Sunday, July 13, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1389



বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-২৩ + বোনাস পর্ব

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_২৩

আমার কল্পনা জুড়ে
যে গল্পেরা ছিলো
আড়ালে সব লুকোনো
সেই গল্পেরা সব

রঙিন হল পলকে
তোমাকে হঠাৎ পেয়ে যেন
প্রেম তুমি আসবে এভাবে
আবার হারিয়ে যাবে ভাবিনি
আজও আছে সেই পথ শুধু নেই তুমি

হঠাৎ করেই গানটা বন্ধ হয়ে গেল। পিছনে ঘাড় ফিরিয়ে দেখি সাদু এসেছে। এসেই বলতে লাগলো,,,

— ওই তোর যে এক দিন বাদে পরীক্ষা সেই খবর আছে? আর এই জায়গায় এমন কাবির সিং এর ফিমেল ভার্সন হইয়া বইয়া আছোস কেন?

— জানি তো পরশু দিন পরীক্ষা।নোট আনছোস?(আমি)

সাদু মূলত এসেছে আমাকে নোট দেয়ার জন্য। পড়ন্ত বিকেলে লাল আভার চাদর যখন আকাশকে মুড়ে নিয়েছে তখন আমি আর সাদু একসাথে টুকটাক কথা বলছিলাম।কথাচ্ছলে ও আমাকে আসলে হাসাতে চাচ্ছে। হঠাৎ করে সাধু বলে উঠলো,,,

–জুঁই তোকে একটা কথা বলি, ঘুমন্ত মানুষকে জাগানো যায় তবে যে জাগ্রত অবস্থায় ঘুমিয়ে থাকে তাকে জাগানো যায় না।(সাদু)

–কি বলবি স্পষ্ট বল। (আমি)

–যে নিজে থেকে ধরা দেয় না তাকে ধরতে যাবি কেন?

সাদু কথা সত্যি ই তো বলেছে। যে নিজে থেকে ধরা দেয় না তাকে তো কখনো ধরা যায় না।আরও কিছু সময় সাদুর সাথে কথা বলে ওকে বিদায় দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে পরলাম।

ঘরে থাকা একটা ঘড়ির সময় আমি ঘুরাতে পারবো। কিন্তু পৃথিবীর সময়ের কাঁটা ঘুরাতে পারবো না। পৃথিবীর সময়ের কাঁটার সাথে সাথে বদলেছে মানুষ, বদলেছে পরিস্থিতি, বদলেছে জীবনের চাঁকা। প্রকৃতি এক ঋতু পরিবর্তন করে এনেছে আরেক ঋতু। সময় পরিবর্তন করে এনেছে আরেক সময়। চিরচেনা বর্ষা পার হয়ে এসেছে আরেক নতুন বর্ষা। সময় পরিবর্তন হয়ে আমাকে এগিয়ে এনেছে দেড় বছর সামনে। হ্যাঁ, সময়ের চাঁকা ঘুরতে ঘুরতে আমার জীবনের দেড় বছর অতিক্রম হয়ে গিয়েছে। সবকিছু পাল্টে গিয়েছে এই দেড় বছরে। শুধু পাল্টায়নি আমার সত্তায় নিহিত অনুভূতিগুলো।

সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত আমি আমার প্রিয় মানুষটার দেখা পাইনি। তাকে দেখা তো দূরের কথা তার কোন খোঁজ পর্যন্ত পাইনি। আজ মনে হচ্ছে উনিশের কোঠায় পা দিয়ে জীবনের সবচেয়ে বিভীষিকাময় দিনগুলো টেনে এনেছি। সেদিন ছাঁদে না যেয়ে আমাকে যেতে হয়েছিল হাসপাতালের বেডে। সিঁড়িতে পড়ে যাওয়ার পরে আমি মূর্ছা যাই।৭৮ ঘন্টা অতিক্রম করে যখন আমি সজ্ঞানে ফিরি তখন নিজেকে হাসপাতালে আবিষ্কার করি। জ্ঞান ফেরার পর ডান হাতে, ডান পায়ে আর মাথায় ব্যান্ডেজ দেখতে পাই। জানতে পারি আমার ডান হাতের কব্জি আর কনুইয়ের মাঝ বরাবর হাড় ভেঙে গেছে। সেই সাথে পায়ের গোড়ালি থেকে আঙ্গুলের মাঝ বরাবর থাকা দুইটা হাড্ডি ভেঙ্গে গেছে। মাথায় বেশ ভাল ভাবে আঘাত পেয়েছি যার দরুন প্রায় তিন দিনের বেশি সময় লেগেছে আমার জ্ঞান ফিরতে।

আমি ছাঁদে যাওয়ার প্রায় তিন ঘন্টার মত সময় অতিক্রম হওয়ার পরেও যখন বাসায় ফিরছিলাম না তখন নাকি সাদু ছাঁদের দিকে আসে আমাকে খুঁজেতে। সিঁড়িতে এসেই আমাকে অবচেতন অবস্থায় পায়। আর তারপরেই হাসপাতালে আনা হয়। নিয়াজ ভাইয়া ওকে অনেক জিজ্ঞেস করেছে আমি ওই সময়ে ছাঁদে কি করছিলাম। তবে ওর থেকে কোন উত্তর পায়নি।ও শুধু এতোটুকুই বলেছে “জুইঁয়ের জ্ঞান ফেরার পর ও নিজে মুখে বললেই আপনি শুনতে পাবেন”।

হাসপাতাল থেকে আট দিন পর বাসায় এসে আমি যা শুনি তা শোনার জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। বাসায় আসার পরের দিন বিকেলে সাদু এসে বলে,,,

–জুইঁ আলআবি ভাইয়ার আব্বু ইন্তেকাল করেছে।

আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম,,,

— কি? কিভাবে? আর কবে হলো?(আমি)

— তোর জন্মদিনের দিন রাতে। (সাদু)

–এতগুলো দিন হয়ে গেল আর আমি জানালাম না। কেমন তোরা? আমাকে একটু বলবি না?(আমি)

— তুই তখন অসুস্থ ছিলে। আর তোর ব্রেনে চাপ দিতে মানা করেছে ডাক্তার।(সাদু)

— কিন্তু তাই বলে এরকম একটা খবর না দিয়ে পারলি কিভাবে?(আমি)

— বোঝার চেষ্টা কর তুই। ওই মুহূর্তে বলাটা উচিত মনে হয়নি। (সাদু)

–কেমন আছেন ভাইয়া? (আমি)

–সে তো এতদিন ধরে আউট ওফ কন্টাক্ট।
(সাদু)

সেদিনের আউট অফ কন্টাক্ট আজ পর্যন্ত শেষ হয়নি। তার কোন হদিস কারো জানা নেই। সজল ভাইয়া আর নিয়াজ ভাইয়া তাকে একটা মাস ধরে খুঁজেছে কিন্তু তার ছায়ারো দেখা পায়নি কেউ। শুনেছি তার আম্মু নাকি মানসিকভাবে খুব একটা ভালো নেই।

এই দেড় বছর আমার জীবনেও পরিবর্তন এসেছে। আর তা হলো ভার্সিটির ওয়ান ইয়ার লস গিয়েছে। আমার জন্মদিনের আগে ভার্সিটির দ্বিতীয় বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা চলছিল। কেবলমাত্র একটা পরীক্ষা দিয়েছিলাম। ওই একটা পরীক্ষার পরে আমাদের ষোল দিনের একটা গ্যাপ ছিল। অর্থাৎ ষোল দিন পর আরেকটা পরীক্ষার ডেট ছিল।এই ষোল দিনের মাঝখানে আমার জন্মদিন পরে। আর তারপর সব ওলট-পালট হয়ে যায়। পরীক্ষা দিতে পারিনি আমি। এখনো দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী আমি আর সাদু তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী।

আমি সুস্থ হয়ে ভাইয়া আর ভাবি কে আমার ছাঁদে যাওয়ার কারণ বলে দেই। ভাইয়া আগে থেকেই এই সম্পর্কে কিছুটা অবগত ছিল বলে তার কাছে আর কোন কিছুই লুকায়িত রাখি নি। তবে বাবা এই সবের কোন কিছুই জানেনা।

সময় যেমন আমার কাছ থেকে দেড়টা বছর নিয়ে গিয়েছে ঠিক সেইভাবে আমার বর্ষণ সঙ্গী কেও নিয়ে গিয়েছে। তাকে ভালোবাসি কিনা বলতে পারবো না। তবে আমার মনের ভালোলাগার জায়গায় পুরোটা জুড়ে সেই ছিল। যদি কাউকে ভালোবাসতে হয় কখনো তবে তাকেই ভালবাসবো। একটা সময় যেই ম্যাসেজ গুলো আমার বিরক্তির কারণ ছিল এখন সেই ম্যাসেজ গুলো আমার একাকিত্বের সঙ্গী। প্রতিদিন রাতে তার পুরনো ম্যাসেজ পড়ে ঘুমাতে যাই। প্রতিদিন আমাদের যেমন দাঁত ব্রাশ করা রুটিন হয়ে গিয়েছে তেমন তার ম্যাসেজ পড়াটাও আমার রুটিন হয়ে গিয়েছে। বারান্দায় যখন একা থাকি তার গাছ গুলো আমাকে সঙ্গ দেয়। দুইদিন একদিন পর পরই রাতে লুকিয়ে লুকিয়ে ঘরের মধ্যে একা একা তার দেওয়া শাড়িটা পড়ে বসে থাকি। তার দেওয়া চুড়িগুলো প্রতিদিন রুটিন করে পড়ি। একদিন সাদা, একদিন কালো, একদিন লাল,একদিন নীল, একদিন হলুদ একদিন সবুজ এভাবেই কাটে আমার দিন। আমার প্রতিটা দিন শুরু হয় তার নাম নিয়ে। প্রতিটা দিন শেষ হয় তার নাম দিয়ে। প্রতিটা মোনাজাত শুরু হয় তার নাম নিয়ে প্রতিটা মোনাজাত শেষ হয় তার নাম দিয়ে।তার প্রতি আমার এমন অনুভূতি গুলোর নাম ভালো লাগাও দিতে পারে না আবার ভালোবাসাও বলতে পারি না। বারবার অনুভূতিগুলোর মানে খুঁজতে গেলে দোটানায় পড়ে যাই।

পরশুদিন থেকে আমার দ্বিতীয় বর্ষের সেই না দেওয়া ফাইনাল পরীক্ষা শুরু। সেই জন্যই সাদু নোট দিতে এসেছিল। আজ রাতেও পড়াশোনা শেষ করে তার পাঠানো চিঠি গুলো নিয়ে বসে আছি। পাশেই চুড়িগুলো রাখা। বসে বসে তার প্রথম দিনের পাঠানো সেই চিঠিটা পড়লাম। আজ দেড় বছর পর্যন্ত পড়ে আসছি। এক মুহূর্তের জন্যেও আমার কাছে মনে হয় না চিঠিটা পুরনো। যতই পড়ি ততই মনে হয় নতুন চিঠি পড়ছি। চিঠিটা পড়ে শুকনো বেলি ফুলের মালা হাতে নিয়ে ছুঁয়ে দেখলাম। তারপর একমুঠো সাদা চুরি আর একমুঠো নীল চুড়ি মিলিয়ে হাতে পড়ে নিলাম। নীল রঙটা তার পছন্দের ছিল।বারান্দায় গিয়ে হাত নেড়েচেড়ে একা একাই চুড়ির রিনরিনে আওয়াজ তুলে তা শুনতে লাগলাম। একটু পর রুমে এসে চুড়িগুলো খুলে ঠিকঠাকভাবে রেখে সবকিছু গুছিয়ে শুয়ে পড়লাম।

মাঝখানে এক দিন চলে গেল। আজ পরীক্ষা দিতে ভার্সিটিতে যাবো।হালকা নীল আর সাদার মিশ্রনে একটা থ্রি-পিছ পড়ে নিলাম। সাথে নীল রঙের একটা হিজাব পড়লাম। গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সাদুর জন্য অপেক্ষা করছি।ওর আমাদের বাসার সামনে আসার কথা। কিছু সময় দাঁড়ানোর পরেই সাদু এসে পড়ে।এসেই বলতে লাগে,,,

–কিরে এত আগে আগে দাঁড়াইয়া আছোস কেন? তোর জন্য তো আর পাত্র দেখতে যাইতাছি না।এতো তাড়া কিসের?

— আচ্ছা এরপর থেকে লেট করে আসবো।(আমি)

বলেই একটা রিকশা ডেকে তাতে চড়ে বসলাম। সাদু এসে আমার পাশে বসলো। রিকশায় পাঁচ মিনিট যাওয়ার পরে হঠাৎ সাদু বলে উঠলো,,,

— তুই আর আগের মত আমার সাথে ঝগড়া করছ না।

আমাদের মধ্যে আর কোন কথা হল না। রিক্সা এসে ভার্সিটির মেইন গেটের সামনে থামল। ভাড়া মিটিয়ে গেট দিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকে মাঠ পেরিয়ে পরীক্ষার হলে চলে আসলাম। ভালো ভাবে পরীক্ষা টা দিলাম। শেষ হতে হতে প্রায় সাড়ে চার টার বেশী বেজে গেল। নিচে নেমে ভবনের সামনে দাঁড়িয়েই সাদু কে কল করলাম। সাদু বললো ও ক্যান্টিনে আছে এখনি এসে পড়বে। একটু পরে হাতে দুইটা চিপসের প্যাকেট নিয়ে আমার সামনে হাজির হলো।

আমরা যে ভবনের সামনে দাড়িঁয়ে আছি তার সোজাসুজি আমাদের ভার্সিটি থেকে বের হওয়ার মেইন গেট। পকেট গেটটা খুলে হা করে রাখা। গেটের ওপাশের কিছু কিছু মানুষের যাতায়াত দেখা যাচ্ছে। সামনে আগানোর উদ্দেশ্যে পা বাড়ানো মাত্রই দেখতে পেলাম দুইটা ছেলে রাস্তা থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে ভার্সিটির পকেট গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে গেল। ছেলে দুইটা গেট দিয়ে প্রবেশ এর সাথে সাথে পিছনে আরো একজন ঢুকে পরল। প্রথম দুটো ছেলের গায়ে ছেঁড়াফাটা প্যান্ট আর গেঞ্জি। যাকে অনেকেই ফ্যাশন বলে থাকে। মাথার চুলগুলো আরেকটু বড় হলেই বোঝা যেত না এরা মেয়ে নাকি ছেলে। তবে এদের পিছনে যে লোকটা আসছে সে পুরো শুভ্র রঙে ঢাকা। অর্থাৎ সাদা পাঞ্জাবির সাথে সাদা পায়জামা। তবে গলায় একটা কালো রঙের শাল ঝুলিয়ে রাখা। দেখলেই বোঝা যায় শীত নিবারণের জন্য নয় বরং ফ্যাশনের উদ্দেশ্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। দৌড়ে আসার ফলে শালের শেষ দুই প্রান্ত দুইপাশে পতাকার ন্যায় উড়ছে। আমাদের থেকে তাদের দূরত্বটা অনেক বলে কারোই মুখমন্ডল স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে না। পাশ থেকে সাদু গুঁতো মেরে বলল,,,

— কিরে এইটা কোন কাবির সিং এর আবির্ভাব হলো?

ওর এই কথা বলার কারণ হলো সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত লোকটার দূরে থেকে গাল ভর্তি দাড়ি ছাড়া আর কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। মাথার চুলগুলো দৌড়ানোর কারণে উপর-নিচ হচ্ছে।আমি সাদু কে বললাম,,,

–এতো কাবির সিং কাবির সিং করছ কে?

–আরে পরশু তোদের বাসায় যাওয়ার আগে মুভিটা দেইখা তারপর তোদের বাসায় গেছিলাম।এখন শুধু মাথায় কাবির সিং ই ঘুড়ে।(আমি)

সাদুর কথা শেষ হতে না হতেই আমি আর সাদু দুজনেই আতঁকে উঠলাম। কারণ দৌড়ে আসা তিনজনের মধ্য থেকে পেছনের পাঞ্জাবি পরা লোকটা যখন দৌড়ে আসছিল তখন তার পাশ দিয়ে আমাদের ভার্সিটির জুনিয়র ছেলেরা হকিস্টিক নিয়ে খেলতে যাচ্ছিল। ওদের থেকে দুইহাতে দুইটা হকিস্টিক নিয়ে সামনের দুইটা ছেলেকে ইচ্ছেমত মারতে শুরু করলো। মারতে মারতে ক্যান্টিনের সামনে গিয়ে হাতে দুইটা কাঁটা চামচ তুলে নিল। এরপর যে দুইটা ছেলেকে মারছিল তাদের মধ্যে থেকে একজনের কাঁধে কাটা চামচ দুইটা বসিয়ে দিল। তখন পাশের ছেলেটা কাতর কণ্ঠে বলে উঠলো,,,

–কে আপনি ভাই? আমাদের সাথে কি শত্রুতা?আপনাকে তো চিনিও না আমরা। তখন পাঞ্জাবি পরিহিত লোকটা জোরে হুংকার দিয়ে বলে উঠলো,,,

–বড় ভাই!!! নাম মনে রাখিস।

সঙ্গে সঙ্গে ছেলেদুটো লোকটার পা জড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। ওদের কান্নাজড়িত কণ্ঠে ওরা কি বলছে তা একেবারেই অস্পষ্ট। এর মাঝেই আমাদের ভার্সিটির প্রিন্সিপাল স্যার নেমে আসলেন। সঙ্গে একখানা চেয়ার নিয়ে আসলেন। চেয়ার টা যে তার নিজের অফিস রুমে বসার তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমাদের প্রিন্সিপাল স্যারের পিছনে পিছনে ছুটছে তার অ্যাসিস্ট্যান্ট। আমাদের প্রিন্সিপাল স্যার দৌড়ে গিয়ে পাঞ্জাবি পরিহিত লোকটার পাশে চেয়ার টা রেখে তার হাত দিয়ে ঝেড়ে মুছে বলতে লাগলেন,,,

— স্যার প্লিজ আগে বসেন। প্লিজ বসেন স্যার।

প্রিন্সিপাল স্যার তার অ্যাসিস্ট্যান্ট কে উদ্দেশ্য করে বললেন,,,

–তোমার কি কোনো আক্কেল নেই তাড়াতাড়ি
ছাতা নিয়ে আসো।

স্যার একথা বলেছেন তার কারণ হলো আকাশ থেকে ছিটছিটে বৃষ্টির জল কনা পড়তে শুরু করেছে।

চলবে………

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
বোনাস পর্ব

আজ শুধু অবাকের উপর অবাক হচ্ছি।আসলে হচ্ছে টা কি তা দেখার জন্য আমি আর সাদু ক্যান্টিনের দিকে অগ্রসর হলাম।আমাদের ভিসি স্যার আর সেই লোকটার কাছে আসতেই আমার মুখ হা হয়ে যাওয়ার উপক্রম।পাশ থেকে সাদু গুঁতো মেরে বলল,,,

–ওই ছ্যামরি আমি যা দেখি তুইও কি তাই দেখছ?

–দেখমু না কেন?আমি চোখ কি মঙ্গল গ্রহে রাইখা আইছি নাকি। তুইও যেখানে আমিও সেখানে। একই জিনিস দেখতাছি আমরা। (আমি)

আমাদের অবাকের কারণ হলো এমুহূর্তে ভিসি স্যার আর সেই লোকটা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে হাসছে।আর এর চেয়েও তাজ্জব বেপার হলো মুখে একগাল দাঁড়ি ভর্তি লোকটাই আমাদের নিখোঁজ হওয়া আলআবি ভাইয়া। কিন্তু একি হাল?এ কেমন বেশভূষা? তার এরূপ বেশে আমরা তাকে চিনতে ভুল করছিলাম। কিন্তু কাছে এসে তাকে পরখ করতে ই আর তার কন্ঠেই তাকে চিনতে পারলাম। সাদু আর আমি একজন আরেক জনের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে পুনরায় সামনে তাকালাম। এতক্ষণে এখানে সদরঘাটের জটলা পেকে গিয়েছে। এরমধ্যে আলআবি ভাইয়া আমাদের ভিসি স্যার কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,,,

–স্যার অভিনয় কিন্তু বেশ ভাল করেন।

বলেই দুজনে আবার হো হো করে হাসতে লাগলেন। তাদের কান্ড কাহিনী দেখে কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না। মনে হচ্ছে আমি নিজেই পাবনা থেকে পালিয়ে এসেছি। আমরা আলআবি ভাইয়ার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তবে তার দৃষ্টি সীমানার মধ্যেই ছিলাম। কিন্তু একবারের জন্যেও তার চোখ আমাদের দিকে পরল না।

আমাদের ভিসি স্যার হাসি থামে বলে উঠলেন,,,

— চলেন তাহলে স্যার। এদের কাহিনী অফিস রুমে বসে বসে শুনব।

সাদু ফিসফিসিয়ে আমাকে বলল,,,

–ওই স্যারের মাথার তার কি সবগুলা তার বউ রাইখা দিছে নাকি?

–কোন মোমেন্টে কি কছ তুই? (আমি)

–আরে তার যদি বাসায় নাই রাইখা আসে তাইলে আলআবি ভাইয়ারে স্যার স্যার কইতাছে কেন?(সাদু)

–আমারে দেইখা সবজান্তা শমসের মনে করিছ না।(আমি)

–কিরে হঠাৎ কইরা আবার আগের ফর্মে চইলা আসছোস দেখি।(সাদু)

— তোর মুখটা রে একটু শান্তি দে। একটু চুপ কর। আর নিয়াজ ভাইয়া রে ফোন লাগা।(আমি)

–এহ আমার ব্যালেন্স শেষ হইয়া যাইব।আর তোর ফোন কই?(সাদু)

–এখন যদি তোর মোবাইল থিকা নিয়াজ ভাইয়ার কাছে কল না যায় তাইলে তোর হিজাব টা শেষ হইয়া যাইব। আর আমার ফোনে ব্যালেন্স নাই।(আমি)

–ঠিক আছে। কিন্তু কল দিয়া কি কমু?(সাদু)

–কবি তোর জামাই মরছে।বলদ ছেরি!(আমি)

ওর সাথে আর কথা না বাড়িয়ে ওর থেকে ফোনট নিয়ে নিয়াজ ভাইয়া কে কল করলাম। এরমধ্যে আলআবি ভাইয়া আর ভিসি স্যার চলে গেলেন অফিস রুমে। নিয়াজ ভাইয়া কে গুনে গুনে ৮ বার কল করেও পেলাম না।

ভার্সিটি থেকে মাত্র ১০ মিনিট হেঁটে গেলেই ভাইয়ার অফিসে পৌঁছে যাওয়া যায়। সাদুকে নিয়ে ভাইয়ার অফিসে যাওয়ার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। একটু পরেই ভাইয়ার অফিস ছুটি হয়ে যাবে। এখন ভাইয়ার অফিসে গেলে একসাথে বাসায়ও যেতে পারবো। ভার্সিটি থেকে বের হয়ে কিছুদূর আগাতেই বৃষ্টির তেজ কিছুটা বেড়ে গেল। বৃষ্টি মাথায় করেই সামনে পা বাড়ালাম। ঠিক সেই মুহূর্তেই পিছন থেকে পরিচিত কন্ঠ ভেসে আসল,,,

— এই মেয়ে!

আমি আর সাদু দুজনেই পিছনে ফিরে তাকালাম।দেখি আলআবি ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছেন।আমাদের ঘুরে দাঁড়াতেই আমার মুখের উপর তার কালো শাল টা ছুড়ে মারলেন।মুখ থেকে ওটা সরিয়ে যেই না কিছু বলতে যাব অমনি সে আবার বলে উঠলেন,,,

–দুজন ভাগ করে গায়ে জড়িয়ে নিও।আর মনে করে কালকের মধ্যে আমার জিনিস আমাকে ফেরত দিয়ে যেও। আমি ফ্রিতে কাউকে কিছু দেই না।

কথা গুলো বলেই আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই উনি গট গট করে চলে গেলেন। আমার মাথায় একটাই প্রশ্ন শুধু ঘুরছে। উনি এতোদিন কোথায় ছিলেন?আর ওই ছেলে গুলোকেই কেন বা মেরেছেন?আমাদের ভিসি স্যার কে কিভাবে চিনেন?আর চিনলেই বা এতো সখ্যতা কিসের? আমার ভাবনার মধ্যেই আমাদের সামনে একটা রিকশায এসে থামে। রিক্সাওয়ালা বলে উঠেন,,,

— আপুমনিরা যাবেন না?

ভাইয়ার অফিসে পৌঁছাতে রিকশার কোন প্রয়োজনই নেই। কিছুসময়ের রাস্তা মাত্র। তাও রিক্সাওয়ালার জোরাজুরিতে আমি আর সাদু উঠে বসলাম। সাদু আর আমি আমাদের ভার্সিটিতে হওয়া ঘটনাগুলো আর আলআবি ভাইয়াকে নিয়ে গবেষণা করতে করতে ভাইয়ার অফিসের সামনে এসে নামলাম।

অফিসের ভিতরে ঢুকে একজনকে জানালাম আমরা নিয়াজ ভাইয়ার সাথে দেখা করতে এসেছি। লোকটা আমাদের বসতে বলে ভেতরে চলে গেলেন। একটু পর আবার এসে আমাদের ভাইয়ার কেবিনে নিয়ে গেলেন। ভাইয়ার কেবিনে ঢুকে কোনরকম ভনিতা না করে গড়গড় করে বলতে লাগলাম,,,

–ভাইয়া আলআবি ভাইয়া ফিরে এসেছেন। আমাদের ভার্সিটিতেই তাকে দেখেছি।

আমার কথা শুনে নিয়াজ ভাইয়া তড়িৎগতিতে বলে উঠল,,,

–এত তাড়াতাড়ি?

আমি আর সাদু ভাইয়ার কথা শুনে কি বলব বুঝতে পারছি না। আমি বললাম,,,

— কি?

ভাইয়ার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছে। কেমন যেন হাঁসফাঁস করছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে ভুল কিছু বলে ফেলেছে। তখনই ভাইয়া বলে উঠলো,,,

— না মানে। এত তাড়াতাড়ি ওকে পেয়ে যাবো এটা ভাবিনি।

কথাটা বলার সাথে সাথেই ভাইয়ার মুখে চওড়া হাসির রেখা স্পষ্ট দেখতে পেলাম। ভাইয়ার অফিসে কিছু সময় বসে থেকে ভাইয়ার সাথেই আমরা বের হলাম।ভাইয়াকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে আজকে খোশ মেজাজে আছেন।হয়তোবা বন্ধুর খবর পেয়ে খুশি। কিন্তু ভাইয়ার আচরণ কিছুটা অস্বাভাবিক লাগলো। তার মধ্যে খুব একটা উৎফুল্লতা দেখতে পেলাম না। তবে এটুকু বোঝাই যাচ্ছে যে ভাইয়া খুব খুশি হয়েছে। ভাইয়া আমার থেকে আর কোন কিছইু জানতে চাইল না।আমরা তিনজন একটা রিকশায় করে বাড়ির পথে রওনা হলাম।

বাসায় এসে শুধু আলআবি ভাইয়ার ব্যাপারটাই বারবার মাথায় ঘুরছে। তখন খেয়াল করলাম আলআবি ভাইয়ার দেওয়া শাল টা পড়ার টেবিলের পাশের চেয়ারটায় ঝুলছে।ওটা দেখেই একটা কথা মনে পরে গেলো – “দুজন ভাগ করে গায়ে জড়িয়ে নিও”।ব্যাস মাথায় শয়তানি বুদ্ধি আসতে আর সময় লাগলো না।

রাতে খাবার খেয়ে রুমে আসলাম। রিলাক্স এর একটা ঘুম দেব বলে।কালকে কোনো এক্সাম নেই আছে তার পরের দিন। খাবার টেবিলে বসেও সেই এক সংবাদ-“আলআবি ভাইয়া কোথায় ছিল”? আজকের দিনটাই পুরো আলআবিময় হয়ে গিয়েছে। রাতে খাওয়া দাওয়ার পর রুমে এসে আমার সেই পুরনো অভ্যাস চালু হলো।একবার করে সব চিঠি গুলো পড়ে, চুড়ি গুলো থেকে কালো রঙের চুড়ি পরে আবার পুনরায় সব পরিপাটি করে রেখে দিলাম।

চলবে………

[বিঃদ্রঃ গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক। অনুগ্রহ করে বাস্তবিক অর্থ খুজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না আর লেখিকা কে ও বিভ্রান্ত করবেন না]

বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-২২

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_২২

–আমার সম্পদ আর আমাকেই জিজ্ঞেস করছো মালিক কে?

ম্যাসেজটা পড়ে মনের মধ্যে অন্যরকম একটা প্রশান্তির হাওয়া বইছে।মনের মধ্যে চেপে রাখা একটা প্রশ্ন করে বসলাম তাকে।

–আচ্ছা আমাদের দেখা হবে কোথায়?

ওপাশ থেকে জবাব এলো,,,

— ঠিক সময়ে জানিয়ে দেব।

এই লোকটা কেমন যেন অদ্ভুত। সব কিছুই আমার কাছে ধোঁয়াশা ভাবে উপস্থাপন করেন। তাকে বিদায় জানিয়ে শান্ত মস্তিষ্ক নিয়ে খুব আরাম করে ঘুমাতে গেলাম।

কোন একটা পে পো ধরনের বিকট শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ মেলতে আমার সামনে তাসফি আপুকে আবিষ্কার করলাম। হাতে একটা কেক নিয়ে দাঁড়ানো।পাশেই দাঁড়িয়ে আছে নিয়াজ ভাইয়া হাতে দুইটা বেলুন নিয়ে।আমি উঠতেই সাথে সাথে বেলুন দুইটা ফাটিয়ে ফেলল। আমার মাথার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সাদু। ঠিক মাথার পাশে নয় বলতে গেলে একেবারে কানের পাশে একটা বাঁশির মতো কিছু নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।আরেক কানের পাশে একটা ছোট্ট বক্স থেকে সুর ভেসে আসছে…

আজকের আকাশে অনেক তারা
দিন ছিল সূর্যে ভরা
আজকের জোছনাটা আরও সুন্দর
সন্ধ্যাটা আগুন লাগা
আজকের পৃথিবী তোমার জন্য
ভরে থাকা ভালো লাগা
মুখরিত হবে দিন গানে-গানে আগামীর সম্ভাবনায়
তুমি এই দিনে পৃথিবীতে এসেছো শুভেচ্ছা তোমায়
তাই অনাগত ক্ষণ হোক আরও সুন্দর উচ্ছল দিন কামনায়
আজ জন্মদিন তোমার।

গানটা শুনে ওদের মতলব বুঝতে পারলাম। উঠে বসে ঠোঁটের কোণে একটা চওড়া হাসি নিয়ে সবার দিকে তাকালাম। নিয়াজ ভাইয়া গানটা বন্ধ করে দিল। এবার সবাই একসাথে বলতে লাগলো “হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার জুইঁ, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ”। ওদের এমন কর্মকাণ্ডে চোখ বেয়ে খুশির জলকণা পরল। বিগত তিন চার বছরে সাদু, বাবা আর নিয়াজ ভাইয়া ছাড়া কেউ আমাকে বার্থডে উইশ করেনি। আমার জন্মদিন টা উইশ করা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ ছিল। আর কোনো আয়োজন হতো না। হবেই বা কি করে?বিগত দুই বছর ছিলাম জায়েফের বাড়িতে। সবাই কেবল ফোন করে একটু খোঁজখবর নিতো আর উইশ করতো। ব্যাস এইটুকুই ছিলো আমার জন্মদিন। জায়েফের বাড়িতে যাওয়ার তিন বছর আগেই নিয়াজ ভাইয়া বিদেশে চলে গিয়েছিল। বাবা জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালেও কখনো কেক কাটা হতো না। কারণ বাবা এসব পছন্দ করেন না। কমলা আন্টি আমার জন্মদিনের দিন আমার পছন্দের খাবার রান্না করে দিয়ে যেত। আর সাদু সেই সকালে আসতো সারাদিন বাসায় থাকত আর রাতে চলে যেত।

আজকে ওরা যে বাবার অগোচরে আমার রুমে এসে এসব কর্মকাণ্ড করছে তা আমি ভালোই জানি। কারণ এই সময়ই বাবা বাইরে হাঁটতে যান। ফ্রেশ না হয়েই কেক টা কাটলাম। তারপর সবাইকে একটু একটু করে মুখে তুলে দিলাম। সাদু আমার জন্য নিজের হাতে চটপটি বানিয়ে নিয়ে এসেছে। তার সাথে একটা চকলেট বক্স আর একটা কালো হিজাব এনেছে। কালো হিজাব এনেছে কেন তার কারণও আমি জানি। আমার বেশিরভাগ সময়ই কালো হিজাব পরা পড়ে। বলতে গেলে কালো হিজাবটা সবচেয়ে বেশি প্রিয়।

আজ আলআবি ভাইয়া আর সজল ভাইয়া বাসায় আসবে।তার কারণ হলো দুইটা।এক,আমার জন্মদিন বলে আর দুই, তাসফি আপুর হাতের রান্না খাবে বলে।ভাইয়ার বিয়ের পর এই প্রথম তারা দুই জন আমাদের বাসায় আসবে। তাই সজল ভাইয়ার কথা হলো ভাবির হাতের রান্না খাবে।

দুপুরে গোসল করে বের হতেই উপলব্ধি করি পুরো বাড়িতে আমার পছন্দের খাবারের ঘ্রাণ ছড়িয়ে পরেছে।দুইটার দিকে আমাদের বাসায় সজল ভাইয়া, আলআবি ভাইয়া আর সাথে আরেকটা ভাইয়া আসে।পরিচয় পর্বে জানতে পারি তার নাম সাঈম। সাঈম ভাইয়া নিয়াজ ভাইয়ার ভার্সিটি ফ্রেন্ড। তাদের দুজনের যোগাযোগ ছিল কিন্তু বাসায় আসা হয়নি কখনো। আজকেই প্রথম আমাদের বাসায় এসেছে।তাদের কথা বলাতেই বুঝতে পেরেছি সাঈম ভাইয়া একটু অন্য ধাঁচের ব্যাক্তিত্ব বহন করে।কিছুটা ফ্লার্টবাজ টাইপ।সাথে কিছু টা রসিকও বটে। অবশ্য সাঈম ভাইয়া দেখতে মন্দ নন।

দুপুরে খাবার এর টেবিলে আমি,সাদু, বাবা,নিয়াজ ভাইয়া,তাসফি আপু,আলআবি ভাইয়া, সজল ভাইয়া আর সাঈম ভাইয়া বসে খাচ্ছিলাম। আমার ঠিক সামনে বসেছে সাঈম ভাইয়া।তার একপাশে সজল ভাইয়া আর আরেক পাশে আলআবি ভাইয়া।খাওয়ার মাঝে মনে হলো আমার পায়ে কেউ অনবরত গুঁতো দিয়ে যাচ্ছে। একবার মনে হচ্ছে কেউ সামনে থেকে গুঁতো মারছে আরেকবার মনে হচ্ছে কেউ আড়াআড়ি ভাবে গুঁতো মেরে যাচ্ছে। এভাবে আমি শান্তি মতো আমার প্রিয় ইলিশ মাছ টা খেতেও পারছি না।এতোক্ষণের গুঁতো গুঁতিতে মেজাজ টা এবার বিগড়ে গেলো। জোরে আমার সামনে থাকা পা জোড়ায় একটা লাথি মেরে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমার সামনে বসা সাঈম ভাইয়া চিৎকার দিয়ে উঠল। তার দিকে তাকিয়ে আমি নিজেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলাম। তখন নিয়াজ ভাইয়া বলে উঠল,,,

— কোন সমস্যা?

সাঈম ভাইয়া কিছু টা কাতর কন্ঠে বলে উঠলো,,,

–দোস্ত কে যেন লাথি মারলো।

সাঈম ভাইয়ার কথা শেষ হতে না হতেই টেবিলের উপর রাখা আমার ফোনটা তে আলো জ্বলে উঠল বুঝতে পারলাম কোন ম্যাসেজ এসেছে। খাবার টেবিলে সবাই একসাথে থাকবে বলে ফোনের সাইলেন্ট মুড অন করে নিয়েছিলাম। বাহাতে টেবিলের নিচে ফোনটা নিয়ে দেখি একটা আননোন নাম্বার থেকে ম্যাসেজ এসেছে,,,

“খাবার খাওয়ার সময় কেবল খাবারের দিকেই সব ধ্যান জ্ঞান দিলে চলে না। আশে পাশেও তাকাতে হয়। তাড়াতাড়ি জামার ওড়না ঠিক করো”

ম্যাসেজটা পড়ে তড়িৎ গতিতে নিজের দিকে তাকালাম আসলেই আমার ওড়না কিছুটা সরে এসেছে। একটু নড়েচড়ে নিজেকে পরিপাটি করে বসলাম। তবে বোধগম্য হচ্ছে না এই মহান ব্যক্তিটা কে। আমার চিন্তা ভাবনার মধ্যেই আলআবি ভাইয়া সজল ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,,,

–সজল আমি নতুন সিম নিয়েছি তোর ফোনে কল করেছিলাম।দেখ লাস্টের দুইটা ডিজিট ৫৯,গ্রামীন নাম্বার।

— ভাই এত জরুরি কথাতো পরেও বলতে পারতি। একটু শান্তিতে খেতে দেনা।(সজল ভাইয়া)

আলআবি ভাইয়ার বলা কথাটা আমার কর্ণপাত হতেই তাড়াতাড়ি করে আমার মোবাইলে আসা ম্যাসেজটার নাম্বারটা আবার চেক করে নিলাম। নাম্বারটা আলআবি ভাইয়ার বলা নাম্বারটার সংক্ষিপ্ত ডিটেইলস এর সাথে মিলে যায়। মাথা তুলে আলআবি ভাইয়ার দিকে তাকালাম। দেখি সেও আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তবে আমি তাকানোর সাথে সাথে একটা বেপরোয়া ভাব নিয়ে নিজের মতো করে খেতে লাগলেন। এই লোকটার এমন ভাব দেখলে গা জ্বলে যায়। সাহায্য করবে ঠিকই কিন্তু পরে আবার এমন ভাব করবে যেন মনে হচ্ছে সাহায্য করে আবার আমাকে খোটা দিচ্ছেন। তবে এই মুহূর্তে সাঈম ভাইয়ার কথা মনে করে বেশ খারাপ লাগলো। কারন বেচারাকে খুব জোরেই একটা লাথি মেরেছিলাম।

খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে আমরা সবাই ড্রইং রুমের ফ্লোরে মাদুর পেতে গোল হয়ে বসে পড়লাম। আমাদের উদ্দেশ্য হলো সবাই মিলে বালিশ ছোড়াছুড়ি খেলব। বুদ্ধিটা অবশ্য তাসফি আপু আর সাদুর।সকাল বেলার সেই ছোট্ট বক্সটায় ছোট্ট করে গান ছেড়ে দিলাম। অর্থ্যাৎ কিছু টা কম সাউন্ড দিয়ে। কিছুসময়ের মধ্যেই আমাদের খেলার আসর জমে উঠলো। খেলার শেষ পর্যায়ে গিয়ে টানটান উত্তেজনার মধ্য দিয়ে নিয়াজ ভাইয়া আর আলআবি ভাইয়ার মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করল আলআবি ভাইয়া।

গত মাসেই আলআবি ভাইয়ারা বাসা চেঞ্জ করে আমাদের এলাকায় শিফট হয়েছেন। তার প্রধান কারণ হলো আলআবি ভাইয়ার অফিস। আমাদের এখান থেকে অফিস টা একটু কাছে বলে তারা বাসা শিফট করে এই এলাকায় এসেছেন। নিয়াজ ভাইয়ার থেকে শুনেছিলাম আমাদের বাসা থেকে তাদের বাসায় যেতে আধা ঘন্টার পথ অতিক্রম করতে হয়। তাই আলআবি ভাইয়া আজ আমাদের বাসা থেকে একটু দেরী করেই বের হবেন।সজল ভাইয়া আজকে আলআবি ভাইয়ার বাসায় থাকবেন।

সন্ধ্যার দিকে সাঈম ভাইয়া চলে যায়। সাদুকে আগেই বলে দিয়েছিলাম ও যেন আজকে রাতে আর বাসায় না যায়। তার একমাত্র কারণ হচ্ছে আমার বর্ষণ সঙ্গীর সাথে দেখা করতে যাওয়া। একা থাকলে কোনো বাহানা দিতে পারব না। কিন্তু সাদু থাকলে কোনো রকমের বাহানায় বাসা থেকে বের হতে পারব। সাদুকে যখন বলেছি আমি আমার বর্ষণ সঙ্গীর সাথে দেখা করতে যাব। তখন ও নিজে থেকেই বলেছে আমাকে দেখা করার জন্য ও রাতটা থেকে যাবে।

বিকেল পর্যন্ত খুশিই ছিলাম। তবে ধীরে ধীরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে যখন চারদিকে অন্ধকার হয়ে রাত বাড়তে লাগল তখন আমার মনেও অন্ধকার নামতে লাগল। কারণ বর্ষণ সঙ্গীর কোন খোঁজ খবরই নেই। তাকে ম্যাসেজ দিয়েছিলাম কিন্তু সে আমাকে কোনো উত্তর দেয়নি। বিকেলবেলা সাদুর সাহায্য নিয়ে তার দেওয়া শাড়িটা পড়ে অপেক্ষায় ছিলাম কখন এসে দেখা করার কথা বলবে। কিন্তু একটু আগে এশারের আজান দিয়ে দিয়েছে বলে শাড়ি টাও খুলে ফেললাম। মনটা বিষন্নতায় ভরে গেল। আজ বুঝি আর তাকে দেখা হবে না। খুব খারাপ লাগছে এই মুহূর্তে।মনে হচ্ছে একটু পরেই আমার চোখের জল গড়িয়ে পড়বে। সাদু শুধু আমাকে সান্ত্বনা দিয়েই যাচ্ছে। একটু পর পরই বলছে “আসবে আসবে”।কিন্তু তার তো আসার কোন নামই নেই। আর কখনোই বা আসবেন? রাত ৮ টার বেশি বাজে। অপেক্ষা করতে করতে রাতের ডিনারটা সেরে ফেললাম। কিন্তু সে এখনো ম্যাসেজ দেয়নি। সজল ভাইয়া আর আলআবি ভাইয়া বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে। রাত প্রায় সাড়ে দশটা। বিষন্নতায় ঘেরা ভাঙ্গা মন নিয়ে ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। অজান্তেই চোখের কার্নিশ বেয়ে এক ফোটা জল গড়িয়ে পড়ল। চোখের জল পড়তে দেরি কিন্তু আমার ফোনের মেসেজ টোন বাজতে দেরি হলো না। তাড়াতাড়ি করে উঠে তড়িৎ গতিতে ফোনের ম্যাসেজ চেক করলাম। যে কাঙ্খিত ব্যক্তির ম্যাসেজ দেয়ার কথা ছিল সেই ই ম্যাসেজ দিয়েছে।

” প্রথমেই আমার বর্ষণ সঙ্গিনীকে অনেকগুলো সরি জানাই। সরি! সরি! সরি!তিন সরি বললাম। এবার ঝটপট করে তোমাদের বাসার ছাদে এসে পড়ো”।

ম্যাসেজটা পড়ে খুশিতে আটখানা হয়ে বাসার পুড়নো থ্রি পিছটা পড়েই দৌড় লাগালাম। একদৌড়ে দরজার সামনে এসে দরজা খুলে যেই না পা বাড়াতে যাব অমনি কেউ এসে পিছন থেকে খপ করে আমার হাতের বাহু ধরে ফেলল। এরকম হওয়ায় অনেকটা ভয় পেয়ে গেলাম। কিন্তু পরক্ষনেই পিছনে তাকিয়ে দেখি আমার কলিজার বান্ধবী শয়তান মার্কা একটা হাসি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর এমন হাসি দেখে অগ্নিমূর্তি হয়ে ওর দিকে তাকালাম। সঙ্গে সঙ্গে গড় গড় করে ও বলতে লাগল,,,

— বইন এমনে তাকাইছ না। তোরে এহন পুরাই পেত্নীর মত লাগতাছে। একটু নিজের দিকে তাকা।দেখ তুই কি পইড়া আছোস?এমন রংচঙ ওঠা জামা পইড়া তো আমি হাগতেও যাইনা। এগুলো পইড়া যদি তুই আমার জিজুর সামনে যাছ মান-সম্মান তোর না গেলেও আমার যাইবো।

ওর কথা শুনে আমি আমার পরনের জামার দিকে তাকালাম সত্যিই জামাটা একেবারেই বেমানান। রং জ্বলে গিয়ে খুব বিশ্রী অবস্থা জামাটার। নিজের অবস্থা উপলব্ধি করতে পেরে সাদুর দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলাম। তারপর সাদু আমার হাত ধরে টেনে রুমে নিয়ে আসলো। পুনরায় ও আমাকে খুব যত্ন করে সেই শাড়িটা পরিয়ে দিল। এরপর আমি নিজ হাতে সাদুর কালো হিজাবটা পড়ে নিলাম। কালকের দেয়া তার সেই আধশুকনো বেলি ফুলের মালাটা এক হাতের কব্জিতে জড়িয়ে নিলাম।কাঁধের একটু নিচে সেফটি পিন দিয়ে গোলাপ গাছ থেকে একটা হালকা হলুদ গোলাপ নিয়ে আটকে দিলাম।সাদু আমাকে চার দিকে ঘুড়িয়ে ঘুড়িয়ে দেখে বলে উঠলো,,,

–একদম মাশাল্লাহ। পুরা ঝাক্কাস। এবার যা। সিমরান টাইপ একটা দৌড় দিয়ে চলে যা।

ওর কথায় একটু লজ্জা পেলাম। এরপর হাতে মোবাইলটা তুলে দেখি এগারোটা বেজে গিয়েছে। তাই তাড়াতাড়ি করে দরজা খুলে বের হতে যেয়ে আবার ভেতরে ঢুকে পড়লাম। সাদুকে এসে জিজ্ঞেস করলাম,,,

–ভাবি বা ভাইয়া যদি খোঁজ করতে আসে তখন কি হবে?

— তোমার ভাই ভাবী এখন রোমান্সে বিজি আছে। প্যারা নাই। চিল চিল। যা তুই মনের সুখে তোর বর্ষণ সঙ্গীরে দেইখা আয়।(সাদু)

— ওই ছ্যামরি তুই জানোছ কেমনে আমার ভাই ভাবী এখন কি করে?(আমি)

— আরে বোইন এইটা কমন সেন্স এর ব্যাপার। নতুন নতুন বিয়ে হইছে। এখন তুমি বুঝবা না তোমার বিয়ে হইয়া নেক তারপর বুঝবা।(সাদু)

— ও নিজে তে মনে হয় যেন ১০০ টা বিয়ে কইরা বইসা আছো।(আমি)

–বোইন তোর কি যাইতে মন চাইতাছে না? এতোক্ষন তো কাইন্দা সব ভাসাইয়া ফেললি।যা এখন দয়া কইরা।(সাদু)

ওকে একটা মুখ ভেংচি দিয়ে আমি আমার গন্তব্যে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলাম। কয়েক ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে এসে কেমন যেন গা ছমছম করে উঠল। কারন এখানে আলো বলতে গেলে একেবারে নেই ই। প্রথমে ভেবেছিলাম অন্ধকারে উঠতে পারব তবে এখন মনে হচ্ছে ফোনের ফ্লাশ লাইট জ্বালাতে হবে। ফোনের লাইট জ্বালানোর জন্য ফোনটা অন করে অর্ধেক পিনকোড দিয়েছি, ঠিক সেই সময়ে কেউ একজন ঝড়ের গতিতে নেমে এসে আমার সঙ্গে ধাক্কা লাগিয়ে চলে গেল। ধাক্কা সামলাতে না পেরে আমার হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেল। ফোনের সাথে আমিও ছিটকে আমার দাঁড়ানো সিঁড়ি থেকে কয়েক ধাপ নিচে পড়ে গেলাম। পড়ে গিয়ে মাথার মধ্যে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করতে পারলাম। মনে হচ্ছে কোন ব্ল্যাকহোল আমাকে গিলে ফেলছে। চারপাশে অন্ধকার দেখে আমার মনে হচ্ছে সব অন্ধকার গুলো আমার চোখে এসে ভর করছে। বুঝতে পারছি ধীরে ধীরে আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে।

চলবে…..……

[বিঃদ্রঃ গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক। অনুগ্রহ করে বাস্তবিক অর্থ খুজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না আর লেখিকা কে ও বিভ্রান্ত করবেন না]

বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-২১

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_২১

–কলেজ শেষে কলেজের সামনে থেকেই অটো করে বাড়ি ফিরছিলাম।একই অটোতে তোমার ভাইয়া গাজীপুর থেকে তোমার নানা বাড়ি ফিরছিল।দুজন একেবারে মুখোমুখি হয়ে বসেছিলাম। আমার যেই স্ট্যান্ডে নামার কথা তার পরের স্ট্যান্ডে নামার কথা তোমার ভাইয়ার।কিছু দূর আমাদের অটো চলার পরে অপর পাশ থেকে আসা আরেকটা অটোর সাথে আমাদের অটোটার ধাক্কা লাগে। ধাক্কা লেগে আমাদের অটো কিছুটা কাত হয়ে যায় আর আমি অটো থেকে পড়ে যাই।পড়ে গিয়ে মাথায় সামান্য ব্যাথা পাই। কিন্তু হাতের কনুইটা খুব বিশ্রিভাবে ছিলে যায়।রাস্তায় বসেই চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে।আশে পাশের সবাই আমার চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে হায় হুতাশ আর দুঃখ প্রকাশ করছিল।আমাকে যে কেউ এসে একটু ধরবে সেই চিন্তা ভাবনা কারো মধ্যেই নেই। তখন ভিড় ঠেলে একজন যুবক এসে তাড়াহুড়ো করে আমাকে ধরে রিকশায় উঠিয়ে হসপিটালে নিয়ে যায়। আর সেই যুবক টাই হলো তোমার নিয়াজ ভাইয়া। এরপর ওইদিনই তোমার ভাইয়া আর আমার মধ্যে ফোন নাম্বার আদান-প্রদান হয়।বাবাকেও তোমার ভাইয়াই কল করে আমার কথা জানায়।হসপিটাল থেকে বাড়ি আসার পর তোমার ভাইয়া রাতে কল করে খোজ নেয়ার বাহানাতে আমার সাথে কথা বলতো।আমারও কথা বলতে বেশ ভালো লাগতো। এইভাবেই আমাদের একে ওপরের ভালো লাগার সূত্রপাত ঘটে। আর তারপর প্রণয় ঘটে।

তাসফি আপু একনাগাড়ে কথা গুলো বলে তারপর দম ছাড়লো।আমার কাছে ওদের দুজনের প্রণয়ের রচনা টা খুব ভালো লাগলো।আমি উৎসুক হয়ে জানতে চাইলাম,,,

–আচ্ছা আপু তোমার ফ্যামিলি নিয়াজ ভাইয়ার কথা প্রথম কিভাবে জানলো?

