Sunday, July 13, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1390



বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-১৩

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_১৩

এই লোক আলআবি ভাইয়াকে কি করে চেনে?আমি কি করি তাও জানে।ভাইয়াকে কি বলেছি তাও সে জানে কি করে?সারাদিন কি আমায় ফলো করে? না তাহলে বাসার ভিতরে কিভাবে ফলো করবে?ধুর আমি তো পাগলই হয়ে যাবো ভাবতে ভাবতে।আমি একা কেনো পাগল হবো?সাদু কে নিয়েই পাগল হবো। ওকেও আমার সাথে ভাবিয়ে ভাবিয়ে পাগল বানিয়ে ছাড়ব।যাই হোক, হয় তো আমার বেস্টুই।দুজনের মিল না থাকলে চলে নাকি?ফোনটা নিয়ে সাদুকে দিলাম কল।প্রথমবার রিং হতে হতে কেটে গেলো।দ্বিতীয়বারের সময় দুইবার রিং হতে ফোনটা ধরলো।

–ওই থাকোছ কোন দেশে?এতো সময় লাগে ফোন ধরতে?(আমি)

–চা খাইতেছিলাম। এখন ক।ভার্সিটিতে ঝগড়া কইরা মন ভরে নাই?আরেকটু করবি?(সাদু)

–ঝগড়া পরে করমু।এখন শোন কি হইছে, সকালে যেই লোকরে ভাইবা আলআবি ভাইয়ার মাথায় পানি ঢালছিলাম ওই লোক তো আবারও মেসেজ দিছে।জানছ কি কইছে?(আমি)

–না কইলে জানমু কেমতে?(সাদু)

–আরে আমি যে ভাইয়ার কাছে বইলা দিছি তা ওই লোক জানল কেমনে?আমারে কয় আমি কি এখনো ছোট নাকি।আমি ভাইয়ার কাছে বললাম কেন?আর তো আর সে আলআবি ভাইয়ারেও চেনে।(আমি)

–তোর চিঠি প্রেমিক দেখি তোর সব খেয়াল রাখে। আচ্ছা তোরে মেসেজ দিয়া কয় নাই তুই দিনে কয়বার বাথরুমে যাছ।(সাদু)

ওর কথা শুনে রাগে কটমট করে বলে উঠলাম,,,

–তুই যদি আমার সামনে থাকতি সত্যি সত্যি কইতাছি তোর একটা চুলও আমি রাখতাম না তোর মাথায়।(আমি)

–সরি সরি।বেশি রাগ করিছ না। আচ্ছা সিরিয়াসলি কথা বলি।(সাদু)

–তারমানে এতক্ষণ তুই সিরিয়াসলি আমার কথা গুলা নেছ নাই।(আমি)

–আচ্ছা এখন নিচ্ছি তো।তুই যেই কথাগুলো আমাকে বললি তাতে মনে তো হচ্ছে তোর বাসার কেউই ওই লোকটাকে সাহায্য করছে।দেখ তুই যখন নিয়াজ ভাইয়াকে লোকটার কথা বলছিলি তখন কিন্তু তুই, আমি, নিয়াজ ভাইয়া আর আলআবি ভাইয়া ছাড়া কেউ ছিল না।কমলা আন্টি রান্না ঘরে ছিল।(সাদু)

ওর ভাষার কি হইলো।ওহ তার মানে ও সিরিয়াস ভাবেই কথা বলছে।ওর ভালো গুন হলো সিরিয়াস মোমেন্টে বা সিরিয়াস বিষয় নিয়ে কথা বলতে গেলে ও শিক্ষিত মহিলা হয়ে যায়।আবার আমার মন খারাপের সময়ও শিক্ষিত নাগরিক হয়ে ওঠে। আমি ওকে বললাম,,,

–ঠিক কথা। আমি একটা জিনিস খেয়াল করলাম। লোকটা যখনই আমাকে মেসেজ দেয় তোর খুশির আর শেষ থাকে না।আর তুই ই তো আমার কাছে রকেটের বেগে এসেছিলি যেদিন পানি ঢালাঢালি করলাম।ব্যাপারটা কি দাড়ালো? তুই ই ওই ব্যাটাকে খবর পাঠাছ।(আমি)

–তোর বা* পাঠাই।আমিই তো প্রেম পিরিতি পছন্দ করি না তোরে কোন দুঃখে করামু।আমি কি কইতে চাই শোন তুই।ওখানে ছিলাম আমি। আমি কখনই কাউকে এমন কিছু করতে সাহায্য করবো না।বাকি ছিল নিয়াজ ভাই।সেও তোর আপন ভাই।সে এমন করবে না। আর ছিল আলআবি ভাইয়া। খেয়াল করেছিলি সে কিন্তু চুপচাপ বসে ছিল।আমার তো তাকে নিয়ে ডাউট হচ্ছে। মনে হচ্ছে তার মধ্যে গন্ডগোল আছে। লোকটাও নাকি আলআবি ভাইয়া কে চেনে।(সাদু)

–এতো সিওর কীভাবে তুই? আর আলআবি ভাইয়া তো মোটেও এমন না।তার কি বেনিফিট এগুলো করে?(আমি)

–আরে শোন আমি যখন আজকে বাথরুমে হাগতে বইছিলাম ওইসময় আমার মাথায় আলআবি ভাইয়ার চুপচাপ থাকার বিষয়ডা ধরা পরলো।তুই তো জানছ আমি হাগতে মুততে বইয়া তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে কি হইবো তাও ভাইবা ফালাইতে পারি।আর আমার বাথরুম থট্স বেশির ভাগই মিললা যায়।তোরে যাস্ট একটা লজিক দেখাইলাম।(সাদু)

–ঠিক কইছোস। তোর হাগা মুতার লজিকও মাঝে মাঝে মিললা যায়।(আমি)

–আমার লজিক রে সম্মান দে।(সাদু)

–তোর হাগা মুতার লজিক মাইনষের কাছে কইয়া বেড়াইছ না।তাইলে কয়দিন পর তোরে দেখতে আমার পাবনা যাওয়া লাগবো।(আমি) [গল্পের সুবিধার্থে পাবনা ব্যবহার করা হলো।পার্সোনালি কেউ মাইন্ডে নিবেন না]

–আমার পাশেই তোর সিট রাখতে কমুনে।পড়ে দুইজন একসাথে পাগলাগারদ টা ঘুইরা ঘুইরা দেখমু।(সাদু)

–তোর জামাই রে নিয়া দেখিছ।আমার এতো শখ নাই।(আমি)

–দোস্ত আইডিয়া টা জোস দিছোস।মানুষ জামাই নিয়া কতো জাগায় ঘুরতে যায় আমি আর তুই পাগলাগারদ ঘুরতে যামু।কেমন হইবো?(সাদু)

–বাসায় জানে?(আমি)

–কি?(সাদু)

–তাগো ছোট মাইয়াটা যে পাগল হইয়া গেছে।(আমি)

–তুই তো আছোস কইয়া দেওয়ার লেইগা।(সাদু)

–ফোন রাখ তুই।একটু পর পাগল হইয়া দৌড়াইতে হইবো।(আমি)

সাদুর সাথে কথা বলে ভার্সিটির এসাইনমেন্ট নিয়ে বসেছি। রাত সাড়ে আটটার দিকে ভাইয়া বাসায় আসলো।ভাইয়া এসে বললো,,,

–জুইঁ আজ একটু আগে খাবার দেতো।ব্যস্ত ছিলাম বেশি দুপুরে খাওয়া হয়নিরে।

–ঠিক আছে যাও। ফ্রেশ হও আমি আসছি। (আমি)

রাতে আমাদের সাড়ে নয়টার দিকেই খাওয়া দাওয়া শেষ হলো।ড্রয়িং রুমেই আমি এসাইনমেন্ট নিয়ে বসলাম আর ভাইয়া পাশে তার ল্যাপটপ নিয়ে বসলো।বাবা পুরো বাসা জুরে পায়চারি করছে।রাতে খাবার খেয়ে বাবা বাসার মধ্যেই ১৫-২০ মিনিট হাটাহাটি করে।এমন সময় বাসায় কলিং বেল বেজে উঠলো।বাবা গিয়ে দরজাটা খুলে দিলো।দরজা খোলার শব্দের সাথে সাথেই বাবার হুংকার শোনা গেলো।

–কি চাই তোমার? (বাবা)

আমি আর ভাইয়া দ্রুত দরজার কাছে এগিয়ে আসলাম।দরজায় দাঁড়ানো ব্যাক্তিকে দেখে আশ্চর্য হওয়ার কথা। কারণ দরজায় জায়েফ দাঁড়ানো।তবে তার বেশভূষায় অতিরিক্ত মাত্রায় আশ্চর্য না হয়ে পারলাম না।তাকে আমি এই পর্যন্ত পাঞ্জাবি পরিহিত রূপে কখনো দেখিনি।তাও আবার সাদা। মাথায় একটা সাদা রুমাল বেধে চুল গুলো ঢেকে রাখা।বলা যেতে পারে টুপির বদলে সে রুমাল পড়েছে।তাকে বিধস্ত দেখাচ্ছে ভিষণ।ভাইয়া বাবা কে দরজা থেকে সরিয়ে তেড়ে গিয়ে জায়েফের কলার ধরে বলতে লাগলো,,,

–তোর সমস্যা কি?আমার বোনের সাথে তোর কি?এ বাসায় তোর কি?

ভাইয়া প্রথম কথা গুলো দাঁতে দাঁত চেপে বললেও শেষের কথা টা হুংকার দিয়ে বলে উঠলো।

জায়েফ মাথা নিচু করে এক ক্লান্তি ভরা নিস্তেজ কন্ঠে বলল,,,

–আমি শুধু জুইঁফুল এর থেকে ক্ষমা চাওয়ার জন্য এসেছি।ও আমাকে ক্ষমা না করা অবধি আমি এখান থেকে এক পা ও যাবো না আজ।

ভাইয়া আগের চেয়ে দ্বিগুণ জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,,,

–জুইঁফুল কি হ্যা?জুইঁফুল কি।ওরে জুইঁ বলবি।আর তুই জুইঁ বা বলবি কেন?ওর নামই তুই মুখে নিবি না।

জায়েফ আমাদের সবাইকে চমকে দিয়ে নিয়াজ ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে দিল।নিয়াজ ভাইয়া স্তব্ধ হয়ে ওভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো।আমরা সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি।একজন মানুষ এভাবে কান্না করতে পারে?তার উপর জায়েফ তো একজন পুরুষ মানুষ।ছেলেরাও এভাবে শব্দ করে কান্না করে?নিয়াজ ভাইয়া জায়েফ ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই ধীরে ধীরে পিছিয়ে এসে সোফায় জায়েফ কে বসালো।বাবা বলে উঠলো,,,

–নিয়াজ এই আপদকে বিদায় কর।
আর তুমি।তোমার কি লজ্জা শরম নেই? তোমার জন্য আমার ছেলে মেয়ে এর সাথে সম্পর্ক ভালো নেই। তোমার জন্য আমার ছেলেটা আমার সাথে কথা বলে না।

–জুইঁ তাকে বলে দে এই পর্যন্ত সব তার জন্য হয়েছে।(নিয়াজ ভাইয়া)

এর মধ্যেই জায়েফ ভাঙ্গা গলায় বলে উঠলো,,,

— আমার নিশিকে ওরা একটা বারের জন্য দেখতে দেয় নি।ওরা আমার জন্য একটু অপেক্ষা করলো না কেন? আমাকে ওরা কেন বলল না?

নিশি শব্দ টা শুনে আমি তড়িঘড়ি করে বলে উঠলাম,,,

–মানে?কি বলছেন আপনি?

আমার কথায় তিনি আমার দিকে মাথা তুলে তাকালেন।কান্না করার ফলে তার চোখ ফুলে উঠেছে।ঈষৎ লাল দেখাচ্ছে তার চোখ।তার অবস্থা দেখে, কি হয়েছে তা জানার কৌতূহল বেড়ে চলছে। আজ আমার সামনে অদ্ভুত অপরিচিত এক জায়েফ কে বসা দেখছি।নিয়াজ ভাইয়া বলে উঠলো,,,

–কি বলার আছে বলে বিদায় হও।

–নিয়াজ আমাকে একটু ******কবরস্থানে নিয়ে যাবে?এখন এই মুহূর্তে।(জায়েফ)

জায়েফের কথা বলার সময় স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সে অনেক কষ্টে তার ভিতরে কান্না টা চেপে রাখছে।তার কথা শুনে আমি আশ্চর্যের উপর আশ্চর্য হচ্ছি। নিয়াজ ভাইয়া বলে উঠলো,,,

–তোমার পা আছে তুমি পরিপূর্ণ সুস্থ সবল একজন মানুষ।চলে যাও যেখানে খুশি।

–ভালো নেই আমি। আমি সুস্থ নেই। (জায়েফ)

কথাটা বলেই পকেট থেকে একটা কাগজের মতো কিছু বের করে আমার দিকে উঁচু করে ধরলো।আমি কাঁপা কাঁপা হাতে কাগজ টা আমার হাতে নিলাম।ধরে বুঝতে পারলাম এটা আসলে একটা চিঠি। আমি জায়েফ এর দিকে প্রশ্নসূচক চাহনি দিতেই জায়েফ বলে উঠলো,,,

–একটু পড়বে এটা?

তার কথায় অনুরোধ স্পষ্ট। তার এমন অবস্থা দেখে তার জন্য কিছুটা খারাপ লাগছে।তিনজোড়া চোখ আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর বিলম্ব না করে দুই ভাজের চিঠিটা খুললাম।প্রথমেই চোখে পড়লো ভাঙ্গা হাতে একটু বড় করে লেখা,,,

–“ভালোবাসার জায়েফ”

এরপর নিচের লেখায় চোখ বুলাতে শুরু করলাম।

“এই লেখাটা যখন তোমার অব্দি পৌঁছাবে তখন নিশি নামক মেয়েটার অস্তিত্ব হয়তোবা এ পৃথিবীতে থাকবে না।আবার থাকতেও পারে।বুঝতে পারছো না হয় তো তাই না?বুঝিয়ে বলি একটু।

কেউ কেউ বলে জীবনের গন্ডিটা অনেক বড়। পুরো জীবনটাই তো এখনো পড়ে আছে। এখনো অনেক কিছু দেখার বাকি ।আবার কেউ কেউ বলে জীবনের গণ্ডি টা অনেক ছোট। এই ছোট সময়ের মধ্যেই নাকি অনেক কাজ করতে হয়, অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয়। ছোট জীবনটাতেই নাকি অনেক চাওয়া-পাওয়া পূরণ করে ফেলতে হয়। কিন্তু আমার কাছে তো এর কোনটাই মনে হয় না। কারণ সৃষ্টি কর্তা একেক জনকে একেক জীবনের গণ্ডি প্রদান করেছেন। এরমধ্যে হয়তোবা আমি মাঝারি ধরনের গন্ডিতে পড়ি।

জীবনের অনেকটা অংশ পার করে আসার পরে এখন মনে হচ্ছে আরো কয়েকটা দিন তোমার সাথে কাটানো উচিত ছিল। মনে হচ্ছে আরো কয়েকটা রাত তোমার সাথে ফোনে কথা বলে কাটানো উচিত ছিল। তোমার সাথে হয়তবা আমি ঝগড়া না করলেও পারতাম।তোমাকে প্রতিটা ভোরবেলা ফোন করে জ্বালাতে ইচ্ছে করে। তোমার ঘুম মাখা কন্ঠে ধমক খেতে ইচ্ছে করে।এখন তীব্র ইচ্ছে জাগে তোমার হাতে তৃপ্তি করে কয়েক লোকমা ভাত খেতে। প্রত্যেক বার খাওয়ার সময় হলে তোমাকে ফোন দিয়ে বলতে ইচ্ছে করে বাসার খাবার খাবে ফাস্টফুড খাবে না। বাবাকে ফাঁকি দিয়ে প্রতিটা বিকেল এখন তোমার সাথে লুকিয়ে দেখা করতে ইচ্ছে করে।আমার বার বার হাজার বার বলতে ইচ্ছে করে- ভালোবাসি,ভালোবাসি,ভালোবাসি।ভালোবাসি আর শুধুই ভালোবাসি তোমাকে।

আচ্ছা জায়েফ তুমি কি জানো এখন আমি কোথায়?দাঁড়াও আমি বলছি তোমাকে। বর্তমানে আমি সিঙ্গাপুরের একটা হসপিটালে বিগত পাঁচ মাস ধরে ক্যামো নিচ্ছি। জানো কি ক্যামোটা কেন নিচ্ছি? কারন আমার শরীরে নাকি ব্লাড ক্যান্সার নামক কিছু একটা হানা দিয়েছে। সে আমার শরীরে এসে জানান দিয়েছে আমি নাকি বাঁচবো না। তার জন্যই তো তোমার থেকে দূরে চলে আসা। তোমাকে আমি আসার সময় বলে এসেছি আমেরিকায় চলে যাচ্ছি। নিজের ক্যারিয়ার গড়ার জন্য। দেখো তুমিও সেটাই বিশ্বাস করে নিলে। আমি তোমাকে বলেছি আমার জীবনে সবচেয়ে প্রথমে ক্যারিয়ার তারপর অন্য কিছু। সেটাও তুমি বিশ্বাস করে নিলে। কিন্তু সত্যিটা তো আর এটা না। তোমাকে আমি সত্যিটা জানতে দিইনি বলে তুমি জানোনি।

তোমার সাথে কথায় কথায় ঝগড়া করতাম, খারাপ ব্যবহার করতাম নিজের অনিচ্ছায়। তোমার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিতাম নিজের অনিচ্ছায়। আমি জানতাম আমি তোমার জীবনে ক্ষণস্থায়ী। আমি জানতাম তোমাকে মিথ্যে সুখের আশা দেখিয়ে কোন লাভ নেই। তাই ধীরে ধীরে তোমার কাছ থেকে দূরে সরে আসছিলাম। আমি চাইতাম তুমি আমার অবর্তমানে কাউকে নিয়ে সুখে থাকো। দিনশেষে তুমিও যেন তৃপ্তিময় সুখের হাসি হাসো।

জীবনে আঘাত খুব কমই পেয়েছি। কিন্তু বড় আঘাত পেয়েছি যখন শুনেছি তুমি নাকি বিয়ে করেছ। সেটা তো মেনে নিয়েছিলাম। কারণ আমি তখনই বুঝে গিয়েছিলাম আমি আর বেশি দিন নেই। চেয়েছিলাম তুমি ছোট্ট পরীটার সাথে জীবনটা উপভোগ করো। কিন্তু যখন জানতে পারলাম তুমি আমার জন্য ছোট্ট একটা পরীকে কষ্ট দিয়েছ তখন আরো বেশি আঘাত পেয়েছিলাম। আমেনা আন্টি আমায় সব বলেছে জায়েফ। তুমি যদি ছোট্ট পরীটার কাছ থেকে ক্ষমা না চাও আর ক্ষমা না পাও, তাহলে আমার আত্মা কোনদিন শান্তি পাবে না। ছোট্ট পরী টা কে বলবে আমি অনুরোধ করছি তোমাকে যেন সে মাফ করে দেয়। আমি কিন্তু এটাও জানি তোমাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে।

জানো এই চিঠিটা একটা ওয়ার্ড বয় কে অনেক রিকোয়েস্ট করে তোমার কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছি। বাবা তো কোনোদিনই তোমার আর আমার সম্পর্ক মেনে নিতে রাজি হয়নি। হয়তো বা ভবিষ্যতেও হতোনা। তাইতো ওয়ার্ড বয়ের কাছে হাত জোড় করা।

সারাদিন অনেক মানুষই থাকে আশেপাশে। তাই তোমার সঙ্গে খাতা-কলমে কথা বলতে পারিনা। এখানে এখন রাত। রাত বলেই তো তোমার সঙ্গে এখন কথা বলতে পারছি।জানিনা তুমি কবে পাবে এটা। তবে চিঠিটা পাওয়ার পর যদি আমার শ্বাসক্রিয়া চলতে থাকে, যদি আমার অস্তিত্ব এই পৃথিবীতে থেকে থাকে একটা বার দেখতে এসো? আমি আমার প্রাণ ভরে তোমাকে একটু দেখে নিতে চাই। আমার চোখের শেষ পলক টা তোমাকে দেখে ফেলতে চাই। তোমাকে এখনো অনেক কথা বলা বাকি। তোমার সঙ্গে অনেক ইচ্ছের স্বাদ নেয়া এখনো বাকি। এই বাকিটা বাকিই থেকে যাবে। আরো অনেক লিখতে চাইছি এই মুহূর্তে। কিন্তু লিখতে পারছিনা। শরীরটা কেমন নিস্তেজ হয়ে আসছে। দুর্বলতা গ্রাস করছে আমাকে ধীরে ধীরে। শেষ বেলায় এসে এতোটুকুই বলে যাব-

অনেক ভালোবেসে ছিলাম প্রিয় আজও অনেক ভালোবাসি প্রি

এখানেই সমাপ্ত নিশির লেখা চিঠি। মেয়েটা প্রিয় কথাটাও সম্পূর্ণ লিখতে পারেনি। লেখাগুলো পড়তে পড়তে কখন যে নিজের চোখ দিয়ে পানি ঝরছে বুঝতে পারিনি। চিঠিটার হাতের লেখা শেষের দিকে যাচ্ছেতাই অবস্থা। লেখার মাঝে মাঝে কিছু জায়গায় অক্ষর গুলো লেপ্টে গিয়েছে। সম্ভবত তা চোখের পানি।

চলবে…………

বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-১২

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_১২

কাক ভেজা হয়ে আমি আর সাদু দুজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের সামনে এক তিক্ত মেজাজ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আলাআবি। ভাইয়া হাতে তার ভেজা কালো কোর্ট। চশমাটা খুলে তার হাতে নেয়া। চুলগুলো ময়লা পানিতে ভিজে একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা। তার পরনের সাদা শার্ট টারও কিছু অংশ ভিজে গিয়েছে। বলতে গেলে আমরা তিনজনই এখন কাক ভেজা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের পাশেই সোফার উপর বসে নিয়াজ ভাইয়া হাত-পা ছুঁড়ে হাসাহাসি করতে করতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

কিছুক্ষণ আগে,,,

ময়লা পানি গুলো ফেলে যখন তৃপ্তির হাসি হাসছিলাম। তখন পরিচিত কন্ঠের চিৎকারে বারান্দা দিয়ে নিচে তাকালাম। নিচে তাকিয়ে আলআবি ভাইয়া কে দেখার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। তাকে দেখেই এখন বোঝা যাচ্ছে তার রাগ ১০৪ ডিগ্রি হয়ে আছে। আলআবি ভাইয়ার মুখের ভাব ভঙ্গি দেখে আমার মুখের হাসি নিমিষেই উধাও হয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে মনে আর একটা প্রশ্ন জেগে উঠলো। এই মুহূর্তে আলআবি ভাইয়া আমাদের বাসার নিচে কি করছে? আমার অবস্থা দেখে সাদু এগিয়ে এসে নিচে তাকালো। ও বলল,,,

–ঠিক হইছে এক্কেবারে ঠিক হইছে। অতি চালাকের গলায় দড়ি।তোরে কে কইছিল ময়লা পানি গুলি ফিক্কা মারতে?

–হা এখন তো দোষ আমার। তোরে কে কইছিল আমার ফোনটা নিয়ে একেবারে রকেটের বেগে আমার কাছে আসতে। মেসেজ দিছিল থাকতো দেখতে গেলি কেন?(আমি)

সাদু পাল্টা জবাব দেয়ার আগেই আমাদের বাসার কলিং বেল বেজে উঠলো আমরা। দুজনে গিয়ে ড্রয়িং রুমে দাঁড়ালাম। এর মধ্যে কমল আন্টিও দরজা খুলে দিয়েছে। দেখালাম হন্তদন্ত হয়ে আলআবি ভাইয়া বাসায় ঢুকলো। আমাদের দুজনের দিকে এক নজর তাঁকিয়ে সোজা নিয়াজ ভাই এর রুমে গট গট করে চলে গেল। আমি আর সাদু দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে আছি। আসলে কি হচ্ছে বুঝতে পারছি না। ময়লা পানি যেহেতু আলআবি ভাইয়ার উপর পড়েছে সেহেতু তার তো এখন এসে আমাদের একেবারে ধুয়ে দেয়ার কথা। আমাদের কোন প্রকার বকাবকি না করে সোজা ভাইয়ার রুমে চলে গেল কেন? আমরা দুজন কিছু বুঝে উঠার আগেই কেউ আমাদের পানি দিয়ে একেবারে গোসল করিয়ে দিল। ভালো ভাবে লক্ষ্য করে দেখলাম আলআবি ভাইয়া দুই হাতে দুইটা বালতি। যার পানি গুলো এখন আমার আর সাদুর গায়ে গড়াগড়ি খাচ্ছে।

এখন এই মুহূর্তে আলআবি ভাইয়ার সাথে সাদুও আমার দিকে রাগী ভাবে তাকিয়ে আছে। ওর ভাবভঙ্গিতেই বলে দিচ্ছে আমার জন্য আজ এই অবস্থা। হাসতে হাসতে নিয়াজ ভাইয়া বলে উঠলো,,,

–জুইঁ পানি ফালানোর জায়গার কি অভাব পড়ছে? ওর মাথাটাই পাইলি তুই পানি ফলানোর জন্য।

বলেই নিয়াজ ভাইয়া আর একচোট হেসে নিল। তখন আমি নিজেই মনে মনে ভাবছিলাম উনি আবার না সেদিনের মতো বলে বসে “ক্লিন ইট”। আমার মনের ভাবনা শেষ হতে না হতেই আলআবি ভাইয়ার কথা শুরু হয়ে গেল। আমার হাতে তার কোর্ট টা ধরিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন,,,

–ক্লিন ইট!

তার এমন কথায় নিয়াজ ভাইয়ার সাথে সাদুও যোগ দিল।ওদের হাসাহাসি দেখে মনে হচ্ছে আমি মিরাক্কেলের কোনো পার্টিসিপেট আর ওরা দুজন বিচারক। এবার আমার অতিমাত্রায় রাগ উঠে গেলো। আমি কেন তার জামাকাপড় ধুবো? আমাকে দেখে জন্মগত ধোপা মনে হয় নাকি?একবুক সাহস নিয়ে জোর গলায় বলে উঠলাম,,,

— আমি কি আপনার জামা কাপড় ধুয়ে দেয়ার জন্য জন্মগ্রহণ করেছি নাকি?

উনি দ্বিগুন জোরে বলে উঠলেন,,

–তো কি আমার মাথায় পানি ঢালার জন্য জন্মগ্রহণ করেছ?

এবার আমি একটু অনুনয়ের সুরে বলে উঠলাম,,,

–দেখুন এখানে একটু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। আর আপনার মাথায় পানি ঢালার জন্য আমি খুবই দুঃখিত। আই এম সরি!

–তোমার সরি দিয়ে যদি আমার জামা কাপড় শুকিয়ে যেত তাহলে সরি টা একসেপ্টেবল হতো।(আলআবি ভাইয়া)

–আসলে আমি বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম অন্য কেউ। (আমি)

–তা তুমি অন্যের মাথায় পানি ঢেলে বেড়াও কেন? তোমাকে কি কেউ এই চাকরি দিয়েছে নাকি?আজ কতো ইম্পর্টেন্ট একটা মিটিং আছে জানো তুমি?(আলআবি ভাইয়া)

তারপর নিয়াজ ভাইয়া আর আলআবি ভাইয়াকে সব খুলে বলতে লাগলাম। তাদেরকে শুধু লোকটার পাঠানো মেসেজ দেখিয়েছি। নিয়াজ ভাইয়া কে যখন লোকটার পাঠানো সেই বিকেল বেলার মেসেজ দেখালাম তখন হঠাৎ করে ভাইয়ার কাশি উঠে গেল। বুঝতে পারলাম না কি এমন হল যে মেসেজ দেখে তার কাশি উঠবে। ভাইয়াকে ধীরেসুস্থে বসিয়ে সাদু আর আমি পানি খাওয়াতে লাগলাম। তখন হঠাৎ করে খেয়াল করলাম আলআবি ভাইয়ার এসব নিয়ে কোন ভাবান্তর নেই। সে সোফায় বসে আরাম করে মোবাইলে কিছু একটা করছে। এরই মাঝে দ্বিতীয়বারের মতো কলিংবেল বেজে উঠলো। আমি গিয়ে দরজা খুলে দেখি বাবা এসেছে। আলআবি ভাইয়া বাবাকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে পরল। সালাম দিয়ে বললেন,,,

–আঙ্কেল ভালো আছেন?

বাবা হাসিমুখে উত্তর দিল,,,

–আলহামদুলিল্লাহ ভালোই আছি। তোমার কি খবর?তুমি কেমন আছো?

–জ্বী আঙ্কেল আমিও আলহামদুলিল্লাহ ভালই আছি।(আলআবি ভাইয়া)

–তো তুমি এতদিন পরে যে বাসায় আসলে? এর মাঝে আর আসলেনা কেন?(বাবা)

–আঙ্কেল আসলে অফিস আজকে একটা ইমপোরটেন্ট মিটিং ছিল তো তাই নিয়াজের সাথে কিছু ডিসকাস করার ছিল। এজন্য আজ আমরা প্ল্যান করেছি একসাথে অফিসে যাব। রাস্তায় ডিসকাস করতে করতে যেতে পারবো।(আলআবি ভাইয়া)

আলআবি ভাইয়া যতক্ষণ বাবার সাথে কথা বলেছি ততক্ষণ নিয়াজ ভাইয়া সোফায় গোমরা মুখ করে বসে ছিল। তারা দুজন অফিসে চলে গেলে আমি আর সাদু ভার্সিটির জন্য রেডি হয়ে বাসা থেকে বের হয়ে পড়ি। ভার্সিটিতেও আমি আমার সাদু আজকের সকালের এই পুরো ঘটনা নিয়ে সারাক্ষণ ঝগড়া করি। দিনে মানুষের তিনবেলা খাবার যেমন প্রয়োজন আমাদের তিন বেলা ঝগড়া প্রয়োজন। ভার্সিটিতে ক্লাস করে বাসায় এসে দুপুরের খাবার খেয়ে দেয়ে একটু ঘুমিয়ে থাকি।

মাগরিবের নামাজের পর নুডুলস রান্না করে বাবাকে দিয়ে এসে আমি আমারটা আমার রুমে বসে খাচ্ছিলাম। এমন সময় ফোনের মেসেজ টোন বেজে উঠলো। খেতে খেতেই ফোনটা হাতে নিলাম মেসেজ দেখার জন্য।

” আমার বর্ষণ সঙ্গিনী,

তুমি কি এখনো ছোট আছো বলো। এইসব কি ভাইয়াকে বলতে হয়? তুমি যতই ভাইয়াকে নালিশ করো তুমি তো আমার সারা জীবনের #বর্ষণ_সঙ্গিনী হয়েই থাকবে। আর আজকে সকালের কাজটা কিন্তু তুমি মোটেও ভালো করনি ।ওখানে আলআবি ছিল বলেই তুমি বেঁচে গিয়েছ।

তোমার বর্ষণ সঙ্গী ”

চলবে………..

বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-১১

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_১১

–নিজের জামাই মরলেও তো এমনে কান্দে না কেউ।

অনেকটা বিরক্তি নিয়ে কিছুটা ঝাঁঝালো কণ্ঠে ই সাদুকে কথাটা বললাম।অযথাই কথাগুলো ওকে বলি নি।ওর ফেচ ফেচানি কান্নার শব্দ আমার একদম সহ্য হচ্ছে না এখন।কিসের জন্য যে ওকে বাসায় আনার ভুত মাথায় চেপেছিল।

আজকে ভার্সিটি থেকে বাসায় আসার সময় সাদু কে সঙ্গে করে আমাদের বাসায় নিয়ে আসি। আন্টিকে ফোন করে বলে দিয়েছিলাম। প্রথমে আন্টি ওকে আমাদের বাসায় দিতে রাজি হয়নি। কারণ আজকে আমাদের বাসায় থাকবে। কালকে ভার্সিটিতে ক্লাস করে সাদু বাসায় যাবে। আমার অনেকবার বলার পরে ওকে দিতে রাজি হয়েছে।

নিয়াজ ভাইয়ার বিয়ের আর অল্প কয়েকদিন বাকি। আজকে ভাইয়া বিয়ের কার্ডের স্যাম্পল রাতে অফিস থেকে আসার সময় নিয়ে আসবে। তাই সাদুকে আমাদের বাসায় আজ রাত থাকার জন্য নিয়ে এসেছি। ওর পছন্দ আবার অনেক ভালো। তার ওপর ও আমাদের সাথে শপিং-এ যায় নি। শপিং দেখানোর উদ্দেশ্যেও ওকে আজ বাসায় নিয়ে এসেছি।

ভার্সিটি থেকে আমরা দুজন বাসায় ফিরে লাঞ্চ করে একটু রেস্ট নিয়ে বিকেলের দিকে বারান্দায় মুভি দেখতে বসে ছিলাম। আবহাওয়া টা ভালই ছিল। এখন প্রায় দিন ই বিকেলের দিকে আকাশে মেঘের দলেরা হানা দেয়। আজকেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।সাদু আর আমি একটা তামিল মুভি দেখছিলাম। মুভির থিমটা কিছুটা এমন ছিল–” গল্পের নায়ক নায়িকা তখন টিন এজের ছিল। দুজন একই স্কুলে পড়তো। তাদের বন্ডিংটাও খুব ভাল ছিল।তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটা ধীরে ধীরে ভালোবাসার বন্ধনে রূপ নেয়। কিন্তু কেউ কাউকে বলতে পারেনি তাদের ভালোবাসার কথা। তারা যখন কলেজ লাইফে ওঠে দুইজন দুই দিকে চলে যায়। আর সেখান থেকে তাদের দূরত্ব বাড়তে থাকে। তারপর যখন তারা আস্তে আস্তে বড় হতে থাকে একপর্যায়ে তাদের কোন যোগাযোগই থাকেনা। এর মাঝে নায়ক একদিন তাদের সেই পুরোনো স্কুলে যায়। সেখানে তার পুরোনো বন্ধুদের কথা মনে পড়ে। আর এরপর একটা রিইউনিয়নে নায়ক নায়িকাদের আবার দেখা হয়। কিন্তু ততদিনে নায়িকার জীবনেও অন্য একজন এসে পড়ে। মানে নায়িকার বিয়ে হয়ে যায়। নায়ক-নায়িকার দেখা হয়, তাদের পুরনো স্মৃতির কথাও তাদের দুজনের মনে পড়ে, দুজনে খুব ইমোশনাল হয়ে পড়ে এবং নায়িকাটা অনেক কান্না করে। এরপর নায়িকাকে তার নিজের স্বামীর কাছে আবার চলে যেতে হয়।”

এখন সেই নায়িকার শোকে আমার প্রাণ প্রিয় বান্ধবী ও শোকাহত। অবশ্য আমারও খারাপ লেগেছে। চোখে পানি একটু ছল ছল করছিল। কিন্তু ওর মতন মরা কান্না জুড়ে দেই নি। ওকে আমি আবারো জোর গলায় বলে উঠলাম,,,

–প্রেম পিরিতি তো জীবনেও করছ নাই। এত কান্না আসে কই থেকে তোর?

— এইসবের জন্যে কি প্রেম পিরিতি করা লাগে। দেখলেই তো কষ্ট লাগে। ক্যামনে মাইয়াডা কানতাছে।(সাদু)

— ওই নায়িকা কান্দে তার নায়কের জন্যে। তুই কোন নায়ক এর জন্যে কান্দোছ।(আমি)

–যা সর।তুই বুঝবি না এগুলা।(সাদু)

–আচ্ছা আমারে একটু সত্যি কইরা কতো কার প্রেমে পড়েছোস?(আমি)

–আমি আবার কার প্রেমে পড়তে যামু?(সাদু)

— আমার মনে হইতাছে তুই কারো প্রেমে পড়ছোস। কারণ তোর মধ্যে গুন্ডি গুন্ডি ভাবটা দেখতাছি দিন দিন লোপ পাইতাছে।(আমি)

–তোর মাথা পাইতাছে।(সাদু)

এরপর সাধু দ্বিগুণ উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠলো,,,

–ওই তোর চিঠি প্রেমিক কি আর কোনো চিঠি দেয় নাই? আমার কিন্তু চিঠিটা পড়তে অনেক ভালো লাগছে।(সাদু)

–ভালো লাগলে বইসা বইসা ওই চিঠি গুইলা খা তুই।(আমি)

–আরে বা* কছ না।আর চিঠি দেয় নাই?(সাদু)

–হ।কালকে বিকালে বই পড়তে ছিলাম তখন একটা মেসেজ দিছিল-

“প্লিজ চুলগুলো একটু বেঁধে নাও। না হলে আমি আর পারছিনা। তোমার খোলা এলোমেলো চুলগুলো ছুঁয়ে দিতে এতটা ইচ্ছে করছে যা তোমাকে বলে বুঝাতে পারব না।

তোমার বর্ষণ সঙ্গী”

সাদু অনেক টা ভাবুক হয়ে বললো,,,

–ও মা সব রাইখা তোর চুল ধরতে মন চাইলো কে?

–কেন আমারে জড়াইয়া ধরতে চাইলে কি খুশি হইতি বেশি?(আমি)

— আরে ধুর। আমি তো তোর কয়ডা কালা চুল ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাইনা। ওই ব্যাডায় কি দেখল তোর চুলে?(সাদু)

–আমারে জিজ্ঞেস করছ কেন?আমি জানি?আর তুই ওই লোকরে নিয়া পইরা আছোস কে?কিরে এমন ছিলি না তো।হইলো কি তোর?(আমি)

–হয় নাই হইবো।একটা পোলা একটা মাইয়া।(সাদু)

–ওওও তলে তলে এতো দূর।(আমি)

রাতে ভাইয়া কার্ড নিয়ে আসে আমাদের আপন আত্মীয়-স্বজন কম হলেও আশে পাশের মামাতো,চাচাতো আত্মীয়-স্বজনের অভাব নেই। আমাদের গ্রামের বাড়িটা মফস্বল শহর আর গাছপালায় ঘেরা গ্রামের মাঝামাঝি। অর্থাৎ একেবারে গ্রামের ভিতরেও না আবার মফস্বল শহরে ও না। তবে তাসফি আপুদের বাড়ি মফস্বল শহরে। ওখানে মফস্বল শহরে একটা কমিউনিটি সেন্টার আছে। সেখানেই মূলত নিয়াজ ভাইয়ার বিয়েটা হবে। আমরা বসে বসে কার্ড গুলো দেখছিলাম। তখন সাদু বলে উঠলো,,,

–নিয়াজ ভাইয়া? তাসফি আপুকে একটা ভিডিও কল দিলে কেমন হয়? তাসফি আপুরো কিন্তু একটা পছন্দের ব্যাপার আছে।

একথা শুনে আমিও বলে উঠলাম,,,

–হ্যাঁ ভাইয়া।তাসফি আপু কে ভিডিও কল দেও।

–আচ্ছা দাঁড়া মোবাইলটা নিয়ে আসি।( নিয়াজ ভাইয়া)

ভাইয়া ভিডিও কলে কথা বলতে বলতে আমাদের কাছে আসলো। আপুর পরীক্ষা বলে বেশি সময় কথা বললাম না আমরা। শুধু তাসফি আপুকে কার্ড গুলো দেখালাম। আপু বলল আমাদের যেটা পছন্দ হয় সেটাই যেন ছাপাই।

কার্ড পছন্দ করে আরও কিছু সময় আমরা কথাবার্তা বলে ডিনার করে ঘুমাতে চলে আসলাম। ঘুমানোর সময় হল আরেক সমস্যা। আমার খাট খুব বেশি একটা বড় না। দুজন মানুষ ঘুমানো যায়। তবে ঘুমাতে গেলে একজনের সাথে আরেকজনের স্পর্শ লাগবে।

— ওই তোর এইটুকুন খাটে আবার তোর জামাইরে আনছোস কেন?(সাদু)

–কি?(আমি)

— মানে কোলবালিশ দিসছ কেন মাঝখানে?(সাদু)

— কেন তুই মনে হয় জানছ না ঘুমানোর সময় কারো হাত পা আমার গায়ে লাগলে আমার ঘুম হয় না।(আমি)

— তোর জামাইয়ের কাছে কইয়া দেখিছ। তোরে ফুটবলের মত লাথি মাইরা ফালায় দিবো ঘরের থেকা। (সাদু)

— জামাই বানাইলে তো ফালাইবো।(আমি)

–যা এখন এই তুলার বস্তা সরা।(সাদু)

–আমি জানি তোর ঘুমাইতে ঘুমাইতে মানুষের শরীরে উইঠা যাওয়ার রোগ আছে।তাই এমনেই ঘুমাবি(আমি)

–জীবনেও না।(সাদু)

–জীবনেও হ(আমি)

–না না না (সাদু)

–হ হ হ(আমি)

এমন যুদ্ধ করতে করতে শেষ মেশ সাদু আর না পেরে ওভাবেই শুয়ে পরলো। আমিও সুন্দর করে মাঝখানে কোলবালিশ দিয়ে শুয়ে পড়লাম।

সকালে উঠে দেখি আমার কোলবালিশ বারান্দার দরজার সামনে। আর আমি কোলবালিশের জায়গায়। সাদুর বাম পা খাটের নিচে অর্থাৎ ফ্লোরে। ডান পা টা খাটের উপর এবং দুহাত দুদিকে ছড়ানো। মূলত ওর একটা হাত আমার মাথার কাছে এসে লাগার ফলে ঘুমটা ভেঙে গিয়েছে। উঠে পুরো বাসায় একটু হাটাহাটি করলাম। তখন হঠাৎ ভাইয়া দরজা খুলে এসে সোফায় বসে পরলো। আমাকে দেখে বলল একটু তাড়াতাড়ি বের হবে। আজ একটা মিটিং আছে। আমি রুমে এসে ফ্রেশ হয়ে সাদুকে উঠানোর জন্য গুঁতোগুঁতি শুরু করলাম। ও আমার সাথে থাকলে আমরা সারাদিন ঝগড়া করি। কিন্তু সাথে থেকেও যদি ঝগড়া না করতে পারি তাহলে ভালো লাগেনা। তাই ওকে উঠানোর জন্য ওর হাত পা ধরে টানাটানি করছি। অনেক টা বিরক্তি নিয়ে সাদু ঘুম থেকে উঠলো। ওকে ঠেলে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিলাম। এমন সময় দরজায় কলিং বেল বেজে উঠলো। খুলে দেখি কমলা আন্টি এসেছে। সচরাচর আন্টি এত সকালে আসে না। আরেকটু পরে আসে। আন্টি এসে প্রতিদিন না করা সত্ত্বেও ঘর মুছে দিয়ে যাবে। মাঝে মাঝে নাস্তাও বানিয়ে দিয়ে যায়।

আমি নাস্তা বানাচ্ছিলাম আর কমলা আন্টি ঘর মুচ্ছিল। তখন সাদু আমার ফোনটা নিয়ে দৌড়ে আমার কাছে আসলো। এমন দৌড় দিয়েছে যে মনে হয় ওকে অলিম্পিকে দিলেও এতো স্পিডে ও দৌড় দিতো না।ও রান্না ঘরে এসে বলল,,,

–এই দেখ তোর চিঠি প্রেমিক হাজির।

ওর থেকে মোবাইল নিয়ে দেখলাম একটা মেসেজ এসেছে –

“তোমার বাবার বারান্দায় একটু আসো। কয়েক দিন একটু বিজি থাকব। তাই আমার বর্ষণ সঙ্গিনীকে দেখতে পাবো না। আর আমি জানি তোমার বাবা এখন ঘরে নেই তিনি বাইরে হাঁটতে বের হয়েছেন। তাই এখন একটু আসো।

তোমার বর্ষণ সঙ্গী”

এরকম একটা মেসেজ দেখে আর আমার সামনে সাদুর বত্রিশ পাটি দাঁত এর হাসি দেখে মোবাইলের ভলিউম বাড়ানোর মত আমার রাগও তরতর করে বেড়ে গেল। সামনেই চোখে পরলো কমলা আন্টি উইপার দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘর মুচ্ছে। পাশেই ঘর মোছা ময়লা পানির বালতি। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে বালতি টা পানিসহ হাতে নিয়ে ছুটলাম বাবার রুমে। আমার পিছনে পিছনে সাদুও আসলো। বাবার বারান্দায় যেতেই দেখলাম বান্দা বরাবর নিচে কেউ একজন কালো স্যুট প্যান্ট পড়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মাথাটা নিচু করে মোবাইলে কিছু একটা করছে। তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না। দেরি না করে বালতি টা উঁচু করে সব পানি গুলো দিলাম ফেলে। পানি ফেলে মনের মধ্যে যে এত আনন্দ হচ্ছে তা বলে বোঝানোর মতো না।মুখে চওড়া একটা হাসি নিয়ে সাদুর দিকে তাকালাম। ঠিক তখনই নিচ থেকে কেউ চেঁচিয়ে বলে উঠলো,,,

–ইডিয়েট! স্টুপিড! এই মেয়ে এই!

চলবে…………..

বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-১০

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_১০

–জুইঁফুল!

জায়েফ কেমন যেন এক কাতর কন্ঠে বলে উঠলো।

হ্যাঁ।জায়েফ ই কল করেছে।আমি আগে থেকেই ধারণা করে রেখেছিলাম সে আমাকে অবশ্যই বিরক্ত করবে।নিয়াজ ভাইয়ার রাতের কথাগুলো কেও ভালো করে মাথায় ঢুকিয়ে নিয়েছি। কোন প্রকার ভঙ্গিমা না করেই তাকে সোজাসাপ্টা উত্তর দিলাম,,,

–জ্বী বলুন।আমি শুনছি।

সে পূর্বের ন্যায় বলল,,,

–আই এম রিয়েলি সরি।

আমি তাকে কঠিন গলায় জবাব দিলাম

–কিসের জন্য?

–আমার করা অন্যায়ের জন্য।(জায়েফ)

–যেই আমি সামান্য আঘাতটুকু ভুলতে পারি না,সেই আমি কি করে একটা জ্বলজ্যান্ত মানুষের দেয়া আঘাত ভুলে যাবো?(আমি)

— তুমি আমাকে তার বদলে আঘাত দাও, শাস্তি দাও। আমি হাসিমুখে সব মেনে নিব।(জায়েফ)

— একদমই না। আমাকে আপনার মত ভেবে থাকলে আপনি ভুল করছেন। খুনের বদলে কখনোই খুন হয় না, আমার মতে। আমাকে আঘাত দেয়ার কারণে আপনাকে আঘাত দিলে আপনার আর আমার মধ্যে পার্থক্য রইল কোথায়।(আমি)

— ঠিক আছে। তাহলে অন্যায়ের তো শাস্তি হয় তুমি আমাকে না হয় শাস্তিই দাও।(জায়েফ)

— এত করে যখন আপনি শাস্তি চাচ্ছেন তাহলে শুনে রাখুন – আমি আপনাকে কখনো ক্ষমা করতে চাইনা। হয়তোবা কখনো ক্ষমা করতে পারবও না। আর এটাই হবে আপনার শাস্তি।(আমি)

— জুঁইফুল তুমি এটা বলতে পারলে? (জায়েফ)

–হ্যাঁ পারলাম। কারণ আপনি যদি জেনে শুনে অন্যায় করে বলতে পারেন আপনি অন্যায় করেছেন এখন আপনি ক্ষমা চাচ্ছেন তাহলে আমিও বলতে পারি। শুনে রাখুন আপনি আমার অতীত। অতীত কে আমি অতীতই রাখতে চাই। আর আমি বলে দিয়েছি আপনার শাস্তি কি তাই দয়া করে আমাকে আর বিরক্ত করবেন না।(আমি)

আর এক মুহূর্তের জন্যেও কথা না বাড়িয়ে ফোনটা কেটে দিলাম। মোবাইলটা বালিশের উপর রেখে বিছানায় নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলাম। আজ মনে হচ্ছে আমারও আম্মু থাকলে বুঝি এরকম টা হত না। আজ আমারও আম্মু থাকলে তার কোলে মাথা রেখে নিশ্চিন্তে তাকে আমার সব দুঃখ, কষ্ট,বেদনার অংশ ভাগ করতাম। আজ আমারও আম্মু থাকলে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে প্রতিরাতে এক নিশ্চিন্তময় ঘুমের রাজ্যে পাঠিয়ে দিত।

আজ মনে হচ্ছে এই এক শব্দের মা নামক ব্যক্তি টা থাকলে বুঝি সব অসম্ভবই সম্ভব হয়ে যেত। মা নামক ছোট্ট শব্দের মহান ব্যক্তির মাঝে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা’ নিহিত থাকে। যে ভালোবাসা মা ছাড়া পৃথিবীর আর অন্য কোনো ব্যক্তির কাছেই থাকে না। এখন মনে হচ্ছে চিৎকার করে বলি আমারও কেন একটা মা নেই। হাটুর উপর বালিশ রেখে মুখ গুঁজে অঝোর ধারায় কান্না করে যাচ্ছি।

অনেকটা সময় পর নিজেকে একটু স্বাভাবিক করে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসলাম। ওয়াশ রুম থেকে বের হয়েই বিছানার উপর সেই বক্সটা চোখে পড়ল। বক্সের পাশে গোলাপ ফুলটা পড়ে রয়েছে। বিছানার উপর আরাম করে বসে বক্সটি খুলতে লাগলাম। মনের মাঝে হাজারো প্রশ্নের পাহাড় জমে গিয়েছে। বক্সটা কে রাখল? বারান্দায় কে দিল বক্স টা? সত্যিই কি আমার জন্য? নাকি অন্য কারো? ধুর! অন্য কারো হবে কেন? আমার বারান্দায় রেখেছে অবশ্যই আমার জন্য হবে।

বক্সটা খোলার সাথে সাথে বেলি ফুলের মাতাল করা ঘ্রাণ আমার নাকে এসে ধাক্কা দিল। দেখালাম বক্সের ভিতরে একটা বেলি ফুলের মালা। মালাটার নিচে কাগজে লেখা কিছু একটা গুঁজে দেওয়া হয়েছে। বেলীফুল দেখে মনটা আনন্দে একেবারে বাকবাকুম হয়ে গেল। বেলি ফুল আর তার ঘ্রাণ আমার সবচেয়ে প্রিয়। আমার বারান্দায় অবশ্য বেলি ফুলের গাছও রয়েছে। ফুল টার নিচে একটা হালকা আকাশী রঙের শাড়ি ও দেখা যাচ্ছে। শাড়ীটায় হাল্কা আকাশী রঙের সাথে হালকা গোলাপি রঙের পাড় রয়েছে। শাড়িটার ভেতরের অংশে ও হালকা গোলাপী রঙের স্টেপ রয়েছে। সাথে আরও দেখতে পেলাম একটা এন্টিকের কোমর বন্ধনী। এটাকে হয়তোবা কোমর বিছাও বলে থাকে। এতক্ষণে আমার চোখ পড়ল কাগজ টার দিকে। যেখানে গোটা গোটা অক্ষরে কিছু একটা লেখা রয়েছে। কাগজটা নিয়ে পড়তে শুরু করলাম।

“আমার #বর্ষণ_সঙ্গিনী,

তুমি কি জানো তুমি যে নিজের অজান্তেই কত বড় একটা ভুল করে বসে আছো? তুমি কি জানো তুমি যে তোমার নিজের অজান্তেই আমার হয়ে গেছো? তুমি কি জানো তোমার সুবাস যে শুধু আমার জন্যই? তুমি কি জানো তোমার ওষ্ঠদ্বয় এর নিচের ঈষৎ গর্তে কতটা মাদকতা জড়িত? তুমি কি জানো তোমার হরিণী আঁখিদ্বয় কতটা বিমোহিত করে আমায়? জানো না তুমি। তুমি এর কোন কিছুই জানোনা।জেনে রাখ, তোমার বেদনাসিক্ত চেহারা আমায় জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে। তোমার চোখের এক এক ফোটা অশ্রু বিন্দু আমার বুকের বা পাশে লাভার ন্যায় গড়িয়ে পড়ে। সব শেষে শুধু এতোটুকুই জেনে রাখ যে, আমার জীবনের #বর্ষণ_সঙ্গিনী শুধু তুমিই হবে। অপেক্ষা শুধু সঠিক সময়ের।

তোমার বর্ষণ সঙ্গি”।

লেখাটা পড়ে মনে হচ্ছে আমার চারপাশ ভোঁ ভোঁ করে ঘুরছে। হায়! হায়! এমন পাগল আবার কোথা থেকে উদয় হল? আমি তো বাঁচি না আমার দুশ্চিন্তায়। তার উপর নতুন পাগলের আমদানি। উফফ কি যে হচ্ছে আমার সাথে। ভার্সিটির ও সময় হয়ে গিয়েছে। তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে সাদু কে বলতে হবে এগুলো।

হালকা-পাতলা কিছু নাস্তা করে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হলাম। সাদু আর আমার একটা নির্দিষ্ট জায়গা আছে। ওখানেই দুজনে একত্রিত হই তারপর একসাথে ভারসিটি যাই। দূরে থেকেই দেখতে পাচ্ছি সাদু দাঁড়িয়ে রয়েছে। মুখে বিরক্তির ভাব একেবারে স্পষ্ট। ওর কাছে যেতেই ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলে উঠলো,,,

–কোন বিমান দিয়া আইছোস তুই?এই জায়গার থেইকা এই জাগায় আইতে এতো সময় লাগে?

–আমি না হয় দেরি কইরা আসলাম। তুই কোন বিমান দিয় এতো তাড়াতাড়ি আইছোস?কি কেসটা কি বাবু?কার লগে দেখা করতে এতো তাড়াতাড়ি বেড় হইছোস?(আমি)

–তোর শশুর এর লগে দেখা করতে আইছি।(সাদু)

–নাউজুবিল্লাহ! ছিঃ!ছিঃ!ছিঃ!আর মানুষ পাছ নাই? শেষ পর্যন্ত বুড়া বেডার লগে দেখা করতে আইলি। বাসায় জানে?(আমি)

সাধু আমার দিকে কটমট করে কতক্ষণ তাকিয়ে হাটা ধরল। ওর পিছন পিছন আমিও হাঁটা ধরলাম। এরপর আমরা দুজন রিক্সা দিয়ে ভার্সিটির সামনে এসে নামলাম। ক্লাসের ফাকে ফাকেই সাদুকে সকালের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বললাম।সাথে জায়েফ এর কথাও বললাম। যে কাগজটায় লেখা ছিল সে কাগজ টা ভার্সিটি আসার সময় সাথে করে নিয়ে এসেছিলাম।সাদুকে সেটাও দেখালাম।

— বাহ! তোর জীবনে তাহলে নতুন দিওয়ানার এন্ট্রি হইলো। ভেরি ইন্টারেস্টিং। আই লাইক ইট।(সাদু)

— বাট আই ডোন্ট লাইক ইট। এইসব দেখলে এখন আমার গা চুলকায়। যাই হোক, আজকের পরে যদি এমন কোন কান্ড আবার ঘটেরে তাইলে দেখিছ সোজা ভাইয়ারে বইলা দিব।(আমি)

— তোর মধ্যে কি কোন রস কস দেয় নাই আল্লাহ। দেখ তোরে কত সুন্দর সুন্দর গিফট দিছে। সামনে আরো দিলে আরো ভালো হইবো। মজা হইবো রে! আমারেও দিছ একটু ভাগ(সাদু)

— আয় তোরা ভাগ দেই।

কথাটা বলেই সাদুর চুল ধরে টানাটানি শুরু করে দিলাম।সাদুও আমার হিজাব ধরে টানাটানি শুরু করে দিলো। মারামারি করতে করতে আমরা যে যার বাসায় চলে আসলাম।

বাসার সামনে এসে আরেকদফা ঝাটকা খেলাম। আমাদের বাসার গেটের সামনে এসে দেখি আলআবি ভাইয়া দাঁড়ানো। মুখমন্ডল তার গম্ভীরতায় ছেয়ে গিয়েছে। তাকে কিছু বলার আগেই সে আমার হাত ধরে গেটের ভিতরে নিয়ে এলো। এরপর এক বাজখাঁই গলায় চিৎকার করে বলে উঠলো,,,

–রাস্তায় কিভাবে চলতে হয় সেই ম্যানার্স টুকুও নেই?

তার এরূপ ব্যবহার দেখে অনেকটা ভড়কে গিয়েছি আবার একটু ভয়ও লাগছে। আমি মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে আবারো জোর গলায় বলে উঠলো,,,

–ভার্সিটিতে কি যাও ঝগড়া করার জন্য?

তার এমন আচরণ আর এমন কথাবার্তার কোন কিছুই আমার কাছে বোধগম্য হচ্ছে না মাথা তুলে তার দিকে কিছুটা প্রশ্নসূচক ভাবে তাকালাম। তার কপালে বিন্দুবিন্দু ঘামের ছোঁয়া রয়েছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে ক্লান্ত অথবা খুব দ্রুততার সঙ্গে কোন কাজ করেছে যার জন্য সে হাঁপিয়ে উঠছে বারবার। আমি তাকে কিছু বলার আগেই সে হন হন করে গেট দিয়ে বের হয়ে বাইকে করে চলে গেল। আজকে আমার সাথে ঘটা আজব আজব কান্ড দেখে মনে হচ্ছে নিজেই পাবনায় টিকিট কেটে চলে যাই।

বাসায় এসে দেখি কমলা আন্টি রান্না করছে। তাকে জিজ্ঞেস করলাম,,,

–আজকে তুমি হঠাৎ রান্না করছো যে? (আমি)

–মনে চাইলো তোমারে একটু রাইন্দা খাওয়াই। ডেইলি তুমিই তো রান্দো।( কমলা আন্টি)

দুপুরে ভাইয়া বাসায় লাঞ্চ করে না। আমি আর বাবাই লাঞ্চ করে থাকি। মাঝে মাঝে কমলা আন্টিও থাকে আমাদের সাথে। দুপুরে খাচ্ছিলাম আমরা। আজকে কমলা আন্টিও আমাদের সাথে খাচ্ছে। তখন বাবা বলে উঠলো,,,

— জুই তোদের সব শপিং শেষ হয়েছে?

— হ্যাঁ হয়েছে তো সব।

এরপর আমাদের মধ্যে আর কোন কথা হল না। ভাইয়া এখনো বাবার সাথে কথা বলে না। ভাইয়াকে অনেক বলেছি যা হওয়ার তা তো হবেই। এখন কথা না বলে লাভ কি? বাবা ও তো এখন কষ্ট পাচ্ছে। সে তো বুঝতে পেরেছে। তখন ভাইয়া আমার প্রশ্নের উত্তর দেয়নি। এড়িয়ে চলে গিয়েছিল।

বিকেলের দিকে সেই বক্সটা আর চিঠিটা সুন্দর করে গুছিয়ে আলমারিতে রেখে দিলাম। ফুল গুলো বাইরেই রাখলাম। রাতে ভাইয়া আসার পরে ডিনার করে একটু বই-খাতায় চোখ বুলিয়ে ভাইয়ার সাথে কিছু সময় গল্প করে ঘুমিয়ে পড়লাম।

এভাবেই রুটিনমাফিক তিন চার দিন চলে গেল। একদিন বিকেলবেলা বারান্দায় বসে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী গল্পটা পড়েছিলাম। হঠাৎ করে ফোনে একটা মেসেজ আসলো। মেসেজটা চেক করতে গিয়েই চমকে উঠলাম। কারণ মেসেজটায় লেখা ছিল,,,

“প্লিজ চুলগুলো একটু বেঁধে নাও। না হলে আমি আর পারছিনা। তোমার খোলা এলোমেলো চুলগুলো ছুঁয়ে দিতে এতটা ইচ্ছে করছে যা তোমাকে বলে বুঝাতে পারব না।”

চলবে……………..

বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-০৯

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_০৯

ভরা মজলিশে আলআবি ভাইয়া যে এমন দুঃসাহসিকতার পরিচয় দিবেন তা আমি কল্পনাতেও ভাবতে পারিনি। আলআবি ভাইয়া আমার ডান হাতের কব্জি ধরে দৌড়াচ্ছেন। আমিও তার পিছনে পিছনে দৌড়ে যাচ্ছি। এমন মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে কেউ পিছন থেকে বলবে “ভাগ সিমরান ভাগ”। এই মুহূর্তে আমার ভেতরের অনুভূতিটাও এমনই হচ্ছে। আমারও মনে হচ্ছে “জিলুঙ্গি আপনি জিন্দেগি”।

কিছুক্ষণ আগে,,,

জায়েফের কণ্ঠ শুনেই ফোনের স্ক্রিন থেকে সামনে দৃষ্টি রাখি। আমার মুখোমুখি হয়ে সামনের চেয়ারটায় বসে আছে জায়েফ। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে নিজেকে লুকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেই আমার সামনে বসে আছে। কারণ এই মুহূর্তে সে চোখে কালো সানগ্লাস পড়ে, মুখে মাস্ক পড়ে, তার হুডি দিয়ে মাথা ঢেকে রেখেছে। তার হাবভাব দেখেই আমি আন্দাজ করতে পারছি চারপাশের উপচে পড়া জনতার জন্য সে এই বেশভূষা গ্রহণ করেছে।

তাকে দেখে না যতটুকু ভয় করছিল এখন তার বলা বাক্যটি শুনে তার থেকে বেশি রাগ হচ্ছে। নিজেকে সংযত করে তাকে বললাম,,,

— আমাকে একদম বোকা ভাববেন না আর বোকা বানাতে ও আসবেন না। আমি জানি আমাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে।

সে তার পূর্বের ভঙ্গিমাতেই আবার বলে উঠলো,,,

–ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। ক্ষমা তো হয়নি।

আমি স্বাভাবিক কন্ঠে তাকে বললাম,,,

–ক্ষমা করার কথা ছিল কোন দিন? আপনার ব্যবহার তো এখনো ঠিক নেই। একটু আগেই আপনি আপনার ভদ্রতার পরিচয় দিয়েছেন।

–আসলে কি বলতো? ফ্লার্ট না করলে একদমই ভালো লাগেনা। এইটুকু অন্তত জানই যে আমি বড় হয়েছি বাইরের দেশে। তোমাদের কালচারের সাথে অভ্যস্ত না।

তার সামনে বসে থাকতে মোটেও ভালো লাগছে না। কিছুটা অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। এমন সময় তড়িৎ গতিতে আলআবি ভাইয়া এসে আমার পাশে ধপ করে বসে পড়লেন। জায়েফ আর আলআবি ভাইয়া দুজন দুজনকে কিছুটা মুহূর্তের জন্য ভাল করে পরখ করে নিলেন। এরপর জায়েফ সবার আগে হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করার উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,,,

–হ্যালো! আমি জায়েফ এহমাদ।

আলআবি ভাইয়া একপলক জায়েফের পানে তাকিয়ে আরেক পলক তার হাতের দিকে তাকালো। এরপর সেও হাত বাড়িয়ে বলে উঠলো,,,

–হায়! আমি আলআবি মাশরুখ।

জায়েফ আলআবি ভাইয়া কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,,,

–চিনেছেন নিশ্চয়ই?

তখন আমি আলাবি ভাইয়ের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। দেখি সে কেমন একটা বিটকেল মার্কা হাসিমুখে ঝুলিয়ে বলল,,,

–না। চিনতে একটু অসুবিধা হচ্ছে। ওয়েট!

কথাটা বলেই আলআবি ভাইয়া একটু দাঁড়িয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে গিয়ে হুট করে জায়েফের মুখের মাস্ক টান দিয়ে নিচে নামিয়ে দিল। সাথে সান গ্লাসটা ও নিয়ে নিলো। হঠাৎ করেই এক বাজখাঁই গলার স্বরে আলআবি ভাইয়া চেঁচিয়ে বলে উঠলো,,,

–ও মাই গড! জায়েফ এহমাদ!

সঙ্গে সঙ্গে উৎসুক জনতার উপচে পড়া ঢল নামলো জায়েফের উপর।সবাই জায়েফ জায়েফ করে চেঁচিয়ে তার দিকে ছুটে আসছে।এমুহূর্তে বেচারার মুখটা দেখার মতো হয়েছে। ঠিক তখনই আলআবি ভাইয়া আমার হাত ধরে আমাকে একপ্রকার টেনে তুলে দৌড়াতে শুরু করলো।আর তখনি আমর সিমরানের কথা মনে পরলো।

একটু আগে আলআবি ভাইয়ার করা কাজটি আমার তখন বোধগম্য না হলেও এখন হচ্ছে।আমরা দুজনে এখন চতুর্থ ফ্লোরে এসে লিফট থেকে নেমেছি।দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দীর্ঘ শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছি।তখন চোখের সামনে ঘড়ি পরিহিত একজনের লোমশ হাত দেখতে পেলাম, যেই হাতে রয়েছে একটা পানির বোতল।হাত অনুসরণ করে দেখি আলআবি ভাইয়া থমথমে মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বোতল টা আমার সামনে ধরে রেখেছেন। তাকে দেখে কেউ উপলব্ধিই করতে পারবে না সে যে একটু আগে এতো বড় কান্ড ঘটিয়ে এলো। পানির বোতল টা নিয়ে ধীরে সুস্থে খেয়ে নিলাম।হঠাৎ আলআবি ভাইয়া বলে উঠলেন,,,

–যেখানে অস্বস্তি হচ্ছিল সেখানে বসে থাকার দরকার কি ছিল?

তার দিকে দৃষ্টি দিতেই দেখি সে প্রশ্নসূচক চাহনিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।সে যে আমার থেকে পাল্টা উত্তর আশা করছে তা আমার বুঝতে বেশি বেগ পেতে হলো না।কিন্তু এমুহূর্তে আমার মাথায় ঘুরছে অন্য ভাবনা।আলআবি ভাইয়া কেনো এমন একটা কান্ড করলেন? তার সাথে যেহেতু আগের থেকে কথাটা এখন একটু বেশি বলি,যেহেতু তার সাথে সহজ হয়ে এসেছি তাই তাকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম।

–আচ্ছা আপনি ওমন কেন করলেন? (আমি)

উনি হতাশাগ্রস্ত এক চাহনি দিয়ে আমাকে বললেন,,,

–যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর!

সে আবারো বলে উঠলেন,,,

–তোমার ছোট মাথায় ঢুকবে না।চলো তোমার ভাই আবার তোমাকে এতোসময় না দেখলে ভাববে তার ফিডার খাওয়া বোন নিয়ে আমি ভেগেছে।

তার এরূপ কথায় আমি রেগে গেলাম।তাকে কটমট করে বললাম,,,

–হ্যাঁ! আমি ফিডার খেলে আপনি এখনো ডায়াপার পরে বেড়ান।

বলেই হনহনিয়ে তিন তলায় চলে গেলাম।একা এসেও পরে গেলাম মুসিবতে।ভাইয়ারা কোন স্টলে বুঝবো কীভাবে? তাই প্রত্যেকটা স্টলেই ঘুড়ে ঘুড়ে ওঁদের খুঁজে বেড়াচ্ছি। হঠাৎ করেই কেউ আমার হাত ধরে সোজা হেটে যাচ্ছে। একমুহূর্তের জন্য মনে হলো আমার কলিজার পানি শুকিয়ে গেছে। কিন্ত হাত ধরে হাটতে থাকা লোকটার পানে তাকিয়ে আলআবি ভাইয়াকে দেখে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।

একটু সামনে এগিয়ে এসে ভাইয়াদের পেয়ে গেলাম।আমাদের দেখে সজল ভাইয়া বলে উঠলেন,,,

–আলুবাবু?ফুডকোর্টের খাবার কি সব একলাই খেয়ে এসেছিস?

কথাটা আমার কর্ণপাত হতেই হাসতে হাসতে আমার গড়াগড়ি খাওয়ার অবস্থা হয়ে গেলো।কথাটা যে আলআবি ভাইয়াকেই বলা হয়েছে তা বুঝে গিয়েছি।আমার সাথে তাসফি আপুও হেঁসে উঠলো। কিন্তু আপু হাসিটা চেপে রাখছে।আমি কোনো মতেই হাসি থামাতে পারছি না।

পরিস্থিতি বেগতিক দেখে নিয়াজ ভাইয়া আমাদেরকে চুপ থাকতে বললেন।কিন্তু আলআবি ভাইয়া কোথায় যেন চলে গেলেন। আমি সজল ভাইয়া কে বললাম,,,

–কি হলো?

সজল ভাইয়া বলতে লাগলো,,,

–ওকে আলুবাবু বললে রাগ করে।আসলে ও ছোট বেলায় খুব স্বাস্থ্যবান ছিল।বুঝই তো ছোট গলুমলু বাচ্চাদের আদর করে সবাই একটু আকটু আলু খালু বলে ডেকে থাকে।ওর বেলাতেও ব্যতিক্রম হয়নি।আমরা ফ্যামেলি মেম্বাররা, কাজিনরা এখনো দুষ্টমির ছলে ওকে আলুবাবু বলে ডাকি।আজকে আসলে ভুলটা আমারই।ওকে কাজিন সার্কেলের বাইরে আলু খালু বলে ডাকতে ও একদম নিষেধ করে দিয়েছে।রাগটা আজকে মনে হয় ও একটু বেশিই করে ফেলেছে।এখান থেকে গিয়ে ওকে সরি বলতে হবে।

–ও তাহলে এই ব্যাপার।আমার হাসাটা উচিৎ হয়নি তাই না?(আমি)

–একক্ষেত্রে উচিৎ হয়নি আবার আরেক ক্ষেত্রে হয়েছে। দেখ তুমি তো আর জানতে না তাই না।আর তোমার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে সেও তোমার মতো রিয়েক্ট করতো।

সব শপিং শেষ করে আমরা মলের বাইরে এসে দেখি আলআবি ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে।নিয়াজ ভাইয়া বলল,,,

–তাসফি ফুচকা খাবে?

তাসফি আপুর আগেই আমি বলে উঠলাম,,,

–হ্যাঁ!হ্যাঁ!হ্যাঁ!অবশ্যই খাব।এগুলো কি আবার বলা লাগে?

নিয়াজ ভাইয়া বলে উঠলো,,,

–এহ ভাব দেখ! মনে হয় যেনো আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছি।

–আমি তো হ্যাঁ ই বললতাম।আমার টা জুইঁ বলে দিয়েছে। একই তো হলো।(তাসফি আপু)

–হ্যাঁ।বলে দিয়ে আমার রোমান্স টাইম স্পয়েল করে দিল।কোথায় আমি একটু বলব “তাসফি ফুচকা খাবে”? তখন তুমি আমার কাছে ওর মতো বাচ্চামো করে লাফিয়ে লাফিয়ে ফুচকা খেতে চাইবে।আর আমি তখন ওই দৃশ্য দেখে আমার মন জুরাবো।আহা!

কথা গুলো বলেই আমার মাথায় দুই আঙুল দিয়ে গুঁতো মেরে বলল,,,

–মাথায় শুধু গোবর ভরা তোর।

আমি সবার প্রতিক্রিয়া অনুধাবন করতে আড় চোখে সবাইকে দেখছি।তখন দেখি তাসফি আপু একটু রাগী রাগী চেহারা করে দেখছে ভাইয়াকে।সজল ভাইয়া তার মুখে মৃদু হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে আর আলআবি ভাইয়া একমনে পারলে মোবাইলের ভিতরে ঢুকে যাচ্ছে। তখন আলআবি ভাইয়া মোবাইলটা পকেটে ঢুকিয়ে বলে উঠলেন,,,

–তোর বাচ্চা বোন কি জানে তার ভাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে রোমান্স শুরু করে দিবে।আর তোর রাস্তায় রোমান্স জাগে কীভাবে ভাই?

আলআবি ভাইয়ার বাচ্চা বলায় তাকে জোড় গলায় বলে উঠলাম,,,

–বাচ্চা কে?

–১৮ বছরের নিচে সকল ছেলে-মেয়ে কে সরকার বাচ্চা বলে ঘোষণা করেছে।আই মিন শিশু বলে।যেখানে তোমার নামও আছে।(আলআবি)

–আর কয়েক মাস পরেই আমার ১৯ হবে।আর ১৮ যেহেতু চলে সেহেতু আমি আর শিশু নই।(আমি)

–মাশাল্লাহ! জানতাম না তো? তাহলে বিয়ে করাই যায়।বয়স হয়েছে। (আলআবি)

তার মুখে এরূপ কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলাম আমি।মুহূর্তের মধ্যেই বিষন্নতা এসে ঝেকে বসলো।বিয়ে নামক শব্দটাই তো আমার জীবন বিষিয়ে তুলেছে। একবার এই শব্দ টার সঙ্গে পরিচিত হয়ে জীবনের এক নিদারুণ অভিজ্ঞতা আর অধ্যায়ের সাথে সাক্ষাৎ হয়েছে। যার স্বাদ দ্বিতীয় বার আর নিতে চাই না।

হঠাৎ আমার সম্বিত ফিরে এলো ভাইয়ার কথায়।

–দয়া করে এখন ফুচকা খেতে চল?

ফুচকা খেতে এসে চুপচাপ শুধু খেয়ে যাচ্ছি। আজ আর ফুচকায় তৃপ্তি বলে কিছু খুজে পাচ্ছি না।দু একবার আলআবি ভাইয়ার দিকে নজর পরেছে।তাকে দেখলাম একটা চেয়ারে বসে কিছুটা ঝুকে মাথা নিচু করে দুই হাতের কনুই দুই হাটুর উপর ভর দিয়ে নিচের দিকে দৃষ্টি রেখে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে।

রাতে বারান্দায় বসেছিলাম তখন ভাইয়া এসে দরজায় নক করে।দরজা খোলাই ছিলো।সচারাচর খোলাই থাকে।শুধু রাতে দরজা বন্ধ করে ঘুমাই। ভাইয়া দরজা খোলা থাকা সত্ত্বেও নক করে আসে।ভাইয়া এসে আমার পাশেই বসে পরলো।

–আজ জায়েফ এসেছিলো আমি জানি।

ভাইয়ার কথায় অবাক করা দৃষ্টিতে তাকালাম।ভাইয়া আবারও বলতে শুরু করলো,,,

–কখনো অতীত আর ভবিষ্যৎ নিয়ে পরে থাকতে হয় না।বর্তামানে তুই কি করছিস তা হলো মুখ্য বিষয়।যখন কেউ একটা জামা পরিধান করে তখন তার ওড়না ঠিক আছে কিনা, পায়জামা ঠিক আছে কিনা, জামাটা আয়রন করা কিনা,জামাটার সাথে কোন ব্যাগ বা হিজাব টা মানাবে তা নিয়ে ব্যস্ত থাকে।জামাটা পরিধানের আগে যেই জামা টা সে পরে থাকে সেটা হয়তো পুড়নো হলে ফেলে দেয় অথবা ধুয়ে আলমারিতে তুলে রাখে।কখনো দেখেছিস সে এক জামার সাথেই দুইটা ওড়না বা দুইটা পায়জামা এক সাথে পরেছে।আবার অপর দিকে সে ভবিষ্যতের জন্য ভালো জামা গুলো তুলে রাখছে।সঠিক সময় সঠিক স্থানেই সেগুলো পড়বে বলে।তোকে কেবল উদাহরণের জন্য জামা দিয়ে বুঝালাম।এখন কতটুকু তুই বুঝেছিস তা তোর ব্যাপার।

ভাইয়ার সাথে আরো কিছুসময় কথাবার্তা বলে ঘুমিয়ে পরলাম।ভোরের দিকে মেঘের গর্জন এসে জানান দিলো বৃষ্টি হচ্ছে।ঘুম ভাঙতেই দেখলাম ঘড়িতে ৫ টা বেজে ১০ মিনিট। বাইরে তুমুল বেগে ঝড় হচ্ছে। নামাজ টা পড়ে খেয়াল করলাম, বৃষ্টির গতি এতই বেশি যার ফলে বৃষ্টির ঝাপটা এসে বারান্দা পেড়িয়ে কিছুটা বারান্দার দরজার সামনের জায়গা টুকু কেও ছুঁয়ে দিচ্ছে। দরজা টা বন্ধ করার জন্য বারান্দার দিকে এগিয়ে যেতেই চোখে পরলো নীল রঙের একটা বক্স।নীল রঙের বক্স বললে ভুল হবে কারণ বক্সটা মুলত নীল রঙের একটা রেপিং পেপারে মোড়ানো। তার উপরে হালকা হলদে রঙের একটা গোলাপ ফুল। গোলাপ টাকে বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। নীল রঙের রেপিং পেপারে মোড়ানো বক্সটাতে ফোঁটা ফোঁটা জল কণা জমেছে। কাছে গিয়ে বক্সটা নিয়ে রুমে এসে পরলাম। বক্সটার উপর কাগজের টুকরোর ন্যায় কিছু একটা লক্ষ্য করলাম।ভালো করে খেয়াল করতেই দেখলাম নীল কালিতে লেখা “বর্ষণ সঙ্গিনীর জন্য”যা বৃষ্টির পানিতে অস্পষ্ট হয়ে আছে।তবে লেখাটা বোধগম্য হচ্ছে।

হঠাৎ করে ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রীনে একটা আননোন নাম্বার ভেসে উঠেছে।নাম্বার টা কিছুটা পরিচিত বলে মনে হচ্ছে। আবার অপরিচিত মনে হচ্ছে। ফোনটা দুইবার বেজে বেজেই বন্ধ হয়ে গেলো।তিনবার এর বার ফোনটা রিসিভ করলাম। ফোনের ওপাশের লোকটার কন্ঠ আমার চিনতে অসুবিধা হলো না। অন্য সময় হলে হয়তো রাগ হতাম বা ভয় পেতাম। তবে আজ আর তেমন কিছু হলো না। আগে থেকেই একটা ধারনা ছিল এমন কিছু হতে পারে।

চলবে…………..

বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-০৮

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_০৮

–এই মেয়ে! বুদ্ধিশুদ্ধির ছিটেফোঁটাও নেই? মাথায় কি নিয়ে চলো?

কিছুক্ষন আগে,,,

অনেক সময় নিয়ে ধীরে ধীরে মই বেয়ে উঠে ছাদে উঠলাম।আমাদের ছাদের সিঁড়ি হলো করিডরের শেষ মাথায়। আমরা দুজন গিয়ে নানুর ড্রয়ার থেকে তাসিফা আপুর রিংটা নিয়ে আবারও ছাদে আসি।আগের মতো করেই আলআবি ভাইয়া আগে অর্ধেক মই পর্যন্ত নামেন তারপর তার হাত ধরে আমি নামতে থাকি।যখন আমার নামতে আর তিন ধাপ বাকি তখন আলআবি ভাইয়া খালি পায়ে মাটিতে দাঁড়িয়ে ছিল। তাড়াতাড়ি নামতে পারবো ভেবে মইয়ের তিন ধাপ থেকেই দেই জোড়ে এক লাফ।আমার অতিরিক্ত পাকনামির কারণে আমার পা গিয়ে পরে আলআবি ভাইয়ার পায়ের বৃদ্ধা আঙুলের উপর।

আমার এমন বুদ্ধিমানের মতো কাজের জন্যই বর্তমানে আমাকে পুরষ্কার দেওয়া হচ্ছে।ইশ! বেচারা আসলেই ব্যাথা পেয়েছে।নিজের কাছেই এখন গিল্টি ফিল হচ্ছে। আমি মাথা নিচু করেই বললাম,,,

–সরি ভাই! আমি বুঝতে পারিনি! আই এম রিয়েলি সরি!

তার মুখের ভাব ভঙ্গি দেখেই যে কেউ বলবে সে ব্যথা পেয়েছে একটু আগে।আমিও ঠিকই নিজের করা বোকামি তে উপলব্ধি করতে পারছি লোকটা আসলেই ব্যথা পেয়েছে। তিনি আমাকে আর কিছু বললেন না।

বাড়ির মূল দরজার সামনে তিন ধাপের সিঁড়ি দেওয়া রয়েছে। সেখানে আলআবি ভাইয়া বসে তার জুতোর ফিতা বাঁধতে লাগলেন। ফিতা বাধা শেষ হলে আমার দিকে একবার তার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হন হন করে বাইকের দিকে ছুটে চললেন। আমিও তাকে অনুসরণ করে পিছু পিছু গিয়ে বাইকে উঠে বসলাম। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হল আলআবি ভাইয়া বাইকের স্পিড কমিয়ে চালায়। এতটা স্পিড কমে চালাতে আমি কাউকে দেখিনি। কেবলমাত্র আংটি নিতে আসার সময় একটু দ্রুত চালিয়েছিল

তাসিফা আপুদের বাড়িতে গিয়েও আরেক দফা কথা শুনতে হয়েছে ভাইয়ার কাছে। তাসিফা আপুদের বাড়ি থেকে আমাদের ফিরতে ফিরতে প্রায় রাত ৮ টার মত বেজে গেল। ভাইয়ার বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়েছে আরো একমাস পরে। ভাইয়া নিজ ইচ্ছাতে একমাস পরে তারিখ দিতে বলেছে। তাসিফা আপুর বর্তমানে ভার্সিটিতে পরীক্ষা চলছে।পরীক্ষার মাঝখানে তো আর বিয়ে দেয়া যায় না। তাই অনেক দিনের একটা গ্যাপ নিয়ে বিয়ের তারিখ ঠিক করা হয়েছে।
অতিরিক্ত ক্লান্ত না হলেও সবাই কিছুটা তো ক্লান্ত ছিল। ক্লান্তি বোধ থেকেই অন্যান্য দিনের চেয়ে আজকে একটু তাড়াতাড়ি ঘুমাতে চলে গেলাম।

সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে সুবহা আর জুনায়েদের সাথে বাড়ির পিছনে এসেছি।আমার নানাভাই নিজ হাতে অনেক রকমের গাছ লাগিয়েছেন বাড়ির পিছনে। এখানে অনেক বড় বড় আম গাছও আছে। গাছের নিচে দাঁড়িয়েই দেখা যাচ্ছে গাছে ছোট বড়, মাঝারি ধরনের আম ঝুলে আছে। আমরা তিনজন যখন এখানে হাটাহাটি করছিলাম তখন সুবহা বলে উঠলো,,,

— আপু জানো আমি কিন্তু গাছে উঠতে পারি।

তখন জুনায়েদ বলে উঠলো,,,

–এখানে সবচেয়ে বড় আম গাছে আমি উঠতে পারি।

আমি একটু ভাব নিয়ে ওদের সামনে বলে উঠলাম,,,

–ঘোড়ার ডিম পাড়ছ।তোদের দুজনের থেকে আমি লম্বা বেশি। তার মানে কি হলো? আমি সবচেয়ে উঁচু ডালে উঠতে পারি।

আন্ডা বাচ্চার সামনে ভাব না নিলে হয় নাকি?
জুনায়েদ তখন বাহানা ধরল আমাকে সব চেয়ে উঁচু ডালে উঠতেই হবে। আমাদের তিনজনের কথার মাঝেই কারো অট্টহাসির আওয়াজে পিছে ঘুরে দাঁড়ালাম।দেখি আলাআবি ভাইয়া আর সজল ভাইয়া দুজনের দাঁড়িয়ে হু হা করে হাসছে। তাদের হাসির ধরন দেখে মনে হচ্ছে গিনেস বুকে রেকর্ড করে ছাড়বে আজকে। সজল ভাইয়া হাসতে হাসতে বলে উঠলেন,,,

–তুই ওদের থেকে লম্বা বলে যদি সবচেয়ে উঁচু ডালে উঠতে পারিস তাহলে আমরা দুজন কোথায় উঠবো?

বলেই আবার তিনি আবার অট্টহাসিতে মেতে উঠলেন। তখন আলআবি ভাইয়া কিছুটা তাচ্ছিল্যের স্বরে বলে উঠলেন,,,

–সিরিয়াসলি!!! চাপা মারারও একটা বয়স লাগে। তোমার তো সেই বয়সও হয়নি এখনো। কালকেই আমার দেখা হয়ে গিয়েছে তুমি কত উপরে উঠতে পারো।

তার এমন কথায় রাগ করবো নাকি অপমানিত বোধ করব বুঝতে পারছি না। তবে মনে হচ্ছে এখন রাগটাই বেশি করা উচিত। উনি তো আমাকে ডিরেক্টলিই অপমান করছেন। রাগে কটমট করে আমি বলে উঠলাম,,,

–আপনি এতই যখন উপরে উঠতে পারেন, তাহলে যান আকাশে উঠে বসে থাকুন। যত্তসব!!!

কথাগুলো বলে আমি দ্রুত পায় তাদের দুজনকে পাশ কাটিয়ে বাড়ির ভিতরে ঢুকে পড়লাম।

গ্রামের বাড়ি ভালই আনন্দ করে কাটিয়ে আসলাম আমরা।তবে আলআবি ভাইয়ার একটা জিনিস খুব ভালোভাবে খেয়াল করতে পেরেছে। তা হল এই দুইদিনে উনি নিজে থেকে আমার সাথে শুধু ঝগড়া বাধিয়ে দিত।আমাকে পিন্চ করতো। দুই দিনে আমরা অনেকটা ফ্রি ও হয়ে গিয়েছে।দুই দিনে যে কীভাবে কীভাবে আমরা একজন আরেকজনের সাথে খুব ফ্রী ভাবে কথাও বলেছি তা আমাদেরও জানা নেই।

গ্রাম থেকে আমরা এসেছি প্রায় দুই থেকে তিন সপ্তাহর মতো হয়ে গিয়েছে।আজ আমরা তাসফি আপুর জন্য বিয়ের শপিং করতে যাবো। বড়রাই আমাদের বলেছে নিজেদের ইচ্ছামত কেনাকাটা করতে। তাদের পছন্দ আর আমাদের পছন্দ নাকি এক হবে না। আমি, নিয়াজ ভাইয়া, তাসফি আপু, আলআবি ভাইয়া আর সজল ভাইয়া যাচ্ছি শপিংয়ে। মজার ব্যাপার হচ্ছে তাসফি আপু যে আমাদের সাথে যাবে তা আমরা ছাড়া আর কেউ যানে না। তাসিফা আপুদের বাড়ির কেউ জানেনা। আমাদের বাড়িতেও কেউ জানে না। সবাই জানে তাসিফা আপু এখন নিজের হোস্টেলে পরীক্ষার জন্য মনের সুখে প্রিপারেশন নিচ্ছে। আমি আর ভাইয়া বাসা থেকে কিছুটা সামনে এগিয়ে এসে মেইন রাস্তায় দাঁড়ালাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর আলআবি ভাইয়া আসলো। আমরা সবাই একসাথে শপিং মলের সামনে এসে একত্রিত হলাম। সাদু কে আসতে বলেছিলাম। ওর নাকি আবার কোন আত্মীয়র বেবি হয়েছে তাই বলে দিয়েছে আসবেনা।

প্রথমেই হলুদের অনুষ্ঠানের জন্যে একটা শাড়ির দোকানে ঢুকলাম। এখান থেকে হলুদের শাড়ি কিনে অন্য দোকানে গিয়ে বিয়ের শাড়ি দেখা শুরু করলাম শপিংমলে এসে মনে মনে খুব খুশি লাগছে। তার একটাই কারণ, ফ্রিতে আলআবি নামের একজন বডিগার্ড পেয়ে গিয়েছি। তার কানে সবসময় সালমান খানের বডিগার্ড মুভির মত ব্লুটুথ থাকে।এতক্ষণে বোঝা হয়েগিয়েছে আলআবি ভাইয়া গম্ভীর হলেও মিশুক টাইপের। ভাইয়া বলেছিলো সে নাকি কথা কম বলে। কিন্তু কথা কম বলেও সে সবার সাথে মিশতে পারে।

হঠাৎ করে আলআবি ভাইয়া বলে উঠলো তার নাকি ক্ষুধা পেয়েছে। আমার আবার ভালো গুণ হচ্ছে মানুষের ক্ষুধা পেয়েছে শুনলে নিজের পেটের ক্ষুধা লেগে যায়। কখনো আমি খাবার দেখলে আর না করতে পারি না। লজ্জা লাগে না করতে।

আমি আর আলআবি ভাইয়া একেবারে নিচে চলে আসি এখানে নিচে এক সাইডে ফুডকোর্টের ব্যবস্থা আছে। এই শপিং মলের নিচ তলায় অনেক মানুষের আনাগোনা। আলআবি ভাইয়া একেবারে একটা কর্নার সাইটের টেবিলে আমাকে বসিয়ে রেখে খাবার অর্ডার করতে গেলেন। বসেছিলাম তখন সাদু হোয়াটসঅ্যাপে একটা মেয়ে বাবুর ছবি পাঠাল। দেখেই মনে হচ্ছে এক থেকে দুই দিনের নবজাতক শিশুর ছবি।বুঝতে পারলাম এটা ওর আত্মীয়র সেই বেবি। বসে বসে বাবুটার ছবি দেখছিলাম। মাশাল্লাহ অনেক সুন্দর হয়েছে! হঠাৎ করেই এক পরিচিত কন্ঠ কানে ভেসে আসতে আমার আত্মা কেঁপে উঠল

–জুইঁফুল!মানুষের টা আর কতো দেখবে?কয়দিন পর আমাদের বেবির টাই দেখ।

চলবে………..

বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-০৭

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_০৭

মুষলধারের বৃষ্টির পরে ঠান্ডা আবহাওয়ায় ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে কিছুটা ভেজা শরীরে যে ব্যাক্তি বাইকে চড়েছে সেই বুঝতে পারবে বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসেও শীত লাগে। আর এইমুহূর্তে আমারও লাগছে।হাড় কাঁপানো শীত অনুভব করছি না। তবে বাতাসের সাথে টিপটিপ বৃষ্টি আমার হাত পা ঠান্ডা করে দিয়ে শরীরের লোম কূপকেও দাঁড় করিয়ে দিয়ে যাচ্ছে।

কিছুক্ষনের মধ্যেই বাড়ির সামনে এসে বাইক থেমে যায়।বাইক থামতেই আমি একপ্রকার দৌড়ে চলে আসলাম বাসার ভিতরে।মনে মনে ভাবছিলাম লোকটাকে একটা ধন্যবাদ দেই।কিন্তু পরক্ষনেই মনে হলো, সে তো ঠিকি আমাকে দিয়ে তার জামা পরিষ্কার করিয়ে ছেড়েছে।এখন আমি কেন ধন্যবাদ জানাবো?আমিও তো জামা ধুয়ে দিয়েছিলাম। আমাকে ধন্যবাদ দিয়েছিল নাকি?ইতিহাস ভাবতে ভাবতে দরজার সামনে এসে দেখি নিয়াজ ভাইয়া আগেই দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। কি ব্যাপার আমি কি বিশেষ কেউ হয়ে গেলাম নাকি?আলআবি ভাইয়া দিয়ে গেলো বাসায়। আবার নিয়াজ ভাইয়া দরজা খুলে দাঁড়িয়ে আছে। বাহ কেয়া বাত!!!

একগাল হেঁসে যেই না ভাইয়াকে বলতে যাবো কিছু তখন ভাইয়া নিজ থেকে বলে উঠলো,,,

–আলআবি তুই তো একেবারে ভিজে পটকা হয়ে গিয়েছিস।তোর না বৃষ্টিতে ভিজলেই জ্বর আসে?

আমি আকাশে উড়তে গিয়েও ভাইয়ার কথা শুনে ধপ করে মাটিতে নেমে আসি।পিছনেই আলআবি ভাইয়াকে দেখতে পাই।আলআবি ভাইয়া নিয়াজ ভাইয়ার দিকে একটা ল্যাপটপ দিয়ে বললো,,,

–তাড়াতাড়ি ল্যাপটপ টা দে।আম্মু বাসায় একা।

ভাইয়া ল্যাপটপটা নিয়ে কিছু না বলেই দরজা ছেড়ে ভিতরে চলে গেলো।আমিও ভিতরে যাওয়ার জন্য ডান পায়ের জুতোটা কেবল খুলেছি তখন আলআবি ভাইয়া গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলেন,,,

–সাহায্যকারী থেকে সাহায্য নিয়ে তাকে ধন্যবাদ দিতে জানতে হয়।এটা ম্যানার্স এর মধ্যে পরে।

আমি কিছুটা ঝুঁকে জুতো খুলছিলাম। তার কথা শুনে সোজা হয়ে তার দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে পরলাম।আমাকে বলার সুযোগ না দিয়েই উনি আবার বললেন,,,

–ছোট বলে হয়তো বুঝতে পারো নি।নো প্রবলেম,এখন ধন্যবাদ বলো।

আমি ভ্রুকুচকে তার দিকে তাকালাম।আলআবি ভাইয়া আমার থেকে উত্তর পাওয়ার আসায় তাকিয়ে আছে।আমি তাকে সুর টেনে বললাম,,,

–ধ ন্য বা দ, একদমই বলবো না আপনাকে।

বলেই আমি তাড়াতাড়ি করে আমার জুতো খুলে দরজা দিয়ে ঢুকতে যাবো তখন দেখি নিয়াজ ভাইয়া হাতে করে একটা ল্যাপটপ নিয়ে দরজার দিকেই আসছে।আমি ভাইয়াকে ক্রস করে চলে আসার আগে একটু পিছনে তাকালাম দেখি আলআবি ভাইয়া থমথমে একটা ভাব নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।আমি আমার মতো করে সামনে তাকিয়ে আমার রুমে চলে আসলাম।

বৃষ্টি জিনিসটা আমার ছোট থেকেই খুব পছন্দের।বৃষ্টিতে ভিজতে আরও বেশি ভালো লাগে।বৃষ্টিতে ভিজলে নিজেকে সবচেয়ে বেশি ভাগ্যবতী বলে মনে হয়।কারণ হলো আমার উপর যতই সিডর,আইলা,ফনা বা নার্গিস আসুক না কেন কখনোই আমার জ্বর আসবে না।খুব বেশি হলে গলাটা ভারী ভারী হয়ে যাবে।সচারাচর যেমনটা ঠান্ডা লাগলে হয় তেমন।

গোসল করে এসে কেবল বিছানায় বসলাম।তখন ভাইয়া রুমে এসে জিজ্ঞেস করে গেলো রাতে খাবো কি না?আমি না বলে দিয়ে ভাইয়ার পিছু পিছু খাবার টেবিলের দিকে গেলাম।আমি খাই আর না খাই টেবিলে সব সময় রাতের খাবার সার্ভ করে দেই আমিই।ভাইয়া অবশ্য আমাকে না খেয়ে ঘুমাতে দেয় না কখনো।আর আমাকেও খাওয়ার জন্য জোর জবরদস্তি করার প্রয়োজন হয় না।কারণ ক্ষুধা আবার আমার সহ্য হয় না।আমার যখন যেটা খেতে মন চায় ভাইয়াকে অফিস থেকে আসার সময় বলে দেই ভাইয়া নিয়ে আসে।সবজি হলো আমার চোখের বিষ।এই সবজি নামক বস্তু টা বাদ দিয়ে সকল খাবার আমি খেতে পারি।

আমার পড়ালেখা শেষ করে রাতে নিয়াজ ভাইয়া আর আমি আমার বারান্দায় বসে প্রতিদিন রুটিন করে আড্ডা দেই।ভাইয়ার বারান্দাটা ছোট।আর ওই বারান্দা থেকে কিছু দেখাও যায় না। পাশের বিল্ডিংয়ের দেওয়ালে বারান্দাটা ঢেকে গেছে।এই বাসায় একমাত্র আমার বারান্দাই বড়। আমি আর ভাইয়া আড্ডা দিতে বসলে পৃথিবীর এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তের মেয়ে-ছেলে বিয়ে দিয়ে দিতে পারব। এত কথার ফুলঝুরি আসে কোথা থেকে তা আমরা নিজেরাও জানিনা।

আমার একটা হবু ভাবিও আছে,তাসিফা আপু। আপু এবার অনার্স তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। আমাদের গ্রামের বাড়ির এক গ্রাম পরে তাসিফা আপুদের বাড়ি। তাসিফা আপুর সাথে আমার মাত্র দুইবার কথা হয়েছিল। আপু পড়ালেখার সুবাদে ঢাকায় হোস্টেলে থাকে আর মা-বাবা গ্রামের বাড়ি থাকে।

আড্ডা দিতে গিয়ে ভাইয়ার কাছ থেকে জানতে পারলাম, আলআবি ভাইয়া আর নিয়াজ ভাইয়ার ল্যাপটপ অদল বদল হয়ে গিয়েছে। আসলে তাদের দুজনের ল্যাপটপ এর ব্যাগ নাকি একই রকমের। তাই ভুলবশত একজনেরটা আরেকজনের কাছে চলে এসেছে। সেজন্যেই আলাবি ভাইয়া আবার ব্যাক করে আমাদের বাসায় এসে তার ল্যাপটপ নিয়ে গিয়েছে আর মাঝপথে আমাকে দেখে বাসায় পৌঁছে দিয়ে গিয়েছে।

সময় কখনো কারো জন্য অপেক্ষা করে বসে থাকে না। মাঝে মাঝে মনে হয় এই পৃথিবীতে কেবলমাত্র সময়েরই কোনো পিছুটান নেই। সময় কে কেউ কখনো ধরে বেঁধে রাখতে পারেনা। সময়ের স্রোতে আমাদেরও প্রায় ছয়টা মাস কেটে গেল। আমি আর সাদু এখানে গাজীপুরেই একটা ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি। আমাদের ভার্সিটি বাসা থেকে খুব একটা বেশি দূরেও না আবার কাছেও না। হাতে সময় থাকলে মাঝে মাঝে আমি আর সাদু কথা বলতে বলতে হেঁটেই ভার্সিটিতে যাই আবার মাঝে মাঝে রিক্সা করেও যাই।

আজকে সকাল থেকেই ব্যস্ততার মধ্যে কাটছে। তার কারণ হলো কাল আমরা তাসিফা আপুকে আংটি পড়িয়ে বিয়ের কথা পাকা করতে যাব। আপু আর ভাইয়ার সম্পর্কে দুই পরিবার আগে থেকেই অবগত ছিল কিছুটা। তাই বলতে গেলে বিয়ের তারিখ ঠিক করতে যাচ্ছি আমরা। ভোরবেলায় বাসা থেকে গ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হব বলে রাতের বেলায় ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিলাম। গ্রামে বেশি দিন থাকবো না। কেবল চার দিনের জন্য যাচ্ছি আমরা। ভাইয়া অফিস থেকে চার দিনেরই ছুটি নিতে পেরেছে।

একটা কালো জর্জেটের থ্রি-পিছ পড়ে নিলাম। থ্রি-পিছ এর সাথে গোলাপি সুতোর কাজ করা আছে। ম্যাচিং করে একটা কালো হিজাব পড়লাম। ভাইয়া দুইদিন আগেই বাসের টিকেট কেটে রেখেছিল। দুই দিন আগেই টিকিট কেটেছে বলে ভাই কে নিয়ে আমি আর সাদু অনেক হাসাহাসি করেছিলাম। বাসা থেকে বের হয়ে সিএনজি নিয়ে বাসস্ট্যান্ডের সামনে এসে নামলাম। কিছু সময় অপেক্ষা করার পর আমাদের বাস এসে পরল। দীর্ঘসময়ের একটা যাত্রা পথ পাড়ি দিয়ে আমরা গ্রামের বাড়িতে এসে পৌছালাম। ভাইয়া অবশ্য বিদেশ থেকে এসে এই প্রথম গ্রামের বাড়ি এসেছে। তাই তাকে নিয়ে মামা-মামীর বাড়াবাড়ি একটু বেশিই। খালা খালুও আজকে বাড়িতে এসে পড়েছে আমরা আসবো বলে। এখানে আসতে আমাদের প্রায় দুপুর ১ টার মত বেজে গিয়েছে। দুপুরে খাওয়া-দাওয়ার পাঠ চুকিয়ে লম্বা একটা ঘুম দিলাম। বিকেলে উঠে দেখি সুমনা আপু এসেছে সাথে সুমাইয়া আছে। ওদের সঙ্গে গল্পগুজব করে সন্ধ্যা হয়ে গেল। ওরাও ওদের বাড়ি চলে গেল। ওরা অবশ্য আমাকে ওদের সাথে দাদুর বাড়ি যেতে বলেছিল। কিন্তু আমার ইচ্ছে করছিল না বলে আর যাইনি। রাতের বেলা আমি, সুবহা আর আমার খালাতো ভাই জুনায়েদ, আমরা তিনজন একসাথে ঘুমিয়েছি।

সকাল বেলা ফজরের নামাজ পড়তে পারিনি। ঘুম ভেঙেছে সুবহার ডাকাডাকিতে। এখনো ঘুমের রেশ পুরোপুরি কাটেনি। ঘুম ঘুম চোখে উঠে কল পাড়ের দিকে যাচ্ছিলাম হাত মুখ ধুতে। নানু বাড়িতে অবশ্য ভিতরে ওয়াশ রুম রয়েছে। কিন্তু তাও সকালবেলা উঠে গ্রামে চাপ কলের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করতে করতে মুখ ধোয়ার আনন্দই আলাদা। আমার রুম থেকে বের হয়েই যখন বাড়ির কেচি গেট দিয়ে বের হতে যাবো, তখন হঠাৎ কিছুর সাথে ধাক্কা লেগে একেবারে ফ্লোরে বসে পড়ি। চোখ টেনে মেলে উপরের দিকে তাঁকাতেই ভড়কে গেলাম। ভাল করে চোখের পাপড়ি কয়েকবার ঝাপটা দিয়ে সামনে আবারও তাকালাম। নাহ, ভুল দেখছি না। ঠিকই তো দেখছি। আমার সামনে স্বয়ং আলআবি ভাইয়া দাঁড়ানো। পেছনেই সজল ভাইয়া দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছে। আর তাদের দুজনের পিছনে নিয়াজ ভাইয়া দাঁড়ানো। এর মধ্যে আরো একটা জিনিস দেখলাম। তা হল আলআবি ভাইয়ার কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকা। পিছন থেকে নিয়াজ ভাইয়া বলে উঠলো,,,

–হাটার সাথে সাথে কি দাঁড়ানোটাও ভুলে গেলি?

ভাইয়ার কথায় পা ছড়িয়ে বসে থাকা থেকে উঠে দাঁড়ালাম।এদিক ওদিক না তাকিয়ে এক দৌড়ে আবার রুমে চলে আসলাম। মনে মনে ভাবছি মান-সম্মান আর কিছুই থাকল না। প্রথম দেখায় ধরলাম জড়িয়ে। আজকে আবার ধাক্কা খেয়ে গেলাম পড়ে। আমার সাথেই মনে হয় পৃথিবীর সব আজগুবি কাহিনী ঘটে। ধুর আর ভালো লাগেনা। আমার সাথেই কেন এমন হয় সাদুর সাথে হয়না কেন?জীবনেও তো শুনলাম না ওর সাথে এমন কিছু ঘটেছে।ও আমার বেস্টু। তাই ওর সাথে যতদিন না এমন কোনো ঘটনা ঘটছে আমি কি আর শান্তি পাবো?

সজল আর আলআবি ভাইয়া নাকি রাতের বেলা বাইকে করে এসেছে। আলআবি ভাইয়া নাকি চারদিনের বদলে তিন দিনের ছুটি পেয়েছে। তাই একদিন অফিস করে তারপর এসেছে। আমি এখনো চিন্তা করে কুল পাচ্ছিনা সামান্য আংটি পরানোর জন্য তাকে আবার কেন ডাকা হয়েছে। বিয়ে তো এখনই হয়ে যাচ্ছে না। যাইহোক আমার আর কি? ভাইয়ার এনগেজমেন্ট, ভাইয়ার ফ্রেন্ড, ভাইয়াই ভালো বুঝবে।

তাসিফা আপুদের বাড়িতে আমরা বিকেলের দিকে রওনা হলাম।দাদু আর নানু বাড়ির কিছু আত্মীয়-স্বজন নিয়ে আমরা রওনা হলাম। নিয়াজ ভাইয়া, সজল ভাইয়া আর আলআবি ভাইয়া এই তিনজন আলআবি ভাইয়ার বাইকে করে আসছে। আর আমরা বাকিরা মাইক্রোতে করে যাচ্ছি। ভাইয়াদের নিয়ে আমরা মোট ১৫ জন যাচ্ছি।

এই প্রথম তাসিফা আপু কে সরাসরি দেখলাম। আপু আসলেই অনেক সুন্দর। তবে সব কথার এক কথা হলো আপুকে ফু দিলেই উড়ে যাবে। তাকে দেখলে মনে হয় আমার অর্ধেক সে।

আমি বসে বসে তাসিফা আপুর সাথে কথাবার্তা বলছিলাম। তখনই হঠাৎ ভাইয়া আমার ফোনে ফোন দিল। ফোন দিয়ে বলল,,,

— জুইঁ একটু তাড়াতাড়ি বাড়ির বাইরে আয় তো।

— এখন আসবো? কেন কি হয়েছে?(আমি)

–তোকে তাড়াতাড়ি আসতে বলেছি আয়(ভাইয়া)

আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ভাইয়া ফোনটা রেখে দিল। ভাইয়ার কথামতো আমি বাড়ির বাইরে এসে দেখি ভাইয়া আর আলআবি ভাইয়া একসাথে দাঁড়ানো। আমাকে দেখে ভাইয়া দ্রুত গতিতে বলে উঠলো,,,

— শোন তুই ওর সাথে গিয়ে তাসিফার জন্য যেই রিং টা কিনেছিলাম সেটা নিয়ে আসবি।

–মানে?(আমি)

–আমি তাড়াহুড়ো করে না দেখে খালি বক্সটা নিয়ে এসেছি। এই নে ড্রয়ারের চাবি। গিয়ে দেখবি আম্মুর চুরির বক্সের মধ্যে তাসিফার জন্য কেনা রিংটা রাখা আছে।(ভাইয়া)

নিয়াজ ভাইয়ার কথা শেষ হতেই আমি আলআবি ভাইয়ার দিকে তাকালাম দেখি সে মুখে বিরক্তিকর একটা চাহনি নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সাতপাঁচ না ভেবেই আমি বাইকে উঠে বসলাম। সেদিনের মতোই আমি বাইকের পিছনে ধরে বসে রইলাম।তবে আজকে বাইকের স্প্রিডটা সেদিনের থেকে একটু বেশি। তাও নিজেকে সামলে নিলাম।

বাড়িতে এসে ঘটলো আরেক বিপদ। আমি যে ভাইয়ার বোন সেই নাম রক্ষার্থে মেইন গেটের চাবি টাই আনতে ভুলে গিয়েছে। গেটের সামনে আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আলআবি ভাইয়া বলল,,,

–কি সমস্যা কি তোমার? এখন কি তালাচাবি ও খুলতে পারো না?

আমি আমতা আমতা করে বললাম,,,

–বাড়িতে ঢুকবো কিভাবে?

আলআবি ভাইয়া কিছুটা রাগী কন্ঠে বলে উঠলেন,,,

–উড়ে উড়ে ঢুকবে। গর্ধব একটা!!!

আমাকে গর্ধব বলল? আমি কি গর্ধব নাকি? আমি রেগে গিয়ে বললাম,,,

–আমি গর্ধব?

— নিজেরটা নিজে জানোনা? এত কথা না বলে তাড়াতাড়ি তালা খুলো।

আমি একটু নিচু স্বরে বললাম,,,

–খুলবো কিভাবে চাবি আছে নাকি?

তিনি ভ্রুকুটি করে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট ছোট করে বললেন,,,

–হোয়াট?

আমি মাথা নিচু করে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। তিনি আবার বিরক্তিকর একটা ভাব নিয়ে বললেন,,,

–যেমন ভাই তেমন বোন। একটা গেছে এনগেজমেন্টে আংটিই নেই নি।আরেকটা আংটি নিতে এসে চাবিই আনেনি।

আমাকে এভাবে দাঁড় করিয়ে রেখে উনি কোথায় যেন চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আবার ফিরে এসে বললেন,,,

— তোমাদের কি ছাদের দরজা খোলা আছে?

আমি শুধু মাথা নড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দিলাম। আমার জবাবের সাথে সাথে তিনি আবার বলে উঠলেন,,,

–মই কোথায় রাখে?

আমি কাচারি ঘরের দিকে আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে দিলাম। উনি সাথে সাথে সেদিকে ছুটে গেল। তারপর হাতে একটা মই নিয়ে বের হয়ে আসলেন। মই টাকে বাড়ির পিছন দিকে নিয়ে দেয়ালের সাথে আড়াআড়িভাবে রেখে দিলেন। আসলে আমাদের নানু বাড়িটা একতলা বিশিষ্ট। তাই খুব সহজেই মই দিয়ে ছাদে নাগাল পাওয়া যায়। মইটা রেখে তিনি আমার আগে মই বেয়ে ছাদে উঠে গেলেন। আমি নিচে দাঁড়িয়ে মাথা উপরের দিকে দিয়ে তাকিয়ে আছি। উনি ইশারায় আমাকে দুই তিনবার মই টা বেয়ে উঠতে বলেছেন। কিন্তু আমি উঠার জন্য সাহস পাচ্ছিলাম না। নিচে দাঁড়িয়ে ইতস্তত বোধ করছিলাম। মুখ ফুটে বলতেও পারছিলাম না যে আমি উঠতে ভয় পাচ্ছি। আমার এমন অবস্থা দেখে উনি নিজেই মই বেয়ে আবার অর্ধেক নেমে আসেন। আমাকে উদ্দেশ্য করে হাত বাড়িয়ে বললেন,,,

–হাত দাও।

কিছুক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থেকে আমি আমার পায়ের জুতো খুলে আমার হাতটা বাড়িয়ে তার হাত ধরলাম। দুই ধাপ উপরে উঠতেই ভয়ের চোটে আমার দুই হাত দিয়ে তার এক হাত খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম।

চলবে……….

বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-০৬

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_০৬

–আগে গেলে বাঘে খায় পিছে গেলে সোনা পায়।(সাদু)

সাদু ব্যঙ্গ করে কথাগুলো বলল। আমি বিছানায় মুখ গোমড়া করে বসে আছি। সাদু আবারো বললো,,,

–দোস্ত এই উক্তিটা কে বানাইলো রে।(সাদু)

কিছুটা রাগী ভঙ্গিমায় কর্কশ কন্ঠে সাদু কে বলে উঠলাম,,,

–তোর জামাই বানাইছিল!

— ওমা চেতছ কেন? আমি তো সত্যি কথাই কইলাম। তুই যদি দরজা টা না আটকাইতে তাইলে কি তোর আর ওই ব্যাডার গলায় ঝুইলা পরা লাগতো?(সাদু)

— ঠিকি কইছোস আমার জায়গায় তুই ঝুইলা থাকতি।(সাদু)

কিছুক্ষন আগে,,,

দরজা খুলেই ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরলাম ভাইয়া কোন কথা বলছিল না। তাই তাকে ছেড়ে দিয়ে সামনে তাকালাম। সামনে তাকাতেই মনে হলো আমার চোখের মনি কোটর থেকে বের হয়ে আসবে। সামনে একজন অপরিচিত ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। তার চেহারায় ক্লান্তির ছাপ খুব স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। তার পরনের কালো প্যান্ট এর সাথে ইন করা সাদা শার্টটির কাধের দিকের অংশ ঘামে ভিজে গিয়েছে। তার লম্বাটে মুখমন্ডলে ঘামের ছাপ রয়েছে। গালে রয়েছে হালকা দাড়ির ছোঁয়া। মনে হচ্ছে ১ থেকে ২ দিন আগে শেভ করা। তার মাথার চুলগুলো ছোটো না আবার বলতে গেলে বড় না যাকে বলে মাঝারি ধরনের।কালো ফ্রেমের চশমাটাকে এক আঙুল দিয়ে ঈষৎ ঠেলে নিলেন।তখনি লক্ষ্য করলাম তার পিছনে বাবা আর মামা দাঁড়িয়ে আছে। ভাইয়াকে কেবল দেখলাম সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে।নিজের করা বোকামির জন্য প্রচুর লজ্জা লাগছে। ওখানে দাঁড়িয়ে না থেকে এক দৌড়ে চলে আসলাম আমি। রুমে এসে ধপ করে বিছানায় বসে পরলাম।ছিঃ!ছিঃ!ছিঃ! কি করলাম আমি?ওই লোকটা কি ভাববে এখন?আচ্ছা লোকটা কে?লজ্জায় যখন লাল নীল হলুদ হচ্ছিলাম তখন সাদুকে দেখলাম ওয়াশরুম থেকে বের হচ্ছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে হাত-মুখ ধুয়ে বের হয়েছে। বারান্দায় গিয়ে মুখ মুছে এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল,,,

–কিরে তোরে দেইখা তো মনে হইতাছে বাসর ঘরে বইসা আছোস।আর নয়তো তোর জামাই তোরে ধইরা চুমা দিছে।(সাদু)

আমি ওর দিকে কটমট করে তাকালাম। আমার তাকানোতে ওর কোন ভাবান্তর হলো না । ও পুনরায় বলল,,,

–কিরে কোনটা বাসর না চুমা?

–তোর মাথা।(আমি)

তারপর আমি কি অঘটন ঘটিয়েছি সাদুকে সব বললাম।ও শুনে হাসতে হাসতে ফ্লোরে বসেই গড়াগড়ি খাচ্ছে। আমাকে একেকটা বলে যাচ্ছে আর মজা নিচ্ছে।সাদুকে বললাম,,,

–এখন কিছু একটা ক।আমি কি করমু?

–আগে দেখতে দে তুই কার গলায় ঝুইলা পরছিলি।(সাদু)

–আর একবার যদি মজা করছোস না,দেখিছ তোরে কি করি।(আমি)

–আরে বাপ চল আগে। দেখতে দে আমারে। (সাদু)

–যা তুই।আমার লজ্জা লাগতাছে।(আমি)

–গলায় ঝুইলা আছিলি কেমনে?তহন শরম লাগে নাই না?আয়!(সাদু)

একপ্রকার জড়তা নিয়ে সাদুর সাথে ড্রইংরুমে গেলাম। সাদু গিয়েই ভাইয়াকে জোরে ডাক দিয়ে বসে।

–নিয়াজ ভাইয়াআআআ

ড্রইংরুমের সকলের দৃষ্টি এমুহূর্তে আমাদের দুজনের উপর।সেই লোকটাও এখানে আছে আমাদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে আবার অন্য দিকে ঘুরে গেলো।ভাইয়া বলল,,,

–কিরে দুই শয়তান! কোথায় ছিলি এতো সময়?

–শয়তান আমরা?আমাদের শয়তান বললেন?(সাদু)

–কোনোদিন দেখেছিস নাকি ছাগল কে গরু বলতে?তাই শয়তানকে তো শয়তানই বলব।(ভাইয়া)

ওদের কথা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুধু শুনে যাচ্ছি।
ভাইয়া বলে উঠলো,,,

–জুইঁ তুই চুপচাপ আছিস কেনো?

–কোথায় চুপচাপ? (আমি)

আমি মনে মনে বললাম যেই কান্ড করেছি। চুপচাপ থাকবো না তো কি ঢোল পিটাবো নাকি?

এতক্ষণে লোকটার পরিচয় পেয়ে গিয়েছে। তার নাম আলআবি।সে হলো সজল ভাইয়ার কাজিন।আর সজল ভাইয়া হলো নিয়াজ ভাইয়ার ফ্রেন্ড।সজল ভাইয়া আর নিয়াজ ভাইয়া একসাথ ফ্রান্সে গিয়েছিলো।তারা দুই বন্ধু একসাথে একই ফ্ল্যাটে থাকতো।সজল ভাইয়া বাংলাদেশে ফেরার কয়েক দিন আগে আলআবি ভাইয়া ফ্রান্সে যায়।তখন তিনজন মিলে একই সঙ্গে নাকি থাকতো।এর কয়েক দিন পরে সজল ভাইয়া চলে আসে বাংলাদেশে।তখন থেকে আলআবি ভাইয়া আর নিয়াজ ভাইয়া একসাথে থাকা শুরু করে।আর এভাবে তাদের মধ্যে ভালো ফ্রেন্ডশিপ হয়ে যায়।নিয়াজ ভাইয়া আর আলআবি ভাইয়া একই অফিসে চাকরি করতো।তারা যে অফিসে চাকরি করতো ওটা একটা কনস্ট্রাকশন কোম্পানি।তাদের কোম্পানি বাংলাদেশে নতুন শাখা অফিস খুলেছে বলে কয়েকজন লোক এদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যে নিয়াজ আর আলআবি ভাইয়ার নামও এসেছিল।তাই তারা এদেশে পার্মানেন্ট এসে পরেছে।নিয়াজ ভাইয়া কে ম্যানেজার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে আর আলআবি ভাইয়াকে সিনিয়র আর্কিটেক্ট হিসেবে।

এয়ারপোর্টের থেকে আমাদের বাসা কাছে বলে নিয়াজ ভাইয়া আলআবি ভাইয়াকে আমাদের বাসায় নিয়ে এসেছে। আলআবি ভাইয়ার বড় ভাই নাকি এয়ারপোর্টে আসতে চেয়েছিলেন। তাকে নিয়াজ ভাইয়া আসতে বারন করে দিয়েছে।

সাদু, আন্টি আর সাথে কমলা আন্টি চলে গেছে। এখন বাসায় বাব,আমি ভাইয়া,মামা-মামী, ছোট্ট সুবহা(মামাতো বোন) আর আলআবি ভাইয়া।রাতে খাবার টেবিলে সবাই একসাথে খাচ্ছিলাম।আমি সুবহাকে আমার কোলে নিয়ে খাওয়াচ্ছি। আমার একেবারে সামনেই বসেছে আলআবি ভাইয়া।তার পাশে ভাইয়া।সুবহা হঠাৎ জেদ ধরে ও নিয়াজ ভাইয়ার হাতে খাবে।ওকেও ভাইয়া খাওয়াতে শুরু করলো।টেবিলে বসে আমি একমনে নীচের দিকে তাকিয়ে নিজের খাবার খেয়ে যাচ্ছি। মামা ভাইয়ার সাথে নানা কথা জুড়ে দিয়েছে। আলআবি ভাইয়াকেও নানা প্রশ্ন করছে।কিন্তু সে হু হা করছে কেবল।নতুন কোনো পরিবেশে এটাই স্বাভাবিক। তবে ভাইয়া বাবার সাথে আসার পর থেকে কথা বলছে না।ভালো করে তাকাচ্ছেই না।

রাতে মামী, সুবহা আর আমি আমার রুমেই ঘুমালাম। বাবা আর মামা একসাথে বাবার ঘরে ঘুমিয়েছে। নিয়াজ ভাইয়া আর তার বন্ধু ঘুমিয়েছে নিয়াজ ভাইয়ার রুমে।

সকালে ফজর এর নামাজ পরে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে পরলাম।এই সময় টা খুব বেশি স্নিগ্ধ লাগে আমার কাছে।অল্প অল্প অন্ধকার থেকে চারপাশে ধীরে ধীরে আলো ফোটার মুহূর্তটাকে আরো বেশি ভালো লাগে।একটা ঠান্ডা শীতল হাওয়া বইছে চারপাশে।বুক ভরে কয়েকটা লম্বা দম নিলাম। আকাশে মাঝে মাঝে দু একটা কাক কাকা করে উড়ে চলে যাচ্ছে।দুই একটা চড়ুই পাখি এসে কারেন্ট এর তার এর উপর বসছে, কিছুক্ষন ডাকাডাকি করে আবার চলে যাচ্ছে। কফি বা চা হলে মন্দ হতো না এখন।রুম থেকে বেরিয়ে এলাম।রান্না ঘরে এসে বেশি করে দুধ কফি দিয়ে একেবারে মনের মাধুরি মিশিয়ে কফি বানাচ্ছিলাম।হঠাৎ কেউ পিছন থেকে বলে উঠলো,,,

–এই মেয়ে!একটু কফি পাওয়া যাবে?

পিছনে ঘুরে দেখি আলআবি ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে।ট্রাউজার এর পকেটে দুই হাত ঢুকিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে যেভাবে বলল মনে হয় আমি নিজের বাসাতেই কাজের বেটি হয়ে এসেছি। এহ কথার কি ছিঁড়ি দেখো।আমি শুধু বললাম,,,

–জ্বী।

বলেই আমি পিছনে আবার চুলোর দিকে মুখ ঘুরিয়ে ফেললাম। আমার এতো সময় নিয়ে বানানো কফিটা তাকে দিয়ে আমি আবার কফি বানিয়ে আমার রুমে চলে আসলাম।

দুপুরে খাবার টেবিলে দিলাম আরেক অঘটন ঘটিয়ে।খেতে বসে মামী বলল,,,

–জুইঁ ডালের বাটি টা আনা হয়নি।একটু নিয়ে আয় তো মা।

আমি ডাল নিতে এসেছি বলে সুবহাও আমার পিছু চলে আসলো।মামী ডাইনিং থেকে আবার জোর গলায় বলে উঠলো,,,

–জুইঁ লেবু গুলোও নিয়ে আসিস।

সুবহা একবার ডাইনিং রুমে যাচ্ছে আরেকবার আমার কাছে আসছে।একহাতে ডাল আর লেবুর বাটি নিয়ে খাবার টেবিলের দিকে আসছিলাম।সুবহা অন্যদিক থেকে রকেট এর গতিতে আমার দিকে ছুটে আসছিল।তারপর আর কি?ডাল আর লেবু হাতে জুইঁ নামের মানুষের সাথে রকেটের গতিতে ধেয়ে আসা সুবহা নামের মানুষের সংঘর্ষে আহত হলো আলআবি নামের মানুষ।

আলআবি ভাইয়ার পিঠের দিকটা পুরো ডালে মাখামাখি। তার জলপাই রঙের টি-শার্টে হলুদ রঙ এর ডাল। মনে হচ্ছে কেউ এক গুচ্ছ সরষেফুল তার পিঠে ছড়িয়ে দিয়েছে।আমি তড়িঘড়ি করে হাত দিয়েই তার পিঠের ডাল মুছতে লাগলাম। আর শুধু বলতে লাগলাম,,,

–সরি!সরি!ভাইয়া আমি খেয়াল করি নি।সরি!

–আরে দেখে আসবি তো। সুবহা!!!তোমাকে বলিনি দুষ্টমি কম করবে।(মামী)

–আলআবি যা তুই চেঞ্জ হয়ে আয়।(ভাইয়া)

উনি চেয়ার থেকে উঠে আমার দিকে একবার তাকিয়ে চলে গেলেন রুমে। একটু বললও না -থাক কোনো সমস্যা নেই।বলতে তো পারতো ইটস ওকে।আমি কি ইচ্ছে করে ফেলেছি নাকি।ভালোই হলো অজান্তেই একটা রিভেঞ্জ নেয়া হয়ে গেলো।হুহ।সকালে আমার সাথে ভালো করে ব্যবহার করলে এমন হতো না।হাহাহা, এখন মনে হচ্ছে যা হয় ভালোর জন্যই হয়।এমন ব্রেকিং নিউস অবশ্যই সাদুকে বলা উচিৎ। ওর হক আছে জানার।সাদুকে কল দিয়ে রাজ্যের সকল সংবাদ শোনাতে বসে পরলাম।খাটে বসে কথা বলছিলাম তখন দরজায় দুবার টোকা পরলো।দরজা হালকা করে চাপানো ছিল।খাটে বসেই দেখতে পেলাম আলআবি ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন দরজার কাছে। দরজার সামনে যেতেই উনি আমার কাধের উপর তার সেই সরষে ফুলওয়ালা মানে ডালে নষ্ট হয়ে যাওয়া টিশার্ট টা কিছুটা ঢিল মেরে দিলেন। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।তিনি বলে উঠলেন,,,

–ক্লিন ইট।

আমি হাবলাকুমারীর মতো তার দিকে চেয়েই আছি।কি বললেন উনি?”ক্লিন ইট”!আমি পরিষ্কার করবো এটা?উনি আবারও বলে উঠলেন,,,

–সন্ধ্যায় আমি চলে যাওয়ার আগে চাই।

বলেই উনি চলে গেলেন।এখন সুবহার উপর রাগ লাগছে খুব।আমি একা একাই ঘরে পাইচারি করছি আর বলছি,,,

–আমাকে কি দেখে লন্ড্রি বয় মনে হয়?না গার্ল হবে তো।ধুর আমিই বা কোন দুঃখে লন্ড্রি গার্ল হবো।এহ,ভাব দেখো।মনে হয় কোন দেশের প্রেসিডেন্ট। একসময় এসে বলবে কফি চাই এক সময় এসে বলবে জামা ধোয়া চাই।ধুবো না। ধুবো না আমি কি করবে?

পিছনে ঘুরেই ভুত দেখার মতো চমকে উঠলাম।আলআবি ভাইয়া পকেটে একহাত ঢুকিয়ে আরেক হাতে ফোন নিয়ে হাতটা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন।উনি বললেন,,,

–অবশ্যই তুমি পরিষ্কার করবে। আফটার অল ভুলটা তোমার।

বলেই উনি হনহন করে চলে গেলেন।মন চাচ্ছে সুবহাকে ধরে আচ্ছা মতো দেই কয়টা।বড় হলে এখন সত্যি সত্যি ওর সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে ফেলতাম।

সন্ধ্যাবেলা নিয়াজ ভাইয়ার কাছে আলআবি ভাইয়ার টিশার্ট টা দিয়ে আসার জন্য ভাইয়ার রুমে উকি ঝুঁকি দিচ্ছিলাম। দেখি নিয়াজ ভাইয়া একাই রুমে।কার সাথে যেনো দেখলাম কথা বলছে।সুরসুর করে আমি রুমে ঢুকে পরলাম।ভাইয়ার দিকে টি-শার্ট টা বাড়িয়ে দিতেই বললো,,,

–এটা কোথায় পেলি?

ভাইয়াকে সকাল থেকে সব ঘটনা গরগর করে বলে দিলাম।আসলে ভাইয়ার কাছে আর সাদুর কাছে কোনো কথা না বলে থাকতে পারি না। ভাইয়া আমার কথা শুনে ফিক করে হেসে দিল। তারপর বললো,,,

–আসলে আলআবি কিছুটা অন্য রকমের। সব সময় মানুষের মুখের উপর কথা বলে দেয়।ও ওর বাপকেও ছাড়ে না। আর সব সময় সত্যি কথা বলে। এ পর্যন্ত ওকে মিথ্যে বলতে খুব কমই দেখেছি। বলতে গেলে খুব একটা কথাই ও বলে না। বাট হি ইস ভেরি ব্রিলিয়েন্ট।

আমার আর ভাইয়ার কথার মধ্যেই আলআবি ভাইয়া বারান্দা থেকে রুমের মধ্যে প্রবেশ করলেন। তাকে দেখেই আমি দ্রুত পায়ে আমার রুমে চলে আসলাম।

হাসি খুশির সময়গুলো মনে হয় খুব তাড়াতাড়ি চলে যায়। ভাইয়া এসেছে আজ প্রায় দেড় মাসের বেশি হয়ে গেল। আমাদের ভালই দিন কাটছিল। এর মাঝে ভাইয়াকে জায়েফের কথা একদিন বলেছিলাম। ডিভোর্স না হওয়ার বিষয় নিয়েও কথা বলেছিলাম। ভাইয়া আমাকে বলেছিল আমি সাইন করার তিন মাসের মধ্যে যেহেতু জায়েফ সাইন করেনি তার মানে আমাদের অটো ডিভোর্স হয়ে গেছে। ভাইয়া আমাকে এই বিষয় নিয়ে আর চিন্তা করতে বারণ করে। এখন আমিও কিছুটা স্বস্তি বোধ করি।ভাইয়া বাসায় থাকাতে খুব ভালোই লাগে এখন। আগে শুধু বাবা আর আমি থাকতাম। কেমন যেন চুপচাপ থাকতো বাসা। একা একা থাকত আগে ভালো লাগতো না। এখন আর একা নেই আমরা।

আজকে আবার আমার ওই চুন্নি টার জন্মদিন। ভাইয়াকে কালকে রাত্রে অফিস থেকে আসার সময় বলে দিয়েছিলাম কোন একটা গিফট নিয়ে আসতে। ভাইয়া আসার সময় দুইটা তাঁতের শাড়ি নিয়ে এসেছিল কালকে। আমার শাড়িটায় হাল্কা আকাশী রঙের সাথে সাদা রঙের ছোঁয়া আছে।সাদুর শাড়িটা গারো নীল রঙের সাথে সাদা রঙের ছোঁয়া আছে।

আসলে আমি শাড়ি খুব একটা ভালো ভাবে পড়তে পারি না বলে জর্জেটের একটা সবুজ রঙের থ্রি পিছের সাথে কালো হিজাব পড়ে রেডি হয়ে গেলাম।৪ টার দিকে বাসা থেকে বের হলাম। একটা রিকশা নিয়ে ওদের বাসার সামনে এসে পৌছালাম। ওদের বাসায় রিকশায় করে আসলে ১৫ মিনিটের মত লাগে।ওদের বাসার কলিং বেল দিতেই সার্থক ভাইয়া দরজা খুলে দিলেন।আমাকে দেখে বললেন,,,

–রাফিদা!!!আমার ছোট বউ এসে গেছে।

সার্থক ভাইয়া খুব মজার মানুষ। আমাকে মজার ছলে ছোট বউ বলে ডাকে। ভাইয়ার ডাক শুনে রাফিদা আপু চলে আসলো এসে বলল,,,

–কিরে তুই এত দেরি করে আসলি কেন? তোকে না বলেছিলাম সকালবেলা আসতে।

পিছন থেকে সাদু এসে বলল,,,

–ওই তুই আজকে আমার বাসায় এত তাড়াতাড়ি আসছোস কেন? যা আরো দুই ঘন্টা লেট করে আয়। দুই ঘন্টা পরে পার্টি শুরু হবে।

আমি ওকে বললাম,,,

–যা সর তোর কাছে আসছে কে আমি তো রাফিদা আপুর কাছে আসছি। আমি চিনি নাকি তোরে। কেডা তুই বইন?

আমাদের কথার মাঝে আন্টিও চলে আসলো আন্টি এসে বলল,,,

— জুঁইকে ভিতরে ঢুকতে দে।

সাদুর নাকি শাড়ীটা খুব পছন্দ হয়েছে। ও আবার শাড়ি পড়তে খুব পছন্দ করে। ওদের বাসায় অল্পস্বল্প আত্মীয়-স্বজন এসেছিল। সাদমান ভাইয়াও এসেছিলো। তবে সাদমান ভাইয়া সাদুকে খুব জ্বালিয়েছে। সাদু ও চুপ করে থাকে নি।দুজনে একেবারে টম এন্ড জেরির মতো জুটি। ওদের বাসা থেকে বের হতে হতে রাত ৯ টার কাছাকাছি বেজে গেল। ওদের বাসা থেকে কিছুটা সামনে এগিয়ে আসলে রিক্সা পাওয়া যায়। কিন্তু হঠাৎ করেই বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। এখানে অবশ্য একটা যাত্রী ছাউনি রয়েছে। যাত্রী ছাউনীর নিচে প্রায় ২০ থেকে ২৫ মিনিটের মতো দাঁড়িয়ে আছি। বৃষ্টির বেগ আরো বেড়ে চলেছে, বৃষ্টি থামার কোন নামই নেই। এই ছাউনির নিচে আরো অনেকেই দাঁড়ানো ছিল তবে যে যার মতো ব্যবস্থা করে চলে যেতে লাগলো। হঠাৎ উপলব্ধি করতে পারলাম এখানে কেবলমাত্র আমি একাই আছি। অনেকেই এখানে যারা দাঁড়ানো ছিল তাদের মধ্যে মেয়ে ছিল তবে এখন আর নেই। কিছু যুবক আর কিছু মধ্য বয়স্ক পুরুষ লোকের দাঁড়ানো এখানে। এখন কিছুটা ভয় লাগা শুরু করলো। কারণ আমি একাই মেয়ে আছি এখানে। চুপচাপ জবুথবু হয়ে এক কোনায় গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। বৃষ্টির ফোঁটা কিছুটা আমার গায়ে আছড়ে পড়ার কারণে অল্প অল্প ভিজে যাচ্ছি। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে ভাইয়াকে ফোন দিলাম। একবার রিং হওয়ার পরের বার ফোন বন্ধ পেলাম। এখন মনে হচ্ছে কেন পাকনামি করতে গেলাম। ভাইয়া তো বলেছিল আমাকে নিতে আসবে আমিই বারণ করে দিলাম। হঠাৎ করে একটা বাইক দূরে থেকে এসে আমার সামনে থামল। আমি আগে থেকেই বাইকটার আলো দেখতে পাচ্ছিলাম। কিন্তু আশা করিনি যে বাইক টা আমার সামনে এসেই থামবে।বাইকটা কিছুটা রয়েল এনফিল্ড এর মতো। বাইক থেকে সাদা পাঞ্জাবি ও মাথায় কাল হেলমেট পরিহিত একজন এসে আমার সামনে দাড়ালো। লোকটা বৃষ্টিতে একেবারে কাকভেজা হয়ে গেছে। তার সাদা পাঞ্জাবীটা ও গায়ে লেপ্টে রয়েছে। হঠাৎ এমন হওয়ায় কিছুটা ঘাবড়ে গেলাম। লোকটা বলে উঠল,,

–এই মেয়ে! কমনসেন্স টুকুও নেই? বাসায় ফোন তো দিতে পারতে।

কন্ঠ শুনে কিছুটা আঁচ করতে পারলাম এটা সেই খচ্চর ব্যাটা।না থুক্কু, আলআবি ভাইয়া। উনি আমার হাত ধরে বাইকের সামনে নিয়ে আসলো। সে বাইকে উঠে বাইক স্টার্ট দিয়ে আমাকেও উঠার জন্য ইশারা করলো। আমি কেবল অবাক এর উপর অবাক হচ্ছি। এই সময় সে কোথা থেকে আসলো? আর এদিকে কি?তার বাসা তো উল্টো দিকে। তার বাইকে উঠতে কেমন ইতস্তত বোধ করছি। আমি বাইকে উঠছি না বলে সে কিছুটা জোর গলায় বলল,,,

–বাসায় কি যাওয়ার ইচ্ছে নেই?

তার কথা শুনে আমি তড়িঘড়ি করে বাইকে উঠে পড়লাম। অনেকখানি জায়গা ফাঁকা রেখে পিছনে হাত দিয়ে বাইক ধরে বসলাম। এখন বলতে গেলে বৃষ্টির বেগ কিছুটা কমেছে। কিছুটা নয় অনেকখানি কমেছে। মুষুলধারের সেই বৃষ্টি এখন নেই। এটাকে ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি বলা যেতে পারে।

চলবে……..

বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-০৫

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_০৫

–বেমানান এক্স ওয়াইফ কে এতো দেখতে ইচ্ছে করে কেন মিঃ জায়েফ এহমাদ?

দুই হাত বুকে গুজে তার সামনা সামনি দাঁড়িয়ে এক নাগাড়ে বললাম কথা গুলো।
জায়েফ কিছুটা কাছে এগিয়ে এসে বলল,,,

–আরে কিসের এক্স ওয়াইফ?আমি তো আমার জুঁইফুল কে একবার দেখার জন্য এসেছি।৮০ ঘন্টার বেশি হয়ে গিয়েছে জুইঁফুল কে দেখি না।আসলে মিনিট সেকেন্ড গুনে রাখিনি।তাই এক্সাক্ট টাইম টা বলতে পারছি না।সরি!(জায়েফ)

দাঁত খিঁচিয়ে আমি ধীর কন্ঠে বলে উঠলাম,,,

–সমস্যা টা কি আপনার?কি? কি চাই আর?এটাই দেখতে চলে এসেছেন তো যে গ্রামে আবার আমি ভুল করে হাসি খুশি আছি কিনা?

–রাইট।হুট করে গ্রামে আসলে তাই দেখতে আসলাম কোনো প্রবলেম হলো কিনা?কিন্তু তুমি তো দেখি পড়াশোনা বাদ দিয়ে সামার ভ্যাকেশনে চলে এসেছো।এখন যখন ভালোই আছো তাহলে আসো একটা বিগ হাগ দিয়ে যাও।কাম!!!(জায়েফ)

তার এমন আচরণে স্তব্ধ হয়ে গেলাম।কিন্তু মুহূর্তেই তার করা কৃতকর্ম গুলো চোখের সামনে ভেসে উঠলো।উনি ধীরে ধীরে এগিয়ে আসতে আসতে আমাদের মধ্যবর্তী দূরত্ব অনেকটা কমিয়ে ফেলেছেন।হাত বাড়ালেই তাকে আমি ছুঁয়ে দিতে পারবো।মনের সব রাগ ক্ষোভকে এক করে শরীরের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে তাকে দু’হাতে স্ব জোড়ে ধাক্কা দিলাম।আমার এমন ভাবে ধাক্কাটা নিতে না পেরে উনি পিছিয়ে গিয়ে তার গাড়ির সাথে জোড়েসোড়েই একটা ধাক্কা খেলেন।আমার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছেন উনি।এমন একটা ধাক্কা তার কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল।নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে আবার এসে আমার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লেন। আমি কিছুটা পিছিয়ে তার আর আমার দূরত্ব আরেকটু বাড়িয়ে নিলাম। উনি আমার দিকে তাকিয়ে স্মিতহেসে বললেন,,,

–আমি যদি তোমাকে সরি বলি তাহলে ব্যাপারটা জুতো মেরে গরু দানের মতো হয়ে যাবে।আমি তোমাকে সরি বলতে আসিনি। আমি ক্ষমা চাইতে এসেছি।ক্ষমা করবে আমায় জুঁইফুল? (জায়েফ)

–ক্ষমা চাওয়া শেষ?এবার আসতে পারেন।(আমি)

–ওকে চলো।(জায়েফ)

কথা টা বলেই উনি বাড়ির দিকে হাটা ধরলেন।আমি হকচকিয়ে বলে উঠলাম,,,

–ওই দিকে কোথায় যাচ্ছেন আপনি?

সে আমার কাছে ফিরে এসে বললেন,,,

–তুমি তো বললে এবার আসতে পারেন।(জায়েফ)

তার কথা এবার সহ্য হলো না।তাকে এক নাগাড়ে বলতে লাগলাম,,,

–দেখুন মিস্টার জায়েফ এহমাদ, আপনাকে আর আপনার অত্যাচারকে এতদিন সহ্য করলেও আমি আর আপনাকে সহ্য করব না। কি ভেবেছেন আপনি আমি কি খেলনা পুতুল নাকি? যেমনভাবে ইচ্ছা হবে ব্যবহার করবেন ইচ্ছে হলোনা ব্যবহার করবেন না। এতদিন আমাকে দেখতে ইচ্ছা করে নি তাই না! আর এখন রাতের বেলাও একেবারে দৌড়ে চলে আসেন আমাকে দেখার জন্য। আপনাকে এখন আর আমার দেখতে ইচ্ছা হয় না। আপনাকে দেখলেই কষ্ট হয়। আপনাকে এখন দেখলে আপনার করা অত্যাচার আর অপমান গুলো আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আপনি আমার সামনে অন্য মেয়েদের ঘরে তুলে এনে আমাকে অপমান করেছিলেন। আমি কিছুই ভুলিনি। আপনি ক্ষমা চেয়েছেন আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি কিন্তু এখন যদি আমি বলি আমার উপর করা অত্যাচার গুলো ফিরিয়ে নিন পারবেন ফিরিয়ে নিতে? অপমান গুলোকে আপনি ফিরিয়ে নিন পারবেন ফিরিয়ে নিতে? কখনো পারবেন না। আমার জীবনটাকে কি আগের জায়গায় নিয়ে দাঁড় করিয়ে দিতে পারবেন? পারবেন না। আমি যখন এতই বেমানান ছিলাম আপনার জন্য তাহলে আমাকে বিয়ে কেন করে ছিলেন আপনার লজ্জা করেনি একটা ১৬ বছরের মেয়েকে বিয়ে করতে। শুধুমাত্র আপনার জন্য আজ আমি এই গ্রামে চলে এসেছি আপনার থেকে দূরে থাকার জন্য। আপনি দয়া করে প্লিজ আমার সামনে আসবেন না। আপনার থেকে আমি অনেক দূরে থাকতে চাই। অনেক দূরে। আপনার সংস্পর্শে আমি আসতে চাই না।

কথাগুলো বলেই আমি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করে দিলাম তখন উনি গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,,,

–জুঁইফুল আমরা কখনই কোন বিচ্ছেদের বন্ধনে আবদ্ধ ছিলাম না।

তার বলা বাক্যটি শুনে নির্বোধের মতো তার দিকে কেবল তাকিয়ে আছি। আমার চোখ থেকে টুপ টুপ করে অজস্র অশ্রু গাল বেয়ে পড়ে যাচ্ছে। বুঝতে পারছি না আসলে সে কি বলতে চায়। আমার ভাবমূর্তি দেখে হয়তোবা উনি কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছেন। একটু পরে নীরবতা ভেঙে সে বলে উঠলো,,,

–জুঁইফুল তুমি আমাকে ডিভোর্স দিয়েছো কিন্তু আমি তোমাকে ডিভোর্স দেইনি।

তাকে বলার মত কোন ভাষাই আমি এই মুহূর্তে খুঁজে পাচ্ছিনা। আমি নিজেকে যথাসম্ভব শক্ত করে তাকে আমি বললাম,,,

— দয়া করে কি আপনি আপনার এই ড্রামা টা বন্ধ করতে পারবেন? আমি আর নিতে পারছি না। আর ডিভোর্স আবার একজন দেয় কিভাবে?

— সত্যি বলছি। আমাকে বিশ্বাস হচ্ছে না? আচ্ছা ওয়েট আমি তোমাকে দেখাচ্ছি।

কথাগুলো বলেই সে তার গাড়ি এর ভিতরে গিয়ে একটা ফাইল এর মত কিছু নিয়ে আমার সামনে এসে দাড়ালো। তারপর আমাকে ফাইলটা হাতে দিয়ে বলল,,,

–নাও এটা খুলে দেখলেই বুঝে যাবে। তোমার বিশ্বাস হয়ে যাবে তুমি আমাকে ডিভোর্স দিয়েছো কিন্তু আমি তোমাকে ডিভোর্স দেই নি। তার এমন আচরণ দেখে আমি আসলে কি রিয়েকশন দেবো বুঝতে পারছিলাম না। কাঁপা কাঁপা হাতে ফাইলটা নিয়ে খুললাম
এটা তো সেই ডিভোর্স পেপারের যেটা কয়েক মাস আগে আমার জীবনটাই পাল্টে দিয়েছে। জায়েফ আমাকে বলল,,,

— যেখানটায় সাইন করেছ ওখানটা একটু দেখো। তোমার না তোমার না, আরে আমার সাইনটা দেখো।

ফাইলের ভিতরে থাকা পেপারটার সাইন করার জাগায় চোখ বোলাতেই চমকে উঠলাম।একবার জায়েফ এর দিকে তাকাচ্ছি আর একবার ফাইল টার ভিতরে থাকা পেপার টার দিকে তাকাচ্ছি। যেখানটায় উনার সাইন করার কথা ছিল সেখানে স্পষ্ট একেবারে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা -“ওয়ান্ট মোর ড্রিঙ্ক”

আমি বললাম,,,

–একটা নকল বানানো কাগজ নিয়ে এসে বললেন আমাদের ডিভোর্স হয়নি। আমিও তা মেনে আপনার সাথে ঢেং ঢেং করে চলে যাবো সংসার করতে এমনটা ভাববেন না।

উনি তড়িৎ গতিতে বললেন,,,

— না না।জুঁইফুল কাগজ টা আসল।ট্রস্ট মি।

আমি বললাম,,,

–ভাঙ্গা হাঁড়িতে পানি ঢালা আর আপনাকে বিশ্বাস করা একই কথা।কাগজ টা আসল হলে সাইন করেন নি কেন?আপনি ই তো ডিভোর্স টা চেয়েছিলেন।

–যেদিন সকাল বেলা তোমার থেকে সাইন নিয়ে ছিলাম ওই দিন রাতে আমি ড্রাঙ্ক ছিলাম
প্রচুর।তখন টেবিলের উপর পেপার টা দেখে এতটুকুই মনে করতে পারছিলাম যে আমি ডিভোর্স পেপার টায় সাইন করিনি।তাই ভেবেছিলাম সাইনটা করে দেই।কিন্তু সাইন করতে গিয়ে যে লিখেছিলাম “ওয়ান্ট মোর ড্রিঙ্ক” তা আমি বুঝিনি।তুমি চলে গেছো বলে আর ওই সব পেপার টেপার নিয়ে আর মাথা ঘামাই নি।(জায়েফ)

–আজ আমার জবাব চাই।আমাকে কেন অত্যাচার করেছিলেন? আমার দোষ ছিল কোথায়? আমাকে কিসের শাস্তি দিয়েছেন আপনি?(আমি)

— আমি নিশিকে খুব ভালবাসতাম। তাকে আমি আজও ভালোবাসি। আমি ভেবেছিলাম তোমার সাথে খারাপ আচরণ করলে তুমি চলে যাবে। বয়স তোমার কম ছিল। ছোট ছিলে তাই ভেবেছিলাম অত্যাচার সহ্য করতে পারবে না চলে যাবে। কিন্তু বিশ্বাস করো আমি তোমাকে মারধোর করতে চাই নি।প্রতিবারই নিশির রাগ তোমার উপর ঝারতাম।তোমাকে কেবল আব্বুর কথা রাখতে আর জেদের বসে বিয়ে করেছিলাম।নিশির সাথে তখন রাগারাগি করে ওকে দেখাতে চেয়েছিলাম আমি ওকে ছাড়াই থাকতে পারি।কিন্তু যখন দেখলাম তোমার সাথে খারাপ আচরণ করে কোন লাভ হচ্ছে না তুমি তোমার মতই আছো, তখন ঘরে মেয়েদের আনা শুরু করলাম। কিন্তু তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা ওদেরকে নিয়ে এসে অতিরিক্ত মাত্রায় ড্রিঙ্ক করাতাম কারণ ওরা তাতে অভ্যস্ত ছিল। তবে যতই অভ্যস্ত থাকুক মেয়ে মানুষ তো তাই অতিরিক্ত ড্রাংক হওয়ার পর ওরা নিজেরাই সেন্স হারিয়ে ফেলতো আর সারারাত পড়ে পড়ে ওরা ঘুমাতো। কেউ কেউ ওই অবস্থায় সেন্সলেস হয়ে পড়ে থাকত। সকালে ওদেরকে উঠিয়ে ড্রাইভারকে দিয়ে গাড়ি করে পাঠিয়ে দিতাম। যেখানে আমি নিশিকে ভালোবাসি সেখানে অন্য মেয়েদের সঙ্গে আমি কিভাবে রাত কাটাই। আমি মানছি আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি।সত্যি আমি তার জন্য আজ অনুতপ্ত। শুধুমাত্র তুমি জেনো তোমার বাড়ি ফিরে আসো, তুমি জেনো নিজের ইচ্ছেয় আমাকে ডিভোর্স দাও সেজন্য ওগুলো করেছিলাম। তবে আমি আজ বুঝতে পারছি কতটা অন্যায় করেছি। আজ তোমার কাছে আমি ক্ষমা চাইতে এসেছি আমাকে কি ক্ষমা করা যায় না?(জায়েফ)

তার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই শরীরের প্রায় সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে তার গালে চর মেরে দিলাম আমি। তার কথাগুলো আমি আর নিতে পারছিলাম না। তাকে বললাম,,,

— জানেন আপনাকে দেখে এই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছে আমার সামনে মানুষরূপী কোন পশু দাড়িয়ে আছে। ক্ষমা তো আমি আপনাকে এ জীবনেও করব না।

— জুঁইফুল তুমি কি ভাবছো? তোমাকে আমার জীবনে ফিরিয়ে নিতে এসেছি?না জুঁইফুল তা আমি চাইলেও পারবো না।আমি জানি তুমি আমাকে পছন্দ করো না। তাই তোমাকে আমি আমার মতো খারাপ মানুষ টার জীবনে দ্বিতীয় বার জড়িয়ে আর কষ্ট দিতে চাই না।তোমাকে আমার ভালোলাগে কিন্তু আমি তো আর তোমাকে ভালোবাসি না।জুইঁফুল একটা বার আমাকে মাফ করে দেও না?

উনি বলতে বলতে আমার পায়ের কাছে হাটু গেড়ে বসে পরলেন।আবারও বলতে শুরু করলেন,,,

–তুমি আমাকে তোমার ইচ্ছে মতো শাস্তি দিতে পারো। আমি সব শাস্তি মেনে নিতে রাজি আছি। গত কয়েক দিনের করা কাজের জন্যও আমি ক্ষমাপ্রার্থী তোমার কাছে। আমি শুধু দেখতে চাচ্ছিলাম আমার প্রতি তোমার প্রতিক্রিয়াটা এখন কি রূপ। সেজন্যই তোমাকে গত কয়েকদিন ধরে ডিস্টার্ব করছিলাম।তার জন্যেও আমি ক্ষমা চাই তোমার কাছে।

চোখের পানি মুছে গলা ঝেড়ে বললাম,,,

— আমার জীবনে আপনার ছায়াও দেখতে চাই না। আমাকে মুক্তি দিন।

আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে চলে আসি। পিছন থেকে জায়েফ ডেকে যাচ্ছে।এই মুহূর্তে পিছন ফিরে তাকানোর প্রয়োজন বোধ মনে করছি না। এসে দেখি বাবা আমার দরজার সামনে দাড়ানো। বাবাকে এভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিছুটা হকচকিয়ে গেলাম। মনে মনে ভাবছি বাবা কি সব দেখে ফেলল বা শুনে ফেলল। আমি কিছু বলার আগেই বাবা বলে উঠলেন,,,

— তোর জীবনটা এলোমেলো করে দেয়ার জন্য কেবলমাত্র আমিই দায়ী।

বাবার কথা শুনে তার দিকে অবাক হয়ে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইলাম। বাবার সঙ্গে এই মুহূর্তে কথা বলতে মোটেই ইচ্ছে করছে না। বাবাকে বললাম,,,

— আমার ভাগ্যে যা লেখা ছিল তাই হয়েছে আর ভবিষ্যতেও যা লেখা আছে তাই হবে। যাও তুমি ঘুমিয়ে পড়ো এখন।

রুমে এসে সটান হয়ে শুয়ে পড়লাম। মনের মধ্যে হাজার ও জল্পনা-কল্পনা চালিয়ে যাচ্ছি। আমি জানি না তাকে আমি ভালোবাসি কিনা তবে তার প্রতি কিছু একটা অনুভব হয়। জীবনটা আসলে বড়ই অদ্ভুত। ১৮ বছর বয়সে কত কিছুর মুখোমুখি হতে হলো। কিছু সময় পর অনুভব হতে লাগল আমার চোখ থেকে হালকা উষ্ণ তরল পদার্থ ঝরছে। বুঝতে পারলাম চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছে আজ শব্দ করে কান্না করতেও মন চাইছে না।আমার সাথেই এমন হলো কেন? অন্য সব মেয়েদের মতো এখন আমিইও তো হেসে খেলে জীবন টাকে উপভোগ করতে পারতাম।

গ্রামে এসেছি আজ এক সপ্তাহ হতে চলল।জায়েফ এর মাঝে ২ বার কল দিয়েছিল আমি তাকে মাফ করে দেই যেনো।সাদুকে ওই দিনের কথা গুলো বলে দিয়েছি। এই মেয়েটাকে কিছু না বলে থাকতে পারিনা। আমার সকল খারাপ সময়েই ওকে আমার পাশে পেয়েছি। এরমধ্যে কমলা আন্টি ফোন করে প্রতিদিন আমার খোঁজখবর নিতেন। খেয়েছি কিনা ঘুমিয়েছে কিনা সব খেয়াল রাখতেন

এর মধ্যে আরো কয়েকদিন চলে গেলো। আমার এইচএসসি এর রেজাল্ট আউট হয়ে গেছে।জিপিএ এসেছে ৪:০০।আমার কাছে এটাই অনেক।কারণ যেখানে ভালো ভাবে ক্লাসই করিনি সেখানে এমন রেজাল্ট হবে আশা ছিল না।বাবা আমাকে একদিন জিজ্ঞেস করে,,,

–জুইঁ মা গাজীপুরে যাওয়া দরকার এখন আমাদের। তুই যেতে না চাইলে থাক।তোর যেখানে খুশি সেখানে থাক তুই। জোর করতে চাই না। কিন্তু তোর পড়াশোনা টাও যে দরকার। এখানে তো লেখাপড়া হচ্ছে না।সামনে তো এডমিশন টেস্ট ও আছে।

–চলো কালকে তাহলে চলে যাই। আর বাসাও পাল্টানোর দরকার নেই।(আমি)

বাবার কথাটা ভুলতো বলে নি।এখানে লেখা পড়া তো হচ্ছে না।জীবনের কিছুটা সময়ের বিষাদ এর জন্যে ভবিষ্যতটাকে কেন নষ্ট করবো?জায়েফ আমাকে বলেছিল সে তার নিজের বাড়ি ফিরে গিয়েছে। তাহলে আমার তো সমস্যা ই নেই আর।এখন শুধু নিজেকে তৈরি করার পালা।বেঁচে থাকলে জীবন টাকে উপভোগ করতে পারবো নতুন ভাবে।

আজ ভাইয়া বাংলাদেশ ফিরবে। ভাইয়া দেশে ফিরবে বলে গ্রামের থেকে মামা মামী এসেছে। খালামণি আর খালু তারা আজকে আসতে পারবেনা। তাই তারা কাল বা পরশু দিন আসবে। মামি আমাদের দুই ভাই-বোনকে ছোট থেকেই খুব ভালোবাসেন। ভাইয়া আসবে বলে মামি নিজের হাতে ভাইয়ের সবরকম পছন্দের খাবার রান্না করছে। আমি ভাইয়ার থাকার ঘর ভাল করে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখছি। ভাইয়ার ঘর গোছানো থাকে তবে সবকিছুই একটু নতুনভাবে আবার গুছিয়ে রাখছি। আজকে সাদুও আসবে আমাদের বাসায়।কলিং বেলের শব্দে আমি ভাইয়ার রুমের থেকে বেরিয়ে দরজা খুলে দেখি সাদু দাঁড়িয়ে আছে সাথে আন্টিও আছে।সাদু এসেই আমার রুমে ঢুকে গেলো।ওর পিছনে আমিও আসলাম।

–ওই চুন্নি এতো তাড়াতাড়ি আসলি কেন?তোরে কি এখন দাওয়াত দিছি?তোর তো বিকালে দাওয়াত ছিল। (আমি)

–হ আমি বুঝিনা না?নিয়াজ ভাইয়া যেই চকলেট আনবো সব জানি আগে তুই নিতে পারছ তাই তো কইছোস পরে আসতে।(সাদু)

–এহ তোর লালা পরতাছিলো চকলেট খাওয়ার জন্য তাই ফাল দিয়া আইসা পরলি (আমি)

–বাহ।আয় তোরে একটা চুমা দেই।এই না হইলো আমার বান্ধবী। কতো বুঝে আমাকে। (সাদু)

–তোর মতো খাদকরে আবার বুঝমু না।(আমি)

–আচ্ছা শোন তোর ভাই আসবো কখন?(সাদু)

–কে এয়ারপোর্টে যাইয়া খাড়াইয়া থাকবি নি চকলেট এর লাইগা।(আমি)

–আরে বা* জানতে চাইলাম। (সাদু)

–একটু পরে বাবা আর মামা এয়ারপোর্টে যাবে।সন্ধ্যা ৬ টায় ল্যান্ড করার কথা।(আমি)

–আগে কবি না?এহন বাজে মাত্র ৩ টা।আরেকটু ঘুমাইতে পারতাম। (সাদু)

সাদুর চুল ধরে টান দিয়ে বললাম,,,

–ওই তোরে কইছি আমি ১৪ ঘন্টা আগে আইসা বইসা থাক।(আমি)

–যা সর আমি আরেকটু ঘুমাইয়া নেই।(সাদু)

–ঘুমা তুই। যা মরার ঘুম দে।(আমি)

আমার রুম থেকে বের হতে নিব তখনি সাদু এসে আমার চুলে ধরে একটা টান দেয় আর বলে,,,

–একটু আগে দিছিলি। তখন দিতে মনে ছিলো না।(সাদু)

–তোরে চকলেট এর প্যাকেটও দিমু না।ঘুমা তুই।(আমি)

বলেই দরজা বাইরে থেকে লক করে দিলাম।সাদু তো বুঝতেই পারেনি দরজা যে বাইরে থেকে লক।

বাবার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ভাইয়ার অপেক্ষা করছিলাম।এই বারান্দা থেকে মেইন রাস্তা দেখা যায়।দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ দেখলাম একটা সাদা রঙ এর মাইক্রো গেট এর কাছে এসে দাঁড়িয়ে পরলো। দেখলাম মামা বের হয়েছে।দেরি না করে দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পরলাম।অপেক্ষা করছি কখন ওরা উপরে আসবে।আসলেই ভাইয়াকে টাইট করে একটা হাগ করবো।কলিং বেল বাজতেই দরজা খুলে ভাইয়াকে জড়িয়ে ধরে বললাম,,,

–ভাইয়াআআআআআআআআআ

একি এতো দিন পরে আমাকে দেখেও ভাইয়া কিছু বলছে না কেন?এভাবে স্টেচু হয়ে আছে কেন?ভাইয়াকে ছেড়ে দিয়ে সামনে তাকালাম।সামনে তাকিয়ে মনে হলো এই মুহূর্তে আমি হার্টস্ট্রোক ব্রেনস্ট্রোক একসাথে করলাম।

চলবে………………

বর্ষণ সঙ্গিনী পব-০৪

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_০৪

–বাবা আমি গ্রামের বাড়ি যেতে চাই।

নির্লিপ্ত গলায় বাবার সামনে দাঁড়িয়ে ডান হাতের ব্যাগটা ফ্লোরে রাখতে রাখতে বলে উঠলাম আমি।বাবা টি টেবিলের উপর পত্রিকাটা রেখে আমার দিকে তাকালেন।সকাল সকাল এমন কথা শুনে বাবা কিছুটা অবাক হয়েই বলে উঠলেন,,,

–হঠাৎ!আমাকে বললি না যে? এখনি যাবি নাকি?তোর ব্যাগ গুছিয়েও ফেলেছিস?

–হ্যাঁ।আজ এক্ষুনি যাবো।কমলা আন্টিকে বলে দিয়েছি ফোন দিয়ে।তুমি কি আমাকে দিয়ে আসবে? না দিয়ে আসলেও সমস্যা নেই।একা চলে যেতে পারবো।এখন থেকে একা পথ চলাটাও শিখে নিতে হবে।(আমি)

–মা চল তোকে দিয়ে আসবো।তুই যা বলবি তাই ই হবে।(বাবা)

–এই কথাটা আগে বুঝলে আরো ভালো হতো।(আমি)

বাবা নিজের রুমে চলে গেলো কোনো প্রকার জবাব না দিয়েই। তার বলারই বা বাকি আছে কি।ইদানিং আমি কোনো কিছু বললে বা চাইলে বাবা সাথে সাথেই হ্যাঁ বলে দেয়।কিন্তু এখন হ্যাঁ বলে আর লাভ কি?বিয়ের সময় ভাইয়ার তত একটা সম্মতি ছিল না।আমার বিয়ের পরে কি করেছে জানি না তবে ডিভোর্স এর পর থেকে ভাইয়া বাবার সাথে কথাই বলে না।আমাকে সপ্তাহে ১-২ বার কল দেয়।আগে প্রতিদিন একবার করে খোঁজ নিতো।শুনেছি ভাইয়ার নাকি প্রমোশন হয়েছে হয়তোবা তাই ব্যস্ত ইদানিং।

বাসায় তালা দিয়ে বাবা আর আমি বাস স্টেশনের দিকে চললাম। সাদুকে একবার কল দিয়েছিলাম। ওর ফোনটা বন্ধ পাই।কাউন্টার থেকে দুই সিটের টিকেট কেটে বাসে উঠে বসলাম। ১৫ মিনিটের অপেক্ষাকে বিদায় দিয়ে বাস তার নির্দিষ্ট গতিতে চলতে লাগলো। বাসে জানালার পাশের সিটে বসেছি আমি। মাথাটা একটু বা দিকে এলিয়ে দিলাম।

পৃথিবীতে নানান রোগের নানান ঔষধ তৈরি করা যায় কিন্তু স্মৃতি, অনুভুতি,যন্ত্রণা দুঃখ কষ্ট ভুলে যাওয়ার কোনো ঔষধ তৈরি করা যায় না কেন?যদি এমন কোনো ঔষধ পৃথিবীতে থাকতো তাহলে যেকোনো কিছুর মূল্যেই আমি তা ক্রয়ের চেষ্টা করতাম।কারণ ওই লোকটাকে এই পর্যন্ত যতবারই দেখেছি ততবারই অতীত এসে আমাকে কষ্ট দিয়ে যায়।ওই লোকটাকে সামনে দেখলে কষ্ট হয় আমার। খুব কষ্ট হয়।

কালকে সকালে তাকে দেখে বুঝতে বাকি ছিল না যে সে পাশের বিল্ডিংয়ে উঠেছে।কিন্তু আমার জানা মতে তো তার নিজের বাড়ি আছে। কিন্তু তাও সে ভাড়া বাড়িতে কি করছে?আমার সাথেও কেমন আচরণ করছিল।যাইহোক, তার লাইফ তার ইচ্ছে। সে আকাশে, বাতাসে, পানিতে যেখানে খুশি সেখানে থাকুক আমার কি?আমি শুধু তার থেকে দূরে থাকতে চাই। অনেক দূরে। যেই লোক সামান্য দুধ নিতে ডিরেক্ট বাসায় এসে পরে সে কয়দিন পরে আদা রসুন নিতেও বাসায় এসে পরতে পারবে।এখন থেকে তার সঙ্গে হয়তোবা বার বার দেখা হয়ে যাবে।যা আমি চাই না।তার সামনে যেনো পরতে না হয় তাইতো আজ গ্রামের বাড়ি যাওয়া।

চোখে হালকা ঘুম এসে পরেছিল।বাসের ঝাঁকুনি খেয়ে ঘুম চলে যেতেই দেখি বাসটা কিছুটা গ্রামের দিকে এসে পড়েছে। গ্রাম বললে আসলে ভুল হবে।কারণ পিচঢালা রাস্তার কোল ঘেষে চারপাশে অনেক বড় আর মোটা মোটা গাছ।এরপর দৃষ্টি যতটুকু যায় তাতে ফসলের মাঠ দেখা যাচ্ছে। সবশেষে ছোট ছোট ঘড় চোখে পরছে।নাকে একটা মাটির গন্ধ ভেসে আসছে। সব মিলিয়ে ভালো লাগার মতোই পরিবেশটা।

দীর্ঘ কয়েক ঘন্টার বাস জার্নি করে বাস থকে নামলাম বাবা আর আমি।সময় টা এখন আসর আর মাগরিবের মাঝামাঝি। এখান থেকে একটা অটোতে করে ২০-২৫মিনিটের রাস্তা পাড়ি দিলেই আমাদের গন্তব্য “দাদু বাড়ি”পৌঁছে যাবো।

দাদু বাড়ি এসেছি আজ দু’দিন হলো।এখানে এসে কিছুটা ভালোই লাগছে।দাদু বাড়ি আর নানু বাড়ির দূরত্ব বেশি নয়। এখানে একটা বাজার রয়েছে। বাজারের একপ্রান্তে দাদু বাড়ি আর আরেক প্রান্তে নানু বাড়ি।আমার আপন কোনো কাজিন নেই তবে দাদু আর নানু বাড়িতে আশেপাশে আমার সমবয়সী কয়েকজন মেয়ে আছে। ওদের সাথে একটুআধটু ভাব আছে।

দুপুর এর দিকে জাম মাখিয়ে খাচ্ছিলাম।সাথে সুমনা আপু ছিল,আঁখি ছিল, সুমাইয়া ছিল।সুমনা আপু এখানেই একটা ডিগ্রি কলেজে পড়ে।আঁখি আর সুমাইয়া আমার ক্লাসে পড়ে। ওরা সবাই ই দূর সম্পর্কের আত্মীয়।ওই গ্রামের বাড়ি পাশাপাশি বাড়ি যেমন থাকে ওদের বেলাতেও তেমনই আরকি।এমন সময় সাদুর কল আসে।ওর সাথে প্রায় ১ ঘন্টার মতো কথা বলে আমার ফোন টা কে ঘুমাতে পাঠাই।এই দুই দিন আমি কি কি করলাম।আর সাদু কি কি করলো এইসব নিয়েই কথা বলে কেটে দেই। ফোন রাখার পরে বুঝতে পারি যে আসলে পুরো ১ঘন্টা পাড় হয়ে গেছে।সাদুকে গ্রামে এসেই জায়ফের গাজীপুর আসার কথা, আমাদের বাসায় আসার কথা বলেছিলাম।

সাদুর সাথে কথা বলে সুমনা আপুদের সঙ্গে একসাথে পুকুরে গোসল করতে আসি।সুমনা আপুরা সাঁতার কাটার প্রতিযোগিতা করছে।আমি বসে বসে ওদের জন্য রেফারির চাকরি করছি। ছোট থেকে বেশির ভাগ সময়টা গাজীপুর থাকা হয়েছে বলে সাঁতার টা শিখে ওঠা হয়নি।গোসলের পাট চুকিয়ে, খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে বিকেল বেলা নানু বাড়ি এসেছি। আজকে এখানেই থাকবো আবার ২-৩ দিন পরে দাদু বাড়ি যাবো।

নানুদের বাড়িতে নানা নানু আর মামা মামি থাকে।এই বাড়িতে বাচ্চা পার্টি বেশি।এখন কেবল রাত ৮টা বাজে। বাচ্চা পার্টি এতক্ষনে ঘুমিয়ে সমুদ্রের তলদেশে চলে গেছে। নানু বাড়ি এই এক সমস্যা, গ্রামে ওরা ৯-১০ টার দিকেই ঘুমিয়ে পড়ে। আর বাচ্চা গুলো আরও তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে। আমার তো ১১ টা ১২ টার আগে ঘুমই আসে না।তাই একা একা আমার রুমেই বসে থাকতে হয়।

বিকেলে বৃষ্টি হওয়ায় গাছগাছালি আর মাটির ভিজে গন্ধের সাথে হালকা ঠান্ডা পরিবেশটা এখন ভালোই লাগছে। জানালার পাশে একা একা অনেক সময়ই হলো বসে আছি।হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো। নাম্বার টা অবশ্য আননোন।কারণ বাবা,ভাইয়া, সাদু ওদের নাম্বার ছাড়া আর কারো নাম্বার আমার ফোনে নেই। ২ বার ফোনটা বেজে বন্ধ হয়ে গেছে। প্রায় ৫-৬ মিনিটের মাথায় আবার বেজে উঠলো। একটু বিরক্তি হয়েই কল টা রিসিভ করলাম।সালাম দেয়ার সাথে সাথে অপর পাশ থেকে বলে উঠলো,,,

–জুইঁ আমি সাদমান।তোমাকে এতোবার কল করে বিরক্ত করার জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত।

–না না।আমি বিরক্ত হইনি।আসলে নাম্বার টা অপরিচিত বলে আমি পিক করছিলাম না।(আমি)

–ওহ।আচ্ছা শোনো, তোমার সাথে কি সাদিয়ার কথা হয়েছে আজকে বা কালকে?(সাদমান)

–হ্যাঁ।আজকেও তো কথা বললাম আমরা।(আমি)

–আসলে ও আমার নাম্বার টা ব্লক করে রেখেছে মনে হয়।তুমি কি একটু ওকে বলে আমার সাথে ওর যোগাযোগ করিয়ে দিতে পারবে? (সাদমান)

আমি বুঝেও না বোঝার ভান করে বললাম,,,

— ও আপনাকে ব্লক করে রাখবে কেন?(আমি)

–না মানে,আসলে।আমি ওকে প্রপোজ করেছি ২-৩ দিন আগে।ওকে একটা বই আর চকলেট দিয়েছিলাম।ও চকলেট টা নিয়ে কিছু না বলেই চলে যায়।এরপর থেকে ওকে কল করলেই ব্যস্ত বলছে।(সাদমান)

তার কথা শুনে চাপা হাসিটা আর রাখতে না পেরে ফিক করে হেসেই ফেললাম। পরমুহূর্তেই বুঝতে পারলাম হাসাটা উচিৎ হয়নি।বেচারা এসেছে তার সমস্যা নিয়ে।আর আমি বেআক্কলের মতো হাসছি। হাসি থামিয়ে বললাম,,,

— ভাইয়া সরি! সরি!সরি!আপনি মনে করেন না কিছু। সাদু কেমন তা তো জানেনই আপনি।প্রেম করার মতো মেয়েতো আর ও নয়।আমি ওর সাথে কথা বলে আপনাকে জানাচ্ছি। (আমি)

–আচ্ছা তাহলে ওর সাথে একটু কথা বলো।আর ওকে বলো আমি ওকে প্রেম করতে বলছিনা আমার সাথে। আমি শুধু আমার মনের কথা ওকে প্রকাশ করেছি।এখন ওর মনে কি আমি শুধু তাই ই জানতে চাই।(সাদমান)

–জ্বি ভাইয়া ওর সঙ্গে কথা বলে দেখি। রাখছি তাহলে।(আমি)

সাদমান ভাইর কল টা কেটে সাদু কে কল দিলাম দুই বার রিং হতেই রিসিভ করলো।

–এতোই যখন তোর আমারে মনে পরে তাইলে গ্রামে গেলি কেন?(সাদু)

–তোর এতই যখন সাদমান ভাইরে অপছন্দ তাইলে তার চকলেট খালি কেন?আমারে দিলেই পারতি।(আমি)

–ওই ব্যাডা তোরে কল দিসিলো তাই না?(সাদু)

–তুই নাকি নাম্বার ব্লকে রাখছোস?(আমি)

–হ।শোন তোরে সিক্রেট একটা কথা কই।ওই ব্যাডারে নাকে দড়ি দিয়া ঘুরাইয়া দেখতে হইবো।যদি আমার কাছে পাশ করে তাইলে তো ভালোই আর পাশ না করলে আরো ভালো।(সাদু)

–তোরে তো আর এখনি প্রেম ট্রেম করতে হইতাছে না।ব্লক টা অন্তত খোল।(আমি)

–আচ্ছা দেখতাছি।ওই তুই গাজীপুরে আসবি কবে?(সাদু)

–যদি আর কোনো দিন না আসি?(আমি)

–মানে?আসবি না কেন? ওই শয়তান ব্যাডার জন্যে?

–হ্যাঁ।আমি তার সামনে পরতে চাই না।তাকে আমি দেখতে চাই না।(আমি)

–বাসা পাল্টে ফেল।তাইলেই কিচ্ছা খতম।(সাদু)

–বাসা কে খুজবো।তুই?মালপত্র কে টানবো।তুই?ভাইয়া নাকি সামনে মাসে আসবে।তাই ভেবেছি এই কয়েকদিন গ্রামে থাকবো।ভাইয়াকে বলেছি এসব।তাই ভাইয়াও বলেছে বাংলাদেশে এসে নতুন বাসা নিয়ে তারপর আমাকে গ্রাম থেকে নিয়ে যাবে।(আমি)

–আচ্ছা বোইন আমারে একটু কতো ওই ব্যাডা চায় টা কি?(সাদু)

–যাইয়া তারেই জিজ্ঞেস কর।ফোন রাখ আমি ঘুমাবো।(আমি)

সাদু কল টা কাটার সাথে সাথে আবার ফোন বেজে উঠলো।সেভ করা না বলে খেয়াল না করে সাদমান ভাই ভেবেই রিসিভ করে বললাম,,,

–নিন আপনার রাস্তা এখন ক্লিয়ার।এবার একটু মন ভরে আমাকে ট্রিট দেন।(আমি)

–নিজের রাস্তা নিজে ক্লিয়ার করে আবার নিজেই ট্রিট চাচ্ছো।

অন্যরকমের ভয়েস শুনে তাড়াতাড়ি করে নাম্বার টা চেক করে দেখলাম এটা সাদমান ভাইর নাম্বার না।হঠাৎ মনে হলো কন্ঠ টা জায়েফ এর মতো।ফোনটা আবার কানে দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,,,

–কে আপনি?

–জানালা দিয়ে সোজা তাকাও।আমাকে স্ব শরীরেই দেখতে পাবে।

মনে মনে যা ভাবছি যদি তাই হয় তাহলে আমি কি করব?আস্তে আস্তে জানালার পর্দা সরিয়েই মনে হলো আমার পৃথিবী শুদ্ধ আমি চরকির ন্যায় ঘুরছি।জানালা দিয়ে তাকালেই বাড়ির উঠোন দেখা যায়।২৫-৩০ কদমের উঠোন টা পাড় হলেই বাড়ির গেট দেখা যায়।গেট টা এখনো খোলা আর গেট এর বাইরেই পাকা রাস্তায় জায়েফ কে দেখা যাচ্ছে।তার পিছনে তার সাদা রঙ এর গাড়ি টাও দাঁড়িয়ে আছে। রাতের বেলা বাইরে লাইট জ্বালিয়ে রাখা হয় এখানে। তাই লাইটের ফকফকা আলোতে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে কালো জিন্সের সাথে সাদা টি-শার্ট পড়ে একহাতে একটা জ্যাকেট নিয়ে আরেক হাতে ফোনটা কানে ধরে জায়েফ দাঁড়িয়ে আছে।আমাকে দেখার সাথে সাথে ফোন হাতেই আমাকে ইশারা করলো।তার মুখে কিঞ্চিৎ হাসির রেখা দেখে কেনো যেনো খুব রাগ লাগছে। তখন উনি আবার ফোনট কানে নিয়ে বলে উঠলেন,,,

–জুইঁফুল একটা বার বের হবে?যাস্ট দেখে চলে যাবো।

তার এমন কথায় মনে হলো আমার রাগে পুরো শরীর রিরি করে উঠলো।মনে মনে ভেবে নিলাম তার সাথে আজকে বোঝাপড়াটা শেষ করতে হবে।কয়কদিন ধরেই কেমন যেনো করে আসছে উনি।আজকে আমাকে দেখতেও চাইছে।উনি সত্যি সত্যি ই কি চায় আজ জানতে হবে।

ওনার ফোনটা কেটে গায়ে ওড়না টা ভালো করে পেচিয়ে উঠোনের লাইটটা অফ করে উঠোনটা অন্ধকার করে নিলাম। কেউ যেন না দেখে আর দেখলেও যেন চিন্তে না পারে।একট ছেলের সঙ্গে দাঁড়িয়ে কথা বললে তা গ্রামে দৃষ্টিকটু দেখায়।জায়েফকে মামা মামি,নানা নানু চিনলেও তো আর অন্য মানুষরা চেনে না।আমাদের সম্পর্কের কথা তো আর জানে না।তাই তো এই ব্যবস্থা করা। মোবাইলের আলোতেই বের হয়ে পড়লাম ঘর থেকে।

চলবে……