Wednesday, June 25, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1457



বৃষ্টি ভেজা রাত পর্ব-০৩

0

#বৃষ্টি_ভেজা_রাত💖
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ💖

#পর্বঃ__৩

বাসর ঘরে বসে আছে বৃষ্টি। পুরু রুমটায় ফিনফিনে নিরবতা বিরাজ করছে। বাইরে লোকজনের কোলাহল কানে আসছে তার। বধু সেজে সেই তিন চার ঘন্টা ধরে বসে আছে এই ঘরে। রাতের আসার কোনো নাম গন্ধও নেই। কি থেকে কি হয়ে গেলো তার জীবনটা? যেনো প্রকৃতির মতো একটা ঝড় এসে এলো মেলো করে দিয়েছে তাকেও। গতকাল এই সমটায়ও তার চিন্তা ধারা ছিলো সম্পুর্ন ভিন্ন। আর আজ তার নিয়তি তাকে কোথায় এনে দার করালো। গতকাল পর্যন্ত যাকে ভাইয়া বলে সম্মোধন করেছে আজ কিনা সেই লোকটারই স্ত্রী সে।
ভয় যেনো পিছু ছারছেনা তার। এভাবে বিয়ে হলো তাদের। আরেকজনের জন্য সাজানো ঘরটাতে সে আজ নিজে বৌ সেজে বসে আছে। কিন্তু এই সাজে নেই কোনো মুগ্ধতার আভাস ও। কারণ এটা যে তার জন্য সাজানো হয়নি।
এসির মাঝেও ঘামাচ্ছে বৃষ্টিকে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আছে। রাত কেনো আসছেনা। আসবে কিনা তাও সন্দেহ। ছয় বছরের রিলেশন থাকার শর্তেও বর্ষা যে ধোকাটা দিলো তাকে। তাতে সে ঠিকটাক আচরণ করবেনা এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু কেনো বর্ষা এমন করলো? ভালোবাসার থেকে কি অর্থটাই বড় হয়ে গেলো তার কাছে। সম্মান বাচাতে রাতের হাতে তুলেদিয়েছে তাকে পরিবারের সবাই। বাবা কতো সুন্দরেই বলে দিয়েছে, অনেক সুখি হবি তুই। কিন্তু ভালোবাসা যেখানে থাকবেনা সেখানে আদৌ সুখ মিলবে?

দরজা নারানোর আওয়াজ পেয়ে একটু নরে চরে বসলো বৃষ্টি। মুহুর্তেই যেনো এক ভিন্ন অনুভুতি হানা দিলো মনে। পিট পিট করছে বুকের ভেতরটা।
রুমে প্রবেশ করলো রাত। বড় ঘোমটা টেনে বিছানায় বসে আছে বৃষ্টি। এক পা এক পা করে বিছানার পাশে এসে দাড়ালো রাত। কিছুক্ষন স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বৃষ্টির দিকে। চক্ষু জোড়া লাল বর্ণ ধারণ করে আছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে একটু আগে কেদেছে সে, প্রচুর কেদেছে। আঘাতের কান্না নয় এটি, প্রিয়জন হারানোর কান্না এটা। হৃদয় ভাঙার আর্তনাৎ।
কিছুক্ষন ওখানে দাড়িয়ে থেকে বারান্দায় চলে গেলো রাত। সিগারেটের পেকেট টা খুলে একটা সিগারেট মুখে তুলে নেয় সে। এক দলা ধোয়ার সাথে একনাগারে কাশির শব্দ কানে এলো বৃষ্টির। এক নিয়মে বসে আছে সে। বর্ষা কতো কষ্টই না দিয়েছে তাকে। একের পর এক সিগারেটে কাশির শব্দটা ভারি হয়ে এলো রাতের। আর চোখে বারান্দার দিকে তাকিয়ে আছে বৃষ্টি। তার স্বপ্নের রাতটা কি এমনই লেখা ছিলো তার ভাগ্যে? এই রাত নিয়ে কতো স্বপ্নই বুনা ছিলো মনে। আর আজ? একেই বলে ভাগ্যের লিখন।

একের পর এক সব সিগারেট শেষ করে বারান্দা থেকে ঢুলতে ঢুলতে রুমে প্রবেশ করলো রাত। আগে কখনো সিগারেট মুখে তোলেনি সে। আজ হটাৎ হওয়ায় মাথাটা ধরে গিয়েছে তার।
রুমে এসেই এক ঝাটকায় হাতটা ধরে খাট থেকে নামিয়ে নিলো বৃষ্টিকে। চক্ষু জোড়া লাল করে তাকিয়ে আছে বৃষ্টির দিকে। মাথা নিচু করে রাতের সামনে দাড়িয়ে আছে বৃষ্টি।
– তোর মতো মেয়ের কোনো যোগ্যতাই নেই এই বিছানায় বসার। ওরে বাবা অনেক সেজেছিসও দেখছি। তোকে আমি বিয়ে করে এনেছি তার অর্থ এই নয় যে, আমি সব ভুলে তোর সাথে ঢেং ঢেং করে সংসার করা শুরু করবো। নেভার, তোকে আমি বিয়ে করেছি মাত্র ওই ফ্যামিলিকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য। বাসর করতে আসছে। বাসর।
দত খটমট করতে করতে সাজানো রুমের সব ফুল ছিরে ফ্লোড়ে ফেলে দিতে থাকে রাত। রুমে থাকা সকল কাঁচের জিনিস গুলো একে একে ফ্লোড়ে ছুরে ফেলছে রাত। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাঁচের টুকরো ছরিয়ে ছিটিয়ে আছে সারা রুমে। বৃষ্টির দিকে গরম চোখে তাকিয়ে বলে উঠে,
– এখনো দাড়িয়ে আছিস কেনো। গেট আউট ফ্রম মাই রুম।
রাতের ধমকে কিছুটা কেপে উঠে বৃষ্টি। কাপা গলায় বলে উঠে,
– এতো রাতে কোথায় যাবো? এখানে কাওকেই তো চিনিনা আমি।
ঠাস করে একটা চর পরে যায় বৃষ্টির গালে।
– যেখানে যাবি যা, প্রয়োজনে জাহান্নামের চৌরাস্তায় যা। তবুও আমার সামনে থেকে সর। তোকে যতই দেখছি ততোই মেজাজ খারাপ হচ্ছে আমার। কাওকে চিনিস না তো আমাকে ভালো করে চিনিস যে ঢেং ঢেং করে বাসর করতে চলে এলি? আর সেইদিন তোর উপর দয়া দেখিয়েছিলাম তাই বলে আমি অতটাও মোহান নই।
গালে হাত দিয়ে এখনো নিশ্চুপ হয়ে দাড়িয়ে আছে বৃষ্টি। শুধু এবার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পরছে পানি। বুকের ভেতরটা দুমরে মুচরে যাচ্ছে রাতের প্রতিটা কথায়।
রাত এবার ঠান্ডা মাথায় বলে উঠে,
– ওহ্, এখন তো তুই আমার বৌ। বের করে দিলেও লোকে খারাপ ভাববে। আজ থেকে ওই সোফাটাই তোর বিছানা। এই খাটের ত্রি-সীমানায়ও আসার চেস্টা করবিনা। মনে রাখবি তুই আমার বৌ শুধু মাত্র নামে।
ক্লান্তি নিয়ে এলো মেলো বিছানায় সুয়ে পরে রাত। বৃষ্টি এখনো ঠায় দাড়িয়ে অশ্রু বিশর্জন দিচ্ছে ওখানে। তখনি চোখ পরলো, একটি সোনালি রঙের ছোট মাছ পানির জন্য মেঝেতে ছটপট করছে। তার থাকার পাত্রটাও যে একটু আগে মেঝেতে ফেলে টুকরু টুকরু করে ফেলেছে রাত। গাল থেকে হাত সরিয়ে মাছটাকে তুলে নিলো বৃষ্টি। মাছটাকে বাচানোর জন্য আশেপাশে তাকায় সে। মনে হচ্ছে আজ মাছটাও তার মতো অসহায়।
,
,
সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে নিলো বৃষ্টি। শেষ রাতের দিকে হালকা চোখ লেগে এসেছিলো তার। সকালে আবার ঘুম ভেঙে যাওয়ায় শরিরটা ভার হয়ে ছিলো। তাই ফ্রেশ হয়ে একটা নীল রঙের শাড়ি পরে সে। রাত এখনো বেগোরে ঘুমাচ্ছে। পর্দা সরিয়ে দিতেই সকালের নব সূর্যের মিষ্টি কিরণে কিছুটা মুখে এসে পরছে তার। স্নিদ্ধ চুলে ও ফর্সা মুখ সোন্দর্য যেনো আরো বেড়ে উঠেছে রাতের মধ্যে। বারান্দায় ছোট চেয়ারটায় ফ্যাকাসে মুখ করে বসে রইলো বৃষ্টি। তাকিয়ে আছে বাইরে রাঙা প্রভাতের কিরণে মেতে উঠা প্রকৃতির দিকে।

ঘুম ভাঙায় ফ্রেশ হয়ে ছাদে গিয়ে দোলনাটায় বসে রইলো রাতের ছোট বোন আরশি। মা আর চৈতি মিলে নিচে সবার জন্য নাস্তা তৈরি করছে। আরশি দোলনায় বসে গুন গুন করে গান গাইছে তখনি কেও একজন এসে একটা চটি মারে তার মাথায়। রাগে দাত মুখ খিচকে পেছন তাকিয়ে দেখে রিদ ভাইয়া একটা দাত কেলানো হাসি দিয়ে তার পাশে এসে বসলো। রিদ তার মামাতো ভাই। লোকটা চরম বিরক্তিকর। তার থেকে চার বছরের বড়। রাত ও রিদ সম বয়সি। দুজনের মাঝে মামাতো ফুফাতো ভাইয়ের চেয়ে বন্ধুত্বটাই গভির। এই রিদকে দেখলেই রাগটা চরম পর্যায়ে চলে যায় আরশির। কারন তার পেছনে একবার পরলে নাকানি চুবানি খাইয়ে তারপর ছারবে।
রিদ একটা হাসি ফুটিয়ে বলে উঠে,
– এভাবে তাকিয়ে আছিস কেনো? খুব সুন্দর লাগছে বুঝি আমায়? লাগারই কথা শশুর মশাইয়ের একমাত্র জামাই বলে কথা। বাই দ্যা ওয়ে, এভাবে তাকিয়ে থাকিসনা এই অবলা ছেলেটার প্রেমে পরে যাবি।
আরশি একটু গাল মোচরে বলে উঠে,
– এ্যা,, এভাবে তাকিয়ে তাকিস না প্রেমে পরে যাবি!! তোমার মতো সাইকোর প্রেমে পরবো আমি? হুহ্।
– কি আমি সাইকো? তুই আমার ফুফা ফুফির এক মাত্র জামাইকে সাইকো বলতে পারলি?
আরশি এবার চোখ বড় বড় করে তাকালো রিদের দিকে।
রিদ আবারও বলে উঠে,
– ওসব বাদ দে, শুনলাম ইদানিং কলেজের বেশ কিছু ছেলের সাথে ভাব জমিয়েছিস। কারা ওরা?
– তোমাকে বলবো কেনো? তুমি কে? আর ওরা হলো আমার নতুন ফ্রেন্ড।
– দেখিস উল্টোপাল্টা কিছু করলে আমার শশুরেরই কপাল পুরবে।
– তুমি তো আন ম্যারিড তাহলে তোমার শশুর আসলো কোথা থেকে? আর আমি কিছু করলে তোমার শশুরের কপাল পুরতে যাবে কেনো?
– কারণ তার মেয়ে, আমার মতো হেন্ডসাম ছেলে রেখে আরেকজনের দিকে চোখ দেওয়া, তাহলে আমি কি চেয়ে থাকবো। তাই আমার শশুরের কপালই তো পুরবে।
– তোমার কথার আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারছিনা আমি।
রিদ এবার আরশির নাক টেনে দিয়ে বললো,
– বুঝবি বুঝবি সময় হলে সবই বুঝবি। আমার এতো চালাক শশুরের মেয়ে হয়ে তুই কিভাবে এতো মাথামোটা হলি সেটাই বুঝতে পারিনা আমি।
বলেই চায়ের কাপটা নিয়ে একটা মুচকি হাসি দিয়ে নিচের দিকে হাটা ধরলো রিদ।
চোখ দু,টি বড় বড় করে রিদের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে আরশি। মনে হচ্ছে এক্ষুনি চোখ দুটি বেড়িয়ে আসবে।
“তার মানে ওনি এতোক্ষন আমার বাবাকেই ইনডিরেক্টলি শশুর শশুর বলে সম্মোধন করে গেলেন?
,
,
আরশি বেশ কিছুক্ষন ধরে ডাকছে রুমের বাইরে থেকে। বৃষ্টি বারান্দা থেকে এলো রুমে। রাত এখনো ঘুমের দেশে। কিছুক্ষন স্তব্দ হয়ে চেয়ে আছে বৃষ্টি। এই মানুষটাকে কতোইনা কষ্ট দিয়েছে আপু। এই মানুষটা যে তার স্বামী এটা এখনো অবিশ্বাস্য তার কাছে। তবুও হাজার হোক এখন এটা আমার সদ্য বিয়ে করা স্বামী। আচ্ছা আমি চাইলে কি তাকে আগের সাভাবিক জীবন ফিরিয়ে দিতে পারিনা? আর আমি তার জীবন ঘুচিয়ে দিবোই বা কোন অধিকারে? কারন সে তো গত কাল বলেই দিয়েছে, তার স্ত্রী হওয়ার জোগ্যতা আমার নেই। নামেই মাত্র আমি তার স্ত্রী, অন্যথায় নয়।

To be continue…………

~~ ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।💖

বৃষ্টি ভেজা রাত পর্ব-০২

0

#বৃষ্টি_ভেজা_রাত💖
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ💖

#পর্বঃ__২

ঘরে প্রবেশ করতেই কোমরে বাধা ওড়নাটা খুলে নিলো বৃষ্টি। শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ গুলো স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে পাজামায়। দ্রুত পায়ে নিজের রুমের দিকে হাটা ধরলো সে। পেছন থেকে ডাক দিলো তার মা। রান্না ঘরে কাজ করছে সে।
– এতোক্ষন কোথায় ছিলি বৃষ্টি।
– ওইতো মা মিমদের বাসায় গিয়েছিলাম কিছু নোটস আনতে। সামনে তো পরিক্ষা তাই।
– ফ্রেশ হয়ে আয় নাস্তা রেডি করছি। নাস্তা করে সোজা পড়তে বসবি।
রান্না ঘর থেকেই কথাগুলো বললো বৃষ্টির মা। লক্ষি মেয়ের মতো নিজের রুমে চলে গেলো বৃষ্টি।
ব্যাগ রেখে জামা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায় সে।লম্বা একটা সাওয়ার নিয়ে চুল মুছতে মুছতে বেড়িয়ে আসে। জামা কাপর গুলো ধুয়ে শুকাতে দেয়।
মায়ের ডাকে চলে যায় নাস্তা করতে। ওদিকে রুমে সোফায় বসে আছে বর্ষা। মাথায় চিন্তার ভার। কানে আসছে মায়ের বর্ষা বর্ষা বলে গলা ফাটানো ডাক।
,
,
আজ বর্ষাকে দেখতে আসবে রাতের বাড়ির লোকজন। এর আগে শুধু তাদের সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে কথা দিয়ে রাখা হয়েছিলো।

রাতের মা বাবা ও তার ছোট বোন এসেছিলো আজ। কথা বার্তা পাকা করে গেছে তারা। ওদিকে বর্ষাও মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছেনা কাউকে।
রাত বার বার ফোন দিয়ে বর্ষার নাম্বার বিজি পেলো। কার সাথে এতো কথা বলছে বর্ষা?

বসে বসে ফোন ঠিপছে বর্ষা। তখনই বৃষ্টি এসে বসলো তার পাশে।
– কিরে কিছু বলবি?
– রাত ভাইয়া ফোন দিয়েছিলো। বললো, তুমি নাকি ফোন ধরছোনা।
– ওহ্। আর শুন, ছোট মানুষ এসব নিয়ে মাথা ঘামাতে আসবিনা।
– আচ্ছা আপু, ইদানিং তোমাকে কেমন চিন্তিত মনে হয়, তুমি কি নিয়ে এমন চিন্তিত একটু বলবে?
হটাৎ বর্ষা বৃষ্টির দু,গালে হাত রেখে বলে উঠে,
– আমায় ভালোবাসিস?
– এটা আবার কেমন প্রশ্ন অবশ্যই বাসি।
– আমার জন্য কি করতে পারবি?
– সব।
– যা ঘুমিয়ে পর।
– কিন্তু আপু হটাৎ এমন প্রশ্ন করার কারণ?
– কিছুনা এমনি, যা ঘুমা অনেক রাত হয়েছে।
– তুমি ঠিক আছো তো আপু?
– লাইট টা অফ করে যা শুয়ে পর।
বর্ষার এমন আচরণ বুজে উঠতে পারছেনা বৃষ্টি। লাইট অফ করে নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পরলো সে ও।

দেখতে দেখতে বিয়ের দিন ঘনিয়ে এলো। রাত ইদানিং বর্ষার মাঝে কিছুটা পরিবর্তন খুজে পেলেও সব স্বাবাভিকই মনে হয়েছে তার।

আজ গায়ে হলুদ। রাতকে ফোন দিয়ে আসতে বললো বর্ষা। কিছু ইনফর্টেন্ট কথা আছে তার সাথে।
রাতও বর্ষা দাড়িয়ে আছে একে অপরের সামনে।
– রাত তোমাকে আমার কিছু বলার আছে। যা আমার আরো আগে বলা উচিৎ ছিলো।
– ওফ বর্ষা, আমি তো শুনতেই এসেছি তাই না? আর কি এমন কথা যা বলার জন্য এই সময়ে আমায় ডেকে এনেছো। ওদিকে হয়তো বাসায় আমায় খুজতেই শুরু করে দিয়েছে।
– রাত আমি….
তার আগেই রাতের ফোনটা বেজে উঠলো। রাতে ছোট বোন আর্শির ফোন।
– হ্যালো ভাইয়া, কই তুই? এদিকে সবাই তোকে খুজতেছে।
– এইতো একটু দরকারে বাইরে এসেছি। এক্ষুনি চলে আসছি।
রাত ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে বলে উঠে,
– ওফ বর্ষা এতো নার্ভাস হলে কি চলে? আমার সামনে নিঃসংকোচে কথা বলার অধিকারটা তোমার এখন আছে।
– আসলে নার্ভাস না আমি কথাটা কিভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছিনা। আর এটাও বুঝতে পারছিনা কথাটা শুনার পর তোমার রি-একশানটা কেমন হবে?
এবার একটু কপাল কুচকে বর্ষার দিকে তাকায় রাত। তখনি বৃষ্টি সহ কয়েকজন মেয়ে আসে বর্ষার কাছে।
– আরে আপু তুই এখানে? সেই সারা বাড়ি খুজে বেড়াচ্ছি তোকে। আর রাত ভাইয়া, কথা বলার জন্য তো সারা জীবন সময় পাবেন। এই মিলি এক কাজ কর রাত ভাইয়াকেও ধরে নিয়ে আপুর সাথে হলুদ মাখিয়ে দিই, কি বলিস?
পরিস্থিতি খারাপ দেখে এক দৌড়ে সেখান থেকে বেড়িয়ে রাস্তায় চলে এলো রাত। ওদিকে বৃষ্টির হেসে গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা।

বিয়ের দিন রাতে,
একটা বিয়ের শাড়ি ও কিছু গহনা নিয়ে রুমে আসলো বর্ষার মা। বারান্দায় ফোন কানে নিয়ে দাড়িয়ে আছে বর্ষা। মাকে দেখেই ফোন কেটে একটা হাসির রেখা টানলো।
– এখানে কি করছিস? রুমে আয়, পার্লারের লোক এসে গেছে। আর পাত্র পক্ষও চলে আসবে একটু পর।

বাইরে কাজ ও মেহমানদের আপ্যায়নে দৌড়া দৌড়ি করছে বৃষ্টি। বড়ো বোনের বিয়েতে তারও কিছু দায়িত্ব আছে। তাছারা বরের জুতা চুরির প্লেন তো আছেই।
বর্ষাকে সাজিয়ে রেডি করে ফেলেছে। ওদিকে পাত্র পক্ষও চলে এসেছে। সবাইকে রুম তেকে বের করে এদিক ওদিক পায়চারি করছে বর্ষা। বার বার তিহানের নাম্বারে ফোন দিয়ে চলছে সে।

বিয়ের সব রেডি। হটাৎ ভেতর থেকে আওয়াজ এলো বর্ষাকে কোথাও খুজে পাওয়া যাচ্ছেনা। সারা ঘর খুজেও বর্ষার কোনো দেখা পেলোনা কেও। সবাই মিলে খুজেও কোনো হদিস পেলোনা বর্ষার। পেয়েছে শুধু টেবিলে একটি চিরেকুট।
হতাশা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বর্ষার বাবা। সবাই একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করছে।বিয়ের দিন কনে পালিয়ে যাওয়া তাও আবার লাব এ্যারেজ মেরেজে। পাগড়িটা হাতে নিয়ে স্তব্দ হয়ে দাড়িয়ে আছে রাতও।
বৃষ্টি বার বার ফোন দেওয়ার চেষ্টা করছে কিন্তু বর্ষার ফোন বন্ধ।
রাতের বাবা রুদ্র ঠান্ডা মেজাজের মানুষ। ঠন্ডা মাথায় বৃষ্টির বাবাকে বলে উঠে,
– আমাদের ডেকে এনে এভাবে অপমান না করলেও পারনে। আপনার জদি ফোনে আপনাদের মতামত জানিয়ে দিতেন তাহলে আমরা কখনোই আসতাম না এখানে।
বর্ষার বাবা হাত দুটি জোড় করে বলে উঠে,
– আজ আমি নিজে আপনাদের সামনে লজ্জিত। নিজের মেয়ে যে এমন একটা কাজ করবে তা ভাবতেি পারিনি আমি।
পাশ থেকে রাতের মা বলে উঠে,
– এমন একটা মেয়েকে নিজের পূত্র বধু বানাবো ভেবেছিলাম ভাবতেও লজ্জা হচ্ছে আমার। ছি ছি।
হটাৎ রুদ্র চৌধুরি বলে উঠে,
– দেখুন এতো লাকজনের সামনে এখন আমাদের দুই ফ্যামিলিরই মান সম্মান নিয়ে টানাটানি পরছে। তাই আপনার জদি কোনো আপত্বি না থাকে, তাহলে আমটা আপনার অপর মেয়েকেই বৌ হিসেবে নিয়ে যেতে চাই।
কথাটা শুনা মাত্রই যেনো আকাশ থেকে পরলো বৃষ্টি। মাথাটাও ধরে গিয়েছে সাথে সাথে। বোনের বিয়েতে আজ কতো আনন্দ কতো মজা বরকে নিয়ে কতো কিছুই প্লেন করে রেখিছিলো বৃষ্টি। আর শেষে এমন একটা পরিস্থিতিতে পরতে হবে তা কখনো ভাবতেও পারেনি বৃষ্টি। আপু তো এই ব্যাপারে আমাকেও কিছু বলেনি।আর কিছু ভাবতে পারছেনা বৃষ্টি, আশে পাশে পরিস্থির দিকে তাকিয়ে থাকা ছারা আর এই মুহুর্তে কিছুই মাথায় আসছেনা তার।
পাশ থেকে রাতের মা বলে উঠে,
– অসম্ভব, রাত এটা কিছুতেি মেনে নিবেনা। কারণ লাইফটা রাতের, আমরা সিদ্ধান্তের উপরে রাতের উপর চাপ প্রয়োগ করতে পারিনা।
তখনি পাশ থেকে রাত বলে উঠে,
– আমি রাজি।
এটা বলেই সেখান থেকে সরে গেলো রাত। চোখ দুটি লাল হয়ে আছে, রাগে কাপছে ঠোট জোড়া। বুঝাই যাচ্ছে এই সিদ্ধান্তটা সে মন থেকে নয়, রাগের ক্ষোপ থেকেই নিয়েছে। মান সম্মানের কথা চিন্তা করে রাজি হয়ে যায় বৃষ্টির বাবাও।
বৃষ্টির কাছে গিয়ে বলে উঠে,
– মারে, আমি জানি তোর উপর অন্যায় হচ্ছে এটা। তবুও এটা একটা মান সম্মানের প্রশ্ন। আজ এতো মানুষের সামনে আমার সম্মানটা নিচু করিস না মা। বাবা হয়ে তোর কাছে অনুরুধ করছি আজ। দেখিস অনেক সুখি হবি তুই জীবনে। প্লিজ মা আজ কথাটা পিরিয়ে দিসনা তুই।
বৃষ্টি বাবার হাত দুটি ধরে বলে উঠে,
– আমার কারণে জদি তোমরা সম্মার ফিরে পাও তাহলে আমার কিছু বলার নেই বাবা তোমরা যেটা ভালো মনে করো সেটাই করো।

কবুল বলার পর মুহুর্তে নিজেকে একটা নতুন মানুষ হিসেবে আবিস্কার করলো বৃষ্টি। আজ থেকে নতুন পরিচয় তার। আজ থেকে নিজের সব দায় দায়িত্ব একটা নতুন মানুষের। রাতের মুখেও কোনো কোনো হাসির আভাস নেই। একটু আগে শুধু কবুল বলার আগ মুহুর্তে একটা তাচ্ছলের হাসি দিয়েছিলো সে।
বৃষ্টি ভালোই বুঝতে পারছে এই হাসিতে তার সুখ নয়, জীবন তছনছ হওয়ার হাসি এটা।

To be continue…….

বৃষ্টি ভেজা রাত পর্ব-০১

0

বৃষ্টি_ভেজা_রাত💖
#মেহেদী_হাসান_রিয়াদ💖
#পর্বঃ__১

ফ্লোড়ে ছিপছিপে রক্তের দাগ। ব্যাথায় কোমড়ে হাত দিয়ে বসে আছে বৃষ্টি। রক্তের দাগ গুলো স্পষ্ট দেখা যাওয়ায় ওড়নাটা খুলে কোমড়ে বেধে নিয়েছে সে। একটা ছাউনির নিচে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলো, আর তখনি এমনটা শুরু হয়েছে বৃষ্টির। প্রায় অন্ধকার নেমে এসেছে। দুরে বসে থাকা কয়েকজন ছেলে বার বার আড় চোখে তাকাচ্ছে তার দিকে। একে অপরকে কি বলছে তা স্পষ্ট বুঝতে পারছেনা বৃষ্টি। প্রচুর ভয়ও করছে তার। ওড়নাটা কোমরে বেধে রাখায় চুলগুলো সামনে এনে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করছে সে। এবার ছেলেগুলোও এসে তার পাশে দাড়ালো। একজনের হাতে সিগারেট আর বাকি দু,জনের মুখে বাকা হাসি।
– আপু মনে হয় বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন তাইনা? আমাদের গাড়ি আছে চলুন আমরাই দিয়ে আসবো আপনাকে।
কথাটা বলেই মুখে থাকা সিগারেট টা ছুরে ফেলে ছেলেটি। খিক খিক করে হেসে উঠলো পাশের ছেলে দুটি।
কোনো উত্তর না দিয়ে ভয়ার্ত চেহারায় ওখান থেকে হাটা ধরলো বৃষ্টি। পেছন থেকে ছেলেটা হাতটা চেপে ধরলেই এক ঝাটকায় হাতটা ছারিয়ে দ্রুত পায়ে হাটা ধরে সে। বৃষ্টি পেছনে তাকাতেই দেখে ছেলেগুলোও তার পিছু নিয়েছে। এবার ভয় যেনো পুরুপুরি ভাবে গ্রাস করে নিয়েছে তাকে। আশেপাশেও কাওকে চোখে পরছেনা যে হেল্প চাইবে। ধিরে ধিরে দৌড়াতে শুরু করে সে।
দৌড়াতে দৌড়াতে হটাৎ রাস্তার বাম পাশ থেকে একটা গাড়ি এসে ব্রেক চাপে তার সামনে। তবুও তাল সামলাতে না পেরে গাড়িটার সাথে হালকা ধাক্কা খেয়ে রাস্তায় পরে যায় বৃষ্টি।
ডান হাতটা কিছুটা ছিলে গিয়েছে তার। মাথায়ও হালকা লেগেছে। হাত থেকেও রক্ত বের হয়ে আসছে কিছুটা।
গাড়ি থেকে নেমে আসে একটা ছেলে। ফর্সা গায়ের রং, জামার হাতা গুলো কুনুই পর্যন্ত পোল্ড করা। গালে হলকা খোচা খোচা কালো রংয়ের দাড়ি। ফর্সা মুখে কালো রঙের দাড়িগুলোও যেনো ভালোভাবেই ম্যাচিং করে নিয়েছে। বৃষ্টিকে কিছু বলতে চেয়েও তেড়ে আসা ছেলেগুলো দেখে কিছু বললোনা সে।
বৃষ্টির দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো ছেলেটা। আরেক হাত পকেটে গুজা। মোটামুটি এটিটিউট বিধ্যমান। ছেলেটার হাত ধরে উঠে দাড়িয়ে ভয়ার্ত চেহারায় ছেলেটার পেছনে গিয়ে দাড়ালো বৃষ্টি।
তেড়ে আসা ছেলেগুলো বৃষ্টির কাছে আসতেই রাতকে দেখে থমকে গেলো তারা।
– র. রাত ভাই আপনি?
পকেট থেকে হাতটা বের করে রাত সজোরে একটা চর বসিয়ে দেয় ছেলেটার গালে। রাত ছেলেটার কলার চেপে ধরে, বৃষ্টিকে বলে উঠে,
– সামনে আসো।
বাধ্য মেয়ের মতো সামনে এসে দাড়ালো বৃষ্টি। রাত ছেলেটাকে বলে উঠে,
– মা ডাক তাকে।
– ভাইয়া ও তো আমার বয়সে ছোট হয়ে আ…..
তার আগেই আরেকটা চর পরে ছেলেটার গালে।
– মা ডাক। (হুঙ্কার দিয়ে)
ছেলেটা গালে হাত দিয়ে বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে।
– মা।
– আবার ডাক,,,
– মা।
– আবার ডাক,,,
– মা।
রাত ছেলেটার কলার ধরা অবস্থায় আরেক হাতে চুল ঠিক করে দিতে দিতে বলে উঠে,
– মেয়েরা হলো মায়ের জাত। মা কে যেমন সম্মান দিস, তেমনই সম্মান করতে শিখ পুরু মেয়ে জাতিকে। আর মেয়েদের দুর্বলতার সুজুগ নেওয়াটা কোনো সু-পুরুষের কাজ হতে পারেনা।
– সরি ভাইয়া।
– এই রাস্তা ধরে সোজা এক দৌর দিয়ে চলে যাবি, পেছন ফিরবিনা একধম।

ছারা পেয়েই দৌড়ে চলে যায় ছেলেটি। রাত ঘুরে দাড়ায় বৃষ্টির দিকে।
– এভাবে রাস্তায় একা চলাচল না করলে কি হয়না? তাও আবার এমন অবস্থায়? যদি কিছু হয়ে যেতো আজ?
ভয়ে চুপ করে আছে বৃষ্টি। কিছু নোটস আনতে গিয়েছিলো বান্ধবির বাসায়। ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধা হয়ে গেলো। আর ফিরতি পথেই এমনটা হতে হলো তার সাথে। মাথায় চোট পাওয়ায় ধিরে ধিরে চোখ বন্ধ হয়ে আসছে তার।

চোখ খুলে তাকাতেই নিজেকে একটা হসপিটালে আবিস্কার করলো বৃষ্টি। বুঝতে পারছেনা এখানে এলো কি করে? হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে, ছিলে যাওয়া জায়গায় বেন্ডেজ করা। পাশে তাকাতেই সেই রাত নামের ছেলেটাকে দেখতে পায় সে। ফোনে কার সাথে যেনো কথা বলছে।

বৃষ্টিকে বাড়ি পৌছ দিচ্ছে রাত। পিট পিট করে লুকুচুরি দৃষ্টিতে রাতের দিকে বার বার তাকাচ্ছে বৃষ্টি। স্নিদ্ধ চুল, মায়াবি চোখ, গালে খোচা খোচা কালো দাড়ি। সাদা জামার হাতা গুলো কুনুই পর্যন্ত পোল্ড করা। ফর্সা হাতে কালো রঙের একটা ব্রন্ডের এ্যাপেল ওয়াচ। সব মিলিয়ে যেনো পুরুই একটা ক্রাশ বয়। এতোক্ষন ভালো করে খেয়াল না করলেও এবার বৃষ্টির দৃষ্টি আটকে আছে রাতের দিকে। বিষয়টা লক্ষ করে রাত বলে উঠে,
– কোন দিকে?
রাতের কথায় ধ্যান ভাঙলো বৃষ্টির। মাথা নিচু করে উত্তর দিলো,
– একটু সামনে গিয়ে বামে।

বাসার সামনে গিয়ে রাত একবার বৃষ্টির দিকে তাকাচ্ছে আবার বাড়ির দিকে তাকাচ্ছে। বৃষ্টি গাড়ি থেকে নেমে রাতকে একটা থ্যাংস দিয়ে হাটা ধরলো বাড়ির দিকে। পেছন থেকে রাত ডেকে উঠে,
– এই যে শুনুন।
পেছন ফিরে তাকায় বৃষ্টি,
– এটা কি আপনাদের বাসা?
– হ্যা, কেনো?
– তুমি কি বর্ষার ছোট বোন বৃষ্টি?
– হ্যা, কিন্তু আপনি আপুকে চিনেন কিভাবে?
একটা হাসি দিয়ে গাড়ি নিয়ে ওখান থেকে চলে গেলো রাত। বৃষ্টি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাতের চলে যাওয়ার দিকে। হিসেব মিলাতে পারছেনা সে। হটাৎ তুমি করে বললো, আবার আপুর কথা জিঙ্গেস করলো। আর লোকটা আমাকে আর আপুকেই বা চিনে কি করে? আর চিনেতো পরিচয় না দিয়ে হুট করে কেনো চলে গেলো? আজব!

কিছুটা দুরে গিয়েই বর্ষাকে ফোন দিলো রাত। দু,বার বাজতেই রিসিভ করলো বর্ষা। ফোন কানে নিয়ে বেলকনিতে গিয়ে দাড়ালো সে। হাতে কফির মগ। কফিতে চমুক দিয়ে বলে উঠে,
– হ্যালো,,,,
– কেমন আছো?
– ভালো।
– সারাদিন তো একবার ফোনও দিলেনা।
– একটু ব্যাস্ত ছিলাম তাই। তো কি করছো, খেয়েছো ঠিক মতো?
– হুম,,,
– দেশে ফিরছো কবে?
একটা হাসি দেয় রাত,
– একটু নিচে আসতে পারবে?
– কেনো?
– আগে আসোনা, সারপ্রাইজ আছে।
– পারবোনা, কি সারপ্রাইজ আগে বলো। তাছারা আমি এই অসময় নিচে যেতে পারবোনা।
– আমি এখন তোমার বাসার সামনে।
কথাটা শুনতেই বিষম খেলো বর্ষা। নিচে তাকাতেই দেখে একটা কালো গাড়ি দাড়িয়ে আছে। আর তার পাশে দাড়িয়ে আছে রাত। হাত পা যেনো মুহুর্তেই অবস হয়ে আসছে বর্ষার।
নিরবতা ভেঙে রাত বলে উঠে,
– কি হলো? মনে হচ্ছে আমাকে দেখেই তুমি আতঙ্কিত হয়ে আছো?
আর কিছু বলতে চেয়েও বলতে পারছেনা বর্ষা। ফোনটা কেটে এক দৌড়ে ভেতরে চলে গেলো সে।

ভিতরে গিয়েই তিহানকে ফোন দিলো বৃষ্টি।
– হ্যালো তিহান।
– হুম।
– সর্বনাস হয়ে গেছে।
– কেনো কি হয়েছে?
– রাত ফিরে এসেছে দেশে।
– রিলেক্স, মাই ডিয়ার।

ওদিকে রাত বর্ষার নাম্বারে ফোন দিয়ে দেখে নাম্বার বিজি। রাতের ধারনা হয়তো বর্ষাকে না বলে এভাবে চলে আসায় রাগ করেছে সে। ছয় বছরের সম্পর্ক তাদের। পারিবারিক ভাবে সব ঠিকঠাকও হয়ে আছে তাদের। রাত পড়ালেখা শেষ করে দেশে ফিরলেই তাদের বিয়ের ব্যাপারে আগাবে পরিবারের লোকজন। কিন্তু এর ফাকে বর্ষা অন্য একজনের সাথে জড়িয়ে গিয়েছে। তার মনে হচ্ছে তিহানই রাতের থেকে ব্যাটার। বিদেশে স্যাটেল সে। তার দেশ বিদেশে ঘুরে বেড়ানোর স্বপ্নটা তিহানই পুরণ করতে পারবে। রাতকেও তিহানের ব্যাপারে কিছু বুঝতে দেওয়া যাবেনা। হয়তো সব উলোট পালট করে ফেলবে রাত। আর ওদিকে বিয়ের জন্য আগাবে পরিবার। এখন যা করার সব ঠান্ডা মথায়ই করতে হবে।

রাতকে এক মেসেজ পাঠায় বর্ষা।
“এখন আসতে পারবোনা রাত। কাল দেখা করবো তোমার সাথে। আর হ্যা, তুমি আসার আগে আমায় একটিবার জানালেও পারতে।””

বর্ষার এমন আচরণে অবাক হলো রাত। যেই বর্ষা আগে মধ্য রাতে তাকে ফোন করে নিয়ে আসতো তাকে বাসার সামনে। আর আজ সেই বর্ষাই তাকে এ্যাবোএট করছে? নাকি এটা তার অভিমান? সাত পাঁচ ভেবে গাড়ি নিয়ে চলে গেলো রাত।

ওদিকে কিছুক্ষন ওখানে দাড়িয়ে থেকে ঘরের দিকে হাটা ধরলো বৃষ্টি। তার এতোক্ষনে মনে হলো, আপুর সাথে রাত নামের একটা ছেলের সম্পর্ক আছে। কিন্তু তাকে কখনো দেখেনি বৃষ্টি। তাহলে এই সেই রাত। ছি ছি শালিকা হয়ে হবু দুলাভাইর উপরই ক্রাশ খাওয়া। কি লজ্জা।

ঘরে প্রবেশ করতেই কোমর থেকে ওড়নাটা খুলে নিলো বৃষ্টি। পাজামাতে রক্তের দাগ গুলো প্রায় শুকিয়ে গেছে। কিন্তু স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে দাগ গুলো। দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকে নিজের রুমের দিকে হাটা ধরলো সে। তখনই পেছন থেকে ডাক দিলো তার মা।

To be continue……..

তৈমাত্রিক পর্ব-৩৭ এবং শেষ পর্ব

0

#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ৩৭ {অন্তিম পর্ব}

🌸🤍🌸

।।

।।

।।

দেখতে দেখতে কেটে যায় আরো দুই মাস। ইতোমধ্যে মেহের খানিক বড়ো হয়েছে। কিন্তু তাকে দেখে বোঝা যায় না যে সে মাত্র দুই মাসের বাচ্চা। আয়ুশ,লায়লা খতুন বা কণার আসা যাওয়া প্রায় প্রত্যেক দিন লেগেই থাকে। আয়ুশ তো মাঝে মাঝে অফিস ছেড়েও এসে পরে মেহেরের জন্য। আর যদি মেহের একবার আয়ুশ কে দেখেছে তাহলে তো হলোই। তখন মনে হয় তার মাকেও তার লাগে না। তবে এখনো আয়ুশ & মেহরামের বিয়ে টা হয় নি। সবাই চায় পুরো বিধিবিধান মেনে বিয়ে টা করাতে। বিয়ে হয় নি তবে খুব শীঘ্রই হয়ে যাবে। তবে সবার খুশি এখন মেহের কে ঘিরেই। মেহরাম ঠিক আগের মতো হয়ে গেছে। এখন সে হাসতে জানে। খুব কষ্টে এসেছে মুখের তার এই হাসিটা। সম্পূর্ণ টাই নিজের মেয়ের জন্য। সবাই মেলাতে যায় যে আসলে মেহের দেখতে হয়েছে কার মতো। সবাই বলে মেহের পুরো মেহরামের কার্বান কপি কিন্তু মেহরামের কাছে তার মেয়েকে ঠিক তনুর মতো লাগে। মাঝে মাঝে মনে হয় তনুই ঘুড়েফিরে এসে পরেছে মেহরামের কাছে। মেহের হওয়ার সাত দিন পর মেহরাম আর আয়ুশ মিলে মেহেরকে নিয়ে তনুর কবরের পাশে গয়েছিলো। তবে মেহরাম কাদে নি। একবার তনুর দিকে তো আরেকবার মেহেরের দিকে তাকাচ্ছিলো। আয়ুশ আজ সকালে মেহরামদের বাড়ি এসে মেহের কে দেখে গিয়েছে। এখন সে অফিসে। তবে লায়লা খাতুন আর কণা মেহরামদেরই বাড়িতে। কথা বলার ফাকেই আরেক প্রসঙ্গ উঠে আসে।

লায়লা;; আপা আসলে বলছিলাম কি যে দুই মাস তো পার হয়ে গেলো। এবার না হয় আয়ুশ আর মেহরামের বিয়ে টা….

আতিয়া;; হ্যাঁ আমিও তাই বলতে চাইছিলাম। কেননা ডেলিভারি তো হয়েই গিয়েছে। আর মায়ের হায়েজ নেফাসের তো ৪৫ দিন পার হয়ে গিয়েছে এবার সব ঠিক আছে আর বিয়ে করাও জায়েজ।

কনিকা;; তাহলে আর কি ভালো দিন দেখো, দেখে শুনে দিয়ে দাও দুইটার বিয়ে।

লায়লা;; মেহরাম আর আয়ুশের সাথে একটা বার কথা বলা উচিত।

আতিয়া;; আয়ুশকে বিকেল বেলা অফিস থেকে আসতে বলুন এখানে তারপর দুইজন কে সামনা সামনি বসিয়ে না হয় কথা বলা যাবে।

কনিকা;; হ্যাঁ তাই কর।

কণা;; তার মানে এবার পুরো পাক্কা যে বিয়ে খাবো।

লায়লা;; আরে হ্যাঁ।

যেই ভাবা সেই কাজ। বিকেল বেলা অফিসে কাজের চাপ কম থাকলে লায়লা খাতুন আয়ুশকে মেহরামদের বাড়িতে আসতে বলে। আয়ুশ বেশ কিছুক্ষণ পর এসেও পরে। বাড়ির ভেতরে এসেই দেখে হলরুমে বসে বসে সবাই আড্ডা দিচ্ছে। তবে মেহরাম মেয়েকে খাওয়ানো নিয়ে তুলকালাম কান্ড বাধিয়ে ফেলেছে। মেহরামের এমন জংলি মার্কা অবস্থা দেখে আয়ুশ ফিক করে হেসে দেয়। কিন্তু মেয়ে কে খাওয়াতে না পেরে মেহরাম যেমন অতিষ্ঠ হয়ে গেছে এখন আয়ুশের এমন হাসি দেখে রাগে বোম হয়ে গেলো।

মেহরাম;; খুব হাসি পাচ্ছে তাই না, মানে খুব একদম। হাসো হাসো।

আয়ুশ;; না মানে আসলে আমি তো এমনি হাসছিলাম আর কি। আহাম…আহাম..

মেহরাম;; না না থামলে কেন হাসো বেশি করে হাসো। আমার জ্বালা তো কেউ আর বুঝে না। বাপরে বাপ। গলা, গাল, মুখ, হাত একদম লেপ্টে ফেলেছে।

আয়ুশ;; বাচ্চা দের আস্তে ধীরে সুন্দর করে খাওয়াতে হয়। এভাবে ঠেসে ধরে খাওয়ালে তো এমনই হবে। দাও দেখি আমাকে দাও।

মেহরাম;; বাব্বাহ,, খুব অভিজ্ঞতা দেখি আপনার।

আয়ুশ;; জ্বি এখন আপনি আমাকে দিন আমি খাওয়াচ্ছি। এগুলো আপনার কর্ম নয়।

আয়ুশ প্রথমে মেহরামের কাছ থেকে মেহেরকে কোলে তুলে নেই। তারপর ওয়েট টিস্যু পেপার দিয়ে মেহেরের গলা মুখ সব মুছে দেয়। মেহরামের হাত থেকে খাবারের বাটি টা নিয়ে আস্তে করে খাইয়ে দিতে থাকে। আর এটা ওটা কত্তো কিছু বলছে। মেহের যেন এখন খিলখিল করে হাসছে আর খাচ্ছে। মেহরাম তো অবাকের চরম পর্যায়ে। আর বাকি সবাই গালে হাত দিয়ে তাদের কান্ড দেখছে। দেখতে দেখতে দশ মিনিটের মধ্যেই খাওয়ানো শেষ হয়ে গেলো। যা মেহরাম গতো আধা ঘন্টা তেও পারে নি। খাওয়ানো শেষ হলে আয়ুশ বাটি টা মেহরামের হাতে দিয়ে দেয়। ফিডারে করেই কিছুটা পানি খাইয়ে দেয়। মেহরাম হাতে বাটি নিয়েই হাবলার মতো করে তাকিয়ে আছে। আয়ুশ তা দেখে বলে ওঠে…..

আয়ুশ;; বাচ্চাদের এভাবে খাওয়াতে হয়, তোমার মতো যুদ্ধ করে নয়। বুঝলে

মেহরাম;; বাহহ কতো সুন্দর করে খেলো তাহলে আমি কি দোষ করেছিলাম।

আয়ুশ;; কীভাবে খাওয়াতে হয় তা জানো?

মেহরাম;; মানে বলছিলাম কি যে আগে কি বাচ্চা সামলানোর কাজ করতে নাকি তুমি।

আয়ুশ;; বাচ্চাদের সামলাতে কাজ করতে হয় না, ভালোভাবে করলেই হয়।

কণা আয়ুশের কোল থেকে মেহের কে নিয়ে বাড়ির বাগানে ঘুড়তে চলে আসে, সাথে আকাশও চলে যায়। এবার মেহরাম আর আয়ুশ একসাথে বসে পরে আর বাকিরাও।

আয়ুশ;; তো মা ডেকেছিলে কি হয়েছে?

লায়লা;; বিয়ে কবে করবি?

আয়ুশ;; যেদিন তোমরা করতে বলবে আর মেহরামের মত থাকবে সেইদিনই।

লায়লা;; ভাবছিলাম যে এখনই করে ফেললে কেমন হয় মানে ৪৫ দিন তো পার হয়ে গেছে। আর এখন সবকিছু নরমাল আছে সাথে মেহরাম আগে থেকে সুস্থও আছে। তাহলে

আয়ুশ;; তোমরা সবাই এক কথা বলছো?

আতিয়া;; হ্যাঁ বাবা সবাই।

আয়ুশ;; মেহরাম রাজি থাকলে আমার কোন আপত্তি নেই।

কনিকা;; মেহরাম, তুই কি বলিস..!

মেহরাম;; আমার কিছুই বলার নেই। যা ভালো বুঝ

লায়লা;; তাহলে কোন একটা ভালো দিন দেখে বিয়ের দিন তারিখ সব ঠিক করে ফেলি।

অবশেষে সবার মতামতেই বিয়ে ঠিক করা হয়। আজ থেকে শুরু করে ঠিক তিনদিন পর আয়ুশ আর মেহরামের বিয়ে। বিয়ে টা যেহেতু ঘরোয়া ভাবেই হবে তাই বাড়ির মানুষ জন ছাড়া তেমন কেউ নেই। তবে ঘরোয়া ভাবে হবে বলেই যে আয়োজন কম হবে তা কিন্তু নয়। আস্তে আস্তে সব আয়জোন করা হচ্ছে। মাঝ খানে দু-দুটো দিন যেন চোখের পলকেই কেটে গেলো। পুরো বাড়ি কে সাদা আর নেভি ব্লু কালারের মরিচ বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে। বাড়িটা যেন দূর থেকেও ঝলমল করছে। বাড়িতে কেমন একটা জমকালো ভাব। সবাই এটা ওটা বলছে, হাসছে, কাজ করছে। কণা বাড়িতে যায় নি। মেহরামের সাথেই থেকে গিয়েছিলো। তার মা জোর করলে মেহরামই বলে কয়ে রেখে দেয় তাকে। কণা মেহের কে নিয়ে আছে। আর মেহরাম বাড়ির এই সবকিছু ঘুড়ে ঘুড়ে দেখছে। ঘুড়তে ঘুড়তেই হঠাৎ করে মেহরামের চোখ আটকে যায় টি-টেবিলের ওপরে থাকা তনুর ছবির দিকে। মেহরাম মুচকি হাসে। তখনই আকাশ দৌড়ে আসে মেহরামের কাছে ফোন নিয়ে। দেখে আয়ুশের ফোন। মেহরাম কিছু টা দূরে গিয়ে রিসিভ করে৷

মেহরাম;; হ্যালো..

আয়ুশ;; হাই মেহেরের মা।

মেহরাম;; 😆😅

আয়ুশ;; মেহেরের আম্মা শুনতে আছো নি মোর কতা..!

মেহরাম;; এই কি বলো এগুলা, কি ধরনের ভাষা।

আয়ুশ;; হাহাহা,,হাহাহা। মজা করছিলাম। কি করো?

মেহরাম;; কিছুই না শুধু সারা বাড়ি তে ঘুড়ে বেড়াচ্ছি।

আয়ুশ;; বাকি সবাই কি করে আর মেহের কোথায়?

মেহরাম;; বাকি সবাই কি এটা ওটা কাজ করছে। মানে বিয়ে বলে কথা। কিন্তু আমার না কেমন যেন লাগছে মানে বিয়ে তো ঘরোয়া ভাবে তাহলে এত্তো মাতামাতি।

আয়ুশ;; আরে বিয়ে এটা মাতামাতি থাকবে না।

মেহরাম;; মেহের কণার কাছে।

আয়ুশ;; ওহহ আচ্ছা।

মেহরাম;; হুমম

আয়ুশ;; আচ্ছা শুনো..

মেহরাম;; বলো

আয়ুশ;; আমি না একটা প্ল্যান করেছি।

মেহরাম;; সেটা কি?

আয়ুশ;; আমাদের বিয়ের শপিং তো এখনো হয় নি তাই না। তো আমরা এক কাজ করবো। আমার জন্য বিয়ের কাপড় তুমি কিনবে আর তোমার জন্য আমি কিনবো কেমন..!

মেহরাম;; কিন্তু যদি তোমার পছন্দ না হয় তাহলে!

আয়ুশ;; আরে ধুর তোমার চয়েজ আমি জানি, পছন্দ হবে না মানে আলবাদ হবে। তবে আমি তো আছি আমার চিন্তায় যদি তোমার পছন্দ না হয় তো।

মেহরাম;; আরে না হবে। আর না হলে আবার যাবে, গিয়ে আবার কিনে আনবে।

আয়ুশ;; এ্যাহ্ 😟

মেহরাম;; হ্যাঁ

আয়ুশ;; 😵

মেহরাম;; আরে মজা করছি পাগল।

আয়ুশ;; উফফ বাচলাম।

এভাবেই কতোক্ষণ কথা বলে কেটে গেলো। বিকেলের দিকে আয়ুশ & মেহরাম, আতিয়া, কণা আর লায়লা খাতুন গেলেন বাইরে। মেহের তার নানুর সাথে বাড়িতেই আছে। তবে আয়ুশ আর মেহরাম আলাদা আলাদা গেলো কাপড় কিনতে। আয়ুশ প্রথমেই চলে গেলো মেয়েদের শো-রুমে। আর মেহরাম ছেলেদের। সেই কখন থেকে মেহরাম একটার পর একটা কাপড় দেখেই চলেছে কিন্তু কোন মতেই পছন্দ হচ্ছে না। মেহরামের সাথে সবাই রয়েছে কিন্তু আয়ুশের সাথে কেউ যায় নি। যায় নি বলতে আয়ুশ সাথে নেয় নি। কাপড় উলোট পালোট করতে করতেই একটা শেরওয়ানি মেহরামের চোখে বাধে। শেরওয়ানি টা পুরো সাদা কালারের আর তার মাঝে স্টোনের কাজ করা। ভারি সুন্দর দেখতে। মেহরাম ঠিক করলো সেটাই নিবে। কিন্তু এদিকে নিজের সামনে এতোগুলো লেহেঙ্গা সিস্টেমের জামা দেখে আয়ুশের মাথা ঘোড়াচ্ছে। এর আগে সে মেয়েদের এমন জামা কখনোই কিনে নি হ্যাঁ অবশ্য কণার জন্য নিয়েছে কিন্তু সেগুলো সিম্পল ছিলো। দোকানের মালিক নিজেও হয়রান হয়ে গিয়েছেন। তবুও আয়ুশের পছন্দ হয় না। অবশেষে আরো কিছু কালেকশন নিয়ে এলো এগুলোই দোকানের একদম লেটেস্ট। খুব কষ্টে বেছে বেছে একটা জামা হাতে তুলে নেয় আয়ুশ। একদম মন মতো পেয়েছে এবার। সেটাই প্যাক করে নিয়ে এসে পরে। আয়ুশ বাইরে বের হয়েই দেখে মেহরাম দাঁড়িয়ে আছে। একহাত কোমড়ে দিয়ে আরেকহাত দিয়ে কপালে ঠেকিয়ে রোদ আসাকে বাধা দিচ্ছে। আয়ুশ বুঝলো যে অনেক দেরি করে ফেলেছে সে। আয়ুশ গিয়ে মেহরামের সামনে দাড়াতেই মেহরাম তাকে কতো গুলো ঝাড়ি মেরে দেয়। আর কণা খিলখিল করে হেসে দেয়। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যারও পরে আসে সবাই। জিনিসপত্র সব এসে সোফার ওপর রেখে দিয়েই মেহরাম আগে মেহেরকে কোলে তুলে নেয়। কতোক্ষণ নিয়ে থেকে তারপর মেহেরকে আয়ুশের কোলে দিয়ে দেয়। আর মেহরাম বসে সবার সাথে কথা বলতে থাকে। সেই রাত টা সবার এভাবেই কেটে যায়। তবে মেহরাম আর আয়ুশ একে ওপর কে নিজেকের ব্যাগ গুলো খুলতে মানা করে। বাড়িতে গিয়ে তারপর সব দেখতে বলে। এক সময় কথা বলতে বলতে আয়ুশ আর তার মা চলে যায়। সবার কাছ থেকে বিদায় নিতে থাকে

আয়ুশ;; কিরে চল (কণার উদ্দেশ্যে)

কণা;; না না আমি যাবো না। আমি এখানেই থাকবো আমি মেয়েদের পক্ষ থেকে। আমার কতো শখ ছিলো যে নিজের বোনের বিয়েতে কত্তো মজা করবো। মেয়েদের তরফ থেকে থাকবো কিন্তু আল্লাহ কপালে দিয়েছে একটা হারামী ভাই। আমি যাবো না বাড়ি আমি এখানেই থাকবো। কাল আসিস তুই যা।

আয়ুশ;; হপ আমার পক্ষ থেকে থাকবি, চল।

কণা;; না না না

মেহরাম;; আয়ুশ, থাক না। জেদ করছে থাক। তুমি যাও

কি আর করার আয়ুশ কণাকে মেহরামের কাছেই রেখে গেলো। আয়ুশ আর তার মা চলে এলো সবাইকে বলে। অনেকক্ষণ বাইরে ছিলো তাই সবাই অনেক ক্লান্ত মেহরাম ওপরে নিজের রুমে চলে গেলো। গিয়েই বিছানাতে গা এলিয়ে দিলো। তারপর আস্তে আস্তে উঠে নিজের ব্যাগ থেকে আয়ুশের পছন্দ করে কেনা কাপড় টা বের করলো। সত্যি বলতে মেহরাম একটানা ঠিক কতোক্ষন যে জামার দিকে তাকিয়ে ছিলো জানা নেই। ভীষণ সুন্দর জামা টা। তবে অবাক ভাবেই দেখা গেলো যে আয়ুশের শেরওয়ানির সাথে মেহরামের জামা মিলে গেছে। মেহরামের জামা টাও সাদা তবে ভারি কারুকাজ করা। এইসব বসে বসেই মেহরাম ভাবছিলো তখনই আয়ুশের ফোন আসে। মেহরাম ধরে…

মেহরাম;; হ্যালো

আয়ুশ;; পছন্দ হয়েছে?

মেহরাম;; তোমার চয়েজ এতো ভালো হলো কবে থেকে?

আয়ুশ;; অনেক আগে থেকেই আমার চয়েজ ভালো ছিলো শুধু তুমিই দেখতে পেতে না।

মেহরাম;; হয়েছে এবার বলো শেরওয়ানি কেমন হয়েছে?

আয়ুশ;; অনেক বেশি সুন্দর আর দুইজনের টাই একদম মিলে গেছে। আমার মতে সাদা সুভ্রতার আর পবিত্রতার প্রতীক।

মেহরাম;; হ্যাঁ।

মেহরাম আর আয়ুশ কথা বলে রেখে দেয় সেইদিনের মতো। সবই ঠিকঠাক ভাবে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে ভোরের আলো ফুটে ওঠে। আজ আয়ুশ & মেহরামের বিয়ে। মেহের ও মনে হয় এতো সকালে ঘুম থেকে উঠে না যতোটা তাড়াতাড়ি আজ মেহরাম কে ঘুম থেকে টেনে তোলা হয়েছে। ফ্রেশ হয়ে এসে পরে। তারপর কণাকেও টেনে তোলে। কণা যে ঘুম কাতুরে উঠে না। অবশেষে মেহরাম কাতুকুতু দেওয়া শুরু করে তারপর কণা উঠে পরে। বাড়িতে গতরাতে সবাই ঘুমিয়েছিলো কিনা সন্দেহ। মেহরাম নিচে গেতেই দেখে আতিয়া আর কনিকা শ্বাস নেবার সময় পাচ্ছে না সাথে মেহরামের বাবা আর চাচাও। তড়িঘড়ি করে সব কিছু করছে। মেহরাম কিছুটা অবাকই হয় সবার এমন অবস্থা দেখে। মেহরাম নিচে সিড়িতে দাঁড়িয়ে ছিলো তখনই কানে মেহেরের কাদার শব্দ ভেসে আসে। মেহরাম দ্রুত উঠে রুমে চলে যায় গিয়ে দেখে কণা কোলে নিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। কণার কাছ থেকে মেহেরকে নিয়ে তাকে দুধ খাইয়ে দিতে থাকে আর কণা ততোক্ষণে ফ্রেশ হয়ে আসে। প্রায় সবকিছুই ঠিক কিছুক্ষন পর আয়ুশ আর তার বাবা মা এসে পরবে আর সাথে কাজিও। মেহরাম রেডি হচ্ছে, কণা তাকে হেল্প করছে টুকিটাকি। মেহের হলরুমে তার নানুর কাছে। বেশকিছুক্ষন পর মেহরাম রেডি হয়ে এসে পরে নিচে। সবার নজর একবার মেহরামের দিকে যায়। ভারী মিষ্টি লাগছে দেখছে। সাদা কাপড় যেন একদম মানিয়ে তুলেছে তাকে। মেহরাম গিয়ে সবার মাঝেই বসে পরে। মেহের মেহরাম কে দেখে হেসে দেয়। মেহরাম মেহেরের সাথে বসে খেলছিলো। তখন আতিয়া একটা বাটিতে ক্ষীর নিয়ে মেহরাম কে খাইয়ে দিতে থাকে। তার বেশকিছু সময় পরেই আয়ুশ এসে পরে। আয়ুশ আর তার মাকে দেখে সবাই এগিয়ে যায়। কাজিও এসে পরেছে। সবার সাথে কুশল বিনিময় করে আয়ুশ আর মেহরাম একসাথে বসে পরে সোফাতে। আয়ুশ মেহরাম কে এক নজর মাথা থেকে শুরু করে পা পর্যন্ত দেখে নিয়ে মুচকি হাসে। মেহের কণার কোলে। আয়ুশ & মেহরামের সামনেই কাজি বসে পরে। তাদের পাশেই সবাই বসে আছে। সবার মুখেই হাসি। কণা মেহের কে কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কণা ফিসফিস করে মেহের কে বলে ওঠে…..

কণা;; তুই ই এই প্রথম মেয়ে হবি যে কিনা নিজের বাবা-মার বিয়ে দেখছিস। কত্তো লাকি।

কণার কথায় মেহের হেসে দেয়। আর ওদিকে ইসলামের বিধি-বিধান মেনে তিন বার কবুল বলে আয়ুশ আর মেহরামের বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মেহরাম এসে পরে আয়ুশদের বাড়িতে সাথে মেহেরও। কণাও এসে পরেছে। আয়ুশদের বাড়িতে আসার পর লায়লা খাতুন মেহের কে কোলে নেয় আর কণা গিয়ে মেহরাম কে আয়ুশের ঘরে বসিয়ে দিয়ে আসে। কিন্তু মেহের তো মেহরামকে ছাড়া থাকে না তাই বাধ্য হয়েই মেহের কে মেহরামের কাছে দিয়ে আসতে হয়েছে। মেহরাম এখন আয়ুশের রুমে। রুম টা তেমন ভাবে সাজানো না হলেও একদম হালকা ভাবে সাজানো হয়েছে। তাতেও অনেক ভালো লাগছে। কিন্তু মেহরাম মেহেরকে কোলে নিয়ে সারাঘরে পায়চারি করছে। এভাবেই থাকতে থাকতে এক সময় রুমের দরজা খোলে আয়ুশ ভেতরে আসে। দরজার কিছুটা কটকট শব্দ হলে মেহরাম হাতের ইশারাতে থামিয়ে দেয় আয়ুশকে। আয়ুশও ব্যাপার টা বুঝতে পেরে আস্তে ধীরে কাজ করতে থাকে। মেহরাম মেহেরকে নিয়ে ঘুম পারাচ্ছিলো। আয়ুশ এক ধ্যানে মেহরামের দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসে তারপর মেহরামের পেছনে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। মেহরামের কাধে নিজের থুতনি রেখে সেও মেহেরের দিকে তাকিয়ে থাকে। আয়ুশ & মেহরামের একসাথে ছোয়া পেয়ে মেহের যেন আরো বেশি হেসে ওঠে ঘুমের মাঝেই। মেহের ঘুমিয়ে গেলে মেহরাম তাকে বিছানাতে শুইয়ে দেয়। এবার ঘুড়ে আয়ুশের দিকে তাকায়। দেখে আয়ুশ নিজেই ওর দিকে তাকিয়ে আছে।

মেহরাম;; কি হয়েছে তাকিয়ে আছো কেন। ভালো লাগছে না দেখতে?

আয়ুশ;; অনেকটা বেশিই ভালো লাগছে।

মেহরাম;; তোমাকেও।

আয়ুশ;; আমি তোমাকে ভালোবাসি।

মেহরাম;; আমিও।

আয়ুশ এগিয়ে গিয়ে মেহরামের দুইহাত ধরে। তারপর তার কপালে চুমু একে দেয়।




আয়ুশ মেহরামের বিয়ের পর সময়ের চাকা ঘুড়িয়ে কেটে যায় আরো ৫ বছর। সময় আসলেই খুব দ্রুত চলে যায়। এই ৫ টা বছরে কি না পালটে গেছে। জীবনের এক নতুন মোড় গ্রহন করেছে। জীবনের কালো ছায়া টা যেন অনেক দূর হয়ে গিয়েছে। আর জীবন কে রাঙিয়ে দিয়ে গেছে এক নতুন ধাচে। আয়ুশ আর মেহরাম নিজেদের খুশিতে জীবন চলাচ্ছে। মেহের অনেক বড়ো হয়ে গেছে। সে এখন দুষ্ট-মিষ্টি একটা বাচ্চা। যে পুরো ঘরে দৌড়ে বেড়ায়। সবাইকে জ্বালিয়ে বেড়ায়। বাড়িকে মাতিয়ে রাখে। বাবার আদরের দুলালি আর মায়েরও। তবে দিন শেষে মেডামের জন্য বাড়িতে এত্তোগুলো বিচার আসে। এই ছেলের নক ফাটিয়ে দিয়েছে, এই ছেলের সাথে ঝগড়া করেছে। বাগানের মালিকে পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিয়েছে আরো কত্তো কি। মেহরাম তাকে বকলে সোজা বাবাই বাবাই বলে আয়ুশের কাছে চলে যাবে। আয়ুশ মেয়েকে শাসন করবে তো দূর উলটা বাবা মেয়ে মিলে মেহরামের নামে চুগলি করে বেড়ায়। আর মেহরাম সময় পেলেই বাবা মেয়ে কে বকে দেয়। এই টুকু বয়সেই এই দশা এই মেয়ে বড়ো হলে কি করবে মেহরাম তা ভেবে পায় না। লায়লা খাতুন তো মেহেরের জান আর মেহের নিজেও দাদি বলতে পাগল। মেহের যখন আস্তে আস্তে কথা বলতে শিখে তখন সবার আগে ‘বাবাই’ বলাটাই শিখেছিলো। সেইদিন আয়ুশ খুশির চোটে কেদে কেদে মেহরাম কে জড়িয়ে ধরেছিলো। তবে মেহের এখন কিছুটা তুতলিয়ে কথা বলে। স্কুলে দেওয়া হয়েছে মেহেরকে। আয়ুশের অফিসে যাবার সময় আয়ুশ তাকে স্কুলে দিয়ে তারপর অফিসে যায়। ওহহ হ্যাঁ কণার বিয়ে হয়ে গেছে,,বিয়ে পাগল মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে 😅। সেও ভালোই চলছে নিজের হাসবেন্ড আর শশুড়বাড়ির লোকদের সাথে।


~বিকেল বেলা~

মেহের;; বাবাই বাবাই বাবাই

আয়ুশ;; হ্যাঁ আমার মামনি আসো।

আয়ুশ বাইরে বাগানের সাইডে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো তখনই মেহের দৌড়িয়ে দৌড়িয়ে আয়ুশের কাছে আসে। আয়ুশ হাত পাতে আর মেহের দৌড়ে এসে আয়ুশের কোলে উঠে পরে। বাবা মেয়ে মিলে খুনশুটি করছিলো তখনই মেহের আসে বাগানে ফোনে ভিডিও কলে কথা বলতে বলতে। বাড়ি থেকে ভিডিও কল দিয়েছে। তাদের সাথেই মেহরাম কথা বলছে। মেহরাম আয়ুশ আর মেহেরের কাছে গিয়ে ফোন ধরে। তারা কথা বলছে। মেহের তো বেশি কথা বলতে গিয়ে দম ছাড়ছে বারবার তবুও থামছে না। কথা বলবেই। আকাশকে মামা মামা বলে পাগল বানিয়ে দেয়। আকাশও অনেকটা বড়ো হয়ে গিয়েছে।

.
.
.

এখন সন্ধ্যা বেলা, সন্ধ্যা না আসলে রাতই বলা চলে। চারিদিকে কেমন একট শীতল বাতাস। পরিবেশ টা মনোমুগ্ধকর। আকাশে অনেক বড়ো চাঁদ উঠেছে। তারা গুলো কেমন মিটমিট করছে। আয়ুশ ছাদের ওপর দাঁড়িয়ে আছে তখনই মেহরাম হাতে দুই কাপ কফি নিয়ে ছাদে আসে। একটা কফি আয়ুশের দিকে এগিয়ে দেয়। আয়ুশ কফিটা নেবার সময় মেহরামের গালে টুক করে একটা চুমু খায়, মেহরাম হেসে দেয়। তখনই মেহের আসে ছাদে। হাতে তার কি যেন

মেহের;; মাম্মাম

মেহরাম;; হ্যাঁ সোনা।

মেহরাম মেহের কে নিয়ে ছাদের এক সাইডে বসে পরে সাথে আয়ুশও বসে। মেহরাম খেয়াল করলো যে মেহেরের হাতে কি যেন। মেহরাম মেহেরকে কোলে নিয়ে বলে ওঠে…

মেহরাম;; হাতে কি সোনা?

মেহের;; মাম্মাম আমি এতা পেয়েছি রুমে।

মেহরাম;; দেখি তো কি?

মেহরাম মেহেরের হাত তুলে দেখে একটা ফটো ফ্রেম আর সেটা মেহরাম আর তনুর। মেহরাম দেখে হেসে দেয় এক গাল।

মেহের;; মাম্মাম এতা কে। অনেকতা তোমাল মতো দেখতে। আমি তো ভুলেই গিয়েতিলাম যে কোনতা তুমি আর কোনতা সে। মাম্মাম কে এতা (তনুর উদ্দেশ্যে)

মেহরাম;; এটা তোমার মাম্মামের জীবন। তোমার মাম্মম এর দুনিয়া আগেও ছিলো, আছে আর থাকবে।

মেহের;; তাহলে আমি কি 😒।

মেহরাম;; হাহাহা, হাহাহা আরে মা তুমি তো আমার কলিজা। আমার সব।

মেহের;; আর বাবাই।

মেহরাম;; নাহ, বাবাই কিছুই না। বাবাই নেই

আয়ুশ কফি খাচ্ছিলো মেহরামের কথা শুনে আয়ুশের কাশি উঠে পরে। কপাল কুচকে মেহরাম কে বলে ওঠে..৷

আয়ুশ;; এএইইইইই…!

মেহরাম;; হিহিহিহি,, আরে বাবা মজা করছি।

মেহের;; মাম্মাম, এই আমাল কি হয়। (তনুকে দেখিয়ে)

মেহরাম;; তার নাম তনু, আর সে তোমার ছোট মা হয়।

মেহের;; উনি কোথায় তাকেন, আমি তো দেখি না।

মেহরাম;; উনাকে দেখা যায় না কিন্তু উনি সবসময়ই আমাদের সাথে থাকেন।

মেহের;; কিন্তু আমি তো উনাকে দেখবো।

মেহরাম মুচকি হেসে মেহের কে কোলে তুলে নেয়। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে…

মেহরাম;; ওই যে ওপরে দেখো।

মেহরাম তার আঙুল দিয়ে আকাশের দিকে তুলে মেহের কে দেখায়। মেহের ও তার মাম্মামের ইশারাতে আকাশের দিকে তাকায়।

মেহরাম;; ওই তো আকাশের সবচেয়ে বড়ো যেই তারা টা আছে, আর যেটা সবচেয়ে বেশি ঝলমল করছে সেটাই তোমার তনুমা।

মেহের;; তাই..!

মেহরাম;; হ্যাঁ

মেহের;; তনুমা আমাকে ভালোবাসে তো?

মেহরাম;; সবথেকে বেশি, আমার থেকেও অনেক বেশি। এত্তো বেশি (দুইহাত ছড়িয়ে দিয়ে)

মেহরামের কথায় মেহের দুইহাত মুখে দিয়ে হিহিহি করে হেসে ওঠে। সাথে আয়ুশ আর মেহরাম ও। মেহরাম আয়ুশের দিকে তাকালে আয়ুশ গাঢ় এক হাসি দেয়। এভাবেই ছাদের ওপর থাকতে থাকতে মেহের মেহরামের কোলেই ঘুমিয়ে পরে। মেহরাম এতোক্ষন অবাক হয়ে কি যেন ভাবছিলো। হঠাৎ আয়ুশ তাকে ডাক দিলে আয়ুশের ডাকে মেহরামের হুশ ফিরে আসে। মেহরাম মেহের কে আয়ুশের কোলে দিয়ে নিজের রুমে চলে যায়। অনেক পুরনো একটা বক্স বের করে আর তার ভেতর থেকে একটা ডায়েরি। ডায়েরি টা অনেক বছর যাবত লিখা হয় না। এটা মেহরামের সেই আগের ডায়েরি টা। আজ হুট করেই আগের পুরনো সব স্মৃতি গুলো তরতাজা হয়ে উঠলো। মেহরাম ডায়েরি টা নিয়ে ছাদে চলে গেলো। ছাদের এক কিণারে আগুন লাগানো ছিলো। মেহরাম ডায়েরিটা নিয়ে আগুনের পাশে বসে পরে। আয়ুশ মেহেরকে কোলে নিয়ে শুধু মেহরাম কে দেখছে। মেহরাম কিছু না বলেই ডায়েরি টা শেষ একবার ভালোভাবে দেখে নেয়। এটাতেই তার জীবনের সব গল্পকাহিনী লিখা আছে। আর কিছু না বলেই মেহরাম ডায়েরি টা আগুনে দিয়ে দেয়। আগুনের তীব্র তাপে ডায়েরি টা আস্তে আস্তে জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। আর মেহরাম অপলক হীন ভাবে তাতে তাকিয়ে আছে। আয়ুশ কিছুই বলে না শুধু একটা কথা ছাড়া।

আয়ুশ;; কেন পুড়ালে?

মেহরাম;; কারণ সেইসব কথার এখন আর কোন মানেই হয় না, কোন মুল্য নেই সেইসব কিছুর। মূল্যহীন একদম।

মেহরাম আগুনের দিক তাকিয়ে কথা টা বলেই আয়ুশের দিকে তাকায়। আয়ুশ মুচকি হেসে মাথা নিচু করে ফেলে। খানিক সময় পর মেহরাম এসে আয়ুশের কাধে মাথা রাখে। আয়ুশ একহাতে নিজের মেয়ে আরেক হাতে মেহরাম কে জড়িয়ে ধরে। এভাবেই সেইদিন চলে যায়। পরেরদিন সকাল হয়ে যায়। আজ আয়ুশের অফিসে আর মেহেরের স্কুল দুটোই বন্ধ। তারা সাজ সকালেই গাড়ি নিয়ে বাইরে এসে পরেছে। মেহের গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। আর বাতাসে তার বড়ো বড়ো চুল গুলো উড়ে যাচ্ছে। মেয়ে হয়েছে পুরো মায়ের মতো। মায়ের চুল গুলোও যেমন অনেক বড়ো মেয়ের চুল গুলোও এই বয়সেই কোমড় অব্দি। মেহের অনেক জিজ্ঞেস করেছে মেহরাম কে যে আমরা কোথায় যাচ্ছি কিন্তু “এটা সারপ্রাইজ” এই বলেই মেহরাম চুপ। আয়ুশ আর মেহরাম সামনে বসেছে আর মেহের পেছনে। অবশেষে গাড়ি একটা জায়গায় এসে থেমে পরে। আয়ুশ মেহের কে নিয়ে নেমে পরে। আর মেহরাম নিজে একা নেমেই সোজা পথে চলে যায়। রাস্তা টা অনেক ফাকা। আর গাড়ি যেখানে থেমেছে তার সামনে বিশাল একটা জায়গা। আসলে এটা কবরস্থান তবে অনেক সেফ আর ভালো একটা জায়গা। আর আজ তনুর মৃত্যুবার্ষীকি। তাই মেহরাম এখানে এসেছে। মেহরাম প্রতিবছরই এখানে আসে। এইদিনে, এই তারিখে, ঠিই এই সময়েই। তবে আজ মেহের কে নিয়ে। মেহরাম গিয়ে তনুর কবরের পাশে বসে পরে। আর রাস্তার ওপারে আয়ুশ মেহের কে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেহের অপলক ভাবে তার মাম্মামের দিক তাকিয়ে আছে। মেহরামের আর কি প্রতিবারের মতো নিজের বোনের কাছে গিয়ে বিলাপ পারা শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু আজ মেহরাম বেশি কান্না করছে না কেন যেন তার অনেক বেশি খুশি লাগছে। প্রায় দুই ঘন্টা পরে মেহরাম সেখান থেকে এসে পরে। মেহেরের কত্তো প্রশ্ন মেহরাম সবকিছুরই উত্তর দেয় তাকে।

.

এখন সবাই নিজেদের বাড়িতে এসেছে। কণা বেড়াতে এসেছে নিজের মায়ের কাছে। তাদের দেখে সবাই আরো বেশি খুশি। তবে এবার বাড়ির বাগানে মেহের দৌড়াচ্ছে আর মেহেরের পিছন পিছন মেহরামও হাতে খাবার নিয়ে দৌড়াচ্ছে। দৌড়াতে দৌড়াতে আয়ুশ মেহেরকে ধরে ফেলে। আয়ুশ মেহের কে নিয়ে নিজের কাধের ওপর বসিয়ে দেয়। আর তখন যেন মেহরাম একটু শান্তি পায়। আস্তে আস্তে মেহের কে খাইয়ে দিতে থাকে। এক সময় খাওয়ানো শেষ হয়ে যায়। আয়ুশ আর মেহরাম মেহেরের সাথে খেলছিলো আর হাসছিলো ঠিক তখনই কণা তার হাতে একটা ক্যামেরা নিয়ে তাদের কাছে আসে।

কণা;; এভরিওয়ান স্মাইল প্লিজ…!

এই বলেই কণা ক্যামেরা টা তাদের দিকে ধরে ছবি তোলার জন্য আর মেহরাম-আয়ুশ & মেহের সবাই হেসে দিয়েই খুনশুটি করতে থাকে। আর তাদের এই মাত্রাতিরিক্ত হাসি মাখা মুখটা ক্যামেরা তে ছবি হিসেবে বন্দি হয়ে যায়। এভাবেই চলতে থাকে আয়ুশ & মেহরামের রঙিন জীবনকাহীনি ❤️।



~~সমাপ্ত 🍂

তৈমাত্রিক পর্ব-৩৫+৩৬

0

#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ৩৫

মানুষের জীবন তো বয়ে চলে সমুদ্রের স্রোতের মতো। আর এই জীবনে কতো বাধা-বিপত্তি ই না আসে। কখনো কাদায় আবার কখনো হাসায়। জীবন থেকে সব হারিয়ে গেলেও কোথাও না কোথাও কিছু একটা থেকেই যায় যা মানুষকে তার জীবনে সামনে এগিয়ে নিয়ে যায়। বা হয়ে থাকে তার জীবনের শেষ অবলম্বন হিসেবে। মেহরামেরও আচ্ছে আর তা তার অনাগত বাচ্চা। কিন্তু এখানে এখন অবলম্বন দুইজন। আয়ুশ আর তার বাচ্চা। মেহরাম কখনোই ভাবে নি যে আয়ুশ একটা সময়ে এসে তার জীবনের সাথে এভাবে জুড়ে যাবে। যাই হোক যেমন হোক ভালোই আছে। এগুলোই সোফার ওপর বসে বসে ভাবছিলো মেহরাম। তখনই কণা এসে ধপ করে মেহরামের পাশে বসে পরে। মেহরাম প্রথমে অবাক হলেও পরে হেসে ওঠে….

মেহরাম;; আরে কখন এলে?

কণা;; এইতো মাত্রই।

মেহরাম;; কিন্তু বাইরে তো অনেক বৃষ্টি, আর এই বৃষ্টিতে তো…

কণা;; আরে রিকশা দিয়ে এসেছি আর ছাতা ছিলো।

মেহরাম;; একা এসেছো, খালামনি কোথায় আসে নি?

কণা;; না মানে বাবা বাসায় তো বাবা কে রেখে আর মা কিভাবে আসতে পারে তাই আমি এসে পরেছি।

মেহরাম;; অনেক ভালো করেছো।

কণা;; আর তোমার জন্য একটা জিনিসও এনেছি, দাড়াও

মেহরাম;; কি?

কণা;; দাড়াও দাড়াও

কণা তার ব্যাগ থেকে একটা বক্স বের করে। সে বক্সটার মুখ খুলে মেহরামের দিকে ধরে। মেহরামের তো দেখেই খুশিতে মুখ ঝলমল করে ওঠে। কারণ বক্সে বিরিয়ানি।

মেহরাম;; বিরিয়ানিইইইইইইইইই!!

কণা;; হ্যাঁ, আমি এখানে আসার প্লেন আগে থেকেই করছিলাম। আর মা তখন আমার হাতে এই বক্স টা ধরিয়ে দিলো। তুমি নাকি খেতে ভালোবাসো তাই আর কি।

মেহরাম;; খালামনি তো এখানে নেই তা না হলে একটা পাপ্পি আর একটা ঝাপ্পি দিতাম।

কণা;; তার বদলে আমাকে দিয়ে দাও।

মেহরাম;; হিহিহিহিহি।।

মেহরাম আর কনা বসে কথা বলছিলো। তখন মেহরামের মা আর চাচি এলো। সবাই বসে বসে অনেক কথা বলছে। এদিকে বাইরে তুমুল বেগে বৃষ্টিও হচ্ছে। মেহরাম আরামছে বৃষ্টি দেখছে আর বসে বসে খাচ্ছে। মেহরাম কে এখন আর খাওয়ার জন্য জোর করতে হয় না সে একা একাই অনেক খাবার খায়। পেট যেন আগের থেকে আরো অনেক ফুলেছে। নড়তে চড়তেও ভারি কষ্ট হয়। বসতে গেলে কিছু একটা ধরে তারপর বসতে হয় দাড়াতে গেলেও একই দশা। আগে তো রুম ওপরে ছিলো মেহরামের কিন্তু এখন রুম নিচে। কারণ এই সিড়ি বেয়ে ওপরে ওঠা আবার সিড়ি বেয়ে নিচে নামার কর্ম মেহরামের না। দশমাশ তিন দিন চলছে। ডাক্টর দশমাশ বারো দিনের মাথায় ডেলিভারির ডেট দিয়েছেন। একদম নজরে নজরে রাখে সবাই তাকে, কারণ কখন কি হয়ে যায়। মেহরাম কে কেউ দেখলে ভাববে হয়তো টুইন বেবি কিন্তু না ডক্টর বলে দিয়েছেন একজনই। আর বেবি একটু স্বাস্থ্যবান তাই এমন মোটা দেখায় পেট টা। আয়ুশ আসে মেহরাম আর বাকি সবার সাথেই কথা হয়। মানে সবকিছুই অনেক ভালো চলছে। মাঝে মাঝে তনুকে প্রচন্ড ভাবে মিসও করে মেহরাম। আবার মাঝে মাঝেই আয়ুশকে নিয়ে তনুকে দেখতে চলে যায়। সবার কত্তো প্লেন বেবি হলে এই করবে সেই করবে। তবে যখন মেহরাম ঘরে একা থাকে। বা যখনই নিজের দিকে নজর পরে তার কেন জানি সোহেলের কথা মনে পরে যায়। স্পেশালি যখন চোখ জোড়া পেটের দিকে যায়। মেহরাম মাঝে মাঝে পেটের ওপর হাত দিয়ে আয়নাতে নিজেকে দেখে। কেমন এক আলাদা অদ্ভুত অনুভুতি হয়। শুনেছে মেয়েদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মূহুর্ত যখন সে মা হয়। কখনো ভাবেনি নিজের ক্ষেত্রেও এমন হবে। সেও মা হবে। এইসব ভাবতে ভাবতেই হেসে ওঠে। মেহরাম কখনো কাউকে দেখি নি যে কেউ বাচার জন্য এতো আকুতি করছে। চোখে মুখে বাচার প্রবণতা এত্তো বেশি। মেহরাম সোহেল কে দেখেছে। নিজের বাচ্চার মুখ দেখার জন্য কতোই না আগ্রহ ছিলো, বাচতে চেয়েছিলো সে কিন্তু ভাগ্য তা মেনে নেয় নি। এক লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ে মেহরাম। দিন খুব দ্রুত গতিতে চলেছে। কখন দিন কখন রাত বুঝায় যায় না।

একদিন মেহরাম হলরুমে বসে ছিলো সবার সাথেই। এটা বিকেল বেলা। তখন কণাও আসে বাসায়। ইদানীং প্রায়ই কণা মেহরাম দের বাড়িতে আসে। যখনই সময় পায় তখনই। মেহরাম হেলান দিয়ে বসে ছিলো। পাশেই তার দাদি, চাচি, মা সবাই বসে আছে। কণাও গিয়ে গল্প শুরু করে দেয়। মেহরাম সবার কথা শুনছে আর হাসছে। তবে হুট করেই মেহরাম তার কপাল কুচকে ফেলে। হাতটা আপনা আপনিই পেটের নিচে চলে যায়। কেমন যেন একটু ব্যাথা অনুভব করে। কিন্তু এখন এই ব্যাথা যেন তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে৷ অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয়ে যায়। এবার মেহরাম এক হাত কোমরে আরেক হাত পেটের নিচে ধরে। আর থাকতে না পেরে চিৎকার দিয়ে ওঠে…..

মেহরাম;; আহহহহহহ, মায়ায়ায়ায়ায়ায়ায়া..

আতিয়া;; মেহরু কি হয়েছে তোর। ব্যাথা শুরু করেছে। ভাবী

কনিকা;; ল্যাবার পেইন

কণা;; কিন্তু আপুর ডেলিভারির তো আরো পাঁচ দিন বাকি।

কনিকা;; কণা মাঝে মাঝে এমন হয় যে ডেটের আগেই ডেলিভারি হয়ে গেছে। এবার বেশি দেরি না করে দ্রুত বাইরে গিয়ে ড্রাইভার কে গাড়ি বের করতে বলো।

কণা;; হ্যাঁ যাচ্ছি।

কণা দৌড়ে বাইরে চলে যায় আর আতিয়া মেহরামের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। কনিকাও একই ভাবে মেহরামের হাত ধরে রেখেছে। কিন্তু এদিকে যেন কারো কোন কথা মেহরামের কান দিয়ে যাচ্ছেই না। তীব্র ব্যাথায় সে ছটফট করছে। অবশেষে গাড়ি বের করে আতিয়া আর কনিকা মেহরাম কে ধরে ধরে নিয়ে হস্পিটালে চলে গেলো। বড়িতে আকাশ আর দাদি কে কোন রকমে বুঝিয়ে রেখে গেলো। আর হস্পিটালে মেহরামের সাথে কণা আতিয়া আর কনিকা গেলো। যেই ডাক্তারের আন্ডারে মেহরামের চেকাপ হচ্ছিলো উনিই মেহরামের ডেলিভারি করবেন। তাকে ফোন করে বলেও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তাড়াহুড়োর কাজই খারাপ। সময় আর রাস্তা যেন যেতেই চাচ্ছে না। যদিও গাড়ি জোরে চালানো হচ্ছে। প্রায় পচিশ মিনিট পর হস্পিটালের সামনে আনা হয়। হাটার শক্তি টুকুও মেহরাম পাচ্ছে না। ব্যাথায় যেন ছিড়ে যাচ্ছে। হস্পিটালের সামনে নামলে দুইজন নার্স ছুটে আসে। ধরাধরি করে মেহরাম কে কোন রকমে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে এবার আর মেহরাম হাটতে পারে না। বেড নিয়ে আসা হয়, বেডের ওপর মেহরাম কে শুইয়ে দেওয়া হয়। এদিকে মেহরামের চাচি আর মার চিন্তায় যায় যায় অবস্থা। কনিকা তো আরো ঘাবড়ে যাচ্ছে কারণ মেহরাম ব্যাথায় চিল্লাচ্ছে অনেক। আতিয়া কোন রকমে কনিকা কে একটা জায়গায় বসিয়ে দেয়। তারপর শান্তনা দেয়। কণা হস্পিটালে আসার সময়ই লায়লা কে খাতুন কে ফোন করে বলে দিয়েছিলো। তিনি হয়তো আসছেন। তবে কণার মাথায় হুট করেই এবার আয়ুশের চিন্তা আসে। কণা তো ভুলেই গিয়েছিলো, এতো তাড়াহুড়ো তে মাথা থেকে তার ভাইয়ের খেয়াল একদম বের হয়ে গিয়েছিলো। সে আর দেরি না করে দ্রুত আয়ুশকে ফোন দেয়। প্রথম বার ফোন বেজে কেটে যায় একা একাই। এতে কণার রাগ মাথায় উঠে পরে। একশ একটা গালি দিয়ে আয়ুশকে আবার ফোন দেয়। আয়ুশের ফোন তার কেবিনে ছিলো আর সে বাইরে ছিলো। হাতে ফাইল দেখতে দেখতে কেবিনের ভেতরে প্রবেশ করে আয়ুশ। এসেই দেখে কণা ফোনের ওপর ফোন করে চলেছে। আয়ুশ গিয়ে জলদি রিসিভ করে। হ্যালো বলতে না বলতেই ওপর পাশ থেকে কণা চিল্লিয়ে বলে ওঠে…..

আয়ুশ;; হ্যল….

কণা;; এই কোথায় রে তুই, ফোন রেখে কই গিয়েছিলি। কখন থেকে ফোন দিচ্ছি। কাজের সময় তো পাওয়াই যাবে না।

আয়ুশ;; আরে ভাই থাম হয়েছে কি?

কণা;; আরে মেহরাম আপুর পেইন শুরু হয়েছে।

আয়ুশ;; কিহহ কিন্তু এখনই কেন। আরো কয়েক দিন দেরি

কণা;; হ্যাঁ ছিলো কিন্তু এখন পেইন শুরু হয়ে গেছে। আর আমরা সবাই হস্পিটালেই আছি আপু কে নিয়ে। মা কে ফোন করে আমি বলে দিয়েছে মা হয়তো আসছে। আর প্লিজ সব ছেড়ে জলদি আয় এখানে।

আয়ুশ;; আচ্ছা মেহরাম কোথায়?

কণা;; আপু কে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অনেক চিল্লাচ্ছে ব্যাথা করছে অনেক। তুই আয় জলদি ভাই।

আয়ুশ;; জাস্ট গিভ মি ফাইভ মিনিটস্।

আয়ুশ ফোন রেখে দ্রুত অফিস থেকে বের হয়ে পরে। ওদিকে খুব কষ্টে মেহরামের ড্রেস চেঞ্জ করিয়ে দেওয়া হয়েছে। ডাক্তার ভেতরে। অবস্থা বেশি ভালো না খুব ক্রিটিকাল তাই জলদি জলদি ডেলিভারির কাজ শুরু করে দিয়েছে। নরমাল ভাবেই ডেলিভারি হওয়া সম্ভব। আর আয়ুশ যেন ঝড়ের গতিতে চলছে। আধাঘন্টার রাস্তা পনেরো মিনিটে শেষ করে এসেছে। হস্পিটালের সামনে গাড়ি থামিয়ে গাড়ির দরজা টা কোন রকমে লাগিয়ে চাবি নিয়ে এসে পরে। দৌড়ে দৌড়ে যাচ্ছে। গিয়েই দেখে কণা পায়চারি করছে। তার মাও এসে পরেছে তার আগেই। কনিকার পাশে আতিয়া আর লায়লা খাতুন বসে আছে। আয়ুশ দেখছিলো তখন তার কানে মেহরামের চিৎকার ভেসে আসে। আয়ুশ সেদিকে তাকায়। গিয়ে কেবিনের বাইরের গ্লাস দিয়ে উকি দেয়। তেমন কিছুই দেখে যাচ্ছে না তবে শুধু রক্ত আর রক্ত দেখা যাচ্ছে। এগুলো দেখে তো আয়ুশের মাথা ঘুড়ে পরে যাওয়ার মতো অবস্থা। কণা ব্যাপার টা বুঝতে পেরে আয়ুশকে সেখান থেকে এনে পরে। আয়ুশকে বুঝাতে থাকে যে কিছুই হবে না সব ঠিকই হবে। এভাবেই থাকতে থাকতে প্রায় ৪৫ মিনিট পর ডাক্তার বের হন। ডাক্তার কে দেখেই সবাই দ্রুত তার কাছে যান। তবে এবার ডাক্তার যা বলেন তাতে সবাই ঘাবড়ে যায়…

ডাক্তার;; দেখুন আসলে আমরা আগে ভেবেছিলাম যে প্রেগন্যান্সিতে তেমন কোন অসুবিধা হবে না কিন্তু উনার ওয়াটার ব্রেক করেছে। আর অনেক বেশি ব্লিডিং হচ্ছে। কেন যে হচ্ছে এতো তাও বুঝতে পারছি না। আর বেবির ব্যাপারে একদম চিন্তা করবেন না। বেবি সুস্থ আছে শুধু মায়ের একটু সমস্যা হচ্ছে। অনেক বেশি ব্লিডিং যাচ্ছে। আর এখন রক্তের প্রয়োজন। তো…

আয়ুশ;; আপনি, আপনি আমার ব্লাড নিন। আমার আর মেহরামের ব্লাড গ্রুপ সেম। আপনি যতো ইচ্ছে রক্ত নিন কিন্তু মেহরাম বা বাচ্চার কোন রকম যেন কোন সমস্যা না হয়। আপনি আমার ব্লাড নিন।

ডাক্তার;; জ্বি আসুন আমার সাথে।

আয়ুশ ডাক্তারের সাথে চলে যায়। এদিকে এবার মেহরামের মা অঝোরে কেদে দেন। কারণ মেয়ের সাথে আজ পর্যন্ত কিছু না কিছু হয়েই এসেছে এখন যদি তার মেয়ের বা বাচ্চার কিছু হয় তাহলে এই জীবন রাখার চেয়ে না রাখাই ভালো। কনিকা কাদছে আর বাকি সবাই তাকে কোন রকমে বুঝিয়ে যাচ্ছে। প্রায় বিশ মিনিট পর আয়ুশ আসে। দুই ব্যাগের মতো রক্ত নেওয়া হয়েছে তার বডি থেকে। যার ফলে আয়ুশের শরীর এখন অনেক খারাপ লাগছে৷ ডাক্তার কেবিনে গিয়ে আবার তাদের কাজ শুরু করে। মেহরাম যেন এই চোখ বন্ধ করে করে এমন কিন্তু তাকে চোখ খোলা রাখার জন্য অনেক বলা হচ্ছে। এদিকে যেহেতু বেবি নরমালে হচ্ছে তাই মায়ের পুশ করতে হবে। তবে শক্তি যেন আর বাকি নেই। কিন্তু এবার শেষ চেষ্টা করে নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে মেহরাম পুশ করে আর ডাক্তার একটা বেবি কে আনেন। বের করার সাথে সাথে কেবিন একদম ফাটিয়ে বাচ্চা কান্না করে দেয়। বাচ্চার কান্নার শব্দ কেবিনের বাইরে পর্যন্ত আসছে। ভেতর থেকে বাচ্চার কান্নার শব্দ পেয়ে বাইরে সবার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। আয়ুশ ফট করে মাথা তুলে কেবিনের দিকে তাকায়। বুকের ভেতরে ধুকপুকানি শুরু হয়ে গেছে তার। মেহরাম নিভু নিভু চোখেই তাকিয়ে থাকে। জোরে জোরে দম ছাড়ছে আর মুখে ঝুলছে হাসি। অনেক ক্লান্ত হয়েছে গিয়েছে সে। ডাক্তার খুব সাবধানে সিজার দিয়ে বেবির নাভির সাথে নাড় টা কেটে দেয়। নার্স কে বলে একটা সাদা ধবধবে টাওয়াল নিয়ে আসে। তাতে বাচ্চাকে শুইয়ে দেয়। ডাক্তারের নিজেরই যেন মুখ থেকে হাসি সরছে না। ডাক্তার হেসে মেহরামকে বলে ওঠে….

ডাক্তার;; Congratulations!! মেয়ে বাচ্চা হয়েছে।

এটা শোনার পর মেহরামের মুখের হাসি টা যেন আরো চওড়া হয়ে গেছে। সোহেলের কথা গুলো এখন মেহরামের কানে বাজছে। যেন বারবার একই কথা ঘুরেফিরে মেহরামের কানে এসে ঠেকছে।

“” মেহরাম, দেখো আমাদের মেয়েই হবে। তুমি আমার কথা মিলিয়ে নিও। আমার মেয়ে বাচ্চাই চাই। যে একদম তোমার মতো হবে দেখতে। মেহরাম, আমাদের মেয়েই হবে “”।

মেহরামের এখন বলতে ইচ্ছে করছে যে ” হ্যাঁ সোহেল, ইট’স্ এ বেবি গার্ল। মেয়েই হয়েছে। আপনি ঠিক ছিলেন। মেয়ে হয়েছে”।

ডাক্তার বেবিকে একদম সুন্দর করে পরিষ্কার করে একটা সাদা টাওয়ালে মুড়িয়ে নিলো। মেয়ে অনেক মোটা সোটা হয়েছে। মাথা ভর্তি চুল। গাল গুলো একদম লাল হয়ে আছে। আর ফর্সার কথা তো বাদই দিলাম। পুরাই পুতুল। শরীরে যে ব্যাথাই ছিলো যাই ছিলো নিজের বাচ্চা কে দেখার পর থেকে সব যেন দূর হয়ে গেছে মেহরামের । বাচ্চাকে ডাক্তার নার্সের কাছে দেবার পর মেহরামকে আবার দেখে। কেননা মেহরামের অনেক ব্লাড গিয়েছে। আর এইসব ঠিক ঠাক করতে হবে। পুরো দুই ঘন্টার কাছাকাছি লেগেছে এই সব করতে। মেহরাম কে কেউ দেখে এখন বলবেই না যে তার শরীরে রক্তের স্বল্পতা ছিলো। সবকিছু পরিষ্কার করে এখন বেডে শুয়ে আছে। তবে হাতে সুই পুশ করা। যখন থেকে বাচ্চা হয়েছে মেহরামের নজর যেন তার থেকে সরছেই না। মেহরামের যদিও তেমন শক্তি নেই তবুও সে উঠে বসতে চায়৷ ডাক্তার তাকে হাল্কা উঠিয়ে হেলান দিয়ে বসায়। তারপর মুচকি হেসে বাচ্চাকে মেহরামের কোলে দেয়। মেহরামের মনে হচ্ছে যে সে এখন তার হাতে আকাশের চাঁদটা পেয়ে গেছে। তার জীবনে কোন কমতিই নেই। কে বলেছে মেহরাম জীবনে কিছুই পায় নি। পৃথিবীর সব থেকে বড়ো সুখ এখন তার হাতে, তার কোলে আছে। মেহরাম বাচ্চার ছোট ছোট হাত গুলো ছুইয়ে দিলো। বুক টা ফেটে কান্না বের হচ্ছে তার। মেহরামও বলতে পারবে যে এটা আমার মেয়ে। খুশি, কান্না, হাসি সব যেন একসাথে কাজ করছে। ইতোমধ্যে কান্নাও করে দিয়েছে মেহরাম। মেহরাম তার হাত দিয়ে বাচ্চার গাল গুলোতে হাল্কা ভাবে ছুইয়ে দেয়। বাচ্চা হেসে ওঠে মুচকি। তা দেখে মেহরামও কান্নার মাঝেই হেসে ওঠে। ডাক্তার বাইরে বের হয়ে পরে। তারপর সবাইকে বলে যে এখন সবাই দেখা করতে পারে মেহরামের সাথে। আর মেয়ে বাবু হয়েছে। সবার খুশি আর কে দেখে। ছুটে চলে যায় কেবিনে। মেহরামের মা গিয়েই আগে মেহরামকে জড়িয়ে ধরে। তারপর বাচ্চা কে কোলে নেয়। এইতো হলো কাজ কেউ যেন আর কারো মাঝে নেই। বাচ্চা কে পেয়ে সবাই খুশিতে দিশেহারা। মেহরাম উকি দিয়ে একটু বাইরে দেখে। তাকিয়ে দেখে যে আয়ুশ সবার পেছনে দুই হাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে। মেহরাম আয়ুশ বলে ডাক দেয়। আয়ুশ এসে মেহরামের পাশে দাঁড়ায়।

আয়ুশ;; কেমন আছো?

মেহরাম;; আমার মনে হয় না যে এখন আমার থেকে ভালো বা খুশি অন্য কেউ আছে।

আয়ুশ;; এখনো ব্যাথা করছে?

মেহরাম;; একদমই না। তুমি কেমন আছো?

আয়ুশ;; আমি, আরে আমি আবার কেমন থাকবো অনেক ভালো।

মেহরাম;; দুই ব্যাগ রক্ত দিলে অবশ্যই কেউ এতো ভালো থাকে না। শরীর দূর্বল লাগছে না!!

আয়ুশ;; তুমি..

মেহরাম;; আমি জানি।

আয়ুশ আর কিছুই বলে না, মেহরামের হাত ধরে মুচকি হাসে। সবার দিকে তাকিয়ে দেখে তারা এখনো বাচ্চাকেই নিয়ে পরে আছে। তা দেখে মেহরাম আর আয়ুশ হেসে দেয়। তবে এবার আতিয়া গিয়ে তার কোল থেকে আয়ুশের কোলে বাচ্চা কে দিয়ে দেয়। আয়ুশ একবার মেহরামের দিকে তাকায়। মেহরাম মুচকি হাসি দেয়। এবার আয়ুশ বাচ্চা কে কোলে নেয়। তারপর চোখে মুখে যেই হাসি ফুটে ওঠে তার। আয়ুশের মনে হয় না যে এমন খুশি সে তার পুরো জীবনে আর কখনো হয়েছিলো। সবাই সিচুয়েশন টা বুঝতে পেরে মেহরাম আর আয়ুশকে কেবিনে রেখে বাইরে বের হয়ে পরে। আয়ুশ বাচ্চার ছোট ছোট হাত গুলো দেখছে। আয়ুশ গলা টা হাল্কা খাকাড়ি দেয়। মেহরামের কেমন যেন একটু খটকা লাগে মেহরাম আয়ুশের নাম ধরে ডাক দেয়।

মেহরাম;; আয়ুশ..!

আয়ুশ মেহরামের ডাকে মাথা তুলে তার দিকে তাকায়। মেহরাম অবাক হয়ে যায় আয়ুশকে দেখে। আয়ুশের চোখে পানি এসে পরেছে।

মেহরাম;; আয়ুশ তুমি..

আয়ুশ;; জানো কখনো ভাবি নি যে বাচ্চাকে কোলে নেবো। আমারই বাচ্চা এটা।

মেহরাম কি বলবে খুঁজে পায় না। হঠাৎ করেই মেহরামের মনে হয় যে আজ ঠিক কয় তারিখ। মেহরাম কপাল কুচকে আয়ুশকে বলে ওঠে…

মেহরাম;; আয়ুশ..!

আয়ুশ;; হুমম।

মেহরাম;; আজ কয় তারিখ?

আয়ুশ;; ৮ এপ্রিল

আয়ুশের কথা শুনে মেহরাম হাসে। আয়ুশ বেবি কে নিয়ে খেলছে। একসময় আয়ুশ বেবি কে মেহরামের কোলে দিয়ে দেয়। মেহরাম বাচ্চার মুখের দিকে এক নয়নে তাকিয়ে থাকে। আর আয়ুশ তাদের দুজনের দিকেই। আয়ুশ বলে ওঠে….

আয়ুশ;; মেহরু..!

মেহরাম;; হুমম

আয়ুশ;; ওর নাম কি দিবে?

মেহরাম;; ওর নাম…!!

মেহরাম অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে বাচ্চার দিকে। সোহেল যখন বেচে ছিলো তখন সোহেল মেহরামকে কিছু কথা বলেছিলো। কথা গুলো মেহরামের কানে এসে বাজছে।

“” মেহরাম আমাদের না খুব সুন্দর ফুটফুটে একটা মেয়ে বাচ্চা হবে দেখো, ঠিক হুবাহু তোমার মতোন। আর জানো আমি না মেয়ের নামও ঠিক করে রেখেছি। তোমার নামের সাথে মিলিয়ে রেখেছি। ওর নাম হবে ”মেহের”। আমি জানি নাম টা অনেক সুন্দর””।

মেহরাম সোহেলের বলা এই কথা গুলো ভাবছিলো ঠিক তখনই আবার আয়ুশের ডাকে মেহরামের হুস ফিরে।

আয়ুশ;; মেহরু..

মেহরাম;; হুমমম

আয়ুশ;; ওর নাম কি হবে??

মেহরাম আবার তার মেয়ের দিকে তাকায়। আর মেহরাম এখন আয়ুশকে আজকের তারিখের কথা জিজ্ঞেস করেছে। কারণ আজ ৮ এপ্রিল৷ আজ তনুর জন্মদিন। কি মিল তাই না। আজ তনুর জন্মদিন আর আজই মেহরামের মেয়ে জন্ম নিলো। মনে হচ্ছে তনু হয়তো আবার মেহরামের মেয়ের মাঝেই জন্ম নিয়ে নিয়েছে। আজ তনুর জন্মদিন।
মেহরাম তার মেয়েকে আরো কিছুটা আগলে নিয়ে বলে ওঠে..

মেহরাম;; ওর নাম হবে “” তনু আফরোজা মেহের “”।

এই বলেই মেহরাম তার মেয়ের কপালে অর্থাৎ মেহেরের কপালে চুমু একে দেয়। এবার মেহরাম আয়ুশের দিকে আর আয়ুশ মেহরামের দিকে তাকায়। হেসে দেয়। আর সাথে মুচকি হেসে ওঠে ছোট্ট প্রাণ মেহেরও ❤️।





🍂চলবে~~

#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ৩৬

🌹~~

মেহরাম কে তার ডেলিভারির একদিন পরে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে। অর্থাৎ ডেলিভারির দিন এবং তার পরের দিন হস্পিটালে থাকতে হয়েছে তাকে। তবে বাচ্চা অনবরত কেদেই চলেছে ক্ষিদায়। এখন এই নবজাতক শিশুকে ডাক্তার তো মায়ের বুকের দুধ ছাড়া আর কিছু খাওয়ানোর জন্য সাজেস্ট করবেন না। এই নিয়ে হলো আরেক বিপদ। মায়ের বুকে দুধ নেই এখন বাচ্চা খাবে কি। ক্ষুদায় জ্বালায় যে পরিমাণে কান্না করছিলো এতে হস্পিটালের জানালার কাচ গুলো যেন ফেটে পরার উপক্রম হয়ে গিয়েছিলো। কেউই নিয়ে শান্ত করাতে পারছিলো না। অবশেষে আর কোন উপায় না পেয়ে বাইরের লিকুইড দুধ খাওয়াতে হয়েছে। মুখে দেবার সাথে সাথে খাবার উধাও, যেন কত্তো ক্ষিদে তার পেটে লুকিয়ে ছিলো। মেহরামের চাচি বাচ্চা কে খাইয়ে দেয়। আজ সকাল বেলাই হস্পিটাল থেকে রিলিজ করে দিয়েছে মেহরাম কে। হাতের ওপরে এখনো একটু ব্যান্ডেজ করা। পেটের দিকে হাল্কা ব্যাথা হয় কিন্তু এটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হবে না। আয়ুশ, মেহরামের মা কনিকা আর লায়লা খাতুন গিয়েছিলো মেহরাম কে হস্পিটাল থেকে আনতে। হস্পিটাল থেকে সবকিছু গাড়িতে করে নিয়ে এসে পরেছে। লায়লা খাতুনের কোলে মেহের, সে ঘুম আর ঘুমের মাঝেই সে ছোট্ট আঙুল গুলো চুষছে। মেহরামের মা মেহরামের সব কিছু নিয়ে বাড়ির ভেতরে আস্তে আস্তে যাচ্ছে। মেহরাম গাড়ি থেকে নামলে তার এক হাত আয়ুশ ধরে, নিজের আরেক হাত মেহরাম তার পেটে ধরে রেখেছে। কণা মেহরাম দের বাড়িতেই রয়েছে। গাড়ির শব্দ পেয়ে তাদের বুঝতে আর বাকি রইলো না যে মেহরাম এসে পরেছে। দ্রুত বাড়ির ভেতর থেকে কণা আর আতিয়া বাইরে আসে। কণা তো এসেই মেহের কে কোলে তুলে নেয়। খুশিতে গদগদ যাকে বলে আর কি। আতিয়া গিয়ে এক গাল হেসে মেহরাম কে আরেক দিক দিয়ে ধরে। আস্তে আস্তে বাড়ির ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। মেহরাম বাড়ির সোফার ওপর বসে পরে। সবার মাঝে যেন খুশি ঢলে পরলে। তবে আয়ুশ খেয়াল করলো যে এতো কিছুর মাঝেও মেহরামের মন টা কেমন যেন খারাপ খারাপ ভাব। আয়ুশ মেহরাম কে জিজ্ঞেস করে….

আয়ুশ;; মেহরাম, কি হয়েছে। ভালো লাগছে না শরীর??

মেহরাম;; আমি ভাবছি।

আয়ুশ;; কি?

মেহরাম;; মাঝ খানে অনেক সময় পার হয়ে গিয়েছে। তো এতে তো এমনিতেই বোঝা যায় যে ডেলিভারি হয়ে গেছে। আমার মেয়ে টা হলো। কিন্তু তবুও সোহেলের মা একটা বার দেখতে পর্যন্ত আসলো না। দেখতে আসা তো দূর একটা বার ফোন করে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন অব্দি মনে করলো না।

মেহরামের এমন কথা শুনে সচারাচর সবারই একটু খারাপ লাগলো। আর তখন মেহরামের মন ভালো করার জন্য লায়লা খাতুন বলে উঠলেন…

লায়লা;; কেন, সোহেলের মায়ের জানতে হবে কেন। উনি তো নিজেই সব কিছুর মায়া ছিন্ন করে দিয়েছেন। আর আমি কি একা যথেষ্ট নই নাকি। আমাকে পছন্দ হয় না।

মেহরাম কিছুটা শব্দ করেই হেসে দিলো সাথে বাকিরাও।

মেহরাম;; আবার জিগায়, পছন্দ নাকি হবে না। খালামনি কি যে বলো না।

লায়লা;; এই যে দিলে তো মুড টা নষ্ট করে। আরেকবার খালামনি ডাকলে খবর আছে।

মেহরাম;; মানুষের একটা মা থাকে আমার তিন তিনটা।

সবাই হাসছিলো তবে এর মধ্যে মেহের কেদে ওঠে। মানে মনে হয় সবার এই হাসি হাসি মুখ টা তার আর ভালো লাগলো না তাই দিলো কেদে। হয়তো ক্ষিদে পেয়েছে। মেহরামের মা কনিকা গিয়ে কোলে নেয় তারপর খাইয়ে দেয়। এখনো তাকে বাইরের লিকুইড দুধই খাওয়ানো হয়। কারণ মায়ের বুকে দুধ এসে সারে নি। আর এছাড়াও মেহরামের বডিতে ব্লাড দেওয়া হয়েছে। সেটারও তো বডির সাথে খাপ খেতে কিছুদিন দরকার। তাই ডক্টরের পরামর্শেই এমন টা করা হয়েছে। মেহের কে কনিকা খাইয়ে দিচ্ছে আর অনেক গল্প করছে। মেহরাম তার দিকে তাকিয়ে আছে। মা কে দেখতে পেয়েই হেসে দেয়। মেহরাম মেহেরের দিকে তাকিয়েই ক্ষীণ দম ছেড়ে হেসে দেয়। মেহরাম পাশে তাকিয়ে দেখে আয়ুশও মেহেরের দিকে তাকিয়ে আছে। আয়ুশ মেহরামের বাম হাতের ভাজে আলতো করে নিজের হাত রেখে দেয়। মেহরাম মুচকি হাসে। আয়ুশ তার মুখের কাছে নিয়ে হাতের উলটো পাশে চুমু আকে।
এভাবেই দিন যেতে থাকে। মেহরাম এখন অনেক টাই সুস্থ। হাটাচলা করতে পারে আগের মতোই। সারাদিন মেয়েকে নিয়েই কেটে যায় বেলা গুলো। বাড়ির সবার চোখের মনি মেহের। সারাক্ষণ সবার কোলে কোলেই থাকে। বাড়ি যেন আলো করে এসেছে। সারাক্ষণ মেতেই থাকে। কণা তো এখন পারে না এই বাসাতেই থেকে যেতে। হুট হাট এসে পরে শুধু এই মেহেরের জন্যই। এখন সবাই বোঝে যে বাড়িতে একটা ছোট্ট বাচ্চা থাকলে সেই বাড়ির রুপ আপনা আপনিই পালটে যায়। ইদানীং মেহরামের মাঝেও অনেক টা চেঞ্জ এসেছে। আর এটা সবার নজরেই বাধে। কেমন একটা মা মা ফিলিংস। এখন আর মেহের কে বাইরের লিকুইড দুধ খাওয়ানো হয় না। মেহরামই দুধ ফিডিং করায়। আকাশ তো ছোট। কিন্তু মেহের কে নেবার জন্য তার কি জেদ। মেহরামের সাথে এক প্রকার ঝগড়া লাগিয়ে দেয় মেহের কে নেবার জন্য। বাকি সবাই না করলেও কে শোনে কার কথা। যখন আতিয়া আকাশ কে বকতে শুরু করে দিলো তখন আর না পেয়ে মেহরাম নিজেই থামিয়ে দিলো। আকাশ কে নিজের পাশে বসিয়ে আস্তে করে মেহের কে তার কোলে দেয়। আকাশের সে কি খুশি। মেহেরও নিজের মামার কোলে গিয়ে হাসছে। তবে এভাবেই কিছুক্ষণ থাকতে থাকতে আকাশ নিজেই কান্না করে দেয়, মেহের আর কি কানবে। মেহরাম তো অবাক হয়ে যায়। কি হয়েছে জানতে চাইলেই আকাশ বলে মেহের হিশু করে দিয়েছে তার কোলে। আকাশের এমন কথায় সবাই যেন হাসিতে ফেটে পরলো। আতিয়া শুধু আকাশ কে চেতাচ্ছে যে সে তো আগেই মানা করেছিলো কিন্তু ত্যাড়ামি করে কোলে নিয়েছে এখন বুঝুক ঠ্যালা। মেহরাম মেহের কে কোলে নিয়ে নেয় আর আকাশ কানতে কানতে ওয়াসরুমে চলে যায়।

দিন যেতে যেতে পার হয় যায় এক সপ্তাহ। মেহের আস্তে আস্তে বড়ো হচ্ছে। তবে বাড়িতে এতো গুলো মানুষের মাঝে একটা মাত্র বাচ্চা থাকলে যা হয় আরকি। আদরবে কমতি নেই। এই টুকু বয়সেই তার কাপড়ের যেন অভাব নেই। মেহেরের আসার পর থেকে মেহরামের জীবনের পুরো নকশাই উলোট পালোট হয়ে গেছে। কাবার্ডে মেহরামের নিজের থেকে মেয়ের জামা কাপড় বেশি। কাপড় এক প্রকার এদিক সেদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে। মেহরাম মাঝে মাঝে ভাবে যে তার মেয়ে যে এতো গোলুমোলু হবে সে ভাবেও নি। মেহেরের ওজন ৫ কেজি। হয়েছে এক সপ্তাহ হলো এখনোই ৫ কেজি। মুখ দেখলে কেউ ভাববে যে অনেক রেগে আছে। কিন্তু মাঝে মাঝে হুট করেই এমন এক হাসি দেয়। প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয় মেয়ে কে নিয়ে মেহরামের। এখনই এই দশা যখন আরেকটু বড়ো হবে বা হাটতে শিখবে তখন পাগল বানিয়ে দিবে। এখন মেয়েকে বিছানার ওপর শুইয়ে দিয়ে মেহরাম তার সামনে দু হাত ভাজ করে চিন্তা মাখা মুখ বানিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কারণ মেহের কে ডায়পার পরাতে হবে। আরেক যুদ্ধ। পা নড়াচড়া করে অনেক। এক পা ভেতরে দিলে আরেক পা বাইরে বের করে ফেলে সেই ফাকে। এখনো তার ব্যাতিক্রম না, মেহরাম ডায়পার পরানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে কিন্তু পারছে না। হাপিয়ে গিয়েছে। আর উপায় না পেয়ে মেহরাম ডায়পার না পরিয়েই তা হাতে করে নিয়ে নেয়। তারপর মেহের কে নিয়ে নিচে নেমে পরে। নিচে যে যার কাজ করছিলো তখনই মেহরাম নেমে আসে আর মেহরাম কে এমন পাগল পাগল অবস্থায় দেখে আতিয়া বলে ওঠে…

আতিয়া;; কিরে কি হয়েছে। এই অবস্থা কেন?

মেহরাম;; আমি আর পারবো না। এই যে ডায়পার আর এই যে ডায়পারের মালিক। পরাও তুমি। আল্লাহ জীবন শেষ আমার।

আতিয়া;; হেহ কি ভাবছো ময়না একটা বাচ্চা মানুষ করা মুখের কথা। জীবন তামা তামা করে দিবো। আর মেহের তো বড়োই হয়নি এখনই এই অবস্থা আর বাকি দিন গুলো তো পরেই আছে তখন কি করবি তুই।

মেহরাম;; তোমরা সবাই আছো না আমার আর চিন্তা কিসের।

কনিকা;; হ্যাঁ হ্যাঁ ওই আমরা থেকেই রক্ষা বুঝলা নইলে তুমি মেহরাম এতোদিনে পাবনা থাকতা।

মেহরাম;; আচ্ছা হইছে বুঝলাম এখন ওকে দেখো।

কনিকা হাতের কাজ ছেড়ে মেহের কে কোলে নিয়ে নেয়। নানু আপুর কাছে গেতেই তার কি খুশি। কনিকা সুন্দর করে ডায়পা পরিয়ে দিলো মেহের কে।

তবে আগে তো মেহরাম রাতে ঘুমাতে পারতো না, পারতো না বলতে ঘুম আসতো না কিন্তু এখন তো আর পেটে বেবি নেই। এখন রাতে ঘুমে একদম পরে যায় কিন্তু তবুও ঘুমাতে পারে কারণ মেহের। এই হুট করে ক্ষিদে লাগছে, আবার ঘুম আসছে না, আবার কান্না শুরু। আহহহ, মায়েদের জীবন। মেয়েকে ঘুম পারাতে গিয়ে মাঝে মাঝে নিজেই ঘুমিয়ে পরে কিন্তু মেয়ের চিৎকার শুনে বেজে যায় ঘুমের বারো টা। মেহরামের মন চায় মাঝে মাঝে মেহেরের সাথে নিজেরও কেদে দিতে। কিন্তু তা তো আর পারে না। এখনও তাই মেয়ে কে নিয়ে করিডরে ঘুরছে আর মেয়ে আরামে ঘুমিয়ে পরেছে। হঠাৎ মেহরামের ফোন বেজে যায়। এইতো কাজ হলো। কি কষ্টে মেয়েকে ঘুম পারিয়েছিলো এই ফোনের শব্দে মেহের আবার কেদে দেয়। তার ঘুম অনেক বেশি পাতলা। মেহরাম দ্রুত গিয়ে ফোন তুলে। দেখে আয়ুশের ফোন, মেহরাম হাবলা হয়ে যায়। রাগ করবে নাকি নিজে কেদে দিবে খুঁজে পায় না। ফোন টা কানে ধরে আবার মেয়েকে ঘুম পাতানোর চেষ্টা করে। এদিকে আস্তে আস্তে কথাও বলছে।

মেহরাম;; হুম

আয়ুশ;; কি করো?

মেহরাম;; হুম

আয়ুশ;; খেয়েছো রাতে আর মেহের কোথায়?

মেহরাম;; হুম

আয়ুশ;; কি সেই কখন থেকে হুম হুম করছো কি হয়েছে?

মেহরাম;; হুম

আয়ুশ;; মেহরাম

মেহরাম;; আরে মেহের ঘুমাচ্ছে আমার কাধেই আছে এখন জোরে কথা বললে ঘুম ভেংে যাবে এমনিতেই তুমি প্রায় ওর ঘুম ভাংিয়ে দিয়েছিলে।

আয়ুশ;; ওহহ আচ্ছা। এখন ঘুমিয়েছে?

মেহরাম;; হ্যাঁ ঘুমিয়েছে দাড়াও একটু।

মেহরাম ফোন টা হোল্ডে রেখে মেহের কে শুইয়ে দেয় ঠিকঠাক ভাবে। তারপর আবার কানে ফোন নিয়ে কথা বলতে থাকে।

মেহরাম;; হ্যাঁ হ্যালো

আয়ুশ;; হুম আছি

মেহরাম;; ওকে শুইয়ে দিলাম।

আয়ুশ;; কি করো?

মেহরাম;; নিজেও জানি না কি করি। এতোক্ষণ ঘুমে ঢলে পরছিলাম কিন্তু এখন ঘুম এমনিতেই চলে গেলো। আর তুমি এখনো জেগে আছো যে?

আয়ুশ;; না এমনি। আচ্ছা শুনো তোমার আর মেহেরের কিছু পিক দাও তো আর একসাথেই দিবে।

মেহরাম;; আচ্ছা ওয়েট।

মেহরাম গিয়ে মেহেরের পাশে কিছুটে ঝুকে পরে। তারপর ফটাফট মা & মেয়ের কয়েকটা সেলফি তুলে ফেলে সেগুলো আয়ুশকে পাঠিয়ে দেয়। আয়ুশ আবার ফোন দেয়।

মেহরাম;; পেয়েছো?

আয়ুশ;; হ্যাঁ পেয়েছি। আমার মেয়ে বেশি সুন্দর তোমাকে পেত্নী পেত্নী লাগে কেমন জানি।

মেহরাম;; এহহহহহ আইছে রে নিজের দিকে দেখছো একবার ছাগল কোথাকার একটা।

আয়ুশ;; ওইই ভার্সিটির মেয়েরা মরতো আমার ওপর ওকে।

মেহরাম;; এখন আমি তোমাকে মাইরা ফালাই 🙂।

আয়ুশ;; মজা করছি তো বাবা ক্ষেপো কেনো?

মেহরাম;; হেহ ভার্সিটির মেয়েরা মরতো আমার ওপর (বেংগ করে) হেই লিসেন ওটা ভার্সিটি লাইফ ছিলো ওকে। অনেক বছর আগের কাহিনী এখন টেনে এনো না অযথা।

আয়ুশ;; তো তুমি এখন কি বলতে চাচ্ছো। আমি এখনো বের হলে মেয়েরা তাকিয়ে থাকবে। আমি তেমনই। আর অফিসের সব মেয়ে স্টাফরা তো ড্যাবড্যাব করে তাকায় আমার দিকে।

মেহরাম;; তো যাও না ওইসব মেয়েদের কাছেই যাও এখানে কি করো। আমি রাখলাম আমার মেয়ে আছে বায়।

আয়ুশ;; এই না না না না না। আরে মজা করছি তো। আচ্ছা সরি সরি।

মেহরাম;; মা কোথায় আর কণা?

আয়ুশ;; মা ঘুম আর কণাও হয়তো ঘুম। ওহ হ্যাঁ বলতেই ভুলে গেছি। কাল মা আসছে তোমার কাছে।

মেহরাম;; তুমি আসবে না?

আয়ুশ;; না মানে আসলে আমার তো একটু কাজ আছে।

মেহরাম;; হ্যাঁ কাজ নিয়েই থাকো। আমাকে দিয়ে আর কি করবে।

আয়ুশ;; হ্যাঁ যেখানে নিজের জীবন আটকে আছে সেই কিনা বলছে যে আমাকে দিয়ে কি করবে। এইতো আর কিছুদিন তখন বললেও বাইরে যাবো না।

মেহরাম;; হ্যাঁ হয়েছে।

আয়ুশ;; এইযে শুনেন আমার চাপাবাজ আপনার চাপার জোরে তো আর কিছু পারবো না। তো এখন কথা হচ্ছে রাত অনেক হয়েছে। মেয়ে ঘুমিয়ে পরেছে আর আপনিও ঘুমান। আমিও ঘুমাবো।

মেহরাম;; আচ্ছা, আল্লাহ হাফেজ।

আয়ুশ;; আল্লাহ হাফেজ।

মেহরাম ফোন কেটে দিয়ে মেহেরের পাশে শুয়ে পরে। আয়ুশও মেহরামের দেওয়া ছবি গুলো জুম করে করে দেখছে আর হাসছে। মেয়ের কপালে-গালে চুমু দিয়ে ঘুমিয়ে পরে মেহরাম।





💞চলবে~~

তৈমাত্রিক পর্ব-৩৩+৩৪

0

#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ৩৩

💖🌹

।।

এভাবেই চলে গেলো পাঁচ দিন। মেহরাম যে বিয়েতে রাজি হয়ে গেছে এতে বাড়ির কার খুশি কে দেখে। বিয়ে হবে, এই কিছুদিনের মাঝেই হবে। তবে আয়ুশ চাইছে যে বিয়েতে যেন বেশি কোলাহল না থাকে। একটা শান্তশিষ্ট ঘরোয়া ভাবেই যেন বিয়েটা হয়ে যায়। মেহরামও তাই চাইছে। শুধু বাড়ির মানুষ গুলোই থাকবে, তাদের নিয়েই ছোট খাটো একটা আয়োজন করে বিয়ে টা শেষ করে নিবে। সবাই তাদের মতামতকে সাই দেয়। আর বড়ো কথা হচ্ছে মেহরাম এই অবস্থায় বেশি দৌড় ঝাপ করতে পারবে না, এখন তো আরো না। তাই এই কথা মাথায় রেখেই আয়ুশের বিয়ের ব্যাপারে এই চিন্তা করা। আজ ১৭ ই মার্চ, ২০ মার্চের দিন আয়ুশ আর মেহরামের বিয়ে। সব ঠিকঠাক এখন শুধু ভালোয় ভালোয় সব কেটে গেলেই হয়। এখন রাত বেজে চলেছে প্রায় ১;৩৫ মিনিট। মেহরাম ঘুমায় না। প্রতিদিন রাতে কথা হয় আয়ুশের সাথে তার। কারণ মেহরাম যে রাতে ঘুমাতে পারে না এটা আয়ুশ জানে। একা একা থাকতেও ভালো লাগে না তাই আয়ুশ রোজ রাতে মেহরামকে ফোন দেয়। মেহরামের বেশি খারাপ লাগলে সে চুপ করে শুয়ে থাকে আর আয়ুশ নিজে নিজেই বকবক করে যায়। এখনো তার ব্যাতিক্রম নয়। মেহরাম আয়ুশের সাথে কথা বলছে। আয়ুশ তার হাতে একটা ছোট বল নিয়ে ঘোড়াচ্ছে আর সারা ঘরে পায়চারি করে মেহরামের সাথে কথা বলছে। আর মেহরাম সে জানালার পাশে হেলান দিয়ে সব শুনছে। হঠাৎ আকাশে ঘন কালো মেঘ জড়ো হয়ে গেলো। বিদ্যুৎ চমকে উঠলো। মেহরাম এক ধ্যানে আয়ুশের কথা শুনছিলো কিন্তু এভাবে হুট করে আকাশে বিদ্যুৎ চমক দিলে মেহরাম চমকে কিছুটা চিৎকার দিয়ে ওঠে।

আয়ুশ;; মেহরাম, ঠিক আছো?

মেহরাম;; হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছি আমি, ওইতো হুট করেই আকাশ জোরে ডেকে ওঠেছে তো তাই খানিক চমকে গিয়েছিলাম আরকি।

আয়ুশ;; ভয় পাচ্ছো?

মেহরাম;; আরে না না।

আয়ুশ;; আচ্ছা বসে থাকো এক জায়গায় চুপ করে। বেশি নড়াচড়া করো না। আমি কি বড়োমা কে ফোন দেবো, তোমার রুমে আসতে বলবো?

মেহরাম;; আরে না না একদম না, ওরা সবাই হয়তো ঘুম। ফোন দিও না আর আমি ঠিক আছি তো কিছুই হয় নি। তুমি শুধু কথা বলে যাও।

আয়ুশ;; আচ্ছা। তো কি কি প্ল্যান করলে?

মেহরাম;; কি নিয়ে প্ল্যান?

আয়ুশ;; আরে বিয়ে আর কি।

মেহরাম;; আরে তেমন কোন প্ল্যান নেই।

আয়ুশ;; কিন্তু আমার আছে তো।

মেহরাম;; কি প্ল্যান শুনি?!

আয়ুশ;; শোন, বিয়ের দিন একদম সাদা একটা ড্রেস পরবে কেমন।

মেহরাম;; আচ্ছা পড়লাম। তারপর?

আয়ুশ;; তারপর আর কি তোমাকে বিয়ে করে এনে পরবো আমি।

মেহরাম;; হুমম হয়েছে।

তারা কথা বলছিলো তৎক্ষনাৎ আরো একটা বিদুৎ চমক দিয়ে উঠলো আকাশে। তবে এবার মেহরাম চমকায় না। তীব্র বাতাশ বয়ে যাচ্ছে চারিপাশে। জানালা খোলা সেখানের পর্দা অনেক জোরে দুলছে বাতাসে। বাইরে থেকে শীতল বাতাসও আসছে। মেহরাম জানালার দিকে তাকিয়ে আছে।

আয়ুশ;; কি করো?

মেহরাম;; তেমন কিছুই না, বসে আছি। বাইরে থেকে অনেক ভালো বাতাস আসছে।

আয়ুশ;; হ্যাঁ।

মেহরাম;; কিছু খাবো আমি, খিদে লেগে গেছে।

আয়ুশ;; রাতে কি খেয়েছিলে?

মেহরাম;; রাতে কি খেলাম, কি খেলাম? ওহহ হ্যাঁ মনে পরেছে কষা মাংস, খিচুড়ি আর…

আয়ুশ;; হয়েছে থাক থাক আর বলতে হবে না। আমারই খিদে পেয়ে যাচ্ছে তোমার কথা শুনে। আচ্ছা এখন কি খাবে?

মেহরাম;; খাবো না।

আয়ুশ;; কেন?

মেহরাম;; এখন সিড়ি বেয়ে আবার নিচে নামতে হবে তারপর খাবার গরম করতে হবে তারপর খেতে হবে আর অনেক শব্দ হবে। ধুর ছাই এতো ভেজাল করবে কে তার থেকে খাবোই না।

আয়ুশ;; হায়রে, আচ্ছা কি খেতে ইচ্ছে করছে এখন?

মেহরাম;; ফুচকা, ইশশশশ। কি যে ভালো লাগে আর কবে থেকে খাওয়াই হয় না।

আয়ুশ;; ফুচকা খাবে?!

মেহরাম;; হ্যাঁ কিন্তু উপায় নেই যাজ্ঞে বাদ দাও। কি করো?

আয়ুশ;; কেন বাদ দিবো। আচ্ছা শুনো আমি তোমার সাথে আধা ঘন্টা পর কথা বলি!!

মেহরাম;; না না বেশি দরকার হলে কাল কথা বলো। এতো তাড়া নেই কিন্তু করবে টা কি?

আয়ুশ;; কি করবো তা তো আমিই জানি। এবার তুমি ফোন টা রেখে একটু চুপ করে বসে থাকো। আমি পরে ফোন দিচ্ছি কেমন। টাটা

মেহরাম;; আচ্ছা।

মেহরাম এই বলেই ফোন কেটে দেয়। বিছানার ওপর দুই পা তুলে চুপ করে বসে থাকে। এর মধ্যে ধুপ করে কারেন্ট ও চলে যায়। শুরু হয় আরেক জ্বালা। মেহরাম ফোনের ফ্ল্যাস লাইট জ্বালিয়ে আগের মতো করেই বসে থাকলো। আর এদিকে আয়ুশ সোজা চলে যায় রান্নাঘরে কারণ সে ফুচকা বানাবে হ্যাঁ ফুচকা বানাবে। আয়ুশ আগে থেকে মোটামুটি ভালোয় রান্না করতে পারে। আগে একা বাইরে থাকতে হতো তাকে তো সেই সুবাধে তাকে রান্না টা শিখতে হয়েছে। এখন অনেক দিন যাবত রান্না করে না তবে ভুলেও যায় নি। মেহরাম ফুচকা খেতে চেয়েছে। আর আয়ুশ জানে যে এটা আগে থেকেই মেহরামের কি পরিমান পছন্দের একটা খাদ্য। প্রথময় এতো রাতে ফুচকা পাবে না বাইরে। আর দ্বিতীয়ত মেহরামের এই অবস্থায় বাইরের ফুচকা বা অন্য কিছু খাওয়া তেমন একটা ভালো হবে না। তাই নিজেই বানাতে চলে এলো। আয়ুশ রান্নাঘরে এসেই দেখে গ্যাসের ওপর একটা পাতিল জাতিয় কিছু রাখা। তবে গ্যাস অফ করা। সেটার ঢাকনা তুলেতেই ভাগ্যক্রমে সিদ্ধ আলু পেয়ে যায়। ফুচকার যে চিপস গুলো ছিলো সেগুলো নিয়ে এক এক করে গরম তেলে ছেরে দিলো। আর সাথেসাথেই এক একটা ফুলে উঠছে। এভাবেই বেশ কিছু ফুচকা ভেজে ফেলে। আস্তে আস্তে ফুচকা গুলো বানাতেও থাকে। তবে একটু দেরি হয়ে যায়। ত্রিশ মিনিটের জায়গায় চল্লিশ মিনিট হয়ে গেছে। আয়ুশ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দ্রুত কাজ করা শুরু করে দেয়। অবশেষে দুটো বক্স রেডি করে। একটা বক্স নিয়ে নেয় আরেকটা বক্স রান্নাঘরেই রেখে দেয়। ওদিকে মেহরাম চুপ করে বসে আছে। তবে এখন কারেন্ট এসে পরেছে। ফলে হাতে বই নিয়ে পরছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে দশ মিনিট টাইম ওভার হয়ে গিয়েছে। মেহরাম ভাবে হয়তো আয়ুশ কোন দরকারি কাজ করছে তাই দেরি। যাই হোক মেহরাম আবার বই পড়াতে মনোযোগ দেয়। এভাবেই আরো চলে গেলো ত্রিশ মিনিট। এদিকে এখন বাইরে ঝড় শুরু হয়ে গেছে। যেমন জোরে বাতাস চালাচ্ছে তেমন ভাবেই বৃষ্টি পরছে। ঘরের বাতি বার বার আসা-যাওয়া করছে। আর এগুলো দেখে তো মেহরাম ভয়ে জমে গেছে পুরো। বিছানার এক কোণায় গিয়ে খাপটি মেরে বসে থাকলো। কারণ পরিবেশ টা এখন খানিক ভয়ার্ত লাগছে মেহরামের কাছে। ফোন টা বিছানার ঠিক মাঝখানে রাখা ছিলো। অন্ধকার ঘরে ক্ষীন আলো নিয়ে টুটু করে ফোন টা বেজে ওঠে। এভাবে একদম নীরব অবস্থায় হুট করে ফোনের শব্দে মেহরাম ভয় পেয়ে যায়। সামান্য ঝুকে ফোন টা হাতে তুলে দেখে আয়ুশের ফোন। এবার যেন সে হাফ ছেড়ে বাচে। ফোন টা রিসিভ করে কানে ধরে।

মেহরাম;; হ্যালো..

আয়ুশ;; হ্যাঁ মেহরু ভয় পাচ্ছো?

মেহরাম;; আরে না আমি, আমি ভয় পাই নাকি। তুমি জানো না আমি কতো সাহসী।

আয়ুশ;; হ্যাঁ হ্যাঁ তা তোমার গলা শুনেই বোঝা যায়। (হেসে)

মেহরাম;; এইই, একদম মশকরা করবা না।

আয়ুশ;; আচ্ছা কি করো?

মেহরাম;; বসে আছি।

আয়ুশ;; খেয়েছো কিছু?

মেহরাম;; না।

আয়ুশ;; কন্ঠ এমন কেন বেশি ভয় পাচ্ছো?

মেহরাম;; আরে না, আচ্ছা শোন ঘুমাও তুমি আমি রাখি।

এই বলেই মেহরাম ফোন কেটে দেয়, আয়ুশকে কিছু বলার সুযোগ পর্যন্ত দেয় না। আয়ুশ অবাক হয়। সে আবার মেহরাম কে ফোন দেয়।

মেহরাম;; আরে আবার ফোন কেন দিলে শোন রাত অনেক হয়েছে ঘুমাও, আমিও ঘুমাবো। যাও যাও ঘুমাও আমি রাখি বায়।

মেহরাম আবার ফোন কেটে দেয়। আয়ুশ কিছু বলতে গিয়েও বলে না। সুযোগই দিচ্ছে না। কিন্তু এবার আয়ুশের সত্যি রাগ হতে লাগে প্রচুর। আয়ুশ আবার ফোন দেয় মেহরামকে । তবে এবার আয়ুশ কিছুটা চিল্লিয়ে ওঠে….

মেহরাম;; আরে তুমি…

আয়ুশ;; এইই গাধা মেয়ে তোমার রুমের দরজা খোল। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি কখন থেকে। এই বৃষ্টি তে ভিজে আমার জ্বর এলে সব তোমার দোষ।

মেহরাম;; কিহহহ, এই সময়ে তুমি এখানে কি করো। আর কোন দরজা খুলবো?

আয়ুশ;; তোমার রুমের সামনের করিডরের দরজা খোল দ্রুত।

মেহরাম;; হ্যাঁ খুলছি খুলছি।

মেহরাম উঠে কিছুটা দ্রুত গিয়েই রুমের দরজা খোলে দেয়। আসলে করিডরের সাথে একটা দরজা আছে ওটা দিয়ে মেহরামের রুমে ঢোকা যায়। দরজা টা খুলে দাড়াতেই আবার সামনে করিডর টা পরে। আর আয়ুশ ওইদিক দিয়েই এসেছে। মেহরাম জলদি গিয়ে দরজা খুলে দেয় দেখে আয়ুশ কাক ভেজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সামনের চুল গুলো দিয়ে টপ টপ করে পানি গড়িয়ে পরছে। আয়ুশকে মেহরামের দেখে হাসিও পাচ্ছে আবার মায়াও লাগছে। কিন্তু খুব কষ্টে হাসি টা ধামাচাপা দিয় দেয়।

আয়ুশ;; এখন কি সামনে থেকে সরবা নাকি আবার চলে যাবো।

মেহরাম;; আরে আরে রাগ করো কেনো। এসো ভেতরে।

আয়ুশ রুমের ভেতরে এসে পরে। আর মেহরাম মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসছে। আয়ুশ এসে তার কাধ থেকে বিছানার ওপর একটা ব্যাগ রাখে। মেহরাম আয়ুশের দিকে একটা টাওয়াল এগিয়ে দেয়। তা দিয়ে আয়ুশ হাত মুখ মাথা মুছছে। কিন্তু মেহরাম এবার অবাক হয়ে আয়ুশকে জিজ্ঞেস করে…৷

মেহরাম;; তুমি কোথা দিয়ে আর কীভাবে এলে? তাও সোজা আমার দরজার সামনে?

আয়ুশ;; বাড়ির নিচে দাঁড়িয়ে ছিলাম ওপরে তাকিয়ে দেখলাম তোমার রুমের দরজা তো করিডরের সাথে একদম লাগানো। তাই করিডর বেয়ে ওপরে এসে পরেছি।

মেহরাম;; কি, বানর নাকি তুমি। যদি পরে টরে যেতে তো?

আয়ুশ;; কিন্তু পরি নি।

মেহরাম;; আর তুমি এখন এখানে কি করছো আর এই ব্যাগ কেন??

আয়ুশ;; আরে আস্তে হরান হয়ে গিয়েছি আমি। আর তুমি না বললে যে ফুচকা খাবে তাই ফুচকা এনেছি। গ্যারাজ থেকে বাইকের চাবি টা নিয়ে দ্রুত এসে গেলাম। আর রইলো ব্যাগের কথা তো ওইটা কণার ব্যাগ। হারামীর রুমে গিয়ে দেখি কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছে। সেই ফাকে ওর কলেজ ব্যাগ টা নিয়ে এসেছে পরেছি।

মেহরাম;; বাহহহ 😕😕। আর কি লাগে।

আয়ুশ;; আর আধা ঘন্টা টাইম চেয়েছিলামও এর জন্যই।

মেহরাম;; মানে?

আয়ুশ;; ফুচকা নিজে বানিয়েছি।

মেহরাম;; এ্যাহ..!

আয়ুশ;; হ্যাঁ।

মেহরাম;; তুমি কীভাবে বানালে। আর পারো তুমি বানাতে?

আয়ুশ;; তো পারি না তো কি হাওয়ায় উড়ে এসেছে। এটা বানাতে গিয়েই সময় লেগে গিয়েছে এতো।

মেহরাম;; কেন শুধু শুধু কষ্ট করতে গেলে?

আয়ুশ;; এখানে কষ্টের কিছুই নেই। বাইরের খাবার তো আর খেতে দিতে পারি না। আর বড়োমা যদি শুনেছে যে তুমি বাইরের ফুচকা খেয়েছো তো তোমায় পরে আবার বকবে তাই নিয়ে এলাম। আর ব্যাগের ভেতরে বক্স আছে সেখানে সব কিছুই আছে। শুধু খুলে খাওয়া শুরু করো। আর হ্যাঁ ইউ টিউবের হেল্প লেগেছে আমার একটু। তবে এতো বাজেও হয়নি যে খাওয়া যাবে না। খাও।

মেহরাম;; 😒😒

আয়ুশ;; আরে তাকিয়ে না থেকে খাও তো।

মেহরাম আর কোন কথা না বলেই ব্যাগ টা খুলে দিলো। ভেতর থেকে বক্স বের করলো। বক্স টা খুলেই দেখে বক্স ভর্তি ফুচকা। আরেক টা ছোট বক্সে তেতুলের টক রাখা। মেহরাম মুচকি হেসে আয়ুশের দিকে তাকায়। দেখে আয়ুশ এক মনে ফোন ঘাটছে। মেহরাম মুচকি হেসে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। কি বলবে ভাষা খুঁজে পায়না। মেহরাম আয়ুশের দিকে তাকিয়ে ছিলো আর আয়ুশ ফোনের দিকে নজর রেখেই মেহরামকে বলে ওঠে…

আয়ুশ;; খাবার এখানে না ওইদিকে, তাকিয়ে না থেকে খাও।
মেহরাম;; 😆

মেহরাম বিছানার ওপর দুই পা তুলে গপাগপ খাওয়া শুরু করলো। আয়ুশ এবার তার ফোন রেখে দুই গালে হাত দিয়ে মেহরামের দিকে তাকিয়ে রইলো। মেহরাম তো মেহরাম ই খাচ্ছে সে।

মেহরাম;; তাকিয়ে আছো ভালো কথা, কিন্তু আমার যদি পেট খারাপ হয়েছে দেইখো তোমারে কি করি। (খেতে খেতে)

আয়ুশ;; আরে না হবে না।

মেহরাম;; তাহলে তাকিয়ে থাকা বন্ধ করো।

প্রায় পঁচিশ মিনিট পর মেহরামের খাওয়া শেষ হয়। মেহরাম আর আয়ুশ জানালার কাছেই বসে আছে। কথা বলছে মাঝে মাঝে হাসছে তবে কি যেন ভেবে হঠাৎই মেহরামের মন টা খারাপ হয়ে যায়। সে আয়ুশকে বলে ওঠে…

মেহরাম;; আয়ুশ..!

আয়ুশ;; হুমম বলো।

মেহরাম;; তোমাকে কিছু কথা বলার ছিলো।

আয়ুশ;; হুম বলে ফেলো।

মেহরাম;; দেখো আমি জানি না ব্যাপার টাকে তুমি ঠিক কীভাবে নিবে তবে হ্যাঁ প্লিজ সত্যি কথা বলবে আর যদি এটা নিয়ে তোমার মনে কোন করম কোন খুট থাকে তাও প্লিজ বলে দিবে ওকে..!

আয়ুশ;; হ্যাঁ বাবা বুঝেছি এবার বলো (হেসে)

মেহরাম;; আয়ুশ আসলে তুমি তো জানোই যে আমার গর্ভের বাচ্চা টা সোহেলের। হ্যাঁ ঠিক আছে যে তুমি আমায় ভালোবাসো আর বিয়ে করবে এতে সবাই খুশি। কিন্তু যতোই হোক বাচ্চা টা আমার আয়ুশ। আমি চাই না যে ও কখনো কারো জীবনে ঝামেলা হয়ে দাড়াক। তাই বলছি যে যদি তোমার কোন আপত্তি থাকে ওকে নিয়ে তাহ……….

মেহরামের পুরো কথা শেষ হবার আগেই এবার আয়ুশ বলে ওঠে…

আয়ুশ;; মেহরাম পাগল হয়েছো তুমি, মাথা ঠিক আছে তোমার। কি সব উল্টো-পাল্টা বকছো। সোহেল একজন অনেক ভালো মানুষ ছিলেন। না ই কখনো সোহেল কে নিয়ে আমার কোন সমস্যা ছিলো আর না ই ওর বাচ্চা কে নিয়ে। আর দাড়াও তুমি কেন বারবার বলছো যে এটা তোমার বাচ্চা। মেহরাম এটা আমাদের বাচ্চা বুঝলে তুমি। এটা শুধু তোমার একার না এটা আমার বাচ্চাও, আমাদের বেবি এটা। আমাদের দুজনের। আর জানো আমার কাছে সবথেকে বড়ো আর খুশির ব্যাপার হচ্ছে এটা যে যখন ও বড়ো হবে তখন আমাকে বাবা বলে ডাকবে। আর তখন আমার খুশির কোন সীমা থাকবে না। আর তুমিও শুনে রাখো। আজ & এখন বলেছো বলেছোই। আজই ফার্স্ট আর লাস্ট এই কথা টা আর কখনোই তুমি বলবে না যে এটা তোমার বাচ্চা। বেবির বাবা মা আমরা দুইজন বুঝলে বোকা মেয়ে। (মেহরামের হাত ধরে)

মেহরাম;; হুমম….

আয়ুশ;; এই দেখো আবার কাদছে। আরে মেয়ে তোমাকে নিয়ে আমি কোথায় যে যাবো।

মেহরাম তার মাথা টা আয়ুশের কাধে রেখে দেয় আর আয়ুশ তার এক হাত মেহরামের মাথার পেছনে রেখে দেয়। আর কিছুক্ষণ থেকে যায় আয়ুশ। এদিকে ঝড় & বৃষ্টির বেগ অনেক টাই কমে এসেছে। আয়ুশ মেহরামের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসে পরতে ধরে….

আয়ুশ;; মেহরু তুমি থাকো ভালোভাবে থেকো বেশি চলাচল করতে হবে না। আর আমি এখন যাই।

মেহরাম;; তা বুঝলাম কিন্তু যাবে কোন দিক দিয়ে?

আয়ুশ;; কেন যেই দিক দিয়ে এসেছি সেইদিন দিয়েই।

মেহরাম;; এতো বেশি বুঝো কেন। আমি বাড়ির মেইন গেট খুলে দিচ্ছি সেখান দিয়ে যাও।

আয়ুশ;; আচ্ছা।

মেহরাম;; এই দাড়াও কণার ব্যাগ টা তো নিয়ে যাও।

আয়ুশ;; ওহহ হ্যাঁ মনেই ছিলো না। ভালো কথা মনে করিয়ে দিয়েছো নয়তো কাল সকালে আমার মাথা খেতো।

আয়ুশ এসে পরে। মেহরাম খুব সাবধানে হলরুমে এসে পরে। মেইন গেটের চাবি নিয়ে আস্তে করে বের হয়ে পরে। দরজা খুলে দেয়। আয়ুশ বাইরে গিয়ে বাইকে করে চলে যায়। আর মেহরাম গেটে আবার তালা লাগিয়ে হলরুমের বাতি অফ করে নিজের রুমে গিয়ে শুয়ে পরে। এবার মেহরামের চোখে আপনা আপনিই ঘুম চলে আসে আর সে ঘুমিয়ে পরে। ধূসর আকাশ আস্তে আস্তে পরিষ্কার হয়ে যায়। কালো মেঘ সরে যায়। আকাশে সূর্যের আলো ফুটে ওঠেছে। প্রখর রোদ। কেউ দেখে ভাববেই না যে গতকাল রাতে এতো জোরে তুফান হয়েছে।


কণা ঘুম থেকে ওঠে পরে। আড়মোড়া ভেংে ঘুম থেকে ওঠেই প্রথমে কণার নজর যায় তার পড়ার টেবিলের ওপর থাকা তার ব্যাগ টার দিকে। কণা কপাল কুচকে সেদিকে তাকায়। এগিয়ে গিয়ে ব্যাগ টার দিকে হাত বাড়ায়। ব্যাগ টা কেমন যেন ভেজা ভেজা। ব্যাগ টা হাতে নিতেই ভেতরে কিছু একটা বেজে ওঠে। কণা আবার কপাল কুচকায়। ব্যাগ টা হাতে নিয়ে চেইন খুলে ভেতরে দেখে একটা বক্স। বক্স টা হাতে নিয়ে কণা আরো অবাক হয়। কেননা বক্সের ভেতরে অনেক গুলো ফুচকা। কেন যেন কণার আয়ুশের ওপর না চাইতেও সন্দেহ হলো। কণা হাতে ব্যাগ টা নিয়ে সোজা তার ভাইয়ের রুমে চলে গেলো। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখে আয়ুশ নেই। কণা আবার চলে গেলো নিচে। নিচে গেতেই দেখে আয়ুশ সোফার ওপর বসে ফোনে কথা বলছে। কণা গিয়ে আয়ুশের পাশে দাঁড়িয়ে পরে। আয়ুশ কণা কে দেখে ফোন টা কেটে দেয়।

আয়ুশ;; আয়নাতে দেখেছিস নিজেকে একবারও। কেউ দেখলে অজ্ঞান হয়ে নিচে পরে যাবে। কি হয়েছে ঘুম থেকে উঠেই এসেছিস কেন এখানে?

কণা;; ঝাড়ি কম মার আমায়। আমার ব্যাগে ফুচকা কিভাবে এলো আর ব্যাগ ভিজা কেন??

আয়ুশ;; আমি কি করে জানবো তা? আমায় কেন বলছিস?

কণা;; কারণ আমার গুণোধর ভাই আপনি ছাড়া এই কাজ আর কেউই যে করবে না তা আমি জানি।

আয়ুশ;; ফুচকা পেয়েছিস না এক বক্স??

কণা;; হ্যাঁ, তা তো পেয়েছি।

আয়ুশ;; তাহলে এখন মুখ বন্ধ কর আর যা গিয়ে ফ্রেশ হ।
কণা;; হুম হুম যাচ্ছি।

কণা এক নজর আয়ুশকে দেখে আবার চলে গেলো। এদিকে আয়ুশ কণা কে কথা শুনিয়ে মুচকি হাসছে। কণা আবার কিছুক্ষন পর ঘুড়ে এসে আয়ুশের গালে টুক করে একটা চুমো খায়।

কণা;; থ্যাংস্ ভাই। লাপ্পিউ 🥰।

কণা আবার ব্যাগ নিয়ে দৌড়ে চলে যায়। আয়ুশ এবার হেসে দেয়। আয়ুশ কাল রাতে দুটো বক্স ফুচকা বানিয়েছিলো। একটা বক্স মেহরামের জন্য নিয়ে গিয়েছিলো আর একটা বক্স কণার জন্য। মেহরামের কাছ থেকে আসার পর কণার জন্য বক্স টা তার ব্যাগে তুলেই আবার তার রুমে রেখে দিয়ে আসে চুপটি করে। আর কণা সকালে উঠেই তা পেয়ে যায়। এভাবেই মাঝখানে দিনগুলো চলে যায়। আস্তে আস্তে বিয়ের দিন চলে এলো আয়ুশ & মেহরামের। আজ ২০ মার্চ।





🌼চলবে~~

#তৈমাত্রিক
#লেখিক; Tamanna Islam
#পর্বঃ ৩৪

আজ ২০ মার্চ। আয়ুশ & মেহরামের বিয়ে ঠিক হয়েছিলো এই দিনেই। আয়ুশের মা লায়লা খাতুন আর কণা মেহরামদের বাড়িতে। তবে আয়ুশ অফিসে। বাকি সবাই যেতে মানা করলেও কাজের চাপের ফলে তাকে বাধ্য হয়ে যেতেই হয়েছে। মেহরামের বাড়িতে তার মা চাচি কণা আর কণার মা সবাই মিলে গল্প করছিলো। কিন্তু এরই মাঝে মেহরামের মা বলে ওঠেন….

কনিকা;; আচ্ছা মেহরামের আর মাত্র কিছুদিন বাকি আছে দশ মাসে পরার। আর এখনই আমরা সবাই বিয়ের আয়োজন করছি। কিন্তু গর্ভবতী থাকা কালিন তো বিয়ে করা যায় না। এটা নিয়মে নেয়। বাচ্চা হবার পর বিধান অনুযায়ী বিয়ে করতে হয়।

কণা;; তাহলে কি এখন বিয়ে হবে ভাইয়া আর আপুর।

কনিকা;; না আসলে…

লায়লা;; তাহলে ডেলিভারির পর বিয়ে টা হোক।

আতিয়া;; হ্যাঁ তাই হবে, তাহলে বিয়ের ডেট টা পিছিয়ে দেই।

লায়লা;; হ্যাঁ মেহরাম মা তোর কোন সমস্যা আছে।

মেহরাম;; না আমি আর কি বলবো। তোমরা সবাই যা ভালো বুঝো তাই।

আতিয়া;; তাহলে তো হলোই। আয়ুশকে বলে দিতে হবে।

মেহরাম;; ওকে শুধু বিয়ে পিছাচ্ছে এটা বলে দিলেই হবে।

সবাই আলোচনা করে ডেলিভারির পরই বিয়ের আয়োজন করার সিদ্ধান্ত নিলো। কথা বলার মাঝেই মেহরামের হুট করে ফোন বেজে ওঠে। তাকিয়ে দেখে আয়ুশেরই ফোন। মেহরাম উঠে গিয়ে কিছুটা দূরে চলে গেলো। তারপর কথা বলতে থাকে।

আয়ুশ;; হ্যালো

মেহরাম;; হুমমম

আয়ুশ;; কি করো আর বাকি সবাই কোথায়?

মেহরাম;; হ্যাঁ এইতো আছি আর বাকি সবাই কথা বলছে।

আয়ুশ;; কি নিয়ে?

মেহরাম;; আসলে আয়ুশ আমি না বিয়ে টা করবো না।

আয়ুশ;; মানে কি?

মেহরাম;; মানে এই যে আমি বিয়ে করবো না।

আয়ুশ;; এখন এইসব কি বলছো মেহরাম।

মেহরামের এমন খাপছাড়া কথা শুনে তো আয়ুশ অবাকের চরম পর্যায়ে চলে যায়। কিন্তু এদিকে আয়ুশকে এমন কথা বলে মেহরাম নিজেই মুখ চেপে ধরে হাসছে। আসলে মেহরাম আয়ুশের সাথে ফাজলামি ছাড়া আর কিছুই করছে না। তবে আয়ুশ তো আর তা টের পায় নি। সে ভেবেছে মেহরাম সিরিয়াস। আয়ুশ ঘাবড়ে গিয়ে মেহরামের সাথে বকবক করেই যাচ্ছে আর মেহরাম হাসছে।

আয়ুশ;; দেখো মেহরু এমন করো না তো আমার ভালো লাগে না। এগুলো কি ধরণের কথা। আর এখন এইসব বলার মানেই বা কি। আর কি হয়েছে এনি প্রব্লেম। খুলেও তো বলতে পারো আমায় তাই না..?!

অবশেষে মেহরাম আর না পেরে জোরেই হেসে দেয়।

মেহরাম;; হাহাহাহাহাহা,,, হিহি হাহাহাহাহ আল্লাহ হাহাহাহাহাহা 😆।

আয়ুশ;; কি হলো আবার এমন পাগলের মতো হাসছো কেন?

মেহরাম;; আরে আমি মজা করতাছি, সিরিয়াস ভাবে নিও না।

আয়ুশ;; ধুউউউর ছাই। এমন করে কেউ। যেভাবে তুমি বললে আমি তো ভেবেছি যে কি না কি। তো কি হয়েছে এভাবে হঠাৎ বললে যে!

মেহরাম;; আমি আসলে জানতাম না, মা বললো যে প্রেগন্যান্ট অবস্থায় বিয়ে করা জায়েজ না। এটা নিয়মে নেই।

আয়ুশ;; ওহহ আচ্ছা।

মেহরাম;; তো বিয়ের ডেট পেছানো হয়েছে।

আয়ুশ;; ওহহ আচ্ছা। আচ্ছা যা ভালো হয় তাই। এখন নিজের দিকে মনোযোগ দাও। বেশি খেয়াল রাখো নিজের।

মেহরাম;; আমি কিছুই করি না, বাড়ির সবাই অনেক করে আমার জন্য।

আয়ুশ;; তা তো অবশ্যই।

মেহরাম;; এই জানো কণা আজ কি বলছিলো!

আয়ুশ;; কি বলে?

মেহরাম;; বলছিলো যে ” আমার ভাইটা কবে যে এত্তো বেশি ভালো হলো, কাল আমার জন্য আমার ব্যাগে এক বক্স ফুচকা রেখে দিয়েছিলো, আমাকে বলেও নি। সারপ্রাইজ দিয়েছে জীবনে ফার্স্ট যদিও কিন্তু দিয়েছে তো “।

আয়ুশ;; হাহাহা, ওর কথা বাদ দাও। তাড় ছিড়া বোন আমার। তুমি কিছু বলো নি তো?

মেহরাম;; না আমি আর কি বলবো শুধু শুনছিলাম।

আয়ুশ;; 😅। আচ্ছা আমি এখন রাখি ওকে ফাইল আছে অনেক গুলো চেক করতে হবে।

মেহরাম;; আচ্ছা।

মেহরাম আয়ুশের সাথে কথা বলে ফোন রেখে দেয়। হলরুমে এসে দেখে এখনো সবাই আগের মতোই কথা বলছে। মেহরাম এসে কণার পাশে বসে পরে।

কণা;; আমার বিয়ে খাওয়া টা আবার পিছিয়ে গেলো 😒।

কণার কথা শুনে সবাই হেসে দেয়। সেইদিন এক বেলা কণা আর তার মা সেখানে থেকে এসে পরে। এভাবেই সেইদিন চলে যায়। আস্তে আস্তে রাত হয়। মেহরাম চেয়ারে হেলান নিয়ে বসে করিডরের দরজা খুলে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। রুমটা অন্ধকার। এটা তেমন কিছু না এখন। এটা তার নিত্যদিনের অভ্যাস। নিজেকে অনুভব করা যায় এমন পরিস্থিতিতে। মেহরামের হাতে একটা ছবি আছে। সেটা বুকের ওপরে রেখে দিয়েছে। অবশ্যই ছবি টা তনুর। আগে তনু কখনোই মেহরামকে এমন করে একা একা বসে থাকতে দিতো না। সে ভাবতো যে মেহরামের মন খারাপ হলেই সে এভাবে বসে থাকে আসলে তা না। এমন পরিবেশ খুব বেশি পছন্দের। মেহরাম ছবি টা তুলে তনুর দিকে তাকায়। তনুর বাম গালের টোল টা একদম ঝকঝক করছে। হাসলে তনুর গালে টোল পরতো। কিছু কিছু জিনিসে মেহরাম আর তনুর মাঝে এক অদ্ভুত মিল পাওয়া যায়। তনুর বাম গালে টোল পরতো আর আর মেহরামের ডান গালে। ছোট থাকতে কখনো দুইজন ভিন্ন ভিন্ন রকমের ড্রেস পরতো না। তনুর কথা ছিলো সবকিছুই এক থাকতে হবে তাদের। যার দরুন দুইজন একই ড্রেস পরলে মনে হতো জমজ। বড়ো হলে তাদের মাঝে কিছুটা ভিন্নতা এসেছে। মেহরাম ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই হেসে ওঠে। পরিস্থিতি টা এমন যে তার ঠোঁটে হাসি ঝুলছে আর চোখের কার্নিশ বেয়ে পানি গড়িয়ে পরছে। কার কার তনুর কথা মনে পরে তা তো জানে না কিন্তু মেহরামের খুব করে মনে পরে। আজ পুরনো কথা গুলো যেন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠছে। হ্যাঁ আগেও মনে পরতো কিন্তু আজ যেন অনেকটা বেশিই। স্কুলে যখন একসাথে পরতো তখন মেহরামের পাশে কেউ যদি ভুল করেও বসে পরতো তাহলে ওর কাম সারছে। একদিন স্কুলে এক নতুন মেয়ে এসেছিলো, আর হ্যাঁ না জেনেই মেহরামের পাশে বসেছিলো। তনু যেইভাবে ওর চুল গুলো টেনেছিলো একদম দেখার মতো। ব্যাপার টা মনে হতেই মেহরাম খিলখিলিয়ে হেসে দেয়। বইয়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে কথা বলতো যেন স্যার না বুঝে যে তারা গল্প করছে। বেশি দুষ্টমি করলে কান ধরে ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে বলতো স্যার। কান ধরে তো দাড়াতোই না উল্টো ঝালমুড়ি খেতে চলে যেতো। খুব করে মনে পরছে আগের কথা গুলো। দিন গুলো কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। আর দিনগুলোর সাথে মেহরামের তনুও। মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে যে বোনটাকে দুই হাত দিয়ে অনেক শক্ত করে জড়িয়ে ধরুক কিন্তু চেয়েও পায় না। মেহরাম তার পরনের ওরনা দিকে তনুর ছবিটা মুছে আবার আগের জায়গায় রেখে দেয়। রুমের দরজায় কড়া নাড়ে। মেহরাম ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে পনে একটা বাজে। এই সময়ে কে আবার! মেহরাম গিয়ে দরজা খুলে দেয় দেখে তার মা।

মেহরাম;; আম্মু ঘুমাও নি?

কনিকা;; না আসলে ঘুম ধরছিলো না তুইও তো ঘুমাস না তাই ভাবলাম যে একটু আসি।

মেহরাম;; অনেক ভালো করেছো ভেতরে আসো।

কনিকা;; হুমম।

মেহরাম;; বাবা ঘুমিয়েছে?

কনিকা;; অনেক আগেই।

মেহরাম;; হুমম।

কনিকা ভেতরে বসে মেহরামের সাথে কথা বলতে থাকে।

কনিকা;; জানিস ভাবতেই খুশি লাগছে আমারও নাতিন হবে। ইইইইইইই কি যে খুশি লাগে। (হেসে)

মেহরাম;; আমি তো আমার নানু আপু কে কখনো দেখিই নি। নয়তো তাকে বলতাম যে তোমার মেয়ে এখনো বাচ্চামো করে। আর এতো তাড়াতাড়ি কেন বিয়ে দিয়েছো।

কনিকা;; হাহাহা, আরে তখন যুগ টাই ছিলো এমন যে মেয়েদের তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দিতো।

মেহরাম;; দেখো আমার আদর যেন আবার না কমে।

কনিকা;; এহহ তুই কে আমি চিনিই না।

মেহরাম;; এইই খবরদার আমার আদরে কাউকে ভাগ বসাতে দিবো না আমি। আল্লাহ বাচাইছে যে আমার বাপের আর কোন ছেলে মেয়ে নাই। নয়তো বিশ্বযুদ্ধ লেগেই থাকতো।

কনিকা;; তোর বাবার খুব শখ ছিলো যে একটা ছেলে হবে।

মেহরাম;; কিন্তু হয়েছি আমি।

কনিকা;; হ্যাঁ।

মেহরাম;; আচ্ছা মা একটা সত্যি কথা বলো তো।

কনিকা;; কি?

মেহরাম;; আমি হয়েছি বলে কি তোমরা খুশি ছিলে না?

কনিকা;; না।

মেহরাম;; কি!

কনিকা;; খুশি ছিলাম কিভাবে কারণ ওইদিন তো আমার খুশি হয়েছিলো।

মেহরাম;; মানে?

কনিকা;; আমার আমার সকল খুশির মূল তুই। আমার মুখে হাসি থাকার কারণ তুই। আমার খুশি হ্যাপিনেস সব তুই। আর তুই তো সেইদিন হয়েছিলি তাই না। তাই খুশি আগে ছিলাম না কিন্তু পরে হয়েছি।

মেহরাম;; এটা কোন কথা 😐।

কনিকা;; আচ্ছা যাই হোক আয়ুশের সাথে কথা হয়েছে?

মেহরাম;; দিনে হয়েছিলো রাতে হয় নি। হয়তো কাজের চাপ বেশি তাই। কিন্তু ওকে সব ক্লিয়ারলি বলে দিয়েছি।

কনিকা;; ওহহ আচ্ছা।

মেহরাম;; আচ্ছা আমার মতো জেগো না তো। আমার তো ঘুম আসে না। আর তোমার ঘুম আসবে গিয়ে শুয়ে পরো।

কনিকা;; আচ্ছা আমি যাই তাহলে আর তুই শুয়ে থাকিস। থাকতে থাকতেই ঘুম এসে পরবে।

মেহরাম;; আচ্ছা।

কনিকা মেহরামের রুম থেকে চলে যায়। মেহরাম শুয়ে থাকে। একসময় ঘুমিয়েও পরে। এভাবেই আস্তে আস্তে আকাশে ভোরের আলো ফুটে ওঠে। ফজরের আজানের শব্দে মেহরামের ঘুম ভেংে যায়। আস্তে করে বিছানা থেকে নেমে। ওয়াসরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ওযু করে আসে। তারপর বসে থেকেই নামাজ আদায় করে নেয়। ১০-১৫ মিনিট পর নামাজ শেষ হয়ে যায় মেহরামের। উঠে জায়নামাজ টা গুছিয়ে নেয়। দরজা খুলে বাইরে এসে পরে। কাউকে দেখা যাচ্ছে না, হয়তো এখনো কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি। মেহরাম তো আজান দেওয়ার সাথে সাথেই একদম উঠে পরেছে। হয়তো খানিক পরে সবাই উঠে পরবে। মেহরাম আস্তে হেটে তার দাদির রুমে যায়। তার দাদি সালেহা বেগম। বয়স্ক কিন্তু মোটা সোটা। মেহরামের সবচেয়ে বেশি ভালো লাগে তার দাদির গাল গুলো। তার দাদির আগের ছবি গুলো দেখলেই বুঝা যায় যে তার দাদি কি পরিমাণ সৌন্দর্যের অধিকারী ছিলেন। আর এর জন্যই হয়তো মেহরামের দাদা তার দাদির পেছনে লাট্টু ছিলো। মেহরাম তার দাদির রুমে গিয়ে দরজা টা হাল্কা খুলে দেয়। তার দাদির রুমের দরজা কখনোই লাগানো থাকে না। চাপানো থাকে। মেহরাম কিছুটা উকি দিয়ে দেখে তার দাদি নামাজ পড়ছে। মেহরাম এক নজর তাকে দেখেই এসে পরে। হঠাৎ মেহরামের খেয়াল হয় যে এখন তো ভোরের সময়। একদম সাজ সকাল। এখন নিশ্চই বাইরের খোলা ঠান্ডা বাতাস আছে। মেহরামের যেন আর তর সইলো না। সে নিচে নেমে পরে। মাথায় এখনো সাদা ওরনা দিয়ে ঘোমটার মতো করে পরে আছে। কি যে সুন্দর লাগছে দেখতে তাকে। মেহরাম বাড়ির বাইরে বের হয়ে পরে। বাড়ির বাইরে আসতেই নাকে বেলি ফুলের তরতাজা গন্ধ ভেবে আসে। মেহরাম তার পাশে তাকিয়ে দেখে গাছ ভর্তি বেলি ফুল ফুটে রয়েছে। কিছু ফুল গাছের নিচেও পরে রয়েছে। মেহরাম গিয়ে নিচ থেকে কিছু ফুল হাতে তুলে নেয়। তারপর তাদের গন্ধ নিতে থাকে। মন টা যেন জুরিয়ে গেলো। মন মাতানো গন্ধ এক প্রকার। ভোর সকাল, রাস্তায় হাতে গোনা দু একজন মানুষ রয়েছে। সাই সাই করে বাতাস বইছে। মেহরাম মুচকি হেসে বাইরের রাস্তায় চলে গেলো। উদ্দেশ্য খানিক রাস্তা হাটবে। হাটতে হাটতে বেশ দূরেই চলে গেলো। এক সময় যেতে যেতে মেহরামের হুট করে খেয়াল হলো বাড়ির বাইরে যেহেতু এসেছেই তাহলে তনুর পাশেও চলে যাক। যেই ভাবা সেই কাজ মেহরাম হাটতে হাটতে তনুর কবরের পাশে এসে পরে। যেই দাড়োয়ান এই কবরস্থান টা পাহাড়া দেন তাকে দেখা যাচ্ছে না। উনি মেহরাম কে বেশ ভালো করেই চিনেন। এই কবরস্থানের কবর গুলো টাইলস্ দিয়ে সুন্দর করে চারিদিকে মুড়ে দেওয়া আছে। কিন্তু যেই দরজা টা দিয়ে করবস্থানের ভেতরে প্রবেশ করা হয় তা চিকন বাশের বেড়া দিয়ে লাগানো। মেহরাম এখন কবরস্থানের বাইরের দরজা তে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ তার তনুর কবরের দিকে স্থীর। মন চাইছে ছুটে যেতে কিন্তু এখন দাড়োয়ান নেই। আর উনার অনুমতি ছাড়া কেউ ভেতরে প্রবেশ করতে পারবে না। পাশেই মসজিদ রয়েছে। মসজিদে নামাজ শেষ। মেহরাম ঘুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর তার পেছন দিয়ে কয়েকজন হুজুর যাচ্ছে। হঠাৎ একজন মেহরামের নাম ধরে ডাক দেয়।

আব্দুল সাহেব;; কে ওখানে মেহরাম মা না?

মেহরাম পেছন ঘুড়ে তাকায়।

মেহরাম;; আরে আব্দুল চাচা আপনি। কেমন আছেন?

আব্দুল সাহেব;; হ্যাঁ আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছি মা। তুমি কেমন আছো?

মেহরাম;; জ্বি চাচা আলহামদুলিল্লাহ।

আব্দুল সাহেব একজন ইমাম। মেহরাম আর তার পরিবারের সাথে উনার খুন ভালো সম্পর্ক। আব্দুল সাহেব এক নজর তনুর কবরের দিকে তাকিয়ে আবার বলে ওঠেন..

আব্দুল সাহেব;; বোনের কথা মনে পড়ছিলো বুঝি??

মেহরাম;; হ্যাঁ। কবে থেকে যে দেখি না। আর দেখতেও পারবো না জানি। কিন্তু না এসে তো আর থাকা যায় না।

আব্দুল সাহেব;; নামাজ পরে দোয়া করো।

মেহরাম;; জ্বি।

আব্দুল সাহেব;; বাসায় সবাই কেমন আছে?

মেহরাম;; হ্যাঁ চাচা সবাই ভালোয় আছে।

আব্দুল সাহেব;; শোন মা নিজের প্রতি খেয়াল রাখবে। দেখে শুনে চলাচল করবে। আর এখন তো সকালই হয়ে গেলো মানুষের আনাগোন বেড়ে যাবে। বাড়িতে চলে যাও।

মেহরাম;; জ্বি চাচা ভালো থাকবেন, আজ আসি। আসসালামু আলাইকুম।

আব্দুল সাহেব;; ওয়ালাইকুম সালাম মা।

মেহরাম একবার পেছনে ফিরে তনুর দিকে তাকিয়ে এসে পরে। আস্তে আস্তে হেটে বাড়িতে চলে যায়। বাড়িতে গিয়েই দেখে সবাই উঠে পরেছে। আর মেহরামকে দেখেই অবাক। সবাই ভেবেছিলো যে মেহরাম তার রুমে।

আতিয়া;; কি রে কোথায় গিয়েছিলি তুই?

মেহরাম;; না মানে বাইরে এইতো এখানেই একটু হাটতে গিয়েছিলাম আর কি।

আতিয়া;; একা কেন গেলি। কাউকে নিজে যেতি আমাকেই ডাক দিতি। একা বাইরে বের হলি তাও এতো সকালে।

মেহরাম;; আরে চাচি কিছুই হবে না। আর আমি ভেবেছি তোমরা সবাই ঘুম তাই।

আতিয়া;; আচ্ছা খেতে আয়।

মেহরাম;; আচ্ছা আমি রান্না তে হেল্প করছি আসো। বসেই আর কতো থাকবো।

সবাই উঠে পরেছে। মেহরাম তার চাচিকে টুকিটাকি সাহায্য করছে কাজে। এভাবে সকালের সময় টুকু কেটে যায়। দুপুরের পরে মেহরামকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়া হয় চেকাপের জন্য। ডাক্তার চেকাপ করে দেখে সবকিছুই ঠিক। প্রেগন্যান্সিতে কোন কমপ্লিকেশনস্ নেই। চেকাপ করিয়ে সেইদিন বাসায় এসে পরে। মাঝখানে আরো কয়েকদিন কেটে যায়। এখন মেহরামের দশ মাস হয়ে একদিন চলছে। ডাক্তার ডেলিভারির ডেটও বলে দিয়েছে। সবকিছুই ভালোই যাচ্ছে।





💖চলবে~~

তৈমাত্রিক পর্ব-৩০+৩১+৩২

0

#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ৩০



মেহরাম চুপ করে বসে আছে সে বুঝতে পারছে না যে সবাই এভাবেই বসেই বা আছে কেন আর কিই বা বলবে। অবশেষে নীরবতা ভেংে মেহরামের চাচি আতিয়া বলা শুরু করে দিলো….

আতিয়া;; দেখ মা আসলে ব্যাপার টা হচ্ছে যে কেউ তার জীবনে একা চলতে পারে না। সবার জীবনেই কাউকে না কাউকে লাগে। আমরা সবাই জানতাম যে তুই পড়াশোনা করে একটা ভালো চাকরি করতে চাস, নিজের পায়ে দাড়াতে চাস। কিন্তু তা আর হয়ে উঠেনি। আসলে আমরাই তোকে বিয়ের জন্য এক প্রকার চাপ দিয়েছিলাম। আর পরিবারও ভালো ছিলো।

মেহরাম;; তোমরা সবাই বলতে কি চাও বলতো ক্লিয়ারলি। আমি কিছু বুঝছি না। এতোদিনে সেই আগের কথা গুলো কেন বলছো?

কনিকা;; তোর শাশুড়ি ফোন করেছিলেন।

মেহরাম;; হ্যাঁ তো?

আতিয়া;; সোহেল আর নেই তো এখন তোর শাশুড়ী একমাত্র আপন বলতে তার সেই বড়ো ভাই-ই আছে। এখন কুসুম আপা চাইছেন যে উনি বর্তমানে যেই বাড়িতে রয়েছেন সেই বাড়ি টা বিক্রি করে দিতে।

মেহরাম;; হুম এছাড়াও বাড়ি টা আমার শশুড়ের ছিলো না, তারা কিনেছিলেন। তো এখন ওই বাড়ি বিক্রি করে দিলেও তেমন কিছু যায় আসে না।

কনিকা;; কিন্তু বড়ো কথা হচ্ছে তোকে নিয়ে।

মেহরাম;; আমাকে নিয়ে মানে?

কনিকা;; মানে কুসুম আপা একজন বয়স্ক মানুষ তিনি এখন তার ভাইয়ের সাথেই থাকবেন। সত্যি বলতে এখন তোর হাসবেন্ড আর বেচে নেই আর এটা মেনে নিতেই হবে তো….

মেহরাম;; ওহহ আচ্ছা আচ্ছা, তো এই কথা হয়েছে। থাক আমাকে আর কিছু বলতে হবে না আমি বুঝে গেছি। মানে মা যদি উনার ভাইয়ের বাসায় চলে যান আজীবনের জন্য তাহলে আমি কোথায় থাকবো তাই না। মানে আমি তো আর আমার শাশুড়ীর ভাইয়ের বাড়ি গিয়ে একদম পারমানেন্ট ভাবে থাকতে পারি না তাই তো।

আতিয়া;; হ্যাঁ সেটাই।

মেহরাম;; বাবার বাড়ি কি জায়গা হবে আমার?

আতিয়া;; ছি মেহরাম এগুলো কি ধরনের কথা তোর। বাড়ির মেয়ে বাড়িতে থাকবে না তো আর কোথায় থাকবে। তুই এখানে না থাকলে তোর পা ভেংে দেবো। আর এর জন্যই তোকে ডাকছিলাম যে তুই আসলে কোথায় থাকতে চাস এখানে না ওখানে?

মেহরাম;; তুমি কি বলছো বুঝে বলছো চাচি?

কনিকা;; দেখলি আতিয়া আমি আগেই বলেছিলাম যে মেহরাম জীবনেও তার মামা শশুড়ের বাড়ি গিয়ে উঠবে না।

মেহরাম;; আসলে আমি না খেয়াল করেছি যে তনু যখন আমাদের সাথে ছিলো তখন থেকে শুরু করে আজ এখন পর্যন্ত মা আমার তেমন কোন খোঁজ-খবর ই নেন নি। শুধু তনুর ওইদিন এসেছিলেন একটু। আমার জন্য না হোক আমার বাচ্চা টার জন্যও আসেন নি। জানো আম্মু মা না আগে এমন ছিলো না বুঝলে। আমি ভাবতাম আমার মতো লাকি আর কোন মেয়েই হয় না কারণ এত্তো ভালো একজন শাশুড়ি কে পেয়েছি দেখে তাই। কিন্তু সোহেলের যাবার পর থেকে তিনি কেমন যেন একটু পালটে গেলেন। ইভেন আমি ফোন দিলেও ধরেন না।

আতিয়া;; আজ সকালে ফোন করেছিলেন।

মেহরাম;; সত্যি আমাকে আগে কেন বলো নি কেউ।

আতিয়া;; কি বলতাম, উনি শুধু ফোন করে বললেন যে মেহরাম কি এখন আমাদের সাথে থাকবে না আপনাদের সাথে।

মেহরাম;; তুমি কি বললে?

আতিয়া;; কিছুই বলি নি। তার জন্যই তো আগে তোর কাছ থেকে শুনে নিলাম যে তোর ইচ্ছে কি।

মেহরাম;; মা কে বলে দিও যে মা যাতে ভয় না পায় এই অপয়া মেহরাম কে নিয়ে। সে কখনোই তাদের কাছে যাবে না। ওদের ওপর বোঝা হতে যাবে না। জামাই বেচে নেই তাই এখনো তাদের ঘাড়ে ঝুলে থাকবো তেমন মেয়ে আমি নই। না আমি এটা বলছি না যে সব শাশুড়ীই খারাপ কিন্তু মা আগে থেকে অনেক পালটে গেছেন। আগের মতো নেই আর। আর হ্যাঁ অবশ্যই আমাকে ক্ষনিকের জন্য হলেও তাদের উটকো ঝামেলা মনে হয়েছে নয়তো আজ ফোন দিয়েই বাকি সব কথা ছেড়ে সোজা এই কথা বলতো না। যাই হোক মানুষ পরিবর্তনশীল।

এই বলেই মেহরাম উঠে পরে। উঠে চলে যেতে নেয়, তবে মেহরাম আবার পেছনে তাকায়। তাকিয়ে দেখে সবাই মনমরা হয়ে বসে আছে। মেহরাম তখন সবার মুড ঠিক করার জন্য হুট করে বলে ওঠে…

মেহরাম;; আমার হাতের চা কে কে খাবে?

সবাই ফট করে মাথা তুলে মেহরামের দিকে তাকায়। মেহরাম তার ভ্রু জোড়া নাড়া দিয়ে ইশারাতে আবার জিজ্ঞেস করে। তৎক্ষনাৎ সবাই বলে ওঠে আমি। মেহরাম আস্তে আস্তে হেটে সবার জন্য চা বানাতে চলে যায়। এদিকে মেহরামের চাচি আতিয়া মেহরামের মা কনিকার দিকে তাকিয়ে দেখে মুখ টা কেমন ছোট করে রেখেছে। আতিয়া কনিকার হাতে হাত রেখে দেয়….

আতিয়া;; ভাবী মন খারাপ করো না তো।

কনিকা;; শুনেছি আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। কিন্তু এমন ভালো যেন আল্লাহ আর কারো সাথেই না করেন।

আতিয়া;; মেহরামের মতো মেয়ে পেয়েছো শুকুর করো। নয়তো অন্য সমস্ত মেয়ে হলে এতোক্ষণে তুলকালাম কান্ড বাধিয়ে দিতো।

কনিকা;; তার আর দরকার নেই। এমনিতেই জীবনে কম ঝামেলা নেই তার ওপর আবার এই নতুন কাহিনি। আমি আমার মেয়ে কে তেমন শিক্ষা দেয় নি। যে একজন বড়ো মানুষ যতোই অন্যায় করুক, যতোই আঘাত করুক তুই তাদের মুখের ওপর কোন কথা বলবি না। সহ্য হবে না ব্যাস সেই জায়গা ত্যাগ কর কিন্তু বেয়াদবের উপাধি নিয়ে ঘরে আসবি না। আমার মেয়ে আমার শিক্ষার দাম দিয়েছে। নয়তো কীভাবে কুসুম আপা আজ সকালে ফোন দিয়ে এটা বললেন যে
“”” মেহরাম এখন কি আপনাদের সাথেই থাকবে না আমাদের সাথে। আপনাদের সাথে থাকলেই আমাদের সকলের জন্যই সুবিধে হয়””। লাগবে না কাউকে আমার মেয়ে এখানেই থাকবে আজীবন। এটা ওর বাড়ি (কিছুটা রেগে)

আতিয়া;; তোমার মেয়ে না আমাদের মেয়ে বলো।

আতিয়ার কথা শুনে কনিকা একটু হেসে দিলন। তখনই আশরাফ আলম অর্থাৎ মেহরামের বাবা এসে সবার সাথে বসলেন। মেহরামের শাশুড়ি যে এই কথা গুলো বলেছেন তা তিনি জানেন। চোখ ঘুড়িয়ে মেয়ের দিকে তাকিয়ে দেখেন মেহরাম রান্নাঘরে চা বানাচ্ছে। অন্য দিকে তার নজর নেই। ইচ্ছে করেই গুটি গুটি পায়ে কাজ করছে। আশরাফ আলম তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। তারপর আবার সবার সাথে কথা বলা শুরু করেন। তাদের কথা বলার মাঝেই মেহরাম চা নিয়ে এলো ট্রে তে করে।

মেহরাম;; এই নাও তোমাদের চা (টেবিলের ওপর ট্রে টা রেখে)

আতিয়া;; আরে এটা একা আনতে গিয়েছিস কেন। আমাকে ডাক দিতি।

মেহরাম;; আরে হলো একই কথা। দাড়াও আমি দিচ্ছি।

মেহরাম একে একে সবাইকে চা দিচ্ছে।

মেহরাম;; মা চা নাও, চাচি তুমিও নাও। এই আকাশ চা খাবি?

আকাশ;; আমি চামচ দিয়ে চা খাবো।

মেহরাম;; আঙুল দিয়ে খা 😅। এদিকে আয় চায়ের কাপ নিয়ে যা।

আকাশ;; আসতাছি।

মেহরাম;; চাচ্চু তোমার চা।

বিল্লাল;; চিন…

মেহরাম;; নেই, চিনি নেই। আমি জানি।

বিল্লাল;; হুমমম।

এবার মেহরাম তার বাবার কাছে গেলো। কোন রকম কথা বললো না। শুধু চা টা তার বাবার সামনে ধরলো তার বাবাও চা টা হাতে তুলে নেন। মেহরাম ঘুড়ে গিয়ে চায়ের ট্রে টা রাখবে তখন তার বাবা বলে ওঠে…….

আশরাফ আলম;; মেহরাম

মেহরাম;; জ্বি

আশরাফ আলম;; একটু বাবার কাছে বোস মা।

মেহরাম;; হুম।

মেহরাম হাত থেকে ট্রে টা রেখে তার বাবার পাশে বসে। আসলে পাশে না বেশ কয়েক হাত দূরেই বসে। আর এটা বাকি সবাই খেয়াল করে…

আশরাফ আলম;; মেহরু মা আসলে আমার বলার কিছুই নেই। আমি জানি যে ছোট থেকেই আমি তোকে কোন সময় দিতে পারিনি। তোর স্কুলেও যাই নি কখনো। এমনকি তোর জন্মদিন টাও আমার মনে নেই, থাকে না। হ্যাঁ বলতে পারিস যে বাবা হিসেবে আমি তোর কোন খেয়ালই রাখতে পারিনি। কিন্তু মা একটা কথা তোর এই বাবা তোকে অনেক বেশি ভালোবাসে।

এতোক্ষণ মেহরাম তার মাথা নিচু করে রেখেছিলো কিন্তু তার বাবার কথা শুনে মাথা তুলে তাকায়।

আশরাফ আলম;; সব বাবাই তাদের সন্তান দের অনেক ভালোবাসে৷ হয়তো কেউ কম প্রকাশ করে আবার কেউ বেশি প্রকাশ করে। আমি না হয় কমের ভাগেই পরলাম কিন্তু ভালোবাসি। আরে মেয়ে শোন শোন আমি তোর মাকে পছন্দ করে বিয়ে করেছিলাম কিন্তু তোর জন্য এই যে এখানে (বুকের দিকে দেখিয়ে) যে ভালোবাসা আছে না তা হয়তো তোর মায়ের জন্যও নেই বুঝলি। (চোখের কোণে পানি চিকচিক করছে)

মেহরাম মাথা তুলে তার বাবার দিকে তাকায়। ফিক করে হেসে দেয়। আজ এই প্রথম তার মনে হচ্ছে যে সে তার বাবার আদর ভালোবাসা পেয়েছে।

আশরাফ আলম;; আমার মেয়ে টা যে কখন আর কবে এতো বড়ো হয়ে গেলো তা বুঝতেই পারিনি।

মেহরাম;; তুমি হেরে গেছো (তার মায়ের দিকে তাকিয়ে)

কনিকা;; কীভাবে?

মেহরাম;; বাবা তোমার থেকে আমাকে বেশি ভালোবাসে।

মেহরামের মা হেসে দেন। এভাবেই সময় যেতে থাকে। আস্তে আস্তে রাত হয়ে যায়। সবাই এখনো নিচে বসে বসে আড্ডা দিচ্ছে। তবে মেহরামের একটু রেস্টের প্রয়োজন ছিলো তাই সে তার রুমে এসে পরেছে। মেহরাম রুমের আলো নিভিয়ে বারান্দায় বসে আছে। বাইরে থেকে জোছনা রাতের আলো ভেতরে এসে পরেছে। তার মধ্যে বাইরে থেকে খানিক ল্যাম্প পোস্টের আলোও এসে পরেছে ভেতরে। রকিং চেয়ারে বসে বসে হাতে একটা হুমায়ুন আহমেদের বই নিয়ে পড়ছে। সাধারণত মেহরামের কাছে এমন পরিবেশ খুব বেশি পছন্দের। হঠাৎ হাত থেকে বই টা রেখে বাইরের দিকে তাকায় মেহরাম। মূলত তনুকে মিস করছে সে, অনেক বেশি। চোখ নামিয়ে অন্যদিকে তাকাতেই চোখ পরে তনু আর তার একসাথে সেই ছবিটার দিকে৷ মনে হচ্ছে সেইদিন সেই ছবি তোলার ব্যাপার টা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। ছবি টা হুট করেই তোলা। মানে মেহরাম আর তনু কি যেন একটা নিয়ে হাসছিলো আর ঠিক তখনই মেহরামের চাচ্চু এসে ছবি টা ক্লিক করে। তখন কেউই জানতো না যে এই হঠাৎ তোলা ছবিটা এত্তো বেশি পছন্দের আর মেমোরেব্যাল হয়ে ওঠবে। ছবিটা হাতে নিয়ে মেহরাম দেখতে থাকে। কেন জানি মেহরামের মনে হয় যে যখনই সে তনুকে অনেক বেশি মিস করে বা ওর কথা মনে পরে তখন এমন লাগে যে তনু এখানেই আছে তার আশে পাশে। সে তনুকে অনুভব করতে পারে এমন কিছু একটা। পরিবারের সবার মাঝেই কষ্ট তো আছে কিন্তু তবুও সবাই যথাসম্ভব হাসি খুশি থাকার চেষ্টা করে। নয়তো এভাবে তিলে তিলে যন্ত্রণা আর কতো। মেহরাম তাদের ছবিটা হাতে নিয়ে দেখছিলো তখনই দরজাতে আকাশ আসে।

আকাশ;; মেহরাপু মেহরাপু

মেহরাম;; হ্যাঁ রে আয়,, ওহ দাড়া আগেই আসিস না রুমের বাতি টা জ্বালিয়ে দেই। নয়তো অন্ধকারে আবার হোচট খেয়ে পরে যাবি।

মেহরাম উঠে গিয়ে রুমের বাতি টা জ্বালিয়ে দেয়। এবার আকাশের দিকে তাকিয়ে মেহরাম অবাক হয়। কেননা আকাশের হতে ইয়ায়ায়া বড়ো একটা পারপাল কালারের বক্স। বক্সে আকাশের মুখ টাই ঢেকে গিয়েছে।

মেহরাম;; কিরে এটা কি আর কে দিয়েছে?

আকাশ;; ভাইয়া দিয়েছে।

মেহরাম;; কোন ভাই?

আয়ুশ;; আমি (আকাশের পেছনে দাঁড়িয়ে)

মেহরাম;; ওহহ আব.. আসলে মানে তুমি কখন এলে?

আয়ুশ;; একটু আগেই।

মেহরাম;; এটা কি?

আয়ুশ;; ওইতো.. আসলে তুমি এইটা খুলেই দেইখো যে কি আছে।

মেহরাম;; হুম তবে আকাশ…!

আকাশ;; ভাইয়া আমাকে তোমার থেকেও বড়ো একটা বক্স দিয়েছে।

মেহরাম; হাহা তাই, আচ্ছা ভালো।

আকাশ;; ধরো।

আকাশ মেহরামের হাতে বক্স টা ধরিয়ে দিয়ে দৌড়ে নিচে চলে গেলো। মেহরাম আকাশের দিকে তাকিয়ে আবার আয়ুশের দিকে তাকায়।

আয়ুশ;; তো..!

মেহরাম;; কি?

আয়ুশ;; নিচে যাবে না?

মেহরাম;; হ্যাঁ যবো, তুমি যাও আমি আসছি।

আয়ুশ;; ওকে।

আয়ুশ নিচে চলে যায়। আয়ুশ যাচ্ছে আর মেহরাম তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। যাওয়ার মাঝেই আয়ুশ আবার ঘুড়ে মেহরামের দিকে তাকায়। এভাবে দুইজনের চোখাচোখি হয়ে গেলে মেহরাম কিছুটা ইতস্তত বোধ করে পিছিয়ে দরজা টা লাগিয়ে দিয়ে রুমের ভেতরে চলে যায়। আয়ুশ কোন রিয়েকশন না করেই সোজা চলে আসে। আয়ুশ একা না সাথে তার মা আর কণাও এসেছে। আয়ুশ তার পকেটে হাত দিয়ে রেখেছিলো তখনই তার হাতে কিসের যেন একটু খোচা লাগে। মনে হচ্ছে কাগজ জাতীয় কিছু একটা। আয়ুশ কিছুটা কপাল কুচকে পকেটের ভেতর থেকে তা বাইরে আনে। এনে দেখে টা একটা কাগজ, মেলে দিয়ে দেখে যে এটা তনুর হাতে লিখা সেই ল্যাটার টা। এটা সেইদিন আয়ুশ তুলে তার কাছেই রেখেছিলো। ঠিক সেইদিন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত এটা তার কাছেই আছে। আয়ুশ কাগজ টার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে আবার সুন্দর করে আগের মতোই রেখে দেয়। তখন মেহরাম আসে, এসেই সবার সাথে বসে পরে। টুকটাক কথা হচ্ছে। কণা তো মেহরামের পাশ ছেড়ে উঠছেই না। মেহরামের মা আর চাচি আয়ুশের মায়ের সাথে মেহরামের শাশুড়ীর ব্যাপার টা শেয়ার করে। আরো নানা কথা হয়, ইতোমধ্যে তাদের মাঝে বেশ কয়েকবার তনুর কথাও উঠেছে। এভাবেই যাচ্ছে সময়, খানিক পর আয়ুশের মা আবার মেহরামের মা আর চাচির সাথে কথা বলতে শুরু করে।





💖চলবে~~

#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ৩১

🧡🍂
..
..
..
..
..