আমার কথায় তাসফি আপু খিলখিল করে হেসে উঠলো। তারপর বলল,,,

–তোমার ভাই প্রেম নিবেদন করতে এসে আমার আব্বার কাছে হাতেনাতে ধরা পড়েছিল।

আমি আরো উৎসুক হয়ে বলে উঠি,,,

–সেইটা কিভাবে?

পুনরায় আপু বলতে লাগলো,,,

–আমাদের মাঝে কথা হতে হতে একপর্যায়ে খুব ভালো বন্ডিং হয়ে যায়। এরমাঝে ৪ মাস কেটে যায়। ৪মাস পরে তোমার ভাইয়া আবার গ্রামে আসে আমার সাথে দেখা করবে বলে।অবশ্য আমাকে বলেছিল তার নাকি আমাকে কিছু বলার আছে। বাসা থেকে খুব একটা বের হতে দিত না আমাকে। আমাদের প্ল্যান ছিল সন্ধ্যার দিকে আমাদের বাড়ির পিছন সাইডে আমরা দেখা করব। বাড়ির পিছন সাইডে ওই দিন তোমার ভাইয়া নাকি এসে আমাকে কিভাবে প্রপোজ করবে সেটা প্র্যাকটিস করছিল। আমার আসতে একটু দেরি হচ্ছিল আর দুর্ভাগ্যবশত তোমার ভাইয়াকে ওই অবস্থায় আমার আব্বা দেখে ফেলে। আব্বার যা বোঝার বুঝে ফেলে। আমার আব্বা খুব একটা রাগী মানুষ নয়। সবকিছু ঠান্ডা মাথায় সামলান।সেদিন তোমার ভাইয়াকে আব্বা বুঝিয়েছে তোমার ভাইয়ার প্রেম করার বয়স হলেও আমার প্রেম করার বয়স হয়নি। আর সাথে নাকি এটাও বলেছিলো তোমার ভাইয়া যদি নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে পারে তাহলে আমাদের কথা ভেবে দেখবেন।

–নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলেছি আমার বোনের সাথে গল্প করার জন্য নাকি?

হঠাৎ করে নিয়াজ ভাইয়ার কণ্ঠ শুনেই আমি আর আপু দুজনেই পেছন ফিরে তাকালাম। তাকিয়ে দেখি ভাইয়া দুহাত বুকে গুঁজে দেয়ালের সাথে হেলে দাড়িয়ে আছে। আমি একটু মুচকি হেসে বলে উঠলাম,,,

–ভাইয়া কখন এসেছ?

–যখন থেকে ম্যাডাম আমাদের প্রেম কাহিনী শুরু করেছেন তখন থেকে।(নিয়াজ ভাইয়া)

–এসে যখন পড়েছ তাহলে এবার দুজনে মিলে আমাকে তোমার আর তাসফি আপুর প্রেম কাহিনী শোনাও।(আমি)

— তাসফি আপু কিরে? এতগুলো কচকচে নোট খরচ করে বউ নিয়ে আসলাম আপু ডাকার জন্য নাকি? ভাবি ডাকবি এরপর থেকে।(নিয়াজ ভাইয়া)

নিয়াজ ভাইয়া এসে আমাদের গল্পের আসরে যোগদান করল। আমাদের গল্পের আসর শেষ হতে প্রায় এগারোটা বেজে গেল। এর মাঝখানে রাতের খাবার খেয়ে নিয়েছিলাম তারপর আবার গল্প শুরু করেছিলাম।

ঘড়ির কাটায় রাত প্রায় আড়াইটা ছুইঁ ছুইঁ। বৃষ্টি তার জলকণা দিয়ে প্রকৃতিকে স্নান করিয়ে দিচ্ছে সেইসাথে পরিবেশকে করছে শীতল। আমার গাঢ় ঘুমটাকে ফোনের রিংটোন বেজে ছুটি জানাচ্ছে। ঘুমটাকে কোনমতেই ছুটি দিতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ঘুম আমার চোখের পাতাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। কিন্তু একই সাথে মস্তিষ্ক জানান দিচ্ছে ফোনের ওপাশ থেকে কেউ আমাকে ডেকে যাচ্ছে। ফোনটা বেজে যাচ্ছে তো বেজেই যাচ্ছে। কোন প্রকার ক্লান্তিই তাকে গ্রাস করতে পারছে না। ঘুমের সাথে আমার চোখের পাতা অনেক সময় যুদ্ধ করে একপর্যায়ে খুলে গেল। পাশ থেকে ফোনটা নিয়ে ঘুম ঘুম চোখে দেখার চেষ্টা করলাম কে ফোন দিচ্ছে। কিন্তু চিনতে ব্যর্থ হলাম। কারণ নাম্বারটা একটা আননোন নাম্বার। ঘড়ির কাটায় চোখ রাখতে দেখি ঘড়ির কাঁটা ঠিক রাত আড়াইটার ঘরে পা দিয়েছে। এমন সময় একটা অপরিচিত নাম্বার চোখে ভেসে উঠতেই চরম মাত্রায় বিরক্ত লাগছে সাথে কিছুটা রাগও হচ্ছে। কলটা বাজতে বাজতে কেটে গেল। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি মোট ১২ টা কল। তাও আবার এই একই অপরিচিত নাম্বার থেকে। এর মাঝেই ফোনটা আবারও বেজে উঠল। কলটা রিসিভ করে আমি কিছু বলে উঠার আগে অপর পাশ থেকে একটা পুরুষালী কন্ঠে ভেসে আসলো,,,

–ফোন ধরছো না কেন? ঘুমাচ্ছিলে?

ঘুমন্ত মানুষকে ঘুম থেকে উঠিয়ে যদি কেউ বলে ঘুমাচ্ছিলে তখন কি পরিমান রাগ হবে? মনে তো চাচ্ছে পারলে ব্যাটাকে ফোনের মধ্যেই গলা চেপে ধরি।একপ্রকার ঝাঁঝালো কণ্ঠেই বলে উঠলাম,,,

— ঘুমের থেকে উঠাইয়া আবার জিজ্ঞেস করতাছোস ঘুমাইছি নাকি। ওই তোর ঘরে মা বোন নাই?আমার শান্তির ঘুম নষ্ট করলি কেন? ঘুম নষ্ট করতে মন চাইলে নিজের বৌরে কল দিয়া ঘুম ভাঙ্গাইয়া পিরিতের আলাপ কর।

–তাই তো করছি।( অপরিচিত লোক)

এমন একটা কথা বলায় আমি একটু ভরকে গেলাম। আমি কপালে দুইটা ভাঁজ ফেলে বলে উঠলাম,,,

— কি?

অপর পাশ থেকে আবারও উত্তর এলো,,,

— আমার বউকেই তো কল দিয়েছি পিরিতের আলাপ করার জন্য।( অপরিচিত লোক)

এবার সম্পূর্ণরূপে ঘুম আমার থেকে ছুটি নিয়ে পালিয়ে গেল। একটু নড়েচড়ে খাটের উপর শোয়া থেকে বসে পরলাম।তাকে বললাম,,,

— কে আপনি? কি উল্টাপাল্টা বলছেন?

অপর পাশ থেকে কানে বেজে উঠলো,,,

— তোমার সারা জীবনের বর্ষণ সঙ্গী।

লোকটার কথা শুনে বুকের মধ্যে ধুকপুক ধুকপুক একটা আওয়াজ বেজে উঠলো। একটু স্বাভাবিক হয়ে নিজের কন্ঠটা কেও স্বাভাবিক রেখে তাকে প্রশ্ন করলাম,,,

— কি চাই আপনার?

লোকটা জবাবে বলল,,,

–বউয়ের সাথে পিরিতের আলাপ করতে চাই।

— এখানে আপনার কোন বউ নেই। রং নাম্বারে কল করেছেন।(আমি)

— যার সঙ্গে কথা বলছি তার কন্ঠটা আমার বউয়ের মত মনে হচ্ছে তাই এখন আমি তার সাথেই পুরো রাতটা কথা বলব।(বর্ষণ সঙ্গী)

— আমি রাত বিরাতে কোন পাগলের সাথে কথা বলি না।(আমি)

কথাগুলো বলেই ফোনটা কেটে দিলাম। এরপর ফোনটা ইচ্ছে করেই বন্ধ না করে সাইলেন্ট করে রেখে ঘুমানোর জন্য আবার শুয়ে পড়লাম। কারণ সকালে উঠে দেখতে হবে না লোকটা কতবার কল দিয়েছি?

সকালে ঘুম থেকে উঠে আর ভার্সিটি যাইনি। কারণ আজকে তাসফি ভাবির আমাদের বাসায় প্রথম দিন। তাই চিন্তা করলাম তাকে সঙ্গ দেবো। কালকে থেকে না হয় ভার্সিটি যাব।ঘুম থেকে উঠে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি বর্ষণ সঙ্গী নামক লোকটার ৭৮ টা কল স্ক্রিনে ভেসে আছে।সকাল সকালই অদ্ভুত একটা কাজ করে বসলাম। আর তা হলো লোকটার নাম্বার মোবাইলে বর্ষণ সঙ্গী দিয়ে সেভ করে রাখলাম। নিজের কাজে নিজেই অবাক না হয়ে পারলাম না। কিন্তু পরমুহুর্তেই মনে মনে একটু হেসে উঠলাম।

সারাদিন আমাদের দুজনের খুব ভালোই কেটেছে। সকালে কমলা আন্টি এসে একবার আমাদের দুজনকে দেখে গিয়েছিলো। বিয়েতে কমলা আন্টি ছিল বিধায় ভাবিকে আর কমলা আন্টিকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কোন প্রয়োজন হয়নি। দুপুরে দুজন একসাথে রান্না করেছি। বিকেলের দিকে ভাবিকে নিয়ে ছাদে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করেছি।

পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ফোন টা চেক করে দেখি একটা মেসেজ এসেছে। তবে মেসেজটা রাত দুইটার দিকে এসেছিল। মেসেজ ওপেন করে দেখি লেখা আছে,,,

“আজ আর আমার #বর্ষণ_সঙ্গিনীর ঘুম নষ্ট করতে চাই না। তাই ম্যাসেজ করেই জানতে চাচ্ছি – ঘুমাচ্ছো?”

মেসেজটা দেখে আমার এই মুহূর্তে বিরক্ত হওয়ার কথা। তবে আমার স্নায়ু এই মুহূর্তে বিরক্তির কোন অনুভূতি মস্তিষ্কে প্রেরণা না করে বরং একরাশ ভালো লাগার অনুভূতি মস্তিষ্কে পাঠাচ্ছে। আচ্ছা লোকটার এমন অদ্ভুত কর্মকাণ্ড কি আমার ধীরে ধীরে ভালো লাগতে শুরু করেছে? নাকি লোকটাকেই এখন ভালো লাগতে শুরু করেছে?

জীবনের কয়েকটা দিন পেরিয়ে গেল। খুব ভালোভাবেই জীবনটা চলছে।মানুষের যে কখন কাকে ভালো লেগে যায় তা আসলেই বলা মুশকিল। আমারও ভালো লেগে গেছে আমার বর্ষণ সঙ্গিকে।

সেই দিন তার নাম্বার সেভ করার পরে থেকে আমাকে মাঝে মধ্যেই সে ম্যাসেজ করত।প্রথম প্রথম তার পাঠানো বার্তা পরে মনকে ভালো লাগার রঙে রাঙাতাম।এরপর আমিও একটু আকটু তার ম্যাসেজের উত্তর দিতাম। তাকে আমি একদিন বলেছিলাম আমি তাকে দেখতে চাই কিন্তু সে বলেছিল এটা নাকি একটা সারপ্রাইজ। যেদিন উনিশের কোঠায় আমি পা বাড়াবো সেদিনই নাকি সে আমার সামনে আসবে। এরপর থেকে শুরু হয় আমার অপেক্ষার প্রহর। যে প্রহরের আমি কাল ইতি টানবো। হ্যাঁ কাল আমি আঠারো তে পা দিয়ে সব অপেক্ষার ইতি টানতে যাচ্ছি।

রাতে বারান্দায় বসে বসে মোবাইলে গান শুনছিলাম আর অপেক্ষা করছিলাম কখন বর্ষণ সঙ্গী মেসেজ দিবে। একটু পরেই টুংটাং শব্দে মেসেজ আসলো,,,

“প্রিয়তমা, তোমাকে শুভ্র বেলি ফুলের ঘ্রাণ মাতানো শুভেচ্ছার সঙ্গে জানাই শুভ জন্মদিন।প্রতীক্ষার অন্ত ঘটিয়ে দেখা হবে আমাদের ইনশাআল্লাহ।”

কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটির ছোট্ট এই বার্তা পেয়েই আমার ঠোঁটের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাসতে লাগলো আমার চোখ। অপেক্ষা না করে তাকে দ্রুত উত্তর দিলাম,,,

— সত্যি আমরা কাল দেখা করব?

সঙ্গে সঙ্গে ফোনের মেসেজ টোন শব্দ করে জানান দিলো আমার বর্ষণ সঙ্গী আমাকে উত্তর দিয়েছে।

–হ্যাঁ করব। তবে তার আগে দরজার সামনে এসে দরজা টা একটু খুলে দেখো।

মেসেজটা পড়ে তড়িৎ গতিতে ছুটলাম দরজার দিকে। দরজা খুলে দেখি সেই ঠিক প্রথম দিনের মতো নীল রেপিং পেপারে মোড়ানো একটি বক্স যার উপর রয়েছে ঈষৎ হালকা হলুদ বর্ণের গোলাপ ফুল। সেই আগের মতই লেখা রয়েছে বর্ষণ সঙ্গিনীর জন্য। তবে এই বক্স টা একটু বড়। কেউ দেখার আগেই তাড়াতাড়ি করে দুই হাতে কুড়িয়ে নিলাম বক্সটা। এরপর আবার তড়িৎগতিতে রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিলাম।

রেপিং পেপার এর মোড়ানো বক্স টা খুলে নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে একটা হাসির রেখা ফুটে উঠলো। বক্সের ভিতরে সেই আগের মতই রয়েছে একটা বেলি ফুলের মালা। তবে এবারে মালার নিচে কোন শাড়ি নেই রয়েছে সারি সারি কাচের চুড়ি। সাদা, কালো, লাল, নীল, সবুজ, হলুদ প্রায় সব রঙের চুড়ি রয়েছে এখানে। সাথে কিছু চকলেটও আছে। তাড়াতাড়ি করে মোবাইলটা হাতে নিয়ে বর্ষণ সঙ্গী দিয়ে সেভ করা নাম্বারে মেসেজ করলাম,,,

–আপনি কিভাবে জানলেন চুরি আমার পছন্দের?

চলবে…..……

[বিঃদ্রঃ গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক। অনুগ্রহ করে বাস্তবিক অর্থ খুজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না আর লেখিকা কে ও বিভ্রান্ত করবেন না]

বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-২০

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_২০

–ওরে চান্দু! তলে তলে তুমি জাহাজ চালাইয়া ফালাইতাছো আর আমি জানি না কিছু।

হঠাৎ করেই সাদুর গলার আওয়াজ পেয়ে হকচকিয়ে উঠলাম। পিছনে ফিরে দেখি সাদু বিছানার উপর বসে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর তাকানো দেখে মনে হচ্ছে ও গোয়েন্দা বিভাগের জন্য কাজ করে একে বারে সব উদ্ধার করে ফেলবে।আমি ওকে বললাম,,,

–জাহাজ চালাইতে পারলে কি আর এই জায়গায় বইসা থাকতাম নাকি?

–আমি তো দেখতাছি তুই এই জায়গায় বইসাই জাহাজ চালাইতাছোস।কিরে কাহিনী কি?

ওকে বলা শুরু করলাম,,,

সকালে ড্রেসিং টেবিলের দিকে চোখ পরতেই দেখি টেবিলের উপরে একটা ছোট বেলিফুলের চারা আর নীচে একটা গোলাপ গাছ।গাছের দুই ডালে দুইটা হালকা হলুদ রঙের ফুল ফুটে আছে।দুইটা ডালেই একটা একটা করে চিরকুটের মতো কাগজ বেঁধে রাখা। একটা খুলে দেখি আমার সেই চেনা হাতের নীল কালিতে লেখা,,,

“গাছ টা তোমার জন্যই।আমি জানি তুমি গাছটাকে আগলে রাখবে। তাই আর বলার প্রয়োজন নেই”।

দ্বিতীয় টায় লেখা,,,

” বেলিফুল আমার #বর্ষণ_সঙ্গিনীর পছন্দের আর এই হলুদ গোলাপ তোমার বর্ষণ সঙ্গির পছন্দের। তাই দুটো একসাথে দিলাম।এখন আপাতত এতটুকু জেনে রাখ”।

–কি?বুঝলি কিছু?(আমি)

— বুঝলাম তোর ও ভালোবাসার মানুষ আইসা পড়ছে। (সাদু)

কথাটা বলেই সাদু ফ্রেশ হতে চলে গেল। সাদুর কথা শুনে আমি দুই হাতে দুইটা চিরকুট নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। সত্যিই কি আমাকে কেউ ভালবাসে? আমি ও কি বেলা শেষে একটা ভালোবাসার হাত পাব? লোকটা যদি আমাকে সত্যিই ভালোবেসে থাকে তাহলে আমার সামনে আসে না কেন? ভালোবাসার মানুষকে কি না দেখে থাকা যায়? ধুর! কি যে চিন্তাভাবনা করছি।লোকটা আমাকে কেন ভালোবাসবে? সে তো আর আমাকে বলেনি সে আমাকে ভালোবাসে।

সকালে হালকা-পাতলা নাস্তা করে ব্যাগ পত্র গুছিয়ে অটোতে উঠাচ্ছিল নিয়াজ ভাইয়া। বাড়ি থেকে দশ পনেরো মিনিটের রাস্তা আমরা অটো করে যাব। মেইন রোডে আমাদের ভাড়া করা মাইক্রো আসবে। আমার ব্যাগের পাশে নিয়াজ ভাইয়া গাছ দুটো দেখে বলল,,,

–এই গাছপালা নিয়ে যাবি নাকি?

আমি বললাম,,,

— হ্যাঁ।

ভাইয়া কপালটা একটু কুঁচকে আবার আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করল,,,

— এই দুইটা কোথায় পেলি?

ভাইয়ার প্রশ্নে আমি অনেকটা ঘাবড়ে গেলাম। হুট করেই সাদু বলে উঠল,,,

— আরে ভাইয়া এগুলোতো ওকে সুমনা আপু দিছে।

আমি সাদুর দিকে তাকাতেই আমাকে একটা চোখ মেরে পুনরায় ভাইয়া কে বলল,,,

— আমাদের জুঁইফুলের বেলিফুল খুব পছন্দের। এই জন্যইতো সুমনা আপু ওরে বেলিফুল দিছে।সাথে গোলাপ ফুলও এক্সট্রা ফ্রী দিল।

ভাইয়া “ওহ আচ্ছা ” বলে গাছ দুইটা উঠিয়ে নিল। আসলে গাছ দুইটা পেয়ে আমিও মনে মনে একটু খুশি হয়েছি।

গাড়ির সামনে এসে খেয়াল করলাম এটা আগের তুলনায় একটু বড়। আর মানুষও আমরা আগের তুলনায় ৩-৪ জন বেশি। গাড়িতে ওঠার সময় সাদু বলল,,,

–সজল ভাইয়া আমি তোমার পাশে বসব।

–ওই সজল ভাইয়ার সাথে বসবি কেন?(আমি)

–বিয়ার সব পিক নিতে হইব না?(সাদু)

–আগে কি করছিলি? (আমি)

–পিক তুলছি।(সাদু)

–সাদমান ভাই জানে তার বউ সজল সজল করে।(আমি)

–ওই তো কইছে সজল ভাইর থিকা আমার বিয়ার সুন্দর সুন্দর পিক নিয়া যেন ওরে দেই।(সাদু)

–তোর আবার বিয়া হইলো কবে?(আমি)

–আরে বা* তোর ভাইর বিয়াতে আমি যেই পিক তুলছি ওগুলি চাইছে।বুঝছোস নাকি আরও কইতে হইব?(সাদু)

–ওহ্।ভালো কইরা কবি না।(আমি)

গাড়িতে আমার পাশে আলআবি ভাইয়া বসে। তার পাশে সজল ভাইয়া আর তার পরে বসে সাদু। রাতে সাদুর সাথে ঘুমানোর কারণে ভালোভাবে ঘুম হয়নি। কারন ও আমার উপর একটু পর পর হাত পা উঠিয়ে দিয়েছিল। তাই এখন একটু ঘুম ঘুম ভাব আসছে। অনেক চেষ্টা করেও চোখটাকে মেলে রাখতে পারছি না। চোখটার সাথে অনেক সময় যুদ্ধ করতে করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। মাথায় কারো স্পর্শ পেয়ে হঠাৎ করে চোখ মেলে তাকালাম। দেখি আলআবি ভাইয়া তার ডান হাতে আমার হিজাব পরিহিত মাথাটার একপাশ চেপে ধরে আছেন।আরেকটু হলেই তার কাধে গিয়ে আমার মাথা ঠেকতো। এমন অবস্থা দেখে তাড়াতাড়ি করে নিজেকে সামলে নিলাম। তারপর সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের এমন অবস্থা কেউ দেখেনি। সজল ভাইয়া সিটে মাথা হেলিয়ে দিয়ে মুখটা হা করে ঘুমাচ্ছে। সাদু কানে ইয়ারফোন গুঁজে দিয়ে মাথাটা জানালায় ঠেকিয়ে চোখ বুজে আছে।ঘুমাচ্ছে কিনা তা বুঝা মুশকিল। এবার আলাবি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি মোবাইলে কিছু একটা করছেন। তাই আমি আর কিছু না বলেই বাইরের দৃশ্যের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। তখনই আলআবি ভাইয়া আস্তে করে বলে উঠলেন,,,

— ম্যানার্স ভুলে গেলে?

তার কথার মানে বুঝতে পেরে আমিও আস্তে করেই তাকে বললাম,,,

— সরি।

বলে আবারো বাইরের দিকে তাকালাম। কারণ বাইরের এই দৃশ্য টাকে মিস করতে চাইনা। অন্যদিকে ঘাড় ঘোরানোর সাথে সাথে আবার আলআবি ভইয়া বলে উঠলেন,,,

–ধন্যবাদ কে বলবে?

তার এমন ভাব দেখে মনে হচ্ছে তাকে এক্ষুনি ধাক্কা মেরে গাড়ি থেকে ফেলে দেই। একটুখানি মাথা ধরে ভাব এমন করছে যেন পুরো দেশকে করোনা মুক্ত করে ফেলেছে। তাকে আস্তে করে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বললাম,,,

— আমি কি বলেছিলাম আপনাকে আমার মাথা ধরে বসে থাকেন?

–আমিও তো বলিনি বারবার আমার কাধের উপর এসে ঢোলে পড়ো।(আলআবি ভাইয়া)

–আমার মাথা আমার ইচ্ছে।আমি ঢোলে পড়বো না হলে লাফিয়ে পড়বো তাতে আপনার কি?(আমি)

–অবশ্যই আমার কিছু। আমার গায়ে পড়বে কেন তুমি?(আলআবি ভাইয়া)

–আমি ইচ্ছা করে কি পড়েছি নাকি?(আমি)

–সেটা তুমিই ভালো জানো।(আলআবি ভাইয়া)

–কথা কম বললেও ঝগড়া তো কম পারেন না।(আমি)

— সামনে তোমার মত একটা ঝগড়াটে মেয়ে থাকলে সবাই এসে এসে একটু করে ঝগড়া করে যাবে।(আলআবি ভাইয়া)

আমি এবার আর না পেরে চেঁচিয়ে বলে উঠলাম,,,

–আমি ঝগড়াটে মেয়ে?

গাড়ির সবার দৃষ্টি এখন আমার দিকে। সাথে সাথে সাদু বলে উঠলো,,,

–এতদিন পরে বুঝলি?

ওর দিকে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকাতেই নিয়াজ ভাইয়া বলে উঠলো,,,

–হঠাৎ করে তোর নিজের পরিচয় দিতে ইচ্ছা হল কেন?

এমনভাবে যে ফেঁসে যাবো তা বুঝতেই পারিনি। নিজের উপর খুব রাগ হচ্ছে এখন।আলআবি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি আরাম করে ফেসবুকে নিউজ ফিড স্ক্রল করেছেন। কাউকে আর কোন কিছু না বলে সোজা বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে হচ্ছে ঘুম নামক কোন বস্তু যদি আমার সামনে পেতাম তাহলে তার সাথে এখন বক্সিং খেলতাম।

বাসায় পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমাদের সাড়ে তিনটার মতো বেঁজে যায়। আজকে অবশ্য রাস্তায় জ্যাম একটু বেশি ছিল। বাসায় আসার সময় নিয়াজ ভাইয়া বিরিয়ানি কিনে নিয়ে আসে। আমরা সবাই ফ্রেশ হয়ে খাওয়া দাওয়া করে যে যে যার যার রুমে চলে আসি। রুমে এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। একটা জিনিস ভেবে খুবই ভালো লাগছে যে এখন বাসায় আমাদের একজন সদস্য বেড়ে গেল। এখন বাসায় তাসফি আপুও থাকবে। আমার গল্প করার জন্য খুব ভালো একজন পার্টনার পেয়ে গেলাম। ধীরে ধীরে নিয়াজ ভাইয়া আর বাবার সম্পর্কটা ও স্বাভাবিক হচ্ছে। এখন আমার একটা হ্যাপি ফ্যামিলি হবে। এই হ্যাপি ফ্যামিলি তে যদি আম্মু থাকতো তাহলে আরো অনেক বেশি ভালো হতো। এসব ভেবেই মনে অনেকটা প্রশান্তি পেলাম।

কারো ডাকে আমার ঘুম ভাঙলো। চোখটা মেলে দেখি আমার সামনে তাসফি আপু বসে আছে আর আমাকে ডাকছে। তাসফি আপুর ডাকের সাথে চারপাশে থেকে আজানের ধ্বনি কানে এসে লাগছে। আমার সামনে তাসফি আপু কে দেখে উঠে বসলাম। আপু বলল,,,

— মাগরিবের আজান দিচ্ছে? এখনো ঘুমাচ্ছ? তাড়াতাড়ি ওঠ।

আপুকে এভাবে ডাকতে দেখে কতটা যে ভালো লাগলো তা বলে বোঝানোর মত নয়। বিছানায় বসেই আপুর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। তখন আপু বলে উঠলো,,,

–কি দেখছ? নামাজ পড়বে না?

আপুর দিকে তাকিয়েই বললাম,,,

— জানো ছোটবেলায় বাবা ডেকে ঘুম থেকে উঠাতো।বড় হওয়ার পরে ফোনের এলার্ম শুনে শুনে উঠতে হয়। অনেক কয়েক বছর পর এই প্রথম আমাকে কেউ এভাবে ডেকে তুলেছে।তোমার এভাবে ডেকে তোলায় আমার যে কতটা ভালো লেগেছে তোমাকে বলে বুঝাতে পারব না।

–এখন থেকে আরও অনেক কিছইু ভালো লাগবে।এই পিচ্চি মেয়েটাকে আমিই দেখে শুনে রাখব এখন থেকে।

বলেই আমার গালটা একটু টেনে দিল।তারপর আবার বলল,,,

–এবার ওঠ তাড়াতাড়ি। মাগরিবের আযানও শেষ হয়ে গিয়েছে।

আপু রুম থেকে বের হতেই উঠে অযু করে নামাজ পড়ে জায়নামাজ টা ভাজ করছিলাম তখন তাসফি আপু আবার এসে হাজির। আমার সামনে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করল,,,

— বাসায় তো তুমিই রান্না করতে তাইনা?

আমি বললাম,,,

— হ্যাঁ। মাঝে মাঝে কমলা আন্টি করে দিত। কেন?

–আসলে কিচেনে গিয়ে কিছুই খুঁজে পাচ্ছিলাম না ভালো ভাবে। তাই তোমার কাছে জানতে আসলাম কোথায় কি রাখা হয়।একটু আসো আমার সাথে।(তাসফি আপু)

–এসেই রান্নাঘরে পাকনামো শুরু করে দিয়েছো?(আমি)

–আরে বেশি কিছু না একটু কফিই শুধু বানাতে যাচ্ছিলাম। নিজের হাতে কফি তৈরি করে নিজের শশুর়কে, হাসবেন্ডকে আর এই পিচ্চি মেয়েটাকে খাওয়াতে চাই। বুঝেছ?(তাসফি আপু)

–জ্বি বুঝেছি ম্যাডাম(আমি)

আমার কথা শুনে তাসফি আপু হেসে দিল। তারপর বলল,,,

–দুই ভাইবোন তো দেখি একই ধাঁচের।

আমি বললাম,,,

–কিভাবে জানো?

–তুমি যে ভঙ্গিতে আমাকে ম্যাডাম বললে তোমার ভাইয়া ও মাঝে মাঝে এভাবে আমাকে বলে।(তাসফি আপু)

— প্লিজ! প্লিজ! প্লিজ! তোমাদের লাভ স্টোরি কিন্তু শোনাবে আমাকে। (আমি)

–আচ্ছা চলো কফি খেতে খেতে শোনাবো(তাসফি আপু)

কফি বানিয়ে তার সাথে ফ্রিজে রাখা সিঙ্গারা ভেজে আমি আর তাসফি আপু ভাইয়া আর বাবাকে ড্রইংরুমে দিয়ে আসলাম। তাসফি আপুকে নিয়ে আমার বারান্দায় এসে টুল ছাড়াই ফ্লোরে বসে পড়লাম আমরা। কফির মগে একবার চুমু দিয়ে তাসফি আপুর দিকে তাকালাম। তারপর বললাম,,,

–এবার কিন্তু বলতে হবে। শুরু করো।

তখন আপু একটু মুচকি হেসে বলল,,,

— আচ্ছা বলছি তাহলে শোনো।

চলবে……..……

[বিঃদ্রঃ গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক। অনুগ্রহ করে বাস্তবিক অর্থ খুজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না আর লেখিকা কে ও বিভ্রান্ত করবেন না]

বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-১৯

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_১৯

–ওহে আঙ্কেল ইহার চেয়েও উচ্চ শব্দের রিংটোন মোর মুঠোফোনে রহিয়াছে।আপনার কি লাগিবে? (সজল ভাইয়া)

সজল ভাইয়ার এমন ভাবে কথা বলা দেখে আমরা সবাই এক ধাপ হেসে নিলাম।কিন্তু সবাই মুখ চেপে হাসি থামানোর বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।মোর্শেদ খালু তখন তার ফোনটা উচু করে এপাশ ওপাশ করছে।সজল ভাইয়ার কথা তার কর্নপাত হয়নি।খালু আমাদের কে দেখে বললেন,,,

–নেটওয়ার্কের নাতি পুতিকেও দেখা যাচ্ছে না।

তখন সজল ভাইয়া বলল,,,

–আঙ্কেল নিয়াজদের এবাড়িতে তো আর আম গাছ নেই।

— হ্যাঁ তাইতো কি যে করি। (খালু)

তখন সার্থক ভাইয়া বলে উঠলেন,,,

–আঙ্কেল আমার কাছে কিন্তু একটা আইডিয়া আছে। যদি চান তো আমি আপনাকে বলতে পারি।

খালু উত্তেজিত হয়ে বলতে শুরু করলেন,,,

— আরে বল বল। তাড়াতাড়ি বল।

–আসলে আমার জানামতে নিয়াজ দের বাড়ির পিছনে কিন্তু একটা নারিকেল গাছ আছে। তো আপনি যদি চান ওটায় ট্রাই করতে পারেন।

–ইউ মিন টকিং টু নারিকেল গাছ?(খালু)

— আরে না না না। আমি সেটা বলিনি তো।(সার্থক ভাইয়া)

তাদের দুজনের কথা শুনে আমার হাসি চেপে রাখতে পারলাম না। আস্তে করে নিচু স্বরে সবাইকে শুনিয়েই বললাম,,,

–আমাদের খালু একবার মাধ্যমিক ফেল।

এমন ভাবে বললাম যেনো খালু শুনতে না পায়।

সার্থক ভাইয়াও আমাদের কাছে ফিসফিসিয়ে বললেন,,,

— আগে বলবা না। এই পিছ তোমার খালামণি পাইল কিভাবে?

–আরে লাভ ম্যারেজ।তাই তো খালু খালামনিকে হালকা পাতলা ভয়ও পায়। (আমি)

আমাদের ফুসুরফাসুর করার মধ্যেই খালু বলে উঠলেন,,,

–আচ্ছা গাছে উঠব কিভাবে?আগের বার তো আম গাছে উঠেছিলাম।এটা তো নারিকেল গাছ। লুঙ্গি কেন, সব খুলেও তো উঠতে পারব না।

খালুর এমন বোকা বোকা কথায় আমরা তার সামনেই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ি। তখন খালুকে খুঁজতে খুঁজতে খালামণি ছাদে এসে পড়ে আর খালু কে সঙ্গে করে নিয়ে যায়। খালু চলে যাওয়ার পর আমরা অনেক সময় ছাদে বসে সবাই গল্প করি।

নিয়াজ ভাইয়ার রিসেপশনের অনুষ্ঠান টা ভালোয় ভালোয় কেটে গেল। রিসিপশনের পরে আরো দুই দিন কেটে গিয়েছে। এই দুই দিনে আমরা অনেক মজা করেছি। খুব ভালো কেটেছে এ দুটো দিন। কাল আমরা তাসফি আপুকে নিয়ে গাজীপুর চলে যাব। আমাদের এ বাড়িতে কাল শেষদিন বলে আজকে আমরা সবাই মিলে ঘুরতে বের হওয়ার প্ল্যান করেছি।দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ করে আমরা সবাই রেডি হচ্ছি ঘুরতে যাওয়ার জন্য।

আমরা মূলত একটা নদীর পাড়ে ঘুরতে যাচ্ছি। আজকে যাওয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে মেলা দেখা। সেই ছোটবেলায় একবার মেলায় ঘুরতে এসেছিলাম। এরপর আর মেলা দেখা হয়নি। আমরা আজ যেই মেলায় যাচ্ছি সেটা টানা ৩ দিন ব্যাপী চলবে। আজকে দ্বিতীয় দিন চলছে মেলার।

আমরা সবাই বাড়ির সামনে থেকেই অটোতে করে মেলায় এসে পৌঁছালাম। নদীর পাশে বড় মাঠের মতো বিস্তর জায়গাজুড়ে মেলার আয়োজন করা হয়েছে। মেলায় আমরা মোট আটজন এসেছি। আমি, সাদু, রাফিদা আপু, তাসফি আপু, নিয়াজ ভাইয়া, সজল ভাইয়া, আলআবি ভাইয়া, আর সার্থক ভাইয়া।

মেলায় আনন্দের সাথে বিরক্ত বলে একটা জিনিস আছে। তা হচ্ছে কিছু মানুষের ইচ্ছাকৃতভাবে গা লেগে হেঁটে যাওয়া। এত এত মানুষের ভিড়ে একজন আরেকজনের সাথে ধাক্কা লাগতেই পারে। কিন্তু কিছু কিছু মানুষ আছে ইচ্ছাকৃতভাবেই তারা এসে ধাক্কা দিয়ে যায়। এ পর্যন্ত মেলায় এসে তিনবার করে ধাক্কা খেয়েছি আমি। তাও আবার একজনের সাথেই।এখন একেবারে স্পষ্ট ছেলেটা ইচ্ছে করে এসে ধাক্কা লেগেছে। এমন পরিস্থিতিতে বলাও যাবে না যে লোকটা ইচ্ছাকৃতভাবে ধাক্কা দিচ্ছে। বললে বলবে এমন ভিড়ে একটু আকটু ধাক্কা লেগে যায় এটা স্বাভাবিক। তাই এসব বিষয়ে মাথা না ঘামিয়ে মেলায় মনোযোগ দেই। হঠাৎ করে মনে হল আমার দুই বাহু পেছন থেকে কেউ চেপে ধরেছে। পিছন ফিরে আমি হতবাক হয়ে যাই। দেখি আলাবি ভাইয়া আমার দুই বাহু ধরে পেছন পেছন আসছেন। ভিড়ের মাঝে কেউ অত একটা আমাদের লক্ষ্যও করছে না। ছোটবেলায় যেমন আমরা একজন আরেকজনের কাঁধে হাত রেখে ট্রেন ট্রেন খেলতাম ঠিক সেইরকম আলাবি ভাইয়া আমার কাঁধে হাত না রেখে কেবল দুই বাহুতে হাত রেখেছেন। তিনি যদি আমার কাঁধে হাত রাখতেন তাহলে যেকোনো বাচ্চা দেখলেই বলতো আমরা দুজন ট্রেন ট্রেন খেলছি। মুহুর্তের মধ্যেই আমার মনে হল আমি মনে হয় সবচেয়ে সুরক্ষিত কোন খাঁচার মধ্যে আবদ্ধ আছি। কোন খারাপ স্পর্শ আমাকে ছুতে পারবে না। অদ্ভুত একটা ভালো লাগা কাজ করে গেলো মনে। আমার আর বুঝতে বাকি নেই যে আলআবি ভাইয়া আমাকে প্রটেক্ট করার জন্যই এভাবে আমার পেছন পেছন আসছেন। তাকে এখন মন থেকে খুব বড় করে একটা ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করছে। মনে মনে ভেবে রাখলাম বাড়ি গিয়ে তাকে একটা ধন্যবাদ জানিয়ে দেবো।

আমরা যে মেলায় এসেছি এটাকে এক ধরনের গ্রাম্য মেলাই বলা চলে। আর এই গ্রাম্য মেলার সবচেয়ে আকর্ষণীয় প্রকরণগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে পুতুল নাচ। আমরা এখন পুতুল নাচ দেখার জন্য টিকেট কেটে বসে আছি।একটু পরে পুতুলদের নাচ শুরু হবে। পুতুলনাচের মঞ্চের পেছনে একজন লোক সুতো দিয়ে পতুল বেঁধে তাদের নানাভাবে নাচাচ্ছে। ছোট ছোট পুতুলগুলোর ছোট ছোট হাত-পা হেলিয়ে দুলিয়ে নাচ গুলো বেশ উপভোগ করছি। প্রায় বিশ মিনিটের মত পুতুল নাচ দেখে আমরা “পুতুল নাচ ঘর” থেকে বের হয়ে এলাম।

মেলার আরেকটা মজার জিনিস হল বাইস্কোপ। সাধারণত বাইস্কোপ দেখানোর সময় ছড়া কেটে বাইস্কোপের ভিতর দেখানো চিত্রের বর্ণনা দেওয়া হয়। বাইস্কোপ দেখতে গিয়ে সাদু আর আমি এক দফা ঝগড়া করেছি। মেলাতে খাবারের মধ্যে অনেক ধরনের মিষ্টি জাতীয় খাবার রয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে মজার হল হাওয়াই মিঠাই। মেলায় ঘুরতে ঘুরতে হাওয়াই মিঠাই খাওয়ার অনুভূতিটাই অন্যরকম। মেলাটা ঘুরে দেখতে দেখতে আমার চোখ যায় একটা কাচের চুড়ির দোকানের দিকে। চুড়ির দোকানে গিয়ে আমরা সবাই চুড়ি কিনলাম। সাদু সবুজ রঙের কাঁচের চুড়ি কিনেছে আর আমি কিনেছি সাদা রঙের কাঁচের চুড়ি। আসলে সাদাটা আমার বরাবরই একটু বেশি পছন্দের। চুড়ির দোকানের সামনে সার্থক ভাইয়া রাফিদা আপুকে চুড়ি পরিয়ে দেয়। নিয়াজ ভাইয়াও তাসফি আপুকে চুড়ি পরিয়ে দেয়। দুই জোড়া কপোত-কপোতীদের এমন একটা রোমান্টিক সিন দেখে সাদু,আমি আর সজল ভাইয়া এক সঙ্গে বলে উঠলাম,,,

–হাউ রোমান্টিক!!!

সজল ভাইয়া তখন একটু কাঁদো কাঁদো ভঙ্গিতে বলে উঠলো,,,

–ওভাই আমারেও একটা বউ আইনা দে।আমিও একটু চুড়ি পরাইতে চাই।

সজল ভাইয়ার কথায় আমরা একটু হেসে উঠলাম। চুড়ি কেনা শেষ করে আমরা নাগরদোলায় উঠলাম। নিয়াজ ভাইয়া, তাসফি আপু, সার্থক ভাইয়া আর রাফিদা আপু একসাথে উঠেছে। আমি, সাদু, সজল ভাইয়া আর আলআবি ভাইয়া একসাথে উঠেছি। নাগরদোলা ২বার ঘুরে আসতেই সজল ভাইয়া আলআবি ভাইয়ার বাহুধরে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলতে লাগলো,,,

–ভাই আমারে নগরদোলায় উঠাইছোস নাকি রকেট দিয়া পৃথিবী ঘুরাইতাছোস?ভাই রে ভাই আমার তো দুনিয়টাই ঘুরতাছে।থামা ভাই থামা।তুই আমার আলুবাবু,গুলুমুলু,তুলুতুলু।প্লিজ ভাই থামা।

সজল ভাইয়া ভয়ের চোটে যে কি বলছে তা নিজেও বুঝতে পারছে না। আলআবি ভাইয়া কে ওইভাবে নাম ধরে ডাকায় আমি আর সাদু হাসি চেপে রাখতে না পেরে হাসতে হাসতে একজন আরেকজনের উপর হেলে দুলে পড়ছি। এমন সময় আমার অসাবধানতায় হাত ফসকে আমার হাতে থাকা চুড়ি গুলো পড়ে গেল। চুড়িগুলো পড়ে একেবারে চুরমার হয়ে গিয়েছে তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। চুড়ি গুলো পড়ে যাওয়াতে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ঠিক তখনই আলআবি ভাইয়া বলে উঠলেন,,,

–হাসো আরো বেশি বেশি করে হাসো। হাহাহা।

কথাটা বলেই উনি হাহাহা করে আমাদের ব্যঙ্গ করলেন। আমি মুখটা গোমড়া করে চুপচাপ বসে রইলাম। সজল ভাইয়া তার প্রলাপ বকে যাচ্ছে। সে কি বলছে তা নিজেও জানেন না।

কিছু সময় পর নাগরদোলা থেমে গেলে আমরা সবাই নেমে আসি। তখন সজল ভাইয়া বলে,,,

–আরেকটু হইলেই তো যাইতাম ফুটুস হইয়া। তখন আমার হবু বউ টা রে কে চুড়ি পড়াইত

নিয়াজ ভাইয়া বলে উঠলো,,,

–তোর হবু বউয়ের জামাই।

মেলা থেকে ফিরে আসার সময় আমরা ফুচকা খায় ফুচকা খেতে গিয়ে সেখানে ঘটে আরেক ঘটনা। ফুচকায় বরাবরই ঝাল বেশি দিয়ে খেতে ভালো লাগে। আমি, সাদু তাসফি আপু,আর রাফিদা আপু ঝালের প্রতিযোগিতায় নেমে পরি।কে কত বেশি ঝাল খেতে পারি। অবাক করার বিষয় হলো আমাদের সাথে আলআবি ভাইয়াও ফুচকা খেতে বসেছে। তাকে ফুচকা খেতে দেখে অবাক হয়েছি তার কারণ, একটু গম্ভীর টাইপের ছেলেরা ফুচকা খেতে চায় না। এটা আসলে আমার ধারণা। ভেবেছিলাম হয়তো আলআবি ভাইয়াও বলবে এসব বাইরের অস্বাস্থ্যকর খাবার আমি খাই না। আমার ধারনা কে ভুল প্রমাণ করে সেও বসে পড়ে খেতে।

ভাইয়াদের খাওয়া শেষ কারণ তারা এক প্লেট করে ফুচকা খেয়েছে। আমরা মেয়েরা একবার ফুচকা খেয়ে এরপর দ্বিতীয় প্লেট ফুচকা নিয়ে বসেছি তাও আবার আগের তুলনায় ঝাল বেশি। দ্বিতীয় প্লেটের কয়েকটা ফুচকা খাওয়ার পরে আমার চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করল। মুখটা “ও” আকৃতি করে মুখের ভেতর বার বার বাতাস ঢুকাচ্ছি। ঝাল আমি খেতে পারি তবে আজকের ঝাল টা মাত্রাতিরিক্ত হয়ে গিয়েছে। তাই আর খেতে পারছি না। চারপাশে তাকিয়ে পানি খুঁজতে লাগলাম। তখনই দেখি আলআবি ভাইয়া এক বোতল পানি আমার সামনে ধরে রেখেছেন। দেখে মনে হচ্ছে বোতল টা পুরোই নতুন। হয়তোবা এইমাত্র কিনে আনা। আমি সাতপাঁচ না ভেবে তাড়াতাড়ি বোতলটা নিয়ে বোতলেই মুখ লাগিয়ে খেতে শুরু করলাম। তার এমন কাজে অবাক হইনি। কিন্তু পরবর্তীকাজে অবাক না হয়ে পারলাম না। কারণ আমার পাশের চেয়ারে বসে আমার মুখ লাগিয়ে খাওয়া বোতল টায় আলআবি ভাইয়া ও মুখ লাগিয়ে পানি খেতে শুরু করলেন। আমি তড়িৎগতিতে বলে উঠলাম,,,

— ভাইয়া এটায় আমার মুখ লাগানো।

আমার কথা শুনে আলআবি ভাইয়া একবার আমার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলেন। এরপর পুনরায় আগের মত করেই বোতলে মুখ লাগিয়ে আমার অর্ধেক খাওয়া পানিটা পুরো খেয়ে বোতলটা ফেলে দিলেন। আমি ড্যাবড্যাব করে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিন্তু সে একটা গা ছাড়া ভাব নিয়ে নিজের মোবাইল ফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। তখন আমি আমতা আমতা করে আলআবি ভাইয়াকে বললাম,,,

–ধন্যবাদ ভাইয়া।

তখন আলাবি ভাইয়া ফোন থেকে তার দৃষ্টি সরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রুকুটি করে বললেন,,,

— কোনটার জন্য?

ভাব দেখলে আর বাঁচি না। মনে হয় যেন সারা জীবন আমাকে সাহায্য করে উদ্ধার করেছেন। এই জুইঁয়ের কাছ থেকে ধন্যবাদ পাচ্ছে তাও আবার বলছে কোন টার জন্য?
আমি পুনরায় বললাম,,,

–তখন মেলায় আমাকে সেফ রাখার জন্য।

আমার কথার পৃষ্ঠে কোন জবাব না দিয়ে তিনি কেবল “হুম” বলে আবার ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।

বাড়িতে এসে আমরা রাতে খাবার কেউই খেতে পারলাম না। মেহমান এর চাপ একটু কমে যাওয়ায় আমার রুমে আমি আর সাদু ঘুমালাম। এই কয়দিন আমাদের দুজনের মাঝে কোন দেশের বর্ডার দিতে পারিনি, মানুষজন বেশি ছিল বলে। আজকে ঘুমানোর সময় সাদু আর আমার মাঝখানে একটা বর্ডার দিয়ে দিলাম অর্থাৎ কোলবালিশ দিয়ে দিলাম। তারপর আমি আর সাদু কথা বলতে বলতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।

এলার্মের শব্দে সকালে ঘুম ভাঙ্গলো। ফোনের এলার্ম টা বন্ধ করে বিছানায় বসেই একটু মোচড়ামুচড়ি করছিলাম। বাইরে একটা মোরগ অনবরত ডেকে যাচ্ছে। ঘরে বসেই বাইরে কারও উঠোন ঝাড়ু দেওয়ার শব্দ পাচ্ছি। সকালের নাস্তা খেয়েই ব্যাগপত্র গুছিয়ে আমরা চলে যাব। এই কথা মনে পরতেই বিছানা থেকে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালাম। পাশেই ড্রেসিং টেবিলের উপর চোখ পড়তেই চমকে উঠলাম।

চলবে…….……

[বিঃদ্রঃ গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক। অনুগ্রহ করে বাস্তবিক অর্থ খুজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না আর লেখিকা কে ও বিভ্রান্ত করবেন না]

বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-১৮

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_১৮

আমি মোহতারাম হাবিব রহমান এর পুত্র নিয়াজ রহমান মোহতারাম এনামুল হক এর কন্যা তাসফি হক কে **টাকা দেনমহর ধার্য করিয়া নিজের স্ত্রী হিসেবে স্বীকার করিলাম।

–বলুন কবুল।(কাজী)

–কবুল(নিয়াজ ভাইয়া)

–বলুন কবুল(কাজী)

–কবুল(নিয়াজ ভাইয়া)

–বলুন কবুল (কাজী)

–কবুল(নিয়াজ ভাইয়া)

–আলহামদুলিল্লাহ… আমিন।আপনাদের বিবাহ সম্পন্ন হইলো।(কাজী)

নিয়াজ ভাইয়া আর তাসফি আপুর বিয়ে টা হয়ে গেল।তারাও নতুন এক পবিত্র সম্পর্কে আবদ্ধ হয়ে গেল।অবশেষে তাদের ভালোবাসা পূর্ণতা পেল।

বিয়ে সম্পন্ন হতেই সবাইকে খেজুর দেয়া হলো।তাসফি আপু তো কবুল বলেই কান্নায় ভেঙে পরেছে।একপাশে নিয়াজ ভাইয়া আর আরেক পাশে তাসফি আপুর বাবা বসে তাসফি আপকে সামলাচ্ছে। এভাবে কিছু সময় পরে তাসফি আপুকে স্বাভাবিক করলো।

শুরু হলো আমাদের ছবি অধিবেশন।স্টেজের পিছনের দেয়াল লাল গোলাপ দিয়ে সম্পূর্ণ রূপে ঢেকে রাখা। এক ফোটা ফাঁক ফোকড় নেই। আমরা সকলেই শাড়ি পড়েছি ।তবে কারো সাথে কারো শাড়ির মিল নেই। আমরা সবাই শাড়ির সাথে হিজাব পরেছি। কেবল এই একটা দিকেই মিল আছে। আমরা সব মেয়েরা একসাথে ছবি তুলেছি। ছেলেরা একসাথে তুলেছে। আবার আমার পারিবারিক ছবিও তুলেছি। অদ্ভুত ব্যাপার হলো আমাদের ক্যামেরাম্যান ছিল আলআবি ভাইয়া। তার নাকি ছোটকাল থেকেই ফটোগ্রাফির শখ ছিল। আর সে ছবিও খুব সুন্দর তোলেন।বিদায় বেলায়ও তাসফি আপু কান্না করেছিল।

ঘড়ির কাটায় প্রায় দশটা ছুঁই ছুঁই। বর্তমানে আমি, সাদু, রাফিদা আপু, সার্থক ভাইয়া, সজল ভাইয়া আর আলআবি ভাইয়া কাঁচা মাটির রাস্তা দিয়ে হেঁটে আমাদের বাড়ি যাচ্ছি। আমাদের এভাবে হেঁটে যাওয়ার একমাত্র কারণ হল আমার প্রাণ প্রিয় বান্ধবীর ইচ্ছা পূরণ। আসলে আমারও কিছু টা ইচ্ছে ছিল। আমাদের বাড়ির সামনে যে রাস্তা আছে তার ১০ থেকে ১৫ মিনিট পার হলে বড় রাস্তা অর্থাৎ মেইনরোড পাওয়া যায়। আমরা বরযাত্রীর গাড়িতেই আসছিলাম। সুমনা আপুরা অন্য গাড়িতে ছিল।তখন সাদু বায়না করে ও এখান থেকে হেঁটে যাবে। ওর আর বসে থাকতে নাকি ভালো লাগছে না। ওর সাথে আমারও গাড়িতে বসে থাকতে ভাল লাগছিল না। যখন রাফিদা আপুকে বললাম তখন রাফিদা আপুও আমাদের সাথে হেঁটে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। তখন আমাদের বডিগার্ড হিসেবে নিয়াজ ভাইয়া আলআবি ভাইয়া, সজল ভাইয়া আর সার্থক ভাইয়া কে পাঠিয়ে দিল।

পরিবেশটা খুব শীতল সরু কাঁচা রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আমরা ছয় জন। রাস্তার দুই ধারে রয়েছে গাছপালা। মাঝে মাঝে দু একটা ডোবা দেখা যাচ্ছে। চারপাশ থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছে। রাফিদা আপু আর সার্থক ভাইয়া সকল এর পিছনে গল্প করতে করতে আসছে। ওদের সামনেই সজল ভাইয়া আর সাদু দুজন বিয়ের ছবি ক্যামেরায় দেখতে দেখতে আসছে। সকলের সামনে আমি আর আলআবি ভাইয়া প্রায় দুই হাতের মতো দূরত্ব রেখে হেঁটে যাচ্ছি। হাঁটার একপর্যায়ে পায়ের নিচে কিছু একটা বেধে যাওয়ায় আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে পড়ে যেতে নেই। সঙ্গে সঙ্গে পাশ থেকে আলআবি ভাইয়া আমার ডান হাতের বাহু ধরে নেয়। এই যাত্রায় আমি পড়ে যাওয়া থেকে বেঁচে যাই। আমি নিজেকে ঠিক করে ভালো ভাবে দাঁড়িয়ে আলআবি ভাইয়ার দিকে তাকালাম। তখন সে বলে উঠল,,,

–চোখ কোথায় রেখে হাঁটো?

