তৈমাত্রিক পর্ব-১১+১২+১৩

0
1050

#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ১১

💙🌸
.
.
.
.

মেহরাম সোহেলের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সোহেল যেন ভাবতেই পারছে না যে সে এইমাত্র কি শুনেছে। সে মুখ ঘুড়িয়ে ডান হাত দিয়ে মাথায় কিছুটা স্লাইভ করে নিলো। ঘুড়ে গিয়ে মেহরামের থেকে কিছুটা দূরে সরে দাড়ালো। পরক্ষণেই আবার হুট করেই মেহরামের কাছে এসে অবাক হয়ে বলতে থাকে…

সোহেল;; মা মামানে, তুতুমি প্রেপ্রেগন্যান্ট। মেহরু আমার না কেমন বিশ্বাসই হচ্ছে না। আমাকেও কেউ বাবা বলে ডাকবে। মানে আমার ভাষা নেই আমি কি করে বলবো কি করে বুঝাবো। তুমি, তুমি আগে কেন বলোনি (মেহরামের গাল ধরে)। মা পর্যন্ত আমায় বলে নি। আমি পাগল না হয়ে যাই এখন।

মেহরাম;; আমি নিজেই ধারণা করতে পারিনি যে টেস্ট করানোর পর এমন একটা কিছু হবে।

সোহেল;; মেহরাম তুমি, তুমি হ্যাপি তো??

মেহরাম;; হ হ হহ্যাঁ, আমি হ্যাপি।

সোহেল;; তোমার তো পড়াশোনা করার ইচ্ছে ছিলো তাই না। এখনই বাচ্চা। মানে ভেবে দেখতে পারো মেহরাম।

মেহরাম;; না, আমি ভেবেছি। আমার নিজের লাইফের কথা ভেবে আমি আরেকটা জীবন নষ্ট করতে পারি না। এ কেমন কথা। এই বাচ্চাটা আমার চাই, আমার লাগবে।

সোহেল;; দেখো মেহরু বাচ্চা তোমার একার না আমারও। As a would be Father আমার হ্যাপি হওয়াটা নরমাল। কিন্তু সবার আগে তুমি, বাকি সবার কথা ভেবে তুমি নিজের টা ভাববে না তা হয় না। তো পুরোপুরি তোমার ইচ্ছের ওপর ডিপেন্ড করে।

মেহরাম;; আমি সিওর আমার বাচ্চাটা চাই।

সোহেল মুচকি হেসে মেহরামকে জড়িয়ে ধরে। তবে সত্যি বলতে মেহরামের ভেতরে কিছুই শান্ত নেই। তার ভেতরে শুধু ঝড় বয়ে যাচ্ছে। বারবার নিজের গলা শুকিয়ে আসছে। না চাইতেও কেন যে আয়ুশের কথা টা মাথায় বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে তার। সোহেল মেহরাম কে বলে ফ্রেশ হতে চলে যায়। তারপর ধীরে ধীরে নিচে নেমে পরে। নিচে নামতেই কুসুম বেগম মেহরামের কাছে যায়।

কুসুম;; কিরে সোহেল কে বলেছিস?

মেহরাম;; হ্যাঁ মা বলেছি।

কুসুম;; শুনে কি বললো?

মেহরাম;; উনি অনেক বেশি খুশি।

কুসুম;; খুশি আবার হবে না। আচ্ছা তুই বোস আয়। বাড়িতে ফোন দিবো?!

মেহরাম;; হুম দাও।

কুসুম বেগম খুশিতে গদগদ হয়ে আগে মেহরামের বাপের বাড়িতে ফোন দিলো। ফোন দিতেই মেহরামের মা ধরে।

কুসুম;; আসসালামু আলাইকুম আপা কেমন আছেন?

কনিকা;; ওয়ালাইকুম সালাম, জ্বি আলহামদুলিল্লাহ আপা ভালো আছি। এতো দিন পর আমাদের কথা মনে পরলো। ফোনই তো দেনই না। বাসায় সবাই কেমন আছে ?

কুসুম;; জ্বি আপা সবাই বেশির থেকেও একটু বেশি ভালো।

কনিকা;; বাব্বাহ, তা কারণ?

কুসুম;; কারণ এই যে হাতে বেশি সময় নেয়। আপনি নানুআপু হচ্ছেন আর আমি দিদুন।

কনিকা;; জ্বি আপা মানে। (অবাক হয়ে)

কুসুম;; মানে আপনি যা ধরেছেন তাই।

কনিকা;; ককি মেহরু আমার, আমার মেয়ে প্রেগন্যান্ট। আপা মানে সত্যি তো। আল্লাহ এতো একটা খুশির খবর। আমি কি করবো বুঝতেই পারছি না।

কুসুম;; আপাদত নিজের মেয়ের সাথে কথা বলুন।

কনিকা;; জ্বি।

মেহরাম;; হ্য হ্যালো মা।

কনিকা;; মারে কি খবর শুনালি এটা। আমাদেরও ঘর আলো করে একটা ছোট্ট প্রাণ আসবে।

মেহরামের আম্মুর এমন হাসি+কান্না মিশ্রিত কন্ঠ শুনে সবাই তার কাছে আসেন। একে একে সবাই জানে মেহরামের বেপার টা। কারো খুশি যেন এখন ধরে না। তবে আকাশ কাদছে। এই ভেবে যে তাকে কেউ মামা বলে ডাকবে। কিন্তু সে এতো ছোট বয়সে মামা হতে চায় না 😅। মেহরামকে বলেছে যে সে তো এতোদিন রিকশাওয়ালা মামা, দারোয়ান মামা, ফুচকাওয়ালা মামা কেই মামা ডেকেছে এখন তাকে কেন মামা ডাকবে। মেহরাম তার কথা শুনে হাসে। তবে মেহরাম তাদের বলেছে যে তনু কে যেন তারা কিছুই না বলে মেহরাম নিজে বলবে তাকে। বাড়ির সবার সাথে অনেক কথা হয় মেহরামের। তবে তার চাচির সাথে কথা বলতে আজ কেন যেন মেহরামের একটু বাধছে। এটা কখনো হয় নি তার, কখনোই না। কিন্তু আজ কেন! ফোন তার চাচির কাছে দিলে তার চাচি সোজা হুহু করে কেদে ওঠে।

মেহরাম;; চাচি কথা বলো।

আতিয়া;; কি কি বলবো আমি। আমার তো খুশিই শেষ হচ্ছে না। (কেদে)

মেহরাম;; চাচি।

আতিয়া;; কে বলেছে যে আমার, আমার একটা মেয়ে আমার দুইটা মেয়ে। আর আমার নাতনিও আছে। আমার সবকিছু আছে।

মেহরাম বুঝতে পারলো যে তনুর মা না হতে পারার বেপার টা তার চাচির মাথা নাড়া দিয়ে উঠেছে। মেহরাম আর তনু কে কখনো আলাদা করে দেখেনি কেউই। কিন্তু তনুর বেপারের দুঃখ টা কোথাও না কোথাও চেপে রেখেছে। যা মেহরাম বুঝতে পারলো।
বাড়ির লোকদের সাথে অনেকক্ষণ কথা হয়, সোহেলের সাথেও তাদের অনেক আলাপ হয়েছে। শেষে ফোন কেটে দেয়। তারপর মেহরাম ফোন হাতে নিয়ে বাইরে বারান্দায় চলে যায়। তনুর ফোনে ফোন দিয়েছে। দুইবার বেজে ফোন কেটে যায়। এতে মেহরাম কিছুটা কপাল কুচকায়। কেননা তনুকে ফোন করার সাথে সাথেই সে ফোন ধরে। আরেকবার ফোন দেওয়াতেই তনু ফোন টা হাতে নেয়।

তনু;; হ্যালো।

মেহরাম;; কিরে কোথায় ছিলি ফোন দিচ্ছি তো।

তনু;; আরে ওইতো একটু কাজ ছিলো রে। কিন্তু এখন নেই এবার বল।

মেহরাম;; তনু,।

তনু;; হুম হুম কি হলো বল।

মেহরাম;; আমি প্রেগন্যান্ট।

তনু;;____________

মেহরান;; তনু।

তনু;; ____________

মেহরাম;; ওইই।

তনু;; তুই না মানে প্রেগন্যান্ট। আল্লাহ বইন এইটা কি শুনাইলি। সত্যি। মানে আমি, আমি খালামনি হবো। কিন্তু কেউ তো আমাকে বলেইনি কিছু। আর তুই কবে জানতে পেরেছিস। আগে বলিস নি কেন আমায়।

মেহরাম;; আরে আস্তে তো। এমন পাগল হলি কেন।

তনু;; হবো না। আমার তো মানে আমি কি করি, তুই মেহরু, মেহরু তুই মা হবি। বুঝতে পারছিস বেপার টা।

মেহরাম;; হ্যাঁ (মাথা নিচু করে)

তনু;; আরে আরে গলা এমন ফ্যাকাশে হয়ে গেলো কেন। কি হলো? তুই খুশি না!

