Friday, July 11, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1394



চন্দ্ররঙা প্রেম পর্ব-২৫ এবং শেষ পর্ব

0

#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্বঃ২৫(শেষ)
#আর্শিয়া_সেহের

সময়টা বসন্তকাল। তখন পড়ন্ত বিকেল। রোদের তাপ কমে গেছে। বসন্তকে আরো রঙিন করতেই যেন থোকা থোকা লাল রঙের কৃষ্ণচূড়া ফুটে রয়েছে শানদের বাগানের গাছটায়। গাছের সবচেয়ে নিচু ডালে দড়ি বেঁধে দোলনা বানানো। সেখানে দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে রুমঝুম। পেছন থেকে ধাক্কা দিচ্ছে শান্ত। রুমঝুম খিলখিল করে হাঁসছে।
শান গার্ডেনের একপাশে বসে ল্যাপটপে কাজ করছে আর উপভোগ করছে তার প্রিয়তমার তীক্ষ্ণ হাঁসির ঝংকার।

-“পাপা,পাপা। আমাল তকলেত পাততি না।”
(পাপা,পাপা।আমার চকোলেট পাচ্ছি না।)

আড়াই বছর বয়সী মেয়ে সাঁঝের কন্ঠে ল্যাপটপ থেকে মুখ তুললো শান। মেয়েকে কাছে টেনে নেয়ে নিয়ে বললো,
-“আমি তো ঘরেই রেখেছিলাম, সোনা। কোথায় গেলো বলো‌ তো?”

সাঁঝ মুখ ফুলিয়ে বললো,
-“বুদেতি আমি এতা কাল কাদ। দালাও তুমি।”
(বুঝেছি আমি এটা কার কাজ। দাঁড়াও তুমি।)

সাঁঝ কোমরে হাত রেখে ফুঁসতে ফুঁসতে রুমঝুমের দিকে এগিয়ে গেলো। দোলনার সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললো,
-“এ্যাই মাম্মা, আমাল তকলেত কাইতো কেন?”
(এ্যাই মাম্মা,আমার চকোলেট খাইছো কেন?)

রুমঝুম সাঁঝের কথায় পাত্তা না দিয়ে দোল খেয়েই যাচ্ছে। রাগে সাঁঝের মুখ লাল হয়ে উঠেছে। দুধ ফর্সা রঙের পিচ্চি মেয়েটা রেগে গেলে একদম লাল টমেটো হয়ে ওঠে। রুমঝুম এই ব্যাপারটা খুব উপভোগ করে।

সাঁঝ কোমরে হাত দিয়ে শান্তর কাছে গেল। শান্তর দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললো,
-“তাত্তু, দোলনা তামাও। তামাও বলচি।”
(চাচ্চু,দোলনা থামাও। থামাও বলছি।)

শান্ত আড়চোখে চেয়ে বললো,
-“আমি কারো তাত্তু না। যেদিন চাচ্চু বলবি সেদিনই তোর কথা শুনবো।”

-“আলে আমি তো তাত্তুই বলি তোমাকে।”
-“ওই তাত্তুই তো‌ বলা যাবে না।”
-“তাত্তু বলিনি তো। তাত্তু বলচি।”
শান্ত রেগে গেলো। সাঁঝের দিকে চেয়ে বললো,
-“তুই যাবি এখান থেকে? আমারে চাচ্চু ফাচ্চু কিছু ডাকতে হবে না। যা এখান থেকে।”

সাঁঝ এবার কেঁদে ফেললো। ঠোঁট উল্টে বললো,
-“মাম্মা আমাল তকলেত কেয়ে পেলচে। তুমি আমায় বকে দিচো। পাপা,পুপি,দাদু আল মামা চালা কেউ আমাকে বালোবাতে না।”
(মাম্মা আমার চকোলেট খেয়ে ফেলছে। তুমি আমায় বকা দিচ্ছো। পাপা,ফুফি,দাদু আর মামা ছাড়া কেউ আমাকে ভালোবাসে না।)

শান্ত ফিক করে হেঁসে ফেললো। প্যান্টের পকেট থেকে চারটা কিটক্যাট বের করে সাঁঝের হাতে দিলো। সাঁঝ চকোলেট পেয়ে কাঁদতে কাঁদতেই হেঁসে দিলো।‌ শান্ত নিচু হয়ে সাঁঝের চোখ মুছে দিয়ে বললো,
-“এবার আমার সাঁঝ বুড়ি খুশি তো?”

সাঁঝ একটু উঁচু হয়ে শান্তর গলা ধরে গালে চুমু দিলো। আহ্লাদে আটখানা হয়ে বললো,
-“এত্তগুলা কুতি আমি। তুমি আমাল গেলেট তাত্তু।”
(এত্তগুলা খুশি আমি। তুমি আমার গ্রেট চাচ্চু।)

রুমঝুম সাঁঝের দিকে চেয়ে বললো,
-“আমার কোলে আসো, আম্মু। একসাথে দোল খাই।”
সাঁঝ শানের দিকে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে বললো,
-“আমাল তকলেত কেয়ে পেলার দন্য দাকচো আমাকে। আমি তোমাল মতলব বুদিনা বেবেচো?”
(আমার চকোলেট খেয়ে ফেলার জন্য ডাকছো আমাকে। আমি তোমার মতলব বুঝিনা ভেবেছো?)

সাঁঝের কথায় শান্ত আর শান হো হো করে হেঁসে উঠলো।‌ সাঁঝ দৌড়ে গিয়ে শানের কোলের বসে পড়লো। শান সাঁঝকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিলো। রুমঝুম মুখ ফুলিয়ে দোলনায় বসে রইলো। শান্ত হাসতে হাসতে রুমঝুমের কাছে এগিয়ে এলো। একটা পঁচিশ বছর বয়সী মেয়েও তার বাচ্চার সাথে চকোলেট নিয়ে কাড়াকাড়ি করতে পারে এটা রুমঝুমকে না দেখলে শান্ত বুঝতোই না।
পকেট থেকে একটা কিটক্যাট বের করে রুমঝুমের হাতে দিলো। রুমঝুম শান্তর দিকে তাকিয়ে বোকার মতো হাসলো। শান্ত ভেঙচি দিয়ে বললো,
-“আমার ভাইঝির খাবারে নজর দিতে পারো বলে এটা দিলাম। খবরদার আমার ভাইঝির চকোলেট আর ছুবা না।”

রুমঝুম শুধু হাসলো। ছেলেটা তাকে কখনো ভাবির মতো ভালোবাসেনা। সবসময় বোনের মতো সম্মান করে,ভালোবাসে। গত পাঁচটা বছর ধরে রুমঝুমের সার্বক্ষণিক সাথী শান্তই।‌ পড়াশোনা, স্কুল বাদে পুরোটা সময় সে রুমঝুম আর সাঁঝকে নিয়েই কাটায়। এই পরিবারের প্রতিটা সদস্যের চোখের মনি রুমঝুম আর সাঁঝ। পাকনিটা শুধু দাদুবাড়িই না ,নানুবাড়িতেও সকলের চোখের মনি।

..

সেদিন রুমঝুমদের বাড়ি থেকে আসার পর পাঁচ বছর কেটে গেছে। চোখের পলকে কেটে যাওয়া সময় পাল্টে দিয়ে গেছে অনেক কিছুই। মাঝখানে কেটে যাওয়া চার বসন্ত সবার জীবনই রঙিন করে দিয়ে গেছে।

বিয়ের চারমাসের মাথায় পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গিয়েছিলো রুমেল। অবশ্য এর পুরো কৃতিত্ব মেঘার। অনেক কষ্ট সহ্য করে রুমেলকে পুরোপুরি সুস্থ করেছে সে। এখন তাদের সুখের সংসার চলছে। দুই বছর বয়সী একটি ছেলে আছে তাদের । মেঘা তাহমিনা মেগমের সাথে ছেলের নাম মিলিয়ে রেখেছে তাহমিদ। তাহমিদ জন্মানোর পর থেকে রেজাউল সাহেবের একাকীত্ব দূর হয়েছে।

রুশান এখন অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। ভার্সিটি বাড়ির কাছে থাকা সত্ত্বেও সে হলে থেকেই পড়াশোনা করে । এ ব্যাপারে রুমেল প্রশ্ন করলেও রুশান এড়িয়ে যায়।শুধু বলে ওর হলে থাকতে ভালো লাগে।বড় রকমের ছুটি পেলে এক ছুটিতে সে ভাইপোর কাছে যায় তো পরের ছুটিতে বোনের মেয়ের কাছে যায়। এই দুই পিচ্চি তার জীবনের অর্ধেক জায়গা জুড়ে রয়েছে।

মেহেদী আর সিন্থিয়ার তিন বছর বয়সী জমজ ছেলে রয়েছে। মাহিম আর সিনিম । মাহিম যতটা দুষ্টু সিনিম ততটাই শান্ত। দু’জন পুরোপুরি একরকম। তাদেরকে আলাদা করতে সিন্থিয়ারই বেশ বেগ পেতে হয়। তবে সাঁঝ কিভাডে যেন তাদের দেখেই বলে দেয় কে সিনিম আর কে মাহিম। সাঁঝ আবার মাহিম ভাইয়ের ভক্ত। সিনিম চুপচাপ থাকে বলে তাকে ভালো লাগে না সাঁঝের।

প্রান্ত আর শিরীনের দু’বছর আগে বিয়ে হয়ে গেছে। শিরীন চার মাসের অন্তঃসত্ত্বা এখন।

বিথীর সাথে আর কখনো কারো যোগাযোগ হয়নি। বিথী নিজ ইচ্ছাতেই কারো সামনে আসেনি। কেন আসেনি সে কারন সবার অজানা।

প্রান্ত আর শিরীনের বিয়ের পরপরই তিহান তল্পিতল্পা গুটিয়ে বিদেশ চলে গেছে। সেখানেই এক ভিনদেশীর প্রেমে পড়েছে সে। খুব তাড়াতাড়িই বিয়ে করবে তারা।

দুদিন পর শান্তর চৌদ্দতম জন্মদিন। শান্ত চায় তার এবারের জন্মদিনটা বড় করে করা হোক। আত্মীয়-স্বজন সবাই একসাথে হোক। তার ইচ্ছাকে পূরন করতে ইমতিয়াজ মাহমুদ সব রকমের ব্যবস্থা শুরু করে দিয়েছেন।
শিরীনকে আজই এবাড়িতে রেখে গেছে প্রান্ত। সে আগামীকাল আসবে।

রুমেল-মেঘা, রেজাউল সাহেব,সিন্থিয়া-মেহেদী ,মাহেরা খাতুন সবাইকে দাওয়াত দেওয়ার দায়িত্ব রুমঝুমের। তবে এই গুরুদায়িত্ব নিজ দায়িত্বে পালন করছে সাঁঝ। রুমঝুম সবার নাম্বার ফোনে তুলে দিচ্ছে আর সাঁঝ দাওয়াত করছে‌ ।
শান অফিস থেকে ফিরে ড্রেস চেঞ্জ করছে আর মা-মেয়ের কান্ড দেখছে। এই ছোট্ট সাঁঝ তার জীবনে তীব্র আলোর ঝলকানি এনে দিয়েছে। সাঁঝের জন্মের সময়টা এখনো মনে আছে তার।

রুমঝুমের প্রেগন্যান্সির সাত মাসের সময় সে মাথা ঘুরে খাটের কোনায় পড়ে বেশ বড়সড় আঘাত পেয়েছিলো। রুমে এসে রুমঝুমকে নিচে পড়ে থাকতে দেখে শানের মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো। বহুকষ্টে নিজেকে সামলে শাফিয়া আক্তারকে ডেকেছিলো শান। সেদিনের ঘটনায় সবাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলো।
ডাক্তার বলেছিলো বাচ্চার আঘাত লাগলেও সেটা গুরুতর নয়। তবে একটু সাবধানে রাখবেন । দ্বিতীয়বার যেন কোনো প্রকার আঘাত না পায়।

তারপর থেকে অফিস যাওয়া বন্ধ করে দেয় শান। একদম সাঁঝের দুনিয়াতে আসা অবধি রুমঝুমকে এক মূহুর্তও একা ছাড়েনি শান। ইমতিয়াজ মাহমুদ সে ক’দিন অফিস সামলান।
যে রাতে সাঁঝের জন্ম হয়েছিলো সে রাতে আকাশে এক ফালি চাঁদ উঠেছিলো। তোয়ালেতে মোড়ানো সাঁঝকে নিয়ে কেবিনের জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলো শান। তার চন্দ্ররঙা প্রেমের পূর্ণতা দিয়েছে এই বাচ্চাটা। তার মেয়ে। তার কলিজা। শান মেয়ের কপালে চুমু এঁকে তার নাম দিয়েছিলো চন্দ্রিমা।

তবে মেয়ের উপর তার চেয়ে তার ভাইয়ের অধিকারই যেন বেশি। শান্ত সারাদিন বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে ঘোরে আর সাঁঝ সাঁঝ করতে থাকে। অগত্যা মেয়ের ডাকনাম সাঁঝই হয়ে গেলো। তবে শান মেয়েকে চন্দ্রি বলেই ডাকে।

অতীত থেকে তাকে ফিরিয়ে আনলো তার ঘরের দুই চাঁদের খিলখিল হাঁসির আওয়াজ। শান মেয়ের কাছে গিয়ে বসলো। মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
-“আমার চন্দ্রি সোনা খুব খুশি আজকে?”
সাঁঝ ফোন নিয়ে টুপ করে শানের কোলের মধ্যে বসে পড়লো। সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো,
-“তুপ কলো পাপা। মামাল কাতে কল কলেতি।”
শান নিজেই ঠোঁটে আঙুল দিয়ে মাথা ঝাঁকালো। সাঁঝ মিষ্টি হেঁসে ফোন কানে ধরলো।

রুশান এই বিকেল বেলায় বোনের কল দেখে অবাক হলো। রুমঝুম তো এই সময়ে ফোন করেনা। সামনে উপস্থিত লোকগুলোকে একটু অপেক্ষা করতে বলে রুশান সাইডে এসে ফোন রিসিভ করলো।
-“হ্যালো, আপু বল।”
-“এতো দেলি হলো কেন হু? পতা মামা। ইত্তু তালাতালি লিতিব কলতে পালো না?”
(এতো দেরি হলো কেন হু? পঁচা মামা। একটু তাড়াতাড়ি রিসিভ করতে পারো না।)

রুশান হেঁসে ফেললো। অসহায় কন্ঠে বললো,
-“আমি সরি চাঁদ সোনা। আর কখনো লেট করবো না। এখন বলো মামাকে কেন ফোন করেছো?”

সাঁঝ কেন ফোন করেছে সেটা কিছুক্ষণ ভাবলো। রুমঝুম মেয়ের ভাবনার গভীরতা দেখে ফোন নিয়ে নিলো। সাঁঝ তখনো ভাবছে সে কেন ফোন করেছে।
রুমঝুম রুশানকে আগামীকাল আসার জন্য বলে দিলো। উপলক্ষ টাও বলে দিয়েছে।
একে একে সবাইকে দাওয়াত দেওয়া শেষ করলো রুমঝুম।

..

দেখতে দেখতে দু’দিন কেটে গেলো। শানদের বাড়িতে হইচই লেগে আছে। সাঁঝ আর মাহিমই মাতিয়ে রেখেছে পুরো বাড়ি। শান্ত দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। উর্বিন্তা এখনো আসে নি দেখে তার মন খারাপ। আর বাল্যকালের ভালো লাগা সময়ের সাথে সাথে ভালোবাসায় পরিনত হচ্ছে। উর্বিন্তা ক্লাস সিক্সে গার্লস স্কুলে ভর্তি হলে শান্তর সে কি কান্না। পরে অবশ্য কোনো এক কারনে উর্বিন্তা গার্লস স্কুল ছেড়ে শান্তর স্কুলে ভর্তি হয়েছিলো। সেইদিন শান্ত ভীষণ খুশির দিনগুলির মধ্যে একদিন।

সাঁঝ দৌড়াতে দৌড়াতে শান্তর কাছে এসে বললো,
-“তাত্তু ,একানে দালিয়ে আচো কেন?”
শান্ত হতাশ কন্ঠে বললো,
-“তোর চাচীর জন্য দাঁড়িয়ে আছি রে মা।”
সাঁঝ কিছুক্ষণ ঠোঁট লটকে রেখে জিজ্ঞাসা করলো ,
-“তাতি কি তাত্তু?”
শান্ত বেজার হয়ে সাঁঝের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“তুই ওদিকে যা মেরি মা। আমার দুঃখ বাড়াইস না তাত্তু ,তাতি এসব বলে।”

সাঁঝ আরো আরো কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্ত সিনিমকে একা একা সোফায় বসে থাকতে দেখে বললো না। দৌড়ে সেদিকে চলে‌ গেলো।
প্রায় আধঘণ্টা পর উর্বিন্তা এলো। উর্বিন্তাকে দেখেই শান্তর দিল ধাকধাক কারনে লাগা।
উর্বিন্তা এগিয়ে এসে শান্তর হাতে একটা গিফট বক্স দিলো। মিষ্টি কন্ঠে বললো,
-“হ্যাপি বার্থডে,শান্ত।”

শান্ত কোনোমতে ধন্যবাদ জানিয়ে উর্বিন্তাকে বসতে বলে দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেলে। গিফটটা দেখে মুচকি হেঁসে ড্রয়ারে রাখলো। এটা ধীরে সুস্থে দেখবে সে। তার ভালোবাসার মানুষটির দেওয়া প্রথম উপহার বলে কথা।

শান্তর জন্মদিনে রাফিনকেও দাওয়াত দিয়েছে শান। সন্ধ্যার একটু আগে রাফিন এসেছে। রুশান গেটের কাছে থাকায় রাফিনকে সেই প্রথম দেখেছে। রুশান রাফিনকে দেখেই দৌড়ে গেলো তার কাছে। সৌজন্যমূলক হেঁসে বললো,
-“হাই স্যার। কেমন আছেন? সমস্যা হয়নি তো?”
-“ও তোমার স্যার কিভাবে হলো রুশান?”

শানের কন্ঠ শুনে থতমত খেয়ে গেলো রুশান। রাফিনের চোখের দিকে একপলক চেয়ে বললো,
-“আরে ভাইয়া ,পুলিশকে তো স্যারই ডাকা উচিত তাই না?”
শান হেঁসে বললো,
-“এখানে সে পুলিশ হিসেবে আসেনি। সো তুমি স্যার না বলে ভাইয়া বলতে পারো।”
রুশান ‘আচ্ছা’ বলেই জায়গা ত্যাগ করলো। শান সেদিকে মাথা না ঘামিয়ে রাফিনকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলো।

রাত নয়টার মধ্যেই অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেলো। সাঁঝ ,তাহমিদ,মাহিম আর সিনিমের একসাথে অনেকগুলো ছবি তোলা হয়েছে। পরিবারের সবাই মিলেও একসাথে ছবি তুলেছে । মাহেরা খাতুন মেহেদী-সিন্থিয়া আর রুমেল মেঘাকে নিয়ে রাতেই নিজেদের বাড়িতে চলে গেছে। কাছাকাছি বাড়ি হওয়ায় কেউ আর না করেনি।

রাত প্রায় বারোটা । চারপাশে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। রুমঝুম সাঁঝকে ঘুম পাড়াচ্ছে। শান বেলকনিতে দাঁড়িয়ে একধ্যানে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই প্রথম দিনের মতো আজও আকাশে মস্ত এক চাঁদ অবস্থান করছে। গত পাঁচ বছর ধরে প্রতি পূর্ণিমায় শান আর রুমঝুম বেলকনিতে বসে চন্দ্রবিলাস করে।

রুমঝুম ধীর গতিতে এসে শানের পিছনে দাঁড়ালো। শান মেঝেতে বসে রুমঝুমের হাত ধরে টান দিলো। রুমঝুম এসে শানের কোলে পড়লো। আর চাঁদের আলো এসে পড়লো দু’জনের পুরো শরীর জুড়ে। রুমঝুম মুচকি হেঁসে শানের বুকে মাথা রাখলো।

শান রুমঝুমের মাথায় হাত বুলিয়ে ছড়া কেটে বললো-

হঠাৎ সেদিন মধ্যরাতে
দেখেছিলাম এক কন্যা
চন্দ্ররঙে গা ভিজিয়ে সে
ছড়ালো রুপের বন্যা।
আ..

শানের ছড়ার মাঝেই সাঁঝ এসে ধপ করে রুমঝুমের কোলে বসে পড়লো। সাঁঝকে এভাবে আসতে দেখে রুমঝুম হকচকিয়ে গেলো। আধঘন্টা ধরে এ কাকে ঘুম পাড়ালো সে‌। শান মেয়েকে টেনে নিজের বুকে নিলো। ধীর কন্ঠে বললো,
-“এখন ঘুমাও আমার চন্দ্রি সোনা।”
সাঁঝ বাবার বুকে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে বললো,
-“আত্তা পাপা।”

প্রিয়তমা স্ত্রী আর কলিজার টুকরা মেয়েকে বুকে আগলে রেখে শান আবার আকাশের দিকে তাকালো। আকাশ তার বুকে চাঁদসহ কতশত তারাকে আগলে রাখে।
তার জীবনের চাঁদ তো তার চন্দ্রকন্যা। আর তারা তার একমাত্র কন্যা। শান চাঁদের দিকে তাকিয়ে আনমনে বললো,
-“আমাকে আরেকটা তারা এনে দিবে চন্দ্রকন্যা?
রুমঝুমের বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগলো শানের কথা বুঝতে। যখন বুঝলো,তখন লজ্জায় লাল হয়ে উঠলো। অস্ফুট স্বরে বললো,
-“হু।”
-“কবে দিবে?”
রুমঝুম আর কিছু বলতে পারলো না। বিয়ের এতোবছর পরও সে শানের কাছে এলে লজ্জা পায়। লজ্জা পেয়ে মুখ লুকায় শানের বুকে। আজও সেটাই করলো। গভীরভাবে মিশে গেলো শানের বুকের সাথে। এখানেই তো তার প্রশান্তি।
মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করলো, তার জীবনের শেষ দিন অবধি যেন সে এখানেই ঠাঁই পায়।

অনেকক্ষণ কেটে গেলো নিরবতায়। একসময় শান আবেগময় অনুভূতি মিশিয়ে বললো,

-“জানো, ঝুম? আমার জীবনে যতকিছু পেয়েছি তার মধ্যে সবচেয়ে বড় পাওয়া তুমি। আমার চন্দ্রকন্যা, আমার ভালোবাসা, আমার চন্দ্ররঙা প্রেম তুমি।”

সমাপ্ত।।

(প্রথমেই দুঃখিত গল্পটাকে বড় করতে পারিনি বলে। সমাপ্তি এখানে আবার এখানে নয়। আপনাদের সবার প্রিয় রুশান আর শান্তর প্রেমকাহিনী নিয়ে ‘চন্দ্ররঙা প্রেম’ সিজন ২ আসবে। কবে আসবে সেটা এখনি বলতে পারবো না।
এন্ডিং কার কেমন লাগবে জানি না। সবাই ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দিয়ে যাবেন। শুধরে নেওয়ার চেষ্টা করবো।
পরিশেষে অনেক অনেক ধন্যবাদ সব্বাইকে। ভালোবাসা অবিরাম সবার জন্য।)

চন্দ্ররঙা প্রেম পর্ব-২৪

0

#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্বঃ২৪
#আর্শিয়া_সেহের

সূর্যের তীক্ষ্ণ রশ্মি সরাসরি এসে পড়েছে রুমেলের মুখে। রুমেল ভ্রু কুঁচকে মাথা ঘুরিয়ে নিলো। সূর্যের প্রখর তাপে শরীর পুড়ে যাওয়ার মতো অবস্থা। রুমেল বিরক্তিতে চোখ মেলে তাকালো।
চোখ খুলতেই ভেসে উঠলো মেঘার মায়াবী মুখটা। ফ্লোরে বসে খাটে দুই হাত ভাঁজ করে তার উপর মাথা রেখে ঘুমুচ্ছে সে। চোখমুখ শুকিয়ে গেছে। গালি পানি শুকিয়ে হালকা দাগ হয়ে আছে।
রুমেলের চোখে মেঘার দুই হাতের ক্ষতগুলোও দৃশ্যমান হলো। কালচে হয়ে গেছে ক্ষতস্থানগুলো।

নিমিষেই রুমেলের বুকের মধ্যে ব্যাথাদের আনাগোনা শুরু হলো। ধীরে ধীরে চোখে ভেসে উঠলো গতরাতের সবকিছু। আপনাআপনিই চোখে পানি চলে এলো। স্বপ্নের রাতে দুঃস্বপ্নের মতো কিছু ঘটে যাওয়াটা সত্যিই অনাকাঙ্ক্ষিত।

রুমেল বিছানা ছেড়ে উঠে জানালার পর্দা টেনে দিলো। ধীর পায়ে মেঘার পাশে বসে হাতের ক্ষতগুলোতে আলতো করে চুমু খেলো। ফার্স্ট এইড বক্স থেকে মলম বের করে মেঘার হাতে আর পিঠে পরম যত্নে লাগিয়ে দিলো। মেঘা ঘুমের মধ্যেই হালকা নড়েচড়ে উঠলো।

রুমেল মলম রেখে ঘড়ির দিকে তাকালো। সবে সাতটা বাজে। মেয়েটাকে এখনই ডাকা যাবে না। এভাবে ঘুমালে হাত পায়ে ব্যাথা হবে ভেবে রুমেল খুব সাবধানে মেঘাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলো। আস্তে করে বিছানায় শুইয়ে দিলো। মেঘাও আদুরে বাচ্চার মতো হালকা নড়েচড়ে রুমেলের বুকের মধ্যে মাথা গুঁজে শুয়ে পড়লো। রুমেল মুচকি হেঁসে মেঘার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করলো।

একবার সুস্থ হলে এই মেয়ের শরীরে একটা টোকাও লাগতে দিবে না সে। মেয়েটা নিঃস্বার্থে ভালোবেসেছে তাকে। এই মেয়েকে জেনেবুঝে কষ্ট দিলে সৃষ্টিকর্তাও তাকে ক্ষমা করবে না।

সাড়ে নয়টার দিকে ঘুম ভাঙলো মেঘার। ঘুম ভেঙে নিজেকে রুমেলের বুকের মধ্যে আবিষ্কার করে কিছুটা অবাক হলো সে।
এক বালিশেই মেঘার পাশে ঘুমিয়ে পড়েছে রুমেল। মেঘার যতদূর মনে আছে সে বিছানায় ঘুমায়নি। তাহলে কি রুমেল তাকে বিছানায় এনেছে? কথাটা ভেবেই মুচকি হাসলো মেঘা। রাতের সমস্ত কষ্ট-বেদনা এক নিমিষেই হাওয়ায় উড়ে গেলো তার।

মেঘা খুব সাবধানে রুমেলের পাশ থেকে উঠে এলো। হাতে মলম লাগানো দেখে মৃদু হাসলো। মলমের উপর নিজেই একবার আলতো স্পর্শ করলো।‌ পেছনে ফিরে রুমেলের দিকে একবার তাকিয়ে ফ্রেশ হতে চলে গেলো।

গোসল শেষে বেরিয়ে দেখলো রুমেল এখনো ঘুমিয়ে আছে। মেঘা চুল মুছতে মুছতে রুমেলের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। শরীরে হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো,
-“এই উঠুন। অনেক বেলা হয়েছে উঠুন।”

রুমেল মেঘার ডাককে পাত্তা না দিয়ে পাশ ফিরে ঘুমালো আবার। মেঘা ফোঁস করে দম ফেলে তোয়ালে সাইডে রেখে দুই হাতে ধাক্কাতে শুরু করলো রুমেলকে। রুমেল মেঘার দিকে ফিরে পিটপিট করে চোখ মেললো। একনজর তাকিয়ে ঝট করে চোখ বন্ধ করে ফেললো। বিরবির করে বললো,
-“আল্লাহ বাঁচাও, আল্লাহ বাঁচাও।”

মেঘা কোমরে হাত রেখে রাগী দৃষ্টিতে চেয়ে আছে রুমেলের দিকে। রুমেল এক চোখ মেলে মেঘার দিকে তাকালো। মেঘার রাগী চেহারা দেখে হেঁসে ফেললো। মেঘার হাত ধরে টেনে নিজের বুকের মধ্যে নিয়ে এলো। কপালে চুমু দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো,
-“সকাল সকাল আমাকে পরীতে ধরতে এসেছে ভেবে ভয় পেয়েছিলাম, বউ।”

‘বউ’ শব্দটা মেঘার মস্তিষ্কে গিয়ে বিধলো। তাকে বাহুবন্ধনে জড়িয়ে রাখা মানুষটার বউ সে। আহ! কি সুখের অনুভুতি। মেঘা প্রশান্তির হাঁসি হাঁসলো। সৃষ্টিকর্তার কাছে এই মূহূর্তে খুব করে নিজের স্বামীর সুস্থতা কামনা করলো।

..

মেঘা আর রুমেলের বিয়ের চারদিন কেটে গেছে। তাদের বিয়ের পরদিনই মেহেদী-সিন্থিয়া, তিহান,শান্ত,শাফিয়া আক্তার-ইমতিয়াজ মাহমুদ চলে গিয়েছিলেন। প্রান্ত-শিরীন, শান-রুমঝুম আর মাহেরা আক্তার থেকে গিয়েছিলেন। আজ তারাও চলে যাবেন।

রুমেলের অবস্থা কিছুটা ভালো‌ এখন। ভায়োলেন্ট হলেও হুঁশ থাকে তার। মেঘা ইনজেকশন দিতে আসলে চোখ মুখ খিচে পড়ে থাকে সে। চেষ্টা করে মেঘাকে কষ্ট না দেওয়ার। তবুও মাঝে মাঝে দু-একটা আঘাত করে ফেলে যেটা মেঘা সবার থেকে লুকিয়ে যায়। সবাই ভীষণ খুশি তাদের দু’জনকে এভাবে মানিয়ে নিতে দেখে।

প্রান্ত-শিরীনের প্রেম চোখে চোখেই সীমাবদ্ধ। গতকাল রাতে প্রান্ত শিরীনকে ছাদে ডেকেছিলো। খুব সুন্দর করে বুঝিয়ে বলেছে শিরীনকে সব। শিরীন যেন ঠিকমতো পড়াশোনা করে, তার কথা চিন্তা করে পরীক্ষায় খারাপ না করে, তার চাকরি হলে শিরীনকে বিয়ে করবে সবকিছুই বলেছে। শিরীন হাঁসি মুখে সবকিছু মেনে নিয়েছে। ছাদ থেকে নামার আগে একবার প্রান্তর দিকে তাকিয়ে বলেছিলো,
-“আমি কি তোমাকে একবার জড়িয়ে ধরতে পারি, প্রান্ত ভাইয়া?”

প্রান্ত আমতাআমতা করলো। তারও ইচ্ছে করছে কিন্তু ..
প্রান্তর উত্তর না পেয়ে শিরীনও অপেক্ষা করলো না । এগিয়ে এসে আলগোছে জড়িয়ে ধরলো প্রান্তকে। প্রান্ত ধরলো না। স্বপ্নকুমারীর প্রথম স্পর্শে জমে গিয়েছিলো সে।
কিছুক্ষণ পর শিরীন নিজ থেকেই প্রান্তকে ছেড়ে দিলো। ক্ষীণ কন্ঠে বললো,
-“আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো। নিজের পড়ালেখাতেও মন দিবো। তোমাকে খুব ভালোবাসি আমি।”

শিরীন গটগট শব্দ করে চলে এলো ছাদ থেকে। প্রান্ত সেদিকে তাকিয়ে অস্পষ্ট ভাবে বললো,
-“আমিও তোমায় ভীষণ ভালোবাসি শিরীন।”

.
রুমঝুম চলে যাবে শুনে সকাল থেকেই মুখ ভার করে বসে আছে রুশান। এই কয়েকদিনে বোনের সাথে কত্তো খুনসুটি করেছে সে‌। আজ বোনটা চলে যাবে সুদূর চট্টগ্রাম। ভেবেই রুশানের খারাপ লাগছে।

মেঘা ব্রেকফাস্ট তৈরি করে ডাইনিং টেবিলে রাখতে এসে চোখ পড়লো রুশানের দিকে। এগিয়ে এসে রুশানের পাশে বসলো মেঘা। আদুরে গলায় বললো,
-“আমার ছোট্ট ভাইটার কি মন খারাপ?”

রুশান আনমনেই বললো,
-“হু।”
-“কেন মন খারাপ?”
-“আজ আপু চলে যাবে ভাবি। ও চলে গেলে আমি একা হয়ে যাবো।”
-“হ্যাঁ তোমার তো ওই একটাই আপু। আমি তো তোমার কেউ না। আপু চলে গেলে তোমার কি আর কেউ থাকবে? তুমি তো একা হবাই।”
মেঘা কথাগুলো বলতে বলতে ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো।

রুশান মেঘার পিছু‌ পিছু দৌড়ে এলো। প্যানপ্যান করে বললো,
-“ভাবি রাগ করতেছো কেন? ও ভাবি । রাগ করে না ভাবি‌ । তুমিও আমার আপু তো। আমি তো এমনিতেই বলেছি।”

মেঘা আড়চোখে তাকিয়ে বললো,
-“আমি কারো‌ আপু নই। যাও তুমি।”
-“ভাবি সরিইই। সরি তো। আর বলবো না। রাগ করো‌ না প্লিজ প্লিজ।”

-“কি রে‌, মেঘা আবার তোর উপর রাগ করলো ক্যান রুশান?”
রুমঝুম সিঁড়ি বেয়ে নামতে নামতে বললো।
রুশান উত্তর দেওয়ার আগেই মেঘা বললো,
-“ওর একমাত্র আপু চলে যাবে। ও একা হয়ে যাবে। বেচারা দুঃখ বিলাস শুরু করেছে এখন থেকেই।”

রুশান মাথা নিচু করে শুনছে শুধু। সে বেশ‌ বুঝতে পারছে মেঘা তার কথায় রাগ করেছে।
রুমঝুম রুশানের পাশে এসে দাঁড়ালো। রুশানের মাথায় গাট্টা মেরে বললো,
-“তুই আমার জন্য দুঃখ বিলাসও করিস। হাউ ফানি।”

রুশান ভেঙচি কেটে বললো,
-“তোমার জন্য দুঃখ বিলাস করতে বয়েই গেছে আমার। ভাগো তুমি।”
রুশানের কথার ধরনে রুমঝুম খিলখিল করে হেঁসে উঠলো। মেঘাও আর না হেঁসে পারলো‌ না। রুশান মুগ্ধ চোখে দুই রমনীর হাঁসি দেখছে। প্রাণবন্ত হাঁসি জোরা দেখে তার ঠোঁটেও মৃদু হাঁসি ফুটলো।

বেলা এগারোটা নাগাদ শান সহ বাকিরা রওনা হওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। রুমেল আরো কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর মেঘা তাকে নিয়ে শ্বশুরবাড়ি যাবে।
মাহেরা খাতুন মেঘাকে জড়িয়ে ধরে বেশ কিছুক্ষণ কান্নাকাটি করলেন। সংসার জীবন সম্পর্কে বিভিন্ন উপদেশ দিলেন। মেঘাও লক্ষী মেয়ের মতো সবটা মাথায় ঢুকিয়ে নিলো।

রুমঝুম রুমেলকে জড়িয়ে ধরে অনেক কাঁদলো। এতো দিন পর ভাইকে পেয়েও তার কাছে থাকতে পারলো না। বিয়ের পর মেয়েদের জীবনটা বোধহয় এমনই হয়।‌ সংসারের বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে ইচ্ছেমতো আর থাকা হয় না কোথায়। রুমেলকে ছেড়ে রুশানকে জড়িয়ে ধরলো রুমঝুম। রুশানের কপালে চুমু দিয়ে বললো,
-“লক্ষী ভাই ,আমার। দুষ্টুমি করবি না। বাবার,ভাইয়ার ,মেঘার খেয়াল রাখবি। তুই আমার ব্রেভ ভাই।”
রুশান টলমলে চোখেই মুচকি হাসলো। টুপ করে তার চোখ বেঁয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো।

রুমঝুম কান্না ভেজা মুখেই বাচ্চাদের মতো শব্দ করে হাসলো। রুশানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“তুই আমার জন্য কাঁদছিস? হি হি হি..
তুই তো আমাকে সহ্য করতে পারিস না তাহলে কাঁদছিস কেন?”

রুশান শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রুমঝুমকে। শব্দ করে কেঁদে উঠলো। বললো,
-“আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি আপু। আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি তুমি।”
রুশানের কথায় রুমঝুমও হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।

শান রেজাউল সাহেবের সাথে কথা বলছিলো। দুই ভাইবোনের কান্নার শব্দে এগিয়ে এলো সেদিকে । বুঝিয়ে শুনিয়ে ঠান্ডা করলো দু’জনকে। প্রান্ত আর শিরীন সব ব্যাগপত্র গুছিয়ে গাড়িতে তুলে ফেলেছে। সবার থেকে বিদায় নিয়ে দু’জন গাড়িতে বসে পড়েছে।

রুমঝুম রুশানকে ছেড়ে মেঘার কাছে গেলো। এই মেয়েটা তার জীবনে আশির্বাদ। একে একে তাকে, তার পরিবারকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেছে। এমন‌ মেয়ের দেখা সহজে পাওয়া যায় না।
মেঘা রুমঝুমের হাত ধরে কেঁদে ফেললো। সবচেয়ে বেশি একা তো সেই হয়ে যাচ্ছে। অসুস্থ স্বামী, অচেনা শহর, নতুন পরিবেশ। সবকিছু কিভাবে সামলাবে সে?

রুমঝুম মেঘার চোখের পানি মুছে দিলো। কান্না মাখা কন্ঠে বললো,
-“এই পরিবারের তিনজন পুরুষের দায়িত্ব তোকে দিয়ে গেলাম মেঘা। আমার বাবাকে দেখে রাখিস। লোকটা অনেক কষ্ট পেয়েছে কিন্তু কষ্ট গুলো প্রকাশ করার মানুষ পায়নি। আমার ছোট ভাইটাকে সামলে রাখিস। ও অনেক ভালো। সবাইকে মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবাসতে জানে ছেলেটা। নিজের ভাইয়ের মতো করে ওর খেয়াল রাখিস।
আর ভাইয়ার ব্যাপারে কিছু বলবো না। তাকে তুই তোর মতো করে গুছিয়ে নে।”

মেঘা কিছু বললো না। রুমঝুম গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। শান গাড়িতে বসে পড়েছে। রুমঝুম রেজাউল সাহেবের কাছে গিয়ে বললো,
-“ভালো থেকো, বাবা। মেঘা অনেক ভালো মেয়ে। ওর দিকে খেয়াল রেখো । আর নিজেরও যত্ন নিয়ো।”

রেজাউল সাহেব চোখ মুছলেন। গাড়িতে বসা শানের দিকে একনজর তাকিয়ে বললো,
-” ওই ছেলেটাকে কখনো কষ্ট দিয়ো না,মা। তোমার জন্য অগাধ ভালোবাসা দেখেছি ওর চোখে। আমার জন্মদুঃখী মেয়েটার জন্য একবুক ভালোবাসা নিয়ে হাজির হয়েছে ছেলেটা। ওর ভালোবাসার সম্মান করো। তোমার কাছে বাবা হিসেবে এটুকুই চাই।”

রুশান পেছন থেকে এসে বললো,
-“জানো আপু,যে রাতে তুমি পালালে? সেই রাতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে চেয়েছিলাম ,’তোমার জীবনটা যেনো চন্দ্র রঙে রেঙে যায়। আমার চাওয়া পূরন হয়েছিলো আপু। পরের রাতেই তোমার জীবনে আগমন ঘটেছিলো চন্দ্রকুমারের। সে তার চন্দ্রকন্যাকে ভীষণ যত্নে আগলে রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমি সবসময় চাইবো চন্দ্রকুমার তার চন্দ্রকন্যাকে নিয়ে সুখময় একজীবন কাটাক।”

রুমঝুম মুচকি হেঁসে গাড়ির দিকে এগিয়ে গেলো। গাড়িতে উঠে বসার পর শান গাড়ির ভেতর থেকে সবার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানালো। রুমেল এগিয়ে এসে বললো,
-“সাবধানে যাও সবাই। পৌঁছে কল করো।”

শান হেঁসে গাড়ি স্টার্ট দিলো। গাড়ি যতক্ষণ দেখা গেলো ততক্ষণ সবাই চেয়ে রইলো সেদিকে। একসময় গাড়িটি তাদের দৃষ্টি সীমা‌ অতিক্রম করলো। কেউ জানেনা আর কবে তাদের দেখা হবে। আদৌ দেখা হবে কি না।
মানবজীবন বড়ই অদ্ভুত। কখন কার সাথে কি ঘটে কেউ বলতে পারে না।

চলবে…..

( ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

চন্দ্ররঙা প্রেম পর্ব-২৩

0

#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্বঃ২৩
#আর্শিয়া_সেহের

একে একে চারদিন পার হয়ে গেছে। তাহমিনা বেগমের আত্মার শান্তি কামনা করে রেজাউল সাহেব ছোট একটা মিলাদ দিয়ে দিয়েছেন। সে চান না তার ছেলেমেয়েদের উপর আর কোনো অশুভ ছায়া পড়ুক। তাহমিনা বেগমের ব্যবহৃত সবকিছু তার রুমে রেখে রুমটা অস্থায়ী কালের জন্য তালাবন্ধ করে দিয়েছে রুশান। সে শোক কাটিয়ে উঠেছে মোটামুটি। এমন পাপীদের জন্য কষ্ট পাওয়াও পাপ।

রুমেলের অসুস্থতা তেমনই আছে। মাঝে মাঝেই উন্মাদ হয়ে উঠছে সে। মেঘা খুব দক্ষ হাতে সামলাচ্ছে রুমেলকে। বেশি ভায়োলেন্ট হয়ে গেলে ঘুমের ইনজেকশন পুশ করে দেয় ।
মেঘার রুমেলকে সামলানোর ধরন,তার ধৈর্য্য মুগ্ধ করছে সবাইকে। সবার বিশ্বাস,মেঘাই রুমেলকে সুস্থ করে তুলতে পারবে।

মেহেদীরও ছুটি শেষ হয়ে আসছে। শান্তর স্কুল, শিরীনের কলেজ, ইমতিয়াজ আহমেদের অফিস সামলানো সবকিছুতেই সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তাই তারা দ্রুত চট্টগ্রাম ফিরতে চান। রেজাউল সাহেব ঘরোয়া ভাবে সেদিন রাতেই মেঘা আর রুমেলের বিয়ের ব্যবস্থা করলেন।

হঠাৎ এভাবে বিয়ের জন্য রুমেল প্রস্তুত ছিলো না। তার অসুস্থতা জানার পরও সবাই মেঘার সাথে তার বিয়ে দিচ্ছে এটা মানতে পারছিলো না সে। তাছাড়া তার মনে হচ্ছিলো মেঘা তাকে করুনা করে বিয়ে করছে।
রুমেল রুমঝুম আর রুশানকে ডেকে পাঠালো। রুমঝুম দুই হাতে মেহেদী ভর্তি করে ভাইয়ের কাছে আসলো। রুশান রুমঝুমের হাত দেখে ভেঙচি কেটে বললো,
-“ঢং দেখে বাঁচি না। এমন সাজ সাজতেছে,মনে হয় যেন ওরই বিয়ে হচ্ছে।”
-“বাঁচতে বললো কে তোকে? মরে যাহ,হুহ।”

রুমেল ধমক দিয়ে দু’জন কে থামালো। রুশান আর রুমঝুম ঝগড়া থামিয়ে ভাইয়ের কথায় কান দিলো।
রুমেল সিরিয়াস ভঙ্গিতে বসে আছে। একটু সময় নিয়ে ভাই-বোনের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আমি এই বিয়ে করবো না। তোরা বাবাকে বোঝা। আমি এখন বিয়ে করার অবস্থায় নেই।”

রুশান আর রুমঝুম দু’জনেই ভাইয়ের কথায় ঘাবড়ে গেলো। আজ রাতে বিয়ে আর এখন তাদের ভাই কি বলছে এসব?
রুশান কিছুটা রেগে বললো,
-“মেঘাপু স্বেচ্ছায় তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছে ভাইয়া। তোমার অবস্থা তো সে জানে । জেনে শুনেই….”

-“আমি জানি মেঘা নিজেই আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছে। কিন্তু ওর হয়তো আমাকে দেখে,আমার অতীত শুনে ,আমার বর্তমান অবস্থা দেখে আমার প্রতি মায়া লেগেছে।হয়তো করুনা করে বিয়ে করতে চাইছে আমাকে ।”
রুশানের কথার মাঝেই রুমেল বললো।

রুমেলের কথায় রুশান ক্ষেপে উঠলো। মেঘার প্রতি রুশানের আলাদা একটা ভালোবাসা তৈরি হয়েছে। রুমঝুমের মতো মেঘাও এখন তার নিজের বোনের মতোই। নিঃস্বার্থভাবে কতটা খেয়াল রাখে সবার। আর এই মেয়েকে নিয়ে এরকম মন্তব্য ভাইয়ার।

রুশান কিছু বলতে যাবে তার আগেই রুমঝুম চোখের ইশারায় থামালো তাকে। দরজার দিকে ইশারা করে বেরিয়ে যেতে বললো রুম থেকে। রুশান ইশারা বুঝতে না পেরে দাঁড়িয়ে রইলো। রুমঝুম গলা ঝেড়ে বললো,
-“আচ্ছা,আমি বলছি সবাইকে যে তুমি বিয়ে করতে চাও না। রুশান আয়।”

রুশান ভ্রু কুঁচকে বোনের দিকে তাকালো। রুমঝুম কি করতে চাইছে এটা তার বোধগম্য হলো না। রুশানকে হাবলার মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে রুমঝুম ওর হাত টেনে বাইরে নিয়ে গেলো। যাওয়ার সময় দাড়াম করে দরজা লাগিয়ে গেলো।

রুমেল সেদিকে একবার তাকিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইলো বিছানায়। তার ভাই বোন দুটো কি জানে, সে কত কষ্টে বিয়ে না করার কথাটা বলেছে? সে নিজেও ভালোবেসে ফেলেছে মেঘাকে । কিন্তু তার মতো একটা ছেলে কি দিতে পারবে ওই মেয়েটাকে?
সে তো ঠিকমতো পরিবারই চেনে না তাহলে মেয়েটাকে কিভাবে একটা পরিবার দিবে? তাছাড়া তার যোগ্যতাই বা কি? রুমেল দুহাতে মাথা চেপে ধরলো এসব ভাবতে ভাবতে।

দরজার খটখট আওয়াজ রুমেলের কানে এলো। হয়তো রেজাউল সাহেব এসেছেন। বিয়ের জন্য রুমেলকে বোঝাতে। অবশ্য বোঝাবেন নাই বা কেন? এমন ছেলের জন্য আর তো মেয়ে পাবেন না।
রুমেল মাথা নিচু করেই বললো,
-“বাবা,আমি মেঘাকে বিয়ে করতে চাই না। এ ব্যাপারে আর কোনো কথা বলো না দয়া করে।”

-“কেন বিয়ে করতে চান না আমায়?”
মেঘার কন্ঠে চমকে তাকালো রুমেল। বাসন্তী রঙের একটা শাড়ি পড়ে দাঁড়িয়ে আছে মেঘা। দু’হাতে মেহেদী দেওয়া। কানে ,গলায় গাঁদা আর গোলাপের সেট। রুমেলের গায়েও বাসন্তী রঙের একটা পাঞ্জাবি। একটু পরেই তাদের হলুদ সন্ধ্যা।
মেঘাকে হঠাৎ করেই এখন একটু বেশি সুন্দর লাগছে। কেন লাগছে রুমেল জানেনা। জানার চেষ্টাও করলো না। চোখ সরিয়ে নিলো মেঘার দিক থেকে।

মেঘা আরেকটু এগিয়ে এসে বললো,
-“বললেন না তো,কেন বিয়ে করতে চান না আমায়?”

-“আমি তোমার যোগ্য নই, মেঘা। এরকম একটা ছেলেকে বিয়ে করে তোমার সুন্দর ভবিষ্যৎটা নষ্ট করো না।”

মেঘা বেশ শক্ত কন্ঠে বললো,
-“আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে না। কেন বিয়ে করতে চান না সেটা বলুন।”

রুমেল পেছন দিকে ফিরে মেঘাকে দেখলো। মেয়েটার চোখে অসহায়ত্বের ছাপ অথচ কি দৃঢ় কন্ঠ। চোখ আসলেই মিথ্যা বলতে পারে না। রুমেল মেঘার চোখে তাকিয়েই বললো,
-“আমি কারো করুনার পাত্র হত…”

আর কিছু বলার আগেই মেঘা দৌড়ে এসে ঝাপ্টে ধরলো রুমেলকে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
-“আমি আপনাকে ভালোবাসি। ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি। এখানে করুনার কোনো স্থান নেই। দয়া করে আমাকে দূরে সরিয়ে দিবেন না । বড্ড বেশি ভালোবেসে ফেলেছি আপনাকে।”

রুমেলের চোখে অশ্রু ভীর করেছে। এমন ভালোবাসা পায়ে ঠেলে দিবে কিভাবে ও? সারাজীবন ভালোবাসা না পাওয়া ছেলেটা হঠাৎ এতো ভালোবাসার সাক্ষাৎ পেয়ে কেঁদে উঠলো। নিজেও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মেঘাকে।
দরজার বাইরে থেকে এই দৃশ্য দেখছিলো রুমঝুম আর রুশান। দু’জন কাউকে কিছু না বলে সরাসরি মেঘাকে নিয়ে চলে এসেছিলো এখানে। মেঘাকে ভেতরে পাঠিয়ে দুজন বাইরে দাঁড়িয়ে উঁকি মেরে দেখছিলো দুজনের কান্ড।

দু’জনকে একসাথে দেখে রুমঝুম আর রুশান চৌদ্দ পাটি দাঁত বের করে হেঁসে হাত মিলালো। আবার রুমেলের রুমে উঁকি মারতে যাবে তার আগেই কেউ একজন একহাতে রুমঝুমের কোমড় পেঁচিয়ে ধরে, অন্য হাতে রুমঝুমের মুখ চেপে ধরে দরজার পাশ থেকে সরিয়ে আনলো। রুশান রুমঝুমের হালকা গোঙানির আওয়াজ শুনে পাশে তাকিয়ে দেখলো শান রুমঝুমকে মুখ চেপে ধরে উঁচু করে রেখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। রুশান শুকনো ঢোক গিললো শানকে দেখে।

শান ভেতরে একনজর উঁকি মারলো। রুমেল আর মেঘার অবস্থা দেখে রুমঝুম আর রুশানের দিকে চোখ ছোট করে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললো,
-“এইসব দেখতেছো দুইজনে? লজ্জাশরমের মাথা খাইছো? চলো এখান থেকে।”
শান রুমঝুমের মুখ ছেড়ে দিলো। একহাতে রুমঝুমকে ঝুলিয়ে অন্য হাতে রুশানকে ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেলো রুমেলের রুমের সামনে থেকে।
কি বিচ্ছু দুইটা। বড় ভাইয়ের কেমিস্ট্রি দেখে লুকিয়ে লুকিয়ে।

মেঘা রুমেলকে ছেড়ে অন্য দিকে তাকালো।এখন তার লজ্জা লাগছে ভীষণ।। রুমঝুম কেন‌ লজ্জা পাচ্ছিলো সেদিন এখন তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে নিজেও। মেঘা মাথা নিচু করে তাকাতেই আঁতকে উঠলো। তার সুন্দর মেহেদী মাখা হাত দুটোর এ কি অবস্থা? পুরো হাতে লেপ্টে গেছে মেহেদী।

মেঘা কাঁদো কাঁদো হয়ে পেছন দিকে তাকালো। রুমেলের পুরো পাঞ্জাবীতে মেহেদী মাখামাখি হয়ে গেছে। মেঘা ফিক করে হেঁসে দিলো রুমেলের পাঞ্জাবি দেখে। রুমেল মেঘার হাঁসির কারন না বুঝে পাঞ্জাবির দিকে তাকালো। পাঞ্জাবির সামনে পিছনে মেহেদি মেখে পাঞ্জাবির কালারই চেন্জ হয়ে গেছে।
এই পাঞ্জাবি পরে এখন‌ মানুষের মধ্যে যাবে কিভাবে? রুমেল হতাশ দৃষ্টি মেলে মেঘার দিকে তাকালো। মেঘা তখনো হেঁসে চলেছে। মেঘার হাঁসিতে রুমেলের মনটা হালকা থেকে আরো হালকা হচ্ছে। তার সমস্ত কষ্ট ভুলিয়ে দিতেই যেন মেয়েটার আগমন। রুমেল মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে রইলো মেঘার হাঁসিমাখা মুখের দিকে।

-“রুমেল?”
প্রান্তর ডাকে রুমেলের ঘোর ভাঙলো। মেঘাও হাঁসি থামালো। দু’জনেই দরজার দিকে তাকিয়ে দেখলো প্রান্ত একটা প্যাকেট হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
প্রান্ত মাথা চুলকাতে চুলকাতে ভেতরে এসে বললো,
-“তোমার পাঞ্জাবিতে নাকি মেহেদী মাখামাখি হয়ে গেছে? তাই শান‌ এটা পাঠালো।”
মেঘা মাথা নিচু করে এক সাইড দিয়ে বেরিয়ে গেলো। এখানে থাকলে লজ্জায় পড়তে পারে।

রুমেল মেঘার যাওয়ার দিকে একবার তাকিয়ে প্রান্তকে বললো,
-“এই সময়ে পাঞ্জাবি কোথায় পেলে?”
-“শানের কাছে এক্সট্রা ছিলো এই পাঞ্জাবিটা।”
-“ওহ । কিন্তু আমার পাঞ্জাবিতে মেহেদি লেগেছে এটা শান কিভাবে জানলো?”
প্রান্ত ভাবুক ভঙ্গিতে বললো,
-“এটা তো‌ জানিনা। রুমঝুমকে উঁচু করে দোলাতে দোলাতে ছাদের দিকে নিয়ে গেলো আর আমাকে বললো তোমাকে এটা দিতে।”

রুমেল হেঁসে বললো,
-“দাও। ধন্যবাদ তোমাকে। আমার এটার খুব দরকার ছিলো।”
প্রান্ত হেঁসে পাঞ্জাবিটা দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।

প্রান্ত দোতলা থেকে নামার সময় দেখলো শিরীন ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে একদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আশেপাশের কোনো কিছুতেই নজর নেই তার। প্রান্ত পান্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে এদিকসেদিক তাকাতে তাকাতে শিরীনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো।
হালকা নিচু হয়ে বললো,
-“দেখার অনেক সময় বাকি। একদিনেই সব দেখে নিবা নাকি?”

শিরীন হকচকিয়ে আশেপাশে তাকালো। প্রান্ত তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে সে খেয়ালই করেনি। তার খেয়াল হতে হতে প্রান্ত মেইন ডোর ক্রস করে বেরিয়ে গেছে।
প্রান্তর বলা কথাটা নিজ মনে কয়েকবার আওড়ালো শিরীন। বেশ খানিকটা সময় লাগলো কথাটার অর্থ বুঝতে। যখন বুঝলো তখন খুশিতে লাফিয়ে উঠলো। তার বহু প্রতীক্ষিত ভালোবাসার নাগাল‌ পাবে ভেবেই খুশির জোয়ার বয়ে গেলো তার মনে।

-“আম্মুউউউ, আব্বুউউ,আপুউউ, প্রান্ত ভাইয়াআআ, তিহান ভাইয়াআআ, মেঘা আপুউউ, আন্টিইই, ভাবির আব্বুউউ তোমরা সবাই কোথায়?? তাড়াতাড়ি আসো।”

শান্তর চিল্লানিতে সবাই একে একে ড্রয়িং রুমে এলো। শাফিয়া আক্তার খুন্তি হাতে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন,
-“কি হইছে? চেঁচাচ্ছিস কেন?”
শান্ত সিঁড়ি বেয়ে নেমে হাঁপাচ্ছে। কিছুক্ষণ শ্বাস নিয়ে বললো,
-“তাড়াতাড়ি ছাদে চলো। ভাইয়া ভাবিকে তুলে নিয়ে ছাদে গেছে। মনে হয় ছাদ থেকে ফেলে দিবে।”

শাফিয়া আক্তার মুখ বেঁকিয়ে আবার রান্নাঘরে ঢুকে পড়লেন। বাকিরাও শান্তর দিকে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে চলে‌ গেলো। শিরীন যেতে যেতে বললো,
-“তোর মাথা ফেলবে ছাদ থেকে।”

সবাই চলে যাওয়ায় হতাশ হলো শান্ত। সে বুঝতে পারলো‌ কেউ তার ভাবিকে বাঁচাতে যাবে না। তাই নিজেই তার ভাবিকে বাঁচানোর জন্য আবার ছাদের দিকে দৌড় দিলো।
বহু কষ্টে ছাদে উঠে দেখলো রুমঝুম পিলারে হেলান দিয়ে বসে আছে। তার কোলে মাথা রেখে শান শুয়ে আছে। শান্ত কোমড়ে হাত দিয়ে এগিয়ে এলো তাদের দিকে। বেচারা ঠিকমতো নিঃশ্বাসও নিতে পারছে না। শান আড়চোখে শান্তর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“কি হয়েছে? হাপাচ্ছিস কেন?”

শান্ত এগিয়ে এসে ফ্লোরে ধপ করে বসে পড়লো। তারপর পেছন ঘুরে শানের পাশাপাশি রুমঝুমের কোলে মাথা রাখলো।
আকাশের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বললো,
-“তুমি না ভাবিকে ফেলে দেওয়ার জন্য এনেছিলে? ফেলোনি‌ কেনো?”

রুমঝুম ঠোঁট বাঁকিয়ে শান্তর দিকে তাকালো। বলে কি এই ছেলে? শান ঠোঁট কামড়ে হাঁসি আটকে বললো,
-“তা ফেলে দেইনি দেখে কি কষ্ট পাইছিস?”
-“কষ্ট পাইনি কিন্তু বাঁচানোর সুযোগও তো পেলাম না।”

শান হাহা করে হেসে উঠলো। শান্ত মাথাটা অন্য দিকে ঘুরিয়ে মুখ ফুলালো। রুমঝুম হালকা হেঁসে দু’জনের মাথায় হাত বুলাতে লাগলো।
এদের বয়সের ব্যবধান অনেক তবুও কতটা খুনসুটি ওদের মধ্যে। দেখলেই প্রান জুড়িয়ে যায়। রুমঝুম আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,’এরা যেন সারাজীবন এভাবেই একসাথে কাটাতে পারে। কোনো বাধা যেন না আসে ভাই-ভাই বন্ধনের মাঝে।’

রাত আটটার মধ্যে বিয়ে হয়ে গেলো রুমেল আর মেঘার। অল্প কিছু লোক এসেছে বিয়েতে তবুও জাঁকজমক ভাব বাড়িতে। সকলেই প্রান ভরে দোয়া করেছে রুমেল-মেঘাকে। মেঘার মুখে একটা মিষ্টি হাঁসি লেগে আছে।
রুমঝুম মেঘার দিকে এগিয়ে এলো। মেঘার হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বললো,
-“আমার ভাইটার দায়িত্ব আজ থেকে তোর মেঘা। বাকি দশ জনের মতো আমার ভাই তোর দায়িত্ব নিতে পারবে না এখনি। আপাতত তুই তার দায়িত্ব নে। একসময় আমার ভাই তোকে সবটা সুদে-আসলে ফিরিয়ে দিবে দেখিস।”
রুমঝুমের কথার বিপরীতে মেঘা মুচকি হাসলো শুধু।

রুমেলের অসুস্থতার কথা মাথায় রেখে রাত এগারোটার মধ্যেই সবকিছু শেষ করে রুমেল আর মেঘাকে বাসর ঘরে রেখে বাকিরা চলে এলো।‌ মাহেরা খাতুন একবার অশ্রুসিক্ত চোখে মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। দোয়া করলেন তার মেয়ের সুখের জন্য।

সবাই চলে যাওয়ার পর রুমেল আর মেঘা দু’জনই ফ্রেশ হয়ে কাপড় বদলে ফেললো। একসাথে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে নিলো। রুমেল জায়নামাজ গুছিয়ে রাখতে রাখতে বললো,
-“ঘুমুবে এখন? খারাপ লাগছে বেশি?”
মেঘা আড়চোখে তাকালো রুমেলের দিকে। স্নিগ্ধতায় ঘেরা এই যুবকটি তার স্বামী।
মেঘা মুচকি হেসে বললো,
-“না। একটু পরে ঘুমাবো। চলুন একটু বেলকনিতে বসি।”
.
রুমেলের বুকে হেলে বসে আছে মেঘা। আকাশে অর্ধচন্দ্র বিরাজমান।রুমেলের হাত মেঘার চুলের ভাঁজে ভাঁজে ঘুরছে। দু’জনেই চুপচাপ নিরবতা উপভোগ করছে।

রুমেল হঠাৎই হাঁসফাঁস শুরু করলো। মেঘা রুমেলের কোলেই ঘুমিয়ে পড়েছিলো।রুমেলের হাঁসফাঁসে ধরফরিয়ে উঠে বসলো সে। রুমেলের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“কি হয়েছে? কষ্ট হচ্ছে আপনার?”
-“পানি খাবো।”
মেঘা রুমেলকে উঠিয়ে রুমে নিয়ে এলো। রুমেলকে বিছানায় বসিয়ে জগ থেকে পানি এনে রুমেলের মুখের সামনে ধরলো। রুমেল রক্তচক্ষু মেলে মেঘার দিকে তাকিয়ে গ্লাস ছুড়ে ফেলে দিলো। মেঘা কেঁপে উঠলো। রুমেল উত্তেজিত হয়ে পড়েছে।এদিক ওদিক তাকিয়ে বিরবির করছে। চুল টানছে নিজের।

মেঙা দৌড়ে গিয়ে ঘুমের ইনজেকশন রেডি করলো। ডান হাতে ইনজেকশন নিয়ে ধীরে ধীরে রুমেলের কাছে এসে দাঁড়ালো। বিছানায় বসা রুমেলকে সর্বশক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরে ইনজেকশন পুশ করে দিলো। ততক্ষণে রুমেল মেঘার পিঠ,হাত আর ঘাড়ে ইচ্ছা মতো খামচে দিয়েছে। মেঘা অস্ফুট আর্তনাদ করে সরে এলো। রুমেল আরো বেশি ভায়োলেন্ট হয়ে পড়লো‌ কিন্তু ইনজেকশনের প্রভাবে বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারলো না। ধীরে ধীরে লুটিয়ে পড়লো বিছানায়। মেঘা দু’পা পিছিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো। সিরিঞ্জটা বেলকনির দিকে ছুড়ে মারলো।

মেঘার কষ্ট হলো ভীষণ। বুক ফেটে কান্নারা উপচে পড়তে চাইলো। যে রাতে মেয়েরা স্বামীকে একান্ত ভাবে কাছে চায় সে রাতে সে স্বামীর থেকে আঘাত পেলো। ক্ষতস্থানগুলো চেপে ধরে মেঘা ডুকরে কেঁদে উঠলো। এই নিয়তিকে সে নিজেই আমন্ত্রণ জানিয়েছে। তাকে ভেঙে পড়লে চলবে না। নিজের সবটুকু চেষ্টা দিয়ে সে রুমেলকে পরিপূর্ণ সুস্থ করবে। করবেই।

চলবে….

(ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

চন্দ্ররঙা প্রেম পর্ব-২২

0

#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্বঃ২২
#আর্শিয়া_সেহের

রাত নয়টা বাজে। মেঝেতে পড়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করছে আরমান। টানা দু ঘন্টা নিজ হাতে ওকে পিটিয়েছে রুশান। পিটিয়ে মেঝেতে ফেলে রাখার ঘন্টাখানেক পর আরমানের পুরো শরীর ফুলে উঠেছিলো।

রুশানের অসুস্থ শরীরে এতটা দম দেখে তাকে বাহবা দিলো রাফিন। বড় হয়ে পুলিশ বা গোয়েন্দা সংস্থাতে যোগদানের জন্য বললো রুশানকে। গোয়েন্দাগিরিতে রুশানের ঝোঁক আছে তাই তার ও প্রপোজালটা‌ খারাপ মনে হলো না। তবে এখনি এসব নিয়ে ভাবতে চায় না সে।

রুমেল চেয়ারে বসে পুরোটা সময় হেঁসেছে। শেষ সময়ে শান রুমেলের কাছে এসে কিছু একটা বললো।‌ রুমেল চেয়ার ছেড়ে উঠে বাম সাইডের একটা রুমে গেলো। ওই রুমেই রুমেলকে রাখতো আরমান। সেখান থেকে সেই ছুরিটা আনলো যেটা আরমান ওকে নিজের শরীর ক্ষতবিক্ষত করতে দিতো।

রুমেল ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো আরমানের দিকে। একহাতে ওর মুখ উঁচু করে ধরে বললো,
-“আমি আমার বোনকে পেয়েছি‌ । আর আটকে রাখতে পারলি না তো আমায়।”
আরমানের কিছু বলার শক্তি নেই। তবুও মুখ খোলার চেষ্টা করলো।‌ কিন্তু কিছু বলার আগেই শান বাতাসের গতিতে এসে রুমেলের হাত থেকে ছোঁ মেরে ছুরিটা নিয়ে পরপর দুইটা টান দিলো আরমানের ঠোঁট থেকে থুতনি পর্যন্ত। ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো।
শান ছুরিটা আবার রুমেলের হাতে দিয়ে দিলো।
আরমানের দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে বললো,
-“এই আঘাতটা আমার চন্দ্রকন্যার ঠোঁট থেকে রক্ত বের করার জন্য তোর পাওনা ছিলো । ওর শরীরে একটা ফুলের টোকাও আমি সহ্য করতে পারি না বুঝেছিস?”

রুমেল অবাক চোখে চেয়ে রইলো শানের দিকে।
রাফিন বেশ অবাক হলো শানের এমন রুপ দেখে। শান্তশিষ্ট ছেলের মধ্যেও এতো ক্ষমতা চলে আসে ভালোবাসার জোরে? প্রান্ত খুব একটা অবাক হলো না। রুমঝুম আসার পর শানের পাল্টে যাওয়াটা সবার চোখেই কমবেশি পড়েছে। মেয়েটাকে আগলে রাখতেই ছেলেটা বদলেছে।

রুশান একটু দূরে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। আরমানকে পিটিয়ে ভীষণ ক্লান্ত সে। ক্লান্তি মাখা উজ্জ্বল শ্যামলা মুখে শানের দিকে চেয়ে কৃতজ্ঞতাপূর্ন হাঁসি হাঁসলো সে। তার বোনের নিরাপদ আশ্রয় একমাত্রই শান। এই ছেলেটার কাছে তারা আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে।

শান রুমেলকে রেখে সরে এলো আরমানের সামনে থেকে। আরমান মেঝেতে পড়ে গোঙাচ্ছে। রুমেল শানের দিকে একবার তাকিয়ে আবার আরমানের দিকে তাকালো। ওর স্মৃতিতে এসে ভর করলো আট-নয় বছর আগের সেই ভয়াবহ দিনগুলো। চোখ বন্ধ করে একটা শ্বাস নিলো রুমেল। এরপর চোখ মেলে আরমানের দিকে তাকালো। একে একে কেটে দিলো হাত ও পায়ের শিরা গুলো।‌ রক্তে ভেসে যাচ্ছে ফ্লোর। আরমান এখনো জীবিত তবে নিস্তেজ।

রুমেল, প্রান্ত আর শান মিলে এই গোডাউনের একটি ঘরে বড় এক কাঠের বাক্সের মধ্যে আটকে রাখলো আরমানকে। বাইরে থেকে তালাবন্ধ করে দিলো বাক্সটা। তারপর তালাবদ্ধ করলো রুমটা।
তারা জানেনা এখানে কতদিন বা কতবছর মানুষের আনাগোনা হবে না। তবে যতদিনে এখানে লোকালয় হবে ততদিনে আরমানের দেহটা একটা শুকনো কঙ্কালে পরিনত হয়ে যাবে।
সবাই গোডাউন থেকে বেরিয়ে সেটাকে আগের মতোই তালাবন্ধ করে দিলো। তারপর রওনা দিলো যশোরের উদ্দেশ্যে। শান বাড়ির সবাইকে বলেছিলো পুলিশের ঝামেলা শেষ করার জন্য থানায় যাচ্ছে রুমেল আর রুশানকে নিয়ে। সেখান থেকে সরাসরি যশোর পৌঁছে যাবে ওদের নিয়ে। বাকিরাও তাই নিজেদের মতো করে যশোরের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিলো।

মেহেদী আর তিহান সবাইকে নিয়ে যশোর পৌঁছেছে রাত আটটার মধ্যেই। শান,রাফিন,প্রান্ত,রুশান,রুমেল পৌঁছেছে দশটার দিকে। রাফিনকে অনেকটা জোর করেই এনেছে শান। ছেলেটা অনেক সাহায্য করেছে ওকে।
রেজাউল সাহেব সবাইকে নিয়ে সাড়ে দশটা নাগাদ বাড়িতে পৌছালেন।

গাড়ি থেকে নেমে রুমঝুম আর রুশান দৌড় দিলো । কে আগে কলিং বেল চাপ দিতে পারে?
রুমেল পেছন থেকে উচ্চ স্বরে বললো,
-“আরে দৌড়াচ্ছিস কেন,দুজন? আস্তে যা। পড়ে যাবি তো।”

শান সহ বাকি সবাই ওদের তিনজনের দিকে তাকালো। কি মধুর সম্পর্ক।শান ভাবলো, তারা তিনজনও তো এভাবে হেঁসে খেলে বড় হয়েছে।‌ কিন্তু এরা তিনজন? কষ্টে জর্জরিত এক অতীত পার করে এসেছে।

রেজাউল সাহেব শানের কাঁধে হাত রাখলো। শান মাথা ঘুরিয়ে তাকালো তার দিকে। রেজাউল সাহেব শানের সামনে দুহাত জোড় করে মাথা নিচু করে ফেললো। কাঁপা গলায় বললো,
-“তোমাকে অনেক ধন্যবাদ বাবা। আমাকে আরেকবার আমার ছেলেমেয়েদের কে পাইয়ে দেওয়ার জন্য আমি চির কৃতজ্ঞ থাকবো।”

শান মুখ ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বললো,
-“বুঝেছি তো। আমাকে ছেলে মনে করেন না। করলে এভাবে বলতে পারতেন না।”

রেজাউল সাহেব হেঁসে ফেললেন। এই ছেলেটা ভীষণ ভালো। কত সুন্দর ম্যাজিক করে তার ভাঙা সংসারটা জুড়ে দিলো। তার শূন্য সংসার ভরিয়ে দিলো। তার প্রাণহীন সংসারটাতে প্রান এনে দিলো।এই ছেলের কাছে সারাজীবন ঋণী হয়ে থাকবে সে।

রুশান আগে দরজার কাছে পৌঁছালেও সে রুমঝুমকে কলিং বেল চাপতে দিলো। রুমঝুম হেঁসে কলিং বেল বাজালো। মিনিট খানেকের মধ্যেই কাজের মেয়েটি এসে দরজা খুললো। একজন একজন করে সকলেই ভেতরে ঢুকলো। রুমেল,শান‌,মেঘা আর রাফিন এখনো বাইরে দাঁড়ানো।‌ রুমেল একদৃষ্টিতে বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। কত বছর আগে এই বাড়িটি দেখেছিলো। তার শৈশব, কৈশোর কেটেছে এবাড়িতে। বাড়িটির তার মায়ের পছন্দে করা হয়েছিলো।‌ ঠিক তেমন ভাবেই আজও দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটি।

শান মেঘাকে ইশারা করে রাফিনকে নিয়ে ভেতরে চলে গেলো। মেঘা রুমেলের ডান বাহুতে হাত রাখলো।রুমেল বাড়ি থেকে চোখ ফিরিয়ে মেঘার দিকে তাকালো। তাদের বিয়ের ব্যাপারে রুমেল এখনো কিছু জানে না। তবে রুমেলের মনে মেঘার জন্য একটা সফট কর্নার আগে থেকেই তৈরি হয়েছে।

প্রথম দিন থেকেই মেয়েটা তার খুব যত্ন নিয়েছে। অপরিচিত একটা মানুষকে এভাবে যত্ন‌ করা যায় তা মেঘাকে না দেখলে বোঝা যেতো না।‌ সময় মতো খাওয়ানো, শরীর মুছে দেওয়া, উত্তেজিত হয়ে পড়লে ডাক্তার ডাকা এগুলো বেশিরভাগই মেঘা করেছে।
রুমঝুম রুশানকে দেখাশোনা করতো আর মেঘা রুমেলকে।

মেঘার ডাকে হুঁশ এলো রুমেলের। মেঘা রুমেলের হাতে হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে বললো,
-“ভেতরে চলুন। অনেক রাত হয়েছে। আর কতক্ষণ দাঁড়াবেন?”
রুমেল নিজেকে সামলে বললো,
-“হ্যাঁ হ্যাঁ চলুন।”
বলেই হনহন করে ভেতরে ঢুকে পড়লো রুমেল। মেঘা ঠোঁট বাঁকিয়ে রুমেলের পিছু পিছু নিজেও বাড়িতে ঢুকে পড়লো।

বাড়িতে ঢুকে বিশ্রী গন্ধ নাকে আসলো সবার। শাফিয়া আক্তার নাক ঢেকে ফেললেন। শান সিঁড়ি অবধি হেঁটে গিয়ে বললো,
-“গন্ধ উপর থেকে আসছে বোধহয়। সিঁড়ির দিকে এগুলে গন্ধ তীব্র হচ্ছে।”

রাফিন, শান,তিহান, প্রান্ত আর রুশান উপরে গেলো। রাফিন রুশানের মায়ের রুমটা দেখিয়ে বললো,
-“ওই ঘরটা কার?”
রুশান ভাবলেশহীন ভাবে বললো,
-“আমার মায়ের।”

রাফিন শানের দিকে তাকালো। গলার স্বর নিচু করে বললো,
-“এটা লাশ পঁচা গন্ধ শান। লাশের মৃত্যু তিন থেকে চারদিন আগেই হয়েছে।”
রুশানের বুক ধক করে উঠলো। যতই ঘৃনা করুক, মা তো। মায়ের জন্য কোথাও না কোথাও একটুখানি ভালোবাসা থেকেই যায়। তবুও নিজেকে সামলানোর ব্যার্থ চেষ্টা করলো রুশান। বাকিরা এটুকু ছেলের সহ্য শক্তি দেখে অবাক হয়ে গেলো। কি সুনিপুণ ভাবে চোখের পানি লুকাচ্ছে।

শান আর তিহান নিচে এসে সবাইকে গন্ধের উৎসের ব্যাপারে বললো। একের পর এক বিপদে সবাই ক্লান্ত এখন। রেজাউল সাহেবের কোনো ভাবান্তর নেই। রুমঝুম ঘাড় ঘুরিয়ে রুমেলকে দেখলো। রুমেলের ঠোঁটে হাঁসি ঝুলে আছে। তার সাথে করা সকল অন্যায়ের শাস্তি পাচ্ছে আজ অপরাধীরা। নিঃসন্দেহে এটি তার জীবনের একটি শ্রেষ্ঠ দিন।

প্রান্ত রুশানের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। রাফিন পুলিশে খবর দিয়েছে। তারা এসেই দরজা ভেঙে লাশ নামাবে। পুরো বাড়িতে নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। বাতাসে ভাসছে লাশ পঁচা গন্ধ।

মিনিট বিশেকের মাথায় পুলিশ এলেন। আশেপাশের প্রতিবেশীরাও জমা হলেন বাড়িতে। শাফিয়া আক্তার শান্ত, শিরীন, মেঘা আর রুমেল কে গেস্ট রুমে দরজা আটকে থাকতে বললেন। লাশের কি অবস্থা সেটা কেউ জানেনা । বাচ্চারা দেখলে ভয় পেয়ে যেতে পারে।

রুশান দোতলায় তাহমিনা বেগমের দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে। শেষ কয়েকটা দিনে তাহমিনা বেগম অপরাধবোধে ভুগতো। তবে‌ ততদিনে তিনি সবই হারিয়ে ফেলেছেন।

কয়েকজন পুলিশ ড্রয়িং রুমে বসে রেজাউল সাহেবকে প্রশ্ন করছে। শান রেজাউল সাহেবের পাশে দাঁড়িয়ে অধিকাংশ উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। রাফিন,তিহান, প্রান্ত, শানের বাবা,রুশান সহ কয়েকজন তাহমিনা বেগমের দরজা ভাঙছে। রুমঝুম নীচে থেকে পলকহীন চোখে চেয়ে আছে সেদিকে।

দরজা ভাঙার সাথে সাথেই বিশ্রী দূর্গন্ধ বেরিয়ে এলো বাইরে। তিহান মুখ চেপে সাইডে গিয়ে বমি করে দিলো। প্রান্তও মুখ পেট চেপে ধরে সরে দাঁড়ালো। সবারই অবস্থা শোচনীয় হয়ে দাঁড়ালো এই দূর্গন্ধে। তবে রুশানের ভঙ্গি তেমন নির্বিকারই আছে। সে ধীরে ধীরে পা ফেলে ঢুকে পড়লো তার মায়ের রুমে। রাফিন বহুকষ্টে নিজেকে সামলে রুশানের পিছু পিছু ঢুকলো। বাকিরাও নাক টিপে ভেতরে এলো।

পুরো রুম অন্ধকারে ছেয়ে আছে। রুশান হাতড়ে গিয়ে লাইট অন করলো। সাথে সাথেই একজন পুলিশ চিৎকার করে উঠলো। চোখ ফিরিয়ে নিলো প্রত্যেকেই।

শান দৌড়ে উপরে চলে এলো। দরজা থেকেই কেঁপে উঠলো সে। তাহমিনা বেগম ফ্লোরে পড়ে আছেন। চোখের কোটর ফাঁকা। ইঁদুরে বোধহয় চোখ খেয়ে নিয়েছে। পুরো শরীরেও একটু একটু করে খেয়ে গেছে । কালশীটে হয়ে গেছে পুরো শরীর। ঠোঁটের আশেপাশেও খেয়ে গেছে খানিকটা।

ভয়াবহ অবস্থা লাশের। শান নিজেকে শক্ত করলো রুশানের জন্য। রুশান তার মায়ের পাশে হাঁটু গেড়ে বসলো। আলতো করে ছুঁয়ে দিলো পুরো মুখ।
হুট করেই আবার দাঁড়িয়ে পড়লো। রুম থেকে বের হয়ে যেতে যেতে বললো,
-“উনার লাশ নিয়ে যান। যা করার করুন। এই বাড়িতে যেন আর না আসে এই লাশ। এমন মহিলার কবরে মাটিও দিতে চাই না আমরা।”

কথাটা বলেই দেরি না করে বেরিয়ে গেলো রুশান। নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিলো।
পুলিশ লাশ ঢেকে দিয়ে পুরো ঘরে তল্লাশি করলেন। তাহমিনা বেগম স্পষ্ট ভাবে লিখে গেছেন, তার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। সেই লেখার পাশেই রয়েছে একটি চার ভাজের খোলা চিঠি।

রাফিন গিয়ে চিঠিটি হাতে নিলো। চিঠি হাতে নিয়ে লাশ সহ ড্রয়িং রুমে নেমে এলো। রেজাউল সাহেব হাতের ইশারায় লাশ নামাতে বারন করলেন। অগত্যা লাশ নিয়ে বাইরে দাড় করানো অ্যাম্বুলেন্স রাখলেন ।

পরিবারের সদস্য বাদে উপস্থিত সকলেই অবাক হলেন। একটা মানুষ ঠিক কতটা ঘৃন্য হলে আপনজনেরা তার লাশটি অবধি দেখে না। এমন মানুষের পৃথিবীতে জন্মে লাভ কি? কি পেয়েছে জীবনে মানুষের ঘৃনা ছাড়া? টাকাগুলো আজ কোন কাজে লাগছে?

রাফিন সকলের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে বললো,
-” উনি একটি চিঠি লিখে গেছেন। বেনামি চিঠি। চিঠিটা গত চারদিন আগের রাতে লেখা। আমি পড়ছি। আপনারা শুনুন।”
সকলে অনিচ্ছা সত্ত্বেও শোনার চেষ্টা করলো।

“এই চিঠি যখন পাবে তখন আমি এ দুনিয়ায় থাকবো না। এই জীবনে অনেক পাপ করেছি আমি। জানি আমি ক্ষমার যোগ্য নই। ভেবেছিলাম নিজ হাতে আরমানকে খুন করবো। কিন্তু তার আগেই ও আমার ছেলেটাকে মেরে ফেললো। আমাকে ফোন করে আমার ছেলের মৃত্যু সংবাদ দিয়ে পৈশাচিক হাঁসি হাঁসছিলো সে। নিজের ছেলের মৃত্যু সংবাদ মেনে নিতে পারিনি। মনে হচ্ছিলো সবকিছু শেষ করে দেই। হঠাৎ ভাবলাম, আমার ছেলে মরে গেছে তাহলে আমার সতীনের মেয়ে শান্তি পাবে কেন? ওর জন্যই তো মরলো আমার ছেলে।
আমি সেই রাতে নিজেই আরমানকে বাড়ির ভিতরে আসতে দিয়েছিলাম। আমি কতটা নোংরা মস্তিষ্কের ভাবতে পারছো? নিজ ছেলের খুনির সাথে কাজ করেছি শুধুমাত্র রুমঝুমের সুখ শেষ করার জন্য।রুমঝুমকে আরমান ছাদ থেকে নিয়ে যাওয়ার পর রুমে এসে দরজা বন্ধ করে ভাবতে থাকি আমি কি করলাম?
ওই সময়ে আমার টনক নড়লো। আমি কি জঘন্য কাজ করলাম আবারও। ঘৃনা হতে লাগলো নিজের উপর। মেয়েটা ভাইয়ের হারানোর কথা শুনে তাকে খুঁজতে এখানে এসেছে আর আমি তারই সর্বনাশ করলাম। শান ছেলেটা নিঃস্বার্থে আমার ছেলেকে খোঁজার কত প্রচেষ্টা চালাচ্ছে আর আমি তার ভালোবাসাকে এভাবে শত্রুর হাতে তুলে দিলাম?
নিজের প্রতি প্রচন্ড ঘৃনা হচ্ছে আমার। আমি জানি শান ঠিকই রুমঝুমকে পাবে। ছেলেটার চোখে অগাধ ভালোবাসা দেখেছি মেয়েটার জন্য। ওরা আবারও এক হবে,ভালো থাকবে। কিন্তু আমি আর এই মুখ কাউকে দেখাতে পারবো না। তাই চলে যাচ্ছি পৃথিবী থেকে। নিজ হাতেই একটা কীটকে খুন করছি আমি।

জানি ক্ষমা করা সম্ভব না, তবুও ক্ষমা করার চেষ্টা করো আমাকে। রুমঝুম,আমাকে মাফ করিস তুই।”

রাফিন চিঠি পড়া শেষ করলো। একজন মানুষের মৃত্যুতে কেউ কষ্ট পেলো না এরকমটা সে আর কখনো দেখেনি। রুমঝুমের আগে কষ্ট হলেও এখন বিন্দুমাত্র কষ্ট হচ্ছে না। সে ভাবলেশহীন ভাবে হেঁটে রুমেলের কাছে গেস্ট রুমে চলে গেলো। রুশানও নিজের রুম থেকে বেরিয়ে গেস্ট রুমে ঢুকলো।
প্রতিবেশীরা নানা ধরনের কথা বলতে বলতে চলে গেলো। আত্মীয়-স্বজন তেমন‌ কেউ আসেনি। তাহমিনা বেগম কারোরই প্রিয় পাত্রী হতে পারেন নি।
একটা মৃত্যু হয়েছে অথচ কোথাও কোনো শোকের ছায়া নেই। এমনও বুঝি মৃত্যু হয়?

চলবে……..

(গল্প শেষের পথে। ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

চন্দ্ররঙা প্রেম পর্ব-২১

0

#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্বঃ২১
#আর্শিয়া_সেহের

প্রায় তিনদিন হয়ে গেছে সেদিনের পর। রুশান এখন অনেকটা সুস্থ হয়ে গেছে। রুমেলও আগের মতো মাথা নিচু করে থাকে না। সবার দিকে তাকায়,সবার কথা শোনে। সে হাঁসতে চায়। কিন্তু পারে না। কতদিন হয়ে গেছে হাঁসির সাথে তার সাক্ষাৎ নেই।
তবে রুমেল কথা বলে না। গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হয় না। এটা নিয়ে অবশ্য কেউ এখনো তাকে জোর করেনি। ডাক্তার বলেছে সে ধীরে ধীরে একটু স্বাভাবিক হওয়ার পর কথা বলবে।

রুমঝুমের বাবাকে সেদিন রাতেই শান সবটা বলেছিলো। রেজাউল সাহেব হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন সবটা শুনে। যাকে একটা পরিবার সাজানোর জন্য এনেছিলেন সেই তার অগোচরে তার পরিবার ভেঙে খানখান করে দিয়েছিলো।
শান রেজাউল সাহেবকে রুমেলের আশেপাশে বেশি‌ বেশি‌ আনে। রুমেল প্রথম কয়েকবার চোখ ফিরিয়ে নিতো। তবে রেজাউল সাহেবের আলিঙ্গন ধীরে ধীরে তার সাথে রুমেলকে কিছুটা স্বাভাবিক করেছে।

এই তিনদিনে কেউই রুমঝুমদের বাড়িতে যায়নি। শানের পরিবার আর মেহেদীর পরিবারও দু’দিন আগেই চলে এসেছে। সবাই এখন রাফিনের বাড়িতে আছে। তাহমিনা বেগমের খোঁজও আর কেউ করেনি। কাজের মেয়েটা বার কয়েক ফোন করে বলেছে যে তাহমিনা বেগম রুম থেকে বের হয়নি সেদিনের পর। তার রুম থেকে নাকি উদ্ভট গন্ধ বের হয়।
রেজাউল সাহেব কাজের মেয়েকে একবাক্যে বলে দিয়েছেন,
-“ও ঘরের আশেপাশে যাবি না। ও যা খুশি করুক।”

আজ তিনদিন পর দুই ছেলে, এক মেয়ে আর মেয়ে জামাইকে নিয়ে বাড়ি ফেরার বন্দোবস্ত করছেন রেজাউল সাহেব। শান তার ছেলের চেয়ে অধিক প্রিয় হয়ে উঠেছে এই কয়দিনে। নিঃস্বার্থভাবে কত কি করছে তাদের জন্য।

ডাক্তার এসে রেজাউল সাহেবকে ডাকলেন।শানও গেল রেজাউল সাহেবের পিছু পিছু। মেঘা ,রুমঝুম,সিন্থিয়া আর মাহেরা খাতুন রুমেলের কেবিনে বসে আছে।‌ শাফিয়া আক্তার শিরীনকে নিয়ে রাফিনের বাড়িতে গিয়েছেন ওদের সবার জন্য খাবার রান্না করার উদ্দেশ্যে। শাফিয়া আক্তার রুমেল আর রুশানকে খুব পছন্দ করে ফেলেছেন। শুধু তিনি নয়, প্রত্যেকটা মানুষই ওদের দুই ভাইকে খুব ভালোবেসে ফেলেছে এই তিনদিনে। এমন সোনার টুকরো ছেলে ক’জনার হয় ? যারা এদের কদর করতে পারেনি তারা মহাবোকা।

-“আপনার ছেলে মানে রুমেলকে আপনি বাড়ি নিতে চাচ্ছেন একা ঠিক আছে তবে তার উন্নতির ব্যাপারটাতে আপনাকে সতর্ক হতে হবে। গত তিনদিনে আপনি তার অবস্থা দেখেছেন। তাকে যখন তখন ড্রাগস দেওয়া হতো তাই সে প্রায় সময় পাগলামি করে। এটা থেকে রিকভারি করতে বেশ সময় লাগবে ।”

ডাক্তারের কথায় রেজাউল সাহেব কিছুটা চিন্তিত হলেন। শানও ভাবনায় পরে গেলো।
রেজাউল সাহেব বললেন,
-“আপনি আসলে কি বলতে চাইছেন? বুঝিয়ে বলুন তো ।”

ডাক্তার এবার ঝেড়ে কাঁশলেন। বললেন,
-“দেখুন আপনার ছেলের অবস্থা তো দেখেছেনই। তার এখন সার্বক্ষণিক একটা সঙ্গী প্রয়োজন। এক্ষেত্রে একজন মা ই সবথেকে বেশি ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়। কিন্তু আপনাদের থেকে সবটা শোনার পর বুঝলাম রুমেলের ক্ষেত্রে এই মানুষটি সঠিক না। তো সেকেন্ড..”

-“আপনি কি কোনোভাবে রুমেলকে বিয়ে করানোর কথা বলতে চাচ্ছেন?”
ডাক্তারের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে শান প্রশ্ন ছুড়লো ডাক্তারের দিকে।

মধ্যবয়স্ক ডাক্তারটি মাথা দোলালেন। মানে তিনি এটাই বলতে চেয়েছেন। শান ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব? রুমেলকে এই অবস্থায় কোন মেয়ে বিয়ে করবে? কেউ জেনেশুনে তো নিজের ক্ষতি করতে চাইবে না।”

রেজাউল সাহেব অনেকক্ষণ ভাবলেন। তারপর ডাক্তারের দিকে তাকিয়ে বললেন,
-“একজন ভালো সেবিকা কি আমার ছেলেকে ঠিক করতে পারবে না? যত টাকা প্রয়োজন আমি তাকে দিবো।”

ডাক্তারটি হতাশ হয়ে বললেন,
-“টাকা দিয়ে এটা আপনি করতেই পারবেন তবে আপনার ছেলের সুস্থতার নিশ্চয়তা আমি দিতে পারবো না। একজন মা আর একজন স্ত্রী অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে অসুস্থ ছেলে বা স্বামীর সেবা করে। সেই সেবার সাথে দুনিয়ার কোনো সেবাকেই তুলনা করা যায় না।”

শানের হঠাৎ মেঘার কথা মনে হলো। ও যদি ভুল না হয় তাহলে মেঘা রুমেলের প্রতি দূর্বল।আর এটা সে শতভাগ নিশ্চিত। এই ব্যাপারে মেঘার সাথে কথা বলা প্রয়োজন।
রেজাউল সাহেব চিন্তিত মুখে ডাক্তারের কেবিন থেকে বের হলেন। শান উনির পিছু পিছু বের হচ্ছিল তখনই প্রান্তর কল এলো। শান এক সাইডে গিয়ে কল রিসিভ করলো।

-“এই ব্যাটারে আর বাঁচায় রাখা সম্ভব না। যা করবি জলদি কর। এরে নিজের টাকায় খাবার গেলাইতেও আমার অসহ্য লাগে বাল।”

প্রান্তের কথায় শান হাঁসলো। বললো,
-“আর কিছুক্ষণ বাঁচায় রাখ। আজ বিকেলেই ওর জারিজুরি শেষ করে দিবো।”

প্রান্ত একটা বড়সড় হাই তুলে বললো,
-“আচ্ছা। জলদি আসিস। শালা এটার জন্য আমি আমার জানেমান টারেও একটু দেখতে পারতেছি না।”
-“চুপ কর বেয়াদব। তোর জানেমান পালাচ্ছে না। তুই ভালো করে ওইটারে পাহাড়া দে।”

প্রান্ত ব্যাঙ্গ করে হেঁসে বললো,
-“তোর দায়িত্বে রেখেছি তো এজন্যই যাতে পালাতে না পারে।”
-“এ তোর ফালতু প্যাঁচাল সাইডে রাখ। আমি সন্ধ্যার আগে চলে আসবো। এখন রাখতেছি।”
-“ওকে বস।”

শান ফোন কেটে রুমেলের কেবিনের দিকে এগিয়ে গেলো। মেহেদী আর তিহান খাবার নিয়ে এসে গেছে।
রুমেল ঘুমিয়ে আছে। রুমেলের পাশে রুশানের জন্যও বেড দেওয়া হয়েছে। গতকাল থেকে সে ভাইয়ের পাশেই থাকে। রুশান বেডে বসে রুমেলের দিকে তাকিয়ে আছে।
পাশে সবাই চিন্তিত মুখে দাঁড়িয়ে আছে। রেজাউল সাহেব রুমেলের বেডে মাথা নিচু করে বসে আছেন।রুমঝুম আর সিন্থিয়া মাহেরা খাতুনের বসে থাকা চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মেঘা দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শান বুঝতে পারলো রেজাউল সাহেব সবটা বলেছেন এখানে এসে। তাই সবাই নিরবতা পালন করছে।

নিরবতা ভেঙে মেঘাই প্রথম কথা বললো। নতমুখে ধীর কন্ঠে বললো,
-“তোমাদের আপত্তি না থাকলে আমি রুমেলকে বিয়ে করতে চাই। তাকে সুস্থ করার দায়িত্ব নিতে চাই।”

মাহেরা খাতুন চকিতে মাথা তুলে তাকালেন। পাগল হয়ে গেলো নাকি মেয়ে? মেহেদীও বোনের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
-“বিয়ে ছেলে খেলা না ,মেঘা। তাছাড়া রুমেল অসুস্থ। এমন ছেলের সাথে তোকে জড়িয়ে দেওয়ার কথা ভাবতেই পারি না আমরা।”
-“আমি যদি তার সাথে থাকতে পারি তবে তোমাদের কেন আপত্তি,ভাইয়া?”
-“চুপ কর তুই। নিজের ভালো মন্দ বোঝার মতো বয়স এখনো তোর হয়নি।”

রেজাউল সাহেব সহ বাকি সবাই কাঠের পুতুলের মতো বসে আছে। মেঘার এমন ডিসাশনে শান ব্যাতীত সবাই কিছুটা চমকেছে। তবে মেহেদী নিজের জায়গায় ঠিক। জেনেশুনে বোনকে কেউ এমন একটা ছেলের হাতে তুলে দিবে না।

শান বুকে হাত গুঁজে এগিয়ে এলো মেঘার দিকে। মেঘার সামনে দাঁড়িয়ে বললো,
-“তুমি ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত নিয়েছো?”
মেঘা নতমুখেই বললো,
-“হ্যাঁ ভাইয়া। এই ছেলেটার এতো কষ্ট আমার সহ্য হয় না।‌ ওর কিছু কষ্ট কমাতে পারলে আমারই ভালো লাগবে।”

মেহেদী গর্জে উঠে বললো,
-“কারো কষ্ট কমানোর দায়ভার নিতে বলেনি কেউ তোকে। এতো মানবসেবার প্রয়োজন নেই।”
মাহেরা খাতুন চুপচাপ শুনছেন। সে মেয়ের মতামতকে ছুড়ে ফেলতে পারছে না আবার একটা অনিশ্চয়তায় ও ভুগছেন।

শান মেহেদীর কাছে গিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখলো। শান্ত কন্ঠে বললো,
-“রিল্যাক্স ভাইয়া। আপনাকে আমরা সম্মান করি। আপনি যেটা বলছেন একজন ভাই হিসেবে যে কোনো ছেলে সেটা বলবে আমি জানি। আজ আমার বোন মেঘার জায়গায় থাকলে আমিও বলতাম। কিন্তু মেঘার দিকটা ভাবুন একবার। ও কেন এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে? শুধুমাত্র মায়ায় পড়ে বা তার সেবা করার জন্য না বরং তাকে ভালোবেসে। মেঘা প্রথম দিন থেকেই রুমেলের প্রতি দুর্বল। হয়তো আপনাদের চোখে সেটা পড়েনি।

যাই হোক ,এবার আসুন রুমেলের কথায়। ছোট থেকেই অনেক কষ্ট পেয়ে বড় হয়েছে সে। পড়াশোনা করার সুযোগ তেমন হয়নি ওর তবে মাধ্যমিক পাশ করেছে। এটুকু আপনার আমার কাছে যথেষ্ট নয় আমি জানি। কিন্তু তার বাবার ব্যবসার হাল সে ধরলে আপনার বোনের ভরনপোষন খুব ভালো ভাবেই চালাতে পারবে।

তাছাড়া ছোট থেকে কষ্ট পেয়ে বড় হওয়া ছেলেটি হঠাৎ কারো থেকে এক বিন্দু ভালোবাসা পেলে তাকে কতটা ফিরিয়ে দিবে এটা ভাবতে পারছেন? মেঘাকে তো রানী করে রাখবে। শুধুমাত্র ওর সুস্থ হওয়ার অপেক্ষা। আর আল্লাহ চাইলে সেটা হতেও খুব বেশি সময় লাগবে না।
এবার আপনি ভেবে দেখুন ভাইয়া।”

মেহেদী কে রেখে শান মাহেরা খাতুনের দিকে গেলো। মাহেরা খাতুন শানের কিছু বলার আগেই মুচকি হেঁসে বললো,
-“আমার মেয়ের সিদ্ধান্তে আমি খুশি। আমার আপত্তি নেই।”

শান মুচকি হেঁসে বললো,
-“আলহামদুলিল্লাহ।”
সবাই বেশ খুশি হলো। মেঘা মুখ তুলে সবার খুশি খুশি মুখ দেখে কান্না ভরা চোখেই হেঁসে ফেললো। সে হাঁসি দেখে মেহেদী চোখ ফেরাতে পারলো না। বোনের হাসি দেখে নিজের অজান্তেই হাঁসলো মেহেদী। রুমের সবার দিকে চোখ বুলিয়ে বললো,
-“আমার কোনো আপত্তি নেই। আপনারা সবকিছু ঠিকঠাক করুন।”
মেঘা অবাক হয়ে মেহেদীর দিকে তাকালো।‌ মেহেদী মেঘার কাছে গিয়ে বললো,
-“এবার খুশি তো তুই?”
মেঘা মেহেদী কে জড়িয়ে ধরে বললো,
-“ভীষণ খুশি ভাইয়া।”
মেহেদী তৃপ্তির হাঁসি হাসলো। হাঁসিতে ভরে উঠলো হসপিটালের একটি কেবিন।

….

পিটপিট করে চোখ খুললো আরমান। কিছুদিন ধরে কখন চোখ খোলে,কখন বুঁজে সে খবর নেই তার। সারাদিন রাত চেয়ারেই বাঁধা পড়ে থাকে সে।
আরমান এদিক সেদিক চেয়ে হালকা আলো দেখতে পেলো।‌ আলো দছখে মনে হচ্ছে সকাল ছয়টা-সাতটা বা বিকেল পাঁচটার মতো বাজে। তবে সঠিক আন্দাজ করতে পারলো না। সারাজীবন মানুষকে কষ্ট দিয়ে আজ নিজে কষ্ট পাচ্ছে। এখন বুঝতে পারলেও অনেকটা দেরি হয়ে গেছে।সে বুঝতে পারছে তার সময় ঘনিয়ে এসেছে। রুমঝুমের কথা গুলোই সত্যি হতে চলেছে।

সেদিন মেহেদীর সামনেই তার সহযোগী নাঈমকে হত্যা করেছে শান। কিন্তু তার গায়ে ফুলের টোকাও দেয়নি। এর কারন সে বুঝতে পারেনি। তার পুরোনো গোডাউনেই বেঁধে রেখেছে তাকে।এখানে কত মানুষকে মেরেছে ,কত মেয়ের ইজ্জত নিয়েছে,কত মেয়েকে পাচার করেছে এখান‌ থেকে তার ইয়ত্তা নেই।আজ সেখানেই বাঁধা পড়ে আছে নিজে। প্রকৃতির প্রতিশোধ হয়তো এমনই হয়। আজকাল সে বেশিক্ষন চোখ মেলে রাখতে পারে না। চোখ বন্ধ হয়ে আসে কেন জানি।

দরজায় খটখট শব্দ শুনে হালকা মেলে রাখা চোখে তাকালো সেদিকে। অল্প আলোতে তিন-চারটা অবয়ব দেখতে পেলো । তার ঝাপসা দৃষ্টি আস্তে আস্তে পরিষ্কার হলো। হালকা খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে প্রথমে এলো রুশান। তার পেছনে প্রান্ত আর রাফিন । একদম শেষে শান এলো রুমেলকে নিয়ে। রুমেলের চোখ বাঁধা। রুমেল কে একটা চেয়ারে বসিয়ে ওর চোখ খুলে দিলো শান। মৃদু হেঁসে বললো,
-“লেটস্ এনজয়।

আরমান রুমেলকে দেখে কিছুক্ষণ অপলক তাকিয়ে রইলো। হ্যাংলা ছেলেটা তিনদিনেই কতটা পরিবর্তন হয়েছে। ঠিক নয় বছর আগের সেই ফর্সা, স্বাস্থ্যবান, আদুরে ছেলেটার মুখ ভেসে উঠলো আরমানের চোখের সামনে।

মূহুর্তেই বিকট চিৎকার করলো আরমান। চোখের পাতা থেকে রুমেলের ছবি সরে গিয়ে জমা হলো একরাশ ভয় আর ব্যাথার। হাঁটুটা বোধহয় ভেঙেচুরে গেছে। আরমান বহু কষ্টে চোখ মেললো। ঠিক সেই রকম এক ক্রিকেট ব্যাট হাতে রুশান দাঁড়িয়ে আছে। মুখে লেগে আছে তৃপ্তিময় হাঁসি। এই তিনদিনের মধ্যে এটাই তাকে করা প্রথম আঘাত যেটা রুশান করলো।

প্রান্ত শিস বাজাতে বাজাতে এগিয়ে এসে বললো,
-“এবার বুঝেছিস ,তোকে এতো আপ্যায়ন করে বাঁচিয়ে রাখার কারন?”
আরমান প্রান্তর কথা শুনলো না। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রুমেলের দিকে। রুমেল হাঁসছে। হ্যাঁ, সত্যিই হাঁসছে। দীর্ঘ নয়টি বছর পর হেঁসেছে সে।

চলবে…..

(অতি দ্রুত লিখে রি-চেক ছাড়া পোস্ট করে দিলাম।
ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

চন্দ্ররঙা প্রেম পর্ব-২০

0

#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্বঃ২০
#আর্শিয়া_সেহের

রুশান রুমঝুমকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসে আছে। হাত-পা কাঁপছে অস্বাভাবিক গতিতে। রুমঝুম ভাইকে জড়িয়ে ধরে চুপচাপ বসে আছে। মেঘা রুশানের পায়ের দিকটাতে বসে আছে। শান দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে।

রুশান‌ ক্ষনকাল চুপ থেকে বিরবির করে বললো,
-“আপু ভাইয়া মরে নি। ভাইয়া বেঁচে আছে। আমি দেখেছি ভাইয়াকে। ”
রুমঝুম রুশানের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
-“আমি জানি ভাইয়া বেঁচে আছে। ভাইয়াকে আমি নিয়ে এসেছি।”

রুশান তড়িৎ গতিতে রুমঝুমকে ছেড়ে উঠে বসলো। বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
-“ভাইয়াকে কি করে পেয়েছো তুমি? ও তো আরমানের কাছে। ও তো আরমানের লোক। ভাইয়া আমাদের চিনে না তো আপু।”

বলতে বলতে রুশান কেঁদে উঠলো। রুমঝুম মুচকি হেঁসে বললো,
-“ভাইয়া আমাদের না চিনলে তোকে কে বাঁচালো?”
রুশানের এতক্ষণে মনে হলো,’আসলেই তো। কে বাঁচালো ওকে?”

শান রুশানের কাছে এগিয়ে এলো। রুশানের মুখে হাত বুলিয়ে বললো,
-“সেদিনের কথা কিছু মনে আছে?”
রুশান চোখ বন্ধ করে পুরোটা মনে করলো।
সেদিন আরমান ওকে বেধড়ক পিটিয়েছিলো। রুশান প্রচন্ড ব্যাথায় অজ্ঞান হওয়ার আগে আবছা চোখে দেখেছিলো রুমেলকে ওর দিকে এগিয়ে আসতে। এরপর আর কিছুই মনে নেই ওর।

রুশান মেঘা,শান আর রুমঝুমকে সবটা বললো। শান রুশানের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসলো। রুশানের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,
-“তোমার সাথে হওয়া প্রতিটি অত্যাচারের বদলা তুমি নিজ হাতে নিবে।”
রুশানের চোখ চকচক করে উঠলো শানের কথা শুনে।

মেঘা এক সাইডে গিয়ে রেজাউল সাহেবকে ফোন করলেন। এতো খুশির সংবাদ তাকে না জানালে হবে?
রেজাউল সাহেব প্রথমবারেই ফোন রিসিভ করলেন। ছেলেমেয়েদের খবর জানার জন্য এতোক্ষণ চাতকের মতো চেয়ে ছিলেন ফোনের দিকে।

-“আসসালামু আলাইকুম আঙ্কেল। আমি মেঘা।”
-“হ.. হ্যাঁ মেঘা বলো। ওদের পেয়েছো? পেয়েছো আমার ছেলেমেয়েকে?”
মেঘা মুচকি হেঁসে বললো,
-“পেয়েছি তো। আপনার ছেলে মেয়ে সবাইকে পেয়েছি। সাথে আরেকজনকে পেয়েছি।”

রেজাউল সাহেব অধীর আগ্রহে জিজ্ঞাসা করলেন,
-“আর কাকে পেয়েছো ,মা?”
-“রুমেল। আপনার হারানো সন্তানকে।”

রেজাউল সাহেব ক্ষণিকের জন্য বোবা হয়ে পড়লেন। কি বলবেন? অবাক হবেন নাকি খুশি হবেন? বুঝতে পারলো না। তার প্রথম সন্তান,তার পিতৃত্বের অনুভূতি জাগানো প্রথম মানিক। রেজাউল সাহের হঠাৎ করেই কেঁদে উঠলেন। তার বিশ্বাসই হচ্ছে না যে এতো বছর পর তার ছেলে ফিরে আসবে।

মেঘা রুশানের দিকে ইশারা করে জিজ্ঞেস করলো সে বাবার সাথে কথা বলবে কি না?
রুশান মাথা হেলিয়ে হ্যাঁ বোঝালো।
মেঘা ফোন হাতে রুশানের পাশে বসলো। রেজাউল সাহেবের উদ্দেশ্যে বললো,
-“রুশানের সাথে কথা বলুন , আঙ্কেল।”

রেজাউল সাহেব কান্না আটকালেন। ছেলে-মেয়েদের সামনে কান্না করা লজ্জার ব্যাপার। রুশান বেশ কিছুক্ষণ বাবার সাথে কথা বলে ফোনটা রুমঝুমের কাছে দিলো।
রেজাউল সাহেব হসপিটালের ঠিকানা চাইলো রুমঝুমের কাছে। রুমঝুম হসপিটালের ঠিকানা দেওয়ার পর রেজাউল সাহেব বললেন,
-“আমি রাতের মধ্যেই তোর মা’কে নিয়ে চলে আসবো।”
রুমঝুমের ইচ্ছে করলো না ওই মহিলার মুখ দেখার তবুও বাবার সামনে না করতে পারলো না। নতমুখে বললো,
-“আচ্ছা, সাবধানে এসো তোমরা।”

রুশান আড়চোখে চেয়ে বললো,
-“তোমরা মানে?কে কে আসছে?”
-“বাবা আর মা।”
রুশান ক্ষিপ্ত বাঘের মতো তেতে উঠে বললো,
-“খবরদার আপু। ওই মহিলা যেন আসে না। উনি আসলে আমি এখনি এখান থেকে চলে যাবো।বাবাকে বারন করো ওই মহিলাকে আনতে।”

রুমঝুমকে কিছু বলতে হলো না। রেজাউল সাহেব সবটাই শুনেছেন। তবে ছেলের এতো রেগে থাকার কারন বুঝলেন না। তারপরও ছেলেকে শান্ত করতে বললেন,
-“আমি একাই আসছি। ওকে শান্ত হতে বল।”

রুশান শান্ত হলো। রেজাউল সাহেব ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন ড্রয়িং রুমে বসে। উপরে তাহমিনা বেগমের রুমের দরজায় একনজর তাকিয়ে বেরিয়ে গেলেন বাড়ি থেকে। যেতে যেতে কাজের মেয়েকে বললেন,
-“দরজা আটকে দে। রাতে আমি নাও ফিরতে পারি। তবে যখন ফিরবো আমার ভরা সংসার নিয়ে ফিরবো। তোর ম্যাডামকে বলে দিস।”

এতো বছরের কাজের জীবনে আজ প্রথম মেয়েটা রেজাউল সাহেবকে হাসতে দেখলো। তার চোখে মুখে ফুটে ওঠা আনন্দের ঝলকানি দেখলো। আহা! কাউকে এমন খুশি হতে দেখলেও কতই না ভালো লাগে।

শান,মেঘা,রুমঝুম অবাক চোখে তাকিয়ে আছে রুশানের দিকে। নিজের মা’কে এতো ঘৃনা করার কারন কেউই বুঝতে পারছে না। তাহমিনা বেগম যতই খারাপ হোক রুশানকে ভীষণ ভালোবাসে। রুশানও তো তার মাকে ভালোবাসতো। হ্যাঁ,রুমঝুমের সাথে হওয়া অন্যায় দেখে মায়ের প্রতি তার ঘৃনা জন্মেছে এটা ঠিক কিন্তু তাই বলে এতোটা?

রুমঝুম রুশানের কাঁধে হাত রাখলো। রুশান মাথা নিচু করে আছে। রুমঝুমের স্পর্শে রুশান হালকা নড়ে উঠলো কিন্তু মাথা উঁচু করলো না। মাথা নিচু রেখেই বললো,
-“আমি জানি তোমরা কি ভাবছো। চলো আজ তোমাদেরকে সেই সময়টা থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসি যে সময়টা থেকে ওই মহিলা মানে আমার তথাকথিত মা আমাকে ঘুরিয়ে এনেছিলো কিছুদিন আগে।

আজ থেকে বিশ বছর পূর্বের কথা। রুমেল ভাইয়ার তখন বছর পাঁচেক বয়স। সেই সময়টাতে তোমার মা রেহনুমার গর্ভে এসেছিলে তুমি। রুমেল ভাইয়া ছিলো আব্বুর জান।‌ হঠাৎ তোমার আগমনী বার্তায় রুমেল ভাইয়া মুখ ফুলালো।‌ সে চায় না তার ভালোবাসায় কেউ ভাগ বসাতে আসুক।
কিন্তু সে না চাইলেই কি হবে? সৃষ্টিকর্তা তো চেয়েছিলো তুমি আসবে। তাই সকল বাঁধা পেরিয়ে চলে এলে এ পৃথিবীতে। কিন্তু বাঁচলো না তোমার মা। তোমাকে মা ছাড়া দুনিয়ায় রেখে চললেন ওপারে আর তার সবটুকু মমতা বোধহয় রুমেল ভাইয়ার অন্তরে রেখে গেলেন। রুমেল ভাইয়া তার অপরিপক্ক হাতে তুলে নিলো তোমায়‌। সেই যে তোমায় হাতে তুলে নিলো তারপর এগারোটা বছর তার হাতেই গড়ে উঠেছো তুমি।

তোমার তিন মাস বয়সের সময় আব্বুর মনে হলো তোমাদের দুজনেরই একটা মা প্রয়োজন। পাঁচ-ছয় বছরের একটা ছেলে আর তিন মাসের একটা মেয়েকে তিনি একা হাতে কিভাবে সামলাবেন? তাছাড়া বড় আম্মুকে হারিয়ে আব্বু ভীষণভাবে ভেঙে পড়েছিলো। ব্যবসা বাণিজ্যেও লস হচ্ছিলো। রুমেল ভাইয়ার জন্য আব্বু কাঁদতেও পারতো না। আব্বুকে কাঁদতে দেখলেই রুমেল ভাইয়া কাঁদতো আর আব্বুর হাত ধরে কান্নার কারন জিজ্ঞেস করতো। আব্বুকে সারাদিন বলতো তার মা’কে এনে দিতে।

এই সবকিছু আব্বু বলেছিলো আমার সো কল্ড মা’কে। তবুও তোমাদের প্রতি তার একবিন্দু ভালোবাসা জাগে নি। তোমাদের না তোমাদের না। শুধুমাত্র ভাইয়ার। তার দূর্বিষহ দিনগুলো নেমে এসেছিলো আব্বু দ্বিতীয় বিয়ে করার পর মানে আমার মা’কে ঘরে আনার পর।

মা সবসময় ভাইয়ার উপর অত্যাচার করতো। ভাইয়া যদি মায়ের কথা না শুনতো তাহলে মা তোমার উপর অত্যাচার করতো। তুমি ছিলে ভাইয়ার উইক পয়েন্ট। তাই তোমার প্রতি অত্যাচার দেখে ভাইয়া দমে যেতো। মায়ের সব কথা মুখ বুঁজে মেনে নিতো। একটু ওলটপালট হলেই তোমাকে খাবার দিতো না মা । এই ভয়ে ভাইয়া শত কষ্ট সহ্য করতো। তুমি তো দুধের শিশু ছিলে। তুমি কিভাবে জানবে বলো এসব?

আব্বু বাড়িতে থাকতো না তেমন। এজন্য তোমাদের দিকে তেমন খেয়াল দিতে পারনি। একে একে কেটে যায় তিনটি বছর। এরপর দুনিয়াতে এলাম আমি। আমার আসার পর আব্বুও ঘরমুখো হলো। তবে ততদিনে হারিয়ে গেছে আগের রুমেল। একটা বাচ্চা ছেলের বদলে যাওয়ার জন্য তিনটি বছর নেহাৎই কম নয়।
আমি মায়ের জান ছিলাম অথচ তোমাদের সাথে কুকুরের মতো ব্যবহার করতো। তবুও ভাইয়া কতটা ভালোবাসতো আমাকে।

জানো আপু, ভাইয়ার একটা আলাদা পৃথিবী ছিলো? সেই পৃথিবীতে না‌ ছিলো কোনো বাবা,আর না ছিলো কোনো মা। সেই ছোট্ট পৃথিবীর একচ্ছত্র আধিপত্য তুলে দিয়েছিলো তার একমাত্র বোন রুমঝুমের হাতে। পড়াশোনা,সৎ মায়ের নিত্যদিনের অত্যাচার আর একমাত্র বোন নিয়েই তার দিন কাটতো।

তার সেই ছোট্ট পৃথিবীতে সে আমাকেও জায়গা দিয়েছিলো। মা আমাকে সেদিন কেঁদে কেঁদে বলেছে, ভাইয়া একহাতে তোমাকে ধরে আর অন্য হাতে আমায় বুকে আগলে নিয়ে সারা বাড়ি হেঁটে বেরাতো। তার ছোট্ট পৃথিবীটা নিয়ে সে একপা দু’পা করছ ঘুরতো।

আম্মু প্রথম আমাকে নিতে বারন করতো ভাইয়াকে। কিন্তু ভাইয়া চুরি করে নিতো। টুপ করে চুমু খেয়ে চলে যেতো মাঝে মাঝে। তবে কয়েকদিন পর থেকে মা আর ভাইয়াকে বারন করতো না আমাকে নিতে। বিনা কষ্টে তার ছেলে বড় হয়ে যাবে এটা ভেবেই হয়তো বারন করেনি।

গুটি গুটি পায়ে বছর এগুতে থাকলো।তোমার সেদিন এগারো তম জন্মদিন ছিলো। ভাইয়া আব্বুর থেকে তোমার জন্য কিছু টাকা চেয়েছিলো। আব্বু ভাইয়ার হাতে হাজার পাঁচেক টাকা দিয়ে ব্যবসার জন্য কুমিল্লা চলে গেলো সেদিন। তোমাকে আর আমাকে বাসায় রেখে ভাইয়া তোমার জন্য কেক আনতে দোকানে গিয়েছিলো। তোমার খালাতো বোনের জন্মদিনে গিয়ে কেক দেখে তুমিও নাকি ভাইয়ার কাছে বায়না করেছিলে কেক খাওয়ার। ভাইয়া তোমার সেই বায়নাই পূরন করতে গিয়েছিলো সেদিন। কিন্তু আফসোস! সেই যাওয়াটাতেই সে পার করে দিলো গোটা নয়টি বছর। তুমি আর আমি ভাইয়ার পথ চেয়ে কতশত দিন পার করে দিয়েছি কিন্তু,ভাইয়া আর ফেরেনি। তাকে ফিরতে দেয়নি। কে দেয়নি জানো? ”

-“হুম। মা দেয়নি।”
নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বললো রুমঝুম।
রুশান কিছুটা চমকে উঠলো। বললো,
-“তুমি সব জানো?”
-“না। শুধু এটুকুই জানি।”
মেঘা দু’হাতে মুখ চেপে কাঁদছে। এতোটাও নিষ্ঠুর মানুষ হয়? আরে, ভালোবাসতে সম্পর্ক লাগে নাকি? ছোট ছোট নিষ্পাপ বাচ্চা দেখলে তো এমনিতেও ভালোবাসতে মন চায়। তবে কিছু কিছু সৎ মায়েরা এমন করে কিভাবে? মেঘার কেন যেন খুব কষ্ট হলো রুমেলকে ভেবে। ছেলেটা সেই ছোট থেকে কষ্ট পেয়েছে। সে যদি কোনো ম্যাজিক জানতো তাহলে এক নিমিষেই রুমেলের সব কষ্ট শেষ করে দিতো।

রুমঝুম কাঁদছে না আজ। এগুলোর সাথে তো সে অভ্যস্ত। রুমেল নিরুদ্দেশ হওয়ার পর সমস্ত অত্যাচার সহ্য করতে হয় রুমঝুমকে। তাকে বাঁচানোর মানুষটা যে হারিঢয়ে গিয়েছিলো।

শান নির্বাক। যে মায়ের পায়ের নিচে জান্নাত দিয়েছেন আল্লাহ সেই মায়েরও এমন রুপ হয়? তার কাছে তার মা শ্রেষ্ঠ কিন্তু অপর প্রান্তে অন্য কারো কাছে তার মা ই সবচেয়ে ঘৃন্য।

শান এগিয়ে এলো রুশানের দিকে। প্রশ্ন ছুঁড়ে বললো,
-“আরমানকে তোমার মা কিভাবে চিনতো? আর রুমেলকে কেন উনার হাতে তুলে দিয়েছিলো?”

রুশান তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
-“দুইটি কারনে।
১. রুমেল ভাইয়াকে আরমান টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছিলো।আর আমার মা তো টাকার কাঙাল।
২. আব্বুর সম্পত্তির একজন ভাগীদার কমানোর জন্য।

তাছাড়া তার ছেলেও তো তখন বড় হয়ে গেছে। আটটা বছর যে ছেলেটি তার ছেলেকে মানুষ করেছে সেই ছেলেটির আর কোনো প্রয়োজন রইলো না তার কাছে। দু’টো ছেলেমেয়ে একসাথে হারালে তার দিকে আঙুল উঠবে ভেবে আপুকে রেখে দিলো। নতুবা সেদিন আপুকেও হয়তো তুলে দিতো আরমানের হাতে।

আরমান ভাইয়াকে দেখেছিলো শপিং মলে। আম্মু তাকে বকে বকে কাজ করাচ্ছিলো। সেদিন শপিং এর বিল আরমান দিয়ে দিয়েছিলো। ব্যাস এতেই আম্মু খুশিতে আটখানা। আরমান কথায় কথায় জেনে নিলো ভাইয়া আম্মুর সৎ ছেলে। তারপর সুযোগ বুঝে তিনি আম্মুর কাছে ভাইয়াকে কিনে নেওয়ার কুপ্রস্তাব দেয়। টাকার কথা শুনে ওই লোভী মহিলাও রাজি হয়ে যায়।

আরমানের একটা কিশোর ছেলের দরকার ছিলো। গরম টগবগে রক্তে ভরপুর একটা ছেলে। কুৎসিত মস্তিষ্কের লোকটা সেই ছেলেকে অত্যাচার করে আনন্দ পাবে এজন্য দরকার ছিলো। আর কপাল দোষে সেই ছেলেটি হলো আমাদের ভাইয়া।

সেদিন আরমান আমাকে মেরে খুব মজা পাচ্ছিলো। পৈশাচিক আনন্দ পাচ্ছিলো লোকটা। ও একটা অসুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ। একটা বদ্ধ উন্মাদ। একটা জানোয়ার।”

রুশানের চোখে মুখে একরাশ রাগের আভা ফুটে উঠলো কথা গুলো বলতে বলতে।
ধীর পায়ে এগিয়ে এলো শান। রুশানের কাঁধে হাত রেখে বললো,
-“দেখো তোমার মায়ের সাথে তোমরা কি করবা এটা সম্পূর্ণ তোমাদের ব্যাপার। তার শাস্তি তোমাদের হাতে।
তবে তোমাকে এটুকু বলতে পারি যে, এবার আরমানের সহ্য করার পালা। আর মজা নেওয়ার পালা আমাদের। প্রস্তুত তো তুমি?”

রুশান কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো শানের মুখের দিকে ।তারপর ধীরে ধীরে প্রসারিত হলো তার ঠোঁট। শানের ইঙ্গিত বুঝতে পেরেছে সে। মেঘা আর রুমঝুম হয়তো কিছু বুঝলো বা বুঝলো না। তারা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো শুধু।

চলবে……

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

চন্দ্ররঙা প্রেম পর্ব-১৯

0

#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্বঃ১৯
#আর্শিয়া_সেহের

দীর্ঘ নয়টি বছর পর কোনো হারিয়ে যাওয়া আপনজনকে চোখের সামনে দেখতে পেলে ঠিক কেমন রিয়েক্ট করা উচিৎ বুঝতে পারছে না রুমঝুম। হা করে তাকিয়ে আছে রুমেলের দিকে।

তবে রুমেল মাথা তুলছে না। সে মাথা নিচু করেই রুমঝুমের সামনে খাবার রাখছে। রুমঝুম কয়েকবার ভাইয়া ভাইয়া করে ডেকেছে। তবুও সে মাথা তুলে তাকায়নি। যেন রুমঝুমের ডাক তার কানেই পৌঁছাচ্ছে না।

রুমঝুম একসময় ডাকা বন্ধ করে দিলো। নিষ্পলক চেয়ে রইলো তার ভাইয়ের দিকে। চেহেরাতে তেমন পরিবর্তন না এসেও আমূল পরিবর্তন এসেছে। একটা দাগও যে শরীরে পাওয়া যেতো না সে শরীরে আজ দাগের অভাব নেই। মুখের জায়গায় জায়গায় গর্ত। হাতে অসংখ্য কাটা দাগ।‌ কপালে কয়েক জায়গায় লম্বাটে দাগ বসে গেছে। কিছু ক্ষত এখনো তাজা। কয়েকদিনের মধ্যেই হয়েছে। আবার কিছু ক্ষত অনেক পুরোনো।

রুমঝুম মুখ চেপে কেঁদে উঠলো। এভাবে নির্যাতন করেছে ছেলেটার উপর এতদিন। রুমঝুম রুমেলকে ছোঁয়ার জন্য একহাত বাড়ালো রুমেলের দিকে। তখনি আরমান আদেশের সুরে বললো,
-“ভেতরে যা,রুমেল। আমি না ডাকলে আসবি না।”

রুমেল এদিক ওদিক কোথাও না তাকিয়ে ঠিক যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই মাথা নিচু করে চলে গেলো। আশ্চর্যের বিষয় হলো সে কারো দিকে না তাকায় আর না কোনো কথা বলে।
রুমঝুম চেয়ে রইলো তার গমনপথে।

আরমান ধীরপায়ে রুমঝুমের সামনে এসে বসলো।‌ রুমঝুম চোখ তুলে তাকালো না। নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে যাচ্ছে সে। আরমান নিজে থেকেই বলতে শুরু করলো,

-“তোমার ভাইকে যেদিন তোমার মা আমার হাতে দিয়ে গিয়েছিলো সেদিন তোমার এগারোতম জন্মদিন ছিলো। রুমেলের বয়স তখন পনেরো। তোমার জন্য গিফট কিনতে বের হয়েছিলো বেচারা।”

রুমঝুম চকিতে আরমানের দিকে তাকালো। এখানেও তার সৎ মা? তাদের জীবনটাই ধ্বংস করে দিয়েছে।
আরমান রুমঝুমের চাহনি দেখে বুঝলো এখনো সে রুমেলের ব্যাপারে কিছু জানে না। শুধু ওই রুশান বিচ্ছুটাই বোধহয় জেনেছিলো।

আরমান গলা ঝেড়ে বললো,
-“আচ্ছা ওসব ছাড়ো। তখন তো তুমি বেশ ছোট। এর পরের ঘটনা শোনো।
রুমেলকে প্রথম যখন এখানে আনলাম তখন সে কি টগবগে ছিলো ও। কাউকে পরোয়া করতো না। সারাক্ষণ বোন বোন করতো। সামনে যাকে পেতো মারতো। পালানোর পথ খুঁজতো সবসময়। তোমার ছোট ভাইটা একদম ওর ডুপ্লিকেট কপি হয়েছিলো। সারাক্ষণ বোন বোন করে ঘ্যানঘ্যান করতো। আমার সব কাজে বাম হাত ঠেলতো।”

বলতে বলতে আরমান মেঝেতে বসে পড়লো। দু’হাত পেছনের দিকে রেখে সেখানে ভর দিয়ে রুমঝুমের দিকে তাকালো। বিশ্রী ভঙ্গিতে হেঁসে আবারও বলা শুরু করলো,

-“আজকের যে রুমেলকে তুমি দেখছো না? ওকে বহু কষ্টে এমন বানিয়েছি আমি। টানা একবছর ওর উপর অত্যাচার করার পর ওর রক্তিম দৃষ্টি শীতল হয়েছে। ও আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলতো। একটা পুঁচকে ছেলে আমাকে চোখ রাঙাতো। ভাবতে পারো তুমি? ”

রুমঝুম যেন ওর ভাইয়ের কষ্টটা অনুভব করতে পারছে। কত কষ্ট পেয়ে জীবনের নয়টা বছর পার করেছে সে। রুমঝুম কথা বলতে চাইলো। কিন্তু পারলো না। ওর কন্ঠ রোধ করে রেখেছে কেউ। খুব কষ্টে বললো,
-“ভা.. ভাইয়ার শরীরের দ.. দাগ গুলো আপ..নি করেছেন?”

আরমান দাঁত বের করে হেঁসে দিলো। রুমঝুমের দিকে খানিকটা ঝুঁকে বললো,
-“হ্যাঁ, আমি। আমি করেছি। ও আমাকে মারতে আসতো। এজন্য শাস্তি দিয়েছি। লোহার শিক গরম করে ওর কপালে ঠেসে ধরতাম। হাত-পা বেঁধে ঘন্টার পর ঘন্টা উল্টা ঝুলিয়ে রাখতাম। একটা বছর। বুঝতে পারছো কতটা সময়?
তবে ওর হাতের দাগগুলো আমার করা না। ওগুলো ও নিজেই করেছে।”

রুমঝুম কান্না করেই চলেছে। ওর সবকিছু বিষাক্ত লাগছে। কিছু শুনতে ইচ্ছে করছে না। কিন্তু আরমান ওকে জোর করেই শুনালো আবারও।

-“রুমেলকে রেগুলার ড্রাগ দিতাম। ইচ্ছে করেই দু একদিন দিতাম না। ও তখন নিজেই নিজের উপর অত্যাচার করতো। আমি ওর আশেপাশে ব্লেড, ছুড়ি এগুলো রাখতাম। আর ও পাগলের মতো আচরন করে যখন ওই ব্লেড,ছুড়ি দিয়ে হাত-পা কাটতো আমি মজা করে দেখতাম সেগুলো।
ওইযে একটা কথা আছে না? ‘সাপ ছেড়ে দিয়ে খেলা দেখা’ ওই টাইপ আর কি।

এতোকিছু করে ওই ছেলেকে বশে এনেছি আমি। এখন ও তোমাকে চিনলেও কথা বলবে না। তোমার দিকে তাকাবেও না। তোমাকে চিনবে কি না সে গ্যারান্টিও দিতে পারছি না বুঝলে? দেখেছো তো,আমার চোখের দিকে পর্যন্ত তাকায় না। যা বলি চুপচাপ সেটাই করে। সারাক্ষণ মাথা নিচু করেই রাখে। কারন আমার চোখে চোখ রাখলে কি হয় সেটা ও খুব ভালো করেই জানে।

তোমার বিচ্ছু ভাইটা সেদিন কি কাঁদা কাঁদলো ওকে জড়িয়ে ধরে। কতবার ভাইয়া,ভাইয়া করলো। উহু,রুমেল ওর দিকে তাকালোও না। হয়তো চিনতেই পারলো না।

আমি নিজ হাতে আধমরা করে রেখেছিলাম ওকে। প্রথম যখন ওর হাঁটু বরাবর ক্রিকেট ব্যাট দিয়ে একটা আঘাত করলাম , বিশ্বাস করো কি সুন্দর একটা সাউন্ড যে করেছিলো
আহ! আমার প্রানটা জুড়িয়ে গিয়েছিলো। শালা, আমার পিছনে লাগতে এসেছিলো।”

রুমঝুম আচমকা একদলা থুথু ছিটিয়ে দিলো আরমানের মুখে। ঘৃনা ভরা দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
-“তুই মরবি শয়তান। এতো এতো পাপ করে পার পেয়ে যাবি ভেবেছিস? পাবি না। তোর সাথে যে কি হবে তুই নিজেও জানিস না।”

আরমান হা হা করে কিছুক্ষণ হাসলো। যেন রুমঝুম খুব হাসির একটা জোকস্ বলেছে।
বেশ কিছু সময় হেঁসে রুমঝুমের ওড়না টেনে মুখের থুথু মুছলো । রুমঝুমের দুই গাল চেপে ধরে বললো,
-“আমি পার না পেলে তোর ভাইও পাবে না। তোর ছোট ভাইকে তো তোর বড় ভাই খুন করেছে রে। আমার সামনে থেকেই টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়েছিলো টুকরো টুকরো করার জন্য। হা হা হা।”

রুমঝুম গাল চেপে ধরা অবস্থাতেই হাঁসলো। আরমান সেটা দেখে গাল ছেড়ে দিলো। ভ্রু কুঁচকে আড়চোখে চেয়ে রইলো রুমঝুমের দিকে। রুমঝুমের হাঁসির মানে খোঁজার চেষ্টা করলো কিন্তু ব্যর্থ হলো বারংবার।
রুমঝুম মুখে ঈষৎ হাঁসির আভা ফুটিয়ে বললো,
-“নিজ চোঁখে দেখেছেন আমার ভাইয়ের লাশ?”

আরমান কিছুটা ভড়কে গেলো এই প্রশ্নে। রুমেলকে নিয়মিত ড্রাগ দেওয়া হয়। ওর কাউকে চিনতে পারার সম্ভাবনা খুবই কম। ও শুধু আদেশ মানে। গত সাত বছর ধরে রুমেলের হাত দিয়েই খুন করায় আরমান। রুমেলকে সে বিশ্বাসও করে এখন। কারন ছেলেটা অতীত মনে করতে পারে না তেমন একটা। অতীত মনে করতে না পারলে অতীতের মানুষগুলোকে কিভাবে চিনবে? তাও আবার যাদের নয় বছর আগে দেখেছে শেষবার।
এজন্যই রুশানকে মেরেছে কি না সেটা নিয়ে নিজে আর মাথা ঘামায়নি আরমান। তবে এখন রুমঝুমের কথা শুনে নিজের মধ্যেই কেমন জানি লাগছে।

রুমঝুম মুখে হাঁসি ধরে রেখেই বললো,
-“আমার ভাই পাগল না। তার দুইটা কলিজার টুকরাকে চিনতে কষ্ট হবে এতোটা নির্বোধও হয়নি সে। জন্মের পর থেকে আমাকে আর আমার ভাইকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছে সে। এগারোটা বছর আমি আমার ভাইয়ের বুকে ঘুমিয়েছি। রুশান ঘুমিয়েছে সাড়ে আট বছর। আর রুশান তো দেখতে একদম আমার বাবার মতো। আমার ভাইয়া তাকে চিনতে ভুল করবে? কক্ষনো না। ”

আরমান রুমঝুমের কথার বিপরীতে কিছু বলতে যাবে তার আগেই বাইরে থেকে ধুপধাপ শব্দ এলো। অনেক মানুষের পায়ের শব্দ। আরমান রুমঝুমের দিকে তাকালো। রুমঝুম মিটমিট করে হাসছে। রুমঝুমের হাঁসি দেখে আরমানের রাগ উঠে গেলো। রুমঝুমের গালে কষে একটা থাপ্পড় মেরে দিলো। রুমঝুমের পাতলা ঠোঁট জোড়ায় রক্তের ফোয়ারা নামলো। তবুও তার মুখে হাঁসি।

আরমান আরো একটা থাপ্পড় দিতে যাবে তখনই দরজায় দাড়াম করে শব্দ হলো।
আরমান এদিক সেদিক চেয়ে একটা ছুড়ি পেলো। দৌড়ে ছুড়িটা এনে রুমঝুমের গলায় ধরলো।
রুমঝুম চুপচাপ বসে রইলো নিজের জায়গায়। ও জানে কে এসেছে। লোকটার অস্তিত্ব সে আগে থেকেই টের পায়।

মিনিট খানেকের মধ্যেই আরমানের চোখের সামনে এসে দাঁড়ালো শান, প্রান্ত,মেঘা আর তিহান। আরমান ডান দিকের কাঁচের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলো বাইরে বিশ-বাইশের মতো পুলিশ দাঁড়ানো।

হঠাৎ এমন আক্রমনের জন্য আরমান প্রস্তুত ছিলো না। এই গোডাউনের খোঁজ ওরা কি করে পেলো‌ সেটাই বুঝতে পারছে না সে। গোডাউনে আরমান,রুমেল এবং আরমানের এক বিশ্বস্ত লোক ছাড়া আপাতত কেউ নেই।

আরমান রুমঝুমের গলা থেকে ছুড়ি সরাচ্ছে না। শানের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে সেটা দেখে। যে কোনো মূহুর্তে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এর মধ্যেই আরমানের বিশ্বস্ত লোক নাঈম বেরিয়ে এলো। হঠাৎ এতো মানুষ দেখে সে কিছুটা ভয় পেয়ে গোডাউনের পেছন দরজা দিয়ে দৌড় দিলো। প্রান্তও ছুটলো নাঈমের পিছু পিছু।

আরমান সেদিকে তাকাতেই এদিক দিয়ে শান কিছুটা এগিয়ে এলো। আরমান চকিতেই মাথা ঘুরিয়ে বললো,
-“একদম কাছে আসবি না। তোর বউয়ের দেহ থেকে মাথা কেটে ফেলবো কিন্তু।”
শান নিজের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে পড়লো। তিহান আর মেঘা মেইন দরজা ব্লক করে দাঁড়িয়ে আছে।

আরমান রুমঝুমের গলায় ছুড়ি ধরেই পেছনের দরজার দিকে এগুতে লাগলো। উদ্দেশ্যে,আপাতত এই দরজা দিয়ে পালিয়ে যাওয়া।
আরমান প্রায় দরজার কাছাকাছি চলে গেছে এমন সময় কোত্থেকে রুমেল চলে এলো । হাতে মোটা একটা লাঠি। সেটা দিয়ে আরমানের ঘাড়ের কাছ টাতে সজোরে আঘাত করলো। পেছন থেকে হঠাৎ এমন আঘাত পেয়ে আরমান রুমঝুমের থেকে বেশ খানিকটা সরে ফ্লোরে পরে গেলো। রুমেল আবার মারতে গেলে আরমান হঠাৎ ঘুরে রুমেলের পেট বরাবর ছুড়ি চালিয়ে দিলো। রুমেল লাঠি ফেলে পেট চেপে ধরে ফ্লোরে বসে পড়লো। আরমান এই সুযোগেই উঠে দৌড় দিলো ।

রুমঝুম রুমেলের দিকে চেয়ে থ হয়ে বসে আছে। কোনো প্রতিক্রিয়া করতে পারছে না।
শান,তিহান,মেঘা তিনজনই দৌড়ে এলো। মেঘা আর তিহান রুমেলকে ধরলো। শান রুমঝুমকে জড়িয়ে ধরলো। রুমঝুমের হুঁশ ফিরলো তখন। সঙ্গে সঙ্গে কেঁদে উঠে বললো,
-“আমার ভাইয়া। শান, আমার ভাইয়া। আমার ভাইয়াকে পেয়েছি। আমার ভাইয়াকে বাঁচান। আপনার পায়ে পড়ি, আমার ভাইয়াকে বাঁচান।”

শান রুমঝুমকে নিজের সাথে আরো শক্ত ভাবে জড়িয়ে নিলো। রুমঝুমের কপালে চুমু দিয়ে ঠোঁটের রক্ত মুছে দিলো। রুমঝুমকে দাঁড় করিয়ে বললো,
-“তোমার ভাইয়ার কিচ্ছু হবে না।আমি কথা দিচ্ছি। তোমরা সবাই একটা সুন্দর জীবন পাবা এবার।”

মেঘা আর তিহান রুমেলকে নিয়ে ততক্ষণে গাড়িতে বসে পড়েছে।রুমেলের ক্ষতস্থান খুব বেশি গভীর না হলেও রক্ত বের হচ্ছে অনেক। শান রুমঝুমকে নিয়ে বেরিয়ে আসতে আসতে ওর ফোনে মেসেজের টুংটাং শব্দ হলো। একহাতে রুমঝুমকে ধরে অন্যহাতে ফোন বের করে মেসেজটা অন করলো। মেসেজে একবার চোখ বুলিয়ে হালকা হেঁসে আবার ফোন পকেটে পুরে রাখলো।
বাইরে এসে একজন পুলিশকে ডাকলো। ব্যাস্ত ভঙ্গিতে হ্যান্ডশেক করে বললো,
-“অনেক ধন্যবাদ,রাফিন। তুই না থাকলে আজ কিছুই হতো না। আর আরমান আমাদের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে গেছে বুঝলি?”

রাফিন হাসলো । হাসলো শান ও। দু’জনের রহস্যময় হাঁসির মানে অন্যরা বুঝলো না। শান গাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললো,
-“পরে কথা হবে দোস্ত। এখন আসি।”
রাফিনও হেঁসে বললো,
-“নিজের খেয়াল রাখিস। আর যা করবি সাবধানে করিস।”

শান আর পিছনে ফিরলো না। রুমঝুমকে গাড়িতে তুলে নিজেও গাড়িতে উঠে বসলো। মিনিট দশেকের মাথায় হসপিটালে এসে পৌঁছালো। শান হসপিটালে‌ পৌঁছানোর পূর্বেই রাফিন ফোন করে হসপিটাল কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে নিয়েছে। এজন্য রুমেলের ব্যাপারটা পুলিশ কেস অবধি গড়ায়নি। শান আর তিহান দু’জন রুমেলকে নিয়ে স্ট্রেচারে তুলে দিলো। রুমঝুম মেঘাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই চলেছে।

রুমেলকে ডাক্তাররা নিয়ে যাওয়ার পরপরই একজন নার্স হাঁফাতে হাঁফাতে শানের সামনে এসে দাঁড়ালো। বললো,
-“এইমাত্র যে জখম হওয়া ছেলেটাকে নিয়ে এলেন সে আপনার কি হয়?”
রুমঝুম মেঘাকে ছেড়ে উঠে এলো। নার্সের পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
-“আমার ভাই হন উনি। কেন?”

নার্সের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। রুমঝুমের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আপনার আরেকটা ভাই আছে? ষোলো-সতেরো বছরের?”
রুমঝুম চমকে উঠলো। মেঘাও উঠে এসে রুমঝুমের পাশে দাঁড়ালো। শান আর তিহানও উৎসুক হয়ে তাকালো নার্সের দিকে।
রুমঝুম কিছু বলার আগে মেঘা বললো,
-“হ্যাঁ ওর ওই বয়সের একটা ভাই আছে। কিন্তু আপনি কিভাবে জানলেন? আর ওর ভাইয়াকে চিনলেন কিভাবে?”

নার্সটি বললো,
-“আরে এই ছেলেটাই তো দু’দিন আগে ওই ছেলেটাকে এখানে দিয়ে গেছে। আহা! বাচ্চা ছেলেটার পুরো শরীরে আঘাতের দাগ ছিলো। এই ছেলেটা ওকে রেখেই চলে গিয়েছিলো। কোনো কথা বলেনি।
গতকাল রাতে ছেলেটার জ্ঞান ফিরেছে। তারপর থেকেই শুধু ভাইয়া ভাইয়া বলছে। আর কিছুই বলতে পারছে না। আমি অনেক কষ্টে যেটুকু বুঝলাম, তাতে এই ছেলেটাকেই ও বারবার ভাইয়া ভাইয়া বলছিলো।”

রুমঝুম কি বলবে বুঝতে পারছে না। ওর একে একে হারিয়ে যাওয়া দুটো ভাইকেই ও ফিরে পেয়েছে। আনন্দে ওর মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। শান এগিয়ে এসে বললো,
-“আমাদেরকে ওর কেবিনে নিয়ে যেতে পারবেন ,এখন?”
-“কেন পারবো না? আসুন আমার সাথে।”

রুমেলকে তিহানের দায়িত্বে রেখে শান,মেঘা আর ও রুমঝুম চললো নার্সের পিছু পিছু। গন্তব্য রুশানের কেবিন।

চলবে…….

(ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। )

চন্দ্ররঙা প্রেম পর্ব-১৮

0

#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্বঃ১৮
#আর্শিয়া_সেহের

রুমঝুমের যখন হুঁশ ফিরলো তখন মধ্যরাত। বাড়ির পেছনের ঝোপঝাড় থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছে। দূরে কোথাও থেকে হালকা‌ আলো ভেসে আসছে।
ঘরের দক্ষিণ দিকের জানালাটা খোলা। ফুরফুরে হাওয়া ঢুকছে ভেতরে। ঠান্ডা ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছে রুমঝুমের।

চোখ মেলে বেশ কিছু সময় ধরে মনে করলো তার কি হয়েছিলো। রুশানের কথা মনে পড়তেই উঠে বসলো সে। পাশে শান একহাতের উপর মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে। কিছুক্ষণ আগেই ঘুমিয়েছে হয়তো।
রুমঝুম চোখ ফিরিয়ে নিলো।

ধীর পায়ে বিছানা থেকে নেমে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। বাইরে বেশ আলো ছড়ানো। হয়তো জোৎস্না আছে আজকে। জানালাটা হালকাভাবে টেনে দিলো রুমঝুম। পেছনে শানের দিকে একবার তাকিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে।

আকাশের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে আছে রুমঝুম। রুশান চাঁদ,তারা, আকাশ ভীষণ ভালোবাসতো। কতশত রাত দুই ভাইবোন ছাদে বসে আকাশ দেখেছে। রুশান বলেছিলো, ও যখন আল্লাহর কাছে চলে যাবে তখন চাঁদের সবচেয়ে কাছের তারাটি ও হবে। সবচেয়ে বেশি উজ্জ্বলতা থাকবে ওর। রুমঝুম যেন ওই তারাটির দিকে তাকিয়ে ওকে খোঁজে।

রুমঝুম এলোমেলো দৃষ্টি খুঁজে চললো সেই তারাকে।‌ কিন্তু কই? কোথাও তো এমন তারা নেই। সব তারাই তো একইরকম ভাবে জ্বলজ্বল করছে আকাশে।
হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো রুমঝুম। মুখ চেপে ধরে কেঁদে উঠলো। চাঁপাকন্ঠে বললো,
-“আমার ভাই। কোথায় চলে গেলি আমাকে রেখে? একটাবার ফিরে আয় রে ভাই। একটাবার আয়।
তোকে আগলে রাখবো আমি। আমি জানি তুই মরিসনি। আয় না ভাই,ফিরে আয়।”
রুমঝুম কাঁদতে কাঁদতে গড়িয়ে পড়লো ছাদের উপর।

রুমঝুমের হঠাৎই মনে হলো ওকে কেউ দেখছে। হামাগুড়ি দিয়ে রেলিংয়ের ধারে চলে গেলো। দুহাতে চোখ মুছে বাড়ির পেছনদিকের বাগানে নজর দিলো।
নাহ! কোথাও তো কেউ নেই। হয়তো ওর মনের ভুল।

রেলিংয়ে মাথা লাগিয়ে সেভাবেই বসে রইলো রুমঝুম। রুশান ওর জন্যই মরে গেছে। শুধুমাত্র ওর জন্য। কে বলেছিলো ছেলেটাকে ওকে এতো ভালোবাসতে? রুমঝুম আবারও ঠোঁট কামড়ে ধরে কেঁদে উঠলো। নিজের দাঁতেই কেটে গেলো ঠোঁট। সেদিকে খেয়াল নেই রুমঝুমের। ওর মনটা পড়ে আছে ওর ভাইয়ের কাছে। অস্ফুট স্বরে বললো,
-“কোথায় আছিস ভাই? আয় না ফিরে। একটাবার আয় । আমার কলিজাটা ঠান্ডা করে দে।”

আচমকা রুমঝুমের মুখ‌ রুমাল দিয়ে কেউ একজন চেপে ধরলো পেছন থেকে। রুমঝুম কিছু বুঝে ওঠার আগেই নেতিয়ে পড়লো ফ্লোরে। সম্পূর্ণ অজ্ঞান হওয়ার আগে শুনতে পেলো কেউ ফিসফিস করে ওর কানের কাছে বলছে,
-“মরা মানুষ কখনো ফিরে আসে না। কখনো না। তোর ভাইও ফির…”
রুমঝুম ততক্ষণে পুরোপুরি সেন্স হারিয়েছে।

..

জানালের ফাঁকা দিয়ে সূর্যের রশ্মি সরাসরি এসে শানের মুখে পড়লো। শান ভ্রু কুঁচকে মুখ ফিরিয়ে নিলো সেদিক থেকে। আস্তে আস্তে চোখ খুলে দেখলো ভালোই আলো ছড়িয়েছে চার পাশে। পাশ ফিরে রুমঝুমকে দেখতে পেলো না বিছানায়। দরজা চাপানো তবে লক করা না। ভাবলো ,রুমঝুম হয়তো বাইরে গেছে।

শান শোয়া থেকে উঠে বসলো। রুমঝুমের ঘরের দেয়াল ঘড়িটা নষ্ট। শান বিছানা হাতিয়ে ফোন খুঁজে বের করলো। অন করে দেখলো নয়টা চৌদ্দ বাজে।
অবাক করা বিষয় হলো‌ আটচল্লিশটা মিসড কল ভেসে আছে স্ক্রীনে।
শান তাড়াতাড়ি ফোন আনলক করে দেখলো তিহান আর প্রান্ত এতোগুলো কল করেছে। সে অনতিবিলম্বে কল ব্যাক করলো তিহানের নাম্বারে।

একবার বাজতেই তিহান রিসিভ করলো। রাগী কন্ঠে বললো,
-“এতো কিভাবে ঘুমোচ্ছিস তুই? কখন থেকে কল করছি সে খেয়াল‌ আছে?”
শান একহাতে চোখ ,কপাল ডলে বললো,
-“আমি মাঝরাতের দিকে ঘুমিয়েছিলাম ইয়ার। এজন্য উঠতে পারিনি।”

তিহান সিরিয়াস কন্ঠে বললো,
-“দেখ রুশানের ব্যাপার,ওই ছবি ,চিঠি এগুলো কিন্তু কেউ জানেনা। আমাদের এখনো অনেক কাজ বাকি । রুশানকে ও মারুক বা না মারুক ওকে ছাড়া যাবে না। ও একটা বিষাক্ত কীট।”
কথাগুলো বলতে বলতে তিহান তেতে উঠলো।

শান আস্তে নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
-“রুমঝুমকে একটু পাঠিয়ে দে। রুমঝুমের হাতেই শাস্তি পাবে ওই শয়তান। ওকে আগে বুঝাতে হবে।”

তিহান ভ্রু কুঁচকে বললো,
-“রুমঝুমকে পাঠাবো মানে? ও তো এখনো বাইরে বের হয়নি। ঘরেই আছে দেখ।”
শান চকিতে বিছানা ছেড়ে নেমে দাঁড়ালো। বাথরুমের দরজা বাইরে থেকে আটকানো। শানের বুক কেঁপে উঠলো। কম্পমান কন্ঠে বললো,
-“ও ঘরে নেই তিহান। ও কোথায় গেলো?”

তিহান অবাক হয়ে বললো ,
-“ঘরে থাকবে না তো কোথায় যাবে? আরে ভালো করে দেখ।”
শান একটু ভেবে বললো,
-“ছাদে আয় তো।”
বলেই ফোন বিছানায় ফেলে ছাদের উদ্দেশ্যে দৌড় দিলো। তিহানও বিনা বাক্য ব্যয়ে ছাদে এলো।

সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতেই শানের চোখে পড়লো রুমঝুমের স্যান্ডেল। জোড়া নয় ,একটা। শানের হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে বহুগুণ।‌ ছাদের দরজায় পড়ে আছে আরেকটা জুতো। পুরো ছাদের কোথাও রুমঝুম নেই।

তিহান ততক্ষণে চলে এসেছে। প্রান্তও তিহানের পিছু পিছু এসেছে। শান দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছে। রুমঝুম এখানে এসেছিলো আর ওর সাথে কিছু একটা হয়েছে সেটা ওরা বুঝে গেছে।
তিহান‌ মেঘাকে ফোন করে পুরো বাড়িতে রুমঝুমকে খুঁজতে বললো।

শান দু’হাতে মাথা চেপে ধরে বসে পড়লো খোলা আকাশের নিচে। দম বন্ধ হয়ে গেছে ওর । প্রান্ত দৌড়ে এসে শানের পাশে বসলো। শান প্রান্তর স্পর্শে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।

মেঘা হাঁফাতে হাঁফাতে ছাদে উঠে এলো। শানকে এভাবে কাঁদতে দেখে থমকে দাঁড়ালো দরজাতেই। কতখানি ভালোবাসলে একটা ছেলে একটা মেয়ের জন্য এভাবে কাঁদতে পারে।
তিহান মেঘার কাছে গিয়ে বললো,
-“সবজায়গাতে দেখেছো?”
মেঘা কান্নাভেজা চোখে চেয়ে বললো,
-“ও কোথাও নেই। ও এই বাড়িতেই নেই। ওর চুলে আটকানো কাঁটাটা বাড়ির বাইরে গেটের কাছে পড়ে ছিলো।”

শান কান্না থামিয়ে উঠে এসে মেঘার হাত থেকে কাঁটাটা নিয়ে নিলো। একনজর তাকিয়ে বললো,
-“এটা ওর মাথায় ছিলো রাতে।”
চারটা মানুষই ভয় পাচ্ছে রুমঝুমের কি অবস্থা সেটা ভেবে। তিহান তড়িঘড়ি করে বললো,
-“আমাদের দেরি করা উচিৎ হবে না। এখনি আরমানের দ্বিতীয় গোডাউনের উদ্দেশ্যে বের হতে হবে। বেশি দেরি করলে হিতে বিপরীত হতে পারে।

মেঘা প্রান্ত আর তিহানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“বাড়িতে জানাবো একবার?”
শান তড়িৎ গতিতে বললো,
-“একদম না। এই কথা যেন কেউ না জানে। এসব জানলে রুমঝুমের দিকে আঙুল তুলবে মানুষ। এগুলো শুধু আমাদের মধ্যেই থাকবে।”
বাকি তিনজন সম্মতি দিলো সে কথায়। সবাই কালবিলম্ব না করেই সাতক্ষীরায় যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করলো।

তাহমিনা বেগম কাল রাতে দরজা আটকেছেন তারপর আর খোলেননি। মেঘা কয়েকবার ডেকেও কোনো সাড়া পাননি। রুমঝুমের বাবা মাথা নিচু করে সোফায় বসে আছে। শান এসে তার সামনে দাঁড়ালো। রেজাউল সাহেব মাথা উঁচু করে শানের দিকে একবার তাকিয়ে আবার মাথা নিচু করে নিলেন। ধীর কন্ঠে বললেন,
-“আমার সংসারটা এমন ছিলো না। এমন হতোও না যদি ওই নাগিনকে এই সংসারে আনতাম।”

একটু থেমে চোখ মুছলেন রেজাউল সাহেব। শানের হাত দুটো ধরে বললেন,
-“আমার ছেলে-মেয়েদুটোকে এনে দিবে বাবা? আমি আর কত সহ্য করবো হারানোর ব্যাথা? এক সন্তানকে বহু আগে হারিয়েছি ,আর কাউকে হারাতে পারবো না।”

তিহান একবার হারানো সন্তানের কথা জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করলো না। এখন এসব জিজ্ঞেস করার উপযুক্ত সময় না।
শান রেজাউল সাহেবকে আশ্বস্ত করে বললো,
-“আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো আপনার মে.. ছেলেমেয়েকে ফিরিয়ে আনার জন্য। আপনি দোয়া করবেন শুধু। ”

শান,মেঘা, প্রান্ত, তিহান হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে। রেজাউল সাহেব তাদের পিছু পিছু এসে দাঁড়ালেন গাড়ির কাছে। গাড়ি স্টার্ট করার আগে বললেন,
-“তোমাদের কথায় আমি পুলিশ ইনফর্ম করিনি। তোমরা সাবধানে যা করবা কইরো। ”
শান তাঁকে চোখের ইশারায় আশ্বস্ত করে গাড়ি স্টার্ট দিলো।

মেঘা অবাক হয়ে শান, প্রান্ত আর তিহানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আপনার পুলিশকে ইনফর্ম করতে দেননি কেন ভাইয়া? প্ল্যান কি আপনাদের?”

প্রান্ত বললো,
-“শান বারন করেছে পুলিশকে ইনফর্ম করতে। আর প্ল্যান টাও বলেনি।”
শান ড্রাইভিং করতে করতে একবার ওদের তিনজনের দিকে লাল রঙা ফোলা চোখ মেলে তাকালো। তারপর রহস্যময় এক হাঁসি দিলো।

প্রান্ত সেদিকে কিছুক্ষণ অবাক চোখে তাকালো। শানের এই রুপ তাদের কাছে একদম নতুন। তিহান পেছনের সিট থেকে সামনে ঝুঁকে বললো,
-“শান ,তুই কি করতে চাইছিস প্লিজ বল আমাদে। এখন কিন্তু খুব টেনশন হচ্ছে ইয়ার।”

শান একই ভঙ্গিতে আবারও হাসলো। তবে সেই হাঁসির আড়ালে একরাশ ভয় আর চিন্তাও রয়েছে তার।
গম্ভীর কন্ঠে শান বললো,
-“চিন্তা করিস না। আমি পুলিশকে ইনফর্ম করেছি। আর আপাতত আমি রুমঝুমের কাছে পৌঁছাতে চাই। আর কিছু না।”

তিনজনই হতাশ হলো। তারা জানে শান অন্য কিছু ভাবছে তবে সেটা বলছে না। শান নিজে যতক্ষণ না কিছু বলবে ততক্ষণ কিছুই জানা সম্ভব না।

রুমঝুম পিটপিট করে চোখ মেললো। চোখ খুলেই আঁতকে উঠলো রুমঝুম। অন্ধ হয়ে গেছে নাকি সে? অন্ধকার ছাড়া কিছুই মিলছে না চোখে। চারপাশে শুধুই অন্ধকার। কোথায় আছে,কয়টা বাজে,এটা দিন নাকি রাত? অনুমান করতে পারছে না সে কিছুই । তার হাত দুটো পিছমোড়া করে বাঁধা। মুখও বাঁধা। আস্তে আস্তে গতরাতের কথা মনে পড়লো তার। কে ওকে তুলে আনলো এখানে? রুমঝুমের বুক কেঁপে উঠলো।
বেশ কিছু সময় নিজের সঙ্গে ধস্তাধস্তি করেও হাত ছাড়াতে ব্যার্থ হলো রুমঝুম।

একসময় চুপসে পড়ে রইলো সেই জায়গাতেই। হঠাৎ চোখে একঝাঁক আলো এসে পড়লো। চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেললো রুমঝুম। ধীর ধীরে চোখ মেলে দেখলো সামনে সেই জানোয়ার দাঁড়ানো। সাথে সাথেই চোখ ফিরিয়ে নিলো।‌ ঘৃনা লাগছে ওই পশুর দিকে তাকাতে তার।
রুমঝুম আশেপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলো এতক্ষণ একটা গ্যারেজের মধ্যে গাড়ির ডিকিতে ছিলো সে।

আরমান রুমঝুমকে পাঁজাকোলা করে তুলে গোডাউনের ভেতর ঢুকে পড়লো। রুমঝুমের গা গুলিয়ে উঠলো আরমানের ছোঁয়ায়। তবে এখন তার হাত-পা বাঁধা। কিছু করার নেই।

একটা পুরোনো কাঠের চেয়ারে বসিয়ে দিলো রুমঝুমকে। হাত -মুখ মুক্ত করে দিলো। হাত খোলার সাথে সাথে রুমঝুম ক্ষ্যাপা বাঘিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়লো আরমানের উপর। আরমান জানতো এমন হবে। রুমঝুমের এমন রুপে সে বিন্দুমাত্র বিচলিত হলো না। রুমঝুম একেরপর এক আঘাত করছে যেভাবে পারছে আর আরমান উচ্চস্বরে হেঁসে সেগুলো গ্রহন করছে। একসময় রুমঝুম থেমে গেলো। কাল বিকেল থেকে না খেয়ে থাকায় সে এখন বেশ ক্লান্ত। রুমঝুম মেঝেতে বসে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে শুরু করলো।

আরমান এগিয়ে এলো রুমঝুমের দিকে। রুমঝুমের পুরো শরীরে চোখ বুলিয়ে বললো,
-” তোমার বিনিময়ে গুনে গুনে পনেরো লক্ষ টাকা দিয়েছি তোমার মা কে। আই মিন সৎ মা। এতো সহজে তোমাকে ছেড়ে দেবো? তোমাকে কাজে লাগিয়ে আমি কত টাকা ইনকাম করতে পারবো জানো? ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া?”

রুমঝুম ঘৃনা ভরা দৃষ্টিতে তাকালো আরমানের দিকে। ঘৃনা হলো তার সৎ মায়ের প্রতিও। মানুষ কিভাবে এমন হয়?
আরমান রুমঝুমের দৃষ্টি উপেক্ষা করে বললো,
-“খাবার পাঠাচ্ছি। খেয়ে নাও। আর দেখে নাও তোমার আদরের ছোট ভাইয়ের খুনি কে।”

আরমান একটু উচ্চ কন্ঠে ডাকলো,
-“রুমেল। খাবার নিয়ে আয় ।”
রুমঝুম কেঁপে উঠলো।ঝনঝন করে উঠলো পুরো শরীর। এই নাম? এই নাম তো..
রুমঝুম দৃষ্টি নিবদ্ধ করে রাখলো সেই ব্যাক্তির আসার পথে। সে পথেই এক মিনিটের মতো ব্যয় করে ধীর পায়ে মাথা নিচু করে বেরিয়ে এলো এক যুবক। চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়সী এক যুবক।

রুমঝুমের সামনে তার চেহারা স্পষ্ট হলো বেশ কাছে আসার পর। তাকে দেখেই থমকে গেলো রুমঝুম। বুকের পাঁজরে কেউ কামড়ে ধরে রেখেছে যেন । খুব কষ্টে টেনে উঠালো একটা শ্বাস। জড়ানো গলায় বললো,
-“ভ.. ভাইয়া।”

চলবে…….

(রি-চেক দিতে পারিনি।
ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

চন্দ্ররঙা প্রেম পর্ব-১৭

0

#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্বঃ১৭
#আর্শিয়া_সেহের

আজ দুইদিন ধরে রুশানের কোনো‌ খোঁজ খবর নেই।‌ গতকাল ফোনে রিং হলেও আজ সেটাও হচ্ছে না। ফোন সুইচ অফ। মেঘাও অনেকবার চেষ্টা করেছে কিন্তু ফলাফল শুন্য। রুমঝুম চিন্তায় নাওয়া খাওয়া ভুলে গেছে।

গতকাল মেহেদীর হলুদ সন্ধ্যা ছিলো। রুমঝুম সেখানেই ব্যাস্ত ছিলো। তাই ব্যাপারটাতে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু সারারাতেও যখন রুশানের খোঁজ পেলোনা তখন অস্থির হয়ে উঠলো সে।
রুমঝুম গতকাল রাতেই তার বাবাকে কল করে রুশানের কথা বলেছে। কিন্তু তিনি তখন মোংলায় থাকার জন্য রুশানের খোঁজ করতে পারেনি। সকালে বাড়ি ফিরে দেখলেন তার স্ত্রী সদর দরজায় হেলান দিয়ে বসে আছে। বিদ্ধস্থ অবস্থা তার। তাকে বিভিন্ন রকম প্রশ্ন করলেও তিনি কোনো প্রকার নড়াচড়া করলেন না। শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে ছিলেন।

রুমঝুমের বাবা পুরো বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজেও রুশানকে কোথাও পায়নি।‌ তিনি ব্যাপারটা রুমঝুমকে জানানোর পর থেকেই রুমঝুমের অবস্থা শোচনীয়। রুমঝুম মনস্থির করেছে,আজ মেহেদীর বিয়ে শেষ হলেই সে বাপের বাড়িতে যাবে। তার মন বলছে আরমানই রুশানের সাথে খারাপ কিছু করেছে।

শান রুমঝুমের অবস্থা সহ্যও করতে পারছে না আবার কিছু বলতেও পারছে না। গতকাল‌ সকালেই মেঘা রুশানের পাঠানো ছবিগুলো শান আর মেহেদীকে দেখিয়েছে। তারপর সারাদিন তারা তিন জন রুমঝুমের আড়ালে রুশানের ফোনে কল‌ করেছে কিন্তু কল তোলেনি‌ কেউ। মেঘা আর শানও নিজেকে সামলে‌ রেখেছে শুধুমাত্র মেহেদীর বিয়ের জন্য।

মেহেদী বেশ‌ কয়েকবার ওদের বলেছে রুমঝুমকে নিয়ে যশোর চলে যাওয়ার কথা তবে ওরা যায়নি।‌ বিয়ে বাড়িতে মানুষ নানা রকম কথা বলতে পারে এজন্য।

সন্ধ্যার মধ্যেই মেহেদী সিন্থিয়াকে বিয়ে করে বাড়ি ফিরলো। রুশানের জন্য আপাতত কেউই মজা করার মুডে নেই। বিয়ে বাড়িটাও শান্ত হয়ে আছে। প্রান্ত আর তিহানও ঠিক করেছে যশোর যাবে।

রাত আটটার দিকে রুমঝুম চুপচাপ বসে ছিলো মেহেদীদের বাড়ির পেছন দিকটায়। সিন্থিয়া আর মেহেদী বাদে সবাই এখানেই বসে আছে। শিরীন মেঘার সাথে হেঁসে হেঁসে গল্প করছে।তবে মেঘার মুখে হাঁসি নেই। রুমঝুমের প্রতি রুশানের ভালোবাসা দেখে ও নিজেও কখন যে রুশানকে নিজের ছোট ভাইয়ের মতো ভালোবেসে ফেলেছে সেটা ও জানে না। ওর হাঁসি বিহীন মুখে রুশানের জন্য গভীর দুঃশ্চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।

শিরীন মেঘার সাথে গল্প করলেও ওর চোখ দুটো প্রান্ততেই আটকে আছে। বিয়ে বাড়ির রংবেরঙের আলোতে প্রান্তকে এক একসময় এক একরকম লাগছে। শিরীন মুগ্ধ চোখে দেখছে নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে।

রুমঝুমের উদাসীন দৃষ্টি শিরীনে গিয়ে আটকালো। শিরীন আজও প্রান্তর দিকে আগের দিনের মতোই তাকিয়ে আছে। প্রান্ত মাঝে মাঝে উঁকি মারছে তবে সেটা শিরীনের অগোচরে। রুমঝুমের আজ খুব ইচ্ছে করলো প্রান্ত-শিরীনের এই লুকোচুরি খেলা সম্পর্কে।

রুমঝুম নিজের জায়গা থেকে উঠবে তখনই দেখলো শান তার দিকে আসছে। হাতে একটা চেয়ারও আছে। রুমঝুমের মুখোমুখি বসে বললো,
-“আমার বউয়ের খুব মন খারাপ?”
রুমঝুম মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো। শান একটু এগিয়ে রুমঝুমের মাথাটা টেনে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে ধরলো।‌ ধীর কন্ঠে বললো,
-“মন‌ খারাপ করো না। আমরা সকালেই যশোরের উদ্দেশ্যে রওনা হবো। রুশানের কিছু হবে না।”

রুমঝুম চুপ করে রইলো। কিছুক্ষণ পর শানের বুক থেকে মাথা তুলে বললো,
-“আচ্ছা একটা প্রশ্ন করবো?”
শান মুচকি হেঁসে বললো,
-“যে কয়টা পারো করো।”
রুমঝুম ইতস্তত করে বললো,
-“শিরীন কি প্রান্ত ভাইয়াকে ভালোবাসে?”

শান কোনো প্রতিক্রিয়া করলো না। একবার ঘাড় ঘুরিয়ে বোনের দিকে তাকালো। শিরীন তখনো প্রান্তর দিকে তাকিয়ে মেঘার সাথে কথা বলছে। শান মুচকি হেঁসে পুনরায় ঘাড় ঘুরিয়ে রুমঝুমের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“হুম। তবে শিরীন ভালোবাসার আগে থেকে প্রান্ত শিরীনকে ভালোবাসে। ”

রুমঝুম অবাক হয়ে তাকালো শানের দিকে। কপাল কুঁচকে বললো,
-“তবে সেদিন শিরীন যে বললো প্রান্ত ভাইয়া নাকি ওকে ইগনোর করে। ভালোবাসে না।”

শান হাঁসি মুখেই বললো,
-“একটা গল্প শোনাই চলো।”
রুমঝুম শুনতে বেশ আগ্রহ প্রকাশ করলো। শান বলতে শুরু করলো,
-“প্রায় চার বছর আগের কথা। সেদিন একটা ছেলে প্রথম তার বন্ধুদের নিয়ে বাড়িতে আসে। কারন সেদিন ছেলেটির জন্মদিন ছিলো। ছেলেটির সদ্য কিশোরী বয়সে পদার্পণ করা একটি বার্বি ডলের মতো দেখতে বোন ছিলো। সেই বার্বি ডলকে দেখে সেদিন ছেলেটির দুটো ফ্রেন্ড তার প্রেমে পরে যায়। মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে একটা চলন্ত মানবী পুতুলের দিকে।
তারপর থেকে প্রায় দিনই ছেলেটির বন্ধু দুইটা তার বাড়িতে আসতো। একদিন ছেলেটি বুঝতে পারে তার এক বন্ধুর মনের কথা। অন্য বন্ধুটির সামনেই তাকে জিজ্ঞেস করে সে ছেলেটির বোনকে ভালো বাসে কি না। বন্ধুটি অকপটে স্বীকার করে নেয় ভালোবাসার কথা। মূহুর্তেই ভেঙে খানখান হয়ে যায় অন্য ছেলেটির মন।
সেই মন ভাঙা ছেলেটি কে জানো চন্দ্রকন্যা?”

শানের শীতল প্রশ্নে রুমঝুমের ধ্যান ভাঙলো। সে গল্পটা এতো মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো যে শানের প্রশ্নটা সে বুঝতে পারেনি। রুমঝুম প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালো শানের দিকে। শান একবার পেছনে তার বন্ধুদের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
-“ছেলেটি ছিলো তিহান। তিহানও শিরীনকে ভালোবেসেছিলো কিন্তু প্রান্তর মনের কথা জানার পরই ও নিজের ভালোবাসা শেষ করে দিয়েছিলো। ভাগ্যের পরিহাস দেখো। শিরীনও দুবছরের মধ্যে প্রান্তের মায়ায় আটকে গেলো।

সেদিনের পর থেকে তিহান হয়ে ওঠে অন্য তিহান। ওর জীবনে সিরিয়াস বলে আর কিছুই থাকে না। সবকিছুতে হাসি ঠাট্টা করেই কাটছে ওর। সম্পর্কে বিশ্বাসটাও সেদিনই উঠে গেছিলো ওর। শিরীনের দিকে ভুলেও তাকায়না তিহান। আমি খেয়াল করি ওকে জানো?
আমি জানিনা ওর পরবর্তী জীবনে কি হবে। তবে আমি চাই ও ভালো থাকুক।”

রুমঝুম কখন কেঁদে ফেললো বুঝে ওঠেনি সে। জীবন কত খেলাই না খেলে। রুমঝুম চোখ মুছে বললো,
-“প্রান্ত ভাইয়া শিরীনকে ভালোবাসে তবে সেটা প্রকাশ করে না কেন?”

-“ও আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে চায়। শিরীনও এই বয়সে প্রেমের চক্করে পড়ে পড়াশোনা মাথায় তুলবে ভেবে ও বেশি‌ করে দূরত্ব সৃষ্টি করেছে।”

-“শিরীন উনাকে ভালোবাসে এটা কিভাবে জেনেছিলেন ,আপনারা?”

-“এইতো গতবছরই শিরীন ওকে লাভ লেটার দিয়েছিলো।‌ সেখানেই সব লেখা ছিলো। তারপর থেকেই ওরা আমাদের বাড়িতে আসে না ।”

রুমঝুম ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললো। সে প্রায়ই দোয়া করে যেন দুনিয়ার সব ভালোবাসা পূর্ণতা পায়। কিন্তু সেটা আর হয় না। দুনিয়া এক আজব জায়গা ।এখানে সব রহস্যের খেলা চলে।

রুমঝুমের মনটা আবারও ঘুরে ফিরে রুশানে গিয়ে আটকালো। তার ভাইটা কোথায় আছে? কোন পরিস্থিতিতে আছে? কেমন আছে? খুব জানতে ইচ্ছে করলো তার।

..

ভোর বেলাতেই রুমঝুমের ঘুম ভেঙে গেছে। মাথা ভর্তি চিন্তা থাকলে কি আর কারো ঘুম হয়? রুমঝুম উঠে ঘরে কিছুক্ষণ পায়চারি করলো। এর মধ্যে রুশানকে প্রায় আটবার কল করেছে। প্রতিবারই ভেসে আসছে এক নারী কন্ঠ। রুমঝুম ফজরের নামাজ পড়ে মোনাজাতে কেঁদে কেঁদে ভাইয়ের সুস্থতা কামনা করলো। বারবার আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করলো তার ভাই যেন সুস্থ থাকে। রুমঝুমের কান্নার সূক্ষ্ম আওয়াজে শান ঘুম থেকে উঠে বসলো। তার চন্দ্রকন্যাকে এভাবে কাঁদতে দেখে বুকের পাঁজরে ব্যাথা অনুভূত হলো তার।

রুমঝুম চোখ মুছে জায়নামাজ তুলে পেছনে ফিরে দেখলো শান তার দিকে তাকিয়ে আছে। জায়নামাজ রাখতে রাখতে জিজ্ঞেস করলো,
-“কখন উঠলে?”
শান হাতের ইশারায় রুমঝুমকে ডাকলো। রুমঝুম কাছে যেতেই তার হাত ধরে বিছানায় বসালো। দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো বুকের মাঝে। রুমঝুমও গুটিসুটি মেরে পরে রইলো শানের বুকে। এই একটা জায়গায় সে নিশ্চিন্তে কাটিয়ে দিতে পারে তার গোটা জীবন।

বেলা আটটার মধ্যে শান সবাইকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হলো। তারা এখনো মেহেদীদের বাড়িতেই আছে। এখান থেকেই রওনা হবে। তিহান আর প্রান্তও হাজির হয়েছে। মেঘা নিজের আর রুমঝুমের জন্য কিছু কাপড় গুছিয়ে নিয়েছে।

বাড়ির লোকদের আসল কাহিনী জানানো হয়নি। তারা শুধু জানে রুমঝুমের ছোট ভাইকে পাওয়া যাচ্ছে না। মেঘা, মেহেদী,শান, প্রান্ত আর তিহানই শুধুমাত্র রুশানের পাঠানো ছবির কথা আর তারপরেই তার নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়ার কথা জানে। বাকিদেরকে চিন্তায় ফেলবে না বলেই জানানো হয়নি।

শানদের মাইক্রোবাসেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওরা। সব ব্যাগপত্র গাড়িতে উঠানো হয়ে গেছে। সিন্থিয়া আর শিরীন রুমঝুমকে শান্তনা দিচ্ছে। সিন্থিয়া রুমঝুমকে জড়িয়ে ধরে বললো,
-“ভয় পেয়ো না ঝুম। তোমার ভাইয়ের কিচ্ছুটি হবে না। তুমি তো ব্রেভ গার্ল ।এতো ভয় পেলে হবে?”
রুমঝুম নিঃশব্দে কাঁদছে। ওর কষ্টটা চাইলেও অন্যরা বুঝবে না।

মেহেদী একটু দূর থেকে মেঘাকে ইশারা করে বললো,
-“আমি তোদের সাথে আসি?”
মেঘাও ইশারায় বুঝালো,
-“কোনো দরকার নেই। তুমি এদিকটা সামলাও।”
মেহেদী ফের ইশারায় জিজ্ঞেস করলো,
-“তুই রুমঝুমকে সামলাতে পারবি তো?”
মেঘা চোখ বুজে মাথা হালকা হেলিয়ে বুঝালো,”সে পারবে।”
মেহেদী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। তবুও মনের মধ্যে ভয় রয়েই গেছে। ছেলেটা ওদের হাতে পড়লে এতক্ষণ বাঁচিয়ে রেখেছে তো?

সবাই গাড়িতে উঠতে যাবে এর মধ্যে শান্ত গাড়ির সামনে বসে গগনবিদারী চিৎকার করে কান্না শুরু করলো। রুমঝুম নিজের কান্না থামিয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে। উপস্থিত সকলেই শান্তর এমন কান্ডে হতবাক।
শাফিয়া আক্তার দৌড়ে গিয়ে শান্তকে তুললো। শান্তর মোটাসোটা শরীরটা টেনে তুলতে বেশ কসরত হলো তার।

শান্ত গাড়ির সামনে থেকে সরলো‌ না। সেখানে দাঁড়িয়েই কাঁদছে। তিহান এগিয়ে গিয়ে বললো,
-“আরে ভাই এভাবে কাঁদতেছিস কেন? কি হইছে তোর?”
সবাই একই প্রশ্ন করে যাচ্ছে কিন্তু শান্ত কান্নার জন্য কোনো উত্তর দিতে পারছে না। বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে কোনো রকমে বললো,
-“তো.. তোমরা সব্বাই আ.. আমাকে রেখে হ.. হানিমুনে চলে যাচ্ছো কেন?”

সবারই বেশ সময় লাগলো কথাটা বুঝতে। শান মাথায় হাত দিয়ে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। শিরীন তো হেঁসে কুটিকুটি।
সবাই মিলে শান্তকে বোঝানোর চেষ্টা করলো যে ওরা হানিমুনে যাচ্ছে না ,তবে শান্ত সেটা মানতে নারাজ। তার দৃঢ় বিশ্বাস এরা তাকে রেখে হানিমুনেই যাচ্ছে। শাফিয়া আক্তার শান্তকে বোঝাতে না পেরে বকবক করতে করতে বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়লেন। উদ্দেশ্য একটা লাঠি খোঁজা।

শান বুঝলো শান্তর কপালে মাইর আছে। তাই নিজেই এগিয়ে এসে শান্তর কাঁধ চাপড়ে বললো,
-“আমরা হানিমুনে যাচ্ছি না ভাই। বিশ্বাস কর।”
শান্ত অকপটে বললো,
-“তোমাকে আমি বিশ্বাস করি না।”
শান উপায় না পেয়ে বললো,
-“আচ্ছা আমি তোকে প্রমিস করছি তোর বিয়ে হলে আমরা একসাথে হানিমুনে যাবো। এর আগে না।”
শান্ত এবার চুপ করলো। সে জানে তার ভাই প্রমিস করে কিছু বললে সেটা ঠিকই করে। শান্ত মিষ্টি হেঁসে বললো
-“তাহলে যাও।”
পেছন থেকে প্রান্ত বিরবির করে বললো,
-“শালা আমার একের চিজ। কি সুন্দর করে আমার টাকা বাঁচিয়ে দিলো।”
শান চোখ, ভ্রু, কপাল কুঁচকে তাকালো প্রান্তর দিকে। প্রান্ত সেটা না দেখার ভান করে গাড়িতে উঠে বসলো।

..

রুমঝুমদের বাড়িতে পৌঁছাতে প্রায় বিকেল হয়ে গেলো। রুমঝুম তার বাবাকে আগে থেকেই বলে দিয়েছিলো আসার খবর। তিনি বাড়িতে তাদের জন্য রান্নাবান্না করিয়ে রেখেছে। ওরা খেয়েই রুশানের খোঁজে নেমে পড়বে।

তাহমিনা বেগম প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি দরজার কাছেই বসে থাকেন। তার শরীর ভীষণ দূর্বল হয়ে পড়েছে। কোনো মতে নিজেকে টেনে নিয়ে বেড়ায়। তিনদিন ধরেই কিছু খায় না । অসুস্থ হয়ে গেছে ভীষণ সে।

আজও সে দরজায় হেলান দিয়ে বসে ছিলো।হুট করেই তার চোখে আবছায়া ভাবে ধরা পড়লো পরিচিত একটা মুখ। তাহমিনা বেগম নড়ে বসলেন। কোনো মতে উঠে দৌঁড়ে রুমঝুমের দিকে যেতে গেলেন। তবে পারলেন না। দু কদম এগিয়েই পড়ে গেলেন মাটিতে। রুমঝুম দৌঁড়ে এসে তাঁকে তুললো। তাহমিনা বেগম বিলাপ করে বললেন,
-“আমার ছেলেটা হারিয়ে গেছে রে রুমঝুম। ওই আরমানই ওকে নিখোঁজ করেছে। আমার পাপের ফল আমার ছেলেটা পেয়েছে। ওরে খুঁজে দে না রুমঝুম। আমি আর কোনোদিন তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করবো না। আমার বুকের মানিকটারে এনে দে না ।তোর পায়ে ধরতেছি আমি,ওরে এনে দে। আমার কলিজার টুকরাটারে খুঁজে দে। ”

রুমঝুম তাহমিনা বেগমকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। এর মধ্যে রুমঝুমের বাবাও বেরিয়ে এলেন। মেঘা আর রেজাউল সাহেব মিলে থামালেন রুমঝুম আর তাহমিনা বেগম কে। মেঘা বোঝানোর ভঙ্গিতে বললো,
-“আন্টি আমরা রুশানকে খুঁজে বের করবো। আরমান শয়তানটাকেও শাস্তি দিবো। এর জন্য আপনার সাহায্য প্রয়োজন আমাদের। আপনি এভাবে ভেঙে পড়লে আমাদের কে সাহায্য করবে?”

তাহমিনা বেগম চুপ করলেন। সত্যিই তো এভাবে ভেঙে পড়লে কিভাবে চলবে? তিনি চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালেন। শান এগিয়ে এসে তার শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে সালাম করলো। তাহমিনা বেগম ছলছল চোখে তাকিয়ে শানের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-“বেঁচে থাকো বাবা।আর আমার মে.. মানে রুমঝুমকে দেখে রেখো।ওকে সুখে রেখো। আমি কখনো ওকে শান্তি দেই নি।”

রুমঝুম বললো,
-“মা থামেন। ভেতরে চলেন। তাড়াতাড়ি খেয়ে বের হতে হবে।”
তাহমিনা বেগম সায় জানিয়ে সবার সাথে ভেতরে ঢুকলেন।

মেঘা খেতে খেতে বললো,
-“আন্টি আপনি কি আরমানের কোনো গোডাউন বা ফার্ম হাউস চেনেন ?”
তাহমিনা বেগম মেঘার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“এখানে যেটা সেটা চিনি। তবে আরো একটা আছে ।ওটা চিনি না।”
প্রান্ত কিছু ভেবে বললো,
-“ইয়েস। ইটস্ এনাফ। একটা পেলে সেখানে অন্যটারও কোনো না কোনো ক্লু পাওয়া যাবে।”
শান অন্যমনস্ক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“আম্মা আপনি রুশানকে খুঁজতে সেখানে গিয়েছিলেন?”
-“গিয়েছিলাম। তবে ওদের পাইনি।”
শান আগেই ভেবেছিলো ওরা জায়গা পরিবর্তন করবে। এখন সেই জায়গাটা খুঁজতে হবে শুধুমাত্র।

..

সবাই যখন আরমানের গোডাউনের সামনে পৌঁছালো তখন সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই।
তাহমিনা বেগম আগে আগে হাঁটছেন। গোডাউনের সামনে এসে দেখলো দরজায় অনেক বড় তালা ঝুলানো। প্রান্ত সাথে করে একটা লোহার শাবল এনেছে। শান ফ্ল্যাশ লাইট অন করেছে আর প্রান্ত শাবল পিটিয়ে দিয়ে তালা ভেঙেছে।
ভেতরে গাঢ় অন্ধকার। তিহান মেইন দরজাতেই দাঁড়িয়ে রইলো। বাকিরা ভেতরে ঢুকে প্রথমে সুইচ খুঁজে লাইট অন করলো। লাইট জ্বলতেই চমকে উঠলো সবাই। পুরো ঘর জুড়ে একদম বাজে অবস্থা। মনে হচ্ছে কেউ পুরো রুমে দৌঁড়ে বেরিয়েছে আর এক এক করে জিনিসগুলো ছুড়ে ফেলেছে।

টানা আধঘন্টা খোঁজাখুঁজির পর একটা ফাইলের মধ্যে পাওয়া গেলো আরমানের দ্বিতীয় গোডাউনের খোঁজ। সেটা যশোরে না। যশোরের অদূরে খুলনার সাতক্ষীরা জেলার একদম শেষ প্রান্তে শ্যামনগরে অবস্থিত সেটা।
প্রান্ত প্রতিটি রুমের ছবি তুলেছে। সব ফাইল, ডকুমেন্টস ও সাথে নিয়েছে।

রুমঝুম রুশানের ব্যাপারে এখনো কিছু জানতে না পেরে হতাশ হলো। শরীরটা দূর্বল লাগছে।
সবাই গোডাউন থেকে বেরিয়ে বাইরে দাঁড়ালো। তিহান দরজা টেনে দেওয়ার সময় মেঘা ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে সেদিকে ধরলো। তখনই নজরে পড়লো দরজার বাইরে ডানদিকে একটু উপরে একটা খাম ঝুলছে। মেঘা শানের দিকে তাকিয়ে বললো,
-“ভাইয়া, দেখুন তো ওটা কি?”

শানের সাথে বাকি সবাই সেদিকে তাকালো। শান এগিয়ে গিয়ে খামটা নিলো। রুমঝুম তড়িৎ বেগে গিয়ে ছো মেরে খামটা নিয়ে নিলো। কাঁপা হাতে খাম খুলতেই বেরিয়ে এলো একটা চিঠি।
রুমঝুম সবার দিকে তাকিয়ে একটা ঢোক গিলে চিঠি খুললো। মেঘা চিঠিটা রুমঝুমের হাত থেকে নিয়ে বললো,
-“আমি পড়ছি। তুই শান্ত হয়ে শোন।”
রুমঝুম চুপচাপ দাঁড়ালো। মেঘা চিঠিটা পড়তে শুরু করলো,

‘হাই রুমঝুম,
আমি জানতাম তুমি আসবে। তবে এভাবে আনতে চাইনি তোমাকে। আমার প্ল্যান ছিলো অন্যরকম। কিন্তু তোমার এই বা*পাকনা ভাই সেটা হতে দিলো কই?
ভুল সময়ে আমার সামনে চলে এলো। তোমাকে বাঁচানোর জন্য সে আমার বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করতে উঠেপড়ে লেগেছিলো। হাহাহা। পুঁচকে ছেলেটা। আমাকে পুলিশে দিয়ে ও বোনকে বাঁচাতে চেয়েছিলো।
বিশ্বাস করো, ওকে মারার ইচ্ছে ছিলোনা। ও যেচে মরতে এসেছিলো সিংহের গুহায়।
তবে আমি ওকে মারিনি। আধমরা করেছিলাম শুধু। ওকে মেরেছে অন্য কেউ।
কে মেরেছে সেটাও জানতে পারবে অতি শীঘ্রই।তোমার সময়ও ঘনিয়ে এসেছে।

আর শোনো,আদরের ছোট ভাইকে খোঁজা বন্ধ করো। এতে কোনো লাভ নেই বুঝলে? কারন ওকে টুকরো টুকরো করে…”

মেঘা হাঁসফাঁস করছে। বাকিটুকু পড়ার শক্তি নেই ওর । রুমঝুম মৃদুস্বরে বললো,
-“আমার ভাই, আমার রুশ…”
পুরোটুকু বলার আগেই ঢলে পড়লো শানের বুকে।

চলবে……..

( রি-চেক দেওয়া হয়নি।
ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)

চন্দ্ররঙা প্রেম পর্ব-১৬

0

#চন্দ্ররঙা_প্রেম
#পর্ব-১৬
#আর্শিয়া_সেহের

রুমঝুম রুশানকে কল করতে গিয়ে দেখলো ওর ফোন অফ। চার্জ শেষ হয়ে গেছে । ফোন চার্জে লাগিয়ে রুমঝুম রুমের বাইরে এলো। প্রান্ত,তিহান,শান,সিন্থিয়া,বিথী সবাই এখনো গার্ডেনে আড্ডা দিচ্ছে।
রুমঝুম গেস্ট রুমে গিয়ে দেখলো মেঘা আর শিরীন গল্প করছে আর হেঁসে লুটোপুটি খাচ্ছে।

রুমঝুমকে দেখে শিরীন বলে উঠলো,
-“আরে ভাবি, দাঁড়িয়ে না থেকে এদিকে এসো। গল্প করি।”
রুমঝুম মুচকি হেঁসে ভিতরে ঢুকে বললো,
-“তোমরা গল্প করো। আমি পরে যোগ দিবো তোমাদের গল্পে।”
তারপর মেঘার দিকে তাকিয়ে বললো,
-“মেঘা তোর ফোনটা একটু দে। রুশানকে কল করবো। আমার ফোনে চার্জ নেই।”
-“হ্যাঁ,চার্জ দেওয়ার সময় পেলেই না চার্জ দিবি আর ফোনে চার্জ থাকবে।”

রুমঝুম চোখ পাকিয়ে তাকালো মেঘার দিকে। শিরীন পাশে বসে ঠোঁট চেপে হাসছে।
রুমঝুম মেঘার পাশ থেকে ছো মেরে ফোনটা নিয়ে ধুপধাপ পা ফেলে বাইরে চলে গেলো।

রুমে এসে নিরিবিলি বসে তারপর কল করলো রুশানকে। রুশান তখন বিছানায় শুয়ে উদাস দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলো। ফোন বাজার শব্দে ঘোর কাটলো তার। আননোন নাম্বার দেখে প্রথমে রিসিভ করতে ইচ্ছে হলো না তার। তৃতীয় বারের সময় রিসিভ করলো।
রুমঝুমের কন্ঠ শুনে একটু নড়েচড়ে বসলো রুশান।বললো,

-“এটা কার নাম্বার আপু? তোমার নাম্বার তো না।”
-“কেন রে? আননোন বলে রিসিভ করিসনি বুঝি? কোনো মেয়ে আবার ফোন দিয়ে জ্বালাতন করে না তো?”

রুমঝুমের কথায় ফিক করে হেসে ফেললো রুশান। সাথে সাথেই টান লাগলো ঠোঁটের কাঁটা অংশে। ব্যাথা পাওয়ার দরুন ছোট্ট করে ‘আহ’ শব্দ বের হলো তার মুখ থেকে। রুমঝুম উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“কি হয়েছে ভাই? ব্যাথা পেয়েছিস কোথাও?”

রুশান কাঁটা জায়গাটা আঙুল দিয়ে চেপে ধরলো। বোনের কাছে গতকালকের ব্যাপারগুলো বলা যাবে না। রুমঝুম এতে ভয় পেয়ে দূর্বল হয়ে পড়বে। খুব দ্রুতই নিজেকে সামলে নিয়ে রুশান বললো,
-“আরে না আপু। মশারা ইদানিং কত্ত জোড়ে কামড় দেয় জানোই তো। আমাকেও মাত্রই একটা মশা খুব জোড়ে কামড়ে দিলো। এজন্য ব্যাথা পেয়েছি ,বুঝলে?”

রুমঝুম বিন্দুমাত্র সন্দেহ করলো না রুশানের কথায়। কারন রুশান কখনোই তাকে মিথ্যা বলে না।
এর মধ্যেই মেঘা একবার এসে বললো ,
-“আমি আর শিরীন গার্ডেনে যাচ্ছি। কথা শেষ করে তুই ও আয়।”
রুমঝুম ঘাড় কাত করে আচ্ছা বুঝালো।
রুশান ওপাশ থেকে বললো,
-“কে রে আপু?”
-“মেঘা এসেছিলো। ওর ফোন থেকেই কল করেছি তোকে। বাদ দে এসব। এখন বল কেমন আছিস?”

রুশানের আর ইচ্ছে করছে না বোন কে মিথ্যা বলতে। ব্যাথাগুলো আড়াল করে মুখে মিথ্যে হাঁসি টেনে বললো,
-“আমার কথা ছাড়ো তো। তোমার কথা বলো। বিবাহিত জীবনে কেমন লাগছে?”

ছোট ভাইয়ের মুখে এমন কথায় রুমঝুম বেশ লজ্জা পেলো। মাথা নিচু করে এক নখ দিয়ে অন্য নখ খুঁটতে খুঁটতে বললো,
-“এরা সবাই অনেক ভালো রে রুশান। মাথায় তুলে রেখেছে আমাকে। তোর দুলাভাইও খুব ভালো। সবাই ভীষণ ভালবাসে আমাকে। আমি আগে কখনো এতো ভালোবাসা পাইনি যতটা এ বাড়িতে এসে পেয়েছি।”

রুশানের বুকটা শীতল হয়ে গেলো রুমঝুমের উত্তর শুনে। ও তো এমনই চেয়েছিলো। ওর বোনটা যেন অনেক সুখ পায়। ওর সারাজীবনের দুঃখটা যেন দূ্র হয়‌। এবার ও সেই সুখের মুখ দেখেছে। এখানে কারো নজর পড়তে দেবে না রুশান। প্রয়োজনে যা কযতে হয় সে করবে।

রুমঝুম রুশানের সাড়াশব্দ না পেয়ে বললো,
-“চুপ করে গেলি কেন? আচ্ছা মা কেমন আছে?”
রুশানের শরীর জ্বলে উঠলো এই প্রশ্নে। তবুও কোনো প্রতিক্রিয়া না করে বললো,
-“আছে ভালো।‌ এই আপু শুনো?”
-“হ্যাঁ শুনছি তো। বল ।”
-“দুলাভাইকে তো দেখালে না। একটা ছবি দাও না তোমাদের।”

রুমঝুম হেঁসে বললো,
-“আচ্ছা দিচ্ছি। মেঘার হোয়াটসঅ্যাপ থেকে পাঠাচ্ছি। চেক করে নিস। এখন রাখছি কেমন?”
-“ঠিক আছে,রাখো। নিজের খেয়াল রেখো।”
-“তুইও নিজের খেয়াল রাখিস।”

রুমঝুম কল কেটে মেঘার গ্যালারি থেকে গতকালকের তোলা ছবিগুলো থেকে কয়েকটা ছবি রুশানকে সেন্ড করে দিলো। এরপর গুটিগুটি পায়ে নিচে নেমে এলো।

শাফিয়া খাতুন রান্না করছিলেন কিচেনে। রুমঝুম সেদিকে এগিয়ে গেলো। শাফিয়া খাতুন রুমঝুমকে আসতে দেখে কিচেন থেকেই বললো,
-“এদিকে আসলে পা ভেঙে দিবো,বুঝেছো মেয়ে? যাও গিয়ে সবার সাথে আড্ডা দাও।”

অগত্যা রুমঝুমকে সেখান থেকে ব্যাক করতে হলো।‌ যেচে গিয়ে পা ভেঙে আনার দরকার কি? এর চেয়ে বরং সবার সাথে আড্ডা দেওয়া যাক।

রুমঝুম মেইন ডোরের কাছে আসতেই ভেতরে ঢুকলো শান্ত। রুমঝুমের হাত ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসলো। মুখ ফুলিয়ে বললো,
-“এখন একটুও বাইরে যাওয়া চলবে না ভাবি‌। ওদের জন্য তোমার সাথে আমি ভালো করে কথা বলতে পারি না। এখন তুমি আমার সাথে কথা বলবে । শুধু আমার সাথে।”

রুমঝুম হেঁসে বললো,
-“বেশ। এখন আমি তোমার সাথে কথা বলবো। শুধু তোমার সাথে।”
রুমঝুমের এই কথায় শান্ত খুশি হয়ে গেলো। রুমঝুমের পাশে বসে পা দুটোকে সোফায় উঠিয়ে আয়েশ করে বসলো। তারপর বললো,
-“এখন তুমি আমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবে আর আমি তোমার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবো । প্রথমে আমি জিজ্ঞেস করি। তুমি আগে শিখে নাও কিভাবে প্রশ্ন করতে হয় বুঝেছো?”

রুমঝুম বলদের মতো হাসলো। মানে সিরিয়াসলি? এই বয়সে এই পিচ্চি ওকে প্রশ্ন করতে হয় কিভাবে সেটা শিখাবে? তবুও চুপচাপ মাথা হেলিয়ে বললো,
-“আচ্ছা,শিখাও।”
শান্ত বিজ্ঞদের মতো করে রুমঝুমের চৌদ্দ গোষ্ঠীর ব্যাপারে প্রশ্ন করলো। রুমঝুম ধৈর্য সহকারে সব উত্তর দিলো। শান্ত সবগুলো দাত বের করে হেঁসে ফেললো। সে উত্তর পেয়ে খুবই সন্তুষ্ট।

রুমঝুম হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। শান্তর দিকে তাকিয়ে বললো,
-“আচ্ছা, তুমি কোন ক্লাসে পড়?”
শান্ত ভাব নিয়ে বললো,
-” ক্লাস ফোর এ পড়ি আমি। ক্লাসে আমার রোল কত জানো? থার্টি সিক্স। আমি কখনোই কম রোল করি না। ম্যাথে আমি সবচেয়ে বেশি মার্কস পাই। বাংলা আর ইংলিশে বানান ভুল করার জন্য মার্কস কম পাই। এজন্য ভাইয়া আমায় বকে। আমি নাকি গবেট।

জানো ভাবি,ক্লাসে উর্বিন্তা নামে একটা মেয়ে আছে? আমি ওকে খুব ভালোবাসি। প্রপোজ করবো করবো করে করা হচ্ছে না। ওকে দেখলেই আমি কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলি।
উর্বিন্তাও তোমার মতো সুন্দরী জানো? ওকে প্রপোজ করতে সাহায্য করবে আমায়?
উর্বিন্তা একটু একটু রাজি আছে । আমাকে দেখলে মিটিমিটি হাসে। কি যে সুন্দর লাগে।”

রুমঝুম এতোক্ষণ হা করে শান্তর কথা শুনছিলো। ওর একটা প্রশ্নের জবাবে ছেলেটা এতোবড় একটা প্যারাগ্রাফ শুনাবে এটা ওর ধারনাতীত ছিলো।
রুমঝুম একটা ঢোক গিলে বললো,
-“বাবু, তোমার বয়স কত?”

শান্ত এবার দুহাতে মখ ঢেকে ফেললো। মাঝে মাঝে চোখ থেকে আঙুল হালকা সরিয়ে রুমঝুমকে দেখে আবার ঢেকে ফেলছে।
রুমঝুম ভ্রু কুঁচকে শান্তর কাজকাম দেখছে। শান্ত মুখ ঢেকে মাথা নিচু করে বললো,
-“আমার বয়স নয় বছর।”

-“তোর‌ বয়স নয় বছর সে না হয় বুঝলাম কিন্তু এটা মুখ ঢেকে বলছিস কেন? তুই কি কোনো কারনে লজ্জা পেয়েছিস?”
শিরীনের কথা শুনে শান্ত মুখ থেকে হাত সরালো। লাজুক দৃষ্টিতে রুমঝুমের দিকে একবার তাকিয়ে বললো,
-“লজ্জা পাবো না তো কি করবো? ভাবি আমাকে বাবু ডেকেছে জানো? এজন্যই তো লজ্জা পেয়েছি।”

রুমঝুম ভড়কে গেলো। বাবু ডেকেছে বলে এই পিচ্চি লজ্জা পেয়েছে?
গার্ডেনের সবাই ততক্ষণে ড্রয়িং রুমে চলে এসেছে। প্রান্ত সোফায় বসতে বসতে বললো,
-“তো তোরে বাবু না‌ ডেকে বুড়ো ডাকতে বলতেছিস? নয় বছরের বাচ্চাকে বাবু ডাকলছ সমস্যা কি? এখানে লজ্জা পাওয়ার কি হলো?”

শান্ত লজ্জামাখা মুখেই বললো,
-“বাবু কে কাকে ডাকে তোমরা বুঝি জানো না?”
উপস্থিত সকলেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। শান ধপাধপ পা ফেলে শান্তর কাছে এসে ওকে চ্যাঙদোলা করে তুলে নিলো। তারপর সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বললো,
-“আমার বউয়ের সাথে ফ্লার্ট করতেছিস বসে বসে? দাঁড়া করাচ্ছি তোকে ফ্লাট।”

শান্ত হাত-পা ছুঁড়তে ছুঁড়তে চিৎকার করে বললো,
-“তোমার বউ যে আমাকে বাবু ডাকলো এতে দোষ নেই না? যত দোষ নন্দ ঘোষ। ছাড়ো আমাকে। নামাও বলছি।”

দুই ভাইয়ের কান্ডে সবাই হাসতে হাসতে শেষ। শিরীন হাসতে হাসতেই তাকালো প্রান্তর দিকে। তিহানের গায়ের উপর গড়াগড়ি খাচ্ছে প্রান্ত। কি প্রাণবন্ত হাসি। শিরীনের প্রান জুড়িয়ে গেলো সেই হাঁসিতে।

..

দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পর সবাই ছাদে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো। মূল টপিক শান-রুমঝুমের হানিমুন। শান‌ বললো , হানিমুনে এখন যাবে না। হালকা শীত পড়লে যাবে। বাকিরাও তাতে সায় জানিয়েছে।

রুমঝুম মেঘার পাশে বসে শুধু শুনছে ওদের কথা। আড্ডার মাঝেই ফোন বেজে উঠলো বিথীর। বাড়ি থেকে ফোন দিয়েছে। বিথী উঠে এক সাইডে গিয়ে ফোনে কথা বলা শুরু করলো।

বাকিরা আবারও আড্ডায় মন দিলো। মিনিট দুয়েক পরে বিথী মুখ কালো করে এসে বসলো নিজের জায়গায়। ঠোঁট দুটো যথাসম্ভব চেপে রাখছে। কাঁদতে চাচ্ছে না বলেই এটা করছে সে।
সিন্থিয়া বিথীর অবস্থা খেয়াল করলো। বিথীর মুখটা উঁচু করে ধরে বললো,
-“কি হয়েছে বিথী? বাড়ি থেকে কি বললো?”

বিথী ঝরঝর করে কেঁদে ফেললো। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
-“বিকেলে বাড়ি যেতে বলেছে। সন্ধ্যায় ছেলেপক্ষ দেখতে আসবে। বাবার বন্ধুর ছেলে। আমি জানি রে ,এই বিয়েটা হয়ে যাবে ।আটকাতে পারবো না আমি।”

বিথী কথা শেষ করা মাত্রই লাফিয়ে উঠলো তিহান । চেঁচিয়ে বললো,
-“আরে আরে বিয়ে আটকাবি কেন? বিয়ে করে নে বলদী। আহহা.. একটা বিয়ে শেষ হলো তো‌ আরেকটা হবে।”

তিহানের কথা শুনে বিথীর মধ্যে যে কি ঝড় বয়ে গেলো তা কেউ টের পেলো না। চুপচাপ ভালোবেসে যাওয়ার ফল বোধহয় এমনই।
বিথীকে অনবরত কাঁদতে দেখে তিহান আবার বললো,
-“কাঁদিস কেন বাল? আচ্ছা শোন ,তোর বিয়েতেও শানের মতো হানিমুন প্যাকেজ গিফট করবো‌ ওকে? কান্না থামা।”

বিথী কান্না থামালো না। তিহানের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিচে নেমে এলো। ভরদুপুরের তপ্ত রোদেই বেরিয়ে এলো শানদের‌ বাড়ি থেকে। সবাই পিছু ডাকলেও ওর কানে কিছুই ঢোকে নি। এতোবছরের ভালোবাসাটা ও বোঝাতে পারেনি তিহান কে। ওর ভালোবাসাটা তিহানের কাছে ছিলো বিরক্তি। ওর বিয়ে হয়ে গেলে তিহান মুক্তি পেয়ে যাবে । এজন্যই হয়তো এতো খুশি হলো সে।
বিথী ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে ভাবলো,
‘ভালোবাসার মানুষটির বিরক্তির কারন হওয়ার চেয়ে তাকে মুক্ত করে দেওয়াই ভালো।আর ও সেটাই করবে।’

সেদিনের পর কেটে গেছে প্রায় এক মাস। এই এক মাসের মাঝে পাল্টেছে অনেক কিছুই।সিন্থিয়া-মেহেদীর সম্পর্ক একটা নাম পেতে চলেছে। দুদিন বাদেই তাদের বিয়ে। আর বিথীও এখন‌ বিবাহিত।

বিথী সেদিন শানদের বাড়ি থেকে যাওয়ার পর কারো সাথে আর যোগাযোগ করেনি। সেই সন্ধ্যায় পাত্রপক্ষ এসে বিথীকে পছন্দ করে আংটি পরিয়ে দিয়ে যায়। তার এক সপ্তাহ পর বিথীর ইচ্ছেতেই ঘরোয়াভাবে বিয়ে হয়ে যায় তার। বিথী বন্ধুদের কাউকেই জানায়নি বিয়ের কথা। সে এ জন্মে আর তিহানের মুখোমুখি হতে চায় না।

বিথীর সমস্যাটা সিন্থিয়া বুঝতে পেরেছিলো। তবে সেটা অনেক পরে। বিথীর কথা দিনরাত ভাবতে ভাবতেই সিন্থিয়া বুঝেছিলো বিথী কেন হারিয়ে গেলো। তিহানের প্রতি বিথীর পজেসিভনেসটাকে ওরা শুধুমাত্র বন্ধুত্ব হিসেবেই ধরে নিতো। কিন্তু বিথীর মনে যে অন্য কিছু ছিলো তা কখনই বুঝতে পারেনি কেউ।
সিন্থিয়া সবটা বোঝার পর বিথীকে কিছু টেক্সট করে। এরপর কল করলে বিথী রিসিভ করেছিলো। বিথীর বিয়ের তখন আটদিন হয়ে গেছে।

বিথী ফোন রিসিভ করেই কেঁদে ফেলে। কাঁদে সিন্থিয়াও। অভিযোগ করে বলে,
-“নিজের মনের কথাটা কাউকে অন্তত জানাতে পারতিস। এভাবে কেন চেপে রাখলি? তুই যদি মনের কথাটা প্রকাশ করতি তবে আজ গল্পটা ভিন্নও হতে পারতো বিথী।”

বিথী কেঁদেই চলেছে। উত্তর নেই এসবের। অনেকবার বলতে চেয়েও পারেনি। বন্ধুত্বটাও যদি নষ্ট হয় এই ভয়ে। বিথী সেদিন সিন্থিয়াকেই প্রথম জানায় তার বিয়ের কথা। সিন্থিয়া শুনে থ হয়ে গিয়েছিলো। মেয়েটা এতবড় ডিসিশন নিয়ে বিয়েও করে ফেলেছে? বন্ধুত্বের এই মান রেখেছে সে।
সিন্থিয়া তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো। ধীর কন্ঠে বললো,
-“ভালো। ভালো থাক। শুভ কামনা রইলো।”

বিথী আর কিছু বলতে চেয়েও পারলো না। কারন সিন্থিয়া ততক্ষণে ফোন কেটে দিয়েছে। বিথী চোখ বন্ধ করে বিছানায় বসলো। সে তো জানতো এমন হবে। সবার থেকে দূরত্ব বাড়বে তার। তবে আজ এতো কষ্ট হচ্ছে কেন? বন্ধুত্বটা আসলেই হৃদয়ে গাঁথা সম্পর্ক। এ সম্পর্কে টান লাগলে কষ্ট তো হবেই।

তিহান অবশ্য সবটা জানার পরও তার মাঝে কোনো হেলদোল দেখা যায়নি। সে সবসময় বিথীকে ফ্রেন্ডের মতোই দেখেছে। তাছাড়া তিহানের ভালোবাসা, সম্পর্ক, বিয়ে এসবে ইন্টারেস্ট নেই এটা সবাই জানতো। তার কাছে জীবন মানে আনন্দ, আড্ডা, ফুর্তি। সম্পর্কের জটিল ধাঁধা থেকে সে যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রাখে।

.

আরমান এই একমাস দেশের বাইরে ছিলো। এই সুযোগে রুশান তার ব্যাপারে অনেক খোঁজ খবর নিয়ে ফেলেছে। তাহমিনা বেগম বেশ কয়েকবার রুশানকে বলেছে এসব বাদ দিতে কিন্তু রুশানও নাছোড়বান্দা। সে আরমানের সমস্ত কুকীর্তির প্রমান জোগাড় করতে উঠে পড়ে লেগেছে। সে জানে,আরমান দেশে ফিরেই রুমঝুমের জীবন নষ্ট করবে।

রাত প্রায় এগারোটা বাজে। রুশান চুপিসারে বেরিয়ে পরলো বাড়ি থেকে। উদ্দেশ্য আরমানের গোডাউন।
গতকাল রাতেই আরমান ফিরেছে। রুশান গোডাউনের খোঁজ পেলেও ভেতরে ঢুকতে পারে নি। আরমান যেহেতু ফিরেছে এবার তার গোডাউন খোলা পেতেও পারে সে।

রুশান মনে মনে সৃষ্টিকর্তার নাম নিয়ে গোডাউনে ঢুকে পরলো। একদমই শুনশান একটা জায়গা। আরমান হয়তো ভেতরেই আছে এজন্য গোডাউনের দরজা খোলা।
রুশান ক্যামেরা অন করে লুকিয়ে পরলো এক সাইডে। আশেপাশে বিশ্রী গন্ধ। ভেতর থেকে করুন কতগুলো কন্ঠস্বর ভেসে আসছে।

রুশান মূহুর্তেই সতর্ক হয়ে উঠলো। পা টিপে টিপে সেদিকে এগিয়ে গেলো। দরজা দিয়ে উঁকি মেরে দেখলো প্রায় তেরো-চোদ্দটা মেয়ে সেখানে। সবার হাত আর মুখ বাঁধা। সেই রুমের এক কোনে আরমানও আছে। দুইজন লোকের সাথে কথা বলছে।

রুশান এর শরীর বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেলো। ওর বোনের জীবনটাও হয়তো এমন হবে এই শয়তানের লাগাম না টানলে। রুমঝুমের কথা মনে হতেই রুশানের সাহস বেড়ে গেলো।‌ ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে নিলো ওই রুমের মধ্যের। ছবিতে আরমানের মুখটাও স্পষ্ট।

রুশান যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই পা টিপে টিপে বের হয়ে যাচ্ছিলো। এর মধ্যেই আরমান সেই রুম থেকে বের হয়ে এলো। আরমানের থেকে প্রায় দশ হাত দূরত্বে মাথা নিচু করে বের হলো আরেকজন। তাকে দেখেই থমকে গেলো রুশান। সামলাতে পারলো না নিজেকে। হেলে পড়লো পাশে থাকা বড় একটি ড্রামের উপর। সেই শব্দ আরমান অবধি পৌঁছে গেলো। আরমান তার সাথের লোকদুটিকে পাঠালো শব্দের উৎস খোঁজার জন্য।

রুশানের হাত পা কাঁপছে। কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না। উঠে দাঁড়ানোর শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই ওর। সমস্ত শরীর যেন অসাড় হয়ে যাচ্ছে।
রুশান ওই জায়গাতে বসেই ছবিগুলো কাঁপা হাতে হোয়াটসঅ্যাপে প্রথম যার বক্স আছে তার বক্সে সেন্ড করে দিলো। ছবি সেন্ড হওয়ার সাথে সাথেই আনইন্সটল করে দিলো হোয়াটসঅ্যাপ। ফোন ড্রামের পেছনে মেরে দিলো। কোথায় গেলো সে জানে না। তার চোখে এখন সবটা ধোঁয়াশা।

চলবে…..

(ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।)