Sunday, July 13, 2025
বাড়ি প্রচ্ছদ পৃষ্ঠা 1388



বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-৪১+ বোনাস পর্ব

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_৪১

প্রায় অনেক সময় ধরে আলআবি ভাইয়া আমাকে তার কোলে নিয়ে হাঁটছেন।৩৭ মিনিট ধরে আমাকে নিয়ে হাঁটছেন তিনি।চারপাশে অন্ধকারও নেমে এসেছে।আলআবি ভাইয়ার ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট দিয়ে আমরা পথ চলছি।এক হাতে তার গলা আঁকড়ে ধরেছি আর আরেক হাতে ফোন টা ধরে রেখেছি। তার যে কষ্ট হচ্ছে আমাকে নিয়ে হাটতে, তা আমি ঠিক বুঝতে পারছি।হালকা শীতল আবহাওয়াতেও তিনি ঘেমে গিয়েছেন।তাই আমি নিজে থেকে ই এবার একটু নড়েচড়ে উঠলাম আর বললাম,,,

–আমাকে এখন নামিয়ে দিন।আমি হাঁটতে পারবো।

তিনি একটু থেমে গিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,,

–এখন তোমাকে নামনোর মুড নেই।

তার দিকে তাকাতেই দেখি উনি একটা বিটকেল মার্কা হাসি হেসে আবার পথ চলতে শুরু করেছেন।আমি আবার বললাম,,,

–আপনার তো কষ্ট হচ্ছে। প্লিজ নামিয়ে দিন।

উনি হাঁটতে হাঁটতে ই বললেন,,,

–আমি এক কথা দুবার বলি না।

আমি আবার কিছু বলার জন্য উদ্যত হলে আমাকে বলতে না দিয়ে তিনি আবার বললেন,,,

–তুমি যদি আমাকে বোকা ভেবে থাকো তাহলে ইউ আর এ্যাবসল্যুটলী রং।

তার কথার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত কিছুই আমার বোধগম্য হলো না। হালকা কপাল কুঁচকে তার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললাম,,,

–মানে? পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পেয়ে পাগল টাগল হয়ে গেলেন নাকি?

আলআবি ভাইয়া আগের মত পথ চলতে চলতে বললেন,,,

— আজকে সকালের অভিনয়টা তুমি দারুন করেছ। তবে কি জানো তো? মার কাছে মামা বাড়ির গল্প করা যতটা বোকামির কাজ তুমি তার থেকে বেশি বোকামির কাজ করেছ।

তার কথায় এবার আমার টনক নড়ে উঠলো। মাথায় শুধু একটা কথা ই ঘুরপাক খাচ্ছে। তা হলো উনি কি আমার সকালের করা অভিনয়টা ধরে ফেলেছেন?আমার ভাবনার সুতো ছিঁড়ে উনি আবার বলে উঠলেন,,,

–তোমার কি মনে হয় যার প্রতিটা নিঃশ্বাস এর খবর আমি রাখি তার “জান”,”বাবুর” খবর আমি রাখব না?সকালে তুমি যে কোন জান,বাবুর সাথে কথা বলছিলে তা আমার জানা আছে। আমি তো যাস্ট চেক করছিলাম তোমার অ্যাক্টিং স্কিল কেমন?

কথাগুলো শুনে আমি কিছুটা ভেবাচেকা খেয়ে গেলাম। আমি যে এভাবে ধরা খেয়ে যাব তা কল্পনাতো দূরে থাক বাস্তবেও ভাবিনি।আর এই কানা ব্যাটা যে এতো চালাক তাও ভাবতে পারি নি।চোখে চশমা পড়ে নাহয় বেশি দেখে, তা তো বুঝলাম। কিন্ত বেশি বোঝার জন্য মস্তিষকেরও কি কোনো চশমা আছে নাকি তার?আমার সব আজগুবি চিন্তাভাবনার অবসান ঘটিয়ে আলআবি ভাইয়া কে উদ্দেশ্য করে বললাম,,,

–কিক…কিসের অ্যাক্টিং।আর কিসের স্কিল?

–সকালে তোমার ফোনে বিনা রিং এই তুমি বুঝে গেলে তোমাকে তোমার জান কল করছে?আবার বিনা কলেই তুমি তোমার জানের সাথে কথাও বলে ফেললে?বাহ্।এই না হলো আমার #বর্ষণ_সঙ্গিনী?(আলআবি ভাইয়া)

–দেখুন যা বলবেন সোজাসাপটা ভাবে বলুন।(আমি)

–আচ্ছা সোজাসাপটা ভাবে ই বলছি।তুমি যখন সকালে আমাকে জেলাস ফিল করার জন্য ফোনে বাবু সোনা,বাবু সোনা করে যাচ্ছিলে তখন তোমার ফোনের স্ক্রীনে সুন্দর করে তোমার ওয়ালপেপার টা ভেসে উঠছিল। তোমার কানে ফোন ধরা ছিল বলে আড়াআড়িভাবে অর্ধেকটা দেখতে পেরেছিলাম। আর আমাকে দেখেই তুমি যেভাবে রকেটের গতিতে ফোনটা কানে চেপে ধরেছিলে তাতে পিচ্চি অন্তুও বুঝে যেত তুমি যে অভিনয় করছিলে।(আলআবি ভাইয়া)

আমি কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি।ফোনে কথা বললেও কেউ যে অর্ধেক স্ক্রীন দেখতে পায় তা আমার এই জন্মে জানা ছিল না।এবার বুঝলাম তার চশমা পরার স্বার্থকতা কোথায়।কিন্তু আমার যে হাঁটে হাঁড়ি ভেঙে গেল তাতে এখন কেমন যেন লজ্জা লাগছে।চোর চুরি করে ধরা খেলে প্রথম প্রথম একটু লজ্জা পায়ই।এটা স্বাভাবিক। আমিও মিথ্যে অভিনয় করতে গিয়ে ধরা খেয়েছি। তাই আমার ও লজ্জা করবে। এটাই স্বাভাবিক।লজ্জার সঙ্গে যখন লড়াই করছিলাম ঠিক তখন আলআবি ভাইয়া বলতে লাগলেন,,,

–আর কখনো আমাকে জেলাস ফিল করানোর মতো ভুল কাজটা করতে যাবে না।তোমাকে যদি অন্য কেউ ভালোবেসে থাকে তাহলে আমি কখনোই হিংসায় বশিভূত হয়ে উল্টো পাল্টা কাজ একদম ই করব না।জেলাসি থেকেই একপর্যায়ে গিয়ে বড় ধরনের একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়ে যায়। এটা তো আমার সৌভাগ্য যে তোমাকে অন্যরাও ভালোবাসে।সবাই একটা ভালো ব্যাক্তিত্বের সত্তাকেই সবসময় ভালোবেসে থাকে।এখানে তো হিংসের কিছু নেই।আর যদি তোমার রূপটাকেই কেবল ভালোবাসে তাহলে সেটাও আমার ই সৌভাগ্য। কারণ আমার
#বর্ষণ_সঙ্গিনী এতই রূপবতি যার রূপ প্রত্যেকেই দেখে বলবে সুবহানাল্লাহ।

এতোক্ষণ আমি তার কথা মনোযোগ সহকারে শুনছিলাম। কিন্তু এখন তার দিকে আমি মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছি।আবারও নতুন করে তার চিন্তা ধারার প্রেমে পরতে ইচ্ছে করছে।আমি সামনের দিকে তাকিয়ে আনমনে ই অস্পষ্ট সুরে বলে উঠলাম,,,

–এটা আমারও সৌভাগ্য যে আপনার মতো একজনকে আমি ভালোবাসতে পেরেছি।

আমি কি বলেছি তা বুঝতেই হুট করে আলআবি ভাইয়ার দিকে দৃষ্টি দিতে ই দেখি তার ঠোঁটের কোণে তৃপ্তিময় এক হাসি খেলা করছে।হাসছেন তিনি কিন্তু মনে হচ্ছে তৃপ্তি পাচ্ছে আমার হৃদয়।

হঠাৎ করেই আমাদের সাথে চারজন মধ্যবয়স্ক লোকের সাথে দেখা হয়ে গেল।তাদের দুজনের মাথায় গাছের মোটা মোটা ডালের গোছা রয়েছে। আমরা যেই পথ ধরে যাচ্ছিলাম তারা সেই পথেরই ডান দিকে বসে বসে হারিকেনের আলোতে,তাদের ডালের গোছা সামলাচ্ছিলেন।আমরা সকলে মুখোমুখি হতেই লোকগুলো বলে উঠলো,,,

— এই কেডা!কেডা এইহানে এইসময়ে!

লোক গুলোকে দেখে আমি নড়েচড়ে আলআবি ভাইয়ার কোল থেকে নেমে পড়লাম। তিনিও এত সময় আমাকে কোলে রেখেছিলেন বলে ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়ে দিলেন। আলআবি ভাইয়া লোকগুলোকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,,

–আসসালামু আলাইকুম চাচা! আসলে আমরা পথ হারিয়ে ফেলেছি।আমাদেরকে যদি একটু সাহায্য করতেন তাহলে উপকার হতো।

চারজনের মধ্যে থেকে একজন লোক সালামের উত্তর দিয়ে আমাদেরকে নানান প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন। আমরা কিভাবে এখানে আসলাম? কোথা থেকে এসেছি? কোথায় যাব? ইত্যাদি নানা প্রশ্ন করতে লাগলেন। প্রশ্ন শেষে যখন বুঝতে পারলেন আসলেই আমরা বিপদে পড়েছি তখন তারা বললেন,,,

–আপনাগো তো এহন সাহাইয্য করতে পারুম না।এইহান থিকা বাইর হওনের রাস্তা তো একখানই আছে।আর এইহান থিকা তো দূরও মেলা!যাইতে হইলে আরও ঘন্টা তিনেকের মতো লাগব।তয় সেইহানে যাইতে যাইতে তো গাড়ি ঘোড়া কিছু পাইবেন না।

–তাহলে এখন আমরা কি করতে পারি?(আলআবি ভাইয়া)

–এই সামনেই আমাগো একখান পাড়া আছে।রাইতটা আমাগো লগে থাইকা যান।সকালে একখান ব্যবস্থা হইবোই।যদি আপনাগো মর্জি থাহে আরকি।

–আচ্ছা আপনাদের পাড়ায় গেলে কি একটু ফোনে কথা বলতে পারবো?মানে নেটওয়ার্ক পাওয়া যাবে? (আলআবি ভাইয়া)

–হয়,তা কইতে পারবেন।

এই মুহূর্তে একটা ভরসা পেয়ে আমরা তাদের সাথে যাওয়ার জন্য উদ্যত হলেই একজন বলে উঠলেন,,,

— কিন্তু এই মাইয়াডা কেডা আপনার লগে? আপনাগো দুইজনের মইধ্যে সম্পর্ক কি?

আলআবি ভাইয়া আমাকে দেখিয়ে বললেন,,,

–সে আমার #বর্ষণ_সঙ্গিনী।

–কি!এইডা আবার কোন সম্পর্ক?

আলআবি ভাইয়া আর লোকটার কথায় আমার খুব হাসি পেলো।কিন্তু এই হাসি ক্ষণস্থায়ী হলো না। কারণ আলআবি ভাইয়া তখন হুট করে বললেন,,,

–সে আমার বাচ্চার মা।

তার মুখ থেকে এরূপ কথাবার্তা শুনে তার দিকে আমি বিস্ফোরিত নয়নে তাকালাম। উনি আমার দিকে একটা শয়তান রুপি হাসি ছুড়ে মারলেন। আমি যখন কিছু বলতে যাবো তার আগেই আলআবি ভাইয়া লোকগুলোর সামনেই আমাকে আবার কোলে তুলে নিলেন। আলআবি ভাইয়ার নির্লজ্জ স্বরূপ কাজ কারবারে আমাদের সামনে থাকা লোক গুলো একজন আরেকজনের দিকে চাওয়া-চাওয়ি করছে। তাদের অবস্থা বুঝে উনি তাদেরকে বললেন,,,

–ওর পা অনেকখানি কেটে গেছে।

কথাটা বলেই লোকগুলোকে ইশারা দিয়ে আমার পায়ের দিকে তাকাতে বললেন। তারা আমার পায়ে রুমাল বাধা দেখে আর কোন কথা বাড়ালেন না। এরপর তাদের পিছু পিছু আমরা চলতে লাগলাম।

চলবে…………

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
“বোনাস পর্ব”

১৬-১৭ টা পরিবার নিয়ে একটা পাড়া তৈরি করা হয়েছে। বাঙালিদের সঙ্গে এদের মাঝে কয়েকটা উপজাতি পরিবার ও রয়েছে।তবে সকলেই ইসলাম ধর্মালম্বীর।সুরু মাটির রাস্তার দুপাশে সারি সারি ১৬-১৭টা বাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। প্রতিটা বাড়ির দেয়াল বাঁশের চটি দিয়ে তৈরি।মাটি থেকে কিছু টা উপরে তৈরি করা হয়েছে বাড়ি গুলো।এখানে কেউ না জেনে শুনে আসলে ভাববে কোনো উপজাতি গোষ্ঠীদের পাড়ায় এসে পরেছে। এই পরিবার গুলোর জন্য এখানে ছোট পরিসরে একটা মুদি দোকান রয়েছে। সেই সাথে সকলে মিলে ছোটখাটো একটা মসজিদ ও দাঁড় করিয়েছে।বলতে গেলে লোকালয় থেকে ভালোই দূরে অবস্থিত এই পাড়াটা।ইলেক্ট্রিসিটি বলতে কিছু নেই এখানে।সৌরবিদ্যুতে চলছে পুরো পাড়াটা।

রাত এখন ৯টা।আমরা এখানে যে ভালো আর বিপদমুক্ত আছি তা আলআবি ভাইয়া নাকি কল করে নিয়াজ ভাইয়াদের জানিয়ে দিয়েছেন।তখন ভাবছিলাম এখানে নেটওয়ার্ক পেলো কোথায় গিয়ে।কিন্তু পরমুহূর্তে আবার ভাবলাম জানিয়ে দিয়েছে এতেই ভালো।আমার এতো ভাবার দরকার নেই।

এই পাড়ায় উইং চু নামে একজন সরদার রয়েছেন।তবে সে চাকমা সম্প্রদায়ের।এই সরদার এর বাড়িতেই আমরা উঠেছি।রাতের খাবার তার বাড়িতেই খেয়েছি।তার স্ত্রী আমাদের আপ্যায়নে কোনো কমতি রাখেননি।তবে উইং চু লোকটা নাকি একটু একরোখা আর কঠোর টাইপের। আশ্চর্যের বিষয় হলো উইং চু এর স্ত্রী বাঙালি। তার নাম রোকেয়া। তাদের সন্তান আছে দুজন।

এতোসব তথ্য বসে বসে আমি রোকেয়া আন্টির থেকেই শুনেছি।খাওয় দাওয়া শেষ করে রোকেয়া আন্টি আমার থেকে অনেক কিছইু জানতে চাইলেন। আমিও তাকে একটা একটা করে উত্তর দিলাম।এখানে আমার আর আলআবি ভাইয়ার পরিচয় হয়েছে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে। রোকেয়া আন্টি কথাবার্তা বলে একপর্যায়ে আমাকে তাদের সামনাসামনি বাড়িটায় নিয়ে আসলেন।রুমটায় দুজন মানুষ শোয়া যাবে এমন একটা চৌকি বসানো আছে।একপাশে ছোট করে একটা জানালা রয়েছে।এককোণে রয়েছে একটা আলনা।চৌকির পাশেই আছে একটা ছোট টেবিল আর চেয়ার।রোকেয় আন্টি বললেন,,,

–এটা তোমাদের জন্য খালি করেছি।তোমাদের দেখে তো মনে হয় নতুন নতুন বিয়ে করেছ।আচ্ছা এটা কি তোমাদের হানিমুন ট্রিপ?

রোকেয়া আন্টির কথায় আমি চমকে গিয়ে বড় বড় চোখ করে তার দিকে তাকালাম। ঠিক তখনই পিছন থেকে আলআবি ভাইয়া এসে বললেন,,,

–হ্যাঁ এটা আমাদের প্রথম মধুচন্দ্রিমা।

–ওহ।তাই নাকি?তাহলে তো বেশ ভালো হলো।এমন লোকালয় থেকে দূরে কজন হানিমুন করতে আসতে পারে বলো।এখানে কেউ বিরক্ত করতে আসবে না তোমাদের। থাকো তবে।আমরাও কেউ বিরক্ত করতে আসব না।(রোকেয়া আন্টি)

রোকেয়া আন্টি কথাগুলো বলে ই দ্রুত পায়ে চলে গেলেন।আন্টি যাওয়ার সাথে সাথে আলআবি ভাইয়া দরজা টা আটকে দিলেন।তাকে দরজা আটকাতে দেখে আমি তড়িঘড়ি করে বলে উঠলাম,,,

–একি দরজা আটকাচ্ছেন কেন?

–তো?দরজা খুলেই কি কেউ হানিমুন করে নাকি?(আলআবি ভাইয়া)

আমাকে একটা চোখ টিপ মেরে তার সেই অতি পরিচিত শয়তান রূপি হাসিটা মুখে বজায় রাখলেন।তাকে হাসতে দেখে একটা শুকনো ঢোক গিলে বললাম,,,

–হাহ…হানিমুন আবার কি?হানিমুনে কি করে?

আমার কথায় তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন।এরপর একটু একটু করে আমার দিকে পা বারাতে লাগলেন। তাকে আমার দিকে এগোতে দেখে আমিও তার থেকে দূরত্ব বজায় রাখার জন্য একপা একপা করে পিছনে যেতে লাগলাম আর বললাম,,,

–সমস্যা কি আপনার?এগোচ্ছেন কেন?

–তুমি তো বললে হানিমুন কি তা জানো না। তাই ভাবলাম তোমাকে প্র্যাক্টিকালি বোঝাতে হবে।আর তার জন্য তো তোমার কাছে আসতেই হবে। (আলআবি ভাইয়া)

–কি হানিমুন হানিমুন করছেন?আমাদের তো এখনো বিয়ে ই হয়নি।আর বিয়ে যেহেতু হয় নি সেহেতু আমি আপনার মতো খবিশ লোকের সাথে একরুমে থাকব না।যত যাই হোক আপনি তো একজন পুরুষ মানুষ ই।(আমি)

আমার কথা শেষ হতে না হতেই আলআবি ভাইয়া ঝড়ের গতিতে এসে আমাকে জাপটে ধরলেন।একেবারে নিজের সঙ্গে মিশিয়ে নিলেন। এতো জোরে বল প্রয়োগ করে আমাকে জড়িয়ে ধরেছেন মনে হচ্ছে আমার ভিতরের হাড়গোড় সব ভেঙে একেবারে ছাতু ছাতু হয়ে যাবে।ঠিক ভাবে দমটাও নিতে পারছি না।নিজেকে ছাড়ানোর জন্য তার সাথে একপ্রকার ধস্তাধস্তি শুরু করে দেই।ধস্তাধস্তি করতেই আলআবি ভাইয়া আমাকে ছেড়ে দেন।
আমি ছাড়া পেতেই জোড়ে জোড়ে দম নিতে থাকি।তখন আলআবি ভাইয়া বলে উঠলেন,,,

–আর জীবনেও খবিশ বলবে?যদি এমন আরও টাইট হাগ চাও তাহলে খবিশ বলতে পারো।আমার কোনো সমস্যা নেই। কারণ খবিশরা এমনি করে থাকে।

আলআবি ভাইয়া গিয়ে চৌকিতে বসে পরলেন। আমি আগের মতোই দাঁড়িয়ে আছি।আমার পিছনে আলনা।এখন পায়ের ব্যাথাটা অনেক কম।এখানে আসার পর রোকেয়া আন্টি কি কি যেন পায়ের কাটা স্থানে লাগিয়ে একটা পরিষ্কার কাপড় দিয়ে বেধে দিয়েছেন।দাড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে না।তাই আমিও গিয়ে তার পাশে অনেকটা দূরত্ব রেখে বসে পরলাম। কিছু সময় নিরবতার মাঝেই কাটিয়ে দিলাম আমরা। নিরবতা ভেঙে আলআবি ভাইয়া বলে উঠলেন,,,

–জুইঁ তোমাকে একটা কিছু শোনাতে চাই শুনবে?

আমি আলআবি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি আমার দিকে খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন।আমি তার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললাম,,,

–শুনবো।বলুন!

আল‌আবি ভাইয়া বসা অবস্থা থেকে দাঁড়িয়ে পরলেন।আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,,

— এখানে নয়।

আলআবি ভাইয়া গিয়ে দরজা খুলে আমার কাছে আসলেন।আমি তার দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকাতেই উনি আমার দিকে তার ডান হাত বাড়িয়ে দিলেন।আমি বিনা দ্বিধায় আমার একহাত বাড়িয়ে দিলাম তার হাতে।বাহিরে বের হয়ে তার ডান হাতের বাহু আমি দুহাতে আঁকড়ে ধরে ধীর পায়ে তার সাথে সোলার প্যানেলের দ্বারা জালানো লাইটের ঈষৎ নিভু নিভু আলোয় সামনে এগোতে লাগলাম।কয়েক কদম সামনে এগিয়ে একটা ঘর দেখতে পেলাম।এটা দেখে আশ্চর্য না হয়ে পারলাম না।কারণ অন্যান্য ঘরগুলো মাটি থেকে একটুখানি উঁচু। কিন্তু এটা মাটি থেকে না হলেও ৭ কিংবা ৮ ফিট উঁচু।এর চারপাশে কোমর অব্দি বাঁশের চটির বেড়াঁ দেয়া। মাথার উপরে ছাউনি দেয়া।এখানে আসার উদ্দেশ্য বুঝতে না পেরে আলআবি ভাইয়ার দিকে তাকালাম।তারপর বললাম,,,

–এতো জায়গা থাকতে আকাশের মধ্যে ঘর বানিয়েছে কেন ওরা?

–কথা বলার জন্য। (আলআবি ভাইয়া)

–কিহ্!(আমি)

–কেবল মাত্র এখানেই নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। ওরা এখানে এটার উপর গিয়ে কথা বলে। আমিও এখান থেকেই নিয়াজ কে কল করেছি।(আলআবি ভাইয়া)

আলআবি ভাইয়া একটু থেমে আবারও বললেন,,,

–চলো উপরে উঠি আগে।

আলআবি ভাইয়ার সাহায্যে ধীরে ধীরে বাঁশের সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে পরলাম। এটা পাড়ার একে বারে শেষ মাথায় আর উঁচু হওয়ায় এখান থেকে পুরো পাড়াটা সুন্দর ভাবে দেখা যাচ্ছে। চারপাশে যে গাছগাছালিতে ঘেরা তা আবছা আলোয় কিছু টা উপলব্ধি করতে পারছি।উপরে উঠে বুঝতে পারলাম এটার ফ্লোরিং করা হয়েছে কাঠের পাটাতন দ্বারা। দুইটা টুলও আছে এখানে আমি আর আলআবি ভাইয়া পাশাপাশি টুল দুইটায় জায়গা দখল করে নিলাম।বসা মাত্র ই আলআবি ভাইয়া আমার এক হাতে মধ্যে তার আরেক হাত দিয়ে আমার পাঁচ আঙুলের মাঝে তার পাঁচ আঙুল গলিয়ে দিলেন।আমি হকচকিয়ে তার দিকে দৃষ্টি দিতেই তিনি বলে উঠলেন,,,

–প্লিজ থাকনা?

তার এমন আকুল আবেদনকে উপেক্ষা করতে পারলাম না।খুব আগ্রহের সহিত তাকে জিজ্ঞেস করলাম,,,

–কি বলবেন?

উনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন,,,

–বলছি।

চলবে…………

[বিঃদ্রঃ গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক। অনুগ্রহ করে বাস্তবিক অর্থ খুজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না আর লেখিকা কে ও বিভ্রান্ত করবেন না]

বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-৩৯+৪০

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_৩৯

সকাল থেকে ই সবার সাথে রাগ করে আছি। নিয়াজ ভাইয়া, ফারাবী ভাইয়া, অনুরাধা আপু আর অন্তু ছাড়া অন্য সকলের সঙ্গে তেমন একটা কথা বলছি না।সেইসাথে গুরুত্বপূর্ণ একটা মিশনে নেমেছি।মিশনের নাম হলো – “ইগনোর আলআবি ভাইয়া”।সকালের নাস্তা করে রেনুমাকে ছাড়াই অনুরাধা আপুর কটেজে যাওয়ার জন্য কেবল আমার কটেজ থেকে বের হয়েছি।তারমধ্যেই দেখি আলআবি ভাইয়া পা বাড়িয়ে আমার দিকে ই আসছেন।তাকে দেখা মাত্র ই হাতের ফোনটা কানে চেপে ধরলাম। যখন দেখলাম আলআবি ভাইয়া আমার আমার আরেকটু কাছে এসে পরেছেন আর এখন কথা বললেই সে শুনতে পাবেন তখন আমি বলতে লাগলাম,,,

–হ্যাঁ বাবু এইতো মাত্র ই নাস্তা করেছি।তুমি নাস্তা করেছ?

আলআবি ভাইয়ার দিকে আড় চোখে তাকালাম তার ভাব-ভঙ্গি দেখার জন্য। তাকে দেখে স্বাভাবিক ই মনে হচ্ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে বুঝতে চেষ্টা করছেন আমি কার সাথে কথা বলছি।তাকে শুনিয়ে আবার বলে উঠলাম,,,

–সেকি বাবু তুমি নাস্তা করো নি।ইশ! শরীর খারাপ করবে তো জান।

কথাটা বলে আলআবি ভাইয়ার দিকে দৃষ্টি দিতে ই দেখি উনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।আমি আবারও বললাম,,,

–ওকে জান।লাভ ইউ ঠু।

ফোনটা কানের থেকে নিচে নামাতেই হুট করে আলআবি ভাইয়া আমার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে পরলেন।কিছুটা ক্ষুদ্ধ কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,,,

–কোন বাবুর সাথে কথা বলেছিলে? আর এই জানটাকে কে?

আমি একটু দূরে সরে এসে কিছুটা ভাব নিয়ে বললাম,,,

–আমার এখন মুড নেই বলার।

আলআবি ভাইয়া আমার দিকে তেড়ে এসে বলতে নিলেন,,,

–এই মেয়ে!…..

আর একমুহূর্তও দেরি করলাম না। দ্রুত পায়ে কটেজে এসে পরলাম। বলতে গেলে এক প্রকার দৌড়েই এসেছি। একটু সময়ের জন্য মনে হচ্ছিল আমার দুগালে এখনই বুঝি উনি তবলা বাজানো আরম্ভ করবেন।আসলে সেদিন রাইয়াম এর নাম্বার টা নিয়াজ ভাইয়ার ফোন থেকে নিয়ে নিয়েছিলাম।আমার ফোনে রাইয়ানের নাম্বার টা সেভ করা ছিল না তাই ওটা হারিয়ে ফেলেছি।রাইয়ানের নাম্বার টাই মুলত “রাইয়ান বাবু” দিয়ে সেভ করেছি।কিন্তু একটু আগে তার সামনে শুধু কথা বলার মিথ্যে অভিনয় করেছি। হঠাৎ করে একসময় আলআবি ভাইয়া কে কৌশলে দেখিয়ে দিব রাইয়ানের নাম্বার টা আমার ফোনে রাইয়ান বাবু দিয়ে সেভ করা।

অনুরাধা আপুর সাথে খুব ভালো জমেছে আমার।
আপুর সাথে কথা বলে বেশ ভালো বুঝতে পারলাম অন্তু তার সাড়ে ছয় বছর বয়সেই অনেক বেশি বুঝে।যেকোনো জিনিস খুন তারাতাড়ি ই বুঝতে পারে ও।সেই সাথে পাকামো টাও করে বেশি।

অবাক করার ব্যাপার হলো অনুরাধা আপু হিন্দু ধর্মালম্বী থেকে আগত।কিন্তু শাফিন ভাইয়া মুসলিম ধর্মের।অনুরাধা আপু শাফিন ভাইয়াকে বিয়ে করার সময় ইসলাম ধর্ম গ্রহন করে ইসলামি পন্থাতেই নাকি বিয়ে করেছে।তবে দুঃখের বিষয় হলো অনুরাধা আপুর সাথে তার বাড়ির যোগাযোগ একেবারে ই বন্ধ।আপুকে প্রথমে শাফিন ভাইয়ার বাড়িতেও মেনে নেয় নি।কিন্তু অন্তু জন্মের পরে সব ঠিক হয়েছে। অনুরাধা আপুকেও মেনে নিয়েছে।

চলবে,,,,,,,

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_৪০

সকালে নাস্তা শেষ করে অনুরাধা আপু কে জানাই যদি সাঙ্গু নদীতে যাওয়া না হয় তাহলে আমি আর কোথাও যাব না। চিম্বুক পাহাড়ে ও আমি যাব না।আর এটাও জানিয়ে দেই আমাকে রেখে ই সবাই যেন চিম্বুকের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে।

সাঙ্গু নদী। এতো দিন ধরে যার নাম শুনে এসেছি, বইতে পরে এসেছি আজকে ঠিক তার সামনে দাঁড়িয়ে। আমাদের চিম্বুক যাওয়ার প্ল্যানটা মূলত আমার কারনেই ক্যানসেল করা হয়েছে।

বর্তমানে সাঙ্গু নদীর গা ভেসে আমরা নৌকায় করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। সময়টা এখন সাড়ে তিনটা।একটু আগেও সূর্য তার তাপে দগ্ধ করে দিচ্ছল সবুজ গাছপালা গুলোকে।কিন্তু হঠাৎ করেই একদল মেঘ এসে সূর্য টাকে নিজের মধ্যে আবদ্ধ করে নিয়েছে। সাঙ্গুর শীতল পানি আর পরিবেশে বইতে থাকা মৃদু ঠান্ডা হাওয়া মস্তিষ্ক কে বারবার বলছে-“আমার প্রেমে পরো”।

আমরা দুটো নৌকা ভাড়া করেছি। এই নৌকা গুলো দৈর্ঘে বেশ লম্বা।একটা নৌকায় আমি,অনুরাধা আপু,শাফিন ভাইয়া,সজল ভাইয়া আর রেনুমা উঠেছি।আর আরেক টাতে আলআবি ভাইয়া, অন্তু,নিয়াজ ভাইয়া,ভাবি,মিথিলা আপু আর ফারাবী ভাইয়া উঠেছে। আমাকে নিয়াজ ভাইয়া বলেছিল যেন তাদের নৌকায় উঠি। কিন্তু আমি তা শুনিনি।এপর্যন্ত কয়েকবার ই আলআবি ভাইয়া আমার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছেন।তবে আমি সেই সুযোগ দেই নি তাকে।এমনকি একবারও তার দিকে ভালো করে তাকাই নি পর্যন্ত।

প্রায় অনেকটা ভিতরের দিকে চলে এসেছি আমরা।আমাদের নৌকা একটার পিছনে আরেকটা চলছে। ওই নৌকা থেকে অন্তু আমাকে দুষ্টুমি করে পানির ঝাপটা দিচ্ছে আমি ও ওকে এই নৌকা থেকে পানির ঝাপটা দিচ্ছি।আলআবি ভাইয়া তার গলায় ঝুলানো ক্যামেরা দিয়ে কিছু স্মৃতি বন্ধ করে নিচ্ছেন।আমরা একেকজন একেকজনের মতো করে এই মুহুর্ত উপভোগ করে চলছি।

হঠাৎ করেই আকাশ কোনো আগাম বার্তা না দিয়েই ঝমঝমিয়ে আমাদের উপর তার জলকণার পতন ঘটাতে শুরু করল।আমরা যে স্থানে ছিলাম সেখান থেকে বা দিকে তাকালেই কিছু টা উঁচুতে একটা গোলাকার ছাউনির মতো দেখা যাচ্ছে। আমাদের কে মাঝি দুজন পাড়ে নামিয়ে দিলেন আর বললেন আমরা যেন বৃষ্টি থামার আগ পর্যন্ত ওখানেই অবস্থান করি।তাদের কথা মতো আমরা সবাই ছাউনির দিকে এগোচ্ছি।পিছনে মাঝি দুজন নিয়াজ ভাইয়া আর ভাবি কে নিয়ে পাড়ে একটা মোটা গাছের নিচে দাড়িয়ে রইলো।নিয়াজ ভাইয়া ভাবিকে নিয়ে কোনো মতেই উপরে উঠবে না।আর গাছের নিচে সকলে এক সাথে দারানোও যাবে না।তাই ওদের দুজনকে মাঝির সাথেই রেখে আমরা উপরে উঠতে শুরু করলাম।দূর থেকে আসলে উপলব্ধি করতে পারিনি জায়গাটা যে এতো খাড়া হবে। এখন উঠতে গিয়ে একটু কষ্ট হচ্ছে। তার সাথে আবার ওঠার রাস্তাও কিছু টা পিচ্ছিল আর সরু।আমার সামনে অনুরাধা আপু আর পিছনে রেনুমা আসছে।উঠতে গিয়ে মাঝখানে হালকা স্লিপ কেটে রেনুমা পড়ে যেতে নিচ্ছিল আমি সামনে থাকায় আমাকে ধরে বসে। আমি ব্যালেন্স সামলাতে না পেরে অনুরাধা আপুর উপরে আমার কিছুটা ভর ফেলে দেই।ভাগ্য ভালো ছিল বলে অনুরাধা আপু সামলে নিতে পেরেছে।আসতে আসতে আমরা সবাই ই হালকা ভিজে গিয়েছি।আলআবি ভাইয়ার দিকে চোখ দিতেই দেখি তার মসৃণ চুলে পানির বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা জমেছে।তিনি হাত দিয়ে চুল গুলো ঝাড়তে ব্যস্ত।তার সাদা পাঞ্জাবির কাধে বৃষ্টির পানির ছিটে ছিটে ছাপ দেখা যাচ্ছে।তার লোমশ হাতে ও ফোঁটা ফোঁটা পানির বিন্দু লেপ্টে আছে। বাহ্! লোকটাকে তো এভাবেও বেশ মায়াময় লাগছে।হঠাৎ করেই মাথায় চিন্তা এলো এই কানা ব্যাটা একদমই ভালো না।অকারণেই আমায় কাঁদিয়েছে।তারাতারি তার থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলাম।

আমরা এখানে প্রায় একঘন্টা যাবত বসে আছি।বৃষ্টি এখন পুরোপুরি থেমে গিয়েছে। ফোনটা বের করে দেখি ৫ টা বেজে ১৫ মিনিট। এখানে বসে আমাদের সময় খুব একটা বেশি খারাপ কাটেনি।এখান থেকে পিছনের দিকে তাকালে দূরে সবুজ অরন্যের মাঝে কয়েকটা ঘড় বাড়ি চোখে পরে।একেবারেই পিপড়ের ন্যায় ছোট মনে হয়।ওটা সম্ভবত ছোটখাটো একটা গ্রাম।প্রায় এক ঘন্টার মতো সবাই মিলে গল্প করেছে বসে বসে।আমি কোনো টু শব্দ করিনি।শুধু বসে বসে ওদের কথা শুনে গিয়েছি।

মায়ের ঘর্মাক্ত দেহের ঘ্রাণ যেমন প্রত্যেক সন্তানের কাছেই সুগন্ধি স্বরূপ। তেমন প্রকৃতির এই ভিজে ঘ্রানটাও আমার কাছে সুগন্ধির ন্যায় লাগছে।

যেহেতু বৃষ্টি থেমে গিয়েছে তাই আর দেরি না করেই আমরা এই জায়গা প্রস্থানের জন্য উদ্যত হলাম।এবার আমার সামনে আলআবি ভাইয়া আর পিছনে অনুরাধা আপু আসছে।রাস্তা টা মনে হচ্ছে আগের তুলনায় এখন একটু বেশিই পিচ্ছিল।নিজের ভারসাম্য সামলাতে আমাকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।মনে হচ্ছে এখনি পরে যাবো। বাম পাশে চোখ বুলাতেই মাথা ঘুরে উঠলো।ভূপৃষ্ঠ এখান থেকে অনেক নিচে।ওঠার সময় এতো ভয় লাগেনি।এখন মনে হচ্ছে বাম পাশে না তাকালেই ভালো হতো।

হঠাৎ করেই পা পিছলে পড়ে যেতে নিলাম।বাঁচার জন্য হাত দিয়ে সামনে পিছনে কিছু একটা আঁকড়ে ধরে রাখার চেষ্টা করতেই আলআবি ভাইয়ার বাহু ধরলাম।কিন্ত শেষ রক্ষা আর হলো না।সেই বা পাশেই পরে গেলাম।আমি পড়তে পড়তে মনে হচ্ছে আমি বুঝি আর বাঁচব না।তৎক্ষনাৎ আলআবি ভাইয়ার চেহারা টা চোখে ভেসে উঠলো।মুহূর্তের জন্য মনে হলো তাকে বুঝি আর বিয়ে করা হলো না।আচ্ছা আমার মৃত্যুর পরে কি উনি চিরকুমার থেকে যাবেন?নাকি আবার অন্য কাউকে বিয়ে করবেন।না না এটা হতে দেয়া যাবে না।কিন্তু তার বিয়ে আমি আটকাবো কি করে?আমি তো নির্ঘাত মরে যাবো এখন।ইশ তখন যদি বলে দিতাম আমিও আপনাকে বিয়ে করতে চাই।আমি মরে ভূত হয়ে গেলেও তো আমার মানুষরূপি সতীনকে সহ্য করতে পারব না।

হঠাৎ মনে হলো আমি একা গড়িয়ে পরে যাচ্ছি না।আজেবাজে চিন্তা মাথা থেকে বাদ দিয়ে ভালো করে খেয়াল করতেই দেখি আলআবি ভাইয়া আর আমি দুজন একসাথে পাশাপাশি গড়িয়ে গড়িয়ে পরে যাচ্ছি।গড়াগড়ি খেতে খেতে এক পর্যায় দুজনেই থেমে গেলাম। যখন পড়ে যাচ্ছিলাম তখন উপর থেকে ওদের চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম কিন্তু শব্দ টা এখন আর কান অব্দি পৌঁছাচ্ছে না।

পড়ে গিয়ে যেভাবে আছি সেভাবে ই চোখ জোড়া বন্ধ করে শুয়ে রইলাম। কারণ মাথাটা এখন চড়কির ন্যায় ঘুরছে। পায়ে যে খুব ভালোভাবে ব্যথা পেয়েছি তা অনুভব করতে পারছি। হাতেও হয়তোবা কেটে ছিঁড়ে গিয়েছে। মোট কথা হল শরীরের কিছু কিছু জায়গায় বেশ যন্ত্রণা অনুভব করতে পারছি। আমার চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায় অনুভব করলাম আলআবি ভাইয়া আমার কাছে এসে দু গালে আলতো করে চাপড় মারছেন আর বলছেন,,,

–এই।জুইঁ?জুইঁ?শুনতে পাচ্ছো আমাকে?কথা বলো।

খেয়াল করলাম আলআবি ভাইয়ার কন্ঠে অস্থিরতার ছাপ স্পষ্ট। এতক্ষণে আমার মাথাটা তার কোলে জায়গা দখল করে নিয়েছে। হালকা করে চোখ মেলে তাকে একটু দেখে নিলাম। তার কণ্ঠের মত চেহারাতেও অস্থিরতা ফুটে উঠেছে। এই মুহূর্তে তার কোলে মাথা রাখতে পেরে খুব শান্তি লাগছে। আবার তার অবস্থা দেখে অনেক হাসিও পাচ্ছে। আলআবি ভাইয়া আমার নাকের কাছে তার আঙুল আনতে ই আমি ফট করে আমার দম আটকে রাখলাম।উনি কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন,,,

–জুইঁ! ওপেন ইওর আইস।জুইঁ!

তিনি সেই কখন থেকে সিনেমার নায়কের মতো জুইঁ জুইঁ করেই যাচ্ছেন।আর আমি তার এরূপ কাজের পুড়ো দমে সুযোগ নিচ্ছি।দুঃখের বিষয় হলো প্রাণখুলে হাসতে পারছি না।অনেক কষ্টে হাসি চেপে রাখছি।সেই সাথে বেঁচে গিয়ে অনেক খুশি হয়েছি। আল্লাহর কাছে লাখ লাখ শুকরিয়া জানাই।খুশির মূল কারণ হলো আমার আর সতীনের মুখ দেখা লাগবে না।
আমার ভাবনার মাঝে ই হুট করে আলআবি ভাইয়া আমার মাথাটা খুব জোরে তার বুকের সঙ্গে চেপে ধরলেন।তার এমন কান্ডে অনেকটা ভোড়কে গেলাম। এই প্রথম আমরা দুজন এত কাছাকাছি। আমাদের দুজনের মধ্যে ইঞ্চি পরিমাণ ও ফাঁকা নেই। এই মুহূর্তে আমার কানে ধুকধুক ধুকধুক করে একটা শব্দ বারবার প্রতিধ্বনিত হচ্ছে।এই শব্দ টা আমার কানে এক প্রশান্তির সুর সৃষ্টি করেছে। অনেক সময় ধরে মুহূর্তটাকে উপভোগ করতে পারলাম না তার আগেই আলআবি ভাইয়া আমার মাথাটা তুলে আমার কপালে, গালে, মাথায় অগণিত বার তার ওষ্ঠদ্বয় স্পর্শ করাতে লাগলেন।আমি তড়িৎ গতিতে তার থেকে নিজেকে মুক্ত করে বলে উঠলাম,,,

— কি করেছিলেন আপনি?

তার দিকে তাকিয়ে দেখি তিনি অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার চোখের কোনে জল চিকচিক করছে।আলআবি ভাইয়া আমার কাছে এসে দু গালে হাত রেখে বলে উঠলেন,,,

–তুমি ঠিক আছো? ব্যথা পেয়েছ কোথাও?দেখি?

কথাটা শেষ করেই আমার গাল থেকে তার হাত নামিয়ে আমার হাত ধরে এপাশ-ওপাশ দেখতে লাগলেন। তার মধ্যে কেমন যেন অস্থিরতা ছেয়ে গিয়েছে। তার এই অস্থিরতা আমার মন আর মস্তিষ্ক উভয়কে ই প্রশান্তির হাওয়ায় দুলিয়ে যাচ্ছে। এখন তাকে দেখে খুব মায়া লাগছে। তার উপর জমিয়ে রাখা মান-অভিমান গুলো মুহূর্তের মধ্যে ই উবে গেল। তার চোখের এই অস্থিরতা আমার সিদ্ধান্তকে নড়বড়ে করে দিয়েছে। যখন আমিও তাকে ভালোবাসি আর সেও আমাকে ভালোবাসে তখন আমার কাছে এই মান অভিমান গুলোকে আমাদের মধ্যে আর মানানসই বলে মনে হচ্ছে না। সবকিছুই আবার অতিরিক্ত ভালো নয়। আজ পুরো দিন তাকে ইগনোর করেছি, কথা বলিনি এটাই আমার কাছে যথেষ্ট মনে হচ্ছে। কারণ দিনশেষে এই মানুষটাই আমার ভালোবাসার মানুষ। তার সাথে কথা না বলে আমিও শান্তি পাচ্ছি না। তখন তো রাগের বশে বলে দিয়েছিলাম তাকে বিয়ে করবো না, তার সাথে কথা বলব না। কিন্ত এখন আমি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি তাকে ছাড়া আমি নিজেই তো থাকতে পারব না। তাকে ছাড়া তো আমার চলবে না। তাহলে কেন তাকে দূরে দূরে রাখব। আমার ভাবনার মধ্যেই আলআবি ভাইয়া আমার দুবাহু ধরে একটু জোরে ঝাকিয়ে বললেন,,,

–আমি কি বলছি তুমি শুনতে পাচ্ছো?

আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললাম,,,

–হ্য্..হ্যাঁ। শুনতে পাচ্ছি তো।

তিনি আবারও জিজ্ঞেস করলেন,,,

–ব্যাথা পেয়েছ কোথাও?

আমি দু দিকে মাথা নাড়িয়ে না সূচক ইশারা করলাম। আলআবি ভাইয়া আমার দিকে কিছুটা সন্দেহের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,,,

— সত্যি তো?

আমি আর তার দিকে তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। কারণ আমি মিথ্যে বলেছি। এই মুহূর্তে আমার পায়ে অসম্ভব যন্ত্রণা করছে। তার সামনে মাথা নিচু করে বললাম,,,

— হাতের কনুইতে আর পায়ে একটু ব্যথা পেয়েছি।

আমরা দুজন এখনো মাটিতেই বসে আছি।হাতের কনুই দেখে আলআবি ভাইয়া আমার পায়ের জুতা খুলতে নিলেন। তাকে বাধা দিয়ে আমি বলে উঠলাম,,,

— আপনি আমার জুতায় হাত দিচ্ছেন কেন? আপনি আমার থেকে বড়। আপনি বসুন আমি খুলছি।

আলআবি ভাইয়া একমনে আমার জুতা খুলতে ব্যস্ত হয়ে পরলেন। তাকে দেখে মনে হচ্ছে আমার কথাটা তার কর্ণপাত হয়নি। তাকে নিশ্চুপ দেখে আমি আর কোন কথা বাড়ালাম না। পায়ের গোড়ালি থেকে চার পাঁচ আঙুল উপরে অনেকখানি কেটে গিয়েছে সাথে রক্তও পরছে। হাতের কনুই ও ছিলে গিয়েছে।আলআবি ভাইয়া কোত্থেকে যেন কি একটা পাতা এনে হাতের মধ্যে ডোলে আমার পায়ের কাটা স্থানে লাগিয়ে দিলেন। পকেট থেকে তার রুমালটা বের করে সেখানে বেঁধে দিলেন। আগে ব্যথা হলেও খুব বেশি একটা জ্বালাপোড়া করেনি কিন্তু এখন অনেক জ্বালাপোড়া করছে। আমি কাঁদো কাঁদো কন্ঠে আলআবি ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বললাম,,,

–এগুলো কি দিয়েছেন আপনি? তাড়াতাড়ি খুলে দিন? পায়ে অনেক জ্বলছে।

–এটা রক্ত পরা কমাবে।একটু সহ্য করো।(আলআবি ভাইয়া)

আলআবি ভাইয়াকে ভালো করে পরখ করে দেখে তার কপালে একটু কাটা ছাড়া আর কিছু পেলাম না। তাও তাকে জিজ্ঞেস করলাম,,,

–আপনি কোথাও ব্যাথা পেয়েছেন?

উনি আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসি বজায় রেখে বললেন,,,

–তোমার এই ব্যাথার কাছে আমার ব্যাথা খুবই সামান্য। চিন্তা করো না আমি ব্যাথ পাইনি।

আমি তার দিকে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে আমার হিজাব এর বাড়তি অংশ দিয়ে তার কপালের কাটা অংশের চারপাশে লেগে থাকা ঈষৎ রক্তগুলো মুছে দিলাম। আলআবি ভাইয়ার দিকে চোখ পরতেই দেখি উনি আমার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন।আমার কাজে আমি নিজেই লজ্জা পেয়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি করে তার থেকে একটু সরে বসলাম।

চারপাশে অন্ধকার নামতে শুরু করে দিয়েছে। আমরা এই মুহূর্তে যেখানে অবস্থান করছি সেখান থেকে গাছপালা ছাড়া আর কিছু ই দেখা যাচ্ছে না। ঠিক কোন দিকে গেলে আমরা বের হতে পারব তাও আমাদের অজানা।আলআবি ভাইয়ার হাতের ঘড়িতে সময় এখন ঠিক ছয়টা।এখানে নেটওয়ার্ক একেবারেই পাওয়া যাচ্ছে না। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা উঠছে “নো সার্ভিস”।
আমার সাইড ব্যাগটা কোথায় পড়েছে তা আমি নিজেও জানিনা।ওই ব্যাগের মধ্যে ই আমার মোবাইলটা রয়েছে। সোজা কথা হলো মোবাইল সহ পুরো ব্যাগটাই হাড়িয়ে ফেলেছি।

বর্তমানে আমার অবস্থান হলো আলআবি ভাইয়ার কোলে।এমন নয় যে আমি হাটতে পারছিনা।হাটতে পারছি তবে খুব ধীরে ধীরে। আমার হাটার গতি দেখে আলআবি ভাইয়া আমায় না বলেই হুট করে কলে নিয়ে চলেছেন অজানা কোনো এক গন্তব্যে।

চলবে…………

[বিঃদ্রঃ গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক। অনুগ্রহ করে বাস্তবিক অর্থ খুজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না আর লেখিকা কে ও বিভ্রান্ত করবেন না]

বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-৩৮+ বোনাস পর্ব

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_৩৮

ভগ্নহৃদয়ের আর্তনাদ গুলো হয়তো বালিশে মুখ গুঁজে তার কাভার আর তুলোগুলোর মধ্যে ই সীমাবদ্ধ রাখতে হয়।আমিও এমুহূর্তে তাই ই করছি।তবে আমার আর্তনাদে মিশে আছে প্রিয় মানুষ টার থেকে প্রতারিত হওয়ার আর ধোঁকা খাওয়ার চাপা কষ্ট।

ওখানে তখন অন্তু নামের বাচ্চা টা বারবার বাবাই বাবাই করে আলআবি ভাইয়া কে ডাকছিল।অনুরাধা নামের মেয়েটাকে মামুনি বলে ডাকছিল।মেয়েটার আগমন শুধু আমাকেই অস্বস্তিতে ফেলছিল।অন্য সবার মুখ দেখে মনে হচ্ছিল অন্তু আর অনুরাধা সবার সাথে ই পূর্ব পরিচিত।তাসফি ভাবিকে তো দেখে মনে হচ্ছিল আমার থেকেও বুঝি আগন্তুক মেয়েটা তার কাছে অধিক পরিচিত। সবার ব্যবহারে প্রচুর রাগ উঠছিল।আলআবি ভাইয়ার ব্যবহারে তো রাগ দ্বিগুণ হচ্ছিল।অনুরাধার সাথে কেমন দাঁত কেলিয়ে কেলিয়ে হাসছিলেন। যদি আল্লাহ তাকে ৩২ পাটি দাঁত না দিয়ে ৩৫ পাটি দাঁত দিত তাহলে মনে হয় ৩৫ পাটি দাঁতের সবগুলোই বের করে ভেটকি মাছের মতো মেয়েটার সাথে বসে বসে ভেটকাতে থাকতেন। তাকে ওই মুহূর্তে জঘন্য থেকে জঘন্যতম গালি গুলো দিতে ইচ্ছে করছিল।

আর থাকা সম্ভব হয়নি ওখানে। একপ্রকার রাগের বশেই এসে পরি কটেজে। ওরা জিজ্ঞেস করেছিল আমার কি হয়েছে,কিসের জন্য কটেজে আসতে চাচ্ছি। আমি সোজাসাপটা জবাব দিয়েছিলাম আমার শরীরটা খারাপ লাগছে। আমার জবাবে ওরা আর আটকায়নি।সবচেয়ে খারাপ লেগেছিল তখন যখন চলে আসছিলাম আর আলআবি ভাইয়া কিছুই বলেন নি। বলবেন কিভাবে? উনিতো তার অন্তুকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন।আমি চলে এসেছি হয়তো সেটাও তার চোখে পরেনি।

কটেজে এসেছি তো রাগের বশেই কিন্তু এখন আর রাগটা নেই।এখন বারবার মনে হচ্ছে এই ছিল তার ভালোবাসা? এতো সুন্দর অভিনয় মানুষ করে কীভাবে?এতোদিন তাহলে আমাকে কেন তার সারাজীবন এর বর্ষণ সঙ্গিনী বানানোর স্বপ্ন দেখিয়েছেন?বারবার কান্নায় ভেঙ্গে পরছি।কোনোমতেই নিজেকে ঠিক রাখতে পারছি না।আমার সাথে ই কেনো এমনটা হয়?আমার সাথে এমন করে তার লাভ টা কি হলো?

চোখের অশ্রু কে এখন আর থামিয়ে দেয়ার ইচ্ছে হচ্ছে না। মন ভরে কান্না করতে ইচ্ছে করছে।মনের ইচ্ছে টাকেই প্রাধান্য দিয়ে মুখে ভালো করে বালিশ গুঁজে দেই।জানি সকালে উঠেই দেখব সর্দি লেগে গিয়েছে।গলার স্বরও স্বাভাবিক থেকে কিছু টা মোটা হয়ে যাবে। এভাবে অনেক সময় চোখের অশ্রু বিসর্জন দিতে দিতে একসময় কান্নার বেগ কিছুটা কমে আসে।একপর্যায়ে ফোপাঁতে ফোপাঁতে ই চোখজোড়া বন্ধ হয়ে আসে। গভীর ঘুমে তলিয়ে যাই আমি।

দরজায় খুব জোরে শব্দ হওয়া তে ঘুম ভাঙলো। রেনুমার শব্দ পেতে ই উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম। লক্ষ্য করলাম ওর হাতে খাবারের প্লেট। মাথা টা ব্যাথা করছে অনেক।তাই রেনুমার সঙ্গে কোনো কথা না বলেই আমার বেডে এসে পুনরায় শুয়ে পরলাম।রেনুমা বলল,,,

–জুইঁ আপু তোমার খাবার।আমরা সবাই বাইরেই খাচ্ছি। তুমি নেই বলে নিয়াজ ভাইয়া বললেন তোমাকে যেন ভিতরে এসে দিয়ে যাই।

ওর সাথে কথা বলতে মোটেও ইচ্ছে হচ্ছে না।একই ভাবে শুয়ে থাকলাম।তবে রেনুমার অস্তিত্ব এখনো টের পাচ্ছি।রেনুমা আবার বলে উঠলো,,,

–আপু তোমার কি বেশি খারাপ লাগছে? ভাইয়াদের বলবো গিয়ে?

রেনুমার কথায় আমি তাড়াতাড়ি করে শোয়া থেকে বেডে বসে ওর দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের কোণে জোরপূর্বক কৃত্রিম হাসি টেনে বলে উঠলাম,,,

–না! না! আমি ঠিক আছি।আসলে চোখের ঘুম ঘুম ভাব টা কাটেনি তো তাই আবার একটু শুয়েছিলাম।তুমি যাও আমি খেয়ে নিব।

–ওহহ!আমি ভাবলাম তোমার বোধ হয় খারাপ লাগছে বেশি।আচ্ছা খেয়ে নিও কিন্তু।

কথাগুলো বলেই রেনুমা চলে গেলো। রেনুমা যেতেই টেবিলের উপরে থাকা আমার মোবাইলটা বেজে উঠলো। মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি সাদু কল করছে। কল টা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে সাদু বলতে লাগলো,,,

— আলআবি ভাইর লগে ঘুরতে যাইয়া তো আমারে ভুইল্লাই গেছো।ভুলবাইতো, উডবির সাথে থাকলে আমারে কি আর মনে থাকবো নাকি? তা রোমান্স শোমান্স কেমন চলে?

সাদুর কথা গুলো কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেয়ার চেয়ে কম কিছু ছিল না।মোবাইল কানে দিয়েই ফোপাঁতে লাগলাম।ওপাশ থেকে সাদুর কোনো কথার আওয়াজ আসছে না।কল এখনো ডিসকানেক্ট হয়নি।ধীরে সুস্থে নিজেকে শান্ত করলাম। মোবাইলের স্ক্রীন টা একবার চেক করে দেখলাম। দেখি ১১ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড চলছে। এখনো কল যেহেতু কেটে যায়নি তাই আবার কানে দিলাম ফোনটা।ওপাশ থেকে সাদু নরম কন্ঠে বলে উঠলো,,,

–এবার বল কি হয়েছে?

–সাদু সে অনেক খারাপ একটা লোক।একটা প্রতারক,ধোঁকাবাজ।জঘন্য লোক!(আমি)

–আচ্ছা! আচ্ছা!রিলাক্স!বল কি হয়েছে। খুলে বল।(সাদু)

তারপর সাদু কে সব বলতে লাগলাম। আমার সব কথা শুনে সাদু বলল,,,

–একটা কথা কই বোইন?তোর মাথায় তো মনে হয় গরুর গোবরেরও অভাব আছে। গোবরেও সার হয়।তোর তো তাও নাই।মনে তো হইতাছে তোর মাথায় গন্ডারের চামড়া ভরা।বাপ ডাকলেই কি কেউ বাপ হইয়া যায়? রাস্তা ঘাটে তো কত জনরেই মামা,চাচা,খালা ডাকি আমরা তাই বইলা কি তারাও মামা,চাচা হইয়া যায় নাকি?

কোন সিচুয়েশনে ও কি বলছে?সাদুর কথায় আমি ওকে ঝাঁঝাল কন্ঠে বলে উঠলাম,,,

–আমি মরি আমার কষ্টে আর তুই ফালাছ আমার মাথায় গন্ডারের চামড়া তার লেইগা?আর ওই পিচ্চি রে কোলে কইরা নিয়া আসছে।রাস্তা ঘাট থেইকা তুইলা আনে নাই। ফোন রাখ তুই।এই জন্মে আমারে আর কল দিবিনা।

কলটা কেটে চুপচাপ বসে আছি। সব কিছু অসহ্য লাগছে।এখন সাদুর মাথার কয়েকটা চুল ছিঁড়তে পারলে ভালো হতো।সাদুর জায়গায় যদি ওই অনুরাধা না ফনুরাধার চুল ছেঁড়াছিঁড়ি অভিযানে নামতে পারতাম তাহলে আরও বেশি ভালো হতো।আমার মোবাইলটা একনাগাড়ে বেজে ই চলেছে। মোবাইলটা উল্টো করে রাখা বলে কে কল করছে দেখতে পারছি না।তবে মনে হচ্ছে সাদুই কল করছে।অনেক কয়েকবার রিং হওয়ার পরে কল টা রিসিভ করে বলতে লাগলাম,,,

–তোরে কইছি না কল দিবি না।ওই কানা ব্যাডার যা ইচ্ছা করুক।একটা ক্যান আরও দশটা বিয়ে করুক।দুনিয়ার সব মাইয়া বিয়ে কইরা ফেলুক।আমার কিচ্ছু যায় আসে না। আই ডোন্ট কেয়ার।

–সত্যি কিছু যায় আসে না?

অপর পাশ থেকে পরিচিত পুরুষালি কন্ঠ কর্ণপাত হতেই আমার কথা বন্ধ হয়ে গেল। মোবাইলের স্ক্রিনটা চোখের সামনে এনে টাস্কি খেয়ে গেলাম। এটাতো আলআবি ভাইয়ার নাম্বার।তাড়াতাড়ি করে আবার ফোনটা কানে ধরলাম।ওপাশ থেকে উনি গম্ভীর গলায় আবার বলে উঠলেন,,,

–আমি কানা ব্যাডা?বের হও এক্ষুনি। বোঝাপরা আছে তোমার সাথে। আমি কানা কিনা তা তোমায় বুঝিয়ে দেব আজ।২ মিনিটের মধ্যে তোমার কটেজের পেছনে আসো।যাস্ট টু মিনিটস।

এহ আমাকে হুকুম দেয়া?আমি ও তেজি কন্ঠে বলে উঠলাম,,,

–আসছি আমি। দুই মিনিট কেন, এক মিনিটের মধ্যে ই আসছি আমি। বোঝাপড়া তো আমি আপনার সাথে করবো।

তাড়াহুড়ো করে মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে মোবাইলটা হাতে নিয়ে কটেজের পেছনে এসে পড়লাম।আবছা আলোতেই আলআবি ভাইয়া কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে দ্রুতপায়ে তার কাছে গিয়ে মাথাটা হালকা একটু উঁচু করে তার পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরে বলতে লাগলাম,,,

–কেন করলেন আপনি এমন?আপনি বিবাহিত হয়ে ঘরে বউ রেখে আবার আমাকে আপনার সারাজীবনের বর্ষণ সঙ্গিনী বানাতে চেয়েছিলেন কেন?

কথাগুলো বলার সময় মনে হচ্ছিল আমার কন্ঠনালিতে কেউ অনেক ওজনের পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে। ধরা গলায় আবার বলতে লাগলাম,,,

–আপনি তো জানতেন আমি আপনাকে প্রচুর পরিমানে ভালোবাসি।অনেক ভালোবাসি। অনেক!অনেক!অনেক!

চোখের জল আর ধরে রাখতে পারলাম না। আমার গাল বেয়ে জলকণা পরতে লাগলো।সেই সাথে আকাশ গর্জে উঠলো।ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি কণা এসে পরতে লাগলো আমার গায়ে।এই বৃষ্টি কণা কাউকে ভিজিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রাখে না।ক্ষনে ক্ষনে আকাশ গর্জে উঠছে।আলআবি ভাইয়ার কলার ছেড়ে একটু পিছিয়ে আসতেই উনি বলে উঠলেন,,,

–এই কথাটাই তো শুনতে চাইছিলাম। শেষমেশ তাহলে ভালোবাসি বলেই দিলে।

তার কথা শেষ হতে ই বিকট একটা আওয়াজ হলো।হুট করে আলআবি ভাইয়া আমার মাথাটা হালকা বা পাশে আকাশের দিকে ঘুরিয়ে দিলেন।ওদিকে তাকাতেই দেখি একটা লেখা চোখে স্পষ্ট ফুটে উঠলো—-

“Will you be mine forever & ever?”

লেখাটা মুছে যেতেই এরপর আরেকটা বিকট শব্দ হওয়ায় আবার আকাশে আরেকটা লেখা ভেসে ওঠে —-

“Will you marry me”?

হঠাৎ করেই কটেজের পেছনের আলো জ্বলে উঠলো। আমাদের থেকে কিছুটা দূরে ই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাসফি ভাবি,মিথিলা আপু আর রেনুমা মুখ চেপে হাসছে।

চলবে…………

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
“সারপ্রাইজ পর্ব”

–শশুর বাবাই!ফাটিয়ে দিয়েছ।

বাচ্চা কন্ঠ শুনে পিছনে তাকাতেই দেখি অন্তু অনুরাধার হাত ধরে সাথে দাঁড়িয়ে আছে।অনুরাধা মুচকি হেসে আমাদের কিছুটা কাছে আসলো।সবার ভাব ভঙ্গি তে এতক্ষনে বুঝে গিয়েছি আমার সঙ্গে অনেক বড় একটা গেম খেলা হয়েছে। সামনে তাকিয়ে দেখি আলআবি ভাইয়া মিটমিটিয়ে হাসছেন।অন্তু দৌড়ে এসে আমার হাত ধরে ঝাঁকিয়ে বলল,,,

–শাশুড়ী আম্মু, আমার শ্বশুর বাবাই তো অপেক্ষা করছে।তাড়াতাড়ি উত্তর টা দাও।

এইটুকু বাচ্চার মুখ থেকে শশুর শাশুড়ী ডাক শুনে ঠিক হজম করতে পারছি না।অন্তু আবারও আমাকে বলল,,,

–কি হলো তুমি নাকি আমার শাশুড়ী আম্মু। তাহলে আমার শশুর বাবাইয়ের উত্তর দিচ্ছ না কেন।

–জুইঁ আপু এক্সেপ্ট করে ফেলো তারাতাড়ি। (রেনুমা)

রেনুমার কথায় ওদের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখি সজল ভাইয়া আর শাফিন ভাইয়া ও এসে উপস্থিত।এখন শুধু নিয়াজ ভাইয়া আর ফারাবী ভাইয়া বাদে সকলেই উপস্থিত এখানে। এতো জনগণের মধ্যে আমি কিভাবে বলব “আমিও আপনাকে বিয়ে করতে চাই”।এরাও কেমন বেআক্কল!ওদের তো বোঝা উচিৎ আমার ও লজ্জা বলে কিছু আছে।

ওয়েট!ওয়েট! জুইঁ তোর সাথে এতো বড়ো গেম খেলল আর তুই কি না নির্লজ্জের মতো তার প্রপোজাল এক্সেপ্টের চিন্তা মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস।এই পুচকো ছেলে আর অনুরাধা কে সেটাও তো জানা হলো না। নিজের মনের সঙ্গে কথাগুলো বলে মনে মনেই কঠোর এক সিদ্ধান্ত নিলাম।সবাইকে একবার পরখ করে আলআবি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,,,

–আপনার না একটা বাচ্চা আছে। আবার বউ ও তো আছে।বউ বাচ্চার সামনে আমাকে বেহায়ার মতো বলছেন “আমাকে বিয়ে করবে”?আপনাকে তো জিন্দেগীতেও বিয়ে করবো না।আপনাকে তো আমি জেলের রুটি খাওয়াবো।

আর কিছু বলার আগেই চারপাশ হাসির শব্দে মুখরিত হয়ে উঠলো। আলআবি ভাইয়া কোনো মতে হাসি থামিয়ে বললেন,,,

–আরে ওইটা শাফিনের বউ আর বাচ্চা।আমার নাকি ছোট একটা প্রিন্সেস হবে আর ও প্রিন্সেসটাকে বড় হলে বিয়ে করবে। সেই জন্য এখন থেকেই বাবা ডাকার প্রেক্টিসে আছে।

কথা টা বলে একটু থেমে আবার বলে উঠলেন,,,

— আমাকে নাকি মানতে পারবে না। তাই তোমাকে একটু মজা দেখালাম।

কথার শেষে আমাকে একটা চোখ টিপ মারলেন।
তার কথা আর কাজে প্রচুর রাগ হলো।এমন মজা কেউ করে?আমার চোখের কতগুলো পানি খরচ হলো!কতো কষ্ট হচ্ছিল সে কি তা জানে?জোড়ালো গলায় বললাম,,,

–সবাই খারাপ!সবাই!নিয়াজ ভাইয়ার কাছে এক্ষুনি আমি বিচার দিব।

এরপর আলআবি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম,,,

–আর আপনি!আপনার সাথে আগামী এক বছর এর জন্য কথা বলা বন্ধ।আমাকে বিয়ের স্বপ্ন এ জীবনে আর দেখা লাগবে না।করবো না আমি আপনাকে বিয়ে।আমার দিকটা কেউ ভাবলেন না।

আলআবি ভাইয়া একটু নিচু স্বরে বলতে নিলেন,,,

–জুইঁ আসলে….

তার কথায় কর্ণপাত না করে আমি আমার কথা শেষ করে গটগট করে আমি কটেজে এসে পরলাম। পিছন থেকে ওরা ডাকাডাকি করছিল।কিন্তু আমি না শুনেই এসে পরেছি।কি ভেবেছে?আমাকে কান্না করিয়ে উনি বলবে এটা মজা ছিল আর আমিও মজা ভেবে ধেই ধেই করে তার প্রপোজাল এক্সোপ্ট করে ফেলবো?আমাকে তো চেনো নাই।কি মনে হয়?আমি গেম খেলতে পারি না।দাড়াও বাছা ধন!এবার দেখবা এই জুইঁয়ের কেরামতি।খুব সুন্দর করে মুখে একটা হাসি টেনে ধীর পায়ে নিয়াজ ভাইয়ার কটেজে এসে উপস্থিত হলাম।কথার শব্দে মনে হচ্ছে মোটামুটি সবাই ই এখানে জটলা পাকিয়ে বসে আছে।দরজায় পরপর দুবার নক করতেই আলআবি ভাইয়া দরজা খুলে দিলেন।তার দিকে না তাকিয়ে দরজায় দাড়িয়ে ই সোজা নিয়াজ ভাইয়া কে উদ্দেশ্য করে বললাম,,,

–নিয়াজ ভাইয়া তোমার ফোনটা একটু দিবে?বাবাকে কল করবো।আমার ফোনের বেল্যান্স শেষ।

–আচ্ছা আয়!ভিতরে আয়।আর তোর কি এখন একটু ভালো লাগছে?(নিয়াজ ভাইয়া)

ভিতরে থাকা সকলের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললাম,,,

–হ্যাঁ ভালো লাগছে। খুব ভালো লাগছে। সবাই মিলে আমাকে অনেক বড় একটা সারপ্রাইজ দিয়েছে।এখন কি ভালো না থেকে পারি?(আমি)

নিয়াজ ভাইয়া সবার দিকে তাকিয়ে কৌতুহল নিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল,,,

–কি সারপ্রাইজ রে।যা আমি জানি না।

ভাইয়া কে তারা দেখিয়ে বললাম,,,

–পরে বলব।আগে মোবাইলটা দেও তো।বাবার সাথে কথা বলিনি আজকে সারাদিন।

ভাইয়া আর কথা না বাড়িয়ে আমার হাতে মোবাইল দিয়ে দিল।আমি মোবাইলটা নিয়ে ভাইয়ার কটেজ থেকে একটু দূরে আসলাম। ভাইয়ার ফোনের সেভ নাম্বারে গিয়ে একটা নাম্বার আমার ফোনে টুকে নিলাম। নাম্বার টা খুব সুন্দর করে “রাইয়ান বাবু” লিখে আমার ফোনে সেভ করে নিলাম। ঠোঁটের কোণে হাসি ঝুলিয়ে বাবাকে কল করলাম। বাবার সাথে কিছু সময় কথা বলে পুনরায় ভাইয়ার কটেজে গিয়ে ভাইয়াকে মোবাইলটা দিয়ে কারো দিকে দৃষ্টি না দিয়ে সোজা আমার কটেজে চলে আসলাম।

চলবে…………

[বিঃদ্রঃ গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক। অনুগ্রহ করে বাস্তবিক অর্থ খুজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না আর লেখিকা কে ও বিভ্রান্ত করবেন না]

বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-৩৬+৩৭

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_৩৬

রেনুমার ডাকে সকালে ঘুম থেকে উঠলাম।রেনুমা বলেছিল ও সকাল ১০ টার আগে ঘুম থেকে ওঠে না।আমার এলার্মের আগেই ও আমায় ডেকে দিয়েছে।আমি বিছানায় বসে চোখ বন্ধ করেই বললাম,,,

–রাতের চাঁদ মনে হচ্ছে দিনেই দেখতে পাচ্ছি। তা ব্যাপারটা কি?ভোর বেলাই উঠে পরলে যে।

–আরে এখন বাজে ৪:৩৫।তুমি তো একটু পরেই নামাজের জন্য উঠতে।তাই আরকি। (রেনুমা)

আমি চোখটা খুলে ওর দিকে সন্দেহ ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে গলায় অবিশ্বাসের রেশ টেনে বললাম,,,

–আমাকে ওঠানোর জন্য?সত্যি তো?

–সস..সত্যি নাতো কি মিথ্যা নাকি?(রেনুমা)

আমি একটু অনুকরণ করার ভঙ্গিমায় বললাম,,,

–কেউ একজন বলেছিল “ইশ ওনাকে যদি রাত-দিন চব্বিশ ঘন্টাই বসে বসে দেখতে পারতাম।আপু কালকে কিন্তু আমাকে ভোরবেলাই ডেকে দিবে”।

আমি কথাটা শেষ করতেই দেখি রেনুমা দৃষ্টি লুকানোর জন্য এদিক ওদিক তাকাচ্ছে।আসলে কাল রাতেই একফাঁকে রেনুমা কথার তালে তালে এই কথাটা বলে ফেলেছিল।রেনুমার একটা স্বভাব হলো পেটে কথা হজম করতে পারে না।আর তার থেকে আরেক টা মজার স্বভাব হলো সজল ভাইয়াকে উনি ওনার বলে সম্মোধন করে। সামনাসামনি আপনি বলে কথা বলে। এপর্যন্ত ভাইয়া ডাক ওর মুখ থেকে শুনিনি। আমাকে বলেছিল ভোরবেলা যেন ওকে আমি ডেকে দেই।কিন্তু আমার আগে দেখি ওই উঠে গেছে। এখন তো আমারই ডাউট হচ্ছে ও সারারাত ঘুমিয়েছে কিনা?
আমি বসে বসে যখন কালকের কথা ভেবে যাচ্ছিলাম তখন রেনুমা বলে উঠলো,,,

–তুমি যা ভাবছো ঠিক তাই ই।এখন উঠেই যখন গিয়েছি তাহলে ফজর এর নামাজ টা পড়ে চলো তাড়াতাড়ি বাইরে যাই।

–ওহোওওও এতো তাড়া।ঠিক আছে চলো তাহলে।

দুজনে মিলে নামাজ পড়ে কিছু সময় পরে সাড়ে পাঁচ টার দিকে ভিলা থেকে বের হলাম।আমি আমার পড়নের থ্রি-পিছ টার ওড়না টা ভালো করে মাথায় দিয়ে নিলাম।আমরা বের হতেই দেখি নিয়াজ ভাইয়া আর ভাবি ও বের হয়েছে। নিয়াজ ভাইয়া আমাদের দুজনকে উদ্দেশ্য করে বলল,,,

–শোন রিসোর্টের শেষ মাথায় একটু ফাঁকা স্পেস আছে।বসার জায়গাও আছে।আমরা নাস্তা করে আপাতত ওখান টা ঘুরে দেখে আসবো। তোরা দুজন চাইলে সামনে এগোতে পারিস।আমি আলআবিদের কল করে ডেকে নিচ্ছি।

রেনুমা ফট করে বলে উঠলো,,,

–না না।আমরা আগে আগে যাবো কেন?চলেন একসাথে ই যাই।

আমি ওর কান্ডে মিটমিটিয়ে হাসলাম।নিয়াজ ভাইয়া আলআবি ভাইয়াদের কল করতেই দেখতে পেলাম তারা দুজন অলরেডি ভিলা থেকে বের হচ্ছে। আলআবি ভাইয়াকে দেখলাম সাদা টি-শার্ট এর সঙ্গে সাদা টাউজার পড়েছেন।তার চুল গুলো একহাত দিয়ে পিছনে চেপে দিয়ে আমাদের সামনে এসে হাজির হলেন।হঠাৎ করেই এক উদ্ভট ভাবনা মস্তিষ্কে হানা দিল। মনে মনে চিন্তা করছি যদি আলআবি ভাইয়ার চশমার কালো ফ্রেমটায় শুভ্র রঙ স্থান পেতো, কালো চুলগুলোয় যদি শুভ্র রঙ স্থান পেতো, চোখের ভ্রু থেকে শুরু করে চোখের পাপড়ি,গালের দাঁড়ি পর্যন্ত যদি শুভ্র রঙ ছেয়ে যেত তাহলে কেমন হতো?নিশ্চয়ই তাকে শুভ্র ভূত বলে ডাকতো সবাই।অথবা বলতো শুভ্র আলআবি। তাকে ভূত ভেবে বেজায় হাসি পেলো।মনে মনে যখন তাকে ভূত সাজাচ্ছিলাম তখন খেয়াল করলাম ফারাবী ভাইয়া আর মিথিলা আপুও এসে পরেছে।রিসোর্ট টা আমাদের ঘুরে দেখা হয়নি তেমন ভাবে।তাই কিছু সময় এখানে ঘুরে ফিরে আমরা রিসোর্টের ওপেনিং এ ৯ টার দিকে বের হবো।

সবাই মিলে ধীর পায়ে এগোতে এগোতে রিসোর্টে এর শেষ প্রান্তে এসে পরলাম।এখানে এসে দেখি অবাক কান্ড।খোলা আকাশে রঙবেরঙে এর ঘুড়ির মেলা বসেছে।লাল, নীল,হলুদ, সবুজ রঙের ঘুড়ি স্বচ্ছ নীল আকাশটাকে নিজেদের দখলে নিয়ে নিয়েছে।খোলা জায়গাটায় ঘুড়তে আশা নানান বয়সের পর্যটকরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাটাই সামলাচ্ছে। দূরে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড় গুলো মনে হচ্ছে উকিঝুঁকি দিয়ে ঘুড়িবিলাস করে যাচ্ছে। পাহাড়ের গায়ে লেপ্টে থাকা সবুজ গাছ গুলো কাল শেষরাতে হওয়া বর্ষণে স্নান করে গায়ে স্নিগ্ধতা জড়িয়ে মুগ্ধ করেছে আগত পর্যটকদের।আকাশ একেবারে ঝকঝকে পরিষ্কার। মাঝে মাঝে তুলোর ন্যায় শুভ্র মেঘ এসে আমাদের দেখা দিয়ে যাচ্ছে।

আমাদের সামনে হাজির হলেন রিসোর্টের ম্যানেজার।তার হাতে থাকা ফাইলটা একটু নেড়ে আলআবি ভাইয়া কে উদ্দেশ্য করে বললেন,,,

–গুড মর্নিং স্যার!আমাদের এখানে আমরা “ঘুড়ি উৎসব” নামে একটা ছোটখাটো উৎসবের আয়োজন করেছি।আমাদের পক্ষ থেকে এখানে আসা পর্যটকদের জন্য আয়োজন করা হয়েছে এই উৎসব।স্যার আপনারা চাইলে ইনজয় করতে পারেন।

–সকালবেলা ঘুড়ি উৎসব! ব্যাপারটা কেমন হয়ে যায় না?(আলআবি ভাইয়া)

— স্যার আসলে বিকেলে দেখা যায় পর্যটকদের অনেকে ঘোরাফেরা করে ক্লান্ত হয়ে ফিরে আসে।সব দিক চিন্তা করে সেজন্য আমরা সকালের দিকে আয়োজন করেছি।(ম্যানেজার)

–ইন্টারেস্টিং তো!(ফারাবী ভাইয়া)

— ভাইসব চল তাহলে একবার প্রতিযোগিতা হয়ে যাক। (সজল ভাইয়া)

আলআবি ভাইয়া ম্যানেজারের উদ্দেশ্যে বললেন,,,

–ঠিক আছে আমরাও তাহলে পার্টিসিপেট করবো

শুরু হয়ে গেল তাদের চারজনের ঘুড়ি কাটাকাটির প্রতিযোগিতা। কিছু কিছু মানুষ নিজেদের ঘুড়ি ওড়ানো বাদ দিয়ে নিয়াজ ভাইয়া দের ঘুড়ি প্রতিযোগিতা উপভোগ করেছেন।আমি, রেনুমা,তাসফি ভাবি আর মিথিলা আপু বসার জন্য যে বেঞ্চ রয়েছে সেখানে বসে বসে তাদের দেখেছি।

সজল ভাইয়া আর নিয়াজ ভাইয়ার ঘুড়ি অনেক আগেই আকাশ থেকে বিদায় নিয়েছে।এখন আলআবি ভাইয়া আর ফারাবী ভাইয়া মানে দুই ভাইয়ের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। টানটান উত্তেজনার ইতি ঘটিয়ে ফারাবী ভাইয়া প্রথম হলো।

আমরা যেখানে বসে আছি তার পাশেই আর একটা বেঞ্চ আছে। সজল ভাইয়া আর আলআবি ভাইয়া সেখানে বসে পড়লেন। আলআবি ভাইয়া কে লেগপুল করতে করতে ফারাবী ভাইয়াও এসে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে পরলেন। ফারাবী ভাইয়া মিথিলা আপু কে উদ্দেশ্য করে বললেন,,,

— মিথু চলো আজকে তোমাকে ঘুড়ি ওড়ানো শিখিয়েই ছাড়বো।

–এখন?এখানে?(মিথিলা আপু)

ফারাবী ভাইয়া মিথিলা আপুর এক হাত ধরে বসা থেকে টেনে তুলে বললেন,,,

— হ্যাঁ এখন। এই মুহূর্তে ই চলো।

তারা যেতেই ভাবি নিয়াজ ভাইয়া কে বলল,,,

–প্লিজ চলনা আমরাও ঘুড়ি উড়াই?

–এই সময়ে একদমই না (নিয়াজ ভাইয়া)

–প্লিজ চলো না বেশি সময় না। প্লিজ! প্লিজ! প্লিজ!(ভাবি)

–বেশি নড়াচড়া করবে না।(নিয়াজ ভাইয়া)

–তুমি বললে সারা জীবনেও নড়াচড়া করবো না। এখন প্লিজ চলো।(ভাবি)

নিয়াজ ভাইয়া স্মিত হেসে বলল,,,

–ওকে চলো।

ওরা চলে যাওয়ার কিছুক্ষন পর সামনে তাকিয়ে দেখি নিয়াজ ভাইয়ার দুই বাহুর মধ্যে তাসফি ভাবি। দুজনই এক নাটাই দিয়ে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে।ফারাবী ভাইয়া আর মিথিলা আপুরও একই অবস্থা। পাশ থেকে রেনুমা বলে উঠলো,,,

–হাউ রোমান্টিক!

আমাদের দুই বেঞ্চের দুরত্ব বেশি নয়।রেনুমার বলা কথাটা শুনে সজল ভাইয়া বলল,,,

— তুই এইটুকুন বয়সে রোমান্টিকের কি বুঝিস?

–আপনি তো বুড়ো বয়সেও রোমান্স কি বুঝলেন না।(রেনুমা)

–এক চড়ে দাঁত ফেলে দিব।বেয়াদব মেয়ে!তোর মাকে এখনই কল দিয়ে জানাচ্ছি। (সজল ভাইয়া)

–কি বলবেন?আপনি বুড়ো বয়সে ও রোমান্স শিখতে পারেননি বলবেন।(রেনুমা)

রেনুমার বলা কথায় আমি আর হাসি চেপে রাখতে পারলাম না। কিছু টা শব্দ করে ই হেঁসে ফেললাম। রেনুমা যে সজল ভাইয়া কে জব্দ করায় ওস্তাদ তা বুঝতে বাকি নেই।আলআবি ভাইয়া বলে উঠলেন,,,

–ভাই মানসম্মান আর ও প্লাস্টিক বানানোর ইচ্ছা থাকলে আরও কিছুক্ষণ বসতে পারিস।

তৎক্ষনাৎ সজল ভাইয়া হনহন করে চলে গেলেন।সজল ভাইয়ার প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে খিলখিল করে আমি আর রেনুমা হাসতে শুরু করলাম। আমাদের হাসির মাঝেই আলআবি ভাইয়া রেনুমাকে বললেন,,,

–যা তো।গিয়ে দেখ তোদের ভিলায় গিফট পৌঁছেছে নাকি?

রেনুমা উত্তেজিত হয়ে বলল,,,

–কিসের গিফ্ট?

–গেলেই তো জানতে পারবি।যা গিয়ে দেখ।(আলআবি ভাইয়া)

রেনুমা আমার একহাত ধরে বলল,,,

–জুইঁ আপু চলো।

আমি রেনুমার সাথে যাওয়ার জন্য উঠতেই আলআবি ভাইয়া বলে উঠলেন,,,

–ওর যাওয়ার দরকার নেই।তুই গিয়ে দেখ।

কথাটা শুনে আমি বলে উঠলাম,,,

–আমি যাব না কেন?

–কারণ গিফ্ট ওর।ও যাবে।(আলআবি ভাইয়া)

আলআবি ভাইয়া আবার রেনুমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,,

–কিরে তুই এখানে দাঁড়িয়ে যে?

