বর্ষণ সঙ্গিনী পর্ব-২১

0
1363

#বর্ষণ_সঙ্গিনী
#হুমাশা_এহতেশাম
#পর্ব_২১

–কলেজ শেষে কলেজের সামনে থেকেই অটো করে বাড়ি ফিরছিলাম।একই অটোতে তোমার ভাইয়া গাজীপুর থেকে তোমার নানা বাড়ি ফিরছিল।দুজন একেবারে মুখোমুখি হয়ে বসেছিলাম। আমার যেই স্ট্যান্ডে নামার কথা তার পরের স্ট্যান্ডে নামার কথা তোমার ভাইয়ার।কিছু দূর আমাদের অটো চলার পরে অপর পাশ থেকে আসা আরেকটা অটোর সাথে আমাদের অটোটার ধাক্কা লাগে। ধাক্কা লেগে আমাদের অটো কিছুটা কাত হয়ে যায় আর আমি অটো থেকে পড়ে যাই।পড়ে গিয়ে মাথায় সামান্য ব্যাথা পাই। কিন্তু হাতের কনুইটা খুব বিশ্রিভাবে ছিলে যায়।রাস্তায় বসেই চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে।আশে পাশের সবাই আমার চারপাশে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে হায় হুতাশ আর দুঃখ প্রকাশ করছিল।আমাকে যে কেউ এসে একটু ধরবে সেই চিন্তা ভাবনা কারো মধ্যেই নেই। তখন ভিড় ঠেলে একজন যুবক এসে তাড়াহুড়ো করে আমাকে ধরে রিকশায় উঠিয়ে হসপিটালে নিয়ে যায়। আর সেই যুবক টাই হলো তোমার নিয়াজ ভাইয়া। এরপর ওইদিনই তোমার ভাইয়া আর আমার মধ্যে ফোন নাম্বার আদান-প্রদান হয়।বাবাকেও তোমার ভাইয়াই কল করে আমার কথা জানায়।হসপিটাল থেকে বাড়ি আসার পর তোমার ভাইয়া রাতে কল করে খোজ নেয়ার বাহানাতে আমার সাথে কথা বলতো।আমারও কথা বলতে বেশ ভালো লাগতো। এইভাবেই আমাদের একে ওপরের ভালো লাগার সূত্রপাত ঘটে। আর তারপর প্রণয় ঘটে।

তাসফি আপু একনাগাড়ে কথা গুলো বলে তারপর দম ছাড়লো।আমার কাছে ওদের দুজনের প্রণয়ের রচনা টা খুব ভালো লাগলো।আমি উৎসুক হয়ে জানতে চাইলাম,,,

–আচ্ছা আপু তোমার ফ্যামিলি নিয়াজ ভাইয়ার কথা প্রথম কিভাবে জানলো?

আমার কথায় তাসফি আপু খিলখিল করে হেসে উঠলো। তারপর বলল,,,

–তোমার ভাই প্রেম নিবেদন করতে এসে আমার আব্বার কাছে হাতেনাতে ধরা পড়েছিল।

আমি আরো উৎসুক হয়ে বলে উঠি,,,

–সেইটা কিভাবে?

পুনরায় আপু বলতে লাগলো,,,

–আমাদের মাঝে কথা হতে হতে একপর্যায়ে খুব ভালো বন্ডিং হয়ে যায়। এরমাঝে ৪ মাস কেটে যায়। ৪মাস পরে তোমার ভাইয়া আবার গ্রামে আসে আমার সাথে দেখা করবে বলে।অবশ্য আমাকে বলেছিল তার নাকি আমাকে কিছু বলার আছে। বাসা থেকে খুব একটা বের হতে দিত না আমাকে। আমাদের প্ল্যান ছিল সন্ধ্যার দিকে আমাদের বাড়ির পিছন সাইডে আমরা দেখা করব। বাড়ির পিছন সাইডে ওই দিন তোমার ভাইয়া নাকি এসে আমাকে কিভাবে প্রপোজ করবে সেটা প্র্যাকটিস করছিল। আমার আসতে একটু দেরি হচ্ছিল আর দুর্ভাগ্যবশত তোমার ভাইয়াকে ওই অবস্থায় আমার আব্বা দেখে ফেলে। আব্বার যা বোঝার বুঝে ফেলে। আমার আব্বা খুব একটা রাগী মানুষ নয়। সবকিছু ঠান্ডা মাথায় সামলান।সেদিন তোমার ভাইয়াকে আব্বা বুঝিয়েছে তোমার ভাইয়ার প্রেম করার বয়স হলেও আমার প্রেম করার বয়স হয়নি। আর সাথে নাকি এটাও বলেছিলো তোমার ভাইয়া যদি নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে পারে তাহলে আমাদের কথা ভেবে দেখবেন।

–নিজেকে উপযুক্ত করে গড়ে তুলেছি আমার বোনের সাথে গল্প করার জন্য নাকি?