কণা মেহরামকে ধরে বসলো যে ছাদে যাবে। আসলে মেহরামদের বাড়ির ছাদ টা বেশ বড়োসড়ো আর অনেক খোলামেলাও। জোৎস্না রাতের আলো আর শীতল বাতাস দুটোই খুব ভালো আসে ছাদের ওপর। আর তার জন্য মেহরামের কাছে বাড়ির সবথেকে পছন্দের জায়গা টা হচ্ছে ছাদ। কণা জেদ ধরে বসে মেহরামকে সাথে নিয়ে ছাদে যাবে।

কণা;; মেহরাপু ওও মেহরাপু চলো না ছাদে যাই।

লায়লা খাতুন;; এই না, কণা তুই ছোট বাচ্চা নাকি রে দেখছিস না। মেহরাম এই অবস্থায় ছাদে কিভাবে উঠবে।

মেহরাম;; আরে না খালামনি সমস্যা নেই। আমি ছাদে উঠতে পারি। আর প্রায়ই যাই।

লায়লা খাতুন;; কিন্তু এই সময়ে আর রাত হয়ে গেছে তো!

মেহরাম;; সমস্যা নেই খালামনি, যেতে পারবো। কণা চলো।

কণা;; আচ্ছা।

লায়লা;; এই সাবধানে সবাই।

ছাদের চাবি নিয়ে সিড়ি বেয়ে কণা আর মেহরাম ছাদে চলে গেলো। কিন্তু এখানে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মেহরাম বুঝতে পারলো যে কণা হয়তো কিছুটা ভয় পাচ্ছে। তা দেখে মেহরাম ফিক করে হেসে দিলো।

মেহরাম;; আরে ভয় পেয়ো না কিছুই হবে না। (হেসে)

কণা;; আপু এখানে অনেক অন্ধকার তো।

মেহরাম;; আরে অন্ধকার দেখে এতো ভয় পেতে নেই। দেখবে যখন তোমার জীবনে কেউ থাকবে না তখন শুধু তোমার জন্য তুমি নিজে থাকবে আর থাকবে এই অন্ধকার। তখন এই অন্ধকার কেই এতো ভালো লাগবে যে তুমি অন্য কিছুর কথা ভুলেই যাব। (আলো জ্বালিয়ে দিতে দিতে)

কণা;; হুমম বুঝলাম।

মেহরাম;; হুমম।

কণা;; আচ্ছা আপু পাশের বাড়িতে এতো তোড়জোড় কিসের?

মেহরাম;; বিয়ের, আসলে পাশের বাড়ির এক মেয়ের বিয়ে তো তাই আর কি।

কণা;; হুমম অনেক সুন্দর করে ডেকোরেট করেছে।

মেহরাম;; হুম। কণা একটা কাজ করলে কেমন হয়..!

কণা;; কি কাজ?

মেহরাম;; পাশেই কিছু শুকনো কাঠ আছে। একটা পটের ভেতরে কাঠ গুলো নিয়ে আগুন ধরাই এতে আলোও হবে আর দেখবে সুন্দরও লাগবে।

কণা;; বাহহ ভালো তো। আচ্ছা চলো।

কণা গিয়ে সেই শুকনো কাঠ গুলো এনে দিলো। মেহরাম সেগুলো একত্রে করে একটা পটে নিয়ে নিলো। তারপর আগুন ধরিয়ে দিলো। আগুনের পট টা মাঝখানে রেখে তার পাশে গোল হয়ে কণা আর মেহরাম বসে থাকলো। রাতের এমন মনোমুগ্ধকর পরিবেশ তার ওপর আলতো আচে আগুন জ্বলছে। এটা যেন ভালো লাগার আরেকটা উৎস। কণা আর মেহরাম বসে বসে কথা বলছিলো আর হাসছিলো তখনই আকাশ আয়ুশের হাত ধরে টেনে টেনে ছাদে নিয়ে আসে।

আকাশ;; আরে আসো আসো। সবাই এখানে তুমি আর আমি ওখানে কি করবো বলো। আরে আসো (হাত ধরে টেনে)

আয়ুশ;; আচ্ছা আমি না হয় না যাই। তুমি যাও,

আকাশ;; না আসো তুমি, ভাইয়া আসো।

আয়ুশ;; আহা কিন্তু আমি, আরে..

কণা;; আরে ভাই আয় না, এতো করে বলছে। এসে পর।

অবশেষে আর না পেয়ে আয়ুশ ছাদে এসে পরলো। এসেই দেখে মেহরাম বসে আছে তাদের সামনেই হালকা আগুন লাগানো দেখে অবাক হয়।

আয়ুশ;; এই তোরা আগুন কোথায় পেলি?

কণা;; আরে সাইডেই কিছু শুকনো কাঠ ছিলো সেগুলো নিয়ে আগুন লাগিয়ে দিয়েছি। অবশ্য বুদ্ধি টা মেহরাপুর ই ছিলো। সুন্দর লাগছে না!

আয়ুশ;; হ্যাঁ অনেক সুন্দর।

কণা;; আরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন বসে পর।

আয়ুশ আর আকাশ এক পাশে বসে পরে আর কণা আর মেহরাম আরেক পাশে। কণা, মেহরাম আর আয়ুশ নানা ব্যাপার নিয়ে কথা বলছে। আর আকাশ সারা ছাদে টই টই করে ঘুড়ছে। হঠাৎ আকাশ ছাদের কিণারে গিয়ে দাঁড়িয়ে হাল্কা উকি ঝুকি দিয়ে পাশের বাড়ির দিকে দেখতে লাগলো। দেখলো প্রায় অনেক মানুষ। সবাই অনেক সেজেছে আর বাড়িও অনেক সাজানো। আকাশ আবার দৌড়ে গিয়ে মেহরামের পাশে বসে পরে।

আকাশ;; মেহরাপু..!

মেহরাম;; হুমম

আকাশ;; আচ্ছা বিয়ে কি?

মেহরাম;; কি?

আকাশ;; না মানে শুধু তো দেখেই আসলাম যে বিয়ে করে সবাই আসে বাড়িতে এত্তো করে সাজগোছ করে। তারপর আবার কান্না করতে করতে মেয়ে চলে যায়। এগুলোর মানে কি, বিয়ে কি?

আকাশের এমন উদ্ভট প্রশ্নে কণা হিহি করে হেসে দিলো। আয়ুশ চুপ করে মুখে দুই আঙুল ঠেকিয়ে তাকিয়ে আছে। কিন্তু মেহরাম তো পরে গেলো এক মুশকিলে এখন একে কি করে বুঝাই যে বিয়ে কি। এর জন্যই বাচ্চাদের আশে পাশে এমন কিছু দেখাতে নেই কারণ কখন কি প্রশ্ন ছুড়ে মারে বলা বড়ো দায়।

আয়ুশ;; বলোনা বিয়ে কি?

মেহরাম;; আ আব..বিয়ে মানে হচ্ছে। মানে হচ্ছে, আসলে বিয়ে মানে হচ্ছে এক সুতোয় দুইজন মানুষ কে আজীবনের জন্য বেধে দেওয়া। আমরা তো দেখি যে বিয়ে একটা ছেলে আর মেয়ের মধ্যে হয় তাই না কিন্তু না আসলে বিয়ে হয় দুটো পরিবারের মধ্যে। বিয়ে খুব পবিত্র একটা বন্ধন। মানুষের জীবনকে নতুন রুপে শুরু করা হচ্ছে বিয়ে। তাই তো বলা হয় যে “জন্ম, মৃত্যু আর বিয়ে এই তিনটে জিনিস হচ্ছে আল্লাহ’র হাতে”।

আকাশ;; তাহলে এতো কান্না করে নে সবাই। চোখে কি পানি দিয়ে কাদে নাকি। কই আমার তো কান্না বের হয় না। নাকি চোখে আঙুল দিয়ে গুতো মেরে কাদে সবাই।

এবার আয়ুশ হেসে দেয়। কিছুটা জোরেই হেসে দেয়। সাথে কণাও। আর মেহরাম হাবলাকান্তের মতো করে তাকিয়ে থাকে।

মেহরাম;; আরে ভাই আমার তোর মাথায় এইসব যাবে না। এই ছোট্ট মাথায় এতো কিছু ঢুকবে না। বড়ো হলে আপনা আপনিই সব বুঝে যাবি। এখন শুধু তুই এটা জেনে রাখ যে একটা সময়ের পর সবাই কেই বিয়ে করতে হয় বুঝলি।

আকাশ;; হুমম।

এভাবেই গল্প করতে করতে কখন যে বেশ কয়েক ঘন্টা পেরিয়ে গেছে তার ওপর কারো খেয়ালই নেই। এদিকে মেহরামের মা চাচি দাদি আর আয়ুশের মা মিলে বসে বসে কথা বলছেন। কথার মাঝেই হঠাৎ আয়ুশের মা কথা বলেন আরেক নতুন প্রসঙ্গ নিয়ে।

লায়লা;; আব..আপা আসলে আপনাদের সাথে আমার বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা ছিলো। আমি আসলে জানি না যে কথা টাকে আপনারা ঠিক কিভাবে নিবেন বা ভাববেন। তবে আমার যতটুকু বলার আমি বলবো। বাকি টুকু আপনাদের ওপর নির্ভর করে।

আতিয়া;; আরে না আপা আপনি যাই বলেন না কেন নির্দ্ধিধায় বলতে পারেন।

লায়লা;; আসলে আমরা সবাই ব্যাপার টা জানি।

কনিকার কেমন যেন একটু সন্দেহ হয় তাই তিনি বলে ওঠেন।

কনিকা;; কথা টা কি মেহরাম আর আয়ুশকে নিয়ে?

লায়লা;; জ্বি।

আতিয়া;; আপা সব খুলে বলুন তো।

লায়লা;; দেখুন আমরা সবাই জানি যে আয়ুশ আর মেহরামের মাঝে আসলে কি ছিলো। তবে তখনকার পরিস্থিতি আর এখনকার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। আমি চাইছি যে দুটো পরিবার যেন আবারও এক হয়। আবারও খুশি থাকে।

আতিয়া;; আপা আপনি কি চাইছেন হয়তো তা আমি বুঝতে পেরেছি। আয়ুশ আর মেহরামের

লায়লা;; বিয়ে।

কনিকা শুধু এমন কথায় অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। আতিয়া এগুলো শুনে মুচকি হাসে। কিন্তু লায়লা খাতুন তো বেশ ভয় নিয়ে তাকিয়ে আছে যে কি না কি বলে।
কিন্তু কিছুটা শব্দ করে হেসে আতিয়া বলে ওঠে।

আতিয়া;; বিয়ের দুই বছরের মাথায় যখন ডাক্তারের কাছে যাই ডাক্তার তখন আমার চেকাপ করে সুস্পষ্টভাবে বলে দেন যে আমি কখনো মা হবো না। সেই ক্ষমতা নেই আমার মাঝে। তারপর তনুর বাবার সাথে মুখ টা কালো করে বাসায় আসি। সবাই অনেক বুঝায় আমাকে কিন্তু আমার অবুঝ মন তো আর মানে না। বুঝতাম আমি যে মা হওয়ার বেদনা ঠিক কতটুকু আর কেমন। ঠিক তার ২-৩ মাস পর জানতে পারি যে ভাবী প্রেগন্যান্ট। বিশ্বাস করেন আপা আমি মিথ্যা বলবো না। ভাবী যখন প্রেগন্যান্ট হয় তখন সেই খবর শুনে আমি কি যে খুশি হয়েছিলাম। আমি যে মা হবো না তার বেদনা টা প্রায় ভুলতেই বসেছিলাম এক প্রকার। ভেবেছিলাম আমি নিজেই মা হবো। আমার বাচ্চা। আমি না তবে মাঝেমাঝে ভাবী এই ভেবে মন খারাপ করতো যে আমি সব কিছু ভুলে ভাবীর বাচ্চাকেই নিজের বাচ্চা ভাবি। আর গুণে গুণে ঠিক তার এক মস সতেরো দিন পর আমার শরীর কেমন খারাপ লাগে। ডাক্তারের কাছে গিয়ে শুনি আমি প্রেগন্যান্ট। আমার জীবনের সব থেকে বড়ো পাওয়া ছিলো। আমার তিন ছেলে মেয়ে। মেহরাম, তনু, আকাশ। আমি জানি মেহরাম তনুর জন্য যা করেছে তা তনুর জন্য ভালো থাকলেও নিজের সাথে বড্ড অন্যায় করেছে মেহরাম। আগে যদি আমরা মানে পরিবারে লোকেরা এই ব্যাপার টা জানতাম তাহলে মেহরামকে এমন কোন পদক্ষেপ নিতেই দিতাম না। যাই হোক যা হয়েছে তা হয়েছে। এবার মূল কথা হচ্ছে কবে থেকে শুরু করছি আমরা।

কনিকা;; মানে কি বলছিস তুই?

আতিয়া;; আরে ভাবী মানে এই যে বিয়ের আয়োজন কবে থেকে শুরু করবো?

কনিকা;; কিইইইহ সত্যি?!

আতিয়া;; হ্যাঁ অবশ্যই সত্যি।

লায়লা;; এতো জলদি আপনারা মেনে যাবেন আমি সত্যিই ভাবি নি।

কনিকা;; কিন্তু এখন তো আরেকটা প্রব্লেম হয়ে গেলো।

আতিয়া;; আবার কি?

কনিকা;; মেহরাম, মেহরাম যদি রাজি না হয় তাহলে কি হবে?

আতিয়া;; কেন রাজি হবে না।

কনিকা;; আতিয়া তুই জানিস যে তনু আয়ুশের সাথে ছিলো এখন মেহরাম কি করে..!

আতিয়া;; ভাবী হয়তো ভুলে যাচ্ছো যে মেহরাম আয়ুশকে ভালোবাসে।

কনিকা;; কিন্তু বিয়ে অব্দি। আমার না কেন জানি মনে হচ্ছে যে মেহরাম হ্যাঁ বলবে না।

আতিয়া;; আচ্ছা ওটা দেখা যাবে। আগে আয়ুশের সাথে কথা বলতে হবে।

লায়লা;; আয়ুশের সাথে আমি কথা বলে নিবো।

আতিয়া;; সব যেন ভালোয় ভালোয় কেটে যায়।



মেহরাম;; আচ্ছা এখন হয়েছে অনেক সময় হয়েছে। এবার ঘরে চলো সবাই।

কণা;; হ্যাঁ অনেক তো সময় হলো।

আয়ুশ;; তোমরা যাও আমি আগুন নিভিয়ে তারপর আসি।

মেহরাম;; আগুনও শেষ হয়ে এসেছে। বেশি কিছু করতে হবে না। শুধু যেই কাঠ গুলো পুড়ে নি সেগুলো কিছু একটা দিয়ে ফেলে দাও আর ওপরে ছাই ফেলে দাও তাহলেই সবটুকু নিভে আসবে।

আয়ুশ;; হুমম।

মেহরাম, কণা আর আকাশ চলে গেলো নিচে। তাদের নিচে আসতেই মেহরামের মা মেহরামকে নিজের কাছে ডাকে। মেহরাম সেখানে গিয়ে বসে পরে।

মেহরাম;; কি হয়েছে মা?

কনিকা;; কিছু না।

আতিয়া;; আয়ুশ কোথায় রে?

মেহরাম;; হ্যাঁ আসছে।

কনিকা;; আপা আজ থেকে কাল চলে যায়েন।

লায়লা;; না আপা আজ যাই, আপনারা এইদিক টা সামলান আর আমি ওইদিক টা। আর এছাড়াও কণার কাল সকালেই কলেজ আছে তো যেতে হবে।

মেহরাম;; কি সামলাবে খালামনি বুঝলাম না।

আতিয়া;; ও তোকে এখন বুঝতে হবে না পরে বুঝিস।

ততক্ষণে আয়ুশও নিচে নেমে পরে। এসেই দেখে দবাই কথা বলছে।

কণা;; ওই তো ভাই এসে গেছে।

আয়ুশ;; হুমম।

আতিয়া;; আয়ুশ বাবা কিছু খাবে না?

আয়ুশ;; না মা এখন আর কিছুই খাবো না। আজ চলি রাত হয়ে এলো।

কনিকা;; বলছিলাম কি যে আজকের রাত টা থেকে যেতে।

কণা;; হ্যাঁ আমিও তো তাই বলছি।

আয়ুশ;; এই একদম চুপ,, না বড়োমা কাল এই পেত্নির কলেজ আছে। পড়াচোর কোথাকার। আর আমার অফিস আছে, বাবা দুইদিন পর বাইরে থেকে আসছেন। অনেক কাজ তাই যেতে হবে। আজ না তবে আরেকদিন থাকবো।

কনিকা;; আচ্ছা।

লায়লা;; তাহলে আপা আজ চলি।

এই বলেই তারা উঠে পরে। সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এসে পরে। মেহরাম আয়ুশের দিকে তাকিয়ে ছিলো। আয়ুশের চোখ তার ওপর পরতেই সে চোখ নামিয়ে ফেলে। আজ সারাদিন ধরেই এটা হচ্ছে মেহরামের সাথে জানে না কেন। না চাইতেও বার বার মানুষ টার সাথে নজরবন্দি হয়ে যাচ্ছে। ফলে তাকে লজ্জা পেয়ে বার বার চোখ নামিয়ে ফেলতে হচ্ছে। যাই হোক সবাই বিদায় নিয়ে এসে পরে।

.
.

সবাই ঘুমিয়ে পরেছে। কিন্তু মেহরাম না। কি আর করবে ঘুমই আসে না। একবার পুরো রুমে পায়চারি করছে তো আরেকবার আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে। হাসি পাচ্ছে তার পেট এতো বড়ো দেখে। মেহরাম ভাবছে যে এমন যদি তার ভুড়ি হতো তাহলে তাকে কেমন লাগতো এটা ভেবে আরো হাসি পাচ্ছে। মেহরামের তো কোন কাজ নেই তাই সে ভাবলো যে পুরোনো কিছু বই আছে হয়তো ধুলো জমেছে তাত। বসেই তো আছি শুধু শুধুই তাহলে বের করে একটু পরিষ্কার করা যাক। যেই ভাবা সেই কাজ মেহরাম একটা কাপড়ের অংশ বিশেষ নিয়ে বুকসেল্ফ টা খুলে দাড়ালো। একটা একটা করে বই মুছে মুছে নিজের পাশে রাখছে। হঠাৎ বই গুলো বের করতে করতে একটা বইয়ের মাঝ থেকে কিছু পরে যায়। মেহরাম সেটা হাতে তুলে নেয়। তুলেই দেখে আয়ুশের একটা ছবি। এটা ভার্সিটি লাইফের ছবি। মানে যখন এই জনাব আয়ুশ তার বাইককে উড়োজাহাজ বানিয়ে ঘুরতো, চুলগুলো বাতাসের সাথে কথা বলতো, ভার্সিটির সিনিয়র বলে একটা ভাব ছিলো নিজের মাঝে তখনকার ছবি এটা। খুব স্টাইল মেরে বাইকে বসে আছে। মেহরাম তার এক বন্ধুকে বলে লুকিয়ে এই ছবি টা তুলেছিলো। তবে হঠাৎ করে হলেও বেশ ভালো হয়েছে ছবি টা। মেহরাম ছবিটা দেখতে দেখতেই হেসে দিলো খিলখিল করে। তার এখন একদম গলা ফাটিয়ে জোরে হাসা যাবে না কারণ পেটে ব্যাথা পায় নয়তো এখন হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খেতো সে। যাই হোক ছবিটা আবার আগের জায়গা তেই রেখে দেয়। আবার বই গুলো সুন্দর করে গোছানো তে মনোযোগ দেয়।

ওদিকে আয়ুশ ল্যাপটপ সামনে নিয়ে কাজ করছে। তার মা কে ঘরে আসতে দেখে আয়ুশ ল্যাপটপ টা বন্ধ করে রেখে দেয়।

আয়ুশ;; আরে মা এসো এসো। কিছু বলবে?

লায়লা;; না আমি আর কি বলবো। তবে কিছু বলার আছে।

আয়ুশ;; কিছু বলবে না আবার কিছু বলার আছে। মানে কি 😅 আচ্ছা কি বলবে বলো না।

লায়লা;; বলছিলাম যে। আসলে

আয়ুশ এবার তার মায়ের দিকে ঘুড়ে বসলো। তার মায়ের হাত ধরে হেসে বলে ওঠে।

আয়ুশ;; মা বলো তো।

লায়লা;; মেহরাম

আয়ুশ;; হ্যাঁ মেহরাম কি?

লায়লা;; দেখ বাবা যা হয়েছে তা হয়েছে। আমি চাইছি সবকিছু আবার নতুন করে শুরু কর। জীবন কারো জন্য থেমে থাকে না, সবকিছুর যেমন একটা শেষ আছে তেমন শুরুও আছে। সবকিছু নতুন করে শুরু কর, এগিয়ে নিয়ে যা।

আয়ুশ;; মানে?

লায়লা;; আমি চাইছি তুই আর মেহরাম বিয়ে করে নে।

আয়ুশ তার মায়ের কথা শুনে কপাল কুচকে ফেলে। মাথা নিচু করে মলিন হাসে। তারপর আবার বলে ওঠে…

আয়ুশ;; মা মেহরাম রাজি হবে না।

লায়লা;; কেন হবে না। সব কিছু কেন আবার শুরু করা যায় না। ওইখানে ওই মেয়টা ভালো নেই এখানে তুই ভালো নেই। এভাবে হয় না আয়ুশ।

আয়ুশ;; মানলাম ভালোবাসি দুইজনই তবে বিয়ে। মা মেহরাম মানবে না।

লায়লা;; আর যদি মানে তাহলে।

আয়ুশ;; ______________________

দেখতে দেখতে ফজরের আজান দিয়ে দেয়। মেহরাম সেগুলো পরিষ্কার করে উঠে পরে। তারপর ওযু করে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজ পরে। দাঁড়িয়ে নামাজ পরতে পারে না মেহরাম। এতে বারবার উঠা-বসা করতে হয়। পেটে চাপ পরে। তাই মেহরাম বসে বসেই নামাজ আদায় করে নেয়। নামাজের সময় শেষ হতেই মেহরামের দরজায় টোকা পরে। মেহরাম তখন সবেমাত্রই নামাজ পরে উঠেছে জায়নামাজ গোছাচ্ছে। জায়নামাজ হাতে নিয়েই দরজা খোলে দেয়। দিয়েই দেখে তার চাচি আতিয়া দাঁড়িয়ে আছে। আতিয়া কে দেখেই মুখে হাসি ফুটে ওঠে তার।।

মেহরাম;; আরে চাচি এসো এসো।

আতিয়া;; নামাজ পড়েছিস?

মেহরাম;; হ্যাঁ মাত্রই। এসো বসো। আমি চা বানিয়ে আনি।

আতিয়া;; এই তোকে কেউ বলেছে চা বানাতে। সাজ সকালেই রান্নাঘরে কেন যাবি। এখানে আমার পা।শে বোস। দুটো কথা বলি আগে।

মেহরাম;; আচ্ছা 😊।

মেহরাম আর তার চাচি মিলে বসে কথা বলতে থাকে।





🥀🥀চলবে~~

#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ৩২

💙🐦

।।

।।

।।

মেহরাম আর তার চাচি বসে কথা বলতে থাকে।

আতিয়া;; আর মাত্র এগারো দিন বাকি।

মেহরাম;; কিসের চাচি?

আতিয়া;; তোর দশ মাস হাওয়ার।

মেহরাম;; ওহহ আচ্ছা।

আতিয়া;; খাবি খিদে পেয়েছে?

মেহরাম;; না ঠিক আছি।

আতিয়া;; মেহরাম কিছু কথা ছিলো রে তোর সাথে।

মেহরাম;; হ্যাঁ বলো না।

আতিয়া;; দেখ মা আমি জানি তনুর ওপর তুই নিজের জান দিতি কিন্তু হায়াতের কথা তো আর কেউ বলতে পারে না তাই না। আর সময়ও কারো জন্য বসে থাকে না। কিছুই থামে না কারো জন্যই না। কিন্তু

মেহরাম;; কিন্তু কি?

আতিয়া;; দেখ মেহরু আমি কোন বাহানা করতে চাইছি না। আমি সোজাসাপটা সব বলে দেই। বাকি তোর ইচ্ছে। শুধু একটা কথা জেনে রাখ যে এটা শুধু আমি না বাড়ির সকলেই চায়।

মেহরাম;; হয়েছে কি চাচি?

আতিয়া;; আয়ুশ খুব ভালো একটা ছেলে। আমি আসলে ভাগ্যবান যে মেয়ের জামাই হিসেবে ওকে পেয়েছি নয়তো সবার ভাগ্যে কিন্তু ভালো জামাই জোটে না। কিন্তু দেখ না যার জন্য তুই এতো কিছু করলি সেই আর রইলো না। এখন দুইজন দুই প্রান্তে না থেকে এক হয়ে যা না। শোন কিছুদিন পর যখন তোর বাচ্চা দুনিয়ার আলো দেখবে তখন হয়তো তুই ওকে বাবা-মা উভয়েরই ভালোবাসা দিয়ে বড়ো করতে পারবি। তবে যখন তোর বাচ্চাটা বড়ো হবে, বুঝতে শিখবে তখন মনের কোণে বাবা না থাকার কষ্ট টা কিন্তু ঠিকই তাকে তাড়া করে বেড়াবে। মুখ ফুটে হয়তো বা কখনো বলবে না কিন্তু কষ্ট টা রয়েই যাবে। তোদের দুইজনের এক হওয়াতে যদি দুটো পরিবার আবার জোড়া লাগে বা পরিবার টা পূর্ণ হয় তাতে ক্ষতি কি।

মেহরাম;; চাচি….

আতিয়া;; আমরা শুধু এটা চাইছি যে তুই আর আয়ুশ বিয়ে করে নে।

মেহরাম;; কিন্তু চাচি তনুর জায়গায় আমি কি করে…

আতিয়া;; তনুও তো এটাই চাইতো তাই না। যখন সে সব জেনে গেলো।

মেহরাম;; আমার ভালো ঠেকছে না। (অন্য দিকে ঘুড়ে)

আতিয়া;; মানুষ যখন মিথ্যা বলতে পারে না তখন এভাবে চোখ ফিরিয়ে নেয়। চোখে চোখ রেখে কথা বলতে বাধে তাদের।

মেহরাম;; চাচি তুমি বুঝছো না কেন?

আতিয়া;; তুই কেন বুঝিস না। আয়ুশ ছেলেটা পাগলের মতো ভালোবাসে তোকে আর তুই…

মেহরাম;; চাচি এমন হয় না। লায়লা খালামনি কি ভাববেন?

আতিয়া;; লায়লা আপা কি ভাববেন তাই না..! আরে লায়লা আপা নিজেই এই প্রস্তাব দিয়েছেন।

মেহরাম;; কিইইহ?

আতিয়া;; হ্যাঁ।

মেহরাম;; কি বলছো এইসব?

আতিয়া;; সত্যি।

মেহরাম;; কিভাবে কি!!

মেহরাম মুখে চিন্তার ছাপ নিয়ে কপাল কুচকে অন্য দিকে তাকিয়ে রইলো। আতিয়া মেহরামের দিকে তাকিয়ে উঠে পরে তারপর মেহরামের জায়নামাজ টা ভাজ করে কাবার্ডে রাখতে রাখতে বলে ওঠে….

আতিয়া;; মেহরু কোন মা কখনোই চায় না যে তাদের সন্তানের কোন ভাবে কোন ক্ষতি হোক। আমরাও চাই না। যা ভেবেছি বা যা করার জন্য ভাবছি তা নিতান্তই তোদের ভালো ছাড়া আর কিছুই না। কারণ এভাবে থাকলে পরিবার টা একদম আলাদা হয়ে যাবে। ভাংা ভাংা অংশে ভাগ হয়ে যাবে। একজন এই প্রান্তে তো আরেকজন ওই প্রান্তে। তবে আমরা যে শুধু পরিবার বা আমাদের কথা ভেবে এই পদক্ষেপ টা নিয়েছি তা কিন্তু না। আমরা সবার কথাই ভেবেছি। বড়ো কথা হচ্ছে তোরা ভালোবাসিস একে অপরকে। (মেহরামের হাত ধরে)

মেহরাম;; কিন্তু চাচি তনু তো…… (চোখের কোণে ইতোমধ্যেই পানি জড়ো হয়ে গেছে)

আতিয়া;; মনে রাখবি তনুর শেষ কথা। ভাববি যে দূর থেকে হলেও তনু তোকে দেখছে আর শান্তি পাচ্ছে। কারণ ওই ও এটাই চাইতো।

মেহরাম;; চাচি আমার কিছুটা সময় দরকার প্লিজ। আমি আগেই কিছু বলতে পারছি না।

আতিয়া;; হুম তা নে। যতো সময় নেবার নে কিন্তু পরবর্তীতে যেন হ্যাঁ ই হয়।

আতিয়া এই বলেই ঘর ত্যাগ করে কিন্তু এদিকে তো মেহরামের মাথায় আরেক চিন্তা ভর করে বসে। সবেমাত্রই কি বলে গেলো তার চাচি। আর প্রস্তাব নাকি লায়লা খাতুনই দিয়েছেন। তাহলে তো অবশ্যই এই সব ব্যাপারে কনিকা অর্থাৎ মেহরামের মা ও জানে। এইসব চিন্তাই যেন মাথার ওপরে এখন ঘুর ঘুর করছে মেহরামের। সাদা ওরনা দিয়ে হিজাব পড়েছিলো সেটাও খুলে নি এখনো। বিছানাতে বসে ভাবছে এই সব। তার কিছুক্ষণ পর আকাশ আসে। রুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মেহরামকে ডাকতে থাকে….।

আকাশ;; মেহরাপু

মেহরাম;; হ্যাঁ

আকাশ;; ওভাবে বসে আছো কেন?

মেহরাম;; না রে এমনি। তুই কি কিছু বলবি? আর আজ এতো সকাল সকাল উঠে পরেছিস যে?

আকাশ;; ওমা ভুলে গেলে আমার না আগামীকাল পরিক্ষা আর তুমিই তো সকালে উঠতে বলেছো।

মেহরাম;; ওহহ হ্যাঁ। আচ্ছা নাস্তা করে তারপর বই খাতা নিয়ে আসিস।

আকাশ;; আচ্ছা। আর চলো তোমাকে ডাকতেই তো এসেছিলাম।

মেহরাম;; আসছি।

আকাশ চলে যায়। মেহরাম ধীরে উঠে মুখ চোখ সব মুছে নেয়। চুল গুলো কোন রকমে খোপা করে নেয় একটা চিকন কাটা দিয়ে। তারপর নিচে নেমে আসে। এসেই দেখে সবাই বসে আছে। মেহরামের বাবা আর চাচা মিলে কথা বলছে আর চা খাচ্ছে। মেহরাম তাদের দেখে মুচকি হাসে তারপর তার দাদির পাশে বসে পরে।


লায়লা খাতুন এসে ছেলের রুমে দেখে গেছেন। কাথা গায়ে দিয়ে মুখ অন্যপাশে ঘুড়িয়ে ঘুম পারছে। তিনি ভেবেছেন আয়ুশ ঘুম কিন্তু না আয়ুশ অন্যপাশে ঘুড়ে চোখ মেলে তাকিয়ে আছে। লায়লা খাতুন একবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আবার আয়ুশের দিকে তাকায়। অফিসের সময় প্রায় পেরিয়ে যাচ্ছে কিন্তু আয়ুশের ওঠার নাম নেই। অন্যান্য দিন হলে ঝড়ের গতিতে উঠে অফিসে চলে গেতো কিন্তু আজ…..। যাই হোক লায়লা খাতুন চলে গেলেন। নিচে গিয়েই দেখে কণা মনের সুখে খাচ্ছে। কারণ তার বান্ধবী ফোন করে বলেছে যে আজ তাদের ক্লাস নেই তো কলেজেও যেতে হবে না। কণা খেয়াল করলো যে তার মায়ের মুখ টা কেমন ভার ভার। খাওয়া রেখে কণা বলে ওঠে…..

কণা;; মা কি হয়েছে?

লায়লা;; আয়ুশের কি যেন হয়েছে।

কণা;; মানে, ভাইয়ের আবার কি হলো? ভালোই না ছিলো।

লায়লা;; ওহহ তোকে তো বলাই হয় নি। আসলে আমরা সবাই মেহরাম আর আয়ুশের বিয়ের ব্যাপারে কথা বলছি।

কণা;; কি?

লায়লা;; হ্যাঁ আর এই ব্যাপারে আয়ুশের সাথে গতকাল রাতে আমার কথাও হয়েছে।

কণা;; ওহহ তো এই কথা বুঝেছি। তবে মেহরাপু কি মানবে?

লায়লা;; আটকে যাই ওই কথা তেই।

কণা;; ধৈর্য ধরো, সবুর করো আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।

লায়লা;; তাই যেন হয়।

কণা;; ভাই কোথায়?

লায়লা;; রুমেই।

কণা;; উঠে নি?

লায়লা;; না।

কণা;; আমি দেখছি।

কণা টেবিল ছেড়ে ওঠে আয়ুশের রুমে চলে যায়। রুমের দরজা টা ধীরে খোলে উকি দেয়। দেখে তার ভাই ওপর পাশ হয়ে শুয়ে আছে। কণা আয়ুশের রুমে চলে গেলো।

কণা;; ভাইয়া, ভাইয়া।

আয়ুশ;; _______________

কণা;; ভাইয়া, ওইই ভাইয়া।

আয়ুশ;; _______________

কণা;; এইই আয়ুশের বাচ্চা।

আয়ুশ;; কি বললি?

কণা;; এইতো বুলি ফুটেছে।

আয়ুশ;; কেন এসেছিস?

কণা;; তোকে তুলতে।

আয়ুশ;; আমি উঠতে জানি।

কণা;; অফিসে যাবি না?

আয়ুশ;; জানি না রে বইন। কাজও আছে আর ইচ্ছেও করছে না। কি যে করি।

কণা;; ভাইয়া তাহলে তুমি এক কাজ করো বাসায় থেকেই কাজ গুলো করে ফেলো না।

আয়ুশ;; ওরে এতো মিষ্টি সুরে ডাক।

কণা;; না ইয়ে মানে মাঝে মাঝে ডাকতে হয় আরকি।

আয়ুশ;; হুমমম।

আয়ুশ উঠে বসে পরে। কণা আয়ুশকে দেখেই হেসে দেয়। কারণ আয়ুশের চুলগুলো খানিক বড়ো বড়ো। সেগুলো কাকের বাসা হয়ে আছে।

আয়ুশ;; ভেটকাচ্ছিস কেন?

কণা;; বহোত খুবসুরাত লাগতাছে তুমারে ভাইজান 😁।

আয়ুশ;; পেত্নী, এই তোর কলেজ নেই।

কণা;; ক্লাস নেই এখন কি কলেজ গিয়ে মুড়ি খাবো। এহহহ আমাকে খালি কথা শুনাস নিজের অফিসে যাবার নাম নাই।

আয়ুশ;; হাহ আরামে পড়াশোনা করো তো ভালো লাগে না তাই না। আমার মতো রাত দিন খাটতে হতো বুঝতা।

কণা;; এর জন্যই তো বলি যে বিয়ে টা দিয়ে দাও ভালো কাউকে দেখে।

আয়ুশ;; কিইইই তবে রে দাড়া,, ওওওও মা তোমার মেয়ে কে নিয়ে যাও তো। হারামী গেলি এখান থেকে।

কণা;; যাক তোকে উঠানো আমার কাজ ছিলো তা হয়ে গেছে এবার আমি যাই।

আয়ুশ চিল্লাচ্ছে আর এদিকে কণা হাসতে হাসতে দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে পরে।

লায়লা;; কি রে কি করে এসেছিস?

কণা;; আবোল তাবোল কথা বলে চেতাই রাইখা আসছি। এছাড়া আমার কাজই একটা ওকে চেতানো। হিহিহিহিহি।

লায়লা;; বড়ো কবে হবি?!

কণা;; কেন বড়ো হলে কি বিয়ে দিবে।

আয়ুশ;; দেখলে মা দেখলে তোমার মেয়ের কান্ড। কি রকম বিয়ে পাগল মেয়ে তোমার। শোনো শোনো একটা বুড়া ধামকে ধরে ওর গলায় তোমার মেয়েকে ঝুলিয়ে দাও তখব বুঝবে। (নিচে এসে)

কণা;; এই তুই অফিসে যা।

আয়ুশ;; যাবো না আমি।

লায়লা;; আসলেই যাবি না?

আয়ুশ;; না আসলে যাবো না। ভালো লাগছে না সব কাজ বাসায় থেকেই করবো।

লায়লা;; আচ্ছা ফ্রেশ হয়ে খেতে আয়।

আয়ুশ চলে যায় ফ্রেশ হতে। কণা আবার তার খাবার নিয়ে টিভি দেখতে লেগে পরে। ওদিকে মেহরামের বাড়িতে সবাই যার যার কাজ করছিলো। তখনই লায়লা খাতুনের ফোন আসে। কনিকা গিয়ে ফোন রিসিভ করে…..

কনিকা;; হ্যালো আসসালামু আলাইকুম।

লায়লা;; ওয়ালাইকুম সালাম আপা। কেমন আছেন?

কনিকা;; আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি আর ছেলে মেয়ে কেমন আছে?

লায়লা;; সবাই অনেক ভালো। আপা আসলে কথা হয়েছে কি মেহরামের সাথে?

কনিকা;; জ্বি আজ সকালেই আতিয়া গিয়ে মেহরামকে বুঝিয়ে বলে এসেছে।

লায়লা;; মেহরাম কি বললো?

কনিকা;; ওর নাকি কিছুদিন সময় দরকার।

লায়লা;; ওহহ আচ্ছা।

কনিকা;; আপা কি যে হবে..!

লায়লা;; দোয়া করি সব যেন ভালোই হয়।

কনিকা;; আপা এককাজ করুন না আপনি আয়ুশকে নিয়ে আজ এসে পড়ুন।

লায়লা;; কিন্তু আজ?

কনিকা;; আপা আমার মনে হয় আয়ুশ আর মেহরামের একা কিছুক্ষণ একে ওপরের সাথে কথা বলা উচিত।

লায়লা;; হ্যাঁ যদি একে ওপরের সাথে কথা বলে ভালো হয় বা সব ক্লিয়ার করে নেওয়া যায় তাহলে এতে আর মন্দ কি।

কনিকা;; জ্বি তাই বলছি এসে পড়ুন বিকেলের দিকে।

লায়লা;; জ্বি আচ্ছা আপা।

কনিকা;; আচ্ছা।

লায়লা খাতুন আরো কিছুক্ষন কথা বলে ফোন রেখে দেন। পেছনে ঘুড়তেই আতিয়া কে দেখে। আতিয়া ইশারাতে তার ভাবী কে জিজ্ঞেস করে কে ছিলো কনিকা বলে লায়লা খাতুন। আর তারা বিকেলে আসছেন৷ মেহরামকে কিছু জানাতে মানা করে দেন। তারপর গিয়ে সবার সাথে বসে পরে।

মেহরাম;; হুমম অংক এটা কর আগে। ২০ জন শ্রমিক যদি ১ টি পুকুর ৬ দিনে খনন করতে পারে তাহলে ২৭ জন শ্রমিকের পুকুরটি খনন করতে কতোদিন লাগবে। কর এটা

আকাশ;; একটু দেখি না।

মেহরাম;; মাইর না খাইতে চাইলে না দেখে অংক কর। সেম নিয়মের অংক ৩ টা করেছিস এটা পারবি না কেন। তাহলে কি করলি এতোক্ষন, অংক কর চুপচাপ।

মেহরামের ধমক খেয়ে আকাশ চুপটি মেরে অংক করতে লাগলো তখনই তার চাচি হাতে এক গ্লাস দুধ নিয়ে এসে মেহরামের পাশে বসে। দুধের গ্লাস দেখে এই যেন মেহরামের মাথা চক্কর দিয়ে উঠে। কারণ দুধ থেকে তার জন্ম-জন্মান্তরের শত্রুতা।

আতিয়া;; ওভাবে নাক কুচকে লাভ নেই। চুপ করে খেয়ে নে।

মেহরাম;; আমি মাফও চাই দোয়াও চাই। আমার পক্ষে সম্ভব না গো চাচিজান।

আতিয়া;; হপ চুপ করে খা। বেশি না তো হাফ গ্লাস।

মেহরাম;; কি এটা হাফ গ্লাস, এটা তুমি বলতে পারলে। কানার ভাই আন্ধাও তো এটাকে হাফ গ্লাস বলবে না।

আতিয়া;; হ্যাঁ হাফ গ্লাস না ফুল গ্লাসই এবার খা তো।

মেহরাম;; চাচি দেখো সত্যি আমি পারবো না। এটার স্মেলও ভালো লাগে না।

আতিয়া;; নাক চেপে ধরে গিলে ফেল। তোর জন্য না হোক বেবির জন্য খা।

মেহরাম;; ওর জন্য আর কতো দোহায় যে দিবে তোমরা।

মেহরাম আর কোন উপায় না পেয়ে নাক চেপে ধরে বাধ্য হয়ে খেয়ে নিলো। কিন্তু হাফ গ্লাস খেয়েই আর পারলো না। আতিয়াও আর জোরাজোরি করে না ছেড়ে দেয়। এভাবেই সময় যেতে যেতে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেলো।

.
.

লায়লা;; আয়ুশ রেডি হ।

আয়ুশ;; কেন কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লায়লা;; মেহরামদের বাড়িতে।

আয়ুশ সোজা হয়ে বসে পরে।

আয়ুশ;; কালই না এলাম আজ আবার…!

লায়লা;; কাজ আছে তাই যাচ্ছি। তাড়াতাড়ি উঠ

আয়ুশ;; কণা..

কণা;; আমি রেডি হয়ে বসে আছি।

আয়ুশ;; বাপরে বাপ। যাচ্ছি

আয়ুশ গিয়ে রেডি হয়ে নেয়। সে রেডি হচ্ছে আর ভাবছে যে সেখানে গিয়েই কি করবে আর মেহরাম কি আদৌ রাজি হবে। অত:পর সব চিন্তা ভাবনা কে এক সাইডে রেখে রেডি হয়ে আয়ুশ নিচে নেমে আসে।
তারপর সবাই রওনা দেয় মেহরামদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। প্রায় আধাঘন্টা পর পৌছেও যায়। মেহরাম আকাশের সাথে বসে বসে দশ বিশ খেলছিলো আর হাসছিলো তখনই তারা ভেতরে আসে। তাদের আসতেই কনিকা আতিয়া আর বিল্লাল এগিয়ে যান। আয়ুশ আর মেহরামের চোখাচোখি হয়ে যায়। তারা বসে পরে। সবাই বসে কথা বলছে। মেহরাম তাদের মাঝখান থেকে উঠে আসতে নেয় তবে আতিয়া আবার হাত ধরে তাকে থামিয়ে দেয়। কিন্তু মেহরাম বুঝিয়ে আবার এসে পরে। সোজা চলে যায় ছাদে। আয়ুশ তার দিকে তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে ফেলে। এবার মূল কথা উঠে। এক কথায় বাড়ির সবাই রাজি শুধু মেহরাম কিছুটা কনফিউশনে পরে আছে। আয়ুশ হয়তো মেহরামের অবস্থা টা এবার আন্দাজ করতে পেরেছে। তাই সে উঠে গিয়ে ছাদে চলে আসে। এসে এদিক ওদিক খুজতে থাকে মেহরামকে কিন্তু ছাদের কোথাও নেই মেহরাম। আয়ুশ ভাবে হয়তো মেহরাম তার রুমে চলে গিয়েছে। এই ভেবে আয়ুশ চলে আসতে নেয়। কিন্তু ঠিক তখনই কারো ফুপিয়ে কান্নার শব্দ কানে আসে, আয়ুস থেমে যায়। এটা মেহরামের কান্নার আওয়াজ। আয়ুশ ছাদের মাঝখানে চলে যায়। আরো একটু এগিয়ে নিজের ডান পাশে তাকাতেই দেখতে পায় মেহরাম ছাদের এক কিণারে দাঁড়িয়ে দুই হাত দিয়ে সমানে চোখের পানি মুছে যাচ্ছে আর হিচকি তুলে কাদছে। আয়ুশ তাকে দেখে থেমে যায়। এগিয়ে গিয়ে মেহরামের পেছনে দাঁড়িয়ে পরে। মেহরাম এখনো টের পায় নি যে তার পেছনে আয়ুশ দাঁড়িয়ে আছে। হঠাৎ আয়ুশের ডাকে মেহরামের হুস আসে। সে তড়িঘড়ি করে নিজের চোখের পানি গুলো মুছে ফেলে।

আয়ুশ;; মেহরাম।

মেহরাম;; আব..হুম হ্য হ্যাঁ বলো। আর তুতুমি এএখানে কেন? (আয়ুশের দিকে তাকিয়ে)

আয়ুশ;; কাদছো কেন?

মেহরাম;; কই ননা না আমি কাদছি কই না তো। ঠিক আছি আমি।

আয়ুশ;; প্রথমে কীভাবে মিথ্যা বলতে হয় তা আগে ভালোভাবে শেখো তারপর মিথ্যা বলতে এসো তাও আবার আমার সাথে ওকে।

মেহরাম;; হ্যাঁ কাদছি, কি হয়েছে তাতে। কান্না পাচ্ছে আমার কি করবো আমি (কেদে)

আয়ুশ;; আচ্ছা কেন কাদছো তা তো আগে বলবে নাকি?

মেহরাম;; সবাই কি চাইছে জানো তুমি?

আয়ুশ;; কি চাইছে?

মেহরাম;; তোমার… ত তোমার আর আমার ববিবিয়ে।

আয়ুশ;; সবার ভালো আর খুশির কথাই ভেবেই এই কথা উঠে এসেছে। তবে তুমি চিন্তা করো না। সবটাই তোমার ওপর নির্ভর করে মেহরাম। কেউ তোমাকে কোন প্রকার জোর করবে না। সবটাই তুমি আর তোমার ইচ্ছে। তুমি রাজি থাকলে আমি আছি নয়তো না।

মেহরাম;; তনু…

আয়ুশ;; মাঝে মাঝে হিংসে হয় জানো। তনুর থেকে অনেক হিংসে হয়। কারণ তুমি তনু কে এত্তো বেশি যে ভালোবাসো তাই। কেন এতো ভালোবাসো। আমাকে দেওয়া যায় না কিছুটা 😅। তনুর কথা এখনো ভাবছো। জানি আমি সেটা আর তুমি আজীবন ভাববে। কারণ ভাবার অধিকার টা আছে তোমার। কাশ আমার পেত্নী মার্কা বোন টাও এতো ভালোবাসতো আমায়।

মেহরাম;; সবাই ভালোবাসে।

আয়ুশ;; তুমি আমাকে বাসো?

মেহরাম;; ________________

আয়ুশ;; কি হলো বলো..!