তার কথায় রেনুমা একাই চলে গেলেন।রেনুমা চলে যেতেই আলআবি ভাইয়া হুট করে আমার সামনাসামনি দাঁড়িয়ে পরলেন। তার এভাবে দাঁড়ানোতে আমি দু পা পিছিয়ে গেলাম।আলআবি ভাইয়া আমাকে বললেন,,,

–তখন ম্যানেজার কি বলেছিল মনে আছে?

আমি একটু ভ্রুকুচকে বলে উঠলাম,,,

–কি বলেছিল?

–ইনজয় করতে বলেছিল। (আলআবি ভাইয়া)

–করেন ইনজয়।আমাকে বলছেন কেন?(আমি)

–ওকে লেট’স গো।(আলআবি ভাইয়া)

বলেই আমার হাত ধরে হাটা ধরলেন।২০ নাম্বার ভিলার পিছনে এসে আমার হাত ছেড়ে দিলেন। আমার মনে প্রশ্ন জাগলো উনি এখানে আনলেন কেন?তাও আবার একা।হায়!হায়!আমাকে এখান থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিবেন না তো?এখান থেকে ভূপৃষ্ঠ ভালোই নিচে। মানুষ পরলে ওঠার কোনো চান্স নেই।আমি ভয়ে ভয়ে তার দিকে তাকালাম।দেখি পাশে উনি নেই। পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখি ওনার হাতে একটা খাঁচা। সেখানে তিনটা টিয়ে পাখি দেখা যাচ্ছে। আমি উৎফুল্লতার সহিত বললাম,,,

–টিয়াপাখি! কি করবেন এগুলো?

–পাখি খাঁচায় পুরে রাখার জিনিস নয়। আল্লাহ তো এদের ডানা এমনি এমনি দেয়নি।আসো এদিকে আসো।(আলআবি ভাইয়া)

আমি তার কাছে যেতেই একটা পাখি আমার হাতে তুলে দিলেন।পাখিটা হাতে নিতেই খুশি লাগছে অনেক।হাতের মধ্যে নিয়েই পাখি টাকে দেখতে লাগলাম। হুট করে আলআবি ভাইয়া আমার পিছনে দাঁড়িয়ে পরলেন। আমি দুই হাতে পাখি টাকে ধরে রেখেছি।আলআবি ভাইয়া পিছন থেকে আমার হাত ধরে পাখিটাকে আলগা করে নীল আকাশে মুক্ত করে দিলেন। পাখিটা উড়তে উড়তে চলে যাচ্ছে ।কানের কাছে ফিসফিসে আওয়াজে ভেসে আসলো,,,

–ইট ওয়াস ইউর গিফ্ট।

চলবে…………

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_৩৭

৩টা পাখিই ছেড়ে দেয়ার পর দুজন পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পাখিদের চলে যাওয়া দেখছি আলআবি ভাইয়া কে উদ্দেশ্য করে বললাম,,,

–একটা কথা বলি?

আলআবি ভাইয়া আকাশ পানে তাকিয়েই বললেন,,,

–বলে ফেলো

–সাদা রঙ ছাড়া আপনি অন্য রঙ এর জামা পড়েন না কেন?(আমি)

–সাদা জামায় দাগ ভরলে কিছু দাগ উঠবে কিছু দাগ উঠবে না।যে দাগগুলো উঠবে সেগুলো তাদের ছাপ রেখে যাবে সারাজীবন এর জন্য। আমি যখন সাদা পাঞ্জাবি পড়ি তখন সবসময় দাগ থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করি।আমি যে পথে চলছি এ পথে সৎ থাকাটা কিছু টা কষ্টের।রাজনীতির মাঠে নামলে আমার এই সাদা পাঞ্জাবি ই আমাকে মনে করিয়ে দেয় চরিত্রে দাগ লাগানো যাবে না।সময়ের তালে তালে দাগ ফিকে হয়ে যাবে ঠিকই কিন্তু আজীবনের জন্য একটা ছাপ রেখে যাবে। (আলআবি ভাইয়া)

–আরেকটা কথা বলি?(আমি)

আলআবি ভাইয়া এবার আমার দিকে দৃষ্টি দিয়ে ঠোঁটের কোনে মুচকি হাসি বজায় রেখে নরম কন্ঠে বললেন,,,

–বলো।

তার এই “বলো” শব্দ টা অতি সামান্য হলেও কেন যেন আমার কাছে অন্য রকম লাগলো।এ মুহূর্তে খুব আবেদনময় লাগছে তাকে। মনে হচ্ছে কোনো ছোট বাচ্চার থেকে মুখের বুলি শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। তার দিকে তাকিয়ে বললাম,,,

–ধন্যবাদ এতো সুন্দর মুহূর্ত উপহার দেয়ার জন্য।

আলআবি ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে অমায়িক হাসি হাসলেন।মনে হলো হাসিটা হুট করেই আমাকে লজ্জায় ফেলে দিল। কাউকে ধন্যবাদ দিলেও কি লজ্জা লাগে নাকি?এ দিনও আমার দেখতে হচ্ছে। নাকি আমারই কোনো অসুখ হলো? কথাটা বলে আর একমুহূর্তও দেরি করলাম না। সোজা ঘুড়ি উড়ানোর স্পটে এসে পরলাম।

আজ বান্দরবান আমাদের ২য় দিন।পরশুরাতে আমরা এখান থেকে বিদায় নিব।একটু আগেই আমাদের প্ল্যান চেঞ্জ হলো।তাহলো,ভিলায় আমরা আর ব্যাক করবো না।পরশুদিন পর্যন্ত আমরা নতুন রিসোর্টে ই থাকবো। তার কারণ হলো রিসোর্ট থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরেই চিম্বুক পাহাড় অবস্থিত। তাই ভিলায় ব্যাক না করেই আমরা ওখান থেকে ই চিম্বুক পরিদর্শন করতে পারি। এতে জার্নিটাও কম হবে।

সকাল এখন ৯ টা বেজে ১৫ মিনিট। আমরা সবাই আলআবি ভাইয়ার রিসোর্টের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পরেছি।অনেকটা সময় পথ অতিক্রম করে আমরা আমাদের সেই কাঙ্ক্ষিত রিসোর্টে পৌঁছালাম৷

রিসোর্টের প্রতিটা কটেজই দৃষ্টি কেঁড়ে নিবে প্রত্যেকের।এখানে মোট ১৩ টা কোটেজ আছে।সবচেয়ে দৃষ্টি আকর্ষনের দিক হলো প্রত্যেকটা কটেজই ছোটখাটো একটা গোলাপ বাগানে ঘেরা।সাথে বেলিফুলও রয়েছে।গোলাপ আর বেলি বাদে কিছু নাম না জানা অপরিচিত ফুলও রয়েছে।কটেজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো প্রতিটা কটেজ কাঠের তৈরি যা মাটি থেকে একটু উঁচুতে।কটেজে ওঠার জন্য রয়েছে কাঠের সিঁড়ি। এই রিসোর্টের সীমানা গোলাকৃতির।এখানে যার নামে কটেজ বুক করা হয় তার নামের নেমপ্লেট টানিয়ে দেয়া হয় দরজায়।এখানে খাবার এর ও ব্যবস্থা আছে।তবে খাবারটা নাকি যার যার কটেজে এসে দিয়ে যাওয়া হয়।আরো ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হলো খাবার রান্না হয় মাটির চুলোয়।বাঙালি খাবার ছাড়া মেনুতে অন্য কোনো বাইরের ফুড নেই।এক কথায় বলতে গেলে রিসোর্ট প্ল্যান টা খুব ই দারুণ।

আজকে রিসোর্টে বাইরের কোনো পর্যটক নেই। অফিস স্টাফ, আর আমরাই পুরো রিসোর্টে।এখানে এসে দুপুরের খাবার খেয়ে রিসোর্টটা সবাই মিলে ঘুড়ে দেখলাম।এখানে আসার পরেই আলআবি ভাইয়া কোথায় যেন হাওয়া হয়ে গিয়েছেন।কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির মুখ দর্শন করতে না পেরে মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল।রিসোর্ট টা ভালো করে দেখা শেষ হলে আমার আর রেনুমার জন্য বরাদ্দকৃত কটেজে এসেই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে ঘুমের দেশে পারি জমালাম।রাতে একটা ছোটখাটো পার্টি হবে। হয়তোবা অনেক সময় রাত জেগে থাকা হবে।

দরজায় কড়া আঘাতের শব্দে চোখ মেলে তাকালাম। দেখি রেনুমা পাশের সিঙ্গেল বেডে বেঘোরে অগোছালো ভাবে ঘুমাচ্ছে।আমার বেড থেকে উঠে গিয়ে ওকে একটু ঠিকঠাক করে দরজা খুলে দিলাম। দেখি রিসোর্টের একজন স্টাফ দাঁড়িয়ে আছে। আমার হাতে দুটো শপিং ব্যাগ ধড়িয়ে দিয়ে বলল,,,

–ম্যাম এটা স্যার এর পক্ষ থেকে আপনাদের দুজন এর জন্য।

–কোন স্যার?(আমি)

–আলআবি স্যার এর পক্ষ থেকে। (স্টাফ)

সে তার কথা শেষ হতেই চলে গেলেন। দরজা আটকে ভিতরে এসে দেখি টেবিল ঘড়িতে বিকেল পাঁচ টা বাজে। শপিং ব্যাগ দুটোয় খেয়াল করলাম একটার মধ্যে রেনুমা লেখা আর একটার মধ্যে জুইঁ লেখা। ওয়াশরুম থেকে একটু ফ্রেশ হয়ে এসে ভাবলাম এক সাথেই না হয় দুটো ব্যাগ খুলবো। তাই রেনুমা ডেকে তুললাম। ওকে ফ্রেস হয়ে আসতে বললাম কিন্তু ও আগেই ব্যাগ দুটো খুলে ফেলল। ব্যাগ থেকে দুটো বেগুনি রংয়ের শাড়ি পেলাম। আমাদের দুজনের শাড়ি একরকমের ই দেখতে। আমার ব্যাগ থেকে একটা কালো রঙের হিজাব স্কার্ফও পেলাম। রেনুমাকে আমি হিজাব পরতে দেখিনি।ওর ব্যাগ থেকে কোনপ্রকার হিজাব পেলাম না।রেনুমা আমাকে জিজ্ঞেস করে বসলো,,,

–এগুলো কি সন্ধ্যার ইভেন্টের জন্য? নাকি এমনি এমনি দিয়ে গেলো?

–দাঁড়াও ভাইয়াকে কল দিয়ে জেনে নেই। (আমি)

নিয়াজ ভাইয়া কে কল করতেই ভাইয়া জানালো এই শাড়ি পরে একেবারে রেডি হয়েই যেন আমরা কিছুক্ষণের মধ্যে বাইরে আসি। ভাইয়ার কথামতো শাড়ি পড়ে রেডি হয়ে নিলাম। আগে থেকেই প্ল্যান করে এসেছিলাম শাড়ি পড়বো। তাই সাথে দুটো শাড়ি আর তার সাথে দুটো ব্লাউজ নিয়ে এসেছিলাম। এখান থেকে একটা রেনুমাকে দিলাম।

কটেজের বাইরে খোলামেলা স্থানে এসে দেখি নিয়াজ ভাইয়া, ভাবি, ফারাবী ভাইয়া, মিথিলা আপু সহ অন্যান্য কলিগরাও একসাথে এক জায়গায় ভিড় জমিয়েছে। সকল মেয়েদের পড়নেই আমাদের মতো বেগুনি বর্ণের শাড়ি। ছেলেদের মধ্যে কেউ কেউ সাদা পাঞ্জাবি পড়েছে। পুরো রিসোর্টটা ও মরিচ বাতি দিয়ে হালকা পাতলা ডেকোরেশন করা হয়েছে। স্পিচ দেয়ার জন্য ছোটখাটো একটা স্টেজ সাজানো হয়েছে। স্টেজের সামনে সারি সারি চেয়ার আর গোল টেবিল বসানো হয়েছে তবে এখনো মরিচ বাতি গুলো জ্বালানো হয়নি। এক অংশে বারবিকিউ এর জন্য স্টোভ সাজানো হচ্ছে। চারপাশে কিছুটা রমরমা পরিবেশ হলেও আমার কাছে পুরো পরিবেশটাই নির্জীব মনে হচ্ছে সবকিছুই ফাঁকা ফাঁকা মনে হচ্ছে এখন পর্যন্ত আলআবি ভাইয়ার দেখা মেলেনি। কয়েকদিন ধরে আলআবি ভাইয়া আশেপাশে থাকলে সবকিছু পরিপূর্ণ লাগে। আজকে হঠাৎ তার অনুপস্থিতিতে মনে হচ্ছে আমার চারপাশ অপূর্ণতায় ঘিরে যাচ্ছে। আমরা যেখানটায় বসে রয়েছি সেখান থেকে রিসোর্টে ঢোকার প্রধান রাস্তা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। বারবার শুধু আশেপাশে পরখ করে যাচ্ছি। সজল ভাইয়া আর আলআবি ভাইয়ার দুজনের একজনকেও দেখতে পাচ্ছি না।কাউকে জিজ্ঞেস ও করতে পারছি না। আমার জায়গায় উল্টো দু-তিনবার রেনুমা আমাকে জিজ্ঞেস করে ফেলেছে সজল ভাইয়ার কোন খোঁজ জানি নাকি।

আমি বসে বারবার যখন চারপাশে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছি তখন আমার চোখ এক জায়গায় আটকে যায়।দেখি আলআবি ভাইয়া রিসোর্টে ঢোকার রাস্তা দিয়ে এদিকে আসছেন।তার কোলে একটা ৫-৬ বছরের বাচ্চা।বাচ্চাটাকে এক হাতে আগলে কোলে নিয়ে অন্যহাতে একটা লাগেজ নিয়ে এদিকে এগোচ্ছেন।তার পাশেই হেটে হেটে একটা মেয়ে আসছে।মেয়েটার মুখমন্ডলে সাজসজ্জার কোনো কমতি নেই।তবে তার পোশাক-আশাকে শালীনতার ছাপ রয়েছে। তিনজনকেই খুশি খুশি দেখাচ্ছে। লক্ষ্য করলাম তাদের পিছনে ই সজল ভাইয়া আসছে।ওদের দেখে মনে কুচিন্তার পাহাড় জমা হয়ে যাচ্ছে। তিনজন কে দেখে মনে হচ্ছে একটা সুখি পরিবার হেঁসে খেলে এদিকেই আসছে।মনের মধ্যে এমন ভাবনা আসতেই বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো।বাচ্চা ছেলেটা কি যেন বলতে বলতে আসছে আর আলআবি ভাইয়া হেঁসে হেঁসে তার জবাব দিচ্ছেন। তারা আমাদের কাছে আসতেই শুনতে পেলাম বাচ্চা টা মিষ্টি গলায় বলে উঠলো,,,

–আমার বাবাই বেস্ট বাবাই।

বলেই তার গলা জড়িয়ে ধরে তার সাথে আরো লেপ্টে গেলো।ওদের কে চোখে পরতেই মিথিলা আপু বলে উঠলো,,,

–আরে অনুরাধা!!!

মেয়ে টা আমাদের সামনে এসে ই সুন্দর করে গাল ভরা হাসি দিয়ে মিথিলা আপুর উদ্দেশ্যে বলল,,,

–কেমন আছো ভাবি?

এই কথাটা আমার পুরো শরীর অসাড় করে করে ফেলল।মস্তিষকে একটা কথা বারবার যন্ত্রণাদায়ক খোঁচা দিচ্ছে। “উনি বিবাহিত”।

চলবে…………

[বিঃদ্রঃ গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক। অনুগ্রহ করে বাস্তবিক অর্থ খুজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না আর লেখিকা কে ও বিভ্রান্ত করবেন না]

বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-৩৪+৩৫

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_৩৪

–আমি আমার জনকে সামলাবো মানে?আপনি বুড়ো মানুষটাকে কি বলেছেন? আমার তো এখন মনে হচ্ছে আপনি পুরো এলাকায় ঢোল পিটিয়ে বলেছেন আমি আপনার বউ। আপনার সাথে আর এক মুহূর্ত থাকা যাবে না। তাড়াতাড়ি আমার হাত খুলুন। আমি এক্ষুনি এখান থেকে চলে যাব।

এক নিশ্বাসে আলআবি ভাইয়া কে উদ্দেশ্য করে কথাগুলো বললাম। আলআবি ভাইয়া আমার দিকে একটু চেপে বসে বললেন,,,

–আমাকে এই আইডিয়াটা আগে কেন বললে না? তাহলে তো এত কষ্ট করতে হত না। চলো তাহলে এখনি আইডিয়া টা কাজে লাগিয়ে ফেলি।

কথাটা শেষ করে আলআবি ভাইয়া বিছানা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লেন।আমি হড়বড়িয়ে তাকে বললাম,,,

— কোথায় যাব? এখন আবার কোন অঘটন ঘটাতে চলেছেন?

–তুমি না একটু আগে বললে ঢোল পিটিয়ে পুরো এলাকাকে বলতে হবে।তোমার কথা ফেলি কি করে বলো?

–উফ! আপনি আসলেই একটা খবিশ।(আমি)

— তোমার তো দেখি আজকে ছাড়া পাবার কোন ইচ্ছে নেই।(আলআবি ভাইয়)

–কি বললেন?(আমি)

— আরও একবার খবিশ বলে ফেলেছ। আজকে দিনের মধ্যেও তোমাকে ছাড়ছি না,গজদন্তিনী।(আলআবি ভাইয়া)

–এই গজদন্তিনী উদয় হলো কোথা থেকে আবার? (আমি)

আলআবি ভাইয়া হুট করে ই আমার অনেক টা কাছে এসে কানে কানে ফিসফিসে গলায় বললেন,,,

— গজদন্তিনী! তুমি কি জানো তোমার গজ দাঁত বিশিষ্ট হাসি দেখলে তোমার গজদাঁতে আমার ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে দেয়ার প্রবল ইচ্ছা জাগে।কথাটা মনে আছে নিশ্চয়ই।এখন যদি আর একবার ছাড়া পাওয়ার কথা বলো তবে আমার এই ইচ্ছেটা পূরণ করতে বেশি সময় লাগবে না।

আলআবি ভাইয়া এভাবে কাছে আসলেই আমার হৃদপিণ্ড তার ধকধক শব্দ ধ্বনি কে তড়িৎ গতিতে বাড়িয়ে দেয়।আমার আঙুলের ডগা গুলো ঈষৎ শীতল হয়ে যায়।আলআবি ভাইয়ার ফিসফিসে আওয়াজ শরীরে চিকন এক শিহরণের দোলা দিয়ে যায়।আমি নিজেকে যথা সম্ভব স্বাভাবিক রেখে আলআবি ভাইয়ার কাছ থেকে দুইকদম পিছিয়ে এলাম।মনের অভ্যন্তরে কেমন অনুভূতি অনুভব করছি তা নিজেও বুঝে উঠতে পারছি না।কিন্ত এতটুকু বুঝতে পারছি যে লজ্জা আমাকে পূর্ণ রূপে গ্রাস করে ফেলেছে।যার কারণে চোখ তুলে তার দিকে তাকাতে অব্দি পারছি না।মাথা নিচু করে ওইভাবেই দাঁড়িয়ে রইলাম। এর মধ্যেই দেখলাম সিতারা বানুর সাথে আরেকটা পিচ্চি মেয়ে ভাত নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন।সাথে তরকারিও আছে।আমাদের উদ্দেশ্য করে বললেন,,,

–খাড়ইয়া আছো ক্যান?আমার ছোট চৌকিতে বইবার মন চায় না তাই তো?

–না না।এমন কিছু না।আপনি ভুল ভাবছেন।(আমি)

–তুমি আবার এগুলো এনেছ কেন?(আলআবি ভাইয়া)

–তোর লেইগা আনছি নাকি।তুই তো দিনে ১৪ বার কইরা আহোছ।জুইঁবুড়ি তো ১৪ বার আহে না।এই প্রথম আইলো।খালি মুখে কি রাহন যায় ওরে।(সিতারা বানু)

তার জুইঁবুড়ি ডাকটা অতি সামান্য হলেও কেন যেন আমার কাছে খুব ভালো লাগলো।আমি হাসি মুখ করে বললাম,,,

–এতো দিন আসিনি তবে এখন থেকে আসবো।আর কি এনেছেন আমার জন্য?খুব খিদে পেয়েছে। দুপুরে এখনো খাওয়া হয়নি।তাড়তাড়ি দিন।

আমার এইটুকু কথাতে তার মুখে খুশির হাসি ফুটে উঠল। তাকে দেখেই বুঝতে পারছি তিনি বেজায় খুশী হয়েছেন। খেতে বসে আমি আর আলআবি ভাইয়া পাশাপাশি বসে আছি।আমি আমার মতো খাওয়া শুরু করে দিলাম। কিন্তু আলআবি ভাইয়া চুপচাপ বসে আছেন।তাকে বসে থাকতে দেখে আমার যে কি পরিমাণ খুশি হচ্ছে। খুশির কারণ হলো হাতকড়ায় রয়েছে আমার বাম হাত কিন্তু আলআবি ভাইয়ার রয়েছে ডান হাত। বেচারার মুখ টা একেবারে দেখার মতোন হয়েছে। মনে মনে আমি হাসতে হাসতে কয়টা গড়াগড়ি যে খেয়েছি তার হিসেব নেই। সিতারা বানু সামনে আছেন বলে মন ভরে হাসতে পারছি না। আলআবি ভাইয়াকে না খেয়ে চুপ করে বসে থাকতে দেখে সিতারা বানু বলে উঠলেন,,,

–কি হইলো তোর?খাইতাছো না ক্যান?

–তোমার জুইঁবুড়ি ই তো খেতে দিচ্ছে না। (আলআবি ভাইয়া)

–ক্যান?আমার জুইঁবুড়ি তোরে কোন দিক দিয়া ধইরা রাখছে?(সিতারা বানু)

আলআবি ভাইয়া আমার আর তার হাতটা সামনে এনে দেখালেন।আলআবি ভাইয়া বললেন,,,

–চাবি আমার অফিসে রেখে এসেছি।

সিতারা বানু আমাদের দুজনকে দেখে হেসে ফেললেন। তারপর আমাকে বললেল,,,

–আমার নাতিডা একটু শয়তানি করে বেশি।এহন কি আর করবা।খাড়াও দেহি কি করা যায়।

তার কথা শুনে আমি হাসি হাসি মুখ করে আলআবি ভাইয়ার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। সিতারা বানু রুম ত্যাগের আগেই আলআবি ভাইয়া বললেন,,,

–আমার কাছে কিন্তু উপায় একটা আছে।

–কি?(সিতারা বানু)

–আমাদের দুজনের হাত আটকানো কিন্তু তোমার হাত তো আর আটকানো না।তাই জলদি এসে আমাকে আর তোমার জুইঁ বুড়িকে খাইয়ে দাও।(আলআবি ভাইয়া)

আলআবি ভাইয়ার কথায় আমিও হাত ধুয়ে নিলাম।সিতারা বানু এসে আমাদের দুজনকে খাওয়াতে শুরু করলেন।রক্তের সম্পর্ক থেকে যে আত্মার সম্পর্ক বড় তার উদাহরণ এই সিতারা বানু। কতো যত্নে আমাদের দুজনকে খাওয়াচ্ছেন।

খাওয়া শেষ করে জানতে পারলাম এখানে মাগরিবের নামাজ এর পরে ছোট পরিসরে মিলাদ পড়ানো হবে।নিয়াজ ভাইয়াকে আমিই নিজে কল করে বলি আমি এখানে আছি। ভেবেছিলাম নিয়াজ ভাইয়া বলবে আমি এখানে কি করি বা এখানে আসলাম কি করে এসব জিজ্ঞেস করবে কিন্তু ভাইয়া এসব কিছুই জিজ্ঞেস করে নি। মনে একটা খটকা লাগলো।নিয়াজ ভাইয়া কিছু বলল না কেন?হাতকড়ার চাবি আনার জন্য শাফিন ভাইয়াকে পাঠানো হয়েছে।আলআবি ভাইয়াকে যখন বলেছি নামাজ পরতে হবে আলআবি ভাইয়া ও আর দেরি করেন নি।দ্রুত শাফিন ভাইয়াকে পাঠিয়ে দিয়েছেন।এর মধ্যেই হাতে টান পরলো।দেখি আলআবি ভাইয়া আমাকে ধরে টানছেন।তার দিকে তাকাতেই উনি একটা মেকি হাসি দিয়ে বললেন,,,

–একটু ওয়াশরুমে যেতে হবে।

তার কথায় কেমন প্রতিক্রিয়া করবো বুঝতে পারছি না।তবে তাকে জব্দ কার ভালো সুযোগ পেয়ে গেলাম।আমি বললাম,,,

–তো যান।ধরে রেখেছি নাকি আমি?

–তুমি ভালো করেই জানো আমি কিসের কথা বলছি।(আলআবি ভাইয়া)

আমি একটু ভ্রু কুচকে বললাম,,,

–কিসের কথা বলছেন?

–তুমি এখানে খুঁটি গেড়ে বসে থাকলে আমি ওয়াশরুমে যাবো কি করে।(আলআবি ভাইয়া)

–তা আমি আপনার সঙ্গে এক সাথে ওয়াশরুমে যাব কি করে।(আমি)

আমার কথায় তিনি দমে গেলেন। তারপর শাফিন ভাইয়াকে কল করে তাড়াতাড়ি করে আসতে বললেন।আমি আলআবি ভাইয়া কে বললাম,,,

–অন্যের জন্য গর্ত করলে নিজেকেই পড়তে হয়।

বলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লাম। আনুমানিক পাঁচ থেকে ছয় মিনিটের মধ্যেই শাফিন ভাইয়া চাবি নিয়ে এসে পড়লেন। হাতটা ছাড়া পেয়ে যোহরের নামাজ আদায় করে নিলাম। নামাজ শেষে সিতারা বানু আর বাচ্চাগুলোর সাথে ভালোই সময় কেটে গেল।

বিকেলের দিকে নিয়াজ ভাইয়া, ভাবি আর বাবাকে এখানে দেখে বেশ অবাক হলাম। তাদের থেকে জানতে পারলাম নিয়াজ ভাইয়া এ জায়গা সম্পর্কে আগেই অবগত ছিল। তবে ভাবি আর বাবা জানতে পেরেছে আজকে সকালে। সকালবেলা নাকি আলআবি ভাইয়া নিয়াজ ভাইয়া কে কল করে সবাইকে নিয়ে এখানে মিলাদ উপলক্ষে আসতে বলেছেন। আমাকে ভার্সিটি থেকে আলআবি ভাইয়া এখানে নিয়ে আসবেন সেটা নাকি আগেই নিয়াজ ভাইয়াকে বলে দিয়েছিলেন। নিয়াজ ভাইয়াকে যখন আমি কল করেছিলাম, তখন আমাকে চমকে দেয়ার জন্য ই নাকি বলেনি যে তারাও এখানে আসবে।

আলআবি ভাইয়ার বাবা এই জায়গার নাম দিয়েছেন “পরিবার”। এখানে ঢোকার আগে গেটে দেখেছিলাম একটা সাইনবোর্ড টানানো “পরিবার” নামে।

“পরিবার” থেকে আমরা প্রায় আটটার দিকে আমাদের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দেই। চল্লিশ মিনিটের মত সময় লাগে ওখান থেকে আমাদের বাসায় আসতে। রাতে ঘুমানোর জন্য যখন বিছানায় শুয়ে পড়ি তখন ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। আমার জানা ছিল এই সময়ে কে ফোন দিতে পারে। তাই ফোনটা রিসিভ করার জন্য যখন হাতে নিলাম তখন ফোনের স্ক্রিনে বর্ষণ সঙ্গী নামটা দেখে আলআবি ভাইয়ার বলা কথাগুলো মনে পড়ে গেল—

” তোমাকে এখানে এনে আজকে ওই বাচ্চা ছেলে-মেয়ে গুলোকে না দেখিয়েই মিলাদ পড়িয়ে বিদায় দিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু বাচ্চা গুলোর কথা তোমাকে এই জন্যে বললাম যাতে তুমি জানতে পারো আমি কয়েকদিন ব্যস্ত থাকবো,তোমার সাথে হয়তো দেখাটাও করতে পারবো না। তাই প্লিজ যখন আমি দিন শেষে কল করব তখন কথা না বললেও অন্তত ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে রেখো। তোমার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনেই না হয় রাত পাড় করবো”

আমার ভাবনার মধ্যেই ফোনটা বাজতে বাজতে কেটে গিয়ে দ্বিতীয়বার বাজতে লাগল। ফোনটা রিসিভ করে কথা বললাম না। কেবল কানে ধরে রাখলাম। এই মুহূর্তে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। ওপাশ থেকে ভেসে আসা কন্ঠটা চুপচাপ শুনতে ইচ্ছে করছে। ওপাশ থেকে শান্ত কন্ঠে ভেসে আসলো -“হ্যালো, হ্যালো। শুনতে পাচ্ছ? হ্যালো। সত্যি কথা বলবে না “এরপর তার আর কোন শব্দ শোনা যায়নি তবে। আমরা কেউই কল টা কাটিনি।

এভাবে কেটে গিয়েছে অনেকগুলো সেকেন্ড, অনেক গুলো মিনিট, অনেকগুলো ঘন্টা আর সেই সাথে কেটে গেছে পাঁচদিন। এই পাঁচ দিনে আমার সঙ্গে আলআবি ভাইয়ার কোনো দেখা সাক্ষাত হয় নি।কিন্তু প্রতিদিন রাতে সে কল করতো। তবে কেউ কোন কথা বলতাম না। আলআবি ভাইয়া কিছু সময় “হ্যালো হ্যালো” বলে চুপ হয়ে যেতেন।ওভাবেই কেটে যেত রাত। সকালে উঠে আমি কলটা কাটতাম।

ঘড়িতে রাত আটটা বেজে ত্রিশ মিনিট। আমি,নিয়াজ ভাইয়া আর ভাবি রেডি হচ্ছি। কারণ আমরা আজ বান্দরবানের উদ্দেশ্যে রওনা দিব। আমাদের বাস রাত সাড়ে নয়টায় ছাড়বে। নিয়াজ ভাইয়ার অফিস থেকেই বাস দেওয়া হবে। যে রিসোর্টের ওপেনিং সেলিব্রেশনে আমরা যাচ্ছি সেটা মূলত অন্য কারো নয়।ওটা আলআবি ভাইয়ার নিজের।তাই অফিসের প্রত্যেকটা স্টাফ কেই নেয়া হচ্ছে।বলতে গেলে কিছুটা পিকনিকের মতোও।অর্থ্যাৎ এক কাজে দুই কাজ হচ্ছে।

চলবে…………

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_৩৫

বাস স্ট্যান্ডে সারি সারি তিনটা এসি বাসের সামনে আমি, নিয়াজ ভাইয়া আর ভাবি দাঁড়িয়ে আছি।ভাইয়ার কিছু কিছু কলিগও ইতোমধ্যে এসে পরেছে।ভাইয়ার সাথে কুশল বিনিময়ের পর্ব শেষ করে তাদের মধ্যে কেউ কেউ বাসে উঠেও পরেছে।আমাদের দাঁড়িয়ে থাকার কারণ হলো আলআবি ভাইয়া। আমি যতটুকু জানি আলআবি ভাইয়ার সঙ্গে সজল ভাইয়া ও আসবে।

আমাদের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে আলআবি ভাইয়া আর সজল ভাইয়া আমাদের সামনে উপস্থিত হলেন।এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে আলআবি ভাইয়া পুরো দুনিয়া উল্টে গেলেও তার শুভ্র বর্ণ কে কোনদিন ছাড়বেন না। অবশ্য দুনিয়া কখনো উল্টাবে না। এটা তো কথার কথা বললাম। তবে একটা কথা না বললেই নয় তা হলো আলআবি ভাইয়াকে পাঞ্জাবিতে সবচেয়ে বেশি মানানসই লাগে।আলআবি ভাইয়ার উপর চোখ পড়তেই উপলব্ধি করতে পারলাম তার ক্লিন শেভ করা ক্ষুদ্রতম দাড়ি, ঘনত্বের ছোঁয়া পেয়েছে। আজ অনেকদিন বাদে সেই চশমা পরিহিত আলআবি মাশরুখ কে দেখতে পাচ্ছি।যেই শাল নিয়ে এতো কাহিনী হয়ে গিয়েছিল সেই রকমই একটা কালো বর্ণের শাল তার গলায় বিদ্যমান।তাকে দেখে মোটেও কেউ বলবে না সে কোথাও ঘুরতে যাচ্ছেন। তাকে দেখে বলবে সে কোনো সভায় নেতৃত্ব দিতে যাচ্ছেন।

আলআবি ভাইয়া আর সজল ভাইয়া একা আসেন নি। তাদের সঙ্গে রয়েছে আরও তিনটে অচেনা মুখ দেখা যাচ্ছে ।একজন ৩২-৩৩ বছর এর পুরুষ রয়েছে, তাসফি ভাবির সমবয়সি একটা আপু রয়েছে আর সেই সাথে রয়েছে কিশোরী বয়সের একটা মেয়ে।মনে হচ্ছে ১৫ কি ১৬ তে পদার্পণ করেছে।

সজল ভাইয়া আমাদের উদ্দেশ্য করে বললেন,,,

–সরি গাইস লেট করানোর জন্য। আসলে এই দুই লেডিস এর জন্য লেট হয়ে গিয়েছে আমাদের।

পরিচয় পর্বে জানতে পারলাম কিশোরী বয়সের মেয়েটা (রেনুমা), আলআবি ভাইয়া আর সজল ভাইয়ার ফুফাতো বোন। বলে রাখা ভাল সজল ভাইয়া আর আলআবি ভাইয়া দুজন কিন্তু চাচাতো ভাই। আর যে দুজন রয়েছে ওরা আলআবি ভাইয়ার বড় ভাই (ফারাবী) আর ভাবি (মিথিলা)।

সব কিছু চেক করে আমরা বাসে উঠে পড়লাম। ঠিক ৯:৪৫ মিনিটে আমাদের বাস বান্দরবানের জেলা শহরের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। কিছু কিছু মানুষ আগেই বাসে উঠে যাওয়া তে আমরা সবাই একসাথে বসতে পারলাম না। অর্থাৎ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসতে হয়েছে। একেবারে সামনের দিকের সিটে বসেছে ফারাবী ভাইয়া আর মিথিলা আপু। রেনুমা মেয়েটা আর আমি একেবারে শেষের দিকে বসেছি।আমাদের ঠিক পিছনের সিটে আলআবি ভাইয়া আর সজল ভাইয়া বসেছেন। নিয়াজ ভাইয়া আর তাসফি ভাবি বসেছেন আমাদের দুটো সিট আগে।

আমাদের বাস ছেড়েছে প্রায় এক ঘন্টা হয়ে গেছে। এই এক ঘন্টায় রেনুমার সাথে কথা বলে যা বুঝতে পারলাম তাতে মনে হলো রেনুমা অনেকটাই চঞ্চল স্বভাবের।মিশুক ও বলা যেতে পারে। তবে মেয়েটা কথা একটু বেশি বলে।ওর এই বেশি কথা বলাটা আমার কাছে মোটেও বিরক্ত মনে হচ্ছে না। কারণ আমিও কোন কথা বলার সঙ্গী পেলে পুরো রাজ্যের কথা বলে ফেলতে পারি। সে দিক দিয়ে চিন্তা করলে কথা আমিও বেশিই বলি। আমাদের দুজনেরই কথা বেশি বলার অভ্যাস আছে বলেই এই ষাট মিনিটের মধ্যে ই জানতে পারলাম রেনুমা সজল রোগে আক্রান্ত।মানে ফুপাতো বোন যখন মামাতো ভাইয়ের প্রেমে হাবুডুবু খায়।মেয়েটা সবে নবম শ্রেণীতে পা দিয়েছে। কিন্তু সপ্তম শ্রেণীতে থাকতেই নাকি সে সজল ভাইয়ের প্রেমে পড়ে গিয়েছে। অর্থাৎ যখন সজল ভাইয়া ফ্রান্সে ছিলেন। রেনুমার এই প্রেমে পড়ার কথা ওদের কাজিন গোষ্ঠী সকলেরই জানা আছে।স্বয়ং সজল ভাইয়া নিজেও জানেন। শুধু বড়রা এ বিষয়ে অবগত নন। এ বিষয়ে সজল ভাইয়ার কথা হলো, সে বাবা মার পছন্দ মতে বিয়ে করবে।তাই রেনুমার থেকে দূরে দূরে থাকে সজল ভাইয়া।রেনুমার কথায় প্রথমে মনে হচ্ছিল এটা ওর কিশোরী মনের আবেগ। তবে এখন মনে হচ্ছে ও সজল ভাইয়া কে ভাল না বাসলেও অতিরিক্ত মাত্রায় পছন্দ করে। কে বলতে পারে হয়তোবা এই অতিরিক্ত মাত্রায় পছন্দ টাই ভালবাসায় পরিণত হবে।

বাস টায় জানালা খোলার কোনো ওয়ে নেই। মোটা কাচঁকে ভেদ করে ই বাইরের দৃশ্য দেখতে হচ্ছে। জানালার পাশে বসে যদি বাইরের দৃশ্য উপভোগ না করি তাহলে তো জানালার পাশে বসাই বৃথা। তবে এই মুহূর্তে বাইরের দৃশ্য দেখার চেয়ে চোখ বন্ধ করে রাখাটাই সমীচীন মনে করছি। কারণ ওই মোটা কাচঁ ভেদ করে বাইরের দৃশ্য দেখতে দেখতে চোখ সহ মাথায় চিনচিন ব্যথা অনুভব করছি।একরাশ বিরক্তি নিয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে সিটে মাথা এলিয়ে দিলাম।

একটু পরেই নাকে একটা পরিচিত সুবাস এসে ভিড় জমাতেই ফট করে চোখ খুলে ফেললাম।আমার মস্তিষ্ক আমাকে যা জানান দিচ্ছে ঠিক তাই হয়েছে। আমার পাশে আলআবি ভাইয়া এসে বসেছেন।দ্রুত পিছনের সিটে তাকাতেই দেখি রেনুমা সজল ভাইয়ার সাথে বসে বসে বকবক করে যাচ্ছে। কিন্তু বেচারি হয়তো খেয়ালই করেনি যে সজল ভাইয়ার কানে ইয়ারপড লাগানো।

ইতোমধ্যে বাসের ভিতরে থাকা লাইট নিভিয়ে দেয়া হয়েছে। অনেকে ঘুমিয়ে ও পড়েছে। মাথার চিনচিনে ব্যাথাটা ধীরে ধীরে গাঢ় হচ্ছে। কথা বলতে মোটেই ইচ্ছে করছে না।তাই আলআবি ভাইয়াকেও জিজ্ঞেস করা হলো না সে এখানে কেন বসেছে।পুনরায় সিটে মাথাটা এলিয়ে দিলাম। হঠাৎ করেই কপালে একজোড়া শক্তপোক্ত হাতের ছোঁয়াতে চোখ মেলে তাকালাম। দেখি আলআবি ভাইয়া আমার দিকে কিছুটা বাঁকা হয়ে বসে আমার মাথায় হাত দিয়ে টিপে দিচ্ছেন। আমি সোজা হয়ে বসে তার হাত সড়িয়ে দিয়ে হড়বড়িয়ে বলে উঠলাম,,,

–কি করছেন আপনি?

তিনি তর্জনী আঙুল টা তার দুই ঠোঁট যুগলের মধ্য বরাবর চেপে ধরে মুখ দিয়ে শব্দ করলেন,,,

–হুঁশশ!!!

তারপর আমার দুই বাহু ধরে আমাকে আগের মতো করে সিটে এলিয়ে দিলেন। কিন্তু আমি তড়িৎগতিতে আবার সোজা হয়ে বসে পরলাম। বসে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,,,

–এমন করছেন কেন?এখানে কি আপনার? আর আমার এই ছোট্ট মাথা টা আপনার ওমন দানবের মতো হাত দিয়ে চেপে ভেঙে ফেলবেন নাকি?

আমার কথাটা শেষ হতে ই আলআবি ভাইয়া হুট করে আমার হাত ধরে উপর পিঠে একটা চুমু খেয়ে বসলেন। ঘটনা টা এতো তাড়াতাড়ি হয়েছে যে আমি বুঝে ওঠার আগেই আমার হাতটা তিনি ছেড়ে দিয়েছেন। আমার হাতটা ছেড়ে দিতেই অনুভব করলাম হাতের উপর পিঠে কেমন যেন ভিজে ভিজে মনে হচ্ছে।যখন বুঝতে পারলাম আসলে ভিজে জিনিস টা কি তৎক্ষণাৎ হাতটা আলআবি ভাইয়ার বাহুতে পাঞ্জাবির সাথে ঘষতে ঘষতে বলে উঠলাম,,,

–ই ছিঃ! খচ্চর লোক!আপনি আমার হাতে থুথু লাগালেন কেন?