হঠাৎ করে নিয়াজ ভাইয়ার কণ্ঠ শুনেই আমি আর আপু দুজনেই পেছন ফিরে তাকালাম। তাকিয়ে দেখি ভাইয়া দুহাত বুকে গুঁজে দেয়ালের সাথে হেলে দাড়িয়ে আছে। আমি একটু মুচকি হেসে বলে উঠলাম,,,

–ভাইয়া কখন এসেছ?

–যখন থেকে ম্যাডাম আমাদের প্রেম কাহিনী শুরু করেছেন তখন থেকে।(নিয়াজ ভাইয়া)

–এসে যখন পড়েছ তাহলে এবার দুজনে মিলে আমাকে তোমার আর তাসফি আপুর প্রেম কাহিনী শোনাও।(আমি)

— তাসফি আপু কিরে? এতগুলো কচকচে নোট খরচ করে বউ নিয়ে আসলাম আপু ডাকার জন্য নাকি? ভাবি ডাকবি এরপর থেকে।(নিয়াজ ভাইয়া)

নিয়াজ ভাইয়া এসে আমাদের গল্পের আসরে যোগদান করল। আমাদের গল্পের আসর শেষ হতে প্রায় এগারোটা বেজে গেল। এর মাঝখানে রাতের খাবার খেয়ে নিয়েছিলাম তারপর আবার গল্প শুরু করেছিলাম।

ঘড়ির কাটায় রাত প্রায় আড়াইটা ছুইঁ ছুইঁ। বৃষ্টি তার জলকণা দিয়ে প্রকৃতিকে স্নান করিয়ে দিচ্ছে সেইসাথে পরিবেশকে করছে শীতল। আমার গাঢ় ঘুমটাকে ফোনের রিংটোন বেজে ছুটি জানাচ্ছে। ঘুমটাকে কোনমতেই ছুটি দিতে ইচ্ছে হচ্ছে না। ঘুম আমার চোখের পাতাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে। কিন্তু একই সাথে মস্তিষ্ক জানান দিচ্ছে ফোনের ওপাশ থেকে কেউ আমাকে ডেকে যাচ্ছে। ফোনটা বেজে যাচ্ছে তো বেজেই যাচ্ছে। কোন প্রকার ক্লান্তিই তাকে গ্রাস করতে পারছে না। ঘুমের সাথে আমার চোখের পাতা অনেক সময় যুদ্ধ করে একপর্যায়ে খুলে গেল। পাশ থেকে ফোনটা নিয়ে ঘুম ঘুম চোখে দেখার চেষ্টা করলাম কে ফোন দিচ্ছে। কিন্তু চিনতে ব্যর্থ হলাম। কারণ নাম্বারটা একটা আননোন নাম্বার। ঘড়ির কাটায় চোখ রাখতে দেখি ঘড়ির কাঁটা ঠিক রাত আড়াইটার ঘরে পা দিয়েছে। এমন সময় একটা অপরিচিত নাম্বার চোখে ভেসে উঠতেই চরম মাত্রায় বিরক্ত লাগছে সাথে কিছুটা রাগও হচ্ছে। কলটা বাজতে বাজতে কেটে গেল। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি মোট ১২ টা কল। তাও আবার এই একই অপরিচিত নাম্বার থেকে। এর মাঝেই ফোনটা আবারও বেজে উঠল। কলটা রিসিভ করে আমি কিছু বলে উঠার আগে অপর পাশ থেকে একটা পুরুষালী কন্ঠে ভেসে আসলো,,,

–ফোন ধরছো না কেন? ঘুমাচ্ছিলে?

ঘুমন্ত মানুষকে ঘুম থেকে উঠিয়ে যদি কেউ বলে ঘুমাচ্ছিলে তখন কি পরিমান রাগ হবে? মনে তো চাচ্ছে পারলে ব্যাটাকে ফোনের মধ্যেই গলা চেপে ধরি।একপ্রকার ঝাঁঝালো কণ্ঠেই বলে উঠলাম,,,

— ঘুমের থেকে উঠাইয়া আবার জিজ্ঞেস করতাছোস ঘুমাইছি নাকি। ওই তোর ঘরে মা বোন নাই?আমার শান্তির ঘুম নষ্ট করলি কেন? ঘুম নষ্ট করতে মন চাইলে নিজের বৌরে কল দিয়া ঘুম ভাঙ্গাইয়া পিরিতের আলাপ কর।

–তাই তো করছি।( অপরিচিত লোক)

এমন একটা কথা বলায় আমি একটু ভরকে গেলাম। আমি কপালে দুইটা ভাঁজ ফেলে বলে উঠলাম,,,

— কি?

অপর পাশ থেকে আবারও উত্তর এলো,,,

— আমার বউকেই তো কল দিয়েছি পিরিতের আলাপ করার জন্য।( অপরিচিত লোক)

এবার সম্পূর্ণরূপে ঘুম আমার থেকে ছুটি নিয়ে পালিয়ে গেল। একটু নড়েচড়ে খাটের উপর শোয়া থেকে বসে পরলাম।তাকে বললাম,,,

— কে আপনি? কি উল্টাপাল্টা বলছেন?

অপর পাশ থেকে কানে বেজে উঠলো,,,

— তোমার সারা জীবনের বর্ষণ সঙ্গী।

লোকটার কথা শুনে বুকের মধ্যে ধুকপুক ধুকপুক একটা আওয়াজ বেজে উঠলো। একটু স্বাভাবিক হয়ে নিজের কন্ঠটা কেও স্বাভাবিক রেখে তাকে প্রশ্ন করলাম,,,

— কি চাই আপনার?

লোকটা জবাবে বলল,,,

–বউয়ের সাথে পিরিতের আলাপ করতে চাই।

— এখানে আপনার কোন বউ নেই। রং নাম্বারে কল করেছেন।(আমি)

— যার সঙ্গে কথা বলছি তার কন্ঠটা আমার বউয়ের মত মনে হচ্ছে তাই এখন আমি তার সাথেই পুরো রাতটা কথা বলব।(বর্ষণ সঙ্গী)

— আমি রাত বিরাতে কোন পাগলের সাথে কথা বলি না।(আমি)

কথাগুলো বলেই ফোনটা কেটে দিলাম। এরপর ফোনটা ইচ্ছে করেই বন্ধ না করে সাইলেন্ট করে রেখে ঘুমানোর জন্য আবার শুয়ে পড়লাম। কারণ সকালে উঠে দেখতে হবে না লোকটা কতবার কল দিয়েছি?

সকালে ঘুম থেকে উঠে আর ভার্সিটি যাইনি। কারণ আজকে তাসফি ভাবির আমাদের বাসায় প্রথম দিন। তাই চিন্তা করলাম তাকে সঙ্গ দেবো। কালকে থেকে না হয় ভার্সিটি যাব।ঘুম থেকে উঠে ফোনটা হাতে নিয়ে দেখি বর্ষণ সঙ্গী নামক লোকটার ৭৮ টা কল স্ক্রিনে ভেসে আছে।সকাল সকালই অদ্ভুত একটা কাজ করে বসলাম। আর তা হলো লোকটার নাম্বার মোবাইলে বর্ষণ সঙ্গী দিয়ে সেভ করে রাখলাম। নিজের কাজে নিজেই অবাক না হয়ে পারলাম না। কিন্তু পরমুহুর্তেই মনে মনে একটু হেসে উঠলাম।

সারাদিন আমাদের দুজনের খুব ভালোই কেটেছে। সকালে কমলা আন্টি এসে একবার আমাদের দুজনকে দেখে গিয়েছিলো। বিয়েতে কমলা আন্টি ছিল বিধায় ভাবিকে আর কমলা আন্টিকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কোন প্রয়োজন হয়নি। দুপুরে দুজন একসাথে রান্না করেছি। বিকেলের দিকে ভাবিকে নিয়ে ছাদে গিয়ে হাঁটাহাঁটি করেছি।

পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ফোন টা চেক করে দেখি একটা মেসেজ এসেছে। তবে মেসেজটা রাত দুইটার দিকে এসেছিল। মেসেজ ওপেন করে দেখি লেখা আছে,,,

“আজ আর আমার #বর্ষণ_সঙ্গিনীর ঘুম নষ্ট করতে চাই না। তাই ম্যাসেজ করেই জানতে চাচ্ছি – ঘুমাচ্ছো?”

মেসেজটা দেখে আমার এই মুহূর্তে বিরক্ত হওয়ার কথা। তবে আমার স্নায়ু এই মুহূর্তে বিরক্তির কোন অনুভূতি মস্তিষ্কে প্রেরণা না করে বরং একরাশ ভালো লাগার অনুভূতি মস্তিষ্কে পাঠাচ্ছে। আচ্ছা লোকটার এমন অদ্ভুত কর্মকাণ্ড কি আমার ধীরে ধীরে ভালো লাগতে শুরু করেছে? নাকি লোকটাকেই এখন ভালো লাগতে শুরু করেছে?

জীবনের কয়েকটা দিন পেরিয়ে গেল। খুব ভালোভাবেই জীবনটা চলছে।মানুষের যে কখন কাকে ভালো লেগে যায় তা আসলেই বলা মুশকিল। আমারও ভালো লেগে গেছে আমার বর্ষণ সঙ্গিকে।

সেই দিন তার নাম্বার সেভ করার পরে থেকে আমাকে মাঝে মধ্যেই সে ম্যাসেজ করত।প্রথম প্রথম তার পাঠানো বার্তা পরে মনকে ভালো লাগার রঙে রাঙাতাম।এরপর আমিও একটু আকটু তার ম্যাসেজের উত্তর দিতাম। তাকে আমি একদিন বলেছিলাম আমি তাকে দেখতে চাই কিন্তু সে বলেছিল এটা নাকি একটা সারপ্রাইজ। যেদিন উনিশের কোঠায় আমি পা বাড়াবো সেদিনই নাকি সে আমার সামনে আসবে। এরপর থেকে শুরু হয় আমার অপেক্ষার প্রহর। যে প্রহরের আমি কাল ইতি টানবো। হ্যাঁ কাল আমি আঠারো তে পা দিয়ে সব অপেক্ষার ইতি টানতে যাচ্ছি।

রাতে বারান্দায় বসে বসে মোবাইলে গান শুনছিলাম আর অপেক্ষা করছিলাম কখন বর্ষণ সঙ্গী মেসেজ দিবে। একটু পরেই টুংটাং শব্দে মেসেজ আসলো,,,

“প্রিয়তমা, তোমাকে শুভ্র বেলি ফুলের ঘ্রাণ মাতানো শুভেচ্ছার সঙ্গে জানাই শুভ জন্মদিন।প্রতীক্ষার অন্ত ঘটিয়ে দেখা হবে আমাদের ইনশাআল্লাহ।”

কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটির ছোট্ট এই বার্তা পেয়েই আমার ঠোঁটের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাসতে লাগলো আমার চোখ। অপেক্ষা না করে তাকে দ্রুত উত্তর দিলাম,,,

— সত্যি আমরা কাল দেখা করব?

সঙ্গে সঙ্গে ফোনের মেসেজ টোন শব্দ করে জানান দিলো আমার বর্ষণ সঙ্গী আমাকে উত্তর দিয়েছে।

–হ্যাঁ করব। তবে তার আগে দরজার সামনে এসে দরজা টা একটু খুলে দেখো।

মেসেজটা পড়ে তড়িৎ গতিতে ছুটলাম দরজার দিকে। দরজা খুলে দেখি সেই ঠিক প্রথম দিনের মতো নীল রেপিং পেপারে মোড়ানো একটি বক্স যার উপর রয়েছে ঈষৎ হালকা হলুদ বর্ণের গোলাপ ফুল। সেই আগের মতই লেখা রয়েছে বর্ষণ সঙ্গিনীর জন্য। তবে এই বক্স টা একটু বড়। কেউ দেখার আগেই তাড়াতাড়ি করে দুই হাতে কুড়িয়ে নিলাম বক্সটা। এরপর আবার তড়িৎগতিতে রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দিলাম।

রেপিং পেপার এর মোড়ানো বক্স টা খুলে নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে একটা হাসির রেখা ফুটে উঠলো। বক্সের ভিতরে সেই আগের মতই রয়েছে একটা বেলি ফুলের মালা। তবে এবারে মালার নিচে কোন শাড়ি নেই রয়েছে সারি সারি কাচের চুড়ি। সাদা, কালো, লাল, নীল, সবুজ, হলুদ প্রায় সব রঙের চুড়ি রয়েছে এখানে। সাথে কিছু চকলেটও আছে। তাড়াতাড়ি করে মোবাইলটা হাতে নিয়ে বর্ষণ সঙ্গী দিয়ে সেভ করা নাম্বারে মেসেজ করলাম,,,

–আপনি কিভাবে জানলেন চুরি আমার পছন্দের?

চলবে…..……

[বিঃদ্রঃ গল্পটি সম্পূর্ণরূপে কাল্পনিক। অনুগ্রহ করে বাস্তবিক অর্থ খুজতে গিয়ে বিভ্রান্ত হবেন না আর লেখিকা কে ও বিভ্রান্ত করবেন না]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে