গিয়ে সোজা তার ভাইয়ের রুমে গেলো। দরজা টা একটু খুলে মাথা বের করে দেখে আয়ুশ নিজের সামনে ল্যাপটপ অন করে দুহাত ভাজ করে মুখের সামনে রেখে দিয়েছে।
কণা;; ভাইয়া!
আয়ুশ;; হুমম।
কণা;; তুই কি না খাওয়ার পণ করছস?
আয়ুশ;; আরে ভাই প্রজেক্টে প্রব্লেম হয়েছে অনেক বড়ো। এখন এটা কি করে সামলাবো তাই ভেবে পাচ্ছি না। কাল থেকে মাথা পুরো হ্যাং মেরে গেছে আমার আর খাওয়া দাওয়া।
কণা;; আচ্ছা বুঝলাম কিন্তু কিছু একটু খেয়ে নে।
আয়ুশ;; আচ্ছা তুই যা আমি আসছি।
কণা;; আচ্ছা
কণার চলে যাওয়ার প্রায় দশ মিনিট পর আয়ুশ নিচে নেমে আসে। তাড়াহুড়ো তে নিজের চোখের চশমা টা খুলতে ভুলে গেছে, তাই চশমা পরেই নিচে নেমে পরেছে। সোজা এসে খাবার টেবিলে বসে কিন্তু তনুর পাশে না। একাই এক জায়গায় বসে টেবিলের। আর আজ সেই সকাল থেকে আয়ুশের সব কাজ গুলো তনু বেশ তীক্ষ্ণ নজরে খেয়াল করছে।
কণা কারো কথা শুনে না আয়ুশের চশমা নিয়ে নিজে পরে নিলো। তনুর দিকে তাকিয়ে একটা ভেটকি দিলো। তনুও মুচকি হাসে। আয়ুশ আর কিছুই না বলে খেতে লাগলো। খাওয়ার মাঝেও কোন কথা নেই, নিজের মন মতো খাচ্ছে। অবশেষে হাফ খাবার খেয়ে আয়ুশ উঠে যায়। নিজের মা কে বলে দ্রুত পায়ে বাইরে বেরিয়ে পরে। তনুর দিকে তাকায় পর্যন্ত না। সবার খাওয়া এখন শেষ। কণা আর লায়লা খাতুন নিচে থাকে তবে তনু নিজের রুমে চলে যায়। এসেই বারান্দায় চলে যায়। বারান্দার বড়ো পর্দা টা সরিয়ে দেয়। বাইরে রোদ উঠেছে কড়া তবে বাতাসও আছে। বারান্দার গ্রিল দিয়ে সাই সাই করে বাতাস প্রবেশ করছে ভেতরে। তনু গ্রিলে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে পরে।
তনু;; নাহ, এভাবে সমুদ্র আর খাদের মাঝখানে ঝুলে থাকতে পারছি না আমি। মনে হচ্ছে আমি কোন কাটা যা সবার মাঝেই খোচা দিচ্ছি। এভাবে আর কতো, আমি পারবো না এভাবে থাকতে। কিছু একটা বিহিত করতেই হবে। ডিভোর্স, হ্যাঁ এটাই বেস্ট হবে আমাদের ডিভোর্স হয়ে যাক। আয়ুশ আয়ুশের মতো আর আমি আমার মতো। কারণ এভাবে সংসার টিকে না। কেমন এক বিষাদময় হয়ে যাচ্ছে সব কিছু। যাচ্ছে না আসলে গেছেই। আমি চলে যাবো আয়ুশের জীবন থেকে। এভাবে কেউ খুশি না। জানি না আমার এই ডিসিশনের পর কার কি অবস্থা হবে বাট হ্যাঁ আমি ডিভোর্স নিয়েই ছাড়বো। আমি আলাদা হবো ভালো লাগে না আর। তখন তো আর কোন দোটানা থাকবে না। আয়ুশের সাথে এই ব্যাপারে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কথা বলতে হবে। (মনে মনে)
।
।
আতিয়া;; মেহরু নে খা।
মেহরাম;; কি?
আতিয়া;; মাংস দিয়ে ভুনা খিচুড়ি। তোর না পছন্দের নে খা।
মেহরাম;; থাংকু চাচি, কখন বানালে?
আতিয়া;; সকালেই।
মেহরাম বসে বসে খাচ্ছে। তখনই তার মা আসে। দেখে তো মনে হচ্ছে বাইরে যাবে। তখনই মেহরাম বলে ওঠে…
মেহরাম;; মা কোথায় যাচ্ছো?
কনিকা;; এইতো বাজারের দিকে যাচ্ছি।
মেহরাম;; শপিং
কনিকা;; হ্যাঁ
মেহরাম;; আমাকেও নিয়ে যাও না!
কনিকা;; এই বাইরে রোদের মাঝে গিয়ে কি করবি। তার চেয়ে বরং এখানেই থাক।
মেহরাম;; আর কতো ঘরে থাকবো বলো। আর ভালো লাগে না একটুও তো বাইরে যেতে দাও। ও মা নিয়ে যাও না।
কনিকা;; যেতে পারবি?
মেহরাম;; হ্যাঁ হ্যাঁ পারবো।
কনিকা;; আচ্ছা চল।
মেহরাম উঠে চলে গেলো। ইদানীং মেহরাম নিজে পুরো বাচ্চা হয়ে গেছে। কিছু না দিলে জেদ করে, হুট হাট রেগে যাওয়া। আকাশ তো এমন ভাব ধরে মনে হয় মেহরাম ওর ছোট বোন আর সে বড়ো ভাই। যাই হোক মেহরাম তার আম্মুর সাথে চলে যায়।
.
কণা;; ভাবি,, ভাবি!
কণার ডাকে তনুর হুস ফিরে। পেছনে তাকিয়ে দেখে কণা হাতে কিছুর ফাইল এনে তনুর কে ডাকছে।
কণা;; ভাবি
তনু;; হ্যাঁ
কণা;; দেখো ভাইয়া তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ফাইল রেখে গেছে অফিসের। দেখে তো মনে হচ্ছে কোন প্রজেক্টের। আর আজ সকালেও ভাইয়া কি যেন এক প্রজেক্টের কথা বলছিলো। হয়তো ওইটার-ই।
তনু;; ওহহ..
কণা;; ভাবি এক কাজ করো না তুমি দ্রুত গিয়ে একটু দিয়ে আসো।
তনু;; আমি আ….
কণা;; ভাবি আমি এখন যেতে পারবো না প্লিজ তুমি একটু যাও না।
তনু;; আচ্ছা ঠিক আছে। দাও
তনু কণার কাছ থেকে ফাইল টা নিয়ে যেমন ছিলো সেভাবেই বের হয়ে পরে আয়ুশের অফিসের উদ্দেশ্যে। বেশ কিছুক্ষণ পর অফিসে এসেও পরে। হাতে ফাইল গুলো নিয়ে তনু সোজা আয়ুশের কেবিনে চলে যায়। তবে কেবিনে গিয়ে একদফা অবাকই হয়। কারণ আয়ুশের কেবিন বেশ এলোমেলো হয়ে আছে। তনু দরজা টা খুলে কপাল কুচকে ভেতরে যায়। টেবিল বেশ অগোছালো। আরো একটু সামনে গিয়ে দেখে আয়ুশ ফোনে আগ-বাবুলা হয়ে কার সাথে যেন কথা বলছে। তনু অবাক হয় কেননা আজ পর্যন্ত সে আয়ুশকে এমন ভাবে রেগে যেতে কখনোই দেখে নি। তনু এক প্রকার ভরকে যায় যে আয়ুশ কে ডাক দিবে কি দিবে না। তবুও কোন রকম করে ডাক দেয়….
তনু;; আ..আয়ুশ
আয়ুশ তনুর কথায় পেছন ঘুড়ে তাকায়। দেখে তনু।
আয়ুশ;; তুমি?
তনু;; হ্যাঁ মানে।
আয়ুশ;; তুমি আবার কেন এসেছো?
তনু;; মানে তুমি ফাইল বাসায় রেখে এসেছিলে তাই তা দিতে এসেছি। ভেবেছি তোমার ইম্পর্ট্যান্ট ফাইল তাই।
আয়ুশ;; আর ইম্পর্ট্যান্ট, প্রজেক্ট ক্যান্সেল হয়ে গেছে।
তনু;; মানে?
আয়ুশ;; মানে মিটিং ক্যান্সেল আর তাতে ঠিক কতো লাক্ষ টাকা ক্ষতি হবে হিসেব নেই।
তনু;; কি, কিন্তু
আয়ুশ;; তনু ফাইল গুলো আর লাগবে না প্লিজ তুমি যাও। আমার মাথা আজ অনেক বেশি গরম। মন-মেজাজ ভালো নেই। তুমি বাড়ি যাও।
তনু;; তোমার মন-মেজাজ ভালো নেই তাতে আমার কি আয়ুশ। অনেক হয়েছে সেই সকাল থেকে দেখে যাচ্ছি। কিভাবে ইগ্নোর করছো তুমি আমাকে। যেন আমি তোমার লাইফে কোন মেটার-ই করি না। থাকা না থাকা সব সমান। কথা বলছো না, তাকাচ্ছো না পর্যন্ত। এতোই তেতো হয়ে গেছি আমি তাই না। কই মেহরাম হলে তো ঠিকই দেখতে তুমি।
একে তো এতো বড়ো একটা প্রজেক্ট হাত ছাড়া হওয়াতে কোম্পানির এতো বড়ো একটা লস হলো আর তার ওপর তনুর এমন বাকা কথা। আয়ুশের রাগে ঘি ঢালার সমান ছিলো। সবসময় কি আর মন-মেজাজ ঠিক থাকে। আয়ুশ তো গেলো চটে।
আয়ুশ;; তনু মুখের লাগাম দাও। তুমি কোন কথা কোথা থেকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো। আমি বলছি অফিসের কথা আর তুমি তা টেনে মেহরামের কাছে নিয়ে যাচ্ছো। তুমি কি। যেই বোন তোমার জন্য এতো কিছু করলো আর এখন তুমি এমন বলছো।
তনু;; শোন মেহরাম আমাকে যতো ভালোবাসে আমিও ঠিক ততো টাই। বোন হয় ও আমার কিন্তু তুমি তো ওকে ভালোবাসো তাই না।
আয়ুশ;; ফর গড সেক তনু এখন এইসব বলো না, কি সব যা তা বলছো এখানে মেহরাম এলো কোথা থেকে।
তনু;; তো কি করবো আমি সকাল থেকে কোন কথা বলছো না কেন?
আয়ুশ;; কারণ আমার মন ভালো নেই। ইচ্ছে করছে না কথা বলতে।
তনু;; কিন্তু আমার সাথেই কেন?
আয়ুশ;; তনু এখন এই সব কথা আমরা অফিসে না বলে বাড়ি তে গিয়েও বলতে পারি কেমন। প্লিজ এখানে সীন ক্রিয়েট করো না তো।
তনু;; এহহ এখন আমি সীন ক্রিয়েট করছি তাই না। মানে সব দোষ আমারই।
আয়ুশ;; তুমি আসলেই খুব বেশি প্যাচালো। একটা কথা কে টেনে অনেক বেশি লম্বা বানাতে পারো।
তনু;; আমারই দোষ কোন দুঃখে যে তোমাকে বিয়ে করেছিলাম আমি।
আয়ুশ;; তো এখন ছেড়ে দাও, থাকতেও চাই না আমি তোমার সাথে।
তনু;; ঠিক বলেছো, আমাদের এখন এক সাথে থাকাই যাবে না।
তনু এই কথা বলে ফাইল টা টেবিলের ওপর রেখে সেখান থেকে এসে পরে। প্রচুর ঝগড়া হয় তার আর আয়ুশের মাঝে। আয়ুশ ফাইল টা টেনে ছিড়ে ফেলে। আর তনু সেখান থেকে কাদতে কাদতে বের হয়ে পরে। তনুর মনে এখন ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আয়ুশ এত্তো টা রুড ভাবে তার সাথে জীবনেও কথা বলে নি কিন্তু আজ। তবে তনুরও দোষ ছিলো একে তো আয়ুশের মেজাজ গরম তার ওপর হুট করেই এই কথা গুলো বলা। তনু কাদতে কাদতে অফিস থেকে বাইরে এসে পরেছে। বাড়ি যেতেও তার ইচ্ছে করছে না কেমন এক মরা মরা ভাব। তনু অফিস থেকে বের হয়ে সোজা হেটেই যাচ্ছে হেটেই যাচ্ছে। হাটতে হাটতে একদম বাইরে এসে পরেছে।
অন্যদিকে মেহরাম তার আম্মুর সাথে বাইরে এসেছে। একটা ট্রলি দাঁড়িয়ে আছে সেখানে অনেক গুলো সবজি বিক্রি করছে। মেহরামের আম্মু সেখানেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সবজি দেখছে। সাথে মেহরাম ও। কি লাগে কি না লাগে সব কিনছে। হঠাৎ মেহরাম অন্যদিকে তাকায়। কিন্তু তাকিয়েই অবাক হয়। কেননা রাস্তার ওপাশে তনু দাঁড়িয়ে আছে। মুখ টা কেমন মলিন হয়ে আছে। চুল গুলো খানিক এলোমেলো। মেহরাম তনুকে দেখে খুশিও হয় আর সাথে অবাক ও। কারণ আরেকটু সামনে এগোলেই আয়ুশের অফিসে তা মেহরাম জানে। তবে তনু এখানে কি করছে তাই ভাবছে সে। মেহরাম তনুর দিকে তাকিয়ে আছে তখন তনুর চোখ ও মেহরামের ওপর পরে।
মেহরাম;; আম্মু দেখো তনু।
কনিকা;; তনু!
মেহরাম;; হ্যাঁ
কনিকা;; কোথায় তনু?
মেহরাম;; আরে ওইযে।
কনিকা;; ওহহ, আরে ডাক দে।
মেহরাম সেখান থেকে একটু এগিয়ে আসে। বারবার নিজের আশেপাশে দেখছে মেহরাম। কারণ এখানে গাড়ির যাতায়াত অনেক বেশি। আর অনেক দ্রুত গতিতে যাচ্ছে সব গাড়ি, যেন ঝড়। তাই খুব সাবধানে নিজের আশেপাশে দেখে কিছুটা এগিয়ে যায় মেহরাম। কনিকা এখনো সবজি দেখছে। কেন শেষ টাকা দিচ্ছে। এদিকে মেহরাম তনুকে হাত নেড়ে ইশারা করছে। কিন্তু তনুর এখন বেশ কান্না পাচ্ছে। বিনা শব্দে চোখে দিয়ে অঝোরে পানি বয়ে যাচ্ছে তার। তনুর মনে শুধু একটা কথাই ঘুরপাক খাচ্ছে যে এই সেই মেহরাম যাকে আয়ুশ পাগলের মতো ভালোবাসে। তাকে বাসে না। মেহরামের সাথে ওর বিয়ের আগে সম্পর্ক ছিলো। এই মেহরামের জন্য আয়ুশের মনের জায়গা কখনো তনুর হবে না। এই মেহরাম। তনুর মাথায় এগুলোই ঘুড়ছিলো তখনই মেহরামের ডাকে তনুর হুস আসে। তনু তার সামনে তাকিয়ে দেখে মেহরাম রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে তনুকে ইশারাতে ডাকছে।
মেহরাম;; তনু,, এই তনুউউউউ!!
তনু মেহরামের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। তারপর সামনে পা বাড়ায়। অন্য কোন দিকে হুস নেই তনুর। কেন যানি শুধু আয়ুশের কথা গুলোই কানে বেজে চলেছে। চারিদিকে শুধু গাড়ির কোলাহলের শব্দ। সাই সাই করে এক একটা গাড়ি যাচ্ছে। তনুর কোন দিকে খেয়াল নেই। সে তার মতো করে সামনে আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে। মেহরামের দিকেই তাকিয়ে আছে সে। হাটতে হাটতে রাস্তার মাঝ বরাবর গেতেই একটা ট্রাক তীব্র গতিতে এসে ঠাস করে তনুর সাথে বারি খায়। ট্রাকটা তনুকে সেখান থেকে ছিটকে দূরে নিয়ে যায়। রক্ত সব জায়গায় ছিটকে পরেছে। ট্রাকের শুধু জোরে একটা শব্দ হলো। মেহরাম তার হাত খানিক ওপরে তুলে তনুকে ডাকছিলো। তনুর আসার দিকেই তাকিয়ে ছিলো সে। হঠাৎ তার চোখের সামনে থেকে এক বড়ো ট্রাক এসে সব চোখের পলকে শেষ করে দিলো। সামনে তনু নেই। শুধু রক্ত আর রক্ত। মানে সবেমাত্রই ঘটনাস্থলে কি থেকে কি হয়ে গেলো কেউই বুঝে উঠতে পারলো না। চারিদিকে ইতোমধ্যে মানুষের কোলাহল শুরু হয়ে গেছে। মেহরামের ওপরে তোলা হাত টা আপনা আপনিই নিচে নেমে আসে। মুখে যেই হাসি টা ছিলো তার রেখা ধীরে ধীরে কমে আসে। কান দিয়ে যেন কোন কথায় যাচ্ছে না। শুধু বুকের ধুকপুকানির শব্দ শোনা যাচ্ছে। এমন আকষ্মিক কান্ডে সবার হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে গেছে। মেহরামের মা ও সামনের দিকে তাকিয়ে আছে।
মেহরাম;; তনুউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউউ।
.
তনুর অনেক বাজে ভাবে এক্সিডেন্ট হয়েছে ট্রাক দিয়ে। আর ট্রাক তো কোন ছোট খাটো গাড়ি না। রাস্তা গুলো রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আর সেখানেই রক্তমাখা শরীর নিয়ে পরে রয়েছে তনু। ট্রাক তার ওপর দিয়ে গেছে। মুখ, নাক দিয়ে রক্ত পরে একাকার অবস্থা। এক দমকা হাওয়া এসে সব কিছু ওলট-পালট করে দিয়ে গেলো। মানুষ অনেক ভয় পেয়েছে তাই কেউ কেউ দূরে সরে যাচ্ছে। আবার কেউ হায় হায় করছে যে এটা কি থেকে কি হলো। যেই রাস্তা মানুষে ভরে ছিলো তা মূহুর্তেই একদম জন-মানব শূন্য হয়ে গেছে। গাড়িও কমে গেছে। তবে মেহরাম এটাই মেনে নিতে পারছে না যে এটা তার চোখের সামনে এটা কি হলো। তনু তার দিকে এগিয়ে আসছিলো আর সেকেন্ডেই তাকে ট্রাক এসে……….। কনিকার হাত থেকে বাজারের ব্যাগ টা নিচে পরে গেছে। মেহরামের বুক টা যেন ফেটে যাচ্ছে। মেহরাম তার পেটে হাত দিয়ে কোন রকমে পা ফেলে দ্রুত তনুর কাছে যায়। গিয়েই তনুর কাছে বসে পরে। তনুর পরনের জামা টা রক্তে লাল হয়ে গেছে। তনুর মাথা টা তুলে মেহরাম তার নিজের কোলে নিয়ে নেয়। নিয়েই একদম বুকফাটা চিৎকার করে বসে। মেহরাম হাউমাউ করে কেদে দেয়। কনিকাও দৌড়ে ছুটে আসে সেখানে।
।
।
।
।
🌱চলবে~~
#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#{বোনাস পার্ট🌼}
মেহরাম তনুর মাথা টা নিজের কোলে নিয়ে হাউমাউ করে কেদে দিলো। কনিকাও ছুটে এলো তনুর কাছে।
মেহরাম;; ততনু, তনু রে তনু। চোখ খোল তনুউউ তনু চোখ খোল বোন আমার চোখ খোল। এই তনু, মা জলদি চাচি আর চাচ্চু কে ফোন দাও। তনু, কেউ এম্বুল্যান্স কে ডাকো প্লিজ। তনুউউউউউউউউ
মেহরাম তো নিজের মধ্যে আর নেই। আর সামনে এখন শুধু তনু আর তনু আছে। সে নিজের চারিদিকে শুধু অন্ধকার দেখছে। কনিকা দ্রুত তনুর বাবা মা কে ফোন করে। তনুর এমন খবর শুনে তনুর মা অজ্ঞান হবার উপক্রম প্রায়। এদিকে মেহরামের অবস্থাও ভালো না। এতো বড়ো পেট তার ওপর তনুর এই অবস্থা। কাদতে কাদতে মেহরামের অবস্থা খুব বেশি খারাপ হয়ে গেছে। কিন্তু তনুর কোন হুস নেই, সে রক্তাক্ত অবস্থায় মেহরামের কোলেই পরে আছে। আর এদিকে মেহরাম শুধু ছটফট করছে। আশে পাশে প্রচুর মানুষের ভীড় জমেছে। সবাই শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। অবস্থা খুব খারাপ, একদম ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছে।
মেহরাম;; তনু তনু চোখ খোল, আমি এই তো ততনু প্লিজ চোখ টা খোলা রাখ। আমি আছি তো ততনু।
মেহরামের আহাজারি তে যেন সেই জায়গা টুকু ফেটে পরছে। এর মধ্যে কেউ হয়তো এম্বুল্যান্স কে ফোল করেছিলো। তবুও বেশ দেরি হয়েছে। এম্বুল্যান্স আসার সাথে সাথে সেখান থেকে তিনজন ওয়ার্ডবয় নেমে আসে। এম্বুল্যান্সের ভেতর থেকে বেড বের করে। ধরাধরি করে তনু কে বেডে শুইয়ে দেওয়া হয়। মেহরাম পেটের ওপরে হাত দিয়ে কোন রকম করে উঠে দাঁড়ায়। উঠেই আবার তনুর কাছে। ঘটনা টা ঘটেছে তনুর সাথে কিন্তু কষ্ট মনে হচ্ছে মেহরামেরই হচ্ছে। মেহরাম আবার উঠে গিয়ে তনুর একটা হাত ধরে। মেহরাম এক প্রকার চিৎকার করছে তনুর হাত ধরে। কনিকা তো তনুর পায়ের কাছে বসে ঢুকরে কাদছে।
মেহরাম;; তনু রে তনু কিছু হবে না তোর। আমি মরে যাবো তোর কিছু হলে। প্লিজ আমাকে আর মারিস না, আমি একদম বরবাদ হয়ে যাবো তোকে ছাড়া। আমি তো এমন কিছুই চাই নি। যা চাই নি তাই হচ্ছে। তনু বোন আমার, কথা বল। তনু রে। আল্লাহ তনুউউউউউ, তনু ওও তনু কথা বল না বোন। তনু
এম্বুল্যান্সের ভেতরে মেহরাম আর কনিকা দুজনেই উঠে বসে পরে। আর যে এম্বুল্যান্স নিয়ে এসেছিলো তিনি মেহরামের আহাজারি দেখে তাকে আসতে আর না বললেন না। এম্বুল্যান্সের ভেতরে মেহরাম তনুর হাত ধরে এখনো বসেই আছে। তনুর রক্ত মাখা হাত টা মেহরাম তার দুহাতের মাঝে নিয়ে কেদেই যাচ্ছে। আর কনিকা তনুর পাশে বসে কাদছে। মেহরাম কয়েকবার চিল্লিয়ে এম্বুল্যান্স কে দ্রুত যেতে বললো। তার প্রায় বিশ মিনিট পর হস্পিটালে আসে এম্বুল্যান্স। একে তো এমন ক্রিটিক্যাল অবস্থা তার ওপর রাস্তায় জ্যাম। সব মিলিয়ে অনেক বেশি দেরি হয়ে গেছে। হস্পিটালের সামনে নেমে দ্রুত তনু কে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। ভেতরে গেতেই ভাগ্যক্রমে ডাক্তার কে পেয়ে যায়। ডাক্তার তনুর অবস্থা দেখেই কপালে আগে হাত দিয়ে দেয়। অনেক ব্লিডিং হয়েছে। সবাই কেবিন রেডি করে দ্রুত তনু কে এডমিট করালো। এদিকে তনুর রক্তে মেহরামের জামা পুরো ভিজে একাকার হয়ে গেছে। তনুর কে ভেতরে নিয়ে গেছে কিন্তু মেহরাম তনুর কেবিনের গ্লাস দিয়ে উকি দিচ্ছে আর হিচকি দিয়ে কাদছে। এমন করতে থাকলে মেহরামের ওপর আবার প্রভাব পরবে তাই কনিকা মেহরামের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
কনিকা;; মেহরাম (কাধে হাত রেখে)
মেহরাম;; ওও মা দে দেখো না, কি.. কি থেকে কি হয়ে গেলো। ততনু
কনিকা;; কিছু হবে না, ভরসা রাখ তনু তোকে ছেড়ে যেতে পারে না। এভাবে কাদিস না ভেংগে পড়িস না সব ঠিক হয়ে যাবে।
মেহরাম;; মা তনুর কিছু হলে আমি পাগল হয়ে যাবো। তনুর কিছু হহহবে না। মা আমি পারবো না তনু আমাকে ছেড়ে,, আম.. আমি আমি মরে যাই হ্যাঁ কিন্তু তনু বেচে থাক। মা তততনু
কনিকা;; চুপ চুপ।
মেহরাম এক প্রকার পাগলামি শুরু করে দিয়েছে। কনিকা তাকে কোন রকমে শান্ত করায়। তখন হস্পিটালে দৌড়ে আতিয়া আর বিল্লাল আসে অর্থাৎ তনুর বাবা মা। তনুর মা তো তনু কে দেখে পরে যেতে ধরে আর মেহরাম সামলে নেয়। মেহরামের চাচি মেহরামকে ধরে কেদে দেয়। সবাই মিলে শান্তনা দিচ্ছে। এটা ছাড়া আর কোন উপায় নেই। কিন্তু তখনই হুট করে মেহরামের মাথায় আয়ুশের চিন্তা আসে। আয়ুশ বা তার বাড়ির কাউকেই কিছুই বলা হয় নি। মেহরাম সেখান থেকে কিছুটা দূরে সরে আসে। এসেই নিজের ফোনে আয়ুশের নাম্বার বের করে কল দেয়।
মেহরাম;; হ্য হ্যা হ্যালো আয়ুশ।
আয়ুশ;; কি হয়েছে এভাবে ফুপাচ্ছো কেন?
মেহরাম;; তনুর, তনুর এক্সিডেন্ট হয়ে গেছে।
আয়ুশ;; কিহহহহহ, কি সব যা তা বলছো। না এটা কি করে। ও একটু আগেই আমার অফিস থেকে বের হয়েছে।
মেহরাম;; আয়ুশ আমি এখন হস্পিটালে আছি। তনুর অবস্থা খারাপ। অনেক ব্লিডিং যাচ্ছে। তুমি এসো।
আয়ুশ;; না না তনুর কিছুই হবে না, হবে না। আর আমি আসছি এখনই। (তড়িঘড়ি করে বের হয়ে)
মেহরাম ফোন টা কেটে দেয়। এদিকে আয়ুশের মাথায় চিন্তার ভর করে বসলো। নরমাল ভাবে লাইফ কেউই লিড করতে পারছে না একটার পর একটা ঝামেলা লেগেই থাকে। আয়ুশ সোজা গাড়িতে উঠে বসে। সে ড্রাইভ করছে আর বারবার তনুর চেহারা টা তার চোখের সামনে ভাসছে। তনুর চিল্লিয়ে কথা বলা, হাসা আবার মেহরামের জন্যও মাঝে মাঝে রেগে যাওয়া। সব, সবই যেন এখন আয়ুশের চোখের সামনে এসে দাড়াচ্ছে। কিছুই ভালো লাগছে না আয়ুশের। খানিক সামনে গেতেই আবার জ্যামে আটকে যায় আয়ুশ। রাগের বশে গাড়ির স্টেয়ারিং-এ জোরে বারি দিয়ে বসে। এদিকে মেহরাম দুহাত দিয়ে নিজের মাথা চেপে ধরে বসে আছে। এভাবেই সময় যাচ্ছে। মেহরাম কণা আর তার শাশুড়ি মা কেও ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে। তারা এক প্রকার ছুটে আসে তনুর খবর শুনে। হস্পিটালে এক ইলাহি কান্ড বেধে গেছে। তার প্রায় বেশ সময় পর আয়ুশ আসে। এসেই দেখে সবাই পাথর হয়ে গেছে। আয়ুশ তনুর মাকে সামলায়। একদম কেদে একাকার হয়ে গেছে। মেহরাম তনুর কেবিনের দিকে তাকিয়ে আছে শূন্য দৃষ্টিতে। মনে হচ্ছে তার মাঝে কোন ফিলিংস নেই। অনুভূতি শূন্য হয়ে গেছে তার। তার মাথায় শুধু একই কথা আসছে যে তনুর কিছু হলে সে পাগল হয়ে যাবে, ঠিক থাকবে না। পুরো দুই ঘন্টা পর ডাক্তার কেবিন থেকে বের হয়। মেহরাম উঠেই সোজা ডাক্তারের সামনে যায়। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে না ডাক্তার কে কারণ ডাক্তার জানে যে সবাই তাকে কি জিজ্ঞেস করতে পারে।
ডাক্তার;; দেখুন, মেয়েটর অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে। খুব বাজে ভাবে যখম হয়েছে। আমরা ব্লাড একদম পরিষ্কার করে দিয়েছি। অক্সিজেন লাগবে তার ব্যাবস্থাও করে দিয়েছি। তবে উনার ব্লাড লাগবে,
মেহরাম;; তনু, তনুর ব্লাড গ্রুপ A+..
ডাক্তার;; আপনাদের মধ্যে কারো A+ আছে?
কনিকা;; আম..আমার আছে। আপনি নিয়ে নিন।
ডাক্তার;; জ্বি আপনি তাহলে আসুন।
কনিকা ডাক্তারের সাথে চলে যায়। মেহরামের মাথা টা খানিক চক্কর দিয়ে উঠলে সে আবার সীটে গিয়ে বসে পরে। মেহরাম আবার না অসুস্থ হয়ে যায় তাই আতিয়া তাকে ধরে রেখেছে। তবে আয়ুশ কেবিনের গ্লাস দিয়ে তনুর দিকে উকি দেয়। খারাপ লাগছে আয়ুশের। আয়ুশের কাছে লাগছে যে হয়তো এটার জন্য সে নিজেই দায়ি। কিন্তু আসলে না, সেখানে তো মেহরামের কথা টা তনুই তুলেছিলো। আয়ুশের মন তখন ভালো ছিলো না এর মধ্যে তনুর এইসব কথা বলা আরো যেন রাগিয়ে দিয়েছিলো তাকে। আর হুট করেই ডিভোর্সের কথা বলায় আয়ুশের মাথা একদম শূন্য হয়ে গিয়েছিলো। তাই রাগ করে ফেলেছে। আর তনু মন মরা হয়েছিলো আর তখনই এই……………………………!! আয়ুশ তার হাত টা কেবিনের গ্লাসের ওপরে রাখে। কিন্তু এই এক্সিডেন্টের পেছনে কারোর হাত নেই। যা হওয়ার ছিলো তা হয়েছে। আয়ুশ তার পেছনে তাকিয়ে দেখে মেহরাম বসে আছে কিন্তু তার জামা তে লেগে আছে তনুর তরতাজা রক্ত। মেহরামের ওপর দিয়ে এখন কি যাচ্ছে তা একমাত্র মেহরাম আর আল্লাহ জানে। ততক্ষণে ডাক্তার আর কনিকা এসে পরেছেন। পুরো দুই ব্যাগ রক্ত দেওয়া হয়েছে। হয়তো পরর্বতীতে আরো লাগলে লাগতে পারে। এভাবেই থাকতে থাকতে রাত হয়ে যায়। মেহরাম ওই যে এক জায়গায় বসেছে এখনো ওই একই জায়গায় বসেই আছে। পাগলের প্রলাপ বকছে মেহরাম। তাকে নিয়ে কোন রকমে বাসায় যাওয়া হয়। কনিকা হস্পিটালেই থেকে গেলো। মেহরাম তার চাচির সাথে বাসায় এসে পরে। বাসায় এসে মেহরাম এখনো তার চাচির সাথে তনুর কথাই বলে যাচ্ছে। আতিয়া কোন রকমে মেহরামের পরনের জামা টা পালটে নিলো। আতিয়া মেহরামকে রুমে রেখে একটু বাইরে গিয়েছিলো। খানিক পরে রুমে এসে দেখে মেহরাম তার রক্তমাখা জামা টা বুকে জড়িয়ে ধরে কাদছে, যেখানে তনুর রক্ত লেগেছিলো। আতিয়া এখন নিজেই কেদেই দেয়। কোন রকমে মেহরামকে ধরে ঠিক করে। তখন মেহরাম আবার তনুর কাছে যাওয়ার জন্য জেদ ধরে বসে। আতিয়া বুঝে যে এখন যদি মেহরামকে হস্পিটালে তনুর কাছে না নিয়ে যাওয়া হয় তাহলে হিতে বিপরীত হবে। তারা হস্পিটালে চলে যায়। মেহরাম গিয়ে দেখে আয়ুশ কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে গ্লাসের ভেতর দিয়ে তনু কে দেখছে। কারো আসার শব্দ শুনে আয়ুশ পেছন ঘুড়ে তাকায়। দেখে মেহরাম। মেহরামকে দেখে আয়ুশ কিছু শুকনো ঢোক গিলে। ডাক্তার সময় দিয়েছে দুইদিন। এই দুইদিনের মাঝে যখন তখন তনুর জ্ঞান ফিরে আসতে পারে।
তনু;; আরে তুই যা করেছিস সেটা আজ কাল নিজের মায়ের পেটের বোন পর্যন্ত করে না। একটা বার নিজের কথা ভাবলি না।
মেহরাম;; যদি নিজের কথাই ভাবার হতো তাহলে আর এই কাজ করতাম না।
তনু;; কিন্তু কেন? তুই, তুই আমাকে একটা বার শুধু একটা বার বলতি আমি সরে যেতাম। তনু নামে যে কোন ব্যাক্তি ছিলো তা পর্যন্ত জানতে দিতাম না।
মেহরাম;; কিভাবে বলতাম হ্যাঁ, কিভাবে বলবো আমি। সেইদিন রাতে মরতে গিয়েছিলি তুই। আর কেন মরতে গিয়েছিলি কারণ তুই শুনেছিলি যে আয়ুশ অন্য কাউকে ভালোবাসে। আর যখন তুই এটা জনতে পারতি যে আয়ুশ আর কাউকেই না বরং তোর-ই বোন এই আমাকে ভালোবসে তখন। তখন সামলাতে পারতি?
তনু;; কিন্তু আম…..
মেহরাম;; আমার পক্ষে সম্ভব না যে তোর চোখের সামনে আমি আর আয়ুশ মিলে যাবো আর কষ্ট হবে তোর।
তনু;; তাই তুই নিজে….
মেহরাম;; দেখ তনু আমি কখনোই চাই না যে কারো জন্য তোর আর আমার সম্পর্ক টা নষ্ট হোক, বিগড়ে যাক। যে কষ্ট টা তোর হতো সেটা আমি আমার ভাগে নিয়ে নিয়েছি।
তনু;; খুব না, মানে খুব মহান হয়ে গেছিস। আয়ুশকে আমার কাছে দিয়ে খুব উদারতার কাজ করে ফেলেছিস তাই না। খুব বড়ো মন তোর। সবাইকে হাসি খুশি রাখার তো তুই একাই ঠেকা নিয়ে রেখেছিস তাই না।
মেহরাম;; তনু এ…..
তনু;; আমি বুঝি নি, আমি সত্যি বুঝি নি যে আমার পিঠ পিছে এতো কিছু হয়েছে। অনেক দক্ষ ভাবে কাজ করিস তুই। টেরই পাওয়া যায় না।
মেহরাম;; আমি শুধু এটা চাইতাম যে তুই খুশি থাকিস।
তনু;; খুশি, এমন খুশির কি লাভ। এক মূহুর্তে আমার দিন দুনিয়া সব উলটে গেছে। আমি খুশি থাকি তুই এটা চাইতি আর তুই তোর কি, আয়ুশ ওই বেচারা টার কি দোষ ছিলো। তুই ওকে কেন এমন বলির পাঠা বানালি। ও আসলে কাকে চায় তা বুঝলি না।
মেহরাম;; তনু মানলাম ও ভালোবাসতো, কিন্তু এটা ভালবাসা আমি ভেবেছি হয়ে যাবে আবার অন্য কারো সাথে। ভুলে যাবে আমায় এক সময় আর তোকে মেনে নিবে। তোকে পেয়ে আমায় ভুলে যাবে, জীবনে এগিয়ে যাবে।
তনু;; জানিস আয়ুশ বিয়ের পর কখনো আমায় মুখ ফুটে বলে নি যে তনু ভালোবাসি। যা বলার বিয়ের আগেই সেইদিন ভার্সিটির মাঠেই প্রথম আর শেষবার বলেছিলো। আয়ুশ পর্যন্ত আমকে একটা বার কিছুই বলে নি। তবে আয়ুশ নিজের কর্তব্য থেকে কোনো দিন পিছ পা হয় নি। সবসময় ঠিক ছিলো। চাইলেই ও ভুল কিছু করতে পারতো কিন্তু না সে করে নি।
মেহরাম;; _______________
তনু;; ও কেন ভুল কিছু করে নি জানিস কারণ ওর নিজের সাথেই সেই প্রথম দিন থেকে ভুল হয়ে আসছে। মেহরু আমি জানি যে তুই আমাকে কত্তো ভালোবাসিস। সেইদিক থেকে ভাবলে তুই তোর বোনের জায়গায়, নিজের জায়গায় একদম ঠিক আছিস। কিন্তু এমন হয় না মেহরু। সবার জীবন এভাবে চলে না।
মেহরাম;; চলছে তো।
তনু;; একে চলা বলে না মেহরাম, ঝুলে থাকা বলে। একটা গাছকে পানি না দিলে তা মরে যায়। সংসারে ভালোবাসা না থাকলে সেটা ভেংে যায়। আমি অচল। না দিতে পারবো কোন দিন কাউকে বাবা হওয়ার সুখ আর না ই পাবো কারো ভালোবাসা।
মেহরাম;; তনু..
তনু;; আমার জন্য, তুই সব আমার জন্য করেছিস তাই না। জানিস এখন আমার নিজেকে কাটা মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে যে আমি কোন তৃতীয় ব্যাক্তি যা তোর আর আয়ুশের মাঝে চলে এসেছি। কেন বললি না আমায় তুই?
মেহরাম;; কি বলবো আমি তখন তোকে কিভাবে হ্যাপি করা যায় তা ভাববো নাকি স্বার্থপরের মতো আমি আর আয়ুশ কিভাবে এক হবো তার কথা ভাববো কোনটা বল। এমনিতেই এই “স্বার্থপর” উপাধি টা তো অনেক আগেই আমি পেয়েছি। আর নতুন করে কি দিবি। তোকে আর আয়ুশকে আমি মিলিয়ে দিয়েছি বলে আমি স্বার্থপর হয়ে গেলাম। আয়ুশের কথা ভাবলাম না। কেন হলাম কারণ শুধু নিজের বোনের কথা ভেবেছি তাই আর তখন যদি তোকে বাদ দিয়ে আমি আর আয়ুশ মিলে যেতাম তাহলে আমি আমার নজরে পরে যেতাম, তাহলেও স্বার্থপর হয়ে গেতাম। তাহলে কোন দিকে যাবো আমি কি করবো। (চিল্লিয়ে)
তনু;; আয়ুশ সেইদিন কেন ওভাবে এসে আমায় প্রোপজ করেছিলো? তুই বলেছিলি তাই না।
মেহরাম;; হ্যাঁ বলেছিলাম।
তনু;; আয়ুশ কেন বললো না আমায়। তুই না হয় পারিস নি। কিন্তু আয়ুশ!
মেহরাম;;_____________
তনু;; কেন বলে নি জানিস, তোকে ভালোবাসে তো তাই।
মেহরাম;; তনু একটু বোঝ প্লিজ…
তনু;; এতোদিন ধরে সব আমিই বুঝে এসেছি। কিন্তু উল্টো ভাবে।
মেহরাম;;_______________
তনু;; এই কষ্ট লাগে না তোর, রক্তে মাংসে গড়া মানুষ না তুই। এতো বড়ো একটা কাজ তুই কিভাবে করতে পারলি?!
মেহরাম;; _______________
তনু;; এখনো ভালোবাসিস আয়ুশকে তাই না?
মেহরাম;; _______________
তনু;; এখন চুপ করে কেন আছিস। বল, আয়ুশ সবসময় মন খারাপ করে থাকতো। কেমন এক উদাস ভাব। আয়ুশ সবকিছু জেদের বশে করেছে তাই না। আমাকে প্রোপজ করা তারপর বিয়ে এই সব কিছুই রাগের বশে তার জেদের বশে করেছে। জানিস নিজেকে এখন আর ওই বাড়ির মানুষ লাগছে না। মনে হচ্ছে আমি ওই বাড়ির কেউ না জাস্ট একজন আউটসাইডার, বাইরের কেউ। কাকে এতো দিন ভালোবেসে এসেছি আয়ুশকে। যে কখনো আমার ছিলোই না। আয়ুশ এটা করে দাও, ওটা করে দাও কত্তো কিছু। সব ভুল মনে হচ্ছে। আমি যাই করি না কেন আয়ুশের মনে তোর জন্য যেই জায়গা আছে সেটা কখনো এই তনুর নামে হবে না। আমার এক তরফা প্রেম তোদের দুই তরফা প্রেমের মাঝে বেড়াজাল হয়ে এসেছিলো। আমার দোষ, আমি আলাদা করেছি তোদের।
মেহরাম;; না তনু, প্লিজ এভাবে বলিস না। তুই কিছুই করিস নি। সব আমার জন্য হয়েছে আর আমি ইচ্ছে করেই করেছি।
তনু;; “” কেউ বা কিছু মানুষ কখনোই জানবে না যে তারা আমাদের মনের কোণে এক বিশাল জায়গা জুড়ে ছিলো “”।
মেহরাম;; জীবনে যে কোন দিন এমনও এক পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে কখনো ভাবি নি। আর আয়ু……
তনু;; খুব বাজে লাগছে জানিস। আয়ুশের জন্য। সাথে রাগ ও। আমার খুশি, আমার হ্যাপিনেস, আমার সব। কেন সব কেন করতে হবে আমার জন্য। আমি আসতাম না তোদের মাঝে। যতটুকু বাকি ছিলো….
মেহরাম;; তা আমি টেনে এনেছি তাই না!
তনু;; না তা বলবো না। আমি বোকা ছিলাম, গাধা ছিলাম তাই সেদিন মরতে যাচ্ছিলাম। এমন কিছু না করলে আজ তুই আয়ুশের হতি। আয়ুশ আর তুই হ্যাপি থাকতি। আর আমাকে এভাবে তিলে তিলে মরতে হতো না।
মেহরাম;;______________
তনু;; আয়ুশের কাছে তোর ছবি পাওয়া, তোর কথা শুনলেই হাইপার হয়ে যাওয়া, সোহেল ভাই আর তুই একসাথে বসে থাকলে সেখান থেকে চলে যাওয়া, আমি বুঝি নি কিছুই। বোকা ছিলাম। আয়ুশে এতো টাই মগ্ন ছিলাম যে বাকি কিছু চোখেই পরেনি। কিন্তু কি লাভ হলো কিচ্ছু না। এতো ভালোবেসে পেলাম কি কিছুই না। কারণ কি জানিস? কারণ তুই যেভাবে আয়ুশকে ভালোবাসিস পাগলের মতো আমি সেই ভাবে আয়ুশকে ভালোবাসতে পারি নি। কোথাও না কোথাও আমার ভালোবাসা তোর ভালোবাসার কাছে অতি নগন্য ছিলো তাই। শুনেছি যে যাকে ভালোবাসা যায় তার খুশির জন্য তার কাছ থেকে দূরেও সরে আসা যায়। তুই দূরে সরেছিস তাই না। কিন্তু এখানে কেউ খুশি না। আর এতে তোর কোন দোষ নেই সব ভাগ্য। আমার জীবন তো তখনই প্রায় শেষ হয়ে গেছিলো যেদিন আমি শুনি যে আমি কখনো মা হবো না। তুই হয়তো আমার ভালো করার জন্য এগুলো করেছিস কিন্তু ভালো থাকা টা আমার কপালেই নেই তাই সবকিছু থেকেও আমার কাছে আজ কিছুই নেই।
মেহরাম;; আমি কি করবো, জীবনে আমার কিছু আছে। আমার মতো অভাগা আছে কি কেউ। কি পেয়েছি আমি কিচ্ছু না। ছোট থেকেই সব হারিয়েই আসছি। কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে যে বাবা ডাকের অর্থ কি আমি বলতে পারবো না। সবাই বলতো ভাই-বোন নেই। আমি বলতাম তুই আছিস। বড়ো হলাম বুঝতে শিখলাম। আয়ুশ আসলো জীবনে ভালোবাসা হয়ে আমি মেনে নিতে পারলাম না। জানিস একাকিত্ব আমায় কুড়ে কুড়ে খায়। বিয়ে হলো, ক্যান্সার নামক জিনিস এসে সব কেড়ে নিলো। তাও তখন যখন আমি প্রেগন্যান্ট। ঝড়ের গতিতে এসে আমার জীবন ওলট-পালট। আর এখন তুই কেন বুঝতে পারছিস যে যা হয়েছে তা হয়ে গেছে।
তনু;; কিছুই হয় নি।
মেহরাম;; তনু
তনু;; এখনো ভালোবাসিস আয়ুশকে তাই না, বল এখনও সেই আগের মতোই ভালোবাসিস তুই?
মেহরাম;; হ্যাঁ এখনো ভালোবাসি, তো? সরাতে পারি না ওকে, ভেবেছি তোদের সামনেই আর আসবো না কখনো। কিন্তু তা আর হয়নি। যার যার জীবনে নির্দিষ্ট একজনের জায়গা থাকে। তা তার নামে লিখা থাকে।ভুলি নি আমি আয়ুশকে ভুলতে পারবো না। কিন্তু এখন এইসবের কোন মানেই হয় না। আলাদা হয়ে গেছি আমরা।
তনু;; সবকিছুরই মানে হয়। আর আমিই এভাবে কিছুই থাকতে দেবো না।
মেহরাম;; তনু, তনু, আমার কথা টা শোন। তনু
মেহরাম তনুকে পেছন থেকে ডাকতে থাকলো কিন্তু তনু মেহরামের কথা না শুনে রুম থেকে বাইরে বের হয়ে পরে। মেহরামের এদিকে দম বন্ধ হয়ে আসছে। অনেক কেদেছে তনুও আর সেও। মেহরাম নিচেই বসে পরে কেদেয় দেয়। ওদিকে তনু ছাদের ওপরে চপে গেছে। রুমের ভেতরে থাকলে হয়তো এখন তনু মরেই যাবে। আর সহ্য করতে পারছে না এইসব কিছু। ছাদের এক কিণারে দাঁড়িয়ে আছে আর বারবার হাতের উল্টো পাশ দিয়ে চোখ মুছছে।
।
।
ওদিকে আয়ুশ একা রুমে বসে বসে হাতে একটা পেনসিল নিয়ে গোড়াচ্ছে। তখনই রুমে আয়ুশের বোন কণা আসে হাতে খাবারের ট্রে নিয়ে।
কণা;; ভাইয়া আসবো?
আয়ুশ;; আরে আয় আয় বলতে হবে নাকি আয়।
কণা;; কি করো?
আয়ুশ;; কিছুনা এমনি বসে ছিলাম।
কণা;; কিছু তো খাও নি, তাই রুমে খাবার নিয়ে এলাম।
আয়ুশ;; না রে খাবো না, খিদে নেই।
কণা;; কিছু খেয়ে নাও। রাতে না খেয়ে শুতে হয় না।
আয়ুশ;; বাব্বাহ, আচ্ছা খাবো নি। মা কোথায়?
কণা;; ঘুম।
আয়ুশ;; ওহহ, তা তুই জেগে আবার খাবার নিয়ে এসেছিস কেন। ঘুমিয়ে পরতি।
কণা;; না খাও তুমি।
আয়ুশ;; হুম।
কণা;; কি হয়েছে ভাইয়া?
আয়ুশ;; না কিছু না।
কণা;; ভাইয়া কিছু বলার ছিলো তোমাকে।
আয়ুশ;; হুম বল না।
কণা;; ভাবছিলাম যে অনেক দিন ধরেই কথা তোমাকে বলে দিবো কিন্তু সাহসই হয়ে উঠছিলো না।
আয়ুশ;; কণা আমি তোর ভাই। আমাকে বলতে তোর বাধছে। বোনু আমাকে বল।
কণা;; প্রথমে এটা বল যে তুমি ভালো আছো তো?
আয়ুশ;; আব..হ হ্যাঁ আছি তো। যার কাছে এত্তো বেশি মিষ্টি একটা বোন আছে সে কি করে ভালো না থাকে বল।
কণা;; ভাইয়া আমি সিরিয়াস। উলটা বুঝিয়ো না আমায়। আমি জানি সবকিছু। অনেক দিন, অনেক দিন ধরে বলবো কিন্তু সাহসই হয় না।
আয়ুশ;; কি বলছিস তুই?
কণা;; আমি মেহরাপু আর তোমার ব্যাপারে জানি সব।
আয়ুশ;; মানে?
কণা;; মানে এই যে রিসিপশনের দিন, বিয়ের পরেরদিন যখন তুমি আর মেহরাপু কথা বলছিলে তখন আমি সব শুনেছিলাম। আমি মা কে পাচ্ছিলাম না খুজতে খুজতে পুলের পাশে যাই আর তোমার কথা শুনি।
আয়ুশ;;_____________
কণা;; আচ্ছা যখন মেহরাপু কে এতো বেশি ভালোবাসো তখন কেন ছাড়লে। আবার ওর-ই বোন কে বিয়ে।
আয়ুশ;; কারণ মেহরাম যা করেছে সব তার বোনের জন্য। একজন বোন হিসেবে দেখলে মেহরাম ওর জায়গায় পারফেক্ট। আমি আগে বুঝি নি অযথা মেহরাম কে দোষ দিয়ে গেছি। কিন্তু এখন বুঝি।
কণা;; এখনো মেহরাপু কে অনেক ভালোবাসো?
আয়ুশ;; হাহা, তুই আমার বোন হোস। অন্যান্য ভাইদের মতো আমিও বলবো যে ভালোবাসিস না। দূরে থাক। এগুলো থেকে তোকে দূরে রাখবো আসলে না। জানিস আমার ভাই হিসেবে যতো টুকু কর্তব্য আমি সব করবো। কিন্তু আমি যতোই বারণ করি ভালোবাসা একদিন না একদিন আসবেই। এটা আপনা আপনি এসে পরে। মন কে কি আর কেউ আটকাতে পারবে। দেখবি এটা একদিন তোর কাছে অজান্তেই আসবে। আর যখন আসবে তখন যদি সত্যি ওকে ভালোবেসে থাকিস তখন বুঝবি যে কাউকে ভালোবাসলে তাকে ভুলা ঠিক কতো টা কঠিন হয়।
কণা;; আর মেহরাপু?
আয়ুশ;; হয়তো..!
কণা;; _________।
আয়ুশ;; আরে পাগলী তুই কাদছিস কেন?
কণা;; এমনি।
আয়ুশ;; আরে পাগল বোন আমার। (জড়িয়ে ধরে) কাদিস না আইসক্রিম কিনে দিবো নি।
কণা;; তুমি কিভাবে ঠিক আছো?
আয়ুশ;; থাকতে হয়।
কণা;; __________
আয়ুশ;; অনেক দিন খাইয়ে দিস না। আজ খাইয়ে দিবি আমায়?
আয়ুশের কথায় যেন কণার কান্না আরো বেশি বেড়ে গেলো। তার মধ্যে আয়ুশ আবার কাতুকুতু দিলে কণা কান্নার মাঝেই হেসে দেয়। তারপর কণা খাইয়ে দেয়। আয়ুশও একটু খাইয়ে দেয়। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলে কণা রুম থেকে এসে পরে। আয়ুশ তো নিশাচর, ঘুমায়ই না। তাই সে আবার আগের মতো বসে থাকলো। তবে এবার নিজের সামনে মেহরামের ছবি নিয়ে বসলো। আর ওদিকে মেহরাম নিচে এখনো বসেই আছে। তনু ছাদে ছিলো সারারাত। কখন যে রাত গড়িয়ে সকাল হয়ে গেছে তা কারো খেয়ালই নেই। একদম ভোরের সময় এটা। আযানের শব্দ কানে এলে তনুর হুস আসে। তার কিছু সময় পর তনু ছাদ থেকে নেমে এসে রুমে চলে যায়। রুমে গিয়েই দেখে মেহরাম এখনো বসে আছে।
তনু;; এখনো এভাবে বসে আছিস কেন, পেটে চাপ পরবে। তোর যা হবার হোক বেবির কিছু যাতে না হয়। উঠ।
তনু গিয়ে মেহরাম কে টেনে তুলে। মেহরাম কে বিছানাতে বসিয়ে দিয়ে পানি খাওয়ায়। এভাবেই বেশ সকাল হয়ে যায়। সবাই উঠে পরেছে। তবে তনু কিছু না খেয়েই, কোন রকমে বের হয়ে পরে। একবার রুমে এসে মেহরামকে দেখে তারপর কোন কথা না বলেই রুম থেকে বের হয়ে যায়।
মেহরাম;; কোথায় যাচ্ছিস?
তনু;; আয়ুশের অফিসে।
মেহরাম;; কিন্তু সেখানে কেন? তনু, তনু।
তনু সোজা বাড়ি থেকে বের হয়ে পরে। এদিকে মেহরাম চিন্তায় শেষ যে তনু কি করতে কি না করে বসে আবার।
।
।
।
।
🌻চলবে~~
#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ২১
💙 . . . .
তনু মেহরামের ডাক না শুনেই ঘর থেকে বাইরে বের হয়ে পরে। বাড়িতে বলে যায় বাসায় যাওয়ার কথা কিন্তু আসলে তনু তার বাবার বাড়ি থেকে বের হয়ে সোজা চলে যায় আয়ুশের অফিসে। আয়ুশের অফিসে গিয়ে রিসিপশনের কাছে যায়। কেবিন নং জেনে তারপর দ্রুত পায়ে যেতে থাকে। তনুর মাঝে বিচলতা এতো টাই কাজ করছে যে সে নক না করেই কেবিনের দরজা খুলে দেয়। দেখে আয়ুশ বসে আছে তার সামনে আরো দুজন ভদ্র লোক বসে আছেন আর তারা কথা বলছে। আয়ুশ তাকিয়ে দেখে তনু। তনু এর আগে কখনোই আয়ুশের অফিসে আসে নি, শুধু এড্রেস টা জানতো। আয়ুশ এই সময় তনু কে দেখে বেশ অবাক। সে সবাইকে বাইরে জেতে বললো তারাও বাইরে বেরিয়ে পরে। তাদের যেতেই তনু কেবিনে প্রবেশ করে।
আয়ুশ;; তনু তুমি এই সময়ে?
তনু;; তো কি হয়েছে?
আয়ুশ;; না মানে বাড়ি যাও নি?
তনু;; তোমার সাথে অনেক বেশি দরকারি কিছু কথা ছিলো।
আয়ুশ;; হ্যাঁ তা তো বাড়ি তে গিয়েও বলতে পারতে এভাবে অফিসে।
তনু;; না এসে উপায় ছিলো না। বাড়িতে কখন তুমি যাবে কখন আমি বলবো সেই ধৈর্য টুকু এখন আর আমার মাঝে বাকি নেই।
আয়ুশ;; মানে কি হয়েছে?
আয়ুশের বলা শেষ হতেই তনু এক প্রকার দৌড়ে গিয়ে আয়ুশকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আয়ুশ তনুর হঠাৎ এমন করাতে অবাক হয়। কিছু বলতে যাবে তখনই তনু মাথা তুলে তার দিকে তাকায়। তনুর চোখে পানি গুলো চিকচিক করছে। আয়ুশ তো আরো অবাক যে তনুর হুট করে কি হলো। তনু আবার আয়ুশকে জড়িয়ে ধরে, কিছুক্ষণ বাদে আয়ুশকে ছেড়ে দাঁড়িয়ে আয়ুশের কপালে আলতো করে চুমু একে দেয়।
আয়ুশ;; তনু কি হয়েছে কি বলবে তো?
তনু;; অনেক কিছুই হয়েছে যা না হলেই ভালো হতো।
আয়ুশ;; মানে, তনু ঠিক আছো তুমি?
তনু;; না। এতোদিন আমি ঠিক ছিলাম কিন্তু তোমরা না।
আয়ুশ;; কি সব বলছো?
তনু;; মেহরাম আর তুমি একে ওপরকে ভালোবাসতে (চিল্লিয়ে)
তনুর চিল্লানো যেন কেবিনের চারিদিকে বাজতে থাকলো এক প্রকার। আয়ুশের তো মাথা পুরো খালি হয়ে গেছে তনুর কথা শুনে। তার মাথায় শুধু একটা কথাই ঘুরছে তনু এই সব কি করে জনলো।
তনু;; অবাক লাগছে না যে আমি কি করে এইসব জনলাম। জেনে গেছি।
আয়ুশ;; মেহ….
তনু;; না, কেউ আমায় কিছুই বলে নি। মেহরাম ও না। হয়তো ভাগ্য ও এটা চাইতো যে আমি জেনে যাই। তাই জেনে গেছি।
আয়ুশ;; তনু আমি….
তনু;; যাকে ভালোবাসা যায় তাকে হয়তো ছাড়া যায় কিন্তু ভোলা কখনই সম্ভব না, কখনোই না।
আয়ুশ;; ____________
তনু;; রাগ মানুষ কে শেষ করে দেয় আয়ুশ। তুমি আমার সাথে যা ই করেছো সব রাগ আর জেদ ছাড়া কিছুই ছিলো না। রাগের বশে ডিসিশন নেওয়াই ভুল। দেখো না আমার জীবনে ভালোবাসা বলে কিছু ছিলোই না। আর নেই ও। তুমি রাগ আর জেদের বশে আমার সাথে এসব করেছো, কিন্তু রাগ আর জেদ টা করলে কার সাথে মেহরামের সাথেই।
আয়ুশ;; তনু আমার কাছে আর কোন উপায় ছিলো না।
তনু;; ছিলো, একটা বার যদি আমাকে সব বলে দিতে তাহলে….
আয়ুশ;; তাহলে কি তনু, মেহরাম এত্তো কিছু করেছে তোমার জন্য আর আমি তোমাকেই সব বলে দিতাম।
তনু;; বললে হয়তো আজ তোমরা খুশি থাকতে।
আয়ুশ;; কিন্তু ভেংে তুমি পরতে।
তনু;; গুটিয়ে নিতাম।
আয়ুশ;; সেটা মেহরাম চাইতো না, তোমাকে সত্য টা বলে যদি শুধু নিজের কথা ভেবে সে আমার হয়ে যেতে তাহলে, তাহলে কোথাও না কোথাও সে নিজের কাছে ছোট হয়ে যেত।
তনু;; আমি সব কিছুর মূল।
আয়ুশ;; নিজেকে দোষে লাভ নেই। এখানে যা হয়েছে যেমন হয়েছে সব ভাগ্য। ভাগ্যে লিখা না থাকলে আমরা যতোই চাই কিছুই হতো না।
তনু;; প্লিজ এবার থামো সেই কখন থেকে ভাগ্য ভাগ্য ভাগ্য লাগিয়ে রেখেছো। ভাগ্যে ছিলো, ভাগ্যে ছিলো আয়ুশ ভাগ্যে থাকলেই সেটা আপনা আপনি চলে আসে না। সেটা করার জন্য মানুষ কেও কিছু না কিছু করতে হয়।
আয়ুশ;; ________________
তনু;; আয়ুশ আমি তোমাকে ভালোবাসি আর তুমি মাহরামকে। মেহরাম ও তোমাকে। কিন্তু তার সাথে যা হয়েছে বা হচ্ছে একটা অন্ধকারে ফেসে গেছে সে। মুখ ফুটে বলতে পারে না। তোমরা দুইজন দুইজনকে ভালোবাসো তার মাঝে আমি কেন?!
আয়ুশ;; ________________
তনু;; এক তরফা প্রেমের কখনো কোন ভবিষ্যৎ হয় না আয়ুশ যেমন টা আমার নেই। মন কি চাইছে জানো এখান থেকে দূরে চলে যেতে পারলে, শুধু দূরে অনেক দূরে যেতে পারলে। কারণ কাটা হয়ে তোমাদের দুইজনের মাঝে আর ঝুলতে পারছি না আমি। আমার বাধছে।
আয়ুশ;; ________________
তনু;; এভাবে চুপ করে থেকো না আয়ুশ, রাগ লাগছে আমার।
আয়ুশ;; কি বলবো আমি, আমার বলার না তখন কিছু ছিলো আর না-ই এখন কিছু আছে।
তনু;; কেন এমন করছো যখন দুজনেই দুজনকে এত্তো পরিমাণে ভালোবাসো।
আয়ুশ;; __________________
তনু;; তোমরা অবশ্যই স্বার্থপর, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে। নিজেদের সাথে এমন অন্যায় কিভাবে করতে পারলে তোমরা। আরে নিজের ভালো তো পাগলেও বুঝে।
তনু এবার ধপ করে একটা চেয়ারে বসে পররে কেদেই দিলো। আয়ুশ এখন তনু কে কি বলে বুঝাবে তা তার জানা নেই।
তনু;; তুমি আমাদের বিয়ের প্রথম রাতে বলেছিলে “নিজেকে শক্ত ভাবে তৈরি করো”। এইদিনের জন্যই বলেছিলে তাই না। যে যখন আমি সত্যি টা জানতে পারবো হয়তো ঠিক থাকতে পারবো না। হয়তো মেহরাম ভয় পেতো যে যেদিন আমার সামনে সত্যি টা আসবে তখন আমার ওপর দিয়ে কি যাবে। আর আজ সব জেনে গেছি।
আয়ুশ;; তনু…
তনু;; তুমি কেন বুঝো না যে জেদের বশে কিছুই হয় না। আজ হয়তো তুমি এইসব কিছুই রাগে করলে কিন্তু কাল, কাল তোমাকে আফসোস করতেই হবে। বারবার করতে হবে।
আয়ুশ;; করছি আমি। আগেও আর এখনো করছি। কি বলতে চাইছো আমি দূরে চলে যেতাম। মেহরাম আমাকে তোমাকে মেনে নিতে বলেছিলো তখন যদি আমি মেনে না নিয়ে সরেই আসতাম তখন লাভ টা কি হতো। মেহরাম যে এতো কিছু করলো তা কোথায় যেত। সেই তো সরেই আসতাম। তখন না ই হতে পারতাম মেহরামের আর না ই তোমার।
তনু;; তুমি আমার হয়েছো?