— তোমার ভাগ্য ভালো যে তোমার গালে লাগাই নি। এখন আমাকে আমার কাজ করতে না দিলে গালে যেটা লাগাইনি তাও লাগিয়ে দেবো।(আলআবি ভাইয়া)

কথাটা বলেই আর এক মুহূর্ত দেরি করলেন না। আমার দুই কানের উপর তার দুই হাত দিয়ে মাথাটা সিটের সাথে লাগিয়ে দিলেন। আমি তার দিকে আড়চোখে তাকাতেই এক হাত আমার চোখের উপর চেপে ধরে বললেন,,,

-নো মোর টক।

আমি আর কথা বাড়াতে গেলাম না।এমনিও মাথা ব্যাথা করছে। তাই চুপচাপ বসে রইলাম। আলআবি ভাইয়া মাথাটা টিপে দেওয়াতে আস্তে আস্তে ভালো লাগতে শুরু করলো।একপর্যায়ে আমার চোখজোড়ায় গভীর ঘুম নেমে এলো।ঠিক কয় ঘন্টা ঘুমিয়েছি তা বলতে পারবো না।কারণ তখনকার সময় টা মনে নেই।কিন্তু এখন সময় ৪ টা বেজে ৭ মিনিট।এসি এখনও চালু আছে। আমি চোখ মেলতেই নিজের মাথা আলআবি ভাইয়ার কাধের উপর আবিষ্কার করলাম। আমার হিজাব পরিহিত মাথার তালু বরাবর আলআবি ভাইয়ার গাল এসে ঠেকেছে। তিনি এখনো ঘুমে বিভোর। খেয়াল করলাম তার কালো রঙা শালটা আমার উপরে কিছুটা কাঁথার মতো করে দেয়া। ঘুমের রেশ এখনো কাটেনি তাই কিছু সময় এইভাবে চুপচাপ বসে রইলাম। আমাদের পাশের সিঙ্গেল সিটে যে ব্যক্তি বসেছে খেয়াল করলাম ঘুমাতে ঘুমাতে তার মুখ হাঁ হয়ে আছে। আমার দৃষ্টির সীমানা যতদূর যায় ততদূর চোখ বুলিয়ে পরখ করে দেখি সকলেই ঘুমানো। বাইরে এখনো আলো ফোটেনি।আমি আলআবি ভাইয়ার মুখমন্ডল দেখতে পাচ্ছি না কিন্তু এই মুহূর্তটাকে আমার ভালো লাগার তালিকায় লিপিবদ্ধ করে নিচ্ছি। হাত ঘড়িটায় আরও একবার চোখ বুলাতেই দেখি ৪ টা বেজে ১৫ মিনিট। আমার মস্তিষ্ক হঠাৎ করে জানান দিল আমাদের দুজনের এই অবস্থায় থাকাটা অন্য কারো চোখে পড়লে অনেক দৃষ্টিকটু দেখাবে।তাই আমি খুব ধীরে ধীরে সতর্কতার সহিত আলআবি ভাইয়ার মাথাটা সিটের সঙ্গে এলিয়ে দিলাম।তার চোখের চশমা টা খুলে আমার হাতের মুঠোয় নিয়ে নিলাম।শালটাকেও তার গায়ে কাঁথার মতো জড়িয়ে দিলাম।যেই না শালটা জড়িয়ে দিয়ে তার কাছ থেকে সরে আসতে নিলাম ওমনি আলআবি ভাইয়া হুট করে আমার হাত ধরে বসলেন। এমনটা হওয়ায় আমি হকচকিয়ে উঠলাম।আলআবি ভাইয়া আমার দিকে তার ঘুম মাখা ফোলা ফোলা চোখজোড়া দিয়ে তাকালেন।কোথাও একটা শুনেছিলাম দিনের অন্য সময়ের চাইতে নাকি সকালবেলা ঘুম থেকে উঠার পরের মুহূর্তে মানুষের সৌন্দর্য সবচেয়ে বেশি বেড়ে যায়।কথাটা মোটেও আমার কাছে যুক্তিসংগত মনে হতো না। কারণ আমি ঘুম থেকে উঠে মুখে তৈলাক্ত ভাব ছাড়া আর কিছুই খুঁজে পাইনি কোনদিন। কিন্তু আজ এমুহূর্তে মনে হচ্ছে সেই কথাটা আলআবি ভাইয়া সত্যি বলে প্রমাণ করে দিয়েছেন। সত্যি সত্যি আজ এমুহূর্তে আলআবি ভাইয়া কে আমার কাছে সবচেয়ে সুদর্শন পুরুষ বলে মনে হচ্ছে। আলআবি ভাইয়ার কন্ঠ শুনে আমার সম্বিৎ ফিরে এলো।

— আমার ঘুমন্ত অবস্থায় সুযোগ নিতে যাচ্ছিলে?আমাকে বললেই তো পারো ইউ নিড অ্যা হাগ।কামঅন, আসো একটাই তো হাগ ব্যাপার না।

তার কথায় আমি রেগে গিয়ে বললাম,,,

–কি আমি সুযোগ নিতে যাচ্ছিলাম?বরং আপনিই তো সুযোগ নিয়েছেন। আপনিই তো এসে তখন আমার পাশে বসে মাথা টিপতে….

এটুকু বলেই থেমে গিয়ে আবারও বললাম,,,

–দাড়ান! দাড়ান!আপনি তখন আমার মাথা টিপছিলেন কেন?আর আপনি জানলেন কি করে আমার মাথা ব্যাথা করছে।

–এমনি এমনি বাতাসেই তো আর বড় হইনি। তুমি না বললেও তোমার চোখ আমাকে বলে দেয় তোমার কি প্রয়োজন।(আলআবি ভাইয়া)

কথা টা বলে আর এক মুহূর্ত দেরি করলেন না। আমার হাত থেকে তার চশমাটা নিয়ে পিছনের সিটে গিয়ে রেনুমাকে সামনে পাঠিয়ে দিলেন।আলআবি ভাইয়াকে যত দেখছি ততই মনে হচ্ছে তার প্রতি দুর্বল হয়ে পরছি।আমার মস্তিষ্ক বলে তাকে কিছু সময়ের জন্য দূরে দূরে রেখে শাস্তি দেয়া দরকার। কিন্তু মন বলে জুইঁ তাকে আগলে আপন করে নে।তোকে ভালোবাসার মানুষ এর অভাব না হলেও তার মতো করে কেউ তোকে ভালোবাসবে না।

রেনুমা আমার পাশে আসার পর জানতে পারি ওর ভাষ্যমতে,আলআবি ভাইয়া ওকে সজল ভাইয়ার সাথে বসার সুযোগ করে দেয়ার জন্যই সামনে এসে আমার সাথে বসেছেন।

[বান্দরবানের সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি। এ সম্পর্কে জ্ঞান নিতান্তই কম রয়েছে। তাই কিছু কিছু জায়গায় আমি আমার মতো করে কল্পনা থেকে লিখব। আর কিছু কিছু জায়গায় সঠিক ইনফরমেশন দেওয়ার চেষ্টা করবো।যদি কোন ইনফরমেশনে ভুল হয়ে থাকে তাহলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন]

ঘড়িতে যখন ঠিক পাঁচটা বেজে আঠারো মিনিট তখন আমরা বান্দরবানের জেলা শহরে এসে পৌঁছাই।এখান থেকে যে গাড়িগুলো যায় ও গুলোকে মূলত চান্দের গাড়ি বা চাঁদের গাড়ি বলা হয়। চাঁদের গাড়ীতে করে আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে আমরা থাকার জন্য যে রিসোর্ট বুক করেছি সেখানে এসে পৌঁছালাম। এর মাঝে একবার চেকপোস্টে গাড়ি থেমে ছিল।রিসোর্ট থেকে একজন লোক এসে আমাদের রিসিভ করে রিসোর্টের ভিতর নিয়ে গেল। এই রিসোর্টায় মোট বিশটা সিঙ্গেল রুম রয়েছে। প্রত্যেকটা কে বলা হয় ভিলা। আনুমানিক ৪০ থেকে ৫০ মিটার দূরত্বে একেকটা ভিলা স্থাপিত হয়েছে। প্রত্যেকটা ভিলায় দুইজন থেকে চারজনের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। এক নম্বর ভিলায় উঠেছে ফারাবী ভাইয়া আর মিথিলা আপু। দুই নম্বর ভিলায় আলআবি ভাইয়া আর সজল ভাইয়া।তিন নম্বর ভিলায় আমি আর রেনুমা উঠেছি। আর চার নম্বর ভিলায় নিয়াজ ভাইয়া আর ভাবি কে দেওয়া হয়েছে। এর পরের বাকিগুলোতে অন্যান্য কলিগদের দেওয়া হয়েছে।আমার কালকে আলআবি ভাইয়ার রিসোর্ট ওপেনিং এ যাবো।

আমরা যে যে যার যার ভিলায় এসে ফ্রেশ হয়ে নাস্তা করার জন্য বের হলাম। এখানে রিসোর্ট এর ভিতরে খাবারের জন্য ছোটখাটো একটা রেস্টুরেন্ট রয়েছে। যদি সবাই মিলে একসঙ্গে খেতে চাই তাহলে ওরা সেই ব্যবস্থা করে দেবে অর্থাৎ বড় ডাইনিং টেবিলের মতো ব্যবস্থা করে দিবে আবার যদি চাই ছোট টেবিল এর ব্যবস্থা ও করে দিবে। তাই আমরা ৮জন একসঙ্গে খেতে বসলাম।অন্য টেবিলে নিয়াজ ভাইয়ার অফিসের কলিগ চারজন চারজন করে বসেছে। খাবার টেবিলে মিথিলা আপু আর ফারাবি ভাইয়ার সঙ্গে টুকটাক কথা হলো। ফারাবী ভাইয়া আর মিথিলা আপু নিয়াজ ভাইয়ার বোন হিসেবে নাকি আগে থেকেই আমাকে চেনেন। খাওয়ার আগে নিয়াজ ভাইয়া বাবাকে কল করে জানিয়ে দেয় আমরা এখানে পৌঁছে গিয়েছি।

খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে আমরা নিজ নিজ ভিলায় ফেরত আসলাম। আমরা যেই রিসোর্টে উঠেছি তা নীলগিরির খুব কাছেই। আমাদের ভিলার ছোট্ট বারান্দায় দাঁড়ালে নীলগিরির হেলিপ্যাড এর কিছু অংশ এখান থেকেই দেখা যায়। প্রত্যেকটা ভিলাতে ছোটখাটো একটা কিচেন রয়েছে, রাতে রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকলেও যেন এখানে চা কফি বানিয়ে খেতে পারি। এখন বাজে ঠিক সকাল সাড়ে সাতটা। আমরা সবাই রেস্ট নিয়ে ঠিক বারোটার মধ্যে আমাদের দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ করে নামাজের পরে নীলগিরি ঘোরার উদ্দেশ্যে রওনা দিব। যেহেতু আমরা এখানে পিকনিকের উদ্দেশ্য করে আসে নি সেহেতু অন্যান্য কলিগরা তাদের মতো করে ঘোরাফেরা করবে আর আমরা আমাদের মতো ঘোরাফেরা করব।

দুপুরে খাওয়া-দাওয়া সেরে সাদুকে কল দিয়ে জানিয়ে দেই আমরা খুব ভোরে এখানে এসে পড়েছি। ওর সাথে কথাবার্তা শেষ করে যোহরের নামাজ পরে আমরা সবাই নীলগিরির সৌন্দর্য উপভোগ করতে বেরিয়ে পড়ি।

নীলগিরি থেকে ঘোরাফেরা করে আসতে আসতে আমাদের সন্ধ্যা হয়ে যায়।নীলগিরিতে একটা হোটেলে আমরা বিকেলে হালকা পাতলা নাস্তা করে নিয়েছিলাম। নীলগিরি থেকে ফিরে বিশ্রামের পর রাত ৯ টার দিকে রাতের খাবার খেয়ে সবাই ফারাবী ভাইয়া আর মিথিলা আপু ভিলায় জড়ো হলাম। কারন তাদের বারান্দাটা সবচাইতে বড় আর এখান থেকে ভিউ টাও খুব সুন্দর।সবাই মিলে বারান্দাতেই আড্ডার আসর বসিয়ে দিলাম। সবাই বলতে আমি আর রেনুমা বাদে। ভাইয়া,ভাবি আপু ওরা সবাই ওদের ভার্সিটি লাইফের কথা বলছে। মাঝেসাঝে অন্যান্য কথাও বলছে। আমি আর রেনুমা দু’একটা কথা বলছি মাঝখান দিয়ে। ওদের আড্ডায় বসে থাকতে খুব একটা ভালো লাগছে না আবার খারাপও লাগছে না। হঠাৎ করেই সজল ভাইয়া বলে উঠলো,,,

— আলআবি কিন্তু আমাদের ফ্যামিলি সিঙ্গার। আগে কলেজ লাইফে থাকতে মাঝে মাঝে যখন সব কাজিনরা এক হতাম তখন ও থাকতো আমাদের আড্ডার মধ্যমণি। তার কারণ ছিল ওর গান।

–আলআবি শুরু করে ফেল।(ফারাবী ভাইয়া)

–দোস্ত আজকে এই জায়গার মধ্যমনি হয়ে যা।নে শুরু কর।(নিয়াজ ভাইয়া)

ওদের জোরাজোরি তে আর টিকতে না পেরে আলআবি ভাইয়া কোন প্রকার বাদ্যযন্ত্র ছাড়াই খালি কন্ঠে গাইতে লাগলেন,,,

তুমি হাসলে আমার ঠোঁটে হাসি,
তুমি আসলে জোনাকি রাশি রাশি
রাখি আগলে তোমায় অনুরাগে
বলো কিভাবে বোঝাই ভালোবাসি?
সব চিঠি সব কল্পনা জুড়ে
রং মিশে যায় রুক্ষ দুপুরে
সেই রং দিয়ে তোমাকেই আঁকি
আর কিভাবে বোঝাই ভালোবাসি।

প্রাণ দিতে চাই, মন দিতে চাই
সবটুকু ধ্যান সারাক্ষন দিতে চাই
তোমাকে, ও.. তোমাকে।

স্বপ্ন সাজাই, নিজেকে হারাই
আর দুটি নিয়নে রোজ নিয়ে শুতে যাই
তোমাকে, ও.. তোমাকে।

চলবে…………

[বিঃদ্রঃ গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক। অনুগ্রহ করে বাস্তবিক অর্থ খুজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না আর লেখিকা কে ও বিভ্রান্ত করবেন না]

বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-৩২+৩৩+ বোনাস পর্ব

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_৩২

–আপনি আমাকে বর্ষণ সঙ্গিনী হিসেবে মানবেন নাকি জুইঁ হিসেবে মানবেন তা আপনার ব্যাপার। কিন্তু ভুলেও এই মুহুর্তে বউ হিসেবে একদমই মানতে পারবেন না বলে দিলাম।

আলআবি ভাইয়া তার কথা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে আমিও তাকে পাল্টা জবাব দিয়ে দিলাম। দেড় বছর সে আত্মগোপন করে আমার থেকে দূরে দূরে ছিলেন। এবার তাকেও বোঝাবো দূরে দূরে থাকার মজা। আমি তার দিকে তাকিয়ে আমার কথাটা শেষ করলাম। দেখি সে কটমট করে আমার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকিয়ে আছেন। তার এমন চাহনিকে মনে মনে আমি একটু হলেও ভয় পাই। তাই তার দিকে আর না তাকিয়ে আশেপাশে পরখ করতে লাগলাম। তার থেকে চোখ ফিরানো মাত্রই তিনি হুট করে দাঁড়িয়ে ঝুঁকে পড়লেন আমার দিকে। তার এভাবে দাঁড়ানো দেখে আমি হকচকিয়ে তার দিকে তাকালাম। কিছু বুঝে উঠার আগে ই তিনি তার ওষ্ঠদ্বয় আমার কপালে ছোঁয়ালেন তারপর আবার নিজের স্থানে বসে পড়লেন।বসেই বলে উঠলেন,,,

–আর কিছু? কি যেন বলছিলে?

বলেই আমার দিকে তার সেই চিরচেনা ইবলিসি মার্কা হাসি ছুঁড়ে দিলেন। তার আকস্মিক এমন কাজে আর কথায় আমি একরাশ লজ্জা নিয়ে স্তম্ভিত হয়ে বসে রইলাম।তার যে হুটহাট মুড চেঞ্জ হওয়ার ব্যামো রয়েছে তা আমার অজানা নয়। তবে তার এমন আচার-আচরণ আমার ঠিক হজম হচ্ছে না। আমাদের কয়েক হাত দূরে ই পাশের টেবিলে একজোড়া মধ্য বয়স্ক দম্পতি দেখা যাচ্ছে। সাথে রয়েছে তাদের ছয় অথবা সাত বছরের একটা মেয়ে। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই আলআবি ভাইয়ার এমন এহেন কান্ড দেখে ফেলেছেন।তারা মিটমিট করে হাসছেন। যা আমাকে আরও অস্বস্তিতে ফেলে দিচ্ছে। আমি আলআবি ভাইয়া কে কোন জবাব দিলাম না মাথা নিচু করে বসে রইলাম। এর মধ্যে একজন ওয়েটার এসে আমাদের জিজ্ঞেস করলেন আমরা কি খাবো। এখানে মূলত এখন ভাত আর ইলিশ মাছের নানা রকম আইটেম পাওয়া যাবে। এছাড়া তাদের কাছে আর কিছু নেই।আলআবি ভাইয়া কি কি অর্ডার করলেন সেদিকে আমার কর্ণ পাত হলো না।আমি নিরব মনে আশেপাশের মানষ দেখতে ব্যস্ত ছিলাম।আশে পাশে দেখে যা বুঝলাম তাহলো এখানে আগতো প্রায় সব মানুষই হয়তোবা পদ্মা নদীর ওপারে যাবে আর নয়তো পদ্মা নদী পেরিয়ে এসেছে।পেট পূজো হলেই নিজের গন্তব্য মুখী হবে।

বই পুস্তকে পড়া এই পদ্মা নদী আজই প্রথম দর্শন করলাম। প্রিয় মানুষ টার সাথে অপরিচিত স্থানে ঘোরাঘুরি করায় অন্যরকম অনুভূতি জড়িয়ে থাকে। কতগুলো অচেনা মুখের ভিড়ে কেবল একটা চেনা মুখের উপরই থাকে সকল আশা ভরসা।

আমি আলআবি ভাইয়ার মুখোমুখি বসে আছি। একটু পর পর তাকে আড় চোখে দেখে নিচ্ছি। তাকে যে আমি বারবার পরখ করছি সে হয়তো তা বুঝতে পারছেন না। বুঝবেন কি করে, সে তো তার মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত আছেন।তার হাতে মোবাইল দেখে বাসার কথা ফের মনে পরলো।তাই তাকে ডাক দিয়ে বসলাম,,,

–আলআবি ভাইয়া?

আমার ডাকে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে হালকা করে ভ্রুকুটি করলেন তারপর বললেন,,,

–আমি তোমার কোনো জন্মেরই ভাই হই না।তাই এরপর থেকে ভাইয়া ডাক যেন না শুনি।

–আপনি আমার এ জন্মের ই ভাই।এহ্ আসছে ভাইয়া ডাক যেন না শুনি।আপনি যদি আগেই আপনার পরিচয় দিতেন তাহলে হয়তো ভাইয়া ডাকতাম শুনতে হতো না।এখন তো একশো বার বলব ভাই। ভাই! ভাই! ভাই!(আমি)

–তখন তো কপালে ঠোঁটের ছোঁয়া পেয়েছ।এরপর আর একবার ভাইয়া বলে দেখ, ঠোঁটের ছোঁয়া এরপর যেখানে দিব তা তোমার ধারণার বাইরে হবে।(আলআবি ভাইয়া)

আমি নাক মুখ কুঁচকিয়ে বলে উঠলাম,,,

–নির্লজ্জ লোক! দিন দিন মুখটাকেও নষ্ট করে ফেলছেন।

উনি কিছু বলার আগেই একজন লোক এসে গরম গরম ধোঁয়া ওঠা ভাত ভর্তি দুটো প্লেট টেবিলের উপর রাখলেন।এরপর প্লেটে করে রাখলেন ভাজা ইলিশ মাছের সাথে নানান রকমের ভর্তা। আর কথা না বাড়িয়ে খাওয়া শুরু করলাম এভাবে কোন খোলামেলা রেস্তোরাঁয় বসে ভাত খাওয়াটাও আমার জীবনে প্রথম। তাঁর জন্যেই রাত থেকে সকাল পর্যন্ত কিছু নতুন নতুন অনুভূতিকে আলিঙ্গন করতে পারলাম। তেতুল বলতেই যেমন জিভে জল এসে পড়ে তেমন ইলিশ মাছ নাম শুনলেই আমার জিভে জল এসে পড়ে। তাই আশেপাশের কোন খবর না নিয়েই যখন নিজের পেট পূজোয় ব্যস্ত ছিলাম তখন হঠাৎ করে আলআবি ভাইয়ার প্লেটের দিকে চোখ পরল। দেখি উনি বিনা ইলিশ মাছেই কেবলমাত্র ভর্তা দিয়ে ভাত খেয়ে যাচ্ছেন। তাকে জিজ্ঞেস করলাম,,,

— আপনি মাছ নিবেন না?

আলআবি ভাইয়া আমার দিকে কিছুটা অসহায় চাহনি দিয়ে বললেন,,,

— এই মাছে প্রচুর কাঁটা তাই…..

এটুকু বলেই থেমে গেলেন।তারও আর বলার প্রয়োজন হলো না।আমার যা বোঝার তা বুঝে গিয়েছি।আমার জন্মদিনের দিন আমি লক্ষ্য করেছিলাম উনি ইলিশ মাছ নেন নি।সেদিন তার না খাওয়ার পিছনে যে এই কাহিনী ছিল তা আজ জানতে পারলাম।তার পানে একটা মুচকি হাসি দিয়ে সামনে থাকা মাছের প্লেট থেকে এক পিছ মাছ নিয়ে সন্তপর্ণে কাঁটা বেছে বেছে তার প্লেটে উঠিয়ে দিলাম।আমার থেকে এমন ব্যবহার হয়তো তার কাছে একেবারেই অপ্রত্যাশিত ছিল।তিনি আমার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে খাওয়া শুরু করলেন।

ইলিশ মাছের কথা মনে পড়তেই সেদিন রাতের কথাও মনে পড়ে গেল।কথা টা অনেকদিন ধরেই আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সেদিন আমাকে সিঁড়িতে ধাক্কাটা কে মেরেছিল? যদি আলআবি ভাইয়াই হয়ে থাকেন, তাহলে বলতে হয় সে হয়তোবা ছাঁদে থাকতেই তার বাবার মৃত্যু সংবাদ শুনেছেন।তাই তার হিতাহিত জ্ঞান হয়তোবা সাময়িকের জন্য লোপ পেয়েছিল। বাবার এমন একটা সংবাদ শুনে যেকোন সন্তানেরই দিশেহারা অবস্থা হয়ে যাবে।তার উপর আলআবি ভাইয়ার সাথে তার বাবার সম্পর্ক ছিল গভীর বন্ধুত্বের। ওই সময়ে তার ওইরকম আচরণ মেনে নেয়া গেলেও দেড় বছরের আত্মগোপন একেবারে ই মেনে নেয়া যায় না। কোন কারণের জন্য তার এমন করতে হলো? ভেবেই আমি কূল পাচ্ছিনা। আর যদি অন্য কেউই আমাকে ধাক্কা দিয়ে থাকে তাহলে, আমাকে ধাক্কা দেয়ার তার কি উদ্দেশ্য ছিল? মোটকথা সেদিন রাতের ঘটনার কিছুর সাথেই কিছুর যোগ সূত্র খুঁজে পাচ্ছিনা।মনে মনে ভেবে নিলাম তাকে এসম্পর্কে জিজ্ঞেস করব। কিন্তু এখন না। আরো কয়েকদিন পরে। কারন এখন তো আমি তার সাথে দূরে থাকার অভিনয় অভিনয় খেলা খেলবো।

আমার আকাশ কুসুম ভাবনার মধ্যে ই আমাদের খাওয় শেষ হলো। রেস্তোরাঁর বাইরে এসে সামনেই তার সাদা বর্ণের গাড়িটা দাঁড়ানো দেখলাম। গাড়ির বাইরে শাফিন নামের ছেলেটা দাঁড়িয়ে আছে। আমরা দুজনে গাড়ির কাছে যেতেই শাফিন বলে উঠলো,,,

— ভাই আপনার বাইক পাঠিয়ে দিয়েছি আর এই যে গাড়ির চাবি।

বলেই শাফিন আরেকটা ছেলের সাথে একটা বাইকে করেই চলে গেল।শাফিন চলে যেতেই আমি আলআবি ভাইয়া কে প্রশ্ন করলাম,,,

–গাড়ীতে কেন?বাইকেই তো ঠিক ছিলাম।ফুড়ফুড়ে বাতাস খেতে খেতে বাসায় যেতাম।

–হ্যাঁ আর আমি আমার বউয়ের চেহারাটা সবাইকে দেখাতে দেখাতে যেতাম তাই না? (আলআবি ভাইয়া)

–কে আপনার বউ? কীসের বউ? আর আমি তো মাস্ক পড়েই আছি।(আমি)

–আসো দেখাই কীসের বউ।(আলআবি ভাইয়া)

কথাটা বলা শেষেই তার মুখে দুষ্টুমি ভরা হাসির ছাপ দেখতে পেলাম।তিনি একপা একপা করে আমার দিকে এগিয়ে আসতেই আমি দ্রুতগতিতে গিয়ে গাড়ি তে উঠে বসলাম। গাড়ি কিছুদূর যাওয়ার পর আমি আলআবি ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম,,,

— আচ্ছা আমাদের যেতে আর কত সময় লাগবে?

–দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। জ্যামে পড়লে তিন ঘন্টার মতোও লাগতে পারে। (আলআবি ভাইয়া)

এখন প্রায় পৌনে আটটা বাজে। তার মানে বাসায় যেতে যেতে দশটা বা দশটার বেশি বেজে যাবে। আমি আলআবি ভাইয়াকে পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম,,,

— বাবা আর ভাইয়া যখন জিজ্ঞেস করবে কোথায় ছিলাম? বাসায় গিয়ে তখন আমি কি বলবো? (আমি)

–সেটা তোমার ব্যাপার। (আলআবি ভাইয়া)

–কি!!! আমার ব্যাপার মানে? আপনি ই তো আমাকে নিয়ে এসেছেন।(আমি)

— আমি তোমাকে কোন জোরজবরদস্তি করেছি নাকি। বর্ষণ সঙ্গীর নাম শুনেই তো তুমি লাফিয়ে লাফিয়ে চলে আসলে।

এই মুহূর্তে তার উপর খুব রাগ হচ্ছে বলার মত কিছু মুখেও আসছে না। তার দিকে কটমট করে তাকালাম কিন্তু তাতে তার কোনো ভাবান্তর নেই। সে একমনে গাড়ি ড্রাইভ করে যাচ্ছে। কিছু সময় তার দিকে তাকিয়ে থেকে সিটে মাথা এলিয়ে দিলাম। ভাবতে লাগলাম বাসায় যেয়ে কি বলা যায়।

আমার ভাবনার রাজ্য থেকে কখন যে ঘুমের রাজ্যে চলে গিয়েছে তা টের পাইনি। ঘুম ভাঙতেই দেখি আমার জানালার পাশের গ্লাস টা খোলা সেই সাথে আমার চুলের খোঁপা টাও খোলা। জানালা দিয়ে মাঝারি গতির বাতাস এসে আমার চুলকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। মূলত এলোমেলো চুল আমার মুখে আছড়ে পড়ার কারনেই ঘুমটা ভেঙে গিয়েছে। আমার পাশেই লক্ষ্য করলাম আলআবি ভাইয়া একমনে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছেন। গাড়ির স্টিয়ারিং এর সাথে ঝুলছে খোপায় লেপ্টে থাকা বেলি ফুলের মালাটা। মালাটা ওখানে দেখে একটু অবাক হলাম। কারণ আমার মনে হচ্ছে খোঁপাটা খুলে চুল এলোমেলো হয়েছে বাতাসের বেগে। সেই হিসেবে মালাটা আমার চুলে খোলা অবস্থায় থাকতো অথবা নিচে পড়ে যেত। মানে আমার আশেপাশে ই থাকতো। অত দূরে গেল কিভাবে? ওহ নিশ্চয়ই আলআবি ভাইয়া রেখেছেন।মালাটা থেকে এখন তীব্র সুবাস ছড়াচ্ছে না। কিন্তু তাও মৃদু একটা সুবাস ছড়িয়ে আছে পুরো গাড়ি জুড়ে।

প্রায় দশ টার দিকে গাড়ি আমাদের এলাকায় ঢুকলো। কিন্তু আমার বাসার রাস্তায় না ঢুকে সাদুদের বাসার রাস্তার দিকে ঢুকছে। ওদের বাসার রাস্তা দেখে আমি বলে উঠলাম,,,

–এই রাস্তায় কেন ঢুকছেন আপনি? আমাদের বাসার রাস্তা তো পেছনে বা দিকে ফেলে এসেছেন।

আমার কথা শেষ হতে না হতেই গাড়ি সাদুদের বাসার গেটের সামনে থেমে গেল। আলআবি ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,,,

–তোমার বান্ধবীর থেকে গিয়ে যেকোন একটা নোট নিয়ে আসো। এক মিনিটের মধ্যে যাবে আর আসবে। নো গসিপ। বাসায় গিয়ে বলবে তোমার বান্ধবীর বাসায় এসেছিলে নোট আনার জন্য। এতোটুকু বললেই হবে। বাকিটা নিয়াজ সামলে নিবে।

–মানে?নিয়াজ ভাইয়া কি করবে আবার?কি সামলাবে? (আমি)

— তাড়াতাড়ি যাও আমার সময় নেই হাতে।

আমি আর কথা না বাড়িয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। সাদুকে এর আগে আমি আলআবি ভাইয়ার কথা বলেছিলাম। তাই ওকে সবকিছু বলা লাগেনি। শুধু আলআবি ভাইয়ার স্বীকারোক্তি মুখে বলে তারাহুরো করে একটা নোট নিয়ে আবার নেমে পড়লাম। বাসায় এসে আলআবি ভাইয়ার শেখানো বুলি গুলোই বললাম। আজও বর্ষণ সঙ্গীর চক্করে ভার্সিটি মিস হয়ে গেল। বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে বিশাল বড় একটা ঘুমের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে শুয়ে পরলাম।

সন্ধ্যাবেলায় ভাইয়া অফিস থেকে এসেই দারুণ একটা খবর দিলো। নিয়াজ ভাইয়ার ভাষ্য মতে তাদের কনস্ট্রাকশন কম্পানি মানে আলআবি ভাইয়াদের কম্পানি বান্দরবানে তিন বছরের একটা রিসোর্ট প্রজেক্ট শেষ করেছে। এক সপ্তাহ বাদেই রিসোর্টের ওপেনিং সেলিব্রেশন।আমরা মাত্র ছয় দিন পরে ই চার দিনের জন্য পুরো পরিবার বান্দরবান যাচ্ছি। অফিস থেকেই তাকে সকল খরচাপাতি দেওয়া হবে। ভাইয়ার কথায় যেমন খুশি হয়েছি ঠিক তেমনই মনে একটা খটকা লাগছে। ওপেনিং সেরেমানিতে ভাইয়া একলা যেতে পারে বড়জোর সাথে করে ভাবিকে নিতে পারে কিন্তু পুরো পরিবার শুদ্ধ আমন্ত্রিত কেন? যাই হোক আমি এতকিছু দিয়ে আমি কি করব? ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ যখন পেয়েছি তখন আমি শুধু ঘুরে বেড়াবো। রাতে খাবার টেবিলে বাবা জানিয়ে দিল সে যাবেনা। বাবা বলল আমরা তিনজন যেন যাই অনেক জোরাজুরির পরেও বাবাকে রাজি করতে পারলাম না। তাই সিদ্ধান্ত নেয়া হলো আমরা তিনজনেই যাব। ভাবির প্রেগনেন্সির দেড় মাসের একটু বেশি চলছে। তাই আপাতত এই মুহূর্তে ভাবির খুব একটা বেশি সমস্যা হওয়ার কথা না।

রাতে সাড়ে এগারোটার দিকে ঘুমাতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।সে সময় আমার ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের স্ক্রিনে সেই চিরচেনা নামটা জ্বলজ্বল করছে –“বর্ষণ সঙ্গী”।আজ দেড় বছরেরও বেশি সময় পর এই নাম্বার থেকে আবার কল আসলো। অজান্তেই ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। কলটা তাড়াহুড়ো করে রিসিভ করতে গিয়েও থেমে গেলাম। ভাবলাম একটু মজা দেখাতে হবে তাকে। ফোনের সাইলেন্ট মুড অন করে রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। ঘুম তো দূরের কথা চোখের পলকটাই ফেলতে ইচ্ছে করছেনা। একদৃষ্টিতে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে আছি।প্রথমে কলটা রিসিভ করতে ইচ্ছে না করলেও এখন একটু প্রিয় মানুষটার গলার স্বর শুনতে খুব ইচ্ছে করছে। মন আর মস্তিষ্কের যুদ্ধে মস্তিষ্ককের পরাজয় করে ঘোষণা করে চারবারের সময় রিং হতেই কলটা রিসিভ করে বসলাম।

–আসসালামু আলাইকুম। (আমি)

–ওয়ালাইকুম আসসালাম। ফোন ধরতে এতে সময় লাগে কেন?(আলআবি ভাইয়া)

–আমার ফোন,আমার ইচ্ছে। (আমি)

–তোমার দেখছি ইদানীং মুখে খই ফুটছে।ব্যাপার কি?(আলআবি ভাইয়া)

— ব্যাপার হলো আমার এখন ঘুম পাচ্ছে। আপনার সঙ্গে খেজুরে আলাপ করার ইচ্ছে মোটেও নেই।(আমি)

— আমারও তোমার সঙ্গে খেজুরে আলাপ করার কোনো ইচ্ছা নেই। (আলআবি ভাইয়া)

–তাহলে আপনি ফোন দিয়েছেন কেন শুনি? (আমি)

–প্রেম আলাপ করার জন্য(আলআবি ভাইয়া)

— তাহলে বসে বসে আপনার ঘরের মশার সাথে প্রেমালাপ করুন আমি রাখলাম।(আমি)

কথাটা বলেই আর এক মুহুর্ত দেরি করলাম না। সঙ্গে সঙ্গে কলটা কেটে দিলাম। ফোনটা সাইলেন্ট মুডে রেখে দিলাম। তারপর দু চোখের পাতা বন্ধ করে নিলাম। এবার খুব শান্তির ঘুম হবে।

চলবে…………

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_৩৩

২২৩ টা মিসড কল দেখে যেটুকু ঘুম ঘুম ভাব ছিল তাও জানালা দিয়ে ফুড়ুৎ করে পলায়ন করল।এত গুলো কল কেউ কিভাবে দিতে পারে।সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই দেখি আলআবি ভাইয়ার এতগুলো কল। সারারাত ধরে কি আলআবি ভাইয়া না ঘুমিয়ে আমাকে কলই করে গিয়েছেন।তাতে আমার কি?যা হয়েছে, ভালো হয়েছে। একদম উচিৎ শিক্ষা হয়েছে। আমাকে কল করেছেন মাত্র একরাত।আর আমি যে কতগুলো রাত অপেক্ষা করেছি তা?

হালকা পাতলা নাস্তা বানিয়ে খেয়ে আলআবি ভাইয়ার দেওয়া সেদিনের সেই কালো বোরখা আর হিজাব টা গায়ে চাপিয়ে বেড়িয়ে পরলাম।সাদু আর ওর আম্মু কোন এক কারণে ওদের গ্রামের বাড়ি গিয়েছে। ভার্সিটি দুই দিন মিস যাওয়ায় একাই বেড়িয়ে পরলাম।

ভার্সিটিতে কিছু “হায়-হ্যালো”করার ফ্রেন্ড রয়েছে। ওদের সাথে বসেই ক্লাস করলাম।শেষের যে ক্লাস টা হওয়ার কথা ছিল সেটা ক্যানসেল হয়ে যাওয়ায় আমি মনে মনে ভেবে নিলাম নিশাদ ভাইয়ার কাছে যাব। গতদিনের একটা ইম্পর্টেন্ট লেকচার মিস হওয়াতে ই মূলত নিশাদ ভাইয়ার কাছে যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম।নিশাদ ভাইয়া হলো আমাদের এক ব্যাচ সিনিয়র। সেই সাথে ডিপার্টমেন্টের টপারদের মধ্যে একজন।পড়াশোনা বুঝে নেয়া ছাড়া তার সাথে আর অন্য কোনো কারণে সাক্ষাৎ হয় না।ভার্সিটি লাইফেও কিছু শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে, যারা পড়াশোনা ছাড়া কিছুই বোঝে না।তাদের সাথে বন্ধু মহলের পরিবর্তে পাওয়া যায় বইমহল।এই নিশাদ ভাইয়াও ওইসব শিক্ষার্থীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। ক্লাসে গিয়ে তাকে না পেয়ে লাইব্রেরিমুখী হলাম। কারণ এই বান্দার বিচরণ কেবল ক্লাস আর লাইব্রেরিতেই।

লাইব্রেরি তে প্রবেশ করেই দেখতে পেলাম নিশাদ ভাইয়া বইয়ে মুখ গুঁজে আছেন। আমি গিয়ে তার সামনাসামনি বসতেই ঝড়ের গতিতে কেউ একজন এসে আমার পাশে বসে পরলো।তাকাতেই দেখি আলআবি ভাইয়া আমার পাশে বসে বসে হাপাচ্ছেন।তাকে এখানে দেখেই তার ২২৩ টা কলের কথা মনে পরে গেল।হায়!হায়! এখন এখানে বসেই দু-চারটা টা লাগিয়ে দিবে নাকি? সামনে চোখ পড়তেই দেখে নিশাদ ভাইয়া আমাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে। তার চাহনি বলে দিচ্ছি আমাদের দুজনকে তার সামনে বসে থাকতে দেখে তিনি কিছুটা বিরক্ত। আমি যখনই কিছু বলার জন্য উদ্যত হলাম তখন আলআবি ভাইয়া নিশাদ ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,,

— ও যেটা বুঝতে এসেছে তাড়াতাড়ি ওকে সেটা বুঝিয়ে দাও।

আলআবি ভাইয়ার কথা শুনে আমি তার দিকে তাকিয়ে তড়িৎ গতিতে বললাম,,,

–আপনি কি করে জানেন আমি এখানে কিসের জন্যে এসেছি?

— তুমি দিনে কয় কদম ফেলো সেই খবরও আমার কানে আসে।(আলআবি ভাইয়া)

আমাদের কথার মাঝেই নিশাদ ভাইয়া বলে উঠলেন,,,

— আমার মনে হয় আপনাদের দুজনের একটু ব্যক্তিগতভাবে কথা বলে আসা দরকার।

নিশাদ ভাইয়ার কথা শেষ হতেই আলআবি ভাইয়া আমার বাম হাত চেপে ধরে বললেন,,,

–আমি বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র বলে তোমাকে আজ অন্যের কাছ থেকে পড়া বুঝে নেয়ার সুযোগ টা দিচ্ছি।

কথাটা বলেই উনি নিশাদ ভাইয়ার উদ্দেশ্যে বললেন,,,

–ওর যেটাতে প্রবলেম আছে সেটা সলভ করে দাও।

নিশাদ ভাইয়ার কাছে যেহেতু আগেও প্রবলেম সলভ করতে এসেছিলাম সেহেতু ভাইয়া বুঝে গিয়েছেন আলআবি ভাইয়া কিসের কথা বলছেন।আমি যখন কিছু বলতে যাব তার আগেই নিশাদ ভাইয়া বলল,,,

–জুইঁ শুরু করি তাহলে?

আমি আর কোনো কথা বাড়ালাম না।আমার সমস্যা গুলো নিশাদ ভাইয়াকে দেখাতে লাগলাম। আলআবি ভাইয়া সেই যে আমার হাত ধরে রেখেছেন ছাড়ার নাম গন্ধ ও নেই।আমি হাত টা ছাড়ানোর জন্য মোচড়ামুচড়ি করতেই আলআবি ভাইয়া বলে উঠলেন,,,

–কি সমস্যা?

–আপনার কি সমস্যা? এভাবে হাত ধরে রেখেছেন কেন? আমি ভালো ভাবে মনোযোগ দিতে পারছি না আপনার জন্য।(আমি)

কথাগুলো বলতেই আলআবি ভাইয়া হাতটা ছেড়ে দিলেন। হাত ছাড়া পেতেই আমি বইয়ের ওপর পুনরায় চোখ রাখলাম। তৎক্ষণাৎ ই হাতে টান লাগতে আবার ও হাতের দিকে তাকালাম।হাতের দিকে তাকাতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ। আলআবি ভাইয়া তার এক হাতে আর আমার আরেক হাতে হাতকড়া পরিয়ে রেখেছেন। আলআবি ভাইয়ার দিকে তাকাতেই একটা গা জালানো হাসি আমার দিকে ছুড়লেন। ঠোঁটের কোণে সেই হাসি বজায় রেখে বললেন,,,

— এটা কল না ধরার জন্য শাস্তি।

তার কথায় আমি থ হয়ে গেলাম।কি বলছেন উনি এগুলো?এমন শাস্তি তো আমি আমার দাদার জন্মেও দেখিনি। এখন কোন উপায়ও নেই। এভাবেই আমাকে থাকতে হবে। তাই আবার পড়ায় মনোযোগ দিলাম। কোনমতে পড়াটুকু বুঝে তাড়াতাড়ি করে আলআবি ভাইয়াকে নিয়ে লাইব্রেরি থেকে বেরিয়ে আসলাম। এতক্ষণ লাইব্রেরিতে আমরা নিচু স্বরে ই কথা বলছিলাম। বাইরে এসে আলআবি ভাইয়াকে স্বাভাবিক কন্ঠে বললাম,,,

–শাস্তি দিয়েছেন এবার খুশি তো? তাড়াতাড়ি এখন এটাকে খুলুন।আমি বাসায় যাব।

— আমার হাতকড়া, আমার ইচ্ছে। তাই যখন আমার মন চাইবে তখনই খুলবো(আলআবি ভাইয়া)

তার কথা শুনে আমি জোরে বলে উঠলাম,,,

–কি?কি বললেন?

–জানোই তো এক কথা আমি দুবার বলি না।

— ভার্সিটিতে না হয় ঢুকেই গিয়েছেন। কিন্তু আপনি লাইব্রেরি তে কি করে ঢুকলেন আগে সেটা বলুন।(আমি)

— তোমার হাজবেন্ডের পরিচয় দিয়েছি।বলেছি আমি আমার বউকে নিয়ে যেতে এসেছি। (আলআবি ভাইয়া)

–কি? কাকে কাকে বলে বেরিয়েছেন এ কথা?(আমি)

— কাউকে না শুধুমাত্র তোমাদের ভিসি স্যার কে বলেছি।(আলআবি ভাইয়া)

তার কথা শুনে আমার মাথায় বাজ পড়ল।তরতর করে রাগ বাড়তে লাগল। বেশ জোরালো কন্ঠেই তাকে বললাম,,,

–কি সব বলে বেড়াচ্ছেন আপনি?আর ভিসি স্যার কে কি করে বললেন এগুলো? লজ্জা শরমের ছিটেফোটাও তো দেখছি আপনার মধ্যে নেই। দেড় বছরে কি সব খেয়ে ফেলেছেন?

–আরে তার তো জানার অধিকার আছে তার বউমা কে হবে।(আলআবি ভাইয়া)

–মানে?(আমি)

— মানে হল আমরা দূর সম্পর্কের চাচা ভাতিজা।(আলআবি ভাইয়া)

তার কোথায় আমি একটু দমে গেলাম তারপর বললাম,,,

— আপনারা যা ইচ্ছা তাই হন।আপনি কেন বলবেন আমি আপনার বউ? এরপর আর আমাকে উল্টোপাল্টা কথা বলে দেখেন। আমি কিন্তু সোজা গিয়ে নারী উত্যক্তের কেস করব।

আমার কথার তিনি কোনো জবাব না দিয়ে সোজা হেঁটে যেতে লাগলেন। হাতে টান অনুভব করায় আমিও তার পিছু ছুটলাম। তার পিছু পিছু হাঁটছি আর বারবার হাতকড়াটা খুলে দিতে বলছি। কিন্তু তাকে দেখে মনে হচ্ছে আমার কোন কথাই তার শ্রবণন্দ্রিয় পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছাচ্ছে না। ভার্সিটি থেকে বের হয়ে একটা রিকশায় উঠে পড়লেন সাথে আমাকেও টেনে রিকশায় উঠালেন। রিক্সায় উঠে তাকে বললাম,,,

–বাসার সামনে গিয়ে ছেড়ে দিবেন তাইতো? এটা বললেই তো হয়।

এটুকু বলেই আমি আর কোন কথা না বলে চুপ করে বসে রইলাম। আমাদের রিকশার হুডি তুলে দেওয়া। বাইরে পরিবেশ স্বাভাবিক। না আছে রোদ আর না আছে আকাশে মেঘ। সেইসাথে আবহাওয়াটাও বলতে গেলে নাতিশীতোষ্ণ। আমার আর আলআবি ভাইয়ার মাঝখানে দেড়-দুই ইঞ্চির মতো ফাঁকা রয়েছে। তবে তার ডানহাত আর আমার বাম হাত একসাথে মিলানো।

রিক্সাটা আমাদের ভার্সিটি ক্যাম্পাস থেকে একটু এগিয়ে বাসার দিকে না গিয়ে উল্টো পথে চলতে লাগলো। আসলে আলআবি ভাইয়া যখন রিকশায় উঠেছেন তখন রিক্সাওয়ালা মামাকে কি বলেছেন সেটা স্পষ্ট শুনতে পাইনি। অচেনা পথ দেখে আমি বলে উঠলাম,,,

— আরে মামা এই রাস্তা না তো। আপনি তো অন্য রাস্তায় চলে এসেছেন।

তখন রিক্সাওয়ালা মামা পেছনে ফিরে আলআবি ভাইয়ার দিকে তাকালেন। তিনি রিক্সাওয়ালা মামাকে ইশারায় আশ্বস্ত করলেন এই রাস্তা দিয়েই যেতে। তখন আমি আলআবি ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলাম,,,

— আপনার মতলবটা কি? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে?

— এত কথা কেন বল তুমি? মুখ দিয়ে আর একটা শব্দ বের করলে এই রিক্সা সোজা কাজী অফিসে গিয়ে থামবে।জানোই তো কাজী অফিসে কি করা হয়। কি জানো না? (আলআবি ভাইয়া)

শেষের কথাটা বলে তার এক ভ্রু উঁচু করে আমার দিকে তাকালেন।তার কথার অর্থ বুঝতে আমার বেগ পেতে হলো না। তার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বললাম,,,

–সারাদিন বউ বউ আর বিয়ে বিয়ে করা ছাড়া আর কোনো কাজ নেই আপনার?

— কতগুলো কথা বলে ফেললে। এখনতো আমি নিজেও এই রিকশাকে কাজী অফিসে যাওয়া থেকে থামাতে পারবে না।(আলআবি ভাইয়া)

তার কথায় আমার মনের মধ্যে ভয় ঢুকে গেল। কারণ একবার সে যা বলে সেটা করে ছাড়ে। তাহলে কি সত্যি সত্যি উনি আজকেই আমাকে বিয়ে করে ফেলবেন? আমি এখন তাহলে কি করব? রিক্সা থেকে লাফ দিয়ে নেমে দৌড়ে চলে যাবো? হাতটা একটু উঁচু করতেই মনে পড়ল এই খবিশ লোকটা তো সেই রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছেন। এখন আমার কি হবে? এই মানুষরূপী খবিশ টাকে জব্দ করার আগেই কি বিয়ে হয়ে যাবে? রিক্সাটা হঠাৎ থামতেই আমার ভাবনার মধ্যে তালা ঝুলে যায়। রিক্সায় বসা থেকে সামনে দৃষ্টি পড়তেই আমার শ্বাস ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়ে যায়। সামনে একটা সাইনবোর্ড এ কালো রং এর মধ্যে সাদা রং দিয়ে খুব সুন্দর করে নিপুন হাতে লেখা আছে——–“কাজী অফিস”।

আমি ভয়ে ভয়ে একবার সাইনবোর্ড দিকে তাকাচ্ছি আর একবার আলআবি ভাইয়ার দিকে তাকাচ্ছি। তখন আমাকে আলআবি ভাইয়া বলে উঠলেন,,,

— কি হলো চলো দেরি হয়ে যাচ্ছে তো। শুভ কাজে নাকি দেরি করতে হয় না।

আলআবি ভাইয়া আমাকে টান দিয়ে রিক্সা থেকে নামিয়ে নিলেন। রিক্সার ভাড়া মিটিয়ে সোজা কাজী অফিসের দিকে হাঁটা ধরলেন। আমি যেতে না চাইলে এক প্রকার টেনেই সঙ্গে করে নিয়ে চললেন।

চলবে…………

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
“বোনাস পর্ব”

আমার সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আলআবি ভাইয়া হাসতে হাসতে গলে পরছেন।বহুদিন পর তার এমন দম ফাটা হাসি যেমন আমায় মুগ্ধ করছে তেমন কিছুটা রাগও হচ্ছে।রাগটা মূলত হচ্ছে নিজের উপর ই।নিজের বোকামিতে নিজেকে ই এখন মনে মনে বকে চলেছি।

কিছুক্ষণ আগে,,,

আলআবি ভাইয়া আমাকে নিয়ে সোজা কাজী অফিসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। আমি মনে মনে দোয়া দুরুদ যপে যাচ্ছি। ঠিক অফিসটার সামনে আসতেই চোখ বুজে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে উঠলাম,,,

–আমি বিয়ের জন্য এখনো রেডি নই।আমি বিয়ে করব না।

কথাটা বলে চোখ খুলেই দেখি আলআবি ভাইয়া আমাকে নিয়ে কাজী অফিস টা পেড়িয়ে পাশের ছোট গলিটা দিয়ে সুরসুর করে ঢুকে গেলেন।আমি তার দিকে তাকিয়ে তার পিছুপিছুই হেঁটে যাচ্ছি। গলিটার শেষ মাথায় এসে আলআবি ভাইয়া দাঁড়িয়ে পরলেন। তার দিকে হতবাক হয়ে আমাকে তাকিয়ে থাকতে দেখেই এখন এই ভাবে হাসছেন।তার দিকে তাকিয়ে তার হাসি দেখেই বুঝতে পারলাম উনি আমাকে কিভাবে বোকা বানিয়েছেন।

আলআবি ভাইয়া কোনো রকমে হাসি থামিয়ে ব্যঙ্গ করে বললেন,,,

–আমি বিয়ে করব না।

বলেই আবারও শরীর দুলিয়ে হো হো করে হাসতে লাগলেন।আমি রেগে তাকে বললাম,,,

–একদম দাঁত বের করে হাসবেন না।আস্তো খবিশ!!! কোথায় নিচ্ছেন আমাকে?

–খবিশ বলায় তোমার শাস্তির মেয়াদ আরও বাড়লো।ভেবেছিলাম এখনই হাতকড়া খুলে ফেলব কিন্তু মুডটাই তুমি নষ্ট করে দিলে।

তিনি কথা শেষ করে আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ ই দিলেন না। পাশেই আর একটা সরু গলিতে ঢুকে পড়লাম আমরা। এই গলিটারও একেবারে শেষ মাথায় এসে একটা গেটের সামনে দাড়িয়ে পড়লাম আমরা।সামনেই একটা খোলামেলা জায়গায় দেখা যাচ্ছে। যার শেষ প্রান্তে সারি সারি ঘর দেখা যাচ্ছে। সবগুলোই সাদা রং এর সেমিপাকা ঘর।খোলামেলা জায়গায় কিছু বাচ্চারা খেলছে। এক প্রান্তে রয়েছে টিউবওয়েল। কেউ কেউ টিউবওয়েল থেকে পানি নিচ্ছে।কয়েকটা মুরগি এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছে।এখানে না হলেও ২৫-৩০ টা ঘর রয়েছে। আমি যখন এসব দেখতে ব্যস্ত তখন আলআবি ভাইয়া বলে উঠলেন,,,

–যেটা দেখছ এটা আমার ২য় পরিবার।আমার জীবন ওতোপ্রোতো ভাবে ওদের সাথে জড়িত।

আলআবি ভাইয়ার কথায় আমি তার দিকে তাকালাম। দেখি আলআবি ভাইয়া একদৃষ্টিতে খেলতে থাকা বাচ্চা গুলোর দিকে তাকিয়ে আছেন।আলআবি ভাইয়া আবার বলতে লাগলেন,,,

–যে বাচ্চাটাকে দেখছ চোখ না বেঁধেই কানামাছি খেলছে ও চোখেই দেখতে পায় না।

আমি ভালো ভাবে লক্ষ্য করে দেখি সত্যি ই ৭-৮ বছর এর একটা মেয়ে নির্বিঘ্নে কানামাছি খেলে যাচ্ছে চোখ না বেধে ই।আলআবি ভাইয়ার কথায় আবার তার দিকে তাকালাম।

–চার দিন বাদেই বাচ্চা টার আই ট্রান্সপ্ল্যান্ট হবে। (আলআবি ভাইয়া)

আমাকে ইশারা করে একটা ছেলেকে দেখিয়ে বললেন,,,

–ওখানে খেলার দর্শক সেজে বসে থাকা ছেলেটার পায়ের একটা রগ শুঁকিয়ে গিয়েছে। ছেলেটা ভালো করে হাটতে পারে না।দুই দিন পরেই ওর অপারেশন। ওই যে ওখানে দেখ,যে বুড়ো মহিলা টা বসে আছে তার আপনজন বলতে আমি আর এখানে থাকা মানুষগুলো ছাড়া কেউ নেই।টিউবওয়েল এর ওখানে যে মেয়েটাকে দেখছ ওকে ওর ভালোবাসার মানুষটা ধোঁকা দিয়ে বিক্রি করে দিচ্ছিল।এখানে আজ মেয়েটা এসেছে ১৩ দিন হয়েছে। কাল ওকে ওর পরিবার এর কাছে হস্তান্তর করব।ওদিকটায় যে ৩ টা ঘর দেখছ তাতে কিছু পথ শিশু থাকে।ওদের প্রত্যেককেই ৫-৬ বছর বয়সে আমি পেয়েছি। তবে এখন ওরা পথশিশু নয়।

তার কথা আমি একমনে শুনে যাচ্ছিলাম। আলআবি ভাইয়া সামনের খোলামেলা জায়গাটা দেখিয়ে বললেন,,,

–এখানে প্রতিদিন ওদের পাঠশালা বসাই।স্কুলে যা যা শিখে আসে সেগুলো আমাকেও এসে শিখাতে শুরু করে দেয়।সজল আর নিয়াজও মাঝে মাঝে আসে ওদের সাথে আড্ডা দিতে। এই মানুষ গুলোও আমার বাবার আরেকটা পরিবার ছিল।কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো এই মানুষ গুলোকে আমার জীবনে আনতে অনেক দেরি করে ফলেছি।ওদের দেয়া পরিচয় টাই এখন আমার বড় পরিচয় –“বড় ভাই”।

আলআবি ভাইয়া কথাগুলো বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আমাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলেন। আমার কানে এখনো তার বলা কথা গুলো বেজে যাচ্ছে।মুহূর্তে মুহূর্তে তাকে আমি নতুন রূপে আবিষ্কার করছি।আর কত রূপ আছে তার?সারাজীবন এমন একটা মানুষের সাথে থাকার সৌভাগ্য কি হবে আমার?

গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই বাচ্চা গুলো একেবারে মৌমাছির মতো ধেয়ে আসলো আমাদের কাছে।আমাদের পিছনেই শাফিন ভাইয়ার কন্ঠ শুনতে পেলাম।দেখি শাফিন ভাইয়ার হাতে অনেকগুলো চিপসের প্যাকেট আর চকলেট। তার পিছনেই একটা ভ্যানে রান্নার সরঞ্জাম সাথে বাজারও রয়েছে। বাচ্চাগুলোর সাথে কথা বলে বেশ ভালো লাগলো।ওরা বসয়ের চেয়ে একটু বেশিই পাকা।একটা পিচ্চি মেয়ে তো বলেই বসলো,,,

–বড় ভাই এইডা আফনের বউ?

মেয়েটার কথায় আমি থতমত খেয়ে আলআবি ভাইয়ার দিকে দৃষ্টি দিতেই দেখি উনি হাসি হাসি মুখ করে বাচ্চা টাকে বললেন,,,

–সারাজীবনের #বর্ষণ_সঙ্গিনী।

পিচ্চি টার ছোট মাথায় আলআবি ভাইয়ার বলা কথাটার অর্থ বোধগম্য না হলেও আমার ঠিকই বোধগম্য হয়েছে।তার কথায় একটুও বিরক্তি বা রাগ আমার মধ্যে ধারণ করতে পারলাম না।কিছু সময় তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।

হঠাৎ করেই মনে পরলো তাকে তো রাগ দেখাতে হবে।আমি তো তাকে শিক্ষা দিব।তৎক্ষনাৎ আমি একটু মিথ্যে রাগ এনে আলআবি ভাইয়ার দিকে রাগীদৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,,,

–আমি কারো বর্ষণ সঙ্গিনী না।

–আমার জানা মতে তোমাকে তো কেউ কিছুই জিজ্ঞেস করে নি।তাহলে একা একা পাগলের মতো বিলাপ করে যাচ্ছ কেন?(আলআবি ভাইয়া)

আমাকে আলআবি ভাইয়া কোথায় যেন নিয়ে যাচ্ছেন। আমি তার পিছু পিছু হাঁটতে হাঁটতে বললাম,,,

–আপনি কিন্তু আমার কথা এড়িয়ে যাচ্ছেন।আমি পাগ…..

আর কিছু বলতে পারলাম না।আমাকে নিয়ে আলআবি ভাইয়া তার দেখানো সেই বুড়ো মহিলার ঘরের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরলেন। আলআবি ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে মহিলাটি বললেন,,,

–এতো সময় লাগে তোর আহনে।

আমাকে দেখিয়ে আলআবি ভাইয়া বললেন,,,

–ওনার ভার্সিটি থেকে আসতে দেরি হয়েছে।

–কি কিহের থেইকা?(বুড়ো মহিলা)

–ভার্সিটি।(আলআবি ভাইয়া)

আলআবি ভাইয়া জোড়ে কথাটা বললেন। আমি আলআবি ভাইয়াকে আস্তে করে বললাম,,,

–আপনি এতো জোড়ে কথা বলছেন কেন?

–তার কানে একটু প্রবলেম আছে। (আলআবি ভাইয়া)

–ওওহ (আমি)

আমি তাকে হাত দিয়ে ইশারা করে সালাম দিলাম সাথে মুখেও বললাম,,,

–আসসালামু আলাইকুম।

–ওয়ালাইকুম আসসালাম।তুমিই তাইলে জুইঁ?(বুড়ো মহিলা)

আমি মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালাম।তখন আলআবি ভাইয়া দুষ্টমির স্বরে বললেন,,,

–সিতারা বানু কেমন লাগলো?চলবে তো?

–আরে চলবো মানে ফালাইবো।আয় তুই এইহানে বয়।কহন থেইকা দাঁড়াইয়া দাঁড়াইয়া কথা কইতাছোস। (সিতারা বানু)

সিতারা বানু আলআবি ভাইয়া কে চৌকি দেখিয়ে বসতে বলায় আলআবি ভাইয়া গিয়ে বসে পরলেন।হাতে হাতকড়া থাকাতে আমাকেও তার পাশাপাশি বসে পড়তে হলো।আমাকে উদ্দেশ্য করে সিতারা বানু বলে উঠলেন,,,

–কি গো মাইয়া তুমি দেহি আমার নাতিডারে ছাড়া একমুহূর্তও থাকতে পারো না।হাত ধইরাই রাহো দেহি।বুজবার পারছি বেশিই ভালোবাসা তোমগো মইধ্যে।তোমার কতা কইতে কইতেই তো আমার কানডারে ঝালাপালা কইরা একেবারে বয়রা বানাইয়া তুইছে আমারে। এহন থিকা তুমিই তোমার জনরে সামলাও।বহো তোমরা আমি একটু আইতাছি।

সিতারা বানুর কথায় আমি বকাবনে গেলাম।কি বলে গেলেন উনি।হাত পিছনে রাখায় আমাদের হাতকড়া এখনো কারো চোখে পরেনি।আমি আলআবি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি উনি মিটমিটিয়ে হাসছেন।

চলবে…………

[বিঃদ্রঃ গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক। অনুগ্রহ করে বাস্তবিক অর্থ খুজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না আর লেখিকা কে ও বিভ্রান্ত করবেন না]

বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-৩০+৩১

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_৩০

এক মুহূর্তের জন্য মনে হচ্ছে আমি বুঝি দেড় বছর আগে চলে এসেছি। আমাদের ড্রয়িংরুমে নিয়াজ,আলআবি আর সজল নামের তিন যুবক ঠিক সেই দেড় বছর আগের মতো বসে বসে তাদের জমানো কথার ঝুড়ি খালি করছে।আমার এতো অবাক হওয়ার কারণ আলআবি ভাইয়া তার বাবা ইন্তেকালের পর একবারের জন্যেও আমাদের বাসায় আসেন নি।কালকে রাতে ১ম এসেছিলেন।আর সজল ভাইয়া ও আসেন নি।নিয়াজ ভাইয়ার সাথে সজল ভাইয়ার শুধু ফোনেই কথা হতো।তাকে বাসায় আসতে বলা হয়েছে অনেকবার কিন্তু সে নাকচ করে দিয়েছিলেন।আজ অনেক গুলো দিন বাদে সেই পুরনো বন্ধু গুলো এক হয়েছে। কাল রাতের তুলনায় আজ আলআবি ভাইয়ার মুখশ্রী বেশ স্পষ্ট আমার কাছে।দেড় বছর আগের সেই আলআবি ফিরে এসেছে মনে হচ্ছে। আমি পা বাড়িয়ে তাদের নিকটে গিয়ে দাড়ালাম। আমাকে দেখা মাত্রই সজল ভাইয়া বলল,,,

–আরে জুইঁ কই ছিলি এতো সময়?আর আছিস কেমন?

আমি একগাল হাসি এনে বললাম,,,

–আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়া।ভালো আছি অনেক।তুমি কেমন আছো? আর এতো দিন কি আমাদের বাসার রাস্তা ভুলে গিয়েছিলে নাকি?

–তেমন না।আসলে আলআবি ছিল না তাই আমারও আসা হয়নি।(সজল ভাইয়া)

আমি একটু টের চোখে আলআবি ভাইয়ার দিকে তাকালাম। তার চোখে চোখ পরতেই তিনি আমাকে চমকে দিয়ে আমার উদ্দেশ্যে চোখ টিপ মারলেন।এরূপ কাজে আমি আহাম্মক বনে গেলাম। তার থেকে চোখ সড়িয়ে অন্য দিকে দৃষ্টি রাখলাম।যতটুকু সময় ড্রয়িংরুমে ছিলাম তার দিকে তাকানোর সাহস করলাম না।

আলআবি ভাইয়ারা দুপুরের খাবার খেয়ে চলে গেলেন। তারা চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।যতটুকু সময় তারা ছিলেন তাতে আলআবি ভাইয়ার কর্মকান্ডে বেশ অবাক হয়েছি।তার এরূপ কর্মকান্ড আমি আমার জন্মে এই প্রথম দেখলাম। যেমন, দুপুরে খাওয়ার টেবিলে—–

আমি চেয়ার টেনে বসতেই হুট করে আলআবি ভাইয়া এসে আমার পাশের চেয়ারে বসে পরলেন।প্রত্যেকের জন্য ই আলাদা করে গ্লাস রেখেছি টেবিলে।সেই সুবাদে আমারও একটা গ্লাস আর আলআবি ভাইয়ার ও একটা গ্লাস ।কিন্তু আলআবি ভাইয়া আমার গ্লাস থেকে ইচ্ছে করে তিন বার পানি খেলেন।১ম বার যখন খেলেন আমি মনে করলাম ভুলবশত হয়ে গেছে তাই তাকে আমি তার গ্লাস দেখিয়ে দিলাম কিন্তু তাতে কোনো লাভই হলো না।

আবার আমি যখন এটা ওটা নেয়ার জন্য হাত বারাচ্ছি তিনি তখন সবার সামনে আমার নাম ধরে বলছেন জুইঁ এটা দেও তো, জুইঁ ওটা দেও তো, জুইঁ কাটা ফালাবো কোথায়? জুইঁ জুইঁ করে আমার মাথা টা খেয়ে ফেলছেন। এমনিতে তো উনি সবার সামনে কথা কম বলেন।আর বাবার সামনে তো আরও কম।কিন্তু আজকে এমন ভাবে পটর পটর শুরু করেছেন যে থামার নামই নিচ্ছেন না।

আবার খাওয়া শেষ করে যখন বেসিনে হাত ধুতে আসলাম তখন হ্যান্ডওয়াশে প্রেস করে হাতে হ্যান্ডওয়াশ নিয়ে যখনই হাতটা সরিয়ে নিতে যাব তখনই আলআবি ভাইয়া এসে আমার বৃদ্ধাঙ্গুলির উপরই তার বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে আরেকবার প্রেস করলেন যার ফলে পরিমাণের চেয়ে বেশি হ্যান্ডওয়াশ আমার হাতে পরে যায়।তখন আলআবি ভাইয়া বলেন,,,

–ও সরি!বেশি হয়ে গিয়েছে তাই না?

বলেই উনি ওনার এঁটো হাত টা দিয়ে আমার এঁটো হাতে থাকা কিছু পরিমান হ্যান্ডওয়াশ নিয়ে নিলেন।তার কাজে আমি তার দিকে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে রইলাম ।তার কাজে মনে হচ্ছিল এটা সত্যি ই আলআবি ভাইয়া তো?চোখের পলকে সে পাল্টে গেলেন কীভাবে?মাথার মধ্যে শুধু আলআবি ভাইয়া আর তার কৃতকর্ম গুলো ভনভন ভনভন করছে।

বিকেলবেলা আমি, ভাবি আর নিয়াজ ভাইয়া ছাঁদে বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম।আজ নিয়াজ ভাইয়ার অফ ডে।তাই আমাদের ছাঁদে বসে আড্ডা দেয়ার প্ল্যান করা। আড্ডা দেয়ার এক পর্যায়ে আলআবি ভাইয়ার একটা কথা মনে পড়ে গেল। তার চাকরি নিয়ে যখন কথা বলেছিলাম তাকে খুব রেগে যেতে দেখেছিলাম।নিয়াজ ভাইয়া কে ফুরফুরে মেজাজে দেখে জিজ্ঞেস করে বসলাম,,,

–আচ্ছা ভাইয়া আলআবি ভাইয়াকে হঠাৎ করেই চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল কেন?

আমি জানি আলআবি ভাইয়া নিজে থেকে রিজাইন দিয়েছিলেন। ভাইয়াও এখন এই উত্তরটাই দিবে। কিন্তু কেন রিজাইন দিয়েছিলেন সেটা আমাকে জানতে হবে। তাই ভাইয়াকে প্রশ্নটা একটু ঘুরিয়েই করলাম।

–তোর বাসা থেকে তোকে কেউ তারিয়ে দেবে?(নিয়াজ ভাইয়া)

–মানে?(আমি)

— মানে হল দীর্ঘদিন ধরে যে অফিসে কাজ করে আসছি সেটা আলআবির বাবার অফিস। ওর বাবা আমাদের অফিসের ৭০%শেয়ার হোল্ডার।আর ও চাকরিটা ছাড়েনি।শুধু সশরীরে অনুউপস্থিত থেকে কাজ করছে।

ভাইয়া কথাটা শেষ করে একটু থেমে পুনরায় বলতে লাগলো,,,

–শোন মজার ব্যাপার হলো ও যখন ওর সার্টিফিকেট পেয়েছে মানে পড়ালেখা শেষ করে কোম্পানিতে জয়েন করে তখন জানতে পারে কোম্পানির ৭০% শেয়ার হোল্ডার ওর বাবা।আলআবির বাবা নিজেও কখনো বিলাসিতা কে ভোগ করেন নি আর আলআবিকেও বিলাস পূর্ণ অবস্থায় রাখেননি। সবসময় মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো জীবন যাপন করিয়েছে ওকে। ওর বাবার ধারণা ছিল ছেলেকে দুহাতে ইচ্ছামত টাকা উড়াতে দিলে ছেলে বখে যাবে। সব সময় আদর্শ বাবার আদর্শ ছেলে হিসেবে থেকেছে আলআবি। বাবা ছেলে দুই বন্ধুর মত ছিল।সজল একবার আমাকে বলেছিল আলআবি কলেজে থাকতে মারামারির ওস্তাদ ছিল। ওর জন্য বাসায় নালিশ আসত। কিন্তু এমন নয় যে রাস্তাঘাটে মারামারি করে বেড়াতো। সব সময় ওর বিরুদ্ধে খারাপ লোক গুলোই নালিশ নিয়ে আসতো। ওর বাবা কি করতো জানিস, লোকগুলোকে বলতো ছেলেকে বুঝিয়ে বলবে এটা বলে বিদায় করে বাপ ছেলেকে এসে বলতো যা যা করেছিস একদম ঠিক কাজ করেছিস অন্যায় কে কখনোই প্রশ্রয় দিবি না। খুব বড় ধরনের মারামারি বাধতো না বলে ঝামেলা বাড়িতে নালিশ অব্দিই চুকে যেত।

–তার মানে আলআবি ভাইয়া আঙ্কেলের চলে যাওয়াতে খুব কষ্ট পেয়েছে তাই না

–হ্যাঁ। পৃথিবীতে কোন বাপ ছেলে একসাথে সিগারেট খায় বলতো? আলআবি আর ওর বাবা আমার চোখে প্রথম দেখা বাপ ছেলে ছিল যারা দুজনকে একসঙ্গে সিগারেট ফুঁকত। ও ওর বাবাকে হারিয়ে জীবনে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা খেয়েছে। তার কারণ কি জানিস? ওর বাবাকে………

নিয়াজ ভাইয়া কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারল না সঙ্গে সঙ্গে ভাইয়ার ফোন বেজে উঠলো ফোনে কথা বলতে বলতে সোজা নিচে চলে গেল সম্পূর্ণ কথাটা শোনা হলো না। কিন্তু আলআবি ভাইয়ার জন্য এখন খুব খারাপ লাগছে। আমার সাথে আমার মায়ের খুব বেশি স্মৃতি ছিল না। কম সময়ের স্মৃতি গুলো কে আঁকড়ে ধরে আমি আজো মায়ের জন্য কান্না করি। তাহলে আমার থেকেও তো করুন অবস্থা আলআবি ভাইয়ার। কারণ তার পুরো আঠাশ টা বছরের স্মৃতি জড়িয়ে আছে তার বাবার সাথে । আঠাশ বছরের স্মৃতি হয়তোবা এখনো তাকে কুড়েকুড়ে খায়।

এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে আমরা কখনোই নিজেকে সুখী বলে মানতে পারব না যতক্ষণ না অন্য কোন মানুষের কষ্টের কথা শুনতে পাবো। একটা মানুষকে নিজের থেকে দ্বিগুন কষ্টে দেখলে তখনই আমরা উপলব্ধি করতে পারব এই মানুষটার থেকে আমরা ঢের সুখে শান্তিতে আছি।

সময়ের কাটা ঘুরতে ঘুরতে এক সপ্তাহ শেষ করে ফেলেছে। এই এক সপ্তাহের মধ্যে আমার চোখ জোড়া আর আলআবি নামক মানুষটার দেখা পায়নি। ভার্সিটি থেকে বাসায়, বাসায় থেকে ভার্সিটি। এমন করেই এক সপ্তাহ চলে গিয়েছে। না পেয়েছি বর্ষণ সঙ্গীর কোন খবর।

রাতে ঘুমন্ত অবস্থায় মনে হচ্ছে কেউ আমার পায়ের পাতায় সুড়সুড়ি দিচ্ছে। ঘুমের থেকে লাফিয়ে উঠে পরলাম। আমার সুড়সুড়ি একটু বেশিই।তাই ঘুম যতই গভীর থাক না কেন সুরসুরি অনুভব হলেই ঘুম তার চৌদ্দগুষ্টি নিয়ে আমার চোখের উপর থেকে পলায়ন করে।

আমার ঘুম ছুটতেই দেখি আলআবিব ভাইয়া আমার পড়ার টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারটা উপর আয়েশি ভঙ্গিতে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছেন। তাকিয়ে দেখে হড়বরিয়ে বিছানা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। পাশ থেকে দ্রুত ওড়না টা নিয়ে ভালোভাবে গায়ে জরিয়ে নিলাম।তারপর আলআবি ভাইয়ার দিকে ক্ষুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললাম,,,

–এতো রাতে একটা মেয়ের ঘরে কি আপনার?হুটহাট এভাবে চলে আসেন কেন?

তিনি হুট করে আমার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন। তারপর বললেন,,,

— যাবে আমার সাথে?

রাগের সহিত আমি তাকে বললাম,,,

— রাত-বিরাতে আমি আপনার সাথে কোথায় যাব?আর রাত এখন কয়টা বাজে জানেন আপনি?

–সরি! আজকে ঘড়ি পড়তে মনে নেই। তাই বলতে পারছি না।(আলআবি ভাইয়া)

তার এই কথাটা আমার রাগে ঘি ঢালতে যথেষ্ট ছিল। আমি রাগে গজগজকরতে করতে তাকে আমার দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ইশারা করে বললাম,,,

–এখন রাত তিনটা বেজে দশ মিনিট। এত রাতে আপনার এখানে আসার মতলবটা কি?

–মতলব কিছুইনা।আজ বর্ষণ সঙ্গীর সাথে দেখা হলেও হতে পারতো। যাই হোক ভালো ভাবে নাক ডেকে ঘুমাও আমি চললাম।

আমি আলআবি ভাইয়ার কথা শুনে তড়িৎ গতিতে বলে উঠলাম,,,

–কোথায় নিয়ে যাবেন নিয়ে চলুন। আমি দুই পায়ে দাঁড়া

আমার কথা শেষ হতে না হতেই আলাবি ভাইয়া আমার হাত ধরে আমাকে বারান্দায় নিয়ে আসলেন। আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলাম,,

— দাঁড়ান আমি একটু পরিপাটি হয়ে নেই। মুখটা অন্তত ধুয়ে নেই।

–কোন দরকার নেই। তোমার বর্ষণ সঙ্গী তোমাকে এই ভাবেই পছন্দ করে। তার কথায় আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। কারণ ঘুমিয়ে থাকার ফলে আমার মুখটা একটু ভার ভার হয়ে আছে। সেইসাথে চুলে অগোছালো একটা হাত খোঁপা বাঁধা পরনে আমার কুঁচকে যাওয়া একটা নীল রঙের সুতি থ্রি পিস। এই মুহূর্তে যে আমাকে ভিকারিবেশ থেকে কম লাগছে না তা আমি ভালই বুঝতে পারছি। এই রূপে আবার কেউ কাউকে কিভাবে পছন্দ করতে পারে? আম আলআবি ভাইয়াকে বলে উঠলাম,,,

–তাহলে বোরখাটা পড়ে নেই? বেশি সময় লাগবে না।

আলআবি ভাইয়া আমাকে একটা ধমক দিয়ে বললেন,,

— এই মেয়ে! বললাম না কিছু দরকার নেই। বিয়ে করতে তো আর যাচ্ছো না।

বলেই উনি আমার পিছনে দাঁড়িয়ে পরলেন।তারপর ওড়না টা দুই হাত দিয়ে আমার মাথায় ঘুমটা তুলে দিলেন।তার এই দু দিনের ব্যবহার আমার ঠিক হজম হচ্ছে না।আমাকে আরও অবাক করে দিয়ে উনি সেইদিন যে মইটা বেয়ে উঠেছিলেন সেই মইটা দেখিয়ে বলে উঠলেন,,,

–এখান দিয়ে সাবধানে নামো।

–এখান দিয়ে নামবো মানে? আমাকে কি আপনি পাগল পেয়েছেন নাকি? এখান দিয়ে নেমে যাব টা কোথায়?(আমি)

–পাতালে যাবো।ইডিয়েট একটা।নামতে বলেছি নামো।

তার ফিসফিসে হুংকার শুনে তাড়াতাড়ি করে আমি রেলিং টপকে মইয়ের উপর দাঁড়ালাম। সাহস করে এসে তো পড়েছি কিন্তু এখন নিচের দিকে তাকালেই ভয় লাগছে। তাই কোন প্রকার দ্বিধা না রেখেই আমার সামনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা আলআবি ভাইয়ার হাত দুটো খপ করে ধরে ফেললাম। আমি ভয় পাচ্ছি তা হয়তো উনি টের পেয়েছেন।তাই আমার সঙ্গে সঙ্গে আলআবি ভাইয়া ও আমার হাত ধরে ধরে নেমে আসলন।

নিচে নেমে ঐদিন আলআবি ভাইয়ার উধাও হওয়ার ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। আসলে যে বরাবর মইটা রাখা সেখানেই একটা ছোট্ট কালো রংয়ের দরজার রয়েছে।এই দরজা দিয়ে ঢুকলে এই বাড়িটার গ্রাউন্ড ফ্লোরের দেখা মিলবে। অর্থাৎ বলতে গেলে এটা এই বাড়ির পেছনের দরজা। এখানে দিয়ে ঢুকে বাড়ির মেইন গেট দিয়ে বের হওয়ার ব্যবস্থা আছে। আমি মনে মনে ভাবছি হয়তোবা আমরা এখান দিয়েই ঢুকবো। কিন্তু আমার ভাবনায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে আলআবি ভাইয়া আমাকে বললেন,,,

–উঠে পড়ো।

পিছনে ঘুরে দেখি আলআবি ভাইয়া বিলের কিনারে একটা ছোট খেয়া নৌকার উপরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রায় সময়ই আমি এমন একটা নৌকা দেখে থাকি এখানে। তবে এই নৌকা টাই দেখি কিনা তা আমার অজানা।নৌকা আমার কোনদিনই বিরক্তির কারন হয়ে ওঠেনি। নৌকায় চড়ে ঘুরতে আমার বেশ ভালো লাগে। তাই এই মুহূর্তে মনে একরাশ উৎফুল্লতা নিয়ে উৎকণ্ঠা হয়ে বলে উঠলাম,,,

–দাড়ান! দাড়ান! আমি আসছি।

যখনই আমি পা বাড়াতে যাব ঠিক তখনই আলআবি ভাইয়া তার হাত আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন। তার হাত বাড়িয়ে দাওয়াতে মনে হলো তিনি আমার দিকে হাত না বাড়িয়ে একরাশ মুগ্ধতা বাড়িয়ে দিয়েছেন। তার আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দাওয়াতে আমার মনে আনন্দেরা উকিঝুকি মারছে। মনের মধ্যে মুগ্ধতা নিয়ে আমিও আমার হাত বাড়িয়ে দিলাম তার হাতের উপর। তার হাতে ভর দিয়ে নৌকায় উঠে পড়লাম। নৌকায় উঠে দেখি আলআবি ভাইয়া আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন। তাই তাড়াতাড়ি করে হাতটা সরিয়ে নিলাম। সে যদি এই মুহূর্তে আমার দিকে না তাকাতেন তাহলে হয়তোবা লজ্জা পেতাম না। কিন্তু তার দৃষ্টি আমাকে এখন লজ্জা দিচ্ছে। তাই যেখানে আছি সেখানেই চুপ্টি করে বসে পড়লাম। আলআবি ভাইয়া আমি যেখানে বসে আছি তার থেকে একটু দূরে গিয়ে নৌকার এক মাথায় বসে হাতে বৈঠা নিয়ে নৌকা চালানো শুরু করলেন। তাকে নৌকা চালাতে দেখে বিস্ময় নিয়ে বলে উঠলাম,,,

–আপনি নৌকা চালাতে পারেন?

আলআবি ভাইয়া একটু ভাব নিয়ে বললেন,,,,

–নৌকা থেকে শুরু করে প্লেন পর্যন্ত চালাতে পারি।

তার গুজবে কান না দিয়ে পরিবেশটাকে উপভোগ করতে লাগলাম। পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ এসে বারবার কানে বাজনা বাজিয়ে যাচ্ছে। সেইসাথে আকাশে মেঘেরা ও একটু পরপর উকিঝুকি মারছে। এই বিলের পানি থেকে অদ্ভুত একটা পানির গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা দিচ্ছে।গন্ধটা অসহ্য কর নয় বরং সহ্য কর। হয়তো বা পানির এই গন্ধটা না থাকলে এই মুহূর্তের পরিবেশটা খাপছাড়া হয়ে যেত। ভাবতেও অবাক লাগে যে বিলের পানিতে আজ নৌকায় চড়ে অজানা গন্তব্যে যাচ্ছি, সেই বিলের পানি ই বর্ষা শেষে নেই হয়ে যাবে। হঠাৎ করে একফোঁটা পানি আমার হাতের উপর পড়তেই চারপাশে তাকিয়ে দেখি টিপটিপ বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এই বৃষ্টি আমাদের শরীর ভেজানোর কোনো ক্ষমতা রাখেনা। খুব স্বল্প মাত্রায় ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছে। এর মাঝে কয়েকবার আমার আর আলআবি ভাইয়ার মধ্যে চোখাচোখি হয়েছে। তবে যতবারই আমি তার দিকে টের চোখে তাকিয়েছি ততোবারই দেখেছি সে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে।

কিছু সময় অতিবাহিত করে আমরা বিলটা পাড়ি দিয়ে একটা মেইন রোডে এসে উঠলাম। পূর্বের ন্যায়ই আমার হাত ধরে আলআবি ভাইয়া নৌকা থেকে আমাকে নামতে সাহায্য করলেন। এতক্ষণে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তবে আবার যে দেখা দিবে না তার কোন নিশ্চয়তা নেই। রাস্তার ধারে দেখতে পেলাম আলআবি ভাইয়ার সেই পুরনো রয়েল এনফিল্ড বাইক টা কারো অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে।
বাইকের কাছে এগিয়ে গিয়ে ভাইয়া বলে উঠলো,,,

— এখন অনেকটা পথ পাড়ি দিব। অনেক দূর পর্যন্ত যেতে হবে। তোমার কিছু লাগলে অথবা কোন সমস্যা থাকলে বলতে পারো।

আমি তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললাম,,,

— আমার বর্ষণ সঙ্গীর জন্য যত দূর যেতে হয় যাব।

আমার বলা কথাটা শেষ হতেই আলআবি ভাইয়া বাইকে ঝুলে থাকা হেলমেটটা পড়ে নিলেন। আমাকে তার পিছনে উঠতে বললে আমিও উঠে পড়লাম। আমি বাইকে উঠে বসতেই আলআবি ভাইয়া বাইক স্টার্ট দিলেন। চলতে লাগলাম আমার অজানা আর আলআবি ভাইয়ার জানা গন্তব্যে। আশেপাশের দোকানপাট সব বন্ধ। মাঝে মাঝে ছোট ছোট চায়ের টং গুলোর দু একটা খোলা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। রাস্তাঘাটে মানুষ নেই বললেই চলে। রয়েছে দূরপাল্লার কিছু ট্রাক। হলুদ ল্যাম্পপোস্টের আলোতে আমার আর আলআবি ভাইয়ার জামার আসল বর্ণ পাল্টে অন্য বর্ণ ধারণ করেছে। একটা জিনিস খুব সূক্ষ্মভাবে আমার কাছে পরিলক্ষিত হলো।তা হলো আলআবি ভাইয়া আজকে বাইকটা অন্যান্য দিনের তুলনায় একটু জোরে ড্রাইভ করেছেন। যার দরুন আমি নিজের ভারসাম্য সামলাতে না পেরে আমার একহাত আলআবি ভাইয়ার কাধে রেখে বসে আছি। বাতাসের বেগ এসে আমার মাথার ঘোমটা ফেলে দিয়েছে বহু আগে।

চলবে…………

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_৩১

দীর্ঘ ২ ঘন্টার মতো পথ অতিক্রমের পর আলআবি ভাইয়া তার বাইক টা বন্ধ করে দেন।চারপাশে নীলাভ আলোরা লুকোচুরি খেলায় মেতে উঠেছে।এই আবছা নীলাভ আলোতেই বুঝতে পারছি আলআবি ভাইয়া যে রাস্তায় বাইক থামিয়েছেন তার আশে পাশে বাস টার্মিনাল।আলআবি ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে আমি বলে উঠলাম,,,

— কোথায় এসেছি আমরা?

