Saturday, July 12, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1391



বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-০৩

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_০৩

–বাবাআআ,কমলা আন্টিইই!!!

এক গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে বাবার রুমে দৌড়ে চলে আসলাম।আমার চিৎকারে সোফায় বসে আরাম করে যে লোকটা পায়ের উপর পা তুলে স্মোক করছিল তার এক হাতে থাকা মোবাইল ফোন টা ফ্লোরে পড়ে গিয়েছে। আমার ডাকে বাবাও শোয়া থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আমার কাছে আসলেন।৷ হন্তদন্ত হয়ে এসে বললেন,,,

–কি হয়েছে জুইঁ?ভয় পেয়েছিস?

আমি বললাম,,,

–বাবা ওই লোকটা!ওই লোকটা!

–কে?(বাবা)

–তুমি ড্রইং রুমে চলো।তাড়াতাড়ি চলো।(আমি)

বাবাকে নিয়ে ড্রইংরুমে এসে দেখি টিভি ছেড়ে টি টেবিলের উপর দুই পা তুলে আরাম করে লোকটা টিভি দেখছে।বাবা উচু কন্ঠে বলে উঠলো,,,

–জায়েফ এটা একটা ভদ্রলোক এর বাড়ি। এগুলো কেমন বাচনভঙ্গি তোমার?আর এ বাড়িতে কি তোমার?

জায়েফ তখন সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পরলো তার গায়ের জ্যাকেট টা ঠিক করতে করতে বলল,,,

–শশুর বাড়িতে যা থাকে আমারও এ বাড়িতে তা।

বাবা উত্তেজিত হয়ে বললো,,,

— কিসের শশুর বাড়ি?

জায়েফ নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে ই উত্তর দিলো,,,

–আরে শশুরবাবা কয়দিন পরে নানা হবেন আর আজকে বলছেন শশুর বাড়ি কি জানেন না।

বাবা যে এবার রেগে গেছেন প্রচুর তা আমি ভালোই বুঝতে পারলাম। কিন্তু তাও চুপ করে বাবার পিছনে দাঁড়িয়ে রইলাম।বাবা বজ্রকন্ঠে বলে উঠলেন,,,

–ভদ্র ভাবে কথা বলো।আর এখানে কি চাই?

জায়েফ বাবাকে ক্রস করে কিছুটা দূরত্ব রেখে আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরলো। আমার বুকের ভিতর মনে হচ্ছে একটা ধকধক শব্দ বার বার ধাক্কা খাচ্ছে।দ্রুত গতিতে আমরা যখন কোনো কিছুর জন্য দৌড়ে হাঁপিয়ে পরি তখন আমাদের হার্ট যেমন দ্রুত বিট করতে থাকে এখন আমারও ঠিক তেমন ভাবে বিট করছে।জায়েফ আমার সামনা সামনি দাঁড়িয়ে বলল,,,

–আপাতত একটু দুধ হলেই চলবে।

আমি মাথানত করা অবস্থা থেকে মাথা তুলে অনেকটা বিস্ময়মূলক চাহনি নিয়ে তার দিকে তাকালাম।আমার চাহনি বুঝতে পেরে উনি আবার বললেন,,,

–মিল্ক!মিল্ক!আসলে আমার বাসায় দুধ শেষ হয়ে গেছে তো।তাই কফি খাওয়ার জন্য একটু দুধ নিতে আসলাম।

–ঢাকা থেকে গাজীপুর এসেছেন দুধ নিতে?

জায়েফ আমার দিকে চোখ মেরে বললেন,,,

–জুইঁবাবু এই রহস্য তো একটু পরেই বুঝবে।

তখন কমলা আন্টি দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো।এতক্ষণে উপলব্ধি করলাম কমলা আন্টি বাসায় ছিলনা। আসলে তার আজকে নাইট ডিউটি করতে হবে বলে সকাল সকাল আমাদের বাসায় এসে পরেছেন।তাকে দরজা খুলে দিয়ে আমি আমার রুমে এসে একটু শুয়েছিলাম।কমলা আন্টিকে দেখে বাবা বলল,,,

–কোথায় ছিলে তুমি?

বাবার কথায় আমি আর জায়েফ দুজনেই আন্টির দিকে তাকালাম। আন্টি মুখের ভিতর একটা পান চাবাতে চাবাতে বলল,,

–ভাইজান ময়লাওয়ালা নাকি আজকে আসবো না। ৩দিন এর ছুটি তে গেছে।তাই আমিই নিচে গিয়া ময়লা ফালাইয়া আইছি।খালি খালি জুইঁমনি নিচে যাইবো কেন?

বাবা একটু ধমকের স্বরে বললেন,,,

–দরজা কি বাইরে থেকে লক করে যাওয়া যেতো না?জুইঁ বা আমাকে ডাকলেই তো হতো।

–আমি তো ভাবছি দুই মিনিট এর কাম। তাই দরজাডা হালকা চাপাইয়া থুইয়া গেছিলাম। আরে জুইঁমনি এই ব্যাডা ডা কেডা?(আন্টি)

আমি জায়েফ এর দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বললাম,,,

–একজন আগন্তুক।

আন্টি কিছুটা অবাক হওয়ার মতো করে বলল,,,

–আরে এই ব্যাডারে তো আমি নিচে যাওয়ার সময় দেখছিলাম।

জায়েফ গিয়ে আন্টির সামনে দাঁড়িয়ে বলল,,,

–কমলা সুন্দরী!রাইট?

আন্টি কিছুটা লাজুক হেসে বলল,,,

–আরে এহন আর সুন্দরী আছি কই।

এই কথাটা অবশ্য উনি ভুল বলেন নি।কমলা আন্টি আসলেই কমলা সুন্দরী। লাল ফর্সা গায়ের রঙে জোড়া ভ্রুযুগল তার রূপকে অনেকটা বাড়িয়ে তোলে।পান খাওয়ায় তার ঠোঁটে তার নামের মতোই একটা কমলা আর খয়েরী রঙের মিশ্রণে তাকে অন্যরকম লাগে।দেখলে তো মনে হয়না বয়স তার পঞ্চাশউর্ধ্ব।

এরমধ্যেই ঝাঝালো কন্ঠে বাবা বলে উঠলেন,,,

–শুরু হয়ে গেল তোমার। যাকে পাও তার সাথেই গল্প শুরু করে দাও।তুমি কি চেনো এই ছেলেকে?তোমাকেই বা কি বলছি।তোমার তো চেনা অচেনা লাগে না।মানুষ হলেই তোমার শুরু হয়ে যায়।আল্লাহ জানে কবে জেনো পশু পাখির সাথেও গল্প শুরু করে দিবে।

–ইশশশ!!শশুরবাবা কার রাগ কার উপর দেখাচ্ছেন? আমি জানি তো আপনি আমার উপর ক্ষেপে আছেন। তাই বলে কমলা সুন্দরীর সাথে রাগটা দেখাবেন?দিস ইজ নট ফেয়ার।(জায়েফ)

–কমলা আন্টি উনি দুধ নিতে এসেছেন,ওনাকে দুধ দিয়ে বিদায় করো তাড়াতাড়ি।(আমি)

–আরে পরিচয় হওন লাগবো না?(আন্টি)

এবার আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না।জোড়ে বলে উঠলাম,,,

–আন্টি!!!!!!!!তাকে বিদায় করো।

দেখলাম জায়েফ আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। হয়তো আমার এমন আচরণ দেখে ব্যাপারটা তার হজম হচ্ছে না।তার সাথে থাকাকালীন আমি কখনো তার সাথে জোড়ে শব্দ করে কথাই বলিনি।তখনকার আমি আর আজকের আমির মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত রয়েছে। তাকে তখন যেমন ভয় পেতাম আজও ভয় পাই।তবে সেই সময় আমার মধ্যে তার জন্য ভয় ছাড়া আর কিছু ছিল না। কিন্তু আজ আমার মধ্যে তার জন্য ক্রোধ,ঘৃণা, ক্ষোভ আর অভিমান ছাড়া কিছু নেই।

কমলা আন্টি তাকে ফ্রীজ থেকে এক প্যাকেট দুধ বের করে দিলেন।জায়েফ যাওয়ার সময় আমার দিকে তাকিয়ে চোখ মেরে বললেন,,,

–আই এম ইমপ্রেসড।

সে চলে যেতেই কমলা আন্টি এসে আমার কাছে জানতে চাইলো কি হয়েছে। আমি আন্টিকে সব খুলে বললাম। আমার যখন বিয়ে হয়েছিল তখন আন্টি তার গ্রামের বাড়ি গিয়েছিল। তার চাচাত ভাই ইন্তেকাল করেছিলেন। জায়েফ কে না চেনাটাই স্বাভাবিক। কমলা আন্টিকেও জায়েফ সম্পর্কিত তথ্য খুব একটা বেশি বলিনি।তাকেও একই কথা বলে কাটিয়ে দিয়েছি।আর তা হলো – আমি জায়েফ এর সাথে বেমানান। এখন নিজের কাছেও মনে হয় আসলেই তো আমি বেমানান। কোথায় একজন রকস্টার আর কোথায় আমি!!!

কমলা আন্টি দুপুরের খাবার টা আমাদের এখান থেকেই খেয়ে চলে গেলো তার ডিউটি তে।বিকেল বেলা আসর এর আযান দেবার আগে আগে একটু ঘুমিয়ে থাকি।তবে প্রতিদিন না,মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে থাকি। ঘুম না আসলে আমার বারান্দায় বসে বসে গল্পের বই পড়ি, কোনো দিন কফি খাই, কোনোদিন বসে বসে সামনের বিলের পানে নিশ্চিুপ হয়ে চেয়ে থাকি।আবার অনেক সময় এখানে বসে নাটক বা মুভি দেখি।বারান্দায় বসে হাতে চা পা কফি নিয়ে নাটক – সিনেমা দেখার মজাই আলাদা।

এতো কিছুর মাঝেও নিজেকে বড্ড একা মনে হয়।এখন বাবা থেকেও তার সাথে আগের মতো গল্প করা হয় না।সাদুও বড় হয়েছে ওকে ওর মা আগের মতো হুটহাট বাড়ির বাইরে বের হতে দেয় না।ভাইয়াও হয়তো বা ব্যস্ত থাকে।আগের মতো কথা হয়না।সব মিলিয়ে জীবনটা কেমন জেনো ছন্ন ছাড়া মনে হচ্ছে। একা একা যখন থাকি তখনই কষ্টেরা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। অন্যের সামনে কখনোই আমি নিজের কষ্ট দেখাতে পারি না।সবসময় হাসি-খুশি থাকি।

বারান্দায় দাঁড়িয়ে এতো কিছু ভাবতে ভাবতে যখন আমি প্রায় ভাবুক হয়ে যাচ্ছিলাম তখনই আমার প্রাণভোমড়া তথা মোবাইলটা বেজে উঠলো।স্ক্রীনে “রাণু মন্ডলের ২য় ভার্ষণ” লেখাটা একেবারে চকচক করছে।ফোনটা কানে তুলতেই ওপাশ থেকে সাদু বলতে লাগলো,,,

–দোস্ত ওই পাদমান আমারে প্রপোজ করছে আজকে একটু আগে।

–কতোবার বলবো তোরে মানুষের নাম নিয়া ভেঙ্গাইস না।(আমি)

–আমারে ওই জোকার প্রপোজ করছে আর তুই পইরা আছোস নাম নিয়া?(সাদু)

–শোন তোরে প্রপোজ কইরা যে সাদমান ভাইর কপাল পুরাটাই পুড়ছে তা কি সাদমান ভাই জানে?(আমি)

–ও না জানলেও আমি জানি!(সাদু)

হাহাহাহাহাহাহহা!!!!দুজনেই ফোনের দুপাশে একেবারে হেসে কুটি কুটি হচ্ছি।

আসলে সাদু কিছুটা গুন্ডি টাইপ।একবার ক্লাসের বাইরে মাঠে বসে একটা ছেলে সাদুকে পটানোর চেষ্টায় ছিলো।তখন ছেলেদের ক্লাস ছিলো ১২:৩০ মিনিটে আর আমাদের ছুটির সময় ছিলো ১২ টায়। আমাদের শেষ ক্লাস চলছিলো তখন।আমরা দোতলায় ক্লাস করছিলাম।জানালার পাশে ছিলো সাদু।জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেই করিডোরের পরে মাঠ দেখা যায়।সেখানেই একছেলে ওকে ইশারায় প্রেম বিনোদনের চেষ্টায় ছিলো।সাদু হঠাৎ ক্লাস চলাকালীন সময়ে দাঁড়িয়ে যায়।আর স্যারকে বলে মাঠে দাঁড়িয়ে একজন ওকে ডিস্টার্ব করছে।একটু পরে ছুটির ঘন্টা দিলে স্যারকে নিয়ে সেই ছেলের কাছে গিয়ে একে বারে ধুয়ে রঙ উঠিয়ে এসেছিল।আরেক বার ক্লাস নাইনে কোচিং এর এক বড়ো ভাই ওকে প্রপোজ করেছিল।সাদু আগে থেকেই বুঝতে পেরে কোচিং এর নিচে যেখানে সিসি ক্যামেরা ছিলো সেখানে দাঁড়িয়ে পরে ছেলেটাও বলদের মতো ওকে ওখানে প্রপোজ করে বসে।আর তারপরের দিন কোচিং এ এসে ওই ছেলেরও কেল্লাফতে হয়ে যায়।এবার সাদমান ভাইর কি হয় আল্লাহ ই জানে।

আমাদের হাসাহাসির এক পর্যায়ে হঠাৎ আমার চোখ যায় পাশের বিল্ডিংয়ের বারান্দায়।জায়েফ একটা হালকা বাদামী রঙ এর থ্রি-কোয়াটার প্যান্ট আর মেরুন রঙ এর টিশার্ট পড়ে পাশের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার হাতে একটা ফোন, যা দেখে মনে হচ্ছে ফোনটার ক্যামেরা আমার দিকে তাক করা। কিছুটা ভিডিও করার ভঙ্গিতে সে দাঁড়িয়ে আছে।তাকে এভাবে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। ফোনটা কেটে তার আরেকটু কাছে গিয়েই বুঝতে পারলাম এটা আসলেই জায়েফ স্ব শরীরে দাঁড়িয়ে আছে।
হঠাৎ করেই বুকের ভিতর মনে হচ্চে আমার শ্বাস – প্রশ্বাসেরা ধাক্কাধাক্কি শুরু করে দিয়েছে। মনে হচ্ছে আমি কোনো দৌড় প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহন করে এসেছি। তাকে উদ্দেশ্য করে কিছু বলার আগেই উনি বললেন,,,

–আরে জুইঁবাবু এটা আমিই।তোমার ওয়ান পিছ হাসবেন্ড।

–আমি ঢাকায় আসলাম কখন?(আমি)

–What?(জায়েফ)

–না মানে আপনি ঢাকায় আসলেন কবে?(আমি)

আমি যখন অতিরিক্ত মাত্রায় ঘাবড়ে যাই বা ভয় পাই তখনই আমি উল্টো পাল্টা কথা বলি।আসলে মাথায় এক কথা থাকলে মুখে বলে ফেলি আরেক কথা।উপন্যাস বা গল্পের চরিত্রের মতো ভয় পাই ঠিকই কিন্তু তাই বলে যে ভয় পেয়ে বোবা হয়ে যাবে তেমন টাও নই আমি।দেখতে হবে না কার সাথে থাকি। সাদুর স্বভাব একটু হলেও বাতাসে বাতসে উড়ে এসে আমার গায়েও লেগে গেছে। তখনি জায়েফ ওপাশ থেকে বলল,,,

— জুইঁবাবু আমরা এখন গাজীপুরে।

–হ্যাঁ।মানে তাই ই।আপনি এখানে কি করেন।(আমি)

–তুমি যেখানে আমি সেখানে সে কি জানো না।(জায়েফ)
কিছুটা সুর তুলেই বললেন।

চলবে…….

বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-০২

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_০২

–তুই সত্যিই আমার বোনের বিয়েতে যাচ্ছিস তো?

সাদু কিছুটা সন্দেহ করার মতো ভাব নিয়ে বলল।

–মানে?(আমি)

–তুই যেভাবে নিজেরে প্যাকেট করলি মানে বোরকা, হাত মুজা, পা মুজা পরলি মনে তো হচ্ছে আজকেই হজে চলে যাবি।(সাদু)

–ওই খারাপ লোকটা আবারো আসলে?(আমি)

–আরে ধুর ওই ব্যাডার তো খাইয়া দাইয়া কাম নাই।এতো দিন তোমারে ধরে নাই আর কালকে আইসা একেবারে জড়াইয়া ধরলো তাও আবার কই?ওয়াশরুমে!!!(সাদু)

সাদু আমাকে আবারও বলল,,,

–হয়তো তোর মনের ভুল। আচ্ছা একটা কথা বলবি?

— কী?(আমি)

— k-drama কি বেশি দেখছ ইদানিং? (সাদু)

–না বোইন। তোর মতো আমারে রাণু মন্ডলের ফাগলে গুতা মারে নাই।(আমি)

–ওহহ।তাহলে নিশ্চয়ই C-drama দেখছ।তাই না?(সাদু)

–ধুর কি শুরু করলি? ওই সব খচ্চর মার্কা ড্রামা তুই ই দেখ বইসা বইসা।(আমি)

–বাট তুই আর যা বলবি তাই বিশ্বাস করবো কিন্তু তোর এক্স জামাই আইসা যে তোরে জরাইয়া ধরছে এই কথা বিশ্বাস করতে পারবো না।আর এই টপিক এখানেই শেষ।(সাদু)

হ্যাঁ।গত কালকে আমি ওনাকে দেখেছিলাম।ওটা জায়েফ ই ছিলো।ওখানে নাকি আমি সেন্স হাড়িয়ে ফেলেছিলাম। ওয়াশরুম এর দরজার কাছে নাকি পড়েছিলাম।আমাকে আমার বাসায় সাদু নিয়ে আসে।আর আজ একপ্রকার ভয় পেয়েই বোরকা পরে বিয়েতে যাচ্ছি।সে কেনো এসেছিলো আমি জানিনা।আর না জানত চাই। শুধু তার থেকে দূরে থাকতে চাই।

যেকোনো অনুষ্ঠান নিয়ে আমি আবার এক্সাইটেড একটু বেশি ই থাকি।কোনো দাওয়াত ই আমি মিস করতাম না আগে।আমি আর সাদু আগে ঘুরতেও যেতাম এক এক জায়গায়। সাথে রাফিদা আপু থাকতো।মাঝে মাঝে সার্থক ভাইয়াও থাকতো।

আমার ডিভোর্স এর পরে এই প্রথম বার আমি আর সাদু একসাথে কোনো অনুষ্ঠানে যাচ্ছি। বাইরে ও আগের মতো যেতাম না।সাদু প্রায়ই বলতো চল ঘুড়ে আসি এই করি ওই করি কিন্তু আমার ওই সময় বাসায় থাকতেই ভালো লাগতো বেশি।বাসায় কাজ বেশি থাকতো না।আমি আর বাবা।কাজ শেষ করে সময় পেলে বারান্দায় বসে থাকতাম।বাবার সাথেও প্রয়োজন ছাড়া কথা বলতাম না।এখনো কথা কম বলি তার সাথে। কেমন যেনো একটা অভিমান কাজ করে।মাঝে মাঝে সাদু বাসায় এসে আমার সাথে গল্প করে যেতো।

হঠাৎ চলন্ত অবস্থা থেকে সব কিছু স্থির হয়ে যাওয়াতে আমার ভাবনার সুতোঁ কাটলো।আমরা বিয়ের সেন্টারে এসে পরেছি।কাল যেটা ছিল আজো সেটাই। শুধু ডেকোরেশনটা আলাদা। ভালোই বুঝতে পারছি যে কালো বোরকা পড়ে আসাতে সবাই এমন ভাবে আমার দিকে দৃষ্টিপাত করছে মনে হচ্ছে আমি চাঁদের দেশ থেকে নেমে এসেছি।

এখানে সাদুর কাজিন সার্কেল এর সাথে ভালোই মিশে গিয়েছি।ওর একটা মামাতো ভাই আছে সাদমান ভাই।সে ঢাকার একটা ভার্সিটিতে অনার্স প্রথম বর্ষে অধ্যায়নরত অবস্থায় আছে।লোকটা অনেক হাসাতে পারে।সাদু কে সে পছন্দ করে।তবে তা অপ্রকাশিত এখনো।অনেক খেয়াল রাখে সাদুর।আগে কেবল সাদুর মুখে শুনেছিলাম।কাল নিজ চোখে দেখা হয়ে গেছে।সাদুর কাজিনগুলোর মধ্যে ছেলেমেয়ে সবাই আমরা সমবয়সি, ২-৩বছর এর ছোট বড় হবো।

খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষে রাফিদা আপুকে এখন বিদায় দেয়ার পালা।সবাই কান্না করছে।সাদু তো আপুকে জড়িয়ে ধরে সেইযে কান্না শুরু করেছে থামার নামই নেই।আমারও কিছুটা খারাপ লাগছে।গেট এর কাছে একপ্রকার নিউমার্কেটের ভিড় জমে গেছে।হঠাৎ আমার কানের কাছে এক পরিচিত কন্ঠে কেউ বলে উঠলো,,,

–বাহ জুইঁফুল!কালকের গাল ধরে টেনে ধরা তাহলে কাজে দিয়েছে।কিন্তু তুমি ভাবলে কি করে এমন ভাবে নিজেকে কয় গজ কাপড়ে আবদ্ধ করলেই আমি তোমাকে চিনতে পারবো না।

তড়িৎ গতিতে আমি পিছনে তাকালাম।কালো পাঞ্জাবি পরে মুখে সাদা মাস্ক আর চোখে কালো সানগ্লাস পড়ে জায়েফ দাঁড়িয়ে আছে।
আমি কিছুটা ভীতু রূপে বলে উঠলাম,,,

–আপনি?

সাথে সাথে তাকে ভিড়ের মাঝে হাড়িয়ে ফেললাম। তাকে দেখে আমি নিজেই আশ্চর্য হলাম।তার মাথার চুল অনেক বড় বড় হয়েগেছে।এতটা বড় যাতে একটা পনিটেল করা যাবে।মুখে তার চাপ দাঁড়ির ঘনত্ব বেড়েছে।

তাড়াতাড়ি করে আর কিছু না ভেবে বাসায় এসে পড়লাম।মনের মধ্যে শান্তি পাচ্ছি না। বাসায় আসতে আসতে এরমধ্যে সাদু কল করেছে ৭বার।ওর কল ধরি নি ইচ্ছে করে।কেনো যেনো খুব ভয় করছে।এক অজানা আতঙ্ক আমায় চেপে ধরেছে।তাকে দেখার পর একটা চাপা কষ্ট মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে।ওয়াশরুমে গিয়ে ঝর্নাটা ছেড়ে দিয়ে বসে বসে ইচ্ছে মতো কান্না করলাম। আজ আমার কান্নার কারণ কী নিজেও জানি না।বিছানায় এসে ফুল স্প্রীডে ফ্যানটা ছেড়ে শুয়ে পড়লাম রাত এখন ১১ টা।যখন চোখে আধো আধো ঘুম এসে পড়েছে আমার মাথায় কেউ হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তা টের পেয়েছি।ফ্যান এর স্প্রীডও কমানো বুঝতে পেরেছি। এটা আমার বাবা।আমি জানি সে প্রতিদিন এসে এভাবে আমাকে দেখে যায়।

সকালে ফজর এর নামাজ পরতে পারিনি। ঘুমিয়েছিলাম বলে টের পাই নি।কাল এলার্ম টাও দিতে ভুলে গিয়েছিলাম।সকালে সব সময়ই এলার্মের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে।সেটা নামাজ এর জন্যই হোক বা অন্য কোনো কারণে। উপন্যাসের চরিত্রে মতো আমার কোনো কালেই পাখির কিচিরমিচির কিংবা আযানের শব্দে ঘুম ভাঙ্গে না।

বাবার রুমে চা দিয়ে এসে নিজে এক কাপ চা খেলাম।সকালে শহরে আমার জানা মতে হয়তো খুব কম লোকজন আছে যারা ভাড়ি খাবারে অভ্যস্ত।আমি সকালে চা বিস্কুটে অভ্যস্ত।আমার বাবাও তাই।

একটু পরে কমলা চাচি আসলো।সে আসলে আমি ছোট থাকতেই আমাদের বাসার কাজ করে দেয়।বয়স তার ৫০ – ৫৫ হবে তবে এখনো হাজার কাজ সে এক সাথে করতে পারে।অনেক টা রসিক টাইপের সে।কিন্তু আমাকে সবসময় ভালো উপদেশ দেয়।কীভাবে যেন আমার প্রয়োজন অপ্রয়োজন টাও বুঝেন তিনি।তাকে আমি অনেক শ্রদ্ধা করি।ছেলেমেয়ে নেই তার।বলতে গেলে মেয়ের মতো দেখেন আমাকে।আমিও তাকে মায়ের মতোই ভাবি।আমার প্রথম পিরিয়ড এর সময় আমার এই মা টা আমার পাশে ছিলেন। আমাকে সব কিছু বুঝিয়ে দিয়েছিলেন।আমার এই কমলা মা নাকি টেন পর্যন্ত পড়া লেখা করেছে।সে বর্তমানে একটা বাচ্চাদের ডে-কেয়ারে হাফবেলা চাকরি করেন।আর কিছুটা সময় আমাদের বাসার আর তার বাসার কাজ করেন।তাকে বলে ছিলাম তোমাকে কাজ করা লাগবে না।আমাকে এসে কেবল দেখে যেও।কিন্তু কে শোনে কার কথা।সে এসে হাতের কাছে যেই কাজ পায় তাই করে দিয়ে যায়।

দুপুরে শাওয়ার নিতে ঢুকেছি এমন সময় মনে হচ্ছিলো কেউ ওয়াশরুমের দরজায় টোকা দিচ্ছে। পানির আওয়াজে শুনতে পাচ্ছি না ঠিক কি বলছে।সব কল বন্ধ করে বুঝতে পারলাম সাদু এসেছে।ওকে বললাম,,,

— কি এই ঠাডা পরা গরমে তোর আবার কি চাই?

ও বললো,,,

— শাওয়ারে বসেও যদি তোর গরম লাগে তাইলে আমার কি হবে?বের হ এখন।

আমি বললাম,,,

–আমি কি এমনেই বের হইতে পারবো নাকি।যা বসে বসে মদ খা আর মানুষ হ।আমি একটু গোসল করি।যা তো!

–তুই বের হবি নাকি আমি এখানেই হিসু করে দিবো।(সাদু)

–ওই তোর বাসায় বাথরুম নাই? তুই চোইদ্দো মাইল হাইট্টা আইছোস আমার বাসায় মুততে।(আমি)

–রাস্তায় আসার সময় হাফ লিটার এর সেভেন আপ খাইছিলাম।(সাদু)

— নিজের টাকায় তো মনে হয় না খাইছোস।(আমি)

সাদু চিৎকার করে বলল।

–তুই বাইর হবি?

আমি বললাম,,,

–বেশি ধরছে বাবু?

–হ।বাইর হ তুই।(সাদু)

–আমার বাপের টায় যা।(আমি)

–না। আঙ্কেল এর টায় যাইতে কেমন জানি লাগতেছে।(সাদু)

–তাইলে আর কি করবি বইসা থাক(আমি)

–জুইঁইইই!!!(সাদু)

–চিল্লাস কে?এক কাজ কর আমার খাটের নীচে আমার নেংটু কালের হিসুর পট আসে।তোর মনে নাই?ওই যে নীল রঙের।যা ওই টায় যাইয়া বইসা পর।(আমি)

–একবার খালি বের হ তুই।তোরে আমি দেখাইয়া ছাড়বো।(সাদু)

–থাক তোর টা দেখবো না।আমি দেখলে তোর জামাই কি দেখবো?৫ মিনিট দাড়া তুই। আমি ১০ মিনিটে বের হইতাছি।(আমি)

আমি বের হতেই তড়িৎ গতিতে সাদু ওয়াশরুমের দিকে ছুটে গেলো।আমি বারান্দায় জামাকাপড় গুলো রোদে দিয়ে এসে রুমে সাদুকে বসে থাকতে দেখে বললাম,,,

–এমন জোড়ে দৌড় দিলি ডায়াবেটিস এর রোগীরাও তো এমনে দৌড় দেয় না।

–চুপ থাক।তোর সাথে কথা নাই।কালকে তুই হুট কইরা আইসা পরলি কেন?কতবার কল দিলাম। মোবাইল কি চান্দের দেশে থুইয়া দেছ?(সাদু)

ওর কথা শুনে কালকের কথা মনে পরতেই চুপচাপ বারান্দায় চলে আসলাম।আমার বারান্দার সাথে পাশের বাসার বারান্দার দূরত্ব এক হাতেরও কম।বারান্দার সামনের দিকে দৃষ্টি রাখলে একটা ছোট বিলের মতো চোখে পড়ে।এটা আসলে পিছনের সাইড।তাই কোনো রাস্তা ঘাট নেই এদিকে।বিলটার পাশ ঘেঁষেই এই ৬ তলা বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে।আমরা এই ভাড়া বাড়িটির ৩ তলাতে থাকি।

আমার পাশে সাদু এসে দাঁড়ালো। আমাকে জিজ্ঞেস করলো,,,

–কি হয়েছে রে?

আমার মন খারাপের সময় এই মেয়েটার মুখে শুদ্ধ ভাষার বুলি ফোটে।আমি বললাম,,,

–বললে তো বিশ্বাস করবি না। লাভ কি বলে?

–অতীতের কথা মনে করে মন খারাপ করছিস?(সাদু)

–অতীত যদি বার বার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরে, মন খারাপ কি হবে না?(আমি)

–তুই কি আবারও কিছু দেখেছিস?(সাদু)

ওকে সব খুলে বললাম। সব শুনে ও বলল,,,

–এখন নবাবজাদা তোকে চিনতে আসছে কে?২বছর আগে কি করছিলো?

–তাকেই যেয়ে জিজ্ঞেস কর।(আমি)

সাদু আমাকে ওর বোনের রিসিপশনের জন্যে নিতে এসেছিল। আমার মনের এমন অবস্থা দেখে আর জোড়াজুড়ি করে নি।

এইভাবেই একসপ্তাহ চলে গেলো।কয়দিন পর আমার এইচএসসি এর রেজাল্ট দিবে।একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ড্রইং রুমে এসে ধপ করে সোফায় বসে পড়লাম ঘুম তখনো কাটেনি।আমার এই একটা বাজে অভ্যাস।ঘুম থেকে উঠে কোনো দিনই সাথে সাথে ফ্রেশ হতে যাই না।এই রুম ওই রুম হাটা হাটি করে ঘুম টা কাটলে তার পর ফ্রেশ হতে যাই।সোফায় বসে থেকেই পাশে তাকিয়ে মনে হলো পৃথিবীর সবচেয়ে আশ্চর্যতম বস্তু আমার সামনে।

চলবে……..

বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-০১

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_০১

১৬ বছর বয়সে একটি পেপারে যেই সাইন করেছিলাম, ১৮ বছর বয়সেও সেই একই সাইন করেছিলাম। তফাৎ ছিলো শুধু পেপারে। ১৬ বছর বয়সে সাইন করে মিসেস হয়েছিলাম আর ১৮ বছর বয়সে হয়েছিলাম ডিভোর্সি। হ্যাঁ আমি একজন ডিভোর্সি নারী। আজ ৬ মাস হয়ে গেলো স্বামী নামক মানুষটির থেকে আমি দূরে।

যেই বয়সে আমার মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়ে ঘুরে বেড়ানোর কথা ছিলো সেই বয়সে আমি কাজী অফিস নামক স্থানের থেকে তিন অক্ষর এর মিসেস শব্দ আমার নামের পাশে বসিয়ে বাবা এর বাড়ি থেকে বিদায় নিয়েছিলাম।

শুধু মাত্র আমার আম্মুর ইচ্ছে পূরণ এর জন্যে তার প্রাণ প্রিয় বান্ধবীর ছেলের সাথে আমাকে বিয়ে দেয়া হয়েছিল।

মা আমার ১০ বছরের সময় ব্রেন স্টোকে ইন্তেকাল করেছিলেন।আমার একটা বড় ভাইও আছে।সে বিগত ৩ বছর ধরে ফ্রান্সের প্রবাসী।ভালো বেতনে চাকরি করছে সেখানে।আমার বাবা খুব ভালোবাসে আমাকে।মায়ের চলে যাওয়াতে সে খুব একা হয়ে যায়।কেবল আমার জন্য বাবা কোনো নতুন বন্ধনে এখনো আবদ্ধ হন নি।বাবা ছিলেন স্কুল টিচার। এখন অবশ্য রিটায়ার্ড হয়ে গেছেন। ভালোই চলতো আমাদের বাপ মেয়ের ছোট্ট সংসার।বাসায় একজন আন্টি আসতেন। এসে কাপড়চোপড় ধুয়ে দিতেন আর ধোয়ামোছা করে যেতেন।আমিই রান্না করতাম।রান্নার প্রচুর শখ ছিলো।আর রান্নাও ভালো হতো বলে বাবা কিছু বলতেন না।প্রথম প্রথম গা হাতে তেলের থেকে ফোসকা পরতো বা ছেঁকা খেতাম তবে আস্তে আস্তে মানিয়ে নিয়েছি।মা তো ছোট বেলা থকেই ছিলো না।তাই অনেক কিছুই নিজে নিজে করতে গিয়ে শেখা হয়ে গেছে।বাবা কখনো আদর স্নেহ কম দিতেন না।কিন্তু তাও মনে তো একটা চাপা কষ্ট থেকেই যেতো।সেই সাথে মন ভালোর ঔষধ ছিলো ভাইয়া আর আমার নেংটু কালের বান্ধবী সাদিয়া।

বর্তমানের অতি পরিচিত মুখ ৩০ বছরের এক বিখ্যাত ও জনপ্রিয় কন্ঠ শিল্পী হলো জায়েফ এহমাদ।কন্ঠের জন্য যেমন সে পরিচিত। তেমনি চরিত্রের জন্য কন্ঠের চেয়ে আরো বেশি পরিচিত। যদি কোনোদিন সেরা ফ্লার্টবাজের অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠিত হয় তবে কর্তৃপক্ষ তাকে প্রথম স্থান দিতে বাধ্য।যেদিন জানতে পারলাম এমন এক লোকের সাথে বাবা আমার বিয়ে দিচ্ছে সেদিন বাবাকে বলেছিলাম,,,

–বাবা তুমি যদি এই লোক কে বিয়ে করার কথা না বলে আমাকে বিষ খেতে বলতে আমি তাও হাসিমুখে খেয়ে নিতাম।

বাবা বলেছিলো,,,

–জুইঁ তুমি যদি তোমার মাকে ভালোবেসে থাকো তো ওকেই বিয়ে করতে হবে।আর ওর মধ্যে খারাপ কি আছে বলো আমাকে।

— সে এতই খারাপ যা তোমাকে এই মুখ দিয়ে বলতেও আমার বাঁধবে (মনে মনে বললাম)

বাবাকে বললাম,,,

— বাবা আমার মাধ্যমিক এর রেজাল্ট এখনো দেয় নি।বয়স তো কেবল ১৬।আর তার বয়স ৩০বছর।১৪ বছর এর বড়। তুমি না একজন টিচার। বাবা আমার সাথে এমন করো না দয়া করে।

— জুইঁ মা, ওর মা এই পৃথিবী থেকে চলে গেছে ১ বছরও হয়নি।ওর বাবা বর্তমানে অনেক অসুস্থ। ওর মায়ের ইচ্ছে পূরণ করতে চায় ওর বাবা।আর তোর মায়ের ও তো একই ইচ্ছে ছিলো। মা আমার রাজি হয়ে যা ওরা তোকে পড়াবে বলেছে তো।

এভাবে আরো অনেক ইমোশনাল হয়ে বাবা বুঝালেন।আমিও ভাবলাম সেলিব্রিটি দের নিয়ে তো গুজন কতোই ছড়ায়।তার বেলাতে ও এমন হতে পারে।আর তারা পুরো পরিবার আগে থাকতো লন্ডনে। মায়ের মৃত্যুর পরে সে আর তার বাবা দেশে এসেছে। তার বড় দুজন নাকি বোনও আছে স্বামী সন্তান নিয়ে তারা ওই খানেই সেটেল্ড। বিদেশে থাকতেই তিনি গান করতেন। তবে তা বাংলা। বাংলাদেশে এসে আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন।নিজেই নিজেকে বুঝ দিলাম আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করে থাকেন।

বিয়ের দিন খুব বেশি ই অবাক হয়েছিলম।কারণ তার পক্ষ থেকে তার দুই বোন,বাবা আর তার এসিস্ট্যান্ট ছাড়া কেউ ছিলো না।এটা কে তো কোনো মতেই আমার বিয়ে বাড়ি বলে মনে হচ্ছিলো না।আমার বাবা ছিলো একাই।আমার কোনো চাচা বা ফুপু নেই।আছে কেবল একজন খালামনি আর একজন মামা।তারা এসেছিলেন বিয়েতে।কাজিনরা সবাই ছোট ছোট। খালাতো ভাই একটা পড়ে ফাইভে আর মামাতো বোন একটা ওয়ানে।আমার ভাইয়াও সেদিন আমার পাশে ছিলো না।তবে সাদিয়া ছিলো।সাদিয়াকে জড়িয়ে ধরে অনেক কান্না করেছিলাম।সেদিন আম্মুকে অনেক মনে পড়ছিলো।আর শুধু মনে হচ্ছিলো এভাবে কোনো বিয়ে হয়? আমিতো চেয়ে ছিলাম ধুমধাম করে ভালোবাসার মানুষটার হাত ধরবো।বিয়েতে অনেক মানুষ আসবে।বাবা বলেছিলো জায়েফ নাকি বলেছে এভাবে বিয়ে করবে।গায়ে হলুদেও কেবল ওই কয়জনই মানুষ ছিলো।

সব শেষে আমিও চলে আসি স্বামী বাড়ি।গাজীপুর থেকে চলে এসেছিলাম ঢাকায়।তবে এখানে এসে বুঝলাম স্বামী বাড়ি কেবল নামেই।স্বামী টাও আমার ছিলোনা কোনোদিন আর না বাড়িটা।

তার জন্য রান্না করতাম, তার জামাকাপড় ধুয়ে দেয়া থেকে শুরু করে প্রত্যেকটা কাজ করতাম।শুধু তার সাথে রাতে ঘুমাতাম না। সে ইচ্ছে করে আমাকে তার বারান্দায় রাখতো রাতের বেলা।তার বারান্দা টা খুব বড় ছিলো।তার বাবা অসুস্থ বলে তাকে আবার লন্ডনে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো।একজন কাজের মহিলা (আমেনা আন্টি) এসে শুধু বাড়ি ঘড় আর আসবাবপত্র পরিষ্কার করে দিয়ে যেতেন।প্রথমে প্রতিবাদ করেছিলাম।তবে কোনো লাভ হয়নি।

আমাকে বলেছিলো পড়াবে। তবে কোনোদিন কলেজে যেতে দেন নি।বাসায় একজন টিচার রেখেছিলেন।কিন্তু সেটাও পরে আর জোটে নি।কারন স্যারটা সুবিধার ছিলোনা।তাকে দেখে আগেই বুঝেছিলাম লোকটা ভালো হবে না।কিন্তু জায়েফ কে যে বলবো সেই সাহসও ছিলো না।একদিন পড়তে বসে হঠাৎ আজব আজব কাজ করছিলেন।হাত ধরতে চাচ্ছিলেন, বার বার পায়ে স্লাইড করছিলেন।হঠাৎ তার আচরনে ভয়ে কলিজার পানি শুকিয়ে গিয়েছিলো।সেই সময় জায়েফ এসে হাজির হয় রুমে।সচারাচর এই সময় তাকে পাওয়া যায় না।সে যায় বেলা ১২ টায় আসে রাত ১টা বা ২টার দিকে।তাকে দেখে মনে হচ্ছিলো আমার কলিজায় পানি এসেছে।জায়েফ এসে তার কলার ধরে টেনে উঠিয়ে এতো জোড়ে জোড়ে ঘুষি দিচ্ছিলেন যার ফলে লোকটার নাক মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছিল। তাকে বাড়ি থকে বের করে দিয়ে সেদিন আমাকেও মেরেছিলেন। তার বক্তব্য ছিলো আমাকে কীভাবে ওই লোক টাচ করলো।আমি কি করছিলাম বসে বসে।সে আমাকে মেরেছিলো ঠিকি তবে হাত দিয়ে নয় লাঠি দিয়ে।আর দুই আঙুলের মধ্যে কলম দিয়ে চাপ দিয়েছিলেন।সেদিন আঙুলে অনেক ব্যাথা পেয়েছিলাম।

এভাবেই চলছিলো দিন। রাতে প্রতিদিন আসতো মাতাল হয়ে।তবে আমার ধারে কাছেও আসতো না।সেদিক দিয়ে সে খুব সচেতন ছিলো।কথায় কথায় বলতো আমার মতো মেয়ে তার পছন্দ নয়।আমি তার সাথে বেমানান।

দেখতে দেখতে একবছর চলে যায়।আমি শুধু কলেজে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসতাম।সেজন্য কোনো ফ্রেন্ডও আমার ছিলো না।এতো দিন তার সব কিছু মেনে আসলেও বিয়ের একবছর পরে আর পারছিলাম না।কারণ সে দুদিন এক দিন পর পরই কোনো না কোনো মেয়ে নিয়ে এসে হাজির হতো।সারা রাত একসাথে থাকতো।তখন আমি থাকতাম অন্য ঘরে।আর বেলা ১২ টায় দুজন একসঙ্গে চলে যেতো।কেউ আমার পরিচয় যানতে চাইলে এক নিমিষে বলে দিতো তার কাজের মেয়ে।অনেক সময় কেউ ভালো চোখে দেখতো।কেউ আবার অন্য চোখে। ওই সময় টাতে আমি শুধু মোনাজাতে আমার মৃত্যু কামনা করতাম আর চোখের পানি ফেলতাম। সে আমার দিকে কখনো তাকিয়ে দেখত ও না।

তার অত্যাচারও দিন দিন বেড়ে গিয়েছিল। ১৯ থেকে ২০ হলেই মারতো।একদিন রাতে সে আগের মতোই একটি মেয়ে নিয়ে এসেছিলেন।আমি প্রতিবার এর মতো তাকে বাধা দিতে গেলে আমাকে পেটানো শুরু করে। সেদিন সে হয়তো বেশি ড্রাঙ্ক ছিলো।ভুলবশত আমার তলপেটে তার লাথি লাগে।সে আর যাই করতো আমাকে হাত দিয়ে কখনো মারতো না।বেল্ট বা লাঠি দিয়ে মারতো।আমার পিরিয়ড এর তারিখ ছিলো সেদিন। একপর্যায়ে আমি বুঝতে পারছিলাম আমার ব্লিডিং শুরু হয়েছে। তল পেটে প্রচুর ব্যাথা হচ্ছিল। আমি সহ্য করতে না পেরে সেন্স হারাই।সকালে উঠে দেখি আমি বিছানায়। পাশে আমেনা আন্টি বসা।সেও সব কেবল দেখে যেতো বলতে পারতো না কিছু।

এরপর কয়েক মাসের ব্যবধানে আমাকে ডিভোর্স দেয় আর গাজীপুর পাঠিয়ে দেয়।সেদিন কেবল একটা কথাই বলেছিলাম আমাকে কেন বিয়ে করে ছিলো।সে বলে তার গার্লফ্রেন্ড এর সাথে রাগারাগি করে আমাকে বিয়ে করেছিলো।পরে আবার তাদের সব নাকি মিটমাট হয়ে গেছে।

বাবাকে সব কিছু বলিনি।কিছু কিছু বলেছি।আমাকে তার পছন্দ না।আমি তার সাথে বেমানান এগুলো বলে কাটিয়ে দেই।বাবাও আমাকে এখন আর ওই লোকের ছায়াও পরতে দিতে চায়না আমার জীবনে।

–একটা কথা বলবি জুইঁ?
সাদু জিজ্ঞেস করলো আমাকে।ওকে সাদিয়া ডাকিনা আমি। সাদুই বলি।

আমি বললাম,,,

— এতেকথা যখন বললাম তাহলে আরেকটা কেনো বলবো না?

সাদু আবার বলল,,,

–ভালোবাসিস তাকে?

আমি মৃদু হেসে বললাম,,,

–২ বছরে তার বাড়ির কাজের মহিলাকে যদি ভালোবেসে আন্টিমা ডাকতে পারি তাহলে তাকে তো………….

বলেই থেমে গেলাম।আমি আবারও বললাম,,,

— জানিস এতো কিছুর মাঝেও কিন্তু সে একটা ভালো কাজ করেছে আর তা হলো কাউকে না জানিয়ে আমাকে বিয়ে করা।যদি এই সমাজ জানতো আজ আমি ডিভোর্সি তাহলে এই সমাজে আমি টিকে থাকতে পারতাম না।

শুধু এক তপ্ত নিঃশ্বাস বেড়িয়ে আসলো। তখন সাদু বলল,,,

— আচ্ছা চল এবার আপুর হলুদ শুরু হবে এখন।

আমি বললাম,,,

— হমম।চল।

আসলে আজ সাদুর বড় বোন রাফিদা আপুর বিয়ে।তাদের লাভ ম্যারেজ হচ্ছে। সার্থক ভাইয়ার সাথে তার ৪বছর এর সম্পর্ক। ভাইয়ার ফ্যামিলি পলিটিক্স এর সাথে যুক্ত। তার বাবা, চাচা, দাদারা মনে হয় জন্ম গ্রহন করেই পলিটিক্স করে আসছে। তাই হলুদের জন্যে ও সেন্টারে অনুষ্ঠান করছে।সাদুর অনেক জোরাজোরি তে এসেছি এখানে।

আজ অফ হোয়াইট কালার এর সাথে গোল্ডেন কালার এর সুতো আর পাথর এর কাজের একটা শাড়ী পড়েছি।এই শাড়ী টা অনেক পছন্দের আমার।সাথে গোল্ডেন রঙ এর থ্রী কোয়াটার ব্লাউজ পরেছি।এই প্রথম কোনো অনুষ্ঠানে হিজাব ছাড়া এসেছি। মাথায় খোপা করে বেলীফুল দিয়েছি।বেলী ফুল পছন্দের আমার।আমার রুমের বারান্দায় বেলীফুলের গাছও আছে।সাদুর সাথে আমার পরিচয় ছোটবেলার। যার কারণে ওর প্রায় কাজিনকেই আমি চিনি।

মনে মনে ভেবে নিয়েছি এখন থেকে অতীত কে বিদায় দিবো।ভাববো না আর ওই লোকটার কথা।যে অতীত কেবল আর কেবলই মাত্র কষ্ট দেয় তা নিয়ে ভেবে নিজেকে কষ্ট দেয়া বোকামি ছাড়া কিছু না।পাগলেও তো নিজের ভালো নিজে বুঝে। আজ থেকে নিজেই নিজের মন ভালোর ঔষধ হবো।নিজেই যদি নিজের মনকে ভালো রাখতে না পারি তবে অন্য কেউ যে এসে মন ভালো রাখবে তা ভাবি কি করে।

আজ মন খুলে অনেকদিন পরে হাসলাম।রাফিদা আপুকে হলুদ দিলাম।সবার সাথে আড্ডাও দিলাম।বাসায় যাবো বলে একটু ওয়াশরুমে যেয়ে শাড়ী টা ঠিক করতে হবে।মুখেও ওরা হলুদ দিয়ে ভূত বানিয়ে দিয়েছে।তাই সাদুকে খুজে চলেছি কিন্তু কোথাও তো পাচ্ছি না।রাত বেড়ে যাচ্ছে বলে একাই গেলাম ওয়াশরুমের দিকে।দুই একজনকে দেখা যাচ্ছে এদিকে।তবে সবই অপরিচিত মুখ। কিছুটা ভিতরের দিকে গেলেই হঠাৎ এদিকের আলো নিভে গেলো।কিছুটা ভয় পেলেও ওখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম।পার্সের মধ্যে আমার ফোন ছিলো।কিন্তু পার্সটাতো সাথে আনি নি।

হঠাৎ মনে হলো কেউ পিছনের দিক থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরেছে।যখনি জোড়ে চিৎকার দিতে যাবো তখন ওই ব্যাক্তি আমার মুখ চেপে ধরলো।এতোক্ষনে বুঝে গিয়েছি কোনো পুরুষ লোক আমাকে এভাবে ধরে রেখেছে। ভয়ে আমার হিতাহিত বুদ্ধি শক্তি মনে হচ্ছিলো লোপ পেয়েছে। নিজেকে ছুটানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি তবে কোনো লাভ হচ্ছে না।হঠাৎ লোকটা আমাকে একটা ওয়াশরুমের ভিতর নিয়ে গেলো।লোকটা এবার দেয়ালে তার সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরলেন আমাকে।লোকটা বলে উঠলো,,

–জুইঁফুল!!! তোমার ঘ্রাণ নিতে দিবে একটু?

তার কন্ঠ শুনে আমার অন্তর আত্মা কেপে উঠলো। সেই পরিচিত কন্ঠ।কিন্তু এখানে কেনো?লোকটা আমার কপালে তার কপাল দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।দুজনের শ্বাস-প্রশ্বাস একে অপরের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে।ধাক্কাও দিতে পারছি না।হাতে ব্যাথা পাচ্ছি। চোখ দিয়ে পানি পরতে শুরু করলো।লোকটা আবার বলল,,,

–তোমার গালে স্পর্শ করেছিলো তাই না?

বলেই সে আমার যে গালে হলুদ ছিলো সে গালে তার বৃদ্ধা আর তর্জনি আঙুল দিয়ে জোড়ে গালটা টেনে ধরলেন।ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে শব্দ করে কান্না করে দিলাম।হঠাৎ করে লাইট জ্বলে উঠলো। সামনের মানুষটিকে দেখে মনে হলো চারদিকে অন্ধকার আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে। ধীরে ধীর মনে হলো কোনো কালো রঙের সাথে আমি মিশে গেলাম।

চলবে…………

ক্লিওপেট্রা পর্ব-১৩ এবং শেষ পর্ব

0

#ক্লিওপেট্রা
পর্ব- ১৩ (শেষ)
লেখা: ত্রয়ী আনআমতা

ঘরের সকলে মনোযোগী শ্রোতা হয়ে ক্লিওপেট্রার কথা শুনছে।
ক্লিওপেট্রা বলতে লাগল, ‘মাত্র ছয়দিন হল অ্যানি বিড়াল থেকে মানুষরূপে ফিরেছে। আমি তোমাকে বলেছিলাম না আহান মানুষরূপে ফেরার পর বিড়াল জীবনের কথা ওর কিছু মনে থাকবে না? এটা সঠিক ছিল। ওর কিছুই মনে ছিল না সেসব কথা। ও যেদিন প্রথম মনুষ্য রূপে ফেরে সেদিন তুমি অফিসে ছিলে। অহনা কলেজে ছিল। একমাত্র মা বাসায় ছিল। ক্বাহাফ অনেক কান্নাকাটি করছিল বলে মা আমার কাছ থেকে ওকে নিয়ে যায় ঘুম পারানোর জন্য। আমি নিজের ঘরে কাপড়চোপড় ভাজ করছিলাম। হঠাৎ বিড়াল মিথি দৌড়ে এসে খাটের তলায় ঢুকে পড়ে। বের হয় মনুষ্যরূপে অ্যানি হয়ে। আমাকে দেখে ও একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকে। ও কোথায়, এ বাড়িতে কীভাবে এল, আমি এখানে কী করছি।

আমেরিকা থাকতে আমাদের প্রতিশোধ নেওয়ার পর অ্যানি শওকত চৌধুরীর পরিবারের লোকদের খুঁজতে থাকে। ওই লোকের দ্বিতীয় স্ত্রী এবং সে ঘরের দুই ছেলেকে অ্যানি মেরে ফেলে। আমি এসবের কিছুই জানতাম না। আমি জানলে ওকে আটকাবার চেষ্টা করব বলে ও আমাকে কিছুই জানায় নি। অ্যানি কীভাবে যেন জানতে পেরে যায় শওকত চৌধুরীর অতীতে আরেক স্ত্রী ছিল এবং সে ঘরে সন্তানও আছে। তাই ও প্রতিশোধ নেবার জন্য উন্মাদ হয়ে উঠে। ভাগ্য ভালো ছিল আমি জানতে পেরে যাই অ্যানি নিষ্পাপ মানুষদের খুন করছে। আমি অ্যানিকে বোঝানোর চেষ্টা করি শওকত চৌধুরী, এলেক্সা আমাদের ক্ষতি করেছে। ওদের পরিবারের কেউ তো করেনি তাহলে আমরা তাঁদের কেন ক্ষতি করব!
কিন্তু অ্যানি আমার কোনো কথা শোনে না। তুমি যখন আমেরিকা এলে ও তোমাকে কয়েকবার মেরে ফেলতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু পারে নি। আমি ওর প্ল্যান সফল হতে দেই নি। আমিই যে ওর সব পরিকল্পনা নষ্টকারী ও অবশ্য তা জানে না।
কিন্তু একপর্যায়ে কোনোভাবেই আটকাতে পারছিলাম না অ্যানিকে। তাই ওকে আটকানোর জন্য গুরু তান্ত্রিকের সাহায্যে জাদু বিদ্যা দ্বারা ওকে বিড়াল বানিয়ে দেই।

তোমাকে যেদিন আমি মিথ্যে বলি যে আমিই মিথি সেদিন ভোরে চলে যাবার সময় ওকে সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। অন্য এক বাড়িতে রেখে এসেছিলাম ওকে। কিন্তু কিছুদিন পর ও কীভাবে যেন সে বাড়ি ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। হয়তো তোমাকে খোঁজার উদ্দেশ্যে। এটা বিড়ালজাতদের সাধারণ প্রবৃত্তি বলে। কারণ ও তখন অন্যসব বিড়ালদের মতোই সাধারণ একটা বিড়াল হয়ে ছিল। আর তুমি ওকে রাস্তায় কুড়িয়ে পেয়ে আশ্রয় দিয়েছিলে।
একসময় তুমি পুনরায় ওকে খুঁজে পাও।

এসব কিছু তো আর ওকে বলা সম্ভব নয়। তাই ওকে মিথ্যে বলি। ওকে বলি, প্রতিশোধ নিতে আমরা এ বাড়িতে এসেছি। ওর সাময়িক স্মৃতিশক্তি হ্রাস পেয়েছে। ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। ও সেটাই বিশ্বাস করে নেয়। আমাকে বলে কতদিন ধরে আমরা এখানে আছি। আমি উত্তর দেই, এক বছর।
ও তোমাদের মেরে ফেলতে চাইলে আমি ওকে বলি, আমি নিজের হাতে তোমাদের মারব। ওর এসবে জড়ানোর দরকার নেই। ওকে মিথ্যে বলেছি এ কারণে যাতে আমি কিছু সময় পাই ওকে তোমাদের ক্ষতি করা থেকে বিরত রাখতে। আর কোনো বুদ্ধি বের করতে পারি ওকে আটকানোর।

বিড়াল থেকে মানুষরূপে ফিরলেও ওর ওপর থেকে জাদুবিদ্যার প্রভাব পুরোটা কাটেনি। তাই ছয়দিনের মধ্যে দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে ও মানুষরূপে ফিরতে পারত। আর বাকি সময় বিড়াল রূপেই কাঁটাত। তবে বিড়াল হয়ে গেলে তখনকার কিছুই ওর মনে থাকত না। এমনকি এটাও মনে থাকত না ও যে বিড়াল হয়ে গিয়েছিল।

গুরু তান্ত্রিকের ফোন নম্বর আমার কাছে ছিল। আমি ওনাকে ফোন করে সবকিছু জানাই। উনি বলেন, অ্যানিকে আটকানোর কোনো উপায় নেই। ও তোমাদের মেরে ফেলবে খুব শীঘ্রই। আমি ওকে আটকাতে পারব না। শুধু তোমাদের নয় ও অকারণে আরো নিষ্পাপ মানুষদের হত্যা করবে। কারণ ও একজন শয়তানে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। কোনো সাধারণ ডাকিনী নেই আর।
অ্যানিকে আটকানোর একটা উপায়ই আছে কেবল। ওকে মেরে ফেলতে হবে। তবে যখন ও বিড়াল রূপে থাকবে তখন। ‘

কথা শেষ করে ক্লিওপেট্রা আমার দিকে তাকাল। এরপর বলল, ‘আর সে কাজটা তুমিই নিজের হাতে একটু আগে সম্পন্ন করেছ আহান!’

আমার মাথা থেকে এটা সম্পূর্ণভাবে চলে গিয়েছিল যে আমি কিছুক্ষণ আগেই মিথি রূপে অ্যানিকে মেরে ফেলেছি। ক্লিওপেট্রা স্মরণ করিয়ে দিল। আমি আমার টি-শার্টের দিকে তাকালাম। এ কি! একটু আগেই তো এখানে রক্ত লেপ্টে ছিল। কোথায় চলে গেল! ক্লিওপেট্রা হয়তো বুঝতে পারল আমার ভাবনা।
বলল, ‘রক্ত কোথায় চলে গেল ভাবছ? হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। কারণ প্রকৃতি কখনো মৃত ডাকিনীদের কোনো অস্তিত্ব রাখে না।’

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহলে মৃতদেহ?’

ক্লিওপেট্রা উত্তর দিল, ‘সেটাও মিলিয়ে গেছে। চলো দেখবে।’

আমরা সবাই কৌতুহল নিয়ে ক্লিওপেট্রার পিছু পিছু ড্রয়িং রুমে গেলাম। সেখানে রক্ত তো দূরের কথা লাশেরও ছিটেফোঁটা নেই! এমনকি ঘরে ছিটিয়ে পরা রক্তও বিন্দুমাত্র নেই!

আমি ক্লিওপেট্রাকে আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি আমাকে সব বলে দিলে পারতে। তাহলে আজ এতো বড় ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হতো না।’

ক্লিওপেট্রা হাসার চেষ্টা করে বলল, ‘তাহলে যে তোমার বাবা শওকত চৌধুরীর কথাও বলতে হতো!’

আমি বুঝতে পারলাম ক্লিওপেট্রা আমাকে এগুলো আগে কেন বলেনি। ও যদি এগুলো সব বুঝিয়ে আমাকে বলতোও তাহলেও আমার মনে এ ভাবনাটা আসতো, ও প্রতিশোধ নিতে আসে নি তো!
শুধু আমি কেন আমার স্থানে অন্য কেউ থাকলেও তাদের মনেও এ প্রশ্নের অস্তিত্ব ঘটতো। এখানে ক্লিওপেট্রার কোনোই দোষ নেই। বেচারী তো শুধুমাত্র আমার ভালোবাসার জন্যে এসব করেছে।

মা আচমকা আমাকে জিজ্ঞেস করল, ‘হয়েছে? তুই তোর সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছিস? এবার ওকে ঘরে নিয়ে যাই? বেল্টের আঘাতে ঘা হয়ে গেছে পিঠে। মলম লাগাতে হবে।’

আমি বললাম, ‘ মা, আমি লাগিয়ে দিচ্ছি। চলো ক্লিওপেট্রা। ঘরে চলো। ‘

মা চেঁচিয়ে উঠল, ‘একদম না! কোন অধিকারে তুই ওকে তোর সাথে যেতে বলছিস? কোনো অধিকার নেই তোর ওর ওপর।’

‘কী বলছ মা ক্লিওপেট্রা আমার বউ!’

মা উচ্চস্বরে বলল, ‘সেটা বেল্ট দিয়ে জলহস্তীর মতোন মারার সময় মনে ছিল না?’

আমি কানে ধরে বললাম, ‘স্যরি, মা। এবারের মতো প্লিজ ক্ষমা করে দাও!’

মা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। ‘আমার কাছে ক্ষমা চাইছিস কেন! যার ওপর অন্যায় করেছিস তার কাছে চা।’

আমি ক্লিওপেট্রার দিকে ছলছল দৃষ্টিতে তাকালাম। ক্লিওপেট্রা আমাকে পাত্তা না দিয়ে অহনাকে জিজ্ঞেস করল, ‘সবকিছু জানার পর ভাবিকে তোমার খুব ঘৃণা লাগছে তাই না অহনা?’

অহনা দৌড়ে এসে ক্লিওপেট্রাকে জড়িয়ে ধরল। ‘কী বলো এগুলো ভাবি! যা ঘটেছে তাতে তো তোমার কোনো দোষ নেই! তুমি কতো লক্ষী একটা মেয়ে! ভাইয়া কত লাকি তোমার মতো একটা মেয়েকে বউ করে ঘরে আনতে পেরেছে। আমার তো মাঝে মাঝে ভাইয়াকে হিংসা হয়।’
বলেই অহনা আওয়াজ করে হাসতে লাগল। ক্লিওপেট্রাও ওর হাসিতে তাল মেলালো।
আমি ক্লিওপেট্রার হাত ধরে বললাম, ‘ননদ-ভাবী মিলে পরে সারাদিন হেসো। এখন চলো। ঘা ছড়িয়ে যাবে!’

ক্লিওপেট্রার পিঠময় বেল্টের আঘাতে তৈরি হওয়া কালশিটে দাগ। আমি সেখানে আলতো করে মলম লাগিয়ে দিচ্ছি। ব্যাথায় ও বারবার আমার হাত খামচে ধরছে। এতক্ষণ ধরে এ যন্ত্রণা ও মুখ বুজে কীভাবে সহ্য করে ছিল কে জানে! আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। একটা যন্ত্রণা বুকের বাম পাশ থেকে তৈরি হয়ে সারা বুকে ছড়িয়ে পড়ল। হঠাৎই সেগুলো কান্না হয়ে ঝরে পরতে লাগল। আমি ক্লিওপেট্রার কাঁধে মুখ গুঁজে কাঁদতে লাগলাম। ও আচমকা আমার দিকে ঘুরে আমার বুকের ওপর ঝাপিয়ে পরে হেঁচকি তুলে কাঁদতে লাগল। আমি আরো শক্ত করে ওকে জড়িয়ে ধরলাম।

_____________

পাঁচ বছর পর…

আজ অহনার গায়ে হলুদ। সকাল থেকে ক্লিওপেট্রার দেখা পাওয়া মুশকিল হয়ে গেছে। ঘরে তো আসছেই না। যখনই আসছে কিছু একটা নিয়ে আবার তৎক্ষনাৎ দৌড়ে চলে যাচ্ছে। আচ্ছা, বাসায় কি কাজ করার মতো আর কেউ নেই না-কি! ও একাই যে সব করে যাচ্ছে!
আমি আর মা কাজের ফাঁকে নিজেদের ঘরে এসে জিরোচ্ছি। আর ও রোবটের মতো একটানা দৌড়াদৌড়ি করেই যাচ্ছে।

অবশেষে সন্ধ্যায় তাকে পাওয়া গেল। ঘরে ঢুকে দেখি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছে। কোমড় ছাড়িয়েছে চুলগুলো। আমি ওর সামনে গিয়ে পেছন থেকে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। হঠাৎ আমার চোখ পরল আয়নার ওপর।
ক্লিওপেট্রার পড়নে গাঢ় হলুদ রঙের শাড়ি। ঠোটে গোলাপী লিপস্টিক। আমার চোখ আটকে গেল আয়নার ওপর ওর প্রতিচ্ছবিতে। আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছে।
আচ্ছা, মিশরের অতি রূপবতী রানী ক্লিওপেট্রা কি এর চাইতেও বেশি সুন্দর ছিল?

“সমাপ্ত”

ক্লিওপেট্রা পর্ব-১২

0

#ক্লিওপেট্রা
পর্ব- ১২

মা, অহনা তখনও বাইরে থেকে সমানে দরজা ধাক্কা দিচ্ছিল। তাই খুলে দিয়ে এলাম। ঘরে ঢুকেই মা তেড়ে এসে সর্বশক্তি দিয়ে আমাকে চড় মারল। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম। মা ক্লিওপেট্রার কাছে গিয়ে বলল, ‘কোথায় মেরেছে দেখি আমাকে দেখতে দে, মা!’

ক্লিওপেট্রা আঁচল দিয়ে প্যাঁচিয়ে পিঠ ঢেকে রেখেছিল। মা টেনে পিঠের ওপর থেকে আচল সরিয়ে দিতেই সদ্য বেল্টের আঘাতে তৈরি হওয়া দাগগুলো দৃশ্যমান হল। মা’র চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পরল। অহনা আঁতকে উঠল দাগগুলো দেখে। আমার বুকের ভেতরে যেন আগুন জ্বলছে। প্রচন্ড যন্ত্রণা হতে লাগল বুকের মাঝখানটায়।
মা বলতে লাগল, ‘যার বাপ একটা জানোয়ার তার ছেলে মানুষ হবে কী করে! জানোয়ারের বাচ্চা তো জানোয়ারই হবে।’

আমি কথা বলার ভাষা খুঁজে পেলাম না। কী বলব! মা তো ঠিকই বলেছে। আমি কী আর কোনো মানুষ আছি! অমানুষ হয়ে গেছি।

ক্লিওপেট্রা মা’কে বলল, ‘মা এখন এসব থাকুক। আমার তেমন কিছু হয়নি।’

মা অতি উচ্চস্বরে বলল, ‘কী হয়নি সেটা তো দেখতেই পাচ্ছি। ওকে কি আমি এমনি এমনি ছেড়ে দেবো! গায়ে হাত তোলা? এর শোধ নিয়ে ছাড়ব আমি।’

আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। নিজেকে আমিও কখনোই ক্ষমা করতে পারব না ক্লিওপেট্রার গায়ে হাত তোলার জন্য।
ঘটনার শুরু যেখানটায় সেখানেই ফিরে গেলাম। সবার সামনেই ক্লিওপেট্রাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমার প্রশ্নের উত্তর দিলে না?’

মা চেঁচিয়ে উঠল, ‘কীসের উত্তর চাইছিস ওর কাছে?’

ক্লিওপেট্রা আমাকে বলল, ‘তোমাকে যদি এখন আমি নিজের মুখে সব খুলে বলিও তবুও তুমি আমাকে পুরোপুরি কখনোই বিশ্বাস করতে পারবে না। ভাববে, বোধহয় এ আমার নতুন ছলনা! একবার যদি কারো মনে অবিশ্বাসের বীজ জন্মে যায় তাহলে সেটা ডাল-পালা না গজানো পর্যন্ত কখনোই থামে না।’

আমি চুপ করে রইলাম। ক্লিওপেট্রা আবার বলল, ‘তাই বলে আমি চাইনা তুমি সেই ভ্রান্ত ধারণা নিয়েই থাকো। তাই আজ যা বলার মা বলবে আমি না।’

আমি ওর দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকালাম। মা বলবে মানে! মা এসব কীভাবে জানবে!

ক্লিওপেট্রা ঠান্ডা গলায় মা’কে বলল, ‘মা, আহান ভাবছে আমি তোমাদের সবাইকে ফেরে ফেলতে চাইছি। আমার মনে হচ্ছে ও হয়তো আমার আর অ্যানির কথাবার্তা শুনেছে। তাই ই হয়তো…!’

মা বলল, ‘ক্লিওপেট্রা যা বলছে সেটাই কি তোর এমন আচরণের কারন?’

আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললাম। মা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বলল, ‘যাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিস তার ওপর এইটুকু বিশ্বাস নেই? অন্তত ওকে জিজ্ঞেস করে নিতে পারতি আসল ঘটনাটা কী!’

মা এতোটা স্বাভাবিক কীভাবে আমি বুঝতে পারছি না। তবে অহনাকে মোটেও স্বাভাবিক লাগছে না। আমার মতো হয়তো অহনাও কিছু বুঝে উঠতে পারছে না!

মা আবার বলল, ‘ অবাক হচ্ছিস? ক্বাহাফ পেটে থাকতেই ক্লিওপেট্রা আমাকে সব খুলে বলেছে। তুই যা না জানিস তাও বলেছে।’

আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। মা সব জানে! আর আমি যা না জানি মানে! ক্লিওপেট্রা মা’কে কী এমন কথা বলেছে যা আমিও জানিনা!

মা বলল, ‘তুই কী জানিস না তা বুঝতে পারছিস না তাই না?’

আমি মায়ের দিকে প্রশ্ন বোধক দৃষ্টিতে তাকালাম।

মা বলল, ‘তোর জন্মদাতা পিতাই হচ্ছে ক্লিওপেট্রার মা-বাবার মূল হত্যাকারী। ওই মানুষরূপী জানোয়ারটাই ওর পরিবারটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।’

আমার মাথায় যেন বাজ ভেঙে পরল। এসব কী বলছে মা! তবে কী আমার ধারণাটাই সঠিক! আমিও তো ভেবেছিলাম হয়তো ওই লোকটা কোনোভাবে ক্লিওপেট্রাদের ক্ষতি করেছে তাই ও আর ওর বোন অ্যানি মিলে আমাদের ওপর প্রতিশোধ নিতে চাইছে!

মা আবার বলল, ‘শওকত চৌধুরীর জন্যেই ক্লিওপেট্রাকে এতো ভুগতে হয়েছে। ওই জানোয়ারের লোভ ও লালসার শিকার হয়েই ওর মা-বাবাকে মরতে হয়েছে।’

আমার আচমকা অতীতের কথা মনে পড়ে গেল। তখন আমার ছয় বছর বয়স। অহনা মায়ের গর্ভে। সেদিন রাতে আমি মায়ের সঙ্গে ঘুমিয়ে ছিলাম। তখন গভীর রাত। মা পাশে না থাকলে আমি কিছুতেই ঘুমোতে পারি না। হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গতেই দেখি মা পাশে নেই। ড্রয়িংরুম থেকে মায়ের চিৎকার ভেসে আসছে। আমি শোয়া থেকে উঠে দৌড়ে সেখানে যাই। দেখি বাবা মা’কে মারছে। আর মা মেঝেতে আধশোয়া হয়ে কাঁদছে। বাবার অপর পাশে অশ্লীল পোশাক পড়নে এক মহিলা দাঁড়ানো।
বাবাকে প্রায়ই অমন অশ্লীল পোশাক পড়নের মহিলাদের বাসায় আনতে দেখতাম। একেক সময় একেক মহিলাদের দেখা যেত। মা তাদেরকে বাসায় দেখে বাবার বিরুদ্ধে কথা বলতো। প্রতিবাদ করতো। আর বাবা রেগে গিয়ে মা’কে মারত।

বাবা মা’কে প্রায়ই মারত। খাবার দিতে এক মিনিট দেরি হলেও মা’কে মারত। মা সব মুখ বুঝে সহ্য করে নিয়েছিল তবুও। কিন্তু একসময় বাবা আমার ওপর হাত তুলতে শুরু করল। নিজের সন্তানের ওপর অত্যাচার হতে দেখে হয়তো মায়ের টনক নড়ে। লোকটাকে ডিভোর্স দেবার স্বীদ্ধান্ত নেয়।
মা একদিন কাউকে না জানিয়ে চুপিচুপি আমাকে নিয়ে নানাবাড়ি চলে যায়। নানা-নানীকে সব জানানোর পর তারা আফসোস করেন মেয়েকে অমন নরকে তুলে দিয়েছেন বলে। অতিসত্বর ডিভোর্সের ব্যবস্থা নেন। ডিভোর্সের পর আমরা নানাবাড়িই রয়ে যাই। নানা আমাদের কোথাও যেতে দেননি। অহনা জন্মানোর পর কখনো ওর জন্মদাতা পিতাকে আর দেখতে পায়নি। আমরা বড় হই নানার পরিচয়ে। ধীরে ধীরে অনেকগুলো বছর কেটে যায়।
আমি পড়াশোনা শেষ করে চাকরির সন্ধানে নেমে পড়ি। চাকরিতে জয়েন করার পরপরই ঢাকায় চলে আসি। এখানেই এক ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকতে শুরু করি। নানা আমাদের আসতে দিতে চাননি। হাজার বুঝিয়ে শুনিয়ে রাজি করাই। বলি, এখন আমি বড় হয়েছি। এখন অন্তত আমার মা, অহনার দায়িত্ব নেওয়া উচিৎ!
নানা একসময় রাজি হলেও এখনো খানিকটা রেগে আছেন আমার ওপর।

পরিচিতদের কাছে শুনেছি, ওই লোক না-কি এখন আমেরিকায় চলে গেছে। সেখানেই না-কি নতুন স্ত্রীকে নিয়ে স্থায়ীভাবে থেকে গেছে।

আচ্ছা, সেজন্যই কী ক্লিওপেট্রা আমাকে কখনো ওর মা-বাবার খুনির নাম বলতো না! শুধু বলতো ‘ওই লোকটা!’

আমার ভাবনায় ছেদ ঘটিয়ে মা বলল, ‘কী ভাবছিস এতক্ষণ ধরে?’

‘কিছুনা, মা।’ এরপর ক্লিওপেট্রাকে বললাম, ‘তুমি আমাকে কেন বলোনি যে তোমার মা-বাবার খুনি শওকত চৌধুরী? ‘

ক্লিওপেট্রা এখনো কাঁদছে। জলভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘বললে তুমি আমাকে কখনোই ভালোবাসতে না আহান! কখনোই বাসতে না! ভাবতে তোমার বাবা এলেক্সা আর আমাদের অফিসের সহকর্মীর সাথে মিলে আমার মা-বাবাকে মেরে ফেলেছে বলে আমিও প্ল্যান করে তোমাকে বিয়ে করে প্রতিশোধ নিতে এসেছি।’
কিছুক্ষণ থেমে ক্লিওপেট্রা হাসার চেষ্টা করল, ‘অবশ্য এখনও তা-ই ভাবছো।’

ক্লিওপেট্রা আবার বলল, ‘আচ্ছা, আহান তুমি কি মনে করো আমি এখনো ডাকিনীই রয়ে গেছি?’

আমি উত্তর দিলাম না। ও আবার বলল, ‘এসব ব্যাপারে আমি তোমাকে একটাও মিথ্যে বলিনি আহান। তুমি আমাকে যেদিন থেকে ভালোবাসতে শুরু করেছো সেদিন থেকে আমার সব অভিশাপগুলো কাটতে আরম্ভ করেছে। ডাকিনী হবার কিছু দিন পর যখন সাইড-এফেক্টসগুলো দেখা দিতে শুরু করল তখন আমার অনুভবের ক্ষমতাও চলে গিয়েছিল। আমি কিছু অনুভবও করতে পারতাম না। মনে আছে একদিন তোমাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, সেদিন অন্যদিনের চাইতে বেশি ঠান্ডা পড়েছিল কি-না? তখন আমি কিছু অনুভব করতে পারতাম না। কিন্তু সেদিন হঠাৎই খুব ঠান্ডা অনুভূত হচ্ছিল। তাতেই আমি বুঝতে পারি তুমি আমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছো। ‘

আমি বললাম, ‘আমার মনে আছে।’

ক্লিওপেট্রা বলল, ‘সেগুলো সব সত্যিই ছিল আহান! আর পাঁচটা মানুষের মতো অনুভব করার ক্ষমতা ফিরে পাবার পর আমি তোমার চরিত্রের প্রেমে পড়ে যাই। ধীরে ধীরে তোমাকে ভালোবাসতে শুরু করি। তোমার সাথে বিয়ের পর আমার ওপর থেকে পার্শ-প্রতিক্রিয়াগুলো অনেকটাই সরে গিয়েছিল। ক্বাহাফ হবার পর সম্পূর্ণ মুক্ত হই আমি। আমি আর ডাকিনী নেই আহান! তাই সেই ক্ষমতাগুলো কিংবা সাইড-এফেক্টসগুলো কোনোটাই নেই। এখন আমি তোমাদের মতোই সুস্থ-স্বাভাবিক সাধারণ মানুষ আহান! কোনো প্রতিশোধের নেশায় উন্মত্ত নানা শক্তির অধিকারী ডাকিনী নই!

আমি বললাম, ‘আমি বলিনি ক্লিওপেট্রা তুমি এখনো তেমনটাই রয়ে গেছ। আমি জানি তুমি এখন আর চার-পাঁচটা সাধারণ মানুষের মতোই।’

ও বলল, ‘তাহলে তুমি কী করে ভাবলে আমি প্রতিশোধের নেশায় তোমার বাড়িতে পরে আছি! আমি তোমাকে ভালোবাসি আহান! শুধু তোমাকে নয়। মা’কে, অহনাকে সবাইকে। এ বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষকে আমি নিজের পরিবার মনে করি আহান! আমি মা’কে আমার আপন মায়ের চাইতে কোনো অংশেই কম ভাবিনি কখনো! আর অহনা! অহনাকে আমি নিজের বোনের সাথে তুলনা দেবো না। কারণ অ্যানি তো হিংস্র পশুর চাইতেও জঘন্য হয়ে গিয়েছিল! ‘

আমি বললাম, ‘তুমি বলেছিলে অ্যানিকে জাদুবিদ্যা দ্বারা সাধারণ বিড়ালে রূপান্তরিত করা হয়েছে। তাহলে আমি যে তোমাদের সেদিন কথা বলতে শুনলাম!’

ক্লিওপেট্রা বলল, ‘আমি সত্যিটাই বলেছিলাম তোমাকে। এমনকি এ-ও বলেছিলাম শাস্তি শেষ হলে কখনো মানুষ রূপে ফিরলেও ফিরতে পারে। তবে ও যে মানুষরূপে ফিরলেও ডাকিনীই রয়ে যাবে তা আমি সত্যিই জানতাম না।’

চলবে…

লেখা: #ত্রয়ী_আনআমতা

ক্লিওপেট্রা পর্ব-১১

0

#ক্লিওপেট্রা
পর্ব- ১১

অকস্মাৎ আমার এমন আচরণে ক্লিওপেট্রা হতভম্ব হয়ে গেল। আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে বলল, ‘কী হয়েছে আহান? তুমি এমন করছো কেন?’

আমি ওকে জবাব না দিয়ে শোবার ঘর ছেড়ে ড্রয়িংরুমে এসে বসলাম। ক্লিওপেট্রা ক্বাহাফকে কোলে নিয়ে আমার পিছু পিছু আসলো। আমাকে বলল, ‘তুমি কি কোনো ব্যাপার নিয়ে আমার ওপর রেগে আছো?’

আমি জবাব দিলাম না।

মা এসে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে ক্লিওপেট্রা? ‘

ক্লিওপেট্রা বলল, ‘জানিনা মা। ক্বাহাফকে খাওয়াচ্ছিলাম। হঠাৎ আহান ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ওর সুজির বাটিটা ছুড়ে মারল।’

মা রাগত স্বরে আমাকে বলল, ‘কী রে আহান তুই দিন দিন এমন বদরাগী হচ্ছিস কেন বলতো! আগে কত শান্তশিষ্ট ছিলি কেউ হাজার বকলেও মুখ ফুটে কিছু বলতিস না। আর এখন! কিছুই ঘটতে পারে না। কেউ কিছু তোকে বলতেও পারে না। পান থেকে চুন খসলেই তুই রেগে যাস!’

আমি মায়ের কথা কানে তুললাম না। টিভি অন করে খবর দেখতে লাগলাম। মা আমার হাত থেকে রিমোটটা কেড়ে নিয়ে বলল, ‘কী হল উত্তর দিচ্ছিস না কেন?’

আমি সোফা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে হেটে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে এলাম। মা পেছন থেকে আমাকে ডাকতে লাগল।

একঘন্টা যাবৎ একটা টং দোকানের বেঞ্চিতে বসে আছি। পরিচিত দোকান। প্রায়ই এখানে বসে চা খাই। তাই হয়তো দোকানি জিজ্ঞেস করল, ‘ভাইজান আপনের কিছু হইসে? আপনে কি কিছু নিয়া রাইগা আছেন?’

আমি মাথা ঝাঁকিয়ে না বললাম। তবুও দোকানি অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

দুঃশ্চিন্তায় আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে। কেন ক্লিওপেট্রা আর ওর বড় বোন অ্যানি আমার পরিবারটাকে ধ্বংস করে দিতে চায়? কেন হত্যা করতে চায় আমাদের? আমাদের সাথে কি ওদের কোনো পুরোনো শত্রুতা আছে! না এমন কিছু তো মনে পড়ছে না! মা আর অহনাকে তো কোনোদিন কারো সাথে কথা কাটাকাটি করতেও দেখিনি। আমারো তো কারো সঙ্গে অমন কিছুই নেই। তবে!
অতীত ঘাটতে লাগলাম আমি। কারো সঙ্গে আমাদের পুরোনো শত্রুতা ছিল কি-না ভাবতে লাগলাম। কিছুই এলো না মনে। আমাদের তো কারো সঙ্গে অমন শত্রুতা নেই!
হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ল। একজন আছে! ওই লোকটা! তবে কি ওই লোকটার জন্য ক্লিওপেট্রা আমাদের ক্ষতি করতে চায়! ওই জঘন্য লোকই কি তবে দায়ী এর জন্যে!

এ পরিস্থিতির জন্য যদি ওই লোক দায়ী হয়েও থাকে তবে এতে আমাদের কী দোষ? আমরা কেন এর শাস্তি ভোগ করব!
ক্লিওপেট্রা আর ওর বোন অ্যানি আমাদের কোনোরকম ক্ষতি করার আগেই আমার কিছু একটা করতে হবে। দরকার পরলে আমিই নিজের হাতে ওদের শেষ করে দেবো।

বেঞ্চি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাটা ধরলাম।
বাসায় ফিরে কলিংবেল বাজাতেই ক্লিওপেট্রা দরজা খুলে দিল। ওকে থেকে আমার মাথায় আগুন জ্বলে উঠল। রাগটা যা একটু হালকা-পাতলা কমেছিল তা যেন মুহূর্তেই দ্বিগুণ পরিমাণে বেড়ে গেল।
ক্লিওপেট্রা আমাকে দেখে মুখটাকে এমন করে ফেলল যেন সে খুবই চিন্তিত আমাকে নিয়ে। বলল, ‘না খেয়ে কোথায় চলে গিয়েছিলে বলো তো! সেই সকালবেলা কোনোরকম একটা রুটি খেয়েছিলে। এত বেলা হয়ে গেল এখনো খাওয়ার নাম নেই! শুধু শুধু রাগ করে বাইরে গিয়ে বসে আছেন উনি।’

আমার হাসি পেল। মনে মনে হাসলাম আমি। ও ভেবেছিল ওর ছলনা বুঝি কখনোই ধরতে পারব না! এমন ভান করছে যেন কতোই না ভালোবাসে ও আমায়!

আমি ওকে ধাক্কা দিয়ে সামনে থেকে সরিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে গেলাম। নিজের রুমে এসে বসতেই মা, অহনা এসে খাওয়ার জন্য ডাকতে লাগল। আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘প্লিজ তোমরা এখন আমাকে ডাকাডাকি করো না। আমার যখন খিদে পাবে তখন আমি নিজে থেকেই খেয়ে নেব।’

মা, অহনা থামলেও ক্লিওপেট্রা থামল না। আমার সামনে এসে যেন আবৃত্তি করতে লাগল, ‘খেতে এসো! খেতে এসো!’

আমি ক্লিওপেট্রাকে ধাক্কা দিয়ে রুম থেকে বের করে দিলাম। তখনই আমার চোখ পরল ড্রয়িংরুমে হাঁটতে থাকা মিথির ওপর। আর নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারলাম না রাগটাকে৷ জানিনা আমার কী হয়ে গেল! আমি হন্তদন্ত হয়ে রান্নাঘরে চলে গেলাম। রান্নাঘরে ঢুকতেই সর্বপ্রথম বটিটার ওপর আমার নজর পরল। ওটাকেই হাতে তুলে নিলাম। ড্রয়িংরুমে একপ্রকার দৌড়ে এসে শুয়ে জিরোতে থাকা মিথির ওপর বসিয়ে দিলাম এক কোপ। রক্ত ছিটকে এসে লাগল আমার শরীরে। থামলাম না। পরপর কয়েক কোপ দিতেই মিথির শরীরটা দু’ভাগ হয়ে গেল। গলগলিয়ে রক্ত বেরোতে লাগল। কিছুক্ষণ মিথির শরীরটা মৃদু লাফালো। একপর্যায়ে নিস্তেজ হয়ে পরে রইল ওর প্রাণহীন নিথর দেহটা।

এতক্ষণ আশেপাশে তাকাইনি। এখন ঘরে চোখ বুলাতেই দেখলাম অহনা, ভয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে দূরে দাঁড়িয়ে আছে। মায়ের কোলে ক্বাহাফ ঘুমিয়ে। মা এমন ভাবে আমার দিকে তাকাল যেন আমি কোনো মানুষ নই। একটা অমানুষ! ক্লিওপেট্রা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছে। সবাই আমার দিকে ঘৃণা ও ভয় দুটো মিশ্রিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমি বটিটা কিনারে ছুড়ে ফেলে আমার ঘরে চলে গেলাম।
ফিরে এলাম হাতে করে চামড়ার লেদারের বেল্টটা নিয়ে। ক্লিওপেট্রাকে টেনে ঘরে নিয়ে এসে মাটিতে ফেলে দিলাম। রুম ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগিয়ে এলাম। ক্লিওপেট্রা আমার দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। আমি সেদিকে গ্রাহ্য করলাম না। ওকে চমকে দিয়ে ওর ওপর আক্রমণ করে বসলাম। চামড়ার বেল্টটা দিয়ে ইচ্ছে মতোন মারতে লাগলাম ওকে। ও প্রতিবার ব্যাথায় ককিঁয়ে উঠতে লাগল। মা আর অহনা বাইরে থেকে দরজা ধাক্কাতে লাগল। আমার হাতে বেল্ট দেখেই হয়তো বুঝে নিয়েছে ওকে মারার জন্যই ঘরে টেনে এনেছি।
আমি থামলাম না। মারতেই থাকলাম ওকে। ক্লিওপেট্রা হাত দিয়ে আমাকে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করল। আওয়াজ করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগল, ‘আমার খুব কষ্ট হচ্ছে আহান! আমার খুব কষ্ট হচ্ছে! আমি সহ্য করতে পারছি না। ‘
তবুও আমি থামলাম না। তাই হয়তো ও হাল ছেড়ে দিল। আর বাঁধা দেবার চেষ্টা না করে শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। ওর চোখ বেয়ে অনবরত জল গড়াতে লাগল। কেন জানি আমি আর বেল্ট চালাতে পারলাম না ওর ওপর। হাত থেকে বেল্টটাকে ছুড়ে ফেলে চলে যেতে পা বাড়ালাম। হঠাৎই তখন ক্লিওপেট্রা আমার পা জড়িয়ে ধরল। পা জড়িয়েই কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘আমি কী করেছি আহান! কেন আমাকে এভাবে শাস্তি দিচ্ছো তুমি! প্লিজ বলো আহান! প্লিজ বলো!’

আমার আচমকা কী হল জানিনা। ঘটে যাওয়া সবকিছুর জন্য আফসোস করতে লাগলাম। সবচাইতে বেশি কষ্ট হতে লাগল ক্লিওপেট্রার জন্য। ওকে এভাবে অমানুষের মতোন মারলাম আমি! একটাবার কী জানতে চাওয়া উচিত ছিল না সত্যিটা কী!
আমি ক্লিওপেট্রার পাশে ধপ করে বসে পড়লাম। ক্লিওপেট্রা আমার সামনে এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগল। আমি আর সহ্য করতে পারলাম না। ওকে বুকের সাথে পিষে ফেললাম। আমিও যে কখন কাঁদতে শুরু করেছি বুঝতে পারিনি। ক্লিওপেট্রা আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘প্লিজ বলো আহান আমি কী দোষ করেছি? তুমি না বললে আমি কীভাবে বুঝব!’

আমি ওকে জড়িয়ে ধরেই বললাম, ‘দোষ তো করেছি আমি। তোকে নিজের চাইতেও বেশি ভালোবেসে ফেলে। সেজন্যেই বোধহয় তুই আমাকে এভাবে ধোঁকা দিলি!’

কাঁদতে কাঁদতে ক্লিওপেট্রার হেঁচকি উঠে গেছে। ও ওভাবেই বলল, ‘একটাবার পরিষ্কার করে বলো আহান আমি কী করেছি!’

আমি ঠান্ডা গলায় বললাম, ‘আমাদের সবাইকে মেরে ফেলতে চাইছো কেন?’

ক্লিওপেট্রা আমার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে হঠাৎ দূরে সরে গেল। তারপর বলল, ‘তুমি আমাকে এই দেড়বছরে এ-ই চিনলে!’

চলবে…

লেখা: #ত্রয়ী_আনআমতা

ক্লিওপেট্রা পর্ব-১০

0

#ক্লিওপেট্রা
পর্ব- ১০

ক্লিওপেট্রা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বলো কেন মিথ্যে বলেছিলে আমাকে?’

ক্লিওপেট্রা জবাব না দিয়ে একই ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল। আমি উচ্চস্বরে বললাম, ‘কী হল চুপ করে আছো কেন উত্তর দাও!’

ক্লিওপেট্রা মেঝের দিকে তাকিয়েই বলল, ‘এমনি।’

‘এমনি! তুমি আমাকে এতটাই বোকা ভাবো ক্লিওপেট্রা? এমনি তুমি এতবড় একটা মিথ্যে কথা বলবে? তুমি এমনি এমনি কিছু বলো না, করোও না। তার পেছনে নিশ্চয়ই বড়সড় কোনো কারণ থাকে।’

মা পেছন থেকে আমাকে চেঁচামেচি করতে দেখে বলল, ‘কী হয়েছে আহান? ক্লিওপেট্রার সঙ্গে অমন ব্যবহার করছিস কেন?’

আমি কথাটা এড়িয়ে যাবার জন্য বললাম, ‘কিছু না মা! দেখো তো অহনা, ক্বাহাফকে নিয়ে কোথায় গেল। সবাই আসতে শুরু করেছে অথচ ওরা আসছে না এখনো সেটাই বলছিলাম ক্লিওপেট্রাকে।’

মা আমাকে বলল, ‘তার জন্যে ওর সঙ্গে অমন করছিস কেন? ও কী করবে? ‘
এরপর ক্লিওপেট্রাকে বলল, ‘তুই কিছু মনে করিস না তো মা! আজ ব্যস্ততায় ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তুই আমার সঙ্গে আয় তো আমরা মা-মেয়ে মিলে ওদিকটা দেখি!’

ক্লিওপেট্রা বলল, ‘আসছি মা।’

আমি মা’কে বললাম, ‘তুমি যাও ও আসছে।’

মা যেতে-যেতে বলল, ‘ওকে বকবি না খবরদার!’

মা চলে যেতেই আমি বললাম, ‘এবার বলো! কেন মিথ্যে বলেছ?’

ক্লিওপেট্রা আচমকা আমার হাত ধরল। অনুরোধের স্বরে বলল, ‘প্লিজ আহান আমি তোমাকে সব বলছি। ক্বাহাফের জন্মদিনের অনুষ্ঠানটা শেষ হতে দাও!’

আমি ধাক্কা দিয়ে ওর হাত সরিয়ে দিয়ে আমার ঘরে চলে এলাম।

সন্ধ্যেবেলা সাদামাটাভাবে ক্বাহাফের জন্মদিনটা পালন করা হল। রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষে ঘুমুতে আসার পর আমি কথাটা আবার তুললাম।

ক্লিওপেট্রা বলল, ‘তুমি যাকে মিথি ভাবছ সে আসলে মিথি নয়। ‘

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তাহলে কে সে?’

‘আমার বড় বোন অ্যানি!’

আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। ‘কী!’

‘হ্যাঁ। তোমাকে আমি একটা মিথ্যে বলেছিলাম। তোমায় বলেছিলাম না, যেদিন মা’কে খুন করা হয় সেদিন আমরা পালাতে গিয়ে আলাদা হয়ে গিয়েছি? বোধহয় আপুকেও মেরে ফেলেছে ওরা?’

‘হ্যাঁ, বলেছিলে।’

‘ওটা আসলে মিথ্যে ছিল। সেদিন আমি আর আমার আপু দু’জনই পালাতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমি অজ্ঞান হয়ে গেলেও সেদিন আপু সজ্ঞানে ছিল। জেনিফার আন্টি আমাদের দেখে দুজনকেই উদ্ধার করে। ‘

আমি বললাম, ‘তাহলে মিথ্যে কেন বলেছিলে?’

ক্লিওপেট্রা বলল, ‘বলছি। জেনিফার আন্টি মারা যাবার পর শুধু আমি না, আমার বোনও ডাকিনীবিদ্যায় অংশ নিয়েছিল। আর মহিলা তান্ত্রিকটি আমাকে ধোঁকা দিয়ে আমার ওপর ত্রিবিদ্যা প্রয়োগ করলেও আপুর ওপর শুধু ডাকিনীবিদ্যা প্রয়োগ করে। তাই সাইড-এফেক্টসগুলো শুধু আমার মাঝেই দেখা দিতে শুরু করে, আপুর মাঝে নয়।
আমি আর আপু দু’জন মিলেই আমাদের প্রতিশোধ নেই।
কিন্তু আপু প্রতিশোধ নেওয়া শেষ হলে তার ক্ষমতার অপপ্রয়োগ শুরু করে। নিষ্পাপ মানুষদের ওপর ওর ক্ষমতার কলকাঠি নাড়ায়। তাই আমি আপুকে থামানোর উদ্দেশ্যে গুরু তান্ত্রিকের সঙ্গে দেখা করি। তার কাছে জানতে চাই কীভাবে আপুকে থামাবো। তিনি বলেন আপুকে এভাবে থামানো সম্ভব নয়। ওর ওপর জাদুবিদ্যা প্রয়োগ করে কোনো একটা ব্যবস্থা নিতে হবে। আপুর ক্ষমতার অপপ্রয়োগ থেকে সাধারণ মানুষকে বাঁচানোর জন্য আপুর ওপর গুরু তান্ত্রিক জাদুবিদ্যা প্রয়োগ করেন। যার ফলে আপু মানুষ থেকে একটা সাধারণ বিড়াল হয়ে যায়। এটাই ছিল আপুর পাপের শাস্তি।
আমি দেশে ফেরার সময় সাথে করে ওকে নিয়ে আসি। তুমি যাতে ওকে পাও সেজন্যই তুমি যে রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করো সেখানে ড্রেনের পাশে ওকে রেখে আসি। আর তুমি ওকে ওখান থেকে পেয়ে বিড়াল ভেবে বাসায় নিয়ে আসো।’

আমি বললাম, ‘আমার পাওয়ার জন্য ওকে ছেড়েছিলে কেন?’

‘সেফটি! যতোই হোক ও আমার বোন ছিল একসময়। তাই মায়ায় পড়ে…।’

‘বুঝতে পেরেছি। ও কি আর কখনো মানুষ হবে না?’

ক্লিওপেট্রা উত্তর দিল, ‘সে সম্ভাবনা নেই। তবে একেবারে যে নেই তাও না। শাস্তি শেষ হয়ে গেলে মানুষ হিসেবে ফিরলে ফিরতেও পারে।’

‘ও কি বুঝতে পারে যে ও আগে মানুষ ছিল?’

‘একটুও না। ও এখন একদম অন্যান্য সাধারণ বিড়ালদের মতোই। যদি ও ভবিষ্যতে মানুষ হিসেবে ফিরেও তবুও ওর বর্তমানের বিড়াল জীবনের ব্যাপারে কিছুই বলতে পারবে না। স্মরণই থাকবে না কিছু।’

আমি বললাম, ‘ব্যাপারটা কম্পলিকেটেড।’

ক্লিওপেট্রা সম্মতি জানাল। ‘হুম।’

পনেরো দিন পর…

সেদিন অফিসে হাফ ডে ছিল। দুপুরে অফিস থেকে ফিরে দেখি ঘরের মেইন দরজা হাট করে খোলা। মা নিশ্চয়ই পাশের ফ্ল্যাটে গিয়েছে। আর বন্ধ করার কথা খেয়াল নেই। নিজের ঘরে ঢুকতে নিতেই দুজন মানুষের কথোপকথন আমার কানে ভেসে এলো।

ক্লিওপেট্রা ইংরেজিতে বলছে, ‘আপু তুই এখন চলে যা। আমি দেখছি কী করা যায়।’

অপর কন্ঠস্বরটিও ইংরেজিতে বলল, ‘আর কতদিন! দু’বছর হতে চলল তুই এখনো কিচ্ছু করিসনি। আর কত ধৈর্য ধরতে হবে আমার বল তুই!’

ক্লিওপেট্রা চুপ হয়ে গেল হঠাৎ। অপরজন আবার বলল, ‘তুই না পারলে ঠিকাছে। আমি নিজের হাতে আহানকে আর ওর পরিবারকে শেষ করে দেবো।’

ক্লিওপেট্রা বলল, ‘না! আমি থাকতে তোর এসব কিছু করতে হবেনা। তোকে তো আমি বলেছি আমি যেহেতু এ বাড়িতে আছি সেহেতু সুযোগ বুঝে আমিই যা করার করব।’

‘কবে মারবি ওদেরকে?’

‘এক সপ্তাহের মধ্যেই।’

আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরল। এসব ক্লিওপেট্রা কী বলছে! হঠাৎই আমার মাথা ঘোরাতে লাগল। আমি টলতে টলতে অহনার ঘরে চলে গেলাম। ঘরে অহনা নেই। কলেজে গিয়েছে। কেউ নেই যে আমাকে ধরবে। পুরো পৃথিবী আঁধার হয়ে যাচ্ছে আমার। আমি ঘরের সোফায় ধপ করে বসে পড়লাম। কিছুক্ষণ কিছু ভাবতে পারলাম না। ঘোরগ্রস্তের মতো বসে রইলাম।

কয়েক মিনিট সময় লাগল আমার স্বাভাবিক হতে। স্বাভাবিক হতেই আমি বুঝে গেলাম ক্লিওপেট্রা কার সঙ্গে কথা বলছিল। ওর বোন অ্যানির সঙ্গে। যে এ বাড়িতে মিথির বেশে আছে। ক্লিওপেট্রা আমাকে আবারও ঠকালো। তবে এবার কোনো সামান্য ধোঁকা নয়। আবার জীবন ধ্বংস করে দিল ও। আচ্ছা আমি কি দোষ করেছিলাম? ওকে মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছিলাম এটাই কি আমার দোষ!

হঠাৎ ক্বাহাফের কথা মনে হতেই আমার বুক কেঁপে উঠল। ক্লিওপেট্রা কি ওকেও ফেরে ফেলবে? ও তো আমার পরিবারেরই একটা অংশ! এজন্যই কি আমি সেদিন অমন বিদঘুটে একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছিলাম! ওটা কি তবে আমার জন্যে একটা সাবধান বানী ছিল!
নাহ! আমি কিছুতেই ওই ছলনাময়ীকে আমার পরিবারের দিকে হাত বাড়াতে দেবো না। কিছুতেই না! তার জন্যে যদি আমার নিজের জীবন ত্যাগ করতে হয় তো করব।

আমি বাকি সময়টকু আর অহনার ঘর থেকে বের হলাম না। ক্লিওপেট্রাকে জানতে দেওয়া যাবে না যে আমি সব জেনে গেছি।
অহনা কলেজ থেকে ফিরে আমাকে ওর ঘরে দেখে জিজ্ঞেস করল, ‘ভাইয়া, তুই এসময় বাসায়! তাও আবার এ ঘরে? কিছু বলবি?’

আমি বললাম, ‘এই যে এখনি ফিরলাম অফিস থেকে। কি যেন বলতে এসেছিলাম ভুলে গেছি।’

এরপর নিজের ঘরে চলে এলাম। হাত-মুখ ধুয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরোতেই দেখি, ক্লিওপেট্রা ক্বাহাফকে সুজি খাওয়াচ্ছে। আমার বুকটা ধ্বক করে উঠল। আচ্ছা ও ক্বাহাফের খাবারে কিছু মিশিয়ে দেয়নি তো ওকে মেরে ফেলার জন্যে! আমি দৌড়ে ক্লিওপেট্রার হাত থেকে সুজির বাটিটা কেড়ে নিয়ে দূরে ছুড়ে মারলাম। বাটিটা আওয়াজ করে মেঝেতে পড়ে গড়াতে গড়াতে সুজিগুলো সারাঘরে ছিটাতে লাগল।

চলবে…

লেখা: #ত্রয়ী_আনআমতা

ক্লিওপেট্রা পর্ব-০৯

0

#ক্লিওপেট্রা
পর্ব- ০৯

গুরু তান্ত্রিকের বাড়ির কথা শুনে ভেবেছিলাম লতাপাতায় ঘেরা অতি পুরোনো কোনো ভূতূড়ে বাড়ি হবে। কিন্তু বাড়ির গেইটে পা রাখতেই আমি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলাম। এত সুন্দর বাড়ি! এরকম ডিজাইনের বাড়ি আমি এর আগে কখনো দেখিনি।
আমি কখনো শুনিনি এমন ধরনের বাড়িতে যে তান্ত্রিকেরা থাকতে পারে। তাও আবার এমন তান্ত্রিকদেরও গুরু। ক্লিওপেট্রাকে বললাম,
‘তুমি শিউর এটাই তোমার সেই গুরু তান্ত্রিকের বাড়ি?’

ক্লিওপেট্রা হাসল।

বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই একজন মহিলা হাসিমুখে আমাদের আমন্ত্রণ জানালেন। যেন আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন। আমাদের ড্রয়িংরুমে বসিয়ে রেখে উনি কোথায় যেন চলে গেলেন। আমি ক্লিওপেট্রাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ইনি কে? গুরু তান্ত্রিকের স্ত্রী? ‘

ক্লিওপেট্রা আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকাল। ‘আস্তে কথা বলো। উনি তো বিয়েই করেননি। এটা এ বাড়ির একজন মেইড।’

‘দেখে তো মনে হলো না।’

‘তিনি খুব ভালো একজন মানুষ। তার বাড়ির সবকটা কাজের লোকদের তিনি বাড়ির সদস্যদের মতোই ট্রিট করেন। এজন্য বাইরের লোক এসে বুঝতে পারেনা যে এনারা এ বাড়িতে কাজ করেন।’

‘ওহ আচ্ছা!’

কিছুক্ষণ পরেই ওই মহিলাটি ফিরে এল। সঙ্গে নানান রকম খাবার-দাবার নিয়ে। পরিষ্কার ইংরেজিতে আমাদের খেতে বলল।
ক্লিওপেট্রাও ইংরেজিতে ধন্যবাদ জানালো। তারপর জিজ্ঞেস করল, গুরুতান্ত্রিক কখন আসবেন?

মহিলাটি বলল, মাস্টার এখন মেডিটেশন করছেন। আধা ঘণ্টা বসতে হবে।

ক্লিওপেট্রা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানাতেই মহিলাটি চলে গেল।

ত্রিশ মিনিট পরেই উপর তলা থেকে সিড়ি বেয়ে একজন সত্তর- পঁচাত্তর বয়সী ভদ্রলোককে নিচে নামতে দেখা গেল। একদম ফাদারদের মতোন পোশাক পড়নে। গলায় ক্রুশ।
আমি ক্লিওপেট্রাকে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘উনি ফাদারদের পোশাকে কেন?’

ক্লিওপেট্রা বলল, ‘উনি এভাবেই থাকতে পছন্দ করেন। ‘ এরপর ঠোঁটে আঙুল দিয়ে আমাকে চুপ থাকতে ইশারা করল।

আমি আর কোনো কথা বললাম না।

গুরু তান্ত্রিক নিচে নেমেই ড্রয়িংরুমের পাশের ঘরে চলে গেল। ওই মহিলাটি পুনরায় এল। এসে ক্লিওপেট্রাকে বলল, মাস্টার ডাকছে।

ক্লিওপেট্রা আমাকে বলল, ‘ দু’মিনিট বসো। আমি কথা বলে আসছি।’

ঠিক পাঁচ মিনিট পর ক্লিওপেট্রা ফিরে এল। ওকে দেখে বিমর্ষ মনে হল। গুরু তান্ত্রিক কী এমন বলল যে ওর মন খারাপ হয়ে গেল!
ও আমার কাছে এসে বলল, ‘চলো।’

আমি বললাম, ‘উনি কী বলল?’

ক্লিওপেট্রা বলল, ‘গাড়িতে বলব। এখন চলো।’

গাড়িতে উঠে বসতেই বললাম, ‘এবার বলো।’

ও বলল, ‘আসলে আহান…।’

‘কী? বলো! ভয় পাচ্ছো কেন?’

ক্লিওপেট্রা মাথা নিচু করে বলল, ‘ উনি বললেন, এখনো শাপ কাটেনি! আমাদের বেবি নিতে হবে। তাহলেই আমি পুরোপুরি অভিশাপ মুক্ত হতে পারব।’

আমি ক্লিওপেট্রার ডান হাতটা আমার বুকের বামপাশে ধরলাম। ‘বোকা মেয়ে! এতে এতো মন খারাপ করার কী আছে? বাচ্চা নিতে হবে তো নিয়ে নেবো! তুমি কি মায়ের কথা ভেবে ভয় পাচ্ছো? মা একদমই ওরকম নয়। মা উল্টো আরো খুশি হবে নাতি-নাতনি পেলে। মা, অহনা দুজনই অনেক খুশি হবে ঘরে নতুন সদস্য এলে।’

ক্লিওপেট্রা আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম।


তিন মাস পর ক্লিওপেট্রা কনসিভ করল।

বাচ্চাটা আমাদের কোল আলো করে আসছে যেদিন শুনলাম সেদিন আমি ঠিক কতটা খুশি হয়েছি সেটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।

সবার ব্যাপারে আমি যেটা ভেবেছিলাম সেটাই। মা খুশিতে একেবারে আত্নহারা হয়ে গেছে। এখন থেকেই নিজ হাতে কাঁথা সেলাই করতে শুরু করে দিয়েছে অনাগত শিশুর জন্য। অহনাও প্রচন্ড খুশি। বলে কি না রোজ ওর কলেজে যাওয়ার সময় বাচ্চাটাকে কোলে করে নিয়ে যাবে। ওকে ছাড়া এক মূহুর্তও না কি থাকতে পারবে না সে। আমি ওদের কান্ডকারখানা দেখে হাসি। আনন্দ পাই।


আটমাস পর আমাদের ঘর আলো করে একটা পুত্রসন্তান এল।
ক্লিওপেট্রা হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। আমি বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে কাঁদছি। মা আমার থেকে কেড়ে নিয়ে বাচ্চাটাকে কোলে নিয়ে কাঁদতে আরম্ভ করল। অহনা মা’র কোল থেকে একপ্রকার ছিনিয়ে নিল বাচ্চাটাকে। অহনাও ওকে কোলে নিয়ে কাঁদতে শুরু করল। আমরা সবাই কাঁদছি। ক্লিওপেট্রা হাসপাতালের বেডে শুয়ে শুয়ে আমাদের কান্ড দেখছে। বলল, ‘তোমরা সবাই এত খুশি হয়েছ বাচ্চাটাকে পেয়ে? ‘

আমরা তিনজনই হ্যা সূচক মাথা নাড়লাম। আমাদের সঙ্গে হঠাৎ ক্লিওপেট্রাও কাঁদতে আরম্ভ করল।


সকালে ঘুম ভাঙ্গতেই বিছানা ছেড়ে উঠে দেখি বিছানায় ক্বাহাফ নেই। এতো সকালে তো ও ঘুম থেকে জাগেনা! কোথায় গেল আমাদের ছেলেটা! বোধহয় মা নিয়ে গেছে। ড্রয়িংরুমে গিয়ে দেখি কেউ নেই। মা’র ঘরেও মা’কে পেলাম না। অহনার ঘরেও অহনা, মা কেউ নেই। সারা বাড়ি খুঁজতে লাগলাম সবাইকে। কাউকেই পেলাম না!
রান্নাঘরটা বাকি রয়ে গেছে। ওখানে যেতেই দেখলাম, ক্লিওপেট্রা রান্না করছে। আমাকে দেখে পেছন ফেরে মুচকি হাসল।
বিশাল এক পাতিল চুলোয় বসানো। এত বড় পাতিলে ও কী রান্না করছে। দেখার জন্য আমি সামনে গিয়ে উঁকি দিলাম। সাথে সাথে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরল। পৃথিবীটা আঁধারে তলিয়ে গেল যেন। আমাদের ছেলে! আমাদের ছেলে ক্বাহাফকে ক্লিওপেট্রা গরম পানিতে আস্ত সেদ্ধ করছে! আমি চিৎকার করে ক্লিওপেট্রাকে ডাকলাম। ওকে থামাতে চাইলাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে ভয়ংকরভাবে হাসলো। তৎক্ষনাৎ ক্লিওপেট্রার চেহারা মুহূর্তেই বদলে গিয়ে বিদঘুটে হয়ে গেল। কুৎসিত কালো দাতগুলো বের করে বিকৃত হাসি হাসতে লাগল ও।
আমি আবার জোরে চিৎকার করে ওকে ডাকলাম, ‘ ক্লিওপেট্রা! ‘

তারপরই লাফিয়ে ঘুম থেকে উঠে বসলাম আমি। বসে হাঁপাতে লাগলাম। আমাকে এভাবে জাগতে দেখে ক্লিওপেট্রাও লাফিয়ে উঠল। আমাকে ধরে বলল, ‘কী হল আহান? খারাপ স্বপ্ন দেখেছ?’

আমি ক্লিওপেট্রার ওপাশে ক্বাহাফকে শুয়ে থাকতে দেখলাম। আমি বিছানা থেকে নেমে নিচু হয়ে ওর কপালে চুমু খেলাম।
এরপর পুনরায় বিছানায় ফিরে এসে ক্লিওপেট্রাকে জড়িয়ে ধরে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। বললাম, ‘হুম, স্রেফ একটা দুঃস্বপ্ন। ‘

আজ আমাদের ছেলের একবছর পূর্ণ হল। ঘরোয়া ভাবে ওর জন্মদিনটা পালন করা হবে। সকালেই একটা দু’পাউন্ডের কেকের অর্ডার দিয়ে এসেছি। সন্ধ্যায় কেক কাটা হবে।
অফিসে ছুটি নিয়ে বিকেল হবার আগেই ফিরে এলাম আমি। ঘর সাজিয়ে কেক আনতে দোকানে চলে গেলাম। ক্বাহাফের জন্যে গিফট কিনতে হবে। তাই পরিচিত একটা ছেলেকে দিয়ে কেকটা বাসায় পাঠিয়ে দিলাম।

কী কিনবো, কী কিনবো ভেবে ওর জন্য শেষমেশ একটা খেলনা রোবট কিনে নিলাম। ব্যাটারিচালিত রোবট। সুইচ চাপলে হাঁটে। ক্বাহাফ খুব খুশি হবে এটা পেলে।
রাস্তা দিয়ে হেঁটে বাসায় ফিরছি। হঠাৎ পেছন থেকে একটা অতিপরিচিত স্বরের ডাক শুনে থেমে গেলাম।

বাসায় ফিরে কলিংবেল চাপতেই ক্লিওপেট্রা দরজা খুলে দিল। আমি ওর হাতে একটা বেশ বড়সড় সাইজের বাক্স ধরিয়ে দিলাম। ও হেসে বলল, ‘এটা আহানের বার্থডে গিফট? ‘

আমি আমার হাতের ব্যাগ দেখিয়ে বললাম, ‘এই যে ওর গিফট। ওটা তোমার জন্য।’

ক্লিওপেট্রা লজ্জা মিশ্রিত হাসল, ‘আমার জন্য আনার কী দরকার ছিল!’

আমি বললাম, ‘খুলে দেখো।’

ও জিজ্ঞেস করল, ‘এখন?’

‘হ্যাঁ, এখন!’

ক্লিওপেট্রা উৎফুল্ল হয়ে বাক্সটা খুলতে লাগল। বাক্সটা খুলতেই ভেতর থেকে মিথি লাফিয়ে বেরোলো।

সঙ্গে সঙ্গে ক্লিওপেট্রার মুখ কালো হয়ে গেল। আমি ভ্রু নাচিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কেমন লাগল গিফট? ‘

ক্লিওপেট্রা জবাব না দিয়ে চলে যেতে লাগল। আমি ওর হাত ধরে ওকে আটকালাম। বললাম, ‘আমি কতো গাধা তাই না ক্লিওপেট্রা? তুমি যখন বললে তুমিই মিথি তখন সাথে সাথেই সেটা বিশ্বাস করে ফেলেছিলাম। একবার জিজ্ঞেস করারও প্রয়োজন বোধ করিনি। ভেবে নিয়েছিলাম রূপ বদল করতে পারাটা হয়তো তোমার পাওয়ার কিংবা সাইড-এফেক্টস!’

চলবে…

লেখা: #ত্রয়ী_আনআমতা

ক্লিওপেট্রা পর্ব-০৮

0

#ক্লিওপেট্রা
পর্ব- ০৮

রাত পেরিয়ে ভোর হয়ে গেল ক্লিওপেট্রা এখনো এলো না। মা ওর সঙ্গে কী এমন কথা বলছে কে জানে! ও আবার মাকে ওর জীবন কাহিনী এ টু জেড সব বলে দিল না তো! তাহলেই সব শেষ। এ দুঃশ্চিন্তায় বাকি রাতটুকু আমার আর ঘুম হয়নি।

সকাল আটটার দিকে ক্লিওপেট্রা আমার ঘরে এল। ঘরে ঢুকতেই দেখলাম গতকালকের পড়নের এলোমেলো লাল শাড়িটা সুন্দর করে কুঁচি দিয়ে পড়নে। আমার তাকানো দেখে ও বোধহয় কিছু বুঝল। আমাকে বলল, ‘মা পড়িয়ে দিয়েছে।’

আমি অবাক হলাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘রাতে মা তোমাকে ডেকে নিয়ে কী বলল?’

ক্লিওপেট্রা মুচকি হাসল। বলল, ‘তেমন কিছু না। জিজ্ঞেস করল, আমাদের সম্পর্ক কতদিনের।’

‘তুমি কী বলেছ?’

ও বলল, ‘মিথ্যে বলেছি। বলেছি দু’বছরের প্রেম।’

আমি বললাম, ‘মা আর কিছু জিজ্ঞেস করেনি?’

ও হাসল, ‘হ্যাঁ। বলল তুমি কি বিদেশী?’

‘তারপর? ‘

‘তারপর আমি বলেছি হ্যাঁ। উনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন কোন দেশী? আমি বলেছি, মিশরীয়। ‘

‘সবটুকু বলো।’

ক্লিওপেট্রা বলতে লাগল,
‘এরপর মা বললেন, তাহলে তুমি এত ভালো বাংলা কীভাবে বলো। আমি উত্তর দিয়েছি, তোমার সঙ্গে পরিচিত হবার পর শিখেছি। যাতে আমাদের কমিউনিকেশনে কোনো প্রবলেম না হয়।’

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আচ্ছা ক্লিওপেট্রা আমাকে সত্যি করে বলো তো তুমি এত ভালো বাংলা কীভাবে পারো?

ক্লিওপেট্রা লজ্জা পাবার ভঙ্গিতে বলল, ‘এই প্রশ্নের উত্তরটা মা’কে সত্যিটাই দিয়েছি। তোমার সাথে যোগাযোগে যাতে সমস্যা তৈরি না হয় সেজন্যই শিখে নিয়েছিলাম।’

আমি বললাম, ‘এত দ্রুত?’

ও বলল, ‘দ্রুত কই! ছ’মাস লেগেছে পুরোপুরি ভালো করে শিখতে। এখন আমি তোমার চাইতেও ভালো বাংলা পারি।’
বলে ও শব্দ করে হাসলো।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘লিখতে পারো?’

ও জবাব দিল, ‘হুম। সব পারি। একটু পরেই দেখবে।’

‘কী দেখব?’

ও উত্তর দিল না।

আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ‘মা তোমাকে তোমার বাবা-মা’র ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করেনি?’

‘করেছে। বলেছে, তোমার বাবা-মা কী মিশরেই থাকে? আমি বলেছি, তারা আর বেঁচে নেই।
এরপর মা আর কিছু জিজ্ঞাসা করেন নি। আমাকে বলল, এসো ভালো করে শাড়িটা পরিয়ে দেই।’

এরপর ক্লিওপেট্রা আমাকে শাড়িটা দেখিয়ে বলল, ‘দেখো! মা কি সুন্দর করে শাড়িটা পরিয়ে দিয়েছেন! ‘

আমি ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। ও আহ্লাদে আটখানা হয়ে গেল।


সকাল দশটার দিকে মা হঠাৎ আমার ঘরে এসে বলল, ‘আহান জলদি তৈরি হয়ে নে। আর হ্যাঁ আলমারিতে তুলে রাখা একটা সোনালী রঙের নতুন পাঞ্জাবি আছে না? সেটা পরিস।’

আমি বললাম, ‘কেন মা? হঠাৎ পাঞ্জাবি পরতে হবে কেন?’

মা বলল, ‘পরতে বলেছি পরবি। এত প্রশ্ন কীসের?’

বলে মা একমুহূর্ত দেরি করল না। চলে গেল।

আমি মা’র কথামতো তৈরি হয়ে ড্রয়িংরুমে চলে এলাম। সোফার ওপর চোখ পরতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেল। ক্লিওপেট্রা বউ সাজে বসে! ওর পাশে অহনা বসে আছে। অপর প্রান্তে কাজী বসে আছে!

একটা ঘোরের মধ্যে ঘটে গেল সবকিছু। আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই ক্লিওপেট্রার সঙ্গে আমার বিয়েটা হয়ে গেল।

বিয়ে হবার পর থেকেই মা ক্লিওপেট্রার সঙ্গে এমন আচরণ করছে যেন ও মায়ের কত পরিচিত। ক্লিওপেট্রাও মা’র পিছুপিছু ঘুরছে সারাক্ষণ।
আর অহনা তো এক ডিগ্রি এগিয়ে। সারাদিনই ভাবি, ভাবি করতে করতে মুখে ফেনা তুলে ফেলছে। আমাকে কেউই কোনো পাত্তা দিচ্ছে না। না মা, না অহনা আর না ক্লিওপেট্রা!

রাত এগারোটা। আমি সোফায় বসে টিভি দেখছি। অহনা কোত্থেকে তেড়ে এসে বলল, ‘তুই এখানে কী করছিস?’

‘চোখ নেই? দেখতে পাচ্ছিস না টিভি দেখছি?’

অহনা চেঁচিয়ে বলল, ‘আজকে তোর বাসর রাত। আর তুই বসে বসে টিভি দেখছিস! ভাবি সেই কখন থেকে তোর জন্যে বসে অপেক্ষা করছে।’
এরপর মা’কে ডেকে বলল, ‘মা! তোমার ছেলেকে কিছু বলো!’

মা তার ঘর থেকে চিৎকার করে বলল, ‘কি রে আহান কী হয়েছে?’

আমি অহনার কান টেনে বললাম, ‘চুপ! একদম চেঁচাবি না! যাচ্ছি!’

আমার ঘরে ঢুকতেই দেখতে পেলাম রজনীগন্ধা ফুল দিয়ে ঘর সাজানো হয়েছে। ঘরটা ফুলের গন্ধে মোঁ মোঁ করছে।
সাজানো বিছানায় ক্লিওপেট্রা ঘোমটা টেনে বসে আছে। আহারে! বেচারি আমার জন্যে এভাবে কতক্ষণ ধরে বসে আছে কে জানে! আমি ভেতর থেকে দরজা আটকে বিছানায় গিয়ে বসলাম। আমাকে দেখে ক্লিওপেট্রা মাথা তুলে তাকাল। ওকে দেখে আমার ভেতরটা তোলপাড় হয়ে গেল। কোনো মানুষ কি এত সুন্দর হতে পারে! ও কি রূপকথার রাজ্য থেকে উঠে এসেছে আমার ঘরে?

আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে ক্লিওপেট্রা লজ্জা পেল। বলল, ‘এভাবে কী দেখছ?’

‘আমার বউকে।’

‘ইশ!’

ক্লিওপেট্রা বিছানা ছেড়ে নেমে দৌড়ে কোথাও চলে যেতে নিল। আমাকে ঘোরানো হচ্ছে? কোথায় পালাবে ও! আমি ওর হাত ধরে হেচঁকা টানে নিজের কাছে নিয়ে এলাম। ও তাল সামলাতে না পেরে আমার হাত ধরল। আমি ওকে কোলে তুলে নিলাম। ও আমার বুকে মুখ লুকালো। আজ আর কোনো দূরত্ব অবশিষ্ট থাকবে না আমাদের মাঝে!


সকালে ঘুম ভাঙ্গলে দিনের আলোয় জীবনে প্রথমবারের মতো ক্লিওপেট্রাকে আমার পাশে ঘুমোতে দেখলাম। আমার বুকে মাথা রেখে একেবারে জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে। আমি ওর কপালে চুমু খেলাম। ও নড়ে উঠল। ধীরে ধীরে তাকাল। আমি আলতো করে কয়েকবার ওর পিঠ চাপড়ে দিলাম। ও আবার ঘুমিয়ে গেল। আমার হাসি পেল। ঘুমোলে ও একেবারে বাচ্চা হয়ে যায়।

সকালে জাগার পরে আবার কখন ঘুমিয়ে পড়েছি টেরই পাইনি। ঘুম ভেঙ্গে ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখলাম নয়টা বাজে! সর্বনাশ! আজ আর অফিস হয়েছে!

আমি বিছানা ছেড়ে উঠে বসতেই ক্লিওপেট্রা ওয়াশরুম থেকে বেরোলো। চুল ভেজা। গোসল করেছে নিশ্চয়ই। ভেজা চুলে বড্ড মোহনীয় দেখাচ্ছে ওকে। আমাকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুচকি হাসল।
একটা সোনালী পাড়ের কালো শাড়ি পড়েছে ক্লিওপেট্রা। একেবারে বাঙালি নতুন বউদের মতোই দেখাচ্ছে ওকে।
ও একটা শুকনো তোয়ালে নিয়ে চুল মুছতে লাগল। আমি ওর হাত থেকে তোয়ালেটা কেড়ে নিলাম। নিজের হাতে মুছে দিতে লাগলাম ওর ভেজা চুল। ও লক্ষী মেয়ের মতো চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল।


দু’মাস হতে চলল আমাদের বিয়ের। ক্লিওপেট্রার ওপর থেকে ওই ত্রিবিদ্যার প্রভাব অনেকটাই কেটে গেছে। পুরোপুরি নিশ্চিত হবার জন্য ও চাইছে একবার আমেরিকা গিয়ে গুরু তান্ত্রিকের সঙ্গে দেখা করতে। আমিও ওর সাথে একমত। আমি চাইনা এই ফুলের মতো মেয়েটি আর কোনো কষ্ট পাক।
মা’কে সত্যিটা বলা যাবে না। তাই বললাম, আমি আর অহনা হানিমুনে আমেরিকা যেতে চাইছি। মা দ্বিমত করলো না। আমরা স্বীদ্ধান্ত নিলাম আগামীকালই আমেরিকার উদ্দেশ্য রওয়ানা দেবো।


গতকাল আমেরিকায় এসে পৌঁছেছি। একটা লোকাল হোটেলে এসে উঠেছি আমরা। ক্লিওপেট্রা প্রথমে ওদের পুরোনো বাড়িতে উঠতে চেয়েছিল। আমিই নিষেধ করেছি। কতশত ভয়ানক স্মৃতি জমা ওখানে! ওকে আর কখনোই ও বাড়িতে যেতে দেবো না। ওকে রাজি করিয়ে বাড়িটা বিক্রি করে দেবো।

আমরা এখন গুরুতান্ত্রিকের সাথে দেখা করার জন্য বেরোবো। ক্লিওপেট্রা ও ঘরে তৈরি হচ্ছে। মিনিট দুয়েকের মধ্যেই বেরিয়ে এল। দেখলাম এখানেও ওর পড়নে শাড়ি। নীল রঙের একটা শাড়ি পড়েছে। এত সুন্দর দেখাচ্ছে ওকে! চোখ ফেরানো দায়!
আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘আমেরিকা এসেও শাড়ি পড়লে যে?’

ও উত্তর দিল, ‘বরাবরের মতো তোমার ওই মুগ্ধ দৃষ্টি উপভোগ করার জন্য।’

আমি স্মিত হেসে ওর হাত নিজের মুঠোয় নিয়ে নিলাম। ‘চলো।’

চলবে…

লেখা: #ত্রয়ী_আনআমতা

ক্লিওপেট্রা পর্ব-০৭

0

#ক্লিওপেট্রা
পর্ব- ০৭

ক্লিওপেট্রা শোয়া থেকে উঠে বসে আচমকা ওর দু’হাত দিয়ে আমার গাল চেপে ধরল। আমার চোখে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, ‘আমাকে বিয়ে করবে, আহান?’

ঘটনার আকস্মিকতায় আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেলাম। কিছু সময় পেরিয়ে গেল নিরবতায়। আমাকে চুপ থাকতে দেখে ক্লিওপেট্রা অভিমানিনী হল হঠাৎ। মন খারাপ করে বলল, ‘থাক বলতে হবে না। আমি জানি।’

‘কী জানো?’

‘তুমি যে আমাকে বিয়ে করতে চাও না।’

আমি কিছু বললাম না। ও হঠাৎ তড়িৎ গতিতে একদম আমার কাছে চলে এল। হুট করেই আমাকে জড়িয়ে ধরে আমার থুতনিতে চুমু খেয়ে নিল।
এই মেয়ে এমন করছে কেন! প্রত্যেক মুহূর্তে ওর কথা ও কাজ দ্বারা আমাকে স্তম্ভিত করে দিচ্ছে!

ক্লিওপেট্রা আমার বুকে ওর মাথা রাখল। আমি ওকে বাঁধা দিলাম না। ও নিচু স্বরে বলতে লাগল, ‘তুমি আমাকে বিয়ে নাই-বা করলে। তাতে আমার কোনো আফসোস নেই। তোমার দেখা পেয়েছি, তোমার সঙ্গে কথা বলতে পেরেছি, এই যে তোমাকে ছুঁয়ে আছি আর কি চাই! এইতো বড় ভাগ্য! বিয়ে! ওটা তো বামন হয়ে চাঁদ ছোঁয়া হবে! তুমি আমার চাইতে হাজারগুন ভালো মেয়ে ডিজার্ভ করো, আহান।’

কথা শেষ করেই ক্লিওপেট্রা কাঁদতে লাগল। কাঁদতে কাঁদতে আমার হাত খামচে ধরল। নখ বসে গেল তাতে। আমি ওকে সরিয়ে দিলাম না। কাঁদুক। কাঁদলে মন হালকা হয়।

কিছুক্ষণ বাদে ও নিজে থেকেই সরে গেল। সরে বলল, ‘ভোর হয়ে যাচ্ছে ঘুমোও।’

আমি ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ও বলল, ‘আমি যাচ্ছি না। আমি জানি তুমি আমাকে ছাড়া ঘুমুতে পারো না।’

আমি চমকে উঠলাম। ‘কে বলেছে?’

‘কাউকে বলতে হবে কেন? আমি সব জানি। গত এক মাস ধরে দেখছি তুমি ঘুমের ভান ধরে পড়ে থাকো শুধু। আমি এলে তবেই ঘুমাও।’

একটু থেমে ও জিজ্ঞেস করল, ‘এ অভ্যাস কেন বানালে আহান?’

আমি কিছু বলতে পারলাম না। ও আবার বলল, ‘এখন ঘুমাও। কাল থেকে আমি আর আসবো না।’

আমি এবারও কিছু বললাম না। বসা থেকে লেপ টেনে গায়ে দিয়ে শুয়ে পড়লাম। ও পেছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেলাম।

সকালে ঘুম ভাঙ্গলে পাশে ক্লিওপেট্রাকে দেখতে পেলাম না। চলে গেছে বোধহয়। আর আসবে না। আসবে না মনে হতেই আমার বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা হতে লাগল। আশ্চর্য! আমার কেন এমন অনুভব হচ্ছে! ও তো আমার কেউ না! দু’দিনের জন্য এসেছিল। আবার চলে গেছে। এতে তো কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই!

একদিন, দুদিন, তিনদিন করতে করতে সাতদিন চলে গেল। আজ এক সপ্তাহ হয়ে গেল ক্লিওপেট্রা আসে না। মিথিও নিখোঁজ সাত দিন যাবৎ। স্বাভাবিক। কারণ মিথিই তো ক্লিওপেট্রা।
মা মিথির শোকে জর্জরিত। অহনা মিথির লিটারবক্সের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। আর বলে, ‘আহারে! লক্ষী বেড়ালটা এখানে বসে বাথরুম সারতো!’
তখন রাগে আমার গা পিত্তি জ্বলে যায়। দুনিয়াতে মিথির এত কিছু থাকতে ওর লিটারবক্স দেখে ওকে স্মরণ করতে হবে কেন! অহনার বদ স্বভাব। নোংরা কোথাকার!


পনেরো দিন হতে চলল ক্লিওপেট্রা আসছে না। এই পনেরো দিন আমার কতটা ভয়ংকরভাবে কেটেছে বলে বোঝাতে পারব না। যেখানেই যাই ওকে দেখি। সেদিন দেখি ফ্রিজের ভেতর বোতলের ওপর বসে আছে। এটা কখনো সম্ভব! আমি আসলে পাগল হয়ে যাচ্ছি। তারই আলামত এগুলো। ইদানীং আমার মনে হচ্ছে ক্লিওপেট্রাকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না। নির্ঘাত মারা পড়ব।

ওকে ফেরানোর উপায় খুঁজতে লাগলাম। মনে মনে একটা প্ল্যানও এটে ফেললাম। যেই ভাবা সেই কাজ। ফারিয়াকে ফোন করে বললাম, আমি ওর সঙ্গে দেখা করতে চাই। ব্যাপারটা রিস্কি হয়ে যাবে। কিন্তু আপাতত এর চাইতে ভালো উপায় আর মাথায় আসছে না।

সেদিন সারাদিন ফারিয়ার সঙ্গে ঘুরলাম। ওকে শপিং করে দিলাম, ওর সঙ্গে লাঞ্চ করলাম। শেষে এক রিকশা করে ওর সঙ্গে বাড়ি ফিরলাম। ও রিকশায় আমার হাতের ওপর ওর হাত রাখল। আমি মনে মনে হাসলাম।
এতেই কাজ হবার কথা!

রাতে বিছানায় শুয়ে আছি। এখন আর ঘুমের ওষুধ না খেলে ঘুম হয় না। কিন্তু আজ খেলাম না। শুয়ে শুয়ে ক্লিওপেট্রার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। রাত বারোটা বাজল। একসময় ঘড়ির কাঁটা দুটোয় গিয়ে থামল। তবুও ও এল না।
তিনটা বাজতে চলল। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। তবে কি ও আমাকে ছেড়ে একেবারেই চলে গেছে! আমার ভাবনায় ছেদ ঘটালো কারো পায়ের আওয়াজ। আমার বুক ধুকপুক করতে লাগল। তবে কি ও ফিরে এসেছে!
আমি শোয়া থেকে লাফিয়ে উঠে বসলাম। ডিম লাইটের আবছা আলোয় ক্লিওপেট্রাকে স্পষ্ট দেখতে পেলাম। ও দরজার কাছে দাঁড়িয়ে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। দেখে মনে হল ভীষণ মন খারাপ। আমি বিছানা থেকে উঠে গিয়ে একপ্রকার ঝাঁপিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। সঙ্গে সঙ্গেই ও পালটা আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি ওর গাল চেপে বললাম, ‘এতদিন আসোনি কেন?’

ও শান্ত গলায় বলল, ‘আমার তো আসার কথা ছিল না আহান! তুমিই তো আজ বাধ্য করলে!’

আমি হেসে ফেললাম। ‘কী করেছি আমি?’

ও রেগে বলল, ‘কী করোনি বলো! ওই মেয়ে তোমার হাত ধরেছে কেন? তুমি কেন ফোন করে ওকে তোমার সঙ্গে দেখা করতে বলেছ? ও তোমার কী হয়? বলো ওই বদ নারী তোমার কী হয়?’

বলতে বলতে ক্লিওপেট্রা কেঁদে দিল। আমার খুব হাসি পেল। এজন্য কেউ কাঁদে! ওর চোখ মুছে দিয়ে বললাম, ‘বোকা মেয়ে! এজন্য চোখের জল ফেলতে হয়!’

ও বলল, ‘তুমি বুঝবে না ওসব।’

আমি বললাম, ‘কে বলেছে বুঝব না? তুমি ভেবেছ তুমি একাই সবার মনের কথা পড়তে পারো? আমিও পারি।’

‘কী পড়তে পারো তুমি?’

আমি বললাম, ‘এইযে তুমি মনে মনে বলছ, যেভাবেই হোক আমার সঙ্গে তোমার বিয়েটা হয়ে যাক!’

ও চমকে আমার দিকে তাকাল। আমি শব্দ করে হাসতে লাগলাম। আজ যে আমার কি হল! শুধু হাসতে ইচ্ছে করছে!

ও আমাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল। ‘বদমাইশ!’

আমার আরো হাসি পেয়ে গেল। আমি ঘর কাঁপিয়ে হাসতে লাগলাম।

কিছুক্ষণ পর হাসি থামতেই ওকে বললাম, ‘দু’মিনিট দাড়াও। আমি আসছি।’

আলমারি থেকে ওর জন্যে কেনা সেই লাল শাড়িটি নিয়ে এলাম। ওর হাতে দিয়ে বললাম, ‘এটা একটু পরে আসবে, প্লিজ?’

ও আমার হাত থেকে শাড়িটা নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল। আমি ঘরে আলো জ্বালিয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম।

পাঁচ মিনিট পর ক্লিওপেট্রা ওয়াশরুম থেকে বেরোতেই দেখলাম, শাড়িটা ঠিকমতো পরতে পারেনি। শুধুমাত্র গায়ে কোনোরকম ভাবে পেঁচিয়ে রেখেছে। বেচারির জন্য আমার মায়া লাগল। তবুও আমাকে না করেনি।
এই এলোমেলো প্যাঁচানো শাড়িতেই ক্লিওপেট্রাকে অপ্সরীর মতো দেখাচ্ছে। লাল শাড়িটা গায়ে একদম মানিয়ে গিয়েছে। মনে হচ্ছে এর কারিগর যেন ওর কথা চিন্তা করেই শাড়িটাকে তৈরি করেছে।

ক্লিওপেট্রা আমার সামনে এসে বলল, ‘স্যরি! ঠিকভাবে পড়তে পারিনি।’

আমি কিছু বললাম না। হাটু গেড়ে ওর সামনে বসে পড়লাম। এরপর ডায়মন্ডের আংটিটা ওর সামনে এগিয়ে দিয়ে বললাম, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি ক্লিওপেট্রা! প্লিজ আমাকে বিয়ে করবে?’

ক্লিওপেট্রা আমার সামনে বসে আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘কেন করবো না! একশো বার করবো। হাজার বার করবো। তুমি চাইলে কোটি কোটি বারও বিয়ে করবো!’

আমি ওর থুতনি ধরে মুখ উঁচু করে ওর কপালে চুমু খেলাম।

ঠিক সে সময়ে দরজা ঠেলে মা, অহনা ভেতরে ঢুকে পড়ল।

আমি, ক্লিওপেট্রা দুজনেই বসা থেকে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে পরলাম। নিজেই নিজেকে লানত দিতে থাকলাম কেন যে দরজাটা না আটকে ভিজিয়ে রেখেছিলাম!
মা ক্লিওপেট্রাকে দেখে আবার অজ্ঞান হয়ে গেল। আমার আগেই দৌড়ে গিয়ে ক্লিওপেট্রা মা’কে গিয়ে ধরল। মা’র হাত ধরে বলতে লাগল, ‘ও মা তোমার কী হলো! আমার দিকে তাকাও মা!’

আমি, অহনা দুজনেই অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। ও উঠে কোথায় যেন চলে গেল। ফিরে এল পানিভর্তি গ্লাস নিয়ে। সামান্য পানি ছিটিয়ে দিতেই মার জ্ঞান ফিরে এল। মা ক্লিওপেট্রার দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। মা’র জ্ঞান ফিরতেই ক্লিওপেট্রা মা ‘কে জড়িয়ে ধরল। মা’র চোখে এবার রাগের পরিবর্তে বিস্ময় দেখতে পেলাম। প্রথম সাক্ষাতেই কোনো মেয়ে যে শত বছরের পূর্ব পরিচিত মানুষের মতো আচরণ করতে পারে তা বোধহয় মা’র জানা ছিল না।

কিছুক্ষণ পর সব স্বাভাবিক হতেই মা ক্লিওপেট্রাকে বলল, ‘তুমি আমার ঘরে এসো। তোমার সঙ্গে আমার কিছু জরুরী কথা বলার আছে।’
এরপর অহনাকে বলল, ‘অহনা ওকে নিয়ে আমার ঘরে আয়।’

অহনা মা’র পিছুপিছু ক্লিওপেট্রাকে নিয়ে মা’র ঘরে চলে গেল। যাবার আগে ক্লিওপেট্রা একবার আমার দিকে পিছু ফিরে তাকাল। আমি বুঝলাম না ওই দৃষ্টিতে কী ছিল। আত্নবিশ্বাস না কি ভয়!

চলবে…

লেখা: #ত্রয়ী_আনআমতা