আয়ুশ;; _____________
তনু;; এখন চুপ কেন হলে, বলো তুমি আমার আদৌ কখনো ছিলে বা আছো?!
আয়ুশ;; তনু
তনু;; তুমি এখনো ভালোবাসো মেহরু কে আমি জানি। তুমি কখনোই ওর জায়গাতে আমাকে বসাতে পারবে না। কেউ কারো জায়গা কোনোদিন নিতে পারে না। বরং এটা আমার ব্যার্থতা যে আমি তোমার মনে কখনো জায়গা করে নিতে পারিনি।
আয়ুশ;; ভালোবাসা সবার জন্য আসে না তনু।
তনু;; হ্যাঁ আর তাই তো তুমি যেমন মেহরামের জায়গা আমাকে দিতে পারো নি ঠিক তেমনই আমিও তোমার জায়গা অন্য কাউকে দিতে পারবো না।
আয়ুশ পেছন ঘুড়ে তনুর আড়ালে নিজের চোখের পানি টুকু মুছে নেয়।
তনু;; আয়ুশ!
আয়ুশ;; হুম
তনু উঠে গিয়ে আয়ুশের সামনে দাঁড়িয়ে পরে।
তনু;; ভালোবাসাকে ছাড়তে নেই, ধরে বাচতে শেখো। সে তোমার ছিলো আর থাকবেই।
আয়ুশ;; এম……
তনু;; আয়ুশ..!
আয়ুশ;; হুম
তনু;; “”এই তনু তোমাকে অনেক ভালোবাসে””।
আয়ুশ;; _______________
তনু;; আর তার থেকেও হাজার গুণে বেশি মেহরাম বাসে।
আয়ুশ;; তনু…
তনু আর কিছু না বলেই টেবিলের ওপর থেকে নিজের ব্যাগ টা নিয়ে সোজা বাইরে চলে আসে। তারপর অফিসে থেকে বাইরে বের হয়ে পরে। এদিকে আয়ুশের ভেতর টা যেন জ্বলে যাচ্ছে। ভয় হতো তার যে যদি কখনো তনু সব জেনে যায় তাহলে কি হবে। কিন্তু বলে না যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়। যেটার ভয় ছিলো আজ তাই হলো। আয়ুশ চায় নি কোন ভাবে কাউকে হার্ট করতে, আয়ুশ এটাও জানে যে তনু তাকে অনেক ভালোবাসে। কিন্তু সে নিরুপায় তার মনে মেহরাম ছাড়া কেউই নেই। আর ভাবতে পারছে না সে, মাথা চেপে ধরে টেবিলে বসে পরে। মনে হচ্ছে নিজের অজান্তেই এক গভীর খাদে পরে গেছে সে যেখান থেকে আর চাইলেও উঠে আসতে পারছে না। আর তনু রিকশা করে বাড়ি ফিরছে আর চোখের পানি ফেলছে।
।
।
আকাশ;; মেহরাপু টুকিইইইইইইই..!
মেহরাম;; হ্যাঁ, হ্যাঁ আকাশ আয় ভেতরে আয়।
আকাশ নাচতে নাচতে মেহরামের কাছে চলে গেলো।
মেহরাম;; কিরে!
আকাশ;; কিছু না তো।
মেহরাম;; হাতে কি?
আকাশ;; ওহহ হ্যাঁ এটা তেতুলের আচার। তোমার জন্যই আনা। নাও নাও শুরু করো।
মেহরাম;; মনে হচ্ছে বেবি আমার পেটে না তোর পেটে আছে। কারণ আমার কথা বলে মায়ের কাছ থেকে তুই-ই বেশি আচার খাস।
আকাশ;; আহা বুঝো না কেন আমি আমার কথা বললে আচার তো দিবেই না উল্টো এটা ওটার বাহানা বলে আমায় বের করে দিবে।
মেহরাম;; তবে রে দাড়া তোর ভান্ডা ফুটো করছি। ওওওওও মায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়া..
আকাশ;; এই না না না, আপু না বইন না। বইলো না প্লিজ লাগে। যা বলবা তাই করবো তাও প্লিজ বইলো না।
মেহরাম;; যা বলমু তাই করবি?
আকাশ;; হ্যাঁ সত্যি।
মেহরাম;; তাহলে বাড়ির পেছনে যে আমের গাছ আছে সেখান থেকে আম পেড়ে দিবি বল।
আকাশ;; ওহহ এটা কোন ব্যাপার নাকি। কিন্তু দাড়াও ওইটা তো বাগানের আম গাছ। সেখানে তো মালি থাকে সারাদিনই। কিভাবে যাবো।
মেহরাম;; কেন স্কুলে যাবার আগে যখন প্রতিদিন চুরি করতি সেভাবেই পেড়ে দিবি।
আকাশ;; 😬😬..
মেহরাম;; তা না হলে, মায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়া।
আকাশ;; আচ্ছা দিমু তো না করছি নাকি।
মেহরাম;; আচ্ছা তুই আমাকে কাচা আম দিবি আর আমি তোকে এক বক্স আচার যা।
আকাশ;; মনে থাকে যেন।
মেহরাম;; হ হ থাকবো।
আকাশ আর মেহরাম বসে বসে আচার খাওয়া শেষ করলো। তারপর আকাশ চলে গেলো বাইরে। তবে এখন আবার মেহরামকে তনুর চিন্তায় ধরলো। মেয়েটা এই যে গেলো আর আসার কোন নাম গন্ধ নেই। মেহরাম তার ফোন হাতে নিয়ে যেই না তনু কে ফোন দিবে তখনই আয়ুশের ফোন আসে তার ফোনে। কিছুক্ষণ ফোন বেজে গেলে মেহরাম তা রিসিভ করে…
মেহরাম;; হ্য হ্যালো
আয়ুশ;; মেহরু..!
মেহরাম;; _____________
আয়ুশ;; তনু এসেছিলো আমার কাছে।
মেহরাম;; আমি জানতাম ও তোমার কাছেই আসবে। এখন কোথায়?
আয়ুশ;; বাড়ি চলে গেছে।
মেহরাম;; তোমার সাথে কিছু হয়েছে?
আয়ুশ;; তেমন কিছুই না কিন্তু নিজের ভেতরে চাপা কথা গুলো বলছিলো।
মেহরাম;; _______________
আয়ুশ;; কি করো?
মেহরাম;; কিছু না।
আয়ুশ;; তনু কি করে জানলো এইসব?
মেহরাম;; আমি যখন হস্পিটালে তখন তনু বাড়ি গিয়েছিলো, আর ড্রয়ারের ওপর আমার ডায়েরি পায়।
আয়ুশ;; হুম।
মেহরাম;; আমি রাখি।
আয়ুশ;; হ্যাঁ।
আয়ুশ ফোন কেটে দেয়। তিন দিকে তিন জন মানুষ পুরো শেষ হয়ে যাচ্ছে। আয়ুশ অফিসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলো, মেহরামের মাথায় আয়ুশ আর তনু দুজনের চিন্তাই ঘুরঘুর করছে আরেক হাত পেটের ওপরে দিয়ে আছে, আর তনু বাড়ি এসে কাউকে কিছু না বলে সোজা নিজের ঘরে চলে যায়। কণা টুকটাক কাজ করছিলো হঠাৎ তনুকে এভাবে আসতে দেখে কিছুটা কপাল কুচকায়। তনু নিজের রুমে গিয়ে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দেয়। কণা তনুর ঘরের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার নিজের কাজে মনোযোগ দেয়।
এভাবেই সময় যেতে থাকে। মেহরাম আর বসে থাকতে পারছে না। এবার সারা বাড়ি তে পায়চারি করছে আর সবার সাথে কথা বলছে। তখনই বাইরে মেঘ ডাকতে থাকে। এখন মাঝে মাঝে ঝড় উঠে, কোন সময় মানে না। রাত বাজছে অরায় ১১ টা আয়ুশের এখনো বাড়ি ফেরার নাম নেয়। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। আর বাইরের বৃষ্টি দেখছে। তনু তার বাড়িতে, কণা এসে কতোক্ষণ তার পাশে ছিলো। কিন্তু কণা বুঝলো যে হয়তো কোন কারণে তনুর মন ভীষণ খারাপ। একটু একা থাকতে দেওয়া টাই ভালো। তাই সে উঠে চলে আসে। মেহরাম এখনো তার বাড়ি যায় নি। তার বাবার বাড়িতেই আছে। কুসুম বেগম বিকেলের দিকে এসে সবার সাথে দেখা করে গেছে। মেহরাম এখন তার রুমের জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। তখনই দরজাতে কারো টোকা পরে। মেহরাম কপাল কুচকায় এতো রাতে কে। সে ভেবেছে যে সবাই হয়তো ঘুম। মেহরাম দরজা খুলেই দেখেই আতিয়া অর্থাৎ তার চাচি। হাতে খাবারের ট্রে রয়েছে। মেহরাম তাকে দেখে মুচকি হাসে সাথে কপাল কুচকায়। আতিয়া ইশারাতে মেহরামকে সামনে থেকে সরতে বললে মেহরাম সরে দাঁড়ায়। আর উনি ভেতরে এসে বসে পরেন।
।
।
।
।
🧡চলবে~~
#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ২২
🧚♀️ . . . .
আতিয়া মেহরাম কে ইশারাতে সামনে থেকে সরতে বললে মেহরাম সরে দাঁড়ায়। আর আর উনি ভেতরে এসে বসে পরেন।
আতিয়া;; এদিকে আয়।
মেহরাম;; তুমি এতো রাতে..!
আতিয়া;; তুই যে সারারাত ঘুমাতে পারিস না তা আমি জানি। আর রাতেও তো আজ খেলি না। ভাবি কে বলতে চাইছিলাম যে কিছু খাবা নিয়ে যেন তোর রুমে যায়। কিন্তু গিয়ে দেখি ভাবি ঘুম। তাই আমিই এলাম।
মেহরাম;; আরে চাচি আমার খিদে নেই, এতো রাতে শুধু শুধু খবার নিয়ে আসতে গেলে কষ্ট করে। ঘুমিয়ে পরতে।
আতিয়া;; হয়েছে, এদিকে আয়। খাইয়ে দেই।
মেহরাম বিছানার এক কোণায় বসলে তার চাচি তাকে খাইয়ে দিতে থাকে।
মেহরাম;; এটা তুমি রেধেছো তাই না?!
আতিয়া;; হুম কেমম হয়েছে?
মেহরাম;; অনেক বেশি ভালো।
আতিয়া;; হুম।
মেহরাম;; তুমি খেয়েছো?
আতিয়া;; হ্যাঁ আমি, ভাবি, তোর চাচ্চু বাবা সবাই এক সাথেই খেয়ে নিয়েছি।
মেহরাম;; ওহহ…
আতিয়া;; তোর সাথে কিছু কথা ছিলো রে মা!
মেহরাম;; হ্যাঁ হ্যাঁ বলো না।
আতিয়া;; আগে খেয়ে নে।
আতিয়া মেহরাম কে সব গুলো খাবারই জোর করে খাইয়ে দিলো।
আতিয়া;; খুব তো বলছিলি যে খিদে নেই, খাবার গুলো কার পেটে গেলো?!
মেহরাম;; হিহিহি।
আতিয়া;; পানি খা।
মেহরাম;; আচ্ছা কি না বলবে বলো।
আতিয়া;; তনুর সাথে তোর কি কোন কথা হয়েছে?
মেহরাম;; হ্যাঁ হয়েছে তো।
আতিয়া;; আর আয়ুশ?
আয়ুশের কথা শুনেই মেহরাম কিছুটা অবাক হয়ে তার চাচির দিকে তাকায়।
আতিয়া;; দেখ মেহরু ভাগ্য কে দোষে লাভ নেই। কারণ ভাগ্যে যা লিখা থাকে তাই হয়।
মেহরাম;; তুমি কি বলছো?
আতিয়া;; কাল আমি তোদের ঘরেই আসার জন্য এসেছিলাম। কিন্তু এসেই শুনি তুই আর তনু চিল্লাচ্ছিস।আমি সব শুনেছি মেহরাম।
তার চাচির কথা শুনে মেহরামের হাত কাপাকাপি শুরু হয়ে গেছে।
আতিয়া;; এখন বুঝতে পারছি তুই কেন সহজে বাড়ি আসতে চাইতি না। আর তনুদের বাড়ি তো মোটেও না। বিয়ে শেষ হতে না হতেই দ্রুত ঢাকা চলে যাওয়া।
মেহরাম;; চাচি..!
আতিয়া;; তুই একটা বার বলতি আমাদের, এমন তো না যে আমরা কেউই মেনে নিতাম না। সবটা বুঝিয়ে বললেই পারতি।
মেহরাম;; তনুর কি হতো?
আতিয়া;; কাদতো, হয়তো কষ্ট হতো। বুঝাতাম সামলে নিতাম। ঠিক হয়ে যেতো।
মেহরাম;; তুমি বলছো ও কাদতো আর তোমরা সবাই সামলে নিতে। চাচি কি বলছো। যার জন্যই আমার এতো কিছু করা তাকে বলছো তোমরা মিলে বুঝাতে। চাচি সব কিছু এতো সোজা না যতোটা তুমি ভাবছো।
আতিয়া;; এখন তো জানাজানি হলোই তাই না।
মেহরাম;; সে আজ হোক দশ বছর পর হোক সবাই জানতোই।
আতিয়া;; কিন্তু কষ্ট তো এখনো তুই ই পাচ্ছিস তাই না। আর হয়তো আয়ুশ ছেলেটাও।
মেহরাম;; চাচি বাদ দাও।
আতিয়া;; আগে তুই আর আয়ুশ জানতি কিন্তু তবুও কেউ খুশি ছিলি না। এখন তনু সহ জানে এখন কেউ খুশি থাকবে না।
মেহরাম;;_______________
আতিয়া;; মা রে আমি যখন এই পরিবারে বউ হয়ে আসি তখন কেমন জানি লাগতো জানিস। আস্তে আস্তে তোর মায়ের সাথে এত্তো ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠলো যে কি আর বলি। হয়তো এত্তো আপন বাপের বাড়ির ও কেউ ছিলো না। ভাবির পেটে তুই এলি তার কিছু মাস পর তনু এলো। আমার দুই টা মেয়ে। আমার কাছে তুই আর তনু একই। এখানে যদি আয়ুশের সাথে তনুর বদলে তোর বিয়ে হতো তাহলেও আমি এই একই ভাবে খুশি থাকতাম। কিন্তু একটা কথা মনে রাখবি সবসময়, ভালোবাসা কখনো না ভুলা যায় আর না ই কখনো মন থেকে সরে। এটাকে ধরে রাখতে শিখ। কারণ এটা যখন নিজের চোখের সামনে অন্যের হয়ে যায় না তখন তা মরণ যন্ত্রণা থেকে কোন দিক দিয়ে কম হয় না। (মেহরামের গালে হাত রেখে)
মেহরাম;; ___________________
আতিয়া;; জানি ঘুমাবি না। তাই আর বলবো না, তুই তো আবার লিখিস। আমি জানি। হয়তো বসে লিখালিখি কর নয়তো……..। যা ইচ্ছে। আমি যাই।
মেহরাম;; আচ্ছা।
আতিয়া মেহরামের রুম থেকে চলে আসে। মেহরাম দরজা টা আটকিয়ে দেয়। শ্বাস নিচ্ছে জোরে জোরে। বাম পাশে মাথা ঘুড়াতেই তার আর তনুর একটা ছবি চোখে পরে। ছবি টা অনেক আগের তোলা। মেহরাম দাঁড়িয়ে আছে আর এক পাশ দিয়ে তনু তাকে জড়িয়ে ধরে আছে। দুজনেরই মুখেই যেন হাসির শেষ নেই। মেহরাম সেদিকে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে ছবি টা হাতে তুলে নেয়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আলতো হাতে ছুইয়ে দেয়। ভীষণ কান্না পাচ্ছে তার। মেহরাম তনুর দিকে তাকিয়ে আছে। এই হাসি টা সে খুব মিস করে। যা এখন আর নেই। মেহরাম ছবি টা বুকে জড়িয়ে ধরে কেদেই দেয়।
।
।
এভাবেই কেটে গেলো মাঝ খানে কয়েকটা দিন। তনু এখন আয়ুশের সাথে ঘুমায় না। রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পরে তখন তনু লুকিয়ে অন্য ঘরে চলে যায়। আবার ভোর সকালে উঠে নিজের রুমে এসে পরে। আয়ুশ কিছুই বলে না, কারণ বলে লাভ নেই। এখন আর কিছুই লুকিয়েও লাভ নেই। ব্যাপার টা ঠিক এই রকম হয়েছে যে আয়ুশের সাথে তনু এখন আর চোখে চোখে রেখেও কথা বলতে পারে না। কোথাও না কোথাও বাধে তার। এখন রাতের সময়। তনু অন্য ঘরে হয়তো ঘুমাচ্ছে। আর আয়ুশ কাজ করছে। সারা ঘরে কোন সাড়াশব্দ নেই, একদম পিনপতন নীরবতা। বিছানার পাশে টেবিলে থাকা ছোট ল্যাম্প লাইট টা জ্বলছে। তা থেকে জ্বলজ্বল করে হলুদ আলো সারা ঘরে ছড়িয়ে পরেছে। আর আয়ুশ ল্যাপটপে মগ্ন। ল্যাপটপের কিবোর্ডে টুক টাক শব্দ যেন চারিদিকে বাজছে। বেশ দ্রুত ভাবে টাইপ করার ফলে এমন সাউন্ড হচ্ছে। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা পরে এক নয়নে সেদিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু হঠাৎ করেই ল্যাপটপ টা বন্ধ করে দেয়। বন্ধ করেই চশমা টা খুলে ডান হাত দিয়ে চোখ দুটো চেপে ধরে। ভালো লাগছে না মোটেও। বিছানা থেকে উঠে এসে বারান্দায় জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরে একদম ঘুটঘুটে আঁধার। সবাই হয়তো এই আঁধার আলোয় ঘুমে বেঘোর। কিন্তু তার চোখে ঘুমের ছিটেফোঁটাও নেই। আয়ুশ কি যেন মনে করে সোজা তার মায়ের ঘরে চলে গেলো। আজ তার বাবা বাসায় নেই। ঢাকার বাইরে গিয়েছেন কাজে। আয়ুশ তার মায়ের রুমের কাছে গিয়ে আস্তে করে দরজা টা খুলে দিলো। দরজার চাপা শব্দ টা যেন একটু জোরেই শোনা গেলো এই নীরবতার মাঝে। আয়ুশ দরজার ফাক দিয়ে একটু মাথা বের করে রুমে উকি দেয়। দেখে তার মা বসে বসে পান খাচ্ছে। লায়লা খাতুন বেশ বুঝে যে এটা আয়ুশ ছাড়া আর কেউ না। লায়লা খাতুন মুচকি হেসে ফেলে।
লায়লা খাতুন;; আয় আয় ভেতরে আয়। সেই লুকিয়ে লুকিয়ে আমার ঘরের ভেতরে উকি দেওয়ার স্বভাব টা ছোট থেকে আর গেলো না তোর।
এবার আয়ুশ দরজা সম্পূর্ণ মেলে দাঁড়ায়।
আয়ুশ;; না, যায় নি আর যাবেও না।
লায়লা;; বড়ো হবি কবে বাবা?
আয়ুশ;; কি যে বলো না মা, এত্তো বড়ো হয়েছি চাকরি করছি তবুও বলছো বড়ো কবে হবো? (তার মায়ের কোলে মাথা দিয়ে)
লায়লা;; ছেলে মেয়েরা যতোই বড়ো বুড়ো হয়ে যাক না কেন মায়ের কাছে সেই আগের মতো ছোটই থাকে।
আয়ুশ;; মা..
লায়লা;; হুম।
আয়ুশ;; আমি না তোমাকে অনেক ভালোবাসি।
লায়লা;; হাহাহা, হলো কি তোর?
আয়ুশ;; কিছু না।
লায়লা;; খিদে পেয়েছে?
আয়ুশ;; না।
লায়লা;; পান খাবি?
আয়ুশ;; কিহ 😅😅
লায়লা;; হাহাহা, না এমনি বললাম আর কি। আগে মনে আছে আমার কাছ থেকে পান খাওয়ার জন্য তুই কতো কি না করতি কিন্তু আমি খেতে দিতাম না।
আয়ুশ;; হ্যাঁ তার জন্য আমাকে চোর সাজতে হয়েছে আর আমি পান চুরিও করেছি।
লায়লা;; মার তো আর কম খাস নি।
আয়ুশ;; হুমম।
লায়লা;; আয়ুশ..!
আয়ুশ;; মা আমি ভালো নেই ( চোখের কোণে পানি জমেছে)
লায়লা;; তোর এই অসুখের নাম কি “মেহরাম”?!
আয়ুশ;; আমি অবাক হবো না এখন কারণ যার জানার জানুক।
লায়লা;; কণা সব বলেছে আমায়। আর অনেক আগে থেকেই আমার কেমন সব ঘোলাটে লাগছিলো। কিন্তু ভেবেছি যদি আমার ধারণা টা ভুল হয় তাহলে, কিন্তু কণার আমকে বুঝিয়ে বলার পর যেন সব ক্লিয়াল হয়ে গেলো। আয়ুশ আমি জানি তোর পছন্দ খারাপ না। তুই বড়ো হয়েছিস বুঝিস। কখনো খারাপ কোন কাজ আমার ছেলে করবে না। তুই আমাকে বলতি ব্যাপার টা।
আয়ুশ;; না মা তখন তেমন সিচুয়েশন ছিলো না।
লায়লা;; মেহরাম অনেক বেশি ভালো। সত্য বলতে ওর মতো মেয়ে আমি খুব কম দেখেছি। মেয়েটার ওপর দিয়ে কতো কি না গেলো। তাও আবার এই সময়ে কিন্তু সে ঠিক আছে। মেহরামকে আমার আগে থেকেই অনেক পছন্দের। মেয়েটার মধ্যে এক আলাদা মায়া কাজ করে। কিন্তু তনু যে খারাপ তা কিন্তু না। আমি ভাবছি ওই মেয়েটার ওপর এখন কি যাচ্ছে।
আয়ুশ;; মা..
লায়লা;; তুই মেহরামকে ভালোবাসিস আর তনু তোকে। কেমন এক ত্রিকোণ।
আয়ুশ;; যাতে আমি কখনো ফাসতে চাই নি কিন্তু ফেসে গেছি,, অজান্তেই।
লায়লা;; এখনো ভালোবাসিস মেহরামকে তাই না?
আয়ুশ;; অনেক বেশি। ওর জন্য আমার মনে যা ছিলো বা আছে তা কখনো অন্য কারো জন্য হবে না। আমি চেয়েও পাই না।
আয়ুশ তার মা কে এক হাতে জড়িয়ে ধরে থাকলো। এখনো কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। তবে মাথা নিচু করা। লায়লা খাতুন মুচকি হেসে আয়ুশের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। নিজের কোলে পানির বিন্দুর মতো অনুভব হতেই তিনি বুঝে গেলেন যে আয়ুশ কাদছে। আয়ুশ এমনই। এতো রাতে যখন সে নিজের মায়ের রুমে এসেছিলো তখনই লায়লা খাতুনের সন্দেহ হচ্ছিলো যে কিছু একটা হয়েছে। ছোট থেকেই কিছু হলে আয়ুশ সবার আগে তার মায়ের কাছে যায়। এভাবেই জড়িয়ে ধরে কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকে। এতেই যেন আয়ুশের শান্তি। আসলে মায়েরা হয়-ই এমন। যা কিছুই হোক দুনিয়া উলটে যাক মায়ের কাছে কিছুসময় বসলে সব নিমিষেই উধাও। শান্তি আর শান্তি।
ওদিকে তনু ভালো নেই। ঢুকরে কাদছে। মন চাইছে এখান থেকে বের হয়ে যাক। কেন এলো মেহরাম আর আয়ুশের মাঝে এই কথা টাই তার মাথায় বারি খাচ্ছে। নিজেকে কেমন নগন্য লাগছে।
সোহেল হস্পিটালেই রয়েছে। আগে যতটুকু কথা বলতে পারতো এখন তাও পারে না। তবুও তাকে দেখে বোঝা যায় যে মেহরামের সাথে তার কথা বলার কতো আকুতি-ইচ্ছে। তবে মেহরাম তো জানে যে সোহেল তেমন কথা বলতে পারে না তার বডি তে বুকের দিকে অনেক ইঞ্জেকশন পুশ করা। গলাতে বেশকিছু যন্ত্রপাতি লাগানো। তাই মেহরাম নিজেই তার সাথে কথা বলে। সকাল থেকে সারাদিন সোহেলের পাশেই ছিলো মেহরাম। এভাবেই প্রতিটি দিন যাচ্ছে। এখন বিকেল সময়। এর মধ্যে আয়ুশ এসে দুবার দেখে গেছে সোহেলকে। মেহরামের বসে থাকতে থাকতে এখন খারাপ দশা বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারে না সে। তাই সারাঘরে একটু পায়চারি করছিলো। তখন নার্স আসে সোহেলের কেবিনে। এসে সোহেলের গলাতে যে যন্ত্র টা লাগানো ছিলো তা ধীরে খুলে দিলো। এবার যেন সোহেল তার ঘাড়ে আর গলাতে কিছুটা শান্তি পাচ্ছে। নার্স তা খুলে কিছু কথা বলে কেবিন থেকে বের হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ এভাবেই শুয়ে থেকে সোহেল আধো আধো গলায় মেহরাম কে ডাকতে থাকে…
সোহেল;; মেমমেহ মেহ…
মেহরাম;; জ্বি আছি আমি এইতো।
সোহেল তার বাম হাতের আঙুল গুলো খানিক তুলে। মেহরাম বুঝতে পারলো যে সোহেল তাকে তার কাছে ডাকছে। মেহরাম সেখানে গেলো। গিয়ে সোহেলের পাশে বসে পরে। সোহেল কিছুটা মুচকি হেসে ওঠে। মেহরাম তার দিকে তাকিয়ে থাকলে হঠাৎ সোহেল খুব আস্তে আস্তে তার বাম হাত টা ওপরে তোলে। আস্তে ধীরে হাত টা তুলে মেহরামের পেটের ওপর হাত রাখে। মেহরাম প্রথমে তার হাতের দিকে তাকায় তারপর সোহেলের দিকে। তার মুখের কোণে হাসির রেখা ফুটে ওঠেছে। সে তার হাত মেহরামের পেটে আলতো করে ছুইয়ে দিতে থাকে। মেহরামও হেসে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। সোহেল এবার বড়ো বড়ো কিছু শ্বাস নিয়ে বলে ওঠে…
সোহেল;; আম..আমাদের, আমাদের মে মেয়েহ। ও..ওকে ওকে বলো যযে ওর ববাবা ওকে অননেক বেবেশি ভাভালোববাসে।
মেহরাম;; হুম।
সোহেল;; ককি হলো আম আমি ওর সাসাথে নেই কিকিন্তু আমি ওকে খখুব বেশি ভালোবাসি,,।
মেহরাম;; এমন করে বলবেন না কিছুই হবে না আপনার। আর হয়েছে অনেক কথা বলেছেন। এবার চুপ করুন।
সোহেল এবার চোখ বন্ধ করে শুয়ে পরে, আর বেশি একটা কথা বলে না। মাঝে মাঝে চোখ গুলো খুলে মেহরামকে দেখে। মেহরাম এবার বসছে আরেকবার হাটছে। ইদানীং পানি অনেক বেশি খায় সে। রাত নেমে এলো। সোহেল তাকিয়ে আছে মেহরাম তার পাশে হাত ভাজ করে বসে আছে। তখনই রুমে তনু আসে।
তনু;; মেহরু..!
মেহরাম;; এসেছিস।
তনু;; হ্যাঁ, ভাইয়া কেমন আছে এখন?
মেহরাম;; হ্যাঁ আছে ভালোই। কণা তারপর খালামনি তারা কোথায়?
তনু;; ওরা বাড়িতেই।
মেহরাম;; চাচি কোথায় রে কাল থেকে দেখছি না যে?
তনু;; আম্মু তো খালামনির কাছে মানে তোর বাড়ি। বড়ো মা একটু পরেই আসবে।
মেহরাম;; না প্লিজ আম্মুকে আসতে বারণ কর। আমি আছি এখানে আর কাউকে লাগবে না। অযথা এতো গুলো মানুষ কষ্ট করছে। আমি আছি তো।
তনু;; আচ্ছা পরের টা পরে দেখা যাবে। খেয়েছিস কিছু?
মেহরাম;; হ্যাঁ রুটি, খেতেই ভালো লাগছে না পানি খাচ্ছি শুধু।
তনু;; কেন, তুই না খেলি তুই যা ইচ্ছে কর কিন্তু আমি আমার সোনামনি টার জন্য তোকে এমন খাওয়ার জোর দেয়। তোর জন্য আমার ময়না পাখি টা কষ্ট করবে নাকি। খা কিছু। (মেহরামের পেটে হাত দিয়ে)
মেহরাম;; পানি।
তনু;; আচ্ছা নে।
এভাবেই সময় যায়। রাত বেজে চলেছে ৪;৪৫ মনিট। হস্পিটালে এখন আয়ুশ মেহরাম আর মেহরামের চাচি রয়েছে। উনি কুসুম বেগমের কাছ থেকে চলে এসেছেন। সবাই বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ডক্টর ভেতরে চেকাপ করছে। প্রায় আধা ঘন্টা পর কেবিন থেকে ডক্টর বের হয়। মেহরাম চলে যায় কেবিনের ভেতরে। গিয়েই দেখে সোহেল ওপরের দিকে তাকিয়ে আছে। মেহরাম পাশে বসে তাকে জিজ্ঞেস করে…
মেহরাম;; এখন কেমন লাগছে?
সোহেল শুধু তার চোখ দুটো বন্ধ করে আবার খুলে। অর্থাৎ কিছুটা ভালো। মেহরাম মলিন হাসে। এর মধ্যে আয়ুশ আর মেহরামের চাচি গিয়ে সোহেলের সাথে দেখা করে এসেছে। এখনো মেহরাম সোহেলের কেবিনেই। রাত বাজছে ১২;৩৩ মিনিট,, মেহরামের চাচি মেহরামকে তাড়া দিচ্ছে বাড়ি যাওয়ার জন্য এখানে উনি আছেন। মেহরাম প্রথমে যেতে না চাইলে অবশেষে আয়ুশ আর তার চাচির জোরাজোরি তেই যেতে হয়। যাওয়ার আগে মেহরাম সোহেলের কেবিনে আরেকবার ঢুকে…
মেহরাম;; চাচি আমাকে বাড়ি যেতে বলছেন বারেবার।
সোহেল তার হাত টা আলতো করে মেহরামের হাতের ওপর রাখে। সোহেলও যেতে বলছে তাকে বাড়ি।
মেহরাম;; আচ্ছা আমি যাই আপনি বেশি কথা বলবেন না। চাচি এখানেই এসে বসে থাকবে কখন কি লাগে না লাগে সব দেখবে। আর আমি বাকি সবাইকে বলে দিয়েছি। থাকুন।
সোহেল হাসে। তবে এবার সে অন্যান্য দিনের থেকে বেশিই হাসে। ঠিক আগে যেমন টা হাসতো। মেহরাম হেসে সেখান থেকে উঠে চলে আসতে নিলে সোহেল মেহরামের ওরনা টেনে ধরে। মেহরাম ঘুড়ে পেছনে তাকায়। আবার খানিক বসে তার পাশে।
মেহরাম;; কিছু বলবেন?
সোহেল;; অনেক ভালোবাসি।
সোহেল মেহরামের চোখে তার চোখ রেখে কথা টা বলে ওঠে। কথা টা এমন ভাবে বললো যেন সোহেলের কিছুই হয় নি। একদম আগের কন্ঠস্বরের মতো। মেহরাম বিদায় নিয়ে এসে পরে। সে তো এতো রাতে আর একা বাড়ি যেতে পারবে না তাই আয়ুশ তাকে বাড়ি পৌছে দেয়। তবে এই সময়ে আয়ুশ আর মেহরামের মাঝে একটা কথাও হয় না। সোজা বাড়ির সামনে নেমে মেহরাম চলে যায়। গিয়েই দেখে কুসুম বেগম খাবার টেবিলে একা একা বসে আছেন। মেহরামকে দেখেই একদম বাচ্চাদের মতো কুসুম বেগম কেদে দেন। মেহরাম সামলে নেয়। তারপর নিজেও কিছুটা খেয়ে তার মা কেও খাইয়ে দেয়। ঘুমের ঔষধ খাইয়ে তার শাশুড়ী মাকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়ে মেহরাম নিজের রুমে চলে যায়। এইটা নিশ্চিত যে মেহরামের চোখে এক ফোটা ঘুমও আসবে না। রুমের প্রায় সবদিকেই সোহেলের জিনিস পত্র রয়েছে। মেহরাম সেগুলো এক নজর দেখে নিলো। হঠাৎ সে এগিয়ে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পরে। মেহরামের হাত টা আপনা আপনিই তার পেটের ওপর চলে যায়। দিন দিন ফুলছে। পেটের দিকে হাত দিয়ে তাকিয়ে আছে। মূহুর্তেই ফিক করে হেসে দেয় সে। সে বিশ্বাসই করতে পারছে না যে সেও মা হবে। হাটতে হাটতে করিডরে চলে যায়। রকিং চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পরে। বাইরে থেকে ল্যাম্পপোস্টের কিছুটা আলো এসে সম্পূর্ণ জুড়ে আলো করে রেখেছে। তার সাথে মৃদু বাতাস। সাথে রাতে ফোটা ফুল “হাসনাহেনা”। তার সুমিষ্ট গন্ধে চারিদিক কেমন মৌ মৌ করছে। একে রাতের রাণিও বলা হয়। অনেক ভালো লাগছে। পরিবেশ টাই ভালোলাগার মতো। মেহরাম তার পেটের ওপর হাত দিয়ে চেয়ারে দুলতে দুলতে কখন যে ঘুমিয়ে পরেছে সে নিজেও জানে না। বাকি রাত টুকু এভাবেই কেটে গেলো।
।
।
পরেরদিন সকালে উঠে মেহরাম দ্রুত নিচে নেমে গেলো। এক হাত দিয়ে নিজের চুল গুলো বাধছে আর নিচে নামছে। সকাল বেলাই তাকে তার চাচি ফোন দিয়েছিলো মেহরাম কে হস্পিটালে আসতে বললো তার একটু বাসায় যেতে হবে। মেহরাম সকালের ঔষধ তার মাকে খাইয়ে আর নিলা কে সবকিছু বলে বুঝিয়ে এসে পরে। হস্পিটালে সামনে এসে গাড়ি থেকে নামতেই আয়ুশের সাথে মেহরামের দেখা হয়ে যায়।।
মেহরাম;; তুমি..!
আয়ুশ;; আব..আমি চলে যাচ্ছি।
মেহরাম;; ওহহ,,
আয়ুশ;; ব্রেকফাস্ট করেছিলে?
মেহরাম;; মানে আসলে..
আয়ুশ;; তোমাকে বলে লাভ নেই। আচ্ছা মা ভেতরেই আছেন তুমি যাও।
মেহরাম;; আচ্ছা।
এই বলেই আয়ুশ গাড়িতে ওঠে চলে যায় অফিসে। সকাল সকাল তাকে অফিসে যেতে হয়। তাই এখান থেকে আর বাড়িতে না গিয়ে সোজা অফিসে চলে যায় কেননা সেও সারারাত হস্পিটালেই ছিলো। মেহরাম হস্পিটালের ভেতরে চলে যায়। গেতেই তার চাচির সাথে দেখা হয়।
আতিয়া;; এসেছিস মা?
মেহরাম;; হ্যাঁ চাচি আসলাম। কি করো?
আতিয়া;; কিছু না, এমনিই বসে আছি।
মেহরাম;; ওহহ..
আতিয়া;; আচ্ছা শোন আমি না এখনো সোহেলের কেবিনে যাই নি বুঝলি। মানে সকাল হয়েছে তো, এই সকাল বেলা আর যাই নি। তুই ওর কাছে যা। একটু ওর সাথে থাক।
মেহরাম;; শোন এক কাজ করো তুমি এখন বাড়ি যাও।
আতিয়া;; কিন্তু..
মেহরাম;; চাচি যাও আমার পরে দরকার হলে আমি ডাকবো। প্লিজ এবার একটু বাড়ি যাও আর বাড়িতে মা একা তুমি যাও।
আতিয়া;; আচ্ছা তাহলে আমি যাই আর তুই সোহেল বাবার কাছে যা। সমস্যা হলে ফোন দিস কিন্তু।
মেহরাম;; হ্যাঁ হ্যাঁ তুমি সাবধানে যাও।
মেহরামের চাচি চলে যায়। তার খানিক পরেই মেহরাম সোহেলের কেবিনে ঢুকে পরে। মেহরাম গিয়েই দেখে সোহেল গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে। তবে মেহরামের কেমন একটু অদ্ভুত লাগে যে সোহেল তো এভাবে ঘুমায় না। তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে যে সে কতো টা গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে আছে। তবে সোহেলের ঘুম অনেক বেশি পাতলা, ঘুমিয়ে থাকলে কিছুটা একটার হাল্কা শব্দ হলেও তার ঘুম ভেংে যায়। যাই হোক মেহরাম কেবিনের ডেস্কের ওপর নিজের ব্যাগ টা রেখে দেয়। টুকটাক কাজ করছে আর সোহেলের সাথে কথা বলছে।
মেহরাম এক নজর সোহেলের দিকে তাকায়। দেখে নাহ, এখনো সোহেল আগের মতোই ঘুম। মেহরাম কপাল খানিক কুচকায় কিন্তু আবারও নিজের কাজে মন দেয়।
মেহরাম;; কি হলো আজ এতো ঘুম পেয়েছে আপনার। উঠুন, স্যালাইনও তো শেষ প্রায় ওটা চেঞ্জ করতে হবে। জানেন মা আপনার বেপারে কতো কথা যে বলে। এখন শুধু আপনার জলদি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পালা। সবাই সেখানে আপনার জন্য চিন্তায় শেষ আর আপনি এখানে আরাম করে ঘুমাচ্ছেন। উঠুন।
মেহরাম এবার সোহেলের দিকে অবাক হয়ে তাকায়। এতো কথা বলছে তাও তার উঠার নাম নেই। কেমন যেন লাগে মেহরামের। অজান্তেই মেহরামের বুকের ভেতরে হাতুড়ি পেটাতে শুরু করে দিয়েছে। গলা ভয়ে শুকিয়ে গেছে তার। মেহরাম ধীর পায়ে সোহেলের দিকে এগিয়ে যায়। গিয়ে সবসময়ের মতো সোহেলের পাশে বসে পরে। আস্তে করে সোহেলকে ডাকতে থাকে…
মেহরাম;; সোহেল, সোহেল। এই যে দেখুন আমি এসেছি। উঠুন। উঠছেন না কেন। কথা বলুন। আমি এসেছি তো।
মেহরাম সোহেলের হাত টা কিছুটা ওপরে তুলে কিন্তু তার হাতে কোন শক্তি নেই, আবার হাত টা নিচে পরে যায়। মেহরাম যেন বড়োসড়ো একটা ঝটকা খেলো। মাথায় বাজ ভেংে পড়েছে তার। শ্বাস গুলো ভারী হয়ে এসেছে। মেহরাম সোহেলের পার্লস গুলো চেক করে। কিন্তু কিছুই হচ্ছে না। তাহলে কি…
মেহরাম;; সোহেল প্লিজ দেখুন আমার ভয়, আমার ভয় হচ্ছে অনেক। এমন করবেন না। কথা বলুন আমি, আমি এসেছি তো। সোহেল দেখুন আপনি জানেন আমার অবস্থা ভালো না। অযথা ভয় দেখিয়েন না তো আমায়। কথা বলুন। কিছু হয় নি তো। (কেদে)
মেহরাম এই যে ডাকে সোহেল কে কিন্তু তার ওঠার নাম নেই। মেহরাম জেনে গেছে যে সোহেল আর নেই।সোহেল মারা গেছে। চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছে সে। কিন্তু কেন যেন মেহরাম সত্য টা মেনে নিতে পারছে না। সোহেল আর নেই এর জন্যই সে এতো চুপ আজ, এতো ডাকার পরও উঠছে না। “সোহেল আর নেই” এটা যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না তার। মেহরাম কেদে কেদে হিচকি তুলে ফেলেছে তখনই একজন নার্স সোহেলের কেবিনের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো মেহরামের কান্নার শব্দ শুনে নার্স টা কেবিনের দরজা টা হাল্কা ভাবে খুলে দেখে মেহরাম অঝোরে কাদছে। আর মেহরামকে সেই নার্স টা ভালোভাবেই চিনে। সে দ্রুত ডাক্তার কে ডেকে আনতে যায়। পেসেন্টের অবস্থা বেশি ভালো না শুনে ডাক্তার দ্রুত ছুটে আসে। নার্স এসে মেহরামকে ধরে উঠায়। কোন রকমে শান্ত করায়। মেহরামও কিছুটা চুপ হয়ে যায়। মেহরাম জলদি সবাইকে ফোন দিয়ে হস্পিটালে ডাকে। তার প্রায় দশ মিনিট পরেই ডাক্তার কেবিন থেকে বের হয়ে পরে। মেহরাম তড়িঘড়ি করে ডাক্তারের সামনে যায়।
মেহরাম;; ডক্টর, কি হয়েছে, কককি হয়েছে উনার। ঠিক আছেন তো?
ডাক্তার;; মিসেস মেহরাম আমি জানি যে আপনার এই অবস্থায় এই সত্য টা মেনে নিয়ে বেশ কষ্ট হবে কিন্তু কি আর করার। মিস্টার সোহেল ইস নো মোর। মারা গেছেন উনি, আমি দুঃখিত।
মেহরামের মাথায় যেন বাজ ভেংে পরে। কি থেকে এ কি হয়ে গেলো। তখনই বাড়ির সবাই এসে পরে। ডাক্তার তাদেরও এই একই কথা বলে। আসলে কেউই এই কথা টা এখন বিশ্বাস করতে পারছে না। কুসুম বেগম ইতোমধ্যেই জ্ঞান হারিয়েছেন। মেহরাম ধপ করে বসে পরে। তনু তাকে সামলিয়ে নেয়। অতি শোকে সবাই পাথর হয়ে গিয়েছে। একটা নবজাতক বাচ্চা জন্মানোর আগেই তার বাবাকে হারালো। এটা মেনে নেবার মতো কথা না। পুরো বাড়িতে শোকের ছায়া নেমে পরেছে। মেহরামের তো এই অবস্থা যে কাদতে কাদতে পানি গুলোও শুকিয়ে গেছে। সে শুধু মূর্তির ন্যায় বসে আছে। সোহেলের লাশটা হস্পিটাল থেকে নিয়ে নিজের বাড়িতে আনা হয়েছে। সোহেলের মামা & মামাতো বোন এসেছে। সবার আহাজারি আর কান্নায় যেন বাড়ি ফেটে পরছে। ঘুমের মাঝেই সোহেল মারা গিয়েছিলো। তার ক্যান্সার একদম ফুটে ওঠেছে। এমনও হয়েছে যে শরীরের মাংস গুলো খয়ে খয়ে পরেছে। তবুও তাকে শেষ গোসল করিয়ে কাফনের কাপড় পরিয়ে স্টীলের বিছানাতে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। সোহেলের সাথে যারা আর্মিতে কাজ করতো তারা সকলেই এসেছে। সবারই চোখে আজ অশ্রুবিন্দু। আর মেহরাম সব সময়ের মতো সোহেলের মাথার পাশে বসে আছে। একদম টাস্কি খেয়ে বসে আছে। চারিদিকে কি হচ্ছে না হচ্ছে সেদিকে কোন খেয়াল নেই। হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে গেছে মেহরামের। আয়ুশ একপাশে দুহাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে। সোহেলের সেদিনের বলা কথা গুলো কানে বাজছে তার।
সবার জীবনের চিরন্তন সত্য হচ্ছে “মৃত্যু”। জীবনের ইতি ঘটানোর নাম হচ্ছে “মৃত্যু”। এই ক্ষুদ্র দুনিয়ায় সবকিছুই খনিকের সব। অবশেষে যা থাকে তা হচ্ছে এই “মৃত্যু”। আর এটাই সত্য। হাজার নামি দামি অট্টালিকা তে থাকলেও অবশেষে সবার স্থান হয় সেই তিন ফুট মাটির নিচে। কবরের বাশ পচার আগে মানুষ হাড়-মাংস পচন ধরে। বেপার টা কষ্ট দায়ক কিন্তু এটাই সত্য। আজ হোক কাল হোক, দুইদিন আগে আর পরে হোক সবারই এই একই স্থানে যেতে হবে ”কবর”। যেখানে আজ সোহেলকেও যেতে হলো সবাইকে কাদিয়ে।
সোহেল সকাল বেলা মৃত্যুবরণ করে। আর সন্ধ্যার দিকে তার জানাযা। কুসুম বেগম তো মা, আর একজন মায়ের মন কি বলে যখন নিজের চোখের সামনে নিজের সন্তানের লাশ থাকে। উনার কান্নায় বাড়ির দেওয়াল গুলো যেন ফেটে পরছে। তনু, সোহেলের মামাতো বোন আর মেহরামের আম্মু কুসুম বেগম কে সামলাচ্ছে। সোহেলের লাশ নিয়ে যাওয়ার পালা এবার। মেহরাম পাথরের মতো সেখানে ঠাই বসে আছে। তার সামনে থেকে সোহেলের লাশ টা নিয়ে যাওয়া হয়। আয়ুশ সবার আগে সোহেলের লাশ টা তার কাধে নেয়। বাড়ির সব ছেলে মানুষ আর মসজিদের বেশ কিছু মুন্সী মিলে সোহেলের লাশ টা নিয়ে যায় জানাযা পড়ানোর জন্য। কুসুম বেগমের শরীর অতিমাত্রায় খারাপ হয়ে গেছে। মেহরাম খালি চোখে তাকিয়ে আছে তাদের দিকে। সে দেখছে যে সোহেল কে তারা তার সামনে থেকে নিয়ে গেলো। তাদের বাড়ির বাইরে গেতেই মেহরাম উঠে এক দৌড় দিয়ে বাড়ির গেটের কাছে চলে যায়। চোখ নাক মুখ তার সব ফুলে লাল হয়ে গেছে। মাথা থেকে ঘোমটা টা নিচে নেমে পরেছে। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে গেছে। শ্বাস যেন আটকে গেছে তার। মেহরাম আর পারে না নিজের গলা ছেড়ে জোর চিল্লিয়ে দেয় এক ডাক….
মেহরাম;; সোহেএএএএএএএএএএএএএএএএএএল।
।
।
।
।
💕চলবে~~
#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ১৮
🌺. . .
সোহেলের জানাযা শেষে সবাই এসে পরেছে। বাড়িতে এখনো অনেক মানুষ আছে। তারা কেউই কারো বাড়ি যাই নি আজ। সবাই এখানেই থাকবে। কুসুম বেগমকে সামলানো এক প্রকার দায় হয়ে পরেছে। এদিকে বাড়িতে কোথাও মেহরামকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কিন্তু সেদিকে কারো খেয়াল নেই। হঠাৎ করেই আয়ুশের খেয়াল আসে যে সবাই এখানে আছে কিন্তু মেহরাম নেই। আয়ুশ তাকিয়ে দেখলো কাউকে যে কিছু জিজ্ঞেস করবে সেই পরিস্থিতি টুকু নেই। সবাই এখানে তাহলে তো মেহরামেরও এখানেই থাকার কথা। আয়ুশ তাকে পায় না তাই সে নিজেই সেখান থেকে উঠে এসে মেহরামকে খুঁজতে থাকে। হলরুমে, বারান্দায়, ছাদে সব জায়গায় খুঁজে নেই। কিন্তু মনে পরে যে মেইন জায়গা তেই তো খোজা হয় নি। সে মেহরামের রুমের কাছে চলে যায়। তবে এতোক্ষণে বাইরে একদম কালো মেঘ করে এসেছে। আকাশে ভারি বিদুৎ চমকাচ্ছে। দেখে বোঝা যাচ্ছে যে তীব্র বেগে একটা বৃষ্টি নামবে।
আয়ুশ মেহরামকে খুজছে আর এরই মধ্যে বৃষ্টি নেমেও গেছে। আয়ুশ মেহরামের রুম অতিক্রম করে গেলে কি যেন একটা লক্ষ্য করে। সে ধীর পায়ে আবার পিছিয়ে আসে। দেখে মেহরাম ফ্লোরে খাটের সাথে হেলান দিয়ে দুহাত-পা ভাজ করে বসে রয়েছে। রুমের বড়ো বড়ো জানালা গুলো কিছুই লাগানো হয়নি। বড়ো বড়ো পর্দা গুলো বাতাসে উড়ছে। সব একদম খোলা। সেদিক দিয়ে সাই সাই করে বাতাস আসছে। কিন্তু মেহরামের হুশ নেই সে তার মতো করে বসে আছে। আয়ুশ মেহরামের দিকে তাকিয়ে আছে কিছু বলবে কি বলবে না দোটানার মধ্যে পরে গেছে। তবে আয়ুশ বুঝলো যে এখন এই মূহুর্তে মেহরামকে একা থাকতে দেওয়া টাই ভালো হবে। কারণ এখন কারো মনের অবস্থাই ভালো না। তাই আয়ুশ মাথা নামিয়ে সেখান থেকে চুপচাপ এসে পরে। কিন্তু মেহরাম খেয়াল করেছিলো যে সেখানে আয়ুশ দাঁড়িয়ে আছে। আয়ুশের চলে গেতেই সে চোখ তুলে তাকায়। মেহরাম উঠে গিয়ে তার ঘরের দরজা টা লাগিয়ে দেয়। তারপর চলে যায় করিডরে। প্রচুর পরমাণে বাতাস এখানে। বাতাসে মেহরামের ওরনা টা উড়ছে। তবুও মেহরামের সরার নাম নেই। হয়তো তার মনের ভেতরে যে ঝড় বইছে তার কাছে এই ঝড় নিতান্তই তুচ্ছ। এখনো বাইরে থেকে সবার কান্নার আওয়াজ কানে আসছে। মেহরাম ঘাড় টা ঘুরিয়ে একটু তার পেছনে তাকায়। আবারও সামনে তাকিয়ে দেখে বৃষ্টি নেমে গেছে। সেখানে বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই থেকে মেহরাম এসে পরে। রুমের দরজা খুলে বাইরে বের হয়ে পরে। বাইরে যেন সবার এক আহাজারি শুরু করে গেছে। সোহেলের বোন টাও পাগলের মতো কান্না করছে। মেহরাম সোজা বের হয়ে পরে রুম থেকে। আপন মনে সামনে হেটে যেতে থাকে। সবার অগোচরে বাড়ির বাইরেও এসে পরে। তবে মেহরাম বাড়ির বাইরে বের হলে আয়ুশের তা চোখে বাধে। সে মেহরামের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। মেহরাম কাউকে কিচ্ছু না বলে সোজা নিজের মতো করে বাইরে বের হয়ে পরে। আয়ুশ কুসুম বেগমের পাশে বসে ছিলো। মেহরাম যে চলে গেলো তা সে দেখেছে। এতো বৃষ্টির মাঝে সে গেলো কোথায়? আয়ুশ এখন এদের এভাবে রেখে কোথাও যেতেও পারছে না। আয়ুশ সেখানেই কিছুক্ষন বসে থাকে। এদিকে মেহরাম এই ঝড়ের মাঝেই বাইরে বের হয়ে পরেছে। বাড়ির গেট পেরিয়ে বাইরে বের হতেই আরেক দমকা বাতাস এসে যেন মুখের ওপর আছড়ে পরলো। যেখানে সবাই এই ঝড়ের হাত থেকে বাচার জন্য ছুটছে সেখানে মেহরাম একাই হেটে চলেছে হেটেই চলেছে । বেশ সময় পার হয়ে গেলো তবুও মেহরামের আসার নাম গন্ধ নেই। এবার যেন আয়ুশের টনক নড়ে। সে উঠে গিয়ে বাইরে চলে যায়। আয়ুশকে তনু জিজ্ঞেস করলে সে কোন উত্তর না দিয়েই চলে যায়। সেও মেহরামের খোঁজে বাইরে বের হয়ে পরে। আশে পাশে সব জায়গায় মেহরাম কে খুজে চলেছে আয়ুশ কিন্তু সে নেই। প্রায় পনেরো মিনিটের ওপরে হয়ে গেলো মেহরামকে আয়ুশ খুজছে কিন্তু সে নেই। এদিকে মেহরাম হাটতে হাটতে এক নির্জন জায়গায় এসে পরে। চারিদিকে কেমন এক শুনশান নীরবতা। চারিদিকের কোথাও মানুষ নেই। মেহরাম আরেকটু হেটে সামনে গেতেই দেখে এক কবরস্থান। এখানেই সোহেলকে কবর দেওয়া হয়েছে। আসলে মেহরাম সোহেলের কবরের কাছে এসেছে। মেহরাম হেটে গিয়ে কবরস্থানের ভেতরে চলে যায়। ওইতো সামনেই সোহেলের কবর। ওপরে ছোট্ট একটা দেওয়াল তার সাথে লিখা “সোহেল শেখ”। মেহরাম খানিক দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কবরের দিকে অপলক ভাবে তাকিয়ে আছে। এর মধ্যেই ঝুমঝুম করে বৃষ্টি নেমে পরে। আকাশে কয়েকবার ভারি মেঘ ডেকে আবার চুপ হয়ে যায়। এখানে বেশ কিছু কবর রয়েছে। তাদের মধ্যে সোহেলের একটা। বৃষ্টিতে সব কবর গুলো ভিজে যাচ্ছে। মেহরামও প্রায় ভিজে একাকার করে গেছে। মেহরাম এক চুল পরিমাণ ও নড়ছে না। সোহেলের কবরের দিকেই স্থীর ভাবে তাকিয়ে আছে। তার গাল চোখ বেয়ে ঝরে যাচ্ছে অজস্র অশ্রু। মেহরামের এখন একটা কথা বারবার মনে পরছে~~
~“`একদিন চিরনিদ্রায় শায়িত থাকবো আমি কবরের শায়নে,, একা কোন এক বৃষ্টি ভেজা দিনে“`~
খুব খুব কষ্ট বুকে নিয়ে কেউ একজন এই কথা টা বলেছিলো। এই নিষ্ঠুর দুনিয়া তাকে তার কষ্ট গুলোকে সুখে পরিণত-ই হতে দেয় নি। বেচারার কষ্ট গুলো তার বুকে চাপা দিয়েই পরকালে পারি জমাতে হয়েছে। মেহরাম সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। আর ওদিকে আয়ুশের হঠাৎ মাথায় আসে যে মেহরাম সোহেলের কাছে তো যায় নি। আয়ুশ কোন কিছু না ভেবে দ্রুত সেদিকেই যায়। আর যা ভেবেছিলো তাই হয়। মেহরাম ভিজে একাকার হয়ে সোহেলের কবরের কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। আয়ুশ কি বলবে কি করবে ভেবে পায় না কারণ সিচুয়েশন টাই এমন। এভাবে ঠিক কতোক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলো মেহরাম জানে না। মেহরাম এবার তার হাত টা তার পেটের ওপরে রাখে। শেষ একবার সোহেলের দিকে তাকিয়ে সে এসে পরে। মেহরাম সারা টা রাস্তা এসেছে পেটের ওপর হাত রেখে, মেহরামকে যেতে দেখে আয়ুশও তার পিছু যায়। আয়ুশ তাকে আটকায় নি, না ই ভিজতে বারণ করেছে। কি বলবে সে, কোন ভাষাই নেই তার কাছে। তবে পেছন ঘুড়ে যাবার সময় মেহরাম আয়ুশকে দেখে। সে কিছু না বলেই এসে পরে। হাটতে হাটতে এক সময় মেহরাম বাসায় এসে পরে। বাড়ির ভেতরে যেতেই সবাই অবাক হয়ে মেহরামের দিকে তাকায়। অতি মাত্রায় ভিজে গেছে সে। আর বাড়ি থেকে কখন কিভাবে বের হলো তার কেউ বলতেই পারবে না। টুপ টুপ করে পানি পরছে। মেহরাম চুপ করে তাকিয়ে আছে। তনু কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই হঠাৎ মেহরামের মাথা টা চক্কর দিয়ে উঠে। নিজের চারিদিক অন্ধকার হয়ে এলে হুট করেই অজ্ঞান হয়ে পরে মেহরাম। অজ্ঞান হয়ে নিচে পরে যাবার আগেই পেছন থেকে আয়ুশ এসে তাকে ধরে ফেলে। আর তনু, মেহরামের আম্মু, চাচি সবাই ”’মেহরাম”’ বল চিল্লিয়ে ওঠে দ্রুত তাকে ধরে। তনু আর মেহরামের আম্মু তাকে ধরে ধরে রুমে নিয়ে যায়।
তনু;; এইসব কি হচ্ছে, মেহরাম গিয়েছিলো কোথায়?
কনিকা;; তাই তো জানি না, আর গেলোই বা কখন তাও তো বুঝতে পারলাম না।
তনু;; কিহহ এই কড়া বৃষ্টি তে ভিজছিলো আর আয়ুশ তুমি আটকাও নি?!
আয়ুশ;; কি বলবো আমি, কি বলবো যে মেহরাম এসে পরো। আরে অবস্থা টাই এমন। কান্ডজ্ঞান কারোর ই এখন ঠিক নেই। ওর মনের মাঝে কি চলছে আল্লাহ আর ও ছাড়া কেউ জানে না। মেয়ে টা শেষ হয়ে গেলো একদম। প্লিজ ওকে দেখো।
আয়ুশ এই বলেই মেহরামের রুম থেকে এসে পরে। তনু আর মেহরামের মা মিলে মেহরামের ভেজা কাপড় পালটে দিলো। চুল মাথা এগুলো মুছে একদম ঠিক করে দিলো। কিন্তু এখনো মেহরাম অজ্ঞান। ডাক্তার কেউ ডাকতে পারছে না। কারণ এখন বাইরে যে পরিমাণ বৃষ্টি তাতে কেউই আসবে না। বাইরের অবস্থা খারাপ। মেহরাম এখনো অজ্ঞান হয়ে শুয়ে আছে। মেহরামের মা মেহরামের পাশে বসে পরে। মেহরামের একটা হাত তার দুহাতের মাঝে নিয়ে ফুপিয়ে কেদে ওঠে। তনু তার বড়ো মা কে কি বলে বুঝ দিবে জানা নেই তার। সবাই এভাবেই থাকতে থাকে। ঘন্টা খানিক পর বৃষ্টির বেগ কমে গেল। আয়ুশ দ্রুত একজন ডাক্তার কে ফোন দেয়। তারপর উনি এসে মেহরামের চেকাপ করতে থাকেন…
ডাক্তার;; দেখুন উনি ৫ মাসের প্রেগন্যান্ট, কিছুদিন পর ৬ মাস হবে। একজন মেয়ের জন্য প্রেগন্যান্সির ৬ মাস থেকে শুরু করে বাকি সময় টুকু খুব বেশি স্যান্সিটিভ হয়। প্রোপার কেয়ার করতে হবে। আর আমি জানি উনার হাজবেন্ড ইতোমধ্যেই মারা গিয়েছেন। তো উনার ওপর এর প্রভাব টা পরবেই। তবুও বেশ কিছু মেডিসিন দিচ্ছি টাইম মতো খাওয়াবেন।
তনু;; জ্বি একদম।
ডাক্তার;; উনাকে বেশি একা থাকতে দিবেন না। কারণ উনি অনেক বেশি টেনশন করেন। আর এটার এফ্যাক্ট বেবির ওপর কেমন পরে তা বলে বুজানো দায়। বেশি মানুষের মাঝে রাখবেন। কারণ একা থাকতে দিলেই শতো চিন্তা ভাবনা এসে মাথায় জড়ো হবে। আর খাবারের কথা তো রইলোই। যতো বেশি সম্ভব উনাকে খাওয়াবেন। আসলে কি এখানে মেডিসিন না উনার ঠিকঠাক মতো খেয়াল রাখলেই হয়ে যাবে।
তনু;; হুমমম।
ডাক্তার সব কিছু বলে বুঝিয়ে সেখান থেকে এসে পরে। তনু মেহরামের পাশে বসে পরে। এখনো মেহরাম চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। তবে চোখ বন্ধ থাকা অবস্থা তেও তার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পরছে। তনুর এবার বেশ কান্না পাচ্ছে। নিজের চোখের সামনে নিজের বোনের এই অবস্থা যেন সে কোন ভাবেই মেনে নিতে পারছে না। তনুর চোখের পানি গুলো টুপ টাপ করে মেহরামের মুখের ওপর পরে। মেহরাম আস্তে আস্তে চোখ খুলে তাকায়। তাকিয়েই তনুর মুখ টা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। মেহরাম দেখে তনু হাউমাউ করে কাদছে। মেহরাম মুচকি হেসে তনুর চোখের পানি গুলো মুছে দেয়। মেহরাম উঠে বসে, তনু হেল্প করে। তনু খাবার এনে মেহরামের মুখের সামনে ধরে। মেহরাম প্রথমে খেতে না চাইলেও তনুর জোর করে খাইয়ে দেয়। খাইয়ে চলে যায় তনু। মেহরাম এখন রুমে একা। এবার যেন মেহরামের বাধ ভেংে গেলো। নিজের পাশে তাকিয়েই দেখে সোহেলের ছবি। মেহরাম সেটা হাতে নিয়ে কেদে দেয়। মেহরাম এবার কেদে দেয়, একদম সবকিছু ভুলে কাদছে।
মেহরাম;; আপনি কেন চলে গেগেলেন,, নিনিজের মমায়ের কথা এএএকবার ভাভাবলেন ননা। এএভাবে একা ফেলে কেন গেলেন। ফিরে আসুন না প্লিজ। মানলাম আমি আমি আপনাকে আমার, আমার সবটুকু দিয়ে ভালোবাসতে পারিনি কিন্তু আপনি, আপনি এভাবে চলে যাবেন। অনেক মিস করছি আপনাকে প্লিজ ফিরে আয়ায়াসুন না। আপনার যেযে মেয়ে, মেয়ে হবে আমি ওকে কি বলবো, বলবো যে তোর বাবা তোতোকে একা রেরেখে চলচলে গেছে। সবার, সবার বাবা যখন তাতাদের মেয়েকে আদর করবে আমার মেময়ে কি তাতাকিয়ে তাকিয়ে দেখবববে নাকি। আপনি খুব বেশি খাখারপ। সোহেএএএএল। (অঝোরে কেদে)
।
।
এভাবেই দিন যেতে থাকে। কুসুম বেগম আগে থেকে কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছেন। তবুও কোথাও না কোথাও ছেলে হারানোর আর্তনাদ রয়েই গেছে। তনু প্রতিদিন নিজের বোনের কাছে আসে। মেহরামের বাবা মা চাচি চাচ্চু সবাই আসে। মেহরামও মাঝে মাঝে নিজের বাবার বাড়িতে যায়। কুসুম বেগম মেহরামকে আগের মতোই ভালোবাসে। তবে ইদানীং উনি নিজের ভাইয়ের কাছে যাতায়াত করেন বেশি। আয়ুশের সাথে মেহরাম আগে থেকে একটু ভালোভাবেই কথা বলে। মেহরামের ছয় মাস চলছে। বাড়ির সবাই মেহরামের সাথে সবসময় থাকে। তনু আর তার মা মানে মেহরামের চাচি মেহরামকে খাইয়ে খাইয়ে শেষ করে। আগে থেকে সবকিছুই রিকভার হয়েছে একটু। সবই ঠিক আছে কিন্তু মাঝে মাঝে সোহেলের কথা সবারই মনে পরে। মেহরাম আগে থেকে হাল্কা মোটা হয়েছে। মেহরামও নিজের বাচ্চার কথা ভেবে হাসি খুশিই থাকে। ডাক্তারের কাছে যেতে হয় তাকে মাঝে মাঝে। মেহরাম যখন তার বাবার বাড়িতে যায় তখন যেন কারো খুশি আর ধরে না। সবাই মেহরামের সামনে অনেক নরমাল থাকে। আর মেহরামের মায়ের যেন এটা প্রতিদিন কার কাজ হয়ে গেছে। মেয়ে বাড়ি এলে তাকে নিজ হাতে আচার বানিয়ে খাওয়ানো। তবে যখন তনু আর তার শশুড় বাড়ির লোকজন আর মেহরাম সবাই মিলে মেহরামের বাবার বাড়িতে এক হয় তখন মেহরামের খানিক হলেও কষ্ট লাগে। তনু আর আয়ুশ একসাথে যে। মেহরাম সেখান থেকে উঠে দূরে সরে আসে। হয়তো তখন তার কিছুটা হলেও সোহেলের কথা মনে পরে। মেহরাম এখন ছাদের এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। তখন আকাশ আসে হাতে তার এক বয়াম আচার নিয়ে। কারণ সে জানে যে তার মেহরাপু আচার খেতে ভালোবাসে। মেহরাম তার পাশে তাকিয়ে দেখে আকাশ দাঁড়িয়ে আছে। আচারের বয়াম মুখের সামনে নিয়ে যার ফলে তার মুখই ঢেকে গেছে। মেহরাম খিলখিল করে হেসে দেয়। সাথে আকাশও। মেহরাম আকাশ কে নিয়ে একসাথে বসে আচার খেতে থাকে। আর আকাশের সব বোকা বোকা কথায় হাসছে। আর আয়ুশ ছাদের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। সে ছাদে এসেছিলো এসেই দেখে এখানে দুই ভাই বোন মিলে বসে আছে। সময়ের চাকা যেতে যেতে আরো কেটে যায় দুমাস।
।
।
।
।
🌹চলবে~~
#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ১৯
🌺. . . .
সময়ের চাকা যেতে যেতে আরো কেটে যায় দুমাস। মেহরামের ৮ মাস চলছে। পেট অনেক বেশি ফুলে গেছে। মেহরামের হাতে গালে বেশ মাংস বেড়েছে। চুলগুলো ঘন কালো লম্বা। হাটার সময় পেটে হাত দিয়ে হাটতে হয় তাকে। অনেক বেশি সুন্দর লাগে তাকে। আচ্ছা মা হবার আগে সব মেয়ে দেরই কি এমন সুন্দর লাগে বা তারা এমন সৌন্দর্যের অধিকারীনি আপনা আপনিই হয়ে যায়!? একটা মেয়ের জীবনের সবচেয়ে বেশি, সবচেয়ে বেশি মূল্যবান একটা সময় এটা। মেহরাম এখন তার বাবার বাড়িতেই তনুও সেখানেই রয়েছে। তনু মাঝে মাঝে মেহরামের পেটের ওপর কান পেতে শুনে। মেহরাম হাসে। বেবি হলে এই করবে সেই করবে কতো কিছু। মেহরামের চাচি যেন আজ সকাল থেকে পণ করে রেখেছেন যে মেহরামের মুখ এক মিনিটের জন্যও ফাকা রাখবে না। কেননা বেশ কিছু দিন আগে ডাক্তার দেখানো হয়েছিলো মেহরামকে, ডাক্তার বলেছে বেবি হ্যালদি হলে আপনার কেও ওইসব হ্যালদি খাবার খেতে হবে। ব্যাস এই বললো আর শুরু হলো সবার তাকে খাওয়ানোর পালা। কুসুম বেগম এখনো আগের মতোই রয়েছে। মেহরামকে নিজের মেয়েই ভাবেন। তিনি তার বাড়িতেই আছেন। মেহরামকে বলেছে তার বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে। সকাল বেলা তার সাথে সবার কথাও হয়েছে। আয়ুশ অফিসে। তনু তাকে সেখানেই ভিডিও কল দিয়েছিলো। সবার সাথেই তার কথা হয়। এখন মেহরামকে দুইজন দুইদিক থেকে ধরেছে। তনু আর মেহরামের চাচি। তনুর কাছে মেহরামের চুল গুলো নাকি হেব্বি লাগে। তাই আচড়ে দিচ্ছে আর তার চাচির খাবার মিশন।
চাচি;; এটা, এটা খা তারপর আমি আরো আনছি।
মেহরাম;; কি শুরু করলা টা কি তোমরা। আমারে কি মানুষ মনে হয় না। গরু লাগে আমারে। গতো দুই ঘন্টা যাবত এইটা ওইটা খেতেই আছি। চাচি আমি আর পারবো না গো।
চাচি;; তুই না খেলি আমার ছোট মেহরাম খাবে।
মেহরাম;; না না ছোট টার ও পেট একদম ভরে গেছে আর খাবে না।
চাচি;; আচ্ছা এখন রাখলাম পরে আবার খাস।
মেহরাম;; ইশশশশ!
তনু এদের কান্ড দেখে হেসে দেয়। মেহরামের মাথা বাধা শেষ হলে তনু আর মেহরাম মিলে গল্প করতে থাকে। তখনই মেহরামের বাবা আর সাথে বাড়ির মালি বাইরে থেকে বাজার করে নিয়ে আসে। মেহরামের বাবা বাড়ি এসেই কনিকা বলে চিল্লিয়ে ওঠে। বাইরে তাকিয়ে দেখে মেহরামের বাবা পুরো বাজার তুলে এনেছে। তড়িঘড়ি করে সেগুলো নিয়ে আসে। তারপর মেহরামের চাচি আর মা মিলে সেগুলো গোছগাছ শুরু করে দেয়। মেহরামের দাদি বসে বসে সুপারি কাটছেন। এভাবেই সবাই হেসে খেলে চলছিলো। তবে এরই মধ্যে মেহরামের শ্বাস কেমন ছোট হয়ে এলো। তলপেটের সাইডে প্রচন্ড ব্যাথা শুরু হলো। তনু তাকে সোফাতে বসিয়ে রেখে একটু রান্নাঘরে গিয়েছিলো। কিন্তু এদিকে তো মেহরামের অবস্থা খারাপ। নিজের হাত টা একাএকাই পেটে চলে গেলো। চোখ মুখ কেমন কুচকে ফেললো মেহরাম। হঠাৎ মেহরামের পেটে ব্যাথা শুরু হলো….
মেহরাম;; আ আ আহহ.. মায়ায়া।
তনু পেছন ফিরে দেখে মেহরাম পেটে হাত রেখে চোখ মুখ সব ছোট করে ফেলেছে।
তনু;; মেহরু… বড়ো মা মেহরাম কে দেখো। (চিল্লিয়ে)
তনু ছুটে গেলো মেহরামের কাছে সাথে সবাইকে ডাক দিলো। সবাই দ্রুত এসে মেহরামকে ধরে। তার অবস্থা একদম খারাপ হয়ে গেছে।
তনু;; কিন্তু এখন তো ডেলিভারির টাইম না এখন এমন ব্যাথা। বাবা গাড়ি বের করো।
বিল্লাল;; হ্যাঁ হ্যাঁ করেছি, মেহরামকে একটু ধরে বাইরে নিয়ে আয়।
তনু;; হ্যাঁ আনছি।
মেহরামের মা কেদে দিয়েছে। কেননা তার মেয়ের ওপর দিয়ে এমনিতেই অনেক বেশি ঝড় গিয়েছে। এখন যদি কিছু হয় পুরো পরিবার ঝড়ে যাবে। আর নিজের চোখের সামনে নিজের সন্তানের এমন দশা কোন মা-ই সহ্য করতে পারবে না। মেহরামের ব্যাথা বেড়ে গেলো। তাকে সবাই ধরে কোন রকমে গাড়িতে তুলে দিলো। কিন্তু মেহরাম এই যে তার মায়ের শাড়ির আচল ধরেছে আর ছাড়ে না। এগুলো যেন মেহরামের মায়ের মন কে আরো ক্ষত-বিক্ষত করে তুলছে। উপায় না পেয়ে ড্রাইভিং সিটে মেহরামের চাচা বসলো পাশে মেহরামের চাচি, আর পেছন মেহরাম তার মা আর তনু। মেহরামকে দুপাশ থেকে ধরে রেখেছে। বেশ সময় পর হস্পিটালে পৌঁছে গেলো। যে ডাক্তারের আন্ডারে মেহরাম ছিলো সেই ডাক্তারের কাছেই গেলো। ডাক্তার আর দুইজন নার্স মেহরাম কে ধরে খুব সাবধানে ভেতরে নিয়ে গেলো। রক্ত পরছে মেহরামের। লাল জামা পরে থাকার কারণে রক্তে যেন তা খয়েরী রঙের হয়ে গেছে। কুসুম বেগমকেও জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। উনি ছুটে আসেন মেহরামের খবর জেনে। মেহরামকে কেবিনের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। আর বাইরে সবাই বসে আছে। চিন্তায় এক একজনের ঘাম ঝড়ে যাচ্ছে। তনু জলদি আয়ুশকে ফোন দেয়। হাত-পা যেন তার কাপছে। তড়িঘড়ি করে আয়ুশকে ফোন দেয়। আয়ুশ তখন মিটিং-এ ছিলো। কিন্তু এই অসময়ে ফোন বাজাতে কছুটা বিরক্তি-ই হয় আয়ুশ। ফোন তুলে দেখে তনুর ফোন। আয়ুশ প্রথমে কেটে দেয়। কিন্তু পরের বার আবার ফোন বাজে আয়ুশের মনে হয় যদি কল টা দরকারি হয় তাহলে তাই সে সবার কাছ থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে ফোন টা পিক করে…
আয়ুশ;; কিহহ, ব্লিডিং মানে। ৮ মাস না এখনই কিসের ব্লিডিং। কি বলছো তনু?
তনু;; আয়ুশ আমি জানি না প্লিজ তুমি আসো।
আয়ুশ;; না না মেহরামের কিছুই হবে না। ও ঠিক থাকবে, তুমি চিন্তা করো না। আর আমি, আমি এখনই আসছ।
তনু;; হুম।
আয়ুশ ফোন কেটে দ্রুত আবার মিটিং রুমে যায়। আয়ুশ এক প্রকার দৌড়াচ্ছে।
আয়ুশ;; অল মিটিংস্ আর ক্যান্সেল।
মেনেজার;; কিন্তু স্যার..
আয়ুশ;; কোন কথা না বলছি ক্যান্সেল মানে ক্যান্সেল। আরে আমার গলা শুকিয়ে যাচ্ছে। তুমি সব সামলে নিও আমি গেলাম।
মেনেজার;; জ্বি স্যার।
সবাই প্রায় আয়ুশের দিকে তাকিয়ে আছে কারণ তাকে এর আগে এমন করতে কখনোই কেউ দেখে নি। ঝড়ের গতিতে গাড়ি চালিয়ে চলে গেলো হস্পিটালে।
ওদিকে মেহরামকে নিয়ে যে হস্পিটালের কেবিনে ডাক্তার ঢুকেছে আর কোন শব্দ নেই। বাইরে সবাই চিন্তায় নাজেহাল। তনুর মা মেহরামের মায়ের পাশে বসে আছে। তনু পায়চারি করছিলো তখনই আয়ুশ দ্রুত হস্পিটালে আসে।
তনু;; আয়ুশ..!
আয়ুশ;; মেহরাম কোথায়?
তনু;; ভেতরে।
আয়ুশ;; ডাক্তার কিছু বলে নি এখনো? (কেবিনের দিকে তাকাতাকি করে)
তনু;; না।
সাথে সাথেই ডাক্তার কেবিন থেকে বের হয়। ডাক্তার কে দেখেই আয়ুশ এগিয়ে যায়। তারপর তনুও যায়। সবাই ডাক্তারের কাছে যায়।
ডাক্তার;; দেখুন চিন্তার কোন কারণ নেই। মা & বেবি দুইজনই আল্লাহ রহমতে সুস্থ আছে। আসলে ব্যাপার টা হলো সবার শারীরিক গঠন এক নয়। তো সেই অনুযায়ী সবার প্রেগ্ন্যাসি ও এক নয় ভিন্ন ভিন্ন। অনেকের বডি তে হিমোগ্লোবিন বেশি তো আবার অনেকের বডিতে কম থাকে। আর আমরা জানি যে প্রেগন্যান্ট থাকার সময় টুকু পিরিয়ড জিনিস টা বন্ধ থাকে। এভাবে রক্ত পড়ে যাওয়া টা ওই তুলনায় কিছুটা স্বাভাবিক ছিলো। এতে ভয় পাবার কিছুই নেই। আর সামান্য হাত কাটলেও তো ব্যাথা পাই তাই না তো মেহরামের এই ব্যাথা টা নরমাল ছিলো। আর ওইযে বললাম সবার প্রেগ্ন্যাসি এক রকম হয় না। ডেলিভারি টাইম মতোই হবে। এখন মেহরাম আর বাচ্চা একদম ঠিক আছে, ভয় পাবেন না। মেহরাম ভেতরেই আছে দেখা করতে পারেন। আর আজ বিকেলের দিকে তাকে নিয়ে যেতে পারেন।
ডাক্তারের এমন সুস্পষ্ট কথায় সবাই যেন হাফ ছেড়ে বাচলো। তনু, তার বড়ো মা, মা সবাই মেহরামের কেবিনে গেলো। গিয়ে দেখে সে শুয়ে আছে। মেহরামের মা তার পাশে বসে পরে।
কনিকা;; মারে ঠিক আছিস? জানিস আত্মা উড়ে গিয়েছিলো। এখন শান্তি লাগছে তুই ঠিক আছিস দেখে।
মেহরাম;; মা কিছুই হয় নি আমার, অযথা ভয় পাচ্ছো। আমি ঠিক আছি।
তনু তার মা সবাই মিলে কথা বলছিলো তখন কেবিনে আয়ুশ আসে। মেহরাম আর আয়ুশ দুইজনকে দেখে। মলিন হাসে তারা। তখন একজন নার্স কেবিনে আসে।
নার্স;; আপনারা উনার মা-বোন?
তনু;; হ্যাঁ।
নার্স;; আসলে উনাকে এখানে কিছুক্ষণ থাকতে হবে তো তাই উনার প্রয়োজনীয় সব জিনিস দরকার ছিলো। আর ব্লাড লেগেছিলো তার কাপড় গুলো তে সেগুলো এখনো পড়িয়ে রাখলে ব্যাপার টা আনহাইজেনিক হতো তাই ড্রেস চেঞ্জ করে হস্পিটালের ডেস পড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তো উনার যাবতীয় যা যা লাগে সব লাগতো।
মেহরাম;; চাচি আমি ভেবেছি আজই বাসায় চলে যাবো তাই আর আনা হয় নি। সেগুলো তো আমার বাড়িতে।
তনু;; আব.. সমস্যা কি আমি গিয়ে আনছি তো। মেহরাম তোর জিনিস তো সব তোর রুমেই তাই না। আমি গিয়ে নিয়ে আসি।
কনিকা;; পারবি তো?
তনু;; আলবাদ পারবো। মেহরু চাবি দে!
মেহরাম;; মার কাছ থেকে নিয়ে নিস।
তনু কুসুম বেগমের কাছ থেকে চাবি নিয়ে দ্রুত চলে যায়। মেহরামের পাশে সবাই বসে আছে। আয়ুশও সেখানেই এক চেয়ারে বসে পরলো।
ওদিকে তনু রিকশা করে দ্রুত মেহরামের বাড়িতে চলে গেলো। রুম খুলে ভেতরে গেলো। তারপর এক এক করে মেহরামের কি লাগে না লাগে সব কিছু একটা ব্যাগে নিতে লাগলো। হঠাৎ কাজ করতে করতে তনু একটা ড্রয়ার দেখতে পেলো। তার জানা আছে যে মেহরাম তার বেশি প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো এই ড্রয়ারেই রাখে। তাই তনু সেটা নিতে লাগলো। কিন্তু সেটা অনেক উচু কোন ভাবেই থা পাচ্ছিলো না। তাই সে নিজের পায়ের নিচে একটা মোড়া নিলো তারপর তাতে দাঁড়িয়ে হাত উচু করে নিতে লাগলো। হাতিয়ে হাতিয়ে তা তো পেয়ে গেলো কিন্তু নিচে নামানোর সময় একদম সব হুমড়ি খেয়ে প্রায় তনুর ওপরে পরে। তনু কিছু একটা ধরে পরে যাওয়া থেকে বেচে গেলো। কিন্তু মাথায় হালকা ব্যাথা পেয়েছে। সব কাগজ বা ফাইল যা কিছু ছিলো সব নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে গেছে। তনু মাথার পেছনে হাত দিয়ে নিচে তাকায়। দেখে সব ছড়িয়ে গেছে ফ্লোরে।
তনু;; আসলেই তাড়াহুড়ো তে কাজ করতে গেলেই বিপত্তি। আমিও না দিলাম তো সব আউলে ঝাউলে।
তনু সেগুলো গোছানোর জন্য পা বাড়ালে হঠাৎ তার পায়ে একটা মোটা কিছু বাধে। তনু নিচু হয়ে ঝুকে পরে। ওপরে সব সাদা সাদা ফাইল। সেগুলো সড়াতেই চোখে বাধে একটা গাঢ় কালো মোটা ফ্রেমের ডায়েরি। তনু কপাল কুচকে সেদিকে তাকায়। তার মনে পরে যে এটাই মেহরামের সেই ডায়েরি টা যা সে কাউকেই দেখতে দিতো না। ডায়েরি টা হাতে নিয়ে আসতে চাইলে আবার সেটা নিচে পরে যায়। তনু আবার নিচু হয় সেটা তোলার জন্য কিন্তু এবার ডায়েরির ভেতরে কিছু পাতা উলটে গেছে। আর তাতে মেহরামের হাতের লেখা স্পষ্ট। তনু মেহরামের লেখা দেখে খানিক কপাল কুচকে সেটা হাতে তুলে নেয়। সেখানে যে লেখা টা ছিলো তা দেখে তনুর দুনিয়া ঘুড়ে যায় “” আমি আয়ুশকে ভালোবাসি””। তনুর মাথায় যেন ভাজ ভেংে পড়েছে এটা দেখে। মানে কি মেহরামের ডায়েরি তে এটা লেখা কেন। আর মেহরাম এটাই বা কেন লিখবে? এগুলো সব চিন্তা যেন এখন তনুর মাথায় ভর করে বসেছে। তনুর ভেতরে ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেছে। সে কোন রকমে বিছানার এক কোণায় বসে পরে হাতে ডায়েরিটা নিয়ে। কেন যেন তনুর মনে হচ্ছে এমন অনেক কিছুই আছে যার ব্যাপারে তনু কিছুই জানে না, কিচ্ছু না। আর এখন সে যদি এই ডায়েরি টা না পড়ে তাহলে বড়ো অন্যায় হয়ে যাবে। যদিও সে জানে যে মেহরামের এই ডায়েরি টা পরলে সে খুব রেগে যাবে তবুও সে পড়বে। তনু একবার তার চোখ বন্ধ করে আবার খোলে। ডায়েরিটা একদম প্রথম পৃষ্ঠা থেকে পড়া শুরু করে দেয় সে……
।
।
১.. আমার একটা বোন আছে ‘তনু’। কে বলেছে যে আমার কোন ভাই বোন নেই। আমার সব আছে, আমার তনু আমার বোন। জীবনে দুইজনকে খুব বেশি ভালোবাসি আমার মা আর আমার বোন। এই দুইজন না থাকলে হয়তো আমার নিজের কোন অস্তিত্ব-ই থাকতো না। আমার কলিজার টুকরা দুইটা।
.
২.. আচ্ছা আমার বাবা আমার সাথে কথা বলে না কেন। আমি কি মেয়ে হিসেবে খুব বেশি খারাপ। মানুষ কে কতো দেখি তার বাবা দের সাথে ঘুড়তে যায়, ছবি তোলে, খাইয়ে দেয় আরো কতো কি। কিন্তু কই আমার বাবা তো আমার সাথে কথাই বলে না। কেন বলে না? সবাইকে ভালোবেসে তাদের বাবা নিকন্যাম দেয়। আর আমাকে, যেখানে বাবা আমার সাথে কথাই বলে না সেখানে নিকন্যাম দেওয়া টা হাস্যকর। বাবার সাথে আমি কখনো আমার স্কুলেই যাই নি আর ঘুড়তে যাওয়া হাহ্। বাবার সাথে আমার একটা ছবি আছে তবুও মাঝে অনেক দূরত্ব, আমার বাবা আমাকে কখনোই খাইয়ে দেয় নি। শুনেছি মেয়েরা বাবার জন্য পাগল হয়, কিন্তু আমি মায়ের জন্য। আমি মনে হয় আম্মুর মেয়ে শুধু 😅।
.
৩.. আমার খুশির আজ সীমা নেই। মানে আমি কি করবো কি বলবো বুঝি না। আমার আর তনুর একই ভার্সিটিতে চান্স হয়েছে। মানে আমরা এট লাস্ট আমাদের জীবন লিড করতে পারবো আমাদের মন মতো। ওয়াও ভাবতেই খুশি লাগে। যা ইচ্ছে করবো, ঘুড়বো কত্তো কি। শুধু তনু আর আমি। দুই জনই তো পাজির হাড্ডি। ইচ্ছে মতো ক্লাস ফাকি দিবো কেউ আটকাবে না। হায়য়য় কি খুশি আমি।
.
৪.. খুব কষ্টে আজ বাড়ির সবাইকে মেনেজ করেছি। আল্লাহ কি যে প্যারা রে ভাই। তবুও কষ্ট করলে তেষ্ট মিলে। সবাই রাজি হয়েছে বাইরে পাঠানোর জন্য আমাদের, খুব খুশি লাগছে। যেতে তো পারবো বাইরে। ইইয়ায়ায়াহুউউউউ 🥳।
.
৫.. আজ বাড়ির সবাইকে বিদায় জানিয়ে এলাম। বাইরে আসতে পেরেছি বলে হ্যাপি কিন্তু কিছুটা খারাপ লাগছে। আমার মা কে আমি মিস করবো। তার গাল গুলো আর টানা হবে না। Hay mamma i miss you yaar 🥺❤️।
.
৬.. আজ ভার্সিটির প্রথম দিন ছিলো আমার। প্রথম দিন গেতেই দুইজন শয়তান কে ফ্রেন্ড হিসেবে পেয়েছি। উর্মি আর বাবলি অনেক ভালো মাইয়া গুলা। কিন্তু আমি কি জন্য আছি শয়তান বানাই দিমু 😁। তবে একটা কথা বুঝলাম না আজ ভার্সিটিতে একটা ছেলে ছিলো। ফালতু ছেলে একটা। কিভাবে তাকিয়ে ছিলো আমার দিকে। মনে হয় জীবনে মেয়ে দেখে নি। আবার বাদর কোথাকার ক্লাসে এসে আমায় বলে যে সিনিয়র দের সম্মান করতে জানি না। বেয়াদ্দপ পোলা। ভাব কি হাহ সে নাকি আবার ক্রাশবয় না ছাই। নাম আয়ুশ ব্লা ব্লা ব্লা।
.
৭.. এটা কি ছিলো এভাবে আমার ক্লাসে এসে এভাবে আমাকে তুলে নিয়ে কেন গেলো আয়ুশ। মানে কি আমি তার ব্যাপারে কিছু জানি না তাকে চিনিও না ঠিকঠাক। আর এভাবে আমাকে নিয়ে গেলো কেন। আর ক্লাসে স্যার পর্যন্ত কিছুই বললো না। এমনকি ক্লাসে কোন ছাত্র-ছাত্রী পর্যন্ত মাথা তুলে তাকাচ্ছিলো না। শালা গুন্ডা না তো, ভয় করে। আর নিয়ে গেলো কোথায় নদীর কিণারে। মানে আজব। আমাকে ক্লাস থেকে নিয়ে নদীর কিণারে গিয়ে একসাথে বসে থাকলো। এগুলোর কোন মানে হয়। জিজ্ঞেস করলে বলে ”’ গল্প করার জন্য নিয়ে এসেছি, মনের মধ্যে আর পেটের মধ্যে অনেক কথা জমে আছে”’। পাগল নাকি, আমি তো উঠে এসে পরেছি।
.
৮.. আজ ভালো লাগছে কারণ আজ আয়ুশকে আমি দেখেছি রাস্তায় প্রায় অনেক অসহায় মানুষ কে খাবার দিতে। না ছিলো তাদের জন্য কোন ঘৃণা, অহংকার কিছুই না। শুধু ছিলো ভালোবাসা, মায়া আর মুখের সেই বিরাট হাসি। সেখানে কিছু বয়স্ক মহিলাও ছিলো তারা আয়ুশকে মাথায় ছুইয়ে ছুইয়ে দোয়া করছিলো। আর সে তার মাথায় নামিয়ে তা নিচ্ছিলো। সত্যি ব্যাপার টা খুব ভালো লেগেছে। ছেলে টাকে যতো টা খারাপ ভেবেছিলাম আসলে ততো টাও খারাপ না। সে ভালো🍂।
.
৯.. মানে কি থেকে কি হলো। আয়ুশ, আয়ুশ আমাকে প্রোপজ করেছে। আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। ভার্সিটির সব মেয়ে তার ওপর মরে কিন্তু সে এতো মেয়ে রেখে আমার ওপরই কেন। এগুলো দুইদিনের টাইম পাস না তো আবার। কে জানে। না বাবা আমি এই সব ভালোবাসা টালোবাসা তে নেই।
.
১০.. এই নিজেও মরবে সাথে আমাকেও মারবে। পাগলামো এতো করে কেউ। বাসার নিচে হুট হাট এসে পরা। ভার্সিটির কেউ আমার থেকে টাকা নেয় না। স্যার দের এক্সট্রা কেয়ার আমার ওপর। মানে কি কোন ছেলেও কথা বলে না। হায়রে। আচ্ছা আয়ুশ কি সত্যি ভালোবাসে আমাকে?
.
১১.. আমি ভালোবাসি আয়ুশকে, ভালোবেসে ফেলেছি। কখন, কিভাবে, কেন ভাসলাম জানি না। কিন্তু আমি ভালোবেসে ফেলেছি।
.
১২.. আজ বলে দেবো। আসলেই কি বলে দিবো?
.
১৩.. ‘ভালোবাসি’ বলে দিয়েছি আয়ুশকে। আয়ুশ পাগল হয়ে গিয়েছিলো তাকে ভালোবাসি কথাটা শোনার পর। মানে সে কি থেকে কি করবে দিশা পাচ্ছিলো না। ভাবতেই অবাক লাগে আমিও এভাবে কারো মায়ায় পড়ে গেছি। আমি ভালোবাসি আয়ুশকে হয়তো আমার থেকে আয়ুশ আরো হাজার গুণে বেশি ভালোবাসে আমাকে।
.
১৪.. না, এটা হতে পারে না। তনু আয়ুশকে ভালোবাসে। কি হচ্ছে এটা। আমি বেশ কিছুদিন যাবত দেখছিলাম তনুর মন খারাপ। কিন্তু সে যে তার ভেতরে এগুলো লুকিয়ে রেখেছে কে জানে। আর আজ হয়তো ভার্সিটি গিয়ে কারো কাছ থেকে শুনেছে যে আয়ুশ অন্য কাউকে ভালোবাসে। তাই মন খারাপ। এটা নরমাল যে তুমি যাকে ভালোবাসো পরে যদি শুনো যে সে অন্য কাউকে ভালোবাসে তাহলে খারাপ লাগবেই। আর আজ কিনা আমার বোন নিজেকে শেষ করে দিতে গিয়েছিলো। এতো বেশি হয়তো আমিও ভালোবাসি না আয়ুশকে। আচ্ছা তনু, তনু যখন জানবে যে আয়ুশ আমাকে ভালোবাসে তাহলে কি হবে। তনু যখন জানবে যে সে যাকে ভালোবাসে সেই তার বোনকে ভালোবাসে। না না সব শেষ হয়ে যাবে। আয়ুশ হয়তো পরে আমাকে ভুলে যাবে। হ্যাঁ তনু আমার থেকে হাজার গুণে বেশি ভালো। আয়ুশ এক সময় তনু কে পেয়ে আমাকে ভুলে যাবে, আর তনুকে মেনে নিবে। আর আমি কখনো তাদের সামনেই যাবো না। আর তনুও হ্যাপি থাকবে। আমার বোন সুখে থাকবে। জানি এতে আমি আয়ুশের চোখে হয়তো বা নিচে নেমে যাবো। কিন্তু আমি পারবো না। আমার কষ্ট আমারই থাক। যদিও পাগলের মতো আয়ুশকে ভালোবাসি কিন্তু আমার কাছে না আমার বোন কম আর না ই আয়ুশ। সবার আগে আমি একজন বোন ছিলাম। হ্যাঁ আমিই সরে যাবো। আয়ুশ এক সময় তনুকে পেয়ে আমাকে ভুলে যাবে। হুম এটাই ভালো।
.
১৫.. আজ আয়ুশকে বলে দিবো সব আমি। কথা হয়েছে তার সাথে আমার সে বাসার নিচে আসতে চেয়েছিলো। আগের মতোই পাগলামি করছিলো। কিন্তু এখন আমার নিজেকে শক্ত করতে হবে। কালই আয়ুশকে সব বলে দেবো। বলবো যে আমার মন উঠে গেছে তার থেকে, তাকে আমার আর ভালো লাগে না, আমি টাইম পাস করেছি শেষ। আমাকে ভুল বুঝেও বলেও তো দূরে সরবে। হ্যাঁ এটাই করবো।
.
১৬.. সব বলে দিয়েছি আমি আয়ুশ কে। বিনিময়ে অনেক কথা শুনেছি যা আমার প্রাপ্তি ছিলো। আমি জানতাম। কলিজা ভেতর থেকে কেউ টেনে ছিড়ে নিচ্ছিলো যখন কথা গুলো আমি বলছিলাম। প্রথমে আয়ুশ কে ভুল বুঝাচ্ছিলাম কিন্তু সে বুঝে নি। আমায় বিশ্বাস করে নি। এক সময় বাধ্য হয়ে তাকে আমার সত্য টা বলে দিতে হয়েছে। থাপ্পড় খেয়েছি দুটো। আয়ুশ আমাকে অনেক কথা বলেছে। আমি শুনেছি। যখন বলছিলাম আমার মন উঠে গেছে কতো কি তখন একদম বিশ্বাস করছিলো না। অবশেষে বলে দিলাম। আমি এর আগে কখনো আয়ুশকে এতো টা রেগে যেতে দেখি নি। এতো বেশি জেদ করতে দেখি নি। যাই হোক আয়ুশ আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। লিখার অবস্থায় নেই আমি। হাত কাপছে।
.
১৭.. আজ তনু কে সবার সামনে আয়ুশ প্রোপজ করেছে। জানি না কিভাবে কিন্তু করেছে। তনুর খুশি কে দেখে। আমার বোন খুশি তাতেই আমিও খুশি। হ্যাঁ সত্যি বলতে আমার খারাপ লাগছিলো। খুব বেশি 😅। কিন্তু তারা হ্যাপি থাক। আমি সেখান থেকে সরে আসি।
.
১৮.. অনেক হ্যাপি হ্যাপি লাগছে। কেননা আয়ুশ আজ তনুকে বিয়ের প্রপোজাল দিয়েছে। আমি ভাবি নি যে আয়ুশ এতো এগিয়ে যাবে। যাই হোক বিয়ে ঠিক তনু আয়ুশের। বাড়িতে বিয়ের সাজ। চারিদিকে বিয়ে বিয়ে গন্ধ। আমার বোনের বিয়ে, তনুর বিয়ে। আমি তো পাগল হয়ে যাবো। কতো প্লেন আছে আমার তনুর বিয়েকে নিয়ে সব পূরণ করবো সব। মানে আমার তো খুশি সইছে না। সাড়া বাড়ি ঢাক পিটিয়ে দিবো 🥰🥰।
.
১৯.. আর পারছি না। সারাদিন অনেক হাসি তামাশা করেছি। জানি না আসল ছিলো নাকি নকল। দম খাটো হচ্ছে আমার। মরেই না যাই। আমার পাগলি বোন টা আয়ুশের ছবি নিজের ফোনের ওয়ালপেপার বানিয়ে রেখেছে। তনুর বিদায় হয়ে গেছে। অনেক কাদছিলো। কিন্তু আমি কাদি নি। হেসেছি আর হাসিয়েছি। আয়ুশকে অনেক সুন্দর লাগছিলো। নির্লজ্জের মতো একটু দেখেছি। সারা বাড়ি আমার বোনের জিনিস দিয়ে ভরা। এগুলো কি করবো আমি। কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে আমাকে সব। মরণ যন্ত্রণা কি একেই বলে।
.
২০.. আমি আমার মতো জীবন চালাচ্ছি। ঢাকাতে আছি, এখন ভার্সিটি একাই যাই। ঢাকায় যে বাসায় থাকি সেখানেও একাই থাকি। তনুকে অতি মাত্রায় মিস করি। আর আয়ু………। যাজ্জে আমি আমার মতো। তনু আসে ভার্সিটিতে,, আয়ুশ তাকে দিয়ে যায় আবার নিয়ে যায়। আমার ওপর আয়ুশের অনেক রাগ জমে আছে। আমার ওপর তার অনেক জেদ। হয়তো জেদের বসেই এগুলো করছে। যাই হোক তনু হ্যাপি। আর আয়ুশকেও দেখে মনে হয় সে খুশি। আমিও খুশি 😊।
.
২১.. বলির পাঠা লাগে নিজেকে। বিয়ের জন্য বাড়ি থেকে এতো চাপ। মানে একজনের বিয়ে কি হলো আরেক জনেরও বিয়ে দিতে হবে।
.
২২.. ‘সোহেল শেখ’ ছেলের নাম। দেখতে এসেছিলো। ভালোই আছে। আর্মি সে। তার মা আছে বাবা নেই। সত্যি ছেলে হিসেবে সে অনেক ভালো।
.
২৩.. আজ বিয়ে হলো আমার সেই সোহেলের সাথেই। আমি ভাই নি আমার শাশুড়ি মা এতো ভালো হবে। সবাই অনেক ভালো।
.
২৪.. তনু মা হতে পারবে না, ইয়া আল্লাহ 😭। কেন এমন করলে। আমার বোন মা হতে পারবে না, কেন। কি দোষ করেছিলো ও।
.
২৫.. আমি প্রেগন্যান্ট। মানে আমি। আমাকে কেউ মা মা বলে ডাকবে। ছোট ছোট পায়ে আমার দিকে আসবে। এত্তো বেশি খুশি কখনোই হয় নি। আমার জীবনের পাওয়া সব থেকে বড়ো প্রাপ্তি। আমি মা হবো, আমি প্রেগন্যান্ট। খুশিতে কেদে দিয়েছি। বাড়ির সবাই তো আমাকে মাথায় করে রাখছে। তাদের কি খুশি।
আমার থেকে দ্বিগুণ।
.
২৬.. অতীত হয়তো একেই বলে। বারবার হাজার বার না চাইতেও সামনে এসে পরে। পিছুই ছাড়তে চায় না। তাই হয়তো এর নাম “অতীত”।
.
২৭.. সোহেলের ক্যান্সার, লাস্ট স্টেজ।
.
২৮.. কেন আমার সাথে এমন হলো। যাকে ধরে বাচতে চাইলাম তাকে বেধে দিলাম অন্যের সাথে। ইচ্ছে করেই। না পারছি এগিয়ে যেতে না পারছি পিছাতে। এক নদীতে পরে গেছি আমি। যেখানে কোন ঢাল নেই, নেই কোন কুল কিণারা।
.
২৯.. সোহেল মারা গেছে। আর সে নেই। আজ সকালে হস্পিটালে গিয়ে এই যে ডাকি সে আর সাড়া দেয় না। সোহেল নেই, মারা গেছে। আমার বাচ্চা তার বাবাকে হারালো। একজন মা তার ছেলে কে। আর আমি তো সেই কবে থেকে হারিয়েই আসছি। হায়রে জীবন। আমার ভাগ্য।
.
৩০.. জীবন কেন এতো নিষ্ঠুর। এখন আমার বেচে থাকার একমাত্র সম্বল আমার এই অনাগত বাচ্চা।
।
এরপরে ওই ডায়েরি তে আর কিছুই লিখা ছিলো না। তনুর পড়া শেষ হতেই হাত থেকে ডায়েরিটা ঠাস করে নিচে পরে গেলো। এদিকে তনুর চোখ থেকে পানি পরে সাগর হয়ে গেছে। হাত – পা ক্রমাগত কাপছে। সবকিছু কেমন ঘোলাটে হয়ে গেলো। তনু প্রায় এভাবেই মূর্তির মতো ২০ মিনিট বসে ছিলো। কিন্তু পরে রুমে নিলা এসে তনু কে ডাক দেয় তখন তনুর হুস আসে। পরে কোন রকমে সেই কাগজ গুলো গুছিয়ে ডায়েরিটা আগের জায়গায় রেখে তনু এসে পরে। হাতে একটা ব্যাগ সেখানে মেহরামের সবকিছুই আছে। সিড়ি দিয়ে নেমে আসার সময় তনু বেশ কয়েকবার পরে যেতে ধরেছিলো। তার কোন ঠিক ঠিকানা নেই এখন। অন্যমনস্ক হয়ে কাজ করছে। তনু এক বড়ো ধরনের শক খেয়েছে সব কিছু জানার পর। যা তার জীবনকে এলোমেলো করে দিয়েছে মূহুর্তেই।
।
।
।
।
🦋চলবে~~
#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#{বোনাস পার্ট 🦋}
🤎🍂. . . .
এক বড়ো ধরণের শক খেয়েছে তনু সবকিছু জানার পর। যা তার জীবনকে এলোমেলো করে দিয়েছে মূহুর্তেই। মেহরামের সবকিছু নিয়ে বাড়ি তালা দিয়ে তনু বের হয়ে পরে। তবে তার মন সব & মস্তিষ্ক সব অন্যদিকে। তনু বাড়ির বাইরে বের হয়ে পরে। চোখের পলক গুলো মিটমিট করে ফেলে। গাল বেয়ে পানি পরে যাওয়ার আগেই তনু সেটা মুছে ফেলে। সে যাচ্ছে,, যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। কোন দিকে কোন খেয়াল নেই। এভাবেই যেতে যেতে অনেক সময় পার হয়ে যায়। কিন্তু না ই তনুর হুস আছে আর না ই কোন কথা তার কান দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ তনু থেমে যায়। তার পা গুলো যেন আর চলছে না। কিভাবে পারলো তার বোন তার কাছ থেকে এগুলো লুকাতে। এতো কিছু মেহরাম এতো টা দিন ধরে সহ্য করে আসছে আর কেউ কিছুই টের পর্যন্ত পায় নি। মেহরামের হাসি দেখে বুঝাই যায় না যে মেয়েটার মাঝে এতো কিছু লুকিয়ে আছে। তনুর মাথায় বারবার শুধু মেহরামের বলা একই কথা গুলো বারি খাচ্ছে “আমি আয়ুশকে ভালোবাসি, “এক্কেবারেই পাগলের মতো ভালোবাসি”, ” আয়ুশ আর আমি”, “আয়ুশ আজ আমাকে প্রোপজ করেছে”, ” তনু আমার বোন আমার সব”, “আমার থেকে আরো অনেক বেশি আয়ুশ আমাকে ভালোবাসে”, ” তনু আয়ুশ কে ভালোবাসে”, “আমি তাদের মাঝ থেকে সরে যাবো”। কানে এসে বাজছে এই কথা গুলো তনুর। হঠাৎ কারো জোরে চিল্লানোর আওয়াজ কাছে আসে তার। এবার যেন তনুর হুস ফিরে। তনু নিজের আশে পাশে তাকিয়ে দেখে সে একদম রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। আর চারিপাশে অনেক গুলো গাড়ি আটকে রয়েছে। অনেকে গাড়ির জানালা দিয়ে মাথা বের করে তনু কে মাঝ রাস্তা থেকে সরে যেতে বলছে। আর অনেক গাড়ির হর্ণ বাজাচ্ছে। অনেক শোরগোল সবদিকে। তনু ঘেমে গেছে, হাত দিয়ে কোন রকমে নিজের মুখ মুছে দ্রুত সেখান থেকে সরে আসে। এভাবেই হাটতে হাটতে তনু এক সময় হস্পিটালে এসে পরে। এখনো তার তেমন হিতাহিত জ্ঞান নেই। যেন একটা ঘোড়ের মধ্যে রয়েছে সে। হস্পিটালে গেতেই আয়ুশের সাথে তনুর দেখা হয়। আয়ুশ ফোনে কার সাথে যেন কথা বলছিলো। আয়ুশ তনু কে দেখে ফোন কেটে দিয়ে তার দিকে এগিয়ে যায়। তনু এক দৃষ্টিতে আয়ুশের দিকে তাকিয়ে আছে। এখন তনুর মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে আয়ুশের কথা। মাহরাম যেমন তেমন, আয়ুশ ও কি পারে নি তনু কে সবকিছু একটা বার বলতে। নাকি কোন এক অজানা বাধায় আয়ুশ নিজেও আটকে ছিলো। আয়ুশ তনুর সামনে যায়….
আয়ুশ;; তনু এসেছো। দেরি করলে যে এতো?
তনু;;________________
আয়ুশ;; কি হলো কিছু তো বলো।
তনু;; আমার সাথে কথা বলো না প্লিজ।
আয়ুশ;; কিন্তু তনু..
তনু;; ________________
তনু কিছু না বলেই আয়ুশের সামনে থেকে সরে আসে। মেহরামের কেবিনের ভেতরে চলে যায়। আয়ুশ কিছুক্ষণ তনুর দিকে তাকিয়ে থেকে আবার ফোন ব্যাস্ত হয়ে পরে। তনু ভেতরে গিয়ে দেখে মেহরাম হেলান দিয়ে শুয়ে আছে। তার পাশেই সবাই আছে।
আতিয়া;; কিরে দেরি করলি যে পেয়েছিস সবকিছু?
তনু;; হুম।
মেহরাম;; আমি তো ভেবেছি যে কিছুই হয়তো পাবি না।
তনু;; না পেয়েছি তো, অনেক কিছুই পেয়েছি। যেগুলো আমার পাওয়া অনেক আগেই দরকার ছিলো।
কনিকা;; আচ্ছা দে দেখি সবকিছু গুছিয়ে নেই।
তনুর হাত থেকে তার বড়োমা ব্যাগ টা নিয়ে নেয়। তারা উঠে যায়। তনু এসে মেহরামের পাশে বসে। তনুর মুখ টা একদম মলিন দেখে মেহরাম বলে ওঠে…
মেহরাম;; কি রে কি হয়েছে তোর? মুখ টা এমন শুকনো লাগছে কেন?
তনু;; কিছু না।
আতিয়া;; মেহরাম মা একটু ওঠ দেখি কাপড় টা পালটে দেই।
মেহরামের চাচি সব কিছু গুছিয়ে দেয়। তারপর তাকে খাইয়ে দেয়। দেখতে দেখতে সময় গড়িয়ে এলো। আয়ুশ মেহরামের ঔষধ গুলো অনেক আগেই এনে দিয়েছে। বিকেল হয়ে এলে মেহরামকে হস্পিটাল থেকে নিয়ে আসা হয়। এখন সবাই বাড়িতে। একদিক দিয়ে তনু আরেক দিক দিয়ে মেহরামের মা ধরেছে তকে। অনেক ব্লাড গিয়েছে তো তাই হাটলে পেটে ব্যাথা পায় সে। একটু ধরতে হয়। ধরে ধরে তাকে সোফায় বসিয়ে দেওয়া হয়।
তনু;; এখন কেমন লাগছে?
মেহরাম;; আগে থেকে ভালো, ব্যাথা নেই।
কনিকা;; আকাশ, জলদি করে তোর আপুর জন্য এক গ্লাস ঠান্ডা পানি নিয়ে আয়।
সবাই মেহরামের পাশে বসে তার সাথে কথা বলতে লাগলো।
আয়ুশ;; বড়োমা (মেহরামের আম্মু)
কনিকা;; হ্যাঁ বাবা বলো।
আয়ুশ;; এগুলো মেডিসিন, কখন কিভাবে খেতে হবে সব লিখাই আছে। একটা বেলার মেডিসিনও যেন মিস না যায়। একদম টাইম মতো খাওয়াবেন।
কনিকা;; হ্যাঁ।
আয়ুশ;; তনু..!
তনু;; হুম।
আয়ুশ;; আজকে কি এখানেই থাকবে নাকি বাড়ি যাবে?
তনু;; এখানেই থাকবো আমি।
আতিয়া;; কিন্তু আয়ুশ বাবা আজ তুমি এখানেই থেকে যাও না। সবাই তো এখানেই আছে তুমিও….
আয়ুশ;; না মা আজ আমি যাই, এছাড়াও বাড়িতে কণা আর মা একা। মেহরামকে দেখে রাখবেন আমি যাই।
তনু এক নয়নে আয়ুশের দিকে তাকিয়ে ছিলো। তনু খেয়াল করলো যে আয়ুশ যাওয়ার আগেও মেহরামের কথাই জিজ্ঞেস করলো আর তাকেই দেখে গেলো। ধীরে ধীরে রাত হয়ে আসে। কুসুম বেগমও চলে গেছেন তার বাড়িতে। মেহরাম তার সাথে যেতে চাইলে মেহরাম কে সে মানা করে দেই। এখানেই সবাই আছে, মেহরাম এখানেই থাকলে প্রোপার কেয়ার টুকু সে পাবে। তাই সে এখানেই থেকে যায়।
কনিকা;; মেহরাম মা রাতে কি খাবি?
মেহরাম;; পানি..!
আকাশ;; রাতে কেউ পানি খায়?
মেহরাম;; হ্যাঁ হ্যাঁ আমি খাই তো।
আতিয়া;; চুপ কর পাজি, মেহরাম কি খাবি বল। আর এতো পানি খাস। মানলাম ডাক্তার পানি বেশি খেতে বলেছে কিন্তু এতো!
মেহরাম;; বারবার গলা শুকিয়ে যায়, আর খাবার পেটে যাবে না একদম ভরাপেট। আমি তো খালি পানিই খাবো।
কনিকা;; আচ্ছা খা, তনু!
তনু;; ______________
কনিকা;; তনু কিছু বলছিস না কেন, অন্যমনস্ক হয়ে আছিস কেন?
তনু;; আব.. নননা বড়োমা আমি ঠিক আছি। আর আমি কিছু খাবো না পেট ভরা আমার।
কনিকা;; কিন্তু ত…
তনু খাবার টেবিল থেকে উঠে চলে যায়। মেহরাম অবাক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকে।
মেহরাম;; হলো কি ওর?
আতিয়া;; আমিও বুঝলাম না।
কনিকা;; আচ্ছা যাই হোক মেহরাম মা রাত জাগিস না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়িস।
মেহরাম;; কিন্তু মা ঘুমই আসতে চায় না। আর তনু আমার সাথেই আমার রুম থাক।
আতিয়া;; হ্যাঁ দুইবোন এক সাথে থাক তাই ভালো হবে। এছাড়াও কেউ তো কাউকে ছাড়া কিছুই বুঝিসই না।
মেহরাম;; আচ্ছা থাকো তোমরা তাহলে আমি রুমে যাই।
আতিয়া;; আচ্ছা।
কনিকা;; এই হাটতে পারবি না দিয়ে আসবো?
মেহরাম;; আরে না না যেতে পারবো।
মেহরাম হেটে রুমে এসে পরে। রুমে গিয়েই দেখে তনু দুহাত ভাজ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেহরাম খানিক কপাল কুচকায়। দরজার শব্দে তনু পেছনে ফিরে তাকায়।
তনু;; সত্যি সবসময় তেতো হয়। মাঝে মাঝে আমরা সত্যের থেকে লুকিয়ে বেড়াই কিন্তু এটা যেন একটা কালো ছায়ার মতো যতোক্ষণ না আমাদের সামনে এসে আমাদের মনকে ভেংে চুড়ে চুরমান করে দিচ্ছে ততোক্ষণ স্বস্তি নেই।
মেহরাম;; উপন্যাস নাকি সাহিত্য?
তনু;; কি?
মেহরাম;; না মানে কথা গুলো ভালোই গুছিয়ে বললি। কোন বই-এর? (হেসে)
তনু;;মেহরু আমি ফাজলামো করছি না আর না ই আমি ফাজলামো করার মুডে আছি।
তনুর কথায় মেহরাম তার হাসি থামিয়ে দেয়। তার কাছে মনে হচ্ছে যে তনু অনেক বেশি সরিয়াস। কারণ তার চোখ মুখ সব ফুলে গেছে। এবার মেহরাম তার গলা ঝেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তনুর কাছে গিয়ে তনুকে বসিয়ে দেয়। সাথে নিজেও বসে পরে জানালার পাশে। জানালা খোলা সেদিক দিয়ে সাই সাই করে ঠান্ডা বাতাস আসছে। মেহরাম তার হাত টা তনুর গালে আলতো করে রেখে দেয়। তনুর মেহরামের হাত টা শক্ত করে ধরে।
মেহরাম;; তনু আমার দিকে তাকা। আচ্ছা কি হয়েছে আমায় বল।
তনু এবার মেহরামকে জড়িয়ে ধরে। মেহরাম এতে অবাক হয়ে যায়, সে বুঝে যে ব্যাপার অনেক বেশি সিরিয়াস। মেহরাম নিজের কাধে ভেজা কিছু অনুভব করলে বুঝে যে তনু কাদছে। এবার মেহরাম কপাল ভাজ করে ফেলে।
মেহরাম;; আচ্ছা তনু বল আমার হয়েছে কি? তোকে কেউ কি কিছু বলেছে আমায় বল না?
তনু;;_______________
মেহরাম;; আচ্ছা এভাবে কাদছিস কেন আরে আমকে ছাড় তো আগে।
তনু; না।
মেহরাম কি করবে না করবে বুঝে উঠতে পারে না। কোন রকমে তনুকে বুঝাচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ তনু বলে ওঠে…
তনু;; মেহরাম কেন এমন করলি?
মেহরাম;; মানে কি করেছি?
তনু;; আমাকে কেন একটা বার বলিস নি।
মেহরাম;; তনু আমি কিছু বুঝতে পারছি না তুই কি বলছিস?
তনু;; আয়ুশ আর তোর ব্যাপারে মেহরাম। তোর আর আয়ুশের সম্পর্কের ব্যাপারে। কেন বলিস নি আমায়।
মেহরামের পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেছে তনুর কথা শুনে। মানে কি তনু কি করে জানলো এই সব কিছু। মেহরামের গলা দিয়ে যেন আর কোন কথা বের হচ্ছে না।
মেহরাম;; ততন তনু…
তনু;; চুপ কর চুপ, প্লিজ আর একটা কথাও বলিস না। তুই আমার জন্য সব করে আমাকেই অপরাধী বানিয়ে দিয়েছিস জানিস। আমার জন্য এতো কিছু করলি কিন্তু তোর, তোর কি হবে একটা বারও ভাবলি না। (অঝোরে কেদে)
মেহরাম;; কিকিন্তু ততনু ততুই, তুই কি করে এইসব…?
তনু;; আজ যখন আমি তোর বাসায় যাই তখন কোন ভাবে তোর ডায়েরি টা আমি পেয়ে গেছিলাম। যেখানে তুই লিখে রেখেছিলি যে “আমি আয়ুশকে ভালোবাসি”। ঠিক সেই পেজ টাই প্রথমে চোখে পরে আমার।
মেহরামের আত্মা ধক করে উঠে তনুর কথা শুনে। তনু কাদতে কাদতে হেচকি তুলে ফেলেছে তবুও না মেহরাম কিছু বলতে দিচ্ছে আর না ই নিজে থামছে। তনু কেদে কেদে আবার বলতে শুরু করে।
দেখতে দেখতেই কেটে গেলো মাঝখানে আরো দুই সপ্তাহ। সোহেল কে হস্পিটালে এডমিট করা হয়েছে। তার অবস্থা খুব খারাপ। তবে মেহরাম সবসময় তার পাশে থাকে। মেহরামের বাড়ি থেকে সবাই দুই দিন পর পরই আসে সোহেল কে দেখার জন্য। যখন সোহেল কে হস্পিটালে ভর্তি করানো হয় তখন আয়ুশ এসেছিলো তাকে দেখতে। তবে সোহেল যেন তার এই মৃত্যু কে হাসিমুখে আপন করে নিয়েছে। মেহরাম সোহেলের কাছে থাকলে সোহেল বাকি সব কথা ছেড়ে ছুড়ে শুধু তাদের অনাগত বাচ্চার কথাই বলে। তাদের বেবি এমন হবে তেমন হবে কতো কথা। মেহরাম যথেষ্ট স্ট্রং একজন মেয়ে, আর তা তাকে দেখেই বুঝা যায়। নয়তো এতো সব কিছু সহ্য করে এভাবে এগিয়ে যাওয়া চারটে খানিক কথা না। আর রইলো সোহেলের কথা সে তো নিরব দর্শক। যা হচ্ছে যেমন হচ্ছে সব মুখ বুজে দেখছে। তবে সোহেল এতো গুলো দিনে আয়ুশের ব্যাপারে এটা কনফার্ম হয়েছে যে আয়ুশ যথেষ্ট ভালো আর বিশ্বাসী একজন। কেননা আয়ুশ এখনো মেহরামকে বে-ইন্তেহা ভাবে ভালোভাবে। মেহরাম তার ভালোবাসা, জিদ না। আয়ুশ চাইলেই ভুল কিছু করতে পারতো, অন্যায় করতে পারতো। কিন্তু সে তা ভাবেও নি কখনো করবে তো দূর। মেহরাম একসময় একদম সঠিক একজন কে ভালোবেসেছিলো। হয়তো এখনো ভাসে কিন্তু চারিদিকের সব বাধ্য-বাধকতা থাকার ফলে চাপা পরে গেছে।
সোহেল হস্পিটালের বেডে শুয়ে আছে, তখন মেহরাম খাবার নিয়ে এসে তার পাশে বসলো..
মেহরাম;; নিন হা করুন।
সোহেল;; মেহরাম খেতে ইচ্ছে করতে না, মুখে কিছুই ভালো লাগে না।
মেহরাম;; হ্যাঁ ওইতো একটু ব্লাড গিয়েছে তো তাই এমন লাগছে। আর মেডিসিন খেতে হবে তো জলদি এটা খান।
সোহেল;; মেহরাম ভালো লাগছে না পরে খাবো।
মেহরাম;; দেখুন প্লিজ বাচ্চাদের মতো জেদ করবেন না।
সোহেল;; তুমি খেয়েছো?
মেহরাম;; হ্যাঁ আমি বাসা থেকেই খেয়ে এসেছি।
সোহেল;; মা কেমন আছে? কি করে?
মেহরাম;; আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছে। আজ আসতে চেয়েছিলো কিন্তু জানেনই তো উনার শরীর তেমন ভালো না তাই বাড়িতেই রেখে এসেছি।
সোহেল;; ভালো করেছো। অযথা চিন্তা করে।
মেহরাম;; এগুলো অযথা চিন্তা?
সোহেল;; তা নয়তো আর কি!
মেহরাম;; হয়েছে বুঝলাম এবার প্লিজ খান।
মেহরাম সোহেল কে খাইয়ে দিতে থাকে। খাইয়ে মেডিসিন খাইয়ে দেয়। বিকেলের দিকে হঠাৎ তনু আসে। এসে সোহেলের সাথে অনেক কথা বলে। খানিক বাদে ডাক্তার এসে সোহেল কে কিসের যেন একটা ইঞ্জেকশন দেয়। সোহেল রেস্ট নিতে থাকে। তনু & মেহরাম হস্পিটালের করিডরে গিয়ে দাঁড়ায়। দুই বোন এক সাথেই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তেমন কথা নেই দুজনের মাঝে।
তনু;; পরিস্থিতি মানুষকে কি থেকে কি করে দেয় তাই না মেহরু!?
মেহরাম;; পরিস্থিতি যেমনই হোক নিজেকে আগে ঠিক থাকতে হবে, ভেংগে পড়লে চলবে না।
তনু;; তুই কি রোবট?
মেহরাম;; তা কেন হতে যাবো?
তনু;; কিভাবে ঠিক আছিস তুই। ভাইয়ের এই অবস্থা তুই, তুই প্রেগন্যান্ট।
মেহরাম;; আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া একটা পাতা পর্যন্ত নড়ে না। হয়তো আল্লাহ আমার ভাগ্যে এগুলোই লিখেছে তাই এমন হচ্ছে। মেনে নিলাম আমি।
তনু এবার হু হু করে কেদে দেয়। মেহরাম তনুর কাছে গিয়ে তার চোখের পানি গুলো মুছে দেয়। তনু শক্ত ভাবে মেহরাম কে জড়িয়ে ধরে। মেহরাম কোন মতে চুপ করায়। আর এক সময় বাসায় পাঠয়ে দেয়। মেহরাম সোহেলের কেবিনে যায়। গিয়ে দেখে সোহেল গভীর ঘুম। মেহরাম তার কেবিনের মাঝেই পায়চারি করতে থাকে। কেবিনে ভালো না লাগলে সামনের থাই গ্লাস টা খুলে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। তখনই তার মাথা টা কেমন এক চক্কর দিয়ে ওঠে। মেহরাম সামলে নেয়। তার কিছুক্ষণ বাদেই সোহেলের ডাক পরে। মেহরাম জলদি করে যায়।
সোহেল;; কোথায় গিয়েছিলে?
মেহরাম;; কোথাও না।
সোহেল;; কি হয়েছে চোখ মুখ এমন কুচকে রেখেছো কেন?
মেহরাম;; না মানে মাথা টা কেমন একটু চক্কর দিয়ে উঠেছে আর কি।
সোহেল;; কি বেশি খারাপ লাগছে। এখানে এসো বসো। বারবার বলি রাতে হস্পিটালে থাকতে হবে কিন্তু কে শোনে কার কথা।
মেহরাম;; তাহলে আপনাকে দেখবে কে?
সোহেল;; হস্পিটালে কেন আছি আমি। এখানে ডাক্টর নার্স সবাই আছে।
মেহরাম;; রাতে হস্পিটালের ডিউটি প্রায় ৮৫% ডক্টার আর নার্স রা করে না। কখন কি লাগে না লাগে এতো কিছুর চিন্তা মাথায় রাখতে পারবো না তার থেকে আমিই থাকি।
সোহেল;; তোমার সাথে কেউ পারবে না।
মেহরাম;; ____________
সোহেল;; কটা বাজে?
