Friday, July 11, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1395



চন্দ্ররঙা প্রেম পর্ব-১৫

0

#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্ব-১৫
#আর্শিয়া_সেহের

শান্তর কোনো হেলদোল নেই। সে আজকে পন করেছে, ম্যাথ না করে এক পা ও নড়বে না। শান‌ এই ঘর থেকে যাওয়ার জন্য অনেকক্ষণ ধরে বুঝাচ্ছে শান্তকে কিন্তু শান্ত তো শান্তই। সে ও নাছোড়বান্দা। ম্যাথ না করে ও এই ঘর ছাড়বে না।

শান হতাশ হয়ে বিছানায় বসে পড়লো। রুমঝুম তো দুই ভাইয়ের কান্ড দেখে রিতিমত বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে। রুমঝুমকে এভাবে হাসতে দেখে শানও মুচকি হাসলো। শান্তর দিকে তাকিয়ে দেখলো সে ম্যাথ বই খুলে নিয়ে বসেছে।

-“তোর ভাবি খুব টায়ার্ড। তোর ঘরে চল। ওখানে গিয়ে ম্যাথ করাবো”।
শানের কথা শুনে শান্ত ভ্রু কুঁচকে রুমঝুমের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ পরখ করে বললো,
-“ভাবি তোমাকে বলেছে যে সে এখন টায়ার্ড?”

শান ভরকে গেলো এই পিচ্চির কথায়। এখন‌ তার মেজাজ গরম হলেও সে নিজেকে সামলে নিলো। ব্যাপারটা সফটলি হ্যান্ডেল করতে হবে। শান্তর দিকে তাকিয়ে দাঁত কেলিয়ে বললো,
-“আরে দেখিসনি ওকে কেমন সারাক্ষণ সোফায় বসিয়ে রেখেছিলো? এখনো কত ভারি ড্রেস পড়ে আছে। বুঝতেছিসই তো ওর কষ্ট টা।”

শান্ত হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
-“কোথায় ভাবলাম ভাবি কে দেখবো আর ম্যাথ করবো ,তা আর হলো কই? সে নাকি এখন ক্লান্ত। আর হয় নাহ। চলো আমার রুমেই চলো।”

শান্তর কথার স্টাইলে শান রুমঝুম দুজনই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। এই ছেলে এতো পাকা কিভাবে হলো সেটাই ভেবে পায়না শান।

শান্ত বইখাতা নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। শান পেছন থেকে বললো,
-“দাঁড়িয়ে আছিস কেন? চল।”
শান্ত কাঁদাহীন সাদা মন নিয়ে যেই না বাইরে গেলো‌ অমনি শান ভেতর থেকে দাড়াম করে দরজা আটকে দিলো।

শান্ত কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো দরজার বাইরে। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার। একটু ম্যাথ করতে এসে তার মানসম্মান শেষ হয়ে গেলো। ভাবির সামনে তার ভাই তাকে ঘর থেকে বের করে মুখের উপর দরজা আটকে দিলো?
শান্ত বাইরে থেকে চিৎকার করে বললো,
-“আমার বিশ্বাসের এমন মূল্য দিলে ভাইয়া? তোমার কাছে আর কখনো আসবো না ম্যাথ করতে।”

শান একই রকম চিৎকার করে বললে,
-“বড় বাঁচা বেঁচে গেলাম।”

এরকম উত্তর বোধহয় শান্ত আশা করে নি। ভেবেছিলো ভাই বাইরে এসে সরি বলবে । শান্ত ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কান্না করতে করতে দরজার সামনে থেকে প্রস্থান করলো।

.

শান এতোক্ষণে রুমঝুমকে ভালো ভাবে দেখলো। বিছানায় রুমঝুমের সামনাসামনি বসে আছে সে। রুমঝুমের হাত দুটো আলতো করে ধরলো শান। হাতের পিঠে চুমু খেলো। রুমঝুম কাঠ হয়ে বসে আছে। ওর সমস্ত শক্তি যেন শেষ হয়ে গেছে। শান‌ আরেকটু এগিয়ে রুমঝুমের কপালে চুমু খেলো।
রুমঝুম চোখ খিচে বন্ধ করে রেখেছে। শানের নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে তার সারামুখে। চোখ খোলার সাহসটাও হারিয়েছে রুমঝুম।

শান অনেকক্ষণ ধরে তাকিয়ে আছে রুমঝুমের ঠোঁটের দিকে। অস্বাভাবিক ভাবে কাঁপছে ঠোঁটজোড়া। মাঝে মাঝে দুই ঠোঁট একসাথে চেপে ধরছে রুমঝুম। শান মুচকি হেঁসে চুমু খেলো রুমঝুমের ঠোঁটে।
সাথে সাথেই রুমঝুমের দেহে বয়ে গেলো এক অদ্ভুত শিহরণ। চোখ খুলে গেলো আপনাআপনিই।

রুমঝুম চোখ মেলে দেখলো শান ঘোর লাগা চোখে চেয়ে আছে তার দিকে। রুমঝুম আজ আর সেই চোখ থেকে নিজের চোখ লুকালো না। শানের চোখে চেয়ে রইলো খানিক সময়। কারো মুখেই কথা নেই।
আচমকা রুমঝুম এক ভয়ানক কাজ করলো। শানের গলা জড়িয়ে ধরে ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো শানের ঠোঁটের মাঝে।

রুমঝুমের এই কাজ শানের কল্পনাতীত ছিলো। সে প্রথমে একটু অবাক হলেও পরে মুচকি হেঁসে দুহাতে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো রুমঝুমকে।

শান চুমু খেতে খেতেই রুমঝুমের বেশ কিছু জুয়েলারি খুলে ফেললো। রুমঝুম ঠোঁট ছেড়ে শানের বুকে মুখ লুকিয়ে হাঁফাতে লাগলো। শানের বুকের মাঝে শীতল শিহরণ খেলে গেলো তখন। তার প্রেয়সী তার বুকের মাঝে। তার চন্দ্রকন্যা এখন থেকে শুধুমাত্র তার।
শান শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রুমঝুমকে। রুমঝুমও মিশে গেলো শানের বুকের সাথে।

এভাবে কেটে গেলো অনেকটা সময়। শান রুমঝুমকে বললো,
-“তোমার ড্রেসটা পাল্টে নাও। এটা পরে কিভাবে আছো এখনো? আমারে শরীরে তো কাঁটা কাঁটা ফুটছে।

রুমঝুম শানকে আরেকটু ঝাপ্টে ধরে বললো,
-“আমার জামাকাপড় নেই তো এই ঘরে। আম্মু শিরীন কে দিয়ে যেতে বলেছিলো। ও বোধহয় ভুলে গেছে।”
শান রুমঝুমের হাত থেকে চুড়ি খুলতে খুলতে বললো,
-“তাহলে আজ রাতের জন্য আমার টিশার্ট আর ট্রাউজার পড়ো। মন্দ হবে না কিন্তু।”

রুমঝুম শানের বুক কিল ঘুষি মেরে বললো,
-“চুপ করো পাজি ছেলে। শুধু লজ্জায় ফেলার ধান্দা।”

শান সবগুলো চুড়ি খুলে রুমঝুমকে বিছানায় বসিয়ে উঠে পড়লো।‌ জুয়েলারি সব খোলা শেষ হয়ে গেছে। সে নিজের ঢোলা একটা টিশার্ট আর একটা ট্রাউজার এনে রুমঝুমকে দিলো। রুমঝুম তা দেখে ঠোঁট ফুলিয়ে শানের দিকে তাকালো। মুখ বাঁকিয়ে বললো,
-“আমি এসব পড়বো না। আমি ফ্রেশও হবো না।”

শান এক ভ্রু উঁচু করে বললো,
-“ওয়াশরুমে যাবে নাকি কোলে করে নিয়ে যাবো?”
রুমঝুম লজ্জায় আর কিছু বলতে পারলো না। জামাকাপড় নিয়ে দৌড়ে ওয়াশ রুমে ঢুকে পড়লো।
শান মুচকি হেসে রুমেই কাপড় পাল্টে ফেললো।

মিনিট দশেকের মাথায় ছিটকিনি খোলার শব্দে শান ওয়াশ রুমের দিকে তাকালো। ছিটকিনি খুললেও দরজা এখনো খোলে নি। শান এগিয়ে গেলো ওয়াশরুমের দিকে। দরজা ঠেলে দেখলো রুমঝুম গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে।
রুমঝুম মাথা না তুলে চুপচাপ পাশ কাটিয়ে বাইরে চলে এলো। শান পেছন থেকেই রুমঝুমের হাত ধরে টান দিয়ে দেয়ালের সাথে মিশিয়ে দাড় করালো। রুমঝুমের দুপাশে হাত রেখে বললো,
-” আমার কাছে এতো লজ্জা কিসের হু? সারাজীবন আমিই তো দেখবো?”

রুমঝুমের কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো। শানকে তার দিকে এগুতে দেখে চোখ বন্ধ করে ফেললো।
পানি পড়ার শব্দ পেয়ে রুমঝুম চোখ খুললো। সে দেয়ালের সাথে লেগে দাঁড়িয়ে থাকলেও শান কোথাও‌ নেই। সে ফ্রেশ হতে ওয়াশ রুমে ঢুকে পড়েছে।

রুমঝুম নিজের মাথায় গাট্টা মেরে বেলকনির দিকে হাঁটলো।
আজ এক ফালি চাঁদ উঠেছে আকাশে। আকাশের বুকে নকশা কেটে অনেকগুলো তাঁরাও আছে। সেগুলো দেখতে দেখতেই রুমঝুম অনুভব করলো দুটো বলিষ্ঠ হাত পেছন থেকে তার কোমর জড়িয়ে ধরেছে। রুমঝুম আকাশের দিকে মুখ করেই চোখ বন্ধ করে গা এলিয়ে দিলো শানের বুকে।

শান রুমঝুমের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,
-“আকাশ দেখা হলে এবার এই অধমের দিকে একটু তাকান চন্দ্রকন্যা। ”
রুমঝুম কথা বললো না। পেটের উপর থাকা শানের হাতটা আরো শক্ত করে ধরলো সে। শান রুমঝুমকে নিজের দিকে ঘুরালো। থুতনি ধরে মুখটা উচু করে চোখে চোখ রাখলো। বললো,

-“তোমাকে ভালোবাসার পূর্ন অধিকার দেবে চন্দ্রকন্যা? দেবে আমার চন্দ্ররঙা প্রেম কে নিজের রঙে রাঙাতে?”

কি মধুর আকুতি। রুমঝুম হাঁসলো। রাতের আঁধারেও সে হাঁসিতে আরেকবার হারিয়ে গেলো শান।
রুমঝুমকে কোলে তুলে নিয়ে রুমে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো । ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে মুখ গুজে দিলো রুমঝুমের গলায়। রুমঝুমও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো শান কে।
দুজনে ডুবে গেলো ভালোবাসার অতল গহ্বরে।
কেটে গেলো সময়। অনুভবে রয়ে গেলো জীবনের ভালোবাসাময় প্রথম রাত্রিটি।

….

দরজা ধাক্কানোর শব্দে ঘুম ভাঙলো রুমঝুমের। পিটপিট করে চোখ খুলে দেখলো পুরো ঘর আলোয় ঝলমল করছে। দেয়াল ঘড়িতে সময় তখন নয়টা সাইত্রিশ । রুমঝুমের চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। এতো বেলা হয়ে গেলো কখন। অবশ্য ঘুমিয়েছেই তো ভোরের দিকে।

দরজা অনবরত ধাক্কিয়েই চলেছে কেউ। রুমঝুম পাশ ফিরে দেখলো শান খালি গায়ে উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। সমস্ত পিঠে আঁচড়ের দাগ। রুমঝুম বুঝলো এই দাগের ক্রেডিট তার নখের ।
নিজের দিকে তাকিয়ে খানিকটা লজ্জা পেলো রুমঝুম। বিছানার চাদরে ঢেকে আছে দুজন।
রুমঝুম শানকে ডেকে তুললো।

শান আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো। পাশে চোখ ফুলিয়ে বসে আছে রুমঝুম। তার বউ। এখনো তার চোখে ঘুমের রেশ।
শান মুগ্ধ চোখে রুমঝুমকে দেখছিলো তখনই আবার দরজা ধাক্কানোর শব্দ এলো। রুমঝুম মিনমিন করে বললো,
-“অনেকক্ষণ থেকে দরজা ধাক্কাচ্ছে কে যেন। আমি কিভাবে যাবো বলুন? এদিকে বেলাও হয়েছে অনেক। তাই ডেকে তুললাম।”

শানের তখন মাথায় এলো রুমঝুমের কাপড়ের কথা। শান চাদর সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো। মেঝে থেকে টিশার্ট তুলে গায়ে জড়িয়ে নিলো। রুমঝুম ততক্ষণে চাদর দিয়ে নিজেকে একদম মুড়ে নিয়েছে। শান মুচকি হেঁসে এগিয়ে এসে রুমঝুমের কপালে চুমু দিলো। দুহাতে চাদরে আবৃত রুমঝুমকে কোলে তুলে ওয়াশ রুমে নামিয়ে দিলো।
-“তুমি ফ্রেশ হও। আমি তোমার কাপড় আনার ব্যবস্থা করছি।”

রুমঝুম মাথা হেলিয়ে ফ্রেশ হতে গেলো। শান দরজা খুলে উঁকি মেরে দেখলো সিন্থিয়া আর তিহান দাঁড়ানো। সিন্থিয়া দরজা খুলতে দেখেই মুখ ভেঙচি দিয়ে একগাদা কাপড় তুলে দিলো শানের হাতে। শান এতো গুলো কাপড় কোনো রকমে সামলে বললো,
-“এভাবে মুখ ফুলিয়ে আছিস কেন?”

সিন্থিয়া কর্কশ কন্ঠে বললো,
-“এতো অল্পতে কিভাবে উঠলি? আরেকটু ঘুমাতি। মাত্র আধঘন্টা ধরে দরজা ধাক্কালাম।”
বলেই হনহন করে চলে গেলো।

শান বেক্কল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। তিহানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“এভাবে দরজা না ধাক্কিয়ে ফোন তো করতে পারতি।”
তিহান গমগমে সুরে বললো,
-” দুজনের মধ্যে একজনের ফোনও সুইচ অফ রাখলে না দিবো?”
-“চার্জ শেষ মনে হয়।”
-“দুজনেরই?”
শান চোখ পাকিয়ে তাকালো তিহানের কথা শুনে। তিহান শানের কাঁধ চাপড়ে দিয়ে যেতে যেতে বললো,
-“গলা-টলা একটু ঢেকে ঢুকে আসিস।”
বলেই অন্য দিকে তাকিয়ে বললো,
-“যদিও আমি কিছু দেখিনি।”
শানের দুঃখ হয় মাঝে মাঝে এরকম একটা ফাজিলের পাল্লায় পড়ার জন্য। কি কুক্ষণে যে পাইছিলো এটারে‌।

শান কাপড়গুলো বিছানায় রাখলো। বেশিরভাগই শাড়ি। কয়েকটা থ্রিপিসও আছে।
রুমঝুমকে শাড়িতে দেখতেই শানের ভালো লাগে । তাই সবগুলো শাড়ি থেকে বেছে বেছে একটা ক্রিম কালারের শাড়ি দিয়ে এলো রুমঝুমকে। রুমঝুম ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এলো। ব্লাউজটা তার গায়ে কিছুটা ঢিলা হয়েছে। তবুও কম্ফোর্টেবল।

সদ্য গোসল করা রুমঝুমকে দেখে শান বিষম খেলো। একধ্যানে চেয়ে রইলো তার দিকে। এমন রুপবতী তার ঘরে থাকলে সে অফিস -কাজ এগুলোতে মন দিবে কিভাবে? সারাক্ষণ তো এই রুপবতীর আশেপাশেই থাকতে ইচ্ছে করবে।

রুমঝুম শানের চোখের সামনে এসে তুড়ি বাজালো। সেই শব্দে শানের ধ্যান ভাঙলো। শান এক হাত মাথায় তুলে ঘাড়টা হালকা কাত করে বললো,
-“এতো সুন্দর কে হতে বলেছে তোমার? আমার তো সারাক্ষণ আদর করতে ইচ্ছে করে।”

রুমঝুমের গাল‌ লাল হয়ে উঠলো। শান টুপ করে গালে একটা চুমু খেয়ে বললো,
-“এখনো এতো লজ্জা? কাল রাতের পরও এতো লজ্জা আসছে কোথা থেকে, আমার লজ্জাবতী?”

রুমঝুম মাথা নিচু রেখেই শানকে ঠেলে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে দিলো। নিচু স্বরে বললো,
-“সবসময় শুরু লজ্জা দেওয়ার ধান্দা। যান তো,গোসল সেড়ে নিন।”
শান উচ্চ শব্দে হেঁসে গোসলে ঢুকে পড়লো। মেয়েটাকে লজ্জাতে ফেলতে তার খুব ভালো লাগে। মেয়েটার লজ্জামাখা মুখটা শানের ভীষণ প্রিয়।

.

শান্ত বাদে এখনো কেউ ব্রেকফাস্ট করেনি। সবাই টেবিলে বসে শান-রুমঝুমের অপেক্ষা করছে। শিরীন আর মেঘার বেশ ভাব জমে গেছে ইতিমধ্যে। দুজন বসে বসে দুনিয়ার সব গল্প জুড়ে দিয়েছে।
মাহেরা খাতুন সকালেই বাড়িতে চলে গেছেন। মেহেদী বাড়িতে একা আছে। সারারাত ছেলেটার জন্য চিন্তা হয়েছে তার। বাইরে নিজেকে যতই শক্ত দেখাক,তিনি জানেন ছেলেটা ভেতর থেকে ভেঙে পড়েছে।তাই সকাল সকাল বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে সে।
মেঘাকে সবাই জোর করে রেখে দিয়েছে। আজকে তারা সারাদিন হৈ হুল্লোড় করবে এজন্য। মেঘাও আপত্তি করেনি। এদের সাথে থাকতে তার ভালোই লাগে।

ইমতিয়াজ মাহমুদ টেবিলে বসে অফিসের এক কর্মচারীর সাথে কথা বলছিলেন। কথার মাঝখানেই তিনি সিঁড়ির দিকে চেয়ে বললেন,
-“মাশাআল্লাহ।”
শাফিয়া আক্তার খাবার গোছাচ্ছিলেন। স্বামীর কথা শুনে তিনিও তাকালেন সিঁড়ির দিকে। শান আর রুমঝুম পাশাপাশি হেঁটে নেমে আসছে। চোখ জুড়িয়ে গেলো শাফিয়া আক্তারের। মুগ্ধ চোখে সেদিকে চেয়ে বললেন
-” আমার রাজপুত্রের সাথে আমার ঘরের লক্ষীকে কি দারুন মানিয়েছে। ওদের দিকে কারো নজর না পড়ুক।”

শান আর রুমঝুমকে পাশাপাশি বসালেন শাফিয়া আক্তার। সবাই বসে পড়লো যার যার জায়গায়। রুমঝুম কখনোই এমন একটা পরিবার পায়নি। আজ নিজের এরকম সুন্দর একটা পরিবার আছে ভেবেই আনন্দে কান্না পাচ্ছে তার।

খাওয়া দাওয়া শেষে সবাই গার্ডেনে গিয়ে বসলো আড্ডা দেওয়ার জন্য। রুমঝুমের চোখ পড়লো সেই কৃষ্ণচূড়া গাছটার দিকে। মাটি থেকে বেশ উঁচুতে মোটাসোটা একটা ডাল আছে। গাছটা কম করে হলেও বিশ-ত্রিশ বছর আগের।

আড্ডার একপর্যায়ে প্রান্ত বললো ,
-“তোদের জন্য আমাদের পক্ষ থেকে স্পেশাল হানিমুন প্যাকেজ দেওয়া হবে। তোদের বিয়ের গিফট হিসেবে। এখন বল কোথায় যাবি? দেশেই নাকি দেশের বাইরে কোথাও?

শান দাঁত কেলিয়ে বললো,
-“অবশ্যই দেশের বাইরে।”
প্রান্ত নিচু কন্ঠে বললো,
-“জানতাম তো। ”
বিথী‌ বললো,
-“আচ্ছা পাহাড় নাকি সমুদ্র?”
শান রুমঝুমের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“এটা তুমিই বলো।”
রুমঝুম লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। মেঘা পাশ থেকে গুঁতা মেরে বললো,
-“আর লজ্জা পেতে হবে না। বলে দে।”
রুমঝুম কিছু সময় ভেবে বললো,
-“সমুদ্র।”

তিহান লাস্ট চিপসটা মুখে পুরতে পুরতে বললো,
-“তাহলে তো মিটে গেলো। শান আর রুমঝুমের হানিমুনের জন্য আইল্যান্ড বীচ স্টেট পার্কই বেস্ট। সমুদ্র সৈকতের জন্য এটাই উপযুক্ত জায়গা। তাহলে ওটাই ফিক্সড ওকে?”

শান্ত ঝড়ের গতিতে দৌড়ে এলো রুমঝুমের কাছে। রুমঝুমের হাত ধরে বললো,
-“এ্যাই ভাবি। আমিও তোমাদের সাথে হানিমুনে যাবো। নিবে তো?”
রুমঝুম কি বলবে খুঁজে পেলো না। শান মাথায় হাত দিয়ে ধপাস করে বসে পড়লো ঘাসের উপর। বিরবির করে বললো,’ যার এমন একটা ভাই থাকে তার বেঁচে থেকে কি লাভ?

চলবে………

চদ্ররঙা প্রেম পর্ব-১৪

0

#চদ্ররঙা_প্রেম
#পর্ব-১৪
#আর্শিয়া_সেহের

রুমঝুম চুপচাপ বসে আছে ড্রয়িং রুমের সোফায়। শরীরে জড়ানো খয়েরী রঙের ভারী লেহেঙ্গা। শাফিয়া আক্তার মোটামুটি ভালোই মেকআপ করিয়েছে তাকে। একদম পুতুলের মতো সাজিয়েছে। শান্ত তো ঘুরে ফিরে রুমঝুমের পাশে এসে বসতেছে।

শানদের কিছু আত্মীয় স্বজন এসেছে যাদের বাড়ি কাছাকাছি। প্রতিবেশীরাও বেশ কয়েকজন এসেছে বউ দেখতে। এক একজন এসে এক একরকম প্রশ্ন জিজ্ঞেস করছে। তবে রুমঝুমের উত্তর দেওয়া লাগছে না। শাফিয়া আক্তারই সব উত্তর দিচ্ছেন। রুমঝুম মাথা নিচু করে বসে আছে।
খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছে ওর কিন্তু শ্বাশুড়ির এতো কষ্টে কথানো মেকআপটা নষ্ট হয়ে যাবে বলে কাঁদতে পারছে না।

শানকে নিয়ে তিহান, প্রান্ত,সিন্থিয়া,মেঘা সবাই ছাদে চলে গেছে। ছাদেও হালকা পাতলা সাজিয়েছে। এখন রাত নয়টার মতো বাজে। রাত বারোটার আগে সবকিছু শান্ত হবে বলে আশা করছে না কেউ।

মেহেদী যদিও বয়সে এদের বড় তবুও ওকে তিহান টেনে টুনে নিয়ে এসেছে। সবাই ছাদের মাঝখানে বসে আড্ডা দিচ্ছে। তবে শানের মন পড়ে আছে তার চন্দ্রকন্যার কাছে। কখন‌ যে এসব ফর্মালিটি শেষ হবে?

মেহেদী শানের অস্থিরতা খেয়াল করলো। খুব গোপনে একটা নিঃশ্বাস ফেললো সে। আল্লাহ চাইলে হয়তো এই অস্থিরতাটা আজ তার মধ্যে থাকতো। মেহেদী সেখানে আর বসলো না।‌ উঠে ওদের থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়ালো। ওদের হইহুল্লোড় এর শব্দ কানে আসলেও ওরা এখন মেহেদীর চোখের আড়ালে।

মেহেদীকে চলে আসতে দেখে সিন্থিয়াও উঠে দাঁড়ালো।সাথে সাথেই প্রান্ত বললো,
-“ওয়ে ওয়ে,স্যার উঠে গেছে বলে এখন ম্যামও উঠে পড়লো নাকি?”
সিন্থিয়া কিঞ্চিত রাগ নিয়ে তাকিয়ে বললো,
-“একদম চুপ কর বেয়াদ্দপ। নিজের কাজ কর।”

সিন্থিয়া কিছুটা সরে আসলে সবাই হেঁসে উঠলো। মেঘাও এতদিনে সিন্থিয়াকে বেশ বুঝে গেছে। তাছাড়া প্রান্তও সেদিন সিন্থিয়ার ব্যাপারে অনেক কিছুই বলেছে। মেঘার খুব পছন্দ সিন্থিয়াকে। মেয়েটা তার ভাবি হলে বেশ জমে যাবে।

রুমঝুমের অন্ধকারে দেখা সেই গাছটি ছিলো একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। এখন অবশ্য ফুল নেই। মেহেদীর সম্মুখ বরাবর কিছুটা সামনে এসে থেমেছে একটা ডাল। গাছটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে,এটা অনেক পুরোনো। মেহেদী একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সেদিকে।

-“রুমঝুমকে অনেক ভালোবাসেন তাই না?”
মেহেদী আনমনেই বললো,
-“হু। ভীষণ।”
উত্তর দেওয়ার পর পরই সম্বিত ফিরলো তার। অনেকটা হকচকিয়ে পেছনে তাকালো। ভুল জায়গায় ভুল কথা বলে ফেলেছে সে। এটা রুমঝুমের শ্বশুরবাড়ি এটা সে কিভাবে ভুলে গেলো?
পেছনে তাকিয়ে সিন্থিয়াকে দেখে স্বস্তি পেলো মেহেদী। সিন্থিয়া শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে।

-“এতোই ভালোবাসেন তাহলে আগে জানান নি কেন ওকে?”
সিন্থিয়া এগিয়ে এসে মেহেদীর পাশে দাঁড়িয়ে বললো।
মেহেদী পুনরায় কৃষ্ণচূড়া গাছটির দিকে তাকালো। কাঁপা গলায় বললো,
-“আমি আসলে বুঝতে পারিনি মেয়েটা অন্য কারো সাথে জড়িয়ে পড়বে। ওর মনের অবস্থা বুঝেই ওকে সময় দিয়েছিলাম। নিজের অজান্তেই কখন যে প্রানপাখির খাঁচা খুলে দিয়েছি বুঝতেই পারিনি।”

সিন্থিয়া মুখ লুকিয়ে কান্না মুছলো। নিজের ভালোবাসার মানুষটির মুখে অন্য কারো নাম শোনা যে কতটা কষ্টের তা যে শোনে সেই বোঝে। সিন্থিয়া চোখ মুছে বললো,
-“ওর স্মৃতিতেই ডুবে থাকবেন নাকি? জীবনকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দেওয়া উচিত নয় কি?”