মেহরাম;; বাসলেই কি?

আয়ুশ;; বিয়ে।

মেহরাম;; কিন্তু তনু..!

আয়ুশ;; হয়তো তুমি ভুলে গেছো।

মেহরাম;; কি?

আয়ুশ;; এটা।

আয়ুশ তার পকেট থেকে তনুর লিখা ওই চিঠি টা বের করে মেহরামের হাতে দেয়। মেহরাম অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। একবার চিঠির দিকে তো আরেকবার আয়ুশের দিকে তাকাচ্ছে।

মেহরাম;; এটা??

আয়ুশ;; তনুর লিখা শেষ চিঠি। আমি এটা সরাই নি কখনো। সেইদিন নিজের পকেটে খুঁজে পাই আর তখন থেকে প্রতিবার নিজের কাছেই রাখি। তনু কি লিখেছে হয়তো ভুলে গেছো তুমি।

মেহরাম;; ভুলি নি, কিছুই ভুলিনি আমি।

মেহরাম চিঠি টার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে তারপর আবার আয়ুশ কাছে দিয়ে দেয়। আয়ুশ নিজের কাছে রাখে।

আয়ুশ;; সব তোমার ইচ্ছে মেহরু, সব।

আয়ুশ পেছন ঘুড়ে চলে আসতে নেয়। তবে এখন মেহরাম আয়ুশকে পেছন থেকে ডাক দেয়।

মেহরাম;; আয়ুশ..!

আয়ুশ থেমে যায়, পেছন ফিরে তাকায়।

আয়ুশ;; হমম।

মেহরাম আবার তার চোখের পানি ছেড়ে দিয়েছে। ছলছল চোখে আয়ুশের দিকে তাকিয়ে থাকে। আয়ুশ হয়তো বুঝে এই চোখের ভাষা। আয়ুশ মেহরামের সামনে দাঁড়িয়ে নিজের হাত টা খানিক এগিয়ে দেয় মেহরামের দিকে। আয়ুশ বলে ওঠে….

আয়ুশ;; তো মেহরাম আফরিন আপনি কি আমার অর্ধাঙ্গিনী হবেন। আমার অংশবিশেষ। বিয়ে করবেন আমাকে..?! (বেকুল দৃষ্টিতে মেহরামের দিকে তাকিয়ে)

মেহরাম তো এবার আরো কেদে দেয়। জোরে জোরে কয়েকবার মাথা নাড়িয়ে কোন রকমে বলে ওঠে…

মেহরাম;; হ্য..হ হ্যাঁ। (কেদে)

আয়ুশের হাতে মেহরাম তার হাত রেখে দেয়। আয়ুশ মুচকি হেসে মেহরামকে জড়িয়ে ধরে। তার এক হাত মেহরামের মাথার পিছনে রেখে দেয়। মেহরাম ও তাকে জড়িয়ে ধরে।





🍂চলবে~~

তৈমাত্রিক পর্ব-২৮+২৯

0

#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ২৮

🧚‍♀️✨

দিনটা সেইদিনের মতো আজও মেঘলা। বাইরে বৃষ্টির সাজ করেছে। এখানে সবাই রয়েছে, তাদেরই মাঝখানে স্টীলের বিছানাতে সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে তনুকে। তার একপাশে আয়ুশ বসে আছে আরেক পাশে মেহরাম। তনুর লাশের মুখ টা খোলা রাখা হয়েছে। আয়ুশ টাসকি খেয়ে বসে আছে। মেহরাম স্থীর নয়নে তনুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। মাঝেমধ্যে দমকা বাতাস এসে ছোয়া দিয়ে যাচ্ছে। আসরের আজানের প্রতিধ্বনি কানে ভেসে আসছে। মন চাইছে সময়ের চাকা টা ধরে টান দিয়ে সময় টাকে এখানেই থামিয়ে দেই। সমটা থাকুক স্থীর, এটা যেন এখন বয়ে না, থাক। কেননা এখন যতো সময় যাচ্ছে বুকের ধুকপুকানি যেন ততোই বেড়ে যাচ্ছে। এভাবে সময় গড়িয়ে গেলেই তো তনুকে ওরা নিয়ে চলে যাবে অজানায়। সময়টা একটু থামলে তনুও আরেকটু থেকে যাবে। থাক না আরেকটু…………….!! কিন্তু প্রকৃতি যে তা মানতে নারাজ। চোখের সামনে যেন পুরনো স্মৃতি গুলো ছুটোছুটি করছে। ওই মেহরাম & তনুর একসাথে বেড়ে ওঠা, দৌড়াদৌড়ি করে সারা বাড়ি কে মাতিয়ে রাখা। সবই যেন মনের দরজায় আজ উঁকি দিয়ে যাচ্ছে, একদম শেষ উঁকি। মেহরাম অনেক শক্ত থেকেছে, এতো কিছুর পরও সবসময় হাসিখুশি থাকার জন্য চেষ্টা করেই গেছে। কিন্তু এখন আর না, এখন আর তার পক্ষে সম্ভব না। ভেংে গেছে, একদম পুরো ভেংে চুরমার হয়ে গিয়েছে। যে ভাংা কখনো আর জোড়া লাগানোর নয়। কোন কাচ বা আয়না ভেংে গেলে তা জোড়া তো পুনরায় লাগানো যায় কিন্তু তার মাঝে ফাটলের দাগ টা রয়েই যায়। মেহরাম ভেংে গেছে হ্যাঁ অবশ্য জোড়া লেগেছিলো কিন্তু এখন এত্তো পরিমাণে টুকরো টুকরো হয়েছে যে টুকরোর কণা গুলোই খোঁজা দায়। বাড়ির চারিদিক কান্নার আহাজারি আর আত্নচিৎকারে যেন ফেটে পরছে।

দেখতে দেখতে একসময় বিকেলের গোধুলি লগ্ন হয়ে গেলো। আকাশে সূর্য যেন এই ডুব দেয়। বাড়িতে বেশ কিছু হুজুর এসেছেন। তারাই তনুর জানাযা আদায় করবেন। তবে অবাকের ব্যাপার হচ্ছে এটা যে বাড়ির সকলেই কান্নায় ফেটে পরলেও মেহরামের চোখের পানি নেই। সে মুচকি হাসছে। তার মতে তনু এখনও আছে। একদম তনুর মাথার কাছ বসে তনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মনে হচ্ছে তনু ঘুমাচ্ছে আর খানিক বাদেই সে উঠে পরবে। আর মেহরাম পরম যত্নে তনুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে আনমনেই কথা বলে উঠছে। এখন কেউ মেহরামকে দেখলে সোজা পাগল ছাড়া আর কিছুই ভাববে না। মেহরামকে কয়েকবার সেখান থেকে নিয়ে আসার জন্য চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু নিয়ে আসতে গেলেই প্রচুর রেগে যায়। এভাবে তার শরীর টা বিগড়াচ্ছে কিন্তু সেদিকে খেয়ালই নেই। এভাবেই থাকতে থাকতে এক সময় মাগরিবের আজান পরে যায়। জানাযার সময় হয়ে গেছে। কিন্তু কারো সাহস অব্দি নেই যে মেহরামকে তনুর কাছ থেকে উঠিয়ে আনবে। মেহরামের চাচি এবার উঠে গিয়ে মেহরামের কাছে যায়।

আতিয়া;; মেহরাম

মেহরাম;; ___________

আতিয়া;; মেহরাম

মেহরাম;; ___________

আতিয়া;; মেহরাম

মেহরাম;; কি হয়েছে এতো ডাকছো কেন?

আতিয়া;; উঠে আয় মা।

মেহরাম;; না না আমি উঠবো না, চাচি তুমি বুঝছো না আমি চলে গেলে তনু থাকতে পারবে না।

আতিয়া;; পাগলামি করিস না মা উঠে আয়।

মেহরাম;; চাচি আমি তনুকে ছেড়ে যাবো না।

আতিয়া;; তনুই তোকে ছেড়ে চলে গেছে। (চিল্লিয়ে কেদে)

মেহরাম;; চাচি কেউ কাউকে ছেড়ে যায় নি। তনু আছে। আমি যাবো না।

আতিয়া;; মেহ….

আতিয়া মেহরামকে নিয়ে অনেক জোরাজোরি করে কিন্তু কিছুতেই কোন লাভ হয় না। উপায় না পেয়ে আতিয়া সেখান থেকে চলে যায়। সময় যতো যাচ্ছে জানাযার সময়ও চলে যাচ্ছে। কেউ পারছে না মেহরামকে নিয়ে আসতে। অবশেষে আতিয়া আয়ুশকে বলে মেহরামকে তনুর পাশ থেকে উঠিয়ে আনতে। আয়ুশ ধীর পায়ে মেহরামের কাছে যায়।

আয়ুশ;; মেহরাম..!

মেহরাম;; আয়ুশ দেখো না সবাই আমাকে সরে আসতে বলছে। আর কখন থেকে দেখছি তনুকে এই সাদা কাপড়ে মুড়িয়ে রাখা হয়েছে। খোল এইসব, ভালো লাগছে না।

আয়ুশ;; মেহরাম ছেলেমানুষী করো না। প্লিজ উঠো

মেহরাম;; না আমি উঠলেই তো তনুকে ওরা নিয়ে যাবে।

আয়ুশ;; তনুকে কেউ কোথাও নিবে না, তনু তোমার কাছে ছিলো আছে আর থাকবেই। তোমার বোন তোমাকে ছেড়ে দূরে কোথাও যাবে না।

মেহরাম;; তাহলে তনু এভাবে শুয়ে আছে কেন। ওকে বলো না উঠে যেতে। কখন থেকে আমার সাথে কথা বলছে না। আমার আর ভালো লাগে না। আচ্ছা ও কি আমার সাথে রাগ করেছে? ওও আয়ুশ বলো না। আমি আর পারছি না। একদম শেষ হয়ে যাবো আমি। প্লিজ ওকে বলো জলদি উঠে গেতে।

আয়ুশ বুঝলো যে মেহরামের বর্তমানে কোন হিতাহিত জ্ঞানই নেই। তাই এইসব উলটা পাল্টা বকছে। এদিকে হুজুর রা এক প্রকার তাড়া দিচ্ছে। তাদের মতে মৃত কাউকে বেশিক্ষণ বাড়ির আঙিনায় রাখতে নেই। কারণ মৃত্যুর পর তার দুনিয়া-জায়গা আলাদা হয়ে যায়। তাই যতো দ্রুত সম্ভব তাকে তার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়া উত্তম। কেউই মেহরামকে তনুর কাছ থেকে আনতে পারে না। সে যাবেই না এক কথায়। পরে আয়ুশ গিয়ে অনেক কথা বলে বুঝিয়ে সুঝিয়ে মেহরামকে নিয়ে আসে। তবে এবার মেহরামকে তার চাচি আর মায়ের কাছে রেখে এসে আয়ুশ এসে তনুর লাশ কাধে নেয়। একপাশে মেহরামের বাবা আরেকপাশে চাচা লাশ টাকে কাধে নেয়। আরেকজন হুজুর মানুষ। মেহরাম ছাড়া পাওয়ার জন্য অনেক ছুটছে কিন্তু তাকে শক্ত করে ধরে রাখা হয়েছে। মনে হচ্ছে কোন পাগল কে বেধে রাখা হয়েছে। অনেক পরিমাণে চিল্লাচ্ছে। আল্লাহ’র নাম নিয়ে তনু কে বাড়ির বাইরে নিয়ে আসা হয়। এবার আতিয়া ধপ করে নিচে বসে পরে। তার কোল খালি হয়ে গেছে। তার মেয়ে আর নেই। যদিও আরেক মেয়ে আছে কিন্তু তবুও আরেকটা না থাকার শূন্যতা রয়েই যাবে। তনুকে নিয়ে বাইরে এসে পরলে মেহরাম ঝটকানা মেরে সবাইকে সরিয়ে দেয়। এতে সে পেটে হাল্কা ব্যাথা পায়। চোখ মুখ কুচকে পেটের নিচে হাত দিয়ে দেয়। কিন্তু আবার দ্রুত কদম ফেলে বাইরে এসে পরে। তনু তনু বলে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। সবাই জানে যে এখানে কেউ একজন মারা গিয়েছে। মেহরাম যখন বাইরে এসে গলা ফাটিয়া তনু বল চিল্লিয়ে ওঠে তখন সবাই তাকিয়ে থাকে তার দিকে। সবারই খারাপ লাগে মেহরামকে দেখে। পা ফেলে গেটের একদম বাইরে চলে আসতে নিবে তখনই আরো কিছু লোক মেহরামকে নিয়ে ভেতরে আসে। মেহরাম এখনো তনু তনু বলে চিল্লিয়েই যাচ্ছে। কিন্তু বাড়ির ভেতরে আনতেই মেহরাম মাথা ঘুড়িয়ে পরে যায়। মেহরামের মা আর চাচি গিয়ে ধরে। এই অবস্থায় আবার মেহরামের কিছু না হিয়ে যায়। এই ভেবে তার মা আর চাচির আহাজারি আবার শুরু।


ওদিকে আয়ুশ কখনো কল্পনাও করে নি যে সে একদিন তনুর লাশকে কাধে নিবে। তনুকে সে মেহরামের জায়গায় বসাতে পারে নি ঠিক আছে কিন্তু তনু তনুই ছিলো। আয়ুশ তাকে সবসময় নিজের ফ্রেন্ড ভেবেই এসেছে। যদি খুব বেশি মিশুক বা ভালো মনের একজনকে বলা হয় তবে তা হচ্ছে তনু। তনুর সব কিছু চোখে ভাসছে। সেগুলো ভেবে ভেবেই চোখের কার্নিশ বেয়ে নোনাজল বেয়ে যাচ্ছে। সেগুলো মুছার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই আয়ুশের। হাটতে হাটতে কবরস্থানে এসে পরে। কাধ থেকে নামিয়ে নিচে রাখা হয় লাশ। তারপর কবর খোড়া হয়। পালা আসে তনুকে কবরে নামানোর। আয়ুশ এক চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। মন টা চাইছে যে তনুর হাত দুটো ধরে আটকে দেয়। কি হয় না গেলে। আয়ুশের বেশ মনে পরছে তনুর তার দিকে মাঝে মাঝে অপলক ভাবে তাকিয়ে থাকা। হুটহাট আয়ুশের নাম ধরে ডেকে ওঠা। খুব বেশি মনে পরছে। অবাধ্য মনকে বাধ্য করে নিলো। তনুর লাশ ধরে কবরে নামানো হয়। সর্বপ্রথম কবরে মাটি দেওয়া হয় তনুর বাবার হাতে। এভাবেই মাটি দিয়ে পরিপূর্ণ করে দেওয়া হয় কবর। মোনাজাত ধরে সবাই দোয়া করে এসে পরে। কিন্তু আয়ুশ যায় না। মাথা থেকে টুপি টা খোলে হাটু গেড়ে মাটির ওপর বসে পরে। দম আটকে আসছে, শ্বাস গুলো কেমন জানি থেমে থেমে বের হচ্ছে। আয়ুশ আর পারে না নিজেকে সামলাতে। কাপা কাপা হাতে তনুর কবরের ওপরের মাটি গুলো ছুইয়ে দেয়। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে আর গাল নাক বেয়ে পানির ফোটা গুলো পরছে। এভাবে ঠিক কতোক্ষণ সে ছিলো তার হিসেব নেই।

রাত হয়ে গেছে। মেহরামের জ্ঞানও ফিরে এসেছে। জ্ঞান ফিরেছে ধরে কোন কথা নেই মুখে। হঠাৎ চোখ গুলো ঘুড়িয়ে দেখে সবাই ফুপিয়ে কাদছে। আয়ুশও বসে আছে। মেহরামের চোখ গুলো মুছে উঠে দাঁড়িয়ে পরে। কাউকে কিছু না বলেই সোজা উঠে হেটে যেতে লাগে। মেহরামের বাইরে যাবার কিছুক্ষণ পর সবাই মনে করে যে মেহরাম নেই। আয়ুশের মনে এবার ভয় ঢুকে যায় যে ইদানীং যখন তখন পেটে ব্যাথা শুরু হয়ে যায় তার। আবার সে এতো রাতে কোথায় গেলো। মেহরামের চাচি গিয়ে সব জায়গায় মেহরামকে খুঁজে কিন্তু সে নেই। তনুকে তাদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। মেহরাম এই রাতের অন্ধকারে সোজা সেখানে চলে যায়। এদিকে আয়ুশ, মেহরামের বাবা চাচা চাচি দবাই খুজছে। অবশেষে বড়ো টর্চ লাইট নিয়ে সেই বাইরে কবরস্থানে যাওয়া হয়। আর গিয়েই যা দেখে তা দেখার জন্য কেউই প্রস্তুত ছিলো না।
মেহরাম তনুর কবরের পাশে গিয়ে শুধু মাটির গুলো সরাচ্ছে। আর পাগলের মতো তনু তনু করে ডাকছে। সবাই জলদি গিয়ে মেহরামকে ধরে ফেলে। মেহরাম তো সেখান থেকে উঠবেই না। সে এই মাটির নিচ থেকে তনু কে বের করবে।

আয়ুশ;; মেহরাম কি করছো টা কি তুমি?! উঠো

মেহরাম;; না তনুর এখানে দম আটকে আসছে তো। ওকে বের করতে হবে। আমার মতো তনুও অন্ধকার দেখে ভয় পায় তো তুমি জানো না আয়ুশ। তুমি কিচ্ছু জানো না। আমাকে ছাড়ো আমি তনু কে নিয়েই বাড়ি যাবো।

এই বলেই মেহরাম আবার কবরের মাটি গুলো সরাতে লাগে। আয়ুশ এবার মেহরামের হাত ধরে এক ঝটকায় তাকে তুলে আনে।

আয়ুশ;; মেহরাম তুমি বুঝো না, এতো পাগলামি কেন করছো। তনু নেই। আল্লাহ’র তাকে পছন্দ হিয়েছে আর নিয়ে গেছে। বাস্তবতা বুঝো।

আয়ুশের এমন ধমকে মেহরামের অন্তর আত্মা যেন কেপে ওঠে। এক লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে হু হু করে কেদে দেয় মেহরাম। খুব কষ্টে তাকে বাড়ি নিয়ে যাওয়া হয়। বলার কিছুই নেই। ভাষাহীন এই পরিস্থিতি, কার অবস্থাবকেমিন বা মেহরাম এখন ঠিক কিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তা বলা বাহুল্য। বাড়ি গেতেই মেহরাম সোজা তার রুমে চলে যায়। যেই রুমে তনু আর সে একসাথে থাকতো। সোজা রুমে গিয়ে কাবার্ড খুলে দাঁড়ায়। পাগলের মতো খামছে খামছে কাবার্ড থেকে তনুর সব কাপড় জিনিসপত্র সব বের করে। সেগুলো নিয়ে নুচে বসে পরে। সবগুলো হাতে খামছে বুকের ধরে হাউমাউ করে কেদে দেয়। আয়ুশ এগুলো সব দরজায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। সে ভেবেছিলো রুমের ভেতরে যাবে কিন্তু মেহরামকে দেখেই সে থেমে যায়। কি বলবে ভাষা নেই, কি বলে শান্তনা দিবে জানা নেই তার। যখন মানুষ ভেতর থেকে ভেংে যায় তখন তাকে একা থাকতে দেওয়াই ভালো। আয়ুশ পারবে না মেহরামের সামনে গিয়ে দাড়াতে এখন। একে তো তনুর এই আচমকা মৃত্যু তার ওপর মেহরামের এই দশা। এগুলো যেন আয়ুশের নিজের কাছে ঠিক মৃত্যুর সমতুল্য তাই সে সেখান থেকে এসে পরে। নিচে চলে যায়। নিচে সবাই মনমরা হয়ে বসে আছে। সবার মনে এখন কি ভলছে তা বলে বোঝানো অসম্ভব। এভাবেই রাত যেতে থাকে। মেহরাম সেখানে বসে কাদতে কাদতেই কখন যে চোখ লেগে এসেছে তা সে জানে না। চোখ খোলে ফজরের আজানের শব্দে। আলতো করে চোখ মেলে তাকায়। আশেপাশে তাকিয়ে দেখে পুরো ঘরে তনুর জিনিসগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এগুলো মেহরামই করেছে। মেহরামের কেন যেন মনে হলো যে তনু তার পাশেই বসে আছে আর “মেহরু” “মেহরু” বলে ডেকে যাচ্ছে। মেহরাম এখনো কাবার্ডের সাথে হেলান দিয়ে নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে আছে। কাল সারাদিন রাত কান্না করে চোখ গুলো আজ বড়োই ক্লান্ত। চোখ মুখ সব ফুলে একাকার হয়ে গেছে। তাই চোখে মেলে তাকাতেও ব্যাথা পাচ্ছে। কিন্তু কানে ওই তনুর হাসি শব্দ মেহরামকে ডাকার শব্দ সব কানে ভেসে আসছে। মেহরাম আবার ফুপিয়ে কেদে ওঠে। ফোলা ফোলা চোখ গুলো দিয়ে পানি পরে যায়। বাইরে থেকে জানালার পর্দা ভেদ করে খানিক রোদ রুমের ভেতরে এসেছে। দিন টা অনেক চড়া। রোদ প্রখর। হঠাৎ মেহরামের হাত টা তার পেটের ওপর যায়। মাথা নামিয়ে এক নজর পেটের দিকে তাকিয়ে আবার ঠিক আগের মতোই বসে থাকে। তখনই দরজাতে কড়া নাড়ার শব্দ আসে। মেজরাম সেদিকে ক্লান্ত নয়নে তাকিয়ে থাকে।





❤💔চলবে~~

#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ২৯

🖤✨



দরজাতে কারো কড়া নাড়ার শব্দ কানে এলে মেহরাম সেদিকে ক্লান্ত নয়নে তাকায়। এখান থেকে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিতে বড্ড অনিচ্ছা করছে তার। তবুও নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে বিছানা-দেওয়াল এইসব কিছু ধরে ধরে কোন রকমে উঠে দাঁড়ায়। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। দরজা খোলে দাড়াতেই দেখে মেহরামের আম্মু দাঁড়িয়ে আছে। মেহরাম দরজা খোলে এক নজর তার মায়ের দিকে তাকিয়ে আবার রুমের ভেতরে এসে পরে। কনিকা রুমের ভেতরে এসে পরে। এসেই দেখে তনুর সব জিনিসপত্র সারা ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। বেশ বুঝতে পারলো যে এগুলো মেহরাম ছাড়া আর কেউই করে নি। সারা টা রাত যে তনুর এই সব জিনিস গুলো নিয়েই পার করে দিয়েছে তা টের পাওয়া যাচ্ছে। সারা ঘরে একবার নজর দিয়ে কনিকা আবার মেহরামের দিকে তাকায়। দেখে যে বারান্দায় গিয়ে বড়ো দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মেহরাম। কনিকা এগিয়ে গিয়ে তার দিকে যায়। মেহরামের কাধে হাত রাখে কিন্তু তবুও যেন মেহরামের কোন হুস নেই। সে তার চিন্তায় মগ্ন।

কনিকা;; মেহরাম…..!

মেহরাম;; যদি এই দুনিয়াতে আসার আগে খোদার সাথে কথা বলার মতো কোন রাস্তা বা পথ থাকতো তাহলে আমি খোদার কাছে এটাই চাইতাম যে আমাকে যেন এই দুনিয়াতেই না পাঠানো হয়। আমি আসতামই না।

কনিকা;; এমন বলে না মা।

মেহরাম;; খুব বাজে ভাবে আমি ভেংে গেছি মা। খুব ভয়ানক ভাবে। আমি আমার কল্পনাতেও কখনো ভাবি নি যে আমার সাথে কখনো এগুলো হবে। এই সমস্ত কাহিনী গুলোর সাথে আমাকে একদিন না চাইতেও মুখোমুখি হতে হবে।

কনিকা;; ভাগ্যে সবকিছু লিখা থাকলে হোক তা অতি জলদি বা দেরিতে ভোগ করতেই হয়।

এবার মেহরাম মাথা ঘুড়িয়ে তার মায়ের দিকে তাকায়।

মেহরাম;; কেন এগুলো লিখা ছিলো। এ আমার কোন জন্মের শাস্তি। কি এমন করেছিলাম তার ফল আমায় এভাবে ভোগ করতে হচ্ছে। এর থেকে ভালো হতো যদি আমিই আগে মরে গেতাম। অন্তত এগুলো তো সহ্য করতে হতো না

কনিকা;; এগুলো বলে না। তুই তো আর এখন একা না তাই না।

মেহরাম;; হ্যাঁ আমি মেহরাম তো সেই কবেই মারা গিয়েছি এখন শুধু আমি আমার বাচ্চার জন্যই বেচে আছি। নয়তো তোমরা কেউ জানতেই না যে আদৌ মেহরাম নামে কেউ আছে কি নেই।

কনিকা;; এখানে কারো কোন হাত নেই। আল্লাহ যা চান তাই হয়েছে।

মেহরাম;; এমন না চাইলেও পারতেন।

কনিকা;; করার কিছুই নেই রে মা। মেনে নে সবকিছু।

মেহরাম;; মেনে তো সেই কবেই নিয়েছি মা। যা হচ্ছে যেমন হচ্ছে সব মেনেই নিয়েছি।

কনিকা;; মা তুই….

মেহরাম;; তনুকে মিস করছি মা 🥺। নিজেকে কেমন ফাকা ফাকা লাগে। কি যেন নেই। কেমন এক শূন্যতা কাজ করে। ব্যাপার টা এমন যে সব থেকেও আমার কিছুই নেই। আমি মেনেই নিতে পারছি না যে আমার তনু এখন আর নেই। আমার বিশ্বাস হয়না।

কনিকা;; তুই না আমার ভালো মেয়ে। এভাবে কাদিস না। সব আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে।

মেহরাম;; চাচি কোথায়?

কনিকা;; নিচেই রয়েছে।

মেহরাম;; চাচ্চু & আকাশ?

কনিকা;; সবাই আছে।

মেহরাম;; হুমম।

কনিকা;; আয়ুশও নিচেই আছে।

মেহরাম;; হুম।

কনিকা আরো টুকটাক কথা বলে মেহরামের কাছ থেকে এসে পরে। মেহরাম সেই একই ভাবে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে কিছুক্ষণ পর রুমে এসে পরে। তারপর নিজ হাতে সারা ঘর পরিষ্কার করে ফেলে। তবে তনুর জিনিস গুলো সব গুছিয়ে এক সাইডে রেখে দিয়েছে। পুরো ঘর গোছানো শেষে এবার তনুর জিনিস গুলোর কাছে বসে। তারপর চোখের পানি মুছে তনুর সব কাপড় আর বাকি জিনিস গুলো গুছিয়ে ফেলে। তারপর আলাদা বড়ো এক কার্বাডে রেখে দেয়। কার্বাড টাতে শুধু তনুর জিনিসপত্র। আর বাকি কারো কোন কিছুই নেই। মেহরাম খুব যত্নের সাথে গুছিয়ে সেগুলো রেখে দেয়। গোছানোর পর কার্বাড সম্পূর্ণ নিজের সামনে মেলে দাঁড়িয়ে থাকে। ভেজা ভেজা চোখে নিজের হাত দিয়ে এক এক করে সব জিনিস গুলো ছুইয়ে দেয়। তখনই রুমে আয়ুশ আসে। এসেই দেখে মেহরাম তনুর একটা জামা হাতে নিয়ে বুলাচ্ছে আর কাদছে। সাথে সাথে আয়ুশের চোখজোড়াও ভিজে ওঠে। চোখের পানি গুলো মুছে দরজাতে নক করে।

আয়ুশ;; মেহরাম…

মেহরাম;; হুম এসো।

আয়ুশ;; কি করছো?

মেহরাম;; নিজেকে গুছাচ্ছি।

আয়ুশ;; নিচে চলো।

মেহরাম;; ইচ্ছে করছে না।

আয়ুশ;; সবাই বসে আছে তোমার জন্য।

মেহরাম;; কেন?

আয়ুশ;; এমনি।

মেহরাম;; আসছি

আয়ুশ;; তনু….

মেহরাম;; না, একদম না। আমি তনু কে মিস করছি না। ও চলে গেছে আমাকে ছেড়ে। একটা বার ভাবলো না যে ওকে ছাড়া আমার কি হাল হবে। আমি কি করে একা থাকবো। তো আমি ওর কথা কেন মনে করবো। মনে করে শুধু নিজে কষ্ট ছাড়া আর কিছুই পাবো না। তনু জানতো যে ওকে ছাড়া আমি আমার একটা দিন পর্যন্ত থাকতে পারবো না। তারপরও আমাকে একা ছেড়ে চলে গেছে।

আয়ুশ;; তনু যায় নি, তনু আছে। তোমার কাছেই আছে। তনু তোমাকে ছাড়া থাকতে পারবে এটা তুমি কি করে ভাবলে। তুমি যেমন তনু কে ভালোবাসো ঠিক তেমনই তনুও তোমায় ভালোবাসে।

মেহরাম;; এতোই যখন ভালোবাসে তাহলে চলে গেলো কেন। ও আমার সাথে আছে তাহলে কেন আমি ওকে ধরতে পারি না, ছুতে পারি না, দেখতে পারি না।

আয়ুশ;; অনুভব করতে পারো..?!

মেহরাম;; হ্যাঁ

আয়ুশ;; অনুভবেই মিশে আছে তোমার বোন।

মেহরাম;; একটা বার শুধু একটা বার কি আমার সাথে কথা বলতে পারলো না, শুধু একটা বার। আমি শেষ বারের মতো ওর সাথে একটু কথা বলতাম, শেষ বার। শেষবার আমাকে একটু মেহরু বলে ডাকতো।

আয়ুশ;; তুমি জানো ও এখনো তোমাকেই দেখছে। এখন যদি তনু দেখে যে তুমি কাদছো তাহলে কেমন লাগবে। তনু তোমাকে কাদতে না বলেছিলো তাই না কারণ তুমি কাদলে তো বেবি সহ কাদবে আর তুমি হাসলে বেবিও হাসবে তাই না। আর তুমি তো এটাও জানো যে তনু বেবি কে কত্তো ভালোবাসে তাই না।

মেহরাম;; হ হহ্য হ্যাঁ।

আয়ুশ;; তাহলে চোখের পানি মুছে ফেলো দ্রুত।

মেহরাম;; হুম।

আয়ুশ;; এবার এগুলো রেখে জলদি নিচে এসো কেমন।

আয়ুশ এই বলেই চলে আসতে নিলে মেহরামের ডাকে আবার থেমে যায়। আয়ুশ পেছন ফিরে মেহরামের দিকে তাকায়।

মেহরাম;; আয়ুশ…!

আয়ুশ;; হুমম

মেহরাম;; আমাকে একটু ত, ততনুর কাছে নিয়ে যাবে?

আয়ুশ;; অবশ্যই।

এই বলেই আয়ুশ বের হয়ে পরে। মেহরাম তার যাওয়ার দিকে খানিক তাকিয়ে থেকে আবার তনুর জামাটার দিকে তাকায়। এখনো হাত থেকে তা রাখেই নি। তনুর জামাটা নিজের সামনে তুনে গালের ওপর রাখে। চোখ বন্ধ করে গালের সাথে লাগিয়ে রাখে। মনে হচ্ছে এইতো তনু এসে তাকে জড়িয়ে ধরে আছে আর মুচকি হাসছে। তনুর গায়ের গন্ধ লেগে আছে এতে। এগুলোতে এখন সে তনুকে খুঁজে পায়। মেহরাম খানিক পর তা রেখে দেয়। কার্বাডের ভেতরে ফ্রেমে তনুর একটা হাসি মাখা ছবি আছে। মেহরাম তার দিকে তাকিয়ে থেকেই কার্বাডের দরজা টা বন্ধ করে দেয়। তারপর রুমের দরজা খোলে বাইরে বের হয়ে পরে। গেতেই দেখে তার চাচি বসে আছে। মেহরাম গিয়ে সোজা তার চাচির পাশে বসে পরে। মেহরাম গিয়ে বসতেই তার চাচি তাকে জড়িয়ে ধরে।

মেহরাম;; চাচি

আতিয়া;; মারে একটা মেয়ে আমাকে রেখে চলে গেছে। তুই জাস না। আমি মরেই যাবো। আমার তনু আমাকে রেখে চলে গেছে রে। আমার মেয়ে। ওও মেহরাম তনু তো তোর সব কথা শুনে ওকে এক বার বল না আমার কাছে আসতে। একটা বার বল তার মায়ের কাছে আসতে। ও জানে না যে ওর মা কি হালে আছে ওকে ছাড়া। ও মেহরাম

.
.

মেহরাম নিজেই জানে না যে এখন তার চাচি কে ঠিক কি বলে বুঝাবে। অবশেষে কনিকা গিয়ে মেহরামের চাচি কে ধরে। অনেকক্ষন বলে বুঝিয়ে আতিয়া কে শান্ত করা হয়। প্রেসার বেড়ে গেছে উনার। মেহরামের মা কোন রকমে ধরে ধরে নিয়ে তাকে রুমে নিয়ে গেছে। মেডিসিন খাইয়ে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। এভাবেই সময় যেতে থাকে। বাড়িতে কারো মনের অবস্থাই ভালো না। সবাই মনমরা হয়ে বসে আছে। কারো মুখ দিয়ে কোন খাদ্য দানা কিছুই যাচ্ছে না। আয়ুশ অনেক বার তার বাড়িতে ফোন দিয়েছিলো। আয়ুশের সাথে কণা আর তার মায়ের অনেক কথা হয়েছে। আয়ুশ বাড়িতে যেতে চেয়েছিলো কিন্তু তার মা তাকে না বলে দিয়েছে। এই বাড়িতে এখন সবার আয়ুশের দরকার। এখন চলে গেলে কেমন দেখায় তাই এখানেই থেকে গেছে। দেখতে দেখতে বিকেল গড়িয়ে এলো। আয়ুশ মেহরামকে নিয়ে তনুর কবরের পাশে এসেছে। কবরস্থানের কাছে গেতেই আয়ুশ থেমে যায় কিন্তু মেহরাম না। সে গেট টা খুলে ভেতরে চলে যায়। এবার সাথে আয়ুশও যায়। মরুভূমিতে দীর্ঘক্ষণ কেউ পানি ছাড়া তৃষ্ণাময় থাকলে অবশেষে যখন পানি পায় তখন তাকে দেখে মনে হয় যেন তার জীবন ফিরে পেয়েছে। এখন এই মূহুর্তে মেহরামকে দেখেও ঠিই তেমন মনে হচ্ছে। তনুর কবরের কাছে যেতেই হালকা ভাবে দৌড় দিয়ে সেখানে চলে যায়। গিয়েই পাশে হাটু ভাজ করে বসে পরে। কিছুটা ঝুকে যায়। বৃষ্টি হয়েছে, কবরের ওপরের মাটি গুলো কেমন ভেজা ভেজা। মেহরাম সেখানে হাত দিয়েছে তাই মাটি গুলো হাল্কাভাবে তার হাতে লেগে যায়। সেই হাত টা নিজের মুখের কাছে আনে মেহরাম। মনে হচ্ছে যেন তনু তাকে ছুইয়ে দিলো।

মেহরাম;; তনু, তনু তুই না বলতি যে আমরা একসাথেই থাকবো। যেখানেই থাকি। সবসময় পাশাপাশি থাকবো। মরে গেলেও একসাথে ভূত হয়ে থাকবো। সবাইকে ভয় দেখাবো। কিন্তু, কিন্তু তুই তো চলে গেলি আগেই। এটা এটা কেমন হলো বল। এটা কিন্তু ঠিক না। জানিস চাচি তোর জন্য কত্তো কান্না করে। প্রেসার বাড়িয়ে দিয়েছিস তুই আমার চাচির। তোর তো সাহস কম না। তনু, তনু একটা বার উঠে পর না। উঠে সবাইকে ভুল প্রমাণ করে দে যে বাকি যারা বলছে তারা সবাই মিথ্যা বলছে। তনু, প্লিজ তনু…….

.
.

মেহরাম এভাবেই তনুর পাশে একা একাই কথা বলতে থাকলো। আয়ুশ খানিক দূরে দাঁড়িয়ে দুহাত ভাজ করে মেহরামের এই অবস্থা দেখছে। অন্যপাশে ঘুড়ে চোখের কোণায় পানি গুলো মুছে নিলো। একসময় মাগরিবের আজান পরে গেলো। রাস্তার পাশ দিয়ে দুই-একজন হুজুর যাচ্ছিলো। তারাও মেহরামের এই অবস্থা দেখলো। তারা মেহরামকে কে চেনে। কারণ তনুর মৃত্যুর দিন তারাও সেখানে ছিলো। এক নজর মেহরামকে দেখে তারাও মাথা নামিয়ে দুঃখ প্রকাশ করলো।

আকবর আলী;; আহারে মেয়েটা, বোনটা মারা গেছে গতকালই। গিয়েছিলাম আমি ওদের বাড়িতে। মা তো মা ই হয়। তবে আমার সব থেকে খারাপ লেগেছে এই মেয়েটাকে দেখে। মেয়েটা অন্তঃস্বত্বা। জানেন ইমাম সাহেব, আমি আমার জীবনে কখনো দেখি নি যে কেউ তার বোন কে এতো ভালোবাসতে পারে।

ইমাম সাহেব;; জীবন & মৃত্যুর মালিক আল্লাহ। কিছু করার নেই। খারাপ লাগারই কথা। তবে ওই ছেলেটা কে যে দাঁড়িয়ে আছে?

আকবর আলী;; জ্বি উনি হয়তো মেয়েটির জামাই।

ইমাম আলী;; আহারে। এসো দেখি একটু যাই।

আকবর আলী;; জ্বি

তারা দুইজন গিয়ে আয়ুশের পাশে দাড়ালো। আয়ুশ পেছন ঘুরে তাদের দেখলো। দেখেই তাদের সালাম দিলো। তারা সালাম নিয়ে কথা বলতে থাকলো।

ইমাম সাহেব;; বাবা এই সন্ধ্যা বেলা এখানে না থেকে বাড়ি যাও।

আয়ুশ;; জ্বি আসলে কবর টা একটু দেখতে এসেছিলাম।

ইমাম সাহেব;; মেয়েটি গর্ভবতী, এই সন্ধ্যায় এভাবে কবরস্থানে থাকাটা বেশি একটা ভালো হবে না বাবা। তাই তুমি যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব চল যাও।

আয়ুশ;; জ্বি।

ইমামা সাহেব আর আকবর আলী তাকিয়ে দেখলো মেহরাম এখনো সেখানে বসে বসে কাদছে। তারা দেখে মন টা খানিক খারাপই করলো। আয়ুশ গিয়ে মেহরামকে আস্তে করে তুলে। চোখের পানি গুলো মুছে দিয়ে মেহরাম কে বুঝিয়ে বাড়ি নিয়ে এসে পরে। এসে দেখে বাড়ি ঠিক আগের মতোই। তবে তার চাচি উঠে গিয়েছে। কোন রকম সবাই কথা বলে যার যার রুমে চলে গেলো। পরেরদিন উঠেই আয়ুশ চলে যায় সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে। মেহরামের সাথে কথা হয়। এভাবে দেখতে দেখতে চলে যায় পুরো দুই সপ্তাহ। মেহরমের পেটের অবস্থা তেমন ভালো না। আর কিছুদিন গেতেই একদম দশমাসে পরে যাবে তার প্রেগ্ন্যাসি। আয়ুশের সাথে কথা হয় সবারই। তনু মারা যাবার পরও আয়ুশদের সাথে মেহরামের বাবার বাড়ির লোকজন দের মাঝে কোন ঝামেলা হয় নি। বরং তারা আগে যেমন ছিলো এখনো তেমনই। মেহরাম বসে বসে বই পড়ছিলো। তখনই আয়ুশ ছুটে মেহরামের কাছে আসে। এসেই মেহরামকে জড়িয়ে ধরে। মেহরাম ও জড়িয়ে ধরে আলতো করে। আকাশ ছোট মানুষ ও তো আর এতো কিছু বুঝে না। আকাশ এসেই বলে মেহরামকে নাকি নিচে সবাই ডাকছে জরুরী ভাবে। আর সবাই তার জন্য বসে আছে, একেবারে সবাই। আকাশ এই কথা বলেই চলে যায়। যাবার আগে মেহরামের কাছ থেকে এত্তো গুলো চকোলেট নিয়ে যায়। মেহরামও আস্তে করে নেমে একহাত পেটের ওপর রেখে গুটি গুটি পায়ে চলে যায়। গিয়েই দেখে আকাশ যা বলছিলো তা আসলেই সত্যি। সবাই একদম সারি ধরে বসে আছে। মন হচ্ছে সিরিয়াস কিছু। মেহরাম তাদের দেখে খানিক কপাল কুচকায়। কিন্তু আবার আস্তে করে নিচে নেমে পরে। নিচে নামতেই মেহরামের চাচি তাকে নিয়ে নিজের কাছে বসে পরে। মেহরাম শুধু চুপ করে বসে আছে সে বুঝতে পারছে না যে এরা সবাই এভাবে বসেই বা আছে কেন আর কিই বা বলবে। নীরবতা ভেংে অবশেষে বলা শুরু করে……





✨💖চলবে~~

তৈমাত্রিক পর্ব-২৬+২৭

0

#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ২৬

.
.
.

তনু মেহরামকে ডাকলে মেহরাম তার পাশে এসে বসে পরে। তনু কিছুক্ষণ মেহরামের দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর তার পেটের ওপর আস্তে করে হাতটা রাখে। আনমনেই হেসে ফেলে, তারপর আবার বলা শুরু করে।

তনু;; মেহরু..!

মেহরাম;; হুমমম

তনু;; আমার না জীবনে কখনো কিছু চাইতে হয়নি জানিস। কারণ চাবার আগেই তুই সব কিছু আমার কাছে এনে দিয়েছিস। কি আর চাইবো, আমার তো বলার প্রয়োজন টুকুও পরে নি আগেই সব বুঝে গেছিস।

মেহরাম;; হুমম।

তনু;; জানিস “” নিঃশ্বাস & বিশ্বাস এই দুটু জিনিস একবার হারিয়ে গেলে আর ফিরে পাওয়া যায় না। অনেকের থেকেও অনেক বেশি মূল্যবান এই দুটো জিনিস””।

মেহরাম;; এগুলো কেন বলছিস?

তনু;; আমি জানি না, আমার শুধু ভয় লাগছে। কখন কিনা কি হয়ে যায়।

মেহরাম;; আরে কিছুই হবে না, সব আগের মতোই ঠিক হয়ে যাবে।

তনু;; আগে কি কিছু ঠিক ছিলো..?! (মেহরামের দিকে তাকিয়ে)

মেহরাম;; পরিস্থিতি খারাপ করে দিলেও ঠিক থাকার দায়িত্ব টা কিন্তু আমাদের।

তনু;; আর যখন নিজেই ভেংে পরি তখন?

মেহরাম;; আবার উঠে দাড়াতে হবে এছাড়া উপায় নেই।

তনু;; হাহাহা…

মেহরাম;; হাসছিস কেন?

তনু;; সেই উঠে দাঁড়ানোর শক্তি বা ইচ্ছে কোনটাই আর আমার মাঝে নেই।

মেহরাম;; হয়েছে বকবক করা বন্ধ কর তো এবার।

তনু;; কবে থেকে কথা বলি না, মুখে এই ঘোড়ার ডিমের মাস্ক পরে থাকতে হয় ভালো লাগে না।

মেহরাম;; মাত্র ২-৩ দিন হয়েছে।

তনু;; ৪৮-৭২ ঘন্টা। কম মনে করলি এটা?!

মেহরাম;; হুমম।

তনু;; আর যাই হোক আমি ইহকাল আর পরকালে গিয়ে বলতে পারবো যে আর কিছু পাই বা না পাই একটা বোন যে পেয়েছি না। জীবনে আর কি লাগে।

মেহরাম;; দোয়া করি এমন বন যেন আর কারো ভাগ্যে না পরে।

তনু;; কেন? ওই যে একজনের ভালোবাসা আরেকজন কে দিয়ে দিবে তার জন্য বুঝি?

মেহরাম;; ঠিক তা না। আসলে একদম সত্যি কথা বলতে এই জেনারেশনে কেউ নিজের একটা পুরোনো জিনিস পর্যন্ত কাউকে দেয় না….

তনু;; আর সেখানে তুই তোর জীবন কেই আমার কাছে দিয়ে দিয়েছিস।

মেহরাম;; আমার জীবন তুই।

তনু;; একসময় আয়ুশ ছিলো আর এখনো আছে।

মেহরাম;; ________________

তনু;; মেহরু,

মেহরাম;; হ্যাঁ

তনু;; আমার যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে আমাকে মিস করবি না?

মেহরাম;; আল্লাহ বাচাইছে যে এখন তুই অসুস্থ তা না হলে চড় যে কতোগুলা খাইতি না একদম হিসাব ছাড়া।

তনু;; হ হ মাইরা মাইরা মাইরাই ফালা আমারে।

মেহরাম;; চুপ কর হারামি।

তনু;; মেহরু,

মেহরাম;; হুমম।

তনু;; এই দুনিয়ায় যে যতো বেশি স্বার্থপর সে ততো বেশি সাফল্যবান।

মেহরাম;; হুমমম।

তনু;; আমার না বুকের ধুকপুকানি ক্রমশ বেড়েই চলেছে। আমি তোর কাছে একটা জিনিস চাইবো দিবি?

মেহরাম;; কি বলছিস তুই, শুধু একবার বলে তো দেখ মুখ থেকে বলার আগেই পেয়ে যাবি বল।

তনু;; সত্যি?

মেহরাম;; অবশ্যই।

তনু;; মনে রাখিস এটা আমার শেষ চাওয়া তোর কাছে। আর এতে আর যাই হোক আমি খুশি থাকবো। অনেক বেশি খুশি।

মেহরাম;; তুই একবার বলে তো দেখ।

তনু;; ‘”তুই আর আয়ুশ এক হয়ে যা”’ (মেহরামের হাত ধরে)

তনুর এই কথা শুনে মেহরামের অন্তর-আত্না সব কেপে উঠলো। হাত গুলো কেমন যেন কাপছে। তনু একবার মেহরামের হাতের দিকে তাকিয়ে আবার তার দিকে তাকায়। মেহরাম ফট করে মাথা তুলে তনুর দিকে তাকায়। চোখের কোণে পানি জমেছে।

মেহরাম;; তনু, তনু এমনটা হয় না রে।

তনু;; কেন হয় না?

মেহরাম;; _________________

তনু;; সবাই এই ব্যাপার টা জানে। আর সত্যি বলতে তুই হ্যাপি নেই।

মেহরাম;; তুই তো আছিস।

তনু;; না নেই আমি, আগে ছিলাম এখন না। কারণ আমি আর নিতে পারছি না। এগুলো কুড়ে খায় আমাকে। তোর মতো এতো বেশি ধৈর্য আমার মাঝে নেই। আমি পারবো না, আমি পারবো না সারাজীবন আয়ুশের চোখে তোর জন্য ভালোবাসা দেখতে। যেটা আমার নামে কখনোই ছিলো না। তবে আমি এটা বলতে পারবো যে আয়ুশের মতো লাইফ পার্টনার যে পাবে সে সত্যি অনেক লাকি। এতো কিছু হবার পরেও আয়ুশ কখনোই আমার সাথে উচু গলায় কখনো কথা বলে নি। শুধু সেইদিন অফিসে একটু কথা কাটাকাটি হয়েছে। সেইদিন দুজনেরই মাথা গরম ছিলো আর লেগে গেলো। মেহরাম আমি আর কিছুই চাই না, কিচ্ছু না প্লিজ তুই এই কাজ টা করে দে। আমার জন্য হলেও আয়ুশের হয়ে যা। ছেলে টা শেষ হয়ে গেলো, গেছেও। আমি জানি সব করেছিস আমার জন্য কিন্তু সব জানার পর খুব বেশি অপরাধ বোধ কাজ করে নিজের মাঝে।

মেহরাম;; এমন হয় না তনু।

তনু;; কেন হয় না। হবে তো তুই চাইলেই সব হবে। একটা বার হ্যাঁ বলে দে।

মেহরাম;; শোন এই সব বকা বন্ধ করে, কিছুই হবে না তোর তুই একদম আগের তনু হয়ে যাবি। আর বাসায় যাবি। আগের মতোই থাকবি আর আয়ুশের সাথে যা কথা কাটাকাটি হয়েছে সব মিটমাট করে নিবি। এখানে আমি, আমি কোথা থেকে এলাম।

তনু;; তুই ছিলি, তুই আছিস আর তুই-ই থাকবি। না চাইলেও আয়ুশ আর আমার মাঝে অনেক দূরত্ব এসে পরেছে রে মেহরু। আমি আয়ুশ কে আর তুমি বলে ডাকি না, আপনি ডাকি। সুই-এর মতো খোচা লাগে আমার। ওই যে কথায় আছে না “” আমি পাই না ছুতে তোমায়, আমার একলা লাগে ভারি “”। ঠিক তেমন।

মেহরাম;; রেস্ট নে।

মেহরাম সেখান থেকে উঠে চলে আসতে নিলে তনু মেহরামের আচল খামছে ধরে। মেহরাম পেছন ফিরে তাকায়।

তনু;; তোর এই আচল খামছে ধরার অভ্যাস আমার কখনোই যাবে না।

মেহরাম;; না যাক থাকুক।

তনু;; আর আমিই যদি না থাকি তাহলে..!!

মেহরাম;; যাবি কোথায় টেনে নিয়ে আসবো।

তনু;; আমি থাকি বা না থাকি তোর মুখে যেন হাসি থাকে। আমি দেখবো আর বলতে তো পারবো যে না মহান গিরি খালি তুমি দেখাও নি আমিও দেখিয়েছি।

তনুর কথায় মেহরাম হেসেই দেয়।

তনু;; মেহরু কথা টা মাথায় রাখিস, আমি সত্যি মন-প্রাণ থেকে যাই তুই আর আয়ুশ যেন একসাথে থাকিস। জেলে কোন আসামী কেও মৃত্যুদন্ড দিলে তার জীবনের শেষ ইচ্ছে জিজ্ঞেস করা হয়। তুই আমাকে জিজ্ঞেস তো করিস নি কিন্তু আমিই বলে দিয়েছি।

মেহরাম;; হ্যাঁ আমি জিজ্ঞেস করিনি কারণ আমি জানি যে তোর কিছুই হবে না।

তনু;; হোক বা না হোক, আমি চাই তোরা দুজন এক হয়ে যা।

মেহরাম চলে যেতে নিলে তনু আবার থামিয়ে দেয়।

তনু;; মেহরাম প্লিজ,, আ আমি আমি আর পাপারছি না, পপ্লিজ কথা টা শোন। আম আমার কিকিইছু হয়ে যাবে। প্লিজ আয়ায়ুশ কে এএভাবে কস কষ্ট দিদিস না। হয়ে যা না ওর। (শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে)

মেহরাম;; আল্লাহ, তনু তোর অবস্থা খারাপ হচ্ছে। ডাক্টার মানা করেছে বেশি কথা বলতে আর তুই সেই কখন থেকে বকবক করেই চলেছিস। প্লিজ চুপ কর।

মেহরাম কোন উপায় না পেয়ে জলদি ডক্টার কে ডেকে আনে। ডক্টর এসে অক্সিজেন মাস্ক টা মুখে পরিয়ে দেয়। কেননা এতোক্ষণ তা খোলা ছিলো। নার্স এসে ইঞ্জেকশন দিয়ে দেয়। মূহুর্তেই তনু শান্ত হয়ে যায়। মেহরাম সব বাইরের কেবিন দিয়ে দেখছিলো। ডাক্তার বাইরে বের হলে মেহরাম খানিক সরে দাঁড়ায়।

ডাক্তার;; অক্সিজেন মাস্ক টা খুলতে বারবার বারণ করি কিন্তু উনি শুনেই না। উনার তীব্র শ্বাসকষ্ট আছে। বেশিক্ষণ এভাবে থাকলে হীতে বিপরীত হবে।

মেহরাম;; জ্বি।

ডাক্তার চলে গেলেন এগুলো বলেই। মেহরাম আরেকবার তনুর কেবিনের দিকে উকি দিয়ে তারপর এসে বসে। পেটের ওপর এক হাত দিয়ে বসে আছে। কেন জানি বারবার কানের কাছে ঘুরেফিরে তনুর বলা কথাগুলোই আসছে। আর তনুর জন্য না চাইতেও এক অজানা ভয় মনের মধ্যে এসে বাসা বাধছে। এরই মধ্যে আয়ুশ আসে, এসেই দেখে মেহরাম বসে আছে। বেশ চিন্তিত লাগছে। আয়ুশ হেটে মেহরামের কাছে চলে যায়। আয়ুশ যে এসে মেহরামের পাশে দাঁড়িয়ে আছে তার প্রতি মেহরামের কোন খেয়ালই নেই, সে এতো টাই চিন্তায় মগ্ন রয়েছে।

আয়ুশ;; মেহরাম?

মেহরাম;; আব..হ হ্যাঁ এসেছো।

আয়ুশ;; হ্যাঁ, কি হয়েছে। Is everything Okay?! (তনুর কেবিনের দিকে তাকিয়ে)

মেহরাম;; হ্যাঁ সবকিছুই ঠিক আছে।

আয়ুশ;; মনে হচ্ছে না।

মেহরাম মাথা তুলে আয়ুশের দিকে তাকায়। আয়ুশ এসে মেহরামের পাশে বসে পরে।

আয়ুশ;; কি হয়েছে?

মেহরাম;; তনু পাগলামি করছে।

আয়ুশ;; মানে?

মেহরাম;; কিছু না।

আয়ুশ;; খেয়েছো কিছু?

মেহরাম;; খিদে নেই।

আয়ুশ;; তনু কেমন আছে?

মেহরাম;; বেশি কথা বলছিলো তাই আবার একটু শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো। নার্স আর ডাক্তার এসে দেখে গেছে।

আয়ুশ;; ওহহ,

মেহরাম;; খালামনি & কণা কেমন আছে?

আয়ুশ;; আলহামদুলিল্লাহ সবাই ভালো।

মেহরাম;; হুমম।

এভাবেই সেই সময় টুকু চলে যায়। হস্পিটালে কুসুম বেগম এসেছিলেন তনু কে দেখতে। এসেই আয়ুশ, মেহরাম, তনু সবার সাথেই কথা হয়। কিছুক্ষণ থেকে আবার চলেও গেছে। মেহরাম গিয়ে তনু কে খাইয়ে দেয়।

মেহরাম;; আরেকবার খা এই শেষ বার।

তনু;; আমাকে এভাবে ঠেসে ঠেসে খাওয়াচ্ছিস। অথচ নিজে খাস নি কিছুই।

মেহরাম;; আরে হলো তো, তুই খা।

তনু;; মেহরু

মেহরাম;; জ্বি বলেন আমি শুনছি। (বেংঙ করে)

তনু তখন কিছু না বলে একদম চুপ করে থাকে। সামান্য উঠে বসে মেহরাম হেল্প করে তাতে। খাবারের বাটি সব রেখে এসে মেহরাম আবার তনুর কাছে বসে। মেহরাম গিয়ে দেখে তনু মাথা নিচু করে হেলান দিয়ে আছে।

মেহরাম;; কিরে কি হয়েছে?

তনু মেহরামের একটা হাত তার দুই হাতের মাঝখানে কোন রকমে এনে জড়িয়ে ধরে। চোখের পানি ছেড়ে দিয়েছে তনু। এক প্রকার হাউমাউ করে কেদে দিয়েই তনু বলে ওঠে…

তনু;; প্লিজ মেহরাম, প্লিজ আয়ুশের হয়ে যা। আমি তোর কাছে অনুরোধ করছি। প্লিজ আমার এই কথা টা রাখ, এভাবে তিলে তিলে মরার থেকে ভালো তো আমি একেবারেই মরে যাই। প্লিজ মেহরু প্লিজ আয়ুশের হয়ে যা। প্লিজ।

মেহরাম নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে কোন রকমে ঠিক হয়ে বসে। তনুর চোখের পানি গুলো টলমল করছে, সেগুলো মুছে দেয়।

মেহরাম;; তুই শুয়ে থাক ঘুমানোর চেষ্টা কর।

তনু;; __________

মেহরাম তনু কে শুইয়ে দিয়ে কেবিনের বাইরে চলে আসতে ধরে। তখনই তনু আবার নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে গলা খাকাড়ি দিয়ে বলে ওঠে….

তনু;; যদি আমাকে কখনো একদিন এক মিনিটের জন্য হলেও নিজের বোন ভেবে থাকিস তাহলে মেহরাম তুই আয়ুশের হয়ে যাবি।

সামনে একদম স্থীর চোখে তাকিয়ে তনু কথা টা বলে উঠলো। কেন জানি মেহরাম বাইরে পা রাখিতে গিয়েও রাখতে পেলো না। একবার মাথা ঘুড়িয়ে তনুর দিকে তাকালো। দেখে তনু শুয়ে আছে। মেহরাম আবার গিয়ে অক্সিজেন মাস্ক তা সুন্দর করে লাগিয়ে দিয়ে এসে পরে। তনু তার চোখ গুলো বন্ধ করে ফেলে। মেহরাম বাইরে গেতেই আয়ুশকে দেখে। মেহরামেকে দেখে আয়ুশ দাঁড়িয়ে পরে। আয়ুশ খেয়াল করে মেহরামের চোখের পানি চিকচিক করছে যেন এই পরে গেলো। আয়ুশের মনে ভয় ঢুকে গেলো যে এই দুই বোনের মাঝে আবার কিছু হলো না তো। তাই আয়ুশ আবার মেহরামকে কিছু বলতে যাবে তখনই মেহরাম আবার বলে ওঠে….

মেহরাম;; “” মন & মস্তিষ্কের মাঝে যে কোন একটা কে চুস করা অনেক কঠিন “”। মস্তিষ্কের কথা শুনলে নিজের কাছে নিজেকে ঝুকে যেতে হয়। মনে হয় নিজের সাথে বড্ড বেশি অন্যায় করে ফেলেছি। আর যদি মনের কথা শুনি তাহলে বাকি সব কিছু বেমানান লাগে। তাহলে কি করবো?

আয়ুশ মেহরামের দিকে কয়েক কদম এগিয়ে যায়।

আয়ুশ;; যখন তুমি তোমার এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে, সীমাহীন কষ্ট নিয়ে রাতের অন্ধকারে একলা ঘরের কোণে বসে থেকে দুঃখবিলাশ করবে তখন মনে হবে হয়তো মনের কথা শুনলে ভালো হতো। তুমি নিজে খুশি থাকতে। কারণ আমাদের আশে পাশের লোক-সমাজ এমনই,, তুমি লোকে কি ভাববে তা ভেবে যদি নিজের ইচ্ছেকে তুচ্ছ ভেবে কাজ করো তাহলে নেহাত তুমি নিজের সাথে অন্যায় করছো। আর যদি নিজের ইচ্ছে কে প্রাধান্য দিয়ে নিজের মনের কথা শোন হ্যাঁ তাহলে হয়তো মানুষ কিছু কথা বলবে তবে আবার চুপও হয়ে যাবে। আর হ্যাঁ সেই রাতের গভীর আঁধারে তোমাকে ঢুকরে মরতে হবে না রোজ রোজ। তুমি নিজে খুশি থাকতে পারবে। মনে রেখো “” পাছে লোকে কিছু বলে””।

মেহরাম;; কিন্তু তনু..?

আয়ুশ;; কি হয়েছে তনুর?

মেহরাম;; কিছু না ভালো লাগছে না আমার।

আয়ুশ;; একটু বসে থাক।

মেহরাম;; আয়ুশ!

আয়ুশ;; হ্যাঁ

মেহরাম;; _____________

আয়ুশ;; অনেক সময় কিছু কথা মুখ ফুটে আমরা বলতে পারি না। সমস্যা নেই তুমি মনে মনে বলতে পারো।

মেহরাম;; _____________


মেহরাম আর আয়ুশ এভাবেই বসে থাকে। আসলে আয়ুশ জানে যে মেহরাম তাকে ঠিক কি বলতে চায়। কারণ আয়ুশ তনু আর মেহরামের সব কথা শুনেছে। পরে আয়ুশ সেখান থেকে দূরে গিয়ে কেদেও এসেছে। তারপর আবার চোখে মুখে ইচ্ছে মতো পানি। যেন কেউ না বুঝে। আয়ুশের এখন ইচ্ছে করছে মেহরাম কে চিল্লিয়ে বলতে যে “” হয়ে যাও না আমার, অনেক তো অন্যের জন্যে করলে এবার একটু আমার কথা টা ভাবো। জেদের বশে তো আমিও তনুকে বিয়ে করে ফেলেছিলাম। বুঝি নি, কারো কথা ভাবি নি। এবার একটু না হয় ভাবলাম। হয়ে যাও আমার “”। কিন্তু আমরা যা ভাবি তা যদি সত্যিই বলতে পারতাম তাহলে জীবন টা কতোই না সোজা হয়ে গেতো। ওদিকে তনুর চোখে ঘুম নেই। অথচ তাকে মেডিসিন দেওয়া হয়েছে ঘুমের কিন্তু ঘুমের ছিটেফোঁটাও নেই। তনুর দম বন্ধ হয়ে আসছে। চোখের সামনে শুধু বার বার মেহরাম & আয়ুশের মুখখানা ভাসছে। ডাক্তার রেস্টে রেখেছে তনুকে। তাই বলেছে এই সময়ে তনুর কেবিনে কারো প্রবেশ করা অর্থাৎ কারো এখন এই মূহুর্তে দেখা না করা টাই ভালো হবে।

তনু;; আমি শুধু মুক্তি চাই, আর কিচ্ছু না মুক্তি চাই আমি। এখান থেকে এই জীবন থেকে। আমি একা কোথাও চলে যেতে যাই। আর আসবো না এখানে। আমি চলে যেতে যাই। কিন্তু আমি আমার বোন কে অনেক ভালোবাসি (মনে মনে)

তনুর যেন এখন রাগ হতে লাগলো মুখের এই অক্সিজেন মাস্কের ওপর। ৩ দিন ধরে পরে থাকতে থাকতে আর ভালো লাগে না। জাস্ট তিক্ততা এসে পরেছে এর ওপর। তনু পাশে তাকিয়ে দেখে নার্স তার হাতের পেট বই টা রেখে গিয়েছে। পাশে একটা কলমও আছে। তনু তা একটু টানা দিয়ে হাতে নিয়ে নেয়। খুব কষ্টে কিছু একটা লিখে নিজের পাশেই রেখে দেয় আবার। এবার তনু তার মুখ থেকে আলতো করে মাস্ক টা খুলে ফেলে। মুখ থেকে মাস্ক টা হাতে নিয়ে শুয়ে থাকে ওপরের দিকে তাকিয়ে। এবার যেন সে আগে থেকে ভালো বাইরে নিঃশ্বাস নিতে পারছে। বুক ভরে শ্বাস নিতে লাগলো সে। এভাবেই থাকতে থাকতে তনু এক সময় নিজের চোখ গুলো বন্ধ করে ফেলে। মাস্ক টা হাতে রয়েছে। মনে হচ্ছে আগে থেকে তনু অনেক শান্তি পাচ্ছে এখন।





🖤চলবে~~

#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ২৭

.
.
.

তনু মুখের ওপর থেকে মাস্ক টা খুলে নিলো। বাম হাতের ওপর মাস্ক টা নিয়ে বেডে রেখে দিয়েছে। যদিও শ্বাস তেমন ভাবে নিতে পারছে না কিন্তু তবুও বুকভরে শ্বাস নেওয়ার প্রচুর ব্যার্থ চেষ্টা তার। চোখ গুলো কেমন নিভু নিভু হয়ে এসেছে। কিন্তু এতে তার কষ্ট না যেন আরাম লাগছে। মনে হচ্ছে মুক্তি পাচ্ছে সব রকম কষ্ট থেকেই। আর ভালো লাগে না কিছুই। তার মনে হচ্ছে এই মাস্ক টা যদি সে অনেক আগেই খুলে দিতো তাহলে আরো আগেই সবকিছু থেকে মুক্তি পেয়ে যেতো। চোখের সামনে বারবার মেহরামের ওই হাসিমাখা মুখটা ভাসছে। তনু এবার একটু চোখ মুখ কুচকে আবার স্পষ্ট দৃষ্টিতে চোখ মেলে তাকায়। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে আর শূন্যে তাকিয়ে আছে। আগের দিনের কথা গুলো অনেক মনে পরছে। সেই ভার্সিটি লাইফের কথা গুলো। মেহরামের সাথে মারামারি কথা, তার পেছনে ছুটা, একসাথে এত্তো হাসাহাসি কথা সেইসব কিছুর শব্দ যেন কানে এসে লাগাতার বারি খাচ্ছে। চোখের সামনে সবকিছু আজ সাদা-কালো হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। খানিক হেসে ওঠে সে। দম যেন ক্রমশ খাটো হয়েই আসছে। আরেকবার চোখ বন্ধ করে বুকে ভরে শ্বাস জোড় করে নেয়। তবে এবার যেন আর সে পারছে না। চোখ বন্ধ হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। মাথা টা একদম আস্তে করে একটু কাত করে হাতে থাকা মাস্ক টার ওপর এক নজর তাকায়। মূহুর্তেই তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে ওঠে সে। কষ্ট হচ্ছে ঠিকই কিন্তু মাস্ক টা তুলে যে আবার মুখের ওপর দিবে তার ইচ্ছেশক্তি কিছুই নেই। মন চাইছে এক নজর মেহরামকে দেখতে পারলে অনেক ভালো হতো। বেশি না হলেও কিছু কথা বলতে পারতো কিন্তু এখন নেই। চোখ ঘুড়িয়ে টেবলের ওপর তাকিয়ে দেখে সে যেই লেটার টা লিখেছিলো তা সেখানেই আছে। একটু চোখ বন্ধ করে আবার খোলে। এখন তার মাঝে চোখ জোড়া মেলে তাকাবার শক্তি টুকু নেই। হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে মাস্ক। এবার তনু মাস্ক টা নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে খানিক দূরেই ছুড়ে ফেলে দিলো। মুক্তি চায় সে চিরতরে।


ডাক্তার অনেক গুলো মেডিসিন প্রেসক্রিপশনে লিখে দিয়েছে। মেহরাম তনুর জন্য খাবার আনতে বাড়ি গিয়েছে কারণ হস্পিটালের খাবার তনু খেতে পারে না। আর আয়ুশ গিয়েছে মেডিসিন আনতে। এদিকে তনুকে যতো টুকু টাইম ডাক্তার দিয়েছিলো রেস্টের জন্য তা প্রায় শেষ, এখন সবাই চাইলে দেখাও করতে পারবে। নার্স তনু কে যে ইঞ্জেকশন দিয়েছিলো তার ডোসও শেষের পথে। সব মেডিসিন কেনা শেষে আয়ুশ আবার হস্পিটালে এসে পরে। সব গুলো অনেক হাই পাওয়ারের মেডিসিন। আয়ুশ আসতেই ডাক্তারের সাথে তার দেখা হয়।

ডাক্তার;; ওহ ভালো হলো আপনি এসেছেন মি.আয়ুশ। উনার টাইম তো শেষ এবার আপনারা দেখা করতে পারেন। আর মেডিসিন?

আয়ুশ;; হ্যাঁ মেডিসিন আমি এনেছি সব।

ডাক্তার;; জ্বি তাহলে আপনি কেবিনে যান আমি কিছুক্ষণ বাদে আসছি।

আয়ুশ;; জ্বি।

ডাক্তার সেখান থেকে চলে গেলে আয়ুশ এক ক্ষীণ দম ছেড়ে আলতো করে কেবিনের দরজা খুলে দেয়। ভেতরে এসে এক নজর তনুর দিকে তাকায়। তনু একদম চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। হয়তো ঘুমিয়েছে, দেখে মনে হচ্ছে অনেক গভীর ঘুমের মধ্যে রয়েছে। আয়ুশ মলিন হাসে তনুকে দেখে। ডেস্কের ওপর মেডিসিনের ব্যাগ টা রেখে তা চেক করতে করতে আয়ুশ বলে ওঠে…..

আয়ুশ;; তনু, তনু উঠো। টাইম শেষ, আর যে মেডিসিন গুলো দেওয়া হয়েছে সেগুলোর ডোসও শেষ হয়ে এসেছে। তনু উঠো।

আয়ুশ ডেস্কের ওপর মেডিসিন গুলো দেখছে আর কথা গুলো বলছে। তনুর কোন সাড়াশব্দ না পেয়ে আয়ুশ আবার বলে ওঠে….

আয়ুশ;; তনু উঠে পরো। জানো মেহরাম তোমার জন্য পাগল হয়ে গেছে। যা যা পছন্দ সব বানিয়ে আনতে গিয়েছে বাসায়। সেও প্রায় এলো বলে। উঠো তনু।

তনু;; _______________

আয়ুশ;; তনু, তনু। তনু উঠো, তনু।

আয়ুশের হাজার ডাকার পরও তনু উঠে না। আয়ুশ ভাবে হয়তো ঘুমের ঔষধ দেওয়া হয়েছে বেশি। কিন্তু ডাক্তার তো বললো তনুর এখন জেগে ওঠার কথা। আয়ুশ একই ভাবে আরো বেশ কয়েকবার ডাক দিলো কিন্তু তনুর কোন সাড়াশব্দ কিছুই নেই। আগের ন্যায় শুয়ে আছে। এবার আয়ুশ তনুর দিকে ঘুড়ে দাঁড়ায়। তনুকে দেখে যেন এবার আয়ুশ সব বুঝতে পারে। অক্সিজেন মাস্ক টা ফ্লোরে পরে আছে। তনুর হাতে যে ইঞ্জেকশন টা ছিলো তা খুলে বেডের এক কিণারেই পরে আছে। যেখানে সুই টা লাগানো ছিলো সেখান থেকে খানিক রক্ত গড়িয়ে পরছে। রক্ত টা কেমন কালো বর্ণের হয়ে গেছে। অজান্তেই আয়ুশের মনে কেমন এক ভয় ঢুকে যায়। কপাল কুচকে খানিক শুকনো ঢোক গিলে। ধীরে পায়ে তনুর দিকে এগিয়ে গিয়ে আরো খেয়াল করে দেখে তাকে। আয়ুশ বসে পরে তনুর পাশে। নিচে তাকিয়ে দেখে মাস্ক টা সেটা খানিক ঝুকে তুলে নেয়। আয়ুশের কেমন ভয় হতে থাকে।

আয়ুশ;; তনু, তনু। এই তনু। তনু প্লিজ দেখো কথা বলো। খুব অস্বস্তি লাগছে এভাবে চুপ হয়ে থেকো না। তনু প্লিজ চোখ খোল। এখানেই আছি তো যাই নি, এইতো আমি। তনু, তনু ভালো লাগছে না আমার প্লিজ চোখ খোল। এই তনু, তনুউউউ।

আয়ুশের এবার ঘাম ছুটে যেতে থাকে, চিন্তায় যেন আর কোন কূল-কিণারা পাচ্ছে না। আরো কয়েকবার তনু কে ডাক দিলো কিন্তু তনুর কোন রেসপন্স নেই। চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে আয়ুশের। হাতের তালু দিয়ে কপালে জোড় হওয়া ঘামগুলো মুছতে মুছতে নিজের আশেপাশে তাকাচ্ছে। তাকাতে তাকাতে হঠাৎ আয়ুশের চোখ যায় বেডের পাশে থাকা টেবিলের ওপর একটা কাগজের ওপর। কাগজ টা হাল্কাভাবে ভাজ করে রাখা আছে। আয়ুশ তা হাতে নিয়ে মেলে দেয়। সে তনু হাতের লেখা অনেক ভালো করেই চিনে। এখন একটু অগোছালো কিন্তু এটা যে তনুর হাতের লিখা তা বুঝতে আর বাকি রইলো না আয়ুশের। আয়ুশ লেটার টা মেলে পড়তে থাকলো…..

“” তনু, নামটাই কেমন যেন লাগে এখন আমার কাছে। ছোট থেকেই যা চেয়েছি সব পেয়েছি। যদি আমার প্রাপ্তির হিসেব মেলানো হয় তাহলে তা পরিপূর্ণ পাবে। কখনোই কোন কিছুর কমতি আমার ছিলো না, এখনো নেই। শুধু একটা জিনিস ছাড়া। কিন্তু সত্যি বলতে আমার সেটার জন্য আফসোস নেই। আমার আফসোস আমার বোনটা আমাকে কিছুই বলে নি। বললে হয়তো আমি ভেংে পড়তাম, কষ্ট পেতাম এগুলো ভেবেই বলে নি। হাসি পায় বড্ড হাসি, সেদিন মরতে গিয়েছিলাম তাই হয়তো আমার বোন আমাকে বলার আরো শক্তি-সাহস পায় নি। এটা ভেবেছে যে নিজের বোন আর আয়ুশের সম্পর্কের কথা শুনলে যদি আমি সহ্য করতে না পেরে আরো খারাপের পথে চলে যাই তাহলে। বোন হিসেবে মেহরামের ভাবনা একদম ঠিক। আয়ুশ তুমি যদি এই চিঠি টা পড় তাহলে একটা কথা শুনে রেখো তুমি অনেক ভালো। এতো কিছু হবার পরও আমার ওপর চাইলেই তুমি মেহরামের রাগ জেদ টা দেখাতে পারতে কিন্তু দেখাও নি। হ্যাঁ অবশ্যই তোমার চোখে আমরা দুই বোন দুই রকম ছিলাম তাই না ই কখনো তুমি আমার ওপর মেহরামের রাগ টুকু দেখাতে পেরেছো আর না ই মেহরামের ভালোবাসা টা আমাকে দিতে পেরেছো। ভালোবাসার রশি অনেক শক্ত তোমার সহজে কারো ওপর ট্রান্সফার হয়ে যায় না। মনে রেখো আয়ুশ একতরফা হলেও আমি তোমায় ভালোবাসি। আর তুমি আমার মেহরামকে। হ্যাঁ আমার মেহরাম। আমি আল্লাহ’র কাছে দোয়া করবো যে পরেরবার যদি আমাকে কারো বোন হিসেবে দুনিয়াতে পাঠানো হয় তাহলে যেন আমার বোন মেহরামই হয়। তবে হ্যাঁ চিন্তা করো না। পরেরবার এই এতোসব ঝামেলা হবে না। হাহাহা,, আয়ুশ কখনো তোমার কাছে নিজ ইচ্ছায় কিছু চাই নি। কারণ চাবার আগেই তুমি দিয়েছো কিন্তু আজ & এখন চাচ্ছি প্লিজ আমার মেহরাম টাকে দেখে রেখো। আমার মেহরামের বাচ্চা মানে আমারও বাচ্চা। আর আমার বাচ্চা যেন বাবাহারা না হয়। হাসি পাচ্ছে কিন্তু হাসতে পারছি না। কি আর বলি, আমি যদি ছেলে হতাম তাহলে তোমাকে আসতেই দিতাম না। ধুর ছাই, আমি ছেলে হলে আমি নিজেই মেহরামকে বিয়ে করে নিতাম। সব সমস্যার এক সমাধান। অতিরিক্ত সবকিছুই খারাপ হলেও মেহরাম হয়তো আমার জন্য অনেক বেশি করে ফেছেলে। আমি তো এতোকিছু করতে পারিনি কিন্তু হ্যাঁ এক বুক ভালোবাসা আছে মেহরামের জন্য। আমার একটা ভাই আছে নাম আকাশ। সত্যি বলতে মেহরাম যতো আমার জন্য করেছে বা আমাকে ভালোবাসে তা হয়তো বড়ো হয়ে আমার ভাই টাও করতো না। যাই হোক আয়ুশ মেহরামকে বলো যে তনু মেহরামকে অনেএএএএএক বেশি ভালোবাসে। কিন্তু এখন আমার জীবনে তিক্ততা এসে পরেছে। জানো তো মরার আগে একটা মানুষ বাচার জন্য লাক্ষ চেষ্টা করে কিন্তু আমার সেই ধৈর্য টা নেই আর বাকিই নেই। আমি পারবো না। শুনেছি কোন মানুষ মরার ঠিক চল্লিশ দিন আগে নাকি বুঝতে পারে যে তার সময় হয়তো বা শেষ আমিও বুঝেছি। তাই ভাবলাম যে কেননা জমরাজের কাজ টা আরেকটু এগিয়ে দেই। তাই এমন করলাম। জানো মাস্ক টা আর পরে থাকতে ইচ্ছে হয় না আমার। ভাবতেই অবাক লাগে যে এখন আমার জীবন টা এই ছোট্ট একটা অক্সিজেন মাস্কে অবধারিত। পরলাম না মাস্ক কি হলো। ছুড়ে ফেলে দিয়েছি রাগ লাগে অনেক। লিখার শক্তি আর পাচ্ছি না, হাত ব্যাথা করছে। হাতের রগে টান লাগছে অনেক। আমার সময় শেষ, হয়তো আমি শেষ করে দিয়েছি। আমি শুধু এখান থেকে চলে যেতে চাই। আমি যাবো। আয়ুশ আমি জানি মেহরামকে অনেক ভালোবাসো তুমি। কারণ আমার বোনটাই এমন, কেউ না ভালোবেসে থাকতেই পারে না। মেহরাম আমাকে সবার উর্ধ্বে রেখেছে সবসময়, আমি জানি। আয়ুশ একটা কথা রাখবে আমি হাত জোর করে অনুরোধ করছি প্লিজ মেহরামকে নিজের করে নিও। আমার মেহরু তোমাকে আজও একই ভাবে ভালোবাসে বেচারি বলতে পারে না। আমি বুঝি। আমি হাত জোর করে বলছি মেহরামের হয়ে যাও আয়ুশ। আমি এতেই খুশি হবো সবথেকে বেশি। আর আমার মেহরামের ব্যাপারে বলার কিছুই নেই। আমার জীবন ও। মেহরাম বোন তোর কাছে আমি আমার দুহাত মেলে দিয়ে তোর নিজেরই খুশি চাইছি। এবার থাম আর না প্লিজ। আমি দূরে থাকবো কিন্তু খুশি থাকবো এই ভেবে যে তোরা একসাথে আছিস। আমার সময় হয়তো সত্যি শেষ তাইতো এখনো লেখার শক্তি টুকুও পাচ্ছি না। আমি আমার ইচ্ছেতেই চলে যাচ্ছি। আয়ুশ & মেহরাম। আমি তোমাদের অনেক ভালোবাসি। তবে হ্যাঁ মেহরামকে বেশি। তবে সবার থেকে বেশি বাসি আমার ছোট মেহরামকে যে কিছুদিন পর আসবে। শেষ ইচ্ছে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে তবে এটাই বলবো “আয়ুশ & মেহরাম”। মেহরাম আমার মা টাকে দেখে রাখিস। আকাশ কে দেখিস। যদিও আমার থেকে তুই সবার বেশি কেয়ার করিস বলার কিছুই নেই। আমার মেহরু। নিজে যেখানে খুশি খুঁজে পাস প্লিজ তাই করবি। আর হ্যাঁ যাচ্ছি আমি ঠিকআছে কিন্তু তোর পিছু ছাড়ছি না। ভুত হয়ে আসবো 😅। ভালোবাসি মেহরাম & আয়ুশ””।


পড়া শেষ হতেই আয়ুশের হাত থেকে কাগজ টা পরে যায়। সবাই বলে ছেলেদের নাকি কানতে নেই। কিন্তু এখন আয়ুশের কান্না আসছে। কানতে বাধ্য সে। হাত থেকে কাগজ টা পরে যায় নিচে। আয়ুশ অশ্রুসিক্ত নয়নে তনুর দিকে তাকায়। তখনই এক চাপা শব্দ কানে আসে তার। আয়ুশ তার পাশে তাকিয়ে দেখে পেসেন্ট’স হেলথ্ ডিভাইসের সবুজ রঙের দাগ গুলো একদম সরু, সোজা হয়ে আছে। আর তা থেকেই চাপা শব্দ গুলো আসছে। আয়ুশের মাথায় যেন এবার ভাজ ভেংে পরে। মানে কি এইসবের। আয়ুশ যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না। মানে তনু আর নেই। জেনারেল ডেথ ওর সুইসাইড…!? আয়ুশের মুখ দিয়ে যেন কোন কথা বের হচ্ছে না। সবকিছু গলায় দলা পাকিয়ে আটকে গেছে। নিঃশব্দে তনুর দিকে তাকিয়ে আছে, চোখ দিয়ে পানি ভেসে যাচ্ছে। কাপা কাপা হাতে তনুর দিকে হাত বাড়ায় কিন্তু আবার হাত টা গুটিয়ে নেয়। আয়ুশ আর পারে না। সে তনুকে হুট করেই নিজের সাথে জড়িয়ে ধরে। একদম কেদে দেয় শব্দ করে। তনু তনু করে হাজার ডেকেও কোন লাভ হচ্ছে না। তনু চুপ, আয়ুশ খুব কাদছে। তখনই মেহরাম তনুর কেবিনের ঢোকে। গিয়েই দেখে আয়ুশ তনুকে ধরে এক প্রকার হাউমাউ করেই কাদছে। আয়ুশের এমন অবস্থা দেখে মেহরামের আত্মা টা কেমন কু ডেকে উঠলো। মানে কি হয়েছে আয়ুশ এভাবে কাদছে কেন। এটাই ভেবে যাচ্ছে মেহরাম। মেহরাম আয়ুশের দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু যেতেই তার পায়ের কাছে কিছু একটা অনুভব করে। তাকিয়ে দেখে একটা কাগজ পরে আছে। মেহরাম হালকা ভাবে ঝুকে সেটা তার হাতে তুলে নেয়। তুলে নিয়ে পড়া শুরু করে দেয়।





🥀চলবে ~~

#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#{বোনাস পার্ট 💖}



মেহরাম নিচ থেকে লেটার টা তুলে হাতে নেয়। তারপর তা মেলে পড়তে শুরু করে। এদিকে আয়ুশ তনুকে নিয়ে কেদেই যাচ্ছে। এই যে ডাকছে সে আর কথা বলে না। আয়ুশ শুধু একবার মেহরামের দিকে তাকায়। মেহরাম খুব মনোযোগ দিয়ে লেটার পড়ছে। আয়ুশ কোন রকম করে তনুকে বেডে শুইয়ে দিয়ে ছুটে ডক্তারের কাছে চলে যায়। মেহরাম একবার তনুর দিকে তাকিয়ে আবার পড়তে শুরু করে। কিছুক্ষণ পর আয়ুশ ডাক্তারকে নিয়ে ছুটে আসে। ডাক্তার তো তনু কে দেখেই অবাক হয়ে যায়। কেননা যেভাবে তনুকে মাস্ক লাগিয়ে বা সব কিছু সেট করে গিয়েছিলো তার কিছুই নেই। ডাক্তার দ্রুত গিয়ে নার্সের সাহায্যে তনু কে ভালোভাবে শুইয়ে দেয়। তারপর অক্সিজেন দেয়। হাতের পার্লস চেক করে বাট নো রেসপন্স। মেহরামের হাত থেকে কাগজ টা নিচে পরে যায়। নিজের সামনে যে তনুর দিকে তাকাবে তার সাহসই পাচ্ছে না মেহরাম।

আয়ুশ;; ডক্টর প্লিজ সে সামথিং, হয়েছে কি। তনুর কিছু হয় নি তাই না। মেডিসিনের ডোস বেশি হয়েছে মেবি। আপনি প্লিজ ভালোভাবে ওর চেকাপ করুন।

ডাক্তার;; মি.আয়ুশ প্লজ আপনি শান্ত হন, এভাবে হাইপার হয়ে যাবেন না। আমরা আমাদের যথাসম্ভব দেখছি।

আয়ুশ তার দাত দিয়ে ঠোঁট গুলো কামড়ে ধরে। চিন্তায় মাথা ফেটে যাচ্ছে। মেহরামের দিকে তাকিয়ে দেখে পুরো মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। তার প্রায় পাচ মিনিট পরেই ডাক্তার হতাশভাবে হাত থেকে গ্লাপস্ গুলো খুলতে খুলতে বলে ওঠে…

ডাক্তার;; মি.আয়ুশ আমরা আন্তরিক ভাবে দুঃখিত, উনি আর নেই। সি ইস নো মোর…

ডাক্তার এই কথা বলে আয়ুশের দিকে হতাশার নয়নে একবার তাকিয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে পরে। আর নার্স সবকিছু ঠিকঠাক করছে। ঠিক তখনই মেহরাম মাথা ঘুড়িয়ে একদম পরে যেতে নেয়। কিন্তু আয়ুশ ধরে ফেলে। নার্স ছুটে এসে মেহরামকে ধরে। ধরাধরি করে বাইরে নিয়ে এসে পরে। আয়ুশ মেহরামের মাথা টা নিজের কাছে এনে রেখে দিয়েছে। গালে হাল্কাভাবে চড় দিচ্ছে, আবার কখনো হাতের তালুতে ঘষা দিচ্ছে। ডাকছে কিন্তু মেহরামের হুস নেই। চোখে মুখে পানির ছিটা দেওয়া হয়। তার বেশ খানিক সময় পর মেহরামের জ্ঞান ফিরে আসে। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকায়। তাকিয়েই দেখে মেহরাম আয়ুশের কাছে। মেহরাম মাথায় হাত দিয়ে উঠে বসে।

আয়ুশ;; ঠিক আছো?

মেহরাম;; হুম।

মেহরামের ফট করে মনে পরে তনুর কথা। আর এক মূহুর্ত না দাঁড়িয়ে উঠে কেবিনের দিকে ছুটে যায়। কিন্তু তনুর বেডের কাছে গিয়ে মেহরামের আর সাহস হয় না পা আগানোর। পা গুলো যেন জমে যাচ্ছে। তার নিজের বোনের লাশ তার চোখের সামনে পরে আছে। ভাবতেই গা কেমন গুলিয়ে আসছে। মেহরামের মনে হচ্ছে সে এই দুনিয়াতে নেই, সে এক ভিন্ন গ্রহে আছে। আর এখানে সবকিছুই মিথ্যা হচ্ছে। যাই হচ্ছে, নিজের সাথে ঘটছে সব কিছুই একটা কল্পনা। হ্যাঁ কিছু কিছু সত্য আছে যেগুলো কল্পনাকেও হার মানায়। বিশ্বাসই হয় না, কিন্তু তবুও সবাই বিশ্বাস করতে বাধ্য। করার কিছুই নেই। মেহরাম তনুর কাছে বসে পরে। হাত দিয়ে তনুর কপালে এসে পরা চুল গুলো সরিয়ে দিলো। তনুর আরো একটু কাছে গিয়ে বসে মেহরাম। কপাল ক্রমশ কুচকে আসছে, ঠোঁট গুলো সমাল তালে কাপছে, চোখের বাধ যেন ভেংে যাচ্ছে। এক লম্বা শ্বাস নিয়ে নাক মুছে ফেলে মেহরাম। হাতের উলটো পাশ দিয়ে নাকের ডগা মুছে কোম রকমে একটু চুপ করে। হাত দিয়ে তনুর মাথায় বুলিয়ে দিতে দিতে বলে ওঠে….

মেহরাম;; ত..তনু, তনু

একদম চিকন ভাবে গলার স্বর বের হচ্ছে তার। আবার খানিক গলা খাকাড়ি দিয়ে ঠিই করে।

মেহরাম;; ততনু, তনু জানিস বাড়িতে না সবাই অনেক অপেক্ষা করছে, তুই ঠিক হয়ে বাড়ি যাবি। সবার কত্তো কথা। আকাশ লাফাচ্ছে তুই কবে বাড়ি যাবি তা শুনে। শোন না এভাবে আর থাকিস না প্লিজ উঠে পর না। আমার তো ভেতরে সব ভেংে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। প্লিজ এভাবে থাকিস না। তনু।

অন্যদিকে তাকিয়ে চোখের পানি গুলো মুছে ফেলে মেহরাম। আবার তনুর হাত ধরে নিয়ে বলে ওঠে…

মেহরাম;; না না এভাবে শুয়ে থাকলে চলবে না। তনু উঠ প্লিজ। আমার কলিজা টা মনে হচ্ছে কেউ ছিটে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। তনু উঠে পরে। ডাক্তার রা আসলে পাগল বুঝলি, ওরা ঠিক ভাবে চেকাপই করে নি। তোর কিছু হবেই না। আমি হতেই দিবো না। আমাকে ছেড়ে তুই কি করে যাবি, কোথায় যাবি।

মেহরাম এবার ফুপিয়ে কেদে দেয়। হেচকি পারতে পারতে বলে ওঠে…

মেহরাম;; তনু উঠ না বোন এভাবে আর শুয়ে থাকিস না। আমি পাগল হয়ে যবো। আমার জিনিসে এখন কে ভাগ বসাবে। আমার চুল ধরে এখন কে টানবে। আমার আচল, এই আয়া আচল ধরে কে টানবে (ওরনা সামনে এনে) তনু প্লিজ উঠ। আমার বোন আমার কলিজা রেএএএ, আমার তনু তনু। তনু উঠ তোর কিছু হয় নি। আমি জানি। আমি জীবন্ত লাশ হয়ে যাবো তনু। আমাকে একা ফেলে যাস না তনু। গেলি আমাকে কেন নিলি না। আমাকে একা ফেলে যাস না তনু।

আয়ুশ এতোক্ষন দরজার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ফালাচ্ছিলো আর মেহরামের কথা গুলো শুনছিলো। মেহরামের এমন পাগলামি দেখে আয়ুশ আরো ভেংে পরেছে। তবে এবার মেহরাম তনুর হাত ধরে ঝাকাচ্ছে। আয়ুশ বুঝলো যে মেহরামকে এখন এখানে রাখলে তার পাগলামো আরো বেড়ে যাবে। আর তার সম্পূর্ণ প্রভাব পড়বে বেবির ওপর। মেহরাম এক প্রকার চিল্লাচ্ছে আয়ুশ সিচুয়েশন খারাপ দেখে দ্রুত মেহরামের কাছে যায়। তাকে সেখান থেকে টেনে তুলে। নার্স র’ হেল্প করছে। মেহরামকে সামলানো অনেক কঠিন হয়ে পরেছে। আয়ুশ মেহরামকে অনেক বুঝাচ্ছে, কিন্তু এখন মেহরাম নিজের মাঝে নেই। সে মানতেই পারছে না যে তনু এখন আর তার সাথে নেই। মেহরামের আবোল তাবোল বকা যেন বাড়ছেই। আয়ুশ খুব কষ্টে মেহরামকে সামাল দেয়। আয়ুশের সাহস হচ্ছে না যে সে বাড়িতে সবাই কে কি করে বলবে। মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হচ্ছে না। আয়ুশ কয়েকবার ফোন বের করে কল দেবার জন্য। কিন্তু মনে যেন সাহসই জোড় করতে পারছে না।

আয়ুশ;; তনু নেই, মানে আমি পাগল হয়ে যাব। এতো কিছু আমি আর মেনে নিতে পারছি না। তনু, আমি কি করে বলবো যে তনু নেই। আমি কিভাবে, মেহরামকে কিভাবে সামলাবো। মেহরাম কখনোই ঠিক থাকতে পারবে না।



তনুর লাশ হস্পিটাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে। তনুর মা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। তনুর বাবা বিল্লাল হায় হায় করছে। তনুর বড়ো মা তনুর পায়ের কাছে বসে আছে। বাড়িতে মরণ যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে সব যেন যমের দুয়ার বেধে এসেছে। আর যমরাজ যেন এই বাড়ি টা একদম চিহ্ন করে রেখে গিয়েছে। আয়ুশ মাথা নিচু করে বসে আছে। চোখ মুখ কেমন শুকিয়ে গেছে। তার কানে শুধু তনুর কথা গুলো বারি খাচ্ছে “” আয়ুশ এই ড্রেস টা আমায় কেমন লাগবে, আয়ুশ বলোনা আমায় ভালোবাসো, আয়ুশ আমরা কাল ঘুড়তে যাবো আর তুমি কাল আমার পছন্দের পাঞ্জাবি পড়বে কেমন, আয়ুশ জানো মেহেদী পরেছি আমি তো তোমার নাম লিখেছি তবে মেহরামকে দেখে আমার খুব খারাপ লাগছে ওই কার নাম লিখবে””। এগুলো মনে পরতেই আয়ুশ তার চোখ দুটো বন্ধ করে ফেলে। গাল বেয়ে চোখের পানি গুলো পরে যায়। মেহরাম তনুর মাথার কাছ বসে বসে পাগলের মতো প্রলাপ বকছে। সোহেলের সময়ও ঠিক এই ব্যাপার গুলোই হয়েছিলো। আজ ঠিক সেই দিনটি আবার ঘুড়ে ফিরে এসেছে। ইতিহাস যেন আবার চোখের সামনে দৌড়াচ্ছে। শীতল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে,। মেহরামকে কেউ টেনেও তনুর কাছ থেকে আনতে পারছে না। এদিকে মেহরামের শরীর দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। সবাই একদম ভেংে পড়েছে। এই মূহুর্তে যে কেউ মেহরামের অবস্থা দেখলে ঠিই থাকতে পারবে না। সকাল ১১ টার দিকে তনুকে বাড়ি আনা হয়েছে। এখন ধীরে ধীরে বিকেল হয়ে এসেছে। জানাযার সময়ও বলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সবাই এখন ভয় পাচ্ছে মেহরামকে নিয়ে। না জানি কি করে বসে।





❤️❤️চলবে~

তৈমাত্রিক পর্ব-২৪+২৫

0

#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ২৪

🌸~ ~

তনুর এক্সিডেন্ট হয়েছে আজ পুরো একদিন হয়ে গেছে। কিন্তু তনুর অবস্থায় কোন উন্নতি নেই। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো তার। হাতে সুই পুশ করা। হস্পিটালের বেডে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। কিন্তু বাইরে কারো মনে শান্তি নেই। আয়ুশ অফিসে যায় নি আজ। কাপড় চেঞ্জ করার জন্য শুধু বাড়িতে গিয়েছিলো তারপর আবার হস্পিটালে। মেহরাম হস্পিটালের বাইরেই আছে একবার হাটছে আরেকবার তনুর কেবিনের দিকে তাকাচ্ছে। কোন এক জায়গায় স্থীর নেই তার। মেহরাম তনুর কেবিনের ভেতরে উকি দেয় কিন্তু তখন হঠাৎ দেখে যে তনুর নিঃশ্বাস ভারি হচ্ছে আর সে অচেতন অবস্থা তেই বার বার শ্বাস নিচ্ছে খুব জোরে জোরে। মেহরামের এটা দেখে তো মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো।

মেহরাম;; আ আ..আয়ুশ, আয়ুশ

আয়ুশ;; হ্যাঁ কি হয়েছে?

মেহরাম;; আয়ুশ দেখো তনু, তনুর শ্বাস নিতে হয়তো কষ্ট হচ্ছে।

আয়ুশ;; কিহহ?

আয়ুশ জলদি এসে তনুর কেবিনের ভেতরে দেখে। দেখে যে সত্যি তনুর অবস্থা বেশি ভালো না। আয়ুশ দ্রুত ডাক্তার কে ডেকে আনে। ডাক্তার সহ নার্স এলো। তনুর কাছে গিয়ে আগে তার হাতের সুই টা আগে খুলে দিলো। নার্স গিয়ে তনুর মাথায় হাত দিয়ে শান্ত করানোর চেষ্টা করছে কিন্তু কোনো তেও কিছু কাজ হচ্ছে না। ডাক্তার তনুকে দেখতে থাকে। এদিকে মেহরাম গ্লাসে ওপর হাত রেখে দিয়ে তনুর দিকে তাকিয়ে আছে আর হেচকি দিয়ে কাদছে। আয়ুশ মুখে একরাশ চিন্তার ছাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আয়ুশ মেহরাম কে কিছু বলবে কি বলবে না বুঝতে পারে না। কেননা ব্যাপার টা তার বোনের। এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মেহরাম হঠাৎ পরে যেতে ধরে আর আয়ুশ ফট করে তাকে ধরে ফেলে। আস্তে করে ধরে এক জায়গায় বসিয়ে দেয়।

মেহরাম;; আ আয়ুশ

আয়ুশ;; হ্যাঁ বলো

মেহরাম;; চাচি কে ফোন দাও প্লিজ। আসতে বলো জলদি

আয়ুশ;; হ্যাঁ দিচ্ছি।

আয়ুশ মেহরাম কে বসিয়ে দেয়। তারপর তার হাতে একটা পানির বোতল দিয়ে তনুর আম্মুকে ফোন দেয়। তনুর এমন অবস্থা শুনে তার মা তড়িঘড়ি করে হস্পিটালে এসে পরে। এদিকে যতো সময় যাচ্ছে ততোই যেন মেহরামের শরীর খারাপ হচ্ছে। মেহরামের পাশেই দুহাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে আয়ুশ। ঠিক পনেরো মিনিট পর ডাক্তার বের হয়।

ডাক্তার;; উনার অক্সিজেন লাগে। মানে শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হয়। কেননা এক্সিডেন্ট টা খুব মারাত্মক ভাবে হয়েছে। আরো রক্ত দেওয়া হয়েছে তাকে। তবে বর্তমানে অক্সিজেন মাস্ক ছাড়া উনি এক প্রকার অচল। আর হ্যাঁ খুশির খবর হচ্ছে এটা যে উনার খুব দ্রুত জ্ঞান ফিরে আসতে পারে।

ডাক্তার তার কথা গুলো বলে চলে গেলেন। সবাই যেন এতে হাফ ছেড়ে বাচলো। মন থেকে খুব ভারি একটা বোঝা দূর হলো সবার। তার কিছুক্ষণ পরই আতিয়া এলো। এসেই দেখেই সবাই বসে আছে।

আতিয়া;; মেহরাম..!

মেহরাম;; এসেছো।

আতিয়া;; হ্যাঁ তনু কেমন আছে?

মেহরাম;; ওর আসলে অক্সিজেন শেষ হয়ে গিয়েছিলো তাই ওমন শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো কিন্তু এখন ঠিক আছে একদম।

আতিয়া;; ওহহহ আচ্ছা।

মেহরাম;; বোস৷

আতিয়া;; তোর কি হয়েছে মুখ টা এমন শুকনো কেন?

মেহরাম;; না মানে..

আয়ুশ;; মাথা ঘুরে পরে যেতে নিচ্ছিলো।

আতিয়া;; তোকে যে বলি যে একটু বাড়ি যা এখানে আমরা থাকি। কথা তো শুনিস না।

মেহরাম;; আচ্ছা ছাড়ো না এইসব। তনুর জ্ঞান ফেরার সম্ভাবনা বেশি।

আতিয়া;; যাক ভালোই হলো।

আয়ুশের ফোন আসাতে সে সেখান থেকে দূরে চলে গেলো খানিক টা। আতিয়া মেহরামের পাশেই বসে আছে। আস্তে আস্তে রাত হয়ে আসছে। এখনো হস্পিটালে আয়ুশ মেহরাম আর তার চাচি রয়েছে। কিছুক্ষণ আগে আবার একজন নার্স আর ডাক্তার কেবিনের ভেতরে গিয়েছে। বেশ সময়পর মুখে খানিক হাসি ফুটিয়ে ডাক্তার বাইরে বের হয়ে পরে।

ডাক্তার;; আপনারা ভেতরে গিয়ে পেসেন্টের সাথে কথা বলতে পারেন। জ্ঞান ফিরেছে তার।

ডাক্তার এটা বলে চলে গেলেন। আয়ুশ চোখ টা বন্ধ করে এক শান্তির দম ছাড়ে। মেহরামের তো যেন মুখ থেকে হাসিই সরছে না। তারা সবাই কেবিনের ভেতরে যায়। গিয়েই দেখে তনু শুয়ে আছে কিন্তু চোখ দুটো খোলা। ওপরের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে। আতিয়া গিয়ে তনুর পাশে বসে পরে। মাথায় হাত দিয়ে বুলিয়ে দেয়। কিন্তু তনু একটু তার মায়ের দিকে আবার মেহরামের দিকে তাকায়। তার একটু দূরেই আয়ুশও তনুর দিকে তাকিয়ে আছে। আতিয়া তার মতো কথা বসে সেখান থেকে সরে যায়। তনু এক দৃষ্টিতে মেহরামের দিকে তাকিয়ে আছে তা সবাই খেয়াল করেছে। মেহরাম গিয়ে তনুর পাশে বসে। মেহরাম তার হাত দিয়ে তনুর মাথায় ছুয়ে দিতে যাবে কিন্তু তখনই তনু আলতো করে তার মাথা টা সরিয়ে নেয়। এতে মেহরাম বেশ অবাক হয়। তনু তার কাপা কাপা হাত দিয়ে মুখের মাস্ক টা খুলে ফেলতে ধরে। আয়ুশ খুলতে বারণ করলেও কোন রকম করে তনু তার মুখের মাস্ক টা খুলে। জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে মেহরামের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে….

তনু;; আম আমার, আমার জীবনের স..সসবথেকে বড় অ..অভিশাপ তুই।

তনুর এমন কথায় মেহরামের মাথায় এক প্রকার ভাজ ভেংে পড়েছে। সে কখনো কল্পনাও করেনি যে তার বোনের মুখ থেকে তাকে কোন দিন এই কথা টা শুনতে হবে। তনুর মুখ থেকে। তনুর এমন কথায় মেহরামের মুখের হাসিটা ফিকে হয়ে যায় একদম। মূহুর্তেই চোখের কোণে পানি জমা হয়ে গেছে। মেহরাম কিছু শুকনো ঢোক গিলে কাপা কাপা গলায় বলে ওঠে…

মেহরাম;; ততনু, আমি তো

তনু;; আমার জীবন দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। এক দিকে তুই আরেক দিকে আয়ুশ। আমার জীবনের অভিশাপ তুই।

মেহরাম;; তনু 🥺। আমি ত

তনু;; একটা কথাও বলবি না। আমার সাথে কোন কথাই বলবি না। সব ভালোবাসা ঘৃণায় পরিণত হচ্ছে আমার। মন চাইছে তোকে মেরে ফেলি। মরে যা তুই।

তনুর এই কথা শুনে মেহরাম ভেতর টা একদম দুমড়েমুচড়ে গেলো। মন ট যেন ঠাস করে খান খান হয়ে গেলো। তবে তনুর এমন কথায় তার মা আর চুপ করে থাকতে পেলো না।

আতিয়া;; তনু চুপ কর, এগুলো কি যা তা বলছিস তুই। মেহরামের অবস্থার কথা তোর মাথায় আছে নাকি নেই ও। আর এই দশায় কিনা তুই এই কুলক্ষণে কথা গুলো মুখ থেকে বের করছিস। যেই মেহরাম তোর জন্য এত্তো কিছু করলো তার জন্য তুই এগুলো বলছিস। মেহরাম কি জানতো যে সবার লাইফে এমন এক মোড় নিবে। তাতে ওই বেচারির কি দোষ। তোর যখন এক্সিডেন্ট হয় তখন মেহরামের অবস্থা দেখলে তুই নিজে পাগল হয়ে যেতি। আর মেহরাম এখন প্রেগন্যান্ট তুই এই অবস্থা এগুলো কি উলটা পাল্টা বকছিস। হুস আছে তোর। ছিঃ তনু।

তনু;; দেখেছো আজ আমার মা আমার বিপক্ষে কথা বলছে, আমাকে মা কেও কেড়ে নিয়েছিস তুই।

মেহরাম;; 😔

আতিয়া;; তনু বেশি হচ্ছে।

তনু;; খুব হিংসে হয় আমার। না চাইতেও হয়, অনেক বেশি হয়।

আতিয়া;; কারণ তোর মনে দিন দিন বিষ ভরে যাচ্ছে আর তা তোর দোষে। কখন কোন কথা টা বলতে হবে তার তো খেয়াল রাখ।

তনু;; আমি ভাগ্য খারাপ যে এমন এমন সবাইকে আমার লাইফে পেয়েছি।

তনুর এমন ধরণের কথা শুনে আয়ুশ আর কি কোন কথা বলবে রাগে দুঃখে সোজা কেবিন থেকে বের হয়ে পরে বাইরে। কেউ ভাবেও নি যে তনু উঠেই এমন সব কথা বলবে। তবে মেহরামের কাছে মনে হচ্ছে যে সত্যি তনুর এমন কথা শোনার আগে হয়তো তার মরে গেলেই ভালো হতো। যখন সে আয়ুশের সাথে বিচ্ছিন্ন হয় তখনও যেন এমন কষ্ট হয় নি তার। তনু মেহরামের জীবন, কিন্তু সেই যে এক সময় মেহরামের জীবন নেওয়ার কথা বলবে তা কখনো ভাবে নি। তনু এখন যেন মেহরামকে দেখতে পারচ্ছে না। তাই মেহরাম মাথা নিচু করে কেবিন থেকে বের হয়ে পরে। তনুর মা তনুর সাথে রাগ করে বাইরে বের হয়ে পরে। তখনই একজন নার্স এলো এসেই দেখে তনু মুখের মাস্ক সরিয়ে রেখেছে। তা দেখে নার্স কিছুটা রাগই করলো।

নার্স;; আরে পেসেন্টের মাস্ক মুখের বাইরে কেন, আরে জলদি মুখে লাগান। এতে আপনারই কষ্ট হবে। আর পরে একটা থেকে আরো উলটো কিছু একটা হিয়ে যাবে। মাস্ক লাগান, মাস্ক লাগান।

নার্স এসে তনুকে আবার অক্সিজেন মাস্ক টা পরিয়ে দিয়ে আর সবকিছু চেক করে চলে গেলো। আতিয়া বাইরে গিয়ে দেখে মেহরাম বাইরের বড়ো জানালার কাছে পেটের ওপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। আয়ুশ কে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। আতিয়া দ্রুত পায়ে মাহরামের কাছে চলে যায়। গিয়েই দেখে সামনে একমনে তাকিয়ে আছে সে আর চোখ দিয়ে পানি পরতে পরতে তা শুকিয়ে গেছে।

আতিয়া;; মেহরাম মা তুই মনে কিছু নিস না। মাথা ঠিক নেই তনুর।

মেহরাম;; না চাচি সবার মাথাই ঠিক আছে। সবগুলোই সত্যি কিথা ছিলো। আর মাথা যদি ঠিক নাও থাকে তাহলেও আমার লাভ-ই হলো। কেননা মাথা ঠিক ন থাকলেই মানুষ একমাত্র সত্যি কথা তার মুখ দিয়ে বের করে। তনুও বলেছে।

আতিয়া;; মেহরাম

মেহরাম;; আসলেই চাচি এর থেকে আমার মরে গেলেই ভালো হতো।

আতিয়া;; চুপ চুপ।

আতিয়া দ্রুত মেহরামের মুখের ওপর হাত রেখে দিলো।

মেহরাম;; আমি ভেবেছিলাম তনুর জ্ঞান ফিরতেই সে আবার আমাকে মেহরু বলে ডাক দিবে। কিন্তু এটা যে বলবে ভাবি নি। জানো চাচি খুব বেশি খারাপ লাগছে (ফুপিয়ে কেদে)

আতিয়া;; কাদিস না।

আতিয়া কোন রকম করে মেহরামকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। আয়ুশ কে কোথাও দেখা যাচ্ছে না বলে। মেহরামের ফোন দিয়েই আয়ুশকে ফোন করে। এতোক্ষণ আয়ুশ হস্পিটালের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো। আতিয়ার ফোন পেয়ে তাড়াতাড়ি ভেতরে যায়।

আতিয়া;; আয়ুশ

আয়ুশ;; জ্বি মা

আতিয়া;; মেহরামকে বাড়ি দিয়ে এসো।

মেহরাম;; চাচি আমি রকা যেতে পা…

আতিয়া;; চুপ কর তো, আয়ুশ যাও দিয়ে আসো। এই অবস্থায় একা বাড়ি যেতে দেবো পাগল হয়েছি তো আমি। আয়ুশ যাও তো বাবা।

আয়ুশ মেহরাম কে গাড়িতে করে বাসায় দিয়ে আসে। গাড়িতে থাকা কালিন কোন কথা হয় না তাদের। মেহরাম যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলো। এক চোখে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিলো। ড্রাইভ করার সময় আয়ুশ কয়েকবার মেহরামের দিকে তাকিয়েছিলো। কিন্তু মেহরামের কোন হুস নেই। তনুর বলা কথা গুলো তার কানে বারবার বাজছে। “” তুই আমার জীবনের সব থেকে বড়ো অভিশাপ””, “মন ভাইছে তোকে মেরে ফেলি”। মেহরাম তার চোখ গুলো বন্ধ করে ফেলে খানিকপরে আবার খোলে। আয়ুশ তাকিয়ে দেখে মেহরামের চোখ দিয়ে টুপ করে বিন্দুর ন্যায় এক ফোটা পানি গড়িয়ে পরলো আর সে দ্রুত তা মুছে ফেললো। আয়ুশ বুঝতে পারছে যে এখন মেহরামের ওপর দিয়ে ঠিক কি যাচ্ছে। তাই সে কোন কথাই বলে না। দেখতে দেখতে এক সময় বাড়ি এসে পরে। গাড়ি অনেক উচু সেখান থেকে মেহরাম একা নামতে পারে না। তাই আয়ুশ গাড়ি থেকে নেমে জলদি মেহরামের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। সেখানে দাঁড়িয়ে গাড়ির দরজা টা খুলে দিলে মেহরাম তার এক হাত পেটে রাখে, আয়ুশ মেহরামের আরেক হাত ধরে নিচে নামিয়ে আনে। তারপর মেহরাম আস্তে আস্তে হেটে বাড়ির ভেতরে চলে যায়। আয়ুশ কতোক্ষণ মেহরামের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে চলে আসে। আবার চলে যায় হস্পিটালে। গিয়ে দেখে আতিয়া বাইরে বসে আছে। আয়ুশ গিয়ে আতিয়ার পাশে বসে পরে।

আয়ুশ;; মা এভাবে বসে আছেন কেন, ভেতরে যান নি?

আতিয়া;; আমি ভাবি নি তনু এভাবে মেহরামকে কথা গুলো বলবে। মেয়েটার খুব মন লেগেছে।

আয়ুশ;; মা ছাড়ুন না, তনু রাগে বলে ফেলেছে।

আতিয়া;; কিন্তু এখানে রাগের কিছুই নেই। কখন কার সাথে কি হয় বা জার কপালে কি লিখা আছে তা আমরা কেউ কিছুই জানি না। কে জানতো যে এমন হবে। তাই বলে মেহরামকে এগুলো। আয়ুশ আমি বলতে অয়ারবো না ছোট থেকেই এরা দুইজন দুইজনের জীবন। কিন্তু তনু…। আজ সে মেহরামকে অভিশাপ। মেয়েটা অন্তঃস্বত্বা তার ওপর এগুলো। মেহরাম আজ ঠিক নেই।

আয়ুশ;; মা প্লিজ এইসব এখন ছাড়ুন। তনুর কি অবস্থা?

আতিয়া;; ভালোই আছে। জ্ঞান আছে।

আয়ুশ বসে থাকে আতিয়ার পাশে। আর এদিকে মেহরাম কোন রকমে তার মা আর চাচ্চুর সাথে কথা বলে তার রুমে চলে যায়। বেশি নড়াচড়া করতে পারছে না পেটে হুট করেই ব্যাথা শুরু করে যাচ্ছে। এক জায়গায় গিয়েছে চুপ করে বসে পরলো। কিন্তু তবুও যেন মনের মধ্যে বিচলতা কাজ করছে তার। কোন রকমে ওঠে ওয়াসরুমের দিকে চলে গেলো। বেছিং-এ গিয়ে পানি হাতে নিয়ে ইচ্ছে মতো মুখে ছিটা দিতে থাকলো। তনুর কথা গুলো মাথায় ঘুড়ছে। আর মেহরাম কেদে কেদে জোরে পানির ছিটা গুলো সব মুখে দিচ্ছে। সে শুধু বের হতে চাচ্ছে এই নরক থেকে। আর ভালো লাগে না। শুধু মুক্তি চায় সে। নিচ থেকে মাথা তুলতে ওপরে আয়নার দিকে তাকাতেই দেখে নাকমুখ সব ফুলে গেছে। তা দেখে মেহরামের কান্না যেন দ্বীগুণ হয়ে যায়।





~~চলবে“

#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ২৫

.
.
.

মেহরাম কখনো ভাবেই নি যে একদিন তনুর মুখ থেকেও তাকে এইসব শুনতে হবে। সত্যি মন টা একদম ভেংগে গেছে। মেহরামের এখন নিজের কাছে নিজেরই অপরাধী মনে হচ্ছে। “”মেহরাম তনুর জীবনে অভিশাপ”” মেহরামের কানে শুধু তনুর বলা এই কথা টাই বাজছে। সে তো অভিশাপ হতে চায় নি। কিন্তু তবুও না চাইতেই হয়ে গেছে। যা চাইলো তা পেলো না, আর যেটা চাইলো না তাই হয়ে গেলো। হয়তো অভিশাপের কোন কাজ করেছিলো তাই আজ সে না চাইতেও শুধু তনুর কাছে না সবার কাছেই অভিশাপ। রাত বাজছে প্রায় ৩ টার কাছাকাছি কিন্তু হস্পিটাল থেকে আসার পর থেকে কান্না যেন কোন বাধই মানছে না মেহরামের। এক সময় আতিয়া অর্থাৎ মেহরামের চাচি বাসায় এসে পরেন। এসেই দেখে হলরুমে কনিকা বসে আছেন। মুখ টা কেমন ভার। বাকি সবাই হয়তো ঘুম। আতিয়া কনিকার সামনে চলে যায়…

আতিয়া;; ভাবি ঘুমাও নি?

কনিকা;; না আসলে তোরই আসার অপেক্ষা করছিলাম।

আতিয়া;; ওমা কেন?

কনিকা;; আচ্ছা তনু মা কেমন আছে, ভালো আছে তো। আর হস্পিটালে কি কিছু হয়েছে?

আতিয়া;; না না কিছুই হয় নি কিন্তু কেন?

কনিকা;; মেহরাম এইযে হস্পিটাল থেকে এসে রুমে গিয়েছে আর বের হওয়ার নাম নেই। বুঝলাম না কিছুই। চোখ মুখ কেমন ফুলে আছে। তনুর কিছু হলে তো মেহরাম শেষ কিছু হয়েছে কিনা তাই জিজ্ঞেস করছি?

আতিয়া;; না ভাবি কিছুই হয় নি, আর তনুও একদম ঠিক আছে। জ্ঞান ফিরেছে।

কনিকা;; ওহহ আচ্ছা যাক আলহামদুলিল্লাহ।

আতিয়া;; আচ্ছা মেহরাম তো রুমে তাই না আমি গিয়ে দেখি তো।

কনিকা;; হ্যাঁ যা। আর খেয়েছিস কিছু?

আতিয়া;; না ভাবি আসলে খিদে নেই, খিদে এক প্রকার মরেই গেছে। খেতে আর মন চায় না। আমি যাই।

কনিকা আর কি বলবে আসলেই তো খাওয়ার মন সবারই এক রকম উঠেই গেছে। কেননা জীবনে একটার পর একটা ভেজাল লেগেই আছে, লেগেই আছে। কনিকাও আতিয়া কে আর কিছুই বলে না। আতিয়া সিড়ি বেয়ে উঠে মেহরামের রুমের কাছে চলে যায়। গিয়ে আস্তে করে রুমের দরজা টা খুলে। দরজা লাগানো ছিলো না শুধু চাপানো ছিলো। গিয়েই দেখে মেহরাম বসে বসে কাদছে। পুরো একটা বাচ্চার মতো। আতিয়ার এত্তো মায়া লাগলো দেখে। সে দ্রুত করে রুমে চলে গেলো। মেহরাম খেয়ালই করে নি যে তার চাচি এসেছে রুমে। যখন আতিয়া মেহরামের সামনে গিয়ে দাড়ালো তখন বুঝতে পারলো। মেহরাম মাথা উঠিয়ে দেখে আতিয়া তার দিকে তাকিয়ে আছে। মেহরাম আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। তার চাচির কোমড় জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেদে দেয়।

মেহরাম;; ওওও চাচি আমি আসলেই অভিশাপ তাই না। তা না হলে এমন কেন হলো। বিয়ের পর সোহেল মারা গেলো। আমার বাচ্চা টা বাবার মুখ টা পর্যন্ত দেখতে পেলো না। ফ্যামিলি তে এতো প্রব্লেম আর এই তনুর এক্সিডেন্ট। আমি আসলেই অভিশাপ তা না হলে এমন কিছুই হতো না। যা ছুই তাই ধ্বংস…..

আতিয়া;; চুপ চুপ চুপ। একদম চুপ। এমন কথা বলতে হয় না। কে বলেছে যে তুই অভিশাপ। শোন তুই হলি এই বাড়ির লক্ষি বুঝলি।

মেহরাম;; আমি আজ পর্যন্ত দেখলাম না যে আমার জন্য কিছু ভালো হয়েছে।

আতিয়া মেহরাম কে ছাড়িয়ে তার পাশে বসে। মেহরামের চোখের পানি গুলো মুছে দিয়ে তাকে বুঝিয়ে বলতে থাকে।

আতিয়া;; তুই জানিস তোর দিদুন আগে হাটতে পেতো না। এমনও দিন গিয়েছে যেখানে তোর দিদুন কে হুইল চেয়ারে বসে বসে কাটাতে হয়েছে। হাত অব্দি নড়াতে পারতো না। কিন্তু যখন সবাই জানলাম যে ভাবির পেটে তুই আছিস। সেইদিন প্রথম তোর দিদুন হাত নাড়িয়েছিলেন। আর যখন তুই হলি তখন তোর দিদুন সবাইকে অবাক করে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলো। তোর চাচ্চুর ব্যাবসায় এত্তো লস হয়েছিলো যে বলার বাইরে। কিন্তু যতো টাকা হারিয়েছিলাম তার থেকে দ্বীগুণ আয় করেছি। আর তুই তনুর কথায় মন খারাপ করছিস, ধুর পাগলি তনু কি জানে। তনু ছোট থাকতে একদিন হারিয়েও গিয়েছিলো। কিন্তু তুই জানতি যে তনুর মিষ্টি জিনিস অনেক পছন্দের। পরে তুই যদি আমদের সেই মিষ্টির দোকানে না নিয়ে গেতি তাহলে তো তনুকে মনে হয় না আর পেতাম। অবশ্য তনুকে তার পরে কতো গুলো উত্তম-মধ্যমও দিয়েছিলাম।

আতিয়ার কথা শেষ হতেই মেহরাম খানিক হেসে দেয়। আর চোখের পানি মুছে ফেলে।

আতিয়া;; এই তো এইবার হয়েছে। এই যে এভাবে হাসলে কি হয় হ্যাঁ।

মেহরাম;; হাসি তো!

আতিয়া;; শোন তনুর অবস্থা আসলে ভালো না জানিসই তো। সব কিছু কেমন এলোমেলো হয়েছে। তাই এইসব বলে ফেলেছে।

মেহরাম;; আমি জানি চাচি।

আতিয়া;; হ্যাঁ অবশ্য এটা ঠিক যে আজ তনু একটু বেশিই বলেছিলো। যার জন্য আমার নিজেরই মেজাজ চটে গিয়েছিলো।

মেহরাম;; আহা বাদ দাও না চাচি।

আতিয়া;; খেয়েছিস?

মেহরাম;; খিদে নেই।

আতিয়া;; আচ্ছা ফ্রিজে আমি ফল রেখে দিয়েছি যখন মন চায় খেয়ে নিস আর ওয়াটার পটে পানি আছে। আর শোন সকালে রেডি থাকিস হস্পিটালে যাবো।

মেহরাম;; আমি আবার?

আতিয়া;; কিচ্ছু হবে না আমরা যাবো কেমন। এখন কান্নাকাটি একটু অফ কর আর ঘুমা তো।

মেহরাম;; আচ্ছা।।

আতিয়া মেহরামের রুম থেকে বের হয়ে পরে। এদিকে মেহরামকে যতোই না বলুন চিন্তা তো আর সহজে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারে না।
আর অন্যদিকে তনু হস্পিটালের বেডে শুয়ে আছে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক রাত দিন ২৪ ঘন্টাই পরে থাকতে হয়। তা ছাড়া সে অচল। হাতে সুই পুশ করা। স্যালাইন দেওয়া আছে। হাতে যেখানে সুই লাগানো সেই জায়গাটা কালো কুচকুচকে বর্ণের হয়ে গেছে। বেশ ব্যাথাও করছে। মন তো চাইছে যে একদম টান দিয়ে সুই টা খুলে ফেলতে হাত থেকে কিন্তু লাভ নেই। নার্স এসে আবার লাগিয়ে দিয়ে যাবে। তনুর মাথার ঠিক সামনেই জ্বলজ্বল করছে একটা সাদা ধবধবে বাতি। সেখান থেকে আলো পুরো ঘরকে আলোকিত করে রেখেছে। এখন অনেক রাত, ২-৩ জন নার্স ছাড়া আর তেমন কেউ রাতের ডিউটি তে নেই। মধ্য রাত একদম চুপচাপ, তার মধ্যে ঘড়ির টিকটিক আওয়াজ যেন আরো গাঢ় হয়ে গেছে। ঘড়ির এই আওয়াজ জানান দিচ্ছে যে “সময় চলমান, সময় বহমান। এটা কারো জন্যেই থেমে থাকে না। সময় সময়ের মতো চলে যায়”। আর তার জন্যই হয়তো বলে যে সময়ের সঠিক ব্যাবহার করতে শেখ। কেননা সময়ের সঠিক ব্যাবহার না করলে পরর্বতীতে আফসোস ছাড়া আর কোন উপায় পাবে না। আর সেই আফসোসের কোন দাম থাকবে না। আর আজ এই আফসোস টা তনুর হচ্ছে যে কেন সে আগে সবকিছু জানলো না, বুঝলো না। তাহলে হয়তো আজ সবার জীবন চক্রের দৃশ্য টা ভিন্ন থাকতো। কিন্তু তনুর এই আফসোসের এখন কোন মূল্য নেই। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে আখি দুটো মেলে শূন্যে তাকিয়ে আছে। মেহরামের মুখ টা তনুর চোখে ভাসছে। আজ নিজের রাগের মাথায় বোন টাকে কি না কি বলেছে। তনুর জীবনে খুব খারাপ হয়েছে আর সে এগুলো সামলাতে না পেরে উলটা পালটা সব বলে দিয়েছে। কিন্তু মেহরাম, ওই বেচারির জীবন তো আরো আগুনে পুড়ে সেই কবেই ছাই হয়ে গেছে।

তনু;; ভুল করেছি আমি, অনেক বড়ো ভুল। এই ভুলের কোন পশ্চাতাপ নেই। শুধু হায় হায় করে যেতে হবে আমার। এই কি করলাম এই ভেবেই। মেহরামকে আজ কি না কি বলেছি আমি। কিভাবে পারলাম আমি এইসব বলতে। রাগের মাথায় সব ছিঃ। কিভাবে পারলাম আমি। আমি আসলে কারো ভালোবাসা পাবারই যোগ্য না। কেননা আমার থেকে আরো হাজার গুণে বেশি মেহরাম আয়ুশকে ভালোবাসে তবুও সে মুখ বুজে সব সহ্য করেছে। আর আজ আমি কিনা এই সামান্য জিনিস গুলো সহ্য করতে না পেরে এগুলো বলে দিয়েছি। বোন নামে কলংক আমি। আমার সাথেই এইসব হবার কথা কেননা আমি এগুলোই পাবার যোগ্য। আমি মেহরাম কে মরে যেতে বলেছি তাও সেই সময় যখন যে প্রেগন্যান্ট,, অভিশাপ বলেছি। যেখানে আমি নিজেই জীবন মরণের মাঝে ঝুলে আছি। মেহরাম কে কি করে পারলাম আমি এগুলো বলতে। (মনে মনে)

তনু এই কথা গুলো মনে মনে আওড়াচ্ছে। আর তার চোখের কার্নিশ বেয়ে বয়ে যাচ্ছে বহু অশ্রুবিন্দু। ওইযে আফসোস, সেই আফসোসের কোন মানেই হয় না এখন। কারণ অনেক সময় “মানুষকে মারতে কোন ধারালো ছুরি বা অস্ত্রের প্রয়োজন হয় না, মুখের বুলিই যথেষ্ট”। বাইরে আয়ুশ বসে আছে। সে বাসায় যায় নি। কারণ এখানে কেউ নেই। কাউকে না কাউকে তো থাকতেই হবে। তনুর মা থাকতে চেয়েছিলো কিন্তু আয়ুশ জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছে। ঘুম নেই চোখে। আয়ুশের খুব খারাপ লেগেছে তনু মেহরামকে এই কথা গুলো বললো। এটা অন্য যে কেউ শুনলেই খারাপ লাগবে। দুহাত ভাজ করে বসে আছে আয়ুশ। সব চিন্তা মাথায় খেলা করছে। সকাল থেকে শুরু করে এই এতো রাত অব্দি সে কমপক্ষে ১২ কাপের মতো কফিই খেয়েছে। কিন্তু কোন ভাবেই শান্তি নেই। জীবন তো তেতোই সেই শুরু থেকেই, এখন এই এত্তো পরিমাণে কফি খেয়ে জীবন টাকেও তেতো বানিয়ে দিয়েছে। আয়ুশ একদম বসে আছে, একবার হাটছে, আরেকবার দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আবার মাঝে মাঝে তনুর কেবিনে উকি দিচ্ছে। মনে শান্তি না থাকলে কোন কিছু করেই লাভ নেই। অবশেষে আয়ুশ নিজের ফোন টা বের করে। কেননা সে জানে যে মেহরামকে যেভাবে আজ কথা গুলো বলা হয়েছে তাতে সে ভালো নেই। মেহরামের নাম্বার টা বের করে কল দিবে কি দিবে না এক দোটানার মাঝে পরে যায়। এভাবেই কিছুক্ষণ নাম্বারের দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ দুটো অন্যদিকে ঘুড়িয়ে ফোন টাকে আবার পেন্টের পকেটে রেখে দেয়। কিন্তু কথায় আছে না যে হাত পা এইসব আটকানো যায় কিন্তু মন কে আটকানো কিছুতেই সম্ভব না, কিছুতেই না। আবার দ্রুত ফোন টা বের করে কিছু না ভেবেই মেহরামকে কল দেয়। আয়ুশ ফোন কানে রেখে এদিক ওদিক হাটছে। মেহরাম বারান্দায় বাতাসে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে রুমে ফোন বাইব্রেট করছে। কিন্তু মেহরামের সেদিকে কোন খেয়ালই নেই। এভাবে তিনবার ফোন বেজে এক সময় কেটেই যায়। ফোন রিসিভ হয় না। আয়ুশ ভাবে হয়তো মেহরাম ঘুমিয়ে পরেছে। নয়তো ঠিক ফোন ধরতো। আয়ুশও ফোন দেওয়া বন্ধ করে দেয়। কিন্তু তখনই হঠাৎ তনুর কেবিন থেকে কিছু পরে যাওয়ার শব্দ আসে। আয়ুশ কপাল কুচকে দ্রুত কেবিনে যায়। গিয়ে দেখে তনু চোখ মেলে তাকিয়েই আছে কিন্তু তার পাশে থাকা স্টীলের ট্রে টা পরে গেছে। সেখানে হেক্সিছল, ব্যান্ডেজ, কাচি, আরো না জানি কতো কি কি রাখা। আয়ুশ গিয়ে তা তুলে আবার আগের জায়গায় রাখে। তবে এবার সে বাইরে যায় না। কেবিনে তনুর পাশে চেয়ারে গিয়ে বসে। তনু হাল্কা ভাবে ঘাড় টা ঘুড়িয়ে দেখে যে আয়ুশ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। নিভু নিভু চোখে তনু তাকায়। তনু ভেবেছে যে আয়ুশ এভাবে তাকিয়ে আছে হয়তো অনেক বেশি অভিমান তার মনে জমে আছে। কিন্তু তনুর ধারণা কে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে আয়ুশ বলে ওঠে..

আয়ুশ;; আমার মনে কারো জন্য কোন ঘৃণা নেই। আহা, একবিন্দুও না। কারণ সবাই পরিস্থিতির শিকার। যার যার মনের অবস্থা একমাত্র সেই জানে। কেউ কখনো নিজের অবস্থা থেকে অন্যের মনের খবর জানতে পারবে না। সো যেই সাফার করে শুধু সেই বুঝে।

তনু;; আ..আআপনি বা ববাড়ি যান নি?

আয়ুশ;; কি করে যাই। এখানে কেউ নেই। একজন কে তো থাকতে হবে তাই না।

তনু;; মা

আয়ুশ;; মা কে জোরে করেই বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। সেই কখন এসেছিলো আর কতো বসে থাকবে।

তনু;; মে ম মেহরু..

আয়ুশ;; কে ওই অভিশাপ?!

তনু;; _____________

আয়ুশ;; না ওই অভিশাপ কে আমি ডাকি নি। যদি ওর জন্য আবার কিছু হয়ে যায় তাই।

তনু;; আয়ুশ…

আয়ুশ;; রাগ হোক বা ডিপ্রেশন এভাবে কাউকে কথা বলতে হয় না তনু। কথা বলার আগে অন্তত একবার ভেবে নেওয়া উচিত। কারণ কথার আঘাত অনেক বেশি ভয়ংকর হয়।

তনু;; আমার আম..

আয়ুশ;; বাদ দাও, তুমি সবকিছু সহ্য করে উঠতে পারো নি তাই বলে দিয়েছো, আমি বুঝি। কিন্তু তোমার একবার এটা বোঝা উচিত ছিলো যে তোমার এই কথা গুলো মেহরাম সহ্য করতে পারবে নাকি। কারণ মেহরাম অনেক বেশি ভালবাসে তোমায়। আমি মেহরামের সাইড নিচ্ছি না, কারো পক্ষে কথা বলছি না আমি। কিন্তু কথা গুলো এক অপরিচিত কেউ শুনলেও খারাপ লাগতো। আর মেহরাম একজন বোন হিসেবে তোমাকে কতো টুকু ভালোবাসে তা বলতে হবে না। কারণ তা আমার থেকে ভালো তুমিই জানো।

তনু;; আয়ুশ..

আয়ুশ উঠে গিয়ে তনুর পাশে দাঁড়ায়। নিজের হাত টা তনু কপালে রেখে দেয়।

আয়ুশ;; আমি জানি তুমি কি বলবে। তোমার দোষ নেই। এখানে দোষ বলতেই কোন শব্দ নেই। জানি বলেও লাভ নেই চিন্তা মাথায় আসবেই। তুমি প্লিজ চোখ টা বন্ধ করো আর শুয়ে থাকো। আর হ্যাঁ ভুলেও মুখের মাস্ক সরাবে না। স্যালাইন আছে শেষ হতে বেশ কয়েক ঘন্টা বাকি ততোক্ষণে সকাল হয়ে যাবে আর সকালে ডক্টর এসে পরবে। তুমি শুয়ে থাকো আমি বাইরেই আছি।

আয়ুশ এই বলে উঠে বাইরে চলে গেলো। তনু আয়ুশের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। খনিকের জন্য হলেও হয়তো অনেক বেশি ভালো আর পারফেক্ট কাউকে তনু তার জীবনে পেয়েছিলো তাই না বকে উলটো বুঝিয়ে গেলো। অন্য কেউ হলে মনে হয় না এমন করতো। যদিও পৃথিবীতে “পারফেক্ট” বলে কোন শব্দ নেই। হাতের পাঁচ আঙুল সমান না। আল্লাহ কাউকে একদম পরিপূর্ণ করে দুনিয়ার বাড়িতে পাঠায় না। তবুও কিছু কিছু মানুষ কে দেখলে মনে হয় যে না এই পারফেক্ট। আয়ুশ অনেক বেশিই ভালো। এতো ভালো হতে নেই। মানুষ খারাপ বানিয়ে দেয় নয়তো মাজবুরি তে হয়ে যেতে হয়। তনু এগুলো ভাবতে ভাবতেই চোখ দুটো বন্ধ করে থাকে। কখন যে ঘুমিয়ে পরেছে তা সে জানে না। আস্তে আস্তে ভোরের আলো ফুটে। হস্পিটালে নামাজ পড়ার জন্য আলাদা রুম আছে। ফজরের আজান দিলে আয়ুশ গিয়ে ওযু করে এসে নামাজ পড়ে ফেলে। নামাজ শেষ হলে আয়ুশ আবার তনুর কেবিনের সামনে আসে। তবে এবার তার ফোন বাজে ফোন তুলে দেখে মেহরামের ফোন। আয়ুশ সেখান থেকে দূরে গিয়ে ফোন রিসিভ করে।

আয়ুশ;; হ্যালো

মেহরাম;; কেমন আছো?

আয়ুশ;; আল্লাহ ভালোই রেখেছেন। তুমি?

মেহরাম;; আলহামদুলিল্লাহ, কোথায় আছো তুমি?

আয়ুশ;; আমি তো হস্পিটালে।

মেহরাম;; বাসায় যাও নি?

আয়ুশ;; না।

মেহরাম;; তনু কোথায় কেমন আছে?

আয়ুশ;; হ্যাঁ আগে থেকে কিছুটা ভালো।

মেহরাম;; ওহহ আচ্ছা।

আয়ুশ;; মা কোথায়?

মেহরাম;; এই তো যা যা লাগে সব নিচ্ছে। হস্পিটালে আসবে।

আয়ুশ;; ওহহ,

মেহরাম;; ডক্টর এসেছেন?

আয়ুশ;; এখনো না কিন্তু এসে পরবেন।

মেহরাম;; আচ্ছা।

আয়ুশ;; তুমি আসবে?

মেহরাম;; আসলে যেতে তো চাইছি না কিন্তু চাচি নিয়ে যাবে। আচ্ছা আমি যাবো তনু যদি…?

আয়ুশ;; কাল রাতে তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিলো।

মেহরাম;; সত্যি আমার কথা..! (হেসে)

আয়ুশ;; হ্যাঁ, (মেহরামের হাসি শুনে সেও হেসে দেয়)

মেহরাম;; আমি আসছি।

আয়ুশ;; এসো।

মেহরাম ফোন কেটে দেয়। আয়ুশ আবার কফির অর্ডার দিয়েছিলো তখন একজন ওয়ার্ডবয় এসে আয়ুশকে কফি দিয়ে যায়। আয়ুশ পায়চারি করছে আর কফি খাচ্ছে। মাঝে মাঝে কেবিনের দরজা খুলে তনুকে দেখছে। তনু এখনো ঘুম। এভাবেই দেখতে দেখে একসময় ডাক্তার এসে পরে। ডাক্তারের সাথে আয়ুশ কথা হয়। তনু ঘুমাচ্ছে দেখে ডাক্তার এখনই তনুর চেকপের জন্য যায় না। কারণ পেসেন্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার টা হচ্ছে ঘুম। তো ঘুমাক পরে দেখা যাবে। এভাবেই চলতে থাকে। তার ঘন্টা খানিক পর মেহরাম আর তার চাচি এসে পরে। মেহরাম আসতেই আয়ুশ আগে তার দিকে তাকায়। মেহরাম গোলুমোলু হয়েছে, চুল গুলো আগের মতোই ঘন আছে যা এক সময় আয়ুশের সব থেকে বেশি পছন্দের ছিলো আসলে এখনো আছে। ফর্সা দ্বীগুণ হয়েছে, আকাশী কালারের একটা গোল জামা পরে এসেছে। আয়ুশ তাকিয়ে আছে তার দিকে। আসলে ভালোবাসা এমনই যার জন্য একবার জন্ম নেয় তার জন্য আজীবনই থাকে। তারপর লাইফে যেই আসুক না কেন। আগের মতো ফিলিংস আরেকজনের জন্য আবার আসা বড্ড বেশি দায়। মেহরাম গিয়ে আয়ুশের সামনে যায়। আয়ুশ কেন জানি মুচকি হেসে মাথা নিচে নামিয়ে ফেলে।

আতিয়া;; একি বাবা?

আয়ুশ;; জ্বি মা।

আতিয়া;; এভাবে কফি খেলে তো অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে।

আয়ুশ;; না মা প্রব্লেম নেই আমার অভ্যাস আছে।

আতিয়া;; ধুর রাখো অভ্যাস, আমি বাড়ি থেকে খাবার এনেছি খেয়ে নিও।

আয়ুশ;; না মা আসলে আপনারা তো এসেছেন আমি ভাবছিলাম যে একটু বাড়ি যাবো।

মেহরাম;; অফিসে?

আয়ুশ;; না অফিসে যাবো না। বাড়িতেই যাবো। শুধু গিয়ে ফ্রেশ হয়ে মা আর কণা কে দেখেই এসে পরবো আবার।

আতিয়া;; ওহহ আচ্ছা।

মেহরাম;; তনুর কাছে যাবে না?

আতিয়া;; হ্যাঁ চল।

আতিয়া, মেহরাম আর আয়ুশ একসাথেই কেবিনে গেলো। গিয়ে দেখে তনু উঠে পরেছে কিন্তু সেখানে শুয়ে তাকিয়ে আছে। তনু হঠাৎ মেহরামকে দেখে। মেহরাম তো আকুপাকু করছে এই ভেবে যে এই তনু না আবার রেগে যায়। কিন্তু মেহরাম যখন থেকে কেবিনে এসেছে তখন থেকেই তনু তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে পানি গুলো যেন জ্বলজ্বল করছে। তনু তার হাত টা হাল্কা করে তুলে মেহরামের দিকে বাড়ায়। মেহরাম একবার আয়ুশের দিকে তাকায়। আয়ুশ তাকে তনুর কাছে যাবার জন্য ইশারা করতেই মেহরাম তনুর পাশে বসে তার হাত টা নিজের হাত গুলোর মাঝে রাখে। তনু তার মুখের মাস্ক টা খুলে। মেহরাম না খোলার জন্য হাত দিয়ে আটকিয়ে দেয় কিন্তু তনু তবুও খোলে ফেলে। বুক ভরে কিছু টা বাইরের হাওয়া মুখে লাগায়। মাথায় শক্ত করে ব্যান্ডেজ করে দেওয়া আছে। তাতে সে কিছুটা চোখ কুচকে ফেলে। কিন্তু বাইরে যেন সে শ্বাস নিতে পারছে না। তবুও কোন রকমে বলে ওঠে…

তনু;; মেহরু

মেহরান;; হ্য হ্যাঁ (কান্না করে)

তনু;; আমি জানি বলেও লাভ নেই। কারণ মানুষ যাকে সব চেয়ে বেশি ভালোবাসে তার থেকেই সব চেয়ে বেশি আঘাত পায়। আর তোর ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম নয়। আমি তোকে আঘাত করে ফেলেছি। কাল যাই বলেছি, যেভাবেই বলেছি সব আমার রাগ ছিলো। যা কেটে গেছে। কিন্তু এখন আমার কাছে আফসোস আছে।

মেহরাম;; চুপ করবি। বোনে বোনে কতো ঝগড়া হয় আবার মিটমাট হয়ে যায়। তাই কালও তুই বলেছিস আর কাল কের দিন চলে গেছে আর সেগুলোও আমার মন থেকে চলে গেছে। অযথা আর বলিস না তো।

তনু;; মাঝে মাঝে তোকে দেখলে মনে হয় তুই আমার থেকে ভালো বোন ডিজার্ভ করিস। হয়তো আমার এটা চৌদ্দ পিড়ির ভাগ্য বা আমি কোন পূণ্যের কাজ করেছিলাম হয়তো কখনো তাই আমার ভাগ্যে খোদা তোকে দিয়েছিলো।

মেহরাম;; এতো পাম দিলে ফুটে যাবো।

তনু;; শোন কখনো যদি আমি তোর কাছে না থাকি বুঝবি যে আমি সবসময় তোর সাথেই আছি। হয়তো আমাকে দেখা যাবে না, স্পর্শ কিরা যাবে না কিন্তু মনে রাখবি আমি সবসময় তোর সাথে আছি, পাশে আছি। তোর মাঝেই আছি।

মেহরাম;; কিন্তু তোকে আমার লাগবে। আর তুই থাকবি আমি জানি। অযথা এগুলো বলা বন্ধ কর আর তোর জন্য কি বানিয়ে এনেছি বল তো?

তনু;; কি? (হেসে)

মেহরাম;; সেমাই আর পুডিং।

তনু;; ডক্টর যদি খেতে না দেয়?

মেহরাম;; তাহলে ডাক্টর কেই কাচা খেয়ে ফেলবো।

মেহরামের কথা শুনে তনু হেসে দেয়। আর খানিক দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আয়ুশ আর আতিয়া এগুলো দেখছে। তবে এবার আয়ুশ বলে ওঠে…

আয়ুশ;; মা আমি যাই, এরা দুই বোন আর আপনি থাকেন।

আয়ুশ;; আচ্ছা বাবা সাবধানে যেও। আর হ্যাঁ বাড়িতে গিয়ে আপা আর কণার সাথে কথা বলিয়ে দিও।

আয়ুশ;; আচ্ছা ঠিকআছে।

আয়ুশ আরেকবার মেহরাম আর তনুর দিকে তাকিয়ে হাতে নিজের জেকেট টা নিয়ে বাইরে বের হয়ে পরে। গাড়িতে বসে ড্রাইভ করছে আর মাথায় সব কিছু ঘুড়ছে। মেহরাম একজন নার্সের সাহায্যে তনু কে একটু বসিয়ে দেয় হেলান দিয়ে। আগে তো সব খাবার স্যালাইনের মাধ্যমেই নিতে হয়েছে কিন্তু এখন অবস্থা কিছুটা ভালো। তাই ডাক্তার কিছু সময়ের জন্য মাস্ক টা মুখ থেকে খুলে দিয়েছে। তবে ট্রিটমেন্টের সময় তনুর আরেকটা প্রব্লেম ধরা পরেছে তা হচ্ছে শ্বাসকষ্ট। আগে মাঝে মাঝেই তনুর নিঃশ্বাস থেমে গেতো। পরে আবার ভালো হয়েও গেতো কিন্তু কেউ টের পায় নি যে এটা শ্বাসকষ্টের লক্ষণ। কিন্তু এবার রিপোর্টে বেশ ভালো ভাবেই ধরা পরেছে। যাই হোক মেহরাম তনুকে খাইয়ে দিতে থাকলো। কয়েকবার খেয়েই আর তনু খেতে পারলো না। আবার নতুন স্যালাইন হাতে পুশ করে শুয়ে থাকলো। আস্তে আস্তে সময় গেতে গেতে বিকেল হয়ে গেলো। মেহরাম তনুর কেবিনেই বসে ছিলো। তনু হাল্কাভাবে ডাক দিলো মেহরাম কে মেহরাম আবার এসে তনুর পাশে বসে পরলো। তনু কতোক্ষণ তাকিয়ে থাকলো মেহরামের দিকে। যেন কতোদিন তনু মেহরামকে দেখে নি আজ দেখছে নিজের বোনকে। তনু আবার মেহরাম কে বলে ওঠে।





💙চলবে~~