মেহরাম;; ১১ঃ২৩ মিনিট।
সোহেল;; মেহরাম বাইরের ওই জানালা টা খুলে দাও না।
মেহরাম;; দিচ্ছি।
মেহরাম উঠে গিয়ে জানালার পর্দা টা সরিয়ে দেয়। সাথে সাথে এক দমকা হাওয়া রুমের ভেতরে আসে। মেহরাম ক্ষীণ এক নিশ্বাস ছেড়ে আবার সোহেলের পাশে এসে বসে। দুজনেই পাশাপাশি বসে আছে কিন্তু একদম চুপ।
সোহেল;; মেহরাম!
মেহরাম;; হুম।
সোহেল;; আমি তোমাকে ভালোবাসি।
মেহরাম সোহেলের বলা কথা তে মাথা ঘুড়িয়ে অন্য পাশে থাকায়।
মেহরাম;; “ভালোবাসা” এই যে এই শব্দ টা আছে না এখন এটার কোন মানেই হয় না আমার কাছে। এগুলো বোকামি, বাচ্চামি আর আবেগ লাগে আমার কাছে।
সোহেল;; লাগার কারণ আছে তাই লাগে।
মেহরাম;; হঠাৎ এই কথা বললেন যে!
সোহেল;; ৩৩ দিন সময় ছিলো আমার কাছে তার থেকে ১৪ দিন পার হয়ে গেছে রইলো আর ১৯ দিন। যদি মনের কথা বলার সুযোগ টুকুও না পাই তাহলে। তাই আগে ভাগেই বলে রাখলাম।
মেহরাম সোহেলের অগোচরেই তার চোখের পানি মুছে নিলো।
।
।
আয়ুশ;; আজ মেহরামের কাছে গিয়েছিলে?
তনু;; হ্যাঁ, সোহেল ভাইয়ের অবস্থা তেমন ভালো নেই।
আয়ুশ;; হুম।
তনু;; মেহরামের জন্য খুব খারাপ লাগে।
আয়ুশ;; ________________
তনু;; দেখতে যাবে!
আয়ুশ;; হ্যাঁ ২-১ দিন পরই যাই।
তনু;; যেটা ভালো মনে করো।
তনু আজ কণার সাথে ঘুমিয়েছে। কণার নাকি ইদানীং একা ঘুমাতে সমস্যা হয় তাই তনু সাথে ঘুমিয়েছে। রুমে আয়ুশ একা। সারা ঘর পায়চারি করছে। একবার এখান থেকে ওখানে, ওখান থেকে এখানে। সব আছে কিন্তু মনের শান্তি নেই। সবকিছু থেকেও কি যেন একটা নেই। নিজের মাঝে এক শূন্যতা কাজ করে। আয়ুশ তার ড্রয়ার টা খুললো, খুলতেই একটা মানিব্যাগ পেলো। এটা গতো ৮ বছর যাবৎ আয়ুশের সাথে আছে। ভার্সিটির লাইফে এটা নিজের লাকি মানিব্যাগ ছিলো। হাতে টাকা না থাকলেও এই ব্যাগে সে সবসময় টাকা খুঁজে পেতো। খুব যত্ন করে এখন রেখে দিয়েছে আয়ুশ। মানিব্যাগ টা তুলে হাতে নিলো। অজান্তেই মুখের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। যত্নে রাখলেও ওপরে কিছু ধুলো বালি জমে আছে। আয়ুশ সেগুলো হাত দিয়েই আর ফু দিয়ে ঝেড়ে ফেললো। মানিব্যাগ টা ভেতরে খুলতেই মেহরামের একটা হাস্যজ্বল ছবি বের হয়ে আসে। ছবি টা আকারে ছোট কিন্তু মেহরামের হাসি টা সেখানে অনেক বড়ো। চুল গুলো উড়ছে আর সে হাসছে। কতো দিন পেরিয়ে গেলো মেহরামকে সে আর এভাবে হাসতে দেখে না। আসলে কি কিছু কিছু জিনিস দ্বিতীয় বার জীবনে কখনোই আসে না। তাই ঝড়ে পরার আগে সেগুলো গুছিয়ে নিতে হয়। আয়ুশ ছবি টার দিকে তাকিয়ে আছে। নিজের ডান হাতের বৃদ্ধা আঙুল দিয়ে ছবিটার ওপর হাল্কাভাবে ছুইয়ে দিলো। চোখ থেকে পানির বিন্দু গড়িয়ে পরার আগেই চোখ গুলো অন্যদিকে ঘুড়িয়ে মুছে ফেললো। ব্যাগ টা মুছে ভালোভাবে আবার আগের জায়গা তেই রেখে দিলো। ঘুম যেন আয়ুশের চোখ থেকে মুখ নামিয়ে নিয়েছে। আয়ুশের নিজেকে এখন পেঁচার মতো লাগে। রকিং চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পরলো। চোখ গুলো তে অয়ানি চিকচিক করছে তবুও পলক ফেলছে না, একধ্যানে তাকিয়ে আছে।
।
।
পরেরদিন আয়ুশের তেমন কোন কাজ নেই অফিসে তাই সে হস্পিটালে চলে যায়। তনুকেও বাড়িতে বলে এসেছে। কিন্তু আয়ুশ হস্পিটালে গেতেই যেন অবাক হয়। কারণ মেহরাম সোহেলের কেবিনের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। মুখে হাত দিয়ে কোন রকমে কান্না ধরে রেখেছে। আর ভেতরে ডাক্তার আর নার্সরা এক প্রকার দৌড়াদৌড়ি করছে। আয়ুশ জলদি করে মেহরামের কাছে চলে যায়।
আয়ুশ;; মেহরাম!
মেহরাম;; আয়ুশ, দেখো না উনার কি হয়েছে। মুখ দিয়ে অনবরত রক্ত যাচ্ছে, শ্বাস নিতে পারছে না।
আয়ুশ;; মেহরাম কেদো না, তোমার শরীর খারাপ হয়ে যাবে। আর কিচ্ছু হবে না।
মেহরাম;; আমার আর ভালো লাগছে না।
আয়ুশ;; বাসায় বলেছো?
মেহরাম;; হ্যাঁ আম্মু চাচ্চু কে বলে দিয়েছি তারা আসছেন। চাচি আমার বাড়িতে মা কে সামলাচ্ছেন।
আয়ুশ;; তুমি আমায় কেন ফোন দাও নি, একটা বার ফোন দিতে।
মেহরাম;; মাথা পুরো কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে আমার কি থেকে কি করবো বুঝছি না।
আয়ুশ;; তুমি এখানে বসো আগে।
আয়ুশ মেহরামের হাত ধরে বসিয়ে দেয়। মেয়েটা ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে। আয়ুশ একবার কেবিনের ভেতরে উকি দিয়ে দ্রুত ফোন বের করে কাকে যেন ফোন দিলো। মেহরাম তার কপালে দুহাত ঠেকিয়ে বসে আছে। আর আয়ুশ হাটছে আর কাকে যেন বারবার ফোন দিচ্ছে। খানিক পরই বাড়ির সবাই ছুটে আসে। মেহরামের আম্মু এসে তার মেয়ের পাশে বসে পরে।
।
।
।
।
🍁চলবে ~~
#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#{বোনাস পার্ট🥀}
🥀. . .
প্রায় ১ ঘন্টা পর ডাক্তার কেবিন থেকে বের হয়ে পরলেন। ডাক্তার বের হতেই সবাই একদম তড়িঘড়ি করে উনার সামনে গেলেন। কিন্তু মেহরাম কোন কিছু বলছে না সে শুধু ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে আছে। ডাক্তার সবাইকে সাইড করে মেহরামের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে….
ডাক্তার;; মিসেস মেহরাম আপনি প্লিজ আমার কেবিনে আসুন।
মেহরাম;; জ্বি।
মেহরাম সবাইকে সেখানেই থাকতে বলে এসে পরে। ডাক্তারের কেবিনে যাওয়ার আগে চোখ মুখ সব ভালোভাবে মুছে তারপর সে গেলো।
মেহরাম;; ম্যা আই কাম ইন ডক্টর!!
ডাক্তার;; জ্বি আসুন।
মেহরাম এসে বসে পরে। ডাক্তার তখন সোহেলের রিপোর্টস গুলোই দেখছিলো। মেহরাম এসে বসলে ডাক্তার তার সামনে রিপোর্ট গুলো রেখে দেয়। মেহরাম ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে রিপোর্টস গুলো হাতে তুলে নেয়।
ডাক্তার;; দেখুন মিসেস মেহরাম মিস্টার সোহেলের কন্ডিশন অনেক বেশি খারাপ। উনার শরীরের ভেতরে এক ধরনের ঘা এর সৃষ্টি হয়েছে। আর এটা তার শরীরের প্রায় সকল পার্টস গুলোকেই নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছে। এমনকি দিয়েছে।
মেহরাম রিপোর্ট গুলো ভালো ভাবে দেখে এবার ডাক্তারের দিকে তাকালো। কথা গুলোতে এমন একটা ভাব ছিলো যেন আর কিছুই করার নেই, সব শেষ।
মেহরাম;; কিছুই কি আর করার নেই?
ডাক্তার;; আমি দুঃখিত।
মেহরাম মাথা নুইয়ে ডাক্তারের কেবিন থেকে এসে পরে। মেহরামের আসার সাথে সাথে আবার সবাই তাকে ঘিড়ে ধরে। মেহরাম সবাইকে কোন রকমে আশ্বাস দেয় যে কিছুই হয় নি সব ঠিক আছে। মেহরাম উঠে গিয়ে সোহেলের কেবিনের পাশে গিয়ে দাড়ালো। চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে সোহেল। হাতে স্যালাইন লাগানো। এভাবেই সময় যেতে থাকে। সবাইকে অনেক বলে কয়ে মেহরাম জোর করেই যার যার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। তবে সবাই চলে গেলেও তনু আর আয়ুশ থেকে যায়। মেহরামের আম্মু তার শাশুড়ীর কাছে থাকে সেদিন। মেহরাম এখনো সেই সকাল থেকে না খাওয়া। একটা দানা পানি কিছুই মুখে তোলে নি। মেহরাম মাথা নিচু করে বসে ছিলো। এবার হঠাৎ তনু এসে খাবার মেহরামের মুখের সামনে ধরে। মেহরাম মাথা তুলে তাকায়। দেখে সে যেভাবে তনুর সামনে আগে খাবার নিয়ে বসে থাকতো এখন তনুও ঠিক সেভাবেই তার সামনে খাবার নিয়ে বসে আছে। তনু তাকে মাথা দিয়ে ইশারা করে হা করার জন্য। মূহুর্তেই মেহরামের চোখ গুলো ভিজে গেলো। তনু তার বাম হাতের উল্টো পাশ দিয়ে চোখের পানি গুলো মুছে দেয়। তারপর মেহরাম কে খাইয়ে দিতে থাকে। মেহরামও খাচ্ছে। দুহাত ভাজ করে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে মেহরামকে দেখছে আয়ুশ। বড্ড ইচ্ছে করে তার নিজের দুহাত দিয়ে মেহরামের চোখের পানি গুলো মুছে দিতে কিন্তু পারে না সে। দেখতে দেখতে রাত বেজে গেলো ৯ টা। এদিকে তনুর মাথা ব্যাথার প্রব্লেম আছে এটা মেহরাম জানে। সবারই আজ সারাটা দিন অনেক ধকল গিয়েছে। এখন বেশি রাত জেগে থাকলে আবার সমস্যা তাই মেহরাম বলে ওঠে…
মেহরাম;; ততনু..
তনু;; হু হুম বল।
মেহরাম;; শোন তুই না প্লিজ বাড়ি চলে যা, এখানে আমি আছি তুই বাড়ি যা।
তনু;; আরে না একদম না। তোকে এভাবে এখানে একা রেখে যাবো মাথা খারাপ হয়েছে নাকি। আমি থাকি
মেহরাম;; তনু প্লিজ বোঝার চেষ্টা কর, আমি আছি। আর এখানে এতো জনের থাকতে হবে না, ডাক্তার নার্স সবাই আছে। তোর পরে সমস্যা হবে তুই বাড়ি যা। আর বাড়িতে কণা তোর শাশুড়ী আছে তুই যা।
তনু;; কিন্তু..
আয়ুশ;; তনু তুমি যাও আমি এখানে থাকি।
তনু;; হ্যাঁ সেটাই আমিও তাই বলতে চাইছিলাম যে তুমি থেকে যাও।
মেহরাম;; না মানে কি দরকার কষ্ট করার, তোমরা চলে যাও।
তনু;; মেহরু প্লিজ কথা শোন আয়ুশ এখানে থাক আমি চলে যাচ্ছি। যদি কোন প্রব্লেম হয় আর লাগে কাউকে তখন। আর তুই এই অবস্থায় একা কি করে সামলাবি। আয়ুশ থাকুক।
মেহরাম;; হুম।
তনু মেহরামের সাথে কথা বলে, আর সোহেল কে আরেক নজর দেখে সেখান থেকে চলে আসে। আয়ুশ আর মেহরামের চোখাচোখি হয়ে গেলে আয়ুশ দ্রুত চোখ নামিয়ে ফেলে। কারো চোখে বিন্দু মাত্র ঘুম নেই। সেভাবেই রাত কেটে যায়। তবে আয়ুশের বসে থাকতে থাকতে কখন যে চোখ লেগে গিয়েছিলো তা সে জানে না। সকাল বেলা মেহরামের ডাকে তার হুস আসে।
মেহরাম;; আয়ুশ, আয়ুশ!
আয়ুশ;; হাম.. হুমমম বলো।
মেহরাম;; না মানে সকাল হয়ে গিয়েছে তো, আর এখন সবকিছু স্বাভাবিক আছে তাই বলছি যে তুমি বাড়ি যাও।
আয়ুশ;; তোমায় এভাবে রেখে কি করে যাই।
আয়ুশের কথায় মেহরাম তার দিকে তাকায়। আয়ুশ সাথে সাথেই মাথা নামিয়ে ফেলে।
আয়ুশ;; আচ্ছা আমি যাই, কোন প্রব্লেম হলে ফোন দিও। আর নিজের একটু তো খেয়াল রেখো।
আয়ুশ এই বলেই চলে যায় সেখান থেকে। মেহরাম সেখান থেকে এসে সোহেলের কেবিনে চলে যায়। গিয়ে দেখে সোহেল তাকিয়ে আছে। মেহরাম অবাক কেননা সে ভেবেছে সোহেল ঘুমিয়ে আছে।
মেহরাম;; আরে আপনি ঘুমান নি?
সোহেল;; নননা.. আ আ ম আমি
মেহরাম;; না থাক থাক কথা বলতে হবে না। প্লিজ নিজের ওপর প্রেসার দিয়েন না। আমি বুঝে যাবো সবকিছু কথা বলতে হবে না।
সোহেল;; মেহ মে মেহ
মেহরাম;; হ্যাঁ আমি আছি তো বলুন।
মেহরাম সোহেলের পাশে বসে পরে। সোহেল এক নয়নে মেহরাম কে দেখছে। মেহরাম সেখান থেকে খানিক সরে বসলে সোহেল মেহরামের ওরনার কিছু অংশ ধরে রাখে অর্থাৎ যেও না। মেহরামও সেখানেই বসে থাকে। একটু পরে একজন নার্স আসে সোহেলের হাতের সুই টা খুলে দেয়। স্যালাইন শেষ হয়ে গেছে তাই আগের টা খুলে আরেকটা লাগিয়ে দেয়। এখন সোহেলের অবস্থা এতো টাই খারাপ যে সে আর মুখ দিয়ে খেতে পারবে না। তাকে স্যালাইনের মাধ্যমেই সব খাবার খেতে হবে। হাতে-পায়ে তেমন শক্তি পায় না সে এখন। এভাবেই দিন যাচ্ছে তাদের। বাড়ির সবাই একবার হলেও প্রতিদিন এসে সোহেল কে দেখে যায়। সোহেলের মা সোহেলের কাছে গিয়ে একদম ভেংগে পরে। তাকে সবাই সামলে নেয়। দেখতে দেখতেই আরো ১ সপ্তাহ কেটে যায়। সোহেলের শরীরে ভেতরে ঘা গুলো ফুটে ওঠেছে। মাথার চুল গুলো সব ঝড়ে গিয়েছে। তবুও মেহরাম সোহেলের সামনে না কাদার যথেষ্ট চেষ্টা করে। সবসময় হাসে। মেহরাম এটা ওটা কতো কি বলে সোহেল কে, মাঝে মাঝে মেহরামের কথায় সোহেল হাসে। একদম অল্প করে হাসে। হাসতে কষ্ট হলে এক ধ্যানে মেহরামের দিকে তাকিয়ে থাকে। মেহরাম বুঝে যায় যে সোহেল হেসেছে। একদিন মেহরাম হস্পিটালে থাকতে চাইলে মেহরামকে জোর করে তার চাচ্চু আর আম্মু বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। মেহরামও আর কোন উপায় না পেয়ে বাড়ি এসে পরে। হস্পিটাল থেকে বাইরে বের হলে হঠাৎ তার সামনে একটা গাড়ি থামে। গাড়ির ভেতর থেকে আয়ুশ বের হয়।
আয়ুশ;; কোথায় যাচ্ছো তুমি?
মেহরাম;; আসলে আম্মু আর চাচ্চু আমাকে জোর করে বাড়ি পাঠিয়ে দিলো।
আয়ুশ;; এসো আমি পৌছে দেয়।
মেহরাম;; আমি রিকশা দিয়ে চলে যাই।
আয়ুশ;; পাগল হয়েছো। এতো রাতে এই অবস্থায় তুমি একা বাড়ি যাবে। আর রিকশা ইম্পসিবল। কথা না বলে গাড়িতে ওঠো।
মেহরাম গাড়িতে উঠে পরে। আয়ুশ খুব আস্তে ধীরে গাড়ি চালাচ্ছে। একদম আস্তে যেন মেহরামের কোন অসুবিধে না হয়। মেহরাম একবার আয়ুশের দিকে তাকিয়ে আবার সামনে তাকায়। তবে এবার মেহরামের চোখ আটকে যায়। কেননা মেহরাম একবার আয়ুশকে একটা কাচের ঘরের ভেতরে কালো গোলাপের একটা সো-পিস দিয়েছিলো। জিনিস টা ছোট কিন্তু দেখতে ভারী সুন্দর। গোলাপ টা কালো কিছুটা ঝুকে রয়েছে। এতো বছর আগে সেটা দিয়েছিলো আর এটা আয়ুশ এখনো গাড়িতে রেখে দিয়েছে। মেহরাম এবার গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। রাত ভারী হয়েছে, রাস্তা-ঘাট কেমন যেন নিশ্চুপ। অনেক বাতাস বইছে। তবে মাঝ রাস্তায় গিয়ে ঘটলো আরেক বিপত্তি। গাড়ির টায়ার পাঞ্চার। আয়ুশ আর মেহরামকে বাধ্য হয়ে গাড়ি থেকে নেমে যেতে হলো। আয়ুশ গাড়ির ডিকি থেকে সব নামিয়ে নতুন টায়ার লাগাতে থাকে। এরই মধ্যে বাতাস যেন আরো জোরে বয়ে যেতে লাগলো। আকাশে বিদ্যুৎ চমক দিলো। বুঝাই যাচ্ছে প্রচন্ড বৃষ্টি নামবে। আবহাওয়া বেশি ভালো না দেখে আয়ুশ দ্রুত কাজ করতে লাগলো। এরই মধ্যে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পরতেও ধরেছে। প্রায় ২০ মিনিট পর আয়ুশের টায়ার লাগানো শেষ হলো।
মেহরাম;; কাজ শেষ?
আয়ুশ;; হ্যাঁ, চলো।
আয়ুশ আর মেহরাম গাড়িতে উঠতে ধরলে বাতাসের বেগে একটা কাগজের মতো কিছু আয়ুশের পায়ের সামনে এসে থামে। মেহরামও সেটা লক্ষ্য করে। আয়ুশ কপাল কুচকে নিচু হয়ে সেটা হাতে তুলে নেয়। আয়ুশ দেখে একটা মেয়ের ছবি। মেয়েটা শাড়ি পরা, বেনুনী করা। তখনই জোরে জোরে হেসে একটা লোক আয়ুশের কাছে আসে। মূলত সে একজন পাগল। লোক টা আয়ুশের কাছে এসে আশে পাশে তাকাচ্ছে আর মাথা চুলকাচ্ছে।
লোকটি;; এই এই তুতুতুমি কককি আমার আমার পরি পরি কে দেখেছো হ্যাঁ। আমার পরি আমার, পরি শুধুই আমার। ওর ওর না একটা একটা অনেক সুন্দর ছবি আছে আমার কাছে জানো। অনেএএএএক সুন্দর। পরি তো সুন্দরই হয় তাই না তাই না। আমার পরি। আমার আমার পপপরি আমার, দেখেছো তুমি আমার পরিকে হ্যাঁ!!?
আয়ুশ;; এটা তোমার পরি? (ছবিটা তার দিকে ধরে)
ছবি টা ধরার সাথে সাথে লোক টা ছবি টা কেড়ে নিয়ে নিলো আয়ুশের হাত থেকে। নিয়েই বুকের ভেতরে লুকিয়ে নিলো।
লোকটি;; হ্যাঁ এই এই এইটাই আমার পরি। ওর নামও পরি ও দেখতেও পরি। পরিকে আমি অনেক অনেক ভালোবাসি অনেক বেশি। কিন্তু আমার পরি যে কোথায় উড়ে চলে গেলো আমাকে ফেলে জানি না। আমার পরি আমার। ওওও পরি পরি…
লোকটি এগুলোই বিলাপ পারছিলো তখনই একজন মাঝ বয়স্ক মহিলা আসে। বুঝা গেলো সে তার মা।
মহিলা;; বাবা মাফ করে দিও, আসলে আমার ছেলেটা পাগল বুঝলা। পরি নামে এই মেয়েটাকে ভালোবাসতো। মেয়েটা একদিন ওর চোখের সামনেই মারা যায়। আমার ছেলেটা মেয়েটার এমন মরণ সহ্য করবার পাই নাই। মেয়েটার একটা মাত্রই ছবি আছিলো। এইটা নিয়াই সারাদিন পইরা থাকে। ওর জন্যে এখনো এই পরি বাইচা আছে। এর এই ছবি টা না থাকলে হয়তো আমার ছেলে ডাও থাকতো না বাবা। তোমাগোর কোন সমস্যা করলে আমি মাফ চাইতাছি।
আয়ুশ;; না না আপনি আমার মায়ের বয়সি। মা দের ছেলের কাছে মাফ চাইতে হয় না। আপনি আপনার ছেলেকে নিয়ে যান।
মহিলা টি তার ছেলেকে নিয়ে চলে গেলো। ছেলে টি এখনো তার মতো করে বিলাপ পারছে। কেন জানি মেহরামের ভেতর টা এখন দুমড়েমুচড়ে আসছে। খুব বেশি কান্না পাচ্ছে তার। ইতোমধ্যে কেদেও দিয়েছে। আয়ুশ মেহরামের দিকে তাকালে মেহরাম দ্রুত চোখ মুছে ফেলে। আয়ুশ আর মেহরাম গাড়িতে উঠে পরে। এক সময় মেহরামের বাড়ির সামনেও চলে আসে। তবে এতোক্ষনে মুষুলধারে বৃষ্টিও নেমে পরেছে। আয়ুশ মেহরামকে কিছু বলবে বলবে ভাব তবুও বলতে পায় না। আয়ুশ গাড়ির সামনে থাকা আয়নাতে দেখে মেহরাম ফুপিয়ে কাদছে। আয়ুশ সাথে সাথে চোখ সরিয়ে ফেলে। সে পারে না সহ্য করতে যে মেহরাম তার সামনে কাদছে।
মেহরাম;; আয়ুশ আমি যাই।
এই কথা বলেই মেহরাম তীব্র বৃষ্টির মাঝেই নেমে পরে গাড়ি থেকে। নেমে বাড়ির ভেতরে চলে যেতে ধরলে আয়ুশ দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে মেহরামকে পেছন থেকে ডাক দেয়।
আয়ুশ;; মেহরাম।
মেহরাম থেমে যায়। আয়ুশ মেহরামের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে দম ছাড়ছে। কিন্তু এবার আর কেউই নিজেকে সামলাতে পারে না। কেদে দেয়। কিন্তু বৃষ্টি পানিতে সব ধুয়ে যায়। মেহরাম পেছনে ঘুড়ে তাকায়। আয়ুশ মেহরামের সামনে দাঁড়িয়ে পরে। আয়ুশ মেহরামের হাত গুলো নিজের দুহাতের ভাজে এনে মাথা একদম নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। এদিকে মেহরাম তার ঠোঁট গুলো কামড়ে ধরে রেখেছে। আয়ুশ কিছুটা কেপে ওঠে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে সে কাদছে। আয়ুশ মেহরামের হাত গুলো তার হাতে নিয়ে মাথা নিচু করেই ফুপিয়ে বলে ওঠে….
আয়ুশ;; মেহরাম, মেহরাম তফাৎ শুধু এই টুকুই যে
“” তুমি কাদিয়ে বলো ভালোবাসি,
আর আমি কেদে বলি ভালোবাসি””।
আয়ুশ এই কথা বলে ওপরে তাকায় দেখে যে মেহরামের চোখ নাক মুখ সব লাল হয়ে গেছে। আয়ুশ আর এক মূহুর্তের জন্যও সেখানে না দাঁড়িয়ে থেকে চোখ মুছতে মুছতে এসে পরে। গাড়িতে ওঠে এসে পরে। মেহরাম সেদিকে কতোক্ষণ তাকিয়ে থাকে। সে এই মুষুলধারে বৃষ্টিতে ভিজেই যাচ্ছে। তখনই বাড়ির ভেতর থেকে নিলার জোর চিল্লিয়ে ডাক আসে…
মেহরাম বাড়িতে চলে যায়। ওদিকে আয়ুশও বাড়ি চলে গিয়েছে। হস্পিটালে মেহরামের মা, বাবা আর চাচ্চু আছেন।
।
।
পরেরদিন সকালে উঠেই মেহরাম দ্রুত হস্পিটালে চলে যায়। এর মধ্যে মেহরামের মামা শশুড় মানে কুসুম বেগমের বড়ো ভাই উনি বেশ কয়েকবার এসেছেন। সোহেলকে দেখেছে সোহেলও তার মামা কে দেখেছে। নিজের বড়ো ভাইকে কাছে পেয়ে কুসুম বেগম কিছুটা শান্ত। তবে এবার মেহরাম দ্রুত হস্পিটালে চলে যায়। গিয়েই দেখে ডাক্তার কাজ করছে। মুচকি হেসে নার্স ডাক্তার সবাই এসে পরে। আর মেহরাম সোহেলের পাশে বসে। সে ঘুমাচ্ছে। হঠাৎ তনুর আওয়াজ আসে বাইরে থেকে। মেহরাম বাইরে গিয়ে দেখে তনু এসেছে। তনু মেহরামের দিকে তাকিয়ে হাসে। মেহরামও মুচকি হেসে ওঠে।
তনু তার ঘরে কাজ করছিলো ঠিক তখনই তার ফোনে ফোন আসে। তাকিয়ে দেখে তার খালামনি অর্থাৎ মেহরামের শাশুড়ী কুসুম বেগম। তনু জলদি করে ফোন রিসিভ করে…
তনু;; হ্যালো খালামনি কেমন আছেন?
কুসুম;; মা রে ভালো আর থাকলাম কোথায়।
তনু;; মানে খালামনি হয়েছে কি? (কপাল কুচকে)
কুসুম বেগম এবার কেদে দিলেন। আর তনুও অবাক, সে বারবার বলছে কি হয়েছে কিন্তু কুসুম বেগমের কাদার বেগ এতো টাই বেশি যে তিনি কিছু বলতেই পারছেন না।
তনু;; আহা খালামনি দেখুন এতো কাদবেন না শরীর খারাপ হয়ে যাবে আপনার। কি হয়েছে বলুন তো আর মেহরাম কোথায়?
কুসুম;; মারে সোহেলের ক্যান্সার হয়েছে!
তনু;; কিহহ এগুলো কি বলছেন। কিভাবে কবে মানে?
কুসুম;; হ্যাঁ মেহরাম আর সোহেল আগে থেকেই জানতো কিন্তু আমাকে বলেনি কারণ অতিরিক্ত চিন্তা করবো তাই। ক্যান্সার হয়েছে ওর।
তনু;; আল্লাহ এই সব কি বলছেন। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। আচ্ছা খালামনি আপনি ফোন টা রাখুন আর মেহরাম কোথায়?
কুসুম;; সোহেলের কাছেই আছে। জানো মা ছেলে টাকে এখন আর চেনা যায় না। সোহেল আম….
তনু;; খালামনি প্লিজ এভাবে কাদবেন না। আচ্ছা আপনি ফোন টা রাখুন আমি আসছি এখনই।
তনু এই বলে ফোন টা কেটে দেয়। যেমন ছিলো তেমন ভাবেই শুধু হাতে একটা ব্যাগ নিয়ে বের হয়ে পরে সে।
লায়লা (তনুর শাশুড়ী);; আরে তনু কোথায় যা….
তনু;; মা মা আমি না একটু মেহরাম দের বাসায় যাচ্ছি বুঝলে একটু দরকার। (দ্রুত যেতে যেতে)
লায়লা;; কিন্তু হয়েছে কি আর সাথে কাউকে নিয়ে যা।
তনু;; না মা থাকো তোমরা এদিক টা দেখো আমি যাই।
তনু যেন এক প্রকার দৌড়াচ্ছে। বাইরে আসতেই রিকশা নিয়ে চলে যায়। প্রায় ত্রিশ মিনিট পর তনু এসে থামে মেহরামের বাসায়। কলিংবেল বাজাতেই নিলা এসে দরজা খুলে দেয়। তনু গিয়ে দেখে মেহরাম তার শাশুড়ী কে ঔষধ খাওয়াচ্ছে। তনু দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে কুসুম বেগমের পাশে বসে।
তনু;; মেহরাম কবে ধরা পরেছে সোহেল ভাইয়ের ক্যান্সার??
মেহরাম;; ২-১ মাস আগে।
তনু;; ২-১ মাস! এতো দিন আগে ধরা পরেছে তাও তুই আমাদের কাউকেই জনানোর প্রোয়জন মনে করিস নি?
মেহরাম;; সোহেল না করেছিলো তাই।
তনু;; কিন্তু মেহরাম এতো বড়ো একটা ঘটনা এটা অবশ্যই সবাইকে বলা দরকার ছিলো।
মেহরাম;; কি আর বলি।
তনু;; আচ্ছা ভাইয়া কোথায়?
মেহরাম;; রুমে শুয়ে আছে।
তনু;; এখন কেমন আছেন?
মেহরাম;; আছেন কোন রকমে।
তনু খেয়াল করে দেখে মেহরামের চোখের নিচে দাগ, পেট টা হাল্কা বের হয়েছে, একদম ছন্নছাড়া। নিজের প্রতি কেয়ার বা খেয়াল যে করে না তা তাকে দেখেই প্রমাণিত।
মেহরাম;; কিরে কোথায় হারিয়ে গেলি?
তনু;; ননা কোথাও না। আচ্ছা শোন ভাইয়ার সাথে দেখা করা যাবে না?
মেহরাম;; আরে যাবে তো কেন যাবে না। তুই আমার রুমে যা আমি একটু পর আসছি।
তনু;; হুম।
তনু সিড়ি বেয়ে ওপরে রুমে চলে গেলো। ভেতরে যাওয়ার আগে নক করে গেলো।
তনু;; সোহেল ভাইয়া আসবো?
সোহেল;; আরে তনু যে এসো এসো।
তনু ভেতরে এসে বসে। দেখে সোহেল বিছনাতে হেলান দিয়ে আধো শোয়া হয়ে আছে। কম্বল দিয়ে কোমড় অব্দি রেখে দিয়েছে। তনু তো দেখে বিশ্বাসই করতে পারছে না যে এতো সুন্দর একটা লোকের এই অবস্থা হয়েছে। তার হাতে রয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের একটি বই। তাই হয়তো বসে বসে পরছিলো।
সোহেল;; কেমন আছো অনেকদিন পর দেখলাম আর কখন এসেছো মেহরাম কিছু বললো না তো আমায়!
তনু;; না ভাইয়া আমি এইতো কিছুক্ষণ আগেই এসেছি আর এতোক্ষণ নিচে মেহরাম আর খালামনির সাথেই ছিলাম।
সোহেল;; ওহহ তা বাসায় সবাই কেমন আছে তোমার?
তনু;; আপনি কেমন আছেন ভাইয়া?
সোহেল;; হয়তো তুমি জানো!
তনু;; জ্বি ভাইয়া জানি আর তার জন্যই ছুটে এসেছি।
সোহেল;; হাহা, কি আর করবো বলো কেউ তো আর ইচ্ছে করে এইসব চায় না। আল্লাহ হয়তো আমার ভাগ্যে এটাই রেখেছিলেন।
তনু এবার কাদো কাদো হয়ে গেলো।
তনু;; ভাইয়া প্লিজ এভাবে বলবেন না, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। সবকিছুরই সমাধান আছে এটারও আছে। দরকার হলে বাইরে যাবো ট্রিটমেন্টের জন্য।
সোহেল;; তনু আসলে আমার ভেতরে ক্যান্সার টা বাসা বাধছিলো অনেক দিন ধরেই কিন্তু আমরা কেউ সেটা টের পাই নি। ডক্টর বলেছেন যে আগে হঠাৎ করেই যখন তীব্র শ্বাসকষ্ট হতো বা বুকে ব্যাথা করতো তখনই যদি ডাক্তার দেখাতাম তাহলে হয়তো কিছু করা যেত। কিন্তু আগে তো বুঝি নি আর আমাকে বাইরে বাইরেই থাকতে হতো বেশি তাই।
তনু;; এখন ডক্টর কি বলেছেন?
সোহেল;; লাস্ট স্টেজ। আর আমাকে দেখেই তো বুঝতে পারছো যে কি হালে রয়েছি। প্রথমবার টেস্ট করালে ধরা পরেনি কিন্তু দ্বিতীয়বার একদম রিপোর্টের লেখা গুলো যে জ্বলজ্বল করে বলছিলো যে “এটা ক্যান্সার”।
তনু;; ভাইয়া প্লিজ এভাবে বলবেন না। মেহরাম প্রেগন্যান্ট (চোখের জল গুলো মুছে)
সোহেল;; জানো তো তনু খুব ইচ্ছে ছিলো যে নিজের নবজাতক বাচ্চা টাকে কোলে নিবো। এটাও জানি যে মৃত্যু একদিন না একদিন সবারই হবে কিন্তু আমার মৃত্যু যে এতো জলদি ঘনিয়ে আসবে বুঝি নি।
তনু;; ভাইয়া কিছুই হবে না আপনার। অযথা এগুলো বলবেন না। আপনি আপনার বাচ্চার মুখও দেখতে পারবেন আর কোলেও নিবেন।
সোহেল;; যাজ্ঞে ছাড়ো তো এইসব কথা আর ভালো লাগে না। তুমি যে এসেছো মেহরাম কি দেখে নি নাকি। কিছু খেতে দেবে, বসে গল্প করবে। মেহরাম কোথায়?
মেহরাম;; আছি আমি।
সোহেল;; ওহহ এসেছো। দেখো না তনু শুধু শুধু মন খারাপ করছে।
মেহরাম;; ও এসেছেই আপনাকে দেখতে।
তনু;; ভাইয়া এতো বড়ো কথা টা আপনি লুকাতে কেন বলেছেন? আপনি জানেন সবাই জানলে কি হবে? তাদের ওপর কি ঝড় বয়ে যাবে?!
সোহেল;; কিন্তু…
মেহরাম;; বলে দিস সবাইকে।
মেহরাম এই কথা বলেই এক গাদা মেডিসিন নিয়ে সোহেলের পাশে বসে পরে তাকে খাইয়ে দিতে থাকে। মাঝে মাঝে মেহরামের সাথে টুকটাক কথা বলছে সোহেল। তনু এবার বুঝতে পারলো যে মেহরাম কেন এতো চুপচাপ হয়ে গেছে। পরিস্থিতি তাকে এমন বানিয়ে দিয়েছে। কোথায় ছিলো ভার্সিটি লাইফের মেহরাম আর এখন হাহ্ চেনায় যায় না। তনুর বিয়ের আগ পর্যন্তও সব ঠিক ছিলো। তনু বসে এই সব কিছুই ভাবছিলো। হঠাৎ মেহরাম বলে ওঠে…
মেহরাম;; তোর বাসায় সবাই কেমন আছে?
তনু;; ভালোই। আমি কাউকে কিছুই বলে আসিনি শুধু জলদি বাড়ি থেকে বের হয়ে পরেছি। জানি না এই বেপার টা আমি বাসায় কি করে কিভাবে জানাবো। আর বড়োমা, মা, বাবা ওদেরই বা আমি কিভাবে বলবো। বড়ো মা ঠিক থাকতে পারবে না এটা শোনার পর।
সোহেল;; সত্য মেনে নিতেই হবে উপায় নেই।
তনু আরো বেশ কিছুক্ষন সেখানে বসে সোহেলের সাথে কথা বললো। অবশেষে বিদায় জানিয়ে বের হয়ে এসে পরে। তনু কুসুম বেগমের পাশে বসে তাকে অনেক বুঝায় অনেক কথা বার্তা বলে এসে পরে। এখন মেহরাম আর তনু বাড়ির দরজাতে দাঁড়িয়ে আছে।
তনু;; ভাইয়ার এমন কেন হলো বল তো!
মেহরাম;; আহা তনু কাদিস না।
তনু;; বড়োমা পাগল হয়ে যাবে রে এটা শোনার পর।
মেহরাম;; মাকে একটু বুঝিয়ে বলিস। আমি বলি নি কারণ মায়ের সামনে আমার মুখ থেকে বের হবে না কিছুই।
তনু;; আমি তো নিজেই ঠিক থাকতে পারছি না (কেদে)
মেহরাম;; তনু..
মেহরাম তনু কে জড়িয়ে ধরে। তনু তো এবার শব্দ করেই কেদে দিয়েছে। মেহরাম তনু কে বুঝি শুনিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। তনু একদম ফ্যাকাশে একটা চেহারা নিয়ে বাড়ি প্রবেশ করে। তনু কে ফিরতে দেখেই কণা-লায়লা খাতুন একদম আকড়ে ধরে। তনু অবশেষে বলে সোহেলের ক্যান্সার। সবাই যেন এক প্রকার ঝটকা খায়। তনু কাদতে কাদতে শেষ কণা কোন রকমে সামলাচ্ছে। লায়লা বেগমও প্রায় কাদো কাদো একটা ভাব। কারণ নিজেরও তো একটা ছেলে রয়েছে। তনুর তো প্রথমে সাহসই হলো না যে বাড়িতে কি করে জানাবে। খুব কষ্টে তনু বাড়িতে ফোন দেয়। বাড়িতে ফোন দিতেই তনুর বাবা ফোন ধরে…
বিল্লাল;; হ্যালো..
তনু;; হ্যালো বাবা।
বিল্লাল;; হ্যাঁ রে তনু মা কেমন আছিস?
তনু;; ভালো বাবা। বাবা কিছু কথা ছিলো।
বিল্লাল;; হ্যাঁ বল না।
তনু;; শুধু তোমার সাথেই না সবার সাথেই।
বিল্লাল;; মা হয়েছে কি সব ঠিক আছে তো। মেহরাম তো শশুড় বাড়ি। ও ঠিক আছে তো??
তনু;; কিছুই ঠিই নেই বাবা, কিছুই না।
বিল্লাল;; তনু মা কাদছিস কেন, কি হয়েছে?
বিল্লালের আওয়াজ শুনে বাড়ির সবাই একে একে ছুটে এলো।
আতিয়া;; আরে হয়েছে কি এমন করছো কেন?
কনিকা;; ভাইজান কি হয়েছে?
বিল্লাল কিছু না বলে ফোন সোজা মেহরামের মা কনিকার হাতে দিয়ে দেয়। বিল্লাল মাথায় হাত দিয়ে বসে পরে।
কনিকা;; তনু মা কাদছিস কেন?
তনু;; বড়োমা সোহেল,, সোহেল ভাইয়ের ক্যান্সার হয়েছে। লাস্ট স্টেজে আছে। এটা মেহরাম আর সোহেল ভাই আগে থেকেই জানতো কিন্তু কাউকে কিছুই বলে নি।
তনুর বলা শেষ হতেই কনিকার হাত থেকে ফোন টা ঠাস করে নিচে পরে যায়। তিনি পরে যেতে ধরলে আতিয়া দ্রুত তাকে ধরে সোফায় বসিয়ে দেয়। একে একে সবাই জানতে পারে বিষয় টা। সবার মাথার ওপরে যেন বাজ ভেংগে পড়েছে। কেউ বিশ্বাসই করতে পারছে না। সারা বাড়িতে এক দুঃখের কালো ছায়া ছেয়ে গেছে। কারো মনেই নেই কোন শান্তি। কেমন এক মরা মরা ভাব। এমনও হয়েছে যে কাদতে কাদতে চোখের পানিই এক সময় বলে দিয়েছে যে “” থাক না চোখের কার্নিশ গুলো–গাল গুলো একটুখানি শুষ্ক””। পরেরদিনই মেহরামের বাবা মা চাচি আর চাচ্চু আসে দেখা করতে। তার দিদুন কে আনা হয় নি। উনি সামলাতে পারবেন না তাই। মেহরাম সোজা বলে দিয়েছে যে সোহেলের কাছে যেন কেউ না কাদে। কেননা উনার মন এমনিতেই খারাপ মেহরাম চায়না যে আরো বেশি খারাপ হোক। এদিকে কুসুম বেগম কে সামলানো দায় হয়ে পরেছে। ছেলেকে হারানোর আহাজারি তার মধ্যে আছেই। তারা এসেছে বলে সোহেল একপ্রকার মেহরামের সাথে জিদ ধরেই নিচে চলে গিয়েছে। সোহেল বসে আছে আর তারা সবাই কথা বলছে। কুসুম বেগম ছেলে কে ছেড়ে এক মিনিটের জন্যও দূরে যাচ্ছেন না। মেহরামের মা এবার খেয়াল করলো মেহরাম কাজ করছে। অন্যান্য দিকে তার খেয়াল নেই। আপন মনে কাজ করে যাচ্ছে। মুখে নেয় কোন হাবভাব। দেখে মনে হচ্ছে যে ভাগ্য কে সে মেনে নিয়েছে। এগুলোই যেন তার জীবনের প্রাপ্তি ছিলো। জীবনের কাছে কোন অভিযোগ নেই তার, নেই কোন নালিশ। যেভাবেই হোক যেমনই হোক মেনে নিয়েছে, রাজি সে। মেহরাম পরিবেশ রক্ষার্থে সকলের সামনে চা দিলো। দিয়েই সে আবার কাজে মনোযোগ দিলো। তবে এবার মেহরামের মা কনিকা উঠে গিয়ে মেহরামের সামনে গিয়ে দাড়ালো।
মেহরাম;; আরে আম্মু, কিছু বলবে?
কনিকা;; আমার মেয়ে (মেহরামের মাথায়-মুখে হাত বুলিয়ে দিয়ে)
কনিকা মেহরামের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তার কপালে চুমু খায়। হাত টা মাথা থেকে নামিয়ে মেহরামের পেটের ওপরে রাখে। সেদিকে তাকিয়ে কনিকা মুচকি হাসে। মেহরাম তাকিয়ে আছে তার মায়ের দিকে। কিন্তু হুট করেই মেহরাম বলে ওঠে…
মেহরাম;; আমিও তো এভাবেই তোমার পেটে ছিলাম তাই না মা!
মেহরাম তার মায়ের দিকে তাকিয়ে কথা টা বললো। কনিকা এখনো মেহরামের পেটে হাত রেখে তাকিয়ে আছে। মুখে ঝুলছে মুচকি হাসি।
কনিকা;; হ্যাঁ, যখন তুই ছিলি সবাই ভেবেছিলো হয়তো দুটো বাচ্চা যমজ। এতো টাই বড়ো ছিলো পেট। কিন্তু অবশেষে হলি তুই। (মেহরামের দিকে তাকিয়ে)
মেহরাম তার মায়ের কথাতে এবার হেসেই দেয়।
মেহরাম;; এভাবে বলো, শুনো তুমি খুব লাকি বুঝলে যে আমার মতো মা পাগল একটা মেয়ে পেয়েছো!
কনিকা;; এহহ আসছে রে মা পাগল।
মেহরাম;; মা..
মেহরাম এবার এগিয়ে গিয়ে তার মাকে জড়িয়ে ধরে। কনিকাও তাই। তিনি বেশ বুঝতে পারলেন যে তার মেয়ে কাদছে। মেহরামের দূর্বলতা হচ্ছে একমাত্র তার মা। মেহরামের বাবার সাথে তার তেমন কোন মিল নেই। আসলে মেহরাম তার বাবাকে তেমন পছন্দই করে না। আর এর কারণ সে নিজেও জানে না। প্রয়োজন ছাড়া তেমন কথাও বলে না। কিন্তু মেহরাম তার মা বলতে পাগল।
মেহরাম;; মা. .
কনিকা;; হুমম বল।
মেহরাম;; কিছু না ডাকতে ভালো লাগছে।
কনিকা;; পাগলি একটা।
মেহরাম;; মা শুনো না!
কনিকা;; হ্যাঁ বল শুনছি তো।
মেহরাম;; আমাকে, আমাকে ফফেলে কককখনো যযদি দূদূরে গিয়েছো তাতাহলে কিন্তু ভালো হবে ননা ববলে দিচ্ছি। (কান্না কোন রকমে আটকিয়ে)
কনিকা;; যদি আমার দিন শেষ হয়ে যায়। আমার আয়ু আল্লাহ তোকে দান করুক। (মহরামের গালে হাত দিয়ে)
মেহরাম;; কবরে তোমায় নামানোর আগে আমাকে নামাতে হবে।
কনিকা;; নিজের দিকে একটু খেয়াল রাখিস মা।
মেহরাম;; রাখি তো। আচ্ছা চলো।
মেহরাম তার মাকে নিয়ে গিয়ে সবার মাঝে বসে পরলো। মেহরামের চাচি চাচ্চু বাবা প্রায় সবারই কাদার মতো অবস্থা। কুসুম বেগমের শরীর ইদানীং খারাপের দিকে যাচ্ছে ছেলের চিন্তায়। তারা সবাই এক বিকেল থেকে কুসুম বেগম কে কোন রকম আস্থা দিয়ে চলে যায়।
।
।
তনু সারাঘরে পায়চারি করছে। যতোই হোক মেহরাম যেমন তনুকে ভালোবাসে তনুও ঠিক তেমনই। দুইজন একে ওপরের কলিজা। কিন্তু এদিকে তো তনুর মনে শান্তি নেই। সকাল বেলা মেহরামের বাসা থেকে এসে পরার পর কমপক্ষে ১৬ বার ফোন দিয়ে মেহরামের সাথে কথা বলেছে। কিন্তু এখনো যেন তনুর ভালো ঠেকছে না। সে আয়ুশকে ফোন দেয় প্রথমবার বেজে কেটে যায় কিন্তু পরেরবার দেবার সাথে সাথে রিসিভ হয়।
তনু;; আয়ুশ।
আয়ুশ;; হ্যাঁ মানে ফোন কেবিনে ছিলো আর আমি বাইরে বুঝি নি।
তনু;; তা বেপার না। আয়ুশ..
আয়ুশ;; কি হয়েছে তনু গলার আওয়াজ এমন কেন। সবকিছু ঠিক আছে তো?
তনু;; না। আয়ুশ, আয়ুশ সোহেল ভাইয়ের ক্যান্সার।
আয়ুশ;; What?!
তনু;; হ্যাঁ,
আয়ুশ;; কি বলছো এইসব। মাথা ঠিক আছে?
তনু;; আয়ুশ আমি সিরিয়াস। আজ সকালে আমি মেহরামের বাসায় গিয়েছিলাম। ভাইয়ার অবস্থা খুব বেশি ক্রিটিকাল। বাড়ির সবাই জানে। মেহরাম আর ভাইয়া প্রায় অনেকদিন আগেই জেনেছে কিন্তু কেউই এই খবর টা শোনার পর ঠিক থাকতে পারবে না তাই তারা কাউকে কিছুই বলে নি।
আয়ুশ;; মানে কি এইসবের, কি থেকে কি হলো। আচ্ছা এখন কেমন আছেন?
তনু;; বেশি একটা ভালো না। খালামনি তো কাদতে কাদতে শেষ।
আয়ুশ;; মেহরাম কেমন আছে?
তনু;; মেহরাম। তার কথা আর বলোই না। বোন টা আমার মরে গেছে পুরো। কোন সাড়াশব্দ নেই, কিচ্ছুনেই। আয়ুশ মেহরাম প্রেগন্যান্ট, এই অবস্থায় নিজের হাসবেন্ডের এমন খবর শোনার পর কেউই ঠিক থাকতে পারবে না।
আয়ুশ;; হুমম।
তনু;; আয়ুশ চলো আমরা আগামীকালই যাবো সেখানে।
আয়ুশ;; আমাকে কাল আউট অফ ঢাকা যেতে হবে আমরা বরং আগামী পরশু যাই কেমন।
তনু;; আচ্ছা। তাড়াতাড়ি বাড়ি এসো।
আয়ুশ;; হুমম।
।
।
পরেরদিন সকালে~~
মেহরাম;; আস্তে ধীরে উঠুন।
সোহেল;; সমস্যা নেই আমি উঠতে পারবো।
মেহরাম সোহেল কে ধরে ধরে উঠায়। মূলত ডাক্তারের কাছে যেতে হবে চেকাপের জন্য। সোহেল নিজেই রেডি হয়ে নিলো। মেহরাম খুব সাবধানে তাকে ধরে ধরে নিচে নামিয়ে আনে। বাড়ির বাইরে বের হতেই ড্রাইভার গাড়ি বের করে। কুসুম বেগম কেদে কেদে বলছে মেহরামকে তাকেও যেন সাথে নিয়ে যায়। কিন্তু মেহরাম অনেক ভালো করে বুঝিয়ে তাকে বাড়িতেই রেখে যায়। কেননা একে তো অসুস্থ মানুষ তাকে এভাবে হস্পিটালে নেওয়া ঠিক হবে না।
মেহরাম;; মা তুমি একদম চুপ করে বসে থাকবে। বেশি হাটা হাটি করবে না মাথা ঘুড়িয়ে যাবে নয়তো। আর প্লিজ কেদো না তো। একটু চুপ করো। আর এই নিলা..
নিলা;; জ্বি আপা!
মেহরাম;; মাকে এক সেকেন্ডের জন্যও একা ছাড়বি না। সবসময় পাশে থাকবি।
নিলা;; আচ্ছা।
মেহরাম;; আর দরজা আটকিয়ে রাখ, অপরিচিত কেউ আসলে একদম খুলবি না।
নিলা;; আচ্ছা আপা, আপনে ভাই রে নিয়া যান চিন্তা কইরেন না। আমি আছি।
মেহরাম;; হ্যাঁ মা আমি যাই।
মেহরাম সোহেল কে নিয়ে গাড়িতে উঠে হস্পিটালের উদ্দেশ্যে চলে যায়। বেশ সময় পর এসেও পরে। ডাক্তারের কাছ থেকে স্পেশাল এপোয়েন্টমেন্ট নেওয়া ছিলো তাই তাদের যাওয়ার সাথে সাথে একজন নার্স এসে তাদের একটা কেবিনে নিয়ে যায়। ডাক্টার সোহেল কে দেখেই কিছু কুশল বিনিময় করেন। তারপর চেকাপ শুরু করে দেন। প্রায় এক ঘন্টার কাছাকাছি হয় ডাক্তার সোহেল কে দেখছে। টেস্ট দিয়ে একদম ভরে ফেলেছে। ডাক্তার নিজেই সেগুলো করিয়ে নেন। সোহেল হস্পিটালের জামা পরে বেডে বসে আছে। আর ডাক্তার তার পাশে বসে লিখালিখি করছে। কয়েক মিনিট পরেই সোহেলের নতুন রিপোর্ট আসবে। শরীরের সিচুয়েশন কতোটা ঠিক হয়েছে বা কতো টা অবনতি হয়েছে সব ক্লিয়ারলি বুঝা যাবে। মেহরামও সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু তখনই মেহরামের ফোনে ফোন আসে। মেহরাম একটু বাইরে যায় কথা বলার জন্য।
.
সোহেল;; ডক্টর রিপোর্ট!
ডাক্তার;; এসেছে (রিপোর্ট দেখতে দেখতে)
সোহেল;; কি এসেছে রিপোর্টে ?
সোহেলের কথায় ডাক্তার শূন্য দৃষ্টিতে তাকায় তার দিকে। সোহেল হয়তো ডাক্তারের এমন চাহনির মানে বুঝে গেছে। তাই সে শুকনো কিছু ঢোক গিলে তারপর বলে ওঠে…
সোহেল;; ডক্টর আর কতো দিন সময় আছে আমার কাছে?
ডাক্তার;; ________________
সোহেল;; ১ মাস বাকি নাকি তার থেকেও কম?!
ডাক্তার;; আর ১ মাস ৩ দিন বাকি আছে।
সোহেল;; জ্বি সে তো আমার ভাগ্য (মুচকি হেসে)
তখনই হঠাৎ মেহরাম ডাক্তারের কেবিনে ঢুকে। মেহরামকে দেখে সোহেল মুচকি হাসে। মেহরাম তাকিয়ে দেখে ডাক্তারের হাতে রিপোর্ট গুলো বাতাসে উড়ছে। তার মনের ভেতরে ধুকপুকানি ক্রমশ বেড়ে গেছে। মনে হচ্ছে কেউ শক্ত কোন বস্তু দ্বারা খুব জোরে জোরে পিটাচ্ছে। মেহরাম সোহেলের দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে যায়।
।
।
।
।
🥀চলবে~~
#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ১৫
🍂
.
.
.
.
মেহরাম সোহেলের দিকে ধীর পায়ে এগিয়ে যায়। মেহরামের যেতেই সোহেল কিছুটা তাড়া দিয়ে রিপোর্ট গুলো লুকানোর চেষ্টা করে। আর সোহেল এমন একটা ভাব ধরে যেন কিছুই হয় নি। মেহরাম অবাক হয়ে ডাক্তারের দিকে তাকায়। তখন সোহেল বলে ওঠে…
সোহেল;; আব..মেহরাম এসেছো কোথায় গিয়েছিলে?
মেহরাম;; এইতো একটু বাইরেই আর কি। রিপোর্ট এসেছে?
সোহেল;; হ্যাঁ হ্যাঁ এসেছে তো। আগে থেকে একটু রিকভার করেছি আমি। তোমায় বলেছিলাম না যে আস্তে আস্তে সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে একদম।
মেহরাম;; ______________
সোহেল;; মেহরাম, তুমি খুশি নও?
মেহরাম;; রিপোর্ট গুলো কোথায়?
সোহেল;; ওগুলো রয়েছে তুমি পরে দেখো তো আগে এখানে কিছুক্ষণ বোস।
মেহরাম;; হুমম।
ডাক্তার;; মিসেস মেহরাম.
মেহরাম;; জ্বি
ডাক্তার;; হয়তো মিস্টার সোহেল কে কিছুদিন পর হস্পিটালে এডমিট করতে হবে।
ডাক্তারের কথা শুনে মেহরাম কিছুটা ভ্রু কুচকায়।
মেহরাম;; কেন?
সোহেল;; কারণ এখানে থাকলে আমার কেয়ার বেশি করা হবে তাই।
মেহরাম;; মানে কি?
সোহেল;; কিছু না, মানে ডাক্তার যা বলছে তাই শুনবো শেষ।
মেহরাম;; জ্বি আচ্ছা।
এই বলেই ডাক্তার বের হয়ে পরে। মেহরাম কতোক্ষণ সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সোহেলের দিকে। সোহেলের যেন কোন হেলদুল নেই সে তার মন মতো কথাই বলে চলেছে।
সোহেল;; মেহরাম।
মেহরাম;; __________
সোহেল;; মেহরাম..
মেহরাম;; হ্যাঁ জ্বি ববলুন।
সোহেল;; বাসায় নিয়ে যাবে না আমায় (হেসে)
মেহরাম;; হ্যাঁ যাবো তো, চলুন।
মেহরাম উঠে সোহেলের হেল্প করে দিতে থাকলো। তারপর আস্তে ধীরে উঠে সোহেলের এক হাত মেহরামের কাধের ওপর রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তখনই দুজন ওয়ার্ডবয় আসে তারা এসে মেহরামের সাহায্য করে। সোহেল কে ধরে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে বসিয়ে দেয়। মেহরাম হস্পিটাল থেকে বের হয়ে এসে পরবে তখন একজন নার্স মেহরামের সাথে কি যেন কথা বলতে থাকে। আর সোহেল গাড়ি থেকে জানালা দিয়ে বাইরে মেহরাম কে দেখছে। সোহেল তার আরেক ব্যাগের দিকে তাকিয়ে দেখে রিপোর্ট গুলো। সে লুকিয়ে ফেলে। এবার সোহেল গাড়ির উইন্ড-এর দিকে আরেকটু লেগে বসে। বাইরে তাকিয়ে মেহরাম কে দেখছে। নার্স টার সাথে হয়তো মেহরামের আগে থেকেই পরিচয় ছিলো তাই একটু হেসেই কথা বলছে। সোহেল লক্ষ্য করে দেখলো যে যেই মেহরামকে বিয়ে করে সে নিজের ঘরের বউ করে এনেছিলো তা আর এখন নেই। মেহরাম এবার সোজা হেটে চলে আসে। সূর্যের প্রখর রোদ মেহরামের মুখের ওপর আছড়ে পরলে বাম হাত তুলে মুখের ওপর রোদ আসাকে আটকে দেয়। তারপর এসে গাড়ির পেছন সীটে সোহেলের পাশে বসে পরে। মেহরাম আসতেই সোহেল কিছুক্ষণ তার দিকে তাকয়ে থাকে। মেহরাম তার ব্যাগের ভেতরে কি যেন চেক করে এবার ভালোভাবে বসে। সোহেল তার হাত টা মেহরামের হাতের ওপর রাখে। মেহরাম সোহেলের দিক তাকালে সে মুচকি হাসে। মেহরাম এক বড়ো দম ছাড়ে।
সোহেল;; মেহরাম
মেহরাম;; জ্বি
সোহেল;; ধন্যবাদ
মেহরাম;; কেন?
সোহেল;; আমার জীবনে আসার জন্য। হয়তো তোমার সাথে আমার জীবনের সময়সীমা কম ছিলো কিন্তু আমি লাকি তোমায় ক্ষনিকের জন্য পেয়েও। ধন্যবাদ।
মেহরাম;; হুমম (মুচকি হেসে)
মেহরাম আর সোহেল বাড়ি এসে পরে। ড্রাইভার তাদের সাহায্য করেন। বাড়ি এসেই কুসুম বেগম আস্তে করে নিজের ছেলেকে ধরেন তারপর সোফায় বসিয়ে দেন।
কুসুম;; মেহরাম ডাক্তার কি বললো?
মেহরাম;; বলেছেন কিছুদিন পর হস্পিটালে এডমিট করাতে হবে।
কুসুম;; কেন বাসায় থাকলে কি সমস্যা?
মেহরাম;; মা বাসায় হস্পিটালের সব Possibilities নেই। আর এখানে যদি কিছু সমস্যা হয় তখন দ্রুত হস্পিটালাইস করাতেও প্রব্লেম হবে বুঝলে। তাই ডাক্তার হস্পিটালে এডমিট করাতে বলেছেন।
কুসুম;; ওহহ আচ্ছা। সোহেল বাবা এখন কেমন লাগছে?
সোহেল;; আমি ভালো আছি মা।
সেইদিন এভাবেই কেটে যায়। মেহরাম সোহেল কে ঘরে এনে শুইয়ে দেয়। খাইয়ে দেয় তারপর সোহেল ঘুম। এর মধ্যে দুবার মুখ-নাক দিয়ে রক্ত পরেছে। মেহরাম সামলে নিয়েছে। রাতের বেলা মেহরাম টেবিলে বসে লিখালিখি করছিলো। তখন সোহেল ঘুম থেকে ওঠে পরে।
সোহেল;; কি লিখছো?
মেহরাম;; উঠে পরেছেন?
সোহেল;; হুমম, আচ্ছা কি লিখছো?
মেহরাম;; তেমন কিছুই না। আসলে একা থাকলে আমার লিখালিখির অভ্যাস আছে তাই আর কি।
সোহেল;; তোমার হাতের লিখা গুলো অনেক সুন্দর জানো!
মেহরাম;; মোটেও না, এই হাতের লিখার জন্য স্যারদের কাছে কতোই না বকা শুনেছি।
সোহেল;; আমার থেকে হ্যান্ড রাইটিং তোমার অনেক ভালো দেখেছি আমি। আমার লিখা তো এক প্রকার কাকের ঠ্যাং বকের ঠ্যাং।
মেহরাম;; (মেহরাম হেসে দেয়) না সুন্দর।
সোহেল;; গল্প পরতে ভালোবাসো?
মেহরাম;; বাসতাম।
সোহেল;; আর এখন?
মেহরাম;; পড়াই হয় না। যাই হোক এই সব কথা ছাড়ুন। খিদে পেয়েছে?
সোহেল;; না। মেহরাম অনেক দিন তোমার হাতের চা খাওয়া হয় না খাওয়াবে।?
মেহরাম;; এমা এটা কেমন কথা, আমি এক্ষুনি আনছি।
মেহরাম উঠে টেবিল টা কোন রকমে গুছিয়ে নিচে চলে যায়। চায়ের পানি গরম দিয়ে কিছুক্ষণ হাটে। পানি গরম হয়ে গেলে তাতে বেশি করে আদা-লং এগুলো দিয়ে কড়া চা বানিয়ে নিয়ে যায় রুমে। রুমে যাবার আগে কুসুম বেগমের ঘরে একবার দেখে যায়। নাহ, ঠিকই আছে তিনি গভীর ঘুম। মেহরাম চলে যায় রুমে।
মেহরাম;; এই নিন আপনার গরম গরম চা।
সোহেল;; চিনি..
মেহরাম;; এক চামচ আমি জানি।
সোহেল;; মনে আছে।
মেহরাম;; খান।
মেহরাম চেয়ারে বসে পরে। সোহেলের খাওয়া শেষ হলে সেগুলো আবার নিচে রেখে আসে। রুমে মেহরাম আর সোহেল দুজনেই বসে আছে একদম চুপ। কারো মাঝে কোন কথা নেই। সোহেল খেয়াল করে দেখে মেহরাম তার হাত বারবার চোখে দিচ্ছে। সোহেল কিছুটা কপাল কুচকে তার দিকে তাকায়।
সোহেল;; মেহরাম
মেহরাম;; ১ মাস ৩ দিন তাই না!! (কেদে)
সোহেল;; মেহরাম! তুমি…
মেহরাম;; আমি জানি। রিপোর্ট গুলো লুকিয়ে লাভ নেই। আজ হস্পিটালে যখন ডাক্তার আপনাকে বলেছিলো যে আপনার কাছে আর ১ মাস ৩ দিন আছে আমি তখনই শুনেছিলাম। কেন লুকাচ্ছেন আমার কাছ থেকে।
সোহেল;; প্লিজ এভাবে কান্না করো না।
মেহরাম;; আপনি একবার ভেবেছেন এটার কথা মা জানলে সেখানেই……
সোহেল;; মেহরাম কান্না করো না শরীর খারাপ হয়ে যাবে আর তার ইফেক্ট পরবে বেবির ওপর প্লিজ কান্না করো না।
সোহেলের এমন ধমকে মেহরাম কেপে ওঠে। ফট করে মাথা তুলে তাকায়। আসলে মেহরাম অবাক। কারণ এর আগে সোহেল তার সাথে জীবনেও এভাবে কথা বলে নি, ধমক দেওয়া তো দূরের কথা। মেহরাম অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। সোহেল এবার হেসে দেয়।
সোহেল;; আরে ভাই আর্মি তে ছিলাম কিছু তো রেস্পেক্ট দাও। তুমি যে বলতে না খিটখিটে-বদমেজাজী, খবিস টাইপের লোক হয়। আরে আমার মধ্যে সব টাইপের কোয়ালিটি-ই আছে। কিন্তু প্রকাশ-ই যা করি না। কারণ আমার ভালো লাগে না রুড বিহেভ।
মেহরাম;; তাই বলে ধমক দিবেন। সত্যি ভয় পাইছি।
সোহেল;; ভয় পাবার জন্যই তো দিয়েছি। কানবা না একদম না তাতে আমার যাই হোক যেমনই হোক কানবা না।
সোহেলের বারণ করা সত্বেও যেন মেহরামের এবার আরো বেশি কান্না পাচ্ছে। সোহেল মেহরামকে জড়িয়ে ধরে। এভাবেই সেদিন কেটে যায়।
।
।
আয়ুশ;; মেহরাম দের বাসায় নাকি যাবে?
তনু;; হ্যাঁ রেডি হয়ে নাও।
আয়ুশ;; আমি রেডি চলো।
তনু আর আয়ুশ সবাইকে বলে বের হয়ে পরে। খানিক সময় পর এসেও পরে। তনু কলিংবেল বাজাতেই কুসুম বেগম এসে দরজা খোলে দেয়। কুসুম বেগম কে দেখেই তনু দ্রুত জড়িয়ে ধরে। কুসুম বেগম কেদে দেন। তনু তার চোখের পানি মুছে দেয়। কুসুম বেগম নিজেও স্বাভাবিক হয়ে তাদের তাড়াতাড়ি ভেতরে এনে বসায়।আয়ুশের সাথেও কুসুম বেগম অনেক কথা বলে। কুসুম বেগমের কাছে আয়ুশ আর সোহেল যেন সমান। তাদের ভেতরে আসতেই মেহরাম নিচে নেমে যায়। আর নিচে নামার সাথে সাথেই আয়ুশের আর মেহরামের চোখাচোখি হয়ে যায়। মেহরাম চোখ নামিয়ে ফেলে।আয়ুশ সে প্রথমেই মেহরামের দিকে তাকায়। সে প্রেগন্যান্ট, আর আয়ুশ তাকে দেখার পর অন্য পাশে তাকায়। মেহরামের প্রেগন্যান্সির পর এই প্রথম আয়ুশ তাকে দেখলো। তনুর সাথে মেহরাম অনেক কথা বলে। এভাবে যেতে থাকে। সোহেল নিচে নেমে পরে। নিচে নামতেই সোহেল গিয়ে আগে আয়ুশের সাথে কথা বলে। আয়ুশও হাসি মুখে অনেক কথা বলে। এবার তনু মেহরাম আর কুসুম বেগম রান্নাঘরে চলে যায় তারা কথা বলছে। মেহরামের মতে আজকে তনুকে যেতে দিবে না। কিন্তু আয়ুশের কাজ আছে তাই তাকে যেতেই হবে। এখন করিডরে আয়ুশ আর সোহেল বসে গল্প করছে। তবে কেন যেন সোহেল এক মূহুর্তের জন্যও আয়ুশকে ছাড়ছে না। আর আয়ুশ সেই বেপার টা খেয়াল করেছে।
আয়ুশ;; সোহেল…
সোহেল;; আয়ুশ জানো একটা কাহিনি আছে।
আয়ুশ;; কিহ (কপাল কুচকে খানিক হেসে)
সোহেল;; আগের যুগে একটা গ্রামে একটা মেয়ে ছিলো। নাম ছিলো ‘বাহার’। সে এতো টাই সুন্দর ছিলো যা বলার বাইরে। তবে কি জানো মানুষ তার সৌন্দর্যে বিমহিত হতো না। বাহারের সাথে কিছুদিন থাকলে, কথা বললে বা বন্ধুত্ব করলে তার দিকে এক আলাদা মায়া অনুভব করতো। মানে সবাই বাহারের প্রেমে পরে গেতো। কিন্তু তার সৌন্দর্য দেখে না, আচার আচরণ, কথা বার্তা এই সব দেখে। যাকে বলে ভেতরের সৌন্দর্য আর কি। বাহারের মাঝে এমন কিছু ছিলো যা আর কারোর মাঝেই ছিলো না। সে ছিলোই এমন, না ভালোবেসে, না প্রেমে পরে কেউ থাকতেই পারতো না।
আয়ুশ;; হুমম।
সোহেল;; তবে মূল বেপার কি জানো। মূল কথা হচ্ছে এটা যে সেই বাহার প্রকৃতপক্ষে কাকে ভালোবাসতো সেটা। সবাই তো তাকে ভালোবাসতো কিন্তু আসলে বাহার কাকে চাইতো?
আয়ুশ;; তো এই যে বাহার আছে। তুমি এর কাহিনি আমায় কেন বলছো? (হেসে)
সোহেল;; কারণ এখানে বাহারের বাস্তব চরিত্র হচ্ছে ‘মেহরাম’।
সোহেলের কথা আয়ুশ কপাল কুচকে তার দিকে তাকায়।
আয়ুশ;; মানে কি?
সোহেল;; মেহরামকে অনেক ভালোবাসতে তাই না?
আয়ুশ;; সোহেল, তুমি..
সোহেল;; মেহরাম কে আমি একটা প্রমিস করেছিলাম যে যদি কখনো তার ভালোবাসা ফিরে আসে আমি নিজে তাকে হেল্প করব তার কাছে ফিরে যেতে। কিন্তু মেহরাম নিজে বলেছিলো আমায় যে তার সম্ভব নয়।আমি ধারণাও করিনি যে সেটা তুমি হবে। এখানে কারো কোন দোষ নেই। না তোমার না মেহরামের আর না ই তনুর। সে বেচারি তো কিছু জানেই না।
আয়ুশ;; সোহেল বাদ দাও ওসব কথা। আমি পায়নি ওকে।
সোহেল;; একদিন মেহরাম কাজ করছিলো, আসলে তার ভার্সিটিতে পরিক্ষা ছিলো আর বিয়ের পরও ফাইনাল এক্সাম পর্যন্ত মেহরাম তার স্টাডি চালিয়ে গিয়েছিলো। আমি বাসায় ছিলাম। মেহরাম তো তার এক্সামের জন্য তাড়াহুড়ো করে চলে গিয়েছিলো। কিন্তু কিছু ফাইল নিতে গিয়ে হঠাৎ তার ব্যাগ থেকে একটা ডায়েরি নিচে পরে। আমি মেহরাম কে বললে সে আমায় বলে গুছিয়ে রাখতে। ডায়েরি টা হাতে নিলাম আমি। ওপরে সুন্দর করে লিখা ছিলো ‘মেহরাম’। আমি জানি যে কারো কিছু বিনা পারমিশনে ধরা ঠিক না কিন্তু কেন যেন সেদিন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারিনি। তুমি জানো পুরো কয়েক ঘন্টা লেগে গিয়েছিলো আমার ডায়েরি টা পরতে। হয়তো পুরো ডায়েরি টা হাজার বার পরলেও মেহরামের ভেতরের খবর কেউ জানবে না। মেহরাম কখনো তার বাবার আদর পায়নি। সে বুঝে না বাবার আদর কাকে বলে। তার মা তার কাছে সবার ওপরে। মেহরাম এটাও লিখেছিলো তাতে যে “সে ততোদিন অব্দি হজ্জ করতে যাবে না যতোদিন তার মা বেচে আছে”। নিজের পুরো লাইফের কাহিনি হয়তো লিখে দিয়েছে তাতে। সব লিখা ছিলো তাতে। অনেক কিছু লিখে রেখেছে মেহরাম। তোমার বেপারেও।
সোহেলের এই কথায় আয়ুশ মাথা ঘুড়িয়ে তার দিকে তাকায়।
সোহেল;; হ্যাঁ তোমার বেপারে। যেগুলো হয়তো কখনো তোমাকে বলতে পারে নি সেগুলো।
আয়ুশ;; সোহেল ভালোবাসা না করা যায় না, এটা কোন কাজ বা জিনিস না যে পছন্দ হলো করে নিলাম। এটা হয়ে যায়। যারা ভালোবাসি মুখ ফুটে বলে নিজের করে নিতে পারে হয়তো তাদের মতো লাকি আর দ্বিতীয় জন হয় না। আমি বুঝি মেহরামের অবস্থা টা। সে একদম মাঝ খানে পরে গিয়েছিলো না যেতে পারছিলো এইদিকে আর না যেতে পারছিলো ওইদিকে।
সোহেল;; এখনো ভালোবাসো মেহরাম কে?
আয়ুশ;; তুমি বলছো এই কথা?
সোহেল;; হ্যাঁ আমি বলছি। জনাব তুমি মেহরামের প্রেমিক হতে পারো তবে আমি, আমি ওর বেস্টফ্রেন্ড। সব খবর রাখি।
আয়ুশ আর সোহেল হেসে দেয়।
আয়ুশ;; কাশ ভুলতে পারতাম তাহলে আমার জীবন টাই সফল হয়ে গেতো। মৃত্যু ব্যাতীত সম্ভব না।
সোহেল;; বুঝি আমি।
আয়ুশ;; হিংসে হয় না?
সোহেল;; কার তোমার থেকে?!
আয়ুশ;; হ্যাঁ এইতো আমি যে এক সময় মেহরামের প্রাক্তন ছিলাম আর এখনো ভুলি নি?!
সোহেল;; মোটেও না। হিংসা তার ওপর করা যায় যে একজনের জিনিস আরেকজনের কাছ থেকে কেড়ে নেয়। আমি মেহরাম কে কাড়ি নি। সে আমার ভাগ্যে এসেছিলো। আরে হিংসা তো আমার ওপর তোমার করা উচিত। যে আমি মেহরামের সাথে আছি। কেননা মেহরামের জীবনে আমার আগে তুমি ছিলে। হিংসে হয়?
আয়ুশ;; না হিংসে না তবে হ্যাঁ কষ্ট ঠিকই হয়।
সোহেল;; হবারই কথা।
আয়ুশ;; এটা জরুরী না যে “যাকে তুমি ভালোবাসো তারও তোমাকেই ভালোবাসতে হবে”। একাও ভালোবাসা যায়, মেহরামকে ভালোবাসার জন্য আমার মেহরামেরই দরকার নেই।
সোহেল;; ডায়েরি টা মেহরাম খুব যত্ন করে রেখে দিয়েছে। সে জানে না যে আমি সব জানি।
আয়ুশ;; খুব ভালোবাসো মেহরামকে তাইনা?
সোহেল;; হাহা, বললাম তো যে বাহার কে ভালোবাসতো সবাই কিন্তু মূল বেপার ছিলো এটা যে বাহার কাকে ভালোবাসতো।
আয়ুশ;; 😅😅।
তীব্র হাসিতে অতিমাত্রায় চাপা কষ্ট নিয়ে কথা বলা কাকে বলে তা জানার জন্য কারোর এখন আয়ুশ আর সোহেলকে দেখলেই হবে। একসময় আয়ুশ আর তনু সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসে পরে। তনুর সাথে মেহরামের আগেই কথা হয়েছে। আয়ুশ আর তনু চলে গেলে সেখানে মেহরাম আসে না আর এটা আয়ুশ সোহেল দুজনেই লক্ষ্য করেছে। প্রায় রাত ৮ টার দিকে তারা তাদের বাসায় এসে পরে। সকল কাজ টাজ করে যে যার রুমে চলে যায়। আয়ুশ তনুর দিকে তাকিয়ে দেখে সে ঘুম। সেও শুয়ে শূন্য দৃষ্টিতে ওপরের দিকে তাকিয়ে থাকে। সোহেলের বলা কথাগুলো যেন তার কানে বাজছে। এদিকে হুট করেই সোহেলের গা ভরে জ্বর আসে। মেহরাম তার পাশে বসে সোহেলের মাথায় জলপট্টি দিয়ে দিচ্ছে। আর সে নিজের আপন ভাবনায় মগ্ন।
মেহরাম সোহেলের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সোহেল যেন ভাবতেই পারছে না যে সে এইমাত্র কি শুনেছে। সে মুখ ঘুড়িয়ে ডান হাত দিয়ে মাথায় কিছুটা স্লাইভ করে নিলো। ঘুড়ে গিয়ে মেহরামের থেকে কিছুটা দূরে সরে দাড়ালো। পরক্ষণেই আবার হুট করেই মেহরামের কাছে এসে অবাক হয়ে বলতে থাকে…
সোহেল;; মা মামানে, তুতুমি প্রেপ্রেগন্যান্ট। মেহরু আমার না কেমন বিশ্বাসই হচ্ছে না। আমাকেও কেউ বাবা বলে ডাকবে। মানে আমার ভাষা নেই আমি কি করে বলবো কি করে বুঝাবো। তুমি, তুমি আগে কেন বলোনি (মেহরামের গাল ধরে)। মা পর্যন্ত আমায় বলে নি। আমি পাগল না হয়ে যাই এখন।
মেহরাম;; আমি নিজেই ধারণা করতে পারিনি যে টেস্ট করানোর পর এমন একটা কিছু হবে।
সোহেল;; মেহরাম তুমি, তুমি হ্যাপি তো??
মেহরাম;; হ হ হহ্যাঁ, আমি হ্যাপি।
সোহেল;; তোমার তো পড়াশোনা করার ইচ্ছে ছিলো তাই না। এখনই বাচ্চা। মানে ভেবে দেখতে পারো মেহরাম।
মেহরাম;; না, আমি ভেবেছি। আমার নিজের লাইফের কথা ভেবে আমি আরেকটা জীবন নষ্ট করতে পারি না। এ কেমন কথা। এই বাচ্চাটা আমার চাই, আমার লাগবে।
সোহেল;; দেখো মেহরু বাচ্চা তোমার একার না আমারও। As a would be Father আমার হ্যাপি হওয়াটা নরমাল। কিন্তু সবার আগে তুমি, বাকি সবার কথা ভেবে তুমি নিজের টা ভাববে না তা হয় না। তো পুরোপুরি তোমার ইচ্ছের ওপর ডিপেন্ড করে।
মেহরাম;; আমি সিওর আমার বাচ্চাটা চাই।
সোহেল মুচকি হেসে মেহরামকে জড়িয়ে ধরে। তবে সত্যি বলতে মেহরামের ভেতরে কিছুই শান্ত নেই। তার ভেতরে শুধু ঝড় বয়ে যাচ্ছে। বারবার নিজের গলা শুকিয়ে আসছে। না চাইতেও কেন যে আয়ুশের কথা টা মাথায় বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে তার। সোহেল মেহরাম কে বলে ফ্রেশ হতে চলে যায়। তারপর ধীরে ধীরে নিচে নেমে পরে। নিচে নামতেই কুসুম বেগম মেহরামের কাছে যায়।
কুসুম;; কিরে সোহেল কে বলেছিস?
মেহরাম;; হ্যাঁ মা বলেছি।
কুসুম;; শুনে কি বললো?
মেহরাম;; উনি অনেক বেশি খুশি।
কুসুম;; খুশি আবার হবে না। আচ্ছা তুই বোস আয়। বাড়িতে ফোন দিবো?!
মেহরাম;; হুম দাও।
কুসুম বেগম খুশিতে গদগদ হয়ে আগে মেহরামের বাপের বাড়িতে ফোন দিলো। ফোন দিতেই মেহরামের মা ধরে।
কুসুম;; আসসালামু আলাইকুম আপা কেমন আছেন?
কনিকা;; ওয়ালাইকুম সালাম, জ্বি আলহামদুলিল্লাহ আপা ভালো আছি। এতো দিন পর আমাদের কথা মনে পরলো। ফোনই তো দেনই না। বাসায় সবাই কেমন আছে ?
কুসুম;; জ্বি আপা সবাই বেশির থেকেও একটু বেশি ভালো।
কনিকা;; বাব্বাহ, তা কারণ?
কুসুম;; কারণ এই যে হাতে বেশি সময় নেয়। আপনি নানুআপু হচ্ছেন আর আমি দিদুন।
কনিকা;; জ্বি আপা মানে। (অবাক হয়ে)
কুসুম;; মানে আপনি যা ধরেছেন তাই।
কনিকা;; ককি মেহরু আমার, আমার মেয়ে প্রেগন্যান্ট। আপা মানে সত্যি তো। আল্লাহ এতো একটা খুশির খবর। আমি কি করবো বুঝতেই পারছি না।
কুসুম;; আপাদত নিজের মেয়ের সাথে কথা বলুন।
কনিকা;; জ্বি।
মেহরাম;; হ্য হ্যালো মা।
কনিকা;; মারে কি খবর শুনালি এটা। আমাদেরও ঘর আলো করে একটা ছোট্ট প্রাণ আসবে।
মেহরামের আম্মুর এমন হাসি+কান্না মিশ্রিত কন্ঠ শুনে সবাই তার কাছে আসেন। একে একে সবাই জানে মেহরামের বেপার টা। কারো খুশি যেন এখন ধরে না। তবে আকাশ কাদছে। এই ভেবে যে তাকে কেউ মামা বলে ডাকবে। কিন্তু সে এতো ছোট বয়সে মামা হতে চায় না 😅। মেহরামকে বলেছে যে সে তো এতোদিন রিকশাওয়ালা মামা, দারোয়ান মামা, ফুচকাওয়ালা মামা কেই মামা ডেকেছে এখন তাকে কেন মামা ডাকবে। মেহরাম তার কথা শুনে হাসে। তবে মেহরাম তাদের বলেছে যে তনু কে যেন তারা কিছুই না বলে মেহরাম নিজে বলবে তাকে। বাড়ির সবার সাথে অনেক কথা হয় মেহরামের। তবে তার চাচির সাথে কথা বলতে আজ কেন যেন মেহরামের একটু বাধছে। এটা কখনো হয় নি তার, কখনোই না। কিন্তু আজ কেন! ফোন তার চাচির কাছে দিলে তার চাচি সোজা হুহু করে কেদে ওঠে।
মেহরাম;; চাচি কথা বলো।
আতিয়া;; কি কি বলবো আমি। আমার তো খুশিই শেষ হচ্ছে না। (কেদে)
মেহরাম;; চাচি।
আতিয়া;; কে বলেছে যে আমার, আমার একটা মেয়ে আমার দুইটা মেয়ে। আর আমার নাতনিও আছে। আমার সবকিছু আছে।
মেহরাম বুঝতে পারলো যে তনুর মা না হতে পারার বেপার টা তার চাচির মাথা নাড়া দিয়ে উঠেছে। মেহরাম আর তনু কে কখনো আলাদা করে দেখেনি কেউই। কিন্তু তনুর বেপারের দুঃখ টা কোথাও না কোথাও চেপে রেখেছে। যা মেহরাম বুঝতে পারলো।
বাড়ির লোকদের সাথে অনেকক্ষণ কথা হয়, সোহেলের সাথেও তাদের অনেক আলাপ হয়েছে। শেষে ফোন কেটে দেয়। তারপর মেহরাম ফোন হাতে নিয়ে বাইরে বারান্দায় চলে যায়। তনুর ফোনে ফোন দিয়েছে। দুইবার বেজে ফোন কেটে যায়। এতে মেহরাম কিছুটা কপাল কুচকায়। কেননা তনুকে ফোন করার সাথে সাথেই সে ফোন ধরে। আরেকবার ফোন দেওয়াতেই তনু ফোন টা হাতে নেয়।
তনু;; হ্যালো।
মেহরাম;; কিরে কোথায় ছিলি ফোন দিচ্ছি তো।
তনু;; আরে ওইতো একটু কাজ ছিলো রে। কিন্তু এখন নেই এবার বল।
মেহরাম;; তনু,।
তনু;; হুম হুম কি হলো বল।
মেহরাম;; আমি প্রেগন্যান্ট।
তনু;;____________
মেহরান;; তনু।
তনু;; ____________
মেহরাম;; ওইই।
তনু;; তুই না মানে প্রেগন্যান্ট। আল্লাহ বইন এইটা কি শুনাইলি। সত্যি। মানে আমি, আমি খালামনি হবো। কিন্তু কেউ তো আমাকে বলেইনি কিছু। আর তুই কবে জানতে পেরেছিস। আগে বলিস নি কেন আমায়।
মেহরাম;; আরে আস্তে তো। এমন পাগল হলি কেন।
তনু;; হবো না। আমার তো মানে আমি কি করি, তুই মেহরু, মেহরু তুই মা হবি। বুঝতে পারছিস বেপার টা।
মেহরাম;; হ্যাঁ (মাথা নিচু করে)
তনু;; আরে আরে গলা এমন ফ্যাকাশে হয়ে গেলো কেন। কি হলো? তুই খুশি না!
মেহরাম;; আরে না তেমন না আমি অনেক খুশি।
তনু;; আর তার থেকেও আমি অনেক খুশি, আমার বোন প্রেগন্যান্ট। আমি ভাবতেও পারছি না। আমি তোকে বলতে পারবো না মেহরু আমি কতো টা খুশি।
বাড়ির সবাইকে বলতে হবে। আমি তো হুমড়ি খেয়ে পরবো। এই শোন আমি আজ আসবো তোর কাছে।
মেহরাম;; সত্যি?
তনু;; হ্যাঁ তিন সত্যি।
মেহরাম;; জলদি আসবি কিন্তু আর কণা কে নিয়ে আসিস। মেয়েটাকে অনেক দিন দেখি না।
তনু;; আচ্ছা আচ্ছা, শোন এবার রাখি বাসার সবাইকে বলতে হবে।
মেহরাম;; আচ্ছা আর আস্তে।
তনু ফোন কেটেই দেয় এক দৌড়। মেহরাম প্রথমে ভেবেছিলো যে তনুকে কি করে এই কথা টা বলবে। যদি তনু মন খারাপ করে বা মন ভার করে রাখে। কিন্তু মেহরামের ভাবনা কে পাল্টে দিয়ে তনু উল্টো খুশি। তাকে দেখে কেউ ভাববে যে মেহরামের থেকে সে বেশি খুশি হয়েছে এতে। তনু দৌড়ে সিড়ি দিয়ে নেমে তার শাশুড়ীর কাছে চলে যায়।
তনু;; মা মা মা,
লায়লা;; আরে পাগলি আস্তে ব্যাথা পাবি তো।
তনু;; আরে পেলে পেলাম। মা আমার বোন প্রেগন্যান্ট।
লায়লা;; কিহ মেহরাম?
তনু;; হ্যাঁ।
লায়লা;; আলহামদুলিল্লাহ,
কণা;; কি কি ভাবী মেহরুপু কনসিভ করেছে?
তনু;; হ্যাঁ।
কণা;; আল্লাহ, কি বলো।
তনু;; আমি না এখানে পরে যাবো খুশিতে।
বাড়িতে সবাই অনেক খুশি হয়েছে মেহরামের খবর শুনে। মেহরামের বাবার বাড়িতে, নিজের শশুড় বাড়িতে আর তনুর বাড়িতে যেন এক প্রকার খুশির ধুম পরে গেছে। সোহেলের যেন বারবার চোখ ভিজে আসছে। সোহেল আর তার মা হলরুমে বসে বসে কথা বলছে। কুসুম বেগম সোহেল কে কড়া অর্ডার দিয়েছেন যেন এই দিন গুলোর মাঝে মেহরামকে কোথাও একা না ছাড়ে। সবসময় তার সাথে থাকতে। এতে যদি চাকরি যায় যাক। কিন্তু মেহরামের সাথে থাকতে হবে। মেহরাম তাদের কাছ থেকে বলে কিছু কাজের ছুতো দিয়ে নিজের রুমে আসে। এসেই ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দেয়। দম যেন এতোক্ষণ আটকে আসছিলো তার। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। মাথা সাথে সাথে কিছুটা চক্কর দিয়ে উঠলে হাতের পাশে থাকা টেবিল টা ধরে কোন রকমে। কেন যে এমন হচ্ছে নিজের সাথে মেহরাম তা বুঝতে পারছে না। নিজের চোখের সামনে বারবার আয়ুশের মুখ টা ভেসেভেসে আসছে। ওই আয়ুশের তাকে জড়িয়ে ধরা, কপালে চুমু আকা, একসাথে হাসা, কতোই না গল্প করা। আয়ুশের সেই হুটহাট করেই ডাক দিয়ে ওঠা “মেহরু”। আয়ুশ যখন সিরিয়াস থাকতো তখন শুধু তার পুরো নাম ধরে ডাকতো। নতুবা না। মেহরাম ধপ করে নিচে বসে পরে। আর পারে না সে। সবার সামনে খুশি থাকতে থাকতে আর পারে না। আয়ুশের কথা তার খুব মনে পরছে। কিন্তু মুখ ফুটে তা তো আর কাউকে বলতে পারে না। ঘরের এক কোণে নিজেকে একদম গুটিয়ে রেখে মেহরাম অঝোরে কাদছে। ওদিকে তনু এবার তার রুমে চলে যায়। কাজ করতে করতে হঠাৎ তার মনে পরে যে সবাইকেই মেহরামের বেপারটা জানানো হয়েছে কিন্তু আয়ুশকে না। তনু ফোন টা হাতে তুলে নেয়।
তনু;; ধুর মনেই ছিলো না, আয়ুশকে তো বলাই হয় নি। (ফোন দিতে দিতে)
আজ অফিসে তেমন কোন কাজ নেই। যা মিটিং ছিলো তা সব আগেই কমপ্লিট হয়ে গেছে। আয়ুশ অফিসের করিডরে দাঁড়িয়ে ছিলো। এখানে খোলা বাতাস আছে, অন্যান্য দিনের থেকে আজ একটু বেশিই বাতাস। বাতাসে আয়ুশের ওপরের চুল গুলো উড়ে উড়ে যাচ্ছে। একদম ফরমাল গেটাপে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ তার ফোন বেজে ওঠলে তা হাতে নেয়। নিয়ে দেখে তনুর ফোন সে রিসিভ করে।
আয়ুশ;; হ্যালো তনু।
তনু;; হ্যাঁ আয়ুশ কি করছো?
আয়ুশ;; কিছুনা এমনি দাঁড়িয়ে আছি। তুমি কি করো?
তনু;; আমিও কিছুই না তবে নাচতে মন চাইছে।
আয়ুশ;; হাহা তাই। আচ্ছা নাচো। কিন্তু কোন খুশিতে?
তনু;; গেস করো তো?
আয়ুশ;; আমি কিভাবে গেস করবো। তুমি বলো?
তনু;; আয়ুশ আয়ুশ তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না। আমার খুশির আজ কোন কুল কিণারা নেই।
আয়ুশ;; তনু হয়েছে কি?
তনু;; আয়ুশ মেহরাম প্রেগন্যান্ট।
আয়ুশ;; _________________
তনু;; তুমি জানো মেহরাম আমাকে ফোন করেছিলো বলেছে সে প্রেগন্যান্ট, আমার মা বড়মা বাবা তারা যে কত্তো খুশি আয়ুশ তুমি ভাবতেও পারবে না। মা কণা বাবা ওরাও অনেক খুশি। আর সোহেল ভাই উনি তো পারছেন না কেদে দিতে। কিন্তু আসলে কি আর্মি তে কাজ করেন তো এর জন্যই আরো বেশি শক্ত পক্ত। কিন্তু এমনি অনেক ভালো একজন মানুষ। আচ্ছা শুনো তুমি জলদি এসে পরো না। আজ আমি মেহরামের বাসায় যাবো একটু, কণা আর মা কেও নিয়ে যাবো। বাবা তো বাইরে গেছেন। শুনো তুমি জলদি এসে পরো তোমাকেও সাথে নিয়ে যাবো।
আয়ুশ;; ____________________
তনু;; হ্যালো আয়ুশ…
আয়ুশ;; আব..হ্য হ্য হ্যাঁ শুনছি আমি।
তনু;; কোথায় হারিয়ে গেলে। কি বলেছি শুনেছো?
আয়ুশ;; হ্য হ্যাঁ শুনেছি, আর আমি না আসলে যেতে পারবো না তুমি মাকে আর কণাকে নিয়ে চলে যাও।
তনু;; কিন্তু চলো গিয়ে ঘুড়ে আসি ভালো লাগবে।
আয়ুশ;; তনু মানে বলছিলাম কি যে আমায় না এদিক টা সামলাতে হবে বুঝলে। তুমি চলে যাও।
তনু;; আচ্ছা তাহলে থাকো।
আয়ুশ;; আচ্ছা।
তনু ফোন কেটে দেয়। তনুর গলা শুনেই বুঝা যাচ্ছিলো যে সে কতো খুশি নিজের বোনের জন্য। আয়ুশ ফোন টা কেটে দিয়েই অন্য পাশে মুখ করে নেয়। কিছুটা এগিয়ে গিয়েই করিডরের রেলিং-এ হাত দিয়ে কিছুটা ঝুকে দাঁড়ায়। কয়েক সেকেন্ড এভাবে থেকে আবার সোজা হয়ে দাঁড়ায়। দুইহাত দিয়ে চোখ মুখ সব চেপে ধরে। মাথা যেন পুরো হ্যাং মেরেছে। কাজ করাই বন্ধ করে দিয়েছে। আয়ুশ তার কেবিনে চলে যায়। বাইরে মেনেজার কে বলেছে আগামীকাল দুই ঘন্টা যেন তার কেবিনে কেউ না প্রবেশ করে। আয়ুশ তার চেয়ারে বসে আছে দুইহাত এক করে। এসি ফুল স্পিডে দেওয়া আছে, এখন এই রুমে যে কেউ ঢুকলেই ঠান্ডায় বরফ হয়ে যাবে কিন্তু তবুও যেন আয়ুশের ভালো লাগছে না। দরদর করে ঘেমে যাচ্ছে। এসির রিমোট টা নিয়ে আরো পাওয়ার বাড়াতে চাইলে দেখে যে লাস্ট পাওয়ার এটাই আর নেই। রাগে আয়ুশ এসির রিমোট টাই এক আছাড় মেরে ভেংে ফেলে। তারপর দুই হাত দিয়ে নিজের মাথা চেপে বসে পরে। কয়েক মিনিট এভাবে থেকে হঠাৎ ঢুকরে কেদে ওঠে আয়ুশ।
আয়ুশ;; আমি তো এমন টা চাইনি। যা হচ্ছে, যেমন হচ্ছে এইসবের কিছুই না ই আমি আশা করেছিলাম আর না ই চেয়েছিলাম। মেহ..মেহরাম পপ্রেপ্রেগন্যান্ট। আমাকে ছাড়া অনেক খুশি আছো তাই না মেহরু, আর থাকবেই তো। আমি কে ছিলাম কি ছিলাম এগুলো কিছুই না। আর এখন অন্য কারো বউ, আমার অধিকার নেই। কিন্তু কি করবো আমি ভুলতে পারি না, পারবো না।
আয়ুশ এইসব বলে একদম আহাজারি করে কাদছে। আর এদিকে মেহরামের চোখ থেকে পানি পরতে পরতে নিজের জামার বুক ওরনা সব ভিজে গেছে। কতোক্ষণ যে এভাবে ছিলো খেয়াল নেই। খানিক পর দরজার কড়া নারলে মেহরাম আস্তে করে উঠে যায়। চোখ মুখ মুছে স্বাভাবিক ভাবেই দাঁড়িয়ে পরে। দরজা খুলেই দেখে নিলা দাঁড়িয়ে আছে।
মেহরাম ছুটে চলে যায় নিচে। গিয়েই দেখে তনু কনা আর তনুর শাশুড়ী সবাই বসে আছে। মেহরাম নিচে চলে যায়। আজ কেন যেন মেহরাম ভারী বেহায়া হয়ে গেছে। তনু তার মা আর ননদ এসেছে কিন্তু তবুও মেহরামের চোখ দুটো অন্য আরেকজনকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। মূলত আয়ুশ কে। সে ভেবেছে যে যদি আয়ুশ আসে আর একটা বার শুধু একটা বার তাকে দেখতে পারে। ওইযে বেপার টা কিছু এই রকম যে মুখে তো হাজার কথাই বলা যায় কিন্তু ভেতরের টা আর কইজনই বা দেখেতে-শুনতে পারে। মেহরাম গিয়ে দেখে শুধু তারা তিনজনই। মেহরামের শুধু বাইরে তাকাতাকি করছে। ভেবেছে হয়তো আয়ুশ এসেছে। এদিকে সবাই তার সাথে কথা বলছে কিন্তু তার নজর বাইরে। বেকুল হয়ে খুঁজে যাচ্ছে।
তনু;; মেহরু (জড়িয়ে ধরে)
মেহরাম;; হ্য হ্যাঁ।
তনু গিয়ে মেহরামকে জড়িয়ে ধরে। তনুর শাশুড়ীও মেহরাম কে খুব আদর করে। কণা তো মেহরামকে ছেড়ে আসতেই চাইছে না। তারা বসে আছে। খুব গল্প করছে। মেহরামের পাশে সোহেলও বসে আছে। তনুর শাশুড়ী আর মেহরামের শাশুড়ী মেহরামকে নিয়ে প্লেনিং শুরু করে দিয়েছে। তাকে এই করবে সেই করবে। মেহরামের এই খবর শুনে কারো মনই খারাপ হয় নি। তনুর শাশুড়ী তো বলেই দিয়েছে যে নাতনি কিন্তু আমারও। বাড়ির সবাই খুশি। আবার কারো না চাইতেই খুশি থাকতে হচ্ছে।
এভাবেই দেখেতে দেখতে আরো এক মাস কেটে যায়। এর মধ্যে সোহেল দুইবার বাইরে গিয়ে কয়েকদিন থেকে কাজ করে আবার এসে পরেছে। একদিন মেহরাম শুয়ে ছিলো আর সোহেল মেহরামের সাথে বসে আছে। কিন্তু পরক্ষণেই যা হলো তার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলো না।
।
।
।
।
🦋চলবে~~
#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ১২
❤️🥀
.
.
.
.
সোহেল হঠাৎ করেই কেশে ওঠে। তাও যেনতেন কাশি না, বুকের পাশে হাত দিয়ে প্রচুর পরিমাণে কাশছে। সোহেলের এমন অবস্থা দেখে মেহরাম তড়িঘড়ি করে উঠে তার কাছে যায়। সোহেলের পিঠে ঘষে দিচ্ছে তবুও থামার নাম নেই। মেহরাম একগ্লাস পানি এনে সোহেল কে দিলো কিন্তু সে তা খেতে পারে না। কাশির পরিমাণ যেন আগে থেকে আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেলো। সোহেল এবার জলদি করে ওয়াসরুমের দিকে ছুট লাগায়। মেহরামও তার পিছু পিছু যায়। এবার বেছিং-এ কিছুটা ঝুকে কাশতেই থাকে। সোহেল টিস্যু চাইলে মেহরাম দ্রুত তার দিকে একটা টিস্যু এগিয়ে দেয়। সেটা মুখে নিয়ে কাশতে থাকে সোহেল। কয়েক সেকেন্ড পর টিস্যু মুখের সামনে থেকে এনে পরলে দেখে তাতে গাঢ় রক্ত লেগে আছে। এটা দুজনেই দেখেছে। সোহেল দেখে মুখ কুচকিয়ে ফেলে আর মেহরাম তো এক প্রকার আতকে উঠে।।
মেহরাম;; এএএটা ককি। রক্ত রক্ত কেন?
সোহেল;; বুঝলাম না কিভাবে বের হলো (কাশতে কাশতে)
মেহরাম;; আপনাকে আমি আগেই বলেছিলাম যে চলুন ডাক্তারের কাছ যাই ডাক্তারের কাছে যাই কিন্তু না আপনি আমার কথা শুনেন নি।
সোহেল;; আমি তো…
সোহেল আর কথাই বলতে পারলো না তার সাথে সাথে আবার কাশি শুরু। এবার মেহরাম বেশ চিন্তায় পরে গেলো। আর এখনো রক্ত বের হচ্ছে মুখ দিয়ে। মেহরাম কোন রকমে সোহেল কে ধরে ধরে রুমে নিয়ে এলো। তারপর শুইয়ে দেয়।
মেহরাম;; এখন শুয়ে একটু রেস্ট নিন বিকেলের দিকে আমার সাথে ডাক্তারের কাছে যাবেন।
সোহেল;; কিন্তু আমি…
মেহরাম;; একটা কথাও বলবেন না আপনি।
এই বলে মেহরাম সোহেলের পাশেই বসে পরে। সোহেল চোখ গুলো বন্ধ করে শুয়ে আছে। তবে এবার মেহরাম খেয়াল করলো যে ইদানীং সোহেল কেমন যেন হয়ে গেছে। ভালোভাবে লক্ষ্য করলে বুঝা যায় সোহেলের চাপা কেমন ভাংগা ভাংগা, চোখের নিচে গাঢ় কালো দাগ। যেখানে সোহেল অতিমাত্রায় ফর্সা ছিলো। চোখ মুখ কেমন মলিন একটা ভাব। মেহরাম সোহেলের কপালে হাত দিয়ে দেখে, না জ্বরও নেই। তাহলে এমন শরীর খারাপ কেন হলো।
যাই হোক দেখতে দেখতে বিকেল হয়ে এলো। কুসুম বেগম কে বলেছেন একটু তারা দুজন বাইরে যাচ্ছে। সোহেল আর মেহরাম সোজা হস্পিটালের চলে যায়। এর মধ্যে সোহেল অনেক বার বারণ করেছে যে হস্পিটালে যাবার কি দরকার কিন্তু তা তো আর হয় না। মেহরাম সোহেল কে নিয়ে ডাক্তারের কেবিনে গেলে সবার আগেই ডাক্তার দেখেন সোহেলের মাঝে কেমন এক মলিন ভাব। কিন্তু যখন বলা হলো যে সোহেল আর্মি তে জব করে তখন যেন ডাক্তার কিছুটা অবাকই হলেন। আর যে কেউই অবাক হবে। কারণ তারা সাধারণত এমন থাকে না। ডাক্তারও এবার সিরিয়াস হয়ে বসলেন। যা যা প্রব্লেম ছিলো তার সব মেহরাম ডাক্তার কে খুলে বললো। ডাক্তার হয়তো কিছু একটার আন্দাজ পেয়েছেন। উনি প্রায় অনেক গুলো টেস্ট দিলেন। মেহরাম সোহেল কে নিয়ে গেলো। সেইদিনই একে একে সকল টেস্ট গুলো করে ফেললো। তবে এবার এলো ব্লাড টেস্টের পালা। আর যিনি পেসেন্টের এগুলো টেস্ট করিয়ে দেন উনি সোহেলের কাছে এলেন ব্লাড নিবেন বলে। কিন্তু তিনি আরেক দফা অবাক হলেন। কেননা সোহেলের বডি তে পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্লাড নেই। মানে সে রক্তশূন্যতা ভুগছে। মেহরাম এবার চিন্তিত হয়ে পরলো। তবে যেভাবেই হোক ব্লাড নিলো। সকল টেস্ট করানো শেষ হলে মেহরাম আর সোহেল এসে পরে। কেননা তখন ভারি রাত হয়েছিলো আর ডাক্টার ছিলো না তাই তাদের আগামীকাল যেতে হবে। বাসায় এসে সোহেলের অবস্থা যেন আরো বেশি বিগড়ে গেলো। কাশিও দিচ্ছে অনেক বেশি। মেহরাম সোহেলের অনেক দেখভাল করছে। একটু কিছু খেয়েই সোহেল উঠে যায়। কুসুম বেগম সোহেলের কথা মেহরামকে জিজ্ঞেস করলে মেহরাম মুচকি হেসে বলে “কিছু না মা তুমি খাও”। পরেরদিন মেহরাম আর সোহেল উঠে আবার হস্পিটালের উদ্দেশ্যে চলে যায়।
এখন মেহরাম আর সোহেল বসে আছে ডাক্তারের কেবিনে। ডাক্তার ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখলো। কিন্তু রিপোর্টে তেমন কিছুই নেই। নরমাল রিপোর্ট।
মেহরাম;; ডক্টর, কি হয়েছে? রিপোর্টে কি এসেছে?
ডাক্তার;; রিপোর্টে কিছুই আসে নি। স্বাভাবিক কিছু ধরা পরেছে মাত্র যেমন জ্বর, ঠান্ডা, কাশি, আর হ্যাঁ রক্তশূণ্যতা। আর মিস্টার সোহেলকে দেখে কেউ বলবে না যে তার মাঝে শুধু এই রোগ গুলোই রয়েছে।
মেহরাম;; মানে আর কি হবে ডাক্তার? এগুলোই তো আর কিছু হয় নি তো (কপাল কুচকে চিন্তিত হয়ে)
ডাক্তার;; দেখুন মিসেস মেহরাম আপনি চিন্তা করবেন না। এককাজ করুন আপনি আবার উনাকে টেস্ট গুলো করান। এতে ধরা পরতে পারে যে আসলে উনার হয়েছে কি। কারণ অনেক রোগ আছে যেগুলো সহজে ধরা পরতে চায় না। তো টেস্ট গুলো আরেকবার করান।
মেহরাম;; জ্বি আচ্ছা।
মেহরাম সোহেলকে নিয়ে এসে পরে। সোহেল মেহরাম কে এইসব করতে বারবার না করছে কিন্তু মেহরাম তো শোনার পাত্রি না। সে আবার চলে যায় টেস্ট গুলো করাতে। এবার সবার আগে ব্লাড টেস্ট করানো হয়। কিন্তু সোহেলের বডি তে রক্ত যেন এক প্রকার নেয়-ই। ইঞ্জেকশন দিয়ে ব্লাড নেওয়া এক প্রকার অসম্ভব তাই এবার আর কোন উপায় না পেয়ে ক্যানোলা লাগানো হয়েছে। আর তার মাধ্যমে রক্ত নেওয়া হয়েছে। তবুও রক্তের পরিমাণ খুবই অল্প। অতঃপর সব টেস্ট করা শেষ হলে আবার মেহরাম আর সোহেল ডাক্তারের কেবিনে যায়। ডাক্তার এবার রিপোর্ট হাতে নিয়ে খুব মনোযোগ সহকারে দেখেন। উনার চোখে যে মোটা ফ্রেমের চমশা টা ছিলো তা খুলে ফেলে। কিন্তু এবার যেন আর মেহরামের ভালো লাগছে না। বেকুল ভাবে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে আছে। ডাক্তার রিপোর্ট টা হাতে রেখে সামনে দুহাত ভাজ করে বসেন। এদিকে সোহেলও বেশ চিন্তিত যে কি হয়েছে তার।
মেহরাম;; ডক্টর এবার কি হয়েছে, রিপোর্টে কি এসেছে??
ডাক্তার;; ইট”স্ ক্যান্সার।
ডাক্তারের এই কথা বলার সাথে সাথে মেহরাম আর সোহেল চুপ মেরে গেলো। কেবিনে বিরাজ করছে পিনপতন নীরবতা।
মেহরাম;; মমমানে কি এইসবের। হুয়াট ডু ইউ মিন বাই ক্যান্সার। ননা এটা না, আমি সিওর ডক্টর রিপোর্টে হয়তো ভুলভাল কিছু একটা এসেছে। ভুয়া সবকিছু। এমন টা হবেই না। ডক্টর আমরা বরং আরেকবার চেকাপ করিয়ে আনি কেমন তারপর পাক্কা কনফার্ম হবো।
মেহরাম উঠে যেতে চাইলেই সোহেল আবার তার হাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে দেয়। মেহরাম এক নয়নে সোহেলের দিকে তাকিয়ে আছে। সোহেল সামনের দিকে তাকিয়ে থেকেই মেহরামের হাত ধরে বসিয়ে দেয়।
সোহেল;; ডাক্তার আপনি সিওর এটা ক্যান্সার?
ডাক্তার;; দেখুন মিস্টার সোহেল আমি বুঝতে পারছি যে বেপার টা কতো টা কষ্টদায়ক কিন্তু এটা সত্যি। বিশ্বাস না হলে ইউ ক্যান চেক দি রিপোর্ট। আর এটা একদম লাস্ট স্টেজে আছে। কিন্তু এতোদিন ফুটে ওঠেনি। আর ভেতরে থাকতে থাকতে এটা এক মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।
মেহরাম যেন এবার এখানেই পরে যাবে এমন একটা অবস্থা। মাথা পুরো কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। সে ভেবেছিলো যে সোহেলের হয়তো ছোটখাট কিছু হয়েছে কিন্তু এখানে এসে যে সে এমন কিছু একটা শুনবে তার বিন্দুমাত্র ধারণাও তার ছিলো না। এখন প্রায় সপ্তাহে একদিন করে হলেও সোহেল কে চেকাপের জন্য আনতে হবে। সোহেল আর মেহরাম এসে পরে। মেহরাম যেন এখন এক মূর্তি হয়ে গিয়েছে। হু হা কিছুই করছে না। সারাটা রাস্তা এসেছে চুপ থেকেই। সোহেল তাকে কতো কথাই না বলছে কিন্তু মেহরাম কিছুই না। এক সময় বাসায় এসে পরে তারা। এসেই দেখেন কুসুম বেগম বসে আছেন। তিনি মেহরাম কে কিছু জিজ্ঞেস করলে মেহরাম কিছুই বলে না। যেন রোবট, সোজা নিজের ঘরে চলে আসে। কুসুম বেগম এতে অবাক হন, কেননা মেহরান এর আগে কখনোই এমন করেনি। সোহেল তার মাকে কিছু একটা বলে সেও ঘরে চলে যায়। গিয়েই দেখে মেহরাম বিছানার ওপর হতাশ ভাবে বসে আছে। সোহেল গিয়ে মেহরামের সামনে এক হাটু ভাজ করে বসে পরে। এখনো মেহরাম মাথা নিচু করেই রয়েছে।
সোহেল;; মেহরাম!
মেহরাম;;__________
সোহেল;; মেহরাম..!
মেহরাম;;__________
সোহেল এবার তার দুহাতে মেহরামের গাল গুলো ধরে ফেললো। মেহরাম চোখ তুলে তাকাতেই সোহেল দেখে তার চোখে পানি গুলো টলমল করছে যেন এই পরে গেলো।
সোহেল;; আমাদের বিয়ের প্রথম রাতে আমি তোমায় একটা কথা বলেছিলাম, মনে পরে কি??
মেহরাম;; ___________
সোহেল;; আমরা স্বামী-স্ত্রী ছাড়াও আরেকটা সম্পর্কে আছি। আজীবন থাকবো। বন্ধু, বেস্টফ্রেন্ড। তো আর যে কটা দিন রয়েছে জীবনে সেই দিন গুলো বেস্টফ্রেন্ড হিসেবে কাটিয়ে দেই আমরা।
মেহরাম এবার মাথা তুলে সোহেলের দিকে তাকায়। আর সোহেল তখন বাচ্চামো করে বলে ওঠে “প্লিজ”। এবার যেন মেহরামের বাধ ভেংে গেলো। সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। ফট করে সোহেল কে জড়িয়ে ধরেই হাউমাউ করে কেদে দেয়। সোহেলও তার চোখ দুটো বন্ধ করে নেয়।
মেহরাম;; কেকেন এএমন হলো। আমি এএবার কি করবো। ক্যান্সার আমি, আমি ভাবতেও পারি নি যে এমন একটা কিছু ধরা পরবে। আপনার কিছুই হবে না, হতে পারে না। আপনি ঠিক আছেন। সবাই মিথ্যা বলছে। আমি, আমি মাকে কি জবাব দিবো। মাকে বললে উনি একদম ভেংে পরবেন। সোহেল, আমি প্রেগন্যান্ট। বুঝতে পারছেন আপনি। আমি কি বলবো। কি করবো আমি।
মেহরাম তো প্রায় পাগল হয়ে যাচ্ছে। সোহেল তার পিঠে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে চুপ করিয়ে দেয়। আর মেহরামও এক সময় একদম চুপ হয়ে পরে। সোহেল মেহরাম মেহরাম বলে কয়েকবার ডাক দিলে কোন সাড়াশব্দ আসে না। সোহেল আস্তে করে মেহরামকে তুলে সামনে আনলে দেখে মেহরাম অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। চোখের পানি গুলো এখনো জ্বলজ্বল করছে। সোহেল দ্রুত তার মাকে ডাক দেয়। তারপর কুসুম বেগম জলদি করে ঘরে এসে পরলে দেখে মেহরামের এই অবস্থা। তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে যে কতো পরিমাণে ভয় পেয়েছে আর টেনশন নিয়েছে। সোহেল হাত ধরে মেহরামের পাশে বসে আছে। সোহেল খেয়াল করে যে এই অচেতন অবস্থাতেও মেহরামের বাম হাত টা তার পেটের ওপর রেখে দিয়েছে। তবে আশ্চর্যজনক ভাবে সোহেলের যে এতো বড়ো একটা রোগ ধরা পরেছে তাতে তার কোন মাথা ব্যাথাই নেই। এর মানে খুঁজে পায় না সোহেল। তার প্রায় ১৫-২০ মিনিট পর মেহরামের জ্ঞান ফিরে আসে। আর চোখ খুলতেই দেখেতে পারে সোহেল তার পাশে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। চোখ গুলো বন্ধ করে রেখেছে। কি যেন মনে করে সোহেল তার চোখ মেলে তাকায়। আর মাথা ঘুড়িয়ে তাকিয়ে দেখে মেহরাম তার দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে।
সোহেল;; উঠেছো।
মেহরাম;; হুম।
মেহরাম উঠে বসে পরে।
সোহেল;; বেশি কাদবে না, এতো কান্না কোথা থেকে আসে। তুমি কাদলে বেবির কষ্ট হবে না। তো এখন থেকে কান্নাকাটি বন্ধ।
সোহেল এই কথা বলেই উঠে নিতে চাইলে মাথায় হাত দিয়ে আবার বসে পরে। মেহরাম এবার জলদি করে সোহেল কে ধরে।
মেহরাম;; শরীরের অবস্থা বেশি ভালো না জানেন। তবুও কেন কাজ করতে যান। সব আমি করবো আপনি এখানে বসুন।
মেহরাম ধরে ধরে সোহেলকে বসিয়ে দেয়। এখন দুপুর টাইম আর সোহেল সকালে তেমন কিছু খায় নি। মেহরাম খাবার আনতে যেতে ধরলে সোহেল হঠাৎ মেহরামের হাত ধরে ফেলে। মেহরাম ঘুড়ে পেছনে তাকায়।
সোহেল;; মেহরাম, প্লিজ মাকে কিছুই বলো না।
মেহরাম তাকিয়ে দেখলো সোহেলের চোখে পানি স্পষ্ট। মেহরাম তার চোখের পানি পরার আগেই সেটা মুছে ফেলে।
মেহরাম;; হুম।
সোহেল মেহরামের হাত ছেড়ে দিলে মেহরাম দ্রুত নিচে চলে যায়।
।
।
।
।
চলবে~~
#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ১৩
🖤✨
.
.
.
.
সময় গড়িয়ে দিন যেতে থাকে। কিন্তু সবার পরিস্থিতি যেমনের তেমনই। ওই যে বলে না কৃত্রিম সুখ-হাসি মুখে না চাইতেও রাঙিয়ে রাখতেই হয়। মেহরামের বাবার বাড়ি, তনুর বাড়িতে হাসি খুশি লেগেই আছে। কিন্তু মেহরামের বাড়িতে নেই। যেন সুখ তার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে মেহরামের কাছ থেকে। সোহেল আগে থেকে আরো বেশি রোগা হয়ে গেছে। বাইরে আর আগের মতো যায় না। সোহেলকে মাঝে মাঝে মেহরামের খাইয়ে দিতে হয়। সোহেলের সবকিছু মেহরাম তার নিজ হাতে সামলায়। কুসুম বেগম কেও ইদানীং বেশ চিন্তিত দেখায়। কিন্তু মেহরাম কোন রকমে এড়িয়ে যায়। মেহরামের প্রেগন্যান্সির তিন মাস গড়িয়ে এবার চার মাসে পরবে। সব কিছুর চিন্তা একসাথে মাথায় নিয়ে ঘুড়ে সে। মেহরামের চোখের নিচেও গাঢ় কালো দাগ, কেমন একটা ফ্যাকাশে ভাব। মেহরাম তার রুমে বসে বসে কাজ করছিলো আর সোহেল করিডরে দাঁড়িয়ে ছিলো।
মেহরাম;; আপনি কি রুমে আসবেন। কখন থেকে বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন, রুমে আসুন।
সোহেল;; আসছি।
মেহরাম;; খাবেন কিছু এনে দিই (কাপড় ভাজ করতে করতে)
সোহেল;; না।
মেহরাম;; চুল গুলো কেমন উষ্কখুষ্ক হয়ে আছে। ঠিক করুন (সোহেলের দিকে তাকিয়ে)
সোহেল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পরলো। তবে এখন সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভালোভাবে দেখছে। আয়নার পাশেই তার আর্মির গেটাপে একটা ছবি রয়েছে। দুহাত ভাজ করা, মুখে ঝুলছে বিরাট হাসির রেশ। ছবি টা থেকে চোখ সরিয়ে আবার আয়নাতে নিজের দিকে তাকায় সোহেল। তখনকার আর এখনকার সময়ে তার মাঝে রাত-দিন তফাৎ। ক্যান্সারে এটাই সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণাদায়ক। নিজের রুপ-রঙ, স্বাস্থ্য, শক্তি-বল সব কেড়ে নেয় সব। সোহেল হাতে একটা চিরুনি তুলে নিয়ে চুল গুলো আচড়াতে থাকে। তবে দু-একবার আচড়াতেই একদম চিরুনি ভরে একগাদা চুল ঝড়ে আসে। সোহেল কতোক্ষন তাকিয়ে থাকে…
সোহেল;; মেহরাম..!
মেহরাম;; জ্বি।
সোহেল;; দেখো না,
মেহরাম;; কি হয়েছে? (সোহেলের পাশে এসে)
সোহেল;; চুল ঝড়ছে।
মেহরাম সোহেলের দিকে তাকিয়ে দেখে সে এক হাতে চিরুনি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে তার মাথার চুল অনেক বেশি ঘন তাই এখনো মাথার চামড়া দেখা যায় নি। মেহরাম তাকিয়ে দেখলো সোহেলের মুখটা কেমন মলিন হয়ে গেছে। কেননা তার এই চুল গুলো তার খুব বেশি পছন্দের। সোহেলের যেন মন খারাপ না হয় তাই দ্রুত মেহরাম বলে ওঠে…
মেহরাম;; আব..ননা না চুল আসলে ঝড়ছে। আরে মানে চুল তো এমনিতেই ঝড়ে তাই না। আমারও ঝড়ে, এটা নরমাল। আপনি এদিকে দিন আমি চুল আচড়ে দিচ্ছি।
মেহরাম নিজে আলতো ভাবে চুল গুলো আচড়ে দিলো। সোহেল বিছানাতে বসে ছিলো। মেহরাম তার সাথে টুকটাক কথা বলছে আর স্যুপ ঘাটছে। ঘোটা শেষ হলে বিছানার এক কোণায় বসে সোহেল কে আস্তে আস্তে খাইয়ে দিতে থাকে মেহরাম। খাওয়ার মাঝেই সোহেল বলে ওঠে….
সোহেল;; মেহরাম, আমার না বাসায় মোটেও ভালো লাগছে না জানো।
মেহরাম;; বাড়ির সাইডে একটু হাটবেন, নিয়ে যাবো?
সোহেল;; চলো না বাইরে যাই কোথাও।
মেহরাম;; আপনি যা…
সোহেল;; যেতে পারবো আমি। যাবে!
মেহরাম;; অবশ্যই যাবো। আপনি রেডি হয়ে নিন আর আমি বাটি টা নিচে রেখে আসি।
সোহেল;; আচ্ছা।
মেহরাম নিচে চলে যায়। আর সোহেল এদিকে রেডি হতে শুরু করে। মেহরাম কে দেখেই তার শাশুড়ি বলে ওঠে…
কুসুম;; কিরে মা সোহেল কোথায়?
মেহরাম;; মা ওপরেই আছে।
কুসুম;; ছেলে টা আমার পালটে গেলো। আগের মতো আর আমার কাছে আসে না।
মেহরাম;; না মা তেমন কিছুই না।
সোহেল;; কে বলেছে আমি পালটে গেছি (নিচে নামতে নামতে)
মেহরাম;; আপনি, আপনি নিচে কেন এসেছেন শরীর তো ভালো না (আস্তে করে সোহেলের কাছে গিয়ে)
সোহেল;; প্রব্লেম নেই। আমি পারবো।
কুসুম;; পাল্টেই তো গেছিস, কথাও বলিস না আগের মতো।
সোহেল;; তুমি ভুল বুঝছো মা, আমার লাইফে সবথেকে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট তুমি। (পেছন থেকে তার মা কে জড়িয়ে ধরে)
কুসুম;; হয়েছে হয়েছে থাক।
সোহেল;; আচ্ছা মা শুনো না!
কুসুম;; হ্যাঁ বল।
সোহেল;; আমার না বাসায় খুব খারাপ লাগছে, আমি একটু মেহরাম কে নিয়ে বাইরে যাবো।
কুসুম;; ওমা এতে বলার কি আছে, আরে যা যা ঘুড়ে আয় ভালো লাগবে। মেহরাম মা এইসব রাখ নিলা কে দিয়ে আমি করিয়ে নিবো তুই সোহেলের সাথে যা।
মেহরাম;; মা প্রায় শেষ কাজ গুলো, একদম করেই যাচ্ছি।
সোহেল এতোক্ষণ হলরুমে বসে বসে তার মায়ের সাথে কথা বলছিলো। আর মেহরাম হাতের কাজ গুলো শেষ করে আসতেই সোহেল আর সে মিলে বের হয়ে পরে।
মেহরাম;; গাড়ি নিবো?
সোহেল;; না, আজ আমরা হুড তোলা রিকশায় করে ঘুড়বো।
মেহরাম;; আচ্ছা আমি না কখনো বুঝি না।
সোহেল;; কি?
মেহরাম;; এই যে আপনার মতো একজন মানুষ কে কেউ কি করে আর্মিতে নিলো।
মেহরামের কথায় সোহেল কপাল কুচকে তার দিকে তাকায়।
সোহেল;; মানে?
মেহরাম;; না মানে আমি শুনেছি যে আর্মি তে যারা থাকে তারা নাকি অনেক বেশি খিটখিটে, বদমেজাজি আর কষটে টাইপের হয়। কিন্তু আপনি তার বিপরীতে।
মেহরামের কথা শুনে সোহেল কিছুটা জোরেই হেসে দেয়।
সোহেল;; সবাই তো আর এক না তাই না।
মেহরাম;; হুমম বুঝলাম, আচ্ছা কোথায় যাবেন?
সোহেল;; দেখি কোথায় যাওয়া যায়।
সোহেল আর মেহরাম একটা রিকশায় উঠে পরে। রিকশা যাচ্ছে আপন গতিতে। হঠাৎ করেই সোহেল মেহরাম কে বলে ওঠে…
সোহেল;; মেহরাম!
মেহরাম;; হুমম।
সোহেল;; একটা কথা বলবে!
মেহরাম;; জ্বি, কি কথা?
সোহেল;; জানো তো আমাদের সবার জীবনেই ভালোবাসা নামক শব্দ টা আসে। হোক তা অতি তাড়াতাড়ি বা অতি দেরিতে কিন্তু আসে ঠিকই। যারা ভাগ্যবান হয় তারা পেয়ে যায় আর যাদের ভাগ্যেই না থাকে তারা পায় না।
মেহরাম;; আপনি এই কথা গুলো কেন বলছেন?
সোহেল;; তুমি ভালোবাসতে কাউকে তাই না!!
