Friday, June 27, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1459



তৈমাত্রিক পর্ব-০৫

0

#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ০৫

🍂
.
.
.

আমি রুমের দরজা খুলেই দেখি আমার মা। আমি আম্মুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি দেই। তারপর আবার ঘরের ভেতরে চলে আসি। আম্মু রুমে ঢুকে বিছনার ওপর বসে পরে। আমি জায়নামাজ টা গুছিয়ে কাবার্ডে রাখলাম, তাকিয়ে দেখি এখনো আম্মু আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। আমি এবার হেসে আম্মুর দিকে তাকাই..

মেহরাম;; আম্মু কিছু বলবে?

কনিকা;; এদিকে আয়।

আমি চলে গিয়ে আম্মুর পাশে বসলাম। আম্মু আমার দিকে ঘুড়ে আমার মাথায় হাত রাখলো। এবার আমার খুব বেশি কান্না পাচ্ছে। হুট করেই কেউ মাথায় হাত রাখলে খুব কান্না পায়। আর এটা শুধু আজকে না সবসময়ই। আমি আম্মুর কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরি। অন্যান্য দিন আম্মুর কোলে মাথা রাখলে আম্মু কাজের বাহান দিয়ে চলে গেতো বা বলতো যে বড়ো হয়েছিস এমন বাচ্চামো কেউ করে। কিন্তু আজ তার দুটোর একটাও বললো না। সুন্দর করে মথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। আমি অপলকহীন ভাবে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ আম্মু আমায় জিজ্ঞেস করে বসে…

কনিকা;; মেহরু!

মেহরাম;; হুমম।

কনিকা;; মা তুই এই বিয়েতে খুশি তো?

এবার আমি ফট করে মাথা তুলে আম্মুর দিকে তাকাই। জানি না কেন খুব বিরক্তি লাগতে শুরু করলো আমার।

মেহরাম;; আচ্ছা আম্মু তোমাদের কি হয়েছে বলো তো, কাল চাচি এই একই কথাটা আমাকে বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছে। দিদুনও করলো। আর আজ তুমি করছো। ধুর হয়েছে কি, আমার বোনের বিয়ে আর আমি হ্যাপি হবো না। এই প্রশ্ন টা তোমরা তনু কে গিয়ে করো যে ও খুশি কিনা। আর খুশি থাকবো না মানে কি যে বলো না। আমি অনেক খুশি, তনুর বিয়ে নিয়ে আমার কতো শত প্লেন ছিলো সব হয়েছে।

আম্মু আমার কথা শুনে একগাল হেসে দেয়। আমিও দেই। তখনই হলরুম থেকে চাচির আওয়াজ আসে। গলা শুনেই টের পাই যে এটা আমার গুনধর চাচির গলা। সবাইকে ঘুম থেকে ডাকছে আর বকাবকি করছে। আমি আর আম্মু ফিক করে হেসে দেই। অতঃপর চাচি আমার রুমে আসে ভেবেছে আমি উঠি নি।

আতিয়া;; কিরে মেহরু….

মেহরাম;; উঠেছি।

আতিয়া;; এই তো লক্ষী। ভাবী তুমি এখানে কি করো, আমি তো ভেবেছি সব ঘুম।

কনিকা;; হ্যাঁ তোমায় বলেছে। আচ্ছা চলো অনেক কাজ আছে তো।

আতিয়া;; হ্যাঁ, আর মেহরু মা শোন আজ কিন্তু তনুর রেসিপশন, তৈরি থাকিস।

চাচি আর আম্মু চলে যেতে নেয় কিন্তু চাচি আবার থেমে যায়।

আতিয়া;; মেহরু আজ কি পরবি রে?

মেহরাম;; আমার আর পরা, একটা হলেই হলো।

আতিয়া;; কিসের একটা হলেই হলো। ফ্রেশ হয়ে আমার রুমে আয় জলদি।

মেহরু;; আচ্ছ আসছি তোমরা যাও।

আম্মু আর চাচি চলে যায়। আমিও ওয়াসরুমে গিয়ে চোখে ইচ্ছেমতো পানি দেই। মাথা তুলে সামনে আয়নার দিকে তাকাই। চোখ গুলো কেমন ফুলে গেছে। নাক গাঢ় লাল হয়ে গেছে। নিজের ওপর নিজেরই মায়া হচ্ছে এখন। আমি সবসময় এই ‘ভালোবাসা’ নাম জিনিস কে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করেছি। সবসময় দূর দূর ভগেছি। নিজেকে অনেক সাবধান করেছি যেন এই ঝামেলা তে না পরি। কিন্তু দেখে শুনে কি হলো সেই ফাদেই পা ফেলে দিলাম। আমি আমার এই পর্যন্ত লাইফে যত গুলো রিলেশন দেখেছি একটাও সাক্সেসফুল হয়নি। সেগুলো দেখে বুঝেছি যে প্রেম ভালোবাসা মানেই ফাদ। কিন্তু কখন যে আমার নিজের সাথে এমন হলো বুঝলামই না। এমন কিছু হবে কখনো ভাবিও নি। মানুষ প্রেম করে ছেকা খেয়ে বেকা হয়ে যায়। কথা টা শুনেই হাসি পেতো, আমি অবশ্য ছেকা খায়নি কিন্তু স্বইচ্ছায় অন্যকে দিয়ে দিয়েছি। চোখ দিয়ে পানি পরছে টুপটাপ করে। আমি আবার পাগলের মতো করে চোখে মুখে পানি দিচ্ছি। চোখের পানি আর টেপের পানি মিশে একাকার হয়ে গেছে। এমন ঠিক কতোক্ষন করেছি মনে নেই। রুমে এসে পরি। টাওয়াল দিয়ে মুখ মুছছিলাম তখন ফোন বেজে ওঠে। ফোন টা হাতে নিতেই আমার কলিজা শুকিয়ে গেলো। এটা আয়ুশের নাম্বার, ফোনের স্ত্রিনে আয়ুশ নামটা কেমন জ্বলজ্বল করছে। আমি কাপা কাপা হাতে রিসিভ করি। কানে ধরে খুব কষ্টে বলে উঠি….

মেহরাম;; হ্যালো..

আমার হ্যালো বলার পরেই ওপর পাশ থেকে একটা চঞ্চলমুখর কন্ঠ ভেসে আসে।

তনু;; মেহরুউউউউউউ..

মেহরাম;; ততনু।

তনু;; কেমন আছিস বইন?

মেহরাম;; হ্যাঁ অনে.. অনেক ভালো। তুই?

তনু;; অনেকের থেকেও ভালো। আর শোন আমার ফোনে ব্যালেন্স নেই তাই আয়ুশের ফোন দিয়ে ফোন দিতে হয়েছে। আর জানিস এখানকার মানুষরা এত্তো বেশি ভালো যে কি আর বলবো। আমার শাশুড়ি মা আমাকে নিজের বউ না মেয়ে দেখে। শশুড় আব্বু তো মা ছাড়া কথাই বলে না।

মেহরাম;; হুমম 😊।

তনু;; আর আয়ুশ জানিস, আয়ুশ আমাকে অনেক ভালোবাসে। কাল রাতে আমরা অনেক গল্প করেছি। কিন্তু সে কোথায় জানি বারবার হারিয়ে যায়। মনে হয় এক গভীর চিন্তায় মগ্ন।

মেহরাম;; হুম।

তনু;; কিরে তোর কি হলো?

মেহরাম;; কিছুই হয় নি। (হেসে)

তনু;; তো এখন তো পুরো বাসাই তোর হয়ে গেলো, সবকিছু একা পেয়ে গেলি। কেমন লাগছে😒?

মেহরাম;; হ্যাঁ আসলেই পুরো বাসা টা আমার হয়ে গেছে। সবকিছুর মালিক এখন আমি একা। কিন্তু জানিস কি এটা এক সময় আমাদের দুজনের ঘর ছিলো, এখানে কতো শয়তানি বুদ্ধি করেছি, কতো মারামারি ঝগড়া করেছি। জানিস এই রুমের চারিপাশে তোর আওয়াজ শুনি আমি। আমার কানে বাজে। এখনো আমি বসে আছি জানালার কাছে। এই জানালার কাছে বসার জন্য কতোই না ঝগড়া করেছি কিন্তু এখন আর কেউ ঝগড়া করে না জানিস। এই তো তোর আর আমার ছবি, তুই আমাকে জড়িয়ে ধরে আছিস (ছবি হাতে নিয়ে, হেসে)

তনু;; আর বলিস না, কান্না আসছে (চোখের পানি মুছে)

মেহরাম;; আরে কাদানো তো তোকে এখনো বাকি আছে।

তনু;; মানে?

মেহরাম;; আমাদের প্লেন কি ছিলো। যে আমি তোর বিয়েতে “চান্না মেরেয়া” গাবো।

তনু;; খুন করে ফেলবো। আমি সেখানেই কান্না করতে করতে অজ্ঞান হয়ে নিচে পরে যাবো যদি তুই গান গাস।

মেহরাম;; কিন্তু..

তনু;; গান গা ঠিক আছে কিন্তু এতো ইমোশনাল কেন?

মেহরাম;; হাহাহা।

তনু;; বড়োমা আর জেঠু কে বলে তোরও বিয়ের সানাই বাজাতে হবে বুঝেছি।

মেহরাম;; হোপ মাইয়া কি কস না কস। আর এখানে কি করিস তুই এতো সকালে ফোন দিয়েছিস কেন, মানে একটু পরেই ফাংশন আর তুই।

তনু;; আরে আরে থাম, আমি জানি রেসিপশন আছে কিন্তু তাই বলে তোর সাথে কথা বলবো না।

মেহরাম;; আরে হলো তো কথা বলা এবার কল কেটে রেডি হতে যা জলদি।

তনু;; কিন্তু আমি পরবো টা কি?

মেহরাম;; এটা কোন কথা, শোন এককাজ কর তোর শাশুড়ি আম্মু কে জিজ্ঞেস কর গিয়ে, আর এটা জিজ্ঞেস করলে উনি খুশিই হবেন। জলদি যা।

তনু;; তুই কি পরছিস?

মেহরাম;; নিজেও জানি না। চাচির রুমে যাবো জাবো পছন্দ হয় তাই।

তনু;; আমি কি যাবো?

মেহরাম;; অবশ্যই।

তনু;; আল্লাহ হাফেয,, চুম্মাহ 😘।

মেহরাম;; আরে তার ছিড়া রাখ 😆।

তনুর সাথে কথা বলে আমি ফোন কেটে দেই। তখনই আবার চাচির ছোট খাটো একটা ষাড়ের মতো গলা কানে আসে। আমি চিল্লিয়ে বলি “আসছি”। তারপরই চলে যাই। চাচির রুমে গিয়েই তো আমার মাথায় হাত। তাকিয়ে দেখি শুধু আমার না প্রায় সবার মাথা তেই হাত। সারা রুম জুড়ে শুধু কাপড় আর কাপড়। আম্মু চাচি আমার আরো কয়েকজন কাজিন সবাই বসে আছে।

মেহরাম;; এগুলো কি চাচি?

আতিয়া;; এই গাধা গুলোকে বলেছিলাম যে জাপড় গুলো কাবার্ড থেকে ধীরে সুস্থে নামাতে। একসাথে নামাতে গিয়ে পরে গেছে (আমার দুই কাজিনের মাথায় গাট্টা মেরে)

মেহরাম;; ওরা ছোট ধুর তুমিও না। আমাকে বলতে আমি নামিয়ে দিতাম। আচ্ছা ছাড়ো দেখি আমাকে করতে দাও সরো সবাই।

আমি বসতেই সবাই সাইড হয়ে গেলো। আমি এক এক করে কাপড় দিতে বলছি আর তারা দিচ্ছে। যে যা পরবে তা তাদের দিয়ে বাকি গুলো গোছাচ্ছি। এখন বর্তমানে আমকে একজন কাপড় ব্যাবসায়ীর থেকে কম লাগছে না। আম্মু বাইরে চলে যায়, ধীরে ধীরে সবাই এক এক করে রুম থেকে চলে যায়। নিচে অনেক কাজ আছে। তখন চাচি আমাকে বলে ওঠে…

আতিয়া;; মেহরু এটা দেখ! (একটা পেকেট হাতে দিয়ে)

মেহরাম;; কি এটা চাচি?

আতিয়া;; আরে খুলেই দেখ না।

মেহরাম;; আচ্ছা।

আমি পেকেট টা খুলে দেখি তাতে একটা মেরুন কালারের শাড়ি। আমি একগাল হেসে দিলাম। কেননা মেরুন আমার নামের সাথে মিল। আর বরাবরই মেরুন কালার টা আমার পছন্দের। আর তা চাচি সবসময় মাথায় রাখেন। আমি হেসে চাচির দিকে তাকাই।

মেহরাম;; চাচি!

আতিয়া;; আমার মনে আছে যে এটা তোর পছন্দের। আর তুই এটাই পরিস। আমি পরিয়ে দিবো নি।

মেহরাম;; আচ্ছা চাচি।

সবাই সব কাজে চলে গেলো। আমিও জমিয়ে কাজ করছি। নিজেকে যতো টা সম্ভব ব্যাস্ত রাখার চেষ্টা করছি। একটু হলেও ভেংেছি কিন্তু সম্পূর্ণ না। পুরো বাড়িতে কাজ আছে কতো গুলো। রিসিপশন নাকি তনুর শশুড় বাড়িতেই হবে। তাই আমাদের সবাইকে সেখানেই যেতে হবে। আমি আব্বু আর চাচ্চুর সাথে সব জিনিস গুলো নিয়ে এক এক করে গাড়িতে তুলছিলাম। তখনই আম্মু ডাক দিলো। সেখানের জিনিস গুলো দেখে আমি সোজা চলে গেলাম রান্নাঘরে। সেখানে কিছু খাবার রান্না হচ্ছে তা দেখতে গিয়েছিলাম। সব ঠিক আছে। তারপর চাচির ডাক পরে আমি রুমে চলে যাই। গিয়েই দেখি সবাই রেডি হচ্ছে। চাচি তো আমাকে দেখেই বকাবকি শুরু করে দিয়েছে। আমি এখনো রেডি হয়নি তাই। চাচি আমাকে আর কোন কাজই করতে দিলো না টেনে নিয়ে গেলো। আমি দাঁড়িয়ে থাকলাম আর চাচি শাড়ি পরিয়ে দিলো আমায়। আমি সাজলাম অনেক বেশি সাজলাম। প্রায় এক ঘন্টা পর আমি রেডি হয়ে গেলাম। চাচি আমাকে দেখে বললো “বিয়ে আজই নাকি দিয়ে দেই তোরও”। আমি হেসে বের হয়ে আসি। এক গাড়িতে আব্বু চাচ্চু আম্মু আর চাচি চলে গেলো। আরেক গাড়িতে আমি, আকাশ, আর কাজিনরা মিলে চলে গেলাম। প্রায় আধা ঘন্টা পর আমরা তনুর শশুড় বাড়ির সামনে নেমে পরি। আমাদের আসতে দেখেই তনুর শশুড় শাশুড়ি এক প্রকার ছুটেই আসলেন। তারা সবাই অনেক কথা বললো। তনুর শাশুড়ি এবার আমার দিকে এলো।

রুকশানা বেগন;; তুমি তনুর বোন তাই না?

মেহরাম;; জ্বি।

রুকশানা বেগম;; বিয়েতে তো তোমার সাথে তেমন কথাই বলতে পারিনি। ভারি মিষ্টি দেখতে গো তুমি।

আমি তনুর শাশুড়ির সাথে অনেক কথা বলি। তনুর শশুড় বাড়ির লোকজন সবাই অনেক ভালো। যাকে বলে একদম মাটির মানুষ। তনুর একটা ছোট্ট ননদ আছে। তার নাম কণা। সে তো আমাকে পেয়ে পাগল। আমি সারাক্ষণ প্রায় তার সাথেই ছিলাম। আমি যখন ভেতরে গেলাম তনু সবাইকে রেখে আমাকে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরে। এসেই কেদে দেয়। আমি আবার হাসিয়ে দেয়। আমি গিয়ে সবার সাথে কুশল বিনিময় করি। সামনেই স্টেজের কাছে আয়ুশ আর তনু বসে আছে। এবার পুরো হলরুমের লাইট অফ হয়ে গেলো। আমরা সবাই অবাক। কিন্তু তাদের মাঝে দুই তিনজন ছেলে এলো। লাইট এখন তাদের দিকেই। আর সারা হলরুমে আবছা আলো। তারা নাকি নাচবে। কণা বললো তারা আয়ুশের বন্ধু হয়। ধুমিয়ে গান হচ্ছে আর নাচ। সবাই চিল্লাচ্ছে আর নাচ দেখছে। তনু আমকে ইশারা দিয়ে তার কাছে ডাকলো আমি মানা করে দেই। কণার সাথেই আমি বসে থাকি। হঠাৎ ফোন বাজে আমার তাকিয়ে দেখি উর্মির ফোন। অনেক দিন পর ফোন দিলো সে আমাকে। এখানে গানের জোর শব্দের কারণে কিছুই শোনা যাবে না তাই এক কানে হাত দিয়ে ফোন টা নিয়ে বাইরে এসে পরলাম। ধীরে ধীরে আমি বাড়ির পেছনে চলে এলাম। এখানে একটা সুইমিং পুল আছে, আমি তার পাশেই দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছি। উর্মি বা বাবলি কেউই আমার আর আয়ুশের সম্পর্কে কিছুই জানতো না। তবে তনুর বিয়ে সম্পর্কে জানে। আমি তাদের অনেক করে বিয়েতে আসতেও বলেছিলাম। কিন্তু তারা আসতে পারেনি কিন্তু সমস্যার কারণে। আমি উর্মির সাথে কথা বলছিলাম, প্রায় অনেকক্ষণ কথা বলি তার সাথে। কথা বলা শেষ হতেই পেছন ঘুড়ে অবাকের ওপর অবাক হয়ে যাই আমি। আমার ঠিক পেছনেই আয়ুশ দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকে এভাবে দেখে ভেবাচেকা খেয়ে যাই। দ্রুত চোখ নামিয়ে চলে যেতে ধরি, সামনে কয়েক কদম এগোতেই আয়ুশ আমার হাত ধরে ফেলে। তারপর সামনে এসে দাঁড়ায় আমার। আমি চোখ মুখ শক্ত করে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকি। আয়ুশ এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়েই থাকে।

মেহরাম;; আয়ুশ হচ্ছে টা কি ছাড়ো আমার হাত।

আয়ুশ;; _____________।

মেহরাম;; আয়ুশ আমি কিছু বলছি তোমায়। হাত ছাড়ো।

এবার আয়ুশ আমাকে ঘুড়িয়ে তার দিকে করে। বাহু শক্ত করে চেপে ধরে রেগে বলে ওঠে…

আয়ুশ;; কিচ্ছু নেই তাই না, মানে কিচ্ছু নেই তোমার মাঝে। কোন ফিলিংস কিছুই নেই। একদম ফাকা, খালি। রাগ, অভিমান, ইমোশন, জেলাসি কিছুই নেই তোমার মাঝে।

মেহরাম;; _______________

আয়ুশ;; আদৌ কি ভালোবাসতে আমায়! বিয়ে হয়ে গেছে আমার। অন্য কারো হয়ে গেছি আমি। ভেবেছি একটু হলেও বিয়ে টা আটকানোর চেষ্টা করবে কিন্তু না তুমি তা করো নি।

মেহরাম;; হাসালে আয়ুশ তুমি আমায় হাসালে। আমি আটকাবো আর বিয়ে প্রশ্নই আসে না। আর ফিলিংস সব ফিলিংস -ই আছে আমার মাঝে। আমিই আমার বোনের সাথে তোমার বিয়ে দেওয়ার কথা বলেছিলাম, তোমাদের এক করে দেবার চেষ্টা করছিলাম আর সেই আমি কিনা বিয়ে আটকাবো। পাগল হয়েছো। আর রইলো আমার ওপর তোমার রাগ করে তনু কে বিয়ে করার কথা তো আমি তো এটাই চাইছিলাম। এখানে তোমার কোন দোষ নেই।

আয়ুশ;; হ্যাঁ আর আমি তো কাঠের পুতুল যেমন নাচালে তেমনই নাচলাম। সব তোমার ইচ্ছেমতোই হয়েছে। (আমাকে ছেড়ে দিয়ে)

মেহরাম;; এগুলো কথার এখন কোন মানেই হয় না। সম্পর্কে আপনি আমার বোনের হাসবেন্ড। আর আমি যে পরে থাকার মেয়ে না তা আপনি জানেন। আমি মুভ অন করে ফেলেছি। আর আমার কাছে আমার বোন খুশি আছে এটাই অনেক। আর তনু আপনার ওয়াইফ হিসেবে কতো টা পারফেক্ট তা আপনি আপনার পরিবারের মানুষের মুখে হাসি দেখেই টের পাবেন।

এই কথা বলে আমি আর এক মূহুর্তও দাড়াই না। সাথে সাথে চলে আসি। এসেই দেখি তনু কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হয়তো আমাকে খুজছিলো আর না পেয়ে রাগ করেছে। আমি হেসে তনুর সাথে চলে গেলাম। তখনই একটা মহিলা আমার কাছে এলো। এসেই আমাকে সোজা আপাদমস্তক দেখতে থাকলো।




🌿চলবে~~
.

তৈমাত্রিক পর্ব-০৪

0

#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ০৪

🤍🌸
.
.
.

তারপর কয়েকদিন এভাবেই চলে যায়। অনু ঠিক হয়ে যায়। আবার আগের মতো হাসি খুশি। তাকে সেইদিন কান্না করার কারণ জিজ্ঞেস করলে সে উলটো আমাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে কথা এড়িয়ে যায়। আমিও আর বেশি একটা ঘাটাঘাটি করি না। তাই ছেড়ে দেই বেপার টা। তারপরে প্রায় কেটে যায় সাত দিন। তবে আমি এইবার ঠিক করি যে আয়ুশ আর আমার সম্পর্ক এক বছরের বেশি পেরিয়ে গেছে। তনু কে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সব কিছু জানিয়ে দিবো। আজ আমাদের বন্ধ ভার্সিটি, তাই বাসাতেই। বসে বসে এগুলো ভাবছিলাম তখনই তনু এলো, এসেই সোজা আমাকে পাশ দিয়ে জড়িয়ে ধরে। আমি কিছুটা অবাক হই পরেই হেসে দিয়ে বলে উঠি…

মেহরাম;; হলো কি তোর?

তনু;; উহু, কিছু না।

মেহরাম;; চড় না খাইতে চাইলে বইনা কইয়া ফালাও কি হইছে!

তনু;; মেহরু আমার না তোকে কিছু বলার আছে অনেক বেশি ইম্পর্ট্যান্ট।

মেহরাম;; হ্যাঁ তা তোমার মুখের নকশা দেখেই বুঝেছি, বলে ফেল হারামি।

তনু;; মেহরু…

মেহরাম;; তনু আসলে আমিও তোকে কিছু বলবো, ইন ফ্যাক্ট অনেক দিন যাবতই বলার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না।

তনু;; কি বলিস আগে বলবি না, বল তুই কি বলবি।

মেহরাম;; আগে তুই বল, আর একটা কথাও বলবি না আগে বলতে বলেছি বল।

তনু;; মেহরু।

তনুর ভেতর একটা অস্থিরতা কাজ করছে। বারবার নিজের হাত গুলো মুচড়াচ্ছে। আমি তাকে খেয়াল করলাম। তারপর তনুর হাত গুলো ধরে বলে ওঠলাম…

মেহরাম;; তনু তুই আমাকে বলতে এতো কাচুমাচু করছিস, পাগল তুই। বল (হেসে)

তনু;; আচ্ছা শোন তাহলে তুই আমায় যা বলবি আর আমি তোকে যা বলবো তা কিন্তু একসাথে বলতে হবে বুঝলি।

মেহরাম;; মানে কি!

তনু;; হ্যাঁ

মেহরাম;; ওকে ফাইন, এবার তো বল।

তনু একগাল হেসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমিও ধরি তারপর হেসে দেই। আমি কিছু বলবো তার আগেই তনু বলে ওঠে…

তনু;; মেহরু, মেহরু I am in love.. অনেক ভালোবাসি ওকে।

আমি তনুর কথা শুনে ফট করে তাকে নিজের সামনে আনি।

মেহরাম;; আয় হায় তু তো ছুপা রুস্তাম নিকলি, মানে তুই প্রেমে ডুব খাচ্ছিস আর আমায় বলিস নি একটাবারও না। এই তুই হারামি বোন আমার। এবার জলদি বল কে সে। আহাহাহাহাহা দুলাভাই পেয়ে গেলাম। এই তুই কি বলবি কে সে?

তনু;; কি আর বলি তাকেই তো বলা হয় নি যে আমি তাকে কতো ভালোবাসি।

মেহরাম;; কি এখনো বলিস নি। আর কবে বলবি তুই বুড়ি হয়ে গেলে। শোন যত জলদি পারিস বলে ফেল তাকে।

তনু;; কিন্তু তুই আমাকে কি বলবি তা তো বললি না।

মেহরাম;; আরে রাখ আমার কথা, তুই যা বললি তারপর আবার আমি। এখন বল না কে?

তনু আমাকে আবার জড়িয়ে ধরি। আমি এবার জোরেই হেসে দেই তনুর এমন বাচ্চামো দেখে। আর হয়তো সেই হাসি টাই আমার শেষ প্রাণখোলা হাসি ছিলো।

মেহরাম;; তনু বল।

তনু;; মেহরু, মেহরু ওর নাম আয়ুশ আহমেদ। আমাদের ভার্সিটির সবার সিনিয়র। অনেক ভালো একটা ছেলে। জানিস একদিন ক্লাসে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করেছে যে আমি মেহরাম আফরিনের বোন কিনা। তাকে আমি প্রায় দেখি, এমন কেউ নেই যে খারাপ বলে তার বেপারে। প্রথমে তো তাকে দেখেই ক্রাশ খেয়ে ফেলি আর ধীরে ধীরে কবে যে প্রেমে পরি তাও জানি না। আমি খুব ভালোবেসে ফেলেছি রে। এতো বেশি ভালোবাসি যে হয়তো পাগলই হয়ে যাবো।

এই কথা বলে তনু আমাকে জড়িয়ে ধরে থাকে। কিন্তু আমি এখন যা শুনলাম তা তো আমি নিজেই বিশ্বাস করতে পারছি না। এটা কি সত্যি ছিলো। টপ করে পানি গড়িয়ে পরে আমার চোখ দিয়ে। বেপার টা কিছুটা এমন হয়ে গেলো যে জিনিস একটা কিন্তু তার ভাগিদার দুইটা। আমার মাথা মন সব অগোছালো হয়ে গেছে মূহুর্তেই। মানে,, মানে আমি যাকে ভালোবাসি তাকেই আমার বোন এতো টা দিন ধরে ভালোবেসে আসছে। আমি আর আমার কথা টা বলার সুযোগ বা সাহস কিছুই পেলাম না। মন ভেংে গেলো আমার, থাক আমারই কি দরকার আরেকজন সত্যি বলে কাদানোর। যদিও মিথ্যা বলে হাসানোর চাইতে সত্যি বলা কাদানো ভালো। কিন্তু কেন যেন এখন তনু কে আমার কাদাতে ইচ্ছে করছে না। আমি দ্রুত হাতের তালু দিয়ে চোখ মুছে ফেলি। তনু আমাকে ছেড়ে বসে আমার সামনে। তখনই তনু বলে ওঠে…

তনু;; জানিস মেহরু আয়ুশ কে যখন….. এইরে মেহরু কিছুর গন্ধ পেয়েছিস। মানে কি যেন একটা পুড়ছে না।

মেহরাম;; আব..হ্যাঁ হ্যাঁ। চুলোয় কিছু দিয়েছিস।

তনু;; আল্লাহ আমি শেষ, চুলোর ওপর তো দুধ বসিয়েছিলাম।

মেহরাম;; গেলো, আরে জলদি যা।

তনু এই কথা বলেই এক দৌড়ে রান্নাঘরে চলে যায়। আর আমার হাসি টা যেন লোপ পেয়ে গেলো। বিছানার ওপর ছেচড়ে ছেচড়ে পেছিয়ে গেলাম জানালার কাছে। আমি বুঝতেই পারছি না যে তনু আমাকে কি বলে গেলো। আয়ুশকে সে ভালোবাসে। অথচ তার সাথে আমার এতো দিনের সম্পর্ক। আমি কি বলবো তনুকে। আর আয়ুশকেই বা আমি এখন কি বলবো। মাথা কেমন ঘোড়াচ্ছে আমার। মনের মধ্যে বিচলতা কাজ করছে। ইতোমধ্যে চোখে কান্নার বন্যা বয়ে গেছে। হয়তো তনু এখন না থাকলে আমি চিৎকার দিয়ে উঠতাম যা এখন পারছি না। সত্যি এতো কষ্ট আমার কখনোই হয়নি। মানুষকে দেখতাম ভালোবাসার মানুষ তার থেকে দূরে চলে গেলে জীবন্ত লাশের মতো বেচে থাকতো। তখন তোয়াক্কা করতাম না বা পাত্তা দিতাম না। কিন্তু এখন বুঝছি। একদিকে আমার বোন আরেক দিকে আয়ুশ। আমার কাছে এখন মন হচ্ছে আমি সমুদ্রের মাঝখানে পরে গেছি। না যেতে পারছি এদিকে আর না যেতে পারছি ওদিকে। তখনই তনু এসে জোরে জোরে বলতে লাগলো…

তনু;; মেহরু দুধ পুড়ে গেছে।

আমি জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিলাম তনু কথায় দ্রুত চোখ মুখ মুছে তার দিকে তাকাই।

মেহরাম;; হ্যাঁ দে দেখি আমাকে। বলেছিলাম না খেয়াল রাখবি। আচ্ছা দে আমি দেখি কি করা যায়।

তনু;; হুমম।

মেহরাম;; কি খাবি, কি রেধে দিবো।

তনু;; বাইরে যাই খেতে।

মেহরাম;; হাহাহা,, আচ্ছা ঠিকআছে। রেডি হয়ে নে।

তনু হেসে গিয়ে রেডি হতে থাকে। আমি বাড়ির সব কিছু ঠিকঠাক করে রেডি হয়ে নেই। তারপর বাইরে চলে যাই। সেইদিন এভাবেই কাটে আমাদের। রাতে ঘুমানোর জন্য বিছানাতেই যাই। পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখি তনু গভীর ঘুম। কিন্তু আমার তো চোখে ঘুমের ছিটেফোঁটাও নেই। আয়ুশের কথা মনে পরছে। আজ সে অনেক ব্যাস্ত ছিলো তাই বেশি একটা কথা বলা হয়নি। তনুর কথা গুলো যেন মাথায় ঘুড়পাক খাচ্ছে বারবার। এক পাশ ফিরে শুয়ে ছিলাম তখনই ফোন বেজে ওঠে। ফোন হাতে নিয়ে দেখি আয়ুশ। তড়িঘড়ি করে উঠে পরি। খুব সাবধানে ফোন নিয়ে বারান্দায় যাই।

মেহরাম;; হ্যালো।

আয়ুশ;; কি করছো?

মেহরাম;; না কিছু না।

আয়ুশ;; কি হয়েছে, গলার স্বর এমন লাগছে কেন?

মেহরাম;; কিছু না বললাম তো। তুমি কি করো?

আয়ুশ;; আব..আমি।

মেহরাম;; আয়ুশ ওয়েট, তুমি। আয়ুশ তুমি আবার স্মোক করছো।

আয়ুশ;; কি করে বুঝলে?

মেহরাম;; তুমি যেভাবে শ্বাস নিচ্ছো তাতে বুঝা যায়। আচ্ছা মানা নেই যতো পারো খাও।

আয়ুশ;; ভূতে ধরেছে নাকি। আজ তো বকলে না।

মেহরাম;; না এমনি।

আয়ুশ;; মেহরু।

মেহরাম;; আয়ুশ, ভালোবাসি।

আয়ুশ;; ভালোবাসি।

মেহরাম;; আমি রাখি।

আয়ুশ;; কাল আসবে?

মেহরাম;; আসলে না, কারণ কাল আর পরশু আমাদের ক্লাস নেই।

আয়ুশ;; আমি বাসার সামনে চলে আসবো কিন্ত।

মেহরাম;; হুম এসো।

আয়ুশ;; হয়েছে কি তোমার আজ বলো তো?

মেহরাম;; কিছু না, আমি ঘুমাবো। রাখি আল্লাহ হাফেয।

আয়ুশ;; গুড নাইট।

আমি আয়ুশের সাথে কথা শেষ করে এসে পরি। এসেই তনুর দিকে তাকাই। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে। আমি তার পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিই। হয়তো আমার মায়ের পেটের বোন থাকলেও তার ওপর আমার এতো ভালোবাসা আসতো না যতোটা তনুর ওপর আসে। আমার বোন। আমি তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে শুইয়ে পরি এক পাশ ফিরে। ফোন টা অন করে গেলারি তে গেলাম। আয়ুশের হাসিমাখা মুখ। ছবিতে সে হাসছে কিন্তু এখানে আমার চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পরছে হাজারো অশ্রুবিন্দু। সে রাতে আর ঘুমাতে পারিনা। ভোরের দিকে চোখ লেগে আসে আমার। সকালে তনুর ডাকে ঘুম ভাংগে আমার। আমি তাকিয়ে দেখি ফোনে এখনো আয়ুশের ছবি বের হয়ে আছে। আমি জলদি করে তা বালিশের নিচে লুকিয়ে ফেলি।

তনু;; মেহরু ভার্সিটে তে যাবি না?

মেহরাম;; আজ & কাল ক্লাস নেই হুদাই গিয়ে কি করবো। তুই চলে যা না। আর সাবধানে যাবি আসবি।

তনু;; আচ্ছা তাহলে থাক তুই, আমি গেলাম। আর শোন টেবিলের ওপর তোর খাবার বানিয়ে রেখে দিয়েছি তুই উঠে খেয়ে নিস। আর জলদি উঠ ঠান্ডা হয়ে যাবে।

মেহরাম;; হ্যাঁ আচ্ছা।

তনু;; ওইই দেখ তো বিছানার সাইডে আমার ফোন আছে ওটা দে।

মেহরাম;; দিচ্ছি।

বিছানার সাইড থেকে তনুর ফোন টা নিলাম। সাইডে হাতের চাপ লেগে ফোন টা অন হয়ে যায় আর ওয়ালপেপারে তাকিয়ে দেখি আয়ুশের ছবি। আমার নিজের কাছেই কেমন যেন লাগলো বিষয় টা। আবার অফ করে হেসে তনুকে ফোন টা দিয়ে দিলাম। তনু হেসে আমার গালে চুমু খেয়ে চলে যায়। যতক্ষণ না তনু চলে যায় আমি তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আমি আর সেখানে বসে না থেকে উঠে ওয়াসরুমে চলে যাই। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নিই। কোন কাজেই মন বসছে না। মনের ভেতরে কেমন একটা ছটফটানি। এই টুকু সময়ে আয়ুশ ২০ বারের ওপর ফোন করে ফেলেছে আমি ধরি নি। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করেই ফোন ব্যাস্ত দেখিয়েছি। আয়ুশের সাথে কথা বলা কমিয়ে দিয়েছি। এক প্রকার ইগ্নোর করার চেষ্টা করছি। এভাবেই দুদিন চলে যায়।আগামীকাল ক্লাস আছে তাই ভার্সিটিতে যেতে হবে আমার। এর মধ্যে আয়ুশ আমার বাড়ি আসার জন্য অনেক পাগলামো করেছে কিন্তু খুব কষ্টে সামাল দিয়েছি। তনু সেইদিন বাসায় আসে তবে তার মুখটা অনেক বেরঙিন দেখাচ্ছে। আমি যানি যে কিছু তো হয়েছে নইলে এই মেয়ে কখনোই এমন করবে না। আমি উঠে গিয়ে তনুর পাশে বসি। কাধে ধাক্কা দিয়ে বলে উঠি…

মেহরাম;; হয়েছে কি?

তনু;; কিছু না।

এই বলেই তনু উঠে যায় আমি অবাক হয়ে তাকাই। ফ্রেশ হয়ে এসে তনু বই নিয়ে বসে। আমি ভাত মাখিয়ে তনুর মুখের সামনে ধরি। তনু টলমল চোখে আমার দিকে তাকায়। তনুর চোখে পানি দেখে বুকের ভেতরে ধুক করে উঠে। আমি আবার ভাত তনুর দিকে বাড়িয়ে ধরি। তনু এবার খেয়ে নেই। তাকে খাইয়ে দিয়ে শুইয়ে পরি। আমি কয়েকবার জিজ্ঞেসও করি যে কি হয়েছে তনু কাদছিস কেন। কিন্তু সে কিছুই বলে না। আমি বুঝি যে তনুর মন বেশ খারাপ তাই আর কিছু জিজ্ঞেস করি না। ঘুমিয়ে পরি। তবে মাঝরাতে কি যেন মনে করে আমার ঘুম ভেংে যায়। পাশে হাত দিয়ে দেখি জায়গা ফাকা সেখানে। এবার আমি তাকাই। পাশে তাকিয়ে দেখি তনু নেই। আমি কপাল কুচকে মাথা তুলি। এতো রাতে মেয়ে টা গেলো কোথায়। ওয়াসরুমের তো লাইট অফ। আমি উঠে পরি। তারপর ধীর পায়ে এগিয়ে যাই। তনু বলে দুবার ডাক দেই কিন্তু সারা নেই। তখনই কিছু ভাংগার জোরে শব্দ আসে। আমি এবার কিছুটা ভয় পেয়ে যাই। রুমের লাইট জ্বালিয়ে দিই। বুঝলাম যে শব্দ টা বারান্দা থেকে আসছে। দ্রুত সেখানে যাই আর গিয়েই যা দেখি তাতে আমার মাথায় বাজ ভেংগে পরে। নিজের চোখেই যেন সব ঘোলাটে লাগছে। আমি গিয়ে দেখি তনু ফ্লোরে বসে আছে হাতে তার একটা কাচের টুকরো। আর তনু তা তার হাতের শিরার কাছে ধরে রেখেছে। কাটবে কাটবে ভাব। চোখ দিয়ে তার পানি পরছে, দেখেই বুঝা যাচ্ছে যে অনেক কেদেছে। আমি দৌড়ে গিয়ে তনু কে টেনে তুলি, তার হাত থেকে কাচের টুকরো টা সাবধানে নিয়ে ছুড়ে ফেলে দিই। তনুর এই অবস্থা দেখে আমার মাথা এতো গরম হয়ে যায়। তনুর গালে ঠাটিয়ে একটা থাপ্পর মেরে দেই। তার বাহু ধরে ঝাকিয়ে বলে উঠি…

মেহরাম;; কি করছিলি তুই তনু, কি করতে যাচ্ছিলি তুই। মাথা ঠিক আছে তোর। কি মানে কি এমন হয়েছে যে তুই নিজেকে মেরে ফেলতে চাইছিলি। আমার কথা ভাবলি না, আচ্ছা আমার কথা রাখ নিজের পরিবারের কথা ভাবলি না। এতো টা স্বার্থপর কবে থেকে হলি তুই তনু।

তনু কে রেগে কথা গুলো বলছিলাম। তখন তনু কাদতে কাদতে আমাকে জড়িয়ে ধরে শক্ত ভাবে।

তনু;; আমি জীবনে যা চেয়েছি তা কখনোই পাই নি রে মেহরু। হয়তো হারিয়ে গেছে নয়তো চলে গিয়েছে।

মেহরাম;; তনু কি হয়েছে বল আমাকে।

তনু;; আয়ুশ অন্য কাউকে ভালোবাসে রে। আজ ভার্সিটিতে গিয়েছিলাম। তখন জানতে পারি। আয়ুশ নাকি অন্য কাউকে ভালোবাসে। সত্যি খুব খারাপ লাগছে আমার। আমি ওকে না পেলে মরেই যাবো মেহরু।

তনুর কথা শুনে আমি ভয় পেয়ে যাই। কোন ভাবে তনু এটা যেনে গেলো না তো যে আয়ুশ আর আমি রিলেশনে আছি। তাই আমি বলে ওঠি..

মেহরাম;; কে বলেছে তোকে এটা, আমি যত দূর জানি আয়ুশ কাউকেই ভালোবাসে না। ভুল শুনেছিস তুই। আর শুন এটা সিওর থাক যে আয়ুশ তোরই হবে।

কথা গুলো বলার সময় আমার নিজেরই গলা ধরে আসছিলো। তবুও খুব কষ্টে তনু কে বুঝিয়ে সুঝিয়ে ঘরে নিয়ে আসি। আর অনেক বকি অনেক। এমন কাজ যেন আবার না করে তাই তাকে হুমকি ধমকিও দেই। তনু কাদতে কাদতে আমার কোলেই ঘুমিয়ে পরে। যেন আমি আমার চোখের ঘুম টুকু সম্পূর্ণ তনুর চোখে ঢেলে দিলাম। আমার বোন কি পরিমান পাগল তা এখন বুঝলাম। কি করতে যাচ্ছিলো ও এখন যদি আমি সময় মতো না উঠতাম তাহলে কি হতো এটা ভাবতেই আমার গায়ে কাটা দিয়ে উঠছে। সারারাত আমার সেভাবেই বসে কেটে যায়। ভাবি যে আয়ুশকে কি বলবো আমি। কয়েকদিনে চোখের নিচের কালো দাগ টা যেন গাঢ় হয়ে গেছে। সকালে তনু উঠে দেখে আমি সেভাবেই বসে আছি।

তনু;; কিরে তুই ঘুমোস নি?

মেহরাম;; ঘুমিয়েছি তো এভাবেই।

তনু;; কিন্তু এভাবে।

মেহরাম;; হয়েছে তোর ওপর রাগ কিন্তু কমে নি আমার কাল যা করেছিস। তোকে আমার এখন ঠেংাতে ইচ্ছে করছে। আর বেশি বকবক না করে ফ্রেশ হতে যা ভার্সিটি যাবো।

তনু;; সরি আর যাচ্ছি।

তনু উঠে ফ্রেশ হতে চলে গেতেই আমি জলদি আয়ুশকে ফোন দেই।

আয়ুশ;; হ্যালো মেহরু।

মেহরাম;; ভার্সিটি আসছি আমি, ক্লাস করবো না তুমি কি ভার্সিটির মাঠে অপেক্ষা করতে পারবে?

আয়ুশ;; আজীবন অপেক্ষা করতে পারবো।

আয়ুশের এমন কথায় আমি চোখ বন্ধ করে ফেলি।

মেহরাম;; সেখানে থেকো আমি আসছি।

আয়ুশ;; আচ্ছা।

তনু আর আমি খেয়ে দেয়ে একসাথে বের হয়ে পরি। তনু তার ডিপার্টমেন্টর সামনে নেমে চলে যায়। আমিও সেখানে নেমে পরি। তারপর সোজা চলে যায় ভার্সিটির মাঠে। গিয়েই দেখি আয়ুশ দাঁড়িয়ে আছে পেছন ঘুরে। আমি ধীরে ধীরে হেটে তার কাছে যাই। হয়তো সে আমার হাটার শব্দ পেয়ে বুঝতে পারে যে এটা আমি।তাই যাওয়ার আগেই সে আমার দিকে তাকায়। আয়ুশ দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে। আমি আয়ুশের পিঠে হাত রাখতে গিয়েও আবার হাত টা কুচকে ফেলি।

আয়ুশ;; আই মিসড্ ইউ সো মাচ।

মেহরাম;; আয়ুশ তোমার সাথে কিছু কথা আছে আমার অনেক দরকারি আর সেগুলো বলতেই এখানে আসা।

আয়ুশ;; তার আগে আসো কোথাও বসি।

আয়ুশ আমার হাত ধরে নিয়ে একটা লেকের কাছে নিয়ে যায়। আর সেখানেই আমরা দুজন বসে পরি। আমি লেকের পানির দিকে শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকি।

আয়ুশ;; মেহরু আমি…

মেহরাম;; আয়ুশ আমার পক্ষে আর এই সম্পর্ক টা টিকিয়ে রাখা সম্ভব না।

আমার কথায় আয়ুশ যেন ৪৪০ ভোল্টের শক খেলো। আয়ুশ ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে পরে। আমি চোখ তুলে আয়ুশের দিকে তাকাই। আয়ুশ জোরে জোরে দম ছাড়ছে। আমি বুঝতে পারলাম যে আমার কথা তা আয়ুশ ঠিক মেনে নিতে পারছে না।
আয়ুশ চিল্লিয়ে বলে ওঠে…

আয়ুশ;; মানে কি এইসবের মেহরাম?

মেহরাম;; মানে তাই যা তুমি শুনেছো। আমি আমাদের সম্পর্কের এখানেই ইতি ঘটাতে চাই।

আয়ুশ;; কিন্তু কেন, কারণ কি? কি হয়েছে হুট করেই এমন কথা?

মেহরাম;; মন ভরে গেছে আমার। চাই না তোমাকে।

আয়ুশ;; মেহরাম দেখো এমন ফাজলামো একদম ভালো লাগে না আমার। প্লিজ ডোন্ট জোক উইথ মি।

মেহরাম;; এটা কোন মজা না আয়ুশ আমি সিরিয়াস। আই ওয়ানা ব্রেকাপ। আমার মন উঠে গেছে।

আয়ুশ;; রিজন?

মেহরাম;; বলেছি তোমায়, ভালো লাগে না তোমাকে।

আয়ুশ;; মেহরাম আমি জানি তুমি ওই রকম মেয়েই না। অযথা পেচাল পাইরো না।

মেহরাম;; আমি কতো টুকু খারাপ তা কেবল আমিই জানি। তো আমার যে এই ভালো চেহারা আছে না এটাতে যেয় না।

আমি এই কথা বলে চলে আসতে নিলে আয়ুশ আমার হাত ধরে আমার গালে নিজের হাত দুট চেপে ধরে। নিজের মাথার সাথে আমার মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে।

আয়ুশ;; কেন এমন করছো মেহরাম? আমি পারবো না তোমাকে ছাড়া।

মেহরাম;; জেদ করো না আয়ুশ।

আয়ুশ;; হ্যাঁ আমি অনেক জেদি আর আমি করবো। কিন্তু তোমাকে চাই আমার।

মেহরাম;; আয়ুশ ভালোবাসি না আমি।

আয়ুশ;; মেহরাম সত্যি কারণ বলো আমায় কি হয়েছে (আমার চোখে চোখ রেখে)

মেহরাম;; আয়ুশ, আয়ুশ তনু। আয়ুশ তনু তোমাকে অনেক ভালোবাসে। কাল রাত সুসাইড পর্যন্ত করতে গিয়েছিলো তোমার জন্য এই জেনে যে তুমি অন্য কাউকে ভালোবাসো। তনু অনেক ভালোবাসে তোমায়। আমার থেকে হাজার গুণে বেশি আয়ুশ। তুমি ওর সাথে হ্যাপি থাকবে। আমি পারবো না তুমি প্লিজ ওর হয়ে যাও আয়ুশ। আমি হাত জোর করছি তোমার কাছে প্লিজ। নয়তো আমার বোন মরেই যাবে।

আমি আর পারিনি নিজেকে আটকাতে কান্না করে দেই। আর আয়ুশকে সব বলে দিই। আমার কথা শেষ হতেই আমার গালে কষে এক চড় বসিয়ে দেয় আয়ুশ। আমি গালে হাত দিয়ে মাথায় নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকি আয়ুশের সামনে। আয়ুশ তার মাথায় কতোক্ষণ হাত দিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে। পরক্ষণেই ঘুড়ে আমার দিকে তাকায়।

আয়ুশ;; তোমার বোন তনু তুমি ওর জন্য এমন করছো। পাগল তুমি মেহরান। তোমার বোন আমাকে না পেলে মরে যাবে আর আমি তোমাকে না পেলে মরে যাবো। এতো বেশি সেল্ফিস তুমি। তোমার বোনের দিক টাই ভাবলে আমার না। আরে আমার কথা ছাড়ো তুমি নিজের দিক টা ভাবলে না। আমাকে ছাড়া কি তুমি নিজে ভালো থাকবে বলতে চাইছো কখনোই না। মেহরাম আমাদের সম্পর্কের সময়সীমা কম হতে পারে কিন্তু ভালোবাসার গভীরতা কম না।

মেহরাম;; আয়ুশ এতো সবকিছুর পর আমি পারবো না। আজ হোক কাল হোক যখন তনু জানবে যে তোমার সাথে আমার সম্পর্ক আছে তখন সেই শক টা সে সেড়ে উঠতে পারবে না। কষ্ট হবে তার। তার থেকে বরং আমিই সেই কষ্ট টা নেই। প্লিজ আয়ুশ।

আয়ুশ;; ভুল করেছি আমি অনেক বড় ভুল। তোকে, তোকে নিজের জীবন দিয়ে ভালোবেসে অনেক বড় একটা ভুল করেছি আমি। ইউ আর দি বিগেস্ট মিস্টেক অফ মাই লাইফ।

মেহরাম;; আয়ুশ আমি কখনো কিছুই চাই নি তোমার কাছে প্লিজ তনুকে মেনে নাও। আয়ুশ প্লিজ।

আয়ুশ;; মিস মেহরাম আফরিন ফর ইয়র কাইন্ড ইনফরমেশন আমি আপনাকে জানিয়ে দেই যে আমার ভালোবাসা বিক্রির জন্য না। আর নাই আমি কোন দ্রব্য যে আমাকে যেখানে খুশি সেখানে আপনি বিক্রি করে দিবেন। আমি বিকাও না। আর নাই আমার ভালোবাসা।

মেহরাম;; আয়ুশ তুমি যা বলবে আমি তাই করবো প্লিজ তনু কে মেনে নাও। আয়ুশ প্লিজ। আই এম বেগিং টু ইউ।

আয়ুশ;; তোমাকে চাই আমি।

মেহরাম;; আয়ুশ (চিল্লিয়ে) কেন বুঝতে পারছো না আমার দিক টা। আমি যে কিসের মধ্যে আছি তা কেবল আমিই জানি। পারবো না আমি তোমার সাথে থাকতে।

আয়ুশ;; মেহরাম…

মেহরাম;; এই সম্পর্ক না ভাংলে আর তনু কে যদি তুমি না মেনে নাও তাহলে তুমি আমার মরা মুখ দেখবে।

হাত দিয়ে আয়ুশকে থামিয়ে দিয়ে তার দিকে চোয়াল শক্ত করে কথা টা বললাম।
আমার কথা শোনার পর আয়ুশ আর কিছু বললো না অন্য দিকে ঘুড়ে তাকিয়ে থাকে। আমি বুঝতে পারলাম যে আয়ুশের এখন বেশ রাগ উঠেছে। আমি এক কিণারে দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমাদের মাঝে আর কোন কথা নেই, পিনপতন নীরবতা। আমি নিচ থেকে আমার ব্যাগ টা তুলে চলে আসতে নিবো। তখন ডাক পরে আয়ুশের। আমি থেমে যাই।

আয়ুশ;; মেহরাম।

মেহরাম;; __________

আমি দাঁড়িয়ে পরি। আয়ুশ আমার সামনে আসে।

আয়ুশ;; আজ থেকে আপনি দেখবেন যে আমি এই আয়ুশ কি কি করতে পারি। জেদের তো কিছুই দেখেন নি। আর রইলো কথা তনুর তো আমি এটা বলবো যে দশ বছর পর হলেও আপনি একদিন আমাকে আর তনুকে দেখে কপাল চাপড়াবেন আর আফসোস করবেন কিন্তু সেইদিন কোন সময় থাকবে আপনার কাছে। তনু কে মেনে নেবার কথা বললেন তাই না। নিবো মেনে। আরেক টা কথা আপনার জন্য যে ভালোবাসা টুকু আমার মনে পোষা ছিলো এখন তা দ্বীগুণ হয়ে ঘৃণায় পরিণত হয়েছে। আই হেট ইউ মেহরাম।

আয়ুশ এই কথা বলেই হনহন করে চলে যায়। আমি মাথা নিচু করে শুধু তার কথা গুলো শুনি। আমার কিছুই করার নেই। এতে যে যাই বলুক। আমি সেখান থেকে এসে পরি। বাইরে আসতেই তনু কে দেখি। কিছুই বুঝতে দেই না তাকে। সোজা বাসায় চলে যাই। সেদিন অনেক কান্না করি আমি। রাতের ঘুম হারাম আমার। পরেরদিন ভার্সিটিতে আসি। এসেই দেখি মাঠ ভর্তি মানুষ শুধু আমাদের ডিপার্টমেন্টর না অন্যান্য ডিপার্টমেন্টর ছাত্র-ছাত্রী রাও আছে। সবাই ভীড় করে আছে। আমি আর তনু গেলাম কিন্তু বুঝলাম না কিছুই। হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখি আয়ুশ। বেশ ফুরফুরে মেজাজের লাগছে তাকে। হুট করেই দেখি আয়ুশ তনু বলে চিল্লিয়ে ওঠে। আমি মাথা তুলে তাকাই। আর তনুর দিকে তাকিয়ে দেখি তার চোখ খুশিতে ঝলমল করছে। আয়ুশ হাতে এক তোড়া ফুল এনে সবার মাঝে তনুকে হাটু ভাজ করে প্রপোজ করে। চারিদিকে সবাই চিল্লিয়ে ওঠে। আমার পাশে তনু দাঁড়িয়ে ছিলো আর আয়ুশ তাকে প্রপোজ করে। আমি তাদের দেখে কিছু টা সরে দাড়াই। উর্মি দাঁড়িয়ে আছে দেখে আমি তার কাছে যাই। তনু প্রথমে আমার দিকে তাকায় আমি বিনিময়ে মুচকি হাসি দেই। তনু সাথে সাথে এক্সেপ্ট করে নেয়। সবাই একসাথে চিল্লিয়ে ওঠে। আয়ুশ আর তনু হেসে একে ওপর কে জড়িয়ে ধরে। আমার সাধ্যি নেই সেখানে দাড়াবার তাই চলে যাই। ভেংে চুরমার হয়ে গেছি আমি। এতো টা ভেংেছি যে দাড়ানোর শক্তি নেই। কিছুক্ষণ পর তনু আমাকে খুজতে খুজতে এসে পরে। এসেই আমাকে জড়িয়ে ধরে। মুখ থেকে যেন তার হাসি যাচ্ছেই না। এতো খুশি সে যে এখন কেদেই দিয়েছে। আমি হেসে তনুর চোখের পানি মুছে দেই। তনু ভেবেছে যে আমি হয়তো আয়ুশকে তনুর বেপারে বলেছি। আর আয়ুশও যে তনুকে ভালোবাসে এটাও আমাকে বলেছে আর তাই আজ সে তনুকে প্রপোজ করেছে। সারা টা দিন তনু বকবক করেছে। আমি আর আয়ুশ আলাদা হয়ে যাই। তনু আর আয়ুশ এক হয়ে যাই। আয়ুশ যেন আমাকে দেখিয়েই বেড়াচ্ছিলো এক প্রকার। এভাবেই চলে থাকে সময়। একদিন বাড়ি থেকে ফোন এলো আমার ফোনে। আমি আর তনু ফোন নিয়ে বসলাম বিছানাতে। ফোনের ভলিউম লাউড স্পিকারে দিলাম। চাচি অনেক খুশি খুশি মনে বলে ওঠে যে তনুর জন্য একটা বিয়ের সম্পর্ক এসেছে। তনুর তো কাদো কাদো চেহারা এইসব দেখে। আমিও কিছুটা ঘাবড়ে যাই যে কিভাবে সম্ভব এটা। তাকিয়ে দেখি তনু কেদেই দিয়েছে কারণ সে কি করে অন্য কাউকে বিয়ে করবে যেখানে সে আয়ুশকে ভালোবাসে। আমি তনু কে শান্তনা দিয়ে বসিয়ে রাখি। আমি চাচিকে বরের নাম জিজ্ঞেস করলে চাচি বলে উঠে আয়ুশ আহমেদ। ব্যাস এই টুকুই যেন যথেষ্ট ছিলো। তনু লাফিয়ে ওঠে, তনু সাথে সাথে বলে ওঠে যে আমি রাজি আমি রাজি। আর আমি হেসেই খুন 😅। অনেক কথা বলার পর ফোন কেটে দেই। আর তখন তনুর ফোনে আয়ুশ ফোন দেয়। তনু ইচ্ছে করেই ফোনের ভলিউম বাড়িয়ে দেয়। আয়ুশ বলে ওঠে “কেমন লাগলো সারপ্রাইজ টা” তনু তো খুশিতে পাগল হয়ে যাচ্ছে। তাদের কথা বলার মাঝেই হঠাৎ আয়ুশ বলে ওঠে “তোমার বোন কোথায়, হ্যাঁ কি যেন নাম মেহ মেহ…” তনু বলে ওঠে ‘মেহরাম’। আমি তনু কে ইশারা দিয়ে বাইরে চলে যেতে বলি আয়ুশের সাথে কথা বলার জন্য। তনু চলে যায়। ব্যাস হয়ে গেলো। কয়েকদিনের মাঝেই তনু আর আমি বাড়ি চলে গেলাম। আয়ুশের ফ্যামিলি এসে আমাদের ফ্যামিলির সাথে কথা বলে গেছে। বিয়ে তাদের একদম পাকা পাকি হয়ে যায়। এর মধ্যে কখনো কখনো কারো না কারো মাধ্যমে আয়ুশ আমাকে খোচা মেরে অনেক কথা বলেছে। আমি না শোনার ভান করেই থাকি। এই তো হয়ে গেলো আস্তে আস্তে তনু আর আয়ুশের বিয়ে।

.

অতীত শেষ 🌸~~


বাইরে মুষুলধারে বৃষ্টি হচ্ছে, আমি এই সবকিছুই মনে মনে একবার মনে করে নিলাম। সবশেষে চোখ দুটো বন্ধ করি আমি। আর টুপ করে পানি পরে যায়। বাইরে তাকিয়ে দেখি কালো মেঘময় আকাশ, কিন্তু ফোন অন করে দেখি ৪;৫৫ বাজে। ভোর হয়ে গেছে। খানিক পরেই আযানের ধ্বনি কানে এলো। আমি উঠে গিয়ে ওযু করে নামায পরে নিলাম। নামায শেষে জায়নামাজ গোছাচ্ছি তখনই আমার দরজাতে কড়া নাড়ে। আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দেই।




🥀চলবে~~

তৈমাত্রিক পর্ব-০৩

0

#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ০৩

❣️
.
.

আমি ক্লাসের বাইরে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই উর্মি আর বাবলি দৌড়ে আমার কাছে ছুটে আসে…

উর্মি;; দোস্ত তোর তো ভালোই সাহস, জানিস এই তুই কোন প্রথম মেয়ে যে কিনা উনার মুখের ওপর কথা বলেছে।

মেহরাম;; দেখ সাহস টাহসের কিছুই নেই এখানে। তার কথা বলা আমার কাছে ভালো লাগেনি তাই প্রতিউত্তর দিয়েছি মাত্র আর কিছুই না।

বাবলি;; দেখা যাক কাল কি হয়।

মেহরাম;; হ্যাঁ আমি এবার চলি।

এই কথা বলেই আমি বের হয়ে পরি। ভার্সিটি গেটের কাছে গিয়ে কাউকে পেলাম না তাই একটু দাঁড়িয়ে থাকলাম। খনিক বাদে তনু এলো। আমি আর কি বলবো তনুই বকবক করছে যে আজ ক্লাসে কি কি হলো, কি কি করালো। আমিও তাই শুনছি। অতঃপর একটা রিকশা ভাড়া করে একদম বাড়ি চলে গেলাম। আমাদের যেন ডেইলি রুটিন হয়ে গেলো। বাসা থেকে ভার্সিটি, ভার্সিটি থেকে বাসা আর মাঝে মধ্যে বাইরে ঘুড়তে যাওয়া। রাতের বসে আছি আর তনু ফোন চালাচ্ছে। তখন হঠাৎ সে বলে উঠে…

তনু;; মেহরু..

মেহরাম;; হুমম।

তনু;; আজ কি ক্লাসে কিছু হয়েছে মানে তোর ক্লাসে?

মেহরাম;; কই না তো, মাত্র একটা ক্লাস ছিলো তাই করে এসে পরেছি।

তনু;; ওহহ আচ্ছা।

অনেক গল্প করে আড্ডা দিয়ে প্রায় ১ টার দিকে তনু আর আমি ঘুমাতে যাই। পরেরদিন উঠেই আবার ভার্সিটির জন্য ছুটে চলে যেতে হয়। তনুকে তার ডিপার্টমেন্টর সামনে নামিয়ে দিয়ে আমি চলে যাই। ভার্সিটির ভেতরে তো গেলাম কিন্তু আজকে আর সেই ভার্সিটির সো-কল্ড সিনিয়র আয়ুশকে দেখতে পেলাম না। আমি যেন কিছুটা শান্তিই পেলাম। সোজা চলে যাই ক্লাসে। তবে গিয়েই দেখি সবার মুখে বারো টা বেজে আছে। আমি গিয়ে বাবলির পাশে বসে পরি…

মেহরাম;; হয়েছে কি তোদের এমন করে আছিস কেন?

বাবলি;; আয়ুশ আহমেদের এক চেলা এসে আমাদের সবাইকে চুপচাপ বসে থাকতে বলেছে কি যেন আজ আছে নাকি তাই।

মেহরাম;; মানে?

উর্মি;; মানে এই যে হয়তো আমাদের রেগিং করা হবে।

মেহরাম;; আজাইরা।

আমি এই কথা বলেই সামনে তাকাই তখনই একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ ক্লাসে আসেন এবং আমাদের সাথে কথা বলতে থাকেন।


আয়ুশ;; কিরে ওই মেয়ে টার বেপারে যে সব খবরাখবর নিয়ে আসতে বলেছিলাম। নিয়ে এসেছিস?

রাকিব;; জ্বি ভাইয়া। মেয়েটার নাম মেহরাম আফরিন। এখানে মিরপুরে থাকে। মূল বাড়ি কিশোরগঞ্জ,, এখানের ভার্সিটিতে চান্স হয়েছে তাই এসেছে। সে ইংলিশ ডিপার্টমেন্টর। তার একটা বোনও আছে নাম আশফিয়া তনু এই ভার্সিটিতেই পরে কিন্তু ফিলোসোফি ডিপার্টমেন্টর।

আয়ুশ;; হুমমম বুঝলাম, চল।

আয়ুশ এই বলেই আমাদের ক্লাসে এসে পরে। আর তার আসতেই ক্লাসে থাকা সেই ব্যাক্তি টি চলে যায়। আমরা সবাই দাঁড়িয়ে পরি।

আয়ুশ;; সবাই আস্তে ধীরে বের হয়ে ভার্সিটির হলরুমে গিয়ে জড়ো হও, ফাস্ট।

আমি উর্মির দিকে তাকালে সে আমাকে জলদি যাওয়ার জন্য বলে। আমরাও চুপচাপ গেলাম। মেয়েরা আগে দাঁড়িয়েছে আর ছেলেরা পরে। আয়ুশ সামনে এসে একটা টেবিলের ওপর বসে পরে। এক এক করে সবার নাম বলছে সে আর তাদের রেগ দিচ্ছে। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম যে হয়তো কোন উল্টা পালটা কাজ করতে বলবে কিন্তু না আয়ুশ সবাইকে অনেক ভালো ভালো রেগ দিচ্ছে। যেমন ভার্সিটির পাশে একটা মসজিদ রয়েছে তাতে একজন কে টাকা দিতে বলছে, স্যারদের মাঝে মিষ্টি দিতে বলছে কাউকে, জুনিয়র দের এসাইনমেন্টে হেল্প করতে বলছে আরো কতো কি কি। আমি আমার জীবনে এমন এই প্রথম দেখলাম। সে যাই হোক সবার নাম ধরে এক এক কাজ করতে বললেও সবার শেষে পরি আমি। আর আশ্চর্যজনক ভাবে আমার নাম আয়ুশ ডাকে না আর রেগও দেয় না। আমার দিকে সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে আয়ুশ চলে গেলো। সে চলে গেতেই বাবলি আমাকে ঝাপটে ধরে।।।

বাবলি;; কিরে সবাইকে কিছু না কিছু দিলো কিন্তু তোকে কিছুই দিলো না।

মেহরাম;; আমিও তো তাই ভাবছি। আচ্ছা যাজ্ঞে, না দিলেই ভালো আমি বেচে গেছি।

সবাইকে যা যা দেওয়া হয়েছে তারা সেই কাজে নেমে পরলো। কিন্তু আমি কি করবো বসে থাকলাম। এক সময় বোর হয়ে গেলাম। তখনই তনুর ফোন আসে আমি রিসিভ করি। ওপর পাশ থেকে সে বলে ওঠে…

তনু;; আমার তো ক্লাস শেষ তোর হয়েছে?

মেহরাম;; হ্যাঁ হয়েছে।

তনু;; তাহলে এসে পরে।

মেহরাম;; আচ্ছা আসছি।

আমি উর্মি আর বাবলি কে বলে সেখান থেকে চলে যাই। ভার্সিটির বাইরে এসে দেখি তনু দাঁড়িয়ে আছে। এখন কড়া রোদ তাই আমরা দুজন একটু ছায়াতে দাঁড়িয়ে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। তখনই আমার চোখ পরে রাস্তার এক কিণারে। আমি কিছুটা লক্ষ করলেই দেখতে পাই যে সেটা আয়ুশ। রাস্তার পাশে কিছু অসহায় মানুষকে খাবার দিচ্ছে। মুখে লেগে আছে বিরামহীন হাসি। অজানতেই আমার মুখের হাসি ফুটে ওঠে। মানুষটাকে যতোটা খারাপ ভেবেছিলাম আসলে ততোটা না। আমি আর তনু রিকশা করে এসে পরি। যতক্ষণ না আয়ুশ আমার চোখের আড়াল হয় আমি তাকিয়েই ছিলাম।

.
.

তনু আর আমি দুজনেই বসে বসে গল্প করছিলাম আর পড়ছিলাম। আমি একটু হেটে বারান্দায় আসলাম। এখান থেকে আবার বাইরের রাস্তা দেখা যায়। হঠাৎ টুং করে আমার ফোনে মেসেজ আসে। আমি চিনি না নাম্বার টা। যাই হোক মেসেজ টা ওপেন করলাম…

“পূর্নিমা সন্ধ্যায় তোমার রজনীগন্ধায়, রুপ সাগরের পারের পানে উদাসী মন দায়”।

আমি হেসে দেই, কেননা এতো রাতে এক অচেনা নাম্বার থেকে এমন মেসেজ আমাকে কে দিবে। আমি ভাবলাম হয়তো ভুলে কেউ পাঠিয়ে দিয়েছে। বাইরে কতোক্ষণ থেকে ঘরে চলে যাই। তবে আমি গিয়ে দেখি তনু বুকের ওপর বই রেখেই ঘুমিয়ে পরেছে। আমি গিয়ে বই টা আলতো করে টেবিলে রেখে দিই। তারপর গায়ে চাদর টেনে দিই। আমিও ঘুমিয়ে যাই।

পরেরদিন ভার্সিটিতে গেলে দেখি ক্লাসে সবাই কেমন চুপ। কথা নেই। মানে আমি এসেই দেখি চিল্লাপাল্লা কিন্তু যেই না আমি ভেতরে গেলাম ওমনি সবাই চুপ মেরে গেলো। আমি কিছু বুঝলাম না। যাই হোক ভার্সিটির কারো সাথে আমি তখনও তেমন কথা বলতাম না, শুধু উর্মি আর বাবলি বাদে। ছেলেরাও কথা বলে না। আগে যতো টুকু বলতো এখন আরো না। প্রয়োজনে আমি বলতে গেলে যেন আরো পালিয়ে যাই। এর জন্য আমি কথাই বলি না। স্যার আমাদের ক্লাস নিচ্ছিলো। মাঝখানে আয়ুশ টপকে পরে এসেই আমার নাম ধরে ডাকে। তার ডাক দেওয়াতে যেন পুরো ক্লাসে একটা ধ্বনি বেজে উঠলো।

আয়ুশ;; মেহরাম।

আমি মাথা তুলে তাকাই

আয়ুশ;; এসো।

মেহরাম;; কো.. কোথায়?

আয়ুশ;; এসো।

উর্মি আমাকে ইশারা দিয়ে যেতে বলে। আমিও যাই। ক্লাসের বাইরে আসতেই আমি বলে উঠি..

মেহরাম;; আমাকে এভাবে ক্লাসের মাঝখান থেকে আনার মানে কি। জানেন কতো ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস ছিলো। নোটস পরে কোথায় পাবো আমি।

আয়ুশ;; নোটস ক্ললেক্ট করা একটা বেপার হলো। আমি দিয়ে দিবো নি।

মেহরাম;; চাই না আপনার কাছ থেকে। আমি গেলাম।

আমি চলে আসতে ধরলেই আয়ুশ আমার হাত ধরে ফেলে। আমি চোখ গুলো গোল গোল করে আয়ুশের দিকে তাকাই। সে ভাবলেশ হীন ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি চোখ নামিয়ে হাতের দিকে তাকালে আয়ুশ কয়েক কদম হেটে আমার কাছে চলে আসে। আমি কিছুটা পেছাই।

আয়ুশ;; আসো আমার সাথে।

আমি কিছুই বলছি না মূলত আমি অবাক আয়ুশের কান্ডে সে আমার হার ধরে শুধু নিয়ে যাচ্ছে আর আমি তার দিকে তাকিয়ে আছি। ভার্সিটির মাঠের পেছনে চলে এলাম আমরা।

আয়ুশ;; হুম এখানে আনতে চেয়েছি তোমায়।

মেহরাম;; এখানে আমি কি করবো?

আয়ুশ;; কিছুই করতে হবে না, এখানে বসো।

আয়ুশ নিজে বসে পরে আর সাথে আমাকেও বসিয়ে দেয়। নীরবতা ভেংে আয়ুশ বলে ওঠে…

আয়ুশ;; প্রথমে কি ভেবেছিলে আমি গুন্ডা, একদম না। কলেজের স্যাররা আমাকে কিছুই বলে না কারণ তারা জানে যে আমি তেমন ছেলেই না। হ্যাঁ হয়তো রাগের বসে একটু বেশি করে ফেলি মাঝে মাঝে। কিন্তু তা না করলে হয় না।

মেহরাম;; আমার সাথে কেউ কথা বলে না কেন? (কপাল কুচকে তার দিকে তাকিয়ে)

আয়ুশ;; কোথায় কেউ বলে না। ওই তো উর্মি তারপর বাবলি ওরা বলে তো।

মেহরাম;; ছেলেরা কেউ কেন কথা বলে না?

আয়ুশ;; কেন তাদের সাথে কথা বলার খুব শখ?

মেহরাম;; তেমন না কিন্তু ক্লাসমেট হিসেবে।

আয়ুশ;; আমি বারণ করেছি।

মেহরাম;; কেন?

আয়ুশ;; তোমাদের ব্যাচের কিছু পোলাপান খুব বেশি খারাপ তাই।

আমি আর আয়ুশের কথায় কিছু বলি না। এক সময় আমি উঠে পরি। আয়ুশ আমার দিকে তাকায়। কিন্তু আমি “আমি এবার আসি” এই কথা বলেই দ্রুত চলে আ
যাই। ক্লাসে গিয়ে দেখি সবাই ধীরে ধীরে বাইরে আসছে। আমিও ব্যাগ নিয়ে এসে পরি। তখন বাবলি আমাকে খোচা মেরে বলে….

বাবলি;; কিরে হুম কি চলছে?

মেহরাম;; কই কি আবার চলবে?

বাবলি;; ওই যে আয়ুশ ভাইয়ের সাথে।

মেহরাম;; আরে ধুর হুদাই বুঝলি। নিয়ে বসিয়ে রেখেছিলো।

বাবলি;; ওহহ আচ্ছা তাই নাকি।

মেহরাম;; হ্যাঁ তাই, লাথি খাবি চুপ কর।

বের হয়ে পরি ভার্সিটি থেকে। আজ তনু আর আমি মিলে অনেক ফুচকা খাই। তারপর বাসা। এভাবেই দিন যেতে থাকে,২-১ মাসও পেরিয়ে গেছে। একদিন তনুর শরীর ভীষণ খারাপ হয়। তাই তাকে একা রেখে আমিও ভার্সিটিতে যাই না। সেইদিন রাতের ঘটনা। প্রায় ১;৩০ বাজে এমন। আমার ফোনে কল আসে। আমি রিসিভ করতেই ওপর পাশ থেকে বলে ওঠে..

আয়ুশ;; মেহরাম আমি আয়ুশ জলদি নিচে নামো।

আমি তো আয়ুশের কথা শুনে ভেবাচেকা খেয়ে যাই। দ্রুত বারান্দায় গিয়ে দাড়াই। নিচে উকি দিতেই দেখি আয়ুশ দাঁড়িয়ে। আমি কোন উপায় না পেয়ে বাড়ির চাবি দিয়ে দরজা খুলে আস্তে করে বাইরে চলে যাই। বাইরে গেতেই আয়ুশ ছুটে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে, আমি অবাকের ওপর অবাক।

আয়ুশ;; কেন ভার্সিটিতে আসো না দুদিন ধরে। জানো তোমাকে না দেখতে পেরে আমার তো অবস্থা নাজেহাল।

মেহরাম;; আচ্ছা ছাড়ুন দেখি আমাকে কেউ দেখলে কি বলবে প্লিজ ছাড়ুন। আর আমার ভার্সিটি আসা বা না আসা সেটা কোন বেপার না।

আয়ুশ;; অবশ্যই বেপার। আমার জন্য।

মেহরাম;; আরে কিন্তু কেন?

আয়ুশ;; ভালোবাসি, মেহরাম সেই প্রথম দিন থেকে ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে।

আমি টাসকি খেয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। আয়ুশ তার মতো করেই বলে যাচ্ছে।

মেহরাম;; আয়ুশ, আয়ুশ দেখুন আমার কিছু সময় দরকার।

আয়ুশ;; যতো সময় নেবার নাও। কিন্তু আমি ভালোবাসি।

আমি কোন রকম করে আয়ুশের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসে পরি। ঘরে গিয়েই দরজা আটকিয়ে জোরে জোরে দম ফেলি। তনুর দিকে তাকিয়ে দেখি ঘুম, জ্বর এসেছিলো তার। আর এখন অনেকটাই কম। আমার আর ঘুম আসে না। বসে বসে শুধু ভাবি যে আয়ুশ যে পরিমান জেদি আর রাগি প্রকৃতির না জানি কি করতে কি করে বসে। পরেরদিন আমি একাই ভার্সিটিতে যাই তনু আগামীকাল থেকে যাবে। গিয়েই দেখি ক্লাস পুরো ফাকা শুধু আয়ুশ বসে আছে তাও সেখানে যেখানে আমি প্রায়ই বসি। আমি এগিয়ে যাই। আয়ুশ আমাকে দেখে সামনে আসে।

মেহরাম;; ক্লাসের সবাই কোথায়?

আয়ুশ;; আজ ক্লাস নেই।

মেহরাম;; তাহলে আমি কি করবো আমিও চলে যাই।

আয়ুশ;; আহা, দাড়াও। তুমি এখানেই থাকবে আমার সাথে।

মেহরাম;; কেন?

আয়ুশ;; ভালোবাসি যে।

মেহরাম;; বার বার একই কথা।

আয়ুশ;; যতক্ষণ না হ্যাঁ বলছো আমি বলেই যাবো এই কথা।

আয়ুশের কথায় আমি হেসে দেই। দুজনেই গিয়ে একসাথে হাটতে থাকি। হাটার মাঝে আয়ুশ আমার হাত ধরে। আমি খুব কষ্টে আমার হাসি দমিয়ে রাখি। সেদিন এভাবেই কাটে আমার। রাতে বাসায় এসে জানি না কেন আয়ুশের খেয়াল মাথা থেকে যাচ্ছিলোই না। আনমনেই হেসে উঠছিলাম। তনু এগুলো দেখে আমাকে অনেক জ্বালিয়েছে কিন্তু আমি উলটো ওকেই ঝাড়ি মেরে বসিয়ে রেখেছি। আমি বুঝে যাই যে হয়তো আমিও ভালোবেসে ফেলেছি আয়ুশকে। আমার অজানতেই। তনু কে নিয়ে পরেরদিন ভার্সিটিতে যাই। আর সেদিন আমি ইচ্ছে করেই ক্লাস ফাকি দিয়ে আয়ুশের সাথে দেখা করতে আসি। মাঠে গেতেই আয়ুশকে পাই। আয়ুশ সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে আমাকে দেখে এগিয়ে আসে। আর তার সাথে বাকি যারা ছিলো তারা চলে যায়।

আয়ুশ;; কিছু বলবে মেহরু?

মেহরাম;; যদি বলি ভালোবাসি!

আয়ুশ;; তাহলে আমিও বলবো।

আয়ুশ আমাকে জড়িয়ে ধরে আর আমিও। কখনো কারো সাথে আমি এমন একটা সম্পর্কে জড়িয়ে যাবো তা ভাবি নি। আয়ুশের পাগলামো, বাচ্চামো, কেয়ারিং সব যেন আমার ওপর গভীর ভাবে আঘাত করেছিলো। মাঝেই মাঝেই হাতে একগুচ্ছ ফুল নিয়ে আয়ুশের আমার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা। আরো না জানি কতো কি। এভাবেই চলছিলো আমাদের। কিন্তু আমি মাঝে মাঝে অবাক হতাম এই ভেবে যে আমি নিজেই হয়তো আমার এত্তো সিক্রেট জানি না যতো গুলো তনু জানতো আমার বেপারে। কিন্তু এইবার তার ভিন্ন। এইবার আমি তনুকে আমার আর আয়ুশের সম্পর্কের বেপারে কিছুই বলি না। অনেকবার বলার ট্রাইও করেছি কিন্তু পারিনি। আমি ভাবলাম যে কোন একদিন সঠিক সময় বুঝে তনু কে সব খুলে বলবো। আর আয়ুশ আর আমি তো একে ওপর কে অনেক বেশি ভালোবাসতাম। ভালোবেসে ফেলেছিলাম। এভাবেই দিন গড়িয়ে গড়িয়ে কখন যে পুরো ১ টা বছর কেটে গিয়েছিলো বুঝতেই পারিনি। এর মধ্যে আমিও তনুকে কিছু জানানোর সুযোগ পাইনি। আমরা প্রথম বর্ষ থেকে ভার্সিটির দ্বিতীয় বর্ষে উঠি। একদিন ক্লাস শেষে আয়ুশের সাথে বসে ছিলাম। তখন তনুর ফোন আসে, এই টাইমে কখনো অনু আমাকে ফোন করে না কিন্তু আজ করলো। আমি দ্রুত ফোন রিসিভ করি।

মেহরাম;; হ্যালো তনু..

তনু;; মেহরু আমি বাসায় এসে পরেছি, আমার একদম ভালো লাগছিলো না। তোর ক্লাস শেষ হলে প্লিজ তুইও এসে পর।

মেহরাম;; মানে শরীর খারাপ লাগছে নাকি তোর আর তোর গলার আওয়াজ এমন কেন। আচ্ছা রাখ দেখি আমি এখনই আসছি।

আমি দ্রুত ফোন কেটে দেই। আয়ুশকে বলে কয়ে আমি এসে পরি। রিকশা ফুরিয়ে ছুটে চলে যাই। বাসায় গিয়েই দেখি অনু জানালার কাছে বসে আছে। আমি গিয়ে তার কপালে হাত রেখে দেই।
সে মুচকি হেসে বলে…

তনু;; মেহরু আমার কিছু হয়নি।

আমি খেয়াল করে দেখলাম যে তনুর নাক মুখ একদম ফুলে আছে। বেশ বুঝলাম যে এই মেয়ে কান্না করতে করতে একাকার করেছে। আমি কারণ খুঁজে পেলাম না এমন করার। কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবো তার আগেই তনু এসে আমার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পরে। আমি মলিন হেসে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম।

মেহরাম;; খারাপ লাগছে কি! বাড়ির কথা আম্মু-চাচির কথা মনে পরছে??

তনু;; না আমার শুধু খুব কষ্ট হচ্ছে। এভাবেই থাকতে দে একটু।

আমার কোলে আমি ভেজা কিছু অনুভব করলাম, বুঝলাম তনু কাদছে। আমিও কিছু বলি না সেভাবেই তনু কে নিয়ে বসে রইলাম।




🖤চলবে~~

তৈমাত্রিক পর্ব-০২

0

#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ০২

🍂🍂
.
.

২ বছর পূর্বে ~~
.
.
.

মেহরাম;; মা তুমি কেন এমন করছো বলতো, আরে আমরা কি বেড়ানোর জন্য শহরের বাইরে যাচ্ছি নাকি। পড়াশোনার জন্য যাচ্ছি সেখানে। (মায়ের পেছনে ঘুরতে ঘুরতে)

কনিকা ইসলাম (আমার মা);; না বাপু বাড়ির মেয়েদের এতো দূর গিয়ে পড়ালেখা করতে হবে না। বলি এখানে থেকেও তো পড়ালেখা করা যায় নাকি!

মেহরাম;; মা কিন্তু সেখানের ভার্সিটিতে আমাদের চান্স হয়েছে।

কনিকা;; যেতে দেবো না মানে না, দুটো মেয়ে চোখের সামনে থাকবি তাই শান্তি।

তনু;; উফফ বড়োমা (তনু আমার মা কে বড়োমা বলেই ডাকে) কেন বুঝতে চাইছো না তুমি?

কনিকা;; কি বুঝবো হ্যাঁ আমাকে কি তোদের অবুঝ মনে হয়?

মেহরাম;; তার থেকেও বেশি।

কনিকা;; এই কি বললি?

মেহরাম;; আপনি মহান আম্মাজান।

কনিকা;; আমি গেলাম আমার কাজ আছে।

মা আমাদের এক প্রকার ঠেলেই চলে গেলো। আর আমি মুখ বাংলার পাচঁ বানিয়ে রেখে দিয়েছি। তনুর দিকে তাকিয়ে দেখি মাথা চুলকাচ্ছে আর তাকিয়ে আছে। তখনই আমি তার মাথায় দিলাম এক বারি।

তনু;; কিরে হারামি তুই আমারে মারস কেন?

মেহরাম;; আরে কিছু কর। সেখানে চান্স হয়েছে দুনিয়া উলটে গেলেও যেতে হবে। এখানে থেকে কে পড়াশোনা করবে। তুই করবি?

তনু;; আমার এতো শখ নাই বইন।

মেহরাম;; কি করবো?

তনু;; হরতাল।

মেহরাম;; মানে কি?

তনু;; খাওয়া-দাওয়া বন্ধ, রুম থেকে বেড়নো বন্ধ। মানে একদম সবকিছু বাদ দিয়ে আমাদের বসে থাকতে হবে যতোক্ষণ না বাসার সবাই রাজি হচ্ছে।

মেহরাম;; তোর কি মনে হয় এতে কাজ হবে?

তনু;; আলবাদ হবে। কিন্তু?

মেহরাম;; কি?

তনু;; না খেয়ে থাকবো কি করে?

মেহরাম;; আরে আগে থেকেই রুমে খাবার নিয়ে বসে থাকবো আর খাবো। কিন্তু সবাই ভাববে কিছুই খাই নি।

তনু;; আচ্ছা এবার চল।


আমার আর তনুর অনেক কষ্টে ঢাকার নেশনাল ইউনিভার্সিটিতে চান্স হয়েছে। যখন রেজাল্ট বের হলো তনুর আর আমার খুশি দেখে কে। সারা বাড়ি পাগলের মতো দৌড়িয়েছি। তনু তো খুশির চোটে কেদেই দিয়েছিলো। কিন্তু এখন ঘটলো আরেক বিপত্তি। বাড়ির সবার মুখে একই কথা পড়াশোনা করে উল্টিয়ে-বল্টিয়ে ফেলো মানা নেই কিন্তু যাই কিছু করো না কেন পরিবারের সাথে থাকতে হবে। যা তনু আর আমি মোটেও মেনে নিতে পারছি না। এতো বড়ো একটা সুবর্ণ সুযোগ কেউ কি হাত ছাড়া করবে। তবে আমাদের প্লেন অনুযায়ী আমি আর তনু রুমেই মুখ ফুলিয়ে বসে থাকলাম। আর এদিকে একবার আমার মা আরেকবার চাচি এসে জোরে দরজা ধাক্কিয়ে গেছে কিন্তু আমরা তো খুলছি না। আর খুলবো কি করে নাকে-মুখে দুজন মিলে খাচ্ছি যে। খেতে খেতেই আবার দরজাতে কড়া নাড়ার আওয়াজ এলো।

মেহরাম;; এই রে মরেছে। এসে গেলো তো (মুখে খাবার পুরেই)

তনু;; জলদি এগুলো সরা এখান থেকে।

আমি আর তনু মিলে তড়িঘড়ি করে সবকিছু লুকিয়ে ফেললাম। আর এমন একটা ভাব ধরলাম যেন দুজনেরই মন ভীষণ খারাপ। আমি দরজা খুলেই দেখি সামনে আমার বাবা দাঁড়িয়ে আছে।

আশরাফ আলম (আমার বাবা);; কিরে মা তোদের হয়েছে কি। শুনলাম খাচ্ছিস না বাইরে পর্যন্ত বের হচ্ছিস না। কি হয়েছে তোদের?

মেহরাম;; বাবা আসলে…

তনু;; জেঠু আসলে কি আর বলি কষ্টের কথা (তার জেঠুর হাত ধরে কাদো কাদো ফেইস বানিয়ে)

মেহরাম;; বইন আমার একটু থাম বেশি ওভার একটিং হইতাছে (মেকি হেসে ফিসফিস করে)

তনু;; আহাম আহাম… না মানে বলছিলাম কি জেঠু আমাদের না ঢাকার ইউভার্সিটিতে চান্স হয়েছে। মানে শহরের বাইরে আর কি। একই কলেজে, এখন তুমি তো জানোই যে আমাদের পড়ার কতো শখ। মানুষ পড়ালেখার জন্য এবোর্ড চলে যায় আর আমরা তো মাত্র শহর টা চেঞ্জ করছি বলো। প্লিজ যাই না। তুমি একটু আমাদের হেল্প করো না প্লিজ।

আশরাফ আলম;; আহারে বাবা তোরা তো ইমোশনাল ব্লেকমেইল করছিস। আচ্ছা দেখি কি করা যায়। এবার আয় বেরো রুম থেকে।

বাবার পিছু পিছু আমি আর তনু বের হয়ে পরি। এখন যেহেতু দুপুর বেলা তাই সবাই খাবার টেবিলে একসাথেই খেতে বসলাম। আমি টেবিলে বসতেই দিদুন এসে আমার পাশে বসে পরে। আমি সোজা তাকে জড়িয়ে ধরি।

দিদুন;; কিরে বুড়ি আমাদের ছেড়ে নাকি চলে যাচ্ছিস?

দিদুন আমাকে পাকনা বুড়ি বলেই ডাকে। আমি দিদুনের কথায় হেসে দিলাম। তারপর তার গাল গুলো আলতো ভাবে টেনে বলে উঠলাম।

মেহরাম;; না গো দিদুন না। ছেড়ে কোথায় যাচ্ছি না,শুধু কিছুদিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি। আর দেখো না আগে যেতে দেয় কিনা।

আতিয়া;; যেতে হবে না। কোথাও যেতে হবে না। পড়াশোনা এখানেই কর নইলে বাদ দে।

চাচি এই কথা বলেই রেগে চলে গেলেন। তনু আর আমি আহত চোখ নিয়ে একে ওপরের দিকে তাকাই। তখনই আমার চাচ্চু বিল্লাল আলম এসে টেবিলে বসে পরেন।

তনু;; বাবা

বিল্লাল আলম;; হ্যাঁ মা বল আর কোথায় হয়েছে চান্স তোদের?

মেহরাম;; চাচ্চু ঢাকা নেশনাল ইউনিভার্সিটিতে।

বিল্লাল আলম;; আসলে কি পড়াশোনার জন্য মানুষ বাইরে যায় এটা বড়ো কনো কথা না। কিন্তু সেখানে গিয়ে থাকতে পারবি একা একা তোরা?

তনু;; অবশ্যই পারবো বাবা। একটা বাসা ভাড়া নিয়ে থাকবো। হোস্টেলে থাকবো না। আর আমরা তো দুজন একা কোথায়? রাত দিন একসাথেই থাকবো। বাবা প্লিজ যেতে দাও না।

বিল্লাল আলম;; আচ্ছা দেখছি।

একে একে সবাই এসে খাবার টেবিলে বসে পরে। আড়চোখে শুধু তনু আর আমি তাকাতাকি করছি। তখনই আমার বাবা বলে উঠেন…

আশরাফ আলম;; কনিকা।

কনিকা;; হ্যাঁ বলো।

আশরাফ আলম;; বাচ্চারা যেতে চাইছে বাইরে। যেতে দিই। আর তাদের এখন ভালো মন্দ বোঝার বয়স হয়েছে। হাজার বাচ্চারা বাইরে যায় ওদেরও যেতে দেই না।

কনিকা;; আচ্ছা যেতে দেই কিন্তু আমার কথা হল সেখানে আমাদের কোন আত্নীয় নেই। একা একটা জায়গা কিভাবে সামলাবে?!

মেহরাম;; মা এবার সত্যি তোমরা অনেক বারাবারি করছো। মানুষ যায় না বাইরে পড়তে নাকি। আর ছোট বাচ্চা আমরা। আমাদের এখানে ভারসিটিতে চান্স হতো চুপচাপ পড়ে নিতাম। কিন্তু যেখানে হয়েছ সেখানে যেতে তো হবে নাকি। (কিছুটা রেগে)

সবার এমন কথা আমি আর মেনে নিতে পারছিলাম না। তাই কিছুটা রেগেই কথা গুলো বলে ফেললাম। আমার বলার পরই টেবিলে এক নিরবতা ছেয়ে গেলো। টানা ৫ মিনিট কেউ কোন কথা বলে নি। কিন্তু হঠাৎ করেই চাচ্চু আর আমার মা বলে উঠে….

বিল্লাল আলম;; আমার এক বন্ধু আছে তাকে আমি বলছি সেখানে একটা ভালো বাসা দেখতে তোদের থাকার জন্য।

কনিকা;; সবকিছু ঠিকঠাক ভাবে চেক করে গুছিয়ে নিস। আর কি কি লাগবে আমাকে বলিস।

চাচ্চুর আর মার কথা শুনে আমি আর তনু ফট করে মাথা তুলে তাকালাম। আমার খুশিতে যেন মাথা ঘুড়ে গেলো। তনু এতো টাই অবাক যে বলেই ফেললো।

তনু;; বড়োমা আমরা যাবো?!

কনিকা;; হ্যাঁ যাবি।

তনু আর আমি শান্ত হয়ে রইলাম। সেখানে আর আমাদের খুশির বহিঃপ্রকাশ করলাম না। খেয়ে দেয়ে আস্তে করে টেবিল ছেড়ে সোজা ছাদে চলে যাই। তনু সারা ছাদে লাফাতে লাগলো।

তনু;; আল্লাহ আমি ভাবতে পারছি না যে সবাই মেনে গেছে।

মেহরাম;; এখন মনে হচ্ছে যে তোর পাখা গজিয়ে গেলো।

তনু;; তার থেকে কম কোথায়।

এভাবেই দুইদিন কেটে গেলো। চাচ্চু তার এক বন্ধুর সাহায্যে একটা সুন্দর ফ্ল্যাট দেখে নিয়েছে। সব কিছু ঠিকঠাক। ইউনিভার্সিটির প্রফেসরের সাথেও সব কথা হয়ে গিয়েছে। এখন শুধু আমরা যাবো ফ্ল্যাটে উঠবো আর পরেরদিন থেকে ভার্সিটি। তনু আর আমি নাচতে নাচতে সবকিছু পেকিং করে নিলাম। বাইরে এসে পরেছি। চাচ্চু নিজ হাতে আমাদের সব ব্যাগ গুলো গাড়ির ডিকিতে তুলে দিলো। সবকিছু রাখার পর এবার এলো বিদায় নেবার পালা। আমি ঘুরে আম্মুর দিকে তাকালাম। দেখি চোখে যেন পানি চিকচিক করছে।
বরাবরই আমি আম্মুর ওপর অনেক বেশি দূর্বল। তাই দ্রুত গিয়ে চোখের পানি মুছে দিলাম। আমি কিছু একটা বলতে যাবো তার আগেই আম্মু বলে ওঠে…

কনিকা;; শোন ঘন্টায় ঘন্টায় ফোন দিবি। কি কি রান্না করলি খেলি সব আমায় বলবি। কোন কিছু হলে বিনা দিধায় বলবি।

মেহরাম;; হুম হুম বলতে থাকো আমি নোট করে নিচ্ছি সব।

কনিকা;; মারবো একটা টেনে।

মেহরাম;; হাহাহাহাহা,,,

কনিকা;; আমি একটা কফি মগ ভেংগে ফেলবো।

মেহরাম;; কিহহহ কিন্তু কেন?

কনিকা;; প্রতি রাতে তো তুই আর আমি বসে কফি খেতাম একই কালারের মগে। এখন তো তুই থাকবি না আমার খারাপ লাগবে না।

মেহরাম;; আরে আমার পাগলি মা (জড়িয়ে ধরে) এতো বড়ো আমি হয়ে গেলাম। কিন্তু মাঝে মাঝে তোমার বাচ্চামো স্বভাব দেখে মনে হয় যে তুমিই বাচ্চা আর আমিই মা।

আমার কথা শুনে সবাই হেসে দিলো। তনুও তার বড়োমা আর মার সাথে কথা বললো। আমি চাচি কে অনেক বুঝিয়ে এলাম। দিদুনের মন অনেক খারাপ। তবুও খুব কষ্টে সামাল দিলাম। এবার দেখি আকাশ চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তার কাছে চলে গেলাম।

মেহরাম;; কিরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন, দেখা করবি না?

আকাশ;; চলেই তো যাচ্ছো।

মেহরাম;; আহহ ভাই তুইও। আচ্ছা এদিকে আয় দেখি।

আকাশ;; কি?

মেহরাম;; এই নে (তার হাতে একটা বড়োসড় চকোলেটের বক্স দিয়ে)

আকাশ;; এগুলো আমার জন্য!

মেহরাম;; অবশ্যই। শোন এখন থেকে তোকে মায়ের কাছে পরতে বসতে হবে বুঝলি। দুষ্টুমি কম করবি।

আকাশ;; আচ্ছা।

আকাশ অনেক ছোট তাই সবাই আদর করে। অবশেষে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি আর তনু গাড়িতে উঠে পরলাম। বাবা আর চাচ্চু আমাদের সাথেই যাবেন। তারাও গাড়িতে উঠে পরে। গাড়ি যাচ্ছে আপন গতিতে। আর এদিকে তনু আর আমার কান ঝালাপালা হয়ে গেলো। সারাটা রাস্তা বাবা আর চাচ্চু আমাদের জ্ঞান প্রদান করে এসেছেন। আমরাও ভদ্র মেয়ের মতো তা শুনে এসেছি। প্রায় অনেকক্ষণ যার্নি করে আমরা এসে পরলাম। এটা মিরপুর। চাচ্চু আমাদের দেখিলো দিলো যে এই আমাদের ফ্ল্যাট। আমরা ছোট খাটো জিনিস নিয়ে চলে গেলাম। আর ব্যাগ গুলো বাবা আর চাচ্চুই নিলো, আমাদের ধরতেই দিলো না। এটা একটা দোতালা বাসা। চারিদিকের পরিবেশও ভালোই লাগলো। ফ্ল্যাটের ভেতরে গিয়ে ঘুড়ে ঘুড়ে দেখলাম। ভালোই লাগলো। দুটো রুম আছে যদিও দুটো রুমের কোন দরকারই নেই। একটা কিচেন, একটা ওয়াসরুম। আর সামনেই ছোট একটা বারান্দা। তাতে কয়েকটা ছোট ছোট ফুলের গাছ। ভারি পছন্দ হলো বাসাটা আমারও আর তনুরও। বাড়ির মালিক একজন বয়স্ক মহিলা। অনেক ভালো তিনি যা তার ব্যবহারেই বোঝা গেলো। সবকিছু গুছিয়ে বাবা আর চাচ্চুর বাড়ির চাবি আমাদের দিয়ে গেলো। আমরা নিচ পর্যন্ত গেলাম তখন বাবা আর চাচ্চু গাড়িতে করে চলে গেলো। তাদের চলে গেতেই আমি তনুর দিকে আর তনু আমার দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকেই দুজন একসাথে হেসে দিলাম।

তনু;; দেখলি ঠিকই আসতে দিয়েছে আমাদের।

মেহরাম;; হুমম। দিবে না কেন। না দিলে তুলকালাম কান্ড বাধিয়ে দিতাম।

তনু;; হিহিহি চল। ভেতরে যাই।

সেদিন তনুর আর আমার সবকিছু গোছগাছ করতে করতেই চলে যায়। এর মধ্যে বাড়িতে ফোন করেছিলাম। তারা পারছে না ফোনের মাঝে চলে আসতে। প্রায় অনেক সময় কথা বলে আমরা খেতে বসি। খাবার বাইরে থেকে আনতে হয়েছে কারণ বাসায় আজ তেমন ব্যাবস্থা নেই। কাল সকালেই উঠে ভার্সিটি চলে যেতে হবে। আর আজ অনেক ক্লান্তও তাই তাড়াতাড়ি দুজনেই ঘুমিয়ে পরি।



পরেরদিন সকালে~

মেহরাম;; কিরে তনু আজ কি ঘুম থেকে উঠবি না নাকি তুই। কটা বাজে দেখিছিস, তনু বইন উঠ তাড়াতাড়ি।

তনু;; আরে হয়েছি কি? কটাই আর বাজে। (ঘুমে থেকেই)

মেহরাম;; ৮ঃ২৫ বাজে আর ৯ টায় ক্লাস।

তনু;; এইরে, উঠছি উঠছি।

তনু জলদি চলে গেলো ফ্রেশ হতে। খানিক পরে বের হতেই আমি খাবার তার সামনে রাখলাম।

মেহরাম;; খেয়ে নে জলদি।

তনু;; তুই রান্না করেছিস?

মেহরাম;; হ্যাঁ, কোন রকম। রুটি বানালাম আর ডিম। এখন খেয়ে নে।

তনু;; হুমমম।

তনু আর আমি খেয়ে বের হয়ে পরি ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। তবে হ্যাঁ আমাদের ভার্সিটি একই কিন্তু তনুর আর আমার ডিপার্টমেন্ট আলাদা। তনু ফিলোসোফি ডিপার্টমেন্টের আর আমি ইংলিশ। রিকশা করে তনু আর আমি পৌছে গেলাম।

তনু;; মেহরু শোন আমার ক্লাসের টাইম হয়ে গিয়েছে। আমি যাই বুঝেছিস।

মেহরাম;; হ্যাঁ যা কিন্তু ক্লাস শেষে গেটের বাইরে দাড়াস কিন্তু।

তনু;; হ্যাঁ আচ্ছা আমি যাই।

এই বলেই তনু দৌড়ে চলে গেলো। আমিও হেটে হেটে আমার ক্লাসের দিকে যেতে থাকলাম। কিন্তু কিছুদূর গেতেই ভার্সিটির মাঠে কিছু ছেলেকে জরো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। সামনে আরো একটু এগোলে দেখতে পেলাম তাদের মাঝখানে একটা কালো বাইকে একজন বসে আছে। যেভাবে বসে আছে আর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে যে সে তাদের লিডার এমন। বা কলেজের ভিআইপি। কিন্তু আমি এক প্রকার তাদের ইগ্নোর করেই চলে গেলাম। আমি খেয়াল করলাম যে যখন আমি তাদের পাশ দিয়ে আসছিলাম তখন তারা সবাই অবাক চোখে আমার দিকে তাকিয়েছিলো। তাতে আমার কি যাই হোক আমি চলে গেলাম আমার ক্লাসে। গিয়েই দেখি কতো গুলো মেয়ে গোল হয়ে আড্ডা দিচ্ছে আবার কতো গুলো ছেলে চিল্লিয়ে চিল্লিয়ে কথা বলছে। আমি ধীর পায়ে গিয়ে একজন মেয়ের পাশে বসে পরলাম। মেয়েটা ভারি মিষ্টি দেখতে, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা পরে আছে। আমি কারো সাথে তেমন কথা না বলে চুপ করে বসে থাকলাম। কিন্তু হুট করেই আমার পাশের মেয়েটা বলে ওঠে…

উর্মি;; হেই হাই।

মেহরাম;; হ্যালো।

উর্মি;; আমার নাম উর্মি। তুমি?

মেহরাম;; মেহরাম আফরিন।

উর্মি;; এখানে নতুন?

মেহরাম;; হ্যাঁ।

উর্মি;; ওহহ, আমাদের এখানে সবাই প্রায় ফ্রেন্ডলি শুধু কিছু মানুষ বাদে। আচ্ছা যাই হোক আমাকে নিজের ফ্রেন্ড ভাবতে পারো। (একগাল হেসে)

মেহরাম;; হুমমম। আচ্ছা।

উর্মি;; আর এই যে আমি কিন্তু তুমি তুমি করে ডাকতে পারবো। তুই করে ডাকতে হবে।

আমি এবার হেসেই দিলাম। যতো টুকু বুঝলাম উর্মি অনেক বেশি মিশুক প্রকৃতির মেয়ে। অনেক ভালো ফ্রেন্ডশিপও হয়ে গেলো আমাদের। এখানে আসার পর উর্মিই আমার এতো পরিচিত। কিছুক্ষন পর স্যার ক্লাসে এসে পরে। তবে বরাবরই কখনোই আমার ক্লাসে কোন মনোযোগ ছিলো না। উর্মি আর আমি বইয়ের দিকে তাকিয়ে আছি আর ফিসফিস করে গল্প করছি। হঠাৎ আরেক টা মেয়ে বলে ওঠে…

বাবলি;; উর্মি চুপ কর।

উর্মি;; আরে ছাড় তো।

মেহরাম;; ও কে?

বাবলি;; আমি বাবলি, পরে পরিচিত হবো এখন আগে ক্লাস করি। কারণ এই স্যার অনেক বেশি কড়া।

মেহরাম;; আমি তা অনেক আগেই বুঝতে পেরেছি।

বাবলি;; কিভাবে?

মেহরাম;; স্যারের বেল মাথা দেখে।

আমার কথাই আমরা তিনজনই হেসে দিলাম। প্রায় ৫০ মিনিট বা ১ ঘন্টা পর ক্লাস শেষ হলো। স্যার গেতেই যেন পুরো ক্লাসের পোলাপানরা হাফ ছেড়ে বাচলো।

উর্মি;; উফফফ আপদ গেলো।

মেহরাম;; আচ্ছা খুব বেশি খবিশ নাকি স্যারটা?

বাবলি;; অনেক বেশি।

আমরা তিনজন মিলে গল্প করছিলাম ঠিক তখনই প্রায় ৩-৪ জন ছেলে আমাদের ক্লাসে ঢুকে পরে তাও হুড়মুড়িয়ে। তাদের আসার সাথে সাথে ক্লাসের সবাই কেমন একদম চুপ হয়ে যায় আর একসাথে দাঁড়িয়ে পরে। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলে উর্মি জলদি আমাকেও দাড় করিয়ে দেয়। আমি সামনে তাকাই। যারা আমাদের ক্লাসে এসেছে তাদের মাঝখান থেকে একজন সাদা রিপ পেন্ট পরা আর ব্রাউন কালারের শার্ট পরা ছেলে আসে। আমি লক্ষ করে দেখলাম যে আজ সকালে যাকে দেখেছিলাম এই সেই ছেলেটি।

আমি কিছুটা ঝুকে বাবলি কে জিজ্ঞেস করলাম…

মেহরাম;; বাবলি, কেরে ইনি?

বাবলি;; তুই ইনাকে চিনিস না?

মেহরাম;; আরে চিনি না বিধায় তো জিজ্ঞেস করছি কে এই?

বাবলি;; ইনি আয়ুশ আহমেদ। ভারসিটির সিনিয়র। সাথে সবার ক্রাশবয় ও। এখানে তার আলাদা নাম ডাক আছে। সবাই আয়ুশ আহমেদ বলতে পাগল।

মেহরাম;; পাগল! লাইক সিরিয়াসলি। এই হনুমান মুখোর ওপর পাগল।

উর্মি;; এই আস্তে বল। একবার শুনে ফেললে না খবর খারাপ করে ছাড়বে। চিনিস না একে। ভার্সিটিতে কারো সাহস হয় না এই আয়ুশ আহমেদের ওপর কিছু বলার।

মেহরাম;; হয়েছে থাম।

আমি কথা বলছিলাম। ঠিক তখনই একটা কঠোর কন্ঠস্বর কানে ভেসে আসে।

আয়ুশ;; এই যে তুমি!

আয়ুশের কথায় আমি দ্রুত সামনে তাকালাম। আর এই প্রথম আয়ুশ আমার সাথে কথা বললো।

আয়ুশ;; এই মেয়ে তোমাকে বলছি কানে শুনতে পারো না নাকি?

আয়ুশের কথায় আমার মেজাজ গেলো বিগড়ে। আমি ভালোভাবে তাকিয়ে দেখলাম শার্টের হাতা গুলো ফোল্ড করা, মুখে চাপদাড়ি আছে। আর যেভাবে দাঁড়িয়ে আছে তাতে কেমন এক গুন্ডার মতো লাগছে। আমি আমার আশেপাশে তাকালাম দেখি সবাই হাবলার মতো আয়ুশের দিকে তাকিয়ে আছে। কিন্তু তার কথায় আমার রাগ হচ্ছে তাই আমি কড়া গলায় বলে উঠলাম…

মেহরাম;; জ্বি আমি অবশ্যই শুনতে পারি কানে, নয়তো আমি কানের ডাক্তারের কাছে থাকতাম এখানে না।

সবাই আমার কথা শুনে হেসে দিলো।

আয়ুশ;; খুব ইগো তোমার তাই না। নয়তো দেখলাম সকালে নিজের সিনিয়র কে দেখলে আর সম্মান না জানিয়েই এসে পরলে।

আয়ুশের কথায় আমার রাগ মাথায় চড়ে গেলো। আর যতটুকু দেখতে পেলাম তাতে বুঝলাম যে এই ভার্সিটিতে আয়ুশ দাদাগিরি করে বেড়ায়।

মেহরাম;; আমি এখানে কে সিনিয়র বা কে জুনিয়র তা দেখতে আসিনি। আর রইলো সম্মান জানানোর কথা তো আপনাকে তা দেখানোর প্রয়োজনবোধ আমি করিনি তাই জানাইনি।

বাবলি আমাকে ইশারা দিয়ে চুপ থাকতে বলছে কিন্তু আমি তা তোয়াক্কা করলাম না। আজ আমাদের প্রথম দিন ছিলো তাই আর ক্লাস মনে হয় না হবে। আর আয়ুশকে এই কথা বলে আমিও সোজা আমার ব্যাগ নিয়ে তার সামনে দিয়ে বের হয়ে এসে পরি।



🥀চলবে~~

তৈমাত্রিক পর্ব-০১

0

#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ০১

আজ আমার প্রেমিকের সাথে আমার বোনের বিয়ে। আমার সেই বোনের বিয়ে যাকে আমি নিজের থেকেও কয়েক গুণ বেশি ভালোবাসি। হয়তো তার সামনে আমার নিজের ইচ্ছে গুলো খুবই তুচ্ছ তাই এতো বড়ো একটা সিন্ধান্ত আমি নিজেই নিয়েছি। আমার প্রেমিক আয়ুশ নামক ছেলেটি যে এখন আমার বোনের বর, তাকে যে আমি কম ভালোবাসি বা আমার জন্য তার ভালোবাসায় যে কমতি ছিলো তা কিন্তু না। তবে না চাইতেও সে এখন আমার প্রাক্তন। তার সাথে আমার কোন ব্রেকাপ হয়নি, হয়নি কোন বিচ্ছেদ। তবুও ইচ্ছেকৃত ভাবেই সম্পর্ক টাকে মাঝ রাস্তায় ছেড়ে দিতে আমি। আমাকে এখানে স্বার্থপরের মতো কাজ করতে হয়েছে আমার। যার ভাগ্যে নিজের নাম লিখতে চেয়েছিলাম তার ভাগ্যে নিজের বোনের নাম তুলে দিতে হলো আমায়। আমি কখনোই চাই নি যে আমাদের সম্পর্ক টা এমন একটা মোড়ে ঘুরুক। কিন্তু আমরা যা কখনো কোনোদিন কল্পনা পর্যন্ত করি না পরর্বতীতে আমাদের জীবনে ঠিক তাই হয়। এই সব কিছুর মাঝে আমি কিছু উপাধিও পেয়েছি যেমন বেইমান, বিশ্বাসঘাতক। আর হ্যাঁ আমি যা করেছি তার জন্য এই খেতাব গুলো পাওয়া অনেক টাই স্বাভাবিক। খুব সুন্দর মানিয়েছে আমার বোন এবং তার বর কে। নিজের বুকের ওপর আকাশ সমান কষ্ট নিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুখের কোণে নিছক এক চিলতে হাসি রেখে এই সবকিছুই দেখে যেতে হচ্ছে আমাকে। কারণ কষ্ট গুলো যে একান্তই আমার, শুধুই আমার।

এক কোণে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এগুলো ভাবছিলাম ঠিক তখনই আমার বোনের জোর চিল্লিয়ে ডাক আসে।

তনু;; এইই মেহরু তুই ওখানে কি করিস রে, জলদি এদিকে আয়।

আমাকে স্টেজের ওপরে ডাকলে আমি হেসে হাতের ইশারায় তনু কে মানা করে দিই। কারণ সেখানে আমার অনেক পূর্বপরিচিত ব্যাক্তি টি বর বেশে দাঁড়িয়ে আছে। তার পাশে গিয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা বা অধিকার দুটোই আমি হারিয়ে ফেলেছি। নিজেকে এখন বড্ড অপরাধী লাগে। আমি এখনো সেই আগের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে আছি। আর তা দেখে তনু তেড়ে এলো আমার দিকে। এসেই আমার হাত ধরে টানতে লাগলো।

তনু;; মানে কি মেহরু এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে আছিস কেন, আরে আমার বিয়ে তোর বোনের বিয়ে। কোথায় সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখবি তা না। এভাবে এক জায়গায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছিস।

মেহরাম;; আরে না মানে থাকি না এখানেই। সবাই তো আছিই।

তনু;; একদম না আমার সাথে স্টেজে থাকবি তুই। আফটার অল তোর জন্যই তো আমার বিয়ে টা হচ্ছে।

তনুর এই কথা টা শুনেই আমার বুকের মাঝে কেমন এক মোচড় দিয়ে উঠলো।

তনু;; আরে চল, চল তো তুই। (আমার হাত ধরে টেনে)

আমি লাগাতার তনু কে মানা করেই যাচ্ছি। কিন্তু সে আমার কথা শুনার পাত্রি না। তাই আমাকে এক প্রকার টেনেই সে নিয়ে গেলো। স্টেজে যেতেই আয়ুশের সাথে আমার একদম চোখাচোখি হয়ে গেলো। আমার সাধ্যি নেই সেই চোখে তাকিয়ে থাকার তাই দ্রুত চোখ নামিয়ে ফেললাম। কেন যেন মনে হলো যে আয়ুশ আমার এই অবস্থা দেখে হাসছে। আমি সোজা মাথা নুইয়ে তনুর পাশে গিয়ে দাড়ালাম। ততক্ষনাৎ একজন ক্যামেরাম্যান এগিয়ে এলো হাতে বড়ো একটা ক্যামেরা নিয়ে। শুরু হলো ছবি তোলা। এগুলো আমার কাছে বেশ বিরক্তিকর লাগছে। আমি অনেকবার তনু কে বলেছিও যে আমি চলে যাই এখান থেকে আমার ভালো লাগছে না। কিন্তু তনু আমাকে কোনমতেই এখান থেকে যেতে দিচ্ছে না। এবার তনু হঠাৎ বলে ওঠে…

তনু;; মেহরু তুই এদিকে আয়।

এই বলেই তনু আমাকে নিয়ে তাদের মাঝে দাড় করিয়ে দিলো। অর্থাৎ তনু আর আয়ুশের মাঝে। এবার আমি তনুর দিকে তীর্যক নয়নে তাকাই। তনু আমার দিকে একগাল হেসে তাকায়। কিন্তু এবার আর আমি পারছি না। আমার ঠিক ডান পাশেই আয়ুশ দাঁড়িয়ে আছে। সত্যি বলতে এখন আমার নিজেকে তাদের মাঝের কাটা মনে হচ্ছে কাটা। আমার চোখের কার্নিশে জল জমতে শুরু করে দিয়েছে এখন। তবুও নিজেকে যথাসম্ভব দমিয়ে রাখছি। আমি তাদের মাঝে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে ছিলাম তখনই ক্যামেরাম্যান বলে ওঠে “ম্যাম প্লিজ মাথা তুলে হাসুন”। আমি সবার অগোচরে চোখের পানি টুকু মুছে সামনের দিকে তাকালাম। মুখে কৃত্রিম হাসির রেশ টেনে নিলাম। আমার পাগলি বোন টা বড়ো এক হাসি দিয়ে তার গাল আমার গালের সাথে লাগিয়ে নিলো। এখন যেন আমি প্রকৃতপক্ষেই হেসে দিলাম। আমার বাম হাতটা তনুর মাথার পাশে ধরে নিলাম। তার মাথার সাথে আমি আমার মাথা টা ঠেকিয়ে দিলাম। সত্যি এবার হাসছি আমি। আর ক্যামেরাম্যান ছোট্ট একটা ক্লিক করে আমাদের তিনজনকে একই ফ্রেমে বন্দি করে দিলো। আমি একটা বারের জন্যও আয়ুশের দিকে তাকায় নি। ছবি তোলার সাথে সাথে আমি সেখান থেকে এসে পরি। তনু আটকানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু আমি একটু তাড়া দেখিয়ে এসে পরেছি। চলে গেলাম বাড়ির অন্য এক জায়গায়। মূলত এটা বাড়ির পেছন রাস্তা। এখানে হাতে গোনা দু-একটা মানুষ ছাড়া আর কেউ নেই। সবাই বাড়ির ভেতরে। আমি বাইরে এসেই জোরে জোরে শ্বাস ছাড়তে লাগলাম। যেন অনেক রাস্তা দৌড়িয়ে এসেছি। পাশেই দেখতে পেলাম পানির বোতল তা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিলাম। সেখানে খানিকক্ষন থেকে আবার বাড়ির সামনে গিয়ে দাড়ালাম। সবকিছু দেখতে লাগলাম আমি। এটা বিয়ে বাড়ি। চারিদিকে মানুষের কত্তো আনাগোনা। সবাই যার যার কাজে ব্যাস্ত। যেন ছুটে চলেছে। সবার মুখেই হাসির শেষ নেই। একটা জমজমাট ভাব। ভাবতেই আমার হাসি পাচ্ছে যে যেই বিয়েবাড়ি টা আমার হওয়ার কথা ছিলো তা এখন আমার বোনের।

[ওহহ, বলাই হলো না। আমি মেহরাম আফরিন আর আমার বোন তনু আশফিয়া। আর এখন যে বর সেজে আছে সে আয়ুশ আহমেদ। তার আর আমারও একদিন ভালোবাসার ছোট্ট এক দালানকোঠা ছিলো। কিন্তু তা বাধ্য হয়ে ভাংতে হয়েছে। আয়ুশ অনেক ভালো আর বড়ো পরিবার থেকে বিলং করে। দেখতে শুনতে অনেক ভালো। আমাদের যৌথ পরিবার। মূলত আমি আমার বাবা-মা এই তিনজনই। তার ওপর আমার চাচা-চাচি, তনু আর তার একটা ছোট ভাই আছে। আমার দিদুন আছে। দাদুভাইকে আমি কখনো দেখি নি। তনু আমার চাচাতো বোন। কিন্তু কখনো মনেই করিনি। আমি সবসময় বলি যে আমরা তিন ভাই বোন আমি তনু আর আকাশ মানে তনুর ভাই। তনু আর আমার মাঝেও তেমন তফাৎ নেই। মাত্র দুই-তিন মাসের। আমরা সমবয়সী। তনু আমার জান, আমি আমার জীবনে সবথেকে বেশি দুইজন কেই ভালোবাসি। এক আমার মা আর দুই তনু। একই ক্লাসেও পরি আমরা। অর্নাস দ্বিতীয় বর্ষে। তবে তনুর আর আমার অনেক ইচ্ছে ছিলো বাইরের শহরের পড়ার। আর ভাগ্যক্রমে আমাদের দুইজনেরই ঢাকার একই কলেজে চান্স হয়। আর সেখান থেকেই সবকিছুর শুরু হয়।]

.
.

আমি বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আর সেখান থেকেই দেখতে পেলাম তনু আর আয়ুশকে। তনুর মুখের ঝলকানো হাসি টাই বলে দিচ্ছে যে সে কি পরিমাণ খুশি আজ। তনু অয়ুশকে অনেক ভালোবাসে। আর নিজের ভালোবাসার মানুষের সাথে বিয়ে হলে বুঝি এমন খুশিই হয়। যে খুশি আমার ভাগ্যে কখনোই ছিলো না। আয়ুশের মুখেও হাসি চিকচিক করছে। আমি ঠিক বুঝলাম না যে আয়ুশের এই হাসি মিথ্যে না সত্যিকারের। আমি ধীর পায়ে আবার বিয়ে বাড়ির সামনে গিয়ে দাড়ালাম। বুকের ভেতরে একশ এক হাতুড়ি পেটাচ্ছে আমার। সব কিছু দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে আমার। গলা দিয়ে কোন কথায় বের হচ্ছে না। এক দৃষ্টিতে সামনে তাকিয়ে তাদের দেখছি। কতোই না খুশি লাগছে তাদের। আমি মন ভরে তাদের দেখছি। আর এরই মাঝে কখন যে আমার অবাধ্য চোখ দুটো ভিজে একাকার হয়ে গিয়েছে আমি তা জানি না। হুট করেই আবার আমার ডাক আসে। দ্রুত চোখ দুটো মুখে ফেলে পেছনে তাকালাম। দেখি আমার চাচি দাঁড়িয়ে আছে। আমি দেখেই হেসে দিলাম। আমি গিয়ে চাচিকে একপাশ দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম।

মেহরাম;; আরে চাচি তুমি এখানে কি করছো, আজ তোমার মেয়ের বিয়ে। কোথায় সেখানে গিয়ে মেয়ের সাথে থাকবে। এখানে কি করো তুমি?

আতিয়া (আমার চাচি);; মেহরাম (আমাকে নিজের সামনে এনে দাড় করিয়ে দিলো)

মেহরাম;; বলো চাচি।

আতিয়া;; মা তুই খুশি তো তোর বোনের এই বিয়েতে?

চাচির এই কথায় যেন আমি আর ঠিক থাকতে পারলাম না। কি যেন মনে করে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম চাচিকে। চোখের পানি গুলো তো লুকাতে হবে তাই না। এগুলো যে বড়ো বেইমান।

মেহরাম;; অনেক অনেক বেশি খুশি চাচি, অনেকটাই বেশি। (জড়িয়ে ধরে আস্তে করে নিজের চোখের পানি টা মুছে ফেললাম)

কয়েক সেকেন্ড পর চাচিকে ছেড়ে দিয়ে দাড়ালাম।

মেহরাম;; চাচি আমার খুশির কথা ছাড়ো তুমি একটা বার তনুর দিকে তাকিয়েছো।

চাচিকে নিয়ে সামনে স্টেজের দিকে তাকালাম।

মেহরাম;; তনুর মুখের হাসি টা দেখো। একদম ফুটছে।

আতিয়া;; হ্যাঁ রে মা।

মেহরাম;; এতো খুশি হওয়ার পরও তুমি বলছো আমি খুশি কিনা। এটা কোন কথা (চাচির দিকে ঘুড়ে)

চাচি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে হেসে চলে গেলেন। চলে যেতেই আমি আমার চারিপাশে একবার চোখ বুলালাম। চারিদিকে খুশির সীমা নেই কিন্তু আমার মনে যে ঝড় বয়ে চলেছে তা থামার নাম নেই। আমি একবার তনু আর আয়ুশের দিকে তাকালাম। বেশ মানিয়েছে দুজনকে। আমি আয়ুশকে বেহায়ার মতো আরেকবার মন ভরে দেখে নিলাম। কেননা আর তো তাকে দেখার অধিকার নেই আমার। অনেক বেশি সুন্দর লাগছে আয়ুশকে বর বেশে। আমি তাকিয়ে ছিলাম তখন হুট করে আয়ুশও আমার দিকে তাকায়। আমি জলদি করে হেটে নিজের রুমে চলে যাই। ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিয়ে নিচে বসে পরি। কান্নাও যেন এখন আর আসছে না। ভেতরে থেকে শুধু বড় বড় নিঃশ্বাস ছাড়ছি। সেভাবেই বসে থাকলাম। বাইরে থেকে গান বাজনার, সবার চিল্লাপাল্লার তীব্র শব্দ কানে ভেসে আসছে। এভাবে ঘরের ভেতরে যে কতোক্ষণ ছিলাম জানি না।

.
.

বেশ সময় পর আমার দরজাতে কারো টোকা পরে। আমি বুঝতে পারলাম যে হয়তো বাইরে আমাকে খুঁজে না পেয়ে এখানে এসেছে। চোখের পানি গুলো খুব নিখুঁতভাবে মুছে মুখে হাসি আনলাম। যেন কিছুই হয়নি। গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। খুলেই দেখি আকাশ।

আকাশ;; মেহরু আপু তুমি এখানে কি করো আরে চলো। তনু আপুর তো বিদায় এখন। তনু আপু তোমাকে খুঁজছে।

মেহরাম;; বিদায় মানে, চল দেখি।

আকাশের কথা শুনে আমার আত্মা ধক করে উঠে। মানে তনুর বিদায়, এখন সে আমাকে রেখে চলে যাবে। বাড়িতে একা হয়ে যাবো আমি। ভাবতেই কলিজা শুকিয়ে আসছে আমার। তাই দ্রুত আকাশের হাত ধরে বাইরে এসে পরলাম। এসেই দেখি বাইরে অনেক মানুষ। তনু চাচি আর আমার আম্মুর হাত ধরে কাদছে। সে সবার মাঝখানে। তার কিছুদূরেই আয়ুশ দাঁড়িয়ে আছে। আমি ধীর পায়ে তনুর কাছে গেলাম। আমাকে দেখতে পেরেই তনু ভীড় ঠেলে দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো। অঝর ধারায় কেদে দিলো।

তনু;; মেহরু আমি যাচ্ছি রে। আমি চলে যাচ্ছি।

এই টুকু বলেই আর কিছু বললো না তনু। সে কাদছে অনেক। আমিও তাকে জড়িয়ে ধরে থাকলাম। আশে পাশে তাকিয়ে দেখি আমার পরিবারের সবার চোখেই পানি। বাবা আর চাচ্চু কোন মতে নিজেদের সামলাচ্ছে। দিদুন কে আম্মু ধরে রেখেছে নয়তো শরীর খারাপ করবে অনেক। আমি কেন যেন এগুলো সহ্য করতে পারলাম না। তাই মাথা তুলে তাকিয়ে তনু কে ভালোভাবে দাড় করালাম নিজের সামনে।

মেহরাম;; আচ্ছা এটা কি হচ্ছে হ্যাঁ। তনু এটাই কি কথা ছিলো তোর আর আমার হুমম। বলেছিলাম না যে বিয়েতে কোন কান্নাকাটি কিছুই হবে না। তোর বিয়ে সবথেকে আলাদা হবে। আর কতো কষ্ট করে মেকাপ করেছিস, সেজেছিস বল কাদলে এগুলো নষ্ট হয়ে যাবে না। তখন তো তোকে একদম পেত্নির মতো লাগবে। আর তোর জামাই ভাগবে। আর কাল তো রেসিপশন পাগলি দেখা তো হবেই বল।

আমার এই কথা শুনেই তনু ফিক করে হেসে দেয় কাদার মাঝেই। আমার হাতে আলতো ভাবে দু- একটা চড় দিয়ে বলে ওঠে…

তনু;; হারামি তুই খুব খারাপ, কাদার সময় যে করেই হোক আমাকে হাসাবিই।

মেহরাম;; আমার বোন কে যে কাদাবে তাকে মেরে ফেলবো আমি। এবার একটু হাস পেত্নি (তনুর গালে ধরে)

তনুও হেসে দিলো। সাথে সবাই। সবার সাথে কথা বার্তা বলে এবার সময় এলো তনুর চলে যাওয়ার। গাড়িতে উঠবে তনু। তখনই তনু আমাকে ‘মেহরু’ বলে ডাক দেয়। আমি এবার এগিয়ে গিয়ে তনুকে আর কিছু বলি না সোজা আয়ুশের কাছে চলে যাই। তার দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বলি…

মেহরাম;; আমার বোনকে সবসময় হাসি খুশি রাখবেন। তার চোখ দিকে যেন কখনোই অশ্রুবিন্দু না ঝরে। আর আপনার জন্য তো কখনোই না।

আয়ুশ;; নিশ্চিন্তে থাকুন, আমি তনুকে এতো হ্যাপি রাখবো যে সে আপনার কথা ভুলেই যাবে। (কড়া গলায়)

আমি সাথে সাথে আয়ুশের কাছ থেকে সরে আসি। আর এটাই ছিলো আয়ুশের সাথে আমার শেষ কথা। তনু আর আয়ুশ গাড়িতে ওঠে চলে যায়। সবাই ধীরে ধীরে বাড়ির ভেতরেও চলে যায়। কিন্তু আমি দাঁড়িয়ে থাকি বাইরে। যতক্ষণ না তাদের গাড়ি চোখের আড়াল হয় ততক্ষণ আমি সেদিকে তাকিয়েই ছিলাম। একধ্যানে তাকিয়েই আছি আমি তাদের যাওয়ার পানে। তখন আমি আমার হাতের কারো টান অনুভব করি। তাকিয়ে দেখি আকাশ কাদো কাদো হয়ে আছে। আমি তাকে জড়িয়ে ধরি। তারপর ভেতরে চলে যাই।

বাইরের সবাইকে বলে আমি আমার ঘরে চলে যাই। ভারি কাপড় ছেড়ে একটা সাদা সালোয়ার সুট পরে নিলাম। ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানার ওপর ধপ করে নিজের ক্লান্ত শরীর টাকে এলিয়ে দিলাম। আমি সত্যি অনেক ক্লান্ত মানসিক ভাবেও। বাইরে হঠাৎ বিকট বিদ্যুৎ চমকানোর শব্দ আসে। আমি আমার রুমের জানালা টা খুলে দেই। ফট করে এক দমকা বাতাস আমার মুখে-গায়ে আছড়ে পরে। আমি চোখ বন্ধ করে ফেলি। আলতো করে চোখ মেলে বাইরে তাকাই। আকাশ অনেকটা মেঘলা। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে আর এরই মাঝে ঝিরঝির করে বৃষ্টি নেমে এলো। আমি ইচ্ছে করেই রুমের লাইট অফ করে দিলাম। জানালা টা খুলে দিয়ে তার পাশে বসলাম। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকানোর আলোতে আমার আধার ঘরটা আলোকিত হয়ে উঠছে। টুপটাপ করে চোখ বেয়ে নোনাজল পরছে। তাদের মুছে ফেলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে আমার নেই। ঝরুক না কিছু অশ্রু। এই অসময়ের বৃষ্টি যেন আমার কষ্ট টাকে আরো হাজার গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে। বেশ বুঝলাম যে আজ আমার রাতের ঘুম হারাম। বাইরে শূন্যে তাকিয়ে আছি, আর চোখে কান্নার ধারা। এতো কিছু হয়ে যাবে ভাবিনি আমি। সময়ের চাকা ঘুড়িয়ে আমাকে এমন একটা পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হবে তার ধারণাই কনোদিন ছিলো না আমার। ডুব দিলাম আবার সেই পুরনো অতীতে আমি।

.
.

🍂চলবে~~

মেঘবতী পর্ব-১৩ এবং শেষ পর্ব

0

#গল্পঃমেঘবতী
#পর্বঃ১৩(অন্তিম পর্ব)
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

স্মিতাঃকিরে এভাবে চুপচাপ বসে আছিস কেন?কখন থেকে দেখছি চুপচাপ বসে কি যেন ভাবছিস।কি হয়েছো?

প্রিসাঃকিছু না।

স্মিতাঃমন খারাপ নাকি?

প্রিসাঃনা।

স্মিতাঃতাহলে এরকম চুপচাপ কেন?তুইতো আমার সাথে কোনদিন এরকম চুপচাপ বসে থাকিস না।তাহলে আজ কি হয়েছে?

প্রিসাঃকই কি হয়েছে?কিছুই হয়নি,কথা বলার কোন বিষয় নেই তাই চুপ করে আছি।

স্মিতাঃএই শুন তোকে আমি ভালো করে চিনি,তাই আমাকে মিথ্যা বলতে আসিস না।কিছু তো হয়েছে, এখন কি হয়েছে সেটা তুই আমাকে সোজাসুজি বল নয়তো থাপ্পড় দিবো।

প্রিসা এতক্ষণ ধরে এটাই ভাবছিল যে কি করে সে কথাগুলো স্মিতাকে বলবে।প্রিসা জানে এগুলো স্মিতা জানলে কষ্ট পাবে তাই বলতে চাইছে না কিন্তু না বলেও যে সে থাকতে পারবে না।স্মিতাও এদিকে প্রিসাকে জোর করছে কি হয়েছে সেটা বলার জন্য।অবশেষে প্রিসা শুভর সাথে দেখা হওয়ার পর থেকে কি কি হয়েছে তার সাথে সবকিছু স্মিতাকে বলে।বলার পর প্রিসা খেয়াল করে তার গাল ভেজা,হাত দিয়ে দেখে তার চোখ থেকেই পানি পড়ছে।চোখমুছে প্রিসা স্মিতা দিকে তাকাই,তার চোখও ভেজা।

স্মিতাঃতার মানে সেইদিন অয়ন ভাইয়ার মারের কারণে তোর জ্বর এসেছিল?

প্রিসাঃহয়তো।

স্মিতাঃসব বুঝলাম কিন্তু একটা বিষয় বুঝলাম না শুভর সাথে কথা বলার জন্য অয়ন ভাইয়া তোকে মারলো এরপর তোকে ভালোবাসিও বললো আবার পরে নিজেই সম্পর্ক শেষ করে দিয়ে তোরিই চাচাতো বোনেকে বিয়ে করার প্রস্তুতি দিয়েছে।ব্যপারটা কেমন যেন লাগছে,কোথাও একটা গন্ডগোল আছে মনে হচ্ছে।

প্রিসাঃকিছু গন্ডগোল নেই সবঠিক আছে।আমি উনার মোহ ছিল আর আপুনি উনার ভালোবাসা,এটা বুঝতে পেরেই উনি নিজে থেকেই সরে গিয়েছেন।

স্মিতাঃআচ্ছা মিলা আপুর সাথে উনার পরিচয় কিভাবে?

প্রিসাঃপরিচয় কিভাবে তা জানি না তবে আপুনি বলেছে আমার যখন পরীক্ষা চলছিল তখন কোন এক কারণে নাকি উনি আপুনিকে ফোন দেয়।এরকম মাঝেসাঝে আরো কয়েকবার কথা হয়েছে তারকিছু দিন পর থেকেই তারা রেগুলার কথা বলতে শুরু করে।তারপর নাকি তারা রিয়েলাইজ করে তারা দুজন দুজনকে ভালোবাসে,তাই তারা দুজন ঠিক করে বিয়ে করে ফেলবে।

স্মিতাঃতার মানে এর কারণে অয়ন ভাইয়া তোর সাথে কথা বলা কমিয়ে দিয়েছিল।

প্রিসাঃহুম।

স্মিতাঃআচ্ছা তুই সায়ন ভাইয়াকে বিয়ে করতে রাজি হলি কেন?

প্রিসাঃকারণ বাবা-মা চাই আমি যাতে ওনাকে বিয়ে করি।যেহেতু আমার মনে এখন কেউ নেই আর সেটা ছিল সেটাও একতরফা ভালোবাসা এখন, তাহলে বাবা-মার কথা অনুযায়ী কাজ করাটাই বেটার।আর একটা কারণ সায়ন ভাইয়া সবটা জানে তাই উনি কখনই আমাকে এই বিষয়ে কিছু বলবে না বা খোঁটা দেবে না।অন্যকেউ হলে যদি কখনো এই বিষয়ে কিছু জানে তাহলে আমাকে যে কোন কাজে আমার অতিত নিয়ে খোঁটা দেবে।

স্মিতাঃতুই অয়ন ভাইয়ার কথা সবাই বলে দিসনি কেন?

প্রিসাঃকি হতো বলে?কোন কিছু হতো না।আমি যদি এসব বাড়িতে বলি তাহলে উনি কারো সামনে মুখ দেখাতে পারবেন না,ছোট হয় যাবেন।হয়তো সবাই জোর করে উনার সাথে আমার বিয়ে দিয়ে দিতেন কিন্তু উনি কখনো আমাকে স্ত্রীর অধিকার দিতেন না আর না ভালো ব্যবহার করতেন।আর সবচেয়ে বড় কথা এসব কিছু আপুনি জানলে কষ্ট পেতো,আমি চাই না আমার জন্য আপুনি কষ্ট পাক।

স্মিতাঃকিন্তু তোর কি হবে?তুই যে কষ্ট পাচ্ছিস।

প্রিসাঃআল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।আমার বিশ্বাস কোন কিছু খারাপ হবেনা,সব ঠিক হয়ে যাবে।

স্মিতা আর কিছু বলতে পারছে না,কি বলবে তার বলার মতো কিছুই নেই।স্মিতার খুব কষ্ট হচ্ছে প্রিসার জন্য,সে জানে বাইরে থেকে প্রিসা নিজেকে স্ট্রং দেখালেও ভেতরে ভেতরে সে ভেঙে পড়েছে।এসব ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস নেই স্মিতা।
________________________________________

দেখতে দেখতে বিয়ের দিন চলে এলো।আপাতত ঘরোয়াভাবে তাদের বিয়ে হবে,প্রিসার পড়াশোনা শেষ হলে তারপর বড় করে অনুষ্ঠান করা হবে।ঘরোয়াভাবে হলেও মানুষ মোটামুটি ভালোই এসেছে।প্রিসা বউবেশে নিজের রুমে বসে আছে।কি মনে করে যেন প্রিসা আয়নার সামনে দাঁড়াই,নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে।

প্রিসাঃআমি আজ বউ সেজেছি কিন্তু আপনার জন্য নয় অয়ন ভাইয়া আপনার ভাইয়ের জন্য।কিন্তু আমি তো সেটা চাইনি,আমি তো আপনার জন্য সাজতে চেয়েছিলাম কিন্তু আপনি তা হতে দিলেন না।খুব কি বেশি ক্ষতি হয়ে যেতো আমাকে ভালোবাসলে?আমি যদি ইমম্যাচিউর হয়ে থাকি তাহলে কেন আমাকে ভালোবাসি বলেছেন?কেন আমায় আপানাকে ভালোবাসার জন্য বাধ্য করেছেন?

কথাগুলো বলতে বলতে প্রিসার চোখ থেকে আপনা-আপনি পানি গড়িয়ে পড়ছে।প্রিসা চোখের পানি মুছে নেয়।

প্রিসাঃনা আমি কান্না করবো না,কার জন্য কান্না করবো যে কখনো আমার ছিলনা।কি লাভ তার জন্য কান্না করে।

দেখতে দেখতে বিয়ের সময় ঘনিয়ে এলো।একহাত লম্বা ঘোমটা দিয়ে বসে আছে প্রিসা কিন্তু এটা সে দেয়নি তার মা তাকে দিয়ে দিয়েছে।বিয়ে পড়ানোর সময় প্রিসা খেয়াল করে এখানে বউ দুজন না তিনজন কিন্তু সে আর মিলা বাদে আরেকজনটা কে সেটা বুঝতে পারছেনা প্রিসা।প্রিসা এতটায় চিন্তায় বিভোর ছিল যে বিয়ে পড়ানোর সময় বর বউ কারো নামেই ঠিক মতো শুনেনি।

বাসর ঘরে,

এখনো একহাত লম্বা ঘোমটা দিয়ে একটা ঘন্টা যাবত বসে আছে প্রিসা।এখন এসবকিছু তার বিরক্ত লাগছে কিন্তু বিরক্ত লাগলেও কিছু করার নেই।প্রিসার ভাবনার মাঝে দরজা খোলার আওয়াজ হলো,প্রিসা বুঝতে পেরেছে সায়ন এসে গিয়েছে।

প্রিসাঃশুনুন সায়ন ভাইয়া,আমি জানি আমাদের বিয়ে হয়ে গিয়েছে কিন্তু আমার এসব মানিয়ে নিতে কিছুটা সময় লাগবে।আমি জানি আপনি সবটা জানেন তাও বলছি আমি এখনো অন্য কাউকে……

—- ভালোবাসো তাই তো?

গলার আওয়াজটা শুনে প্রিসা চমকে যায়।তাড়াতাড়ি ঘোমটা তুলে দেখে তার সামনে অয়ন দাঁড়িয়ে আছে।বরবেশে অয়নকে খুব সুন্দর লাগছে কিন্তু পরক্ষণে প্রিসার মনে পরে অয়ন এখন অন্য কারো।

প্রিসাঃঅয়ন ভাইয়া আপনি এখানে কেন?আপনি হয়তো ভুল রুমে চলে এসেছেন।

অয়নঃআমি ঠিক রুমেই এসেছি।

প্রিসাঃকিসব বলছেন আপনি?(অবাক হয়ে)

অয়ন প্রিসার সামনে বসে তারপর কপালে থাকা ছোটছোট চুলগুলোকে কানের কাছে গুঁজে দিয় বলে—

অয়নঃবলেছি আমি ঠিক রুমেই এসেছি।আমার তো এখানেই আসার কথা কারণ আমার বউ তো এখানেই আছে।

বলে প্রিসা গালে হালকা করে নিজের ঠোঁট ছোঁয়ায়।প্রিসা রেগে গিয়ে অয়নকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়।

প্রিসাঃআপনি এখানে কেন এসেছো?আমাকে একবার কষ্ট দিয়ে আপনার শান্তি হয়নি?কেন আবার এসেছেন আমার কাছে?আমি তো নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলাম,তাহলে কেন আবার এসেছেন?আপনি চলে যায় এখান থেকে,আপুনি দেখলে কষ্ট পাবে।চলে যান আপনি।(কান্না করতে করতে)

অয়নঃকান্না বন্ধ করো প্লিজ।

প্রিসাঃআপনাকে আমি কি বলেছি শুনতে পাননি।চলে যান এখান থেকে,চলে যায়।

অয়নঃমেঘবতী প্লিজ কান্না বন্ধ করো,আমার কথাটা আগে একটু শুনো প্লিজ।

প্রিসাঃকি বলবেন আপনি হ্যাঁ?কি বলবেন?বলার আর কি বাকি রেখেছেন আপনি?আর আপনি আমাকে মেঘবতী কেন বলছেন?বলবেন না আমাকে মেঘবতী,আমাকে মেঘবতী ডাকার অধিকার আপনার নেই।(রেগে)

প্রিসা আর কিছু বলতে যাবে তার আগেই অয়ন নিজের ঠোঁট দিয়ে প্রিসার ঠোঁট বন্ধ করে দেয় যার কারণে প্রিসা আর কিছু বলতে পারেনা।অনেক ধাক্কাধাক্কি করেও প্রিসা নিজে ছাড়াতে পারেনি।কিছুক্ষণ পর অয়ন নিজেই প্রিসার ঠোঁট ছেড়ে দেয়।

অয়নঃতোমাকে মেঘবতী ডাকার অধিকার আছে আমার কারণ তুমি আমার মেঘবতী।(প্রিসার চোখের পানি মুছে দিতে দিতে)

প্রিসা রেখে অয়নের হাত সরিয়ে দেয়।

প্রিসাঃনা আপনার কোন অধিকার নেই,আপনি আমাকে মেঘবতী ডাকার সেইদিন হারিয়ে ফেলেছেন যেদিন আপনি এটার অধিকার অন্যকাউকে দিয়ে দিয়েছেন।

অয়নঃকাকে দিয়েছি?

প্রিসাঃআমি যেদিন ছাদে আপনার আর সায়ন ভাইয়ার সব কথা শুনে নিয়েছিলাম।

অয়নঃজানি আমি।(মুচকি হেসে)

প্রিসাঃমানে?

অয়নঃমানে আমি আর সায়ন দুজনেই জানতাম যে তুমি আমাদের কথা শুনছো।

প্রিসাঃসে যাই হবে হোক নিজের বউয়ের কাছে যান, আপুনি আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।

অয়নঃআমি তো নিজের বউয়ের কাছেই আছি।

প্রিসাঃমানে?

অয়নঃমানে তোমার সাথেই আমার বিয়ে হয়েছে।তুমি কি ভেবেছিলে আমি আমার মেঘবতীকে এতো সহজে অন্য কারো হাতে তুলে দেবো আর অন্য কাউকে আমার মেঘবতীকে মেঘবতী বলে ডাকার অনুমতি দেবো,কখনোই না।মেঘবতী শুধু আমার,আমি তাকে কখনই নিজের থেকে আলাদা করবো না।

প্রিসাঃতাহলে এসব কি?(অবাক হয়ে)

অয়নঃপ্রথমে তুমি ফ্রেশ হয়ে এসো তারপর সব বলছি।

অয়ন প্রিসাকে একটা ড্রেস দেয় কারণ প্রিসা শাড়ি পড়তে জানেনা।ফ্রেশ হয়ে এসে প্রিসা দেখে অয়ন রুমে নেয়।

অয়নঃএদিকে এসো মেঘবতী।

প্রিসা পেছন ফিরে দেখে বারান্দায় দাড়িয়ে আছে অয়ন।আস্তে আস্তে প্রিসা বারান্দায় যেয়ে অয়নের পাশে দাঁড়ায়।

প্রিসাঃবলুন।

অয়নঃতুমি প্রশ্ন করো,আমি উওর দিচ্ছি।

প্রিসাঃআমার বিয়ে কার সাথে হয়েছে?

অয়নঃআমার সাথে।

প্রিসাঃতাহলে আপুনির সাথে কেন প্রেম করলেন?

অয়নঃআমার আর মিলার মধ্যে কখনই কিছু ছিলনা,আমরা একে অপরকে শুধু বন্ধুই ভাবতাম।তুমি যা দেখেছো সবকিছু প্রিপ্লেন নাটক ছিল।

প্রিসাঃকি!(অবাক হয়ে)তাহলে ওই ফোন ক’লসগুলো কি ছিল?

অয়নঃওইদিন ফোনটা আমি ইচ্ছে করেই করেছিলাম,আমি জানতাম ফোন মিলা না তুমিই রিসিভ করেছো।তুমি তো জানোই ওই সময় মিলা তোমার সামনে ছিল না কিন্তু মিলা দরজার বাইরেই ছিল।ওই আমাকে অন্য ফোন থেকে ফোন করে বলেছে যে তুমি ওর রুমে আছো,তাই আমি ইচ্ছে করিই ফোন দিয়েছি।

প্রিসাঃতাহলে এর আগে যে আপনারা দুজন এতোটা সময় ধরে কথা বলেছেন সেটা?

অয়নঃহুম আমরা কথা বলেছি তবে সেটা সর্বোচ্চ এক মিনিট।

প্রিসাঃমিথ্যা কথা বলবেন না।আমি কল রেকর্ড চেক করে দেখেছি আপনারা পনেরো-বিশ মিনিট বা তার থেকেও বেশি সময় নিয়ে কথা বলেছে।

অয়নঃহুম ওটা ঠিক তবে আমি মিলার সাথে বা মিলা আমার সাথে কথা বলি নিয়।আমি যখন ওকে ফোন দিতাম তখন ও তোমার কাছে চলে যেতো,ও তোমাকে কথায় ডুবিয়ে রাখতো আর আমি আমার মেঘবতীর কন্ঠ শুনতে পেতাম।(মুচকি হেসে)

প্রিসাঃতাহলে মেয়ে দেখতে আসা?(অবাক হয়ে)

অয়নঃওটাও একটা সাজানো নাটক বলতে পারো যেটা সম্পর্কে তুমি ছাড়া সবাই সত্যিটা জানতো।

প্রিসাঃতাহলে ওইদিন কেন এসেছিলেন?আর এসব কিছু সম্পর্কে বাসার সবাই আগে থেকে জানতো?

অয়নঃহুম আর কেন এসেছিলাম ওটা একটু পড়েই জানতে পারবে।

প্রিসাঃআচ্ছা আপুনি আর সায়ন ভাইয়ার কি হয়েছে?আর একটা কথা বিয়ে পড়ানোর সময় আমি খেয়াল করেছিলাম ওখানে আমি আর আপুনি বাদে আরেকজনও ছিল,ওটা কে?

অয়নঃএকমিনিট।(হালকা হেসে)

অয়ন তার পকেট থেকে ফোনটা বের করে কি কি যেন করলো তারপর ফোনের স্ক্রিনটা প্রিসার দিকে ঘুরিয়ে দিলো।প্রিসা তাকিয়ে দেখে অয়ন ভিডিও কল দিয়েছে।প্রিসা অয়নের দিকে তাকাই,অয়ন ইশারায় প্রিসা ফোনের স্ক্রিনে দেখতে বলে।প্রিসা তাকিয়ে দেখে এখানে সে এবং অয়ন ছাড়া সায়ন,মিলা এবং আরো দুজন ছেলে-মেয়েও আছে।সায়নের পাশে থাকা মেয়েটার দিকে তাকাই প্রিসা,কেন যেন মেয়েটাকে তারা চেনা চেনা লাগছে।হঠাৎ প্রিসা মনে পড়ে মেয়েটার ছবি সে সায়নের ফোনের ওয়ালপেপারে দেখেছে।এবার প্রিসা মিলার ওখানে তাকাই কিন্তু মিলার সাথে যাকে দেখে তাতে তো প্রিসা যেন আকাশ থেকে পড়ে।কারণ এটা ওই ছেলেটা যে সেদিন পাত্রপক্ষ হিসেবে অয়নদের সাথে এসেছিল।

—- হ্যালো আপু।(সায়নের পাশে থাকা মেয়েটা)

—- হ্যালো শালিকা।কেন দিলাম সারপ্রাইজ?(মিলার সাথে থাকা ছেলেটা)

প্রিসাঃতারমানে ওনাদেরও?(অয়নের দিকে তাকিয়ে)

অয়নঃহুম।

প্রিসা আবার ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাই।

সায়নঃ দেখো প্রিসা আমি জানিনা ভাই তোমাকে কতটুকু বলেছে তবে আমি তোমাকে একটা কথা বলি আমি তোমাকে সবসময় নিজের বোনের চোখে দেখেছি,এর বাইরে আমি কোনদিনও কিছু ভাবনি তোমাকে।

প্রিসা চুপ করে আছে।অয়ন ফোনটা নিজের দিকে করে নেয়।

অয়নঃআজ অনেক ধকল গিয়েছে আর রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়ো তোমরা,পরে কথা হবে।

অয়ন ফোনটা আবার পকেটে ঢুকিয়ে নেয়।

প্রিসাঃএসব কি?

অয়নঃআমি ক্লিয়ার করে বলছি।সায়নের সাথে যে মেয়েরটাকে দেখেছো,ওর নাম মৌ।ওরা দুজন-দুজনকে অনেক দিন ধরে ভালোবাসে।তোমার মনে আছে একদিন তুমি ভার্সিটি থেকে এসে বাসায় কাউকে দেখতে পাওনি কিন্তু আমার সাথে ঘুরতে যাওয়ার পরে তুমি তাদের সবাইকে তোমার বাসায় দেখেছো,ওইদিন সবাই গিয়েছিল সায়ন আর মৌ এর বিয়ের কথা পাকা করতে।কিন্তু এটা তোমাকে কেন বলেনি সেটা আমি জানিনা তবে এটা পরে আমার অনেক কাজে এসেছিল।

প্রিসাঃতাহলে আপুনিরটাও একই?

অয়নঃহুম,ছেলেটার নাম সিদ্ধার্থ।মিলা আর সিদ্ধার্থও একে অপরকে ভালোবাসতো।সেইদিন মিলাকে আমার জন্য না সিদ্ধার্থের জন্য দেখতে আসা হয়েছিল।সবাই সত্যিটা জানতো যে পাত্র আসলে আমি না সিদ্ধার্থ,তবে তোমার সামনে নাটক করেছিল সবাই।কিন্তু এটাও সত্য সিদ্ধার্থ আর আমার বাবা একে অপরের বন্ধু।

প্রিসাঃতাহলে সবকিছু প্রিপ্লেন ছিল।তাহলে এই রেস্টুরেন্টের ঘটনাও আপনি জেনে বুঝে করেন,তাইনা?

অয়নঃকোন রেস্টুরেন্টে?আর কোন ঘটনার কথা বলছো তুমি?

প্রিসাঃকিছুদিন আগে আপনি আর একটা মেয়ে ” ……… ” এই রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলেন না?

অয়নঃহুম।

প্রিসাঃআপনি কি জানতেন আমি ওখানেই ছিলাম?

অয়নঃকি!তুমি ওখানে ছিলে?(অবাক হয়ে)

প্রিসাঃহুম।কেন আপনি জানতেন না?

অয়নঃনাতো।

প্রিসাঃতারমানে ওইদিনের ঘটনাগুলো সত্যি।

অয়নঃকিসের ঘটনা?আর কিসব বলছো তুমি?

প্রিসাঃওইদিন আপনার সাথে ওই মেয়েটা কে ছিল?

অয়নঃআরে ওই মেয়েটা আমার একটা ক্লাইড ছিল,সেইসাথে আমার ফ্রেন্ডও।

প্রিসাঃতাহলে ওই মেয়েটা আপনার হাতে হাত রেখেছিল কেন?

অয়নঃআরে ওটা কথায় কথায় টাচ হয়ে গিয়েছে।

প্রিসাঃতাহলে আমার ফোন ধরেনি কেন?

অয়নঃআসলে প্রথমে আমি খেয়াল করিনি কিন্তু পরে যখন রিভিউ করতে যাবো তখন দেখি ফোনের ব্যাটারি লো,পরে দেখি ফোনটাই অফ হয়ে গিয়েছে।বাসায় এসে তোমাকে ফোন দেবো ভেবেছিলাম কিন্তু তখনি মিলা আমাকে ফোন দিল আর এরপরের টাতো তোমাকে আগেই বলেছি।

প্রিসাঃকিন্তু এতো কিছু কেন করলেন?আর আমাকে এভয়ডও কে করেছিলেন এতোদিন?

অয়ন একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আবার বলতে শুরু করলো—-

অয়নঃএসব কিছু করার পেছনে একটাই কারণ ছিল আর সেটা হচ্ছে তোমার মনে আমার জন্য জায়গা সৃষ্টি করা।আমি জানতাম আমাকে তোমার ভালোলাগতো কিন্তু তুমি আমাকে ভালোবাসতে না।ভালোলাগা আর ভালোবাসা দুটোই আলাদা,আমি চেয়েছিলাম যাতে তুমি আমাকে ভালোবাসো।জানো যখন আমি তোমাকে ভালোবাসি বলতাম আর তুমি তার প্রতিউওরে চুপ থাকতে তখন আমার খুব কষ্ট হতো।একদিন সায়ন আমাকে আমাদের কথা জিজ্ঞেস করে তখন ওকে আমি সব বলি।তারপর সায়ন আর মিলা মিলে এসব প্লেন করে।অন্যসময় তোমাকে এভয়ড করতে পারতাম না কারণ তখন কোন ভালো রিজেন পেতাম না তাই তোমার পরীক্ষার বাহানা দিয়েই তোমার সাথে কথা বলা কমিয়ে দিয়,তারপর সব তো তুমি জানো।

প্রিসাঃবলুন এবার।

অয়নঃকি বলবো?(অবাক হয়ে)

প্রিসাঃএইযে যার জন্য এতোকিছু করলেন।

অয়নঃকিন্তু তুমি তো…..

প্রিসাঃআপনাকে বলতে বলেছি আপনি বলবেন,এতো কিন্তু কিন্তু কেন করছেন?

অয়নঃআই লাভ ইউ মেঘবতী।

প্রিসা মুচকি হেসে অয়নকে জরিয়ে ধরে।

প্রিসাঃআই লাভ ইউ টু।

অয়নঃসত্যি?(অবাক হয়ে)

প্রিসাঃহুম।

অয়নঃআমি তো বিশ্বাসই করতে পারছি না যে আমার মেঘবতী আমাকে ভালোবাসি বলেছে।

প্রিসাঃআচ্ছা আপনি আমাকে মেঘবতী কেন বলেন?

অয়নঃএকদিন অন্যের ফোনে আমি একটা পিচ্চি মেয়ের ছবি দেখেছিলাম,যে সদ্য কিশোরী বয়সে পা দিয়েছিল।যার পড়নে ছিল মেঘের মতো সাদা একটা ফ্রগ সাথে চুলগুলো দুটো জুটি করা,চোখে চশমা,পুরোই বাচ্চা বাচ্চা লাগছিল আর সেই পিচ্চি বাচ্চা বাচ্চা দেখতে মেয়েটা ছিল আমার মেঘবতী।

প্রিসাঃতারমানে আপনি আমাকে আগে থেকেই..?

অয়নঃহুম,তোমাকে আমি তখন থেকে ভালোবাসতাম যখন আমি ভার্সিটিতে পড়াশোনা করছিলাম।তুমি যখন অন্যের সাথে ভিডিও কলে কথা বলতে আমি লুকিয়ে লুকিয়ে দেখাম,অন্যের ফোন থেকে তোমার ছবি নিয়ে নিজের কাছে রেখেছিলাম।

প্রিসাঃএতো ভালোবাসেন আমায়।

অয়নঃনিজের চেয়েও বেশি।আমাকে কখনো ছেড়ে যেওনা মেঘবতী,আমি শেষ হয়ে যাবো।বেঁচে তাকলেও তোমাকে ছাড়া আমি জীবন্ত লাশে পরিণত হবো।

প্রিসাঃকিসব বলেন আপনি,এরকম কথা আর কখনো বলবেন না।আপনাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না,কখনো না।(জরিয়ে ধরে)

——————- সমাপ্ত—————

মেঘবতী পর্ব-১২

0

#গল্পঃমেঘবতী
#পর্বঃ১২
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

প্রিসাঃমা কি হয়েছে?এত শোরগোল কেন?আর এতো প্রিপারেশন কিসের জন্য?

প্রিসার মাঃকারণ আজকে মেহমান আসবে।

প্রিসাঃকোথায়?আমাদের বাসাই?

প্রিসার মাঃনা মেহমান তো তোর চাচীর বাসায় আসবে।

প্রিসাঃতাহলে আমাদের বাসাই এতো শোরগোল কেন?আর কে আসবে?

প্রিসার মাঃআরে আজকে মিলাকে পাএপক্ষ দেখতে আসবে।তোর চাচী একা সবকিছু সামলাতে পারছে না তাই আমি কিছু সাহায্য করছি আর আমাদের এতো প্রিপারেশন নেওয়ার কারণ পাএপক্ষ যদি আমাদের বাসাই আসে,তাই আগে থেকেই সব প্রিপারেশন নিয়ে রাখছি।

প্রিসাঃআপুনি কে পাএপক্ষ দেখতে আসবে তাও আজ।মা তুমি আমার সাথে মজা করছো নাতো?

প্রিসার মাঃএই তোর কি আমাকে দেখে মনে হয় আমি মজা করছি?আর এমনভাব করছিস যেন তুই কিছু জানিস না।

প্রিসাঃআমি আবার কি জানবো?আচ্ছা এসব বাদ দাও এবার এটা বলো পাএপক্ষ আমাদের বাসাই আসবে এটার মানে কি?পাএপক্ষ আমাদের বাসায় কেন আসবে?

প্রিসার মাঃআরে আমরা মিলার চাচা-চাচী তো যদি পাএপক্ষ আমাদের সম্পর্কেও জানতে চাই তখন।তাই আগে থেকেই প্রিপারেশন নিয়ে রাখা ভালো।এবার তুই যাতো,এসেই একগাদা প্রশ্ন করতে শুরু করে দিয়েছে।

বলে প্রিসার মা নিজের কাজে চলে গেলো কিন্তু প্রিসা এখনো সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে।

প্রিসাঃএটা কি হলো?আপুনিকে পাএপক্ষ দেখতে আসবে এটা সবাই জানে কিন্তু আমি জানিনা কেন?আপুনি কি জানে?হয়তো আপুনিও জানেনা,জানলে কি আর আমার থেকে লুকাতো।কিন্তু পাএপক্ষ আমাদের বাড়িতে আসতে চাইবে কেন?ধুর,কিছুই বুঝতে পারছি না।যাই একবার আপুনির সাথে দেখা করে আসি।

প্রিসা মিলাদের বাসায় যায় সেখানেও কাজ চলছে।প্রিসা সেদিকে এতো পাত্তা না দিয়ে মিলার রুমে যায়।সারারুমে খুঁজেও প্রিসা মিলাকে পাইনি,যখনি রুম থেকে চলে যাবে তখন কারো কথা বলার শব্দ সে পাই।বুঝতে পারে শব্দটা কোথা থেকে আসছে,প্রিসা নিঃশব্দে পা পেলে বারান্দায় যায়,দেখে মিলা কারো সাথে হেসে এসে কথা বলছে।

প্রিসাঃআপুনি।

মিলাঃকে?(ভীত গলায়)

প্রিসাঃআমি।

মিলাঃও পাখি তুই।ওই আসলে…. আচ্ছা তুই ভেতরে যা আমি আসছি।

প্রিসা ভেতরে চলে আসে কিছুক্ষণ পর মিলাও চলে আসে।মিলাকে দেখেই প্রিসা বলতে শুরু করে—

প্রিসাঃআপুনি তোমাকে বলে আজকে পাএপক্ষ দেখতে আসবে?

প্রিসা ভেবেছিলাম কথাটা শুনে মিলা অবাক হবে কিন্তু প্রিসার ভাবনা পুরোটাই ভুল প্রমানিত হলো।

মিলাঃহুম।(লজ্জা পেয়ে)

প্রিসাঃতুমি আগে থেকেই জানতে?

মিলাঃহুম।

প্রিসাঃতাহলে আমাকে আগে বলোনি কেন?

মিলাঃতুই জানতিস না?

প্রিসাঃনা আমি তো আজকেই জানতে পারলাম।

মিলাঃও আচ্ছা আমি তো ভেবেছিলাম তুই জানতিস তাই আর বলিনি।

প্রিসাঃআচ্ছা আমি আসছি।

প্রিসা চলে যেতে নিলেও আবার ফিরে আসে।

প্রিসাঃআপুনি।

মিলাঃকি কিছু বলবি?

প্রিসাঃআপু কালকে রাতে আমি এসেছিলাম তোমার কাছে কিন্তু তোমাকে দেখিনি।কোথায় ছিলে তুমি?

মিলাঃওই ছাদে ছিলাম।

প্রিসাঃও আচ্ছা।কালকে আমি যখন এসেছিলাম তখন কেউ তোমাকে ফোন করেছিল,’অয়ু’ নামে।কে এই ‘অয়ু’ আপুনি?(না জানার ভান করে)

মিলাঃ ওই ‘অয়ু’ আমার একটা ফ্রেন্ড।পুরো নাম অায়ুশী আমি ওকে অয়ু বলে ডাকি।

প্রিসাঃ(আপুনি তুমি আমাকে মিথ্যা কথা বললে।কিন্তু কেন?— মনে মনে)ও আচ্ছা।

মিলাঃতুই কি ফোনটা রিসিভ করেছিস?(কিছুটা ভীত গলায়)

প্রিসাঃনা,রিসিভ করার আগেই কেটে গিয়েছে।কেন তুমি দেখোনি?

মিলাঃনা আসলে আমি খেয়াল করিনি।

প্রিসাঃ(দেখবে কেমন করে আমি তো নম্বর ডায়াল লিস্ট থেকে ডিলিট করে দিয়েছিলাম।—- মনে মনে)ও আচ্ছা।আমি আসছি,পরে আবার আসবো।

প্রিসা নিজের রুমে চলে আসে।বিছানায় বসে ভাবতে থাকে কেন মিলা থাকে মিথ্যা কথা বলেছে।প্রিসা সাইড থেকে ফোনটা নিয়ে অয়নকে ফোন দেয় কিন্তু ফোন বিজি,তারপর কি মনে করে যেন মিলাকে ফোন দেয়।হ্যাঁ সে যেটা ভেবেছিল সেটাই মিলার ফোনও বিজি।এতোসবের চিন্তায় প্রিসা মাথাব্যথা করছে,মনে হচ্ছে কেউ যে মাথার উপর ভারী কিছু রেখে দিয়েছে।না খেয়ে আবার শুয়ে পরে প্রিসা,কিছুক্ষণ পর আবার ঘুমের দেশে তলিয়ে যায় প্রিসা।

বিকেলে,

মিলা আর প্রিসা দুজনের বাড়িতে তোরজোর চলছে।প্রিসা বুঝতে পারছে না তার মা কেন শুধু শুধু তাদের বাড়িতে এতো কিছু করছে।প্রিসা এখন মিলার সাথে তার রুমে বসে আসে।মিলা কলাপাতা রঙের একটা শাড়ি পরেছে সেই সাথে হালকা মেকাপ আর চুলগুলো খোঁপা করা।প্রিসাকেও জোর করেছিল শাড়ি পড়ার জন্য কিন্তু প্রিসা সাফসাফ মানা করে দিয়েছে।তার একটাই প্রশ্ন কেন সে শাড়ি পড়বে?তাকে তো আর দেখতে আসছে না।

প্রিসাঃআপুনি আমার এবার কেন যেন সন্দেহ হচ্ছে।

মিলাঃকিসের…সন্দেহ?(সামান্য ভীত গলায়)

প্রিসাঃআমার কেন যে মনে হচ্ছে তোমার সাথে ওরা আমাকেও পাএপক্ষের সামনে বসাবে।দেখো পাএপক্ষ দেখতে আসবে তোমাকে আর তারা তোমাদের বাসাই আসবে তাহলে আমাদের বাসায় কেন এতো তোড়জোড় আর তোমার সাথে সাথে আমাকেও কেন শাড়ি পড়তে জোর করেছিল?

মিলাঃআরে মেরি বেহেনা,এরকম কিছু না তুই শুধু শুধু শুধু চিন্তা করছিস,রিলেক্স।

প্রিসাঃহুম।

প্রিসা মুখ হুম বললেও কেন যেন তার ভয় ভয় লাগছে,প্রিসা জানে তার বাবা-মা তাকে না জানিয়ে এরকম কাজ করবে না কিন্তু তাও কেন যেন তার ভয় ভয় লাগছে।

কিছুক্ষণ পর পাএপক্ষ এলো।প্রিসার মা আর চাচী মিলাকে নিয়ে গেলো,প্রিসাকেও নিয়ে যেতে চেয়েছে কিন্তু প্রিসা পরে আসবে বলে যায়নি।মিলা যাওয়ার কিছু সময় পর প্রিসাও বাইরে আসে কিন্তু যাদের দেখে তাতে তো প্রিসা অবাক না অনেকটাই অবাক।প্রিসার চোখ একজনের দিকে আটকে যায়,হ্যাঁ সেই ব্যক্তিটি হচ্ছে অয়ন।প্রিসা একদৃষ্টিতে অয়নের দিকে তাকিয়ে আছে।কতদিন পর সে অয়নকে এতোটা কাছ থেকে দেখছে কিন্তু অয়ন তার দিকে একবারের জন্যও তাকাইনি,যেটা দেখে প্রিসার অনেক খারাপ লাগে।অয়নের থেকে চোখ সরিয়ে প্রিসা দেখে এখানে তার মামা-মামী এবং সায়ন-অয়ন ছাড়াও তিনজন ব্যক্তি উপস্থিত আছে।একজন মধ্যবয়স্ক মহিলা,একজন মধ্যবয়স্ক পুরুষ আর একটা ছেলে,যার বয়স মোটামুটি অয়ন বা সায়নের সমান হবে কিন্তু এদের কাউকে প্রিসা চিনেনা।তাদের কথায় প্রিসা বুঝতে পারলো ছেলেটা নাকি অয়নের বন্ধ সেই সাথে মধ্যবয়স্ক লোকটা নাকি তার মামার বন্ধু।এছাড়াও আরো একটা কথা প্রিসা জানতে পেরেছে মিলাকে যার জন্য দেখতে এসেছে সে আর কেউ না বরং অয়ন,তার থেকেও যে কথাটায় প্রিসা বেশি কষ্ট পেয়েছে সেটা হচ্ছে অয়ন আর মিলা নাকি একে অপরকে আগে থেকেই পছন্দ করতো।এটা কথাটা শুনে প্রিসার চোখ জলে ভিজে যায়।প্রিসা একবার অয়নের দিকে তাকাই কিন্তু অয়ন একেবারে জন্যও প্রিসার দিকে তাকাইনি,এমন ব্যবহার করছে যেন প্রিসা ওখানে নেই।প্রিসার এখন কান্না করতে ইচ্ছা করছে কিন্তু পারছে না,কোনভাবে সে তার চোখের জল আটকানোর চেষ্টা করছে।এই বিষয়টা অন্যকেও খেয়াল করুন আর না করুক সায়ন ঠিকই খেয়াল করেছে কারণ প্রিসার নাকটা আস্তে আস্তে লাল হয়ে যাচ্ছে আর সায়ন এটা জানে যে কান্না করলে প্রিসার নাকটা লাল হয়ে যায়।এদিকে,সবার কথাবার্তা শেষ হলে অয়ন আর মিলাকে আলাদা কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয় কিন্তু সায়ন তার মাঝে বলে উঠে সে নাকি অয়নের সাথে একটু আলাদা কথা বলতে চাই,সবাই অবাক হলেও তাদের আলাদা করে কথা বলতে দেয়।

ছাদে সামনাসামনি দাঁড়িয়ে আছে অয়ন আর সায়ন।

অয়নঃকি হয়েছে?আলাদা করে কথা বলতে চাইলি।যা বলার বাড়ি গিয়েও তো বলতে পারতিস।

সায়নঃনা পারতাম না।আচ্ছা তুই কেন এরকম করছিস?

অয়নঃকি কি রকম করছি?

সায়নঃএইযে একজনে ভালোবাসি বলে অন্যজন কে বিয়ে করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিস।

অয়নঃকিসব বলছিস তুই?

সায়নঃআমি যা বলছি ঠিক বলছি।তুই না কিছুদিন আগে তোর মেঘবতীকে ভালোবাসি বলেছিস তাহলে আজকে এসব কি?

অয়নঃতুই কিভাবে জানলি?

সায়নঃওইদিন যখন তুই ওকে ভালোবাসি বলেছিস আমি তখন দরজার বাইরেই ছিলাম।কেন তুই তোর মেঘবতীকে কষ্ট দিচ্ছিস?জানিস মেয়েটা তোর সাথে মিলার বিয়ের কথা শুনে কতটা কষ্ট পেয়েছে।

অয়নঃও আচ্ছা এবার বুঝতে পেরেছি।শুন ব্রো আমি প্রিসাকে কখনোই ভালোবাসিনি ওটা জাস্ট কিছুদিনের মোহ ছিল,আমি তো মিলাকে ভালোবাসি।

সায়নঃকিসব বলছিস তুই এগুলো?মেঘবতী তোর মোহ ছিল?(অবাক হয়ে)

অয়নঃহ্যাঁ আমি ঠিকই বলছি প্রিসা আমার কিছুদিনের মোহ ছিল আর মিলার আমার সত্যি কারের ভালোবাসা।আর তাছাড়া প্রিসার থেকে মিলা অনেক ভালো।দেখতে শুনতে প্রিসার থেকে মিলা অনেক ভালো আর প্রিসার এখনো ইমমেচিউর কিন্তু আমার মেচিউর কাউকে চাই।

সায়নঃঅয়ন কি বলছিস তুই এসব?তুই মেঘবতীকে এরকম বলতে পারলি।

অয়ন বুঝতে পেরেছে সায়ন রেগে গিয়েছে কারণ তারা রেগে গেলেই একজন অপরজনের নাম ধরে ডাকে।

অয়নঃআমি যা বলছি একদম ঠিক বলছি।

সায়নঃঅয়ন?(কিছুক্ষণ চুপ থেকে)তুই কি খেয়াল করেছিস আমি তোর মেঘবতীকে মেঘবতী বলে ডেকেছি কয়েকবার।তাও তুই কিছু বললি না যে?

অয়নঃএতে বলার কি আছে?তোর যদি নামটা পছন্দ হয় তাহলে তুই প্রিসাকে মেঘবতী বলে ডাক আর ইচ্ছে হলে তুই ওকে বিয়েও করতে পারিস,আমার কোন সমস্যা নেই।

কিছুক্ষণ চুপ থেকে,

সায়নঃঠিক আছে আমি প্রিসাকে বিয়ে করবো আর আজ থেকে তুই ওকে আর মেঘবতী বলে সম্বোধন করবিনা।

এদিকে সিঁড়ি কাছে দাঁড়িয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে কেউ,সে আর কেউ না প্রিসা।এতক্ষণ সে অয়ন আর সায়নের সব কথা শুনেছে।প্রিসার এটা জেনে কষ্ট হচ্ছে যে সে অয়নের মোহ ছিল,সেই সাথে তাকে মেঘবতী বলে সম্বোধন করার অধিকার সে অন্যকাউকে দিয়ে দিয়েছে।প্রিসা ওখানে থেকে নেমে আসতে থাকে।

সায়নঃঅয়ন তুই এমন কেন করছিস?প্লিজ এসব বন্ধ কর,নয়তো খারাপ কিছু হয়ে যেতে পারে।

এরপর আর কোন কথা প্রিসা শুনতে পাইনি।প্রিসা দৌড়ে এসে নিজের রুমে চলে যায়।দরজা বন্ধ করে নিচে বসে পড়ে আর হাঁটুতে মুখ গুজে কান্না করতে থাকে।

প্রিসাঃকেন আমার সাথে এমনটা হলো,কেন?আমি তো ওনার কাছে ভালোবাসার প্রস্তাব নিয়ে যাইনি,উনিই তো এসেছিলেন আর এখন যখন আমি ওনাকে ভালোবেসে ফেলেছি তখনই উনি বলেন আমি ওনার মোহ ছিলাম।

আরো কিছুক্ষণ কান্না প্রিসা ওয়াশরুমে চলে যায়।মুখ ধুয়ে এসে কিছুক্ষণ বসে তারপর দরজা খুলে মিলাদের বাসাই যায়।প্রিসার মোটেও সেখানে যাওয়ার ইচ্ছে নেই কিন্তু যেতে তো হবেই না হলে সবাই সন্দেহ করবে।ওখানে গেলে প্রিসাকে তার বাবা-মা বলে সায়ন নাকি তাকে বিয়ে করবে,যেটা শুনে সে মোটেও অবাক হয়নি কারণ সে এটা আগে থেকেই জানতো।প্রিসাও সায়নকে বিয়ে করার জন্য হ্যাঁ বলে দেয় আর অয়নের কথাও কাউকে বলেনি।কারণ বলে কি লাভ ভালোবাসাটাতো এখন একতরফা আর একতরফা ভালোবাসা কখনো পূর্ণতা পাইনা।তার থেকে বরং চুপ থাকাটাই বেটার,এতেই সবার ভালো হবে।

চলবে………..

মেঘবতী পর্ব-১১

0

#গল্পঃমেঘবতী
#পর্বঃ১১
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

২মাস পর,

দেখতে দেখতে ২মাস চলে গেলো।এই দুই মাসে অনেক কিছু পরিবর্তন না হলেও ছোটখাটো কিছু হলেও পরিবর্তন হয়েছে।প্রিসা আর অয়ন পুরোপুরি প্রেমিক-প্রেমিকা না হলেও নিয়ম করে তাদের ফোনে কথা হতো,তাও বেশি না ১ কি ২ মিনিট।তাদের কথা বলার টপিক সবসময় একিই ছিল।এই যেমন সকালে খেয়েছে কিনা,ভার্সিটিতে প্রিসা পৌঁছেছে কিনা বা অয়ন অফিসে গিয়েছে কিনা,বাড়িতে ফিরেছে কিনা এইসব।বেশিরভাগ সময় অয়নই প্রিসাকে ফোন দিত তবে মাঝে দুএকবার প্রিসাও ফোন দিয়েছিল।এভাবেই চলছিল তাদের দিনকাল।কয়েকদিন আগেই প্রিসা পরীক্ষা শুরু হয়েছে।পরীক্ষা তাই অয়ন বলেছে শুধু একবারেই তাদের কথা হবে তাও অয়ন নিজে ফোন দেবে।প্রিসাও অয়নের কথাই রাজি হয়ে যায়।তবে গত তিন-চারদিনে অয়ন শুধু একবারেই তাকে ফোন দিয়েছে।প্রথমে তো প্রতিদিন একবার হলেও ফোন করতো প্রিসাকে কিন্তু আসতে আসতে তা কমতে শুরু করে।কালকে প্রিসার পরীক্ষা কিন্তু সে কোনভাবেই পড়াই মন বসাতে পারছে না,তার মনে আর মাথায় তো শুধু একটাই চিন্তা ঘুরছে এখন আর সেটা হচ্ছে ‘অয়নে ফোন দেবে কি দেবে না’।
অনেক সময় নিয়ে সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব সাইডে রেখে অয়নের নম্বরে ডায়াল করে।কিন্তু আফসোস অয়নের ফোন তো বাজছে কিন্তু সে রিসিভ করছে না।কিছুটা সময় পর আবার ফোন দেয় প্রিসা কিন্তু এভাবো ফলাফল শূন্য।

প্রিসাঃকি হলো?অয়ন ভাইয়া ফোন তুলছে না কেন?আচ্ছা উনি কি কোন বিষয় নিয়ে আমার উপর রাগ করেছেন?কিন্তু আমি তো এমন কোন কাজ করিনি যাতে উনি রাগ করেবেন বা কষ্ট পাবেন।তাহলে?আরে ধুর,হয়তো উনি ব্যস্ত আছে।মাএ নতুন নতুন অফিস শুরু করেছে তো তাই হয়তো কাজে ব্যস্ত আছে।আমি বরং এখন পড়তে বসি,নয়তো কালকে পরীক্ষায় কিছু লিখতে পরবো না।আর যদি পরীক্ষার রেজাল্ট খারাপ হয়তো আমি কি গেলাম।

প্রিসা নিজেকে অয়ন ব্যস্ত আছে বলে শান্তনা দিয়ে আবার পড়তে বসে।
__________________________________________

অবশেষে দীর্ঘ সময় পর আজ প্রিসার পরীক্ষা অবশেষে শেষ হয়েছে কিন্তু তার মন মোটেও ভালো নেয়।কারণ আজ প্রায় ১ সপ্তাহ অয়নের সাথে প্রিসার কোন যোগাযোগ নেই।না অয়ন নিজে ফোন দেয় আর না প্রিসা ফোন দিলে রিসিভ করে।সেইদিনের পর অয়নের সাথে প্রিসার সর্ব্বোচ তিন বার কথা হয়েছে তাও কিছু সময়ের জন্য।আজও প্রিসা অয়নে ফোন দিয়েছিল কিন্তু তার ফোন প্রত্যেক বারেই বন্ধ বলছে।তাই প্রিসা ঠিক করেছে পরেরদিন সে অয়নের অফিসে যাবে কাউকে না বলে।

পরেরদিন সকালে,

সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পড়ে প্রিসা।তারপর নিজ হাতে অয়নের জন্য রান্না করতে শুরু করে।প্রিসা রান্না তেমনটা জানে না,তাই ইউটিউব দেখেই রান্না শেষ করে।রান্না শেষ হলে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নেয়।তারপর অপেক্ষা করতে তাকে কখন সময় হবে আর কখন সে অয়নের সাথে দেখা করতে পারবে।অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত সময়টা এলো।প্রিসা তাড়াতাড়ি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরে অয়নের অফিসের উদ্দেশ্য।অফিসে এসে রিসেপশনিস্ট থেকে অয়নের কেবিন কোনটা জিজ্ঞেস করে নেয়,তারপর লিফটে উপরে উঠে যায়।কিন্তু অয়নের কেবিনে গিয়ে প্রিসার মন ভেঙে যায় কারণ কেবিনে কেউ নেই পুরো কেবিন খালি।দুঃখী মন নিয়ে প্রিসা নিচে নেমে আসে।রিসেপশেনিস্ট থেকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন অয়ন এখন অফিসে নেই,কিছু কাজে নাকি বাইরে গিয়েছে।সায়নের কথা জিজ্ঞেস করলে রিসেপশেনিস্ট বলে সে নাকি মিটিং এ আসে।প্রিসা খাবার গুলো রিসেপশেনে রেখে বলে এগুলো যাতে তিনি সায়নকে দিয়ে দেয় কারণ প্রিসা দুজনের জন্যই খাবার এনেছিল।

দুঃখী মন নিয়ে বাড়ি ফিরছে প্রিসা।কত আশা করে এসেছিল সে যে এতোদিন পর আবার অয়নের সাথে তার দেখা হবে,অয়নকে তার নিজের হাতে রান্না করা খাওয়ার খাওয়াবে কিন্তু কোন আশায় তার পূরণ হয়নি তার।ট্রাফিক জ্যামে আটকে পরে প্রিসা গাড়ি হঠাৎ তার চোখ পরে কিছুটা দূরে গাড়িতে থাকা একটা লোকের দিকে।প্রিসা ভালো করে তাকিয়ে দেখে,না সে ভুল না ঠিকই দেখেছে লোকটা আর কেউ না অয়ন।ট্রাফিক জ্যাম খুলে গিয়েছে প্রিসা তার ড্রাইবারকে বলে অয়নের গাড়িকে ফলো করতে।প্রিসার মনে আবার একটা আশা জেগেছে যে সে অয়নের সাথে দেখা করতে পারবে।অয়নের গাড়ি একটা রেস্টুরেন্টের সামনে এসে থামে।প্রিসা অয়নের বের হওয়ার অপেক্ষা করছে।কিছুক্ষণ পর অয়ন বের হয় তবে সে একা নয় তার সাথে আরো একজন বের হয়,সে কোন পুরুষ না একটা কমবয়সী মেয়ে।অয়ন আর মেয়েটি রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকে পরে।প্রিসার কেন যে ভেতরে ঢুকতে ভয় ভয় লাগছে,ভিন্ন নেগেটিভ চিন্তা তার মাথায় ভর করছে।প্রিসা সবকিছু সাইডে রেখে তারপর ভেতরে ঢুকে।প্রিসা নিজের মুখ ঢেকে নিয়েছে যাতে অয়ন তাকে দেখলেও যাতে চিনতে না পারে।প্রিসা ভেতরে গিয়ে একটা টেবিলে বসে।এদিক-ওদিক তাকিয়ে অয়ন আর ওই মেয়েটাকে খুঁজতে থাকে আর একসময় পেয়েও যায়।প্রিসা খুব খারাপ লাগছে অয়নকে একটা মেয়ের সাথে দেখে।অয়ন আর মেয়েটা হেসে হেসে কথা বলছে,যেটা দেখে প্রিসার আরো বেশি খারাপ লাগছে।কি মনে করে যেন প্রিসা অয়নকে ফোন দেয় কিন্তু অয়ন ফোন রিসিভ করে না।প্রিসা আবার দেয় কিন্তু এবারো অয়ন দেখেও ফোন রিসিভ করেনি।প্রিসার চোখে পানি জমতে শুরু করে,প্রিসা আবারো অয়নে ফোন দেয় কিন্তু এবার অয়নের ফোন বন্ধ বলছে।প্রিসা কোনবতে নিজের চোখের পানি গরিয়ে পরা থেকে আটকাচ্ছে।প্রিসা ওখান থেকে উঠে বাইরের দিকে চলে যাওয়ার জন্য বেরিয়ে পরে তবে শেষবারের মতো আরেকবার পেছনে ফিরে তাকাই কিন্তু যেটা দেখে তাতে প্রিসা আর নিজের চোখের পানি আটকে রাখতে পারেনি কারণ ওই মেয়েটা অয়নের হাতে হাত রেখে কথা বলছে।প্রিসা আর ওখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি।গাড়িতে প্রিসা চুপচাপ বসে থাকে কারণ এখন কান্না করলে ড্রাইবার বাসাই কাউকে না কাউকে বলে দেবে।বাড়িতে এসে প্রিসা সোজা ওয়াশরুমে চলে যায়,সাওয়ার ছেড়ে নিচে বসে পড়ে আর চিৎকার করে কান্না করতে থাকে।কেন যেন প্রিসার কান্না পাচ্ছে,প্রচুর কান্না পাচ্ছে।

প্রিসাঃকেন উনি আমার সাথে এরকম করছেন?কেন,কেন?কি করেছি আমি যে উনি আমাকে এভয়ড করছেন?আজকে কেন উনি আমার সাথে এরকম করলেন?কি হতো একবার ফোনটা তুললে?ফোনটা না ধরুক অন্তত একটা মেসেজ তো করতে পারতো।কিন্তু উনি,উনি তো ফোনটাই বন্ধ করে দিয়েছেন।(কান্না করতে করতে)

আরো কিছুক্ষণ সাওয়ারের নিচে বসে কান্না করে প্রিসা।

প্রিসাঃআচ্ছা এমনটাও তো হতে পারে মেয়েটা ওনার কোন ক্লাইন্ড।হয়তো ওনারা কোন মিটিং করার জন্য রেস্টুরেন্টে গিয়েছিল।আর কথা বলতে বলতে হয়তো মেয়েটা ওনার হাতে উপর ভুলে হাত রেখে দিয়েছে।হ্যাঁ এটাই হবে।ধুর আমিও না পাগলের মতো ওনাকে ভুল বুঝছিলাম।

প্রিসা সাওয়ার অফ করে ড্রেস চেঞ্জ করে বাইরে বেরিয়ে আসে।প্রিসার এখন মোটেও খাবার খাওয়ার ইচ্ছা নেই তাই সে না খেয়েই শুয়ে পড়ে।কিন্তু প্রিসা যতই এটা সেটা বলে নিজেকে বোঝাক না কেন কিন্তু তার মাথা থেকে বিষয়টা বেরই হচ্ছে না।যতবারই সে কিছুক্ষণ আগের ঘটনাটা মনে করছে ততবারই তার চোখ থেকে আপনা-আপনি পানি পড়ছে।এসবকিছু ভাবতে ভাবতে আর কান্না করতে করতে প্রিসা একসময় ঘুমিয়ে পরে।

রাতে,

প্রিসার কিছুই ভালো লাগছে না তাই সে মিলার কাছে যায়।মিলার রুমে এসে দেখে মিলা নেই,ওয়াশরুমের গিয়ে দেখে সেখানেও নেই।তাই প্রিসা বিছানায় বসে মিলার অপেক্ষা করতে থাকে।তখনই ফোনের আওয়াজ তার কানে আসে,তাকিয়ে দেখে মিলার ফোন বাজাচ্ছে।প্রিসা ধরতে চাইনি তাও কেন যেন ফোনটা তুললো।স্ক্রিনে লেখা ‘অয়ু’,প্রিসা কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করে কিন্তু রিসিভ করে যার গলা শুনতে পাই এতে প্রিসা প্রচুর অবাক হয়।কারণ ফোনের ওপাশের ব্যক্তিটি আর কেউ না বরং অয়ন।প্রিসা ফোনটা কান থেকে সরিয়ে স্ক্রিনে থাকা নামটা দেখে,এবার সে বুঝতে পেরেছে ‘অয়ু’ মানে কি।প্রিসা ফোনটা আবার কানে দেয়,ওপাশ থেকে অয়ন হ্যালো হ্যালো করেই যাচ্ছে।

অয়নঃহ্যালো মিলা,শুনতে পাচ্ছো?

প্রিসাঃহুম।

অয়নঃকি হয়েছে মন খারাপ?

প্রিসাঃউহু…..(কোনভাবে নিজের কান্না আটকে)

অয়নঃআচ্ছা বাবা সরি রাগ করো না আসলে মিটিং ছিলাম তাই ফোন করতে পারিনি।

প্রিসাঃহুম।

অয়নঃআচ্ছা এসব কথা ছাড়ো তুমি বাসাই বলেছো?

প্রিসাঃ(কি বলার কথা বলছেন উনি?— মনে মনে)

অয়নঃকি হলো?তুমি বাসাই আমাদের কথাগুলো বলেছো?

অয়নের এরকম কথাশুনে প্রিসার ভয় হতে থাকে।মুখে কোন কথাই বের হচ্ছে না,সে চাইছে অয়নের সাথে কথা বলতে কিন্তু কথা যেন গলাই আটকে রয়েছে।

অয়নঃহ্যালো মিলা?শুনতে পাচ্ছো?হয়তো শুনতে পাচ্ছে না,হ্যালো?

অয়ন ফোন কেটে দেয় কিন্তু প্রিসা এখনো ফোনটা কানের কাছে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আস্তে আস্তে ফোনটা সে নিচে নামাই।কি মনে করে যেন প্রিসা মিলার ফোন কল’স চেক করে।কিন্তু যেটা দেখে সেটা প্রিসা মোটেও আশা করেনি।অয়নের সাথে মিলার প্রায় প্রতিদিন কথা হতো,বেশিরভাগ কল তো অয়নই মিলাকে দিয়েছে।আর কথা বলার সময়ও অনেকটা বেশি প্রায় দশ-পনেরো মিনিট।প্রিসা মোবাইলটা রেখে চুপচাপ চলে আসে।নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ে।প্রিসার চোখ থেকে পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।মাথা ব্যথা করছে প্রিসার,প্রচুর মাথা ব্যথা করছে।তাই একটা মাথা ব্যথার ওষুধ আর একটা ঘুমের ঔষধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে প্রিসা।ঘুমানো আগে বলে এসেছে যাতে কেউ তাকে ডিস্টার্ব না করে।

পরেরদিন সকালে,

হালকা শোরগোলের আওয়াজে ঘুম ভাঙে প্রিসার।ফ্রেশ হয়ে দরজা খুলে বাইরে যায় কিন্তু বাইরে এসে যে এরকম কিছু দেখবে সেটা সে মোটেও আশা করেনি।

চলবে……

মেঘবতী পর্ব-১০

0

#গল্পঃমেঘবতী
#পর্বঃ১০
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

বেশ কিছুদিন পর,

ভার্সিটি থেকে এসে প্রায় ৫ মিনিট যাবত বেল বাজিয়ে চলেছে প্রিসা কিন্তু কেউ দরজা খুলছে না।তাই শেষে বাধ্য হয়ে ডুপ্লিকেট চাবি দরজা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে প্রিসা।ভেতরে ডুকে প্রিসা আরো অবাক হয় কারণ বাড়িতে কেউ নেই।

প্রিসাঃমা…..ভাইয়া……।(চিৎকার করে)

প্রিসা পুরো বাড়ি খুঁজে কাউকে পেলোনা।ব্যাগ থেকেই ফোন বের করে একে একে সবাইকে ফোন দেয় কিন্তু কেউ ফোন তুলছে না।কিছু একটা ভেবে প্রিসা পরের তালায় চলে যায়,মিলাদের বাসাই।এবার যেন প্রিসা আরো বেশি অবাক হয় কারণ মিলাদের দরজার সামনে তালা ঝুলছে।

প্রিসাঃএটা কি হলো?কোথাও কেউ নেই কেন?সকালে যে মা আর ভাইয়া বললো তারা আজকে বাড়িতে থাকবে কিন্তু এখন তাহলে নেই কেন?আর কেউ আমার ফোনও তুলছে না কেন?

এসব বিরবির করে নিজের রুমে চলে আসে প্রিসা।তারপর ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে আসে কিছু খাওয়ার জন্য।কিন্তু ড্রয়ংরুমে এসে তো প্রিসা ভুত দেখার মতো চমকে যায় কারণ সোফায় বসে পায়ের উপর পা তুলে ফোন টিপছে অয়ন।

প্রিসাঃএনি আবার কোথা থেকে এলো?আমি তো পুরো বাসা ঘুরে দেখেছি।কই তখন তো ওনাকে দেখতে পেলাম না।আচ্ছা উনি কি জাদু জানে নাকি?(বিরবির করে)

অয়নঃএতো ছোট মাথায় এতো বেশি চাপ নিওনা মেঘবতী আর আমি কোন জাদু জানিনা।তুমিই মেইন ডোর ওপেন করে চলে গিয়েছিলে রুমে।(ফোন টিপতে টিপতে)

প্রিসাঃ(উনি কিভাবে জানলেন আমি এসব ভাবছিলাম?উনি কি মনোবিজ্ঞানী নাকি?নাকি আসলেই জাদু জানে?— মনে মনে)

অয়নঃআমি কোন মনোবিজ্ঞানী বা জাদুঘর নয়।তোমার মুখের এক্সপ্রেশন আর তোমার চোখ দেখেই আমি বলে দিতে পারি তুমি কি ভাবছো,বুঝতে পেরেছো মেঘবতী।

প্রিসাঃও আচ্ছা(মাথায় হাত দিয়ে)।আচ্ছা আমার বাসার আর মিলা আপুর বাসার সবাই কোথাই?

অয়নঃআমি জানি না।অন্য আমায় ফোন করে বলেছে বাসাই আসতে কারণ তোমার নাকি একা থাকতে ভয় লাগে।

প্রিসাঃতা তো লাগেই।আচ্ছা আপনি কখন এসেছেন?

অয়নঃঅনেক আগে।

প্রিসাঃতাহলে আপনি কোথায় ছিলেন?আপনাকে তো বাড়ির ভেতরে কোথাও দেখতে পাইনি।

অয়নঃআমি ছাদে ছিলাম এতক্ষণ।ছাদে খুঁজলে তুমি আমাকে পেয়ে যেতে।

প্রিসাঃআচ্ছা তাহলে…..

অয়নঃএখন আর কোন কথা নয় মেঘবতী।এখন খাবার খেয়ে নাও পরে তোমার প্রশ্ন শুনবো।

প্রিসা আর কোন কথা না বাড়িয়ে রান্না ঘরে চলে যায়।সব রান্না করা ছিল বিদায় প্রিসাকে আর কোন ঝামেলা করতে হয়নি।দুটো প্লেট খাবার নিয়ে প্রিসা ড্রয়ংরুমে চলে আসে।ড্রয়ংরুমে এসে দেখে সোফায় হেলাম দিয়ে চোখ বন্ধ করে রেখেছে অয়ন।

প্রিসাঃউহু….উহু…..।

অয়নঃকি হয়েছে মেঘবতী?

প্রিসাঃএই নিন খাবার,খেয়ে নিন।

অয়নঃআমি খাবো না,তুমি খেয়ে নাও।(চোখ বন্ধ করে)

প্রিসাঃআপনাকে খেতেই হবে,দেখি ঠিক করে বসুন তো।

অয়ন উঠে না তবে চোখ খুলে প্রিসার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

প্রিসাঃকি হয়েছে?

অয়নঃভাবছি তুমি এখন থেকেই আমাকে এভাবে শাসন করছো,তাহলে বিয়ের পর কি করবে?

অয়নের কথায় প্রিসা লজ্জা পেয়ে যায়।এদিক-ওদিক থাকিয়ে তারপর আবার অয়নের দিকে তাকাই।

প্রিসাঃশুনুন আপনি খাবেন কিনা সেটা বলুন।প্লেট এখানে রাখছি খেলে খান না হলে ঘুমান।

অয়নঃআরে আমার মেঘবতী তো রাগ করেছে দেখছি।আচ্ছা ঠিক আছে দাও আমি খাচ্ছি।

প্রিসাঃঠিক আছে তবে আগে হাত ধুয়ে আসুন তারপর খাবেন।

অয়ন প্রিসার কথা বলার ধরণ দেখে মুচকি হেসে উঠে চলে যায় হাত ধোঁয়ার জন্য।এরপর দুজনে একসাথে খেতে বসে।খাওয়ার সময় কেউ কথা বলেনি কারণ দুজনেই টিভি দেখতে ব্যস্ত ছিল।খাওয়া শেষ হলে প্রিসা প্লেটগুলো পরিষ্কার করে আগের জায়গায় রেখে দেয়।বাইরে এসে দেখে অয়ন এখনও টিভি দেখছে।

অয়নঃমেঘবতী যাও কিছুক্ষণ রেস্ট নাও।বাইরে রোদটা কমলে বিকেলের দিকে আমরা ঘুরতে যাবো।

প্রিসাঃকিন্তু বাসায়….

অয়নঃসেটা নিয়ে তোমাকে চিন্তা করতে হবে না তুমি এখন ঘুমাতে যাও।

প্রিসাও আর কথা না বাড়িয়ে রুমে যেয়ে শুয়ে পড়ে।বিকেলের দিকে অয়নের ডাকে তার ঘুম ভাঙে।অয়নের কথামত উঠে ফ্রেশ হয়ে তৈরি হয়ে নেয় প্রিসা।তারপর দুজনে মিলে ঘুরতে যাওয়ার জন্য বের হয়।

প্রিসাঃঅয়ন ভাইয়া গাড়ি নেবেন না?

অয়নঃনা।

প্রিসাঃকেন?

অয়নঃকারণ আজকে আমি আমার মেঘবতীর সাথে রিকশা চড়ে ঘুরবো।(মুচকি হেসে)

অয়নের কথায় প্রিসা আবার লজ্জায় পড়ে যায়।এরপর একটা রিকশায় উঠে তারা।প্রিসা যথাসম্ভব অয়নের কাছ থেকে দুরত্ব বজায় রাখতে চেষ্টা করছে,অয়নও বুঝতে পারছে সেটা।তাই সেও যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রেখেই বসেছে।কিছুক্ষণ পর একটা পার্কের সামনে এসে রিকশাটা থামে।রিকশা থেকে নেমে পার্কের ভিতরে গিয়ে একটা বেঞ্জ এ বসে তারা।আশেপাশে কিছু বাচ্চা খেলাধুলা করছে আবার কেউ এমনিতেই এসেছে নয়তো প্রিয় মানুষের সাথে দেখা করতে এসেছে।

অয়নঃএই নাও মেঘবতী বাদাম খাও।

প্রিসা বাদামের প্যাকেট টা অয়নের হাত থেকে নিয়ে তারপর অয়নকে প্রশ্ন করে—

প্রিসাঃআচ্ছা আপনি আমাকে মেঘবতী ডাকেন কেন?

অয়ন প্রিসার কথা শুনে মুচকি হেসে তার দিকে তাকাই।

অয়নঃবলবো একসময় তবে এখন না।

প্রিসাঃকেন?এখন কেন নয়?

অয়নঃকারণ এখন সেই মুহুর্তটা নয়।

প্রিসা আর কিছু না বলে চুপচাপ বাদাম খেতে থাকে।সে বুঝতে পারছে অয়ন তার দিকে এখনো তাকিয়ে আছে তবুও সে কিছু বলছে না।

অয়নঃআই লাভ ইউ মেঘবতী।

অয়নের কথা শুনে প্রিসা বাদাম চিবোনো বন্ধ করে দেয়।তার হার্ট এখন এতো জোরে বিট করছে মনে হচ্ছে কেউ ড্রাম বাজাচ্ছে।প্রিসা অয়নের দিকে তাকাই।প্রিসার তাকানোর পর অয়ন মুচকি হেসে সামনের দিকে তাকাই।প্রিসাও আর কথা না বাড়িয়ে বাদাম চিবোতে থাকে।

প্রিসা অয়নকে ভালোবাসে কিনা জানে না তবে তার অয়নকে ভালোলাগে।অয়ন তার আশেপাশে থাকলো সবকিছু তার ভালোলাগে,অয়নে কথা শুনলে তার হার্টবিট বেড়ে যায়,এছাড়াও আরো অনেক কিছু।কিন্তু প্রিসা জানেনা এটা আদৌও ভালোবাসা নাকি শুধু ভালোলাগা।

আরো কিছুক্ষণ বসে থেকে তারা দুজন বাড়িতে চলো আসে।বাড়িতে এসে প্রিসা যেন আকাশ থেকে পড়লো কারণ যাওয়ার সময় পুরো বাসা খালি ছিল কিন্তু এসে দেখে পুরো বাসাই মানুষ ভর্তি মানে সবাই ফেরত চলে এসেছে,এমনকি তার মামা-মামী আর সায়নও আছে।অয়নের সাথে প্রিসাকে দেখে সায়ন কিরকম করে যেন তাদের দিকে তাকাই,প্রিসা সেটা খেয়াল করেছে কিন্তু ওতোটা পাত্তা দেয়নি।প্রিসা সবার থেকে জিজ্ঞেস করছে তারা এতোক্ষণ কোথায় ছিল কিন্তু আশ্চর্যের ব্যপার কেউ থাকে কিছু বলছে না উল্টো তাকে এড়িয়ে চলছে।প্রিসা খেয়াল করে দেখে সবাইকে অনেক খুশি খুশি লাগছে,তারা কোন একটা বিষয়ে নিজেদের মধ্যেই কথা বলছে কিন্তু প্রিসাকে দেখলেই তারা চুপ হয়ে যাচ্ছে নয়তো কথা ঘুরিয়ে ফেলছে।প্রিসার কেন যেন এবার সন্দেহ হয়ে লাগে।

প্রিসাঃকি হলো সবাই এরকম করছে কেন?আচ্ছা ওরা কি আমার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছে?কিন্তু কি লুকাবে তারা আমার কাছ থেকে?(মনে মনে)

চলবে……

মেঘবতী পর্ব-০৯

0

#গল্পঃমেঘবতী
#পর্বঃ০৯
#লেখিকাঃঅনন্যা_অসমি

বিকেলে স্মিতা প্রিসার বাসাই চলে আসে।দুজনেই কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা হয়ে যায়।স্মিতা চলে যাবে তখনিই প্রিসার মনে পড়ে সকালে স্মিতা ফোনে তাকে বলেছিস যে সে কিছু বলবে।

প্রিসাঃস্মিতা শোন।

স্মিতাঃকি হয়েছো?শুন আজ আরো গল্প করলে লেট হয়ে যাবে।লেট হলে কালের ভার্সিটির পড়া কমপ্লিট করতে পারবো না।

প্রিসাঃআরে বাবা দাঁড়া দাঁড়া,আগে শুনে তো নে আমি কি বলছি।

স্মিতাঃআচ্ছা বল।

প্রিসাঃআমি কি বলবো,তুই না বলবি।সকালে ফোনে বললি না কি যেন বলবি সেটা তো বলিস নি।

স্মিতাঃসকালে….. ও আচ্ছা আমি তো একদমই ভুলে গিয়েছিলাম।শুন তোকে যেটা এখন বলবো না সেটা শুনে তুই তো ভাবতে ভাবতে পাগল হয়ে যাবি।

প্রিসাঃকি এমন কথা যেটা শুনে আমি ভাবতে ভাবতে পাগল হয়ে যাবো?

স্মিতাঃতাহলে শুন,এইদিন ওই শুভ না অশুভ তোর কাছে এসেছিল না।

প্রিসাঃশুভ!তো কি হয়েছে?তোকে কি কিছু বলেছে?এই তোর সাথে কিছু করেছে কি?স্মিতা ও যদি তোকে কিছু করে বা বলে থাকে প্লিজ আমাকে বল।(কিছুটা চিন্তিত হয়ে)

স্মিতাঃআরে বাবা শান্ত হয়,শুভর এতো সাহস আছে নাকি আমার সাথে কিছু করার আর শুভ আমাকে কিছু বলেনি।আসলে ওর সাথে তো আমার দেখাই হয়নি।

প্রিসাঃতাহলে?

স্মিতাঃকিন্তু শুভর একটা খবর পেয়েছি।

প্রিসাঃকি?

স্মিতাঃকালকে রাতের আঁধারে কেউ ওকে”……” মেরে ফেলে রেখে গিয়েছে।পুরোপুরিভাবে মারা যায়নি তবে অনেকটাই জখম হয়ে আর ডানহাতটা তো পুরোটাই ভেঙে গিয়েছে।

প্রিসাঃকি!কিসব বলছিস তুই?আর এসব তুই কিভাবে জেনেছিস?

স্মিতাঃআমি যা বলছি একদম ঠিক বলছি।শুভকে যেখানে পাওয়া গিয়েছে ওই জায়গাটা আমাদের বাসার কাছেই।আর তুই তো জানি আকথা-কুকথা বাতাসের থেকেও তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পরে।এই কথাটাও ছড়িয়েছে আর আমার কানেও এসেছে।পরে খোঁজ খবর করে জানতে পারি ওটা আর কেউ না ওই শুভ অশুভ।

প্রিসাঃও আচ্ছা।

স্মিতাঃকিন্তু ওই ব্যাটাকে মারলোটা কে?

প্রিসাঃজানিনা।

স্মিতাঃতা যেই মারুক না কেন একদম ঠিক করেছে,বেয়াদব শয়তান একটা।যাইহোক আমি এবার আসছি,ভালো থাকিস আর নিজের খেয়াল রাখিস।

প্রিসাঃতুইও।

স্মিতা চলে যায়।স্মিতা চলে যাওয়ার পর প্রিসা শুয়ে পরে আর চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকে —-

প্রিসাঃকে মারতে পারে শুভকে?অয়ন ভাইয়াই বা কালকে আমাকে ওভাবে মারলো কেন?আবার পরে নিজেই ঔষধ ও খাওয়ালো।কি করেছিলাম যার জন্য উনি এভাবে আমাকে মেরেছে?

চোখবন্ধ করে এসব ভেবে চলছে,প্রিসা হঠাৎ প্রিসার মনে হতে থাকে কেউ তাকে দেখছে,খুব কাছে থেকে কেউ থাকে দেখছে।প্রিসা তাড়াতাড়ি উঠে বসে।উঠে যাকে দেখে তাতে তো প্রিসা অবাক না অনেক বেশি অবাক হয়।

প্রিসাঃঅয়ন ভাইয়া।(অস্ফুট স্বরে)

প্রিসা কোনদিনও আশা করেনি এভাবে মারার পর অয়ন তার কাছে আসবে।প্রিসা অয়নের ভালো করে দেখে চুলগুলো এলোমেলো,চোখের নিচে কালি পড়ে গিয়েছে,চোখগুলোও ফোলা ফোলা।

প্রিসাঃ(অয়ন ভাইয়ার চোখগুলো এরকম কেন?উনি কি রাতের ঘুমান না নাকি?আচ্ছা উনি কি কান্না করেছেন?— মনে মনে)অয়ন ভ…..

প্রিসা আর কিছু বলবে তার আগেই অয়ন তাকে জরিয়ে ধরে।হঠাৎ এরকম কিছু হওয়ায় প্রিসা ঘাবড়ে যায় কিন্তু চুপচাপ বসে থাকে।কিছুক্ষণ পর প্রিসা হালকা হালকা ফোঁপানোর আওয়াজ পাই।প্রিসা বুঝতে পারে অয়ন কান্না করছে।

প্রিসাঃআরে অয়ন ভাইয়া আপনি কান্না করছেন কেন?

অয়ন প্রিসাকে জরিয়ে ধরেই বলতে শুরু করে—

অয়নঃআই এম সরি মেঘবতী,আই এম রিয়েলি সরি।আমি তোমাকে এভাবে কষ্ট দিতে চাইনি কিন্তু কি করবো বলো তোমাকে অন্য কারো সাথে দেখে আমার ভিষণ রাগ হয়েছিল।জানো এইদিন যখন তুমি ওর সাথে রাস্তায় দাঁড়িয়ে কখা বলছিলে আমার ভিষণ কষ্ট হয়েছিল।তারপর ও যখন তোমাকে প্রপোজ করে সেটা দেখে আর নিজে সামলাতে পারিনি।আমি এতটাই রেগে গিয়েছিলাম যে আশেপাশের সবকিছু ভুলে গিয়েছিলাম,রাগে অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম।তোমাকে ওই ভাবে মারার আমার কোন ইচ্ছা ছিল না কিন্তু কিভাবে যে কি হয়ে গেলো।আই লাভ ইউ মেঘবতী,আই রিয়েলি লাভ ইউ।

প্রিসা এতক্ষণ চুপ করে কিছু একটা ভাবছিল।তারপর অয়নকে বলে—-

প্রিসাঃঅয়ন ভাইয়া ছাড়ুন।

অয়ন প্রিসাকে ছেড়ে দেয়।প্রিসা কিছুক্ষণ অয়নের দিকে তাকিয়ে তার হাত দুটো সামনে আনে।দুটো হাতেই বেশ অনেকখানি চোট লেগেছে।প্রিসা আবার একপলক অয়নের দিকে তাকিয়ে পাশের টেবিল থেকে ফার্স্ট এড বক্সটা নেয়।অয়নও কিছু বলছেনা,সে চুপচাপ তার মেঘবতীর কাজগুলো দেখছে।প্রিসা ফার্স্ট এড বক্স থেকে সেভলন বের করে কেটে যাওয়া জায়গাগুলো পরিষ্কার করে তারপর তাকে মলম লাগাতে থাকে।

প্রিসাঃআপনিই মেরেছেন না মিস্টার শুভকে?(মলম লাগাতে লাগাতে)

প্রিসার মুখে শুভর কথা শুনে অয়ন রেগে যায়,তাও কোনভাবে নিজের রাগটাকে কনট্রোল করে সে।

অয়নঃকিসব বলছো তুমি?কে বলেছে তোমাকে এসব?

প্রিসাঃবলেছে কেউ।এবার আপনি বলুন যে বলেছে তার কথা কি ঠিক নাকি ভুল?

অয়নঃহ্যাঁ আমিই মেরেছি,তো?সে আমার মেঘবতীর দিকে চোখ তুলে তাকাবো,তাকে প্রপোজ করবে,তাকে আমার থেকে কেড়ে নেবে আর আমি বসে বসে তা দেখবো।

প্রিসা অয়নের কথাই অবাক হয় কারণ প্রিসা আন্দাজে কথাটা বলেছিল কিন্তু ভাবতে পারেনি কাজটা আসলে অয়নই করেছে।মলম লাগানো শেষ হলে অয়নের হাতে ব্যান্ডেজ করে দেয় প্রিসা।
তারপর সবকিছু গুছিয়ে সরিয়ে রেখে অয়নের দিকে তাকাই।

প্রিসাঃমেঘবতীটা কে?

অয়নঃমেঘবতী?আমার সামনে এখন যে বসে আছে সেই আমার মেঘবতী।(হালকা হেসে)

আজ প্রিসা শুধু অবাকে উপর অবাক হচ্ছে।অয়নের কথাটা শুনে প্রিসার হার্টবিট বেড়ে যায় তাও নিজেকে যথাসম্ভব শান্ত রাখার চেষ্টা করছে সে।

প্রিসাঃশুনুন অয়ন ভাইয়া,এটা কোন নাটক বা সিনেমা নয় এটা রিয়েল লাইফ।তাই আমাদের সবকিছু বুঝে শুনে করতে হয়।আপনার কি দরকার ছিল শুধু শুধু মিস্টার শুভ কে এভাবে মারার?

অয়নঃমেঘবতী আমি তোমার মুখ থেকে ওই রাসকেলটা ব্যাপারে আর কিছু শুনতে চাইছি না।(গম্ভীরভাবে)

প্রিসা বুঝতে পেরেছে এখন কিছু বললেই ঝামেলা আরো বাড়বে তাই চুপ করে গিয়েছে।

প্রিসাঃআপনি বলেছেন না আপনি মিস্টার শুভর সাথে আমাকে কথা বলতে দেখেছেন?

অয়নঃহুম।(গম্ভীরভাবে)

প্রিসাঃতাহলে ওইদিন আপনি ওখানে কি করছিলেন?

অয়নঃওই আসলে…. এটার জন্য গিয়েছিলাম।

একটা কাগজ প্রিসার সামনে এগিয়ে দেয়।কাগজটা দেখে প্রিসা মাথা নিচু করে ফেলে।অয়ন মুচকি হেসে প্রিসাকে বলে—-

অয়নঃএটা তুমিই আমার রুমে রেখেছো তাই না?

প্রিসাঃহুম।

আসলে এইদিন প্রিসা অয়ন আর সায়নের রুমে যে কাজটা রেখে এসেছিল সেটাতে অয়ন আর সায়নের স্কেচ ছিল,যেটা প্রিসা নিজের হাতে ড্র করেছিল।

অয়নঃআই লাভ ইউ মেঘবতী।

প্রিসা চমকে অয়নের দিকে তাকাই কিন্তু মুখে কিছু বলেনা।

অয়নঃকি হলো?জবাব দাও।

তবুও প্রিসা কিছু না বলে অয়নের দিকে তাকিয়ে আছে।

অয়নঃশোনো আমি আমাকে ভালোবাসো আর না বাসো এতে আমার কিছু যায় আসেনা।আমি তোমাকে ভালোবাসি এটাই অনেক।আমার শুধু তোমাকে চাই।আমার সুখে,দুঃখে,আমার জীবনের প্রতিটা মুহূর্তে তোমাকে আমার পাশে চাই,আমার মেঘবতী কে আমার পাশে চাই,এতেই আমার হবে।আসছি,পরে আবার দেখা হবে।

এটা বলেই প্রিসার কপালে একটা কিস করে চলে যাই অয়ন।এদিকে এসব কিছু এতক্ষণ বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে দেখেছে একজন।কেউ তাকে দেখার আগে সেই ব্যক্তিটি সেখান থেকে চলে যায়।

এদিকে,অয়ন চলে যাওয়ার পর বালিশে মুখ গুজে শুয়ে পরে প্রিসা।এতক্ষণ তার দম বন্ধ হয়ে আসছিল।প্রিসা উঠে আস্তে আস্তে বারান্দায় চলে যায়।আকাশের দিকে তাকিয়ে অয়নের কথাগুলো ভাবছিল আর একটা শব্দই বারবার আওরা ছিল।

প্রিসাঃ”মেঘবতী”

চলবে……….