-“জানো সিন্থিয়া? কিছু কষ্ট আড়ালেই অপ্রকাশিত ভাবে থেকে যায়। কিছু কষ্ট একান্তই নিজের থাকে। এই কষ্ট গুলো ভেতরটা ঝাঁঝড়া করে দেয়।”

সিন্থিয়া ডুকরে কেঁদে উঠলো মেহেদীর কথা শুনে। মেহেদী আবারও বললো,
-“তুমি যত সহজে বললে জীবনকে দ্বিতীয়বার সুযোগ দেওয়ার কথা ,তত সহজে আসলে দেওয়া যায় না।”

সিন্থিয়া কথা বললো না। মুখ চেপে উল্টো পথে হাঁটা ধরতেই মেহেদী তার হাত ধরলো। মেহেদী হাত ধরায় সিন্থিয়া যতটা না অবাক হলো তার চেয়ে বেশি লজ্জা পেলো। তার ভেতরকার কান্না এক মূহুর্তে কোথায় হারিয়ে গেলো।

নিজেকে স্বাভাবিক করে সিন্থিয়া মেহেদীর চোখে চোখ রাখলো। মেহেদী শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সিন্থিয়ার দিকে। সিন্থিয়া দৃষ্টি নামিয়ে ফেললো। মেহেদী সিন্থিয়ার হাত ছেড়ে দিলো। দম নিয়ে বললো,
-“তুমি তো আমাকে রুমঝুম এখানে আসার দুমাস আগে থেকেই পছন্দ করো। তখন বলোনি কেন, সিন্থিয়া?”
সিন্থিয়া মায়াভরা চোখে তাকালো মেহেদীর দিকে। মেহেদীর মতো একই সুরে উত্তর দিলো,
-“ওই যে,একি কারনে। বুঝতে পারিনি ছেলেটা জড়িয়ে পড়বে কারো সাথে। সময় দিচ্ছিলাম নিজেকে আর নিজের ভালোবাসা কে।”

মেহেদী হাঁসলো। সিন্থিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আমাকে আরেকটু সময় দিবে? কথা দিচ্ছি, নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে আমার আকাশপরীর কাছেই ফিরবো আমি।”

সিন্থিয়া কেঁপে উঠলো। এই নামটা কি ওর জন্যেই? ও মেহেদীর আকাশপরী?
সিন্থিয়া খুশিতে কেঁদে ফেললো। কান্না মেশানো গলায় বললো,
-“সত্যিই ফিরবেন?”

মেহেদী শব্দ করে হেঁসে ফেললো এবার। সিন্থিয়ার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো,
-“ফিরবো না তো কি করবো? এতো ভালোবাসা উপেক্ষা করার সাধ্য আমার আছে নাকি? আর তাছাড়া আমি চিরকুমার থাকবো নাকি?”

মেহেদীর কথা শুনে সিন্থিয়াও হেঁসে ফেললো। দুজনই খিলখিল করে হাসছে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে। রাতের আকাশটাও হাঁসছে তাদের হাঁসিতে।

-“আরমান,রুশানকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? ওকে ছাড়ো । ওকে ছাড়ো প্লিজ।”
আরমান রুশানকে ড্রয়িং রুমে এনে সর্বশক্তি দিয়ে থাপ্পড় মারলো।
শক্তপোক্ত হাতের থাপ্পড় খেয়ে টাল সামলাতে পারলো না রুশান। ফ্লোরে পড়ে গেলো। ঠোঁট কেটে রক্ত বেরিয়ে এসেছে। আরমান রুশানকে টেনে তুলে আবারও থাপ্পড় মারলো।
হ্যাংলা পাতলা রুশান এই থাপ্পড়গুলো সহ্য করতে পারছে না। তবুও মুখ বুজে রয়েছে।

তাহমিনা বেগম আরমানের পা ধরে বসে পড়লেন। বিলাপ করে করে বললেন,
-“ওকে মেরো না। দয়া করো। ও ছোট মানুষ আরমান।দয়া করো আমাকে।”

আরমান‌ পা ঝাড়া দিয়ে সরে এলো। চিৎকার করে বললো,
-” এই কু*র বাচ্চা আমার সব প্লান শেষ করছে। দুই দুই বার। ওরে জ্যান্ত দাফন করবো আমি।”
বলেই তেড়ে গেলো রুশানের দিকে।

তাহমিনা বেগম রুশানকে আগলে দাঁড়ালো। মিনতি করে বললো,
-“ওকে মেরো না আর। ও মরে যাবে বাবা। ওকে আর মেরো না।”

আরমান রুশানের দিকে একবার তাকিয়ে সোফায় বসে পড়লো। বাঁকা হেঁসে বললো,
-” বোনের বিয়ে হইছে বলে বোন বেঁচে গেছে এমনটা ভাবিস না।তোর বোন রে বউ বানানোর জন্য কিনি নি আমি বুঝছিস?

ক্লান্ত রুশান জ্বলন্ত চোখ মেলে তাকালো আরমানের দিকে। আরমান রুশানের দিকে তাকিয়ে বিদঘুটে এক হাঁসি দিয়ে বললো,
-” শালীর চেহারা দেখে কিনছি। ওর ছবি দেখে এক লোকে কত দাম দিয়ে কিনতে চাইছে ওরে জানিস? হাহ,তোরা ক্যামনে জানবি ? ওই মাইয়া রে তো আমার লাগবোই।”

আরমান সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালো। ধপধপ পা ফেলে রুশানের সামনে এসে বসলো। ফিসফিস করে বললো,
-“ওই মেয়েরে আনা আমার বাঁ হাতের খেল। শুধু দেখে যা সামনে কি হয়।”

আরমান বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে। রুশান সেদিকে তাকিয়ে একদলা থুথু ফেললো মাটিতে। আরমান এভাবে হুট করে এসে সরাসরি তার রুমে গিয়ে তার ফোন চেক করবে সেটা ও ভাবতেই পারে নি। আগে টের পেলে এসএমএসটা ডিলিট করতে পারতো।

তাহমিনা বেগম রুশানের কাছে এসে বসলো। রুশান তার দিকে তাকিয়ে হাসলো। তাহমিনা বেগমের বুক কেঁপে উঠলো সেই হাঁসি দেখে। ঘৃনা আর তাচ্ছিল্যে ভরা সেই হাঁসি।

রুশান নিজেই কোনো রকমে উঠে দাঁড়ালো। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে কয়েক পা সামনে এগিয়ে আবার পেছনে তাকালো। সেই একই ভঙ্গিতে হেঁসে বললো,
-“নিজের সন্তানের জন্য খুব কষ্ট হয় তাই না, আম্মু? অন্য কারো সন্তানের বেলায় কেন এমন হলো না তোমার?”

রুশান ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে উঠে নিজের ঘরে চলে গেলো। তাহমিনা বেগম সেখানেই বসে রইলেন। তার খুব ইচ্ছে করলো নয় বছর আগের সময়টাতে ফিরে যেতে।


এগারোটার দিকে সবাই ছাদ থেকে নিচে নেমে এলো। রুমঝুম তখনও সোফায় বসে আছে। ওদের নামার আওয়াজ পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে সেদিকে তাকালো। রুমঝুমের অসহায় দৃষ্টি দেখে মেঘা আর সিন্থিয়া মুখ টিপে হাসছে। রুমঝুম ঠোঁট ফুলিয়ে তাকিয়ে আছে ওদের হাঁসি দেখে। ওকে বাঁচাবে তা না করে হাসছে ওখানে দাঁড়িয়ে।

ওদিকে শানকেও চ্যাংদোলা করে নিয়ে ঘুরছে তিহান আর প্রান্ত।
শাফিয়া আক্তার ওদের সবাইকে খেতে বসালেন। রুমঝুম শানের দিকে তাকিয়ে ছিলো। হঠাৎ চোখ পড়লো প্রান্তের দিকে। প্রান্ত একধ্যানে কোথাও তাকিয়ে আছে। রুমঝুম সেই দৃষ্টি অনুসরন করে তাকিয়ে দেখলো শিরীন একটা বাচ্চার সাথে হেসে হেসে গল্প করছে। প্রান্ত সেটাই দেখছে মনোযোগ দিয়ে।

শিরীন বাচ্চাটাকে রেখছ রুমঝুমের কাছে এসে বসলো। রুমঝুমের সাথে গল্প করলেও ওর দৃষ্টি অন্য কোথাও। রুমঝুম এবার সেদিকে তাকিয়ে দেখলো প্রান্ত অন্যদিকে তাকিয়ে আছে।
রুমঝুম কিছু কিছু বুঝতে পেরে মুচকি হাসলো তবে এটা নিয়ে কিছু বললো না তখন।
..

রাত প্রায় সাড়ে বারোটা বাজে। শানদের বাড়ি প্রায় ফাঁকা হয়ে গেছে। রুমঝুমকে নিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে এসেছে শাফিয়া আক্তার। শিরীন আর মেঘা এসে রুমঝুমকে খাইয়ে দিয়ে গেছে একটু আগে।

শান্তর দেখা নেই অনেকক্ষণ আগে থেকেই। মেহেদী বাড়িতে চলে গেছে সাড়ে এগারোটার দিকেই। মেঘা আর মাহেরা খাতুন সকালে যাবে।

এই রাতে তিহান, প্রান্ত,সিন্থিয়া আর বিথী শানকে আবার ছাদে নিয়ে গেলো। তিহান কোন ফাঁকে যেন অ্যালকোহল নিয়ে এসেছে। এখন সেটাই খাওয়ানোর জন্য নিয়ে গেছে শান কে।

শান একদম মুখ বন্ধ করে পরে আছে। সে কিছুতেই খাবেনা এই অখাদ্য। সবাই চেষ্টা করেও যখন‌ খাওয়াতে পারলো না শান কে।
ওদিকে তিহান ঢকঢক করে খেয়েই যাচ্ছে। বিথী তিহানের হাত থেকে বোতল কেড়ে নিয়ে বললো,
-” আর কত খাবি? রাখ এবার।”
তিহান বিথীর হাত থেকে বোতল ছিনিয়ে নিলো। গমগম করে বললো,
-“তোর কি হ্যাঁ? আমি যত ইচ্ছা খাবো। বন্ধুর বিয়ে হয়ে গেলো আর আমি সিঙ্গেলই মরতেছি। এই কষ্ট কমানোর জন্য হলেও খাবো। সর তো তুই।”
বিথী কপাল চাপড়ালো। এই ছেলে যে কি করবে আজ রাতে।

এরমধ্যেই মেঘা ছাদে এলো। শাফিয়া খাতুন সবাইকে ডেকে পাঠিয়েছে নিচে। অনেক আড্ডা হয়েছে। এখন ঘুমাতে হবে। সিন্থিয়ে উঠে এসে মেঘার হাত ধরে আগেভাগে নেমে এলো। শানের থেকে টাকা খসাতে হবে এখন।

শিরীন রুমঝুমের কাছে বসে ছিলো। রুমঝুম ছলেবলে জিজ্ঞেস করলো,
-“ডিয়ার ননদিনী। কাউকে ভালোবাসো?”
শিরীন লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। মিনমিন করে বললো,
-“বাসি তো। কিন্তু সে আমাকে পাত্তাই দেয়না ভাবিজান ।”
-“সে কি প্রান্ত ভাইয়া?”
শিরীন লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া মুখে ক্ষীণ কন্ঠে জবাব দিলো,
-“হুম।”

রুমঝুম বেশ অবাক হলো। প্রান্ত শিরীনকে পাত্তা দেয় না এটা কেন বললো শিরীন? তবে কি প্রান্ত ভাইয়া নিজের অনুভূতিগুলো লুকিয়ে রাখে?

বাইরে থেকে চেঁচামেচির আওয়াজে শিরীন বেরিয়ে গেলো। রুমঝুম যখন বুঝতে পারলো দরজার ওপাশে সবার সাথে শান ও দাঁড়িয়ে আছে তখনই তার বুকের মধ্যে ধুকপুক শুরু হয়ে গেলো। হাত-পা ও মৃদুমন্দ কাঁপছে।

সবাই মিলে দশহাজার টাকা নিয়ে তারপর শানকে ছাড়লো। শান ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,
-“সব কয়টাকে দেখে নিবো আমি।”
তিহান টলতে টলতে বললো,
-“আব্বে যা যা,দেখিস।”
শান প্রান্তর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“ওই মাতালরে ঘরে নিয়ে যা এখনি। কোথায় কি করে ফেলবে আবার।”

প্রান্ত দাঁত কেলিয়ে তিহানকে নিয়ে চলে গেলো। দরজার সামনে থেকে সবাই চলৈ গেলে শান রুমঝুমের দিকে তাকালো। বিছানায় জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে তার চন্দ্রকন্যা। মুচকি হাসলো শান। দরজা আটকাতে যাবে তক্ষুনি হুড়মুড় করে বই-খাতা বগলডাবা করে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো শান্ত।

শান শান্তর দিকে তাকিয়ে হা হয়ে গেলো। এই ছেলে এখন এখানে আসলো কেন? শান্ত ততক্ষণে বইখাতা নিয়ে বিছানায় বসে পড়েছে। রুমঝুম ঘোমটা তুলে তাকিয়ে আছে ক্ষুদে বাঁদরটার দিকে।

শান এগিয়ে এসে কোমরে দুই হাত রেখে বললো,
-“এই তুই এখন এই ঘরে এলি কেন?”
-“আজকে তোমার বাসর রাত না?”
শান‌ গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
-“হ.. হ্যাঁ তো?”

শান্ত নিরীহ প্রাণীদের মতো বললো,
-“তুমিই তো সেদিন বলেছিলে,বাসর রাতে নাকি তুমি অনেক খুশি থাকবা। তাই তোমার বাসর রাতে যেন আমি তোমার কাছে ম্যাথ করতে আসি। এজন্যই তো এসেছি।”

রুমঝুম ফিক করে হেঁসে দিলো শান্তর কথা শুনে। আর শান অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো তার ম্যাথপাগলা ভাইয়ের দিকে।

চলবে….

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

চন্দ্ররঙা প্রেম পর্ব-১৩

0

#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্ব-১৩
#আর্শিয়া_সেহের

শাফিয়া আক্তার ছেলের গালে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
-“জোরে লেগে গেছে ,শাফায়াত?”
শান‌ মায়ের কথায় হতবুদ্ধি হয়ে গেলো। একসময় মারছে,একসময় আদর করছে । হচ্ছেটা কি‌ আসলে?
শান‌ বাচ্চা ছেলের মতো মাথা দুদিকে নাড়ালো মানে সে ব্যাথা পায়নি। শাফিয়া আক্তারের চোখ পানিতে টলমল করছে।

ইমতিয়াজ মাহমুদ এগিয়ে এসে বললেন,
-“ছেলেকে মেরে যদি নিজেই ব্যাথা পাও তো তেমন মাইর দেওয়ার দরকার কি?”
শাফিয়া খাতুন‌ চোখ পাকিয়ে তাকালেন স্বামীর দিকে। ইমতিয়াজ মাহমুদ সাথে সাথেই চুপসে গেলেন। এই চুপসে যাওয়া মানে এই নয় যে তিনি ভয় পেয়েছেন বরং এটা করে তিনি মজা পান। স্ত্রীর সামনে বেড়াল সেজে থাকার মজাই আলাদা।

শাফিয়া আক্তার শানকে পাশ কাটিয়ে রুমঝুমের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। রুমঝুম তখন থরথর করে কাঁপছে। শাফিয়া খাতুন মুচকি হেঁসে রুমঝুমের থুতনি ধরে মুখটা উঁচু করলেন। রুমঝুম পিটপিট করে তাকাচ্ছে। পুরোপুরি তাকাতে তার ভয় লাগছে। শাফিয়া খাতুন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হালকা আওয়াজে বললো,
-“মাশাআল্লাহ! আমার ছেলের পছন্দ আছে।”

রুমঝুম চোখ মেললো। এখনো ভয় কাটেনি তার। শাফিয়া আক্তার রুমঝুমকে নিয়ে শানের সামনে এসে দাঁড়ালো। শান একবার তার মা আর একবার হবু বউয়ের দিকে তাকাচ্ছে। ইশশ মেয়েটার সামনে এমন থাপ্পড় মারলো ওকে। পরে নিশ্চিত এই মেয়ে তার খিল্লি উড়াবে। এসব ভেবে শানের হাত আপনাআপনি আবারও গালে চলে গেলো।

শাফিয়া আক্তার সেটা দেখে গমগমে কন্ঠে বললেন,
-“তোমাকে এজন্য মারিনি যে তুমি বিয়ে করতে এসেছো। তোমাকে মারার কারন হলো তুমি আমাদের কাউকে না জানিয়ে বিয়ে করতে এসেছো।”
শান মাথা নিচু করে ফেললো মায়ের কথায়। শাফিয়া আক্তার শানের মাথায় হাত দিয়ে বললেন,
-“তোমার খুশিই আমাদের কাছে সব । তোমার সাথে আমরা অন্যায় করতাম না।”

শান মাথা নিচু রেখেই বললো,
-“আ’ম সরি , আম্মু। এমনটা আর কখনো করবো না।”

সাথে সাথেই ইমতিয়াজ মাহমুদ এগিয়ে এসে বললেন,
-“আর কখনো করবে না মানে? কতবার আমাদের না জানিয়ে বিয়ে করতে আসবা?”

শান বেকুব বনে গেলো। সে কি অর্থে কথাটা বলেছিলো আর কথাটার অর্থ কি হয়ে গেলো সেটা ভেবেই দাঁত কেলিয়ে রুমঝুমের দিকে তাকালো। রুমঝুম শানের দিকেই ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে ছিলো। শানকে কেলাতে দেখে চোখ গরম দিলো সে।

মেহেদী বাদে উপস্থিত সবাই হাসাহাসি করছে। মেহেদী চেয়েও হাঁসতে পারছে না। কিভাবে হাসবে ও? ওর হাঁসির কারনটাই তো আজ অন্য কারো দখলে চলে যাবে। ওর হাঁসির কারনটা এখন রোজ অন্য কারো হাঁসির কারন হবে। মেহেদীর বুকের মধ্যে ভাঙচুর চলছে। আজ পুরোপুরি হারিয়ে যাবে রুমঝুম।

কাজী সাহেব একটা বিয়ে পড়াচ্ছে। সেটা শেষ হলে শান আর রুমঝুমের বিয়ে পড়াবে। শান ,রুমঝুম,শানের বাবা-মা,মেঘা,মেঘার মা-ভাই সবাই কাজী অফিসের বাইরে বেঞ্চিতে বসে আছে। মেঘা রুমঝুমের হাত ধরে ওর পাশে বসে আছে। শান মেঘার দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে বললো,
-“বাবা-মা এসব কি করে জানলো? তোমরা বলেছো তাই না?”

শান ফিসফিস করে বললেও সেটা শাফিয়া আক্তারের কানে ঠিকই পৌঁছে গেলো। তিনি শানকে তাড়া দিয়ে বললেন,
-“কেন‌ আমরা জেনেছি বলে ক্ষতি হয়ে গেলো?”

শানের কপাল চাপড়াতে ইচ্ছে করছে এখন। তবুও কাচুমাচু মুখ করে বললো,
-“না আম্মু। আসলে জানতে চাচ্ছিলাম আর কি ।”

শাফিয়া আক্তার বললেন,
-“হ্যাঁ ওরাই বলেছে। আমাকে আর তোমার বাবাকে বলেছে সিন্থিয়া আর প্রান্ত। মেহেদী আর ওর মা কে বলেছে মেঘা।”

রুমঝুম মাহেরা খাতুনের দিকে এগিয়ে গেলো। চুপচাপ তার পাশে বসে বললো,
-“আমার উপর রাগ করো নি তো আন্টি? আসলে আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”

মাহেরা খাতুন হেঁসে বললেন,
-“পাগলী মেয়ে। আমি রাগ করি নি মোটেও।”
রুমঝুম মুচকি হেঁসে জড়িয়ে ধরলেন তাকে।

এতোক্ষণে কথা বললো মেহেদী।‌সে রুমঝুমের দিকে এগিয়ে এসে বললো,
-“আমার মনে হয়, তোমার বাবা কে একবার জানানো উচিত। নতুন জীবনে তার দোয়া‌ নিলে সুখী হবা হয়তো।”

রুমঝুমের টনক নড়লো। আসলেই তো,তার বাবাকে আর ভাইকে একবার ফোন করা উচিৎ।

রুমঝুম একটু সাইডে এসে ওর বাবার নাম্বারে কল করলো। মেঘা ওর পিছু পিছু এসে দাঁড়ালো। রুমঝুম মেঘার দিকে একবার তাকিয়ে ফোন কানে ধরলো।
দুবার রিং হওয়ার পর রিসিভ হলো ওপাশ থেকে। রুমঝুমের বুক দুরুদুরু করছে। নিজের বিয়ের কথা বাবাকে কি করে বলবে ও? মেঘা রুমঝুমের সমস্যা বুঝতে পারলো। তাই ফোনটা ওর হাত থেকে নিয়ে নিজেই কথা বলা শুরু করলো।

-“হ্যালো আংকেল, আমি মেঘা।রুমঝুমের বান্ধবী। চিনতে পেরেছেন?”
রেজাউল তালুকদার বেশ কিছু সময় নিয়ে চেনার চেষ্টা করলো। একসময় চিনতে পারলো। সে বললো,
-“হ্যাঁ,চিনতে পেরেছি।”
মেঘা রুমঝুমের দিকে আড়চোখে একবার তাকিয়ে রেজাউল তালুকদারকে সবকিছু খুলে বললেন। রুমঝুমের বিয়ে হচ্ছে তাও তার পছন্দের মানুষের সাথে এটা যেন তিনি বিশ্বাসই করতে পারছেন না। মেঘাকে বললো ,
-“ফোনটা রুমঝুমের কাছে দাও।”

রুমঝুম ফোন কানে নিয়ে কেঁদে ফেললো। ওপাশ থেকে রেজাউল তালুকদার বললেন,
-“পাগলী মেয়ে আমার। কাঁদছিস কেন? বাবা হয়ে কখনো তোর জন্য কিছু করতে পারিনি। তুই নিজেই নিজের জন্য সব করে নে ,মা।”
রুমঝুম কেঁদেই চলেছে। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলার পর রুমঝুম কল কাটলো। আজ অনেক দিন পর বাবার সাথে মন খুলে কথা বললো সে।

এখন তাদের বিয়ে পড়ানো হবে। কাজী সাহেব ডেকেছেন।রুমঝুম রুশানকে একটা টেক্সট পাঠিয়ে সেদিকে গেলো। কাজী অফিসে ঢোকার আগে শাফিয়া আক্তার নিজের গলা থেকে মোটা স্বর্ণের চেইনটা খুলে রুমঝুমের গলায় পরিয়ে দিলেন। রুমঝুম ঝুঁকে সালাম করতে গেলো তাকে। তিনি তড়িঘড়ি করে রুমঝুমকে তুলে বুকে নিলেন।এখন কিছু দিতে পারেননি তবে মেয়েটাকে বাড়িতে নিয়ে পুতুলের মতো সাজাবেন তিনি।

রুমঝুম যখন মিসেস শাফায়াত হলো তখন বিকেলের শেষ ভাগ। শেষ বিকেলের শীতল বাতাসে তার দূর্বিষহ অতীতের অনেক কিছুই ভেসে চলে গেলো।বেশ হালকা অনুভূত হচ্ছে এখন তার।

মেহেদী একটু দূর থেকে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে রুমঝুমের দিকে। এমন অভাগাও মানুষ হয়? যে নিজে স্বাক্ষী হয়ে ভালোবাসার মানুষটির নাম অন্য কারো নামের সাথে জুড়ে দেয়।

তিহান আর বিথী বস্তা বোঝাই করে ফুল নিয়ে শানদের বাড়িতে এলো। মেঘাও কাজী অফিস থেকে চলে এসেছে শান-রুমঝুমের বিয়ে শুরুর আগেই। সিন্থিয়া,প্রান্ত আর শিরীন ওদের বাসরঘর সাজাচ্ছে। মেঘা,তিহান,বিথী ড্রয়িং রুম সাজাচ্ছে। শান্ত দৌড়ে দৌড়ে সবকিছুর তদারকি করছে। মনে হচ্ছে ডেকোরেশনের পুরো দায়িত্বটা তার উপরেই।

শিরীন কাজের চেয়ে বেশি প্রান্তকে দেখছে। প্রান্তের কালচে গোলাপি ঠোঁট আর খাড়া নাকটা শিরীনের ভীষণ পছন্দ।
সিন্থিয়া আরো ফুল আনার উদ্দেশ্য নিচে গেলে প্রান্ত শিরীনের দিকে তাকালো। শিরীন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে নিচের দিকে তাকালো। প্রান্ত গম্ভীর গলায় বললো,
-“আর একবার যদি আমার দিকে তাকাও তবে আমি তক্ষুনি এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবো। আগেও বারন করেছি তোমায়।”
শিরীন মাথা নিচু করেই রইলো। কান্না আটকানোর ক্ষমতা ক্রমশই শেষ হয়ে যাচ্ছে। সিন্থিয়ার আসার শব্দ পেয়ে সে বাথরুমে ঢুকে পড়লো।

একতরফা ভালোবাসা জিনিসটা বড্ড কষ্টের। আর যদি সেটা হয় আবেগের বয়সে তাহলে তো কষ্টের অন্তই থাকে না। শিরীনের প্রান্তের প্রতি এই অনুভূতি আজকের না, আরো দুবছর আগে থেকেই সে প্রান্তকে ভালোবাসে। তবে প্রান্ত তাকে সবসময় ইগনোরই করে গেছে। যে শিরীনের রুপে হাজার ছেলে কুপোকাত হয় সেই শিরীনের দিকে এই ছেলেটা ফিরেও তাকায় না।

শিরীন চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিয়ে বেরিয়ে এলো। সিন্থিয়ার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আপু আমার মাথাটা ঝিমঝিম করছে। আমি এখন রুমে যাচ্ছি। শান্ত কে পাঠাচ্ছি।”
সিন্থিয়া তড়িঘড়ি করে বললো,
-“ওকে পাঠাতে হবে না। ও কাজের চেয়ে অকাজ বেশি করে। আমরা শেষ করতে পারবো। তুমি গিয়ে রেস্ট নাও।”

শিরীন মাথা দুলিয়ে বেরিয়ে গেলো। প্রান্ত সেদিকে একপলক তাকিয়ে ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেললো।

তিহান কাজ করছে আর মাঝে মাঝে মেঘাকে বেয়াইন,ঝগড়ুটে বেয়াইন এসব বলে রাগাচ্ছে । মেঘা তেড়ে এসে বললো,
-“এসব কি হ্যাঁ? আমাকে এসব বলছেন কেন?”
তিহান দাঁত কেলিয়ে বললো,
-“এসব বলে আমি জোর বাড়াচ্ছি বেয়াইন। এনার্জি যা লস হচ্ছে তা আপনাকে রাগিয়ে আবার গেইন করতেছি। ”

মেঘা মুখ ঝামটা দিয়ে নিজের কাজে মন দিলো আবার।
বিথীর চোখ ছলছল করছে। এই ছেলেটা কারো সাথে কথা বললেও তার কলিজায় আঘাত লাগে। ছেলেটা কি কখনোই তাকে বুঝবে না?
ও জানে তিহানের মনে মেঘার জন্য ভালোবাসা টাইপ কোনো ফিলিংস নেই । তিহান মজা‌ করতে পছন্দ করে ভীষণ। মেঘার সাথেও মজা করে। ছেলেটা যে কোনো পরিস্থিতিতে চিল করতে পারে।

সন্ধ্যা গড়িয়ে পড়েছে । আবছা অন্ধকারে প্রকৃতি নিজেকে আড়াল করছে। রুমঝুম শাশুড়ির হাত ধরে বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ালো। পেছনে শান দাঁড়ানো। মেহেদী আর ওর মা’কে ও জোরপূর্বক ধরে এনেছে শাফিয়া আক্তার।

রুমঝুম আশেপাশে তাকাচ্ছে। বাড়িটা রাজপ্রাসাদের মতো। বাম সাইডে গার্ডেন। গার্ডেনের মাঝ বরাবর শেষ দিকে অনেক বড় একটা গাছ তার ডালপালা মেলে দাঁড়িয়ে আছে।তবে অন্ধকারের জন্য বোঝা যাচ্ছে না ওটা কি গাছ।
গাছটা দেখে রুমঝুম মুচকি হাসলো। তার এখন ভয়ংকর সুন্দর একটা ইচ্ছা জেগেছে। তবে সেটা পূরণ করার সময় এটা না।

রুমঝুম যখন গাছটির দিকে তাকিয়ে ছিলো তখনই দরজা খুলে দিলো তিহান। আলোর ছটায় সেদিকে তাকালো রুমঝুম। সাথে সাথেই চোখ বড় হয়ে গেলো তার। মেইন দরজা থেকে সিঁড়ি পর্যন্ত গাঁদা আর গোলাপের পাপড়ি ছড়িয়ে রাস্তা বানানো। সিঁড়িতেও ছিটানো আছে ফুল।

শানের হাত ধরে ইমতিয়াজ মাহমুদ আগে ঢুকলেন ভেতরে। শানকে দরজার পাশে দাঁড় করিয়ে বললেন,
-“বউকে ওয়েল কাম করে ভেতরে নিয়ে আয় গাধা। জানিস আমি তোর‌ মা কে …”
আরো কিছু বলার আগে শাফিয়া আক্তার তার মুখ চেপে ধরলেন। ইমতিয়াজ মাহমুদ অসহায় দৃষ্টিতে তাকালেন তার দিকে। তাদের কর্মকাণ্ডে সবাই একদফা হাসলেন। মেহেদী আর ওর মা’কে শিরীন এসে ভেতরে নিয়ে গেলো। শান‌ রুমঝুম ব্যাতীত সবাই ভেতরে চলে গেলো। ওরা লজ্জা পাচ্ছিলো দেখে সবাই ওদের একা ছেড়ে দিলো।
মেহেদী কয়েকবার পেছনে তাকিয়ে দেখলো রুমঝুমের লজ্জামাখা মুখটা।

সবাই চলে যেতেই শানের সাহস বেড়ে গেলে তরতর করে। সে রুমঝুমের দিকে এগিয়ে গেলো। তার দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
-“ওয়েলকাম। ওয়েলকাম মাই হার্টকুইন।
চন্দ্ররাজ্যে চন্দ্রকন্যাকে স্বাগতম। ”
রুমঝুম মিষ্টি হেঁসে শানের হাত ধরলো। শানের হাত ধরেই ফুল বিছানো রাস্তা ধরে হেঁটে ভেতরে গেলো। সিঁড়ি অবধি যেতেই শাফিয়া আক্তার এসে রুমঝুমকে ধরলেন। শানকে বললো,
-“তুই আপাতত এখানেই সবার সাথে আড্ডা দে। ওকে আমি নিয়ে যাবো।সিন্থিয়া আর শিরীন আমার সাথে যাবি।।”

শানের মুখটা কালো হয়ে গেলো। সে বেজার হয়ে উল্টো দিকে হেঁটে গিয়ে সোফায় বসলো।
ইমতিয়াজ মাহমুদ ছেলের অবস্থা দেখে বেশ দুঃখ পেলেন। ছেলের কাঁধে হাত রেখে বললেন,
-“দুঃখ পেয়ো না বেটা। বউ তো তোমারই। ওটা কেউ একদম নিয়ে যাচ্ছে নাকি? সারাজীবন তোমাকেই সহ্য..”
এটুকু বলে শাফিয়া আক্তারের দিকে একনজর তাকিয়ে দাঁত বের করে আবার বললেন,
-“মানে বলতে চাচ্ছিলাম যে, সারাজীবন তোমার কাছেই তো থাকবে। তোমাকেই তো আগলে রাখতে হবে। ”

সাথে সাথেই হাঁসির রোল পড়ে গেলো ড্রয়িং রুমে। শান বেশ লজ্জা পেলো বাবার কথায়। প্রান্ত এসে শানের কাঁধ চাপড়ে ওর পাশে বসে পড়লো। শান‌ প্রান্তের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“ফোন করে বললাম তোরা আয়। আর তোরা এসে আব্বু-আম্মুকে বললি? ”
-“এটা সিন্থুর বুদ্ধি ছিলো। তবে আই থিংক এটাই ভালো‌ হয়েছে।”
-“ভালো তো‌ হয়েছে তবে আমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”

-“আমি আর সিন্থু ও প্রথমে বেশ ভয় পাচ্ছিলাম। বাট বিলিভ মি শান, আন্টি-আঙ্কেল একদমই রাগ করেননি। উনারা পুরোপুরি কুল ছিলেন।”
-“তোরা কনভেন্স করলি কিভাবে?”
-“আরে আমাদের কিছুই করতে হয় নি। শুধু এসে রুমঝুমের ব্যাপারটা বলেছি।‌ আর তুই এমন ডিসিশন কেন নিলি সেটা বুঝিয়ে বলেছি।”

সিন্থিয়া এগিয়ে এসে বললো,
-” আন্টি তো সাথে সাথেই রুমঝুমের জন্য লেহেঙ্গা আর কিছু জুয়েলারি অর্ডার করে ফেলেছিলো। এখন‌ সেগুলো এলেই রুমঝুমকে নিজ হাতে সাজাবেন তিনি।”

সবার কথার মাঝে শান্ত কোথা থেকে উড়ে এলো। রুমঝুমের হাত ধরে ঝাকুনি দিয়ে বললো,
-“তুমিই আমার ভাবি তাই না? ওই গোমরামুখোটার বউ।”
রুমঝুম ফিক করে হেসে ফেললো। শান্তর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“হ্যাঁ আমিই তোমার ভাবি।”

শান্ত জ্বলজ্বল চোখে বললো,
-“তুমি ম্যাথ করতে পারো?”
রুমঝুম কিছু বলতে যাবে তার আগেই শিরীন দৌড়ে এসে বললো,
-“আরে না ভাই। ভাবি একদমই ম্যাথ পারে না। এই দেখ না , লাস্ট পরীক্ষায় ম্যাথে ফেল করেছে বলে তাকে ধরে বিয়ে দিয়ে দিলো।”

শান্ত রুমঝুমের দিকে তাকিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো এটা সত্যি কি না। রুমঝুম শিরীনের দিকে একবার তাকিয়ে বেচারি লুকে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালো ।
শান্ত আফসোসের সুরে বললো,
-“ইশশ.. আমি আগে জানলে তোমাকে নিজ দায়িত্বে ম্যাথ শিখাতাম। তাহলে তুমি ফেলও করতে না আর তোমাকে ওই গোমরুটাকেও বিয়ে করতে হতো না। আমি তোমাকে পড়ালেখা করিয়ে আরো বড় করতাম তারপর তোমাকে বিয়ে করে নিতাম। কত্ত কিউট তুমি।”

শান্তর পাঁকা পাঁকা কথায় হাসতে হাসতে সবার অবস্থা কাহিল। ছেলেটা প্রচুর ম্যাথপ্রেমী। যাকে পায় তার কাছেই ম্যাথ করতে বসে যায়। ওর থেকে রুমঝুমকে বাঁচানোর জন্যই আপাতত এমন মিথ্যা বলেছে।

হাসাহাসির মধ্যেই রুমঝুমের জন্য অর্ডার করা ড্রেস আর জুয়েলারি চলে এলো। সবকিছু‌ হাতে পেয়ে রুমঝুমকে নিয়ে শাফিয়া আক্তার,শিরীন‌ আর সিন্থিয়া উপরে চলে গেলো। সিন্থিয়া উপরে উঠার সময় একবার মেহেদীর দিকে তাকালো। মেহেদী তখনও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রুমঝুমের যাওয়ার পথে।
সিন্থিয়ার বুক কেঁপে উঠলো। মেহেদীর দৃষ্টি স্পষ্ট পড়তে পেরেছে ও। সেই দৃষ্টিতে ফুটে উঠেছে প্রিয়জন হারানোর বেদনা।

চলবে……..

চন্দ্ররঙা প্রেম পর্ব-১২

0

#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্ব-১২
#আর্শিয়া_সেহের

-“আরমান,তোমার সব টাকা আমি ফিরিয়ে দেবো। দয়া করে রুমঝুমের পেছনে আর পরে থেকো না।
-“আহা শ্বাশুড়ি আম্মা। এখন এই কথা বললে তো হবে না। এগ্রিমেন্টের কথা ভুলে গেছেন?”
-“দেখো আরমা..”
-“হুশশশ… হঠাৎ মেয়ের প্রতি দরদ উথলে উঠলো কিভাবে?আমার কাছে বিক্রি করে দেওয়ার সময় এই দরদ কোথায় ছিলো?”

রুশান কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দরজার আড়ালে। ওদের দুজনের কথা শুনে নড়ার শক্তিটুকুও হারিয়েছে সে। তার বোনকে বিক্রি করে দিয়েছিলো? টাকার প্রতি এতো লোভ এই মহিলার?

-“আমি কাল সকালেই যাচ্ছি রুমঝুমকে আনতে। আর এই কথা যেন আপনার বিচ্ছু ছেলের কানে না‌ যায়।”

আরমানের বের হওয়ার আভাস পেয়ে রুশান দ্রুত লুকিয়ে পড়লো।‌ আরমান বাড়ি থেকে বের হয়ে গেলে রুশান তার মায়ের দরজার সামনে এসে দাঁড়ালো। তাচ্ছিল্যের হাসি হেঁসে বললো,
-“বাহ্ আম্মু বাহ্। মা না‌ হও ,একটা মেয়ে হয়ে কিভাবে করলে এমন? বিবেকে‌ বাঁধলো না তোমার? আমার ঘৃনা হচ্ছে তোমার প্রতি। জানিনা আল্লাহ কেন তোমার মতো মহিলার গর্ভে পাঠালো‌ আমাকে। এতো অন্যায় কিভাবে করো তুমি? তোমাকে মা ডাকতে লজ্জা করছে আমার।”

রুশানের কথায় চমকে উঠে পেছনে তাকালো‌ তাহমিনা বেগম। রুশানকে সে এই কথাটা জানতে দিতে চায়নি। সে জানে রুশান‌ কতটা ভালোবাসে রুমঝুমকে। রুশান কখনো ক্ষমা করবে না তাকে। রুশান তাকে ঘৃণা করে মা ডাকা বন্ধ করে দিবে ভেভেই তার বুক কেঁপে উঠলো।
তাহমিনা বেগম তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এলেন রুশানের দিকে। রুশান দু’পা পিছিয়ে গেলো। কড়া কন্ঠে বললে,
-“কখনো‌ আমার আশেপাশে আসবে না তুমি। আমি ঘৃনা করি তোমাকে।”
বলেই ধুপধাপ পা ফেলে নিজের ঘরে চলে গেলো রুশান।

তাহমিনা বেগম অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়েছে। এমন জীবন রেখে কি লাভ যেখানে নিজের সন্তানই তাকে ঘৃনা করে। তাহমিনা বেগম ধীরে ধীরে মেঝেতে বসে পড়লো। মনে মনে জীবনের সবচেয়ে বড় ডিসিশনটাও নিয়ে নিলো। তবে সেটা কার্যকর করার জন্য সঠিক সময়ের অপেক্ষা করতে হবে।

রুশান নিজের ঘরে ঢুকে দরজা আটকে দিলো। বিছানায় বসে দুহাতে মুখ চেপে বসে রইলো। কলিজা ছিড়ে যাচ্ছে তার। কষ্টে বুকের মধ্যে ভাঙচুর শুরু হয়েছে। তার মা ই কেন এমন হলো? মায়ের এই রুপ কোনো সন্তান কিভাবে সহ্য করে? রুশান নিজেকে সামলে নিলো। এখন তার আপুকে বাঁচাতে হবে। ওই স্বার্থপর মহিলার কথা ভেবে সময় নষ্ট করলে চলবে না।

দুপুর আড়াইটার মতো বাজে। শান আর রুমঝুম দু’জনই ঘেমে একাকার। কিছুক্ষণ আগেই ওরা নেভাল থেকে ফেরার উদ্দেশ্যে বাইকে বসেছে। বেশ কিছু পথ আসার পর রুমঝুমের ফোন বেজে উঠলো। রুমঝুম ফোন বের করে দেখলো রুশান কল করেছে। রুশানের কল দেখেই রুমঝুমের ভ্রু কুঁচকে এলো।‌ এমন টাইমে তো‌ রুশান কল করে না। রুমঝুম ভাবনা বাদ দিয়ে ফোন রিসিভ করলো।

-“হ্যালো, রুশান।”
ওপাশ থেকে থেকে কথা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে না রুমঝুম। ছুটে চলা বাইকের শাঁ শাঁ শব্দে কথা শোনা মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। রুমঝুম শানকে বাইকটা একটু সাইড করে দাঁড় করাতে বললো।শান‌ বাইক দাঁড় করালে রুমঝুম কথা শুরু করলো আবার।

-“হ্যালো, হ্যালো, আপু শুনতে পাচ্ছো?”
-“হ্যাঁ পাচ্ছি, বল এবার।”
-“আপু আরমান শয়তানটা আবার তোমার খোঁজ পেয়ে গেছে। আপু পালাও তুমি।আবার পালাও।”
রুমঝুম বাইক থেকে নেমে গেলো। আচমকা চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এলো। আর কত সহ্য করবে ও?
রুমঝুমের হঠাৎ এমন অবস্থা দেখে ঘাবড়ে গেলো শান। রুমঝুমের কাঁধ ধরে নিজের দিকে ঘুরালো। রুমঝুম শানের বুকে হেলে পড়ে ঝরঝর‌ করে কেঁদে উঠলো। রুশান তখনও লাইনে আপু আপু করে যাচ্ছে।

শান রুমঝুমকে এক হাতে বুকে আগলে ধরে অন্য হাতে ফোন কানে ধরলো। রুশান আবারও আপু বলতেই শান উত্তর দিলো,
-“আমি তোমার আপু নই। তোমার আপুকে কি বললে যার জন্য সে এভাবে ভেঙে পড়লো?”

রুশান থেমে গেলো। কিছুটা সময় নিয়ে বললো ,
-“আপনি কে? আমার আপুর কাছে কি করছেন?”
-“তোমার আপুর শুভাকাঙ্ক্ষী আমি। তার সুরক্ষা বলয়।”
রুশানের বুঝতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগলো। যখন বুঝলো তখন মুখে ফুটে উঠলো স্বস্তিময় হাঁসি। যাক ,তার বোনেরও শেষমেশ কেউ একজন হয়েছে।

রুশানের নিরবতা দেখে‌ শান আবারও বললো,
-“হ্যলো, শুনতে পারছো আমার কথা?”
-“জ্বি ভাইয়া শুনতে পাচ্ছি।”
-“কি সমস্যা হয়েছে আমাকে বলো।”
রুশান একে একে আজকের সব কাহিনী বললো। শানের চোয়াল শক্ত হয়ে এলো সব শুনে। রুশানকে আশ্বস্ত করে শান বললো,
-“তুমি চিন্তা করো না। তোমার আপুকে আমি দেখে রাখবো। নিজের খেয়াল রেখো।”
-“আপনারাও আপনাদের খেয়াল রাখুন ভাইয়া।”
ফোন কেটে রুশান‌ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তার কেন জানি আর চিন্তা হচ্ছে না আপুর জন্য। হয়তো তার চিন্তা কমানোর জন্য আরেকজন এসে গেছে‌ তাই।

রুমঝুম শানের বুকে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। শানও রুমঝুমকে আগলে ধরে বসে আছে । রুমঝুম দীর্ঘ সময় পর মাথা তুলে বললো,
-“ও আমাকে পেয়ে গেছে। ও আমাকে নিয়ে আঁটকে রাখবে। জোর করে বিয়ে করবে। অনেক বাজে লোক ও। আমি মরে যাবো এবার । বিশ্বাস করুন, আমি মরে যাবো।

শানের নিঃশ্বাস আটকে যাওয়ার উপক্রম হলো রুমঝুমের শেষ কথায়। সে রুমঝুমের মাথা শক্ত করে বুকের সাথে চেপে ধরলো। ধরা গলায় বললো,
-“এমন কিচ্ছু হবে না ,চন্দ্রকন্যা। আমি আছি তো।”

আবারও কিছু সময় নিরবতায় কাটলো। হঠাৎ করেই রুমঝুম দাঁড়িয়ে পড়লো। আচমকা এমন হওয়াতে শান কিছুটা ভড়কে গেলো। সেও উঠে রুমঝুমের মুখোমুখি দাঁড়ালো। রুমঝুমের মুখে চোখের পানি শুকানোর দাগ পরে গেছে ইতোমধ্যে। রুমঝুম শানের চোখে চোখ রেখে বললো,
-“বিয়ে করবেন আমাকে? আজই ।”

শান হঠাৎ এমন কথা শুনে খানিক চমকে গেলো। বাড়িতে না জানিয়ে বিয়ে করবে কিভাবে? আবার রুমঝুমের দিকটাও ভাবতে হবে।
তাছাড়া এখানে না করার কোনো অপশন নেই। বাবার অফিসের অর্ধেক দায়িত্ব তার উপরে। এখন বিয়ে করা তার জন্য কঠিন কিছু না। তাছাড়া ভালোবাসাটাও হালাল হবে আর মেয়েটা শান্তিও পাবে। বাবা-মাকে বুঝিয়ে বললে তারা অবশ্যই বুঝবে।

শান কোনো কথা না বলে প্রান্তর কাছে ফোন করলো। প্রান্ত ,সিন্থিয়া আর মেঘা ক্যান্টিনে বসে খাচ্ছিলো তখন।
শানের কল দেখে প্রান্ত স্পিকার অন করে টেবিলে রেখে কথা বলা শুরু করলো।
-“হ্যাঁ শান‌, বল।”
-“ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে কাজী অফিসে পৌঁছাবি। আমি রুমঝুমকে আজই বিয়ে করবো।”

প্রায় সাথে সাথেই মেঘা কেঁশে উঠলো। শান মেয়েলি শব্দ শুনে বললো,
-“তোর পাশে কে?”
প্রান্ত তখনও ঘোরের মধ্যে। শানের হঠাৎ বিয়ের ডিসিশন তার মস্তিষ্ক এখনো মেনে নিতে পারে নি। প্রান্তকে হতভম্ব হয়ে বসে থাকতে দেখে সিন্থিয়া ফোন তার দিকে টেনে নিলো।
গলা খাঁকারি দিয়ে বললো,
-“আমি,মেঘা আর প্রান্ত আছি এখানে। হঠাৎ এমন ডিসিশন কেন‌ নিলি?”
ভেবে চিন্তে নিয়েছিস?”

শান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুশানের বলা সবকিছুই খুলে বললো। মেঘা, প্রান্ত ,সিন্থিয়া তিনজনই নির্বাক। এই মেয়েটার কপালটা এমন হলো‌ কেন?
প্রান্ত বললো,
-“কিন্তু আঙ্কেল-আন্টি? উনাদের বলবি না? ”
-“আমি ঝুমকে বউ করে নিয়ে উনাদের সামনে যাবো। বুঝিয়ে বললে নিশ্চয়ই বুঝবেন তারা। তোরা প্লিজ কাজী অফিসে চলে আসিস।”

প্রান্ত উত্তর দেওয়ার আগেই শান ফোন কেটে দিলো। রুমঝুম এতক্ষণ হা করে শানের মুখের দিকে চেয়ে ছিলো। সে ভাবতেই পারেনি যে শান এতো সহজে রাজি হয়ে যাবে। শান ফোন পকেটে ঢুকিয়ে রুমঝুমের দিকে তাকানো মাত্রই রুমঝুম মাথা নিচু করে ফেললো। বিয়ে করতে বলার সময় লজ্জা না‌ লাগলেও এখন বেশ লজ্জা লাগছে।

শান মুচকি হেঁসে প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে শিষ বাজাতে বাজাতে রুমঝুমের দিকে এগিয়ে এলো। কানের কাছে ফিসফিস করে বললো,
-“এখনই এতো‌ লজ্জা পেলে কি করে হবে লজ্জাবতী? আজকে রাতের জন্যও কিছু রাখো। ”
রুমঝুমের এবার লজ্জায় মাটির নিচে ঢুকে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো। শান রুমঝুমের মুখভঙ্গি দেখে শব্দ করে হেঁসে ফেললো।

রুমঝুমের হাত ধরে নিয়ে বাইকে উঠে বসলো। রুমঝুম পেছন থেকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরলো শানকে। মনের মধ্যে অন্যরকম প্রশান্তি কাজ করছে এখন।

-“আমি কাজী অফিসে যাবো না। ”
সিন্থিয়ার কথা শুনে মেঘা আর প্রান্ত দু’জনই বেশ‌ অবাক হলো। সবকিছু জেনেও মেয়েটা বেকে বসলো কেন?
প্রান্ত ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“কেন যাবি না? সবকিছু শোনার পরও বলছিস যাবো না?”
সিন্থিয়া উল্টো দিকে ঘুরে ঠোঁট টিপে হাসলো। তারপর কন্ঠে গাম্ভীর্য ঢেলে বললো,
-” হ্যাঁ যাবো না। আমি চাই না ওদের বিয়ে এভাবে হোক।”

মেঘার এবার রাগ হলো। রুমঝুমের এমন বিপদের সময় সিন্থিয়ার এই রুপ ওর মোটেই ভালো লাগছে না। মেঘা ধপধপ করে এগিয়ে গেলো সিন্থিয়ার সামনে। রাগী মুখে সিন্থিয়ার দিকে তাকিয়ে বেকুব বনে গেলো। মেয়েটা মিটিমিটি হাসছে কেন?

সিন্থিয়া হা হা করে হেঁসে উঠলো। দুজনের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“দু’জন তো দেখছি আমাকে চোখ দিয়েই গিলে খাবি। আরে আমি আসলেই চাই না ওদের বিয়ে এভাবে হোক কিন্তু এটা তো চাই যে ওদের বিয়ে হোক।”

প্রান্তের ভ্রু কুঁচকে কপালে ভাঁজ পড়লো‌ সিন্থিয়ার কথা শুনে। কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
-“সরাসরি বল যা বলবি। এভাবে ঘুরায় পেঁচায় বলছিস কেন?”
সিন্থিয়া দাঁত কেলিয়ে বললো,
-“চল ওদের একটা সারপ্রাইজ দেই।”
মেঘা বললো,
-“কি সারপ্রাইজ?”

এরপর সিন্থিয়া ওদের সবটা বুঝিয়ে বললো। সবকিছু শুনে প্রান্ত আর মেঘার মুখেও হাঁসি ফুটে উঠলো। সিন্থিয়া মেঘার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“কি মেঘা? পারবে তো?”
মেঘা ভাব নিয়ে বললো,
-“আলবাত পারবো।”
সিন্থিয়া হেঁসে বললো,
-“তাহলে কাজ সেরে ফেলো।”
মেঘা ওদের দুজনকে বিদায় জানিয়ে দ্রুতপদে বাড়ির রাস্তা ধরলো।

সিন্থিয়া উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে প্রান্তের উদ্দেশ্যে বললো,
-“তিহান‌ আর বিথীকে ফোন‌ দে। হাতে সময় কম। তাড়াতাড়ি করতে হবে সবকিছু।”

শান কাজী অফিস থেকে বেশ দূরে একটা শপিং মলে ঢুকেছে রুমঝুমকে নিয়ে। উদ্দেশ্য রুমঝুমকে একটা শাড়ি আর একটা সোনার নাকফুল কিনে দেওয়া। কিছু না দিয়ে বিয়ে করাটা কেমন দেখায়। অ্যাটলিস্ট একটা নতুন শাড়ি তো পড়ুক।

রুমঝুম শানের পিছু পিছু হাঁটছে আর হাত দুইটা মুচড়াচ্ছে নিজেই। শান একবার পিছনে তাকিয়ে রুমঝুমের অবস্থা দেখে নিলো। আবার সামনে তাকিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
-” এতো বেশি টেনশন‌ করছো কেন?”

রুমঝুম হয়তো এই প্রশ্নের জন্যই অপেক্ষা করছিলো।‌ সে ধীর গতিতে দৌড়ে শানের পাশাপাশি এসে হাঁটা শুরু করলো। আড়চোখে একবার শানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আপনার বাবা-মা,আন্টি, মেহেদী ভাইয়া এদেরকে নিয়ে টেনশন হচ্ছে। এরা ব্যাপারটা কিভাবে নিবে বুঝতে পারছি না। আমাকে খুব খারাপ মেয়ে ভাববে এরা।”

শান হাঁটার গতি কমিয়ে দিলো। রুমঝুমের হাতের আঙুলের ফাঁকে নিজের আঙুলের জায়গা করে নিয়ে শক্ত করে হাতটা ধরলো। রুমঝুমকে আশ্বস্ত করে বললো,
-“আমি সব্বাইকে ম্যানেজ করে নিবো দেখো। একটুও ভয় পেয়ো না তুমি।”
রুমঝুম মুচকি হেঁসে মাথা দোলালো।
মুখে এমন কথা বললেও মনে মনে শান বেশ ঘাবড়ে আছে। প্রথমে সবাই কেমন রিঅ্যাক্ট করবে সেটা ভেবেই ঘাম ছুটে যাচ্ছে তার। মনে মনে প্রার্থনা করছে, সবটা যেন ভালোয় ভালোয় মিটে যায়।

রুমঝুম শাড়ি পছন্দ করার দায়িত্ব শানের উপর ছেড়ে দিয়েছে। তার মতে,শানের পছন্দ অনেক সুন্দর। জন্মদিনের গাউনটা শান নিজের পছন্দে কিনেছে এটা জানার পরই তার এমন ধারনা জন্মেছে।
শান অনেক খুঁজে একটা সিঁদুর লাল রঙের শাড়ি বের করলো। রুমঝুমেরও বেশ পছন্দ হলো সেটা। শান‌ শাড়িটা কিনে রুমঝুমকে ট্রায়াল রুমে পাঠালো চেন্জ করে আসার জন্য। আর সে পাশের একটা জুয়েলারি দোকানে গেলো নাকফুল কিনতে।

রুমঝুম শাড়ি পড়ে বেরিয়ে এলো প্রায় সতেরো মিনিট পর। বের হয়ে আশেপাশে শান কে কোথাও দেখতে পেলো না সে। কিন্তু একেবারের জন্যও বুক কাঁপেনি তার। রুমঝুমের দৃঢ় বিশ্বাস,শান কখনোই তাকে ঠকাবে না।

প্রায় চার মিনিট পর শান রুমঝুমের পাশে এসে দাঁড়ালো। একসাথে হাঁটতে হাঁটতে রুমঝুমকে জিজ্ঞেস করলো,
-“কতক্ষন দাঁড়িয়ে আছো?”
রুমঝুম বললো,
-“পাঁচ মিনিটের মতো।”
-“ভয় পেয়েছো?”
রুমঝুম আড়চোখে তাকিয়ে বললো,
-“ভয় পাবো কেন?”
শান হেঁসে বললো,
-“এই যে তোমাকে বিয়ে না করার জন্য যদি ফেলে চলে যেতাম?”
রুমঝুম হাঁসলো । খুবই চমৎকার সেই হাঁসি। হাঁসির মাধ্যমেই হয়তো বুঝিয়ে দিলো যে সে কতখানি বিশ্বাস করে শান কে।

..

প্রায় একঘন্টা যাবৎ শান‌ আর রুমঝুম কাজী অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের কারোরই পাত্তা নেই। শান এই পর্যন্ত প্রায় একশোবারের মতো কল করেছে ওদের চারজনকে। একজনও ফোন তুলছে না। শানের এবার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে আর রুমঝুমের হচ্ছে ভয়।

কাজী অফিস থেকে বেশ কিছুটা দূরে পার্কিং এরিয়া। শান সেদিকে তাকাতেই হোঁচট খেলো। চোখ বড় বড় হয়ে গেলো তার।
খানিক দূরেই দেখা যাচ্ছে তার বাবা-মা,মেঘা ,মেঘার মা আর ভাই আসছে।
রুমঝুম তাদেরকে দেখে শানের হাত খামচে ধরলো।
শাফিয়া আক্তার শানের সামনাসামনি এসে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ শানের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে ঠাসস করে থাপ্পড় বসিয়ে দিলো তার বাম গালে।
রুমঝুম কেঁপে উঠলো থাপ্পড়ের শব্দে। শান হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো তার মায়ের দিকে।

চলবে…..

চন্দ্ররঙা প্রেম পর্ব-১১

0

#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্ব-১১
#আর্শিয়া_সেহের

সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে। মেঘা আর রুমঝুম বাড়ির কাছাকাছি চলে এসেছে। রুমঝুম চোখ বন্ধ করে মেঘার ঘাড়ে মাথা হেলিয়ে বসে আছে। মুখে মুচকি হাঁসির ছটা লেগে আছে। মস্তিষ্কে ঘুরপাক জীবনের সবচেয়ে খুশির দিনটা। শানের চোখে আজ নিজের জন্য ভালোবাসার এক অতল সমুদ্র দেখেছে রুমঝুম। ওই সমুদ্রে একবার ডুবলে শানের ভালোবাসায় তার মৃত্যু নিশ্চিত। রুমঝুম নিজের কল্পনায় অন্য এক ভুবনে শানের সাথে ঘর বাঁধতে ব্যস্ত এখন।

চারপাশে আবছা অন্ধকার‌ নেমে গেছে। বাড়ির গেট খুলে মেঘা আগে আর পিছে পিছে রুমঝুম আসছে। মেইন দরজা খোলা ছিলো। দুজন দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখলো সারাবাড়ি অন্ধকার। রুমঝুম একটু এগিয়ে মেঘার হাত ধরে বললো,
-“বাড়ি এমন অন্ধকার হয়ে আছে কেন রে?”

মেঘার উত্তরের আগেই লাইট জ্বলে উঠলো। ড্রয়িং রুমের মেঝেতে বেলুনের ছড়াছড়ি। দরজার অপজিট দিকে দেয়ালে লাল জারবেরা ফুল দিয়ে লেখা,
* HAPPY BIRTHDAY
RUMJHUM *

রুমঝুম হাঁ করে তাকিয়ে আছে। আজকে তার চমকের উপর চমক পাওয়ার দিন। মাহেরা খাতুন মুচকি হেঁসে এগিয়ে গেলো রুমঝুমের দিকে। রুমঝুম তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। জন্মের পর কখনোই সে এমাবে জন্মদিন উদযাপন করার সুযোগ পায়নি। তার একটা মা ছিলো যে জন্মদিনের দিন তাকে বাড়িতে আটকে রাখতো। সমস্ত কাজ তাকে দিয়ে করাতো। রুমঝুমের মনে হতো তার প্রতিটি জন্মদিনই তার জন্য বেদনার তবে আজ তার সেই ধারনা ভুল প্রমাণ হলো। আজকের দিনটা তার জন্য অনেক কিছু বয়ে এনেছে।

রুমঝুম নাক টেনে কেঁদে বললো,
-” তোমাদেরকে অনেক ধন্যবাদ, আন্টি।”
মাহেরা খাতুন রুমঝুমের চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বললো,
-“পাগলী মেয়ে। কাঁদছিস কেন? আর এই সবকিছু মেহেদী করেছে। আমি কিছুই করিনি।”

রুমঝুম মেহেদীর দিকে তাকালো। মেহেদী একটু দূরে দাঁড়ানো। রুমঝুম মুখ খুলতে যাবে তখনই মেহেদী বললো,
-“আমাকে ধন্যবাদ জানানোর কোনো দরকার নেই। এসে কেকটা কেটে আমাকে উদ্ধার করুন মহারানী।”
রুমঝুম ফিক করে হেঁসে ফেললো। চারজন মিলে কেক কাটলো, অনেক হাসি আনন্দের মধ্যে কিছু সময় কাটালো। কিছু সময় পর মেহেদী রুমঝুম আর মেঘার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“সারাদিন দু’জন বাইরে ছিলে। গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। ”

দুজনই চুপচাপ ফ্রেশ হতে চলে গেলো।রুমঝুম রুমে ঢুকে দরজা আটকে দিলো। কাঁধ থেকে ব্যাগটা নামিয়ে ব্যাগের মধ্যে থেকে শানের দেওয়া গাউন টা বের করলো। জামাটা বুকে জড়িয়ে বসে রইলো কিছুক্ষণ। জামাটা অতি যত্নে গুছিয়ে রেখে ফ্রেশ হতে ঢুকলো ওয়াশ রুমে।

-“ঝুম ,ঝুম দরজা খোল।”
খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে আজকের তোলা ছবিগুলো দেখছিলো রুমঝুম। শান হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছে ছবিগুলো। মেঘার ডাক শুনে ফোন রেখে দরজা খুললো রুমঝুম। মেঘা হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকলো। রুমঝুমকে টেনে নিয়ে খাটে বসিয়ে বললো,
-“কি করছিলি রে? জিজু ফোন টোন দেয়নি এখনো?”
-“তার কি আর কোনো কাজ নেই? সারাক্ষণ চিপকে থাকবে আমার সাথে?”

মেঘা দাঁত কেলিয়ে হাসলো। খানিকক্ষণ পরে সিরিয়াস হয়ে বললো,
-“তুই খুশি তো ঝুম?”
রুমঝুম চুপ রইলো। তার লজ্জা লাগছে খুব। মেঘা টিপ্পনী কেটে বললো,
-“আহা !আবার লজ্জা পাওয়া হচ্ছে? দুই দুইবার জড়িয়ে ধরার সময় লজ্জা লাগেনি হু?”
রুমঝুমের এবার লজ্জায় কান গরম হয়ে গেলো। মেঘাকে মিছিমিছি মারতে লাগলো সে।

..

-“মা ,তুমি এগুলো উঠায় রাখো। আমি রুমঝুমকে ওর গিফটটা দিয়ে আসি।”
-“আচ্ছা যা। আমি এদিকে দেখছি।”
মেহেদী ধূসর পাঞ্জাবির পকেটে নুপুরজোড়া ঢুকিয়ে হাতে একটা চকোলেট বক্স নিয়ে রুমঝুমের ঘরের দিকে গেলো।তবে ভেতরে ঢুকতে পারলো না । তার আগেই কানে এলো রুমঝুমের উচ্ছাসিত কন্ঠ। রুমঝুম আর মেঘার কথপোকথন পুরোটাই তার কানে এলো।

মেহেদীর পুরো দুনিয়াটাই যেন ঘুরে উঠলো। তার বহু প্রতীক্ষিত ভালোবাসার মানুষটি নিজেকে হাসিমুখি অন্য কারো বন্দিনী বানাতে চায় । এর চেয়ে কঠিততম বাক্য এ পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি কি হতে পারে? মেহেদী শরীরের ভার ধরে রাখতে পারলো না। ধপ করে মেঝেতে বসে পড়লো। হাত থেকে চকোলেট বক্সটা মেঝেতে পড়ে গেলো। সেই শব্দে মেঘা আর রুমঝুম বাইরে বেরিয়ে এলো।

মেহেদী সেকেন্ডের মধ্যেই নিজেকে সামলে নিলো। মেঘা আর রুমঝুম বাইরে এসে দেখলো মেহেদী মেঝেতে বসে আছে। মেঘা উচ্চকণ্ঠে বললো,
-“ভাইয়া ,পড়লে কিভাবে?”
মেহেদী আড়চোখে তাকিয়ে স্বাভাবিক কন্ঠে উত্তর দিলো,
-“নিজের পায়ে বেঁধে পড়ে গেছি।”
সাথে সাথেই রুমঝুম উচ্চ স্বরে হেঁসে উঠলো। মেহেদী অপলক তাকিয়ে রইলো সেই হাঁসি মাখা মুখটার দিকে। মন থেকে হাসছে মেয়েটা। কি সুন্দর লাগছে দেখতে। মেহেদী চোখ ফিরিয়ে নিলো । এই হাঁসি দেখার অধিকার বোধহয় সে হারিয়ে ফেলেছে।

মেহেদীর হঠাৎ চোখ পড়লো রুমঝুমের পায়ের দিকে। মেঝে থেকে উঠতে উঠতে বললো,
-“নুপুর কোথায় পেলে, রুমঝুম?
রুমঝুম লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। সে মেহেদীকে কি করে বলবে যে এটা তার ভালোবাসার মানুষটির কাছে ছিলো। রুমঝুম কোনো মতে বললো,
-“পেয়েছি একজায়গায়,ভাইয়া।”
বলেই রুমঝুম ঘরে ঢুকে গেলো।

আশ্চর্য! রুমঝুমের মুখে ভাইয়া ডাক শুনে এখন আর খারাপ লাগছে না মেহেদীর। মানুষের জীবনে হয়তো একটা মূহুর্তই যথেষ্ট অনেক কিছু পাল্টে দেওয়ার জন্য।

মেঘা হাসতে হাসতে মেহেদীর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“বুঝলে ভাইয়া, আমাদের রুমঝুম ভয়ংকর প্রেমে পড়েছে।”
মেহেদী হাসলো।‌ সেই হাঁসিতে ফুটে উঠলো একরাশ কষ্ট,বেদনা আর ব্যার্থতা। মেঘা তা দেখতে পেলো না। মেহেদী মেঘার হাতে চকোলেটের বক্সটা দিয়ে বললো ,
-“দু’জনে ভাগ করে খেয়ে নিস।”
মেঘা মাথা হেলিয়ে রুমঝুমের রুমে ঢুকে পড়লো। নুপুরজোড়া আর বের করা হলো না। অবহেলিত ভাবে পড়ে রইলো মেহেদীর পাঞ্জাবির পকেটে।

মেহেদী বহু কষ্টে নিজেকে টেনে আনলো ড্রয়িং রুম পর্যন্ত। মাহেরা খাতুন টেবিল মুছছিলো তখন। ছেলের বিদ্ধস্থ দৃষ্টি তার চোখ এড়ালো না। অনেকটা দৌড়ে এলো মেহেদীর কাছে। মেহেদী মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। মাহেরা খাতুন কিছু একটা আন্দাজ করে মেহেদীকে নিয়ে মেহেদীর ঘরে চলে গেলেন। পাছে মেয়ে দুটো দেখে ফেলে এজন্য।

মেহেদী মায়ের কোলে মাথা রেখে ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। বাবার মৃত্যুর পর আজই প্রথম কাদলো মেহেদী। মাহেরা খাতুন ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,
-“কি হয়েছে বাবা? কাঁদছিস কেন তুই? ”
মেহেদী নিজেকে সামলাতে চেয়েও পারলো না। কেঁদে কেঁদেই বললো,
-“আমার ঝুমটা অন্য কাউকে ভালোবাসে, মা। ও আমাকে বোঝেনি, মা। আমাকে একটু খানি বুঝলে কি এমন ক্ষতি হতো বলো তো?”

মাহেরা খাতুনের হাত থেমে গেলো। ছেলেকে কি বলে শান্তনা দেবেন তিনি? ধরা গলায় বললেন,
-“ভালোবাসা মানুষের মন থেকে আসে বাবা। কাকে কখন মন ভালোবেসে ফেলে সেটা মানুষ নিজেও জানেনা। তোর কপালে ঝুম ছিলো না। হয়তো অন্য কেউ তোকে চেয়েছে আর আল্লাহ তোকে তার জন্যই কবুল করেছেন।”

মেহেদীর কান্না সাথে সাথেই বন্ধ হয়ে গেলো। চোখের পাতায় ভেসে উঠলো সেই আকাশপরী।

-“আমি আজকে ক্লাস করবো না। আমাকে ঘুরতে নিয়ে চলুন না প্লিজ।”
রুমঝুম বাচ্চাদের মতো আবদার করছে শানের কাছে।‌ মেঘা ডিপজল স্যারের ক্লাস করছে। রুমঝুম পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে এসেছে লুকিয়ে। জানালা দিয়ে শানকে ক্যাম্পাসে দেখেই তার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চেপেছিলো।

রুমঝুমের বাচ্চামি আবদারে শান হেঁসে মেললো। বাইকে ভর করে দাঁড়িয়ে বললো,
-“তা কোথায় ঘুরতে যাবেন ,শুনি?”
রুমঝুম একটু এগিয়ে এসে বললো,
-“যেখানে ঘুরতে নিয়ে যাবেন।”
শান দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে বললো,
-“একদিনেই তোমার মধ্যে প্রেমিকা প্রেমিকা ভাব চলে এসেছে দেখছি।”
রুমঝুম দুই ভ্রু উঁচু করে বললো,
-“প্রোপার্টি যখন পার্সোনাল,ভাব তো একটু হবেই স্যার।”

রুমঝুমের কথায় শব্দ করে হেঁসে দিলো শান সহ আরো তিনজন। এতো গুলা গলার আওয়াজ পেয়ে রুমঝুম ভড়কে গেলো। পেছনে তাকিয়ে দেখলো সিন্থিয়া, প্রান্ত আর বিথী দাঁড়ানো। সিন্থিয়া হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে বললো,
-“হেব্বি উত্তর দিয়েছো রুমঝুম।”
রুমঝুম লজ্জায় নুইয়ে পড়লো। এরা কখন পেছনে এসে দাঁড়ালো? এদের অস্তিত্ব আগে টের পেলে ও কখনোই এমন করে কথা বলতো না। ইশশ কি লজ্জার ব্যাপার।

.
মেঘা ক্লাস থেকে বেরিয়ে চারপাশে রুমঝুমকে খুঁজছিলো। আশেপাশে কোথাও না পেয়ে সোজা চলে গেলো কৃষ্ণচূড়া তলায়। সেখানে সিন্থিয়া, প্রান্ত আর বিথী বসে আছে। প্রান্ত মেঘাকে দেখেই হাতের ইশারায় ডাকলো। মেঘা মুচকি হেঁসে সেদিকে এগিয়ে গেলো।

এদিক ওদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“রুমঝুমকে দেখেছেন,ভাইয়া?”
-“রুমঝুম আর এ জগতে নেই রে বইন। সে তার প্রেমিক পুরুষের সাথে এতক্ষণে কোথায় উড়ে বেড়াচ্ছে কে জানে?”
সিন্থিয়ার উত্তর শুনে মেঘার ভ্রু কুঁচকে গেলো।‌সিন্থিয়া মেঘার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“বসো এখানে। রুমঝুম আর শান একটু ঘুরতে গেছে। চলে আসবে তাড়াতাড়িই।”

মেঘা ফসস করে একটা দম ফেলে বসে পড়লো সেখানে। তিহানকে দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
-“তিহান ভাইয়া কই? উনাকে দেখতেছি না।”
মেঘার প্রশ্ন সিন্থিয়া আর প্রান্ত স্বাভাবিক ভাবে নিলেও বিথী স্বাভাবিক ভাবে নিলো না। সে তৎক্ষণাৎ বললো,
-“কেন? তিহানের কাছে কি প্রয়োজন তোমার?”

মেঘা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো।কোনো মতে মুখে হাসি টেনে বললো,
-“এমনিতেই জিজ্ঞাসা করেছি আপু। প্রতিদিন আপনাদের সাথে থাকে কিন্তু আজ নেই ,তাই।”
বিথী মুখ বাঁকিয়ে অন্য দিকে তাকালো। সিন্থিয়া বিথীর এহেন আচরণে বেশ রেগে গেলো। বিথীর উদ্দেশ্যে বললো,
-“এটা কেমন কথার ধরন বিথী? ও একটা প্রশ্ন করেছে, সেটার উত্তর সোজা ভাবে দিয়ে দিলেই তো হয়।”

বিথী মুখ ভেঙচি দিয়ে বললো,
-“তোর হবু ননদের সাথে তুই মিষ্টি করে কথা বল সিন্থু। আমাকে প্লিজ জ্ঞান দিতে আসিস না।”

বিথীর কথায় মেঘার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। সিন্থিয়া বিথীকে আর কিছু না বলে মেঘার দিকে তাকালো। মেঘার এমন রিঅ্যাকশন দেখে কিছুটা ভড়কে গেলো । জোরপূর্বক হেঁসে বললো,
-“আরে ওর কথা সিরিয়াসলি নিও না। মজা করেছে ও।”

তিন নারীর কথপোকথনের মাঝে বসে প্রান্ত‌ হাসতে হাসতে খুন । অবশেষে পেট চেপে বললো,
-“এবার তিনটায় থাম। তোরা কেউ কারো ননদ-ভাবী না, সবগুলা আমার শালী।”

রুমঝুম শানের পিঠে মাথা এলিয়ে দিয়ে বসে আছে বাইকের পেছনে। শানের শরীরের কড়া পারফিউমের ঘ্রানে বেশ ভালো লাগছে তার। খোলা আকাশের নিচে ছুটে চলা দু’জন তরুন তরুনীকে দেখছে আকাশে উড়ে বেরানো মেঘগুলোও। দুজনের হৃদয়েই প্রস্ফুটিত হয়ে আছে ভালোবাসার পদ্ম।
রুমঝুম মাথা তুলে জিজ্ঞেস করলো,
-“আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
-“নেভাল বীচে।”
-“ওখানে কি আছে?”
শান ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“কি আছে মানে?”

রুমঝুম আমতা আমতা করে বললো,
-“মানে আমি তো এই জায়গার ব্যাপারে কিছু জানি না তাই বলছিলাম আর কি।”
শান হেঁসে ফেললো। রুমঝুম শানের পিঠে গুতা মেরে কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
-“হাসছেন কেন? একদম হাসবেন না।”
শান‌ হাঁসি থামিয়ে বললো,
-“আচ্ছা শুনো, কর্ণফুলী আর বঙ্গোপসাগরের মোহনা চট্টগ্রামে নেভাল বীচ নামে পরিচিত। নদী আর সাগর এখানে একাকার। তোমার প্রিয় পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতের আগে থেকে হযরত শাহ আমানত (রা:) আন্তার্জাতিক বিমান বন্দরের সামনের এই স্পটটি চট্টগ্রামবাসীদের কাছে জনপ্রিয়। জাহাজ আর ওপারের শিল্প-কারখানার আলোতে সন্ধ্যায় আরো মায়াবী হয়ে উঠে নেভাল এলাকা।

রাতের বেলা নেভাল একাডেমী সংলগ্ন কর্ণফুলী পাড়ের নেভাল বীচ থেকে কর্ণফুলী এবং বঙ্গোপসাগরের মিলন কেন্দ্র মোহনার সৌন্দর্য উপভোগের মজাই আলাদা। মধ্যরাত পর্যন্ত পর্যটকের কোলাহলে মুখরিত থাকে নেভাল বীচ।”

শানের কথার মাঝেই রুমঝুম গাল ফুলিয়ে বললো,
-“তাহলে তো রাতে গেলেই ভালো হতো। সৌন্দর্য রাতে দেখা যাবে তাহলে এখন গিয়ে কি করবো।”
শান হেঁসে বললো,
-“এখনো তোমাকে রাতে নিয়ে যাওয়ার সময় হয়নি বুঝোছো?”
-“তা কবে‌ হবে হুহ?”
-“একটা পূর্ণিমা রাতে। সেদিন চারপাশে ঝলমলে জোৎস্না থাকবে। আর আমার পাশে থাকবে আমার চন্দ্রকন্যা।”

রুমঝুম মুগ্ধ হয়ে শুনলো শানের কথা। চোখের পাতায় নিজেই এঁকে নিলো ভবিষ্যতের সেই রাতটির ছবি।

এই ভরদুপুরে আরমান কেন এসেছে সেটা বুঝতে পারছে না রুশান। খেতে নামার সময় উপর থেকে আরমানকে দেখেই আড়ালে চলে গেলো সে। আরমান হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢুকে চারদিকে চোখ বুলালো। আসলে সে তাহমিনা বেগমকে খুঁজছে। তাকে কোথাও না দেখে কাজের মেয়েটাকে ডাক দিলো। কাজের মেয়েটাও আরমানকে খুব ভয় পায়। সে আরমানের সামনে এসে কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়ালো। আরমান গমগমে কন্ঠে প্রশ্ন করলো,
-“তোমার ম্যাডাম কোথায়?”

মেয়েটি ছোট করে উত্তর দিলো,
-“উপরে নিজের ঘরে ।”
আরমান ধপধপ পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলো। মাঝপথে গিয়ে আবার পেছনে তাকিয়ে বললো,
-“আর ওই বিচ্ছু ছেলেটা কোথায়?”
কাজের মেয়েটা বুঝতে না পেরে ফ্যালফ্যাল করে তাকালো আরমানের দিকে। আরমান বুঝতে পেরে বললো,
-“তোমার ছোট স্যার কোথায়?”
-“সে তো সকাল থেকেই নিজের ঘরে।”
-“ওকে।”
আরমান সোজা তাহমিনা বেগমের রুমে চলে গেলেন।

রুশান বুঝতে পারলো গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা আছে হয়তো। নাহলে তার ব্যাপারে শুনতো না। রুশান পা টিপে টিপে তার মায়ের ঘরের দরজার সাইডে দাঁড়ালো। তখনি ভেতর থেকে আরমানের কন্ঠ শোনা গেলো।
-“আপনার মেয়ের খোঁজ পেয়েছি আমি।চট্টগ্রাম গিয়ে রংঢং করে ছেলেদের সাথে জন্মদিন পালন করতেছে সে।ছবি তুলে আবার ফেসবুকেও ছাড়ে। এবার ওকে এনে বোঝাবো যে আরমানের থেকে পালানোর শাস্তি কেমন হতে পারে। এতোগুলো দিন নাকে দড়ি দিয়ে ঘুরিয়েছে আমায়।

রুশানের পিলে চমকে উঠলো আরমানের কথায়। জানোয়ারটা আবারও তার বোনের খোঁজ পেয়ে গেলো।

চলবে……….

চন্দ্ররঙা প্রেম পর্ব-১০

0

#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্ব-১০
#আর্শিয়া_সেহের

-“শুভ জন্মদিন,আপু। অনেক অনেক শুভকামনা রইলো তোমার জন্য।”
-“ধন্যবাদ,ভাই।এই শোন…”
রুমঝুম আর কিছু বলার আগেই রুশান কল কেটে দিলো। গত পরশু কথা শেষ হওয়ার পর রুশান আর কল করেনি রুমঝুমকে। রুমঝুম কল করলেও রিসিভ করে না। হঠাৎ কি হলো ছেলেটার?
রুমঝুম ভাবলো হয়তো রুশানকে ছাড়া প্রথম জন্মদিন অন্য কোথাও কাটাচ্ছে এজন্যই ওর মন খারাপ।

বাম হাতে জানালার গ্রিল চেপে ধরে বাইরে তাকিয়ে আছে রুশান। বিড়বিড় করে বলছে,
-“আমি কোন মুখে তোমার সাথে কথা বলবো রে আপু। আমার মা তোমার সব কেড়ে নিয়েছে। মায়ের করা কাজে আমি নিজেই আজ ভীষণভাবে লজ্জিত, অনুতপ্ত। তোমার জীবনে আর কারো কালো ছায়া না পড়ুক সেই কামনাই করবো দূর থেকে।”

….

-“হ্যাপি বার্থডে,মাই ডিয়ার ফেরেন্ড ।”
পাশের রুম থেকে মেঘার করা এসএমএস দেখে রুমঝুম আওয়াজ করে হেঁসে দিলো। উত্তরে লিখলো,
-“ধন্যবাদ,মাই বিয়ার ফেরেন্ড।”
রিপ্লাই পাঠিয়ে রুমঝুম একা একা হাসতে লাগলো।
মেঘা এমন রিপ্লাই দেখে মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। তাকে ভাল্লুক বললো? ছিঃ। দেখে নিবে সে এই মেয়েকে।

সময়টা রাত বারোটা বেজে তেরো মিনিট। শান বাদে সবাই এই তেরো মিনিটেই রুমঝুমকে উইশ করে ফেলেছে।তবে রুমঝুম যার উইশের আশায় চাতক পাখির মতো বসে আছে সে কোনো টেক্সট করলো না। কষ্টে রুমঝুমের চোখে পানি চলে এলো।
আচ্ছা তার কি রুমঝুমকে উইশ‌ করার কথা ছিলো? কি সম্পর্ক তার সাথে রুমঝুমের? সে উইশ করেনি বলে এতো খারাপ কেন লাগছে?
রুমঝুম উত্তর পেলো না। কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরেই ঘুমিয়ে পড়লো। তীব্র অভিমান ঝাপ্টে ধরেছে তাকে।

সকাল সাড়ে আটটার দিকে রুমঝুম আর মেঘা ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। বের হওয়ার সময় মেহেদী ইশারায় মেঘাকে বুঝালো রুমঝুমকে দেরি করে বাসায় আনার জন্য। মেঘাও ইশারায় ‘ওকে’ বুঝিয়ে বের হলো বাসা থেকে।

রুমঝুমের মন খারাপ ভাবটা মেঘার চোখ এড়ালো না। সে জানে রুমঝুম কেন মন খারাপ করে আছে। প্লানটা এমনই ছিলো। আজকের দিনটা আর রুমঝুমকে জ্বালাতে ইচ্ছে করলো না মেঘার। এমনিতেও বেচারির মন খারাপ । তাই চুপচাপ ভার্সিটি গেলো দুজন।

ডিপজল স্যারের ক্লাস শেষে রুমঝুমকে নিয়ে বেরিয়ে এলো মেঘা। রুমঝুম বাইরে এসে দেখলো সিন্থিয়া,প্রান্ত,তিহান আর বিথী দাঁড়িয়ে আছে। এতোজনের মাঝে চোখ যাকে খোঁজে তাকেই পায় না। শানকে কোথাও না দেখে রুমঝুমের মন খারাপ দ্বিগুণ হয়ে গেলো। প্রচন্ড কান্না পেলো তার কিন্তু কাঁদলো না। এত্তো গুলো মানুষের সামনে কেঁদে লজ্জায় পড়তে চায় না সে।

সিন্থিয়া এগিয়ে এসে রুমঝুমকে জড়িয়ে ধরলো। স্নেহমাখা কন্ঠে বললো,
-“মেনি মেনি হ্যাপি রিটার্নস অফ দা ডে ,ঝুম। হ্যাপি বার্থডে।”
ঝুম মিষ্টি হেঁসে ধন্যবাদ জানালো।
প্রান্ত বললো,
-“তোমরা দুজন কি আর কোনো ক্লাস করবে ?”
মেঘা ঝটপট করে বললো,
-“নাহ। আজ আর ক্লাস করবো না। আজকে ঝুমকে নিয়ে ঘুরবো।”
-“বাহ্, বেশ তো। চলো আমরাও তোমাদের সাথে জয়েন হই।”
প্রান্তের কথায় মেঘা হেঁসে বললো,
-“অবশ্যই। কেন নয়?”

সবার এতো হাঁসি তামাশার মধ্যেও রুমঝুমের মন খুবই খারাপ।তার খুব ইচ্ছে করলো আকাশ ভেঙে আসা বৃষ্টির মতো ঝরঝর করে কাঁদতে। সিন্থিয়া রুমঝুমকে খেয়াল করলো। সবাইকে একমিনিট দাঁড়াতে বলে সাইডে গিয়ে শানকে কল করলো। তিনবারের সময় শান ফোন রিসিভ করলো।

-“হ্যাঁ,সিন্থু বল।”
-“মেয়েটা প্রচন্ড মন খারাপ করে আছে শান। আজকের দিনটাও ওকে এভাবে কষ্ট দিচ্ছিস কেন বল তো?”
-” উফফ সিন্থু তুই বুঝিস না। কোন সারপ্রাইজ দেওয়ার আগে এমন একটু করা উচিৎ। তাহলে বড়সড় ঝাটকা খাবে বুঝলি?”
-“এ্যাঁহহ, থাম তো তুই।আর কতোক্ষণ লাগবে তাই বল?”
শান হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়ে চোখ বুলিয়ে বললো,
-“এখন দশটা বাজে। ওকে নিয়ে একটার দিকে আসবি। তারপর কি করতে হবে জানিস তো।”
-“আল্লাহ । এখনো তিন ঘন্টা শান।”
-“একটু ম্যানেজ করে নে, প্লিজ।”
সিন্থিয়াকে আর কিছু বলতে না দিয়ে শান কল কেটে দিলো। সিন্থিয়া একটা গাড় নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে গেলো বাকিদের কাছে।

তিন ঘন্টায় আশেপাশে অনেক জায়গাতেই ঘোরাঘুরি করলো ছয়জন মিলে। ঘোরাঘুরির ফাঁকে সিন্থিয়া মেঘাকে সবার অগোচরে জিজ্ঞাসা করলো,
-“তোমাদের বাড়িতে কোনো সারপ্রাইজ প্লান করেছো ঝুমের জন্য?”
-“হ্যাঁ, ভাইয়া বললো সন্ধ্যার পর ছোটখাটো একটা পার্টি করবে।”
-“তোমার ভাইয়া তো ভার্সিটিতে। তো কিভাবে করবে সবকিছু?”
-“ভাইয়া তিনটার মধ্যে বাসায় ফিরবে বললো।”
সিন্থিয়া ছোট্ট করে বললো,
-“ওহ।”

মনে মনে বললো,
‘তারমানে আমাকে আড়াইটার মধ্যে ভার্সিটিতে যেতে হবে। কোনোভাবেই আজকে মিস করা যাবে না। মেহেদীকে আজ ভালোবাসার কথা বলেই ছাড়বো।’
সিন্থিয়া এগুলো ভেবে লজ্জায় লাল নীল হয়ে যাচ্ছিলো।

বারোটা বেজে পঞ্চান্ন মিনিটে শান সিন্থিয়ার ফোনে একটা এসএমএস পাঠালো। সিন্থিয়া সেটা দেখে সবার উদ্দেশ্যে বললো,
-“গাইস,আমার খুবই ক্ষুধা লাগছে। তোমাদের ও নিশ্চয়ই ক্ষুধা লেগেছে। চলো সবাই খেয়ে আসি।”
সবাই সম্মতি প্রকাশ করলো।রুমঝুম চুপচাপ সবার তালে তাল মিলাচ্ছে। কোনো কথা বলছে না সে।

সবাই মিলে যখন রেস্টুরেন্টে পৌঁছালো তখন এক টা বেজে সতেরো মিনিট। রেস্টুরেন্টে ঢুকে সবাই একটা টেবিলে বসে পরলো। রুমঝুম পুরো রেস্টুরেন্টে চোখ বুলিয়ে দেখলো তারা ছাড়া আর কেউ নেই। সিন্থিয়া রুমঝুমকে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসতে বললো। রুমঝুম অবাক হয়ে বললো,
-“আমি একা ফ্রেশ হবো? তোমরা হবে না?”
-“হবো তো,আগে তুমি হও তারপর।”
রুমঝুম মাথা হেলিয়ে চুপচাপ ওয়াশ রুমে ঢুকে পরলো। ওয়াশ রুমে ঢুকে খানিকটা অবাক হলো সে। কারন সেখানে একটা ডিপ পিংক কালারের গাউন রাখা সাথে ম্যাচিং জুয়েলারি। কানের দুলের নিচে গোলাপি রঙের একটা চিরকুট চাপা দিয়ে রাখা। কৌতুহলী রুমঝুম সেদিকে এগিয়ে গিয়ে চিরকুটে উঁকি মারলো।

একদম নিচে ডান দিকে তার নাম লেখা। সাথে সাথেই চোখ দুটো বড় বড় হয়ে গেলো রুমঝুমের। একটানে চিরকুটটা বের করলো দুলের নিচ থেকে। তেলাপোকার ঠ্যাং এর মতো সুন্দর অক্ষরে লেখা-
-” দশ মিনিটের মধ্যে ড্রেসটা পড়ে সেকেন্ড ফ্লোরে চলে এসো , চন্দ্রকন্যা। দেরি হয় না যেন‌।”
তারপর একদম নিচে ছোট্ট করে লেখা ‘ফর রুমঝুম’।

রুমঝুম চিরকুট সেখানে রেখে তাড়াহুড়ো করে বাইরে বের হতে গিয়ে দেখলো দরজা লক করা।সে দরজায় টোকা দিয়ে বললো,
-“ওপাশে কেউ আছেন? দরজা খুলুন।”
রুমঝুমের টোকা দেওয়ার সাথে সাথেই কথা বললো মেঘা।
-“ড্রেসটা পরেছিস?”
রুমঝুম গমগমে কন্ঠে বললো,
-” ওটা না পরা অবধি দরজা খোলা হবে না।”
-“কিন্তু ওটা কে রেখেছে?”
-“সব জানতে পারবি আগে ওটা পরে বাইরে আয়।”

উপায় না পেয়ে রুমঝুম ড্রেসটা পরে নিলো। ড্রেস, জুয়েলারি পরে দরজার কাছে এসে বললো,
-“পরেছি। এবার খোল। ”
সঙ্গে সঙ্গে মেঘা দরজা খুলে দিলো। রুমঝুম কিছু বলতে যাবে তার আগেই মেঘা ওর চোখ বেঁধে দিলো। রুমঝুম কপট রাগ নিয়ে বললো,
-“কি হচ্ছে এগুলো? চোখ বাধলি কেন?”
-“সময় হলে দেখতে পাবি। এখন কথা কম বল।”

রুমঝুমকে ধরে নিয়ে দ্বিতীয় তলায় গেলো মেঘা। রুমঝুমকে দাঁড় করিয়ে রেখে বললো,
-“আমি না বলা অবধি বাঁধন খুলবি না। চুপচাপ দাঁড়া।”
বেশ খানিকক্ষণ অতিবাহিত হলেও কেউ রুমঝুমের কাছে এলো না। রুমঝুম চোখ বাঁধা অবস্থায় মেঘাকে ডাকতে শুরু করলো। সিন্থিয়ার নাম ধরেও ডাকলো বেশ কয়েকবার। কারো সাড়াশব্দ না পেয়ে যেই না নিজেই চোখের বাঁধন খুলতে গেলো তখনই হুট করে তার চোখের বাঁধন খুলে দিলো মেঘা।

রুমঝুম বিষ্ময়ে হতবাক। চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি ঝরছে তার। সামনেই হাঁটু গেড়ে একগুচ্ছ কদম হাতে বসে আছে শান। মুখে নজরকাড়া সেই হাসি।শান তার চন্দ্রকন্যার চোখে চোখ রেখে বললো,
-” ভালোবাসবে আমায়? ভালোবাসতে দেবে তোমায়? বানাবে তোমার মনোরাজ্যের রাজা? যেখানে শুধু আমার কর্তৃত্ব থাকবে। ”

রুমঝুম কি বলবে খুঁজে পেলো না। হুড়মুড়িয়ে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়লো শানের বুকে। শান টাল সামলাতে না পেরে পেছনে হেলে পড়লো। রুমঝুমের সেদিকে খেয়াল নেই। সে শানের বুকে মুখ ডুবিয়ে রাজ্যের অভিযোগ জুড়ে দিলো। শান মুচকি হেঁসে শুনছে প্রিয়তমার অভিযোগ। রুমঝুম কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে ফেলেছে। শান রুমঝুমকে বুক থেকে তুলে চোখ দুটো মুছিয়ে দিলো। রুমঝুম তখন বুঝতে পারলো এতক্ষণ সে কি করেছে। লজ্জায় আর মুখ তুলে তাকাতে পারলো না রুমঝুম। শান দেখছে রুমঝুমের লজ্জামাখা মুখ। চোখের পাপড়ি গুলো কাঁপছে। পাতলা ঠোঁটজোড়া মাঝে মাঝে দাঁত দিয়ে চেপে ধরছে। শান ঠোঁট টিপে হাঁসতে শুরু করলো। বাকিরা পাশে দাঁড়িয়ে দেখছে দুজনের প্রেমময় প্রহর।

রুমঝুম ধীরে ধীরে শানের দিকে তাকিয়ে দেখলো সে ঠোঁট টিপে হাসছে। রুমঝুম মুখ ঘুরিয়ে উঠে পড়লো সেখান থেকে। শান আলতো করে রুমঝুমের হাত ধরলো। রুমঝুম থেমে গেলো সেখানেই। শান হাত ছেড়ে রুমঝুমের পা ধরলো। কেঁপে উঠলো রুমঝুম। কাঁপা কন্ঠে বললো,
-“পা ধরছেন কেন? পা ছাড়ুন।”
শান চোখ পাকিয়ে রুমঝুমের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“বেশি‌ কথা বলবে না। চুপ করে দাঁড়াও।”
শান বুকপকেট থেকে বের করলো রুমঝুমের হারিয়ে যাওয়া সেই নুপুরটা। অতি যত্নে সেটা রুমঝুমের পায়ে পরিয়ে দিলো। রুমঝুমের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বললো,
-“আমার হৃদশেকল বেঁধে দিলাম তোমার পায়ে।”

নুপুরটা পেয়ে রুমঝুম এতোই খুশি হলো যে স্থান ভুলে দ্বিতীয় বারের মতো শানকে জড়িয়ে ধরলো। রিনরিনে কন্ঠে বললো,
-“আপনার বাঁধা শেকল পরে আমার সারাজীবন কাটিয়ে দিতে পারবো।”
শান রুমঝুমকে বুকে জড়িয়ে ধরেই মুচকি হাসলো। আরো শক্ত করে আলিঙ্গন করলো তার চন্দ্রকন্যাকে।

হাঁসি খুশিতে কখন যে সময় পেরিয়ে গেলো কেউ টেরও পেলো না। দুইটা বেজে পনেরো মিনিটের সময় টনক নড়লো সিন্থিয়ার। সে ব্যাস্ত ভঙ্গিতে বললো,
-“আমার আর্জেন্ট একটা কাজ আছে। তোরা থাক। কাল দেখা হবে।”
বলেই হনহন করে বেরিয়ে গেলো রেস্টুরেন্ট থেকে। বাকিরা বোকা চোখে তাকিয়ে তার চলে যাওয়া দেখলো। প্রান্ত বিথীর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“এর আবার দরকারি কি কাজ পড়লো?
-“আমি কি জানি? আছে হয়তো‌ কোনো কাজ।”
-“হ্যাঁ, থাকতেই পারে কাজ। আচ্ছা বাদ দে।”

মেহেদীর ফ্রি হতে হতে তিনটার কাছাকাছি বেজে গেলো। ডিপার্টমেন্ট থেকে বেরিয়ে সোজা গেটের দিকে হাঁটতে শুরু করলো সে। যাওয়ার পথে কি কি কিনতে হবে সেটা নিয়ে মনে মনে হিসাব কষা শুরু করলো। রুমঝুমের জন্য তার মায়ের দেওয়া নুপুরের মতো অবিকল একটা নুপুরের অর্ডার করেছিলো সেদিন। যাওয়ার পথে সেটা নিয়ে যাবে।

মেহেদী আশেপাশে আনমনে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থমকে দাড়ালো। চোখ আটকে গেলো আকাশী রঙের একটা আকাশপরীতে। পরীটা একদম তার মনের মতো সেজেছে। আকাশী রঙের শাড়ি, আকাশী-সাদা মিশানো রেশমি চুড়ি, বাতাসে দোদুল্যমান কোমর ছাড়ানো চুল আর চোখে গাঢ় করে দেওয়া কাজল। মেহেদী পলক ফেলতেও ভুলে গেলো। এক মূহুর্তের জন্য সে সিন্থিয়ার মধ্যে রুমঝুমকে দেখতে পেল। সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে ফেললো মেহেদী।
ছিঃ!এভাবে ভ্যাবলার মতো একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে ছিলো ও?
তার ভালোবাসা শুধুই রুমঝুম, অন্য কারো দিকে তাকানো তার জন্য ঘোর অন্যায়।
তবে মেয়েটাকে দেখতে বেশ সুন্দর লাগছে। তার পছন্দের সাথে মেয়েটার সাজগোজ মিলে যাওয়া কি কাকতালীয় কোনো ব্যাপার? হতেই পারে।

মেহেদী এসব ভাবনা ঝেড়ে ফেলে সামনে অগ্রসর হওয়ার জন্য উদ্যত হতেই সামনে এসে দাঁড়ালো সিন্থিয়া। মেহেদীর ভাষায় আকাশপরী।
সিন্থিয়া মেহেদীর দিকে তাকালো না। নিচের দিকে তাকিয়ে এক হাত দিয়ে অন্য হাত মুচড়াতে লাগলো। মেহেদী চুপচাপ সিন্থিয়ার কাজকর্ম খেয়াল করছিলো।সিন্থিয়ার জোড়া ভ্রু যেটা মেহেদীর খুব পছন্দ। না চাইতেও মেহেদীর চোখ বারবার সিন্থিয়াকে পরখ করছে।
মেহেদী কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বললো,
-“কিছু বলবে?”
সিন্থিয়া মেহেদীর কন্ঠে হালকা কেঁপে উঠলো। বুক ভরে শ্বাস টেনে নিয়ে বললো,
-“জ্.. জ্বি ,বলবো।”
-“তাহলে বলো । চুপ করে আছো কেন?”

সিন্থিয়া এদিক ওদিক তাকিয়ে তার ব্যাগ থেকে একটা রঙিন কাগজ বের করে চটপট মেহেদীর হাতে গুঁজে দিলো।
এক নিঃশ্বাসে বললো,
-“আমি আপনাকে ভালোবাসি। ভীষণ ভালোবাসি।”
কথাটা বলেই সিন্থিয়া দৌঁড় দিলো। একটু দূরে গিয়ে পেছনে তাকালো আবার। সেখান থেকেই চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
-“দয়া করে চিঠিটা পড়বেন। ভালোবাসলেও পড়বেন ,না বাসলেও পড়বেন।”
বলে আবারও ছুট লাগালো । মেহেদী হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে। শাড়িতে বেঁধে বারবার পরে যেতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিচ্ছে মেয়েটা। আচ্ছা মেয়েটা খামোখা দৌঁড়াচ্ছে কেন?

সিন্থিয়া চোখের আড়াল হতেই মেহেদী সম্বিত ফিরে পেলো। চিঠিটা ফেলতে গিয়েও ফেললো না। চিঠিতে মেয়েটা কি লিখেছে সেটা পড়ার কৌতুহল জাগলো। তবে এখন পড়ার উপযুক্ত সময় না ভেবে চিঠিটা পকেটে পুরে রাখলো।
পুনরায় হাঁটা শুরু করলো মেহেদী। হাঁটতে হাঁটতে নিচের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বললো,
-“যার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য এতো আকুলতা, সে ভাইয়া ভাইয়া করে দুনিয়া উল্টায় ফেলে আর বাকিরা আসে ছাইয়া বানাতে। কি কপাল রে তোর মেহেদী !”

চলবে……..

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

চন্দ্ররঙা প্রেম পর্ব-০৯

0

#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্ব-৯
#আর্শিয়া_সেহের

আজ প্রায় এগারো দিন পর আরাফাত আবারও ভার্সিটির গেটে এসে বসেছে। বেলা গড়িয়ে দুপুর বারোটায় এসে ঠেকেছে তখন।
রুমঝুম আর মেঘা গল্প করতে করতে ক্যাম্পাসের পথ ধরে গেটের দিকে এগোচ্ছে। কথা বলতে বলতেই মেঘার দৃষ্টি খেলো গেটের দিকে। আরাফাত ভয়ানক চাহুনি নিক্ষেপ করে আছে তাদের দিকে।

মেঘা আরাফাতকে দেখেই দাঁড়িয়ে পড়লো।রুমঝুম মেঘাকে দাঁড়িয়ে পড়তে দেখে নিজেও দাঁড়িয়ে পড়লো। মেঘার ভয়ার্ত দৃষ্টি‌ অনুসরণ করে তাকালো রুমঝুম। গেটের কাছে আরাফাতকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আঁতকে উঠলো খানিকটা। সামনে এগোবে কি না ভাবছে। তবে না এগিয়েও বা যাবে কোথায়?

-“হেই , দুজন মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
প্রান্তের কন্ঠে পেছনে তাকালো রুমঝুম আর মেঘা। শান‌ বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পেছনে। শানকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো রুমঝুম। শান একটু উঁকি মেরে দেখলো গেটের কাছে বসা আরাফাতকে। শানকে দেখে আরাফাত মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিলো‌ দ্রুত।

সেদিন আরাফাতকে বেধড়ক মারধর করার পর ওর বাবা শাসিয়েছিলো শান কে। তবে শান সেসবে পাত্তা দেয় নি। তার চন্দ্রকন্যার দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছিলো । এগুলো তো কম হয়েছে ওর জন্য।

শান হালকা হেঁসে বললো,
-“এতো ভয় পেলে পড়াশোনা করার দরকার কি? পড়াশোনা ছেড়ে বাড়িতে বসে থেকো পা গুটিয়ে।”
রুমঝুম মাথা নিচু করে নিলো। আরাফাত ছেলেটাকে সে ভয় পায় না,ঘৃনা করে। এমন ছেলের আশেপাশে যাওয়াটাও রিস্ক।

প্রান্ত হালকা গলা ঝেড়ে বললো,
-“তো বাড়ি যাচ্ছো নাকি দুজন?”
-“জ্বি ভাইয়া।”
মেঘা সাবলীল ভাবে উত্তর দিলো।
-“শান,তুই রুমঝুমকে নিয়ে আয়। আমার কিছু কথা আছে মেঘার সাথে।”
-“আব.. ভাইয়া আমাদের সামনেই বলুন না। আলাদা যাওয়ার কি দরকার?”
-“আহ রুমঝুম,আলাদা‌ দরকার বলেই তো আলাদা যাচ্ছি।”
রুমঝুম মুখটা ছোট করে দাঁড়িয়ে রইলো। প্রান্ত মেঘার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“চলো মেঘা।”

মেঘা এদিক সেদিক তাকিয়ে মেহেদীর উপস্থিতি দেখছিলো। আশেপাশে কোথাও ভাই কে না দেখে তাড়াহুড়ো করে বললেন,
-“চলুন ভাইয়া। তাড়াতাড়ি পা চালান।”
প্রান্ত হেঁসে মেঘার সাথে হাঁটা ধরলো।

-“বাইকে উঠো।”
শানের কথা রুমঝুম শুনেছে কি না সন্দেহ। সে বিন্দুমাত্র নড়লো না। শান‌ বিরক্ত ভঙ্গিতে বললো,
-“কোলে করে তুলতে হবে?”
রুমঝুম চকিতেই মাথা তুলে মৃদু চিৎকারে বললো,
-“নাউজুবিল্লাহ।”
শান‌ আওয়াজ করেই হেঁসে ফেললো।রুমঝুম মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো শানের হাঁসিমাখা মুখের দিকে।

-“চোখ দিয়ে গিলে না‌ খেয়ে উঠে বসুন মহারানী।”
রুমঝুম থতমত খেয়ে গেলো।‌ এদিক সেদিক তাকিয়ে ধীর গতিতে উঠে বসলো বাইকে।
-“ধরে বসো।”
রুমঝুম ইতস্তত করে হালকা ভাবে হাত রাখলো শানের কাঁধে। রুমঝুমের হালকা স্পর্শেও প্রশান্তিতে ভরে গেলো শানের বুক। মৃদু হেঁসে বাইক স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে গেলো ভার্সিটি থেকে। আরাফাত হা করে তাকিয়ে রইলো সেদিকে।

দুদিন পর রুমঝুমের জন্মদিন। সেদিনই রুমঝুমকে মনের কথা জানাবে শান। তাদেরকে সব বিষয়ে সাহায্য করছে মেঘা তবে সেটা রুমঝুমের আড়ালে। রুমঝুমকে অনেক বড় সারপ্রাইজ দেওয়ার ইচ্ছা আছে সেদিন।

যে যা নিয়ে ভাবুক না কেন সিন্থিয়া আছে মেহেদীর চিন্তায়। সেদিন মেঘার থেকে ছলে বলে মেহেদীর পছন্দ সম্পর্কে জেনে নিয়েছে। সিন্থিয়াও ভেবে রেখেছে রুমঝুমের জন্মদিনে সে ও মেহেদীকে ভালোবাসার কথা বলবে।

শান ,প্রান্ত,তিহান আর সিন্থিয়া রেস্টুরেন্ট‌ বুকিং দিতে এসেছে। হাতে সময় আছে আর একদিন। সবকিছু‌ ঠিকঠাক করে বের হবে তখনই শানের ফোনে তার বাবার নাম্বার থেকে কল এলো। শান রিসিভ করে সাইডে গিয়ে কথা বলে এলো।
-“আচ্ছা তোরা যা। আমাকে অফিসে যেতে হবে এখন।”
প্রান্ত ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“এখন‌ অফিসে যাবি কেন? কোনো সমস্যা?”
-“আরে না,ইয়ার। বাবা চট্টগ্রামের বাইরে আছে। তাই আমাকে বললো একবার অফিস থেকে ঘুরে আসতে।”
-“আচ্ছা যা। ”

শান‌ ওদেরকে বিদায় দিয়ে অফিসে চলে গেলো।
সিন্থিয়া প্রান্ত আর তিহানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আমার সাথে একটু শপিংমলে চল না‌ রে।”
তিহান‌ ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“এখন‌ শপিংমলে কেন?”
-“একটা আকাশি রঙের শাড়ি কিনবো। চল না প্লিজ।”

তিহান মুখ ভেঙচি দিয়ে বললো,
-“তুই শাড়িও পড়িস নাকি? জানতাম না তো।”
-“তোর জানা‌ লাগবে না। চল।”
প্রান্ত বললো,
-“তোরা দুজনে যা। আমার এসব শপিং ভাল্লাগে না জানিসই তো।”
-“তোর ভাল্লাগতে হবে না। তুই আমার সাথে যাবি এটাই ফাইনাল।”
সিন্থিয়ার জেদের কাছে হার মেনে দুজকেই ওর সাথে শপিং এ যেতে হলো।

-“আচ্ছা মা,পরশু তো রুমঝুমের জন্মদিন। সেদিনটা একটু স্পেশাল হওয়া উচিত তাই না?”
মাহেরা খাতুন মেহেদীর কথা শুনে মুচকি হাসলেন। মায়েরা সন্তানকে খুব ভালো‌ করে বুঝতে পারে। মাহেরা খাতুনও বোঝে তার ছেলেটা রুমঝুমকে কতখানি পছন্দ করে। তার নিজেরও রুমঝুমকে খুব পছন্দ।
-“কি হলো মা?”
-“হ্যাঁ হ্যাঁ, উচিত তো। কিন্তু কিভাবে স্পেশাল করা যায় বলতো?”
-“ভাবছি বাড়িতেই ছোট্ট একটা পার্টি করবো। আমাদের চারজনের জন্য শুধু। মেঘাকে বলবো সেদিন রুমঝুমকে বাইরে ঘুরিয়ে বাসায় আনতে আনতে যেন সন্ধ্যা করে ফেলে।বাকিটা আমরা দুজন করে ফেলবো।”

-“পাগল ছেলে। তুই যা ভালো বুঝিস তাই কর।”
মাহেরা খাতুন হাসতে হাসতে বললেন।

-“তোমরা‌ কি নিয়ে কথা বলছো মা?”
মেঘা আপেল‌‌ খেতে খেতে প্রশ্ন করলো।মাহেরা খাতুন কিছু বলার আগে মেহেদী বললো,
-“তোর ওতো জানতে হবে না। ”
মেঘা গাল ফুলিয়ে বললো,
-“হুহ। যাও বলতে হবে না।”
-“বলবো ও না। শোন ,রুমঝুমকে নিয়ে পরশু একটু দেরি করে বাড়ি ফিরবি। ওকে ছোটখাটো একটা সারপ্রাইজ দেওয়ার চেষ্টা করবো ওইদিন।”
মেঘার খুশিতে চোখ চকচক করে উঠলো। সে তো এটাই চেয়েছিলো। ওইদিন কত্ত কাজ আছে। এমনিতেও তো দেরি হবে সেদিন ফিরতে।

সবকিছু অল্পেতে বুঝে যাওয়া মেঘা ঘুনাক্ষরেও নিজের ভাইয়ের মনের কথা বুঝতে পারলো না। মেঘার ধারনা ,রুমঝুমকে খুশি করার জন্যই তার মা ভাই সারপ্রাইজ প্লান করেছে।

মেঘা নাচতে নাচতে রুমে এসে দেখলো রুমঝুম ফোনে কথা বলছে। মেঘা শয়তানি হাসি দিয়ে এক ভ্রু উচু করে বললো,
-“কার সাথে কথা বলছিস ,হুম?
রুমঝুম কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
-“রুশানের সাথে কথা বলছি ,স্টুপিড।”
মেঘা দাঁত কেলিয়ে বললো,
-“ওহ আচ্ছা। আমি ভাবলাম কে না কে।”
রুমঝুম ড্রেসিং টেবিল থেকে চিরুনি নিয়ে মেঘার দিকে ছুঁড়ে মারলো। মেঘা হাসতে হাসতে দৌড় দিলো সেখান থেকে।

-“আপু?”
রুশানের কন্ঠে আবার ফোনের দিকে খেয়াল এলো রুমঝুমের।
-“হ্যাঁ রুশান ,বল।”
-“এটাই তোমার প্রথম জন্মদিন যেটা আমাকে ছাড়া করবে ,তাই না?”
রুশানের কথায় রুমঝুমের ভীষণ মন খারাপ হলো। রুশানই তো তার একমাত্র সঙ্গী ছিলো এতদিন। আর আজ সেই ছেলেটা ছাড়া কত সঙ্গী হয়েছে তার। রুমঝুম দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

-“পরশু রুমঝুমের জন্মদিন,তাই না রুশান?”
হাতে একটা এলবাম নিয়ে রুশানের ঘরে ঢুকতে ঢুকতে কথাটা জিজ্ঞেস করলো তাহমিনা বেগম।
রুশান রুমঝুমের সাথে কথা শেষ করে খাটে উপুড় হয়ে শুয়ে ফোন টিপছিলো তখন। তাহমিনা বেগমের প্রশ্নে সে কিছুটা অবাক হলো। তার মা আবার আপুর ব্যাপারে আগ্রহী হলো কবে থেকে?

রুশান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-“হ্যাঁ। কেন বলো তো?”
তাহমিনা বেগম চুপ করে রইলেন। রুশানের বিছানার এক কোনায় বসে ছবির এলবামটা দেখতে শুরু করলেন। হঠাৎ করেই তিনি হুহু করে কেঁদে উঠলেন। রুশান তার মা কে এভাবে কাঁদতে দেখে বেশ অবাক হচ্ছে। রুশান তাহমিনা বেগমের কাছে এসে বসে বললো,
-“কাঁদছো কেন মা? অপরাধবোধে?”
তাহমিনা বেগম ছলছল চোখে ছেলের দিকে তাকালো। রুশান মুচকি হেসে বললো,
-“পাপের শাস্তি তো‌ পেতেই হয় আম্মু। অনেক অপরাধ করেছো যে।”

তাহমিনা বেগম মাথা নিচু করে নিলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন,
-“আজ তোর সামনে একটা পুরোনো বিভৎস অধ্যায় তুলে ধরতে চাই ,রুশান।”
রুশান মায়ের কন্ঠে কেঁপে উঠলো। এই কথাটায় কি যেন একটা ছিলো যা তাকে নড়িয়ে দিলো। তাহমিনা বেগম এলবামটি বিছানায় রেখে উঠে দাঁড়ালেন। রুশান এলবামটির দিকে তাকালো একনজর। সাথে সাথেই চোখ বড় হয়ে গেলো রুশানের।

তাহমিনা বেগম জানালার কাছে দাঁড়িয়ে বললেন,
-“ঠিকই ধরেছিস, রুশান। আজ ওর ব্যাপারেই তোকে বলবো আমি। এটা বলতে পারলে হয়তো কিছুটা শান্তি পাবো মনে।”
রুশানের কেন জানি শুনতে ইচ্ছে হলো না। তবুও শুনতে হলো।

রুশান স্তব্ধ হয়ে বসে আছে মেঝেতে। এই নির্মম সত্যিটা তার সামনে কেন এলো? খুব ক্ষতি হতো এটা অগোচরেই থেকে গেলে?
তাহমিনা বেগম জানালার কাছ থেকে এগিয়ে এসে এলবামটা হাতে নিলেন। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বললেন,
-“রুমঝুমকে আমার পক্ষ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে দিস।”

রুশান শুনলো কিন্তু ফিরে তাকালো না তার মায়ের দিকে। ঘৃনা হচ্ছে ওই জঘন্য মহিলার প্রতি ওর।
তাহমিনা বেগম জানতেন এমনটাই হবে। তিনি দরজা থেকেই ছেলের দিকে একবার তাকালেন। তারপর নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন।

ছেলে তাকে যত খুশি ঘৃনা করুক, তবুও আজ তার শান্তি।

শপিংমল থেকে বের হতে হতে সাড়ে পাঁচটা বেজে গেলো। তিহান আর সিন্থিয়াকে বিদায় জানিয়ে প্রান্ত তার বাড়ির পথ ধরলো।
ছয়টার সময় একটা টিউশনি আছে তার। মধ্যবিত্ত ছেলেগুলো খুব ভালো করেই জানে জীবনের মানেটা আসলে কি।

শান,তিহান,প্রান্ত,সিন্থিয়া আর বিথীর মধ্যে শান আর সিন্থিয়া উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। সিন্থিয়ার বাবা-মা কানাডা থাকে। তবে সিন্থিয়া বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে রাজি না বলে সে এখানেই ফ্ল্যাট কিনে থাকে।
তিহান উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। প্রান্ত আর বিথী মধ্যবিত্ত পরিবারের। এক একজন এক এক সোসাইটিতে বিলং করার পরও ওদের বন্ধুত্বের বন্ধন অটুট।

প্রান্ত রিকশা‌ করে যাওয়ার সময় রাস্তার একপাশে শিরীনকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। এই সময়ে শিরীন কোচিং থেকে ফেরে। আজ রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে কেন? গাড়িও তো নেই সাথে।
শিরীনের পেছনে তিনজন ছেলে দাঁড়ানো। অনবরত ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু বলছে। শিরীনের মুখের অভিব্যক্তিতে প্রান্ত বুঝলো ওরা শিরীনকে ইঙ্গিত করেই কিছু বলছে। প্রান্ত রিকশা থামিয়ে ভাড়া চুকিয়ে এগিয়ে গেলো সেদিকে। গম্ভীর কন্ঠে বললো,
-“এখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন , শিরীন? গাড়ি কই তোমার?”

বহু পরিচিত কন্ঠে শিরীনের বুকটা ধক করে উঠলো। তড়িৎ বেগে ঘুরে তাকালো পেছন দিকে।প্রান্তকে দেখে আপনা আপনি মুখ হা হয়ে গেলো তার। কতগুলো দিন‌ পর দেখছে এই প্রিয় মুখটা। তার তৃষ্ণার্ত হৃদয়ে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে আজ প্রান্ত তার সামনে এসে দাড়িয়েছে। শিরীন অপলক দৃষ্টিতে দেখছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা তার হৃদয়রাজকে।

চলবে………

চন্দ্ররঙা প্রেম পর্ব-০৮

0

#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্ব-৮
#আর্শিয়া_সেহের

-“এই ভাইয়া,ভাবির সাথে কবে দেখা করাবি?”
সপ্তাদশী শিরীনের কন্ঠে শান পেছনে তাকালো। মুচকি হেঁসে বললো,
-“আগে ভাবি বানানোর প্রসেসিং শেষ করি তারপর দেখা করাবো।”
শিরীন খুব ব্যস্ত ভঙ্গিমায় বিছানায় বসে পড়লো। বাবা-মা বেরিয়ে যাওয়ার পর সে ঢুকেছে। শানের দৃষ্টি তখন জানালার কাঁচ গলিয়ে বাইরে কোথাও বিচরণ করছিলো।
-“ভাইয়া ,ভাবি বুঝি দেখতে খুব সুন্দর?”
শান হেঁসে বোনের মাথায় একটা গাট্টা মারলো।
-“বেশি পেঁকেছিস তুই। যা এখান থেকে।”

শিরীন মুখ ফুলিয়ে উঠে পড়লো। দরজা দিয়ে বের হওয়ার আগে আরেকবার পিছু ফিরে বললো,
-“ভাইয়া তোর বন্ধুরা এখন আমাদের বাড়িতে আর আসে না কেন?”
শান আড়চোখে একবার শিরীনের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
-“ওদের দরকার হয়না এজন্য আসে না। দরকার পড়লে ঠিকই আসবে। এখন যা তুই আর দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যাস।”

-“দরজা ভেজাতে হবে না আপু। আমি এখন ম্যাথ করবো ভাইয়ার কাছে। ”
-“আমি কি তোকে ডেকেছি এখন ম্যাথ করার জন্য? যা ফুট।এখন আমি ম্যাথ করিয়ে দিতে পারবো না।”
শান্ত বই-খাতা নিয়ে শানের বিছানায় উঠতে উঠতে বললো,
-“আম্মু বলেছে আজ তোমার মন‌ অনেক ভালো। আজ তোমার কাছে ম্যাথ করতে চাইলে তুমি সারারাত করাতেও পিছুপা হবা না। তাই আম্মু আমাকে বই খাতা নিয়ে এখন পাঠিয়ে দিয়েছে। তুমি আজ ম্যাথ না করানো অবধি আমি এখান থেকে যাবো না।”

-“আমার বিয়ের দিনও আমি খুব খুশি থাকবো। তুই তোর আম্মুকে বলে আমার বাসর রাতে এসেও সারারাত আমার কাছে ম্যাথ করিস , ঠিক আছে?”

শিরীন দুই ভাইয়ের কথা শুনে দরজায় দাঁড়িয়ে হো হো করে হেঁসে উঠলো। শান অসহায়ের মতো তাকালো সেদিকে একবার।

..

রুমঝুম জানালায় মাথা ঠেকিয়ে দূরে একটা নারিকেল গাছের দিকে তাকিয়ে আছে। নারিকেল গাছের লম্বা লম্বা পাতার ফাঁকা দিয়ে আকাশ দেখতে খুব সুন্দর লাগে। বাতাসে যখন পাতাগুলো মৃদু দুলে ওঠে তখন আরো ভালো লাগে। রুমঝুম একধ্যানে সেদিকে তাকিয়ে আছে।

তার ধ্যান ভাঙে ফোনের রিংটোনের শব্দে। কলেজ থেকে এসে রুমে ঢুকেছে আর বের হয়নি ।‌ আজ তার মনটা কেমন যেন উদাস হয়ে আছে।
ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো রুশান ফোন করেছে। রুশানকে নিজ থেকে ফোন দিতে পারে না রুমঝুম।রুশানই বারন করেছে। ছেলেটা নিজে যখন ফোন দেয় তখনই কথা হয়। রুমঝুম দীর্ঘশ্বাস ফেলে কল রিসিভ করলো।

রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে রুশানের কন্ঠ ভেসে এলো ।
-“হ্যালো আপু। কেমন আছো?”
-” এইতো ভালো‌ আছি। তোরা কেমন আছিস?”
-“আমি ভালো আছি আপু। বাবার খবর জানি না। তুমি যে রাতে চলে গেছো তার পরের রাতে বাবাও চলে গেছে। তারপর আর যোগাযোগ হয়নি। ফোনও অফ বলছে।”

রুমঝুম আৎকে উঠলো। হালকা চেঁচিয়ে বললো,
-“তুই আগে জানাসনি কেন আমাকে?”
রুশান গাঢ় একটা শ্বাস ছাড়লো। বললো,
-“জানালে কিছু করতে পারতে তুমি?”
রুমঝুম কিছু বললো না। সত্যিই তো,সে কি বা করতে পারতো। রুশান আবারও বললো,
-“তবে চিন্তা করো‌ না। বাবা ভালো‌ আছেন। শুধু আমাদের থেকে একটু দূরে থাকছেন। হয়তো কোনো ব্যাপার নিয়ে ডিপ্রেশনে আছে।”

-“তুই কিভাবে জানলি?”
-” আজ দুপুরের পরপরই উকিল আঙ্কেল এসেছিলো। বাবা সব সম্পত্তি তোমার আর আমার নামে উইল করে দিয়েছেন। তবে তোমার নামে একটুখানি বেশি দিয়েছেন। কেন দিয়েছে জানোই তো।”
রুমঝুমকে হঠাৎ করেই খারাপ লাগা জেঁকে ধরলো। যে নেই তার অংশ রুমঝুমকে কেন‌ দিবে বাবা? রুমঝুম হতাশ কন্ঠে বললো,
-“হুম জানি।‌ কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি সম্পত্তি ভাগ করলো কেন বাবা?”
-“আমি তো জানিনা।”
-“ওহ।‌ মায়ের কি খবর?”

রুশান হালকা হাসলো। বললো,
-” যে তোমার এতো এতো ক্ষতি করলো তাকে তুমি মা ডাকো কেন আপু? তোমার রাগ হয়না তার উপর?”
-“না রে,হয়না। সে যে আমাকে তিন মাস বয়স থেকে এতো বড় করেছে এটাই তো কত। চাইলে তো‌ আমাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলতে পারতো। কিন্তু মারেনি । এটার জন্য হলেও তার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা উচিৎ আমার তাই না?”

রুশান চুপ রইলো কিছুক্ষণ। আসলেই মেয়েদের মন খুব নরম। তবে তার মা টা কেন‌ ভিন্ন‌ হলো? শুধুই কি টাকার জন্য?
রুশান উদাস কন্ঠে বললো,
-“জানো আপু, আজকাল আম্মু ও কেমন যেন বদলে গেছে। সারাক্ষণ কাঁদে। গতকাল সকাল অবধিও তোমার ব্যাপারে জানতে চাইতো কিন্তু তারপরই কেমন নিস্তেজ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছে ভয়ংকর রকমের অনুশোচনায় ভোগা শুরু করেছে।”

রুমঝুম একটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেললো।পাপের শাস্তি সবাই ভোগ করে।কেউ আগে, কেউ পরে। তবে রুমঝুম বুঝতে পারছে না যে তাহমিনা বেগম এমন কি বড় অপরাধ করেছে যার জন্য এতোটা অনুশোচনায় ভুগছে। রুমঝুম আর মাথা ঘামালো না এ নিয়ে। এক হাতে জানালার গ্রিল ধরে সেই হাতের উপর মাথা এলিয়ে দিয়ে বললো,
-“এসব ছাড়। তোর কথা বল রুশান। দিনকাল কেমন যাচ্ছে তোর?”

রুশান বুঝলো রুমঝুম টপিক চেন্জ করতে চাইছে। তাই সে ও এই ব্যাপারে আর কথা বললো না। চুপচাপ বোনের কথাতেই সুর মেলালো। কথা বলার এক পর্যায়ে রুশানের মনে হলো রুমঝুমের মন ভালো নেই। সে অকপটে জিজ্ঞেস করলো,
-“আপু তোমার কি মন খারাপ?”

রুমঝুম নড়ে উঠলো। তার ভাইটা এতোই বড় হয়ে গেছে যে কথা শুনেই বুঝে ফেলছে মন‌ খারাপ কি না? রুমঝুমের ইচ্ছে করলো না মিথ্যে বলতে। এই ছেলেটা তাকে বইয়ের লেখার মতো স্পষ্টভাবে পড়তে জানে। একে মিথ্যে কেন বলবে? রুমঝুম চোখ বন্ধ করে ক্ষীণ আওয়াজে বললো,
-“হ্যাঁ, রে। মনটা ভীষণ খারাপ।”
-“কারনটা কি আপনার এই অধম ভাই জানতে পারে ,আমার প্রিয় আপু?”

রুমঝুম না চাইতেও হালকা হাসলো। সকালের পুরো কাহিনী বললো রুশানকে। সাথে সেদিনের বাসের কাহিনীটাও বললো। রুশান সবটা শুনে খুশিতে গদগদ হয়ে বললো,
-“ওই ভাইয়াটা একদম বাংলা সিনেমার মতো মেরেছে ভিলেনটাকে তাই না আপু?”
রুমঝুম খিলখিল করে হেঁসে বললো,
-“একদম।”

হঠাৎ রুমঝুমের মনে হলো তার মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে উঠেছে। এটা কি শানের কথা মনে পড়ার জন্য নাকি রুশানের সাথে কথা বলছে সেজন্য? রুমঝুম বুঝতে পারলো না। তবে এটুকু বুঝতে পারলো, তার মন শান্ত, শীতল, স্নিগ্ধ জোৎস্নার মতো আলোকিত হয়ে উঠেছে।শতশত রঙিন প্রজাপতি উড়ছে তার মন বাগানে। রুমঝুম চোখ দুটো খিচে বন্ধ করে নিলো। ওপাশ থেকে রুশানের কন্ঠস্বর আর তার কানে আসছে না।

কেটে গেছে এক সপ্তাহ। রুমঝুম আর মেঘাকে এই এক সপ্তাহ মেহেদী ভার্সিটি যেতে দেয়নি। ভার্সিটির পরিস্থিতি স্বাভাবিক দেখে তাদের আজ ভার্সিটিতে যাওয়ার অনুমতি দিলো মেহেদী। মেঘা বিরবির করে ভাইয়ের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করতে করতে রুমঝুমের হাত ধরে ভার্সিটির পথে রওনা হলো।

ডিপজল স্যারের ক্লাস শেষে দুজন বাইরে বের হলো। রুমঝুম নিচের দিকেই চেয়ে আছে। তার মন বলে সে হারানো নুপুরটা পাবে।
মেঘা এদিক সেদিক চেয়ে বললো,
-“চল , কৃষ্ণচূড়া তলায় যাই। সেদিন শান ভাইয়ারে থ্যাংকস জানানো‌ হয়নি। অনেক বড় উপকার করেছিলো আমাদের। আজকে জানিয়ে আসি চল। ”
রুমঝুমের ভীষণ শান্তি লাগলো এই ভেবে যে ওখানে গেলে শানকে এক সেকেন্ড দেখতে পাবে। রুমঝুম সেকেন্ডের মধ্যে উত্তর দিলো,
-“হ্যাঁ,ঠিক বলেছিস। চল, চল।”

মেঘা রুমঝুমের অগোচরেই মুচকি হাসলো। রুমঝুমের মনের কথা বোধহয় ওর সামনে ভেসে উঠলো। মেঘা তো এমনটাই চাইতো যে রুমঝুমের একটা নিজের মানুষ হোক,যে ওর রক্ষাকবচ এর মতো ওকে সব বিপদ থেকে রক্ষা করবে। সেই রক্ষাকবচটা বোধহয় রুমঝুম এবার পেতে চলেছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই দুজন এসে উপস্থিত হলো কৃষ্ণচূড়া তলায়। বিথী আর শান সেখানে নেই। রুমঝুমের মন হঠাৎই নিকষ কালো আঁধারে ঢেকে গেলো। তবে সেই আঁধার প্রায় সাথে সাথেই কেটে গেলো শানকে খানিকটা দূর থেকে আসতে দেখে। রুমঝুমকে দেখেই সিন্থিয়া চেঁচিয়ে উঠলো।
-“ঝুমমম। কোথায় ছিলে এতো দিন? জানো তোমাদের দুজনকে কত খুঁজেছি?”

সিন্থিয়ার কথায় রুমঝুম হাসলো। সিন্থিয়ার কাছে এগিয়ে গিয়ে বললো,
-“জানি তো খুজেছো। এজন্যই এসে গেছি।”
শান ততক্ষণে এসে সবার মধ্যে বসে পড়েছে। রুমঝুমের দিকে তাকাচ্ছে না। তার কেন যেনো মেয়েটার উপর রাগ হচ্ছে এভাবে না বলে কয়ে উধাও হয়ে যাওয়ার জন্য। মেয়েটা কি জানে এই সাতটা দিন শানের কেমন কেটেছে? আচ্ছা,রুমঝুম কি ওকে ফিল করে মোটেও? কথাটা ভাবতেই শান মাথা উঁচু করে তাকালো রুমঝুমের দিকে। রুমঝুম শানের দিকেই তাকিয়ে ছিলো তাই দু’জনের চোখাচোখি হয়ে গেলো। রুমঝুম আচমকা এমন হওয়াতে হকচকিয়ে গেলো। চোখ সরিয়ে আশেপাশে মন দেওয়ার চেষ্টা করলো। শান মনে মনে কিছু একটা ভেবে মুচকি হাসলো।

সিন্থিয়ার দিকে তাকিয়ে শান ইশারাতে কিছু একটা বুঝাতেই সিন্থিয়া উঠে দাঁড়ালো। রুমঝুমের কাছে গিয়ে বললো,
-“ঝুম আমার সাথে একটু চলো তো। মেঘা এখানে একটু অপেক্ষা করো। ওদের সাথে কথা বলো,ঠিক আছে? আমরা এক্ষুনি আসছি।”
মেঘা কিছু না বুঝেই মাথা নাড়িয়ে আচ্ছা বুঝালো। রুমঝুমও বুঝতে পারলো না মেঘাকে কেন রেখে যাচ্ছে। তবে কেউই কোনো কথা বললো না এটা নিয়ে।

-“মেঘা?”
শানের ডাকে ওদের দিকে ফিরলো মেঘা। গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে বললো,
-“জ্বি ভাইয়া।”
শান মুচকি হেসে বললো,
-“এখানে বসো। তোমার সাথে কথা বলার জন্যই রুমঝুমকে সরালাম এখান থেকে।”
মেঘা এক মূহুর্তেই সব বুঝে ফেললো। শানের কথা শেষ হতেই অতি আগ্রহের সাথে প্রশ্ন করলো,
-“ভাইয়া আপনি কী সত্যিই রুমঝুমকে ভালোবাসেন?”
জবাবে শান চোখ ধাঁধানো একটা হাসি উপহার দিলো। কোনো কথা বললো না।

-“মেঘা,রুমঝুমের অতীত সম্পর্কে বলো।”
প্রান্তের প্রশ্নে মেঘার মুখটা ছোট হয়ে গেলো। রুমঝুম পালিয়ে এসেছে এটা জানলে শান ভাইয়া কি ওকে মেনে নিবে?
মেঘার মনের কথাটা হয়তো প্রান্ত ধরতে পারলো। তাই মেঘা কিছু বলার আগেই বললো,
-“ডোন্ট ওয়ারি। রুমঝুমের পালিয়ে আসার ব্যাপারটা আমরা জানি। তুমি শুধু ওর পরিবার আর পালিয়ে আসার কারন সম্পর্কে বলো।”

মেঘা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। ওরা এটুকু আগে থেকে জানা মানে প্রবলেম অর্ধেক সলভ্। তিহান আর বিথী মনোযোগী শ্রোতার ভূমিকা পালন করছে। তবে বিথী মেঘার কথা শোনার থেকেও তিহানের দিকে মনোনিবেশ করছে বেশি। বোঝার চেষ্টা করছে যে তিহানের মনে মেঘার জন্য কিছু আছে কি না।

মেঘা একটু চুপ থেকে বলতে শুরু করলো,
-“ওর জন্মের সময়ই ওর মা মারা যায়। দুধের বাচ্চা লালন-পালন করা চারটি খানি কথা না। ওর বাবা অনেকটা বাধ্য হয়েই ওর তিন মাস বয়সে আরেকটা বিয়ে করে আনেন। ওর সৎ মা ওদের সাথে বাজে ব্যবহার করতো। ওর বাবা ও কিছু বলতে পারতেন না। মেয়েটা অনেক ছোট ,যদি কিছু করে ফেলে মেয়েটার সাথে। বাবার বিশাল সম্পত্তি থাকার পরও অনাদরে অবহেলায় বড় হতে শুরু করলো।
ঝুমের তিন বছর বয়সে ওর সৎ মায়ের কোলে জন্ম নেয় একটি ছেলে।ছেলেটা ভীষণ ভালোবাসে ঝুম কে। সেই ছেলে বড় হয়েছে রাজকুমারের মতো। অথচ ওরা পথশিশুর চেয়েও কষ্টে বড় হয়েছে।”

-“ওরা মানে? রুমঝুম আর কে?”
তিহানের প্রশ্নে মেঘা খানিকটা চুপ থাকলো। ও নিজেও পুরোপুরি ভাবে কিছু জানে না। মেঘা প্রসঙ্গ পাল্টে বললো,
-“আপনাদের যা‌ জানা প্রয়োজন আমি সেটুকু বলি আজ। সময় কম তো।”
প্রান্তেরও ওই বিষয়ে জানার ইচ্ছা থাকলেও সেটা আপাতত চেপে গিয়ে বললো,
-“আচ্ছা এরপর বলো।”

মেঘা জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আবার বলতে শুরু করলো,
-“আরমান নামে একটা লোক আছে। এমন খারাপ কাজ নেই যা সে করে না। বয়স সাইত্রিশ বা আটত্রিশের কাছাকাছি। রুমঝুমের বয়সের প্রায় দ্বিগুণ। বড় কথা হলো তার মেয়ে নেশা আছে। প্রতিদিনই নতুন নতুন মেয়ে লাগে তার। রুমঝুমের সৎমা তার টাকা দেখেই গলে গিয়েছিলো। রুমঝুমকে ওখানে বিয়ে দিলে আরো টাকা পাবে ভেবে ওকে জোর করে ওখানে বিয়ে দিচ্ছিলো। কিন্তু এমন মানুষকে কি কেউ জেনে বুঝে বিয়ে করবে বলুন?
করবে না। রুমঝুম উপায়ান্তর না পেয়ে পালিয়ে এসেছে। ওই লোকের হয়তো ইগো হার্ট হয়েছে তাই এখন‌ পাগলা কুত্তার মতো খুঁজছে রুমঝুমকে। জানি না ওকে পেলে কি করবে।”

উপস্থিত সকলেই চুপ করে আছে। মেয়েটা ছোট থেকেই কত ঝড় ঝাপটা পেরিয়ে এসেছে।
মেঘা শানের দিকে ফিরে আকুতি ভরা কন্ঠে বললো,
-“ভাইয়া ,আপনি কি ঝুমের নিজের মানুষ হবেন? ওকে আগলে রাখবেন সব বিপদ থেকে? একটু সুখের মুখ দেখাবেন ওকে?”

শান তখন তাকিয়ে আছে বেশ খানিকটা দূরে হেঁটে আসা রুমঝুমের দিকে। নিজ মনেই বললো,’ এই মেয়েটার সুরক্ষা বলয় হলে ক্ষতি কি? বুকপিঞ্জিরায় লুকিয়ে রাখবো যেন কেউ খুঁজে না পায় ওকে।’

শান‌ ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে মেঘাকে বললো,
-“আমি ওর নিজের মানুষ হবো, মেঘা। একান্তই তার নিজের।ইর সেটা খুব দ্রুতই হবো।”

রুমঝুম ধীর গতিতে হেঁটে আসতে আসতে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে শানের সেই হাঁসি মাখা মুখের দিকে।

-“আচ্ছা তোমরা দুজন কি আজ আর ক্লাস করবে?”
প্রান্তের প্রশ্নে রুমঝুম মেঘার দিকে তাকালে মেঘা ডানে বায়ে মাথা নাড়ালো। সিন্থিয়া হেঁসে বললো,
-“গ্রেট। চলো ফুসকা খাই। খূব ফুসকা খেতে ইচ্ছে করছে।”
রুমঝুম বোকার মতো তাকালো সিন্থিয়ার দিকে। এই মাত্র ফুসকার ওখান থেকেই ঘুরে এলো অথচ সেদিকে তাকালো পর্যন্ত না আর এখন বলছে ফুসকা খেতে ইচ্ছে করছে। কি অদ্ভুত।

প্রান্ত মেঘাকে বললো,
-“চলো মেঘা,গল্প করতে করতে হাঁটি।”
মেঘা কয়েক সেকেন্ড হা করে তাকিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলো। বোঝার পর দাঁত কেলিয়ে বললো,
-“চলুন ভাইয়া।”
সিন্থিয়া তিহান আর বিথীর সাথে এমনভাবে কথা বলতে বলতে হাঁটছে যেন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মিটিং করছে সে। রুমঝুম বলদের মতো দেখছে শুধু। মেঘা পেছনে তাকিয়ে বললো,
-“ঝুম, শান ভাইয়ার সাথে আয়।”

মেঘার কথায় রুমঝুমের হঠাৎই খুব লজ্জা লাগলো। তবে সে লজ্জাবিলাস করার সময় পেলো না।কারন শান ততক্ষণে দুই-চার পা এগিয়ে গেছে। শানকে এভাবে চলে যেতে দেখে সে খানিকটা রুমঝুম দৌড়ে তার কাছাকাছি চলে গেলো। ছেলেটার আজ হয়েছে কি? কথাও বলছে না, তাকাচ্ছেও না। শান এমন ভাব করছে যেন সে জানপ্রাণ দিয়ে ফোন টিপছে।

রুমঝুম খানিকটা ইতস্তত করে বললো,
-“শুনছেন? ”
শান তার দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিলো,
-“বলো।”
-“আ.. আপনি কি আমার উপর রাগ করেছেন?”
শান ভ্রু কুঁচকে তাকালো রুমঝুমের দিকে। রুমঝুম সাথে সাথে চোখ নামিয়ে নিলো। শান ঠোঁট টিপে হাসলো। বললো,
-“তোমার সাথে রাগ করার কোনো কারন আছে?”

রুমঝুম উত্তর দিতে পারলো না। নিচের দিকে তাকিয়ে হাঁসফাঁস করছে সে। শান রুমঝুমের এই অবস্থা দেখে মনে মনে বেশ মজা পাচ্ছে। রুমঝুমের গাল দুটো হালকা লাল হয়ে উঠেছে। শান দাঁত দিয়ে ঠোট কামড়ে নিজের হাঁসি আটকালো। বললো,
-“বাই দা ওয়ে,তুমি কি লজ্জা পাচ্ছো রুমঝুম?”

রুমঝুম আরো নিচু করে ফেললো মাথা। ইশশ ছেলেটা বুঝলো কিভাবে? সে লজ্জা পেলে কি তার মুখে লেখা ভেসে ওঠে যে এই মুহূর্তে রুমঝুম লজ্জা পাচ্ছে? রুমঝুম মুখ লুকাতে তার অগোছালো দৃষ্টি দিয়ে আশেপাশে দেখতে লাগলো। আর শান প্রেমময় দৃষ্টিতে দেখলো তার লজ্জাবতী চন্দ্রকন্যা কে।

চলবে…….

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

চন্দ্ররঙা প্রেম পর্ব-০৭

0

#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্ব-৭
#আর্শিয়া_সেহের

আজ খুব তাড়াতাড়িই ভার্সিটিতে এসেছে রুমঝুম আর মেঘা। কোনোমতেই যেন ডিপজল স্যার তাদেরকে বের করে দিতে না পারে সেজন্য। ক্লাস শুরু হওয়ার দশ মিনিট আগে ক্লাসে পৌঁছেছে দুইজন।

রুমঝুমকে ভার্সিটিতে ঢুকতে দেখেই আরাফাতের কাছে কল করলো তার এক শিষ্য । আরাফাত বললো,
-“নজর রাখ। কোথায় যায় আমাকে বলিস। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি।”
-“ওকে ভাই। আমি মেয়েটার দিকে নজর রাখছি।”
-“ওই ওই,মেয়ে কি? ভাবি বল, বেয়াদপ।”
ছেলেটা কাঁচুমাচু মুখে জবাব দিলো,
-“সরি ভাই। আমি ভাবির দিকে খেয়াল রাখতেছি।”
-“আচ্ছা।”

আরাফাত কল কেটে কোলবালিশটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। মনে মনে সেখানে রুমঝুমকে কল্পনা করলো। চোখ বন্ধ করে কোলবালিশেই এলোপাথাড়ি চুমু খেতে শুরু করলো।
আরাফাতের মা আরাফাতকে ডাকতে এসে দেখলো দরজা লক করা নেই। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে ওর এমন‌ কান্ডে হতভম্ব হয়ে গেলেন তিনি। সেকেন্ড কয়েক বাদে চিৎকার করে বললেন,
-“আরাফাতের বাবা,তোমার ছেলে পাগল হয়ে গেছে। দেখে যাও কি করছে।”

মায়ের চিৎকারে চোখ মেললো আরাফাত। কাল রাতে মদ গিলে এসে শুয়ে পড়েছিলো সে। দরজা লক করতে মনে ছিলো না। ইশশ!কি লজ্জার ব্যাপার।আরাফাত একলাফে উঠে বাথরুমে চলে গেলো। মায়ের সামনে আর থাকা যাবে না।

যথাসময়ে ক্লাস শুরু হয়ে গেলো মেঘা আর রুমঝুমের। মেঘা মন দিয়ে ক্লাস করলেও রুমঝুমের মন ক্লাসে নেই। সে আনমনে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে। মন পরে আছে হারিয়ে যাওয়া নূপুরটায়।

ক্লাস শেষ হলো দশটার দিকে। এরপরের ক্লাসটা একটা বোরিং ম্যামের। উনার ক্লাসে অর্ধেকের বেশি স্টুডেন্টই অনুপস্থিত থাকে। আজও তার ব্যতিক্রম হলো না। রুমঝুমকে নিয়ে মেঘাও বেরিয়ে গেলো ম্যাম আসার আগেই।

ক্লাস থেকে বেরিয়ে মেঘা বললো,
-“এখন‌ কোথায় যাবি?”
-“কৃষ্ণচূড়া তলায় চল। ”
মেঘা মুখ ভার করে বললো,
-“সিনিয়রদের সাথে সময় কাটাতে আমার ভাল্লাগে না।”
-“আরে অল্প কিছুক্ষণ থেকে চলে আসবো। তাছাড়া গতকালকে যেতে বলেছে। এখন না‌ গেলে কেমন দেখায় না?”
মেঘা মুখ লটকে বললো,
-“চল‌ তাহলে।”

দুজন মিলে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে যাওয়ার জন্য হাঁটা শুরু করলো। মেঘা আশেপাশে তাকালেও রুমঝুম নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। এই পথেই তো কাল হেঁটেছিলো। যদি এখানেই পেয়ে যায় তার হারিয়ে যাওয়া নূপুরটা সেই আশায়।

কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছে দেখলো ওরা এখনো আসে নি। অন্যান্য যায়গার তুলনায় এই জায়গাটা বেশ নির্জন। এতো গরমেও এই জায়গাটা অনেকটা শীতল। রুমঝুম আর মেঘা মোটা একটা শিকড়ের উপর বসলো।

-“হাই সুন্দরীরা।”
অপরিচিত এক কন্ঠ শুনে রুমঝুম আর মেঘা দুজনই পাশ ফিরে তাকালো। মেঘা ছেলেটাকে দেখে চমকে উঠলো। আরাফাতের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বেশ ধারনা আছে তার।
রুমঝুম শক্ত গলায় বললো,
-“কি চাই?”
আরাফাত বাজে ভাবে ইঙ্গিত করে বললো,
-“তোমাকে, সুন্দরী।”

রুমঝুম রাগী চোখে তাকালো আরাফাতের দিকে। তেজী গলায় বললো,
-“ভদ্রভাবে কথা বলুন। অসভ্য ছেলে।”
মেঘা রুমঝুমের বাম হাত চেপে ধরলো। ফিসফিস করে বললো,
-“এই ছেলের সাথে তর্কে যাস না। বখাটে একটা। ওঠ,এখান‌ থেকে চল।”

রুমঝুম আর মেঘা দুজনই উঠে পড়লো। ওখান থেকে চলে যেতে নিলেই পথ আগলে দাঁড়ালো আরাফাত। মেঘার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“তোমার যেতে ইচ্ছে করলে তুমি যাও, সোনা। আমার লায়লা যাবে না। আমরা এখন প্রেম করবো।”
রুমঝুমের ঘৃনা লাগছে এই ছেলের দিকে তাকাতেও। মেঘার হাত চেপে ধরে আরাফাত কে পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যেতেই পেছন দিয়ে রুমঝুমের হাত টেনে ধরলো আরাফাত। রুমঝুম সাথে সাথে চোখ বন্ধ করে ফেললো। ঘৃনায় গা গুলিয়ে উঠলো। আরাফাতের দিকে না ফিরেই হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো,
-“আমার হাত ছাড়ুন । আমি কিন্তু চিৎকার করে লোক জড়ো করবো।”
-“করো চিৎকার। দেখি কে আসে।”

রুমঝুম আশেপাশে তাকালো। সবাই তাদেরকে দেখছে কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছে না। মেঘা তাচ্ছিল্যের হাসি হেঁসে বললো,
-“এরা কেউই এগিয়ে আসবে না রুমঝুম। এই পিশাচের ক্ষমতার দাপটে সবাই চুপসে থাকে।”

মেঘার কথার বিপরীতে দাঁত বের করে হাঁসলো আরাফাত। বিশ্রী ভঙ্গিতে বললো,
-“এবার এই পিশাচকে কে প্রেম করার সুযোগ দাও, শালিকা।”
মেঘা কোনো কথা বললো না। আলোয় ঝলমল করা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আরাফাতের পেছনে।

-“তোকে প্রেম করাচ্ছি আমি কুত্ত** বাচ্চা।”
বলেই আরাফাতের ডান গালে ঘুসি মারলো প্রান্ত । আরাফাত হঠাৎ আক্রমণে টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পরে গেলো। রুমঝুমের হাত ধরে থাকায় রুমঝুমও টান খেয়ে পরে যেতে নিলে একজোড়া শক্তপোক্ত হাত তাকে আগলে নিলো। রুমঝুম তড়িৎ গতিতে মাথা ঘুরিয়ে দেখলো শান ধরে রেখেছে তাকে। তবে শান রুমঝুমের দিকে তাকিয়ে নেই। তার আগুনঝরা দৃষ্টি তখন আরাফাতকে ভষ্ম করতে ব্যাস্ত।

রুমঝুমকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে দিয়ে শান এগিয়ে গেলো মাটিতে পড়ে থাকা আরাফাতের দিকে। কোনো‌ কথা না বলেই এলোপাথাড়ি লাথি দেওয়া শুরু করলো। প্রান্ত হা করে তাকিয়ে রইলো‌ সেদিকে। যে ছেলে কোনোদিন কারো সাথে তর্ক পর্যন্ত করেনি সে আজ মারপিট করছে। এটাও দেখা লাগলো তার? সিন্থিয়া ,বিথী, তিহান অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। এ যেন এক নতুন শানকে দেখছে তারা। মেঘা রুমঝুমকে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। দুই জনই হতভম্ব হয়ে গেছে। আশেপাশে ভীড় জমে গেছে ভালোই।

প্রান্ত এগিয়ে এসে শানকে পেছন থেকে ধরে থামানোর চেষ্টা করছে। ততক্ষণে আরাফাতের চ্যালারাও চলে এসেছে। প্রান্ত আর তিহান অনেক কষ্টে শানকে সরিয়ে নিলো। শানের চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। সে হাপাচ্ছে। দম টেনে টেনে বললো,
-“ওর চোখ উপড়ে নিবো আমি। ছাড় আমাকে। ও কার সাথে প্রেম করতে চায়? ওকে তো আমি…”
শান ছুটে যাওয়ার চেষ্টা করছে । আরাফাতকে নিয়ে ওর শিষ্যরা হসপিটালের উদ্দেশ্যে চলে গেছে। চারপাশের ভীরও কমে এসেছে ধীরে ধীরে।

হঠাৎ করেই মেহেদী এসে হাজির হলো সেখানে। মেঘাকে বললো,
-“এখানে কি হয়েছিলো মেঘা? ওদিকে একজন বললো এখানে তুই আছিস। এনিথিং সিরিয়াস?”
মেঘা সবটা বললো মেহেদীকে। সবটা শুনে মেহেদীর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো। রুমঝুমের দিকে তাকিয়ে দেখলো ও নিচের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
মেহেদী শান্ত কন্ঠে বললো,
-“মেঘা,ঝুম দু’জনই বাড়িতে চলো।”

সবার দিকে একবার তাকানোর দরুন সিন্থিয়ার সাথে চোখাচোখি হয়ে গেলো মেহেদীর। মেহেদী আসা থেকেই তার দিকে তাকিয়ে ছিলো সিন্থিয়া। মেহেদী ওদের পাঁচজনের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“তোমাদের সবাইকে অনেক ধন্যবাদ ওদেরকে সাহায্য করার জন্য।”

মেহেদী রুমঝুম আর মেঘাকে নিয়ে বাড়ির পথ ধরলো। রুমঝুম একবার পেছনে তাকিয়ে দেখলো শান তার দিকেই তাকিয়ে আছে। বুকটা ধুক করে উঠলো তার। কি বিদ্ধস্থ চাহনি‌ শানের। রুমঝুম আর পেছনে তাকালো না। শান বুকপকেটে হাত দিয়ে শীতল চোখে রুমঝুমের চলে যাওয়া দেখলো।

-“শান?”
বিথীর ডাক শান শুনতে পেলো কিনা বোঝা গেলো না। কারন সে একদম চুপচাপ বসে আছে।
-” রুমঝুমকে ভালোবাসিস ,শান?”
প্রান্তর সরাসরি প্রশ্নে শান তাকালো প্রান্তের দিকে।
প্রান্তর আর শানের উত্তরের প্রয়োজন হয়নি। বন্ধু তো তাই শানের চোখের ভাষাতেই সবটা বুঝে গেলো প্রান্ত। মুচকি হেঁসে আস্তে আস্তে বললো,
-“তাহলে দেরি করছিস কেন? জানিয়ে দে ওকে।”

সিন্থিয়া এতোক্ষণ অন্য দুনিয়ায় ছিলো। শান-প্রান্তর কথা শুনে ও এগিয়ে এলো। শান্তভাবে বললো,
-“শান ,তুই রুমঝুমের সম্পর্কে কিছু না জেনেই ওকে ভালোবেসে ফেলেছিস?”
-“ভালোবাসার জন্য তার সম্পর্কে জানাটা খুব দরকার,সিন্থু? ভালোবাসার জন্য তো মানুষটাই যথেষ্ট।”

সিন্থিয়া হালকা হাসলো। বললো,
-“রুমঝুম কিন্তু বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে, শান। বিয়ের আগের রাতে পালিয়ে এসেছে।”

উপস্থিত সবাই চমকে উঠলো। চমকালো শান নিজেও। সিন্থিয়াকে কিছু জিজ্ঞাসা করবে তার আগেই সিন্থিয়া বললো,
-“আমি এটুকুই জানি। সেদিন বাসে অনেক জোরাজুরি করার পর ও এটুকুই বলেছিলো। এর বেশি আমি জানিনা। ”
-“আমার মনে হয় ওর পালিয়ে আসার ব্যাপারে বাকিটা ওর ঝগড়ুটে বান্ধবী মেঘা আমাদের বলতে পারবে।”

তিহানের কথা শুনে প্রান্ত বললো ,
-“রাইট। মেঘা চাইলে আমাদেরকে সাহায্য করতে পারে।”
-“মেঘা ঝগড়ুটে এটা তোকে কে বললো ,তিহান?”
বিথী বেশ গম্ভীর সুরে বললো কথাটা।
তিহান কোনো মেয়ের সাথে কথা বললে বা কোনো মেয়ের ব্যাপারে কথা বললেই বিথীর অসহ্য লাগে। কেন লাগে সেটা ও জানে না। বাকিদের ক্ষেত্রে তো এমন লাগে না ওর। তিহানও এ ব্যাপারে অবগত। সে আমতা আমতা করে বললো,
-“ওই তো গতকাল ক্যান্টিনে আমার সাথে ঝগড়া করছিলো শুধু শুধু। এজন্য বললাম।”
বিথী নির্জীব ভাবে বললো,
-“ওহ আচ্ছা।”

….

-“আম্মু আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।”
ছেলের কথা শুনে শাফিয়া আক্তার খানিকটা অবাক হলেন। এর আগে শান কখনো এভাবে কথা বলেনি। শাফিয়া আক্তার শানের পাশে বসলেন। শান সাথে সাথেই মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। এটা নতুন না। শাফিয়া আক্তার পাশে বসলে শান সবসময়ই তার কোলে শুয়ে পড়ে এভাবে। শাফিয়া আক্তার মৃদু হেঁসে ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
-“কি কথা বলবি? বল।”
-“একটু অপেক্ষা করো। বলছি।”

শাফিয়া আক্তার চুপচাপ ছেলের মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন আর একদৃষ্টিতে ছেলেকে পরখ করছিলেন। শানের ডান ভ্রু এর উপরে আর থুতনির নিচে কাঁটা দাগ আছে। ছোটবেলায় কেটে গিয়ে হয়েছিলো এই দাগ দুটো। সময়ের সাথে সাথে ক্ষত সারলেও দাগ দুটো জীবন্ত। এই কাঁটা দাগ দুটোর জন্য শানকে আরো বেশি ভালো লাগে দেখতে।

-“ইয়েস, মাই সন। আমি চলে এসেছি। বলো তুমি কি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবে।”
ইমতিয়াজ মাহমুদের কথায় শাফিয়া আক্তার দরজার দিকে তাকালেন। খানিকটা বিষ্মিত হলেন সে। ছেলের এমন কি কথা যা বাবা-মা দুজনকে ডেকে বলতে হচ্ছে।

শিরীন পা টিপে টিপে এসে শানের দরজার বাইরে দাঁড়ালো। সে ও শুনবে ভাইয়া কি বলার জন্য বাবা-মা দু’জনকেই ডেকেছে।

শান শাফিয়া আক্তারের কোল থেকে মাথা উঠালো। দু’জনকে বিছানায় বসিয়ে তাদের সামনে মাথা নিচু করে বসলো।
-“আসলে আমি একটা মেয়েকে ভালবাসি আম্মু।”
শাফিয়া আক্তার কথাটা শুনেই বিস্ফোরিত নয়নে তাকালেন ছেলের দিকে। দরজার বাইরে দাঁড়ানো শিরীনও চোখ বড় বড় করে ফেললো বিষ্ময়ে। শান একবার মাথা উঁচু করে তার বাবা-মা দুজনের দিকে তাকালো। ইমতিয়াজ মাহমুদ নির্বিকার ভঙ্গিতে বসে আছে। শান আবারও বললো,

-“আব্বু, আমি যে মেয়েটাকে ভালোবাসি এ কথা মেয়েটা এখনো জানেনা। আমার মনে হলো‌ প্রথমে তোমাদের সাথে কিছু বিষয়ে ক্লিয়ার হওয়া দরকার।
দেখো আমি ওকে ভালোবাসি তাই ওর সব কিছু আমি মেনে নিলেও তোমরা হয়তো মানতে পারবে না। তাই তোমাদের মতামত নিয়েই আমার সামনে আগানো দরকার।
আম্মু,মেইন ব্যাপারটা হচ্ছে, মেয়েটা বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে। বিয়ের আগের দিন রাতে পালিয়েছিলো। তারপর এখানে বান্ধবীর বাড়িতে এসে থাকছে। আমার ভার্সিটিতেই পড়াশোনা করছে।
আম্মু ওকে দেখলেও বোঝা যায়, ও ভালো পরিবারের মেয়ে। ও কেন পালিয়েছে সেটা আমি জানিনা। তোমরা যদি এটুকু শুনে রাজি হও তবেই আমি সবটা জানবো এবং ওকে ভালোবাসার কথা জানাবো।
আর ওকে ভালোবেসে বিয়ে করবো। তখন তোমরা যদি ওকে ইঙ্গিত করে বলো ,’এই মেয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলো,এই মেয়ে ভালো না, এর চরিত্রে সমস্যা আছে’ এসব আমি মেনে নিতে পারবো‌ না। কারন ও তখন আমার অর্ধাঙ্গিনী হয়ে থাকবে। ওর অপমান আমি সহ্য করতে পারবো‌ না আম্মু। তাই আমি আগে তোমাদের মতামত চাইছি।

শান এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে চুপ হয়ে আছে।তার বুকের মধ্যে ঢিপঢিপ আওয়াজ হচ্ছে। বাবা-মা যদি‌ রাজি না হয় তবে কি হবে? সে তো তার চন্দ্রকন্যাকে ভুলতে পারবে না। পাগল হয়ে যাবে সে। শান‌ সেই‌ মুহূর্তে মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলো, যে কোনো কিছুর বিনিময়ে হলেও সে যেন তার চন্দ্রকন্যাকে পায়।
শাফিয়া আক্তার-ইমতিয়াজ মাহমুদ চুপ করে বসে আছে। শিরীন দেয়ালে কান পেতে উদগ্রীব হয়ে আছে তার বাবা-মা কি বলে সেটা শোনার জন্য।

বেশ কিছুক্ষণ নিরবতায় কাটার পর ইমতিয়াজ মাহমুদ ধমকের স্বরে বললেন,
-“ও ও করছিস কেন? ও টা‌ কে? আমার হবু বউমার নাম নেই নাকি?”

শান তড়িৎ গতিতে মাথা তুলে তাকালো। শাফিয়া বেগম আর ইমতিয়াজ মাহমুদ দুজনই ঠোঁট চেপে চেপে হাসছে। তাদের হাসতে দেখে শান‌ও হেঁসে দিলো। সঙ্গে সঙ্গেই তার চোখের কার্নিশ বেয়ে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো। মিনমিন করে বললো,

-” আছে তো নাম। তোমাদের জন্য ওর নাম রুমঝুম আর আমার জন্য চন্দ্রকন্যা।”

চলবে………

(রি-চেক দেওয়া হয়নি।)

চন্দ্ররঙা প্রেম পর্ব-০৬

0

#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্ব-৬
#আর্শিয়া_সেহের

-“রুশান ,তুই কি সত্যিই ঝুমের কোন খোঁজ জানিস না?”
-“না মা ,জানিনা। আর কতবার বলবো?”
তাহমিনা বেগম ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলেন আদরের ছেলেকে। কাঁদতে কাঁদতে বললেন,
-“জেনে থাকলে সত্যিটা বল, বাবা। না জানলে কোনো ভাবে জেনে নে । ওকে খুঁজে বের করতে না পারলে যে তোর অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যাবে রে সোনা।”

রুশান কিছুটা অবাক হলো। আপুকে না পেলে তার কি ক্ষতি হবে। যা হয় হোক। তাহমিনা বেগম কে নিজের থেকে ছাড়াতে ছাড়াতে কঠোর গলায় রুশান বললো,
-“বলেছি তো‌ জানি না আমি। আমাকে এটা নিয়ে আর জ্বালাতন করবা না মা, প্লিজ।”
বলেই সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো রুশান।

তাহমিনা বেগম কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পড়লেন। সে জানে রুশান সবটা না জানলেও ঝুমের ব্যাপারে অনেক কিছুই জানে কিন্তু মুখ খুলছে না। হয়তো খুলবেও না। নিজের ছেলেকে বাচানোর জন্য এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে তাহমিনা বেগম।

তাছাড়া আরমান আরো একটা ব্যাপার নিয়ে আজ সকালে তাকে শাসিয়েছেন। নয় বছর আগের ঘটনা নিয়ে আরমান তাকে এখনো ব্লাকমেইল করবে সেটা তার কল্পনায়ও ছিলো না। সেই ঘটনা সামনে এলে তাকে তার স্বামী নিজ হাতে খুন করবে এটা সে শতভাগ নিশ্চিত। দুশ্চিন্তা,ভয় সবকিছু একসাথে জেঁকে বসেছে তার উপর।

তার স্বামীও সেদিন রাতে বাড়ি থেকে বেরিয়েছেন তারপর আর ফেরেনি। ফোন করলেও‌ রিসিভ করে না। সবাই তার থেকে দূরত্ব বাড়াচ্ছে। তার পাপের শাস্তি শুরু হয়েছে বোধ হয়।

-” ঝুম তোর হলো?”
-“হ্যাঁ হয়েছে। আর একটু দাঁড়া।”
-“হুহ দাঁড়াতে দাঁড়াতে পায়ে ব্যাথা হয়ে গেলো। তাড়াতাড়ি কর।”
-” আর দুই মিনিট দে ।”

রুমঝুম আর মেঘা রেডি হয়ে দ্রুত রুম থেকে বের হলো। তড়িঘড়ি করে কলেজ যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হতে গেলে পিছু ডাকলো মাহেরা খাতুন ।
-“এই এই না খেয়ে কোথায় যাচ্ছিস দুজন? খেয়ে যা চুপচাপ।”
-“সময় নেই মা। একদম সময় নেই। প্রথমেই ডিপজল স্যারের ক্লাস বুঝলে? লেট করলে রক্ষে থাকবে না।”

মেঘার কথার ধরন দেখে তার মা আর রুমঝুম দুজনই হেঁসে ফেললো। পেছন থেকে মেহেদী এগিয়ে এসে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসা করলো,
-“হু ইজ ডিপজল স্যার,মেঘা? আমি যতদূর জানি তোর ডিপার্টমেন্টে ডিপজল নামে কোনো স্যার নেই।”
মেহেদীকে দেখে মেঘা খানিকটা চমকে গেলো। শুকনো ঢোঁক গিলে আমতা আমতা করে বললো,
-” মানে ভাইয়া ওই যে ডিপজলের মতো ভয়ংকর দেখতে ওই স্যারটা। আনিসুল ইসলাম স্যার আর কি।”

মেহেদী চোখ পাকিয়ে তাকালো বোনের দিকে। অসভ্যদের মতো টিচারদের নিয়ে ফাজলামি তার একদমই পছন্দ না।মেঘা মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে আছে। কথাটা বলার আগে ভাইকে দেখলে কক্ষনো বলতো না ওটা।
মেঘাকে এই বিব্রতকর পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার করলো রুমঝুম। মাহেরা খাতুনের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আন্টি আমরা ক্যান্টিন‌ থেকে খেয়ে নিবো। তুমি চিন্তা করো না। মেঘা চল।”
বলেই হুড়মুড় করে বেরিয়ে গেলো দুজন। মেহেদী আরো একঘন্টা পরে যাবে। তাই সে বাড়িতেই রয়ে গেলো।

মেঘাদের বাড়ি থেকে ভার্সিটি পৌঁছাতে প্রায় চল্লিশ মিনিট লাগে। ভার্সিটিতে এসে দুজন ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ালো ক্লাসের দিকে।
কিন্তু বিধিবাম। সেই তাদের বারো মিনিট লেট হয়েই গেলো। ফলস্বরূপ ক্লাসে ঢুকতে দিলো না মেঘার তথাকথিত ডিপজল স্যার। মেঘা পেঁচার মতো মুখ করে মাঠে এসে বসে পড়লো।

রুমঝুম তো মেঘার দিকে তাকিয়ে হেঁসে কুটিকুটি। মেঘা দাঁত কিড়মিড় করে বললো,
-“একদম হাসবি না বিয়াদ্দপ মেয়ে। তোর জন্য ক্লাস মিস হলো আজকে আমার।”
রুমঝুম বহু কষ্টে হাঁসি থামালো। নিজেকে সামলে নিয়ে বললো,
-“আচ্ছা সরি। কাল থেকে একটুও দেরি করবো না। এখন চল খেয়ে আসি। ক্ষুধা লাগছে আমার।”
মেঘা রুমঝুমের দিকে তাকিয়ে ভেঙচি কাটলো। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
-“চল। খেয়ে আসি। পরের ক্লাসটা মিস দেওয়া যাবে না।”

দুজন মিলে ক্যান্টিনের উদ্দেশ্যে রওনা হলো।
ক্যান্টিনে গিয়ে দুজন দুটো স্যান্ডউইচ নিয়ে কর্নারের টেবিলে গিয়ে বসলো। রুমঝুম খাওয়া শেষ করে উঠতে গেলে মেঘা বললো,
-“আমি আরেকটা স্যান্ডউইচ খাবো, ঝুম। আরেকটু বস।”
রুমঝুমকে বসিয়ে মেঘা গেলো স্যান্ডউইচ আনতে।

হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচির আওয়াজে পেছনে তাকালো রুমঝুম। দেখলো মেঘা একটা ছেলের সাথে তর্কাতর্কি করছে। ছেলেটা উল্টাদিকে দাঁড়ানো বলে রুমঝুম ভালো‌ করে তার মুখ দেখতে পারছে না।মেঘাকে থামানোর উদ্দেশ্যে রুমঝুম টেবিল ছেড়ে মেঘার কাছে গেলো।

-“আরে আমি ইচ্ছা করে ফেলেছি নাকি? তাড়াহুড়ো করে হাঁটতে গিয়ে ধাক্কা লেগেছে।”
-” ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক ধাক্কা তো মেরেছেন ,আর আমার স্যান্ডউইচ টাও পরে গেছে আপনার জন্য।”
-“আমি তো‌ বলছি স্যান্ডউইচ কিনে দিচ্ছি তবুও আপনি পায়ে পা দিয়ে আমার সাথে ঝগড়া করছেন কেন?”
-“কি বললেন? আমি আপনার সাথে পা..

-“এই মেঘা থাম তো। কি শুরু করেছিস? সবাই দেখছে।”
পরিচিত কন্ঠস্বর শুনে পেছনে তাকালো তিহান। রুমঝুমকে এখানে দেখে বেশ অবাক হয়েছে সে। রুমঝুমও কম অবাক হয়নি তিহান কে দেখে। রুমঝুম হেঁসে বললো,
-“কেমন আছেন ভাইয়া?”
তিহানও হালকা হেঁসে বললো,
-“এইতো ভালো আছি। তুমি এখানে?”
-“এই কলেজে ভর্তি হয়েছি । ”
-“বাহ।খুব ভালো করেছো। তা এই ঝগড়াটে মেয়েটা তোমার বান্ধবী নাকি?”

তিহানের কথায় মেঘা আবার রাগে ফুঁসে উঠলো। মেঘাকে আরো রাগাতে রুমঝুম ফিক করে হেঁসে দিলো।
মেঘা বেচারি এবার রাগ বাদ দিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে রুমঝুমের দিকে তাকালো।চোখের ভাষায় বুঝালো,’তোর মতো বান্ধবীর চেয়ে শত্রু অনেক ভালো।’

তিহান আর রুমঝুম একদফা হেঁসে তারপর শান্ত হলো। তিহান বললো,
-“ওরা চারজনও চলে এসেছে ক্যাম্পাসে। চলো দেখা করে এসো।”
রুমঝুমেরও সিন্থিয়ার সাথে দেখা করতে খুব ইচ্ছে করছিলো তাই সেও বিনা বাক্যব্যয়ে রাজি হয়ে গেলো। ও ভাবতেও পারেনি এভাবে আবারও ওদের পাঁচজনের সাথে ওর দেখা হবে।

তিহান ,রুমঝুম আর মেঘা বের হয়ে এলো ক্যান্টিন থেকে। ভার্সিটির দক্ষিণে বড় একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ আছে। সবসময় ওখানে বসে আড্ডা দেয় ওরা পাঁচজন। রুমঝুম আর মেঘাকে নিয়ে সেদিকেই গেলো তিহান।

-“ঝুউউউউউমম ।হোয়াট আ প্রেজেন্ট সারপ্রাইজ !তুমি কোত্থেকে এলে এখানে?”
সিন্থিয়ার চিল্লানিতে বিথী ,প্রান্ত আর শানও তাকালো রুমঝুমের দিকে।
ঝুম মিষ্টি হেঁসে জড়িয়ে ধরলো সিন্থিয়াকে। শান শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার চন্দ্রকন্যার দিকে। মেয়েটার হাঁসিও ভীষণ মিষ্টি। তিহান বললো,
-“ও কোত্থেকে এলো মানে কি? এটা তোর পৈত্রিক ভার্সিটি নাকি যে কেউ এখানে আসলে জিগাস কোত্থেকে আসলো?”

সিন্থিয়া তিহানের দিকে চোখ গরম করে তাকালো। তখনই চোখে পড়লো মেঘার দিকে। রুমঝুমকে বললো,
-“এটা কে ঝুম?”
-“মেঘা। আমার ফ্রেন্ড। আরে তুমিও তো চিনবা। ওইযে মেহেদী স্যার আছে না?”

মেহেদীর নাম শুনতেই সিন্থিয়ার চোখ চকচক করে উঠলো। অতি আগ্রহের সাথে বললো,
-” হ্যাঁ আছে তো।”
-“মেঘা উনার বোন।”
সিন্থিয়া মৃদু চিৎকার করে বললো,
-“সত্যি? এজন্যই দেখতে কিছুটা মিল আছে।”

মেঘা সিন্থিয়ার কথার মধ্যেই বলে উঠলো,
-“না আপু। আমার আর ভাইয়ার মধ্যে কোনো‌ মিল নেই। আপনি ভুল দেখেছন হয়তো।”
রুমঝুম ,মেঘা আর সিন্থিয়া বাদে বাকি সবাই হেঁসে উঠলো। প্রান্ত হাসতে হাসতেই চাপা গলায় বললো,
-“ননদিনীকে পেয়ে আমাদের সিন্থুর মাথার তার সবগুলো ছিড়ে গেছে। বেচারি আবেগে অতি আপ্লুত হয়ে কি থেকে কি বলছে নিজেই জানে না।”

রুমঝুম সবাইকে হাঁসতে দেখে নিজেও হেঁসে ফেললো। হঠাৎ করেই চোখাচোখি হয়ে গেলো শানের সাথে। রুমঝুম একনজর তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো। তবে একনজরেই যেন শানকে মস্তিষ্কে এঁকে নিলো সে। ইসস ছেলেরাও বুঝি নজরকাড়া হাঁসি হাসতে জানে?
রুমঝুম আর দ্বিতীয়বার তাকানোর সাহস পেলো না। সে ওই একনজরেই শানের গভীর সমুদ্রের মতো চোখজোড়া দেখে নিয়েছে। ওই চোখের দিকে আবার তাকালে তলিয়ে যেতে পারে। ভরসা নেই।

শান একদৃষ্টিতে রুমঝুমের দিকে তাকিয়ে আছে। কি সুন্দর করে কথা বলছে মেয়েটা। শান একটা জিনিস খুব ভালো মতো খেয়াল করলো। সেটা হলো রুমঝুম কথা বলার সময় খুব বেশি পরিমাণে হাত নাড়ায়। শান মুচকি হাসলো এটা দেখে। শানের সেই হাঁসিটা মেঘার চোখ এড়ালো না । অল্পতে সবকিছু বুঝে ফেলা মেয়েটা আজও অনেককিছুই বুঝে নিলো।

-“ঝুম এখন চল। ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।”
মেঘার কথায় রুমঝুম উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
-“আচ্ছা চল। সিন্থিয়া আপু আমরা আসি।”
-“আচ্ছা এসো। কাল কখন ক্লাস আছে তোমাদের?”
সিন্থিয়ার প্রশ্ন শুনে রুমঝুম প্রশ্নবোধক চোখে তাকালো মেঘার দিকে।মেঘা বললো,
-“কাল নয়টায় ক্লাস আছে।”
-“গ্রেট। আমাদেরও ওই টাইমে ক্লাস আছে। ক্লাস শেষে দুজনই এখানে চলে এসো। অনেক আড্ডা হবে।”
রুমঝুম মেঘা দুই জনই হেঁসে ফেললো। একসাথেই বললো,
-“আচ্ছা আপু। আজ তাহলে আমরা আসি। সবাই ভালো থাকবেন।”
সবার থেকে বিদায় নিয়ে রুমঝুম আর মেঘা তাদের ক্লাসের পথ ধরলো। শান উদাস ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে রুমঝুমের যাওয়ার পানে।

বেলা একটা নাগাদ রুমঝুম আর মেঘার ক্লাস শেষ হলো। ক্লাস শেষে দুজন তাড়াহুড়া করে বের হয়ে এলো ক্যাম্পাসে। ক্লাস যখন শেষের পথে তখন রুমঝুম বুঝতে পারলো তার বাম পায়ের নুপুরটা নেই। এটা খেয়াল করেই রুমঝুমের বুকটা ধক করে উঠলো। নুপুরটা তার মায়ের। রুমঝুমের আঠারো তম জন্মদিনে তার বাবা এই নুপুরটা তাঁকে দিয়েছিলো। তার বাবা অনেক যত্নে এই নুপুর জোড়া তুলে রছখেছিলেন।
সেদিন রেজাউল সাহেব এই নুপুর রুমঝুমকে দিয়ে বলেছিলেন ,
-“ভেবে নিয়ো এটা তোমার মায়ের দেওয়া উপহার। সামলে রেখো এটাকে।”

রুমঝুম কি তবে সামলে রাখতে পারলো না‌ নুপুর জোড়া? ক্যাম্পাসে যেখানে যেখানে ওরা গিয়েছিলো সবখানেই দেখেছে। কোথাও নেই তার মিসিং নুপুরটা। রুমঝুম ডুকরে কেঁদে উঠলো। রুমঝুম কেঁদে কেঁদে বলছে,
-“আমার মা কে ও ধরে রাখতে পারলাম না,মায়ের স্মৃতিকেও ধরে রাখতে পারলাম না। কেমন‌ মেয়ে আমি,বল তো মেঘা?”

মেঘা কিছু বললো না। কিই বা বলবে ও। রুমঝুম খানিকক্ষণ কেঁদে নিজেকে শান্ত করলো। কান্নার ফলে রুমঝুমের ঠোঁট,চোখ আর নাক লাল হয়ে উঠেছে। ভয়ংকর সুন্দরী লাগছে তাকে।
রুমঝুম অন্য পায়ের নুপুরটা শক্ত করে লাগিয়ে নিলো। তারপর মেঘাকে নিয়ে ক্যাম্পাস‌ ছেড়ে বেরিয়ে এলো।

গেটের কাছে আরাফাত আর ওর দলবল মিলে আড্ডা দিচ্ছে। এলাকার এক নাম্বারের বখাটে ছেলে আরাফাত। সারাক্ষণ ভার্সিটির গেটে দাঁড়িয়ে মেয়েদের টিজ করাই ওর কাজ। এলাকার প্রভাবশালী নেতার ছেলে হওয়ায় কেউ কিছু বলতেও পারে না তাকে।

আজ আরাফাতের নজর খুব বাজেভাবে পড়লো রুমঝুমের উপর। লাল ঠোঁট,লাল নাক,ফোলা চোখ আর মুখে সূর্যের আলোতে যেন এক আগুন সুন্দরী হয়ে উঠেছে রুমঝুম। আরাফাত হা করে তাকিয়ে রইলো রুমঝুমের দিকে। তবে রুমঝুম সেদিকে খেয়াল করলো না।সে তো তার নুপুর হারানোর শোকে কাতর।

রুমঝুম আর মেঘা গেট ছেড়ে চলে যাওয়ার পর আরাফাত একজনকে বললো,
-“এই সুন্দরীটা কে রে? আগে তো‌ দেখিনি। ভার্সিটিতে নতুন নাকি?”
-“মনে হয় নতুনই ভাই। আমিও আজকেই দেখলাম।”
-“কালকে ও ভার্সিটিতে আসা মাত্রই আমারে খবর দিবি। মাইয়াটারে আমার ভীষণ ভাল্লাগছে।”

চলবে………..

(ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। )