মেহরাম;; আরে না তেমন না আমি অনেক খুশি।

তনু;; আর তার থেকেও আমি অনেক খুশি, আমার বোন প্রেগন্যান্ট। আমি ভাবতেও পারছি না। আমি তোকে বলতে পারবো না মেহরু আমি কতো টা খুশি।
বাড়ির সবাইকে বলতে হবে। আমি তো হুমড়ি খেয়ে পরবো। এই শোন আমি আজ আসবো তোর কাছে।

মেহরাম;; সত্যি?

তনু;; হ্যাঁ তিন সত্যি।

মেহরাম;; জলদি আসবি কিন্তু আর কণা কে নিয়ে আসিস। মেয়েটাকে অনেক দিন দেখি না।

তনু;; আচ্ছা আচ্ছা, শোন এবার রাখি বাসার সবাইকে বলতে হবে।

মেহরাম;; আচ্ছা আর আস্তে।

তনু ফোন কেটেই দেয় এক দৌড়। মেহরাম প্রথমে ভেবেছিলো যে তনুকে কি করে এই কথা টা বলবে। যদি তনু মন খারাপ করে বা মন ভার করে রাখে। কিন্তু মেহরামের ভাবনা কে পাল্টে দিয়ে তনু উল্টো খুশি। তাকে দেখে কেউ ভাববে যে মেহরামের থেকে সে বেশি খুশি হয়েছে এতে। তনু দৌড়ে সিড়ি দিয়ে নেমে তার শাশুড়ীর কাছে চলে যায়।

তনু;; মা মা মা,

লায়লা;; আরে পাগলি আস্তে ব্যাথা পাবি তো।

তনু;; আরে পেলে পেলাম। মা আমার বোন প্রেগন্যান্ট।

লায়লা;; কিহ মেহরাম?

তনু;; হ্যাঁ।

লায়লা;; আলহামদুলিল্লাহ,

কণা;; কি কি ভাবী মেহরুপু কনসিভ করেছে?

তনু;; হ্যাঁ।

কণা;; আল্লাহ, কি বলো।

তনু;; আমি না এখানে পরে যাবো খুশিতে।

বাড়িতে সবাই অনেক খুশি হয়েছে মেহরামের খবর শুনে। মেহরামের বাবার বাড়িতে, নিজের শশুড় বাড়িতে আর তনুর বাড়িতে যেন এক প্রকার খুশির ধুম পরে গেছে। সোহেলের যেন বারবার চোখ ভিজে আসছে। সোহেল আর তার মা হলরুমে বসে বসে কথা বলছে। কুসুম বেগম সোহেল কে কড়া অর্ডার দিয়েছেন যেন এই দিন গুলোর মাঝে মেহরামকে কোথাও একা না ছাড়ে। সবসময় তার সাথে থাকতে। এতে যদি চাকরি যায় যাক। কিন্তু মেহরামের সাথে থাকতে হবে। মেহরাম তাদের কাছ থেকে বলে কিছু কাজের ছুতো দিয়ে নিজের রুমে আসে। এসেই ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দেয়। দম যেন এতোক্ষণ আটকে আসছিলো তার। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। মাথা সাথে সাথে কিছুটা চক্কর দিয়ে উঠলে হাতের পাশে থাকা টেবিল টা ধরে কোন রকমে। কেন যে এমন হচ্ছে নিজের সাথে মেহরাম তা বুঝতে পারছে না। নিজের চোখের সামনে বারবার আয়ুশের মুখ টা ভেসেভেসে আসছে। ওই আয়ুশের তাকে জড়িয়ে ধরা, কপালে চুমু আকা, একসাথে হাসা, কতোই না গল্প করা। আয়ুশের সেই হুটহাট করেই ডাক দিয়ে ওঠা “মেহরু”। আয়ুশ যখন সিরিয়াস থাকতো তখন শুধু তার পুরো নাম ধরে ডাকতো। নতুবা না। মেহরাম ধপ করে নিচে বসে পরে। আর পারে না সে। সবার সামনে খুশি থাকতে থাকতে আর পারে না। আয়ুশের কথা তার খুব মনে পরছে। কিন্তু মুখ ফুটে তা তো আর কাউকে বলতে পারে না। ঘরের এক কোণে নিজেকে একদম গুটিয়ে রেখে মেহরাম অঝোরে কাদছে। ওদিকে তনু এবার তার রুমে চলে যায়। কাজ করতে করতে হঠাৎ তার মনে পরে যে সবাইকেই মেহরামের বেপারটা জানানো হয়েছে কিন্তু আয়ুশকে না। তনু ফোন টা হাতে তুলে নেয়।

তনু;; ধুর মনেই ছিলো না, আয়ুশকে তো বলাই হয় নি। (ফোন দিতে দিতে)

আজ অফিসে তেমন কোন কাজ নেই। যা মিটিং ছিলো তা সব আগেই কমপ্লিট হয়ে গেছে। আয়ুশ অফিসের করিডরে দাঁড়িয়ে ছিলো। এখানে খোলা বাতাস আছে, অন্যান্য দিনের থেকে আজ একটু বেশিই বাতাস। বাতাসে আয়ুশের ওপরের চুল গুলো উড়ে উড়ে যাচ্ছে। একদম ফরমাল গেটাপে দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ তার ফোন বেজে ওঠলে তা হাতে নেয়। নিয়ে দেখে তনুর ফোন সে রিসিভ করে।

আয়ুশ;; হ্যালো তনু।

তনু;; হ্যাঁ আয়ুশ কি করছো?

আয়ুশ;; কিছুনা এমনি দাঁড়িয়ে আছি। তুমি কি করো?

তনু;; আমিও কিছুই না তবে নাচতে মন চাইছে।

আয়ুশ;; হাহা তাই। আচ্ছা নাচো। কিন্তু কোন খুশিতে?

তনু;; গেস করো তো?

আয়ুশ;; আমি কিভাবে গেস করবো। তুমি বলো?

তনু;; আয়ুশ আয়ুশ তুমি বিশ্বাস করতে পারবে না। আমার খুশির আজ কোন কুল কিণারা নেই।

আয়ুশ;; তনু হয়েছে কি?

তনু;; আয়ুশ মেহরাম প্রেগন্যান্ট।

আয়ুশ;; _________________

তনু;; তুমি জানো মেহরাম আমাকে ফোন করেছিলো বলেছে সে প্রেগন্যান্ট, আমার মা বড়মা বাবা তারা যে কত্তো খুশি আয়ুশ তুমি ভাবতেও পারবে না। মা কণা বাবা ওরাও অনেক খুশি। আর সোহেল ভাই উনি তো পারছেন না কেদে দিতে। কিন্তু আসলে কি আর্মি তে কাজ করেন তো এর জন্যই আরো বেশি শক্ত পক্ত। কিন্তু এমনি অনেক ভালো একজন মানুষ। আচ্ছা শুনো তুমি জলদি এসে পরো না। আজ আমি মেহরামের বাসায় যাবো একটু, কণা আর মা কেও নিয়ে যাবো। বাবা তো বাইরে গেছেন। শুনো তুমি জলদি এসে পরো তোমাকেও সাথে নিয়ে যাবো।

আয়ুশ;; ____________________

তনু;; হ্যালো আয়ুশ…

আয়ুশ;; আব..হ্য হ্য হ্যাঁ শুনছি আমি।

তনু;; কোথায় হারিয়ে গেলে। কি বলেছি শুনেছো?

আয়ুশ;; হ্য হ্যাঁ শুনেছি, আর আমি না আসলে যেতে পারবো না তুমি মাকে আর কণাকে নিয়ে চলে যাও।

তনু;; কিন্তু চলো গিয়ে ঘুড়ে আসি ভালো লাগবে।

আয়ুশ;; তনু মানে বলছিলাম কি যে আমায় না এদিক টা সামলাতে হবে বুঝলে। তুমি চলে যাও।

তনু;; আচ্ছা তাহলে থাকো।

আয়ুশ;; আচ্ছা।

তনু ফোন কেটে দেয়। তনুর গলা শুনেই বুঝা যাচ্ছিলো যে সে কতো খুশি নিজের বোনের জন্য। আয়ুশ ফোন টা কেটে দিয়েই অন্য পাশে মুখ করে নেয়। কিছুটা এগিয়ে গিয়েই করিডরের রেলিং-এ হাত দিয়ে কিছুটা ঝুকে দাঁড়ায়। কয়েক সেকেন্ড এভাবে থেকে আবার সোজা হয়ে দাঁড়ায়। দুইহাত দিয়ে চোখ মুখ সব চেপে ধরে। মাথা যেন পুরো হ্যাং মেরেছে। কাজ করাই বন্ধ করে দিয়েছে। আয়ুশ তার কেবিনে চলে যায়। বাইরে মেনেজার কে বলেছে আগামীকাল দুই ঘন্টা যেন তার কেবিনে কেউ না প্রবেশ করে। আয়ুশ তার চেয়ারে বসে আছে দুইহাত এক করে। এসি ফুল স্পিডে দেওয়া আছে, এখন এই রুমে যে কেউ ঢুকলেই ঠান্ডায় বরফ হয়ে যাবে কিন্তু তবুও যেন আয়ুশের ভালো লাগছে না। দরদর করে ঘেমে যাচ্ছে। এসির রিমোট টা নিয়ে আরো পাওয়ার বাড়াতে চাইলে দেখে যে লাস্ট পাওয়ার এটাই আর নেই। রাগে আয়ুশ এসির রিমোট টাই এক আছাড় মেরে ভেংে ফেলে। তারপর দুই হাত দিয়ে নিজের মাথা চেপে বসে পরে। কয়েক মিনিট এভাবে থেকে হঠাৎ ঢুকরে কেদে ওঠে আয়ুশ।

আয়ুশ;; আমি তো এমন টা চাইনি। যা হচ্ছে, যেমন হচ্ছে এইসবের কিছুই না ই আমি আশা করেছিলাম আর না ই চেয়েছিলাম। মেহ..মেহরাম পপ্রেপ্রেগন্যান্ট। আমাকে ছাড়া অনেক খুশি আছো তাই না মেহরু, আর থাকবেই তো। আমি কে ছিলাম কি ছিলাম এগুলো কিছুই না। আর এখন অন্য কারো বউ, আমার অধিকার নেই। কিন্তু কি করবো আমি ভুলতে পারি না, পারবো না।

আয়ুশ এইসব বলে একদম আহাজারি করে কাদছে। আর এদিকে মেহরামের চোখ থেকে পানি পরতে পরতে নিজের জামার বুক ওরনা সব ভিজে গেছে। কতোক্ষণ যে এভাবে ছিলো খেয়াল নেই। খানিক পর দরজার কড়া নারলে মেহরাম আস্তে করে উঠে যায়। চোখ মুখ মুছে স্বাভাবিক ভাবেই দাঁড়িয়ে পরে। দরজা খুলেই দেখে নিলা দাঁড়িয়ে আছে।

নিলা;; আপা আপনার বোন আইছে নিচে। আপনাকে জলদি যাইতে কইলো।

মেহরাম;; তনু।

মেহরাম ছুটে চলে যায় নিচে। গিয়েই দেখে তনু কনা আর তনুর শাশুড়ী সবাই বসে আছে। মেহরাম নিচে চলে যায়। আজ কেন যেন মেহরাম ভারী বেহায়া হয়ে গেছে। তনু তার মা আর ননদ এসেছে কিন্তু তবুও মেহরামের চোখ দুটো অন্য আরেকজনকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। মূলত আয়ুশ কে। সে ভেবেছে যে যদি আয়ুশ আসে আর একটা বার শুধু একটা বার তাকে দেখতে পারে। ওইযে বেপার টা কিছু এই রকম যে মুখে তো হাজার কথাই বলা যায় কিন্তু ভেতরের টা আর কইজনই বা দেখেতে-শুনতে পারে। মেহরাম গিয়ে দেখে শুধু তারা তিনজনই। মেহরামের শুধু বাইরে তাকাতাকি করছে। ভেবেছে হয়তো আয়ুশ এসেছে। এদিকে সবাই তার সাথে কথা বলছে কিন্তু তার নজর বাইরে। বেকুল হয়ে খুঁজে যাচ্ছে।

তনু;; মেহরু (জড়িয়ে ধরে)

মেহরাম;; হ্য হ্যাঁ।

তনু গিয়ে মেহরামকে জড়িয়ে ধরে। তনুর শাশুড়ীও মেহরাম কে খুব আদর করে। কণা তো মেহরামকে ছেড়ে আসতেই চাইছে না। তারা বসে আছে। খুব গল্প করছে। মেহরামের পাশে সোহেলও বসে আছে। তনুর শাশুড়ী আর মেহরামের শাশুড়ী মেহরামকে নিয়ে প্লেনিং শুরু করে দিয়েছে। তাকে এই করবে সেই করবে। মেহরামের এই খবর শুনে কারো মনই খারাপ হয় নি। তনুর শাশুড়ী তো বলেই দিয়েছে যে নাতনি কিন্তু আমারও। বাড়ির সবাই খুশি। আবার কারো না চাইতেই খুশি থাকতে হচ্ছে।

এভাবেই দেখেতে দেখতে আরো এক মাস কেটে যায়। এর মধ্যে সোহেল দুইবার বাইরে গিয়ে কয়েকদিন থেকে কাজ করে আবার এসে পরেছে। একদিন মেহরাম শুয়ে ছিলো আর সোহেল মেহরামের সাথে বসে আছে। কিন্তু পরক্ষণেই যা হলো তার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলো না।





🦋চলবে~~

#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ১২

❤️🥀
.
.
.
.

সোহেল হঠাৎ করেই কেশে ওঠে। তাও যেনতেন কাশি না, বুকের পাশে হাত দিয়ে প্রচুর পরিমাণে কাশছে। সোহেলের এমন অবস্থা দেখে মেহরাম তড়িঘড়ি করে উঠে তার কাছে যায়। সোহেলের পিঠে ঘষে দিচ্ছে তবুও থামার নাম নেই। মেহরাম একগ্লাস পানি এনে সোহেল কে দিলো কিন্তু সে তা খেতে পারে না। কাশির পরিমাণ যেন আগে থেকে আরো কয়েকগুণ বেড়ে গেলো। সোহেল এবার জলদি করে ওয়াসরুমের দিকে ছুট লাগায়। মেহরামও তার পিছু পিছু যায়। এবার বেছিং-এ কিছুটা ঝুকে কাশতেই থাকে। সোহেল টিস্যু চাইলে মেহরাম দ্রুত তার দিকে একটা টিস্যু এগিয়ে দেয়। সেটা মুখে নিয়ে কাশতে থাকে সোহেল। কয়েক সেকেন্ড পর টিস্যু মুখের সামনে থেকে এনে পরলে দেখে তাতে গাঢ় রক্ত লেগে আছে। এটা দুজনেই দেখেছে। সোহেল দেখে মুখ কুচকিয়ে ফেলে আর মেহরাম তো এক প্রকার আতকে উঠে।।

মেহরাম;; এএএটা ককি। রক্ত রক্ত কেন?