সোহেলের মুখ থেকে এমন কথা শুনে যেন মেহরামের দম আটকে আসছে। সে জোরে জোরে কিছু দম ছেড়ে সোহেল কে বলে ওঠে…
মেহরাম;; দেখুন আপনিই তো বললেন যে ভালোবাসলেও অনেকে তা পায় না। হয়তো আমিও সেই অভাগাদের মধ্যেই একজন ছিলাম। যাজ্ঞে চলুন নেমে কিছুক্ষণ হাটি।
সোহেল;; হ্যাঁ চলো।
সোহেল আর মেহরাম নেমে পরে রিকশা থেকে। রাস্তায় একটা ছেলেকে দেখে বাদাম বিক্রি করছে সেখান থেকে মেহরাম বাদাম কিনে আনে। ছেলে টাকে তার বাদামের দামের থেকে আরো বেশ কিছু টাকা দিলো মেহরাম। কিন্তু হঠাৎ ছেলে টা মেহরামকে খুব ভালোভাবে দেখে তারপর বলে…
ছেলে;; আরে আপু, আপনি মেহরাম আপু না?! (কপাল কুচকে)
মেহরাম;; হ্যাঁ, কিন্তু তুমি কি করে চিনলে??
ছেলে;; আরে আমারে চিনলেন না। আমি শিমুল। আপনি ওই যে ওই সামনের ভার্সিটি টাতে পড়তেন না?
মেহরাম;; হ্যাঁ আরে তুই, আমি তো তোকে চিনতেই পারিনি। বেশ বড়ো হয়ে গেছিস তো। আগে তো তোর ফোকলা দাত ছিলো এখন নেই।
শিমুল;; ফোকলা দাতের কথা ভুলেন নাই এহনো।
মেহরাম;; না, তা কেমন আছিস তুই?
শিমুল;; জ্বি ভালাই। ইনি কে (সোহেল কে দেখিয়ে)
সোহেল;; আমি, আমি হলাম তোমার মেহরাম আপুর বেস্টফ্রেন্ড।
শিমুল;; বেস্টফেরেন্ড।
সোহেল;; হ্যাঁ হ্যাঁ ওইটাই। (হেসে)
মেহরাম;; আপনি এখানে বসবেন?
সোহেল তাকিয়ে দেখে কিছু দূরেই একটা ভার্সিটি রয়েছে। আর এখানে গোল চত্ত্বরের মাঝে বিশাল জায়গা ধারণ করে রয়েছে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। গাছ থেকে বেশ কিছু ফুল পরে গাছের নিচটা একদম রাঙিয়ে তুলেছে। ভারী সুন্দর জায়গা টা। সোহেল আর মেহরাম গিয়ে বসে পরে। মেহরাম সোহেল কে বাদাম ছুলে দিচ্ছে আর সোহেল সেগুলো খাচ্ছে।
সোহেল;; তুমি এই ভার্সিটিতে পড়তে মেহরাম?
মেহরাম;; হ্যাঁ।
সোহেল কে বাদাম গুলো দিয়ে মেহরাম তার ভার্সিটির গেটের দিকে তাকায়। যদি এখন এখানে কেউ না থাকতো তাহলে হয়তো মেহরাম এবার হাউমাউ করে একদম কেদেই দিতো। এক আলাদা মায়া কাজ করছে তার মাঝে। এতো গুলো বছর পর হঠাৎ করেই নিজের ভার্সিটি কে দেখে পুরোনো স্মৃতি গুলো যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। কতোই না স্মৃতি জড়িয়ে আছে তার এই জায়গা টার সাথে। তনু, উর্মি, বাবলি সবার কথাই মনে পরে গেলো। ভার্সিটির বাইরে এখন তালা দেওয়া হয়তো ক্লাস নেই। নিজের দাত দিয়ে ঠোঁট গুলো কামড়ে ধরলো মেহরাম। কান্না দমানোর ব্যার্থ চেষ্টা। বছর পেরিয়ে চোখের সামনে হঠাৎ করেই এমন কিছু একটা ভেসে উঠলে বুকের ভেতরে তো তোলপাড় শুরু হবেই। মেহরামের শিরদাঁড়া গুলো তে যেন এক শিহরণ বয়ে গেলো। তনু আর সে এই মাঠে বসেই কতো না আড্ডা দিয়েছে। আয়ুশ আর তার বন্ধুদের আড্ডা দেবার জন্য একটা জায়গা নির্দিষ্ট করা ছিলো। কিন্তু আজ, আজ সেই জায়গা টা একদম ফাকা। যে জায়গা টা বন্ধুদের হাসি-তামাশায় মেতে থাকতো সেই জায়গা টা আজ নিতান্তই শূন্য। শুধু রয়ে গেছে বেশ কিছু স্মৃতি। আয়ুশের কথাও মনে পরে গেলো। এগুলোই হয়তো সত্য। কিন্তু এই ক্ষুদ্র সত্য গুলো মানতেও যে ভারী কষ্ট হয়। হঠাৎ মেহরামের কানে কিছু বাচ্চার খিলখিল করে হাসির শব্দ এলো। মেহরাম তাকিয়ে দেখে ৫ বছরের দুটো ছোট ছোট মেয়ে একে ওপরের পিছে দৌড়ে দৌড়ে খেলছে। মেহরামের মুখে অজান্তেই হাসি ফুটে ওঠে। তনুর কথা মনে পরে যায় তার। এখানকার বাতাসে কেমন একটা সুগন্ধ মিশে আছে। চারিদিকে মৌ মৌ একটা ভাব। মেহরাম অপলক ভাবে সেদিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ সোহেলের কথায় মেহরামের হুস ফিরে।
সোহেল;; মেহরাম!
মেহরাম;; জজজ্বি।
সোহেল;; আগের দিনের কথা গুলো মনে পরছে?
মেহরাম;; হ্যাঁ কিছুটা সেরকমই।
মেহরাম আর সোহেল সেখানে বসে বসে কথা বলছিলো। আর অন্যদিকে আজ আয়ুশের অফিস থেকে জলদি ফিরতে হয়েছে। মানে অফিস কাজ শেষ তাই বাসায়। কিন্তু সচারাচর আয়ুশ যেই রাস্তা দিয়ে বাসায় যায় সেই রাস্তা আজ বন্ধ কাজ চলছে তাই তাকে অনেক টাই ঘুরে তারপর যেতে হচ্ছে বাসায়। রাস্তা ঘুড়তে ঘুড়তে আয়ুশ কখন যে তার ভার্সিটির সামনের রাস্তায় এসে পরেছে তার দিকে তার কোন খেয়াল নেই। গাড়ি টান দিয়ে সোজা সে চলে গেলো। কিন্তু হুট করেই আবার তার গাড়ি টা থামিয়ে দিলো। আয়ুশের কেমন যেন কিছুটা ঘোলাটে লাগে। সে ধীরে ধীরে গাড়িটা আবার পেছনের দিকে নিয়ে আসে। তারপর গাড়ির বাম পাশের উইন্ডো টা খুলে দেয়। আয়ুশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে মেহরাম আর তার পাশে সোহেল। তারা একসাথেই বসে অনেক কথা বলছে। মুখে হাসি রয়েছে। আয়ুশ দূর থেকে তাদের দেখে মলিন হাসে। কয়েক মিনিট তাদের দেখে আয়ুশ গাড়ি নিয়ে আবার এসে পরে। এবার মেহরাম আর সোহেল কথা বলতে বলতে হঠাৎ মেহরাম বেশ ঘাবড়ে গিয়ে বলে ওঠে…
মেহরাম;; আরে রিপোর্ট..
সোহেল;; কি??
মেহরাম;; আরে গতকাল আপনার চেকাপ করালাম না তারপর তো রিপোর্ট গুলো আর আনতে যাই নি। মানে আমি হস্পিটালের একজন কে টাকা দিয়ে বলে এসেছিলাম যে বাসায় যেন পৌঁছে দেয়। এড্রেসও দিয়ে এসেছি।
সোহেল;; হ্যাঁ তো?
মেহরাম;; ছেলেটার আসার সময় অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে। মানে অনেক আগেই সে বাসায় এসে দিয়ে গেছে। সময় দেখেছেন। আর বাসায় কেউ নেই মা আছে। রিপোর্ট গুলো যদি মায়ের হাতে…. ননা নননা।
সোহেল;; কি আম্মুর হাতে, তাহলে তো জেনে যাবে। আর আম্মু একদম ঠিক থাকতে পারবে না জানার পর।
মেহরাম;; আমাদের এখনই যেতে হবে। চলুন
সোহেল;; হ্যাঁ চলো।
মেহরাম আর সোহেল রিকশায় উঠে বসে। কিছুটা দ্রুত রিকশাকে যেতে বলে। প্রায় অনেকক্ষণ পর মেহরাম আর সোহেল বাসায় পৌঁছে। কিন্তু এবার ঘটলো আরেক বিপত্তি। সোহেলের মাথা টা হঠাৎ চক্কর দিয়ে ওঠে। মেহরাম ধরে ফেলে তাকে। আস্তে আস্তে করে খুব সাবধানে সোহেলকে ভেতরে নিয়ে আসে। তবে ভেতরে আসতেই মেহরাম আর সোহেল যেন এক প্রকার অবাক হলো। কুসুম বেগমের হাতের সোহেলের চেকাপের রিপোর্ট গুলো। তিনি উল্টিয়ে উল্টিয়ে সবকিছু দেখছেন।
মেহরাম;; মমমা..
মেহরাম কুসুম বেগমকে ডাক দিলেন তবুও তার কোন হেলদুল নেই। এবার সোহেল আস্তে ধীরে তার মায়ের দিকে এগিয়ে যায়।
সোহেল;; মা।
এবার কুসুম বেগম মাথা তুলে সোহেলের দিকে তাকালেন। চোখে বয়ে যাচ্ছে তার অশ্রুর ধারা। হাত থেকে টাস করে রিপোর্ট গুলো নিচে পরে যায়। কুসুম বেগম আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। ছেলেকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলেন।
কুসুম;; বাবা তোর, তোর ক্যান্সার হয়েছে। এএএগুলো ককি বলছে ডাক্তার রা। আমি বিশ্বাস করিনা। এগুলো সব মিথ্যা। আমার ছেলে। আমার বুক টা খালি করে যাস না বাবা। আল্লাহ আমার হায়াত নিয়ে তোকে দিক।তাও তুই যাস না বাবা। তোর মায়ের কি হবে। মেহরাম মার কি হবে। তোর বাচ্চা টা, ইয়া আল্লাহ তুমি এইটা কি করলে। ইয়া খোদা তুমি এতো নিষ্ঠুর কেন হলে। সোহেল বাবা কবে হয়েছে তোর ক্যান্সার, কবে জেনেছিস। আমাকে আগে কেন বলিস নি। কেন বলিস নি।
সোহেল তার মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। মেহরাম মূর্তির মতো করে দাঁড়িয়ে আছে আর চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পরছে। কুসুম বেগম এক রকম আহাজারি শুরু করে দিয়েছেন। সোহেল কে ছেড়ে দাড়ালে মেহরাম খেয়াল করে যে উনার চোখ গুলো নিভু নিভু হয়ে গেছে। সাথে সাথে মেহরাম ছুটে গিয়ে কুসুম বেগম কে পেছন থেকে ধরে ফেলেন। তারপর সোহেল আর মেহরাম মিলে তাকে আস্তে করে শুইয়ে দেয়। ছেলের চিন্তায় নিজের শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছে। নিলা কে দ্রুত পানি আনতে বলে অতঃপর মেহরাম তার পাশে বসে তাকে দেখাশোনা করে। কয়েক ঘন্টা পর কুসুম বেগম উঠে বসেন। উঠেই আবার নিজের ছেলে কে নিয়ে বিলাপ পারা শুরু করে দেন। মেহরাম তাকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে তার রুমে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেন। মেডিসিনের সাথে ঘুমের ঔষধও খাইয়ে দেয় মেহরাম। কিছুক্ষণ তার শাশুড়ীর পাশে বসে থেকে মেহরাম চলে আসে। এখন সন্ধ্যা রাত। মেহরাম রুমে গিয়েই দেখে সোহেল নেই। মেহরাম কপাল কুচকে তাকায়। অবশেষে ওয়াসরুম থেকে শব্দ আসলে মেহরাম সেদিকে যায়। দরজা টা হাল্কা ধাক্কা দিতেই খুলে যায়। মেহরাম তাকিয়ে দেখে সোহেল মুখে টিস্যু দিয়ে প্রচুর পরিমাণে কাশছে। সে ছুটে গিয়ে সোহেলের কাছে যায়। আলতো করে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। তারও অনেকক্ষণ পর সোহেল কিছুটা স্বাভাবিক হয়। রুমে এসে জলদি তাকে মেডিসিন খাইয়ে দেয় মেহরাম। শুয়ে থাকতে থাকতে সোহেল এক সময় ঘুমিয়ে পরে। মেহরাম রুমের আলোটা হাল্কা করে দেয়। তারপর তার ড্রয়ার থেকে তার সেই অতি পছন্দের ডায়েরি টা হাতে নিয়ে বারান্দায় ফ্লোরের এক কোণায় বসে লিখতে শুরু করে। লিখতে লিখতে কখন যে এতো সময় পার হয়ে গেছে মেহরাম জানে না। হঠাৎ রুমের ভেতরে থেকে আওয়াজ আসে “মেহরাম”। মেহরাম বুঝে যে এটা সোহেলের ডাক। সে দ্রুত উঠে রুমে যায়। হাত থেকে ডায়েরি টা ড্রয়ারে রেখে রুমের আলো জ্বালিয়ে দেয়। তাকিয়ে দেখে সোহেল শুয়ে থেকেই তাকে ডাকছে। মেহরাম তার কাছে যায়। সোহেল কে কিছুটা ধরে উঠিয়ে বসিয়ে দেয়। সোহেল আস্তে করে নেমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসে।
মেহরাম;; এই সময়ে ঘুম ভেংগে গেলো যে?
সোহেল;; আরে আমি তো সন্ধ্যা বেলা ঘুমিয়েছিলাম আর দেখো এখন বাজছে প্রায় বারো টার কাছাকাছি।
মেহরাম;; হুমম। কিছু কি খাবেন?
সোহেল;; না। খিদে নেই।
মেহরাম;; হুমম।
সোহেল;; মেহরাম চলো না ছাদে যাই একটু!
মেহরাম;; এই সময়ে ছাদে!
সোহেল;; চলো যাই না।
মেহরাম;; আচ্ছা চলুন।
মেহরাম সোহেল কে নিয়ে চলে যায় ছাদে। সিড়ি বেয়ে ছাদে ওঠার সময় মেহরাম সোহেল কে ধরে ছিলো যাতে পরে না যায়। ছাদের এক কিণারে এসে মেহরাম বসে পরে। তবে এবার হুট করে সোহেল মেহরামের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পরে। মেহরাম কিছু বলে না।
সোহেল;; মা কোথায়?
মেহরাম;; উনি অনেক কান্না করছিলেন তাই মেডিসিন খাইয়ে শুইয়ে দিয়ে এসেছি। এখন ঘুমাচ্ছে।
সোহেল;; ওহহহ।
মেহরাম;; হুমম।
সোহেল;; তোমার অনেক বেশি কষ্ট হয়ে গেছে তাই না মেহরাম!?
মেহরাম;; মানে বুঝলাম না।
সোহেল;; মানে এই যে এক হাতে পুরো সংসার সামলানো। মাকে দেখা আমাকে দেখা, তার ওপর তুমি অন্তঃসত্ত্বা। তুমি তো নিজের প্রতি কেয়ারই করো না।
মেহরাম;; আরে নাহ তেমন কিছুই না। এগুলো আমার কর্তব্য। আর আমি করবোই।
তারপর তাদের মাঝে চলে কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতা। তার মাঝেই আবার হুট করে সোহেল বলে ওঠে…
সোহেল;; মেহরাম আমাদের না একটা সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে হবে।
মেহরাম;; মেয়েই কেনো?
সোহেল;; উহু, মেয়েই হবে দেখো। ঠিক তোমার মতো। অনেক সুন্দর।
মেহরাম;; হুমম আচ্ছা।
সোহেল;; জানো আমি না মেয়ের নামও ঠিক করে রেখেছি!
মেহরাম;; ওমা তাই!
সোহেল;; হ্যাঁ।
মেহরাম;; নাম কি শুনি!
সোহেল;; মেহের।
মেহরাম এবার ফট করে সোহেলের দিকে তাকায়। সোহেলও মেহরামের দিকে তাকায়।
সোহেল;; তোমার নামের সাথে মেয়ের নাম মিলিয়ে রেখেছি আমি “মেহের”। নাম টা কেমন?
মেহরাম;; সুন্দর ❤️~
মেহরাম আর সোহেল বসে রাতের আকাশের তারা গুলো কে দেখতে থাকলো ✨।
যে যার মতো করে চলছে। সময়ের চাকা গড়িয়ে আরো প্রায় ৫ মাস চলে গেছে। তবে সবার মাঝেই কেমন একটা ফ্যাকাশে ভাব। মেহরাম তার শশুড় বাড়িতেই রয়েছে। সোহেল বাইরে চলে গিয়েছে বেশ কিছুদিনের জন্য। তনুও আয়ুশের সাথেই আছে। তনু আগে থেকেই বেশ নরমাল হয়ে গিয়েছে। সত্যি বলতে বাড়িতে কেউ তাকে সেই কথা টা মনেই পরতে দেয় না। তার নিজের মধ্যেও যে একটা কমতি আছে তা বুঝতেই দেয় না তনুকে। তবে আয়ুশ চুপচাপ থাকে, তেমন কথা বলে না। তনু মাঝে মাঝে আয়ুশকে লক্ষ করে। কেননা এই আয়ুশকে তো সে চিনতো না। যেই কিনা সারাদিন বাইকে করে ঘুড়ে বেড়াতো, বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে শেষই হতো না সে এখন এমন একটা পরিস্থিতিতে এসে দাড়িয়েছে। সেই আগের আয়ুশের সাথে এখনকার আয়ুশের রাত দিন তফাৎ। আজ অফিসের অফ ডে তাই সবাই একসাথে বসে টেবিলে খাচ্ছিলো। আয়ুশ শুধু খাবার সামনে নিয়ে বসে আছে। আর তনু বারবার আয়ুশকে দেখছে।
তনু;; আয়ুশ।
আয়ুশ;; হ্য..হ্যাঁ বলো।
তনু;; খাচ্ছো না কেন?
আয়ুশ;; ন.. না খাচ্ছি আমি।
তনু;; হুম।
কোন রকমে খেয়ে আয়ুশ জলদি রুমে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর তনুও খেয়ে ওপরে রুমে এসে পরে। তনু এসেই দেখে আয়ুশ বাইরে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তনু গিয়ে আয়ুশের পেছনে দাঁড়িয়ে পরে।
তনু;; আয়ুশ।
আয়ুশ;; হুম।
তনু;; তোমার কি হয়েছে? এমন চুপ মেরে গিয়েছো কেন?
আয়ুশ;; আমার দম বন্ধ হয়ে যায় তনু। পানি যখন নাকের ওপরে চলে যায় তখন মানুষ বাচার চেষ্টা করে কিন্তু যখন তার কাছে সেই বাচার উপায় টুকুও না থাকে তখন মৃত্যু ব্যাতীত আর কোন পথ থাকে না।
তনু;; আয়ুশ তুমি এমন কেন হলে, আমার দোষ তাই না। সব, সব আমার দোষ আমি তোমাকে কখনো কোন বাচ্চা দিতে পারবো না তাই এমন করছো তাই না?!
আয়ুশ;; না তনু অযথা ভুল বুঝো না। এতে তোমার কোন দোষই নেই।
তনুর এবার কাদো কাদো ভাব হয়ে গেলো।
তনু;; আয়ুশ তুমি অনেক পালটে গেছো অনেক।
আয়ুশ;; মানুষ পরিবর্তনশীল তনু।
তনু এবার আয়ুশকে জড়িয়ে ধরে। আয়ুশও তার হাত টা তনুর পিঠে রেখে দেয়। আয়ুশ মুখ ঘুড়িয়ে অন্যপাশে তাকিয়ে থাকে। তনু তখন মাথা তুলে আয়ুশের দিকে তাকিয়ে বলে…
তনু;; আয়ুশ, আমাকে কখনো ছেড়ে যাবে না তো? (চোখে পানি টলমল করছে)
আয়ুশ;; হাহা, যদি তোমার আগে আমার মরণ হয়ে যায় তাহলে তো ছেড়ে যেতেই হবে বলো! (মলিন হেসে)
তনু;; আয়ুশ চুপ করো প্লিজ।
তনু আরো শক্ত করে আয়ুশকে জরিয়ে ধরে। আয়ুশকে ক্ষীন হেসে উঠে। তনু হুহু করে কেদে দিয়েছে। আর এদিকে অজান্তেই আয়ুশের চোখের কার্ণিশ বেয়ে এক ফোটা জল গড়িয়ে পরে। সাথে সাথে সে তা মুছে ফেলে।
।
।
কুসুম;; মেহরু মা কোথায় তুই?
মেহরাম;; হ্যাঁ মা বলো এই তো আমি।
কুসুম;; এটা খা। (একটা লাড্ডু মেহরামের মুখে পুড়ে)
মেহরাম;; হুম হুম কিন্তু মমমা এটা কিকিশের লাড্ডু? (খেতেখেতে)
কুসুম;; কিছুরই না, আগে যখন সোহেল আমার কাছেই থাকতো মানে আর্মি তে যোগ দেবার আগে। তখন প্রায় বলতো মা এটা বানিয়ে দাও ওটা বানিয়ে দাও। নতুন নতুন রেসিপি তাকে আমার বানিয়ে দিতেই হতো রোজ। এখন তো ছেলে নেই তাই মেয়ে কেই খাওয়াই।
মেহরাম;; হুমম বুঝলাম। আচ্ছা এদিকে এসো দেখি তোমার না মাথায় ব্যাথা ছিলো। এখন কেমন লাগছে?
কুসুম;; ওইতো আছে আর কি।
মেহরাম;; এমনিতেই মাথা ব্যাথা তার ওপর এই গরমে রান্নাঘরে কেন গেলে। এদিকে এসো মাথায় তেল লাগিয়ে দেই।
মেহরাম কিছুটা জোর করেই তার শাশুড়ীর মাথায় তেল মালিশ করে দিলো। কিছুক্ষন পর মালিশ শেষ হলে মেহরাম কেমন কপাল কুচকে ফেলে। দুজনেই এসে সোফায় বলে পরে। তবে মেহরামের শাশুড়ীর একটা অভ্যাস আছে উনি প্রায় মাঝে মাঝে পান খান। মেহরাম বসে বসে পান বানাচ্ছিলো। কিন্ত তখনই তার মাথা টা কেমন চক্কর দিয়ে উঠে। মেহরাম ঠিক হয়ে বসে তার শাশুড়ী কে পান দেন। কুসুম বেগম তার মতো করেই কথা বলে যাচ্ছেন। কিন্তু এরই মাঝে মেহরামের মাথা ভনভন করে ঘোড়াতে থাকে। আর এর পরিমাণ বেশি হয়ে গেলে মেহরাম সেখানে সোফাতে অজ্ঞান হয়ে পরে যায়। এটা দেখে কুসুম বেগম মেহরাম বলে চিল্লিয়ে উঠে দ্রুত তার কাছে যায়। মেহরামের গালে হাত দিতে ডাকতে থাকে। কুসুম বেগম দ্রুত বাসার কাজের মেয়েকে ডেকে মেহরাম কে ভালোভাবে শুইয়ে দেয়। তাদের পারসোনাল ডাক্তার ছিলো কুসুম বেগম দ্রুত তাকে ফোন করে বাসায় ডাকেন।
কুসুম;; মেহরামের কি হয়েছে?
ডাক্তার;; উনি কি কোন কিছু নিয়ে অনেক চিন্তা করেন নাকি। মানে কোন বেপারে কি অনেক স্ট্রেস নেন নাকি উনি?
কুসুম;; না, মেহরাম অনেক হাসি খুশি একটা মেয়ে। সারা বাড়ি নিজে মাতিয়ে রাখে। আসলে ও বাসায় না থাকলে বাড়িই মরে যায়। একে দেখে কেউ বলবে না যে ওর মতো মেয়েও কোন বেপারে চিন্তিত থাকে।
ডাক্তার;; অতিরিক্ত চিন্তার জন্য এমন হয়েছে। তাকে দেখে রাখবেন আর কিছু মেডিসিন দিচ্ছি এগুলো নিয়মিত খাওয়াবেন। আর উনার হয়তো রাতের ঘুম খুব কমই হয়। তাকে রাতে ঘুমাতে বলবেন।
কুসুম;; জ্বি।
ডাক্তার মেহরামকে দেখে সেখান থেকে চলে আসেন। তবে এবার কুসুম বেগম চিন্তায় পরে গেলেন। মেহরাম কি নিয়ে এতো টেনশন করে তাই সে বুঝে উঠতে পারেন না। কুসুম বেগম বাইরে তাকিয়ে ছিলো তখনই মেহরামের জ্ঞান আসে।
মেহরাম;; মমমা..মা (আধো আধো গলায়)
কুসুম;; হ্যাঁ রে মা আমি আছি। এখন কেমন লাগছে তোর?
মেহরাম;; হ্যাঁ মা ভালো।
মেহরাম উঠে বসে। আর কুসুম বেগম তাকে এক গ্লাস ঠান্ডা শরবত খাইয়ে দেয়। গ্লাস টা টেবিলে রেখে কুসুম বেগম মেহরামের পাশে বসে পরে…
কুসুম;; হ্যাঁ রে কি হয়েছে তোর? এতো কিশের চিন্তা?
মেহরাম;; মা অতিরিক্ত গরম তাই হয়তো এমন হয়েছে আর হ্যাঁ রাতে একটু ঘুমাতে আমার সমস্যা হয়। কিন্তু চিন্তা কি নিয়ে করবো আমি। ধুর ছাড়ো তো।
কুসুম;; কি আর বলি তোকে। আচ্ছা শোন।
মেহরাম;; হুমম।
কুসুম;; তোর শরীর ভালো না দেখে আমি সোহেলকে ফোন করে বলে দিয়েছি।
মেহরাম;; আরে মা কিন্তু, কেন বললে উনাকে। উনি এমনিতেই এত্তো ব্যাস্ত থাকেন, কাজের এতো চাপ। তার মধ্যে তাকে কেন ফোন দিয়ে বলতে গেলে। এখন উনি অযথা চিন্তা করবেন।
কুসুম;; আসছে।
মেহরাম;; কি?
কুসুম;; তোর কথা শুনে অনেক চিন্তিত হয়ে গিয়েছিলো তাই পরশু আসছে।
মেহরাম;; মা তুমিও না।
কুসুম;; আচ্ছা পরের টা পরে দেখা যাবো এবার তুই রেস্ট নে। রুমে যাবি?
মেহরাম;; নাহ সেখানে একা একা কি করবো। এখানেই থাকি।
কুসুম;; আচ্ছা।
এভাবেই তারা থাকে। বিকেলের দিকে তনুর ফোন আসে মেহরামের কাছে।
মেহরাম;; হ্যালো..
তনু;; মেহরু কেমন আছিস?
মেহরাম;; হুম এতো দিনে বোনের কথা মনে পরেছে তাই না। ভালোই আছি। তুই কেমন আছিস আর বাড়ির সবাই কেমন আছে?
তনু;; আরে আস্তে। হ্যাঁ সবাই অনেক ভালো আছে। আচ্ছা শোন যে কারনে তোকে ফোন করা!
মেহরাম;; হ্যাঁ বল না।
তনু;; অনেক দিন তো বাড়িতে যাওয়া হয় না, চল না একদিন সবাই একসাথে গিয়ে ঘুড়ে আসি।
মেহরাম;; হুম বুদ্ধি মন্দ না। যাওয়াই যায়। কিন্তু তোর ভাইয়া বাসায় নেই।
তনু;; কবে আসবেন?
মেহরাম;; আর বলিস না আমি আজ একটু অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম তো আ…..
তনু;; কিহহহ, মেহরু তোর আক্কেল কবে হবে। অজ্ঞান হয়েছিলি মানে কিভাবে, আর আমায় একটাবার বলার প্রয়োজন মনে করিস নি তুই?
মেহরাম;; আরে তেমন বেশি সিরিয়াস কিছু না এমনি আর এখন আমি একদম ঠিক আছি।
তনু;; তুই যে কি করিস না। আচ্ছা এখন কি শরীর ভালো আছে তোর। মাথা ঘুড়াচ্ছে না তো আবার?
মেহরাম;; আরে না। কিন্তু মা এইদিকে চিন্তায় পরে সোহেল কে ফোন করে দিয়েছেন। উনি কিছুদিন পর আসতেন কিন্তু এখন আমার কথা শুনে পরশু দিনই আসছে।
তনু;; ওহহ তাহলে তো হলোই। শোন এখান থেকে আমরা সবাই যাবো আর তুইও খালামনি কে আর ভাইয়া কে নিয়ে এসে পরিস কেমন। ভাইয়া তো পরশু আসবেন আমরা না হয় তার পরেরদিন গেলাম।
মেহরাম;; আচ্ছা, তো প্লেন ডান।
তনু;; হ্যাঁ, আচ্ছা বোনু শোন একটু কাজ আছে বুঝলি এখন রাখি।
মেহরাম;; হ্যাঁ।
তনু;; লাভ ইউ বইনা।
মেহরাম;; টুউউউউ 😅।
।
এভাবেই দেখতে দেখতে মাঝ খানে দুইদিন কেটে যায়। পরেরদিন সকাল ১১ টায় সোহেল এসে পরে। তখন মেহরাম আর তার শাশুড়ী মিলে আড্ডা দিচ্ছিলো। সোহেল কে এভাবে আসতে দেখেই মেহরাম অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। কুসুম বেগম ছুটে চলে যান ছেলের কাছে। গিয়েই কেদে দেন। অনেক কথা বলে সোহেল সোজা মেহরামের কাছে আসে। মেহরাম সোহেলের সামনে দাঁড়িয়ে পরে। সোহেল তার হাত থেকে ব্যাগ টা নিচে রেখেই মেহরামকে জড়িয়ে ধরে। মেহরাম সোহেলের পিঠে হাত দিবে কি দিবে না কেমন এক দোটানায় পরে যায়। মেহরাম আর সোহেল যে পুরো পুরি ভাবে একে ওপরের হয়নি তা কিন্তু না। কিন্তু তবুও প্রায়ই কেমন এক জড়তা কাজ করে মেহরামের মাঝে।
সোহেল;; কি হয়েছিলো তোমার? নিজের ওপর তো একটু খেয়াল রাখতে পারো নাকি?
মেহরাম;; আপনি কেন এতো চিন্ত করছেন। সামান্য অজ্ঞনই তো হয়েছিলাম। আর এখন একদম ঠিক।
সোহেল;; হুমম বুঝলাম।
মেহরাম;; আচ্ছা ভালো হয়েছে আপনি এসেছেন। আমরা আগামীকাল একটা জায়গায় যাবো।
কুসুম;; হ্যাঁ আর মেহরু মা আমার সাথে আগেই কথা বলে নিয়েছে।
সোহেল;; কিন্তু যাবো টা কোথায়?
মেহরাম;; শশুর বাড়ি।
সোহেল;; কিছুদিন পর গেলেই পারতে, এখন তো..
মেহরাম;; না এখনই ঠিক আছে। আপনি আবার চলে যাবেন তখন কবে না কবে আসবেন। কালই যাবো আমরা।
সোহেল;; আচ্ছা।
।
পরেরদিন হলে মেহরাম, সোহেল, কুসুম বেগম সবাই বেড়িয়ে পরেন। ওদিকে তনুর বাড়ির সবাই বেরিয়ে পরেছে। প্রায় অনেকক্ষণ পর তারা সবাই বাড়িতে চলে চলে যায়। মানে তনু আর মেহরামের বাবার বাড়িতে। বাড়িতে একটা ছোটখাটো আনন্দের রেশ পরে গেছে। মেহরামের বাবা মা চাচি চাচ্চু দিদুন তাদের কি খুশি। তবে মেহরাম যতো পারছে আয়ুশের থেকে দূরে থাকছে। আয়ুশও খেয়াল করছে যেন সে মেহরামের সামনে না পরে। সবাই হলরুমে বসে আছে অনেক গল্প করছে। এরই মাঝে সোহেল মেহরামের ওপর অনেক নজর রাখছে। মূলত সে কিছুটা অসুস্থ তাই। সোহেল মেহরামকে খাইয়ে পর্যন্ত দিচ্ছে। তবে আয়ুশ কোন এক জায়গায় স্থির হয়ে বসছে না। তার ভেতরে ছটফট অনেক, এক প্রকার অস্থিরতা কাজ করছে। যা তনু বেশ ভালোই খেয়াল করেছে। যেখানে মেহরাম আর সোহেল একসাথে বসে ছিলো সেখান থেকে আয়ুশ উঠে আসে। সারা টা দিন সেখানে থেকে তারপর সবাই চলে আসে। সবাই অনেক বেশি খুশিছিলো। কেউ কেউ অতিমাত্রায় খুশি, কেউ সামান্য, আবার কারো মাঝে খুশির ছিটেফোঁটাও ছিলো না, আবার কেউ খুশি থাকার ভনিতাই করে গেছে মাত্র। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসে পরে।
.
রাতে মেহরাম বসে বসে বই পড়ছিলো। তখনই সোহেল বলে ওঠে…
সোহেল;; মেহরাম আমার না শরীর টা তেমন ভালো লাগছে না।
মেহরাম;; এমা কেন কি হলো আবার। (সোহেলের কাছে গিয়ে)
সোহেল;; জানি না। আচ্ছা আমি ঘুমাই।
মেহরাম;; হ্যাঁ আসুন।
সোহেল ঘুমিয়ে পরে। মেহরামও কিছুক্ষণ পর ঘুমের দেশে পাড়ি জমায়। তার একদিন পরেই সোহেল আবার বাইরে চলে যায়। মেইন অফিসার ফোন দিয়েছিলো সোহেলকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এসে পরতে বলেছে। সেও বেশি দেরি না করে দ্রুত চলে যায় পরেরদিনই।
একদিন আয়ুশ অফিসের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো। মূলত গাড়িতে করে কোথাও যাচ্ছিলো। তখনই তার চোখে পরে মেহরামকে। হয়তো বাইরে গিয়েছিলো, হাতে কিছু ব্যাগও আছে। আয়ুশ আর নিজেকে আটকাতে পারলো না। দ্রুত তার গাড়ি সাইডে করে মেহরামের কাছে ছুটে গেলো। চোখ যেন তার ঝলমলিয়ে উঠে। মেহরাম যাচ্ছিলো হঠাৎ আয়ুশকে এভাবে নিজের সামনে আসতে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে যায়। আয়ুশ মেহরামের সামনে দাঁড়িয়ে বড়ো বড়ো শ্বাস ছাড়তে লাগলো। মেহরাম আয়ুশের এমন করার মানে বুঝতে পারছে না। আয়ুশ কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার জন্য মাথা নিচু করে রাখে। মেহরাম তার সামনে থেকে চলে আসতে নিলেই আয়ুশ বলে ওঠে…
আয়ুশ;; মেহরাম!!
মেহরামের পা গুলো না চাইতেও থেমে পরে। আয়ুশ এবার মেহরামকে দেখতে থাকে।
মেহরাম;; ককি..কিছু ববলবেন?
আয়ুশ মেহরামের কথায় অন্য পাশে মাথা ঘুড়িয়ে ফেলে। তারপর নিজের ডান হাত দিয়ে কপাল টা একটু স্লাইভ করে আবার বলে ওঠে…
আয়ুশ;; কেমন আছো মেহরু??
মেহরামের সাহস নেই সে আয়ুশের ওই চোখের দিকে তাকিয়ে নিজের উত্তর দিবে। “মেহরু” ডাকটা কখনোই কি আর মুখ থেকে যাবে না তার। তবে আসলেই কি দুই কিণারের দুটো মানুষ প্রকৃতিপক্ষে ভালো আছে। যদি না ই থাকে তাহলে কি এবারও মিথ্যেই বলতে হবে। কারণ মাঝে মাঝে একদম ছোট্ট একটা কথার মাঝেও ভারি সত্য লুকিয়ে থাকে। তখন প্রশ্ন টা আর তার উত্তর টা তো সহজ ভাষারই হয়, কিন্তু তা কি আদৌও সত্য নাকি নিছক মিথ্যেই। মেহরাম এবার খুব কষ্টে কিছুটা সাহস জুগিয়ে আয়ুশের দিকে তাকায়। তবে আয়ুশ মেহরামের আর মেহরাম আয়ুশের চোখের দিকে তাকানোর আগেই ঝমঝমিয়ে মুষুলধারে বৃষ্টি নেমে পরে। আকাশে মেঘ গর্জে উঠে। চারিদিকে সবাই এদিক ওদিক ছুটছে বৃষ্টি থেকে বাচার জন্য। কেউ কেউ মাথায় হাত রেখেই দৌড়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের দুজনের কোন হেলদুল নেই। সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে। মূহুর্তেই দুজন ভিজে একাকার হয়ে গেলো। এতে অবশ্য তাদের সুবিধেই হয়েছে। চোখের পানি গুলো বৃষ্টি পানির সাথে ধুয়ে মুছে যাবে। না দেখতে পারবে আয়ুশ মেহরামের চোখের পানি আর না দেখতে পারবে মেহরান আয়ুশের। কখনো কখনো হয়কি যে প্রকৃতিও মানুষের মনের ভাষা বুঝে ফেলে। যদি বেশি চাপা কষ্ট হয় তাহলে বাধ্য হয়েই নেমে পরতে হয়, বিনা অনুমতিতেই। আর এর জন্যই হয়তো কিছু প্রেমিক-প্রেমিকাদের কাছে এই বৃষ্টিটা অতি পছন্দের একটা জিনিস। যদি এতে কিছুটা দুঃখবিলাশ কমে, কিছুটা🥀।
।
।
।
।
💙চলবে~~
#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ১০
🤎🦋
.
.
.
.
বাইরে এখনো মুষুলধারায় বৃৃষ্টি হচ্ছে। দরজায় কলিং বেল বাজতেই কুসুম বেগম গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। খুলতেই অবাক হন। বাইরে পুরো চুপচুপে ভিজে মেহরাম দাঁড়িয়ে আছে। দুইহাতে দুটো ব্যাগ।
কুসুম;; কিরে তোর এই অবস্থা কেন? এভাবে ভিজলি কি করে?
মেহরাম;; _______________
কুসুম;; আরে জলদি আয় ঘরের ভেতরে, ভিজে কি একটা অবস্থা করেছে। এই নিলা (বাড়িতে কাজ করে) এই জলদি এখানে আয়। তোর আপার কাছ থেকে এগুলো ব্যাগ নে।
নিলা;; জ্বি খালাআম্মা।
কুসুম;; বাইরে এতো বৃষ্টি কতো বলি বাইরে গেলে ড্রাইভারকে নিয়ে যা কে শোনে কার কথা। এদিকে আয় দেখি মাথা মুছে দেই।
এতো গুল কথার মাঝে মেহরাম হু হা কিছুই বলছে না। শুধু মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। কুসুম বেগম তাকে নিয়ে গিয়ে আগে মাথা মুছে দিলেন। মেহরাম ওপরে তার রুমে চলে এলো। হাত-পা যেন তার বরফ হয়ে গিয়েছে। কোন রকমে একটা টাওয়াল নিয়ে সোজা ওয়াসরুম চলে গেলো। শাওয়ার ছেড়ে দিয়ে তার নিচে ধপ করে বসে পরে। চোখের সামনে খালি আয়ুশের চেহারা টাই ভাসছে। আয়ুশ হুহু করে কেদে দিয়েছিলো তার সামনে। ভেবেছিলো সে হয়তো লুকাবে তার কান্না গুলো কিন্তু না। কথায় বলে ছেলেদের নাকি কাদতে নেই। কিন্তু ফিলিংস,ইমোশন এগুলো তো সবারই আছে তাই না। এমন তো আর না যে দুইজন একে ওপরের থেকে মিলো দূরে থাকে। বারবার, হাজার বার একে ওপরের সাথে চোখাচোখি হয়ে যায়। আয়ুশ একদম বাচ্চাদের মতো করে কাদছিলো। মেহরাম শুধু এই সব মনে করছে আর কাদছে শাওয়ারের নিচে বসে থেকে। সে এবার নিজের মাথার চুল গুলো হাতে খামছে ধরলো। হিচকি উঠে গেছে কাদতে কাদতে। অনেকক্ষন যাবত এমন থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে পরে। নাক মুখ সব লাল হয়ে গেছে। চোখ গুলো ফোলা ফোলা। সে নিচে নেমে পরে। নামতেই দেখে কুসুম বেগম সোফায় বসে বসে পান খাচ্ছেন। মেহরাম সোজা সিড়ি বেয়ে নেমে তার শাশুড়ীর কাছে চলে যায়। তারপর তার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরে। কুসুম বেগমও তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।
।
।
তনু;; আয়ুশকে কখন থেকে ফোন দিচ্ছি। কিন্তু ফোন কেন তুলছে না (ফোন দিতে দিতে)। আয়ুশ প্লিজ পিক আপ দি ফোন।
আরো প্রায় ২-৩ বার ফোন বাজার পর আয়ুশ ফোন ধরে।
আয়ুশ;; হ্য….
তনু;; এইই ধরেছো তুমি ফোন এতোক্ষণে। জানো আমি সেই কখন থেকে ট্রাই করছি। কোথায় ছিলে তুমি?
আয়ুশ;; কোথায় আর থাকবো অফিসেই।
তনু;; বাসায় আসছো না কেন কতো রাত হয়েছে। ১২ টা বাজতে চললো।
আয়ুশ;; কাজের চাপ বেশি ছিলো। আসছি আমি।
তনু;; আচ্ছা।
আয়ুশ ফোন কেটে দিয়ে বাইরে বের হয়ে পরে। আয়ুশ বাসায় এসেই দেখে তার আম্মুর মাথায় আইস ব্যাগ দেওয়া। আর তার পাশে তনু কণা সবাই বসা। আয়ুশ দ্রুত সেখানে চলে যায়৷
আয়ুশ;; কিরে কণা কি হয়েছে মায়ের?
কণা;; প্রেসার বেশি।
আয়ুশ;; মা, কি হয়েছে? সেইদিন না দেখলাম প্রেসার ঠিক। আজ হঠাৎ করেই কেন বাড়লো।
তনু;; সেটাই তো ভাবছি।
আয়ুশ;; আচ্ছা ডাক্তার কে ফোন করেছিলে কেউ তোমরা?
তনু;; হ্যাঁ আমি করেছিলাম, কিন্তু উনি বললেন ঠান্ডা জাতীয় কিছু দিতে। আর এই গরমে মাংস টা একটু কমিয়ে খেতে। মানে যেগুলো তে প্রব্লেম আছে আরকি সেগুলো একটু এভোয়েড করতে বলেছেন।
আয়ুশ;; মা এখন কেমন লাগছে?
লায়লা খাতুন;; না বাবা আমি একদম ঠিক আছি, তুই চিন্তা করিস না। বাইরে থেকে এসেছিস ফ্রেশ হতে যা।তনু মা তুই আয়ুশের সাথে যা এখানে কণা আছে তো।
তনু;; আচ্ছা।
আয়ুশ রুমে এসে পরে। তনুও তার পিছু পিছু। আয়ুশ তার ওপর থেকে কোর্ট টা খুলে দিলে তনু তা টাংগিয়ে দেয়। তনু খেয়াল করে দেখলো যে আয়ুশের চোখ মুখ কেমন একটু ফোলা ফোলা।
তনু;; বৃষ্টির পানি লেগেছিলো নাকি গায়ে, কোর্ট টাও তো ভিজা?!
আয়ুশ;; হ্যাঁ বাইরে গিয়েছিলাম একটু তখন ভিজে গেছি।
তনু;; তুমি জানো না যে বৃষ্টির পানিতে তোমার সমস্যা হয় তবুও!
আয়ুশ;; আরে ওইতো একটু ভিজে গেছি।
তনু;; আচ্ছা ফ্রেশ হতে যাও। আমি খাবার বাড়ছি।
আয়ুশ;; আব..খিদে নেই আমার বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি।
তনু;; কি শুরু করলে তুমি, প্রতিদিন বাইরে থেকে খেয়ে আসো কেন?
আয়ুশ;; এমনি, আমি ফ্রেশ হতে গেলাম।
আয়ুশ ওয়াসরুমে চলে গেলে তনু একটা ছোট খাটো হাফ ছেড়ে বাইরে চলে আসে।
।
পরেরদিন সকালে~~
মেহরাম;; মা মাথা টা ঘোড়াচ্ছে!
কুসুম;; আবার। কাল রাতে ঘুমিয়েছিলি?
মেহরাম;; হ্যাঁ।
কুসুম;; সকালে খেয়েছিস?
মেহরাম;; ওহ আর বলো না, কাল রাত ২ টায় উঠে খেয়েছি। জানি না খিদে লেগে গিয়েছিলো খুব।
কুসুম;; হাহাহা…
মেহরাম;; আচ্ছা তুমি কি খাবে বলে ফেলো, জলদি বানিয়ে দেই।
কুসুম;; আমি খেয়ে নিবো মাথা নাকি ঘোড়াচ্ছে তোর। কিচেনে যেতে হবে না।
মেহরাম;; আহা বলো তো তুমি।
কুসুম;; হ্যাঁ আমি……
তমাল মোহাম্মদ;; কুসুম…
মেহরাম;; আরে আপনি কে, আর এভাবে ভেতরে এলেন কি করে?
মেহরাম আর কুসুম বেগম কথা বলছিলেন তার মাঝে একজন লোক এসেই মেহরামের শাশুড়ীর নাম ধরে ডাক দেয়। মেহরাম তো চিনেই না লোকটিকে তাই সে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন গুলো করে বসে। কিন্তু এবার মেহরাম তাকিয়েই দেখে যে কুসুম বেগম উঠে দাঁড়িয়ে পরেছেন। যেই লোক টি ভেতরে এসেছিলো তার চোখে আর কুসুম বেগমের চোখেও পানি টলমল করছে। মেহরাম তো কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। কুসুম বেগম উঠে গিয়ে লোকটির কাছে যায় তারপর ‘দাভাই’ বলেই অঝোরে কেদে দেন।
কুসুম;; দাভাই কেমন আছো? আজ এতো গুলো বছর পর এই বোনের কথা মনে পরলো তোমার?
তমাল;; বোন হোস তুই আমার, হাজার বছর পর হলেও মনে করবো। মাফ করে দিস বোন আমার তোকে আমি আমার কাছে রাখতে পারিনি।
কুসুম;; না দাভাই দয়া করে এমন ভাবে বলো না। সেখানে তোমার কোন দোষই ছিলো না। মাঝে মাঝে তো আমাকে দোষী মনে হয় যে আমি ভাবীর মৃত্যুর দিন যেতে পারিনি।
তমাল;; আমাকে মাফ করে দিস বোন। তোকে আমি ভাই হিসেবে কিছুই করে দিতে পারি নি। আমি ব্যার্থ রে বোন।
কুসুম;; এভাবে বলো না দাভাই। তুমি, তুমি আসো তো।এদিকে আসো। আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না যে তুমি এসেছো।
কুসুম বেগম তার ভাইকে এনে ঘরে বসিয়ে দিলেন। তারপর দ্রুত মেহরাম কে ডেকে নিয়ে আসেন।
কুসুম;; দাভাই, আমাদের সোহেলের বউ।
তমাল;; সোহেলের বউ! মাশআল্লাহ। নাম কি মা তোমার?
মেহরাম;; জ্বি মেহরাম।
তমাল;; মাশআল্লাহ ভারী মিষ্টি তুমি মা।
মেহরাম বসে পরে। নিলা কে বলে খাবার-নাস্তা দিয়ে গেলো। তারপর সবাই এক সাথে বসে কথা বলতে থাকে। মেহরাম তার শাশুড়ী কে খেয়াল করলো। আজ কতোটা দিন ধরে সে এখানে আছে কিন্তু কোন দিনও এভাবে তাকে কাদতে দেখেনি। অনেক বছর পর নিজের কোন আপন জনকে দেখলে বোধ হয় এমনই লাগে। মেহরামের ভাবনাতে ছেদ ঘটিয়ে কুসুম বেগম বলে উঠেন…
কুসুম;; মেহরাম মা উনি আমার বড়ো ভাই।
এবার কুসুম বেগম মেহরামকে সবকিছু খুলে বললেন।
কুসুম বেগম আর তার বড়ো ভাই তমাল আগে একসাথেই থাকতো। কিন্তু কথায় আছে না বাইরে থেকে চাপ পরলে সব জিনিসেরই ফাটল ধরে। ঠিক তেমন। কুসুম বেগমের ভাই তমাল বিয়ে করলে তার বউ কুসুম বেগমকে কোন ভাবেই সহ্য করতে পারেন না। কুসুম বেগমের হাসবেন্ড মারা যাবার পর তো আরো না। এমনকি বাবার সম্পত্তিতেও কোন ভাগ দেয় না। আর কোন উপায় না পেয়ে কুসুম বেগমের ছেলে কে নিয়ে বাইরে বের হয়ে আসতে হয়েছে। আর তমাল মোহাম্মদ উনার চোখের সামনে সবকিছু হয়েও তিনি কিছুই করতে পাছিলেন না। কেননা তমাল মোহাম্মদের বউ তাকে হুমকি দিয়েছিলো যে উনি যদি নিজের বোনের সাইড নেন তাহলে তার বউ তার মেয়েকে নিয়ে বের হয়ে পরবেন। তখন তমাল মোহাম্মদের একটা ফুটফুটে মেয়ে ছিলো। তখন থেকে তমাল মোহাম্মদ শুধু লুকিয়ে লুকিয়েই তার বোন কুসুমের সাহায্য করে এসেছেন। রোজ কথা হতো তার। এর মাঝে সোহেলের মনে তার মামা মামির জন্য ভারি তেজ জমা হয়। কিন্তু সোহেল যখন ধীরে ধীরে বড়ো হলো আর পুরো বেপার টা বুঝলো যে সেখান তার মামার কোন দোষ নেই তখন ঠিক হলো। তমাল মোহাম্মদের মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। আর নিজের ভাবীর জন্য কুসুম তার আপন ভাগ্নীর বিয়েতেও যেতে পারেন নি। বিয়ের দিন লুকিয়ে লুকিয়ে নিজের ভাই আর ভাগ্নীর সাথে কথা বলতে হয়েছে তাকে। তবে প্রায় দু বছর আগে তার ভাবী মৃত্যুবরণ করেন। কুসুম বেগম সেখানে যেতে চাইলে সোহেল সোজা মানা করে দেয়। এমনকি সোহেলের বিয়ে তেও কুসুম বেগম তার ভাইকে ডাকতে পারেন না। আর আজ হঠাৎ করেই তমাল মোহাম্মদ বোনের বাসায় এসে পরেন। কুসুম বেগম বলেছিলেন তো যে নিজের ছেলে বাদে তার আর কেউ নেই। আসলে কথা টা তাকে বাধ্য হয়েই বলতে হয়েছে। কুসুম বেগম সবকিছু মেহরাম কে খুলে বললেন। আর বাম হাতে নিজের চোখ দুটো মুছে ফেললেন। কুসুম বেগম তাকিয়ে দেখেন তার ভাই কাদছে। তারপর নিজ হাতে তার চোখের পানি গুলো মুছে দেন।
কুসুম;; দাভাই হিয়া কে কেন আনলে না। কতো টা দিন ধরে মেয়েটাকে দেখি না বলো তো। (তমাল মোহাম্মদের মেয়ে)
তমাল;; আসলে কি জানিস তো। মেয়েটা ইদানীং খুব ব্যাস্ত থাকে বুঝলি। আমি তাকে বলিই নি যে আমি তোর কাছে আসছি শুনলে তো পাগল হয়ে যাবে।
কুসুম;; (কুসুম বেগম কাদার মাঝেই হেসে দিলেন), এটা কোন কথা।
তমাল;; আচ্ছা পরের বার আসলে ওকে নিয়ে আসবো। আচ্ছা সোহেল বাবা কবে ফিরবে, এতো টা দিন পর এলাম তবুও আমার বাপজান কে দেখতে পেলাম না।
কুসুম;; এসে পরবে জলদিই। ফোন করলে তোমার কথা বলবো নি।
তমাল;; আচ্ছা।
নিজের মামা শশুড়ের সাথে মেহরাম অনেক কথা বললো। যেমন বোন তার তেমন ভাই। খুব মিশুক আর খুব মজার একজন মানুষ। একদিনেই অনেক ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। মেহরাম সোহেল আর নিজের বোন কে তার বাসায় যেতে বলে তমাল মোহাম্মদ চলে গেলেন। মেহরাম তাকিয়ে দেখে কুসুম বেগম মুখে শাড়ির আচল গুজে নিজের ভাইয়ের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে এখনো কাদছেন। এবার সত্যি মেহরামের নিজেরই কান্না বের হচ্ছে। আড়ালে চোখের কোণা মুছে মেহরাম এক পাশ থেকে তার শাশুড়ী কে জড়িয়ে ধরে বলে….
মেহরাম;; আরে মা, এখনো কাদছো কেন। আরে এবার সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে তো। তোমার ওই দজ্জাল ভাবী গেছে পরপারে। এবার তো আর কোন বাধা নেই। ভাই বোন এখন আগের মতোই থাকবে।
কুসুম;; নারে মা একজন মানুষ যতোই খারাপ হোক তার বেপারে এভাবে বলতে নেই। আর ভাবী তো মারা গিয়েছেন। ইন্না-লিল্লাহ। এভাবে বলিস না মা।
মেহরাম;; কেন যে আমার মন টা এতো বড়ো হলো না তোমার মতো।
কুসুম;; ধুর চল ভেতরে যাই। আর তোর ফোন টা দে সোহেলের কাছে ফোন দেই।
মেহরাম;; নাও।
মেহরাম আর তার শাশুড়ী সোহেলের সাথে অনেক কথা বললো। সোহেলও অনেক খুশি হলো এই শুনে যে তার মামা এসেছিলো।
রাতের দিকে সবাই হলরুমে বসে টিভি দেখছিল। মেহরাম কোলে একটা কুশন নিয়ে বসে বসে আপেল খাচ্ছিলো আর কথা বলছিলো। কিন্তু হঠাৎ বসে থাকতে থাকতে মেহরামের কেমন একটা অস্বস্তি লাগতে থাকে। এভাবে আর বসে থাকতে না পেরে পেটে হাত দিয়ে সোজা বেছিং-এ দৌড় লাগায়। আর সাথে গড়গড় করে বমি। কুসুম বেগম দ্রুত গিয়ে মেহরামের পিঠে চাপড় দিতে থাকে। মেহরাম একটু উঠে দাড়াতেই আবার হরহর করে দেয় বমি করে। কুসুম বেগমের বেপার টা কেমন ভালো ঠেকলো না। মেহরামকে নিয়ে আলতো করে বসে পরলো। একটু ঠান্ডা পানি আর লেবু খাইয়ে দেয়।
কুসুম;; কাল যদি তুই আমার সাথে ডাক্তারের কাছে না গিয়েছিস দেখিস কি করি!
মেহরাম;; আরে মা..
কুসুম;; অনেক হয়েছে। মা ভালো আছি, কিছু হয় নি, গরমের কারণে হাবি জাবি কতো কিছু বলে যে আমাকে বুঝ দেয়। কাল উঠেই আগে আমার সাথে ডাক্তারের কাছে যাবি।
মেহরাম;; আচ্ছা যাবো।
কুসুম;; আচ্ছা তুই থাক দেখি আমি আসছি।
মেহরাম;; হুমমম।
কুসুম বেগম ফোন টা হাতে নিয়ে কিছুটা বাইরে চলে গেলো। তারপর সোজা সোহেল কে ফোন দেয়।
কুসুম;; হ্যালো সোহেল।
সোহেল;; হ্যাঁ মা বলো।
কুসুম;; বাবা তুই কবে আসবি?
সোহেল;; মা দু-একদিনের এসে যাবো।
কুসুম;; ওহহ আচ্ছা, একটু জলদি আসিস বাবা।
সোহেল;; কেন মা কিছু হয়েছে? সবকিছু ঠিক আছে তো?
কুসুম;; না মানে মেহরামের শরীর টা অনেক খারাপ যাচ্ছে বুঝলি। একটু আগেই মুখভরে বমি করেছে। আমার না ভালো ঠেকছে না, তুই জলদি এসে পরিস পারলে।
সোহেল;; এই মেয়ে টাও না কি আর বলি। নিজের বেপারে এতো টা কেয়ারলেস। বাড়ির সবার দিকে নজর আছে নিজের দিকে নেই।
কুসুম;; আচ্ছা শোন আমি মেয়েটার কাছে যাই রাখি। তুই জলদি আসিস।
সোহেল;; আচ্ছা মা, আল্লাহ হাফেয।
।
।
তনু;; ঘুমাবে না তুমি? আর কতো কাজ করবে। অফিসেও থাকো সারাদিন বাসায় এসেও কাজ করো!
আয়ুশ;; একটা ডিল ফাইনাল করতে হবে, কাজ তো থাকবেই। শুনো আমার দেরি হবে তুমি ঘুমিয়ে পরো।
তনু;; আচ্ছা আর বেশি রাত জেগো না শুয়ে পরো।
আয়ুশ;; হুম।
প্রায় ১ ঘন্টা কাজ করে আয়ুশ কিছুটা আড়মোড়া ভেংগে উঠে পরে। কি জেন ভেবে নিজের পাশে থাকা ড্রয়ার টা খুলে। এখানে কেউ হাত দেয় না কারণ আয়ুশ বারণ করেছে এখানে তার যাবতীয় সব কিছু রয়েছে। হঠাৎ ড্রয়ার টা খুলতেই আয়ুশের চোখে বাধে একটা ডায়েরি। জীবনেও কখনো ডায়েরি লিখতো না আয়ুশ। কিন্তু এক সময় মেহরামই তাকে ডায়েরি টা লিখা শিখিয়েছে। মেহরামের মতে “যে কথা গুলো তুমি কাউকে বলতে পারো না, কাউকেই না এমন কি নিজের সাথেও তেমন ভাবে না। তাহলে সেক্ষেত্রে এই ডায়েরিই হচ্ছে তোমার সবথেকে বড়ো ফ্রেন্ড। যখন যা ইচ্ছে, যাই মনে পরুক না কেন সব লিখে ফেলো সব।” আয়ুশ ডায়েরি টা হাতে তুলে নেয়। মোটা ফ্রেমের একটা ডায়েরি। মাঝে নীল রঙের একটা সুতো বের হয়ে আছে। সেটা ধরে টান দিতেই একদম মাঝ বরাবর ডায়েরি টা খুলে যায়। আর খুলতেই আয়ুশের ভেতর টা যেন দুমড়েমুচড়ে গেলো। মেহরাম গিটার নিয়ে বসে আছে। আর আয়ুশ তাকে পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে গিটার বাজানো শেখাচ্ছে। মেহরাম মন খুলে হাসছে আর আয়ুশ মেহরামকে দেখতে ব্যাস্ত। সেইদিন টা যেন আয়ুশের চোখে ভেসে উঠলো। আর এখনো কানে মেহরামের হাসির আওয়াজ গুলো বাজতে থাকলো। আয়ুশ ঠাস করে ডায়েরি টা বন্ধ করে দেয়। তারপর আবার আগের জায়গায় ড্রয়ারে রেখে দেয়।
।
।
মেহরাম;; মা না গেলে হয় না ডাক্তারের কাছে গিয়ে কি করবো। কাল রাতে সামান্য ভমেটিং তো হয়েছে।
কুসুম;; চুপ কর মেয়ে। চল।
কুসুম বেগম মেহরামের কথা কে পাত্তা না দিয়ে সোজা চলে যায় হস্পিটালের দিকে। প্রায় ১৫-২০ মিন পর পৌঁছেও যায়। গিয়ে ডাক্তারকে সবকিছু খুলে বললো। ডাক্তার মেহরামকে কিছু টেস্ট করালেন। তারপর এসে আবার নিজের জায়গায় বসলেন। রিপোর্ট হাতে নিয়ে ডাক্তারের মুখে হাসি ফুটে ওঠে..
ডাক্তার যা বললো মেহরাম যেন তা শুনে ৪৪০ ভোল্টের একটা ঝটকা খেলো। মানে কি সে প্রেগন্যান্ট। কোন ভাবেই মেহরাম এটা বিশ্বাস করতে পারছে না। কুসুম বেগম তো খুশিতে পাগল হচ্ছেন। কিন্তু মেহরাম যেন পাথর হয়ে গিয়েছে। সে ঠাই বসে রয়েছে।
কুসুম;; মেহরু কিরে এভাবে বসে আছিস কেন। আমার আগে থেকেই সন্দেহ ছিলো। আল্লাহ আমার দোয়া কবুল করেছেন। মেহরু মা আমার খুশির আর তর সইছে না। সোহেল কে ফোন দিয়ে বলতে হবে। সে তো কেদেই দিবে খুশিতে।
মেহরাম;; না মা প্লিজ তুমি আগেই উনাকে কিছু বলো না।
কুসুম;; কি কেন?
মেহরাম;; উনি আস্তে ধীরে আগে বাসায় আসুক তারপর আমি নিজেই বলে দিবো।
কুসুম;; আচ্ছা বলিস। আগামীকালই সোহেল আসছে তার ডিউটি শেষ প্রায়। তখন না হয় নিজেই বলিস। আর শোন এখন থেকে কিন্তু আমার সব কথা শুনতে হবে। আরে বাড়ির সবাইকে বলতে হবে, আমার যে কি খুশি লাগছে।
মেহরাম তার শাশুড়ীর এমন অবস্থা দেখে হাসছে। সে যাই হোক তারপর সাবধানে তারা বাসায় ফিরে গেলো। কুসুম বেগম গিয়েই মেহরামের যা যা পছন্দের সবকিছু রান্না করলো। এখনো বাড়ির কাউকেই জানানো হয় নি। শুধু মেহরাম আর তার শাশুড়ী জানেন। আগামীকাল সোহেল এলে প্রথমে তাকে জানাবে আর তারপর বাড়ির সবাইকে। রাতে খেয়ে দেয়ে যে যার ঘরে চলে গেলো। রাতে মেহরামের ঘুম উধাও। এখনো যেন তার বিশ্বাসই হচ্ছে না যে সে মা হতে চলেছে। নিজের অজান্তেই আয়ুশের কথা টা মাথায় এসে বারি খায়। মেহরাম আয়ুশের সাথে থেকে যে স্বপ্ন গুলো একটা সুতোয় গেথেছিলো তার সবগুলোই তো পূরণ হচ্ছে কিন্তু অন্য কারো নামে, অন্য কারো সাথে। মেহরাম প্রেগন্যান্ট। বেপার টা কেমন লাগছে তার কাছে। আবার এটা ভেবেও ভালো লাগছে যে নিজের ভেতরেও একটা প্রাণ বড়ো হয়ে ওঠছে। মেহরামের অজান্তেই তার হাত টা তার পেটের ওপরে চলে যায়। মুচকি হাসে সে।
.
পরেরদিন সকালে মেহরাম উঠেই দেখে তার ফোনে সোহেলের ১১ বার ফোন দিয়েছিলো। কিন্তু ফোন সাইলেন্ট থাকার ফলে শুনেনি। ফোনে এতো গুলো কল দেখেই তো মেহরামের মাথায় হাত। সে জলদি সোহেলকে ফোন দেয়। একবার রিং হতেই সোহেল ধরে।
মেহরাম;; হ্যাঁ হ্যালো। আসলে অনেক গুলা সরি ফোন সাইলেন্ট ছিলো আর আমি ঘুম শুনতে পাইনি।
সোহেল;; ইট’স ওকে।
মেহরাম;; আচ্ছা আপনি কোথায়?
সোহেল;; আমি রাস্তায়।
মেহরাম;; মানে?
সোহেল;; মানে আমি বাড়ি আসছি আরকি।
মেহরাম;; আচ্ছা জলদি আসুন। অনেক দরকারি একটা কথা আছে।
সোহেল;; হুম বলো আমি শুনছি।
মেহরাম;; ফোনে বলা গেলে তো গতকালই বলে ফেলতাম।
সোহেল;; আচ্ছা বাবা আমি আসছি। আর তুমি উঠে ফ্রেশ হয়ে নাও।
মেহরাম;; আচ্ছা।
সোহেল;; রাখি।
সোহেল ফোন কেটে দেয়। মেহরামও উঠে ফ্রেশ হয়ে নেয়। আস্তে আস্তে সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল তারপর রাত হয়। আসতে বেশ দেরি হয়ে যায় সোহেলের। বাড়িতে আসতেই দারোয়ান গেট খুলে দেয়। সোহেল সোজা বাড়ির ভেতরে চলে যায়। গিয়েই দেখে তার মা নিলার সাথে কথা বলছে। পেছনে দরজা খোলার শব্দে কুসুম বেগম ঘুড়ে তাকায়। দেখে সোহেল এসেছে। ছুটে ছেলের কাছে চলে যান।
কুসুম;; এসেছিস বাবা?
সোহেল;; হ্যাঁ মা।
মা-ছেলের মাঝে অনেক গল্প হয়। তবে সোহেল খেয়াল করলো অন্যান্য দিনের থেকে তার মা আজ একটু বেশিই খুশি। সারা বাড়িতে চোখ বুলিয়ে দেখলো কিন্তু কোথাও মেহরাম নেই।
সোহেল;; মা মেহরাম কোথায়?
কুসুম;; ওপরে ঘরে আছে, তুই জলদি যা।
সোহেল;; আচ্ছা।
এই বলেই সোহেল দ্রুত পায়ে সিড়ি বেয়ে ওপরে উঠে পরে। রুমের দরজা খুলতেই দেখে মেহরাম একটা বই নিয়ে শুয়ে শুয়ে পরছে। মেহরাম হাসে সোহেলকে দেখে। সোহেল মেহরামের পাশে বসে। তারপর কপালে চুমু খায়।
সোহেল;; কি হয়েছে বলো তো। এভাবে জলদি জলদি আসতে বলছো তুমিও আর মা ও। ক্লিয়ারলি বলো তো হয়েছে কি?
মেহরাম উঠে গিয়ে সোহেলের সামনে দাঁড়ায়। সোহেলও মেহরামের সামনে দাঁড়িয়ে পরে। সোহেল দাড়াতেই মেহরাম হেসে দেয়। কেননা সে অনেক লম্বা। মেহরাম তার বুক অব্দি।
এবার মেহরাম সোজা সোহেলের দিকে তাকিয়ে বলে উঠে…
মেহরাম;; আমি প্রেগন্যান্ট।
মেহরামের প্রেগন্যান্টের কথা শুনে সোহেলের পুরো মুখের নকশাই পালটে গেলো। সে অবাক হয়ে মেহরামের দিকে তাকিয়ে আছে। মেহরামের মুখ টা কেমন মলিন।
আয়ুশের সামনে যেন এখন এই একই কথা বারবার ঘুড়ছে। মানে কি এইসবের?! আয়ুশের হাত থেকে রিপোর্ট কার্ড টা নিচে পরে যায়। সে বিশ্বাসই করতে পারছে না যে এমন কিছু হয়েছে। আয়ুশের হাত ক্রমাগত ভাবে কেপেই যাচ্ছে। সে মাথা তুলে কপাল কুচকে ডাক্তারের দিকে তাকায়। ডাক্তার একজন মহিলা। আর এখন এই অবস্থায় আয়ুশের মনে কেমন লাগছে তা তিনি ভালোই আন্দাজ করতে পেরেছেন। ডাক্তারের চোখে থাকা মোটা ফ্রেমের চশমা টা খুলে টেবিলের ওপর রাখলেন। কিন্তু আয়ুশ আর এবার চুপ করে বসে থাকতে পারলো না।
আয়ুশ;; ডক্টর হুয়াট ডু ইউ মিন? তনুর হয়েছে কি আর সে কেন মা হতে পারবে না? (তড়িঘড়ি করে ডাক্তার কে জিজ্ঞেস করলো)
ডাক্তার;; দেখুন মিস্টার আয়ুশ মিসেস তনু অনেক উঁচু একটা সিড়ি থেকে গড়িয়ে নিচে পরেছে। মাথায় আঘাত পেয়েছ ইন ফ্যাক্ট তিনটে সেলাই পর্যন্ত দিতে হয়েছে। পায়ের অবস্থা ভালো না বেশি। আর উনি তার পেটের নিচের অংশে অস্বাভাবিক ব্যাথা পেয়েছেন। এতে আমাদের মহিলার বডিতে অর্থাৎ যে স্থানে বেবি কনসিভ করা হয় সেই স্থানে গভীর যখম হয়েছে। আর সাধারণত সেই জায়গা টা অনেক বেশি কোমল হয়। এছাড়াও প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। বডিতে ব্লাড সাপ্লাই করতে হবে।
আয়ুশ;; আমি এবার সবাইকে কি বলবো। জানি এতে তনুর কোন দোষই নেই কিন্তু…
ডাক্তার;; আমি বুঝতে পারছি এখন আপনার ওপর দিয়ে কি যাচ্ছে কিন্তু কি আর করার।
আয়ুশ;; তততনু এখন কেমন আছে?
ডাক্তার;; তেমন একটা ভালো না, জ্ঞান ফিরে নি এখনো। বেশ টাইম লাগবে, এখনো আমরা কিছু বলতে পারি না। ব্লাড উনার বডিতে পুশ করা হয়েছে। ভাবলাম বেপার টা সেন্সেটিভ তাই আপনাকে বলে ফেললাম।
আয়ুশ হাল্কা মাথা নাড়িয়ে বের হয়ে পরে কেবিন থেকে। আয়ুশ বাইরে বের হতেই সবাই যেন ঝাপটে ধরে তাকে। সাথে সাথে রিপোর্ট টা লুকিয়ে ফেলে। তবে আয়ুশ শুধু সবাইকে শান্ত থাকতে বলছে। কাউকেই কিছুই টের পেতে দিচ্ছে না। সবাইকে শুধু বলছে “তনু ঠিক আছে জ্ঞান ফিরবে একটু পরেই”। আয়ুশ তখন সামনের দিকে তাকায় দেখে যে মেহরাম তার দিকে তাকিয়ে আছে এক নয়নে। আয়ুশ চোখ নামিয়ে ফেলে। কোন রকম ভাবে সেখান থেকে এসে অন্য জায়গায় দাঁড়িয়ে পরে। মেহরাম তা খেয়াল করেছে। তনুর মা আতিয়া দম ছাড়ছে না কোন ভাবেই, কাদতে কাদতে নাজেহাল অবস্থা। মেহরামের আম্মু আর চাচ্চু মানে তনুর বাব কোন রকমে বুঝাচ্ছে। মেহরাম এবার জোর করেই কিছুটা পানি খাইয়ে তার চাচি কে শান্ত করায়। কিছুক্ষন পরই মেহরাম আয়ুশের যাওয়ার দিকে তাকায়। তাদের বসিয়ে ভালো ভাবে বুঝিয়ে মেহরাম তাদের কাছ থেকে এসে পরে। আয়ুশ যেদিকে গিয়েছে সে দিকে যায়। কিন্তু পায় না। আরেকটু সামনে এগিয়ে আশে পাশে তাকায় মেহরাম। গেতেই দেখে আয়ুশ দুহাত ভাজ করে কাচের জানালা দিয়ে বাইরে অপলক ভাবে তাকিয়ে আছে। তার চোখে মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। মেহরাম ধীর পায়ে তার দিকে এগিয়ে যায়। আয়ুশের পেছনে দাঁড়িয়ে মেহরাম এক প্রকার দোটানাতে পরে যায় যে আয়ুশকে ডাক দিবে কি দিবে না। তবুও এক সময় মেহরাম ডেকে ওঠে…
মেহরাম;; আয়ুশ!
মেহরামের ডাকে আয়ুশ চোখ মুখ মুছে পেছনে তাকায়।
আয়ুশ;; হুম বলো।
মেহরাম;; কি হয়েছে?
আয়ুশ;; না কিছু না।
মেহরাম;; মিথ্যা বলো না, আমি বুঝি। ডক্টর কি বলেছে?
আয়ুশ;; তনু ভালো আছে।
মেহরাম;; আয়ুশ ক্লিয়ারলি বলো প্লিজ এটা লুকানোর কোন কথা না, বেপার টা আমার বোনের প্লিজ বলো।
আয়ুশ;; একজন ডোনেট করেছে তার ব্লাড গ্রুপের সাথে তনুর ব্লাড গ্রুপ মিলে গিয়েছিলো। হাতে সময় কম ছিলো তাই দিয়ে দিয়েছে।
মেহরাম;; আর কি?
আয়ুশ;; এই টুকুই।
মেহরাম;; আয়ুশ মিথ্যে বলো না অযথা যা তুমি পারো না। হয়েছে কি তনুর??
আয়ুশ জানে মেহরাম কিছু বেপারে অনেক বেশি জেদি তাই বলে লাভ নেই। তাই সে তার হাতে থাকা রিপোর্ট কার্ড টা মেহরামকে দিয়ে দেয়। মেহরাম কপাল কুচকে আয়ুশের হাত থেকে রিপোর্ট কার্ড টা নেয়। দ্রুত গতিতে সেটা খুলে সারা টা একবার চোখ বুলায়। মেহরাম কতোক্ষণ রিপোর্টের দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা তুলে আয়ুশের দিকে তাকায়। আয়ুশ এতোক্ষণ মেহরামের দিকে এক নয়নে তাকিয়ে ছিলো। মেহরাম চোখ তুলে আয়ুশের দিকে তাকালেই আয়ুশ দেখে মেহরামের চোখ লাল হয়ে গিয়েছে একদম। টুপ করে দু ফোটা জল রিপোর্টের ওপর পরে যায়।
মেহরাম;; নননা আআয়ুশ ককি বলছে ডাক্তার এএএগুলো? এটা কি করে হহতে পারে?
আয়ুশ;; এটা সত্য।
মেহরাম;; ননা তনুর এমন হতেই পারে না। কখনো না রিপোর্ট হয়তো ভুল এসেছে আয়ুশ, আয়ুশ তুমি প্লিজ তুমি আরেকটা বার ভালোভাবে চেকাপ করাও না আয়ুশ আমার চাচি পাগল হয়ে যাবে। পুরো পরিবার ভেংে পরবে। আয়ুশ প্লিজ। (কেদে)
আয়ুশ;; আমার কিছুই করার নেই মেহরাম, এটাই সত্য। আমি তো এটাই ভেবে পাচ্ছি না যে আমি তনু কে কিভাবে এটা বলবো আর সবাইকেই বা কি করে বুঝাবো।
মেহরাম;; মানি না এই রিপোর্ট ভুয়া, আমি বিশ্বাসই করি না। তনু…
আয়ুশ;; ______________
মেহরাম একটা শকের ভেতর আছে। কি থেকে কি হয়ে গেলো তাই সে ভেবে কুল পায় না। এখন বর্তমানে পুরো পরিবারে আয়ুশ & মেহরামই শুধু জানে তনুর বেপার টা। এর মধ্যে কেউ কিছুই জানতে পারে নি। আয়ুশ আর মেহরাম চলে যায়। গিয়েই দেখে সবার মুখে এখনো চিন্তা লেগে আছে। ধীরে ধীরে সময় গড়িয়ে রাত হয়। তবুও তনুর জ্ঞান ফিরে না। হস্পিটালে কাউকে না কাউকে থাকতে হবে। আয়ুশ আর মেহরাম সবাইকে জোর করে বাসায় পাঠিয়ে দেয়। রাতে শুধু মেহরাম আর আয়ুশ থেকে যায় হস্পিটালে৷ এর মধ্যে মেহরামের কাছে সোহেল অনেকবার ফোন করেছে তনুর বেপারে জানার জন্য। কিন্তু তনু তেমন একটা ভালো নেই দেখে সোহেল হস্পিটালে আসতে চায়। মেহরাম অনেক বার বারণ করে। বাসায় একা তার শাশুড়ী কে রেখে কি করে আসবে আর এখানে থাকার মতো মানুষ আছে আরো কতো কি বলে মেহরাম কিন্তু সোহেল জেদ করেই হস্পিটালে এসে পরে। সোহেল এসেই দেখে মেহরাম তনুর কেবিনের দরজা দিয়ে তাকিয়ে আছে, মুখ টা একদম মলিন হয়ে গিয়েছে। দেওয়ালের সাথে লাগিয়ে থাকা চেয়ার গুলোতে একজন ব্যাক্তি মাথায় দুহাত ঠেকিয়ে বসে আছে। মেহরাম হঠাৎ পাশে তাকিয়ে দেখে সোহেল তার দিকে তাকিয়ে আছে। মেহরাম দৌড়ে চলে যায় তার কাছে। সোহেল তাকে জড়িয়ে ধরে। আয়ুশ মাথা তুলে তাদের দিকে তাকায়। আবার সাথে সাথে মাথা নিচে নামিয়ে ফেলে। মেহরাম তো সোহেল কে ধরেই কেদে দিয়েছে।
সোহেল;; আহা মেহরু কাদে না সবকিছু তো ঠিক হয়ে যাবে। এভাবে তুমি কাদলে সেদিকে বাড়িতে কি করে সামলাবে। কাদে না।
সোহেল তার হাত দিয়ে মেহরামের চোখের পানি টা মুছে দেয়। সোহেল এবার মেহরাম কে ছেড়ে আয়ুশের কাছে যায়।
সোহেল;; কিছু হবে না আল্লাহ সমস্যা দিয়েছেন উনিই আবার ঠিক করবেন। ভেংগে পড়বেন না একদম। তা নাহলে তনুর আরো বেশি কষ্ট হবে।
আয়ুশ;; জ্বি। আপনি কবে এসেছেন?
সোহেল;; আমি আসলে ১ সপ্তাহের জন্য বাইরে গিয়েছিলাম গতকাল এসেছি।
আয়ুশ;; হুম।
আয়ুশ আর সোহেল একে ওপরের সাথে কথা বলছে আর মেহরাম পায়চারি করেই যাচ্ছে। হুট করেই একজন ওয়ার্ডবয় এসে তাদের বলে…
ওয়ার্ডবয়;; পেসেন্টের জ্ঞান ফিরেছে। মাত্র একজনই দেখা করতে পারবে। কে আসবে?
এই সময় তনুর সাথে তার হাসবেন্ডের দেখা করতে দেওয়া টাই উত্তম হবে তাই ভেবে মেহরাম চেয়েও কিছুই বললো না। কিন্তু আয়ুশ মেহরামের মনের অবস্থা টা বুঝতে পারলো। তাই আয়ুশ বলে ওঠে…
আয়ুশ;; মেহরাম!
মেহরাম;; হুম।
আয়ুশ;; তুমি যাও।
মেহরাম;; আম..আমি কি করে যাই?
আয়ুশ;; যাও তুমি দেখা করে এসো।
যাই হোক মেহরাম একবার সোহেলের দিকে তাকিয়ে চলে গেলো তনুর কেবিনে।
মেহরাম গিয়েই দেখে তনুর মুখে মাস্ক লাগানো, হাতের দুই জায়গায় সুই পুশ করে রেখেছে। গালে কিছুটা ব্যান্ডেজ করা, মাথায় করা। আধো আধো ভাবে তনু চোখ খুলছে। তনুর এই অবস্থা দেখেই মেহরামের বুকে কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো। মেহরাম আস্তে আস্তে পা ফেলে তনুর দিকে যাচ্ছে। তনু হয়তো মেহরামকে দেখেছে তাই হাত টা হাল্কা ওপরে তুলে মেহরামের দিকে ইশারা করে। মেহরাম আর এবার নিজেকে ধরে রাখতে পারে না ছুটে গিয়ে তনুর হাত ধরে ফেলে অঝোরে কেদে দেয়।
মেহরাম;; আমি কখনো ভাবি নি যে এমনও হবে, আমি জানি না কি বলবো কি করবো কিন্তু প্লিজ যাতে তোর কিছু না হয়। আমি পাগল হয়ে যাবো তোর কিছু হলে।
মেহরামের কথায় তনু সেভাবেই মুচকি হাসে।
মেহরাম তনুর হাত টা নিজের দুহাতের মাঝে এনে রেখেছে৷ তনু আস্তে হাত টা তুলে মেহরামের চোখের পানি মুছে দেয়। তারপর নিজের হাতের দু আঙুল দিয়ে মেহরামের ঠোঁটের দুপাশে ধরে সরু টান দেয়। যার মানে স্মাইল। এমন করা মেহরামই তনু কে শিখিয়েছিলো। মেহরামের মতে “যা কিছুই হোক দুনিয়া এদিক থেকে ওদিক হয়ে যাক কিন্তু মুখ থেকে যেন হাসি দূর না হয়। পান থেকে যেমন চুন খষে পরতে দেয় না তেমনই মুখ থেকে যেন হাসি খষে না পরে”। তনুর যখনই কোন বেপারে মন খারাপ থাকতো তখন মেহরাম এভাবে হাতের আঙুল দিয়ে তনুর ঠোঁটে ধরে স্মাইলের মতো করতো আর তনু হেসে দিতো। আজকে মেহরামকে এভাবে কাদতে দেখে তনু নিজেও তেমনই করলো। বেপার টা খেয়াল করতেই মেহরাম হেসে দেয়।
মেহরাম;; আসলেই তুই বদের হাড্ডি, হারামী একবার খালি ঠিক হ।
তনু তার মুখের মাস্ক খুলতে চাইলে মেহরাম তার হাত দিয়ে তনুর কে আটকিয়ে দেয়।
মেহরাম;; I swear, তোর যদি কিছু হয় তাহলে আমি তোকে মেরেই ফেলবো (কেদে)
তনু হাতের ইশারাতে মেহরাম কে কাছে ডাকে মেহরাম তনুর দিকে ঝুকে নিজের কান তনুর মুখের ওপর পাতে।
তনু;; এমনিতেই মরছি আর কতো মারবি!(ফিসফিস করে খুব আস্তে)
মেহরাম এবার হেসে দেয়। মেহরাম তনুর সাথে কথা বলছিলো তখনই একজন নার্স এসে মেহরাম কে বলে…
নার্স;; ম্যাম এখন পেসেন্টের রেস্ট নেবার সময়। আপনি যদি একটু বাইরে যেতেন তাহলে…!
মেহরাম;; জ্বি জ্বি অবশ্যই, তনু তুই রেস্ট নে কেমন আমি যাই হ্যাঁ। আর আমি, সোহেল, আয়ুশ সবাই এখানেই আছি।
মেহরাম তনুর মাথায় একটা চুমু খেয়ে চলে যায়। বাইরে বের হতেই আয়ুশ মাথা তুলে তার দিকে তাকায়। মেহরাম এবার বলে…
মেহরাম;; ভালো আছে তনু।
সোহেল;; আলহামদুলিল্লাহ।
মেহরাম গিয়ে সোহেলের পাশে বসে সোহেল এক হাতে মেহরামকে জড়িয়ে ধরে। আয়ুশ ফট করে উঠে সেখান থেকে চলে যায়। আয়ুশ এক হাতে চোখের জল মুছছে আর সামনে হাটছে। মেহরাম আয়ুশের দিকে তাকিয়ে আছে। সোহেলও দেখলো।
সোহেল;; নিজের বউয়ের এই অবস্থা কোন স্বামীই সহ্য করতে পারবে না তাই হয়তো চলে গিয়েছে।
মেহরাম;; হুম।
মেহরাম আবার ঠিক হয়ে তার জায়গায় বসে। সোহেলের কাধে মাথা রেখে দেয় আর সোহেল এক হাত দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে মাথায় চুমু খায়। এভাবেই দিন যেতে থাকে আজ তিনদিন তনু হস্পিটালে এডমিট। এই তিনদিনে অনেক উন্নতি হয়েছে তনুর কন্ডিশনে। এখন খানিক সুস্থ সে। পুরো পরিবার এসে দেখে গেছে তনু কে। তবে তনুর মা না হতে পারার বেপার টা এখনো কেউ জানেনা শুধু আয়ুশ আর মেহরাম বাদে। আজ তনুর ব্যান্ডেজ খুলবে মাথার।
এখন মেহরাম আর আয়ুশ তনুর দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে। আয়ুশ তনু কে খাইয়ে দিচ্ছে আর মেহরাম অনেক গল্প করছে তনুর সাথে। খানিক পর খাওয়া শেষ হলে আয়ুশ তনুর মুখ মুছে দিতে থাকে তখন ডাক্তার আসে কেবিনে।
ডাক্তার;; এখন কেমন ফিল হচ্ছে?
তনু;; ফাইন ডক্টর। (মুচকি হেসে)
ডাক্তার;; হুমমম।
ডাক্তার তনুর পাশে বসে। তনু সোজা হয়ে বসে আছে আর ডাক্তার ধীরে সুস্থে তনুর মাথার ব্যান্ডেজ খুলে দিতে থাকে। ঘা অনেক টাই সেরে উঠেছে শুধু কপালের সাইডে একটু যখম আছে। ডাক্তার তাতে মেডিসিন দিয়ে ওয়ান টাইম ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দেয়।
ডাক্তার;; আপনারা আগামীকাল উনাকে বাসায় নিয়ে যেতে পারেন। হ্যাভ এ নাইস ডে।
এই বলেই ডাক্তার বের হয়ে পরে৷ তনু মুচকি হাসে আয়ুশ আর মেহরমের দিকে তাকিয়ে।।
মেহরাম;; তো তোরা থাক আমি এবার যাই বাইরে।
তনু;; আরে না কোথায় যাচ্ছিস, এখানে বোস।
মেহরাম;; বুঝিস না কেন, তোরা দুইজন থাক না একটু একা। আমি থেকে কি করবো আমি যাই।
মেহরাম বের হয়ে পরে। তনুর আটকিয়েও রাখতে পারে না ওকে। তনু আর আয়ুশ কথা বলছে কিন্তু মেহরান বাইরে এসে আগে বাড়িতে ফোন দেয়। সবার সাথেই কথা হয় তার। তনু কে বাড়িতে নিয়ে যাবার কথাও বলে। এবার মেহরামের চাচি আর পুরো বাড়িতে যেন একটু শান্তি আসে। তনুর শাশুড়ীও কেদে কেটে শেষ করেছে। তাদের সবার সাথেও অনেক কথা হয়, তারপর রেখে দেয়। মেহরাম এবার একটু তনুর কেবিনের দিকে যায়। দরজাতে থাকা গোল গ্লাসের ভেতরে দিয়ে তাদের দেখে। দেখে যে তনু আয়ুশের বুকে মাথা রেখে শুনে আছে। মেহরাম তা দেখে তৎক্ষণাৎ চোখ নিচে নামিয়ে ফেলে তারপর এসে পরে।
।
পরেরদিন তনুর মা বাবা, বড়োমা শাশুড়ী যায় হস্পিটালে। আয়ুশ আর মেহরাম তনুকে ধরে ধরে হস্পিটালের বাইরে আনে। তারপর গাড়িতে করে চলে যায়। বাসায় নেমে খুব আস্তে করে তনু পা ফেলে কেননা পায়েও ব্যাথা পেয়েছিলো। ধীরেধীরে হেটে ঘরের ভেতরে আসে। আয়ুশ তনুকে ধরে বিছানাতে শুইয়ে দেয়। তারপর চাদর টেনে দেয়। এতোক্ষণ তনুর সেই রিপোর্ট কার্ড টা মেহরামের কাছেই ছিলো তা সে আয়ুশের হাতে দিয়ে দেয়। আয়ুশে কার্বাডে খুব সাবধানে তা রেখে দেয়। কথা বার্তা বলে তনুর সাথে দেখা করে তনুর বাবা মা আর বড়োমা তাদের বাসায় চলে যায় আর মেহরাম তার শশুড় বাড়িতে চলে যায়। এভাবেই দিন যায় যেতে যেতে আরো এক সপ্তাহ পার হয়। তনু এখন অনেকটাই সুস্থ মাঝে মাঝে শুধু তীব্র মাথা ব্যাথা উঠে৷ একদিন আয়ুশ অফিসে যায় না ইচ্ছে করেই। গেতে নাকি তার মোটেও ভালো লাগছে না তাই আর যায় না। তনু রুম গোছাচ্ছিলো হঠাৎ আয়ুশের ফোন বেজে ওঠে কিন্তু সে তো ওয়াসরুমে। তনু তবুও ফোন টা নিয়ে আয়ুশকে দেয়। আয়ুশ একহাত বাড়িয়ে কোন রকমে ফোন টা নিয়ে নেয়। আয়ুশের বের হওয়ার সময় হয়ে গেছে। তনু এবার হাল্কা চিল্লিয়ে আয়ুশকে বলে ওঠে..
তনু;; এইই তোমার জন্য কোন শার্ট বের করবো?
আয়ুশ;; দেখো যেটা ভালো লাগে।
তনু;; আচ্ছা।
তনু কাবার্ডে হাত দিয়ে এক এক করে শার্ট উল্টিয়ে উল্টিয়ে দেখছিলো, কোন টাই ভালো লাগছিলো না। অবশেষে একটা কফি কালারের শার্ট তনুর হাতে বাধে। সে তা নিয়ে নেয়। কিন্তু শার্ট টা টান দিয়ে বের করার সময় কার্বাড থেকে একটা কালো ফাইল নিচে পরে। তনু হাল্কা ভ্রু কুচকে সেটার দিকে তাকায়। তারপর নিচে ঝুকে হাত তুলে নেয়। শার্ট টা হাত থেকে বিছানার ওপর রেখে ফাইল টার ভেতরে খুলে তনু। তনু খেয়াল করে যে সে যেই হস্পিটালে এডমিট ছিলো এটা সেই হস্পিটালেরই ফাইল। নামের জায়গায় তনু তার নিজের নাম দেখতে পায় ‘আশফিয়া তনু’। তনুর এবার কেমন যেন খটকা লাগে যে তারই রিপোর্ট অথচ সেই এতোদিন দেখি নি, আজব। তনু ধীরে ধীরে ফাইল টা আরো দেখে, ভালোভাবে ঘাটাঘাটি করে। আর ফাইনাল রেজাল্ট যখন তনু দেখে তার যেন মাথা টা কেমন চক্কর দিয়ে উঠলো। একটা কাচের গ্লাস যখন ভেংে একদম চুরচুর হয়ে যায়। এখন তনুরও ভেতরে থাকা মন টা একদম ভেংগে খানখান হয়ে গিয়েছে। তনুর গাল বেয়ে ঝড়ে পরছে অজস্র নোনাজল। ঠিক তখনই আয়ুশ ওয়াসরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে চুলগুলো টাওয়াল দিয়ে মুছতে মুছতে বাইরে এলো। বাইরে এসেই দেখে তনুর হাতে ফাইল। আয়ুশ তো বেশ ঘাবড়ে গেলো দেখে। আর তনু জোরে জোরে দম ফেলছে আর আয়ুশের দিকে অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকিয়ে আছে।
।
।
।
।
🍁চলবে~~
#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#{বোনাস পার্ট 🥀}
🧚♀️
.
.
.
.
তনু হাতে তার রিপোর্ট কার্ড টা নিয়ে ছলছল চোখে আয়ুশের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু আয়ুশ যে এখন কি বলবে তারই ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না।
আয়ুশ;; ততনু..
তনু;; ____________
আয়ুশ;; ততনু আসললে…
তনু;; এটা তোমার কাছে ছিলো কিন্তু তুমি আমায় বলোনি!
আয়ুশ;; আমি..
তনু;; কেন বলোনি আমায়? (কিছুটা চিল্লিয়ে কেদে)
আয়ুশ;; কি বলতাম আমি, কিভাবে বলতাম আমি। আমি ভেবেছি তুমি এই শকটা সেড়েই উঠতে পারবে না তাই বলি নি।
তনু;; রোগ টা আমার, মা না হতে পারার অক্ষমতা টা আমার আর তুমি আমাকেই বলোনি। এতো বড়ো একটা কথা কিভাবে লুকাতে পারলে তুমি আমার কাছ থেকে?
আয়ুশ;; _______________
তনু;; আর কেকে জানে?
আয়ুশ;; কেউ জানে না। বাড়ির কেউ না।
তনু;; কিন্তু তুমি..
আয়ুশ;; মেহরাম জানে।
আয়ুশের এই কথায় তনু এবার বাকরুদ্ধই হয়ে গেলো। সে ভেবেছিলো আর কেউ জানুক বা না জানুক কিন্তু মেহরাম যদি জানে তাহলে তাকে বলবেই। কিন্তু না এই কথা টা মেহরাম পর্যন্ত তনুর কাছ থেকে লুকালো। এগুলো এখন তনু ভাবছে।
তনু;; মেহ..মেমেহররু জাজানতো এএটা।
আয়ুশ;; হ্যাঁ।
এবার তনুর হাত থেকে ফাইল টা নিচে পরে যায়। তনু ধপ করে সেখানেই ফ্লোরে বসে পরে। গাল বেয়ে ঝরে পরছে অশ্রুবিন্দু। আয়ুশ দ্রুত গিয়ে এক হাতে তনু কে ধরে ফেলে। তনু এক পলক আয়ুশের দিকে তাকিয়ে আর নিজেকে সামলাতে পারে না। ঢুকরে কেদে উঠে। আয়ুশের ভাষা নেই সে এখন তনুকে কি বলে থামাবে বা কি বলেই শান্তনা দিবে তা সে জানে না।
তনু;; কেন, কেন এমন হলো আমার সাথেই। আমার কি দোষ ছিলো, সবারই তো জীবনের চাওয়া-পাওয়া থাকে তাই না। আমারও তো কত্তো স্বপ্ন ছিলো যে আমার একটা ছোট্ট পরিবার হবে, আমার কোল আলো করেও একটা ছোট প্রাণ আসবে। যে আমাকে মা ডাকবে, পুরো বাড়িকে মাতিয়ে রাখবে। কিন্তু মূহুর্তেই সব কিছু ভেংগে চুরমার হয়ে গেলো। সব শেষ সব। কখনো ভাবি নি আমার সাথে এমন হবে। কেন হলো ও আয়ুশ বলো না। আমার কি কখনো কোন বাচ্চা হবে না। আমি কখনো মা ডাক শুনতে পারবো না। কেন বেচে আছি আমি এখনো। তুমি কেন এটা আমার কাছ থেকে লুকালে, কাউকে কেন বলো নি। তুমি ভাবতে পারছো এই কথা টা যখন সবাই জানবে তখন সবার ওপর দিয়ে কি যাবে। তাদেরও তো কতো কল্পনা ছিলো তাই না, যে নিজের একমাত্র ছেলের ঘরের বাচ্চা হবে, কিন্তু আমার ভাগ্য এতো টাই খারাপ। আয়ুশ। (পাগলের মতো কেদে)
তনুর পাগলামো বাড়ছে তাই আয়ুশ কোন রকমে তনুকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করায়। এভাবে তারা কতোক্ষণ ছিলো তার ঠিক নেই। কিন্তু এবার তনু উঠে পরে। নিজের চোখ মুখ ভালোভাবে মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে।
তনু;; আয়ুশ।
আয়ুশ;; কি করছো তুমি?
তনু;; আমি নিচে যাচ্ছি।
আয়ুশ;; কিন্তু কেন?
তনু;; আয়ুশ আমি পারবো না এতো বড়ো একটা কথা পরিবারের সবার কাছ থেকে লুকাতে। আমি তাদের এক মিথ্যে আশায় আশাবাদী করতে পারবো না।
আয়ুশ;; কিন্তু তনু আমার কথা টা…
তনু উঠেই সোজা চলে যায় হলরুমে। আয়ুশ তাকে আটকানোর অনেক চেষ্টা করছে কিন্তু তনু অনেক জেদি সে তার কথা না শুনেই দ্রুত নিচে নেমে পরে। নিচে নামতেই তনু দেখে তার শশুড়-শাশুড়ী, কণা সবাই একসাথেই বসে আছে। তনুকে এভাবে জলদি নিচে নামতে দেখে কণা বলে ওঠে…
কণা;; আরে ভাবী কি হলো, এভাবে তেড়ে নিচে নামছো কেন?
তনু;; মা-বাবা আপনাদের সাথে কিছু কথা ছিলো আমার। মানে সবার সাথেই আর কি।
লায়লা খাতুন(আয়ুশের মা);; হ্যাঁ মা বল না, কিন্তু তার আগে আয় খেতে আয়।
তনু;; মা বেপার টা আমাকে নিয়ে আর খুব বেশি সিরিয়াস।
মতিন আলম(আয়ুশের বাবা);; তনু মা হয়েছে কি বল তো?
তনু এগুলো বলছিলো ঠিক তখনই আয়ুশ ওপর থেকে নিচে নামে। নিচে নেমেই দেখে তনু দাঁড়িয়ে আছে আর সবাই অবাক নিয়ে তনুর দিকে তাকিয়ে আছে। তনু এবার গিয়ে বসে পরে৷ তার শশুড়-শাশুড়ী এবার বেশ চিন্তায় পরে গেলেন। কেননা যতো বড়োই কথা হোক না কেন তনু কখনোই এমন করে না কিছু নিয়ে। সবাই তনুর পাশে বসে পরে। কিন্তু আয়ুশ মুখে চিন্তার রেখে দাঁড়িয়ে আছে দূরে।
তনু;; মা-বাবা দেখুন আমি জানি যে আয়ুশ আপনাদের একমাত্র ছেলে। তো নিজের ছেলের ঘর থেকে প্রথম নাত-নাতনি আশা করা টা স্বাভাবিক। কিন্তু হয়তো সেই আশা আর পূরণ হবার নয়। আমিই পারব না।
লায়লা;; কি বলছো তনু এইসব। এগুলোর মানে কি?
তনু;; মা, মা আমি নিজেই এই কথা টা জানতাম না। আয়ুশ আমাকে বলেনি এই ভেবে যে আমার ওপর কি যাবে (আয়ুশের দিকে তাকিয়ে)। কিন্তু মা আমি আপনাদের সবাইকে এটা না বলে পারতাম না। মা, আমি কখনো মা হতে পারবো না।
তনুর এই কথায় সবাই চুপ মেরে গেলো। তনু যে এখন এসে সবাইকে এই কথা বলবে তা সবার ধারণারও বাইরে ছিলো। তনু ভেবেছে হয়তো এই কথা টা শোনার পর তনুর শাশুড়ী সোজা তাকে বাড়ি থেকে বা আয়ুশের জীবন থেকে বের হয়ে যেতে বলবে কিন্তু না তিনি তা করেন নি। আর আয়ুশও শুধু তনুর কথাই ভেবেছে তাকে কখনো কোন কটু কথা বলেনি। তনু তার মাথা নিচে নামিয়ে কেদেই যাচ্ছিলো হঠাৎ তার মাথায় কারো স্পর্শ অনুভব হতেই তনু মাথা তুলে তাকায়। দেখে যে তার শাশুড়ী তার মাথায় হাত দিয়ে রেখেছে তনু মাথা তুলে তার দিকে তাকালে দেখে তার শাশুড়ীর মুখে রাগের বদলে হাসি জ্বলছে। তনু তার শাশুড়ীকে জড়িয়ে ধরে…
লায়লা;; না রে মা তুই কি ভেবেছিস তোকে আমরা এখন তুচ্ছ মনে করবো বা বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলবো পরিবার থেকে আলাদা করে দিবো। এমন হয় না মা। সব শাশুড়ীই তো আর এক হয় না। বাচ্চা দেওয়া মানেই যে পরিবার পূর্ণ আর না দিতে পারা মানেই যে অপূর্ণ তা না। সব শাশুড়ী রা এক হয় না। তোকে কি বলবো এই এক্সিডেন্ট টা যদি আমার নিজের মেয়ের সাথে হতো তাহলে। আমার নিজেরও তো একটা মেয়ে আছে নাকি। আল্লাহ না চাইলে কিছুই হয় না। আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।
সবাই তনুর এই বেপারে কোন রিয়েকশনই করে না। উলটো তাকে বুঝ দেয়।
।
।
তনু আর আয়ুশ রুমে বসে আছে। আয়ুশ ল্যাপটপে কাজ করছে কিন্তু তনুর মধ্যে কোন হুশ নেই। সে এক মনে তাকিয়ে আছে। আসলে সে এখনো এটাই মেনে নিতে পারছে না যে সে কখনো কারো মা হতে পারবে না। তনু আয়ুশের দিকে তাকিয়ে দেখে সে নিজের মতো কাজ করছে। তনু হঠাৎ বলে উঠে…
তনু;; আমি একটু বাইরে যাবো।
আয়ুশ;; কোথায় যাবে? বলো আমায় আমি দিয়ে আসবো। (কাজ করতে করতেই)
তনু;; না তোমার কষ্ট করে যেতে হবে না। আমি একাই যেতে পারবো আর জলদি এসে পরবো। আমি যাই তুমি থাকো।
আয়ুশ;; ওকে।।
এই বলেই তনু বের হয়ে পরে। বাইরে এসেই রিকশা পেয়ে যায় তাতে করে উঠে চলে যায়। প্রায় বেশ খানিক সময় পর এসেও পরে। মূলত সে মেহরামের শশুড় বাড়িতে এসেছে। রিকশা থেকে নেমেই বাড়ির ভেতরে চলে যায় তনু। কলিং বেল বাজাতেই বাড়ির কাজের লোক এসে দরজা খুলে দেয়। তনু ভেতরে যায়, ভেতরে গেতেই দেখে মেহরামের শাশুড়ী বসে আছে। তিনি তনু কে দেখে হাসি মাখা মুখ নিয়ে কাছে আসেন।
কুসুম;; আরে তনু মা যে কেমন আছো? আর এভাবেই হুট করে এসে পরলে আগে বলতে আয়জোন করে রাখতাম।
তনু;; না খালামনি আমিও ঠিক করিনি যে এভাবে আসবো। কিন্তু এসে পরলাম। আসলে মেহরামের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম একটু।
কুসুম;; হ্যাঁ আমি ডেকে দিচ্ছি।
তনু;; না না খালামনি ওকে আর এখানে আসতে হবে না আমিই বরং ওর রুমে যাই। জিজু নেই তো আবার?
কুসুম;; হাহা, না নেই তুমি যাও।
তনু;; আচ্ছা।
তনু এই বলেই মেহরামের রুমে চলে গেলো। মেহরাম বসে বসে কাপড় ভাজ করছিলো তখনই হুট করেই তনু তার রুমে আসে। তনুকে দেখেই তো মেহরাম লাফিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠে। তনুও একই অবস্থা। দুই বোনই চিল্লিয়ে ছুটে গিয়ে একে ওপরকে জড়িয়ে ধরে। মেহরাম তো অনেক খুশি হয়েছে এভাবে তনুকে এখানে দেখে। দুজনেই হাসছিলো কিন্তু হাসার মাঝেই তনু হুহু করে কেদে দেয়। মেহরাম অবাক হয়ে গেলো। তনু কে নিজের কাছ থেকে ছাড়াতে চাইলে তনু যেন আরো শক্ত ভাবে মেহরামকে জড়িয়ে ধরে।
মেহরাম;; হলো কি তোর তনু এভাবে কেদে দিলি কেন? এই তনু!
তনু;; কি লাভ পেলি বল আমার থেকে বেপার টা লুকিয়ে।
মেহরাম;; মানে?
তনু;; আমি কখনো মা হতে পারবো না।
মেহরাম চকমে উঠে তনুর কথায়। তার মানে তনু পুরো বেপার টা জেনে গেছে।
মেহরাম;; তনু তুতুই!
তনু;; আমি জানি আমি সব জানি। আজকে আমার রিপোর্ট টা আমি পাই। আর কেউ বলুক বা না বলুক তুই তো বলতে পারতি মেহরু আমায়। কেন বলিস নি? (কেদে)
মেহরাম;; কারণ এটা যদি তখন তুই জানতি তাহলে হয়তো সেই আঘাত থেকে তুই বের হতেই পারতি না। কেননা তোর তখন কন্ডিশন টা বেশি ভালো ছিলো না তার ওপর এই কথা। এটা জানলে তুই নিজেই ঠিক থাকতে পারতি না। জানি তোর এখন খারাপ লাগছে যে আমি কেন তোকে আগে বলি নি। কিন্তু যা করেছি তা তোর ভালোর জন্য।
তনু;; কিন্তু বোন আমার ভালো আর হলো কই। কোথাও না কোথাও এক কমতি থেকেই গেলো।
তনু এই কথা বলে আবার কেদে মেহরাম কে জড়িয়ে ধরে। মেহরাম চুপ করে বসে আছে তনুর কে নিয়ে। এখন তনুর ওপর কি যাচ্ছে তা ভালোই বুঝতে পারছে সে। এক বেলা মেহরামের কাছে থেকে তনু চলে আসে। ধীরে ধীরে বেপার টা তনুর বাপের বাড়ির লোকজনদের জানানো হয়। তনুর বাবা মা একদম ভেংগে পরেছিলেন এই কথা শোনার পর। বলতে গেলে বাড়িতে একটা শোকের ছায়া নেমে পরেছিলো। তনু আগের মতো হাসতো না,কথা তো বলতো কিন্তু খুব আস্তে। একমাত্র মেহরাম তার সাথে থাকলেই একটু আকটু হাসতো তাছাড়া না। মনমরা হয়ে থাকতো। এর মধ্যে আয়ুশের সেই চাচি শাশুড়ী কোন রাস্তাই বাদ রাখে নি তনুকে কটুকথা শোনানোর। কিন্তু তনুর ননদ কণা আর শাশুড়ি একদম ইটের বদলে পাটকেল ছুড়ে দিয়েছেন। এক সময় তো আয়ুশের চাচির সাথে আয়ুশের মার ঝগড়ার মতোই লেগে গেলো। কিন্তু পরর্বতীতে বেপার টা নরমাল হয়। আয়ুশ এখন এই সব কিছু তেমন ভাবে না। অফিসে কাজ করে বাসায় আসে আবার বাসা থেকে অফিসে যায়। একদম নিজের মতো চলছে। তবে এরই মাঝে আয়ুশ আর মেহরাম অনেক বার একে ওপরের সম্মুখীন হয়েছে।
তনুর এই ঘটনার পর দেখতে দেখতেই আরো ২-৩ মাস কেটে যায়। তনু তার সেই এক্সিডেন্টের কথা টা প্রায় ভুলতে বসেছে। কিন্তু মাঝে মাঝেই রাতে ঘুম আসে না তনুর। এক অজানা ভয় কাজ করে মনের মাঝে। তার এই না পাবার ব্যার্থতা তাকে যেন ভেতরে ভেতরেই কোথাও কুড়ে কুড়ে খায়।
.
একদিন মেহরাম আর সোহেল ঘুমাচ্ছিলো কিন্তু ঘুমের মাঝেই সোহেলের দম বন্ধ হয়ে আসে। সে মেহরাম কে ডাকার অনেক চেষ্টা করে কিন্তু পারে না। এক সময় বিছানার পাশে টেবিলের ওপর একটা কাচের গ্লাস ছিলো তা হাতিয়ে হাতিয়ে সোহেল ফেলে দেয়। শব্দে মেহরামের ঘুম ভেংগে যায়। জলদি উঠে রুমের লাইট জ্বালিয়ে দেয়। উঠেই দেখে সোহেলের এই অবস্থা। দেখে সোহেল তার বুকে হাত দিয়ে রেখেছে। মেহরাম দ্রুত উঠে আস্তে ধীরে তাকে বসায়। তারপর পানি খাইয়ে দেয়। অতঃপর সে স্বাভাবিক হয়।
মেহরাম;; কি হলো আপনার, আপনি ঠিক আছেন তো?
সোহেল;; হ্যাঁ ঠিক আছি। আসলে জানি না কি হয়েছিলো। দম নিতে পারছিলাম না। শ্বাস আটকে গিয়েছিলো।
মেহরাম;; এবার ভালো লাগছে?
সোহেল;; হ্যাঁ। আব..সরি তোমার ঘুম নষ্ট করলাম।
মেহরাম;; আরে ধুর রাখুন তো। আপনার এই অবস্থা আর আমার ঘুম, বাদ দিন। আপনি ঘুমান আমি আছি।
সোহেল শুয়ে পরে। মেহরাম কিছুক্ষণ সোহেলের ওপর নজর রেখে সেও শুয়ে পরে। তবে মেহরাম এটাই ভেবে পাচ্ছে না যে সোহেল কে সে কখনো এমন করতে দেখে নি। হঠাৎ এমন হলো কেন। পরেরদিনই ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে এই ভেবে মেহরাম ঘুমিয়ে পরে। তবে সেদিকে আয়ুশ তনুর দিকে তাকিয়ে দেখে সে ঘুম। আয়ুশ নিশ্বব্দে তার পাশ থেকে উঠে পরে করিডরে চলে যায়। করিডর টা অন্ধকার, লাইট জ্বালাতেই আয়ুশের চোখে পরে পাশে থাকা তার অতি পছন্দের গিটার টা। মেহরামের চেহারা যেন তার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে উঠলো। অনেক দিন না প্রায় অনেক বছর হলো গিটার বাজানো হয় না তার। কি করে বাজাবে যার জন্য বাজাতো সেই তো নেই। কেন যেন আয়ুশের খুব ইচ্ছে করলো গিটার টা একটু ছুইয়ে দেখতে। এটার প্রতিটা জায়গায় মেহরামের হাতের ছোয়া লেগে আছে। রকিং চেয়ারে গিয়ার টা নিয়ে আয়ুশ বসে পরে। মানুষ ভালোবাসে কিন্তু যখন তাকে পাওয়া সম্ভব হয়না তখন তাকে ভুলে যায় আর নতুন ধাচে জীবন শুরু করে। কিন্তু কই বিয়ের এতো বছর হয়ে গেলো আয়ুশ তো মেহরামকে ভুলে যেতে পারলো না। এখনো মনের কোনে ছোট্ট একটা জায়গাতে মেহরাম রয়েই গেছে। আচ্ছা সবারই কি এই আয়ুশের মতো অবস্থাই হয় যখন কেউ কাউকে হাজার চেয়েও পায় না। নাকি নতুন জীবনে নিজেকে আগের থেকেও অনেক ভালো মানিয়ে নেয় কোনটা?। তাই যদি হয় তাহলে আয়ুশ কেন পারে না এটা। তাহলে কি এটা ভালোবাসা না। নাকি তার থেকেও বেশি কিছু। কোন এক মহান ব্যাক্তি ভালোবাসায় পাগল হয়ে বলেছিলো যে “মায়া জিনিস টা মাদকদ্রব্যের থেকেও বেশি ভয়ানক, যখন খুব বাজে ভাবে কেউ কারো মায়ায় আটকে পরবে তখন বুঝবে”। এখন আয়ুশ বুঝছে যে সেই কথা গুলো নিতান্তই কোন ভুল প্রেক্ষাপটের ওপর বলা ছিলো না। ভিত্তিহীন ছিলো না। সেগুলো অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। এগুলো ভেবেই আয়ুশ ছাড়া গলায় গান ধরে… “ভালোবেসে ভুল করিনি, ভুল করেও ভালোবাসিনি”🖤।……..
সকালবেলা বেশ আরামে ঘুমোচ্ছিলাম তখনই চাচি এসে আমাকে টেনে তুলে দিলো আমার আরামের ঘুমটা হারাম করে। আমি আড়মোড়া ভেংগে উঠে বসি। চাচি একবার হলরুম থেকে ঘুড়ে আবার আমার রুমে আসে। আমি এখনো ঘুম ঘুম চোখে সেখানেই বসে আছি দেখে চাচি আবার আমাকে টেনে তুলে ঠেলে ওয়াসরুমে পাঠিয়ে দেয়। কি আর করার ফ্রেশ হয়ে আমি এসে পরি। এসেই দেখি চাচি আর আম্মু এক প্রকার ছোট খাটো মিটিং বসিয়ে দিয়েছে। তাদের হাতের দিকে তাকিয়ে দেখি ৩ থেকে ৪ টা ব্যাগ। আমি টাওয়াল দিয়ে মাথা মুছছি আর কপাল কুচকে তাদের দিয়ে এগিয়ে গেলাম। আমাকে দেখেই আম্মু খুশিতে গদগদ হয়ে বলে উঠলো….
কনিকা;; এই নাও এসে গেছে। মেহরু মা এদিকে আয়।
মেহরাম;; আসলাম।
আতিয়া;; এগুলো দেখ তো।
আম্মু আর চাচি আমার সামনে এত্তো ভারি ভারি শাড়ি খুলে বসলো, সাথে মেচিং গহনা। যেগুলো নিতান্তই আমার কাছে বেশ বিরক্তিকর লাগলো।
কনিকা;; দেখ তোর যেটা ভালো লাগে সেটাই পর।
আতিয়া;; আর শোন একটু ভালো হয়ে সুন্দর হয়ে রেডি হবি। দেখতে যে আসছে তোকে।
চাচির কথায় আমি এক রকম ঝটকাই খেলাম।
মেহরাম;; মানে কি? আম্মু হাত থেকে দয়া করে শাড়ি টা রাখো। আর আমার কথা শোন আগে তোমরা দুইজন কি পাগল হয়েছো!
কনিকা;; এমা পাগল হতে যাবো কেন?
মেহরাম;; কাল বলেছি যে বিয়ের জন্য আমি প্রস্তুত আছি কিন্তু এটা বলি নি যে আজই ছেলেদের ডাকো।
আতিয়া;; আরে মা কিন্তু যে ছেলেকে তোকে দেখতে বলেছিলাম সে তো আজই আসতে চেয়েছে। আর দেখলেই কি বিয়ে হয়ে গেলো নাকি। তারা আসুক, কথা বলুক, তোকে দেখুক, তুই দেখ। সবকিছু কেমন লাগে আগে দেখ তারপর না হয় ঠিকঠাক করবো।
মেহরাম;; তোমাদের জ্বালায় আমি পাগল হয়ে যাবো। উগান্ডা চলে যাবো আমি।
কনিকা;; বরকে নিয়েই যাস।
মেহরাম;; এইই মা থামো তো।
আতিয়া;; মেহরু মা তুই কোনটা পরবি দেখলি না তো।
মেহরাম;; চাচি শোন ওই যে মেয়ে ছোটখাটো একটা বধূ বেশে, সামনে ইয়ায়ায়ায়া বড়ো এক লম্বা ঘোমটা টেনে, হাতে শরবত বা চায়ের ট্রে নিয়ে গিয়ে পাত্রপক্ষের সামনে যাবে। হাল্কা লজ্জা পাবে এমন।
আমি আমার দুপাশে তাকিয়ে দেখি আম্মু আর চাচি কল্পনার দেশে ডুব খাচ্ছে। তাই ঝট করে বলে ওঠি…
মেহরাম;; আমি না ই আদিম যুগের এমন কোন রীতি ফলো করবো। না ই ওই সব শরবত বা চা টার ট্রে নিয়ে যাবো কিচ্ছু করবো না আমি। আমি যেমন আমি তেমন। প্রতিদিন যেভাবে থাকি আজও সেম। রুপের গুণ নিয়ে আমাকে বিয়ে করতে হবে না। এই এইসব শাড়ি টারি গহরা নিয়ে যাও আমি গোল জামা পরে নিচে যাবো। যে আমাকে পছন্দ করবে সে এমনিতেই করবে এগুলোর দরকার নেই। আমি রেডি হচ্ছি।
আমার এমন কথায় চাচি আর আম্মুর মুখ টা কেমন শুকিয়ে গেলো। আমি ঘুড়ে গিয়ে তাদের দিকে তাকালাম। তাদের সামনে গিয়ে দুহাত ভাজ করে এক ভ্রু উঁচু করে তাকিয়ে আছি। চাচি আর আম্মু এবার হেসেই দিলো। সাথে আমিও।
কনিকা;; আল্লাহ জানে তোকে কোন ছেলে নিজের বউ বানাবে তার জীবন তেজপাতা।
আম্মু আর চাচি শাড়ি টাড়ি সব নিয়ে চলে গেলো। আমি সাদা আর হলুদের একটা কম্বিনেশনের মধ্যে জামা পরে নিলাম। আর কিচ্ছু করি নি। আয়নাতে তাকিয়ে দেখি চোখের নিচে কালো দাগ স্পষ্ট। মন চাইলো কালি দিয়ে আরো একটু গাঢ় করে নিই। কিন্তু করলাম না তাহলে আমাকে ভয় পেয়ে আমার বাড়ির লোকজনই পালাবে। চুল গুলো আচড়াচ্ছিলাম খানিক পরে নিচে বেশ শোরগোলের আওয়াজ পেলাম। আমি পেছনে ঘুরে কপাল কুচকালাম। ছেলেপক্ষ এলো না তো। যাজ্ঞে আমার কি। আবার নিযের চুল ঠিক করাতে মন দিলাম। তার প্রায় দশ মিনিট পর আকাশ দৌড়ে আমার ঘরে এলো। বিছানার ওপর জোরেই বসে পরলো। আমি আইনাতে তাকিয়ে দেখি সে ফাটা নয়নে আমাকে দেখছে।
মেহরাম;; কিরে ছোটু এভাবে কি দেখছিস, বেশি বাজে লাগছে আমায়?
আকাশ;; আরে না মেহেরাপু তুমি তো বরাবরই কিউট। কিন্তু আমি টাসকি খেয়েছি। তাও অনেক বড়ো।
মেহরাম;; হাহাহা,, কি দেখি খেলি?
আকাশ;; তোমার হবু বরকে দেখে।
আকাশের কথায় আমি কাজ ছেড়ে তার দিকে তাকাই।
মেহরাম;; মানে?
আকাশ;; মেহেরাপু কি পরিমাণ যে লম্বাচওড়া, আমাকেই মাথা তুলে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে হয়েছে।
মেহরাম;; ওহহ এই বেপার, শালা খাম্বা নাকি?
আকাশ;; তুমি তো বউ হবে শালা হলো কিভাবে?
মেহরাম;; হাহাহাহাহা, বাদ দে ভাই। আচ্ছা আর কি দেখলি (কাজ করতে করতে)
আকাশ;; শুনেছি ছেলে নাকি আর্মিতে জব করে। কি বডি রে বাবা মনে হয় স্টীল।
আমি আর কি বলি আকাশের এমন বিবরণ শুনে আমার অনেক হাসি আসতাছে।
যাই হোক আমি ওরনা টা ঠিক ভাবে পরে আকাশ কে নিয়ে নিচে নামি। সিড়ি দিয়ে নামার সময় আকাশ আমার এক হাত শক্ত করে ধরে।
মেহরাম;; কিরে আমার হাত ধরেছিস কেন এভাবে?
আকাশ;; মেহেরাপু আমি শুনেছি বউকে নাকি এভাবে ধরে ধরে নিচে নামাতে হয় এখন আমি তোমাকে নামালাম। তুমি যদি পরে যাও।
মেহরাম;; হ্যাঁ, কি কস। ভাই দুধের দাত পরছে তোর😆।
আমি আর আকাশ নিচে নামি। তখনই আম্মু এসে আমাকে নিয়ে বসিয়ে দেয়। আমি মাথা নিচু করে রাখি নি। সামনে তাকিয়ে আছি। চুপচাপ বসেই আছি কিন্তু একটা বারও ছেলের দিকে তাকাই নি। দেখার ইচ্ছে নেই আমার। বাকি সবাই অনেক কথা বলছে। একটা জমজমাট ভাব এখন। হঠাৎ একজন বয়স্ক মহিলা বলে ওঠেন…
কুসুম বেগম;; মা তোমার নাম কি?
মেহরাম;; জ্বি মেহরাম আফরিন।
কুসুম বেগম;; ভারি সুন্দর তুমি দেখতে। মুখখানায় অনেক মায়া লেগে আছে।
আমি মুচকি হাসি। এবারও আমি ছেলেকে দেখি নি।
কুসুম বেগম;; মেহরাম মামনি আসলে জানি না তুমি কেমন পরিবার আশা করো। কিন্তু এটা সিওর থাকো যে আমাদের পরিবারে আসলে তোমাকে নিজের ছেলের বউ না বরং আমি আমার মেয়ে মনে করবো। আর পরিবার বলতে শুধু আমার এই ছেলে টাই। আমার স্বামী নেই, আমার ছেলেটা যখন ক্লাস নাইনে থাকে তখনই চলে যান। আমার আর কোন সন্তানও নেই তাই আমার পুরো দুনিয়া আমার এই ছেলেই। আমি এখানে আমার ছেলের বউ খুজতে আসি নি আমি আমার একটা মেয়ে কে নিয়ে যেতে এসেছি।
আমি এতোক্ষণ সেই মহিলাটার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সারাজীবন কি কষ্ট দিয়ে পারি দিয়ছেন তা উনার মুখে স্পষ্ট ফুটে ওঠেছে। কেন জানি না উনাকে আমার অনেক ভালো লাগলো। মূলত টিপিকাল শাশুড়ী রা এমনই হয়। মুখে মিষ্টি অন্তরে বিষ। কিন্তু সবাই তো আর এক না। এবার চাচি বলে ওঠে..
আতিয়া;; তা বাবা তুমি কি করো?
সোহেল (ছেলে);; জ্বি আমি আর্মিতে জব করি। সত্যি বলতে বেশির ভাগ বাইরেই থাকি আর যতটুকু সময় বাসায় তা সম্পূর্ণ আমার মায়ের। মা যখন বললো যে মেয়ে দেখবো আমি কোন কিছু বলি নি কারণ আমার মা যা বলবে তাই।
কুসুম বেগম;; না সোহেল এভাবে বললে সবাই ভাববে এখনো মায়ের আচল ধরে থাকিস।
তাকালাম ছেলের দিকে। মুচকি হাসলো সে আমি তাই। আমি তাকিয়ে দেখলাম কুসুম বেগম আর আমার পরিবারের লোকজনের মাঝে ভালোই খাতির জমে গেছে। ওহ হ্যাঁ আব্বু চাচ্চুও আছেন।
সবার মুখে খই ফুটছে। এবার কুসুম বেগম বলে উঠলেন…
কুসুম বেগম;; আব..আপা যদি কিছু মনে না করেন তাহলে কি মেহরাম মামনি আর সোহেলকে একসাথে একটু একা কথা বলতে দেওয়া যায় না।
আমি তো বোকা বনে গেলাম। আমি এই খাম্বার সাথে কি কথা বলবো। আর আকাশ ঠিকই বলেছিলো অনেক বেশি লম্বাচওড়া, এটা পালোয়ান তা দেখেই বোঝা যায়। একটা ব্লেক পেন্ট আরেকটা নেভি ব্লু শার্ট পরে আছে। আর আর্মিতে যেহেতু তো এমনই তো হবে। আমাদের পাঠিয়ে দেওয়া হলো ছাদে। ছাদের দেওয়ালের ওপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছি। আমার পাশে সেও আছে। তবে মাঝখানে কমপক্ষে ৪ ফুটের দূরত্ব। আমি একদম চুপ করে আছি। হঠাৎ গলা খাকারি দিয়ে সোহেলই বলে ওঠে…
সোহেল;; কিসে পরছেন আপনি?
মেহরাম;; অনার্সে।
সোহেল;; জ্বি বিয়ের পর কি আপনার পোড়াশোনার ইচ্ছে আছে?
আমি পাশে সোহেলের দিকে তাকাই।
মেহরাম;; আপনি সিওর যে এই বিয়ে টা হবেই?
সোহেল;; আমি আমার মা কে অনেক ভালোভাবে চিনি। মা আপনাকে অনেক পছন্দ করেছেন। আপনি সত্যি অনেক মিষ্টি দেখছে।
মেহরাম;; দেখুন।
সোহেল;; মা কেমন হবে, স্বামীই বা কেমন হয়। একটা আলাদা পরিবার কিভাবে নিজেকে মানিয়ে নিবেন। বউ-শাশুড়ী তে ঝগড়া হবে কিনা। কি এই গুলোই তো?! (মেহরামের দিকে তাকিয়ে)
মেহরাম;; না আসলে।
সোহেল;; আপনি পড়াশোনা করতে পারেন। চাইলে জবও করতে পারবেন যা হেল্প লাগে আমি করবো। আপনার পরিবারের কথা মনে পরলে যখন ইচ্ছে চলে আসতে পারবেন কারণ একটা মেয়ে শুধু কিছু কাপড় আর দুমুঠো খাবারের জন্য নিজের পরিবারকে ছেড়ে অন্যত্র চলে যায় না। বেশি কিছু না শুধু এটাই চাই যে আপনি যেন আমার পরিবার টাকে পূর্ন করেন ব্যাস।
উনি খুব গুছিয়ে সুন্দর ভাবে কথা বলতে পারেন। যা বুঝলাম সোহেলের মাঝে খুব হাবলা হাবলা একটা ভাব আছে যা উনি উনার শক্ত মুখের পেছনে লুকিয়ে রাখেন। আর মেয়েদের সাথে কথা বলার অভিজ্ঞতা খুব কম আছে উনার। অনেক বার আটকে পরেছিলেন কথা বলতে গিয়ে আমার সাথে। আমার আর কি বলার কারণ আমার সব কথা সোহেলই বলে দিয়েছেন। আমি মুচকি হেসে বলে উঠি…
মেহরাম;; আমরা এখন নিচে যাই!
সোহেল;; জ্বি।
আমার আগে সোহেল যেতে ধরলেন, যেতে ধরলেই আবার পেছন ঘুড়ে আমার দিকে তাকিয়ে একবার বলে ওঠেন…
এই কথা বলেই উনি চলে গেলেন। আমি ঠাই দাঁড়িয়ে থাকলাম। তবুও পরে নিচে নেমে পরি৷ আমাদের একসাথে নামতে দেখে চাচি বলে উঠলেন…
আতিয়া;; এই নাও এসে গেছে।
কুসুম বেগম এতো টা মিশে গেছে বাবা মা চাচি চাচ্চুর সাথে যা বলার বাইরে। উনারা চলে গেলেন। তাদের এগিয়ে দিয়ে আসতে আমি প্রথমে যেতে চাই নি। কিন্তু চাচ্চু জোর করে নিয়ে যায়। গাড়িতে উঠে পরে সোহেল আর তার মা। সোহেল ড্রাইভিং সীটে বসে আমার দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে…
সোহেল;; আবার দেখা হবে।
আমি মৃদু ভাবে মাথা নাড়াই। সোহেল আর তার মা চলে যায়। তারপর সবাই হলরুমে আসি। এসেই সবার কি খুশি। কার খুশি কে দেখে। অবশেষে শুনি যে বিয়ের কথা এইদিকে পাকাপাকি হয়ে গেছে। আমি তো অবাক।
মেহরাম;; মানে কি কথা ছিলো দেখতে আসবে, এখন বিয়ে ঠিক?
কনিকা;; কেন ছেলেকে তোর কি পছন্দ হয় নি। এতো সুন্দর দেখতে ছেলেটা। পরিবার বলতে শুধু তার মা।
মেহরাম;; কিন্তু মা।
আতিয়া;; আরে আর কিছু বলিস না তো বিয়ে ঠিক।
আমি ছেড়ে দিয়েছে। যা হবার হোক, হ্যাঁ তবে আমার মতে সত্যি সোহেল আর তার মা অনেক ভালো মানুষ। সহজেই যে কাউকে মানিয়ে নেয়। আম্মু নাচতে নাচতে তনুকে ফোন দিলো।
তনু;; হ্যাঁ ভালো,, হ্যাঁ কি মা কি বললা। মেহরু, মেহরুর বিয়ে ঠিক। কি বলো, আমার তো নাচ আসছে। মেহরু কই আরে ওকে দাও তো।
আতিয়া;; নে নে কথা বল।
মেহরু;; হ্য.. হ্যালো
তনু;; মেহরু আয় হায় কি শুনছি ঘটনা সত্য নাকি। ছেলের নাম কি রে, কি করে আর দেখতে কেমন?
মেহরু;; সোহেল শেখ, আর্মিতে আছে। দেখতে খাম্বা।
তনু;; এ্যা,, আচ্ছা আমাকে ছবি পাঠাস।
মেহরু;; হুমম।
তনু;; মেহরু।
মেহরাম;; হ্যাঁ
তনু;; মেহরু তুই খুশি তো?
মেহরাম;; আরে হ্যাঁ আমি খুশি, সবাই অনেক পছন্দ করেছে সোহেলকে। আর সোহেলও অনেক ভালো। আমি তো কিছুই বলি নি আমার মনের কথা গুলো সব আমার আগে সেই বলে দিয়েছে। আর উনার মা হলেন একজন পছন্দের মানুষ, সব কিছুই অনেক ভালো রে।
তনু;; যাক আলহামদুলিল্লাহ।
সবাই তনুর সাথে আর তার শশুড় বাড়ির লোকদের সাথে অনেক কথা বলে, সেদিকেও এক প্রকার খুশির রেশ পরে গেছে। আমি হলরুম থেকে উঠে এসে ওপরে আমার রুমে যেতে ধরলাম হঠাৎ কি যেন মনে করে ওপর থেকে নিচে একবার তাকালাম। সবার মুখে হাসি ফুটে ওঠেছে। হয়তো যে খুশি এখন আমার হবার কথা সে খুশি এখন আমার পরিবারের লোকজনদের হচ্ছে। তাই কি তাদের খুশিই আমার খুশি। আমি হেসে দিয়ে রুমে চলে আসি।
।
।
তনুর শশুড় বাড়িতে~~
তনু বসে বসে ফোন চালাচ্ছিলো,তখনই দরজা লাগানোর শব্দে পেছন ঘুড়ে তাকায়। দেখে যে আয়ুশ। তনু লাফ দিয়ে নিচে নেমে পরে আয়ুশের কাছে চলে যায়। আয়ুশ হেসে তনুকে বলে ওঠে..
আয়ুশ;; কি হলো এভাবে লাফাচ্ছো কেন?
তনু;; লাফাবো না। আমার কলিজার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে?
আয়ুশ;; মানে?
তনু;; আরে মেহরু, মেহরুর বিয়ে ঠিক হয়েছে। এই দেখো এই যে মেহরু আমাকে ছেলের ছবি পাঠিয়েছে। হায় কি সুন্দর আমার দুলাভাই টা। দেখো দেখো।
আয়ুশ ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখে।
আয়ুশ;; হুম।
এই হুম বলেই আয়ুশ চলে আসে তনুর সামনে থেকে।
তনু;; আরে কি হলো কিছু তো বলো কেমন?
আয়ুশ কাবার্ড থেকে নিজের জামা বের করতে করতে বলে ওঠে…
আয়ুশ;; ভালো।
তনু;; আমি জানতাম ভালোই হবে।
আয়ুশ ফ্রেশ হতে চলে যায়। ওয়াসরুমে গিয়েই বেছিং-এ হাত রেখে কিছুটা ঝুকে দাঁড়িয়ে থাকে। মাথা নিচের দিকে দিয়ে আছে। হুট করেই মাথা তুলে সামনে থাকা আইনার দিকে তাকায় আয়ুশ। চোখ গুলো রক্ত লাল হয়ে গিয়েছে। টুপটাপ করে পানি পরছে চোখ দিয়ে। নাকের ডগা লাল হয়ে গিয়েছে। তখনই দরজাতে তনুর ডাক পরে।
তনু;; এইযে তোমার ফোন হয়তো অফিস থেকে ফোন এসেছে।
আয়ুশ;; হ্যাঁ হ্যাঁ রাখো আমি আসছি।
তনু চলে যায়। আর আয়ুশ তার মুখে একের পর এক পানির ছিটা দিয়েই যাচ্ছে। যেন বুঝা না যায় সে কেদেছে। এতোই জোরে জোরে পানির ছিটা দিয়েছে যে গায়ে থাকা শার্ট টা ভিজে গেছে। ২০ মনিট পর আয়ুশ ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে পরে। রাতের খাবার পর্যন্ত সে খায় না। তনু জিজ্ঞেস করলে বলে ওঠে অফিসে খেয়ে নিয়েছে তাই খিদে নেই। রুমে এসে পরে। তনুর খুব পা ব্যাথা করছে নাকি তাই সে ঘুমিয়ে পরে। তবে আয়ুশ উঠে গিয়ে রুমের বাইরে করিডরে এসে পরে। হাতে এক পেকেট সিগারেট। সিগারেটের দিকে তাকিয়ে আয়ুশ হেসে দেয়। এই সিগারেট টা খেতে গিয়ে মেহরাম কতোই না বকা বকেছে তাকে। একদিন তো জিদ করে বসলো যে আয়ুশ সিগারেট খেলে মেহরামও খাবে। একদিন আয়ুশ ইচ্ছে করেই মেহরামের সামনে দিগারেট খাচ্ছিলো মেহরাম রাগের চোটে আয়ুশের হাত থেকে সিগারেট কেড়ে নিয়ে নিজেই ঠোঁটে লাগিয়ে টান দিয়েছিলো। সে কি কাশি, কাশতে কাশতে দম বন্ধ প্রায়। আয়ুশ তড়িঘড়ি করে সামলে নিয়েছিলো। সেটাই লাস্ট ছিলো আয়ুশের সিগারেট খাওয়া। আর আজ কেন জানিনা আয়ুশের মেহরামের কথা অনেক মনে পরছে। হয়তো মেহরাম কাছে থাকলে তাকে শেষ বারের মতো জোরে জড়িয়ে ধরে ইচ্ছে মতো চিল্লিয়ে কাদতো। কিন্তু হায়রে ভাগ্য, সেই সুযোগ টুকুও নেই। সারারাত নির্ঘুম কেটেছে আয়ুশের। সিগারেট খেতে খেতে পারি দিয়েছে,, ভোরের দিক রুমে গিয়ে তনুর পাশে শুয়েছে।
।
ধীরে ধীরে দিন গড়িয়ে যায়, এর মধ্যে দুবার সোহেল আর তার মা এসেছে আবার মেহরামও একদিন তাদের বাসায় গিয়েছিলো। অনেক সুন্দর তাদের পরিবার আর বাসাটাও। তবে সোহেলের সবকিছু দেখে মনে হলো সে অনেক গোছালো প্রকৃতির। বাড়ির প্রায় সবদিকেই সোহেলের ছবি টাংানো। আর্মির গেটাপে, ফরমাল গেটাপে। তার মাকে নিয়ে অনেক ছবি তোলা।
মেহরাম;; আপনি আপনার মাকে অনেক ভালোবাসেন তাই না!!
সোহেল;; হ্যাঁ তোমার মতোই।
মেহরাম;; হুমম।
সোহেল আর মেহরাম একে ওপরের সাথে অনেকটা মিলেমিশে গেছে। মেহরাম আপনি বলেই ডাকে কিন্তু সোহেল তুমি। বিয়ের দিন তারিখ সব এগিয়ে আসে দুইদিন বাদে মেহরামের বিয়ে। বাড়িতে রমরমা একটা ভাব। সোহেল কে দেখেই বুঝা যায় যে সে মেহরামের সাথে এই বিয়েতে কত্তো খুশি। মেহরাম যেন পুতুল। সবার খুশিতেই তার খুশি। দুইদিন কখন যে চোখের পলকেই পেরিয়ে গেছে টেরই পাওয়া যায় নি। তনু এসে পরেছে। পুরো বাড়িতে বিয়ের সাজ। মাঝে মাঝেই সবাই অনেক ইমোশনাল হয়ে পরে। কিন্তু মেহরাম যখন রেগে যায় তখন আবার সবাই চুপ। মূলত মেহরাম রাগ করে না সবাইকে হাসানোর জন্য এমন করে। তনুর শশুড় বাড়ির লোকেরা সবাই এসেছে। কণা ও এসেছে। তবে আয়ুশ আসেনি। তাকে তনু অনেক বলে কিন্তু আয়ুশ কাজের অজুহাত দিয়ে আসে নি। বাড়ির সবাই আয়ুশকে অনেক আসার জন্য বলে কিন্তু আয়ুশ আসবে না।
বিয়ের দিন মেহরাম কে বধূ বেশে সাজানো হয়। খুব বেশি সুন্দর কাগছে তাকে। তনু তো সোজা কালো টিকা লাগিয়ে দিয়েছে তার কানের পেছনে যাতে নজর না লাগে কারো। রুমে বসেই তনু-মেহরাম-কণা সবাই অনেক ছবি তুলে। উর্মি আর বাবলিও এসেছে মেহরামের বিয়ে তে। তনু মেহরামের বউ সাজে একটা ছবি আয়ুশকে পাঠিয়ে দেয়। আয়ুশ বসে বসে ফাইল দেখছিলো ফোনে নোটিফিকেশন আসলে সে সেটা অন করে দেখে মেহরামের বউ বেশে ছবি। মূহুর্তেই গাল বেয়ে দুফোটা পানি গড়িয়ে পরে আয়ুশের। ফোনে তনুর ফোন আসলে জলদি নিজেকে স্বাভাবিক করে ফোন ধরে।
তনু;; কি কেমন লাগছে মেহরামকে?
আয়ুশ;; অনেক সুন্দর ❤️।
তনু;; তোমাকে কতো করে বললাম এসে পরো। তুমি আসলে না।
আয়ুশ;; আরে বাবা কাজ আছে তো অনেক নইলে তো গেতামই। (হেসে)
তনু;; তোমার গলা এমন লাগছে কেন? কি হয়েছে?
আয়ুশ;; আরে ওইতো ফ্রিজের ঠান্ডা পানির রিয়েকশন।
তনু;; তুমিও না আচ্ছা শুনো আমি রাখি। বাড়িতে অনেক মানুষ আর আমি মেহরুর কাছে যাবো। রাখলাম।
আয়ুশ;; হুমম।
তনু ফোন কেটে দিয়ে চলে যায়। আর আয়ুশ সে তার চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পরে। সামনে ফাইল গুলো রাগে টেনে ছিড়ে সব লণ্ডভণ্ড করে ফেলে। এবার দুহাতে মাথা চেপে ধরে নিচে বসে পরে সে। চিৎকার দিয়ে ওঠে। অঝোরে কেদে দেয়।
আয়ুশ;; মেহরাম (চিল্লিয়ে)
ওদিকে মেহরামকে নিচে নামানো হয়, এনে সোহেলের পাশে বসিয়ে দেয়। সোহেল হাল্কা ঝুকে মেহরামের কানের কাছে ফিসফিস করে বলে ওঠে “মাশআল্লাহ”। মেহরাম হেসে দেয়। অতঃপর তিনবার কবুল বলে ইসলাম এবং আইনের মতে সোহেল আর মেহরাম স্বামী-স্ত্রী হয়ে যায়। মেহরামের বিদায়ের সময় সবার সে কি কান্না। তবে মেহরাম কাদে না। তার মুখ থেকে যেন হাসি সরার নামই নেই। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মেহরাম চলে আসে।
.
মেহরাম আর সোহেল একই ঘরে রয়েছে। সোহেল এসেই দেখে রুমে কেউ নেই সে বারান্দায় গেলে দেখতে পায় মেহরাম বউ বেশে সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। সোহেল কেশে ওঠে ইচ্ছে করেই। মেহরাম তাকিয়ে দেখে সোহেল। সে রুমে চলে যায়।
সোহেল;; তুমি ওখানে…
মেহরাম;; দেখুন এই দিনে এক হাত লম্বা ঘোমটা দিয়ে বিছানার ওপর বসে থাকবে তেমন না আমি। আমার ভালো লাগে না তাই সেখানে চলে গিয়েছিলাম।
সোহেল;; এখন মনে হচ্ছে যে আমি সঠিক কাউকে বিয়ে করেছি।
মেহরাম;; মানে?
সোহেল;; আমারও এইসব পছন্দ না মোটেও।
সোহেল আর মেহরাম হেসে দেয় একসাথে। এবার তারা দুজনেই চুপ থাকে হঠাৎ সোহেল বলে ওঠে…
সোহেল;; মেহরু।
মেহরাম;; জ্বি
সোহেল;; সবাই তো তোমাকে এভাবেই ডাকে তাই আমিও ডাকলাম।
মেহরাম;; হুমম (হেসে)
সোহেল;; কাউকে ভালোবাসতে?
সোহেলের কথা আমি তার দিকে তাকাই। কি বলবো খুঁজে পাই না। তবুও বলি…
মেহরাম;; না। আপনি?
সোহেল;; বাসতাম, কিন্তু কখনো বলাই হয়নি। তাও স্কুল লাইফে থাকতে। একদিন হঠাৎ করেই তাকে দেখতে পাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে আমার মন মস্তিষ্ক থেকে মুছে যায়। এইতো শেষ।
মেহরাম;; আহা, এটা ভুল যদি ভুলেই যেতেন তাহলে আর তাকে আজকে মনে করতেন না। (দুহাত ভাজ করে সোহেলের দিকে তাকিয়ে)
সোহেল;; কিন্তু এখন তোমাকে ভালোবাসি।
সোহেল মেহরামের মাথায় চুমু একে দিলো। মেহরাম তার হাতের মুঠি শক্ত করে ধরে। তার কেমন যেন লাগছে। কিন্তু তবুও হাসে। আর সত্যি সোহেল মানুষ হিসেবে পারফেক্ট একদম পারফেক্ট।
এভাবেই মেহরাম আর সোহেলের দিন যেতে থাকে। বিয়ের ১ মাস পার হয়ে যায়। মেহরাম তো নিজের মায়ের থেকেও নিজের শাশুড়ির সাথে এখন বেশি ফ্রী। সে যে তার শাশুড়ি মেহরাম তা মনেই করে না।
তবে একদিন তনু কণার জন্য আচার নিয়ে যাচ্ছিলো হঠাৎ সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে গেলে তনু সিড়ি থেকে অনেক জোরে নিচে পরে যায়। মাথা পুরো ফেটে গেছে পেটে অনেক ব্যাথা পেয়েছে আর পা পুরো ছুলে গেছে। তনুর চিৎকারে যেন বাড়ির সবার আত্মা কেপে উঠলো। তনুর কোন হুশ নেই। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। চারিদিকে রক্তে ভেসে গিয়েছে। সবাই ছুটে চলে যায় তনুর কাছে। কণা তাড়াতাড়ি করে আয়ুশকে ফোন দেয়। আয়ুশ তনুর কথা জেনে ছুটে আসে বাড়িতে। সবাই তনুকে নিয়ে হস্পিটালে যায়। সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হয়। তবে যেহেতু সেটা হস্পিটাল তাই বেশি একটা ভীড় না করাই ভালো। মেহরামের শশুড় বাড়ি থেকে শুধু মেহরামই আসে। বাকিরা যেতে চাইলে মেহরাম তাদের বুঝিয়ে শুনিয়ে এসে পরে। মেহরাম তো কাদতে কাদতে এক রকম হিচকি তুলে ফেলেছে। দ্রুত হস্পিটালে গিয়ে দেখে সবাই বসে আছে। সবার মুখেই চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। মেহরামকে দেখেই তার চাচি মানে তনুর মা দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে কেদে দেয়। আয়ুশ মাথা নিচু করে বসে আছে। তার মনেও যে অশান্তি চলছে তা তাকে দেখেই বোঝা যায়। তখন একজন নার্স বের হয়ে আসে তাকে দেখেই সবাই চিন্তা নিয়ে নার্সের কাছে যায়। কিন্তু তখন নার্স বলে ওঠেন….
নার্স;; পেসেন্টের হাসবেন্ড কে?
আয়ুশ;; জ্বি আমি।
নার্স;; আপনি চলুন।
আয়ুশ দ্রুত নার্সের সাথে চলে গেলো। ডাক্তারের কেবিনে গিয়ে আয়ুশ বসে। ডাক্তার তার মুখে অতি মাত্রায় চিন্তা নিয়ে আয়ুশের দিকে একটা রিপোর্ট কার্ড এগিয়ে দেন। আয়ুশ শুধু ডাক্তারের দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু তিনি কিছু বলছেন না। এবার আয়ুশ চোখ রিপোর্টের দিকে দেয়। আর তাতে আয়ুশ যা দেখে তাতে তার পুরো দুনিয়া উলটে যায়।
তনু;; আর পুরো বাড়িতে এই একমাত্র ব্যাক্তি যে বদের হাড্ডি। মেজাজ খুব খিটখিটে আর ফালতু একটা মহিলা (কানের কাছে ফিসফিস করে)
আমি তনুর করা এতো প্রশংসা শুনে হেসে দেই। তখনই সেই মহিলা টি আমাকে বলে ওঠেন।
তাহেরা বেগম;; আমি হলাম তাহেরা বেগম। মানে এই যে তনুর চাচি শাশুড়ি আর কি আর আয়ুশের চাচি।
মেহরাম;; জ্বি।
তাহেরা বেগম;; তো কি নাম তোমার?
মেহরাম;; জ্বি মেহরাম আফরিন। তনুর বোন আমি।
তাহেরা বেগম;; ওহহ তো দুই বোনের মাঝে কে বড়ো??
তনু;; চাচি আমরা সমবয়সী। তবে মেহরু আমার থেকে দুমাসের বড়ো মাত্র।
তাহেরা বেগম;; দুই দিনের হইলেও বড়ো তো। তা বড়ো বইনের বিয়ার আগে ছোট বইনের বিয়া দিয়া দিলো। কোন সমস্যা হইছিল নাকি? (খোচা মেরে)
চাচির কথায় তনু বড়ো ক্ষেপা ক্ষেপে যায়। সে কিছু বলতে যাবে তার আগেই আমি তনুর হাত ধরে তাকে থামিয়ে দেই। আমি বলে ওঠি…
মেহরাম;; না চাচি কোন সমস্যা হয়নি। আসলে আমি আমার যোগ্যের কোন ছেলেকে পাইনি তাই এখনো বিয়ে করিনি। তনু পেয়ে গেছে তাই করেছে।
তাহেরা বেগম;; হাহ, তো তোমার জন্য কি আসমান থেকে উড়াল দিয়া কোন রাজপুত্র আসবো নাকি।
মেহরাম;; রাজপুত্র না, তবে আমি আমার বাবার রাজকন্যা ঠিকই। তো যখন আমি আমার মন মতো কাউকে পাবো তখনই বিয়ে করবো।
তাহেরা বেগম;; বাহ চটাং চটাং কথা জানো দেখি।
মেহরাম;; চাচি এই যুগে এমন চটাং চটাং কথা না জানলে বড়ো মুসিব্বত। তাই জাইনা নিলাম।
আমার কথা শুনে চাচি আর এক মিনিটও দাড়ালো না সাথে সাথে চলে গেলেন।
তনু;; বাহহ রে মেরি জানেমান, এতো কথা কোথায় শিখলি। যা বলেছিস না। আর যাই বলেছিস ঠিক করেছিস। আমি তো রাগ হলেও কিছুই বলতে পারি না। আর এই ২-১ দিনেও বুঝে গেছি আমি যে এই মহিলা বেশি সুবিধের না।
মেহরাম;; মানলাম ভদ্র কিন্তু এতো টাও না যে মানুষ এসে এগুলো বলবে আর আমি একদম চুপ করে থাকবো। এতো ভালো আমি না যতো টা দেখে মনে হয়।
তনু;; হিহিহি হয়েছে, এবার চল।
তনু আর আমি চলে গেলাম। কণা এসেই আমাকে আবার জড়িয়ে ধরে। আমি চমকে যাই কিছু।
কণা;; আপুনি তুমি কোথায় যাচ্ছো বারবার। আমাকে কেন সাথে নেও না।
মেহরাম;; আরে বইনা। আমি কোথাও যাইনি তো।
আমি কণার সাথে হেসে হেসে কথা বলছি। তখন আয়ুশ এলো। আমি সরে যাই সেখান থেকে। আর গেতেই তনু এসে আমাকে ধরে।
তনু;; চল
মেহরাম;; কোথায়?
তনু;; আরে চল।
তনু আমাকে নিয়ে স্টেজের ওপর চলে গেলো। আমি বারবার তাকে থামানোর চেষ্টা করছি কিন্তু কে শুনে কার কথা। সাথে তনুর কিছু ফ্রেন্ড, আরো তার শশুড় বাড়ির কিছু মেয়ে এসে চারিপাশ দিয়ে ঝাপটে ধরে। না চাইলেও অনেক গুলো ছবি তুলতে হয়। এবার তনুর শশুড় আয়ুশকে কে ডেকে স্টেজে আসতে বললো এবং ছবি ক্লিক করতে বললো। আমি সেখান থেকে নেমে এসে পরতে চাইলে তনু আমার দিকে সরু দৃষ্টি তে তাকায় আমার হাত ধরে বলে ওঠে…
তনু;; এমন পালাই পালাই করিস কেন, থেকে যা না। একসাথে থাকি।
তনুর কথায় আমি মুচকি হেসে তার হাতের ওপর হাত রেখে বলি..
মেহরাম;; হয়তো আমার জায়গা টা এখন আর আমার নেই, আর আমার থাকার অধিকারও নেই। এখন যদি আমি থাকি তাহলে সেটা একদমই খাপছাড়া বা বেমানান দেখায় রে বোন।
তনু;; কি বলছিস এগুলো?
মেহরাম;; আরে বুদ্ধু বলছি এই যে তোর বিয়ে হয়েছে বর আছে। তার সাথে ছবি তোল এখন আমার পিছু ছাড়। ছাইরা দে মা কাইন্দা বাচি।
তনুর আর আমি দুজনেই হেসে দেয়। তখন ক্যামেরাম্যান এগিয়ে আসে আর বউ-বরকে একসাথে দাড়াতে বলে। আমি তনু কে তাড়া দেখিয়ে জলদি সেখান থেকে এসে পরি। চাচির পাশে গিয়ে দাড়াই আমি এবার। তারা সবাই বসে আছে। আমিও বসি। আমি গেতেই চাচি আমার মাথার ওপর হাত রেখে দেয়। আমি চাচির কাধে নিজের মাথা রাখি। স্থির চোখে তনু আর আয়ুশের দিকে তাকিয়ে আছে। আয়ুশকে একটু দেখছি। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কোন বলির বাকরা। নিজেকে খুব ছোট লাগে। ছেলেটার সাথে আমি অনেক অন্যায় কয়েছি। যদি তাকে সেদিন আমি আমার কসম না দিতাম তাহলে হয়তো আমার গালে আরো তিন চারটে চড় পরতো। জোর করে হাসছে আয়ুশ। মুখে তেমন কোন চমক নেই যা আমি আগে দেখেছিলাম। হয়তো আমার জন্য। আর তনুকেই বা আমি কি বলবো। বেচারি তো এমনিতেই বাচ্চামো করে। তার ওপর এগুলো। সে যদি জানতো যে এমন কিছু একটা আছে তাহলে হয়তো সে জীবন দিয়ে দিতো কিন্তু বিয়ের পিড়িতে কখনোই বসতো না। কিন্তু আমি জনাবো না। সেইদিনের তনুর হাতে কাচের টুকরো ধরার দৃশ্য টা যেন এখনো আমার চোখে ভাসে। বাড়ির লোকজন এখনো এটা জানে না। হয়তো প্রথম ভালোবাসা আমার আয়ুশ ছিলো। কিন্তু ভালোবাসলেই যে পেতে হবে এমন তো কোন কথা না তাই না। এটাকে কেউ ত্যাগ বলুক বা বেইমানি কিন্তু আমি আমার চোখের সামনে আমার বোন কে ঢুকরে ঢুকরে বাচতে দিবো না। সম্ভব না। আয়ুশ যদি আমারও হতো তাহলে একদিন না একদিন তনু জানতোই যে আয়ুশের সাথে আমার সম্পর্ক ছিলো। তখন কোথাও না কোথাও তনুর এটা ভেবে মাথা নিচু হতো যে “” ছিহ কি করেছি আমি অন্যের ভালোবাসার পাবার জন্য নিজেই মরতে গিয়েছিলাম “”। হয়তো তখন আয়ুশের সাথে তনু নিজেই চোখে চোখ মেলাতে পারতো না। আর এখন বর্তমানে আমার ওপর দিয়ে যা যাচ্ছে তা তনুর ওপর দিয়ে যেত। আমি পারবো না আমার চোখের সামনে নিজের বোনের এমন দশা দেখতে তাই নিজেই সরে গেলাম। কখনো ভয় হয় যে তনু ভুল করেও যদি জেনে যায় তাহলে কি হবে। আল্লাহ’র কাছে এটাই দোয়া যে যেদিন বা যখন তনু সত্য টা জানবে সেদিন যেন আমি মেহরাম বেচে না থাকি। নয়তো আমি আর মাথা তুলেই তাকাতে পারবো না। জানি না তনুর কি হবে। বসে বসে চাচির কাধে মাথা রেখে এগুলো ভাবছিলাম। আর তাদের দেখছিলাম। কিছুক্ষণ পর নিজেই মুচকি হেসে চোখজোড়া তাদের থেকে নিচে নামিয়ে নিলাম। বলা তো যায় না যদি আমার নিজেরই নজর লেগে যায় তাদের ওপর 😅। তখনই চাচির ডাকে হুস আসে আমার…
আতিয়া;; মেহরু
মেহরাম;; জ্বি চাচি।
আতিয়া;; কখন এসেছিস চল কিছু খাবি চল।
মেহরাম;; না মানে চাচি তনু তো এখনো কিছু খায় নি।
আতিয়া;; আর কতো বোন বোন করবি।
মেহরাম;; কি করবো বলো চাচি, আমার অভ্যাস তো। আর অভ্যাস জিনিস টা না ই সহজে তৈরি হয় আর না ই সহজে যায়। (তনুর দিকে তাকিয়ে)
আতিয়া;; আয়।
চাচি আমাকে জোর করেই টেনে নিয়ে গেলো। নিজের সামনে বসিয়ে নিজ হাতে খাইয়ে দিতে লাগলো। আমিও খাচ্ছি আর চাচির কথা শুনে হাসছি।
আতিয়া;; নিজের বোন তো চলেই গেলো। এবার জলদি জলদি তোর জন্যও আরেক টা পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দিবো।
মেহরাম;; তোমার বিয়ের খুব শখ না। নিজেই করে নাও না একটা।
আতিয়া;; কিহহহ মাথা গেছে তোর। আমি চলে গেলে তোর চাচ্চুর কি হবে।
আমি তনু কে খাইয়ে দেই। এভাবেই সেই সারা টা দিন চলে যায়। বেশ রাত করেই আমরা বাড়ি ফিরি। তনুর শশুড় বাড়ির লোকজন আমাদের আসতেই দিচ্ছিলো না। কিন্তু তবুও তাড়া দেখিয়ে আমরা এসে পরি। আসার সময় তনু আবার কান্না করে। এখন আমি আমার বাড়িতে। সবাই অনেক ক্লান্ত হয়ে যে যার রুমে ঘুমোচ্ছে। ভালো লাগছে না আমার একদম। সত্যি আজ আর ভালো লাগছে না। রুমে ছেড়ে চলে গেলাম বারান্দায়। পুরো ঘর কে আমি কালো করে রেখেছি। বাইরে ল্যাম্প পোস্টের আলো কিছুটা বারান্দায় এসে পরেছে। বাতাস চলেছে মৃদু। আমি তনু কে অনেক মিস করছি। সে থাকলে এই টাইমে হয়তো খুব গল্প করতাম বা নিচে গিয়ে ফ্রিজ থেকে সব খাবার এনে কেড়ে কুড়ে খেয়ে নিতাম। ফিক করে হেসে উঠলাম এগুলো ভেবেই। রুমে গিয়ে ড্রয়ার থেকে একটা গাঢ় কালো কালারের ডায়েরি বের করলাম। এই ডায়েরি টা বলতে গেলে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড। যখন যা হয়, যা করি, বা মনে মনে আমি যাই ভাবি সব, সব আমি এতে নিখুঁতভাবে আমি লিখে রাখি। গতো তিন বছর যাবত আমি এই ডায়েরি লিখছি। তবে এখানে আমার একটা পারসোনাল পাসওয়াডও আছে। যেটা আমি ছাড়া আর কেউই জানে না। ইভেন তনুও না। সে এই ডায়েরি টা দেখার জন্য রাতদিন আমার পিছে পরে থাকতো কিন্তু আমি দিতাম না। তাকে আমি একটা কথাই বলতাম যে “সময় হলে দিবো, মনে রাখিস আমার পরে এই ডায়েরিটা তোরই”। সে হাসতো। আমিও এখন বারান্দায় ফ্লোরে বসে বসে ডায়েরি টা লিখছি। সব লিখছি যা আমি মুখে কখনোই বলতে পারি না পারবো না। প্রায় তিন পাতার মতো ডায়েরি টা আমি লিখলাম। তারপর আবার জায়গা মতোই রেখে দিলাম। আমার ছোট থেকেই গিটার বাজানোর অনেক শখ। আম্মু কে অনেক বলে কয়ে পাম টাম দিয়ে এটা কিনেছি। আমার গিটার ডার্ক চোকলেট কালারের। আমার অনেক পছন্দের একটা জিনিস। এটাকে আরো বেশি পছন্দের করে তুলেছিলো আয়ুশ, হ্যাঁ আয়ুশ। যে আমাকে প্রায় ভার্সিটি শেষে নিজ হাতে গিটার বাজানো শেখাতো। আর যখন তনু ছিলো তখন সে রোজ আমার এই গিটার টা পরিষ্কার করে দিতো। মুছে দিতো। নিজ হাতে খুব যত্ন করে রাখতো। এখন তনু নেই। আমার গিটার টার ওপর এতো যত্ন আর নেওয়া হবে না। ঘরের প্রত্যেক টা কোণায় কোণায় আমার বোনের হাতের ছোয়া আছে। আগে বলতাম যে বিয়ে হয়ে গেলে তোর আমি বেচে যাবো। আগে বুঝি নি যে বোনের বিয়ে হলে বা চলে গেলে এতো কষ্ট হয়। আমি আর পারি না। এতোক্ষণ বারান্দায় গ্রিল দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলাম। এই সব কথা মনে হতেই নিচে ধপ করে বসে পরি আর কেদে দিই। ফ্যান ফুল স্পিড়ে ছেড়ে দিয়েছি, দরজা শক্ত করে লাগানো যেন আমার কান্নার আওয়াজ রুমের বাইরে না যেতে পারে।
।
।
।
অন্যদিকে তনুর শশুড় বাড়িতে~~
তনু অনেক ক্লান্ত তাই সে রুমে এসে আইনার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজের গয়না গুলো খুলছে। তখনই আয়ুশ ঘরে প্রবেশ করে। এক নজর তনুর দিকে তাকিয়েই আবার নিজ কাজে ব্যাস্ত হয়ে পরে। তনু আয়ুশকে দেখে মুচকি হেসে তার কাছে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। আয়ুশ চোখ বন্ধ করে নেয়। মূলত নিজেকে আটকানোর চেষ্টা। সে কখনোই চায়নি এমন। আয়ুশ তনু কে ছাড়িয়ে নেয়। তনু মুখ টা ছোট করে ফেলে…
তনু;; কি হয়েছে তোমার?
আয়ুশ;; কিছুনা। হয়তো তুমি অনেক ক্লান্ত, ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পর।
তনু;; কিছু বলার ছিলো তোমাকে।
আয়ুশ;;হুম বলো।
তনু;; কাল থেকে দেখছি এমন মনমরা হয়ে আছো তুমি। কিছু কি হয়েছে?
আয়ুশ;; না কিছুই হয় নি। সব ঠিক আছে।
আয়ুশ চেয়েও তনু কে কোন আঘাত বা হার্ট করতে পারছে না। করতে গেলেই মেহরামের বলা একটা কথাই তার কানে বারবার বাজে “মনে রাখবেন আমার বোন যেন কখনো কষ্ট না পায়, তার চোখ দিয়ে যেন কখনো অশ্রুবিন্দু না পরে, বিশেষ করে আপনার জন্য”। যে কারণে সে চেয়েও কিছুই করতে পারছে না। তনু যে খারাপ একটা মেয়ে তা কিন্তু না, তনু যথেষ্ট ভালো একটা মেয়ে অনেক মিশুক। বাচ্চামো অনেক আছে তার ভেতর। আয়ুশ চেয়েও কিছুই করতে পারছে না। আয়ুশ এবার তনুর দিকে তাকায়। তনুর মুখটা নিজের দুহাতের ভাজে নিয়ে এসে বলে…
আয়ুশ;; তনু।
তনু;; হুম।
আয়ুশ;; নিজেকে শক্ত করো তৈরি করো।
তনু;; মানে?
আয়ুশ;; একদিন মানে বুঝবে, তখন আর আমার কিছুই বলতে হবে না।
আয়ুশ এই কথা বলেই তনুর কাছ থেকে সরে আসতে নেয় তখন তনু আয়ুশের হাত ধরে ফেলে…
তনু;; আয়ুশ,
আয়ুশ;; ______________
তনু;; আমাকে ভালোবাস তো?!
তনুর প্রশ্নে আয়ুশের বুকের ভেতর একশ এক চাকু চালানোর মতো ব্যাথা অনুভব হলো। আয়ুশ কি বলবে এখন সে জানে না। আয়ুশ ঘুড়ে তনুর দিকে দাঁড়ায়। আর তনু আয়ুশকে জড়িয়ে ধরে। কিন্তু আয়ুশ তার হাতগুলো মুঠি বদ্ধ করে ফেলে। ঠাই দাঁড়িয়ে থাকে সে।
।
।
সকালে~~
মেহরাম;; মা, মা (নিচে নেমে)
কনিকা;; হ্যাঁ বল।
মেহরাম;; মা আমার ভার্সিটি চলে যেতে হবে।
আতিয়া;; ঢাকা যাবি এতো জলদি? আর কটা দিন থেকে যা না।
মেহরাম;; না চাচি এখানে এসেছি ৬ দিন হলো আর না। সামনে আমার পরিক্ষা আছে। আর পারলে আমি আজই চলে যাবো।
আতিয়া;; কিন্তু!
মেহরাম;; মা তুমি তো জানো আমার বারাবারি ভালো লাগে না। বিয়ে শেষ এবার আমাকে যেতেই হবে।
আমি এই কথা বলেই সোজা চলে আসতে ধরি তবে আবার পিছন ঘুড়ে সবাইকে বলি…
মেহরাম;; আর হ্যাঁ, তনুর কোন দরকার নেই আমার সাথে থেকে পড়াশোনা করার। মানে এখন তো সে তার শশুড় বাড়ি থেকে পড়াশোনা করতে পারবে। আর এখন যদি সে আমার সাথে থাকে তাহলেও বেপার টা বেশি ভালো দেখায় না। তাই আমি একাই সব ম্যানেজ করে নিতে পারবো।
আমি আমার মতো করে বলে এসে পরি। বাড়িতে অনেক কোলাহল হয় আমার জন্য যে আজ কি দরকার ঢাকা যাবার। কিন্তু এক সময় আমি রাগ করে বসি। তখন সবাই রাজি হয় আর বাবা আমার বেপার টা বুঝতে পারে যে হয়তো আমার পড়ার চিন্তা আছে আর এখানে ভালো লাগছে না। তাই সবাইকে বলে সেইদিন বিকেল বেলাই আমি ঢাকার উদ্দেশ্যে বের হয়ে পরি।
.
.
তনু;; এটা কোন কথা মেহরু?!
মেহরাম;; আরে কিন্তু!
তনু;; তুই এখন আছিস টা কোথায়?
মেহরাম;; ঢাকা।
তনু;; বাহহ পৌছেও গেছিস।
মেহরাম;; তনু জানু তুই তো বুঝিস বেপার টা। প্লিজ তুই আবার শুরু হোস না। বাড়িতে এমনিতেই অনেক ঝামেলা পাকিয়ে এসেছি। আমাকে আসতেই দিবে না এমন।
তনু;; হাহাহা,, আচ্ছা আমিও এসে পরবো কিছু দিনেই।
মেহরাম;; এই দাড়া দাড়া, এখানে এলে তোর পা গুলো ভেংগে আমি হাতে ধরিয়ে দিবো। তনু গ্রো আপ বেব। এখন বিয়ে হয়েছে তোর পড়াশোন করবি ভালো কথা কিন্তু বাইরে এসে পড়ার দরকার নেই। শশুড় বাড়িই থাকেন আপনি বুঝলেন তনু।
তনু;; তনু আয়ুশ আহমেদ।
মেহরাম;; আব.. হ্যাঁ হ্যাঁ ওইতো।
তনু;; সে যাই হোক তুই আমার কাছে সব থেকে বেশি স্পেশাল।
মেহরাম;; তুই ও। আচ্ছা শোন আমাকে একটু বাইরে বাবলির কাছে যেতে হবে। এতো দিনের নোটস্ কালেক্ট করতে হবে।
তনু;; আচ্ছা। আর আমাকেও দিস।
মেহরাম;; হুমমম।
এই বলে আমি ফোন কেটে দেই। তনু অনেক জেদ করে এখানে আমার কাছে আসার জন্য কিন্তু আমি তাকে সাফ বারণ করি। আমি আবার আমার আগের জীবনে ফিরে যাই। এখন আমি আগের থেকে আরো বেশি ব্যাস্ত হয়ে গেছি। সারাদিন পড়াশোনা আর বান্ধবী দের নিয়েই থাকি। তনু ভার্সিটিতে আসে। রোজ দেখা হয়। কিন্তু এখন আর তনুর আর আমার একই সাথে যাওয়া হয় না। একই বাসায় আমরা যাই না। ভার্সিটি থেকে বের হয়ে তনু রোজ আয়ুশের সাথে চলে যায়। তনু আর আমি একই সাথে ভার্সিটি থেকে বের হই। আমি রোজ দেখি আয়ুশকে তনুর জন্য গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে। আয়ুশ এখন তার বাবার বিজনেসটা সামলাচ্ছে। ভালোই চলছে তাদের। তবে তনু কে মাঝে মাঝে মন খারাপ করে থাকতে দেখি। কিন্তু আমি কি আর তা হতে দিতে পারি। মিনিটেই মন ভালো করে দেই। ধীরে ধীরে আমাদের পরিক্ষার সময় এগিয়ে আসে। পরিক্ষা দেই আমরা। রেজাল্টও আসে। অনেক ভালো পয়েন্ট আসে আমাদের দুই বোনেরই। আয়ুশকে এখন আমি আমার অতীত ভাবি। আর সে আমার অতীতই। আয়ুশ আমার সাথে কথা বলার অনেক ট্রাই করেছে, অনেক বার। কিন্তু আমিই তাকে দূর দূর করে সরিয়ে দিয়েছি। এভাবেই দেখতে দেখতে চলে যায় ৭ মাস।
।
🌸🌸চলবে~
#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
# {বোনাস পার্ট 🌿}
🖤🥀
.
.
.
.
পরিক্ষার পর আমি ঢাকাতেই থেকে যাই। বাড়িতে বাবা চাচ্চু মা চাচি সবাই অনেক বলে কিশোরগঞ্জ চলে যেতে কিন্তু আমি যাই না। কেন যেন সেখানে গেলে আমার মোটেও ভালো লাগে না। আগে তনু আর আমি একসাথে থাকতাম বাড়ি টা ভরা ভরা লাগতো। কিন্তু এখন সেখানে গেলে আমি অনেক একা ভালো লাগা তো দূর উলটো তনু কে অনেক বেশি মিস করি। তাই যাই নি। ভেবেছিলাম যে একসাথে ঢাকা দুজন পড়াশোনা করবো। কিন্তু তনু বিয়ে করে চলে গেলো। সেই একার একাই থেকে গেলাম আমি। ভালো লাগছে না আমার তাই ড্রয়ার থেকে ডায়েরি টা আবার বের করি মন যা চায় তাই আবার লিখে ফেলি। জানালার কাছে বসে বসে ডায়েরি লিখছিলাম তখনই তনুর ফোন আসে। এটা আয়ুশের নাম্বার, আমি ভাবলাম হয়তো তার ফোনে ব্যালেন্স নেই তাই আয়ুশের নাম্বার দিয়ে ফোন দিয়েছে। আমি হাসিমুখে ফোন রিসিভ করি…
মেহরাম;; হ্যালো তনুউউউ। কেমন আছিস তুই। জানিস আমি বসে বসে তোর কথাই ভাবছিলাম তোকে অনেক মিস করি রে। আর কি খবর কেমন আছিস তুই? তোর বাড়ির সবাই কেমন আছে?
আয়ুশ;; মেহরু।
আমি বলে বুঝাতে পারবো না যে আয়ুশের জাস্ট এই “মেহরু” ডাক টা আমার মনের ভেতরে কি পরিমাণ তোলপাড় শুরু করে দিয়েছে। কোন এক ক্ষত স্থান প্রায় শুকিয়ে যাবার পর যদি সেখানে আবার আঘাত করে করে ঘা টাকে কাচা করে দেওয়া হয় তাহলে কেমন লাগবে। এখন আমার অবস্থাও তার ব্যাতিক্রম না। আমি সাথে সাথে কান থেকে ফোন টা নামিয়ে ফেলি। ইতোমধ্যে চোখ ভিজে গেছে। জোরে জোরে দম ছাড়ছি। চোখ গুলো ঘুড়িয়ে অন্য দিকে তাকাই। মূলত হাত পা কাপছে আমার। ফোনে এখনো হয়তো সে হ্যালো হ্যালো করেই যাচ্ছে। আমি স্বাভাবিক হয়ে কন্ঠ খাকারি দিয়ে আবার ফোন কানে ধরি।
মেহরাম;; তনু কোথায়?
আয়ুশ;; আছে।
মেহরাম;; কেমন আছে?
আয়ুশ;; আলহামদুলিল্লাহ ভালোই।
মেহরাম;; আচ্ছা আমি রাখি।
এবার আয়ুশ চিল্লিয়ে ওঠে।
আয়ুশ;; আমি ভালো নেই মেহরাম, শুনতে পাও কি তুমি আমি ভালো নেই। তনু অনেক ভালো আমি জানি। ওর কোন দোষ নেই। আর আমি ওকে শাস্তি দিবোও না। ও শাস্তির যোগ্য না। কারণ ও কিছু জানেই না। মেহরাম দম বন্ধ হয় আমার। যখন, যখন তনু আমাকে জড়িয়ে ধরে, আমার কাছে আসে আমার দম বন্ধ হয়ে যায়। আমি তনু কে মেনে নিয়েছি কিন্তু কোথাও না কোথাও কমতি থেকেই গেলো। তোমার জায়গা কেউ নিতে পারবে না মেহরাম কেউ না। আমি তো তনুকে….
মেহরাম;; আয়ুশ প্লিজ ফর গড সেক এখন এগুলো বন্ধ করো এক বছর পেরিয়ে গেলো। একটা বছর এই সবের। আমি আমার রাস্তা মেপে নিয়েছি। কোন কিছু না তোমার সাথে আমার ছিলো আর না ই এখন আছে।
আয়ুশ;; আমি রাখি, আল্লাহ হাফেয।
আয়ুশ এটা বলেই ফোন কেটে দেয়। তবে এখন না আমার আর কান্না আসে না। শুধু করুণা হয়। নিজের ওপর নিজেরই। এতো টাই কেদেছি যে এখন আমার চোখজোড়াও নারাজ পানি ফেলতে। হ্যাঁ আমি ছোট হয়ে গেছি নিজের চোখে নিজেই। আয়ুশের ভালোবাসার দর-দাম আমি করেছি। আল্লাহ’র কাছে আমার এটাই দোয়া যে তনু যেন কিছুই না জানে। তাহলে তনু পাগলই হয়ে যাবে। আমি হাটতে হাটতে চলে গেলাম ছাদে। ছাদের বড়ো দরজা খুলতেই দমকা বাতাস এসে গায়ে পরে। খুব ভালো লাগছে এবার। আকাশে তাকাতেই দেখি এল ঝাক পাখি ডানা মেলে উড়ে গেলো। গোধূলির লগ্ন এটা। কি সুন্দর লাগছে দেখতে। কাশ আমার জীবন টাও এমন সুন্দর হতো। কিন্তু আমরা যা চাই তা তো আর সবসময় পাই না। আয়ুশের বলা কথা গুলো কানে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। তবে এই খোলা বাতাসে ভালো লাগছে। হঠাৎ কোথা থেকে যেন গানের আওয়াজ আসতে লাগলো।
আমি আমার চারিদিকে একবার তাকালাম, গানের মূল উৎস খোঁজার চেষ্টা করলাম কিন্তু পেলাম না। এই গান টাই আয়ুশ আমাকে প্রথম মেসেজে পাঠিয়েছিলো। না চাইতেই হেসে দেয়। গান টা কিছুটা হলেও প্রিয়। ওপরে তাকিয়ে থাকলাম। হিসেব করলাম আজ অব্দি জীবনে কি আমার নিজের হয়ে থেকেছে আর কি থাকে নি। কিন্তু ফলাফল পেলাম শূন্য। মিলাতে গিয়ে দেখলাম আজ পর্যন্ত খুব কম জিনিসই আমার হয়েছিলো বা আমার একান্ত নামে লিখা ছিলো। যেগুলো খুব করে চেয়েছি সেগুলো একটাও নেই আমার। আমার হয়ে থাকে নি বা আমি তাদের আমার কাছে রাখার যোগ্য ছিলাম না। এটাও হতে পারে যে আমি সেই ভাগ্য নিয়েই জন্মায় নি। মাঝে মাঝে আফসোস হয় কেন ভালোবাসতে গেলাম, কেন প্রেমে পরলাম। কিন্তু এই আফসোসের পরিসীমা অতিক্রম করে আমি কখনো বাইরে বের হতে পারি না। মনে হয় এটা এক ভুলভুলাইয়া। আর আমি এই ভুলভুলাইয়া তে আটকে পরেছি, খুব বাজে ভাবে আটকে পরেছি। আর তাই তো এতো গুলো দিন পেরিয়ে গেলো তবুও বেরই হতে পারলাম না।
সেই বিকেল আর সন্ধ্যা আমি ছাদেই কাটিয়ে দেই। আযান পরলে রুমে এসে পরি। রাতে একাই শুয়ে আছি তখন তনু ফোন দেয়। তার সাথে আমার অনেক কথা হয়। তনুর শশুড় শাশুড়ীর সাথেও কথা হয়। তনুর কন্ঠেই বোঝা যায় সে কি পরিমাণ খুশি। আমি আমার প্রাণ খুলে দোয়া করি আল্লাহ”র কাছে যেন আমার বোন টা এভাবেই খুশি থাকুক। কখনো কখনো হয় কি যে আমরা বেচে থাকি নিজেরাই কিন্তু নিজেদের প্রাণ বাস করে অন্যের মাঝে। ঠিক তাই হয়েছে। আমার প্রাণ বাস করে আমার বোনের মাঝে আর আমার মা-এর মাঝে। তনুর শাশুড়ী আমাকে অনেক যেতে বলেছে আমি কোন রকম করে কথা এড়িয়ে যাই।
পরেরদিন আমি উঠেই ভার্সিটি চলে যাই, মাঠে দাঁড়িয়ে উর্মির সাথে কথা বলছিলাম গাড়ির হর্নে পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখি আয়ুশের গাড়ি, আমি না দেখার ভান ধরে থাকি। তনু এসে আমাকে পেছন থেকে চোখ ধরে ফেলে। আমি বুঝে যাই। এভাবেই হাসি ঠাট্টার মাঝে সময় যে কখন পেরিয়ে গেছে বুঝতেই পারিনি। এভাবেই দেখতে দেখতে কেটে গেলো আরো ১২ দিন।
।
।
একদিন সকালে বসে আছি টিভি দেখছি। আজ ভার্সিটি নেই। তখনই হঠাৎ চাচির ফোন আসে। আমি ইয়া বড়ো একটা হাসি দিয়ে ফোন তুলি…
চাচির এমন কথা শুনে তো আমার বুকের ভেতর ধক করে উঠেছে। প্রচুর ঘাবড়ে যাই আমি।
মেহরাম;; চাচি হয়েছে কি এমন কেন করছো? সব, সব কিছু ঠিক আছে তো চাচি?!
আতিয়া;; কিছুই ঠিক নেই ভাবী, ভাবী হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পরে গেছেন। কথা বলছে না কিছুতেই কাজ হচ্ছে না।
মেহরাম;; কিহহহহ, চাচি কি বলো। আম্মুর কি হয়েছে। কিভাবে হলো। তোমরা তো সাথেই ছিলে আম্মুর তাই না। ডাক্তার কে ডেকেছো?
আতিয়া;; হ্যাঁ ডেকেছি কিন্তু তুই আয় মা তুই আয়। তুই এলেই সব ঠিক তুই জলদি আয়। আর তোর চাচ্চু তোর জন্য স্টেশনে অপেক্ষা করবে তুই জলদি আয়।
মেহরাম;; আব..আম আমি আআআসছি।
চাচির কথা শুনে আমার মাথায় পুরো আকাশ ভেংে পরেছে। আমি ঠিক শুনেছি তো। আমি কিছুই করি নি শুধু ব্যাগ টা নিয়েছি। আর হাতে একটা পার্স। দরজাতে তালা দিয়ে বাড়ির মালিক কে কোন রকমে বলেই দৌড়। বাড়ির বাইরে এসেই ভাগ্যক্রমে রিকশা পেয়ে যাই। তাতে উঠে পরি। খানিক পর পরই শুধু রিকশাওয়ালা মামা কে বলছি তাড়াতাড়ি যেতে। ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছি আমি। টেনশনে কিছুই ভালো লাগছে না। সারা টা রাস্তা গিয়েছি আল্লাহ আল্লাহ করতে করতে। আল্লাহ আমার হায়াত নিয়ে আমার মা কে দাও তবুও মায়ের কোন ক্ষতি করো না। আম্মুর কিছু হলে আমি মরেই যাবো, জেন্দা লাশ হয়ে যাবো আমি। কাউকে লাগবে না পুরো দুনিয়া নিয়ে নাও আমার মা কে আমার কাছে ভিক্ষা দাও। শুধু এগুলোই বলেছি আর গিয়েছি। ট্রেনে উঠে পরি, এবার একটু বসে শ্বাস ছাড়ি। ব্যাগ থেকে পানি বের করে খেয়ে নিই। জানালার পাশে সিট পরেছে আমার। সেদিকে তাকিয়ে আছি গালে হাত রেখে। খানিক পরেই ট্রেনে একটা ছোট্ট মেয়ে ওঠে সাথে একজন মহিলা। বুঝলাম যে তারা মা & মেয়ে। মেয়ে টা এসে সিটে বসলো আর তার মা তাকে খাইয়ে দিচ্ছে। এটা ওটা বলে কতো হাসাচ্ছে। কিন্তু আমার এবার কান্না পাচ্ছে খুব। আমার মা যে কতো এভাবে খাইয়ে দিয়েছে। ছোট বেলার কথা মনে পরে গেলো। আমি তাকিয়ে আছি তাদের দিকে। মায়ের কথা খুব মনে পরছে। আর তর সইছে না আমার কখন যাবো। মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে হেসে দেয়। আমিও বিনিময়ে মুচকি হাসি। এভাবে দেখতে দেখতেই অনেক সময় পেরিয়ে গেলো। আমার স্টেশনও এসে পরেছে। আমি দ্রুত পা চালিয়ে নেমে পরি। নেমেই দেখি চাচ্চু। সোজা গিয়ে চাচ্চু কে জড়িয়ে ধরি।
মেহরাম;; আমার মা কই, কি হইছে আম্মুর?
বিল্লাল;; কিছু না রে মা তুই এতো চিন্তা করিস না চল।
সারাটা রাস্তা আমি কি অবস্থায় যে এসেছি তা কেবল আমিই জানি। প্রায় ২০ মনিট পর চাচ্চুর সাথে আমি বাড়ি আসি। হুড়মুড় করে বাড়ির ভেতরে ঢুকে দেখি আম্মু বসে আছে আর চাচি ধরে ধরে পানি খাওয়াচ্ছেন। আমি দৌড়ে গিয়ে আম্মুকে জড়িয়ে ধরি।
মেহরাম;; হয়েছি কি আম্মু, কি হয়েছে তোমার অজ্ঞান হলে কি করে?
কনিকা;; জানি না রে মা হুট করেই মাথা টা কেমন চক্কর দিয়ে উঠলো।
মেহরাম;; ডাক্তার কি বলেছে?
আতিয়া;; প্রেসার বেড়ে গিয়েছে এই যা।
মেহরাম;; চাচি প্লিজ দেখে রাখো আম্মুকে, আমি তো কাছেই থাকি না। সারাক্ষণ চিন্তা লেগে থাকবে এখন।
কনিকা;; তো থেকে যা না।
মেহরাম;; আম্মু।
আতিয়া;; শোন এলি আর এখনই যাই যাই করবি না। কিছুদিন থেকে যাবি।
মেহরাম;; থাকবো তো কিছুদিন এমনি এখন।
সারাটাক্ষণ মায়ের পাশ ধরেই ছিলাম। যেন মায়ের আচল নিজের হাতের সাথে বেধে নিয়েছি এমন। তনুদের কিছু বলা হয়নি। কারণ তনু যদি জানে যে তার বড়োমার এই অবস্থা তাহলে কেদে কেটে একাকার হয়ে যাবে। তাই বেপার টা এখানেই সামলে নিয়েছি। তারপরেরদিন আমরা সবাই হলরুমে বসে ছিলাম। তখন আম্মু বলে ওঠে..
কনিকা;; মেহরাম।
মেহরাম;; বলো মা জাননী।
কনিকা;; কিছু কথা ছিলো আমার। আর দেখ এটা তোকে মানতেই হবে।
চাচির একটা স্বভাব আছে উনি বসে থেকে থেকে সেলাই করেন, বেপার টা আমার কাছে অনেক ভালো লাগে। আর নকশা গুলো দেখলে মনে হয় চোখ জুড়িয়ে গেলো। আমিও চাচির সাথে বসে বসে সেলাই করছিলাম। তখন আম্মুর এই কথা শুনে ফট করে মাথা তুলে আম্মুর দিকে তাকাই।
মেহরাম;; আম্মু কি হয়েছে বেশি সিরিয়ায়া কিছু নাকি?
আতিয়া;; হ্যাঁ সিরিয়াসই।
মেহরাম;; মা বলো তো কি হয়েছে?
কনিকা;; বললে শুনবি?
মেহরাম;; মা কি যে বলো না। আজ পর্যন্ত তোমার কোন কথা ফেলেছি আমি? যা বলবে তাই করবো, বলো তো।
কনিকা;; বিয়ে করতে হবে।
মেহরাম;; কিহ?
কনিকা;; হ্যাঁ বিয়ে করতে হবে তোকে।
মেহরাম;; মানে কি মা, তুমি তো জানো যে আমি এখনোই এগুলোর জন্য প্রস্তুত না।
আতিয়া;; কিন্তু কথা বলে লাভ নেই করতেই হবে।
মেহরাম;; কিহ চাচি তুমিও।
আতিয়া;; হুম আমিও।
মেহরাম;; চাচি।
কনিকা;; তুই কিন্তু বলেছিস যে যাই বলবো তাই করবি।
মেহরাম;; তাই বলে বিয়ে। আমাকে অন্তত আমার পড়াশোনা টা শেষ করতে দাও।
কনিকা;; বিয়ের পরেও তো পড়াশোনা করা যায় নাকি?
মেহরাম;; করা যায় মা কিন্তু বিয়ের আগে পড়াশোনার প্রতি চাহিদাটা একরকম থাকে আর বিয়ের পরেই আরেক রকম। আর সব পরিবার নিজের ছেলের বউকে পড়াশোনা করতে দেয় না।
আতিয়া;; কিন্তু আমরা যে ছেলে কে দেখেছি তার পরিবারও অনেক ভালো আর ছেলেও,, সবদিক দিয়েই অনেক ভালো কি তাই না ভাবী।
কনিকা;; হ্যাঁ একদম।
মেহরাম;; কিন্তু মা…
কনিকা;; এই তুই কিন্তু বলেছিস যে যা বলবো তাই করবি 😒😒।
শুধু এটা বলতে দেরি আমার আর তার সাথে সাথে আম্মু আর চাচি হাল্কাভাবে চিল্লিয়ে উঠে। তখন চাচি বলে ওঠে….
আতিয়া;; মেহরু মা এই দেখ ছেলে।
মেহরাম;; না চাচি আমি ছেলেকে দেখবো না।
কনিকা;; কিন্তু।
মেহরাম;; না মা তোমরা আমার জন্য যাকেই দেখেছো সে নিশ্চয় ভালো হবে। আমার দেখার কিছুই নেই।
এই বলেই আমি হলরুম থেকে বের হয়ে এসে পরি। আম্মু আর চাচি তো অনেক খুশি। কিন্তু আমিই জানি যে বুকের ওপর কতো বড়ো একটা পাথর রেখে আমি হ্যাঁ বললাম। আমি রুমে এসে পরি। কেন জানি না দম বন্ধ লাগছে। ফোন টা অন করে তনুর ছবি দেখতে থাকলাম। দেখতে দেখতে এক সময় আয়ুশ আর তনুর বর-বউ বেশে ছবি টা সামনে আসে। আমি হাসি, এটা ছাড়া আর কোন উপায় নেই আমার। আমাকে হাসতেই হবে। সবকিছু হেসে উড়িয়ে দিতে শিখেছি আমি। এটাই আমার সবথেকে বড়ো কৌশল,”হেসে উড়িয়ে দেওয়া”।