আলআবি ভাইয়া আমার হাত ধরে হাঁটা শুরু করে আর বললেন,,,

–গেলেই দেখতে পাবে।

কিছুটা আগানোর পর আলআবি ভাইয়া আমার হাত ছেড়ে দিয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে পরলেন।আমাদের সামনে বিশাল বড় এক জলরাশি। আলআবি ভাইয়া বললেন,,,

–এটা পদ্মা নদী। তুমি এখন মাওয়া ঘাটে।

আশেপাশে পরখ করে দেখি এদিকটায় মানুষের সমাগম খুব একটা নেই। তবে বাস টার্মিনালের ওখানে মোটামুটি মানুষ ছিল।আলআবি ভাইয়া আমাকে ইশারা করে সামনে দেখালেন।সামনে তাকাতেই চোখ জোড়া জুড়িয়ে গেল। ভোর বেলার সূর্যের উদয়ের সময়ে পরিবেশে মৃদু সূর্যালোক ছড়িয়ে পড়ছে। তবে সূর্যটা দিগন্তের নিচে অবস্থান করেছে। সূর্য টা দেখা না গেলেও সূর্যের অবস্থান কোনদিকে তা বুঝিয়ে দিচ্ছে তার লালাভ আলোর রেখা।সূর্যের একাংশ দিগন্তের উপরে চলে আসছে এবং তা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে উঠছে। অজান্তেই ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির ছাপ পরলো।এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি রক্তিম আভার দিকে।সময় যত অতিবাহিত হচ্ছে রক্তিম বৃত্ত ততই তার রূপ স্পষ্ট করে তুলছে।আশেপাশে থেকেই কানে ভেসে আসছে দক্ষ কন্ঠের মুয়াজ্জিনের আযানের ধ্বনি।আযান শেষ হতেই সূর্য তার পরিপূর্ণ রূপে উদিত হলো।নদীর পানিতে ভেসে উঠেছে সূর্য্যি মামার চোখ ধাঁধান স্বর্নালী অবয়ব।নদী তার চকচকে সোনালী বর্ণের পানিতে দৃষ্টি দিতে বারণ করছে।

হঠাৎ করেই খেয়াল করলাম আমার ঢিলে হাত খোঁপা টা সম্পূর্ণ রূপে খুলে গেছে।মনে হচ্ছে কেউ আমার চুলে হাত গলিয়ে দিয়ে খোঁপা করছে।ঘাড়ে একটা বলিষ্ঠ হাতের ছোঁয়ায় আমি খানিক কেঁপে উঠলাম।পাশে লক্ষ্য করতেই দেখি আলআবি ভাইয়া নেই।বুঝতে দেরি হলো না আমার পিছনে কে দাঁড়িয়ে খোঁপা করছে।খোঁপা করা শেষ হতেই মনে হলো খোঁপায় কিছু একটা গুঁজে দেওয়া হচ্ছে।

মিহি একটা কন্ঠ এসে কানে বাজতেই শুনতে পেলাম,,,

–হবে কি আমার সারাজীবনের বর্ষণ সঙ্গিনী?হবে কি তোমার বর্ষণ সঙ্গীর #বর্ষণ_সঙ্গিনী?

কথাটা কর্ণপাত হতেই আমার চোখ জোড়া অশ্রুসিক্ত হয়ে আসতে চাইল। এই মুহূর্তে কারো মুখে কোন কথা নেই। সেই একই ভঙ্গিমায় দুজন দাঁড়িয়ে আছি। হৃদপিণ্ড ক্রমশ তার ধুকধুক শব্দের বাজনা বাজিয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তেটার অনুভূতি আমার কাছে অবর্ণনীয়। পৃথিবীর কোনো ভাষাতেই প্রকাশ করে বোঝাতে পারবোনা কতটা সুখ মনে দোলা দিচ্ছে। চোখের অশ্রুবিন্দু কে আর ধরে রাখতে পারলাম না। দরদরিয়ে গাল বেয়ে পানি পড়তে লাগল।একেই বুঝি বলে সুখের কান্না। এই মাহেন্দ্রক্ষণেরই তো অপেক্ষায় ছিলাম আমি।

দুই বছর ধরে যাকে আমি ভালবেসেছি তাকে আমি চিনব না কি করে?আমার বর্ষণ সঙ্গীকে তো চিনে গিয়েছিলাম সেদিনই যেদিন তার অফিসে বসে শাল সেলাই করেছিলাম।আমি এতটাও বোকা নই (যতটা হুমাশার পাঠক পাঠিকারা ভাবে)।সেদিন তার অফিসে তার হাতের সেই গোটা গোটা লেখা আমাকে বলে দিয়েছিল কে আমার বর্ষণ সঙ্গী। হাতের লেখা এক ব্যক্তির সঙ্গে আরেক ব্যক্তির মিল থাকতেই পারে তবে অবিকল একই রকমের হয় না। সেদিন আমি আমার বর্ষণ সঙ্গীর হাতের লেখা চিনতে মোটেও ভুল করিনি। ওইদিনই ভেবে নিয়েছিলাম আলআবি ভাইয়াই আমার অদেখা বর্ষণ সঙ্গী। তবে তার আচার-আচরণে খুব একটা নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। আর তাকে পরীক্ষা করে নিশ্চিত হওয়ার সুযোগও পাচ্ছিলাম না। ঠিক সেই সময়ে নিয়াজ ভাইয়া যখন বলে আমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে তখনই সঠিক সুযোগটা পেয়ে যাই। ইচ্ছে করেই তার দেয়া শাড়িটা পড়ে যাই। সেদিন ভেবে নিয়েছিলাম যদি আলআবি ভাইয়া আমাকে একটু পরিমাণ হলেও ভালোবাসেন তাহলে ঠিকই আসবেন। আর সে এসে তার বোকামির পরিচয় ও দিয়েছেন। আগে নিশ্চিত না থাকলেও সেদিন নিশ্চিত হয়ে যাই় আমার বর্ষণ সঙ্গী আর কেউ নয় বরং আলআবি ভাইয়াই।

তার হাতের লেখা দেখার পর থেকেই যতবার তার সঙ্গে দেখা হয়েছে ঠিক ততবারই আমার মন বলেছে এই বুঝি সে বলবে “আমি ই তোমার বর্ষণ সঙ্গী”কিন্তু সে বলেনি। তার মুখ থেকে শোনার অপেক্ষায় ছিলাম আমি। আজ তা সার্থক হলো। কিন্তু তার এত অভিনয় এর পেছনের কাহিনী আমার জানা নেই। শুরু থেকেই তিনি অভিনয় করে গিয়েছেন। তাকে তো এমনি এমনি ছাড় দিব না। তার অভিনয়ের পালা শেষ হলেও এবার আমার অভিনয়ের পালা শুরু।

নিজের মনের সঙ্গে যখন কথাগুলো বলছিলাম ঠিক তখন দেখি আলআবি ভাইয়া আমার মুখোমুখি দাঁড়ানো। তিনি কখন আমার সামনে এসেছে তা ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। আমার সামনে দাঁড়িয়েই তিনি তার মোবাইল টা আমার সামনে তুলে ধরে বলে উঠলেন,,,

–কেমন হয়েছে?

আমি মোবাইলের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি একটা ছবিতে খুব স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে আমার খোঁপায় একটা বেলি ফুলের মালা নিপুণ হাতে গুঁজে দেওয়া। বেলি ফুলের মালাটা দেখে এতক্ষণে বুঝতে পারলাম কোথা থেকে বেলিফুলের ঘ্রাণের সুবাস আসছিল। মনের মধ্যে খুব খুশি খুশি লাগছে। আলআবি ভাইয়াকেও অনেক উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। মুখে হাসি আনতে গিয়ে ও আনলাম না।মুখের মধ্যে গম্ভীরতা টেনে আনলাম।আলআবি ভাইয়া আমাকে কথা না বলতে দেখে মোবাইলটা তার পাঞ্জাবির পকেটে গুঁজে বললেন,,,

–আমার উত্তর কিন্তু এখনো পাইনি?

–আমি আপনাকে বর্ষণ সঙ্গী হিসেবে মানি না।এই দেড় বছরে না ছিল আপনার কোন খোঁজ, আর না নিয়েছেন আমার কোনো খোঁজ।আজ হুট করে এসে বলছেন আমি তোমার বর্ষণ সঙ্গী। বললেই হলো নাকি?(আমি)

আমার কথায় তার মধ্যে কিছুটা রাগের আভাস দেখতে পাচ্ছি। উনি জোরে কথা বলতে গিয়েও বললেন না। তার বদলে আমার হাত দুটো তার হাতের মুঠোয় নিয়ে বলতে লাগলেন,,,

— তুমি কি আমাকে অবিশ্বাস করছো? তাহলে বলতে পারো। আমি তোমাকে প্রমান দেখাতে পারি যে আমিই তোমার বর্ষণ সঙ্গী।

কথাগুলো শেষ করে পাঞ্জাবির পকেট এ পায়জামার পকেট এ হাতাহাতি শুরু করলেন। তাকে দেখে অনেক উত্তেজিত মনে হচ্ছে। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে, আমাদের সেই পুরনো মেসেজগুলো বের করে আমার সামনে ধরে বলতে লাগলেন,,,

–দেখো এই যে এগুলো, এগুলো তো মানবে। আমাদের পুরনো মেসেজ।

তারপর পুনরায় মোবাইল নিয়ে কিছু ছবি বের করলেন। আমার সামনে ধরতেই দেখলাম তার পাঠানো সব চিঠিগুলোর ছবি। আলআবি ভাইয়া উৎকণ্ঠা হয়ে বললেন,,,

–এগুলো ?এগুলো তো মানবে। তোমাকে পাঠানো সব চিঠির ছবি।

— আমাকে বোকা মনে করেছেন? আজকাল ফেক মেসেজ বানানোর অনেক অ্যাপস আছে। আর আপনিও তো বলেছিলেন বর্ষণ সঙ্গীর সাথে আপনার আত্মার সম্পর্ক। তার মানে নিশ্চয়ই সে আপনার ভাই বা বন্ধু বা কোনো আত্মীয়-স্বজন। তার থেকেই হয়তো ছবিগুলো নিয়েছেন। আমি আপনাকে এই মুহূর্তে মানতে পারছি না(আমি)

–আমিই তোমার বর্ষণ সঙ্গী৷ ট্রাস্ট মি!।বিশ্বাস কেন করছ না।ড্যাম ইট!

লাস্টের কথাটা তিনি আমার হাত ধরে ঝাকিয়ে চিৎকার করে বললেন। আহা! মনে কি যে শান্তি অনুভব হচ্ছে বলে বোঝানো যাবে না। চেয়েছিলাম একদিন সে এই ভাবেই চিৎকার করে বলবে আমিই তোমার বর্ষণ সঙ্গী। এই মুহুর্তটা তার কাছে বিষাদ ময় হলেও আমার কাছে জীবনের সবচাইতে প্রিয় অনুভূতির মুহূর্ত। আশেপাশে মানুষের আনাগোনা বেড়েছে। বেড়েছে বলতে গেলে ভুল হবে। বলতে হবে প্রচুর পরিমানে বেড়েছে। প্রায় প্রত্যেকেই একবার হলেও আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। ব্যাপারটা দেখতে শোচনীয় লাগছে না। তাই তার থেকে হাত ছাড়িয়ে বললাম,,,

–সকাল হয়ে গিয়েছে।আমাকে বাসায় দিয়ে আসুন

আমার কথা শেষ হতে না হতেই তিনি আমার হাত খুব শক্ত করে ধরে হাটতে লাগলেন। এমন ভাবে হাতটা ধরে রেখেছেন মনে হচ্ছে তার ভিতরে সকল ক্ষোভ আমার এই হাতের উপরে ঝারছেন। কয়েক কদম এগিয়ে তিনি থেমে গেলে। পিছনে আমার দিকে ফিরে একটা সাদা রঙের মাস্ক পরিয়ে দিলেন। তারপর পুনরায় আবার হাত ধরে হাটতে লাগলেন। এরমধ্যে আমাদের আর কোন কথা হলো না।

তার বাইকটা যেখানে ছিল সেখানে এসে আমার হাতটা ছেড়ে দিলেন বাইকে উঠে বসে আছেন কিন্তু আমাকে ওঠার জন্য বলছেন না। বুঝতে পারছি মশাইয়ের রাগ এখন সাত আসমানে। আমিও কিছু না বলে বাইকে উঠে বসলাম। বাইক স্টার্ট হতেই ভয়ে সিঁটিয়ে গেলাম। বাইকে চড়েছি নাকি রকেটে চড়েছি তা বোঝা মুশকিল। হাত দিয়ে আলআবি ভাইয়ার পাঞ্জাবির কাঁধে অংশ কোনমতে চেপে ধরে বসে রয়েছি। একটু পর অবস্থা বেগতিক দেখে দুই হাত দিয়ে তার কাঁধের পাঞ্জাবি খামচে ধরে বসে রইলাম। রাস্তাঘাটে মানুষের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে যানবাহনের ভীড়। এই মুহূর্তে আমার একটা হাইওয়ে দিয়ে ছুটে চলেছি। আগের তুলনায় বাইক এখন কিছুটা ধীর গতিতে চলছে। কিন্তু একে ও স্বাভাবিক গতি বলা যাচ্ছে না। প্রায় আধা ঘন্টা থেকে পৌনে এক ঘণ্টার মতো সময় হবে আমরা বাইকে উঠেছি। হঠাৎ করেই দেখি আলআবি ভাইয়া বাইক ঘোরাতে শুরু করেছেন। অর্থাৎ আবার পিছনের রাস্তায় ব্যাক করছেন। পুনরায় আগের রাস্তায় যেতে দেখে আমি তড়িৎ গতিতে বলে উঠলাম,,,

–আপনি কোথায় যাচ্ছেন আবার? এই রাস্তা দিয়েই না আমরা আসলাম?

আমার প্রশ্নের পৃষ্ঠে কোন জবাব পেলাম না। কিন্তু আমি থেমে থাকলাম না। তাকে আবারো জিজ্ঞেস করতে লাগলাম। অনেক সময় ধরে তাকে জিজ্ঞেস করার পরেও কোন জবাব পেলাম না। তখন আমি নিজে থেকেই দমে গেলাম।

এতক্ষণ বাসার চিন্তা না হলেও এখন হচ্ছে। কারণ এখন সকাল সাড়ে ছয়টা।আর কিছুক্ষণ পরেই ভাবী এসে আমার রুমে ডাকাডাকি শুরু করবে। তখন তো আমাকে পাবেনা। আর আমি বাসায় গিয়েই বা কি বলবো? ভেবেছিলাম সকাল-সকাল বাসায় পৌঁছে যাব, কিন্তু এখন পড়ে গেলাম আরেক টেনশনে।

আমার ভাবনার মাঝেই বাইকটা থেমে গেল। আশেপাশে পরখ করে দেখি সারি সারি অনেকগুলো খাবার এর রেস্তোরা। মনে মনে ভাবছি আলআবি ভাইয়ার যখন ক্ষুধা পেয়েছে তখন আগে এখান থেকে খেয়ে নিলেন না কেন? অর্ধেক রাস্তা থেকে আবার কেন ফিরে আসলেন? হাতে টান পড়তে আমার হুশ ফিরে আসলো। এবারও হাতটা একটু জোরে চেপে ধরেছেন। উফ!বুঝি না আমার হাত ধরেই কেন সারাক্ষণ ওনার টানাটানি করতে হবে?

একটা রেস্তোরাঁর ভেতরে যেতেই পেটের ক্ষুধা থেকে মনের ক্ষুধা তরতর করে বেড়ে উঠলো। তার কারণ হলো একটাই- ইলিশ মাছ। চারদিকে মাছির মতো ইলিশ ভাজার ঘ্রাণ ভোঁ ভোঁ করছে।সেই সাথে মানুষের কোলাহল পূর্ণ পরিবেশ তো রয়েছেই।

আলআবি ভাইয়া আমাকে নিয়ে একেবারে শেষের একটা টেবিলে বসে পড়লেন। বসা মাত্রই টেবিল থেকে পানির বোতল নিয়ে ঢকঢক করে খেতে লাগলেন। পুরো বোতলের পানি শেষ করে ফললেন। যখন তিনি পানি খাচ্ছিলেন তখন তার ছোট তিলযুক্ত কন্ঠনালিটা বারবার উপর-নিচ হচ্ছিল।বারবার মনে একটা কথাই ভেসে আসছিল।তা হলো সকল যুবকের ই পানি খাওয়ার দৃশ্য কি এতটা মোহনীয় হয় নাকি শুধু এই মানুষটাই পানি খেলে তার কন্ঠনালি এতটা মোহনীয় লাগে? আমি যখন এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, তখন তার গম্ভীর কণ্ঠধ্বনি তে আমার সম্বিত ফিরে এলো।

— আমাকে বর্ষণ সঙ্গী হিসেবে নাই মানতে পারো। আলাবি হিসেবেও নাই মানতে পারো। কিন্তু নিজের স্বামী হিসেবে মানতে হবে এই কথাটা নিজের মগজে ভাল করে গেঁথে নাও।কজ, এক কথা আমি তোমাকে বারবার বলব না।

চলবে…………

[বিঃদ্রঃ গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক। অনুগ্রহ করে বাস্তবিক অর্থ খুজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না আর লেখিকা কে ও বিভ্রান্ত করবেন না]

বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-২৮+২৯

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_২৮

“বর্ষণ সঙ্গী” নামটা শুনেই বুকের বা পাশে দুই ইঞ্চি গভীরে থাকা বৈজ্ঞানিক ভাষায় যাকে বলে হৃদপিণ্ড,তার মধ্যে ধুকধুক শব্দটা তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে উঠেছে।কিছু টা সময় শূন্য দৃষ্টিতে টেবিলে রাখা টিস্যু বক্সটা এর দিকে তাকিয়ে রইলাম।বুক কাঁপানো এই ধুকধুক শব্দটা তীব্র কষ্টের কারণ না হয়ে এমুহূর্তে আমার তীব্র সুখ এর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। জীবনের সবচেয়ে ভালো লাগার মুহূর্তকে কাটিয়ে আলআবি ভাইয়ার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম।সাদু আর রাইয়ানের দৃষ্টি আমাদের দুজনের উপরই। এই মুহূর্তে আমি ওদের দেখা বা বিশেষ করে রাইয়ান আমাদের দুজনের ফুসুরফুসুর করে কথা বলায় কি মনে করবে বা করছে তা ভাবার প্রয়োজন বোধ করছি না।আমার মন আর মস্তিষ্কে কেবল একটা শব্দ ই বারবার প্রতিধ্বনি হয়ে ফিরে আসছে।তা হলো “বর্ষণ সঙ্গী”।আলআবি ভাইয়ার বলা কথাটা মস্তিষ্কে প্রেরণ হতেই মনে হলো আমি আমার বর্ষণ সঙ্গীকে পেয়ে গিয়েছি। আমার এই মুহুর্তের অনুভূতিটা বলে প্রকাশ করার মত নয়।

অন্যের সামনে কানে কানে কথা বলাটা খুবই দৃষ্টি কটু দেখায়।কিন্তু এমুহূর্তে আমার চুপ থাকলে হবে না।আমি একটু আস্তে করেই আলআবি ভাইয়াকে বললাম,,,

–আপনি তাকে চেনেন?

আলআবি ভাইয়া পুনরায় আমার কাছে এসে আস্তে করে বললেন,,,

–আমার সঙ্গে তোমার বর্ষণ সঙ্গীর আত্মার সম্পর্ক।

তার এমন বারবার আমার কাছে চলে আসায় আমার শরীরের লোম কেমন যেন ঝংকার দিয়ে উঠছে।এভাবে তার সাথে কথা বলা সম্ভব নয়।আর রাইয়ান ছেলেটাকেও তো সব বলতে হবে।আমি কালবিলম্ব না করে মনে একরাশ উৎসাহ নিয়ে হাসি হাসি মুখে জোরেই বলে উঠলাম,,,

–সে নিশ্চয়ই আপনার বন্ধু তাই না?

কথাটা বলেই শেষ মুহূর্তেও মুখে হাসি বজায় রাখলাম। আমার এরূপ উৎফুল্লতা দেখে সাদু ওর আগ্রহ মনে চেপে রাখতে না পেরে বলে উঠলো,,,

–কার কথা বলছিস।

–বর্ষণ সঙ্গী।(আমি)

সাদু কে কথাটা বলেই চোখ পরল ওর পাশে অবুঝের মতো নিশ্চুপ ভঙ্গিমায় বসে থাকা রাইয়ানের দিকে। বেচারার আমাদের কথার “ক” টাও যে বোধগম্য হচ্ছে না তা চেহারায় খুব সূক্ষ্মভাবে ফুটে উঠেছে।রাইয়ানের দিকে যখন তাকিয়ে ছিলাম তখন রাইয়ান আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,,,

–জুইঁ আমি একটু তোমার সাথে কথা বলতে পারি?

–ওদিকে নয় এদিকে। আমার সাথে কথা বলো।(আলআবি ভাইয়া)

–জ্বি ভাই।(রাইয়ান)

–ব্লাড ডোনেশন করেছ ভালো কথা তা অন্যের বউ নিয়ে টানাটানি করো কেন?(আলআবি ভাইয়া)

— ঠিক বুঝলাম না ভাই।(রাইয়ান)

–বোঝার বয়স হয় নাই মেয়ে দেখতে এসে পরেছ।(আলআবি ভাইয়া)

–ভাই একটু ক্লিয়ার করে বলবেন আসলে কি বিষয়ে বলছেন? (রাইয়ান)

–শোনো সোজা কথা হলো ও তোমাকে বিয়ে করবে না।এই দেখা পর্যন্তই শেষ।ওর হাসবেন্ড আছে। (আলআবি ভাইয়া)

উনার কথা শুনে আমি আকাশ থেকে ও নয় একেবারে চাঁদের দেশ থেকে পড়লাম। উনি যে গন্ডগোল পাকাতে এখানে এসেছেন তার আভাস পেয়েছি আগেই। কিন্তু এতো বড় গন্ডগোল পাকাতে কে বলেছে ওনাকে?আমি তড়িৎ গতিতে বললাম,,,

–না না আমার তো…..

আর বলতে পারলাম না। আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে আলআবি ভাইয়া বললেন,,,

–হ্যাঁ তোমার তো হাসবেন্ড আছে।

আমি অবাকের উপর অবাক হচ্ছি।সাদুর দিকে তাকিয়ে দেখি ওরও একি অবস্থা। রাইয়ান বলে উঠলো,,,

–কিন্তু নিয়াজ ভাই যে বলল জুইঁয়ের…..

আলআবি ভাইয়া আমার মতো রাইয়ানকেও কথা শেষ করতে না দিয়ে থমথমে গলায় বলে উঠলেন,,,

–একবার না বললাম ওর হাসবেন্ড আছে।

–কিন্তু…. (রাইয়ান)

–বাইরে যাওয়ার রাস্তা ওইদিকে।(আলআবি ভাইয়া)

এতোদিনে বুঝে গিয়েছি আলআবি ভাইয়া রেগে গেলেই কিছু টা গম্ভীর আর থমথমে হয়ে কথা বলেন।রাইয়ান আর কিছু না বলেই চলে গেল। রাইয়ান চলে যাওয়ার পর মুহূর্তেই আমি আলআবি ভাইয়াকে বললাম,,,

— আপনি কি আমার বর্ষণ সঙ্গীর সাথে দেখা করিয়ে দিতে পারবেন? আচ্ছা সে এখন কোথায় আছে? কেমন আছে সে? আর আপনার সাথে পরিচয় হলো কীভাবে? আপনার সাথে তো নিয়াজ ভাইয়ার বন্ধুত্ব খুব ভালো। বলতে গেলে বেস্ট ফ্রেন্ড এর মতো। তাহলে আমার বর্ষণ সঙ্গীর সঙ্গে আপনার আত্মার সম্পর্ক হয় কি করে? তাহলে কি আপনার দুইটা বেস্ট ফ্রেন্ড?

কথাগুলো একদমে বলে তারপর নিশ্বাস ছাড়লাম। এতক্ষণ এই প্রশ্নগুলো আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে খেতে মাথা ব্যথা বানিয়ে ফেলেছিল। মনে হচ্ছে কথাগুলো বলে এখন একটু প্রশান্তি পাচ্ছি। আমার কথা শেষ হতেই আলআবি ভাইয়া বললেন,,,

— তোমার কি এই শাড়িটা ছাড়া আর কোন শাড়ি নেই? ছেলেদের সামনে শুধু একটাই শাড়ি পড়ে ঘুরঘুর করো কেন?

আমি প্রশ্ন করলাম কি আর সে উত্তর দিল কি। এতগুলো কথাই আমার বেকার গেল। তার বলা উত্তরে আমার প্রচন্ড রাগ হল। কত সময় ধরে জানতে চাইছি তার থেকে। কিন্তু সে আছে তার ভাব নিয়ে। আমি একটু ঝাঁঝালো কন্ঠেই বলে উঠলাম,,,

— আপনার কি শোনায় সমস্যা?

আলআবি ভাইয়া আমার দিকে চোখ পাকিয়ে হুংকার দিয়ে বলে উঠলেন,,,

–কী?কী বলতে চাও?

–শোনায়! শোনায়! আপনার কি শোনায় সমস্যা?আই মিন শুনতে পান তো? এতগুলো কথা বললাম এতগুলো প্রশ্ন করলাম আপনাকে। আপনি উত্তর কি দিলেন আমাকে?(আমি)

— তোমার প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মুডে এখন আমি নেই। যখন হবে তখন বলব। এবার আমার প্রশ্নের উত্তর দাও। একটাই শাড়ি কেন পরো তুমি বারবার?(আলআবি ভাইয়া)

–সেম টু ইউ। এখন মুড নেই যখন মুড হবে তখন বলব।(আমি)

আমার কথাটা শেষ হতেই উনি হুট করে দাঁড়িয়ে কোথায় যেন হেঁটে চলে গেলেন। তার প্রস্থানের সাথে সাথেই সাদু এসে আমার পাশের চেয়ারটায় বসে পড়ল আর বলল,,,

–দোস্ত তাইলে তোর ভাগ্য খুইলা গেল। প্রেমিক পুরুষ এর লগে দেখা করার জন্য আর বেশি দিন দেরি করা লাগব না।কি আমি বলছিলাম না আলআবি ভাইয়াই নাটের গুরু।সে তোর বর্ষণ সঙ্গী কে চিনে।কি দেখলি তো আমার বাথরুম থট’স টাই ঠিক।

ওর কথায় আমি এক গাল হেসে বললাম,,,

–সত্যি আজ মনে হচ্ছে আল্লাহ যা করে ভালোর জন্যই করে। বাসায় যাইয়া নিয়াজ ভাইয়ারে একটা থ্যাংক ইউ দিতে হইব। যদি নিয়াজ ভাইয়া রাইয়ান নামের ছেলেটার সাথে দেখা করার জন্য এখানে না পাঠাই তো তাইলে তো আলআবি ভাইয়ার সাথে দেখা হইতো না আর আমার বর্ষণ সঙ্গীর কথাও জানতে পারতাম না। শোন! শোন! নিয়াজ ভাইয়ার জন্যে তার পছন্দের ডোনাট নিয়া যামু নে।

–বাহ বাহ।এমনে ফাল পাড়তাছোস মনে হয় তোর প্রমিক পুরুষ এর লগে বিয়ে ঠিক হইয়া গেছে।(সাদু)

— চুপ থাক তোর নাক চাঁপলে এখনো ঝোল পড়ে। তুই এইডি বুঝবার পারবি না।(আমি)

–বোইন আমার নাক দিয়া ঝোল পরুক,ঘি পরুক,দুধ পরুক।যা ইচ্ছা পরুক।আমার দেখার টাইম নাই।এখন খালি খাওয়ার টাইম।আগে কিছু অর্ডার কর বোইন।তোর বাতিল হওয়া হবু জামাই যে কিপটারে পানিও শেষ কইরা থুইয়া গেছে।দেখ!

ওর কথায় আমি হেঁসে উঠলাম। তারপর আমরা কফি অর্ডার করলাম। সাথে এখানে চকলেট রোল পাওয়া যায়। দুইটা চকলেট রোল অর্ডার করলাম। আমি আর সাদু গল্প করছিলাম আর মনের সুখে আয়েশ করে কফি খাচ্ছিলাম। মাঝে মাঝে সাদু ছবি তুলছিল। আমার মগের কফি যখন অর্ধেক হয়ে এলো তখন সামনে চোখ পড়তেই দেখি আলআবি ভাইয়া তার দলবল নিয়ে ভিতরে ঢুকছেন। তাকে দেখে বুঝতে পারছি না রেগে আছেন নাকি শান্ত ভাবে আছেন। তবে এইটুকু বুঝতে পারছি এই ব্যক্তি নিজের বিয়ের দিনেও সাদা পাঞ্জাবি পড়ে ঘুড়ে বেড়াবে। একটু আগে যখন আমাদের সাথে বসে ছিল তখনও সেই সাদা পাঞ্জাবিই গায়ে ছিল।

তিনি সোজা দলবল নিয়ে আমাদের টেবিলের সামনে এসেই দাঁড়িয়ে পরলেন। কোন প্রকার টু শব্দ ছাড়াই আমার হাত ধরে টান দিয়ে আমাকে দাড় করিয়ে দিলেন। তার কাজে কিছুটা বিরক্ত হয়েই ভ্রু কুঁচকে তার দিকে তাকালাম। কোনো কথা না বলে যন্ত্রমানবের মত আমাকে নিয়ে গট গট করে হেঁটে চললেন।আমি বারবার পিছনের দিকে তাকাচ্ছি। দেখলাম সেই দিনের শাফিন নামের ছেলেটা সাদুর সঙ্গে কি যেন কথা বলছে।

আলআবি ভাইয়া আমার ডান হাত তার বাম হাত দিয়ে ধরে রেখেছেন। তাই আমি আমার হাত ছুটানোর জন্য আমার বাম হাত দিয়ে তার হাত সরানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।হাত কিছুটা ছুটতেই আবার পর মুহূর্তেই আলআবি ভাইয়া আরো জোরে বল প্রয়োগ করে হাত ধরে ফেলেছেন এমন করতে করতে গিয়ে আমরা তার গাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। গাড়ির সামনে এসে আমি তাকে তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললাম,,,

— কি সমস্যা আপনার? এমন করছেন কেন?

–অনেক ছাড় দেওয়া হয়েছে। দেড় বছরে অনেক উরেছ। এখন আর কোন ছাড়াছাড়ি নেই।(আলআবি ভাইয়া)

–মানে?(আমি)

— তোমার বর্ষণ সঙ্গীর তরফ থেকে কথাগুলো আমিই বলে দিলাম।(আলআবি ভাইয়া)

— আপনি জানলেন কিভাবে? আপনার কাছে নিশ্চয়ই তার নাম্বার রয়েছে। তাড়াতাড়ি আমাকে তার নাম্বার দিন।(আমি)

— তোমার তো দেখছি আইকিউ লেভেল খুবই কম। তখন তো আমি তোমাকে বলেই দিলাম, তোমার বর্ষণ সঙ্গীর সঙ্গে আমার আত্মার সম্পর্ক। আমাদের কথা বলতে কোন মোবাইলের দরকার হয় না বুঝলে।(আলআবি ভাইয়া)

আমার হাতটা সে এখনো ধরে আছেন।তাই হাতের দিকে ইশারা করে বললাম,,,

— আমার বর্ষণ সঙ্গী হাতটাও নিশ্চয়ই এভাবে ধরে রাখতে বলেনি আপনাকে।

আমার বলা কথাতেও তিনি আমার হাত ছাড়লেন না। বরং হাত ধরে আমাকে গাড়ির মধ্যে বসিয়ে দিলেন। তারপর নিজে এসে আমার পাশে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়লেন। আমি আর কোন কথা বাড়ালাম না। সে যেহেতু আমাকে এর আগেও বাসায় পৌছে দিয়েছিলেন তাই আজও ভেবে নিলাম আমাকে হয়তোবা বাসায়ই পৌঁছে দেবেন। একমনে আমি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলাম। আশেপাশে বিভিন্ন ধরনের দোকানপাট ফেলে আমরা এগিয়ে চলছি।বাইরে দৃষ্টি রেখে রাস্তাঘাট মানুষজন দেখতে দেখতে চোখটা বারবার লেগে আসছে। কিন্তু এই মুহূর্তে আমি ঘুমাতে চাচ্ছি না। তাই জোরপূর্বক চোখের পাতা দুটো কে মেলে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ করে আমার চলমান অবস্থা স্থির হয়ে যাওয়ায় ঘুম ঘুম ঘোর টা কেটে গেলো। চারপাশে তাকিয়ে দেখি এটা আমাদের বাড়ি নয় বরং একটা শপিং মল। আমি পাশে আলআবি ভাইয়ার দিকে তাকাতেই দেখি তিনি ইতিমধ্যে গাড়ি থেকে নেমে গিয়েছেন। আমিও শীঘ্রই সিট বেল্ট টা খুলে গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। নেমে তাকে জিজ্ঞেস করলাম,,,

–আমরা এখানে কেন? আপনি না আমাকে বাসায় নিয়ে যাচ্ছিলেন?

— কখন বললাম আমি তোমাকে বাসায় নিয়ে যাচ্ছি।(আলআবি ভাইয়া)

— তাহলে আমরা এখানে কেন?(আমি)

— বিয়ে করতে এসেছি।(আলআবি ভাইয়া)

–কি? কি উল্টাপাল্টা বলছেন এসব। শপিংমলে কি কেউ বিয়ে করতে আসে? (আমি)

–নিজেই যখন জানো তাহলে এতো কথা বলছো কেন?(আলআবি ভাইয়া)

পুনরায় তিনি আমার হাত ধরে সিঁড়ি বেয়ে শপিংমলে ঢুকলেন।আমার মস্তিষ্ক কোন ভাবেই চিন্তা করে কোন কিছুই মিলাতে পারছেনা।হঠাৎ করেই আলআবি ভাইয়ার কি হলো? আর সে আমার বর্ষণ সঙ্গীর কথাই বলছে না কেন আমায়?

আলআবি ভাইয়া শপিংমলে ঢুকে ঘুরছেনতো ঘুরছেনই থামার কোনো নামই নেই। অবশেষে একটা বোরখা হাউজের ভিতরে ঢুকে পড়লেন। তখন মনে হল লোকটাকে কয়েকটা কথা শুনিয়ে দেই। আমাকে বললে কি হতো যে তিনি বোরখা হাউজ খুঁজছিলেন। আমাকে বললেই তো হতো। এখান থেকে আমি আর সাদু বেশিরভাগ শপিং করে থাকি। এই বোরখা হাউজ টায় বোরখার সাথে সাথে হিজাবজ বিক্রি করে। এখান থেকেই আমি আর সাদু বেশিরভাগ হিজাবগুলো কিনে থাকি।

আমার কৌতূহল মেটানোর জন্য আমি ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করে বসি,,,

–কার জন্য বোরখা কিনবেন?

–আমি তো আর বোরখা পড়বো না তাই না।তোমাকে সাথে যেহেতু এনেছি তাই নিশ্চয়ই তোমার জন্যই নিব।(আলআবি ভাইয়া)

–না না আমার লাগবে না।(আমি)

–হ্যাঁ তা কেন লাগবে। যদি শাড়ি কিনে দেয়ার কথা বলতাম তাহলে তো লাফিয়ে লাফিয়ে শাড়ি নিতে। ছেলেদের সামনে তো শাড়ি পড়ে শুধু ঘুরঘুর করতে ইচ্ছা করে তোমার।(আলআবি ভাইয়া)

আমি তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে মাথানিচু করে বললাম,,,

— আমার বাসায় বোরখা আছে। তাই কিনতে বারণ করেছিলাম।

এরপর আর কোন কথা বললাম না। আলআবি ভাইয়ার দিকে তাকালামও না। তার কথাটায় খুব খারাপ লেগেছে আমার। না জেনে শুনে আমার নামে খারাপ একটা কথা বলবেন কেন তিনি? তাই তার সাথে আর কোন প্রকার কথা বলতে ইচ্ছে হলো না। এখন বুঝলাম সে মনে মনে আমাকে ভালো মেয়েদের কাতারে দেখেনা। আলআবি ভাইয়া নিজের পছন্দমত একটা বোরখা আর তার সাথে হিজাব কিনে নিলেন। তারপর আগের ন্যায় আমার হাত ধরতে আসলে আমার হাত ধরতে দিলাম না। আমি গটগট করে শপিং মল থেকে বের হয়ে সোজা গাড়ির সামনে এসে দাড়িয়ে পড়লাম। আলআবি ভাইয়া গাড়ির সামনে আসলে আমরা দুজনে গাড়িতে উঠে বসলাম। আমার এই নীরবতা আর ভাঙলো না। বাসাযর সামনে এসে গাড়ি থেকে নেমে বোরখা না নিয়েই দ্রুত পা ফেলে চলে আসলাম। বাসার দরজার সামনে এসে কলিংবেল চাপতেই নিয়াজ ভাইয়া দরজা খুলে দিল। ভাইয়া কে দেখেই আমার ডোনাটের কথা মনে পড়ে গেল। ওই আলআবি নামের খবিশ টার জন্য আমি ডোনাট টাও কিনতে পারিনি। ড্রইংরুমে দেখলাম বাবা বসে বসে চা খাচ্ছে আর টিভিতে খেলা দেখছে।পাশে আরেকটা চায়ের কাপ থাকায় বুঝতে পারলাম বাপ-ছেলে দুজন মিলে খেলা দেখছে আর চা খাচ্ছে। ভাইয়ার সাথে কথা না বলে রুমে এসে দরজা লাগিয়ে দিলাম।

ওইদিনের ঘটনার পর আরো দুইদিন চলে গিয়েছে। আমাকে ভাইয়া কেবল জিজ্ঞেস করেছিল আলাবি ভাইয়া সেদিন ক্যাফেতে এসেছিল কিনা? আশ্চর্যের ব্যাপার হলো আমি বাসায় আসার পর নিয়াজ ভাইয়া আমাকে আর রাইয়ানের সম্পর্কে কিছুই বলেনি। কিন্তু রাইয়ানের সাথে দেখা করে আসার পরের দিন নিয়াজ ভাইয়া শুধু এতোটুকুই বলেছিল “রাইয়ানকে নিয়ে আর কোন চিন্তা নেই। আলআবি আমাকে সব বলেছে”।

সাদুর সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছিলাম শাফিন নামের ছেলেটা আলআবি ভাইয়ার সেক্রেটারি। আর ওই ছেলেটাই সাদুকে বাসায় পৌঁছে দিয়েছিল। রাতে ঘুমানোর আগে ওয়াশরুমে এর বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভালোভাবে মুখটা ফেসওয়াশ দিয়ে ধুয়ে নিচ্ছিলাম। ঠিক তখন মনে হলো কেউ আমার ঘরের মধ্যে বসে গিটার বাজিয়ে গান গাইছে।

Khairiyat poocho
Kabhi to kaifiyat poocho
Tumhaare bin deewane ka kya haal hai
Dil mera dekho
Na meri haisiyat poocho
Tere bin ek din jaise sau saal hai

Anjam hai tai mera
Hona tumhein hai mera
Jitni bhi ho dooriyan filhaal hain
Yeh dooriyan filhaal hain….

আমি একটু তাড়াতাড়ি করে মুখটা ধুয়ে ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে আসলাম এসে রুমে কারোই অস্তিত্ব পেলাম না। কিন্তু গানটা এখনো আমার কানে বেজে যাচ্ছে। দ্রুত বারান্দায় গিয়ে দেখতেই আমার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। কারন বারান্দায় বসে আলআবি ভাইয়া এক মনে আকাশে উদিত হওয়া চকচকে থালার ন্যায় চাদঁটার পানে তাকিয়ে আছেন। এই মুহূর্তে আলআবি ভাইয়াই কেন কোনো মানুষেরই আমার বারান্দায় আসা অবাস্তব একটা ঘটনা। কিন্তু চোখের সামনে যা দেখছি তা মিথ্যেও দেখছি না।হঠাৎ মনে হলো এটা হয়তো বা আলআবি ভাইয়ার রূপ ধারণ করে কোন জিন পরী এসেছেন। পরে দেখই আলআবি রূপি জিনটা বসে বসে গান গাইছে তাই যত দোয়া-দুরুদ আছে পড়তে লাগলাম। আল্লাহাফেজ ভাইয়ার ঝিম বৃষ্টি যখন আবার ওপর পরল তখন জোরে জোরে কি কি যেন দোয়া দুরুদ পড়তে লাগলাম কি পরিচিত আমি নিজেও বুঝতে পারছি না

চলবে…………

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_২৯

আলআবি ভাইয়া রূপি জিনের দৃষ্টি যখন আমার ওপর পরল তখন জোরে জোরে কি কি যেন দোয়া দুরুদ পড়তে লাগলাম। কি পরছি আমি নিজেও বুঝতে পারছি না।ধীর গতিতে জিনটা গিটার টা পাশে রেখে আমার দিকে আগাতে নিলেই জোড়ে “আ” মূলক একটা চিৎকার দিয়ে বসলাম। সাথে সাথে এক জোড়া শক্তপোক্ত হাত এসে আমার মুখ চেপে ধরল।এক হাত দিয়ে আমার ঘাড়ের পিছনের দিকে চেপে ধরা আরেক হাত দিয়ে আমার মুখ চেপে ধরা।
দাতেঁ দাঁত চেপে একটা ফিসফিসে আওয়াজ আমার কানে ভেসে আসলো।

–চুপ!চুপ!একদম চুম!

পরিচিত কন্ঠ টা শুনে মনের মধ্যে একটা স্বস্তির বাতাস বয়ে গেল।নিশ্চিত হলাম আমার সামনে থাকা লোকটা আলআবি ভাইয়া ।আমার সাথে এখনো কোন অস্বাভাবিক কিছু হয়নি।তার মানে এটা আসল মানুষ ই।জিন পরী হলে এতক্ষণে আমার বারোটা তেরোটা বাজিয়ে দিত। মুখের উপর থেকে তার হাত টা সরানোর চেষ্টা করতেই তিনি হাতটা সরিয়ে নিলেন।আমি ছাড়া পেতে ই হড়বড়িয়ে বললাম,,,

–আপনি এখানে কেন?আর এতো রাতে আমাদের বাসায় কি করছেন? তার থেকে বড় কথা হল আপনি আমার বারান্দাতেই বা কি করছেন?

–গিটার বাজাতে এসেছি।(আলআবি ভাইয়া)

কথাটা বলেই তিনি ইবলিশ রূপি একটা হাসি হাসলেন।পূর্নিমার আলো এসে তার মুখমন্ডলে লুকোচুরি খেলা খেলছে।তার পুরু ঠোটের হাসি বাম গালে থাকা ঈষৎ গর্তের অর্থ্যাৎ টোলের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে। হাসির দরুন তার চোখ জোড়া ঈষৎ সংকুচিত হয়েছে। তার গাল ভর্তি থাকা চাপ দাঁড়ি যে বিলীন হয়ে গিয়েছে তা এই পূর্নিমার আলো আমার চোখ জোড়ায় স্পষ্ট তুলে ধরেছে।আজও পড়নে তার সাদা পাঞ্জাবির কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। শুনেছি কোনকিছুই অতিরিক্ত ভালো নয়। তবে আলআবি ভাইয়ার ক্ষেত্রে এই কথাটা এখন একেবারে অপ্রযোজ্য। মনে হচ্ছে সে যদি সাদা পাঞ্জাবি না পড়ে অন্য বর্ণের পাঞ্জাবি পড়তো তাহলে তা মানানসই হতো না। কেন যেন তাকে এই রূপে দেখতে অদ্ভুত রকমের ভালো লাগছে। তাকে পর্যবেক্ষণ করার এক পর্যায়ে ব্যাঘাত ঘটিয়ে আমার সম্বিত ফিরে এলো তখন, যখন দেখলাম সে তার গিটারটার কাছে পুনরায় ফিরে যাচ্ছে। যেখানে গিটার রাখা সেখানে উবু হয়ে তাকে কিছু একটা নিতে দেখলাম। তারপর সে আবার আমার কাছে ফিরে আসলো। আলআবি ভাইয়ার হাতের দিকে দৃষ্টি দিতেই একটা শপিং ব্যাগের মতো দেখতে পেলাম। আমার হাতে ব্যাগটা ধরিয়ে দিয়ে বললেন,,,

–তুমি ছেলেদের সামনে বিনা বোরখায় ঘুরঘুর করলে তা তোমার বর্ষণ সঙ্গীর মোটেও ভালো লাগে না।

“বর্ষণ সঙ্গী” নামটা শুনলেই মনের মধ্যে হাজার ও ভালোলাগার অনুভূতিরা কড়া নেড়ে যায়। একজন ব্যক্তির আসল নাম বাদ দিয়ে ছদ্মনাম নাম শুনলেই যখন এতটা ভাল লাগে তখন ওই ব্যক্তির সংস্পর্শে আসলে কেমন লাগবে? নিশ্চয়ই তার সংস্পর্শে এলে আমি কখনোই খারাপ অবস্থায় থাকবো না। আমি আলআবি ভাইয়া কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলাম,,,

— এই বোরখা তো আপনি কিনেছেন। আমি আপনারটা কেন নিব? নিতে হলে আমার বর্ষণ সঙ্গীর টাই নিব।

–তোমাকে এক কথা বারবার কেন বলা লাগে বলতো?তোমার বর্ষণ সঙ্গীই তো আমাকে বলল “আমার বর্ষণ সঙ্গিনীকে গিয়ে বোরখা কিনে দিয়ে আয়”।সেদিন তুমি এটা আমার কাছেই রেখে এসেছিলে। তাই তোমার বর্ষণ সঙ্গী তোমার বাসায় আসতে আমাকে বাধ্য করলো।(আলআবি ভাইয়া)

আলআবি ভাইয়ার কথা শেষ হতে না হতেই আমি তার হাত থেকে খপ করে ব্যাগ টা নিয়ে নিলাম।তারপর বললাম,,,

–আমার জানা মতে আমার বর্ষণ সঙ্গী না কানা,না কালা আর না ই বা পঙ্গু। আর তার থেকে বড় কথা হলো আপনার মতো লোক কোন কালেই কারো চামচামি করবে না।তাই এবার আমাকে তারাতাড়ি বর্ষণ সঙ্গীর আসল পরিচয় দিন।সে কে, কোথায় থাকে সব কিছু বলতে হবে।বলুন।

আলআবি ভাইয়া হামি তুলতে তুলতে বললেন,,,

— আজ অনেক কথা বলে ফেলেছি। এখন ঘুম পাচ্ছে খুব। যাও তুমিও ঘুমাও গুড নাইট।

বলেই তিনি বারান্দার রেলিং টপকে নিচে নামাতে শুরু করলেন। কেবল এক পা রেলিং এর বাইরে দিয়েছেন তখন আমি তাড়াতাড়ি করে তার সামনে গিয়ে বললাম,,,

–আপনার না ঘুম পেয়েছে।তাহলে সুইসাইড করতে যাচ্ছেন কেন? আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে তারপর আপনি সুইসাইড করতে যান। আগে আমার উত্তর দিন।

–এই বাড়িটা যেই আর্কিটেক্ট বানিয়েছে তার মাথায় কোন ঘিলু নেই। যদি একটু মাথা খাটিয়ে তোমার বারান্দার পাশেই পাইপ লাগানোর স্পেস রাখতো তাহলে আমাকে এত কষ্ট করতে হতো না। পাইপ বেয়ে ই উপরে উঠে যেতাম আর নেমে যেতাম।আমাকে আর কষ্ট করে দুই টা মই একসঙ্গে বেধে এই তিন তলায় উঠতে হতো না।(আলআবি ভাইয়া)

তার এমন বেহুদা কথাবার্তায় আমি চটে গেলাম। একটু শব্দ করেই বলে উঠলাম,,,

–হ্যাঁ আপনার মাথা তো ঘিলুতে ভরা। মাথায় এতই যখন বুদ্ধি তে ভরা তাহলে চাকরিটা ছেড়ে ছিলেন কেন? নিশ্চয়ই দেড় বছর আগে কোন না কোন গণ্ডগোল পাকিয়েছিলেন। তাই আপনাকে অফিস থেকে বের করে দিয়েছিল।

আমার কথায় আলআবি ভাইয়ার মুখের রং পাল্টে গেল। আধো আধো আলোয় ঠিকই তার অগ্নিমূর্তি রূপ দেখতে পেলাম। আমার অন্তর আত্মা কাপিয়ে বলে উঠলেন,,,

–যে বিষয়ে অবগত নও সেই বিষয়ে কোনো কথা ভুলেও মুখে আনবে না।

সে যে খুব রেগে আছেন তা কথার সুরেই বলে দিচ্ছে। আর এক মুহূর্ত দেরি না করে স্থান ত্যাগ করলেন। তাকে নিচে নামতে দেখে মনে পড়ল সে এখান থেকে যাবে কিভাবে? আমার জানা মতে তো কোন রাস্তাই নেই এখানে। আমি দ্রুত নিচে তাকালাম কিন্তু কোনো মানুষেরই অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম না।আলআবি ভাইয়া নিমিষেই হাওয়া হয়ে গেলেন। তার টিকিটারও দেখা পেলাম না।

রুমে এসে আলআবি ভাইয়ার ব্যাপারে কিছু সময় ভাবাভাবি করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম হাতে মোবাইলটা নিয়ে। প্রায় সময়ই বর্ষণ সঙ্গী আর আমার পুরনো মেসেজ পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যাই। আজকেও তার ব্যতিক্রম হলো না।

সকালে এলার্ম এর শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো। উঠে ফজরের নামাজ পড়ে নিলাম। নামাজটা শেষ করতেই বাইরে ঝুম বৃষ্টি পড়তে লাগলো। কিছু সময় বারান্দায় গিয়ে মনোযোগ সহকারে বৃষ্টিবিলাস করে পুনরায় রুমে ফেরত আসলাম। হঠাৎ করে মনে হলো এখন বাসায় ইলিশ মাছ ভাজা দিয়ে ভুনা খিচুড়ি রান্না না হলে বৃষ্টিরাজিরা অভিযোগ জানাতে দলে দলে ছুটে আসবে। মনের এই অদম্য ইচ্ছা টাকে আর পুষে রাখতে পারলাম না। চলে আসলাম খিচুড়ি রান্নার অভিযানে। রান্না ঘরে এসে দেখি ভাবি ও এইমাত্র রান্নাঘরে এসেছে। যেদিন থেকে জানতে পেরেছিলাম আমাদের বাসায় নতুন অতিথির আগমন ঘটবে সেদিন থেকেই ভাবিকে বেশি কাজ করতেন দেইনা। রান্নার কাজ তো একেবারেই করতে দেই না। ভাবী এখন শুধু বাসায় ঘুরে ঘুরে এই ঘর ওই ঘর গুছিয়ে রাখে। কমলা আন্টি এখন আর সকাল সকাল আসে না। যখন আমি ভার্সিটিতে চলে যাই সেই সময়টা এসে ভাবিকে সঙ্গ দেয়।ভার্সিটিতে আমার তৃতীয় বর্ষের ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছিল আমাদের সুবর্ন জয়ন্তীর পরের দিনই। সেদিন থেকে কমলা আন্টি আমার অনুপস্থিতিতে ভাবির সঙ্গে থাকে। আমি আসলে কিছু সময় পরে ডিউটিতে চলে যায়। আমার মত ভাবির ও ইলিশ মাছ পছন্দ। আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ইলিশ মাছ ভেজে চলেছি আর পাশেই ভাবি আমার সঙ্গে গল্প করে চলেছে। ইদানিং ভাবির আচরণে অনেক কিছুরই পরিবর্তন লক্ষ করতে পারছি।হুটহাট করেই একেকটা ইচ্ছে পোষণ করে বসে। তবে তা খুবই ছোট ছোট ইচ্ছে।একেই বুঝি বলে প্রেগনেন্সি সময় এর মুড সুইং।

সকালবেলা আমি, ভাবি আর বাবা হালকা-পাতলা নাস্তা করলেও নিয়াজ ভাইয়ার ভাষ্য মতে, সকালে খেতে হবে রাজার হালে দুপুরে খেতে হবে সেনাপতির হালে আর রাতে খেতে হবে প্রজার হালে। আমার রান্না খিচুড়ি বরাবরই ভাইয়া আর বাবার পছন্দের।এই খিচুড়ি টাও একসময় ভালো রাঁধতে পারতাম না।আর দশ-পাচঁ টা মায়ের মতো আমাকে আমার মা রান্না শেখায় নি।আমার কমলা আন্টি আমাকে রান্না শিখিয়েছে।সে আমাকে কম আদর স্নেহ করে না।কিন্তু ওই যে একটা কথা আছে না মা তো মা ই।মায়ের সমতুল্য আর কেউ হয় না। আমার রান্নার হাতে খড়ি মাকে দিয়ে শুরু হয়নি সেই জায়গায় একটা আফসোস রয়েই গিয়েছে।

খাওয়া-দাওয়া করে রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। বাইরে থেমে থেমে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। এই পরিবেশে বাইরে বের হতে একটুও ইচ্ছে করছে না।ভার্সিটি যাওয়া তো বাদই দিলাম। এমনিতে আমি আর সাদু ভার্সিটিতে অনিয়মিত নই।খুব কমই ক্লাস মিস করি। কিন্তু বর্ষাকাল এসে আমার সকল নিয়ম ভেঙে দেয়। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে কাঁথা মুড়ি দিয়ে কোন একটা নাটক বা মুভি দেখতে দেখতে ঘুমিয়ে পড়ি। মোবাইল চালাতে চালাতে ঘুমিয়ে পড়ার ব্যাপারটা আমার খুব ভাল লাগে। যদিও এটা একটা বদভ্যাস কিন্তু তাও আমার ভালো লাগে। সাদু কে একটা মেসেজ করে জানিয়ে দিলাম আজকে আর ভার্সিটি যাব না। এরপর কাঁথা মুড়ি দিয়ে মনপুরা ছবিটা মোবাইলে চালু করে দিয়ে দেখতে লাগলাম।কিন্তু একটু পরেই বুঝতে পারলাম আমার পক্ষে আর চোখের পাতা খুলে রাখা সম্ভব নয়। ধীরে ধীরে ঘুমের রাজ্যের সঙ্গে সখ্যতা গড়তে পারি জমালাম ঘুম রাজ্যে।

ঘুম ভাঙতেই সর্বপ্রথম চোখে পড়ল আমার ডান পাশে পড়ে থাকা মোবাইল টার দিকে। শোয়া থেকে উঠে বসে মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখি ১১টা বেজে ৩৭ মিনিট। মোবাইলে চলতে থাকো মুভিটা ও শেষ হয়ে গিয়েছে এতক্ষনে। আমার রুম থেকেই কয়েকজন মানুষের অট্টহাসির আওয়াজ পাচ্ছি। আন্দাজ করে বুঝতে পারলাম হয়তোবা ড্রয়িংরুমে চার-পাঁচজন মানুষ বসে কথা বলছে। সেই সাথে আবার হাসির আওয়াজও ভেসে আসছে। কে এসেছে তা পরখ করার জন্য বিছানা ছেড়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসলাম। এর পর মাথায় ভালোভাবে ওড়না দিয়ে রুমের বাইরে পা বাড়ালাম। ড্রইংরুমের দৃশ্য চোখে ভেসে উঠতেই মনে হলো আমার চোখের সামনে কোন দৃশ্য ই স্বাভাবিক নয়।

চলবে…………

[বিঃদ্রঃ গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক। অনুগ্রহ করে বাস্তবিক অর্থ খুজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না আর লেখিকা কে ও বিভ্রান্ত করবেন না]

বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-২৬+২৭

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_২৬

— ভুল করেও ভাবিস না তোর সামনে পুরনো আলআবি দাঁড়ানো।

এরা দুজন যে কি নিয়ে কথাবার্তা বলছে তার আগামাথা ও বুঝতে পারছি না। তবে এইটুকু ধারণা হয়ে গিয়েছে যে দুজনেই পূর্ব পরিচিত। এর মাঝে রাকিব বলে উঠলো,,,

— পুরনো ক্ষত এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলি?

কথাটা বললেই মাথা কিছুটা কাত করে আলআবি ভাইয়ার পিছনে অর্থাৎ আমার দিকে তাকাল। তারপর আবারো বললো,,,

— পরিবেশে কেমন যেন লায়লী-মজনু গন্ধ পাচ্ছি।

— কুত্তা সবকিছুর গন্ধ আগেই পায়।(আলআবি ভাইয়া)

আলআবি ভাইয়া এভাবে কেন কথা বলছেন? দেখে তো মনে হচ্ছে এদের মধ্যে সাপে-নেউলে সম্পর্ক। এদের দুজনেরই চোখ দেখলে যেকেউ মনে করবে চোখ দিয়েই দুজন যুদ্ধের ময়দানে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। কিছু লোকের পায়ের শব্দে দরজার দিকে আমরা সবাই তাকালাম। দেখি সাত থেকে আট জন ছেলে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।একজন তাদের মধ্যে থেকে বলে উঠলো,,,

–বড় ভাই কোনো সমস্যা?

আলআবি ভাইয়া একবার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আবার রাকিবের দিকে তাকালো।হঠাৎ করেই আলআবি ভাইয়ার কথা বলার ভঙ্গিমা পাল্টে গেল।কন্ঠে গম্ভীরতা টেনে বললেন,,,

–এখানে যখন এসেই পরেছিস আবারও দেখা হওয়াটা নিশ্চিত।

আলআবি ভাইয়া আমার হাত ধরে সাদুসহ বাইরে এসে পরলেন।পিছনে পিছনে সেই সাত-আট জন ছেলে গুলোও আসছে। মাঠ পেরিয়ে যখন ভার্সিটির গেটের দিকে যাচ্ছিলাম তখন কেউ কেউ আমাদের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল আবার কেউ কেউ নিজেদের মধ্যে ব্যস্ত ছিল।গেট দিয়ে বের হয়ে আলআবি ভাইয়ার থেকে হাত টা ছাড়ানোর জন্য মোচড়ামুচড়ি করতেই হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠলেন,,,

–এই মেয়ে!

ভয়ে আমি লফিয়ে উঠলাম।আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সাদু। এমন এক বিকট আওয়াজে সাদুও লাফিয়ে উঠলো।আলআবি ভাইয়া পুনরায় বললেন,,,

–এরপর থেকে যদি বোরখা ছাড়া তোকে বাইরে ঢেংঢেং করতে দেখি তাহলে জন্মের মতো বাইরে বের হওয়া দেখিয়ে দিব।

তার এমন কথায় আমার কিছুটা খারাপ লাগলো। কারন আমার সাথে তুই তুকারি করে কথা বললে আমার খারাপ লাগে। আলআবি ভাইয়া যদি আগে থেকেই আমাকে তুই করে ডাকতো তাহলে মানা যেত। নিয়াজ ভাইয়া,সজল ভাইয়া, সাদু ওদের তুই ডাকের মধ্যে আর আলআবি ভাইয়ার তুই ডাক এর মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে। উনি বোরখা পরার যেই বিষয়টা বলেছেন মানছি সেটা ভালো কথাই বলেছেন। আমার ভালোর জন্যেই বলেছেন। কিন্তু বলার ভঙ্গিমার মধ্যেও অনেক কিছু নির্ভর করে। আমাকে তো ভালোভাবে বুঝিয়ে বললেই পারতেন। আমি তো আর অবুঝ নই।আলআবি ভাইয়া হঠাৎ করে স্বাভাবিক কণ্ঠে ছেলেগুলোর মধ্য থেকে কোন একজনকে উদ্দেশ্য করে বললেন

— শাফিন জুঁইয়ের বান্ধবীকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আয়।

আমি বলে উঠলাম,,,

— আমরা আলাদা যাব কেন? এক সাথেই তো এসেছিলাম।(আমি)

–এক কথা আমি দু বার বলি না।(আলআবি ভাইয়া)

আমার হাত ধরে আমাকে সাদা রঙের একটা গাড়ির মধ্যে বসিয়ে দিলেন। আর নিজেও গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসলেন। দেড় বছর সময়ের ব্যবধানে যেমন পাল্টিয়েছেন তিনি তেমন পাল্টিয়েছে তার জীবন যাপনের ধরণ। বলতে গেলে এখন কিছুটা বিলাসিতা তার মধ্যে বিদ্যমান। এখন আর তাকে তার রয়েল এনফিল্ড বাইকে চড়তে দেখা যায় না। আমার ভাবনার সুতো কাটে তার ডাকে। তার দিকে তাকিয়ে দেখি একটা পানির বোতল আমার সামনে ধরে বলছেন,,,

— টেক ইট

তার কথায় এখন তাকে অনেকটা স্বাভাবিক মনে হচ্ছে। পানিটা খেয়ে পুনরায় তাকে ফেরত দিলাম বোতল টা। তখন আবার আলআবি ভাইয়া একেবারে শান্ত কন্ঠে বলতে লাগলেন,,,

— আচ্ছা কখন নিজেকে তোমার খুব সাহসী মনে হয়?

তার এই ধরনের কথা বোধগম্য হলো না আমার। হঠাৎ করে এমন প্রশ্ন করার মানে কি? তার দিকে আমি প্রশ্নসূচক চাহনিতে তাকালাম। তখন আলআবি ভাই ভাইয়া আবার বলে উঠলেন,,,

— উত্তর দাও।

আমি বললাম,,,

— গ্রামের বাড়ীতে ছোটো ছোটো পিচ্চি গুলোর সাথে খেলা করতে গিয়ে যখন ওরা কোন কিছু পারেনা কিন্তু সেটা আমি পারি তখন নিজেকে খুব সাহসী মনে হয়।

–তাহলে এরপর থেকে যদি কোনদিন আজকের মতো সিচুয়েশনে পড়ে যাও তাহলে তোমার সামনে থাকা মানুষগুলোকে তুমি তোমার গ্রামের পিচ্চি মনে করবে। মনে করবে ওদের শক্তি কম তোমার শক্তি বেশি। সব সময় রাকিবের মত খারাপ লোক গুলোকে বুদ্ধি দিয়ে ঘায়েল করবে। ওদের সাথে কখনো কথার পৃষ্ঠে ফটাফট জবাব দিতে যাবে না।(আলআবি ভাইয়া)

কথাগুলো বলে আমার হাতের পাঁচ আংগুলের মাঝের আঙ্গুলে টায় একটা রিং পরিয়ে দিলেন। আমি তাড়াহুড়ো করে তার হাত থেকে আমার হাত সরিয়ে নিলাম। ভালোভাবে পরখ করে দেখলাম ডিজাইনের বদলে রিংটার মধ্যে কেমন যেন ধারালো তিনটা কাঁটার মতো কিছু একটা রয়েছে । এখন আমি যদি হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে কারো শরীরে সজোরে একটা পাঞ্চ মারি তাহলে নির্ঘাত পাঞ্চ মারার স্থানটায় তিনটা ফুটো হয়ে যাবে। আমি একবার আলআবি ভাইয়ার দিকে তাকাচ্ছি আর একবার আমার হাতের দিকে তাকাচ্ছি। তখন আলআবি ভাইয়া বলে উঠলেন,,,

— এটা জাস্ট একটা ছোট সেফটি নিজের জন্য। সব সময় তো আর আমি তোমার সাথে থাকব না। নিজের সেফটির জন্য সবসময় সাথে কিছু একটা রাখতে হয় যেমন ধর ছোটখাটো স্টিলের ধারালো স্কেল, মরিচের গুঁড়ো, কাটা কম্পাস আরও কত কি।(আলআবি ভাইয়া)

লোকটার এরূপ দেখে এখন তাকে অনেকগুলো ধন্যবাদ দিতে মন চাইছে। মাঝে মাঝে তার মধ্যে আমি অনেকগুলো রূপ খুঁজে পাই। মাঝে মাঝে মনে হয় তিনি বহুরূপী নামক উপাধিতে ভূষিত। মাত্র দেড় বছরের ব্যবধানে কি মানুষ বহুরূপী হয়ে যায়? এর মধ্যে আমাদের মাঝে আর কোন কথাই হলো না।অবশেষে কিছুসময়ের মধ্যেই বাসায় পৌঁছে গেলাম। বাসার মেইন গেটের সামনে এসে দেখি এখনও আলআবি ভাইয়া যান নি। তাই আবার পিছনে হেঁটে গিয়ে তাকে বললাম,,,

— ধন্যবাদ?

–কেন? (আলআবি ভাইয়া)

–ধন্যবাদ না দিলে তো আবার খোঁটা দিবেন। বলবেন ম্যানার্স নেই কোনো। (আমি)

বাসায় এসে সব কাজ নিজে একা করলাম। ভাবিকে কাজ করতে দিলাম না। অবশ্য ভাবি আগ বাড়িয়ে কাজ করতে এসেছিল। সন্ধ্যার দিকে ভাইয়া অফিস থেকে ফিরে এসে এমন খবর দিলো যার জন্য আমরা কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। বিশেষ করে আমি।

ভাইয়ার ভাষ্যমতে, পরশু তার অফিসের কলিগের কোন একজন রিলেটিভ আমাদের বাসায় আসবে আমাকে দেখার জন্য। পছন্দ হলেই নাকি আংটি পড়িয়ে যাবে। এসব শুনে এই মুহূর্তে ভাইয়ার উপর প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। কারন ভাইয়াই আমাকে একদিন বলেছিল আমি যদি কখনও কাউকে পছন্দ করি তবেই আমাকে বিয়ে দেবে। আর নয়তো আমি যদি সারা জীবনেও বিয়ে না করতে চাই তাহলে আমাকে বিয়ে দিবেনা। বাবা ও আমাকে একি কথা বলেছিল। কালকে অব্দিও ভাইয়া আমাদের এ বিষয়ে কিছু বলেনি।আজকে হুট করে অফিস থেকে এসে এসব বলা শুরু করেছে। বাবা বলে উঠলো,,,

— জুইঁয়ের অভিভাবক এখনো আমি। আমি ওকে কোন মতেই এই মুহূর্তে বিয়ে দিব না। আর মনে রেখো তোমার অভিভাবক ও কিন্তু আমিই।

— আরে! আরে! তোমরা তো দেখছি আমাকে ভুল ভাবছো। ওদের পছন্দ হলেই হবে নাকি? আমাদের তো পছন্দ হওয়া লাগবে। আর দেখতে আসলেই আমার বোনকে আংটি পরাতে দিব নাকি। আসলে কলিগ বলে একসাথে কাজ করতে হয়। তাই আমি না বলতে পারি নি। ওরা জাস্ট কালকে আসবে আর আমরা না বলে দেবো। বলব আমাদের ছেলে পছন্দ হয়নি। আমি ভেবে রেখেছি ওদের কি বলবো।

আমি রুমে এসে সাদুকে কল করলাম। প্রথমবার কল করতেই ফোনের ওপাশ থেকে মেয়েলি কন্ঠে আমাকে বলে দিল কল এই মুহূর্তে ওয়েটিং এ আছে। নিশ্চয়ই এখন এই মেয়েটা বসে বসে সাদমান ভাইয়ার সাথে চুটিয়ে প্রেম করছে। ওদের প্রেমে আর ব্যাঘাত না ঘটিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। পূর্ণিমার চাঁদ টা বিলের পানিকে তার নিজস্ব আলো দিয়ে ঝকঝকে তকতকে করে তুলেছে।

বারান্দায় দাঁড়ানো অবস্থায় আমার ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি সাদু কল করেছে। কলটা রিসিভ করার পরে সাদু বলল,,,

— এতক্ষণ পরে আমার কথা আপনার মনে পরছে?

— হুম।সেম টু ইউ। (আমি)

–তা এতো বর্ষ পরে আমার কথা মনে হইলো কেন(সাদু)

–ফালতু আলাপের লেইগা কল দেই নাই তোরে।শোন পরশু বাসায় আসিছ।(আমি)

— কেন পরশু কি তোর বিয়া নাকি? (সাদু)

–না তোর দাদার বিয়া।(আমি)

–ছিঃ!ছিঃ!এইডি কইছ না বোইন।আমার দাদি শুনলে কবরের থেইক্কা আইয়া আমার দাদার লগে মারামারি কইরা যাইব। আফটার অল ওনাগো লাভ ম্যারেজ বইলা কথা ।(সাদু)

–তোর দাদা দাদি ও প্রেম কইরা বিয়ে করছিল?(আমি)

–হ।(সাদু)

— আচ্ছা তোর ফ্যামিলিতে কোন বান্দা টা প্রেম কইরা বিয়ে করেনাই নাই আমারে একটু ক তো?(আমি)

— শোন আমার দাদা দাদি, আমার বাপ মা, আমার চাচা চাচি সবাই প্রেম কইরাই বিয়ে করছে। প্রেম আমাদের রক্তে রক্তে শিরায় শিরায় বুচ্ছস। তাই তো আমিও এই পথ ধরছি।বংশের নাম রক্ষা করতে হইবো তো।(সাদু)

— তাইলে তোর জন্ম না নেওয়া বাচ্চা গুলিরে আগেই কইয়া দিছ যেন প্রেম কইরা বিয়ে করে।(আমি)

–না না এই রিক্স নিমু না। তাইলে দেখা যাইবো পেটের মধ্যে থাকতেই প্রেম শুরু করছে। (সাদু)

–ওই বলদ পেটে থাকতে আবার প্রেম শুরু করে কেমনে? এইবার আমার কথা শোন।(আমি)

–আচ্ছা ক।(সাদু)

সাদুকে নিয়াজ ভাইয়ার বলা সব কথাগুলো বললাম। বিয়ে যে হবে না তাও বললাম। সব শুনে সাধু বলল,,,

— দোস্ত তুই শিওর তো বিয়ে হবে না।

–দুইশো পার্সেন্ট সিওর।(আমি)

— আচ্ছা ঠিক আছে। তাইলে আমি পরশু দিন সকালেই তোর বাসায় হাজির হইয়া যামু। এবার খেলা হবে মামা। অনেকদিন ধইরা জীবনে কোনো বিনোদন পাই না।পরশু একটু বিনোদন পাওয়া যাইবো।(সাদু)

–কেমনে?(আমি)

–তোদের বাসায় আসলেই দেখবি “সাদু’স কেরামতি”।(সাদু)

–ঠিক আছে তুই তোর কেরামতি নিয়া থাক আমি ঘুমামু।(আমি)

–জানিতো কেমন ঘুম ঘুমাবা।(সাদু)

–জানছ যহন এতো কথা কছ কে?ফোন রাখ।(আমি)

আর কেউ জানুক আর না জানুক আমার এই প্রিয় মানুষ টা ঠিকি জানে আমি যে প্রতি রাতে একা একা আমার বর্ষণ সঙ্গীর সাথে কথা বলায় ব্যস্ত থাকি।তাকে নিয়ে যে আমার কত পাগলামি তা এই মেয়ে টা খুব পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে জানে।

আজ সকালে সাদু এসেছে। ওকে দেখে তো মনে হচ্ছে কোনো পার্লারের মেয়ে এসেছে আমাকে সাজাতে।ইয়া বড় একখানা ব্যাগে করে ও ওর সব মেকআপ কিট নিয়ে এসেছে। মনে হচ্ছে ও যদি পারতো তাহলে বস্তায় করে ওগুলো নিয়ে আসতো।

বিকেলের দিকে সাদু বসে পড়েছে আমাকে সাজাতে।কিন্তু আমাকে কিছুতেই আয়না দেখতে দিচ্ছে না।চোখ টা অব্দি খুলতে দিচ্ছে না। বারবার বলছে চোখ খুললে নাকি সব সারপ্রাইজ নষ্ট হয়ে যাবে।এতোক্ষণে বুঝতে পেরেছি ও আমার হাতে পায়েও ঘষামাজা করছে। মানে বোধগম্য ভাষায় বলতে গেলে মেকআপ। প্রায় তিন ঘন্টা বাদে আমাকে সাদু ঘষামাজার থেকে মুক্তি দিল।মনে মনে ভাবছি সামান্য দেখাতে এতো মেকআপ কেন দিল?যাই হোক বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে পরলাম নিজেকে দেখার জন্য। আয়নার সামনে যেতেই নিজেকে নিজে চিনতে না পেরে জোড়ে চিৎকার করে বসলাম।নিজেকে ভালো করে পরখ করে সাদুর দিকে অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম।

চলবে…………

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_২৭

–কি বেবি কেমন লাগলো আমার কেরামতি?

আমি সাদুকে কটমট করে বললাম,,,

–তোর এই কেরামতি ওয়ালা মাথার চুল যদি আমি একটাও রাখছি তো আমার নাম জুইঁ না।

ওকে কথাটা বলেই চুল ছেঁড়াছিঁড়ি অভিযানে নেমে পরলাম। ওর হিজাব টানাটানি করে খুলে ফেললাম। খাটের এপাশ ওপাশ করছি সাদুকে ধরার জন্য।একপর্যায়ে সাদু হাঁপিয়ে হাঁপিয়ে বলে উঠলো,,,

–শোন শোন।আমার কথাটা শোন।

ওর সাথে আমিও হাঁপিয়ে উঠেছি।তাই ছোটাছুটি বন্ধ করে বড় বড় দম নিয়ে ওর দিকে কটমট করে তাকিয়ে বললাম,,,

–কি শুনবো?

–আরে রিলেক্স।দেখ তোরে পেতনি সাজ মানে কালো বর্ণের সাজ দিয়া কিন্তু তোরই উপকার করলাম।যে বা যারা তোরে দেখতে আইবো তাদের মন মানসিকতা কেমন তা এই কালো বর্ণ আমাদের বুঝাইয়া দিব।তার উপর প্লাস পয়েন্ট হইলো তারা যদি ধলা চামড়ার মানুষ পছন্দ কইরা থাকে তোরে তো তাইলে এমনেও পছন্দ করবো না।তোরে যে ভালোবাসার সে তামাটে বর্ণের তুইটাকেই ভালোবাসবে। এহন তুই খালি ওনাগো সামনে তোর এই আঁকাবাকা দাঁত কয়ডা নিয়ে না ভেটকাইলেই হইলো। কি বুঝলি?(সাদু)

সাদুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসি হেসে বললাম,,,

–এইটাই বুঝলাম যে তোর মাথায় সার ইদানীংব একটু বেশি বেশি পড়তাছে।

আমাদের কথার মাঝেই রুমে ভাবি আর ভাইয়ার আগমন হলো।ভাইয়া বলল,,,

–শোন ওরা সবাই আসবে না। ওরা চায় ছেলেমেয়েরা আগে একজন আরেক জনকে দেখুক।ছেলে মেয়ের একে ওপরকে পছন্দ হলেই বড়রা আগাবে।ছেলে এখন আপাতত একা মিট করবে।

–কেবল ছেলেই একা আসবে বাসায়?

–আরে বলদ ছ্যামরি কোনদিন দেখছোস পাত্ররে একলা ঢেং ঢেং করতে করতে পাত্রীর বাড়ী আইতে? নিশ্চয়ই বাইরে কোথাও দেখা করার কথা কইছে।তাই না নিয়াজ ভাইয়া?(সাদু)

–কারেক্ট কথা।জুইঁ তুই আমার বোন হইলে কেমনে?(নিয়াজ ভাইয়া)

–আরে এতো কিছু ভাইবা বলছি নাকি। (আমি)

–আচ্ছা তাহলে বের হয়ে পর এখন।তোদের ভার্সিটির পাশের ****ক্যাফের এড্রেস আমি ছেলেকে পাঠিয়ে দিছি।(নিয়াজ ভাইয়া)

–এই সাজেই যাবি নাকি? (ভাবি)

–হ্যাঁ।কোন সমস্যা? (আমি)

–একদমই নয়।(ভাবি)

–আচ্ছা তাহলে আর ১০ টা মিনিট পরে বের হই?(আমি)

–আচ্ছা। কিন্তু একটু তাড়াতাড়ি করিস।(নিয়াজ ভাইয়া)

নিয়াজ ভাইয়া আর ভাবি চলে গেলো। সাদু আমার পিঠ চাপড়ে বলল,,,

–আরেকটু সাজাইয়া দিমু নাকি? (সাদু)

–হ।

বলেই আমি সযত্নে সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা আমার শাড়িটা বের করলাম।আমার হাতে শাড়ি দেখে সাদু বলল,,,

–বোইন এমন কিছু কইছ না যেন যাতে আমার কান শুনতে পায় তুই এই শাড়ি ডা পড়বি।

–আহা এই না হলি তুই আমার পরানের বান্ধবী। (আমি)

–তুই কি এই শাড়িডারে ত্যানাত্যানা না বানাইয়া রেহাই দিবি না?(সাদু)

–বেশি কথা কবি না।এইটা পড়লে আমার সুখ সুখ লাগে। (আমি)

–ওরে কইতোরি বেগম তোমার সুখ সুখ লাগে না? আমার কানা কানা লাগে। (সাদু)

— কি লাগে তোর?(আমি)

–তোর এই শাড়ি ডা দেখতে দেখতে আমার চোখ দুইটাই নষ্ট হইয়া গেছে বুঝলি।(সাদু)

— ভালো হইছে। আমার জামাইর দেয়া শাড়ির দিকে নজর দিছোস কেন?(আমি)

–ওহোওওওওও।জামাই?(সাদু)

শুরু হয়ে গেল সাদুর আমাকে নিয়ে কথা বলা।ওর এতো এতো কথার কিছু ই আমার মাথায় ঢুকছে না।আমার মাথায় শুধু একটা কথাই ঘোরাঘুরি করছে।তাহলো আমি মুখ ফসকে এই কথাটাই কেন বললাম। আমার বর্ষণ সঙ্গীর সাথে তো দেখাটা পর্যন্ত হয়নি।নানা বিষয়ে চিন্তা মাথায় নিয়ে বেরিশে পরলাম আমি আর সাদু।

— তুমি আসলে কি চাও বলতো?(ভাবি)

— একটা ছোট্ট ডোজ দিলাম। এইটা দরকার ছিল।(নিয়াজ ভাইয়া)

–মানে? (ভাবি)

— রুমে চলো বলছি।(নিয়াজ ভাইয়া)

রিকশার ভাড়া মিটিয়ে আমি আর সাদু ***ক্যাফেতে প্রবেশ করলাম। সমস্যা হলো পাত্রকে চিনবো কি করে? এখানে প্রায় সবগুলো টেবিলেই বসা আছে মানুষ। তখনি আমার মোবাইলের ম্যাসেজের টোন টা বেজে উঠে আমাকে জানান দিল কেউ হয়তো বা আমাকে স্মরণ করছে।তৎক্ষনাৎ ম্যাসেজ টা ওপেন করতেই দেখি নিয়াজ ভাইয়া মেসেজ করে একটা ফোন নাম্বার পাঠিয়েছে সেইসাথে বলেও দিয়েছে এটা পাত্রের নাম্বার।কল করার আগেই একটা ছেলে একেবারে কর্নার টেবিল থেকে আমাকে আর সাদুকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ইশারা করছে। দুই তিনবার ইশারা করার পর মনে হলো এটা হয়তো বা আমাদের কাঙ্খিত ব্যক্তি। আমি আর সাদু গিয়ে ছেলেটার সামনে দাঁড়ালাম।

ছেলেটার পরনে হালকা আকাশি বর্ণের একটা টি-শার্ট। সাথে কালো প্যান্ট। যে কেউ তাকে এক পলকে দেখলে ভদ্র বলেই মনে করবে। আমাকে উদ্দেশ্য করে ছেলেটা খুব নম্র ভাবে বলল,,,

–আমি যদি ভুল না করি তাহলে আপনি জুইঁ। ঠিক তো?

আমি সৌজন্যমূলক হাসি হেসে বললাম,,,

–জ্বি।

ছেলেটা মুচকি হেসে করদমর্ন করার উদ্দেশ্যে আৃার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল,,,

— আমি রাইয়ান শেখ।

ভদ্রতার খাতিরে আমিও যখন হাত বাড়াতে যাবো ঠিক সেই সময় অন্য একটা হাত এসে রাইয়ান নামের ছেলেটার হাত ধরে ফেলল। আর সেইসাথে একটা পরিচিত কন্ঠ ভেসে আসল,,,

–আমি ওর রিলেটিভ।

প্রচুর আগ্রগ নিয়ে ঘাড় ঘুড়িয়ে পাশে তাকাতেই অনেকটা চমকে উঠলাম। কারণ এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে অসম্ভব ঘটনাটি ঘটেছে। আর তা ঘটিয়েছে আলআবি ভাইয়া। তাকে এখানে কোন কালেই আশা করিনি।সাদির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম সাদুও কিছুটা অবাক হয়েছে। এমন সময় রাইয়ান ছেলেটা বলে উঠলো,,,

–আসসালামু আলাইকুম বড় ভাই। আমাকে চিনতে পেরেছেন?

আলআবি ভাইয়ার দিকে লক্ষ্য করে দেখি তিনি মুচকি হাসলেন।আলআবি ভাইয়া কিছু বলার পূর্বেই রাইয়ান দ্বিগুণ উৎসাহ নিয়ে বলে উঠলো,,,

–ওইযে ২৭ তারিখে ব্লাড দিয়েছিলাম। মনে আছে?

–ওয়ালাইকুম আসসালাম।মনে থাকবে না কেন। মনে আছে। আরও ভালো করে মনে রাখতে আর মনে করাতে এখানে আসা।(আলআবি ভাইয়া)

আলআবি ভাইয়া কথা বলার সময় আমি তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম।একটা জিনিস খেয়াল করলাম সে আমার দিকে তাকিয়ে শেষের কথা টা বললেন।হুট করেই হাতে টান লাগায় খেয়াল করে দেখি আলআবি ভাইয়া আমার হাত ধরে আছেন।আর বললেন,,,

–চলো বসে কথা বলি।

বাক্যটা শেষ করতেই তিনি আমার হাত ধরে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলেন।সাথে নিজেও পাশের চেয়ার টায় বসলেন।তার কাজে আর কথায় আজ বেশ অবাক হচ্ছি। কিন্তু পরমুহুর্তেই ভাবলাম হয়তোবা নিয়াজ ভাইয়া তাকে আমাদের এখানে অভিভাবক হিসেবে পাঠিয়েছে। কিন্তু নিয়াজ ভাইয়া আমাকে তো বলল না। আলআবি ভাইয়া যখন আসবে তখন আমাকে বললে কি হতো?

সাদু আর রাইয়ান এখনো আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে ড্যাবড্যাব করে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। তখন আলাবি ভাইয়া ইশারা করল ওদের দুজনকে আমাদের সামনের দুটো চেয়ারে বসতে। ওরা ধীর পায়ে এসে বসে পড়ল। এই মুহূর্তে আমার পাশে বসা আলআবি হইয়া আর আমার সামনাসামনি বসা সাদু। সাদুর পাশে অর্থাৎ আলআবি ভাইয়ার সামনাসামনি বসা রাইয়ান।

আমরা চুপচাপ বসে আছি কেউই কোন কথা বলছি না। আলাবি ভাইয়া ফোন টিপছেন। নীরবতা কাটিয়ে রাইয়ান সর্বপ্রথম বলে উঠলো,,,

–জুই তাহলে আমরা কথা বাড়াই?

রাইয়ানের এই কথাটা শেষ হতে না হতেই আলআবি ভাইয়া উদ্ভট একটা কাজ করে ফেললেন। আমি চেয়ারের যে অংশে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছি সেখানে তার বাম হাত উঠিয়ে দিলেন অর্থাৎ আমার পিঠের পিছনে তার বাম হাত। আলআবি ভাইয়া এর এরকম একটা কাজে আমি কিছুটা সামনের দিকে ঝুঁকে বসলাম। তখন রাইয়ান বলে উঠলো,,,

–আপনার ছোট বোন হয়?

–আমার বোন হয় কিনা বলতে পারছি না। কিন্তু তোমার যে বউ হবে না তা নিশ্চিত। (আলআবি ভাইয়)

তার কথা শেষ হতেই আমি তড়িৎগতিতে তার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকালেন। বর্তমানে আমাদের তিনজনের দৃষ্টি আলআবি ভাইয়ার দিকে। তার দিকে যখন তাকিয়ে আছে ঠিক তখন সে আমার অনেকটা কাছে এসে কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললেন,,,

— বলে দিব নাকি তোমার বর্ষণ সঙ্গীর কথা?

তার কথা শুনে আমার ভিতর চিকন সূক্ষ্ম একটা ভয় বয়ে গেল।আলআবি ভাইয়ার প্রত্যেকটা শব্দ উচ্চারণের সময় তার মুখ থেকে বের হওয়া হালকা উত্তপ্ত বাতাস আমার কানে গিয়ে বারবার ধাক্কা দিচ্ছিল।

চলবে…………

[বিঃদ্রঃ গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক। অনুগ্রহ করে বাস্তবিক অর্থ খুজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না আর লেখিকা কে ও বিভ্রান্ত করবেন না]

বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-২৪+২৫

0

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_২৪

–আমার শাল দেওয়ার কথা ছিল কালকে।এখন অব্দি পাইনি কেন?

ফোনে আলআবি ভাইয়া এমন রাগীভাবে কথা গুলো বললেন মনে হয় তার ওই শালের অভাবে সে শীতে মরে যাচ্ছে। আবার এও মনে হচ্ছে যে আমি কোনো ডেলিভারি ম্যান।পন্য দিতে দেরি হচ্ছে বলে আমাকে রাগাচ্ছেন। এহ্,এতো শাল শাল যে করছে তার শালটা কি আমি চাঁদের দেশে গিয়ে দিয়ে আসব নাকি? উনি কোন দেশে থাকে সেই ঠিকানাই তো আমি জানিনা। আমি রাগের বশে তাকে বললাম,,,

–আপনার শাল নিয়ে আমি শালবন বিহারে গিয়ে ফুলশয্যা করে এসেছি।

নাউজুবিল্লাহ! আস্তাগফিরুল্লাহ! এগুলো কি বললাম আমি? কি থেকে কি বলে ফেললাম তা উপলব্ধি করা মাত্রই ফোনটা কেটে দিলাম সাদু কেও দেখি আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।

আসলে ব্যাপার হলো আজ পরীক্ষা দিয়ে আমি সাদুর সাথে ভার্সিটি থেকে বের হচ্ছিলাম। তখন আলআবি ভাইয়া আমাকে কল করেন।আর শাল শাল করতে থাকেন। এর মাঝেই ফোনটা আবারও বেজে উঠলো। কলটা রিসিভ করা মাত্রই ওপাশ থেকে আলআবি ভাইয়া একেবারে শান্ত গলায় বলে উঠলেন,,,

— তুই এই মুহূর্তে যেই জায়গায় দাঁড়ানো তার সামনে একটা সাদা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। কোন প্রকার টু শব্দ করা ছাড়া একা একা গাড়িতে উঠবি। গাড়িতে না উঠলে তোর খবর আছে।

আলআবি ভাইয়া তুই তুকারি করে কোন দিন তো কথা বলেন নি। হঠাৎ কি হলো? বেশ চিন্তায় পড়ে গেলাম। তার ওই ভাবে কথা বলায় কিছুটা ভয়ও লাগছে। এমন হঠাৎ করে পাল্টে গেলেন কেন উনি? সাদুকে তার বলা কথাগুলো বলতেই সাদু বলল আমাকে একা একা গাড়িতে উঠতে। পিছনে পিছনে সাদু একটা সিএনজি নিয়ে আমাদের গাড়িটা কে ফলো করবে। আমাদের প্ল্যান অনুযায়ী আমি গাড়িতে উঠে বসলাম।

গাড়ি প্রায় আধা ঘণ্টার মতো রাস্তা পেরিয়ে একটা বহুতল ভবনের সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরলো। গাড়ি থেকে নেমে এপাশ-ওপাশ ভালোভাবে পরখ করে নিলাম। বিল্ডিংটার নিচ থেকে দাঁড়িয়ে গুনে নিলাম মোট বারো তলা বিশিষ্ট এই বিল্ডিং টা। যেই লোকটা গাড়ি ড্রাইভ করেছিল সেই আমাকে ভিতরে নিয়ে গেল। সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে হাতের বামে দেখলাম আনুমানিক দশটা থেকে বারোটা টা কম্পিউটার। আর তার সামনে বসে কাজ করেছ অনেকে। ভেতরটায় কিছুটা অফিসের মত।ডান পাশে কাঁচ দিয়ে আবদ্ধ রুমে চোখ বুলালে দেখা যাবে একটা সুবিশাল লম্বা টেবিল। দেখেই বোঝা যায় এটা কোন মিটিং রুম। লোকটা আমাকে নিয়ে সোজা গিয়ে একটা স্বচ্ছ কাঁচের দরজা ঠেলে আমাকে ভিতরে যাওয়ার জন্য ইশারা করলেন। ভিতরে প্রবেশ করে দেখি আলআবি ভাইয়া টেবিলের উপর দুই কনুইতে ভর দিয়ে দুই হাত এক করে তাতে থুতনিটার ভর ছেড়ে দিয়েছেন। পড়নে তার সেদিনের মতোই একটা শুভ্র রঙের পাঞ্জাবি। তার একটা জিনিস খেয়াল করলাম কালকে আর আজকে। তা হলো আগের মত চশমাটা তার চোখে নেই। চশমা নেই কেন? চোখে কি এখন বেশি দেখে নাকি? তার দৃষ্টি দরজায় দাঁড়ান মানুষটি অর্থ্যাৎ আমার দিকেই। আমি দরজা থেকে একটু সামনে এগিয়ে এসে ডানদিকে কিছুটা কাচুমাচু ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে পরলাম। দরজা থেকে সামনে যখন ডান দিকে এগিয়ে এসেছি তখন খেয়াল করলাম আলআবি ভাইয়ার চোখের মনিও হালকা ডান দিকে কাত করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছেন মনে হয় আমি কোন ফাঁসির আসামি। নীরবতা ভেঙ্গে আলআবি ভাইয়া আগে বলে উঠলেন,,,

— তখন কি বলেছিলে?

আমি একবার তার দিকে দৃষ্টি দিচ্ছে তো আর আরেকবার ফ্লোরের দিকে দৃষ্টি দিচ্ছি। তিনি আবার বলে উঠলেন,,,

–ফুলশয্যা? এর মিনিং জানো? ফারদার যদি কোন উল্টাপাল্টা কথা তোমার মুখ থেকে শুনেছি তো জিভ কেটে দিবো।এন্ড আই রিয়েলি মিন ইট।

আসছে রিয়েলি মিন ইট! কি এমন বললাম আমি? গালিগালাজ করেছি নাকি এখনো?
আলআবি ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে আমি বলে উঠলাম,,,

–আমি উল্টাপাল্টা কি কথা বললাম? এখন পর্যন্ত গালিও দেই নি কোনো।

— দিতে চাও নাকি?(আলআবি ভাইয়া)

— না! না! না!গালি কেন দিবো? (আমি)

–শাল দিয়ে তাড়াতাড়ি বিদায় হও।(আলআবি ভাইয়া)

— থাকতে ও আসেনি(আমি)

ব্যাগ থেকে শালটা বের করে তার টেবিলের উপরে রাখলাম। তারপর একটু হাসি দিয়ে তাকে বলে উঠলাম,,,

–এইটা আমার ভাগেরটা।

এরপর আবার ব্যাগ থেকে আরেকটা শাল বের করে টেবিলের উপর রেখে বললাম,,,

–এইটা সাদুর ভাগের টা।

আলআবি ভাইয়া ভ্রুকুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে অবুঝ ভঙ্গিতে বললেন,,,

–হোয়াট?

–আরে আপনাকে একটার সাথে আরেকটা ফ্রি তে দিলাম। আপনি তো আবার কাউকে ফ্রি তে কিছু দেন না। কিন্তু আমার দয়া-মায়া একটু বেশিই। কাউকে ফ্রিতে কিছু না দিলে আমার আবার ভালো লাগেনা।(আমি)

কিছু একটা ভেবে আলআবি ভাইয়া আমার সামনেই শাল দুইটার ভাঁজ খুলে ফেললেন। এমনটা আমি মোটেও আশা করিনি। ভেবেছিলাম আমি চলে যাওয়ার পর সে এগুলো দেখবে। কিন্তু এখন তো নিজের করা গর্তে নিজেই পড়ে গেলাম। কারণ আমার তো আর ঠেকা পড়ে নি যে তাকে আমি শাল ফ্রিতে ফ্রিতে দিয়ে যাব। আসলে আমি তো তার শালটাকেই কেটে দু’ভাগ করে ফেলেছি। আলআবি ভাইয়ার রিয়েকশন দেখার জন্য তার দিকে তাকালাম। তার দিকে তাকিয়ে আমি আঁতকে উঠলাম। দেখি তিনি অগ্নিমূর্তি রূপ ধারণ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।মনে হচ্ছে পারলে শালটার মত আমাকেও এই মুহূর্তে দু ভাগ করে ফেলবেন। আলআবি ভাইয়া দাঁতে দাঁত চেপে আমাকে বললেন,,,

— এমন করেছো কেনো?

তাকে এই মুহূর্তে আমার ভয় তো লাগছে ঠিকই কিন্তু তাকে আমার ভয় দেখালে চলবে না। এতে করে সে আরো বেকে বসতে পারে। তাই তার দিকে না তাকিয়ে অন্যদিকে তাকিয়েই বললাম,,,

— আপনিইতো বলেছিলেন দুজনে ভাগ করে গায়ে জড়িয়ে নিও। তাই আমরা দুজনে ভাগ করে গায়ে জড়িয়ে নিয়েছি।

কথাগুলো বলা শেষ করে তার দিকে তাকালাম। তাকিয়েই দেখি আলআবি ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তখন তিনি শান্ত কন্ঠে বলে উঠলেন,,,

— এই দুই ভাগ এখন জোড়া লাগিয়ে দিবে। কিভাবে জোড়া লাগাবে তা তুমিই ভালো জানো।

–আপনার মাথা জানি। আমার কাছে কি আলাদিনের চেরাগ আছে, যে বললেন আর হয়ে যাবে। (আমি)

খেয়াল করলাম উনি আমার কথায় পাত্তা না দিয়ে মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এইতো ফাঁক পেয়েছি। তাড়াহুড়ো করে দরজার কাছে গিয়ে দরজা ধরে টেনে খোলার চেষ্টা করলাম। প্রথমবারে ব্যর্থ হলাম। পরেরবার আবার চেষ্টা করলাম। এবারও ব্যর্থ হলাম। এরপর বারবার দরজার হাতল ধরে টানছি, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। হঠাৎ মনে হলো দরজা লক করা নাতো? এমন সময় পেছন থেকে আলআবি ভাইয়া বলে উঠলেন,,,

— একটা প্রাপ্তবয়স্ক ছেলে আর একটা প্রাপ্তবয়স্ক মেয়ে একই ছাদের নিচে একইসাথে একই রুমে আটকে পড়ল। এরপর যা হলো তা…

এতোটুকু শুনেই আমি তাড়াতাড়ি আলআবি ভাইয়ার দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে পড়লাম। আলআবি ভাইয়া অতটুকু বলেই চুপ হয়ে গেলেন। তারপর হুট করেই চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে পাঞ্জাবির হাতা গুটাতে গুটাতে আবার বলতে লাগলেন,,,

— এ সম্পর্কে তোমার কোন ধারনা আছে?

আমি অবুঝের মতো বললাম,,,

— কি?

তখন আলআবি ভাইয়া আবার ধীরে ধীরে বলতে লাগলেন,,,

–প্রাপ্তবয়স্ক একটা ছেলে আর প্রাপ্তবয়স্ক একটা মেয়ে একসাথে থাকলে কি হয়?

হঠাৎ করে আলআবি ভাইয়ার এমন পরিবর্তনে একটু ভয় পেয়ে গেলাম। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম,,,

— কিক… কি হয়?

উনি আবারও বললেন,,,

— একটা গান আছে না,” হাম তুম এক কামরেমে বন্ধ হো অর চাবি খো যায়ে ”

বলেই কেমন একটা বিটকেল মার্কা হাসি দিলেন। আমি ভয়ে ভয়ে আবারও বললাম,,,

— আমি আপনার শুধু শাল কেন,শালসহ জুতা-মোজা, প্যান্ট ছেঁড়াফাটা যত কাপড়চোপড় আছে সব জোড়া দিয়ে দিবো।

এরপর তাড়াতাড়ি করে টেবিলের উপর থেকে দুভাগ শাল হাতে নিয়ে আবার দরজার সামনে এসে হাতল টানাটানি করতে লাগলাম। কিন্তু কিছুতেই খুলছে না। অসহায় দৃষ্টিতে আলআবি ভাইয়ার দিকে তাকালাম। দেখি তিনি আয়েশী ভঙ্গিতে চেয়ারে বসে পায়ের উপর পা তুলে আমার কর্মকান্ড দেখছেন। আমি বললাম,,,

–খুলছে না কেন এটা?

তখন আলআবি ভাইয়া বললেন,,,

–খুলছে না যেহেতু তাহলে এখানে বসেই জোড়াতালির কাজ শুরু করে দাও।

— মানে? (আমি)

তখন তিনি আমার সামনে একটা বক্স রেখে বললেন,,,

— এখানে সুইঁ সুতা সবই আছে।

এরপর হাতের ইশারায় সোফা দেখিয়ে বললেন,,,

— ঐখানে গিয়ে সুন্দর মত করে জোড়া তালি দিতে থাকো। যাও। এটা তোমার পানিশমেন্ট।

আমি সোফাই গিয়ে বসে ঘট ঘট করে দ্রুত সেলাই করে দিলাম। যে সুন্দর সেলাই করেছি তাতে মনে হয় ধরলেই ছুটে যাবে।আলআবি ভাইয়ার টেবিলের সামনে গিয়ে শাল টা রাখতেই খেয়াল করলাম সে ফোনে কাউকে বললেন,,,

–তোর বোন কে এসে নিয়ে যা।

কথাটা তার বলতে দেড়ি তবে রকেটের বেগে রুম থেকে ছুটে চলে যেতে দেড়ি হলো না তার।তার চলে যাওয়ার পরেই সাদু হুট করে ঢুকে পরলো।ওকে দেখেই বললাম,,,

— কোন চিপায় গেছিলি তুই?

–আরে বইন আমারে কেউ ঢুকতে দিতাছিল না।একটু আগে দেখলাম আলআবি ভাইয়া আর কয়েকটা পোলা হন্তদন্ত হইয়া কই যেন যাইতাছে। তখন আলআবি ভাইয়া আমারে দেইখা ঢুকতে দিতে কইছে।(সাদু)

–আচ্ছা সাদু তোর কি মনে হয় না আগের আলআবি ভাইয়া আর এই আলআবি ভাইয়ার মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত। (আমি)

–হ।কথা ঠিক কইছোস। আলআবি ভাইয়া তো মারপিট করার মানুষ না। হঠাৎ কইরা এমন হইলো কেন?আর দোস্ত আরেকটা জিনিস খেয়াল কর,ভাইয়া কিন্তু একজন আর্কিটেক্ট। তাইলে ওনার এই জায়গায় কি কাজ?(সাদু)

–হুমম।এইটা দেইখা তো অফিসই মনে হয়।কিন্তু কিসের অফিস এইটা?(আমি)

আমরা যখন গভীর গবেষণায় মগ্ন তখন দেখি

চলবে…………

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_২৫

–সার্থক ভাইয়া আপনি?

আমি আর সাদু যখন গবেষণা করছিলাম তখন আগমন ঘটে সার্থক ভাইয়ার।আর তখনি সাদু তাকে এই কথাটা বলে।তাকে এখানে এই মুহূর্তে আমরা আশা করিনি। সার্থক ভাইয়া বলে উঠলেন,,,

–আমারও তো একি প্রশ্ন।

তারপর ভাইয়ার সাথে কথা বলে জানতে পারলাম আমাদের দেখা টা কাকতালীয় ভাবে হয়ে গিয়েছে। সার্থক ভাইয়া নাকি আলআবি ভাইয়ার সাথে দেখা করতে এসেছিল।আলআবি ভাইয়া সার্থক ভাইয়া আসার আগেই বেড়িয়ে পরেছে বলে আমাকে আর সাদুকে সার্থক ভাইয়াই বাসায় দিয়ে আসবে বলেছেন।একটা কথা বারবার মাথায় ঘুরছে। আলআবি ভাইয়া ফোনে কাউকে বলছিলেন “তোর বোনকে নিয়ে যা”।কথার ধরনে মনে হচ্ছিল আমার কথাই বলছিলেন নিয়াজ ভাইয়ার কাছে। কিন্তু নিয়াজ ভাইয়া তো এলো না।বরং তার বদলে সার্থক ভাইয়ার সাথে দেখা হয়ে গেল।

আমি আর সাদু সার্থক ভাইয়ার গাড়িতে বসে আছি।আলআবি ভাইয়ার ওখান থেকে বের হয়ে কিছুদূর আসতেই সার্থক ভাইয়ার একটা কল আসে।তাই ভাইয়া গাড়ি থেকে নেমে ফোনে কথা বলছে। সাদু বসে বসে মোবাইলে একটা ফেসবুক পেজ থেকে ড্রেস দেখছে আর একটু পর পর আমাকে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলছে “এইটা সুন্দর না? দেখ দেখ এইটাও সুন্দর কিন্তু “। ওর এমন কাজে প্রথমে বিরক্ত না লাগলেও এখন বিরক্তি ভাব চলে এসেছে। গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে দেখি সামনের একটা সরু চিকন গলিতে কয়েকজন মিলে জটলা পাকিয়েছে। এখানে এদের মধ্যে যুবক সংখ্যাই বেশি। তবে পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে না স্বাভাবিক। কারণ দেখে বোঝা যাচ্ছে কোন একজনকে সবাই মিলে হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। জটলার ফাঁকফোকর দিয়ে আবছা আবছা দেখতে পেলাম যেই ছেলেটাকে সবাই মিলে কিছু একটা বলছিল সেই ছেলেটাকে কেউ একজন এসে কলার ধরে দুই গালে দুইটা চড় বসিয়ে দিল। চড় দেয়া লোকটাকে দেখে মনে হল কিছুটা পরিচিত। হঠাৎ করেই একটা নাম মাথায় খেলে গেল, তা হলো আলআবি ভাইয়া। যখনই সাদুকে ডাক দিয়ে বলতে যাব তখনি আমাদের গাড়িটা ওখান থেকে প্রস্থান করলো। এর মধ্যে সার্থক ভাইয়া কখন গাড়িতে এসে বসেছে তা টেরও পাইনি।

মনে মনে ভাবছি ওইটা তো আলআবি ভাইয়া নাও হতে পারে। কারণ যাই হোক না কেন আলআবি ভাইয়া এমন গুন্ডাগিরি করবে না কোনদিন। কিন্তু তার পড়নের শুভ্র পাঞ্জাবি তো আমার মস্তিষ্ককে জানান দিচ্ছে এটা হয়তো বা আলআবি ভাইয়া। ধুর ছাতার মাথা! ভার্সিটিতে আলআবি ভাইয়াকে দেখার পর থেকেই আমার অর্ধেক মাথা ব্যথা হয়ে যায় তাকে নিয়ে গবেষণা করতে করতেই।

আমার দৃষ্টির সামনে থাকা বিলের পানিতে টুপটাপ করে বৃষ্টির জলকণা পড়ে নীরব বিলটার পানিকে কে কাঁপিয়ে তুলছে বারবার। বিকেল হওয়া সত্বেও মেঘের দলেরা আকাশে তাদের অধিকার বিস্তার করে চারপাশকে সন্ধ্যার রূপ দিয়েছে। পরীক্ষা শেষ হয়েছে আজ তিন দিন হলো। কাল আমাদের ভার্সিটির সুবর্ণ জয়ন্তী। সেই সুবাদে সকল সাবেক ছাত্র-ছাত্রীরাও আমন্ত্রিত কালকের অনুষ্ঠানে। ভাবছি, সকল সাবেক ছাত্র ছাত্রী অর্থাৎ পঞ্চাশ বছরের পুরনো ছাত্র-ছাত্রীরাও এখন পর্যন্ত বেঁচে আছে নাকি? বেঁচে থাকলে হয়তো বা এখন বার্ধক্য তাদের ছুঁয়ে গিয়েছে। তাদের ছেলে-মেয়েদের হয়তো বা বিয়েও হয় গিয়েছে। আর ছেলে-মেয়েদের সন্তান সন্ততিও হয়ে গিয়েছে হয়তো বা। মানে এখন তাদের নাতি পুতি ও আছে। বাহ কি মজা! ছেলে মেয়ে নাতিপুতি নিয়ে তারা ভার্সিটিতে আসবে। যখন আমাদের ভার্সিটির বর্ষপূর্তি হবে ইনশাল্লাহ তখন আমি আর সাদুও বার্ধক্যের ছোঁয়া নিয়ে ভার্সিটির সেই চিরচেনা গেট অতিক্রম করে ধীরে ধীরে লাঠি ভর দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করব। তখন হয়তো বা মাঠ প্রাঙ্গণে দৌড়াদৌড়ি করতে পারব না কিন্তু সাদু আর আমি ঝগড়া তো করতে পারব। আমার চিন্তা ভাবনায় আমি নিজেই মনে মনে হেসে উঠলাম।

এতোদিনে আলআবি ভাইয়ার পরিবর্তনের কারণ না জানলেও তার কাজ সম্পর্কে জানা হয়ে গিয়েছে। তা হলো সমাজসেবা আর রাজনীতি। তাকে হঠাৎ করে রাজনীতিতে কেন যুক্ত হতে হলো তা বুঝতে যাওয়া আর আমার অন্ধকারে সূচঁ খোঁজা একই কথা। তার একটা নিজস্ব “স্ট্যান্ড ফর জাস্টিস”(কাল্পনিক) নামক সংস্থা রয়েছে। তার সংস্থা মূলত গরিব-দুঃখীদের ন্যায়ের জন্য অধিকারের জন্য লড়ে থাকে।আলআবি ভাইয়ার সংস্থা টার কথা জানতে পেরে খুব ভালো লেগেছিল। তার প্রতি অনেক শ্রদ্ধা বোধ কাজ করে এখন। কিন্তু তার মারামারি-কাটাকাটির ব্যাপারটা মোটেও ভালো ভাবে নিতে পারছিনা। সে তো সারাদিন সংস্থা নিয়েই পড়ে থাকতে পারেন।তা এখানে রাজনীতি করার দরকারটা কোথায়?

সন্ধ্যার দিকে দুই হাতে দুটো শাড়ি নিয়ে ভাইয়ার রুমে অগ্রসর হলাম। উদ্দেশ্য হলো কোন শাড়িটা কালকে অনুষ্ঠানে পড়ে যাব। সাদু কে বলেছিলাম কোন শাড়িটা পড়লে ভালো হবে। ও আমাকে বর্তমানে আমার হাতে থাকা দুইটা শাড়ি থেকে যেকোন একটা পড়তে বলেছে। কিন্তু এখন আমি নিজেই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছি কোনটা রেখে কোনটা পড়বো। দুটো শাড়িই আমার খুব পছন্দের। কারণ দুটো শাড়িই আমার দুজন প্রিয় মানুষ আমাকে দিয়েছে। একটা আমার বর্ষণ সঙ্গীর দেওয়া। আরেকটা নিয়াজ ভাইয়ার দেওয়া।

ভাইয়ার রুমে গিয়ে দেখি তাসফি ভাবি সন্ধ্যেবেলা তেও মাথায় হাত রেখে শুয়ে আছে। ভাবি কে দেখে একটু অবাক হলাম। কারন সচরাচর সন্ধ্যাবেলায় তো ভাবি শুয়ে থাকে না। মনে মনে ভাবলাম হয়ত শরীর খারাপ লাগছে। ভাবি শুয়ে আছে বলে দরজায় নক করে বললাম,,,

— ভাবি আসবো?

ভাবি কাঠগলায় জবাব দিল,,,

— না।

এরকমভাবে না বলায় কিছুটা আশ্চর্য হই। তারপর ভাবিকে আবার বলি,,,

–কেন ?

–অপরিচিত কাউকে আমি রুমে ঢুকতে দেইনা।(ভাবি)

— মানে?(আমি)

–মানে হলো যে ভাবে বললি আসবো সেভাবে অপরিচিতরা বলে। এবার ভনিতা না করে এক দৌড়ে খাটে এসে বসে পড়।(ভাবি)

ভাবির কথায় হেসে দিয়ে তার পাশে গিয়ে বসলাম। তারপর দুইটা শাড়ি ই দেখালাম। ভাবি শাড়ি দুইটা টা থেকে আমাকে আমার বর্ষণ সঙ্গীর শাড়িটা বেছে দিল। ভাবি এই শাড়িটা পছন্দ করায় মনে মনে একটু বেশিই খুশি হলাম। তবে এই খুশি ভাবির বলা পরবর্তী কথাটায় হার মানতে বাধ্য হলো। কারণ ভাবি সুখী নামক রোগে রোগআক্রান্ত হয়েছে। অর্থাৎ আমাদের নতুন অতিথি আসছে। ভাবি মা হতে চলেছে, ভাইয়া বাবা হতে চলেছে, আমি ফুপি হতে চলেছি আর বাবা দাদা হতে চলেছে। খুশিতে ভাবিকে জড়িয়ে ধরলাম। ভাবিকে জিজ্ঞেস করলাম ভাইয়া কিছু জানে কিনা। ভাবি বলল এখন অব্দি বলেনি। খুশিতে একেবারে দৌড়াতে দৌড়াতে বাবার কাছে গিয়ে খবরটা দিলাম। ভাবি আমাকে বলতে মানা করছিল। তার নাকি লজ্জা লাগে।সে নাকি আরো পরে বলবে। কিন্তু আমি তো খুশি ধরে রাখতে না পেরে দৌড়ে গিয়ে বাবাকে বলে ফেললাম। বাবা ও শুনে খুব খুশি হলো। তৎক্ষণাৎ বাবা বেরিয়ে গেল মিষ্টি আনতে। রাতে ভাইয়া আসার পরে আমি আর বাবা প্ল্যান করে ভাইয়ার সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিলাম। ভাবি কেও শিখিয়ে দিলাম যেন কথা না বলে। ভাবি ও আমাদের মত কথা বলল না। ভাইয়া শেষমেষ না পেরে আমাদের তিনজনকে ড্রয়িং রুমে ডেকে নিয়ে আসলো তারপর বলল,,,

— কি সমস্যা তোমাদের কথা বলছো না কেন। কি এমন করলাম আমি? আমার ভুলটা তো বলবে।

তখন বাবা বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,,

— আমাকে এত দেরীতে দাদা বানানোর জন্য এটা তোমার শাস্তি ছিল।

বলেই বাবা আর এক মুহূর্ত দেরি না করে রুমে চলে গেল। বাকি রইলাম আমি আর ভাবি। ভাইয়া একবার আমার দিকে আরেকবার ভাবির দিকে তাকাচ্ছে। হয়তোবা বুঝতে একটু সময় লাগছে। কিছু সময় পরেই তাসফি আপু কে উদ্দেশ্য করে ঠোঁটের কোণে চওড়া হাসি নিয়ে বলল,,,

–সত্যি?

ভাবির অবস্থা দেখে বুঝলাম লজ্জা পাচ্ছে ।তাই আমি ধীরে ধীরে কেটে পরলাম।

সকালে শাড়িটা পড়ে হাত ভরতি সাদা চুড়ি পড়ে নিজেকে পরিপাটি করে সাজিয়ে গুজিয়ে বাসার নিচে দাঁড়িয়ে আছি। অপেক্ষায় আছি সাদুর। একটু পর সাদু আসলে ওকে ভালভাবে পর্যবেক্ষণ করে বলি,,,

— তোরে এত সুন্দর শাড়ি দিলো কেরে?

–কে দিব আবার?আমার কি জামাই আছে? (সাদু)

–সাদমান ভাই তো আছে। (আমি)

সাদু একটু বাঁকা হেসে বলল,,,

— এইটা সাদমান এরই দেওয়া।

–তাইলে যে কইলি তোর জামাই নাই।(আমি)

–ঠিকই তো কইছি।সাদমান আমার জামাই নাকি?(সাদু)

–সাদমান তোমার জামাই না তাই না?তাইল এনগেজমেন্ট করলি কোন ব্যাডার লগে।(আমি)

–এহ্। হইছে তো মাত্র এনগেজমেন্ট।জামাই তো আর হয় নাই।

— যাই হোক, হবু জামাই তো?

সাদু আর আমি কথা বলতে বলতে ভার্সিটিতে এসে পড়লাম। ক্যাম্পাস টাকে় খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। এইরূপেও ভার্সিটি টাকে বেশ সুন্দর
লাগছে। আশেপাশে পরিচিত-অপরিচিত মুখের অভাব নেই। চতুর্থ বর্ষ আর মাস্টার্সের ছাত্র ছাত্রীরা আজকে একটু বেশিই ব্যস্ত। এখানে যেমন বোরকা পড়া রমণী দেখা যাচ্ছে, থ্রিপিস পড়া রমণী দেখা যাচ্ছে, শাড়ি পড়া রমণী দেখা যাচ্ছে ঠিক তেমন পাঞ্জাবি পরিহিত যুবকদের দেখা মিলছে, শার্ট প্যান্ট পড়া যুবকদের দেখা মিলছে আবার ছেঁড়াফাটা নামক ফ্যাশনওয়ালা যুবকদের ও দেখা মিলছে।

মানুষের ভিড়ে এক পলক আলআবি ভাইয়াকে দেখার ভাগ্য হয়েছিল। এখন আলআবি ভাইয়াকেও সাদুর স্টাইলে বলতে ইচ্ছে করছে” মাদার তেরেসার মেল ভার্সন”। কারণ আমাদের আলআবি ভাইয়া সাদা ছাড়া মনে হয় কোন রং ছুঁয়ে ও দেখেনা। এই পর্যন্ত তাঁকে সাদা রঙের পাঞ্জাবি ছাড়া আর কোন কিছুই গায়ে চাপাতে দেখিনি। তবে আজকে একটু ভিন্নতা দেখেছি। তা হলো কালো রংয়ের একটা মুজিব কোর্ট স্টাইলের জ্যাকেট পড়েছেন।

অনুষ্ঠানের মাঝপথে আমাদের একজন এসে বলল আমাদের ডিপার্টমেন্ট হেড আমাদের নাকি ডাকছেন। আমাদের দোতালায় যেতে হবে। আমাদের ক্লাসরুমে গেলেই নাকি স্যার কে পাব। আমি আর সাদু অনেকটাই আশ্চর্য হই। আমাদের কেন ডাকবেন? ব্যাপারটা কেমন যেন লাগছিল কিন্তু তারপরও স্যার যখন ডেকেছে একবার না হলে গিয়ে দেখে আসি।

আমি আর সাদু দোতলার দিকে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আমাদের ক্লাস রুমে যাওয়ার আগের যেই ক্লাসরুম সেটা ক্রস করার সময় আমাদের ডাক পড়ে। আশেপাশে তাকিয়ে খেয়াল করলাম আমাদের ক্লাসরুমের আগে ক্লাসরুমটায় পাঁচজন ছেলে হাই বেঞ্চের উপর বসে আছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এরা কোন সভ্য মানুষ নয়। একেকজনের কানে টপ গলায় কুকুরের বেল্টের মতো চেন আর চুলে আগুন ধরার মতো রং মানে কালার করা। পাঁচজনের মধ্যে তিনজন বসে বসে সিগারেট ফুঁকছে। এদের মধ্যে থেকে দুজনকে চিনতে অসুবিধা হলো না। কারন যে দুজনকে আমরা চিনি ওরা আমাদের ভার্সিটির মাস্টার্স পড়ুয়া ছাত্র। তবে এদেরকে কোনোকালেই ক্লাস করতে দেখা যায় না। কেবলমাত্র পরীক্ষার সময় এদের চাঁদ মুখখানা দেখা যায়। সাথে আরও যে তিনজন ছেলে তারা আমাদের কাছে একেবারেই অপরিচিত। এখানে এসে মনে হচ্ছে আমরা কোন ভুল করে ফেললাম। সাদু আর আমি একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে ওদের কথায় কান না দিয়ে সামনে পা বাড়াতেই একজন বলে উঠল,,,

— এই যে সোনামনিরা! এদিকে এদিকে। আমরাই তোমাদেরকে ডেকেছি।এদিকে আসো।

ওদের কথা শুনে আমরা আমাদের জায়গাতেই দাঁড়িয়ে রইলাম। তখন সাদু বললো,,,

–দোস্ত দেখ এই মাঝখানের ছেলেটাকে আমি চিনি।

— কিভাবে?(আমি)

— আরে রাফিদা আপু আর সার্থক ভাইয়ার বিয়েতে এসেছিল ছেলেটা। একেবারেই ভালো নয়। আসলে বিয়ের আগের দিন সার্থক ভাইয়া আমাকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিল যেন বিয়েতে ছেলেদের সঙ্গে কোন প্রকার কথা না বলি। বিয়ের আগের দিন তো আমাকে তিনটা ছেলের ছবিও দিয়েছিল আর বলেছিল এই তিনজনের থেকে যেন একশো হাত দূরে থাকি। কারণ রাজনীতির সুবাদে সার্থক ভাইয়া আর তার আব্বুকে সকলের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে হয়।সেই কারণে ওদের কেও না পেরে বিয়েতে দাওয়াত দিতে হয়েছিল আর ওই তিনজনের মধ্যে এই ছেলেও ছিল। সম্ভবত রাকিব নাম।

— আচ্ছা তাইলে এখন কি করবি?(আমি)

–চল কোনো খারাপ কিছু করার আগে যাইয়া সার্থক ভাইয়ার পরিচয় দিয়া আসি।(সাদু)

–ভিতরে ঢোকার দরকার কি? চল এই জায়গা থিকাই কাইটা পরি।(আমি)

–গুড আইডিয়া চল চল।(সাদু)

যখনই আমরা দুজন পিছনে ঘুরে চলে যেতে নিলাম তখন আমাদের ভার্সিটির ছেলেদের এসে আমাদের হাত ধরে ফেলল। একপ্রকার টেনে নিয়ে গেল। রুমের ভিতর নিয়ে হোয়াইট বোর্ডের সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। একজন বলে উঠল,,,

–কিগো পাখিরা এতো ফুরুত ফুরুত তো ভালো না। তখন সাদু বলল,,,

–আসসালা মুয়ালাইকুম রাকিব ভাইয়া।

ছেলেটা ভ্রু কুঁচকে সাদুর দিকে তাকালো।সাদু আবার বলল,,,

— আমাকে চিনতে পারেননি? সার্থক ভাইয়ার বোন আমি।

তখন ওই রাকিব নামের ছেলেটা চোখের ইশারা দিয়ে আমাকে দেখিয়ে বলল,,,

–ফ্রেন্ড হয়?

ও বলল,,,

— জ্বি।

— দেখো এত ঘুরিয়ে পেচিয়ে কথা বলার মানুষ আমি না। তুমি যেহেতু বলেছ তুমি সার্থকের বোন তাই আমি কথা আরো সোজাসোজি বলব। কথা হল, তোমার ফ্রেন্ডকে ভালো লাগছে।

আমি আর সাদু দুইজনেই তার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালাম। তখন পুনরায় ছেলেটা বসা থেকে দাঁড়িয়ে বলল,,,

–আমি ওকে প্রপোজ করবো এখনই।ওকে এক্সেপ্ট করতে বলো। আর সেই সাথে রাইট নাও ওর থেকে একটা কিস চাই আমি।

ছেলেটার লাস্ট কোথায় এতক্ষণ ভয় না হলেও এখন মনে ভয় ঢুকে গিয়েছে। মুহূর্তেই চোখে জলকণারা ভিড় জমালো।আমি সাদুর হাত আরো শক্ত করে চেপে ধরলাম। সাদু বলে উঠলো,,,

— ভাইয়া আসলে ও একটু অন্যরকমের। আমার কাছে আরও সুন্দর সুন্দর মেয়ে আছে আপনি চাইলে আমি বলতে পারি ওদের কথা।

— তোমার ফ্রেন্ড অন্যরকমের তাইতো ভালো লেগেছে। ওকে, প্রপোজ বাদ দাও। ওইসব প্রপোজ ট্রপোজ আমারও ভালো লাগে না। তাই নো প্রপোজ নো একসেপ্ট। জাস্ট একটা কিস হলেই হবে।(রাকিব)

কথাটা বলেই সে আমার দিকে আগাতে লাগল। ভয়ে আমি জবুথবু অবস্থায় হোয়াইট বোর্ড এ গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছি। মাথা নিচু করে আছি তাই দেখতে পেলাম লোকটার পা ক্রমশ আমার দিকে এগুচ্ছে। সেই সময় হুট করেই কেউ আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে পরল অর্থাৎ আমার আর রাকিব নামের ছেলেটা ঠিক মাঝখানে। পরিচিত একটা নাম ভেসে আসলো কানে।

“বড় ভাই!”

তড়িৎ গতিতে উপরের দিকে মাথা তুলে তাকালাম। দেখি সামনে আলআবি ভাইয়া দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখমন্ডল আমি দেখতে পাচ্ছি না। আলআবি ভাইয়া রাকিবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে তার পিঠ আমার দিকে।রাকিব বলে উঠলো,,,

–হোয়াট অ্যা কোইন্সিডেন্স!শত্রুকে যে এইভাবে দেখব ভাবিই নি।

–তুই তোর শত্রুর খবর নাই রাখতে পারিস। কিন্তু আমি বন্ধুর খবর না রাখলেও শত্রুর খবর ঠিকই রাখি।(আলআবি ভাইয়া)

— তা তুই কি বড় ভাই? আই মিন আলআবি ওরফে বড় ভাই।(রাকিব)

চলবে…………

[বিঃদ্রঃ গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক। অনুগ্রহ করে বাস্তবিক অর্থ খুজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না আর লেখিকা কে ও বিভ্রান্ত করবেন না]