সোহেল;; বুঝলাম না কিভাবে বের হলো (কাশতে কাশতে)

মেহরাম;; আপনাকে আমি আগেই বলেছিলাম যে চলুন ডাক্তারের কাছ যাই ডাক্তারের কাছে যাই কিন্তু না আপনি আমার কথা শুনেন নি।

সোহেল;; আমি তো…

সোহেল আর কথাই বলতে পারলো না তার সাথে সাথে আবার কাশি শুরু। এবার মেহরাম বেশ চিন্তায় পরে গেলো। আর এখনো রক্ত বের হচ্ছে মুখ দিয়ে। মেহরাম কোন রকমে সোহেল কে ধরে ধরে রুমে নিয়ে এলো। তারপর শুইয়ে দেয়।

মেহরাম;; এখন শুয়ে একটু রেস্ট নিন বিকেলের দিকে আমার সাথে ডাক্তারের কাছে যাবেন।

সোহেল;; কিন্তু আমি…

মেহরাম;; একটা কথাও বলবেন না আপনি।

এই বলে মেহরাম সোহেলের পাশেই বসে পরে। সোহেল চোখ গুলো বন্ধ করে শুয়ে আছে। তবে এবার মেহরাম খেয়াল করলো যে ইদানীং সোহেল কেমন যেন হয়ে গেছে। ভালোভাবে লক্ষ্য করলে বুঝা যায় সোহেলের চাপা কেমন ভাংগা ভাংগা, চোখের নিচে গাঢ় কালো দাগ। যেখানে সোহেল অতিমাত্রায় ফর্সা ছিলো। চোখ মুখ কেমন মলিন একটা ভাব। মেহরাম সোহেলের কপালে হাত দিয়ে দেখে, না জ্বরও নেই। তাহলে এমন শরীর খারাপ কেন হলো।

যাই হোক দেখতে দেখতে বিকেল হয়ে এলো। কুসুম বেগম কে বলেছেন একটু তারা দুজন বাইরে যাচ্ছে। সোহেল আর মেহরাম সোজা হস্পিটালের চলে যায়। এর মধ্যে সোহেল অনেক বার বারণ করেছে যে হস্পিটালে যাবার কি দরকার কিন্তু তা তো আর হয় না। মেহরাম সোহেল কে নিয়ে ডাক্তারের কেবিনে গেলে সবার আগেই ডাক্তার দেখেন সোহেলের মাঝে কেমন এক মলিন ভাব। কিন্তু যখন বলা হলো যে সোহেল আর্মি তে জব করে তখন যেন ডাক্তার কিছুটা অবাকই হলেন। আর যে কেউই অবাক হবে। কারণ তারা সাধারণত এমন থাকে না। ডাক্তারও এবার সিরিয়াস হয়ে বসলেন। যা যা প্রব্লেম ছিলো তার সব মেহরাম ডাক্তার কে খুলে বললো। ডাক্তার হয়তো কিছু একটার আন্দাজ পেয়েছেন। উনি প্রায় অনেক গুলো টেস্ট দিলেন। মেহরাম সোহেল কে নিয়ে গেলো। সেইদিনই একে একে সকল টেস্ট গুলো করে ফেললো। তবে এবার এলো ব্লাড টেস্টের পালা। আর যিনি পেসেন্টের এগুলো টেস্ট করিয়ে দেন উনি সোহেলের কাছে এলেন ব্লাড নিবেন বলে। কিন্তু তিনি আরেক দফা অবাক হলেন। কেননা সোহেলের বডি তে পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্লাড নেই। মানে সে রক্তশূন্যতা ভুগছে। মেহরাম এবার চিন্তিত হয়ে পরলো। তবে যেভাবেই হোক ব্লাড নিলো। সকল টেস্ট করানো শেষ হলে মেহরাম আর সোহেল এসে পরে। কেননা তখন ভারি রাত হয়েছিলো আর ডাক্টার ছিলো না তাই তাদের আগামীকাল যেতে হবে। বাসায় এসে সোহেলের অবস্থা যেন আরো বেশি বিগড়ে গেলো। কাশিও দিচ্ছে অনেক বেশি। মেহরাম সোহেলের অনেক দেখভাল করছে। একটু কিছু খেয়েই সোহেল উঠে যায়। কুসুম বেগম সোহেলের কথা মেহরামকে জিজ্ঞেস করলে মেহরাম মুচকি হেসে বলে “কিছু না মা তুমি খাও”। পরেরদিন মেহরাম আর সোহেল উঠে আবার হস্পিটালের উদ্দেশ্যে চলে যায়।

এখন মেহরাম আর সোহেল বসে আছে ডাক্তারের কেবিনে। ডাক্তার ভালো ভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখলো। কিন্তু রিপোর্টে তেমন কিছুই নেই। নরমাল রিপোর্ট।

মেহরাম;; ডক্টর, কি হয়েছে? রিপোর্টে কি এসেছে?

ডাক্তার;; রিপোর্টে কিছুই আসে নি। স্বাভাবিক কিছু ধরা পরেছে মাত্র যেমন জ্বর, ঠান্ডা, কাশি, আর হ্যাঁ রক্তশূণ্যতা। আর মিস্টার সোহেলকে দেখে কেউ বলবে না যে তার মাঝে শুধু এই রোগ গুলোই রয়েছে।

মেহরাম;; মানে আর কি হবে ডাক্তার? এগুলোই তো আর কিছু হয় নি তো (কপাল কুচকে চিন্তিত হয়ে)

ডাক্তার;; দেখুন মিসেস মেহরাম আপনি চিন্তা করবেন না। এককাজ করুন আপনি আবার উনাকে টেস্ট গুলো করান। এতে ধরা পরতে পারে যে আসলে উনার হয়েছে কি। কারণ অনেক রোগ আছে যেগুলো সহজে ধরা পরতে চায় না। তো টেস্ট গুলো আরেকবার করান।

মেহরাম;; জ্বি আচ্ছা।

মেহরাম সোহেলকে নিয়ে এসে পরে। সোহেল মেহরাম কে এইসব করতে বারবার না করছে কিন্তু মেহরাম তো শোনার পাত্রি না। সে আবার চলে যায় টেস্ট গুলো করাতে। এবার সবার আগে ব্লাড টেস্ট করানো হয়। কিন্তু সোহেলের বডি তে রক্ত যেন এক প্রকার নেয়-ই। ইঞ্জেকশন দিয়ে ব্লাড নেওয়া এক প্রকার অসম্ভব তাই এবার আর কোন উপায় না পেয়ে ক্যানোলা লাগানো হয়েছে। আর তার মাধ্যমে রক্ত নেওয়া হয়েছে। তবুও রক্তের পরিমাণ খুবই অল্প। অতঃপর সব টেস্ট করা শেষ হলে আবার মেহরাম আর সোহেল ডাক্তারের কেবিনে যায়। ডাক্তার এবার রিপোর্ট হাতে নিয়ে খুব মনোযোগ সহকারে দেখেন। উনার চোখে যে মোটা ফ্রেমের চমশা টা ছিলো তা খুলে ফেলে। কিন্তু এবার যেন আর মেহরামের ভালো লাগছে না। বেকুল ভাবে ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে আছে। ডাক্তার রিপোর্ট টা হাতে রেখে সামনে দুহাত ভাজ করে বসেন। এদিকে সোহেলও বেশ চিন্তিত যে কি হয়েছে তার।

মেহরাম;; ডক্টর এবার কি হয়েছে, রিপোর্টে কি এসেছে??

ডাক্তার;; ইট”স্ ক্যান্সার।

ডাক্তারের এই কথা বলার সাথে সাথে মেহরাম আর সোহেল চুপ মেরে গেলো। কেবিনে বিরাজ করছে পিনপতন নীরবতা।

মেহরাম;; মমমানে কি এইসবের। হুয়াট ডু ইউ মিন বাই ক্যান্সার। ননা এটা না, আমি সিওর ডক্টর রিপোর্টে হয়তো ভুলভাল কিছু একটা এসেছে। ভুয়া সবকিছু। এমন টা হবেই না। ডক্টর আমরা বরং আরেকবার চেকাপ করিয়ে আনি কেমন তারপর পাক্কা কনফার্ম হবো।

মেহরাম উঠে যেতে চাইলেই সোহেল আবার তার হাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে দেয়। মেহরাম এক নয়নে সোহেলের দিকে তাকিয়ে আছে। সোহেল সামনের দিকে তাকিয়ে থেকেই মেহরামের হাত ধরে বসিয়ে দেয়।

সোহেল;; ডাক্তার আপনি সিওর এটা ক্যান্সার?

ডাক্তার;; দেখুন মিস্টার সোহেল আমি বুঝতে পারছি যে বেপার টা কতো টা কষ্টদায়ক কিন্তু এটা সত্যি। বিশ্বাস না হলে ইউ ক্যান চেক দি রিপোর্ট। আর এটা একদম লাস্ট স্টেজে আছে। কিন্তু এতোদিন ফুটে ওঠেনি। আর ভেতরে থাকতে থাকতে এটা এক মারাত্মক আকার ধারণ করেছে।

মেহরাম যেন এবার এখানেই পরে যাবে এমন একটা অবস্থা। মাথা পুরো কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। সে ভেবেছিলো যে সোহেলের হয়তো ছোটখাট কিছু হয়েছে কিন্তু এখানে এসে যে সে এমন কিছু একটা শুনবে তার বিন্দুমাত্র ধারণাও তার ছিলো না। এখন প্রায় সপ্তাহে একদিন করে হলেও সোহেল কে চেকাপের জন্য আনতে হবে। সোহেল আর মেহরাম এসে পরে। মেহরাম যেন এখন এক মূর্তি হয়ে গিয়েছে। হু হা কিছুই করছে না। সারাটা রাস্তা এসেছে চুপ থেকেই। সোহেল তাকে কতো কথাই না বলছে কিন্তু মেহরাম কিছুই না। এক সময় বাসায় এসে পরে তারা। এসেই দেখেন কুসুম বেগম বসে আছেন। তিনি মেহরাম কে কিছু জিজ্ঞেস করলে মেহরাম কিছুই বলে না। যেন রোবট, সোজা নিজের ঘরে চলে আসে। কুসুম বেগম এতে অবাক হন, কেননা মেহরান এর আগে কখনোই এমন করেনি। সোহেল তার মাকে কিছু একটা বলে সেও ঘরে চলে যায়। গিয়েই দেখে মেহরাম বিছানার ওপর হতাশ ভাবে বসে আছে। সোহেল গিয়ে মেহরামের সামনে এক হাটু ভাজ করে বসে পরে। এখনো মেহরাম মাথা নিচু করেই রয়েছে।

সোহেল;; মেহরাম!

মেহরাম;;__________

সোহেল;; মেহরাম..!

মেহরাম;;__________

সোহেল এবার তার দুহাতে মেহরামের গাল গুলো ধরে ফেললো। মেহরাম চোখ তুলে তাকাতেই সোহেল দেখে তার চোখে পানি গুলো টলমল করছে যেন এই পরে গেলো।

সোহেল;; আমাদের বিয়ের প্রথম রাতে আমি তোমায় একটা কথা বলেছিলাম, মনে পরে কি??

মেহরাম;; ___________

সোহেল;; আমরা স্বামী-স্ত্রী ছাড়াও আরেকটা সম্পর্কে আছি। আজীবন থাকবো। বন্ধু, বেস্টফ্রেন্ড। তো আর যে কটা দিন রয়েছে জীবনে সেই দিন গুলো বেস্টফ্রেন্ড হিসেবে কাটিয়ে দেই আমরা।

মেহরাম এবার মাথা তুলে সোহেলের দিকে তাকায়। আর সোহেল তখন বাচ্চামো করে বলে ওঠে “প্লিজ”। এবার যেন মেহরামের বাধ ভেংে গেলো। সে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। ফট করে সোহেল কে জড়িয়ে ধরেই হাউমাউ করে কেদে দেয়। সোহেলও তার চোখ দুটো বন্ধ করে নেয়।

মেহরাম;; কেকেন এএমন হলো। আমি এএবার কি করবো। ক্যান্সার আমি, আমি ভাবতেও পারি নি যে এমন একটা কিছু ধরা পরবে। আপনার কিছুই হবে না, হতে পারে না। আপনি ঠিক আছেন। সবাই মিথ্যা বলছে। আমি, আমি মাকে কি জবাব দিবো। মাকে বললে উনি একদম ভেংে পরবেন। সোহেল, আমি প্রেগন্যান্ট। বুঝতে পারছেন আপনি। আমি কি বলবো। কি করবো আমি।

মেহরাম তো প্রায় পাগল হয়ে যাচ্ছে। সোহেল তার পিঠে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে চুপ করিয়ে দেয়। আর মেহরামও এক সময় একদম চুপ হয়ে পরে। সোহেল মেহরাম মেহরাম বলে কয়েকবার ডাক দিলে কোন সাড়াশব্দ আসে না। সোহেল আস্তে করে মেহরামকে তুলে সামনে আনলে দেখে মেহরাম অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। চোখের পানি গুলো এখনো জ্বলজ্বল করছে। সোহেল দ্রুত তার মাকে ডাক দেয়। তারপর কুসুম বেগম জলদি করে ঘরে এসে পরলে দেখে মেহরামের এই অবস্থা। তাকে দেখেই বুঝা যাচ্ছে যে কতো পরিমাণে ভয় পেয়েছে আর টেনশন নিয়েছে। সোহেল হাত ধরে মেহরামের পাশে বসে আছে। সোহেল খেয়াল করে যে এই অচেতন অবস্থাতেও মেহরামের বাম হাত টা তার পেটের ওপর রেখে দিয়েছে। তবে আশ্চর্যজনক ভাবে সোহেলের যে এতো বড়ো একটা রোগ ধরা পরেছে তাতে তার কোন মাথা ব্যাথাই নেই। এর মানে খুঁজে পায় না সোহেল। তার প্রায় ১৫-২০ মিনিট পর মেহরামের জ্ঞান ফিরে আসে। আর চোখ খুলতেই দেখেতে পারে সোহেল তার পাশে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে। চোখ গুলো বন্ধ করে রেখেছে। কি যেন মনে করে সোহেল তার চোখ মেলে তাকায়। আর মাথা ঘুড়িয়ে তাকিয়ে দেখে মেহরাম তার দিকে ফ্যালফ্যাল চোখে তাকিয়ে আছে।

সোহেল;; উঠেছো।

মেহরাম;; হুম।

মেহরাম উঠে বসে পরে।

সোহেল;; বেশি কাদবে না, এতো কান্না কোথা থেকে আসে। তুমি কাদলে বেবির কষ্ট হবে না। তো এখন থেকে কান্নাকাটি বন্ধ।

সোহেল এই কথা বলেই উঠে নিতে চাইলে মাথায় হাত দিয়ে আবার বসে পরে। মেহরাম এবার জলদি করে সোহেল কে ধরে।

মেহরাম;; শরীরের অবস্থা বেশি ভালো না জানেন। তবুও কেন কাজ করতে যান। সব আমি করবো আপনি এখানে বসুন।

মেহরাম ধরে ধরে সোহেলকে বসিয়ে দেয়। এখন দুপুর টাইম আর সোহেল সকালে তেমন কিছু খায় নি। মেহরাম খাবার আনতে যেতে ধরলে সোহেল হঠাৎ মেহরামের হাত ধরে ফেলে। মেহরাম ঘুড়ে পেছনে তাকায়।

সোহেল;; মেহরাম, প্লিজ মাকে কিছুই বলো না।

মেহরাম তাকিয়ে দেখলো সোহেলের চোখে পানি স্পষ্ট। মেহরাম তার চোখের পানি পরার আগেই সেটা মুছে ফেলে।

মেহরাম;; হুম।

সোহেল মেহরামের হাত ছেড়ে দিলে মেহরাম দ্রুত নিচে চলে যায়।





চলবে~~

#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ১৩

🖤✨
.
.
.
.

সময় গড়িয়ে দিন যেতে থাকে। কিন্তু সবার পরিস্থিতি যেমনের তেমনই। ওই যে বলে না কৃত্রিম সুখ-হাসি মুখে না চাইতেও রাঙিয়ে রাখতেই হয়। মেহরামের বাবার বাড়ি, তনুর বাড়িতে হাসি খুশি লেগেই আছে। কিন্তু মেহরামের বাড়িতে নেই। যেন সুখ তার মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে মেহরামের কাছ থেকে। সোহেল আগে থেকে আরো বেশি রোগা হয়ে গেছে। বাইরে আর আগের মতো যায় না। সোহেলকে মাঝে মাঝে মেহরামের খাইয়ে দিতে হয়। সোহেলের সবকিছু মেহরাম তার নিজ হাতে সামলায়। কুসুম বেগম কেও ইদানীং বেশ চিন্তিত দেখায়। কিন্তু মেহরাম কোন রকমে এড়িয়ে যায়। মেহরামের প্রেগন্যান্সির তিন মাস গড়িয়ে এবার চার মাসে পরবে। সব কিছুর চিন্তা একসাথে মাথায় নিয়ে ঘুড়ে সে। মেহরামের চোখের নিচেও গাঢ় কালো দাগ, কেমন একটা ফ্যাকাশে ভাব। মেহরাম তার রুমে বসে বসে কাজ করছিলো আর সোহেল করিডরে দাঁড়িয়ে ছিলো।

মেহরাম;; আপনি কি রুমে আসবেন। কখন থেকে বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন, রুমে আসুন।

সোহেল;; আসছি।

মেহরাম;; খাবেন কিছু এনে দিই (কাপড় ভাজ করতে করতে)

সোহেল;; না।

মেহরাম;; চুল গুলো কেমন উষ্কখুষ্ক হয়ে আছে। ঠিক করুন (সোহেলের দিকে তাকিয়ে)

সোহেল আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে পরলো। তবে এখন সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে ভালোভাবে দেখছে। আয়নার পাশেই তার আর্মির গেটাপে একটা ছবি রয়েছে। দুহাত ভাজ করা, মুখে ঝুলছে বিরাট হাসির রেশ। ছবি টা থেকে চোখ সরিয়ে আবার আয়নাতে নিজের দিকে তাকায় সোহেল। তখনকার আর এখনকার সময়ে তার মাঝে রাত-দিন তফাৎ। ক্যান্সারে এটাই সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণাদায়ক। নিজের রুপ-রঙ, স্বাস্থ্য, শক্তি-বল সব কেড়ে নেয় সব। সোহেল হাতে একটা চিরুনি তুলে নিয়ে চুল গুলো আচড়াতে থাকে। তবে দু-একবার আচড়াতেই একদম চিরুনি ভরে একগাদা চুল ঝড়ে আসে। সোহেল কতোক্ষন তাকিয়ে থাকে…

সোহেল;; মেহরাম..!

মেহরাম;; জ্বি।

সোহেল;; দেখো না,

মেহরাম;; কি হয়েছে? (সোহেলের পাশে এসে)

সোহেল;; চুল ঝড়ছে।

মেহরাম সোহেলের দিকে তাকিয়ে দেখে সে এক হাতে চিরুনি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তবে তার মাথার চুল অনেক বেশি ঘন তাই এখনো মাথার চামড়া দেখা যায় নি। মেহরাম তাকিয়ে দেখলো সোহেলের মুখটা কেমন মলিন হয়ে গেছে। কেননা তার এই চুল গুলো তার খুব বেশি পছন্দের। সোহেলের যেন মন খারাপ না হয় তাই দ্রুত মেহরাম বলে ওঠে…

মেহরাম;; আব..ননা না চুল আসলে ঝড়ছে। আরে মানে চুল তো এমনিতেই ঝড়ে তাই না। আমারও ঝড়ে, এটা নরমাল। আপনি এদিকে দিন আমি চুল আচড়ে দিচ্ছি।

মেহরাম নিজে আলতো ভাবে চুল গুলো আচড়ে দিলো। সোহেল বিছানাতে বসে ছিলো। মেহরাম তার সাথে টুকটাক কথা বলছে আর স্যুপ ঘাটছে। ঘোটা শেষ হলে বিছানার এক কোণায় বসে সোহেল কে আস্তে আস্তে খাইয়ে দিতে থাকে মেহরাম। খাওয়ার মাঝেই সোহেল বলে ওঠে….

সোহেল;; মেহরাম, আমার না বাসায় মোটেও ভালো লাগছে না জানো।

মেহরাম;; বাড়ির সাইডে একটু হাটবেন, নিয়ে যাবো?

সোহেল;; চলো না বাইরে যাই কোথাও।

মেহরাম;; আপনি যা…

সোহেল;; যেতে পারবো আমি। যাবে!

মেহরাম;; অবশ্যই যাবো। আপনি রেডি হয়ে নিন আর আমি বাটি টা নিচে রেখে আসি।

সোহেল;; আচ্ছা।

মেহরাম নিচে চলে যায়। আর সোহেল এদিকে রেডি হতে শুরু করে। মেহরাম কে দেখেই তার শাশুড়ি বলে ওঠে…

কুসুম;; কিরে মা সোহেল কোথায়?

মেহরাম;; মা ওপরেই আছে।

কুসুম;; ছেলে টা আমার পালটে গেলো। আগের মতো আর আমার কাছে আসে না।

মেহরাম;; না মা তেমন কিছুই না।

সোহেল;; কে বলেছে আমি পালটে গেছি (নিচে নামতে নামতে)

মেহরাম;; আপনি, আপনি নিচে কেন এসেছেন শরীর তো ভালো না (আস্তে করে সোহেলের কাছে গিয়ে)

সোহেল;; প্রব্লেম নেই। আমি পারবো।

কুসুম;; পাল্টেই তো গেছিস, কথাও বলিস না আগের মতো।

সোহেল;; তুমি ভুল বুঝছো মা, আমার লাইফে সবথেকে বেশি ইম্পর্ট্যান্ট তুমি। (পেছন থেকে তার মা কে জড়িয়ে ধরে)

কুসুম;; হয়েছে হয়েছে থাক।

সোহেল;; আচ্ছা মা শুনো না!

কুসুম;; হ্যাঁ বল।

সোহেল;; আমার না বাসায় খুব খারাপ লাগছে, আমি একটু মেহরাম কে নিয়ে বাইরে যাবো।

কুসুম;; ওমা এতে বলার কি আছে, আরে যা যা ঘুড়ে আয় ভালো লাগবে। মেহরাম মা এইসব রাখ নিলা কে দিয়ে আমি করিয়ে নিবো তুই সোহেলের সাথে যা।

মেহরাম;; মা প্রায় শেষ কাজ গুলো, একদম করেই যাচ্ছি।

সোহেল এতোক্ষণ হলরুমে বসে বসে তার মায়ের সাথে কথা বলছিলো। আর মেহরাম হাতের কাজ গুলো শেষ করে আসতেই সোহেল আর সে মিলে বের হয়ে পরে।

মেহরাম;; গাড়ি নিবো?

সোহেল;; না, আজ আমরা হুড তোলা রিকশায় করে ঘুড়বো।

মেহরাম;; আচ্ছা আমি না কখনো বুঝি না।

সোহেল;; কি?

মেহরাম;; এই যে আপনার মতো একজন মানুষ কে কেউ কি করে আর্মিতে নিলো।

মেহরামের কথায় সোহেল কপাল কুচকে তার দিকে তাকায়।

সোহেল;; মানে?

মেহরাম;; না মানে আমি শুনেছি যে আর্মি তে যারা থাকে তারা নাকি অনেক বেশি খিটখিটে, বদমেজাজি আর কষটে টাইপের হয়। কিন্তু আপনি তার বিপরীতে।

মেহরামের কথা শুনে সোহেল কিছুটা জোরেই হেসে দেয়।

সোহেল;; সবাই তো আর এক না তাই না।

মেহরাম;; হুমম বুঝলাম, আচ্ছা কোথায় যাবেন?

সোহেল;; দেখি কোথায় যাওয়া যায়।

সোহেল আর মেহরাম একটা রিকশায় উঠে পরে। রিকশা যাচ্ছে আপন গতিতে। হঠাৎ করেই সোহেল মেহরাম কে বলে ওঠে…

সোহেল;; মেহরাম!

মেহরাম;; হুমম।

সোহেল;; একটা কথা বলবে!

মেহরাম;; জ্বি, কি কথা?

সোহেল;; জানো তো আমাদের সবার জীবনেই ভালোবাসা নামক শব্দ টা আসে। হোক তা অতি তাড়াতাড়ি বা অতি দেরিতে কিন্তু আসে ঠিকই। যারা ভাগ্যবান হয় তারা পেয়ে যায় আর যাদের ভাগ্যেই না থাকে তারা পায় না।

মেহরাম;; আপনি এই কথা গুলো কেন বলছেন?

সোহেল;; তুমি ভালোবাসতে কাউকে তাই না!!

সোহেলের মুখ থেকে এমন কথা শুনে যেন মেহরামের দম আটকে আসছে। সে জোরে জোরে কিছু দম ছেড়ে সোহেল কে বলে ওঠে…

মেহরাম;; দেখুন আপনিই তো বললেন যে ভালোবাসলেও অনেকে তা পায় না। হয়তো আমিও সেই অভাগাদের মধ্যেই একজন ছিলাম। যাজ্ঞে চলুন নেমে কিছুক্ষণ হাটি।

সোহেল;; হ্যাঁ চলো।

সোহেল আর মেহরাম নেমে পরে রিকশা থেকে। রাস্তায় একটা ছেলেকে দেখে বাদাম বিক্রি করছে সেখান থেকে মেহরাম বাদাম কিনে আনে। ছেলে টাকে তার বাদামের দামের থেকে আরো বেশ কিছু টাকা দিলো মেহরাম। কিন্তু হঠাৎ ছেলে টা মেহরামকে খুব ভালোভাবে দেখে তারপর বলে…

ছেলে;; আরে আপু, আপনি মেহরাম আপু না?! (কপাল কুচকে)

মেহরাম;; হ্যাঁ, কিন্তু তুমি কি করে চিনলে??

ছেলে;; আরে আমারে চিনলেন না। আমি শিমুল। আপনি ওই যে ওই সামনের ভার্সিটি টাতে পড়তেন না?

মেহরাম;; হ্যাঁ আরে তুই, আমি তো তোকে চিনতেই পারিনি। বেশ বড়ো হয়ে গেছিস তো। আগে তো তোর ফোকলা দাত ছিলো এখন নেই।

শিমুল;; ফোকলা দাতের কথা ভুলেন নাই এহনো।

মেহরাম;; না, তা কেমন আছিস তুই?

শিমুল;; জ্বি ভালাই। ইনি কে (সোহেল কে দেখিয়ে)

সোহেল;; আমি, আমি হলাম তোমার মেহরাম আপুর বেস্টফ্রেন্ড।

শিমুল;; বেস্টফেরেন্ড।

সোহেল;; হ্যাঁ হ্যাঁ ওইটাই। (হেসে)

মেহরাম;; আপনি এখানে বসবেন?

সোহেল তাকিয়ে দেখে কিছু দূরেই একটা ভার্সিটি রয়েছে। আর এখানে গোল চত্ত্বরের মাঝে বিশাল জায়গা ধারণ করে রয়েছে একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। গাছ থেকে বেশ কিছু ফুল পরে গাছের নিচটা একদম রাঙিয়ে তুলেছে। ভারী সুন্দর জায়গা টা। সোহেল আর মেহরাম গিয়ে বসে পরে। মেহরাম সোহেল কে বাদাম ছুলে দিচ্ছে আর সোহেল সেগুলো খাচ্ছে।

সোহেল;; তুমি এই ভার্সিটিতে পড়তে মেহরাম?

মেহরাম;; হ্যাঁ।

সোহেল কে বাদাম গুলো দিয়ে মেহরাম তার ভার্সিটির গেটের দিকে তাকায়। যদি এখন এখানে কেউ না থাকতো তাহলে হয়তো মেহরাম এবার হাউমাউ করে একদম কেদেই দিতো। এক আলাদা মায়া কাজ করছে তার মাঝে। এতো গুলো বছর পর হঠাৎ করেই নিজের ভার্সিটি কে দেখে পুরোনো স্মৃতি গুলো যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। কতোই না স্মৃতি জড়িয়ে আছে তার এই জায়গা টার সাথে। তনু, উর্মি, বাবলি সবার কথাই মনে পরে গেলো। ভার্সিটির বাইরে এখন তালা দেওয়া হয়তো ক্লাস নেই। নিজের দাত দিয়ে ঠোঁট গুলো কামড়ে ধরলো মেহরাম। কান্না দমানোর ব্যার্থ চেষ্টা। বছর পেরিয়ে চোখের সামনে হঠাৎ করেই এমন কিছু একটা ভেসে উঠলে বুকের ভেতরে তো তোলপাড় শুরু হবেই। মেহরামের শিরদাঁড়া গুলো তে যেন এক শিহরণ বয়ে গেলো। তনু আর সে এই মাঠে বসেই কতো না আড্ডা দিয়েছে। আয়ুশ আর তার বন্ধুদের আড্ডা দেবার জন্য একটা জায়গা নির্দিষ্ট করা ছিলো। কিন্তু আজ, আজ সেই জায়গা টা একদম ফাকা। যে জায়গা টা বন্ধুদের হাসি-তামাশায় মেতে থাকতো সেই জায়গা টা আজ নিতান্তই শূন্য। শুধু রয়ে গেছে বেশ কিছু স্মৃতি। আয়ুশের কথাও মনে পরে গেলো। এগুলোই হয়তো সত্য। কিন্তু এই ক্ষুদ্র সত্য গুলো মানতেও যে ভারী কষ্ট হয়। হঠাৎ মেহরামের কানে কিছু বাচ্চার খিলখিল করে হাসির শব্দ এলো। মেহরাম তাকিয়ে দেখে ৫ বছরের দুটো ছোট ছোট মেয়ে একে ওপরের পিছে দৌড়ে দৌড়ে খেলছে। মেহরামের মুখে অজান্তেই হাসি ফুটে ওঠে। তনুর কথা মনে পরে যায় তার। এখানকার বাতাসে কেমন একটা সুগন্ধ মিশে আছে। চারিদিকে মৌ মৌ একটা ভাব। মেহরাম অপলক ভাবে সেদিকে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ সোহেলের কথায় মেহরামের হুস ফিরে।

সোহেল;; মেহরাম!

মেহরাম;; জজজ্বি।

সোহেল;; আগের দিনের কথা গুলো মনে পরছে?

মেহরাম;; হ্যাঁ কিছুটা সেরকমই।

মেহরাম আর সোহেল সেখানে বসে বসে কথা বলছিলো। আর অন্যদিকে আজ আয়ুশের অফিস থেকে জলদি ফিরতে হয়েছে। মানে অফিস কাজ শেষ তাই বাসায়। কিন্তু সচারাচর আয়ুশ যেই রাস্তা দিয়ে বাসায় যায় সেই রাস্তা আজ বন্ধ কাজ চলছে তাই তাকে অনেক টাই ঘুরে তারপর যেতে হচ্ছে বাসায়। রাস্তা ঘুড়তে ঘুড়তে আয়ুশ কখন যে তার ভার্সিটির সামনের রাস্তায় এসে পরেছে তার দিকে তার কোন খেয়াল নেই। গাড়ি টান দিয়ে সোজা সে চলে গেলো। কিন্তু হুট করেই আবার তার গাড়ি টা থামিয়ে দিলো। আয়ুশের কেমন যেন কিছুটা ঘোলাটে লাগে। সে ধীরে ধীরে গাড়িটা আবার পেছনের দিকে নিয়ে আসে। তারপর গাড়ির বাম পাশের উইন্ডো টা খুলে দেয়। আয়ুশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে মেহরাম আর তার পাশে সোহেল। তারা একসাথেই বসে অনেক কথা বলছে। মুখে হাসি রয়েছে। আয়ুশ দূর থেকে তাদের দেখে মলিন হাসে। কয়েক মিনিট তাদের দেখে আয়ুশ গাড়ি নিয়ে আবার এসে পরে। এবার মেহরাম আর সোহেল কথা বলতে বলতে হঠাৎ মেহরাম বেশ ঘাবড়ে গিয়ে বলে ওঠে…

মেহরাম;; আরে রিপোর্ট..

সোহেল;; কি??

মেহরাম;; আরে গতকাল আপনার চেকাপ করালাম না তারপর তো রিপোর্ট গুলো আর আনতে যাই নি। মানে আমি হস্পিটালের একজন কে টাকা দিয়ে বলে এসেছিলাম যে বাসায় যেন পৌঁছে দেয়। এড্রেসও দিয়ে এসেছি।

সোহেল;; হ্যাঁ তো?

মেহরাম;; ছেলেটার আসার সময় অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে। মানে অনেক আগেই সে বাসায় এসে দিয়ে গেছে। সময় দেখেছেন। আর বাসায় কেউ নেই মা আছে। রিপোর্ট গুলো যদি মায়ের হাতে…. ননা নননা।

সোহেল;; কি আম্মুর হাতে, তাহলে তো জেনে যাবে। আর আম্মু একদম ঠিক থাকতে পারবে না জানার পর।

মেহরাম;; আমাদের এখনই যেতে হবে। চলুন

সোহেল;; হ্যাঁ চলো।

মেহরাম আর সোহেল রিকশায় উঠে বসে। কিছুটা দ্রুত রিকশাকে যেতে বলে। প্রায় অনেকক্ষণ পর মেহরাম আর সোহেল বাসায় পৌঁছে। কিন্তু এবার ঘটলো আরেক বিপত্তি। সোহেলের মাথা টা হঠাৎ চক্কর দিয়ে ওঠে। মেহরাম ধরে ফেলে তাকে। আস্তে আস্তে করে খুব সাবধানে সোহেলকে ভেতরে নিয়ে আসে। তবে ভেতরে আসতেই মেহরাম আর সোহেল যেন এক প্রকার অবাক হলো। কুসুম বেগমের হাতের সোহেলের চেকাপের রিপোর্ট গুলো। তিনি উল্টিয়ে উল্টিয়ে সবকিছু দেখছেন।

মেহরাম;; মমমা..

মেহরাম কুসুম বেগমকে ডাক দিলেন তবুও তার কোন হেলদুল নেই। এবার সোহেল আস্তে ধীরে তার মায়ের দিকে এগিয়ে যায়।

সোহেল;; মা।

এবার কুসুম বেগম মাথা তুলে সোহেলের দিকে তাকালেন। চোখে বয়ে যাচ্ছে তার অশ্রুর ধারা। হাত থেকে টাস করে রিপোর্ট গুলো নিচে পরে যায়। কুসুম বেগম আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। ছেলেকে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিলেন।

কুসুম;; বাবা তোর, তোর ক্যান্সার হয়েছে। এএএগুলো ককি বলছে ডাক্তার রা। আমি বিশ্বাস করিনা। এগুলো সব মিথ্যা। আমার ছেলে। আমার বুক টা খালি করে যাস না বাবা। আল্লাহ আমার হায়াত নিয়ে তোকে দিক।তাও তুই যাস না বাবা। তোর মায়ের কি হবে। মেহরাম মার কি হবে। তোর বাচ্চা টা, ইয়া আল্লাহ তুমি এইটা কি করলে। ইয়া খোদা তুমি এতো নিষ্ঠুর কেন হলে। সোহেল বাবা কবে হয়েছে তোর ক্যান্সার, কবে জেনেছিস। আমাকে আগে কেন বলিস নি। কেন বলিস নি।

সোহেল তার মাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছে। মেহরাম মূর্তির মতো করে দাঁড়িয়ে আছে আর চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পরছে। কুসুম বেগম এক রকম আহাজারি শুরু করে দিয়েছেন। সোহেল কে ছেড়ে দাড়ালে মেহরাম খেয়াল করে যে উনার চোখ গুলো নিভু নিভু হয়ে গেছে। সাথে সাথে মেহরাম ছুটে গিয়ে কুসুম বেগম কে পেছন থেকে ধরে ফেলেন। তারপর সোহেল আর মেহরাম মিলে তাকে আস্তে করে শুইয়ে দেয়। ছেলের চিন্তায় নিজের শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছে। নিলা কে দ্রুত পানি আনতে বলে অতঃপর মেহরাম তার পাশে বসে তাকে দেখাশোনা করে। কয়েক ঘন্টা পর কুসুম বেগম উঠে বসেন। উঠেই আবার নিজের ছেলে কে নিয়ে বিলাপ পারা শুরু করে দেন। মেহরাম তাকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে তার রুমে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেন। মেডিসিনের সাথে ঘুমের ঔষধও খাইয়ে দেয় মেহরাম। কিছুক্ষণ তার শাশুড়ীর পাশে বসে থেকে মেহরাম চলে আসে। এখন সন্ধ্যা রাত। মেহরাম রুমে গিয়েই দেখে সোহেল নেই। মেহরাম কপাল কুচকে তাকায়। অবশেষে ওয়াসরুম থেকে শব্দ আসলে মেহরাম সেদিকে যায়। দরজা টা হাল্কা ধাক্কা দিতেই খুলে যায়। মেহরাম তাকিয়ে দেখে সোহেল মুখে টিস্যু দিয়ে প্রচুর পরিমাণে কাশছে। সে ছুটে গিয়ে সোহেলের কাছে যায়। আলতো করে পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। তারও অনেকক্ষণ পর সোহেল কিছুটা স্বাভাবিক হয়। রুমে এসে জলদি তাকে মেডিসিন খাইয়ে দেয় মেহরাম। শুয়ে থাকতে থাকতে সোহেল এক সময় ঘুমিয়ে পরে। মেহরাম রুমের আলোটা হাল্কা করে দেয়। তারপর তার ড্রয়ার থেকে তার সেই অতি পছন্দের ডায়েরি টা হাতে নিয়ে বারান্দায় ফ্লোরের এক কোণায় বসে লিখতে শুরু করে। লিখতে লিখতে কখন যে এতো সময় পার হয়ে গেছে মেহরাম জানে না। হঠাৎ রুমের ভেতরে থেকে আওয়াজ আসে “মেহরাম”। মেহরাম বুঝে যে এটা সোহেলের ডাক। সে দ্রুত উঠে রুমে যায়। হাত থেকে ডায়েরি টা ড্রয়ারে রেখে রুমের আলো জ্বালিয়ে দেয়। তাকিয়ে দেখে সোহেল শুয়ে থেকেই তাকে ডাকছে। মেহরাম তার কাছে যায়। সোহেল কে কিছুটা ধরে উঠিয়ে বসিয়ে দেয়। সোহেল আস্তে করে নেমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসে।

মেহরাম;; এই সময়ে ঘুম ভেংগে গেলো যে?

সোহেল;; আরে আমি তো সন্ধ্যা বেলা ঘুমিয়েছিলাম আর দেখো এখন বাজছে প্রায় বারো টার কাছাকাছি।

মেহরাম;; হুমম। কিছু কি খাবেন?

সোহেল;; না। খিদে নেই।

মেহরাম;; হুমম।

সোহেল;; মেহরাম চলো না ছাদে যাই একটু!

মেহরাম;; এই সময়ে ছাদে!

সোহেল;; চলো যাই না।

মেহরাম;; আচ্ছা চলুন।

মেহরাম সোহেল কে নিয়ে চলে যায় ছাদে। সিড়ি বেয়ে ছাদে ওঠার সময় মেহরাম সোহেল কে ধরে ছিলো যাতে পরে না যায়। ছাদের এক কিণারে এসে মেহরাম বসে পরে। তবে এবার হুট করে সোহেল মেহরামের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পরে। মেহরাম কিছু বলে না।

সোহেল;; মা কোথায়?

মেহরাম;; উনি অনেক কান্না করছিলেন তাই মেডিসিন খাইয়ে শুইয়ে দিয়ে এসেছি। এখন ঘুমাচ্ছে।

সোহেল;; ওহহহ।

মেহরাম;; হুমম।

সোহেল;; তোমার অনেক বেশি কষ্ট হয়ে গেছে তাই না মেহরাম!?

মেহরাম;; মানে বুঝলাম না।

সোহেল;; মানে এই যে এক হাতে পুরো সংসার সামলানো। মাকে দেখা আমাকে দেখা, তার ওপর তুমি অন্তঃসত্ত্বা। তুমি তো নিজের প্রতি কেয়ারই করো না।

মেহরাম;; আরে নাহ তেমন কিছুই না। এগুলো আমার কর্তব্য। আর আমি করবোই।

তারপর তাদের মাঝে চলে কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতা। তার মাঝেই আবার হুট করে সোহেল বলে ওঠে…

সোহেল;; মেহরাম আমাদের না একটা সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে হবে।

মেহরাম;; মেয়েই কেনো?

সোহেল;; উহু, মেয়েই হবে দেখো। ঠিক তোমার মতো। অনেক সুন্দর।

মেহরাম;; হুমম আচ্ছা।

সোহেল;; জানো আমি না মেয়ের নামও ঠিক করে রেখেছি!

মেহরাম;; ওমা তাই!

সোহেল;; হ্যাঁ।

মেহরাম;; নাম কি শুনি!

সোহেল;; মেহের।

মেহরাম এবার ফট করে সোহেলের দিকে তাকায়। সোহেলও মেহরামের দিকে তাকায়।

সোহেল;; তোমার নামের সাথে মেয়ের নাম মিলিয়ে রেখেছি আমি “মেহের”। নাম টা কেমন?

মেহরাম;; সুন্দর ❤️~

মেহরাম আর সোহেল বসে রাতের আকাশের তারা গুলো কে দেখতে থাকলো ✨।





🦋🌸চলবে~~

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে