তৈমাত্রিক পর্ব-২৪+২৫

0
993

#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ২৪

🌸~ ~

তনুর এক্সিডেন্ট হয়েছে আজ পুরো একদিন হয়ে গেছে। কিন্তু তনুর অবস্থায় কোন উন্নতি নেই। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগানো তার। হাতে সুই পুশ করা। হস্পিটালের বেডে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। কিন্তু বাইরে কারো মনে শান্তি নেই। আয়ুশ অফিসে যায় নি আজ। কাপড় চেঞ্জ করার জন্য শুধু বাড়িতে গিয়েছিলো তারপর আবার হস্পিটালে। মেহরাম হস্পিটালের বাইরেই আছে একবার হাটছে আরেকবার তনুর কেবিনের দিকে তাকাচ্ছে। কোন এক জায়গায় স্থীর নেই তার। মেহরাম তনুর কেবিনের ভেতরে উকি দেয় কিন্তু তখন হঠাৎ দেখে যে তনুর নিঃশ্বাস ভারি হচ্ছে আর সে অচেতন অবস্থা তেই বার বার শ্বাস নিচ্ছে খুব জোরে জোরে। মেহরামের এটা দেখে তো মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো।

মেহরাম;; আ আ..আয়ুশ, আয়ুশ

আয়ুশ;; হ্যাঁ কি হয়েছে?

মেহরাম;; আয়ুশ দেখো তনু, তনুর শ্বাস নিতে হয়তো কষ্ট হচ্ছে।

আয়ুশ;; কিহহ?

আয়ুশ জলদি এসে তনুর কেবিনের ভেতরে দেখে। দেখে যে সত্যি তনুর অবস্থা বেশি ভালো না। আয়ুশ দ্রুত ডাক্তার কে ডেকে আনে। ডাক্তার সহ নার্স এলো। তনুর কাছে গিয়ে আগে তার হাতের সুই টা আগে খুলে দিলো। নার্স গিয়ে তনুর মাথায় হাত দিয়ে শান্ত করানোর চেষ্টা করছে কিন্তু কোনো তেও কিছু কাজ হচ্ছে না। ডাক্তার তনুকে দেখতে থাকে। এদিকে মেহরাম গ্লাসে ওপর হাত রেখে দিয়ে তনুর দিকে তাকিয়ে আছে আর হেচকি দিয়ে কাদছে। আয়ুশ মুখে একরাশ চিন্তার ছাপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আয়ুশ মেহরাম কে কিছু বলবে কি বলবে না বুঝতে পারে না। কেননা ব্যাপার টা তার বোনের। এভাবেই দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মেহরাম হঠাৎ পরে যেতে ধরে আর আয়ুশ ফট করে তাকে ধরে ফেলে। আস্তে করে ধরে এক জায়গায় বসিয়ে দেয়।

মেহরাম;; আ আয়ুশ

আয়ুশ;; হ্যাঁ বলো

মেহরাম;; চাচি কে ফোন দাও প্লিজ। আসতে বলো জলদি

আয়ুশ;; হ্যাঁ দিচ্ছি।

আয়ুশ মেহরাম কে বসিয়ে দেয়। তারপর তার হাতে একটা পানির বোতল দিয়ে তনুর আম্মুকে ফোন দেয়। তনুর এমন অবস্থা শুনে তার মা তড়িঘড়ি করে হস্পিটালে এসে পরে। এদিকে যতো সময় যাচ্ছে ততোই যেন মেহরামের শরীর খারাপ হচ্ছে। মেহরামের পাশেই দুহাত ভাজ করে দাঁড়িয়ে আছে আয়ুশ। ঠিক পনেরো মিনিট পর ডাক্তার বের হয়।

ডাক্তার;; উনার অক্সিজেন লাগে। মানে শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হয়। কেননা এক্সিডেন্ট টা খুব মারাত্মক ভাবে হয়েছে। আরো রক্ত দেওয়া হয়েছে তাকে। তবে বর্তমানে অক্সিজেন মাস্ক ছাড়া উনি এক প্রকার অচল। আর হ্যাঁ খুশির খবর হচ্ছে এটা যে উনার খুব দ্রুত জ্ঞান ফিরে আসতে পারে।

ডাক্তার তার কথা গুলো বলে চলে গেলেন। সবাই যেন এতে হাফ ছেড়ে বাচলো। মন থেকে খুব ভারি একটা বোঝা দূর হলো সবার। তার কিছুক্ষণ পরই আতিয়া এলো। এসেই দেখেই সবাই বসে আছে।

আতিয়া;; মেহরাম..!

মেহরাম;; এসেছো।

আতিয়া;; হ্যাঁ তনু কেমন আছে?

মেহরাম;; ওর আসলে অক্সিজেন শেষ হয়ে গিয়েছিলো তাই ওমন শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিলো কিন্তু এখন ঠিক আছে একদম।

আতিয়া;; ওহহহ আচ্ছা।

মেহরাম;; বোস৷

আতিয়া;; তোর কি হয়েছে মুখ টা এমন শুকনো কেন?

মেহরাম;; না মানে..

আয়ুশ;; মাথা ঘুরে পরে যেতে নিচ্ছিলো।

আতিয়া;; তোকে যে বলি যে একটু বাড়ি যা এখানে আমরা থাকি। কথা তো শুনিস না।

মেহরাম;; আচ্ছা ছাড়ো না এইসব। তনুর জ্ঞান ফেরার সম্ভাবনা বেশি।

আতিয়া;; যাক ভালোই হলো।

আয়ুশের ফোন আসাতে সে সেখান থেকে দূরে চলে গেলো খানিক টা। আতিয়া মেহরামের পাশেই বসে আছে। আস্তে আস্তে রাত হয়ে আসছে। এখনো হস্পিটালে আয়ুশ মেহরাম আর তার চাচি রয়েছে। কিছুক্ষণ আগে আবার একজন নার্স আর ডাক্তার কেবিনের ভেতরে গিয়েছে। বেশ সময়পর মুখে খানিক হাসি ফুটিয়ে ডাক্তার বাইরে বের হয়ে পরে।

ডাক্তার;; আপনারা ভেতরে গিয়ে পেসেন্টের সাথে কথা বলতে পারেন। জ্ঞান ফিরেছে তার।

ডাক্তার এটা বলে চলে গেলেন। আয়ুশ চোখ টা বন্ধ করে এক শান্তির দম ছাড়ে। মেহরামের তো যেন মুখ থেকে হাসিই সরছে না। তারা সবাই কেবিনের ভেতরে যায়। গিয়েই দেখে তনু শুয়ে আছে কিন্তু চোখ দুটো খোলা। ওপরের দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে আছে। আতিয়া গিয়ে তনুর পাশে বসে পরে। মাথায় হাত দিয়ে বুলিয়ে দেয়। কিন্তু তনু একটু তার মায়ের দিকে আবার মেহরামের দিকে তাকায়। তার একটু দূরেই আয়ুশও তনুর দিকে তাকিয়ে আছে। আতিয়া তার মতো কথা বসে সেখান থেকে সরে যায়। তনু এক দৃষ্টিতে মেহরামের দিকে তাকিয়ে আছে তা সবাই খেয়াল করেছে। মেহরাম গিয়ে তনুর পাশে বসে। মেহরাম তার হাত দিয়ে তনুর মাথায় ছুয়ে দিতে যাবে কিন্তু তখনই তনু আলতো করে তার মাথা টা সরিয়ে নেয়। এতে মেহরাম বেশ অবাক হয়। তনু তার কাপা কাপা হাত দিয়ে মুখের মাস্ক টা খুলে ফেলতে ধরে। আয়ুশ খুলতে বারণ করলেও কোন রকম করে তনু তার মুখের মাস্ক টা খুলে। জোরে জোরে শ্বাস নিতে নিতে মেহরামের উদ্দেশ্যে বলে ওঠে….

তনু;; আম আমার, আমার জীবনের স..সসবথেকে বড় অ..অভিশাপ তুই।

তনুর এমন কথায় মেহরামের মাথায় এক প্রকার ভাজ ভেংে পড়েছে। সে কখনো কল্পনাও করেনি যে তার বোনের মুখ থেকে তাকে কোন দিন এই কথা টা শুনতে হবে। তনুর মুখ থেকে। তনুর এমন কথায় মেহরামের মুখের হাসিটা ফিকে হয়ে যায় একদম। মূহুর্তেই চোখের কোণে পানি জমা হয়ে গেছে। মেহরাম কিছু শুকনো ঢোক গিলে কাপা কাপা গলায় বলে ওঠে…

মেহরাম;; ততনু, আমি তো

তনু;; আমার জীবন দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। এক দিকে তুই আরেক দিকে আয়ুশ। আমার জীবনের অভিশাপ তুই।

মেহরাম;; তনু 🥺। আমি ত

তনু;; একটা কথাও বলবি না। আমার সাথে কোন কথাই বলবি না। সব ভালোবাসা ঘৃণায় পরিণত হচ্ছে আমার। মন চাইছে তোকে মেরে ফেলি। মরে যা তুই।

তনুর এই কথা শুনে মেহরাম ভেতর টা একদম দুমড়েমুচড়ে গেলো। মন ট যেন ঠাস করে খান খান হয়ে গেলো। তবে তনুর এমন কথায় তার মা আর চুপ করে থাকতে পেলো না।

আতিয়া;; তনু চুপ কর, এগুলো কি যা তা বলছিস তুই। মেহরামের অবস্থার কথা তোর মাথায় আছে নাকি নেই ও। আর এই দশায় কিনা তুই এই কুলক্ষণে কথা গুলো মুখ থেকে বের করছিস। যেই মেহরাম তোর জন্য এত্তো কিছু করলো তার জন্য তুই এগুলো বলছিস। মেহরাম কি জানতো যে সবার লাইফে এমন এক মোড় নিবে। তাতে ওই বেচারির কি দোষ। তোর যখন এক্সিডেন্ট হয় তখন মেহরামের অবস্থা দেখলে তুই নিজে পাগল হয়ে যেতি। আর মেহরাম এখন প্রেগন্যান্ট তুই এই অবস্থা এগুলো কি উলটা পাল্টা বকছিস। হুস আছে তোর। ছিঃ তনু।

তনু;; দেখেছো আজ আমার মা আমার বিপক্ষে কথা বলছে, আমাকে মা কেও কেড়ে নিয়েছিস তুই।

মেহরাম;; 😔

আতিয়া;; তনু বেশি হচ্ছে।

তনু;; খুব হিংসে হয় আমার। না চাইতেও হয়, অনেক বেশি হয়।

আতিয়া;; কারণ তোর মনে দিন দিন বিষ ভরে যাচ্ছে আর তা তোর দোষে। কখন কোন কথা টা বলতে হবে তার তো খেয়াল রাখ।

তনু;; আমি ভাগ্য খারাপ যে এমন এমন সবাইকে আমার লাইফে পেয়েছি।

তনুর এমন ধরণের কথা শুনে আয়ুশ আর কি কোন কথা বলবে রাগে দুঃখে সোজা কেবিন থেকে বের হয়ে পরে বাইরে। কেউ ভাবেও নি যে তনু উঠেই এমন সব কথা বলবে। তবে মেহরামের কাছে মনে হচ্ছে যে সত্যি তনুর এমন কথা শোনার আগে হয়তো তার মরে গেলেই ভালো হতো। যখন সে আয়ুশের সাথে বিচ্ছিন্ন হয় তখনও যেন এমন কষ্ট হয় নি তার। তনু মেহরামের জীবন, কিন্তু সেই যে এক সময় মেহরামের জীবন নেওয়ার কথা বলবে তা কখনো ভাবে নি। তনু এখন যেন মেহরামকে দেখতে পারচ্ছে না। তাই মেহরাম মাথা নিচু করে কেবিন থেকে বের হয়ে পরে। তনুর মা তনুর সাথে রাগ করে বাইরে বের হয়ে পরে। তখনই একজন নার্স এলো এসেই দেখে তনু মুখের মাস্ক সরিয়ে রেখেছে। তা দেখে নার্স কিছুটা রাগই করলো।

নার্স;; আরে পেসেন্টের মাস্ক মুখের বাইরে কেন, আরে জলদি মুখে লাগান। এতে আপনারই কষ্ট হবে। আর পরে একটা থেকে আরো উলটো কিছু একটা হিয়ে যাবে। মাস্ক লাগান, মাস্ক লাগান।

নার্স এসে তনুকে আবার অক্সিজেন মাস্ক টা পরিয়ে দিয়ে আর সবকিছু চেক করে চলে গেলো। আতিয়া বাইরে গিয়ে দেখে মেহরাম বাইরের বড়ো জানালার কাছে পেটের ওপর হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে। আয়ুশ কে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। আতিয়া দ্রুত পায়ে মাহরামের কাছে চলে যায়। গিয়েই দেখে সামনে একমনে তাকিয়ে আছে সে আর চোখ দিয়ে পানি পরতে পরতে তা শুকিয়ে গেছে।

আতিয়া;; মেহরাম মা তুই মনে কিছু নিস না। মাথা ঠিক নেই তনুর।

মেহরাম;; না চাচি সবার মাথাই ঠিক আছে। সবগুলোই সত্যি কিথা ছিলো। আর মাথা যদি ঠিক নাও থাকে তাহলেও আমার লাভ-ই হলো। কেননা মাথা ঠিক ন থাকলেই মানুষ একমাত্র সত্যি কথা তার মুখ দিয়ে বের করে। তনুও বলেছে।

আতিয়া;; মেহরাম

মেহরাম;; আসলেই চাচি এর থেকে আমার মরে গেলেই ভালো হতো।

আতিয়া;; চুপ চুপ।

আতিয়া দ্রুত মেহরামের মুখের ওপর হাত রেখে দিলো।

মেহরাম;; আমি ভেবেছিলাম তনুর জ্ঞান ফিরতেই সে আবার আমাকে মেহরু বলে ডাক দিবে। কিন্তু এটা যে বলবে ভাবি নি। জানো চাচি খুব বেশি খারাপ লাগছে (ফুপিয়ে কেদে)

আতিয়া;; কাদিস না।

আতিয়া কোন রকম করে মেহরামকে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়। আয়ুশ কে কোথাও দেখা যাচ্ছে না বলে। মেহরামের ফোন দিয়েই আয়ুশকে ফোন করে। এতোক্ষণ আয়ুশ হস্পিটালের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো। আতিয়ার ফোন পেয়ে তাড়াতাড়ি ভেতরে যায়।

আতিয়া;; আয়ুশ

আয়ুশ;; জ্বি মা

আতিয়া;; মেহরামকে বাড়ি দিয়ে এসো।

মেহরাম;; চাচি আমি রকা যেতে পা…

আতিয়া;; চুপ কর তো, আয়ুশ যাও দিয়ে আসো। এই অবস্থায় একা বাড়ি যেতে দেবো পাগল হয়েছি তো আমি। আয়ুশ যাও তো বাবা।

আয়ুশ মেহরাম কে গাড়িতে করে বাসায় দিয়ে আসে। গাড়িতে থাকা কালিন কোন কথা হয় না তাদের। মেহরাম যেন একটা ঘোরের মধ্যে ছিলো। এক চোখে জানালার বাইরে তাকিয়ে ছিলো। ড্রাইভ করার সময় আয়ুশ কয়েকবার মেহরামের দিকে তাকিয়েছিলো। কিন্তু মেহরামের কোন হুস নেই। তনুর বলা কথা গুলো তার কানে বারবার বাজছে। “” তুই আমার জীবনের সব থেকে বড়ো অভিশাপ””, “মন ভাইছে তোকে মেরে ফেলি”। মেহরাম তার চোখ গুলো বন্ধ করে ফেলে খানিকপরে আবার খোলে। আয়ুশ তাকিয়ে দেখে মেহরামের চোখ দিয়ে টুপ করে বিন্দুর ন্যায় এক ফোটা পানি গড়িয়ে পরলো আর সে দ্রুত তা মুছে ফেললো। আয়ুশ বুঝতে পারছে যে এখন মেহরামের ওপর দিয়ে ঠিক কি যাচ্ছে। তাই সে কোন কথাই বলে না। দেখতে দেখতে এক সময় বাড়ি এসে পরে। গাড়ি অনেক উচু সেখান থেকে মেহরাম একা নামতে পারে না। তাই আয়ুশ গাড়ি থেকে নেমে জলদি মেহরামের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। সেখানে দাঁড়িয়ে গাড়ির দরজা টা খুলে দিলে মেহরাম তার এক হাত পেটে রাখে, আয়ুশ মেহরামের আরেক হাত ধরে নিচে নামিয়ে আনে। তারপর মেহরাম আস্তে আস্তে হেটে বাড়ির ভেতরে চলে যায়। আয়ুশ কতোক্ষণ মেহরামের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে চলে আসে। আবার চলে যায় হস্পিটালে। গিয়ে দেখে আতিয়া বাইরে বসে আছে। আয়ুশ গিয়ে আতিয়ার পাশে বসে পরে।

আয়ুশ;; মা এভাবে বসে আছেন কেন, ভেতরে যান নি?

আতিয়া;; আমি ভাবি নি তনু এভাবে মেহরামকে কথা গুলো বলবে। মেয়েটার খুব মন লেগেছে।

আয়ুশ;; মা ছাড়ুন না, তনু রাগে বলে ফেলেছে।

আতিয়া;; কিন্তু এখানে রাগের কিছুই নেই। কখন কার সাথে কি হয় বা জার কপালে কি লিখা আছে তা আমরা কেউ কিছুই জানি না। কে জানতো যে এমন হবে। তাই বলে মেহরামকে এগুলো। আয়ুশ আমি বলতে অয়ারবো না ছোট থেকেই এরা দুইজন দুইজনের জীবন। কিন্তু তনু…। আজ সে মেহরামকে অভিশাপ। মেয়েটা অন্তঃস্বত্বা তার ওপর এগুলো। মেহরাম আজ ঠিক নেই।

আয়ুশ;; মা প্লিজ এইসব এখন ছাড়ুন। তনুর কি অবস্থা?

আতিয়া;; ভালোই আছে। জ্ঞান আছে।

আয়ুশ বসে থাকে আতিয়ার পাশে। আর এদিকে মেহরাম কোন রকমে তার মা আর চাচ্চুর সাথে কথা বলে তার রুমে চলে যায়। বেশি নড়াচড়া করতে পারছে না পেটে হুট করেই ব্যাথা শুরু করে যাচ্ছে। এক জায়গায় গিয়েছে চুপ করে বসে পরলো। কিন্তু তবুও যেন মনের মধ্যে বিচলতা কাজ করছে তার। কোন রকমে ওঠে ওয়াসরুমের দিকে চলে গেলো। বেছিং-এ গিয়ে পানি হাতে নিয়ে ইচ্ছে মতো মুখে ছিটা দিতে থাকলো। তনুর কথা গুলো মাথায় ঘুড়ছে। আর মেহরাম কেদে কেদে জোরে পানির ছিটা গুলো সব মুখে দিচ্ছে। সে শুধু বের হতে চাচ্ছে এই নরক থেকে। আর ভালো লাগে না। শুধু মুক্তি চায় সে। নিচ থেকে মাথা তুলতে ওপরে আয়নার দিকে তাকাতেই দেখে নাকমুখ সব ফুলে গেছে। তা দেখে মেহরামের কান্না যেন দ্বীগুণ হয়ে যায়।





~~চলবে“

#তৈমাত্রিক
#লেখিকা; Tamanna Islam
#পর্বঃ ২৫

.
.
.

মেহরাম কখনো ভাবেই নি যে একদিন তনুর মুখ থেকেও তাকে এইসব শুনতে হবে। সত্যি মন টা একদম ভেংগে গেছে। মেহরামের এখন নিজের কাছে নিজেরই অপরাধী মনে হচ্ছে। “”মেহরাম তনুর জীবনে অভিশাপ”” মেহরামের কানে শুধু তনুর বলা এই কথা টাই বাজছে। সে তো অভিশাপ হতে চায় নি। কিন্তু তবুও না চাইতেই হয়ে গেছে। যা চাইলো তা পেলো না, আর যেটা চাইলো না তাই হয়ে গেলো। হয়তো অভিশাপের কোন কাজ করেছিলো তাই আজ সে না চাইতেও শুধু তনুর কাছে না সবার কাছেই অভিশাপ। রাত বাজছে প্রায় ৩ টার কাছাকাছি কিন্তু হস্পিটাল থেকে আসার পর থেকে কান্না যেন কোন বাধই মানছে না মেহরামের। এক সময় আতিয়া অর্থাৎ মেহরামের চাচি বাসায় এসে পরেন। এসেই দেখে হলরুমে কনিকা বসে আছেন। মুখ টা কেমন ভার। বাকি সবাই হয়তো ঘুম। আতিয়া কনিকার সামনে চলে যায়…

আতিয়া;; ভাবি ঘুমাও নি?

কনিকা;; না আসলে তোরই আসার অপেক্ষা করছিলাম।

আতিয়া;; ওমা কেন?

কনিকা;; আচ্ছা তনু মা কেমন আছে, ভালো আছে তো। আর হস্পিটালে কি কিছু হয়েছে?

আতিয়া;; না না কিছুই হয় নি কিন্তু কেন?

কনিকা;; মেহরাম এইযে হস্পিটাল থেকে এসে রুমে গিয়েছে আর বের হওয়ার নাম নেই। বুঝলাম না কিছুই। চোখ মুখ কেমন ফুলে আছে। তনুর কিছু হলে তো মেহরাম শেষ কিছু হয়েছে কিনা তাই জিজ্ঞেস করছি?

আতিয়া;; না ভাবি কিছুই হয় নি, আর তনুও একদম ঠিক আছে। জ্ঞান ফিরেছে।

কনিকা;; ওহহ আচ্ছা যাক আলহামদুলিল্লাহ।

আতিয়া;; আচ্ছা মেহরাম তো রুমে তাই না আমি গিয়ে দেখি তো।

কনিকা;; হ্যাঁ যা। আর খেয়েছিস কিছু?

আতিয়া;; না ভাবি আসলে খিদে নেই, খিদে এক প্রকার মরেই গেছে। খেতে আর মন চায় না। আমি যাই।

কনিকা আর কি বলবে আসলেই তো খাওয়ার মন সবারই এক রকম উঠেই গেছে। কেননা জীবনে একটার পর একটা ভেজাল লেগেই আছে, লেগেই আছে। কনিকাও আতিয়া কে আর কিছুই বলে না। আতিয়া সিড়ি বেয়ে উঠে মেহরামের রুমের কাছে চলে যায়। গিয়ে আস্তে করে রুমের দরজা টা খুলে। দরজা লাগানো ছিলো না শুধু চাপানো ছিলো। গিয়েই দেখে মেহরাম বসে বসে কাদছে। পুরো একটা বাচ্চার মতো। আতিয়ার এত্তো মায়া লাগলো দেখে। সে দ্রুত করে রুমে চলে গেলো। মেহরাম খেয়ালই করে নি যে তার চাচি এসেছে রুমে। যখন আতিয়া মেহরামের সামনে গিয়ে দাড়ালো তখন বুঝতে পারলো। মেহরাম মাথা উঠিয়ে দেখে আতিয়া তার দিকে তাকিয়ে আছে। মেহরাম আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। তার চাচির কোমড় জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেদে দেয়।

মেহরাম;; ওওও চাচি আমি আসলেই অভিশাপ তাই না। তা না হলে এমন কেন হলো। বিয়ের পর সোহেল মারা গেলো। আমার বাচ্চা টা বাবার মুখ টা পর্যন্ত দেখতে পেলো না। ফ্যামিলি তে এতো প্রব্লেম আর এই তনুর এক্সিডেন্ট। আমি আসলেই অভিশাপ তা না হলে এমন কিছুই হতো না। যা ছুই তাই ধ্বংস…..

আতিয়া;; চুপ চুপ চুপ। একদম চুপ। এমন কথা বলতে হয় না। কে বলেছে যে তুই অভিশাপ। শোন তুই হলি এই বাড়ির লক্ষি বুঝলি।

মেহরাম;; আমি আজ পর্যন্ত দেখলাম না যে আমার জন্য কিছু ভালো হয়েছে।

আতিয়া মেহরাম কে ছাড়িয়ে তার পাশে বসে। মেহরামের চোখের পানি গুলো মুছে দিয়ে তাকে বুঝিয়ে বলতে থাকে।

আতিয়া;; তুই জানিস তোর দিদুন আগে হাটতে পেতো না। এমনও দিন গিয়েছে যেখানে তোর দিদুন কে হুইল চেয়ারে বসে বসে কাটাতে হয়েছে। হাত অব্দি নড়াতে পারতো না। কিন্তু যখন সবাই জানলাম যে ভাবির পেটে তুই আছিস। সেইদিন প্রথম তোর দিদুন হাত নাড়িয়েছিলেন। আর যখন তুই হলি তখন তোর দিদুন সবাইকে অবাক করে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিলো। তোর চাচ্চুর ব্যাবসায় এত্তো লস হয়েছিলো যে বলার বাইরে। কিন্তু যতো টাকা হারিয়েছিলাম তার থেকে দ্বীগুণ আয় করেছি। আর তুই তনুর কথায় মন খারাপ করছিস, ধুর পাগলি তনু কি জানে। তনু ছোট থাকতে একদিন হারিয়েও গিয়েছিলো। কিন্তু তুই জানতি যে তনুর মিষ্টি জিনিস অনেক পছন্দের। পরে তুই যদি আমদের সেই মিষ্টির দোকানে না নিয়ে গেতি তাহলে তো তনুকে মনে হয় না আর পেতাম। অবশ্য তনুকে তার পরে কতো গুলো উত্তম-মধ্যমও দিয়েছিলাম।

আতিয়ার কথা শেষ হতেই মেহরাম খানিক হেসে দেয়। আর চোখের পানি মুছে ফেলে।

আতিয়া;; এই তো এইবার হয়েছে। এই যে এভাবে হাসলে কি হয় হ্যাঁ।

মেহরাম;; হাসি তো!

আতিয়া;; শোন তনুর অবস্থা আসলে ভালো না জানিসই তো। সব কিছু কেমন এলোমেলো হয়েছে। তাই এইসব বলে ফেলেছে।

মেহরাম;; আমি জানি চাচি।

আতিয়া;; হ্যাঁ অবশ্য এটা ঠিক যে আজ তনু একটু বেশিই বলেছিলো। যার জন্য আমার নিজেরই মেজাজ চটে গিয়েছিলো।

মেহরাম;; আহা বাদ দাও না চাচি।

আতিয়া;; খেয়েছিস?

মেহরাম;; খিদে নেই।

আতিয়া;; আচ্ছা ফ্রিজে আমি ফল রেখে দিয়েছি যখন মন চায় খেয়ে নিস আর ওয়াটার পটে পানি আছে। আর শোন সকালে রেডি থাকিস হস্পিটালে যাবো।

মেহরাম;; আমি আবার?

আতিয়া;; কিচ্ছু হবে না আমরা যাবো কেমন। এখন কান্নাকাটি একটু অফ কর আর ঘুমা তো।

মেহরাম;; আচ্ছা।।

আতিয়া মেহরামের রুম থেকে বের হয়ে পরে। এদিকে মেহরামকে যতোই না বলুন চিন্তা তো আর সহজে মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারে না।
আর অন্যদিকে তনু হস্পিটালের বেডে শুয়ে আছে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক রাত দিন ২৪ ঘন্টাই পরে থাকতে হয়। তা ছাড়া সে অচল। হাতে সুই পুশ করা। স্যালাইন দেওয়া আছে। হাতে যেখানে সুই লাগানো সেই জায়গাটা কালো কুচকুচকে বর্ণের হয়ে গেছে। বেশ ব্যাথাও করছে। মন তো চাইছে যে একদম টান দিয়ে সুই টা খুলে ফেলতে হাত থেকে কিন্তু লাভ নেই। নার্স এসে আবার লাগিয়ে দিয়ে যাবে। তনুর মাথার ঠিক সামনেই জ্বলজ্বল করছে একটা সাদা ধবধবে বাতি। সেখান থেকে আলো পুরো ঘরকে আলোকিত করে রেখেছে। এখন অনেক রাত, ২-৩ জন নার্স ছাড়া আর তেমন কেউ রাতের ডিউটি তে নেই। মধ্য রাত একদম চুপচাপ, তার মধ্যে ঘড়ির টিকটিক আওয়াজ যেন আরো গাঢ় হয়ে গেছে। ঘড়ির এই আওয়াজ জানান দিচ্ছে যে “সময় চলমান, সময় বহমান। এটা কারো জন্যেই থেমে থাকে না। সময় সময়ের মতো চলে যায়”। আর তার জন্যই হয়তো বলে যে সময়ের সঠিক ব্যাবহার করতে শেখ। কেননা সময়ের সঠিক ব্যাবহার না করলে পরর্বতীতে আফসোস ছাড়া আর কোন উপায় পাবে না। আর সেই আফসোসের কোন দাম থাকবে না। আর আজ এই আফসোস টা তনুর হচ্ছে যে কেন সে আগে সবকিছু জানলো না, বুঝলো না। তাহলে হয়তো আজ সবার জীবন চক্রের দৃশ্য টা ভিন্ন থাকতো। কিন্তু তনুর এই আফসোসের এখন কোন মূল্য নেই। মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে আখি দুটো মেলে শূন্যে তাকিয়ে আছে। মেহরামের মুখ টা তনুর চোখে ভাসছে। আজ নিজের রাগের মাথায় বোন টাকে কি না কি বলেছে। তনুর জীবনে খুব খারাপ হয়েছে আর সে এগুলো সামলাতে না পেরে উলটা পালটা সব বলে দিয়েছে। কিন্তু মেহরাম, ওই বেচারির জীবন তো আরো আগুনে পুড়ে সেই কবেই ছাই হয়ে গেছে।

তনু;; ভুল করেছি আমি, অনেক বড়ো ভুল। এই ভুলের কোন পশ্চাতাপ নেই। শুধু হায় হায় করে যেতে হবে আমার। এই কি করলাম এই ভেবেই। মেহরামকে আজ কি না কি বলেছি আমি। কিভাবে পারলাম আমি এইসব বলতে। রাগের মাথায় সব ছিঃ। কিভাবে পারলাম আমি। আমি আসলে কারো ভালোবাসা পাবারই যোগ্য না। কেননা আমার থেকে আরো হাজার গুণে বেশি মেহরাম আয়ুশকে ভালোবাসে তবুও সে মুখ বুজে সব সহ্য করেছে। আর আজ আমি কিনা এই সামান্য জিনিস গুলো সহ্য করতে না পেরে এগুলো বলে দিয়েছি। বোন নামে কলংক আমি। আমার সাথেই এইসব হবার কথা কেননা আমি এগুলোই পাবার যোগ্য। আমি মেহরাম কে মরে যেতে বলেছি তাও সেই সময় যখন যে প্রেগন্যান্ট,, অভিশাপ বলেছি। যেখানে আমি নিজেই জীবন মরণের মাঝে ঝুলে আছি। মেহরাম কে কি করে পারলাম আমি এগুলো বলতে। (মনে মনে)

