‘ভালোবাসি’ বলেই ক্লিওপেট্রা রহস্যময়ভাবে হাসলো। আমার চোখের দিকে ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমার অপ্রতিভ লাগতে লাগল। তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তারপর? প্রতিশোধ কীভাবে নিলে?’
ক্লিওপেট্রা ঠান্ডা গলায় বলতে লাগল,
‘আমার ওপর ওই ত্রিবিদ্যা প্রয়োগের পর আমার আত্নবিশ্বাস যেন আরো বহুগুণে বেড়ে যায়। আমি আমার হেপ্নোটাইজ করার ক্ষমতার মাধ্যমে প্রথমেই আমাদের আত্নসাৎ হওয়া সম্পত্তি নিজের নামে লিখিয়ে নেই। এরপর ওই লোক, এলেক্সা এবং আমাদের অফিসের সেই সহকর্মীকে বশ করে একে একে আমাদের পুরোনো বাড়িতে ডেকে আনি।
বাড়ির বেসমেন্টে আমি ওদের চেয়ারে বসিয়ে মোটা দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছিলাম ঠিক পনেরো দিন।
কারণ আমি ঠিক করেছিলাম ধীরে ধীরে ওদের নিঃশেষ করব। একবারেই মেরে ফেললে তো ওরা মরে গিয়ে বেঁচে যাবে। তার চাইতে বরং তিলে তিলে ওদের শেষ করা যাক!
আমি ওদের একেকদিন একেক ধরনের শাস্তি দিতাম। তবে শাস্তি দেবার আগে ওদের হ্যালুসিনেট করতে ভুলতাম না। ওদের বিভ্রম তৈরি হতো। ফলে আমার স্থানে ওরা মা’কে দেখতে পেত। ভাবত মা মরে গিয়েও ফিরে এসেছে। তখন ভয়ে ওদের মুখটা চুপসে যেত। আমি যখন ওদের মারতাম ওরা ভাবত মা মারছে।
আমি ওদের হাত-পায়ের নখ তুলে ফেলতাম। আঙুল ভেঙে দিতাম একটা একটা করে। কখনো হাত ভাঙ্গতাম, কখনো পা। পায়ের গোড়ালি কেটে ফেলে দিতাম। তারপর হাতের বাঁধন খুলে দিতাম। পায়ের পাতা না থাকায় ওরা হাঁটতে পারতো না। যন্ত্রণায় ওরা চিৎকার করত। ওরা যখন মা’য়ের নাম ধরে ডেকে বলত, “ক্যাথরিন, আমাদের ক্ষমা করে দাও! হ্যাভ মারসি অন আস! প্লিজ ক্যাথরিন! আমরা নিজেরাই পুলিশের কাছে আত্নসমর্পণ করবো। গড প্রমিজ! ক্যাথরিন আমাদের ক্ষমা করে দাও! আমাদের ক্ষমা করে দাও! ফর গড সেক!”
তখন আমার এত হাসি পেত! একইসঙ্গে একটা অদ্ভুত তৃপ্তি হত। এত শান্তি লাগতো তখন আমার! উফ আহান! তুমি যদি সে অনুভূতিটা টের পেতে!’
বলেই ক্লিওপেট্রা উচ্চস্বরে হাসতে লাগল। এই প্রথম ওকে ভয় লাগল আমার। এই নিষ্পাপ চেহারার মেয়েটা এত নৃশংসভাবে কাউকে খুন করতে পারে!
ক্লিওপেট্রা আবার বলতে শুরু করল,
‘শেষমেশ ওদের শরীরে আগুন ধরিয়ে দেই। ওরা পুড়ে ছাই হয়ে যায়। ওদের মেরে ফেলার পর আমার হঠাৎ একটা স্বাভাবিক জীবন-যাপন করার ইচ্ছে হয়। কিন্তু ওই যে! ত্রিবিদ্যা! তান্ত্রিক মহিলাটি যদি আমার ওপর শুধু ডাকিনীবিদ্যা প্রয়োগ করতো তাহলে হয়তো আমায় এতগুলো বছর ভুগতে হত না।
প্রথম ক’মাস কোনো সমস্যাই দেখা দেয়নি। উলটো নানানরকম ক্ষমতা আমার আয়ত্তে আসে। কিন্তু ত্রিবিদ্যা প্রয়োগের ষাট দিন পেরোতেই সব ওলট-পালট হয়ে যায়। রাত বারোটার পর আমি কোনো সাধারণ মানুষ থাকতাম না। হয়ে উঠতাম পিশাচের চাইতেও ভয়ংকর। আমার শুধু মানুষের মাংস খেতে ইচ্ছে করতো! ‘
আমি বিস্ফোরিত চোখে ক্লিওপেট্রার দিকে তাকালাম। ও হয়তো কিছু বুঝতে পারল। তাই বলল, ‘ভয় পাচ্ছো আমায়?’
আমি তৎক্ষনাৎ মাথা নাড়ালাম। ও বলল, ‘ভয় পেয়ো না। তোমার সঙ্গে ঘুমোলে আমার কখনো অমন ইচ্ছে জাগে না।’
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘পরে? তুমি ধরে ধরে মানুষ খেতে?’
ও আওয়াজ করে হেসে দিল। বলল, ‘কখনোই না। অন্যের মাংস খেতে যাব কেন! আমার নিজের শরীর আছে না?’
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। সম্বিৎ ফিরে পেতেই আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না। দৌড়ে বাথরুমে চলে গেলাম। দরজার কাছে পৌছাতেই বমি করে মেঝে ভাসিয়ে ফেললাম। ক্লিওপেট্রা আমার পিছু পিছু এসেছে। ও আমার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল, ‘ঠিক আছো আহান?
আমি হাঁপাতে হাঁপাতে উপর-নিচ মাথা ঝাঁকালাম।
কিছু সময় লাগল আমার স্বাভাবিক হতে। স্বাভাবিক হতেই ওকে বললাম, ‘তুমি নিজের শরীরের মাংস খেতে? ‘
ও বলল, ‘উপায় কী! নিজেই তো ডাকিনী হবার পথ বেছে নিয়েছিলাম। পরে নাহয় তান্ত্রিক আমায় ত্রিবিদ্যায় ফাসিয়ে দিয়েছিল। এর সম্পূর্ণ দায় আমার। খামোখা কেন নিষ্পাপ মানুষদের খেতে যাব! এর থেকে নিজেকেই নিজের খাবার বানানোটা বেটার নয় কি!’
‘তাহলে তুমি কীভাবে বেঁচে আছো? ‘
ও বলল, ‘ বেশি খেতে হত না। এক কামড়ই যথেষ্ট ছিল। সে ক্ষতও আবার রাত পেরোতে না পেরোতেই সেরে যেত।’
আমি আর সেসব শুনতে পারছিলাম না। তাই এড়াতে বললাম, ‘আচ্ছা, পরে কী করলে?’
ক্লিওপেট্রা লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পরল। শুয়ে বলল, ‘আর বসে থাকতে পারছি না। আজ কি অন্যদিনের চাইতে বেশি ঠান্ডা পরেছে আহান?’
আমি বললাম, ‘তুমি ঠান্ডা অনুভব করতে পারো?’
‘আগে পারতাম না। হঠাৎ আজ পারছি। তুমি কি আমাকে ভালোবাসতে শুরু করে দিয়েছো?’
আমি বুঝলাম না ওর কথার মানে। তাই জিজ্ঞেস করলাম, ‘মানে?’
ও চুপ করে চোখ বন্ধ করে শুয়ে রইল। আমি বললাম, ‘তারপর কী করেছিলে বলবে না?
ক্লিওপেট্রা শুয়ে শুয়েই বলতে লাগল, ‘এভাবেই দিন যাচ্ছিল আমার। অদৃশ্য হয়ে। নিজের শরীরের মাংস খেয়ে।
তোমার কোনো ধারণা নেই আহান আমি কতবার নিজেকে শেষ করে দিতে চেয়েছি! শতবার আত্নহত্যা করতে গিয়েছিলাম আমি। কিন্তু প্রত্যেকবারই ব্যর্থ হয়েছি। ফাঁসি দিতে গেলে দড়ির সঙ্গে ঝুলে থাকতাম কিন্তু কোনো ব্যাথা পেতাম না। ওভাবেই সারারাত ঝুলে থাকতাম মরতাম না। শরীরে আগুনও লাগিয়ে দিয়েছিলাম আমি। অথচ সামান্যও পুড়তো না। পানিতেও ঝাপ দিয়েছি। পানির নিচে থেকেও আমার কিচ্ছু হত না। গাড়ির সামনে ঝাপ দিতে গেলে অদৃশ্য হয়ে যেতাম।
মোটকথা, একটা অভিশপ্ত জীবন কাটছিল আমার। মরতেও পারবো না, বাঁচাটাও মৃত্যুর চাইতে যন্ত্রণাদায়ক।
এ অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে তান্ত্রিক মহিলাটির কাছে ছুটে যাই। কিন্তু উনিও কোনো সমাধান দিতে পারে না। শেষে তান্ত্রিক মহিলাটি তার গুরুর কাছে এর সমাধান চায়। তিনি আমাকে দেখা করতে বলে। সাক্ষাৎ হলে উনি জানান, এর একটামাত্রই সমাধান আছে। আমাকে একজন মানুষকে বিয়ে করতে হবে। তাও আবার কোনো যেনতেন মানুষ নয়। একজন সত্যিকারের ভালো মানুষ। যে জীবনে কোনো পাপ করেনি। ফুলের মতো নিষ্পাপ। তবে আরেকটাও শর্ত আছে। সেই মানুষটাকে ভালোবেসে স্বেচ্ছায় আমাকে বিয়ে করতে হবে।
আমি ভেবেছিলাম অমন সাধু পুরুষ এ যুগে আমি কই পাবো! হয়তো আমার সারাজীবনটাই অভিশপ্তভাবে কাটাতে হবে!
কিন্তু আমাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে তার কয়েকমাস পরেই তুমি আমেরিকা এলে।
সেদিন আমি একা একটা লোকাল রেস্টুরেন্টে বসে লাঞ্চ করছিলাম। তুমি যখন রেস্টুরেন্টে ঢুকছিলে তোমার সঙ্গে আমার চোখাচোখি হয়।’
বলে ক্লিওপেট্রা একটু থামে। তারপর অভিমানী সুরে বলে, ‘অথচ তোমার একটুও মনে নেই সে কথা।’
আমি মনে করার চেষ্টা করি। কিন্তু মনে পড়ে না। আমাকে ভাবতে দেখে ক্লিওপেট্রা বলে,
‘থাক সাধুপুরুষ। আপনার আর কষ্ট করে ভাবতে হবে না।
তোমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই এক সেকেন্ড সময় লাগে আমার তোমার মন পড়ে নিতে। এরপর তোমার কথা আমি গুরু তান্ত্রিককে জানাই। উনি বলেন তবুও তোমাকে একটা পরীক্ষা করে নিতে।
তুমি বাংলাদেশে যেদিন চলে এলে সেদিন তোমার সঙ্গে একই ফ্লাইটে আমিও ঢাকা ফিরি। এরপর কিছু মাস যায়। তোমাকে আমি নিরীক্ষণ করি। একদম শেষ পর্যায়ে এসে পরীক্ষণ করার স্বীদ্ধান্ত নেই। তাই আমি রোজ তোমার সঙ্গে এসে ঘুমিয়ে থাকতাম। প্রথমদিনই তুমি টের পেয়ে যাও আমি তোমার পাশে। একদম নগ্ন গায়ে প্রথমদিন থেকে আজ পর্যন্ত তোমার সঙ্গে এসে ঘুমোই। ছুঁয়ে দেখা তো দূর কোনোদিন কামনার দৃষ্টিতেও দেখোনি। এইযে এখনও ভাবছ, “এই মেয়েটার চোখে এতো মায়া কেন!”
কথা থামিয়ে ক্লিওপেট্রা হো হো করে হাসতে লাগল। আমার খানিক লজ্জা লাগল। এই মেয়ে কেন যে মনের কথা পড়তে পারে!
দিনের আলোয় বেরোলে প্রতিবেশীরা নানান প্রশ্ন করবে। জানতে চাইবে আমরা কোথায় যাচ্ছি। কেন যাচ্ছি। হয়তো আমরা শহর ছেড়ে পালাচ্ছি এ কথা লোকমুখে ছড়িয়ে পড়বে। ধীরে ধীরে খবরটা পৌঁছে যাবে ওই লোকটার কাছে। এসব ভেবে মা স্বীদ্ধান্ত নেয় রাতের আঁধারে রওয়ানা দেবার।
সন্ধ্যা পেরোতেই আমরা বেরিয়ে পড়ি। এলেক্সা বলেছিল ওর পরিচিত লোক আছে। তার ট্যাক্সিতে গেলে পুরো রাস্তা নিরাপদে থাকতে পারব।
আমরা এলেক্সার ঠিক করা ট্যাক্সিতে করেই গ্রামে রওনা দেই।
একসময় গাড়ি চলতে শুরু করে। কিছুসময় যেতেই ট্যাক্সি ড্রাইভার গাড়ি থামায়। আমাদেরকে বলে, সে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যাচ্ছে। পাঁচ মিনিট বসতে। পাঁচ মিনিটের স্থানে আঁধ ঘন্টা পেরিয়ে যায়। ড্রাইভার আসেনা। আমরা ভয় পেতে শুরু করি। এমনিতেই রাস্তাটা ছিল নিরব। দু’ধারে ঘন গাছপালা। ছোটোখাটো জঙ্গলের মতো।
মা’র হঠাৎ সন্দেহ হতে শুরু করে। ড্রাইভারের কি কোনো বিপদ হল! মা আমাদের গাড়িতে বসিয়ে রেখে আশপাশ খুঁজতে যায়। কিন্তু কোত্থাও ড্রাইভারকে খুঁজে পায় না।
এবার মায়ের মনের সন্দেহের দানাটা বেশ বড়সড় আঁকার ধারণ করে। মা আমাদের নিয়ে অতিদ্রুত সেখান থেকে বেরোতে চায়। আমরা রাস্তার কিনারে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করি লিফটের আশায়। কিন্তু একটা গাড়িও আসছিল না। অনেকক্ষণ পর একটা গাড়ি আসে। কিন্তু গাড়ির মালিক আমাদের লিফট দিতে রাজি হয় না। তার কিছুক্ষণ পরে আরেকটা গাড়ি দেখতে পাই আমরা। গাড়ির হেডলাইটের আলোয় ভেতরের মানুষদের দেখা যাচ্ছিল না। তবে একটু কাছে আসতেই মা গাড়ির ভেতরে বসা লোকগুলোকে চিনে ফেলে। মা আমাকে আর আপুকে পালাতে বলে। আমরা মা’কে একা ফেলে যেতে চাইনা। মা আমাদের ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দেয়। আমাদের কসম দেয়। দৌড়ে পালাতে বলে। চিৎকার করে বলে যে পর্যন্ত লোকারণ্য স্থানে না পৌঁছাই সে পর্যন্ত যেন আমরা না থামি।
আমি, আপু অনিচ্ছায় মায়ের কথা মেনে পালাতে থাকি। আমি দৌড়ের গতি কমিয়ে পেছনে তাকাই। দেখি জানোয়ারটা আমার মা’কে হিচড়ে তার গাড়িতে উঠিয়ে নিচ্ছে। দূর থেকেই মায়ের সঙ্গে আমার চোখাচোখি হয়। আমি বুঝতে পারি মা কাঁদছে। মা সে অবস্থাতেই হাতের ইশারায় আমাকে পালাতে বলে। আমি হাত মুঠো করে দাঁতে দাঁত চেপে দৌড়ের গতি বাড়িয়ে দেই। মা’কে, আপুকে পেছনে ফেলে পালাতে থাকি অজানা গন্তব্যে।
জঙ্গল পেরোতেই একটা অজপাড়াগাঁ। অজপাড়াগাঁতে পৌঁছে আমি দৌড় থামিয়ে দেই। অকস্মাৎ জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পরি।’
কথা থামিয়ে ক্লিওপেট্রা কাঁদতে শুরু করে। আমার মায়া লাগে ওর জন্যে। মেয়েটা এত দুঃখী!
আমি ওর কাঁধে স্বান্তনার হাত রাখি।
ও কান্না থামিয়ে আবার বলতে শুরু করে,
‘জ্ঞান ফিরতেই দেখি আমি একটা ঘরে বিছানায় শুয়ে আছি। উঠে বসতেই দেখি আমার সামনে চেয়ারে বসে একজন মহিলা ঝিমুচ্ছে। আমাকে জাগতে দেখে উনি ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আমি ঠিক আছি কি না, এসব কীভাবে হল নানান প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন। মহিলাটিকে আমার বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। আমি ওনাকে সব খুলে বলি। সব শুনে উনি খুব কষ্ট পান। আমাকে স্বান্তনা দিয়ে ভাগ্য মেনে নিতে বলেন। এরপর থেকে আমি ওনার কাছেই রয়ে যাই। জেনিফার আন্টি ছিলেন ডিভোর্সি। তিনি কোনোদিন মা হতে পারবেন না বলে তার স্বামী তাকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়।
জেনিফার আন্টি নিজের সন্তানের মতোন লালনপালন করে আমাকে বড় করে তোলে। মায়ের অভাব উনি অনেকটাই ভুলিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু আমার মনের মধ্যে প্রতিশোধের আগুন তখনো দাউদাউ করে জ্বলছিল।
আমার মা’কে ওই লোক রেপ করে খুন করে। আপুর কোনো খোঁজ পাইনি। আমার ধারণা ওই লোক আপুকেও মেরে ফেলেছে। আমাকে খুঁজে পেলে হয়তো আমাকেও মেরে ফেলত!
আমি জেনিফার আন্টিকে আমার প্রতিশোধ নেবার স্বীদ্ধান্ত জানাই। জেনিফার আন্টি আমাকে বলে উনি আমাকে সাহায্য করবে প্রতিশোধ নিতে। তবে এখন নয়। আমি যখন প্রাপ্তবয়স্ক হব তখন। আমি বাধ্য হয়ে আন্টির কথা মেনে নেই। কারণ তখন তিনিই ছিলেন আমার মা,বাবা, আত্নীয়স্বজন সবকিছু।
বিশে পা রাখার পরপরই আমি আমার রিভেঞ্জ নেবার মিশনে নেমে পরি। জানতে পারি ওই লোকের সঙ্গে সেদিন আরো দু’জন ছিল। দুজনের মধ্যে একজন ছিল এলেক্সা। আরেকজন আমাদের অফিসেরই একজন কর্মচারী। আর এই তিনজন মিলেই আমার বাবাকে খুন করে। জানার পর ঘৃণায়, রাগে আমার গা রি রি করে উঠে। আমি আরো মত্ত হয়ে উঠি প্রতিশোধের নেশায়।
কিন্তু ভাগ্য বোধহয় আমার সহায় ছিল না। সে বছরই টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়ে আমাকে সম্পূর্ণ একা করে দিয়ে জেনিফার আন্টি মারা যান।
জেনিফার আন্টির মৃত্যুর পর আমার অবস্থা পাগলপ্রায়। আমি নাওয়াখাওয়া বাদ দিয়ে দিনরাত কাঁদি। আমার অবস্থা দেখে জেনিফার আন্টির এক প্রতিবেশী মহিলা আমাকে রোজ সঙ্গ দিতে আসত। যাতে আমি উল্টো পালটা কিছু একটা করে না বসি। কথায় কথায় আমি ওনাকে সব বলে দেই আমার প্রতিশোধের ব্যাপারে। আমার কথা শোনার পর উনি আমাকে আশ্বাস দেন সাহায্য করবার।
তারপরের দিন তিনি আমাকে একজন তান্ত্রিক ধরনের মহিলার কাছে নিয়ে যান। তিনি জানান ওই মহিলাটি আমার শত্রুদের ওপর কালো-জাদু করে তাদের ধ্বংস করে দিতে সাহায্য করবে। এরপর থেকে আমি রোজ একাই ওই তান্ত্রিক মহিলার কাছে যেতাম। কিন্তু আমার উদ্দেশ্য ছিল কালো জাদু করা নয়। নিজের হাতে আমার শত্রুদের হত্যা করা।’
এ পর্যন্ত বলে ক্লিওপেট্রা কথা থামায়। আমাকে বলে, ‘ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে। এবার আমাকে যেতে হবে।’
আমি ওকে বাঁধা দেই, ‘কিন্তু কথা তো শেষ হয়নি।’
ও বলে, ‘বাকিটা রাতে বলবো আহান। এবার আমাকে যেতে দাও প্লিজ।’
আমি আর ওকে আটকাই না। বলি, ‘আচ্ছা, ঠিকাছে।’
পরে কী ঘটেছিল জানার জন্য আমি অস্থির হয়ে উঠি। অস্থিরতায় বাকিসময়টকু আমার আর ঘুম হয়না। দিনেও সারাদিন সবকিছুই অমনোযোগীভাবে কাটালাম। অফিসের কাজেও মন বসল না। মা বোধহয় কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছিল। বাসায় ফেরার পর জিজ্ঞেস করল, ‘তুই কি কিছু নিয়ে চিন্তিত, বাবা?’
আমি মাথা ঝাঁকিয়ে ‘না’ বলি।
রাতে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ি। মিথি কিংবা ক্লিওপেট্রার অপেক্ষা করতে থাকি। রাত দুটো বেজে যায় আমার ঘুম আসেনা। দুটোর পরেই মেয়েটা আসল। আমাকে জেগে থাকতে দেখে বলল, ‘ঘুমোওনি?’
আমি না সূচক মাথা নাড়াই। ও আমাকে আর কিছু জিজ্ঞেস করে না।
আমি ওকে বললাম, ‘তারপর তুমি কী করেছিলে?’
ক্লিওপেট্রা বলতে শুরু করল,
‘তান্ত্রিক মহিলাকে আমি জানাই আমি নিজ হাতে বাবা-মায়ের হত্যাকারীদের খুন করতে চাই। উনি আমাকে বলে, একটা উপায় আছে। কিন্তু সেটা করাটা ঠিক হবে না।
আমি জিজ্ঞেস করি, কী উপায়।
তিনি বলেন, ডাকিনীবিদ্যা!
প্রতিশোধের নেশা এমন ভাবে আমায় পেয়ে গেছিল যে আমি হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে সেটাই আমার ওপর প্রয়োগ করতে বলি। আর আমার জীবনের সবচাইতে বড় কাল সেটা!
তান্ত্রিক মহিলাটি শুধু ডাকিনীবিদ্যা নয়। “ডাকিনী”, “শাকিনী”, “হাকিনী” এই তিন বিদ্যাই আমার ওপর প্রয়োগ করে। কিন্তু আমার অনুমতি ছাড়া। শুধুমাত্র তার নিজের এক্সপেরিমেন্টের জন্য। অবশ্য আমি তখন সেটা জানতাম না। পরে হিতে-বিপরীত ঘটতে শুরু করলে তাকে চেপে ধরি। হুমকি দেই জীবন নিয়ে নেবার। তখন তান্ত্রিক মহিলাটি বাধ্য হয়ে সব আমাকে বলে দেয়। কিন্তু তখনো ব্যাপারটাকে তেমন গুরুত্ব দেইনি। যখন সাইড-এফেক্ট দেখা দিতে শুরু করল তখনই আমি ব্যাপারটাকে আমলে নেই।’
আমি জানতে চাইলাম, ‘কী সাইড ইফেক্ট দেখা দিচ্ছিলো? ‘
ও বলল, ‘হঠাৎ হঠাৎ আমি অদৃশ্য হয়ে যেতে শুরু করলাম। আমি সবাইকে দেখতে পেতাম, কিন্তু কেউ আমাকে দেখতে পেত না।’
আমি বললাম, ‘কিন্তু এটা তো তোমার রিভেঞ্জ নেবার জন্য একটা প্লাস পয়েন্ট ছিল।’
‘মোটেও না। কারণ অদৃশ্য হওয়াটা কখনোই আমার হাতে ছিল না। আমি নিজেই জানতাম না কখন অদৃশ্য হব আর কখন দৃশ্য হব! যেমনঃ এখন অদৃশ্য হয়ে গেলাম আবার এখনই দৃশ্যমান হয়ে যেতাম। মাঝে মাঝে সপ্তাহও পার হয়ে যেত আমার ঠিক হতে।’
‘ওহ স্যরি।’
‘ইটস ওকে। তোমার মনে প্রশ্ন জেগেছে তুমি জিজ্ঞেস করেছ। এতে তো দোষের কিছু নেই।’
আমি বললাম, ‘তারপর কী হল? তুমি কীভাবে প্রতিশোধ নিলে?’
ক্লিওপেট্রা বলল,
‘ওই ত্রিবিদ্যা আমার ওপর প্রয়োগ করার পর আমার মাঝে পরিবর্তন দেখা দিতে শুরু করল। আমি অদ্ভুতরকমভাবে শক্তিশালী হয়ে উঠলাম। যে কেউ আমার চোখে একবার তাকালেই তাকে হেপ্নোটাইজ করে ফেলতে পারতাম। কাউকে বশে আনতে আমার দু’সেকেন্ডও সময় লাগতো না।’
অকস্মাৎ আমার কৌতুহল জাগল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমাকেও কি হেপ্নোটাইজ করে বশে আনতে পারবে?’
ও উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ। ‘
‘তাহলে যে আমার ক্ষতি করলে না! কেন হেপ্নোটাইজ করোনি আমায়?’
‘কারন আমি যে তোমায়…! ‘
‘কী?’
ক্লিওপেট্রা আমার কানের কাছে ওর মুখ নিয়ে এল। এরপর ফিসফিস করে বলল, ‘ভালোবাসি!’
আমার সারা শরীর ও মন জুড়ে একটা অদ্ভুত শিহরণ ছেয়ে গেল।
প্রায় দু’মাস হতে চলল মেয়েটার আগমনের। তবে এটাকে ঠিক আগমন বলা যায় কি না জানিনা। মাঝরাতে কোত্থেকে এসে যেন উদয় হয়। সকাল হতেই চলে যায়। ওর এ রহস্যের উদঘাটন কবে করতে পারব তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন।
ক্লিওপেট্রার কিছু কিছু বিষয় অত্যন্ত রহস্যময়। যেগুলোর কোনো লজিক আমি আপাতত খুঁজে পাচ্ছি না। যেমনঃ বাড়ির সকলের মনের কথা ও শুনতে পারে। বুঝতে পারে কে কী ভাবছে। আবার এমন একটা স্থান যেখানে ও উপস্থিত নেই কিংবা ছিলনা। কিন্তু সে স্থানে কী ঘটেছে সেটা সে স্পষ্ট বলে দিতে পারে! যেন সবকিছু সে নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করেছে।
অফিসে আমার সহকর্মী একটা মেয়ে আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। ওর নাম ফারিয়া। ক্লিওপেট্রার থেকে রেহাই পেতে আমি ফারিয়ার প্রস্তাবে রাজি হবার স্বীদ্ধান্ত নেই। কিন্তু ক্লিওপেট্রা আশ্চর্যজনকভাবে সেটা টের পেয়ে যায়। আমাকে হুমকি দেয় ফারিয়ার থেকে দূরে থাকতে।
আমি ক্লিওপেট্রার নিষেধ শুনিনি। ফারিয়ার সঙ্গে আরো বেশি করে মিশতে শুরু করি। রোজ দু’জনে একই সঙ্গে একই বাসে অফিসে যাই। ফিরিও একই সঙ্গে। অফিসের ক্যান্টিনে একসঙ্গে লাঞ্চ করি। এভাবে চলতে থাকলে হয়তো কোনো সমস্যার সৃষ্টি হতো না। কিন্তু ফারিয়া একদিন বিরাট ভুল করে বসে। একদিন অফিস ছুটির দিনে ও আমাকে ফোন করে বলে আমার সঙ্গে ওর খুব জরুরী দরকার। দেখা করতে। কথা ছিল মার্কেটের সামনে দেখা করবার। ফারিয়া এসে বলে আজ লাঞ্চে ও আমাকে ট্রিট দিতে চায়। আমি আগ্রহ দেখাই না। ফারিয়া জোরাজুরি শুরু করে। বাধ্য হয়ে রাজি হই। লাঞ্চ থেকে ফেরার সময় রিকশায় ফারিয়া হঠাৎ আমার গালে টুপ করে চুমু খেয়ে বসে। ব্যাস! এটাই ওর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়।
পরদিন ফারিয়া অফিসের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছিল। সিড়ি বেয়ে নামার সময় ওকে না কি কেউ একজন পেছন থেকে ধাক্কা দেয়! তৎক্ষনাৎ ও সিড়ির গায়ে গড়াতে গড়াতে নিচে পড়ে যায়। মাথায় গুরুতর আঘাত লাগে ওর। হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় ওকে। জ্ঞান ফেরার আগে একবার এবং পরে দু’বার ওকে দেখতে গিয়েছিলাম। ওই আমাকে তৃতীয়বারের সময় সব খুলে বলে। আমি বুঝে যাই এ কাজ কার হতে পারে।
সেদিন রাতে ক্লিওপেট্রা এলে ওকে জেরা করি ও কেন এমনটা করল। ও বলে, ‘আমি তো এমনটা করতে চাইনি আহান! তুমিই আমাকে বাধ্য করেছ। তুমি যদি আমার কথা শুনতে…।’
আমি ক্লিওপেট্রাকে থামিয়ে দেই। ‘চুপ! একদম চুপ! তোমার সঙ্গে আমি আর একটা কথাও বলতে চাইনা। তোমার মতো বর্বর, নিকৃষ্ট প্রাণীর সঙ্গে কথা বলা তো দূর তোমার মুখও আমি দর্শন করতে চাইনা। তুমি আমার জীবন থেকে চলে যাও! মুক্তি দাও আমাকে!’
এরপর এক সপ্তাহ রাগ করে ক্লিওপেট্রা আর আসেনি। সাতদিন পর আবারও কোত্থেকে এসে যেন উদয় হয়। আমি জিজ্ঞেস করি, ‘ নির্লজ্জের মতোন আবার ফিরে এলে কেন? তোমাকে না চিরতরে চলে যেতে বলেছি?’
ক্লিওপেট্রা উত্তর দেয়, ‘কীভাবে যাবো বলো! তোমাকে যে আমার খুব দরকার!’
ও বলল, ‘কাল রাতে আমি তোমাকে সব বলবো। সব বলতেই তো ফিরলাম। কিচ্ছু লুকাবো না। এরপরও যদি তোমার মনে হয় আমি ঘৃণ্য, পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট তাহলে আমার আর কিছুই করার নেই। গলায় দড়ি দেবা ছাড়া।’
কিছুসময় থেমে ক্লিওপেট্রা আবার বলল, ‘একটা জরুরী কথা তোমাকে আজকেই জানানো দরকার। নয়তো আরো দেরিতে বললে হয়তো তুমি খুব রাগ করবে।’
আমি জানতে চাইলাম, ‘কী কথা?’
ও জোরে একটা নিশ্বাস নিয়ে নরম স্বরে বলল, ‘আমি মিথি! তোমার মিউ!’
আমি জ্ঞান হারালাম। সকালে আর অফিসে যেতে পারলাম না। একটা ঘোরের মধ্যে রইলাম সারাদিন। মা এসে একটু পরপর জিজ্ঞেস করতে লাগল, ‘আহান! বাবা আমার! তোর শরীর খারাপ লাগছে?’
আমি প্রতি উত্তরে ‘না’ বললেও মা থামলো না। প্রতি ঘন্টায় অন্তত পাঁঁচবার এসে এই এক কথা জিজ্ঞাসা করতে লাগল।
ওই ঘটনার পর আমি মিথিকে কোলে নেওয়া সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিলাম। যতটা পারলাম ওর থেকে দূরে রইলাম। কিন্তু মিথি যেন হাল ছাড়বার পাত্রী নয়! ও সারাদিনই আমার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে লাগল। পায়ে পায়ে হাঁটতে লাগল। যেখানেই পা রাখতে নেই সেখানেই গিয়ে দাঁড়ায়। বিরক্ত হয়ে মা’কে বললাম ওকে মায়ের ঘরে বন্দী করে রাখতে। আমার এহেন আচরণে মা প্রচন্ড অবাক হল। আমার এত আদরের পোষা প্রাণীকে হঠাৎ দূরে ঠেলে দিচ্ছি বলে।
সেদিন রাতেই আবার ক্লিওপেট্রা কিংবা মিথি যেটাই হোক মেয়েটা আমার ঘরে আসল। ঘুম ভাঙ্গতেই পাশে দেখতে পাই ওকে। আমাকে জাগতে দেখে ও শোয়া থেকে উঠে বসে। বলে, ‘ আহান তোমাকে আমার অনেক কিছু বলার আছে।’
আমি জবাব দেই না। ও আবার বলে, ‘আমি জানি তুমি রাগ করে আছো। আচ্ছা ঠিকাছে আজ তোমাকে কোনো কথা বলতে হবে না। আজ শুধু আমি বলবো, তুমি শুনবে।’
কিছুক্ষণ থেমে দম নিয়ে ক্লিওপেট্রা আবার বলতে শুরু করে,
‘আমার বাবা ছিলেন মিশরীয়। আর মা আমেরিকান। বাবা ব্যাবসার কাজে আমেরিকা গেলে মায়ের সঙ্গে তার সেখানে পরিচয় হয়। তাদের পরিচয় ধীরে ধীরে প্রণয়ে রূপ নিতে থাকে। একসময় তারা বিয়ে করার স্বীদ্ধান্ত নেন। কিন্তু বাবা মুসলিম হলেও মা ছিলেন খ্রিষ্টান। তাই বাবার পরিবার মা’কে মেনে নেন না। মা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় তার বাবা মারা যায়। আমার নানুর একমাত্র মেয়ে ছিল আমার মা। মেয়ের পছন্দে তিনি আর দ্বিমত করেননি। তাই মায়ের তরফ থেকে তেমন কোনো সমস্যা তৈরি হয়নি।
বাবার পরিবারের সৃষ্ট অনেক ঝড় ঝঞ্জাটের পর বাবা-মা পরিবারের অমতেই বিয়ে করেন। বিয়ের পর মা আর বাবা মিশরেই থাকতেন। পরিবার থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় বাবার আর্থিক অবস্থা খুব একটা ভালো ছিল না। তাই ব্যাংক থেকে মোটা টাকার লোন নিয়ে পার্টনারশিপে ব্যাবসা শুরু করেন। মোটামুটি চলছিল বাবার ব্যাবসা।
কিন্তু আমার বড় বোন জন্ম নেবার কিছুদিন পর হঠাৎই বাবার ব্যাবসায় ধ্বস নামে। আগে থেকেই বাবার ব্যাবসার অবস্থা খুবই জটিল ছিল। কিছুতেই উন্নতি করতে পারছিলেন না। তার মধ্যে আবার প্রতারণার শিকার হন। বাবার ব্যাবসার সহযোগীই বাবাকে ধোঁকা দেয়। ফলে সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থার সৃষ্টি হয়। তার ওপর আবার ব্যাংকের মোটার টাকার ঋণ তখনও শোধ হয়নি। এমনও দিন গিয়েছে মা-বাবা শুধু মাত্র এক টুকরো রুটি খেয়ে দিন-রাত পার করে দিয়েছে। এমতাবস্থায় মা বাবাকে পরামর্শ দেয় আমেরিকায় চলে যাবার। আমেরিকায় মায়ের কিছু জায়গা- জমি আছে। সেগুলো বিক্রি করলে নিশ্চয়ই ঋণ পরিশোধ করতে পারবে।
আমেরিকায় চলে যাবার পর মায়ের জমি বিক্রি করে বাবা কিছু টাকা আয় করেন। সে টাকা দিয়ে ঋণ পরিশোধ করে পুনরায় ব্যাংক থেকে লোন তোলেন। ব্যাবসা শুরু করার কিছুদিন পর আমি জন্ম নেই। আমি জন্ম নেবার পর থেকেই না কি অদ্ভুতভাবে বাবার ব্যাবসা রমরমাভাবে চলতে আরম্ভ করে। আমাদের আর্থিক অবস্থায় স্বচ্ছলতা ফিরতে শুরু করে। সংসারেরও উন্নতি হয়। সেজন্য বাবা আমাকে তার ভাগ্যলক্ষ্মী ভাবতে শুরু করেন।
প্রাচীন মিশরের রানী ছিলেন ক্লিওপেট্রা। তিনি ছিলেন মিশরের সর্বশেষ ফারাও এবং নারী শাসক। গ্রিক মিথ অনুযায়ী তিনি ছিলেন অসম্ভব রকমের রূপবতী এবং একই সঙ্গে অশেষ গুনের অধিকারী। তার সৌন্দর্যে পাগল হত না এমন কোনো মানুষ ছিল না। তার গুন সবাইকে মুগ্ধ করে দিত। তার গভীর নীল চোখের দিকে তাকালে না কি চোখ ফেরানো দায় হয়ে পড়তো।
তার রূপের সঙ্গে আমার বাবা-মা আমার মিল খুঁজে পান। এমনকি কাকতালীয়ভাবে আমার চোখও গভীর নীল রঙের। আমার বাবার বিশ্বাস ছিল আমি বড় হয়ে তার মতোই গুনবতী এবং বিচক্ষণ হব। এছাড়া বাবা ভাবতেন আমিই একদিন তার গৌরবের কারণ হব। তাই তিনি রানী ক্লিওপেট্রার নামের সঙ্গে মিল রেখে আমার নাম রাখেন ক্লিওপেট্রা! বাবার গৌরব!
আফসোস! বাবার জীবদ্দশায় আমি বাবার গৌরবের কারণ হতে পারিনি। আমার যখন বারো বছর বয়স তখন বাবাকে খুন করা হয়। শুধুমাত্র বাবার সম্পত্তির লোভে। কারণ তখন আমরা পুরোপুরি স্বচ্ছল হয়ে পড়েছিলাম। ইতোমধ্যেই বাবার অঢেল সম্পত্তি হয়ে গিয়েছিল। বাবাকে কে বা কারা খুন করে আমরা জানতে পারিনি।
বাবা মারা যাওয়ার পর মা-ই তার ফেলে যাওয়া ব্যাবসা সামলাতে শুরু করেন। বিধবা, একাকী পেয়ে মা’র দিকে যারা চোখ তুলে তাকানোরও সাহস পেত না তারাই মা’কে খারাপ প্রস্তাব দিতে শুরু করে। মা বুদ্ধিমত্তার সাথে প্রতিটি পরিস্থিতিই নিয়ন্ত্রণ করেছে। কিন্তু একবার এক ক্ষমতাশালী প্রচুর বিত্তবান লোকের নজর পড়ে মায়ের ওপর। মা তাকে নাকচ করে দিলে মা’কে সে হুমকি দেয়। আমাদের ক্ষতি করবে। তাই মা শহর ছেড়ে গ্রামে পালানোর পরিকল্পনা করে। মায়ের পরিকল্পনার কথা একমাত্র মায়ের বেস্টফ্রেন্ড এলেক্সাই জানত। এলেক্সা মা’কে জানায় সে সবরকমের সাহায্য করবে মা’কে পালানোর জন্য।
টাকার কাছে আজীবনের বন্ধুত্বও বোধহয় অর্থহীন! অঢেল টাকার লোভে এলেক্সা ওই লোককে মায়ের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে দেয়। ওই লোক এবং এলেক্সা মিলে নতুন ষড়যন্ত্র করে।
খোলা জানালা দিয়ে বাতাস ঢুকে ঘরটাকে হিমশীতল করে তুলেছে। গায়ে একটা সুতোও না থাকায় ঠান্ডায় মেয়েটা বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছে। হঠাৎই ওর জন্য কেমন মায়া অনুভব করলাম আমি। সাদা লেপটা ওর গায়ে আলতো করে জড়িয়ে দিলাম। ও ওপাশ ফিরে শুয়ে আছে। আমার ওর মুখটা ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করল। আমি উঁকি মারলাম ওপাশটায়। এই প্রথম ওর চুল আমার নজর কাড়ল। কাঁধ অব্দি ঘন কালো চুল। কিছু চুল মুখে লেপ্টে আছে। আমি হাত দিয়ে সেগুলো ওর কানের পাশে গুঁজে দিলাম। ও মৃদু নড়ে উঠল। আর আমার টনক নড়ল। এসব আমি কী করছি! এত বড় মোক্ষম সুযোগটাকে আমি এসব করে নষ্ট করছি! আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করলাম না।
ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে নামলাম। নিঃশব্দে বেডরুমের দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে আবার দরজা লাগিয়ে দিলাম। যাতে মেয়েটা সুযোগ পেয়ে পালাতে না পারে। মা’কে, অহনা’কে ঘুম থেকে ডেকে তুললাম একটা জিনিস দেখাবো বলে। মা, অহনা তাদের ঘর থেকে বেরিয়ে এল। অহনা চিৎকার – চেঁচামেচি করতে লাগল। ‘এই রাত দুটোর সময় তুই আমাদের কোন আক্কেলে ঘুম থেকে ডেকে তুললি ভাইয়া? ‘
আমি বললাম, ‘আরে চুপ করে আয় তো। তোদের একটা ম্যাজিক দেখাব!’
মা ভ্রু কুঁচকে বলল, ‘বুড়ো বয়সে ভীমরতি। এই আটাশ বছর বয়সে এসে উনি আমাদের পাঁচ বছরের বাচ্চাদের মতো ম্যাজিক দেখাবেন।’
আমি কারো কথাই কানে তুললাম না। কিছুক্ষণ পরে কী হতে যাচ্ছে ভেবে উত্তেজনায় আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে। আমার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে মা বলল, ‘কী হল? খুলছিস না কেন দরজা?’
আমি দরজা খুললাম। ডিম লাইটের আবছা আলোয় দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ভেতরের কিছু স্পষ্ট দেখা গেল না। আমি সুইচ চেপে আলো জ্বালালাম। মেয়েটা লেপ গায়ে বাকা হয়ে শুয়ে আছে। ওকে দেখে বিস্ময়ে মা’র আর অহনার মুখ হা হয়ে গেল। মনে মনে ওরা কী ভাবছে কে জানে!
হঠাৎই মা ‘আল্লাহ গো’ বলে জোরে চিৎকার দিল। আচমকা অজ্ঞান হয়ে গেল। আমি দৌড়ে মায়ের কাছে গেলাম। অহনা মা’কে নিজের কোলে শুইয়ে দিয়ে ডাকতে লাগল। ‘মা! মা! চোখ খুলো।’
আমি মায়ের হাত ধরে বললাম, ‘কী হল মা! মা গো তোমার কী হল!’
অহনা এক ঝটকায় আমার কাছ থেকে মায়ের হাত সরিয়ে নিল। আমার দিকে ঘৃণার দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘তুই ছুবি না আমার মাকে! খবরদার! তোর মতোন নোংরা ছেলে যেন আমার মাকে না ছোয়!’
আমি ওর কথার পাত্তা না দিয়ে দৌড়ে পানি আনতে চলে গেলাম। ফিরে আসতেই অহনা ছো মেরে আমার হাত থেকে পানির বোতল নিয়ে নিল। মায়ের মুখে পানির ছিটা দিতেই পা পিটপিট করে চোখ খুলল। হাতের ইশারায় আমাকে কাছে যেতে বলল। আমি মায়ের কাছে গেলাম। মা অহনাকে ধরে উঠে বসল। বসেই ঠাস করে আমার গালে চড় মেরে দিল। লজ্জায় আমার ইচ্ছে করল মাটির নিচে ঢুকে যেতে। এই বয়সে এসেও মায়ের হাতে মার খাচ্ছি।
মা হাঁপাতে হাঁপাতে বলতে লাগল, ‘কোন কুলাঙ্গারকে পেটে ধরেছি আমি! এতদিন ভাবতাম আটাশ হয়ে গেল ছেলের বাচ্চামি এখনো যায়নি! আর আমাদের চোখে ধূলো দিয়ে তলে তলে এত কিছু! ছি ছি ছি। পাশের ফ্ল্যাটের ভাবি যদি একবার জানতে পারে পুরো ঢাকা শহর ছড়িয়ে যাবে এ খবর। হায় আল্লাহ! এগুলো দেখার জন্য তুমি আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছো!’
আমি মাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ‘মা তুমি এসব কী বলছ? আমার কথাটা তো শুনবে একটাবার!’
অহনা চেঁচিয়ে বলল, ‘কী শুনবে মা? তুই শোনার মতো আর কী বাকি রেখেছিস? রাত-বিরেতে একটা পরনারী তোর বিছানায়…ছিহ!’
আমি অনুরোধের স্বরে বললাম, ‘আমার কথাটা তোরা বিশ্বাস কর প্লিজ! ওই মেয়েকে আমি চিনি না!’
মা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে হাসল। ‘দেখ ছেলে কী বলছে! ওর বেডরুমে শুয়ে। আর ও না কি চেনেই না!’
আমি হাত জোড় করে বললাম, ‘মা প্লিজ আমাকে বিশ্বাস কর! ওই মেয়ে গত তিনদিন যাবৎ রোজ মাঝরাতে কোত্থেকে যেন উদয় হয়। আর আমি ঘুম ভাঙ্গতেই দেখি আমার পাশে শুয়ে। তাইতো তোমাদের ঘটনাটা জানানোর উদ্দেশ্যে নিয়ে আসলাম!’
আমার কথা শেষ না হতেই অহনা মা’কে বলতে লাগল, ‘মা তুমি ওর কথায় কান দিও না তো। ধরা পড়ে গেছে তো তাই ভুলভাল বকছে।’
মা অহনাকে নিয়ে চলে যাবার জন্য পা বাড়াল। যাবার আগে আমাকে বলে গেল, ‘কাল সকালেই তোদের আমি বিয়ে দেবো। তারপর দুটোকে এক কাপড়ে ঢাকা শহর ছাড়া করব।’
আমি হাজার চেষ্টা করেও মা’কে সত্যিটা বোঝাতে পারলাম না।
মা চলে যেতেই আমি মেঝেতে ধপ করে বসে পড়লাম। কী হল এটা আমার সাথে! মেয়েটাকে ফাসাতে গিয়ে সে ফাঁদে আমি নিজেই ফেসে গেলাম। আমি তো কোনো দোষ করিনি! তাহলে ওর স্থানে আমার কেন এগুলো শুনতে হচ্ছে!
বসা থেকেই আমার চোখ গেল বিছানার ওপর। কী সুন্দর আরামে ঘুমোচ্ছে দেখো! ওর ঘুমের যদি আমি বারোটা না বাজাই! তবে আমার নামও আহান না।
বসা থেকে উঠে ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগালাম দরজায়। তারপর ওয়াশরুমে চলে গেলাম। এক বালতি ঠান্ডা পানি নিয়ে বেরোলাম। উদ্দেশ্য মেয়েটার গায়ে ঢালা। তাহলেই আমার পরাণ জুড়োবে। ওর মোক্ষম শাস্তিই এটা। এই শীতে ওর গায়ে ঠান্ডা পানি ঢাললে ওর কেমন অনুভূতি হবে ভেবেই আমার পৈশাচিক আনন্দ হচ্ছে।
পানি নিয়ে বিছানার কাছে পৌঁছাতেই দেখি মেয়েটা উধাও! আশ্চর্য! এই মাত্রই শুয়ে ছিল এখানটায়। কোথায় চলে গেল। দরজাও ভেতর থেকে লাগানো। এই মেয়ে কি জাদু জানে! ঘরে কোথাও লুকিয়ে আছে ভেবে সারাঘর খুঁজে তন্নতন্ন করলাম। কোথাওই নেই।
ওহহো! খাটের নিচটায় চেক করতে ভুলে গেছি। খাটের তলায় উঁকি মারতেই দেখলাম মিথি দলা পাকিয়ে বসে আছে। হাত দিয়ে টেনে ওকে বের করে আনলাম। কিন্তু ও আমার কাছে এল না। উল্টো হাতে কামড়ে দিল। আর আমার থেকে দূরে দাঁড়িয়ে রুক্ষ স্বরে মিউ মিউ করতে লাগল। আমি বুঝতে পারলাম না হঠাৎ ও এমন ব্যবহার কেমন করছে! ও তো এমন স্বভাবের মার্জার নয়! ওর মতো নম্র, মিশুক বিড়াল আমি আর দুটো দেখিনি। আজ ওর কী হল!
আচ্ছা ও কী কিছু দেখেছে! ওই মেয়েটার ব্যাপারে! যার কারণে ভয়ে কিংবা রাগে এমন রূঢ় আচরণ করছে!
আমি নিচু হয়ে বসে মিথিকে কাছে ডাকলাম। ও এল না। হেঁটে ঠান্ডা পানির বালতির কাছে চলে গেল। বালতির দিকে মুখ করে বসে আবারও রুক্ষ স্বরে মিউ মিউ করতে লাগল। আমার মাথায় কিছুই খেলছে না।
সকালে এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙ্গল। রোজ এলার্ম বাজার আগেই মা আমাকে ঘুম থেকে তুলতে আসে। আজ আসেনি। বোধহয় কালকের বিষয়টা নিয়েই রেগে আছে। হাত মুখ ধুতে গিয়ে খেয়াল করলাম হাত আচড়ে ভর্তি। মিথির কাজ এটা। কাল যখন বালতির কাছে বসে মিউ মিউ করছিল। তখন ওকে জোর করে কোলে তুলতে গিয়েছিলাম। তবুও কোলে আসেনি। উল্টো রেগে হাত আঁচড়ে রক্ত বের করে দিয়েছে। বাহ! বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্যই আমার ওপর রেগে। কোনো দোষ না করেও সবার রাগ সহ্য করতে হচ্ছে আমার।
আমি না খেয়েই অফিসে চলে গেলাম। মা একবার পেছন ফিরে ডাকলও না।
অফিসে বসে কাজ করছি। হঠাৎ বস নিজে এসে বলল, আমার ছুটি। বাসায় চলে যেতে। একরাশ কৌতুহল নিয়ে বাসায় ফিরলাম। ঘরে ঢুকতেই মা ‘ওই মেয়েটা কই?’ বলে চেঁচামেচি শুরু করল। আমি বললাম, ‘আমি কীভাবে জানব মা? ওই মেয়েকি আমাকে বলে যাওয়া আসা করে?’
মা আরো রেগে গেল। বলল কেমন মেয়ের সাথে সম্পর্ক রেখেছি যে আমার কথা শোনে না!
হায়রে! মা’কে আমি আর কীভাবে বোঝাবো!
আমি একপ্রকার চিৎকার করে বললাম, ‘অসম্ভব! ওই মেয়েকে আমি কেন বিয়ে করতে যাব?’
মা কঠোর গলায় বলল, ‘নিজের শোবার ঘরে নিয়ে শুয়ে থাকার সময় মনে ছিলনা?’
লজ্জায় আমার চোখে পানি চলে এল। মা প্রচন্ড রেগে গেলে বিশ্রী ভাবে কথা শোনায়। তারই নমুনা এটা। বুঝলাম এখন আর মায়ের সঙ্গে তর্ক করে লাভ নেই। চুপচাপ এখান থেকে কেটে পড়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
আমি নিজের ঘরে চলে এলাম। দরজা আটকে টাইটা ঢিলে করতে করতে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম।
সকাল থেকে কিছুই খাইনি। রাতেও মা খেতে ডাকল না। আমিও রাগ করে না খেয়েই রইলাম।
রাত বারোটা বেজে ত্রিশ মিনিট। সেই কখন শুয়েছি। এখনো ঘুম আসছে না। পেটে খিদে থাকায় বোধহয়। আমার রুমের দরজা খোলা। ইচ্ছে করেই খুলে রেখেছি। মনে মনে ঠিক করে রেখেছি যেভাবেই হোক আজ ওই মেয়ের পরিচয় জানবোই! কে সে! কোথায় থাকে! কেন রোজ মাঝরাতে আমার ঘরে আসে! আমার কাছে কী চায়!
রাত দুটো বেজে পনেরো মিনিট। আমি বিছানায় কপালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছি। হঠাৎ ঘরে কারো উপস্থিতি টের পেলাম। পা টিপে টিপে হেঁটে কেউ বিছানার কাছে এগিয়ে আসছে। আগন্তক আমার পাশে শুয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি চোখ না খুলেই বুঝে গেলাম আগন্তুক আসলে কে!
আমি ধীরে ধীরে চোখ খুলে আমার পাশে তাকালাম। আমি যেটা ভাবছিলাম সেটাই। সেই মেয়েটা! আমি জলদি ওর ওপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। আজও নগ্ন হয়ে আছে মেয়েটা। অসভ্য মেয়ে কোথাকার! ওর কি কোনো জামাকাপড় নেই না কি? আদিমকাল থেকে উঠে এসেছে?
আমি লেপ দিয়ে ওর শরীর ঢেকে ওর হাতদুটো চেপে ধরলাম। মেয়েটা আৎকে উঠে বলল, ‘কী হল! কী হল আহান!’
আমি আরো জোরে ওর হাত চেপে ধরলাম। ‘তুমি কে?’
মেয়েটা আমার বুকের বাম পাশে ওর হাত রাখল। মৃদুস্বরে বলল, ‘আমি তোমার ক্লিওপেট্রা! ‘
চলবে…
লেখা: ত্রয়ী আনআমতা
(পরের পর্ব লিখবো? আপনাদের রেসপন্স আশা করছি।)
ক্লিওপেট্রা
পর্ব- ০৩
ক্লিওপেট্রা!
নামটা শুনে বুকটা ধ্বক করে উঠল কেন যেন। ক্লিওপেট্রা! মেয়েটার নাম কি তবে ক্লিওপেট্রা?
আর কিছু ভাবার সুযোগ পেলাম না। দু চোখে আঁধার নেমে এল।
রোজ সকালে ঠিক আটটায় আমার ঘুম ভাঙ্গে। হয় মায়ের ডাকে। নয়তো এলার্মের শব্দে। হঠাৎ ব্যাতিক্রম হলো কেন জানিনা। আজ ভোর হতেই জেগে গেলাম। উঠে দেখি বরাবরের মতো মেয়েটা উধাও।
গতকাল সারাদিন পেটে কিছু পরেনি। খিদেয় পেট চোঁ-চোঁ করছে। তাই আর দেরি করলাম না। রাগ বিসর্জন দিয়ে জলদি ব্রাশ করে খেতে চলে গেলাম। রান্নাঘরে ঢুকে দেখি মা রুটি বেলছে। আমাকে দেখেও না দেখার ভান করল। মায়ের রাগটা এখনো পড়েনি। টেবিলে গিয়ে বসতেই অহনা প্লেটে করে রুটি – ভাজি নিয়ে এল। আমার সামনে এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘মা তোকে খেয়ে বিদেয় হতে বলেছে।’
আমি খেয়ে আমার শোবার ঘরে চলে এলাম। ওয়ালেটটা পকেটে ভরে শার্টটা বদলে ঘর থেকে বেরোলাম। খাবার ঘরের সামনে দিয়ে যাবার সময় শুনলাম মা আর অহনা খেতে খেতে আমার ব্যাপারে কিছু একটা বলছে। কান পাততেই শুনতে পেলাম মা বলছে, ‘আহান এমন একটা কান্ড ঘটালো আমি এখনো বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার ছেলেটা তো অমন নয়! আমার মনে হচ্ছে মেয়েটাই ডাইনী। ওই ডাইনীই আমার সহজসরল ছেলেটাকে ফুসলিয়ে…! ‘
অহনা মায়ের কথা পুরো শেষ করতে দিল না। ‘আচ্ছা মা তোমার ছেলে কি কঁচি খোকা যে ওকে ফুসলিয়ে যেকোনো মেয়ে ওর বেডরুমে ঢুকে পড়বে?’
‘যেকোনো মেয়ে বলছিস কেন? বল ওই ডাইনীটা। ওই ডাইনীটা নিশ্চয়ই ওমন ধরনের মেয়ে। তাই আমার ছেলেকে বোকা পেয়ে!’
‘চুপ করো তো, মা! তোমার কথা আমার অসহ্য লাগছে। তোমার ছেলে যে কত দুধে ধোঁয়া তুলশী পাতা তা তো সেদিনই টের পেলাম।’
মা অহনার হাত ধরে বলল, ‘আচ্ছা তুইই বল। তোর ভাইটা কি অমন?’
অহনা কিছু বলল না। চুপ করে রইল।
আমি আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। বাইরে বেরিয়ে এলাম।
দু’ঘন্টা যাবৎ এখানে সেখানে ঘুরছি। কিছুই ভালো লাগছে না। আচমকা মনে পরল অহনার লিপস্টিক খুব পছন্দ। ও যদি আমাদের ফ্ল্যাট থেকে পাশের ফ্ল্যাটের আন্টিদের বাসায়ও যায় তবুও লিপস্টিক দেবেই। লিপস্টিক আর অহনা একে অপরের বেস্টফ্রেন্ড।
তাই ঘুরতে ঘুরতে মার্কেটে ঢুকে পড়লাম। একটা কসমেটিকসের দোকানে গিয়ে তাদের সাজেস্ট করা ব্রান্ডের এক ডজন লিপস্টিক কিনে ফেললাম। ওরা বেশ সুন্দর করে প্যাকেজিং করে দিল। আমি বললাম প্যাকেটের উপরে বড় করে ‘টু মাই এডোরেবল সিস্টার’ লিখে দিতে। ওরা তাই করল। আমার বোন খুশিতে নিশ্চয়ই হার্ট অ্যাটাক করবে এতগুলো লিপস্টিক পেয়ে।
মার্কেট থেকে বেরোনোর সময় শাড়ির দোকানে চোখ পরল আমার। মায়ের জন্যও একটা ঘিয়ে রঙের শাড়ি নিয়ে নিলাম। ঘিয়ে মায়ের পছন্দের রঙ।
কেন জানিনা হঠাৎ আমার ওই মেয়েটার কথা মনে পরল। আচ্ছা মেয়েটা কি এতটাই গরীব যে শরীরে কখনো কাপড় থাকে না! আমার ইচ্ছে করল মেয়েটার জন্য কতগুলো শাড়ি কিনে নিয়ে যেতে। দোকানিকে একটা শাড়ি দিতে বলতেই বলল, ‘কোন কালার নিবেন ভাইজান?’
‘যেকোনো একটা দিয়ে দিন তাহলেই হল।’
‘যার লাইগা নিবেন তার বয়স কেমন?’
‘একুশ-বাইশ হবে বোধহয়! ‘
‘গায়ের রঙ কি ভাইজান?’
‘সাদা ফর্সা। এত কিছু জিজ্ঞেস করতে হবে না। যেকোনো একটা শাড়ি দিয়ে দিন।’
দোকানি আমার কথার কোনো পাত্তাই দিল না। একটা লাল শাড়ি হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘দেখেন তো এই শাড়িটা কেমন? তারে মানাইবো? ‘
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ। এবার প্লিজ দয়া করে প্যাকেট করে দিন। আমি চলে যাই।’
বিকেলে মা নিজে থেকেই আমার সঙ্গে কথা বলল। আমি বই পড়ছিলাম। মা এসে বলল, ‘কাল সময় করে একবার ওই মেয়েকে এ বাড়িতে নিয়ে আসিস তো।’
আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললাম, ‘আমি তাকে কোথায় পাবো মা?’
মা বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকালো। ‘সেটা তো আমার দেখার বিষয় না। আমি আনতে বলেছি তুই আনবি।’
বলে মা এক মুহূর্তও দেরি করল না। চলে গেল।
রাতে ডিনারের সময় খাবার টেবিলে বসেই কথাটা তুললাম। ‘মা তোমার জন্য একটা শাড়ি কিনেছি। তোমার ঘরে রেখে এসেছি। পছন্দ হয়েছে কি না আমাকে জানিও।’
মা কিছু বলল না। অহনাকে বললাম, ‘তোর প্যাকেটটা পেয়েছিস? তোর ঘরের ড্রেসিং টেবিলের ওপর রাখা।’
অহনা মুখ বাঁকাল। ‘ঢং! অতগুলো লিপ্সটিক কে আনতে বলেছে তোকে?’
অহনা মুখে এসব বললেও ও যে ভেতরে ভেতরে খুব খুশি হয়েছে সেটা আমি খুব ভালো করেই জানি।
রাত বারোটা বেজে দশ মিনিট। আজও ঘুম আসছে না আমার। যেদিন থেকে ওই মেয়েটার আগমন ঘটেছে ঠিক সেদিন থেকেই ঘুমের বারোটা বেজে গেছে। বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছি। অকস্মাৎ কেউ একজন এসে আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। চমকালাম না। কারণ আমি জানি কে হতে পারে।
আমি তাকে ছাড়িয়ে উঠে বসলাম। বললাম, ‘কাল পুরো কথা শেষ না করে কোথায় চলে গিয়েছিলে?’
মেয়েটা বলল, ‘আমি কোথাও যাইনি আহান। তুমিই ঘুমিয়ে পড়েছিলে!’
আমি বললাম, ‘পরিষ্কার করে বলো তো তুমি কে?’
‘আমি ক্লিওপেট্রা। তোমার ক্লিওপেট্রা। ‘
আজও আমি আমার পুরো কথা শেষ করতে পারলাম না। তমিস্রায় তলিয়ে গেলাম। ঘুমিয়ে যাওয়ার আগ মূহুর্তে শুনতে পেলাম মেয়েটা বলছে, ‘তোমার বুকের বাম পাশটায় হাত রাখলেই তুমি এমন অজ্ঞান হয়ে যাও কেন বলো তো! ‘
পরেরদিন অফিস থেকে ফিরতেই মা আবার রাগারাগি শুরু করে দিল। ‘তোকে না কালকে বললাম মেয়েটাকে নিয়ে আসতে?’
আমি সোফায় গা এলিয়ে দিতে দিতে বললাম, ‘মা তোমাকে আর কতবার বলবো আমি ওই মেয়েকে চিনিনা! মাঝরাতে আসে। আবার সকাল হতে না হতেই উধাও হয়ে যায়।’
‘কেন ওই মেয়ে কি ভূত না কি পরী যে তোকে দেখা দিয়েই উধাও হয়ে যায়?’
‘সেটা তো ওই মেয়েই বলতে পারবে মা।’
মা টিভি দেখছিল। হঠাৎই রিমোটটা আছড়ে ভেঙে চলে গেল।
রেগে গেলে ভাঙ্গচূড় করা মায়ের অভ্যেস। আমি আর অহনা ছোটো বেলা থেকেই এতে অভ্যস্ত। তাই তেমন প্রতিক্রিয়া ঘটল না আমার মনে।
সন্ধ্যেবেলা মা ব্যাগ গুছিয়ে অহনাকে নিয়ে নানার বাড়ি চলে গেল। মা’র না কি আমার মুখ দর্শন করতেও ঘৃণা লাগে এখন। তাই কিছুদিনের জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে। যাবার আগে মিথিকেও সঙ্গে করে নিয়ে গেল। আমি কত করে বললাম অন্তত ওকে রেখে যেতে। মা শুনলো না।
আজ সারারাত আমার বিন্দুমাত্রও ঘুম হল না। আশ্চর্যজনকভাবে মেয়েটাও এলো না আজ। আমি ভীষণ রকম অবাক হলাম।
এক সপ্তাহ যাবৎ আমি ছাড়া আর কেউই বাসায় নেই। মেয়েটাও আসেনি এ’কদিন।
প্রায় দু’সপ্তাহের পর মা, অহনা, মিথি ফিরে এল। মিথি ফিরে এসেই দৌড়ে আমার কোলে চলে এল। আমাকে মিস করেছে নিশ্চয়ই! আমারও ওর কথা রোজ অনেকবার করে মনে পড়েছে।
মা, অহনা নানার বাড়ি বেড়িয়ে আসাতে একটা উপকারই হলো। ওরা একদম স্বাভাবিক আচরণ করছে। যেন আমাদের মাঝে কোনো ঝঞ্জাটই হয়নি।
আমাকে অবাক করে দিয়ে আজ রাতে আবার মেয়েটা এল। মাঝরাতে ঘুম ভাঙ্গতেই দেখি আমার পাশে শুয়ে। আমি ওকে জাগাই। মেয়েটা বিরক্ত হয় না। হাসিমুখে বলে, ‘কিছু বলবে আহান?’
আমি উত্তর দেই, ‘হ্যাঁ। এতদিন আসোনি ঠিক আছে। আজ আবার এসেছো কেন?’
মেয়েটা মৃদু হাসে। ‘তুমি কী রাগ করেছো আমি এতদিন আসিনি বলে?’
‘মোটেও না। আমি কেন রাগ করতে যাব!’
তারপর আবার বললাম, ‘তুমি কোথায় থাকো? তোমার পরিচয় কী?’
‘আমি ক্লিওপেট্রা আহান। তোমার ক্লিওপেট্রা। তুমি কি এখনো আমাকে চিনতে পারছো না!’
আমি মাথা নাড়লাম। ‘ না। আমি তোমাকে চিনতে পারছি না।’
মেয়েটি বোধহয় আশাহত হল। ডিম লাইটের আবছা আলোয় স্পষ্ট দেখতে পেলাম তার নিরাশ মুখখানা।
মেয়েটি উঠে বসতে বসতে বলল, ‘তুমি আমার জন্য যে জিনিসটা এনেছো সেটা দিলে না? ‘
আমি চমকে উঠলাম। মেয়েটা কি করে জানল আমি ওর জন্যে শাড়ি এনেছি!
ও আবার বলল, ‘ এত অবাক হচ্ছো কেন? আমি সব জানি।’
আমি প্রশ্ন করলাম, ‘আর কী জানো তুমি?’
‘তোমার অফিসের একটা মেয়ে তোমাকে পছন্দ করে। সে গতকালকে তোমাকে বিয়ের প্রস্তাবও দিয়েছে। তুমি আমার হাত থেকে বাঁচতে তাকে বিয়ে করে নিতে চাইছো। কারণ তোমার মা তোমাকে আমার সঙ্গে বিয়ে দিতে চান।’
আমি বিস্ময়ের সপ্তম চূড়ায় পৌঁছে গেলাম। মেয়েটা এগুলো কীভাবে জানলো! আমি তো কথাগুলো এখনো কাউকেই বলিনি! এমনকি আমার মাকেও না!
মেয়েটা আমার গালে ওর হাত রাখল। ‘আহান! তুমি যদি মেয়েটার ভালো চাও তবে ওর থেকে দূরত্ব বজায় রাখো। এতেই তোমার মঙ্গল।’
মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গতেই দেখি বিছানায় আমার পাশে শুয়ে এক নগ্ন নারীমূর্তি! আমার গা ঘেঁষে শুয়ে ঘুমিয়ে আছে। মেয়েটির গায়ে একটা সুতো পর্যন্ত নেই। সবুজ ডিম লাইটের আবছা আলোয় দেখতে পেলাম তাকে। শরীরটা যতটা না কামনাদায়ক, তার চাইতে কয়েকগুণ বেশি মায়াবী তার মুখটা। কিছু একটা আছে ওই মুখটায়। যার কারণে কিছুতেই চোখ ফেরাতে পারছি না।
এখন শীতকাল। বছরের বারো মাস চব্বিশ ঘণ্টাই শোবার ঘরের জানালা খুলে রাখার অভ্যাস আমার। জানালাটা বিছানা বরাবর। হু হু করে বাতাস আসছে সেদিক থেকে। লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকার পরেও গায়ে হিম ধরে গেল আমার।
এমন ঠান্ডায় মেয়েটা কি করে নগ্ন দেহে শুয়ে আছে!
আসল ভাবনা বাদ দিয়ে কখন ইতি-উতি ভাবতে শুরু করেছি খেয়ালই করিনি। খেয়াল করতেই গা থেকে লেপ ফেলে দিয়ে একপ্রকার লাফিয়ে বিছানার অপরপ্রান্তে চলে এলাম। সাথে সাথেই মেয়েটা জেগে গেল। আমার ফেলে দেয়া লেপ টেনে সে নিজের গায়ে লেপ্টে নিল। তারপর আমার দিকে সরে আসতে আসতে বলল, ‘কী হয়েছে আহান? দূরে চিলে গেলে কেন?’
কথাটা বলেই সে একদম আমার কাছে চলে এল। তারপর আমার হাতটা তার মাথায় রেখে আহ্লাদী স্বরে বলল, ‘আদর করে দাও!’
আমি ঘোরগ্রস্তের মতো তার মাথায় হাত বুলাতে লাগলাম। সে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল।
এরপর আমার আর কিছু মনে নেই। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি!
সকালে যখন ঘুম ভাঙ্গলো দেখলাম বিছানায় আমি একা শুয়ে। মেয়েটা নেই! সারা ঘর, সারা বাড়ি জুড়ে তাকে খুঁজতে লাগলাম। কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলাম না তাকে। কোত্থাও নেই সে! তাহলে কি আমি স্বপ্ন দেখেছি? আমার ভ্রম ছিল মেয়েটা?
নাহ! এটা কি করে হতে পারে! স্বপ্ন কখনো এত রঙ্গিন এত জীবন্ত হয়!
মা টেবিলে খাবার সাজাচ্ছিল। আমাকে এ ঘর ছেড়ে ও ঘরে ছোটাছুটি করতে দেখে বলল, ‘মিথিকে খুঁজছিস? ও তো আমার ঘরে।’
মিথি আমার পোষা বিড়াল। ছ’মাস আগে ওকে আমি রাস্তায় কুড়িয়ে পাই। নর্দমার পাশে শুয়ে ছিল। ওমন ময়লার স্তূপের মধ্যে সাদা ধবধবে বিড়ালটা নজর কেড়েছিল আমার। তাই ওকে কাছে ডাকি। ডাকতেই দৌড়ে চলে আসে। কেন যেন হঠাৎ অচেনা প্রাণীটির জন্যে আমার মায়া লেগে যায়। কোলে করে বাসায় নিয়ে আসি। বাসায় আনার এক সপ্তাহের মধ্যেই ও বাড়ির সকলের মন জয় করে নেয়। অবশ্য বাড়িতে আমরা তিনজন মাত্র মানুষ৷ মা, আমি আর আমার ছোটো বোন অহনা।
হঠাৎই ঘড়ির দিকে চোখ পরল আমার। সর্বনাশ! সাড়ে আটটা বাজে! নয়টায় অফিস আমার। যেতে সময় লাগে চল্লিশ মিনিট। ফ্রেশ হব কখন! খাব কখন! আর যাব কখন! আর জ্যাম থাকলে তো কথাই নেই। এই ঢাকার রাস্তায় জ্যাম থাকবে না তা কি হয় কখনো?
একপ্রকার দৌড়ে বাথরুমে চলে গেলাম। হাত-মুখ ধুয়ে বেরিয়ে শার্ট-প্যান্ট পরে টাইটা বাঁধতে বাঁধতে ড্রয়িংরুমে চলে এলাম। মা খেতে ডাকল। আমি মায়ের ডাক অগ্রাহ্য করে দরজা খুলে বেরোতে নিতেই মা পেছন থেকে আমার শার্ট টেনে ধরলো। বলল, ‘না খেয়ে কোথায় যাচ্ছিস? অল্প কিছু মুখে দিয়ে যা।’
আমি মায়ের হাত ধরে বললাম, ‘মা প্লিজ! আজকের মতো ছাড় দাও! অফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার।’
মা আমার কথার কোনোরকম পাত্তা না দিয়ে জোর করে টেবিলে নিয়ে বসাল। স্যান্ডউইচের বাটিটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি এক পিস স্যান্ডউইচ হাতে নিয়ে ‘মা আসি’ বলে বেরিয়ে এলাম। গন্তব্য বাস-স্টেশন।
সারাদিন অফিসে কাজের চাপে গত রাতের ঘটনাটা বেমালুম ভুলে গেলাম। অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে একবার কলিংবেল চাপতেই মা দরজা খুলে দিল। ঘরে ঢুকতেই দেখি মিহি সোফায় শুয়ে। আমার দিকে চোখ পরতেই দৌড়ে আমার কাছে চলে এল। আমার পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে মিউ মিউ করতে লাগলো। যার মানে হচ্ছে ‘আমাকে কোলে নাও।’
ওকে কোলে তুলে নিলাম। মা চেঁচিয়ে উঠল। ‘যা ফ্রেশ হয়ে খেতে বস। পরে আহ্লাদীকে কোলে নিয়ে বসে থাকিস।’
মায়ের কথায় আমি মিথিকে নামিয়ে দিতে চাইলাম। কিন্তু মিথি নামতে চাইল না। উলটে আমাকে খামচে ধরে রইল। আমি পুনরায় ওকে কোলে তুলে নিলাম। ও নিশ্চিন্তমনে আমার কোলে শুয়ে মৃদু মিউ ধ্বনি তুলল। আমার বুকে মাথা ঘষতে লাগল। যার মানে ‘সকালে আমাকে আদর না করে কোথায় চলে গিয়েছিলে? এখন আদর করে দাও।’
আমি ওর দিকে তাকিয়ে ‘স্যরি’ বললাম। ও প্রতুত্যরে বলল, ‘মিউ!’
মা ঠিকই বলে। আহ্লাদী একটা!
রাত এগারোটা। বিছানায় এসে শুয়েছি আধ ঘন্টা হলো। ঘুম আসছে না। কেন জানিনা আজ একা শুতে মন সায় দিচ্ছে না। তাই ভাবলাম মিথিকে নিয়ে আসি। ও নিশ্চয়ই মায়ের ঘরে। ওর ঘুমোনোর স্থানের কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। কখনো আমার সঙ্গে, কখনো মায়ের সঙ্গে তো কখনো অহনার সঙ্গে ঘুমোয়।
মিথিকে নিয়ে এসে শুতেই আমার ঘুমে চোখ ভার হয়ে এল। ঘুমিয়ে পরলাম তখুনি।
গতকালকের মতোই ঠিক মাঝরাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। আমার মনে হল বুকের কাছটায় কেউ জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে। মিথিই হবে। রাতে তো মায়ের কাছ থেকে আমিই ওকে নিয়ে এসেছিলাম। আমার গায়ের ওপর থেকে আলতো করে লেপ সরিয়ে নিতেই আমি শিউরে উঠলাম। মিথি নয়! গতকাল রাতের সেই মেয়েটি! আমার বুকের ওপর মাথা রেখে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে। সেদিনের মতোই নগ্ন দেহে!
আমি এক ধাক্কায় আমার বুকের ওপর থেকে ওর মাথাটা সরিয়ে দিলাম। শরীর ঢাকার জন্য লেপ ছুড়ে মারলাম ওর ওপর।
মেয়েটি আমার আচরণে কোনো ভ্রুক্ষেপ করল না। গলা পর্যন্ত লেপ টেনে নিয়ে শুয়ে পরল। কিন্তু ঘুমোলো না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল আমার দিকে।
আমি হন্তদন্ত হয়ে বিছানা ছেড়ে নামলাম। সুইচ চেপে আলো জ্বালালাম। অকস্মাৎ কড়া আলো চোখে পরতেই মেয়েটি চোখ বন্ধ করে ফেলল। পরক্ষণেই আবার খুলে ফেলল। আমার দিকে তাকিয়ে সেই আদুরে স্বরে বলল, ‘ঘুমোবো আহান। আলো নেভাও!’
ওর কথা আমার কান পর্যন্ত পৌছালেও মস্তিষ্ক পর্যন্ত পৌছাতে পারল না। কারণ আমার মস্তিষ্ক জুড়ে ছিল অন্যকিছু। আমি একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলাম মেয়েটির মুখায়বে। এত রূপ, এত সৌন্দর্য, এত মায়া কারো চেহারায় থাকতে পারে! আমি ক্রমশ মোহগ্রস্ত হয়ে পরতে লাগলাম। এ মেয়ে কিছুতেই সাধারণ নারী হতে পারে না! কিছুতেই নাহ!!
তারপরের দিন সকাল বেলা মায়ের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙ্গলো। ঘুম ভাঙ্গতেই দেখলাম আমি মেঝেতে শুয়ে আছি। মা বারবার জিজ্ঞাসা করতে লাগল এই ঠান্ডায় আমি মেঝেতে কেন? মাথা-টাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম না কি!
মায়ের মাথা থেকে দুঃশ্চিন্তা দূর করার জন্য মিথ্যে বললাম। ‘রাতে এত ঘুম পেয়েছিল না মা। মেঝেতে বসে মোবাইলে গেমস খেলছিলাম। কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছি। ‘
মা রেগে গেল। বলল, ‘ তুই কি বাচ্চা ছেলে আহান?তোর কি কোনো কান্ড জ্ঞান নেই? এই ঠান্ডার মধ্যে তুই মেঝেতে বসে গেমস খেলবি কেন? ঘরে কি বসার জিনিসের অভাব পরেছে?’
‘উফফ মা। ভুল হয়ে গেছে। চেঁচামেচি করো না তো!’
মা আমাকে সাবধান করার ভঙ্গিতে বলল, ‘আর কখনো যেন মেঝেতে শুতে, বসতে না দেখি!’
তারপর আবার বলল, ‘ আটটা বেজে গেছে। যা জলদি হাত-মুখ ধুয়ে খেতে আয়। নাহয় পরে দেখব দেরি হয়ে যাচ্ছে বলে না খেয়েই বেরিয়ে পড়েছিস।’
মা চলে যাবার পর আমি গতকাল রাতের ঘটনাটা স্মরণ করতে লাগলাম। গতরাতের ঘটনাটাও কি স্বপ্ন ছিল? একই স্বপ্ন দু’দিন দেখা। এটা কি সম্ভব!
যদি স্বপ্নই হয় তাহলে আমি মেঝেতে এলাম কি করে! নাহ! গতরাতে এবং তার আগের রাতে যা ঘটেছিল সব বাস্তবই ছিল। স্বপ্ন স্মৃতিতে এত স্পষ্ট হয়ে কিছুতেই থাকতে পারে না। স্বীদ্ধান্ত নিলাম। আজকের রাতে কি ঘটবে সেটা আমি ডিসাইড করব। ওই মেয়েটা নয়। মনে মনে ওকে হাতেনাতে ধরার সমস্ত পরিকল্পনা করে ফেললাম। তাতে যদি আমার ইজ্জতের ফালুদা হয় তো হোক।
আজকে অফিসের কাজ ঠিকমতোন করতে পারলাম না। সেজন্য দু’বার বসের ঝাড়িও খেলাম। তবুও কোনো কাজেই মন বসছে না। একটা চাপা উত্তেজনা কাজ করছে মনের ভেতর। আচ্ছা আমি কি আমার পরিকল্পনায় সফল হবো? মন বলল, হবি। মস্তিষ্ক বলল, আজ তোর ইজ্জতের ফালুদা না আইসক্রিম হবে।
দেখি কোনটা সঠিক হয়। মন না কি মস্তিষ্ক!
অবশেষে রাত এল। শোবার আগে মা’কে, অহনাকে বলে এলাম দরজা খুলে ঘুমাতে। মোবাইলে ঠিক রাত দুটো বাজে এলার্ম সেট করে নিলাম। তারপর ঘুমিয়ে পরলাম।
রাত দুটোয় এলার্মের শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিছানার অপর পাশে তাকাতেই আমার মুখে হাসির রেখা ফুটল। এইতো! মেয়েটা আজো আমার পাশে শুয়ে। আমার ঘুম হারাম করে নিজে কেমন নিশ্চিন্ত মনে ঘুমুচ্ছে দেখো! দাড়াও রহস্যময়ী। আজ তোমার রহস্য উদঘাটন করবোই!
তাসু নীল কে দেখে জিজ্ঞেস করে __কি হয়েছে আপনার.?? এমন দেখাচ্ছে কেন..??কিছু হয়েছে..?? নীল এক ফালি মুচকি হেসে বলে__ নাহ..আমার কিছুই হয় নি।তাসু বলে__ তাহলে আপনাকে এমন চিন্তিত দেখাচ্ছে কেন..?? মনে হচ্ছে দুনিয়ার সব চিন্তা পেরেশান আপনার মাথায় এসে পড়ছে…??নীল বলে__আজ অফিসে কাজের খুব চাপ গেছে,, হয়তো এর জন্য এমন দেখাচ্ছে। আচ্ছা তুমি আমার জন্য পানি নিয়ে আসো খুব তৃষ্ণা পেয়েছে।
__এরপর নীল চলে যায় তার রুমে৷বসে আছে চিন্তিত মনে। মাহিরার কথা গুলো নীল কে খুব ভাবাচ্ছে। সত্যি সত্যি মাহিরা উল্টো পাল্টা কিছু করবে না তো.??এমন হাজারো প্রশ্ন নীলের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। তাসু দরজা টা আটকিয়ে নীলের জন্য ঠান্ডা পানি নিয়ে যায়। তাসু দেখে নীল এখনো সোফায় বসে আছে।ফ্রেশ পর্যন্ত হয় নি।অফিস থেকে আসার পর ড্রেস টাও চেঞ্জ করে নাই। আনমনে কি যেন ভেবে যাচ্ছে।
__তাসু বলে__ আপনার পানি। তাসুর কথায় নীল ভাবনার জগত থেকে ফিরে আসে।নীল তাসুর হাত থেকে পানির গ্লাস টা নিয়ে এক ঢোকে পুরো পানি খেয়ে নেয়। তাসু বলে_ পানি আরো দিবো.??নীল বলে__ না আর লাগবে না।তাসু গিয়ে নীলের পাশে বসে বলে__ আচ্ছা আপনি সত্যি করে বলেন তো আপনার কি হয়েছে…??অফিস থেকে আসার পর থেকে দেখছি কি নিয়ে যেন আপনি খুব পেরেশানে আছেন।
__নীল তাসুর মুখের দিকে মায়াবী চোখে তাকিয়ে আছে। নীল ভাবে __ তাসু কে মাহিরার কথা কিছুই বলা যাবে না।বললে হয়তো শুধু শুধু পেরেশানি করবে। আমি তোমাকে আর কোন কষ্ট পেতে দিবো না।তাসু বলে__ এভাবে তাকিয়ে থেকে কি ভাবছেন..?? কি হয়েছে সেটা বলবেন তো..??নীল বলে __সত্যি বলছি আমার কিছুই হয় নি।কাজের খুব চাপ গেছে তো তাই একটু খারাপ লাগতেছে। একটু রেস্ট নিলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
__তাসু বলে__ বেশি খারাপ লাগতেছে ..?? বেশি খারাপ লাগলে বলেন আপনার শরীর টা টিপে দেই ভালো লাগবে।নীল বলে__ না লাগবে না,, এমনেতেই ঠিক হয়ে যাবে।তাসু আর কিছু না বলে চলে যায় রান্না করতে। নীলের হঠাৎ করে কি হয়ে গেলো তাসুও ঠিক বুঝতে পারছে না।তাসু ভাবে__ রাতের জন্য কি উনি আমার উপর রেগে আছে ..??রাতের জন্য এমন করলে তো চিন্তিত দেখা তো না।
__এদিকে নীল ফ্রেশ হয়ে এসে মাহিরা কে একবার ফোন দেয়।কারণ মাহিরার সাথে কথা বলে তাকে বোঝিয়ে সব কিছুর সমাধান করতে হবে। কিন্তু মাহিরার ফোন বন্ধ বলছে। বারবার ফোন দেওয়ার পরেও একই কথা বলছে যে ফোন বন্ধ আছে। নীলের পেরেশান যেন আরো বেড়ে গেলো।রান্না শেষ হওয়ার পর তাসু এসে খেতে বলে নীল কে।
__নীল বলে__ তুমি যাও আমি আসছি। একটু পর নীল খেতে বসে।কোন কিছুই যেন আজ নীলের কাছে ভালো লাগছে না।এমন কি খেতেও ভালো লাগছে না।নীল প্লেটে কিছু খাবার নিয়ে তাসু কে বলে__ তুমি দাঁড়িয়ে আছো কেন..?? খেতে বসো।নীল কে আজ অন্য রকম লাগছে তাই তাসু কিছু না বলে চুপচাপ প্লেট নিয়ে খেতে বসে।নীল অল্প কিছু খেয়ে উঠে চলে যায়। তাসু কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলো না।এর আগেই নীল উঠে চলে যায়।
__রাতে নীলের ঘুম আসছে না।মাহিরা হয়তো ঠিকই বলেছিল__যে নীলের রাতের ঘুম হারাম করে ছাড়বে।সত্যি আজ নীলের চোখের ঘুম কে এক কথায় মাহিরা কেরে নিয়েছে।
__এভাবে চিন্তার মধ্য দিয়ে নীলের কেটে যায় আরো দুই দিন। এই দুই দিনে নীল মাহিরার সাথে দেখা করা বা যোগাযোগ করার অনেক চেষ্টা করেছে বাট কোন টাতেই সফল হয় নি।নীল চলে যায় অফিসে। কাজ করতে থাকে নিজের ল্যাপটপে।তাসুও নীল কে অফিসে পাঠিয়ে নাস্তা করে বাসার টুকটাক কাজ করতে থাকে। এরই মধ্যে কলিংবেলের শব্দে তাসুর বুক টা কেঁপে উঠে। তাসু ভাবে এমন সময়ে আবার কে আসতে পারে। উনি তো মনে হয় এতোক্ষণে অফিসে পৌঁছে গেছে।আবার ফিরে আসলো না তো..??
__এসব আর বেশি কিছু না ভেবে তাসু গিয়ে দরজা খুলে দিতেই অবাক হয়ে যায়। দুই জন মাস্ক পরিহিত ব্যক্তি সাথে সাথে তাসু কে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে দরজা আটকিয়ে নেয়। তাসু আশ্চর্য হয়ে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করে__এই আপনারা কারা..?? আমার বাসায় এভাবে আসছেন কেন..??দরজা আটকিয়ে তাসু কে আর কোন কথা বলতে না দিয়ে ছেলে দুই জন তাসু কে থাপ্পড় দিয়ে ফেলে দেয়। এতে তাসু আরো ভয় পেয়ে যায়। কাঁদতে শুরু করে দেয়,, ভয়ে ধম বন্ধ হয়ে আসছে। তাসু কে মারতে গেলে তাসু উঠে নিজেকে বাঁচাতে চেষ্টা করে।দৌড়ে চলে যেতে চায় অন্য রুমে কিন্তু সাথে সাথে ছেলে দুই জনও রুমে চলে যায়।
__তাসুর চুলে ধরে ইচ্ছে মতো মারতে থাকে। এলোপাতাড়ি ভাবে চড়থাপ্পড়,, ঘুসি,, পেটে পিটে লাথি মারতে থাকে। তাসু এখনো বুঝতে পারছে না কেন তাকে এভাবে মারা হচ্ছে। তাসু তাদের হাত থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু পারে নাই। তাদের পায়ে ধরে অনেক চেষ্টা করেছে বাঁচার জন্য। কিন্তু তারা তাসুর কোন কথাই শুনে নি। কারণ তারা মাহিরার টাকার কাছে বিক্রি হয়ে গেছে। পাশে থাকা ফুলদানি টা নিয়ে তাসুর মাথায় আঘাত করতেই তাসু ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে।মাথা দিয়ে অঝোর দ্বারায় রক্ত পরতে থাকে তাসুর। রক্ত পড়ার কোন বাধ মানছে না।আসতে আসতে তাসুর চোখ দুটি বন্ধ হতে থাকে। চোখে সব কিছু ঝাপসা দেখতে থাকে তাসু।
__ঐ দিকে নীলের কিছু ভালো লাগছে না।আজ নীলের মনটা কেমন অস্থির অস্থির লাগতেছে।কোন কাজই ভালো লাগছে না।মনটা কেমন তাসুর প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। নীল আজ অফিস না করে বাসায় থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। তাই অফিস থেকে ছুটি নিয়ে বাসায় চলে আসে।
__বাসায় এসে নীল কিছু টা আশ্চর্য হয়ে যায়। দরজা টা একেবারে খুলা।নীল ভাবে __তাসু হয়তো দরজা লাগাতে ভুলে গেছে। কিন্তু ঘরে প্রবেশ করে নীল আরো বেশি আশ্চর্য হয়ে যায়। বাসার জিনিস পত্র গুলো কেমন এলোমেলো হয়ে আছে।সব কিছু এদিক সেদিক ছিটে ছাঁটে পড়ে আছে। নীল সব চিন্তা বাদ দিয়ে তাসু কে খুঁজতে থাকে।নীল তাসু কে ডাকতে থাকে কিন্তু কোন সাড়া পাচ্ছে না।নীলের মধ্যে ভয় ঢুকে গেলো। তাসুর আবার কিছু হয়নি তো..??
__এইদিকে তাসু রক্তাক্ত শরীর নিয়ে পরে আছে ফ্লোরে। তাসুর গলায় পা দিয়ে চেপে ধরাতে তাসু কথা বলতে পারছে না।নীল কে জোর করে ডাকতে গেলে কণ্ঠনালীতে আঘাত পাওয়ায় কথা আটকে যাচ্ছে। তাই নিচে পরে থাকা ফুলদানির এক খন্ড টুকরো নিয়ে ফ্লোরে ছুড়ে ফেলে দেয় তাসু। যেন নীল বুঝতে পারে এই দিকে কেউ আছে। নীল কিছু একটা পরে যাওয়ার শব্দ শুনে দৌড়ে সেই দিকে যায়।
__নীল সেখানে গিয়ে তাসুর এই অবস্থা দেখে নিজের চোখ কে বিশ্বাস করতে পারছে না।পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়। নিমিষেই কান্নায় ভেঙ্গে পরে নীল। নীল গিয়ে জড়িয়ে ধরে তাসুকে। তাসু একটু একটু করে চোখ মেলে নীলের দিকে তাকায়। নীল কে জড়িয়ে ধরে তাসু।নীল জিজ্ঞেস করে কিভাবে এমন হলো কিন্তু তাসু কিছুই বলতে পারছে না।বারবার কথা বলার চেষ্টা করার পরেও বলতে পারছে না।মুখে শুধু ইশারা করে যাচ্ছে। নীল আর এক মহূর্তও দেরি না করে সোজা হসপিটাল নিয়ে যায়।
__ডাক্তার এসে তাসু কে অপারেশন থিয়েটারে নিয়ে যায়। তাসুর চিকিৎসা শুরু হয়ে যায়। নীল অপারেশন রুমের বাহিরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে থাকে। নীলের বুকটা ফেটে যাচ্ছে। কাঁদতে কাঁদতে চোখ দুটি লাল করে ফেলছে।নীল বারবার উঠে দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।নীল তার বাবা মার কাছে ফোন করে সব জানিয়ে দেয়। তারা কথা টা শুনে বিশ্বাস করতে পারছে না।দ্রুত তারা হসপিটালের উদ্দেশ্য রওয়ানা দেয়। নীল বুঝতে পেরে যায় যে এটা মাহিরার কাজ ছাড়া অন্য কারোর কাজ না।মাহিরা ঠিকই বলেছিল সে নীলের হতে না পারলে কাউকে নীলের হতে দিবে না।
__ নীলের বাবা মাও দ্রুত হসপিটাল এসে পৌঁছে যায়। নীল তাদের কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। নীলের বাবা নীল কে জড়িয়ে ধরে শান্তনা দিতে থাকে। নীলের বাবা জিজ্ঞেস করে__ তাসনুভা কোথায়..? নীল কেদে কেদে বলে__ বাবা আমার তাসু এটার ভিতর আছে। বাবা ডাক্তার এখনো আসছে না কেন..??তাসু এখন কেমন আছে কিছু বলছে না কেন..?? নীলের বাবা বলে__ বাবা তুই কোন চিন্তা করিস না তোর তাসুর কিছু হবে না একটু ধৈর্য ধর।
_কিছুক্ষণ পরই দুই জন ডাক্তার অপারেশন রুম থেকে বেরিয়ে আসে। তাদের দেখে নীল দৌড়ে তাদের কাছে যায়। নীল বলে__ ডাক্তার আমার তাসু এখন কেমন আছে,, ভালো হয়ে গেছে তো..?কি হলো আপনি কিছু বলছেন না কেন..?? নীল তাসুর কাছে যেতে চাইলে ডাক্তার বলে__ আপনি শান্ত হোন।আপনার স্ত্রীর খুব সিরিয়াস অবস্থা। মাথায় প্রচন্ড আঘাত পরার কারণে মস্তিষ্কে সমস্যা হয়েছে।আর কন্ঠ নালী দিয়ে প্রচুর রক্ত বের হয়েছে। আমরা যতোটুকু সম্ভব চিকিৎসা করেছি রক্ত দিচ্ছি
_কথা টা শুনে নীল মাথায় হাত দিয়ে ফ্লোরে বসে পরে। তাসুর এমন অবস্থা টা নীল মেনে নিতে পারছে না।নীলের মা বাবা নীল কে ধরে নিয়ে বেঞ্চে বসায়।ডাক্তার বলে_ মিস্টার নীল! আপনি পাগলামো শুরু করছেন কেন..?? আপনি প্লিজ শান্ত হোন।আপনি আপনার স্ত্রী কে যত সম্ভব পারেন কালকের মধ্যে কলিকাতা নিয়ে যান। সেখানে আপনার স্ত্রীর ভালো অপারেশন করা হবে। আমরা সেখানকার ডাক্তারের কথা বলে নিচ্ছি। আপনারা যে কোন একজন আমার সাথে আসুন।
__নীলের বাবা ডাক্তারের সাথে চলে যায় কথা বলার জন্য। নীল এখনো বসে কাঁদতে থাকে। আসতে আসতে তাসুর কাছে যায়। তাসু বেডে শুয়ে আছে এখনো জ্ঞান ফিরে আসে নি।ডাক্তার বলছে চার ঘন্টা পর জ্ঞান ফিরে আসবে।নীল তাসুর পাশে বসে অশ্রুভেজা চোখে তাকিয়ে আছে। তাসু কে যত দেখছে তত বেশি নীলের চোখ দিয়ে পানি পরছে। তাসুর পুরো মাথা ব্যান্ডেজ করানো।গলায়,,মুখে,, হাতেও ব্যান্ডেজ করানো।তাসুর হাত জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে নীল।
_বিকাল ছয় টা বেজে গেছে তাসুর এখনো জ্ঞান ফিরছে না।এইদিকে ডাক্তারের সাথে কথা বলে তাসু কে কলিকাতা নিয়ে যাওয়ার জন্য সব কিছু ইমারজেন্সি ভাবে করা হয়েছে। সন্ধ্যার দিকে তাসুর জ্ঞান ফিরে আসে।তাসু চোখ খুলে দেখে নীল তার পাশে বসে আছে। তাসুর জ্ঞান ফিরে আসছে দেখে নীল যেন তার নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে। এতোটাই আজ খুশি হয়েছে। তাসু কথা বলতে চাইছে কিন্তু মুখে অক্সিজেন মাস্ক পড়ানো তাই কথা বলছে পারছে না।মাথা টাও যে নড়াচড়া করতে পারছে না।
নীলও মানা করছে যেন কথা বলার চেষ্টা না করে।মাথাটা নড়াচড়া বেশি না করে।তাসু খেয়াল করে তার মানুষ টা আজ খুব কেঁদেছে। চোখ মুখ গুলো ফুলে একাকার হয়ে গেছে।
__রাত প্রায় দশটা বাজে নীল এখনো তাসুর হাত ধরে বসে আছে। তবে নীলের চোখে কান্নার ভাজ দেখতে পাচ্ছে তাসু।তাসু তার এক হাত দিয়ে মুখ থেকে মাস্ক টা সরিয়ে শক্ত করে নীলের হাত ধরে। তাসুর স্পর্শ পেয়ে নীল তাসুর দিকে মায়া ভরা চোখে তাকায়। নীল শান্ত গলায় বলে__ মুখ থেকে মাস্ক সরালে কেন.? কিছু বলবে…??তাসু মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দেয় যে কিছু বলতে চায়। তাসুর কথা বলতে খুব কষ্ট হচ্ছে তারপর বলার চেষ্টা করছে। তাসু বলে__ আপনি কাঁদছেন কেন…?? নীল কিছু বলছে না নিরব হয়ে গেছে। তাসু বলে__ আপনি কাঁদবেন না। আপনার চোখ থেকে পানি পড়াটা মানায় না।
___ হয়তো চোখ থেকে পানি পড়া টা আমাকেই মানায়। সুখ তো কখনো পায় নি সব সময় দুঃখ টাই আমার পাশে ছিল। তাই তো আজ দুঃখ টাই আমার সঙ্গী।নীল বলে__ তাসু তুমি এখন এতো কথা বলো না।সমস্যা হবে ডাক্তার কথা বলতে মানা করেছে।তাসু বলে__ আমি আর এতো কষ্ট সহ্য করতে পারছি না।জানেন আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি মনে হয় আর বেশিক্ষণ বাচবো না মরে যাবো।মাথা টা খুব যন্ত্রণা করছে। নীল আশ্চর্য হয়ে বলে__ কি বলছো এসব..??তোমার কিছুই হবে না।ডাক্তারের সাথে কথা বলে রেখেছি কালকেই তোমাকে কলিকাতা নিয়ে যাবো ভালো অপারেশন করার জন্য।
__তাসু বলে__ তার মনে হয় আর প্রয়োজন হবে না।নীল বলে__ কি সব আবোল তাবোল বলছো..?? প্লিজ তাসু এসব বলা বন্ধ করো।তাসু বলে__আপনি আমার কাছে একটু ভালোবাসা চেয়েছিলেন কিন্তু আমি দেয় নি।এর জন্য আমি আপনার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। নীল বলে__তাসু এখন এসব বলার সময়..??প্লিজ তুমি এটা মুখে দাও।তাসু নীল কে আটকিয়ে বলে__শুনেন না..? শেষ বারের মতো আপনি আমার একটা কথা রাখবেন..?? নীল বলে_ হুম বলো..?তাসু বলে__ আমি তো আর আপনার কাছে থাকবো না।আপনি আমার কাছে একটু ভালোবাসা চেয়েছিলেন দেয় নি।তার জন্য আপনি অনেক কষ্ট পেয়েছেন।আপনি মাহিরা আপু কে বিয়ে করে নেন।আপনারা খুব সুখে থাকবেন। মাহিরা আপু আপনাকে অনেক ভালোবাসে।
__মাহিরার কথা শুনে নীলের রাগ উঠে যায়।আজ মাহিরার জন্য তাসু এখানে শুয়ে আছে।তাসু এখনো জানে না তার এই অবস্থা টা মাহিরা করেছে। নীলের কাছে প্রমাণ না থাকাতে নীল মাহিরার কিছু করতে পারছে না।আর যারা তাসুর এই অবস্থা করেছে তাসু তাদের কারোর-ই চেহারা দেখে নি।তারা কারা তার কিছুই বলতে পারছে না।
তাসু বলে__ বলেন না..? আপনি মাহিরা আপু কে বিয়ে করবেন।নীল বলে__ তাসু তুমি কি পাগল হয়ে গেছো…?? যে আমি তার মতো একজন বাজে মেয়ে কে বিয়ে করবো।আমি তোমাকে ভালোবাসি তোমাকে ছাড়া আমি অন্য কাউকে আমার জীবনে চাই না বুঝছো তুমি..?? নীলের কথা টা শুনে তাসুর মুখে একটু খুশির হাসি ফুটে উঠে।
__তাসু বলে__ আপনি আমাকে একটু জড়িয়ে ধরবেন..?? আপনার একটু স্পর্শ পেতে খুব ইচ্ছে করছে। প্লিজ একটু জড়িয়ে ধরেন…??আজ কে আমাকে ফিরিয়ে দিবেন না।তাসুর কথা গুলো আজ কেমন অন্য রকম লাগছে। মনে হচ্ছে শেষ বারের মতো কথা গুলো বলছে। নীলের চোখ দিয়ে পানি পরছে।কষ্টে কলিজা টা ফেটে যাচ্ছে। তাসু বলে__ আপনি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন..??আপনি একটু আমাকে জড়িয়ে ধরেন না…??
__নীল কে কাঁদতে দেখে তাসু নীলের চোখের পানি মুছে বলে~ তুমি কাদবে না।তোমাকে কাঁদতে দেখলে আমার আরো বেশি কষ্ট হয়।তুমি আমাকে একটু জড়িয়ে ধরো না..?দেখ এমন যেন না হয় তুমি আমার কাছে আসলে একটু ভালোবাসা পাওয়ার জন্য কিন্তু তখন আামকে পাওয়ার জন্য আমিই রইলাম না।
__নীল আর তাসু কে জড়িয়ে না ধরে থাকতে পারে নি।আঁকড়িয়ে ধরে তাসু কে নিজের বাহুডোরে।নীলের স্পর্শ পেয়ে তাসু আরো শক্ত করে আঁকড়ে ধরে নীল কে।আজ তাসু কাঁদছে,, ইচ্ছে মতো ঠুকরে ঠুকরে কাঁদছে।তাসু বলে__ আপনি আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরেন। প্লিজ আমাকে কোথাও ছেড়ে যাবেন না। নীল তাসুকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে বলে __হুম তোমাকে আমি কোথাও ছেড়ে যাবো না।সব সময় আমার বুকে তোমাকে এভাবে আগলে রাখবো।
__নীল তাসুর কপালে একটু ভালোবাসার পরশ একে দেয়। নীলের ভালোবাসার পরশ পেতেই যেন তাসুর নিশ্বাস সেখানেই বন্ধ হয়ে যায়। নীলের পিঠ থেকে তাসুর হাত দুটো পরে যায়। হ্যা তাসু সবাই কে ছেড়ে চলে গেছে না ফেরার দেশে।যেখান থেকে আর কেউ কখনো ফিরে আসতে পারে না।তাসুর পুরো শরীর আসতে আসতে ঠান্ডা হতে শুরু করে। নীল এক পর্যায়ে খেয়াল করে যে তাসুর কোন সারা শব্দ নেই। নিশ্বাস ফেলার শব্দ টুকু শুনতে পাচ্ছে না।
__নীল আরো খেয়াল করে তার কাঁধ থেকে তাসুর হাত দুটো পরে গেছে। নীল তাসু কে বেডে শুয়ে রেখে তাসুর মুখে হাত দিয়ে দেখে নিশ্বাস ফেলছে কি না।কিন্তু তাসুর নিশ্বাস ফেলার কোন শব্দ অনুভব করতে পারছে না।নীল কোন দিকবিদিক না পেয়ে বাবা বাবা বলে চিৎকার করতে থাকে। নীলের বাবা এসে দেখে নীল তাসু কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করছে।ডাক্তার আসলে নীল বলে __ ডাক্তার আমার তাসু কথা বলছে না কেন..??নিশ্বাসও তো ফেলছে না। কি হয়েছে আমার তাসুর।
–ডাক্তার তাসুর মুখে হাত দিয়ে চ্যাক করে নিয়ে তাসুর চোখ দুটো চিরতরের জন্য বন্ধ করে দেয়। ডাক্তার বলে__ স্যরি আপনার স্ত্রী আরো অনেক্ষণ আগেই মারা গেছে। কথা টা শুনে নীল বিশ্বাস করতে পারছে না যে,, তার তাসু তাকে এভাবে একা রেখে চলে যাবে।নীলের চিৎকারে পুরো হসপিটাল কেঁপে উঠে। তাসু কে জড়িয়ে ধরে বুকে নিয়ে কাঁদতে থাকে।
__নীল যদি শুরু থেকে তাসু কে এভাবে ভালোবেসে আসতো,, তাসুর ভালোবাসা টুকু অনুভব করতে পারতো। তাহলে আজ হয়তো তাসু কে এভাবে হারাতে হতো না।তাদের ভালোবাসা টুকু অমর হয়ে থাকতো তাদের মাঝে। কোন অপূর্ণ থাকতো না তাদের ভালোবাসা মাঝের।
__নীল পুনরায় তাসুর জামার চেইন খুলে দেয়। এই অবস্থায় তাসু না পারছে নীল কে বাধা দিতে।না পারছে উঠে চলে যেতে না,, পারছে শুয়ে থাকতে।কিন্তু এভাবে তাসু যে আর শুয়ে থাকতে পারছে না।নীল তাসুর চেইন টা দুই পাশে সরিয়ে দেয়। চেইন টা খুলার পর নীলের চোখের সামনে তাসুর ধবধবে সাদা পিঠ উম্মুক্ত হয়ে যায়। এই অবস্থা টা দেখে হয় তো নীলের তাসুর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু নীলের এখানে সম্পূর্ণ বিপরীত ঘটলো।
__তাসুর পিঠে এলোমেলো অনেক গুলো কালো দাগ হয়ে আছে। কিছু দাগ আসতে আসতে মিশে যাচ্ছে। আর কিছু দাগ গুলো এখনো স্পষ্ট কিছু বুঝা যাচ্ছে। এই দাগ গুলো দেখে নীলের মন টা ভিষণ খারাপ হয়ে গেল। বুঝতে একটুও দেরি হলো না যে এই গুলো তার অমানুষের মতো অত্যাচারের চিহ্ন।
__দাগ এমন কালো হয়ে গেছে যে,,যে কেউ দেখবে তার চোখে পানি চলে আসতে কয়েক সেকেন্ড সময়ও লাগবে না।নীলেরও তার বেতিক্রম হলো না।চোখ দিয়ে পানি বের না হলেও চোখে পানি জমে গেছে বেশ অনেকখানি। নীল তাসুর ব্রা এর হুক খুলে দেয়। তাসু তখন আরো ভয়ে হাত দুটো বালিশের সাথে চেপে ধরে। চোখ দুটি আরো শক্ত করে বন্ধ করে নেয়। তাসুর প্রিয় মানুষ আজ প্রথম বিয়ের পর তার এতো টা কাছে আসছে।এর আগে নীল কখনো এতো টা কাছে আসে নাই। হ্যাঁ এসেছে মারতে তবে আদর করতে না।
__তাসু ভাবে হয়তো আজ তার মনের চাহিদা পূরণ করতে এতো টা কাছে এসেছে। কিন্তু এটা হয়তো উনি বুঝে নি যে শারীরিক চাহিদা তো যে কোন মূহুর্তেই মেটাতে পারে কিন্তু শারীরিক চাহিদা থেকে প্রয়োজন মনের চাহিদা। যা একজন মানুষ কে অন্য একজন মানুষের প্রতি আকর্ষিত করে।এটা হয়তো উনি জানে না।নীলের চোখেও কিছু টা পানি জমে গেছে হয়তো চোখ দুটো টিপ দিলেই পানি পরতে থাকবে।তাসুর এই দৃশ্য দেখে নীলের মন টা খারাপ হয়ে যায়।
__নীল কিছু না ভেবে তাসুর পিঠে নিজের ঠোঁট দুটো মিশিয়ে দেয়। হালকা করে তাসুর পিঠে চুমুর পরশ একে দেয়। তাসু নীলের ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে কেঁপে উঠে। শিহরণ উঠে যায় পুরো শরীরে। এই মূহুর্তে পুরো রুম জুড়ে শুধু নিরবতা। কারোই কোন শব্দ বা আওয়াজ শুনা যাচ্ছে না।গভীর রাত হয়ে গেছে। বাহিরে চতুর্দিকে ঘোর অন্ধকার।নীল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে প্রায় দেড়টা বেজে গেছে।
__নীলের মনটা ভিষণ খারাপ হয়ে আছে,,তাই তাসুর ব্রা-এর হুক টা লাগিয়ে দিয়ে জামার চেইন টা লাগিয়ে দেয়। তারপর উঠে গিয়ে লাইট টা বন্ধ করে আবার তাসুর পাশে শুয়ে পরে।তাসু তখনও হাত বালিশের সাথে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।নীল তাসুর একেবারে কাছে চলে আসে।
__নীল বলে__ তাসু ঘুমিয়ে যাচ্ছো নাকি…?? তাসু বলে__হুম।নীল বলে__ আমার দিকে তাকাও একটু।তাসু বলে__আমার ঘুম আসছে।নীল খেয়াল করে তাসুর কণ্ঠ স্বর কেমন ভারি শুনা যাচ্ছে। হ্যা ঠিকই ভারি শুনছে নীল কারণ তাসু বালিশে মুখ লুকিয়ে নিজের ইচ্ছে মতো কেঁদেছিল।নীল আবারও বলে__ তাসু আমার দিকে একটু তাকাও না..??তাসু বলে__ আমার ঘুম আসছে তো..??নীল এবার একটু রেগে বলে~ তোমাকে এই দিকে ফিরতে বলছি আমি।
__নীলের এই কথায় তাসু এবার তার দিকে তাকায়। ড্রীম লাইটের আলোতে কিছু টা দেখতে পারছে নীল তাসু কে।নীল দেখে তাসু কাঁদছে তাই জিজ্ঞেস করে__কাঁদছো যে..?তাসু চোখের পানি মুছে বলে~কোথায় না তো..??নীল এবার তাসুর ঘারের উপর হাত রেখে বলে__তোমাকে হয়তো বেশি_ই কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তাই না..??তাসু কিছুই বললো না।
__নীল বলে__ কিভাবে এমন অমানুষ হয়ে গেলাম তা নিজেও জানলাম না।এখন নিজের কাছেই নিজেকে অপদার্থ মনে হচ্ছে। আমাকে খুব ঘৃণা করো তাই না.?? তাসু বলে__ ঘৃণা করলে এতো অবহেলার পরেও আপনার কাছে পরে থাকতাম না। কবেই চোখ যেখানে যেতো চলে যেতাম। নীল বলে__তোমাকে আজ একটা সত্যি কথা জিজ্ঞেস করলে বলবে..?তাসু বলে_ বলেন। নীল বলে__ আমাকে খুব ভালোবাসো. .?? তাসু বলে__ আমার জানা নেই। এমন উত্তর টা শুনে নীল বলে__ আমার উপর খুব রাগ করে আছো তাই না..??তাসু বলে__ কারো উপর রাগ করে থাকার মতো মেয়ে আমি না।
__নীলের আজ খুব ইচ্ছে হচ্ছে তাসুর ভালোবাসায় হারিয়ে যেতে। এক হাত দিয়ে তাসুর কোমড়ে ধরে টান দেয় নীল। এতে তাসু নীলের অনেক টাই কাছে চলে আসে।একেবারেই মুখের কাছাকাছি চলে আসছে। তাসু কাঁপা কাঁপা চোখে নীলের দিকে তাকিয়ে আছে। তাসুর তখন মনে পড়ে গেলো নীলের অবহেলার কথা গুলো।মনে পড়ে গেলো প্রতি দিনের মারের কথা।অন্য মেয়ের কথায় নিজের স্ত্রীর উপর হাত তুলা।তার ইশারায় মারধর করা।তাই তাসু ভাবতে থাকে __চাইলেই কি এমন স্বামী কে সব টা উজাড় করে দেওয়া যায়।ইচ্ছে থাকলেই কি এতো অবহেলা করার পর তাকে নিজের শরীর টা বিলিয়ে দেওয়া যায়। এসব কথা ভেবেই তাসু নীলের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেয়।
__তাসু বলে__ আমার ভালো লাগছে না আমি ঘুমাবো।আপনি লেট না করে ঘুমিয়ে পরেন।এটা বলে তাসু ওপাশ হয়ে মুখ ফিরিয়ে নেয়। নীল বলে__ আমার কাছ থেকে সরে গেলে তাই না..??তাসু বলে_ আপনার কাছ থেকে সরে যাওয়ার ক্ষমতা আমার নাই। এতো অবহেলা করার পর ভালোবাসতে আসছেন। কিন্তু আপনার এই ভালোবাসা টা কি মন থেকে নাকি বাহির থেকে আদৌও আমি বুঝতে পারছি না।হয়তো কাল এই ভালোবাসা আর থাকবে না।আবার সেই অবহেলা মারধর করতে শুরু করবেন।
__কথা টা শুনে নীলের রাগ উঠে যায়। তাই নীল তাসুর আরো কাছে চলে যায়। জড়িয়ে ধরে নীল তাসু কে।সত্যি সত্যি নীল আজ তাসু কে মন থেকে ভালোবাসতে চায়। নিজের করে পেতে চায় আজ তাসুকে। কিন্তু নীল এটা বুঝতে পারছে না এই মূহুর্তে তাসুর মনের অবস্থা টা কি।তাসু কোন উপায় না পেয়ে নিজেকে আলগা করে দেয়। তাকিয়ে আছে নীলের দিকে।নীলের চোখ আজ অন্য কথা বলছে।
__নীল তার ঠোঁট তাসুর ঠোঁটের কাছে নিতেই তাসু মুখ সরিয়ে নিয়ে বলে__আমার ভালো লাগছে না তারপরেও কেন আপনি এমন করতেছেন..?? আচ্ছা আপনি যেটা ভালো মনে করেন সেটাই করেন। আমি আজ বাধা দিবো না। আপনি আমার স্বামী আমার উপর আপনার অধিকার আছে। আমি আজ কোনই বাধা দিবো না।নীল তার হাত দিয়ে তাসুর মুখ টা তার দিকে ফিরিয়ে নিয়ে বলে__ আমি তোমাকে জোর করে পেতে চাই না।তোমার সম্মতিতে আমি তোমাকে আমার করে নিতে চাই। তাসু বলে__ মন থেকে সম্মতি আসতেছে না।তবে বাধা দিবো না,,মন যা চায় করতে পারেন বাধা দিবো না।
__নীল আর সহ্য করতে পারে নি।দ্রুত রাগ দেখিয়ে উঠে বসে পরে। নীল রুম থেকে বের হয়ে বেলকনিতে চলে যায়। এই দিকে তাসু বালিশে মুখ চাপা দিয়ে কাঁদতে থাকে। তাসুর এই মূহুর্তে কোন উপায় ছিল না।যদি উপায় থাকতো তাহলে নীল কে আজ তার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত করতো না।ফিরিয়ে দিতো না নীল কে তার এতো কাছ থেকে। তবে তাসুর মনে হচ্ছে আজ নীল কে সে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলছে। তাই তো নীলের কষ্টেও তাসুও যে খুব কষ্ট পাচ্ছে। তাসু ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে যায়। আর ঐদিকে নীল কিছুই ভাবতে না পেরে সোফায় এসে ঘুমিয়ে পরে।
__সকালে তাসু তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে নীলের জন্য নাস্তা বানিয়ে রাখে। তাসু টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে রাখছে।একটু পরই নীল রুম থেকে বের হয়ে নাস্তা না করে সোজা অফিসের জন্য বের হয়ে যায়। তাসুর দিকে এমন কি নাস্তার টেবিলের দিকেও একবারের জন্যও তাকায় নি নীল। নীল ভেবে নিয়েছে রাতে তাসু তাকে কথার দ্বারা কষ্ট দিয়েছে অপমান করেছে। তাই সে একবারের জন্যও তাসুর দিকে তাকায় নি।নীলের এভাবে চলে যাওয়া টা তাসুর সহ্য হয়নি।তাসুও বুঝতে পারে রাতের জন্যই নীল এখন না খেয়ে চলে গেছে। হয়তো রাগ আর অভিমান নিয়ে আমার উপর বসে আছে। কিন্তু এই মূহুর্তে তাসুর যে কিছু করার নাই সে যে অসহায় হয়ে পড়ে আছে।
___নীল অফিসে গিয়ে কাজ করতে থাকে তখনই নীলের ফোন বেজে উঠে।ফোনের স্কিনে তাকাতেই নীলের কলিজা টা কামড় দিয়ে উঠে ।মাহিরা ফোন করেছে কিন্তু নীলের ফোন রিসিভ করতে ইচ্ছে করছে না।মাহিরা বারবার ফোন দিয়ে যাচ্ছে দেখে নীল তার ফোন টা সাইলেন্ট করে রাখে।নীল ফোন রিসিভ করছে না দেখে মাহিরা এবার ম্যাসেজ দেয়। ম্যাসেজ টা দেখে নীল ভয় পেয়ে যায়। ম্যাসেজ টা ছিল এই রকম _তুমি যদি আমার সাথে আজ দেখা না করো তাহলে আমি আত্মহত্যা করার পর পুরো দায়ভার তোমার নিতে হবে।
__ ম্যাসেজ টা দেখে নীল নিজেই এখন কলব্যাক করে।কারণ নীল জানে মাহিরা যা বলে তা করে ফেলে।এটাও করতে পারে একটু ভয় পাবে না।নীল ফোন করতেই মাহিরা সাথে সাথে ফোন রিসিভ করে বলতে শুরু করে __ তোমার সমস্যা কি..? আমার ফোন তুমি রিসিভ করছো না কেন..?? দেখা করার জন্য ম্যাসেজ দেই তার পরেও আসছো না।কি হয়েছে তোমার…?? নীল বলে__ কি কারণে আমাদের দেখা হচ্ছে না সেটা তুমি ভালো করেই জানো।মাহিরা বলে__ আমি এতো সব কিছু বোঝি না তুমি এখন আমার সাথে দেখা করবে।
__নীল বলে__ তোমার সাথে আমার এখন দেখা করা সম্ভব না। এখন আমি অফিসের কাজ নিয়ে ব্যস্ত আছি। মাহিরা বলে__ তাহলে কি তুমি এখন আমার সাথে দেখা করবে না..??নীল বলে__ আমি চাইনা আমাদের আর কখনো দেখা হোক।আমি তোমার কথায় অনেক অন্যায় করে ফেলেছি।অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলছি তাসুকে।তাসু কে আমি খুব সুখী দেখতে চাই। আর আমি এভাবেই খুব সুখে আছি।আমি আমার ভবিষ্যৎ খুব সুখে কাটাতে চাই। আশা করি আমাদের মাঝখানে আর তুমি আসবে না।
__নীলের কথা গুলো শুনে মাহিরা অনেক রেগে যায়। মাহিরা বলে__ তাহলে কি তুমি বলতে চাইছো আমি তোমাকে ভুলে যাই..?? নীল বলে__ হুম তুমি ঠিকই বুঝতে পারছো তুমি আমাকে ভুলে যাও।এটাই তোমার জন্য বেটার হবে।কারণ আমি তাসু কে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি। মাহিরা বলে __কখনো না,, আমি আমার ভালোবাসা কখনো বুলতে পারবো না।আর আমি যদি তোমার ভালোবাসা না পাই তাহলে তোমাকেও তাসুর ভালোবাসা আমি পেতে দিবো না।তোমাদের মিলন হতে আমি দিবো না। আমি তোমাদের কে আলাদা করেই ছাড়বো বলে দিলাম।
__মাহিরার কথা শুনে নীল অনেক টা ভয় পেয়ে যায়। কারণ মাহিরা তার ভালোবাসা পাওয়ার জন্য যা ইচ্ছে করতে পারে। নীল বলে__ মাহিরা তুমি এমন কিছু করার চেষ্টা করবে না। যদি খারাপ কিছু করার চেষ্টা করো তাহলে ভালো হবে না তোমার। মাহিরা বলে__ তোমার ভালোবাসা আমি না পেলে কাউকেই পেতে দিবো না।আর এর জন্য আমি কাউকে খুন করতেও দ্বিধাবোধ করবো না।এটা বলে মাহিরা ফোন কেটে দেয়। মাহিরার এক কথা নীল তার না হলে নীলকেও কারোর হতে দিবে না।নীল মাহিরার শেষ কথা টা শুনে খুব ভয় পেয়ে যায়। মাহিরা তাসুর কোন ক্ষতি করবে না তো..??নীলের কাছে এখন কিছুই ভালো লাগছে না।
__কোনমতে অফিস টা শেষ করে বাসায় ফিরে। তাসু এসে দরজা খুলে দেয়।তাসু দরজা খুলার পর নীল চিন্তিত চোখে তাসুর দিকে তাকিয়ে আছে। তাসুকে হারানোর ভয় তার মনে ঢুকে গেছে। তাসুও বুঝতে পারে নীল কে আজ খুব চিন্তিত লাগছে। তাই তাসু জিজ্ঞেস করে _কি হয়েছে আপনার..?? আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন..?? নীল এক ফালি হাসি দিয়ে বলে~ না কিছুই হয় নি।
নীল গিয়ে তাসুর পাশে বসে বলে__আজ যদি আমি তোমার কাছে কিছু চাই তাহলে সেটা কি তুমি দিবে আমাকে…??তাসু বলে__এমন কিছু চাইয়েন না যা আমি দিতে পারবো না।আর যদি আপনার সুখের জন্য আমার জীবনটা চান তাহলে খুব সহজেই দিয়ে দিবো।তবুও আমার থেকে এমন কিছু চাইয়েন না যা আমার আয়ত্তের বাহিরে।
__নীল বলে__ তোমার জীবন চাইবো না। কারণ এই জীবন টাই তো আমার। কথাটা শুনে তাসু আঁতকে উঠে। একটু নড়েচড়ে তাসু বলে__ মানে…??নীল বলে__ যদি বলি এখন থেকে তোমাকে আমি সারাজীবনের জন্য চাই। তখন কি বলবে তুমি..??
__নীলের কাছ থেকে এমন কথা কখনো আশা করেনি তাসু।ভাবতেও পারে নি নীল তার থেকে এমন জিনিস টা চেয়ে বসবে।নীলের এই কথা টা তাসুর পরো জীবন থেকে অনেক দূরে ছিল যা তাসুর ধারণাতেই কোন দিন ছিল না।যেই মূহুর্ত টা প্রত্যেক নারীই আশা করে তার প্রাণ প্রিয় স্বামী থেকে। সেই মূহুর্ত টা যে এটা হবে জানা ছিল না তাসুর। আর মূহুর্তটা যে আজকের রাত টা হবে তাও জানা ছিল না। আর জানা_ই বা থাকবে কি করে তাসু তো নীলের অবহেলায় সেই মূহুর্তটার কথা মন থেকে হারিয়েই ফেলেছে অনেক আগে।
__নীলের হঠাৎ করে এই চাওয়া টা কি আদৌ সঠিক নাকি পুরোটাই আবেগের বসে বলছে বুঝতে পারছে না তাসু। তাসু ভাবতে থাকে __এই জন্যই তাহলে আজ আমাকে এই রুমে থাকতে বলছে।তাসু চুপ করে মাথা নিচু করে বসে আছে। তাসুর হাত পা পুরো শরীর আসতে আসতে ঠান্ডা হয়ে আসছে।নীল আবার উঠে গিয়ে দরজা টা হালকা করে লাগিয়ে দেয়।
__তাসু নীলের আরেকটা কাজ দেখে আরো চমকে যায়। নীল রুমের লাইট টা বন্ধ করে দেয়। তাসু ভয়ে লাইট টা অন করতে গেলে নীল খপ করে হাত ধরে নেয়।নীল তাসুর হাত ধরেই বুঝতে পারে যে তাসুর হাত পা পুরো শরীর ঠান্ডা হয়ে গেছে। নীল বোঝে যায় এই মূহুর্ত টা তাসু কে খুব ভয় পাওয়াচ্ছে। কিন্তু তাসু মুখে কিছুই বলছে না।
__নীল বলে__ প্লিজ লাইট টা বন্ধ থাকুক। তাসু নিচু স্বরে বলে__ খুব অন্ধকার তো..??নীল বলে__ এতো ভয় পাচ্ছো কেন..?? ড্রীম লাইট জ্বলছে তো..??তাসু নিরব স্তব্ধ হয়ে গেছে কোন কথা বলছে না।নীল তাসুর গালে ধরে বলে~খুব ভয় পাচ্ছো তাই না৷?? তাসু বলে__ নাহ্ কেন ভয় পাবো…??নীল বলে__ আচ্ছা বসো এখানে।
__নীল তাসুর হাত ধরে নিয়ে তাসু কে একেবারে বিছানার মাঝ খানে নিয়ে বসায়।তাসু তখন একদম চুপচাপ মাথা নিচু করে বিছানার মাঝ খানে বসে থাকে।নীল বলে__ তুমি আমার ফুল টা নিতে চাইলে না কেন..?? কারণ টা কি জানতে পারি..?? তাসু কিছুই বলছে না মাথা নিচু করেই রাখলো।নীল বলে__কি বলো..? কেন নিলে না ফুল টা..??তাসু তখনও চুপ করে রইলো। নীল বলে__ আরে বলো না..? তাসু তখন মাথা টা কিছু তুলে বলে __ কি…??
__ নীল বলে__ আমি যে ফুল টা দিতে চাইলাম তখন তুমি হাতে নিলে না কেন..?? তাসু বলে__ আমার ইচ্ছে ছিল না তাই। আর ঐ ফুলে আমার এলার্জি আছে এই জন্য। নীল বলে__ ওও আচ্ছা।
__এরপর এই ভাবেই কিছুক্ষণ নিরবতা পালন করে নীল আর তাসু। নীল কি বলবে তাসুকে,, কোথা থেকে কথা বলা শুরু করবে কিছুই ভেবে পাচ্ছে না। তাসু কে নিয়ে দীর্ঘ পথ তার পারি দিতে হবে। চুপচাপ থাকলে যে তার সব পথ বন্ধ হয়ে যাবে।এইদিকে তাসুও একদম চুপচাপ বসে আছে। নড়াচড়ার শব্দ টা পর্যন্ত তো শুনা যাচ্ছে না।তাসুরও যে কিছু বলার নেই। তাসুর সব কথা কেন যেন গলা পর্যন্ত এসেও আটকে আছে। মুখ খুলে যেন কিছু বলতেই পারছে না।
__তাসু কে চুপ থাকতে দেখে নীল নিজেই তাসুর কান অবদি মুখ নিয়ে বলে __আমি যদি তোমাকে সারাজীবনের জন্য আমার বুকে আটকিয়ে রাখতে চাই তাহলে তোমার কিছু বলার আছে…??সব সময় আদর্শ স্বামী হয়ে তোমার পাশে থাকতে চাই।মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোমাকেই আমার চাই। তাসু তখনও চুপ হয়ে আছে কিছুই বলছে না।তাসুর বুকের ভিতর টা তখন ধুকপুক শুরু করে দিছে।
__নীল বলে__কি হলো কিছু বলছো না যে.??আজ কি চুপচাপ থাকার সিদ্ধান্ত নিছো নাকি..??তাসু নিচে তাকিয়েই বলে__ শুনতেছি তো….??নীল বলে__ শুনলে যে তার উত্তর দিতে হয় তা তো জানো।তাসু বলে __ আপনার এই প্রশ্নের কোন উত্তর নেই আমার কাছে। নীল বলে__ কেন…?? তাসু বলে__ এই প্রশ্নের উত্তর সেই দিন_ই মরে গেছে যেই দিন তাসু তার স্বামীর কাছ থেকে অবহেলা আর মার থাপ্পড় খেয়েছে। অন্য মেয়ের কথা শুনে যখন তাসুর স্বামী এসে তাসু কে মারতে শুরু করে পদে পদে অপমান লাঞ্চিত করে তখনই তাসুর কাছ থেকে এই উত্তর মরে গেছে।কোন দিন না জানি তাসু নিজেই একদিন মরে যায়,, কে বলতে পারে তাই না…??
__তাসু ভারি শান্ত গলায় কথা গুলো বলে গেছে। আর নীল শান্ত মস্তিষ্কে কথা গুলো শুনে যাচ্ছে। আজ নীল শুনবে তাসুর সব কথা তাসুর মনের ভিতর লুকিয়ে থাকা কষ্ট গুলো নীল শুনতে চায়। তাসুর সব মনের কথা নীল কে আজ বলতে হবে। নীলও যে শুনার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। তাই নীল তাসু কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে। তারপর..??
__তাসু স্বস্তির একটু শ্বাস নিয়ে বলে__ তার আর পর নেই।এরপর তাসু নিজেই একদিন মরে যাবে।কথা টা শুনে নীলের ভিতর টা কেমন কামড়ে উঠে। নীল বলে__তুমি ভালো নেই তাই না..?তাসু এবার নীলের দিকে তাকিয়ে বলে__ কে বললো আমি ভালো নেই। খুব ভালো আছি আমি। স্বামী থাকতেও কোন দিন ভালোবাসা পাইনি।পেয়েছি শুধু নিয়ম করে মার থাপ্পড় আর অবহেলা। সাথে বোনাস হিসেবে পেয়েছি স্বামীর ভালোবাসা মানুষের চড় আবার তার মিথ্যে কথা শুনে স্বামীর মার।এসব সহ্য করে আমি বেশ ভালো আছি। স্বামীর কাছে থাকতে আর খেতে তো পারি..?? আলহামদুলিল্লাহ এই টুকুই যথেষ্ট।
__নীল বলে__ এরপর..?? তাসু বলে __আর কিছুই না। রাত অনেক হয়েছে ঘুমাতে হবে।রুমে যাবো আপনি ঘুমিয়ে পরেন।নীল তাসুর কথায় বেশ বুঝতে পারে তাসু তার কাছ থেকে দূরে থাকতে চাইছে।তবে কেন না জানি আজ নীল তাসুর প্রতি খুব আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে।নীলের আজ তাসু কে কাছে চাই।তা যে ভাবেই হোক বা যে করেই হোক।
__ তাসুর বাম হাতটা নিজের হাতের ভাজে নিয়ে নেয় নীল। নীল বলে__ আজ যদি তোমার সাথে এই রুমে ঘুমাতে চাই তাহলে..??তাসু বলে__ কিন্তু আমি ঘুমাতে চাই না।তাসু এটা বলে__ উঠে চলে যেতে নিলে নীল শক্ত করে তাসুর হাত ধরে নেয়।
__নীল বলে__ উঠে চলে যাচ্ছো কেন…?? আমি তোমাকে যেতে বলছি..?? বসো এখানে। তাসু বলে__রাত অনেক হলো যে..??আপনার কাল অফিস আছে তো।নীল বলে__ অফিস আছে তো কি হয়েছে..?? আমার অফিসের কাজ কি তুমি করতে যাবে..?? তাসু বলে__ নাহ্..।
__নীল বলে__তাহলে আমার অফিস নিয়ে তোমার এতো পেরেশান কেন..?? নাকি থাকতে চাইছো না আমার কাছে..?? কোনটা শুনি…??তাসু সোজাসাপটা বলে দেয় __ কি জানি,, জানা নেই। নীল বলে__তোমার মন কে জিজ্ঞাসা করো।তাসু বলে__মনের দরজায় অনেক আগেই তালা লেগে গেছে। খুলার মতো কোন চাবি নাই।
__তাসু উঠে চলে যেতে গেলে নীল কোন কথা না বাড়িয়ে তাসুকে কোলে তুলে নেয়। তাসু নীলের কাজ দেখে আজ বেশ আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছে। কয়েক বার নীল কে না করে কিন্তু নীল আজ কোন কথাই শুনছে না।তাসু কে বিছানায় এনে শুইয়ে দেয়। এরপর নীল তাসুর বুকের উপর থেকে ওড়না টা সরিয়ে দেয়। এই কাজ টা দেখে তাসু আরো বড় আশ্চর্য হয়ে। তাসু তার দুই হাত দিয়ে বুকটা ঢেকে নেয়। ওড়না টা সরিয়ে নীল অপলক চোখে তাসুর মায়াভরা চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।
__তাসুর চোখের কোণায় পানি জমে গেছে। পানি গুলো তাসুর চোখে বালির মতো চিকচিক করছে।গভীর নিরবতায় চেয়ে আছে শান্ত চোখ দুটি তাসুর দিকে চোখের দিকে। এ যেন এক মায়াবী রাজ কন্যা।এরই মাঝে তাসু একটা ঢোক গিলে।নীল তাসুর দিকে একটু ঝুকে যায়। এরপর নিজেই তাসুর কানের কাছে এসে বলে তাসু গালে হাত রেখে বলে__আমি শুধু তোমার সাথে থাকতে চাই। হারিয়ে যেতে চাই আমি তোমার শহরে ।তোমার মাঝে আমি বিচরণ করতে চাই। স্বাদ নিতে চাই আমি তোমার ঘ্রানের।বিশ্বাস করো আমি শুধু তোমাকে চাই আর কিছুই চাই না,, শুধু তোমাকে চাই আমার জীবনে।
__নীলের কথা গুলো শুনে তাসু কিছুই বলছে না।মনে হচ্ছে মুখ টাও আজ তার কথা মানছে না।চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি গাল বেয়ে পরছে।এরপর নীল তাসু কে উপুর করে শুয়ে দেয়। জামার চেইনে হাত দিবে তখনই নীলের নজর যায় তাসুর ঘাড়ের নিচে ধবধবে সাদা পিঠের দিকে।ঘাড়ের নিচের অংশে অনেক গুলো কালো লম্বা দাগ হয়ে আছে। নীল পিঠে হাত লাগাতেই তাসু শিহরিত হয়ে উঠে। নীল ড্রীম লাইটের আলোতে দাগ গুলো আবছা দেখতে পাচ্ছে।নীল বেশ অবাক হয়ে যায় দাগ গুলো দেখে। নীল বলে__ এই গুলো কিসের দাগ…??তাসু কথা টা শুনে বেশ বড় শক খায়।তাসু বলে_ আমার থেকে ভালো আপনার জানার কথা।
__নীলও তাসুর কথা টা বুঝে নেয়। কারণ নীল তাসু কে বহুবার পিঠে বেত দিয়ে চামড়ার বেল দিয়ে পিটিয়ে ছিল। তাই নীল সব কিছু দেখার জন্য উঠে গিয়ে লাইট টা অন করে আসে।এই ফাকে তাসু উঠে গিয়ে নিজের ওড়না টা দিয়ে নিজেকে আবৃত করে নেয়। এই দিকে নীল এসে তাসুর দাগ গুলো দেখার চেষ্টা করছে কিন্তু তাসু বারবার মানা করছে।
__তাসু জোর করছে দেখে নীল নিজেই তাসুর পিঠের দিকে ঘুরিয়ে যায়। ওড়না টা সরিয়ে দাগ গুলো দেখে নীল অবাক হয়ে যায়। এলোমেলো দাগ গুলো কালো হয়ে আছে।নীল বলে__ এই দাগ গুলো তো আগে দেখি নাই..? তাসু বলে__ কখনো দেখার চেষ্টা করেন নাই।নীল বলে__আমাকে আগে কখনো বলো নাই কেন..?? তাসু বলে__ আচ্ছা এসব বাদ দেন,,কাল তো আপনার অফিস আছে লেট করা ভালো হবে না। ঘুমিয়ে যান।নীল রেগে বলে~এই কথা টা আরেক বার বললে এমন থাপ্পড় দিবো না বুঝবে তখন।
__তাসু বলে__আপনার মার সহ্য করার মতো ক্ষমতা আর শক্তি দুটোই আছে আমার। এরপর নীল তাসু কে উপুর করে শুয়ে দেয়। পিছন থেকে নীল তাসুর জামার চেইনে হাত দিতেই তাসু আবার ঝট করে উঠে বসে যায়। নীল বলে__ কি হলো এমন করে উঠে গেলে কেনো..??তাসু ভয়ে ভয়ে বলে- আপনি এমন করতেছেন কেন..?নীল বলে__ আমি আবার কি করলাম..?? তাসু বলে__ জামার চেইন খুলেন যে…??নীল বলে__যাকে আমি এতো মেরেছি,, পশুর মতো মেরে দাগ করে ফেলেছি। সে কখনো কোন প্রতিবাদ করে নি।তাই সেই মেয়ের মারের চিহ্ন গুলো আজ দেখতে চাইছি।
__নীলের কথায় স্তব্ধ হয়ে যায় তাসু।চুপ করে মাথা নিচু করে বসে থাকে তাসু।নীল পুনরায় শুয়ে দেয় তাসু কে।তাসু দেয়ালের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। নীল পুনরায় তাসুর জামার চেইন টা খুলে দেয়। এই অবস্থায় তাসু না পারছে নীল কে বাঁধা দিতে, না পারছে উঠে যেতে, না পারছে শুয়ে থাকতে।
__এই দিকে নীল এখনো আসছে না দেখে তাসু বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে। মানুষ টা এখনো আসছে না কেন..??তাসু নীলের বাসায় আসার প্রহর গুনছে কখন আসবে।সাথে ভয়ও হচ্ছে রাস্তায় কোন সমস্যা হলো না তো.??এরই মাঝে কিছুক্ষণ পর কলিংবেলের আওয়াজে তাসু দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। নীল দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাহিরে।
__নীল কে দেখে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে তাসু।তাসুর কাছে মনে হচ্ছে পুনরায় সে প্রিয় মানুষ টা কে ফিরে পেয়েছে। তাসু খেয়াল করে তার মানুষ টা কে বড্ড বেশি ক্লান্ত দেখাচ্ছে।তাসু বলে__ আসছেন আপনি..আজ এতো দেরি হলো যে..??
__নীল বলে__ হুম আজ অফিসে মিটিং ছিল তাই মিটিং শেষ করে আসতে দেরি হয়ে গেছে। তাসু বলে_ ওও।তাসু নীলের হাত থেকে অফিসের ব্যাগ টা নিয়ে নীলের পিছু পিছু তার রুমে যেতে লাগে।
__নীল রুমে গিয়ে তাসু কে বলে__ ভালো করে এক মগ কফি নিয়ে আসো।বড্ড ক্লান্ত লাগছে আর মাথা টাও ধরে আছে। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। তাসু বলে__আচ্ছা এখনই নিয়ে আসছি। তাসু যেতে গেলে নীল বলে___ এই দাঁড়াও দাঁড়াও,, তোমার তো সকালে হাত পুড়ে গেছে। তোমার কফি বানাতে হবে না।আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি আমি_ই ঠিক বানিয়ে নিতে পারবো।
__ তাসু আশ্চর্য হয়ে বলে__ কি বলছেন এসব আপনি কফি বানাবেন মানে .?? আপনি মাত্র অফিস থেকে ক্লান্ত হয়ে আসছেন এখন আরাম করেন। আর আমার হাত এতো টা পুড়ে নাই যে আপনাকে কফি বানিয়ে খাওয়াতে পারবো না।আপনি ফ্রেশ হয়ে বসেন আমি নিয়ে কফি নিয়ে আসছি। নীল কিছু বলতে যাবে এর আগেই তাসু চলে যায় কফি বানাতে।
__তাসুর হাত টা বেশ ভালোই পুড়েছে। যার কারণে রাতের জন্য রান্না করতে তাসুর একটু কষ্টই হয়েছে। কফি বানাতে তাসুর তেমন কোন কষ্ট হবে না।তাসু কফি বানিয়ে নীলের রুমে যায়। নীলও সবে মাত্র ফ্রেশ হয়ে ওয়াসরুম থেকে বের হয়েছে। নীল বলে__ তোমাকে তো বলেছিলাম কফি আমি বানিয়ে নিতে পারবো। তারপরও কেন এই হাত নিয়ে কফি বানাতে গেলে।তাসু বলে__ আপনি শুধু শুধু টেনশন করছেন আমার হাতের তেমন কিছুই হয়নি।
__তাসু বলে__ কফি টা খেয়ে নেন ক্লান্ত টা কেটে যাবে। নীল কফি টা হাতে নিয়ে টি টেবিলে রেখে দেয়। তাসু চলে যেতে গেলে নীল ডেকে বলে_ তাসু শুনো না..??তাসু পিছনে ফিরে বলে__ কিছু বলবেন..?? তাসু নীলের হাতে তাকিয়ে দেখে তার হাতে একটি ফুল। নীল অফিস থেকে বের হয়ে অনেক খুঁজাখুঁজির পর তার এই পছন্দের ফুল টা পেয়েছে। নীল হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে~ এটা তোমার জন্য।
__তাসু আশ্চর্য হয়ে বলে__আমার জন্য ফুল মানে..?? আমি তো ফুল আনতে বলি নাই। নীল বলে__ হুম তুমি বলো নাই, কিন্তু আজ আমার প্রমোশন হয়েছে আর কাজ গুলো সবার পছন্দ হয়েছে তাই এটা তোমার জন্য এনেছি। তাসু নীলের প্রমোশনের কথা শুনে অনেক খুশি হয়।তাসু বলে__ আলহামদুলিল্লাহ,, বলেছিলাম না আপনার পরিশ্রম বিফলে যাবে না সব হয়ে যাবে।
নীল বলে__ ফুল টা নিবে না…??তাসু বলে__ফুল নিয়ে কি করবো। আপনি আপনার কাজে সফল হয়েছেন এতেই আমি অনেক খুশি। নীল বলে__ এই ফুল দিয়েই তো কতো মানুষ তাদের প্রিয় মানুষের কাছে তাদের মনের অনুভূতি প্রকাশ করে। আমি না হয় আমার মনের ভিতর লুকিয়ে থাকা অনুভূতি গুলো এই ফুল দিয়েই প্রকাশ করি।তাসু বুঝতে পারে নীল কি বোঝাতে যাচ্ছে। তাসু বলে__ আমি তো এখনো কারো প্রিয় মানুষ হতে পারি নাই। তাহলে আমাকে এই ফুল দিচ্ছেন কেন..?? নীলের কাছে হয়তো এই প্রশ্নের কোন উত্তর নাই।
__তাসু বলে__ কফি টা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে খেয়ে নেন।তাসু চলে যায়। মন খারাপ করে বসে পরে নীল। কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না।এর কিছুক্ষণ পরই নীল তাসুর রুমে যায়। তাসু খাটে হেলান দিয়ে ছোট একটা উপন্যাসের বই পড়ছে। নীল কে দেখে তাসু বই টা রেখে নিজের ওড়না ঠিক করে বলে__ আপনি এখানে..?? নীল বলে__ কেন তোমার রুমে আসতে পারি না..??তাসু বলে__ হুম আপনার বাসা আপনি যে সময় খুশি আসতেই পারেন।
__তো কিছু বলতে আসছেন..?? খাবার খেতে দিবো..??নীল বলে__ না একটু পরে খাবো।নীল বলে__ আমি তোমাকে বলেছিলাম আমার প্রমোশন হলে তুমি যা চাইবে তাই দিবো।কি চাই তোমার..??আজ যা চাইবে মুখ ফুটে বলে ফেলো।
__তাসু বলে__চাইছি তো কাল রাতে এর চেয়ে বেশি কিছু আমি আপনার কাছে চাই না।নীল বলে __ তোমার পছন্দের কি চাই সেটা বলো।দামী দামী জামা কাপড় বা স্বর্ন গহনা।
__তাসু বলে __ এসবের কিছুই আমার চাই না।আমার পছন্দের যা চাই তা কাল কে বলেছিলাম তো..?এর চেয়ে দামী কিছুই চাই না।আপনি খেতে আসেন আমি টেবিলে খাবার দিচ্ছি। নীল কে আর কিছু বলতে না দিয়ে তাসু রুম থেকে বের হয়ে যায়। যেই কথা গুলো তাসু বলে গেলো তা তাসুর অভিমানী কথা নাকি মনের কথা বলে গেলো নীল তার কিছুই বুঝতে পারছে না।তবে এতোটুকু বুঝতে পারছে তাসু কথা গুলো অনেক কষ্ট পেয়েই বলছে।নীল এও ভেবে নিয়েছে তাসুর সাথে করা অন্যায় গুলোর জন্যে তাসুর কাছে ক্ষমা চাইতেই হবে। আর তা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব করা যায়।
__নীল খাবার টেবিলে বসে আছে। তাসু সব কিছু এগিয়ে দিচ্ছে।নীল বলে__ তুমি খাবে না..??তুমিও আমার সাথে খেতে বসো..??তাসু বলে__আপনি খেয়ে যান আমি রাতে খাবো না।নীল বলে_ কেন শরীর খারাপ লাগতেছে..??তাসু বলে_ না না তেমন কিছুই না।খেতে ইচ্ছে করতেছে না তাই আর কি।নীল আর কিছু বলে নাই। খেয়ে চলে যায় রুমে।
__তাসু সব কিছু গুছিয়ে ফ্রেশ হয়ে ঘুমাতে যাবে তখন নীল এসে বলে__ তাসু তুমি একটু আমার রুমে আসো তো।তাসু বলে__ আচ্ছা আপনি যান আমি এখনই আসছি। তাসু হাত মুখ মুছে নীলের রুমে যায়। তাসু বলে__ আপনি আমায় কিছু বলার জন্য ডেকে ছিলেন।নীল সোজাসাপটা তাসু কে বলে দেয়__ তুমি আজ এই রুমে ঘুমাবে।হঠাৎ এমন কথা শুনে তাসুর কলিজায় কামড়ে উঠে। কলিজার সব পানি নড়াচড়া শুরু করে দেয়।
__তাসু একবার নীলের তাকায় আরেকবার নীলের বিছানার দিকে তাকায়। তাসু খুব চিন্তায় পরে যায়,, হঠাৎ করে মানুষ টার আবার কি হলো..??ভুতপ্রেতে ধরে নাই তো.?? আজ হঠাৎ করেই কেন আমাকে এই রুমে থাকতে বলছে। উনি আমার থেকে কি উদ্দেশ্য হাঁচিল করতে চায়। তাসু এক নজর নীলের চোখের দিকে তাকায়।নীলের চোখের ভাষা ঠিক তাসু বুঝতে পারছে না।নীলের চোখও যেন আজ অন্য কথা বলছে।
__তাসু বলে__ আমি তো প্রতিদিন ঐ রুমেই ঘুমাই তাহলে আজ কেন এই রুমে ঘুমাতে যাবো..??নীল বলে__ আমি বলছি তাই। তাসু বলে__ কিন্তু আমি তো ঐ রুমেই ঠিক আছি।নীল বলে__ ঐ রুমে ঠিক নেই। তুমি এই রুমেই ঘুমাবে এটাই ফাইনাল। আর আমার কথা অমান্য করলে আমি কি করতে পারি সেটা তুমি ভালো করেই জানো।মোড ভালো আছে রাগ উঠাবে না বলে দিলাম।
__তাসু কি বলবে তার কিছু মাথায় আসছে না।রাগ উঠে গেলে আবার অন্য কিছু করতে পারে। তাই তাসু মাথা নিচু করে বলে__ ঠিক আছে। আমি একটু পরে আসছি। এটা বলে তাসু চলে যায় নিয়ে নিজের রুমে। তাসু রুমে গিয়ে ভাবে আমাকে আবার মেরে ফেলার চিন্তা করতেছে না তো..??আমাকে তার পথ থেকে সরিয়ে মাহিরা আপু কে বিয়ে করবে না তো..??দূর আমি আবার এসব কি ভাবছি। যা আছে কপালে তাই হবে।এসব নিয়ে ভাবার কোন চিন্তা নাই। উনি যা বলছে সেটাই করি। আজ না হয় উনার রুমেই ঘুমাই।
__তাসু এসব ভাবতে ভাবতে রাত প্রায় এগারো টায় গুটি গুটি পা দিয়ে নীলের রুমের দরজার সামনে যায়। দরজা টা একটু খুলে উকি দিয়ে দেখে নীল সোফায় বসে ফোন টিপছে।এখনো নীল বসে আছে দেখে তাসু চমকে যায়। তাসুর এখন ইচ্ছে করছে নীল কে ইচ্ছে মতো বকাঝকা করতে। তাসু আসতে আসতে পায়ে হেটে খাটের এক পাশ হয়ে শুয়ে পরে। নীল একটু আড় চোখে তাসু কে দেখে।
__তাসু শুয়ে থেকে এখনো বুঝতে পারছে না কেন তাকে আজ এই রুমে থাকতে বললো।তাসু ভয়ে এপাশ ওপাশ করছে। কিন্তু তাসুর চোখে কেন না জানি ঘুম আসছে না।নীল তাসু কে দেখছে তাসু বারবার এপাশ ওপাশ করছে ঘুমানোরও চেষ্টা করছে। ঘুমাতে পারছে না।নীল ফোন টা চার্জে লাগিয়ে মুচকি হাসি দিয়ে বলে__ ঘুম আসছে না..??তাসু শুয়া থেকে উঠে বলে__ অনেক তো চেষ্টা করতেছি ঘুম তো আসছে না।
__নীল বলে__ তখন তোমায় ফুল দিতে চাইলাম ফুল টাও নিলে না।বললাম তোমার কি চাই সেটাও বললে না।আমার কাছ থেকে মুখ ফুটে কিছু চাইলে না কেন..? তাসু বলে__ আমার কিছুই চাই না। আর চাওয়ার ছিল সেটা চেয়েছি তো।এর চেয়ে বড় চাওয়ার মতো আমার কাছে আর কিছু নেই।
__নীল গিয়ে তাসুর পাশে বসে বলে__আজ যদি আমি তোমার কাছ থেকে কিছু চাই সেটা দিবে আমাকে..??
__তাসু নীলের প্লেটে তাকিয়ে বলে__ এমা..আপনার প্লেটে দেখি কিছুই নাই। তাসু নীলের প্লেটে খাবার দিতে গেলে নীল বলে__ এই আমার প্লেটে আর খাবার দিবানা পেট ভরে গেছে।তাসু আর নীলের প্লেটে খাবার দিলো না।
__ তবে নীল বুঝতে পারছে তাসুর এই টুকু খাবার খাওয়ার কারণ টা কি।তাসু নীলের সামনে সহজে বসে থাকতে পারছে না
যার কারণে হয়তো তাসু এই অল্প পরিমাণ খাবার খেয়েছে।অবশ্য এই সবের একমাত্র কারণ তাসুর প্রতি নীলের খারাপ ব্যবহার আর অবহেলা।
নীল তাসু কে আর কিছু বলে নাই হাত ধুয়ে নিজের মতো রুমে চলে যায়।
__তাসু খাবার টেবিলের সব কিছু পরিষ্কার করে খাবার গুলো ফ্রিজে রেখে ঘুমাতে যাবে এমন সময় তাসু দেখে নীল ল্যাপ্টপ নিয়ে আবার কাজ করতে বসছে।তাসু ভাবে রাত এতো গভীর হয়ে গেছে উনি এখন না ঘুমিয়ে ল্যাপ্টপে আবার কি কাজ করবে..?? কিছুক্ষণ আগে তো অফিসের কাজ শেষ করছে মনে হয়।
__ তাসু দাঁড়িয়ে না থেকে নীলের কাছে গিয়ে বলে__ এতো রাতে আবার ল্যাপ্টপ নিয়ে বসছেন যে..??ঘুমাবেন না..?নীল বলে__ হুম ঘুমাবো একটু লেট হবে।হাতে আরো ত্রিশ মিনিটের মতো কাজ বাকি আছে। তাই ভাবছি মোড যেহেতু ভালো আছে কাজ সেরেই ফেলি।সকালে অফিসে গিয়ে আবার তাড়াহুড়ো করতে ভালো লাগবে না।
__নীল বলে__ তুমি ঘুমাবে না..??তাসু বলে__ হুম আমি তো এখনই ঘুমাতাম। আপনি এখন আবার ল্যাপ্টপ নিয়ে বসছেন তাই জিজ্ঞেস করতে আসছিলাম। নীল বলে__ এখন না ঘুমিয়ে একটা কাজ করতে পারো।তাসু বলে__ কি কাজ শুনি..??নীল বলে__ তুমি এখন না ঘুমিয়ে আমার কাজ না হওয়া পর্যন্ত আমার সাথে বসে আড্ডা দাও।আমার জন্যও একটু ভালো হবে। কাজ টা খুব সহজে করতে পারবো।
__ নীল তাকিয়ে আছে তাসুর মুখের দিকে হ্যাঁ বাচক উত্তর শুনার জন্য। তাসু একটু ভেবে বলে__ হুম থাকা যায়। আচ্ছা আপনি এখন কফি খাবেন..?? কফি বানিয়ে নিয়ে আসি..?? এই মূহুর্তে আমার কফি খেতে ইচ্ছে করছে। নীলের এই মূহুর্তে কফি খাওয়ার মোটেও ইচ্ছে নাই। কারণ নীল সবে মাত্র খাবার খেয়ে আসছে।তবে তাসু যেহেতু এখন কফি খেতে বলছে তাই নীল আর না করে নাই। নীল একটু মুচকি হেসে বলে__ হুম খাওয়াতে পারো।
__ তাসু কিচেনে গিয়ে সাত আট মিনিটের মধ্যে দুই মগ কফি বানিয়ে নিয়ে আসে।নীল কে কফি দিয়ে তাসু দাঁড়িয়ে আছে। সাহস পাচ্ছে না মেয়ে টা নীলের পাশে খাটের উপর বসতে।তাসু কে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নীল বলে__ এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেন..? বসো আমার পাশে।তাসু কথা টা শুনে অনেক খুশি হয়।তাসুও খুব সাহস করে নীলের পাশে বসে পরে।
___ নীল ল্যাপ্টপে বসে কাজ করছে আর একটু পরপর কফির মগে ঠোঁট লাগাচ্ছে। তাসুও কফি খাচ্ছে আর নীল কি কি কাজ করছে এটা সেটা জিজ্ঞেস করছে।তাসু বলে__ আচ্ছা আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি..??নীল ল্যাপ্টপে কাজ করতে থেকেই বলে~হুম জিজ্ঞেস করো না.?? কোন সমস্যা নাই।
__তাসু বলে__ আমি কিছু দিন ধরে লক্ষ্য করছি আপনি অফিসে কাজ করার পরেও বাসায় এসে দেরি করেন না আবার ল্যাপ্টপ নিয়ে কাজ করতে বসে যান।আপনার কাছে খারাপ লাগে না..??নীল তাসুর কথা টা শুনে একটু হেসে দেয়। নীল বলে__ নারে পাগলী,, খারাপ লাগলে কি আর সবাই দিনে রাতে এক সমানে কাজ করতো..??এটা যে পরের কাজ সময় মতো কাজ শেষ করে জমা দিতেই হবে।
__নীলের মুখ থেকে পাগলী শব্দ টা শুনে তাসুর বুকে গিয়ে একটু মুচড় দেয়। পাগলী শব্দ টা শুনতে যে তাসুর কাছে ভালোই লাগছে। তাসু তাকিয়ে আছে কাজে মনযোগ দেওয়া মানুষটার দিকে।
__তাসু নীলের দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকে__ মানুষ টাকে কতো শান্ত লাগে দেখতে। কিন্তু কে বলবে এই মানুষ টার হাতেই আমার মার খেতে হয় কারণে অকারণে।প্রতিদিন এই মানুষ টার অবহেলা সহ্য করে নিতে হয়।কে বলবে এই মানুষ টা ঘরে নিজের স্ত্রী রেখে অন্য মেয়ের সাথে রিলেশনশিপে জড়িয়ে আছে। আমার মনের ভিতর তার প্রতি কি পরিমাণ ভালোবাসা জমে আছে সে কখনো দেখবে না।
__না কখনো জানতে চাইবে আমি তার কাছে কি চাই..?? মাহিরা আপু কে বিয়ে না করেও তার জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। তাহলে আমাকে বিয়ে করেও,, সে কি একটুও ভালোবাসতে পারে না..??
তাসু দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলে ভাবে __অবশ্য তার মুখ থেকেই শুনেছিলাম তার জীবনের সব টা জুড়ে নাকি মাহিরা আপু।তাহলে আমি তার কাছ থেকে ভালোবাসা কি করে পাবো..??বিয়ের পর থেকে অপমান,, অবহেলা,, চড়থাপ্পড়,, মার এসবই জুটে এসেছে এই অভাগা কপালে। শ্বশুর শ্বাশুড়ি বা চাচী সবাই হয়তো ভাবছে আমি স্বামীর বাসায় খুব সুখেই আছি। তারা হয়তো জানে না স্বামীর ঘরে আমার বিয়ের পরের জীবন টা কিভাবে কাটতেছে।তারা জানতে পারলে হয়তো কেঁদেই দিবে।
__এসব ভাবতে ভাবতে অজান্তেই তাসুর চোখে পানি চলে আসে। নীল যেন বুঝতে না পারে তাই মুখ মুছার ছলে চোখের পানি গুলো মুছে নেয়।
__নীল বলে__ আর সবচেয়ে বড় কথা হলো __ আমার কাজ দেখে ক্লায়েন্টের যদি পছন্দ হয় তাহলে আমার প্রমোশন হবে সেই জন্যই দিন রাত এক করে কাজ করে যাচ্ছি। তাসু বলে__ চিন্তা করিয়েন না। আপনি আপনার পরিশ্রমের ফল পাবেন ইনশাআল্লাহ।
__নীল তাসুর দিকে তাকিয়ে বলে__ তুমি কিভাবে এতো টা শিওর হলে__ তাসু মুচকি হেসে বলে__ আপনার এতো পরিশ্রম আর আমার মন বলছে তাই। নীল তাসুর আত্মবিশ্বাস দেখে তাসুর দিকে তাকিয়ে আছে। নীল ভাবে তোমার আগে যদি আমার জীবনে মাহিরা নামক মেয়ে টা না আসতো তাহলে হয়তো আজ তুমি আর আমি রাজা রানী হয়ে থাকতাম। থাকতো না তোমার আর আমার মধ্যে এতোটা দূরত্ব।
__নীল বলে__ আচ্ছা তোমাকে তো এই পর্যন্ত আমি কিছুই দেয় নি।আর তুমিও আমার কাছ থেকে কিছু চাওনি।তাই ভাবছি আমার প্রমোশন হলে তোমাকে গিফট দিবো।আর তুমিও আমার থেকে কি চাও সেটা বলো।তাসু কিছু বলছে না।নীল বলে__ কি চাও বলো না..??যেটা চাইবে সেটাই দিবো। তাসু নীলের দিকে তাকিয়ে বলে__ যা চাইবো সেটা দিবেন তো..??নীল বলে __ হুম দিবো.. একবার চেয়েই দেখো।
তাসু বলে__ আপনি আমাকে মারেন কাটেন কষ্ট দেন বা অবহেলা করেন যা ইচ্ছে তা_ই করেন আমি আপনাকে কিছুই বলবো না।কিন্তু আপনি আমাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা বলবেন না।আপনি মাহিরা আপু কে বিয়ে করে নেন তাতেও আমি কিছু বলবো না।সহ্য করে নিতে পারবো। কিন্তু ছেড়ে দিলে সেটা সহ্য করে নিতে পারবো না।যতক্ষণ আমি আপনাকে ছেড়ে না যাবো তার আগে আপনি আমাকে ছেড়ে দিবেন না। আমার এই চাওয়া টা আপনি পূরণ করবেন ..??বলেন না পূরণ করবেন কি না..??
নীল কি বলবে কিছুই ভাবতে পারছে না।
__ নীল কে এভাবে চুপ থাকতে দেখে তাসু কাঁদতে কাঁদতে বলে__ আসছি আপনি ঘুমিয়ে যাইয়েন। তাসু গিয়ে বিছানায় শুইয়ে ফুপাতে ফুপাতে ঘুমিয়ে যায়।
__সকালে নীল অফিসে যাবে তাই রেডি হচ্ছে অফিসে যাওয়ার জন্য। এদিকে তাসু রান্না শেষ করে টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে দিচ্ছে। নাস্তার সময় হলে নীল টেবিলে আসে নাস্তা করার জন্য। তাসু নীলের জন্য চা বানিয়ে আনতে কিচেনে চলে যায়। কিচেন থেকে তাসুর চিৎকারের আওয়াজ শুনে নীল দৌড়ে তাসুর কাছে যায়। নীল গিয়ে দেখে তাসুর হাতে গরম পানি পরে হাত পুড়ে গেছে। নীল এটা দেখে আশ্চর্য হয়ে যায়।
__ নীল তাসুর হাত ধরে পেরেশান হয়ে বলে__ তুমি হাত পুড়লে কি করে হুম..??তাসু বলে__ চায়ের কাপে গরম পানি ঢালতে গিয়ে হাতে পরে গেছে। নীল বলে__ তুমি একটু সাবধানে কাজ করবে না..??সাবধানে কাজ করলে হয়তো এখন তোমার হাত টা পুড়তো না।নীল তাসুর হাত ধরে মাথা টা নিচু করে ফুক দিতে থাকে।
__তাসু বলে__ আপনি এতো পেরেশান হচ্ছেন কেন…?? এটা তো শুধু সামান্য হাত টা পুড়েছে। এর চেয়েও বেশি প্রতিনিয়ত আমার কলিজা টা পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাচ্ছে। নীল কথা টা শুনে তাসুর দিকে তাকায়। তাসুও এক ম্লানমুখে নীলের দিকে তাকিয়ে আছে। নীল তাসু কে টেবিলে বসিয়ে রেখে দ্রুত চলে যায় নিজের রুমে। ড্রয়ার থেকে বের করে বার্না ক্রীম এনে তাসুর হাতে লাগিয়ে দেয়।
__ক্রীম লাগিয়ে দেওয়ার পর নীল বলে__ এখনো কি হাত জ্বলছে..?? তাসু বলে__ হুম কিছু টা। নীল বলে__ কিছুক্ষণ পর ঠিক হয়ে যাবে।
__এরপর নীল কিছু টা নাস্তা করে অফিসে চলে যায়। অফিসে গিয়ে নীল নিজের মতো কাজ করতে থাকে।আজকে অফিসে বিকাল চারটায় মিটিং আছে। অফিসের বস নীল কে ডেকে নেয়। নীলের বস বলে__ নীল আপনাকে যেই কাজ টা দিয়েছিলাম সেগুলো কমপ্লিট করেছেন।নীল বলে__ জ্বি বস এখন শুধু আরেক বার দেখে নিলেই হয়ে যাবে। নীলের বস বলে__ আচ্ছা ঠিক আছে ভালো করে দেখে নেন।বিকালে ক্লায়েন্ট আসবে কোথাও যেন কোন ত্রুটি না থাকে। নীল বলে__জ্বি বস।
বিকালে মিটিং শেষ করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। আর সেই দিকে ক্লায়েন্ট নীলের কাজ দেখে পছন্দ হয়ে যায় এবং সাথে সাথে অফিসের পক্ষ থেকে তার প্রমোশন বেড়ে যায়।
__মিটিং শেষ করে বাসার উদ্দেশ্য রওয়ানা হতে অন্য দিনের তুলনায় আজকে অনেকটাই লেট হয়ে যায়। এদিকে নীলের দেরি হচ্ছে দেখে তাসু খুব অস্থির হয়ে যাচ্ছে। তাসু ভাবতে পারছে না কেন এতো লেট করছে। তাসুর চিন্তা আর অস্থির বেড়েই যাচ্ছে। নীল আসছে কি না সেটা দেখার জন্য তাসু বারবার বেলকনিতে যাচ্ছে। তাসু বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে মানুষ টা এখনো আসছে না কেন..??