আমি তার কথার প্রতি উত্তরে বলি,,,

–ধন্যবাদ ভাইয়া।

তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম কপালে তার কিঞ্চিৎ ভাঁজ পড়েছে। ভ্রু যুগলও হালকা কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।
আমার এরূপ আচরণ বা কথা হয়তোবা তিনি হজম করতে পারেননি। তিনি আশা করছিলেন আমিও কিছু বলবো। কিন্তু তার সাথে এখন ঝগড়া করার কোন মুডই আমার নেই। কারণ এখন আমার খুব পানি পিপাসা লেগেছে। আমাদের কাছে পানিও নেই। বাড়িতে গিয়ে তারপর পানি খেতে হবে। আর তাকে কোন কথা বলেও লাভ হবে না। জানতাম সে হয়তো বলবে “সে সরি”আর না হলে বলত “ধন্যবাদ বল। এটা ম্যানার্স এর মধ্যে পড়ে”। উনি পারে তো শুধু এগুলোই বলতে। তিনি আর কিছু বললেন না আমরা পুনরায় হাঁটা শুরু করলাম।

বাড়ি এসে সকলে লেগে পড়লাম বাসর ঘর সাজানোর কাজে।আমি,সাদু রাফিদা আপু সুমনা আপু,আঁখি, সুমাইয়া,সার্থক ভাইয়া আর সজল ভাইয়া মিলে বাসর ঘর সাজাচ্ছি।সাদু বলে উঠলো,,,

–ইশ কারা যে আমার বাসর ঘর সাজাবে।

–বিয়াই তো করলি না।বাসর ঘরের প্ল্যান ও কইরা ফালাইছোস?(আমি)

–শালিকা তো আমার বড় হয়ে গেছে। (সার্থক ভাইয়া)

–আব্বুর কাছে নাকি রফিক আঙ্কেল বলছিল তার ছেলে ময়লা ওয়ালাদের সিনিয়র পদ পাইছে।মানে এখন তার ছেলের আন্ডার সাতজন ময়লাওয়ালা কাজ করে। (রাফিদা আপু)

–আপু রফিক আঙ্কেল বাসায় বাসায় থেকে ময়লা নেয়। তার ছেলেও তো ময়লা নেয়। তাদের কথা এইখানে টাইনা আনার মানে কি?(সাদু)

— পড়ালেখা শেষ না কইরাই বাসর বাসর করলে তোর কপালে ওই ময়লাওয়ালাই জুটব।(রাফিদা আপু)

রাশিদা আপুর কথা শুনে হাসতে হাসতে আমাদের পেট ব্যথা হয়ে গেল। তখন দরজায় কেউ কড়া নাড়লো। দরজা খুলে দেখি আন্টি মানে সাদুর আম্মু এসেছে দেখার জন্য আমাদের সাজানো হয়েছে কিনা। আমরা সবাই একসাথে বললাম আরেকটু সময় লাগবে।

আন্টি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর আঁখিকে দিয়ে নিয়াজ ভাইয়া কে বাসর ঘর সাজানো হয়েছে যে রুমে সেখানে নিয়ে আসলাম। নিয়াজ ভাইয়া এসে বলল,,,

— আমার আগে দেখি আমার বউকেই বসিয়ে রেখেছিস। বাহ এত সুন্দর করে ঘর কিভাবে সাজালি তোরা?

আমি বললাম,,,

— হাত দিয়ে।

তখন সাদু নিয়াজ ভাইয়ার সামনে এগিয়ে দুই হাত পেতে বলল,,,

–এবার কী দিবেন দেন?

— তোদের সবাইকে একটা করে এক টাকার চকলেট গিফট করবো নে। এখন যা।(নিয়াজ ভাইয়া)

তখন রাফিদা আপু, সার্থক ভাইয়া, সুমাইয়া, আঁখি সুমনা সহ আমরা রুমের যারা ছিলাম সবাই একসঙ্গে ভাইয়ার সামনে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একেক জন একেক জনের মতো করে টাকা চাইতে লাগলাম। কেউ বলছে টাকা দেও! কেউ বলছে টাকা চাই! কেউ বলছে ভাইয়া চিটিং করবেন না! কেউ বলছে বাসর ঘর কিন্তু আমরা ভেঙে দিয়ে যাব! যে যে যার যার মতো করে প্রলাপ শুরু করলাম। একেবারে মাছের বাজার বানিয়ে ফেললাম। ভাইয়া আর সহ্য করতে না পেরে দুই হাতে কান চেপে চিৎকার করে বলে উঠলো,,,

–স্টপ!!!!

ভাইয়ার এক চিৎকারে আমরা সবাই চুপ হয়ে গেলাম। আমরা সবাই সবার দিকে একবার একবার করে তাকিয়ে আবার ভাইয়ার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। তখন ভাইয়া বলল,,,

–ওকে ফাইন!টাকা কত লাগবে বল।

তখন সাদু বলে উঠল,,,

— পঞ্চাশ হাজার টাকা মাত্র!

ওর কথা শুনে আমি নিজেই বোকা বনে গেলাম। কারণ আমাদের বাজেট এত ছিল না। ওর কথা শুনে সার্থক ভাই ও বলে উঠলো,,,

— হ্যাঁ! হ্যাঁ! আমাদের পঞ্চাশ হাজার টাকা লাগবে। এর থেকে পয়সাও কম না।

আমাদের কথার মাঝেই আলআবি ভাইয়া ঘরে প্রবেশ করল। ভাইয়াকে দেখেই নিয়াজ ভাইয়া বলে উঠলো,,,

–ভাই আমারে গরু জবাই করার মতন জবাই করতেছে তাড়াতাড়ি বাঁচা।

আলআবি ভাইয়া একবার আমাদের সবার দিকে দৃষ্টি দিয়ে আরেকবার নিয়াজ ভাইয়ার আর দিকে দৃষ্টি দিলেন। তারপর বলে উঠলেন,,,

— বিয়ে তোর!বউ তোর! বাসর তোর! তাড়াও তোর।ওদের তো আর তাড়া নেই। তাই যা চাচ্ছে তা দিয়ে দে।

আলআবি ভাইয়ার কথা শুনে আমাদের খুশি আর দেখে কে। আমরাও সবাই হাসি হাসি মুখ করে নিয়াজ ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে থাকলাম।তখন নিয়াজ ভাইয়া বলল,,,

–আমি কি ব্যাংক নাকি যে পঞ্চাশ হাজার টাকা সাথে নিয়ে ঘুরব।এখন এতো নেই আমার কাছে।

–ওকে তাহলে কত দিবে? (আমি)

–আপাতত বিশ।(নিয়াজ ভাইয়া)

–আচ্ছা আমাদের তবে বিশ হাজারই দে। আজকের রাতটা তাসফির ছবি নিয়ে ঘুমা।বাকি ত্রিশ যেদিন দিবি সেদিন বউটাও নিয় নিস।(সার্থক ভাইয়া)

–শালা তুই বিয়ে করে তো পাড় পেয়ে গেলি।বিয়ে না করলে আমিও ভবিষ্যতে দেখাইয়া দিতাম তোরে।( নিয়াজ ভাইয়া)

— ভাইয়া বাসর রাতটা কি ইনজয় করতে মন চাচ্ছে না আপনার? তারাতারি টাকা টা দেন।(সাদু)

–আগে তোরা অ্যামাউন্ট টা কমা। প্লিজ ভাই আমার বোন আমার এমন করিছ না তোরা।(সাদু)

— আচ্ছা ভাইয়া তাহলে ফিফটি-ফিফটি দাও। পঁচিশ হাজার দাও।( রাফিদা আপু)

— ওকে পঁচিশ হাজার। বাকি পঁচিশ হাজার কিন্তু মাফ।(নিয়াজ ভাইয়া)

–আরে ব্যাটা আগে টাকা বাইর কর তুই। (সার্থক ভাইয়া)

ভাইয়া টাকা বের করে আমাদের দাওয়ার পর আমরা সবাই বের হয়ে আসলাম। আমরা কাঙ্খিত ঘটনার জন্য সবাই দরজার বাইরে অপেক্ষা করছি। আলআবি ভাইয়া সামনে এগিয়ে কেবল ৪-৫ কদম ফেলেছে। সঙ্গে সঙ্গে নিয়াজ ভাইয়ার রুম থেকে বিকট আওয়াজ ভেসে আসলো। আমরা সবাই এটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। তৎক্ষণাৎ দরজা খুলে গেল।

আমরা সবগুলো হাসতে হাসতে ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছি। তখন আলআবি ভাইয়া আমাদের এমন অবস্থা দেখে পিছিয়ে এলেন। এসে নিয়াজ ভাইয়ার রুমে ঢুকলেন। একটু পরে তিনিও বের হয়ে আমাদের মতো দমফাটা হাসি তে ফেটে পড়লেন। এই প্রথম লোকটাকে এত সুন্দর করে হাসতে দেখলাম। হাসলে তার চোখ গুলো ঈষৎ সংকুচিত হয়ে যায়। তিনি শরীর দুলিয়ে দুলিয়ে হাসছেন। মনে হচ্ছে তার সাথে তার চোখ দুটোও হাসছে। এক গালে তার হালকা করে একটা টোল পড়ে। এই রকম দৃশ্য দেখে আমার নিজের হাসিই বন্ধ হয়ে গিয়েছে।মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকলাম তার দিকে।

এর মধ্যেই নিয়াজ ভাইয়া আর সজল ভাইয়া রুম থেকে বেড়িয়ে আসলেন। তাদের দুজনকে দেখে আমাদের হাসির মাত্রা আরও বেড়ে গেল। কারণ নিয়াজ ভাইয়ার পাশে সজল ভাইয়া শাড়ি পরে দাড়িয়ে আছে।সবচেয়ে বেশি হাসি পাচ্ছে সজল ভাইয়াকে শাড়ি পরা দেখে।সজল ভাইয়ার মুখেও অট্টহাসির ছাপ।

আসল কাহিনী হলো সাদুর আম্মু চলে যাওয়ার পরে আমরা সবাই মিলে সজল ভাইয়াকে তাসফি আপুর শাড়ির মতো একটা শাড়ি পড়িয়ে বড় একটা ঘোমটা দিয়ে বিছানায় বসিয়ে দেই। তারপর নিয়াজ ভাইয়া কে ডেকে নিয়ে আসি। এটা আমাদের সকলেরই মিলিত পরিকল্পনা ছিল।

ধীরেসুস্থে আমাদের হাসির মাত্রা কমিয়ে নিলাম। এরপর সার্থক ভাইয়া বলল,,,

–ভাই দশ হাজার টাকা হবে?

–এহ্ আমি কি টাকা বিতরণ করতে আসছি। আর তুই যেমনে চাইলি এমনে তো ফকিরও টাকা চায়না।(নিয়াজ ভাইয়া)

— আচ্ছা যা তাইলে এখন কোলবালিশ নিয়ে ঘুমা। তাসফির একটা ছবিও দিবো না তোরে।(সজল ভাইয়া)

–ভাই একটু রহম কর। আজকে এই মুহূর্তে তোদের আমি আর টাকা দিতে পারব না। যা প্রমিস করলাম কালকে তোদের দশ হাজার দিব।

–সত্যি তো?(সুমনা আপু)

–হ।তোদের বাড়ির বিলাইটার কসম।(নিয়াজ ভাইয়)

আমরা সবাই একসাথে বলে উঠলাম,,,

“কি?”

–আব…না মানে দিব দিব। কালকেই দিয়ে দেবো।(নিয়াজ ভাইয়া)

আমরা সবাই এরপর তাসফি আপুকে নিয়াজ ভাইয়ার কাছে রেখে এসে বাড়ির ছাদে উঠলাম।উদ্দেশ্য হলো সবাই মিলে আমরা ছাদে গল্প করব। আমরা ছাদে পৌঁছাতে না পৌঁছাতেই মোর্শেদ খালুর সেই বিখ্যাত ফোনের রিংটোন কোথা থেকে যেন বেজে উঠল।

চলবে……..……

[বিঃদ্রঃ গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক। অনুগ্রহ করে বাস্তবিক অর্থ খুজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না আর লেখিকা কে ও বিভ্রান্ত করবেন না]

বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-১৭

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_১৭

গোলাপ আর গাদা ফুল তাদের সুবাস চারদিকে ছড়িয়ে পরিবেশটাকে মাতিয়ে তুলেছে। সেইসাথে আকাশে উঠেছে গোলাকার থালার ন্যায় চকচকে এক চাঁদ। ক্ষণে ক্ষণে কিছু দল মেঘ এসে চাঁদটাকে ঘিরে ফেলছে আবার ক্ষণে ক্ষণে চাঁদ তার চকচকে রূপ নিয়ে হাজির হয়ে যাচ্ছে আমাদের সামনে।

ছাঁদে মানুষের আনাগোনার সাথে সাথে বেড়েছে কিছু চ্যাংড়া ধরনের ছেলেদের আনাগোনা। গ্রাম হোক বা শহর, প্রায় বিয়ে বাড়িতেই কিছু কিছু ছেলেদের দেখা যায় দাওয়াত বিহীন তারা এসে তাদের চাঁদমুখ খানা একবার দেখিয়ে যায় সবাইকে। এরাও তাদের দলেরই অন্তর্ভুক্ত। সব বিয়ে বাড়িতেই যে এরকম হয় তাও কিন্তু নয়।

অনুষ্ঠান চলাকালীন দেখি সার্থক ভাইয়া আর আংকেল মানে সাদুর আব্বু এসে হাজির। আজকের দিনে তাদেরকে আমরা মোটেও আশা করিনি। কারণ তাদের আসার কথা ছিল কালকে। আমরা সবাই মিলে স্টেজের সামনে রাখা চেয়ারগুলোতে বসেছিলাম আর নিজেদের মতো গল্প করছিলাম। কারন এখন বড়দের হলুদ দেওয়ার পালা চলছে। একটু পরেই আমরা হলুদ লাগাবো। তখন সার্থক ভাইয়া এসে রাফিদা আপুর পাশে বসে আপুর কাঁধে ভাইয়ার বাম হাত তুলে দিয়ে বলে,,,

— কি বড় বউ সারপ্রাইজ কেমন দিলাম?

আপু সার্থক ভাইয়ার হাত সরিয়ে একটু রাগী ভাব নিয়ে বলে,,,

— লাজ শরম কি গাজীপুরে সব রেখে আসছো?

–আরে বউ,আমি তো জন্মের আগেই লজ্জা শরম আল্লাহর কাছে রেখে আসছি।(সার্থক ভাইয়া)

–আমার কাছে আসলে লজ্জা শরম সব নিয়া তারপর আসবা। বুঝছ?(রাফিদা আপু)

আমরা সবাই ভাইয়া আর আপুর এমন কথাগুলো ভালোই এনজয় করছিলাম।তখন আমাদের ডাক পড়লো হলুদ ছোঁয়ানোর জন্য।নিয়াজ ভাইয়া একটা সাদা সেন্টু গেঞ্জি পড়া ছিল। একটা টাওয়াল গায়ের উপর দেওয়া ছিল।আর সাথে একটা লুঙ্গি পড়া ছিল।

একে একে রাফিদা আপু,সার্থক ভাইয়া, আলআবি ভাইয়া, সুমনা আপু, আঁখি, সুমাইয়া সহ আরো কিছু ছেলে মেয়ে হলুদ ছোঁয়ালো ভাইয়াকে।সব শেষে আমি, সাদু আর সজল ভাইয়া স্টেজে উঠলাম হলুদ ছোঁয়ানোর জন্য।আমরা তিনজন একটু একটু করে হলুদ দিলাম। হুট করেই আবার সাদু হাতে এক গাদা হলুদ নিয়ে নিয়াজ ভাইয়ার পুরো মাথায় লাগিয়ে দিলো।আমি একগাদা হলুদ নিয়ে ভাইয়ার গালে কপালে লেপ্টে দিলাম।সজল ভাইয়া নিয়াজ ভাইয়ার পুরো শরীরে হলুদ দিয়ে ভরে ফেলল।এইমুহূর্তে নিয়াজ ভাইয়া আর সজল ভাইয়া বসে বসেই একপ্রকার ধস্তাধস্তি করছে।নিয়াজ ভাইয়া নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টায় আছে আর সজল ভাইয়া হলুদ লাগানোর চেষ্টায়।একপর্যায়ে নিয়াজ ভাইয়া না পেরে সজল ভাইয়াকেও হলুদ দিয়ে ভূত বানিয়ে দিল।এখন আমরা দুই হলুদ মানব রূপী ভূতের মাড়ামাড়ি উপভোগ করছি। তাদের কান্ড দেখে তো আমরা সবাই হেঁসে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছি।আসলে এটা আমাদের তিন জনেরই একটা প্লেন ছিল।এর মাস্টার মাইন্ড হলো সজল ভাইয়া। নিয়াজ নামক হলুদ ভূতের কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম।একটু পরে তাসিফা আপুকে ছবি গুলো হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়ে দিব বলে।

হাসাহাসির একপর্যায় সাদুর সাথে আমার ধাক্কা লাগে। আমি ছিলাম ওর সামনে। স্টেজের সিঁড়ি দিয়ে নামতে যাচ্ছিলাম।আর সাদু ছিল আমার পিছনে। ধাক্কা টা সামলাতে না পেরে আমি সামনের দিকে পড়ে যাই।আপনাআপনি আমার চোখ দুটো বন্ধ হয়ে যায়। হঠাৎ করেই খেয়াল করলাম আমি পড়ে যাইনি। উপলব্ধি করতে পারছি একজোড়া বলিষ্ঠ হাত আমাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। আমার হাত জোড়াও কোন একটা স্থানে গিয়ে পড়েছে। কিন্তু কোথায় তা ঠিক বুঝতে পারছিনা। তাড়াতাড়ি করে চোখটা খুলে ফেললাম। আমার সামনের ব্যক্তিটিকে দেখে মনে হচ্ছে আমার চোখ কোটর থেকে বের হয়ে আসবে। দেখি আলআবি ভাইয়া তার হাত জোড়া আমার কোমরে চেপে ধরে রেখেছেন। আমার সমস্ত শরীরের ভর তার হাত জোড়ায়। আমার হাত জোড়া গিয়ে আলআবি ভাইয়ার শুভ্র রাঙা পাঞ্জাবির সারি সারি বোতামের দুইপাশে পড়েছে। অর্থাৎ এক হাত তার বাম পাশের বুকে আর এক হাত ডান পাশের বুকে। তাড়াতাড়ি নিজেকে ঠিক করে দাড়িয়ে পড়লাম। দাঁড়িয়ে পুনরায় অবাক হলাম। কারণ আমার দুই হাতে লেগে থাকা কাঁচা হলুদের ছাপ আলআবি ভাইয়ার পাঞ্জাবিতে লেপ্টে আছে। তার শুভ্র পাঞ্জাবিতে কাঁচা হলুদের একজোড়া হাতের ছাপ জ্বলজ্বল করছে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখি নিয়াজ ভাইয়া, সজল ভাইয়া, সাদু ব্যাতীত আমাদের আর কেউ লক্ষ্য করেনি। তিনজনই আমাদের দিকে অবাক করা চাহনি নিয়ে তাকিয়ে আছে।মাথা নিচু করে আমি আমতা আমতা করে বললাম,,,

–আ..আসলে আমি খেয়াল করিনি।

আলআবি ভাইয়া বলে উঠলেন,,,

–সে সরি।

আমি হকচকিয়ে তার দিকে তাকালাম। আমি তার থেকে এমন কোনো উত্তরই আশা করছিলাম না। এরকম পরিস্থিতিতে যে কেউ ই বলবে “ইট’স ওকে” অথবা বলবে “আমি কিছু মনে করিনি”। এই লোকটা এমন কেন? আর আমিই কি ইচ্ছে করে তার উপর পরতে গিয়েছি নাকি?কিছু টা অভিমান নিয়েই বললাম,,,

–সরি!

বলেই আমি স্টেজ থেকে নেমে এককোনায় চেয়ারে গিয়ে বসে রইলাম।বসে বসে তাসফি আপু কে নিয়াজ ভাইয়ার ছবি গুলো পাঠাচ্ছি আর আমাদের তোলা ছবি গুলোও দেখছি।তখন সাদু এসে আমার পাশে বসলো।কিন্তু ওর সাথে কথা বললাম না।ওর সাথে রাগ করেছি।ধাক্কা টা ওর সাথে লেগেই তখন ওই রকম একটা সিচুয়েশন তৈরি হয়েছিল।তকন সাদু বলল,,,

–কিরে মুখ টা ওমন কেন?

— আমার মুখ আমার ইচ্ছা। (আমি)

আমার সামনে সাদু ওর হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে এনে কিছুটা মাইকের মত করে ধরে বলল,,,

–আচ্ছা বাই দ্যা ওয়ে, রোমান্টিক একটা সিন এর পর আপনার অনুভূতি কি? যদি দর্শকদের একটু বলতেন?

ওর এই কথায় আমি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলাম।ও যে আমার মজা নিতে এসেছে আমি তা ভালোই টের পেয়েছি। শুরু হয়ে গেল আমাদের মারামারি।এর মধ্যেই হঠাৎ করে খেয়াল করলাম কেউ গিটারে টুংটাং শব্দ করে সুর তোলার চেষ্টা করছে। স্টেজের দিকে চোখ পড়তেই দেখি আলআবি ভাইয়া একটা চেয়ারের উপর বসে হাতে গিটার নিয়ে সেটা বাজাচ্ছে। পড়নে তার সেই পাঞ্জাবি যেটা আমি নষ্ট করে দিয়েছি। গিটার হাতে তাকে আমার কাছে দেখতে খুব ভালো লাগছে । মনে হচ্ছে তার দিকে তাকিয়েই থাকি । পরক্ষনেই মনে হলো ছি!ছি! এগুলো কি ভাবছি।

গিটারের শব্দ টা ভালই লাগছে। সবাই একসঙ্গে স্টেজের সামনে জটলা পাকালো।আমারও নড়েচড়ে বসলাম। তখন আলআবি ভাইয়া গলা ছেড়ে গাইতে শুরু করলেন,,,

কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
কেন মেঘ আসে হৃদয়-আকাশে
তোমারে দেখিতে দেয় না
মোহমেঘে তোমারে দেখিতে দেয় না
মোহমেঘে তোমারে
অন্ধ করে রাখে
তোমারে দেখিতে দেয় না

মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাইনা?
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাইনা?

ক্ষনিক আলোকে আঁখির পলকে
তোমায় যবে পাই দেখিতে
ওহে ক্ষনিক আলোকে আঁখির পলকে
তোমায় যবে পাই দেখিতে
ওহে হারাই-হারাই সদা হয় ভয়
হারাই-হারাই সদা হয় ভয়
হারাইয়া ফেলি চকিতে
আঁশ না মিটিতে হারাইয়া
পলক না পড়িতে হারাইয়া
হৃদয় না জুড়াতে
হারাইয়া ফেলি চকিতে

মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাইনা?
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাইনা?

ওহে কি করিলে বলো পাইব তোমারে?
রাখিব আঁখিতে আঁখিতে
ওহে কি করিলে বল পাইব তোমারে?
রাখিব আঁখিতে আঁখিতে
ওহে এত প্রেম আমি কোথা পাব নাথ
এত প্রেম আমি কোথা পাব নাথ
তোমারে হৃদয়ে রাখিতে

আমার সাধ্য কিবা তোমারে
দয়া না করিলে কে পারে?
তুমি আপনি না এলে
কে পারে হৃদয়ে রাখিতে?

মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাইনা?

ওহে আর কারো পানে চাহিব না আর
করিব হে আজই প্রাণপণ
ওহে আর কারো পানে চাহিব না আর
করিব হে আজই প্রাণপণ
ওহে তুমি যদি বল এখনি করিবো
তুমি যদি বল এখনি করিবো
বিষয় বাসনা বিসর্জন
দিব শ্রীচরণে বিষয়
দিব অকাতরে বিষয়
দিব তোমার লাগি বিষয়
বাসনা বিসর্জন

মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাইনা?

কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে?
কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে?
তোমারে দেখিতে দেয়না
মোহমেঘে তোমারে দেখিতে দেয়না
মোহমেঘে তোমারে
অন্ধ করে রাখে তোমারে
দেখিতে দেয়না

মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাইনা?
মাঝে মাঝে তব দেখা পাই
চিরদিন কেন পাইনা?

তার গানের কন্ঠ মাশাল্লাহ! এতক্ষণ মনে হচ্ছিল কোন এক মোহে পড়ে গিয়েছিলাম । তার গান শেষ হতেই করতালির শব্দে মুখরিত হলো চারপাশ। পুরো গানটাই আলআবি ভাইয়া চোখ জোড়া বন্ধ করে গেয়েছেন। করতালির শব্দে চোখ মেলে তাকালেন। তিনি চোখ খুলতেই আমাদের দুজনের মধ্যে চোখাচোখি হয়ে গেল। গানটা শেষ করে সে আর অপেক্ষা করলেন না। স্টেজ থেকে নেমে সিঁড়ি দিয়ে একেবারে নিচে চলে গেলেন। তার যাওয়ার পরে কয়েকটা ছেলে স্টেজে উঠে নাচলো। একটা মেয়ে গান গেলো।এভাবে রাত বাড়তে বাড়তে দুইটায় এসেও পর্যন্ত নাচ-গানের পর্ব শেষ হলো না।আমি অনেক ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। প্রচুর ঘুমও পাচ্ছে। ঘুমের জন্য বারবার চোখের পাতা নেমে আসছে। সাদুকে সহ ওদের সবাইকে একবার জিজ্ঞেস করলাম ওরা কেউ নিচে যাবে কিনা। সবাই বলল না। তাই আমি একাই নিচে আসার জন্য উঠে দাঁড়ালাম। কিছুটা ঘুম ঘুম চোখেই ধীরে ধীরে সিঁড়ি বেয়ে নিচে আসলাম। দেখি উঠোনে সব বড়রা বসে গোল মিটিং এর মতো কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছে। পাশেই ডেকোরেশন এর জিনিসপত্র গুছানো হচ্ছে। কারণ আমাদের বাড়িতে আর অনুষ্ঠান হবে না। এর পরের দুই দিন সেন্টারেই অনুষ্ঠান হবে। তাই বাড়িতে কোন ঝামেলা নেই। উঠোনের দিকে চোখ বুলিয়েই আমার রুমের দিকে পা বাড়ালাম।ঘুমে আমার চোখ ভেঙে আসছে। এখনই তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়বো।

ফ্রেশ হয়ে একটা ঢিলেঢালা থ্রি পিছ পড়ে নিলাম। কারণ আজকে গরম একটু বেশিই পড়েছে। বিছানায় এসেই আমার মহা মূল্যবান সময় গুলোকে নষ্ট না করে বাকিদের জন্য জায়গা রেখে দ্রুত শুয়ে পড়লাম। শুয়ে চোখটা বন্ধ করেছি কিছু সময় হবে। আমার চোখটা লেগে এসেছিল। কিন্তু তৎক্ষণাৎ মনে হলো কোন শীতল বস্তু আমার দুই গালে আর কপালে স্পর্শ করছে। হঠাৎ করে কানে একটা পুরুষালি কণ্ঠ ভেসে আসলো,,,

–গজদন্তিনী!তুমি কি জানো তোমার গজ দাঁত বিশিষ্ট হাসি দেখলে তোমার গজদাঁতে আমার ওষ্ঠদ্বয় ছুয়ে দেয়ার প্রবল ইচ্ছে জাগে।

কানে কোন অপরিচিত কন্ঠ আর এমন একটি কথা ভেসে আসতেই আমি সটান হয়ে বসে পরলাম। জোরে জোরে শ্বাস ক্রিয়া চালাচ্ছি।রুমের লাইটটা অন করে পুরো রুমটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। কিন্তু কাউকেই পেলাম না। এবার মনের মধ্যে ভয় ঢুকে গেল মনে মনে ভাবছি কোন প্রেতাত্মা এসে পড়ল না তো রুমে?আয়নায় চোখ যেতেই আমার চোখ কপালে ওঠার উপক্রম। আমার গালে আর কপালে তিন আঙ্গুলের ছাপ দিয়ে হলুদ ছোঁয়ানো।এটা দেখে ভয়ে রীতিমতো কলিজার পানি শুঁকিয়ে গেছে। অনুষ্ঠানে সবাই সবাইকে যেই হলুদ লাগিয়েছিলাম আমি তো তা ভালোভাবেই ধুয়ে এসেছিলাম।এখন আবার এই হলুদ আসলো কীভাবে?আমার আকাশকুসুম ভাবনার মধ্যে ফোনের মেসেজ টোন বেজে উঠলো। তাড়াতাড়ি করে ফোনটা নিয়ে দেখি একটা মেসেজ এসেছে,,,

“আমার #বর্ষণ_সঙ্গিনী”

” সবার পরের ছোঁয়াটা আমিই দিলাম। যদি সবার আগে তোমায় হলুদ ছোঁয়া দিতাম তবে অন্য সকলের স্পর্শে আমার ছোঁয়াটা ঢেকে যেত। এখন আমার ছোঁয়া টাই থেকে যাবে।”

“তোমার বর্ষণ সঙ্গি”

চলবে…………

[বিঃদ্রঃ গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক। অনুগ্রহ করে বাস্তবিক অর্থ খুজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না আর লেখিকা কে ও বিভ্রান্ত করবেন না]

বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-১৬

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_১৬

–তোমার ফোন যদি আমি ভেঙে গুঁড়া
গুঁড়া না করেছি আজকে।

আমাদের সবার মাঝে থেকে খালামনি আমার খালুকে উদ্দেশ্য করে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা গুলো বলে উঠলো। আমাদের সকলের পূর্ণদৃষ্টি পড়লো খালুর উপর। উনি কিছুটা দুঃখী দুঃখী হয়ে আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে তার পর খালামনিকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,

–আরে শামিমা বেগাম, রাগছো কেন?ফোনে কল আসলে শুনতে পাইনা বেশিরভাগই। তাই এই রিংটন লাগিয়েছি।

খালামনি আবার চেঁচিয়ে বলে উঠলো,,,

–সারাদিন গলায় গরুর ঘন্টার মতো ওইটা ঝুলিয়ে রেখেও শোনো না কীভাবে তুমি?

–শুনতে পারি যেনো তাই বলেই তো গলার সাথে বেধে রাখি এইটা।(খালু)

কথা গুলো বলে মোর্শেদ খালু তার গলায় ঝুলানো ফোনটা কানে নিয়ে চলে গেলেন কথা বলতে।খালু আসলে একটু অন্য কিসিমে’র লোক।তার ছোট খাটো একটা ব্যবসা আছে।অতি ব্যস্ত মানুষই তাকে বলা চলে।বিয়ে শাদি বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো অকেশোন ছাড়া তার দেখা মেলা যায় না।যতটুকু সময়ই তাকে দেখা যাবে, তার গলার ঝুলানো ফোনটা কানেই দেখা যাবে।ফোনে কথা বলতে থাকলে তার হুশ থাকে না। বিগত তিন বছরে তার চার খানা মোবাইল খোয়া গেছে। তিনি চারটা টা মোবাইলই হারিয়েছেন ছিনতাইকারীর কবলে পড়ে ।কথাতে তিনি এতই মশগুল ছিলেন যে তার হাতের উপর থেকে ফোন নিয়ে ছিনতাইকারী উধাও হয়ে গিয়েছে তারপর সে টের পেয়েছে তার ফোন খোয়া গেছে। বলতে গেলে তার একটু খেয়াল কম। এতকিছুর মাঝেও আমার খালামনিকে সে প্রচুর ভালোবাসে।সাথে হালকা পাতলা ভয়ও পায়।খালামনি রেগে গেলে খালু তাকে শামিমা বেগাম বলে ডাকে।

যতোই জার্নি করে আসি না কেন গ্রামে আসলে ক্লান্ত থাকলেও তা গায়ে খুব একটা লাগে না।গ্রাম্য পরিবেশ মনকে ফুরফুরে বানাতে বাধ্য করে। আমার মতে, মনের ক্লান্তি হলো আসল ক্লান্তি।মন যখন ক্লান্তি থেকে কয়েকশো গজ দূরে থাকে তখন দেহের ক্লান্তিও জানালা দিয়ে পলায়ন করে।

খাওয়া দাওয়ার পর্ব শেষ করে সুমনা আপু কে কল করে বলি আমরা এসে পড়েছি। সুমনা আপু কে বলি আমাদের নানু বাড়ি চলে আসতে। নানুবাড়ি আর দাদু বাড়ির দূরত্ব কম হওয়ায় একটু সময় পরে সুমনা আপু সুমাইয়া আর আঁখিকে নিয়ে চলে আসে। আমি রুমে এসে দেখি সাদু ঘুমাচ্ছে। ওকে টেনেটুনে ঘুম থেকে উঠালাম। সাদু ঘুম থেকে উঠে ঘুমঘুম কন্ঠ বলে উঠল,,,

–বইন আমি কি কোন জন্মে তোর সতীন আছিলাম?

— সতীন না হইলেও এই জন্মে তো আমার বান্ধবী। আর তোরে কি এই জাগায় আমি ঘুমানোর লেইগা আনছি? (আমি)

— তো কি আমারে কুতকুত খেলতে আনছোস?তোর ভাইর তো এহনি বিয়া হইয়া যাইতাছে না।(সাদু)

— এই না হইলো আমার বান্ধবী। ঠিক কইছোস।তোরে কুতকুত খেলতেই আনছি।ওঠ তাড়াতাড়ি। সুমনা আপুদের নিয়া কুতকুত খেলমু।কতদিন খেলিনা।(আমি)

–কতদিন ধইরা তো ছোটবেলার মতো সবার সামনে সেন্টু গেঞ্জি আর হাফপেন্ট পইড়া ঘুরছ না।এহন মন চাইলে কি ওগুলি ও পইড়া ঘুরবি?(সাদু)

–হ।আমার মন চাইলে পড়মু।তোর সমস্যা? (আমি)

–দোস্ত ইমেজিন কর।তুই সেন্টু গেঞ্জি আর হাফপেন্ট পইড়া ঘুরতাছোস।কেমন দেহাইবো?(সাদু)

কথাটা বলেই সাধু হু হা করে হাসতে হাসতে একেবারে কুপোকাত হয়ে গেল।এর মধ্যে আমার সাদুর কয়েক দফা মারামারিও হয়ে গেল। দুজন মাড়ামাড়ির পর্ব শেষ করে একসাথে বাইরে আসলাম। এসে দেখি সুমনা আপুরা খেলার জন্য উঠোনে মাটিতে দাগ কেটে ঘরের মতো সাজিয়েছে। আসলে কুতকুত ছোটবেলায় দু-একবার খেলেছিলাম। তাই স্পষ্ট করে কোন কিছু মনে নেই। গ্রামে এসেই উঠোনে খালি পায়ে যখন হাঁটছিলাম তখন হঠাৎ করে মনে হল এখানে দাগ কেটে কুতকুত খেলা যায়। তাই এই প্ল্যান করলাম। সুমনা আপু দেখিয়ে দিল কিভাবে খেলতে হবে। আকাশের দিকে তাকিয়ে অথবা চোখ বুজে দাগ কাটা ঘরগুলো পার করতে হবে। দাগে পা লাগলে সে আউট হয়ে যাবে। একেক কদম ফেলার সাথে সাথে মুখে বলতে হবে আছি নাকি?[বিঃদ্রঃ লেখিকারও সঠিক নিয়ম স্পষ্ট মনে নেই। যতটুকু মনে করা সম্ভব হয়েছে তা দিয়েই লেখেছি]

একে একে সবাই খেলতে শুরু করলাম। সাদুর আগে আসলো আমার পালা। উপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে আমি প্রথম কোর্টে পা রেখে বললাম “আছি নাকি” তারপর পরের কোর্টে আবারও পা ফেলে বললাম “আছি নাকি”। ওরাও সাথে সাথে হ্যাঁ হ্যাঁ করছে। কয়েক ঘর পার করার পর লক্ষ্য করলাম কারো কোন শব্দ নেই। হঠাৎ করেই কোন কিছুর সাথে ধাক্কা লেগে মাটিতে ধপ করে বসে পড়লাম। তৎক্ষণাৎ পেছন থেকে খিলখিলিয়ে সবার হাসির শব্দ পেলাম। সামনে তাকিয়ে দেখি আলআবি ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে।লক্ষ্য করলাম আমি খেলার কোর্ট থেকে নাহলেও দশ হাত দূরে। তখন আলআবি ভাইয়া বলে উঠলো,,,

–এই পৃথিবীতে আছো তো তুমি?

আমি বসা থেকে দাঁড়িয়ে জামা ঝাড়তে ঝাড়তে তার দিকে কটমট করে তাকালাম আর বলে উঠলাম,,,

— চোখে কি কম দেখেন নাকি?ওহ্ চোখে তো আপনি কমই দেখেন। বেশি দেখলে তো ডাক্তার আপনাকে আর চশমা দিত না।

কথাগুলো আমার বলতে দেরি কিন্তু তার হুংকার ছাড়তে দেরি হয়নি। তিনি অগ্নিমূর্তি হয়ে বলে উঠলেন,,,

— এই মেয়ে! কি বললে? আমি চোখে কম দেখি?

তার এমনভাবে বলায় আমি কিছুটা ভয় পেয়ে গেলাম। তিনি আবারও বলে উঠলেন,,,

— চোখে যদি কমই দেখতাম তাহলে তোমার জায়গায় আমি থাকতাম।ইডিয়েট!

বলেই উনি কালো ফ্রেমের চশমাটা তার এক আঙ্গুল দিয়ে একটু ঠেলে নিলেন।তারপর হন হন করে বাড়ির ভিতরে চলে গেলেন।আলআবি ভাইয়ার প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গেই চারদিকে হাসির রোল পড়ে গেল। ওরা সবাই আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে।সাদু বলল,,,

— বান্ধবী আরেকটু খেলবি?কুতকুত!

লাস্টের শব্দ টা ও একটু ব্যঙ্গ করেই বললো। তখন কোথা থেকে যেন মোর্শেদ খালু এসে হাজির হলেন। সাথে তার বিখ্যাত ফোনের রিংটোন নিয়ে “দয়াল তোর লাইগা রে”। দেখি সে বাড়ির গেট দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করছে আর তার গলায় ঝোলানো ফোনটা বেজে চলেছে। এইরকম মুহূর্তে এইরকম একটা ফোনের রিংটোন আমার মেজাজ ১০৪ ডিগ্রি করে দিল। রাগে-দুঃখে ওখান থেকে চলে আসলাম। এসেই ফ্রিজ খুলে এক লিটার ঠান্ডা পানির বোতল বের করে বোতলে মুখ লাগিয়ে ঢকঢক করে পানি খেতে শুরু করলাম।

চারদিকে থেকে মাগরিবের আযানের ধ্বনি কানে বাজছে।সন্ধ্যা নেমে এসেছে বলে সুমনা আপু, সুমাইয়া আর আঁখি কে মামী ওদের বাড়ি যেতে দেয়নি।

রাতের বেলা আমরা সবাই একসাথে খেতে বসে ছিলাম। তখন আমার নানাভাই মোর্শেদ খালু কে উদ্দেশ্য করে বলল,,,

–মোর্শেদ ফোনটা যদি গলা থেকে নামিয়ে রুমে রেখে আসতে তাহলে মনে হয় ভালো হতো।

আমার পাশেই ছিলো সাদু। নানা ভাইয়ের কথা শুনে মুখ চেপে হাসতে দেখলাম ওকে।সুমনা আপু,সুমাইয়া আর আঁখি ও দেখি হাসছে। তখনই খালু বলে উঠল,,,

— জি আব্বা রেখে আসছি।

আসলে খালু তার ব্যবসাটা একাই সামলায়। সে মনে করে সে দূরে থাকলে তার কর্মচারীরা কাজে গাফিলতি করবে। সে জন্যই একটু পর পর সে ফোন দিয়ে সব খোজ খবর রাখে

রাতের খাওয়া দাওয়া শেষে আমরা যে যে যার যার রুমে চলে আসলাম। সবাই অন্যদিনের তুলনায় আজকে একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল। কারণ পরশুদিন যেহেতু গায়ে হলুদ কালকে থেকে টুকটাক কাজ শুরু করে দিতে হবে।

আমার রুমে আমিসহ সাদু, সুমনা আপু,সুমাইয়া আঁখি আর রাফিদা আপুকে ঘুমানোর জন্য দেওয়া হয়েছে। দুই বান্ধবী এক হলে আমাদের কথা শেষ হয় না আর আজ তো আমরা পাঁচ থেকে ছয় জন একসাথে একরুমে ঘুমাবো। ঘুম তো হবেই না বরং গল্প হবে বেশি। খাটের উপরে বসে আমরা সবাই গল্প করছিলাম। মাঝে একটু গানের কলি ও খেলেছি। প্রায় সাড়ে দশটার দিকে রাফিদা আপু বলে উঠলো,,,

— সাদিয়া! জুই! এখন ঘুমাই চল।এখানে তো সকালে বেলা করে ঘুমানো যাবে না। তাড়াতাড়িই উঠতে হবে।

তখন সুমনা আপু বলল,,,

–আচ্ছা তোমরা শুয়ে পড়ো আমি একটু বাথরুমে যাবো।

–ওমা! টুরু সাহস দেখি তোমার।(সাদু)

–আমরা গ্রামে থেকে অভ্যস্ত তো তাই। কিন্তু এখন আর বাইরের টায় যাবো না।ভিতরের বাথরুমে যাবো। (সুমনা আপু)

–আমিও যামু।তোমরা কেউ যাবা?(আঁখি)

–না। যাও তোমরা।(আমি)

সুমনা আপু আর আঁখি ওয়াশরুমের জন্য চলে গেলে আমরা যে যার বালিশ ঠিক করে শুয়ে পড়লাম। ওরা বাইরে যাওয়ার প্রায় পাঁচ থেকে ছয় মিনিট পরে বিকট চিৎকার ভেসে আসলো।

“ওমা গো”

আমি, রাফিদা আপু, সাদু আর সুমাইয়া ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়লাম কারণ কণ্ঠ শুনে বুঝতে অসুবিধা হলো না এটা সুমনা আপু আর আখির কণ্ঠ। তাড়াতাড়ি করে আমরা বাইরে বের হয়ে আসলাম।

বাইরে এসে দেখি আমাদের উঠোনের আমগাছ টার উপর মোর্শেদ খালু বসে ফোনে কথা বলছেন। পরনে তার হাঁটু পর্যন্ত একটা সাদা কালো শর্ট পেন্ট।গায়ে তার সেন্টু গেঞ্জি। নিচেই খেয়াল করলাম তার লুঙ্গি আম গাছের তলায় রাখা।

উঠানের মাঝখানে চোখ বোলাতেই দেখি আঁখি আর সুমনা আপু একটা আরেকটার হাত ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে কি যেন বলছে।ওদের কাছে যেতেই বুঝতে পারলাম ভয়ের চোটে ওরা মুখ দিয়ে সূরা বলার চেষ্টায় আছে। কিন্তু মুখ দিয়ে যে ওদের কি বের হচ্ছে ওরা নিজেরাই জানেনা। আঁখি বলছে “সুবহানাল্লাহ সুবহানাল্লাহ” সুমনা আপু চোখ বুজে বুজে বলছে “আল্লাহু আল্লাহু”। অতি শোকে যেমন পাথর হয়, ওরা হয়েছে অতি ভয়ে পাগল।

এখানে যে কি হয়ে যাচ্ছে সেদিকে মোর্শেদ খালুর কোন চিন্তাই নেই। আমরা চারজন এগিয়ে গিয়ে ওদের দুজনকে ধরলাম। তখন পিছনে দেখি বাড়ির সবাই এসে পড়েছে।নিয়াজ ভাইয়া, আলআবি ভাইয়া, সজল ভাইয়া, মামা-মামী। কেবল নানাভাইকে দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ করে মোর্শেদ খালু বলল,,,

— কি হয়েছে তোমরাও বের হয়ে এসেছ কেন?

খালামণি চেঁচিয়ে বলে উঠলো,,,

— একি অবস্থা তোমার? বোধ বুদ্ধি কি সবই লোপ পেয়েছে ?

তখন খালু ধীরেসুস্থে নেমে এসে তার লুঙ্গি টা ভালো করে পড়ে বললেন,,,

— আরে হয়েছে কি ফোনে নেটওয়ার্ক পাচ্ছিলাম না বুঝেছ। তখন উঠোনে ঘুরতে ঘুরতে আমগাছটা চোখে পড়ল। উঠে গেলাম আমগাছে।আরে তুমি তো জানো না একেবারে ফোরজি নেটওয়ার্ক ওখানে। লুঙ্গি পড়ে তো গাছে উঠতে পারছিলাম না তাই ওটা খুলেই উঠে পড়েছি।

–একেবারে উদ্ধার করেছ আমায় তুমি।(খালামনি)

— ও শামিমা বেগাম রাগ হচ্ছো কেন?(খালু)

–আনন্দের ঠেলায়।যত্তসব! তোমার ওই গরুর ঘন্টা যদি রুমে নিয়ে আসো সাথে করে তাহলে আজকে তোমার একদিন কি আমার একদিন(খালামনি)

খালামণির কথা শেষ হতে না হতেই বেজে উঠল,,,

“দয়াল তোওওওর লাইগা রেএএএএ”

খালামণি কপট রাগ দেখিয়ে চলে গেলেন। একে একে সবাই খালুকে ফোনটা একটু কম ব্যবহার করতে বলে রুমে চলে গেল। তখন খালু এসে আমাদের সামনে দাড়িয়ে সুমনা আপু আর আঁখি কে উদ্দেশ্য করে বললেন,,,

–ওদের দুজনের আবার কি হয়েছে?

খালুকে বললাম তাকে ওভাবে বসে থাকতে দেখে ওরা দুজন ভয় পেয়েছে। তখন খালু ওদের সরি টরি বলে চলে গেলেন। পরে জানতে পারলাম বাড়ির ভেতরের ওয়াশরুমে কেউ একজন ছিল যার জন্য ওরা দুজন বাইরের ওয়াশরুম ব্যবহার করতে গিয়েছিল। আর এত কাহিনী ঘটলো।

পরেরদিন বিকেলের দিকে আমরা সবাই মিলে নানা বাড়ি থেকে দাদু বাড়ি চলে আসলাম। সন্ধ্যার দিকে স্টেজ সাজানোর জিনিসপত্র সাথে সাউন্ড বক্স চলে এসেছে। আজ অবশ্য মোর্শেদ খালু খালা মনির সামনে তার মোবাইলটা ছুঁয়ে ও দেখেনি। কিন্তু তারপরও সেটা গলায় ঝুলিয়ে রেখেছিল। আজকের দিনটা আমাদের ভালোই কেটেছে। রাতের বেলা ঘুমানোর সময় এসে সাদু দুষ্টুমি করে আঁখিকে বলল,,,

–কি গো ওয়াশরুমে আজকে যাবা না?

তখন আঁখি জবাব দিল,,,

–সন্ধ্যার পরপরই তো সব কাজ শেষ করে ফেলেছি। রাতে ওয়াশরুমে যাওয়ার সাধ মিটে গেছে।

ওর কথায় আমরা সবাই হেসে দিলাম।
আজ একেবারে সকাল থেকেই সবার ব্যস্ততা আর ছুটছে না। কারণ সন্ধ্যায় ভাইয়ার গায়ে হলুদ। দুপুরবেলা আমরা সবাই পুকুর পাড়ে এসেছি গোসল করার জন্য। তখন রাফিদা আপু আর সুমনা আপু দুজনে সাঁতার কাটার প্রতিযোগিতা করবে বলে ঠিক করেছে। আমার প্রাণ প্রিয় বান্ধবী বলে ওঠে সেও সাঁতার পারে। ওর বলার ভঙ্গিতেই আমি বুঝে গেছি যে চাপা মারছে ও।আর আমি এটাও জানি ও পুকুরে গোসল করতে কিছুটা হলেও ভয় পায়। রাফিদা আপু বলে ওঠে,,,

— মিথ্যে একটু কম কইরাই বল।

সাধু তখন বলে ওঠে,,,

–দেখবে আমি যে সাতার পারি।

এটা বলেই ও পানির মধ্যে ডান পা দিয়ে বাম পা দেয়ার সময় পিছলে পড়ে যায়। সুমনা আর রাফিদা আপু দুজন মিলে ওকে টেনে হিঁচড়ে উপরে তোলে। ওকে তোলার পড়েই আমরা সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ি।সাদু রাফিদা আপুর দিকে তাকিয়ে বলল,,,

–কেমন বোইন তুমি। আমিতো ভাবছি তুমি আমারে ধইরা রাখবা। তাই তো একটু সাহস দেখাইতে গেলাম।

সন্ধ্যার দিকে আমাদের পুরো বাড়ির চেহারাই পাল্টে গেল। চারদিকে একেবারে বিয়ে বিয়ে গন্ধ লাগছে। আমরা সবাই গোল্ডেন কালার পাড় যুক্ত অফ হোয়াইট শাড়ি পড়লাম।সাথে গোল্ডেন কালার ব্লাউজ। অন্য সময় ভারী মেকআপ পছন্দ না হলেও যেকোনো বিয়ে বা অকেশনে মেকআপ করা আমার ভালই লাগে। কারণ বিয়ে বাড়িতে সবাই সেজেগুজেই আসে। সেখানে নিজেকে একমাত্র সাজগোজ বিহীন দেখতে খুব একটা ভালো লাগে না। বলে রাখা ভালো যে, আমি খোঁপাতে বেলিফুল দিয়েছি। যেটা নিয়ে সাদু আর আমার সাথে একদফা মারামারি হয়ে গিয়েছে। সব ঠিকঠাক করে সেজেগুজে বাহিরে আসলাম। তখন মামী ডেকে বলল মিষ্টির ট্রে নাকি আমার রুমে রেখেছে আমি যেন একটু নিয়ে আসি।

রুমে ঢুকে মিষ্টির ট্রে নিয়ে আসার সময় হঠাৎ বিছানার উপর চোখে পড়ল ঈষৎ হলদে রঙের গোলাপ ফুল একটা বেলি ফুলের মালার সাথে লেপ্টে আছে। তার নিচেই আছে একটা কাগজ। সেখানে কিছু একটা লেখা দেখা যাচ্ছে। আমি একটু এগিয়ে গিয়ে কাগজটা নিচ থেকে বের করে নিলাম। সেখানে দেখলাম খুব সুন্দর করে লেখা আছে,,,

” আমারো পরানো যাহা চায় তুমি তাই গো”

চলবে……………….

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#সাডেন সারপ্রাইজ

“আমার পরানো যাহা চায়, তুমি তাই গো”

হাতের লেখাটা জ্বলজ্বল করছে। মনে হচ্ছে লেখাটাও কথা বলছে।হাতের লেখার ধরণ চিনতে আমার একটুও অসুবিধা হলো না। এটা সেই লোকটার।সে এখানেও পৌঁছে গিয়েছে? কিন্তু কীভাবে?তাহলে কি সাদুর ধারণাই ঠিক ছিল? সত্যি কি আলআবি ভাইয়া লোকটাকে সাহায্য করছে? আমি কি আলআবি ভাইয়াকে সরাসরি জিজ্ঞেস করবো?যদি সে আমাকে কিছু না বলে?কিন্তু সে যদি এসবের পেছনে না থাকে? তখন তো আমাকে নিয়ে সে নেগেটিভ কিছু ভাববে।ভাবনার মাঝেই মামীর ডাক পড়লো।

–আসছি মামী।

মামীকে জোড়ে জবাব দিয়ে ফুলগুলো রেখে কাগজ টা লুকিয়ে রাখলাম। কেন যেন কাগজ টা ছিঁড়ে ফেলতে বা ফেলে দিতে ইচ্ছে করলো না।

আমার দাদা বাড়িটা বেশ বড় জায়গার মধ্যে তৈরী করা।সেই সুবাদে বাড়ির ছাঁদ টাও বিশাল বড়।ছাঁদেই নিয়াজ ভাইয়ার হলুদের স্টেজ করা হয়েছে।ছাঁদে বক্সে গান বাজছে ফুল ভলিউমে। সুমনা আপু, সাদু ওরা সবাই অলরেডি ছাঁদে চলে গেছে।একহাতে মিষ্টির ট্রে টা নিয়ে আরেক হাতে শাড়ির কুঁচি ধরে সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠছি।শাড়ি পড়ে ততটা অভ্যস্ত নই বলে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে কিছু টা অসুবিধা হচ্ছে। এমন সময় মনে হলো আমার পেছনেও কেউ সিঁড়ি দিয়ে উঠছে।পেছনে ঘাড়টা হালকা ঘুড়িয়ে দেখি আলআবি ভাইয়া আমার পেছন পেছন উঠছেন। পড়নে তার রঙ চঙ বিহীন একটা শুভ্র পাঞ্জাবি।সাথে সেই শুভ্র রঙেরই পায়জামা। বুকের কাছটায় সোনালি রঙের কয়েকটা বোতাম উঁকি দিচ্ছে। তার দাঁড়িতে যে ঈষৎ ঘনত্ব বেড়েছে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। মাথার চুল গুলোতেও পরিপাটির ছোঁয়া লাগিয়েছেন।তার ভরাট পাপড়ির চোখদুটো কিছুটা সংকুচিত করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।এই প্রথম তাকে এতো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। এক প্রকার স্ক্যান করা বলা চলে। তাকে দেখে এই প্রথম মনে হলো তাকেও সুদর্শন পুরুষের তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা যায়। হঠাৎ সে আমাকে লক্ষ্য করে তার এক ভ্রু ঈষৎ উচু করলেন। যার দ্বারা সে স্পষ্ট বোঝাতে চেয়েছেন “কি”?। তার এরূপ কাজে আমার সম্বিত ফিরে এলো। তাকে কিছু না বলে আমি সিঁড়ির একপাশে চেপে গেলাম। সে যেন উপরে উঠতে পারে তাই।

আলআবি ভাইয়া আমাকে পাশ কাটিয়ে কয়েক ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে উপরে চলে গেলেন।আমি পুনরায় আমার শাড়িটা ধরে উপরে ওঠার জন্য যখন উদ্যত হলাম, ঠিক সেই মুহুর্তে হুটকরেই আলআবি ভাইয়া আমার সামনে এসে দাড়িয়ে পড়লেন। আমার হাত থেকে মিষ্টির ট্রে টা নিয়ে সে আমার মত করেই সিঁড়ির এক পাশে চেপে গেলেন। তার এমন অদ্ভুত কাজে অবাক চাহনি নিয়ে তার দিকে তাকালাম। তখন আলআবি ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন,,,

–শাড়ি সামলানোর গুন তো নেই।

কথাটা বলেই তিনি এক ধাপ সিঁড়ি পেরিয়ে আমার অনেকটা কাছাকাছি এসে পড়লেন। আমার দিকে কিছুটা ঝুঁকে হুট করেই তিনি আমার পেটের অংশের দিকে থাকা শাড়ি টেনে দিলেন। এমনটা হওয়ায় কিছুটা হকচকিয়ে উঠলাম আমি। সঙ্গে সঙ্গে আমি দুই ধাপ সিঁড়ি নিচে নেমে গেলাম। আসল ব্যাপারটা কি হয়েছে তা বুঝতে পারার পর মাথা নিচু করে দাড়িয়ে রইলাম। আলআবি ভাইয়ার সামনে এমন হওয়ায় এখন প্রচুর পরিমাণে লজ্জা লাগছে। ইশ ওনার সামনে এমনটা না হলেও তো পারতো। লজ্জার কারনে তার দিকে দৃষ্টি দিতে পারছিনা। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে লজ্জাবতী গাছ ও আমার থেকে লজ্জা কম পায়। এমন সময় আবার আলআবি ভাইয়া কড়া গলায় বলে উঠলেন,,,

— সেফটিপিন টাও অবশ্য আমি মেরে দিব না। যাও নিচে গিয়ে ঠিকঠাক হয়ে এসো।

কথাগুলো বলে তিনি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন।আমি তো লজ্জায় পা ও নাড়াতে পারছি না। হঠাৎ আলআবি ভাইয়া বাজ খাই গলায় চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,,,

–কি হলো যাও!

তার চিৎকারে ভয় পেয়ে দ্রুত দুইহাতে কোনো মতে শাড়ি ধরে নিচে নেমে আসলাম।রুমে এসে ভালো করে সেফটিপিন লাগিয়ে নিলাম।যেখানে একটা লাগবে সেখানে দুইটা করে লাগিয়ে নিলাম। রুম থেকে বের হওয়ার আগে আরও একবার ভালো করে নিজেকে পর্যবেক্ষন করে তার পর ছাঁদের দিকে হাঁটা ধরলাম।

ছাদের ঠিক মাঝখানে ভাইয়াকে বসিয়ে হলুদ দেয়ার জন্য স্টেজ করা হয়েছে।স্টেজের পিছনের অংশে রাখা হয়েছে খাওয়ার স্পেস।আর স্টেজের সামনে রাখা হয়েছে সারি সারি চেয়ার।বাড়ির উঠোনে জায়গা একটু কম বলে সেখানে বাবুর্চি দিয়ে রান্না চাপানো হয়েছে। উঠোনটা আরেকটু বড় হলে উঠোনেই স্টেজ সাজানো হতো।

ছাঁদে ওনেক পরিচিত অপরিচিত মুখ দেখা যাচ্ছে। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম স্টেজ এর এক পাশে সাদু, রাফিদা আপু, সুমাইয়া, সুমনা আপু, আঁখি সবাই মিলে সেলফি তোলায় ব্যস্ত।ওদের কাছে গিয়ে সাদুর মাথায় একটা চাপড় দিলাম।সাদু একটু রেগে গিয়ে বলল,,,

–আমার লগে এতো গুতাগুতি কিসের? যা যাইয়া নিজের জামাইর লগে গুতাগুতি কর।

–বুজছ না, তোর লগে গুতাগুতি কইরা প্রেকটিস করি।(আমি)

–কিরে পেত্নী তোরে দেখি আজকে ভালোই লাগতাছে। আলগা কি মাইরা আইছোস আবার?(সাদু)

–দিবি তুই?(আমি)

–হ!হ! কি দিছোস ক।আমি দিমু।(সাদু)

–বান্দরের গু দিছি।দিবি?(আমি)

আমার কথা শুনে সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল।

চলব,,,,,,

[বিঃদ্রঃ গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক। অনুগ্রহ করে বাস্তবিক অর্থ খুজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না আর লেখিকা কে ও বিভ্রান্ত করবেন না]

বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-১৫

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_১৫

আমার”বর্ষণ সঙ্গিনী”,
জানো তো বৃষ্টি পড়ার সময় টা যে অনেক রোমাঞ্চকর?কাঁথা মুড়ি দিয়ে তোমার মাথা আমার পাজোরে রেখে বৃষ্টির শব্দের সাথে সাথে আমাদের দুজনের গল্পের আসোর কিন্তু ভালোই জমবে।তাই না?এই উইশটা কিন্তু অবশ্যই পূরণ হবে।আজকে একটাই ইচ্ছে বললাম। আস্তে আস্তে সব জেনে যাবে।প্রতিদিন ভার্সিটিতে যেয়ো কিন্তু। মাঝে মাঝে মিস দেও কেনো?তাহলে তো আমিও আমার বর্ষণ সঙ্গিনীকে মিস করি।আর মাত্র তো কিছু দিন।এরপর থেকে আর মিস করতে হবে না আমার বর্ষণ সঙ্গিনী কে।আজকের মতো এখানেই আল্লাহ হাফেজ।
তোমার”বর্ষণ সঙ্গী”।

ম্যাসেজটা পড়ে শোয়া থেকে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পরলাম। ছিঃ!ছিঃ!ছিঃ!এই ব্যাটার সাথে আমি কোন দুঃখে এক কাঁথা মুড়ি দিতে যাবো।এই লোক তো বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলছে।লোকটাকে আমি রিপ্লাই দিলাম,,,

–আপনার কাঁথায় আপনি শুয়ে থাকেন। মন চাইলে কাঁথা ছিঁড়ে ছিঁড়ে খান।কিন্তু আমাকে আর ম্যাসেজ দিবেন না, আর ডিস্টার্ব করবেন না।আর একবার যদি ম্যাসেজ দিয়েছেন তাহলে আমি আর আমার বান্ধবী মিলে আপনার চোখ কোটর থেকে বের করে মারবেল খেলব।

উফ!!!আজাইরা পাবলিক যত্তসব!!!৪-৫দিন তো ভালই ছিলাম। কোনো ম্যাসেজের ম ও তো আসতো না। আজকে কোথা থেকে উদয় হলো এই লোক?অনেক সময় অপেক্ষা করেও লোকটার কোনো রিপ্লাই আসেনি।

মাগরিবের নামাজ পরে স্যান্ডউইচ বানালাম।সচারাচর বাসায় বার্গার-স্যান্ডউইচ বানানো হয় না। নিয়াজ ভাইয়া অফিস থেকে আসার সময় মাঝে মাঝে নিয়ে আসে।আবার আমাদের বাইরে গিয়েও খাওয়া হয়। তাই বাসায় বানানো ওইভাবে হয়ে ওঠে না।আমার জন্য, বাবার জন্য বানিয়ে আর একটা ভাইয়ার জন্য তুলে রাখলাম।বাসায় সামান্য নুডলস রান্না করলেও তা থেকে কিছুটা ভাইয়ার জন্য তুলে রাখি।ছোটবেলা থেকেই ভাইয়াকে রেখে না আমি কিছু খেতাম আর না ভাইয়া আমাকে রেখে কিছু খেতো।

রাতের বেলা বসে বসে পড়ছি।রুমে একেবারে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। ফ্যানের ঘটর ঘটর শব্দটা পর্যন্ত নেই।তার প্রধান কারণ হলো বাইরে টিপটিপ ছন্দে বৃষ্টি পড়ছে। তার অস্তিত্ব কে জানান দেওয়ার জন্য চারপাশকে শীতল করে তুলেছে।এমন সময় বিকেলের ওই ম্যাসেজ এর কথা মনে পড়তেই শরীরে কেমন শিহরণ বয়ে গেল।ঠিক তখনই বিছানায় থাকা মোবাইল টা বেজে উঠলো। হাতে নিয়ে দেখি”রানু মন্ডলের ২য় ভার্ষণ”আমাকে কল দিচ্ছে।অর্থ্যাৎ আমার প্রানপ্রিয় বান্ধবী। কল রিসিভ করে আমি হ্যালো বলার আগেই সাদু বলে উঠলো,,,

–জানছ সাদমান ভাইয়ার না পা মচকে গেছে।

আমি আমার প্রিয় মানুষগুলোর মনোভাব অতি সূক্ষ্ম ভাবে পরখ করতে না পারলেও এটুকু অন্তত বুঝতে পারি কখন তাদের মনটা ভালো আর কখন তাদের মনটা খারাপ। যেমন এখন সাদুর কন্ঠেই প্রকাশ পাচ্ছে ওর সাদমান ভাইয়ের জন্য খারাপ লাগছে।

ওকে আমি বললাম,,,

–কীভাবে হলো?

–সন্ধ্যা থেকেই তো বৃষ্টি হচ্ছে একটু একটু।সাদমান ভাইয়া তাদের বাড়ির গেটের সামনে রিকশা থেকে নামতে নিয়ে পিছলে পরে যায়।হাত পা তো ছিলে গেছে সাথে বা পা মচকে গেছে। (সাদু)

–ফোন দিয়েছিলি?(আমি)

–না।আমিই তো নাম্বার ব্লক করে রাখছিলাম।এখন একটু কেমন জেনো লাগতেছে তাকে ফোন দিতে। (সাদু)

–ভালোবাসিস কিনা সেটা তুই ই জানছ।কিন্ত আমি জানি তোর তাকে পছন্দ। আর এইটাও জানি তোর ইচ্ছে হচ্ছে তাকে কল দিতে।দেরি না করে তাড়াতাড়ি কল করে খবর নে।(আমি)

–যাহ্।আমি তো নিজে থেকে কোন দিন তাকে কল করি নাই।এখন আমি করলে কি ভাববে?(সাদু)

–ভাববে তার প্রিয় মানুষটা তার সাথে আছে,তার ভালোবাসায় জোড় আছে।(আমি)

–আচ্ছা তাহলে কল করি?(সাদু)

আমি একটু মৃদু হেঁসে বললাম,,,

–কর কল।আমি রাখলাম।

সকালে উঠে নাস্তা বানিয়ে নাস্তা খেয়ে ভার্সিটি যাওয়া,এসে বাবার সাথে দুপুর এর খাবার খাওয়া,বিকেলে ঘুমানো অথবা বই পড়া অথবা সাদুর সাথে ফোনে ওর আর সাদমান ভাইয়ের প্রেমগল্প শোনা, রাতে ভাইয়া আসলে খেয়ে দেয়ে পড়া শেষ করে ভাইয়ার সাথে গল্প করে ঘুমাতে যাওয়।এইভাবেই এক সপ্তাহ কেটে গেল।

আজ আমরা সবাই গ্রামে যাবো।পরশু ভাইয়া আর তাসফি আপুর গায়ে হলুদ অনুষ্ঠিত হবে। আমার নানা আর দাদা হলো ছোট কালের বন্ধু। একই গ্রামের ছেলে। তারউপর বাজারের এপার আর ওপার দুজনের বাড়ি। সখ্যতা তাদের একটু বেশি ই।দুই বন্ধু মিলেই দাওয়াত এর কাজ সহ বিয়ের আরো কাজের দেখাশোনা করছে। তাসফি আপু চলে গেছে গ্রামে আরো দুই দিন আগে।হলুদের একদিন আগে যাওয়ার কারণ ভাইয়ার চাকরি। অফিস তো আর নিজের না।তাই নিজ ইচ্ছায় ছুটিও কাটানো যায় না।সব মিলে ভাইয়া ছুটি পেয়েছে কেবল ৮ দিনের।তাই আমরা হলুদের একদিন আগে যাচ্ছি।

আমাদের সাথে সাদু, আন্টি আর রাফিদা আপু যাবে। আঙ্কেল বলেছে বিয়ের দিন আসবে। সার্থক ভাইয়া আসবে কি না তা সিওর না।

একেবারে ছোট থেকেই আমাদের দুই পরিবারের পরিচয়। ছোট থেকেই একই স্কুলে পড়ার সুবাদে আমার আর সাদুর ঘনিষ্ঠতা যেমন বেড়ে যায় আমাদের দুই পরিবারের ঘনিষ্ঠতাও তেমন বেড়ে যায়। আমাদের দুই পরিবারের রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও রয়েছে আত্মার সম্পর্ক। গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য সাদুর আব্বুর পরিচিত একজন লোকের কাছ থেকে আমরা মাইক্রো ভাড়া করেছি। সকাল সাতটার দিকে তৈরি হয়ে আমি, নিয়াজ ভাইয়া আর বাবা সাদুদের বাসার সামনে আসি।মূলত গাড়ি আসবে ওদের বাসার সামনে। এসে দেখি ওরা তিনজন দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছে। আমি গিয়ে সাদুর হিজাব ধরে টানাটানি শুরু করে দিলাম। আর বললাম,,,

–কিরে আজকেই তো আমার ভাইয়ের বিয়া হইয়া যাইতাছে না। এত সাজছোস কেন?

–কই সাজছি আমি?খালি তো একটু আইলাইনার দিছি।চোখে কি বেশি দেখছ?(সাদু)

–আগে কবি না? আমিও দিয়া আইতাম। (আমি)

কথা বলতে বলতেই আমরা গাড়িতে উঠলাম। আমাদের গাড়িটা কিছুদূর গিয়েই মেইনরোডে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। তখনি দেখি হুর হুর করে সজল ভাইয়া আর আলআবি ভাইয়া গাড়িতে উঠলেন। সামনের সিটে নিয়াজ ভাইয়া আর ড্রাইভার আঙ্কেল বসেছিলেন। তাদের পিছনে আন্টি, রাফিদা আপু আর বাবা বসেছে।তাদেরও পিছনে আমরা দুই বান্ধবী শান্তি মত গল্প করতে করতে যাওয়ার জন্য বসেছিলাম। কিন্তু সেই শান্তি আর কপালে জুটল না। আমরা দুই বান্ধবী ৩ সিটে আরাম করে বসে ছিলাম সেখানে সজল ভাইয়া আলআবি ভাইয়া এসে ভাগ বসালো। আমাদের দুই জনের বদলে ৪ জন চাপাচাপি করে বসতে হলো। মাঝখানে আমি আমার বাম পাশে আলআবি ভাইয়া আর ডান পাশে সাদু। আলআবি ভাইয়ের পাশেই সজল ভাইয়া।নিয়াজ ভাইয়া আন্টির সাথে সজল ভাইয়া আর আলআবি ভাইয়ার পরিচয় করিয়ে দিল।

আমার পাশের গবেটটা গাড়ি বা বাসে উঠলেই ঘুমিয়ে পড়ে। আমাদের গাড়ি কিছুদূর যাওয়ার পরে সাদু ওর মাথা আমার কাঁধে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পরল। আমার গা ঘেষে কেউ বসলে বা দাড়ালে অস্বস্তি বোধ হয়। এই মুহূর্তেও হচ্ছে। একেতো সাদু পারলে আমার কোলে এসে বসছে তার ওপর আবার আরেক পাশে আলআবি ভাইয়া। এই মুহূর্তে খুবই অসহ্যকর লাগছে পরিস্থিতিটা। হঠাৎ করেই দেখি আলআবি ভাইয়া আমার একটু কাছে এসে আমার উপর দিয়ে হাত নিয়ে সাদুর মাথাটা সরিয়ে জানালার সাথে ঠেকিয়ে দিল।তার কাজে অত্যন্ত অবাক হলাম।উনি বুঝলো কীভাবে? আমার জায়গায় যে কেউই থাকলে অবাক হতো। আমি তাকে প্রশ্ন করেই বসলাম,,,

— ওকে সরিয়ে দিলেন কেন?

–ইচ্ছে হলো তাই?(আলআবি ভাইয়া)

তার জবাব দেয়ার ধরন দেখে মনে হল সে অনিচ্ছাসত্ত্বেও অনেক জোর করে গলা থেকে শব্দ বের করলেন

— ইচ্ছে হলেই সরাবেন? (আমি)

–হ্যাঁ সরাবো। কারণ… (আলআবি ভাইয়া)

–কারণ?(আমি)

–নট ইন্টারেস্টেড টু সে।(আলআবি ভাইয়া)

আমি নিজেই বিড় বিড় করে বললাম,,,

–হ্যা তাতে ইন্টারেস্ট থাকবে কেন? ইন্টারেস্ট থাকবে তো শুধু “ক্লিন ইট ক্লিন ইট” করতে।

— আমি তোমার থেকে একশো হাত দূরে নই। আমার কান আছে সবই শুনতে পাই।(আলআবি ভাইয়া)

এতক্ষণ আমরা আস্তে আস্তেই কথা বলছিলাম। হঠাৎ করে আলআবি ভাইয়া এই কথাটা একটু জোরে বলে ফেললেন। তখন পাশ থেকে সজল ভাইয়া বলে উঠলেন,,,

— কি শোনাশুনি করছ তোরা?

তখন নিয়াজ ভাইয়াও পিছনে তাকালেন। বলতে গেলে সবাই আমাদের দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। তখন আলআবি ভাইয়া নিয়াজ ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন,,,

–তোর বোন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নাক ডাকছিল। আমি বলেছি নাক জেনো না ডাকে।ও অস্বীকার করছ ও নাকি নাক ডাকে না।

হায়! হায়! মুহূর্তের মধ্যেই এমন একটা ডাহা মিথ্যে কথা উনি কিভাবে বললেন। এই বুঝি সত্যবাদী? তখন নিয়াজ ভাইয়া বলে উঠলেন,,,

— কিরে নাক ডাকিস কবে থেকে?

আমি জবাবে বললাম,,,

— আমি নিজেও জানিনা।

ভাইয়া আর কথা না বাড়িয়ে সামনে মুখ করে বসে পড়লো। আমার পাশে তাকিয়ে দেখি সাদু মরা ঘুম ঘুমিয়েছে। যার জন্য এত কাহিনী তারই কোনো খবর নেই। ওর এই ঘুম এখন আমার আর সহ্য হচ্ছে না। ইচ্ছা করেই ওকে জোরে একটা গুঁতো মেরে উঠিয়ে দিলাম। সাদু বিরক্তি নিয়ে উঠে বলল,,,

–কি ?কি সমস্যা তোর? ঘুমের মধ্যে এত গুতাগুতি করছ কেন?

আমিও ওকে শুনিয়ে দিলাম,,,

–ইচ্ছে হলো তাই।

লেগে গেলো আমাদের দুজনের ঝগড়া। আমাদের শান্তির ঝগড়ার এক পর্যায়ে অশান্তি নিয়ে এলো আলআবি ভাইয়া। উনি হুংকার দিয়ে বলে উঠলেন,,,

–জাস্ট স্টপ ইট!

এমন এক চিৎকার শুনে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। তাকে সব সময় আস্তে কথা বলতে শুনেছি। এই প্রথম জোরে ধমক দিলেন সামনাসামনি। তার বাজখাঁই ধমকে আমি আর সাদু দুজনেই চুপ হয়ে গেলাম।রাফিদা আপু তখন বলে উঠলো,,,

–কোন জায়গায় গেলে শান্তি মত থাকতে পারিস না তোরা? আগে ওখানে পৌঁছে নেই তারপর দুইটাকে একরুমে আটকে রাখবো। তখন যত খুশি একটা আরেকটার চুল ছেড়াছেড়ি করিস।

এরপর থেকে আমরা দুজন একেবারে পিনপতন নীরবতা পালন করলাম। আমাদের নীরবতা পালন শেষ হলো একেবারে নানু বাড়িতে এসে। নানু বাড়িতে প্রথমে আসার কারণ কালকে আমরা নানু বাড়ির সবাইকে নিয়ে দাদু বাড়িতে যাব।

আমরা যখন নানু বাড়ি এসে পৌঁছালাম তখন ঘড়ির কাঁটা প্রায় তিনটার ঘরে। নানু বাড়িতে খালামণি আর খালু ও এসে পড়েছেন। আমাদের গাড়ি বাড়ির উঠোনে আসতেই সবাই বাড়ি থেকে বের হয়ে আসে। উঠানেই কুশল বিনিময় শেষ করে আমরা বাড়িতে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে নেই। সবাই মিলে একসাথে খাব বলে আমার নানা বাড়ির সবাইকে না খাইয়ে রেখেছে। তার কথা আমরা বাড়িতে পৌঁছালেই দুপুরে সবাই একসাথে খাব। আন্টি আর সাদু এর আগেও একবার আমাদের গ্রামের বাড়িতে এসেছিল।

আমার নানু বাড়িতে খাবার রুম আলাদা। এখানে সবাই আমরা একসাথে মাটিতে মাদুর পেতে বসে খাই। আমার সাথে সাদু বসেছে আর আরেক পাশে বসেছে রাফিদা আপু। আমদের খাওয়ার মাঝামাঝি পর্বে হঠাৎ করে বিকট শব্দে বেজে ওঠে,,,

“দয়াল তোওওওওওওর লাইগা রেএএএএ”

তখন আমি কেবল পানির গ্লাস টা নিয়ে এক ঢোক পানি মুখে দিয়েছিলাম। হঠাৎ এমন শব্দ হওয়া তে আমার বিষম লেগে যায়। মুখের পানিটাও পড়ে যায়। সাদু বসে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে মাছের কাঁটা বেছে বেছে খাচ্ছিল হঠাৎ সাদুও কিছুটা লাফিয়ে উঠে। আমার খালামণি মাছের তরকারি নিয়ে নানার প্লেটে দিচ্ছিল। খালামনির হাত ফসকে মাছের টুকরো টাও প্লেটের বাইরে পড়ে যায়।সজল ভাইয়া আয়েশি ভঙ্গিতে একটা গরুর হাড্ডি চাবাচ্ছিলেন।হাড্ডি টা পড়তে পড়তে গিয়ে এক পর্যায় বেঁচে যায়।সবাই ই রিতীমতো চমকিয়ে একপ্রকার লাফিয়ে ওঠে।

চলবে…………

[বিঃদ্রঃ গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক। অনুগ্রহ করে বাস্তবিক অর্থ খুজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না আর লেখিকা কে ও বিভ্রান্ত করবেন না]

বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-১৪

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_১৪

প্রতিটি ভোরবেলাই স্নিগ্ধতার পরিচয় বহন করে থাকে। ভোরবেলা প্রকৃতি তার স্নিগ্ধতার চাদরে মুড়িয়ে রাখে পুরো পৃথিবীকে।এই স্নিগ্ধতা নিঃসন্দেহে সুখকর। কিন্তু তা স্থান,কাল আর পাত্র ভেদে। প্রতিটি ভোরবেলা সুখকর হলেও প্রতিটি মানুষের জন্য প্রতিটি ভোরবেলা সুখকর হয় না।যেমন টা জায়েফ এর বেলায়।

কাল রাতে মানবতার খাতিরে হলেও জায়েফ কে আমাদের বাসায় রাখা হয়। কাল যখন ভাইয়া কে নিশি আপুর চিঠি টা দেই ভাইয়াও চিঠি টা পড়ে স্তব্ধ হয়ে বসে ছিল।রাতে আমরা কেউই নিশ্চিন্তের ঘুম ঘুমাতে পারি নি।ফজরের আযানের পর জায়েফ নিশি আপুর কবরের ধারে আসার জন্য অনেক পাগলামি শুরু করে।

বর্তমানে আমরা সবাই কবরস্থানে নিশি আপুর কবরের সামনেই দাঁড়ানো। জায়েফ কবরের সামনে হাটু মুড়ে একধ্যানে আপুর কবরটার দিকে তাকিয়ে আছে।বাবা আর নিয়াজ ভাইয়া তার পিছনে দাঁড়ানো। আমি তাদের থেকে কিছুটা দূরে অবস্থান করছি।বলতে গেলে গেটের বাইরেই অবস্থান করছি ।মেয়ে মানুষদের নাকি সরাসরি কবরস্থানে প্রবেশ নিষেধ।জায়েফের অ্যাসিস্ট্যান্টকে দিয়ে নিয়াজ ভাইয়া নিশি আপু কে কোথায় দাফন করা হয়েছে সেই খবর নিয়েছে।

জায়েফের ভাষ্যমতে, নিশি আপু গত পরশু দিন ইন্তেকাল করেছে।আর জায়েফ চিঠি সহ তার ইন্তেকালের খবর পেয়েছে কালকে।জায়েফ খবর পেয়ে আমাদের বাসায়ই ছুটে আসে সর্বপ্রথম। জায়েফ এর দূরসম্পর্কের আত্মীয় স্বজনরা বাংলাদেশেই আছে তবে একেকজন একেক স্থানে।আমার জানা মতে জায়েফ হয়তো বা তাদের চেনেও না।জায়েফ এর বাসায় থাকতে আমেনা মা আর আমি মাঝে মাঝে গল্প করতাম।সেই সুবাদে জায়েফ এর আত্মীয় স্বজন সম্পর্কে কিছু কিছু জানি।তবে জায়েফ আপুর মৃত্যুর সংবাদ শুনে আমাদের বাসায়ই কেন আসলো?হয়তোবা নিশি আপু ক্ষমা চাইতে বলেছে বলে সে এখানে এসেছে।

হঠাৎ দূরে থেকে দেখতে পাচ্ছি একটা বাইক আসছে।ভোরবেলা বলে রাস্তা ঘাট সব ফাঁকা। দুই একটা দূরপাল্লার ট্রাক শাঁইশাঁই শব্দে আসছে আর যাচ্ছে। অনেক সময় পর পর দু-একজন মানুষ দেখা যাচ্ছে। রাস্তা জনমানবহীন আর যানবাহন মুক্ত বলেই একে বারে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে আলআবি ভাইয়া গায়ে একটা কালো গেঞ্জি চাপিয়ে ছাই রঙা একটা জিন্স পেন্ট পরে তার বাইক নিয়ে আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। তাকে দেখে অবাক তো অবশ্য ই হয়েছি।কিন্তু পরমুহূর্তেই আবার মস্তিষ্ক জানান দিলো নিয়াজ ভাইয়া মনে হয় তাকে আসতে বলেছে।এই লোকটাকে আবার আসতে বলেছে কেন?সে আমাদের কি হয়?শুধুমাত্র ভাইয়ার ফ্রেন্ডই তো হয়।সাদু ও তো আমার ফ্রেন্ড। কই ওকে কি আমি বলেছি নাকি ঢেং ঢেং করে চলে আয়।আলআবি ভাইয়া এসে আমার সামনে বাইকটা দাঁড় করালো।বাইকটাকে আমার সামনে রেখে বাইকের উপরেই বসে রইলেন।তিনিও আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করছেন না আর আমিও না।দুজনই মুখোমুখি হয়ে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম আর উনি বসে রইলেন।

একটু পরেই বাবা আর ভাইয়া জায়েফ কে নিয়ে বেড়িয়ে এলেন।জায়েফ আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরলো।আর বলল,,,

–আমাকে কি এখনো ক্ষমা করা যায় না?তুমি ভেবো না নিশি বলেছে বলে আমি ক্ষমা চাইতে এসেছি। নিশির বলার পূর্বেই আমি নিজে থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছি আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি।আমি অনুতপ্ত।প্লিজ আমায় মাফ করে দেও।আমি এভাবে অপরাধীর মতো আর থাকতে পারবো না জুইঁফুল।আমি তিলে তিলে শেষ হয়ে যাবো।

কথা গুলো বলে জায়েফ আমার সামনেই ধপ করে হাটু মুড়ে বসে পড়লো।কথা বলার সময় তার কন্ঠস্বর কাঁপছিল।হঠাৎ সে আমার দুহাত ধরে তার কপালের সাথে চেপে ধরে বলতে লাগলো,,,

–মাফ চাই!আমি মাফ চাই!দয়া করে আমাকে ক্ষমা করো।

তার কথার মাঝে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে উঠছে।তার এমন করুণ অবস্থা দেখে আমারও খুব খারাপ লাগছে।আশ্চর্যের ব্যাপার হলো এমুহূর্তে আমার চোখে পানির ছিটেফোঁটাও নেই।কিন্তু ভেতরে ভেতরে বড্ড খারাপ লাগছে। আমি ধরা গলায় তাকে বলে উঠলাম,,,

–আপনি এমন করবেন না। আমি আপনাকে মাফ করে দিয়েছি।

সে আবারো বলে উঠলো,,,

–তুমি হয়তো আমাকে মন থেকে ক্ষমা করো নি। আমি তোমার মন থেকে ক্ষমা চাই।

–সত্যি বলছি আমি আপনাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। আপনার প্রতি আমার কোনো রাগ ক্ষোভ নেই। আপনি একটু দাঁড়ান।(আমি)

তখন আলআবি ভাইয়া হুট করে এসে আমার হাত জায়েফ এর কপালের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে এসে আমাকেও সামান্য পিছিয়ে আনলো আর বলে উঠল,,,

— হ্যাঁ! হ্যাঁ! করেছে। বলল তো মাফ করেছে।

এমনটা হওয়ায় আমি একটু চমকে উঠি। এক পলক আলআবি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আবার সামনে জায়েফের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করি। দেখালাম জায়েফ মাথা উঁচু করে আলআবি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে একটা মৃদু হাসি নিয়ে আসলো। যা ছিল একেবারেই ক্ষণস্থায়ী। হয়তোবা এক সেকেন্ডের মত হবে। সঙ্গে সঙ্গে জায়েফ বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল,,,

— নিজের কাছে নিজেকে এখনও বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। আমি শাস্তি চাই। তুমি যে কোন শাস্তি আমাকে দিতে পারো আমি মাথা পেতে নেব।

এবার একটু গলা ঝেড়ে বললাম,,,

–অবশ্যই আপনাকে শাস্তি দিব। আপনি কাজই করেছেন শাস্তি পাওয়ার মত।

মুহূর্তেই দেখলাম বাবা, নিয়াজ ভাইয়া, আলআবি ভাইয়া, জায়েফ সবাই আমার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। তারা হয়তো ভাবতে পারে নি আমি জায়েফকে এই পরিস্থিতিতে কোনো শাস্তি দিব। তাদের অবাক করা চাহনিকে আমি উপেক্ষা করে বলতে লাগলাম,,,

–আপনার শাস্তি হবে আপনি বাংলাদেশে থাকতে পারবেন না। যত দ্রুত সম্ভব আপনি আপনার বাবার কাছে চলে যাবেন। আপনার বোনদের সাথে আর বাবার সাথে লন্ডনে গিয়ে থাকেন।

কথাগুলো বলে সবার প্রতিক্রিয়া দেখবার জন্য একে একে সবাইকে ভাল করে লক্ষ্য করলাম। দেখি বাবা আর ভাইয়া দুজনেই ভ্রুকুটি করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আলআবি ভাইয়া কেমন একটা গাছাড়া ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। জায়েফ আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার মুখোভঙ্গিমাতে কোন কিছুই প্রকাশ পাচ্ছে না। মনে হচ্ছে সে কোন অনুভূতিহীন মানব। জায়েফ আমাকে প্রতি উত্তরে বলল,,,

–আমি রাজি। তুমি যা বলবে তাই হবে।

জায়েফের এমন নির্লিপ্ত ভাবে উত্তর দেয়ায় কিছুটা আশ্চর্য হয়েছি। এক কথাতেই সে মেনে গেল কিভাবে?

আমাদের মাঝে তখন আলআবি ভাইয়া বলে উঠলো,,,

— এবার তাহলে বাসায় যাই সব তো মিটমাট।

তখন নিয়াজ ভাইয়া বলে উঠলো,,,

— আলআবি তুই জুইঁ কে নিয়ে যা।সকালে আমরা কেউই নাস্তা করিনি। রাতেও ঘুম হয়নি কারো ঠিকমত। তুই ওকে তোর বাইক দিয়ে তাড়াতাড়ি বাসায় পৌঁছে দে। আমরা ধীরে সুস্থে আসছি। আর জুইঁ শোন আসার সময় আমি নাস্তা নিয়ে আসব। বাসায় যেয়ে একটু রেস্ট নে ফ্রেশ হ।যা ওর সাথে চলে যা।

আমার ভাইটার মাথায় কি গন্ডগোল আছে নাকি? বোনকে কিভাবে একটা ছেলের সঙ্গে পাঠিয়ে দেয়? আর আমার বাবাও বলিহারি। জায়েফের সাথে ডিভোর্স হওয়ার পরে আমার আর ভাইয়ার কোন কাজেই হস্তক্ষেপ করেন না। আমাদের ইচ্ছামত চলতে দেন। ধুর! আর ভালো লাগেনা। আমাকে কেউ আটকালো না কেন? এখন চশমাওয়ালা কানা বেটার সাথে আমাকে বাসায় যেতে হবে। এই লোকটাকে আমার এখন একদমই সহ্য হয় না।দেখা হলেই শুধু এই মেয়ে! এই মেয়ে! আর ক্লিন ইট! ক্লিন ইট করে।

বাইকে উঠতেই আলআবি ভাইয়া বাইক স্টার্ট দিলেন। এখন মনে হচ্ছে সকাল সাতটা কিংবা সাড়ে সাতটার মতো বাজে। রাস্তাঘাটে মানুষজনের আনাগোনাও বাড়তে শুরু করেছে। চারপাশটা এখনও একটু একটু শীতল রয়েছে। এখনো বুক ভরে তৃপ্তির দম নেয়া যায়। অথচ এই পরিবেশটাই আর দু এক ঘন্টা পর যানবাহনের জটলায় আর মানুষের কোলাহলে মিলিয়ে যাবে। একটু পরেই পরিবেশ টায় হই হই রই রই একটা ভাব চলে আসবে। সকালের এই সময়টায় বাইকে চড়ে নিজ গন্তব্যে পৌঁছাতে মন্দ লাগছে না। আরো ভাল লাগতো যদি বাইকে বসা মানুষটি পছন্দের হত।

বাসায় এসে ফ্রেশ হয় সবাই মিলে আমরা নাস্তা করি। জায়েফও আমাদের সাথে নাস্তা করে। নাস্তা বলতে জায়েফ এক গ্লাস পানি আর একটা ব্রেড পিছ খেয়েছে। আলআবি ভাইয়া আমাকে দিয়েই চলে যায়। আজ আর ভার্সিটি যাওয়ার কোনো চিন্তাভাবনা করলাম না। অ্যাসাইনমেন্ট আরো দুইদিন পরে জমা দিতে হবে তাই কোন টেনশন নেই। নিয়াজ ভাইয়াও অফিসে যায় নি আজ। বিকেল পর্যন্ত জায়েফ আমাদের বাসায়ই থাকলো। কিন্তু লোকটার লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে সে একেবারেই চুপচাপ হয়ে গেছে। বাসায় এসেও তার সঙ্গে আর কথা হয়নি। আমরাও তাকে আর বিরক্ত করিনি। বিকেলের দিকে নিয়াজ ভাইয়া কে জায়েফ নিজে থেকে এসে বলে সে তার বাসায় চলে যাবে। তখন নিয়াজ ভাইয়া তাকে ঢাকায় যাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়।

রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একমনে আকাশে উদয় হওয়ার অর্ধচন্দ্রের দিকে তাকিয়েছিলাম। যাকে বলে চন্দ্র বিলাস। মনে মনে ভাবছিলাম নিশি আপুর ভাগ্য অনেক ভাল ছিল। কারণ তাকে সত্যিকারে ভালবাসার একজন মানুষ ছিল। সাদুর ভাগ্যটাও অনেক ভালো। সাধু বুঝুক আর না বুঝুক আমি বুঝি সাদমান ভাই ওকে অনেক ভালোবাসে। জীবনে খাবারের স্বাদ, ঘুমানোর স্বাদ, বৃষ্টিবিলাস এর স্বাদ, বন্ধুত্বের স্বাদ ছাড়াও আরো নানা রকমের স্বাদ নিলেও কখনো ভালোবাসার সাধ টা নেয়া হয়নি। প্রথমে প্রথমে আমিও ভাবতাম আমি মনে হয় জায়েফ কে ভালোবাসি। কিন্তু ধীরে ধীরে আমার এই ভাবনাটা ভুলে পরিণত হতে থাকে। কারণ জাইফের প্রতি আমার মায়া বা টান ছাড়া অন্য কোন কিছু ছিল না। তার প্রতি ভালোবাসা গড়ে ওঠার আগেই আমাদের সম্পর্কটা ভেঙে যায়। আগে না বুঝলেও এখন বুঝি জীবনের এই সাড়ে আঠারো বছর বয়সেও কাউকে এখনো ওই ভাবে ভালোইবাসতে পারিনি।

হাসিখুশি, দুঃখ-বেদনা নিয়েই তো আমাদের জীবনটা। সুখ-দুঃখ জীবনে দুইটাই থাকবে। তাই বলে জীবন তো আর থেমে থাকবে না। আমাদের বাসা থেকে জায়েফ চলে গেছে চার দিন হয়ে গেল। আর নিশি আপুর মৃত্যুর হলো ছয়দিন।এর মাঝে সাদুকেও সব বলা হয়ে গেছে।

সকালে ভার্সিটির জন্য তৈরি হচ্ছিলাম। তখন নিয়াজ ভাইয়া এসে বলে জায়েফ কাল রাতের তিনটার টার ফ্লাইটে লন্ডন চলে গিয়েছে। কথাটা শুনে তার জন্য আফসোসে ভরা এক তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়া আর কিছুই বের হলো না। ক্ষণিকের জন্য মনে হলো সত্তিকারের ভালোবাসাই কেন পূর্ণতা পায় না? আজ জায়েফ আর নিশিও তো তাদের ভালোবাসার সংসার বুনতে পারতো।এমনটা না হলেও তো পারতো। যাইহোক, যা হওয়ার তা তো হয়েই গেছে। এখন আর আমি আমার অতীত নিয়ে আর ভাববো না। সব কিছুর পাশাপাশি একটা কথা ভেবে ভাল লাগছে যে অতীত আমার পিছু তো ছাড়লো।২-১দিন জায়েফের ঘটনাটা নিয়ে একটু আপসেট ছিলাম। তবে এখন সব স্বাভাবিক। শুধু স্বাভাবিক হতে পারেনি বাবা আর নিয়াজ ভাইয়া। এখনো কথা বলতে গেলে তাদের মধ্যে একটা জড়তা কাজ করে। তবে আগের মত নেই। এখন টুকটাক কথা তাদের মধ্যে হয় তবে তা খুবই কম।

ভার্সিটি শেষে আমি আর সাদু বাসায় ফিরছিলাম তখন সাদমান ভাইয়া আমাদের সামনে এসে হাজির। সাদু সাদমান ভাইয়াকে কিছুটা পছন্দ করে। তবে ওর ইগোর জন্য তা প্রকাশ করে না।আর সাদমান ভাই ইগো বলতে কিছু বোঝেই না।সারাদিন রাত সে সাদুকে ভালোবাসি ভালোবাসি বলে বেড়ায়।

সাদমান ভাইয়া আমাদের সামনে এসে বললো,,,

— কি খবর শালিকা আর বউ?

আমি এক গাল হেসে তাকে জবাব দিলাম,,,

— আলহামদুলিল্লাহ দুলাভাই। খবর আমাদের সেইই!

সাদুর দিকে তাকিয়ে দেখি ও রাগে ফেটে যাচ্ছে। তখন সাদমান ভাইয়া আবার বলল,,,

— শালিকা বউতো আমাকে আবার ব্লক মারছে।

সাদমান ভাইয়ের কথা শেষ হতে না হতেই সাদু চেঁচিয়ে বলে উঠলো,,,

–তুই জানছ গোসল করতে গেলেও এই ব্যাডার লেইগা কোনো শান্তি নাই।উঠতে, বইতে, খাইতে, ঘুমাইতে খালি বাবু খাইছো বাবু খাইছো মার্কা ডায়লগ দেয়।পরশু দিন আমি গোসলে ঢুকছি তখন আমারে ফোন দিয়া পায় নাই বইলা ডিরেক্ট আম্মুর কাছে কল করছে।আম্মু আইসা আমারে গোসলের তে টাইনা বাইর করছে।কিসের জন্য জানছ?এই খাম্বায় আম্মুরে কইছে উনি নাকি আমার সাথে নোট নিয়া কি গুরুত্বপূর্ণ কথা কইবো। আমার আম্মু আমারে অর্ধেক গোসল করা অবস্থায় বাইর কিইরা কয় নে কথা ক সাদমান নাকি কি জরুরী কথা বলবে তোরে।এখন ক এই ব্যাডারে আমি ব্লক মারমু না তো কি করমু?

–বাহ্।এতো সুন্দর প্রেম চালাছ। বাবু খাইছো বাবু খাইছো করছ আর আমারে এখনো কছ নাই? (আমি)

–আমি প্রেম করি কবে কইলাম।বেশি বুজছ কে?

সাদু এবার সাদমান ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,

–আপনি আমারে ৩০ দিনের মধ্যেও আর ফোন দিবেন না।বুঝতে পারছেন?

–এখনো তো একটাও ফোন কিনতে পারলাম না।(সাদমান)

–আমি ফোন কিনার কথা বলি নাই।কল দেওয়ার কথা বলছি।(সাদু)

–আচ্ছা ব্লকটা তাইলে খোলো।ফোন দিব না আর। এখন থেকে শুধু ম্যাসেজ দিব।(সাদমান)

–দেখছস কেমন ঘাড়তেড়া।(সাদু)

–হ তোর মতই।একেবারে খাপে খাপে মিল দুইজনের। (আমি)

বলেই সাথে সাথে আমি আর সাদমান ভাইয়া জোরে জোরে হাসতে লাগলাম। আমার কথায় সাদু তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো। আমাকে রেখেই হাটা ধরল। আমিও তাড়াতাড়ি ওর পিছনে পিছনে হাঁটা ধরলাম।

বাসায় এসে দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করে আমার রুমে শুয়ে শুয়ে ফেসবুক কে নিউজ ফিড স্ক্রল করছিলাম তখন হঠাৎ পিপল ইউ মে নো তে দেখলাম একটা আইডি। সেখানে সুন্দর করে লেখা।”আলআবি মাশরুখ”। প্রোফাইলে তার সাদা একটা গেঞ্জির উপরে কালো কোর্ট পরিহিত ছবি দেওয়া। হঠাৎ করে ছবিটা দেখে কেন যেন তাকে আমার কাছে খুব ভালো লাগলো।ছবিটায় চশমা মেই চোখে। এতে তাকে অন্যরকম লাগছে । এহ! চশমা পরে নাই। দেখাতে হবে না আমি কানা না!তার আইডিতে ঢুকে কেবলমাত্র ওই একটি ছবিই দেখতে পেলাম।তার গায়ের বর্ণ শ্যাম বর্ণের না আবার একেবারে ধবধবে ফর্সাও না। তার গায়ের বর্ণ কে মূলত হলুদে ফর্সা বলা চলে। পুরো আইডি ঘেটে কয়েকটা বিল্ডিং এর ছবি ছাড়া আর কিছুই পেলাম না। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো তার ফলোয়ার্স সংখ্যা ৯ হাজারেরও বেশি (9k+)।তার ওই একটা ছবিতেই রিয়েক্ট এসেছে ৬ হাজার (6k)।রিয়েক্টে বেশির ভাগই মেয়েদের আইডি।তাও আবার সব বাংলাদেশি মেয়ে নয়।কিছু আমাদের দেশের বাইরেরও রয়েছে।এরই মাঝে হঠাৎ ফোনে একটা ম্যাসেজ আসলো।

চলবে…………