তনু এই কথা গুলো মনে মনে আওড়াচ্ছে। আর তার চোখের কার্নিশ বেয়ে বয়ে যাচ্ছে বহু অশ্রুবিন্দু। ওইযে আফসোস, সেই আফসোসের কোন মানেই হয় না এখন। কারণ অনেক সময় “মানুষকে মারতে কোন ধারালো ছুরি বা অস্ত্রের প্রয়োজন হয় না, মুখের বুলিই যথেষ্ট”। বাইরে আয়ুশ বসে আছে। সে বাসায় যায় নি। কারণ এখানে কেউ নেই। কাউকে না কাউকে তো থাকতেই হবে। তনুর মা থাকতে চেয়েছিলো কিন্তু আয়ুশ জোর করে পাঠিয়ে দিয়েছে। ঘুম নেই চোখে। আয়ুশের খুব খারাপ লেগেছে তনু মেহরামকে এই কথা গুলো বললো। এটা অন্য যে কেউ শুনলেই খারাপ লাগবে। দুহাত ভাজ করে বসে আছে আয়ুশ। সব চিন্তা মাথায় খেলা করছে। সকাল থেকে শুরু করে এই এতো রাত অব্দি সে কমপক্ষে ১২ কাপের মতো কফিই খেয়েছে। কিন্তু কোন ভাবেই শান্তি নেই। জীবন তো তেতোই সেই শুরু থেকেই, এখন এই এত্তো পরিমাণে কফি খেয়ে জীবন টাকেও তেতো বানিয়ে দিয়েছে। আয়ুশ একদম বসে আছে, একবার হাটছে, আরেকবার দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আবার মাঝে মাঝে তনুর কেবিনে উকি দিচ্ছে। মনে শান্তি না থাকলে কোন কিছু করেই লাভ নেই। অবশেষে আয়ুশ নিজের ফোন টা বের করে। কেননা সে জানে যে মেহরামকে যেভাবে আজ কথা গুলো বলা হয়েছে তাতে সে ভালো নেই। মেহরামের নাম্বার টা বের করে কল দিবে কি দিবে না এক দোটানার মাঝে পরে যায়। এভাবেই কিছুক্ষণ নাম্বারের দিকে তাকিয়ে থাকে। চোখ দুটো অন্যদিকে ঘুড়িয়ে ফোন টাকে আবার পেন্টের পকেটে রেখে দেয়। কিন্তু কথায় আছে না যে হাত পা এইসব আটকানো যায় কিন্তু মন কে আটকানো কিছুতেই সম্ভব না, কিছুতেই না। আবার দ্রুত ফোন টা বের করে কিছু না ভেবেই মেহরামকে কল দেয়। আয়ুশ ফোন কানে রেখে এদিক ওদিক হাটছে। মেহরাম বারান্দায় বাতাসে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে রুমে ফোন বাইব্রেট করছে। কিন্তু মেহরামের সেদিকে কোন খেয়ালই নেই। এভাবে তিনবার ফোন বেজে এক সময় কেটেই যায়। ফোন রিসিভ হয় না। আয়ুশ ভাবে হয়তো মেহরাম ঘুমিয়ে পরেছে। নয়তো ঠিক ফোন ধরতো। আয়ুশও ফোন দেওয়া বন্ধ করে দেয়। কিন্তু তখনই হঠাৎ তনুর কেবিন থেকে কিছু পরে যাওয়ার শব্দ আসে। আয়ুশ কপাল কুচকে দ্রুত কেবিনে যায়। গিয়ে দেখে তনু চোখ মেলে তাকিয়েই আছে কিন্তু তার পাশে থাকা স্টীলের ট্রে টা পরে গেছে। সেখানে হেক্সিছল, ব্যান্ডেজ, কাচি, আরো না জানি কতো কি কি রাখা। আয়ুশ গিয়ে তা তুলে আবার আগের জায়গায় রাখে। তবে এবার সে বাইরে যায় না। কেবিনে তনুর পাশে চেয়ারে গিয়ে বসে। তনু হাল্কা ভাবে ঘাড় টা ঘুড়িয়ে দেখে যে আয়ুশ তার দিকেই তাকিয়ে আছে। নিভু নিভু চোখে তনু তাকায়। তনু ভেবেছে যে আয়ুশ এভাবে তাকিয়ে আছে হয়তো অনেক বেশি অভিমান তার মনে জমে আছে। কিন্তু তনুর ধারণা কে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে আয়ুশ বলে ওঠে..

আয়ুশ;; আমার মনে কারো জন্য কোন ঘৃণা নেই। আহা, একবিন্দুও না। কারণ সবাই পরিস্থিতির শিকার। যার যার মনের অবস্থা একমাত্র সেই জানে। কেউ কখনো নিজের অবস্থা থেকে অন্যের মনের খবর জানতে পারবে না। সো যেই সাফার করে শুধু সেই বুঝে।

তনু;; আ..আআপনি বা ববাড়ি যান নি?

আয়ুশ;; কি করে যাই। এখানে কেউ নেই। একজন কে তো থাকতে হবে তাই না।

তনু;; মা

আয়ুশ;; মা কে জোরে করেই বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। সেই কখন এসেছিলো আর কতো বসে থাকবে।

তনু;; মে ম মেহরু..

আয়ুশ;; কে ওই অভিশাপ?!

তনু;; _____________

আয়ুশ;; না ওই অভিশাপ কে আমি ডাকি নি। যদি ওর জন্য আবার কিছু হয়ে যায় তাই।

তনু;; আয়ুশ…

আয়ুশ;; রাগ হোক বা ডিপ্রেশন এভাবে কাউকে কথা বলতে হয় না তনু। কথা বলার আগে অন্তত একবার ভেবে নেওয়া উচিত। কারণ কথার আঘাত অনেক বেশি ভয়ংকর হয়।

তনু;; আমার আম..

আয়ুশ;; বাদ দাও, তুমি সবকিছু সহ্য করে উঠতে পারো নি তাই বলে দিয়েছো, আমি বুঝি। কিন্তু তোমার একবার এটা বোঝা উচিত ছিলো যে তোমার এই কথা গুলো মেহরাম সহ্য করতে পারবে নাকি। কারণ মেহরাম অনেক বেশি ভালবাসে তোমায়। আমি মেহরামের সাইড নিচ্ছি না, কারো পক্ষে কথা বলছি না আমি। কিন্তু কথা গুলো এক অপরিচিত কেউ শুনলেও খারাপ লাগতো। আর মেহরাম একজন বোন হিসেবে তোমাকে কতো টুকু ভালোবাসে তা বলতে হবে না। কারণ তা আমার থেকে ভালো তুমিই জানো।

তনু;; আয়ুশ..

আয়ুশ উঠে গিয়ে তনুর পাশে দাঁড়ায়। নিজের হাত টা তনু কপালে রেখে দেয়।

আয়ুশ;; আমি জানি তুমি কি বলবে। তোমার দোষ নেই। এখানে দোষ বলতেই কোন শব্দ নেই। জানি বলেও লাভ নেই চিন্তা মাথায় আসবেই। তুমি প্লিজ চোখ টা বন্ধ করো আর শুয়ে থাকো। আর হ্যাঁ ভুলেও মুখের মাস্ক সরাবে না। স্যালাইন আছে শেষ হতে বেশ কয়েক ঘন্টা বাকি ততোক্ষণে সকাল হয়ে যাবে আর সকালে ডক্টর এসে পরবে। তুমি শুয়ে থাকো আমি বাইরেই আছি।

আয়ুশ এই বলে উঠে বাইরে চলে গেলো। তনু আয়ুশের দিকেই তাকিয়ে ছিলো। খনিকের জন্য হলেও হয়তো অনেক বেশি ভালো আর পারফেক্ট কাউকে তনু তার জীবনে পেয়েছিলো তাই না বকে উলটো বুঝিয়ে গেলো। অন্য কেউ হলে মনে হয় না এমন করতো। যদিও পৃথিবীতে “পারফেক্ট” বলে কোন শব্দ নেই। হাতের পাঁচ আঙুল সমান না। আল্লাহ কাউকে একদম পরিপূর্ণ করে দুনিয়ার বাড়িতে পাঠায় না। তবুও কিছু কিছু মানুষ কে দেখলে মনে হয় যে না এই পারফেক্ট। আয়ুশ অনেক বেশিই ভালো। এতো ভালো হতে নেই। মানুষ খারাপ বানিয়ে দেয় নয়তো মাজবুরি তে হয়ে যেতে হয়। তনু এগুলো ভাবতে ভাবতেই চোখ দুটো বন্ধ করে থাকে। কখন যে ঘুমিয়ে পরেছে তা সে জানে না। আস্তে আস্তে ভোরের আলো ফুটে। হস্পিটালে নামাজ পড়ার জন্য আলাদা রুম আছে। ফজরের আজান দিলে আয়ুশ গিয়ে ওযু করে এসে নামাজ পড়ে ফেলে। নামাজ শেষ হলে আয়ুশ আবার তনুর কেবিনের সামনে আসে। তবে এবার তার ফোন বাজে ফোন তুলে দেখে মেহরামের ফোন। আয়ুশ সেখান থেকে দূরে গিয়ে ফোন রিসিভ করে।

আয়ুশ;; হ্যালো

মেহরাম;; কেমন আছো?

আয়ুশ;; আল্লাহ ভালোই রেখেছেন। তুমি?

মেহরাম;; আলহামদুলিল্লাহ, কোথায় আছো তুমি?

আয়ুশ;; আমি তো হস্পিটালে।

মেহরাম;; বাসায় যাও নি?

আয়ুশ;; না।

মেহরাম;; তনু কোথায় কেমন আছে?

আয়ুশ;; হ্যাঁ আগে থেকে কিছুটা ভালো।

মেহরাম;; ওহহ আচ্ছা।

আয়ুশ;; মা কোথায়?

মেহরাম;; এই তো যা যা লাগে সব নিচ্ছে। হস্পিটালে আসবে।

আয়ুশ;; ওহহ,

মেহরাম;; ডক্টর এসেছেন?

আয়ুশ;; এখনো না কিন্তু এসে পরবেন।

মেহরাম;; আচ্ছা।

আয়ুশ;; তুমি আসবে?

মেহরাম;; আসলে যেতে তো চাইছি না কিন্তু চাচি নিয়ে যাবে। আচ্ছা আমি যাবো তনু যদি…?

আয়ুশ;; কাল রাতে তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিলো।

মেহরাম;; সত্যি আমার কথা..! (হেসে)

আয়ুশ;; হ্যাঁ, (মেহরামের হাসি শুনে সেও হেসে দেয়)

মেহরাম;; আমি আসছি।

আয়ুশ;; এসো।

মেহরাম ফোন কেটে দেয়। আয়ুশ আবার কফির অর্ডার দিয়েছিলো তখন একজন ওয়ার্ডবয় এসে আয়ুশকে কফি দিয়ে যায়। আয়ুশ পায়চারি করছে আর কফি খাচ্ছে। মাঝে মাঝে কেবিনের দরজা খুলে তনুকে দেখছে। তনু এখনো ঘুম। এভাবেই দেখতে দেখে একসময় ডাক্তার এসে পরে। ডাক্তারের সাথে আয়ুশ কথা হয়। তনু ঘুমাচ্ছে দেখে ডাক্তার এখনই তনুর চেকপের জন্য যায় না। কারণ পেসেন্টের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার টা হচ্ছে ঘুম। তো ঘুমাক পরে দেখা যাবে। এভাবেই চলতে থাকে। তার ঘন্টা খানিক পর মেহরাম আর তার চাচি এসে পরে। মেহরাম আসতেই আয়ুশ আগে তার দিকে তাকায়। মেহরাম গোলুমোলু হয়েছে, চুল গুলো আগের মতোই ঘন আছে যা এক সময় আয়ুশের সব থেকে বেশি পছন্দের ছিলো আসলে এখনো আছে। ফর্সা দ্বীগুণ হয়েছে, আকাশী কালারের একটা গোল জামা পরে এসেছে। আয়ুশ তাকিয়ে আছে তার দিকে। আসলে ভালোবাসা এমনই যার জন্য একবার জন্ম নেয় তার জন্য আজীবনই থাকে। তারপর লাইফে যেই আসুক না কেন। আগের মতো ফিলিংস আরেকজনের জন্য আবার আসা বড্ড বেশি দায়। মেহরাম গিয়ে আয়ুশের সামনে যায়। আয়ুশ কেন জানি মুচকি হেসে মাথা নিচে নামিয়ে ফেলে।

আতিয়া;; একি বাবা?

আয়ুশ;; জ্বি মা।

আতিয়া;; এভাবে কফি খেলে তো অবস্থা খারাপ হয়ে যাবে।

আয়ুশ;; না মা প্রব্লেম নেই আমার অভ্যাস আছে।

আতিয়া;; ধুর রাখো অভ্যাস, আমি বাড়ি থেকে খাবার এনেছি খেয়ে নিও।

আয়ুশ;; না মা আসলে আপনারা তো এসেছেন আমি ভাবছিলাম যে একটু বাড়ি যাবো।

মেহরাম;; অফিসে?

আয়ুশ;; না অফিসে যাবো না। বাড়িতেই যাবো। শুধু গিয়ে ফ্রেশ হয়ে মা আর কণা কে দেখেই এসে পরবো আবার।

আতিয়া;; ওহহ আচ্ছা।

মেহরাম;; তনুর কাছে যাবে না?

আতিয়া;; হ্যাঁ চল।

আতিয়া, মেহরাম আর আয়ুশ একসাথেই কেবিনে গেলো। গিয়ে দেখে তনু উঠে পরেছে কিন্তু সেখানে শুয়ে তাকিয়ে আছে। তনু হঠাৎ মেহরামকে দেখে। মেহরাম তো আকুপাকু করছে এই ভেবে যে এই তনু না আবার রেগে যায়। কিন্তু মেহরাম যখন থেকে কেবিনে এসেছে তখন থেকেই তনু তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে পানি গুলো যেন জ্বলজ্বল করছে। তনু তার হাত টা হাল্কা করে তুলে মেহরামের দিকে বাড়ায়। মেহরাম একবার আয়ুশের দিকে তাকায়। আয়ুশ তাকে তনুর কাছে যাবার জন্য ইশারা করতেই মেহরাম তনুর পাশে বসে তার হাত টা নিজের হাত গুলোর মাঝে রাখে। তনু তার মুখের মাস্ক টা খুলে। মেহরাম না খোলার জন্য হাত দিয়ে আটকিয়ে দেয় কিন্তু তনু তবুও খোলে ফেলে। বুক ভরে কিছু টা বাইরের হাওয়া মুখে লাগায়। মাথায় শক্ত করে ব্যান্ডেজ করে দেওয়া আছে। তাতে সে কিছুটা চোখ কুচকে ফেলে। কিন্তু বাইরে যেন সে শ্বাস নিতে পারছে না। তবুও কোন রকমে বলে ওঠে…

তনু;; মেহরু

মেহরান;; হ্য হ্যাঁ (কান্না করে)

তনু;; আমি জানি বলেও লাভ নেই। কারণ মানুষ যাকে সব চেয়ে বেশি ভালোবাসে তার থেকেই সব চেয়ে বেশি আঘাত পায়। আর তোর ক্ষেত্রেও তার ব্যাতিক্রম নয়। আমি তোকে আঘাত করে ফেলেছি। কাল যাই বলেছি, যেভাবেই বলেছি সব আমার রাগ ছিলো। যা কেটে গেছে। কিন্তু এখন আমার কাছে আফসোস আছে।

মেহরাম;; চুপ করবি। বোনে বোনে কতো ঝগড়া হয় আবার মিটমাট হয়ে যায়। তাই কালও তুই বলেছিস আর কাল কের দিন চলে গেছে আর সেগুলোও আমার মন থেকে চলে গেছে। অযথা আর বলিস না তো।

তনু;; মাঝে মাঝে তোকে দেখলে মনে হয় তুই আমার থেকে ভালো বোন ডিজার্ভ করিস। হয়তো আমার এটা চৌদ্দ পিড়ির ভাগ্য বা আমি কোন পূণ্যের কাজ করেছিলাম হয়তো কখনো তাই আমার ভাগ্যে খোদা তোকে দিয়েছিলো।

মেহরাম;; এতো পাম দিলে ফুটে যাবো।

তনু;; শোন কখনো যদি আমি তোর কাছে না থাকি বুঝবি যে আমি সবসময় তোর সাথেই আছি। হয়তো আমাকে দেখা যাবে না, স্পর্শ কিরা যাবে না কিন্তু মনে রাখবি আমি সবসময় তোর সাথে আছি, পাশে আছি। তোর মাঝেই আছি।

মেহরাম;; কিন্তু তোকে আমার লাগবে। আর তুই থাকবি আমি জানি। অযথা এগুলো বলা বন্ধ কর আর তোর জন্য কি বানিয়ে এনেছি বল তো?

তনু;; কি? (হেসে)

মেহরাম;; সেমাই আর পুডিং।

তনু;; ডক্টর যদি খেতে না দেয়?

মেহরাম;; তাহলে ডাক্টর কেই কাচা খেয়ে ফেলবো।

মেহরামের কথা শুনে তনু হেসে দেয়। আর খানিক দূরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আয়ুশ আর আতিয়া এগুলো দেখছে। তবে এবার আয়ুশ বলে ওঠে…

আয়ুশ;; মা আমি যাই, এরা দুই বোন আর আপনি থাকেন।

আয়ুশ;; আচ্ছা বাবা সাবধানে যেও। আর হ্যাঁ বাড়িতে গিয়ে আপা আর কণার সাথে কথা বলিয়ে দিও।

আয়ুশ;; আচ্ছা ঠিকআছে।

আয়ুশ আরেকবার মেহরাম আর তনুর দিকে তাকিয়ে হাতে নিজের জেকেট টা নিয়ে বাইরে বের হয়ে পরে। গাড়িতে বসে ড্রাইভ করছে আর মাথায় সব কিছু ঘুড়ছে। মেহরাম একজন নার্সের সাহায্যে তনু কে একটু বসিয়ে দেয় হেলান দিয়ে। আগে তো সব খাবার স্যালাইনের মাধ্যমেই নিতে হয়েছে কিন্তু এখন অবস্থা কিছুটা ভালো। তাই ডাক্তার কিছু সময়ের জন্য মাস্ক টা মুখ থেকে খুলে দিয়েছে। তবে ট্রিটমেন্টের সময় তনুর আরেকটা প্রব্লেম ধরা পরেছে তা হচ্ছে শ্বাসকষ্ট। আগে মাঝে মাঝেই তনুর নিঃশ্বাস থেমে গেতো। পরে আবার ভালো হয়েও গেতো কিন্তু কেউ টের পায় নি যে এটা শ্বাসকষ্টের লক্ষণ। কিন্তু এবার রিপোর্টে বেশ ভালো ভাবেই ধরা পরেছে। যাই হোক মেহরাম তনুকে খাইয়ে দিতে থাকলো। কয়েকবার খেয়েই আর তনু খেতে পারলো না। আবার নতুন স্যালাইন হাতে পুশ করে শুয়ে থাকলো। আস্তে আস্তে সময় গেতে গেতে বিকেল হয়ে গেলো। মেহরাম তনুর কেবিনেই বসে ছিলো। তনু হাল্কাভাবে ডাক দিলো মেহরাম কে মেহরাম আবার এসে তনুর পাশে বসে পরলো। তনু কতোক্ষণ তাকিয়ে থাকলো মেহরামের দিকে। যেন কতোদিন তনু মেহরামকে দেখে নি আজ দেখছে নিজের বোনকে। তনু আবার মেহরাম কে বলে ওঠে।





💙চলবে~~

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে